১৭. এক ছুটির দিন সকালে

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

এক ছুটির দিন সকালে কয়েকজন লোক কাজলের সঙ্গে দেখা করিতে আসিল। নিশ্চিন্দিপুর হইতে মাইল তিনেক দূরে যে ছোট শহর সম্প্রতি জমিয়া উঠিয়াছে, সেখান হইতে তাহারা আসিয়াছে।

ধুতি আর শার্ট পরা একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক, কথার ভঙ্গিতে মনে হয় তিনিই দলনেতা, কাজলকে বলিলেন—আপনার বাবা আমাদের অঞ্চলের গৌরব। এ বছর তার জন্মদিনে আমরা একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করব সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অপূর্ববাবুর নামেই পাঠাগার হবে। আপনার মাকে দিয়ে আমরা পাঠাগার উদ্বোধন করাতে চাই

কাজল বলিল—সে তো খুব ভালো কথা। মা নিশ্চয় যাবেন।

—আর একটা কথা, আমরা দরজায় দরজায় ঘুরে বই সংগ্রহ করে লাইব্রেরি শুরু করছি। আপনি আমাদের কিছু বই দেবেন—

—তা দেব। বাবার একসেট বই দিচ্ছি, তার সঙ্গে অন্য ভালো বই কিছু। একটু বসুন, চা খান, এখনই বই গুছিয়ে দিচ্ছি।

প্রৌঢ় ভদ্রলোক বলিলেন—আপনার মায়ের সঙ্গে একবার দেখা হবে কি? ওঁকে কখনও দেখিনি–

–বসুন আপনি, মাকে ডাকছি–

হৈমন্তী ঘরে আসিতে প্রৌঢ় ভদ্রলোক ছাড়া বাকি সকলে তাহাকে পায়ে হাত দিয়া প্রণাম করিল। প্রৌঢ় ভদ্রলোক হাতজোড় করিয়া নমস্কার করিয়া বলিলেন—আমরা আপনার শ্বশুরবাড়ির দেশ থেকে আসছি। অপূর্ববাবুর নামে একটা পাঠাগার উদ্বোধন হবে ওঁর জন্মদিনে, আমরা আপনার আশীর্বাদ চাই।

হৈমন্তী বলিল—আমার শুভেচ্ছা তো থাকবেই, তাছাড়া যদি কোনো কাজে লাগতে পারি জানাবেন।

-সে তো আপনার ছেলেকে বলেছি, উনি আমাদের কিছু বই দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের তো একটা দাবি আছে, ওদিন আপনাকে পাঠাগার উদ্বোধন করতে হবে।

—বেশ, যাব। কখন আপনাদের অনুষ্ঠান?

–অনুষ্ঠান বিকেলে। সেদিন হয়তো ফিরতে পারবেন না। তাতে অসুবিধে নেই, আমরা থাকার ব্যবস্থা করবো।

কাজল বলিল–আমরা গ্রামেই কারও কাছে থাকব। আপনাদের ব্যস্ত হবার দরকার নেই।

দলের একজন লোক হঠাৎ প্রশ্ন করিল—আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব? আপনারা গ্রাম ছেড়ে শহরে বাস করছেন কেন?

কাজল একটু অবাক হইয়া বলিল—আপনার প্রশ্নটা ঠিক ধরতে পারলাম না।

—আমি বলতে চাইছি, আপনার বাবা একজন বরেণ্য ব্যক্তি। সাহিত্যে পল্লীগ্রামের কথা লিখে তিনি যশস্বী হয়েছেন। প্রতিমাসে কত মানুষ নিশ্চিন্দিপুরে আপনাদের বাড়ি দেখতে যায় জানেন? তারা গিয়ে অপূর্ববাবু সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসা করবার মতো কোনো মানুষ পায় না। বাড়িটারও অবস্থা ভালো নয়। এ বিষয়ে আপনারা কিছু ভাবছেন না?

কাজল বলিল—দেখুন, নিশ্চিন্দিপুর থেকে বাস উঠিয়ে চলে এসেছিলেন আমার ঠাকুরদা। বাবা তখন ছোট। কাজেই আমি গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছি একথা বলা ঠিক হবে না। তাছাড়া আমি নিশ্চিন্দিপুরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি।

—আর বাস করবেন না সেখানে?

—সেটা কি সম্ভব? আপনিই বলুন? আমার চাকরি, আমার লেখা—এসব তো আছেই, মায়েরও বয়েস হচ্ছে, তার চিকিৎসার প্রয়োজন হয়–

লোকটি একটু বাঁকা ধরনের হাসি হাসিয়া বলিল–গ্রামে যারা বাস করে তাদের কি চিকিৎসা হয় না? আর চাকরি দেশের কোনো স্কুলেও পেয়ে যেতে পারেন। সাধারণ লোকের সঙ্গে নিজের তুলনা করবেন না। অপূর্ব রায়ের ছেলে হিসেবে আপনার দায়িত্ব অনেক বেশি

কথাটা কাজল জীবনে বহুবার শুনিয়াছে। কিন্তু সে একা কী করিবে? স্মৃতিরক্ষা জিনিসটা শুনিতে ভালো, কিন্তু বাস্তবে তাহা করা খুব কঠিন। বাড়িঘর মেরামত করিয়া, পাঠাগার সংগ্রহশালা ইত্যাদি স্থাপন করিতে যে বিপুল ব্যয়, তাহা সে একা সংকুলান করিতে পারিবে কি? না হয় কষ্টেসৃষ্টে করিল, কিন্তু তারপর? স্মৃতিরক্ষা তো একদিনের ব্যাপার নয়, চিরকাল ধরিয়া দেখাশুনা কে করিবে?

লোকটা জিজ্ঞাসা করিল—কী ভাবছেন আপনি?

—আপনার কথাটাই ভাবছিলাম। আচ্ছা একটা কাজ করুন না, আপনারা সবাই মিলে একটা সংস্থা গড়ে তুলুন। আমি সেই সংস্থার হাতে স্মৃতিরক্ষার জন্য বাড়ি, জমি ইত্যাদি দিয়ে দিচ্ছি। আমিও থাকবো আপনাদের সঙ্গে। কেমন হবে?

ইহা যে অতি উত্তম প্রস্তাব, ভদ্রলোকেরা একবাক্যে তাহা স্বীকার করিলেন। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করিয়া পরে এ বিষয়ে তাহাদের সিদ্ধান্ত জানাইবেন এমন বলিয়া গেলেন।

পাঠাগার প্রতিষ্ঠা হইয়া গেল। বেত্রবতী বাহিয়া অনেক জল সমুদ্রে গিয়া পড়িল, কিন্তু উৎসাহী সেই ভদ্রলোকেরা আর সিদ্ধান্ত জানাইতে আসিলেন না।

পাচবৎসর আগে হইলে কাজল অবাক হইত, ক্ষুব্ধও হইত। কিন্তু ক্রমেই জীবনের বাস্তব রুপটা তাহার কাছে উদ্ঘাটিত হইতেছিল। মানুষ সমালোচনা করিতে যত ভালোবাসে কাজ করিতে ততটা নয়। সঠিক লোকের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ হয় নাই, হইলে অপূর্বকুমার রায়ের স্মৃতিবক্ষার কাজ বসিয়া থাকিবে না।

কাজল তাহার রান্না খাইতে ভালোবাসে বলিযা কাজের লোক থাকা সত্তেও হৈমন্তী বান্নাটা নিজেই করিবার চেষ্টা করে। সেদিন মাছের ঝোলের কড়া নামাইতে গিয়া এক বিপত্তি বাধিল।

সকাল হইতেই হৈমন্তীর কোমরে কেমন একটা যন্ত্রণা হইতেছিল। কড়াটা ধবিবার জন্য দাঁড়ানো অবস্থায় সামনে ঝুঁকিতেই হঠাৎ দারুণ যন্ত্রণার একটা প্রবাহ কোমর হইতে হাঁটু পর্যন্ত ছড়াইয়া গেল। কোনোরকমে এক হাত দিয়া সামনের দেয়াল ধরিয়া সামলাইয়া ফেলিয়াছিল তাই বক্ষা, নহিলে গরম মাছের ঝোল গায়ে পড়িয়া রীতিমত আহত হইবাব সম্ভাবনা ছিল। কড়াটা অবশ্য উলটাইয়া গেল, হলদে-কালো ছোপওয়ালা মেনী বেড়ালটা ছুটিয়া আসিয়া মেঝেতে ছড়াইযা পড়া মাছের টুা মহানন্দে খাইতে শুরু করিল।

কাজল নিজের ঘরে বসিয়া লিখিতেছিল, কড়াই পড়িবাব শব্দে রান্নাঘরে আসিয়া অবাক হইয়া বলিল—কী হয়েছে মা? কীসের শব্দ হল? এঃ, ঝোল পড়ে গেছে বুঝি!

হৈমন্তী বলিল—আমাকে একটু ধর তো, হঠাৎ কোমরে এমন ব্যথা

মাকে বিছানায় শোয়াইয়া দিয়া কাজল হেমন্ত ডাক্তারকে ডাকিয়া আনিল। হেমন্তবাবু রোগী দেখিয়া বলিলেন–ভয়ের কিছু নেই। বয়েস হতে আরম্ভ করলে একটু-আঘটু বাতের প্রবলেম দেখা দিতে পারে, সেটা তো মেনে নিতেই হবে। স্লিপ ডিস্ক নয় বলেই মনে হচ্চে। দুদিন বিছানায় রেস্ট নিন, আর যে মলমটা লিখে দিচ্ছি, সেটা দুবেলা মালিশ করুন। ঠিক হয়ে যাবে।

জীবনের সমস্ত বড়ো বড়ো পরিবর্তনগুলি সামান্য প্রাথমিক লক্ষণের মাধ্যমে শুরু হয়। বয়েস যে বাড়িতেছে, এ কথাটা সত্যই হৈমন্তীর খেয়াল ছিল না। কোমরের বাতটা তাহার জীবনে প্রৌঢ়ত্বের প্রথম সংকেত হইয়া আসিল। ডাক্তারবাবুর চিকিৎসায় সে চার-পাঁচদিনের মধ্যে বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িল বটে, কিন্তু শরীরটা যেন আর ঠিকঠাক বশে রহিল না। খাঁটিবার ক্ষমতা কমিয়া আসিল, পূর্বের সেই স্মৃতি আর ফিরিল না। যে নদী বাহিয়া হৈমন্তীর জীবনের নৌকা চলিতেছিল, এই প্রথম তাহার অপর তীর বেশ স্পষ্ট হইয়া ফুটিয়া উঠিল। যে তীর ছাড়িয়া আসিয়াছে, দূরত্বের কুয়াশায় তাহা ঝাপসা। শরীরের ভিতরে কিংবা ঠিক শরীর বা মনের কোথাও নয়—অস্তিত্বের গহনে অত্যন্ত মৃদুস্বরে একটা ঘণ্টা বাজিতেছে। মনোযোগ দিয়া কান পাতিলে শোনা যায়।

ছুটির ঘণ্টা।

ক্ষোভ নাই। জীবনটা ভালোই কাটিয়াহে। কোনো ক্ষোভ নাই।

ওপারের ঘাটে সেই একজন অপেক্ষা করিয়া আছে। হৈমন্তী পৌঁছাইলেই সে পরিচিত পুরাতন হাসি হাসিয়া অভ্যর্থনা করিতে আসিবে।

কাজেই ভয়ও নাই। রাত্তিরে শুইবার সময় কাজল বলিল—তুমি বিছানায় উঠে পড়ো মা, আমি মশারিটা খুঁজে দিয়ে যাই। সামনে ঝুঁকে কাজ করতে ডাক্তারবাবু বারণ করে দিয়েছেন। আবার কোমরে চোট লাগলে মুশকিল হবে।

হৈমন্তী বলিল—সে হবে এখন। তুই বোস দেখি, তোর সঙ্গে কথা আছে।

-কী মা?

–তুই আর কতদিন আমার মশারি খুঁজে দিবি?

কাজল অবাক হইয়া বলিল–তার মানে?

—আমার বয়েস হচ্ছে। দেখলি তত বাতে কেমন কষ্ট পেলাম। এবার শরীর ক্রমেই অপটু হয়ে আসবে। আমাদের সংসারে হাল ধরবার মতো কেউ নই। তোকে বিয়ে না দিলে আমি তো ছুটি নিতে পারছি না!

কাজল ব্যস্ত হইয়া বলিল—কেন মা, তোমার কি আবার শরীর খারাপ লাগছে নাকি? কাল তাহলে ডাক্তারবাবুকে একবার

-ওরে না না, শরীর আমার এখন ঠিকই আছে। আমি সে কথা বলছি না। বয়েসে বুড়ো হচ্ছি, সে তোর ডাক্তারবাবু কী করবে? আমার আর কাজ করতে ভালো লাগছে না। তোর বৌয়ের হাতে সংসার দিয়ে শুধু শুয়ে-বসে কাটাতে ইচ্ছে করছে।

কাজল বলিল–বিয়ে! সে কী কথা! আমি তো—তা কী করে হয়?

–যেমন কবে বিয়ে হয় তেমন করেই হবে। তোর তা নিয়ে মাথা ঘামাবার কিছু নেই। তোকে এখন না বললেও চলতো, তবে আজকালকার ছেলে তো তাহলে আমি কিন্তু খোঁজখবর শুরু করছি–

তখনকার মতো মাকে একটা যাহা হউক উত্তর দিয়া কাজল নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিল। কিন্তু বিছানায় শুইয়া অনেক রাত পর্যন্ত সে ঘুমাইতে পারিল না। বিবাহের প্রসঙ্গ যে কিছুদিনের মধ্যেই উঠিবে তাহা সে আন্দাজ করিয়াছিল, কিন্তু আজ হৈমন্তী স্পষ্টভাবে বলায় কাজল বুঝিতে পারিল আপাতত এড়ানো গেলেও বিষয়টাকে অনির্দিষ্টকাল ঠেকাইয়া রাখা যাইবে না।

মায়ের সঙ্গে তাহার কথা বলিতেই হইবে। সব খুলিয়া বলিতে হইবে। কিন্তু তার আগে সে সমস্ত দিকগুলি নিজে একবার ভালো করিয়া ভাবিয়া লইতে চায়।

অপালার বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা, সংযত বাকভঙ্গি, শরীরটাকে বহন করিয়া বেড়াইবার স্বচ্ছন্দ ও মর্যাদাপূর্ণ বিশিষ্টতা যেমন তাহার মনে আসিতেছিল, তেমনি সব চিন্তার গভীরে নিঃশব্দ মহিমায় জাগিয়া ছিল একজোড়া শান্ত, নিষ্পাপ চোখ।

কাজল বুঝিতে পারিল সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ তাহার পক্ষে কঠিন কাজ হইবে।

সেদিন সকালে হৈমন্তী বসিয়া প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রচনাবলী পড়িতেছে, এমন সময় কাজল ঘরে ঢুকিয়া বলিল—কী বই পড়ছ মা?

হৈমন্তী বেশ কিছুদিন হইল চশমা লইয়াছে। রিডিং গ্লাস। সবসময় চোখে দিতে হয় না, কেবল পড়িবার সময় কাজে লাগে। বই মুড়িয়া চশমা খুলিয়া হাতে লইয়া সে ছেলের দিকে তাকাইয়া বলিল—প্রভাত মুখুজ্যের রচনাবলী। নবীন সন্ন্যাসী-টা আবার পড়ছি। সত্যি, এমন গল্প বলার ক্ষমতা সবার থাকে না। তুই পড়েছিস?

কাজল অন্যমনস্কভাবে বলিল—আঁ? হ্যাঁ, প্রভাতবাবুর লেখা খুবই ইয়ে-মা, তোমার সঙ্গে আমার একটা জরুরি কথা আছে—

–কীরে, কী হয়েছে?

সবুজ চামড়ায় বাঁধানো বই আকারের একটি খাতা হৈমন্তীর হাতে দিয়া কাজল বলিল—এটা চিনতে পারছে তো? বাবার ডায়েরিগুলোর মধ্যে একটা। তুমি জানুয়ারি মাসের দশ তারিখে লেখা এন্ট্রিটা পড়ো। আমি বসছি–তোমার পড়া হলে কথা বলবো।

এসব দিনলিপি হৈমন্তীর বহুবার পড়া আছে। তবে এই ডায়েরিটায় বিশেষ করিয়া জানুয়ারির দশ তারিখে কী লেখা আছে তাহা সে মনে করিতে পারিল না।

কাজল খাটে বসিয়া জানালা দিয়া বাহিরে তাকাইয়া রহিল। হৈমন্তী পড়িতে লাগিল।

কিছুক্ষণ বাদে হৈমন্তী পড়া শেষ করিয়া মুখ তুলিল। তাহার চোখে বিস্ময়। সে বলিল—এ ঘটনা তো আমি জানি, তোর বাবাই আমাকে বলেছিলেন। কাশীতে লীলাদির মেয়ের সঙ্গে ওঁর দেখা হয়েছিল। কিন্তু তারপর তো অনেকদিন-তুই জানিস এ মেয়ে এখন কোথায়?

মুখ না ফিরাইয়াই কাজল বলিল–জানি।

হৈমন্তী অবাক হইয়া বলিল–জানিস? কী করে জানলি? কোথায় সে?

-পরে বলব মা। আগে তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে নিতে চাই, শুনবে?

হৈমন্তী ছেলের মুখের দিকে ভালো করিয়া তাকাইয়া দেখিল। হঠাৎ যেন কাজল বড়ো হইয়া গিয়াছে, তাহার গলা ব্যক্তিত্বপূর্ণ, হাবভাব অচেনা। এই এতটুকু ছেলেকে বুকে করিয়া মানুষ

করিয়াছে, কবে সে এত বদলাইয়া গেল? ভালোও লাগে, আবার বুকের মধ্যে কেমন করে।

সে বলিল–বল কী বলবি

ছোটোবেলা হইতে আজ পর্যন্ত কাজল মায়ের কাছে মন খুলিয়া সব কথা বলিয়াছে, কিন্তু আজ প্রথম তাহার কেমন বাধোবাধো ঠেকিতে লাগিল।

তবু সে আস্তে আস্তে হৈমন্তীকে সমস্ত জানাইল। প্রথমে বলিল অপালার কথা, তারপর বলিল বিমলেন্দুর সহিত অকস্মাৎ দেখা হইবার ঘটনা, তুলির কথাও সে বলিল। তাহার কথা শেষ হইবার পর হৈমন্তী জিজ্ঞাসা করিল—এই দুজনের ভেতর তুই কি কাউকে কোনো কথা দিয়েছিস? এদেব প্রতি তোর দায়িত্ব কতখানি?

তুলিকে কথা দেওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। কারণ তার মামার সঙ্গে আমার যে কথাবার্তা হয়েছিল তাও বোধহয় সে জানে না। অপালার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। সে খুব ভালো আর বুদ্ধিমতী মেয়ে। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বন্ধুর মতো, কিন্তু বেশ গভীর আর অনেকদিনের। মুখে আমাদের স্পষ্ট কোনো আলোচনা না হলেও তার পক্ষে মনে মনে এমন একটা আশা পোষণ করা অন্যায় নয়

–তোর নিজের ইচ্ছের পাল্লা কোনদিকে ভারি?

একটু ইতস্তত করিয়া কাজল বলিল—আমি বুঝতে পারছি না মা। অপালা মেয়ে হিসেবে খুবই ভালো, পুত্রবধু হিসেবে আমাদের পরিবারে তাকে খুব সুন্দর মানাবে। সে নিজেও ইচ্ছুক বলে আমার মনে হয়। অন্যদিকে তুলি খুব সুন্দরী, শান্ত স্বভাবের মেয়ে। স্কুল-কলেজে পড়াশুনো করেনি, তার মামা বাড়িতে শিক্ষক রেখে তাকে পড়িয়েছেন। বাইরের দুনিয়া সম্বন্ধে সে একেবারেই অনভিজ্ঞ। কিন্তু বাবা তার সম্বন্ধে ভেবেছিলেন, ডায়েরিতে তার কথা লিখেছেন। সে ইচ্ছের কি আমি দাম দেবো না?

হৈমন্তী বলিল–লীলাদির মেয়ের সঙ্গে তোর দেখা হল কী করে?

কাজল সমস্ত ঘটনা মাকে খুলিয়া বলিল।

কাজলের কথা শেষ হইলে হৈমন্তী বলিল—আমাকে একটু ভাবার সময় দে। এই ধরআই কী দশদিন। তারপর আমি তোর সঙ্গে কথা বলব।

আট-দশদিন কাটিবার আগেই এক ঘটনা ঘটিল। বিমলেন্দুর কাছ হইতে কাজল একটি চিঠি পাইল। তিনি লিখিয়াছেন—তুলির খুব অসুখ, কাজল কি একবার আসিতে পারে?

দুপুর পার হইয়া চিঠি বিলি হইয়াছিল। সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিলেও সেদিন কলিকাতা হইতে ফিরিবার সম্ভাবনা কম। তবুও সামান্য ভাবিয়া কাজল যাওয়াই স্থির করিল। হৈমন্তীকে তুলির

অসুখের কথা জানাইয়া বলিয়া গেল রাত্রে না ফিরিলে সে যেন চিন্তা না করে।

ট্রেন যেন আর চলেই না। কলিকাতা পৌঁছাইতে এত সময় লাগে? কই, এতদিন তো সে খেয়াল করে নাই। কী অসুখ হইয়াছে তুলির? নিতান্ত সাধারণ কিছু নয়, তাহা হইলে বিমলেন্দু তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইতেন না। তুলি-তুলি বাঁচিবে তো?

তাহার চিন্তার গতিতে সে নিজেই অবাক হইতেছিল। যাহাকে ঠিক প্রেম বা ভালোবাসা বলে, তেমন কিছু তুলির সঙ্গে তাহার গড়িয়া ওঠে নাই। সে ঘনিষ্ঠতাই ঘটে নাই কখনও। তাহা হইলে প্রায় অচেনা, অনাত্মীয় একটি মেয়ের জন্য তাহার বুকের মধ্যে এমন করিতেছে কেন?

কিছুদিন আগে এক বন্ধুর বাড়ি বেড়াইতে গিয়া গ্রামোফোন রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথের একখানি গান শুনিয়া তাহার খুব ভালো লাগিয়াছিল—যৌবনসরসীনীরে মিলনশতদল। আজ এখন ট্রেনের জানালার ধারে বসিয়া তুলিব কথা ভাবিলেই গানটি কানে ভাসিয়া আসিতেছে। কে যেন দিগন্তের ওপারে বসিয়া গাহিতেছে গানটা। আশ্চর্য তো! তুলির সঙ্গে এ গানের সম্পর্ক কী?

তুলিদের বাড়িতে ঢুকিবার মুখেই বিমলেন্দুর সহিত দেখা হইল। তিনি ব্যস্ত হইয়া কোথায় বাহির হইতেছেন। কাজলকে দেখিয়া বলিলেন—এই যে, তুমি এসে পড়েছে। সব কথা পবে হবে, তুমি একটু তুলির কাছে বোসো, আমি ডাক্তারবাবুর কাছে যাচ্ছি—

-তুলিব কী হয়েছে? অসুখটা কী?

-খুব জ্বর আজ কয়েকদিন ধবে। কোনো ওষুধেই নামছে না। এদিকে বাড়িতে এক বুড়ি কাজের লোক ছাড়া কেউ নেই। তাকে দিয়ে রোগীর সেবা হয় না। আমি যতটা পারি করছি, কিন্তু ফিমেল পেসেন্টের নার্সিং আমার কর্ম নয়। এমন বিপদে পড়েছি—যাক, তুমি এসো, তোমাকে তুলিব কাছে বসিয়ে আমি চট করে একবার ঘুরে আসি–

এই প্রথম কাজল বিমলেন্দুর বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকিল। চওড়া বারান্দার শেষপ্রান্তে ডানদিকে একখানি বড়ো ঘরে খাটের ওপর তুলি শুইয়া আছে। মেঝেতে শুইয়া বৃদ্ধা পরিচারিকা ঘুমাইতেছে। বিমলেন্দু সেদিকে তাকাইয়া বলিলেন–কাল সারারাত ঘুমোয় নি, আজও দিনটা জেগে ছিল। বুড়ো মানুষ ওকে আর ডাকতে ইচ্ছে করছিল না। ভালোই হয়েছে তুমি এসেছে

বিছানার পাশে একটা চেয়ার টানিয়া কাজলকে বসিতে বলিয়া বিমলেন্দু বাহিব হইয়া গেলেন।

কাজল সন্তর্পণে বসিল। দেয়ালে লিটন কোম্পানির ঘড়ির টক টক্ শব্দ হইতেছে। একটা বেড়াল কোথায় ডাকিয়া উঠিল। বাড়ির আর কোথাও কোনো শব্দ নাই। কেবল দূরে বড়ো রাস্তা হইতে ভাসিয়া আসা গাড়িঘোড়ার অস্পষ্ট আওয়াজ শোনা যায়।

পরিস্থিতি একটু অদ্ভুত রকমের। কাজল ইহার আগে কখনও কোনো ঘুমন্ত তরুণীর এত কাছে বসিয়া থাকে নাই। অবশ্য তুলি অসুস্থ, তাহার এখানে বসিয়া থাকাটা কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।

অসুখ তুলির অলৌকিক সৌন্দর্যকে স্নান করিতে পারে নাই। বরং তাহাকে একটা বিষণ্ণ মহিমা দান করিয়াছে-হেমন্তসন্ধ্যার হালকা কুয়াশার পেছনে পূর্ণিমার চাঁদকে যেমন দেখায়। একটু ইতস্তত করিয়া কাজল তুলির কপালে হাত রাখিল। অনেক জ্বর। তাহার দুই ঠোঁট ঈষৎ ফাঁক হইয়া আছে। নিখুত দুইসারি দাঁতের কিছু অংশ দেখা যাইতেছে। কাজলের মনে পড়িল-a double row of oriental pearls—এমনই কাহাকে দেখিয়া কবি লিখিয়াছিলেন।

বেচারী তুলি। ইহার মা নাই, বাবা নাই। তেজস্বিনী মায়ের কন্যা, উঁহার মাকে সমাজ সহৃদয়তার সহিত বিচার করিবে না, সে ভার এই অসহায় মেয়েটিকে বহন করিতে হইবে। বিমলেন্দুরও ক্রমে বয়স হইয়া আসিতেছে। কে দেখিবে তুলিকে?

জ্বরে আচ্ছন্ন তুলির আঁচল সরিয়া চাঁপাফুল রঙের ব্লাউজের আড়াল হইতে নিটোল শখের মতো একটি স্তনের উদ্ভাস চোখে পড়ে। কাজল সন্তর্পণে কাপড় বিন্যস্ত করিয়া তুলির শরীর ঢাকিয়া দিল।

ঠিক সেই মুহূর্তে তাহার মনে একটা আশ্চর্য অনুভূতি জাগিয়া উঠিল। জীবনে এমন আর কখনও হয় নাই। কী বিচিত্র সে অনুভূতি!

তুলির প্রতি এক সুগভীর মমতায় তাহার মন ভরিয়া গেল। না, ঠিক মমতা নয়, আরও গভীব কিছু। মানুষের প্রাত্যহিক ভাষায় তাহার কোনো প্রতিশব্দ নাই। তুলির লজ্জা ঢাকিয়া দিবার সঙ্গে সঙ্গে কাজলের মনে হইল—এই পীড়িতা, নিঃসঙ্গ মেয়েটি তাহার একান্ত নিজের। হর্ষ বেদনা অশ্রু পুলক ব্যর্থতা সমস্ত কিছু লইয়া এ আর অন্য কাহারও হইতে পারে না, অনাদৃতাও থাকিতে পারে না। প্রচলিত অর্থে ঈশ্বরবিশ্বাসের খেই কাজলের হারাইয়া গিয়াছে, তবু সে মনে মনে প্রার্থনা করিল— তুলি সারিয়া উঠুক, আগের মতো হাসিয়া কথা বলুক।

বিমলেন্দুর সঙ্গে বৃদ্ধ ডাক্তারবাবু আসিয়া ঘরে ঢুকিলেন। কাজলের দিকে তাকাইয়া ডাক্তারবাবু বলিলেন—এটি কে? আগে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না তো–

–এ আমার ভাগ্নে। বাইরে থাকে। চিঠি পেয়ে এই একটু আগে এসেছে–

ডাক্তারবাবু আর কথা না বলিয়া রোগীর শয্যার দিকে অগ্রসর হইলেন। কাজল ঘর হইতে বাহির হইয়া বৈঠকখানায় আসিয়া বসিল।

একটু বাদেই ডাক্তারবাবু তুলিকে দেখিয়া বাহিরের ঘরে আসিলেন। বিমলেন্দু জিজ্ঞাসা করিলেন—কী মনে হচ্ছে ডাক্তারবাবু?

বৃদ্ধ চিকিৎসক চোখ হইতে চশমা খুলিয়া রুমাল দিয়া তাহার কাচ পরিষ্কার করিতে করিতে বলিলেন–টাইফয়েড নিঃসন্দেহে। ব্লাড টেস্ট করার আর দরকার নেই।

বিমলেন্দু উৎসুক চোখে তাকাইয়া বহিলেন।

চশমা চোখে লাগাইয়া চিকিৎসক বলিলেন—দেখুন আমি প্রাচীনপন্থী ডাক্তার, বহুদিন আগে পাশ করেছিলাম ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুল থেকে। পুরোনো ঢঙেই আজও অবধি চিকিৎসা করে আসছি। সে পথে খুব একটা কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। জানেনই তো, এ বয়েসে টাইফয়েড বড়ো কঠিন রূপ নেয় অনেক সময়। এতটা জ্বর বেশিদিন চললে ব্রেনের স্থায়ী ড্যামেজ হতে পারে। আমি ভাবছিলাম—

বিমলেন্দু বলিলেন–বলুন ডাক্তারবাবু। তুলি আমার ভাগ্নী নয়, আমার মেয়ে। ওর জন্য আমি সব কিছু করতে পারি।

–আমার মনে হয় আপনি আর একজন কাউকে দেখান। কিছুদিন হল বাজারে নতুন এক ধরনের ওষুধ এসেছে, তাকে অ্যান্টিবায়োটিক বলে। তাতে খুব ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু নতুন ওষুধ প্রয়োগ করতে হলে আধুনিক কোনো ডাক্তারকে দিয়ে দেখিয়ে তার পরামর্শ নেওয়া উচিত। উই হ্যাভ বিকাম আউটডেটেড, বুঝলেন না?

বিমলেন্দু একটু ভাবিয়া বলিলেন—বেশ, তাই হবে। আমি অন্য একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিচ্ছি। কিন্তু আমার ভাগ্নী আপনার চিকিৎসাতেই থাকবে। আপনি তাকে যেমন দেখছেন তেমনই দেখবেন, আমি একটা সেকেন্ড ওপিনিয়ন নেবো মাত্র–

হাসিয়া বৃদ্ধ বলিলেন—আচ্ছা আচ্ছা, সে হবে–

সেদিনই রাত্রে একজন তরুণ ডাক্তার আসিয়া রোগী দেখিলেন এবং ক্লোরোমাইসেটিনের ব্যবস্থাপত্র লিখিয়া দিলেন। বলিলেন—টাইফয়েডই বটে। তবে ভয় নাই, এবার জ্বর নামিয়া যাইবে।

রাত্রিতে কাজলের ফিরিবার উপায় ছিল না। বিমলেন্দু তাহাকে বাহিরের ঘরের তক্তাপোশে বিছানা করিয়া ঘুমাইবার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন। কাজল তাহাতে রাজি হয় নাই। বিমলেন্দুকে শুইতে পাঠাইয়া সে তুলির পাশে চেয়ারে বসিয়া রহিল। বিমলেন্দু বলিয়াছিলেন রাত দুইটায় তাহাকে জাগাইয়া দিতে, তাহার পর কাজল একটু বিশ্রাম করিয়া লইতে পারিবে। কাজল তাহাকে আর ডাকে নাই। সকালে ঘুম ভাঙিয়া অপ্রস্তুত মুখে বিমলেন্দু বলিলেন—এ কী! এ যে অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে! আমায় ডাকোনি কেন? তোমার বড়োই কষ্ট হল–

পরে চা খাইতে খাইতে তিনি বলিলেন–আজ মেডিক্যাল কলেজের নার্সিং অ্যাসোসিয়েসনে গিয়ে ভালো একজন নার্স জোগাড় করে আনব ভাবছি। এই সময়টা দিনসাতেক ভালো নার্সিং প্রয়োজন হবে। তুমি কি আর একটু থাকতে পারবে? আমি তাহলে চট করে একবার ঘুরে আসতাম–

কাজল বলিল—আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। আমি বিকেলের ভেতর একটা ভালো ব্যবস্থা করে দেব–

বিমলেন্দু অবাক হইয়া বলিলেন—তুমি? তুমি কি করে–তোমার কী কেউ জানাশোনা আছে নাকি? তুমি কীভাবে

—আমি বিকেলে মাকে নিয়ে আসব, নার্স আনার দরকার নেই—

বিমলেন্দু ব্যস্ত হইয়া বলিলেন–না না, সে কী! ওঁকে তুমি কেন খামোক কষ্ট দিয়ে–

-কিছু কষ্ট না। মাকে বললে মা খুশি হয়েই আসবেন।

বিমলেন্দু আরও দুই-একবার আপত্তি করিয়া ব্যবস্থাটা মানিয়া লইলেন।

পাড়ার একজন ছেলেকে বাড়ি পাহারা দেওয়ার ভার দিয়া কাজল সন্ধ্যাবেলা মাকে লইযা তুলিদের বাড়ি আসিল। ছেলের প্রস্তাবে হৈমন্তীও আপত্তি করে নাই। মানসিকতার দিক দিয়া সে সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহবধূ হইতে কিছুটা পৃথক। অচেনা কোনো বাড়িতে রোগীর সেবা করিতে গেলে অন্য কাহারও যে সংকোচ হইতে পারিত, হৈমন্তী তাহার কিছুই অনুভব করিল না। বরং তুলিব নোগশয্যার পাশে দাঁড়াইয়া প্রথমবাব তাহাকে দেখিয়া এক গভীর স্নেহে তাহার মন ভরিয়া গেল। পৌঁছাইবার আধঘণ্টার মধ্যে সে সেবার সব ভার নিজের হাতে তুলিয়া লইল। বিমলেন্দু কেবলই উদ্ভাসিত মুখে হাতে হাত ঘষিয়া বলিতে লাগিলেন—আমার বড়োই সৌভাগ্য দিদি যে আপনি এসেছেন। আমি যে কিভাবে আপনাকে–

তুলি ক্রমেই সারিয়া উঠিল। ক্লোরোমাইসেটিন শুরু হইবার চারদিনের দিন জ্বর নামিয়া গেল। তখন শেষরাত, রাত্রে জাগিবে বলিয়া হৈমন্তী দুপুরে কিছুটা ঘুমাইয়া লইয়াছিল। তুলি চোখ খুলিয়া তাকাইল এবং প্রথমে কিছুটা বিস্ময়ের সঙ্গে ঘরের চারিদিকে একবার দেখিয়া লইল, যেন সে ঠিক বুঝিতে পারিতেছে না সে কোথায় আছে। পরে তাহার দৃষ্টি আসিয়া হৈমন্তীর উপর স্থির হইল। কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকিবার পর তুলি বলিল–তুমি কে?

তাহার মাথায় হাত দিয়া হৈমন্তী বলিল—আমি—আমি তোমার মা–

জুরতপ্ত মস্তিষ্কে তুলি এই উত্তরের মর্ম গ্রহণ করিতে পারিল না। মা শব্দের সঙ্গে জড়িত কোনো বিশেষ আবেগও তাহার মনে পূর্ব হইতে সঞ্চিত নাই। সে আবার চোখ বুঁজিল।

সেবার গুণেই হোক বা অল্প বয়েসের পরিপূর্ণ জীবনীশক্তির জন্যই হোক—তুলি এত তাড়াতাড়ি সারিয়া উঠিতে লাগিল যে সবাই রীতিমত অবাক হইয়া গেল। হৈমন্তী একদিন বলিল— বিমল ভাই, তুলি এখন ভালো হয়ে উঠেছে, এবার তাকে আপনারাই সামাল দিতে পারবেন। অনেকদিন হল বাড়ি ছেড়ে এসেছি–কাল তাহলে ফিরি?

বিমলেন্দু গাঢ় গলায় বলিলেন—দিদি, মাঝে মাঝে আসবেন, যোগাযোগ রাখবেন। আমিও পৃথিবীতে বড়ো একা, কোথাও এতটুকু স্নেহের ছোঁয়া পেলে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। ভুলে যাবেন না ভাইটাকে—

হৈমন্তী তাঁহার দিকে তাকাইয়া বলিল—ভুলব না আর যোগায়োগও রাখব।

আসিবার সময় তুলি হৈমন্তীকে জড়াইয়া ধরিয়া ছেলেমানুষের মতো কাঁদিল।

জীবনে এই প্রথম সে মা কথাটার তাৎপর্য বুঝিতে শুরু করিয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *