৪. রাজকীয় জাহাজ

পরদিন সকালে অ্যাপেপি ও রাজপ্রতিভূ লর্ড নাজার মধ্যে হিকস্‌দের রাজকীয় জাহাজে তাদের শেষ সভা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল। অ্যাপেপির নয় ছেলের সবাই উপস্থিত হলো এবং মিনটাকা তার পিতার পাশে আসন নেয়। গত দিন বিকাল যখন নেফারকে নিয়ে জাহাজ ছেড়ে গিয়েছিল তখন থেকে অ্যাপেপি তাকে কঠোর তদারকির মধ্যে রেখেছে। অনেক দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে সে তার একরোখা মেয়েকে ভালো করেই জানে। বলা যায় না সে যে কোন কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে।

বিদায় অনুষ্ঠান অ্যাপেপির জাহাজের ডেকে অনুষ্ঠিত হলো এবং পারস্পরিক বিশ্বাস ও শান্তি বজায় রাখার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ঘোষণার মধ্য দিয়ে তা শেষ হল।

এই সম্পর্ক হাজার বছর দীর্ঘ হোক! নাজা সুর করে প্রার্থনা করল এবং সে অ্যাপেপিকে আন্তজীবনের স্বর্ণ বলে আখ্যায়িত করল। এটা সে সম্মান যা সে এই পবিত্র লক্ষ্যের জন্যে সৃষ্টি করেছে।

হাজার হাজার বছর ধরে, অ্যাপেপি উত্তর দিল, সমান গাম্ভীর্যতা সহকারে দামী ও অর্ধ দামী রত্নে সজ্জিত সম্মানসূচক হারটা তার কাঁধের চারপাশে পরিয়ে দিতে দিতে সে বলল। রাজপ্রতিভূ ও রাজা ভাইয়ের মতো কোলাকুলি করল। তারপর নাজা বৈঠা টানা নৌকা দিয়ে নিজের জাহাজে ফিরে গেল। তারপর দুই জাহাজ আলাদা হয়ে গেল। একটা থেবসে ফিরবে অন্যরা স্রোতে ভেসে শত ক্রোশ দূর মেমফিস ও অ্যাভারিসে চলে যাবে, নাবিকেরা একে অপরকে অভিনন্দন জানাল। জয় মাল্য ও পাম গাছের ডালের মালা এবং ফুল এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে তার ছুঁড়ে মারল ও প্রশস্ত নদীর উপর স্তর তা দিয়ে ঢেকে ফেলল।

অ্যাপেপির যাত্রা ততোটা জরুরি ছিল না যে এই চাঁদহীন অন্ধকার রাতেই তাকে জাহাজ চালাতে হবে। ফলে সন্ধ্যাবেলা তারা বালাসফুরায় নোঙ্গর করল, হাপির মন্দিরের অপর দিকে, যে অর্ধ জলহস্তী নীলের উভলিঙ্গ প্রভু। রাজা ও তার পরিবার তীরে নামল এবং মন্দিরের বেদীতে খাঁটি সাদা ষাঁড় বলী দিল। প্রধান যাজক রাজার শুভযোগ পরীক্ষা করে দেখতে গর্জনরত জীবিত পশুটার নাঁড়িভুড়ি বের করে নিল। সে বিস্মিত হলো যখন দেখল যে পশুটার নাড়িভূড়ি দুর্গন্ধময় ও সাদা পোকায় আক্রান্ত যেগুলো মন্দিরের মেঝেতে ছাড়িয়ে পড়ে গিজ গিজ করতে লাগল। সে তার চাদর দিয়ে ঢেকে এই ভয়ংকর দৃশ্য রাজার কাছ থেকে লুকাতে চেষ্টা করল এবং মিথ্যা গল্প বানাতে শুরু করল। কিন্তু অ্যাপেপি তাকে একপাশে সরিয়ে ভয়ংকর দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে রইল। এমনকি সে প্রকাশ্যে কাঁপতে লাগল এবং একটু সময়ের জন্যে সে দমে গেল। তারপর তারা মন্দির ত্যাগ করে নদীর তীরে ফিরে গেল যেখানে টর্ক ও অন্য অফিসাররা তার নির্দেশে তার জন্যে ভোজ সভা ও বিনোদনের আয়োজন করেছে।

এদিকে এমন কি মন্দিরের পবিত্র কালো বাচ্চা মোরগগুলোও পশুটার দূষিত নাড়িভুড়িতে ঠোকর দিতে অস্বীকৃতি জানাল। যাজকরা ঐ বীভৎস বস্তুগুলো মন্দিরের আগুনে নিক্ষেপ করল। কিন্তু নাড়ি ভুড়িগুলোকে তা না পুড়িয়ে যে আগুন যুগ যুগ ধরে প্রজ্জ্বলিত হয়ে আসছে তা হঠাৎ নিভে গেল। ঐ সংকেতও কম অশুভ নয়। তখন প্রধান যাজক নাড়িভুড়ি পুঁতে ফেলার নির্দেশ দিল ও আগুন আবার জ্বালাতে বলল। আমি কখনো এমন অশুভ লক্ষণ দেখি নি। সে তার সহকারীকে বলল। প্রভু হাপি থেকে এরকম ইশারা কেবল কোন ভয়ংকর ঘটনার পূর্বাভাসই হতে পারে। যেমন যুদ্ধ অথবা ফারাও-এর মৃত্যু। ফারাও নেফারের সুস্থতার জন্যে আমাদের অবশ্যই সারারাত ধরে প্রার্থনা করতে হবে।

নদীর তীরে লর্ড টর্ক উজ্জ্বল লাল, হলুদ ও সবুজ রঙের পর্দা দিয়ে রাজ পরিবারের জন্য মঞ্চ তৈরি করেছে। আস্ত বঁড় গর্তের উজ্জ্বল ছাই-এর উপর ঝলসানো হচ্ছে এবং সবচাইতে ভালো মদ নদীর পানিতে ঠাণ্ডা করা হচ্ছে। দাসরা ওগুলোর ভারে তীরের উপর হেলে নুইয়ে পড়ল যখন তারা একজন আরেকজনের হাতে তা দিল এবং অ্যাপেপি নতুন জার আনতে বারবার গর্জন করে আদেশ দিচ্ছিল।

প্রতি বোল গ্রহণের সাথে সাথে রাজার বিষণ্ণতা হালকা হয়ে গেল এবং শীঘ্রই সে তার পুত্রদের সাথে, তার সেনাবাহিনীকে বেফাঁস গান গাইতে যোগ দিতে উৎসাহ দিল। কিছু এতোটাই অকথ্য গালি গালাজ ছিল যে মিনটাকা ক্লান্ত হল ও তার মাথা ব্যথা ধরল এবং সে ও তার দাস মেয়েরা তীর থেকে দূরে নোঙ্গর করা রাজকীয় জাহাজে বিশ্রাম নিতে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াল। সে তার সাথে তার ছোট ভাই খিয়ানকে নেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু অ্যাপেপি বাধা দিল। ভালো মদ তাকে মন্দিরের কথিত ভবিষ্যৎ বাণী যা ছিল তার আসন্ন অভিশাপ তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে। বালকটিকে ছাড়, বদরাগী মেয়ে। ভালো সঙ্গীত কীভাবে প্রশংসা করতে হয় তা তার শেখা উচিত। সে অতিরিক্ত আদরে ছেলেটিকে তার দিকে জড়িয়ে নিল এবং মদের বোল তার ঠোঁটের কাছে ধরল। এক চুমুক খাও বাছা। এটা তোমাকে আরো ভালো গাওয়াবে, আমার ছোট্ট রাজকুমার।

খিয়ান তার পিতাকে ভক্তি করল এবং এরকম প্রকাশ্য সহমর্মিতা তার মাঝে এক প্রকার অহংকার ও বীর পূজার অনুভূতি নিয়ে এল। অবশেষে তার পিতা তাকে একজন পুরুষ ও যোদ্ধা রূপে বিবেচনা করছে। যদিও তা দেখে সে নাক সিঁটকালো তবুও সে বোলটা কোনভাবে মুখে চালান করে দিল এবং টর্কের নেতৃত্বের সঙ্গ তাকে প্রফুল্ল করল যেন সে যুদ্ধের ময়দানে তার প্রথম শত্রু হত্যা করল।

মিনটাকা ইতস্তত করতে লাগল। সে তার ছোট ভাইকে রক্ষা করার একটা প্রায় মাতৃত্ব পূর্ণ দায়িত্ব অনুভব করল কিন্তু সে বুঝল তার পিতার এখন কোন হুশ নেই। সমস্ত গাম্ভীর্যতা নিয়ে সে তার সহচারীদের নিয়ে নদীর তীরে চলল এবং মাতালদের চিৎকার ছেড়ে তারা দূরে জাহাজে চলে গেল।

মিনটাকা তার গালিচার উপর শুয়ে হৈচৈ-এর আওয়াজ শুনতে লাগল। সে ঘুমানোর চেষ্টা করল কিন্তু নেফার তার মনের পর্দা আড়াল করে আছে। হারানোর ব্যথা এবং নেফারের আঘাতে তার চিন্তা যা সারাদিন তার মনকে আচ্ছন্ন করে ছিল তা আবার ফিরে এল এবং যদিও সে তা বাধা দেয়ার চেষ্টা করল তবুও তার অশ্রু ঝড়তেই লাগল। সে তার কান্নার আওয়াজ বালিশে চেপে গোপন করল।

অবশেষে সে একটা কালো, স্বপ্নহীন ঘুমে ডুবে গেল যেখান থেকে যে খুব কষ্টে জাগল। সে অল্প একটু মদ খেয়ে ছিল কিন্তু তারপরও নিজেকে তার নেশা গ্রন্থের মত লাগছে এবং তার মাথা ব্যথা করছে। সে জেগে ভাবতে লাগল কি এমন যা তাকে এভাবে জাগিয়ে দিল। তারপর সে জাহাজের মধ্য দিয়ে কতগুলো কর্কশ পুরুষ কণ্ঠ শুনল যারা নিচে জাহাজে উঠেছে। তার মাথার উপরের ডেক থেকেও মদ্যপায়ীর হাসি ও কণ্ঠস্বর এবং ভারি পায়ের আওয়াজ শুনল। তাদের কথা থেকে বোঝা গেল তার পিতা ও তার ভাইদেরকে জাহাজে তোলা হচ্ছে। তার পরিবারের লোকেরা মদ খেয়ে এই অবস্থায় যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয় কিন্তু তার ছোট খিয়ানের জন্যে চিন্তা হল।

সে নিজেকে টেনে বিছানা থেকে তুলল এবং দ্রুত পোশাক পড়ে নিল। কিন্তু সে অদ্ভুত রকমের একটা হতোদ্যম দ্বিধান্বিতা অনুভব করল। যখন সে ডেকে উঠে এল তখন সে দুলতে লাগল।

প্রথম যে লোকটির সাথে তার দেখা হল সে হল লর্ড টর্ক। যে লোকগুলো তার পিতাকে বহন করছিল সে তাদের নির্দেশ দিচ্ছিল। তার বিশাল জড় দেহটাকে বহন করতে ছয়জন লোক লেগেছে। তার বড় ভাইয়ের অবস্থাও এর চাইতে ভালো না। তার রাগ হলো ও তাদের কারণে তার লজ্জা হলো। সে দেখল একজন মাঝি খিয়ানকে নিয়ে আসছে এবং সে দৌড়ে তার কাছে গেল, এখন তারা খিয়ানকেও তাদের মতো করেছে। সে তিক্ত ভাবে ভাবল। তারা ততোক্ষণ পর্যন্ত থামবে না যততক্ষণ তারা তাকেও মাতাল বনাবে।

যে মাঝি খিয়ানকে বহন করছে সে তাকে বলল তার পিতার কেবিনের গালিচায় খিয়ানকে নিয়ে যেতে। সেখানে নিয়ে গিয়ে সে তার পোশাক খুলল এবং জোড় করে তার জ্ঞান ফিরাতে তার ঠোঁটের মধ্য দিয়ে গুল্মের তৈরি একটা ওষুধ দিল। ওষুধটা সর্বরোগের যা টাইটা তার জন্য তৈরি করেছে এবং মনে হয় এটা কাজ করবে। অবশেষে খিয়ান বিড়বিড় করল এবং তার চোখ খুলল। তারপর সঙ্গে সঙ্গেই গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু স্বাভাবিক ঘুম। আমি আশা করি এ থেকে সে শিখবে। সে বিড়বিড় করে বলল। তাকে ঘুমাতে ছেড়ে আসা ছাড়া তার পক্ষে আর কিছু করার ছিল না। তাছাড়া এখনো তার অস্বাভাবিক নিদ্রালু ভাবটা লাগছে এবং তার মাথা ব্যথাটা অসহনীয় ছিল। সে তার কেবিনে ফিরে গেল এবং পোশাক খোলার কষ্ট না করে সে তার গালিচার উপর শুয়ে পড়ল এবং তৎক্ষণাৎ আবার ঘুমে ডুবে গেল। পরের বার যখন সে জাগল ভাবল সে দুঃস্বপ্ন দেখছে কারণ সে চিৎকার শুনতে পেল এবং সে ভারি ধোয়ার মেঘে শ্বাস নিচ্ছিল যা তার কণ্ঠের পিছন দিক দগ্ধ করল। পুরোপুরি জেগে ওঠার পূর্বেই সে নিজেকে তার বিছানাকে থেকে অন্যত্র বাঁধা অবস্থা পেল, পশুর চামড়ার কম্বলে জড়িয়ে তাকে ডেকে নিয়ে আসা হয়েছে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করল, কিন্তু একটা শক্তিশালী হাতের মধ্যে একটা শিশু যেমন অসহায় থাকে সেও এখন তেমন অবস্থায়।

ডেকের উপর চাঁদহীন রাতটা প্রজ্জ্বলিত আগুনের শিখায় আলোকিত। তারা রাজকীয় জাহাজের সামনের খোলা দরজায় গর্জন তুলছে। লাফিয়ে তা মাস্তুলের উপর উঠছে এবং এক নারকীয় কমলা বর্ণে মাস্তুলটা সজ্জিত করছে। সে পূর্বে কখনো কাঠের নৌ-তরী পুড়তে দেখেনি এবং আগুনের শিখার গতি ও হিংস্রতা তাকে হতভম্ব করে দিল।

সে বেশিক্ষণ ওটার তাকিয়ে থাকতে পারল না কারণ নিজেকে সে দ্রুত ডেকের পাশে বয়ে নিয়ে যেতে দেখল এবং পাশে অপেক্ষারত ছোট নৌকার মধ্যে তাকে নামানো হচ্ছে বুঝল। দ্রুত তার বাস্তব জ্ঞান ফিরে এল এবং সে আবার ধস্তাধস্তি ও চিৎকার করতে শুরু করল। আমার পিতা! আমার ভাইয়েরা! খিয়ান! তারা কোথায়?

নৌকা নদীতে ভাসল এবং সে তার সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার জন্যে যুদ্ধ শুরু করল। কিন্তু যে হাতগুলো তাকে ধরে ছিল তা ছিল অনুকম্পাহীন। কোনো রকমে সে তার মাথা ঘোরাল এবং যে তাকে ধরেছিল তার চেহারাটা দেখল।

টর্ক! সে তার দৃষ্টতায় রেগে গেল। সে তার সাথে যাচ্ছে-তাই ব্যবহার করছে। এবং তার চিৎকার এড়িয়ে যাচ্ছে। আমাকে যেতে দাও। আমি তোমাকে আদেশ করছি।

সে সাড়া দিল না। এখন সে তাকে হালকাভাবে ধরে আছে, কিন্তু জ্বলন্ত জাহাজটা সে শান্ত, নির্বিকার অভিব্যক্তি নিয়ে দেখছিল।

ফিরে চল! সে তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করল। আমার পরিবার! ফিরে যাও এবং তাদের উদ্ধার করো!

তার একমাত্র সাড়া ছিল চিৎকার করে মাঝিদের আদেশ দেয়। জোরে চালিয়ে যাও! তারা বৈঠা চালাল এবং নৌকা স্রোতে দুলতে লাগল। নাবিকার বিমুগ্ধ হয়ে জ্বলন্ত জাহাজ দেখছিল এবং ফাঁদে পড়া জাহাজের ডেকগুলো থেকে আর্তনাদের চিৎকার ভেসে আসছিল। হঠাৎ করে ডেকের পিছনটা আগুনের শিখা ও স্ফুলিঙ্গে বিশাল ভবনের ন্যায় ভেঙে পড়ল। নোঙ্গর করে রাখা রশিগুলো পুড়ে গেল এবং জাহাজটা ধীরে স্রোতের টানে নদীর ভাটিতে ভেসে গেল।

দয়া কর। মিনটাকা তার কণ্ঠ পরিবর্তন করল। দয়া কর, লর্ড টর্ক, আমার পরিবার! তুমি তাদের পুড়তে দিতে পারো না।

এখন আর জাহাজের ভেতর থেকে আসা চিৎকার নেই এবং তার জায়গায় আগুনের নিচু গর্জন শোনা যাচ্ছে। মিনটাকার চোখের পানি গাল বেয়ে চিবুক দিয়ে গড়িয়ে পড়ল, কিন্তু এখন সে শয়তানটার হাতের মুঠোয় অসহায়।

হঠাৎ করে জ্বলন্ত ডেকের প্রধান দরজা খুলে গেল এবং নৌকার নাবিকরা ভয় পেয়ে গেল যখন দেখল একটা অবয়ব বেরিয়ে এল। লর্ড টর্ক মিনটাকাকে শক্ত করে ধরল যতক্ষণ না সে তার পাজরে চাপ দিল। এটা হতে পারে না! সে খসখস করে বলল।

ধোঁয়া ও আগুনের ভেতর দিয়ে মনে হল একটা পাতালপুরীর ছায়া থেকে কোন প্রেতাত্মা–নগ্ন ও চুলে ঢাকা, যার বড় পেটটা ফাঁপানো, অ্যাপেপি জাহাজের কিনারে দিকে হেলে দুলে চলল। সে তার হাতে তার ছোট ছেলের দেহটা বহন করছে, এবং আগুনের ধবংস যজ্ঞের মধ্যে বাতাস টানার জন্যে তার মুখ পুরোটা ভোলা।

দৈত্যটাকে খুন করা কঠিন। টর্কের রাগটা ভয় মিশ্রিত। এমনি নিজের দুর্দশার মধ্যেও মিনটাকা তার কথার অর্থ বুঝতে পারল।

তুমি, টর্ক। সে ফিসফিসাল। শেষ পর্যন্ত তুমি তাদের সাথে এরকম করলে। টর্ক অভিযোগটা এড়িয়ে গেল।

অ্যাপেপির দেহের ঘন নোম এক মুহূর্তের জন্য তাকে নগ্ন ও কালো করে দিয়ে তাপের এক ঝাঁপটায় ঝলসে চলে গেল। তারপর তার চামড়ায় ফোঁসকা পড়তে শুরু করল এবং চামড়া কুঁচকাতে লাগল। তার দাড়ির ঝোঁপ ও মাথার চুল তেলে চোবানো মশালের ন্যায় জ্বলছে। সে আর সামনে এগোচ্ছে না, কিন্তু পায়ের পাতায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং খিয়ানকে তার মাথার উপরে তুলে ধরে রেখেছে। বালকটিও তার মতই ঝলসানো এবং যেসব জায়গায় চামড়া পুড়ে গেছে সেখানে কাঁচা মাংস লাল ও ভেজা দেখাল। সম্ভবত অ্যাপেপি আগুন থেকে বাঁচানোর জন্যে তাকে জাহাজের পাশে নদীতে ফেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার শক্তি অবশেষে তাকে ব্যর্থ করল এবং মাথায় আগুন নিয়ে সে অতিকায় মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল। তার ছেলেকে নিরাপদে নীলের ঠাণ্ডা পানিতে নিক্ষেপ করার জন্যে শেষ শক্তিটুকু এক করতে সে ব্যর্থ হল।

মিনটাকা নড়তে পারল না এবং ঐ দৃশ্যের ভয়াবহতায় সে চুপসে গেল। তার মনে হলো এটা অনন্ত কাল ধরে চলল যতোক্ষণ না অ্যাপেপির পায়ের নিচের ডেক পুড়ে ভেঙ্গে পড়ল। সে ও তার ছেলে তার মধ্য দিয়ে পড়ে গেল এবং লম্বা আগুনের ঝর্ণা, ফুলিঙ্গ ও ধোয়া সহকারে জাহাজটা নীলের পেটের মধ্যে চলে গেল।

সব শেষ। টর্কের কণ্ঠ নিরাবেগ ও নিরাসক্ত। সে মিনটাকাকে এতো আকস্মিকভাবে ছেড়ে দিল যে সে নৌকার মেঝেতে পড়ে গেল। সে তার ভয়ার্ত নাবিকদের দিকে তাকাল। আমার জাহাজের দিকে বৈঠা বাও। সে আদেশ দিল।

তুমি আমার পরিবারের এই হাল করলে? মিনটাকা আবার বলল। সে তার পায়ের কাছে পড়ে ছিল। তোমাকে এর জন্যে খেসারত দিতে হবে। আমি তোমাকে কসম খেয়ে বলছি। আমি তোমাকে এর খেসারত দিতে বাধ্য করবো।

কিন্তু তার নিস্তেজ শরীরে সে বলি শিরের দাগ অনুভব করল যেন তাকে শক্ত হাতলওয়ালা গিটযুক্ত চামড়ার চাবুক দিয়ে পেটানো হয়েছে। তার পিতা নেই, যা তার জীবনের স্মরণীয় বিশাল এক অবয়ব যাকে সে একটু ঘৃণা করেছে এবং তার চেয়ে অনেক বেশি ভালোবেসেছে। তার পরিবার নেই। তার সকল ভাইয়েরা এমনকি ছোট্ট খিয়ান যে তার কাছে সহোদরের চেয়ে পুত্ৰই বেশি ছিল তাকে সে পুড়তে দেখেছে এবং সে জানে এই ভয়ংকর দৃশ্যটা তার জীবনের বাকি সব দিনগুলোতে তার সাথে থাকবে।

নৌকাটা টর্কের জাহাজের পাশে ভিড়ল এবং সে কোন প্রতিবাদ করল না যখন সে তাকে এমনভাবে তুলল যেন সে একটা পুতুল। তাকে নৌকায় তুলে প্রধান। কেবিনে নিয়ে আসা হল। অস্বাভাবিক ভদ্রতা নিয়ে সে তাকে গালিচার উপর বসাল। আপনার দাসীরা নিরাপদ। আমি তাদের আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব। সে বলল এবং চলে গেল। সে দরজায় তালা লাগানোর আওয়াজ শুনল। তারপর মই বেয়ে তার উপরে উঠে যাওয়ার শব্দ শুনল এবং তার মাথার উপরের ডেক পার হবার শব্দ শুনল।

আমি কি তাহলে একজন বন্দী, তারপর? সে ফিসফিস করে বলল। কিন্তু এই মাত্র সে যা অবলোকন করে এসেছে তার কাছে এ বিষয়ের গুরুত্ব অনেক কম। সে বালিশে মুখ ঢাকল যাতে টর্কের ঘামের গন্ধ লেগে আছে, এবং চোখের জল না। শুকানো পর্যন্ত সে কাঁদতে থাকল। তারপর একসময় নিজের অজান্তে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

*

অ্যাপেপির পোড়া রাজকীয় জাহাজ হাপির মন্দিরের অপর তীরে ভাসছিল। ভোরে স্থির বাতাসে ধোয়া অনেক উপরে উঠে গেল যা পোড়া মাংসের দুর্গন্ধে ভরপুর ছিল। যখন মিনটাকা জাগল গন্ধ তখন কেবিনে প্রবেশ করেছে এবং তাকে তা অসুস্থ করে তুলল। ধোয়াটা মনে হল সংকেতের মতো কাজ করল, কারণ পূর্ব দিকের পাহাড়ে সূর্যটা উঁকি দিতে না দিতেই লর্ড নাজার জাহাজকে নদীর বাঁকে দেখা গেল।

দাসীরা মিনটাকার কাছে সংবাদটা নিয়ে এল। লর্ড নাজা তার পুরো বাহিনী নিয়ে এসেছে, তারা উত্তেজিতভাবে তাকে বলল। অথচ গতকাল সে আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে থেবস এর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল। এটা কি অদ্ভুত নয় যে সে এতো দ্রুত এখানে পৌঁছতে পারল, যেখানে সে নদীর উজানে বিশ ক্রোশের মত গিয়েছিল?

বিস্ময়কর অদ্ভুত, মিনটাকা গম্ভীরতার সাথে সম্মত হলো। আমাকে নিশ্চয়ই কাপড় পড়তে হবে এবং তৈরি হতে হবে নতুন কোন জঘন্য নাটকের জন্য যা এখন আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।

তার মালপত্র সব জাহাজে আগুনে পুড়ে গেছে কিন্তু তার সহচারীরা অন্য সম্মানীয় মহিলাদের কাছ থেকে তার জন্যে কাপড় ধার করে আনল। তারা তার চুল ধৌত করল ও কোঁকড়ানো করে তা বিনি করল, তারপর একটা সাধারণ লিনেনের কামিজ, স্বর্ণের কোমর বন্ধ এবং স্যান্ডেল তাকে পড়িয়ে দিল।

দুপুরের আগে একদল সশস্ত্র সৈন্যদল জাহাজে এল এবং সে তাদের ডেকের উপর অনুসরণ করল। তার চোখ প্রথমে গেল কালো হয়ে যাওয়া রাজকীয় জাহাজের কাঠগুলোর দিকে যেগুলো দূরে তীরের অন্য দিকে পড়ে আছে, জলসীমায় পুড়ে ভেঙ্গে আছে। ভগ্নাংশ থেকে কাউকে উদ্ধার করার কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এটা তার পরিবারের চিতা। হিকস্‌দের রীতি হলো দাহ করা; মমি কিংবা অন্য সব শব সকার পদ্ধতির ন্যায় অনুষ্ঠান দীর্ঘায়িত করা নয়। মিনটাকা জানত তার পিতাও তার নিজের শেষ যাত্রাটা এভাবেই করত এবং তা তাকে একটু শান্তি দিল। তারপর সে খিয়ানের কথা ভাবল এবং তার চোখ ফিরিয়ে নিল। খুব কষ্টে সে তার কান্না আটকাল। সে অপেক্ষারত নৌকায় নামল এবং তাকে হাপির মন্দিরের নিচের তীরে নিয়ে যাওয়া হল।

লর্ড নাজা তার সকল সাথীদের নিয়ে তার সাথে সাক্ষাতের অপেক্ষায় ছিল। নাজা যখন তার সাথে আলিঙ্গন করল তখন সে উদাসীন ও বিমর্য রইল। এটা আমাদের সবার জন্য একটা তিক্ত সময়, রাজকন্যা। সে বলল, আপনার পিতা, রাজা অ্যাপেপি ছিলেন একজন মহান যোদ্ধা ও শাসক। দুই রাজ্যের মধ্যে নতুন সাম্প্রতিক চুক্তির জন্যে এবং এই মিশরকে একটা পবিত্র ও ঐতিহাসিক রাজ্যে যুক্ত করার ক্ষেত্রে তিনি একটা বিপদজনক শূন্যতা তৈরি করলেন। সকলের ভালোর জন্য এই শূন্যতা অতি শীঘ্রই পূরণ করতে হবে।

সে তার হাত ধরে তাকে মঞ্চে নিয়ে গেল যা গত সন্ধ্যায় ছিল ভোজ ও উৎসবের স্থান। কিন্তু এখন সেখানে দুই রাজ্যের অধিকাংশ উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি ও আমলাবর্গ নীরবে জমায়েত হয়েছেন।

সে টর্ককে এই ভিড়ের একেবারে সামনে দেখল। পুরোদমে সামরিক সাজে সে একজন লক্ষণীয় অবয়ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার তলোয়ারটা স্বর্ণের আংটা লাগানো বেল্টের সাথে ঝুলিয়েছে এবং কাঁধে তার যুদ্ধের ধনুকটা রাখা। তার পিছনে দাঁড়ানো তার সকল পদস্থ অফিসারেরা গম্ভীর ও শীতল দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে এবং উজ্জ্বল ফিতায় তাদের দাড়ি সাজানোর পরও তাদের নিষ্ঠুর দেখাচ্ছিল। তাদের মুখে হাসি দেখা গেল না এবং সে তিক্তভাবে সচেতন ছিল যে সে-ই অ্যাপেপির বংশের শেষ ব্যক্তি, একা ও অরক্ষিত।

সে ভেবে বিস্মিত হলো এখন কার কাছে সে আবেদন করবে ও কার আনুগত্যের উপর সে নির্ভর করতে পারে। সে লোকজনের মাঝে পরিচিত বন্ধুত্বপূর্ণ মুখ খুঁজল। সেখানে যারা এখন আছে তার সবাই বলতে গেলে তার পিতার সভাসদ এবং উপদেষ্টা ছিল এবং তার যুদ্ধের ময়দানের সেনাপতি ও সহচরেরাও এখানে রয়েছে। সে দেখল তারা কেউই তার মুখের দিকে সরাসরি তাকাচ্ছে না। তার উদ্দেশ্যে কেউ হাসল না কিংবা কেউ তাকে আশ্বস্ত করল না। তার জীবনে এতো একাকীত্ব সে আর কখনো অনুভব করেনি।

নাজা তাকে মঞ্চের একপাশের একটা গদির টুলের কাছে নিয়ে গেল। সে বসতেই নাজা ও তার লোকেরা তার চতুর্দিকে একটা মানব পর্দা তৈরি করে আসন নিল, লোকজনের চোখ থেকে তাকে আড়াল করতে। সে নিশ্চিত এটা ইচ্ছে করেই। করা হয়েছে।

লর্ড নাজা রাজা অ্যাপেপি ও তার ছেলের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ দিয়ে তার কথা শুরু করল। তারপর সে মৃত ফারাও-এর অনেক উচ্চ প্রশংসা করল। সে তার অসংখ্য সামরিক জয়ের কথা স্মরণ করল এবং তার রাজ্য পরিচালনায় কৃতিত্ব, হাথোরের শান্তি চুক্তিতে তার সর্বোচ্চ সহায়তা–যা দুই রাজ্যের কয়েক দশকের আত্মঘাতী যুদ্ধাবস্থা ও বিবাদ সমাপ্তি ঘটিয়ে শান্তি এনেছে তা স্মরণ করল।

রাজা অ্যাপেপি অথবা একজন শক্তিশালী ফারাও ছাড়া নিম্ন রাজ্যের সকল বিষয়াদি পরিচালনা এবং ফারাও নেফার সেটি ও তার রাজ-প্রতিভূর সাথে যুগ্ম শাসন করার জন্যে সম্পাদিত শান্তি চুক্তি একটা বিপদজনক অবস্থায় থাকছে। শান্তি চুক্তির পূর্বোক্ত ষাট বছর আগের যুদ্ধাবস্থা ও অরাজকতায় আরো একবার ফিরে যাওয়া অচিন্তনীয়।

লর্ড টর্ক তার তলোয়ারের খাপ তার ব্রোঞ্জের ঢালের সাথে আঘাত করল ও চিৎকার করে উঠল। বাক-হার! বাক-হার! সঙ্গে সঙ্গে তুমূল জয়ধ্বনি তার পিছনে দাঁড়ানো সব সেনাবাহিনীর সামন্তরা নিয়ে নিল এবং ধীরে ধীরে পুরো সমাবেশে তা ছড়িয়ে পড়ল যতোক্ষণ না এটা একটা কানফাটানো বজ্রের মতো শোনাল।

নাজা এটা আরো কিছুক্ষণ চলতে দিল, তারপর দুই হাত তুলল। যখন নিরবতা নামল সে শুরু করল, তার মৃত্যুর করুণ পরিস্থিতিতে রাজা অ্যাপেপি মুকুটের কোন পুরুষ দাবিদার রেখে যাননি। কোমলভাবে সে মিনটাকার মনোযোগ উপেক্ষা করে গেল। জরুরি বিষয় হিসেবে আমি দুই রাজ্যের উচ্চপদস্থ সভাসদগণ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে আলোচনা করেছি। নতুন ফারাও-এর ব্যাপারে তাদের পছন্দ সর্বসম্মত। এক বাক্যে তারা ক্ষমতার লাগাম ধরার জন্যে মেমফিসের লর্ড টর্কের কথা বলেছেন। তার উপর দ্বৈত মুকুট এবং রাজা অ্যাপেপির ঐতিহ্য অনুযায়ী জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেছেন।

এ ঘোষণার ফলে গভীর ও নাজুক একটা নিরবতা নেমে এল। লোকেরা শূন্য অবাক বিস্ময়ে একে অপরের দিকে তাকাল। আর কেবল মাত্র তখনই তারা বিষয়টার গুরুত্ব বুঝল যখন লর্ড নাজার ঘোষণার সাথে সাথে টর্কের নেতৃত্বের ও বিশ্বস্তের দুই রেজিমেন্ট সৈন্য পাশের ঝোঁপ থেকে নিরবে বের হয়ে এসে সমাবেশ ঘিরে ফেলল। তাদের তলোয়ার খাপে ভরা কিন্তু হাতলের উপর তাদের একটা করে হাত রাখা। তাদের এক মুহূর্ত সময় লাগবে ব্রোঞ্জের ফলাটা বের করতে। হতাশা ও আতঙ্কের একটা প্রবাহ সবার মাঝে বয়ে গেল। মিনটাকা সুযোগটা নিল। সে টুল থেকে উঠে দাঁড়াল যেন সবাই তাকে দেখতে পায়। হে আমার মিশরের লর্ড ও বিশস্ত নাগরিকগণ…

সে আর বেশি কিছু বলতে পারল না। চার জন সবচাইতে লম্বা হিকস্ যোদ্ধা তাকে ঘিরে ধরল ও তাকে আড়াল করে ফেলল। তারা তাদের খোলা তরবারি দিয়ে তাদের ঢালে আঘাত করে আওয়াজ করল ও একসাথে চিৎকার করে উঠল। দীর্ঘজীবী হোন, ফারাও লর্ড টর্ক দীর্ঘজীবী হউন! চিৎকার বাকি আর্মিদের মধ্যে ছড়িয়ে গেল। আনন্দের গর্জনে যা হচ্ছিল তার মধ্যে একটা শক্তিশালী হাত মিনটাকাকে তুলে নিল এবং উৎফুল্ল জনতার মধ্য দিয়ে তাকে টেনে নিয়ে গেল। সে বিফল লড়াই করল এবং একসময় তার চেষ্টা বাদ দিল এবং তার কণ্ঠ জনতার আনন্দের উল্লাসে চাপা পড়ে গেল। নদী তীরে গিয়ে সে ঘুরে পিছনে তাকাল। জনতার মাথার উপর দিয়ে সে দেখল লর্ড নাজা নতুন ফারাও-এর মাথায় দ্বৈত মুকুট পড়াচ্ছে।

তাকে ধাক্কা দিয়ে তীরে অপেক্ষারত নৌকায় উঠানো হল এবং বন্দী ও পাহারা রত লর্ড টর্কের জাহাজের কেবিনে তাকে ফিরিয়ে আনা হল।

*

মিনটাকা তার দাসীদের সাথে জনাকীর্ণ কেবিনে বসে ছিল এবং নতুন ফারাও যখন জাহাজে ফিরবে তখন তার ভাগ্যে কি ঘটে তার অপেক্ষায় আছে। তার সঙ্গীরা তার মতই ভয়ার্ত ও দ্বিধান্বিত ছিল। যাই হোক, সে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করল। যখন তারা একটু শান্ত হল সে তাদের প্রিয় খেলা শুরু করল। কিন্তু এগুলো দ্রুতই বিরক্তি কর হয়ে উঠল। তাই সে বীণা আনতে বলল। তার নিজেরটা তার পিতার জাহাজে হারিয়ে গেছে কিন্তু তারা একজন গার্ড থেকে একটা ধার করে আনল। মিনটাকা একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করল, প্রতিটি মেয়ে ছোট কেবিনের বন্দী স্থানে পর্যায়ক্রমে নাচতে লাগল। কিছুক্ষণের জন্যে তারা সব ভুলে হাসল ও হাত তালি দিল এবং এক সময় তারা নতুন ফারাওকে জাহাজে ফিরতে শুনল। মেয়েরা চুপ হয়ে গেল কিন্তু সে তাদের চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিল। শীঘ্রই তারা আগের মতই হৈ-চৈ আর হাসিতে মেতে উঠল।

মিনটাকা আনন্দ উল্লাসে যোগ দিল না। প্রথমে সে তার চারপাশটা ভালোভাবে দেখল। তার প্রধান কেবিনের সাথে একটা আরো ছোট কক্ষ, একটা কাপবোর্ডের চাইতে ছোট কক্ষ আছে যা পায়খানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যার মধ্যে একটি ঢাকনা যুক্ত মাটির টয়লেট বোল এবং এর পাশেই এক কলস পানি রাখা আছে ব্যবহার করার জন্যে। পরবর্তী কক্ষ থেকে একে যে দেয়াল আলাদা করেছে তা অপেক্ষাকৃত সরু ও পাতলা, কারিগরেরা নৌকা তৈরি সময় ওজন কমানোর ব্যাপারটা মাথায় রেখেছিল। মিনটাকা এ জাহাজে তার সুখের সময়ে এসেছিল যখন সে এবং তার পিতা লর্ড টর্কের অতিথি ছিল। সে জানে দেয়ালের ওপাশে প্রধান কেবিনটা অবস্থিত।

মিনটাকা পায়খানার ঢুকে পড়ল। এমনকি তার দাসীদের হৈ-চৈ-এর মধ্যেও সে দেয়ালের ও পাশের লোকদের কথা শুনল। সে নাজার কণ্ঠ পরিষ্কারভাবে চিনল, কৃতিত্বপূর্ণ কণ্ঠ এবং টর্কের কণ্ঠটা কর্কশ শুনাল। সাবধানে সাথে সে দেয়ালের উপর কান রাখল এবং সঙ্গে সঙ্গেই কতগুলো আরো পরিষ্কার হলো ও শব্দগুলো বোধগম্য হলো।

নাজা রক্ষীদের বিদায় করে দিচ্ছে যারা তাদের সাথে জাহাজে ছিল। সে তাদের চলে যাওয়ার শব্দ শুনল এবং দীর্ঘ নীরবতা নামল। সে ভাবল নাজা হয়তো কক্ষে একা। সে একটা পানের বোলে মদ ঢালার গরগর শব্দ শুনল এবং নাজা তারপর শ্লেষাক্ত কণ্ঠে বলল, মহামান্য, আপনি কি ইতোমধ্যে নিজেকে অতিরিক্ত সতেজ করেন নি?

তারপর টর্কের নির্ভুল হাসি এবং প্রতিবন্ধকের ওপাশ থেকে মিনটাকা তার কথা শুনতে পারল যে এতোক্ষণে তার পান শুরু করেছে। তখন সে নাজার বিদ্রুপের জবাব দিল, এসো, ভাই (কাজিন), অতি নিষ্ঠুর হয়ো না। আমার সাথে এক বোল নাও। আমাদের সকল চেষ্টার সফল পরিণতির আনন্দে চলো আমরা পান করি। আমার মাথার মুকুটের উদ্দেশ্য পান কর এবং এটা শীঘ্রই তোমার মাথায় আশীর্বাদ দিবে। নাজার কণ্ঠ একটু নরম হলো। এক বছর আগে যখন আমরা প্রথমে পরিকল্পনা শুরু করি, এসব তখন অসম্ভব মনে হয়েছিল। অনেক দূরের মনে হয়েছিল। তখন আমরা অবমূল্যায়িত ও উপেক্ষিত ছিলাম, সিংহাসন থেকে ততো দূরে ছিলাম যতোটা চাঁদ পৃথিবী থেকে দূরে। আর এখন আমরা এখানে, আমরা দুই ফারাও আমাদের হাতের মুঠোয় সমগ্র মিশর ধরে আছি।

এবং দুই ফারাও আমাদের চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল, টর্ক যোগ করল। ট্যামোস তোমার তীর তার হৃদপিন্ডে ধারণ করে এবং অ্যাপেপি, বিশাল শূকরটা, তার নিজের চর্বিতে তার সন্তানদের সাথে ভাজা হয়ে। সে বিজয়ীর হাসিতে চিৎকার করল।

ট্রে এতো জোরে না। তুমি অসতর্ক হচ্ছে, এমন কি যদিও আমরা একা, নাজা তাকে কোমল স্বরে শাসন করল। এটা বরং সবচেয়ে ভালো হয় যদি আমরা এসব নিয়ে আর আলোচনা না করি।

আমাদের গোপন এ ক্ষুদ্র রহস্যগুলোকে ট্যামোসের সাথে তার সমাধি ভ্যালি অফ কিংস ও অ্যাপেপির সাথে নদীর তলদেশে হারিয়ে যেতে দাও।

এসো! টর্ক জোর করল। আমরা যা কিছু অর্জন করেছি তার সব কিছুর জন্যে আমরা এক সাথে পান করি।

যা আমরা অর্জন করেছি তার জন্যে। নাজা সম্মত হলো। এবং ঐ সব যা সামনে করবো।

আজ মিশর এবং ভবিষ্যতে অ্যাশিরিয়া, ব্যাবিলন এবং দুনিয়ার বাকি সব স্থানের ধন-সম্পদ ও অর্থ; আমাদের পথে কিছুই দাঁড়াতে পারবে না।

মিনটাকা টর্কের হৈ-চৈ করে গলধকরণ শুনল। তারপর তার কানের সমতলে দেয়ালের উপর একটা পতনের আওয়াজ হলো। এটা তাকে হতভম্ব করে দিল এবং সে লাফ দিয়ে পিছন সরল। তারপর বুঝল টর্ক শূন্য মদের পাত্রটি পাটাতনের উপর জোরে নিক্ষেপ করে ওটাকে টুকরো টুকরো করল। এরপর সে সজোরে ঢেকুর তুলে বলল, এখনো একটা বাঁধা রয়ে গেছে। ট্যামোসের বাচ্চাটা এখনো তোমার মুকুট তার মাথায় ধরে রেখেছে।

যখন কথাটা শুনল মিনটাকা আবেগের ঘূর্ণি স্রোতে পড়ে গেল যা তাকে কখনো একদিকে তারপর অন্যদিকে টানতে লাগল এবং তাকে ঘুরাল যতক্ষণ না তার ইন্দ্রিয় শক্তি নাড়া খেল। সে ভয়ে ভয়ে শুনেছে যখন নিরাবেগভাবে তারা তার পিতা, তার ভাইদের এবং ফারাও ট্যামোসের হত্যার কথা আলোচনা করেছে কিন্তু তারা নেফারের ব্যাপারে যা বলেছে তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না।

বেশি দিনের জন্য নয়। নাজা বলল, আমি থেব পৌঁছেই তার দিকে দৃষ্টি দেবো। সব আয়োজন হয়ে আছে।

মিনটাকা তার চিৎকার রোধ করার জন্য দুই হাতে মুখ চেপে ধরল। তারা ততটাই ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে নেফারকে হত্যা করতে চলছে যেভাবে তারা অন্যদের করেছে। তার মনে হলো হৃদপিণ্ড থেমে যেতে চাইছে এবং সে অসহায়ত্ব অনুভব করল। সে একজন বন্দী এবং সাহায্যের জন্যে কোন বন্ধু নেই। সে নেফারের কাছে সতর্ক বাণী পাঠানোর কোন একটা পথ চিন্তা করে বের করার চেষ্টা করল কারণ এই মুহূর্তে তার জন্য তার ভালোবাসা কতখানি তা সে অনুভব করল; তাকে রক্ষার করতে তার ক্ষমতার মধ্যে যে কোন কিছু সে করতে প্রস্তুত।

করুণ সিংহটা তোমার জন্যে তোমার কাজটি করে নি। টর্ক বলল, তার পরিবর্তে শুধু তাকে একটু খামচে দিয়েছে।

পশুটা ভালোভাবেই তা করেছে। নেফারের শুধু একটু ধাক্কা দরকার এবং আমি তার পিতাকে যে রকম চাকচিক্যময় শেষকৃত্যানুষ্ঠান দিয়েছি তার চাইতেও বেশি দীপ্যমান শেষকৃত্য তাকে দিব।

তুমি সব সময় একজন সহৃদয় ব্যক্তি, টর্ক মাতালের মতো মুখ টিপে হাসল।

যেহেতু আমরা ট্যামোসের ছোকরা সম্পর্কে কথা বলছি তাহলে চল আমরা অ্যাপেপির যে সন্তান রয়ে গেছে তার সম্পর্কে এবার বলি। নাজা বিনয় বিগলিত পরামর্শ দিল।

ছোট রাজকন্যার বাকি সবার সাথে পুড়ে যাওয়ার কথা ছিল, তা নয় কি? আমরা যেমনটা পরিকল্পনা করেছিলাম?

আমি তা পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, টর্কের কণ্ঠ ভারি হয়ে গেল। সে তাকে আরেক বোল মদ ঢালতে শুনল।

অ্যাপেপির কোন বীজকে বাঁচিয়ে রাখা বিপদজনক, নাজা তাকে সতর্ক করল। সামনের বছরগুলোতে মিনটাকা সহজেই বিদ্রোহের প্রতিমা হয়ে উঠতে পারে, এমনকি গণঅভ্যুত্থানের কেন্দ্রবিন্দুও। তার থেকে মুক্ত হও এবং তা শীঘ্রই।

তুমি কেন একই কাজটা ট্যামোস কন্যাদের সাথে করছো না? তারা এখনো কেন বেঁচে আছে? টর্ক আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে তাকে চ্যালেঞ্জ করল।

আমি তাদের বিয়ে করেছি, নাজা বলল, এবং হেজারেট ইতোমধ্যে আমার ভক্ত হয়ে গেছে। আমি তাকে যা বলব সে তাই করবে। আমাদের একই অভিলাষ। সে আমার মতই তার ভাই নেফারকে সমাহিত হতে দেখতে প্রস্তুত। সে মুকুটের ..জন্য প্রায় ততোটাই কামুক যতোটা আমি আমার রাজ ক্ষমতার জন্যে ব্যাকুল।

একদিন আমার মধুকর যখন তার ছোট্ট গোলাপি পদ্মফুলে অনুভূতি জাগাবে, মিনটাকাও তেমনি হবে। টর্ক ঘোষণা করল।

মিনটাকার দেহ কেঁপে উঠল। আরো একবার তার মাথা ঘুরে গেল। সে টর্কের দম্ভের কথা ভেবে এতোটাই আতংকিত হয়ে গেল যে সে প্রায় নাজার পরের কথাটা শুনতে ব্যর্থ হচ্ছিল।

অর্থাৎ সে তোমার হচ্ছে, ভাই, নাজা বলল কিন্তু তার কণ্ঠ বিস্মিত নয়। সে আমার অভিরুচির জন্য খুব দুর্দমনীয় অভদ্র কিন্তু আমি আশা করি তুমি তাকে উপভোগ করবে। তবে তার ব্যাপারে সতর্ক থেকো, টর্ক, তার মধ্যে একটা বন্যতা রয়েছে। তোমার ভাবনার চাইতেও সে বেশি সামলাতে পারে।

আমি শীঘ্রই তাকে বিয়ে করব এবং দ্রুত তাকে বাচ্চা দেব, টর্ক তাকে নিশ্চয়তা দিল। তার পেটের মধ্যে একটা বোঝা নিয়ে সে আরো সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য হবে। কিন্তু পিছনের অনেক বছর ধরে সে আমার নিতম্বের মাংসে আগুন ধরিয়েছে যা তার কচি মিষ্টি রস ছাড়া নিভবে না।

তোমার মাথা তোমার বেশি ব্যবহার করা উচিত এবং তোমার শূল কম। নাজার কণ্ঠ আত্মসমর্পিত। আমরা আশা করি যে আমাদের তোমার এই আবেগের জন্যে অনুশোচনা করতে হবে না। মিনটাকা তার পায়ের নিচের ডেকে কাঁচ ক্যাচ শব্দ শুনল যখন নাজা উঠে দাঁড়াল। তাহলে প্রভু তোমাকে ভালোবাসুক ও রক্ষা করুক। নাজা চলে যেতে উদ্যত হলো। আমাদের দুজনেরই অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আমাদের কাল আলাদা হতে হবে কিন্তু নীলের বন্যার পর মেমফিসে যে পরিকল্পনা ইতোমধ্যে করা আছে সে বিষয়ে চলো বসি।

*

বালাসফুরা থেকে নদীর ভাটিতে বাকিটা পথ যাওয়ার সময় মিনটাকা টর্কের জাহাজে বন্দী থাকল। জাহাজটা চলার সময় সে স্বাধীন ভাবে ডেকে যেতে পারত, কিন্তু যখন তারা পাড়ে ভিড়তো তখন সে তার কেবিনে বন্দী থাকত এবং দরজায় একজন রক্ষী থাকতো।

প্রায়ই এমন হতো কারণ চলার পথের প্রতিটি মন্দিরে টর্ক তীরে নামত বলীদান দেওয়ার জন্য এবং মন্দিরের দেব বা দেবীকে তার মিশরের সিংহাসনে আরোহণের জন্য ধন্যবাদ দিল। যদিও এটা এখনো কেউ জানত না টর্ক ঐসব প্রভুদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করল যাদের সাথে শীঘ্রই সে তাদের সমকক্ষ হয়ে সর্ব দেবতার মন্দিরে যোগ দেবে।

এসব বাধ্যবাধকতা ছাড়াও নিজেকে মিনটাকার অনুগ্রহ ভাজন করে তোলার জন্য টর্কের প্রয়াস অধ্যবসায়ের সাথে চলল। প্রতিদিন কমপক্ষে সে তাকে একটা চমৎকার উপহার দিত। একদিন সে তাকে একজোড়া খোঁজা না করা ঘোড়া উপহার দিল যা সে জাহাজের ক্যাপ্টেনকে দিয়ে দিল। পরের দিনের উপহারটা ছিল একটা সোনার পাতে মোড়া ও অলংকারে সজ্জিত রথ যা তার পিতা লিবিয়ার রাজার কাছ থেকে দখল করেছিল। মিনটাকা ওটা প্রাসাদের গার্ডদের কর্নেলকে দিল যে অ্যাপেপির বলিষ্ঠ সমর্থক ছিল। অন্যদিনের উপহারটা ছিল পূর্বের থেকে আনা সিল্কের জমকালো রোল এবং আরো একদিন একটা মনিরত্ন খচিত রুপার বাক্স সে পেল যা সে তার দাসীদের মাঝে বিতরণ করে দিল। তারপর যখন তারা তাদের জমকালো পোশাকে সজ্জিত হলো মিনটাকা তাদেরকে টর্কের সামনে হাজির করল। এসব রুচিহীন টুকরোয় দাসদেরই ভালো মানায়, সে অবজ্ঞা ভরে মন্তব্য করল, কিন্তু কোন মর্যাদাসম্পন্ন মহিলাকে নয়।

তবে নতুন ফারাও ছিল নাছোড়বান্দা এবং যখনই তারা নিম্ন রাজ্যের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছিল, সে একটা ঘাসে ঢাকা ও উর্বর জমি নির্দেশ করল যা প্রায় পূর্ব তীরে এক ক্রোশ পর্যন্ত বিস্তৃত।

ওটা এখন আপনার মহামাননীয়া, আমার তরফ থেকে আপনার জন্য উপহার। এটা আপনার মালিকত্বের দলিল। টর্ক একটা নির্বোধের মতো হাসি দিয়ে দলিলটা তার হাতে তুলে দিল।

মিনটাকা সেদিনই অনুলেখকদের ডেকে পাঠিয়ে ক্রীতদাসদের মুক্ত করার আইন পাস করলো এবং ঐ সম্পত্তির অধীনস্ত সকল দাসদের মুক্ত করে দিল। দ্বিতীয় আরেকটা দলিল করে সকল সম্পত্তি মেমফিসের হাথোর মন্দিরে দান করে দিলো।

যখন মিনটাকা তার সহচারীদের সাথে জাহাজের পিছন দিকে নেচে গেয়ে, বাও খেলে এবং ধাঁধা বলে তার দুঃখ ও বেদনা দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল তখন টর্ক চেষ্টা করল তার সাথে খেলায় যোগ দিতে। সে তার সাথে দুজন মেয়েকে নাচতে বাধ্য করল, তারপর মিনটাকার দিকে ঘুরে বলল, আমাকে একটা ধাঁধা দিন, রাজকন্যা! সে অনুনয় করল।

কিসের গন্ধ মোষের মতো, মোষের মতো যা দেখতে এবং যখন গজলা হরিণের সাথে তিরিং বিড়িং লাফায় তখন মেষের মতোই সে করে? সে মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করল। মেয়েরা ফিক করে হেসে উঠল।

টর্ক ভ্রুকুটি করল ও উত্তর দিতে না পেরে রাঙা হয়ে উঠল। আমাকে ক্ষমা করুন, এটা আমার জন্য খুব কঠিন। বলে সে ধীর ও দৃঢ় পদক্ষেপে তার অফিসারদের সাথে যোগ দিতে চলে গেল।

পরের দিন সে অপমানটা ক্ষমা করে দিল তবে ভুলল না। তারপর যখন জাহাজটা সামালুত গ্রামে নোঙ্গর করল, সে মিনটাকাকে আনন্দ দেওয়ার জন্যে একটা বিনোদনকারী যাদুকর ও গায়কের দলকে জাহাজে আসতে আদেশ দিলো। একজন যাদুকর ছিল খুব চমৎকার, দ্রুত অনেক কথা বলতে পারত। যাই হোক, তার যাদু ছিল নীরস ও তাতে চাতুর্যতার অভাব ছিল। কিন্তু যখন মিনটাকা জানতে পারল যে দলটি হাথোরের শান্তি চুক্তির সুবিধা নিচ্ছে এবং নদীর উজানে থেবস্ যাচ্ছে এবং সেখানে তারা দক্ষিণের ফারাও-এর রাজসভায় খেলা দেখাবে, মিনটাকা তাদের প্রদর্শনীতে শিহরিত হল, বিশেষ করে ঐ যাদুকরের যাদুতে যার নাম লাসো। প্রদর্শনীর পর সে তাকে তার সাথে শরবত ও মধু মাখা খজুর খাওয়ার। আমন্ত্রণ জানাল। সে যাদুকরটিকে ইশারায় তার পায়ের কাছে রাখা কুশনে বসতে বলল। যাদুকরটি শীঘ্রই তার প্রতি তার ভয় জয় করল এবং আরো কিছু গল্প বলে তাকে আনন্দ দিল, সাথে সাথে সেও আনন্দে শিহরিত হল।

কথার ফাঁকে এবং তার দাসীদের হাসির আড়ালে সে লাসোকে বিখ্যাত ম্যাগোস টাইকে একটা সংবাদ দিতে বলল, বিশেষ করে যখন তারা থেবস্ পৌঁছবে। তার সৌজন্যতায় পরিতৃপ্তি হয়ে লাসো সাথে সাথে তাতে রাজি হয়ে গেল। মিনটাকা প্রথমে তাকে কাজটির গোপনীয়তা ও সূক্ষ্মতার বিষয়টা বোঝাল। তারপর একটা ছোট কাগজের রোল তার হাতে তুলে দিল যা সে দ্রুত তার চিটনের ভেতর লুকিয়ে ফেলল।

যখন সে বিনোদনকারী দলটিকে তীরে যেতে দেখল তখন তার খুব স্বস্তি হল। টাইটা ও নেফারকে সতর্ক করার কোনো একটা উপায় সে পাগলের মতো খুঁজছিল। কাগজের চিরকুটের মধ্যে নেফারের জন্যে তার ভালোবাসার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত রয়েছে সেই সাথে আছে তাকে হত্যার নাজার মনোবাসনার বিষয়ে সতর্ক বাণী এবং তার বোন হেজারেটকে যেন সে বিশ্বাস না করে কারণ সে তাদের শত্রুদের দলে ভিড়েছে। সে তার পিতা ও ভাইদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণটাও লিখেছে। সর্বশেষ সে বলেছে কিভাবে টর্ক তাকে বিয়ে করার পরিকল্পনা করছে, তার সাথে নেফারের সম্পর্কের কথা ও তার অসম্মতির কথা জেনেও এবং বলেছে যেন নেফার তার সমস্ত শক্তি দিয়ে এটা ঘটা রোধ করে।

সে হিসেব করে দেখল যে দলটির থেব পৌঁছতে দশদিন সময় লাগবে এবং নিজেকে ডেকের উপর হাথোরের উদ্দেশ্যে মাথা নত করে প্রার্থনা করল যাতে তার সতর্কবাণী পৌঁছতে বেশি দেরি না হয়। বালাসফুরার ঐ ভয়ংকর ঘটনার পর সে এই প্রথম রাতে ভালো করে ঘুমালো। সকালে তাকে উৎফুল্ল দেখাল এবং তার দাসীরা তাকে সুন্দর দেখাচ্ছে বলে মন্তব্য করল।

ডেকের সামনে তার সাথে সকালের নাস্তা করার জন্যে টর্ক তাকে জোর করল। তার বাবুর্চি একটা ব্যয়বহুল ভোজ দিল। সেখানে আরো বিশ জন অন্য মেহমান ছিল এবং টর্ক মিনটাকার পাশে বসল। সে প্রতিজ্ঞা করল যে সে তার মনের উদ্যমতাকে কোনো ভাবেই কাউকে বুঝতে দিবে না। ইচ্ছাকৃতভাবে সে টর্ককে এড়িয়ে গেল। বরং তার আকর্ষণ ও বুদ্ধিমত্তা বাকি অতিথিদের দিকে ছড়িয়ে দিল।

খাবার শেষে টর্ক মনোযোগ আকর্ষণের জন্য হাততালি দিল এবং একটা নিরবতা নেমে এল। আমার পক্ষ থেকে রাজকুমারী মিনটাকার জন্য একটা উপহার আছে।

ওহ! না! মিনটাকা কাঁধ উঁচু করল। এসব দিয়ে আমি কী করবো?

আমার বিশ্বাস আমার অন্য সামান্য উপহারগুলোর চেয়ে এটা আপনার নিকট অরো বেশি রুচিসম্মত হবে। টর্ককে এতো আত্মতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট দেখাচ্ছিল যে তার অস্বস্তি হলো।

আপনি ভুল জায়গায় ভদ্রতা দেখাচ্ছেন, আমার লর্ড। সে তাকে তার নতুন অসংখ্য রাজকীয় পদবীর কোনটায় সম্বোধন করে ডাকল না। আপনার হাজার প্রজা যুদ্ধ ও প্লেগের শিকার হচ্ছে এবং আমার চেয়ে তাদের ওসব অনেক বেশি প্রয়োজন।

এটা একটু অন্য রকম উপহার যার মূল্য একমাত্র আপনিই দিতে পারেন, সে তাকে নিশ্চয়তা দিল।

সে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত তুলল। আমিই তাহলে একমাত্র রাজ প্রজা। সে তার শ্লেষ লুকানোর কোনো চেষ্টা করল না। যদি আপনি জোর করেন তাহলে তো কোন কিছুতে আপনাকে না করা আমার কাছে অনেক দূরের বিষয়।

টর্ক আবার তার হাততালি দিল এবং তার রক্ষীদের দুজন জাহাজের অগ্রভাগ থেকে একটা বড় কাঁচা চামড়ার থলে নিয়ে ডেকে নেমে এল। ওটার গন্ধ খুব কড়া ও বিশ্রী ছিল। কয়েকজন মেয়ে বিরক্তিতে চিৎকার করল কিন্তু মিনটাকা অভিব্যক্তিহীন রইল যখন দুজন সৈন্য তার সামনে এসে থামল।

টর্ক তাদের উদ্দেশ্যে মাথা নোয়াতেই তারা থলের মুখ বাঁধা রশিটা খুলে ভেতরের বস্তুটা ডেকের উপর ঢেলে দিল। মেয়েরা ভয়ে চিৎকার করে উঠল এবং এমনকি কয়েকজন লোকও চিৎকার করল। মানুষের একটা কাটা মাথা তক্তার উপর দিয়ে গড়িয়ে মিনটাকার পায়ের কাছে এল এবং সেখানেই পড়ে রইল। সে ওটার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কালো লম্বা চুলগুলো কালচে রক্তে শুকিয়ে শক্ত হয়ে আছে।

লাস! মিনটাকা ফিসফিসিয়ে অপটু যাদুকরের নাম নিল যার উপর সে তার বার্তা থেবসে পাঠানের ভরসা করেছিল।

আহ! আপনি তার নাম স্মরণ করলেন। টক হাসল। তার কৌশল আপনাকে তেমনটাই মুগ্ধ করেছে যেমনটা ওগুলো আমাকে করেছে।

গ্রীষ্মের গরমের মাথাটা পচতে শুরু করেছে এবং গন্ধটাও তীব্র। দ্রুত মাছি চলে এল এবং খোলা অক্ষি গোলকের উপর দিয়ে তারা হাঁটতে লাগল। মিনটাকার বমি এল এবং সে তা গিলতে পারল না। সে লাসোর লাল দুঠোঁটের মধ্য দিয়ে এক টুকরো প্যাপিরাসের কাগজ বেরিয়ে থাকতে দেখল।

হায়, মনে হয় তার শেষ কৌশলটা ছিল সব থেকে মনোমুগ্ধকর। টর্ক ঝুঁকে রক্তে মাখা কাগজের টুকরোটা তুলে নিল। সে কাগজটা উঁচিয়ে ধরল যাতে মিনটাকা তা দেখতে পায়। কাগজটা তার নিজের সীল মোহর বহন করছে। তারপর টর্ক প্যাপিরাসটা কাঠ কয়লার বড় কড়াইয়ের মধ্যে ফেলে দিল যার উপর ভেড়ার কাবাব তৈরি হচ্ছিল। কাগজা দ্রুত পুড়ে গেল এবং ছাইগুলো কুচকে ধূসর পাউডারে পরিণত হলো।

টর্ক ইশারায় মাথাটা সরিয়ে ফেলতে বলল। একজন সৈন্য এটার চুল ধরে তুলে আবার তা থলেতে ভরে নিয়ে চলে গেল। সবাই অনেকক্ষণ আতংকিত নীরবতায় বসে রইল শুধুমাত্র একটা মেয়ে আস্তে আস্তে ফোঁপাচ্ছিল।

আপনার মহামান্য কীর্তিমান স্বর্গীয় পিতার স্মৃতি নিশ্চয়ই ভাগ্য সম্বন্ধে যা তার জন্য অপেক্ষা করেছিল সে ব্যাপারে পূর্ববোধ ছিল। টর্ক তাকে গম্ভীরভাবে সম্বোধন করল। মিনটাকা এতো বিমর্ষ যে সে কোন উত্তর দিল না। তার করুণ মৃত্যুর পূর্বে তিনি আমার সাথে কথা বলেছেন। তিনি আপনাকে আমার নিরাপত্তায় দিয়ে গেছেন। আমি তাকে কথা দিয়েছি এবং আমি এটা একটা পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছি। আপনাকে আর অন্যে কারো কাছে নিরাপত্তার জন্যে আবেদন করতে হবে না। আমি ফারাও টর্ক উরুক, আপনার বিশ্বস্ত ও প্রতিজ্ঞাকারী অভিভাবক। সে তার ডান বাহু তার নিচু করা মাথার উপর রাখল এবং অন্য হাতে আরেকটি কাগজের ক্রৌল তুলে ধরল।

এটি আমার রাজ আজ্ঞাপত্ৰ, যা দ্বারা অ্যাপেপির বংশধর রাজকন্যা মিনটাকার সাথে ট্যামোস বংশধর ফারাও নেফার সেটির বিবাহের বিষয়টি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। অধিকন্তু এটা রাজকন্যা মিনটাকার সাথে ফারাও টর্ক উরুকের বিয়ের ঘোষণা ধারণ করে। এ দাবি ফারাও নেফার সেটির পক্ষ থেকে লর্ড নাজা কর্তৃক অনুমোদিত। সে কঠোর নির্দেশনা দিয়ে ক্রৌলটা তার প্রাসাদ সরকারের হাতে দিল। এই আজ্ঞাপত্রের এক হাজার কপি তৈরি করে মিশরের প্রতিটি স্থানে প্রতিটি রাজ্যে প্রদর্শন করুন।

তারপর দুই হাতে ধরে সে মিনটাকাকে দাঁড় করাল, আপনি আর বেশিক্ষণ একা থাকবেন না। আমি এবং আপনি অসিরিসের পূর্ণিমার পূর্বেই স্বামী ও স্ত্রী হবো।

*

তিনদিন পর ফারাও টর্ক উরুক তার মিলিটারি রাজধানী নিম্ন রাজ্যের অ্যাভ্যারিসে পৌঁছল এবং সাথে সাথে অক্লান্ত উদ্যোমে রাজ্যের সকল বিষয়ে নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করল এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করল।

হাথোর শান্তি চুক্তি এবং সামনের দিনগুলোতে শক্তি ও উন্নতির ওয়াদার কথা শুনে জনগণ আনন্দে উন্মত্ত হয়ে গেল। যাই হোক কিছু বিভ্রান্তি ও হতাশার সৃষ্টি হল যখন নতুন ফারাও প্রথমে আইন প্রণয়ন করে আরো সংখ্যক লোক আর্মিতে নেয়ার ঘোষণা দিল। এটা দ্রুতই পরিষ্কার হয়ে গেল যে সে পদাতিক বাহিনী দ্বিগুণ এবং আরো এক হাজার নতুন যুদ্ধ রথ তৈরি করতে চায়।

প্রশ্ন করা হয়েছিল তবে তা টর্কের সামনে নয়, সে এখন আবার নতুন কোন শত্রু খুঁজে পাওয়ার আশা করছে যেখানে মিশর আরো একবার একত্রিত হলো এবং শান্তি এল। শস্যক্ষেত থেকে মজুর কমল এবং আর্মিতে যোগ দেওয়ার ফলে খাবারের ঘাটতি দেখা দিল। ফলে বাজর দর বাড়তে লাগল। নতুন রথ, অস্ত্র এবং মিলিটারি মালপত্রের ব্যয়ের জন্য কর বাড়ানো অপরিহার্য হয়ে পড়ল। একটা গুঞ্জন উঠল যে অ্যাপেপি তার রাগ সত্ত্বেও বর্তমান এই বদরাগী, কর খেকো ও প্রভুদের ঘৃণাকারী শাষকের ন্যায় এতোটা খারাপ ছিল না যতোটা তারা টর্ককে মনে করেছে।

সপ্তাহের মধ্যে টর্ক অ্যাভারিসের প্রাসাদকে আরো বড় ও চকচকে করার আদেশ দিল। সে তার স্ত্রী রাজকন্যা মিনটাকাকে নিয়ে এখানে থাকার ইচ্ছা পোষণ করল। প্রকৌশলীরা হিসেব করে দেখল যে এ কাজে দুই লাখ স্বর্ণমুদ্রা লাগতে পারে। গুজব আরো তীক্ষ্ণ হলো।

এদিকে সদ্য অসন্তোষের ব্যাপারে সচেতন হয়েই টর্ক সর্ব প্রভুর মন্দিরে তার নিজের অলৌকিকতা ও উত্থানের দাবি করল। সপ্তাহের মধ্যে অ্যাভারিসে সেথের মন্দিরের পাশে পছন্দসই স্থানে সে নিজের মন্দির তৈরির কাজ শুরু করল। তার মন্দির যেন তার প্রভু ভাই এর মন্দিরের চেয়ে দীপ্যমানতায় ছাড়িয়ে যায় এ ব্যাপারে টর্ক সংকল্পবদ্ধ ছিল। প্রকৌশলীরা হিসেব কষে দেখল মন্দিরের কাজ শেষ হতে কমপক্ষে পাঁচ হাজার শ্রমিকের পাঁচ বছর লাগবে এবং আরো দুলাখ স্বর্ণের দরকার হবে।

বিদ্রোহ শুরু হলো ব-দ্বীপ এলাকায়, যেখানে এক রেজিমেন্ট পদাতিক বাহিনী যাদের এক বছরের বেশি সময় ধরে বেতন দেওয়া হয় নি। তারা তাদের অফিসারদের হত্যা করল এবং অ্যাভারিসের দিকে এগোতে লাগল। তারা স্বৈরচারের বিরুদ্ধে জনগণকে জাগার আহ্বান জানাল এবং তাদের সাথে যোগ দেবার ডাক দিল।

তিনশ রথ নিয়ে টর্ক মানাশির নিকট তাদের সাথে সাক্ষাৎ করল এবং প্রথমেই তাদের টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলল।

সে পাঁচশ বিদ্রোহীকে খোঁজা করল এবং শূলে চড়াল। একটা ভয়ংকর বনের ন্যায় মানাশি গ্রামের আদূরে অর্ধক্রোশ দূরে তাদের রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধ করে সাজিয়ে রাখা হল। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দানকারীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে অনুশোচনা বর্ণনা করার জন্যে অ্যাভারিসের উদ্দেশ্যে টেনে নিয়ে যাওয়া হল। দুর্ভাগ্যবশত: সে যাত্রায় কোন বন্দীই জীবিত রইল না। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাদের আর মানুষ বলে চেনা গেল না। রুক্ষ ভূমির উপর দিয়ে টেনে নেওয়ার সময় তাদের বেশিরভাগ চামড়া ও মাংস ছিঁড়ে গেল। মাংসের ছিন্ন টুকরো ও হাড়ের টুকরো বিশ ক্রোশ রাস্তা জুড়ে বন্য কুকুর, শিয়াল ও মাংসখোকা কাকদের আনন্দ দানের জন্য ছড়িয়ে রইল।

কেবল কয়েকশ বিদ্রোহী এই নৃশংস হত্যাকান্ড থেকে পালাতে পারল এবং মরুতে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। টর্ক তাদের পূর্বের সীমান্তের বেশি ধাওয়া করার কষ্ট করল না কারণ এই তুচ্ছ বিষয় ইতোমধ্যে তার অনেক মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে এবং তার বিয়েটা একমাস দেরি করিয়ে দিয়েছে। অ্যাভারিসে ফেরার জন্যে সে হিংস্র রকমের অধৈর্য আর তাই সে তিনজোড়া ঘোড়া ব্যবহার করল ফিরতে।

যখন টর্ক বাইরে ছিল, মিনটাকা দুইবার থেবসে টাইটার কাছে বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। তার বার্তাবাহকদের প্রথমজন ছিল হারেমের একজন খোঁজা মোটা, দয়ালু কালো লোক যাকে সে তার পুরো জীবন ধরে চেনে। উভয় রাজ্যে খোঁজাদের মধ্যে একটা বিশেষ বন্ধন রয়েছে আর এখনতো তা এক জাতি বা দেশে পরিণত হয়েছে। এমনকি এ বছরগুলোতে যখন দুই রাজ্য আলাদা ছিল, সোথ যা ঐ খোঁজার নাম টাইটাকে বিশেষ সম্মান করে গেছে এবং সে তার বন্ধু ও বিশ্বস্ত।

কিন্তু টর্কের গুপ্তচরেরা সর্বব্যাপী ছড়ানো ও বিদ্রি ছিল। তাই সোথও অ্যাসউতে পৌঁছাতে পারে নি। তাকে মৃত অবস্থায় চামড়ার থলেতে ভরে ফিরিয়ে আনা হয়। যখন তার মাথাটা ফুটন্ত পানির বড় কড়াইতে ডুবিয়ে দেওয়া হয় তখনই সে মারা গিয়েছিল। তার খুলির মাংস সিদ্ধ হয়ে খুলে গিয়ে রঙিন ও চকচকে হাড় বেরিয়ে এসেছিল। তার অক্ষি কোঠরদ্বয় দামী পাথরে পূর্ণ করে মিনটাকাকে ফারাও টর্কের পক্ষে থেকে সে খুলি বিশেষ উপহার হিসাবে দেওয়া হলো।

ঐ ঘটনার পর মিনটাকা আর নিজে থেকে নতুন কাউকে তার বার্তা বাহক হিসেবে খুঁজে নেয় নি এবং এভাবে আর কাউকে নির্মম মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় নি। তথাপি তার একজন লিবিয়ান দাসী, থানা, যে মিনটাকার ভালোবাসার গভীরতা সম্পর্কে জানত তার বার্তা বহন করার জন্য এগিয়ে এসেছিল। সে মেয়েদের মধ্যে ততোটা সুন্দর নয় কারণ তার এক চোখ টেরা ছিল এবং নাকটা ছিল বড়। কিন্তু সে আনুগত্যে ছিল সৎ ও বিশ্বস্ত। তার পরামর্শে মিনটাকা তাকে একজন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দিল যে পরবর্তী দিনে থেব ভ্রমণ করবে। লোকটা থানাকে সাথে নিয়ে গেল, কিন্তু তিন দিন পর সে অ্যাভারিসে ফিরে এল, সীমান্ত প্রহরীদের রথের পাশের কাঠামোর সাথে কব্জি ও গোড়ালি বাঁধা অবস্থায়।

মানশি থেকে যাবার পথে টর্ক থানার সাথে মিলিত হয়। সে তাকে মৃত্যুদন্ড দিল, তবে ভালোবাসাময় মৃত্যু। তাকে একটি রেজিমেন্টের হাতে তুলে দেওয়া হল যারা মানাশিতে দায়িত্বে ছিল। চারশর বেশি লোক তার সাথে আনন্দে মেতে উঠল, তততক্ষণ পর্যন্ত যখন তিন দিন পর সূর্যাস্তের সময় সে রক্তপাতে মারা গেল।

তিন দিন ধরে মিনটাকা বিরামহীনভাবে তার জন্য কাঁদল।

*

ফারাও টর্ক উরুক ও রাজকন্যা মিনটাকা অ্যাপেপির বিয়ে হিকস্ রীতি অনুযায়ী সম্পন্ন হল, যা ছিল হাজার বছর পুরানো এবং পূর্বদিকের এক হাজার ক্রোশ দূরের বৃহৎ বৃক্ষহীন অ্যাশিরিয়া পর্বত পেরিয়ে কোন এক প্রান্তর থেকে তা এসেছিল, যেখান থেকে তাদের পূর্ব পুরুষেরা এ মিশর দখল করতে এসেছিল।

বিয়ের দিনের সকালে ২০০ জন আত্মীয়স্বজন ও রাজকুমারী মিনটাকার শোমশ্রেণীর সদস্যরা রাজকীয় প্রাসাদে জড়ো হলো। এ প্রাসাদেই সে অ্যাভারিসে ফেরার পর থেকে বন্দী হয়ে আছে। রক্ষীদের পক্ষ থেকে কোন বাধা ছিল না, এমনকি তারা কোন আকস্মিক হামলার আশংকাও করছিল না।

তার গোষ্ঠীর সদস্যরা রাজকন্যা মিনটাকাকে তাদের সাথে করে পূর্ব দিকে নিয়ে চলল। কান ফাটানো চিৎকার, মুগুর ও কাঠের অস্ত্রের ঝনঝনানি আওয়াজে কানে তালা লাগার উপক্রম। যে কোন ধারালো অস্ত্র অনুষ্ঠানে ছিল নিষিদ্ধ।

বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হলে বরের নিজের স্বজাতির একটা দল এগিয়ে এল তার নেতৃত্ব দিতে। এদিকে চিতা বাঘের অনুসারী লোকেরা পালিয়ে যাওয়ার আবশ্যকতা দেখাল না এবং যখনই তারা দৃষ্টি সীমায় এলো তারা পিছু ঘুরল এবং উল্লাসিতভাবে নিজেরা দ্বন্দ্বে যুক্ত হলো। যদিও কোন তলোয়ার ও ছুরি আনার অনুমতি ছিল না তবুও দুজন আঘাত পেল এবং কিছু লোকের খুলি ফেটে গেল। এমনকি বরও কাঁটা ও ক্ষতের হাত থেকে বাঁচল না। শেষে টর্ক তার প্রত্যাশিত পুরষ্কার দাবি করল। সে এক হাতে মিনটাকার কোমর ধরে টেনে নিল এবং তার রথে উঠাল।

মিনটাকার বাধায় ন্যূনতম অভিনয় ছিল না এবং সে তার হাতের নখ দিয়ে টর্কের চেহারার ডান দিকে আঁচড় কাটল যা অল্পের জন্যে তার চোখে লাগল না এবং সে স্থান থেকে বের হওয়া রক্তের ফোঁটা তার পোশাকের দীপ্তি নষ্ট করে দিল।

সে আপনাকে অনেক যোদ্ধ-বাজ সন্তান দিবে। তার সমর্থকরা মিনটাকার বাধার হিংস্রতায় চিৎকার করে প্রশংসা করল।

হবু বধূর তেজস্বিয়তায় আনন্দে দাঁত বের করে হেসে টর্ক বিজেতার মতো তাকে নিয়ে মন্দিরে ফিরে চলল। সেখানে তার নির্দেশে নতুন নিয়োগ পাওয়া যাজকেরা শেষ নিয়ম পালনের অপেক্ষায় আছে।

মন্দিরটা এখনো ভিত্তি প্রস্তরের গর্ত এবং লম্বা পাথরের স্তম্ভের স্তূপে উন্মুক্ত। কিন্তু এসব কিছুই বিবাহে যোগ দেওয়া অতিথিদের খুশি কিংবা বরের উচ্ছ্বাস কোন কিছুকে স্নান করতে পারল না। জলজ উদ্ভিদের তৈরি ছাউনির নিচে তারা দাঁড়াতেই প্রধান যাজক মিনটাকাকে টর্কের সাথে একটা ঘোড়ার রশি দিয়ে বেঁধে দিল।

অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত পর্যায়ে টর্ক তার প্রিয় বৃদ্ধ ঘোড়ার গলা কাটল, যা ছিল একটা চমৎকার সুন্দর বাদামী রঙের স্টালিয়ন। এর দ্বারা সে বোঝালো যে সে তার জন্য মূল্যবান সম্পদের চেয়েও তার নববধূকে সে বেশি মূল্য দেয়। যখন পশুটা মাটিতে পড়ে লাথি মারছিল ও তার কাটা বৃহৎ ধমনী দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিল তখন লোজন হর্ষ ধ্বনি করে উঠল এবং নব দম্পতিকে পুষ্প রথে তুলে দিল।

টর্ক প্রাসাদের উদ্দেশ্যে রথ চালালোলা এবং তার এক হাত নববধূকে শক্ত কর ধরেছিল যেন সে কোন পালানোর সুযোগ না পায়। আর্মিরা রাস্তায় সারিবদ্ধ হয়ে রথটার চারপাশে জড়ো হয়ে থাকল এবং ককপিটে উদ্দেশ্যে চলল সবার উপহার। অন্যেরা টর্কের সামনে মদের বোল ধরল এবং সে তা গলাধরণ করল। এর বেশির ভাগই সে তার পোশাকে ফেলল যা তার কেটে যাওয়া গালের রক্তের সাথে মিশে গেল।

যখন তারা প্রাসাদে পৌঁছল টর্ক তখন রক্ত ও লাল মদে ভিজে একাকার। সে ভ্রমণ ও তার নববধূকে পাওয়ার যুদ্ধে ঘর্মাক্ত এবং চেলাই মদের নেশায় উন্মাদ ও চোখ তার বন্য কামনায় সিক্ত।

সে লোকজনের মধ্য দিকে মিনটাকাকে তাদের নতুন কক্ষে নিয়ে গেল। দরজার দাঁড়ানো রক্ষীরা বিয়ের অতিথিদের তাদের উন্মুক্ত তরবারি দিয়ে পিছু হটালো। তারা কোন গন্ডগোল করল না কিন্তু প্রাসাদ ঘিরে রইল এবং বরকে উৎসাহ দিল ও কনেকে উপদেশ দিল অশ্লীল ভাষায়।

কক্ষে প্রবেশ করেই টর্ক মিনটাকাকে বিছানায় বিছানো সাদা ভেড়ার চামড়া চাদরের উপর ছুঁড়ে মারল। তারপর দুহাত দিয়ে নিজের তলোয়ারের বেল্ট খোলার যুদ্ধে নামল। মিনটাকা বিছানায় পড়ে ভয়ে গর্ত থেকে বের হওয়া খরগোশের ন্যায় উঠে বসল।

হঠাৎ দৌড়ে সে ছাদের উপর যাওয়ার দরজার উদ্দেশ্যে ছুটে গেল এবং তা খুলার চেষ্টা করল। টর্কের নির্দেশে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করা। পাগলের মতো সে তার হাতের নখ দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করল কিন্তু দরজাটা ছিল শক্ত ও পুরু এবং এমনকি তার আঘাতে ওটা কাঁপল না পর্যন্ত।

তার পিছনে টক অবশেষে তার তলোয়ারের বেল্ট থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারল এবং খাপটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সে একটা কর্কশ শব্দ করে অস্থির ভাবে তার দিকে এগিয়ে গেল। তোমার যতো ইচ্ছে লড়াই করো, সুন্দরী! সে অস্পষ্ট করে বলল। যখন তুমি লাথি মার ও চিৎকার কর তখন তা আমার শরীরের আগুন ধরিয়ে দেয়।

এক হাতে তাকে বাহুবদ্ধ করে ধরে অন্য হাতটা মিনটাকার বুকের উপর এনে তার স্তন ধরে সে জোরে চাপ দিল। সেথের দোহাই, কি মিষ্টি আর রসালো পাকা ফল হবে এটি! আরো জোরে জড়িয়ে ধরে সে তাকে চাপ দিতে লাগল। তার দুস্তনে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল এবং চোখে পানি এসে গেল। মিনটাকা ছাড়া পেতে জোড়াজুড়ি করল। দ্বিতীয়বার তুমি আর কোন ছলচাতুরি করে পার পাবে না সুন্দরী।

সে এক হাতে তার কোমর পেঁচিয়ে ধরে শূন্যে তুলে তাকে বিছানায় নিয়ে গেল।বেবুন! মিনটাকা চিৎকার করে উঠল। তুই একটা শিম্পাঞ্জি জানোয়ার।

একটা মিষ্টি ভালোবাসার গান গাও তো, সোনামনি। আমার দেহ মন আনন্দে ভরে উঠে যখন আমি শুনি তুমি কতটা আমায় চাও।

টর্ক আবার তাকে নিচে ছুঁড়ে দিয়ে তার পেশিবহুল হাত দিয়ে মিনটাকার স্তন চেপে ধরল। তার মুখটা মিনটাকার ওষ্ঠ থেকে মাত্র ইঞ্চি দূরে। দাড়ির শক্ত খোঁচা মিনটাকার গালে জ্বালা ধরিয়ে দিল। টর্কের মুখ থেকে মদের গন্ধ ভূস ভূস করে বের হচ্ছে। টর্ক জোরে হেসে উঠে একটা আঙুল চালিয়ে মিনটাকার কাঁধ থেকে জামার বাঁধনটা আলগা করে ফেলল। এক টানে রেশমি গাউনটা খুলে নিচে ফেলে দিল।

তারপর সে তার স্তন ধরে জোরে কচলাতে লাগল, বারেবার যততক্ষণ পর্যন্ত না তার নরম মাংসের দলাটা বেরিয়ে এল। স্তনের বোঁটা ধরে টান দিতেই তা রক্তিম বর্ণ ধারণ করল নিমিষে। অপর হাত দিয়ে তখন সে তার নগ্ন পেটে বুলাতে লাগল বিচ্ছিরি রকম করে। তারপর অনেকটা খেলাচ্ছলে সে তার নিমাঙ্গের উদ্দেশ্যে হাত নামাতে উদ্যত হল। অনেকটা জোর করে তার উরু সন্ধিভেদের উদ্দেশ্যে আঙুল দিয়ে বিনুনি চালাল। কিন্তু মিনটাকা সহজে ভেদ্য নয়। দুপা চেপে সে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা চালাল এবং তাকে প্রত্যাখ্যান করল।

হঠাৎ দানবটা তখন তার পেটের উপর চড়ে বসল। তার দেহের ভারে মিনটাকার প্রায় অসাড় হবার উপক্রম। সে বাধা দেবার ক্ষমতা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে। মিনটাকা চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেল টর্ক পুরোপুরি নগ্ন। তার বিশাল বপু এবং যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত দেহটা দেখে মিনটাকার ভয়ে কান্না এসে গেল।

তখনও সে মিনটাকার উপর চাপ দিয়ে যাচ্ছে। টর্ক তাকে আরো জোরে চেপে ধরল, এবার তার পেটের সাথে মিনটাকার পেট এবং তার উন্মুক্ত স্তন তার প্রশস্ত বুকের চাপে পিষে যেতে চাইছে। ভয়ে গুঙ্গিয়ে উঠে সে আরো অনুভব করল তার মোটা শক্ত লিঙ্গটা তার নিমাংশের গোপন অংশে সজোরে প্রবেশ করতে চাইছে।

সে এবার শুধু তার আত্মসম্মান ও সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য লড়াই-ই করল না, সেই সাথে তার জীবন বাঁচানোরও চেষ্টা করল। কেননা টর্কের বিশাল দেহের নিচে সে প্রায় মারা যাচ্ছে। সে তার মুখে কামড় দেবার চেষ্টা করল, কিন্তু তার ছোট ধারালো দাঁত তার দাঁড়িটা ঢাকল কেবল। সে তার পিঠ খামচে ধরল এবং নখের আঁচড়ে টর্কের পিঠের চামড়া উঠে এল কিন্তু মনে হল না যে সে তা অনুভব করেছে।

দুজনই প্রচণ্ড ঘামছিল, টর্ক বেশি। হঠাৎ করে সে উবু হয়ে নিজের মুখটা তার মুখের উপর চেপে ধরল জোড়ে। তার নাক ও ঠোঁট ঘষতে লাগল। ফলে দৃঢ়ভাবে চেপে রাখা তার চোয়ালে তার ঠোঁট ও নাক কেটে গেল। মিনটাকা তার মুখে রক্তের স্বাদ পেল এবং চোখ-মুখে অন্ধকার নেমে আসতে চাইল।

খুল মাগী! টর্ক তার উপর আরো জোরে চেপে বসেছে। তোর ঐ গরম দরজা খোল আমি তাতে ঢুকতে চাই। বলে আরো চাপ প্রয়োগ করল এবং মিনটাকা বুঝল সে আর বেশিক্ষণ প্রতিরোধ করতে পারবে না। জানোয়ারটা বড় বেশি ভারি ও শক্তিশালী।

হাথোর, আমাকে সাহায্য কর! সে তার চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করল। প্রিয়। দেবী, এমনটা হতে দিও না, আমাকে রক্ষা কর।

হটাৎ টর্ককে গোঙিয়ে উঠতে শুনল এবং মিনটাকা তার চোখ খুলে তাকাল। তার চেহারা স্ফীত ও রক্ত জমলে যেমন কালো হয় তেমন দেখাচ্ছে। পিঠটা বাঁকাতে দেখল এবং যেন ব্যথায় সে ককিয়ে উঠল। তার চোখ প্রশস্ত, দৃষ্টিহীন ও রক্তাভ। ভয়ংকর রকম করে মুখ খোলা।

মিনটাকা বুঝল না কি ঘটছে। মুহূর্তের জন্য সে ভাবল দেবী নিশ্চয়ই তার অনুরোধ শুনেছেন এবং তার অলৌকিক বান দিয়ে টর্কের হৃদপিন্ডে আঘাত করেছেন।

তারপরই হঠাৎ সে অনুভব করল একটা তপ্ত জলধারা তার পেটের উপর ছলকে ছড়িয়ে পড়েছে, এতো তপ্ত যে তা তার কোমল ত্বক যেন পুড়িয়ে দেবে। অবশেষে বর্ষণটা একসময় থামল এবং সে তার থেকে মুক্ত হবার কথা ভাবল। কিন্তু সে ছিল খুব ভারি ও শক্তিশালী। টর্ক শান্ত ভাবে তার উপর পড়ে রইল এবং মিনটাকাও নড়ার সাহস করল না, যদি আবার কোন বিপত্তি ঘটে।

দীর্ঘক্ষণ দুজনে চুপচাপ শুয়ে রইল, যতোক্ষণ না প্রাসাদের দেয়ালের বাইরে অপেক্ষায়মান জনতার চিৎকার তাদের সচেতন করল।

টর্ক নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে বলল, তুমি আমাকে লজ্জা দিলে। তুমি আমার বীর্য বৃথা করে দিয়েছ।

পুরোপুরি বিষয়টা বোঝার আগেই টর্ক তাকে ঘাড়ের পিছন ধরে সাদা ভেড়ার চামড়ার মধ্যে তার রক্তমাখা চেহারা চেপে ধরল সজোরে।

কোন ব্যাপার না, আমি তোমার নাকের রক্ত দিয়ে তা চালিয়ে নেব।

বলেই তাকে একপাশে সরিয়ে তার রক্তাক্ত চেহারা থেকে সাদা চাদরে লাগা লাল দাগটা পরখ করল গম্ভীর সন্তুষ্টির সাথে। তারপর নগ্ন অবস্থায়ই দরজার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে দাঁড়াল সে এবং লাথি মেরে দরজা খুলল। উজ্জ্বল দিনের আলোয় চাদরটা জনতা উদ্দেশ্যে দোলালো।

মিনটাকা নিজেকে সামলে বিছানার চাদর দিয়ে শরীর মুছল এবং তার শরীরের দাগগুলো পর্যবেক্ষণ করল। তার ভয় হিংস্রতায় রূপ নিল।

তলোয়ারের খাপটা টর্ক যেখানে ফেলেছিল তা সেখানেই রয়েছে। নীরবে সে বিছানা থেকে নেমে চকচকে ব্রোঞ্জের ফলাটা খাপ থেকে বের করে হামাগুড়ি দিয়ে ছাদে যাওয়ার দরজার নিকট গিয়ে দরজার বাজুর সাথে নিজেকে মিশিয়ে লুকালো।

বাইরে টর্ক জনতার উল্লাস স্বীকার করছিল এবং দাগওয়ালা ভেড়ার চামড়াটা উড়াচ্ছে সবাইকে দেখাতে। সে এটা পছন্দ করেছে। কোন একটা চিৎকার করা মন্তব্যের জবাব দিয়ে বলল। যখন আমি তার সাথে শেষ করলাম তখন সে ছিল প্রশস্ত এবং তাকে লাগছিল ডেল্টার ভেজা ঝোঁপের ন্যায় স্নিগ্ধ ও সাহারার মতো উষ্ণ।

মিনটাকা ভারি তলোয়ারের বাট তার মুঠিতে শক্ত করে ধরে নিজেকে একত্রিত করল।

বিদায় আমার বন্ধুরা, টর্ক চেঁচাল। আমি সেই মিষ্টি ফলের আরো এক কামড় নেওয়ার জন্যে আবার যাচ্ছি।

মিনটাকা তার খালি পায়ের আওয়াজ মেঝেতে শুনল এবং তারপর তার ছায়া দেখতে পেল প্রবেশ মুখে। দুই হাতে তলোয়ারটা শক্ত করে ধরে পেটের পরিমাণ উচ্চতায় নির্দিষ্ট করল সে।

টর্ক ঘরে প্রবেশ করতেই সে নিজেকে আরো দৃঢ় করল এবং তারপর নিজের সব শক্তি দিয়ে তাকে আঘাত করতে ছুটে গেল তার তল পেট বরাবর লক্ষ্য করে।

একদা অনেক দিন আগে যখন সে তার পিতার সাথে শিকার করছিল তখন সে তাকে একটা বিশাল পুরুষ চিতাবাঘ শিকার করতে দেখেছে যেটি তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে ছিল অসচেতন। বিড়ালটা তার পিতার ধনুকের টাং আওয়াজেই সচেতন হয়ে গিয়েছিল এবং তীরটা তাকে আঘাত করার আগেই একপাশে লাফিয়ে সরে যায়। টর্কও বিপদ ও জীবন সম্পর্কে একই রকম প্রবৃত্তি ধারণ করে।

আঘাতটা তখনো তার কাছে পৌঁছায়নি তার আগেই সে মোচড় দিয়ে তীক্ষ্ম ব্রোঞ্জের প্রান্ত থেকে সরে গেল। চামড়া না কেটে কিংবা এক ফোঁটা রক্ত না ঝড়িয়ে যা তার পাকস্থলির এক আঙ্গুল দূর দিয়ে সরে গেল। এদিকে টর্ক তখন সাথে সাথে তার বিশাল এক থাবায় মিনটাকার উভয় কব্জি ধরে ফেলল। সে হাতটা পিষল যতোক্ষণ না সে তার হাড়ে ব্যথা পেল এবং অস্ত্রটা মেঝেতে ছিটকে পড়ল।

সে তাকে ঘরের ভেতর টেনে নিতে নিতে একটা বিশ্রী শব্দ করে হাসতে লাগল। এলোমেলো ও ঘামে ভেজা বিছানার উপর সে তাকে ছুঁড়ে মারল। তুমি এখন আমার স্ত্রী, সে তার উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল। তুমি আমার আর সব একটা ঘোটকী কিংবা পোষা স্ত্রী কুকুরের মতই আমার সম্পত্তি। তোমাকে অবশ্যই আমাকে মান্য ও সম্মান করা শিখতে হবে।

মিনটাকা লিনেন কাপড়ে চেপে মুখ উপুড় করে শুয়ে আছে, তার দিকে তাকাতে তার রুচি হচ্ছিল না। টর্ক বিছানার পাশে পড়ে থাকা তলোয়ারের খাপটা তুলে নিল। এই আনুগত্যের পাঠটা জানা থাকলে তা তোমার নিজের জন্যে ভালো হয়। এখনকার একটু ছোট কষ্ট আমাদের দুজনকে পরবর্তী দুঃখ ও বেদনার হাত থেকে অনেকাংশে রক্ষা করবে।

সে খাপটা তার ডান হাতে নিল। মসৃণ চামড়া, স্বর্ণ ও অন্যান্য ধাতুর সুন্দর পাথরে সজ্জিত খাপটা সে তার নগ্ন পায়ের উপর এনে দোলালো। ফলে তার শুভ্র চামড়ার উপর তা একটা আঁচড় কেটে গেল এবং সেখানে উজ্জ্বল লাল রঙের দাগ ফেলল। মিনটাকা এতোটাই হত-বিহ্বল হল যে জোরে চিৎকার করে উঠল।

সে তার ব্যথায় হাসল এবং আবার খাপটা তুলে নিল। সে গড়িয়ে তার থেকে দূরে সরে যাবার চেষ্টা করল কিন্তু পরের আঘাতটা তার উঠানো ডান হাতে এবং পরেরটা তার কাঁধে আঁচড় বুলাল পর্যয়ক্রমে। এবার সে নিজেকে চিৎকার করা থেকে নিবৃত করল। বরং একটা তীর্যক হাসি দিয়ে দাঁত চেপে তার কষ্ট লুকানোর চেষ্টা করল এবং বন বিড়ালের মতো তার দিকে থুথু ছুঁড়ে মারল। এবার আরো জোরে তাকে আঘাত করল টর্ক।

টর্ক তাকে বিছানা থেকে নিচে ফেলে দিল। মিনটাকা পুনরায় তার হাত থেকে বাঁচতে মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে দূরে সরে যেতে চাইল, কিন্তু টর্ক তাকে অনুসরণ করে তার পিঠ, কাধ ও নিতম্বে চাবুকের মতো আঘাত চালিয়ে গেল। তাকে নিয়মিত ছন্দে আঘাত করতে করতে সে তার উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, তুমি আর কখনোই আমার দিকে হাত উঠাতে পারবে না, হাহ! দম পুরিয়ে যেতেই আবার জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, পরের বার যখন আমি তোমার কাছে আসব, হাহ্! তখন তুমি একজন স্নেহপরায়ণ স্ত্রীর মতই ব্যবহার করবে, হা-হা! নইলে তখন আমি আমার চারজন লোক দিয়ে তোমাকে ধরে তোমার উপর সওয়ার হবো হা-হা! তারপর যখন আমার দেহের স্বাদ মেটানো শেষ হবে তখন আমি তোমাকে আবার এভাবে পেটাব, হাহ্!

সে তার চোয়াল দৃঢ়ভাবে চেপে রাখল যখন আঘাত তার উপর বৃষ্টির মত পড়ল এবং তা সহ্য করে গেল যততক্ষণ পারল। কিন্তু এক সময় সে আর যুদ্ধ করতে পারল না। এদিকে তা দেখে হয়তো করুণা দেখিয়ে টর্কও সরে গেল, ভারি দম নিতে নিতে।

টর্ক তার দাগওয়ালা ও ধুলোয় মাখা জামা গায়ে চাপিয়ে কোমরে তলোয়ারের খাপটা বেঁধে খাপের মধ্যে ভরল তলোয়ারটা। তখনও ওটা মিনটাকার রক্তে ভিজে আছে এবং দ্রুত দরজার দিকে সে বেরিয়ে গেল। বের হবার পূর্বে সে থামল ও তার দিকে ফিরে তাকাল। একটা কথা মনে রেখো, স্ত্রী, পোষ না মানলে আমি আমার ঘোটকীগুলোর ঘাড় ভেঙ্গে দেই, সে বলল। অথবা, সেথের কসম তারা আমার হাতে মৃত্যুবরণ করে। কথাটা বলেই সে ঘুরে চলে গেল।

মিনটাকা ধীরে ধীরে তার মাথা তুলে তার চলে যাওয়া দেখল। কথা বলার মতো তার অবস্থা ছিল না, তার পরিবর্তে সে তার মুখে থুথু জড়ো করে টর্কের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে মারল। তার স্ফীত মুখ থেকে ছিটকে পড়া রক্ত মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল।

মিনটাকার চামড়ার ক্ষতের আঘাত শুকাতে আইসিস পূর্ণিমা পার হবার পরও অনেক দিন চলে গেল এবং ক্ষতগুলো তার মসৃণ কোমল ত্বকের উপর সবুজাভ হলুদ বর্ণ ধারণ করল। হয় ইচ্ছে করে না হয় ভাগ্য শুনে টর্ক তার কোন কোমল দাঁত ফেলে দেয়নি, কোন হাড় ভাঙেনি অথবা তার মুখ মন্ডলে কোন দাগ ফেলেনি।

তাদের বিয়ের দিনের দুর্দশার পর থেকে সে তাকে একা রেখেছে। তখন থেকে অধিকাংশ সময় সে দক্ষিণে ক্যাম্প করেছে। এমনকি যখন সে অল্প সময়ের জন্য অ্যাভারিসে ফিরত তখনও টর্ক তাকে এড়িয়ে যেত। সম্ভবত সে তার দেওয়া অদৃশ্য ক্ষতগুলো থেকে দূরে থাকতে চেয়েছে অথবা তাদের বিয়েটা সফল করতে ব্যর্থ হয়েছে দেখে সে লজ্জা পেতো। মিনটাকা খুব গভীর ভাবে কারণটা নিয়ে ভাবল না। তবে কিছু সময়ের জন্যে যে সে তার বন্য আকর্ষণের হাত থেকে মুক্ত তাতেই সে খুশি।

রাজ্যের দক্ষিণে আরো গুরুতর বিদ্রোহ দেখা দিল, টর্ক বন্য ভাবে তাতে সাড়া দিল। সে বিদ্রোহীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং যারা তার বিরোধিতা করল তাদের সে হত্যা করল, তাদের সম্পত্তি জব্দ করল এবং তাদের পরিবারের বাকিদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দিল। লর্ড নাজা তার ভাই ফারাওকে সমর্থন দিতে এবং এই কাজে সহযোগিতার জন্যে দুই রেজিমেন্ট সৈন্য পাঠাল।

মিনটাকা জানত তিনদিন আগে টর্ক বিজেতার ন্যায় অ্যাভারিসে ফিরেছে কিন্তু এখনো সে তার দেখা পায় নি। সে কারণে সে দেবীকে ধন্যবাদ দিল, কিন্তু তা স্থায়ী হল না। চতুর্থ দিন তার কাছ থেকে হাজিরা এল। মিনটাকাকে রাজ্যের এক বিশেষ সভায় উপস্থিত থাকতে হবে। এতে গুরুত্বপূর্ণ যে নিজেকে তার তৈরি করতে মাত্র এক ঘণ্টা সময় দেওয়া হল। বার্তায় তাকে সতর্ক করা হয়েছে যে যদি সে আদেশ অবহেলা করে তবে দেহরক্ষী পাঠিয়ে তাকে সভাকক্ষে জোর করে নেওয়া হবে।

এটা ছিল প্রথম উপলক্ষ যেখানে সে তার বিয়ের পর লোকজনের সামনে যাচ্ছে। সতর্কতার সাথে সে প্রসাধন লাগাল যা তাকে সব সময়ের মতই সুন্দর দেখাল। পরিমিতভাবে সাজানো প্রাসাদের সভাকক্ষে প্রবেশ করে সে তার নির্দিষ্ট আসন রাণীর সিংহাসন গ্রহণ করল যা ছিল ফারাও-এর আসনের ঠিক নিচে। সে তার অভিব্যক্তি চেপে রাখার চেষ্টা করল এবং কাজকর্ম থেকে অমনোযোগী থাকতে চাইল। কিন্তু তার সংযম চলে গেল যখন সে রাজদূতকে চিনতে পারল। লোকটা

এখন দ্বৈত সিংহাসনের মধ্যখানে ভূ-লুষ্ঠিত হয়ে কুর্ণিশরত অবস্থায় আছে। মিনটাকা, আগ্রহ নিয়ে সামনে ঝুকল।

টর্ক রাজদূতকে গ্রহণ করে তাকে উঠতে বলল এবং তার বার্তা সভাসদের নিকট উপস্থাপন করার অনুমতি দিল।

যখন সে উঠে দাঁড়াল মিনটাকা দেখল লোকটি খুব আবেগাপ্লুত হয়ে আছে। একটা শব্দ উচ্চারণ করে নিতে তাকে কয়েকবার তার গলা পরিষ্কার করে নিতে হলো। অবশেষে সে কথা বলল এমন কাঁপা কাপ কণ্ঠে যে মিনটাকা প্রথমে বুঝতে পারল না সে কি বলছে। সে শব্দগুলো শুনল কিন্তু নিজেকে বিশ্বাস করতে পারল না।

মহামান্য ফারাও টর্ক উরুক, মিনটাকা অ্যাপেপি উরুক, রাজ্য সভার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, অ্যাভারিসের নাগরিক, ভায়েরা এবং এই পুনরায় সংযুক্ত মিশরের স্বদেশীরা; আমি দক্ষিণ থেকে একটি করুণ সংবাদ নিয়ে এসেছি। এই খবর আপনাদের বলার চাইতে আমি বরং যদি যুদ্ধে শত অগণিত লোকের সাথে এক বেওয়ারিশের মতো মরতে পারতাম তাতে শান্তি পেতাম। সে থামল এবং আবার কাশল। তারপর তার কণ্ঠ আরো শক্তিশালী ও পরিষ্কার হলো।

আমি থেব থেকে ভাটিতে দ্রুত যাত্রা করে এসেছি। রাত দিন চলেছি, শুধু বৈঠা বাহক বদলানোর জন্য থেমেছি, আমি মাত্র বার দিনে অ্যাভারিস পৌঁছেছি।

সে আবার থেমে হতাশার ভঙ্গিতে তার হাত ছাড়ল। গতমাসে হাপির অনুষ্ঠানের বিকেলে, তরুণ ফারাও নেফার সেটি যাকে আমরা সবাই ভালোবাসতাম এবং যার প্রতি আমরা খুব বিশ্বাস ও আশা রেখেছিলাম মারা গিয়েছেন। ভয়ংকর আঘাতের কারণে, যা তিনি ডাব্বায় পেয়েছিলেন যখন গবাদি পশু শিকারী সিংহটা শিকার করছিলেন। হতাশার দীর্ঘ নিঃশ্বাসে কক্ষটা ভরে উঠল। একজন সভাসদ তার চোখ ঢেকে নিরবে কাঁদতে লাগল।

রাজদূত নিরবতার মধ্যে বলে উঠল, উচ্চ রাজ্যের রাজ-প্রতিভূ লর্ড নাজা, বিবাহসূত্রে যে রাজকীয় ট্যামোস পরিবারের সদস্য এবং তিনি পরবর্তী অনুক্রমে মৃত ফারাও-এর স্থানে সিংহাসনে আরোহণ করেছেন। তিনি ভূমিকে তার কাইফান নামে পবিত্র করেন। অনন্ত কাল পর্যন্ত তার যে নামটি সমগ্র বিশ্ব এখন থেকে স্মরণ করবে তা হলো মহান ফারাও নাজা কাইফান।

মৃত ফারাও-এর দুঃখে কান্না এবং তার অনুক্রমীর জন্যে সোৎসাহ কলরবে কক্ষ ভরে উঠল। চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে মিনটাকা রাজদূতের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। প্রসাধনের নিচে সে চুনা পাথরের ন্যায় বিবর্ণ হয়ে গেল এবং তার চোখগুলোকে বড় ও করুণ করার জন্য কোন সুরমার প্রয়োজন হল না। তার চারপাশের পৃথিবী মনে হলো অন্ধকার হয়ে গেল এবং সে তার আসনে দুলতে লাগল। যদিও সে শুনেছে নেফারের মৃত্যু পরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক তবুও সে নিজেকে বুঝিয়েছিল যে এটা হয়ত হবে না। সে নিজেকে বিশ্বাস করিয়েছিল যে এমন কি তার সতর্কবাণী ছাড়াও নেফার টাইটার সাহায্যে হয়তো নাজা ও টর্কের ষড়যন্ত্রের জাল এড়িয়ে যাবে।

টর্ক তাকে লাজুক আত্মতৃপ্তির হাসি নিয়ে দেখছিল এবং মিনটাকা জানে সে তার কষ্টে আনন্দ পাচ্ছে। সে আর কোনো তোয়াক্কা করে না। নেফার আর নেই এবং এর সাথে তার ইচ্ছে ও প্রতিবন্ধকতার কারণ এবং নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার কারণও চলে গিয়েছে। সে সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এবং এক জন ঘুমন্ত হাঁটাকার মতো কক্ষ ছাড়ল। সে আশা করেছিল তার স্বামী তাকে ফিরিয়ে আনার আদেশ দিবে, কিন্তু সে তা করল না। সাধারণ দুঃখ-কষ্ট ও প্রলাপে অন্য অতিথিদের কয়েক জন তার চলে যাওয়াটা দেখল যারা তার ভয়ংকর দুঃখের ব্যাপারে সচেতন ছিল। তারা সবাই স্মরণ করল যে এক সময় সে মৃত ফারাও-এর বাগদত্তা ছিল।

মিনটাকা তিন দিন, তিন রাত পর্যন্ত না খেয়ে তার কক্ষে অবস্থান করল। সে শুধু পানির সাথে একটু ওয়াইন মিশিয়ে পান করল। সে সবাইকে তাকে ছেড়ে যাওয়ার আদেশ দিল, এমনকি তার দাসীদেরও। সে কারো সাথে সাক্ষাৎ করল না এমনকি চিকিৎসকের সাথেও না যাকে টর্ক তার কাছে পাঠাল।

চতুর্থ দিন সে হাহোরের প্রধান যাজিকাকে ডেকে পাঠাল। তারা একসাথে সারা সকাল অবস্থান করল। এবং যখন বৃদ্ধ মহিলাটি প্রাসাদ ত্যাগ করল সে তার ন্যাড়া মাথা তার সাদা ভোয়ালে দিকে ঢেকে রাখল শোকের চিহ্ন স্বরূপ।

পর দিন যাজিকা তার দুজন সহকারী সহযোগে এল যারা একটা বড় পান পাতার তৈরি ঝুড়ি বহন করছিল। তারা ঝুড়িটা মিনটাকার সামনে রাখল। তারপর তারা তাদের মাথা ঢাকল এবং উঠিয়ে নিল।

যাজিকা হাঁটুগেড়ে মিনটাকার পাশে বসে শান্ত ভাবে তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি নিশ্চিত যে দেবীর পথে তুমি আসতে চাও, বাছা?

আমার বেঁচে থাকার আর কোন কিছু নেই। মিনটাকা স্বাভাবিকভাবে বলল।

যাজিকা গতদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে এবং এখনও সে শেষ চেষ্টা করল। তুমি এখনো তরুণী…

মিনটাকা তার একটা সরু হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল। মাতা, আমি বেশি দিন হয় দুনিয়াতে আসিনি, কিন্তু সে অল্প সময়েই আমি বিশাল দীর্ঘ জীবনের মতোই অসহনীয় কষ্ট পেয়েছি।

যাজিকা তার মাথা নিচু করল এবং বলল, চল আমরা দেবীর কাছে প্রার্থনা করি। যখন সে প্রার্থনা করতে লাগল মিনটাকা চোখ বন্ধ করল। আশীবার্দি নারী, আকাশের মহান গো, দেবীর সঙ্গীত ও ভালোবাসা, সর্বদর্শী সর্ব ক্ষমতাবান, তোমার ভক্তদের প্রার্থনা শোন যারা তোমাকে ভালোবাসে। তাদের সামনে রাখা ঝুড়ির মধ্যে কিছু নড়ল এবং প্যাপিরাসের ঝোঁপের মধ্যে নদীর হাওয়া যেমন বয় তেমন একটা ক্ষীণ আন্দোলন হল। মিনটাকা তার পাকস্থলিতে একটা শীতল অনুভূতি অনুভব করল এবং জানত এটা মৃত্যুর প্রথম শিহরণ। সে প্রার্থনা শুনছিল কিন্তু তার চিন্তায় ছিল নেফার। সে স্পষ্টভাবে সে সময়ের কথা ভাবল যা তারা একসাথে কাটিয়েছে এবং তার মনে তার একটা ছবি এল যেন সে এখনো জীবিত! সে আবার তার হাসি দেখল এবং সে তার শক্ত সোজা ঘাড়ে মাথাটা ধারণ করে আছে। সে বিস্মিত হয়ে অনুভব করল পরের জীবনে সে কোথায় যেন ভয়ংকর ভ্রমণ করছে এবং তার নিরাপত্তার জন্যে সে প্রার্থনা করল। সে তার জন্যে সবুজ পাহাড়ের স্বর্গে পৌঁছানোর প্রার্থনা করল এবং সেই সাথে শীঘ্রই তার সাথে সেখানে যোগ দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করল। তোমাকে সেখানে অনুসরণ করবো, আমার হৃদয়। তার উদ্দেশ্যে ওয়াদা করল সে।

তোমার প্রিয় কন্যা মিনটাকা, মহান ফারাও টর্ক উরুর স্ত্রী তোমার কাছে ভিক্ষা চাচ্ছে সেই সবের জন্য যা তুমি এই দুনিয়ায় যারা অনেক কষ্ট পায় তাদের জন্য ওয়াদা করেছ। তাকে তোমার অন্ধকার দূতের সাথে মিলিত হওয়ার অনুমতি দাও এবং তার মাধ্যমে তোমার বুকে শান্তি খুঁজে পেতে, মহান হাথোর।

যাজিকা তার প্রার্থনা শেষ করল এবং অপেক্ষা করল। পরের কাজটা মিনটাকাকে একা করতে হবে। মিনটাকা তার চোখ খুলল এবং ঝুড়িটা পর্যবেক্ষণ করল যেন এটা সে প্রথমবারের মতো দেখছে। ধীরে সে দুই হাত বাড়িয়ে ঢাকনা তুলল। ঝুড়ির ভেতরটা অন্ধকার কিন্তু ভেতরে একটা নড়া-চড়া হচ্ছিল; যেন একটা ভারি অসাড় কিছু কুন্ডলী পাকাচ্ছিল ও খুলছিল, কালোর উপর কালোর ঝলক ঠিক যেন গভীর কুয়ার পানির মধ্যে তেল ছলকে পড়া।

ভেতরে উঁকি দেওয়ার জন্য মিনটাকা সামনে ঝুকল এবং ধীরে একটা রুলারের মতো মাথা তার সাথে সাক্ষাতের জন্য মাথা তুলল উদ্ধত ভঙ্গিতে। যখন প্রাণীটা আলোতে উঠে এল ও ফণা খুলল তখন ওটা একজন মহিলার কটির ন্যায় প্রশস্ত হল যেন কালো ও আইভরিতে সজ্জিত কোন বস্তু। চোখগুলো কাঁচের গোটার মতো জ্বলজ্বলে পাতলা, ঠোঁটগুলো বিদ্রুপাত্মক হাসিতে বাঁকানো, পালক তুল্য কালো জিহ্বা ওগুলো মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আছে। জীবটা বাতাসের স্বাদ গ্রহণ করছে এবং সেই সাথে মেয়েটার গন্ধও যে তার সামনে বসে আছে।

তারা একজন আরেকজনের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইল, মেয়েটা ও কোবরাটা, তাদের শত ধীর হৃদ্স্পন্দন সময় ধরে। এক সময় সাপটা পিছনে সরে গেল যেন আঘাত করবে। তারপর কোমলভাবে সোজা হল ঠিক একটা মারাত্মক ফুলের মতো দীর্ঘ হয়ে।

কেন এটা তার কাজ করবে না? মিনটাকা জিজ্ঞেস করল, কোবরাটার মত ঠোঁট বন্ধ করে। সে তার হাত বাড়িয়ে দিল এবং সাপটা তার মাথা ঘোরাল তার আঙুল দেখার জন্য যা তার দিকে এগিয়ে এসেছে। মিনকাটা কোন ভয় দেখাল না, আলতো করে সে কোবরার ফোলানো মাথার পিছনে আঘাত করল। আক্রমণ করার পরিবর্তে কোবরাটা মাথা নিচু করল ঠিক যেভাবে একটা বিড়াল তার মাথা আদর করার জন্যে এগিয়ে দেয়।

যা করতে হবে তা এটাকে করতে বাধ্য করুন। মিনিটাকা যাজিকার কাছে অনুনয় করল কিন্তু বৃদ্ধ মহিলা বিভ্রান্তিতে মাথা নাড়ল।

এমনটা আমি আর কখনো দেখিনি। সে ফিসফিসিয়ে বলল। তোমাকে অবশ্যই দূতটাকে তোমার হাত দিয়ে আঘাত করতে হবে। যা তাকে দেবীর উপহার সরবরাহ করতে বাধ্য করবে।

মিনটাকা তার হাত পিছনে নিয়ে মুঠি খুলে আঙুল প্রসারিত করল। সে সাপটার মাথা তাক করল এবং আঘাতের স্থানটা ঠিক করল। সে অবাক হয়ে কিছু শুনল এবং হাত নিচু করল। হতভম্ব সে অন্ধকার কক্ষের চারপাশে তাকাল, কোনার। ছায়ার দিকে তারপর সরাসরি যাজিকার দিকে।

আপনি কি আবার কথা বলবেন? সে জিজ্ঞেস করল।

আমি কিছুই বলি নি।

মিনটাকা আবার হাত তুলল, কিন্তু এই সময় কণ্ঠটা তার আরো কাছে আরো পরিষ্কার হয়ে বাজল। সে কিছুটা কুসংস্কাচ্ছন্ন ভয় নিয়ে তা চিনতে পারল এবং অনুভব করল তার ঘাড়ের পিছনের চুল খাড়া হয়ে যাচ্ছে।

টাইটা? সে ফিসফিসিয়ে চারপাশে তাকাল। সে তাকে তার পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় পাবে আশা করল। কিন্তু কক্ষটা তখনো খালি, শুধু তারা দুজন ঝুড়ি সামনে হাঁটুগেড়ে বসে আছে।

হ্যাঁ, মিনটাকা বলল যেন সে কোন প্রশ্ন অথবা নির্দেশনার উত্তর দিচ্ছে। সে নিরবতা শুনল ও দুবার মাথা ঝাঁকাল তারপর নরম সুরে বলল, ও, হ্যাঁ।

যাজিকা কিছুই শুনল না কিন্তু সে বুঝল এ আচরণে কোন যাদুর প্রভাব রয়েছে। সে আশ্চর্য হলো যখন দেখল কোবরাটা ঝুড়ির গভীরে ফিরে যাচ্ছে। সে তখন ঢাকনাটা লাগিয়ে উঠে দাঁড়াল।

আমাকে ক্ষমা করুন, মাতা, মিনিটাকা নরম করে বলল। আমি দেবীর পথে এখন যাচ্ছি না। এই পৃথিবীতে এখনো আমার জন্যে অনেক কিছু রয়ে গেছে।

যাজিকা ঝুড়িটা নিল এবং মেয়েটাকে বলল, দেবী তোমাকে আশীর্বাদ করুক এবং পরকালে তোমাকে অনন্ত জীবন দিন। মিনটাকাকে এক গম্ভীরতায় বসিয়ে সে দরজা দিয়ে ফিরে গেল। তার মনে হল সে এখনো একটা কণ্ঠস্বর শুনছে যা বৃদ্ধ মহিলা শুনতে পায়নি।

*

টাইটা নেফারকে ডাব্বা থেকে থেবস্ এ রেড শেফেন দিয়ে গভীর ঘুমের মধ্যে করে এনেছে। জাহাজ প্রাসাদের নিচে পাথরের জেটিতে ভিড়তেই টাইটা তাকে একটা ছোট পালকিতে করে তীরে নিয়ে গেল, সাধারণ মানুষের দৃষ্টির আড়াল করে। সমগ্র শহর জুড়ে ফারাও-এর মুমূর্ষ অবস্থার কথা জানাজানিটা মূর্খতার শামিল হবে। অতীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যখন রাজার মৃত্যুর খবর শহর বিষণ্ণ করেছে এবং সমগ্র রাজ্য বন্য হতাশায় ডুবে গিয়েছিল এবং তখন শস্য বিনিময়, দাঙ্গা লুটতরাজ এবং সমাজের আরো নানান নিয়ম-নীতির পতন হয়েছে।

একবার নেফার যখন প্রাসাদের রাজ কোয়ার্টারে নিরাপদে পৌঁছে যাবে, টাইটা তখন একাই তার নিরাপত্তার বিষয়ে কাজ করতে সমর্থ হবে। তার প্রথম কাজ হল বালকটির পায়ের ও তলপেটের ক্ষতগুলো পরীক্ষা করা ও পরিমাপ করা সেখানে কোন মারাত্মক পরিবর্তন এসেছে কিনা।

সবচেয়ে বড় ভয়ের বিষয় হচ্ছে তার পেটের ভুড়ি কেটে গেছে এবং ওগুলোর বর্জ্যে পেট ভরে গিয়েছে। যদি সত্যিই এমনটা হয়ে থাকে তবে তার দক্ষতা খুব কমই কাজে আসবে। সে সাবধানে ব্যান্ডেজটা খুলল। আলতোভাবে ভোলা মুখ দিয়ে ভেতর পরীক্ষা করল, ময়লার গন্ধ শুঁকে দেখল এবং ঐ রকম কোন দূষিত গন্ধ না পেয়ে স্বস্তি পেল। ভিনেগার এবং পুবের মশলার একটা মিশ্রণ ক্ষতের গভীরে সে

ঢুকিয়ে দিল। তারপর বিড়ালের নাড়ি দিয়ে সেলাই করে তা বন্ধ করে দিল এবং তার সর্বোচ্চ দক্ষতা দিয়ে স্থানটা ব্যান্ডেজ করল। লসট্রিসের স্বর্ণের কবজ দিয়ে সবগুলো স্পর্শ করল, লিনেন কাপড়ের প্রতি প্যাঁচে নাতির জন্যে তার দাদীর নিকট সুপারিশ করল।

পরের দিনগুলোতে টাইটা ধীরে ধীরে নেফারের উপর রেড শেফেন এর পরিমাণ কমাল এবং পুরস্কৃতও হল যখন নেফারের জ্ঞান ফিরল ও তার দিকে চেয়ে হাসল।

টাইটা আমি জানতাম তুমি আমার সাথে। তারপর সে চারপাশে তাকাল। ওষুধের কারণে এখনো সে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে আছে। মিনটাকা কোথায়?

যখন টাইটা তার অনুপস্থিতির কথা ব্যখ্যা করল, নেফারের হতাশা প্রায় স্পষ্ট হল এবং সে তা লুকিয়ে রাখতে পারল না। টাইটা তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল, এই দূরত্ব সাময়িক এবং শীঘ্রই তুমি দক্ষিণে অ্যাভারিস ভ্রমণ করার জন্য যথেষ্ট সুস্থ হয়ে উঠবে। আমরা নাজার কাছে ভ্রমণে যাওয়ার জন্যে ভালো একটা কারণ খুঁজে পাবো। টাইটা তাকে নিশ্চয়তা দিল।

মুহূর্তের মধ্যে নেফারের সুস্থতা বেগ পেল। পরের দিন সে উঠে বসল এবং রুটি ও ময়ূরের স্যুপ খেল। তারপর দিন সে ক্রাচে ভর দিয়ে কয়েক পা চলতে পারল যা টাইটা তার জন্য তৈরি করে দিয়েছে এবং তার খাবারে মাংস দিতে বলল। তার রক্ত যাতে গরম না হয় সে জন্যে টাইটা লাল মাংস নিষেধ করল তবে মাছ ও মুরগির মাংসের অনুমতি দিল।

পরদিন তার ভাইকে দেখতে মেরিকারা এল এবং দিনের বেশির ভাগ সময় তার সাথে কাটাল। তার উজ্জ্বল হাসি ও ছেলেমানুষি তাকে আনন্দ দিল। নেফার হেজারেটের কথা জিজ্ঞেস করল এবং জানতে চাইল কেন সে আসেনি। মেরিকারা এড়িয়ে যাওয়ার মতো করে উত্তর দিল এবং তাকে আরেকবার বাও খেলতে আমন্ত্রণ জানাল।

তার পরদিনই থেবস্ এসে পৌঁছল বালাসফুরার ভয়ংকর সে খবর। প্রথম খবরটা ছিল অ্যাপেপি ও তার পুরো পরিবার, মিনটাকা সহ আগুনে পুড়ে গেছে। নেফার দুঃখে আরো একবার ভেঙে পড়ল। তাকে রেড শেফেন-এর আরো একটা ডোজ টাইটাকে দিতে হল। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার পায়ের ক্ষত ফিরে এল দ্রুত। পরের কয়েক দিন তার অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগল এবং শীঘ্রই সে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে গেল।

টাইটা তার পাশে বসে রইল এবং নেফার জ্বরের ঘোরে কাঁপতে ও কথা বলতে লাগল অবিরত।

তারপর নিম্ন রাজ্য থেকে খবর এল মিনটাকা মর্মান্তিক ঘটনাটা থেকে বেঁচে গেছে কিন্তু তার পরিবারের বাকিরা মারা গেছে। যখন টাইটা এই চমৎকার খবরটা নেফারের কানে কানে বলল মনে হল সে বুঝল ও সাড়া দিল। পরদিন তাকে অপেক্ষাকৃত কম দুর্বল দেখাল এবং টাইটাকে বোঝাতে চেষ্টা করল যে সে মিনটাকাকে তার বন্দী দশা হতে উদ্ধার করার জন্য লম্বা ভ্রমণ করার পক্ষে যথেষ্ট শক্তিশালী। শান্তভাবে টাইটা তাকে ফেরাল কিন্তু ওয়াদা করল যেই মাত্র নেফার যথেষ্ট শক্তিশালী হবে তখনই সে তার সকল প্রভাব ব্যবহার করবে লর্ড নাজাকে রাজি করাবে তাকে যাওয়ার অনুমতি দিতে। এ লক্ষ্যের সংগ্রামে নেফার আরো একবার নতুনভাবে উজ্জীবিত হল। টাইটা তার জ্বর ও খারাপ অবস্থা দমিত হতে দেখল এবং অবশ্যই এর মূলে ছিল তার অদম্য ইচ্ছা শক্তি।

লর্ড নাজা উত্তর থেকে ফিরে এল এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হেজারেট প্রথম বারের ন্যায় নেফারকে দেখতে এল। সিংহ কর্তৃক তার আঘাত পাবার পর এই প্রথম। সে তার জন্য মিষ্টি মাংস, মৌচাকের বন্য মধু এবং রঙিন সোলোমনি পাথরের তৈরি আইভির খচিত পাথর ও কালো প্রবাল খচিত চমৎকার এটা বাও বোর্ড নিয়ে এল। সে ছিল মিষ্টি, অসীম ভদ্র এবং তার যন্ত্রণা সম্পর্কে সে জানতে চাইল। দেরি হবার জন্যে নিজেকে দোষ দিল।

আমার প্রিয় স্বামী উচ্চ রাজ্যের রাজ-প্রতিভূ কীর্তিমান লর্ড নাজা সপ্তাহ জুড়ে বাইরে ছিলেন; সে ব্যাখ্যা করল এবং আমি তার ফেরার জন্যে এতোটাই দুঃখী ছিলাম যে কারো সঙ্গ দেবার অবস্থায় ছিলাম না, অন্তত তোমার মতো অসুস্থ কারো। আমি ভীত ছিলাম যে আমার কষ্ট হয়তো তোমাকে আরো ব্যথিত করে তুলবে, আমার অসহায় প্রিয় নেফার। সে এক ঘণ্টা অবস্থান করল। তাকে গান শোনাল ও রাজ সভার কিছু ঘটনা বর্ণনা করল যার বেশির ভাগই কেলেংকারির। অবশেষে সে নিজের কারণ দর্শাল–

আমার স্বামী, উচ্চ রাজ্যে রাজ-প্রতিভূ, নিজের কাছ থেকে আমাকে বেশিক্ষণ দুরে সরিয়ে রাখতে পছন্দ করেন না। আমাদের মধ্যে অনেক ভালোবাসা, নেফার। সে একজন অসাধারণ মানুষ, তোমার ও মিশরের প্রতি উদার ও উৎসর্গিত। তোমাকে তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা দরকার যেমনটা আমি করি।

সে উঠে দাঁড়াল এবং তারপর যেন হঠাৎ মনে পড়ল এমনভাবে সে হালকা স্বরে বলল, তুমি এটা শুনে স্বস্তি পাবে যে ফারাও টর্ক উরুক ও আমার স্বামী উচ্চ রাজ্যের রাজ-প্রতিভূ তোমার সাথে ছোট হিকস্ বর্বর মিনটাকার বাগদান ভেঙ্গে দেয়ার ব্যাপারেও একমত হয়েছেন। আমি খুব দুঃখ পেয়েছিল যখন আমি শুনলাম এমন একটা অমাধুর্যতাপূর্ণ বিয়ে তোমার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার স্বামী উচ্চরাজ্যের রাজ প্রতিভূ প্রথম থেকেই এর বিরুদ্ধে ছিলেন, যেমনটা আমিও।

তার যাওয়ার পর নেফার দুর্বলভাবে বালিশে মাথা রাখল এবং চোখ বন্ধ করল। কিছুক্ষণ পর টাইটা ঘরে ঢুকলে সে চমকে উঠল। আবার সে পুনরাবস্থায় উঠে বসল। টাইটা তার ব্যান্ডেজ খুলল এবং দেখল তার ক্ষতগুলো আবারো স্ফীত হয়ে গেছে এবং তার গভীর ক্ষত থেকে ঘন ও হলুদ পুঁজ বের হচ্ছে। সারা রাত তার পাশে থেকে তার সব দক্ষতা ও ক্ষমতা দিয়ে তরুণ ফারাওকে ঘিরে থাকা শয়তানের ছায়া প্রতিহত করল সে।

ভোর বেলা জীবন্ত অবস্থায় পৌঁছে গেল নেফার। টাইটা তার অবস্থায় ভালো করেই জানে। বালকটির দুঃখ যা পুরোপুরি ব্যাখ্যা করার মতো না। হঠাৎ সে চমকে উঠল এবং দরজার সামনের হৈ চৈ এ রেগে গেল। সে প্রায় তাদের চুপ থাকাতে বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সাথে সাথে যখন লর্ড নাজার কর্তৃত্ব পূর্ণ কণ্ঠ শুনল যে রক্ষীদের সরে যাওয়া আদেশ দিচ্ছে তখন সে থেমে গেল। দ্রুত রাজাপ্রতিভূ কক্ষে প্রবেশ করল এবং টাইটাকে অভিবাদন না জানিয়ে নেফারের স্থির দেহের উপর ঝুঁকে তার বিমর্ষ-বিবর্ণ চেহারাটা দেখল ভালো করে। অনেকক্ষণ পর, সে সোজা হল এবং টাইটাকে ইশারা করল তার সাথে ছাদে যাওয়ার জন্যে।

টাইটা তার পেছনে বেরিয়ে এসে দেখল নাজা নদীর দিকে চেয়ে আছে। নদীর অপর পাড়ে এক দল রথ বাহিনী অনুশীলন করছিল। অদ্ভুত ভাবে হাহোরের চুক্তির পর থেকে যুদ্ধের প্রস্তুতি বেড়ে গিয়েছে। আপনি কি আমার সাথে কথা বলতে চান, আমার লর্ড? টাইটা জিজ্ঞেস করল।

নাজা তার দিকে ঘুরল। তার অভিব্যক্তি ছিল গম্ভীর। আপনি আমাকে হতাশ করেছেন বৃদ্ধ, সে বলল। টাইটা তার মাথা নিচু করল কিন্তু কোন উত্তর দিল না। আমি আশা করেছিলাম আমার সামনের রাস্তা, আমার লক্ষ্য যা প্রভুদের দ্বারা ভবিষ্যত্বাণী করা হয়েছে, ঐ দুর্ঘটনা দ্বারা এতোদিনে পরিষ্কার হয়ে যাবার কথা। কঠোর দৃষ্টিতে সে টাইটার দিকে চেয়ে রইল। এখন পর্যন্ত এটাই মনে হচ্ছে যে আপনি আপনার ক্ষমতার মধ্যে সব করেছেন যেন নেফার রক্ষা পায়।

পুরোটা অভিনয়। আমি আমার রোগীর যত্নের একটা ভান করছি। মূলত আমি আপনার ইচ্ছেটাই বাস্তবায়ন করছি। যেমনটা আপনি নিজেই দেখলেন ফারাও অতল গহ্বরে ঝুলছে। টাইটা অসুস্থ কক্ষ যেখানে নেফার শুয়ে আছে যে দিকে ইশারা করল। আপনি তার চতুর্দিকে ঘিরে থাকা ছায়া দেখতে পাবেন। আমার লর্ড, আমরা প্রায় আমাদের উদ্দেশ্যে সফল হতে চলেছি। কিছু দিনের মধ্যে আপনার সামনের রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। নাজা সন্তুষ্ট হল না। আমি আমার ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। সে সর্তক করল এবং ছাদ থেকে চলে এল সবেগে। কক্ষের বিছানার উপর স্থির অবয়টার দিকে না তাকিয়ে সে সোজা চলে গেল।

ঐ দিন নেফারের অবস্থা গভীর কোমায় নেমে গেল এবং ঘাম ও অসুস্থতার ঘোরে প্রলাপ বকে গেল অবিরাম। যখন টাইটা পরিষ্কার বুঝল যে পাটা তাকে গভীর যন্ত্রণা দিচ্ছে তখন সে ব্যান্ডেজ খুলল এবং দেখল সারা উরু ভয়ংকরভাবে ফুলে উঠেছে। সেলাইগুলো যা ক্ষতটাকে আটকে রেখে ছিল স্কিত হয়ে গেছে এবং গরম লাল মাংসের ভেতর পর্যন্ত কেটে গেছে। টাইটা জানে বালকটির পক্ষে কোন নড়াচড়া সহ্য হবে না, তার জীবন এখন এক রকম প্রায় একটা চিকন সুতার উপর ঝুলে রয়েছে। তার পরিকল্পনা যা সে গত কয়েক সপ্তাহ জুড়ে সতর্কভাবে করেছে এখন এর জোরালো কোন পদক্ষেপ না নিলে আর সামনে এগুবে না। এই অবস্থায় ক্ষত নিয়ে আরো দেরি করলে রক্ত মারাত্মক বিষাক্ত হবার ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু এখন তার সামনে আর কোন বিকল্প পথ নেই। সে তার সব যন্ত্রপাতির বের করল এবং ভিনেগারের মিশ্রণ দিয়ে নেফারের আহত পা ধুয়ে পরিষ্কার করল। তারপর জোর করে রেড শেফেন এর আরো এক ডোজ নেফারের ঠোঁটের মধ্যে চালান দিল এবং অপেক্ষায় রইল কখন ওষুধের ক্রিয়া শুরু হয়। সে হুরাস ও দেবী লসট্রিসের কাছে তাদের রক্ষার জন্যে প্রার্থনা করল। তারপর সে তার ছোট ছুরিটা তুলে নিল এবং একটা সেলাই কাটল যা ক্ষতের দুই অংশকে এক সাথে ধরেছিল।

যেভাবে মাংস খুলে গেল ও হলুদ পদার্থের বন্যা বইল তাতে টাইটা পিছু সরে এল। একটা স্বর্ণের চামচ ব্যবহার করে সে ভালোভাবে পরিষ্কার করল ক্ষতটা। হঠাৎ সে অনুভব করল ক্ষতের গভীরে থাকা কিছু একটা শক্ত জিনিস চামচে ঠেকছে। সে আইভরির চিমটা তাতে প্রবেশ করিয়ে বস্তুটাকে তার চোয়ালে শক্ত করে ধরল। অবশেষে চাপ দিয়ে বের করে আনল বস্তুটা। দরজার নিকট আলোতে নিয়ে বস্তুটা সে দেখল, যা হচ্ছে সিংহের থাবার একটা ভাঙ্গা টুকরো; তার কনিষ্ঠা আঙ্গুলের অর্ধেকের সমান লম্বা তা। সিংহ যখন তাকে আক্রমণ করেছিল তখন ওটা ভেঙে ওখানে রয়ে গেছে।

একটা সোনার পাইপ ক্ষতের মধ্য দিয়ে সে ভেতরের সব ময়লা বের করে তারপর পুনরায় ক্ষতটা ব্যান্ডেজ করে দিল দক্ষ হাতে। সন্ধ্যার মধ্যেই নেফারের সুস্থতা চমৎকার পর্যায়ে উন্নতি হল। পরদিন সকালে সে দুর্বল ছিল কিন্তু তার জ্বর চলে গিয়েছে। তাকে সুরক্ষিত করতে টাইটা তাকে একটা টনিক দিল এবং তার পায়ের উপর লসট্রিসের মাছলিটা রাখল। যখন সে দুপুরবেলা তার পাশে বসে তার সিদ্ধান্তগুলো এক সাথে করছিল, তখন দরজার কপাটে মৃদু আওয়াজ হল। দরজা খুলতেই মেরিকারা দ্রুত কক্ষে প্রবেশ করল। সে বিকারগ্রস্ত ও কাঁদছিল। টাইটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে তার পা জড়িয়ে ধরল।

তারা আমাকে এখানে আসতে বারণ করেছে। সে ফিসফিস করে বলল এবং তারা যে কারা তা তার ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হল না। কিন্তু আমি জানতাম ছাদে রক্ষীরা আছে এবং তারা আমাকে আসতে দিয়েছে।

ঠিক আছে আমার বাছা, শান্ত হও, টাইটা তার চুলে হাত বুলাল। অতো দুঃখ পেও না।

টাইটা তারা তাকে খুন করতে যাচ্ছে।

তারা কারা?

তারা দুজন, মেরিকারা আবার ফোঁপাতে শুরু করল এবং তার ব্যাখ্যা সু-সঙ্গ রইল না। তারা ভেবেছিল আমি ঘুমিয়ে গেছি অথবা ভেবেছিল আমি বুঝব না যা তারা আলোচনা করছে। তারা কখনো তার নাম বলেনি। কিন্তু আমি জানতাম তারা নেফারের কথা বলছে।

তারা কি বলেছে?

তারা তোমাকে ডেকে পাঠাবে। যখন তুমি নেফারকে একা ছেড়ে যাবে, তারা বলল বেশি সময় লাগবে না কাজ করতে। সে কান্নায় ভেঙে পড়ল, আমাদের নিজের বোন এবং ঐ ভয়ংকর দৈত্যটা।

কখন? টাইটা উত্তেজনায় মেরিকারার কাঁধ ধরে জোরে ঝাঁকি দিল।

শীঘ্রই, খুব শীঘ্র। তার কণ্ঠ কেঁপে উঠল।

তরা কি বলেছে কি ভাবে, রাজকন্যা?

নূম, ব্যাবিলন থেকে আসা শল্যবিদের মাধ্যমে। নাজা তাকে বলল যেন সে নেফারের নাসিকা দিয়ে একটা সরু সূঁচ তার মস্তিষ্ক বরাবর প্রবেশ করিয়ে দেয়। এতে কোন রক্তপাত কিংবা অন্য কোন সন্দেহ জন্মাবে না। টাইটা নূমকে ভালো করেই চেনে: তারা একে অপরের সাথে থেবসের লাইব্রেরিতে একবার তর্কে জড়িয়েছিল। বিষয়টা ছিল দেহের ক্ষতের সঠিক চিকিৎসা বিষয়ে। নূম টাইটার জ্ঞান ও দক্ষতার কাছে সে দিন হার মেনেছিল। সে টাইটার সুনাম ও জ্ঞানে ঈর্ষান্বিত। ঐ দিনের পর থেকে সে তার বিরুদ্ধচারী এবং চরম শত্রুও বটে।

নিজের জীবন বিপন্ন করেও আমাদের সতর্ক করার জন্যে ঈশ্বর তোমাকে নিশ্চয়ই পুরস্কৃত করবেন, মিরাকারা। কিন্তু এখন তোমাকে ফিরে যেতে হবে এবং তা তোমাকে এখানে তারা খুঁজে পাবার আগেই। যদি তারা তোমাকে সন্দেহ করে বসে তাহলে নেফারের মতো তোমাকেও তারা খতম করতে পিছ পা হবে না।

সে চলে যেতেই টাইটা কিছুক্ষণ চুপ হয়ে বসে তার সব চিন্তা একত্রিত করে বিষয়টা নিয়ে ভাবল এবং একটা পরিকল্পনা করল। সে একা এতে সফল হতে পারবে না। অন্যদেরকেও প্রস্তুত করতে হবে এবং অবশ্যই তাদের হতে হবে বিশ্বস্ত ও সেরা। আর তারা কাজের জন্যে প্রস্তুত হয়েই আছে এবং তার আদেশের অপেক্ষায় রয়েছে। আর দেরি করা সমীচীন হবে না।

*

টাইটার নির্দেশে দাসরা গরম পানির কেটলি নিয়ে এল এবং টাইটা সর্তকভাবে তা দিয়ে নেফারের ক্ষত পরিষ্কার করে পুনরায় ব্যান্ডেজ করল। তার উরুর ক্ষত দিয়ে তখনো ময়লা বের হচ্ছিল তাই সে ভেড়ার পশমের একটা টুকরো তার উপর রাখল ময়লা শুষে নিতে।

কাজটা শেষ হলে সে রক্ষীদের সতর্ক করে দিল যেন কেউ ভেতরে প্রবেশ না করে এবং কক্ষের সকল প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিল। কিছুক্ষণ প্রার্থনা করার পর সে ধূপধানীতে কিছু ধূপ নিক্ষেপ করল এবং নীল সুগন্ধি ধোয়ার মধ্যে আনুবিসের উদ্দেশ্যে পুরানো, শক্তিশালী মন্ত্র উচ্চারণ করল যে হচ্ছে মৃত্যু এবং গোরস্থানের প্রভু।

আর তারপরই সে একটা নতুন ও অব্যবহৃত তেলের প্রদীপে আনুবিসের অমরত্ব-সুধা প্রস্তুত করল। সে মিশ্রণটা বড় কড়াই এ উত্তপ্ত করল, যতোক্ষণ না তা রক্তের উষ্ণতার সমান হল। তারপর সে তা নিয়ে বিছানার নিকট এল যেখানে নেফার ঘুমাচ্ছিল শান্তভাবে। আলতো করে সে নেফারের মাথা একপাশ সরাল এবং প্রদীপের মধ্যকার তরলটুকু তার কানের পর্দার উপর ঢেলে দিল ধীরে ধীরে। সাবধানতার সাথে অতিরিক্ত অংশটুকু সে মুছে দিল, খেয়াল রাখল যেন তা তার নিজের চামড়ায় না লাগে। তারপর সে নেফারের কান একটা ছোট পশমের বল দিয়ে বন্ধ করে দিল এবং ধাক্কা দিয়ে ওটাকে ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। বাইরে থেকে বিশদ পরীক্ষা ছাড়া কারো দ্বারা তা চিহ্নিত হবে না।

যতোটুকু অমরত্ব-সুধা রয়ে গেল তা কড়াই এবং কয়লার মধ্যে সে ফেলে দিল। এবং অ্যাসিড বাস্পের এক ঝলকে ওটা পুড়ে গেল। তারপর সে বাতিটা তেলে পূর্ণ করল এবং অল্প করে জ্বালিয়ে রাখল। সে নেফারের বুকের শ্বাস-প্রশ্বাসে উঠা-নামা দেখল। প্রতিবার দম ধীর হচ্ছিল এবং তাদের মধ্যকার বিরতির সময় বাড়ছিল ক্রমশ। তারপর তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। সে নেফারের কানের নিচে তার দুই আঙ্গুল রাখল এবং তার মধ্যে জীবনী শক্তির ধীর নাড়ি স্পন্দন অনুভব করল। ধীরে ধীরে তাও ক্ষীণ হয়ে গেল যতোক্ষণ না তা শুধুমাত্র একটা ডানা ঝাঁপটানোর মতো মনে হল ঠিক ক্ষুদ্র পোকার ডানার মতো যা সে তার সকল দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়েই কেবল চিহ্নিত করতে পারল। তার বাম হাতের আঙ্গুল দিয়ে সে তার নিজের ঘাড়ের নাড়ি স্পন্দন গণনা করল এবং দুটোর তুলনা করল।

অবশেষে তার নিজের ৩০০ স্পন্দন লাগল নেফারের ঘাড়ের একটা ঝাঁপটা চিহ্নিত করতে। আলতো করে সে বালকটির চোখ বন্ধ করল, মৃত দেহের ঐতিহ্যগত প্রস্তুতি অনুসারে চোখের পাতার উপর সে কবজটা রাখল। তারপর সে তাদের ওপর একটা লিনেনের কাপড় বাঁধল এবং আরেক টুকরো দিয়ে তার চোয়ালের নিচ বাঁধল যা তার মুখ খুলে যাওয়া প্রতিরোধ করবে। সে দ্রুত কাজ করছিল। কারণ প্রতি মুহূর্তে সে ভয়ে ছিল যেহেতু নেফার অমরত্ব-সুধার প্রভাবে রয়েছে। অবশেষে সে দরজার কাছে গেল এবং তা খুলে দিল।

উচ্চ রাজ্যের রাজ-প্রতিভূকে জলদি আসতে বলুন। তার এখনই ফারাও এর ভয়ংকর সংবাদটা শোনার জন্যে আসা উচিত।

লর্ড নাজা আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় এসে পৌঁছল। রাজকন্যা হেজারেটও তার সাথে রয়েছে। তাদের ঘনিষ্ঠদের একটা ভিড় তাদের সাথে ছিল, যার মধ্যে ছিল লর্ড আসমর, অ্যাশিরিয়ান ডাক্তার নূম এবং সভার অধিকাংশ সদস্য। নাজা বাকিদের রাজকক্ষের বাইরের বরান্দায় অপেক্ষা করতে বলল এবং শুধু সে ও হেজারেট কক্ষে প্রবেশ করল। টাইটা তাদের সম্মানার্থে বিছানার পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল।

হেজারেট লোক দেখানো কান্না করছিল এবং তার চোখ একটি অ্যামব্রয়ডারি করা শাল দিয়ে ঢাকা। লর্ড নাজা বিছানায় পড়ে থাকা ব্যান্ডেজ করা দেহের দিকে তাকাল। তারপর চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল টাইটার দিকে।

উত্তরে, টাইটা হালকাভাবে সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। নাজার চোখে জয়ের রশ্মি ছড়িয়ে পড়ল। তারপর সে বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। সে এক হাত নেফারের বুকের উপর রাখল এবং অনুভব করল উষ্ণতা দ্রুত প্রসারিত ঠাণ্ডা দিয়ে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। নাজা জোরে হুরাসের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করল যে মৃত ফারাও এর রক্ষাকর্তা ছিল। যখন সে আবার উঠে দাঁড়াল তখন সে টাইটার বাহু চেপে ধরল জোরে।

নিজেকে শান্ত কর, ম্যাগোস। তুমি তোমার সাধ্য মতো সব করেছে যা আমরা তোমার কাছ থেকে পেতে পারি। তুমি পুরস্কার বঞ্চিত হবে না। সে তার হাতে তালি দিল এবং রক্ষী দ্রুত দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই সে আদেশ দিল, সভার সদস্যদের হাজির হতে বল।

তারা কক্ষে নীবর মিছিল করে বিছানা ঘিরে তিন দিক বেষ্টনী করে দাঁড়াল।

ডাক্তার নূমকে সামনে আসতে দিন, নাজা আদেশ দিল। তাকে ম্যাগোসের পক্ষে ফারাও এর মৃত্যু ঘোষণা নিশ্চিত করতে দিন। সৈন্যরা অ্যাশিরিয়ানটাকে বিছানার কাছে পৌঁছানোর জায়গা করে দিল। গরম আংটা দিকে তার লম্বা চুল কোঁকড়ানো করা হয়েছে এবং সেগুলো তার কাঁধের উপর ঝুলছে। তার দাড়িও ব্যাবিলিয়ন ভঙ্গিতে কোঁকড়ানো। তার লম্বা পোশাক মেঝে ঝাড় দিচ্ছে এবং অজানা প্রভু ও যাদুর মন্ত্রে অ্যামব্রয়ডারি করে সজ্জিত। সে হাঁটু গেড়ে মৃত বিছানার পাশে বসল এবং মরদেহ পরীক্ষা করতে লাগল। সে নেফারের ঠোঁট তার বিশাল বাঁকননা নাক দিয়ে শুকল যা থেকে নাকের কালো চুল বাইরে বেড়িয়ে আছে। তারপর সে তার কান নেফারের বুকে রাখল এবং স্পন্দন শুনার চেষ্ট করল, টাইটার উদ্বিগ্ন হৃদপিন্ডের ১০০ স্পন্দন পর্যন্ত। তার ভান্ডারে আশিরিয়ান অপটু বিদ্যেই কেবল জমা।

তারপর নূম তার জামার ভাজ থেকে একটা রূপার লম্বা পিন নিল এবং নেফারের নিস্তেজ একটা হাত খুলে হাতের নখের গভীরে সূঁচালো অংশটা ঢুকিয়ে দিল এবং মাংসের প্রতিক্রিয়া অথবা এক ফোঁটা রক্ত জমাট হওয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করল।

অবশেষে সে ধীরে উঠে দাঁড়াল এবং টাইটা ভাবল তার কুচকানো ঠোঁটে ও বিষণ্ণ অভিব্যক্তির মধ্যে গম্ভীর হতাশার সাক্ষ্য আছে, অন্তত যখন সে তার মাথা নাড়াল। টাইটা গভীরভাবে ভেবে দেখল নিশ্চয়ই ফারাও এর প্রতিক্রিয়া পেতে রূপার পিন ব্যবহার করার জন্যে নূমকে পুরষ্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। ফারাও মৃত, সে ঘোষণা করল এবং যারা বিছানা চারপাশে ছিল তারা শয়তানের চোখের ও প্রভুদের ক্রোধের বিরুদ্ধে চিহ্ন আঁকল।

লর্ড নাজা তার মাথা পিছনে নিয়ে প্রলাপের প্রথম চিৎকার দিল। আর হেজারেট তার পিছনে দাঁড়িয়ে শোকের কান্না তার মিষ্টি উচ্চ কন্ঠে সুর করে ধরল।

টাইটা তার অধৈর্যতা লুকিয়ে রাখল বহু কষ্টে। সে প্রলাপকারীদের একে একে বিছানা অতিক্রম করে কক্ষ ত্যাগ করার অপেক্ষায় আছে। যখন শুধু নাজা এবং হেজারেট, ম এবং উচ্চ রাজ্যের উজির অবশিষ্ট রইল, টাইটা আরেকবার সামনে এগিয়ে এল। লর্ড নাজা, আমি আপনার অনুমতি ভিক্ষে চাই। আপনি জানেন যে আমি ফারাও নেফার সেটির শিক্ষক ও দাস, তার জন্ম থেকে। অতএব আমি তার শ্রদ্ধা ও দায়িত্বের কাছে ঋণী এমনকি এখন তার মৃত্যুতেও। আমি আপনার অনুগ্রহ কামনা করছি। আপনি কি আমাকে সেই একজন হিসেবে তার মরদেহ হল অফ সরো মানে দুঃখের কক্ষে বয়ে নিয়ে যাওয়ার এবং সেখানে তার হৃদপিন্ড এবং নাড়িভুড়ি কেটে বের করার অনুমতি দিবেন? আমি তা আমার উপর আপনার মহান আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করব।

লর্ড নাজা এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। আপনি সেই সম্মতি অর্জন করেছেন। আমি আপনার উপর ফারাও এর পবিত্র দেহ শেষকৃত্যের মন্দিরে নিয়ে যাওয়া এবং তার দেহকে মমিতে পরিণত করার দায়িত্ব অর্পণ করলাম।

*

বৃদ্ধ যোদ্ধা হিল্টো দ্রুত টাইটার ডাকে সামনে এসে হাজির হল। সে প্রাসাদ ফটকের প্রহরী কক্ষে অপেক্ষা করছিল। সাথে করে সে নুবিয়ান ছলনাকারী বে-কে এনেছে এবং সেই সাথে চারজন তার সবচাইতে বিশ্বস্ত লোক। তাদের একজন ম্যারন, নেফারের শৈশবের বন্ধু ও সঙ্গী। সে এখন রক্ষীদের একজন সুদর্শন সৈন্য, লম্বা গঠন ও স্বচ্ছ চোখের অধিকারী। টাইটা বিশেষ করে এই কাজে তার কথা বলেছে।

তাদের মাঝে মমিকরেরা শেষ কৃত্যের জন্যে মন্দিরে মরদেহ বয়ে নিয়ে যাবার লম্বা ঝুড়িটা বহন করছে। খালি ঝুড়িটা ভারি দেখাল, যা একজনের চিন্তার চাইতেও বেশি।

টাইটা তাদেরকে মৃত কক্ষে প্রবেশ করতে দিল এবং হিল্টোকে ফিসফিসিয়ে বলল, দ্রুত কর। প্রতি সেকেন্ড মূল্যবান।

সে ইতোমধ্যে নেফারকে একটা লম্বা সাদা কাফন দিয়ে পেচিয়ে ফেলেছে, একটা ঢিলা লিনেন কাপড় দিয়ে তার চেহারাটা ঢাকা। শব যাত্রীরা ঝুড়িটা বিছানার পাশে রাখল এবং সম্মানের সাথে নেফারকে উঠিয়ে ওটার মধ্যে রাখল আলতো করে। টাইটা দেহের চারদিকে কোলবালিশ গুঁজে দিল যাতে চলার সময় সে ব্যথা থেকে রক্ষা পায়। তারপর ঢাকনা লাগিয়ে দিল এবং মাথা নেড়ে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিল। মন্দিরে, সে বলল। সব কিছু প্রস্তুত।

টাইটা তার থলে বিশ্বস্ততার সাথে ম্যারনকে দিল এবং তারা দ্রুত বারান্দা ও প্রাসাদের বাগান দিয়ে এগিয়ে চলল। শোক ও প্রলাপের আওয়াজ তাদের অনুসরণ করে আসল পিছু পিছু। যখন মৃত ফারাও প্রসাদের রক্ষীদের অতিক্রম করে যাচ্ছিল তখন তারা তাদের অস্ত্রের সূঁচালো দিক নিচু করে রাখল এবং হাঁটু গেড়ে বসল। মহিলারা তাদের চেহারা ঢেকে দুঃখে আর্তনাদ করে উঠল। সমস্ত প্রদীপ নিভিয়ে দেওয়া হল এবং রান্না ঘরের আগুন নেভানো হল যাতে চিমনি দিয়ে কোনো ধোঁয়া না উঠে।

উঠানোর প্রবেশ মুখে হিল্টোর রথের বাহিনী ঘোড়ার লাগাম ধরে প্রস্তুত ছিল। বাহনকারীরা সামনের রথের পাদানির উপর ঝুড়িটা বসিয়ে দিল এবং চামড়ার রশি দিয়ে তা বেঁধে দিল দ্রুত। ম্যারন টাইটার চামড়ার যন্ত্রপাতির থলে ককপিঠে রাখল এবং টাইটা তাতে চড়ে লাগাম তুলে নিল নিজ হাতে। রেজিমেন্টের বিউবলে শেষ কৃত্যের আওয়াজ ধ্বনিত হল এবং দলটা হাঁটার গতিতে তোরণ পেরিয়ে চলতে লাগল।

প্লেগের ন্যায় ফারাও-এর মৃত্যুর খবর শহরে ছড়িয়ে পড়ল দ্রুত। প্রজারা ফটকে ভিড় করল। যখন দলটা তাদের অতিক্রম করছিল তখন তারা আর্তনাদ ও প্রলাপ করতে লাগল। জনতা নদীর তীরে গিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াল। মহিলারা দুঃখে চিৎকার করে গেল, সামনে দৌড়ে এল এবং পবিত্র ফুটন্ত পদ্ম ফুল ঝুড়ির উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করতে লাগল।

টাইটা ঘোড়াগুলোকে দুলকি চালে চালালো, তারপর অধিবল্পিত গতিতে নিয়ে এল। সে ঝুড়িটা শেষকৃত্য মন্দিরের গোপন কক্ষে নেওয়ার জন্যে উন্মুখ। নেফারের পিতার মন্দিরটা এখনো ভাঙ্গা শেষ হয়নি যদিও ফারাও ট্যামোসকে কয়েক মাস আগে পশ্চিমের শূন্য পাহাড়ে তার কবরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নেফারের জন্য এখনো কোনো মন্দির তৈরি হয়নি, সে এতো তরুণ যে তার আয়ু আরো অনেক দূর পর্যন্ত আশা করা হয়েছিল। এখন অসময়ে তার মৃত্যুতে তার পিতার জন্যে তৈরি করা ভবনটা ব্যবহার ছাড়া আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই।

লম্বা, গোলাপের রঙের গ্রানাইটের দেয়াল এবং দ্বার-মন্ড একটা নিচু স্থানের উপর সবুজ নদী উপেক্ষা করে নির্মিত। যাজকেরা তড়িঘড়ি করে একত্রিত হয়ে দলটাকে অভিবাদন জানাতে অপেক্ষা করছিল। তাদের মাথা নতুন করে মুন্ডনো ও তেল সিক্ত। টাইটা যখন চওড়া সড়ক দিয়ে রথ চালল তখন মৃদু শব্দে বাদ্য বেজে উঠল এবং সে সিঁড়ির কাছে রথটা থামাল যা দুঃখের কক্ষ বা হল অফ সরোর দিকে উঠে গেছে।

হিল্টো ও তার যোদ্ধারা সাবধানে ঝুড়িটা উঠাল এবং তাদের কাঁধে তা সুষমভাবে রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।

যাজকেরা তাদের পিছনে পড়ে গেল। তারা শোক সঙ্গীত গাইছে। দুঃখের কক্ষের কাঠের দরজার সামনে শব বাহকেরা থামতেই টাইটা পিছন ফিরে যাজকদের দিকে তাকাল।

মিশরের রাজাপ্রতিভূর মাধুর্যতা ও ক্ষমতায় আমি, টাইটা ফারাও এর নাড়ি ভুড়ি তোলার দায়িত্ব পেয়েছি। সে একটা সম্মোহিত দৃষ্টি দিয়ে প্রধান যাজককে স্থির করল। অন্য সবাই শুধু অপেক্ষা করবে যখন আমি এই পবিত্র দায়িত্ব পালন করি।

আতংকের একটা গুঞ্জন উঠল আনুবিস এর ভ্রাতৃত্বের মধ্যে। এটা একটা ভুল, ঐতিহ্য ও তাদের নিজেদের আইনের বিরুদ্ধে। কিন্তু টাইটা কঠোরভাবে যাজকের চোখ ধরে থাকল, তারপর ধীরে ধীরে লসট্রিসের কবজ ধরা তার ডান হাতটা তুলল। যাজকটা জানত, ভয়ার্ত শ্রদ্ধার ঐ তাবিজের ক্ষমতা। যেহেতু মিশরের রাজ-প্রতিভূ অনুমতি দিয়েছেন, সে আত্মসমর্পণ করল। আমরা শুধু প্রার্থনা করব যখন ম্যাগোস তার দায়িত্ব পালন করবে।

টাইটা হিল্টো ও বাহকদের দরজার দিয়ে নিয়ে গেল এবং তারা স্থিরভাবে ঝুড়িটা দুঃখের কক্ষের মধ্যখানে অবস্থিত উঁচু কালো বেদির পাশে নামিয়ে রাখল। টাইট হিল্টোর দিকে এক নজর তাকাল এবং ক্ষিপ্র বৃদ্ধ কমান্ডার আত্মমর্যাদা সহকারে দরজার দিকে হেঁটে গেল এবং জড়ো হওয়া যাজকদের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর সে দ্রুত টাইটার পাশে চলে এল। তাদের মাঝে রাখা ঝুড়িটা খুলে নেফারের মোড়ানো দেহ তুলে আনল। কালো বেদীর উপর তারা তা রাখল সাবধানে।

নেফারের ঢেকে রাখা মুখের কাপড় টাইটা খুলে ফেলল। তাকে বিবর্ণ দেখাচ্ছিল এবং স্নেহার্ত দেখাল যেন ঠিক হুরাসের আইভরি খচিত বাচ্চা প্রভু। হুরাস। আলতোকরে টাইটা তার মাথা একদিকে কাত করল এবং বে-এর উদ্দেশ্যে মাথা নিচু করল যে চামড়ার যন্ত্রপাতির থলেটা তার ডান হাতে ধরে আছে। ওটা খুলে টাইটা আইভরির ফরসেপটা নিল এবং সূঁচালো অংশ নেফারের কানে ঢুকিয়ে পশমের গোলাটা বের করে আনল। সে কাঁচের একটা জার থেকে গাঢ় রুবি বর্ণের তরল নিয়ে তার মুখ পূর্ণ করল। একটি স্বর্ণের পাইপের মধ্য দিয়ে আনুবিস-এর অমরত্ব ওলানি নেফারের কানের পর্দা থেকে বের করে আনল সাবধানে। তারপর কানের ফুটো দিকে ভেতরে তাকিয়ে একটু স্বস্তি পেল, সেখানে কোনো প্রদাহ হয়নি। একটা আরামদায়ক মালিশ সে কানের মুখে লাগাল এবং পুনরায় তাদের বন্ধ করে দিল। বে অন্য একটা শিশিতে অমরত্ব-সুধা নষ্ট কারী ওষুধ তৈরি করেছে। সে ওটার ছিপি খুলতেই একটা তীক্ষ্ম কর্পূর ও সালফারের গন্ধে কক্ষ ভরে উঠল। হিল্টো নেফারকে বসার ভঙ্গিমায় ধরে রাখতে তাদের সাহায্য করল এবং শিশির সবটুকু ওষুধ তখন নেফারকে খাইয়ে দিল টাইটা।

ম্যারন ও অন্যান্যরা একটা শূন্যতা ও অপলক দৃষ্টিতে টাইটার কাজকর্ম সব দেখছিল। হঠাৎ নেফার কর্কশ ভাবে কেশে উঠল এবং কুসংস্কারছন্ন ভয়ে তারা সবাই বেদি থেকে লাফ দিয়ে দূরে সরে গেল এবং শয়তানের বিরুদ্ধে চিহ্ন আঁকল। টাইটা নেফারের পিঠ মালিশ করতে গেল একনাগারে। নেফার আবার কাশল ও হলুদ বর্ণের বমি করল। যখন টাইটা তাকে পুনঃজীবিত করতে নিয়ম মাফিক কাজ করতে থাকল, হিল্টো তখন তার লোকদের হাঁটুতে ভর দিয়ে বসতে বসল এবং তারা যা দেখছে তা সবার নিকট গোপন রাখার কঠিন শপথ তাদের করাল। কাঁপতে কাঁপতে ও ভয়ে বিবর্ণ হয়ে তারা তাদের জীবনের কসম খেয়ে শপথ করল।

টাইটা তার কান নেফারের পিঠে রেখে কয়েক মুহূর্ত ধরে শুনল। তারপর মাথা ঝকাল সন্তুষ্ট মনে। সে তাকে আবার মালিশ করল এবং আরো একবার কান রেখে শুনল। বে-কে ইশারা করতেই সে থলে থেকে একটা শুকনো গুল্ম তুলে নিল এবং মন্দিরের একটা প্রদীপে তার শেষ প্রান্ত জ্বালাল। তারপর সে ওটা নেফারের নাকের কাছে নিচে ধরল। বালকটি হাঁচি দিয়ে উঠল এবং তার মাথা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। সন্তুষ্ট হয়ে টাইটা তাকে পুনরায় লিনেন কাপড়ে প্যাচালো এবং বে ও হিস্টোকে আবার ইশারা করতেই তিনজন ঝুড়ির দিকে ঘুরল। অন্যরা জায়গা করে দিল। টাইটা ঝুড়ির ফল গোপন তলদেশ খুলে ফেলল এবং নিচ থেকে অন্য একটা মরদেহ বের করে আনল। এই দেহটাও সাদা কাফনে মোড়া। এ কারণে ঝুড়িটা অস্বাভাবিক ভারি দেখাচ্ছিল তখন।

এসো!, হিল্টো আদেশ দিল। একে বাইরে বের করো!

টাইটার তীক্ষ্ণ চোখ ও কাঠোর নির্দেশে তারা দেহ দুটো অদল বদল করল দ্রুত। তারপর নেফারকে তারা ঝুড়ির তলদেশে লুকানন কুঠরে শুইয়ে দিল। বে ঝুড়ির পাশে নেফারের অবস্থা দেখার জন্য উবু হয়ে বসল। অন্যরা অপরিচিত লাশটাকে বেদির উপর শুইয়ে দিল।

টাইটা কাফনের কাপড় সরাতেই নেফারের বয়সের ও একই দৈহিক গঠনের দেহ উন্মেচিত হল, এমনকি নেফারের ন্যায় একই রকম ভারি কালো চুল শবটার। মরদেহ সংগ্রহ করে দেওয়াটা ছিল হিল্টোর দায়িত্ব। বর্তমান সময়ে এ রাজ্যে কাজটা কঠিন ছিল না। প্লেগ এখানে গরিব এলাকাসমূহে ছড়িয়ে পড়েছে। তদুপরি রাতে শহরের রাস্তা ও সরু গলি থেকে ঝগড়ায়, নির্জলা খুনের শিকার অথবা মারামারিতে নিহত দেহ সহজেই কুড়িয়ে পাওয়া যায়।

হিল্টো এই সকল উৎসে শব খুঁজেছে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সে তরুণ ফারাও এর আদর্শ বদলি খুঁজে পেয়েছে যা ছিল একেবারে নিখুঁত। শহরের শেরিফ এই ছোঁক বালককে থেবসের একজন প্রধান শস্য ব্যবসায়ীর টাকার থলে ছেঁড়ার অপরাধে গ্রেফতার করেছিল এবং বিচারক তাকে ফাঁসি দিতে একটুও ইতস্তত করেনি। দন্ডিত ছেলেটার দেহ এবং সাধারণ চেহারা নেফারের এতো কাছাকাছি ছিল যে তার ভাই বলে তাকে চালিয়ে দেয়া যায়। তদুপরি সে ছিল সুঠাম এবং স্বাস্থ্যবান; অনাহারী এবং প্লেগ আক্রান্তদের ন্যায় নয়। হিল্টো শহর রক্ষীদের কমান্ডার যার উপর ফাঁসি দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তার সাথে কথা বলে এবং এই বিনিময়ের সময় তিনটি ভারি স্বর্ণ মুদ্রা তার টাকার থলেতে স্থান পায়। ঠিক করা হয়েছিল যে যততক্ষণ না হিল্টো আদেশ দেয় তততক্ষণ ফাঁসি দেরি করানো হবে এবং ফাঁসি দানকারীর দক্ষতার দিয়ে যতোটুকু সম্ভব দন্ডিতকে দৃশ্যত ক্ষতি না করা। আজই সকালে বন্দীকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে এবং তার দেহ এখনো ঠাণ্ডা হয় নি।

হলের শেষ প্রান্তে ছোট সমাধির মধ্যে ঢাকনাওয়ালা জারের আয়োজন করা হল। টাইটা ম্যারনকে ওগুলো ধরে রাখতে এবং পূর্ণ হওয়ার জন্য ছিপি খুলে প্রস্তুত রাখার আদেশ দিল। যখন সে এটা করছিল টাইটা তখন মরদেহটাতে উবু করে শোয়াল এবং তার বাম দিকের নিচে দ্রুত কাটল। নিখুঁত ডাক্তারি করার বেশি সময়। ছিল না। সে তার হাত কাটা স্থান দিয়ে ঢুকিয়ে দিল এবং প্রথমে নাড়িটা ধরল। তারপর দুই হাত ব্যবহার করে সে শবদেহের ভিতরে কাজ চালাল। প্রথমে সে বুকের গহ্বরে কাজ করার জন্য ডায়াফ্রাম কেটে ফেলল। তারপর আরো গভীরে পৌঁছে ফুসফুস, কলিজা, এবং প্লীহা অতিক্রম করে বিচ্ছিন্ন করল শ্বাসনালী ও ফুসফুসের সংযোগ স্থল। সবশেষে শবদেহটাকে গড়িয়ে ঘোরাল। ম্যারনকে নিতম্বদ্বয় আলাদা করে ধরে রাখতে আদেশ দিল এবং এক আঘাতে মলদ্বারের মাংসপেশী আলাদা করে ফেলল। ফলে বক্ষ থেকে ভেতরের সব বস্তু আলগা হয়ে গেল।

সে এক টানে তা বেদির উপর বাইরে বের করে নিয়ে এল। ম্যারন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে তার পায়ের উপর দুলতে লাগল এবং হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল।

মেঝেতে নয়, সিংকে যাও, রূঢ়ভাবে আদেশ দিল টাইটা। ম্যারন অ্যাপেপির সৈন্যের বিরুদ্ধে উত্তরে যুদ্ধ করেছে। অসংখ্য লোককে মেরেছে এবং যুদ্ধের ময়দানে ব্যাপক হত্যাকান্ড সত্ত্বেও আহত হয় নি। কিন্তু এখন সে দৌড়ে কোনার পাথরের বেসিনে গেল এবং শব্দ করে তার মধ্যে বমি করল।

কনুই পর্যন্ত রক্ত মেখে টাইটা কলিজা, ফুসফুস, পাকস্থলী ও নাড়িভুড়ি আলাদা করে স্তূপ করল। এটুকু কাজ শেষ হলে সে নাড়িভুড়ি ও পাকস্থলী সিংকে নিয়ে গেল যেখানে ইতোমধ্যে ম্যারন বমি করেছে। সে কাটা পাকস্থলী ও নাড়িভূড়ির ময়লা ধুয়ে সেগুলো জারের ভেতর প্যাকেট করল। প্রতিটি জার লবণ দিয়ে পূর্ণ করল এবং ছিপি লাগিয়ে দিল। তারপর সে তার হাত ও বাহু ব্রোঞ্জের কড়াইতে রাখা পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিল। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে বে-এর দিকে তাকাল, এবং নুবিয়ান সম্মতিসূচকভাবে তার টেকো মাথা নেড়ে নেফারের অবস্থা জানাল টাইটাকে। নিয়ন্ত্রিত দ্রুততার সাথে টাইটা পেটের কাটা সেলাই করে বন্ধ করল। তারপর সে মাথা ব্যান্ডেজ করল যতক্ষণ না শবের অবয়ব ঢাকা পড়ল। কাজ শেষ হলে সে এবং হিল্টো মরদেহটা ন্যাট্রন লবণের পানিতে গোসল করাল। এই রুক্ষ অ্যালকালি দ্রবণে শবটা পুরোপুরি ডুবন্ত অবস্থায় বাথটবের মধ্যে মাথা ঢাকা সহ পরবর্তী ৬০ দিন থাকবে। ঐ সময় অতিক্রান্ত হবার পর কাজ করা ব্যান্ডেজ যে কেউ খুলে ফেলতে পারবে এবং বদলটা আবিষ্কার করতে পারবে। কিন্তু তততক্ষণে টাইটা ও নেফার অনেক দূর চলে যাবে।

পানি দিয়ে বেদিটা পরিষ্কার করতে এবং যন্ত্রপাতি প্যাকেট করতে টাইটার অল্প সময়ই লাগল। নেফার যে ঝুড়িতে শুয়ে আছে তার পাশে হাঁটুগেড়ে বসে টাইটা তার এক হাত নেফারের নগ্ন বুকের উপর রাখল। তার শরীরের উষ্ণতা ও শ্বাস প্রশ্বাসের গতি অনুভব করার চেষ্টা করল গভীর ভাবে। এটা ধীর ছিল। সে একটা চোখের পাতা টেনে উঠাল এবং দেখল পিউপিল আলোতে প্রতিক্রিয়া করছে। সন্তুষ্ট হয়ে সে উঠে দাঁড়াল এবং হিল্টো ও বে-কে ইশরায় গোপন কুঠরীটা ঢেকে দিতে বলল। তারপর তারা ঝুড়ির ঢাকনা পুনঃস্থাপনের উদ্যত হতেই তাদের থামিয়ে দিল টাইটা। খোলা রাখ, সে আদেশ দিল। যাজকদের দেখতে দাও যে এটা খালি।

বাহকেরা হাতল ধরে ঝুড়িটাকে উঠাল এবং টাইটা তাদের দরজার দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল। যখন তারা কাছাকাছি গেলো হিল্টো দখন দরজা খুলে দিতেই যাজকদের সমাবেশ সামনে এগিয়ে এল। তারা অনেকটা দায়সারা ভাবে তাকাল শূন্য ঝুড়িটার দিকে যখন তা রথে নিয়ে যাওয়া হল। তারপর তারা প্রায় অসভ্য দ্রুততায় তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে দুঃখের কক্ষে প্রবেশ করল, যা তাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। মন্দিরের বাইরে জনতার ভিড় এড়িয়ে টাইটার লোকেরা ঝুড়িটা অগ্রবর্তী রথে তুলে দিলে তারা শহরে ফিরতে শুরু করল সারিবদ্ধ হয়ে।

যখন তারা প্রধান ফটকে প্রবেশ করল তারা দেখল সরু রাস্তাগুলো প্রায় খালি। হয় জনগণ শেষকৃত্যের মন্দিরে তরুণ ফারাও এর জন্য প্রার্থনা করতে গেছে নয় তারা তড়িঘড়ি করে প্রাসাদে গিয়ে তার পরবর্তী উত্তরাধিকারের নাম ঘোষণার অপেক্ষা করছে। যদিও সবার তা জানা এবং অল্পই সন্দেহ রয়েছে কে হবে উচ্চ রাজ্যের পরবর্তী ফারাও।

হিল্টো রথ রক্ষীদের নির্দেশ দিল ব্যারাকের পূর্ব ফটকের দিকে এগিয়ে যেতে। তারপর ঝুড়িটা তার ব্যক্তিগত কোয়ার্টারের পেছনস্থ প্রবেশদ্বার দিয়ে বহন করে আনা হল যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করে। এখানে নেফারকে গ্রহণ করার জন্যে সবকিছু প্রস্তুত ছিল। তারা তাকে গোপন কুঠরী থেকে বের করল এবং টাইটা বে কে সাথে নিয়ে নেফারকে পুরোপুরি পুনঃজীবিত করতে চলে গেল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে একটু রুটি ও এক বোল খোটকীর দুধ এবং মধু পান করার মতো সুস্থ হয়ে গেল।

অবশেষে টাইটা বিবেচনা করে দেখল এবার তাকে কিছু সময়ের জন্য বে-এর। দায়িত্বে রেখে যাওয়া যায় এবং বের হয়ে সরু শূন্য রাস্তা দিয়ে রথটা চালাল। তার সে সামনে হঠাৎ হট্টগোল শুনল যেন কোন বন্য উচ্ছ্বাস। যখন সে প্রাসাদের সীমানায় পৌঁছল সে নিজেকে নতুন ফারাও এর উত্থানে উল্লাসিত জনতার ভিড়ের মধ্যে খুঁজে পেল। পবিত্র মহামান্য ফারাও, নাজা কাইফান দীর্ঘজীবী হউন। জনতা রাজকীয় আনুগত্য নিয়ে চেঁচাচ্ছিল এবং হাতে হাতে তাদের ঘুরছিল মদের জগ।

জনতার ভিড় এতো বেশি ছিল যে টাইটা বাধ্য হল রথটা ম্যারনের কাছে দিয়ে বাকি পথ পায়ে হেঁটে যেতে। প্রাসাদের ফটকে রক্ষীরা তাকে চিনতে পারল এবং তাদের বর্শার বাট দিয়ে তার যাওয়ার জন্য রাস্তা পরিষ্কার করে দিল। সে মাটিতে নেমে দ্রুত বড় হল রুমের উদ্দেশ্যে ছুটল এবং সেখানে সে আরো এক ঝাঁক আজ্ঞাবহ মানুষের ভিড় পেল। সকল অফিসার, সভাসদ এবং রাজ্যের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ নতুন ফারাও-এর প্রতি বিশ্বস্ত ও আনুগত্য থাকার শপথ নেওয়ার জন্য অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। কিন্তু টাইটার সম্মান ও তার অবিচল চাহনি জনতা সারির প্রথমে চলে আসতে সাহায্য করল এবং এগুবার জন্য তাকে রাস্তা করে দিল সবাই।

হলের শেষ প্রান্তের দরজার পিছনের ব্যক্তিগত কক্ষে ফারাও নাজা কাইফান ও তার রাণী অবস্থান করছিল, কিন্তু টাইটাকে অল্প সময় অপেক্ষা করতে হলো রাজার সামনে উপস্থিত হবার অনুমতি পেতে।

টাইটা বিস্ময়ের সাথে দেখল নাজা ইতোমধ্যে দ্বৈত মুকুট পরিধান করে ফেলেছে। তার পাশে রাণী হেজারেটকে বৃষ্টিস্নাত ফুটন্ত মরু গোলাপের ন্যায় লাগছে। টাইটা তাকে সব সময় যেমনটা জানে তেমনই তাকে দেখাচ্ছে সুন্দর, মলিন এবং শান্ত। প্রসাধনের নিচে তার চোখ দক্ষতার সাথে সুরমা লাগিয়ে বড় করা হয়েছে। টাইটা প্রবেশ করতেই নাজা তার চারপাশে যারা ছিল তাদের বিদেয় করে দিল এবং শীঘ্রই তারা তিনজন একা হলো; উঁচু সম্মানের চিহ্ন। তারপর নাজা তার হাতের রাজদন্ড এক পাশে সরিয়ে রেখে টাইটার সাথে আলিঙ্গন করতে এগিয়ে এল। ম্যাগোস, আমার কখনোই আপনাকে সন্দেহ করা উচিত হয়নি, সে বলল, আগের চাইতে তার কণ্ঠ আরো মধুর ও কর্তৃত্বপূর্ণ। আপনি আমার কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছেন। সে তার ডান হাত থেকে চমৎকার একটা স্বর্ণ ও রুবির আংটি খুলে তা টাইটার ডান তর্জনীতে পরিয়ে দিল। এটা আমার অনুগ্রহের ক্ষুদ্র নিদর্শন ছাড়া কিছু নয়। টাইটার মনে হল যেন বড় একটা শক্তিশালী কবজ সে তার হাতে পড়িয়ে দিয়েছে। তবে যদি এটা নাজার চুলের এক গোছা অথবা তার নখের একটু অংশ হতো তা হলে তা হতো আরো শক্তিশালী।

হেজরেট সামনে এগিয়ে এল এবং তাকে চুমু খেল। প্রিয় টাইটা, তুমি সব সময় আমার পরিবারের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে। তুমি স্বর্ণ, ভূমি এবং প্রভাব প্রতিপত্তি আরো যা চাও তা পাবে।

তাহলে এতো বছর জুড়ে সে তাকে অল্পই চিনেছে। তোমার বদান্যতাকে কেবল তোমার সৌন্দর্যই অতিক্রম করতে পারে। কথাটা বলে সে একটা হাসি রহস্যময় দিল। তারপর সে নাজার দিকে ঘুরল। প্রভুরা যা আমার কাছ থেকে চেয়েছে আমি তা করেছি, মহামান্য। কিন্তু এটা আমার প্রিয় কাউকেও কেড়ে নিয়েছে। আপনি জানেন যে আমি নেফারকে ভালোবাসতাম। এখন আমি আপনার প্রতি ঐ একই দায়িত্ব ও ভালোবাসা অনুভব করি। কিন্তু কিছু দিন আমাকে অবশ্যই নেফারের জন্যে শোক পালন করতে হবে এবং তার ছায়া থেকে আমাকে মুক্তি পেতে হবে।

সত্যি বলতে যদি আপনি মৃত ফারাও এর জন্যে এমনটা অনুভব না করেন তবে তা অস্বাভাবিক হবে, নাজা সম্মত হলো। আপনি আমার কাছে কি চান, ম্যাগোস? একবার শুধু আপনি বলুন।

মহামান্য, আমি কিছু দিনের জন্য একাকী মরুভূমিতে যাবার অনুমতি চাই।

কত দিন? নাজা জিজ্ঞেস করল এবং টাইটা বুঝল যে সে অনন্ত জীবনের চাবি হারানোর ব্যাপারে সচেতন রয়েছে। যা সে সত্যি বিশ্বাস করে যে টাইটার হাতে তা রয়েছে।

বেশি দিনের জন্য নয়, মহামান্য, টাইটা তাকে আশ্বস্ত করল।

নাজা কিছু সময় এ নিয়ে ভাবল। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানুষ সে কখনও ছিল। অবশেষে একটাদীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিচু টেবিলটার কাছে সে গেল যার উপর স্টাইলার এবং প্যাপিরাস রাখা রয়েছে। দ্রুত সে একটা নিরাপদ পাস লিখে রাজ মোহর দিয়ে তার উপর সীল মারল। এটা স্পষ্ট যে মোহারটা অনেক আগেই তৈরি করে রাখা হয়েছিল। কালি শুকানোর অপেক্ষা করতে করতে নাজা বলল, আপনি নীলের পরবর্তী বন্যা পর্যন্ত অনুপস্থিত থাকতে পারবেন, কিন্তু তারপর আপনাকে অবশ্যই আমার কাছে ফিরতে হবে। এ নিরাপদ চুক্তিনামা আপনাকে যতো দূর ইচ্ছা ভ্রমণ করতে এবং আমার সাম্রাজ্যের যে কোন রাজভান্ডার থেকে খাবার এবং মালপত্র যা আপনার দরকার তার নেবার অনুমতি দিবে।

টাইটা কৃতজ্ঞতায় নতজানু হলো কিন্তু নাজা তাকে কাঁধ ধরে দাঁড় করালো, আরো একটি সৌজন্যতা প্রকাশ করে। যান, ম্যাঙ্গােস। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে আবার আমাদের কাছে ফিরে এসে পুরস্কার গ্রহণ করবেন যার পুরোপুরি হকদার আপনি।

অনুগ্রহ ও আশীর্বাদের চিহ্ন এঁকে টাইটা প্যাপিরাসের স্ক্রৌলটা নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

*

পর দিন সকালের প্রথম প্রহরে যখন শহরের অধিকাংশ মানুষ ঘুমে তখন তারা থেবস ত্যাগ করল। পূর্ব দিকের ফটকের রক্ষীরা তখনও হাই তুলছিল এবং ঘুমে তাদের চোখ ভারি হয়ে ছিল।

চারটি ঘোড়ায় টানা ওয়াগনের পিছনে নেফার শুয়ে। এই প্রাণীগুলো হিল্টো কর্তৃক সর্তকতার সাথে পছন্দ করা হয়েছে। প্রাণীগুলো শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যবান। কিন্তু অসাধারণ নয়, যা শত্রু বা কারো মনে সন্দেহের উদ্রেগ করতে পারে। ওয়াগন প্রয়োজনীয় রসদ এবং মালামালে পূর্ণ যা নদী উপত্যকা ছাড়ার পর তাদের প্রয়োজন হবে। হিল্টো ধনী কৃষকের ন্যায় পোশাক পড়েছে। ম্যারন তার ছেলে এবং বে তাদের দাসের ভূমিকায় অবতীর্ণ।

নেফার ওয়াগনের মধ্যে খড়ের গালিচার বিছানার উপর শুকনো চামড়ার চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছে। সে এখন পুরোপুরি সুস্থ এবং টাইটা তাকে যা বলেছে তা বোঝর সমর্থ ছিল। রাজ নিরাপত্তার দলিল থাকা সত্ত্বেও রক্ষী ও সার্জেন্ট কর্তৃত্বের একটা ভাব দেখাল। টুপির শূন্যে সে টাইকে চিনল না, তাই সে ওয়াগনের পিছনে গিয়ে উঠল মালপত্র পরখ করতে।

এক পর্যায়ে নেফারের মুখের উপরে থাকা চাদর সরাতেই নেফার তার রোগা, মলিন অবয়ব যা নির্ভুল লাল প্লেগের দাগে ভরা তা নিয়ে উঁকি মারল। টাইটা তাকে নিখুঁত করে এ সাজে সাজিয়েছে। দেখামাত্র সার্জেন্ট ওয়াগন থেকে ভয়ে লাফিয়ে নেমে গেল। বার বার শয়তানের বিরুদ্ধে সে মন্ত্র পড়ল, ভয়ে হাতে থাকা প্রদীপটা ফসকে যা তার পায়ের কাছে পড়ে ভেঙে গেল। চলে যাও! সে লাগাম ধরা হিল্টোর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল পাগলের মতো। এই পক্সওয়ালা জঘন্যটাকে শহর থেকে বের করে নিয়ে যাও।

নদীর উপকূলবর্তী এলাকা পর্যন্ত পেরিয়ে যেতে তাদের এ রকম পরিস্থিতিতে আরো দুবার পড়তে হল এবং তারা ক্রমশ পাহাড়ের নিকটবর্তী হচ্ছিল যা চাষের জমি ও মরুভূমির সংযোগ স্থল। মিলিটারী বাহিনী দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হলেই প্রতিবার রাজ স্ক্রৌল ও প্লেগ রোগীই যথেষ্ট ছিল তাদের ছাড়া পেতে, শুধু একটু দেরি হচ্ছিল এই যা।

সৈন্যদের মনোভাব থেকে এটা পরিষ্কার ছিল যে, বেবস্ এ মর দেহের উপকম্পন এখনো আবিষ্কৃত হয়নি এবং কোন সতর্কবাণীও দেওয়া হয়নি। টাইটা পুরোপুরি স্বস্তি পেল যখন তারা মরুভূমি পেরিয়ে পাহাড়ে উঠল এবং উত্তর দিকে লোহিত সাগর বরাবর পুরানো একটা বাণিজ্য রাস্তা অনুসরণ করল।

তখনই কেবল নেফার ওয়াগনে তার বিছানা থেকে বের হয়ে ওটার পাশে খুড়িয়ে হাঁটল কিছু সময়। এটা পরিষ্কার যে তার অস্বীকৃতি সত্ত্বেও পা-টা যন্ত্রণা দিচ্ছিল, কিন্তু শীঘ্রই সে আরো সহজে হাঁটল এবং দীর্ঘ সময় নিয়ে।

পুরানো ভগ্ন শহর গালালায় তারা তিন দিন বিশ্রাম নিল। অসমৃদ্ধ ও তিক্ত কূপ থেকে পানির থলে পূর্ণ করল এবং ঘোড়াগুলোকে সময় দিল শক্ত পাথুরে রাস্তার কঠোর পরিশ্রম থেকে সেরে উঠতে। বে এবং টাইটা তাদের খুরের যত্ন নিল। আবার যাত্রার উপযুক্ত হতেই তারা এবার পরিচিত পথ থেকে সরে এল। রাতের ঠাণ্ডায় ভ্রমণ করে তারা ঐ রাস্তা নিল যা শুধু টাইটা চেনে, যা গেবেল নাগারের দিকে চলে গেছে। বে এবং হিল্টো তাদের পিছনের চলার সকল চিহ্ন ঢেকে দিল।

অবশেষে উজ্জ্বল তারার আলোয় আলোকিত এক মধ্য রাতে তারা গুহাটায় পৌঁছল কোন বিপত্তি ছাড়াই। পাতলা থলেগুলোয় তখন এতো মানুষ ও ঘোড়াকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট পানি ছিল না, তাই যখন ওয়াগন খালি হয়ে গেল হিল্টো ও বে : ফিরে গেল। শুধু ম্যারনকে রেখে গেল টাইটা ও নেফারের কাছে। অসুস্থতার বাহানা দিয়ে হিল্টো তার রেজিমেন্ট থেকে অবসর নিয়েছে। তাই সে মুক্ত। বে-র সাথে প্রতি পূর্ণিমায় তাদের জন্যে রসদ, ওষুধ এবং থেবস থেকে খবর নিয়ে ফিরতো সে।

গেবেল নাগারে প্রথম মাসটা কেটে গেল দ্রুতই। পরিষ্কার, শুকনো মরুর বাতাসে নেফারের ক্ষত আর খারাপ না হয়ে বন্ধ হয়ে গেল এবং শীঘ্রই সে ম্যারনের সাথে খুড়িয়ে খুড়িয়ে মরুতে শিকারে বের হতে লাগল। তারা মরুর খরগোশকে চমকে দিত এবং নিক্ষিপ্ত লাঠি দিয়ে তাদের পরাভূত করত। অথবা টাইটা পর্বত চুড়ায় ঝর্ণার উপর বসে থাকতো এবং তীরের আয়ত্তের মধ্যে হরিণের পালকে আসতে প্ররোচিত করার জন্যে তার মন্ত্র পড়ত।

ঐ মাসের শেষের দিকে হিল্টো বে-কে নিয়ে থেব থেকে ফিরল। তারা খবর এনেছে যে, টাইটার ছলটা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি এবং ফারাও নাজা কাইফান তার জনতাসহ এখনো বিশ্বাস করে নেফারের দেহ হল অফ সরোতে লবণাক্ত জলে ডুবানো আছে।

তারা নিম্ন রাজ্যের বিদ্রোহের সংবাদও এনেছে এবং জানাল অশান্তি উচ্চ রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। নাজা টর্কের ন্যায় আর্মিতে লোক বাড়ানোর আদেশ দিয়েছে। লোকজন সশস্ত্র বাহিনীর লোক বাড়ানো নিয়ে রাগান্বিত, অন্তত দেশে যখন শান্তি বিরাজ করছে। হিল্টো রিপোর্ট করল, আমার মনে হয় শীঘ্রই উচ্চ রাজ্যেও সশস্ত্র বিদ্রোহ হবে এবং যা নাজা টর্কের মতোই নির্দয়ভাবে দমন করবে যে ভাবে উত্তরে করা হয়েছে। যারা এই দুই ফারাও এর অভিষেকে আনন্দ করেছে শীঘ্রই তারা এর জন্যে নিশ্চিত অনুশোচনা করবে।

নিম্ন রাজ্যের আর কি খবর আপনার কাছে আছে? নেফার ব্যাকুল ভাবে জানতে চাইল। হিল্টো দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবসার খবর ও শস্যের দামের খবর এবং অ্যাশিরিয়ান বিশেষ বার্তা বাহকের টর্কের দরবার পরিদর্শনের বিষয়ে বলে গেল। নেফার অধৈৰ্য্য নিয়ে সব শুনল এবং যখন হিল্টো শেষ করল তখন সে জিজ্ঞেস করল, সেখানে রাজকন্যা মিনটাকার খবর কী?

হিল্টোকে অবাক দেখাল। আমি কিছু জানি না। যতোদূর জানি সে অ্যাভারিসে আছে, কিন্তু নিশ্চিত নই।

পায়ে হেঁটে ফিরে আসার সময় হিল্টো একদল অরিক্স-এর পায়ের দাগ দেখেছে এবং তাদের ধাওয়া করে শিকার করতে টাইটার কাছে অনুমতি চাইল। তাদের শুকনো মাংসের মজুদে টান পড়তে পারে, তাই টাইটা তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল।

কিন্তু টাইটা হুকুম করল যে নেফার এখনো শিকারে যাওয়ার মতো শক্ত হয়নি। অদ্ভুত ভাবে এতে নেফার কষ্ট পেল না। পরিবর্তে সে পরামর্শ দিল শিকারী দলের সাথে টাইটার যাওয়া দরকার যাতে সে তার শক্তি দিয়ে শিকার পেতে এবং শিকারীদের লুকিয়ে রাখতে পারে যখন শিকার কাছাকাছি আসবে। যখনই গুহার মধ্যে সে একা হল, তখন নেফার সতেজ প্যাপিরাসের পাইন কাঠের সিন্দুক এবং লেখার সামগ্রী খুলল যা হিল্টো তার জন্যে এনেছে এবং মিনটাকাকে একটা চিঠি লিখতে শুরু করল। সে পুরোপুরি নিশ্চিত এতোদিনে তার মৃত্যুর খবর অ্যাভারিস পৌঁছে গেছে। সে তার নিজের ভয়ংকর অনুভূতির কথা মনে করল যখন তার পুরো পরিবারের সাথে মিনটাকার মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদটা সে শুনেছিল। তাই সে তাকে এই একই রকম যন্ত্রণা থেকে অব্যহতি দিতে চায়। সে আরো ব্যাখ্যা করতে চাইল যে–এটা নাজা ও টর্ক যারা তাদের বাগদান ভেঙে দিয়েছে, কিন্তু নেফার তা জানতো না। সে এখনো তাকে তার নিজের অনন্ত জীবনের আশা থেকে বেশি ভালোবাসে এবং শান্তি পাবে না যতক্ষণ না সে তার স্ত্রী হচ্ছে।

এ সবকিছু সে সাংকেতিক ভাষায় লিখল যাতে অন্য কোন ভুল হাতে পড়লেও ক্রৌলটা অর্থহীন হবে শুধু মিনটাকা ছাড়া।

শুরুতে তাকে সে প্রথম তারা বলে সম্বোধন করল। সে হয়তো স্মরণ করবে কিভাবে যখন তারা দুজন তার নামের উৎস নিয়ে আলোচনা করেছিল। সে তাকে বলেছিল, স্বর্গীয় হান্টারের স্থলে আমি তৃতীয় তারা।

সে উত্তর দিয়েছিল, না, তৃতীয়টা না। নভোমডোলের প্রথমটি।

সে সর্তকতার সাথে সংকেত ব্যবহার করল। লেখালেখির ক্ষেত্রে সে সর্বদাই অন্যদের ছাড়িয়ে। সে নিজেকে ডাব্বার বোকা বলে সই করল। নিশ্চিত ছিল যে সে তার অমার্জিত ব্যবহারের কথা মনে করতে পারবে যখন তারা মরুতে একা ছিল।

ঐ দিন সন্ধ্যায় যখন শিকারীরা ফিরল এবং তারা সদ্য শিকার করা অরিক্সের পোড়া মাংস খাচ্ছিল, নেফার উন্মুখ ছিল হিল্টোর সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগের অপেক্ষায়। সুযোগটা এল যখন টাইটা সবাইকে আগুনের পাশে রেখে মরুতে একটু হাঁটতে গেল। থেবসের রসদ ভান্ডার থেকে হিল্টো কতগুলো বড় বড় মদের বোতল এনেছে এবং টাইটা এক থেকে দুই বাটি পান করল। তার বয়সের ছাপ স্পষ্টত: সবাই দেখতে পেল তার মদ পানের পরিমাণ দেখে।

টাইটা নিরাপদ দূরত্বের বাইরে গেলে নেফার ঝুঁকে হিল্টোর কাছাকাছি এল এবং ফিসফিস করে বলল, আমি তোমাকে একটি বিশেষ দায়িত্ব দিতে চাই।

এটা আমার জন্যে বিশেষ সম্মানের, মহামান্য।

তার হাতে প্যাপিরাসে ছোট রোলটা এগিয়ে দিল নেফার। নিজের জীবন দিয়ে এটা রক্ষা করবে। নেফার আদেশ করল এবং যখন হিল্টো তা তার চাদরের নিচে সুকালো, নেফার তা অ্যাভারিসে রাজকুমারীকে দিতে বলল। সে আরো সতর্কবাণী দিয়ে শেষ করল; এই ব্যাপারে কাউকে বলবে না। এমনকি ম্যাগোসকেও নয়। কসম রইল।

পর দিন বিকেলে সূর্য ডোবার সময় হিল্টো ও বে গেবেল নাগার ত্যাগ করল, বাতাস সবে ঠাণ্ডা হচ্ছিল তখন। তারা নেফারকে রাজকীয় অভিবাদন করে টাইটাকে তার দোয়া ও রক্ষার মন্ত্র দিতে বলল, তারপর দুজন নেমে পড়ল তারায় আলোকিত বন্য পথে। ঘোড়াগুলো খুব কষ্ট করে বালিয়াড়ির প্রথম পাহাড়ের খাজে উঠল এবং রূপালী চাঁদের আলোয় এলোমেলো পাথরগুলো যখন ঠাণ্ডা হচ্ছিল তখন সেগুলো অবিরত পটপট আওয়াজ তুলছিল রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে।

ঘোড়াগুলো আগে দিয়ে বে হঠাৎ পিছিয়ে এল, তার বন্য ভাষায় চিৎকার করে উঠল এবং গলায় ঝুলানো সিংহের হাড়ের কবজটা চেপে ধরল। সে একটা অদ্ভুত অবয়বের দিকে নির্দেশ করল যা বেরিয়ে আসছে পাথরের ছায়া থেকে।

হিল্টো আরো বেশি আলোড়িত হল, সরে দাঁড়াও, অশুভ অবছায়া; সে চিৎকার করল, চাবুক শাসালো এবং শয়তানের বিরুদ্ধে চিহ্ন আঁকল। তারপর ভূত ও পিশাচ দূর করার সব মন্ত্র পড়ল দ্রুত।

শান্ত হও হিল্টো! প্রেত ছায়া অবশেষে কথা বলল। চাঁদ উজ্জ্বল ছিল তাই তা শিলার মতো শক্ত মাটিতে বরাবর লম্বা ছায়া তৈরি করল এবং প্রাণীটার মাথা ধাতু গলানো পাত্রের ন্যায় গলিত সিলভারের মতো অবয়ব তৈরি করল। এটা আমি টাইটা, ম্যাগোস।

আপনি হতে পারেন না! হিল্টো চিৎকার করে উঠল,আমি সূর্যাস্তের সময় টাইটাকে গেবেল নাগার ছেড়ে এসেছি। আমি তোমাকে চিনি। তুমি নিশ্চয় কোন পাতালের ভয়ংকর ছায়া, ম্যাগোসের বেশ ধরেছ।

টাইটা এবার সামনে এগিয়ে এসে হিল্টোর হাত ধরল। আমার শরীরের উষ্ণতা অনুভব করো; সে বলল, তারপর হিল্টোর হাত তার চেহারায় রাখল। আমার চেহারা অনুভব কর এবং আমার কষ্ঠ মনোযোগ দিয়ে শোন।

যাই হোক যখন বে সিংহের হাড় দিয়ে টাইটার বুক স্পর্শ করল ও তার পরিচিত গন্ধ যা কবরের দুর্গন্ধের অনুরূপ তা খুঁজে পেল তখন সে ঘোষণা করল সে আসলেই তাই যা সে দাবি করেছে। আর তখনই বৃদ্ধ যোদ্ধা বিষণ্ণভাবে তাকে মেনে নিল। কিন্তু কি ভাবে আপনি আমাদের আগেই এ স্থানে পৌঁছলেন? সে জানতে চাইল মিনমিন করে।

বিশেষ কুশলী কোন রাস্তা আছে নিশ্চয়ই। বে তাকে থামিয়ে রহস্যজনক কণ্ঠে বলল, এ ধরনের প্রশ্ন না করাটাই উত্তম।

হিন্টো, তোমার কাছে ব্যক্তিগত এমন কিছু আছে যা আমাদের সবার জীবন বিপন্ন করতে পারে। টাইটা সোজাসুজি বলল কথাটা। যা মৃত্যু ও দ্বিধার গন্ধ ছড়াচ্ছে।

আমি বুঝতে পারছি না তা কি হতে পারে! হিল্টো অস্বস্তি নিয়ে জবাব দিল।

এটা এমন কিছু যা এই মিশরের অধিপতি তোমার উপর দায়িত্ব দিয়েছেন। টাইটা জোর দিল। এবং তুমি ভালো করেই জান কি তা।

এই মিশরের অধিপতি, হিল্টো তার দাড়িতে আচড় কাটল এবং মাথা নাড়ল।

টাইটা তার হাত বাড়াল। হিল্টো তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর বাধা না দিয়ে আত্মসমর্পণ করল। সে তার বেল্টে রাখা থলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে কাগজের রোলটা বের করে আনল। তার কাছ থেকে নিজ হাতে জিনিসটা নিল টাইটা। এ ব্যাপারে কিছু বলবে না; টাইটা সতর্ক করে বলল তাকে। কাউকে না, এমনকি ফারাওকেও। আমার কথা কি বুঝেছো হিল্টো?

আমি আপনার কথা বুঝতে পেরেছি ম্যাগোস।

তারপর টাইটা তার ডান হাতে প্যাপিরাসটা নিয়ে ওটার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ড পর একটা ছোট উজ্জ্বল দাগ দেখা গেল ফ্রৌলটায়। এক গুচ্ছ ধোঁয়া রাতের বাতাসে চক্রাকারে উঠে গেল, তারপর হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল তাতে।

তাপের পরোয়া না করে টাইটা তার আঙুলের মধ্যে ওটাকে পুড়ে যেতে দিল, তারপর ছাই পিষে ধুলোয় পরিণত করল।

এটা যাদু হিল্টো হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।

একটা সাধারণ কৃতিত্ব, বে বিড়বিড় করে বলল। এমন যাদু এমনকি একটা শিষ্যও করতে পারবে।

টাইটা আশীর্বাদে তার ডান হাত তুলল সমাপ্তি টানতে। চলার পথে প্রভু তোমাদের নিরাপদ রাখুন, বলেই সে তাদের ওয়াগনকে আঁধারে রেখে হারিয়ে গেল।

*

টাইটা পুনরায় গেলে নাগারের গুহায় ফিরে তার বৃদ্ধ হাড়গুলো মরুর ঠাণ্ডা থেকে উষ্ণ করতে আগুনের পাশে এসে দাঁড়াল। ভেড়ার চামড়ায় ঢাকা ঘুমন্ত নেফারের অবয়ব যা পেছনের দেয়ালের তৈরি করেছে তা সে দেখতে লাগল এক মনে।

তাকে বোকা বানানোর জন্যে বালকটির এ করুণ প্রয়াসে সে কোন রাগ অনুভব করল না। বয়স তার মানবিকতা শুকিয়ে দেয় নি কিংবা তার আবেগী যন্ত্রণার স্মৃতি নিষ্প্রভ করে নি। মিনটাকার ভয় ও কষ্ট দূর করার উদ্দেশ্যে নেফারের চেষ্টার সাথে সে একাত্ম হল।

সে কখনো নেফারকে বুঝাতে পারবে না যে এ সহানুভূতি কাজের ফলাফল কি হতে পারতো। বরং এখন টাইটা যা করল তাকে নেফারের এই মিথ্যা বিশ্বাসের সাথে শীঘ্রই মিনটাকা জানবে যে সে এখন জীবিত। সে নেফারের পাশে আসন করে বসল এবং বালকটিকে স্পর্শ না করে টাইটা বালকটির অন্তর সত্তায় তার নিজের মতো করে আলতো প্রভাব বিস্তার করল। তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় অর্জিত ধৈর্যের ক্ষমতা তৎক্ষণাৎ অর্জন করল সে। নেফার কেঁপে উঠল, গুঙ্গিয়ে উঠল এমনকি গভীর ঘুমের মধ্যেও টাইটার ক্ষমতা জালের মতো তার উপর বিস্তার করল। তাকে ছুঁয়ে গেল এবং তাকে জাগিয়ে দিল প্রায়।

তার স্বাস্থ্য এখন অনেকখানি ভালো হয়েছে। টাইটা আরো গভীরে প্রবেশ করল। তার সত্তা যথেষ্ট শক্তিশালী এবং সে যে কষ্টের মধ্য দিয়ে এসেছে তাতে সে কিছুই হারায়নি। সেই ক্ষণ এখন আর বেশি দেরি নেই, পরবর্তী প্রয়াসে তাদের যাত্রা করার।

সে আগুনের পাশে ফিরে গেল এবং আরো কিছু একাসিয়া কান্ড তার মধ্যে ফেলল। তারপর পাশ ফিরল; ঘুমাতে নয়, কারণ এ বয়সে প্রতি রাতে তার মাত্র কয়েক ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। বরং তার মন চলমান ঘটনার স্রোতে খুলে দিল, কয়েকটা দূরের এবং বাকিগুলো খুব কাছের। সে ওগুলোকে তার চারপাশে ঘুরতে দিল যেন সে অস্তিত্বের ঝর্ণায় একটি পাথর।

*

পরবর্তী পূর্ণিমটা দ্রুত কেটে গেল অন্তত গত পূর্ণিমার চেয়ে। নেফার এখন আরো শক্তিশালী ও আরো অস্থির হয়ে উঠল। প্রতিদিন তার পা একটু করে সূস্থ হতে হতে অবশেষে এক সময় তা ভালো হয়ে গেল পুরোপুরি। শীঘ্রই সে ম্যারনের সাথে উপত্যকার নিচ থেকে পাহাড়ের চূড়ায় দৌড়াতে লাগল। মরুদ্যানে তাদের প্রতিযোগিতা তাদের প্রাত্যহিক অংশ হয়ে উঠল। প্রথম দিকে ম্যারন সহজেই জিতত, কিন্তু দ্রুতই বদলে গেল তা।

হিল্টো যাওয়ার পর বিশতম দিনের সকালে তারা গুহার মুখ থেকে শুরু করে পাথুরে উপত্যকার তলটা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পেরিয়ে গেল। কিন্তু যখন তারা বালিয়াড়ির মুখের দিকে উঠতে লাগল, তখন নেফার সামনের কিনারা ঘেষে চলল একা। অর্ধেক পথ উপরে উঠে সে হঠাৎ দ্রুত গতি দিল, ফলে তার পিছনে পড়ে গেল ম্যারন। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ফিরে তাকিয়ে নিচে থাকা ম্যারনের উদ্দেশ্যে উপহাস সূচক একটা হাসি দিল নেফার। তার দীর্ঘ ঘন চুল কাঁধের উপর উড়ছিল ভোরের বাতাসে দোল খেয়ে। পিছনে তখন সকালের সূর্য উঠছে এবং সোনালি রশ্মি তার মাথার চারপাশে চক্রাকারে আলোর জ্যোতি তৈরি করল।

নিচ থেকে টাইটা এর সবই দেখছিল এবং প্রায় গুহায় ফিরে যাবে এমন সময় মরুর নিরবতায় একটা রহস্যজনক শব্দ তাকে থামাল। সে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে নীলের মধ্যে উঁচু বৃত্তাকার একটা কালো দাগ দেখতে পেল এবং খুব কাছে অনুভব করল একটা স্বর্গীয় উপস্থিতি। ওটা আবার শব্দ করে চিৎকার দিল। ছোট ও ক্ষীণ, কিন্তু তা হৃদয় বিদীর্ন করে গেল। রাজ বাজ পাখির নির্ভুল ডাক!

বালিয়াড়ির চূড়ায় দাঁড়িয়ে নেফারও তা শুনল এবং তার মাথা ঘুরালো উৎসের খুঁজে। অবশেষে সে ক্ষুদ্র অবয়টা খুঁজে পেল এবং পাখিটার দিকে তার দুহাত তুলল। যেন এ ইশারাটা ছিল একটা আদেশ। বাজটা নিচের দিকে নামতে লাগল, আকারে স্ফীত হল। বাতাস তার সঁচালো ডানায় শাই শাই শব্দ তৈরি করছে। বাজটা নেফারের দিকে ঝাঁপ দিল, যদি ওটা ঐ গতিতে আঘাত করে তাহলে পাখিটা মাংস ছিঁড়ে নিবে অথবা হাড় ভেঙ্গে দিবে; কিন্তু নেফার পিছিয়ে গেল না। বাজটা সরাসরি আসছে তার ঊর্ধ্বমূখী চেহারার বরাবর।

সম্ভাব্য শেষ মুহূর্তে পাখিটা নিম্ন গতি ছেড়ে উধ্বমুখী হল এবং বালকটির মাথার উপর খুব কাছে চক্কর দিতে লাগল এক নাগারে। নেফার হাত তুলল এবং প্রায় তার বুকের নরম ও চকচকে সুন্দর পালক স্পর্শ করছিল। এক মুহূর্তের জন্যে টাইটার মনে হল পাখিটা বুঝি নিজে নিজে ধরা দিবে, কিন্তু অন্য দিকে ঘুরে উপরে উঠে গেল ডানা ঝাঁপটিয়ে। আরো একবার পাখিটা নিঃসঙ্গ ও স্নেহার্ত চিৎকার দিল। তারপর সুর্যের দিকে গতি তুলে চলে গেল, জলন্ত গোলকের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল যেন।

*

শেষ বার গেবেল নাগারে আসার সময় তার সাথে করে একটা পূর্ণ ওজনের যুদ্ধ ধনুক এনেছে হিল্টো। টাইটার নির্দেশনায় নেফার প্রতিদিন তা দিয়ে কঠোর অনুশীলন করে গেল, যতদিন না তার পিঠের মাংস পেশী তৈরি হলো এবং যতক্ষণ না সে অস্ত্রটা সঠিকভাবে নিক্ষেপ করতে পুরোপুরি সামর্থ হলো। লক্ষ্য স্থির করতে যেন তার বাহু ক্লান্ত না হয়ে কাঁপে সে দিকটাও দেখল টাইটা। তারপর টাইটার আদেশে সে একটা তীর উপরের দিকে পাঠালো যা ২০০ কিউবিট দূরের লক্ষ্যবস্তু ভেদ করল নিখুঁতভাবে।

নেফার পাহাড়ের পাদদেশের লুকানো ঝোঁপ থেকে নিজে একটা একাসিয়া গাছের কান্ড কেটে এর একটি আকৃতি দিল, ছাঁচলো এবং চকচকে করল যতোক্ষণ তা তার হাতে তা সুষম একটা ভারসাম্য এবং দৈর্ঘ্য পেল। তারপর সে ও টাইটা ঐতিহ্যগত নিয়মে লড়াই করল ভোরের ঠাণ্ডায়। প্রথমে নেফার টাইটার বয়সের কথা ভেবে উদাসী ভাব দেখাল, কিন্তু ম্যাগোস তাকে রক্তাক্ত করল এবং তার মাথার ত্বক থেকে একটা পিন্ড তুললে সে রাগান্বিত ও অপমানিত হল। তৎক্ষণাৎ আক্রমণ করল নেফার। কিন্তু বৃদ্ধ লোকটি দ্রুত এবং চটপটে। সে লাফ দিয়ে নেফারের কাত করা লাঠির আয়ত্তের বাইরে চলে গেল। তারপর দ্রুত হাত চালাল একটা অরক্ষিত কনুই ও হাঁটুতে যন্ত্রণাদায়ক আঘাত করার জন্য। তরবারি চালনায় টাইটা তার দক্ষতা একটু হারিয়ে ফেলেছে। হিল্টো তাদের জন্য ভারি কান্ডের তলোয়ার এনেছে এবং যখন টাইটা বুঝল যে তারা লাঠি দিয়ে যথেষ্ট লড়াই করেছে তখন সে তলোয়ার বের করল। সে নেফার ও ম্যারনকে দেখাল কি করে কাটতে, আঘাত করতে ও ফেরাতে হয়। তাদের সে প্রতিটি কৌশল পঞ্চাশ বার করে অনুশীলন করতে বাধ্য করল। তারপর আবার শুরু করল। দুপুরের খাবারের জন্যে বিরতি যখন পড়ল ততক্ষণে নেফার ও ম্যারন উভয়ই লাল হয়ে গিয়েছে এবং এমনভাবে তাদের ঘাম ঝড়ছিল যেন তারা নীলের জলে নিমজ্জিত হয়ে এসেছে, যদিও টাইটার ত্বক ছিল শুকনো ও ঠাণ্ডা। যখন ম্যারন এই বিষয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে মন্তব্য করল তখন সে শুধু মুখ টিপে হাসল। তোমার জন্মের অনেক আগেই আমি আমার ঘামের শেষ বিন্দু ঝড়িয়েছি।

অন্য দিনের বিকেলগুলোতে নেফার এবং ম্যারন পুরোপুরি নগ্ন হয়ে নিজেদের দেহে তেল মেখে কুস্তি করত। টাইটা তখন তাদের প্রতিযোগিতার আম্পায়ার হতো এবং উপদেশ ও নির্দেশনা দিত। যদিও ম্যারন এক হাত বেশি লম্বা ছিল এবং কাঁধ ও শারীরিক গঠনে ছিল বেশি ভারি, অপরদিকে নেফারের ছিল স্বাভাবিক সুষমতা। টাইটা তাকে শিখিয়েছিল কিভাবে প্রতিপক্ষের ওজন তার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে হয়। তারা একে অপরকে নিক্ষেপের পর নিক্ষেপ করত।

সন্ধ্যায় এবং গভীর রাতে টাইটা ও নেফার আগুনের পাশে বসত। তখন তারা প্রতিটি বিষয়ে ওষুধ থেকে রাজনীতি, যুদ্ধ এবং এমনকি ধর্ম নিয়ে পর্যন্ত বিতর্ক করতো। প্রায়ই টাইটা নতুন নতুন কোন তত্ত্ব দিত। তারপর নেফারকে তার উপস্থাপন ও যুক্তিতে ভুল বের করতে হতো। সে লুকানো ফাঁদ ও অযৌক্তিক বিষয় এই সব পাঠ দিত এবং এখন আরো বেশি ও অধিক কৌশলে নেফার সেসব আবিষ্কার করে গেল এবং জানতে আরো বেশি প্রশ্ন করত তাকে। তারপর সব সময় তারা বাও খেলার বিভিন্ন ধাঁধা উদ্ধার করত এবং পাথরগুলোর গতি ও আকৃতির অসীম সম্ভাবনা ও নিয়ম উদ্ধার করত।

যদি তুমি বাও-এর গুটিগুলোর সব বুঝতে পার, তবে তুমি আপনা আপনি জীবনকে বুঝতে পারবে, টাইটা তাকে বলল। খেলার চতুরতা ও সূক্ষ্ম তারতম্য বৃহৎ রহস্যের দিকে মনকে তীক্ষ্ণ করে।

দ্রুতই মাসটা কেটে গেল। তারপর নেফার যখন একটা আঘাতপ্রাপ্ত গজলা হরিণের পিছনে মরুভূমিতে জোড়ে ছুটছিল তখন তা সবার কাছে একটা ছোট বিস্ময়ের মতো মনে হল। হঠাৎ একদিন দিগন্তে তখন কিছু একটা দেখতে পেল সে। মরীচিকায় ভগ্ন হলুদ ধুলার ক্ষুদ্র মেঘ এবং তার নিচে দূরে নদীর উপত্যকায় ওয়াগনের অবয়ব দেখা গেল। তৎক্ষণাৎ সে গজলা হরিণটার কথা ভুলে হিল্টোর সাথে দেখা করতে ছুটল। যদিও হিল্টো শারীরিক ক্ষমতায় তার লোকদের চেয়ে এগিয়ে তবুও সে অনুপ্রাণিত হল যখন দেখল ভীষণ গতিতে নেফার ঝিকমিক করা তাপের মধ্য দিয়ে দৌড়ে আসছে।

হিল্টো, নেফার উচ্চস্বরে ডাকল, দূর থেকেই এবং হাঁপানোর কোন চিহ্ন ছাড়াই। প্রভু তোমায় ভালোবাসুক এবং তোমাকে অনন্ত জীবন দিক! কি খবর? কি খবর? হিল্টো প্রশ্নটার তাৎপর্য সঠিক ভাবে না বুঝার ভান করল এবং যখন নেফার তার পাশে হাঁটতে লাগল সে রাজ্যের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে বিশদ বর্ণনা করতে লাগল। উত্তরে আবার বিদ্রোহ হয়েছে। এবার টর্করা সহজে তা দমন করতে পারে নি। কঠিন লড়াইয়ে তিন দিনে সে চারশ লোক হারিয়েছে এবং তার ক্রোধ থেকে অর্ধেক বিদ্রোহী পালিয়ে গেছে।

হিল্টো, তুমি জানো এগুলো নয়, আমি তোমার কাছ থেকে অন্য কিছু শুনতে চাচ্ছি।

হিল্টো মাথা ঝাঁকিয়ে বে-র দিকে নির্দেশ করল। মনে হয় বিশেষ কিছু বিষয়ে এখন কথা বলার সময় নয়। সে কৌশলে পরামর্শ দিল। মহামান্য, আমাদের কি পরে এবং একা কথা বলা উচিত নয়?

নেফার বাধ্য হলো তার অধৈৰ্য্য দমাতে।

সে দিন সন্ধ্যায় যখন তারা গুহার মধ্যে আগুনের চারদিকে বসল তখন হিল্টোর সব বিষয়ে বিশদ বর্ণনাটা নেফারের কাছে যন্ত্রণাদায়ক হলো। সে সবকিছু টাইটার কাছে বিশদ করে বর্ণনা করল, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সে খবরটা: তা হচ্ছে আনুবিসের যাজকেরা দুঃখের কক্ষে যখন শবদেহ খুলেছিল তখন দেহ বদলের বিষয়টি আবিষ্কৃত হয়েছে। ফারাও নাজা কাইফান খবরটা চেপে রাখতে তার সর্বোত্তম চেষ্টা করছে এবং জন সাধারণের জানা থেকে তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। কারণ তার সিংহাসনের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। যদি জনগণ সন্দেহ করে বসে নেফার এখনও জীবিত! যাই হোক, এ রকম একটা অসাধারণ ঘটনা গোপন রাখা অসম্ভব যেখানে অনেক লোক বিশেষ করে যাজকেরা এবং সভাসদেরা এ বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন। হিল্টো রিপোর্ট করল যে এই গুজব এখন থেবস্ শহরে রাস্তায় রাস্তায় এবং বাজারে বহুল প্রচলিত। এমনকি তা শহর ও গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে।

আংশিকভাবে এ গুজবের ফলে দুই রাজ্যের অশান্তি আরো বেড়েছে এবং মজবুত হয়েছে। বিদ্রোহীরা নিজেদের বলছে নীল দল। নীল ট্যামোস বংশের রং, যেখানে নাজা তার রাজ রং বাছাই করেছেন সবুজ এবং টর্ক করেছে লাল।

এর সাথে সে আরো জানাল যে পূর্বে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। মিশরীয় ফারাও হুরিয়ান রাষ্ট্র দূতকে তার প্রভু ব্যালিয়নের রাজা সারগনের কাছে ফেরত পাঠিয়েছে, যে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিসের মাঝের বিশাল রাজ্যের অধিকারী। মিশরীয় ফারাও সারগনের বার্ষিক কর বাড়িয়ে বিশ লাখ স্বর্ণ দাবি করেছেন। পরিমাণটা অস্বাভাবিক যাতে সারগন কখনোই রাজি হবে না।

অর্থাৎ, এ কারণেই দুই রাজ্যের আর্মিতে লোক বাড়ানোনা হচ্ছে, টাইটা বলল হিল্টো থামতেই। অবশেষে এটা পরিষ্কার যে দুই ফারাও মেসোপটেমিয়ার সম্পদের প্রতি লোভী। তারা তা দখল করতে ইচ্ছুক। ব্যাবিলনের পর তারা লিবিয়া ও চালদিয়ার দিকেও দৃষ্টি দিবে। এবং যতোদিন না পুরো দুনিয়া তাদের দখলে আসছে তারা থামবে না।

হিল্টোকে হতভম্ব দেখাল। আমি এমন করে ভাবি নি, তবে সম্ভবত আপনিই সঠিক।

তারা দুজন বৃদ্ধ বেবুনের মতই চালাক। তারা জানে যুদ্ধ একটি একতার বিষয়। তারা আরও জানে যদি তারা মেসোপটেমিয়ার দিকে এগোয় তাহলে জনগণ দেশাত্মবোধের কারণে তাদের পিছনে যাবে। সেনারা লুষ্ঠিত মাল ও গৌরব ভালোবাসে। ব্যবসায়ীরা ভালোবাসে বাণিজ্য ও মুনাফা বৃদ্ধি। তাদের লোভ মেটাতে এ এক চমৎকার উপায়। এভাবে সহজেই জনগণকে তারা তাদের দলে নিতে পারবে।

ঠিক, হিল্টো সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। এখন আমি দিব্য চোখে সব দেখতে পাচ্ছি।

অবশ্যই, এটা আমাদেরও সুবিধা বয়ে আনেবে; টাইটা বলল। আমি আমাদের একটা দারুন সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছি। যদি টর্ক ও নাজার সাথে সারগন যুদ্ধে জড়ায়, তাহলে সে তার দলে আমাদের সাদর আমন্ত্রণ জানাবে।

আমরা মিশর ত্যাগ করতে যাচ্ছি! হিল্টো বিস্ময় প্রকাশ করল।

টাইটা ব্যাখ্যা করে বলল, যেহেতু নাজা ও টর্ক জানে নেফার এখনো জীবিত সেহেতু তারা আমাদের ধরতে আসবে। এখন একমাত্র পূর্বের পথটাই শুধু আমাদের জন্য ভোলা। দুই রাজ্যে আমাদের শক্তি ও সমর্থন তৈরি করতে এবং আমাদের শক্তিশালী মিত্রকে পেতে বেশি সময় লাগবে না। তারপর আমরা ফারাও নেফারের জন্মগত অধিকার দাবি করতে ফিরে আসবো।

বিষয়টা এবার তাদের কাছে পরিষ্কার। এখন এ পরিকল্পনার ধাঁধা থেকে বেড়িয়ে এসে সবাই তার দিকে নিরব দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তারা এতোটা ভাবেনি এবং এটা তাদের মাথায় কখনোই আসতো না যে তারা জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হবে। প্রথমে নেফার নিরবতা ভাঙ্গল। আমরা তা করতে পারি না, সে বলল। আমি মিশর ত্যাগ করতে পারি না।

টাইটা অন্যদের দিকে অর্থ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল এবং মাথা ঝাঁকিয়ে সিদ্ধান্তটা খারিজ করে দিল। অনুগতভাবে হিল্টো, বে এবং ম্যারন উঠে দাঁড়িয়ে গুহার বাইরে চলে গেল।

এমন পরিস্থিতি যে হবে টাইটা আগেই জানত। সে জানতো এটা মানাতে তার গুরু অভিব্যক্তি প্রয়োগ করতে হবে। সে বুঝতে পারল নেফারকে এ অবস্থা থেকে নড়ানো কঠিন হতে যাচ্ছে। বালকটি আগুনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাকে সে অবশ্যই এই নিরবতা ভাঙ্গতে বাধ্য করতে হবে। যখন সে তা করতে পারবে তখন টাইটার অবস্থান আরো শক্ত হবে।

এই পরিকল্পনার বিষয়ে আমার সাথে আপনার কথা বলা উচিত ছিল। নেফার অবশেষে বলল। আমি এখন আর বাচ্চা নই টাইটা। আমি যুবক এবং ফারাও।

আমি তোমাকে আমার ইচ্ছার কথা বলেছি, টাইটা শান্ত ভাবে বলল। আবার তারা নিরব হয়ে গেল দীর্ঘক্ষণের জন্যে। আগুনের শিখার মধ্য দিয়ে তাকিয়ে টাইটা বুঝল নেফারের দৃঢ় সংকল্পে ভাঁজ পড়ছে।

অবশেষে নেফার আবার কথা বলল, তুমি ভেবে দেখো, মিনটাকা রয়েছে।

টাইটা কিছু বলল না। সহজাত ভাবে সে বুঝল তারা দুজন তাদের সম্পর্কের একটা সংকটময় পরিস্থিতিতে অবস্থান করছে। এমনটা এক সময় না এক সময় আসতই। তাই সে তা এড়াবার কোন চেষ্টা করল না।

আমি মিনটাকাকে একটা বার্তা পাঠিয়েছিলাম, নেফার বলল। আমি তাকে বলেছি আমি তাকে নিচু এবং সেই সাথে আমি আমার জীবন ও অনন্ত আত্মার কসম খেয়ে জানিয়েছি যে আমি তাকে ছেড়ে যাবো না।

এবার টাইটা নিরবতা ভাঙ্গল, তুমি কি নিশ্চিত যে মিনটাকা তোমার এই বোকার মতো শপথটি গ্রহণ করেছে যা তোমাকে, তাকে এবং তোমার আশপাশের সবাইকে বিপদে ফেলতে পারে?

হ্যাঁ, অবশ্যই। হিল্টো… নেফার থেমে গেল এবং ক্যাম্পের আগুনের শিখার উপর দিয়ে টাইটার দিকে চোখ পড়তেই তার অভিব্যক্তির পরিবর্তন হল। তারপর হঠাৎ লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে সে গুহার প্রবেশ পথের দিকে চলে গেল ধুপ-ধাপ শব্দ তুলে।

বালকের মতো নয় বরং একজন রাগান্বিত যুককের ন্যায় সে উঠে চলে গেল। গত এই কমাসে নেফার পুরোপুরি বদলে গেছে। একটা গভীর সম্ভষ্টি অনুভব করল টাইটা। সামনের পথ কঠিন হবে এবং নেফারের এই সকল নতুন পাওয়া শক্তি ও সংকল্পের দরকার হবে তখন।

হিল্টো, নেফার অন্ধকারে ডাক দিল। আমার কাছে এসো। সম্ভবত হিল্টো তার কণ্ঠে নতুন এক কর্তৃত্ব শুনল কারণ সে দ্রুত এল এবং হাঁটু ভেঙে নেফারের সামনে বসল।

মহামান্য? জিজ্ঞেস করল।

তুমি কি সে বার্তাটা পৌঁছিয়েছে যা আমি তোমাকে বিশ্বস্থতার সাথে ন্যস্ত করেছিলাম? নেফার জানতে চাইল।

হিল্টো আগুনের পাশে থাকা টাইটার দিকে চোখ তুলে তাকাল এক নজর। তার দিকে তাকিয়ো না। নেফার দাঁত কটমট করে বলল। আমি তোমাকে প্রশ্ন করছি। আমাকে উত্তর দাও।

আমি বার্তাটি পৌঁছাইনি। হিল্টো জবাব দিল। আপনি কি কারণটা শুনতে চান, কেন দেইনি?

আমি কারণটা ভালো করেই জানি। নেফার বিরক্ত প্রকাশ করে বলল। কিন্তু এটা শুনো রাখো, যদি ভবিষ্যতে কখনো তুমি আমাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে না মান তবে তুমি এর সর্বোত্তম শাস্তি পাবে।

আমি বুঝেছি। হিল্টো দৃঢ়তার সাথে বলল।

যদি আবার কখনো এমন হয় যে ফারাও ও মধ্যস্থতাকারী এক বৃদ্ধ মানুষের মধ্যে এক জনকে বাছাই করতে হবে তখন তুমি ফারাওকে বেছে নিবে। তোমার কাছে কি তা পরিষ্কার?

দুপুরের সূর্যের মতো এটা আমার কাছে পরিষ্কার। অনুতপ্তভাবে বৃদ্ধ হিল্টো তার মুখ ঝুলিয়ে রাখল কিন্তু তার দাঁড়ির মধ্যে একটা হাসি ফুটে উঠল।

তুমি আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেছো, হিল্টো। এখন বল, রাজকন্যা সম্পর্কে তোমার কাছে আর কি খবর আছে?

হিল্টো হাসি থামাল এবং একটু ইতস্তত করল। সাহস সঞ্চার করার চেষ্টা করল ভয়ংকর সংবাদটা দেবার জন্যে।

কথা বলল। নেফার আদেশ দিল। তুমি এতো দ্রুতই তোমার দায়িত্ব ভুলে গেলে?

মহামান্য, সংবাদটা আপনাকে সুখী করবে না। ছয় সপ্তাহ আগে রাজকুমারী মিনটাকার সাথে ফারাও টর্ক উরুকের বিয়ে হয়েছে।

নেফার এমনভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল যেন সে একটা গ্রানাইটের মূর্তি। দীর্ঘ সময় জুড়ে গুহার মধ্যে শুধু আগুনে একাসিয়ার ডাল পোড়ার শব্দ শুনা গেল। তারপর আর কোন কথা না বলে নেফার হিল্টোকে অতিক্রম করে হেঁটে মরুর আঁধারে বাইরে চলে গেল।

যখন সে ফিরল তখন পূর্ব আকাশে ঊষা লাল রং ধারণ করছে। হিল্টো গুহার পিছনে তাদের ভেড়ার চামড়া ভাজ করছিল। কিন্তু টাইটা ঠিক সেভাবেই বসে আছে যেভাবে নেফার তাকে ছেড়ে গিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্য সে ভাবল বৃদ্ধ মানুষটি ঘুমিয়ে আছে। আর তখনই টাইটা তার মাথা তুলে তার দিকে তাকাল তার উজ্জ্বল চোখ নিয়ে, যা আগুনের আলোতে ছিল অন্য রকম স্বতন্ত্র।

তুমিই ঠিক, আমি ভুল ছিলাম। তোমাকে আমার এখন দরকার, অন্য সব সময়ের চেয়ে বেশি, বুড়ো বন্ধু! নেফার বলল। তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?

তোমাকে তা বলতে হবে না। টাইটা নরম সুরে বলল।

আমি তাকে টর্কের দাসত্বে ছেড়ে দিতে পারি না। নেফার বলল।

না।

টাইটার বিপরীতে এসে নেফার তার মুখোমুখি বসে ধীর লয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে লাগল। ঝড় বয়ে চলে গেছে। এবং তারা এখনো এক সাথে।

নেফার কয়টি কাটা গুঁড়ি তুলে নিয়ে আগুনের গভীরে তা ঠেলে দিল। তারপর টাইটার দিকে চোখ তুলে তাকাল দৃঢ় দৃষ্টি নিয়ে।

তুমি আমাকে শিখিয়েছো দূরে দেখতে, সে বলল। কিন্তু আমি কখনোই সে উপহারটা অর্জন করি নি। অন্তত গত রাতের আগে না। বাইরে অন্ধকারের অখন্ড নিরবতায় আমি দূর থেকে মিনটাকাকে চেষ্টা করেছিলাম দেখতে। এইবার আমি কিছু দেখেছি, টাইটা। কিন্তু তা ছিল ক্ষীণ এবং আমি তার কিছুই বুঝি নি।

তার জন্যে তোমার ভালোবাসা তোমাকে তার অলৌকিকভাবে অনুভূতি প্রবণ করেছে। টাইটা ব্যাখ্যা করল। তুমি কি দেখেছো?

আমি শুধু ছায়া দেখেছি, কিন্তু সেই সাথে আমি ভয়ানক দুঃখ ও কষ্ট অনুভব করছি। আমি এতোটাই হতাশা অনুভব করলাম যে তা আমাকে আমার মৃত্যু কামনা করতে বাধ্য করল। আমি জানি এগুলো মিনটাকার অনুভূতি এবং আমার নিজের নয়।

টাইটা অভিব্যক্তি হীনভাবে আগুনের দিকে চেয়ে রইল এবং নেফার বলে গেল, তোমাকে অবশ্যই আমার জন্য দূর থেকে তাকে দেখতে হবে। ভয়ংকর কোন ভুল আছে। একমাত্র তুমিই এখন তাকে সাহায্য করতে পারবে, টাইটা।

তোমার কাছে কি মিনটাকার কোন কিছু আছে? সে জিজ্ঞেস করল। কোন উপহার বা চিরকুট যা সে তোমাকে দিয়েছিল?

নেফারের হাত তার গলার নেকলেসের কাছে চলে গেল। সে ছোট সোনার লকেটটি স্পর্শ করল যা চেইনের মধ্যবর্তী স্থানে ঝুলছিল। এটি আমার সবচাইতে মূল্যবান সম্পদ।

টাইটা আগুনের উপর দিয়ে তা নিতে হাত বাড়াল। এটি আমাকে দাও। নেফার ইতস্তত করল, তারপর হুক খুলে লকেটটি তার শক্ত মুঠিতে নিল।

আমার কাছে এটা নিজের চাইতেও দামী। শেষ বার সে এটি স্পর্শ করেছিল। তার এক গোছা চুল এর ভেতর রয়েছে।

তাহলে এটি খুবই কার্যকর হবে। এটা তার অংশ ধারণ করে। যদি তুমি চাও যে আমি তাকে সাহায্য করি তাহলে এটি আমাকে দাও। নেফার তাকে তা দিল।

এখানে অপেক্ষা করো। বলেই টাইটা উঠে দাঁড়ালো। যদিও সে অন্ধকারে সারাটা সময় তার পা ভেঙে আসন করে বসেছিল, তবুও তার চলাফেরায় কোন জড়তা নেই। একজন যুবক, পৌরুষ দীপ্ত মানুষ যেন সে। ভোরের বাতাসে সে বেরিয়ে বালিয়াড়ির চূড়ায় গিয়ে উঠল। তারপর আলখেল্লাটা পায়ের চারপাশে একত্রিত করে সে বালির উপর আসন গেড়ে বসল উষার মুখোমুখি হয়ে।

মিনটাকার লকেটটি সে তার কপালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করল। তারপর হালকাভাবে দুলতে লাগল এপাশ ওপাশ। সূর্য দিগন্তে পরিষ্কার হয়ে তার চেহারায় আলো ছড়াতে লাগল।

তার ডান হাতে থাকা লকেটটি মনে হল যেন এক অদ্ভুত জীবন পেল হঠাৎ। টাইটা ওটার মধ্যে তার নিজের হৃদ্স্পন্দনের ছন্দ, নাড়ির মৃদু স্পন্দন অনুভব করল। সাথে সাথে সে মনটা খুলে দিল এবং অস্তিত্বের স্রোত মুক্তভাবে প্রবেশ করতে দিল। তার চারপাশে বিশাল নদীর ন্যায় এক জগৎ ফুটে উঠল তখন। তার নিজের আত্মা তার দেহ থেকে বেরিয়ে অনেক উপরে উঠে গেল। যেন সে কোন দ্বৈত পাখির ডানায় ভর করেছে। সে উড়ছিল; অপরিষ্কার মাঠ, শহর, বন, ভূমি ও মরুর অসংখ্য ছবি তার নিচে ঘুরপাক খাচ্ছে একে একে। সে আর্মিদের এগোতে দেখল, সেনা দল হলুদ ধুলোর ঝড় তুলছে, তাদের বর্শার মাথা চকচক করল। সে উজানে জাহাজ দেখল, ঢেউ ও বাতাসে যা ভেঙে গিয়েছে। সে একটা জ্বলন্ত শহর দেখল, ওগুলো লুণ্ঠন করা হয়েছে এবং সে তার মাথার ভেতর অচেনা কণ্ঠ শুনল। জানে ওগুলো অতীত ও ভবিষ্যত থেকে আসছে। সে অনেক আগের মৃতদের মুখ দেখল এবং এমনকি যারা এখনো জন্মায়নি তাদেরও।

সে চলতেই লাগল এবং তার সত্তা আরো বিস্তৃতি পেল। সবর্দা লকেটটি তার সাথে রইল চুম্বকের ন্যায়। মনে মনে সে ডাকল, মিনটাকা! এবং অনুভব করল লকেটটা গরম হচ্ছে। তারপর এক সময় তা তার হাতের মধ্যে গরম হয়ে হাত পুড়িয়ে দিতে চাইল।

ধীরে দৃশ্য পটগুলো আরো পরিষ্কার হল এবং সে তার মিষ্টি কণ্ঠের জবাব শুনল, আমি এখানে। কে আমায় ডাকল?

মিনটাকা, আমি টাইটা। সে উত্তর দিল, কিন্তু সে বুঝল কোন অশুভ সত্তা বাঁধা দিচ্ছে এবং তাদের দুজনের যোগাযোগ ভেঙে দিল। মিনটাকা চলে গিয়েছে। এবং পরিবর্তে সেখানে উপস্থিতি হল এক চরম অবস্থা। সে সমস্ত শক্তি তার উপর স্থির করল, কালো মেঘটা হটানোর চেষ্টা করল। তারপরই সব কিছু মিলিত হয়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো কোবরার আকার নিল। এই একই রকম অশুভ প্রভাব যা সে ও নেফার এর আগে বার-আম-মাসারার পাহাড়ে মুখোমুখি হয়েছিল রাজ বাজপাখির নীড়ে।

সে মনে মনে কোবরার সাথে লড়াই করতে ও সর্পটাকে ফেরত পাঠাতে তার শক্তি বৃদ্ধি করল। কিন্তু বশ স্বীকার করার পরিবর্তে সাপের প্রতিচ্ছবি আরো স্পষ্ট ও আরো ভয়ংকর হল। হঠাৎ সে বুঝল এটা কোনো মানসিক প্রকাশ নয়, বরং মিনটাকার জন্যে সরাসরি ও মারাত্মক হুমকি। অশুভ সত্তাটা হঠাতে এবং মিনটাকার কাছে পৌঁছতে সে তার চেষ্টা চারগুণ বৃদ্ধি করল, কিন্তু যন্ত্রণা এবং দুঃখটা এতো বেশি যে তাদের মাঝে তা অভেদ্য বাঁধা হয়ে দাঁড়াল।

তারপর হঠাৎ সে একটা হাত দেখতে পেল, চিকন ও মুষ্ঠিবদ্ধ; অভিশপ্ত সরু মাথাটা ধরতে যাচ্ছে। সে জানত এটা মিনটাকার হাত, কারণ নীল লেপিজ লাজুলি পাথরের আংটি যাতে তার স্মারক খোদাই করা তা তার তর্জনীতে শোভা পাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ সে তার সমস্ত জীবনী শক্তি দিকে বিষধর সাপটাকে আয়ত্তে আনল এবং মিনটাকার হাত কামড়ে দেওয়া থেকে প্রতিরোধ করল। এমন কি যখন মিনটাকা সাপটার প্রসারিত ফণায় আঘাত করল তখনও। কোবরা তার অর্ধেক গুটিয়ে নিল এবং প্রায় পোষা বিড়ালের ন্যায় তার মাথা পেতে দিল আদর পেতে।

যা করতে হবে তা এটাকে করতে বাধ্য করুন। টাইটা মিনটাকার কণ্ঠ শুনল এবং আরো এক কষ্ঠ যা উত্তর দিল তাও সে চিনল। এমনটা আমি আর কখনো দেখি নি। তোমাকে অবশ্যই দূতটাকে তোমার হাত দিয়ে আঘাত করতে হবে। যা তাকে দেবীর উপহার সরবরাহ করতে বাধ্য করবে। টাইটা চিনল কণ্ঠটা হচ্ছে অ্যাভারিসের হাহোর মন্দিরের প্রধান যাজিকার। দুঃখে জর্জরিত মিনটাকা দেবীর পথ বেছে নিতে চলেছে।

মিনটাকা! তার কাছে পৌঁছতে সে নিজের আরো জোর প্রয়োগ করল এবং সফলও হল শেষ পর্যন্ত।

টাইটা? সে ফিসফিসিয়ে বলল, কারণ মিনটাকা অবশেষে তার ব্যাপারে সচেতন হয়েছে। টাইটার দৃষ্টি এতো প্রসারিত হল যে সে সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পারল।

মিনটাকাকে একটা পাথুরে দেয়ালের শয়নকক্ষে দেখা গেল। একটা ঝুড়ির সামনে সে হাঁটুগেড়ে বসে আছে। পবিত্র যাজিকা তার পাশে এবং তার সামনে মারাত্মক বিষধর সাপটা ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

তোমাকে এই পথ বেছে নিতে হবে না। টাইটা আদেশের স্বরে তাকে বলল।

এটা তোমার জন্যে নয়। প্রভু তোমার জন্য অন্য ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন। তুমি কি আমায় শুনছো?

হ্যাঁ! মিনটাকা তার দিকে তার মাথা ঘুরাল যেন সে তার মুখ দেখতে পায়।

নেফার জীবিত। নেফার বেঁচে আছে। তুমি কি আমায় শুনছ?

হ্যাঁ! ওহ, হ্যাঁ।

শক্ত হও মিনটাকা, আমরা তোমার জন্যে আসবো। নেফার ও আমি তোমার জন্যে আসছি।

তার মনোযোগ এতো তীব্র ছিল যে, টাইটা তার আঙুলের নখ নিজের হাতের তালুর গভীরে ঢুকিয়ে দিল এবং রক্ত ঝড়তে লাগল। সে আর তাকে ধরে রাখতে পারল না, সে পিছলে যেতে লাগল তার দৃষ্টি থেকে। তার প্রতিচ্ছবি ভোলা ও ক্ষীণ হয়ে গেল এক সময়। কিন্তু তা হারিয়ে যাবার পূর্বে সে তার হাসি দেখল। একটা সুন্দর জিনিস, ভালোবাসায় পূর্ণ এবং আশায় নতুন।

শক্ত হও! তাকে উদ্বুদ্ধ করল সে। শক্ত হও, মিনটাকা! তার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি তার কাছে ফিরে এল, যেন অনেক দূর থেকে তা আসছে।

*

বালিয়াড়ির পাদদেশে দাঁড়িয়ে নেফার তার অপেক্ষায় ছিল। টাইটা অর্ধ পথ নামতেই সে তাকে দেখে বুঝল গুরুত্ব পূর্ণ কিছু ঘটেছে। তুমি তাকে দেখেছ! সে চিৎকার করে উঠল এবং এটা কোন প্রশ্ন ছিল না। তার কি হয়েছে? সে দৌড়ে এগিয়ে এল টাইটার সাথে মিলতে।

আমাদের তার প্রয়োজন। বলে টাইটা একটা হাত নেফারের কাঁধে রাখল। সে কখনোই নেফারকে খুলে বলতে পারবে না সে মিনটাকাকে কি পরিমাণ দুঃখ, দুর্দশার মধ্যে পেয়েছে কিংবা তার আপন ভাগ্য যা সে নিজের জন্যে প্রস্তুত করেছিল। কখনোই নেফার তা সহ্য করতে পারবে না। বরং তা তাকে কোন ভয়ংকর কাজে ঠেলে দিবে যা উভয় প্রেমিক প্রেমিকাকে শেষ করে দিতে পারে। তুমিই ঠিক। টাইটা বলে গেল।

এই ভূমি ছাড়ার আমার পরিকল্পনাটা এবং পূর্ব দিকে নতুন সুরক্ষা খুঁজে পাওয়ার বিষয়টা স্থগিত রাখতে হবে এখন। আমাদের মিনটাকার কাছে যেতে হবে। আমি তাকে ওয়াদা করেছি।

হ্যাঁ! নেফার সম্মতি জানিয়ে বলল। আমরা কখন অ্যাভারিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছি?

টাইটা জবাবে বলল, জরুরি ভাবে। আমরা দ্রুতই রওয়ানা দিচ্ছি।

*

অ্যাভারিস থেকে দক্ষিণের ছোট্ট গ্যারিসনে পৌঁছতে তারা পনের দিনের কঠিন একটা ভ্রমণ করল এবং সেখান থেকে নতুন অশ্ব সরবরাহ স্টেশন থেইন যেতে তাদের লাগল আরো এক দিন। পথে চার বার তারা ঘোড়া বদলালো। এই দীর্ঘ পথে টাইটা মিলিটারী গ্যারিসন এবং ক্যাম্প থেকে রাজ আদেশনামা ব্যবহার করে দুর্বল প্রাণী বদলালো ও প্রয়োজনীয় মালপত্র ভরে নিল, যা নাজা তাকে দিয়েছিল।

গেবেল নাগার ত্যাগ করার পর তারা তাদের পরিকল্পনা নিয়ে অবিরাম ভেবেছে, জানা কথা এসব ফারাও টর্ক উরুকের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। পথে রক্ষী সেনাদলের অফিসারদের সাথে কথা বলে তারা জেনেছে যে টর্কের এখন নিজের অধীনে সাতাশটি পুরোপুরি প্রশিক্ষিত ও অস্ত্রে সজ্জিত রেজিমেন্ট রয়েছে এবং সেই সাথে প্রায় তিন হাজার রথ। বিপরীতে এই বিশাল সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে মোকাবেলা করতে তাদের আছে মাত্র একটা ওয়াগন, যা দীর্ঘ কঠোর পরিশ্রমের চিহ্ন বহন করছে এবং যার একটা চাকা যে কোন অসম পরিস্থিতিতে ভেঙ্গে পড়তে পারে। চাকাটা পাকানো সুতা ও চামড়া দিয়ে আটকানো। সংখ্যায় তারা মাত্র চারজন: নেফার, ম্যারন, হিল্টো এবং বে। আর পঞ্চম জন টাইটা।

ম্যাগোস নিজে কমপক্ষে ২৭টি রেজিমেন্টের সমকক্ষ, হিল্টো বলল। তাই সেদিক দিয়ে বললে আমরা টর্কের সমকক্ষ।

হিল্টো থেইনের সেনা ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা ক্যাপ্টেনকে চিনত। গভীর ক্ষত ও ধূসর কেশর বৃদ্ধ যোদ্ধাটির নামা সোক্কো। অনেক আগে তারা একসাথে রেড রোড দৌড়িয়েছিল। তারা একসাথে যুদ্ধ করেছে, আনন্দ উৎসব করেছে এবং সঙ্গ উপভোগ করেছে। দীর্ঘ এক ঘণ্টা অতীত রোমন্থন করার পর ও এক পাত্র মদ পান করার পর হিল্টো তাকে আদেশ নামাটা দিল। সোক্কো তার নিচে-উপরে হাত দিয়ে ধরল এবং জ্ঞানীর ন্যায় পরখ করল।

ফরাও এর সীলমোহরটা দেখো, হিল্টো মোহরটা স্পর্শ করল।

যদি আমি তোমাকে না জানতাম হিল্টো এবং হুরাসের কসম, আমি সম্ভবত ভাবতাম তুমি ঐ সুন্দর ছবিটি নিজেই এঁকেছো। সোক্কো স্ক্রৌলটা হিল্টোকে ফিরিয়ে দিল। তা তোমার কি প্রয়োজন বৃদ্ধ বন্ধু?

নতুন অশ্ব সরবরাহ দলের কয়েকশ ঘোড়া থেকে তারা সতেজ কয়টা ঘোড়া বাছাই করল। তারপর টাইটা সেন্য দলের পার্ক করা রথগুলোর নিকট গেল যেগুলো মাত্র অ্যাভারিসের কারিগরদের কাছে থেকে পাঠানো হয়েছে। সে তিনটা যান বাছাই করে সতেজ ঘোড়াগুলোকে ওগুলোর সাথে বেঁধে দিল।

থেইন ছাড়ার সময় টাইটা তাদের পুরোনো ওয়াগনটা চালাচ্ছিল। ম্যারন, হিল্টো এবং নেফার প্রত্যেকে একটা করে নতুন রথ চালাচ্ছে। এদিকে বে তখন আরো অতিরিক্ত বিশটি ঘোড়া তাদের পিছনে নিয়ে আসছিল। তারা সরাসরি অ্যাভারিসের উদ্দেশ্যে চলল এবং কিন্তু শহরের যাবার একটু ঘোড়ানো পথ বেছে নিল।

মরু কিনারে একটা ছোট মরুদ্যান ছিল যা বেদুইন ও ব্যবসায়ীরা পূর্বে দিকে যেতে ও ফিরতে ব্যবহার করে থাকে।

সেখানে পৌঁছে যখন অন্যরা গাড়ি থেকে খাবার নামাচ্ছিল, যা তারা থেইন, থেকে এনেছে; টাইটা তখন সেখানে অবস্থানরত অন্য যাত্রী দলের অ্যাশিরিয়ান প্রভু যে কাছেই ক্যাম্প করেছে তার সাথে কুশল বিনিময় করতে গেল। লোকটি দূর সাগরের ভূমি থেকে হাত ভরা নোরাং ছেঁড়া কাপড় ও বিশটি পশমের গালিচা বয়ে এনেছে। ওগুলোর মান ও উপাদান উন্নত ছিল না কিন্তু তারপরও টাইটা জিনিসগুলো অত্যাধিক দাম দিয়ে কিনে নিল। ঐ অ্যাশিরিয়ানের বাচ্চা একটা গলা কাটা ডাকাত, কার্পেটগুলো ওয়াগনে তুলতে তুলতে সে বিড়বিড় করে বলে উঠল।

তা আমাদের এসবের কি প্রয়োজন? নেফার জানতে চাইল। কিন্তু প্রশ্নটা না শোনার ভান করল টাইটা।

ঐ রাতে টাইটা তা রূপালি চুলের কেশর কুজ কন্টক গাছের বাকলের রস দিয়ে রাঙালো যা তার চেহারায় একটা নাটকীয় পরিবর্তন আনল।

খুব ভোরে অন্ধকার থাকতেই আবার সে ঘোড়াগুলো ও রথের দায়িত্ব বে-কে দিয়ে বাকিদের নিয়ে ভাঙা ওয়াগনে চড়ে বসল। ধুলোময় কার্পেটের স্তূপের উপর বসে পশ্চিমে অ্যাভারিসের দিকে চলল তারা।

সবাই টাইটার সংগ্রহ করা ছেঁড়া ও জীর্ণ কাপড় পড়েছে। টাইটা পরিধান করেছে একটা লম্বা জামা এবং তার মুখের নিচের অংশটুকো চালাডিসের অধিবাসীদের ন্যায় নেকাবে ঢাকা। কালো করে রাঙ্গানো চুলে তাকে আর ম্যাগোস বলে চেনা যাচ্ছে না।

উত্তরের রাজকীয় শহরে পৌঁছতেই তাদের সন্ধ্যা হয়ে গেল। সেখানে দেয়ালের বাইরে কয়েক হাজার মানুষের স্থায়ী বসবাস; অধিকাংশই ভিখারী, পরিভ্রমী অভিনেতা বা বিদেশী ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য অভদ্র লোকজন। তারা তাদের মাঝে ক্যাম্প করল। পরদিন সকালে ম্যারেনের কাছে ওয়াগনের দায়িত্বে ছেড়ে শহরের বাইরে সূর্যোদয়ের সময় ফটক খোলার অপেক্ষায় দাঁড়ানো ভিড়ে যোগ দিতে চলে গেল তারা।

যখন তারা শহরের রক্ষীদের পেরিয়ে গেল, হিল্টো সরাইখানা ও গণিকাগৃহের পুরানো কোয়ার্টারের সরু রাস্তা বরাবর এগিয়ে গেল যেখানে সে আশা করল তার কিছু ঘনিষ্ট বন্ধু ও পূর্বের সহযোদ্ধা খুঁজে পাবে এবং তাদের কাছ থেকে সবচেয়ে নতুন খবর সংগ্রহ করতে পরবে। টাইটা নেফারকে তার সাথে নিল এবং তারা জনাকীর্ণ সদা জাগ্রত শহরের রাস্তা দিয়ে প্রাসাদের ফটকের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করল। তারা ভিখারী, ব্যবসায়ী ও সরবরাহকারীদের সাথে যোগ দিল। টাইটা প্রাসাদে ঢোকার কোন চেষ্টা করল না, বরং সকালটা চারপাশের লোকজনের কথা শুনে এবং অন্যান্য অলসদের সাথে কথা বলে ব্যয় করল।

অবশেষে টাইটা ব্যাবিলিয়ানের এক সওদাগরে সাথে আলোচনায় যোগ দিল। তার নিজের মতই লোকটির কাপড় পড়া, যে নিজেকে নিনতুরা বলে পরিচয় দিল। একজন মেসোপটেমিয়ার অধিবাসীর মতো টাইটা আক্কাডিয়ান ভাষায় কথা বলল, কারণ সে এই বেশ নিয়েছে। ইথোপিয়া থেকে আনা দামী ও অপ্রতুল এক পাত্র কফি তারা ভাগাভাগি করল এবং নিতুরাকে মোহিত করার জন্য টাইটা তার সব কৌশল প্রয়োগ করল যে কিনা প্রাসাদের বাইরে দশ দিন যাবৎ ঘুরে বেড়াচ্ছে আর তার পালা আসার অপেক্ষায় রয়েছে কখন টর্কের নতুন স্ত্রীর সামনে সে তার পণ্য প্রদর্শনের করবে। সে ইতোমধ্যে প্রাসাদে ঢুকে তরুণ বধুর সামনে উপস্থিত হওয়ার জন্য প্রাসাদের উজিরকে প্রত্যাশিত চড়া বকশিশ দিয়েছে, কিন্তু তারপরও তার আগে আরো অনেকে রয়ে গেছে।

সে বলল, টর্ক তার নতুন স্ত্রীর সাথে নিষ্ঠুর ব্যবহার করছে। নতুন রাণী তাকে তার সাথে বিছানায় যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে না। নিতুরা মুখ টিপে হাসল, তার জন্যে সে বেশি বন্য, উত্তেজিত পুরুষ হরিণের ন্যায়। রানী তার পা আড়াআড়ি করে রাখে এবং তার ঘরের দরজা তালাবদ্ধ। টর্ক মূল্যবান উপহার দিয়ে তার হৃদয় জিততে চাচ্ছে। কিন্তু তার মন গলছে না। সে সবকিছু কেনে যা তাকে সাধা হয় এবং তারপর তাকে রাগাতে সে তৎক্ষণাৎ তা বিক্রি করে দেয় পানির দরে এবং শহরের দরজায় দাঁড়ানো গরিবদের মধ্যে তা বিলিয়ে দেয়। উরুতে চাপড় দিয়ে নিতুরা হাসিতে ফেটে পড়ল। লোকে বলে সে একই জিনিস বারবার কেনে এবং টর্কও তার মূল্য পরিশোধ করতে থাকে।

টর্ক কোথায়? টাইটা প্রশ্ন করল।

 সে দক্ষিণে ভ্রমণ করছে? নিনতুরা জবাব দিল। সে বিদ্রোহরে আগুন চাপা দিচ্ছে কিন্তু পিঠ ঘোরাতে না ঘোরাতে আবার আগুন তার পিছনে ছড়িয়ে পড়ে।

এই রাণী মিনটাকার সামনে উপস্থিত হতে প্রাসাদে প্রবেশের জন্য আমি কার কাছে যেতে পারি?

প্রাসাদের উজির, সসাথে যার নাম, মোটা, খোঁজা উদ্ভট লোকটার কাছে। নিতুরা টাইটার শারীরিক অবস্থা বুঝতে পারে নি। টাইটা সোলেথকে তার সুনাম দিয়ে জানত এবং সে ঐ খোঁজাদের একজন যাদের মাঝে গোপন ভ্রাতৃত্বটা বিদ্যমান।

আমি তাকে কোথায় পেতে পারি? টাইটা জিজ্ঞেস করল।

তার সামনে যাবার অনুমতি পেতে হলে তোমাকে একটা স্বর্ণের আংটি দিতে হবে, নিতুরা তাকে সতর্ক করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *