০৩. পিকনিক করিতে গিয়া

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

পিকনিক করিতে গিয়া কাজল এমন একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হইল যাহা তাহার জীবনে এই প্রথম। মানবমনের এক বিশিষ্ট অনুভূতির সঙ্গে আজ পর্যন্ত তাহার পরিচয় ছিল না, মধ্য পৌষের এক পড়ন্ত অপরাহে সেই আশ্চর্য সুন্দর অনুভূতির ব্যঞ্জনা তাহার হৃদয়ের তীতে জাগিয়া উঠিল।

শেয়ালদহ হইতে ট্রেন ধরিতে হইবে, সকাল সাড়ে-সাতটার মধ্যে সকলের সেখানে একত্র হইবার কথা। একটি ছোট দল রান্নার ঠাকুর এবং অন্যান্য তৈজসপত্রাদি লইয়া আগের দিন চলিয়া গিয়াছে। তাহারা রান্নার কাজ আরম্ভ করিয়া দিবে। পৌঁছাইয়াই চা-টোস্ট-ডিম তৈয়ারি পাওয়া যাইবে আশা করা যায়।

জামাকাপড় পরিয়া রাস্তায় বাহির হইয়া প্রভাত বলিল—আজ একটা মজার ব্যাপার হবে। নরেন্দ্রর পিসতুতো বোন আমাদের সঙ্গে পিকনিকে যাচ্ছে–

—আমাদের সঙ্গে? সে কী! আর কোনোও মেয়ে যাচ্ছে নাকি?

–নাঃ।

কাজল একটু অবাক হইয়া বলিল—তাহলে একা নরেনের বোন ছেলেদের সঙ্গে যাবে?

–হ্যাঁ হে, মিশনারী কলেজে পড়া মেয়ে। দেরাদুন না সিমলা কোথায় যেন থাকে, ছুটিতে বেড়াতে এসেছে। বাঙালি, মধ্যবিত্ত ঘরের ললিত-লবঙ্গলতা নয়, ছেলেদের ভয় পায় না।

কাজল কথা ঘুরাইবার জন্য বলিল—না হয় যাচ্ছেই, তাতে কী হয়েছে?

—কী হয়েছে একটু পরেই বুঝতে পারবে।

তারপর অর্থপূর্ণ হাসিয়া বলিল—একেবারে অগ্নিশিখা, জানো? দুতিনদিন আগে পিকনিকের ব্যাপারে কথা বলতে নরেনের বাড়ি গিয়ে দেখে এলাম। আজ ছেলেমহলে একেবারে হৈ-হৈ পড়ে যাবে

কাজলের একটু কৌতূহল হইলেও সে অন্য কথা পাড়িয়া তখনকার মতো প্রসঙ্গটা চাপা দিল। বলিল—এসো, দু-প্যাকেট সিগারেট কিনে নেওয়া যাক। যেখানে যাচ্ছি সেখানে কাছাকাছি সিগারেট কিনতে পাওয়া যাবে কিনা কে জানে—

গ্লোব নার্সারির সামনে দলটার জড়ো হইবার কথা। কাজল ও প্রভাত নির্দিষ্ট স্থানে আসিয়া দেখিল তখনও আর কেহই পৌঁছায় নাই। তাহারা একটা করিয়া সিগারেট ধরাইয়া অপেক্ষা করিতে লাগিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই গোপাল আসিল, তাহার একটু বাদেই জগন্ময় ও শরদিন্দু। এক এক করিয়া প্রায় সবাই আসিয়া গেল, ট্রেন ছাড়িতে আর মিনিটদশেক দেরি। কিন্তু নরেন্দ্র আর তাহার মিশনারী কলেজে পড়া পিসতুতো বোন কই? কাজল আড়চোখে একবার প্রভাতের দিকে তাকাইল। প্রভাতও একটু ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছে। পুরা দলটাকে পিকনিকের জায়গায় পৌঁছাইয়া দেওয়ার ভার তাহারই উপর। সে স্টেশনের বড়ো ঘড়িটার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল—ওহে, তোমরা সব গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়। আমি আর অমিতাভ পাঁচমিনিট দেখে চলে আসছি—জায়গা রেখে আমাদের জন্য।

বন্ধুরা প্ল্যাটফর্মের দিকে চলিয়া গেলে প্রভাত বলিল—নরেনের বোনের যে যাবার কথা আছে সেটা আমি ছাড়া কেউ জানে না এলে খুব মজা হত। কেন যে দেরি করছে—বলিতে বলিতেই প্রভাত সামনে তাকাইয়া কনুই দিয়া কাজলকে ঠেলা দিল। কাজল বলিল—কী?

-ওই যে, এসে গিয়েছে।

স্টেশনের সামনে স্টেটসম্যানের ভ্যান হইতে খবরের কাগজ নামানো ইতেছে। তাহার পাশ দিয়া নরেন্দ্র এবং একটি মেয়ে আসিতেছে বটে। তাহাদের দেখিতে পাইয়া নরেন্দ্র হাত নাড়িল। কাছে আগাইয়া আসিতে প্রভাত বলিল—ব্যাপার কী, এত দেরি? আমরা তো আর মিনিট দুই দেখে চলে যাচ্ছিলাম। চল, চল–

ট্রাম না পাইয়া অবশেষে একটি ট্যাকসি ধরিয়া নরেন্দ্র কীভাবে কোনোমতে আসিয়া পোহাইয়াছে সেকথা শুনিতে শুনিতে সবাই প্ল্যাটফর্মে চুকিল।

কাজল কয়েকবার লুকাইয়া মেয়েটির দিকে তাকাইয়া দেখিল। তাহার মতোই প্রভাতও কখনও মেয়েদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসে নাই, ফলে আদবশতঃ সে নরেন্দ্রর বোনকে উর্বশী বা ক্লিওপেট্রাব সমকক্ষ হিসাবে বর্ণনা করিয়াছিল। অতটা না হইলেও মেয়েটি দেখিতে বেশ ভালো। শান্ত মুখশ্রী, সাধারণ বাঙালি মেয়েদের তুলনায় একটু লম্বা, চাপাফুল রঙের শিফনের শাড়িতে তাহাকে দেখাইতেছে মন্দ না।

কামরায় উঠিয়া বসিবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন ছাড়িয়া দিল। দলের অন্যরা নরেনের বোনকে দেখিয়া অবাক, তাহারা পূর্বে এ বিষয়ে কিছু জানিত না। নরেন সবার সঙ্গে মেয়েটির পরিচয় করাইয়া দিল-এ হচ্ছে আমার বোন অপালা। দেরাদুনে থাকে, ছুটিতে বেড়াতে এসেছে। ভাবলাম ওকেও আমাদের সঙ্গে নিয়ে আসি। বোস অপালা, একটু জায়গা করে নে—

সকলে মহাব্যস্ত হইয়া প্রায় পাঁচজনের বসিবার স্থান করিয়া দিল।

শান্টিং ইয়ার্ডের মাকড়সার জালের মতো রেললাইনের জটিলতা ছাড়াইয়া গাড়ি ধীরে ধীরে গতিসঞ্চয় করিতেছে। শীতের সকালের নিরুত্তাপ রৌদ্র কুয়াশার মধ্য দিয়া ক্রমে আত্মপ্রকাশ করিতেছে। কাজলকে কলেজ করিবার জন্য রোজই রেলগাড়ি চড়িতে হয়, কিন্তু আজ কোনও কাজের তাড়া নাই—এখনি কোথাও পৌঁছাইয়া ভয়ানক বেগে পড়াশুনা বা অন্য কাজ শুরু করিয়া দিতে হইবে না। তাহার মনে হঠাৎ খুব আনন্দ হইল, প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করিয়া আজ কেমন একটা দিন কাটানো যাইবে! ভালোমন্দ খাওয়াও হইবে!

নির্দিষ্ট স্টেশনে নামিয়া বাগানবাড়িটা মাইলখানেক দূরে। সবাই গান গাহিতে গাহিতে হাঁটিয়া চলিল। জায়গাটাকে প্রায় গ্রাম বলা যাইতে পারে, বসতি বিশেষ নাই। স্টেশনের ধারে দু-একটা চায়ের দোকান, একটা হোমিওপ্যাথিক ডিসপেনসারি (বৃদ্ধ ডাক্তারবাবু বুক পর্যন্ত দাড়ি লইয়া রোগীর প্রতীক্ষায় বসিয়া আছেন), মুদিখানা—তার পরেই যেন জনপদ ফুরাইয়া গেল। চন্দনী রঙের মিহি ধুলায় পূর্ণ পথের দুইপাশে রাংচিতা আর ভেরেণ্ডা গাছের জঙ্গল। কাছে-দূরে কয়েকটি বড়ো চটকা গাছ প্রশান্ত গাম্ভীর্যের সহিত দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।

বাগানবাড়িটি বেশ বড়ো, অন্ততঃ সাত-আট বিঘা জমি পাঁচিল দিয়া ঘেবা। তাহাতে আম-জামকাঁঠাল প্রভৃতি পরিচিত গাছ ছাড়াও অজানা বহু গাছেব সমারোহ। ফটক দিয়া ঢুকিয়াই ডানদিকে একটি একতলা বাড়ি। গোটাচারেক ঘর, বারান্দা ইত্যাদি। পিছনে পাতকুয়া আছে। বাগানের অপর প্রান্তে বাঁধানো ঘাটসমেত ছোট পুকুর। আগের দিন যাহাবা চলিয়া আসিয়াছে তাহারা বারান্দায় বসিয়া নিজেদের মধ্যে কথা বলিতেছিল, শহরাগত দলটি পৌঁছাইতেই চেঁচামেচি করিয়া অভ্যর্থনা কবিল। হরিনাথ, যাহার মামার বাগানবাড়ি, সে বলিল—এসো প্রভাত, এতক্ষণ আমাদের আড্ডাই জমছে না—পিকনিক করতে এসে কি আর এমন তিন-চারজন বসে কথা বলতে ভালো লাগে?

প্রভাত বলিল–বেশ তো বসে আড্ডা দিচ্ছিলে বাপু, কেন বাজে কথা বলো!

–আমরা মোটেও আড্ডা দিচ্ছিলাম না, আমরা মনের দুঃখ কাটানোর জন্য কড়াইশুটি খাচ্ছিলাম

—সেরেছে! কিছু বাকি রেখেছ তো? কপির তরকারিতে কী দেবে?

রসিকতা করিয়া কী একটা উত্তর দিতে গিয়া হরিনাথ অপালাকে দেখিতে পাইয়া থতমত খাইয়া গেল।

নরেন বলিল—সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই, আমার বোন অপালা-পিসিমার মেয়ে। বাইরে থাকে। ওকেও নিয়ে এলাম–

বারবার সে তো বেশ করেছে, খুব ভালো করেছে বলিতে বলিতে হরিনাথ কেমন তোতলা মতো হইয়া গেল। রথীন অভিভূত হইয়া সাত-আটবার নমস্কার করিল। পরমেশ খামোকাই শার্টের স্কুল টানিয়া হাঁটুর দিকে নামাইতে লাগিল।

একটা বড়ো দল বনভোজন করিতে গেলে যেমন হয়, চা-জলখাবার খাইবার পর সকলে পছন্দমতো ছোট ছোট দলে ভাগ হইয়া এখানে-ওখানে ছড়াইয়া পড়িল। কাজল কোনদিনই হাল্কা কথাবার্তায় যোগ দিতে পারে না, আজও সে কিছুটা একা হইয়া বাগানের মধ্যে আপনমনে ঘুরিতে লাগিল। শীতের দুপুরের একটা নিজস্ব রুপ আছে। রোদে তেমন তেজ নাই, গাছের পাতার ফাঁক দিয়া রোদ আসিয়া মাটির উপরে আলোছায়ার আলপনা তৈয়ারি করিয়াছে। কোথাও কোন শব্দ নাই কেবল একটা কী পাখি যেন ডাকিয়া ডাকিয়া স্তব্ধ দুপুবকে আরও নির্জন করিয়া তুলিতেছে। বেলা বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে রোদের রঙ বদলায়, পরিবেশে যেন স্বপ্নের মোহাঞ্জন মাখাইয়া দেয়। কল্পনার রাজ্যে দূরত্ব বলিয়া কিছু নাই—বাংলাদেশের আমবাগান আর পলিনেশিয়ার মার্কুয়েসাস্ আইল্যান্ডের অরণ্য একই ভূমিতে অবস্থিত। একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া বসিয়া সুদূরের কল্পনায় মগ্ন হইয়া যাইতে বেশ লাগে। কী প্রয়োজন বেশি বন্ধুবান্ধবের? কী প্রয়োজন অকারণ কোলাহলের? নিজের মনের গভীরে ডুব দিতে শিখিলে বহিরঙ্গ আনন্দ বাহুল্য মাত্র।

বেলা আড়াইটা নাগাদ খাইতে বসা হইল। বাগানের গাছ হইতে কলাপাতা কাটিয়া সবাই ঘাসের উপর বসিয়া গেল। মুখোমুখি দুই সারি, কাজলের ঠিক সামনে অপালা বসিয়াছে। জামরুল গাছের পাতার মধ্য দিয়া বোদ আসিয়া তাহার গায়ে পড়িয়াছে। কাজলের হঠাৎই কেন যেন মেযেটির মুখের দিকে বারবার তাকাইয়া দেখিতে ইচ্ছা করিল। সুন্দরী মেয়ে তো সে কলিকাতায় পথে-ঘাটে কতই দেখিয়াছে। এই মেয়েটি হইতে বেশি সুন্দরী মেয়েও যে সে দেখে নাই এমন নয়—তবু অপালার শাড়ির রঙ, বিশেষ একভাবে তাকাইবার ভঙ্গি, ঋজু শরীর ঘিরিযা সংযত প্রাণময়তা-সব মিলাইয়া একটি মধুর ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করিয়াছে। একবার সে দেখিল অপালা কপির তরকারি দিয়া ভাত মাখিতেছে, সরু সুন্দর গঠনেব আঙুলগুলি। অনামিকায় একটি গোেল্ডস্টোন সেট করা আংটি। পরক্ষণেই সে লজ্জা পাইয়া চোখ নামাইয়া লইল। ছিঃ, মেয়েটি দেখিতে পাইলে কী ভাবিবে!

ভাস্কর দলের মধ্যে একটু যণ্ডামতো, সে চেঁচাইয়া বলিল—ওহে নিখিল, এ কী বকম দেওয়া হচ্ছে তোমাদের? মাংসটা আর একবার এদিকে ঘোরাও, আমাকে একটা ভালো আর মোটা দেখে হাড় দাও দেখি–

প্রভাত বলিল—নিখিল, ওকে ভালো দেখে মাংসেব টুকরো কয়েকটা দাও, হাড় দিয়ে কী হবে?

–না হাড় একটা চাই-জাস্ট টু স্যাটিসফাই মাই মিট টুথ—

পরমেশ বলিল—আমাকে আরও হাঁড়িখানেক ভাত দাও তত ভাই–

হরিনাথ পংক্তির একেবারে শেষে পা লম্বা করিয়া কনুইয়ে ভর দিয়া আধশোয়া হইয়া ছিল, মাংস পরিবেশন করিতে গিয়া নিখিল তাহাকে বলিল—এ আবার কী রকম খেতে বসা? সোজা হয়ে বসো–

হরিনাথ রাজকীয় ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়া বলিল—ডোষ্ট বদার, সার্ভ জানো, প্রাচীনকালে রোমান সম্রাটরা এইভাবে শুয়ে শুয়ে খেতেন।

এদিক-ওদিক তাকাইয়া নিখিল অনুচ্চস্বরে বলিল–তাই নাকি? তা হবে। কিন্তু রোমান সম্রাটদের অন্ততঃ পাঞ্জাবির তলা দিয়ে পাজামার দড়ি বেরিয়ে ঝুলত না!

তড়াক করিয়া সোজা হইয়া হরিনাথ এক হাত দিয়া লজ্জাকর তুটিটা সংশোধনের চেষ্টা করিতে লাগিল। অটোম্যান সাম্রাজ্যের সম্মিলিত সৈন্যদল রাজ্যের সীমানায় হানা দিয়াছে সংবাদ পাইলেও ভোজনরত রোমান সম্রাট বোধহয় এতটা চমকাইতেন না। এইভাবে হৈ-হুল্লোড়ের মধ্য দিয়া আহারপর্ব শেষ হইল।

পুকুরঘাটে সুপারিগাছের দীর্ঘ ছায়া আসিয়া পড়িয়াছে। খাওয়ার পর কাজল বাঁধানো ঘাটে বসিয়া একটা সিগারেট ধরাইল। বন্ধুরা গুরুভোজনের অন্তে বারান্দায় পাতা শতরঞ্চির উপর শুইয়া খোশগল্প জুড়িয়া দিয়াছে। এদিকটা একেবারেই নির্জন। কাজল চোখ বুঁজিয়া শুনিতে লাগিল লঘুস্পর্শ বাতাস গাছের পাতায় উদাস ঝিরঝির শব্দ তুলিয়াছে। সুপারিগাছের গায়ে একটা কাঠঠোকরা বহুক্ষণ ধরিয়া ঠক্‌-র-র আওয়াজ করিতেছে। শান্ত দ্বিপ্রহরের কিছু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শব্দ আছে, আলাদা করিয়া তাহাদের খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন। এমন কী সবগুলি কান দিয়া শুনিতে পাওয়া যায় এমন শব্দও নয়–কিন্তু পরস্পর মিশিয়া তাহারা চমৎকার আরহ তৈয়ারি করে, কাজল সিগারেট টানিতে টানিতে সেই আমেজটা উপভোগ করিতেছিল।

অকস্মাৎ তাহার মনে হইল ঘাটের উপর সে আর একা নয়, কে যেন কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। তাহার আসিবার কোন শব্দ সে পায় নাই, কিন্তু মানুষের কাছে মানুষ আসিয়া দাঁড়াইলে ইন্দ্রিয়াতীত এক অনুভূতি দ্বারা তাহা বুঝিতে পারা যায়।

আস্তে করিয়া চোখ খুলিতেই প্রথমে নজরে পড়িল রুপালি পাড় বসানো চাঁপাফুল রঙের শাড়ির নিচের দিকটা।

সে ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। অপালা তাহার দিকে বিস্ময় ও কৌতুক মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকাইয়া আছে। সে অপ্রস্তুত হইয়া বলিল—আপনি কতক্ষণ—মানে, আমি একটু-বসুন না—

অপালা বলিল—আপনি কি রোজই দুপুরে ধ্যান করেন নাকি?

কাজল লজ্জিতমুখে বলিল–না না, ওসব কিছু নয়। আসলে শীতের দুপুরবেলায় একটু আলসেমি করতে ইচ্ছে করে, তাই চোখ বুজে ছিলাম তারপর একটু ইতস্তত করিয়া যোগ করিল—এ রকম নির্জন জায়গায় দুপুরবেলা নানারকম আরছা শব্দ হয়, জানেন? চোখ বুজে থাকলে শোনা যায়—নিতান্ত ঘনিষ্ঠ দু-একজন বন্ধু ছাড়া কাজল নিজের মনের কথা এভাবে কাহাকেও বলে

। কিন্তু সদ্য পরিচিত এই মেয়েটিকে দেখিয়া হঠাৎ তাহার মনে হইল ইহাকে সব কথা বলা যাইতে পারে। কেন মনে হইল তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারিল না! বলিয়াই তাহার কেমন লজ্জা করিতে লাগিল, বিব্রতভাব কাটাইবার জন্য সে বলিল—বসুন না, দাঁড়িয়েই থাকবেন বুঝি?

পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া কাজল ঘাটের একটা অংশ ঝাড়িয়া দিল। স্মিত হাসি অপালা বসিল, বলিল—আপনিও বসুন।

সম্মানজনক দূরত্ব রাখিয়া কাজল বসিল।

—আমি কিন্তু আপনার পরিচয় জানতে পেরেছি।

কাজল একটু অবাক হইয়া বলিল—আমার? কী পরিচয়?

–আপনি বিখ্যাত সাহিত্যিক অপূর্বকুমার রায়ের ছেলে, তাই না?

কাজল হাসিয়া বলিল—ওটা তোত আমার বাবার পরিচয়। তা যাই হোক, আপনি বুঝি আমার বাবার বই পড়েছেন?

অপালা মুখ নিচু করিয়া বলিল—সবচেয়ে লজ্জার কথা কি জানেন, আমি এখনও ভালো বাংলা পড়তে পারি না। বাবা সরকারি কাজ করেন তো, আমি ছোটবেলা থেকে বাইরে বাইরেই মানুষ হয়েছি। গত চার-পাঁচবছর ধরে বাবা বাড়িতে আলাদা করে বাংলা শেখাচ্ছেন, এখন অনেকটা রপ্ত হয়ে এসেছে—আর বছর দুইয়ের মধ্যেই নিজেকে পুরোপুরি বাঙালি বলতে পারব বলে বিশ্বাস রাখি।

তারপর একটু থামিয়া বলিল—বাবা খুব বই পড়েন। সম্প্রতি বাবা অর্ডার দিয়ে কলকাতা থেকে আপনার বাবার সব বই আনিয়েছেন। ছুটিতে এখানে আসার কদিন আগে রাত্তিরে খাবার টেবিলে বসে বলছিলেন বাংলা ভাষায় এমন বই যে লেখা হয়েছে জানতাম না। সাহিত্যের দুর্ভাগ্য এমন লেখক অসময়ে চলে গেলেন।

কাজল চুপ করিয়া রহিল। বাবার কথা উঠিলে সে অন্যমনস্ক হইয়া যায়। তাহার জীবনে ধর্মীয় ঈশ্বরের ছবি মুছিয়া গিয়ে সেখানে বাবার মূর্তি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে। ইষ্টনাম উচ্চারিত হইতে শুনিলে ভক্ত যেমন আবিষ্ট হইয়া পড়ে তাহারও তাই হয়।

–আমি আপনাকে কষ্ট দিলাম, না?

কাজল চমকাইয়া বলিল–না, তা নয়। বাবার মৃত্যুর কথা কেউ উল্লেখ করলে আমি প্রচলিত অর্থে দুঃখ পাই না। কারণ অনেক জীবিত মানুষের চেয়ে বাবা আমার কাছে অনেক বেশি করে জীবিত। অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম কেন জানেন? বাবাকে আমি দেবতার আসনে বসিয়েছি। সনাতন ধর্ম যাকে দেবতা বলে তা নয়—আমার জীবনদেবতা, আমার জীবনদর্শনের উৎস। ক্রীশ্চান পাদ্রীরা আচমকা ঈশ্বরের নাম উচ্চারিত হতে শুনলে চমকে ওঠে, আমারও ওই ধরনের একটা রি-অ্যাকশন হয় আর কী–

-–বাবার মতো আপনিও খুব প্রকৃতি ভালোবাসেন, তাই না?

–প্রকৃতিকে ভালোবাসার কোনও আলাদা অর্থ নেই। যা কিছু বিশ্বে রয়েছে বা ঘটছে, সবই প্রকৃতির অঙ্গ। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমরা যাই করি না কেন, সেটা নিজেদের মতো করে প্রকৃতিকে ভালোবসেই করছি। তবে যদি বিশেষ অর্থে বলেন, যেমন গাছপালা, মাঠ বা আলোবাতাসকে ভালোবাসা-সে অর্থেও আমি নিশ্চয় প্রকৃতিকে ভালোবাসি। আপনিও বুঝি তাই?

অপলা বলিল—আমার কোনও বন্ধু নেই, জানেন? এক জায়গায় কখনও বেশিদিন থাকিনি তো, বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার সুযোগই হয়নি। একা একা পাহাড়ে, জঙ্গলে, সমুদ্রের ধারে বেড়াতাম। বিশেষ করে প্রকৃতিকে ভালোবাসার অর্থ আমিও জানি না, বাইরে থেকে কখনও দেখিনি বলে।

কথা শুনিতে শুনিতে কাজল বিস্মিত চোখে অপালার দিকে তাকাইতেছিল। নারীদের সম্পর্কে কাজলের মোটামুটি ধারণা ছিল যে, তাহারা সচরাচর রান্নাবান্না এবং শিশুপালন করে, প্রায়শই দক্ষতার সহিত ঝগড়া করে এবং শাড়ি ও গহনা পাইলে সন্তুষ্ট থাকে। পুরুষের সঙ্গে সাহিত্য ও দর্শন লইয়া স্বাভাবিকভাবে কথা বলিতে পারে এমন মেয়ে সে আগে দেখে নাই। অপালা বলিলআপনিও বুঝি লেখেন?

-সে রকম কিছু নয়। লিখতে ইচ্ছে করে খুব–অনেক যেন বলবার কথা আছে বলেও মনে হয় মাঝে মাঝে—কিন্তু লিখলেই বন্ধুরা বলে আমার লেখা নাকি বাবার মতো হয়ে যায়।

-সত্যিই কি তাই?

–হতে পারে। আমার জন্মের সময়ে মা মারা গিয়েছিলেন, তাকে আমি দেখিনি। প্রথমে কিছুদিন মামাবাড়িতে, তারপর সমস্ত ছোটবেলাটা আমি বাবার কাছে মানুষ। যে সময়ে মানুষের প্রকৃত ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে যায়। বাবা আমাকে কখনও বকতেন না, তিক্ত শাসন করতেন না–কিন্তু তার আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব সেই অবোধ শিশুবয়েসেই আমাকে স্পর্শ করেছিল। এ ধরণের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন। হয়তো আমার অজান্তেই আমার লেখায় বাবার ছাপ এসে যায়—

হাঁটুর উপর থুতনি রাখিয়া অপালা জলের দিকে তাকাইয়া কাজলের কথা শুনিতেছিল। পুকুরের জলে অপরাহের ছায়া গাঢ় হইয়া আসিয়াছে। সুপারি গাছের কাঠিন্যের কাছে সাময়িক হার মানিয়া কাঠঠোকরাটা বিশ্রামরত। জলের দিকে চাহিয়াই মৃদুস্বরে অপালা বলিল—একটা কথা বলব? কিছু মনে করবেন না তো? না থাক, আপনি রাগ করবেন—

কাজল বলিল—বা রে, রাগ করব কেন? আপনি তো আর আমাকে বকবেন না—

–আমি কিন্তু একটু বকতেই যাচ্ছিলাম–

কাজলের কৌতূহল হইল, কী বলিবে এই প্রায়-অপরিচিত মেয়েটি? কয়েকঘণ্টার পরিচয়ে একজন আর একজনকে রাগ করিবার মতো কী বলিতে পারে? সে বলিল–রাগ করব না, বিশ্বাস করুন—

–আমার এভাবে কথা বলার কোনও অধিকার নেই, তবু বলছি-বাবাকে আপনি খুব শ্রদ্ধা করেন বটে, কিন্তু নিজের ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করার সময়ে তার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করুন। সত্যি হয়তো আপনার অনেক কিছু বলবার আছে, পৃথিবীকে অনেক কিছু দেবার আছে, dont let yourself be possessed

কাজলের প্রথমে একটু বাগ হইল। তাহার বাবার সহিত তার সম্পর্ক অনুভূতির একটা প্রগাঢ়তম স্তরে প্রতিষ্ঠিত, অন্য কেহ তাহা বুঝিতে পারিবে বলিয়া সে বিশ্বাস করে না। এবং সেই পবিত্র সম্পর্কের বিষয়ে কাহারও সমালোচনা সহ্য করাও তাহার পক্ষে কষ্টকর। কিন্তু কথা শেষ করিয়া অপালা তাহার দিকে সোজা তাকাইয়া আছে, সেই সরল অথচ গভীর দুই চোখের দিকে নজর পড়িতেই কাজল অপালার অকপট ঐকান্তিকতার সবটুকু একসঙ্গে দেখিতে পাইল।

কাজল অপালার কথার কোনও উত্তর দিল না। সামনে তাকাইয়া দেখিল পুকুরের জলে ঝিরঝিরে ঢেউ উঠিয়াছে, বিক্ষুব্ধ জলতলে গাছের প্রতিচ্ছবি শত শত খণ্ডে ভাঙিয়া যাইতেছে। বিকালবেলার একটা সুন্দর গন্ধ আছে। সারাদিন রৌদ্রে তপ্ত হইবার পর দিনশেষে ছায়ার স্পর্শে বন্য লতাপাতা একধরনের শান্তিমাখা সুঘ্রাণ বিতরণ করে। বাতাসে সেই গন্ধ ভাসিয়া আসিল। অপালা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল—চলুন যাই—চা খাবেন না? আপনার বন্ধুরা তো সব চা খেয়ে তবে রওনা দেবে। আর হ্যাঁ, আপনার ঠিকানাটা দিন তো—আমি আপনাকে চিঠি দেব।

কাজল অবাক হইয়া বলিল—চিঠি দেবেন? ঠিকানা?

–হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে? ও, আমাদের বয়সি ছেলেমেয়েদের পরস্পরকে চিঠি লিখতে নেই, তাই না? সমাজে নিন্দে হয়? আপনি দিন ঠিকানা—আমি বাংলাদেশে মানুষ হইনি, ও ধরনের অকারণ সংস্কার আমার নেই। বাবাও খুব উদার, তিনি জানতে পারলেও আমার স্বাধীনতায় বাধা দেবেন না।

কাজল একটু ইতস্তত করিয়া বলিল—আমার নোটবই আর কলম বন্ধুদের কাছে রেখে এসেছি। চলুন, দিয়ে দেব–

বাগানবাড়ির বারান্দায় ফিবিবার প্রস্তুতি হিসাবে জিনিসপত্র গোছানো হইতেছে। ঠাকুর উনানের পাশে উবু হইয়া বসিয়া চা হুঁকিতেছে। কাজলকে দেখিয়া হরিনাথ বলিল—এই যে, ছিলে কোথায়? চা খাবে তো? নাও, এবার বেরিয়ে পড়তে হবে। ট্রেনের একঘণ্টা বাকি। এ গাড়ি মিস করলে কলকাতা পৌঁছতে রাত দশটা–

ধুলায় ভরা পথ দিয়া স্টেশনে আসা। সকালের দৃশ্যটাই যেন আবার উল্টা দিক হইতে বহিয়া যাইতেছে। পূব হইতে পশ্চিমের দিকে উড়িয়া যাইতেছে পাখির দল, দিনের শেষে মাঠ হইতে বিদায় লইয়াছে ক্লান্ত কৃষক। কত তাড়াতাড়ি একটা দিন নিঃশেষে ফুরাইয়া গেল! ছোটবেলায় এমন ছিল না–তখন এক একটা দিন যেন জগতের সবটুকু সময় দিয়া গঠিত ছিল। একটা বছর সম্পূর্ণ কাটিবার পর গতবছরের কথা আরছাভাবে মনে পড়িত। বয়েস বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে সময় কাটিবার বেগও বাড়িয়াছে।

স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করিতে করিতে কাজল অপালাকে বলিলআপনার মধ্যেও বেশ কবিত্ব আছে, নইলে কলাবাগানের ধারে গিয়ে বসে ছিলেন কেন?

অপালা অবাক হইয়া বলিল—কী করে জানলেন? আমি তো একা বসে ছিলাম–

—কথাটা ঠিক কিনা?

-বসে ছিলাম সেটা ঠিক, কবিত্বের ব্যাপারটা আপনার মনগড়া। আপনি ওদিকে গিয়ে আমাকে দেখতে পেয়েছিলেন, না?

–না।

–তবে?

কাজল হাসিয়া বলিল—আপনার সমস্ত শাড়িতে চোরকাটা লেগে আছে। বাগানে ওই জায়গা ছাড়া আর কোথাও চোরকাটা নেই আমি দেখেছি। আর না বসলে শুধু পায়ের দিকে লাগত, সমস্ত কাপড়ে লাগত না। এ থেকেই অনুমান করলাম।

—আপনি বুঝি খুব ডিটেকটিভ বই পড়েন? গল্পের গোয়েন্দারা জুতোর তলায় সুরকির দাগ আর বেড়াবার ছড়ির ডগা দেখে সব বলে দিতে পারে—

কাজল বলিল—এটুকুর জন্য ডিটেকটিভ বই পড়তে হয় না, এমনিই বলা যায়। তবে হ্যাঁ, পড়ি বইকি–শার্লক হোমসের গল্প আমার খুব প্রিয়।

—চেস্টারটনের লেখা পড়েছেন? ফাদার ব্রাউন স্টোরিজ?

কাজল লজ্জিতমুখে বলিলনাঃ, খুব প্রশংসা শুনেছি–

–পড়ে দেখবেন, খুব ভালো লাগবে। আপনি, এমনিতে কী ধরনের বই পড়তে ভালোবাসেন, বলুন তো দেখি—আমার সঙ্গে মেলে কিনা—

সমস্ত ট্রেনযাত্রার সময়টা তাহারা গল্প করিয়া কাটাইল। বিশেষ কোনও বিষয়ে আলোচনা নহে, মনে আনন্দ থাকিলে এই বয়েসটায় অকারণেই উচ্ছল হইয়া ওঠা যায়।

নোটবুক হইতে কাগজ ছিড়িয়া কাজল অপালাকে তাহার ঠিকানা লিখিয়া দিল। শেয়ালদা হইতেই পরস্পরের নিকট বিদায় লইয়া যে যাহাব বাড়ি চলিয়া গেল। কেবল কাজল জীবনে এই প্রথম বাড়ি ফিরিবার জন্য কোনও তাড়া অনুভব করিল না। হ্যারিসন রোড ধরিয়া সে অকারণেই আঁটিয়া কলেজ স্ট্রীটের মোড় পর্যন্ত গিয়া আবার শেয়ালদায় ফিরিয়া আসিল। সবই ঠিক আছে সেই অবিরাম জনস্রোত, বিদ্যুৎবাতির সমারোহ, কলিকাতা শহরটা। কেবল তাহার মধ্যে অকস্মাৎ যেন কী একটা পরিবর্তন হইয়া গিয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *