৫.৮ প্রলয় ঝড় শেষ হল

তিন দিনের দিন প্রলয় ঝড় শেষ হল। তবু কাহারেরা বাঁচল। চিরকাল বাচে। দুর্ভিক্ষ মহামারী বন্যা ঝড় কতবার হয়েছে, কাহারেরা মরতে মরতেও বেঁচেছে। এবারও ঝড়ে কয়েকজন মরেছে, ঘায়েল হয়েছে কয়েকজন; সুচাঁদ পিসি পা ভেঙে পড়ে আছে হাসপাতালে করালী। তাকে হাসপাতালে দিয়েছে। নয়ানের মায়ের হয়েছিল কঠিন অসুখ। কোনো রকমে সেরে উঠেছে। বনওয়ারীই তাকে এক মুঠো করে ভাত দিচ্ছে। ঘরদোর গিয়েছে, মাঠভরা ফসল বরবাদ হয়েছে, ফসলের শিষে ধান নাই, তুষ হয়েছে শুধু, শাস নাই-খোসা, শুধু খোসা, শুধু খোসা ধরেছে। গাছপালা ডাল ভেঙে ন্যাড়া হয়েছে। বাঁশগুলো শুয়ে পড়েছে। গরু বাছুর ছাগল মরেছে, হাঁস ভেসে গিয়েছে জলের স্রোতে। এর পরেও যারা বেঁচে রয়েছে, তারা ভাবছে— তাদের বাচাবে কে? বাবাঠাকুর নাই, কে তাদের রক্ষা করবে।

বনওয়ার চেষ্টা করছে। উল্টেপড়া গাছটিকে আবার খাড়া করে গোড়াটা নতুন পাকা মসলা দিয়ে বাধিয়ে দিলে। খুব একটা বড় পুজোও দিলে। ফিরে এস বাবা, ফিরে এস।

ওদিকে হাঁ-হাঁ করে এগিয়ে আসছে পেটের ভাবনা। মাঠের ধান তুষ হয়ে গিয়েছে, তা ছাড়া সে-তুষ গরু-বাছুরেও খেতে পারবে না। ধানের দর হয়েছে চার টাকা থেকে আট টাকা-চালের মন ষোল টাকা। ভূ-ভারতে কেউ কখনও শোনে নাই এ কথা। মুনিঋষিতে ভাবে নাই, পুরাণেও নেকা’ নাই। যুদ্ধে নাকি খেয়ে নিচ্ছে সব। মনিবেরা লাফাচ্ছেন, ধান বিক্রি করে টাকা করবেন। কৃষাণদের ধান দেবেন বলে মনে লাগছে না। শুধু তাগাদা দিচ্ছেন—তুষ হোক আর যাই হোক, ধান কেটে ফেল!

বুঝতে পারে বনওয়ারী তাদের ‘রবিয়টি’ অর্থাৎ অভিপ্ৰায়টি। ধান কাটলে খড় ঘরে। উঠবে। খড়ের দরও চরমে উঠেছে ধানের মতই। চল্লিশ টাকা কাহন বিক্রি হচ্ছে, শেষতক একশো দুশো টাকা পর্যন্ত উঠবে। খড় ষোল আনাই পাবেন মনিবেরা। কাহারদের শুধু তুষের। ভাগ নিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে। যুদ্ধে তুষ খায় না? —রতন প্রহ্লাদ এরা সেই প্রশ্ন করে। বনওয়ারীর কিছু প্রত্যাশা আছে। সায়েবডাঙার পাঁচ বিঘে নতুন বন্দোবস্ত নেওয়া জমির খড়টা পাবে। ভাগের জমিরও খড় কিছু পাবে। সায়েবডাঙা উঁচু মাঠের জমি, ওখানকার ধানও সমতল নিচু মাঠের মত। জলে ডোবে নাই, ওখানে কিছু ধান পাবে সে। কিছু কেন, ভালই পাবে। কিন্তু অন্য কাহারেরা কি করবে?

পাশাপাশি জমিতে ধান কাটতে কাটতে রতন বনওয়ারীকে প্রশ্ন করলে। তখন কার্তিক শেষ হয়েছে, অগ্রহায়ণের প্রথম। এবার ওই জল-ঝড়ের জন্য, শীত এরই মধ্যে ঘন হয়ে উঠেছে, তারপর ক্ষেতে ক্ষেতে এখনও সেই জলস্রোত বয়ে চলেছে; গোড়ালি পর্যন্ত জলে ড়ুবে যাচ্ছে। মাথা কনকন করছে, নাকে টসটস জল ঝরছে।

—কি হবে বল্ দিনি বনওয়ারী? খাব কি?

বনওয়ার প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারলে না। নিত্যই এই প্রশ্ন তার কাছে করছে পাড়ার লোক। কিন্তু বনওয়ারী তার কি উত্তর দেবে? আশ্বিনের প্রলয় ঝড়ে সব তছনছ করে দিয়ে গেল।

হঠাৎ ছুটে এল প্ৰহ্লাদের সেই দিগম্বর ছেলেটা–ওগো মাতব্বর গো, এ-ই মেলা সায়েব গো! মটর-গাড়ি গো!

-—মেলা সায়েব?

–হ্যাঁ গো, সাথে করালী রইছে।

—কোথা রে?

–জাঙলে! কালারুদ্দুতলায়।

—কালারুদ্দুতলায়?

–হ্যাঁ। কালারুদ্র পাট-আগনেতে তাবু ফেলছে। আপিস হবে।

–আপিস হবে? হে ভগবান!

–যাবা না কি? ব্যানো?–রতন প্রশ্ন করলে।

—যাব বৈকি। চল, দেখি। কি নতুন ঢেউ এল?

কালারুদ্রের বাধানো অঙ্গনে লোকে লোকারণ্য। দশ বার জন সাহেব। এরা ঠিক করালীর ‘ম্যান’ নয়। করালী বার বার সেলাম করছে তাদের।

বড় ঘোষও দাঁড়িয়ে আছেন, ওঁরই বাড়িতে সায়েবেরা গিয়ে বসলেন। বনওয়ারী চুপিচুপি বাড়ির ভিতর গিয়ে প্রশ্ন করলে বড় গিন্নিকে—কি বেপার ঠাকরুণ?

—কালারুদ্ৰুতলায় যুদ্ধের আপিসের তাঁবু পড়ছে দেওর।

–কালারুদ্দুতলায় যুদ্ধের আপিসের তাবু?

—যুদ্ধের আপিসের নয়। ঠিকাদারের তাবু, বাঁশ কিনবে, কাঠ কিনবে–

–বাঁশ, কাঠ? যুদ্ধে বাঁশ কাঠ লাগে?

মাইতো গিনি হেসে বললেন-দেওর, তোমার চটকদার দ্বিতীয় পক্ষটিকে সাবধান কোরো হে। গাছ কাটতে এসে লতা ধরে না টান মারে!

বনওয়ারী চমকে উঠল। গভীর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েই বাড়ি ফিরল। সত্যই সুবাসীকে সাবধান। কাল যুদ্ধ! কাল যুদ্ধ!

আরও দিন চারেক পর। মাঠে ধান কাটতে কাটতে যুদ্ধের কথাই বলছিল সে রতনকে প্রহ্লাদকে।

মাথার উপর দিয়ে এক ঝাক উড়োজাহাজ যাচ্ছিল—সেই দিকে তাকিয়ে বনওয়ার কথা বলছিল। পৃথিবীতে যুদ্ধ বাধে, কতবার বেধেছে, শহরে দাঙ্গা হয়েছে, হইচই কলরব হয়েছে, তাতে হাঁসুলী বাঁকের কিছু আসে যায় নাই। শোনা যায়, বড় বড় ভূমিকম্পে শহর ভেঙেছে, হাঁসুলীর বাঁকের ছোটখাটো ঘরগুলির তাতেও কিছু হয় নাই। ছোট বাচ্চার মত মায়ের বুক দুহাতে আঁকড়ে, পৃথিবীর দোলনের সঙ্গে খানিকটা দুলে দিব্যি বেঁচেছে। যুদ্ধ এবার কালারুদ্রের শাসন ভেঙে বাঁশবাঁদিতে ঢুকল। ঘরে ঘরে টান দিচ্ছে। ঢুকিয়েছে করালী। পাপ করালীর কৰ্মদোষে দেবতারা বিমুখ হয়েছেন। দেবতাদের ক্ষমারও একটা সীমা আছে। বাবা কালারুদ্দুও এইবার অন্তর্ধান হবেন। কালারুদ্র মন্দিরও ভেঙে এসেছে, তার উপর উঠানে পড়ল যুদ্ধের ঠিকাদারবাবুদের তাবু। চন্ননপুর থেকে বাঁশবাঁদির মুখ পর্যন্ত পাকা রাস্তা হচ্ছে, মোটর আসবে। আর বাকি কি রইলঃ পাকা রাস্তা ধরে মোটর চড়ে যুদ্ধ আসছেন হাঁসুলী বাকে। কাঠ-বাশ সব চাই তার! হে ভগবান হরি! যুদ্ধে কি না খায়? বাঁশ-কাঠও খায়? শোনা যাচ্ছে গরু ছাগল ভেড়া ডিম এ সবও নাকি চালান যাবে। ওই যে চন্ননপুরের পাশে উড়োজাহাজের আস্তানা, ওখানে দৈনিক একপাল গরু ছাগল ভেড়া মুরগি হাঁস লাগবে, ডিম লাগবে ঝুড়ি-ঝুড়ি। তাতে অবশ্য কাহারদের কিছু লাভ হবে। ছাগল ভেড়া ডিমের দাম এরই মধ্যে অনেক বেড়েছে, আরও বাড়বে, দু পয়সা ঘরে আসবে। গরু তারা কখনও বেচে না কসাইকে, বেচবেও না। বনওয়ারী তা বেচতে দেবে না। কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে, রাখতে কি পারবে? কি হবে?

রতন আবার প্রশ্ন করে–বনওয়ারী?

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বনওয়ারী বললে—কি বলব অতন? অদেষ্টের হাল-হদিস কি আছে, তা ব? নেকনে যা আছে তাই হবে।

–তোমাকে ভাই একটা কথা বলি নাই, তিন ছোঁড়া বউ নিয়ে পালাল্ছে। লারদ, নেদা আর তোমার গিয়ে বেঁকা।

–পালাল্ছে? কোথায়?

—কে জানে ভাই, জিনিসপত্ত নিয়ে ভোর এতে পালাছে। কাল সনজেবেলায় এসে বলছিল—মনিবের ধান মনিব কেটে নিক, আমি ধানও কাৗ ব না, ভাগও লোব না।

—তা বললে হবে কেনে? ই যে মহা অন্যায় কথা। আমরাই দায়িক এর জন্যে।

–অন্যায় তো বটে। কিন্তু আমরা কি বলব বল?

-–তোমরা বারণ করলে না?

–বারণ! বারণ করলে শুনছে কে বল? তুমি তত বারণ করেছ! শুনলে?

খুব ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল বনওয়ারী শুনছে না। যে শুনছে না, সে চলে যাক। কিন্তু তোমরা কাল সনজেতে যখন জেনেছিলে, তখন আমাকে বল নাই কেন দেখি?

—চলে যাবে বলছিল সব, তা আতাআতিই চলে যাবে, সে কি করে জানব বল? তা ছাড়া। আত তখন অ্যানেক। তুমি শুয়েছ। এতে ডাকলে তুমি আগ কর।

কথাটার মধ্যে একটু রসিকতা আছে। রাত্রে ডাকলে বনওয়ারী রাগ করে—এ কথার পিছনে তরুণী সুবাসীর অস্তিত্বের ইঙ্গিত রয়েছে। কথাটা কিন্তু অর্ধসত্য। সুবাসীর উপর বনওয়ারীর সেই অবধি প্রখর দৃষ্টি, এবং তরুণী স্ত্রীর প্রতি আসক্তির কথা মিথ্যা নয়; কিন্তু আরও খানিকটা আছে, কালোবউ আর বড় বউয়ের প্রেতাত্মার শঙ্কায় রাত্রে সে উঠতে চায় না। কেউ ডাকলে কি বাইরে শব্দ হলে সে চিৎকার করে প্রশ্ন করে–কে? কে?

বনওয়ারী ক্রুদ্ধ হয়েই জবাব দিল–কবে? কবে? কবে আগ করেছি রে শালো? কবে?

গাল খেয়ে রতন বিস্মিত হল। বনওয়ারী তাকে গাল দিলে?

বনওয়ারী ঘসঘস করে ধান কেটে যেতে লাগল। এ ধরনের ব্যাপারটার সাড়া সে আবছা আবছা পেয়েছিল, কিন্তু এতটা বুঝতে পারে নাই। অভাবের কথা উঠলে সকলেই মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখে চন্ননপুরের কারখানার টিনের ছাউনিগুলির দিকে, মা-কোপাইয়ের পুল বন্ধনের দিকে, লাইনের উপর পোতা সিগনালের হাতার দিকে, রাত্রে চেয়ে দেখে লাল নীল আলোর দিকে। এ কথা সে জানে। কিন্তু এমন হবে সে ভাবে নাই। মানুষ সব বেচে খায়, ধরম বেচে কেউ খায় না। বনওয়ারী সেই ভেবেই নিশ্চিন্ত ছিল। গোপনে যে এমন ফাটল দেখা দিয়েছে তা বুঝতে পারে নাই। ফাটল ধরেছে, এইবার ধস ছাড়বে। করালী করালীর সঙ্গে বোঝাপড়া শেষ করতে হয়েছে। হয় সে-ই থাকবে, নয় বনওয়ারী থাকবে হাঁসুলীর বাঁকে! বনওয়ারী উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় ঝকি দিলে বারকয়েক। তারপর নীরবেই আবার হেঁট হয়ে ঘসঘস করে ধান কেটে চলল।

রতনও দাঁড়িয়েই রইল, সে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। গতকাল রতনের মনিব হেদো মণ্ডল রতনকে খুব প্রহার করেছেন—অন্যায় করে প্রহার করেছেন। রতনের একটা বাঁশঝাড়কে অন্যায়ভাবে নিজের বলে দাবি করায় রতন তার প্রতিবাদ করেছিল, সেইজন্য প্রহার করেছেন। মুখ বুজে প্রহার আর সহ্য হচ্ছে না রতনের। অনেক ঋণও রয়েছে তার কাছে। ধানের ভাগও সে নেবে না, ঋণও সে শোধ করতে পারবে না। চলে যাবে চন্ননপুর। সে বনওয়ারীকে বললে– তু আমাকে গাল দিলি কেনে?

বনওয়ারী উঠে দাঁড়িয়ে কোমর ছাড়িয়ে নিয়ে বললে–গাল কি তোকে দিলাম? দিলাম তোর করণকে। তা তুও আমাকে দে কেনে গাল! আমি একবার বলেছি, তু তিনবার বল্— শালো—শালো-শালো!

বনওয়ারী ধান কাটা বন্ধ করে তামাক সাজতে বসল। বাঁশের চোঙার মধ্যে থেকে তামাক, খড়ের নুটি, চকমকি, শোলা বার করলে। বললে—আয়, বস্। তামাক খাই।

আলের উপর বসে রৌদ্রে ভিজে পা শুকিয়ে বেশ খানিকটা আরাম বোধ করলে।

রতন বললে—আঃ! গায়ে সান হল এতক্ষণে।

—লে, খা! কাটি এগিয়ে দিলে বনওয়ারী। তারপর বললে—আগ কি সাধে হয় অতন! অনেক দুঃখেই হয়। ‘সব বেচে সবাই খায়, ধম্ম বেচে কেউ খায় না’। ‘ধৰ্ম্মপথে থাকলে আদেক এতে ভাত’। তা কলিকালে কেউ বুঝবে না সব অধম্মের জন্যে, বুল্লি, সব পাপের জন্যে। কলিকালটাই অধম্মের কাল।

রতন হঠাৎ এক আধ্যাত্মিক প্ৰশ্ন করে বসল—আচ্ছা, জাঙলের মণ্ডল মাশায়রা বলাবলি করছিল কলিকালের নাকি শ্যাম—এইবারেই শ্যাষ?

বনওয়ারী ঘাড় নেড়ে বললেমাইতো ঘোষ বই এনেছে একটা ‘চেতামুনি’।

—কি মুনি?

–চেতামুনি মুনি বলছেন—এইবারেই কলির শ্যাম।

—কি হবে? সব একেবারে লণ্ডভণ্ড ওলটপালট তছনছ হেঁট-ওপর পুড়ে-ঝুড়ে হেজে-মেজে শ্যাষ নাকি?

—তাও হতে পারে। আবার ধর, আকাশ একেবারে হুড়মুড় করে ভেঙে সব চেপটিয়ে দেবে—চুরমার করে দেবে।

হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় প্রলয়ের এই আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাটিই সবচেয়ে পুরনো আদিম কালের কল্পনা। এবং এইটির চেয়ে কোনোটিকেই আজ কলিশেষের উপযুক্ত সংঘটন এবং মহত্তর আধ্যাত্মিক বলে মনে হচ্ছে না। বনওয়ারীর মুখে এমনই কিছু শুনতে চেয়েছিল রতন।

বনওয়ারী বললে—লক্ষণ তো সবই দেখা দিয়েছে। এই কি কার্তিক আগন মাসের হাঁসুলী বাক? কোথাও কোনো চেহ্নৎ আছে?

কথা সত্য। কার্তিক-অগ্রহায়ণে হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় পলেনের মাঠের রঙ হয় সোনার বরন। ঝিরঝরে হিমেল বাতাস; পাকা ধানের গন্ধে ভুরভুর করে। গোবিন্দভোগ বাদশাভোগ কনকচুর রামশাল সিঁদুরমুখী নয়ানক কত রকমের ধানের বাস! এক-এক ধানের এক-এক সুবাস, সকল সুবাসে মিলে সে এক সুমধুর বাস। সোনার বরন ধান-ভরা মাঠের বুকে বেড় দিয়ে কাচ-বরন জল রুপার হাঁসুলী টলমল কোপাই নদীর বাঁক। কূলে পাকা কাশগুলির জঁাটায় পাতায় সোনালি রঙের একটি পাড়। পুকুরে পুকুরে পদ্মগুলি শুকাতে শুরু করলেও পুরো ঝরে না, অল্পস্বল্প গন্ধও থাকে। খালে নালায় ঝিরঝরে ধারা জল বয়, রুপার কুচির মত ছোট ছোট মাছ ঝাক বেঁধে চলে নদীর সন্ধানে। আউশের মাঠে আউশ ধান উঠে গিয়ে রবি ফসলের সবুজে। ভরে ওঠে। গম, কলাই, আলু, যব, সর্ষে, মসনে, তিষির অঙ্কুর-রোমাঞ্চ দেখা যায়। হিলহিলে বাঁশবনের মাথা উকুরে বাতাসে দুলতে থাকে, কা-কা-কটকট শব্দে, কখনওবা বাশির মত সুর তুলে। আকাশে উড়ে নেচে বেড়ায় নতুন পাখির দল। বালিহাঁসেরা উড়ে আসে উত্তর থেকে, সবুজবরন টিয়াপাখির আঁক আসে পশ্চিম থেকে, কলকল কলরবে আকাশ যেন নাচনে মেতেওঠা ছেলেমেয়েরা পূজাতলার আঙিনা হয়ে ওঠে। পাখির দল রাত্রিবেলা মাঠে নেমে ধান খায়, দিনের বেলা আকাশে ওড়ে, গাছে বসে, কলকল করে বেড়ায়। দুপুরে রোদ চনচন করে, রাত্তিবেলা গা শিরশির করে।

এবার মাঠ এখনও জলে ভরা, শীত এরই মধ্যে কনকনে হয়ে পড়েছে। রোদের তেজ নাই। পাখিরা এসেছে কিন্তু কেউ থাকছে না, আঁকে আঁকে এসে চলে যাচ্ছে। ধান নাই, থাকবে কেন? ছেলের দলের মত মাঠ-লক্ষ্মীর দরবারে প্রসাদ পেতে আসে, লক্ষ্মী নাই, প্রসাদ নাই, কাজেই চলে যাচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে। আউশের মাঠ এখনও জবজব করছে, পা দিলে পা বসে যায়, কাজেই মাঠে রবি ফসলের নাম নাই, মাঠ খাঁখাঁ করছে, কেমন এক কালচে বর্ণ ধরেছে। বাঁশবন—সেই আদ্যিকালের বাঁশবন, দুলবে কি, শুয়ে পড়েছে উপুড় হয়ে। ‘নালাখালীয়’ এখনও ভরাভৰ্তি ঘোলাটে জল বইছে হুড়হুড় করে, পুকুরে পদ্ম নিমূল, সেই প্রলয় জলে পুকুর ভরে ড়ুবে। হেজে পচে গিয়েছে। কাশ বলতে একটি নাই। ঝড়ে বানে শেষ হয়ে গিয়েছে। সকল দুঃখের সেরা দুঃখ, বলতেও গলা ভেরে যায়, চোখ ভরে জল আসে, মাঠ-ভরা ধান খড় হয়ে গিয়েছে, সোনার অঙ্গে ঘোলাটে জলের ছোপ লেগে ধুলো-কাদামাখা ভিখারিনীর মত নিথর হয়ে পড়ে আছেন। চেতামুনি বলেছে—কলির শেষ। তা মুনি-ঋষির কথা কি মিথ্যা হয়? লক্ষণ দেখা গিয়েছে।

বনওয়ারী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে—অতন, তা যদি না হবেন, তবে বাবাঠাকুর চলে যাবেন কেনে?

রতন চাইল আকাশের পানে। কোথায় কি শব্দ হচ্ছে!

কাহারপাড়ার আকাশময় ড়ুগড়ুগ শব্দ উঠছে।

চমকে উঠল রতন বনওয়ারী দুজনেই। ড়ুগড়ুগড়ুগড়ুগ শব্দে চেঁড়া পড়ছে। কি ব্যাপার? কাহারপাড়াতেই যেন চেঁড়া পড়ছে। যেন কেননির্ভুল, কাহারপাড়াতেই। কিসের চেঁড়া গ্রামের দিকে তারা ছুটে গেল।

চেঁড়া দিচ্ছেন চন্ননপুরের বড়বাবুরা।

সায়েবডাঙার জমি যারা ভেঙেছিল, তারা যেন এবার ধান কেটে বাবুদের খামারে তোলে। খাজনা নেবেন না বাবুরা, ধানের ভাগ নেবেন। সেলামি দিয়ে যারা জমি নিয়েছে, তাদের কথা বাদ। তার মানে জাঙলের সদ্‌গোপ মহাশয়েরা, তারা সেলামি দিয়ে পাকা দলিল করে জমি নিয়েছিলেন। কথাটা বনওয়ারী আর আটপৌরেদের নিয়ে।

রতন শুনে বললে—দূরো! আমি বলি, কি ব্যাপার রে বাবা! পিলুই চমকে উঠেছিল। সায়েবডাঙার জমির সঙ্গে তো তার কোনো সম্বন্ধ নাই। সেই কারণে ব্যাপারটার গুরুত্ব নাই তার কাছে। কিন্তু জমি তার মনিব হেদো মণ্ডল নিয়েছেন, সে তার পাকা বন্দোবস্ত। সুতরাং তার এই সময়টাই মাটি। সে সঙ্গে সঙ্গে ফিরল মাঠে। বনওয়ার কিন্তু নিজের বাড়ির দাওয়ায় মাথায় হাত দিয়ে বসল। তার পায়ে আর বল নাই।

কত সাধের সায়েবডাঙার জমি। কি পরিশ্রম করে পাড়ার লোকের শ্রদ্ধার খাটুনি নিয়ে সে যে এই জমি তৈরি করেছে, সে বাবুরা জানেন না; জানে সে, জানতেন বাবাঠাকুর; জানেন। ভগবান হরি। উঁচু মাঠ বলে এবার ওখানে দুমুঠো হয়েছে। বনওয়ারীর সব ভরসা যে এইবার ওইখানেই!

বিনা মেঘে বজ্ৰাঘাতের মত বাবুমহাশয়ের হুকুম জারি হয়ে গেল। সে চুপ করে বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর সে উঠল, কই, সুবাসী গেল কোথায়? ওই এক ফ্যাসাদ বাধিয়েছে সে নাচুনীর মতো স্বভাব মেয়েটার। চব্বিশ ঘণ্টাই যেন ফড়িং প্রজাপতির মত ফুরফুর করে উড়ে বেড়ায়। এটা যত ভাল লাগে বনওয়ারীর, তত আবার মনের সন্দেহকেও উগ্র করে তোলে! সন্দেহ হয় করালীকে নিয়ে। সে জানে—সে জানে—করালী তার মর্যাদা, ইজ্জত নষ্ট করতে চায়। ধৰ্মনাশা করালী। কোনো বিশ্বাস নাই তাকে—কোনো বিশ্বাস নাই। ক্রমশ তার বিশ্বাস হচ্ছে, তাকে ধ্বংস করবার জন্যই করালী জন্ম নিয়েছে। হাঁসুলী বাঁকের সর্বনাশ করতে জন্ম নিয়েছে।

ছোকরা যেমন ফ্যাশানি, তেমনি জোয়ান। সুবাসীকে সে চন্ননপুরের পথে হাঁটতে দেয় না; কিন্তু করালী সন্ধ্যাবেলা আসে। সে সুবাসীকে ঠায় চোখের সামনে রেখে বসে থাকে, তবু সন্দেহ। হয়। করালী এসে যখন পাড়া মাতিয়ে হাসে, তোলপাড় করে হল্লা করে, সুবাসী তখন চমকে চমকে ওঠে। সেটুকু বেশ লক্ষ্য করেছে বনওয়ারী। করালীর এই কাহারপাড়া আসাটা বন্ধ করতে পারলে না বনওয়ারী—ওই মহা আফসোস রয়ে গেল জীবনে। এইটা তার হার-পরাজয়।

সে জেদ করে রোজ সন্ধ্যাতে আসে; প্রহরখানেক থাকে, ছেলে-ছোকরার কানে ফুসমন্তর দেয়, হল্লা করে চলে যায়; আবার দিনের বেলাতেও কখনও কখনও আসতে কেউ কেউ দেখেছে। বলেছে মিলিটারির কাজে এসেছি। হায় ভগবান, এত লোক ঝড়ে মরল, করালী মরল না!

কিন্তু সুবাসী গেল কোথায়? বুড়ো রমণ ফুড়ৎ ফুড়ৎ করে তামাক খাচ্ছিল, সে বললে— কে জানে?

বুড়ো খাচ্ছেদাচ্ছে, বেশ আছে। কোনো কাজ করবে না। তার উপর করছে চুরি। ওই তো বেশ দেখা যাচ্ছে, তার ঘেঁড়া কাপড়ের তলায় এক মুঠো ধানের শিষ।

এই সময় সুবাসীকে দেখা গেল, নদীর দিকের শুয়ে-পড়া বাঁশবনের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল—কাখে একটা কলসি, মাথার কাপড় খোলা, খোপায় এক থোপা ফুল জেছে। ছাতিম ফুল।

সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল বনওয়ারীর। এ লক্ষণ তো ভাল নয়।

সুবাসী ঘরে আসতেই ফুলের থাবাটা টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলে। পিঠে গোটা দুই কিল বসিয়ে দিয়ে বললে—ফুল জেছে! খুন করে দেব একদিন। দে, মুড়ি দে।

সুবাসী মেয়েটা আশ্চর্য। সে মার খেয়েও হাসতে লাগল। বললে–নাগরে দিয়েছিল, ফুলের থোবাটা ফেলে দিলা?

—এই দ্যাখ! আবার? দোব কিল ধমাধম।

—গতরে বেথা করছে। দিলে আরাম পাব।

—খুন হবি তু কোন্দিন আমার হাতে।

সুবাসী বললে—তার আগে ভাতের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিয়ে তোমাকেও মেরে দেব আমি। এ কথা বলেও হাসতে লাগল সুবাসী।

আতঙ্কিত হয়ে বনওয়ারী মুড়ির গ্রাস চিবানো বন্ধ করলে। সুবাসী এবার জোরে খিলখিল করে। হেসে বললে—মুড়িতে বিষ নাই। মুড়ি খাও। তারপর বললে তুমি খানিক ক্ষ্যাপা পাগলও বটে। মাতব্বর বলে লোকে! মরণ! বলে সে গিয়ে আবার ছাতিম ফুলের গুচ্ছটা তুলে নিয়ে মাথায় জলে।

বনওয়ারী আর কোনো কথা না বলে খেয়ে চন্ননপুর রওনা হল। জানে কিছু হবে না, হাকিম ফেরে তবু হুকুম রদ হয় না। তবু গেল। এই বছরটার মত বাবুরা ক্ষমা করুন। আসছে বছর। থেকে ভাগেই সে করবে।

কাঁধ বেঁকিয়ে ভারী পা ফেলে সে চলল।

জাঙল পার হয়ে খানিকটা এগিয়েই সে শুনতে পেলেচন্ননপুরে কলকল শব্দ। এত শব্দ আগে ছিল না। রেললাইন হওয়ার সময় থেকে চন্ননপুরের কলকলানি বেড়েছে। এবার আবার ভীষণ কাণ্ড! দোসরা লাইন পাতছে। উড়োজাহাজের আস্তাবলে শব্দ উঠছেইউঠছেই। ওঃ, বড় ভীমরুলের চাকে ঢেলা মারলে যেমন গজগজ গোঙানি ওঠে, তেমনি শব্দ! মধ্যে-মাঝে ফাঁস-ফেঁস রেলইঞ্জিনের ফেঁসানি, ভে-ভে-ভো বঁশি কান ফাটিয়ে বেজে উঠছে।

হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল। আলপথের উপর সদ্যভাঙা কয়েকটা পাতা পড়ে ছিল, সেই দিকে সে চেয়ে রইল। ছাতিমপাতা। পিছনেও আরও যেন একটা-দুটো ছাতিমপাতা ফেলে এসেছে। এখানে অনেকগুলি পড়ে রয়েছে। আশ্চর্য হয়ে দাঁড়াবার কথা নয় এতে। কিন্তু বনওয়ারীর মনে পড়ে গেল, সুবাসীর চুলে ছাতিম ফুল। তারপরই তার মনে হল, ছাতিম গাছ আছে মাকোপাইয়ের কূলে। জাঙলে নাই। আর কোথায় আছে? আর? মনে পড়ল না। তা হলে সুবাসীর সঙ্গে আরও কেউ ছাতিমতলায় ছিল। হয় সে-ই ছাতিমফুল ভেঙে সুবাসীকে একটা দিয়ে নিজে একটা ডাল নিয়ে এই পথেই গিয়েছে, নয় সুবাসীই ফুল ভেঙে নিয়ে একটা নিজে খোপায় গুজে অন্য ডালটা যার হাতে দিয়েছে, সে-ই এই পথে গিয়েছে।

কোশকেঁধে বনওয়ারী কাহারের ‘হাটন’ হটতে শুরু করলে। কাধে ভার না চাপলে সে কদমে হটা ঠিক হয় না, তবু মনের আবেগে হাঁটলে।

সমস্ত পথে কেউ নজরে পড়ল না। চন্ননপুরে ইস্টিশানে লোকজন অনেক। সেখানে চারিদিক চেয়ে দেখে সে কোনো হদিস পেলে না, চিন্তিত মনেই সে বাবুদের কাছারির পথ ধরলে। হঠাৎ দাঁড়াল। কাকর-পাথরের পথ। কয়েকটা কঁকর-পাথর তুলে নিয়ে গুনতে গুনতে চলল। বিজোড় যদি হয়, তবে পথের ছাতিম পাতার সঙ্গে সুবাসীর মাথায় গোঁজা ছাতিম ফুলের কোনো সম্বন্ধ নাই—জোড় হলে আছে। এক দুই তিন, সাত আট নয়—বিজোড়। আর খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পথের ধারে একটা মোটা পাথর দেখে সে আবার দাঁড়াল। হাতের একটা পাথর নিয়ে ছুঁড়লে। ওই পাথরটায় লাগলে সুবাসীর দোষ নাই। না লাগলে নিশ্চয়ই দোষ আছে। লাগল ঠিক। আবার ছুঁড়লে। এবারও লাগল। আবার ছুঁড়লে। বারবার তিন বার। এবার লাগলে বনওয়ারীর আর কোনো সন্দেহ থাকবে না। এবার ঠিক লাগল না। তবে খুব কাছেই গিয়ে পড়ল। বনওয়ারী এগিয়ে এসে ঝুঁকে দেখলে। নাঃ, ঠিক লেগেছে। ঠুই করে না লাগুক, আস্তে ‘সন্তৰ্পনে’ লেগেছে। যাক, বনওয়ারীর আর সন্দেহ নাই। সুবাসী আপন মনে খুশিতে ছাতিম ফুল ভেঙে চুলে পরেছে, আর-একজন কেউও আপন মনে খুশিতে তুলে নিয়ে এসেছে। হঠাৎ তার আর একটা পরীক্ষার কথা মনে হল। সে মনে মনে ঠিক করলে বাবু যদি এবার ধান ছেড়ে দেন, তবে নিশ্চয় সুবাসীর দোষ নাই, ঘরে ধর্ম না থাকলে লক্ষ্মী আসেন না। লক্ষ্মী যদি ঘরে আসেন, তবে নিশ্চয় ধর্ম আছে। আর না হলে নিশ্চয় তাই, বনওয়ারী যা ভেবেছে তাই।

***

নিশ্চিন্ত হল বনওয়ারী। আঃ! বাচল বনওয়ারী।

বাবু বনওয়ারীকে এবারের ধান ছেড়ে দিলেন; শুধু বনওয়ারীকেই নয়, বনওয়ারীর দরবারের ফলে আটপৌরেদেরও সকলকেই ছেড়ে দিলেন। তবে আগামীবার থেকে ভাগচাষের শর্ত হয়েছে। ডেমিতে কবুলতি লিখে টিপ-ছাপ নিয়েছেন।

হাঁসুলীর বাঁকের উপকথায় দলিল নাই, দস্তাবেজ নাই, রেজেষ্ট্রি নাই, পাওনার তামাদি নাই। মুখের বাক্যিতে কারবার চলে আসছে আদ্যিকাল থেকে, পঞ্চজন সাক্ষী রেখে টাকা দেওয়া-নেওয়া চলে, কেনা-বেচা চলে। দরকার হলে কর্তার থানে বেলগাছের শিকড়ে হাত দিয়ে শপথ করে বলতে হয়। কিন্তু বাবুদের দলিলদস্তাবেজ আছে, খাতাপত্র আছে, তাদের কারবার উপকথার কারবার নয়; সন, মাস, তারিখ, দলিলদাতার নাম, তস্য পিতার নাম, পেশা, নিবাস, বিক্রয়ের কারণ, স্বত্ব, শর্ত, আমূল মামূল চৌহদ্দি সকল বিবরণ লিখতে হয়—মায় শরীর সুস্থ, অন্তর খোলসা, এ কথাটিও থাকবে সে দলিলে।

বনওয়ারী বুড়ো আঙুলের তেল-কালি মাথার চুলে মুছে বেরিয়ে এল। জয় ভগবান হরি, জয় ধরমদেব! বনওয়ারীর ধন মান বাচালে বাবা। বড় আশার ধন তার। তা ছাড়া সুবাসী যে অন্যায় কিছু করে নাই, তাতে আর তার সন্দেহ রইল না। কোনো সন্দেহ নাই। মনে হল কাল। বোধহয় বাবাঠাকুরের বেলগাছটিতে নতুন পাতার অঙ্কুরও দেখতে পাবে সে। বাবাঠাকুর ফিরবেন। কাছারি থেকে বেরিয়ে দেখলে, বেলা পড়ে এসেছে। আসবারই কথা। ও-বেলা জল খেয়ে বেরিয়ে পথে ঢেলা গুনে, ঢেলা ছুঁড়ে যখন কাছারি এসে পৌঁছেছিল, তখন বারটা পার হয়ে গিয়েছিল। তিনটের পর কাছারি বসেছে, ততক্ষণ বনওয়ারী খানিকটা শুয়েছে, খানিকটা বসেছে, বারকয়েক আরও কয়েক রকম পরীক্ষা করেছে—ছাতিম ফুলের সমস্যা নিয়ে। বাবুর দরবারে কাজ সেরে খুশি হয়ে বেরিয়ে বেলা পড়েছে দেখে সে গেল পচুইয়ের দোকানে।

সাহা মহাশয়দের দোকান গায়ের বাইরে পুকুরপাড়ে। পচুই মদের গন্ধে মোহ-মোহ করছে। বাবুরা নাকে কাপড় দেয়, কিন্তু হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় এ গন্ধ প্রাণমানো গন্ধ নাকে ঢুকলেই জিবে জল সরে, খাবার ইচ্ছাটা প্রবল হয়ে ওঠে। দলে দলে বসেছে সব। চন্ননপুরের জেলেরা ছোট ছোট দলে বসেছে মাছ-পোড়া নিয়ে। সাঁওতালরা এসেছে গোসাপইদুরপাখি মেরে নিয়ে, আগুন জ্বলে পুড়িয়ে নিচ্ছে। চামড়ার পাইকারেরা গোসাপের চামড়া কিনছে। চারিদিকেই হক উঠছে। ডাক উঠছে। যুদ্ধের বাজারে চামড়ার দর দেখে মনে হয় নিজের অঙ্গের চামড়া ছাড়িয়ে বিক্রি করি। মাতন লেগে গিয়েছে অনেকের, গান চলছে—তকরার চলছে, মধ্যে মধ্যে ‘ল্যাইও অৰ্থাৎ কলহও লাগছে টুকরো টুকরো। হাঁসুলী বাঁকের লোকেরাও এখানে দল বেঁধে বসত। তাদের জায়গাটা খাখা করছে। পয়সা নাই, হাঁসুলী বাঁকের লোকেরা মদ খাবে কোথা থেকে? হে ভগবান হরি! একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বনওয়ারী বসল। হামুলী বকের কাহারদের বিক্রম কত এখানে! কতদিন কত দলের সঙ্গে মারপিট করে বাড়ি ফিরেছে। আজ এখানে বসতে ইচ্ছে হল না। এক ভঁড় মদ কিনে নিয়ে সে ফিরল। পথে খাবে। বাড়ি নিয়ে যাবে না, কাহারপাড়ার মাতব্বর সে, কোনমুখে এক ভাড় নিয়ে ঢুকবে সেখানে? কাউকে না দিয়ে ঘরের কোণে একা বসে মদ খাবে সে? সুবাসীই যদি এক ঢোক চায়, তবে? পথেই খাবে।

পথ চলতে চলতেই সে মধ্যে দাঁড়িয়ে খানিকটা করে খেতে লাগল। অবশেষ পথের ধারে বড় ডাঙাটার মধ্যে সেই কঁকড়া গাছতলাটা দেখে তার তলায় সে মদটুকু খেতে বসল। মনে পড়ল, এই গাছতলায় কত কাও করেছে সে! কালোশশী চন্ননপুরে বাবুদের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করত, তখন এইটিই ছিল তাদের মিলবার ঠাঁই। এইখানে কতদিন তারা পালকি বয়ে এসে পাওনা ভাগ করেছে। আগেকার কালে নাকি এই গাছতলাতেই কাহারেরা চুরি করবার আগে জমায়েত হত। শেষ কাণ্ড হয়েছে—এইখানেই হয়েছিল তার সঙ্গে পরমের যুদ্ধ।

আঃ, সেসব দিন কোথায় গেল! বাবাঠাকুর চলে যাওয়াতেই সব গেল। বাবাঠাকুর-থানের পাতা-ঝরে-যাওয়া বেলগাছটি তার চোখের উপর ভেসে উঠল। তলাটা সে বাধিয়ে দিলে কি হবে, প্রতিদিন গাছটি শুকিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ আগেও সে আশা করেছিল, লক্ষ্মী যখন আসবেন তখন ধর্ম আছে, আর ধর্ম যেকালে আছে সেকালে বাবাঠাকুর বোধহয় ফিরবেন। কাল। নিশ্চয়ই সবুজ সুচের ডগার মত অঙ্কুর সে দেখতে পাবে। কিন্তু মদ খেয়ে তার মনে হচ্ছে—না না, আর হবে না! চন্ননপুরে ওই অধর্মের ছটা ঝলমল করছে যে!

আবার সে এক ঢোক মদ খেলে। মদ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, খানিকটা আছে মাত্র। দু ঢোক হবে, সেটাতে চুমুক দিতে গিয়ে সে ভঁড়টা নামালে মুখ থেকে। ভাবতে লাগল, সুবাসীর জন্য এক ঢোক রাখবে নাকি? উই। সুবাসী তো একা নয়, তার কাকা ‘অমন’ বুড়ো আছে। নয়ানের মা আছে। ‘অমন’ বুড়োর লম্বা লম্বা কথা। কাজের মধ্যে কাজ গরু চরায়। আজকাল আবার বুড়ো চোর হয়েছে। বনওয়ারীর ধানের শিষ কেটে নিয়ে দোকানে দিয়ে বেগুনি ফুলুরি খেয়ে আসে। ওর চেয়েও বেশি চোর হয়েছে নয়ানের মা। লোকের বাড়ি চুরি করে হেঁসেল থেকে তরকারি অম্বল খেয়ে বেড়াচ্ছে। ও দুজনেই এই সামনের শীতে যাবে। দায় বনওয়ারীর। হায় রে মাতব্বর! সুচাঁদপিসিও যাবে নিৰ্ঘাত। সে এখন হাসপাতালে। পা জোড়া দেবে বলে রেখেছে, কিন্তু ওই পা কি জোড়া লাগে? কাটবে, কেটে মারবে ওকে। এই একেই বলে–সৎসঙ্গে কাশীবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ। করালী হারামজাদা–মন্দমতি, তার পাল্লায় পড়ে অবশেষে ঠ্যাঙ কেটে ইংরজি ওষুধ খেয়ে জীবনটা যাবে। সাধে কি বনওয়ারী বলে–ও-পথে হেঁটো না! হঠাৎ কাদের কণ্ঠস্বর কানে এল।

কে? কারা? কারা আবার ঝগড়া লাগালে এই ফঁকা মাঠের মধ্যে রাত্রিবেলা? একটি মেয়ের গলা, একটি পুরুষের গলা। ‘অঙের খেলা’। আসলে বনওয়ারী। মেয়েটি রেগেছে, মান করেছে। কে? কার গলা? সোজা হয়ে বসল বনওয়ারী। পাখীর গলা। পাখী বলছে–না না না। তোর সব মিছে কথা। সব মিছে কথা। আমি সব বুঝেছি।

—কি, বুঝেছিস কি? করালী বলছে। ওরা ফিরছে কাহারপাড়া থেকে, সন্ধেবেলার আসর সেরে রোজ যেমন ফেরে।

–আমি সুবাসীর খোপায় ছাতিম ফুল দেখেছি।

–ছাতিম ফুল কোপাইয়ের ধারে আছে, পরেছে।

–পরেছে। দিয়েছে কে? তু সকালবেলা ‘কাজ আছে’ বলে চলে গেলি। দুপুরবেলা ফিরে এলি ছাতিম ফুল নিয়ে। আমার তখুনি সন্দ হয়েছিল, তু নিশ্চয় কাহারপাড়ায় গিয়েছিলি। আমাকে বললি নদীর পুলের ধার থেকে এনেছি। কিন্তু তু পুলের ধারেই যাস নাই—আমাকে বলেছে। নদীর ধারের গ্যাঙের লোকেরা। তবে তু কোথা পেলি ছাতিম ফুল? সুবাসীই বা আমার মাথায় ছাতিম ফুল দেখে কেনে হাসলে, কেনে বললে—তোমাকে ছাতিম ফুল কে দিলে হে? কেনে বললে? সুবাসীর ঘরের উঠানে কেন ছাতিম ফুল পড়ে আছে? কে দিলে তাকে? বুঝি না কিছু, লয়?

—বুঝেছিস, বুঝেছিস। জানিস, পোষ মাসে একটা ইদুরে দশটা বিয়ে করে। আমার এখন বার মাস পৌষ মাস। গ্যাঙের সর্দার আমি। আমি সুবাসীকে নিয়ে এসে সাঙা করব, তাতে তোর ঘর করতে খুশি হয় করবি, না হয় পথ দেখবি।

পাখী চিৎকার করে উঠল—কি বললি?

সঙ্গে সঙ্গে গাছের অন্ধকার তলাটাই যেন গর্জন করে উঠল। মনে হল বাঘের মত কোনো ভয়ানক জানোয়ার চিৎকার করে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসছে। সে চিৎকারে করালী-পাখী ভয়ে চমকে উঠল। অন্ধকার গাছটার ভিতরটায় ঘুমন্ত পাখিরা ভয়ে চমকে উঠে পাখা ঝটপট করতে লাগল। শনশন শব্দ তুলে কয়েকটা বাদুড় উড়েও গেল। করালী চমকে উঠেও চকিতে ঘুরে শক্ত হয়ে দাঁড়াল, হাক দিল—কে?

গা-গাঁ শব্দে জানোয়ারের মত গর্জন করে লাফ দিয়ে তার সামনে দাঁড়াল বনওয়ারী। আকাশ ঘুরছে, মাটি দুলছে, বনওয়ারীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত আগুনের শিখা ছুটে বেড়াচ্ছে, আঙুলগুলো হয়েছে লোহার শিকের মত, নখ হয়েছে সড়কির ডগার মত। পঁতে সঁতে ঘষছে, কটকট শব্দ উঠছে। লাফিয়ে পড়েই সে খপ করে চেপে ধরলে করালীর টুটিটা ছিঁড়ে ফেলবে, সে ছিঁড়ে ফেলবে। চোখ জ্বলছে। গলা দিয়ে বেরিয়ে আসছে গোঙানি। ক্রুদ্ধ গর্জন।

করালীর মনে হল, তার চোখের সামনে সব বুঝি মুছে গেল। তবু তাকে বাঁচতে হবে। শুধু বাচতে হবে নয়, এতদিনের অপমানের শোধ নিতে হবে, কাহারপাড়ার মাতব্বরি ঘুচিয়ে। দিতে হবে। তার এতদিনের চাপা রাগ দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। আর সহ্য সে করবে না।

বনওয়ারীর পেটে সে মারলে এক লাথি। এবার বনওয়ারীকে ছাড়তে হল করালীর টুটি।

কয়েক মুহূর্ত দুজনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল দুজনের দিকে চেয়ে। বনওয়ারী যন্ত্রণায়। কাতর। করালীরও অসহ্য যন্ত্ৰণা। যন্ত্রণা সামলে নিচ্ছে দুজনে। তারপর পরস্পরের দিকে ছুটে এল বুনো শুয়োরের মত। প্রথমে ছুটল বনওয়ারী, সঙ্গে সঙ্গে করালী। দুই বীর হনুমানের মত পরস্পরকে নিষ্ঠুর আক্রমণে জড়িয়ে ধরে পড়ল মাটিতে; ড়ুবে গেল গাছতলার সেই অন্ধকারের মধ্যে। আঁচড়, কামড়, কিল, চড়, ঘুষি। হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবনের ছায়ায় একদিন যুদ্ধটা শুরু হয়েও শেষ হয় নাই। আজ শেষ না করে ছাড়বে না বনওয়ারী। হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবনের অন্ধকার আকাশপথে ভেসে এসে ওই কঁকড়া গাছটার শাখাপল্লব বেয়ে প্রতি মুহূর্তে তলায় নামছে, ওদের দুজনকে ঘিরে গভীর হয়ে উঠেছে। নিষ্ঠুর প্রহারের শব্দ, হিংস্ৰ গর্জন, কাতর মৃদু। স্বর শোনা যাচ্ছে শুধু। পাখী মাটির পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছে, নড়তে পারছে না, চিৎকার করতে পারছে না। মাথার উপরে বাদুড় উড়ছে পাক দিয়ে। এদিকে ওদিকে টিক-টিক্-টক্টক্‌-কটকট শব্দে নানা রকমের সরীসৃপ ডাকছে। কিন্তু পাখীর কানে কিছুই যাচ্ছে না, বা দেখতেও পাচ্ছে না, বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে।

কতক্ষণ কে জানে! তবে অনেকক্ষণ পর অন্ধকারের মধ্যে একটা মূৰ্তি উঠে দাঁড়াল। গাছতলায়। দাঁড়িয়ে একটু সামলে নিয়ে চলতে টলতে বেরিয়ে এল। একজন পড়ে রইল অসাড়ভাবে।

এতক্ষণে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল পাখী।

যে জিতে উঠে এল সে কে? বনওয়ারী হাঁসুলী বাঁকের মাতব্বর, কোশকেঁধের ছেলে? সে-ই হওয়াই তো সম্ভব। আজ তো তা হলে পাখীর আর নিস্তার নাই। করালীর প্রিয়া সে। তাকে আজ এই মুহূর্তে সে কখনই রেহাই দেবে না। ধৰ্ম সমাজ কিছু মানবে না। ছুটে পালাবার মতও শক্তি তার নেই, পা-দুটো থরথর করে কাঁপছে। তবু সে প্রাণপণে শক্তি সঞ্চয় করে বলে উঠল—তোমার পায়ে পড়ি, বাবাঠাকুরের দিব্যি।

হা-হা-হা-হা করে হেসে উঠল করালী।–বাবাঠাকুর, না কচু।

—তুমি? আশ্চর্য হয়ে গেল পাখী।

–হ্যাঁ—বলেই করালী আবার ফিরল, একটা লাথি মারল বনওয়ারীর মাথায়। তারপর ফিরে এসে বললে—চল্‌।

গায়ে হাত দিয়ে পাখী চমকে উঠল—অক্ত নাকি?

–হ্যাঁ।

সর্বাঙ্গে রক্ত ঝরছে। ক্ষতবিক্ষত-দেহ বিজয়ী বীর উলতে টলতে চলে গেল।

***

অন্যজনও উঠল, দীর্ঘক্ষণ পরে।

হাঁসুলী বাঁকের কাহারের প্রাণ অনাহারে, প্রহারে, দুর্ভিক্ষে, মড়কে, ঝড়ে, বন্যায় সহজে যায় না। সমস্ত জীবনই কাটে অর্ধহারে। দুর্ভিক্ষে—ফ্যান উচ্ছিষ্ট কুখাদ্য অখাদ্য খেয়েও বাচে; দাঙ্গায় মাথা ফাটে, কোদালের কোপে পায়ের খানিকটা কেটে পড়ে, গাছের ডাল ভেঙে ঘাড়ে পড়ে। শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে থাকে, দীর্ঘদিন ভোগে, লতাপাতা বেটে লাগায়—ধীরে ধীরে সেরে ওঠে; হয়ত অঙ্গের খানিকটা পঙ্গু হয়ে যায়, কিন্তু জীবন সহজে যায় না। বনওয়ারীও উঠল।

কাহারপাড়ার শ্রেষ্ঠ পুরুষ কোশকেঁধে বনওয়ারী বাবাঠাকুরের পরিত্যক্ত স্থানটিতে টলতে টলতে এসে লুটিয়ে পড়ে হা-হা করে কাদতে লাগল। বুক চাপড়াতে লাগল আহত আরণ্য বানরের মত।

রাত্রি কত, তার ঠিক ছিল না। তবে কৃষ্ণপক্ষ, আকাশে চাঁদ উঠেছে—আধখানা চাদ, পোয়া আকাশ পার হয় হয়। বনওয়ারী খানিকটা বসে খানিকটা উঠে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে এসেছে। এসে কত্তার থানে ঢুকেছে। কত্তার বাধানো থানটি চাদের আলোয় তকতক করছে। বনওয়ারী মাথা ঠুকতে লাগল সেই বেদির উপর। চোখের জলে তার বুক ভেসে গেল। হা-হা-হা-হা। বুক তার ফেটে যাচ্ছে।

হঠাৎ মাথা তুলে চমকে উঠল। সামনেই শেয়ালের মত একটা কি যেন দাঁড়িয়ে। শেয়ালটা হা করতেই তার মুখে দপ করে আগুন জ্বলে উঠল। আবার জ্বলে উঠল। দপ্‌দপ-দপ। জ্বলছে আর নিবছে। বনওয়ারীর মাথার ভিতরেও ঠিক ওইভাবে আগুন জ্বলতে লাগল; উঠে দাঁড়াল সে। শেয়ালটা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে পালাল। শেয়াল নয় ওটা। কখনও নয়। বাবাঠাকুর চর পাঠিয়েছেন। দপ্দ করে আগুন জ্বালিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল, ইশারা পেয়েছে সে, বাবার আদেশ। নিঃশব্দে চকমকির চোঙাটা নিতে হবে, সেটা বাইরের দেওয়ালে ঝুলানো আছে। তারপর উঠতে হবে করালীর কোঠায়। অ-মেরামতি কোঠার উপরে কেউ থাকে না, নিচে থাকে নসুবালা। উপরে উঠে খড়ের নুটিতে আগুন ধরিয়ে কোঠাঘর জ্বলবেচন্ননপুর থেকেও দেখা যাবে। বাবাঠাকুরের আদেশ।

বাড়ির কাছাকাছি এসে সে থমকে দাঁড়াল। কে? কারা?

–হুঁ হুঁ হুঁ।

—হুঁম্। হ্যাঁ। হ্যাঁ।

মৃদুস্বরে কারা কথা কইছে ওই শিরীষগাছের তলায়—বাশবনের ধারে? কে? কারা? ওরা কারা? বাঁশবনের ধারে তার বাড়ির পিছনে? হুঁ। তাকে ঘায়েল করে সে এসেছে সুবাসীর কাছে। আসবারই তো কথা।

সন্তৰ্পণে এগিয়ে চলল বনওয়ারী। কুড়িয়ে নিলে একটা পাথর। লোহার অস্ত্র হলে ভাল হত। কিন্তু সে ধৈর্যও নাই তার, অবসরও নাই। এই পাথরেই হবে পাথরই যথেষ্ট। রেলের পুলের ধার থেকে কুড়িয়ে এনে এটা করালীই তাকে দিয়েছিল অনেকদিন আগে। সেই পাথর। হাঁসুলীর বাঁকে বাঁশবনে পাথর দিয়ে মাথা ঘেঁচার অনেক উপকথা আছে। সুচাঁদ বলে—বনওয়ারীর বাবার বাবার বাবা আর আমার বাবার বাবা এক লোক তো! সে হল আমার কত্তাবাবা। তা, সেই কত্তাবাবা আমার পেথম কত্তামায়ের–মানে, তার পেথম পরিবারের ঘর থেকে আটপৌরেদের একজনকে বেরিয়ে যেতে দেখে শিল নোড়ার নোড়া দিয়ে মাথা ঘেঁচে মেরেছিল। পরিবারের বুকে বসে নোড়া দিয়ে।

শুধু পরিবার সুবাসীর নয়—একটা নয় দুটো হেঁচতে হবে। কালীর মাথাসমেত হেঁচবে সে। আগে করালীর। তারপর সুবাসী। আকাশে আধখানা চাঁদ সত্ত্বেও, বহু পুরাতন বট-পাকুড় শিরীষের নিবিড় পল্লবের ঘন ছায়াপাশের বাঁশবনের ছায়ার সঙ্গে মিশে সে যেন অমাবস্যার অন্ধকার। হাঁসুলী বাঁকের আদ্যিকালের অন্ধকার আদিকাল থেকে এখানে থমথম করছে। এখানে। শুক্লপক্ষ নাই। পূৰ্ণিমা নাই। চিরদিনের অমাবস্যা এখানে। অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে নোড়াটা হাতে এগিয়ে চলল বনওয়ারী। শিরীষ গাছের অদূরে দাঁড়াল—কই? কোথায়? খুব আস্তে হুঁ-হুঁ শব্দে কথা তো শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। একসময়ে উৎকণ্ঠিত বনওয়ারীর মদের নেশার ঘোরে অর্ধআচ্ছন্ন চোখের সম্মুখে স্পষ্ট যেন বেরিয়ে এল দুটি ছায়াছবি। স্পষ্ট দেখলে। বনওয়ারীর বুকটা লাফিয়ে উঠল। ওইওই চলেছে করালী আর সুবাসী। চলল সে পিছনে পিছনে। ওই চলেছে। ওই চলেছে—ওই। এইক্ষণে তার চিত্তলোকে প্রস্তরযুগের আবেগ-বিশ্বাস-উচ্ছাস বাসা গেড়ে বসেছে। উৎকণ্ঠিত দৃষ্টির সম্মুখে পীড়িত-হৃদয়াবেগ-প্রভাবিত কল্পনার দুটি মূর্তি স্পষ্ট এগিয়ে চলেছে। চলছে, চলুক; কতদূর যাবে! বাঁশবন শেষ হয়ে এল। এবার দাঁড়াল সে। কই তারা, কই? হঠাৎ পাশের একটা ঝোপ থেকে দুটো বড় পাখি হুঁ-হুঁ-হুঁ শব্দ করে পাখা বিস্তার করে উড়ে গেল তার বিভ্রান্ত দৃষ্টির সম্মুখ দিয়ে। সে চমকে উঠল। ঠিক মনে হল, মূর্তি দুটিই যেন অকস্মাৎ চন্দ্রালোকিত শূন্যলোকের শুভ্ৰ স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে ভেসে চলে গেল। ক্রমশ উঁচুতে উঠে তারা সামনের কোপাইয়ের ধারে—দহের উপরে সেই শিমুলগাছটার ডালে গিয়ে বসল।

থরথর করে কাঁপতে লাগল বনওয়ারী। শূন্যে ভেসে গেল। তবে—তবে তো করালীসুবাসী নয়! কে? ওরা কে?

ও দুটো নিশাচর পাখি। এ দেশে বলে হুমহুমে পাখি। ওরা রাত্রে এমন মুখোমুখি করে বসে—‘হুঁ-হুঁ-হুঁ-হুম হ্যাঁ-হুম’ শব্দ করে যেন পরস্পরের সঙ্গে কথা কয়। বনওয়ারী এ কথা জানে। কিন্তু আজ বনওয়ারীর মনে পক্ষবিস্তার করে রয়েছে কৃষ্ণপক্ষের আকাশ সে আকাশের নিচে আদিমযুগের পৃথিবীতে বিচরণ করছে সে। তাই পাখি দুটো উড়ে গিয়ে শিমুলগাছে বসার সঙ্গে সঙ্গে তার মস্তিষ্কে বিদ্যুতের মত অন্য কল্পনা খেলে গেল। হাঁসুলী বাঁকের উপকথার কল্পনা। সম্মুখে জ্যোৎস্নায় ধবধব করছে কোপাইয়ের চরভূমি। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে—কেউ কোথাও নাই। কিন্তু সে তত অন্ধকারের মধ্যে দুটি মূর্তি স্পষ্ট দেখেছে। স্পষ্ট কথা তাদের কইতে শুনেছে। অথচ আর কেউ নাই। কৃষ্ণমূর্তি দুটি অশরীরী হয়ে উড়ে গেল। রহস্যময় পক্ষ বিস্তার করে ওই শিমুলগাছের ডালে গিয়ে বসল। ওই দহে মরেছে কালোশশী। ওইখানে পুড়িয়েছে। গোপালীকে–। তবে কে, কে ওরা? তবে কি–?

আবার কেঁপে উঠল বনওয়ারী। কালোশশী? গোপালীবালা? তারাই বি, দুজনে তাকে আজ নিতে এসেছে? দেখাচ্ছে ওই শিমুলতলার শ্মশানভূমি? আতঙ্কের মধ্যে তার অন্ধবিশ্বাসী মন স্মরণ করলে তার হাতে বাঁধা মা-কালীর বাবাঠাকুরের মাদুলি দুটিকে। সে ডান হাতের কনুইটা নিজের বুকে চেপে ধরলে। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল। কই, মা বুলি কই? নাই তো! নাই তো! করালীর সঙ্গে ধস্তাধস্তির মধ্যে মাদুলি ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছে। কি হবে? কে আজ রক্ষা করবে? বাবাঠাকুর নাই। বেলগাছ শুকিয়ে গিয়েছে। কাকে ডাকবে সে? আকাশ বেয়ে বিরাট সৰ্পবাহনে চড়ে বাবাঠাকুর চলে গিয়েছেন। কে বাঁচাবে? অসহায় বনওয়ারীর চোখের সামনে শিমুলগাছের ডালে বসে গোপালী ও কালোশশী কথা বলছে হুম্ হুম্ হুম্—

হুঁ-হুঁ-হুম্-হা-হা-হা! উচ্চ শব্দে একটা পাখি ডেকে উঠল এবার। সঙ্গে সঙ্গে আর্তচিৎকার করে বনওয়ারী পড়ে গেল সেইখানে। জ্ঞান হারিয়ে গেল। হাঁসুলীর বাঁকে বাঁশবনের ওদিকে বসতির মধ্যে কাহারেরা ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখছে। এদিকে হেমন্তের শেষরাত্রে কোপাইয়ের জলের বুকে শরতের হালকা সাদা মেঘের মত কুয়াশা জেগে উঠেছে; চরভূমিতেও সেই সাইক্লোনের প্রচণ্ড বৰ্ষণসিক্ত গলিত পত্ৰজঞ্জাল ভরা মাটিতেও জেগে উঠছে অনুরূপ কুয়াশার এক-একটা পুঞ্জ, সে পুঞ্জ আশ্রয় করছে ঝোপঝাড়গুলিকে। তেমনি একটি কুয়াশার আস্তরণ হাঁসুলী বাঁকের বীর কোশকেঁধে বনওয়ারীর বিশাল দেহখানিকে ঘিরে ক্রমশ জেগে উঠতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *