৫. বর্শার ফলা

বর্শার ফলার চারপাশে জমাট বাঁধা কালো রক্ত ধুয়ে ফেলার সময় আশ্বাসের ভঙ্গিতে ফেনের সাথে কথা বলল তাইতা। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওর পায়ের ক্ষত পরীক্ষা করল। অপরাশেনের জন্যে তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বেঁধে রাখা লিনেনের বাঁধন খুলবে না ও।

তুমি বরাবরই দেবতাদের প্রিয় পাত্র, অবশেষে বলল তাইতা। ধমনী থেকে তোমার কনে আঙুলের নখের সমান দূর দিয়ে চলে গেছে ফলাটা। আমরা না থামলে তীক্ষ্ণ ফলাটার ভেতরে নড়াচড়া না থামালে ছিঁড়ে ফেলত ওটা। এখন, চুপ করে শুয়ে থাকো, তোমার জন্যে একটা পানীয় তৈরি করে দিচ্ছি। একটা সিরামিকের বাটিতে, লাল শেপেন পাউডারের খানিকটা আন্দাজ করে নিয়ে কেন্দ্রীয় ফায়ারপ্লেসে রাখা পাত্র থেকে গরম পানি নিয়ে ঢালল। এটা খেয়ে নাও, ব্যথা থেকে রেহাই দেবে তোমাকে, ঘুমঘুম লাগবে।

ওষুধের প্রতিক্রিয়া শুরু হওয়ার অবসরে চামড়ার ডাক্তারি ব্যাগ হাতড়াল তাইতা। একটা আলাদা খুপরি রয়েছে ওটায় যেখানে রূপার চামচগুলো রাখে ও। ওর জানা মতে আর একজন চিকিৎসকের কাছেই এমন একটা সেট ছিল। সে মারা গেছে। তৈরি হওয়ার পর মেরেনকে তলব করল ও। কুঁড়ের দোরগোড়ায় ঘুরঘুর করছিল সে। কী করতে হবে তুমি জানো, বলল ও।

নিশ্চয়ই। আপনি জানেন এর আগে কতবার একাজ করেছি, জবাব দিল মেরেন।

নিশ্চয়ই হাত ধুয়েছ? জিজ্ঞেস করল তাইতা।

মেরেনের অভিব্যক্তি বদলে গেল। হ্যাঁ, সন্দিহান কণ্ঠে বলল সে।

কখন?

সকালে, টহলে বের হওয়ার আগে।

আবার ধুয়ে এসো।

তার কোনও দরকার দেখি না, বিড়বিড় করে বলল মেরেন, বরাবর যেমন করে। কিন্তু আগুনের কাছে গিয়ে বড় পাত্র থেকে গরম পানিতে একটা বাটি ভরে নিল।

আরেকজোড়া হাত লাগবে আমাদের, সিদ্ধান্ত নিল তাইতা। আগুনের উপর রূপার চামচ ধরে রেখেছে। ইম্বালিকে ডেকে পাঠাও।

ইম্বালি? সে তো একটা বর্বর। আমাদের নিজেদের কাউকে ডাকলে হতো না?

মেয়েটা বুদ্ধিমতী, শক্তিশালী, ওর সাথে দ্বিমত পোষণ করল তাইতা। তারচেয়ে বড় কথা মেয়ে সে। আরেকজন পুরুষ ফেনের নগ্ন দেহ ধরে রাখুক, চায় না তাইতা। মেরেনকে কাজে লাগাতে হচ্ছে, এটাই যথেষ্ট খারাপ, তায় আবার আরেক জন কর্কশ সৈনিক-শিলুক মেয়েরা লড়াকু মানুষ। ইম্বালিকে ডাক, আবার বলল ও। সেও যেন হাত ধুয়ে আসে সেটা নিশ্চিত করো।

লাল শেপেন ফেনকে শিথিল করে দিলেও বর্শার ফলাটা নাড়াচাড়া করার সময় গোঙাতে লাগল ও। মেরেনের উদ্দেশে মাথা দোলাল তাইতা। দুজনে মিলে ফেনকে বসার ভঙ্গিতে নিয়ে এলো। ওর পেছনে চলে গেল মেরেন, ওর বুকের উপর হাত নিয়ে এসে শক্ত করে ধরে রাখল।

রেডি, বলল সে।

ইম্বালির দিকে এক নজর তাকাল তাইতা, ফেনের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। পাটা সোজা করে ধরে রাখ, যেন নড়তে না পারে। সামনে ঝুঁকল ইম্বালি, শক্ত করে চেপে ধরল ফেনের পায়ের গোড়ালি। লম্বা করে দম নিয়ে মনোসংযোগ করল তাইতা। দীর্ঘ হাড়সর্বস্ব আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করার সময় নিজের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি বিচার করে দেখল ও। সাফল্যের মূলে রয়েছে গতি আর দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারটা। রোগী যত দীর্ঘ সময় কষ্ট পাবে, শরীর আর মনে ততবেশি ক্ষতি সৃষ্টি হবে, তাতে সেরে ওঠার সম্ভাবনাও যাবে কমে। চট করে বর্শার ফলা বেঁধে রাখা লিনেনের টুকরোটা কেটে ফেলল ও। আস্তে করে উঁচু করে ধরল ওটা। আবার গুঙিয়ে উঠল ফেন। চামড়ার টুকরোটা তৈরি ছিল মেরেনের হাতে, চট করে ওর দাঁতের মাঝখানে সেঁধিয়ে দিল ওটা, যাতে জিভে কামড়ে দিতে না পারে।

দেখো, ওটা যেন ফেলতে না পারে, বলল তাইতা। সামনে ঝুঁকে ক্ষতস্থান পরখ করল ও। ফলার নড়াচড়ার ফলে এরই মধ্যে বেশ বড় হয়ে গেছে ওটা। তবে গর্তের ভেতর রূপার চামচ ঢোকানোর মতো বড় নয়। ফুলে ওঠা মাংসের উপর হাত বোলাল ও, মহাধমনীর নিয়মিত স্পন্দন টের পেল। গেঁথে থাকা কাঁটার তীক্ষ্ণ ফলার দেখা না পাওয়া পর্যন্ত ক্ষতটাকে টেনে বড় করতে উষ্ণ কাঁচা মাংসের ভেতর তর্জনী ও মধ্যমা ঢুকিয়ে দিল ও। অর্তচিৎকার করে যুঝছে ফেন। কিন্তু বাঁধন শক্ত করে রাখল মেরেন আর ইম্বালি। ক্ষতস্থানের ফোকরটা আরেকটু বড় করল তাইতা। ওর নড়াচড়া অসম্ভব দ্রুত হলেও নিয়ন্ত্রিত, নিখুঁত; কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কাঁটার অবস্থান পেয়ে গেল। মুক্ত হাতে চামমগুলো তুলে নিল ও। ওটা কিনারার উপর রেখে ক্ষতস্থানে বর্শার ফলার দুপাশে দুটো ঢুকিয়ে দিল। তীক্ষ্ণ ফলার উপর দিয়ে আগে বাড়িয়ে ঢেকে ফেলল ওটা যাতে বিনা বাধায় বর্শার ফলাটা বের করে আনতে পারে।

আমাকে মেরে ফেলছ! আর্তচিৎকার করে উঠল ফেন। সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে মেরেন ও ইম্বালি, কিন্তু এত জোরে মোচড় খাচ্ছে ও যে ধরে রাখতে পারছে না। দুবার ক্ষতের উপর দিয়ে চামচ নিয়ে যেতে পারল তাইতা, কিন্তু দুবারই ওর মোচড়ের ফলে ফসকে গেল। উপরে উঠে এলো ওগুলো। ক্ষতস্থানের রক্তাক্ত মুখ নড়াচড়ায় বাধা পড়ায় এক ধরনের টান পড়ার শব্দ হচ্ছে। ফেনের মাংসের গভীরে আঙুল থাকায় ওর ধমনীর স্পন্দন টের পাচ্ছে ও। অবিরাম দপদপ করছে। যেন ওর আত্মায় অনুরণন তুলছে। চামচগুলোকে ওটার পাশ দিয়ে পাঠানোর কাজে মনোযোগ দিল ও। পাথরের একটা চল্টাও ঢেকে রাখা ধাতু থেকে বের হয়ে থাকলে ধমনী কেটে যেতে পারে। মসৃণভাবে আরও চাপ প্রয়োগ করল ও। ক্ষতস্থানের মুখটা হার মানতে যাচ্ছে, টের পেল। তারপর সহসা রক্ত ভরে গেল রূপার চামচ, পাথরের ফলাটা মুক্ত হয়ে বের হয়ে এলো। চট করে ক্ষতস্থান থেকে হাত বের করে এনে ফাঁক হয়ে থাকা মুখটাকে চেপে ধরল। মুক্ত হাতে ঝটপট মেরেনের বাড়িয়ে দেওয়া লিনেনের প্যাডটা নিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে ক্ষতস্থানের উপর চেপে ধরল। ওর আর্তনাদ মৃদু গোঙানিতে পরিণত হয়েছে। শরীর থেকে টেনশন চলে গেছে। মেরুদণ্ডের আড়ষ্ট বাক শিথিল হয়ে গেছে।

আপনার নৈপূণ্য কখনওই আমাকে অবাক না করে পারে না, ফিসফিস করে বলল মেরেন। যখনই আপনাকে ওভাবে কাজ করতে দেখি, বিস্ময়ে হতবাক হই। আপনি সর্বকালের সেরা শল্যচিকিৎসক।

এসব নিয়ে পরে আলাপ করা যাবে, জবাব দিল তাইতা। এখন ওর ক্ষত সেলাই করতে সাহায্য করো।

ঘোড়ার পশম দিয়ে সেলাইয়ের শেষ ফোড় দিচ্ছে তাইতা, এমন সময় উত্তরে প্রহরা মিনার থেকে চিৎকার শুনতে পেল ওরা। ক্ষতস্থানের মুখ বন্ধ করতে ব্যান্ডেজের গিঁট বাঁধতে গিয়ে মেরেনের দিকে তাকাল না তাইতা। মনে হয় বাসমারারা এসে গেছে। এবার তোমাকে নিজের কাজে যেতে হবে। ইম্বালিকে নিতে পারো সাথে। সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ, সৎ মেরেন। ক্ষতটা না পাকলে বেচারা তোমাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা খুঁজে পাবে না।

ফেনের পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধার পর কুঁড়ের দরজায় এসে দাঁড়াল তাই। সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও বুদ্ধিমতী শিলুক স্ত্রী লায়লাকে ডাকল। ফেন আর ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এক সাথে অনেক সময় কাটিয়েছে ওরা, আলাপ করে বাচ্চাদের নিয়ে খেলে। ফেনকে ফ্যাকাশে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে বিলাপ শুরু করে দিল লায়লা। ওকে শান্ত করতে কিছুটা সময় নিল তাইতা। তারপর ভালো করে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিল ওকে। লাল শেপেনের প্রভাবে ঘুমন্ত ফেনের দিকে খেয়াল রাখতে বলে সরে এলো।

*

কোনওমতে বানানো মই বেয়ে উঠে প্রাচীরের উত্তর দেয়ালে মেরেনের সাথে খোযোগ দিল তাইতা। গম্ভীরভাবে ওকে স্বাগত জানাল মেরেন। বিনা বাক্য ব্যয়ে উপত্যকার দিকে ইঙ্গিত করল সে। তিনটা ভিন্ন ভিন্ন ফরমেশনে দুলকি চালে এগিয়ে আসছিল বাসমারারা। এগোনোর সময় বাতাসে দুলছে ওদের শিরস্ত্রান। বনের ভেতর দিয়ে দীর্ঘ কালো সাপের মতো একেবেকে এগোচ্ছে সারিগুলো। আবার গান শুরু করেছে ওরা, গভীর পুনরাবৃত্তিমূলক সঙ্গীত, প্রতিরক্ষায় নিয়োজিতদের রক্ত হিম করে দিচ্ছে, শিরশির করছে গায়ের চামড়া। ঘাড় ফিরিয়ে প্যারাপেটের উপর চোখ বোলাল তাইতা। ওদের পূর্ণ শক্তি সমবেত হয়েছে এখানে। সামান্য সংখ্যা দেখে গম্ভীর হয়ে গেল ও।

আমরা মোট বত্রিশ জন, মৃদু কণ্ঠে বলল ও। আর ওরা অন্তত ছয় শো।

তাহলে সমানে সমানই আছি, ম্যাগাস। বাজি ধরে বলছি বেশ ভালো একটা খেলা খেলতে যাচ্ছি আমরা, এড়িয়ে গেল মেরেন। ওদের উপর আসন্ন ঝড়ের মুখে এমনি নিস্পৃহতা দেখে কপট অবিশ্বাসে মাথা নাড়ল তাই।

প্যারাপেটের দূর প্রান্তে ইদালি ও নিজের মেয়েদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাকোন্তো। ওদের দিকে এগিয়ে গেল তাইতা। বরাবরের মতো ইম্বালির অভিজাত নিলোটিক বৈশিষ্ট শান্ত, দূরাগত।

ওদের তুমি চেনো, ইম্বালি। কীভাবে আক্রমণ করবে ওরা? জানতে চাইল ও।

প্রথমে আমাদের সংখ্যা গুনবে, সাহস পরখ করবে, বিনা দ্বিধায় জবাব দিল সে।

সেটা কেমন করে?

সোজা দেয়ালের দিকে তেড়ে আসবে, যাতে আমরা দেখা দিই।

সীমানা প্রাচীরে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করবে?

না, শামান। এটা ওদের নিজেদের শহর। ওদের পূর্বপুরুষদের কবর আছে এখানে। কোনওদিন তাদের কবর পোড়াবে না ওরা।

মেরেনের পাশে ফিরে এলো তাইতা। এবার প্যারাপেট বরাবর পুতুলগুলো বসানোর সময় হয়েছে, বলল ও। শিলুক স্ত্রীদের দিকে নির্দেশটা চালান করে দিল মেরেন। প্যারাপেটের নিচে আগেই পুতুলগুলো বসিয়ে রেখেছিল ওরা। এবার সীমানা প্রাচীর বরাবর দৌড়ে দৌড়ে এমনভাবে ওগুলোকে বসাতে লাগল যাতে দেয়ালের উপর দিয়ে নকল মুণ্ডগুলো বাসমারারা দেখতে পায়।

মনে হচ্ছে এক ধাক্কায় ফাঁড়ির শক্তি দ্বিগুন করে ফেলেছি, মন্তব্য করল তাইতা। আরেকটু সমীহের সাথে আমাদের দেখতে বাসমারাদের সাহায্য করা উচিত।

ছাই-ঢাকা জমিনের উপর বর্শাধারীদের মহড়া দেখতে লাগল ওরা, ওখানে কুঁড়েগুলো পোড়ানো হয়েছে। বাসমারারা ওদের তিনটা রেজিমেন্ট জড়ো করল, সামনে রয়েছে ক্যাপ্টেনরা।

ওই মহড়া শিথিল, ওদের ফরমেশন অগোছাল, বিভ্রান্ত, মেরেনের কণ্ঠস্বর ভর্ৎসনাপূর্ণ। এটা একটা আবর্জনা, সেনাদল নয়।

আবর্জনা বটে তবে অনেক বড়, বলল তাইতা, কিন্তু আমাদের বাহিনীটা অনেক ছোট, যুক্তি দেখাল তাইতা। জেতার আগে পর্যন্ত এসো উৎসব মূলতবী রাখা যাক।

খোঁচানো বন্ধ হলো, মাঠে নেমে এলো নীরবতা। বাসমারাদের সারি ছেড়ে এগিয়ে এলো একটা অবয়ব। সীমানা প্রাচীরের দিকে আধাআধি দূরত্ব পেরিয়ে এলো সে। লোকটার মাথায় উঁচু ফ্লামিঙ্গো শিরস্ত্রান। নিজের লোকদের সামনে দাঁড়িয়ে যোদ্ধার ভাব দেখার সুযোগ করে দিল ওদের তারপর তীক্ষ্ণ কণ্ঠের চিৎকার করে হুকুম দিল। প্রত্যেক বিরতির সময় শূন্যে লাফিয়ে উঠছে, বর্মের উপর সজোরে আঘাত হানছে বর্শা।

কী বলছে? বিভ্রান্ত দেখাল মেরেনকে।

আমাদের সাথে বন্ধুত্বের কথা বলছে না, এটা ধরে নেওয়া যায়, হেসে বলল তাইতা।

একটা তীর পাঠিয়ে উৎসাহ যোগাচ্ছি ওকে।

তোমার সবচেয়ে দূরপাল্লার লক্ষ্য থেকেও সত্তর কদম দূরে আছে সে, ওকে বাধা দিল তাইতা। নষ্ট করার মতো তীর নেই আমাদের।

বাসমারাদের অবিসম্বাদিত নেতা বাসমাকে লক্ষ করতে লাগল ওরা। অপেক্ষমান দলের কাছে ফিরে গেল সে। এবার পেছন সারির পেছনে নেতৃত্বের অবস্থান নিল সে। আবার নীরবতা এলো রণক্ষেত্রে। কোনও নড়াচড়া নেই। এমনকি হাওয়া পর্যন্ত মরে গেছে। ট্রপিকাল বজ্রঝড়ের পূর্ব মুহূর্তের নিস্তব্ধতার মতো অসহনীয় হয়ে উঠেছে টেনশন। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার ছাড়ল সর্দার বাসমা, হাউ! হাউ! সাথে সাথে আগে বাড়ল সেনা দল।

সামলে! নিজের লোকদের উদ্দেশে বলল মেরেন। কাছে আসতে দাও ওদের। তীর সামলে রাখ!

বাসমারাদের নিবিড় সারিগুলো ঝড়ের বেগে মার্কারের বাইরের চিহ্ন পার হলো; তারপর শুরু করল রণহুঙ্কার। বর্মে আঘাত হানছে ওদের বর্শা। প্রতি পঞ্চম পদক্ষেপে সমবেতভাবে নগ্ন পায়ে মাটিতে আঘাত করছে ওরা। ওদের গোড়ালিতে বাঁধা ঝুমঝুমিতে বাড়ি পড়ছে। আঘতে লাফিয়ে উঠছে জমিন। ভস্মীভূত শহরের ছাইয়ের গাদা থেকে কোমর পর্যন্ত উঠে আসছে সূক্ষ্ম ধুলিকণা, মনে হচ্ছে পানি ভেঙে আগে বাড়ছে ওরা। এক শো কদম মার্কারের কাছে পৌঁছাল ওরা। চিৎকার আর ঢাকের আওয়াজ উন্মাদনা লাভ করল।

সামলে! চিৎকার ছাড়ল মেরেন, যাতে শোরগোল ছাপিয়ে ওর কণ্ঠস্বর পৌঁছে যায়। হাতে হাত ধরো! সামনের সারিটা পঞ্চাশ কদমের চিহ্নের কাছে এসে গেছে। বাসমারাদের মুখের বিচিত্র নকশার খুঁটিনাটি সব দেখতে পাচ্ছে ওরা। নেতারা এখন চিহ্ন পার হয়ে গেছে, এত কাছে এসে পড়েছে যে সীমানা প্রাচীরের তীরন্দাজরা ওদের দেখতে পাচ্ছে।

এইবার নিশানা করো! গর্জে উঠল মেরেন। উঁচু হলো ধনুকগুলো। তীরন্দাজরা ছিলা টেনে ধরায় বেঁকে গেল ওগুলো। দণ্ড বরাবর লক্ষ্য স্থির করায় ছোট হয়ে গেল ওদের চোখ। বাহু ব্যথা করতে শুরু করা পর্যন্ত ওদের তীর ধরে রাখতে দেওয়া ঠিক হবে না, জানে মেরেন। আগের নির্দেশের পায়ে পায়ে এলো ওর পরের নির্দেশ। ঠিক সেই মুহূর্তেই তিরিশ কদম চিহ্নে এসে পা রাখল নিবিড় শত্ৰুসারি।

এবার! চিৎকার করে বলল মেরেন। একযোগে তীর ছুঁড়ে মারল ওরা। এই দূরত্বে একটা তীরও ফস্কাল না। নিবিড় ঘন মেঘের মতো উড়ে গেল ওগুলো। দুই তীরন্দাজ একই বাসমারা যোদ্ধাকে লক্ষ্য করেনি, এটা ওদের নৈপূণ্যের একটা লক্ষণ। প্রথম সারিটা এমনভাবে লুটিয়ে পড়ল যেন পৃথিবীর বুকে একটা গহ্বরে পড়ে গেছে।

ইচ্ছামতো ছেড়ো! হুঙ্কার ছাড়ল মেরেন। চৰ্চিত নৈপূণ্যের সাথে ফের ছিলায় তীর পরাল তীরন্দাজরা। টেনে ধরেই এক সাথে ছেড়ে দিল আবার। দেখে সহজ, শিথিল একটা ভঙ্গি মনে হলো। বাসমারাদের পরের সারিও লুটিয়ে পড়ল। কয়েক মুহূর্ত বাদে ওদের উপর লুটাল পরের সারি। ওদের পেছনে যারা ছিল তারা ক্রমবর্ধমান লাশের স্তূপে হোঁচট খেতে লাগল।

তীর লাগবে এখানে! প্যারাপেটের ছাদ বরাবর বয়ে গেল চিৎকারটা। কাঁধের উপর রাখা তীরের ভারে উবু হয়ে দ্রুত ছুটে এলো শিলুক মেয়েরা। এগিয়ে আসছে বাসমারারা, তীর ছুঁড়ে চলল তীরন্দাজরা, যতক্ষণ না ওরা সীমানা প্রাচীরের নিচে এসে দেয়ালের খুঁটিতে বেয়ে ওঠার মতো একটা কিছু পাওয়ার চেষ্টায় কিলবিল করতে লাগল। কেউ কেউ উপরে উঠে এলো, কিন্তু নাকোন্তা, ইম্বালি আর ওর মেয়েরা অপেক্ষায় ছিল ওদের। যুদ্ধের কুড়োলগুলো ওঠানামা করল যেন লাকড়ি চিড়ছে। ঘাই মারার বর্শা চালানোর সময় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল নাকোন্তোর চিৎকার।

অবশেষে হাতির দাঁতের বাঁশির তীক্ষ্ণ শিষের আওয়াজ সহসা যুদ্ধে বিরতি ডেকে আনল। ছাইয়ে আবৃত মাঠের উপর দিয়ে উধাও হয়ে গেল বাহিনী। জীবিতদের ফের একজোট করতে ওখানে অপেক্ষা করছিল বাসমা।

প্যারাপেট বরাবর দ্রুত আগে বাড়ল মেরেন। কেউ চোট পেয়েছে? পায়নি? ভালো। তীর তুলে আনতে গেলে যারা মরার ভান করে আছে তাদের বেলায় সাবধান থেকো। ওই শয়তানগুলোর এটা একটা প্রিয় কৌশল।

গেট খুলে তীর জড়ো করতে দ্রুত ছুটে গেল ওরা। অনেক তীরের ফলাই মরা মাংসে গেঁথে গেছে, কুড়োল দিয়ে কেটে বের করতে হলো সেগুলো। বিভৎস কাজ, অচিরেই কসাইদের মতো রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল ওরা। তীর সংগ্রহ শেষ হলে মৃত বাসমারাদের বর্শাও সংগ্রহ করল ওরা। তারপর দৌড়ে সীমানায় ফিরে দড়াম করে দরজা আটকে দিল।

মেয়েরা শুকনো মাছ আর ধুরা পিঠা ভর্তি ঝুড়ি ও চামড়ার পানির পাত্র নিয়ে এলো। বেশির ভাগ পুরুষই তখনও খাবার চিবুচ্ছিল, এমন সময় ফের শুরু হলো গান, ক্যাপ্টেনরা আবার প্যারাপেটে তলব করল ওদের। যার যার অস্ত্র তুলে নাও!

নিবিড় সরল রেখায় ফের আগে বাড়ল বাসমারারা। কিন্তু এইবার নেতাদের হাতে রয়েছে দীর্ঘ খুঁটি, বনে বসে বানিয়েছে ওগুলো। দেয়ালের তীরন্দাজদের হাতে আঘাত খাওয়ার সময় পেছনের লোকেরা ওদের ফেলে দেওয়া খুঁটি তুলে নিয়ে আবার আগে বাড়ছে। খুঁটিগুলো সীমানার বাইরের প্রাচীরের কাছে আসার আগে পঞ্চাশ জন লোক প্রাণ হারাল। খুঁটির এক প্রান্ত উপরে দেয়ালের চূড়ার সাথে ঠেস দিতে সামনে ছুটে এলো বাসমারারা। সাথে সাথে খুঁটি বেয়ে ভীড় করে ওঠা শুরু করে দিল ওরা। দাঁত দিয়ে ছোট বর্শা ধরে রেখেছে।

খুঁটির উপর ওদের ভার চেপে বসায় প্রতিরোধকারীদের পক্ষে সেগুলোকে উল্টে দেওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। আক্রমণকারীরা দেয়ালের চূড়ায় পৌঁছানোর পর হাতাহাতি মারপিট করতে বাধ্য হলো ওরা। পুরুষদের সাথে সার বেধে দাঁড়াল ইম্বালি ও ওর মেয়েরা, যুদ্ধ কুড়োলে ভীষণ হত্যালীলা চালিয়ে গেল। কিন্তু বাসমারারা যেন লোক্ষয়ে নির্বিকার। সতীর্থদের লাশের উপর দিয়ে বেয়ে উঠছে, ধেয়ে আসছে হামলা করতে, অধীর ও অদম্য।

শেষে ছোট একটা দল যুদ্ধ করে প্যারাপেটে উঠে এলো। শেষ শত্ৰুটিকে আবার পিছু হটতে বাধ্য করার আগে প্রচণ্ড যুদ্ধ হলো। তবে, নতুন স্রোত ধেয়ে এলো ওদের জায়গা দখল করতে। ঠিক যখন মনে হচ্ছিল ক্লান্ত আত্মরক্ষাকারীরা কেবল রঙচঙে লাশের ওজনের কাছেই হার মানবে, ঠিক তখনই ফের তীক্ষ্ণ সুরে বাঁশি বেজে উঠল। দূরে হারিয়ে গেল হানাদাররা।

মদ পান করল ওরা, ক্ষতস্থান পরিচর্যা করল, ভোঁতা তলোয়ারের জায়গায় নতুন তীক্ষ্ণ তলোয়ার নিল। কিন্তু বিরতিটা ছিল অল্পায়ুর, আবার চিৎকার শোনা গেল। যার যার অস্ত্র তুলে নাও! আবার আসছে ওরা!

মেরেনের লোকেরা সূর্যাস্তের আগে আরও দুটি ধাওয়ার মুখোমুখি হলো, কিন্তু শেষেরটা ছিল ব্যয়বহুল। বর্শা বা মুগুরের আঘাতে বাসমারাদের আবার ফেরত পাঠানোর আগে প্রাণ হারাল আটজন পুরুষ ও ইম্বালির দুটি মেয়ে।

সৈনিকদের অল্প কজনই অক্ষত অবস্থায় দিনটা পার করতে পেরেছে। কয়েক জনের সামান্য কেটে ছিঁড়ে গেছে, ভারি বাসমারা মুগুরের আঘাতে হাড় ভেঙেছে দুজনের। আরও দুজন রাতের শেষ দেখতে পাবে নাঃ পেট আর ফুসফুসে গাঁথা বর্শা ভোরের আগেই পরপারে নিয়ে যাবে ওদের। অনেকেই এত ক্লান্ত যে খাওয়া বা নিজেদের কুঁড়ের আশ্রয়ে টেনে নেওয়ার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে। তৃষ্ণা মেটানোর পরপরই ফের প্যারাপেটের কাছে চলে এলো ওরা, ঘামে ভেজা বর্ম ও রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ নিয়েই ঢলে পড়ল ঘুমে।

এখানে আরও একটা দিন টিকতে পারব না, তাইতাকে বলল মেরেন। গ্রামটা মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। বাসমারারা এতটা নাছোড় হবে ভাবিনি। এখান থেকে যেতে হলে সবকটাকে মারতে হবে। ক্লান্ত, হতাশ দেখাচ্ছে ওকে। চোখের কোটরে ব্যথা হচ্ছে ওর-বারবার পট্টি তুলে হাতের গিঁট দিয়ে ডলছে।

ওকে এমন কাহিল অবস্থায় কমই দেখেছে তাইতা। এই সীমানা সামলে রাখার মতো যথেষ্ট লোকবল নেই আমাদের, সায় দিল ও। ভেতরের রেখার ভেতরে চলে যেতে হবে আমাদের। দেয়াল ঘিরে রাখা চূড়ান্ত প্রতিরক্ষা চক্রের দিকে তাকাল ওরা। রাতের অন্ধকারে কাজটা করা যাবে। তারপর সকালে শত্রুপক্ষের প্রথম দলটা ধেয়ে এলেই সীমানা প্রাচীরে আগুন ধরিয়ে দেব। আগুন না নেভা পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখা যাবে ওদের।

তারপর?

ঘোড়াগুলোকে জিন পরিয়ে রাখব, শহর থেকে সটকে পড়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকব।

কোথায়?

জানতে পেলেই জানাব তোমাকে, কথা দিল তাইতা, উঠে দাঁড়াল আড়ষ্টভাবে। সীমানা পাহারায় যারা আছে তাদের সাথে আগুনের পট আছে কিনা নিশ্চিত করো। আমি ফেনের কাছে গেলাম।

কুঁড়েয় ঢুকে তাই দেখল ফেন ঘুমাচ্ছে। পা পরখ করতে গিয়ে ওকে জাগিয়ে দিতে চাইল না, কিন্তু গাল স্পর্শ করতেই শীতল ঠেকল। তপ্ত বা জ্বরাক্রান্ত নয়। ক্ষতস্থান পচেনি। নিজেকে আশ্বস্ত করল ও। লায়লাকে বিদায় করে ফেনের পাশে শুয়ে পড়ল ও। তিনটা শ্বাস টানার আগেই ঢলে পড়ল গভীর অন্ধকার ঘুমে।

*

ভোরের অনিশ্চিত আলোয় জেগে উঠল ও। ওর মুখের কাছে উদ্বিগ্ন চেহারায় বসে আছে ফেন। ভেবেছিলাম তুমি মরে গেছ, তাই চোখ খুলতেই বলে উঠল ও।

আমিও তাই ভেবেছিলাম, উঠে বসল তাইতা। তোমার পা দেখি। ব্যান্ডেজ খুলে দেখল ক্ষতস্থানটা সামান্য লাল হয়ে আছে, কিন্তু সেটা ওর হাতের চেয়ে তপ্ত নয়। সামনে ঝুঁকে সেলাইয়ের গন্ধ শুকল। পচনের কোনও লক্ষণ নেই। পোশাক পরে নাও। আমাদের দ্রুত সটকে পড়তে হতে পারে। ওকে টিউনিক আর নেংটি পরতে সাহয্য করার সময় বলল, তোমাকে একটা ক্রাচ বানিয়ে দিচ্ছি, তবে তার ব্যবহার শেখার সামান্য সুযোগই পাবে। সূর্যাস্তের সময় ফের আক্রমণ করবে বাসমারারা। চট করে একটা হালকা ছড়ি দিয়ে ক্রাচ আর একটা বাঁকানো ক্রসপিস বানিয়ে ফেলল ও, বাকল দিয়ে গদি বানিয়ে দিল ক্রসপিসে। শরীরের সমস্ত ভর ওটার উপর ছেড়ে দিল ফেন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওকে ঘোড়ার আস্তাবলে যেতে সাহায্য করল তাইতা। দুজনে মিলে ওয়ার্লউইন্ডের পিঠে জিন চাপাল, লাগাম পরাল। সতর্ক বাণী ভেসে এলো সীমানা থেকে।

ওয়ার্লউইন্ডের সাথেই থাকো, ওকে বলল তাইতা। তোমার খোঁজে ফিরে আসছি আমি। দ্রুত পায়ে সীমানার দিকে ফিরে গেল ও। মেরেন ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল।

ফেন-কেমন আছে ও? মেরেনের প্রথম প্রশ্ন ছিল এটাই।

ঘোড়া হাঁকাতে পারবে, ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছে, বলল তাইতা। এখানে কী হচ্ছে?

উন্মুক্ত মাঠের উপর দিয়ে ইশারা করল মেরেন। দুই শো কদম দূরে বনের কিনারে অবার দলবদ্ধ হচ্ছে বাসমারা বাহিনী।

এত কম, মন্তব্য করল তাইতা। গত সন্ধ্যার অর্ধেক।

দক্ষিণের দেয়ালের দিকে তাকান, বলল মেরেন।

বিশাল হ্রদের দিকে তাকাতে পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল তাই। বেশ! গত কাল যেটা করা উচিত ছিল আজ তবে সেটাই করছে, শুষ্ক কণ্ঠে বলল ও। এবার দুই দিক থেকে আক্রমণ করবে। এক এক মুহূর্ত ভেবে তারপর জানতে চাইল, আজ সকালে কয়জন অস্ত্র তুলে নেওয়ার মতো সুস্থ আছে?

রাতে তিন জন মারা গেছে, আমাদের চারজন সৈনিক ওদের শিলুক বেশ্যা আর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে রাতের অন্ধকারে সটকে পড়েছে। বেশি দূরে যাবার আগেই বাসমারাদের হাতে ধরা খাবে বলে আমার ধারণা। তো, নাকোন্তো আর ওর গোত্রীয় বোন আওকাসহ আমাদের সাথে আছে মোটে ষোল জন।

লোকজন আর তাদের মালসামান বইবার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ঘোড়া আছে আমাদের, বলল তাইতা।

বাসমারাদের আরেকটা হামলার মোকাবিলা করার কোনও সুযোগ আছে। আমাদের, নাকি সীমানা প্রাচীরে আগুন লাগিয়ে ধোয়ার ভেতর সটকে পড়ব?

সিদ্ধান্ত নিতে বেশি সময় নষ্ট করল না তাইতা। এখানে থাকলে অনিবার্যকে একটু পিছিয়ে দেওয়াই সার হবে, বলল ও। আমরা ঘোড়ার পিঠে একটা সুযোগ নেব, পালানোর চেষ্টা করে দেখব। সবাইকে আমাদের ইচ্ছার কথা জানিয়ে দাও।

নির্দেশ নিয়ে সারি বরাবর এগিয়ে গেল মেরেন। ফিরে এলো অচিরেই। কী করতে হবে, সবাই জানে, ম্যাগাস। ফায়ার পটগুলো তৈরি আছে। ছক্কার গুটি কৌটায় ঘোড়ার জন্যে তৈরি আছে। নীরব রইল তাইতা; শত্রুবাহিনীর দিকে চোখ। ওর। আবার পরিচিত রণহুঙ্কার শুরু হওয়ার আওয়াজ পেল ওরা। বর্মের দামামা। আর শত শত নগ্ন পায়ের দাপানি।

আসছে ওরা, মৃদু কণ্ঠে বলল মেরেন।

বেড়ায় আগুন লাগিয়ে দাও, নির্দেশ দিল তাইতা। শুকনো ডালপালার তূপের কাছে অপেক্ষমান লোকজন ছুটে গেল ওগুলোর কাছে, ফায়ার পটের জ্বলন্ত জিনিস ছিটকে দিল। মাদুর দিয়ে বাতাস শুরু করল। নিমেষে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল অগ্নিশিখা।

পিছিয়ে যাও! হুঙ্কার দিল মেরেন। জ্বলন্ত প্যারাপেট থেকে লাফ দিল জীবিতরা। অন্যরা যখন ল্যাঙচাচ্ছে বা খোঁড়াচ্ছে, তখন কয়েকজন যন্ত্রণাকরভাবে তাদের সাহায্য করল। ওদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে সহসা ক্লান্ত বোধ করল তাইতা, নিজেকে নাজুক ও বয়স্ক মনে হচ্ছে ওর। এখানেই, জগতের এই প্রত্যন্ত বুনো প্রান্তরেই শেষ হয়ে যাবে সব? এত কষ্ট, ভোগান্তি ও মৃত্যু বিফলে যাবে? ওকে লক্ষ করছিল মেরেন। কাঁধ সোজা করে দাঁড়াল সে। এখন তার পক্ষে হার মানা ঠিক হবে নাঃ মেরেন ও বাকি লোকজনের প্রতি একটা দায়িত্ব রয়েছে ওর, তারচেয়ে বড় কথা ফেনের প্রতি ওর দায়িত্ব আছে।

যাবার সময় হলো, ম্যাগাস, আস্তে করে বলল মেরেন। মই বেয়ে নামতে সাহায্য করতে ওর হাত তুলে নিল। ওরা ঘোড়র কাছাকাছি পৌঁছতে পৌঁছতে গোটা সীমানা প্রাচীর হুহু শব্দ তোলা দাউদাউ লেলিহান শিখায় ঢাকা পড়ে গেছে। গা পোড়ানো ভীষণ তাপ থেকে বাঁচতে কুঁকড়ে গেল ওরা।

ঘোড়া বের করে নিয়ে গেল সৈনিকরা। ঘোড়া বরাদ্দ দিতে সারি বরাবর আগে বাড়ল মেরেন। ফেন অবশ্যই ওয়ার্লউইন্ড হাঁকাবে, ওকে পাহারা দিতে রেকাবে তুলে নেবে ইম্বালিকে। উইন্ডস্মোক পাবে তাইতা, ওর রেকাবের দড়িতে ঝুলে থাকবে নাকোন্তো। বে হাঁকাবে মেরেন, ওর নষ্ট চোখের পাশে থাকবে আওকা। বাকি সওয়ারিরা যার যার ঘোড়ায় চাপবে। একটা খচ্চরও বেঁচে না থাকায় বাড়তি দুটো ঘোড়ার পিঠে খাবার আর মালসামান বোঝাই করা হয়েছে। ওগুলোর লাগাম হাতে তুলে নিয়েছে হিলতো ও শাবাকো।

জ্বলন্ত বেড়ার আড়াল নিয়ে বাইরের দরজার মুখোমুখি ঘোড়ায় চাপল ওরা। লস্ত্রিসের সোনালি মাদুলিটা উঁচু করে ধরল তাইতা, নিজেদের উপর আড়াল করার মন্ত্র পাঠ করতে লাগল। শত্রুপক্ষের চোখের আড়ালে নিয়ে গেল নিজেদের। ঘোড়া ও মানুষের একটা বিশাল দলকে আড়াল করার সমস্যা জানে ও। কিন্তু অদিম বাসমারারা সহজেই ওর সৃষ্টি মায়ায় ভুলে যাবে।

জ্বলন্ত বেড়া পেরিয়ে আসার কোনও চেষ্টাই করল না বাসমারারা। ওরা স্পষ্টতই ধরে নিয়েছে প্রতিপক্ষ ভেতরে আটকা পড়েছে, তাই ওদের খতম করার সুযোগের অপেক্ষা করছে। অগ্নিশিখার অন্যপ্রান্তে চিৎকার করছে ওরা, গান গাইছে। আগুনের শিখা বাইরের গেট পর্যন্ত পৌঁছে হুড়মুড় করে মাটিতে লুটিয়ে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল তাইতা।

এইবার! নির্দেশ দিল ও। ধোয়ার ভেতর দিয়ে ছুটে গেল হিলতো ও শাবাকো, লুটিয়ে পড়া গেটের উপর দিয়ে দড়ির ফাস ছুঁড়ে দিল। একপাশে সরিয়ে নিয়ে গেল ওগুলো। এখন পথ উন্মুক্ত; আবার দৌড়ে অন্যদের পাশে চলে এলো ওরা।

একসাথে থাকবে, যত কাছে থাকা যায় ততই মঙ্গল, আমাকে অনুসরণ করো, বলল তাইতা। জাদুর ক্ষমতা প্রমাণিত হবে গেট দিয়ে বের হয়ে ওপাশের উন্মুক্ত প্রান্তরে পৌঁছানোর পর। বেরুনোর পথ আগুনের কাঠামো পেয়েছে, জীবন্ত পুড়ে মারা যাবার আগেই পথে বের হয়ে যেতে হবে।

দুলকি চালে সামনে বাড়, নীরবে নির্দেশ জারি করল তাইতা। শক্তির কণ্ঠ ব্যবহার করল ও, লাইনের প্রতিটি লোকের কানে পৌঁছে গেল ওর কথা। জ্বলন্ত গেটের দিকে ধেয়ে গেল ওরা। দেয়ালের মতো ওদের বাধা দিচ্ছে তাপ। কয়েকটা ঘোড়া পিছিয়ে আসার চেষ্টা করল, কিন্তু চাবুক ও স্পারের সাহায্যে ওদের সামনে যেতে বাধ্য করল সওয়ারিরা, তাপে কেশর আর চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। লোকজনের চেহারাও পুড়ে যাওয়ার যোগাড়। তবে নিবিড় দলে থেকেই অবশেষে খোলা প্রান্তরে বের হয়ে এলো ওরা।

বাসমারারা ওদের চারপাশে নাচছে, হুঙ্করা ছাড়ছে। এ দিকে তাকালেও ওদের উপর দিয়ে ফাঁকা পার হয়ে যাচ্ছে ওদের দৃষ্টি, চলে যাচ্ছে জ্বলন্ত বেড়ার দিকে। তাইতার জাদুতে কাজ হচ্ছে।

নীরবে, দ্রুত, সতর্ক করল তাইতা। খুব কাছাকাছি থেকো। হুট করে কেউ নড়াচড়া করে বসো না। মাদুলিটা উঁচু করে ধরে রাখল ও। পাশে ফেনও তাই করছে। সোনার তালিসমানটা উঁচু করে রেখেছে ও, ওকে শিখিয়ে দেওয়া কথার পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। জাদু শক্তিশালী করে তোলার কাজে সাহায্য করছে তাইতাকে। প্রায় পরিষ্কার জায়গায় না পৌঁছানো পর্যন্ত খোলা প্রান্তরের উপর দিয়ে এগিয়ে চলল ওরা। বনের সীমানা এখন দুইশো কদমের চেয়ে কম দূরে। কিন্তু এখনও গোত্রীয় লোকগুলোর চোখে ওদের অস্তিত্ব ধরা পড়েনি। তারপর ঘাড়ের পেছনে শীতল হাওয়ার একটা ছোঁয়া টের পেল তাইতা। ওর পাশে ঢোক গিলে তালিসমানটাকে ওটার চেইনে ছেড়ে দিল ফেন। পুড়িয়ে দিচ্ছে! চিৎকার করে বলে উঠল ও, চেয়ে রইল আঙুলের ডগায় লাল দাগের দিকে। তারপর ভীত চেহারায় তাইতার দিকে তাকাল। কিছু একটা আমাদের জাদু নষ্ট করে দিচ্ছে। ঠিক বলেছে ও। দমকা হাওয়ার ঝাপ্টায় ছিঁড়ে যাওয়া নাজুক পালের মতো ছিঁড়ে ফানা ফানা হয়ে যাচ্ছে, টের পাচ্ছে তাই। আড়াল করা জোব্বা থেকে নগ্ন করে ফেলা হচ্ছে ওদের। আরেকটা প্রভাব কাজ করছে ওদের উপর। সেটা ঠেকাতে বা ফেরাতে পারছে না ও।

দুলকি চালে আগে বাড়ো! চিৎকার করে বলল ও। বনের সীমানার দিকে ছুটল ঘোড়াগুলো। বাসমারাদের ভেতর বিরাট চিৎকার উঠল। রঙচর্চিত চেহারাগুলো ফিরে গেল ওদের দিকে। প্রত্যেকটা চোখে রক্তের নেশা। প্রান্তরের সব দিক থেকে ছোট অশ্বারোহী দলটার দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করল ওরা।

দৌড়া! উইন্ডস্মোককে তাগিদ দিল তাইতা। কিন্তু দুজন বিশালদেহীকে বইছে সে। সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো ধীর ভঙ্গিতে ঘটতে শুরু করেছে। ওরা পেছনে ধেয়ে আসা যোদ্ধাদের আগে আগে ছুটলেও ডান দিক থেকে বর্শাধারীদের আরেকটা ফর্মেশন ছুটে আসতে শুরু করেছে।

জলদি! যত তাড়াতাড়ি পারিস! আবার তাগিদ দিল তাইতা। বাসমাকে ওদের বিচ্ছিন্ন করতে নেতৃত্ব দিতে দেখেছে ও। ডান কাঁধে বর্শা নিয়ে সামনে থেকে ছুটে আসছে, নির্ভুল নিশানা করতে তৈরি। শিকারের গন্ধে হাউন্ডের মতো গর্জন করছে তার লোকজন।

জলদি! চিৎকার করে উঠল তাইতা। কোণ আর গতি যাচাই করেছে ও। আমরা পার পাবই।

ঘোড়সওয়ারদের দলটা তিরিশ কদম দূর দিয়ে পার হয়ে যাবার সময় একই হিসাব কষল বাসমাও। ওদের পেছনে বর্শা ছুঁড়ে দিতে ছোটার গতি ও হতাশার শক্তিকে কাজে লাগাল। উঁচুতে লাফিয়ে উঠল সে, তেড়ে এলো মেরেনের বোঝাই বে গেল্ডিংয়ের উদ্দেশে।

মেরেন! চেঁচিয়ে সাবধান করল তাইতা, কিন্তু বর্শাটা ছিল ওর অন্ধ পাশে। ঠিক জিনের পেছনে ওর ঘোড়ার পিঠে বিধল ওটা। বের পা ভেঙে পড়ল। পোড়া জমিনের উপর দলামোচা হয়ে ছিটকে পড়ল মেরেন আর আওকা। ধাওয়ায় ক্ষান্ত দিতে যাচ্ছিল বাসমারারা, কিন্তু এবার খুশিতে সর্দারের নেতৃত্বে ধেয়ে এলো ওর দিকে। গড়ান দিয়ে উঠে দাঁড়াল মেরেন। অন্য ঘোড়সওয়ারদের ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল, নিজেদের ঘোড়া টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওদের। চলে যাও! চিৎকার করে বলল ও। নিজেদের বাঁচাও, কারণ আমাদের বাঁচাতে পারবে না তোমরা। দ্রুত ওকে ঘিরে ফেলতে শুরু করেছে বাসমারারা।

ওয়ার্লউইন্ডের ঘাড় স্পর্শ করল ফেন, হাঁক দিল ওটার উদ্দেশে। হোয়া! ওয়ার্লউইন্ড, হোয়া!

উড়ন্ত অবস্থায় চড়াই পাখির মতো পাঁই করে ঘুরল ধূসর কোল্ট। কী হচ্ছে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেরেন যেখানে আওকার সাথে দাঁড়িয়েছিল সেদিকে ধেয়ে গেল ফেন। ফেনকে ওর দিকে আসতে দেখে মুহূর্তের জন্যে এতটাই হতবাক হয়ে গেল মেরেন যে, মুখে রা সরল না ওর। ওর রেকাবে ঝুলছে ইম্বালি, কুড়োল হাঁকাচ্ছে। হাতের ইশারায় ওকে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করল মেরেন। চলে যাও! কিন্তু ফেন ঘুরে দাঁড়ানোর সাথে সাথে তাইতাও ঠিক একই রকম আত্মঘাতী কাণ্ড করে বসেছে। বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল দলের বাকি সবাই। ঘোড়াগুলো পিছিয়ে যাচ্ছে, ঝাঁপ দিচ্ছে, একটার উপর আরেকটা উল্টে পড়ছে; অশ্বারোহীরা আবার ওদের নিয়ন্ত্রণে না আনা পর্যন্ত এমনি বিশৃঙ্খলা চলল। তারপর একসাথে উল্টো পথ ধরল সবাই।

সর্দারের নেতৃত্বে সবচেয়ে কাছের বাসামারারা এখন প্রায় ওদের উপর এসে পড়েছে। এগিয়ে আসার সাথে সাথে বর্শা ছুঁড়ছে। প্রথমে হিলতোর, তারপর শাবাকোর ঘোড়া আঘাত পেল, হুড়মুড় করে পড়ে গেল ওগুলো, পড়ার সময় সওয়ারিদের ছুঁড়ে ফেলল পিঠ থেকে।

চট করে একবার চোখ বুলিয়ে বদলে যাওয়া পরিস্থিতি দেখে নিল তাইতা। ওদের সবাইকে বইবার মতো যথেষ্ট ঘোড়া নেই এখন। আত্মরক্ষামূলক চক্র গড়ে তোল! চিৎকার করে বলল ও। এখানেই ওদের মোকাবিলা করতে হবে।

জিন থেকে খসে পড়া লোকগুলো অনেক কষ্টে উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে এলো ওর দিকে। অক্ষত ঘোড়ার পিঠে যারা ছিল, তারা লাফ দিয়ে নেমে টেনে একটা বৃত্তের কেন্দ্রে নিয়ে গেল ওদের। ধনুক খসিয়ে নিল তীরন্দাজরা। কুড়োল হাতে নিল ইম্বালি ও আওকা। বাইরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছে ওরা। বর্শাধারীদের জমাট বাঁধা ফর্মেশনকে ধেয়ে আসতে দেখার পর পরিণতি সম্পর্কে ওদের মনে কোনও সন্দেহ রইল না।

এটাই শেষ লড়াই। আমাদের মনে থাকার মতো একটা শিক্ষা দাও ওদের! খুশির সাথে চেঁচাল মেরেন। সামনাসামনি বাসমারারদের প্রথম দলটার মোকাবিলা করল ওরা। হিংস্রভাবে যারপরনাই মরিয়া হয়ে লড়াই করে চলল ওরা। পিছিয়ে দিল হানাদারদের। কিন্তু সর্দার বাসমা ফের ওদের এক করল। লাফাচ্ছে, চিৎকার করছে সে। আবার ওর সাথে আক্রমণ শানাতে এগিয়ে এলো ওরা। নাকোন্তোর দিকে ধেয়ে গেল সে। ওর বর্মকে ফাঁকি দিয়ে উরু লক্ষ্য করে আঘাত হানল।

ওর পাশে ছিল ইম্বালি, ক্ষতস্থান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসতে দেখে সঙ্গীকে বাঁচাতে ক্ষেপে ওঠা সিংহীর মতো উড়ে গেল বাসমার দিকে। নিজেকে বাঁচাতে ঘুরে দাঁড়াল বাসমা, কুড়োলের আঘাত ঠেকাতে বর্শা ওঠাল। ইম্বালির কোপে দুভাগ হয়ে গেল বর্শার হাতল, যেন প্যাপিরাসের আগাছা। বাসমার ডান কাঁধে আঘাত করল ওটার ফলা। টলে উঠে পিছিয়ে গেল সে। অর্ধেক খসে পড়া হাতটা পাশে ঝুলছে। ফলাটা এক ঝটকায় আলগা করেই ফের আঘাত করল ইম্বালি। এইবার মাথা লক্ষ্য করে। পরিষ্কার ফ্লামিঙ্গো পালকের মুকুট দুভাগ করে নেমে গেল ওটা। দাঁত পর্যন্ত কেটে দুর্ফাঁক করে দিল বাসমার মাথার খুলি। এক মুহূর্তের জন্যে বিভক্ত চোখ দুটো ফলার উল্টো দিক থেকে পরস্পরের দিকে পিটপিট করল। তারপর ওটা মুক্ত করে নিল ইম্বালি। বেরিয়ে আসার সময় হাড়ের সাথে মাংসের ঘর্ষণের আওয়াজ উঠল। সেই সাথে বেরিয়ে এলো হলদে ঘিলু।

সর্দারকে লুটিয়ে পড়তে দেখল বাসমারারা, মরিয়া আর্তনাদ ছেড়ে পিছিয়ে গেল। কঠিন ছিল লড়াইটা। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ওদের-রণক্ষেত্রের ছোট বৃত্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মৃতদেহ। মিশরিয়রা সংখ্যায় কম, কিন্তু শেষ করার জন্যে তাড়াহুড়ো করল না ওরা। নিজেদের অবস্থান জোরদার করার জন্যে বিরতির সুযোগ নিল তাইতা। ঘোড়াগুলোকে শুয়ে পড়তে বাধ্য করল। সব অশ্বারোহী সেনাকেই এই কৌশল শিক্ষা দেওয়া হয়। বাসমারাদের বর্শার হাত থেকে কিছুটা আড়াল যোগাল ওদের শরীর। পেছনে তীরন্দাজদের মোতায়েন করে ইম্বালিকে দায়িত্ব দিল ও। ওর সাথে মাঝখানে রয়েছে ফেন ও আওকা। এবার নিজেই ফেনের পাশে অবস্থান নিল ও। শেষ পর্যন্ত ওর সাথে থাকবে ও, ঠিক যেভাবে অন্য জীবনে ছিল। এইবার, ভাবল ও, ব্যাপারটা ওর জন্যে দ্রুত ও সহজতর করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও।

বৃত্তের অন্যদের দিকে তাকাল ও। হাবারি, শোফার ও শেষ দুজন যোদ্ধা মারা গেছে। শাবাকো ও হিলতো এখনও খাড়া থাকলেও আহত। ক্ষতস্থানের পরিচর্যা নিয়ে মাথা ঘামায়নি ওরা। মুঠো ভর্তি ধুলো চেপে রক্তক্ষরণ বন্ধ করেছে কেবল। ওদের ওপাশে হাঁটু গেড়ে বসে নাকোন্তোর উরুতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছে ইম্বালি। কাজ শেষ হলে তাইতার দিকে চোখ তুলে তাকাল, ওর চোখে যোদ্ধার চেয়ে বরং নারীসুলভ দৃষ্টিই বেশি ফুটে উঠল।

ঘোড়া থেকে উল্টে পড়ার সময় উপুড় হয়ে পড়েছিল মেরেন। ওর গালে আঘাত লেগেছে, নষ্ট চোখে ফের রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। রক্তের একটা ধারা চামড়ার পট্টির নিচ দিয়ে নাকের পাশ ঘেঁষে উপরের ঠোঁটের কাছে গড়িয়ে নামছে। শান দেওয়ার পাথরে তলোয়ারের ফলায় শান দেওয়ার সময় জিভ দিয়ে মুছে ফেলল ও। শত্রুপক্ষের নিবিড় ঘেরাওয়ের ভেতর থেকে, যেভাবে আহত আর ভেঙে পড়েছে ওরা, তাতে কারও মাঝেই বীরত্বের কিছু নেই।

কোনও অলৌকিক ঘটনাবলে আজকের দিনে বেঁচে গেলে ওদের জন্যে রণ কাব্য লিখে দেব, যে শুনবে তার চোখে জল এসে যাবে, গম্ভীর চেহারায় নিজেকে কথা দিল তাইতা।

তীক্ষ্ণ কণ্ঠের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে নীরবতা ভঙ্গ করল একটা কণ্ঠস্বর। আমরা মেয়েমানুষ নাকি বাসমারা শয়তানের চ্যালাদের সাথে যুদ্ধ করছি? আবার গুঞ্জন। শুরু করল জনতা। দুলছে, পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করছে।

প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিল আরেকটা কণ্ঠস্বর। আমরা পুরুষ, আমরা হত্যা করতে এসেছি!

মারো! বর্শা নিয়ে এসো! বর্শা কাজে লাগাও! চড়া হয়ে উঠল গানের আওয়াজ। নাচতে নাচতে পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে করতে এগোতে শুরু করল দলটা। নাকোন্তোর পাশে দাঁড়িয়েছিল ইম্বালি, ওর ঠোঁটে ক্ষীণ ক্রুর হাসি। মাথার চুল ঠিক করে নিয়েছে হিলতো আর শাবাকো। আবার হেলমেট চাপিয়েছে মাথায়। ঠোঁট থেকে রক্ত মুছে ফেলেছে মেরেন, দৃষ্টি পরিষ্কার ও তীক্ষ্ণ করে নিতে ভালো চোখটা পিটপিট করল একবার। তলোয়ার খাপে পুরে ধনুক বের করে নিল; শত্রুপক্ষকে এগিয়ে আসতে দেখার সময় ওটার উপর ভর দিয়ে দাঁড়াল। আড়ষ্টভাবে উঠে দাঁড়াল ফেন। আহত পা-টাকে বাঁচাচ্ছে। তাইতার হাত ধরল ও।

ভয় পেয়ো না, পিচ্চি, ওকে বলল ও।

ভয় পাইনি, বলল ফেন, কিন্তু তুমি আমাকে তীর ঘেঁড়া শেখালে ভালো করতে। এখন তোমার অনেক উপকারে লাগতাম।

আইভরি বাঁশি বেজে উঠল। ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল শত্রুবাহিনী। আত্মরক্ষাকারীদের ছোট দলটা পর পর দুবার ওদের বিরুদ্ধে তীরধনুক দিয়ে লড়াই করল। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধনুকে তীর জোড়া যায় তত তাড়াতাড়ি তীর ছুড়ল। কিন্তু ওদের সংখ্যা কম, কালো শরীরের জলোচ্ছ্বাসের ভেতর বলতে গেলে একটা তরঙ্গও সৃষ্টি করতে পারল না।

বৃত্তে ঢুকে পড়ল বাসমরারা। ফের হাতাহাতি লড়াই লেগে গেল। গলায় আঘাত পেয়েছে শাবাকো, মারা যাবার সময় ওর গলা থেকে হারপুনে গাঁথা তিমির মতো রক্ত বের হয়ে আসতে লাগল। অসংখ্য দেহের চাপে ভেঙে পড়ল ছোট বৃত্তটা। পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইম্বালি ও নাকোন্তা, আক্রমণ শানাচ্ছে ওরা। আওকা মারা গেছে। পিছু হটে ফেন তাইতা আর ওর মাঝখানে না আসা পর্যন্ত সরে গেল মেরেন। আরও খানিকটা সময় হয়তো লড়াই করে যেতে পারবে ওরা, কিন্তু তাইতা জানে অচিরেই ফেনকে ছেড়ে দিতে হবে। চট করে ওকে অনুসরণ করবে ও। একসাথে থাকবে ওরা।

সোজা হৃৎপিণ্ড বরাবর আঘাত হেনে এক লোককে শেষ করল মেরেন। ঠিক একই সময়ে ওর পাশের লোকটাকে ফেলে দিল তাইতা।

ওর দিকে ফিরল মেরেন। সময় হয়েছে, ম্যাগাস, আপনি চাইলে আপনার জন্যে কাজটা করব আমি, ভাঙা কণ্ঠে বলল ও। তৃষ্ণা আর ধূলিতে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে।

তাইতা জানে মেরেন এখন ফেনকে কত ভালোবাসে, ওকে হত্যা করা তার জন্যে কত কষ্টকর হবে। উঁহু, সৎ মেরেন, তবে তোমাকে এর জন্যে ধন্যবাদ জানাই। এটা আমার কাজ। স্নেহের চোখে ফেনের দিকে তাকাল তাইতা। প্রিয় আমার মেরেনকে চুমু দিয়ে বিদায় শুভেচ্ছা জানাও, কারণ তোমার আসল বন্ধু ও। তাই করল ফেন। তারপর বিশ্বাসের সাথে তাইতার দিকে ফিরল। মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করল ও। খুশি হলো তাইতা। ওই সবুজ চোখজোড়া ওর দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় কোনওদিনই কাজটা করতে পারত না। তলোয়ার ওঠাল ও, কিন্তু আঘাত হানার আগেই সামলে নিল। বাসমারাদের যুদ্ধের গান এখন হতাশা ও ত্রাসের বিশাল গোঙানিতে পরিণত হয়েছে। ওদের সারিগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে নেকড়ে দাঁত বারাকুড়ার আক্রমণের মুখে সারদিনে ঝাঁকের মতো ছুটে পালাচ্ছে।

বৃত্তের মাঝখানে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ছোট দলটা। নিজেদের আর শত্রু ঘাম-রক্তে নেয়ে গেছে ওরা। বোকার মতো পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা, এখনও বেঁচে আছে কেন বুঝতে পারছে না। পা আর খুরের আঘাতে ওড়া ধুলোর কারণে এখনও রণক্ষেত্র আবছা হয়ে রয়েছে, ওদিকে জ্বলন্ত বেড়া থেকে হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে ধোয়ার অবশিষ্টাংশ। গাছপালার সারি দেখা যায় না বললেই চলে।

ঘোড়া! দাঁতে দাঁত চেপে বলল মেরেন। খুরের আওয়াজ পেয়েছি।

তোমার কল্পনা, একই রকম কর্কশ কণ্ঠে বলল তাইতা। এটা সম্ভব নয়।

না, মেরেনের কথাই ঠিক, বলে উঠল ফেন, গাছপালার দিকে ইশারা করল ও। ঘোড়া!

ধুলো আর ধোঁয়ায় চোখ পিটপিট করল তাইতা। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে না। ওর দৃষ্টি আবছা, ক্ষীণ। জামার হাতায় চোখ মুছে ফের চোখ তুলে তাকাল। অশ্বারোহী বাহিনী? বিড়বিড় করে বলল ও, কণ্ঠে অবিশ্বাস।

মিশরিয় অশ্বারোহীবাহিনী, চিৎকার করে উঠল মেরেন। ক্র্যাক টুপ! ওদের সামনে নীল পতাকা উড়ছে। বাসমারাদের সারির ভেতর দিয়ে ছুটছে অশ্বারোহী বাহিনী, প্রথমে বর্শায় গাঁথছে ওদের, তারপর পাঁই করে ঘুরে এগিয়ে যাচ্ছে। তলোয়ার দিয়ে কাজ শেষ করার জন্যে। অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ভয়ে কেটে পড়ছে বাসমারারা।

এ হতে পারে না, বিড়বিড় করে বলল তাইতা। মিশর থেকে দুই হাজার লীগ দূরে রয়েছি আমরা। ওরা এখানে আসে কী করে? এ সম্ভব নয়।

বেশ, নিজের চোখকে তো বিশ্বাস করতে হয়-নাকি বলব, একটা ভালো চোখকে? খুশির সাথে বলে উঠল মেরেন। ওরা আমাদের দেশি লোক! কয়েক মিনিটের ভেতর কেবল মৃত বা অচিরেই মরতে বসা বাসামারারা ছাড়া আর কেউ রইল না। প্রহরীদল এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আহতদের ঘাই মারতে জিন থেকে সামনে ঝুঁকে পড়ছে। উচ্চ পদস্থ তিনজন কর্মকর্তা অশ্বারোহী বাহিনীর মুল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রেহাই পাওয়া ছোট দলটার দিকে দুলকি চালে এগিয়ে আসতে শুরু করল।

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নীল দলের কর্নেল, বলল তাইতা।

গোল্ড অভ মেরিট ও লাল পথের ভ্রাতৃসঙ্রে ক্রস পরেছে, বলল মেরেন। আসলেই যোদ্ধা!

তাইতার সামনে এসে লাগাম টানল কর্নেল। অভিবাদন জানাতে ডান হাত উঁচু করল। আমরা হয়তো দেরি করে ফেলেছি ভেবে ভয় হচ্ছিল, মহান ম্যাগাস। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি এখনও আপনি বহাল তবিয়তে আছে। সকল দেবতাকে তাদের করুণার জন্যে ধন্যবাদ জানাই।

তুমি আমাকে চেনো? আরও অবাক হয়ে গেল তাই।

গালালার তাইতাকে সারা দুনিয়া চেনে। অবশ্য, ভুয়া পয়গম্বরের পরাজয়ের পর আপনার সাথে রানি মিনতাকার দরবারে দেখা হয়েছিল আমার, তবে সেটা অনেক বছর আগের কথা, তখন আমি এনসাইন ছিলাম। সেটা আপনার স্মৃতি থেকে মুছে গেছে, এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই।

তিনাত? কর্নেল তিনাত আনকুত? লোকটার চেহারার স্মৃতি জাগিয়ে তুলল তাইতা।

কৃতজ্ঞতার হাসি দিল কর্নেল। আপনার স্বীকৃতি দিয়ে আমাকে সম্মানিত করলেন।

তিনাত আনকুত সুদর্শন, শক্তিশালী ও বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, অবিচল দুষ্টি। অন্তর্চক্ষু দিয়ে ওকে দেখল তাইতা। আভায় কোনও রকম দুর্বলতা বা ত্রুটি দেখতে পেল না। যদিও ওটার গভীরে একটা গম্ভীর নীল ঝিলিক এক ধরনের আবেগজাত অস্থিরতার প্রতীক তুলে ধরছে। সাথে সাথে বুঝে গেল ও, তিনাত সম্ভষ্ট মানুষ নয়। আদারি দুর্গ হয়ে আসার সময় তোমাদের খবর পাই আমরা, ওকে বলল তাইতা। কিন্তু ওখানে রেখে আসা তোমার লোকদের ধারণা ছিল বুনো এলাকায় মারা গেছ তোমরা।

দেখতেই পাচ্ছেন, ম্যাগাস, ওদের ভুল হয়েছে, হাসল না তিনাত। কিন্তু এখন এখান থেকে চলে যেতে হবে। আমার লোকেরা আরও হাজার হাজার এই বুনো বর্বরদের আমাদের দিকে এগিয়ে আসার আলামত পেয়েছে। আমাকে যে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল–আপনাকে নিরাপদ হেফাযতে নিয়ে যাওয়া-সেটা পালন করেছি। আমাদের আর সময় নষ্ট না করে এখুনি এখান থেকে সরে পড়তে হবে।

আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে, কর্নেল তিনাত? আমরা এখানে আছি, আমাদের সাহায্য প্রয়োজন, কেমন করে জানলে তুমি? কে তোমাকে আমাদের উদ্ধার করতে পাঠিয়েছে? জানতে চাইল তাইতা।

যথা সময়ে আপনার প্রশ্নের উত্ত দেওয়া হবে, ম্যাগাস। কিন্তু দুঃখের সাথে বলছি সেটা আমার দ্বারা নয়। আপনাদের প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখতে কপ্টেন ওনকাকে এখানে রেখে যাচ্ছি। আবার অভিবাদন জানিয়ে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল সে।

ঘোড়া দাঁড় করাল ওরা। বেশির ভাগই আহত; দুটোর আঘাত এমন মারাত্মক যে ওদের মেরে ফেলা ছাড়া গতি নেই। কিন্তু উইন্ডস্মোক ও ওয়ার্লউইন্ড অক্ষত রয়ে গেছে। ওদের কাছে তেমন মালসামান না থাকলেও তাইতার ডাক্তারি সরঞ্জাম ভারি ও বিশাল। সব কিছু বহন করার মতো পশু ছিল না বলে ক্যাপ্টেন ওনকা আরও প্যাক হর্স আনার হুকুম দিল। নিজ দলের লোক আর ঘোড়াগুলোর ক্ষতস্থানের পরিচর্যা করে দিল তাইতা। ওনকা অধৈর্য, কিন্তু এ কাজে তাড়াহুড়ো করার জো নেই। ওরা রওয়ানা হতে হতে আরও খানিকটা সময় কেটে গেল।

*

ওদের নিয়ে যেতে অশ্বারোহী বাহিনীর একটা স্কোয়াড্রন পাঠালো কর্নেল তিনাত। ওদের মাঝখানে থেকে বেশ সুরক্ষিত অবস্থায় আগে বাড়ল ওরা। আরেকটা বিশাল কলাম ওদের পেছনে খেটে মরছে, সাথে কয়েক শো বিলাপরত বন্দি, বেশিরভাগই বাসমারা মেয়ে।

দাস, অনুমান করল মেরেন। নিরীহ পর্যটকদের বাঁচানোর সাথে দাস পাকড়াও করার কাজটাও মিলিয়ে নিয়েছে তিনাত।

কোনও মন্তব্য না করলেও নিজেদের অবস্থান আর মর্যাদা ভেবে দেখল তাইতা। আমরাও কি বন্দি, নাকি সম্মানিত অতিথি? আমাদের স্বাগত জানানোর বিষয়টি অস্পষ্ট রয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন ওনকাকে জিজ্ঞেস করবে কিনা ভাবল একবার, কিন্তু জানে সেটা হবে নেহাতই ব্যর্থ প্রয়াস। ওনকা তার অধিনায়কের মতোই চাপা।

তামাফুপা ছেড়ে নীলের শুকনো পথ ধরে দক্ষিণে হ্রদের দিকে এগিয়ে চলল ওরা। অচিরেই লাল জোড়া-পাথর ও উপরের ব্লাফের পরিত্যক্ত মন্দিরের দেখা মিলল, কিন্তু এখান থেকে নদী ছেড়ে হ্রদের পাশের পথ ধরে পুবদিকে এগোল। ওনকার সাথে মন্দির ও জোড়া-পাথর নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করল তাইতা, কিন্তু ওনকার ভাণ্ডারে একটাই জবাব: আমি এসব কিছুই জানি না, ম্যাগাস। আমি একজন সাধারণ সৈনিক, মহান সন্ত নই।

আরও কয়েক লীগ এগিয়ে হ্রদের উপরের আরেকটা ব্লাফে উঠে একটা আচ্ছাদিত উপসাগরের দিকে তাকাল ওরা। সৈকতের মাত্র কয়েক কিউবিট দূরে প্রশান্ত জলে নোঙর ফেলা ছয়টা যুদ্ধ গালির একটা বহর এবং বেশ কয়েকটা বিশাল পরিবহন বার্জ দেখে অবাক হয়ে গেল তাইতা ও মেরেন। বাহনগুলোর নকশা অন্যরকম, মিশরের জলে এরকম কখনও দেখেনি; দুই মাথাঅলা খোলা ডেক ওগুলোর। এটা পরিষ্কার, একক দীর্ঘ মাস্তুল খসিয়ে খোলের দৈর্ঘ্য বরাবর শুইয়ে রাখা যায়। খরস্রোতা নদীর জলপ্রপাত ও খাড়া প্রবাহের শাদা পানিতে চলাচল উপযোগি করে নকশা করা হয়েছে তীক্ষ্ণ গলুই আর পেছনের। চতুর নকশা, মেনে নিল তাইতা। পরে জানতে পেরেছিল, খোলসগুলো চারটে ভিন্ন ভিন্ন অংশে বিচ্ছিন্ন করে জলপ্রপাত বা অন্যান্য বাঁধা পাশ কাটিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।

উপসাগরে নোঙর ফেলে রাখা নৌবহরটা দেখে সুদর্শন ও কাজের মনে হচ্ছে। পানি নির্মল, টলটলে, মনে হচ্ছে, খোলসগুলো যেন পানিতে নয় বরং হাওয়ায় ভাসছে।হ্রদের নিচে পরিষ্কার ফুটে রয়েছে ওদের ছায়া। ওগুলো ঘিরে পাক খেয়ে চলা মাছের ঝাক পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে তাই ক্রুদের ফেলে দেওয়া আবর্জনায় আকৃষ্ট হয়ে এগিয়ে এসেছে।

খোলের ওই নকশা অচেনা, মন্তব্য করল মেরেন। মিশরিয় নয়।

প্রাচ্যে সফরের যাওয়ার সময় সিন্ধু নদীর ওধারে এই ধরনের জাহাজ দেখেছিলাম আমরা, সায় দিয়ে বলল তাইতা।

কীভাবে এরকম জাহাজ মানচিত্রের বাইরের অভ্যন্তরীণ সাগরে এলো।?

একটা জিনিস নিশ্চিতভাবে জানা আছে, মন্তব্য করল তাইতা। ক্যাপ্টেন ওনকাকে এসব জিজ্ঞেস করে ফায়দা হবে না।

কারণ সে সাধারণ সৈনিকমাত্র, মহান সাধু নয়, তামাফুপা ছেড়ে আসার পর এই প্রথম হাসল মেরেন। গাইডকে অনুসরণ করে সৈকতে চলে এলো ওরা, প্রায় সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল জাহাজে ওঠার পর্ব। বার্জে তোলা হলো বন্দি বাসমারাদের, ঘোড়া ও তিনাত-বাহিনীকে তোলা হলো অন্যগুলোয়।

উইন্ডস্মোক ও ওয়ার্লউইন্ডকে জরিপ করতে গিয়ে রীতিমতো বাঁচাল হয়ে উঠল কর্নেল তিনাত আনকুর। কী দারুণ জুটি। নিশ্চিতভাবেই মা আর বাচ্চা, তাইতার উদ্দেশে মন্তব্য করল সে। জীবনে এদের সাথে পাল্লা দেওয়ার মতো খুব বেশি হলে তিন থেকে চারটা ঘোড়া দেখেছি। পাগুলো দারুণ, শক্তিশালী বুক কেবল হিব্রাইট বংশেই দেখতে পাবেন। বাজি ধরে বলতে পারি, এগুলো একবাতানার সমতলে জন্ম নিয়েছে।

ঠিক ধরেছ, প্রশংসার সুরে বলল তাইতা। তোমার তারিফ করি। ঘোড়ার দারুণ সমঝদার তুমি।

আরও খুশি হয়ে উঠল তিনাত। ওর জাহাজের যাত্রী তাইতা, ফেন ও মেরেনের জন্যে আলাদা থাকবার ব্যবস্থা করল সে। সবাই উঠলে সৈকত থেকে রওয়ানা হয়ে গেল নৌবহর, এগোল হ্রদের দিকে। রওয়ানা দেওয়ার কাজ শেষ হলে তীর বরাবর পশ্চিমে বাঁক নিল ওরা। খোলা ডেকে খাবার ভাগাভাগি করতে তিনজনকে নিমন্ত্রণ জানাল তাইতা। ওরা কেবুই ছেড়ে আসার পর গত বছরগুলোর সামান্য খাবারের তুলনায় এখানকার রাধুনীর রান্না রীতিমতো খাসা। সদ্য শিকারের পর ঝলসানো হ্রদের মাছের পর এলো বিচিত্র সজি ও লাল মদের অ্যামফোরার একটা ঝর্না। লাল মদের মান এমনকি খোদ ফারাওর টেবিলকেও সম্মানিত করত।

সামনের জলের বুকে সূর্যাস্তের সময় নীলের মুখের লাল পাথরের সাথে একই স্তরে চলে এলো নৌবহর। একটা দীর্ঘ ব্লাফের নিচে নোঙর ফেলল ওরা, ওটার চূড়ায় ইয়োসের মন্দির। দুই বাটি মদ খাওয়ায় দরদী আন্তরিক মেজবানে পরিণত হয়েছে তিনাত। তার হালকা মেজাজের সুযোগ নিতে চাইল তাইতা। ওই দালানটা কীসের? জলের উপর ইশারা করল। দেখে মন্দির বা প্রাসাদের মতো লাগছে, কিন্তু এই রকম নকশা মিশরে কোনওদিন দেখিনি। কারা ওটা বানিয়েছে ভাবছি।

ভুরু কোঁচকাল তিনাত। ওটা নিয়ে তেমন ভাবিনি, কারণ স্থাপত্যে আমার বিশেষ কোনও আগ্রহ নেই, অবশ্য আপনার কথা ঠিক হতে পারে, ম্যাগাস। ওটা মন্দির বা উপাসনালয় হয়ে থাকবে; কিংবা শস্যের গুদামও হতে পারে। কাঁধ আঁকাল সে। আরেকটু মদ দেব আপনাকে? স্পষ্টতই প্রশ্নটা তাকে বিরক্ত করেছে। আবারও দূরবর্তী ও শীতল সৌজন্যমূলক হয়ে উঠল সে। তাছাড়া, এটা পরিষ্কার যে গালি ক্রুদের ওদের সাথে কোনও রকম কথাবার্তা বলতে নিষেধ বা ওদের প্রশ্নের জবাব না দিতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে।

দিনের পর দিন হ্রদের তীর ঘেঁষে পশ্চিমে এগিয়ে চলল নৌবহর। তাইতার অনুরোধে ওদের ছায়া দিতে ও গোপনীয়তা বজায় রাখতে একটা পাল তুলে দিয়েছে ক্যাপ্টেন তিনাত। তিনাত ও নাবিকদের চোখের আড়ালে ফেনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে অগ্রগতি অর্জন করল তাইতা। দক্ষিণে দীর্ঘ যাত্রার সময় একা থাকার তেমন একটা সুযোগ ছিল না ওদের। এখন ওদের ডেকের বিচ্ছিন্ন কোণটা একাধারে আশ্রয় ও পাঠশালায় পরিণত হয়েছে। এখানে ফেনের ধারণা, মনোযোগ ও প্রবৃত্তিকে চমৎকারভাবে গড়ে তোলায় জোর দিতে পারছে ও।

ওকে নতুন নিগূঢ় শিল্পেন নতুন কোনও বৈশিষ্ট্য শেখায়নি। বরং রোজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা আগে রপ্ত করা কৌশলগুলোকেই আরও নিপূণভাবে প্রয়োগের কায়দা শেখাচ্ছে। বিশেষ করে মানসিক ইমেজ ও ভাবনার টেলিপ্যাথিক বিনিময়ের মাধ্যমে যোগাযোগের ব্যাপারে বিশেষভাবে কাজ করছে ও। কেন যেন ওর মনে হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতের কোনও এক সময়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে ওরা। তখন এই ধরনের যোগাযোগের উপরই ওদের বাঁচামরা নির্ভর করবে। ওদের যোগাযোগ দ্রুত ও নিশ্চিত হওয়ার পর ওর আভার বিচ্ছুরণ দমনই তাইতার মূল চিন্তা হয়ে দাঁড়াল। ফেন এইসব অনুশীলন ঠিকমতো রপ্ত করেছে নিশ্চিত হওয়ার পরেই কেবল শক্তির শব্দের সম্মিলন পর্যালোচনার কাজে হাত দিতে পারল ওরা।

অনুশীলনের ঘণ্টা ও দিনগুলো এতই কষ্টসাধ্য ও ক্লান্তিকর যে মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে ফুরিয়ে যাবার কথা ছিল ফেনের। প্রাচীন বিদ্যার বেলায় ও নবীশমাত্র। শরীর ও শক্তির দিক থেকে শিশু। অবশ্য, এমনকি অন্য জীবন যাপনকারী পুরোনো আত্মাকে হিসাবে ধরলেও ওর সামলে নেওয়ার ক্ষমতা বিস্মিত করল তাইতাকে। ওর শক্তি যেন ঠিক নদীর নিচে কাদায় বেঁচে থাকা ওর আত্মার প্রতীক শাপলার মতোই ওর ক্লান্তির উপর ভর করে আবার জেগে ওঠে।

তাইতা অস্পষ্ট বিষয় ছেড়ে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া রুবি পাথর রঙের ফ্লামিঙো পাখি নিয়ে আলোচনায় নামলেই অপ্রতিভভাবে নিমেষে সিরিয়াস ছাত্র থেকে প্রাণবন্ত মেয়েতে পরিণত হতে পারে ও। রাতে ছামিয়ানার নিচে ডেকে বিছানো মাদুরে ওর কাছাকাছি ঘুমিয়ে থাকার সময় ওকে তুলে জোরে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে যেন খোদ মরণও কেড়ে নিতে না পারে।

*

গালির ক্যাপ্টেন আগাম জানান ছাড়াই হ্রদের উপর দিয়ে দমকা হাওয়া বয়ে যাওয়ার কথা বলেছে ওদের। ডুবে যাওয়া অনেক জাহাজের গল্প বলল সে, এখন হ্রদের নিচে অজানা গভীরতায় পড়ে আছে। রোজ সন্ধ্যায় পানির বিশাল বিস্ত গর জুড়ে জুড়ে রাত নামার সময় ছায়াঅলা কোনও খাড়ি বা গুহায় নোঙর ফেলছে ফ্লোটিলা। সূর্যের প্রথম রশ্মি পুব দিগন্তে আকাশের বুকে ময়ূরের লেজের মতো ফুটে ওঠার পরই আবার পাল তোলে ওগুলো, গলুই ঘুরিয়ে নেয়। মহা হ্রদের বিশালতা হতবাক করে রেখেছে তাইতাকে। তীর রেখা যেন অন্তহীন মনে হচ্ছে।

মধ্য সাগর বা ইন্ডিজের মহাসাগরের মতোই বিশাল। নাকি এর কোনও সীমাপরিসীমা নেই? ভাবল ও। অবসর মুহূর্তে ফেন আর ও প্যাপিরাসের পাতায় ম্যাপ আঁকে বা ফেলে আসা দ্বীপ ও সেগুলোর তীরে দেখা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উপর নোট লিখে রাখে।

হাথরের মন্দিরের ভূতাত্ত্বিক পুরোহিতের কাছে নিয়ে যাব এগুলো। ওরা এইসব গোপন ও বিস্ময়কর ব্যাপার জানে না, ফেনকে বলে তাই।

ওর সবুজ চোখে স্বপ্নিল মেঘ দেখা দিল। ওহ, ম্যাগাস, তোমার সাথে আমার আগের জীবনের দেশে ফিরতে চাই। আমাকে অনেক মূল্যবান কথা মনে করতে সাহায্য করেছ তুমি। একদিন আমাকে ওই দেশে নিয়ে যাবে না?

নিশ্চিত থাকতে পারো, কথা দিল ও।

সূর্য, চাঁদ ও অন্যান্য স্বর্গীয় বস্তুর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে তাইতা হিসাব কষে বের করল যে হ্রদের তীর ক্রমে দক্ষিণে দিকে বাঁক নিচ্ছে। আমার বিশ্বাস, আমরা হ্রদের পশ্চিম সীমান্তে পৌঁছে গেছি, অচিরেই বাঁক নিয়ে দক্ষিণে এগোব, বলল ও।

তাহলে পৃথিবীর শেষ সীমায় পৌঁছে আকাশের বুকে ঝরে পড়ার সময় হয়েছে আমাদের। এমন একটা বিপর্যয়ের সম্ভাবনা সত্ত্বেও ফেনকে কেমন নির্বিকার ঠেকল। আমরা কি চিরকাল পড়তে থাকব, নাকি শেষ পর্যন্ত আরেকটা পৃথিবীতে বা আরেক সময়ে পৌঁছে যাব? তোমার কী ধারণা, ম্যাগাস?

আশা করি সামনে শূন্যতাকে মুখ হাঁ করে থাকতে দেখলেই ঘুরে দাঁড়ানোর মতো বুদ্ধি আমাদের ক্যাপ্টেনের আছে। তাহলে আর সময় ও স্থানের ভেতর দিয়ে উল্টে পড়তে হবে না। এখানেই আমি যথেষ্ট সম্ভষ্ট, খুশি। হাসল তাইতা। ফেনের কল্পনার জাল বোনার ক্ষমতা দেখে খুশি হয়েছে ও।

সেদিন বিকেলে ওর উরুর ক্ষত পরখ করল তাইতা, পরিষ্কার সেরে গেছে দেখে খুশি হয়ে উঠল। ঘোড়ার পশমের সেলাইয়ের চারপাশের জায়গাটা টকটকে লাল ও গরম হয়ে আছে। খুলে ফেলার সময় হওয়ার পরিষ্কার লক্ষণ। গিঁট ছিঁড়ে ফোরসেপ দিয়ে তুলে আনল ও। সামান্য হলদে পুঁজ বেরিয়ে এলো ওগুলোর ফুটো থেকে। গন্ধ শুঁকে হাসল ও। মিষ্টি, ক্ষতিকর নয়। এরচেয়ে ভালো ফল আশা করতে পারতাম না। দেখ, কী সুন্দর একটা ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে ওটা, ঠিক তোমার শাপলার পাপড়ির মতো।

ক্ষত পরখ করার সময় একদিকে মাথা কাত করে রাখল ফেন। ওর কনিষ্ঠ আঙুলের নখের চেয়ে বড় হবে না ওটা। তুমি অনেক চালাক, ম্যাগাস। আমি নিশ্চিত ইচ্ছা করেই ওটা করেছ। ইম্বালির টাট্ট ওর কাছে যত প্রিয় এটা আমার কাছে তারচেয়ে অনেক বেশি ভালো লাগছে। খুব ঈর্ষা হবে ওর!

দ্বীপের গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা, ওখানকার গাছগুলো এত পুরু ও লম্বা যে মনে হয় মাথার উপরের নীল বাঁকানো স্বৰ্গকে ঠেস দিয়ে রেখেছে। উঁচু ডালে বানানো নীড়ে ঈগল পাখি বসে রয়েছে। ঝলমলে শাদা পালক ও বাদামী ডানার অসাধারণ সুন্দর পাখি। আকাশে ওড়ার সময় বুনো গানের মতো চিৎকার ছাড়ে, তারপর হ্রদে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠোঁটে টাটকা মাছ নিয়ে উঠে আসে।

সবগুলো সৈকতেই বিশাল বিশাল কুমীরকে রোদ পোহাতে দেখল ওরা, অগভীর পানিতে জলহস্তির জমায়েত। ওদের গোলাকার ধূসর পিঠ গ্রানিট বোল্ডারের মতোই বিশাল। ওরা আবার উন্মুক্ত জলে বের হয়ে এলে তাইতার অনুমান সত্যি প্রমাণ করে দক্ষিণে বাঁক নিল তীরটা। পৃথিবীর শেষ প্রান্তের দিকে ধেয়ে চলল ওরা। কালো মোষ, ধূসর হাতি ও বিশাল নাকের উপর শিঙঅলা শুয়োর সদৃশ জানোয়ারে ভরা অন্তহীন বনের পাশ দিয়ে পাল তুলে ভেসে চলল। এই প্রথম এই ধরনের জানোয়ার দেখছে ওরা। ওগুলোর স্কেচ এঁকে রাখল তাইতা। ওগুলোকে অলৌকিকভাবে নিখুঁত মন্তব্য করল ফেন।

আমার বন্ধু পুরোহিতরা এমন জানোয়ারের অস্তিত্ব থাকার কথা বিশ্বাস করতে চাইবে না, মন্তব্য করল তাইতা। মেরেন, ফারাওর জন্যে নাক কেটে উপহার নিয়ে যেতে একটা জানোয়ার শিকার করতে পারবে? ওদের মেজাজ মর্জি এতটাই প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে যে সবার মনেই শেষ পর্যন্ত অনেক উত্তরের নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে বদ্ধমূল ধারণা জন্মাতে শুরু করেছে।

বরাবরের মতো তাইতার কথায় জানোয়ারের পিছু ধাওয়া করে লাফিয়ে পড়তে উদগ্রীব হয়ে উঠল মেরেন। আপনি তিনাত ও ক্যাপ্টেনকে দিন দুয়েকের জন্যে নোঙর ফেলতে রাজি করাতে পারলে একটা ঘোড়া আর তীর ধনুক নিয়ে তীরে নেমে যেতে পারি।

তিনাতের কাছে দীর্ঘদিন বার্জের বদ্ধ পরিবেশে থাকার পর একটু দৌড়ানোর সুযোগ পেলে ঘোড়াগুলোর উপকার হবে বলে প্রস্তাব রাখল তাইতা। আপাত তাকে বেশ আন্তরিক আবিষ্কার করল ও।

ঠিক বলেছেন, ম্যাগাস। তাছাড়া, ভালো মাংসের এমন দারুণ যোগান হাতছাড়া হতে দেওয়া যায় না। সৈনিক ও দাসদের নিয়ে অনেকগুলো পেটের ব্যবস্থা করতে হয় আমাকে।

সেদিন সন্ধ্যায় হ্রদের কিনারে একটা প্রশস্ত সমতলে এলো ওরা। বনের উন্মুক্ত জায়গাগুলো নানান শিকারে ভরা: ধূসর গণ্ডার থেকে শুরু করে সবচেয়ে ছোট আকর্ষণীয় অ্যান্টিলোপ পর্যন্ত। সমভূমি পুবে বাঁক নিয়ে আসা একটা ছোট মোহনায় দ্বিখণ্ডিত, একটা হ্রদে শেষ হয়েছে ওটা। অল্প দূরত্বের জন্যে চলাচলের উপযোগি, ফ্লোটিলার জন্যে একটা নিরাপদ নোঙরের ব্যবস্থা করেছে। ঘোড়া নামাল ওরা, পুরুষরা নদীর তীরে তাবু খাটাল। পায়ের নিচে কঠিন মাটির ছোঁয়া পেয়ে খুশি হয়ে উঠল ওরা। পরদিন সকালে ঘোড়ার পিঠে চেপে রওয়ানা হওয়ার সময় উৎসবমুখর অনুভূতি হলো ওদের। তিনাত ওর শিকারীদের মোষ শিকারের নির্দেশ দিয়ে গাভী আর বাছুর নিয়ে আসতে বলল; বুড়ো ষাঁড়ের চেয়ে ওগুলোর মাংস অনেক স্বাদু-ষাঁড়ের মাংস শক্ত ও গন্ধযুক্ত, বলতে গেলে অখাদ্য।

তামাফুপায় পাওয়া আঘাত থেকে অনেকটাই সেরে উঠেছে মেরেন ও হিলতো। নাকের ডগায় দানবীয় শিংঅলা গণ্ডারের পিছু ধাওয়ায় নেতৃত্ব দেবে ওরা। নাকোন্তো ও ফেন দর্শক হিসাবে থাকবে পেছনে। শেষ মুহূর্তে কর্নেল তিনাত এসে তাইতাকে বলল, আমি আপনার সাথে খেলাটা দেখতে যেতে চাই। আশা করি, আমার উপস্থিতিতে আপত্তি করবেন না।

অবাক হলো তাইতা। এমন একজন গগোমড়ামুখো মানুষের কাছ থেকে এমনি বন্ধুত্বপূর্ণ আগ্রহ আশা করেনি। তোমাকে সাথে পেলে বরং খুশিই হবো, কর্নেল। তুমি জানো, নাকের ডগায় শিংঅলা জানোয়ারগুলোর একটাকে ধরার চেষ্টা করছি। আমরা।

ততক্ষণে ঘোড়সওয়ারীদের বিভিন্ন দল চিৎকার ছেড়ে মোষের পাল তাড়া করে সমতলের উপর দিয়ে ছুটতে শুরু করেছে। খুব কাছে থেকে আগে বাড়ছে যাতে বর্শা চালাতে পারে। সাহসী ও দ্রুত গতির জানোয়ারগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়লে ওদের উদ্দেশ্য করে ক্রমাগত তীর ছুঁড়ে ওরা। অচিরেই তৃণভূমির উপর ছড়িয়ে পড়ল কালো লাশ। বেদিশা হয়ে সমভূমির এদিক ওদিক ছুটতে লাগল সন্ত্রস্ত পশুগুলো। শিকারীদের হাত থেকে বাঁচতে মরিয়া।

পশুর পাল ও ঘোড়সওয়ারদের বিভ্রান্ত ভীড়ে না পড়তে ও গণ্ডারগুলোকে বেছে শিকার করার মতো একটা উন্মুক্ত জায়গার খোঁজে বনের ভেতরের ফাঁকা জায়গা ছেড়ে সরে এলো মেরেন, তীর বরাবর ঘোড়া হাঁকাল। ওরা জাহাজের দৃষ্টিসীমার বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত বাকিরা অনুসরণ করল। একসময় মাঠে ওরা ছাড়া আর কেউ রইল না। সামনে তৃণভূমির উপর বেশ কয়েকটা মাদী ও বাছুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে অপেক্ষা করছে। তবে একটা সর্দারের শিং সংগ্রহ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মেরেন। ফারাওকে উপহার হিসাবে মানানসই ট্রফি।

নোঙর করা জাহাজগুলো থেকে ওদের আরও দূরে নিয়ে যাবার সাথে সাথে কর্নেল তিনাতের ভেতর ক্রম পরিবর্তন লক্ষ করল তাইতা। তার গাম্ভীর্য মিলিয়ে যাচ্ছে, এমনকি ফেনের কোনও কোনও কথায় হাসছেও। আপনার সঙ্গী বুদ্ধিমতী তরুণী, মন্তব্য করল সে। কিন্তু বিচক্ষণ তো?

তুমি যেমন বললে, তরুণী ও, এবং ঈর্ষা বা শত্রুতা থেকে মুক্ত। আর একটু শিথিল হলো তিনাত, অন্তর্চক্ষু খুলে লোকটার মানসিক অবস্থা খতিয়ে দেখল তাইতা। দ্বিধায় ভুগছে, ভাবল ও। আমার সাথে স্বাধীনভাবে কথা বলার সময় বড়কর্তাদের চোখে পড়তে চাইছে না। নিজের লোকদের কাউকে ভয় পাচ্ছে। আমি নিঃসন্দেহ, লোকটা ক্যাপ্টেন ওনকা না হয়ে পারে না। সম্ভবত নজরদারি করতে ও বড়কর্তাদের কাছে খবর দেওয়ার জন্যে পাঠানো হয়েছে তাকে। তিনাত আমাকে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু ভয় পাচ্ছে।

মনের সাহায্যে ফেনের কাছে পৌঁছাল তাইতা, সচেতন হয়ে উঠতে দেখল ওকে। তেনমাস ভাষায় বার্তা পাঠাল ও। মেরেনের কাছে যাও। তিনাতের সাথে একা থাকতে দাও আমাকে।

সাথে সাথে ওর দিকে তাকিয়ে হাসল ফেন। আমাকে ক্ষমা করবে, ম্যাগাস, মিষ্টি করে বলল সে। খানিকটা পথ মেরেনের সাথে যাব আমি। আমাকে একটা তীর বানিয়ে দেবে বলেছিল ও। হাঁটুর ধাক্কায় দুলকি চালে ওয়ার্লউইন্ডকে ছোটাল ও। তাইতার সাথে একা রেখে গেল তিনাতকে।

নিঃশব্দে এগিয়ে চলল ওরা। অবশেষে তাইতা বলল, ফারাওর সাথে আমার কথা থেকে বুঝতে পেরেছি অনেক বছর আগে মিশর ছাড়ার সময় নীল মাতার উৎস পর্যন্ত যাওয়ার নির্দেশ ছিল ফারাও নেফার সেতির, তারপর অনুসন্ধানের ফল জানাতে কারনাকে ফিরে যাবার কথা ছিল তোমাদের।

ওর দিকে তাকাল তিনাত। জবাব দিল না।

সূক্ষ্মভাবে বিরতি দিল তাইতা, তারপর খেই ধরল। ফিরে গিয়ে তাঁর কাছে তোমাদের সাফল্যের সংবাদ দিয়ে যোগ্যতা অনুযায়ী পুরস্কার দাবি করোনি দেখে খুবই অবাক লাগছে। আমরা মিশর থেকে নাটকীয়ভাবে উল্টোপথে যাচ্ছি দেখে বিভ্রান্ত বোধ করছি আমি।

খানিকক্ষণ চুপ থাকল তিনাত। তারপর বলল, ফারাও নেফার সেতি এখন আর আমার শাসক নন। মিশর আর এখন আমার বাসভূমি নয়। আমি ও আমার লোকজন আরও অনেক সুন্দর, সমৃদ্ধ ও আশীর্বাদপুষ্ট একটা দেশ পেয়েছি, ঠিক যেমন মিশর এখন অভিশপ্ত।

তোমার মতো পদমর্যাদার একজন অফিসার দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারে, কোনওদিনই বিশ্বাস হতো না আমার, বলল তাইতা।

আমিই একমাত্র মিশরিয় নই যে একাজ করেছে। অনেক বছর আগে আরও একজন এমন করেছে, এই নতুন দেশে সেই আবিষ্কার করেছে, তারপর আর মিশরে ফিরে যায়নি। রানি লস্ত্রিস একই রকম অভিযানে তাকে পাঠিয়েছিলেন, নীলের উৎসমুখ আবিষ্কারের মিশন দিয়ে। তার নাম জেনারেল লর্ড আকের।

বেশ ভালো করেই চিনতাম ওকে, বাধা দিয়ে বলল তাইতা। ভালো সৈনিক ছিল বটে, কিন্তু দুর্বোধ্য।

তাইতার দিকে তীর্যক চোখ তাকালেও ওর মূল্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলল না সে। লর্ড আকের চাঁদের পাহাড়ের দেশের জাররি বসতির অগ্রগামী, বলল সে। তার প্রত্যক্ষ বংশধররা শক্তিশালী ও উন্নত দেশে পরিণত করেছে একে। ওদের সেবা করতে পেরে আমি সম্মানিত।

অন্তর্চক্ষু দিয়ে তাকে জরিপ করে তাই দেখল কথাটা ঠিক না। বিদেশী সরকারে সেবা করতে গিয়ে সম্মানিত বোধ করা দূরে থাক রীতিমতো মানসিক অশান্তিতে আছে তিনাত। এখন আমাদের সেখানেই নিয়ে যাচ্ছ তুমি, তাই না? জাররিতে?

আমাকে সেরকমই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ম্যাগাস, সায় দিল তিনাত।

এই দেশের রাজা কে? জানতে চাইল তাইতা।

আমাদের কোনও রাজা নেই। অভিজাত ও জ্ঞানী লোকদের একটা অলিগার্কি আমাদের শাসন করে।

তাদের বাছাই করে কে?

আপাত গুণের ভিত্তিতে মনোনীত করা হচ্ছে।

তাইতা বুঝল, মন থেকে এসব কথা বিশ্বাস করে না তিনাত। তুমিও অলিগার্কদের একজন?

না, ম্যাগাস। অভিজাত বংশে জন্ম হয়নি বলে কোনওদিনই সেই সম্মানের দাবিদার হতে পারব না। জাররিতে ইদানীং এসেছি আমি। নবাগত।

তার মানে জাররির সমাজ গোত্রভিত্তিক? জানতে চাইল তাইতা। অভিজাত, সাধারণ জনগণ আর দাস সমাজে বিভক্ত?

মোটা দাগে তাই। আবশ্য আমরা অভিবাসী হিসাবে পরিচিত, সাধারণ মানুষ না।

তোমরা জাররিয়রা কি এখনও মিশরিয় দেবদেবীদের পূজা করো?

না, ম্যাগাস, আমাদের দেবতা একজনই।

কে সে?

জানি না। কেবল ধর্মে দীক্ষাপ্রাপ্তরাই তার নাম জানে। এক দিন আমি সেই সুযোগ পাবার প্রার্থনা করি। এই বক্তব্যে নানা রকম স্ববিরোধী ধারা দেখতে পেল তাইতা: এমন কিছু আছে তিনাত মুখে বলতে পারছে না। যদিও কথাটা বলার জন্যে ওনকার নজর থেকে দূরে সরে আসতে পেরেছে।

আমাকে এই বিস্ময়কর দেশ সম্পর্কে আরও কিছু বলো, যার জন্যে তোমার মতো বিশ্বস্ত একজন লোক প্রলুব্ধ হতে পারে। কথা বলতে ওকে উৎসাহিত করল তাইতা।

এই কাজের উপযুক্ত কোনও শব্দ নেই, জবাব দিল তিনাত। কিন্তু অচিরেই পৌঁছে যাব ওখানে, নিজেই বিচার করতে পারবেন। খোলামনে কথার বলার সুযোগ পায়ে ঠেলছে সে।

কর্ণেল তিনাত, বাসমারাদের কবল থেকে আমাদের উদ্ধার করার সময় তুমি এমন কিছু বলেছিলে যাতে আমার বিশ্বাস হয়েছিল যে তোমাকে সেই স্পষ্ট উদ্দেশ্যেই পাঠানো হয়েছিল। আমার কথা ঠিক?

এরই মধ্যে অনেক কথা বলে ফেলেছি…আপনার সম্পর্কে অনেক উঁচু ধারণা রাখি আর আপনাকে অনেক সম্মান করি বলে। কিন্তু আমাকে আর জোর না করার অনুরোধ জানাতে বাধ্য হচ্ছি। আমি জানি অনেক উন্নত ও অনুসন্ধিৎসু মন আপনার, কিন্তু এমন এক দেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন যার ভিন্ন রীতিনীতি ও আইনকানুন রয়েছে। এই মুহূর্তে আপনি মেহমান, সুতরাং মেজবানের রীতিনীতির প্রতি সম্মান দেখালেই সবার পক্ষে ভালো হবে। এখন পুরোপুরি পিছু হটে গেছে তিনাত।

তার একটা হচ্ছে আমার সাথে জড়িত নয় এমন সব ব্যাপারে খোঁচাখুঁচি না করা।

ঠিক তাইতা, বলল তিনাত। ভদ্র সতর্কবাণী এটা। এরচেয়ে বেশি কিছু বলতে পারল না সে।

আমি সব সময় ভেবেছি যে সুবিধাজনক নীতিমালা স্বৈরাচারকে যুক্তিসঙ্গত ও প্রজাদের ভোলাতে যৌক্তিক।

বিপজ্জনক দৃষ্টিভঙ্গি, ম্যাগাস, জাররিতে থাকার সময় কথাটা গোপন রাখতে হবে আপনাকে, ম্যাগাস। ব্রোঞ্জ হেলমেটের ভাইজরের মতো মুখে কুলুপ আঁটল তিনাত। তাইতা বুঝল, ওর কাছ থেকে বেশি কিছু জানা যাবে না। তবে হতাশ হলো না ও, বরং এত কিছু জানতে পেরে অবাকই হয়েছে।

শিকারীদের ক্ষীণ চিঙ্কারে বাধা পেল ওরা। অনেক সামনে ওর তীরের উপযুক্ত একটা শিকার কোণঠাসা করেছে মেরেন। কোণঠাসা হয়ে অগ্নিনিঃশ্বাসঅলা ড্রাগনের মতো ফুঁসছে বিরল দানবটা, নিপীড়নকারীদের দিকে শঙ্কিত কিন্তু হিংস্র দৌড় শুরু করেছে। বিরাট খুরের ঘায়ে বালি উড়ছে, এপাশ পোশ ঘোরাচ্ছে শিংঅলা নাকটা, শুয়োরের চোখের মতো জ্বলজ্বল করছে চোখজোড়া। প্রায় এক মানুষ সমান লম্বা। শিংটা অবিরাম গাছের কাণ্ড আর উইপোকার ঢিপিতে শান দেওয়ায় চকচক করছে। ঝিলিক মারছে তলোয়ারের মতো।

এইবার ফেনকে দেখল তাইতা। গলার কাছে কী যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠল ওর। জানোরটার সাথে খেলছে ও। নিজের ঘোড়দৌড় ও ওয়ার্লউইন্ডের গতির উপর স্পষ্ট আস্থা থাকায় পশুটার নাকের সামনে তীর্যক রেখা তৈরি করে পার হয়ে যাচ্ছে। ধাওয়া করতে আহবান করছে ওটাকে। উইন্ডম্মেকের পেটে গোড়ালি ছোঁয়াল তাইতা, ওকে বাধা দিতে ছুটে গেল। সাথে সাথে সরাসরি জরুরি হাওয়াই বার্তা পাঠাল ওর কাছে। বুঝতে পারল দক্ষ তলোয়ারবিদের মতোই সেটাকে ঠেকাল ফেন, তারপর ওর কাছ থেকে মন বিচ্ছিন্ন করে নিল সে। তেতে উঠল তাইতার রাগ ও উদ্বেগ। পিচ্চি শয়তান! বিড়বিড় করে বলে উঠল।

ঠিক সেই মুহূর্তে ওয়ার্লউইন্ডের চকচকে ধূসর চামড়ার দিকে নজর গেল পশুটার, ফেনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল সে। ঘোঁৎ-ঘোঁৎ গর্জন ছেড়ে বিশাল খুরে জমিনে আঘাত করে তেড়ে গেল ওদের দিকে। কোল্টের ঘাড় স্পর্শ করল ফেন, পূর্ণ গতিতে ছুটতে শুরু করল ওরা। শিং ও ওয়ার্লউইন্ডের লেজের ভেতরে দূরত্ব বোঝার জন্যে ঘোড়ার পিঠের উপর বেঁকে পেছনে তাকাল ও। আরেকেটু সামনে এগোনোর পর দূরত্ব কমিয়ে আনতে ওয়ার্লউইন্ডকে থামাল ও। পশুটাকে আগে বাড়ার তাগিদ দিল।

ফেনের নিরাপত্তার কথা ভেবে শঙ্কিত হলেও ওর দক্ষতা ও সাহসের তারিফ না করে পারল না তাই। মেরেনের একদম কাছে নিয়ে এলো সে জানোয়ারটাকে। পর পর তিনটা তীর ছুঁড়ল মেরেন, উড়ে গিয়ে ওটার কাঁধের পেছনে পুরু চামড়ায় গোড়া অবধি গেঁথে গেল ওগুলো। টলে উঠল পশুটা। মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসতে দেখল তাইতা। মেরেনের ছোঁড়া অন্তত একটা তীর ওটার ফুসফুস ভেদ করেছে। জানোয়াটাকে টেনে আনতে লাগল ফেন। দক্ষতার সাথে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে শরীরের অন্যদিক মেরেনের তীরের নাগালে নিয়ে আসছে। একের পর এক তীর ছুঁড়ে চলল মেরেন। গভীরে গিয়ে বিঁধতে লাগল ওগুলো, হৃৎপিণ্ড আর ফুসফুস ছিন্নভন্ন করে দিচ্ছে।

ফুসুফস রক্তে ভরে ওঠায় জানোয়ারটার গতি শ্লথ হয়ে এসেছে। মৃত্যুর আলস্য শক্তিমান পা পাথরে পরিণত করেছে। নিচের দিকে মাথা ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময় ভোলা মুখ ও নাক দিয়ে ফোয়ারার মতো রক্ত বের হতে লাগল ওটার। এক পাশ থেকে ছুটে গেল নাকোন্তো, কানের পাশ দিয়ে সেঁধিয়ে দিল ওর বর্শাটা। মগজের সন্ধানে বাঁকা করে দিল ফলাটা। প্রবল শব্দে লুটিয়ে পড়ল লাশটা, গোটা জমিন কেঁপে উঠল, ধুলোর মেঘ উড়ল।

তাইতা ওদের কাছে পৌঁছুতে পৌঁছুতে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে লাশ ঘিরে দাঁড়িয়েছে সবাই। উত্তেজনায় নাচছে ফেন, বাকিরা হেসে শেষ, হাততালি দিচ্ছে। অবাধ্যতার জন্যে ফেনকে অপমান করে গালিতে ফেরত পাঠাতে দৃঢ়পতিজ্ঞ ছিল তাইতা। কিন্তু পাথরের মতো চেহারা করে ও যখন ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলো, ফেন ছুটে এলো ওর কাছে, লাফিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরল।

তাইতা, তুমি দেখেছে সবটা? দারুণ না? তোমার কি ওয়ার্লউইন্ড আর আমার জন্যে গর্ব হচ্ছে না? তারপর ঠোঁটের কাছে উঠে আসা কর্কশ কণ্ঠে বকাঝকা শুরু করার আগেই ওর কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল, তুমি আমার সাথে এত ভালো আর সুন্দর আচরণ করো, আমি তোমাকে ভালোবাসি, প্রিয় তাইতা।

রাগ মুছে যাচ্ছে, টের পেল তাইতা, পরিহাসের সাথে নিজেকে জিজ্ঞেস করল, কে কাকে শিক্ষা দিচ্ছে? অন্য জীবনে এই কৌশল ওর পছন্দ ছিল। এখনও ওর বিরুদ্ধে আমি অসহায়।

*

চল্লিশটারও বেশি বিশাল পশু হত্যা করেছে শিকারীরা, ফলে সবগুলো লাশের Vছাল খসিয়ে মাংস কেটে ঝলসে বার্জে তুলতে বেশ কয়েক দিন লাগল। কেবল তারপরেই গালিতে চেপে আবার দক্ষিণে যাত্রা শুরু করতে পারল ওরা। নিজের অফিসারদের সাথে যোগ দেওয়ার পর ফের বিচ্ছিন্ন, দুর্গম লোকে পরিণত হয়েছে তিনাত। অন্তর্চক্ষু দিয়ে ওকে পরখ করতে গিয়ে তাইতা বুঝতে পারল ওর সাথে আলাপের সময় বলে দেওয়া বিষয়গুলোর জন্যে নিজেকে দোষারোপ করছে সে। গোপনীয়তা বজায় রাখার ব্যাপারে নিজের অক্ষমতায় এখন ভীত হয়ে উঠেছে।

উত্তরে ঘুরে গেছে বাতাস, সজীব হয়ে উঠেছে। বৈঠা তুলে রেখে বিরাট তেকোনো পাল উড়িয়েছে গালিগুলো। ওদের গলুইয়ের নিচের পাক খাচ্ছে শাদা পানি, ডানদিকে দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে কিনারা। শিকারের পর পঞ্চম সকালে আরেকটা শাখার মুখে পৌঁছাল ওরা। পশ্চিমের উঁচু এলাকা থেকে নেমে আসা শাখাটা বিপুল পরিমাণ পানি ঢেলে দিচ্ছে হ্রদে। ক্রুদের নিজেদের ভেতর আলাপ করতে দেখল তাইতা, বারবার উচ্চারিত হলো কিতানগালে নামটা। নিঃসন্দেহে এটাই ওদের সামনের নদীর নাম। পাল নামিয়ে আবার বৈঠা তুলে নেওয়ার হুকুম দিল ক্যাপ্টেন, তাতে অবাক হলো না ও। ওদের গালি ফ্লোটিলাকে কিতানগালেয় নিয়ে এলো, প্রবল স্রোতের বিরুদ্ধে এগিয়ে চলল।

কয়েক লীগের মধ্যেই নদীর তীর বরাবর গড়ে ওঠা বড়সড় একটা বসতির কাছে পৌঁছে গেল। এখানে ঢালে অসমাপ্ত খোলের দুটো বিশাল আকারের জাহাজ পড়ে আছে। ওগুলোর উপর গিজগিজ করছে শ্রমিকের দল। ইশারায় ওদের তত্ত্ববধানকারীর দিকে মেরেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করল তাইতা। এখানেই জাহাজের বিদেশী নকশার কারণ বোঝা যায়। নিশ্চয়ই এই ইয়ার্ডেই সব বানানো হয়েছে, যারা বানিয়েছে তারা নিঃসন্দেহে সিন্ধু নদের ওপাশের কোনও দেশ থেকে আসা।

কীভাবে এখানে এলো ওরা, নিজ দেশ থেকে এত দূরে? জানতে চাইল মেরেন।

এখানে এমন কিছু আছে যা বাগানের ফুল মৌমাছিকে আকর্ষণ করার মতো যোগ্য লোকদের টেনে আনে।

আমরাও কি মৌমাছি, ম্যাগাস? আমাদেরও কি একই আকর্ষণ টেনে নিয়ে চলেছে?

সবিস্ময়ের ওর দিকে তাকাল মেরেন। মেরেনের পক্ষে এটা অস্বাভাবিক গভীর চিন্তা। ফারাওকে দেওয়া পবিত্র শপথ রক্ষা করতে এখানে এসেছি আমরা, ওকে মনে করিয়ে দিল তাইতা। তবে এসেই যখন পড়েছি, খুব সতর্ক থাকতে হবে আমাদের। কিছুতেই অসংখ্য জাররিয়কে যেমন মনে হচ্ছে সেভাবে স্বাপ্নিক ও বিলাসি হয়ে পড়া চলবে না।

নদীর উজানে এগিয়ে চলল নৌবহর। কয়েক দিনের মধ্যেই নদীর এপার থেকে ওপার পর্যন্ত রুদ্ধ করে রাখা শাদা পানির প্রথম জলপ্রপাতের দেখা মিলল। তিনাত ও ওর লোকরা তাতে দমল না, কারণ জলধারার পায়ের কাছে আরেকটা ছোট গ্রাম রয়েছে, সেটার ওপাশে বিশাল গবাদি পশুর খোয়াড়, কুঁজঅলা ষাড়ের পাল রয়েছে এখানে।

তীরে নেমে এলো যাত্রী, ঘোড়া এবং দাসরা। কেবল ক্রুদের জাহাজে রেখে পাকানো লিয়ানার তৈরি কাছি দিয়ে ষাঁড়ের পালের সাথে বেঁধে টেনে দ্রুত গতির পানির শু্যট দিয়ে তুলে আনা হলো ওগুলো। তীরের মানুষ ও পশু জলপ্রপাতের পাশ দিয়ে উঠে যাওয়া পাহাড় বেয়ে উঠে উপরের জমিনে পৌঁছাল। জলপ্রপাতের উপরে নদী গভীর, প্রশান্ত; নোঙর ফেলে হালকাভাবে আগে বাড়ল গালিগুলো। আবার জাহাজে চড়ল সবাই। পরবর্তী জলপ্রপাতের কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত যাত্রা অব্যাহত রাখল, সেখানে ফের একই কৌশলের পুনরাবৃত্তি ঘটল।

তিনবার এভাবে খাড়া জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছে জাহাজ টেনে উপরে তোলা সম্ভব নয়। মিশরিয় এঞ্জিনিয়ারদের প্রতিভা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা অতিক্রমের ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে: জলপ্রপাত ঘেঁষে আঁকাবাঁকা একটা খাল খনন করা হয়েছে, ওগুলোর প্রত্যেক প্রান্তে তালা দেওয়া, জাহাজকে পরের স্তরে যাবার সুযোগ করে দিতে কাঠের গেট আছে তাতে। জলের মই বেয়ে ফ্লোটিলাগুলো উপরে তুলতে অনেক দিন আর বেশ কঠোর খাটুনি গেল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আরও একবার গভীর প্রশান্ত জলধারায় পৌঁছুল ওরা।

হ্রদ ছাড়ার পর থেকে পার হয়ে আসা এলাকা এর অনন্য বৈচিত্র্যে মনোমুগ্ধকর ছিল। ওরা কিতানগালে ঢোকার পর একশো বা তারও বেশি লীগ দূরত্ব গভীর বনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে নদীটা। মাথার উপরে মিশে গেছে ডালপালা, দুটো গাছকে একই জাতের মনে হচ্ছে না। লিয়ানা, অন্যান্য লতা আর ফুলে আর পরগাছায় ভরে আছে ওগুলো। একবারে মগডালের কাছে শোরগোল করছে বানরের দল। নদীর উপর হেলে পড়া ডালে চকচকে-শরীর গিরগিটি রোদ পোহাচ্ছে। নৌকার আগমন টের পেয়ে হাওয়ায় ভেসে ঝপাত করে পানিতে পড়ল ওরা, ভিজিয়ে দিল বৈঠাঅলাদের।

রাতে তীরে নোঙর করার পর, বিশাল গাছের গোড়ায় নৌকার দড়ি বেঁধে রাখা হলো। অদৃশ্য পশুর দলের চিৎকার আর গুলোকে শিকার করা শিকারী জানোয়ারের গর্জনে ভরে উঠল রাতের অন্ধকার। মাঝিদের কেউ কেউ ব্রোঞ্জের হুকে নাড়িভুড়ির টোপ লাগিয়ে পানিতে বঁড়শি পেতে রাখল। টোপ গিলে নেওয়া একটা মাগুড় মাছ তুলতে গিয়ে রীতিমতো লড়াই করল তিনজন।

জলপ্রপাত ধরে উপরে ওঠার সাথে সাথে ধীরে ধীরে তীর বরাবর জন্মানো গাছপালা বদলে যেতে শুরু করল। গা পোড়ানো গরম কমে ঠাণ্ডা হয়ে এলো, বাতাস হয়ে এলো কোমল। শেষ জল-মই পার হওয়ার পর ঘেসো মাঠ আর পাতাহীন ও কাটাঅলা, কোমল, পালকের মতো আগাছায় ঢাকা বিশাল কালো কাণ্ড ও গাঢ় ডালপালাঅলা নানা জাতের বাবলা গাছে ভর্তি উন্মুক্ত বনের এক নির্মল ল্যান্ডস্কেপে নিজেদের আবিষ্কার করল ওরা। সবচেয়ে লম্বা গাছগুলো উঁচু ডালে তঙুরের মতো ঝুলন্ত ল্যাভেন্ডার ফলে সাজানো।

এটা মাঠ ভরে রাখা মিষ্টি ঘাস আর কিতানগালের মূল ধারায় এসে মেলা কয়েক ডযেন জলধারায় ভর্তি প্রয়োজনীয় জলের উর্বর দেশ। অসংখ্য পশুতে গিজগিজ করছে সমতল, চরে বেড়াচ্ছে ওরা। এমন একটা দিন গেল না যেদিন ওরা সিংহের দলকে খোলা প্রান্তরে শিকার বা বিশ্রাম নিতে দেখেনি। রাতে ওদের বজ্রনির্ঘোষ গর্জন রীতিমতো আত্মারাম খাঁচাছড়া করে দেয়। যতবার ওই ওদের গর্জন শুনুক না কেন, প্রতিবারই শ্রোতার স্নায়ু কেঁপে ওঠে, বেড়ে ওঠে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন।

অবশেষে একটা দীর্ঘ ঢাল মাথা তুলে দাঁড়ালে দিগন্তে। কাছাকাছি যাবার পরপরই একধরনের বিড়বিড়ানি সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠল ওরা। নদীর আরেকটা বাঁক ঘুরে এসে সামনে আরেকটা বিশাল জলপ্রপাত দেখতে পেল, বজ্রের মতো আওয়াজ তুলে একটা ক্লিফের মাথা থেকে নিচের পাক খাওয়া সবুজ পুকুরে পড়ছে শাদা পানি।

ওটাকে ঘিরে রাখা সৈকতে নৌকা তীরে টেনে তুলতে ষাঁড়ের পাল তৈরি রয়েছে। আরও একবার নামল ওরা, তবে এটাই শেষবার। মানুষের বানানো কোনও যন্ত্রের পক্ষে জাহাজগুলোকে এই ক্লিফের উপরে টেনে তোলা সম্ভব নয়। নদীর তীরের বসতিতে অফিসার ও তাইতার দলের থাকার ব্যবস্থা হিসাবে অতিথিভবন রয়েছে। বাকি লোকজন, ঘোড়া ও মালসামান তীরে নিয়ে যাওয়া হলো। ব্যারাকুনে আটকে রাখা হলো বাসমারা দাসদের।

কর্নেল তিনাত ফের যাত্রা শুরু করার আগে তিন দিন কেটে গেল। এবার সব রসদ ষাঁড়ের পালের পিঠে চাপানো হয়েছে। দাসদের ব্যানরাকুন থেকে বের করে লম্বা দড়িতে বাঁধা হলো। সৈন্য বাহিনী ও তাইতার দল ঘোড়ার পিঠে ক্লিফের পাদদেশে ধরে দীর্ঘ কাফেলার মতো এগোল। লীগ খানেক যাবারর পরই চুলের কাঁটার মতো বাঁক নিয়ে ঢাল বেয়ে খাড়া উঠতে শুরু করল রাস্তাটা, সংকীর্ণ হয়ে এলো। এক সময় ঢালটা মারাত্মক খাড়া হয়ে ওঠায় ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে বাধ্য হলো ওরা, ঘোড়া আর বোঝাই ষাড়গুলোকে সামনে বাড়াল। বন্দি দাসরা অনুসরণ করল ওদের।

ক্লিফের মাঝামাঝি উচ্চতায় ওঠার পর একটা জায়গায় হাজির হলো ওরা যেখানে একটা সংকীর্ণ দড়ির সেতু চলে গেছে একটা গভীর গোর্জের উপর দিয়ে। গোর্জ পার হওয়ার দায়িত্ব নিল ক্যাপ্টেন ওনকা, একবারে নাজুক কাঠামোটার উপর দিয়ে প্যাক অ্যানিমেল ও মানুষের একটা ছোট দলকে পার হওয়ার অনুমতি দিল সে। এমনকি সীমিত ওজন সত্ত্বেও সেতুটা ভীতিকরভাবে দোল খেতে শুরু করল। ক্যরাভান গোর্জ পার হতে হতে মধ্যাহ্ন পার হয়ে গেল।

এটাই ক্লিফর চূড়ায় যাবার একমাত্র রাস্তা? ওনকাকে জিজ্ঞেস করল মেরেন।

চল্লিশ লীগ দূরে দক্ষিণে ঢাল বেয়ে উঠে যাওয়া আরেকটা সহজ পথ আছে, কিন্তু তাতে যেতে আরও কয়েকদিন বেশি সময় লাগে।

শূন্যতার ওপারে গিয়ে নিচে তাকাল ওরা, সামনের দৃশ্য যেন গোটা পৃথিবীকে ধারণ করেছে বলে মনে হলো। উঁচু থেকে কালো সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া নদীঅলা সোনালি প্রান্তর, দূরের পাহাড় আর সবুজ বন দেখতে পাচ্ছে। অবশেষে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন দিগন্ত, বিশাল নালুবালের জলধারা গলিত ধাতুর মতো ঝিলিক মারছে-ওটার তীর ধরেই পাল তুলে এসেছে ওরা।

অবশেষে জাররির প্রবেশ পথ কিতানগালে গ্যাপ নামে পরিচিত পাস পাহারা দিতে বসানো রিজের দুর্গে পৌঁছাল ওরা। ওরা যখন বাইরে শিবির গাড়ল তখন আঁধার মিলিয়েছে। রাতে বৃষ্টি হলেও সকাল নাগাদ সূর্য ফের দরাজ আলো বিলোতে শুরু করল। আশ্রয়ের ভেতর থেকে বাইরে তাকিয়ে তাইতা ও ফেন এমন একটা দৃশ্য দেখল যা ওদের এতদিন পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করা সমস্ত দৃশ্য মামুলি ব্যাপারে পরিণত করল। ওদের নিচে বিছিয়ে আছে এক বিশাল মালভূমি, দূর দিগন্তে মিলিয়ে গেছে। মালভূমি বরাবর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে উঁচু উঁচু পাহাড়সারি, নির্ঘাৎ দেবতারের আবাস যেন। তিনটা মূল চূড়া পূর্ণিমার চাঁদের বায়বীয় আলোকচ্ছটায় চকচক করছে। মেরেন ও তাইতা খোরাশান রাজপথের পাহাড়চূড়ার ভেতর দিয়ে পথ চলেছে, কিন্তু এর আগে কখনও বরফ দেখেনি ফেন। এই অসাধারণ দৃশ্য দেখে রীতিমতো বাকহারা হয়ে গেল ও। অবশেষে ভাষা খুঁজে পেয়ে বলে উঠল: দেখ! জ্বলন্ত পাহাড়, চিৎকার করে বলল ও।

চকচকে পাহাড়চূড়াগুলো থেকে ধোয়ার রূপালি মেঘ বের হয়ে আসছে।

আপনি একক আগ্নেয়গিরি খোঁজ করছিলেন, ম্যাগাস, মৃদু কণ্ঠে বলল মেরেন, কিন্তু তিনটা পেয়ে গেছেন। ঘুরে পাসের ওধারে দূরের নালুবালে হ্রদের ঝিলিকের দিকে ইশারা করল সে। আগুন, পানি আর মাটি…

…কিন্তু এসবরেই প্রভু হচ্ছে আগুন, ইয়োসের মন্ত্র শেষ করল তাইতা। নির্ঘাৎ ওটাই ডাইনীর ঘাঁটি। ওর পা কাঁপছে, আবেগে ভেসে যাচ্ছে ও। এখানে পৌঁছতে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে ওরা, অনেক কষ্ট সয়েছে। পাজোড়া ওর শরীরের ভার বহন করার মতো একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে বসতে হবে। দৃশ্যের দিকে নজর রাখার মতো জুৎসই একটা জায়গা পেয়ে গেল ও। আবেগের ভাগ নিতে ওর পাশে পাথরে বসল ফেন।

অবশেষে কাফেলার সামনে থেকে ওদের খোঁজে ফিরে এলো ক্যাপ্টেন ওনকা। এখানে আর দেরি করতে পারবেন না। আমাদের এগোতে হবে।

এবার বেশ সহজভাবে নিচে নেমে গেছে রাস্তাটা। ঘোড়ায় চেপে পাদদেশ বরাবর নিচে নেমে মালভূমিতে পৌঁছাল ওরা। দিনের বাকি অংশ এক মুগ্ধকর প্রান্তরের উপর দিয়ে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলল। হ্রদ থেকে যথে উঁচুতে উঠে এসেছে এখন, বন আর মরুপ্রান্তর এর মিষ্টি উদার ভূখণ্ডে এসে গেছে যেন। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে দেহ যেন উদ্দীপ্ত হয়ে উঠছে, পরিষ্কার করে তুলছে মন। পাহাড় থেকে এসেছে পরিষ্কার জলের ধারা। সোনালি ছাউনিঅলা পাথুরে কটেজ আর খামার পার হয়ে এলো ওরা। ওগুলোর চারপাশে আঙুর আর জলপাইয়ের বাগান। নিপূণভাবে যত্ন নেওয়া আঙুর বাগিচায় পাকা আঙুর টসটস করছে। ক্ষেতে ধূরার চাষ করা হয়েছে, সজি ক্ষেতে তরমুজ, সিম, ডাল, কাঁচা-পাকা মরিচ, কুমড়ো ও অন্যান্য সজি রয়েছে যেগুলো চিনতে পারল না তাই। চারণভূমিগুলো সবুজ, গরুবাছুর, ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। মোটাসোটা শুয়োর ঘুরে বেড়াচ্ছে বনে। নদীর পুকুরে সাঁতার কাটছে হাঁস, রাজহাঁস; প্রত্যেকটা খামারের উঠানে আঁচড়ে বেড়াচ্ছে মুরগির দল।

গোটা সফরে খুব কমই এমন দেশের দেখা পেয়েছি আমরা, বলল মেরেন।

ওরা এগিয়ে যাবার সময় কৃষক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা শরবত ও লাল মদের বাটি নিয়ে স্বাগত জানাতে এলো। দুই রাজ্যের টানে মিশরিয় ভাষায় কথা বলছে। সবাই পুষ্টিকর খাবার খেয়ে স্বাস্থ্যবান, পরনে ভালো চামড়া ও লিনেনের পোশাক। বাচ্চাদের তাগড়া মনে হচ্ছে। অবশ্য বেশ ঠাণ্ডা দেখাচ্ছে। মেয়েরা গোলাপি গালের, ব্যবহার ভালো।

কী সুন্দর সব মেয়ে, মন্তব্য করল মেরেন। একটাও কুৎসিত নেই।

অচিরেই চারণভূমি এত সবুজ হওয়ার কারণ জানতে পেল ওরা। সহসা মেঘের ভারি পর্দার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল বরফ ঢাকা আগ্নেয়গিরির চূড়া-ত্রয়ী। ফিরে এসে তাইতাকে ওনকা বলল, আপনাদের কেইপ পরতে হবে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে।

এই সময় রোজ বিকেলে এখানে বৃষ্টি হয়, ঘনায়মান মেঘের দিকে ইঙ্গিত করল সে। জাররিকে ঘিরে রাখা ওই তিন চূড়ার বেশ কটা নাম রয়েছে: তার একটা হলো বৃষ্টিদাতা। এই দেশের এত সমৃদ্ধ হওয়ার কারণ ওগুলোই। সে কথা শেষ করামাত্র কেঁপে এলো বৃষ্টি, কেইপ থাকা সত্ত্বেও একেবারে চামড়া পর্যন্ত ভিজিয়ে কাদা করে দিল। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার ভেতর একপাশে সরে গেল মেঘ। ফের দেখা দিল সূর্য। পুরো এলাকা ধুয়ে পরিষ্কার, টাটকা হয়ে উঠল। গাছের পাতা ঝিলিক মারছে, মাটি থেকে উন্নত ধুরার গন্ধ উঠে আসছে।

রাস্তার একটা বাকে পৌঁছুল ওরা। বাম দিকের পথ বেছে নিল দাসদের সারিটা। ওরা দূরে চলে যাবার পর তাইতা শুনতে পেল পাহারাদারদের এক সার্জেন্ট বলছ, ইন্দেব্বির দুটো খনিতে ওদের ভীষণ দরকার হয়ে পড়েছে।

ডানদিকের পথ ধরে এগিয়ে চলল দলের বাকি অংশ। বিভিন্ন সময়ের বিরতিতে সৈনিকরা কর্নেল তিনাতকে স্যালুট করতে আসছে, তারপর কলাম ছেড়ে বিভিন্ন দিকে যার যার বাড়ির খামারের পথ ধরছে। শেষ পর্যন্ত কয়েকজন এসকর্টসহ তিনাত ও ওনকাই রইল ওদের সাথে। শেষ বিকেলের দিকে একটা হালকা ঢালে উঠে এলো ওরা, নিচে সবুজ গাছপালা ও চারণভূমির মাঝখানে আরেকটা ছোট গ্রাম দেখতে পেল।

এটা মুতাঙ্গি, তাইতাকে বলল তিনাত। স্থানীয় বাজার শহর ও দরবার। আপাতত এটাই আপনাদের আবাস। আপনার জন্যে বাড়ি বেছে রাখা হয়েছে। আমি নিশ্চিত আরামদায়ক বলেই আবিষ্কার করবেন আপনি। আগেও কথাটা শুনেছেন জাররিতে সম্মানিত মেহমান আপনি।

ওদের স্বাগত জানাতে খোদ ম্যাজিস্ট্রাট এসে হাজির হলো। মাঝবয়সী লোকটার নাম বিলতো। তার লম্বা দাড়িতে রূপালি ছোঁয়া; তবে মানুষটা ঋজু, শক্তিশালী। চোখজোড়া স্থির, মুখে উষ্ণ হাসি। অন্তর্চক্ষু দিয়ে তাকে দেখে তাইতা বুঝতে পারল লোকটা সৎ ও সদিচ্ছাপ্রবণ, কিন্তু কর্নেল তিনাত আনকুরের মতোই খুশি বা সন্তুষ্ট নয়। মহা সম্মানের সাথে তাইতাকে স্বাগত জানালেও অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। যেন ওর কাছ থেকে একটা কিছু আশা করছে। তার স্ত্রীদের একজন হিলতো, নাকোন্তো ও ইম্বালিসহ বাকিদের গ্রামের দূর প্রান্তের কাছে একটা সুবৃহৎ পাথুরে বাড়িতে নিয়ে গেল। ওদের সেবা করতে দাসীরা অপেক্ষা করছিল সেখানে। তাইতা, ফেন ও মেরেনকে রাস্তার উল্টো দিকের একটা অপেক্ষাকৃত বড় বাড়িতে নিয়ে গেল বিলতো। আশা করি আপনাদের আরামের জন্যে প্রয়োজনীয় সবই পাবেন। বিশ্রাম নিন, তরতাজা হয়ে নিন। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই অলিগার্কদের পরিষদ আপনাদের নিতে খবর পাঠাবে। তার আগে পর্যন্ত আমিই আপনাদের মেজবান। আপনাদের যেকোনও নির্দেশ মানতে প্রস্তুত। যাবার আগে অস্থির অনুসন্ধানী চোখে ফের তাইতার দিকে তাকাল বিলতো। কিন্তু আর কিছু বলল না। ওরা বাড়িতে ঢুকলে একজন প্রধান পরিচারক আর পাঁচজন দাস স্বাগত জানাতে লাইন ধরে দাঁড়াল। কামরাগুলো বিশাল, হাওয়াখেলা, কিন্তু জানালাগুলো চামড়ার পর্দায় ঢেকে রাখা যায়, মূল কামরাগুলোয় উন্মুক্ত হার্থ রয়েছে, ওখানে আগে থেকেই আগুন জ্বলছে। সূর্য তখনও দিগন্তের উপরে থাকলেও হাওয়ায় শীতল স্পর্শ, সুতরাং সূর্য ডুবে যাওয়ার পর এই আগুন কাজে আসবে। টাটকা পোশাক ও নতুন স্যান্ডেল সাজিয়ে রাখা ছিল ওদের জন্যে। গোসলের জন্যে গরম পানি এনে দিল দাসরা। তেলের কুপির আলোয় সন্ধ্যার খাবার পরিবেশন করা হলো, বুনোশুয়োরের মাংস দিয়ে রান্না করা স্বাদু স্টু তেজি লাল মদের সাথে খাওয়া হলো।

যাত্রার ধকল ওদের কতখানি ক্লান্ত করে তুলেছিল এর আগে পর্যন্ত টের পায়নি ওরা। চোখে জ্বালা করছিল মেরেনের, চোখের কোটরে জলপাই তেল ও আরামদায়ক গুল্মের উষ্ণ মলম লাগিয়ে দিল, তাইতা, তারপর লাল শেপেনের একটা ডোজ খাওয়াল।

পরদিন সকালে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমাল ওরা। মেরেনের চোখের উন্নতি হলেও এখনও ব্যথা করছে।

নাশতার পর ওদের গ্রাম ঘোরাতে নিয়ে গেল বিলতো। গ্রাম নিয়ে তার ভীষণ গর্ব। লোকজনের জীবন যাপনের ধারা ব্যাখ্যা করল সে। নেতাদের সাথে তাইতার পরিচয় করিয়ে দিল। তাইতা লক্ষ করল মূলত ওরা সৎ ও জটিলতা মুক্ত। বিলতো আর কর্নেল তিনাতের মতো ওদের মনস্তত্বে কোনও ধরনের দুর্বোধ্যতা খুঁজে পাবে বলে আশা করেছিল ও; ইয়োসের কাছাকাছি থাকাটাকে যার কারণ হিসাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, কিন্তু উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই নেই। কেবল মানবীয় খুচরো অহঙ্কার আর ব্যর্থতা। একজন তার স্ত্রীকে নিয়ে অসন্তুষ্ট, আরেকজন পড়শীর একটা কুড়োল চুরি করেছে বলে অপরাধবোধে ভুগছে, আর আরেকজন তার তরুণী সৎ বোনের দিকে নজর দিচ্ছে।

পঞ্চম দিন বেশ সকাল সকাল সুপ্রিম কাউন্সিলের তরফ থেকে সমন জারি করতে মুতাঙ্গিতে ফিরে এলো ক্যাপ্টেন ওনকা। ওদের এখুনি যেতে হবে, বলল সে।

*

সুপ্রিম কাউন্সিলের চেম্বারের অবস্থান দুৰ্গটা চাঁদের পাহাড়ের দিকে যাবার পথে

চল্লিশ লীগ দূরে, তাইতাকে বলল ওনকা। বেশ কয়েক ঘণ্টার যাত্রা। আবহাওয়া চমৎকার, রৌদ্রজ্জ্বল, বাতাস কড়কড়ে, উদ্দীপ্তকারী। ফেনের গাল জলজল করছে, চোখে ঝিলিক খেলছে। তাইতার ইশারা পেয়ে দলের একেবারে শেষ মাথায় ওর সাথে যোগ দিল সে। নিচু কণ্ঠে তেনমাস ভাষায় ওর সাথে কথা বলল তাইতা। এটা কঠিন পরীক্ষা হতে যাচ্ছে, ওকে সতর্ক করে দিল। আমার ধারণা ডাইনীর ঘাঁটির দিকে যাচ্ছি আমরা। এখন তোমাকে আভা গোপন করতে হবে। আমরা মুতাঙ্গিতে না ফেরা পর্যন্ত সেভাবেই থাকতে হবে।

বুঝতে পারছি, ম্যাগাস। তোমার কথামতোই করব, জবাব দিল ফেন। প্রায় সাথে সাথে ওর অভিব্যক্তি নিরাসক্ত আর চোখজোড়া ম্লান হয়ে গেল। ওর আভা মিলিয়ে যেতে দেখল তাইতা, রঙগুলো কমতে কমতে এক সময় ইদালির বিচ্ছুরিত রঙের মতো মামুলি হয়ে গেল।

তুমি যত উৎসাহ বা উস্কানির মুখোমুখিই হও না কেন, কোনওভাবেই একে ঝলসে উঠতে দেবে না। কোন দিক থেকে তোমার উপর নজর রাখা হচ্ছে টেরও পাবে না। এক মুহূর্তের জন্যেও যেন অসাবধান না হও।

দুপুর পার হওয়ার বেশ পরে একটা খাড়া পাসঅলা উপত্যকায় প্রবেশ করল ওরা, পাহাড় সারির কেন্দ্রিয় ম্যাসিফের ভেতর ঢুকে পড়েছে ওটা। আরও এক লীগের মতো এগোনোর পর দুর্গের বাইরের প্রাচীরের কাছে পৌঁছাল ওরা। বিশাল চৌকো আগ্নেয়গিরির পাথরের ব্লক দিয়ে বানানো হয়েছে ওটা, ভিন্ন কোনও যুগের দক্ষ রাজমিস্ত্রিদের হাতে একসাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সময়ের আক্রমণে পাথরে ক্ষয় ধরেছে। গেট খোলা ছিল। হতে পারে বহু বছর কোনও শত্রুর বিরুদ্ধে ওগুলো আর বন্ধ করা হয়নি। দুর্গের ভেতরে ঢুকে বুঝতে পারল মিশর ছাড়ার পর এত মজবুত আর আঁকাল দালানকোঠা আর দেখেনি ওরা। প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে বড়টা কারনাকের হাথরের মন্দিরের কথাই মনে করিয়ে দেয়।

ঘোড়ার দায়িত্ব নিতে অপেক্ষা করছিল সহিসরা। লাল জোব্বা পরা চাকররা একটা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের ছোট একটা দরজার কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত থামঅলা হলঘর ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ওদের। দরজা দিয়ে একটা অ্যান্টিচেম্বারে ঢুকল ওরা। একটা লম্বা টেবিলে খাবারদাবার সাজানো: বাটি ভর্তি ফল, পিঠা ও জগ ভর্তি লাল মদ, তবে পথ চলার পর আগে টাটকা হয়ে নিতে যার যার ঘরে চলে গেল ওরা। সব কিছুর আয়োজন করা হয়েছে ওদের আরামের কথা ভেবে।

ওরা হালকা খাবার শেষ করার পর কাউন্সিল পরিচারক খাস দরবারে নিয়ে যেতে এলো ওদের। কয়লা রাখা আগুনের পাত্র দিয়ে উষ্ণ রাখা হয়েছে। কামরাটাকে। পাথরের মেঝেয় গদিমোড়া মাদুর বিছানো। কে কোথায় বসবে দেখিয়ে দিয়ে ওদের বসতে বলল সে। সবার সামনে তাইতাকে বসিয়ে মেরেন ও হিলতোকে বসাল ওর পেছনে। ফেনকে বাকিদের সাথে পেছনের সারিতে পাঠিয়ে দিল। ওর প্রতি বিশেষ আগ্রহ না দেখানোয় সন্তুষ্ট বোধ করল তাইতা। চোখের কোণ দিয়ে তীর্যক দৃষ্টিতে ফেনের দিকে তাকাল ও। ইম্বালির পাশে বসেছে ও, তাইতা বুঝতে পারল দীর্ঘাঙ্গী মহিলার আভার সাথে খাপ খাওয়াতে নিজের আভা চেপে রাখার চেষ্টা করছে।

কামরার নকশা ও আসবাবের দিকে নজর ফেরাল তাইতা। জুৎসই অনুপাতের একটা বিশাল কামরা। যেখানে ও বসেছে তার ঠিক সামনেই একটা উঁচু প্ল্যাটফর্মে তিনটা টুল রাখা। বাবিলনের বিভিন্ন প্রাসাদে এই ধরনের নকশার টুল দেখেছে ও, তবে সেগুলো আইভরি বা মূল্যবান পাথরে সাজানো ছিল না। ওদের পেছনের দেয়ালটা নকশা করা চামড়ার পর্দায় ঢাকা, উঁচু ছাদ থেকে পাথরের মেঝে পর্যন্ত নেমে এসেছে ওটা, পার্থিব বিভিন্ন রঙের নকশা তাতে। এসব জরিপ করার সময় তাইতা দেখতে পেল ওগুলো নিগূঢ় বা প্রাচীন প্রতীক জাতীয় কিছু নয়, বরং স্রেফ অলঙ্কার।

পাথুরে দরজার উপর পেরেকঅলা স্যান্ডেলের আওয়াজ হলো। এক পাশের একটা দরজা গলে সশস্ত্র সৈনিকদের একটা দল ঢুকল, সার বেঁধে দাঁড়াল প্ল্যাটফর্মের ভিত্তির কাছে। বর্শার বাটগুলো মাটিতে ঠেকাল।

চামড়ার পর্দার পেছন থেকে এলো আরও তিনজন। সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকতে পারে না যে ওরাই অলিগার্ক। হলুদ টিউনিক পরেছে ওরা, মাথায় মসৃণ রূপার মুকুট। হাবভাব রাজকীয়, জাঁকাল। ওদের আভা খতিয়ে দেখল তাইতা: বিচিত্র ও জটিল। শক্তিমান ও দৃঢ় চরিত্রের লোক ওরা, তবে নীল জোব্বাঅলা লোকটাই সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। মাঝখানের টুলে বসেছে সে। তার চরিত্রে গভীরতা আর দ্যোতনা রয়েছে, কিছু কিছু বিভ্রান্তিকর ও অস্বস্তিকর বোধ হলো তাইতার কাছে।

লোকটা ওদের শান্ত থাকার ইঙ্গিত করল। সোজা হলো তাই।

শুভেচ্ছা, ম্যাগাস গালালার তাইতা। চাঁদের পাহাড়ের দেশ জাররিতে আপনাকে স্বাগত জানাই, বলল নীল জোব্বাঅলা নেতা।

শুভেচ্ছা, জাররির সুপ্রিম কাউন্সিলের অলিগার্ক লর্ড আকের, জবাব দিল তাইতা।

চোখ পিটপিট করে মাথা কাত করল আকের। আপনি আমাকে চেনেন?

তোমার দাদাকে ভালো চিনতাম, ব্যাখ্যা করল তাইতা। শেষবার যখন তাকে দেখি, তোমার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল সে, অবশ্য তোমার চেহারা পুরোপুরি তার আদলেই তৈরি।

তাহলে আপনার সম্পর্কে যা যা শুনেছি তার বেশির ভাগই ঠিক। আপনি একজন দীর্ঘায়ু ও মোহন্ত, স্বীকার গেল আকের। আমাদের সমাজে আপনি উজ্জ্বল অবদান রাখতে পারবেন। আপনি কি এবার দয়া করে আপনার সঙ্গীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন, যাদের আমরা সেভাবে চিনি না?

নাম ধরে সামনে ডাকল তাইতা: সবার আগে মেরেন, প্ল্যাটফর্মের সামনে পাঠানো হলো ওকে। এ কর্নেল মেরেন ক্যাম্বিসেস, বীরত্বের স্বর্ণ পদকধারী ও লাল পথের সঙ্গী। নীরবে ওকে জরিপ করল কাউন্সিল। সহসা অস্বাভাবিক একটা কিছু ঘটার ব্যাপারে সজাগ হয়ে উঠল তাইতা। তিন অলিগার্ক থেকে ওদের পেছনের চামড়ার পর্দাটার দিকে মনোযোগ দিল। গোপন সত্তার উপস্থিতি খোঁজ করল, কিন্তু নেই কিছু। যেন পর্দার ওপাশের জায়গাটা কেবলই শূন্যতা। কিন্তু এইটুকুই ওকে সতর্ক করে তোলার জন্যে যথেষ্ট। মনস্তাত্ত্বিক কোনও শক্তি কামরার এই অংশটুকু আড়াল করে রেখেছে।

ইয়োস এখানে! ভাবল ও। সে কোনও আভা ছড়ায় না, নিজেকে চামড়ার চেয়ে অনেক বেশি দুর্ভেদ্য পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে। আমাদের উপর নজর রাখছে। ধাক্কাটা এতটাই প্রবল ছিল যে নিজেকে সামলে উঠতে রীতিমতো কষ্ট হলো। সেই আসল শিকারী, রক্ত বা দুর্বলতার গন্ধ পেয়ে যাবে।

অবশেষে ফের কথা বলল আকের। চোখ খেয়ালে কীকরে, কর্নেল মেরেন ক্যাম্বিসেস?

সৈনিকদের ক্ষেত্রে এমন হয়েই থাকে। আমার জীবনে অনেক অঘটন ঘটেছে।

পরে এক সময় ওসব নিয়ে কথা বলা যাবে, বলল আকের।

এই ধরনের হেঁয়ালিময় কথার সামান্য অর্থই বের করতে পারল তাই। দয়া করে নিজের জায়গায় ফিরে যাও, কর্নেল। সাক্ষাৎকারটা সাধারণ ছিল, কিন্তু মেরেনের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সব তথ্যই বের করে নিয়েছে সে।

এরপর হিলতোকে ডাকল তাইতা। ওকে বিচার করে দেখতে আরও কম সময় নিল অলিগার্করা। কেবল প্রান্তে নীল ফিতের মতো একটা রেখার পতপত করে চলা ছাড়া হিলতোর আভাকে সৎ ও অনার্ষণীয়ভাবে জ্বলতে দেখল তাইতা। তার বিরক্তি প্রকাশ করে দিচ্ছে ওটা। অলিগার্করা ওর আসনে পাঠিয়ে দিল ওকে। নাকোন্তো ও ইম্বালির সাথে মোটামুটি একইরকম আচরণ করল ওরা।

অবশেষে ফেনকে তলব করল তাইতা। মাই লর্ডস, এ হচ্ছে যুদ্ধে এতিম হয়ে যাওয়া একটি মেয়ে, দয়া করে ওকে নিয়ে এসেছি আমরা। আমার সঙ্গী করে নিয়েছি, নাম রেখেছি ফেন। তার সম্পর্কে তেমন একটা কিছু জানি না। আমার কোনও বাচ্চা না থাকায় ওকে বড় ভালোবেসে ফেলেছি।

পরিত্যক্ত শিশুর মতো লাগছে সুপ্রিম কাউন্সিলের সামনে দাঁড়ানো ফেনকে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে লাজুকভাবে এক পা থেকে আরেক পায়ে শরীরের ভর বদল করছে বারবার। যেন সাহস করে প্রশ্নকারীদের দিকে সরাসরি তাকাতে পারছে না। যথারীতি ওকে অন্তর্চক্ষু দিয়ে জরিপ করে চলল তাইতা। চাপা রইল ওরা আভা। ওর জন্যে স্থির করা ভুমিকা নিখুঁতভাবে পালন করছে। আরেকদফা বিরতির পর আকের জানতে চাইল, তোমার বাবার নাম কী, মেয়ে?

হুজুর, আমি তাকে চিনি না। মিথ্যার ঝিলিক দেখা গেল না ওর আভায়।

তোমার মা?

তার কথাও আমার মনে নেই, হুজুর।

তোমার জন্মস্থান কোথায়?

হুজুর, মাফ করবেন, ঠিক জানি না।

ফেন কীভাবে নিজেকে সামলে রাখছে খেয়াল করল তাইতা।

এদিকে এসো, নির্দেশ দিল আকের। অনুগতের মতো লাফ দিয়ে প্ল্যাটফর্মে উঠল ফেন, এগিয়ে গেল আকেরের কাছে। ওর হাত ধরে টুলের কাছে টেনে নিল সে। তোমার বয়স কত, ফেন?

আমাকে বোকা ঠাউড়াবেন, কিন্তু আমি জানি না। ওকে ঘুরিয়ে নিল আকের, টিউনিকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল। লিনেনের নিচে ওর বুক স্পর্শ করল।

এই মধ্যে একটা কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে, হেসে বলল সে। আরও অনেক বেড়ে উঠবে শিগগিরই। মৃদু গোলাপি হয়ে উঠল ফেনের আভা। মেয়েটা নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে বলে ভয় হলো তাইতার। পরক্ষণেই বুঝতে পারল দুর্বোধ্য আচরণের কারণে ওর বয়সী কোনও মেয়ের মতোই লজ্জার আভাটুকুই তুলে ধরছে ও। নিজের ক্রোধ আড়াল করতেই বরং অনেক কষ্ট পেতে হচ্ছে ওকে। অবশ্য, বুঝতে পারছে এই ছোট নাটকটা একটা পরীক্ষা: আকের হয় ফেন বা তাইতার তরফ থেকে উস্কানি দিয়ে ওদের ক্রুদ্ধ করে তুলতে চাইছে। চেহারা পাথরের মতো করে রাখল তাইতা, তবে ভেবে চলল। বদলার সময় এজন্যে কড়ায়গণ্ডায় মাশুল গুনতে হবে তোমাকে, লর্ড আকের।

ফেনকে কচলে চলল অলিগার্ক। আমি নিশ্চিত অসাধারণ সুন্দরী হয়ে উঠবে তুমি। যথেষ্ট ভাগ্যবতী হলে হয়তো এই জাররিতেই মহাসম্মান আর মর্যাদার আসন পেয়ে যাবে। ওর ছোট নিতম্বে চিমটি কাটল সে। ফের হেসে উঠল। এবার ভাগো তো, পিচ্চি। বছর দুয়েকের মধ্যেই এসব নিয়ে ভাবব আমরা।

ওদের বাতিল করে দিল সে, কিন্তু তাইতাকে থাকতে বলল। অন্যরা কামরা ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করল আকের, আমাদের একান্তে আলোচনা করা দরকার, ম্যাগাস। আমরা চলে যাবার সময় আমাদের ক্ষমা করবেন। বেশিক্ষণ একা রাখব না আপনাকে।

ফিরে আসার পর তিন অলিগার্ককে আগের চেয়ে অনেক বেশি নিশ্চিন্ত ও বন্ধুসুলভ মনে হলো। সমীহ দেখানো অব্যাহত রাখল তারা।

আমার দাদা সম্পর্কে কী জানেন বলুন, আমন্ত্রণ জানাল লর্ড আকের। আমার জন্মের আগেই মারা গেছেন তিনি।

অভিবাসন ও দুই সাম্রাজ্যে হিকস্‌স বাহিনীর আক্রমণের সময় রানি লস্ত্রিসের দরবারের একজন সম্মানিত ও অনুগত সদস্য ছিল সে। মহামান্যা রানি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দিয়েছিল তাকে। নীলের খাড়ির উপর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটা সেই আবিষ্কার করে। ওটা এখনও ব্যবহার করা হয়, আসৌন ও কেবুইয়ের পথে কয়েকশো লীগ দূরত্ব বাঁচে। এই জন্যে আর অন্যান্য সাফল্যের জন্যে রানি সম্মানে ভূষিত করেছিল তাকে।

এখনও ওর কাছ থেকে পাওয়া সম্মানসূচক সেই স্বর্ণপদক আছে আমার কাছে।

রানি তাকে এতটাই বিশ্বাস করত যে দুই হাজার সৈন্যের এক বাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে তাকে কেবুইয়ের দক্ষিণে নীলের উৎস আবিষ্কার ও মানচিত্র আঁকার দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিল। মাত্র একজন ফিরে গিয়েছিল। সেনাবাহিনী বা তাদের স্ত্রী পরিজন কিংবা তাদের সাথে যাওয়া অন্য মেয়েদের আর কখনওই কোনও খবর মেলেনি। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, আফ্রিকার বিশালত্বের মাঝে তারা হারিয়ে গেছে।

আমার দাদার বাহিনীর যারা বেঁচেছিল ও জয় লাভ করে শেষ পর্যন্ত জাররিতে পৌঁছেছিল তারাই আমাদের পূর্বপুরুষ।

ওরাই এই ছোট জাতিকে গড়ে তোলা অগ্রগামী? জানতে চাইল তাইতা।

অসামান্য অবদান রেখে গেছে তারা, সায় দিল আকের। অবশ্য, ওদের আগে থেকেই এখানে অন্যরাও ছিল। সময়ের সূচনা থেকেই জাররিতে লোকের বাস। প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে তাদের সম্মান করি আমরা। ডান পাশে বসা লোটার দিকে ফিরল সে। ইনি লর্ড কেইথর। পঁচিশ প্রজন্ম আগের বংশ ধারার কথা বলতে পারে।

সেক্ষেত্রে ওকে সম্মান দেখানোই তোমাদের পক্ষে উচিত। রূপালি দাড়িঅলা অলিগার্কের উদ্দেশে মাথা নোয়াল তাই। তবে আমি জানি তোমার দাদার আমলের পরেও অন্যরা তোমাদের সাথে যোগ দিয়েছে।

কর্নেল তিনাত আনকুর ও তার বাহিনীর কথা বোঝাচ্ছেন আপনি। ওর সাথে তো আগেই পরিচয় হয়েছে আপনার।

আসলে আমাকে ও আমার দলকে তামাফুপায় বুনো বাসমারাদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল সৎ কর্নেল, সায় দিল তাইতা।

তিনাত আনকুরের লোকজন ও তাদের স্ত্রী আমাদের সমাজে কাক্ষিত যোগদানকারী ছিল। আমাদের দেশটা বিরাট, লোকসংখ্যা কম। এখানে ওদের প্রয়োজন ছিল। আমাদেরই রক্তের ছিল ওরা, আমাদের সমাজে অনায়াসে মিশে যেতে পেরেছে। ওদের অনেক যুবকই আমাদের যুবতীদের বিয়ে করেছে।

নিশ্চয়ই পবিত্র ত্রয়ী অসিরিস, আইসিস ও হোরাসের নেতৃত্বে একই দেবদেবীর উপাসক ওরা, বাঁকা স্বরে বলল তাইতা। ক্ষুব্ধভাবে ঝলসে উঠতে দেখল আকেরের আভাকে। পরক্ষণেই রাগ সামলে নিতে দেখল তাকে। যখন কথা বলল, তার সাড়া ছিল কোমল। আমাদের ধর্মের প্রসঙ্গটি পরে কোনও এক সময়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আপাতত এইটুকুই বললেই চলবে যে নতুন দেশগুলো নতুন দেবতাদের হেফাযতে রয়েছে; কিংবা এমনকি একজন দেবতারও হতে পারে।

একজন দেবতা? বিস্ময়ের ভান করল তাইতা।

টোপ গিলল না আকের। বরং আগের প্রসঙ্গে ফিরে গেল। তিনাত আনকুরের বাহিনীর কথা বাদ দিলে পৃথিবীর বিভিন্ন কোণ থেকে হাজার হাজার অভিবাসী এসেছে এখানে, অনেক দূর থেকে জাররিতে এসেছে ওরা। কোনও ব্যতিক্রম ছাড়াই প্রত্যেকেই অত্যন্ত যোগ্য নারী-পুরুষ। আমরা সাধু, চিকিৎসক, আলকেমিস্ট, প্রকৌশলী, ভূতত্ত্ববিদ, খনিবিজ্ঞানী, উদ্ভিদবিদ, কৃষক, স্থপতি ও পাথরের রাজমিস্ত্রি, জাহাজনির্মাতা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা দক্ষ তাদের স্বাগত জানাতে পেরেছি।

তোমাদের জাতি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে, বলল তাইতা।

এক মুহূর্ত থামলো আকের। তারপর প্রসঙ্গান্তরে যেতে চাইল। আপনার সঙ্গী মেরেন ক্যাম্বিসেস। আমাদের মনে হচ্ছে ওর প্রতি আপনার ভালো দুর্বলতা।

সেই ছোট বেলা থেকেই আমার সাথে আছে সে, জবাব দিল তাইতা। আমার কাছে ছেলের চেয়েও বেশি ও।

ক্ষতিগ্রস্ত চোখটা বেশ জ্বালাচ্ছে ওকে, নাকি? বলে চলল আকের।

যেমন চেয়েছিলাম সেভাবে পুরোপুরি সেরে ওঠেনি ওটা, সায় দিয়ে বলল তাইতা।

আমি নিশ্চিত, আপনার দক্ষতা দিয়ে আপনি জানেন, আপনার উত্তরসুরি মরতে বসেছে, বলল আকের। চোখটায় পচন ধরেছে। এক সময় ওর মরণ ডেকে আনবে ওটা…যদি চিকিৎসা করা না হয়।

থতমত খেয়ে গেল তাই। মেরেনের আভা থেকে আসন্ন বিপর্যয়ের কোনও আলামত পায়নি ও, কিন্তু কেন যেন আকেরের কথায় সন্দেহ করতে পারছে না। হয়তো আগাগোড়াই কথাটা জানা ছিল ওর, কিন্তু এমন একটা অগ্রহণযোগ্য সত্যকে ঠেলে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। কিন্তু, ওর অজানা কোনও কিছু কীভাবে জানতে পারল আকের? তার আভা থেকে লোকটার কোনও বিশেষ নৈপূণ্য বা অন্তদৃষ্টি দেখেনি ও; সে সাধু বা শামান, কোনওটাই নয়। এই কামরা থেকে একবার বেরিয়ে গিয়েছিল সে, অবশ্যই সেটা বাকি অলিগার্কদের সাথে পরামর্শ করতে নয়, অন্য কারও কাছে গেছে সে, ভাবল তাইতা। নিজেকে সামলে নিয়ে জবাবে বলল, না, মাই লর্ড। চিকিৎসক হিসাবে আমার জ্ঞান সামান্য, তবে ক্ষতটা মারাত্মক বলে সন্দেহ করিনি।

আমরা সুপ্রিম কাউন্সিল থেকে আপনাকে ও আপনার উত্তরসুরিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছি। খুব বেশি লোককে এই সুবিধা দেওয়া হয় না; এমনকি আমাদের অভিজাত সমাজের গণ্যমান্য লোকদেরও না। আপনার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসাবে এটা করছি আমরা। আমাদের সমাজের উন্নত অবস্থা, আমাদের বিজ্ঞান ও শিক্ষারও একটা প্রদর্শনী হবে এটা। সম্ভবত তাতে করে আপনি হয়তো জাররিতে আমাদের সাথে থেকে যেতে সম্মত হবেন। মেঘ-বাগিচার স্যানেটোরিয়ামে নিয়ে যাওয়া হবে মেরেন ক্যাম্বিসেসকে। সেজন্যে হয়তো কিছুটা সময় লাগতে পারে, কারণ ওর চিকিৎসার দরকারী ওষুধপত্র বানাতে হবে। কাজটা শেষ হওয়ার পর, ম্যাগাস, আপনি হয়তো ওর চিকিৎসা দেখার জন্যে সাথে যেতে পারবেন। স্যানেটোরিয়াম থেকে ফিরে এলে আমরা আবার আপনার সাথে সানন্দে দেখা করে আপনার মতামত নিয়ে কথা বলব।

*

মুতাঙ্গিতে ফেরার পরপরই মেরেনের চোখ ও ওর সামগ্রিক অবস্থা পরখ করল তাইতা। উপসংহার অস্বস্তিকর। ক্ষতস্থানের গহ্বরে গভীর এক ধরনের সংক্রমণ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, বারবার ব্যথা, রক্তক্ষরণ ও পুঁজ জমার কারণ সেটাই। তাই ক্ষতস্থানের আশপাশের এলাকায় জোর চাপ দিতেই নিস্পৃহভাবে সহ্য করে নিল মেরেন, কিন্তু ব্যথায় হাওয়ায় কম্পিত শিখার মতো টলে উঠল ওর আভা। অলিগার্করা ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা নিচ্ছে, জানাল তাই।

আপনিই আমার ক্ষতস্থানের চিকিৎসা করুন, অস্বীকার গেল মেরেন। এই বিদ্রোহী মিশরিয়দের বিশ্বাস করি না। এরা আমাদের দেশ আর ফারাওর সাথে বেঈমানি করেছে। কেউ আমার জন্যে ভেবে থাকলে সেটা আপনি। তাইতা ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেও অটল রইল সে।

*

বিলতো এবং অন্য গ্রামবাসীরা অতিথিপরায়ণ ও বন্ধুসুলভ। তাইতার দল নিজেদের সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন নৈমিত্তিক জীবনে মিশে যাচ্ছে বলে আবিষ্কার করল। বাচ্চারা যেন ফেনের প্রতি মুগ্ধ হয়ে গেছে। ওদের তিনজনের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে যেন, ওদের সঙ্গ বেশ আনন্দ যোগাচ্ছে ওকে। প্রথম প্রথম ওদের সাথে অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছিল ও, বনে ব্যাঙের ছাতার খোঁজ করেছে কিংবা ওদের গান, নাচ বা খেলা শিখেছে। ওকে বাও সম্পর্কে কিছুই শেখাতে পারল না ওরা, অচিরেই গ্রামের চ্যাম্পিয়নে পরিণত হলো ও। বাচ্চাদের সাথে না থাকলে প্রায়ই আস্তাবলের সহিসদের সাথে ওয়ার্লউইন্ডকে প্রশিক্ষণ দেয়। হিলতো ওকে তীরন্দাজী প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। নিজস্ব একটা ধনুক বানিয়ে দিয়েছে ওকে। একদিন বিকেলে ইম্বালির সাথে হাসি ঠাট্টা, আড্ডায় প্রায় ঘণ্টাখানেক কাটানোর পর তাইতার কাছে এসে জানতে চাইল, ওর পুরুষাঙ্গ নেই কেন?

জুৎসই জবাব খুঁজে পেল না তাইতা। ব্যাপারটা ওর কাছ থেকে কখনও আড়াল করতে না চাইলেও ওর সাথে ওকে নির্বীজ করার বিষয়টা আলোচনা করার মতো বয়স হয়নি ওর। তবে অনেক দ্রুত আসবে সেই সময়। ইদালির কাছে প্রতিবাদ করার কথা ভাবল ও, কিন্তু পরক্ষণেই নাকচ করে দিল। দলের একমাত্র নারী হিসাবে সবচেয়ে ভালো গুরু সে। মোটামুটি দায়সারা গোছের জবাব দিয়ে আপাতত সমস্যা মেটাল ও। তবে পরে নিজের অপূর্ণতা নিয়ে এক ধরনের সচেতনতা বোধ করতে লাগল। ফলে ফেনের দৃষ্টি থেকে শরীর আড়াল করার প্রয়াস পেল ও। এমনকি গ্রাম থেকে দূরে ঝর্নার পানিতে একসাথে সাঁতার কাটার সময়ও টিউনিক খুলল না। নিজের দৈহিক অপূর্ণাঙ্গতাকে মেনে নিয়েছে ভেবেছিল ও, কিন্তু এখন রোজই বদলে যাচ্ছে অবস্থা।

মেরেনকে মেঘ-বাগিচার রহস্যময় স্যানেটোরিয়ামে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ওনকার আসতে আর বেশি দেরি নেই। ওকে চিকিৎসায় রাজি করানোর সাধ্যমতো সবই করেছে তাইতা, কিন্তু অবাধ্য হওয়ার অনুকরণীয় ক্ষমতা রয়েছে মেরেনের, ওর সব রকম তোষামোদ দৃঢ়তার সাথে ঠেকাচ্ছে সে।

তারপর এক সন্ধ্যায় মেরেনের চেম্বারে মৃদু গোঙানির শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠল তাইতা। বাতি জ্বেলে ওর ঘরে ঢুকে মাদুরে উবু হয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে রেখেছে মেরেন। আস্তে করে ওর হাত সরিয়ে নিল তাইতা। ওর মুখের একপাশ বিশ্রীভাবে ফুলে উঠেছে। টানটান একটা রেখায় পরিণত হয়েছে শূন্য অক্ষিকোটর। চামড়া যেন পুড়ে যাচ্ছে। গরম পুলটিশ ও আরামদায়ক মলম লাগিয়ে দিল তাইতা, কিন্তু সকালের দিকে সামান্যই উন্নতি হলো পুরোনো ক্ষতের। সেই দিনই ওনকার হাজির হওয়াটা কাকতালের চেয়েও বেশি কিছু মনে হলো ওর।

মেরেনকে যুক্তি দেখাল তাইতা: পুরোনো বন্ধু, তোমার চিকিৎসার জন্যে আমার আর কিছু করার আছে বলে মনে হচ্ছে না। তোমার ভোগান্তি সহ্য করার সিদ্ধান্ত সময়ের অনেক আগেই তোমাকে ওপারে নিয়ে যাবে বলে আমার ধারণা। তবে আমি যেখানে ব্যর্থ হয়েছি, জাররিয় সার্জনদের একবার চেষ্টা করার সুযোগ দিয়ে দেখতে পারো।

দুর্বল ও জ্বরাক্রান্ত হয়ে পড়ায় আর বাধা দিতে পারল না মেরেন। ইদালি ও ফেন পোশাক পরতে সাহায্য করল ওকে। তারপর একটা ছোট ব্যাগে ওর টুকটাক জিনিসপত্র ভরে দিল। লোকেরা বাইরে নিয়ে ঘোড়ায় চাপতে সাহায্য করল ওকে। ঝটপট ফেনকে বিদায় জানাল তাইতা, উইন্ডস্মোকের পিঠে সওয়ার হওয়ার আগে হিলতো, নাকোন্তো ও ইম্বালির দিকে খেয়াল রাখতে বলল ওকে। পশ্চিমুখী রাস্তা ধরে মুতাঙ্গি ত্যাগ করল ওরা। আধা লীগের মতো উইন্ডস্মোকের পেছন পেছন দৌড়ে এলো ফেন। তারপর রাস্তার পাশে থেমে ওরা দৃষ্টিসীমার বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত হাত নাড়তে লাগল।

আরও একবার আগ্নেয়গিরির ত্রয়ী চূড়ার দিকে এগিয়ে চলল ওরা, কিন্তু দুর্গে পৌঁছানোর আগেই আরও উত্তরে চলে যাওয়া পথটা বেছে নিল। অবশেষে পাহাড়ের দিকে যাওয়া সংকীর্ণ পাসে ঢুকল। ওটা বেয়ে এমন একটা উচ্চতায় উঠে এলো যেখান থেকে অনেক দক্ষিণে দুর্গ চোখে পড়ে। অলিগার্কদের সাথে যে দরবার হলে দেখা করেছিল সেটাকে একেবারে ছোট মনে হচ্ছে এখান থেকে। পাহাড়ী পথ ধরে এগিয়ে চলল ওরা। বাতাস শীতল হয়ে এলো। ক্লিফের গায়ে গুঙিয়ে চলেছে বাতাস। যত উপরে উঠছে মনে হচ্ছে পাহাড় আরও উঁচু হয়ে উঠছে। দাড়ি আর ভুরুতে শাদা তুষার জমে উঠছে। কেইপ গায়ে জড়িয়ে ক্রমাগত উপরে উঠে চলল ওরা। জিনের উপর এপাশ ওপাশ দোল খেতে শুরু করেছে মেরেন। ওকে সাহায্য করতে ও পতন ঠেকাতে ওর পাশে থেকে ঘোড়া চালাচ্ছে তাইতা ও ওনকা।

সহসা সামনে কাঠের কাঠামোর ভারি গেটের ওপাশে ক্লিফের প্রাচীরে একটা টানেলের মুখ উদয় হলো। ওরা এগিয়ে যাবার সাথে সাথে ধীরে ধীরে খুলে গেল গেটটা, ভেতের ঢুকতে দিল ওদের। দূর থেকে প্রবেশপথে পাহারাদারদের উপস্থিতি দেখতে পেল ওরা। মেরেনের অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকায় প্রথমে ওদের দিকে তেমন একটা নজর দিতে পারেনি তাইতা। কাছাকাছি যাবার পর লক্ষ করল খাটো আকারের ওরা, স্বাভাবিক মানুষের অর্ধেক হবে বড়জোর। কিন্তু বিশাল ওদের বুকের ছাতি, হাতগুলো এত লম্বা যে প্রায় জমিন ছুঁয়েছে। ওদের দাঁড়াবার ভঙ্গি কুঁজো ও বাঁকা পায়ের। সহসা বুঝতে পারল তাইতা, ওরা মানুষ নয়, বরং বিশালদেহী শিম্পাঞ্জি। ও যেটাকে বাদামী ইউনিফর্মের কোট ভেবেছিল সেটা আসলে ওদের ঝুলন্ত পশম। গুবড়ে পোকার মতো ভুরু পর্যন্ত নেমে এসেছে ওদের ঢালু কপাল। ওদের চোয়াল এতটাই উন্নতি লাভ করেছে যে দাঁতের উপর দিয়ে ঠোঁট সম্পূর্ণ বন্ধ হচ্ছে না। খুব কাছাকাছি বসানো চোখের স্থির দৃষ্টিতে ওর জরিপের উত্তর দিল ওরা। নীরবে অন্তর্চক্ষু খুলল তাইতা, একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের ও পাশবিক বলে আবিষ্কার করল ওদের আভা। ওদের খুনে প্রবৃত্তি প্রতিরোধের ছুরির মতো কিনারায় ঠেকে আছে।

ওদের চোখের দিকে তাকাবেন না, সতর্ক করল ওনকা। উস্কে দেবেন না। অনেক শক্তিশালী, বিপজ্জনক জানোয়ার। পাহারা দেওয়ার ব্যাপারে খুবই একগুঁয়ে। আপনি যেভাবে পোড়ানো কোয়েল পাখিকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করেন, ঠিক সেভাবে মানুষকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে পারে। ওদের সুড়ঙের মুখের কাছে নিয়ে গেল সে, সাথে সাথে ওদের পেছনে বন্ধ হয়ে গেল বিশাল গেটটা। দেয়ালের ব্র্যাকেটে জ্বলন্ত মশাল আটকানো। পাথুরে পথে শব্দ তুলছে ঘোড়ার খুর। দুটো ঘোড়া পাশাপাশি এগোনোর মতো যথেষ্ট প্রশস্ত, সওয়ারিদের স্যাডলের উপর উবু হতে হচ্ছে যাতে ছাদের সাথে মাথার টক্কর না লাগে। চারপাশের দেয়াল ভূগর্ভস্থ নদী ও লুকোনো লাভার পাইপের বিড়বিড়ানিতে ভরা। সময় সুড়ঙটা বা কত দূর পথ অতিক্রম করেছে তার পরিমাপের কোনও উপায় নেই ওদের। তবে অবেশেষে বেশ সামনে স্বাভাবিক আলোর একটা মেঘ দেখতে পেল ওরা। আরও আগে বাড়তেই টানেলে প্রবেশ পথ আটকে রাখা গেটের মতোই আরেকটা গেট দেখা গেল। ওরা কাছে যাবার আগেই খুলে গেল ওটা। শিম্পাঞ্জিদের আরকেটা দলের দেখা মিলল। ওদের পার হয়ে আসার পর উজ্বল রোদের আলোয় চোখ পিটপিট করে উঠল ওদের।

চোখ সয়ে আসতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। তারপর অবাক বিস্ময়ে চারপাশে চোখ বোলাল ওরা। একটা সুবিশাল আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে এসে পড়েছে, এত চওড়া যে সবচেয়ে দ্রুত গতির ঘোড়ারও ওটার একপাশের উলম্ব প্রাচীর থেকে আরেক প্রাচীর পর্যন্ত যেতে দিনের অর্ধেকটা লেগে যাবে। এমনকি দক্ষ কোনও পাহাড়ী আইবেক্সও ওই খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠতে পারবে না। জ্বালামুখের তলাটা একটা সবুজ অবতল বর্ম। ওটার মাঝখানে ছোট একটা হ্রদ, তাতে দুধের মতো নীল আভাঅলা জল। ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠে আসছে উপরিতল থেকে। তাইতার ভুরু থেকে বরফের একটা টুকরো গলে গাল বেয়ে নেমে গেল। চোখ পিটপিট করল ও, বুঝতে পারল জ্বালামুখের হাওয়া কোনও ট্রপিকাল সাগরের দ্বীপের মতো আরামপ্রদ। চামড়ার কেইপ খুলে ফেলল ওরা, এমনকি মেরেনের অবস্থাও যেন উষ্ণ পরিবেশে আগের চেয়ে ভালো হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।

পৃথিবীর অগ্নিকুণ্ডের পানিই এই জায়গাটাকে উষ্ণ রাখে। এখানে বাজে আবহাওয়া বলে কিছু নেই। উদ্ধতভাবে হাত নেড়ে চারপাশ ঘিরে রাখা সুন্দরবনের দিকে ইঙ্গিত করল ওনকা। চারপাশের জন্মানো গাছপালা দেখতে পাচ্ছেন? দুনিয়ার আর কোথাও এসব দেখতে পাবেন না।

স্পষ্ট পথ ধরে আগে বাড়ল ওরা। জ্বালামুখের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য দেখিয়ে দিচ্ছে ওনকা। ক্লিফের রঙ লক্ষ করুন, তাইতাকে আমন্ত্রণ জানাল সে, বিশাল দেয়ালের দিকে তাকাতে ঘাড় করে রেখেছে ও। আগ্নেয়গিরির স্বাভাবিক ধূসর বা কালো নয় ওগুলো, বরং রুবি পাথরের ছোপঅলা কোমল নীল ও লালচে সোনালি রেণুতে ঢাকা। বহুরঙা পাথরের মতো লাগছে যেটাকে সেটা আসলে মেয়েদের চুলের সমান লম্বা ও পুরু ছত্রাক, বলল ওনকা।

ক্লিফের দিকে থেকে চোখ নামাল তাইতা। নিচের বেসিনের বনের দিকে তাকাল। ওগুলো পাইন গাছ, সোনালি বাঁশের ঝাড় থেকে মাথা বের করে থাকা উঁচু সবুজ বর্শাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল ও। দানবীয় লতা। পুরু মাংসল কাণ্ড থেকে ঝলমলে ফুল ঝুলছে। বাজি ধরে বলতে পারি ওগুলো কোনও ধরনের ইউফোরবিয়া, আর গোলাপি ও পালকের মতো রূপালি ফুলেঢাকা ঝোঁপগুলো প্রোটিয়াস। ওপাশের লম্বা গাছগুলো সুবাসিত সিডার। আর ছোটগুলো তেঁতুল ও খায়া মেহগনি। ফেন থাকলে এসব দেখে মজা পেত খুব, মনে মনে ভাবল ও।

হ্রদের কুয়াশা ধোয়ার মতে ছত্রাক পড়া ডালের ভেদ করে উঠে আসছে। একটা জলধারা অনুসরণ করতে বাঁক নিল ওরা, কিন্তু কয়েক শো কদম এগোনোর আগেই মেয়েদের ঝনঝন হাসি আর কণ্ঠস্বর কানে এলো! একটা ফাঁকা জায়গায় এসে দেখল নিচের পুকুরের ধূমায়িত নীল জলে সাঁতার কাটছে তিনটা মেয়ে, জলকেলী করছে। নীরবতার ভেতর ওদের চলে যেতে দেখল মেয়েরা। তরুণী ওরা, গাঢ় গায়ের রঙ, লম্বা ভেজা চুল কৃষ্ণকালো। তাইতা ভাবল, ওরা সম্ভবত পুব সাগরের ওপাশের দেশ থেকে এসেছে। নিজেদের নগ্নতা সম্পর্কে নির্বিকার ঠেকল ওদের। প্রত্যেকটা মেয়ের পেটেই বাচ্চা রয়েছে, স্ফীত পেটের ভারসাম্য রক্ষা করতে বারবার কোমরের উপর ভর বদল করছে।

এগিয়ে যাবার সময় তাইতা জানতে চাইল, এখানে কতগুলো পরিবার থাকে? ওই মেয়েদের স্বামীরা কোথায়?

ওরা হয়তো স্যানেটোরিয়ামে কাজ করে, এমনকি হয়তো সার্জনও হতে পারে। তেমন একটা আগ্রহ দেখাল না ওনকা। ওখানে হ্রদের কিনারে পৌঁছে জানতে পারব বোধ হয়।

ধোঁয়াটে নীল পানির এপাশ থেকে স্যানেটোরিয়ামটাকে অনাকর্ষণীয় পাথুরে দালানের একটা কমপ্লেক্স মনে হচ্ছে। পরিষ্কার বোঝা যায়, দেয়ালের পাথরের ব্লকগুলো ক্লিফের প্রাচীর থেকে কুঁদে বের করা হয়েছে। চুনকাম নয়, বরং স্বাভাবিক গাঢ় ধূসরই রয়ে গেছে। চারপাশে সুন্দর করে ছাঁটা ঘাসের প্রাঙ্গণ, বুনোহাঁসের ঝাঁক ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে। অন্তত বিশ ধরনের জলমুরগি হ্রদে সাঁতার কাটছে, ওদিকে অগভীর জলে ঘুরে বেড়াচ্ছে বক আর হেরন। কাঁকর বিছানো সৈকত ধরে যাবার সময় কয়েকটা বিশাল আকারের কুমীর দেখতে পেল তাইতা, নীল জলে গাছের গুঁড়ির মতো পড়ে আছে।

সৈকত ছেড়ে প্রাঙ্গণ ধরে এগিয়ে ফুলে ভরা লতায় ছাওয়া একটা খিলানের ভেতর দিয়ে মূল ভবনের উঠানে পা রাখতে আগে বাড়ল ওরা। ঘোড়ার দায়িত্ব নিতে অপেক্ষা করছিল সহিসরা। চারজন বলিষ্ঠ পুরুষ পরিচারক স্যাডল থেকে একটা খাটিয়ায় তুলে দিল মেরেনকে। মূল ভবনে নিয়ে যাওয়ার পর ওর পাশে রইল তাইতা। এখন যোগ্য হাতে পড়েছ তুমি, মেরেনকে সান্ত্বনা দিল ও। কিন্তু বাতাস আর ঠাণ্ডায় পাহাড় বাইবার ধকল কাবু করে দিয়েছে ওকে, এখন চেতনার কিনারায় ঝুলছে মেরেন।

পরিচারকরা একটা বিরাট অল্প আসবাবে ভরা কামরায় নিয়ে এলো ওকে। হ্রদের দিকে একটা প্রশস্ত দরজা খুলেছে। দেয়াল ও ছাদ ম্লান হলুদ পাথরের টালিতে ঢাকা। শাদা মাৰ্বল মেঝের মাঝখানে রাখা একটা গদিমোড়া তক্তপোষের উপর ওকে নামিয়ে দিল, নোংরা পোশাক খুলে নিয়ে এক কোণে তামার পাইপ থেকে ঘরে তৈরি বেসিনে জমা গরম পানিতে মুছে দিল। পানিতে সালফারের মতো গন্ধ, তাইতা বুঝতে পারল উষ্ণ ঝর্না থেকেই আসছে ওই পানি। ওদের পায়ের নিচের মাৰ্বল মেঝে বেশ আরামপ্রদভাবে উষ্ণ। ওই একই পানি মেঝের নিচে নালার ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, অনুমান করল তাইতা। কামরা ও পানির উষ্ণতা মেরেনকে শান্ত করে আনছে। লিনেনের তোয়ালে দিয়ে ওকে মুছে দিল পরিচারকরা। তারপর ওদের একজন ওর মুখের সামনে একটা বাটি ধরে পাইনের গন্ধঅলা ভেষজের রস খেতে বাধ্য করল। তাইতাকে ওর তক্তপোশের পাশে বাস অবস্থায় রেখে চলে গেল ওরা। অচিরেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল মেরেন, আরকের প্রভাবেই এসেছে ওই ঘুম।

প্রথমবারের মতো চারপাশ জরিপ করার সুযোগ পেল ও। ওয়াশরুমের দরজা লাগোয়া দেয়ালের কোণের দিকে তাকাতেই ওটার পেছনে মানুষের আভার বিচ্ছুরণ টের পেল। চোখেমুখে তার কোনও ছাপ ফুটে উঠতে না দিয়ে নিবিড়ভাবে সেদিকে নজর দিল। বুঝতে পারল দেয়ালের গায়ে একটা লুকোনো পিপ-হোল আছে, ওটা দিয়ে ওদের উপর নজর রাখা হচ্ছে। জেগে ওঠার সাথে সাথে মেরেনকে সতর্ক করে দেবে ও। এমনভাবে চোখ সরিয়ে নিল, যেন নজরদারের উপস্থিতি সম্পর্কে মোটেই ওয়াকিবহাল নয়।

কিছু সময় পরে একজন পুরুষ আর একজন নারী এলো কামরায়। হাঁটু অবধি লম্বা শাদা পরিষ্কার টিউনিক ওদের পরনে। গলায় কোনও জাদুর পুঁতির নেকলেস বা ব্রেসলেট বা বাঁকানো নখ বা প্রাচীন শিল্পকলার অন্যকোনও সাজসরঞ্জাম না থাকলেও সার্জন বলে চিনতে পারল তাইতা। ভদ্রভাবে নাম ধরে ওকে স্বাগত জানাল ওরা, নিজেদের পরিচয় দিল।

আমি হান্নাহ, বলল মহিলা।

আমি গিব্বা, জানাল লোকটা।

সাথে সাথে রোগির পরীক্ষা শুরু করল ওরা। প্রথমে ব্যান্ডেজ বাঁধা মাথা গ্রাহ্য করে হাত ও পায়ের তালু পরখ করল; পেট আর বুকে টোকা দিল। একটা তীক্ষ্ণ কাঠির সূঁচাল ডগা দিয়ে ওর পিঠে আঁচড় কাটল হান্নাহ, কী ধরনের চল্টা ওঠে পরখ করবে।

সন্তুষ্ট হয়ে তারপর ওর মাথার দিকে নজর দিল। দুই হাঁটুতে মেরেনের মাথা চেপে ধরল গিব্বা, শক্ত করে ধরে রাখল। মেরেনের গলা, কান আর নাকের ভেতর পরখ করল ওরা। তারপর তাইতার বেঁধে দেওয়া ব্যান্ডেজ খুলে ফেলল। শুকনো রক্ত আর খুঁজে নোংরা হয়ে গেলেও ওটা বাধার দক্ষতার তারিফ করল হান্নাহ। তাইতার কাজের নৈপূণ্যের ব্যাপারে সমীহ প্রকাশ করতে ওর উদ্দেশে মাথা। দোলাল।

এবার চোখের পাতা খুলে রাখতে একটা রূপার ডায়ালেটর ব্যবহার করে শূন্য চক্ষুকোটরের দিকে মনোযোগ দিল ওরা। কোটরে একটা আঙুল ঢুকিয়ে দৃঢ়ভাবে চাপ দিল হান্নাহ। গুঙিয়ে উঠে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল মেরেন। কিন্তু হাঁটুর মাঝখানে শক্ত করে ওকে ধরে রাখল গিব্বা। ওরা সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পর তাইতার উদ্দেশে মাথা দোলাল হান্নাহ। আঙুলের ডগা এক করে ঠোঁট স্পর্শ করল। আমাদের কিছুক্ষণের জন্যে ক্ষমা করতে হবে। রোগির অবস্থা নিয়ে আলাপ করতে হবে।

খোলা দরজা পথে প্রাঙ্গণে চলে গেল ওরা। ওখানে আলোচনায় মগ্ন হয়ে একসাথে পায়চারি করতে লাগল। দরজা পথে ওদের আভা পরখ করল তাইতা। গিব্বার আভা রোদের আলোয় ধরে রাখা তলোয়ারের মতো ঝিলিক আছে। তাই লক্ষ করল তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি শীতল, নিরাবেগ।

হান্নাহর আভা পরখ করতে গিয়েই বুঝে গেল দীর্ঘায়ু মহিলা সে। তার পুঞ্জীভূত অভিজ্ঞতা বিপুল, দক্ষতা অসীম। বুঝতে পারল তার চিকিৎসার সামর্থ সম্ভবত ওর ক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে গেছে, কিন্তু তারপরেও সহানুভূতির অভাব রয়েছে তার। তার আভা বন্ধ্যা ও কঠোর। আভা থেকে বুঝতে পারল দায়িত্বের প্রতি নিবেদনের ব্যাপারে মহিলা কঠোর, দয়া বা করুণায় ভোলার নয়।

ওরা আবার রোগির কামরায় ফেরার পর হান্নাহই প্রথম কথা বলবে বলেই মনে হলো ওর। ঘুমের ওষুধের প্রভাব কেটে যাবার আগেই এখুনি ওর অপারেশন করতে হবে, বলল সে।

চারজন পেশিবহুল পরিচারক ফিরে এলো, মেরেনের পা আর হাতের পাশে বসল। রূপালি ট্রেতে সার্জিকাল সরজ্ঞাম সাজিয়ে নিল হান্নাহ।

একটা সুবাসিত ভেষজ মলমে মেরেনের চোখ ও ওটার চারপাশের এলাকা ভিজিয়ে দিল গিব্বা। তারপর দুই আঙুলে চোখের পাতা ফাঁক করে রূপার ডায়ালেটরটা বসাল ওগুলোর মাঝখানে। একটা সংকীর্ণ সুচাল স্কেলপেল বেছে নিল হান্নাহ, চোখের কটোরের মুখে ধরল ওটা। বাম হাতের তর্জনী দিয়ে পেছনটা দেখল, যেন জ্বলন্ত লাইনিংয়ের মাঝে জুৎসই জায়গার খোঁজ করছে। তারপর স্কেলপেলটাকে নির্বাচিত জায়গায় বসাতে সেটাকে ব্যবহার করল। সাবধানে মাংসে খোঁচা দিল সে। ধাতুর চারপাশে রক্ত বের হয়ে এলো। একটা আইভরি দণ্ডের খাঁজে আটকানো এক টুকরো কাপড়ের সাহায্যে সেটা মুছে ফেলল গিব্বা। ফলাটার অর্ধেকটা না ঢোকা পর্যন্ত কেটে আরও গভীরে গেল হান্নাহ। সহসা তার উন্মুক্ত করা ক্ষতস্থান থেকে গলগল করে বের হয়ে এলো সবুজ পুঁজ। সরু একটা ফোয়ারার মতো উঠে এসে রোগির ঘরের ছাদের দিকে ফিনকি দিয়ে ছুটে গেল। আর্তচিৎকার করে উঠল মেরেন, গোটা শরীর বেঁকে গেল ওর, ওঠানামা করতে লাগল, ওকে ধরে রাখা চার চারজন লোক হাতছাড়া হওয়া থেকে বিরত রাখতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে বাধ্য হলো।

স্ক্যালপেলটা ট্রেতে ফেলে দিল হান্নাহা, তারপর চোখের কোটারের উপর একটা তুলার দলা চেপে ধরল। ছাদ থেকে ঝরে পড়া পুঁজের গন্ধ ভয়ঙ্কর পচা। ওকে চেপে ধরা লোকদের ভারে আবার শিথিল হয়ে গেল মেরেন। চট করে চোখে চেপে ধরা তুলোটা সরিয়ে নিল হান্নাহ, তারপর কাটা জায়গায় ব্রোঞ্জের একটা ফোরসেপের মুখ ঢুকিয়ে দিল। ক্ষতস্থানের কোথাও চাপা পড়ে থাকা একটা কিছুর সাথে ওটার,ঘর্ষণের আওয়াজ পেল তাইতা। ওটাকে ফোরসেপে ধরে চেপে ধরতে দুই প্রান্ত মেলাল হান্নাহ। আরেক দফা জলীয় পুঁজের একটা ধারার সাথে বাইরের বস্তুটা বের হয়ে এলো। ফোরসেপে ধরে ওটা উঁচু করল সে। মনোযোগের সাথে পরখ করল। জিনিসটা চিনতে পারছি না, আপনি চেনেন? তাইতার দিকে তাকাল সে। একটা হাত পেয়ালার মতো করে বাড়িয়ে দিল তাইতা। সেখানে জিনিসটা ফেলে দিল সে।

উঠে দরজা গলে ঘরে আসা আলোয় সেটা পরখ করতে এগিয়ে গেল তাই। আকারের তুলনায় বেশ ভারি, পাইনের শাঁসের আকারের একটা টুকরো। তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে ধরে ওটাকে ঢেকে রাখা রক্ত ও পুঁজ মুছে ফেলল ও। লাল পাথরের টুকরো! জোরে বলে উঠল ও।

চিনতে পেরেছেন? জানতে চাইল হান্নাহ।

পাথরের একটা টুকরো। বুঝতে পারছি না, কেমন করে আমার চোখ এড়িয়ে গেল এটা। বাকি সব টুকরাই পেয়েছিলাম।

নিজেকে দোষারোপ করবেন না, ম্যাগাস। অনেক গভীরে ছিল ওটা। সংক্রমণ পথ না দেখালে আমরাও হয়তো পেতাম না। কোটর পরিষ্কার করে ভেতরে তুলোর দলা ঠেসে দিচ্ছে হান্নাহ আর গিব্বা। অচেতন হয়ে গেছে মেরেন। তাগড়া পরিচারকরা বাধন শিথিল করল।

এখন অনেক সহজে বিশ্রাম নেবে ও, বলল হান্নাহ, তবে ক্ষতস্থানটা পুরোপুরি সেরে উঠতে বেশ কয়েকদিন লাগবে। তখন আমরা চোখটা বদলে দিতে পারব। সে পর্যন্ত ওকে অবশ্যই নিরিবিলি বিশ্রাম নিতে হবে।

এর আগে কখনও কাজটা করতে না দেখলেও তাই শুনেছে ভারতের সার্জনরা মাৰ্বল বা কাঁচের তৈরি চোখ খোয়ানো চোখের জায়গায় বসাতে পারে। এত সূক্ষ্মভাবে নকশা করা থাকে যে মনে হয় সত্যিকারের চোখ। নিখুঁত বিকল্প না হলেও মুখ ব্যাদান করে থাকা শূন্য কোটরের চেয়ে অনেক কম ভীতিকর।

চলে যাওয়ার সময় সার্জন ও তাদের সহকারীদের ধন্যবাদ দিল ও। অন্য পরিচারকরা ছাদ ও মাৰ্বল মেঝের পুঁজ পরিষ্কার করে নোংরা বিছানা বদলে দিল। শেষে আরেক মধ্যবয়সী মহিলা মেরেনের জ্ঞান না ফেরা অবধি নজর রাখতে হাজির হলো। মেরেনকে তার হাওলায় রেখে রোগির ঘর থেকে খানিক্ষণের জন্যে পালিয়ে এলো তাইতা। প্রাঙ্গণ ধরে এগিয়ে গেল সৈকতের দিকে। বিশ্রাম নেওয়ার মতো একটা পাথরের বেঞ্চ পেয়ে গেল।

পাহাড়ের চূড়ায় দীর্ঘ কষ্টকর যাত্রা শেষে অপারেশনের প্রক্রিয়া দেখে এখন ক্লান্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। বেল্টের পাউচ থেকে পাথরের টুকরোটা বের করল ও, ফের পরখ করল। সাধারণই মনে হচ্ছে বটে কিন্তু জানে সেটা বিভ্রান্তিকর। ঝিলিক মারছে ক্ষুদে লাল পাথরটা। এক ধরনের উষ্ণ আভা বিলোচ্ছে যেন, ওর মাঝে বিতৃষ্ণা জাগাচ্ছে সেটা। উঠে পানির কিনারায় চলে এলো ও, হ্রদের জলে টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলতে হাত পেছনে নিয়ে এলো। কিন্তু তার আগেই ওটার গভীরে এক ধরনের আলোড়ন উঠল, যেন কোনও দানব দাপাচ্ছে ওখানে। ভীতির সাথে পিছিয়ে এলো ও। ঠিক একই সময়ে শীতল হাওয়া কাঁপন জাগাল ওর ঘাড়ে। শিউরে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও। কিন্তু ভীতিকর কিছু দেখতে পেল না। যেমন নীরবে এসেছিল তেমনি চলে গেছে হাওয়াটা। আবার কোমল ও উষ্ণ হয়ে গেছে চারপাশের বাতাস।

পানির উপরে তরঙ্গের একটা বৃত্ত ছড়িয়ে পড়েছে, আবার হ্রদের দিকে তাকাল ও। তখনই আগে দেখা কুমীরের কথা মনে পড়ে গেল। হাতের লাল পাথরের টুকরাটার দিকে তাকাল। দেখে নিরীহ মনে হচ্ছে। কিন্তু শীতল হাওয়া পেয়েছে ও, অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করেছে। পাথরটা আবার পাউচে রেখে ফের প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে ফিরতি পথ ধরল।

মাঝামাঝি আসার পর আবার থামল ও। অন্যসব বিচ্যুতির সাথে এটাই ছিল স্যানেটোরিয়ামের সামনের দিকটা জরিপ করার প্রথম সুযোগ। মেরেনের ঘরটা যে ব্লকে রয়েছে সেটা মূল কমপ্লেক্সের এক প্রান্তে। আরও পাঁচটা বড় বড় ব্লক দেখতে পাচ্ছে ও। প্রত্যেকটা একটা টেরেস দিয়ে পড়শী থেকে বিচ্ছিন্ন, যার উপর একটা করে পারগোলা আঙুর গাছ ধরে রেখেছে, থোকা থোকা আঙুর ঝুলছে তাতে। এই জ্বালামুখের সব কিছুই উর্বর ও ফলদায়ী ঠেকছে। কেন যেন ওর নিশ্চিত মনে হলো শতশত বছরের পরিক্রমায় এখানেই আবিস্কৃত ও বিকশিত অনেক অনেক অসাধারণ বৈজ্ঞানিক চমক ধারণ করছে দালানগুলো। প্রথম সুযেগেই সেগুলো পরখ করবে ও।

সহসা মেয়েলি কণ্ঠে চিন্তায় ছেদ পড়ল ওর। পেছনে তাকাতেই আগে দেখা সেই গাঢ় ত্বকের তিনজন মেয়েকে দেখতে পেল, সৈকত থেকে ফিরে আসছে। এখন পরনে পুরো পোশাক, চুলে বুনো ফুল পরেছে। এখনও পরিপূর্ণ প্রাণবন্ত মনে হচ্ছে ওদের। বনে চড়ইভাতির সময় জাররির ভালো মদ একটু বেশি চেখে ফেলেছে কিনা ভাবল তাই। ওকে উপেক্ষা করে সৈকত বরাবর দালানকোঠার একেবারে শেষ ব্লকের উল্টোদিকে চলে গেল ওরা। তারপর প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে ভেতরে অদৃশ্য হলো। ওদের অবারিত আচরণ কৌতূহলী করে তুলল ওকে। ওদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করল। এই ছোট অদ্ভুত বিশ্বে কী ঘটছে সেটা বুঝতে হয়তো ওকে সাহায্য করতে পারবে ওরা।

অবশ্য, সূর্যটা এরইমধ্যে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে, মেঘ জমাট বাঁধছে। মৃদু হাওয়া বইতে শুরু করল। মুখ উঁচু করে রাখায় ঠাণ্ডা লাগছে। মেয়েদের সাথে কথা বলতে হলে অবশ্যই তাড়াতাড়ি করতে হবে। ওদের পিছু নিল ও। প্রাঙ্গণের মাঝামাঝি আসার পর কমে এলো চলার গতি। ওদের প্রতি আগ্রহও কমে গেল। ওদের কোনও গুরুত্ব নেই, ভাবল ও। আমি বরং মেরেনের কাছেই থাকি। থেমে আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাল ও। জ্বালামুখের দেয়ালের আড়ালে চলে গেছে। সূর্য। প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। এই অল্প সময় আগেও মেয়েদের সাথে কথা বলাটাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন ভাবনাটা ওর মন থেকে বিদায় নিয়েছে যেন মুছে ফেলা হয়েছে। দালানের কাছ থেকে সরে এসে মেরেনের কামরার দিকে পা বাড়াল ও। তাইতা ঢুকতেই উঠে বসল মেরেন, কৃশ হাসল।

কেমন লাগছে? জানতে চাইল তাইতা।

হয়তো ঠিকই বলেছিলেন, ম্যাগাস। লোকগুলো আমাকে সাহায্য করেছে। বলেই মনে হচ্ছে। এখন তেমন একটা ব্যথা নেই। অনেক শক্তিশালী মনে হচ্ছে নিজেকে। ওরা কী করেছে বলুন।

পাউচ খুলে ওকে পাথরের টুকরোটা দেখাল তাই। তোমার মাথার ভেতর থেকে এটা বের করে এনেছে ওরা। এটাই বিষাক্ত হয়ে তোমার কষ্টের কারণে পরিণত হয়েছিল।

পাথরটা নিতে হাত বাড়াল মেরেন, তারপরই ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিল। কী ছোট, কিন্তু কত খারাপ। বাজে জিনিসটা আমার চোখ কেড়ে নিয়েছে। ওটাকে দিয়ে আমার কোনও কাজ নেই। হোরাসের দোহাই, ফেলে দিন ওটা। কিন্তু জিনিসটা আবার পাউচে রেখে দিল তাইতা।

*

এক ভৃত্য সন্ধ্যার খাবার পৌঁছে দিল ওদের। দারুণ উপাদেয় খাবার, তৃপ্তি ও আয়েস করে খেল ওরা। এক ধরনের গরম পানীয় দিয়ে খাবার শেষ করল, গভীর ঘুমে সেটা ওদের সাহায্য করল। পরদিন বেশ সকালে ফিরে এলো হান্নাহ ও গিব্বা। মেরেনের চোখের ড্রেসিং সরানোর পর ফোলা আর ব্যথা অনেকটা কমে এসেছে এসে দেখে খুশি ওরা।

তিনদিনের ভেতর আবার কাজে নামতে পারব আমরা, বলল হান্নাহ। ততদিনে ক্ষত ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা, তবে বীজ গ্রহণ করার মতো উন্মুক্ত থাকবে।

বীজ! জিজ্ঞেস করল তাইতা। বিজ্ঞ বোন, তোমাদের প্রক্রিয়া ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি তো ভেবেছি তোমরা কাঁচ বা পাথরের তৈরি নকল চোখ বসানোর পরিকল্পনা করছিলে। এখন আবার কীসের বীজের কথা বলছো?

আপনার সাথে বিস্তারিত নাও আলোচনা করতে পারি, ভাই ম্যাগাস। কেবল মেঘ-বাগিচার গিল্ডের পণ্ডিতরাই এই বিশেষ জ্ঞান লাভের অধিকারী।

আমি আরও জানতে পারছি না বলে স্বাভাবিকভাবেই হতাশ বোধ করছি, কারণ তোমাদের দেখানো নৈপূণ্যের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছি আমি। এই নতুন আবিষ্কার এখন আরও উত্তেজনাকর মনে হচ্ছে। অন্তত তোমাদের এই নতুন কায়দার চূড়ান্ত ফল দেখার জন্যে অপেক্ষা করব আমি।

জবাব দেওয়ার সময় কিঞ্চিত ভুরু কোঁচকাল হান্নাহ। একে ঠিক নতুন কায়দা বলাটা ঠিক হবে না, ভাই ম্যাগাস। একে আজকের পর্যায়ে আনতে মেঘ-বাগিচার সার্জনদের পাঁচ প্রজন্মের নিবেদিত প্রাণ শ্রমের প্রয়োজন হয়েছে। এমনকি এখনও ঠিক পুরোপুরি নিখুঁত হয়ে ওঠেনি। তবে প্রতিদিনই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। অবশ্য, আমি নিশ্চিত, হয়তো অচিরেই আমাদের গিল্ডে যোগ দিয়ে এই কাজে আমাদের সাথে অংশ নিতে পারবেন আপনি। আমি নিশ্চিত, আপনার অবদান হবে অনন্য ও অমূল্য। অবশ্যই আপনি যদি ইনার সার্কলের বাইরের কারও জন্যে নিষিদ্ধ নয় এমন কিছু জানতে আগ্রহী হয়ে থাকেন, তাহলে খুশি মনেই সেসব নিয়ে আপনার সাথে আলোচনা করতে পারব।

সত্যিই একটা জিনিস জানতে চাই আমি, বনের ভেতর মেয়েদের প্রথম দেখার কথা, তারপর আবার বৃষ্টির ভেতর ওদের স্যানেটোরিয়ামে ফিরে আসার কথা ওর মনের ভেতর ঘুরে মরছিল। ওদের সম্পর্কে জানার এটা আরেকটা সুবর্ণ সুযোগ মনে হলো। কিন্তু প্রশ্নটা ঠোঁটের ডগায় আসার আগেই মিলিয়ে যেতে শুরু করল। ভাবনটাকে ধরে রাখার বিশেষ চেষ্টা করল ও। আমি তোমার কাছে জানতে চাইছিলাম… প্রশ্নটা মনে করার চেষ্টায় কপাল টিপে ধরল ও। মেয়েদের ব্যাপারে একটা কিছু…মনে করার চেষ্টা করল ও, কিন্তু সূর্য ওঠার সাথে সাথে মিলিয়ে যাওয়া সকালের শিশির বিন্দুর মতো সেটা উড়ে গেল। নিজের নির্বুদ্ধিতায় বিরক্তির সাথে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। ক্ষমা করবে, কথাটা কী ছিল বেমালুম ভুলে গেছি।

তাহলে সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনও ব্যাপার নয়। হয়তো পরে আবার মনে পড়বে, উঠে দাঁড়ানোর সময় বলল হান্নাহ। এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি, ম্যাগাস। শুনেছি আপনি উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও খুবই অভিজ্ঞ ভেষজবিদ। আমরা আমাদের বাগান নিয়ে দারুণ গর্বিত। আপনি চাইলে সেখানে ঘুরে আসতে পারেন। আপনার গাইড হিসাবে আনন্দের সাথে কাজ করব আমি।

পরের দিনগুলোর বেশিরভাগই হান্নাহর সাথে মেঘ-বাগিচায় ঘুরে বেড়ানোর পেছনে কাটাল তাইতা। কৌতূহল জাগানোর মতো অনেক কিছু ওকে দেখানো হবে বলে আশা করেছিল ও, কিন্তু ওর প্রত্যাশা শতগুন অতিক্রম করে গেল। জ্বালামুখের প্রায় অর্ধেক এলাকা জুড়ে বিস্তৃত বাগান বিপুল প্রজাতির অসংখ্য গাছে ভর্তি, পৃথিবীর সব এলাকার সব ধরনের আবহাওয়ার গাছই আছে।

শত শত বছর ধরে আমাদের মালিরা এসব সংগ্রহ করেছে, ব্যাখ্যা করল হান্নাহ। এই পুরো সময় জুড়ে দক্ষতা বাড়িয়েছে তারা, প্রত্যেকটা প্রজাতির প্রয়োজনীয়তা জেনেছে। ঝর্নায় বুদ্বুদ তোলা পানি নানা উপাদানে ভরা। আমরা বিশেষ ধরনের গোলাঘর তৈরি করতে পেরেছি যেখানে আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।

এখানে নিশ্চয়ই আরও বেশি কিছু আছে, পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি তাইতা। এখানে কীভাবে উঁচু পাহাড়ের দানবীয় রোবেলিয়া গাছ ট্রপিকাল বনের টিক আর মেহগনি গাছের পাশে জন্মাতে পারে তার কোনও ব্যাখ্যা মেলে না।

আপনি খুবই বিচক্ষণ, ভাই, সায় দিল হান্নাহ। ঠিকই ধরেছেন। এখানে উষ্ণতা, সূর্যের আলো আর পুষ্টির চেয়েও বেশি কিছু রয়েছে। আপনি গিল্ডে যোগ দেওয়ার পর আমাদের জাররিতে কী পরিমাণ বিস্ময়কর ব্যাপারস্যাপার রয়েছে তার মাত্রা সম্পর্কে একটা ধারণা পাবেন। তবে নগদ জ্ঞান লাভের আশা করতে যাবেন। না। আমরা হাজার বছরের জ্ঞান আর প্রজ্ঞার সমাবেশ নিয়ে আলোচনা করছি। এমন মূল্যবান কিছু একদিনে আয়ত্ত করার নয়। ঘুরে ওর মুখোমুখি হলো সে।

আপনি জানেন এই জীবনে কত দীর্ঘদিন বেঁচে আমি, ম্যাগাস?

তুমি দীর্ঘায়ু এটা বুঝতে পেরেছি, জবাব দিল তাইতা।

ঠিক আপনার মতোই, ভাই, জবাব দিল সে। কিন্তু আপনার জন্মের দিনও অনেক বয়স্ক ছিলাম আমি, কিন্তু এখনও রহস্যের বেলায় নবীশ রয়ে গেছি। গত অল্প কদিনে আপনার সঙ্গ উপভোগ করেছি। আমরা প্রায়ই মেঘ-বাগিচার বুদ্ধিবৃত্তিক ভূখণ্ডে নিজেদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ করে দিই, তো আপনার সাথে কথা বলতে পারাটা আমাদের যেকোনও ভেষজ ওষুধের মতোই কাজের। যাহোক, এবার ফিরতে হয়। কালকের প্রক্রিয়ার জন্যে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাগানের গেটে আলাদা হলো ওরা। এখনও বিকেলের গোড়ার দিক। অলস পায়ের হ্রদের কিনারা বরবার হাঁটতে লাগল তাইতা। একটা জায়গা থেকে জ্বালামুখের ওপারে অসাধারণ একটা দৃশ্য দেখা গেল। সেখানে পৌঁছার পর একটা উপড়ানো গাছের গুঁড়িতে বসে মন উন্মুক্ত করে দিল ও। লেপার্ডের খোঁজে বাতাসে গন্ধ শোকা অ্যান্টিলোপের মতো বৈরী উপস্থিতি খুঁজল ইথারে। কিন্তু তেমন কিছু পেল না। একেবারে প্রশান্ত, কিন্তু তারপরও ও জানে ব্যাপারটা এক ধরনের ভ্রান্তি হতে পারে: নিশ্চয়ই ডাইনীর আস্তানার বেশ কাছাকাছি রয়েছে ও। কারণ সব মনস্তাত্ত্বিক প্রতীক ও ইঙ্গিত তার উপস্থিতির সঙ্কেত দিচ্ছে। গোপন জ্বালামুখ তার পক্ষে নিখুঁত ঘাঁটির ব্যবস্থা করবে। এখানে ওর আবিষ্কার করা অসংখ্য বিস্ময়কর ব্যাপারস্যাপার হয়তো তার জাদুরই ফল। এক ঘণ্টারও কম সময় আগে উষ্ণতা, সূর্যের আলো আর পুষ্টিকর উপাদানের চেয়েও বেশি কিছু আছে, বলে তারই ইঙ্গিত দিয়েছে হান্নাহ।

মনের চোখ দিয়ে দানবীয় কালো মাকড়শার মতো ইয়োসকে জালের মাঝখানে বসে থাকতে দেখল ও, শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে মিহি সুতোয় ক্ষীণতম আন্দোলনের অপেক্ষা করছে। তাই জানে, ওইসব অদৃশ্য জাল ওর জন্যেই পাতা হয়েছে, এবং ইতিমধ্যে তাতে বাঁধা পড়েছে ও।

এতক্ষণ নিষ্ক্রিয় ও নীরবে ইথার পরখ করছিল ও। ফেনকে আহ্বান জানাতে প্রলুব্ধ হলেও জানত, তেমন কিছু করলে উল্টে ডাইনীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বসতে পারে। ফেনকে এখন বিপদে ফেলতে পারবে না। ঠিক মনটাকে রুদ্ধ করতে যাবে, এমন সময় মনস্তাত্ত্বিক গোলমালের একটা মহা তরঙ্গ চিৎকার করে কপালের পাশটা চেপে ধরতে বাধ্য করল ওকে। পাক খেল ও, গাছের গুঁড়ির উপর থেকে প্রায় উল্টে পড়ার দশা হলো।

ও যেখানে বসে আছে তার খুব কাছেই করুণ কিছু ঘটে যাচ্ছে। ওর মনের পক্ষে এমন বিষাদ ও কষ্ট, ইথারে ভেসে আসা এমন চরম অশুভকে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ল। যুঝতে লাগল ও। যেন ভোলা মহাসাগরের বুকে ডুবন্ত সাতারুর মতো প্রবল জোয়ারের মোকাবিলা করছে। মনে হলো তলিয়ে যাচ্ছে ও, কিন্তু তারপর ঝড়ের প্রাবল্য কমে এলো। এমন একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে যাবার জন্যে এক ধরনের গভীর বেদনাবোধে আক্রান্ত হয়ে রইল ও, বাধা দিতে পারেনি।

উঠে দাঁড়ানোর মতো সামলে নিতে অনেকটা সময় লাগল ওর, ক্লিনিকের পথে পা বাড়াল। সৈকতে বের হয়ে আসার পর হ্রদের মাঝখানে আরেকটা তোলপাড় দেখতে পেল ও। এইবার নিশ্চিত হয়ে গেল ও, ভৌত বাস্তবতাই প্রত্যক্ষ করছে। ও। পানির নিচে থেকে উঠে আসা এক দল কুমীরের আঁশঅলা পিঠ দেখতে পেল ও, হাওয়ায় উড়ছে ওদের লেজ। মনে হচ্ছে যেন মরদেহ খাচ্ছে, লোভী উন্মাদনায় পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছে। দেখার জন্যে থামল ও, একটা মদ্দা কুমীরকে পানি থেকে শূন্যে উঠে আসতে দেখল। মাথা নেড়ে এক টুকরো মাংস হাওয়ায় উড়িয়ে দিল ওটা। ওটা নেমে আসার সময় ফের লুফে নিল, তারপর ঘূর্ণী তুলে অদৃশ্য হয়ে গেল পানির নিচে।

অন্ধকার ঘনিয়ে আসা পর্যন্ত দেখতে লাগল তাইতা। তারপর গভীর অস্বস্তি বোধ নিয়ে প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল।

ও ঘরে ঢোকার পরপরই জেগে উঠল মেরেন। তরতাজা মনে হলো ওকে, তাইতার গম্ভীর মেজাজ তাকে প্রভাবিত করছে না। সন্ধ্যার খাবার খাওয়ার সময় হান্নাহর পরদিনের অপারেশনের পরিকল্পনা নিয়ে বাজে রসিকতায় মেতে উঠল। নিজেকে সাইক্লপস বলে উল্লেখ করল সে, যাকে একটা কাঁচের চোখ দেওয়া হবে।

*

হান্নাহ ও গিব্বা এক দল সহকারী নিয়ে পরদিন বেশ সকালে হাজির হলো ওদের ঘরে। মেরেনের চোখের কোটর পরীক্ষা শেষে ওকে পরবর্তী ব্যবস্থার জন্যে তৈরি বলে ঘোষণা করল। এক ডোজ ভেষজ চেতনা নাশক তৈরি করল গিব্বা ওদিকে সরঞ্জামের ট্রে-টা পাতল হান্নাহ। তারপর মেরেনের পাশে মাদুরে বসল। খানিক পর পর ওর অক্ষত চোখের পাতা তুলে চোখের মণির বিস্তৃতি পরখ করছে সে। শেষ পর্যন্ত ওষুধ কাজ শুরু করেছে, মেরেন শান্তিতে বিশ্রাম নিচ্ছে, সন্তুষ্ট হয়ে গিব্বার উদ্দেশে মাথা দোলাল সে।

উঠে কামরা থেকে বের হয়ে গেল সে, অল্প সময় বাদে একটা ছোট অ্যালাবাস্টার পট নিয়ে ফিরে এলো। এমনভাবে বহন করছে, যেন ওটা মহাপবিত্র প্রভু সামগ্রী চার সহকারী মেরেনের হাত-পা বেঁধে ফেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর পটটা হান্নাহর ডান হাতের খুব কাছে নামিয়ে রাখল। আরও একবার মেরেনের মাথাটা দুই হাঁটুর মাঝখানে ধরল। খোয়া যাওয়া চোখের পাতা ফাঁক করে রূপালি ডায়ালেটরটা বসিয়ে দিল জায়গামতো।

ধন্যবাদ, ডাক্তার গিব্বা, বলল হান্নাহ। গোড়ালির উপর মৃদু ছন্দোময় ভঙ্গিতে দুলতে শুরু করল সে। আন্দোলনের সাথে তাল মিলিয়ে মন্ত্র জপতে শুরু করল ওরা। কয়েকটা শব্দ চিনতে পারল তাইতা, মনে হচ্ছে তেনমাসের ক্রিয়া পদের মতো একই উৎস থেকে এসেছে ওগুলো। মনে মনে ধরে নিল এটা হয়তো ভাষার অনেক উন্নত, আরও বিকশিত একটা ধরণ।

ওদের শেষ হলে ট্রে থেকে একটা স্ক্যালপেল তুলে নিল হান্নাহ, তেলের কুপির শিখার উপর দিয়ে খেলাল ওটার ফলা। তারপর চক্ষু কোটরের অভ্যন্তরের লাইনিংয়ে অগভীর সমান্তরাল দ্রুত কয়েকটা গর্ত তৈরি করল। মিস্ত্রিদের ভেজা কাদা লাগাতে দেয়ালের শরীর পানি দিয়ে তৈরি করার কথা মনে পড়ে গেল তাইতার। হালকা ক্ষত থেকে ক্ষীণ ধারায় রক্ত বের হচ্ছে, হান্নাহ একটা শিশি থেকে কয়েক ফোঁটা তরল ছিটাতেই রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে গেল। জমাট বাঁধা রক্ত মুছে ফেলল গিব্বা।

এই তরল শুধু রক্তপাতই বন্ধ করে না, বীজের জন্যেও জোড়া দেওয়ার আঠা তৈরি করে, ব্যাখ্যা করল হান্নাহ।

এর আগে গিব্বার মতো সেই একই রকম সমীহ জাগানো যত্নের সাথে অ্যালাবাস্টার পটের ঢাকনা তুলল হান্নাহ। ভালো করে দেখতে মাথা সামনে বাড়িয়ে দিল তাইতা। খুবই সামান্য পরিমাণ হলদে স্বচ্ছ জেলির মতো পদার্থ দেখতে পেল; বড়জোর নখের ডগা ঢাকার মতো।

চোখ বন্ধ করার জন্যে আমরা তৈরি, ডাক্তার গিব্বা, মৃদু কণ্ঠে বলল সে। ডায়ালেটর তুলে নিল গিব্বা। তারপর বুড়ো আঙুল ও তর্জনী দিয়ে চোখের পাতা বন্ধ করে দিল। ভেড়ার নাড়ী দিয়ে বানানো সূক্ষ্ম সুতো পরানো একটা সরু রূপালি সুই তুলে নিল হান্নাহ। দক্ষ হাতে চোখের পাতায় তিনটা সেলাই দিল। মেরেনের মাথা ধরে রাখল গিব্বা, মিশরিয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মন্দিরের এমবামারদের ব্যবহৃত জটিল প্যাটার্নের পরস্পর লাগানো লিনেনের কাপড়ে ব্যান্ডেজ করে দিল হান্নাহ। স্বস্তি-ভরা চেহারায় পায়ের উপর ভর দিয়ে বসল। ধন্যবাদ, ডাক্তার গিব্বা। যথারীতি তোমার সহযোগিতা অনেক মূল্যবান ছিল।

ব্যস, এই? জানতে চাইল তাইতা। অপারেশন শেষ?

যদি পচন বা অন্য কোনও ধরনের ঝামেলা না দেখা দেয়, বার দিনের ভেতর সেলাই খুলে নেব, জবাব দিল হান্নাহ। ততক্ষণ আমাদের মুল চিন্তার বিষয় হবে চোখটাকে আলো ও রোগির হাত থেকে রক্ষা করা। এই সময়ে অনেক অশান্তিতে থাকবে সে। এমন ব্যথা আর চুলকানি হবে যা কিনা চেতনানাশক ওষুধ দিয়েও চট জলদি কমানো যাবে না। জাগ্রত অবস্থায় নিজেকে সামলাতে পারলেও ঘুমের ভেতর চোখ ডলার চেষ্টা করবে সে। প্রশিক্ষিত পরিচারকদের পাহারায় রাখতে হবে ওকে। হাত বেঁধে রাখা হবে। অন্ধকার জানালাহীন সেলে নিয়ে যেতে হবে ওকে, যাতে আলো ব্যথাকে আরও বাড়াতে বা বীজের অঙ্কুরোদাম ঠেকাতে না পারে। আপনার উত্তরসুরির জন্যে খুব একটা খারাপ সময় যাবে, সামাল দিতে আপনার সহযোগিতার প্রয়োজন হবে তার।

দুটো চোখই বন্ধ করার দরকার হলো কেন, অক্ষতটাও?

চোখে পড়া কিছু ভালো চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করলে নতুনটাও সাড়া দেবে। ওটাকে যতটা সম্ভব নিশ্চল রাখতে হবে আমাদের।

*

ডাক্তার হান্নাহ সাবধান করে দিলেও চোখের বীজ বপন করার পরের তিনটা দিন তেমন একটা অস্বস্তি বোধ করল না মেরেন। সবচেয়ে কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল দৃষ্টিশক্তি থেকে বঞ্চিত হওয়া আর সে কারণে দেখা দেওয়া একঘেয়েমী। বছরের পর বছর একসাথে অংশ নেওয়া অভিযান, সফর করা জায়গা আর পরিচয় পাওয়া নারী পুরুষের স্মৃতি রোমন্থন করে ওকে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করে গেল তাইতা। মাতৃভূমির আর নীলের উপর দিয়ে বয়ে চলা খরার সম্ভাব্য প্রভাব আলোচনা করল ওরা, লোকজনের উপর নেমে আসা দুর্ভোগ ও ফারাও নেফার সেতি ও রানি কীভাবে এই দুর্যোগের মোকাবিলা করছেন তাও আলোচনা করল। গালালায় নিজেদের বাড়িঘর এবং এই অভিযান শেষে ফিরে গিয়ে কী অবস্থায় দেখবে, আলোচনা করল তাও। এইসব প্রসঙ্গে আগেও বহুবার আলোচনা করেছে ওরা, কিন্তু তাইতার কণ্ঠস্বর মেরেনকে শান্ত করল।

চতুর্থ দিন সকালে চোখের কোটরের তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে জেগে উঠল ও। ঠিক হৃপিণ্ডের স্পন্দনের মতোই নিয়মিত বিরতিতে আঘাত হানছে, এতই প্রবল যে প্রতিটি হামলার সাথে সাথে বিষম খাচ্ছে ও, স্বয়ংক্রিয়ভাবে চোখের দিকে চলে যাচ্ছে দুই হাত। হান্নাহর খোঁজে পরিচারকদের পাঠাল তাইতা। নিমেষে হাজির হলো সে, ব্যান্ডেজ খুলে ফেলল। পচন ধরেনি, বলল সে। পুরোনো ব্যান্ডেজের বদলে নতুন ব্যান্ডেজ লাগাতে শুরু করল। আমরা এমন কিছুই আশা করেছিলাম। বীজ জায়গা করে নিয়েছে। শেকড় ছড়াতে শুরু করেছে এখন।

মালিদের মতো কথাবার্তা বলছ, বলল তাইতা।

আমাদের অনেকটা মানুষের মালিই বলা যায়, জবাব দিল সে।

পরের দিন তিন ঘুমাতে পারল না মেরেন। যন্ত্রণা প্রবল হয়ে উঠলে মাদুরের উপর দাপাদাপি করে, গোঙাতে থাকে ও। খায় না, রোজ মাত্র কয়েক বাটি পানি খেতে পারে। অবশেষে যখন ঘুম গ্রাস করে নিল, চিত হয়ে শুয়ে থাকল ও, ওর হাতজোড়া চামড়ার ফিতে দিয়ে পাশে বেঁধে রাখা হলো। ব্যান্ডেজ বাঁধা মুখে প্রচণ্ড শব্দে নাক ডেকে চলল। গোটা এক রাত এক দিন ঘুমাল ও।

জেগে ওঠার পর শুরু হলো চুলকানি। মনে হচ্ছে পিঁপড়ার দল আমার চোখে আঁচড়াচ্ছে। ঘোঁৎ করে শব্দ করে কর্কশ পাথরে দেয়ালের গায়ে মুখ ডলতে চাইল ও। মেরেন বেশ শক্তিশালী লোক, তাই ওকে ঠেকাতে পরিচারকদের আরও দুই সহকর্মীকে ডাকতে হলো। যদিও খাবার আর ঘুমের ঘাটতির কারণে শরীরে মাংস ঝরে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে ওর। বুকের চামড়ার ভেতর থেকে পরিষ্কার পাঁজরের হাড় বেরিয়ে পড়েছে, পেটটা চুপসে মেরুদণ্ডের হাড়ের সাথে মিশে গেছে যেন।

বছরে পর বছর তাইতা আর ও এত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে যে ওর সাথে ভুগতে লাগল তাইতাও। মেরেন সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে অস্থির ঘুমে তলিয়ে গেলেই কেবল ওর সেল থেকে পালিয়ে আসার সুযোগ পাচ্ছে ও। ওকে পরিচারকদের হাতে ছেড়ে দিয়ে সুন্দর বাগানে ঘুরে বেড়াতে পারে।

এইসব বাগানে এক ধরনের শান্তির খোঁজ পেয়েছে তাইতা, সময়ে সময়ে তাই বারবার এখানে ফিরে আসছে। বিশেষ ঢঙে বিন্যাস করা হয়নি বাগানগুলো, বরং কতগুলো পথ, বড় রাস্তা আর গলির একটা গোলকধাঁধা, সেগুলোর কোনওটা আবার আগাছায় ভরা। প্রতিটি বাঁক বা মোড়ই নতুন আনন্দের জগতে নিয়ে যায়। উষ্ণ মিষ্টি হাওয়ায় নানান ফুলের মিশে যাওয়া সুবাস কেমন যেন ঘোর লাগা অনুভূতি সৃষ্টি করে, নেশা ধরিয়ে দেয়। জমিন এত বিস্তৃত যে এই স্বর্গের পরিচর্যাকারী মাত্র হাতে গোণা কয়েকজন মালির দেখা পেয়েছে ও। ওর আগমনের আভাস পেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে তারা, যেন মানুষ নয়, প্রেতাত্মা। প্রতি সফরেই নতুন নতুন খিলান আর ছায়াময় হাঁটাপথের দেখা পাচ্ছে ও, আগের বার যা হয়তো বাদ দিয়ে গেছে। কিন্তু আবার সেখানে ফিরে যাবার প্রয়াস পাচ্ছে যখন, দেখা যাচ্ছে সেগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে, সে জায়গায় সমান সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর অন্য বাগান দেখা দিয়েছে। বৈচিত্র্যময় বিস্ময়ে ভরা উদ্যান এটা।

বীজ বপনের দশম দিনে মেরেনকে অনেক সহজ মনে হলো। চোখে নতুন ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল হান্নাহ, বলল সে খুশি হয়েছে। ব্যথা পুরোপুরি বন্ধ হলেই চোখের পাতার সেলাই খুলে ফেলতে পারব আমি, তারপর বুঝতে পারব কতটা অগ্রগতি হলো।

আরেকটা শান্ত রাত কাটাল মেরেন, জেগে উঠল নাশতার জন্যে চমৎকার খিদে নিয়ে। তার রসবোধও ফিরে এলো। রোগীর চেয়ে বরং তাইতারই কেমন যেন পরিশ্রান্ত ও দুর্বল বোধ হলো। চোখজোড়া ঢাকা থাকলেও তাইতার মানসিক অবস্থা যেন বুঝতে পারল মেরেন। ওর বিশ্রাম দরকার, একা থাকতে দিতে হবে ওকে। অনেক সময় ওর এমনিতে স্পষ্টবাদী ও সরল সিধা সঙ্গীর চকিত প্রখর বুদ্ধির প্রদর্শনে অবাক মানে তাইতা। মেরেন যখন বলল, আমাকে অনেক সময় ধরে নার্সের মতো সেবা করেছেন, ম্যাগাস। লাগলে মাদুর ভেজাতে দিন আমাকে। আপনি বিশ্রাম নিন। আমি নিশ্চিত দেখতে ভয়াবহ লাগছে আপনাকে। খুবই আলোড়িত হলো ও।

উঠে ছড়িটা তুলে নিল তাইতা, বেল্টের নিচে টিউনিকটা একটু তুলে স্যানেটোরিয়াম থেকে সবচেয়ে দূরের বাগানের উপরের অংশের উদ্দেশে রওয়ানা হলো। জায়গাটাকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে ওর। কেবল এটাই জ্বালামুখের সবচেয়ে প্রশস্ত ও যত্নহীন এলাকা, এইটুকু ছাড়া আর কোনও কারণ বলতে পারবে না। পাথুরে প্রাচীর থেকে বিশাল সব চাঁই ভেঙে পড়েছে, গড়িয়ে নেমে এসে প্রাচীন কালের রাজা আর বীরদের নামে নির্মিত সৌধের ধ্বংসস্তূপের মতো পড়ে রয়েছে। সেগুলোর উপর লতাপাতা উঠে এসেছে, ফুলে ভরে গেছে। খুব ভালো করে চেনা ভেবে একটা পথ ধরে আগে বাড়ল ও, কিন্তু দুটো বিশাল বোল্ডারের মাঝখানে একটা হঠাৎ বাঁকে এসে প্রথমবারের মতো লক্ষ করল যে আরেকটা স্পষ্ট রাস্তা সোজা জ্বালামুখের খাড়া দেয়ালের দিকে চলে গেছে। শেষ বার যখন এখানে আসে তখন এটা ছিল না, নিশ্চিত ও। কিন্তু বাগানের এমনি জাদুময় বৈশিষ্ট্যে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে ও, কোনও দ্বিধা ছাড়াই এগিয়ে গেল সে পথে। অল্প কিছুদূর এগোনোর পরেই ডানদিকে কোথাও প্রবহমান পানির আওয়াজ কানে এলো। শব্দ অনুসরণ করে আগে বাড়ল ও, অবশেষে একটা সবুজের পর্দা ভেদ করে সামনে এগিয়ে আরেকটা গোপন ফাঁকা জায়গায় চলে এলো। সকৌতূহলে চারপাশে নজর বোলাল। একটা গুহা-মুখ থেকে ছোট একটা ধারা এসে বেশ কয়েকটা শ্যাওলা ঢাকা চাতালের উপর দিয়ে একটা পুকুরে গিয়ে পড়েছে।

পুরো দৃশ্যটা এতটাই মোহনীয় ও প্রশান্তিময়, তাইতা কেমল ঘাসের একটা জায়গায় এসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপড়ে পড়া গাছের কাণ্ডে ঠেস দিল। কিছু সময় কালো জলের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ও। পুকরের জলের গভীরে একটা বড়সড় মাছের ছায়া দেখতে পাচ্ছে। জলের উপর ঝুলে থাকা ফার্ন আর চাতালের নিচে অর্ধেকটা ঢাকা পড়েছে। অনেকটা অলস হাওয়ায় উড়ন্ত পতাকার মতে সম্মোহনীর শক্তিতে নড়ছে ওটার লেজ। দেখতে গিয়ে তাইতা বুঝতে পারল কতটা ক্লান্ত ও, চোখ বন্ধ করল। মৃদু বাজনার শব্দে যখন ঘুম থেকে জেগে উঠল বুঝতে পারল না ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল।

পুকুরের উল্টোদিকে একটা পাথুরে চাতালে বসে আছে বাদক, তিন বা চার বছর বয়সী কোঁকড়া চুলের একটা ইম্প, আগাছার বাঁশিতে সুর তোলার সময় এপাশ ওপাশ মাথা দোলাচ্ছে, গালে এসে পড়ছে মাথার চুল। গায়ের রঙ রোদে পোড়া সোনালি। দেবদূতসুলভ চেহারা। ছোট ছোট হাত পা নিখুঁত গোলাকার, থলথলে। ছেলেটা সুন্দর, কিন্তু তাই অন্তর্চক্ষু দিয়ে ওর দিকে তাকাতেই তাকে ঘিরে রাখা কোনও আভা দেখতে পেল না।

তোমার কী নাম? জিজ্ঞেস করল তাইতা।

বাঁশিটা ছেড়ে দিতেই সেটা ছেলেটার গলায় ঝোলানো রশিতে ঝুলতে লাগল। অনেক নামই আছে, জবাব দিল সে। ছেলেমানুষি কণ্ঠস্বর, আধোআধো বোল, এতক্ষণ যে মোহনীয় বাঁশি বাজাচ্ছিল তারচেয়েও মধুর।

একটা নাম জানাতে না পারলে তুমি কে সেটা বলো, আবার বলল তাইতা।

আমি অনেক, বলল ছেলেটা। আমি লিজিয়ন।

তাহলে তোমার পরিচয় আমি জানি। তুমি বেড়াল নও, বরং তার থাবার চিহ্ন, বলল তাইতা। তার নাম উচ্চারণ করতে না পারলেও ধারণা করতে পারছে এই দেবদূত ইয়োসেরই একটা প্রকাশ।

আমিও জানি তুমি কে। খোঁজা তাইতা।

দুর্বোধ্য রয়ে গেল তাইতার চেহারা। কিন্তু ওর অন্তস্তলকে রক্ষাকারী বর্মে বরফের তীরের মতো আঘাত করল পরিহাসটা। বনের বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ানো কুকুরছানার মতো মোহনীয় ভঙ্গিমায় উঠে দাঁড়াল ছেলেটা। তাইতার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে, আবার বাঁশি ঠোঁটে ছোঁয়াল। কোমল, ছন্দোময় সুর তুলল, তারপর আগাছার বাঁশিটা নামাল আবার। কেউ তোমাকে বলে ম্যাগাস তাইতা, কিন্তু অর্ধেক পুরুষ কখনও অর্ধেক ম্যাগাসের চেয়ে বেশি হতে পারে না। একটা রূপালি সুর তুলল সে। কিন্তু সুরের মাধুর্য তার কথার যন্ত্রণা দূর করতে পারল না। আবার বাঁশি নামাল সে, কালো পুকুরের দিকে ইঙ্গিত করল। ওখানে কী দেখছ, বিকৃত তাইতা? ছবিটা চিনতে পারছ, না পুরুষ না নারী তাইতা?

কথামতো কালো জলের দিকে তাকাল তাইতা। গভীর থেকে একটা তরুণের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠল দেখল। তার চুল ঘন, ঝলমলে, চোখের ভুরু প্রশস্ত নিবিড়, চোখজোড়া প্রজ্ঞা ও রসবোধে প্রাণবন্ত, উপলব্ধি ও সহানুভূতিময়। পণ্ডিত ও শিল্পীর চেহারা ওটা। লম্বা ও, লম্বা পরিষ্কার হাত-পা। ধড় হালকা পেশিপূর্ণ। হাভভাব শিতল ও মহোনীয়। ব্লিচ করা শাদা লিনেনে কুঁচকি ঢেকে রেখেছে। দৌড়বিদ ও যোদ্ধার শরীর।

এই লোকটাকে চিনতে পারছ? ছেলেটা আবার জানতে চাইল।

হ্যাঁ, কর্কশ কণ্ঠে জবাব দিল তাইতা। কণ্ঠ প্রায় ভেঙে পড়েছে।

ওটা তুমি, বলল ছেলেটা। এককালে যেমন ছিলে, অনেক অনেক বছর আগে।

হ্যাঁ, বিড়বিড় করে বলল তাইতা।

এখন কী হয়েছ নিজের চোখেই দেখ, নারকীয় ছেলেটা বলল। তরুণ তাইতার পিঠ বেঁকে গেল, ওর হাত-পা সরু কাঠিতে পরিণত হলো। ক্ষীণ হয়ে গেল চমৎকার পেশি, পেট বেরিয়ে এলো। মাথার চুল ধূসর হয়ে এলো ওর, দীর্ঘ লম্বা চুলও ফিকে হয়ে গেল। শাদা দাঁত পরিণত হলো হলদে খাঁজকাটা। গালে গভীর বলীরেখা দেখা দিল, ভাঁজ হয়ে ভেঙেচুড়ে গেল চিবুকের নিচের চামড়া। ঝিলিক হারাল দুই চোখ। প্রতিমূর্তিটা একটা ক্যারিকেচার হলেও বাস্তবতা কেবল আরও অতিরঞ্জিতই।

তারপর সহসা কোমরের কাপড় খসে পড়ল, যেন দমকা হাওয়ায় উড়ে গেছে, ফলে উন্মুক্ত হয়ে গেল ওর কুঁচকি। নির্বীজ করা ছুরি ও উত্তপ্ত ছ্যাকা দেওয়ার দণ্ডের রেখে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন মৃদু স্বরে গুঙিয়ে উঠল তাইতা।

তোমার এখনকার চেহারা চিনতে পারছ? জিজ্ঞেস করল শয়তানটা। অদ্ভুতভাবে অসীম সহানুভূতিতে ভরা কণ্ঠস্বর।

তাইতাকে পরিহাসের চেয়ে বেশি আঘাত করল এই করুণা। আমাকে এসব দেখাচ্ছ কেন? জানতে চাইল ও।

তোমাকে সতর্ক করতে এসেছি আমি। এতদিন তোমার জীবন নিঃসঙ্গ, বন্ধ্যা থেকে থাকলে অচিরেই আরও হাজারগুন বেড়ে উঠবে। আরও একবার ভালোবাসার পরিচয় পাবে তুমি, কামনা করবে, কিন্তু সেই কামনা কখনওই প্রশমিত হবে না। ভালোবাসার এক অসম্ভব নরকে দগ্ধ হবে তুমি। ওকে অস্বীকার করার মতো কোনও শব্দ পেল না তাই। কারণ এরইমধ্যে শয়তানটার হুমকির যন্ত্রণা পেয়ে বসেছে ওকে। এটা, জানে ও, কী হতে পারে তার একটা পূর্বাভাস মাত্র। গুঙিয়ে উঠল ও।

এমন সময় আসবে, যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে মৃত্যু কামনা করবে তুমি, নির্দয়ভাবে বলে চলল শয়তানটা। কিন্তু ব্যাপারটা ভেবে দেখ। দীর্ঘায়ু তাইতা। মৃত্যু এসে শস্তি দেওয়ার আগে কত দিন তোমার ভোগান্তি চলবে?

পুকরের জলে প্রাচীন অবয়বটা মিলিয়ে গেল, তার জায়গায় সুদর্শন প্রাণবন্ত তরুণের ছবি ফুটে উঠল। কালো জল থেকে তাইতার দিকে তাকিয়ে হাসছে সে। চোখ ঝকঝক করছে, দাঁত ঝিলিক মারছে।

যা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তোমাকে আমি তা ফিরিয়ে দিতে পারি, বলল ছেলেটা, কণ্ঠস্বর ডাক ছাড়া বেড়ালের বাচ্চার মতো। তরুণের কোমর থেকে রেশমী কাপড়ের টুকরোটা খসে পড়ল, বের হয়ে এলো নিখুঁত পুরুষাঙ্গ।

তোমাকে তোমার পৌরুষ ফিরিয়ে দিতে পারি, তোমার সামনে তুলে ধরা ওই প্রতিবিম্বের মতো পরিপূর্ণ করে তুলতে পারি। পুকুরের ইমেজ থেকে চোখ সরাতে পারছে না তাই। সারা জীবন বোধ না করা কামনা বোধে আক্রান্ত হলো তাই। সেগুলো এতটাই বিকৃত কামনাপ্রসূত যে, তাইতা বুঝতে পারল ওর নিজের ভেতরে তৈরি নয়, বরং ওই শয়তান ছেলেটাই গেঁথে দিচ্ছে ওর মনে। দূর করে দিতে চাইল ও, কিন্তু নর্দমার জলের মতোই চুঁইয়ে বের হয়ে আসতে লাগল।

ছোট হাত তুলে তাইতার কুঁচকির দিকে ইশারা করল সুদর্শন ছেলেটা। সবই সম্ভব, তাইতা, শুধু যদি আমাকে বিশ্বাস করো।

সহসা কুঁচকিতে জোরাল একটা অনুভূতি বোধ করল তাইতা। প্রেতাত্মা তরুণের অভিজ্ঞতাই ওর শরীরে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে বোঝার আগে পর্যন্ত কী হচ্ছে কোনও ধারণাই করতে পারছিল না ও। অজান্তেই ওর পিঠ বেঁকে গেল, দাঁতে দাঁত চেপে ধরায় ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল। গলা থেকে বের হয়ে এলো কর্কশ চিৎকার। ভূতে ধরা মানুষের মতো গোটা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল ওর। তারপর ঘাসের উপর লুটিয়ে পড়ল ও, যেন এক লীগ দূরত্ব দৌড়ে এসেছে, হাঁপাতে লাগল। ওর সব শক্তি ফুরিয়ে গেছে।

শারীরিক আনন্দের চরম শিখরের স্মৃতির কথা চেপে রাখার কথা ভুলে গেছ? এইমাত্র তোমার যার অভিজ্ঞতা হলো সেটা তোমাকে যা দিতে পারি তার তুলনায় পাহাড়ের কাছে বালি-কণার মতো, বলল ছেলেটা। দৌড়ে পাথুরে ঝর্নার কিনারায় গেল সে। ওখানে থেমে শেষবারের মতো তাইতার দিকে তাকাল। ভেবে দেখ, তাইতা। আমার দিকে হাত বাড়াবে কিনা সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার এখন তোমার। বলেই সোজা পুকুরে ঝাঁপ দিল।

সে অদৃশ্য হওয়ার সময় তার ম্লান দেহটাকে ঝলসে উঠতে দেখল তাইতা। সূর্যটা আকাশের গায়ে অর্ধেকটা পথ পার হয়ে যাবার আগে পর্যন্ত নিজেকে টেনে তোলার মতো শক্তি সংগ্রহ করতে পারল না ও।

*

শেষ বিকেলের দিকে স্যানেটোরিয়ামে ফিরে এলো ও। নার্সের সাথে অন্ধকার সেলে বসে থাকতে দেখল মেরেনকে। তাইতার কণ্ঠস্বর শোনার পর ওর আনন্দ ছিল দেখার মতো। ওকে এত দীর্ঘ সময়ের জন্যে অন্ধকার সেলে কুরে কুরে খাওয়া সন্দেহের ভেতর ফেলে রাখায় নিজেকে অপরাধী বোধ হলো তাইতার।

তুমি যখন ছিলে না মহিলা আবার এসেছিল, বলল সেরেন। কাল ব্যান্ডেজটা পুরোপুরি খুলে ফেলার কথা বলে গেছে। নিজেকে অতক্ষণ সামলে রাখতে কষ্টই হচ্ছে আমার।

বিকেলের ঘটনায় তখনও এমনভাবে অভিভূত ছিল তাইতা যে বুঝতে পারছিল রাতে ঘুমাতে পারবে না ও। সন্ধ্যার খাবার শেষে নার্সকে ওকে একটা বাঁশি এনে দিতে পারে কিনা দেখতে বলল।

ডাক্তার গিব্বা বাঁশি বাজান, জবাব দিল লোকটা। আমি তাকে আপনার অনুরোধের কথা জানাব?

চলে গেল সে, খানিক পরে বাঁশিসহ ফিরে এলো। এমন একটা সময় ছিল যখন তাইতার গান শুনে দারুণ আনন্দ পেত সবাই, এখনও সুরেলা ও ভালোই আছে সেটা। বুকের কাছে মেরেনের চিবুক ঝুলে না পড়া পর্যন্ত গান গাইল ও। নাক ডাকতে শুরু করল সে। এমনকি তারপরেও মৃদু সুরে বাঁশি বাজিয়ে চলল তাইতা, ওর আঙুলগুলো বাঁশিতে শয়তান ছেলেটার তোলা সুর না উঠে আসা পর্যন্ত।

মেরেনের সেলের উল্টোদিকের সেলে মাদুরে শুয়ে নিজেকে স্থির করে নিল ও। কিন্তু ঘুম এড়িয়ে গেল ওকে। অন্ধকারে ওর মন ধেয়ে গেল, ছুটতে শুরু করল বুনো ঘোড়ার মতো, সামলে রাখতে পারল না। ওর মনে শয়তানের বুনে দেওয়া ছবিগুলো এত স্পষ্টভাবে আবার ফিরে আসতে লাগল নিস্তার পাওয়ার উপায় রইল না। জোব্বা নিয়ে সেল থেকে পিছলে বের হয়ে এলো ও, তারপর হ্রদের কিনারা বরাবর হাঁটতে শুরু করল। গালে বরফের ছোঁয়া অনুভব করছে, কিন্তু সেটা ওরই নিজের অশ্রু, বাইরের কোনও সত্তা ওকে শীতল করে তোলেনি।

না পুরুষ, না নারী, তাইতা শয়তানের পরিহাসের পুনরাবৃত্তি করল ও। উলের জোব্বার হাতায় চোখের পানি মুছল। তবে কি এই প্রাচীন পঙ্গু দেহেই চিরকাল বন্দি থাকব? ফিসফিস করে বলল ও। ইয়োসের প্রলোভন যে কোনও শারীরিক নিপীড়নের মতোই কষ্টকর। হোরাস, আইসিস আর অসিরিস, ওসব ঠেকানোর শক্তি দাও।

*

আজ তোমার নার্সদের প্রয়োজন নেই আমাদের, বলল ডাক্তার হান্নাহ, মেরেনের পাশে বসল সে, সেলের একমাত্র আলোর উৎস তেলের কুপির সলতেটা নামিয়ে দিল। তোমাকে আর ব্যথা দেব না। বরং আশা করছি তোমার এরই মধ্যে পাওয়া কষ্টের ক্ষতিপূরণ দিতে পারব কুপিটা নামিয়ে রাখল সে। মেরেনের ব্যান্ডেজ বাঁধা মাথায় কোমল আলো ফেলছে ওটা। তুমি তৈরি, ডাক্তার গিব্বা? গিব্বা মেরেনের মাথা ধরে রাখলে আস্তে আস্তে ব্যান্ডেজের গিঁট খুলে ফেলল সে। কুপিটা তাইতার হাতে তুলে দিল এবার। দয়া করে আলোটা ওর চোখের উপর ধরুন।

মেরেনের মুখের উপর আলোর রশ্মি ফেলতে শিখার পেছনে পলিশ করা রূপা ধরল তাইতা। চোখের পাতা বন্ধ করে রাখা সেলাইগুলো ভালো করে দেখতে সামনে ঝুঁকল হান্নাহ। ভালো, স্বস্তির সাথে বলল সে। যেভাবে সেরে উঠেছে তাতে খারাপ কিছু দেখছি না। এবার সেলাই কাটা নিরাপদ হবে বলেই মনে হয়। দয়া করে আলোটা স্থির রাখুন।

সেলাই কেটে ফেলল সে, ফোরসেপ দিয়ে সুইয়ের ফুটো থেকে সুতোর টুকরোগুলো বের করে আনল। শুকনো মিউকাস আর রক্তের পাতাগুলো একসাথে সেঁটে আছে। উষ্ণ সুবাসিত জলে ভেজানো কাপড় দিয়ে আস্তে আস্তে সেটা মুছে ফেলল সে।

এবার চোখ খোলার চেষ্টা করো, কর্নেল ক্যাম্বিসেস, নির্দেশ দিল সে। কেঁপে উঠল চোখের পাতা, চট করে খুলে গেল। চক্ষুকোটরে চোখ ফেলতেই তাইতার মানে হলো ওর বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা অনেক জোরে ও দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে। এখন আর শূন্য গহ্বর নেই ওটা।

পবিত্র ত্রয়ী অসিরিস, আইসিস আর হোরাসের নামে, ফিসফিস করে বলে উঠল তাইতা। তোমার একটা নতুন নিখুঁত চোখ গজিয়েছে!

এখনও নিখুঁত হয়ে ওঠেনি, চিন্তিত কণ্ঠে বলল হান্নাহ। অর্ধেকটা বড় হয়েছে ওটা, এখনও অন্যটার চেয়ে বেশ ছোট। চোখের মণি এখনও আবছা। ডাক্তার গিব্বার হাতে থেকে রূপার থালাটা নিয়ে সরাসরি অপরিপক্ক চোখের ভেতর আলো ফেলল। অন্য দিকে দেখুন চোখের মণি কীভাবে কুঁচকে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ঠিকমতো কাজ শুরু করেছে। তুলোর দলায় মেরেনের ভালো চোখটা ঢেকে দিল সে। কী দেখছ, আমাদের বলল, কর্নেল, বলল সে।

উজ্জ্বল আলো, জবাব দিল ও।

আঙুল মেলে ওর মুখের সামনে দিয়ে হাত নিয়ে গেল হান্নাহ। এখন কী দেখছ বলো।

ছায়া, সন্দিহান কণ্ঠে বলল সে। কিন্তু পরক্ষণেই দৃঢ় কণ্ঠে আবার বলল, না, দাঁড়াও! পাঁচটা আঙুলের রেখা।

প্রথমবারের মতো হান্নাহকে হাসতে দেখল তাইতা। হলদে কুপির আলোয় অল্পবয়সী ও ভদ্র মনে হলো তাকে। না, সৎ মেরেন, বলল ও। আজকের দিনে আঙুলের চেয়ে বেশি কিছু দেখতে পাচ্ছ তুমি। অলৌকিক ঘটনা।

চোখে আবার ব্যান্ডেজ বেঁধে দিতে হবে, আবার পেশাদার ও কাঠখোট্টা হয়ে গেল হান্নাহ। দিনের আলো সহ্য করার মতো হয়ে উঠতে আরও কয়েকটা দিন সময় লাগবে ওটার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *