৪৫২. কালো কুয়াশা ১

মাসুদ রানা ৪৫২ – কালো কুয়াশা – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী

পূর্বকথা

পূর্ণিমার উজ্জ্বল আলো অদ্ভুত এক আভা তৈরি করেছে মিশরের মরুভূমিতে। বালিয়াড়ি পেয়েছে তুষারের শুভ্রতা, অ্যাবাইদোসের পরিত্যক্ত কিছু মন্দির ঝকঝক করছে অ্যালাব্যাস্টারের মতো। আশ্চর্য ওই আলোকসজ্জায় আলোকিত ওই মৃত্যুনগরীর ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে কয়েকজন অনুপ্রবেশকারীর একটা মিছিল।

তাদের গতি মন্থর, যাত্রাটা নিরানন্দ; সংখ্যায় নারী-পুরুষ মিলিয়ে ত্রিশজন। সবার পরনে ঢিলাঢালা আলখাল্লা, চেহারার অনেকখানি ঢেকে আছে হুড তুলে রাখার কারণে। সামনের পথের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ তাদের। ফারাওদের সমাধি প্রকোষ্ঠগুলো ঘেঁষে এগিয়ে চলেছে তারা। হাতের দুপাশে এবং সামনে-পেছনে আছে দেবতাদের উদ্দেশে বানানো গুটিকয়েক মন্দির আর সমাধিসৌধ।

পাথরে-বানানো পায়ে-চলা একটা পথে বালি উড়িয়ে আনছে মরুর বাতাস, ওখানে গিয়ে নিঃশব্দে থামল দলটা। কান খাড়া করল তাদের দলনেতা মেনুহোটেপ, আরেকটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরল হাতের বর্শাটা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।

কয়েকটা পরিবার আছে তার সঙ্গে। কয়েকজন পরিচারকও আছে, বহন করছে পরিবারগুলোর ছোট ছোট বাচ্চাদের।

মেনুহোটেপের পাশে গিয়ে দাঁড়াল ওর স্ত্রী। কিছু শুনতে পাচ্ছ?

মাথা ঝাঁকাল মেনুহোটেপ। মনে হচ্ছে, কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে।

কিন্তু এই শহর পরিত্যক্ত। এই সমাধিক্ষেত্রে প্রবেশের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন ফারাও। এখানে এসে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছি আমরা।

আলখাল্লার হুড ফেলে দিল মেনুহোটেপ। দেখা যাচ্ছে তার কামানো-চাঁদি, আর গলায় সোনার একটা নেকলেস। কণ্ঠহারটা নিঃশব্দে বলে দিচ্ছে, ফারাও আখেনেতেনের রাজদরবারের একজন সদস্য সে। ঝুঁকি? কিছুটা বেপরোয়া কণ্ঠে বলল, ওই ব্যাপারে আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে?

অ্যাবাইদোস এখন মৃত্যুপুরী, অথচ একসময় এটা ছিল জাঁকজমকপূর্ণ, কর্মব্যস্ত এক নগরী। কারণ মৃত্যুদেবতা এবং পরকালের শাসক ওসিরিসের পূজারী পুরোহিত আর তাঁদের সহকারীরা থাকতেন এখানে। শহরের এককোনায় আছে গোরস্থান; ফারাও রাজবংশের বেশিরভাগ শাসক এবং সাম্প্রতিক কয়েকজন রাজাকে তাদের মৃত্যুর পর দাফন করা হয়েছে এখানে। কয়েক বছর আগেও এখানে তৈরি করা হয়েছে মন্দির, ওসিরিসের সম্মানার্থে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ।

কিন্তু আখেনেতেন সিংহাসনে বসেই বদলে দিলেন সব।

ফারাও হওয়ার পর এমন এক কাজ করে বসলেন তিনি যা কখনও চিন্তাও করেনি কেউ। প্রাচীন সমস্ত দেবতাকে অস্বীকার করলেন তিনি, স্রেফ প্রত্যাখ্যান করলেন। হুকুম জারি করে নিষিদ্ধ করলেন তাঁদেরকে, অবসান ঘটালেন তাঁদের উদ্দেশে সবরকমের পূজাঅর্চনা অনুষ্ঠানের। সব দেবতার মূর্তিসহ একটা মন্দির ছিল মিশরে, ভেঙে গুঁড়ো করে ফেলা হলো মূর্তিগুলো। তাঁরই আদেশে ওই মন্দিরে বসানো হলো সূর্যদেবতা আতেনের মূর্তি, ঘোষণা করা হলো তিনিই এখন থেকে মিশরের একমাত্র দেবতা।

এই ঘটনার পর, স্বাভাবিকভাবেই, মৃত্যুপুরীতে পরিণত হলো অ্যাবাইদোস। প্রাণ বাঁচাতে যে যেদিকে পারলেন পালিয়ে গেলেন ওসিরিসের পূজারী পুরোহিতরা। কারণ আখেনেতেন ততদিনে আদেশ জারি করেছেন, যাকেই পাওয়া যাবে ওই শহরের ত্রিসীমানায়, তাকেই কতল করা হবে।

মেনুহোটেপের মতো রাজদরবারের কেউ যদি ধরা পড়ে এখানে, তা হলে শাস্তি হবে আরও ভয়াবহ: যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজের মৃত্যু প্রার্থনা করে কাতরাতে থাকবে আদেশ লঙ্ঘনকারী, ততক্ষণ তার উপর চালিয়ে যাওয়া হবে বীভৎস অত্যাচার।

কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল মেনুহোটেপ, কিন্তু বলল না–অনতিদূরে নড়াচড়া টের পেয়েছে। অন্ধকার ভেদ করে ছুটে আসছে তিনজন লোক, অস্ত্র দেখা যাচ্ছে ওদের হাতে।

স্ত্রীকে একধাক্কায় একটা স্মৃতিস্তম্ভের গাঢ় ছায়ার দিকে ঠেলে দিল মেনুহোটেপ, পরমুহূর্তেই ঘুরে মুখোমুখি হলো ওই তিনজনের। একটুও দেরি না করে নিজের বর্শাটা ছুঁড়ে মারল একজনকে লক্ষ্য করে। সবার আগে ছুটছিল যে-লোক, তার বুকে গিয়ে বিদ্ধ হলো ওটা। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে, পরক্ষণেই লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু বাকি দুজন ততক্ষণে মেনুহোটেপের অনেক কাছে এসে পড়েছে। ওকে ঘাই মারল একজন ব্রোঞ্জের খঞ্জর দিয়ে।

শরীর মুচড়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল মেনুহোটেপ, পারল না ঠিকমতো, পড়ে গেল। বাঁচার তাগিদে চার হাত পায়ে ভর দিয়ে উঠে বসল মুহূর্তের মধ্যে, বিড়ালের মতো কয়েক লাফে গিয়ে হাজির হলো বুকে-বর্শা-নিয়ে পড়ে-থাকা লোকটার কাছে। একঝটকায় আলগা করে নিল বর্শাটা। দুই হামলাকারী আবার কাছে এসে পড়েছে টের পেয়ে, ঘুরেই বর্শার ফলা দিয়ে গুতো মারার চেষ্টা করল একজনকে। একলাফে সরে গিয়ে নিজেকে বাঁচাল লোকটা।

কিন্তু মেনুহোটেপের বর্শা থেকে বাঁচতে পারলেও মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচতে পারল না সে। তার দিকে উড়ে এল আরেকটা বর্শা, পিঠ দিয়ে ঢুকে পেট ফুটো করে বেরিয়ে এল ফলাটা। খুশিতে মৃদু চিৎকার করে উঠল লড়াইয়ে-যোগ-দেয়া একজন ভৃত্য।

হাঁটু আপনাআপনি ভাঁজ হয়ে গেছে মুমূর্ষ লোকটার, বসে পড়তে বাধ্য হয়েছে। দম নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, ব্যথায় চিৎকার করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোনওটাই পারছে না। একদিকে কাত হয়ে পড়ে গেল, নড়ছে না।

অবস্থা বেগতিক, বুঝতে দেরি হয়নি তৃতীয় হামলাকারীর। ঘুরেই ছুট লাগিয়েছে প্রাণ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে। ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে আগে বাড়ল মেনুহোটেপ, পা দুটো জমিন স্পর্শ করামাত্র সর্বশক্তিতে ছুঁড়ে মারল বর্শাটা পলায়নরত লোকটাকে লক্ষ্য করে। একটুর জন্য বেঁচে গেল লোকটা। তারপর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে।

চোর নাকি? জিজ্ঞেস করল কে যেন। কবর খুঁড়ে ভিতর থেকে সোনাদানা নিতে এসেছিল?

হতে পারে, বলল মেনুহোটেপ। আবার গুপ্তচরও হতে পারে। গত কয়েকদিন থেকেই আমার মনে হচ্ছে, কারা যেন অনুসরণ করছে আমাদেরকে।

জলদি করতে হবে আমাদের, বলল আরেকজন। যে লোক পালিয়ে গেছে সে যদি দরবারে গিয়ে আমাদের কথা বলে, আগামীকাল সকাল হওয়ার আগেই মরব সবাই।

আমাদের এই জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত, বলল মেনুহোটেপের স্ত্রী। আমরা ভুল করছি।

হ্যাঁ, ভুল করেছি আমরা, স্বীকার করার ভঙ্গিতে বলল মেনুহোটেপ, তবে সেটা এখানে এসে না, আখেনেতেনের কথা মান্য করে। ওর কথামতো ওসিরিসকে অস্বীকার করেছি, ফলে শাস্তি দিয়েছেন তিনি। এখন উপায় একটাই: ওসিরিসের কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে। …চলো।

শহরের আরও ভিতরে ঢুকে পড়ল দলটা। সবচেয়ে বড় স্থাপনার সামনে হাজির হতে বেশি সময় লাগল না। ওসিরিসের মন্দির নামে পরিচিত এই ভবন।

দালানের ছাদটা চওড়া, সমতল। উঁচু উঁচু অনেকগুলো স্তম্ভ যেন ঠেক দিয়ে রেখেছে ছাদটাকে। স্তম্ভগুলোর ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে গ্ল্যানেটের বড় বড় ব্লক। মন্দিরের পুরোভাগে নিঃসঙ্গ নিঃশব্দ প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে ব্রোঞ্জের বিশালকায় একটা দরজা। ওটার কাছে গিয়ে হাজির হলো মেনুহোটেপ, ধাক্কা দিল পাল্লায়।

আশ্চর্য! দরজাটা খোলা!

ভিতরে ঢুকে পড়ল ও একে একে।

পাথর কেটে চমৎকারভাবে বানানো একটা প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে গেছে ক্রমশ-উঁচু-হওয়া একটা পথ, সিঁড়ির পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে পথটা। মেঝের প্রায় পুরোটাই ইথিয়োপিয়ান মার্বেলের, পার্শিয়ান নীলকান্তমণির সঙ্গে গ্র্যানেট মিশিয়ে বানানো বিচিত্র নকশা আছে জায়গায় জায়গায়।

ধূপের হালকা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। বেদীর সামনে আগুন জ্বলছে, দুদিকের দেয়ালের হুকে আটকে দেয়া হয়েছে একটা করে জ্বলন্ত মশাল। আবারও আশ্চর্য না হয়ে পারল না মেনুহোটেপ।

অনতিদূরে অনুজ্জ্বল আলোয় অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ে অর্ধবৃত্তাকারে সাজানো কয়েকটা বেঞ্চ। বেশ কয়েকটা লাশ, সেইসঙ্গে কয়েকজন মৃতপ্রায় নারী-পুরুষ-শিশুকে শুইয়ে রাখা হয়েছে সেসব বেঞ্চে। ওদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ওদের পরিবারের জীবিত সদস্যরা। কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারছে না তারা, তাই ফোঁপাচ্ছে। কেউ কেউ এত নিচু গলায় প্রার্থনা করছে যে, শুনলে মনে হয় ফিসফিস করছে।

আমাদের মতো আরও কেউ অমান্য করেছে আখেনেতেনের আদেশ, নিচু গলায় বলল মেনুহোটেপ।

বেঞ্চগুলো ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের কেউ কেউ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ওর দিকে। কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না ওদের কারও মাঝে।

মন্দিরের যেখানেই সুবিধাজনক জায়গা পাচ্ছে সেখানেই বয়ে-আনা বাচ্চাগুলোকে নামিয়ে রাখছে চাকররা। ইতিমধ্যে ওসিরিসের বেদীর উদ্দেশে হাঁটছে মেনুহোটেপ। আগুনের কাছে গিয়ে বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে, অনুনয় করার ভঙ্গিতে নত করে ফেলেছে মাথা। আলখাল্লার ভিতর থেকে বের করল উটপাখির দুটো পালক।

মৃত্যুদেবতা, ফিসফিস করে বলছে সে, পরকালের অধিপতি, সীমাহীন দুঃখকষ্টে পতিত হয়ে আজ আপনার কাছে এসেছি। রহস্যময় অসুখে অসুস্থ হয়ে পড়েছে আমার পরিবারের সদস্যরা। অভিশপ্ত হয়ে গেছে আমাদের ঘরবাড়ি। মরুভূমির মতো বিরান হয়ে গেছে আমাদের চাষের জমি। একটার পর একটা গরুবাছুর মারা পড়ছে। …দেবতা, আপনি যদি মৃত্যুই নির্ধারিত করে থাকেন আমাদের জন্য, তা হলে আমাদের যারা মারা যাচ্ছে তাদেরকে পরকালে সুখী করুন। আপনাকে ভুলে গিয়ে পাপ করেছি আমরা, আপনি দয়া করে ক্ষমা করুন আমাদেরকে। আপনি দয়া করে জীবন ফিরিয়ে দিন আমাদের পরিবারের সদস্যদের। অভিশাপ তুলে নিন। আমাদের চাষের জমিন আর গরুবাছুরের উপর থেকে।

শ্রদ্ধাবনত ভঙ্গিতে পালক দুটো নামিয়ে রাখল সে বেদীর উপর, সিলিকা আর স্বর্ণগুড়ার মিশ্রণ ছিটিয়ে দিল ওগুলোয়। তারপর উঠে দাঁড়াল, আগুনের দিকে উল্টো না-ঘুরে নেমে এল বেদী থেকে।

একঝলক বাতাস বয়ে গেল মন্দিরের ভিতরে, একদিকে কাত হয়ে গেল মশাল দুটোর অগ্নিশিখা। অদ্ভুত এক গুম গুম শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দূরে কোথাও।

চট করে ঘুরে শব্দের উৎসের দিকে তাকাল মেনুহোটেপ।

বন্ধ হয়ে গেছে মন্দিরের দরজাটা। সমানে কাঁপছে মশালের অগ্নিশিখা, যে-কোনও সময় নিভে যেতে পারে। কিন্তু শেষপর্যন্ত নিভল না কোনওটাই। বাতাস বন্ধ হয়ে গেল, আবার আগের মতো জ্বলছে মশাল দুটো। বেদীটা আগের চেয়ে বেশি আলোকিত মনে হচ্ছে।

চমকে উঠল মেনুহোটেপ-বেদীর উপর দেখা যাচ্ছে পাঁচটা ছায়ামূর্তি। অথচ মেনুহোটেপ নিশ্চিত কয়েক মুহূর্ত আগেও ওরা ছিল না সেখানে। যা দেখছে, তা ভেলকিবাজি বলে মনে হচ্ছে ওর।

কালচে সোনালি কাপড় পরে আছে চার ছায়ামূর্তি-ওসিরিসের পূজারীরা ও-রকম কাপড় পরত একসময়। পঞ্চমজনের গায়ের ভিন্ন পোশাক দেখলে মনে হয়, তিনি প্রেতলোকের প্রভু। কোমর আর দুই পায়ে চওড়া সাদা ফিতা পেঁচিয়ে রেখেছেন তিনি মমির-গায়ে-পেঁচানো ব্যাণ্ডেজের কায়দায়। অদ্ভুত সবুজাভ চামড়ায় শোভা পাচ্ছে সোনার ব্রেসলেট, নেকলেস আর অন্যান্য অলঙ্কার। উটপাখির পালকওয়ালা একটা মুকুট দেখা যাচ্ছে মাথায়। তাঁর একহাতে রাখালছেলেদের মতো বাঁকা ছড়ি, অন্যহাতে শস্য মাড়াই করার সেকেলে কস্তনী।

আমি ওসিরিসের বার্তাবাহক, অনুনাদে ভরা ভারী গলায় বললেন তিনি। পরকালের প্রভুর অবতার।

তাঁর উদ্দেশে মাথা নোয়াল মন্দিরে উপস্থিত সবাই।

বাকি চার ছায়ামূর্তি ধীর পায়ে নেমে আসছে বেদী থেকে। বেঞ্চগুলোর কাছে গিয়ে হাজির হলো ওরা। মৃত অথবা প্রায় মৃত মানুষগুলোর আশপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে গাছের পাতা, ফুল, পাপড়ি এবং সরীসৃপ ও উভচরদের শুকনো চামড়া।

ওসিরিসের আশীর্বাদ চাও তোমরা, বললেন স্বঘোষিত অবতার। কিন্তু একজন বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছ সবাই। কাজেই তোমরাও বিশ্বাসঘাতক।

মেনুহোটেপসহ বাকিদের মাথা আপনাআপনি নিচু হয়ে গেল।

মাথা নিচু করে রেখেই মেনুহোটেপ বলল, স্বীকার করছি, আখেনেতেনের কথা মতো কাজ করে পাপ করেছি। কিন্তু, প্রভু, আমাদের বাচ্চারা তো কোনও অপরাধ করেনি! পরকালের সুখশান্তির যে-প্রতিজ্ঞা করেছেন মহান ওসিরিস, আমি প্রার্থনা করি তা দেয়া হোক ওদেরকে।

কোনও জবাব এল না।

মুখ তুলে তাকাল মেনুহোটেপ।

ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন “অবতার”, কালো দুই চোখের পলক পড়ছে না। বললেন, তুমি যে আসলেই অনুশোচনায় ভুগছ, তা প্রমাণ করে দেখাতে বলেছেন ওসিরিস।

কী করতে হবে আমাকে? নিজের বুকের ধুকপুকানি টের পাচ্ছে মেনুহোটেপ।

বেদীর একদিকে রাখা আছে একটা লাল অ্যামফোরা, কঙ্কালসার আঙুলের ইশারায় ওটা দেখিয়ে “অবতার” বললেন, স্বাদহীন একজাতের বিষ আছে ওটার ভিতরে। অন্ধ করে দেয়। নিয়ে যাও কলসিটা। বিষ মিশিয়ে দাও আখেনেতেনের মদৈ।

দ্বিধা করছে মেনুহোটেপ। আখেনেতেনের আদেশ অমান্য করা এক কথা, কিন্তু লোকটাকে বিষ খাইয়ে অন্ধ করে দেয়া…

নড়ে উঠলেন “অবতার”, বেদীর আগুনে ঢুকিয়ে দিলেন কস্তনীর একটা প্রান্ত। আগুন লেগে গেল ওই প্রান্তের সঙ্গে আটকানো চামড়ার তন্তুগুলোতে, পরমুহূর্তেই ছোট একটা বিস্ফোরণের মাধ্যমে বর্ধিত হলো অগ্নিশিখা-দাহ্য কোনও তরল মাখানো ছিল ওগুলোয়। একটু আগে যেসব পাতা ছিটিয়েছে “অবতারের” চার অনুসারী, জ্বলন্ত কস্তনী দিয়ে সেগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিলেন তিনি। আগুনের একটা রেখা ছড়িয়ে পড়ল বেদীর উপর।

উত্তাপ লাগছে গায়ে, আরও পিছিয়ে এল মেনুহোটেপ। অসহ্য ঠেকছে ধোঁয়া আর পোড়াপাতার গন্ধ, কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে দৃষ্টি, মাথা ঘুরাচ্ছে। চোখ কচলাচ্ছিল সে; আবার যখন তাকাল বেদীর দিকে, ততক্ষণে পাতায় লাগানো আগুন আরও বেড়েছে, লাশ এবং সেগুলো ঘিরে যারা শোক করছিল তাদেরকে যেন ঘিরে ধরছে চক্রাকারে। ওদিকে চার অনুসারীকে নিয়ে গায়েব হয়ে যাচ্ছেন “অবতার”-বেদীর পেছনের একটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছেন।

এটা কী করলে? চিৎকার করে উঠল মেনুহোটেপের স্ত্রী। কেন কোনও জবাব দিলে না অবতারকে?

আমি ঘাবড়ে গেছি, বিড়বিড় করে বলল মেনুহোটেপ। ভাবল, ওদের সবাইকে শেষ সুযোগ দিয়েছিলেন ওসিরিস, কিন্তু সেটা নিতে পারল না সে।

মর্মবেদনায় ভুগতে ভুগতে বেদীর সেই বিষের অ্যামফোরার দিকে তাকাল মেনুহোটেপ। তাপে কাঁপছে বাতাস, মনে হচ্ছে কাঁপছে কলসিটাও–আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসছে যেন।

একসময় ধোঁয়া এত বেড়ে গেল যে, আরও পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলো মেনুহোটেপ। আবার চোখ কচলাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর যখন চোখ খুলে তাকাল, ততক্ষণে বাড়ন্ত ধোঁয়া অদৃশ্য করে দিয়েছে অ্যামফোরাটাকে।

আগুন নিভে গেল একসময়, বেদীর উপর এখন জায়গায় জায়গায় পড়ে আছে শুধু ছাই। পাতলা ধোঁয়ার একটা চাদরও আছে, ক্ষণে ক্ষণে আকার বদল করছে সেটা। কে বা কারা যেন খুলে দিয়েছে মন্দিরের দরজাটা, সেখান দিয়ে ঢুকছে ঠাণ্ডা বাতাস।

ছোট্ট কয়েকটা আঙুল কাঁপতে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল মেনুহোটেপ। এমনভাবে কাঁপছে ওর মেয়েটা, যেন আক্রান্ত হয়েছে তীব্র জ্বরে। ডাঙায় তোলা মাছের মতো বার বার হাঁ করছে বেচারী, যেন দম নিতে পারছে না।

মেয়ের দিকে এগিয়ে গেল মেনুহোটেপ। বেচারীর গা আসলেই গরম। পুরো শরীরটা কাঁপছে সমানে। একই অবস্থা হয়েছে মেনুহোটেপের ছেলেরও।

ওরা কিছু বলতে চাইছে কি না, বোঝার চেষ্টা করল মেনুহোটেপ, কিন্তু পারল না। থামানোর চেষ্টা করল ওদের কাপুনি, তা-ও পারল না। অসহায়ের মতো আবার তাকাল এদিকওদিক।

অসুস্থ হয়ে পড়া বাচ্চাদের প্রায় সবারই একই অবস্থা হয়েছে।

কী হয়েছে ওদের? চাপা গলায় জানতে চাইল মেনুহোটেপের স্ত্রী।

জীবন আর মরণের মাঝখানে আটকা পড়েছে মনে হয়, বলল মেনুহোটেপ। ইসস…না জানি কী কষ্ট হচ্ছে বাচ্চাগুলোর!

কী হবে এখন?

দ্বিধা কেটে গেল মেনুহোটেপের, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে। ওসিরিস যা চান তা-ই হবে। আখেনেতেনের মদে বিষ মিশিয়ে দেব আমি।

উঠে দাঁড়াল সে, এগিয়ে যাচ্ছে বেদীর দিকে। অ্যামফোরাটা জায়গামতোই আছে, তবে ধোয়ার স্কুলের কারণে লাল রঙ বদলে গিয়ে কালচে হয়ে গেছে। দুহাতে হাতল ধরে কলসিটা তুলে নিল মেনুহোটেপ নতুন বিশ্বাস আর আশা ভর করেছে ওর উপর।

এবার অবস্থার পরিবর্তন হবে।

বাকিদেরকে সঙ্গে নিয়ে মন্দির ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে।

.

০১.

একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের তুলনায় এম.ভি, টায়ানাকে পুরনোই বলা চলে।

জাহাজটা দৈর্ঘ্যে তিন শ ফুট। ওটার কাঠামো স্টিলের। শুরুতে ছিল একটা ফ্রেইটার। নির্মিত হয়েছিল উনিশ শ তিয়াত্তর সালে। ওটার বয়স যত বেড়েছে, গতি তত কমেছে; কাজেই ওটাকে এখন একটা কোস্টার হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

টায়ানা এই মুহূর্তে আছে মাল্টা উপকূল থেকে সত্তর মাইল পশ্চিমে, আজ রাত থাকতেই ছেড়েছে মাল্টার বন্দর। এগিয়ে চলেছে ইটালি-নিয়ন্ত্রিত দ্বীপ লিনোসার দিকে। লিবিয়া, সিসিলি, মাল্টা আর গ্রিসসহ ভূমধ্যসাগরের কয়েকটা দ্বীপে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালাচ্ছে ওটা।

ভোরের আলো এখনও ফোটেনি, তারপরও ব্রিজে জড়ো হয়েছে বেশ কয়েকজন নাবিক। তাদের সবাই উদ্বিগ্ন। গত প্রায় এক ঘণ্টা ধরে অচেনা একটা জাহাজ পিছু নিয়েছে টায়ানার। একটা বাতিও জ্বলছে না ভূতুড়ে ওই জাহাজে। ব্যাপারটা প্রভাব ফেলেছে নাবিকদের মনে।

হুইলের দায়িত্বে থাকা শিপমাস্টারের নাম শেলড্রেক, গাঁট্টাগোট্টা এক লোক। পাইল ড্রাইভারের মতো বাহু ওর, চুল সাদাকালো, গালের না-কামানো দাড়ি দেখলে মনে হয় শিরিশ কাগজের কথা। জিজ্ঞেস করল, ওরা কি এখনও লেগেই আছে আমাদের পেছনে?

হ্যাঁ, চেঁচিয়ে জবাব দিল ফার্স্ট মেইট। যতবার কোর্স বদল করছি আমরা, ততবার তা-ই করছে ওরাও। এবং এগিয়ে আসছে আস্তে আস্তে।

আমাদের সব লাইট নিভাও, আদেশ দিল শেলড্রেক।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আবছা অন্ধকারে ঢাকা পড়ল টায়ানা।

জাহাজের দিক আরেকবার পাল্টাল শেলড্রেক।

ওদের কাছে রেইডার অথবা নাইট ভিশন গগলস থাকলে কোর্স বদলে লাভ হবে না, বলল ফার্স্ট মেইট।

অন্তত কিছুটা হলেও সময় আদায় করে নিতে পারব আমরা, কণ্ঠ শুনে বোঝা গেল অনিশ্চয়তায় ভুগছে শেলড্রেক।

ওরা কাস্টমসের লোকও তো হতে পারে? বলল আরেকজন নাবিক। অথবা ইটালিয়ান কোস্ট গার্ডঃ

মাথা নাড়ল শেলড্রেক। কাস্টমস বা কোস্টগার্ড জানান দিয়ে আসে, বাতি নিভিয়ে ভূতের মতো আসে না।

কথাটা বুঝতে পারল ফার্স্ট মেইট। মাফিয়া?

মাথা ঝাঁকাল শেলড্রেক। ওদের সঙ্গে বনিবনা করে নেয়া উচিত ছিল আমাদের। ওদের জলসীমাতেই চোরাকারবারি করছি আমরা। খবর পেয়ে গেছে ওরা, হাজির হয়েছে ভাগ বসাতে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল, খসাতে পারেনি পেছনের জাহাজটাকে।

আসলে একটা সুযোগ নিতে চাইছিল সে। ভেবেছিল, শেষরাতের অন্ধকার যতক্ষণ আছে, বার বার দিক পাল্টে ফাঁকি দিতে পারবে ভূতুড়ে জাহাজটাকে। কিন্তু বেশিরভাগ জুয়াড়িই প্রতি দশ দানে জেতে এক কি দুবার।

অস্ত্র বের করো, নতুন আদেশ দিল সে। লড়াই করতে হবে।

কিন্তু যে-জিনিস বহন করছি আমরা, ফাস্ট মেইটের কণ্ঠে একইসঙ্গে প্রতিবাদ আর দ্বিধা, লড়াই করলে তার ফল কী হবে…

কথাটা ভাবছে শেলড্রেকও। শিপিং কন্টেইনার দিয়ে বোঝাই হয়ে আছে টায়ানা, বেশিরভাগ কন্টেইনারে লুকানো আছে বড় বড় প্রেশারাইড়-ট্যাঙ্ক, ভিতরে তরলীকৃত প্রোপেন। স্মাগলিং করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিশটা রহস্যময় ব্যারেল, ভিতরে হাশিশ আছে বলে ধারণা করছে টায়ানার সবাই, মোটা টাকার বিনিময়ে ওগুলো জাহাজে তুলেছে হানুফের খালফানি নামের মিশরীয় এক লোক। ব্যারেলগুলো কোনও ব্যাপার না, আসল ব্যাপার হচ্ছে প্রোপেন। ইউরোপের বন্দরগুলোতে তরলীকৃত জ্বালানির শুল্কমূল্য চড়া, তাই একেকটা প্রেশারাইড়-ট্যাঙ্ক যেমন একেকটা বোমা, তেমনই একেকটা স্বর্ণখনিও।

শেলড্রেক বলল, মাফিয়ার হাতে ধরা পড়লে টাকা তো দিতে হবেই, মালও খোয়াতে হবে। এমনকী জানও যেতে পারে।

মাথা নাড়ল ফার্স্ট মেইট। আরেকজনের প্রোপেনের জন্য জান দিতে রাজি না আমি। যাই, অস্ত্র নিয়ে আসি।

ওর দিকে একটা চাবি ছুঁড়ে দিল শেলড্রেক। ঘুম থেকে ডেকে তোলো সবাইকে।

ওয়েপনস্ লকারের দিকে ছুট লাগাল ফার্স্ট মেইট।

একদিক দিয়ে উধাও হলো সে, আরেকদিক দিয়ে হুইলহাউসে আবির্ভাব ঘটল খালফানির। লোকটা লম্বা, হালকাপাতলা। দৃষ্টি অন্তর্ভেদী, চাঁদি কামিয়ে রাখে সবসময়। গায়ের রঙ ক্যারামেলের মতো। ভোতা গলায় বলল, জাহাজের সব বাতি নিভিয়ে দেয়া হলো কেন? আর বার বার দিক বদল করে আসলে কোথায় যাচ্ছি আমরা?

উত্তরটা কষ্ট করে অনুমান করে নিন নিজেই, ইঙ্গিতে পেছনের জাহাজটা দেখিয়ে দিল শেলড্রেক।

খালফানি বুঝতে পারল, ঘটনা কী। জামার নিচে, ট্রাউজারের বেল্টে আটকানো একটা নাইন মিলিমিটার পিস্তল বের করল। ওটা আলগোছে ধরে এগিয়ে গেল দরজার দিকে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কালো সাগরের দিকে।

পেছনে না দেখালাম? খালফানি ভুল জায়গায় দেখছে ভেবে শুধরে দেয়ার চেষ্টা করল শেলড্রেক।

কিন্তু পরমুহূর্তেই প্রমাণিত হলো, আসলে ভুল হয়েছে শেলড্রেকেরই। অন্ধকার চিরে দিল আলোর দুটো রেখা। একটার কারণে উদ্ভাসিত হয়েছে ব্রিজ, আরেকটা নেচে বেড়াচ্ছে রেইলিং-এর উপর।

ছুটে আসছে দুটো রাবার বোট। টায়ানার নাক ঘুরিয়ে নিল শেলড্রেক, পিষে ফেলতে চায় বোট দুটোকে। কিন্তু কোনও লাভ হলো না, ওর উদ্দেশ্য বুঝে গেছে বোটের চালকরা। চট করে দুদিকে সরে গেল ওরা, মাঝখানের গ্যাপ দিয়ে টায়ানা বেরিয়ে যেতেই পিছু নিতে শুরু করল ওটার। দূরত্ব কমাচ্ছে আস্তে আস্তে।

সুযোগ বুঝতেই বোট দুটো থেকে ছুঁড়ে মারা হলো দুটো হুক, টায়ানার রেইলিঙের সঙ্গে আটকে গেল ওগুলো। হুকের সঙ্গে আটকানো ধাতব দড়ি বেয়ে বোট থেকে জাহাজে উঠে আসার চেষ্টা করছে দুই দল সশস্ত্র লোক।

গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল। অটোমেটিক ফায়ারআর্ম চালানো হচ্ছে একটা বোট থেকে।

মাথা নামান! খালফানির উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল শেলড্রেক।

ব্রিজের একটা জানালা চুরমার করে দিয়ে ভিতরে ঢুকেছে কয়েকটা বুলেট, উল্টোদিকের ধাতব দেয়ালে লেগেছে। কিন্তু কোনও ভাবান্তর হয়নি খালফানির চেহারায়। ধীর পায়ে হেঁটে বাল্কহেডের ভিতরে ঢুকে পড়ল সে, একবার উঁকি দিয়ে দেখল বাইরে, পরমুহূর্তে কয়েকবার গর্জে উঠল ওর নাইন মিলিমিটার।

আশ্চর্য হয়ে গেল শেলড্রেক, লোকটার নিশানা সাংঘাতিক। ধাতব দড়ি বেয়ে যারা উঠে আসছিল তাদেরকে কভার দিতে গুলি চালানো হচ্ছিল একটা বোট থেকে, টায়ানার ডেকে উঠেও পড়েছিল দুজন, কিন্তু দুজনই কপালে একটা করে ছিদ্র নিয়ে পড়ে আছে রেইলিং ঘেঁষে। খালফানির তিন নম্বর গুলিতে, অকেজো হয়ে গেছে একটা বোটের স্পটলাইট।

লোকটা জানত, স্ফুলিঙ্গ লক্ষ্য করে পাল্টা জবাব দেয়া হবে কোনও-না-কোনও বোট থেকে, তাই নিজের ভেল্কিবাজি দেখিয়েই চট করে সরে গেছে আরেকদিকে।

বোট দুটো থেকে আসা দ্বিতীয়বারের বুলেটবৃষ্টি কাঁপিয়ে দিল হুইলহাউসটাকে। একটা বুলেট আঁচড় কেটে গেল শেলড্রেকের এক বাহুতে। রেগে গেল সে। হুইল ছেড়ে দিয়ে শোল্ডার হোলস্টার থেকে বের করল ওর পিস্তল, প্রস্তুত হয়ে গেছে লড়াইয়ের জন্য। খালফানির খোঁজে এদিকওদিক তাকাচ্ছে। অনতিদূরে গা ঢাকা দিয়ে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা যে, ওর ছায়ামূর্তি দেখতে পাবে না বোটের কেউ।

আবারও গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, এবার জাহাজের পেছনদিক থেকে। বসে পড়েছিল শেলড্রেক, সুযোগ বুঝে উঠে দাঁড়াল, চুরমার হয়ে যাওয়া জানালা দিয়ে গুলি করল দুবার।

বুলেটের অপচয় করছ, বলল খালফানি। দুই বোট থেকে কম-করে-হলেও একডজন লোক হাজির হয়ে গেছে ডেকে, সংখ্যাটা বেশিও হতে পারে। জাহাজের পেছনদিকে ঘেঁষার চেষ্টা করছে তৃতীয় আরেকটা বোট।

আরেকদফা বুলেটবৃষ্টি হলো টায়ানার পেছনদিক থেকে, প্রমাণিত হলো খালফানির কথাই ঠিক।

ওয়েপন্স লকারটা জাহাজের পেছনদিকে, অসহায়ের মতো শোনাল শেলড্রেকের কণ্ঠ। আমার লোকেরা যদি ওখানে পৌঁছাতে না পারে, স্রেফ কচুকাটা হয়ে যাব।

বাল্কহেডের দরজার দিকে এগিয়ে গেল খালফানি, একটু ফাঁক করল ওটা, তাকাল প্যাসেজের দিকে। মনে হয় ইতোমধ্যেই কচুকাটা হয়ে গেছে তোমার লোকেরা।

থপ্ থপ্ আওয়াজ করতে করতে প্যাসেজ ধরে এগিয়ে আসছে কে যেন। শব্দের উৎস লক্ষ্য করে পিস্তল তুলল। শেলড্রেক। কিন্তু গুলি করার দরকার হলো না–দরজা আরও ফাঁক করেছে খালফানি, খোঁড়াতে খোঁড়াতে হুইলহাউসের ভিতরে ঢুকে পড়েছে টায়ানার এক রক্তাক্ত নাবিক। বলল, নিচের ডেক দখল করে নিয়েছে ওরা। ওয়েপন্স্ লকারের কাছেও যাওয়ার সুযোগ পাইনি আমরা।

পেট চেপে ধরল সে, বুলেট ক্ষত তৈরি করেছে সেখানে, সমানে রক্ত বের হচ্ছে। মেঝেতে আছড়ে পড়ল, নড়ছে না।

আবারও গুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। খুব সম্ভব গুলি করতে করতে এগিয়ে আসছে দখলদাররা, সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই শেষ করে দিচ্ছে।

হুইল ছেড়ে দিয়ে আহত নাবিকের দিকে এগিয়ে গেল শেলড্রেক।

ওর কথা ভুলে যাও, কড়া গলায় বলল খালফানি। পালাতে হবে আমাদেরকে।

সহকর্মীদের মৃত্যুর মুখে ফেলে পালাতে ঘৃণা করে শেলড্রেক, কিন্তু আহত লোকটার জন্য আসলেই কিছু করার নেই ওর। টের পেল, রক্তপিপাসা জেগে উঠেছে ওর ভিতরে। পিস্তলটা কক করে হ্যাঁচওয়ের দিকে পা বাড়াল সে। কিন্তু ওকে খামচে ধরল খালফানি।

যেতে দাও আমাকে, ভয়ঙ্কর গলায় বলল শেলড্রেক।

খামোকা মরতে চাও?

আমার লোকদের নির্বিচারে খুন করছে ওরা। ওদের যতজনকে পারি শেষ করতে চাই।

যারা ইতোমধ্যেই খুন হয়ে গেছে তাদের কথা ভেবে কোনও লাভ আছে? বরং আমার মালের কথা ভাবো।

এই পরিস্থিতিতেও থতমত না খেয়ে পারল না শেলড্রেক। তুমি কি পাগল? তোমার ওই হাশিশ নিয়ে পালানোর কথা ভাবছ কী করে?

হাশিশ? বিশকে দুই ভেবে নিয়েছ নিজে নিজেই?

মানে?

জায়গামতো নিয়ে চলো আমাকে, নিজেই বুঝে যাবে।

কিন্তু পালাবে কীভাবে?

 আহ্, ওটা আমার দায়িত্ব।

অন্ধকারেও যেন জ্বলজ্বল করছে খালফানির চোখ, সেদিকে তাকালে ঐকান্তিকতা টের পাওয়া যায়।

হয়তো…সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল শেলড্রেক…মিথ্যা বলছে না লোকটা। চলো। দরজা দিয়ে বের না হয়ে এগিয়ে গেল চুরমার হওয়া জানালার দিকে। ওটা গলে বেরিয়ে লাফিয়ে পড়ল সবচেয়ে কাছের কন্টেইনারের উপর। ছফুট নিচে লাফ দিতে হয়েছে ওকে, তাল সামলাতে পারেনি অন্ধকারে, ব্যথা পেল একহাঁটুতে।

লাফিয়ে ওর ঠিক পেছনেই ল্যাণ্ড করল খালফানি, কিছুই হলো না ওর। বরং মুহূর্তের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেছে কিছুদূর, অপেক্ষা করছে শেলড্রেকের জন্য।

উঠে দাঁড়াল শেলড্রেক, হাঁটুতে ব্যথা নিয়েই দৌড়ে গিয়ে লাফিয়ে পড়ল আরেকটা কন্টেইনারের ছাদে। এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে দুজনে হাজির হয়ে গেল কন্টেইনারের প্রথম সারির কাছে। দুটো কন্টেইনারের মাঝখানের ফাঁকা জায়গা দিয়ে পিছলে ঝুলে পড়ল শেলড্রেক, তারপর নিঃশব্দে ল্যাণ্ড করল জাহাজের ডেকে।

ওর সঙ্গে আঠার মতো সেঁটে আছে খালফানি।

কিছুদূর যেতে-না-যেতেই আবার শেলড্রেককে খামচে ধরল লোকটা, টেনে নিয়ে গেল দুটো কন্টেইনারের আড়ালে। স্তিমিত হয়ে এসেছিল গুলির শব্দ, এখন আবার শোনা যাচ্ছে মাঝেমধ্যে, এখানে-সেখানে। লড়াই শেষ হয়নি এখনও, তবে শেষ হয়ে আসছে।

 কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর খালফানি যখন বুঝল পরিস্থিতি নিরাপদ, এগোনোর ইশারা করল শেলড্রেককে।

মিশরীয় লোকটাকে নিয়ে একটা কন্টেইনারের সামনে গিয়ে থামল শেলড্রেক।এসে গেছি।

খোলো এটা।

নিজের মাস্টার-কী ব্যবহার করে তালা খুলে ফেলল শেলড্রেক। দরজা আটকে রাখা লিভার ধরে টান মারল। কাঁচকোচ করে উঠল জংধরা কজা, কলিজা কেঁপে গেল শেলড্রেকের।

ভিতরে ঢোকো, আদেশ দিল খালফানি।

ভিতরে ঢুকে একটা হ্যাঁণ্ডহেল্ড লাইট খুঁজে নিল শেলড্রেক, জ্বালল ওটা।

কন্টেইনারটার বেশিরভাগ জায়গা দখল করে রেখেছে সিলিণ্ডারের মতো দেখতে কয়েকটা প্রোপেন-ট্যাঙ্ক, ওগুলো ছাড়িয়ে আরও ভিতরে দেখা যাচ্ছে ঝকঝকে সাদা বিশটা ব্যারেল। পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল শেলড্রেক।

এবার?

জুবাব দিল না খালফানি। পিস্তলটা জল ট্রাউজারের কোমরে, একটা ব্যারেল হাতে নিয়ে চাপ দিয়ে খুলল ওটার ঢাকনা।

আবারও আশ্চর্য হয়ে শেলড্রেক দেখল, ধোঁয়ার মতো কিছু-একটা বের হতে শুরু করেছে ব্যারেলটা থেকে, নামছে নিচের দিকে, ছড়িয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে। তরল নাইট্রোজেন নাকি? আশপাশের বাতাসে শীতলতা টের পেয়ে জিজ্ঞেস করল। এটা দিয়ে শত্রু মারার ফন্দি করেছ?

ওকে আবারও উপেক্ষা করল খালফানি, মুখ বন্ধ করে কাজ করে যাচ্ছে। ব্যারেলের ভিতর থেকে বের করল অদ্ভুত প্রতীকযুক্ত ঠাণ্ডা একটা বোতল।

প্রতীকটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে শেলড্রেক। ভাবছে, নার্ভ গ্যাস? বায়োলজিকাল ওয়েপও হতে পারে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, তোমার এই ব্যারেলগুলো নেয়ার জন্যই এসেছে ওরা, না? প্রোপেন নিতে আসেনি, চাদাও দাবি করবে না আমার কাছে। আমি শিয়োর, তোমার আর তোমার এই রাসায়নিক তরলের কারণেই মরেছে আমার লোকেরা! খপ করে চেপে ধরল সে খালফানির শার্টের কলার।

একটু থমকে গিয়েছিল খালফানি, কিন্তু সামলে নিতে সময় লাগল না ওর। পাল্টা ঝটকায় শেলড্রেকের হাত ছুটিয়ে দিল নিজের কলার থেকে, পরমুহূর্তেই মোচড় দিয়ে হাতটা নিয়ে গেল শেলড্রেকের পিঠের কাছে, তারপর ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল মেঝেতে।

উপুড় হয়ে পড়ে গেল শেলড্রেক, চিৎ হওয়ামাত্র টের পেল, ওর বুকে চড়ে বসেছে খালফানি। একজোড়া নির্দয় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

তোমাকে আর দরকার নেই আমার, নির্দয়ের মতোই বলল খালফানি।

সঙ্গে সঙ্গে তলপেটে তীব্র ব্যথা টের পেল শেলড্রেক-একটা খঞ্জর বের করে ঢুকিয়ে দিয়েছে খালফানি। ওটার হাতল ধরে মোচড় দিল কয়েকবার, পেট চিরে তুলে আনল ফলাটা বুকের কাছে, তারপর মোচড় দিয়ে ওটা বের করে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

তীব্র যন্ত্রণায় বার বার কুঁকড়ে যাচ্ছে শেলড্রেক, হাত থেকে আপনাআপনি ছুটে গেছে পিস্তলটা। উঠে বসার চেষ্টা করতে গিয়ে আছড়ে পড়ল কন্টেইনারের ধাতব মেঝেতে। টের পাচ্ছে, ওরই রক্তে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে ওর কাপড়। চিৎকার করার চেষ্টা করছে, কিন্তু প্রচণ্ড ব্যথায় তা-ও পারছে না।

খঞ্জরের হাতল থেকে রক্ত মুছে ফেলল খালফানি, ঢুকিয়ে রাখল কোমরের লুকানো-খাপে। ট্রাউজারের পকেট থেকে বের করল একটা স্যাটেলাইট ফোন, একটা বাটন চাপল। হামলা চালিয়ে দখল করে নেয়া হয়েছে টায়ানা, চাপা গলায় বলল অপরপ্রান্তের লোকটাকে।

কিছুক্ষণের বিরতি।

মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে শেলড্রেক, ওর দিকে তাকিয়ে আছে খালফানি, কিন্তু মনোযোগ দিয়ে শুনছে কী বলা হচ্ছে ওকে ফোনে।

মাথা নাড়ল সে। লড়াই করা সম্ভব না। ওরা সংখ্যায় অনেক…হা, জানি কী করতে হবে…এমন ব্যবস্থা করছি যাতে অন্য কারও হাতে না পড়ে কালো কুয়াশা।

ফোনের লাইন কেটে দিল। এগিয়ে গেল একটা প্রোপেন ট্যাঙ্কের দিকে, রিলিফ ভাড় ধরে জোরে মোচড় দিল। হিসহিস শব্দে ভরে গেল কন্টেইনারের ভিতরটা, গ্যাস বের হতে শুরু করেছে।

শার্টের পকেট থেকে ছোট একটা এক্সপ্লোসিভ চার্জ বের করল খালফানি, প্রোপেন-ট্যাঙ্কের একদিকে লাগিয়ে দিল ওটা, টাইমার সেট করল। এগিয়ে গেল কন্টেইনারের দরজার দিকে। পাল্লাটা নিজের ভারে চেপে এসেছিল, ওটা ফাঁক করে বেরিয়ে এল অন্ধকার ডেকে।

কন্টেইনারের ভিতরে, মেঝেতে পড়ে আছে শেলড্রেক; মরেনি এখনও। রক্তের একটা পুকুর তৈরি হয়েছে ওর আশপাশে। তাকিয়ে তাকিয়ে অসহায়ের মতো দেখেছে খালফানির কাজ, বুঝে গেছে কী ঘটতে চলেছে একটু পর। বুঝতে পারছে মরণ ঠেকানোর কোনও উপায় নেই। তারপরও সিদ্ধান্ত নিল, পারলে ঠেকানোর চেষ্টা করবে আসন্ন বিস্ফোরণ।

কয়েকবার গড়ান খেল সে, প্রতিবারই গুঙিয়ে উঠল প্রচণ্ড ব্যথায়। যে-ট্যাঙ্কে টাইমার লাগানো হয়েছে সেটা থেকে যখন আর সামান্য দূরে আছে, যেন অপার্থিব কোনও শক্তির প্রভাবে ভর দিতে পারল চার হাত-পায়ে; হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ট্যাঙ্কের দিকে। ওর পেছনে রয়ে যাচ্ছে রক্তের মোটা ধারা।

রিলিফ ভালভ যেদিকে ঘুরিয়েছে খালফানি, শেলড্রেক সেটা ঘোরানোর চেষ্টা করল বিপরীত দিকে, কিন্তু পারল নাশক্তিতে কুলাচ্ছে না। ওটা এমনকী ধরতেও পারছে না ঠিকমতো। ইতিমধ্যে অসহ্য হয়ে উঠেছে প্রোপেনের গন্ধ, বমি আসছে। পেটের যে-জায়গায় খঞ্জর ঢুকিয়েছে খালফানি, একটু নড়াচড়া করলেই মনে হচ্ছে আগুন ধরে যাচ্ছে। সেখানে। কষ্টেসৃষ্টে হাজির হতে পারল এক্সপ্লোসিভ চার্জটার কাছে।

ঝাপসা হয়ে এসেছে শেলড্রেকের দৃষ্টি, প্রতি মুহূর্তে আরও ঝাপসা হচ্ছে; টাইমারের গায়ে সংযুক্ত বাটনগুলো দেখতে পাচ্ছে না ঠিকমতো। হাত বাড়িয়ে টাইমারটা ধরল, কিছুক্ষণ ধরে রেখে টান দিল সর্বশক্তিতে। ট্যাঙ্কের গা থেকে খুলে চলে এল ওটা।

ঠিক তখন তৃতীয়বারের মতো খুলে গেল কন্টেইনারের দরজা।

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল শেলড্রেক।

অস্ত্র উঁচিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছে দুজন লোক, শেলড্রেককে দেখতে পেয়ে ছুটে আসছে ওর দিকে। কিন্তু শেলড্রেকের কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা, ওর হাতে কী আছে দেখতে পেয়েছে।

দুই…এক…তারপর শূন্য দেখা গেল টাইমারের ডিসপ্লেতে।

বিস্ফোরিত হলো শেলড্রেকের হাত, আগুন ধরে গেল প্রোপেনে। অত্যুজ্জ্বল সাদা একটা ঝলকানি দিয়ে মুহূর্তেই বিস্ফোরিত হলো পুরো কন্টেইনার। প্রচণ্ড ধাক্কায় নড়ে উঠল কন্টেইনারের সারি, কোনও কোনওটা ছুটে গিয়ে জাহাজের রেইলিং ভেঙে পড়ল সাগরে।

নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে শেলড্রেক এবং কন্টেইনারটার ভিতরে থাকা অন্য দুজন; কিন্তু যেহেতু টাইমারটা ট্যাঙ্ক থেকে ছুটিয়ে ফেলেছিল শেলড্রেক সেহেতু খালফানির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি পুরোপুরি। ভয়ঙ্কর একটা বিস্ফোরণের বদলে তুলনামূলক অনেক-কম শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটেছে। ট্যাঙ্কের খোলা ভাড় থেকে এখনও সমানে বের হচ্ছে প্রোপেন, এবং বের হওয়ামাত্র পরিণত হচ্ছে অগ্নিকুণ্ডলীতে। সেই কুণ্ডলী সামনে যা পাচ্ছে, তা-ই পুড়িয়ে দিচ্ছে কাটিং টর্চের মতো। গলে যাচ্ছে কন্টেইনারের মেঝে, একটু একটু ফাটল ধরছে জাহাজের ডেকে।

যে যার মতো পারছে পালাচ্ছে হামলাকারীরা। ফাটল বড় হতে হতে ফোকর দেখা দিল টায়ানার ডেকে, সেখান দিয়ে হুড়মুড় করে নিচের খোলে পড়ে গেল একটা কন্টেইনার, ওটাকে অনুসরণ করল আরও কয়েকটা। জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করেনি কেউ, ওটা তাই আপনগতিতে এগিয়ে চলেছে আগুনের একটা গোলক হয়ে। ভোর হওয়ার কিছুক্ষণ আগে লিনোসা উপকূল থেকে আধ মাইল দূরের একটা শৈলশ্রেণীতে বাড়ি খেল ওটা।

ঘুম থেকে সকাল সকাল ওঠা যাদের অভ্যাস, মজা করে জ্বলন্ত টায়ানা দেখল তারা; কেউ কেউ ছবি তুলল। ওদের চোখের সামনে আরেকদফা বিস্ফোরণ ঘটল জাহাজে-প্রচণ্ড উত্তাপে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল পনেরো হাজার গ্যালনের প্রোপেন ট্যাঙ্ক, আলোর প্রচণ্ড ঝলকানি দেখে বোধহয় লজ্জা পেল দিগন্তের এককোনায় সবে-উঁকি-দেয়া সূর্যটা।

ঝলকানিটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল নতুন আরেক অদ্ভুত দৃশ্য। দুমড়েমুচড়ে যাওয়া টিনের ক্যানের মতো অবস্থা হয়েছে টায়ানার, সেটা থেকে সাগরের জোরালো বাতাসে ভর করে কালো কুয়াশার একটা চাদর এগিয়ে আসছে লিনোসা দ্বীপের দিকে। কিন্তু কখনও কখনও মেঘ যেমন জমাট বেঁধে থাকে আকাশে, বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে না, দ্বীপটার উপর সেভাবে স্থির হয়ে থাকল কালো কুয়াশার চাঁদরা।

আকাশ থেকে ঝরে পড়তে শুরু করল শত শত সামুদ্রিক পাখি। কোনও কোনওটা আছড়ে পড়ছে সাগরের পানিতে, কোনওটা আবার ভোতা আওয়াজ তুলে পড়ছে জমিনের বুকে। যারা মজা দেখতে এসেছিল, মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেল তাদের সব আনন্দ; আতঙ্ক ভর করল তাদের মনে। ছুটে পালানোর চেষ্টা করল তারা সৈকত থেকে, কিন্তু কিছুদূর গিয়েই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সবাই। সাগরের জোরালো বাতাস কালো কুয়াশার সেই চাদরকে যেন ধাক্কিয়ে নিয়ে গেল আরও পশ্চিমে।

লিনোসা দ্বীপে পড়ে থাকল চলৎশক্তিহীন অনেক পাখি আর কিছু মানুষ।

.

০২.

সাগরের তলদেশের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে মাসুদ রানা।

ওর নিচে নামার গতি ছন্দময়, সুন্দর। শরীরের সঙ্গে বাঁধা দুটো স্কুবা ট্যাঙ্ক, স্থূলকায় হার্নেস আর পোপালশন ইউনিটের কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে বড়সড় দেখাচ্ছে ওকে। দুটো শোল্ডার-মাউন্টেড লাইটের হলুদাভ আলো পথ দেখাচ্ছে ওকে অন্ধকারে।

সমুদ্র সমতল থেকে এক শ ফুট নামার পর খেয়াল করল, জ্বলন্ত লাইটের কারণে দুটো বৃত্ত তৈরি হয়েছে তলদেশের জমিনে। বৃত্ত দুটোর মাঝখানে যেন ভেসে বেড়াচ্ছে বিসিআই-এর কয়েকজন শিক্ষানবীশ এজেন্ট।

ডান হাতে বাঁধা ইন্টারকম সুইচে চাপ দিল রানা। হেলমেট-মাউন্টেড মাইক্রোফোনের সাহায্যে বলল, তলদেশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। এজেন্টদের সঙ্গে আছি।

ঠিক আছে, হেলমেটের ভিতরে বিশেষ-কায়দায়-বসানো স্পিকারে শোনা গেল সোহেলের কণ্ঠ।

প্রোপালশন ইউনিট চালু করল রানা, ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষানবীশ এজেন্টদের দিকে। ওদের বেশিরভাগের পরনে ড্রাই স্যুট। রানা এবং অন্য দু-একজন ডাইভার পরেছে নুমার নতুন উদ্ভাবিত হার্ড স্লট। ফলে কন্সট্যান্ট প্রেশার ধরে রাখতে পারছে ওরা, ডিকম্প্রেশন-স্টপ ছাড়াই ডাইভ দিতে পারছে, সার্ফেস করতে পারছে। এখন পর্যন্ত স্যুটটা ব্যবহার করতে কোনও অসুবিধা হয়নি রানার।

হঠাৎ ওর হেলমেটের স্পিকারে খড়খড় করে উঠল, তারপর ভেসে এল অচেনা এক নারীকণ্ঠ, শুনছেন? শুনতে পাচ্ছেন কেউ?

থমকে গেছে রানা, শিক্ষানবীশ এজেন্টদের দিকে এগোনো বন্ধ হয়ে গেছে। বুঝতে পারছে, পানির উপর থাকা নুমার স্পেশালাইযড় শিপ সি-হর্স-এ কোনও-না কোনওভাবে হাজির হয়েছে নারীকণ্ঠটা, ওটাই শুনতে, পেয়েছে ও।

ভূমধ্যসাগরে আসার পর রিফুয়েলিং আর রসদের জন্য প্রতি সপ্তাহে একবার করে লিনোসা দ্বীপে যাচ্ছে সি-হর্স, একটা করে রাত কাটাচ্ছে সেখানে। লজিসটিক্স সাপোর্টের জন্য বিসিআই-এর পাঁচ এজেন্ট এখনও আছে ওখানে।

রানা? এবার শোনা গেল সোহেলের কণ্ঠ।

আমাদের ইন্টারকম সিস্টেম বোধহয় কানেক্টেড হয়ে গেছে প্রাইভেট কোনও চ্যানেলের সঙ্গে, বলল রানা। কোথাও কোনও সমস্যা হয়েছে?

মনে হয়। সাহায্যের আশায় অন্য কোথাও যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল কেউ, ঢুকে পড়েছে আমাদের সিস্টেমে।

যে মেয়ে বা মহিলা যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে, আমার ধারণা সে আছে লিনোসায়।

সি-হর্সের রেডিওরুমের অপারেটররা ইতোমধ্যে রেকর্ড করে ফেলেছে মেসেজটা।

শোনাতে পারবি?

একটু দাঁড়া।

কয়েক মুহূর্ত পর মৌমাছির গুঞ্জনের মতো আজব এক আওয়াজ শুনতে পেল রানা ওর হেলমেটের স্পিকারে। তারপর শুনল একসঙ্গে কথা বলছে কারা যেন, আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না কারও কথাই। এরপর কিছুক্ষণের নীরবতা, গুঞ্জন কমছে আস্তে আস্তে। ওটা পুরোপুরি থেমে যাওয়ার পর শোনা গেল নারীকণ্ঠটা।

সম্পূর্ণ শান্ত গলা ওর, কিন্তু কথা বলার ভঙ্গি খেয়াল করলে বোঝা যায় বাইরের-সাহায্য খুব দরকার বেচারীর। ইটালিয়ান ভাষায় বিশ সেকেন্দ্রে মতো বকবক করল সে, তারপর কথা বলতে শুরু করল ইংরেজিতে।

আবারও বলছি…আমি ডক্টর সিয়োর লামিয়া…আক্রান্ত হয়েছি আমরা…এখন আটকা পড়ে আছি একটা হাসপাতালে…সাহায্য খুব দরকার আমাদের…বাইরে বের হতে পারছি না, আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে অক্সিজেন। প্লিয কেউ সাহায্য করুন।

গুঞ্জনধ্বনি শোনা গেল আবারও, তারপর আরও একবার সাহায্যের আবেদন জানাল লামিয়া।

খুট করে একটা শব্দ শোনা গেল।

বন্ধ করা হয়েছে রেকর্ড বাজানো।

ডক্টর লামিয়ার মেসেজ পাওয়ার পর লজিসটিক্স টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি আমি, রানাকে বলল সোহেল,.রিপ্লাই দিচ্ছে না ওদের কেউ।

চেষ্টা করে দেখ অন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় কি না, পরামর্শ দিল রানা। লিনোসা দ্বীপে একটা ইটালিয়ান কোস্টগার্ড স্টেশন আছে।

সে-চেষ্টাও হয়ে গেছে এরই মধ্যে, লাভ হয়নি। যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি ওখানকার স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে, সাড়া দেয়নি কেউ।

লামিয়ার কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে রানার মাথায়। বুলল, পালার্মোতে ইটালিয়ান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানিয়ে রাখ, কিছু একটা হয়েছে লিনোসা দ্বীপে, সাহায্যের আবেদন জানানো হয়েছে সেখান থেকে। কোনও খবর নেই বিসিআই-এর পাঁচজন এজেন্টের, নিজেদের গরজেই ওই দ্বীপে যেতে হবে আমাদেরকে। …উপরে আসছি আমি।

.

সি-হর্সে উঠে এসেছে রানা। ডেকের এককোনায় বসে ডাইভিং সরঞ্জাম খসাচ্ছে শরীর থেকে।  পাশে দাঁড়ানো সোহেল বলল, পালার্মো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রস্তুত অবস্থায় নেই ওদের কোনও হেলিকপ্টার। রিফুয়েলিং করিয়ে দুটোকে পাঠাচ্ছে ওরা, কিন্তু দুঘণ্টার আগে পৌঁছাতে পারবে না লিনোসায়। তাই ওরা আমাদেরকেই যেতে অনুরোধ করেছে লিনোসায়।

চল তা হলে, উঠে দাঁড়াল রানা।

সি-হর্স লিনোসার কাছাকাছি যাওয়ামাত্র সবার আগে দেখা গেল, কালো, ঘন, তেলতেলে ধোয়ার একটা আস্তরণ যেন স্থির হয়ে আছে দ্বীপটার উপরে। ২

চোখে বিনকিউলার লাগাল রানা। কোনও জাহাজ মনে হয় আটকা পড়েছে তীরের কাছাকাছি।

ট্যাঙ্কার?

বলতে পারছি না-এতদূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। তা ছাড়া ধোঁয়াও অনেক বেশি। জাহাজটা মনে হয় দুর্ঘটনায় পড়েছে। সি-হর্সের ক্যাপ্টেন রানার বন্ধু মানুষ, তার দিকে তাকাল রানা। কুপার, আরেকটু কাছে যাও। সামনে গিয়ে দেখি ঘটনা কী।

কোর্স বদল করা হলো সি-হর্সের। দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজটার দিকে যত এগোচ্ছে ওরা, মাথার উপরে ধোয়ার আস্তরণ তত যন আর কালো হচ্ছে।

সাগরের বাতাস ওই জাহাজ থেকে বের-হওয়া সমস্ত ধোঁয়া সোজা নিয়ে যাচ্ছে লিনোসার দিকে, বলল সোহেল।

কী বইছিল জাহাজটা? আপন মনে বলল রানা। বিষ টিষ জাতীয় কিছু?

জবাব দিল না সোহেল, এ ব্যাপারে কিছুই জানা নেই ওর। বলল, মহিলা ডাক্তারটা বলল, ওরা আটকা পড়েছে, ওদের অক্সিজেন ফুরিয়ে আসছে। ওরা কি ওই ধোঁয়ার কবল থেকে বাঁচতে লুকিয়ে আছে কোথাও?

বিনকিউলারটা আবার চোখে লাগাল রানা। এবার আরও স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে আটকা-পড়া হাজটা। দেখে মনে হচ্ছে, কোনও দৈত্যের কবলে পড়েছিল ওটা, দৈত্যটা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে ওটার সামনের অংশ। মনে হচ্ছে, ওটার অর্ধেক আছে, বাকি অর্ধেক গায়েব। ওটার যতটুকু দেখা যাচ্ছে, তার পুরোটাই ঢাকা পড়ে গেছে ধোঁয়ার ঝুলকালি দিয়ে।

জাহাজটা ডুবে যাচ্ছে না কেন ভেবে আশ্চর্য লাগছে আমার, বলল রানা। ওটার কোথাও কোনও নামও দেখা যাচ্ছে না। কুপার, পালার্মোতে যোগাযোগ করতে বলল কাউকে, লিনোসা উপকূলে কী দেখছি আমরা তা জানিয়ে দেয়া দরকার। জাহাজের নাম জানতে পারলে ওটা কী বহন করছিল তা-ও জানা যাবে। নিচু করল বিনকিউলারটা। বাতাস যেদিকে বইছে, সেদিকে জাহাজ চালাও।

জাহাজের কোর্স ঠিক করে নিয়ে গতি কমাল কুপার। তারপর গিয়ে ঢুকল রেডিওরুমে-যোগাযোগ করতে হবে পালার্মোতে। ওর সঙ্গে গেল সোহেল।

দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজ থেকে আর যখন পাঁচ শ গজ দূরে আছে সি-হর্স, ডেকের সামনের দিক থেকে হাঁক ছাড়ল একজন ক্রু, দেখুন! দেখুন!

থ্রটল নামিয়ে সি-হর্সকে আইডল পজিশনে নিয়ে গেল কুপার। হুইলহাউসে গিয়ে ঢুকেছিল রানা, বেরিয়ে এল ডেকে।

সাগরের পানিতে ভাসছে কতগুলো জিনিস, আঙুলের ইশারায় ওগুলো দেখাচ্ছে ওই ক্রু। এগিয়ে গিয়ে রেইলিং ঘেঁষে দাঁড়াল রানা। ছাইরঙা জিনিসগুলো দৈর্ঘ্যে পনেরো ফুটের কাছাকাছি, দেখতে অনেকটা টর্পেডোর মতো।

পাইলট ওয়েইল, বলল ওই ক্রু। চারটা পূর্ণবয়স্ক, দুটো বাচ্চা।

উল্টো হয়ে ভাসছে, বলল রানা। খেয়াল করল, সামুদ্রিক আগাছা এবং কতগুলো মরা মাছ ও ছোট সামুদ্রিক প্রাণীও ভাসছে ওয়েইলগুলোর আশপাশে। লিনোসা দ্বীপে যা-ই ঘটে থাকুক, সেটার প্রভাব পড়েছে সাগরের পানিতে।

এবং সেই প্রভাবের জন্য দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজটাই দায়ী, বলল অন্য কেউ।

মাথা ঝাঁকাল রানা।

সি-হর্সের দিকে ভেসে আসছে আরও কতগুলো সামুদ্রিক জীব। রেডিওরুমে পালার্মো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছে। সোহেল, আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রানা খেয়াল করল, ভেসে আসা জীবগুলোর সবই মৃত না। কোনও কোনওটা জড়াজড়ি করে আছে একটা আরেকটার সঙ্গে, বলা ভালো ছোট ছোট শুড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরার চেষ্টা করছে একটা আরেকটাকে।

আমাদের বোধহয় এখান থেকে কেটে পড়া উচিত, বলল রানার পাশে-দাঁড়ানো সি-হর্সের এক ক্রু, নিজের শার্টের কলার ধরে উঁচু করে ওটা দিয়ে নাকমুখ ঢাকল। ভাবখানা এমন, আশপাশের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে প্রাণঘাতী কোনও বিষ, ওটার কবল থেকে বাঁচতে চাইছে।

কিন্তু রানা জানে এখন যেখানে আছে ওরা, নিরাপদে আছে। কারণ এখনও সিকি মাইল দূরে আছে দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজটা, আশপাশের বাতাসে ধোঁয়ার কোনও গন্ধও নেই।

হুইলহাউসে গিয়ে ঢুকল ও কুপার, দ্বীপের দিকে এগোও। ধোয়ার ওই আস্তরণের দিকে নজর রেখো। যদি দিক বদল হয় বাতাসের, যদি আমাদের দিকে এগিয়ে আসে ওই ধোঁয়া, সঙ্গে সঙ্গে নাক ঘুরিয়ে নিতে হবে জাহাজের।

মাথা ঝাঁকাল কুপার, থ্রটলে টান দিয়ে হুইল ঘোরাল। আবার আগে বাড়ল সি-হর্স।

হুইলহাউসের দরজায় হাজির হলো সোহেল। কথা হয়েছে পালার্মোর সঙ্গে। গতরাতের এ.আই.এস, ডেটা চেক, করে ওরা বলল, দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজটা এম.ভি. টায়ানা।

কী বহন করছিল ওটা? জিজ্ঞেস করল রানা।

ভিতরে ঢুকল সোহেল। মূলত মেশিন পার্টস আর কাপড়চোপড়…বিপজ্জনক কিছু না।

বিপজ্জনক কিছু যদি না থাকবে, সাহায্যের আবেদন কেন জানাল ডক্টর লামিয়া? কেন হুট করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বিসিআই-এর লজিসটিক্স সাপোর্ট টিমের সঙ্গে? কেন কেউ বলতে পারছে না কী ঘটেছে লিনোসা দ্বীপের অধিবাসীদের ভাগ্যে? মাথা নাড়ল রানা। নিজের চোখে দেখতে চাই আমি কী ঘটেছে।

সোহেল বুঝতে পারছে মানা করে কোনও লাভ হবে না। ঠিক আছে, আমিও যাব তোর সঙ্গে।

মুচকি হাসল রানা। বেঘোরে মরা উচিত হবে না বিসিআই-এর চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের।

তোকে চিরকাল বেঁচে থাকার গ্যারান্টি কে দিয়েছে? …ফুল ফেস হেলমেট আছে আমাদের সঙ্গে, আছে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের প্রচুর সাপ্লাই। ওগুলো পরে নিলে কোনও সমস্যা হবে না আশা করি।

কোনও কোনও নার্ভ টক্সিন চামড়ার উপরও প্রতিক্রিয়া করে, বাছাধন, জ্ঞান দেয়ার ভঙ্গিতে বলল রানা।

তুই কি ভেবেছিস সেটা জানি না আমি? ড্রাই স্যুট পরে নেব আমরা…ওগুলো ওয়াটারপ্রুফ। গ্লাভস ব্যবহার করব, চামড়া একটুও যাতে দেখা না যায় সেজন্য শরীরের খোলা জায়গাগুলোয় পেঁচিয়ে নেব ডাক্ট টেপ।

গম্ভীর হয়ে গেছে কুপারের চেহারা। তোমাদের দুজনের ওই দ্বীপে যাওয়াটা শেষপর্যন্ত বিনা-কারণে প্রাণের ঝুঁকি নেয়া হতে পারে। যা-ই ঘটে থাকুক না কেন ওখানে, এতক্ষণে হয়তো বেঁচে নেই কেউই।

একমত হতে পারলাম না, বলল রানা। কারণ, এক, ডক্টর লামিয়ার সাহায্যের আবেদন। যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, নিশ্চয়ই সেটার পরই আবেদন জানিয়েছে সে। বলেছে, আক্রান্ত হয়েছি আমরা, সাহায্য দরকার আমাদের। আমরা, আমাদের-বহুবচন। তারমানে মেসেজটা যখন শুনেছি, তখন পর্যন্ত ডক্টর লামিয়ার সঙ্গে আরও এক বা একাধিক লোক বেঁচে ছিল।

আর দুই?

একটু আগে দেখলাম, সি-হর্সের পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে কিছু সামুদ্রিক জীব; কোনও কোনওটা মরেনি।

মানে?

টায়ানা থেকে ধোঁয়ার সঙ্গে যা-ই বের হয়ে থাকুক, ওটা দুর্বল হয়ে পড়েছে এতক্ষণে। সুযোগটা নিতে চাইছি আমি। যদি এখন পর্যন্ত একজন মানুষও বেঁচে থাকে লিনোসায়, উদ্ধার করতে চাইছি তাকে।

কুপার বুঝে গেছে, তর্ক করে পারবে না রানার সঙ্গে। তোমরা দুজন যখন দ্বীপে যাবে, আমরা কী করব?

কান খোলা রাখবে-যে-কোনও সময় মেসেজ আসতে পারে রেডিওতে। চ্যানেল মার্কারে একটা বয়া ভাসছে, ওটার উপর বসে-থাকা পেলিক্যানগুলো যদি হুট করে মরে পড়ে যায় পানিতে, সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিয়ে নেবে সি-হর্সের নাক, যত দ্রুত সম্ভব পালাবে। …লংবোট নামাতে বলো।

.

০৩.

 টায়ানার লংবোটে বিমর্ষ চেহারায় বসে আছে খালফানি।

জাহাজে বিস্ফোরণ ঘটার আগেই বোটটা চুরি করে পালাতে সক্ষম হয়েছে সে। টাইমারটা যখন বিস্ফোরিত হয়, ততক্ষণে জাহাজ থেকে এক শ ফুট দূরে চলে এসেছিল। ছিটকে ওঠা আগুনের আঁচে ঝলসে যাওয়ার কথা ছিল ওর, কিন্তু বিস্ফোরণটা জোরালো না হওয়ায় বেঁচে গেছে।

কোথাও কোনও গণ্ডগোল হয়েছে। এবং সেটা টের পাওয়ামাত্র বোট নিয়ে টায়ানার পিছু পিছু যাওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল খালফানির। আবার ডেকে উঠে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছিল ওটাকে। কিন্তু তখনও চলছিল জাহাজটা, লংবোট একা চালিয়ে ওটাকে ধরা সম্ভব ছিল না খালফানির পক্ষে।

দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে অসহায়ের মতো দেখেছে, লিনোসার কাছে গিয়ে হঠাৎ নিশ্চল হলো টায়ানা, আবারও বিস্ফোরণ ঘটল সেটাতে। তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতি হলো বেশি। ক্রায়োজেনেকালি কুল সিরাম, মানে খালফানির সেই রহস্যময় কার্গো, পরমাণুতে বিশ্লিষ্ট হয়ে পরিণত হলো প্রাণঘাতী কালো কুয়াশায়, কার্যকরী হয়ে উঠল যে-কোনও নার্ভ গ্যাসের মতো।

অসহায়ের মতো দেখেছে খালফানি, পশ্চিম থেকে আরও পশ্চিমে বিস্তৃত হলো সেই ধোয়া-যেন গ্রাস করে নিল লিনোসাকে। সে এবং ওর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যা গোপন করতে চাইছিল সারা দুনিয়ার কাছ থেকে, তা ঢোল-পেটানোর-মতো জানাজানি হয়ে গেছে।

একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে। পালানোর সময় টায়ানার রেডিওরুম থেকে একটা রেডিওসেট চুরি করেছিল খালফানি, ভেবেছিল পরে কাজে লাগাবে। কিছুক্ষণ আগে শুনল, লিনোসা থেকে সাহায্যের আবেদন জানানো হচ্ছে–আটকা পড়া এক মহিলা ডাক্তার মেসেজ পাঠাচ্ছে। সিগনাল পরিষ্কার ছিল; খালফানি শুনেছে, একটা হাসপাতালে কয়েকজন রোগীসহ আটকা পড়েছে ওই ডাক্তার। আরও শুনেছে, রহস্যময় একটা ধোঁয়ার কথা বলছিল মেয়েটা।

সুতরাং, বিমর্ষতা ঝেড়ে ফেলল খালফানি, সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় হয়েছে।

লিনোসায় যাবে সে। যেভাবেই হোক খতম করবে ওই ডাক্তারনীকে। যে বা যারা ইতোমধ্যে জেনে গেছে কালো কুয়াশার ব্যাপারটা, খতম করবে তাদেরকেও। একটু খুঁজে দেখতে হবে কালো কুয়াশার ব্যাপারে কোথাও কোনও নোট করেছে কি না ডাক্তারনীটা, যদি করে থাকে তা হলে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে তা-ও।

পকেট থেকে একটা প্রিপ্যাকেজড হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ বের করল সে, দাঁতে কামড়ে ছিঁড়ল প্যাকেটের মুখ। দ্রুত কয়েকবার টোকা দিল সিরিঞ্জের গায়ে, নিশ্চিত হলো ভিতরে কোনও বুদ্বুদ নেই। তারপর একপায়ের মাংসপেশিতে ঢুকিয়ে দিল সুঁই, চাপ দিল পাঞ্জারে-কালো কুয়াশার অ্যান্টিডোট ওটা।

সারা শরীরে শীতল একটা শিহরণ অনুভব করছে খালফানি। অল্প কিছু মুহূর্তের জন্য টনটন করে উঠল ওর হাত-পায়ের তালু।

বৈঠা তুলে নিল সে, অনুমান করে নিল কোন্‌দিক দিয়ে গেলে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে লিনোসায়। এগোতে শুরু করল সেদিকে। যত দ্রুত সম্ভব বৈঠা বাইছে, জানে ওর হাতে সময় কম। কারণ কাছেপিঠে থাকা অন্য কোনও জাহাজের ক্রুদের কানেও হয়তো গেছে ডাক্তার মেয়েটার সাহায্যের আবেদন।

লিনোসার নির্জন সৈকতে হাজির হতে বেশি সময় লাগল না।

পাথুরে ঢাল কেটে বানানো সিঁড়ি উঠে গেছে সৈকত ছাড়িয়ে উপরের একটা রাস্তার দিকে। ওদিকে পা বাড়াল খালফানি। এই দ্বীপ চেনে সে। হাসপাতালটা সৈকত থেকে দুই মাইল দূরে। সেটার আধ মাইলের মধ্যে আছে। এয়ারপোর্ট।

ডাক্তার মেয়েটা এবং ওর সঙ্গে অন্য যারা আছে তাদেরকে খুন করে এয়ারপোর্টে চলে যাবে খালফানি। না দেখেও সে জানে, দ্বীপে নিজের প্রভাব যদি ঠিকমতো বিস্তার করে থাকে কালো কুয়াশা, অ হয়ে এখন খাঁ-খাঁ করছে এয়ারপোর্ট। কাজেই ওখানে গিয়ে ছোট একটা প্লেন চুরি কল্পতে অসুবিধা হওয়ার কথা না ওর। প্লেনটা নিয়ে চলে যাবে তিউনিসিয়া, লিবিয়া বা মিশরের দিকে।

কাজটা যদি সফলভাবে করতে পারে, কেউ কোনওদিন জড়াতে পারবে না ওকে কালো কুয়াশার সঙ্গে।

.

ফুল ডাইভিং গিয়ারে আপাদমস্তক আবৃত করে নিয়েছে রানা আর সোহেল।

লংবোট এগিয়ে চলেছে লিনোসার দিকে। সময় যত মচ্ছে, মাথার উপর তত নির্দয় হচ্ছে সূর্য। থেকে থেকে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। কিন্তু সে-শীতলতার স্পর্শ পাচ্ছে না দুজনের কেউই।

লিনোসার বন্দরে হাজির হয়ে গেল ওরা। জেটির সঙ্গে বাধা ডজনখানেক ছোট ছোট নৌকা দুলছে ঢেউয়ের তালে। যতদূর চোখ যায়, কোথাও কেউ নেই।

সোহেলের সঙ্গে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল রানা।

বন্দর ছাড়িয়ে দূরের রাস্তা আর বিল্ডিংগুলোর দিকে তাকাল ও রাস্তাঘাট জনশূন্য। কোনও ট্রাফিক নেই। কোনও পথচারীও নেই।

লিনোসার জনসংখ্যা দেড় হাজারের মতো, কিন্তু রাত গম্ভীর হওয়ার আগপর্যন্ত সাত-আট শ লোক সবসময় থাকে জেটি ও সংলগ্ন এলাকায়। বিভিন্ন দিকে ছুটতে দেখা যায় স্কুটার, ডেলিভারি ট্রাক আর ছোট ছোট গাড়িকে।

এখন সব নিথর।

অদ্ভুত এক শিরশিরানি অনুভব করল রানা তলপেটে। সামনে একটা সেইলবোট দেখা যাচ্ছে। এদিকে গিয়ে ডানে মোড় নেব আমরা। লজিসটিক্স সাপোর্টের অপারেশন শ্যাকে যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা আছে ওখান দিয়ে।

সেইলবোটটার কাছে যেতেই দেখা গেল, ওটার ভিতরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে দুজন মানুষ। একজন পুরুষ, বেচারার একটা হাতের সঙ্গে পেঁচিয়ে আছে সেইল লাইন। অন্যজন একটা মহিলা।

একটা আঙুল তুলে ওদেরকে দেখাল সোহেল। আমরা কি…

মাথা নেড়ে মানা করে দিল রানা। ওদের জন্য কিছুই করার নেই আমাদের। যেদিকে এগোচ্ছিল সেদিকে এগোতে থাকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হলো ছোট একটাপিয়ারের কাছে। ভারী স্যুট পরে পিয়ারে উঠতে কষ্ট হলো ওদের। শর্টকাট ধরে হাজির হয়ে গেল রাস্তায়।

মাঝবয়সী এক দম্পতি পড়ে আছে এককোনায়, সঙ্গে একটা বাচ্চা আর চেইনে-বাধা কুকুর। কাছেই ছায়া দিচ্ছে একটা গাছ, ওটার নিচে পড়ে আছে কয়েকটা পাখি।

ওই দম্পতির কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বয়ে পড়ল রানা। পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছে ওরা, নাকে-মুখে ক্ষতচিহ্ন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু রক্তপাত বা ট্রমার কোনও নমুনা নেই।

দেখে মনে হচ্ছে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে গেছে এরা, বলল রানা। এবং হঠাৎ করেই আক্রান্ত হয়েছে প্রাণঘাতী কোনও সমস্যায়।

যা-ই হামলা করে থাকুক না কেন এই লোকগুলোর উপর, বলল সোহেল, খুব দ্রুত করেছে।

আঙুলের ইশারায় পাশের রাস্তাটা দেখিয়ে দিল রানা। ওই দিকে।

লজিসটিক্স সাপোর্টের জন্য যে-শ্যাক ব্যবহার করছে বিসিআই, দুটো ব্লক পার হয়ে সেটার কাছে হাজির হলো রানা আর সোহেল। শ্যাকের সামনের অংশে ছোট একটা গ্যারেজ আছে, তবে আপাতত ব্যবহৃত হচ্ছে স্পেশালাইড ডাইভিং ইকুইপমেন্টের গুদাম হিসেবে। ওটার পেছনে চারটা ছোট ছোট ঘর-অফিস আর স্লিপিং কোয়ার্টার্স।

গ্যারেজের দরজার হাতল ধরে মোচড় দিল সোহেল। লক করা।

সরে দাঁড়া!

সোহেল একপাশে সরতে-না-সরতেই দরজার হাতলের নিচে প্রচণ্ড এক লাথি হাঁকাল রানা। ভেঙে গেল কাঠ, আলগা হয়ে গেল তালা। হাঁ হয়ে খুলে গেল পাল্লা।

বিসিআই-এর এজেন্টদের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে রানা। ডাকছে সোহেলও। কিন্তু দুজনের কেউই নিশ্চিত না, ওদের হেলমেট ভেদ করে ঠিক কতখানি আওয়াজ বেরুচ্ছে বাইরে। ধাতব প্লেট মেঝেতে পড়ে গেলে যে-রকম ঝনঝন আওয়াজ হয়, ওদের চিৎকার ওদেরই কানে বাজছে সেভাবে।

গলা ফাটানো বন্ধ করল রানা, হাত তুলে থামার ইঙ্গিত দিল সোহেলকে। বলল, চল, পেছনের ঘরগুলো চেক করি।

প্রথম ঘরটাতে ঢুকল রানা। খালি ওটা।

অফিসরুমের দিকে এগিয়ে গেছে সোহেল, দরজা খুলেছে। হঠাৎ জরুরি গলায় পেঁচিয়ে উঠল, রানা, এদিকে!

ঘুরে ছুট লাগাল রানা, গিয়ে দাঁড়াল অফিসরুমের গোবরাটে।

ঘরের একমাত্র টেবিল ঘিরে বসে ছিল পাঁচ এজেন্টের চারজন, হেডডাউন করে রাখার ভঙ্গিতে টেবিলে মুখ থুবড়ে পড়েছে সবার। ওদের সামনে টেবিলের উপর বিছানো আছে একটা ম্যাপ। মনে হচ্ছে, ম্যাপটা দেখছিল ওরা, এমন সময় হামলা চালিয়েছে ওদের উপর। টেবিল থেকে কিছুটা দূরের একটা চেয়ারে বসে আছে পঞ্চম এজেন্ট, নিপ্রাণ খোলা-চোখে তাকিয়ে আছে টেবিলের দিকে।

সকালের মিটিং, বলল রানা।

প্রাণের কোনও স্পন্দন আছে কি না কারও শরীরে, এগিয়ে গিয়ে একে একে চেক করল সোহেল। পালস্ পাওয়া গেল না কারও। রানার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল ও। পালস্ নেই, নাকি মোটা গ্লাভসের কারণে টের পাচ্ছি না, বুঝতে পারছি না।

কোমরের খাপ থেকে ছুরি বের করল রানা, এগিয়ে গেল একজন এজেন্টের দিকে। ফলার চ্যাপ্টা প্রান্তটা ধরল ওই এজেন্টের নাকের নিচে জলীয় বাষ্পের কোনও দাগ বসছে না ফলায়।

দম নিচ্ছে না, বলল রানা। ছুরিটা ঢুকিয়ে রাখল জায়গামতো। টায়ানায় যা ছিল, তা এই দ্বীপের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেছে। মিলিটারি গ্রেড নার্ভ এজেন্ট সম্ভবত।

ওটা এই দ্বীপে ব্যবহার করার দরকার পড়ল কেন? লিনোসা পুঁচকে একটা দ্বীপ। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ হয় ছুটি কাটাতে এসেছে, নয়তো জেলে বা ডাইভার।

জানি না, বিসিআই-এর এজেন্টদের দিকে তাকাচ্ছে। রানা একে একে, একইসঙ্গে ক্ষোভ আর আত্মপ্রতিজ্ঞা টের পাচ্ছে নিজের ভিতরে। তবে যে বা যারাই ব্যবহার করে থাকুক ওই গ্যাস, তাদেরকে খুঁজে বের করব।

সি-হর্সের সঙ্গে যোগাযোগ করছি আমি, বলল রানা। লজিসটিক্স সেন্টারের খবর জানাচ্ছি।

মাথা ঝাঁকাল রানা। তারপর হাসপাতালে যাব।

.

গর্জন করে উঠে যেন প্রাণ পেল জিপের ইঞ্জিন, দ্বীপের সুনসান নীরবতায় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি শোনাল আওয়াজটা। গিয়ার বদল করে জিপ ছেড়ে দিল রানা। ওর পাশের সিটে বসে ম্যাপ দেখছে সোহেল।

রাস্তায় দুর্ঘটনায় পড়েছে ডজনখানেক গাড়ি আর স্কুটার–চলন্ত অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছে ওগুলোর ড্রাইভাররা। একটা আরেকটার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দুমড়েমুচড়ে গেছে, কোনও কোনওটার রেডিয়েটর থেকে ধোয়া বের হচ্ছে। হাসপাতালে যাওয়ার পথে যে-কটা তেরাস্তা-চৌরাস্তা পড়ল, সবগুলোতে প্রায় একই দৃশ্য দেখা গেল-ফুটপাতে মরে পড়ে আছে পথচারীরা।

মৃত্যুপুরী, মন্তব্য করল সোহেল।

 হাসপাতালের সামনে গাড়ি থামাল রানা।

দেখতে বেশ আধুনিক, আবারও বলল সোহেল, উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে জিপের জানালা দিয়ে।

উঁকি দিচ্ছে রানাও। লিবিয়া আর তিউনিসিয়া থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য বড় করা হয়েছিল হাসপাতালটা, সুযোগসুবিধাও বাড়ানো হয়েছিল। ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে দরজা খুলল, বের হলো বাইরে। পা বাড়াতে যাচ্ছিল হাসপাতালের দিকে, কিছু একটা চোখে পড়ায় থমকে গেল।

কী? জিজ্ঞেস করল সোহেল।

যেদিক থেকে এসেছে ওরা সেদিকে তাকিয়ে আছে রানা। কী যেন নড়ে উঠল ওদিকে।

কী?

শিয়োর না। ওই যে… আঙুলের ইশারায় দুর্ঘটনা কবলিত কয়েকটা গাড়ি দেখাচ্ছে রানা, ওই দিকে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল একদৃষ্টিতে, কিন্তু নতুন কিছু চোখে পড়ল না।

চেক করে দেখবি?

মাথা নাড়ল রানা। বাদ দে। মনে হয় আমার হেলমেটের ফেইস-শিল্ডে আলো প্রতিফলিত হয়েছে।

এট্রেন্সের কাছে গিয়ে দাঁড়াল দুজনে। খুলে গেল অটোমেটিক দরজা। ভিতরে ঢুকল ওরা।

ওয়েইটিং রুমে চেয়ারে বসা অবস্থাতেই মারা গেছে দশজন লোক। ফ্রন্ট ডেস্কের পাশে চিৎ হয়ে পড়ে আছে এক নার্স।

আমাদের সাহায্যের আর ডক্টর লামিয়ার দরকার আছে কি না, সন্দেহ আছে, বলল সোহেল।

ফ্রন্ট ডেস্কে একটা ডিরেক্টরি পাওয়া গেল। ওটা খুলল রানা। নামগুলোর উপর দ্রুত নজর বোলাচ্ছে। একটা পাতা উল্টানোর পরই পাওয়া গেল লামিয়ার নাম। অন্য সব নাম টাইপ করা, শুধু লামিয়ার নামটাই হাতে লেখা।

মেয়েটা বোধহয় নতুন এসেছে, বলল রানা।

ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে সোহেল। নামের সঙ্গে কোনও অফিস নম্বর নেই, কোন্ ফ্লোরে বসে তা-ও লেখা নেই।

একটা মাইক্রোফোন তুলে নিল রানা, দেখে মনে হচ্ছে। ওটা কোনও পি.এ. সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত। আমরা যদি বলি সাহায্য এসে গেছে, বেঁচে থাকলে সাড়া দেয়ার চেষ্টা করবেই মেয়েটা।

মাইক্রোফোন সিস্টেম চালু করল ও, সারা হাসপাতালে যাতে শব্দ ছড়িয়ে যায়, সেজন্য অলক লেখা একটা সুইচ অন করল। হেলমেটের ফেইসপ্লেটের একেবারে কাছে নিল মাইক্রোফোন, চেঁচিয়ে বলল, ডক্টর লামিয়া, আমি মাসুদ রানা। তোমার সাহায্যের আবেদন শুনেছি, সাহায্য করতে এসেছি। যদি আমার কথা শুনে থাকো, ফ্রন্ট ডেস্কে যোগাযোগ করো।

পি.এ, সিস্টেমের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে রানার কণ্ঠ। একটু জড়ানো মনে হচ্ছে, কিন্তু প্রতিটা শব্দ বোঝা যাচ্ছে স্পষ্টভাবে। কথাগুলো আবার বলতে যাচ্ছিল ও, এমন সময় শব্দ করে খুলে গেল এস্ট্রেন্সের অটোমেটিক দরজা। একটু চমকে উঠে ঘুরে তাকাল রানা-সোহেল। কিন্তু ভারী স্যুটের কারণে কাজটা করতে সময় লাগল ওদের। যতক্ষণে ঘুরল, তখন বন্ধ হয়ে গেছে দরজাটা। কেউ নেই সেখানে।

গুঞ্জন করছে ফ্রন্ট ডেস্কের লাইন, প্যানেলের একটা সাদা আলো জ্বলতে-নিভতে শুরু করেছে। টের পাওয়ামাত্র আবার ঘুরল রানা, চেপে ধরল স্পিকারের বাটন।

হ্যালো? শোনা গেল একটা উদ্বিগ্ন নারীকণ্ঠ। কেউ আছ? ডক্টর লামিয়া বলছি।

স্পিকারের উপর ঝুঁকে পড়ল রানা। আপনার রেডিও কল শুনেছি আমরা। সাহায্য করতে এসেছি।

তোমার পরিচয়?

ডুবুরি বলতে পারো। লিনোসার কাছেই ছিলাম।

মনে হচ্ছে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওনি তুমি। কীভাবে ঘটল ঘটনাটা? এই দ্বীপের যে-ই স্পর্শ পেয়েছে ওই বিষবাষ্পের, সে-ই মরেছে। নিজ চোখে দেখেছি।

বিষবাষ্পের উপস্থিতি আন্দাজ করে বিশেষ পোশাক পরে এসেছি।

চার তলায় আটকা পড়ে আছি আমরা। প্ল্যাস্টিকের শিট আর সার্জিকাল টেপ দিয়ে একটা অপারেটিং রুম ভালোমতো বন্ধ করে নিয়েছি। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারব না এখানে। অক্সিজেন ফুরিয়ে যাচ্ছে, কার্বন ডাই অক্সাইড বাড়ছে।

ইটালিয়ান আর্মির একটা রেসপন্স টিম আসছে। তবে সময় লাগবে।

কতক্ষণ?

ঘন্টা দেড়েক।

অতক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব না। আমরা উনিশজন আছি এখানে। তাজা বাতাসের জরুরি দরকার।

বাড়তি একজোড়া ডুবুরির পোশাক সঙ্গে করে এনেছি আমরা। হ্যাঁণ্ডহেল্ড ইমার্জেন্সি অক্সিজেন ট্যাঙ্কও আছে। …সারা শরীর ঢেকে রাখা যায়, এ-রকম কোনও স্যুট নেই হাসপাতালে?

নেই।

অক্সিজেন বটল নিশ্চয়ই আছে? প্রত্যেক হাসপাতালে থাকে ওই জিনিস।…তোমাদের সাপ্লাই রুম কত তলায়? যত বেশি সম্ভব অক্সিজেন বটল নিয়ে আসছি আমরা। ইটালিয়ান আর্মি আসার আগ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে তোমরা সবাই।

তৃতীয় তলায়।…প্লিয, জলদি করো।

লাইন কেটে দিল রানা, এগিয়ে যাচ্ছে এলিভেটরের দিকে। ওর আগেই সেদিকে হাঁটা ধরেছে সোহেল।

বাটনে চাপ দেয়ামাত্র খুলে গেল দরজা। এলিভেটরের এককোনায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে একজন ডাক্তার আর একজন নার্স।

ভিতরে ঢুকে তিন সংখ্যাটা লেখা বাটনে চাপ দিল রানা, আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। উপরে উঠছে এলিভেটর।

টুং করে আওয়াজ হলো, হলে বেরিয়ে এল রানা। ডাক্তারের লাশ টেনেহিঁচড়ে এলিভেটরের দরজার একটু বাইরে বের করে রাখল সোহেল, তৈরি হয়ে গেল একটা অটোমেটিক ডোরস্টপ।

সাপ্লাই রুমটা হলের শেষমাথায়, চাবি না থাকায় ভিতরে ঢুকতে হলো দরজা ভেঙে। মেডিকেল অক্সিজেন লেখা একটা কেইজ দেখা যাচ্ছে অনতিদূরে। কাছে গিয়ে ওটা খুলল রানা। ভিতরে অক্সিজেনের সবুজ বোতল দেখা যাচ্ছে আটটা।

ঠেলে একটা চাকাওয়ালা গার্নি নিয়ে এল সোহেল। এটাতে দে সবগুলো বোতল।

গার্নিতে বোতলগুলো তুলে সাপ্লাইরুমের বাইরে বেরিয়ে এল রানা আর সোহেল, ওটা ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে যাচ্ছে এলিভেটরের দিকে। টুং করে আওয়াজ হলো আবারও-অন্য একটা এলিভেটরের দরজা খুলে যাচ্ছে।

ওটা থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে এল বাদামি চামড়ার এক লোক। পড়ে যাচ্ছিল, দেয়াল ধরে সামলে নিল কোনওরকমে। সাহায্য করুন আমাকে! বলল করুণ গলায়, প্লিয!

থমকে গেছে রানা, কিন্তু সামলে নিল। গার্নিটা সরিয়ে রাখল একপাশে, এগিয়ে গেল লোকটার দিকে।

আগম্ভকের চোখ দুটো বন্ধ ছিল প্রথমে, কিন্তু রানা কাছে যেতেই হঠাৎ তাকাল সে। মানসিক বিকার বা ভয়ের কোনও লক্ষণ নেই সে-চোখে, বরং প্রচণ্ড বিদ্বেষ আছে। তার উদ্দেশ্য বুঝিয়ে দেয়ার জন্য খাটো ব্যারেলের একটা পিস্তল বের করল ঝট করে।

ওটা রানার দিকে তাক করেই টান মারল ট্রিগারে।

.

০৪.

সরু হলওয়েতে বোমা বিস্ফোরণের মতো শোনল গুলির আওয়াজ।

মেঝেতে পড়ে গেছে রানা, কাত হয়ে আছে একদিকে। নড়ছে না।

চমকে গেছে সোহেল, কিন্তু রিফ্লেক্স হারায়নি। ওর দিকে পিস্তলওয়ালা ঘোরার আগেই যতদ্রুত-সম্ভব আগে বাড়ল, গ্লাভস-পরা হাত দিয়ে ঘুসি মারল লোকটার পিস্তল-ধরা হাতে। পর পর দুবার ট্রিগারে টান দিয়ে ফেলল আগন্তক, বুলেট দুটো গিয়ে বিধল দেয়ালে। সোহেলের হেলমেট খাঁটি ইস্পাতের ফুটবলে হেড করার কায়দায় ওটা দিয়ে আগন্তুকের মাথায় আঘাত করল ও। টলে উঠল লোকটা, বেসামাল হয়ে গেছে। ওই সুযোগে তার পিস্তলধরা হাতে আরেকবার ঘুসি হকাল সোহেল। অস্ত্রটা পড়ে গেল লোকটার হাত থেকে। ওটাকে লাথি মেরে হলওয়ের আরেকদিকে পাঠিয়ে দিল সোহেল।

নিজেকে সামলে নিয়েছে আগন্তুক, ছুট লাগিয়েছে পিস্তলের উদ্দেশে। লোকটাকে ল্যাং মারল সোহেল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে, কিন্তু উঠে দাঁড়াল। একটা লাথি হাঁকাল সোহেলের উদ্দেশে, জুতসই হলো না সেটা।

ভারী ড্রাই স্যুটের কারণে আনআর্মড কমব্যাটের কৌশল কাজে লাগাতে পারছে না সোহেল। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আগন্তুককে জাপ্টে ধরল সে। ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল দুজনের মধ্যে। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে আছড়ে পড়ল একটা দরজার উপর। ওটার গায়ে লেখা আছে: সাবধান! এম.আর.আই.। একঝটকায় খুলে গেল দরজাটা, হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে পড়ল দুজনে।

এবার ল্যাং মারল আগন্তুক, পড়ে গেল সোহেল। কিন্তু পড়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত ছাড়েনি লোকটাকে, তাই সোহেলের সঙ্গে আছড়ে পড়ল সে-ও।

মেঝের সঙ্গে ভারী স্যুট, বিশেষ করে হেলমেটের সংঘর্ষটা কাঁপিয়ে দিল সোহেলকে, মাথা ঘুরে উঠল ওর। দৃষ্টি কয়েক মুহূর্তের জন্য ঝাপসা হয়ে এল ওর, দেখতে পাচ্ছে না হামলাকারী লোকটা কোথায়। চোখের সামনে সবকিছু পরিষ্কার হওয়ামাত্র উঠে দাঁড়াল।

মেঝেতে পড়ে আছে হামলাকারী লোকটা। মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে গেছে।

ঘুরল সোহেল, এক পা আগে বাড়ল দরজার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চক্কর দিয়ে উঠল ওর মাথা। ওর মনে হচ্ছে, কেউ অথবা কিছু একটা যেন পেছন থেকে টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। ওকে। চেষ্টা করল আরেক পা আগে বাড়ার, সঙ্গে সঙ্গে টলে উঠল আবারও।

ব্যাপার কী, ভাবছে সোহেল। ড্রাই স্যুট অথবা ডাক্ট টেপের ব্যাণ্ডেজের কোনও জায়গা ছিঁড়ে গেছে? বিষবাষ্প ঢুকছে ওখান দিয়ে, আর সে-কারণেই এ-রকম লাগছে ওর? কিন্তু বিষবাষ্প কেন পেছন থেকে টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করবে ওকে?

আরেক পা আগে বাড়তে গিয়ে সোহেল বুঝল, যা ঘটছে তা বাস্তব। কেউ যেন ওর শোল্ডার ব্লেডে দড়ি বেঁধে রেখেছে, ও এগোনোর চেষ্টা করলেই টেনে ধরছে পেছন থেকে।

ব্যাপার কী বোঝার চেষ্টা করল সোহেল। ধস্তাধস্তি করতে করতে হাসপাতালের এম.আর.আই. ল্যাবের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছে হামলাকারী লোকটাকে নিয়ে। ফুট দশেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে ছোটখাট গাড়ির সমান একটা মেশিন। ওটার ভিতরে আছে প্রচণ্ড শক্তিশালী চুম্বক, এবং যে কোনও কারণেই হোক চালু অবস্থায় আছে ওটা। লোহা বা লোহাজাতীয় কোনওকিছু নাগালে পাওয়ামাত্র টেনে ধরবে মেশিনটা। সোহেলের পিঠে ঝুলছে স্টিলের একটা ট্যাঙ্ক, মাথায় আছে ইস্পাতের হেলমেট।

ঘুরল ও, চৌম্বকীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুঝছে। শক্তিটা বার বার বেসামাল করে দেয়ার চেষ্টা করছে ওকে। সোজাসুজি না এগিয়ে আড়াআড়িভাবে এগোনোর চেষ্টা করছে। তেমন। একটা সফল হতে পারছে না, এগোনোর গতি খুব ধীর। মাথাটা ঘুরাতে শুরু করেছে আবার। নিজেও বলতে পারবে না কখন আছড়ে পড়ল মেঝেতে, বলতে পারবে না কখন উড়াল দিল ওর শরীরটা মেশিনের দিকে। ওর পিঠ, দুই পা আর বাঁ হাতটা আটকে গেছে মেশিনের গায়ে, শুধু ডান হাতটা নাড়াতে পারছে। মাকড়সার জালে ধরা পড়লে পোকার যে অবস্থা হয়, ওর হয়েছে তা-ই।

জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল হামলাকারী লোকটা, নড়াচড়া করছে এখন। উঠে দাঁড়াল আস্তে আস্তে, সোহেলের অবস্থা দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। পিস্তলটা খুঁজে বের করে হাতে নিল, কিন্তু ওটা সোহেলের দিকে তাক করামাত্র তার হাত থেকে ছুটে গেল ওটা, উড়ে গিয়ে ঠং শব্দে আটকে গেল মেশিনের গায়ে-সোহেলের পাশে।

শরীর বার বার মোচড়াচ্ছে সোহেল, পিস্তলটার নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ধরতে পারল না ওটা।

আশ্চর্য হয়েছে হামলাকারী লোকটা, কিন্তু সামলে নিল। একটা খঞ্জর বের করল এবার, ওটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে আসছে সোহেলের দিকে। নিজের সাফল্যের ব্যাপারে শত ভাগ নিশ্চিত।

বাঁচার তাগিদে সর্বশক্তিতে আরেকবার শরীর মোচড়াল সোহেল, মুক্ত করতে সক্ষম হলো একটা পা। হামলাকারী লোকটা ততক্ষণে পৌঁছে গেছে ওর কাছে, খঞ্জর তুলেছে। ওর নাকেমুখে জুতসই একটা লাথি বসিয়ে দিল সোহেল। তেলে গেল লোকটার ঠোঁট, রক্ত বেরিয়ে এসেছে, আপনাআপনি নেমে গেছে খঞ্জরধরা হাত। দাঁতে দাঁত পিষল সে, বিষদৃষ্টিতে তাকাল সোহেলের দিকে, আবার খঞ্জর তুলছে।

দরজার গোবরাটে এমন সময় উদয় ঘটল রানার। ওর হাতে আইভি স্ট্যাণ্ডের ধাতব একটা রড। মুহূর্তেই বুঝে নিল ঘরের পরিস্থিতি। হামলাকারী লোকটাকে নিশানা করে জ্যাভেলিন থ্রোর মতো ছুঁড়ে মারল রডটা। ওটা চুম্বকের টানে লোকটার পিঠে বিধল বর্শার মতোই, বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়ে আটকে গেল মেশিনের সঙ্গে। খঞ্জরধরা হাত স্থির হয়ে গেল লোকটার, আঙুলগুলো শিথিল হয়ে যেতেই অস্ত্রটা নিজেকে যেন সঁপে দিল মেশিনের কাছে।

সোহেলের দিকে তাকিয়ে আছে রানা। সোহেলের অ্যাক্রিলিক ফেইস-শিল্ডের একদিকে চিড় ধরেছে, কপালের একটা পাশ কেটে গেছে, রক্ত দেখা যাচ্ছে চেহারায়।

আগে বাড়বি না! রানাকে সতর্ক করল সোহেল। নইলে আমার মতো অবস্থা হবে তোরও।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে রানা, শক্ত করে চেপে ধরে আছে দরজার হাতল যাতে চুম্বক টেনে নিতে না পারে ওকে। এদিকওদিক তাকাচ্ছে। হাতের বাঁয়ে, প্লেক্সিগ্লাসের আড়ালে দেখা যাচ্ছে এম.আর.আই. কন্ট্রোল রুম। ভিতরে কেউ নেই।

মেশিনটা বন্ধ করা যায় কীভাবে, বল তো?

নিয়মকানুন জানা না থাকলে পারবি না, বরং উল্টো বিপদ বাড়তে পারে। তুই বরং যত জলদি সম্ভব খুঁজে বের করার চেষ্টা ক লামিয়াকে, ওকে নিয়ে এখানে আয়।

ইঙ্গিতে হামলাকারী লোকটাকে দেখাল রানা। ওই ব্যাটার সমস্যা কী?

ওর বুক ছেঁদা করে বেরিয়ে এসেছে তোর জ্যাভেলিন, এ ছাড়া আর কোনও সমস্যা নেই।

না থাকলে আমাদেরকে পরপারে পাঠানোর চেষ্টা করছিল কেন?

অনেক চেষ্টা করেও পরপারে যেতে পারছিল না, শেষে আমাদেরকে উছিলা বানিয়েছে।

মাথা নাড়ল রানা, এত সহজে মেনে নিতে পারছে না সোহেলের কথা। ওই ব্যাটা সাধারণ কাপড় পরে ঘুরছিল, চেহারায় মাস্কও নেই।

তারমানে বাতাস হয়তো পরিষ্কার হয়ে গেছে এতক্ষণে। তারমানে,..

না! চেঁচিয়ে উঠল রানা, কোনও ঝুঁকি নিবি না! বাতাস আসলেই পরিষ্কার হয়েছে কি না তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত স্যুট পরে থাক্। লামিয়াকে খুঁজতে যাচ্ছি আমি।

তোকে পাহারা দিতে পারলে ভালো হতো-বলা যায় না, মেয়েটা সুন্দরী হতে পারে!

ভাগ্যদেবী চায় না তুই আমাকে ডিসটার্ব করিস, সোহেলের বর্তমান অবস্থায় হাসি পেল রানার। মেয়েমানুষের বাহুডোর যখন কপালে জুটল না এ-জীবনে, এম.আর.আই. মেশিনের প্রেমেই আটকে থাক্‌ কিছুক্ষণ।

শালা…

আর কিছু শোনার প্রয়োজন মনে করল না রানা, পা বাড়াল হলের দিকে।

.

অপারেটিং রুমের একদিকের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে আছে লামিয়া, অপেক্ষা করছে অসহায়ের মতো। কখনও কল্পনাও করেনি এ-রকম কোনও পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।

পনি টেইল চুলে আঙুল চালাল সে। আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে বদ্ধ ঘরের বাতাস, টের পাচ্ছে সেটা। করার মতো কিছুই নেই, কারণ কিছু করতে গেলেই বাড়তি অক্সিজেনের দাবি জানাবে ফুসফুস। ল্যাব কোটের একটা কোন ধরে কিছুক্ষণ মোচড়াল সে, কোনটা কুঁচকে যেতেই আবার সোজা করার চেষ্টা করল। ইচ্ছা করেই তাকাচ্ছে না ঘড়ির দিকে। কারণ আগে যতবার করেছিল কাজটা, দরজার সিল ছিঁড়ে ফেলার ইচ্ছা হয়েছিল ততবার। ইচ্ছা করছিল, দম আটকে রেখে একছুটে বন্দরে গিয়ে হাজির হতে, তারপর কোনও একটা স্পিডবোট বা নৌকায় চেপে…

কিন্তু লামিয়া জানে, দম আটকে রেখে দৌড়াতে দৌড়াতে বন্দরে হাজির হওয়া সম্ভব না ওর পক্ষে।

বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ যখন কমে আসে, তখন দপদপ করতে থাকে মাথা, ব্যথা ওঠে শরীরের জায়গায় জায়গায়, দুর্বল লাগতে থাকে। লামিয়ারও হচ্ছে ওসব। তারপরও ও জানে, শেষপর্যন্ত ঘরের ভিতরেই থাকতে হবে ওকে। কারণ ঘরের বাতাস দূষিত, আর বাইরের বাতাস প্রাণঘাতী, বিষাক্ত। ঘরের ভিতরে টিকে থাকা যাবে হয়তো আরও পাঁচ-সাত মিনিট; বাইরে বের হলে দশ সেকেণ্ডও বেঁচে থাকা যাবে না।

লামিয়া তাই অপেক্ষা করছে। টের পাচ্ছে, একটু একটু করে কাছিয়ে আসছে মৃত্যু। কিছুই করার নেই বলে ভাবছে অতীত নিয়ে।

ইটালির মিলানে জন্ম ওর, বড় হয়েছে দেশটার বিভিন্ন জায়গায়। ক্যারাবিনারি, মানে ইটালির মিলিটারি পুলিশে চাকরি করতেন ওর বাবা; পোস্টিং ছিল আজ এখানে তো কাল ওখানে। পাঁচ বছর বয়সে একটা দুর্ঘটনায় মাকে হারায় সে। তখন ইটালিতে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল অনেক। স্ত্রীর মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি ওর বাবা, অপরাধের বিরুদ্ধে অঘোষিত ক্রুসেডের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন তিনি। মেয়েকে গড়ে তুলতে শুরু করেন নিজের হাতে, আর সেই সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যান অপরাধ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে।

বাবার সাহস, সহিষ্ণুতা আর দৃঢ়সঙ্কল্পের কিছুটা হলেও পেয়েছে লামিয়া। মার কাছ থেকে পেয়েছে রূপ ও ধীশক্তি। স্কলারশিপ নিয়ে পড়েছে মেডিকেল স্কুলে, শিক্ষাজীবনের সব পরীক্ষাতেই প্রথম হয়েছে। নিজের হাতখরচ নিজেই জোগানোর জন্য মডেলিং করেছে। কিন্তু জানত, ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে না ওই পেশা, কারণ জীবন্ত ক্লথ হ্যাঁঙার হিসেবে ওর পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার শরীরটা পাত্তাই পাবে না ইউরোপিয়ান মডেল-জগতে।

মেডিকেল স্কুলের গণ্ডি পেরুনোর পরই চাকরি পেয়ে যাওয়ায় হাতখরচ কেন, অন্যান্য অনেক খরচ নিয়েও আর চিন্তা করতে হয়নি ওকে। এখন ঊনত্রিশ বছর বয়সে ওকে দেখায় তরুণী সোফিয়া লোরেনের মতো। মাঝেমধ্যে যখন টের পায় ওর পুরুষ কলিগরা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, তখন আত্মতৃপ্তি আর লজ্জা একইসঙ্গে ছুঁয়ে যায় ওকে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল লামিয়া। যে-মিশনে ওকে পাঠানো হয়েছে লিনোসায়, শেষপর্যন্ত সফল হতে পারবে কি না, ভাবছে। বদ্ধ বাতাসে বুক ভরে দম নেয়ার চেষ্টা করল আরেকবার, এবং আবারও ব্যর্থ হলো–কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ আরও বেড়েছে। তাকাবে কি তাকাবে না ভাবতে ভাবতে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়েই ফেলল।

মিনিট দশেক আগে কথা হয়েছে মাসুদ রানার সঙ্গে।

ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে এখানে আসতে এত সময় লাগছে কেন লোকটার? জিজ্ঞেস করল ওর পাশে বসে থাকা এক ল্যাব টেকনিশিয়ান।

এলিভেটর কাজ করছে না মনে হয়, ঠাট্টা করার চেষ্টা করল লামিয়া, কিন্তু প্রাণহীন শোনাল ওর কণ্ঠ। উঠে দাঁড়াল ক্লান্ত ভঙ্গিতে, দেয়ালে ভর দিয়ে তাকাল অন্যদের দিকে।

যে-কজনকে বাঁচাতে পেরেছে সে, তাদের সবাই আছে ঘরের ভিতরে। ল্যাব টেকনিশিয়ান ছাড়াও আছে একজন নার্স, চারটে বাচ্চা এবং বারোজন পূর্ণবয়স্ক রোগী–একেকজন একেক অসুখে ভুগছে।

ওই বারোজনের মধ্যে তিনজন তিউনিসিয়ার অভিবাসী, একটা রৌ-বোটে করে পালিয়ে এসেছে। সামুদ্রিক খররোদ ফোস্কা ফেলে দিয়েছে ওদের চামড়ায়, তারপর একটা আকস্মিক ঝড় গায়েব করে দিয়েছে ওদের অনেক সহযাত্রীকে। বেঁচে-থাকা কয়েকজন যখন বোট থেকে পড়ে গিয়ে সাঁতার কাটছিল লিনোসা উপকূল অভিমুখে, তখন পিছু ধাওয়া করে এসে ছজনকে খেয়েছে হাঙরের দল। শেষপর্যন্ত বাঁচতে পেরেছিল ওরা তিনজন, এখন আবার মরতে বসেছে।

ঘরের ভিতরে আর একটা মাত্র পোর্টেবল অক্সিজেন বটল আছে, বাকিগুলো খালি হয়ে গেছে। ভালভ খুলে দিল লামিয়া। হিসহিস শব্দে গ্যাস বেরিয়ে আসার কথা, কিন্তু ঘটল না ঘটনাটা। তারমানে এই বোতলও খালি।

হাত থেকে বোতলটা ছেড়ে দিল লামিয়া, টলমল পায়ে এগোতে শুরু করেছে দরজার দিকে। মাথার ভিতরটা আরও ফাঁকা লাগছে ওর। যত এগোচ্ছে, টলমল ভাব তত বাড়ছে।

দরজার পাল্লার সঙ্গে লাগানো আছে পুরু কাঁচ, ওপাশে এসে দাঁড়িয়েছে একটা লোক।

লোক? সে যদি সাধারণ কোনও মানুষ হবে তা হলে নভোচারীদের মতো পোশাক পরে আছে কেন? নাকি ভিনগ্রহের কোনও আগন্তুক? এসব কি ভাবছে লামিয়া? হ্যাঁলুসিনেশন হচ্ছে না তো ওর?

উবু হলো সে, একটানে ছিঁড়ে ফেলতে চায় পাল্লা আর মেঝের মাঝখানের শূন্যস্থান আটকে-রাখা টেপ।

না! চেঁচিয়ে উঠল কে যেন।

আরও ফাঁকা হয়ে গেল লামিয়ার মাথার ভিতরটা, হাঁটুতে ভর দিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল সে। ওই অবস্থায় টলে উঠল আবার, এবার পড়ল একদিকে কাত হয়ে। দেখল, টেপের বাধা ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকছে পাতলা একটা টিউব। সাপের মতো হিসহিস শব্দ করছে ওটা। কোনও সাপই ঢুকে পড়ছে। কি না কে জানে!

একটু একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে লামিয়ার মাথা, স্বাভাবিক হয়ে আসছে চিন্তাশক্তি। টিউবের মাধ্যমে আসলে অক্সিজেন ঢোকানো হচ্ছে ঘরের ভিতরে। বিশুদ্ধ অক্সিজেন।

বুক ভরে দম নেয়ার চেষ্টা করল লামিয়া। হ্যাঁ, এবার পারছে। কাঁপছে ওর শরীরটা-একটানা দৌড়ানোর পর কোনও অ্যাথলেটের শরীর যেভাবে কাপে সেইভাবে।

আরেকটা টিউব আসছে দরজার নিচ দিয়ে, হিসহিসানি দ্বিগুণ হয়েছে। ঘরের বাকিরা যাতে অক্সিজেন পায় সেজন্য গড়িয়ে দরজার কাছ থেকে সরে গেল লামিয়া। শরীরে জোর পাচ্ছে এখন, উঠে দাঁড়াল। নভোচারী লোকটাকে আবার দেখা যাচ্ছে কাঁচের ওপাশে। লামিয়াকে উঠে দাঁড়াতে দেখে দরজার কাছ থেকে সরে গেল লোকটা, ইন্টারকম টেলিফোনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অপারেটিং রুমের সেটটা বেজে উঠল কিছুক্ষণের মধ্যেই।

সবাই ঠিক আছে? লামিয়া কলটা রিসিভ করামাত্র জানতে চাইল রানা, কণ্ঠে উদ্বেগ।

মনে হয়, বলল লামিয়া। তোমার মাথায় কী হয়েছে? রক্ত পড়ছে দেখলাম। মনে পড়ে গেল, একটু আগে গুলির শব্দ শুনেছে। গোলাগুলি হয়েছে নাকি হাসপাতালের ভিতরে? কেউ হামলা চালিয়েছে তোমার উপর?

আপনার শেষ দুটো প্রশ্নের জবাব হ্যাঁ, গম্ভীর গলায় বলল রানা।

লোকটা দেখতে কেমন? একা ছিল?

বলছি। তবে তার আগে বলো তো, তুমি বা তোমরা কি ও-রকম কোনও ঘটনার আশঙ্কা করছিলে?

ইতস্তত করছে লামিয়া। বলতে গিয়ে বেশি বলে ফেলছে না তো? কাঁচের ওপাশের লোকটাও যে শত্রুপক্ষের কেউ না, নিশ্চিত হওয়ার উপায় কী? কিন্তু…শত্রুপক্ষের কেউ হলে বাঁচানোর চেষ্টা করছে কেন লামিয়াদেরকে?

কাঁচ ভেদ করে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে লামিয়া। লোকটাও একদৃষ্টিতে দেখছে মেয়েটাকে। হেলমেটের কারণে চেহারা ঠিকমতো ঠাহর করা যায় না ওই লোকের, কিন্তু অন্তর্ভেদী দৃষ্টি চেনা যায়।

মাসুদ রানার সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল লামিয়া, তবে এখনই না।

.

চুরুটে আগুন ধরিয়ে সুইভেল চেয়ারে হেলান দিলেন মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খান, তাকিয়ে আছেন মুখোমুখি-বসা সোহানার দিকে। বুক ভরে টেনে নিলেন কটুগন্ধী ধোঁয়া। ভূমধ্যসাগরে ঘটেছে ঘটনাটা?

জী, স্যর। ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে নিল সোহানা। লিনোসা উপকূল থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থান করছিল এম.ভি. টায়ানা। আশঙ্কা করা হচ্ছে সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে জাহাজটাতে এবং একইসঙ্গে ওই দ্বীপে। বাতিল করা হয়েছে লিনোসার সব ফ্লাইট।

আর?

কী জানতে চাইছেন মেজর জেনারেল, বুঝতে পারল সোহানা। লিনোসা উপকূলে নুমার ব্যানারে বিসিআই-এর যে-এক্সপেডিশন কোর্স পরিচালিত হচ্ছিল, তা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়নি। তবে…

সি-হর্সে যোগাযোগ করে রানা আর সোহেলকে পাওয়া যায়নি, তা-ই তো?

জী, স্যর। ক্যাপ্টেন বলছে, প্রাণঘাতী একটা কালো কুয়াশার বিস্তার ঘটেছে ওই এলাকার অনেকখানি জুড়ে। সাহায্যের আবেদন জানানো হয়েছে লিনোসা থেকে। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সেখানে গেছে রানা আর সোহেল।

ওই দ্বীপে আমাদের একটা লজিসটিক্স সাপোর্ট টিম আছে। ওদের খবর কী?

খবর নেই, স্যর। যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না ওদের সঙ্গেও।

পিঠ খাড়া করলেন রাহাত খান, চুরুটের কোনও স্বাদ পাচ্ছেন না। ওটা সরালেন মুখ থেকে। রানা-সোহেল ঠিক কাজ করেছে।

.

০৫.

 রানা, সোহেল এবং লিনোসা-থেকে-উদ্ধারকৃত অন্যরা বসে আছে একটা ইটালিয়ান সাপ্লাই শিপের ডেকে, মুক্ত বাতাসে। জাহাজটার ফানেলে বড় একটা রেড ক্রস দেখা যাচ্ছে।

রাসায়নিক দূষণ বা বিষক্রিয়া ঠেকাতে সক্ষম এমন পোশাকে নিজেদেরকে আপাদমস্তক আবৃত করে ইটালিয়ান আর্মির একদল সৈন্য গিয়েছিল ওই দ্বীপে, যারা বেঁচে আছে তাদেরকে উদ্ধার করেছে, তারপর হেলিকপ্টারে করে নিয়ে এসেছে নিরাপদ দূরত্বে।

ডিকন্টামিনেশন শাওয়ার নিতে হয়েছে ওদের সবাইকে, করতে হয়েছে একগাদা মেডিকেল টেস্ট। পোশাক হিসেবে পরতে দেয়া হয়েছে বাড়তি মিলিটারি ইউনিফর্ম। গলা ভেজানোর জন্য প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। এসপ্রেসোর ধোঁয়াওঠা কফির মগ। এত ভালো কফি শেষ কবে খেয়েছে, মনে করতে পারছে না রানা। দ্বিতীয় মগ কফি গিলে সোহেলকে বলল, লামিয়াকে দেখতে পাচ্ছি না কোথাও।

ওর যেখানে মন চায় সেখানে গেছে, তোর কী?

কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল মেয়েটাকে।

 কী কথা?

আমাদেরকে খুন করতে চাইছিল যে-লোক, মনে হচ্ছে। তার ব্যাপারে এমনকিছু জানে মেয়েটা, যা আমরা জানি না।

একটা দুর্ঘটনার সঙ্গে খুন করার উদ্দেশ্যে চালানো হামলার সম্পর্ক কী?

জানি না, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল রানা। তারপর বলল, আমাদের পাঁচ এজেন্টের মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না।

কালো কুয়াশার বিস্তার ঘটল লিনোসার আকাশে, মরতে শুরু করল ওখানকার লোকজন, যে-কজনকে পারল সঙ্গে নিয়ে অপারেটিং রুমে ঢুকল ডক্টর লামিয়া, সিল করে দিল রুমটা যাতে বাইরের বাতাস ঢুকতে না পারে সেখানে। যে রেসপন্স দেখিয়েছে সে, একজন ডাক্তারের জন্য বেশি হয়ে যাচ্ছে না সেটা?

ঝামেলা আশা করছিল এ-রকম কারও জন্য রেসপন্সটা স্বাভাবিক, এদিকওদিক তাকাচ্ছে রানা।

উদ্ধারকৃত সবার ওপর নজর রাখছে তিনজন ইটালিয়ান সৈন্য। তবে যেহেতু উদ্ধার করা হয়েছে রানাদেরকে, গ্রেপ্তার করা হয়নি, সেহেতু পাহারা দেয়ায় ঢিলেমি দেখা যাচ্ছে ওই তিন সৈন্যের মধ্যে। দূরের রেইলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুজন, নিচু গলায় কথা বলছে। তৃতীয়জন নিঃসঙ্গ, প্রথম দুজনের চেয়ে একটু কাছে আছে রানা-সোহেলের, ছোট একটা মেকানিকাল ক্রেইনের আড়ালে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে।

ইশারায় ওই তিনজনকে দেখাল রানা। ওদের মনোযোগ সরিয়ে দিতে পারবি অন্য কোথাও?

একচুমুকে মগের বাকি কফি শেষ করল সোহেল। পারব।

উঠে দাঁড়াল ওঁ, অলস পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে তিন নম্বর সৈনিকের দিকে। কাছে গিয়ে খেজুরে আলাপ জুড়ে দিল লোকটার সঙ্গে, কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে হাত নাড়ছে, চেষ্টা করছে যাতে রানার উপর থেকে মনোযোগ সরে যায় লোকটার।

মাথা নিচু করে ছুট লাগাল রানা। বন্ধু একটা হ্যাঁচওয়ের সঙ্গে গাঢ় ছায়া আছে, সেখানে পৌঁছে সোজা হলো, বাল্কহেডে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রেইনের ঝুলন্ত বিশাল হুকটা দেখিয়ে কী যেন বলছে সোহেল, মুখ তুলে সেদিকে তাকাল সৈন্যটা। সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁচ খুলে ফেলল রানা, ঢুকে পড়ল ভিতরে। একটুও দেরি না করে লাগিয়ে দিল ওটা।

হ্যাচের ভিতরে প্যাসেজওয়ে আছে, এই মুহূর্তে নির্জন। আশ্চর্য হলো না রানা। সাপ্লাই শিপটা বেশ বড়, দৈর্ঘ্যে ছশ ফুটের মতো। শ দেড়েক লোক আছে জাহাজে, তাই এখানে ভরা জায়গার চেয়ে খালি জায়গাই বেশি। লিনোসা থেকে নিয়ে-আসা লাশগুলো যেখানে রাখা হয়েছে, রানা আশা করছে সেখানে পাওয়া যাবে লামিয়াকে।

হলের দিকে এগোতে শুরু করল ও। টের পেল, জাহাজের অগ্রভাগের দিকে যাচ্ছে। ডিকন্টামিনেশন শাওয়ার আর মেডিকেল টেস্ট ওখানেই হয়েছিল। তারমানে সিক বে-টা কাছাকাছি কোথাও। ওটা খুঁজে পেলে কী করবে, ভাবছে রানা। ঠিক করল, বন্ধ দরজায় নক করার পর গলা বা পেট ব্যথা বলে চেষ্টা করবে ভিতরে ঢুকে পড়ার। মেশিন রুমের বাইরে পড়ে-থাকা একটা ছোট বাক্স তুলে নিল হাতে। ভাবখানা এমন, ওটা যত-জলদি-সম্ভব যথাযথ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে না দিলেই নয়।

দেখা হয়ে গেল একদল নাবিকের সঙ্গে, জাদুর মতো কাজ করল রানার কৌশল। ওর দিকে একবার তাকিয়েই আগ্রহ হারাল লোকগুলো, যে যার মতো চলে যাচ্ছে। হাঁটার গতি একটু কমাল রানা, ব্যস্ত ভঙ্গিতে এদিকওদিক তাকাচ্ছে-যেন দ্রুত চিনে নেয়ার চেষ্টা করছে সঠিক রাস্তা। অনতিদূরে লোহার-সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে, ওটা বেয়ে এক লেভেল নেমে এসে আবার হাঁটতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরই বুঝল, হারিয়ে গেছে ও। সিক বে-টা খুঁজে পাওয়ার বদলে কয়েকটা স্টোররুম আর তালাবদ্ধ কমপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এখন। কোনদিকে যাওয়া যায় ভাবছে, এমন সময় সাদা ল্যাব কোট পরা একজন পুরুষ আর একজন মহিলা নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কথা বলছে ওরা।

বাক্সটা নামিয়ে রাখল রানা, পকেট হাতড়াচ্ছে–যেন চাবি খুঁজছে মুখোমুখি দরজাগুলোর কোনও একটার। ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল ওই পুরুষ আর মহিলা। ওদেরকে একটু দূরে যেতে দিল রানা, তারপর ফলো করতে শুরু করল। আরও দুটো সিঁড়ি বেয়ে একটা গ্যাংওয়েতে হাজির হলো ওই দুজন, তারপর একটা হচের ভিতরে ঢুকে ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল ওটার দরজা।

হ্যাচটার পাশে গিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়াল, রানা। হাতল ঘুরিয়ে খুলল ওটা। তাকাল ভিতরে।

গুহার মতো একটা ঘর যেন বিস্তৃত হয়েছে সামনে। ছাদ থেকে ঝুলছে অনেকগুলো জ্বলন্ত উজ্জ্বল সাদা বাতি। কার্গো বের মতোই দেখাচ্ছে ঘরটাকে, কিন্তু ভিতরেছফুট বাই তিন ফুটের শত শত ম্যাট্রেসে শুয়ে আছে শত শত মরদেহ। পর্যাপ্ত ম্যাট্রেস না-থাকায় স্টিলের মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে অনেক লাশ। কোনওটার পরনে বেদিংস্যুট-খুব সম্ভব সৈকত থেকে তোলা হয়েছে মৃতদেহগুলো। বাকিদের বেশিরভাগের পরনে শর্টস আর টি-শার্ট। অফিশিয়াল ড্রেসও দেখা যাচ্ছে কারও কারও গায়ে। লিনোসার হাসপাতালে কোনও কোনও স্টাফের গায়ে যে-রকম ধূসর জামা দেখেছিল রানা, কয়েকজন পরে আছে সে-রকম কাপড়।

ঘরের ভিতরে পা রাখল রানা, সারি সারি ম্যাট্রেসের মাঝখান দিয়ে এগোচ্ছে। কালো কুয়াশার কারণে মারা-যাওয়া লাশগুলো দেখে আশ্চর্য হচ্ছে না। কাউকে-না-কাউকে সরাতেই হতো ওগুলো, বার বার হেলিকপ্টারে ঢুকিয়ে বহন করে আনতে হতো এই জাহাজে। ইটালিয়ান মিলিটারির যে ইউনিট উদ্ধার করেছে রানাদেরকে, ওরাই করেছে লাশ উদ্ধারের কাজ। রানা বরং আশ্চর্য হচ্ছে অন্য একটা ব্যাপার খেয়াল করে।

ইলেকট্রোড, মনিটর আর অন্যান্য যন্ত্র জুড়ে দেয়া হয়েছে। কোনও কোনও লাশের সঙ্গে। কোনও কোনও মরদেহের সঙ্গে ঝুলছে আই.ভি.। মেডিকেল স্টাফরা হাতে চোখামতো কী যেন নিয়ে একটু পর পর খোঁচাচ্ছে কোনও কোনও মৃতদেহকে। একজনের শরীরে ইলেকট্রিসিটির তার স্পর্শ করানোমাত্র খিচুনি শুরু হলো, বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ করে দিতেই আবার নিথর হয়ে গেল সে।

রানার দিকে খেয়াল নেই মেডিকেল স্টাফদের কারও–যার যার কাজে ব্যস্ত সবাই। এদিকওদিক তাকাতে তাকাতে এগোচ্ছে রানা, বিসিআই-এর এক এজেন্টকে চিনতে পেরে থমকে গেল। যখন দেখল, এজেন্টের মাথা থেকে ইলেকট্রোড খুলে নিয়ে চোখা জিনিসটা হাতে নিচ্ছে, এক স্টাফ, কঠোর কণ্ঠে বলল, কী হচ্ছে এখানে?

কম করে হলেও এক ডজন লোক ঘুরে তাকাল ওর দিকে। হঠাৎ করেই বুঝতে পারছে ওরা, রানা এখানকার কেউ ।

কে তুমি? জিজ্ঞেস করল ওদের একজন, প্রশ্নটা করেছে। হুমকি দেয়ার ভঙ্গিতে।

তোমরা কারা? জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল রানা। মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি তোমাদের? মরা মানুষগুলোকে নিয়ে এসব কী করছ?

ওর উঁচু কণ্ঠ গমগম করছে বদ্ধ ঘরে। কেউ কেউ মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে, কেউ আবার তাকিয়ে আছে রানার দিকে।

ওর উদ্দেশে কী যেন বলল একজন, ভাষাটা জার্মান বলে মনে হলো ওর কাছে।

আরেকজন চেঁচিয়ে উঠল, সিকিউরিটি! সিকিউরিটি!

হাজির হয়ে গেল ইটালিয়ান মিলিটারি পুলিশের কয়েকজন সদস্য। দুই সারি ম্যাট্রেসের দুদিক দিয়ে তেড়ে আসছে রানার দিকে।

আপনি যে-ই হোন না কেন, রানাকে ইংরেজিতে বলল মেডিকেল স্টাফদের একজন, এখানে ঢুকে পড়ে ঠিক কাজ করেননি।

লোকটার উচ্চারণে ফরাসি টান আছে।

এখান থেকে নিয়ে যান এই লোককে, আমেরিকান ইংরেজিতে মিলিটারি পুলিশদের উদ্দেশে চেঁচাল আরেক স্টাফ।

যার যেভাবে খুশি ঢুকে পড়তে পারছে, অন্য এক স্টাফের কণ্ঠে হতাশা, এভাবে কাজ করা সম্ভব নাকি? নিরাপত্তা বলে কিছু নেই এই জাহাজে।

রানার কাছাকাছি চলে এসেছে মিলিটারি পুলিশরা, এখন হাতে ব্যাটন নিয়ে সতর্ক ভঙ্গিতে এগোচ্ছে রানার দিকে। ঘিরে ধরার চেষ্টা করছে ওকে। ঢিলেঢালা ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করছে রানা, কিন্তু প্রস্তুত হয়ে আছে যে-কোনও জরুরি মুহূর্তের জন্য। রেগে গেছে-বিসিআই-এর এজেন্টরা কারও হাতের গিনিপিগ না, সে-লোক যত শক্তিশালীই হোক না কেন।

উনিশজন মানুষের জান বাঁচিয়েছে যে-লোক, শোনা গেল ইটালিয়ান ইংরেজিতে সুললিত একটা নারীকণ্ঠ, তাকে এভাবে অপদস্থ করার মানে কী?

লামিয়া।

 রানা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে কিছুটা উপরে একটা ক্যাটওয়াকে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যালে নর্তকীর মতো মোহনীয় ভঙ্গিতে একটা মই বেয়ে নেমে এল। রানা তো বটেই, মেডিকেল স্টাফসহ মিলিটারি পুলিশদের সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

কিন্তু, ডক্টর লামিয়া… বিদেশি এক স্টাফের গলায় প্রতিবাদের সুর।

কিন্তু কিছু না, লোকটাকে থামিয়ে দিল লামিয়া। শুধু উনিশজন মানুষের জীবনই বাঁচায়নি সে, লিনোসায় কী হয়েছে সে-ব্যাপারে সবার আগে কু-ও দিয়েছে। অস্বীকার করতে পারবেন, আমাদের হাতে ওই কু ছিল বলেই এত জলদি ইনভেস্টিগেশন শুরু করতে পেরেছি?

তাই বলে লোকটা নিশ্চয়ই ঢুকে পড়তে পারে না এখানে?

তা হয়তো পারে না, রানার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল লামিয়া। স্বীকার করছি আমিও।

মেয়েটাকে দেখছে রানাও। মেডিকেল স্টাফদের মধ্যে সবচেয়ে খাটো সে, কিন্তু সন্দেহ নেই সে-ই এই আজব ল্যাবরেটরির ইনচার্জ। অদ্ভুত এক দৃষ্টি খেলা করছে মেয়েটার চোখে-যেন রানার সঙ্গে অনেকদিনের পরিচয় ওর, দেখা হয়েছে বহুকাল পর। একটুখানি হাসি দেখা যাচ্ছে ওর ঠোঁটের কোনায়, কিন্তু তা রানার রাগ কমানোর জন্য যথেষ্ট না।

কী হচ্ছে এখানে? লামিয়াকে জিজ্ঞেস করল রানা। একান্তে কথা বলতে পারি? লামিয়ার কণ্ঠে যতটা না অনুমতি প্রার্থনা, তারচেয়ে বেশি তাগাদা।

চলো, বলল রানা।

ল্যাবরেটরি থেকে বের হলো লামিয়া, লাগোয়া ঘোট একটা অফিসরুমে ঢুকল রানাকে নিয়ে। দরজা লাগিয়ে দিল।

এদিকওদিক তাকাচ্ছে রানা। দেখে মনে হয়, জাহাজের কোয়ার্টারমাস্টারের জন্য বরাদ্দ ছিল এই ঘর, মেডিকেল স্টাফরা যাতে ব্যবহার করতে পারে সেজন্য ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ওই উদ্দেশ্যে টুকটাক সাজিয়েও নেয়া হয়েছে ঘরটা।

একদিকে ছোট একটা ডেস্ক, ওটার কোনা ঘুরে চেয়ারে বসে পড়ল লামিয়া। মুখোমুখি আরেকটা চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করল রানাকে। প্রথমেই আমার জীবন বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ। তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারতাম আগেই, কিন্তু…

সময়-সুযোগের অভাবে বলতে পারোনি, বুঝতে পারছি। তোমাকেও ধন্যবাদ। আরেকটু হলে আমাকে গ্রেপ্তার করছিল মিলিটারি পুলিশ।

কপালের উপর নেমে-আসা চুল সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিল লামিয়া। অত রেগে গিয়েছিলে কেন?

লাশগুলো নিয়ে কী করছিল মেডিকেল স্টাফরা?

গবেষণা–কোন জাতের বিষের কারণে তথাকথিত লাশ হয়েছে লিনোসার অধিবাসীরা। রক্তপরীক্ষা, টিস্যুর স্যাম্পল কালেকশনসহ ডাক্তারি অনেক ব্যাপার আছে যা বিস্তারিত বলতে গেলে সময় নষ্ট হবে।

চোখা জিনিস দিয়ে লাশের গায়ে বার বার খোঁচা মারা কোন জাতের গবেষণা?

রানাকে চমকে দিল,মেয়েটির উত্তর।

আমরা আসলে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করছি ওই লোকগুলোকে।

.

০৬.

বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে গেছে রানা, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লামিয়ার দিকে।

বিস্মিত হওয়াটাই স্বাভাবিক, বুলল লামিয়া। কারণ ব্যাপারটা যখন টের পাই, আমি নিজেও থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম।

নিজেকে সামলে নিল রানা। কে কবে শুনেছে বাঁচিয়ে তোলা যায় মরা মানুষকে?

যাদেরকে লাশ বলে মনে করছ, তারা কেউই এখনও মরেনি। আমরা তাই মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছি কেন তারা মড়ার মতো হয়ে আছে তা জানতে এবং ওই অবস্থা থেকে তাদেরকে বের করে আনতে।

ওদের কয়েকজনকে চেক করেছি আমি নিজে। কেউই দম নিচ্ছে না। পাস পরীক্ষা করলে ওদের হার্টবিট পাওয়া যায় না।

তারপরও ওরা দম নিচ্ছে, ওদের হৃৎপিণ্ড রক্ত পাম্পও করছে, তবে লম্বা বিরতিতে। গড়ে প্রতি দুই মিনিট পর পর একবার শ্বাস নিচ্ছে। আর হার্টবিট নেমে এসেছে সিঙ্গেল ডিজিটে। ভেন্ট্রিকুলার কন্ট্রাকশন এত দুর্বল যে, তা ধরা সম্ভব না সাধারণ কোনও মনিটরের পক্ষে।

মানে এক ধরনের কোমায় চলে গেছে ওরা?

আমরা তা-ই ধরে নিয়েছি। কিন্তু ও-রকম কোনও কোমা কখনও দেখিনি, শুনিওনি। সাধারণ কোমায় ব্রেইনের একটা অংশ কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। তখন কাজ চালিয়ে যায় ওটার সবচেয়ে গভীর আর আদিম কোনও অংশ। কিন্তু লিনোসার মানুষগুলোর ব্রেইন বলতে গেলে সম্পূর্ণ অচল হয়ে গেছে। অথচ আমরা কোনও ওষুধ বা উদ্দীপনা প্রয়োগ করলে তাতে সাড়া দিচ্ছে।

মানে?

ওদের মস্তিষ্কের কোনও ক্ষতি হয়নি, অথচ ওরা জেগে উঠতে পারছে না।

কিছু বলল না রানা। ডাক্তারি জটিলতায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে ওর।

একটা উদাহরণ দিই, বলে চলল লামিয়া। মনে করো ওরা সবাই একেকটা কম্পিউটার। কেউ একজন স্ট্যাণ্ডবাই বা স্লীপ মোডে দিয়ে রেখেছে ওদেরকে। অন্য কেউ এসে দেখছে, ওরা নষ্ট হয়ে যায়নি, অর্থাৎ মারা যায়নি। কিন্তু ভালো কম্পিউটার, আই মীন জীবিত মানুষের যেসব বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তার প্রায় কোনওটাই নেই ওদের মধ্যে। এখন পাওয়ার সুইচ যতই চাপাচাপি করি, কম্পিউটার আর চালু করা যাচ্ছে না।

অক্সিজেন-বঞ্চিত থাকতে থাকতে এতক্ষণে ব্রেইন ড্যামেজ হয়ে যাওয়ার কথা লোকগুলোর।

আমার মনে হয় যেহেতু ওদের শরীরের তাপমাত্রা কমে গেছে, কোষগুলো স্বাভাবিক কার্যক্রম প্রায় থামিয়ে দিয়েছে, সেহেতু স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে অনেক কম অক্সিজেন লাগছে। অর্থাৎ অনিয়মিত শ্বাসগ্রহণ এবং দুর্বল কার্ডিওভাস্কুলার অ্যাক্টিভিটির পরও বেঁচে আছে ওরা। নষ্ট হয়নি কারও মস্তিষ্ক। তবে ইলেকট্রিক শক অথবা অ্যাড্রেনালিন ইনজেকশনের মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যাচ্ছে না কাউকেই।

কালো কুয়াশা কী ধরনের বিষ?

এখনও জানি না।

কালো কুয়াশাতেই তো ছিল ওই বিষ, নাকি?

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল লামিয়া। নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কুয়াশা বা ধোঁয়াশা যা-ই বলো, ওটার স্যাম্পল জোগাড় করা হয়েছে, পরীক্ষা করা হয়েছে। পোড়া পেট্রোলিয়ামের ধোয়া বাদে পাওয়া গেছে সীসা ও অ্যাযবেস্টসের সামান্য উপস্থিতি-কোমও জাহাজে আগুন লাগলে সাধারণত যা পাওয়া যায়।

কিন্তু এটা নিশ্চয়ই স্বীকার করবে, এম.ভি, টায়ানায় আগুন লাগা, অন্যভাবে বললে লিনোসায় কালো কুয়াশার বিস্তার ঘটা এবং দ্বীপের এতগুলো মানুষের কোমায় চলে যাওয়া কাকতালীয় ঘটনা না?

প্রমাণ কী? চোখ জ্বালাপোড়া করা, হাঁপানি রোগীর মতো শব্দ করে দম নেয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া-কোনও নমুনাই তো নেই লিনোসার কোমা রোগীদের মধ্যে? কাজেই কী করে স্বীকার করি প্রভাব বিস্তার করেছে লিনোসায়?

ডেস্কে দুই কনুই ঠেকিয়ে সামনে ঝুঁকল রানা। তোমার রোগীদের কোমার জন্য যদি দায়ী না হয়, তা হলে দায়ী কী?

যে-জিনিসকে তুমি বলছ, আমাদের ধারণা ওটা কোনও জাতের নার্ভ টক্সিন-টায়ানায় ঘটা বিস্ফোরণের কারণে ছড়িয়েছে। কেউ হয়তো ইচ্ছা করেই ঘটিয়েছে। বিস্ফোরণটা। আবার ওটা দুর্ঘটনাও হতে পারে। লিনোসার মাটি, বাতাস কিংবা যারা বিষের-শিকার-হয়েছে তাদের রক্ত পরীক্ষা করে জানা গেছে, ওই বিষ বায়োলজিকাল এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নিজেকে গায়েব করে ফেলতে সক্ষম।

বিস্ফোরণটা ইচ্ছাকৃত? লিনোসার সঙ্গে শত্রুতা ছিল কার?

জানি না, রানা। যাতে জানতে পারি সেজন্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে, কেন ঘটল বিস্ফোরণটা।

চেয়ারে হেলান দিল রানা, এদিকওদিক তাকাচ্ছে। লামিয়ার পেছনে দুটো হোয়াইটবোর্ডে কিছু ডাক্তারি কথাবার্তা লেখা আছে। ওগুলোর উপর নজর বুলিয়ে ওর মনে হলো, লিনোসার রোগীদেরকে এখন পর্যন্ত কী কী ওষুধ দেয়া হয়েছে তা লিখে রাখা হয়েছে। আরেকদিকের দেয়ালে ঝোলানো আছে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের একটা ম্যাপ। ওটার জায়গায় জায়গায় পিন গাঁথা। একটা পিন লিবিয়ার উপর। আরেকটা ছেঁদা করেছে উত্তর সুদানকে। আরও কয়েকটা বারোটা বাজিয়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব ইউরোপের।

লামিয়া, রেডিও মেসেজে বলছিলে, আক্রান্ত হয়েছ তোমরা। আক্রান্ত শব্দটা ব্যবহার করলে কেন? ইঙ্গিতে ম্যাপটা দেখাল রানা। ও-রকম ঘটনা কি আগেও কোথাও ঘটেছে?

তুমি অনেককিছুই খেয়াল করো। …হ্যাঁ, ঘটেছে। লিনোসায় যারা আক্রান্ত হয়েছে বিষক্রিয়ায়, মাস ছয়েক আগে ওদের মতো অবস্থায় পাওয়া গেছে লিবিয়ার একদল প্রগতিবাদীকে। কেউ জানে না ঠিক কী হয়েছিল লোকগুলোর। অসুস্থ হয়ে পড়ার আটদিনের মাথায় মারা যায় ওরা সবাই। লিবিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে ইটালির, তাই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে রাজি হয় আমাদের সরকার। একটু থেমে দম নিল লামিয়া। কাজ শুরু করার কিছুদিনের মধ্যে জানতে পারি, লিবিয়ার কয়েকটা হাসপাতালে একই ঘটনা ঘটেছে। তারপর…ম্যাপে যেসব জায়গায় পিন গাঁথা আছে সেগুলোর সবখানে…বুঝতেই পারছ।

চুপ করে আছে রানা, ভাবছে। বোঝার চেষ্টা করছে, কোথাও কোনও ক্লু আছে কি না।

আজব এক সামঞ্জস্য পাওয়া গেছে প্রতিটা ঘটনায়, বলছে লামিয়া। হয় প্রগতিবাদী, মানে যারা বিপ্লবের মাধ্যমে দেশ বা সমাজের সংস্কার ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিল, নয়তো বড় মাপের কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বার বার শিকার হয়েছে ওই অসুস্থতার। ওদের বেশিরভাগই মারা গেছে, কেউ কোমায় আছে এখনও।

তোমাদের তদন্তের কী অবস্থা?

উল্লেখযোগ্য কোনও অগ্রগতি নেই। একটা টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, ভাসমান ল্যাবরেটরি হিসেবে ব্যবহার করছি এই জাহাজ। এখনও জানার চেষ্টা করছি, আজব এই অসুস্থতার ব্যাখ্যা কী।

এখানে তোমার ভূমিকা কী?

আমি একজন ডাক্তার, নিউরোবায়োলজিতে বিশেষজ্ঞ। ইটালি সরকারের হয়ে কাজ করছি।

লিনোসা উপকূলে টায়ানায় বিস্ফোরণ ঘটল, ওই সময়ে দ্বীপটাতে ছিলে তুমি-ঘটনাটা কি কাকতালীয়?

মুচকি হাসল লামিয়া। দেখা যাচ্ছে, শেষপর্যন্ত সব কথাই বলতে হবে তোমাকে। …রহস্যময় অসুস্থতার সঙ্গে যোগসূত্র আছে, এ-রকম সন্দেহভাজন এক ডাক্তারকে খুঁজে পেয়েছিলাম লিনোসায়। দ্বীপের হাসপাতালে কাজ করত লোকটা।

কে সে? আমাদের উপর হামলা চালিয়েছিল যে-লোক?

না। তোমাদেরকে খুন করতে চেয়েছিল যে, তাকে আমরা চিনি না। ওর জামাকাপড় খুঁজে কোনও আইডি কার্ড পাওয়া যায়নি। ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে সেটা যে যাচাই করব, তারও উপায় ছিল না-কালো কুয়াশার কারণে আঙুলের টিস্যু ক্ষয়ে গিয়েছিল ওই লোকের। তখন দ্বীপে যারা ছিল, তাদের সবার সঙ্গে মেলানো হয়েছে লোকটার শারীরিক বর্ণনা; কোনও মিল পাওয়া যায়নি।

তারমানে সে একজন অভিবাসী? রাজনৈতিক আশ্রয়ের খোঁজে গিয়েছিল লিনোসায়?

যারাই অভিবাসনের উদ্দেশ্যে আসে ইটালিতে, চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয় তাদের সবার ডিটেইলস। ওই লোকের সঙ্গে কোনও ম্যাচ পাওয়া যায় কি না, জানার জন্য বেশকিছু রেকর্ড চেক করেছি আমরা। কিন্তু কিছুই পাইনি।

তোমাদের সেই সন্দেহভাজনটি কে?

ওর নাম ডারহাম। লিনোসার হাসপাতালে পার্টটাইম ডাক্তারি করত। ওর অতীত ভালো না…মানে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল বেশ কয়েকবার। খবর পেয়েছিলাম, কোনওকিছুর চালান বুঝে নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছে সে লিনোসায়। আজ আসার কথা ছিল চালানটার। কিন্তু ওটা কোত্থেকে আসছে, কে ডেলিভারি দেবে, অথবা ওটা আসলে কীসের চালান-জানতাম না কিছুই।

ডারহামকে সন্দেহ করলে কী করে?

ইঙ্গিতে ম্যাপটা দেখাল লামিয়া। আজব কোমার খবর পাওয়া গেছে, এ-রকম অন্তত চার জায়গায় ওর উপস্থিতির ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি আমরা। ঘটনাটা একবার বা দুবার ঘটলে কাকতালীয় বলতে পারতাম, কিন্তু চারবার? মাথা নাড়ল।

তারমানে আমাকে আর আমার বন্ধুকে খুন করতে চাইছিল যে-লোক, সে-ই ডারহামের এজেন্ট। আর চালানটা ছিল নার্ভ টক্সিনের। কিন্তু টায়ানায় বিস্ফোরণ ঘটায় নষ্ট হয়ে গেছে ওদের পরিকল্পনা।

আমারও তা-ই মনে হয়।

 ডারহামের কী হয়েছে?

 খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

মানে?

আমাদের টিম কড়া নজরে রেখেছিল লোকটাকে। কিন্তু নার্ভ টক্সিনে আক্রান্ত হয়েছে ওরাও, ডারহাম সেই সুযোগে সম্ভবত পালিয়েছে।

তারমানে কালো কুয়াশার বিষক্রিয়া থেকে বাঁচতে পেরেছে শুধু দুজন? ডারহাম আর সেই খুনে এজেন্ট?

মাথা ঝাঁকাল লামিয়া।

সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় কালো কুয়াশার অ্যান্টিডোট ব্যবহার করছিল ওরা, যা পক্ষাঘাতের প্রভাব ঠেকিয়ে দিয়েছে ওদের শরীরে। কোমায় যায়নি কেউই।

কিন্তু ডারহামের অফিস, বাসা বা গাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও ও-রকম কোনও অ্যান্টিডোট পাওয়া যায়নি। খুনে এজেন্টের রক্তও পরীক্ষা করা হয়েছে। কোনও অ্যান্টিডোটের উপস্থিতি ধরা পড়েনি।

আশ্চর্য লাগছে আমার কাছে।

আমার লাগছে না। একটু আগেও বলেছি, কয়েক ঘণ্টা সক্রিয় থাকার পর গায়েব হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে ওই নার্ভ টক্সিনের। একই কথা প্রযোজ্য হতে পারে ওটার অ্যান্টিডোটের ক্ষেত্রেও।

ডারহামকে খুঁজে বের করতে পারলে অনেককিছু জানা যেত। লোকন পালিয়ে কোথায় গেছে?

কিছু বলার আগে রানার চোখে চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল লামিয়া। কেন জানতে চাইছ?

কৌতূহল।

ডারহামকে খুঁজে বের করার কথা ভাবছ?

আমি ওকে খুঁজে বের করার কে? একজন সাধারণ ডুবুরির পক্ষে…।

কেন শুধু শুধু নিজের পরিচয় গোপন করার চেষ্টা করছ? আমি ইতোমধ্যে কথা বলেছি অ্যাডমিরাল হ্যাঁমিল্টনের সঙ্গে। নুমার সঙ্গে তোমার সম্পর্কের ব্যাপারে খোলামেলা মন্তব্য করেছেন তিনি।

রানা কিছু বলল না।

অ্যাডমিরাল বলেছেন, তোমার কাছে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। আরেকটা কথা। কয়েকজন বাংলাদেশীর একটা টিম কাজ করছিল লিনোসায়। ওদের একজনকে যেই খোঁচাতে উদ্যত হলো আমাদের এক ডাক্তার, মারমুখী হয়ে, গেলে তুমি। তারমানে তুমিও কি বাংলাদেশী? ওই টিমের সঙ্গে সম্পর্ক আছে তোমার?

ধরে নাও তা-ই।

রহস্যময় হাসি হাসল লামিয়া। তোমার সঙ্গে তোমার বন্ধু সোহেলকেও জুটিয়ে নিতে বলেছেন অ্যাডমিরাল। বলেছেন, তিনি নাকি তোমাদের বাংলাদেশী বসকে ম্যানেজ করে নেবেন।

ম্যানেজ না করলেও, মনে মনে বলল রানা, আরেকটা অ্যাসাইনমেন্ট যে চাপতে যাচ্ছে আমার আর সোহেলের ঘাড়ে, তাতে সন্দেহ নেই। বুড়ো খোকা যখন জানতে পারবে বিসিআই-এর পাঁচ এজেন্ট কোমায় চলে গেছে, তখন…। তারমানে তুমি অফিশিয়ালি সাহায্য চাইছ আমাদের কাছে? বলল ও।

হ্যাঁ। যে বা যারা নার্ভ টক্সিনের জন্য দায়ী, তোমাদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে ওদেরকে খুঁজে বের করতে চাই, ওদের এই ভয়ঙ্কর খেলা থামাতে চাই।

কিন্তু আমাদেরকে সঙ্গে নিতে চাও কেন?

কারণ আমি বুঝতে পেরেছি, তোমরা দুজন একদল ডাক্তার কিংবা পুলিশের চেয়ে বেশি কিছু। ভেবে দেখো, যদি সফল হই আমরা, যদি ওই অ্যান্টিড়োট উদ্ধার করতে পারি, কোমায় থাকা এতগুলো লোককে বাঁচাতে পারব।

কোত্থেকে শুরু করতে চাও?

মাল্টা। সেখানে গত তিন মাসে তিনবার গেছে ডারহাম। একটা ড্রয়ার খুলল লামিয়া, একটা ফাইল ফোল্ডার বের করে ডেস্কের উপর রাখল। ওটার ভিতর থেকে বের করল একগাদা সার্ভেইলেন্স ফটো, দিল রানাকে। এই লোকের সঙ্গে গত তিন মাসে তিনবার দেখা করেছে ডারহাম। লোকটার সঙ্গে সপ্তাহ দুয়েক আগে তর্কাতর্কিও করতে দেখা গেছে ওকে।

হাতে নিয়ে ছবিগুলো দেখছে রানা।

অচেনা লোকটার চেহারা ভার্সিটির প্রফেসরদের মতো। দুই কনুইয়ে তালিওয়ালা টুইডের জ্যাকেট বোধহয় পছন্দ ওর, কারণ বেশিরভাগ ছবিতে তা-ই পরে থাকতে দেখা যাচ্ছে ওকে। একটা ছবিতে দেখা গেল আউটডোর ক্যাফেতে বসে আছে, সঙ্গে আরও তিনজন লোক। কথা বলছে। দেখলে মনে হয়, ওকে ঘিরে ধরেছে লোকগুলো।

ঝুঁকে এসে ফটোর একজনের উপর একটা আঙুল রাখল লামিয়া। এর নাম ডারহাম। বাকি দুজনের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারিনি আমরা এখনও। ধরে নেয়া যায় ওরা ডারহামের সহচর।

প্রফেসরদের মতো দেখতে লোকটা কে? জিজ্ঞেস করল রানা।

মাল্টা ন্যাশনাল মিউযিয়ামের কিউরেটর।

জাদুঘরের কিউরেটররা সাধারণত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে হাত মেলায় না, নার্ভ টক্সিন বা বায়োলজিকাল ওয়েপন চালান করে না। এই লোকের সঙ্গে ডারহামের যোগাযোগের ব্যাপারে তোমরা নিশ্চিত?

আমরা আসলে কোনও ব্যাপারেই শতভাগ নিশ্চিত না। তবে অনুমান করছি কিউরেটরের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করত ডারহাম।

কেন?

আগামী তরশু একটা পার্টির পর নিলাম হওয়ার কথা ওই জাদুঘরে। ওদের কাছ থেকে প্রাচীন কিছু আর্টিফ্যাক্ট কিনতে চাইছিল ডারহাম।

অসুবিধা কী? সন্ত্রাসীদের কি শখ থাকতে পারে না?

পারে। কিন্তু প্রাচীন আর্টিফ্যাক্ট সংগ্রহ করা ডারহামের শখ না। ওকে জিজ্ঞেস করেছি কয়েকবার, একবারও স্বীকার করেনি কোনও শখ আছে ওর। অন্তত ওই কিউরেটরের সঙ্গে মোলাকাত হওয়ার আগপর্যন্ত ছিল না।

কিন্তু ডারহাম নিশ্চয়ই এত বোকা না যে, লিনোসা থেকে পালিয়ে সোজা হাজির হবে মাল্টায়?

কিউরেটরের সঙ্গে যেদিন সাক্ষাৎ হয় ডারহামের, তার পরদিনই ওখানকার একটা ব্যাঙ্কে নিজের নামে অ্যাকাউন্ট খোলে সে। ইন্টারপোল নিশ্চিত করেছে, ওই অ্যাকাউন্টে এখন পর্যন্ত দুলক্ষ ইউরো জমা হয়েছে। এবং সেটা কখন ঘটেছে, জানো? লিনোসার ঘটনাটার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে।

তারমানে, ভাবছে রানা, ডারহাম শুধু বেঁচেই নেই, লিনোসা ছেড়ে নিরাপদে পালিয়েছে ও। এবং তার আগে মোটা অঙ্কের টাকা ট্রান্সফার করেছে মাল্টায়। কাজেই, অন্তত একবারের জন্য হলেও মাল্টায় যাবে লোকটা, দেখা করবে কিউরেটরের সঙ্গে।

তুমি আর সোহেল সাহায্য করবে আমাকে, রানা? লামিয়ার প্রশ্নে চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল রানার।

হ্যাঁ, করব।

তা হলে মাল্টায় যাও, অপেক্ষা কোরো আমার জন্য। কোমা রোগীদেরকে কোনও একটা হাসপাতালে ভর্তি করিয়েই ওখানে চলে যাব আমি। একটা অনুরোধ-আমি না পৌঁছানো পর্যন্ত কোনও অ্যাকশনে যেয়ো না।

চেষ্টা করব, উঠে দাঁড়াল রানা, এগিয়ে যাচ্ছে দরজার দিকে।

.

০৭.

 সারওয়ার বিন জামাল সিনেমার নায়ক নয়, কিন্তু চেষ্টা করলে হতে পারত।

দীর্ঘদেহী, শরীরের কোথাও এক ছটাক বাড়তি মেদ নেই। সুদর্শন চেহারাটা রোদেপোড়া, কালো চুলেও বাদামি আভা আছে। চৌকোনা চোয়াল নিঃশব্দে বলে দিচ্ছে, অঢেল আত্মবিশ্বাস আছে ওর নিজের উপর। এই মুহূর্তে ওর পরনে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতো ইউনিফর্ম। ওর সঙ্গে যারা আছে তারাও একই রকম উর্দি পরে আছে, কিন্তু সারওয়ারের সাজসজ্জা দেখলে মনে হয় সে প্রেসিডেন্ট, বাকিরা আমজনতা। মিশরের মরুভূমিতে, গিজার পিরামিডগুলো থেকে মাইল সাতেক পশ্চিমে, নিজের হাইড্রো ইলেকট্রিক প্লান্টে আছে সে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহচরসহ।

কয়েক বছর আগেও মিশরের সিক্রেট পুলিশবাহিনীতে ছিল সারওয়ার। তখন হোসনি মুবারাকের শাসনকাল শেষ হয়ে এসেছে। সারওয়ার তখন সিক্রেট পুলিশের সেকেণ্ড-ইন কমাণ্ড হিসেবে মুবারাকের শত্রুদের খুঁজে বের করে গুম করছে, চেষ্টা করছে আরব বসন্তের মিশরীয় সংস্করণের টুটি চেপে ধরার, যাতে দেশটার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উল্টে না যায়। সারা দেশে সে-সময় সাংঘাতিক গণ্ডগোল।

ডামাডোল যখন আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসছে, সবাই যখন একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ব্যাপারে কমবেশি নিশ্চিত হয়ে গেছে, তখন সারওয়ার ভাবল, কেন অযথা আরেকজনের গদি বাঁচানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছে সে? তার চেয়ে নিজের ভবিষ্যতের জন্য কিছু করাই কি ভালো না?

সিক্রেট পুলিশে চাকরির অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আছে তার বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শিতা। বাছাই-করা লোকদের নিয়ে আমেনথেস, মানে, প্রাচীন মিশরের মৃত্যুদেবতা ওসিরিসের আরেক নামে একটা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করল সারওয়ার। যে ব্যবসা চালিয়ে যেতে অন্যরা দশবার ভাববে, পেশিশক্তিকে পুঁজি করে বুক ফুলিয়ে নেমে পড়ল সেটাতে। পয়সাওয়ালা হতে বেশি সময় লাগল না ওর।

জন্মের পর থেকে এতদিন অপরাধের সঙ্গে বড় রকমের সম্পৃক্ততা ছিল না আমেনথেসের। কিন্তু গত সাত-আট মাসে অন্য চিন্তা খেলা করেছে সারওয়ারের মাথায়। কোটিপতি তো অনেক আছে দুনিয়ায়, কিন্তু রাজাদের রাজা আছে কজন? শুধু পয়সাই না, প্রচণ্ড ক্ষমতা চায় সারওয়ার; এমনকিছু হতে চায় যাতে মিশরের মানুষ হোসনি মুবারাককে ভুলে গিয়ে মনে রাখে ওর নাম। এবং ওর হিসেবে গরমিল না হলে আর কিছুদিনের মধ্যে শুধু মিশর না, উত্তর আফ্রিকার বেশিরভাগ অঞ্চল শাসন করবে আমেনথেস।

চার-পাঁচ টুকরো বরফ একটা গ্লাসে নিয়ে তাতে দুপেগ জিন ঢেলে সোফায় বসে আছে সে-ঘোট ঘোট চুমুকে মদ খেতে পছন্দ করে। ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াল ওর সবচেয়ে কাছের লোক হুসাইন আখতার। বলল, খারাপ খবর আছে।

অলস ভঙ্গিতে আখতারের দিকে তাকাল সারওয়ার, কিছু বলল না।

খালফানি মারা গেছে।

জিনের গ্লাসে চুমুক দিতে গিয়ে থমকে গেল সারওয়ার, তাকিয়ে আছে আখতারের দিকে।

শেষপর্যন্ত ডারহামের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি সে। মারা পড়েছে নুমার দুজন সদস্যের হাতে।

নুমা নামটা সারওয়ারের পরিচিত। সংগঠনটার কাজকর্ম সম্পর্কে অবগত।

খালফানি মারা যাওয়ায় আমাদের কোনও সমস্যা হবে না তো? কাজের কথায় চলে গেল আখতার।

সে কী বলতে চায়, বুঝে নিল সারওয়ার। ওই জাহাজ বা চালান বা খালফানিকে যদি তন্নতন্ন করেও খোঁজে কেউ, আমাদের কোনও সম্পৃক্ততা পাবে না।

ডারহামের কী হবে? ওর হাতে কালো কুয়াশার চালান তুলে দেয়ার কথা ছিল খালফানির, যাতে ওটা ব্যবহার করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারকে চাপে রাখতে পারে সে।

ডারহাম পালিয়ে মাল্টায় গেছে। নিলামে ওঠার আগেই আর্টিফ্যাক্টগুলো কিনে নেবে সে। না পারলে চুরি করার চেষ্টা করবে। আগামী দুদিনের মধ্যে আমার কাছে রিপোর্ট করার কথা ওর।

এখন একমাত্র ডারহামই পারে আমাদেরকে ফাঁসিয়ে দিতে। ওকে যত জলদি সম্ভব শেষ করে দেয়া উচিত আমাদের।

তা-ই করব, তবে আগে আর্টিফ্যাক্টগুলো হাতিয়ে নিক। আমি চাই, ওগুলো অন্য কারও হাতে পড়ার আগে আমার হাতে আসুক।

এত কষ্ট করার কি দরকার আছে? আমরা নিজেরাই কিন্তু নিশ্চিত কী আছে আর্টিফ্যাক্টগুলোর ভিতরে।

বিরক্ত হলো সারওয়ার।

তোমার একের পর এক প্রশ্ন শুনে মনে হচ্ছে, আমি আসামি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছি কাঠগড়ায়, আর তুমি বাদীপক্ষের উকিল। …ইউরোপের বড় বড় রাজনৈতিক নেতাকে কোমায় পাঠিয়ে দিতে চাই আমি। ফলে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মহাদেশটার বড় একটা অংশের ওপর আমার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে। কেউ যদি আর্টিফ্যাক্টগুলোর মধ্যে কালো কুয়াশার অ্যান্টিডোটের ফর্মুলা পেয়ে যায়, তা হলে বানচাল হয়ে যাবে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা।

আখতার ভয় পায় সারওয়ারকে, দুপা পিছিয়ে গেল তাই। কিন্তু… বলবে কি বলবে না ভাবতে ভাবতে শেষপর্যন্ত বলে ফেলল, ওই ফর্মুলা যে আর্টিফ্যাক্টগুলোর মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে, জানলে কী করে?

জানি বললে ভুল হবে। অনুমান করেছি। আসলে আমি চাই না আর্টিফ্যাক্টগুলো অন্য কারও হাতে পড়ক।

ডারহাম কি ওগুলো হাতিয়ে নিতে পারবে? সে তো তেমন কৌশলী না।

ওকে ব্যাকআপ দেয়ার জন্য আমাদের লোক পাঠাও। ওদেরকে বলবে, আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ামাত্র অথবা ডারহাম যদি বোঝায় পরিণত হয়, তা হলে যেন সঙ্গে সঙ্গে শেষ করে দেয়া হয় ওকে।

অবশ্যই। কোন কোন এজেন্টকে পাঠাব তা নিজে বাছাই করব আমি। …তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমেনথেসের কয়েকজন স্টকহোল্ডার আর বোর্ডমেম্বার এসেছেন।

আমেনথেস একটা প্রাইভেট মিলিটারি ফোর্স, সারওয়ার সেটার প্রেসিডেন্ট এবং সিইও, তারপরও একচ্ছত্র অধিপতি নয়। জবাবদিহিতা পছন্দ না হওয়ার পরও স্টকহোল্ডার আর বোর্ডমেম্বারদের মুখোমুখি হতে হয় ওকে। কারণ কোটি কোটি টাকা নিয়ে এবং অভাবনীয় ক্ষমতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওই লোকগুলোকে দলে ভিড়িয়েছে সে।

হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রান্টের আশপাশে বেশকিছু পাম্পিং স্টেশন বানিয়েছে সারওয়ার; খররোদে ঝিকমিক করছে সেগুলোর বড় বড় পাইপ। অন্য ব্লক স্ট্রাকচারগুলো কালো রঙের। পুরো স্টেশন সিস্টেম ঘেরাও করে ফেলা হয়েছে কাঁটাস্তারের বেড়া দিয়ে, একদিকের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন গার্ড। সারওয়ারকে এগিয়ে যেতে দেখে দরজা খুলে ধরে রাখল

ওরা। সে ভিতরে ঢোকার পর লাগিয়ে দিল ওটা।

হাঁটতে হাঁটতে স্টেশন সিস্টেমের পেছনদিকে চলে এল সারওয়ার। এখানে একটা মাইনিং এলিভেটল্লকে আড়াল করেছে আরেকটা দরজা। একসঙ্গে অনেক লোক অথবা ভারী যন্ত্রপাতি বহন করতে পারে এলিভেটরটা। দরজা খুলে ওটাতে উঠল সারওয়ার, নিচে নামার বাটনে চাপ দিল।

নামল চার শ ফুট নিচে। এলিভেটরের দরজা খুলে পা রাখল গুহার মতো দেখতে ভূগর্ভস্থ কম্পাউণ্ডে। জমিনের কোনায় কোনায় আর দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় জ্বলছে বেশ কয়েকটা লাইট, আলোকিত হয়ে আছে প্রশস্ত প্রবেশপথ। দৈর্ঘ্যে দুশ গজের মতো এই গুহার কিছুটা অংশ প্রাকৃতিক, বাকিটা বানিয়েছে সারওয়ারের মাইনিং টিম আর ইঞ্জিনিয়াররা। গুহার বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে আছে একতলা বাড়ির সমান আকারের অনেকগুলো বিশাল পাম্প। সাপের মতো এঁকেবেঁকে বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত হয়েছে বড় বড় পাইপ। গুহার একটা নির্দিষ্ট জায়গায় একত্রিত হয়েছে সবগুলো পাইপ, তারপর মাটির ভিতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

কন্ট্রোল সেন্টারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সারওয়ার। এখানে বড় বড় স্ক্রিনে প্রদর্শিত হচ্ছে মিশর আর উত্তর আফ্রিকার মানচিত্র। ওগুলোর উপর দিয়ে আঁকাবাঁকা রেখার মতো বিস্তৃত হয়েছে অনেকগুলো লাইন, বারোটা বাজিয়েছে সব মানচিত্রের। প্রতিটা লাইনের পাশে দেখা যাচ্ছে কতগুলো সংখ্যা-কখনও বাড়ছে, কখনও কমছে। প্রেশার, ভলিউম, ফ্লো চার্ট ইত্যাদি নির্দেশ করছে সংখ্যাগুলো।

সব ঠিক আছে দেখে আত্মতৃপ্তিতে ভরে গেল সারওয়ারের মন। একটা মোড় ঘুরে এখন এগিয়ে যাচ্ছে চটকদার কনফারেন্স রুমের দিকে। কাঁচদরজা ভেদ করে দেখতে পাচ্ছে, ঘরের মাঝখানে একটা বড় মেহগনি টেবিল ঘিরে বসে আছে কয়েকজন দশাসই লোক এবং সারওয়ারের গুটিকয়েক সহচর। দেয়ালে ঝোলানো স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে আমেনথেসের লোগো।

ঘরে ঢুকে টেবিলটার একমাথায় নিজের চেয়ারে বসল সারওয়ার। স্টকহোল্ডার আর বোর্ডমেম্বারদের দেখছে। পাঁচজন মিশরীয়, তিনজন লিবিয়ান, দুজন আলজেরিয়ান এবং সুদান ও তিউনিসিয়া থেকে এসেছে একজন করে। আরও একবার আত্মতৃপ্তি ভর করল সারওয়ারের মনে।

শূন্য থেকে শুরু করেছিল সে, এখন একটা ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশনে পরিণত হয়েছে আমেনথেস, অথচ সময় লেগেছে মাত্র কয়েক বছর। সাফল্যের ফর্মুলা বেশি কিছু নাঃ কঠোর পরিশ্রম, নৃশংস ধূর্ততা, যথোপযুক্ত জায়গায় যোগাযোগ এবং কাড়ি কাড়ি টাকা। সারওয়ার আর ওর সিক্রেট পুলিশের একান্ত সহচররা জোগান দিয়েছে প্রথম তিনটার, টেবিল ঘিরে বসে থাকা দশাসইরা অন্যটার জোগানদার।

আরব বসন্ত গদি উল্টে দিয়েছে নামীদামি নেতাদের, অথচ ওটার প্রভাবেই আজ এই কনফারেন্স রুমে একত্রিত হয়েছে সারওয়ার ও তার পার্টনাররা। সবার উদ্দেশ্য এক: যার যার অঞ্চলের ক্ষমতা দখল।

আসতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হয়নি আপনাদের? আতিথেয়তা না করলেই নয়, তাই কথাটা বলল সারওয়ার।

খেজুরে আলাপ করতে আসিনি আমরা, বলল সাদা চুলের এক মিশরীয়, পরনে পাশ্চাত্য ধাঁচের স্যুট, বা কব্জিতে ঝকঝক করছে দামি হাতঘড়ি। লোকটার প্রতিটা পয়সা দুর্নীতিরমিশরীয় বিমানবাহিনীতে সাম্প্রতিক সময়ে যতগুলো অর্থ-কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, তার সবগুলোর সঙ্গে জড়িত। আমরা জানতে চাই, অপারেশন কখন শুরু হবে? উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি আমরা সবাই।

একজন সহচরের দিকে তাকাল সারওয়ার। পাম্পিং স্টেশনগুলো রেডি?

জবাবে মাথা ঝাঁকাল লোকটা। ওর সামনে, টেবিলের উপর রাখা ল্যাপটপের কী-বোর্ডে আঙুল চালাল। ডিসপ্লে স্ক্রিনগুলোতে দেখা গেল আফ্রিকার ম্যাপ। সেখানে কোথায় কোথায় নিজেদের জাল বিছিয়েছে আমেনথেস তার কম্পিউটার অ্যানিমেটেড ডিজাইন।

আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, একটা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল সারওয়ার, আমাদের নেটওয়ার্ক কমপ্লিট।

টের পেয়েছে কেউ? জানতে চাইল লিবিয়ার এক প্রাক্তন জেনারেল।

না, বলল সারওয়ার। তেল উত্তোলনের পাইপ বসানোর বাহানায় কাজ চালিয়েছি আমরা। কাউকে সন্দিহান হতে না দিয়ে আমাদের পাইপগুলো নিয়ে গেছি সাব-সাহারা অ্যাকুইফারের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ সেকশনের কাছে। মিশর থেকে শুরু করে আলজেরিয়া পর্যন্ত প্রায় সব ঝরনা আর মরূদ্যানের পানির উৎস ওই অ্যাকুইফারগুলো।

অগভীর অ্যাকুইফারগুলোর কী হবে? জিজ্ঞেস করল জনৈক লিবিয়ান।

যেসব অ্যাকুইফারের কথা বললাম, সেগুলো অগভীর অ্যাকুইফারগুলোরও পানির উৎস। সাব-সাহারা থেকে পানি সরিয়ে নিলে, অগভীরগুলোও আপনিই শুকিয়ে যাবে, আস্তে আস্তে।

আস্তে আস্তে কেন? তিউনিসিয়ানের কণ্ঠে আপত্তি, এত ধৈর্য ধরতে পারব না!

একটুখানি হাসল সারওয়ার। কিন্তু ধৈর্য ধরতে হবে। কারণ আমার কাছে আলাদিনের চেরাগ নেই যে, রাতারাতি পানিশূন্য করে দেব অগভীর অ্যাকুইফারগুলো। …তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া আর লিবিয়া যখন দেখবে ওদের পানির সরবরাহ আশি থেকে নব্বই শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে, আমাদের করুণার উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় থাকবে না। তখন একদিক দিয়ে আপনাদেরকে ক্ষমতায় বসাবে ওরা, আরেকদিক দিয়ে পানি পাবে। …আমরা যদি একসঙ্গে কাজ করি, তা হলে উত্তর আফ্রিকার নিয়ন্ত্রণ নিতে বেশি সময় লাগবে না।

আলজেরিয়া থেকে আসা লোকটা নাক সিটকাল। প্রতিদিন বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালন পানি বের করে মরুভূমিতে ফেলে দেবেন আপনি, অথচ কেউ কিছু টের পাবে না–এটা সম্ভব? প্রমাণ…।

কোনও প্রমাণ থাকবে না। স্ক্রিনের দিকে ইঙ্গিত করল সারওয়ার, পানি মরুভূমিতে ফেলা হবে না। বরং ওই যে পাইপলাইনগুলো দেখতে পাচ্ছেন, ওগুলো দিয়ে একটা হাইড্রো-ইলেকট্রিক চ্যানেলের মাধ্যমে সব গিয়ে পড়বে নীল নদে। তারপর সেখান থেকে চলে যাবে সাগরে। কেউ কিছু সন্দেহ করতে পারবে না।

মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে ক্ষমতালোভীরা, সন্তোষ দেখা যাচ্ছে ওদের দৃষ্টিতে।

যার যার দেশের গদিতে গিয়ে বসব আমরা, মুখ খুলল লিবিয়ান লোকটা, অথচ ইউরোপিয়ান বা আমেরিকানরা কিছুই বলবে না?

হা হা করে হেসে উঠল সারওয়ার, কেন তা সে-ই ভালো জানে। যে বা যারা কিছু বলবে, তাদেরকে শীতন্দ্রিায় শুইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছি।

মুখ চাওয়াচাওয়ি করল বোর্ডমেম্বাররা।

ঘটনা ঘটতে শুরু করবে কখন? জিজ্ঞেস করল একজন স্টকহোল্ডার।

অতি শীঘ্রিই। সবই ঘটবে আপনাদের চোখের সামনে।

.

০৮.

হ্যাটটার আকৃতি সমব্রেরোর মতো, তারপরও আসিফ রেজার মনে হচ্ছে, রোদে চেহারা পুড়ে গেছে ওর। দরদর করে ঘামছে সে। কপাল ভালো আর বেশিক্ষণ সহ্য করতে হবে না সূর্যের অত্যাচার, কারণ তিউনিসিয়ার পশ্চিমাকাশে একটু একটু করে ঢলে পড়ছে ওটা।

ন্যাড়া আর পাথরে-ভরা একটা পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উঠছে সে কয়েকজন হাইকারসহ। এগিয়ে আছে ওর স্ত্রী তানিয়া। এমনভাবে ঢাল বাইছে মেয়েটা, যেন কোনও কষ্টই হচ্ছে না ওর। ওর পরনে রানারস আউটফিট, মাথায় বাদামি রঙের বল ক্যাপ। পনিটেইল, বানিয়ে বেঁধেছে কালো চুলগুলো। উপরে ওঠার ছন্দের সঙ্গে মিল থেকে এদিকওদিক দুলছে। টেইলটা।

আসিফ বেশ লম্বা, বিন্তু ওর শরীর মোটেও অ্যাথলেটদের মতো না। হাঁপিয়ে গেছে সে। গলা চড়িয়ে বলল, একটু বিরতি নিলে হয় না?

প্রায় পৌঁছে গেছি, গলা চড়িয়ে বলল তানিয়াও, আরেকটু এগোলেই হাজির হব পৃথিবীর নতুনতম লেকের কাছে। ওখানে গিয়ে একবারে বিশ্রাম নিয়ো।

ছুটি কাটাতে তিউনিসিয়ার গাফসা শহরে এসেছিল আসিফ-তানিয়া। রোমান শাসনামলে শহরটা একটা মরূদ্যান ছিল। এখানে-সেখানে ছিল বিভিন্ন ঝরনা আর জলাশয়, একটার সঙ্গে আরেকটা কোনও-না-কোনওভাবে যুক্ত। কিন্তু এখন যে-লেক দেখতে যাচ্ছে ওরা, তা যেন হুট করেই জন্মেছে কয়েক মাস আগে। এবং ব্যাপারটা কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে আসিফ-তানিয়াসহ কয়েকজন হাইকারের মনে।

 বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আসিফ পেশায় একজন জিয়োলজিস্ট। আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস-এ বড় হয়েছে, বিখ্যাত উডস হোল ওশানোগ্রাফিক ইন্সটিটিউশন-এর আশপাশে ঘুরঘুর করে কাটিয়েছে কৈশোর। পরে পিএইচডি করেছে মেরিন জিয়োলজিতে। কাজেই নতুন জন্মানো ওই লেক কৌতূহলের জন্ম দিতেই পারে ওর মনে। কিন্তু হোটেল থেকে ভাঙাচোরা রাস্তায় একঘণ্টার জিপজার্নি শেষে খররোদে পুড়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠতে গিয়ে খবর হয়ে গেছে ওর।

প্রায় পৌঁছে গেছি আমরা, আবারও আসিফকে আশ্বস্ত করল তানিয়া।

একটু থামল আসিফ, আশ্চর্য হয়ে দেখছে ওর স্ত্রীকে। ক্লান্তি বলে কিছু নেই মেয়েটার? ও ডক্টরেট মেরিন বায়োলজিতে। নিজের বিষয়ে সহজেই ক্লান্ত হয় সে, অথচ খুব আগ্রহ বোধ করে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জে।

নুমা-য় কাজ করছে স্বামী-স্ত্রী দুজনই।

গাইডের আগেই পাহাড়ি ঢলের মাথায় হাজির হলো তানিয়া, বাকিদের জন্য অপেক্ষা করছে আর এদিকওদিক তাকাচ্ছে। এক হাত তুলে আড়াল করেছে মুখ, বিস্ময় গোপন করার চেষ্টা করছে সম্ভবত। কয়েক মুহূর্ত পর ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল গাইডও, সন্তুষ্টির বদলে দ্বিধা ফুটে উঠল লোকটার চেহারায়। কী করবে বুঝতে না পেরে হ্যাট সরিয়ে মাথা চুলকাচ্ছে।

হাঁপাতে হাঁপাতে ঢালের মাথায় যাওয়ার পর আসিফ বুঝতে পারল ঘটনা কী।

কয়েকটা পাহাড় বেষ্টিত হয়ে যেখানে থাকার কথা ছিল টলটলে পানির গভীর লেকটা, সেখানে এখন শুধু আছে বড়জোর দশফুট পরিধির সামান্য পানি, উপরে সাদা ফেনা ভাসছে। লেকের যে-জায়গায় সবচেয়ে উঁচু ছিল পানির স্তর, বৃত্তাকার একটা ধূসর দাগ তৈরি হয়ে আছে সেখানে-বাথটাবে সাবানের ফেনা যে-রকম দাগ বানায় অনেকটা সে-রকম।

এতক্ষণে অন্য হাইকাররাও হাজির হয়েছে ঢালের মাথায়, আসিফ-তানিয়ার মতো বাক্যহারা হয়ে গেছে ওরাও। শুধু লেক দেখার উদ্দেশ্যেই এত কষ্ট করে এখানে এসেছে ওরা। হোটেলে থাকতে লেকের ফটোগ্রাফ দেখে মুগ্ধ হয়েছে; ডেবেছে দেখার মতো অন্তত কিছু একটা পাওয়া গেছে গাফসায়। কল্পনাও করেনি, লেকের বদলে দেখতে হবে লেকের লাশ।

গাইড লোকটা পয়সার বিনিময়ে এ-রকম জায়গায় নিয়ে আসে টুরিস্টদের; এখনও হতভম্ব দেখাচ্ছে ওকে। বলল, বুঝলাম না। এত গভীর একটা লেক এমন শুকিয়ে গেল কী করে? দুদিন আগেও দেখে গেলাম…

বাষ্পীভবন, স্কটল্যাণ্ড থেকে আসা এক টুরিস্ট বলল। কী গরম পড়েছে, দেখছ না?

ঢালু হয়ে নেমে-যাওয়া লেকের জমিনে থকথক করছে কাদা, সেদিকে তাকিয়ে আছে আসিফ। ক্লান্তি ভুলে গেছে। বুঝতে পারছে, চোখের সামনে যা দেখছে তা একটা রহস্য।

পাহাড়ি অঞ্চলে হুট করে একটা লেকের জন্ম নেয়াটা অস্বাভাবিক নয়-জমিনের নিচে সঞ্চিত পানি জমিনের কোনও রন্ধ্রপথে বেরিয়ে জলাশয় তৈরি করতে পারে। কিন্তু ও-রকম কোনও জলাশয়ের রাতারাতি গায়েব হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক। কারণ বড় রকমের ভূমিকম্প না ঘটলে, মাটির নিচে সঞ্চিত পানির স্তর সরে অন্য কোথাও চলে যায় না।

লেকটার আয়তন সম্পর্কে ধারণা নেয়ার জন্য ওটার সার্ফেস এরিয়া আর গভীরতা খালিচোখে অনুমান করার চেষ্টা করল আসিফ। তারপর বলল, লেকে যে-পরিমাণ পানি ছিল তা দুমাসেও বাষ্পীভূত হতে পারবে না, দুদিন তো পরের কথা।

তা হলে এত পানি গেল কোথায়? জিজ্ঞেস করল এক মহিলা।

এখন খরার মৌসুম চলছে তিউনিসিয়ায়, বলল বাষ্পীভবনের থিয়োরি-দেয়া লোকটা, কেউ হয়তো এখান থেকে সব পানি নিয়ে গেছে।

কিন্তু এক হাজার ট্যাঙ্কার ট্রাক পুরো ভর্তি করেও যদি পানি নেয়া হয় এই লেক থেকে, আসিফের কণ্ঠে প্রতিবাদ, তা হলেও এখন তলানিতে যে-পরিমাণ পানি আছে তারচেয়ে অনেক বেশি থাকার কথা। এদিকওদিক তাকাচ্ছে, জমিনের কোথাও কোনও ফাটল আছে কি না খুঁজছে যেখান দিয়ে লেক থেকে পানি বেরিয়ে যেতে পারে।

কিন্তু ও-রকম কিছু নজরে পড়ল না ওর।

পথ দেখিয়ে এখানে আনার জন্য যত টাকা নিয়েছ, গাইডকে শাসাচ্ছে এক মহিলা, হোটেলে গিয়ে সব ফেরত দেবে। মামদোবাজি অন্য কারও সঙ্গে কোরো, বুঝলে? তেজ দেখিয়ে নামতে শুরু করল ঢাল বেয়ে।

লেকের বদলে কাদায়-ভরা একটা বিশাল গর্ত দেখতে রাজি না কেউই, তাই বাকিরাও অনুসরণ করল, ওই মহিলাকে।

হুড়োহুড়ি করে মহিলার পাশে গিয়ে হাজির হয়েছে গাইড, হাত নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে ধোঁকা দেয়নি সে, বলছে আসলেই কত সুন্দর একটা লেক ছিল এই জায়গায়।

যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে আসিফ আর তানিয়া, ওদের দৃষ্টি নিবদ্ধ লেকের তলদেশের দিকে। স্থানীয় কিছু ছোকরা জড়ো হয়েছে সেখানে, কাদামাটির উপর দিয়ে হেঁটে হাজির হয়েছে পানির কাছে, সঙ্গে করে আনা পাত্র প্রার চেষ্টা করছে কাদাপানি দিয়ে। খরার মৌসুমে গৃহস্থালি কাজে ওই পানিই ভরসা।

এখানে কোথাও কোনও ঝরনা নেই, বিড়বিড় করল আসিফ। লেক থেকে পানি বের হওয়ার কোনও পথও নেই।

ওর দিকে তাকাল তানিয়া। তুমি বলতে চাইছ, জমিনের পানি জমিনে গিয়ে ঢুকেছে?

কিছু না বলে মাথা ঝাঁকাল আসিফ।

সঙ্গে করে আনা ক্যামেরা দিয়ে লেকের কয়েকটা ছবি তুলে নিল তানিয়া।

এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে ওদেরকে দেখছিলেন মাঝবয়সী বেঁটে এক লোক, এখন এগিয়ে আসছেন ওদের দিকে। লোকটার মাথায় ঢলঢল করছে একটা ক্যানভাসের হ্যাট, ওটা ছাড়িয়ে কিছু কাঁচাপাকা লম্বা চুল নেমে এসেছে রোদেপোড়া কপালের উপর। সঙ্গে-থাকা ব্যাকপ্যাক, ওয়াকিং স্টিক আর বিনকিউলার নিঃশব্দে বলে দেয়, ওই লোকও একজন হাইকার।

হ্যালো, কাছে এসে বললেন তিনি, একটুখানি উঁচু করলেন হ্যাটটা। কিছু মনে করবেন না-লেকটা কীভাবে গায়েব হয়েছে তা নিয়ে কথা বলছিলেন আপনারা, আপনাদের আলোচনা শুনেছি। আপনাদের মতো আরও টুরিস্ট লেকটা দেখতে আজ সারাদিন এসেছে এখানে, তারপর হতাশ হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেছে। আপনাদের দুজনকেই দেখলাম লেকটা কেন উধাও হলো তা নিয়ে কথা বলছেন। …আপনারা কি জিয়োলজিস্ট?

আমার ব্যাকগ্রাউণ্ড জিয়োজি, হ্যাণ্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের পরিচয় দিল আসিফ। তারপর ইঙ্গিতে তানিয়াকে দেখিয়ে বলল, আমার স্ত্রী…তানিয়া।

অপরিচিত লোকটার উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল তানিয়া। আমার নাম খালিদ সাইফুল্লাহ। আপনাদের মতো আমিও বোঝার চেষ্টা করছিলাম, লেকের পানি কেন এবং কীভাবে গায়েব হলো।

আপনি কি অমেচার কোনও…

না, মাথা নাড়লেন খালিদ। আমি লিবিয়া সরকারের ওয়াটার রিকভারি ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর।

লিবিয়া! আশ্চর্য হয়েছে তানিয়া। কিন্তু এটা তো তিউনিসিয়া!

চাকরির খাতিরে আসতে হয়েছে আমাকে এখানে। এই লেকের মতো আরও জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে লিবিয়া তিউনিসিয়ার মতো কিছু দেশে।

সমস্যাটা কী?

বুঝতে পারছি না, আবারও মাথা নাড়লেন খালিদ। আমার দেশে পানির সরবরাহ অনেক কমে গেছে গত কয়েক মাসে। ঝরনা থেকে পানি এসে জমত যেসব লেকে, সেগুলো শুকিয়ে গেছে। ঝরনাগুলোও মৃতপ্রায়। মরূদ্যানগুলো আর সবুজ নেই, শুকিয়ে বাদামি হয়ে গেছে। পানির অভাবে মানুষ যাতে না মরে সেজন্য জমিনের অনেক গভীর থেকে পানি ভোলা হচ্ছিল, কিন্তু ইদানীং বেশকিছু পাম্পিংস্টেশন থেকে খবর আসছে, আর পারছে না ওরা–মাটির নিচে পানির প্রবাহ বলতে গেলে নেই।

মুখ চাওয়াচাওয়ি করল আসিফ-তানিয়া।

আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম এটা বোধহয় শুধু লিবিয়ারই সমস্যা। কিন্তু পরে শুনলাম, প্রতিবেশী কয়েকটা দেশেও প্রায় একইরকম সমস্যা দেখা দিয়েছে। আর এই লেকটা উধাও হয়ে গেছে শুনে নিজেই দেখতে এলাম। আমার মনে হয় আণ্ডারগ্রাউণ্ড ওয়াটার টেবিলে বড় রকমের পরিবর্তন ঘটেছে।

সেটা কীভাবে সম্ভব?

জানি না। কেউই মনে হয় জানে না। তবে জানার চেষ্টা করছি। আপনারা সাহায্য করবেন আমাকে?

আবারও মুখ চাওয়াচাওয়ি করল আসিফ আর তানিয়া, চোখে চোখে কথা হয়ে গেল দুজনের মধ্যে।

করব, বলল আসিফ। আপনার সঙ্গে গাড়ি আছে? তা হলে আমাদের গাইডকে ছেড়ে দেব।

একটা ল্যাণ্ডরোভার আছে আমার সঙ্গে।

.

মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খানের সঙ্গে কথা হয়েছে সোহেলের। যেমনটা ভেবেছিল রানা, তা-ই ঘটেছে। নতুন একটা অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছে ওদের দুজনকে।

জানতে হবে কী, কোত্থেকে এল। ওটা যদি আসলেই কোনও নার্ভ টক্সিন বা বায়োলজিকাল ওয়েপ হয়ে থাকে, তা হলে এখন কাদের দখলে আছে। জানতে হবে ওই লোকগুলোর উদ্দেশ্য কী। এবং সম্ভব হলে খুঁজে বের করতে হবে কালো কুয়াশার অ্যান্টিডোট, কোমা থেকে ফেরাতে হবে বিসিআই-এর পাঁচ এজেন্টকে, সেইসঙ্গে অন্যদেরও।

মাল্টার ভ্যালেটা বন্দরে নামল রানা-সোহেল।

এখনও প্রাচীনত্বের ছোঁয়া রয়ে গেছে ভ্যালেটার প্রকৃতি ও মানবনির্মিত অনেককিছুতে। বন্দর থেকে সোজা শহরের দিকে তাকালে দৃষ্টির অনেকখানি দখল করে নেয় বিশাল একটা গির্জা। ওটার আশপাশে পুরনো কিছু দালান এবং আরও কয়েকটা ছোট গির্জা আছে। প্রাচীন নগর-রক্ষাব্যবস্থার নিদর্শন হিসেবে বন্দরে আজও রয়ে গেছে গানারি প্লাসহ পাথুরে দেয়ালের গ্যারিসন। সরু সাগর-প্রণালীর দিকে মুখ করে আছে কামানগুলো।

জাহাজঘাটে উঠে পড়ল রানা আর সোহেল, সেখান থেকে নামল রাস্তায়। মধ্যমগতিতে হাঁটছে। জাদুঘরের কিউরেটরের সঙ্গে দেখা করার কথা আছে ওদের।

কী মনে হয় তোর? হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল সোহেল। আমাদের সঙ্গে আসলেই দেখা করবে কিউরেটর?

মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল রানা। সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে। ফিফটি-ফিফটি।

হাত তুলে একটা ট্যাক্সিক্যাব থামাল সোহেল, ড্রাইভারকে ঠিকানা জানিয়ে উঠে পড়ল। ঘোরপ্যাঁচ রাস্তা দিয়ে দক্ষহাতে গাড়ি চালিয়ে, জ্যাম এড়িয়ে ওদেরকে জাদুঘরের সামনে নামিয়ে দিল লোকটা।

জাদুঘরের সদর-দরজায় গিয়ে দাঁড়াল রানা-সোহেল। সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে আছে একজন।

কেন এসেছে ওরা, তা জানাল রানা লোকটাকে। ওদেরকে অপেক্ষা করতে বলে ইন্টারকম টেলিফোনে যোগাযোগ করল গার্ড। দুই কনুইয়ে তালিওয়ালা টুইডের জ্যাকেট পরিহিত একটা লোককে সদর-দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই।

এগিয়ে গিয়ে লোকটার সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করল রানা। ডক্টর হেল্ডন?

জর্জ, কোন্ নামে ডাকা হলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে তা জানিয়ে দিল হেল্ডন, রানার সঙ্গে হাত মেলানো শেষ করে সোহেলের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করছে।

আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে আমাদের, বলল রানা।

একটুখানি হাসি দেখা গেল হেল্ডনের চেহারায়। ব্যাপার না। ভিতরে চলুন।

জাদুঘরের ভিতরে ঢুকল ওরা তিনজন। দরজা লাগিয়ে দিল হেন্ডন, তবে তার আগে গার্ডের উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল–কারণটা ঠিক বোঝা গেল না। হলের দিকে পা বাড়ানোর আগে খড়খড়ি ফাঁক করে কী যেন দেখল বাইরে।

ফোয়ে পার হয়ে মেইন হলে ঢুকল হেন্ডন, ওর পিছনে আছে রান। আর সোহেল। কয়েকদিনের মধ্যেই নিলাম অনুষ্ঠিত হবে, হলের এদিকে-সেদিকে তাকালে বোঝা যায়। জোর প্রস্তুতি চলছে সেটার।

রানা আর সোহেলকে নিজের অফিসে নিয়ে গেল হেল্ডন। রুমটা জাদুঘরের তৃতীয়তলায়, এককোণে।

আর্টিফ্যাক্ট, ম্যাগাজিন আর অন্যান্য কাগজপত্র গাদাগাদি, করে রাখা আছে ঘরের ভিতরে। কোটা দরকারি আর কোন্‌টা অদরকারি বোঝা মুশকিল। সবকিছু এত ঠাসাঠাসি হয়ে গেছে যে, এককোনার একমাত্র জানালাটাও চোখে পড়ে না ঠিকমতো। ময়লা হয়ে গেছে জানালার কাঁচ।

হেল্ডন গিয়ে বসল নিজের চেয়ারে, রানা আর সোহেল বসল ওর মুখোমুখি। উজ্জ্বল ফ্লাডলাইট জ্বলে উঠল বাইরে, আলোর শক্তিশালী রেখাকে ঠেকাতে পারল না কাঁচ, আলোকিত হয়ে উঠল জানালার উল্টোদিকের দেয়াল। নির্মাণকাজের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে–একসঙ্গে শব্দ করছে জ্যাকহ্যামার আর ক্রেন।

কোথাও ভাঙচুর চলছে বুঝি? চারদিকে তাকাল সোহেল।

বাইরের চত্বরের দিকে ইঙ্গিত করল হেল্ডন। নতুন করে বানানো হচ্ছে ওটা। রাত নামলে কাজ শুরু করে শ্রমিকরা যাতে ট্যুরিস্টদের কোনও অসুবিধা না হয়। …ফোনে বলেছেন নুমার হয়ে কাজ করেন আপনারা, আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

প্রি-অকশন রিসেপশনের ব্যাপারে জানতে চাইছিলাম, বলল রানা।

অনেকদিন পর বড় পরিসরে নিলামের আয়োজন করতে যাচ্ছি আমরা। আজ থেকে দুদিন পর একটা পার্টি আছে রাতের বেলায়।

আমরা দাওয়াত পেতে পারি? নিলামে উপস্থিত থাকতে চায় সোহেল।

কিছু মনে করবেন না, অতিথিদের সবাই একটা ক্লোড় গ্রুপের সদস্য। সেটার বাইরের কাউকে…আসলে…মনে হয় বুঝতে পারছেন কী বলতে চাইছি।

পার্টিতে কী হবে?

আমোদফুর্তি। তবে আমাদের উদ্দেশ্য থাকবে তার ফাঁকে ফাঁকে, নিলামের জিনিসগুলোর ব্যাপারে অতিথিদের জ্ঞান দেয়া। এবং তাদের পারস্পরিক পরিচিতিটা যাতে বাড়ে সে চেষ্টা করা।

তাতে লাভ?

ধূর্ত হাসি দেখা গেল হেন্ডনের চেহারায়। আমরা আসলে অতিথিদের দম্ভ বাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। তার ফলে মালের দাম অনেক বেশি পাই। কয়েক শ অথবা কয়েক হাজার বছরে যা দেখেনি লোকে, তা নিজের বাড়িতে নিয়ে সাজানোর জন্য রীতিমতো কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু কেউ বলতে পারবে না অন্যায় করছি আমরা। জাদুঘরের লাভের জন্য করা হয় ওসব। নিলামের আগে অন্য কোথাও দাওয়াত করে খাওয়ানো হয় অতিথিদের। সেই পয়সা কৌশলে উসুল করে নিই তাদের পকেট থেকেই।

এবার কী কী জিনিস নিলাম করবেন আপনারা?

বলা যাবে না–জাদুঘর কর্তৃপক্ষের নিয়ম। কিছু মনে করবেন না।

নিয়ম? বুঝলাম না।

চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে হেল্ডনের চেহারায়। দেখুন, ঐতিহাসিক জিনিস নিয়ে দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে মারামারি-কাড়াকাড়ি লেগে ছিল, আছে এবং থাকবে। আমাদের কারবারই হলো ওসব জিনিস নিয়ে। তাই নিলামের আগে কী বেচতে যাচ্ছি তা ঢাকঢোল পিটিয়ে জানানো হয় না। যা বেচাবিক্রি হবে, নিজেদের মধ্যে হবে।

তারমানে মামলা-মোকদ্দমার আশঙ্কা করছেন আপনারা?

হ্যাঁ।

হেন্ডনের দিকে তাকিয়ে আছে রানা। কেন যেন মনে হচ্ছে ওর, সত্যি কথা বলছে না লোকটা। মনে হচ্ছে, কিছু একটা গোপন করছে। খোলস ছেড়ে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল

হেল্ডনের কয়েকটা ফটোগ্রাফ দিয়েছে ওকে লামিয়া, ওগুলো বের করে রাখল লোকটার সামনে।

কী দেখছি আমি এসব? জিজ্ঞেস করল হেল্ডন, ভাজা মাছ উল্টে খেতে না-জানার ভাব চেহারায়।

আপনারই ছবি। অথচ আপনিই জানতে চাইছেন কী দেখছেন। ছবির টুইডের জ্যাকেটের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে। আপনার গায়ে এখন যেটা আছে সেটা।

তো?

 একটা ফটোগ্রাফ আলাদা করল রানা, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল হেল্ডন বাদে ছবির বাকিদেরকে। এদেরকে চেনেন?

ইশারায় ডারহামকে দেখাল হেল্ডন। শখের ট্রেজার হান্টার আর অ্যান্টিক কালেক্টর-নিজের পরিচয় দেয়ার সময় আমাকে তা-ই বলেছে সে। তবে আসলে নাকি ডাক্তার। বাকিরা ওর কলিগ। কিন্তু…আমাকে কেন প্রশ্ন করা হচ্ছে এসব ছবির ব্যাপারে?

কারণ লোকটা শুধু ডাক্তারই না, একজন সন্দেহভাজন টেরোরিস্টও। লিনোসায় গতকাল যে-ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে ওই লোকের হাত থাকতে পারে ভেবে খোঁজা হচ্ছে। ওকে। ছবির বাকিরা ওর চ্যালা হতে পারে।

সাদা হয়ে গেল হেল্ডনের চেহারা। টিভি চ্যানেলগুলোর বদৌলতে ইতিমধ্যে জানা হয়ে গেছে লিনোসার ঘটনাটা। টায়ানার বিস্ফোরণকে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে।

বলল, টেরোরিজম নিয়ে কিছু শুনিনি আমি। ভেবেছিলাম, লিনোসার ঘটনাটা একটা রাসায়নিক দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু না।

কিন্তু আসল ঘটনা তা না, বলল সোহেল।

ঢোক গিলল হেল্ডন, খাকারি দিয়ে পরিষ্কার করল গলা। আমি…আসলে বুঝতে পারছি না আপনারা আমাকে দিয়ে কী বলাতে চাইছেন। আমি ওই লোকের নামটা পর্যন্ত মনে করতে পারছি না।

ডারহাম, বলে দিল রানা।

 কিছু বলল না হেল্ডন, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল জানালার দিকে।

যারা এই ছবি তুলেছে তারা নিশ্চিত করে বলেছে, বলছে রানা, কমপক্ষে তিনবার বৈঠক করেছেন আপনি ডারহামের সঙ্গে। এতবার কথা বলার পরও ওর নাম ভুলে গেছেন? আপনার সঙ্গে এতবার কথা বলল কেন ডারহাম?

দীর্ঘশ্বাস ফেলল হেল্ডন, এদিকওদিক তাকাচ্ছে-যেন সাহায্যের আশায় খুঁজছে কাউকে অথবা কোনওকিছু। হঠাৎ করেই বলল, পার্টিতে আমন্ত্রণ চাইছিল। আমি বলে দিয়েছি সম্ভব না।

কেন?

কারণটা আগেও বলেছি।

চেয়ারে হেলান দিল রানা। দুই লক্ষ ইউরোর বিনিময়েও?

কিছুটা যেন চমকে উঠল হেল্ডন, তবে সামলে নিল নিজেকে। এক মিলিয়নের বিনিময়েও না।

আমাদের কাছে খবর আছে আপনাকে ঘুষ দেয়ার জন্য টাকাটা নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে এনেছে ডারহাম, আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ল রানা। টাকাটা নিয়ে ডারহাম যা চাইছে তা ওর হাতে তুলে দেয়ামাত্র আপনার হাতে পরপারের টিকেট ধরিয়ে দেবে সে। অথবা ওর দলের অন্য কেউ। দুলক্ষ ইউরোর দুহাজারও খরচ করার সময় পাবেন না।

কিছু বলল না হেন্ডন। চুপ করে বসে আছে, দেখে মনে হচ্ছে রানার কথাগুলো ভাবিয়ে তুলেছে ওকে।

আমার মনে হয় ব্যাপারটা টের পেয়েছেন আপনি নিজেও, আবারও আন্দাজে ঢিল মারল রানা। তা না হলে তখন খড়খড়ি দিয়ে উঁকি দিতেন না। বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছেন–আসলে ঘাবড়ে আছেন।

 আমি ওদেরকে কিছু দিইনি, একটুখানি হলেও ভেঙে পড়েছে হেন্ডন, কিচ্ছু না। আমি ওদেরকে চলে যেতে বলেছি। কিন্তু ওরা…আপনারা বুঝতে পারছেন না… কথা শেষ করল না, একটা ড্রয়ার খুলে ভিতরে হাতড়াচ্ছে।

সাবধান! সতর্ক করল সোহেল।

পিস্তল-রিভলভার কিছু বের করছি না, হেন্ডনের কণ্ঠে তেজ। অ্যান্টাসিডের একটা প্রায়-খালি বোতল বের করল, হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওটার দিকে।

আপনাকে বাঁচাতে পারব আমরা, বলল রানা। আপনি চাইলে যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেব আপনাকে। ওরা আগলে রাখবে আপনাকে। তবে তার আগে আমাদেরকে সাহায্য করতে হবে।

বোতল থেকে দুটো অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট বের করে মুখে দিল হেন্ডন। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে বিচলিত হয়ে পড়েছে। একটা রাইটিংপ্যাড টেনে নিয়ে পাতা ছিঁড়ল, কলম দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কী যেন লিখছে। আসলে মিশর থেকে আনা…মামুলি আর কমদামি কয়েকটা আর্টিফ্যাক্ট…

কথা শেষ করতে পারল না সে। ভীষণ একটা যান্ত্রিক গর্জন শোনা গেল নিচের চত্বরে, দাঁড়িয়ে গেল রানার ঘাড়ের লোম। চট করে তাকাল জানালার দিকে। একটা ছায়া যেন ধেয়ে আসছে।

সাবধান! চিৎকার করে উঠল ও, চেয়ার থেকে ডাইভ দিয়ে মেঝেতে পড়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে জানালা ভেঙে দুরমুশের মতো ভিতরে ঢুকে পড়ল একটা ক্রেনের হুক-ব্লকসহ জিবের খানিকটা।

টুকরো টুকরো কাঁচ ছিটকে পড়ল মেঝের এখানে সেখানে, ধুলোর একটা চাদর আস্তে আস্তে ঢেকে দিচ্ছে ঘরের ভিতরটা। আরও আগে বাড়ল হুক-ব্লক আর জিব, আরও ইট ভেঙে হেন্ডনের ডেস্কটাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে উল্টোদিকের দেয়ালের কাছে। ভারী হুকের ধাক্কায় ডেস্কের সঙ্গে আটকা পড়েছে হেল্ডন, চেয়ারসহ দেয়ালের দিকে এগিয়ে চলেছে সে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। একছুটে এগিয়ে গেল হেন্ডনের দিকে, দুহাতে থাবা দিয়ে সরিয়ে আনল লোকটাকে। এমন সময় জিবটা গিয়ে আঘাত করল ঘরের ছাদে, ভেঙে পড়ল একদিকের ছাদ।

চট করে হেন্ডনের দিকে তাকাল রানা। চেহারা জায়গায় জায়গায় কেটে গেছে লোকটার। নাক ভেঙে গেছে, ঠোঁট থেঁতলে গেছে, ভেঙেছে কয়েকটা দাঁত। মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেছে, যেন বুঝেও বুঝতে পারছে না কী ঘটছে। বেঁচে আছে, কিন্তু নিশ্চল হয়ে গেছে পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো। ওকে মেঝের এককোনায় শুইয়ে দিল রানা। সরে আসতে যাবে, এমন সময় খেয়াল করল, এক হাত মুঠ করে ভিতরে রাইটিংপ্যাড-থেকে-ছেঁড়া কাগজটা ধরে আছে হেল্ডন। চট করে কাগজটা ছাড়িয়ে নিল রানা, ঢুকিয়ে রাখল পকেটে।

সরে যা! শোনা গেল সোহেলের চিৎকার।

সঙ্গে সঙ্গে একলাফে চার-পাঁচ হাত দূরে পড়ল রানা, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল ও সেখান দিয়ে জোরে বেরিয়ে গেল ক্রেনের হুক-ব্লক। হেল্ডন যেখানে শুয়ে আছে সেখান থেকে কয়েক ফুট উপরের দেয়ালে আঘাত করল ওটা। খসে পড়ল একগাদা পলেস্তারা।

জানালাটা যেদিকের দেয়ালে ছিল সেখানে বেশ বড় একটা ফোকর দেখা যাচ্ছে। একছুটে ওটার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল রানা, সাবধানে উঁকি দিল বাইরে। ক্রেনের ক্যাবের ভিতরে বসে আছে এক লোক, জিবটা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। ওর পাশে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন, হাতে সাবমেশিনগান।

রানাকে দেখে ফেলল সাবমেশিনগানওয়ালা। সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র উঁচু করল সে, টান দিল ট্রিগারে। কী ঘটতে যাচ্ছে তা আগেই বুঝে নিয়েছে রানা, চট করে সরে গেল আড়ালে। একটানা ছুটে আসা বুলেটগুলো একাধিক গর্ত তৈরি করল দেয়ালে।

পকেট থেকে স্যাটেলাইট ফোন বের করেছে সোহেল, জরুরি গলায় কথা বলছে কারও সঙ্গে। হঠাৎ করেই কথা থামিয়ে নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে বাধ্য হলো সে, কারণ ওই ফোকর দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়েছে আরও বুলেট–সমানে গর্জন করছে সাবমেশিনগানটা।

আসলে কাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হচ্ছে, বুঝে গেছে রানা। ঝুঁকি নিয়ে আরেকবার উঁকি দিল ও ফোকর দিয়ে। চত্বরের আশপাশে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করছিল পথচারীরা, এখন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে–ওদের উদ্দেশে দুঝাঁক ফাঁকা গুলি করেছে সাবমেশিনগানওয়ালা। ক্রেনের ক্যাব ছেড়ে নেমে পড়েছে দুই গুণ্ডা, দৌড়ে পালাচ্ছে এখন।

হেল্ডনের সঙ্গে থাক তুই, সোহেলকে বলল রানা, আমি আসছি। সোহেল কিছু বলার আগেই লাফ দিল ফোকর দিয়ে, দুহাতে আঁকড়ে ধরল ক্রেনের জিব।

ওটা বেয়ে যত জলদি সম্ভব নেমে যাচ্ছে।

.

০৯.

 দুজন না, গুণ্ডা আসলে তিনজন। তৃতীয়জনকে আগে খেয়াল করতে পারেনিনা। রাস্তার অন্যপারে এককোনায় পার্ক করে রাখা মাইক্রোভ্যানের দিকে দৌড়াচ্ছে ওরা।

জমিন থেকে সাত-আট ফুট উপরে থাকতে জিবের স্টিল বিম ছেড়ে দিল রানা। অনতিদূরে পড়ে আছে কয়েকজন বুলেটবিদ্ধ শ্ৰমিক-ক্রেনে ঢোকার জন্য ওঁদের উপর গুলি চালিয়েছে গুণ্ডারা। লোকগুলো বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে বোঝা যাচ্ছে না। ওদেরকে সাহায্য করবে কি না ভাবল রানা একটা মুহূর্ত, তারপর বাতিল করে দিল চিন্তাটা। ওরা মারা গিয়ে থাকলে কিছুই করার নেই ওর, আর যদি বেঁচে থাকে তা হলে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পথচারীরাই খবর দিতে পারবে পুলিশ বা অ্যাম্বুলেন্সকে।

আলো জ্বলে উঠল ভ্যানটার, গর্জে উঠে চালু হলো ইঞ্জিন।

ওটার পিছু ধাওয়া করার জন্য জুতসই কিছুর খোঁজে এদিকওদিক তাকাল রানা। সবচেয়ে কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটা ডাম্প ট্রাক।

একছুটে ট্রাকের কাছে হাজির হলো রানা, দরজা খুলে উঠে বসল ড্রাইভিংসিটে। ইগনিশনে চাবি ঝুলছে, ওটা মোচড় দিয়ে গিয়ার বদল করল, চেষ্টা করছে যত দ্রুত সম্ভব গতি বাড়ানোর। মাইক্রোভ্যানটার পথ রোধ করতে চায়।

কিন্তু কী গাড়ি নিয়ে এলে মাল্টার রাস্তায় সুবিধা করা যাবে তা জানে গুণ্ডারা, তাই সে-ব্যবস্থা করেই এসেছে। রানার উদ্দেশ্য টের পেয়ে চট করে সাইডওয়াকে ভ্যান তুলে ফেলল ওটার ড্রাইভার, কয়েক মুহূর্ত পর তীক্ষ্ণ মোচড় কেটে নেমে এল রাস্তায়।

ব্রেকপ্যাডেলে জোরে চাপ দিল রানা, আরেকটু হলে ধাক্কা লাগিয়ে দিয়েছিল একটা ল্যাম্পপোস্টে। ব্যাকগিয়ারে দিয়ে বনবন করে ঘোরাচ্ছে স্টিয়ারিং, এমন সময় খেয়াল করল মিউযিয়ামের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ট্রাকের দিকে ছুটে আসছে সোহেল। ট্রাক চালিয়ে সোহেলের কাছে গিয়ে থামল ও, খুলে দিল ড্রাইভিংসিটের পাশের দরজা।

 চট করে উঠে পড়ল সোহেল। ছোট কিছু পেলি না?

না। ট্রাকের গতি বাড়াচ্ছে রানা।

যাক, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো,, বলল সোহেল, তবে ক্রাইম সিন থেকে তোর কানা মামাকে নিয়ে পালানোর কারণে পুলিশ যখন গ্রেপ্তার করবে তোকে, তখন

কী জবাব দিবি?

তিন গুণ্ডাকে পাকড়াও করতে পারলে আমাদের হয়ে জবাব ওরাই দেবে।

গোঁ গোঁ করছে ট্রাকের ইঞ্জিন, তবুও গতি বাড়াচ্ছে রানা। শেষপর্যন্ত সুবিধা করতে পারবে কি না বোঝা যাচ্ছে না। হর্সপাওয়ারের বিবেচনায় ভ্যানটা ট্রাকের তুলনায় কিছু না, তারপরও চটপটে বলা যায় ওটাকে। যানবাহনের মোটামুটি ভিড় আছে রাস্তায়, ওগুলোর চিপাচাপা দিয়ে পথ করে নিয়ে ছুটতে পারছে। ওদিকে রানাকে ব্রেক চাপতে হচ্ছে বার বার, এবং যতবার ব্রেক চাপছে ততবার ভ্যানের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে। ট্রাকের।

গাড়িঘোড়ার ভিড় একটু পাতলা হওয়ামাত্র এক্সিলারেটর চেপে ধরল রানা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বরাবর হয়ে গেল প্লেয়িংফিল্ড। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ভ্যানের পশ্চাদ্দেশে তো দিতে যাবে রানা, এমন সময় কায়দা করে সরে গেল ওটার ড্রাইভার, ঢুকে পড়ল কয়েকটা গাড়ির মাঝখানে। বুঝে গেছে খোলা জায়গায় থাকলে কুলিয়ে উঠতে পারবে না ট্রাকের সঙ্গে।

কোনও কারণে গর্ত খোঁড়া হয়েছিল রাস্তার মাঝখানে-ওটাতে পড়ল ট্রাকের একটা চাকা, জোরে ঝাঁকুনি খেল ট্রাক। বডির একপাশে বাড়ি খেল রানার মাথা, একটা মুহূর্তের জন্য চোখে অন্ধকার দেখল ও। হাত থেকে ছুটে গেল স্টিয়ারিং। সামলে নিয়ে দেখল রং সাইডে চলে এসেছে ট্রাক, মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটতে যাচ্ছে উল্টোদিক থেকে আসা একটা গাড়ির সঙ্গে। বনবন করে স্টিয়ারিং ঘেরাল রানা, কিন্তু কাঁচ ভাঙার আওয়াজ পেয়ে বুঝল বারোটা বেজে গেছে মুখোমুখি গাড়ির সাইডলুকিং মিররের।

প্লেয়িংফিল্ড আবারও বরাবর হয়ে গেছে, আরও একবার ভ্যানটাকে নাগালের মধ্যে পেয়ে গেছে রানা। খেয়াল করল, বন্দর এলাকায় ঢুকে গেছে ওরা। দূরে সাগরের কালো পানির পটভূমিতে ঝলমল করছে অনেকগুলো ফিশিংবোট আর ইয়টের আলো। ওগুলোর উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ভ্যানের পেছনদিকে গুতো মারল রানা।

সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল গুলির আওয়াজ। ভ্যানের ড্রাইভার বাদে অন্য দুজনের একজন গুলি করছে। জোরে ধাক্কা খেয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে লোকটাতো মারতে যদি আর একমুহূর্ত দেরি করত রানা তা হলে খারাপ কিছু হতে পারত।

ধাক্কার কারণে চিড় ধরেছে ভ্যানের পেছনের গ্লাসে, এদিকে বুলেটটা ট্রাকের উইণ্ডশিন্ডে বীভৎস ফুটো তৈরি করে চুরমার করে দিয়েছে রিয়ারভিউমিরর। আবারও গুলি করা হলো ভ্যান থেকে, কিন্তু ট্রাকের বডিতে লালচে কমলা স্ফুলিঙ্গ ওঠানো ছাড়া আর কিছু করতে পারল না বুলেট।

স্টিয়ারিং ডানে-বাঁয়ে ঘোরাচ্ছে রানা, পিস্তলওয়ালার সহজ নিশানায় পরিণত হতে চায় না। কাজটা করতে গিয়ে গতি একটু কমে গেছে ট্রাকের, কিন্তু রানা জানে সুযোগ পেলেই দূরত্ব কমিয়ে আনতে পারবে ভ্যানের সঙ্গে। আরেকবার গুলি করা হলো, রানা আর সোহেলের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে গেল বুলেট। গুলি থেকে বাঁচতে নিজের সঙ্গের দরজা খুলে বাইরে ঝুলে পড়েছে সোহেল।

সাবধান! চিৎকার করে উঠল রানা, তীক্ষ্ণ মোচড় দিয়েছে স্টিয়ারিং-এ। এমনভাবে ঘুরিয়েছে ট্রাকের নাক, যেন সামনের পিস্তলবাজ মনে করে অ্যাক্সিডেন্ট করল ট্রাকটা। একধারের রেলিঙের বারোটা বাজিয়ে বাঁয়ের একটা সরু রাস্তায় ঢুকে পড়েছে ট্রাক, ছুটে চলেছে।

ট্রাক থেকে প্রায় পড়েই গিয়েছিল সোহেল, কোনওরকমে সামলে নিয়ে বলল, আরেকটু হলে খুনই করে ফেলেছিলি, দোস্ত! আগে থেকে সাবধান করবি না? ভ্যানটাকে আর দেখা যাচ্ছে না, সোজা হয়ে বসল সিটে, দরজা আটকাল।

করিনি?

কী? কী করিসনি?

 সাবধান করিনি, ব্যাটা বদমাইশ?

 করেছিলি তো। আমি বুঝিনি।

এবার মাথাটা একটু খাটিয়ে বল, সামনের রাস্তায় বেরিয়ে কী দেখব বলে আশা করছি?

হাতী। বলেই হাসল সোহেল। ভাবছিস, আপদ গেছে মনে করে সামনের ওই রাস্তা দিয়ে ফিরে আসবে ব্যাটারা?

ট্রাকের মেঝের সঙ্গে প্রায় চেপে ধরেছে রানা এক্সিলারেটর, ক্রুদ্ধ বুনো জন্তুর মতো গোঙাচ্ছে ইঞ্জিন।

সামনে বন্দর থেকে শহরে যাবার আর একটা রাস্তা দেখা যাচ্ছে। এটাও ওয়ান-ওয়ে।

ঝড়ের গতিতে ওখানে হাজির হলো রানা, ডানে তাকিয়ে দেখল, ফুলম্পিডে ছুটে আসছে ভ্যানটা। মেইন রোডে উঠে মুখোমুখি সংঘর্ষের মধ্যে না গিয়ে শহরের দিকেই চলতে শুরু করল। ভ্যানটা এখন ওদের পেছনে। রানার যুদ্ধংদেহী ভাবটা চলে গেছে দেখে অবাক হলেও কিছু মন্তব্য করল না সোহেল।

রিয়ারভিউ মিরর নেই, ট্রাকের সাইডলুকিং মিররের দিকে তাকিয়ে একটু একটু করে গতি কমাচ্ছে রানা। হঠাৎ বলল, ব্রেক চাপতে যাচ্ছি আমি। কথা শেষ করেই জোরে চাপ দিল ব্রেকপ্যাডেলে, একইসঙ্গে হ্যাঁচকা টান মারল ডাম্পবেডের হাইড্রলিক লিভারে।

ঝাঁকুনি খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে ট্রাক, আস্তে আস্তে উঁচু হয়ে যাচ্ছে ওটার ডাম্পবেড। কয়েক টন ভাঙা কংক্রিট, বাঁকাত্যাড়া ধাতব পদার্থ, আর নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হয় এমন সব আজেবাজে জিনিস গড়িয়ে পড়ল রাস্তায়, ছড়িয়ে গিয়ে রোড-ব্লক তৈরি করল রাস্তা জুড়ে।

ট্রাকটাকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে বনবন করে স্টিয়ারিং ঘোরাতে শুরু করেছিল ভ্যানের ড্রাইভার, ইচ্ছা ছিল পাশ কেটে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু কংক্রিটের ঢল স্তব্ধ করে দিল ওটার সামনের বাম চাকাকে, সঙ্গে সঙ্গে একদিকে কাত হয়ে গেল ভ্যানটা। গ্রিল ভেদ করে রেডিয়েটরে ঢুকে পড়ল আজেবাজে কিছু জিনিস, প্রচণ্ড গতিতে ছিটকে এসে উইণ্ডশিল্ডটাকে চুরমার করে দিল কিছু ধাতব পদার্থ। কয়েক শ কেজি কংক্রিটের ঠেলায় শেষপর্যন্ত একদিকে কাত হয়ে উল্টে গেল ভ্যানটা।

ট্রাকের দরজা খুলে লাফিয়ে রাস্তায় নামল রানা, ছুটে চলেছে ভ্যানের দিকে। ওর পাশে দৌড়াচ্ছে সোহেল, অস্ত্র হিসেবে একটা ক্রৌবার তুলে নিয়েছে হাতে।

ভ্যানের কাছে গিয়ে দেখল ওরা, সমানে বাষ্প বের হচ্ছে। ওটার রেডিয়েটর থেকে। বাতাসে গ্যাসোলিনের তীব্র গন্ধ।

প্যাসেঞ্জার সিটে বসা এক গুণ্ডা মারা গেছে। কংক্রিটের কোনও ব্লক ছিটকে গিয়ে ছেচে দিয়েছে লোকটার মাথা, কিছুটা মগজ বেরিয়ে এসেছে।

ভ্যানের ভিতরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে সোহেল। বাকি দুজন কই?

দেখা গেল, দূরে ছুটে পালাচ্ছে দুটো ছায়ামূর্তি, ফোর্ট সেইন্ট মার্কাসের দিকে যাচ্ছে।

ওই যে! দৌড়াতে শুরু করল রানা।

.

দুর্গের উদ্দেশে দৌড়াচ্ছে ডারহাম, বড় রকমের মানসিক ধাক্কা খেয়েছে। অবস্থা খারাপ থেকে আরও খারাপ হচ্ছে।

গোপন ডিভাইস বসানো ছিল হেল্ডনের অফিসে, লোকটা আরেকটু হলে সব ফাঁস করে দিয়েছিল নুমার দুই এজেন্টের কাছে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ডারহাম, হেল্ডনকে খুন করতে বলে সঙ্গে-থাকা আমেনথেসের লোকদেরকে। অফিসের যে দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে বসত হেন্ডন, সেটাতে যেভাবে হামলা করা হয়েছে, তাতে এতক্ষণে বেঁচে থাকার কথা নয় লোকটার।

ওই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। ডাম্প ট্রাকটা যত ঘাপলা লাগাল। কল্পনাও করেনি ডারহাম, ওভাবে ধাওয়া করা হবে ওদেরকে। ভাবেনি, হঠাৎ উল্টে যাবে ভ্যান, হাত থেকে উধাও হয়ে যাবে সঙ্গে-থাকা রিভলভার।

সাহায্য দরকার আমাদের, চেঁচিয়ে বলল সে ওর সঙ্গীকে। রেডিওতে যোগাযোগ করো।

 ডারহামের সঙ্গের লোকটার বেল্টে রেডিও ঝুলছে এখনও। দৌড়াতে দৌড়াতেই ওটা হাতে নিল সে। স্ল্যাগো, চার্লি বলছি। সাহায্য দরকার।

কী হয়েছে? রেডিওতে শোনা গেল স্ল্যাগোর উদ্বিগ্ন কণ্ঠ।

নুমার দুই লোকের সঙ্গে দেখা করেছে-হেল্ডন। আরেকটু হলে আমাদের সব কথা ফাঁস করে দিতে যাচ্ছিল সে। ওকে পরপারে পাঠানোর চেষ্টা করেছি আমরা এবং সম্ভবত সফল হয়েছি। কিন্তু এখন নুমার সেই দুই এজেন্ট পিছু ধাওয়া করছে আমাদের।

মেরে ফেলো ওদেরকেও।

সম্ভব না। আর্মস আছে ওদের সঙ্গে।

কথাটা মিথ্যা, কিন্তু তাতে কী? যাদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানানো হচ্ছে, তারা তো জানছে না সেটা!

আমরা আহত, বলে চলল চার্লি। একজন মনে হয় মারা গেছে। কিছু একটা করো জলদি!

এখন কোথায় আছ তোমরা?

ফোর্ট সেইন্ট মার্কাসের দিকে যাচ্ছি।

যাও। ওখানে একটা খাল আছে, তোমাদের জন্য বোট রেডি রাখার ব্যবস্থা করছি। আগে জনমের শিক্ষা দেবে ওই এজেন্ট দুটোকে, তারপর বোটে উঠবে।

.

১০.

 দুই হামলাকারীর পিছু ধাওয়া করতে অসুবিধা হচ্ছে না রানা বা সোহেলের। কিন্তু শুরু থেকেই এগিয়ে ছিল, দুর্গের ভিতরে ঢুকে পড়ে গায়েব হয়ে গেল ওরা।

ক্ষিপ্র গতিতে ছুটছিল রানা, গতি কমাল। এখন জগিং করার ভঙ্গিতে দৌড়াচ্ছে। সোহেলকে পাশে নিয়ে দুর্গের পরিধিপ্রাচীরের ভিতরে ঢুকে পড়ল একসময়। এদিকওদিক তাকাচ্ছে।

দুর্গের ভিতরে জায়গায় জায়গায় জ্বলছে অত্যুজ্জ্বল কমলা আলোর একাধিক স্পটলাইট, চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ছায়ায় ঢাকা-পড়া কোনওকিছু আসলে কী তা প্রথম দেখায় ঠিক বোঝা যায় না। কোনাকাঞ্চি বা সরু পথের কাছ থেকে সরে গেল রানা। ওখানে সহজেই ঘাপটি মেরে থাকতে পারে যে কেউ।

রানা যে-অ্যাঙ্গেল থেকে তাকাচ্ছে সেখান থেকে মনে হচ্ছে, দুর্গের মুখ বন্দরের দিকে ফিরিয়ে ওটা জোর করে জমিনের উপর বসিয়ে দিয়েছে কেউ। বিয়ে বা জন্মদিনের মাল্টিলেয়ার কেক যেমন হয়, দুৰ্গটা দেখতে সে-রকম।

দৌড়ানোর গতি আরও কমাল রানা। মূল দুর্গের দেয়াল এখন ওর ডানদিকে, আর বন্দরটা বাঁ দিকে। সামনে তালাবদ্ধ একটা দরজা দেখতে পেয়ে পথ বদল করল ও, বাঁক নিয়ে এগিয়ে চলেছে। অনতিদূরের একটা দেয়ালের গায়ে সরু গিরিখাতের মতো বানানো আছে কয়েক ধাপ সিঁড়ি, ওটার সামনে আরেকটা দরজা। ওটাতেও তালা ছিল, এখন ভাঙা।

ভিতরে ঢুকেছে ওরা, নিচু গলায় বলল সোহেল।

আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দরজার পাল্লায় ঠেলা দিল রানা, উপরের দিকে একবার তাকিয়ে উঠতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে। দেয়ালের গা ঘেঁষে সাবধানে উঠছে। শেষ ধাপে পা রাখা মাত্র যেন অন্ধকার কুঁড়ে বের হলো একটা লোক, হাতের তলোয়ার দিয়ে কোপ মেরেছে রানার ঘাড় সই করে।

সাবধান ছিল বলে বেঁচে গেল রানা। একটু ঝুঁকে একদিকে কাত হয়ে গেল ও, এড়াতে পারল কোপটা। তলোয়ারটা দুহাতে ধরে আবারও কোপ মারতে যাচ্ছিল লোকটা, ভোতা কিন্তু ভারী একটা আওয়াজ শোনা গেল এমন সময়-হাতের ক্রৌবার সজোরে ছুঁড়ে মেরেছে সোহেল হামলাকারীর মাথায়।

ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল লোকটা, বেসামাল হয়ে গেছে। সুযোগ নিতে দেরি করল না রানা। একলাফে এগিয়ে গেল খানিকটা, বাঁ পায়ে ভর দিয়ে ডান পায়ে প্রচণ্ড লাথি হাকাল প্রতিপক্ষের সোলার প্লেক্সাসে। হুক শব্দ করে কুঁজো হয়ে গেল লোকটা, কয়েক পা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। বেরিয়ে এসেছে ফুসফুসের সব বাতাস, আলগা হয়ে গেছে হাতেধরা তলোয়ার। উবু হয়ে ক্রৌবার তুলে নিল রানা।

স্পটলাইটের আলো উজ্জ্বল আভা তৈরি করেছে একদিকের দেয়ালে, সেটা যেন ঠিকরে আসছে এদিকে। কায়দা করে একটা আর্মারস্যুট দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে কাছেই, তলোয়ারটা ছিল ওটারই হাতে, আলগা করা হয়েছে ওটা।

কাজটা যে করেছে তাকে চিনতে পারল রানা। তুমিই ডারহাম, না?

মাথা নেড়ে নিজের পরিচয় অস্বীকার করল ডারহাম। কোঁকাচ্ছে–জায়গামতো লেগেছে রানার লাথি।

কোমায় চলে গেছে লিনোসার মানুষরা, বলে চলল রানা, ওই অসুখের অ্যান্টিডোট আছে তোমার কাছে। আমাদের হাতে তুলে দাও ওটা।

জবাবে তলোয়ারটা দুহাতে ধরে দুর্বল ভঙ্গিতে মাথার উপর তুলল ডারহাম। এক পা এগিয়ে এসে আবার কোপ মারল রানাকে।

ক্রৌবার দুহাতে ধরে লাঠিখেলার কায়দায় আঘাতটা ঠেকাল রানা, শোনা গেল ঠং শব্দ। একমুহূর্ত দেরি না করে সাইডকিক মারল ও ডারহামের কানে, বেসামাল করে দিল লোকটাকে। ব্যালেন্স ফিরে পেয়ে ক্রৌবার দিয়ে জোরে বাড়ি মারল লোকটার ডান হাতের কব্জিতে। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল লোকটা, তলোয়ার ছেড়ে দিয়েছে হাত থেকে। এক লাথিতে ওটা সোহেলের দিকে পাঠিয়ে দিল রানা।

তলোয়ারটা বরং তুই নে, বলল সোহেল। খুঁজে বের কর এই ব্যাটার পার্টনারকে। ততক্ষণে আমি একটু খাতিরযত্ন করি ডাক্তার সাহেবের।

ক্রৌবার সোহেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তলোয়ারটা নিল রানা। ডাহামকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় জোরে একটা ঘুসি মারল লোকটার বাঁ কানে-যেখানে সাইডকিক মেরেছিল একটু আগে ঠিক সেইখানে। আরেকবার চিৎকার করে উঠল ডারহাম, হাঁটু গেড়ে বসে পড়তে বাধ্য হয়েছে।

কিন্তু যতটা না ব্যথা পেয়েছে তারচেয়ে বেশি ব্যথা পাওয়ার ভান করেছে ডারহাম; রানা চলে যাওয়ামাত্র উঠে দাঁড়িয়ে ছুট লাগাল সোহেলের উদ্দেশে–দুহাতে জাপ্টে ধরতে চায় ওকে। প্রস্তুত ছিল সোহেল, নাগালের মধ্যে পাওয়ামাত্র ক্রৌবারটা ব্যাট আর ডারহামের কপালটাকে বল ধরে নিয়ে ছক্কা হাঁকাল। থমকে গেল ডারহাম, চিৎকার ছাড়তে বাধ্য হলো প্রচণ্ড ব্যথায়।

পরেরবার মারব গর্দানে, হুমকি দিল সোহেল।

মাতালের মতো টলছে ডারহাম, দুর্বল কায়দায় একের পর এক ঘুসি মারছে বাতাসে। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে উপহাসের দৃষ্টিতে লোকটাকে দেখছে সোহেল। ডারহামকে নাগালে পাওয়ামাত্র পা চালাল, থেঁতলে দিল লোকটার ঠোঁট। তারপরও যখন লড়াইয়ের খায়েশ গেল না ডারহামের, ক্রৌবারটা দুহাতে ধরে সজোরে নামিয়ে আনল লোকটার ডান কাঁধের উপর। হাড় ভাঙার আওয়াজ পাওয়া গেল।

যে-হাড়টা ভেঙেছে সেটার নাম কী, ডাক্তার সাহেব?

কোন্ শক্তির কারণে কে জানে, এখনও দাঁড়িয়ে আছে ডারহাম, তবে একদিকে কাত হয়ে গেছে, ডান হাতটা ঝুলছে আংশিক-পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো।

এসো, এবার তোমার বাঁ হাতটাও অবশ বানিয়ে দিই, আগে বাড়ল সোহেল।

না, না, বাঁ হাত তুলে আর্জি জানাল ডারহাম, আর মেরো না, প্লিয। হার মানছি। বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সোহেলের দিকে, বোঝার চেষ্টা করছে ঠিক কতখানি প্রস্তুত অবস্থায় আছে সোহেল। ভালো হাতটা দিয়ে হঠাৎ থাবা চালাল প্যান্টের পকেটে, বের করে এনেছে হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ। নিডলক্যাপটা দাঁতে কামড়ে আলগা করেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সোহেলের উপর।

ভুল করেছে ডারহাম। দেখে যা-ই মনে হোক, আসলে টান টান অবস্থায় ছিল সোহেল। ক্রোবার দিয়ে প্রচণ্ড বাড়ি মারল ডারহামের বাম কব্জিতে, গুঁড়ো করে দিল ওটা। সিরিঞ্জটা আলগা হয়ে গিয়েছিল লোকটার হাত থেকে, ওটা লুফে নিল। ক্রোবার ছেড়ে দিয়ে সুঁই গেঁথে দিল ডারহামের রানে, চাপ বসাল প্লাঞ্জরে।

সিরিঞ্জে কী ছিল তা ডারহামই ভালো জানে, কিন্তু যা ছিল তা কাজ করল তৎক্ষণাৎ। চোখ উল্টে গেল ডারহামের, ডানদিকে কাত হয়ে পড়ে গেল সে। আর নড়ছে না।

ডাক্তার সাহেব, বিড়বিড় করছে সোহেল, তোমাকে বইতে হলে মনে হয় অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। ঝুঁকে পড়ে পালস্ দেখল ডারহামের, লোকটা বেঁচে আছে বুঝে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সিরিঞ্জ বের করে নিল লোকটার রান থেকে, সুঁই ভেঙে ফেলে ঢোকাল নিজের পকেটে।

জানতে হবে কী ছিল এটাতে, বিড়বিড় করল আবারও।

.

ডানহাতে তলোয়ার নিয়ে এদিকওদিক তাকাতে তাকাতে এগিয়ে চলেছে রানা, খুঁজছে ডারহামের সঙ্গীকে।

লোকটার কাছে সম্ভবত কোনও ফায়ারআর্ম নেই। অথবা থাকলেও বুলেট শেষ। নইলে এতক্ষণে একটা-দুটো গুলি চালাতই। কিন্তু তার মানে এই নয়, রানার জন্যে কোথাও ওঁৎ পেতে নেই সে।

আরেকটু এগোতে অন্যদিকের সিঁড়ির কাছ থেকে আলগা কাকরে পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। দেয়ালের সঙ্গে গা মিশিয়ে ফেলল রানা, প্রস্তুত অবস্থায় রেখেছে তলোয়ারটা। দেয়ালের কোনার কাছে এসে সাবধানে উঁকি দিল। অনতিদূরে সর্পিলাকৃতি সিঁড়িটা উঠে গেছে দুর্গের উপরতলায়। সিঁড়ির প্রতিটা বাকের সঙ্গে যেন জড়াজড়ি করে আছে অন্ধকার, ঠিকমতো ঠাহর করা যায় না কিছু।

মূর্তির মতো স্থির হয়ে আছে রানা, কান খাড়া। কয়েক মুহূর্ত আর কোনও আওয়াজ নেই। খুব সম্ভব নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে প্রতিপক্ষও, বোঝার চেষ্টা করছে কেউ পিছু নিয়েছে কি না। হঠাৎ ধৈর্যচ্যুতি ঘটল লোকটার, সিঁড়ির আলগা কাঁকরে আবারও শোনা গেল ওর পদশব্দ। দ্রুত পার হওয়ার চেষ্টা করছে সিঁড়ির শেষ কয়েক ধাপ।

ওদিকে ছুটে গেল রানা, তলোয়ারটা বাগিয়ে ধরে উঠতে শুরু করেছে। উপরতলায় হাজির হওয়ামাত্র দেখল, সমতল গানারি ডেক ধরে ছুটে পালাচ্ছে একজন লোক। যেখানে যাচ্ছে সে, সমুদ্রের দিকে মুখ করে কয়েকটা কামান বসানো আছে সেখানে।

উসাইন বোল্টের গতি তুলে ছুট লাগাল রানা। লাফিয়ে পার হলো খাটো একটা দেয়াল, চত্বর ধরে আড়াআড়িভাবে এগোচ্ছে পলায়নরত লোকটার দিকে। ছুটন্ত অবস্থায় পিছন ফিরে রানাকে দেখতে গিয়ে ভুল করল লোকটা, হোঁচট খেল একটা র‍্যামপার্টের সঙ্গে, সঙ্গে সঙ্গে উল্টে গিয়ে আছড়ে পড়ল আট ফুট নিচের আরেকটা ডেকে। আর্তনাদ করে উঠল ব্যথায়।

র‍্যামপার্টের সারির কাছে পৌঁছে গেল রানা, ঝুঁকে তাকাল নিচের দিকে। কিনারার আরেকটু কাছে গিয়ে কুঁজো হলো খানিকটা, তারপর লাফিয়ে পড়ল নিচে। কিন্তু ততক্ষণে বাঁচার তাগিদে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে ফুট চল্লিশেক দূরে চলে গেছে ওর টার্গেট, বেঁটে একটা দেয়ালের ওপর চড়ে বসে লাফিয়ে নামতে যাচ্ছে ওপারে।

ঘাড় ঘুরিয়ে আরেকবার রানাকে দেখল লোকটা, তারপরই লাফ দিল।

দেয়ালটার কাছে হাজির হওয়ামাত্র একটা ঝপাৎ আওয়াজ কানে এল রানার। উঁকি দিয়ে তাকাল নিচের দিকে।

ফুট ত্রিশেক নিচে খাড়া শেষ হয়েছে দুর্গের দেয়াল, তারপর থকথকে কাদামাটির খানিকটা বিস্তার। এরপরই শুরু হয়েছে সরু খাল। বড় বড় পাথরের ব্লক ফেলে সাগরের মুখ সঙ্কুচিত করে ফেলা হয়েছে খালের মোহনায়, লোকটা সাঁতার কেটে এগিয়ে চলেছে ওদিকে। ওর জন্য একটা ব্লকের আড়ালে অপেক্ষা করছে মোটরবোট।

আফসোস লাগছে রানার-প্রতিপক্ষ নিরস্ত্র হওয়ার পরও ধরতে পারল না। এখন ওর পক্ষে ত্রিশ ফুট নিচে লাফিয়ে পড়া সম্ভব না। যদি তা করেও, সাঁতার কেটে লোকটাকে ধরার আগেই মোটরবোটে উঠে পড়তে পারবে সে। তখন বোট থেকে হয় গুলি করা হবে রানাকে, নয়তো স্রেফ গায়েব হয়ে যাবে সেটা। কাজেই নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল, সাঁতার কেটে বোটের কাছে হাজির হলো লোকটা। ওকে তুলে নেয়া হলো সেটাতে। গর্জন করে উঠল শক্তিশালী ইঞ্জিন। কয়েক মুহূর্ত পরই কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল বোট রাতের অন্ধকারে।

সর্পিল সিঁড়িটা বেয়ে নিচে নেমে এল রানা, হাজির হলো সোহেলের কাছে।

খোলা একটা ল্যাণ্ডিং-এ দাঁড়িয়ে আছে সোহেল, ওটা মুখ করে আছে বন্দরের দিকে। অজ্ঞান ডারহামকে ইতোমধ্যে খাড়া করে ফেলেছে ও, লোকটার একটা হাত তুলে নিয়েছে নিজের ঘাড়ে। সোহেলকে সাহায্য করার জন্য পা বাড়াতে যাচ্ছিল রানা, গুলির শব্দটা শোনা গেল এমন সময়।

তিনটে ঘটনা ঘটল একইসঙ্গে।

একটা ঝাঁকুনি খেল ডারহামের শরীরটা।

লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে ডাইভ দিল সোহেল, গড়িয়ে সরে যাচ্ছে সবচেয়ে কাছের আড়ালের উদ্দেশে।

হাত থেকে তলোয়ার ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রানাও, আড়াল নেয়ার উদ্দেশ্যে গড়াতে শুরু করেছে।

কোন্ শালা গুলি করে, রে? বলল সোহেল।

তোর সব শালাকে চিনে রাখিনি আমি।

গুলির আওয়াজ ভয় পাইয়ে দিয়েছে কয়েকটা পাখিকে, তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করেছে ওরা। কেউ কেউ ডাক ছাড়ছে আর প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে দু-চারটে কুকুর। এ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই।

সোহেল বলল, ডারহাম বোধহয় বেঁচে নেই, রে।

নিশ্চয়ই নবজীবন দান করার জন্যে গুলি করা হয়নি ওকে?

গুলি চালানো হয়েছে কোত্থেকে?

খুব সম্ভব ডক-এরিয়া, ঝুঁকি নিয়ে মাথা একটুখানি উঁচু করল রানা।

মোটরবোটটা চলে গেছে। ওটা যদি ফিরে আসত তা হলে ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা যেত। ডক-এরিয়ার যতটুকু দেখতে পাচ্ছে রানা, কোথাও এমন কোনও প্ল্যাটফর্ম নেই যেখানে পজিশন নিয়ে দূরপাল্লার রাইফেল দিয়ে গুলি করা যেতে পারে। ওই জায়গা ছাড়িয়ে দূরে দেখা যাচ্ছে আরেকটা দুর্গ, ওটার সমতল গানারি প্লযাটাও চোখে পড়ে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গোটাকয়েক দালানও দেখা যায়।

মাথা নামাল রানা। তোর শালার নিশানা দেখেছিস?

না দেখলে কোন্ শখে গড়াগড়ি খাচ্ছি মাটিতে?

আমাদের দুজনকে অনায়াসে শুইয়ে দিতে পারত সে। তা না করে শেষ করে দিল ডারহামকে।

প্রফেশনালরা যেমনটা করে।

প্যাঁ-পোঁ আওয়াজ শোনা গেল। বন্দর এলাকার দিকে ছুটে আসছে পুলিশের কয়েকটা গাড়ি। সম্ভবত খালের কাছে হাজির হয়েছে পুলিশের কোনও পাওয়ারবোট, প্যাঁ-পোঁ আওয়াজ করছে ওটাও।

রোগী মরিবার পর ডাক্তার আসিল, বলল সোহেল।

উপুড় হয়ে ছিল রানা, এবার চিৎ হলো। ডারহাম এত সহজ টার্গেটে পরিণত হলো কীভাবে, বুঝতে অসুবিধা হয় না। স্পটলাইটের আলো দেয়ালে ঠিকরে হলুদাভ উজ্জ্বল আভায় ভরিয়ে তুলেছে ল্যাণ্ডিং-এর এই জায়গা। টার্গেটকে আলাদা করে চিনতে অসুবিধা হয়নি স্নাইপার লোকটার।

পকেটে রাখা হেন্ডনের নোটটার কথা মনে পড়ে গেল রানার। একটু কসরত করে বের করল ওটা।

হেল্ডনেরই রক্তে ভিজে গেছে চিরকুটের একটা প্রান্ত। তবে যা লিখেছে লোকটা, তা পড়তে কোনও অসুবিধা হয় নাঃ

লুসি এল…

ভ্রূ কুঁচকে গেল রানার। এটা কার নাম? কার সঙ্গে দেখা করার কথা মুখে উচ্চারণ করতে পারেনি হেল্ডন, কিন্তু কাগজে লিখে দিয়ে গেছে?

মানুষটা…আসলে মেয়েমানুষটা…কে?

.

১১.

আমার জন্যে একটু অপেক্ষা না করেই হুলুস্থুল বাধিয়ে বসেছ, অনুযোগের সুরে রানাকে বলল লামিয়া।

কী করব, সোফায় হেলান দিল রানা, আমাদের টেনে নামানো হয়েছে এসবের মধ্যে।

মাল্টার সবচেয়ে দামি হোটেলের একটা বিলাসবহুল স্যুইটে আছে ওরা তিনজন এখন। পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল রানা ও সোহেলকে। তখন দু-এক জায়গায় যোগাযোগ করে সোহেল, সঙ্গে সঙ্গে ফোনের পর ফোন আসা শুরু হয় পুলিশ স্টেশনে। এমনকী লামিয়াও ফোন করেছিল। শেষে মেয়েটা নিজেই পুলিশ স্টেশনে গিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে রানা সোহেলকে।

একটা বড় সোফায় একসঙ্গে বসে আছে রানা আর সোহেল। লামিয়া বসেছে কাছের আরেকটা ছোট সোফায়। ওদের সামনে একটা কাঁচের-টেবিল, সেটার উপর স্কচের বোতল আর বরফ।

নিজের গ্লাসে খানিকটা স্কচ ঢেলে নিল লামিয়া, তিন টুকরো বরফ ছাড়ল। হেলান দিয়ে একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছে। হেল্ডন আর ডারহাম দুজনই মারা গেছে। ক্রেনের হুকের বাড়িতে মাথায় ভীষণ চোট পেয়েছিল হেল্ডন, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। দুটো গুরুত্বপূর্ণ সূত্র ছিল আমাদের হাতে, দুটোই হারিয়েছি।

আমার ভুলের কারণে মারা পড়েছে ডারহাম, দোষ স্বীকার করার ভঙ্গিতে বলল সোহেল। ওকে যদি তখন দাঁড় করানোর চেষ্টা না করতাম…

তুই তো আর জানতি না ডারহামকে পরপারে পাঠানোর জন্য অপেক্ষায় ছিল কেউ।

লামিয়ার দিকে তাকাল সোহেল। সিরিঞ্জে কী ছিল, জানা গেছে?

কেটামাইন। একরকমের স্ট্যাণ্ডার্ড অ্যানেসথেটিক, খুব দ্রুত কাজ করে। তবে কালো কুয়াশার মতো কিছু না।

কালো কুয়াশার অ্যান্টিডোট হওয়ার কি সুযোগ আছে। ওটার? জিজ্ঞেস করল রানা।

আমিও ভেবেছি কথাটা। খবর পাঠিয়েছি আমাদের জাহাজে, ওরা ট্রাই করে দেখেছে। কোনও লাভ হয়নি। কাজেই মাল্টায় আসার আগে যে-কানাগলিতে ছিলাম আমরা, সেখানেই রয়ে গেলাম।

পকেট থেকে হেন্ডনের নোটটা বের করল রানা। ওটার কথা সংক্ষেপে বলল লামিয়াকে। তারপর ওটা বাড়িয়ে দিল মেয়েটার দিকে। দেখো তো, নামটা পরিচিত মনে হয় কি না।

লুসি এল… বিড়বিড় করল লামিয়া, নাহ্…পরিচিত।

আমাদের কাছেও না। আমাদেরকে কিছু একটা জানানোর চেষ্টা করছিল হেল্ডন।

স্কচের গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে দিল লামিয়া। হেল্ডন চাইছিল, লুসি এল নামের কোনও মহিলার সঙ্গে দেখা করো তোমরা। নিলামে যেসব আর্টিফ্যাক্ট বেচার কথা, সম্ভবত ওই মহিলা দান করেছে ওগুলো। আবার তাকাল নোটটার দিকে। লিখতে গেল কেন হেন্ডন? তোমাদেরকে মুখে বললে অসুবিধা কী ছিল?

কথাটা ভেবেছে রানা। আমাদের সঙ্গে যখন কথা বলছিল সে, বার বার তাকাচ্ছিল অফিসরুমের এদিকে-সেদিকে। ওর সন্ত্রস্ত ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, মাইক লুকানো আছে ঘরের কোথাও। অথবা হেল্ডন হয়তো ভেবেছিল ও-রকম কিছু আছে।

তারমানে তোমাদেরকে এমন কিছু জানাতে চেয়েছে সে, যা মুখে উচ্চারণ করার সাহস হয়নি ওর।

মাথা ঝাঁকাল রানা। আমাদেরকে সাহায্য করতে চাইছিল সে, একইসঙ্গে চাইছিল নিজে যেন বিপদে না পড়ে।

ভ্রূ কুঁচকে গেছে লামিয়ার। তা হলে ওকে খুন করতে গেল কেন ওরা? সে তো ওদের মুঠোর ভিতরেই ছিল।

যে-কারণে খুন করা হয়েছে ডারহামকে, একই কারণে সরিয়ে দেয়া হয়েছে হেল্ডনকেও। আমাদের প্রতিপক্ষ আসলে কোনও সুযোগ দিতে চায়নি। …আর কোনও উপায় নেই, লুসি নামের ওই মহিলাকে খুঁজে বের করতে হবে।

 মহিলা কি হেন্ডনের বান্ধবী? বলল সোহেল। নাকি মিউযিয়াম বোর্ডের সদস্য? নাকি শুধুই একজন দাতা?

অথবা… কপাল চুলকাল রানা, অকশন পার্টিতে দাওয়াত পাওয়া কোনও গেস্ট?

খবর নিচ্ছি, বলল লামিয়া। মাল্টা বড় দ্বীপ না। লুসি নামের কেউ যদি আসলেই থেকে থাকে এখানে, তাকে খুঁজে বের করতে বেশি সময় লাগবে না। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে, ওটা কারও আসল নাম না। খুব সম্ভব ছদ্মনাম।

মেয়েটার কথায় মন নেই রানার, কী যেন ভাবছে। আমি আর সোহেল যদি যাই ওই পার্টিতে, সমস্যা আছে?

ভিতরে ঢুকতে পারবে? পাল্টা প্রশ্ন করল লামিয়া।

সোহেলের দিকে তাকাল রানা, চোখে চোখে কথা হয়ে গেল ওদের।

.

মরুভূমির পাঁচ হাজার ফুট উপর দিয়ে দুশ নট গতিতে উড়ছে পুরনো একটা ডিসি-৩, কাঁপছে সমানে। আসিফের ধারণা, কিছুটা হলেও ব্যালেন্স হারিয়েছে প্রপেলারগুলো। কোনওটা খুলে গিয়ে খসে পড়বে কি না, আশঙ্কা হলো ওর।

কো-পাইলটের যেখানে বসার কথা, সেখানে বসেছে। তানিয়া। দেখে একটুও বিচলিত মনে হচ্ছে না ওকে। বরং এত কম উচ্চতায় এত জোরে উড়ছে বলে মজা পাচ্ছে, জানালা দিয়ে একটু পর পর উঁকি দিয়ে কী যেন দেখছে। পাইলটের সিটের পেছনে আসিফকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন খালিদ।

এত জোরে যাওয়ার কোনও দরকার আছে? খালিদকে জিজ্ঞেস করল আসিফ।

আছে। বিদ্রোহীদের সহজ নিশানায় পরিণত হতে চাই না।

বিদ্রোহী? আরও বাড়ল আসিফের ঘাবড়ানি।

সৌদি আরব আর ইরান বাদে পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই তো এখন গৃহযুদ্ধের ডামাডোল। মিলিশিয়া আছে, বিদেশি এজেন্টরা আছে। মিশরে আছে মুসলিম ব্রাদারহুড আর লিবিয়ায় আছে গাদ্দাফির অন্ধভক্ত কিছু অনুসারী। ক্ষমতার জন্য লড়ছে সবাই। আমাদেরকে শত্রুপক্ষের লোক মনে করে মিযাইল ছোঁড়া হতে পারে। রাইফেল দিয়ে গুলিও করতে পারে।

সেক্ষেত্রে সড়কপথে গেলে ভালো হতো না?

আট ঘন্টা লাগত। বিমানে লাগছে মাত্র নব্বই মিনিট।

হাতঘড়ি দেখল আসিফ। পৌঁছাতে আর বেশি সময় নেই।

প্লেনটা ল্যাণ্ড করার পর বালিতে পা রেখে হাঁপ ছাড়ল সে। ওর বাড়িয়ে-দেয়া হাত ধরে নামল তানিয়া।

ল্যাণ্ড করার একটু আগে একটা শুকিয়ে-যাওয়া মরূদ্যান দেখলাম, স্বামীকে বলল তানিয়া। তুমি দেখেছ?

না, খেয়াল করিনি।

আসিফ-তানিয়ার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন খালিদ। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে একটুকরো ভূস্বর্গ থেকে প্রাকৃতিক একটা অভিশাপে পরিণত হয়েছে এই জায়গা। গাফসায় যা দেখেছি আমরা, একই ঘটনা ঘটছে সাহারার বেশিরভাগ অঞ্চলে। …চলুন ভিতরে যাই।

যেখানে ল্যাণ্ড করেছে ডিসি-৩, তার অনতিদূরে একটা মেইনবিল্ডিং। সেদিকে যাচ্ছেন খালিদ, তার পেছনে আছে আসিফ-তানিয়া। কতগুলো পাম্প আর পাইপের জট পাশ কাটালেন তাঁরা।

আসিফ অনুমান করল, ওদেরকে বেনগাজির কোনও একটা পাম্পিংস্টেশনে নিয়ে এসেছেন খালিদ।

স্টেশনে কাজ করছে বেশ কয়েকজন লোক। এক টেকনিশিয়ানকে খালিদ জিজ্ঞেস করলেন, অবস্থার কোনও উন্নতি হয়েছে?

না, বলল লোকটা, বরং অবনতি হয়েছে। পানির সাপ্লাই আরও বিশ পার্সেন্ট কমেছে। তিনটা পাম্প বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি আমরা। পানির বদলে কাদামাটি তুলে আনছিল ওগুলো।

চেহারা কালো হয়ে গেল খালিদের। আসিফ-তানিয়াকে পথ দেখিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটা রুমে নিয়ে গেলেন তিনি। ঘরের এখানে-সেখানে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা ডিসপ্লে স্ক্রিন. আর কম্পিউটার টার্মিনাল। তেজি রোদ যতটা সম্ভব ঠেকাতে জানালাগুলোয় লাগামো হয়েছে গাঢ় রঙিন কাঁচ।

এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সেন্টারের কথা মনে করিয়ে দেয় ঘরটা।

কোথায় এসেছি আমরা? খালিদকে জিজ্ঞেস করল আসিফ।

বড় একটা কৃত্রিম নদীর উৎসমুখে, একইসঙ্গে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সেচপ্রকল্পের কাছে। এখান থেকে পানি তুলে পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয় পাঁচ শ মাইল দূর পর্যন্ত। ফলে আজও টিকে আছে বেনগাজি, ত্রিপোলি আর তোবরাকের মতো অনেকগুলো মরুশহর।

কী পরিমাণ পানি তোলা হয় এই স্টেশনে?

সাপ্লাই কমে যাওয়ার আগপর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে সাত মিলিয়ন কিউবিক মিটার। গ্যালনের হিসেবে দুই বিলিয়ন।

তা হলে খরায় সাংঘাতিক ক্ষতি হয়েছে আপনাদের।

শুধু সাংঘাতিক না, ওটার চেয়েও খারাপ কোনও শব্দ যদি থেকে থাকে তা হলে সে-অবস্থা চলছে এখন আমাদের। পানির সাপ্লাই সত্তর পার্সেন্ট কমে গেছে। দিন দিন কমছে আরও।

ইদানীং বড় মাত্রার কোনও ভূমিকম্প হয়েছে এই এলাকায়? অনেক সময় ভূমিকম্পের কারণে অ্যাকুইফারগুলো ডিস্ট্যাবিলাইয হয়ে যায়।

বড়-ছোট কোনও মাত্রারই ভূমিকম্প হয়নি এখানে গত দুবছরে।

অ্যাকুইফারগুলো কি শুকিয়ে যাচ্ছে কোনও কারণে?

যে-পরিমাণ পানি সঞ্চিত আছে অ্যাকুইফারগুলোতে, ক্রমাগত পানি তুললেও পাঁচ শ বছরের আগে শুকাবে না। অন্তত এক শ বছরের আগে তো কিছুই হওয়ার কথা না।

আপনারা এখান থেকে পানি তুলছেন কত বছর ধরে?

মাত্র পঁচিশ। সেজন্যই আমার মাথায় আসছে না, এত পানি যাচ্ছে কোথায়।

খরাটা বিস্তার লাভ করছে, না? বলল তানিয়া।

মাথা ঝাঁকালেন খালিদ। তোবরাকের একজায়গায়। মিলিত হয়েছে লিবিয়া আর মিশর, পানির সরবরাহ ফুরিয়ে গেছে সেখানে। লিবিয়ার মধ্যাঞ্চল থেকে খবর এসেছে, পানির সরবরাহ প্রায় শেষ। আর পাত্রি অভাবে আক্ষরিক অর্থেই মরুভূমি হতে চলেছে ত্রিপোলির পশ্চিমাঞ্চল। একটা স্ক্রিনে টোকা দিলেন, ফুটে উঠল লাল-হলুদ দাগওয়ালা ম্যাপ। আস্তে আস্তে পশ্চিম থেকে আরও পশ্চিমে বিস্তৃত হচ্ছে আজব এই খরা।

ব্যাপারটা খেয়াল করল আসিফ-তানিয়া।

সেচ, শিল্প বা গৃহস্থালি কাজে একমাত্র আণ্ডারগ্রাউণ্ড ওয়াটারের উপর নির্ভরশীল আমরা, বলছেন খালিদ। এই অবস্থা যদি আর দুই সপ্তাহ চলে তা হলে মরতে হবে আমাদেরকে।

সমস্যাটা কি আপনাদের মতো চিহ্নিত করতে পেরেছে অন্য কোনও দেশ?

জানি না। আমাদের যেমন আলাদা একটা স্পেশালাইযুড় ডিপার্টমেন্ট আছে, অন্য কারও সে-রকম নেই। তা ছাড়া গৃহযুদ্ধ চলছে প্রতিবেশী কয়েকটা দেশে, মাথা ঘামানোর জন্য পানির চেয়ে বড় ইস্যু আছে ওদের সরকারের।

বিদ্রোহী কোনও গোষ্ঠী স্যাবোটাজ করছে না তো?

সম্ভব না।

কেন?

বিদ্রোহীদের কাজ হচ্ছে ধ্বংস করা, সন্ত্রাস করা; স্যাবোটাজ করা না। তা ছাড়া সবারই পানি খেতে হয়। সবারই পানি লাগে। আমরা যে-পানির জোগান দিই, তা বিদ্রোহী গ্রুপগুলোও ব্যবহার করে।

এখন তা হলে আপনাদের চলছে কী করে?

রেশনিং।

পরে কী করবেন?

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন খালিদ। পানি না পেয়ে একসময় আতঙ্কিত হয়ে যাবে মানুষ। হাহাকার লাগবে চারদিকে। শুরু হবে ভীষণ গণ্ডগোল, শেষে হানাহানি।

আপনার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কী বলছে?

সমস্যার সমাধান করো, না পারলে মিস-ম্যানেজমেন্টের জন্য তুমিই দায়ী। …সমাধান করতে পারি বা না-পারি, তাঁদের কাছে আবার যাওয়ার আগে এই খরার কারণ জানতে হবে আমাকে। সে-ব্যাখ্যা চাইবেন তাঁরা বাকি সবকিছুর আগে।

এখানকার অ্যাকুইফারগুলো মাটির কত নিচে?

 সাধারণত পাঁচ থেকে ছশ মিটার।

আরও গভীরে খনন করে নলকূপ বসানো যায় না?

এক হাজার মিটার গভীর করে নলকূপ বসানো হয়েছিল দুটো। ফলাফল শূন্য। তারপর দুহাজার মিটার গভীর করে বানানো হলো আরেকটা। ফল শূন্য।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল আসিফ, তারপর বলল, সিগনাল রেকর্ড করার জন্য আপনাদের কোনও সাউণ্ড ইকুইপমেন্ট আছে?

মাথা ঝাঁকালেন খালিদ।

তা হলে রেডি করুন ওগুলো। আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে।

.

১২.

ডিসি-৩ উড়ছে আবারও। ভিতরে কেবিনে দাঁড়িয়ে আছে আসিফ আর তানিয়া, দুই দিক দিয়ে ধরে রেখেছে একটা ঘোড়াবিহীন এক্কা গাড়িকে।

ধাতুনির্মিত এক্কাটা চার চাকাওয়ালা, ভিতরের পাটাতন টোল-খাওয়া। ওটার দুই দিকে দুটো হ্যাণ্ডেল আছে। পাটাতনের উপর রাখা হয়েছে প্রায় চার শ পাউণ্ড ওজনের একটা কংক্রিটের-ব্লক। শক্ত হাতে হ্যাণ্ডেল দুটো ধরে আছে আসিফ আর তানিয়া, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে ব্লকের ভারে কাত হয়ে না যায় এক্কাটা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পড়ে না যায় ব্লক।

ড্রপ যোন আসতে আর কত দেরি? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল আসিফ।

দুই মিনিট, জবাব দিল পাইলট।

ব্রেক লাগানো আছে এক্কায়, ওটা আস্তে আস্তে রিলিয করে দিল আসিফ; একটু একটু করে ঠেলতে শুরু করেছে এক্কাটাকে, একই কাজ করার ইশারা দিল তানিয়াকে। কেবিনের শেষপ্রান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এক্কাটা। এখানে যে-কটা সিট ছিল তার সব সরিয়ে ফেলা হয়েছে। খুলে ফেলা হয়েছে কার্গো ডোরও। আসিফের পরিকল্পনাটা হচ্ছে, ঠেলে খোলা দরজা দিয়ে ফেলে দেবে এক্কাটাকে।

দরজা থেকে আর যখন পাঁচ ফুট দূরে আছে এক্কাটা, বিপত্তি দেখা দিল তখন। একা, ব্লক, আর আসিফ-তানিয়ার ওজন সাড়ে সাতশ পাউণ্ডের মতো; লেজের কাছে এত ওজন বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না পুরনো ডিসি-৩, নাক উঁচু হয়ে গেল ওটার।

প্লেন সামলাতে গিয়ে ওটাকে একদিকে কাত করে ফেলল পাইলট। ফলে কংক্রিটের ব্লকটা এক্কার পাটাতনে নড়ে উঠে ওটার একদিকে চলে আসতে শুরু করল। ওই দিকের হ্যাণ্ডেল ধরে আছে তানিয়া, ব্লক আর খানিকটা এগোলে ফিউযেলাজের সঙ্গে পিষে ফেলবে ওকে।

আসিফ! চিৎকার করে উঠল তানিয়া।

কিন্তু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার নেই অসহায় আসিফের। চার শ পাউণ্ড ওজনের একটা ব্লককে টেনে ধরে রাখতে কষ্ট হতো সুপারম্যানেরও।

হ্যাণ্ডেল ছেড়ে দাও! পাল্টা চেঁচিয়ে উঠল আসিফ। সরে যাও!

একেবারে শেষমুহূর্তে সরে যেতে পারল তানিয়া, একছুটে চলে গেল যে-কটা সিট খোলা হয়নি সেগুলোর আড়ালে।

ঠিক তখন প্লেনের নাক সিধে করতে পারল পাইলট।,

.

ভূগর্ভস্থ শবপ্রকোষ্ঠটা লুকানো; যেসব চোর কবর খুঁড়ে ভিতরের সোনাদানা নিয়ে পালায় তারা আজপর্যন্ত সন্ধান পায়নি সেটার। ফারাও আর তাঁদের পুরোহিতদের জন্য এককালে সংরক্ষিত ছিল ওটা, এখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সারওয়ার।

দেয়ালে খোদাই করা আছে, কিছু চিত্রকর্ম। কিছু হায়ারোগ্লিফিক্সও আছে। একধারে যেন নিতান্ত অবহেলায় পড়ে আছে বারোটা পাথরের-শবাধার। মমিকরা কিছু প্রাণী দেখা যাচ্ছে শবাধারগুলোর আড়ালে-আবডালে।

হায়ারোগ্লিফিক্সগুলো দেখছিল সারওয়ার, আর ভাবছিল, যে-প্ল্যান সে করেছে তা সফল হলে উত্তর আফ্রিকার অঘোষিত সম্রাট হতে পারবে। এখন সফল হওয়াটাই আসল কথা। কারণ ছোট-বড় ঝামেলা লেগেই আছে।

শবপ্রকোষ্ঠ ছেড়ে বের হলো সে, হাজির হলো আরেকটা ছোট ঘরে। আপাতত এই ঘরকে নিজের কন্ট্রোলরুম হিসেবে ব্যবহার করছে। এখানে পিস্তলের মুখে হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে আখতারকে।

কী হচ্ছে এসব? সারওয়ারকে দেখামাত্র জিজ্ঞেস করল আখতার। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!

একটা আঙুল তুলল সারওয়ার, আখতারকে চুপ করানোর জন্য ওটাই যথেষ্ট। মাল্টা থেকে পাওয়া রিপোর্ট তোমার আমার দুজনের জন্যই খারাপ, আখতার। হেল্ডন আর নুমার দুই এজেন্টকে শেষ করে দেয়ার কথা ছিল তোমার বাছাই করা লোকদের। তাদের একজন মরেছে, একজন পালিয়েছে। সবচেয়ে খারাপ কথা, ডারহাম ধরা পড়েছে। ধরা পড়া চলবে না আমার কোনও এজেন্টের–নিয়মটা নিশ্চয়ই নতুন করে বলতে হবে না তোমাকে?

কিন্তু…।

তোমার পাঠানো দুই লোকের একজন, তুমিই বলেছিলে, মারা গেলে মরুভূমিতে। সে যে বেঁচে আছে তা আমার কাছে লুকানোর কারণ কী, আখতার?

লুকাইনি। তুমি আর কিছু জানতে চাওনি, তাই আমিও আগ বাড়িয়ে বলিনি।

বলাটা কি উচিত ছিল না?

লম্বা করে দম নিল আখতার। তোমার আদেশ পালনে কেউ ব্যর্থ হলে মরুভূমিতে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় তাকে। ওদের বেশিরভাগই মরে«রোদে পুড়ে, পানির অভাবে। দু-একজন যারা ফিরে আসে তারা চাকরি ছেড়ে দেয়। কিন্তু যার কথা বলছ সে চেহারা, গলা, হাত ও পায়ে অনেকগুলো ফোস্কা নিয়ে ফিরে এসেছিল, এবং চাকরি ছাড়েনি। …তুমিই কিন্তু সবসময় বলো, যারা ওভাবে ফিরতে পারে তাদেরকে আরেকবার সুযোগ দেয়া উচিত।

মানলাম। কিন্তু সুযোগটা দিয়ে কী লাভ হলো?

সে ডারহামের সঙ্গে ছিল না। এমনকী ওর খবর জানত না ডারহাম অথবা বাকি দুজন। ওকে বলেছিলাম, যদি কোনও কারণে ব্যর্থ হয় ডারহাম, অথবা যদি ধরা পড়ে, তা হলে যেন গুলি করে মারে লোকটাকে যাতে আমাদের গোপন কথা ফাঁস না হয়। ডারহামকে শেষ করে দেয়ার পাকা খবর পাঠিয়েছে সে আমার কাছে।

চুপ করে আছে সারওয়ার। ডারহামকে খুন করা হয়েছে, অথচ খবরটা ছিল না ওর কাছে। কীভাবে শেষ করল সে ইটালিয়ান ডাক্তারকে?

 স্নাইপার রাইফেল। ওই জিনিস ব্যবহারে ওর জুড়ি নেই।

নুমার দুই এজেন্টকে মারেনি কেন?

সুযোগ পায়নি। গুলির আওয়াজ শুনেই লাফিয়ে আড়ালে চলে যায় ওরা। তা ছাড়া পুলিশ চলে এসেছিল।

আখতারের পেছনে দাঁড়িয়ে-থাকা গার্ডের দিকে তাকাল সারওয়ার। পিস্তল সরাও।

.

জমিনে সেন্সর বসিয়ে অপেক্ষা করছেন খালিদ আর তার সহকারীরা–কখন নিক্ষিপ্ত হবে কংক্রিটের বমটা। ইঞ্জিনের আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে তাকালেন তাঁরা। দেখলেন, যান্ত্রিক গর্জন করতে করতে যেন জমিনের দিকে ধেয়ে আসছে ডিসি ৩। একবার ডানে আরেকবার বাঁয়ে কাত হচ্ছে, ওটার নাক একবার উঁচু পরেরবার নিচু হচ্ছে।

কী করছে ওরা? ভেতা আওয়াজ বের হলো খালিদের গলা দিয়ে।

বোধহয় রোলার কোস্টারের মজা নিতে চাইছে, বলল তার এক সহকারী।

.

প্লেনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে পাইলট। ড্রপ যোনের কাছে চলে এসেছি! ঘাড় ঘুরিয়ে গলা ফাটিয়ে বলল সে।

কথাটা না বললেও চলত, কারণ আসিফ বুঝতে পারছে সেটা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, রোলার কোস্টারের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে ওকে এক্কাসহ দরজার আরও কাছে পৌঁছে দিয়েছে প্লেনটা, এখন পড়ি-পড়ি অবস্থা ওর নিজেরই। এক হাতে ঠেলে এক্কাটা ফেলে দেয়ার ঝুঁকি নিতে চাইছে না–আরেকটু বেসামাল হলে ওকে নিয়েই পড়বে ওটা। যেতে হবে খোলা দরজা দিয়ে।

প্লেনটা বাঁয়ে কাত করুন! পাইলটের উদ্দেশে চেঁচাল তানিয়া।

কিন্তু ইতোমধ্যে অনেক বেড়ে গেছে ইঞ্জিনের গর্জন, ওর কথা শুনতে পেল না পাইলট।

একদৌড়ে গিয়ে ককপিটে ঢুকে পড়ল তানিয়া, বসে পড়ল কো-পাইলটের সিটে। ইশারায় বুঝিয়ে দিল পাইলটকে কী বলতে চাইছে সে। বুঝতে পারার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল পাইলট।

বাঁদিকে কাত হয়ে গেল ডিসি-৩।

আসিফ ততক্ষণে একহাতে শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরেছে একটা কার্গোস্ট্র্যাপ। ফিউযেলাজের সঙ্গে ঠেসে ধরেছে নিজের পিঠ, এক পা কেবিনের মেঝেতে রেখে আরেক পা দিয়ে সর্বশক্তিতে ঠেলছে এক্কাটাকে। চাইছে, গড়িয়ে দরজা দিয়ে বাইরে পড়ে যাক ওটা।

ঘটলও তা-ই। বাঁদিকে কাত হয়ে গিয়েছিল এক্কা, আসিফের ঠেলার কারণে গতি পেল ওটার সামনের চাকা দুটো, ওগুলোকে অনুসরণ করল পেছনের দুটো। কার্গোস্ট্র্যাপ ধরে রেখে দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে আসিফ দেখল, এক্কা আর ব্লক পড়ে যাচ্ছে দুটো আলাদা বমের মতো।

কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে টের পেল, ওর দিকে দৌড়ে আসছে তানিয়া।

.

স্যাটেলাইট ফোনে ফোস্কাওয়ালার সঙ্গে কথা বলছে। সারওয়ার-নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছে, ওকে ভুল তথ্য দেয়নি আখতার।

একটা গল্প বলি তোমাকে, ফোস্কাওয়ালার বয়ান শেষ হওয়ার পর ওকে বলল সারওয়ার। আমি তখন খুব ছোট। কায়রোর শহরতলীতে বাবা-মার সঙ্গে একটা ছাপড়াঘরে থাকি। ডাস্টবিন ঘাঁটাঘাঁটি করেন আমার বাবা, লোহালক্কড় কিছু পেলে কুড়িয়ে নিয়ে একটা বস্তায় ভরেন, তারপর সেগুলো নিয়ে বেচেন ভাঙ্গারির দোকানে। যা-টাকা পান তা দিয়ে সংসার চালান। বুঝ-জ্ঞান হওয়ামাত্র টের পেয়েছি আমি, জীবনযুদ্ধ কাকে বলে।

একদিন বড় একটা বিছা ঢুকে পড়ল আমাদের ঘরে। ইট দিয়ে যেই ঘেঁতলে দিতে যাব ওটাকে, অমনি কে যেন টেনে ধরল আমার হাত। পেছনে ফিরে দেখি, বাবা। বললেন, ওটাকে মারিস না, নতুন কিছু শেখাই তোকে।

কায়দা করে ধরে ফেললেন তিনি বিছাটাকে, ঢোকালেন একটা কাঁচের জারে। প্রথমে গরম, তারপর ঠাণ্ডা পানি ঢেলে। ডুবিয়ে মারার চেষ্টা করলেন ওটাকে। মরল না ওটা। জারের মুখ বন্ধ করে কয়েকদিন রেখে দিলেন রোদে, কিছুই হলো না বিছাটার। এবার জারে ঢালা হলো অ্যালকোহল, সাঁতার কাটার চেষ্টা করল বিছাটা, না পেরে বালির মতো থিতিয়ে পড়ে থাকল জারের মেঝেতে।

পরদিন জারটা নিয়ে ঘরের পাশের গলিতে গিয়ে ওটা উপুড় করলেন বাবা। পড়ে গেল অ্যালকোহল, মাটিতে পড়ল বিছাটাও। কিন্তু আশ্চর্য, ওটা তখনও মরেনি, বরং মাটিতে পড়ামাত্র ছুটে এল আমাকে কামড়াতে। নাগালে থাকা, একটা ঝাড়ুর একবাড়িতে ওটাকে দূরে পাঠিয়ে দিলেন বাবা।

বৃশ্চিক আমাদের ভাই, বললেন তিনি আমাকে, জীবনযুদ্ধের একজন সৈনিক। একগুঁয়ে, বিষাক্ত। এবং সহজে মারা যায় না ওটাকে। এটাই শেখাতে চেয়েছিলাম তোকে।

তোমার কথা শুনে মনে পড়ে গেল ঘটনাটা। আজ থেকে তোমার কোড-নেইম বিছা। কেউ যেন সহজে মারতে না পারে তোমাকে। যা বলব তা পালন করবে একগুয়ের মতো। এবং যখন দরকার হয় তখনই নিজের বিষাক্ত চেহারাটা দেখাতে ভুল করবে না।

ঠিক আছে, ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে জবাব দিল ফোস্কাওয়ালা–ডারহামের খুনি।

জাদুঘরে যাবে তুমি। হাতিয়ে নেবে আর্টিফ্যাক্টগুলো, নিশ্চিহ্ন করে দেবে সব রেকর্ড। এটাই এখন তোমার উপর আমার আদেশ। মনে থাকবে?

থাকবে।

.

খালিদ দেখলেন, আসমান থেকে জমিনের দিকে ধেয়ে আসছে ব্লকটা। সবাই রেডি? জানতে চাইলেন।

চারটা দলে বিভক্ত হয়ে কয়েক একর জমি ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন লোক। প্রতিটা দল জমিনে সেন্সর পোব গেঁথেছে। সবকিছু যদি ঠিক থাকে, মানে ব্লকটা যদি ঠিকমতো আছড়ে পড়ে মাটিতে, ডিপ রিভারবেরেটেড ওয়েইভ সনাক্ত করতে সক্ষম হবে লিসেনিং ডিভাইসগুলো। আসিফের ধারণা, ওই ওয়েইভ পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে ঠিক কী পরিবর্তন ঘটেছে বেলেপাথরের নিচে।

ঠিক আছে, চেঁচাল কেউ একজন।

হ্যাঁ, ঠিক আছে, চেঁচিয়ে বলল অন্য কেউ।

নিজের সেন্সর বোর্ডের দিকে তাকালেন খালিদ। সবুজ বাতি জ্বলছে ওটাতেও, তারমানে এখন পর্যন্ত ঠিকই আছে সবকিছু।

তাঁর থেকে দেড় শ গজ দূরে আছড়ে পড়ল ব্লকটা।

মরুভূমিতে ভোঁতা কিন্তু শক্তিশালী আওয়াজ তুলল সংঘর্ষটা–ঘন মেঘ হঠাৎ গুড়-গুড় করে উঠলে যেমন হয়, তারচেয়ে কয়েক গুণ বেশি। খালিদের কর্ণকুহরে তো বটেই, বুকের ভিতরে, এমনকী হাত-পায়েও আলোড়ন তুলল ওটা।

ছড়িয়ে-পড়া বালিমেঘের ভিতর দিয়ে ছুট লাগালেন তিনি। সেন্সর বোর্ডে এখনও জ্বলছে সবুজ বাতিটা। হাতের ল্যাপটপের স্ক্রিনে স্থির হয়ে আছে একটা গ্রাফ।

একটু পরই আঁকাবাকা আরও কতগুলো গ্রাফ দেখা দিল স্ক্রিনে, মূল গ্রাফটাকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়ছে। জমিনের নিচে বিভিন্ন গভীরতায় থাকা বিভিন্ন বেলেপাথর থেকে নানান রকম ফ্রিকোয়েন্সি আসছে। এবার বের করতে হবে, এই ডেটার মানে কী।

ততক্ষণে চক্কর কেটে ল্যাণ্ডিংস্ট্রিপের দিকে নাক ঘুরিয়েছে ডিসি-৩।

.

১৩.

তীক্ষ্ণ, কর্কশ একটা শব্দ খানখান করে দিল রাতের নীরবতা। মাল নামানোর জন্য বড় একটা ওয়্যারহাউসের লোডিং ডকে সুবিধামতো জায়গা করে নিচ্ছে একটা ডেলিভারি ট্রাক।

ওয়্যারহাউসটা মাল্টা ন্যাশনাল মিউযিয়ামের। অদূর ভবিষ্যতে যেসব নিলামের পরিকল্পনা নিয়েছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ, সবগুলোর অকশন আইটেম মজুদ করা হয়েছে এবং হচ্ছে এখানে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে দুজন গার্ড এবং একজন ফোর্ক-লিফট অপারেটর, ট্রাকটা দেখছে।

রাস্তার ওধারে জড়ো হয়েছে বেশ কয়েকটা লিমাজিনসহ বিভিন্ন মডেলের দামি গাড়ি, প্রি-অকশন পার্টিতে যোগ দিতে এসেছে ওগুলোর আরোহীরা। অতিথিদের কেউ কেউ এসেছে নিজস্ব ইয়টে করে।

একজন গার্ড একটা ক্লিপবোর্ড হাতে নিয়ে অন্য গার্ডকে বলল, চলো দেখি কী চালান এসেছে এবার।

লোডিং ডকে হাজির হলো সে তার সঙ্গীকে নিয়ে। এখানে আরও একজন গার্ড আছে। জাদুঘরের পুরো এলাকা ঘিরে দেয়া হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে। এটা নিরাপত্তার প্রথম স্তর। দ্বিতীয় স্তর হিসেবে ওয়্যারহাউসের দরজায় আছে সিকিউরিটি কী-প্যাড, যা শুধু কী-কার্ড দিয়ে খোলা সম্ভব। তৃতীয় স্তর হিসেবে আছে গার্ডরা, হেল্ডন মারা যাওয়ার পর তাদের সংখ্যা তিনগুণ করা হয়েছে।

লোডিং ডকের প্ল্যাটফর্মে উঠে পড়ল ট্রাকটা, একটু আগের কর্ণবিদারী তীক্ষ্ণ আর কর্কশ সাইরেন থামল। দরজা খুলে লাফিয়ে নামল ড্রাইভার, এগিয়ে যাচ্ছে ট্রাকের পেছনের দিকে। ওখানে ট্রাকের বডিতে দুই পাল্লার একটা দরজা আছে, খুলল ওটা।

উঁকি দিয়ে ট্রাকের ভিতরে তাকাল গার্ড। আট ফুট দীর্ঘ, চার ফুট প্রশস্ত আর পাঁচ ফুট উঁচু একটা কাঠের ক্রেট দেখা যাচ্ছে।

ড্রাইভারকে ইনভয়েস নম্বর জিজ্ঞেস করল গার্ড, ওটা মিলিয়ে নিল নিজের ক্লিপবোর্ড পেপারের সঙ্গে। এক ঘন্টা আগে মাল পৌঁছে দেয়ার কথা ছিল তোমার।

রওনা হতেই দেরি হয়ে গিয়েছিল। তার উপর তোমাদের মেহমানরা ট্রাফিক জ্যাম বাধিয়ে রেখেছে। শেষপর্যন্ত যে পৌঁছাতে পেরেছি আমরা, সেজন্য শুকরিয়া আদায় করো।

ঝুড়ির ভিতরে কী?

জবাব না দিয়ে ঝুড়ির একদিক দিয়ে বিশাল একটা স্কু ড্রাইভার ঢুকিয়ে দিল ড্রাইভার, কায়দামতো চাপ দিয়ে খুলে ফেলল একপাশের ডালা। ভিতরে একগাদা খড়ের উপর শুয়ে আছে ছোট একটা অ্যান্টিপার্সোনেল কামানের সরু নল।

হাতের টর্চলাইটের আলো ডেলিভারি পেপারের উপর ফেলল গার্ড। লেখা আছে: আঠারো শতকের এক-মাস্তুলের ছোট একটা পালতোলা ব্রিটিশ জাহাজে ছিল কামানটা। নলের পাশে কাগজে মোড়ানো অবস্থায় দেখা যাচ্ছে কয়েকটা তলোয়ার।

সন্তুষ্ট হলো গার্ড, ফোর্ক-লিফট অপারেটরের দিকে তাকাল। ওয়্যারহাউসের ভিতরে এককোনায় নিয়ে রাখো এগুলো। পার্টি শেষ হওয়ার পর ভালোমতো দেখব।

মাথা ঝাঁকাল ফোর্ক-লিফট অপারেটর। গিয়ারে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে এল ফোর্ক-লিফট, সাবধানে তুলে নিল ক্রেটটা, ঢুকে পড়ল ওয়্যারহাউসে। এককোনায় নামিয়ে দিল ওটা। আগামীকাল সকালের আগে আর কোনও ডেলিভারি আসবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত ছুটি ওর। ব্রেকরুমে গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসে টিভি দেখবে এখন।

কিন্তু ওয়্যারহাউসের দরজা দিয়ে বের হওয়ামাত্র থমকে গেল সে। আজ রাতের শেষ ডেলিভারি চেক করেছিল যে দুজন গার্ড, বিশ্রী ভঙ্গিতে পড়ে আছে তারা। কী ঘটেছে তা বুঝে নিতে মূল্যবান কয়েকটা মুহূর্ত খরচ করে ফেলল অপারেটর লোকটা। উল্টো ঘুরে ছুট লাগাতে যাবে, এমন সময় পর পর তিনটা বুলেট ছিদ্র করে দিল ওকে। সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল দিয়ে গুলি করা হয়েছে, খুক খুক কাশির মতো আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ হলো না।

আপনাআপনি হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল অপারেটরের। চতুর্থ বুলেট ফুটো করল ওর কপাল, ইহজাগতিক সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেল সে। একদিকে কাত হয়ে পড়ে গেল লাশটা।

বিছা, মানে চেহারার জায়গায় জায়গায় ফোস্কাপড়া কদাকার এক লোক বেরিয়ে এল অন্ধকার থেকে। কেউ কিছু টের পেয়েছে কি না তা জানতে ইশারায় আদেশ দিল নিজের তিন লোককে। গার্ডদের বেশ ধারণ করেছে ওরা।

.

একভাবে পড়ে থাকতে থাকতে ঝিঁঝি ধরে গেছে রানার পায়ে। একটানা অনেকক্ষণ অন্ধকারে থাকার কারণে হারিয়ে ফেলেছে সময়ের হিসেব। ছোট একটা রেগুলেটর ব্যবহার করে নিয়মিত বিরতিতে দম নিচ্ছে আর ছাড়ছে। একটু নড়াচড়া করে আরাম দেয়ার চেষ্টা করল পা দুটোকে, পারল না।

ভাগ্যকে ধন্যবাদ দে, ওর পাশে একই কায়দায় শুয়ে থাকা সোহেল বলল ফিসফিস করে, ওরা ভালোমতো দেখেনি। কামানের নলটা। মেইড ইন চায়না লেখাটা যদি দেখত, নলের নিচের ফল্স বটমের অস্তিত্ব টের পেতে বেশি সময় লাগত না।

দেব, ফিসফিস করল রানাও, ওরা যদি আমাদেরকে ঠিক জায়গামতো ডেলিভারি করে থাকে তা হলে।

মোচড়ামোচড়ি করে একটা হাত আলগা করল রানা। অন্য হাতে একটা প্যাকেট বাঁধা আছে, ওটার ভিতর থেকে একটা পাতলা কালো তার বের করল। প্যাঁচ খুলল তারটার। গগলস পরে আছে, ওটার সঙ্গে যুক্ত করল তারের একটা প্রান্ত। এবার প্যাকেটের ভিতর থেকে বের করল সিলিণ্ডার আকৃতির একটা ক্যামেরা, তারের অন্য প্রান্তটা যুক্ত করল ওটার সঙ্গে।

আধুনিক পেরিস্কোপ, আবারও ফিসফিস করল রানা।

কয়েক ফোন্ডে ভাঁজ করে রাখা যায় এ-রকম একটা স্টিক বের করল পকেট থেকে, ওটার সঙ্গে ভালোমতো আটকাল ক্যামেরাটা। চালু করল নাইট ভিশন মোড। আগে থেকেই ফুটো করে রাখা হয়েছে ফল্স বটমের ছাদে, ওখান দিয়ে ঢুকিয়ে দিল ক্যামেরাটা। আস্তে আস্তে উপরের দিকে ঠেলছে।

ঢাকনা নেই ঝুড়ির, তাই ডেলিভারি ট্রাকের ছাদে বিনাবাধায় হাজির হলো ক্যামেরা। ফুটো করে রাখা হয়েছে এখানেও। লেন্স ফোকাস করল রানা, ওয়্যারহাউসের ভিতরের লাইভ দৃশ্য চলে এল ওর বিশেষভাবে তৈরি গগলসে।

ওয়্যারহাউসের ভিতরে আলোর চেয়ে অন্ধকার বেশি। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। স্টিকটা এদিকওদিক ঘোরাল রানা, এবারও নজরে পড়ল না কাউকে।

ক্যামেরা নামিয়ে আনল রানা, ওটা আর স্টিকটা ঢুকিয়ে রাখল জায়গামতো। চল, উঠি।

ফলস বটমের ছাদ সময় নিয়ে সরাল সোহেল, হিসেবে ভুল হলে কামানের নল পড়বে ওদের উপর। সাবধানে উঠে এসে অবস্থান নিল নলের একদিকে, ঠিক হওয়ার সময় দিচ্ছে প্রায়-অবশ-হয়ে-আসা শরীরের একপাশকে। একটু পর ওর পাশে চলে এল রানাও, সময় নিচ্ছে সে-ও।

শরীরে সাড়া ফিরে আসামাত্র ট্রাকের দরজার দিকে এগোল দুজনে, ভোলা আছে ওটা। সাবধানে নামল ওয়্যারহাউসের মেঝেতে। এদিকওদিক তাকাচ্ছে।

ওয়্যারহাউসের ভিতরটা মোটামুটি সাজানোই বলা যায়। একদিকের দেয়ালে দোতলা সমান উঁচু সারি সারি র‍্যাক আর শেফ আছে। অন্ধকারেও ঠাহর করা যায়, বিভিন্ন রকমের জিনিসপত্র দিয়ে ঠাসা ওগুলো।

নিলামের জন্য কোনগুলো? ফিসফিস করে জানতে চাইল সোহেল।

মিশরীয় যে-কোনওকিছু। আমার ধারণা, নিলামের মালগুলো র‍্যাক থেকে নামিয়ে মেঝেতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এমনও হতে পারে, ওগুলো আলাদা কোথাও আছে।

র‍্যাক আর শেলফ কি বাদ দিবি তা হলে?

প্রাথমিকভাবে বাদ। তবে কোনওকিছু যদি নজর কাড়ে… বাকি কথা বলল না রানা। তুই বাঁদিকে যা। আমি ডানদিকে দেখছি। মেঝের মালগুলো দেখতে দেখতে সামনের দিকে এগোব। মিলিত হব দরজার কাছে।

মাথা ঝাঁকাল সোহেল, পুঁচকে একটা স্পিকার ঢুকিয়ে নিল নিজের এককানে। একটা রেডিওর সঙ্গে যুক্ত আছে ওটা, আর রেডিওটা আছে সোহেলের কাছে। একই কাজ করল রানাও।

ইনফ্রারেড ক্যামেরা বের করল দুজনই–যা খুঁজছে তা পেয়ে গেলে ছবি তুলে রাখবে। পরে ভালোমতো দেখবে দুজন মিলে।

.

অভিযানের দায়িত্ব বুঝে নেয়ার জন্য পার্টি শুরু হওয়ার কিছু সময় আগে মাল্টায় হাজির হয়েছে আখতার। আর্টিফ্যাক্টগুলো হাতিয়ে নিয়ে ধ্বংস করে ফেলার আদেশ আছে ওর উপর। ওর লোকেরা ইতোমধ্যে ঢুকে পড়েছে জাদুঘরের সিকিউরিটি সার্ভিসে, আসল গার্ডের ভূমিকা পালন করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তল্লাশির জন্য ওয়্যারহাউসে ঢুকবে ওরা।

সিকিউরিটি সুপারভাইয়ারের পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আখতার এখন। জাদুঘরের বলরুমের, মানে যেখানে পার্টি হচ্ছে, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা গার্ডদের সঙ্গে আখতারের নির্দেশে রেডিওতে কথা বলছে সুপারভাইযার। ফলে মোট গার্ডের তিন-চতুর্থাংশ ইতোমধ্যে হয় ঢুকে গেছে। বলরুমে, নয়তো দাঁড়িয়ে আছে ওটার আশপাশে। ওয়্যারহাউসের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে এখন আটজন, যাদের মধ্যে দুজন লোক ওদেরই।

খড়খড় করে উঠল সুপারভাইযারের রেডিও। হলরুমের চারদিকে চক্কর দেয়া শেষ করেছি। সব ঠিক আছে।

জবাবে কী বলবে বুঝতে পারছে না সুপারভাইর, ইতস্তত করছে। ওর পিঠে পিস্তলের নল দিয়ে ঠেলা মারল আখতার।

খুব ভালো, বলতে বাধ্য হলো সুপারভাইযার। ত্রিশ মিনিট পর আবার রিপোর্ট করবে।

বলরুমের ভিতরে এত গার্ড থাকার দরকার আছে? জিজ্ঞেস করল রেডিওর ওপ্রান্তের লোকটা। বাইরে বের হতে বলব কয়েকজনকে?

মাথা নাড়ল আখতার, সুপারভাইযারকে বুঝিয়ে দিল কী জবাব দিতে হবে।

দরকার নেই, বলল সুপারভাইয়ার। কড়া নজর রাখতে বলল ওদেরকে। ওভার অ্যাণ্ড আউট।

নিশ্চিন্ত বোধ করছে আখতার। পিস্তলের নল দিয়ে আবার ঠেলা মারল সুপারভাইযারের পিঠে। এবার আমার সঙ্গে ওয়্যারহাউসে যাবে তুমি। একত্রিশ, চৌত্রিশ আর সাতচল্লিশ নম্বর লট কোথায় আছে দেখিয়ে দেবে।

ইতস্তত করছে সুপারভাইবার।

লোকটার কোমরে কষে একটা লাথি মারল আখতার, হুড়মুড় করে পড়ে গেল বেচারা। এগিয়ে গিয়ে ওর বুকে আবারও লাথি মারল আখতার।

আমি মোটেও পছন্দ করি না, আমার কাজে এক সেকেণ্ড দেরি করিয়ে দিক কেউ।

কোকাতে কোকাতে উঠে দাঁড়াল সুপারভাইযার। চলুন।

 বিছার দিকে তাকাল আখতার। এক্সপ্লোসিভগুলো নাও। যা খুঁজছি তা পেয়ে গেলে উড়িয়ে দেব। এবার তাকাল আরেকজনের দিকে। পেনড্রাইভে করে আনা ভাইরাসটা ঢুকিয়ে দাও জাদুঘরের কম্পিউটার সিস্টেমে। আর্টিফ্যাক্টের সব তথ্য মুছে দেবে ওটা।

মাথা ঝাঁকাল পেনড্রাইভওয়ালা, এগিয়ে যাচ্ছে কাছের একটা কম্পিউটারের দিকে।

সন্তুষ্ট বোধ করছে আখতার। একটুখানি হাসল। ভাবতে পারেনি, সব এত সহজে হয়ে যাবে।

উত্তেজিত হয়ে আছে সে, উত্তেজিত হয়ে আছে ওর সাঙ্গোপাঙ্গরা; তাই সিসি ক্যামেরার বদৌলতে যেসব লাইভ ইমেজ দেখা যাচ্ছে অনতিদূরের কয়েকটা টিভি স্ক্রিনে, সেদিকে খেয়াল নেই কারও। যদি থাকত তা হলে দেখতে পেত, কালো পোশাক-পরা দুজন মানুষ সতর্ক পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে ওয়্যারহাউসের ভিতরে।

.

একটা প্ল্যাস্টিক বাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সোহেল। ওটার গায়ে রোমান সংখ্যায় লেখা: একত্রিশ।

বাক্সটা খুলে ফেলল ও। ফায়ারফ শিটের আবরণ আছে ভিতরে, সরাল ওটা। একটা ভাঙা লিপিফলক দেখা যাচ্ছে, গায়ের খোদাইকর্ম মিশরীয় বলে মনে হচ্ছে। খোদাইকর্মের দিকে তাকাল ও।

একটা মন্দিরের মেঝেতে শুয়ে আছে বেশ কয়েকজন লোক। ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ চামড়ার লম্বা আরেকটা লোক। খুব সম্ভব পুরোহিত বা আধ্যাত্মিক সাধকু সে। ওর একটা হাত শুয়ে-থাকা লোকগুলোর মাথার উপর। সাদা আলখাল্লা-পরা কয়েকজন নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে ওর পেছনে। ওর হাত থেকে কয়েকটা রেখা খোদাই করা হয়েছে শুয়ে-থাকা লোকগুলোর মাথার উপর, দেখলে মনে হয় মৃতকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চলছে। ফলকের উপরের দিকে একটা চাকতি–খুব সম্ভব সূর্য বা চাঁদ; এমনভাবে খোদাই করা হয়েছে যে, দেখলে মনে হয় গ্রহণ চলছে।

ইনফ্রারেড ক্যামেরা দিয়ে ফলকটার কয়েকটা ছবি তুলল সোহেল। তারপর রেডিওতে যোগাযোগ করল রানার সঙ্গে। মিশরীয় চিত্রকর্মসহ একটা লিপিফলক পেয়েছি।

.

রানার ভাগ্য আজ রাতে সোহেলের মতো ভালো না।

ওয়্যারহাউসের আরেকদিকে, কাঁচ দিয়ে বানানো দুটো ওয়াটার ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও। ওগুলো আকারে ছোটখাট ট্রাকের সমান। প্রথম ট্যাঙ্কে চীনামাটির র‍্যাকে বিভিন্ন জিনিস সাজানো। দ্বিতীয়টার মেঝেতে শুয়ে আছে দুটো কামানের নল। দুটো ট্যাঙ্কই ডিসটিল্ড ওয়াটার দিয়ে পূর্ণ। সাগরের তলদেশ থেকে উদ্ধারকৃত লৌহজাত জিনিসের গায়ে দৃঢ়ভাবে-আটকে-থাকা লবণ আলগা করার জন্য ও-রকম করা হয়।

ট্যাঙ্ক দুটোর কাঁচ ভেদ করে ভিতরে তাকাল রানা। না, মিশরীয় কিছু নেই। এদিকওদিক তাকাল। একসারিতে কতগুলো পিলার আছে কাছেপিঠে।

চোখের কোনা দিয়ে রানা দেখল, আলোআঁধারির পরিবর্তন ঘটল ওয়্যারহাউসের ভিতরে দূরে কোথাও। চট করে একটা পিলারের সঙ্গে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। সতর্ক হয়ে গেছে। চোখ সরু, কান খাড়া।

একজন পুরুষ আর, একজন মহিলার ছায়ামূর্তি দেখা গেল। আশ্চর্য, দুজনের পরনেই পার্টিড্রেস।

এবং দুজনের হাতেই পিস্তল।

.

১৪.

ইয়ারপীসের টক সুইচ চাপ দিয়ে সোহেলের সঙ্গে যোগাযোগ করল রানা। চাপাগলায় বলল, ঝামেলা হাজির হয়ে গেছে।

আমার এখানেও।

ডিসটিল্ড ওয়াটারের দুটো ট্যাঙ্ক আছে আমার এদিকে। চলে আয়।

জায়গামতো এসে সোহেল বলল, আমি যাদেরকে দেখেছি, তাদের পরনে গার্ডদের মতো পোশাক। কিন্তু পিস্তলের মুখে জোর করে নিয়ে এসেছে অন্য এক গার্ডকে–সম্ভবত সিকিউরিটি সুপারভাইযার।

তারমানে ওয়্যারহাউসের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে এখন শত্রুপক্ষ।

লুকাবি? নাকি পালাবি?

পালানোর উপায় নেই। আরও লোক আছে।

 গার্ড?

না। ওদের পরনে পার্টিড্রেস। একজন পুরুষ, একজন মহিলা। দুজনের হাতেই পিস্তল আছে।

কংক্রিটের মেঝেতে ভারী চাকার ঘর্ষণের আওয়াজ পাওয়া গেল। দূরে জ্বলে উঠেছে দুটো ফ্ল্যাশলাইট, আলো নেচে বেড়াচ্ছে একদিকের দেয়ালের শেলফে।

ওয়্যারহাউস পর্যবেক্ষণ করছে শত্রুপক্ষ।

ডেলিভারি ট্রাকের ফল্স বটমে গিয়ে ঢুকবি? বলল সোহেল।

জবাব দেয়ার আগে এদিকওদিক তাকাল রানা। দেখা যাচ্ছে না ওই পুরুষ আর মহিলাকে, কোন্‌দিকে গেছে ওরা তা-ও বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। রানার মনে হচ্ছে, ওই দুজন ভিন্ন দলের। তারমানে, ওয়্যারহাউসের ভিতরে এখন ওদের নিয়ে মোট তিনটে দল।

আয় আমার সঙ্গে, সোহেলকে বলল রানা।

যে-ওয়াটার ট্যাঙ্কে কামানের নল আছে, সেটার মইয়ের কাছে হাজির হলো রানা, উঠতে শুরু করল। ঢুকে পড়ল ট্যাঙ্কের ভিতরে, দুটো নলের পাশে শুয়ে পড়ল ওরা–জলাভূমিতে গুঁড়ির সঙ্গে যেভাবে পড়ে থাকে কুমির। কয়েকজন লোককে এগিয়ে আসতে দেখে লম্বা করে দম নিল দুজনই, তারপর মাথা নামিয়ে নিল পানির নিচে।

পাঁচজন লোক। তিনজনের হাতে পিস্তল। একজন একটা ডলি ঠেলছে। পঞ্চম লোকটার চেহারায় নগ্ন আতঙ্ক, ওকে দেখলেই বোঝা যায় দলের বাকিদের করুণার উপর বেঁচে আছে। সবার পরনে সিকিউরিটি গার্ডের মতো পোশাক। ওয়াটার ট্যাঙ্ক দুটোর দিকে ফিরেও তাকাল না কেউ, হাঁটতে হাঁটতে গায়েব হয়ে গেল কয়েক সারি পিলারের আড়ালে।

পানির নিচ থেকে একইসঙ্গে মাথা তুলল রানা ও সোহেল।

এখান থেকে কিছু একটা নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছে ওই লোকগুলো, ফিসফিস করে বলল রানা।

মাথা নামা! শোনা গেল সোহেলের পাল্টা ফিসফিসানি।

আবার ডুব দিল ওরা।

ট্যাঙ্কের কাছে চলে এসেছে পুরুষ আর মহিলাটা। কালো প্যান্টের সঙ্গে সাদা শার্ট পরেছে প্রথমজন, তার উপর চড়িয়েছে ডিনার জ্যাকেট। দ্বিতীয়জনের পরনে কালো ইভনিং গাউন, পায়ে হাই হিলের বদলে ফ্ল্যাট-সোল জুতো। একটু আগের পাঁচজনের মতো সাবলীল গতিতে হাঁটছে না ওরা, বরং সতর্ক পায়ে এগোচ্ছে। এদিকওদিক তাকাচ্ছে বার বার, ওয়্যারহাউসের কোথায় কী আছে দেখে নিচ্ছে সম্ভবত। অদ্ভুত মাস্ক পরে থাকায় চেহারা দেখা যাচ্ছে না দুজনের কারও।

দম ফুরিয়ে এসেছে, তাই মাথা তুলতে হলো রানা সোহেলকে।

ওরা কি পার্টিতে মুখোশ পরে নাচানাচি আর খানাপিনা করছে? রানার কানে ফিসফিস করল সোহেল।

জবাব দিতে পারল না রানা, কারণ মহিলাটা চাপা গলায় বলে উঠেছে, এদিকে আরেকটা আছে। কিন্তু অন্ধকারের কারণে প্ল্যাকার্ড পড়তে পারছি না।

আরেকবার এদিকওদিক তাকিয়ে নিল মহিলার সঙ্গী। তোমার মোবাইল ফোনের আলো দিয়ে দেখো কী লেখা আছে।

মৃদু আলো জ্বলে উঠল। কিছুক্ষণ পর শোনা গেল মহিলার হতাশ কণ্ঠ, নাহ্, এটা না। অন্য কোথাও আছে।

দূরের পিলারগুলোর দিকে আবারও তাকাল পুরুষ লোকটা। আলো নেভাও। চলো সরে যাই এখান থেকে।

কথামতো কাজ করল ওর সঙ্গিনী।

 এবার? রানার কানে ফিসফিস করল সোহেল।

জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে দিতে পারলে ভালো হতো। ছাদের দিকে ইঙ্গিত করল। ওগুলো কি ফায়ার অ্যালার্ম?

রানা যেদিকে দেখাচ্ছে সেদিকে ইলেকট্রিকাল গ্রিডের মতো বিস্তৃত হয়েছে কয়েকটা পাইপ। কোনও কোনও পাইপের সঙ্গে আটকানো আছে হিট বা স্মোক ডিটেক্টর, সবুজ এলইডি বাতি জ্বলছে ওগুলোতে।

নাগাল পাবি? সোহেলের কণ্ঠে অনিশ্চয়তা।

 মাথা নাড়ল রানা, কী বোঝাতে চাইল ও-ই জানে। উঠে পড়ল, মইয়ের দিকে এগোচ্ছে। ওটা বেয়ে মাত্র নেমে এসেছে, এমন সময় নরক গুলজার হলো দূরে কোথাও।

একের পর এক গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

.

কভার নিল রানা-সোহেল, যেদিক থেকে গুলির শব্দ আসছে সেদিকে তাকাল।

পুরুষ আর মহিলা বুলেট বিনিময় করছে গার্ডের পোশাক পরা লোকগুলোর সঙ্গে। দুদিক থেকে গুলি করা হচ্ছে ওই দুজনকে, কিন্তু তাতে আতঙ্কিত হয়নি ওরা, বরং ওদের পাল্টা জবাব দেয়ার ভঙ্গি দেখলে মনে হয় অভ্যাস আছে এসবের। একবার গুলি করেই গড়ান দিয়ে জায়গা বদল করছে ওরা, পজিশন নেয়ামাত্র গুলি করছে আবার।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরই পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলো ওরা। সাবমেশিনগান হাতে নিয়েছে প্রতিপক্ষের একজন, ওটার একের পর এক বুলেট চুরমার করে দিচ্ছে একটা শেলফে সাজানো মাটির কতগুলো কলসিকে। ভাঙা টুকরোগুলো সশব্দে খসে পড়ছে মেঝেতে, ধুলো উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে। ধাতব শেলফে প্রতিহত হয়ে বিশ্রী শব্দ তুলে পিছলে চলে যাচ্ছে অন্য দিকে। কয়েকটা বুলেট ফুটো করল ওয়াটার ট্যাঙ্ক দুটোকে। পানি পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

পর পর কয়েকটা বুলেট ছুটে গেল মহিলাটির উদ্দেশে, কোনও ক্ষতি না হলেও কিছুটা দিশেহারা হয়ে গেল সে, কী করবে বুঝতে পারছে না। ওর সঙ্গী নিজের পজিশন ছেড়ে দৌড়ে আগে বাড়ল, ডাইভ দিল মহিলার উদ্দেশে, ওকে নিয়ে পড়ল মেঝেতে। গড়াতে গড়াতে সরে যাচ্ছে, নতুন কোনও জায়গায় পজিশন নেবে।

লাফ দিয়ে আড়াল ছেড়ে বের হলো রানা, মাথা নিচু করে ছুট লাগিয়েছে কামানের নলওয়ালা ওয়াটার ট্যাঙ্কের দিকে। দুহাত দিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা দিল ট্যাঙ্কের গায়ে। ধাতব ভিত্তি থেকে হুড়মুড় করে উল্টে পড়ল ট্যাঙ্কটা, চুরমার হয়ে গেল কাঁচ। গার্ডদের পোশাক পরা লোকগুলো যেদিকে আছে, সেদিকে ধেয়ে যাচ্ছে দশ হাজার গ্যালন পানি।

নকল গার্ডবাহিনীর একজন, খুব সম্ভব সাবমেশিনগানওয়ালা, ছুটে আসছিল এদিকে পানির ধাক্কায় উল্টে পড়ল সে। লোকটা উঠে দাঁড়ানোর আগেই ওর কাছে গিয়ে হাজির হলো রানা, বিরাশি সিক্কার একটা ঘুসি বসিয়ে দিল নাকেমুখে। আরেকবার উল্টে পড়ল লোকটা।

ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল ওর এক সহচর। পিস্তল তুলছিল সে রানাকে গুলি করার জন্য, হাতের সামনে যা পেল তা-ই ছুঁড়ে মারল সোহেল, ছোট অথচ ভারী ফিগারিনের প্রচণ্ড আঘাতে কপাল ফেটে গেল পিস্তলওয়ালার। অস্ত্রটা আপনাআপনি ছুটে গেল ওর হাত থেকে, কপাল চেপে ধরে বসে পড়তে বাধ্য হলো সে।

সাবমেশিনগানওয়ালার শরীর হাতড়ে রানা বাড়তি ম্যাগাজিনসহ একটা নাইন মিলিমিটার সেমি-অটোমেটিক লগার পেয়ে গেল। বুলেট শেষ হয়ে গেছে বলে সাবমেশিনগানটা এখন আর কাজের না।

রানা খেয়াল করল, গুলিবর্ষণ করছে না নকল গার্ডবাহিনীর অন্য কোনও সদস্য, প্রতিপক্ষে ঠিক কতজন লোক আছে তা বোধহয় ঠাহর করতে পারছে না ওরা। হামাগুড়ি দিতে শুরু করল ও, একহাতে পিস্তল অন্যহাতে বাড়তি ম্যাগাজিনটা। চলে এল একটা পিলারের আড়ালে। ঠিক তখনই গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল নকল গার্ডবাহিনীর অক্ষত সদস্যদের পক্ষ থেকে। সোহেল যেখানে ছিল, সে জায়গা নিশানা করে তিন রাউন্ড গুলি করল ওরা। ঝনঝন শব্দে ভাঙল আরও কিছু তৈজস। আগেই সরে গিয়ে অন্য একটা পিলারের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে সোহেল।

পিলারের আড়াল থেকে হাত বের করল রানা, প্রতিপক্ষের অবস্থান অনুমান করে নিয়ে ফায়ার করল দুবার। হাতটা পিলারের আড়ালে নিয়ে এসে সোহেলের কী অবস্থা তা দেখার জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।

আড়াল ছেড়েছে সোহেল। ও এখন কয়েকটা কাঠের বাক্স জোগাড় করায় ব্যস্ত। বাক্সগুলো একটার উপর আরেকটা রেখে মইয়ের মতো বানাচ্ছে। কাজ শেষে ঝটপট চড়ে বসল একেবারে উপরের বাক্সটায়, যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে হাত বাড়াচ্ছে স্মোক ডিটেক্টরের দিকে। নিজের দিকে দুটো বুলেট ডেকে নিয়ে এল ও। একটা বিধল ছাদে, আরেকটা চলটা তুলল পিলারের।

পিলারের পাশ ঘেঁষে মাথা আর পিস্তলধরা হাত বের করল রানা। কে কোত্থেকে গুলি করছে সোহেলকে তা দেখে ফেলল। একবার মাত্র টান দিল ট্রিগারে, সঙ্গে সঙ্গে আর্তচিৎকার ছেড়ে লুটিয়ে পড়ল প্রতিপক্ষ একজন।

থমকে গিয়েছিল সোহেল, কিন্তু আর দেরি না করে চালু করে দিল স্মোক ডিটেক্টর। বাজতে শুরু করল কানফাটানো অ্যালার্ম, জ্বলতে-নিভতে শুরু করেছে আলো, ওয়্যারহাউসের জায়গায় জায়গায় হিসহিস শব্দে ছড়িয়ে পড়ছে কার্বন ডাই অক্সাইডের ধোঁয়া।

ছুটন্ত পদশব্দ শোনা যাচ্ছে। রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাচ্ছে নকল গার্ডবাহিনী।

কিছুক্ষণ পর রানা আর সোহেল যখন বুঝল পরিস্থিতি নিরাপদ, ওয়্যারহাউসের দরজায় হাজির হলো দুজনে। বাইরে, লোডিং ডকের কাছে হাজির হয়ে গেছে কয়েকটা ফায়ার ইঞ্জিন; এসে গেছে পুলিশের গাড়িও। উদ্বিগ্ন চেহারায় ছোটাছুটি করছে মিউযিয়ামের আসল গার্ডবাহিনীর কয়েকজন সদস্য। গুদামের ভিতরে ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছে ওরা।

সাইড ডোর, কীভাবে সটকে পড়তে হবে সে-ব্যাপারে পরামর্শ দিল সোহেল।

দরজার কাছ থেকে সরে এল রানা। একটা পার্শ্বদরজা খুলে বেরিয়ে এল ওয়্যারহাউসের সঙ্গের গলিতে। সোহেলের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে টের পেল, সেই পুরুষ আর মহিলা উধাও হয়ে গেছে কখন যেন।

বিক্ষিপ্ত চিন্তা পেয়ে বসল রানাকে। কারা এরা?

.

হোটেলরুমে অপেক্ষা করছিল লামিয়া।

রানা-সোহেলকে আপাদমস্তক দেখল সে, তারপর মুখ গোল করে শিস বাজাল।

কী ঘটেছে, সংক্ষেপে বলল রানা। তারপর বলল, মনে হচ্ছে, আমাদের চেয়ে অনেক ভালো সময় কাটিয়েছ তুমি।

ঠিক, মুচকি হাসছে লামিয়া। কারণটা অনুমান করতে পারো?

লুসি এল, একটা গ্লাসে নিজের জন্য খানিকটা স্কচ ঢেলে নিচ্ছে রানা।

চওড়া হলো লামিয়ার হাসিটা। লুসি এল মানে লুসি লরেন। ফ্রেঞ্চ লেজিসলেটিভ অ্যাসেমব্লির একজন সম্মানিত সদস্য পিয়েরে কার্তিনের প্রেমিকা ছিলেন তিনি। তাকে এতই ভালোবাসতেন কার্তিন যে, নিজের প্রভাব খাটিয়ে ফরাসি নৌবাহিনীকে বাধ্য করেছিলেন ওদের একটা জাহাজের নাম লুসি লরেন রাখতে।

আসল লুসির কী হলো? একচুমুক স্কচ খেল রানা।

বুড়ো বয়সে একদিন মারা যান তিনি ঘুমের মধ্যে। প্যারিসের বাইরের একটা কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।

ভ্রূ কুঁচকে গেছে রানার। আমার মনে হয় লুসি এল দিয়ে জাহাজটার কথা বলেছে হেল্ডন।

মাথা ঝাঁকাল লামিয়া। পকেট থেকে ভাজকরা একটা প্রিন্টআউট বের করে খুলল। নেপোলিয়নের ভূমধ্যসাগরীয় নৌবহরে যুক্ত ছিল লুসি লরেন। সময়ে সময়ে নোঙর ফেলত মাল্টায়। একবার মিশর থেকে মূল্যবান অনেক জিনিস লুট করে ফরাসিরা, ওসব নিয়ে মাল্টার বন্দর ছাড়ে জাহাজটা। কিন্তু ঝড়ে পড়ে ডুবে যায়। পরে উদ্ধার করা হয় বেশিরভাগ জিনিস। কাজটা করে মাল্টারই একটা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, এখানকার এক ধনাঢ্য পরিবারের সহায়তায়। ওই পরিবারের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় দীর্ঘদিন ধরে ছিল উদ্ধারকৃত কিছু আর্টিফ্যাক্ট। জাদুঘরের মাধ্যমে ওগুলো বেচার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

হিসেব মিলতে শুরু করেছে, বলল সোহেল। কিন্তু নিলামে কী ঘটতে যাচ্ছে তা না বলে, জাহাজের কথা বলল কেন হেন?

খুব সম্ভব এখনও এমন কিছু রয়ে গেছে সাগরের তলদেশে-থাকা ওই জাহাজে, যা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

কী সেটা? ওয়্যারহাউসে আমি যে-ভাঙা লিপিফলক দেখেছি, তার বাকি অংশ?

হতে পারে, লামিয়ার দিকে তাকাল রানা। কোথায় ডুবেছিল লুসি লরেন?

ভ্যালেটা থেকে ত্রিশ মাইল পুবে।

স্কচের গ্লাসটা খালি করে টেবিলে নামিয়ে রাখল রানা। আমাদের প্রতিপক্ষের পরবর্তী চাল অনুমান করতে পারছি। যা খুঁজতে গিয়েছিল ওরা ওয়্যারহাউসে তা পায়নি। এখন আমাদের মতো ওদের হাতেও একমাত্র সূত্র ডুবে যাওয়া লুসি লরেন।

তারমানে ওদের আগেই সাগরে ডুব দিতে চাইছিস তুই?

মাথা ঝাঁকাল রানা। যদি সম্ভব হয়।

.

১৫.

রানা, সোহেল, লামিয়া আর কয়েকজন ক্রু নিয়ে ভ্যালেটা ছেড়েছে সি-হর্স।

জাহাজের নাক যদি উত্তরদিকে না ঘুরাই, লুসি লরেনের অবস্থান একটা চার্টে দেখে নিয়ে রানাকে বলল কুপার, তা হলে আসল জায়গা থেকে কয়েক মাইল দূরে চলে যাব।

আপাতত বিচ্ছেদ চাইছি আমি, হাসল রানা।

হাসল কুপারও। যথাজ্ঞা।

জাহাজের পেছনদিকে চলে এল রানা। এখানেই একটা গ্লাইডারের বিভিন্ন পার্ট জোড়া দিচ্ছে লামিয়া আর সোহেল।

রেডি? জিজ্ঞেস করল রানা।

প্রায়, বলল লামিয়া। গ্লাইডারের ল্যাচগুলো ঠিক আছে কি না দেখল শেষবারের মতো, ওটার সঙ্গে কায়দা-করে আটকে-দেয়া শক্তিশালী যুম লেন্সের ক্যামেরাটা চালু করল।

উইঞ্চ কন্ট্রোলের দিকে তাকাল রানা। স্টিলের তার দিয়ে সোনার অ্যারে (sonar aray) টানার জন্য ব্যবহৃত হয় ওটা, কিন্তু তার খুলে ফেলে উইঞ্চে লাগানো হয়েছে। প্ল্যাস্টিকের পাতলা দড়ি, মুক্তপ্রান্ত গ্লাইডারের সঙ্গে যুক্ত।

গ্লাইডারটা বহন করে স্টার্নের দিকে এগোল সোহেল। মাথার উপরে তুলে ছুঁড়ে দিল বাতাসে। শূন্যে উঠে গেল ওটা, ঘুরতে শুরু করেছে উইঞ্চ কন্ট্রোলের ড্রাম।

হাতে ছোট একটা হ্যাঁণ্ডসেট নিয়ে গ্লাইডারটা নিয়ন্ত্রণ করছে লামিয়া। ওটা পাঁচ শ ফুট ওঠার পর, আর যাতে উঠতে না পারে সেজন্য চাপ দিল হ্যাঁণ্ডসেটের একটা বাটনে। রানার দিকে তাকিয়ে বলল, উইঞ্চ কন্ট্রোল লক করে দাও।

কন্ট্রোল লক করে লামিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াল রানা। বার্ডস আই-ভিউ কী বলছে?

ল্যাপটপ কোলে নিয়ে ডেকে বসে পড়ল, লামিয়া। ক্যামেরার অটোফোকাস চালু হতেই দেখা গেল, নীল সাগরের বুক চিরে ছুটছে সি-হর্স।

দেখি আমাদের বন্ধুরা কী করছে, হ্যাঁণ্ডসেটের বাটনে চাপ দিয়ে গ্লাইডারটা উত্তরদিকে ঘোরাল লামিয়া।

এবার অন্য দুটো বোট দেখা যাচ্ছে ল্যাপটপের স্ক্রিনে। মনে হচ্ছে, ঘন নীল টেবিলক্লথের উপর যেন পড়ে আছে দুটো চালের-দানা। ওগুলোর উপর ক্যামেরার যুম লেন্স ফোকাস করল মিয়া। একটা ডাইভ বোট আর একটা বার্জ।

আরও যুম করা যাবে? জিজ্ঞেস করল রানা।

যাবে। কোটার উপর করব?

 বার্জ।

শক্তিশালী টেলিস্কোপিক লেন্সের বদৌলতে দেখা গেল, বার্জের লাল কাঠামোর একদিকে সাদা রঙে লেখা আছে: ডিসুজা কনযারভেন্সি। ওটার এককোনায় ছোট একটা ক্রেন আছে, একটা বড় পিভিসি টিউবকে সাপোর্ট দিচ্ছে। পানি আর গাদের মিলিত স্রোত ছিটকে বের হচ্ছে টিউব দিয়ে, গিয়ে পড়ছে একটা ধাতব ছাঁকনির উপর। হাতের পাঞ্জার সমান বড় যে-কোনও পাথর আটকে যাবে ছাঁকনির জালে।

সোহেল বলল, একটা বই পড়েছিলাম: হলো না, রত্না। ওটার নামের সঙ্গে মিলিয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি, হলো না, রানা।

ওর দিকে তাকাল লামিয়া। কী হলো না?

রানা চেয়েছিল শত্রুপক্ষের আগেই এখানে পৌঁছাতে।

বোটটারও ক্যামেরা লামিয়াকে বলল

কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল লামিয়া, ক্যামেরা আরেকটু ঘোরাল। ছাঁকনি পর্যবেক্ষণ করছে দুজন লোক। ওটাতে আটকা পড়েছে কিছু একটা, জাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিল বার্জের ডেকে।

অন্য বোটটা দেখি? লামিয়াকে বলল রানা।

আবারও ক্যামেরা ঘোরাতে হলো লামিয়াকে। ডাইভ বোটটা ষাট ফুট লম্বা। ডেকের সামনের দিকে স্তূপ হয়ে আছে। স্কুবা ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য গিয়ার। স্টার্নে শুয়ে-বসে আছে কয়েকজন লোর্ক। ওদের থেকে একটু দূরে রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন। লোকটার উপর যুম করার চেষ্টা করল লামিয়া, কিন্তু সম্ভব হলো না-ক্যামেরার যুমিং ম্যাক্সিমামে চলে গেছে।

কোস্ট গার্ড অথবা মাল্টার ডিফেন্স ফোর্সের সঙ্গে যোগাযোগ করব? বলল মেয়েটা। কয়েকটা বোট যদি পাঠায় ওরা, ওই লোকগুলোকে ঘিরে ফেলা সম্ভব হবে।

কিন্তু রাইফেলের মুখে যাদেরকে ডুব দিতে বাধ্য করা হয়েছে, বলল রানা, তাদেরকে বাঁচতে দেবে না শত্রুপক্ষ। হেন্ডন আর ডারহামের বেলায় কী ঘটেছে, দেখেছি আমরা। ওয়্যারহাউসটাও উড়িয়ে দেয়ার প্ল্যান করেছিল ওরা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে।

চেহারার উপর নেমে-আসা চুল সরাল লামিয়া। তা হলে?

ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকাল রানা। ওদেরকে চমকে দিতে চাই আমি।

কীভাবে? ভ্রূ নাচাল সোহেল।

উঠে দাঁড়াল রানা। বিদ্রোহের পয়গাম পৌঁছে দেব ডিসুজা কন্যারভেন্সির ডাইভারদের কাছে।

বিশ মিনিট পর।

পাওয়ার্ড ডাইভ স্যুট পরে একটা আর.ও.ভি. (রিমোটলি অপারেটেড ভেহিকেল)-সহ সাগরে নামল রানা আর সোহেল। ওটা একটা বিশেষ ধরনের আণ্ডারওয়াটার রোবট, সি-হর্সের সঙ্গে কয়েকটা কেবলের মাধ্যমে যুক্ত।

লুসি লরেন যেখানে ডুবেছে, সে-জায়গা এখনও মাইল তিনেক দূরে আছে। সি-হর্সের নাক দক্ষিণদিকে সরিয়ে নিল। কুপার, যাতে ওটার উপস্থিতি রাডার বা বিনকিউলারের মাধ্যমে টের পেয়ে গেলে শত্রুপক্ষ ভাবে, উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াচ্ছে ওটা।

পানিতে নামামাত্র শক্তিশালী স্রোতের ধাক্কায় সি-হর্স থেকে দূরে সরে গেল রানা, সোহেল আর ওদের আর.ও.ভি.। বয়ান্সি অ্যাডজাস্ট করে নিয়ে ডুব দিল ওরা, আস্তে আস্তে নামছে, আর.ও.ভির ফ্রেম ধরে আছে। পঞ্চাশ ফুট নামার পর চালু হলো ওটার প্রপেলার, ঘুরতে শুরু করেছে। ওটার পাওয়ার মেকানিযম সি-হর্সেও আছে, আবার রানা-সোহেলের ডাইভস্যুটেও আছে।

রানার অনুমান, সমুদ্র সমতল থেকে নব্বই ফুট নিচের তলদেশে শুয়ে আছে লুসি লরেনের ধ্বংসাবশেষ।

আর.ও.ভি.র টেলিমেট্রি, মানে স্বয়ংক্রিয় উপায়ে দূরে কোথাও তথ্য ও মেসেজ প্রেরণ ও পরিমাপণ পদ্ধতির সঙ্গে সোহেলের চওড়া হেলমেটের যোগাযোগ আছে; ভিতরের ডিসপ্লেতে ও দেখতে পাচ্ছে কত গভীরে নেমেছে ওরা, কোনদিকে যাচ্ছে, গতি কত ইত্যাদি। বেশ কিছুক্ষণ পর বলল, নিচে চলে এসেছি প্রায়।

নিচের দিকে তাকাল রানা। আর.ও.ভি.র ফরওয়ার্ড মাউন্টেড লাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে সাগরের কর্দমাক্ত তল।

ওই জায়গা থেকে যখন কিছুটা উপরে আছে তখন থামল সোহেল, সমান্তরালে এগোচ্ছে এখন। আর.ও.ভি.র গ্রুটলে চাপ দিল ও। লাইট বন্ধ করে দিচ্ছি। চাই না কেউ দেখে ফেলুক আমাদেরকে।

লাইট নিভিয়ে দেয়ায় মনে হচ্ছে, অন্ধকার কোনও টানেলের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে ওরা। আঁধার একসময় সয়ে এল চোখে।

যতটা ভেবেছিলাম, তারচেয়ে বেশি আলো পাচ্ছি, বলল সোহেল।

প্রায় সাত নট গতিতে এগোচ্ছে ওরা। লুসি লরেনের কাছাকাছি পৌঁছাতে আরও বিশ মিনিটের মতো লাগল। দূর থেকে অস্পষ্ট একটা ছায়ার মতো দেখাচ্ছে ওটার ধ্বংসাবশেষ। জাহাজের আশপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে তিন চারটে ডাইভিং লাইট।

সোহেলের উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল রানা।

লুসি লরেনের কাছে একজায়গায় গাদ জমাট বেঁধে ঢিবির আকতি ধারণ করেছে, ওটার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল আরও দুজন লোক। পঞ্চম আর ষষ্ঠ লাইটটা দেখা গেল। কাছেই কোথাও একটানা কাজ করছে কোনও সাবমার্জড ভ্যাকুয়াম, একটানা দুম দুম শব্দ শোনা যাচ্ছে।

আরেকটু কাছে যা, সোহেলকে বলল রানা। আমি কোথাও নেমে যাই। সবচেয়ে কাছের ডাইভারের সঙ্গে কথা বলে দেখি। চাপ দিয়ে খুলল একহাতে লাগানো একটা স্পেশাল প্যানেল।

ওটা আসলে একটা ওয়াটারপ্রুফ ডিসপ্লে স্ক্রিন। রানা যদি ইংরেজিতে কিছু বলে, তা হলে ওর কথাগুলো শব্দে-বাক্যে রূপান্তরিত হয়ে দেখা দেবে স্ক্রিনে, ফলে অন্য ডাইভারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সহজ হবে।

আর.ও.ভি.র টুলব্ল্যাক থেকে একটা টুইন-রেইল স্পিয়ারগান নিল রানা। ডাইভারদের কে ভালো কে খারাপ জানি না। ওদের কেউ আমাদেরকে দেখতে পেয়েছে বলে মনে হয় না। তারপরও যদি বিপদে পড়ি, কী করতে হবে জানিস তুই।

মাথা ঝাঁকাল সোহেল।

.

একটানা দুম দুম আওয়াজ বাদে রানার চারদিকে অখণ্ড নীরবতা।

লুসি লরেনের বাঁ পাশটা বেশি কর্মচঞ্চল। পাঁচটা লাইট দেখা যাচ্ছে ওখানে। গিয়ার-পরা ডাইভাররা কাজ করছে ভ্যাকুয়াম ঘিরে। ডানদিকে বাঁক নিল রানা। এখানে মাত্র দুটো ডাইভলাইট। জাহাজের কঙ্কালের নিচ থেকে কিছু একটা খুঁড়ে বের করার চেষ্টা করছে দুজন ডাইভার।

ওদের কাজ কিছুক্ষণ দেখল রানা। ধ্বংসাবশেষটাকে আরও ধ্বংস করছে ওরা, সুবিধামতো কেটে টুকরো করছে জাহাজের কোনও কোনও জায়গা। তারপর কাটা অংশগুলো সরিয়ে নিয়ে জড়ো করছে একজায়গায়।

দুই ডাইভারের অগোচরে ওদের কাছে গিয়ে হাজির হলো রানা। সাহায্য করতে চাই, কথাটা উচ্চারণ করল, স্পেশাল প্যানেলে সবুজ আলোয় ফুটে উঠল বাক্যটা। আরও এগিয়ে গিয়ে এক ডাইভারের কাঁধে আলতো থাবা দিল।

ঘুরে তাকাল লোকটা। চেহারা নীল হয়ে গেছে ওর, আধবোজা হয়ে এসেছে দুই চোখ। তারমানে অনেকক্ষণ ধরে পানির নিচে আছে সে। ওর চোখের সামনে ধরল রানা প্যানেলটা।

ইশারায় কী যেন বলল লোকটা। খুব সম্ভব বোঝাতে চাইছে, যত তাড়াতাড়ি পারছি কাজ করার চেষ্টা করছি।

ব্যাটা শিয়োর আমাকে খারাপ লোক ভেবেছে, মনে মনে বলল রানা। এবার উচ্চারণ করল, উদ্ধার করতে চাই। প্যানেলটা আগেরবারের মতো দেখাল।

চোখ পিটপিট করছে লোকটা, বিহ্বলতা দেখা যাচ্ছে ওর চেহারায়।

তোমাদেরকে যারা জিম্মি করেছে তাদের সংখ্যা কত? জানতে চাইল রানা।

প্যানেলটার দিকে তাকাল লোকটা, তারপর দুই হাতের নটা আঙুল দেখাল।

সবাই নেমেছে পানিতে?

আবারও প্যানেলটা দেখে নিয়ে একহাতের পাঁচ আঙুল দেখাল লোকটা, তারপর ইশারা করল উপরের দিকে। তারপর দেখাল চারটা আঙুল, ইশারা করল আশপাশে।

তারমানে শত্রুপক্ষের পাঁচজন আছে পানির উপরে, চারজন নিচে।

দেখাও আমাকে, প্যানেলে ফুটে উঠল রানার কথা।

কিন্তু লোকটা কিছু বলা বা করার আগেই আলোর নাচন এসে পড়ল ওর আর রানার উপর। লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে যা বোঝার তা বোঝা হয়ে গেল রানার। চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরল ও।

একহাতে বল্লম নিয়ে ধেয়ে আসছে আরেকটা লোক।

.

একধাক্কায় গোবেচারা ডাইভারকে সরিয়ে দিল রানা, শুট করার জন্য আরেকহাতে তুলছে স্পিয়ারগান। কিন্তু আক্রমণোদ্যত লোকটা অনেক কাছে চলে এসেছে, নিশানা করার সময় পাবে না রানা। বল্লমের আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য স্পিয়ারগান দিয়ে বাড়ি মারল লোকটার হাতে, তারপর জড়িয়ে ধরল ওকে।

প্রতিপক্ষের পরনে ফুলফেইস হেলমেট, তা না হলে ধাক্কা মেরে ওটা খুলে দিত রানা। আনআর্মড কমব্যাটের কিছু কৌশল প্রয়োগ করতে গেল ও লোকটার উপর, কিন্তু পানির নিচে হার্ডটের কারণে ঠিকমতো করা যাচ্ছে না কাজটা। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করার পর নিজেকে কায়দা করে লোকটার পেছনে নিয়ে গেল ও, সঙ্গে সঙ্গে হেডলকে আটকে ফেলল লোকটাকে। এককালে যে-জায়গা ছিল লুসি লরেনের বো, এখন সেটা ভাঙাচোরা কিছু কাঠ আর প্রবালের স্তূপ; প্রতিপক্ষকে ঠেলতে ঠেলতে সেদিকে নিয়ে যাচ্ছে রানা।

হাত থেকে বল্লম পড়ে গেছে আক্রমণকারীর, বুঝে গেছে রানার ইস্পাতকঠিন হেডলক থেকে মুক্তি নেই ওর। পালাক্রমে দুই কনুই পেছনদিকে চালিয়ে রানাকে আঘাত করার চেষ্টা করছে সে, কিন্তু পানির কারণে জুৎসই হচ্ছে না ওর আঘাত। শরীর মুচড়ে একটা হাত নিয়ে গেল কোমরের কাছে–ছুরি বের করবে।

কিন্তু তার আগেই লোকটাকে ভাঙা কাঠ আর প্রবালের স্থূপের উপর আছড়ে ফেলল রানা।

প্রচণ্ড আঘাত প্রায় পঙ্গু বানিয়ে দিল লোকটাকে। ছুরি বের করে ফেলেছিল সে, ওটা আপনাআপনি ছুটে গেল হাত থেকে। একটা ভাঙা কাঠ কুড়িয়ে নিল রানা, শাবল দিয়ে মাটি গর্ত করার কায়দায় কয়েকবার জোরে গুতো মারল প্রতিপক্ষের বুকে-পেটে। এবার প্রবালপ্রাচীরের একটা কোনা ভেঙে নিয়ে সাগরের তলদেশে লুটিয়ে পড়ল লোকটা, দুই হাত ছড়িয়ে দিয়েছে দুদিকে।

চোখের কোনা দিয়ে রানা দেখল, আরও দুজন লোক আসছে ওর দিকে। দুজনের চেহারাতেই ফুলফেইস হেলমেট।

পানিতে কিছু বুদ্বুদ দেখতে পেয়ে চরকি-পাক খেল রানা, ওর শরীর ঘেঁষে বেরিয়ে গেল স্পিয়ারগান থেকে নিক্ষিপ্ত স্পিয়ার। এলোপাতাড়ি লাথি মারছে ও তলদেশের বালিতে, নিজেকে আড়াল করার জন্য স্মোকস্ক্রিন বানাতে চায়। লাফিয়ে সরে এল বাঁ দিকে, ল্যাণ্ড করামাত্র আবার লাথি মারতে শুরু করল বালিতে।

খুব একটা লাভ হলো না। তৃতীয় হামলাকারীর স্পটলাইটের উজ্জ্বল আলোয় ধরা পড়ে গেল রানা, ওকে দেখামাত্র আণ্ডারওয়াটার রাইফেল কাঁধে তুলল লোকটা। ট্রিগারে চাপ দিতে যাবে লোকটা, এমন সময় ঝট করে বসে পড়ল রানা, জায়গাটা ছেড়ে ব্যাঙলাফের কায়দায় সরে যাওয়ার সময় টের পেল মাথার উপর দিয়ে ছুটে গেল বুলেট।

যেখানে ধস্তাধস্তি করেছিল রানা প্রথম হামলাকারীর সঙ্গে, কেস্ক্রিনটা আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে সেখানে হাজির হলো ও প্রাণপণে; তুলে নিল নিজের স্পিয়ারগান। নিশানা করার সময় নেই, তাই রাইফেলওয়ালা কোনদিকে আছে। অনুমান করে নিয়ে টান দিল ট্রিগারে।

রানা ও-রকম কিছু করতে পারে ভাবতে পারেনি রাইফেলওয়ালা; ওর ডান কাঁধের অনেকখানি মাংস ছিঁড়ে নিয়ে যখন বেরিয়ে গেল রানার স্পিয়ার, হাত থেকে রাইফেল ফেলে দিতে বাধ্য হলো। আরেকহাত দিয়ে চেপে ধরেছে কাঁধের ক্ষতস্থান, ঊ্যাটাবিদ্ধ মাছের মতো ছটফট করছে।

নিজের স্পেশাল প্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে রানা আগেই। থিতিয়ে আসছে স্মোকস্ক্রিন; প্রবালপ্রাচীরের কোন্ জায়গায় প্রথম হামলাকারীকে আছড়ে ফেলেছিল তা মাথায় রেখে হামাগুড়ি দিয়ে পিছিয়ে আসছে ও।

প্রবালপ্রাচীরের কাছে মাত্র হাজির হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ওর বাঁ পার উপর নিজের দুই পা দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল প্রথম হামলাকারী। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রানা। প্রতিপক্ষের হাতে বড় একটা প্রবালখণ্ড, ওটা মাথার উপর তুলছে লোকা, হেলমেটসহ তেলে দিতে চায় রানার মাথা। তাড়াহুড়ো করল না রানা, স্পিয়ারগানটা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিল। নিজের বাঁ পার উপর আরেকটু চড়ে দাঁড়ানোর সুযোগ দিল প্রবালওয়ালাকে, তারপরই ডান পা দিয়ে সর্বশক্তিতে লাথি মারল লোকটার এক মালাইচাকিতে। পানির কারণে অত জোরালো না হলেও টলে উঠল লোকটা, প্রবালখণ্ড পড়ি-পড়ি করছে হাত থেকে।

ইতোমধ্যে স্পিয়ারটা খুলে নিয়েছে রানা গান থেকে; একদিকে কাত হয়ে উঠে বসল ও। স্পিয়ার দুহাতে ধরে ওটার চোখা অংশটা বসিয়ে দিল প্রতিপক্ষের উরুতে। আরেক লাথিতে নামিয়ে দিল লোকটাকে নিজের উপর থেকে। স্পিয়ার ধরে রেখেই শুয়ে পড়ল, গানটা টেনে নিয়ে সরে এল প্রবালপ্রাচীরের একপাশে।

অক্ষত হামলাকারীর আণ্ডারওয়াটার রাইফেলের বুলেট চিড় ধরাল প্রবালপ্রাচীরের গায়ে। লাভই হলো রানার–ক্ষণস্থায়ী আরেকটা স্মোকস্ক্রিনের বদৌলতে শরীরের অনেকখানি ঢুকিয়ে ফেলল প্রাচীরের আড়ালে। মাথাটা বের করে রেখেছে, যত দ্রুত সম্ভব দেখে নিতে চায় কোথায় আছে অক্ষত হামলাকারী। একইসঙ্গে স্পিয়ার লোড করছে গানে।

তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বোকামি করে ফেলেছে ওই লোক-স্পটলাইট জ্বালিয়ে রেখেছে নিজের। প্রবালপ্রাচীরের আড়াল থেকে দুই হাত আর স্পিয়ারগান বের করল রানা, নিশানা করে টান দিল ট্রিগারে।

রানাকে দেখে ফেলেছিল লোকটা, আবারও রাইফেল তুলছিল কাঁধে, কিন্তু ওর ইচ্ছা মঞ্জুর হলো না। কণ্ঠনালী ভেদ করে বেরিয়ে গেল স্পিয়ার, পানিতে রক্তের একটা ঊর্ধ্বমুখী ধারা রেখে পড়ে যাচ্ছে।

প্রবালের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এল রানা, স্পিয়ারগান ছেড়ে দিয়ে আবারও হেডলকে ধরল প্রথম হামলাকারীকে। লোকটা তখনও বসে ছিল, দুহাতে চেপে ধরে থামানোর চেষ্টা করছিল উরুর রক্তক্ষরণ। একবার ডানে পরেরবার বায়ে, এভাবে বার কয়েক ঝাঁকুনি দিল রানা লোকটাকে বাঁ পায়ে ভর রেখে ডান পা দিয়ে সমানে লাথি মারছে লোকটার ক্ষতস্থানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই উরুর মায়া ভুলতে হলো লোকটাকে, কারণ নিস্তেজ হয়ে গেছে।

ওকে ছেড়ে দিল রানা, এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। প্রথম হামলাকারীর ছুরি আর বল্লম কুড়িয়ে নিল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হামলাকারীর রাইফেল দুটো খুঁজছে, এমন সময়, কোত্থেকে তা বলতে পারবে না রানা, ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কাঁধের-মাংস-হারানো লোকটা। বোঝা গেল মাংস হারালেও ক্ষোভ হারায়নি সে।

রানার হেলমেটে জোরে ঘুসি মেরেছে লোকটা, টালমাটাল করে দিয়েছে রানাকে। চেপে ধরেছে রানার এয়ারহোস-ওটা হ্যাঁচকা টানে আলগা করে দিতে চায়।

আক্রমণকারীর তলপেটে হাঁটু দিয়ে জোরালো এক গুতো মারল রানা। হোস ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো লোকটা। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে লোকটার দিকে ঘুরল রানা, সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল। একটা এক্সপ্লোসিভ ব্যাং স্টিক দেখতে পাচ্ছে ও প্রতিপক্ষের হাতে।

ডাইভারদের অনেকেই আজকাল সঙ্গে রাখে ওই স্টিক, কারণ হাঙর হামলা করলে উপযুক্ত জবাব দেয়া যায় ওটা দিয়ে। রানা শুনেছে পনেরো ফুটের হাঙরের শরীরেও মরণক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে স্টিকটার স্পর্শ পাওয়ামাত্র। তাই ওর শরীরে স্টিক দিয়ে যেই গুঁতো দিতে যাবে প্রতিপক্ষ, অমনি ছুরি ছেড়ে দিয়ে লাঠিখেলার কায়দায় মেলে ধরল বল্লমটা, ওটা গলে গিয়ে দুভাগ হতেই চেপে ধরল হামলাকারীর দুই হাত।

লম্বাচওড়ায় রানার প্রায় সোয়া গুণ লোকটা; কাঁধের মাংস ঠিক থাকলে ব্যাং স্টিক ছাড়াই হয়তো মরণক্ষত তৈরি করতে পারত রানার শরীরে। সর্বশক্তিতে বাধা দিয়েও কুলাতে পারছে না রানা, স্টিকটা একটু একটু করে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। কপালে নিজের ঘাম টের পাচ্ছে ও। দেখতে পাচ্ছে প্রতিপক্ষের দুই চোখের ছিটগ্রস্ত দৃষ্টি।

লেখা যাবে না, ছাপা যাবে না এমন একটা খাঁটি বাংলা গালি শুনতে পেল রানা হেলমেটের ভিতরের স্পিকারে। পরমুহূর্তে, ম্যাটাডোরকে যেভাবে একগুতোয় ছিটকে ফেলে খ্যাপা বঁড়, চলন্ত আর.ও.ভি, দিয়ে সেভাবে ধাক্কা মেরে দশাসই লোকটাকে ফেলে দিল সোহেল।

আয়… ছাপার অযোগ্য গালিটা আবারও দিল সোহেল, দেখি কত শক্তি তোর! আর.ও.ভি, উঠিয়ে দিয়েছে দশাসইয়ের উপর, ওটা দিয়ে বালিতে গেঁথে ফেলতে চাইছে লোকটাকে।

মাথায় ধাতব ষাঁড়ের প্রচণ্ড গুঁতো খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে লোকটা, ব্যাং স্টিক পড়ে আছে ওর একপাশের বালিতে।

ডিসুজা কন্যারভেন্সির ডাইভারদের কাছে চল জলদি, সোহেলকে বলল রানা। অনেকক্ষণ ধরে পানির নিচে থাকতে থাকতে মরার দশা হয়েছে ওদের।

.

হাত উপরে তোলেনি, কিন্তু জিম্মি-করা ডাইভারদের ভঙ্গি আত্মসমর্পণ করার মতো।

প্যানেলটা চালু করে রানা বলল, গার্ডরা নেই। তোমাদেরকে এখান থেকে নিয়ে যাব আমরা।

জবাবে একজন ডাইভার আঙুল তুলে কী যেন দেখাল উপরের দিকে, ঠিক বোঝা গেল না।

এখানে কতক্ষণ ধরে আছ তোমরা? জিজ্ঞেস করল রানা।

জবাবে চারটা আঙুল দেখানো হলো।

মানে চার ঘন্টা।

রানার সঙ্গে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল সোহেল।

জলদি উপরে চলো, বলল রানা।

কিন্তু আশ্চর্য, যাওয়ার তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না কোনও ডাইভারের মধ্যে।

একজন ডাইভার বিশেষ একজাতের একটা বোর্ড নিয়ে এল, ওটাতে ওয়াটারপ্রুফ চক দিয়ে দাগ দিলে লেখা ওঠে। কী যেন লিখল সে বোর্ডে। তারপর বোর্ডটা মেলে ধরল রানা সোহেলের চোখের সামনে।

শব্দটা দেখামাত্র চমকে উঠল ওরা দুজনই।

ডাইভার লিখেছে: বম।

.

১৬.

ইঙ্গিতে লুসি লরেনের ধ্বংসাবশেষ দেখাল ডাইভার। তারপর বোর্ডে লিখল: আপনারা যখন হামলা চালিয়েছেন, ওরা তখন জাহাজে বম ফিট করেছে।

তারমানে শত্রুপক্ষ আগেই ঠিক করে রেখেছিল, যা খুঁজছিল তা যদি নিতে না পারে তা হলে অন্য কারও হাতে পড়তে দেবে না। 

বম কোথায় আছে, দেখাও, ডাইভারকে বলল রানা।

সাঁতার কাটতে শুরু করল লোকটা, এগিয়ে যাচ্ছে জাহাজের দিকে। ওটার বাইরের দিকের কিছু তক্তা গায়েব হয়ে গেছে, তবে মোটা গুঁড়ি দিয়ে বানানো কাঠামোটা দেখা যায়। কাছে গিয়ে আলো ফেলে দেখিয়ে দিল লোকটা একদিকের তলদেশ। এখান থেকে ভ্যাকুয়ামের সাহায্যে প্রচুর গাদ অপসারণ করা হয়েছে। যেসব পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন মিশরীয় না, যেমন মাস্কেট, লোহার বেড়ওয়ালা পিপা, পুরনো বুট ইত্যাদি স্তূপ হয়ে পড়ে আছে একপাশে।

রানা দেখল, একটা না, দুটো বম ফিট করা হয়েছে। সংযোগ দেয়া হয়েছে টাইমারের সঙ্গে। আরও কাছে গেল রানা, ডিজিটাল টাইমারটা দেখতে পাচ্ছে এখন। আর দুই মিনিট একান্ন সেকেণ্ড বাকি আছে। প্রতি মুহূর্তে কমছে সেকেণ্ডের হিসেব।

তক্তার ফাঁক দিয়ে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিল রানা, শরীর টানটান করে দিয়েছে, বোমাটার নাগাল পেতে চায়। কিন্তু পারল না। দুফুট দূরে রয়ে গেছে ওটা।

সোহেল, ডাকল ও, তোর সাহায্য লাগবে।

টাইমার যখন বলছে বোমা ফাটতে আর দুমিনিট বাকি, আর.ও.ভি.-সহ তখন হাজির হলো সোহেল। একটা ম্যানিপুলেটর আর্ম আছে রোবটটাতে, সুইচ টিপে ওটা চালু করল সোহেল। কিন্তু যন্ত্রের বর্ধিত বাহুও ওদের উদ্দেশ্য সাধনে সফল হলো না।

এমন সময় কিছু একটা দিয়ে মৃদু আঘাত করা হলো রানার পিঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ও। বোমার কথা জানিয়েছে যে-ডাইভার, হাতে ভ্যাকুয়াম পাইপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ওটা দিয়েই বাড়ি মেরেছে রানার পিঠে।

চমৎকার আইডিয়া, বলল রানা।

ভ্যাকুয়াম কাজ করছে এখনও। পাইপটা জাহাজের পাঁজরার ভিতরে ঢুকিয়ে দিল রানা। ওটা একদিকে এমনভাবে কাত করে রেখেছে যে, ভ্যাকুয়ামের টানে বোমাটা ঢুকে যাবে না ভিতরে, বরং পাইপের মুখে আটকে থাকবে। হলোও তা-ই। পাইপ কিছুটা চেপে ধরল রানা-ভ্যাকুয়ামের জোর কমিয়ে দিচ্ছে, একইসঙ্গে একটু একটু টেনে বের করে আনছে পাইপটা।

বোমাটা বের হওয়ামাত্র ওটা পাইপের মুখ থেকে আলগা করে নিল সোহেল। অভ্যস্ত হাতে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ইলেকট্রিকাল লীডগুলো সরিয়ে নিষ্ক্রিয় করে দিল ওটা। বন্ধ করে দিল টাইমারও। আর চল্লিশ সেকেণ্ড বাকি ছিল। চল দ্বিতীয় বোমাটার ব্যবস্থা করি এবার।

ও বলার আগেই কাজ শুরু করে দিয়েছে রানা। ভ্যাকুয়াম পাইপ আগেরবারের মতো নিয়ে গেছে বোমার কাছে, পাইপের একটা পাশ চেপে ধরে ওটার মুখে আটকে ফেলার চেষ্টা করছে বোমাটা। কিন্তু পারল না এবার-তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে জাহাজের কাঠের সঙ্গে বাড়ি খেল ওর হাত, ছুটে গেল পাইপ। ভ্যাকুয়ামের টানে পাইপের ভিতরে সেঁধিয়ে গেল বেইযবল আকারের বোমা, রানা বা সোহেল কিছু করার আগেই সোঁ করে উঠে গেল পাইপ বেয়ে উপরে।

নব্বই ফুট উপরে, যেখান থেকে আলোর একটুখানি আভা ভেদ করে নেমে এসেছে পাইপটা, সেদিকে তাকিয়ে আছে রানা আর সোহেল।

যা ঘটল তা একটা দুর্ঘটনা।

এবং বোমাটা বিস্ফোরিত হতে আর মাত্র আধ মিনিট বাকি।

.

বার্জের ইনচার্জের নাম জাওয়াদ। বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ করছে সে, কেবল লবণপানি আছড়ে পড়ছে ছাঁকনির গায়ে; না আসছে গাদ, না আসছে অন্যকিছু। তারপরও সন্তুষ্ট সে-প্রথমদিনই কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় অনেকদূর এগিয়ে গেছে কাজ। উদ্ধার করা হয়েছে বেশকিছু জিনিস, তবে ওগুলো মামুলি বলে মনে হয়েছে জাওয়াদের কাছে। নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে এই বলে, বড় মাছ জালে পড়তে সময় নেয়।

তবে জাওয়াদ যে ফুরফুরে মেজাজে, তা কিন্তু না। কাছ দিয়ে তো বটেই, দূর দিয়েও যখন কোনও জাহাজ যাচ্ছে, বুকের ধুকপুকানি টের পাচ্ছে সে। বার বার মনে হচ্ছে ওর, হাজির হয়ে গেছে মাল্টা কোস্টগার্ডের পেট্রোল ভেসেল।

ছাঁকনিটার কাছে এগিয়ে গেল জাওয়াদ। ঠিক তখনই ভ্যাকুয়ামের টানে টাইমবোমাটা উঠে এল সাগরের তলদেশ থেকে। চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল সে, ভয়ঙ্কর একটা বিস্ফোরণ স্তব্ধ করে দিল ওকে চিরদিনের জন্য।

শকওয়েরে ধাক্কায় উড়ে গেল জাওয়াদ আর ওর সঙ্গে বার্জে-থাকা আরেকজন। উড়ে গেল গ্রেইট, কম্প্রেসর আর বার্জের কাঠামোর বড় একটা অংশও।

একদিকে কাত হয়ে গেছে বাজটা। গলগল করে পানি ঢুকছে ওটার খোলসের ভাঙা অংশ দিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডুবে যাবে।

বার্জের একজন মাত্র লোক, অলৌকিকভাবে, বেঁচে গেছে। কান ভোঁ ভোঁ করছে ওর, মাথা ঘুরাচ্ছে, বুঝেও যেন বুঝতে পারছে না বার্জের কাঠামো উল্টে গেলে ওটার নিচে চাপা পড়ে সলিলসমাধি ঘটবে ওর। শেষমুহূর্ত যখন এসে গেছে, সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে; অন্য বোটটার উদ্দেশে সাঁতার কাটছে।

.

ডিসুজা কনরভেন্সির ডাইভ-ল্যাডার ঘেঁষে পানির উপর নিঃশব্দে মাথা তুলল রানা। কারা যেন উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলছে বোটে। কিছুটা দূরের পানিতে প্রায় তলিয়ে গেছে বাজটা।

রানার উল্টোদিকে আর.ও.ভি.-সহ ভেসে উঠল সোহেল, বোটের রাইফেলওয়ালাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। এ ব্যাপারে প্ল্যান করেছে পানির নিচে থাকতেই।

ঘটনা ঘটল পরিকল্পনা মাফিক।

ডেকে ছুটন্ত পদশব্দ শুনতে পেল রানা। তারমানে সোহেল যেদিক দিয়ে দেখা দিয়েছে, সেদিকের রেইলিঙের কাছে দৌড়ে যাচ্ছে রাইফেলওয়ালারা।

নিঃশব্দে কিন্তু দ্রুত বোটে উঠে পড়ল রানা।

সোহেলের দিকে অস্ত্র তাক করছে দুজন রাইফেলওয়ালা, রানার দিকে উল্টো ঘুরে আছে ওরা। ওদেরকে সুযোগ দিল না রানা। সঙ্গে করে আনা আণ্ডারওয়াটার রাইফেল তুলল কাঁধে, শীতল কিন্তু কর্তৃত্বপরায়ণ কণ্ঠে বলল, অস্ত্র ফেলে দাও সাগরে, দুজনই।

বরফের মতো জমে গেছে দুই রাইফেলওয়ালা। বার্জ থেকে সাঁতার কেটে যে-লোক হাজির হয়েছিল বোটে, রেইলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল সে-ও; সঙ্গীদের মতো অবস্থা হয়েছে ওরও।

ঘাড় একটুখানি ঘুরিয়ে চোখের কোনা দিয়ে রানাকে দেখল দুই রাইফেলওয়ালা, তারপর সাগরে ফেলে দিল ওদের অস্ত্র।

দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো ডেকে, আদেশ দিচ্ছে রানা। কপাল আর মুখ ঠেকিয়ে রাখবে ডেকের সঙ্গে।

যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবে শুয়ে পড়ল ওরা তিনজন।

 রানা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে পুরো বোট কভার দিতে পারছে; ওকে বোটের নিয়ন্ত্রণ নিতে দেখে কাছে এল সোহেল, উঠে পড়ল ডেকে। একটা আণ্ডারওয়াটার রাইফেল আছে ওর হাতেও। ওটা তাক করল প্রতিপক্ষের তিন লোকের দিকে, রানাকে বলল, আমি কভার দিচ্ছি এদেরকে। তুই ডাইভ মাস্টারের খোঁজ কর।

খোঁজ করতে হলো না, পাশা পাল্টে গেছে বুঝে হুইলহাউস থেকে গোঁ গোঁ আওয়াজ করে নিজের উপস্থিতির জানান দিল লোকটা। ঘটনা কী ঘটেছে আঁচ করে নিল রানা, রাইফেল কাঁধে ঝুলিয়ে ছুরি হাতে ঢুকল হুইলহাউসের ভিতরে। দড়ির বাঁধন কেটে দিল ডাইভ মাস্টারের হাত পায়ের। কতগুলো বাক্সের আড়ালে ফেলে রাখা হয়েছিল লোকটাকে, ওগুলো সরিয়ে বের করে আনল ওকে। গোঁজ বের করে নিল লোকটার মুখ থেকে।

আমার লোকদেরকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ডুব দিতে বাধ্য করেছে ওরা, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর বয়সী লোকটা।

চিন্তার কিছু নেই, আশ্বাস দিল রানা। ওদের কারও ক্ষতি হয়নি। কী ঘটেছে, তা জানাল সংক্ষেপে।

হায়, হায়! বাৰ্জটা উড়ে গেছে? ওখানে আমাদের ডিকম্প্রেশন ট্যাঙ্কটা ছিল। আমার ডাইভাররা তো মারা পড়বে।

আমাদের বোটে ডিকম্প্রেশন ট্যাঙ্ক আছে। খবর দিচ্ছি, এখনই চলে আসবে। রেডিওতে যোগাযোগ করল সি-হর্সের সঙ্গে।

কিন্তু ডিসুজা দম্পতির কী হবে?

ডিসুজা দম্পতি? ডাইভ মাস্টারের কথা বুঝতে পারেনি রানা।

মাথা ঝাঁকাল লোকটা। আমরা আসলে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মাল্টার নদী, জঙ্গল, বন্দর ইত্যাদি নিয়ে কাজ করি। যারা বন্দি করেছিল আমাকে, জিম্মি করেছিল আমার ডাইভারদের, তাদের আরও কিছু লোক পাকড়াও করেছে আমাদের মালিক আর তার বউকে। ওরাই ডিসুজা দম্পতি।

গম্ভীর হলো রানার চেহারা। ব্যাপারটা বুঝতে পারা উচিত ছিল আমার। হুইলহাউস ছেড়ে বের হলো, এগিয়ে গেল ডেকে শুয়ে-থাকা তিন লোকের দিকে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল একজনের পাশে, রাইফেলের নল ঠেকাল লোকটার পিঠে। যার পা চাটো তার নাম কী?

হুসাইন আখতার, একটুও ইতস্তত না করে বলে দিল লোকটা, বোঝা গেল পা চাটার ইচ্ছার চেয়ে জানের মায়া বেশি ওর।

ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে কীভাবে?

আমার ব্যাকপ্যাকে স্যাটেলাইট ফোন আছে।

ফোনটা বের করল রানা। আখতারের নম্বর বলো। উনিশ-বিশ কিছু করবে না।

উনিশ-বিশ পরের কথা, উনিশ থেকে সোয়া উনিশও করল না লোকটা। বাটনগুলো চাপার সময় নম্বরটা মুখস্থ করে ফেলল রানা।

তোমাদের অগ্রগতি কতদূর? ফোনের স্পিকারে শোনা গেল একটা কর্কশ কণ্ঠ।

ডিসুজা দম্পতিকে জিম্মি করেছ তুমি?

নীরবতা।

অপরিচিত একটা কণ্ঠ এবং অপ্রত্যাশিত একটা প্রশ্ন শুনে থমকে গেছে ওপ্রান্তের লোকটা।

কিছুক্ষণ পর বলল, কে তুমি?

মাসুদ রানা।

আবারও নীরবতা। ওপ্রান্তের লোকটা বুঝতে পারছে না কী বলবে। যে-কোনও কারণেই হোক ফোনের লাইনও কাটতে পারছে না।

আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি, মনে করিয়ে দিল রানা।

 সেটা দিতে আমি বাধ্য নই।

ভুল বললে, হুসাইন আখতার। লুসি লরেন থেকে উদ্ধার-করা আটিফ্যাক্টগুলো যখন আমার হাতে, তখন আমার কথামতো অনেককিছু করতেই তুমি বাধ্য।

আখতারকে বাজিয়ে দেখার জন্য মিথ্যা বলেছে রানা, লোকটা চুপ হয়ে যাওয়ায় বুঝল জায়গামতো টোকা দিয়েছে।

গজব পড়ল নাকি তোমার উপর? সুযোগ পেয়ে টিটকারি মারল রানা। হঠাৎ ব্রেইনস্ট্রোকে মুখটা বাঁকা হয়ে যায়নি তো? শুনছ?

শুনছি।

বলছিলাম, মিশরীয় যেসব পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে, সেগুলো নিয়ে কি চলে যাব? আরও সুতো ছাড়ছে রানা। সবুজ রঙের একটা লম্বাচওড়া লোককে দেখা যাচ্ছে একটা লিপিফলকে, জাদুকরী ক্ষমতা দিয়ে মরা মানুষ জীবিত করছে সে।

আবারও কিছুক্ষণের নীরবতা।

লিপিফলকটা…পেয়েছ তুমি?

জী, জনাব। এবং একটা না, তিনটা।

তা হলে এসো একটা চুক্তি করি।

 শুনছি।

লিপিফলকগুলো আমার হাতে তুলে দেবে তুমি, বিনিময়ে ডিসুজা দম্পতিকে নিয়ে যাবে।

জীবিত?

হ্যাঁ, জীবিত।

কোথায় আসতে হবে?

সেইন্ট পিটারস পুল উপসাগর।

উপসাগর? সৈকতে রোদ পোহাচ্ছ নাকি?

এলেই বুঝবে।

.

১৭.

 ছুটছে সি-হর্স।

ওটার রেইলিঙের সঙ্গে কষে বাঁধা হয়েছে আটক-করা তিন লোককে। ওদেরকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে লামিয়া বলল, আখতার যখন দেখবে লিপিফলকের বদলে ওরই তিন চামচাকে নিয়ে গেছ, তখন কী করবে?

গুলি চালাবে, শান্ত গলায় বলল রানা।

আমরা কী করব?

নব্বই রাউণ্ড বুলেটসহ দুটো একে ফোর্টি সেভেন আর দুটো আণ্ডারওয়াটার রাইফেল দিয়ে যতটুকু যা করা যায়, বলল সোহেল।

আমার কাছে এক্সট্রা ক্লিপসহ একটা বেরেটা নাইন মিলিমিটার আছে, বলল লামিয়া। সবমিলিয়ে আঠারোটা বুলেট।

আর আমার কাছে আছে সি-ফোর–প্ল্যাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, বলল রানা। আচ্ছা, লামিয়া, সেইন্ট পিটারস পুল বের স্যাটেলাইট ইমেজ পাওয়া গেছে?

গেছে, পোর্টেবল মোডেম ব্যবহার করে ওই জায়গার স্যাটেলাইট ইমেজ নামিয়েছে লামিয়া নিজের ল্যাপটপে, ওটা তুলে দিল রানার হাতে।

সাগরসৈকতটা বোঝা যাচ্ছে সহজেই। দেখতে অনেকটা অশ্রুর ফোঁটার মতো। আশপাশে চুনাপাথরের ছোটখাটো পাহাড়। এককোনায় পেয়ালা আকৃতির উপসাগরটা। রোদের কারণে ফিরোজা রঙ ধারণ করেছে সাগরের পানি। চুনাপাথরের পাহাড়গুলোর ঢালে কয়েকটা বহুতল দালান। সারি করে বানানো ব্যালকনিও দেখা যায়। সেতুর মতো দেখতে একটা স্থাপনা সৈকত থেকে এগিয়ে গেছে বাড়িগুলোর দিকে।

পরিত্যক্ত কিছু হোটেল, বলল লামিয়া। গেস্টরা যাতে সহজেই হোটেল থেকে সৈকতে যেতে পারে সেজন্য একসময় ব্যবহৃত হতো ওই সেতু।

এবং ওটাই সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে আমাদের জন্যে, বলল রানা। ওদের স্নাইপার ওখানে পজিশন নিয়ে থাকতে পারে। লোকটাকে, সৈকত থেকে দেখতে পাব না আমরা।

ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল লামিয়া। স্নাইপার?

ডারহাম যেভাবে মরেছে তা মনে করিয়ে দিল রানা।

লোকটা পাহাড়ের উপরেও থাকতে পারে, বলল সোহেল।

কোনও হোটেলের ছাদেও থাকতে পারে, বলল লামিয়া।

ওই ব্যাপারে আর কিছু না বলে অশ্রুবিন্দুর এককিনারায় যুম করল রানা। বোঝা যাচ্ছে, সবচেয়ে কাছের জনবহুল এলাকার সঙ্গে পরিত্যক্ত হোটেলগুলোর দূরত্ব যথেষ্ট। সড়কপথে যোগাযোগের উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ধূলিধূসরিত সরু একটা রাস্তা। একদিকের একটা চুনাপাথরের পাহাড়ের ঢাল কেটে বানানো আঁকাবাঁকা সিঁড়ি ছাড়া সৈকত থেকে ওই রাস্তায় যাওয়ার আর কোনও পথ নেই।

রেইলিঙের সঙ্গে বাঁধা লোকগুলোকে আবারও ইঙ্গিতে দেখাল লামিয়া। ওদেরকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারি।

লাভ হবে না, বলল রানা। নিজের লোকদের খুন করতে দ্বিধা করে না ওরা। তা ছাড়া আমার মনে হয় না আমরা উপসাগরে ঢোকামাত্র আমাদের উপর হামলা করবে ওরা। আগে আর্টিফ্যাক্টগুলো পেতে চাইবে, দেখতে চাইবে। ডেকের উপর পড়ে-থাকা স্কুবা ট্যাঙ্ক, হোস, বোট হুক আর দড়িদড়ার উপর নজর বুলিয়ে নিল।– কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, একটা আইডিয়া এসেছে মাথায়, কিন্তু কতখানি কাজে লাগবে জানি না।

.

ফ্লাইব্রিজে চালকের ভূমিকা পালন করছে সোহেল। সি-হর্স এগিয়ে চলেছে সেইন্ট পিটারস পুল বের নিরালা সৈকতের দিকে। স্কুবা ট্যাঙ্ক আর অন্যান্য হাবিজাবি জিনিস একসঙ্গে জড়ো করে একটা বাঙ্কারের মতো বানিয়ে ফেলেছে রানা।

বুলেট লাগামাত্র উড়াল দেবে ওগুলো, আত্মবিশ্বাসের অভাব আছে লামিয়ার কণ্ঠে।

আমি কিছু কারিগরি ফলিয়েছি. এগুলোর ওপর, বলল রানা, ফলে পুরু হয়ে গেছে এগুলো, জরুরি মুহূর্তে কভার নিতে পারব। আর সোহেলের ক্রোস-নেস্টটাকে রীতিমতো দুর্গ বানিয়ে দিয়েছি।

উপসাগরে ঢুকছে সি-হর্স।

লামিয়ার দিকে তাকাল রানা। তুমি বরং কোথাও লুকিয়ে পড়ো। ওরা এখনও কিছু জানে না তোমার ব্যাপারে।

আমার দেশের জন্য লড়াই করবে তোমরা, আর সে লড়াইয়ে যোগ না দিয়ে আমি থাকব লুকিয়ে? জীবনেও না!

আমি আসলে লুকিয়ে পড়া বলতে আড়ালে চলে যাওয়া বুঝিয়েছি। সি-হর্সের পেছনদিকে স্কাইলাইটওয়ালা অ্যাট কেবিন আছে, ওখানে যাও। ল্যাচটা লক কোরো না, পরে দরকার হলে সাহায্য করতে পারবে আমাদের।

অ্যাফট কেবিনে কেন?

সি-হর্সের পিছনটা গুণ্ডাদের দিকে দিয়ে উপসাগরে ঢুকব আমরা, বলল সোহেল। অবস্থা বেগতিক দেখলে যেন পালাতে পারি।

মেনে নেয়ার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল লামিয়া। মনে থাকে যেন, এ-ই শেষবার। এরপর আর আমাকে তাড়াতে পারবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেরেটা হাতে নিয়ে গিয়ে ঢুকল অ্যাট কেবিনে।

সাগরের বুকে মাথা তুলে আছে কতগুলো বিশাল প্রবালপ্রাচীর, আসলে ওগুলোই সাগর থেকে আলাদা করেছে উপসাগরটাকে। প্রাচীরগুলোর কাছে সি-হর্সকে একবার চক্কর খাওয়াল সোহেল, বোটের নাক সাগরের দিকে রেখে সৈকতের দিকে পিছিয়ে নিচ্ছে ওটাকে, ঢুকছে উপসাগরে।

কয়েকটা অক্সিজেন ট্যাঙ্কের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে রানা, হাতে একে ফোর্টি সেভেন। দূরের ওই সেতু আর চুনাপাথরের পাহাড়গুলো দেখছে, বোঝার চেষ্টা করছে ওখানে কোথাও বিপদ লুকিয়ে আছে কি না।

অস্ত্র হাতে দেখতে পাচ্ছি তিনজনকে, আওয়াজ দিল সোহেল, ব্রিজের পাশে কংক্রিটের ডকে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার এককোনায় দুটো গাড়িও দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোনও বোট নেই।

একটা হোটেলের ছাদে একজন স্নাইপারকে দেখতে পেয়েছি, বলল রানা। রোদ লেগে ঝিক করে উঠেছে একটা টেলিস্কোপিক লেন্স। লামিয়া ঠিকই অনুমান করেছে।

সি-হর্সকে আরও পিছিয়ে নিচ্ছে সোহেল। ওটার স্টার্ন কংক্রিটের-ডকের সঙ্গে আলতো ধাক্কা খেল একসময়। উক থেকে সিঁড়ি এগিয়ে গেছে ব্রিজের দিকে। আরেকদিকে দেখা যাচ্ছে একটা পরিত্যক্ত মেইনটেন্যান্স শ্যাক, দেখভালের অভাবে হতশ্রী হয়ে গেছে নিজেই।

ডকে দাঁড়িয়ে-থাকা তিন লোকের একজন হাতে দড়ি নিয়ে এগিয়ে এল।

বাঁধা পড়তে আসিনি আমরা, স্কুবাট্যাঙ্কের আড়াল থেকে চেঁচিয়ে বলল রানা, দুটো ট্যাঙ্কের মাঝখানের সরু ছিদ্র দিয়ে তাকিয়ে আছে। হুসাইন আখতার কোথায়?

শ্যাকের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এল মোটা আর গাঁট্টাগোট্টা এক লোক। চোখে সানগ্লাস, চুল কাটিয়েছে মিলিটারি ছাঁটে। সানগ্লাস ওর চোখ আড়াল করতে পেরেছে, চেহারার বিরক্তি ঢাকতে পারেনি।

লাজুক-লতা ইস্তিরীলোকের মতো লুকিয়ে থেকে কথা বলছ কেন? কর্কশ ভারী কণ্ঠে বলে উঠল সে। উঠে দাঁড়াও, তোমার নূরানী চেহারাটা দেখি।

অবশ্যই। তবে তার আগে তোমার স্নাইপারকে রাইফেল ফেলে দিতে বলল।

কীসের স্নাইপার?

হোটেলের ছাদে যে আছে।

রানা দেখল, আখতারের চেহারার বিরক্তি বেড়েছে। কিছু বলছে না লোকটা। সম্ভবত সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।

তোমার স্নাইপার হয় রাইফেল ফেলবে, বলল রানা, নয়তো চলে যাব আমরা। এত সাধের আর্টিফ্যাক্ট দেখতে পাবে না আর।

রানার কথার গুরুত্ব বোঝাতে থ্রটলে চাপ বাড়িয়ে সি হর্সের ইঞ্জিনে গর্জন তুলল সোহেল।

মুখের কাছে রেডিও তুলল আখতার, কী যেন বলছে।

কিছুক্ষণ পর একটা হোটেলের ছাদে সিধে হয়ে দাঁড়াতে দেখা গেল এক লোককে, হাতে ভারী রাইফেল। ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। সৈকতের বালিতে এসে পড়ল অস্ত্রটা।

সন্তুষ্ট? জিজ্ঞেস করল আখতার।

হব, যদি ওই লোকের কাছে অন্য কোনও রাইফেল অথবা তোমার অন্য কোনও স্নাইপার না থাকে। উঠে দাঁড়াল রানা।

ওর হাতে একটা আণ্ডারওয়াটার রাইফেল। ডকে দাঁড়িয়ে থাকা তিন গুণ্ডার হাতেও একই জিনিস, তাক করে রেখেছে। রানার দিকে। হাফহাতা শার্টের উপর শোন্ডার হোলস্টার পরে আছে আখতার, সেটাতে একটা পিস্তল আছে।

ডিসুজা দম্পতি কোথায়? জিজ্ঞেস করল রানা।

আগে আর্টিফ্যাক্ট, যেন দাবি করছে এমনভাবে বলল আখতার।

আরও একবার গর্জন করে উঠল সি-হর্সের ইঞ্জিন।

মুখের কাছে আবারও রেডিও তুলতে বাধ্য হলো আখতার।

চোখের কোনা দিয়ে ব্রিজের একদিকে নড়াচড়া দেখতে পেল রানা। পিঠে রাইফেল ঠেকিয়ে দুজন বুড়ো-বুড়িকে নিয়ে আসা হচ্ছে ব্রিজের শেষমাথার দিকে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে বেচারাদের, কারণ তাদের পায়ে শেকল বাঁধা। যেদিকে যাচ্ছেন তারা সেদিকে কোনও রেইলিং নেই, অথবা কোনওকালে থাকলেও এখন গায়েব।

আংটার মতো দেখতে একটা কী যেন বুড়ো লোকটার হাতে। জিনিসটা ভারী, কারণ ওটা বহন করতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। আরেকটা শেকল দিয়ে ওটা বেঁধে দেয়া হয়েছে তাঁর অন্য পায়ের সঙ্গে।

বুড়োবুড়িকে শেকল পরিয়ে দিয়েছে ওরা, চাপা গলায় সোহেলকে বলল রানা। আরেকটা শেকল দিয়ে একটা নোঙর আটকে দিয়েছে মিস্টার ডিসুজার পায়ে।

মানে তাদেরকে ডুবিয়ে মারার ফন্দি করেছে ওরা?

হুঁ।

দেখতেই পাচ্ছ, উঁচু কণ্ঠ শোনা গেল আখতারের, বেঁচে আছে বুড়ো-বুড়ি। তবে আমি যা চাই তা যদি দিতে না পারো তা হলে বেশিক্ষণ বাঁচবে না। …রেইলিঙের সঙ্গে ও-রকম নিষ্ঠুরভাবে কেন বেঁধে রেখেছ আমার লোকদেরকে? বাকিরা কোথায়?

যারা অমানুষ তাদের বেলায়, আবার কীসের নিষ্ঠুরতা? আর তোমার বাকি লোকরা এতক্ষণে চলে গেছে হাঙরের পেটে।

আর্টিফ্যাক্ট দাও, চেঁচাল আখতার।

কথা আর বাড়াল না রানা, নাইলনের একটা দড়ি ধরে টান দিল। তেরপল দিয়ে ঢাকা ছিল সি-হর্সের ডেকের একটা পাশ, সরে গেল সেটা। বড় একটা ট্রাঙ্ক দেখা যাচ্ছে এখন, ওটার ভিতরে ডাইভিং ইকুইপমেন্ট রাখা হয়।

হাতের ইশারায় ট্রাঙ্কটা দেখিয়ে দিল রানা। তোমার আর্টিফ্যাক্টের খনি।

ডকের তিন লোককে আগে বাড়ার ইঙ্গিত করল আখতার।

রাইফেল উঁচিয়ে সাবধানে এগোচ্ছে ওই তিনজন। সি হর্সের ডেকে উঠে পড়ল একসময়, রানার চোখে চোখ রেখে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রাঙ্কের দিকে। রানার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে পড়ল একজন, রাইফেলের নল তাক করল রানার বুকে। বাকি দুজন এমন ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রাঙ্কের দিকে, মনে হচ্ছে ওটা ট্রাঙ্ক, ঘুমন্ত ডাইনোসর-জেগে উঠলেই খবর আছে।

সাবধানে ঘাড় ঘুরিয়ে সোহেল যেদিকে আছে সেদিকে তাকাল রানা। বিশেষ একটা ইঙ্গিত দিল সোহেলকে।

ততক্ষণে ট্রাঙ্কের কাছে পৌঁছে গেছে দুই রাইফেলধারী। ওটার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে একজন, নিজের রাইফেল নামিয়ে রেখে হুড়কো খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্যজন দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো।

রানার মতো সোহেলও পজিশন নিয়েছে কতগুলো স্কুবাট্যাঙ্কের আড়ালে। প্রেশারাইড় অবস্থায় আছে দুটো ট্যাঙ্ক, দুটো থেকেই হোস বেরিয়ে তেরপলের নিচ দিয়ে গিয়ে ঢুকেছে ট্রাঙ্কের ভেতরে-আগেই বানানো ছিদ্রপথে।

ট্রাঙ্কের হুড়কো খোলা হয়েছে মাত্র, সঙ্গে সঙ্গে ট্যাঙ্ক দুটোর ভাড়পুরো আলগা করে দিল সোহেল।

গ্যাসের প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে খুলে গেল ঢাকনা, নাকেমুখে প্রচণ্ড বাড়ি খেল শত্রুপক্ষের লোকটা। ট্রাঙ্কের ভিতরে কায়দামতো গ্যাসোলিন ছিটিয়ে দিয়েছিল রানা, প্রেশারাইড় অক্সিজেন মুক্তি পাওয়ামাত্র ছিটকে উঠল ওসব–সৈকতের পাহাড়ি ঢলে সমুদ্রস্রোত আছড়ে পড়লে যেভাবে ফেনা ছিটকে ওঠে সেভাবে। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা দড়ি ধরে টান মারল সোহেল, ট্রাঙ্কের আরেক ছিদ্রপথে ঢুকে একটা চকমকি পাথরকে পেঁচিয়ে রেখেছিল ওটা। হ্যাঁচকা টানে ট্রাঙ্কের ধাতব কাঠামোর সঙ্গে বাড়ি খেল পাথর, দেখা দিল অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

তখনও, গ্যাসোলিনে অক্সিজেনের জোগান দিচ্ছে হোস, ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে একটা হলিউডি বিস্ফোরণ ঘটল ট্রাঙ্কে, কয়েক সেকেন্দ্রে জন্য বাতাসে ভেসে রইল একটা অগ্নিগোলক।

নাকেমুখে বাড়ি খাওয়া লোকটা উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়েছে রেইলিঙে। একই দশা হয়েছে ওর সঙ্গীর। অপ্রত্যাশিত বিস্ফোরণে মূর্তির মতো জমে গিয়েছিল ডেকে ওঠা তিন নম্বর লোকটা, নিজেকে সামলে নিয়েই রাইফেলের ট্রিগার টানল সে।

কিন্তু তার আগেই ডেকে শুয়ে পড়েছে রানা। আণ্ডারওয়াটার রাইফেল দিয়ে জবাব দিল ও। পাঁচ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের অরী বুলেট টেনিসবলের সমান গর্ত তৈরি করল তিন নম্বর লোকটার বুকে। হুমড়ি খেয়ে চিৎ হয়ে পড়ে গেল লোক ডেকে, হাত থেকে ছুটে গেছে রাইফেল।

গড়ান দিয়ে জায়গা বদল করল রানা, যেদিকে দাঁড়িয়ে ছিল আখতার সেদিকে বুলেট পাঠাল আরেকটা। কিন্তু জাহাজের ডেকে বিস্ফোরণ দেখামাত্র যা বোঝার বুঝে গেছে লোকটা, চট করে সরে গেছে শ্যাকের আড়ালে।

আরেকবার গড়ান দিয়ে আরেকটু ভালো পজিশনে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল রানার, কিন্তু পারল না–হোটেলের ছাদ এবং ব্রিজের উপর থেকে সমানে গুলি চালানো হচ্ছে ওকে নিশানা করে, সি-হর্সের রেইলিং, ডেক আর স্কুবাট্যাঙ্কগুলোয় মুহুর্মুহুঃ কাঁপন তুলছে বুলেটগুলো। চলটা উঠে যাচ্ছে ডেকে, বাতাসে উড়তে শুরু করেছে কাঠের গুঁড়ো, রেইলিং আর স্কুবাট্যাঙ্ক থেকে স্প্রিন্টারের মতো ছিটকে উঠছে ধাতব টুকরো।

ট্যাঙ্কগুলোর আড়ালে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো রানা।

 নীরবতা।

সময় নিচ্ছে উভয়পক্ষ।

রানার আণ্ডারওয়াটার রাইফেলের গুলি খেয়েছে যে-লোক, সে মারা গেছে। নাকেমুখে ট্রাঙ্কের-ঢাকনার বাড়ি-খাওয়া লোকটা নেতিয়ে পড়ে আছে রেইলিং ঘেঁষে, বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে বোঝা যাচ্ছে না। অন্যজন প্রচণ্ড আঘাতে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্য, এখন অল্প অল্প নড়ছে।

রানার কিছু হয়নি, শুধু কিছু গুড়োকাঠ চোখে ঢোকার কারণে বার বার পিটপিট করতে হচ্ছে। সোহেল যেদিকে আছে সেদিক নিশানা করে গুলি চালায়নি শত্রুপক্ষ। লামিয়াও সম্পূর্ণ অক্ষত।

রাইফেলের গুলির আওয়াজ শোনা গেল–সময় নিয়ে বার বাৰু ট্রিগার টানছে কেউ রানাকে নিশানা করে। প্রতিটা বুলেট ফুটো করছে স্কুবাট্যাঙ্কগুলোকে, কিন্তু বেরুবার সময় ট্যাঙ্কের উল্টোদিকে আটকে গিয়ে কেঁড়ার মতো বানাচ্ছে ওটার বডিতে।

সোহেল! চেঁচাল রানা, ছাদের লোকটা আরেকটু সময় পেলে গেঁথে ফেলবে আমাকে!

আড়াল ছাড়ল সোহেল, একে ফোর্টি সেভেনের ট্রিগারে একটু পর পর চাপ দিয়ে একের পর এক বুলেট পাঠাচ্ছে হোটেলের ছাদে। মাথা নামাতে বাধ্য হলো ওখানকার লোকটা। সেই সুযোগে চট করে আড়াল ছাড়ল রানাও, চটপট আণ্ডারওয়াটার রাইফেল তিনটে বাগিয়ে নিয়ে চলে এল ট্রাঙ্কের আড়ালে।

অল্প অল্প নড়ছিল যে-লোক, উঠে দাঁড়াল সে, খানিকটা টলছে। রাইফেলের খোঁজ করল, কিন্তু সেটা আগেই হাতিয়ে নিয়েছে রানা। ইনছাড়া শার্ট সরিয়ে প্যান্টের কোমরে গোঁজা রিভলভার বের করল সে, সোহেলের দিকে তাক করছে।

অ্যাফট কেবিনের স্কাইলাইট সরিয়ে লড়াই পর্যবেক্ষণ করছিল লামিয়া। নাইন মিলিমিটারের পর পর দুই গুলিতে রিভলভারওয়ালার ডান হাঁটুর মালাইচাকি গুঁড়ো করে দিল-পরবর্তীতে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে ভেবে মেরে ফেলেনি। চিৎকার করে হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিল লোকটা, হাঁটু চেপে ধরে শুয়ে পড়েছে ডেকে, গড়াগড়ি খাচ্ছে আর সমানে গালমন্দ করছে। ওর সামনে থেকে রিভলভারটা নাইন মিলিমিটারের আরেক গুলিতে দশ হাত দূরে পাঠিয়ে দিল লামিয়া।

ছাদের উপর থাকা লোকটা জায়গা বদল করেছে, সরে গেছে দূরের এককোনায়। মাথা তুলল সে হঠাৎ, এবার সোহেলের অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি করছে। ব্রিজে থাকা ওর কমরেডরা সাপোর্ট দিচ্ছে ওকে।

ট্রাঙ্কের আড়াল থেকে মাথা আর আণ্ডারওয়াটার রাইফেলের নল বের করল রানা, সময় নিয়ে গুলি করল দুবার। ব্রিজের উপর থেকে নিচের পানিতে খসে পড়ল একশত্রুর লাশ।

ধাক্কা মেরে ফেলে দাও ওই শালা-শালীকে! শ্যাকের আড়াল থেকে চেঁচিয়ে উঠল আখতার।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড ধাক্কা মারা হলো ডিসুজার পিঠে, ব্রিজের রেইলিং-ছাড়া জায়গা দিয়ে উড়াল দিলেন তিনি। শেকলে বাঁধা থাকায় নিজেকে সামলাতে পারলেন না মিসেস ডিসুজা, সহ-উড়াল দিলেন স্বামীর সঙ্গে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই ত্রিশ ফুট নিচের পানিতে আছড়ে পড়লেন দুজনে। তলিয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে।

সোহেল, কাভার দে! হোসসহ একটা স্কুবাট্যাঙ্ক নিয়ে ট্রাঙ্কের আড়াল ছাড়ল রানা, দৌড়ে গিয়ে ডাইভ দিল। ওর উড়ন্ত শরীরটা রেইলিঙের উপর দিয়ে একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করে পড়ল পানিতে।

একটা স্কুবাট্যাঙ্কের আড়ালে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে সোহেল, একে কোটি সেভেন দিয়ে একইসঙ্গে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে মার্কসম্যান আর ব্রিজের লোকটাকে।

ওর পক্ষে একা কুলানো সম্ভব না বুঝতে পেরে অ্যাস্ট কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এল লামিয়া, যত দ্রুত সম্ভব ক্রল করে গিয়ে পজিশন নিল ট্রাঙ্কের পেছনে। এখানে বুলেটভর্তি দুটো আণ্ডারওয়ার্টার রাইফেল রেখে গেছে রানা, একটা তুলে নিল কাঁধে। সোহেল! চেঁচিয়ে ডাকল, ছাদের লোকটাকে সামলাও তুমি। ব্রিজের দায়িত্ব আমার।

এতদিনে মহৎ দুই বাঙালিকে চিনতে শুরু করেছে ও।

.

পানিতে পড়ামাত্র ডুবসাঁতার দিচ্ছে রানা।

একহাতে শরীরের সঙ্গে জাপ্টে ধরেছে স্কুবাট্যাঙ্ক, অন্যহাত চালিয়ে এগোচ্ছে ব্রিজের দিকে। ভালভূ খুলে দিল ট্যাঙ্কের, কিছু বুদ্বুদ উঠে যেতে দিল, তারপর হোস লাগাল মুখে। দম নেয়ার জন্য খুব ভালো না কায়দাটা, তারপরও নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।

উপসাগরটা বিশাল এক পুলের মতো; এখানকার পানি প্রায় স্বচ্ছ। পানি ভেদ করে নিচে ঢুকে পড়তে অসুবিধা হচ্ছে না রোদের। অসহায় ডিসুজা দম্পতিকে দেখতে পাচ্ছে রানা দূরে। সাঁতুরে উপরে ওঠার চেষ্টা করছেন তারা, কিন্তু ভারী নোঙরের কারণে পারছেন না। যত সময় যাচ্ছে, বেঁচে থাকার আশা দূর হয়ে যাচ্ছে তত।

সাঁতারের গতি বাড়াল রানা।

ব্রিজের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, এমন সময় পানিতে বুদ্বুদের সাদা রেখা তৈরি করে একটা বুলেট ধেয়ে এল ওর দিকে।

ব্রিজের উপর থেকে গুলি করা হচ্ছে ওকে।

.

রানা কত বড় বিপদে পড়েছে, বুঝতে পারছে সোহেল।

কাঁচের মতো স্বচ্ছ পানির নিচে কোনও আড়াল নেই রানার জন্য, আছে শুধু প্রতিসরণের সুবিধা। ওর গায়ে গুলি লাগাতে দু-একবার মিস হতে পারে ব্রিজে থাকা লোকটার, কিন্তু তৃতীয়বার?

সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে লামিয়া, কিন্তু গুলি লাগাতে পারছে না ব্রিজের লোকটার গায়ে। আসলে আণ্ডারওয়াটার রাইফেলের মতো ভারী অস্ত্রে অভ্যস্ত নয় সে। ব্রিজের রেইলিঙে অথবা লোহার স্প্যানে নিষ্ফল আঘাত হানছে ওর বুলেটগুলো।

এখন একটাই উপায় আছে, এবং সেটা করারই সিদ্ধান্ত নিল সোহেল।,

নিজেকে আড়াল করে সি-ফোরের একটা ব্লক টেনে নিল ও। পাঁচ সেকেণ্ডে সেট করল টাইমার, চাপ দিল এণ্টার সুইচে। আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে শ্যাকের উদ্দেশে জোরে ছুঁড়ে মারল এক্সপ্লোসিভ, সঙ্গে সঙ্গে সরে এল। শ্যাকেই গিয়ে পড়ল ওটা, বিস্ফোরণের ধাক্কায় উড়ে গেল একদিকের দেয়াল আর ছাদ। কয়েক সেকেণ্ড পর ভেঙে পড়ল পুরো শ্যাক।

অনেক আগেই জয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছিল আখতার, সি-ফোর উড়ে আসতে দেখে ছুট লাগিয়েছে পার্ক-করে-রাখা গাড়ি দুটোর উদ্দেশে। শকওয়েভের ধাক্কায় পড়ে গেল রাস্তায়, চোট পেল, কিন্তু উঠেই দৌড়াতে শুরু করল আবার। যত জলদি সম্ভব পালাতে চাইছে।

সি-হর্সের থ্রটলে চাপ দিল সোহেল, একহাতে হুইল ধরে রেখে আরেকহাতে একে ফোর্টি সেভেন চালাচ্ছে–কোনও সুযোগ দিতে চায় না মার্কসম্যানকে। একইসঙ্গে ব্রিজের কাছে নিয়ে যাচ্ছে জাহাজ, চাইছে ওখানকার লোকটাকে আরও কাছ থেকে গুলি করার সুযোগ পাক লামিয়া।

এবং সে-সুযোগ পেয়ে গেল মেয়েটা। ডক ছাড়িয়ে সি হর্স মোচড় কাটতেই আড়ালবিহীন অবস্থায় পেয়ে গেল সে ব্রিজের লোকটাকে। তখন ওর আণ্ডারওয়াটার রাইফেলে একটামাত্র বুলেট বাকি আছে। সময় নিয়ে নিশানা করল সে, তারপর টান দিল ট্রিগারে।

রানাকে লক্ষ্য করে একটা ম্যাগনাম খালি করছিল লোকটা, বুক আর পেটের মাঝখানে ভারী বুলেটের ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। পতন সামলাতে আঁকড়ে ধরল একদিকের রেইলিং। কিছুক্ষণ পর রেইলিং ঘেঁষে বসে পড়ল আস্তে আস্তে। মারা যাচ্ছে।

.

সহজ টার্গেট হওয়ার পরও আলোর-প্রতিসরণের কারণে বেঁচে গেছে রানা। সে-সুযোগই নিয়েছিল ও। অবশ্য পুরোপুরি বাঁচতে পারেনি-একটা বুলেট আঁচড় কেটে গেছে ওর বাঁ কাঁধে, সরু ধারায় রক্ত বের হচ্ছে সেখান থেকে। আরেকটা বুলেট চুমু দিয়ে গেছে স্কুবাট্যাঙ্কের পাদদেশে, যদিও ফুটো করতে পারেমি ওটাকে।

লবণপানির কারণে জ্বালা করছে রানার ক্ষতস্থান, কিন্তু পাত্তা দিচ্ছে না। অক্সিজেনের অভাবে যখন দপদপ করছে ডিসুজা দম্পতির মাথা, ঠিক তখন তাঁদের কাছে হাজির হলো ও। নিজের মুখ থেকে হোস সরিয়ে পালাক্রমে দিচ্ছে বুড়ো-বুড়িকে। মরতে মরতে বেঁচে যাওয়ায় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন তাঁরা মনে মনে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রানার দিকে।

উপরের দিকে তাকাল রানা। কাছিয়ে আসছে সি-হর্স।

.

১৮.

 গাদা গাদা জিয়োলজিকাল প্রিন্টআউট ঘেঁটে, নুমার ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড-করা কম্পিউটার প্রোগ্রামের সাউণ্ডওয়েভ-অ্যানালাইসিস পাঠ করে, আর মগের পর মগ কফি গিলে সময় যাচ্ছে আসিফের।

সাউণ্ডওয়েভের নতুন একটা প্রিন্টআউট নিল সে, মন দিয়ে দেখল কিছুক্ষণ। প্রিন্টআউটের বিশেষ একটা অংশের উপর আঙুল রেখে ডাকল তানিয়াকে। এটা বেলেপাথর। আর এটা পাথরের নিচে পানির স্তর। তারমানে পাথরের নিচে এখনও পানি আছে।

তা হলে পাম্পগুলো পানি তুলতে পারছে না কেন?

কারণ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে ক্রমশ, ঢুকে যাচ্ছে আরও গভীর পাথর ও কাদামাটির ভেতরে।

মানে?

মানে, আমার ধারণা, নুবিয়ান অ্যাকুইফারের নিচে আরেকটা অ্যাকুইফার আছে।

আরেকটা?

মাথা ঝাঁকাল আসিফ। মাটির সাত হাজার ফুট নিচে। ছোটখাটো একটা সাগর বলা যায় ওটাকে। কিন্তু এখানে, প্রিন্টআউটের বিশেষ একটা দাগ দেখাল, আর এখানে, এবার দেখাল অন্য একটা দাগ, সাউণ্ডওয়েভের যে-ডিসটর্শন দেখতে পাচ্ছ, তার ফলে বোঝা যাচ্ছে সাগরটা সরে যাচ্ছে একজায়গা থেকে আরেক জায়গায়।

ভূগর্ভের নদীর মতো?

হতে পারে…আমি শিয়োর না আসলে। তবে কম্পিউটার কিন্তু মনগড়া কিছু বলতে পারে না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল তানিয়া। তারপর বলল, এত পানি যাচ্ছে কোথায়?

জানি না।

কেন যাচ্ছে?

 তা-ও জানি না। শুধু জানি পানির স্তর সরে যাচ্ছে।

প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল অফিসের জানালা। তারপরই শোনা গেল একটানা গুলির আওয়াজ।

প্রিন্টআউটটা সরিয়ে রাখল আসিফ, চটজলদি গিয়ে দাঁড়াল জানালার পাশে।

বাইরে খররোদে যেন জ্বলছে দক্ষিণ লিবিয়ার প্রকৃতি। আরেকদফা বিস্ফোরণ ঘটল অনতিদূরের একটা পাম্পিং টাওয়ারের কাছে, চোখ ধাধিয়ে গেল উজ্জ্বল লালচে-গোলাপি অগ্নিগোলকের কারণে। একদিকে কাত হয়ে পড়ে গেল টাওয়ারটা।

কী ঘটনা? আসিফের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তানিয়া।

পালাতে হবে আমাদেরকে, দরজার কাছ থেকে শোনা গেল খালিদের উত্তেজিত কণ্ঠ।

আসিফ-তানিয়া দুজনই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল খালিদের দিকে।

বিদ্রোহীরা হামলা করেছে আমাদের স্টেশনে, বললেন খালিদ। জলদি চলুন, প্লেনে গিয়ে উঠতে হবে আমাদের।

প্রিন্টআউটগুলো ঝটপট হাতিয়ে নিল আসিফ। তানিয়া ততক্ষণে ছুট লাগিয়েছে খালিদের পিছন পিছন। অফিসের বাকিরাওঁ জড়ো হয়ে গেছে এতক্ষণে, নুড়িপাথর বিছানো পথ ধরে ছুটে চলেছে ডিসি-৩-এর দিকে। যক্ষ্মারোগীর মতো খকখক করে কাশতে শুরু করেছে ওটার ইঞ্জিন, তৈলাক্ত কালচে ধোয়াউগলে দিচ্ছে বাতাসে।

প্লেনে জায়গা হয়ে যাবে আমাদের সবার, দৌড়াতে দৌড়াতে বললেন খালিদ।

হুড়োহুড়ি করে প্লেনের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকল সবাই। আবারও বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া গেল। রকেট হামলা চালানো হচ্ছে কন্ট্রোল সেন্টারে।

প্লেনে যারা উঠেছে তাদের মাথা গুনছেন খালিদ। তিনিসহ একুশজন, পাইলটকে গণনায় ধরলে বাইশ। যাও! চিৎকার করে বললেন পাইলটের উদ্দেশে।

থ্রটল ঠেলে দিল পাইলট, হেলেদুলে আগে বাড়ল পুরনো ডিসি-৩। যত এগোচ্ছে তত গতি বাড়ছে।

প্লেনের একটা জানালার পাশে নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছে আসিফ, তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। পর পর আরও কয়েকটা রকেট গিয়ে আঘাত হানল কন্ট্রোল সেন্টারে, ওটা আজ ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দের বিদ্রোহীরা।

স্বভাবসুলভ গর্জন করতে শুরু করেছে ডিসি-৩-এর ইঞ্জিন, তারমানে পূর্ণ শক্তি পাচ্ছে ওটার ইঞ্জিন। কিন্তু পুরনো একটা প্লেনে একুশজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ নিয়ে উড়াল দেয়া মুখের কথা না, তাই সময় নিচ্ছে পাইলট। এয়ারস্ট্রিপের শেষমাথায় পৌঁছে গেছে বিমানটা, এমন সময় ওটার নাক উপরে তুলল সে। বাউণ্ডারি দেয়ালের মাথায় চুমু দেয়া থেকে ফুট পাঁচেকের জন্য বঞ্চিত হলো ডিসি-৩-এর চাকা।

এয়ারস্ট্রিপ ধরে পিকআপ ট্রাক নিয়ে ধেয়ে আসছে বিদ্রোহীদের একটা দল, মেশিনগান খালি করছে পলায়নরত ডিসি-৩-এর উদ্দেশে।

কিন্তু বিমানের আরোহীরা ওটার গর্জনের কারণে শুনতে পেল না মেশিনগানের আওয়াজ। ওদের প্রায় সবাই ভয়ে কাঁপছে, দোয়াদরুদ যে যা জানে পড়ছে।

শুধু একজনের কোনও আওয়াজ নেই।

খালিদ সাইফুল্লাহ্।

গুলি খেয়েছেন তিনি।

উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন, হুড়মুড় করে পড়ে গেলেন কাত হয়ে।

আসিফ আর তানিয়া ছুটে গেল সবার আগে। পেট আর পায়ে গুলি লেগেছে খালিদের।

রক্তপাত থামাতে হবে, চিৎকার করে বলল আসিফ, পট্টি বানানোর জন্য খুলতে শুরু করেছে নিজের শার্ট। কোলে তুলে নিয়েছে খালিদের মাথা।

চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে প্লেনের ভিতরে। আরবিতে হইচই করছে বাকিরা। ওদের কথা বুঝতে পারছে না আসিফ বা তানিয়া।

স্বামীর পাশে বসে পড়েছে তানিয়া, শার্টটা ছিঁড়ছে। হাসপাতালে নেয়া দরকার আপনাকে, বলল খালিদকে। সবচেয়ে কাছের হাসপাতালটা কোথায়?

বেনগাজি, দুর্বল গলায় বললেন খালিদ।

তারমানে আবার সেই নব্বই মিনিটের যাত্রা।

কিছু হবে না আপনার, আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছে তানিয়া। আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব আমরা।

চোখ বন্ধ করলেন খালিদ। আল্লাহকে ডাকছেন একমনে।

.

শিকল কেটে ডিসুজা দম্পতিকে সি-হর্সে তুলতে বেগ পেতে হলো রানা আর সোহেলকে।

ওরা ডেকে ওঠামাত্র লামিয়া জানাল, নতুন সমস্যা হয়েছে-পানি ঢুকতে শুরু করেছে জাহাজে। শত্রুপক্ষের উপর্যুপরি গুলিবর্ষণ বিশ্রী চিড় ধরিয়েছে ওটার কাঠামোতে।

গিয়ে দেখো ফরওয়ার্ড কম্পার্টমেন্টের কী অবস্থা, লামিয়ার গলায় হতাশা। বান ডেকেছে ওখানে। আর একঘন্টাও ভেসে থাকতে পারবে না সি-হর্স।

ডিসুজা দম্পতির শুশ্রূষা করছে বলে কোনও মন্তব্য করল না রানা।

ভাগ্যকে ধন্যবাদ, হুইলহাউসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সোহেল, সৈকত থেকে বেশি দূরে নেই আমরা।

জাহাজের ইঞ্জিন চালু করল ও, ওটার নাক ঘুরাল তীর অভিমুখে। কাছাকাছি পৌঁছে কায়দামতো চাপ বাড়াল থ্রটলে। গতির কারণে সৈকতের ভেজা বালিতে পিছলে তীরের বেশ কয়েক গজ ভিতরে উঠে পড়ল সি-হর্স।

বালিতে নামল রানা, তাকিয়ে আছে রেইলিঙের সঙ্গে বাঁধা প্রতিপক্ষের তিন লোকের লাশের দিকে। ভাবছে, হুসাইন আখতার একটা ফ্যানাটিক। প্রয়োজন শেষ হওয়ামাত্র নিজের লোকদের খুন করে বা করায়। যেমনটা করিয়েছে এই তিনজনের বেলায়। অত সহজ তিন টার্গেটের জন্য নিশ্চয়ই তিনবারের বেশি ট্রিগার টানতে হয়নি ছাদের সেই স্নাইপারের। লামিয়ার গুলি-খাওয়া লোকটাও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে, স্নাইপারের গুলিতেই।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা, এগিয়ে গেল সি-হর্সের ডাইভ ল্যাডারের কাছে। ডিসুজা দম্পতিকে ধরাধরি করে নিয়ে আসছে সোহেল আর লামিয়া।

তাঁদেরকে সৈকতে নামানোর পর জাহাজে উঠল রানা, ডেকে পড়ে-থাকা লাশগুলোর পকেট ঘাটাঘাটি করছে।

কাজের জিনিস পাওয়া গেল না কিছুই। কোনও আইডি কার্ড নেই, পেশাগত কাজে লাগে এমন কোনও জিনিস নেই। নেই কোনও অলঙ্কার বা ট্যাটু। দীক্ষাকরণ চিহ্ন ব্যবহার করে কোনও কোনও ফ্যানাটিক সংগঠন, সে-রকম কিছুও নেই।

লোকগুলো আসলে কারা, কার বা কাদের হয়ে কাজ করছিল, জানা গেল না।

রেইলিং ঘেঁষে দাঁড়াল রানা। সৈকতে দাঁড়ানো লামিয়াকে বলল, মাল্টা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করো। চেষ্টা করে দেখো ডিফেন্স ফোর্স অথবা সিকিউরিটি এজেন্সিগুলো কোনও সাহায্য করতে পারে কি না। অনেকেই বলে মরা মানুষ কথা বলে না, কিন্তু কথা বলাতে জানলে অনেককিছুই জানা যায় মরা মানুষদের কাছ থেকে।

কী কী ক্লু আছে আমাদের হাতে? জিজ্ঞেস করল লামিয়া।

ওদের ব্যবহৃত অস্ত্র আর জামাকাপড়। ওদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট। বিশেষ একটা স্যাটেলাইট-ফোনের নম্বর। …আকাশ থেকে আবির্ভাব ঘটতে পারে না এই লোকগুলোর। আমি নিশ্চিত কোনও-না-কোনও অতীত আছে এদের সবার।

মাথা ঝাঁকাল লামিয়া। নেমে এসো তুমি। আগে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে ডিসুজা দম্পতিকে।

.

ডিসুজা এস্টেটের লিভিংরুমে বসে আছে ওরা পাঁচজন। বাইরে সন্ধ্যা ঘনিয়েছে।

পয়সাওয়ালা হয়েও চালচলনে অথবা গৃহস্থালির ব্যবহার্য জিনিসে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাননি ডিসুজা দম্পতি। সাধারণ কাউচ আর চেয়ার দিয়ে সাজিয়েছেন লিভিংরুম। বিভিন্ন রকমের আর্টওয়ার্ক আর গোটা কয়েক মূর্তি আছে ঘরের আনাচকানাচে, একদিকের দেয়াল জুড়ে বানানো সারি সারি র‍্যাকে শোভা পাচ্ছে অনেকগুলো বই। আরেকদিকের দেয়ালের মাঝখানটায় বানানো ফায়ারপ্লেসে পুড়ছে কাঠ।

কিন্তু ঝড় বয়ে গেছে হলওয়ে আর লিভিংরুমে-ডিসুজা দম্পতিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং ভয়ভীতি দেখানোর সময় তাণ্ডব চালিয়েছে আখতারের লোকেরা। এখানে-সেখানে উল্টে ফেলেছে ল্যাম্প অথবা টিপয়, মেঝেতে পড়ে আছে ছোটখাটো বইয়ের পাহাড়।

সৈকত থেকে ফিরে এসে প্রথমে ধাতস্থ হয়েছেন বুড়ো-বুড়ি, তারপর রানা-সোহেল-লামিয়াকে নিয়ে ডিনার করেছেন। এখন কথা বলার জন্য বসেছেন ওদেরকে নিয়ে।

আমাদেরকে সাগরের নিচ থেকে উদ্ধার করার জন্য ধন্যবাদ, রানাকে বললেন মিসেস ডিসুজা।

কৃতিত্বটা আসলে আমার একার না, আমরা তিনজন করেছি কাজটা, বলল রানা। হাসল, তা ছাড়া, এক অর্থে আমরাই বিপদে ফেলেছিলাম আপনাদেরকে।

মোটেও না, অস্বীকার করলেন মিস্টার ডিসুজা। তোমরা আসার আগেই আমাদেরকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ওরা।

কনিয়াক চলবে? প্রস্তাব দিলেন মিসেস ডিসুজা।

আপত্তি করল না কেউ।

মিসেস ডিসুজার সঙ্গে ভিতরের ঘরে গেল লামিয়া, তাকে বহন করতে না দিয়ে নিজেই নিয়ে এল কনিয়াকের ট্রে, পরিবেশন করল সবাইকে।

ওরা কী জানতে চাইছিল আপনাদের কাছে? কনিয়াকের গ্লাসে ছোট একটা চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করল রানা।

মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন বুড়ো-বুড়ি।

আমার স্টাডিরুম তছনছ করে ফেলেছে ওরা, বললেন মিস্টার ডিসুজা। তারপর…নিজের চোখেই তো দেখলে…আরেকটু হলে মেরেই ফেলেছিল আমাদেরকে।

কিছু মনে করবেন না, যা বললেন তা আমার প্রশ্নের জবাব না। যা জানতে চাইছি তা জানাতে যদি অসুবিধা থাকে তা হলে জোরাজুরি করব না। তবে একটা কথা জেনে রাখুন। আপনাদের সহযোগিতার উপর নির্ভর করছে হাজার হাজার…হয়তো লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন।

চেহারায় মেঘ জমেছে মিস্টার ডিসুজার।

মাথা নিচু করে বসে আছেন তাঁর স্ত্রী, জামার প্রান্ত খুঁটছেন।

উঠে দাঁড়াল রানা, এগিয়ে যাচ্ছে ফায়ারপ্লেসের দিকে। আসলে সময় দিচ্ছে ডিসুজা দম্পতিকে, চাইছে ওর কথায় প্রভাবিত হোন তারা।

ফায়ারপ্লেসের উপরে দেয়ালে ঝুলছে বড় একটা পেইন্টিং, ওটার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াল ও। তৈলচিত্রে আশ্চর্য সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ইংরেজ রণতরীর একটা বহর, কোনও এক বন্দরে নোঙর-করে-থাকা অনেকগুলো ফরাসি যুদ্ধজাহাজের উপর হামলা চালিয়েছে ওগুলো।

ওর পাশে এসে দাঁড়াল লামিয়া, পেইন্টিংটা দেখছে সে-ও। কিছুক্ষণ পর বলল, ব্যাটল অভ দ্য নাইল।

মিস্টার ডিসুজার দিকে ঘুরল রানা। আপনার পূর্বপুরুষরা তো ফরাসি, না?

মাথা ঝাঁকালেন বুড়ো।

ব্যাটল অভ দ্য নাইলে পরাজয় বরণ করেছিল ফরাসিরা। নিজেদের পরাজয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়–এমনকিছু এই প্রথম ব্যবহার করতে দেখলাম কোনও ফরাসি দম্পতিকে।

কারণ আছে। ছবিটা যিনি এঁকেছেন…এটিন ডিসুজা…আমার পূর্বপুরুষ।

ঘাড় ঘুরিয়ে আবার পেইন্টিং-এর দিকে তাকাল রানা। তারমানে যুদ্ধে মারা যাননি তিনি?

না।

এবং দেশে ফেরার সময় মিশর থেকে কিছু সুভনির নিয়ে এসেছিলেন?

আবারও দৃষ্টির বিনিময় হলো ডিসুজা দম্পতির মধ্যে।

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন মিসেস ডিসুজা। স্বামীকে বললেন, বলে দাও। এদের কাছে আসলে লুকানোর কিছু নেই আমাদের।

একচুমুকে কনিয়াকের গ্লাস খালি করে ওটা নামিয়ে রাখলেন মিস্টার ডিসুজা। ছবি খুব ভালো আঁকতে পারতেন এটিন, যদিও পেশায় ছিলেন ফরাসি নৌবহরের সৈনিক। ব্যাটল অভ দ্য নাইলে হেরে গিয়ে ধরা পড়েন তিনি, পরে তাঁকে ফ্রান্সে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দেশে ফিরে এসে স্মৃতিচারণ করে আঁকেন ওই তৈলচিত্র।

তারপর?

ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল তাঁর। তিনি তেমন বিখ্যাত কেউ না হওয়ায় কখনও নিলামে ওঠেনি তাঁর সেসব ডায়েরি। কোনওদিন উঠবেও না, কারণ আমাদের পারিবারিক সংগ্রহশালায় থাকতে থাকতে একসময় হারিয়ে গেছে। তবে কয়েকটা ডায়েরি পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। জানতে পেরেছি, মিশরে যখন ছিলেন তখন খননকাজ চালিয়েছেন কোনও কোনও কবর আর সমাধিসৌধে। জানো নিশ্চয়ই, ফারাওদের প্রায় সবাইকে দাফন করা হয়েছে ওসব জায়গায়?

মাথা ঝাঁকাল রানা।

এটিন আর তার সঙ্গের অনেক অফিসার, যে যা পেরেছেন তা-ই চুরি করেছেন ওসব কবর থেকে–পরে বেশি দামে বেচার লোভে। কিন্তু যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় ধ্বংস হয়ে যায় বেশিরভাগ ফরাসি যুদ্ধজাহাজ, যেসব মিশরীয় জিনিস দিয়ে বোঝাই করা হয়েছিল ওসব জাহাজ সেগুলো চলে যায় নীল নদের পেটে।

সব নিশ্চয়ই যায়নি?

মাথা ঝাঁকালেন ডিসুজা। সব ফরাসি যুদ্ধজাহাজ অংশও নেয়নি সেদিনের সেই যুদ্ধে। ও-রকম একটা জাহাজে নিজের কয়েকটা ট্রাঙ্ক তুলে দিতে সক্ষম হন এটিন। ওটার ক্যাপ্টেন সুযোগ পাওয়ামাত্র সব পাল তুলে দিয়ে পালিয়ে আসেন, হাজির হন এখানে।

মানে মাল্টায়?

আবারও মাথা আঁকালেন ডিসুজা।

তারপর নিশ্চয়ই একদিন এটিনের সেই ট্রাঙ্ক তুলে দেয়া হয় লুসি লরেনে? অনুমানে বলল রানা।

খুব সম্ভব। আসলে ওই ব্যাপারে কোনও রেকর্ড নেই কোথাও। অথচ গুণ্ডারা ওটাই জানতে চাইছিল বার বার। মানে মিশর থেকে, বিশেষ করে অ্যাবাইদোস শহর থেকে কী কী জোগাড় করেছিলেন এটিন।

আচ্ছা, এটিনের আর্টিফ্যাক্টগুলোর সঙ্গে কুয়াশা বা ধোঁয়াশার কোনও সম্পর্ক আছে কি, যা একসঙ্গে কয়েক হাজার লোককে মেরে ফেলতে পারে?

মিস্টার ডিসুজার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, বজ্রপাত হয়েছে তার উপর। আছে, ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, কালো কুয়াশা।

নীরবতা।

 থমকে গেছে রানা।

 থমকে গেছে সোহেল আর লামিয়াও।

এটিনের ডায়েরি অনুযায়ী, বলছেন ডিসুজা, কালো কুয়াশা পারে মানুষের জীবন নিতে, আর জীবন কুয়াশা পারে প্রাণ ফিরিয়ে দিতে।

.

১৯.

মরা মানুষকে জীবিত করতে পারে? পুনরাবৃত্তি করল সোহেল। তাকাল রানার দিকে।

চোখে চোখে কথা হয়ে গেল দুজনের।

জীবন কুয়াশা হলো কালো কুয়াশার অ্যান্টিডোট।

অ্যান্টিডোট, বলল রানা।

কীসের? বললেন মিস্টার ডিসুজা। মৃত্যুর? যত চেষ্টাই করুক, কেউ কখনও মৃত্যু ঠেকাতে পারেনি। কোনওদিন পারবেও না।

বিশেষ একজাতের মৃত্যুর।

 বুঝলাম না।

 লিনোসায় কী ঘটেছে, সেখানকার অধিবাসীদের এখন কী অবস্থা, জানাল রানা। বলল, কালো কুয়াশার প্রভাবে দ্বীপের বাতাস বিষাক্ত হয়ে যাওয়ার পরও সুস্থ-সবল একজনের দেখা পাওয়া গিয়েছিল।

তারমানে গুণ্ডারা অ্যান্টিডোট চায়? জিজ্ঞেস করলেন মিসেস ডিসুজা।

না। ওদের কাছে আছে ওই জিনিস। বরং ওরা চায় না, আর কেউ সন্ধান পাক সেই অ্যান্টিডোটের, পেলে অকার্যকর হয়ে যাবে ওদের হাতে থাকা কালো কুয়াশা। এদিকওদিক তাকাল রানা। আর্টিফ্যাক্টগুলো নিশ্চয়ই এখানে নেই, না?

লুসি লরেন থেকে উদ্ধার-করা কোনওকিছুই নেই এখানে, বললেন ডিসুজা। যা ছিল তার বেশিরভাগই দিয়ে দিয়েছি জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে। বাকি সব নিয়ে গেছে গুণ্ডারা। এটিনের ডায়েরিটাও নিয়েছে। মিশরের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এ-রকম যা যা পেয়েছে, তার কিছুই রেখে যায়নি।

রানা বলল, আপনি বললেন লুসি লরেনে কী ছিল সে ব্যাপারে রেকর্ড নেই কোথাও। এমনও তো হতে পারে, এটিনের সব আর্টিফ্যাক্ট তোলা হয়নি জাহাজটাতে?

হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। তখন মাল্টায় চলছে চরম বিশৃঙ্খলা, কোন্ জাহাজে কী তোলা হচ্ছে না হচ্ছে সে-খবর রাখার সময় কই? …হার্বারমাস্টারের লগরেকর্ড অনুযায়ী, লুসি লরেন যেদিন বন্দর ছাড়ে সেদিন আরও দুটো জাহাজ রওনা করে ফ্রান্সের উদ্দেশে। একটা ঝড়ে বিধ্বস্ত হয় লুসি লরেনের মতোই, আরেকটাকে পাকড়াও করে ইংরেজরা।

ইংরেজরা যদি ওই আর্টিফ্যাক্টগুলো পেত, বলল সোহেল, তা হলে কোনও-না-কোনও জাদুঘরে রেখে দিত।

আর ওগুলো যদি মাল্টায় থাকত, বলল লামিয়া, তা হলে পরে কেউ-না-কেউ খুঁজে পেতই।

লুসি লরেনে নেই, বললেন মিসেস ডিসুজা, অন্য জাহাজে নেই। এমনকী মাল্টায়ও নেই। তা হলে কোথায় আছে আর্টিফ্যাক্ট?

অন্যমনস্ক হয়ে গেছে রানা, তাকিয়ে আছে তৈলচিত্রের দিকে। কিছুক্ষণ পর ঘুরে তাকাল ডিসুজার দিকে। আর্টিফ্যাক্ট বা লিপিফলক যা-ই থাকুক না কেন এটিনের কাছে, সেগুলোর গায়ে খোদাই-করা হায়ারোগ্লিফিক্সের অনুবাদই তো ডায়েরিতে লিখেছিলেন তিনি, না?

মাথা ঝাঁকালেন ডিসুজা।

কাজটা কবে করেছিলেন তিনি, মনে আছে? ডায়েরির তারিখ অনুযায়ী, আঠারো শ পাঁচ সালের মাঝামাঝি নাগাদ।

আর মাল্টার যে-বিশৃঙ্খলার কথা বললেন, তা কবে নাগাদ ঘটেছিল?

ওই বছরেরই শুরুর দিকে।

লম্বা করে দম নিল রানা।, আর্টিফ্যাক্ট বা লিপিফলক যদি আগেই তুলে দেয়া হবে লুসি লরেন বা অন্য জাহাজে, অনুবাদের কাজটা কখন করলেন এটিন?

জবাব দিতে পারলেন না মিস্টার ডিসুজা, স্তম্ভিত হয়ে গেছেন।

.

স্টাডিরুমের দরজা ভেঙে ফেলেছে গুণ্ডারা। কিন্তু এসবের দিকে নজর দেয়ার সময় নেই এখন। একটা সাইডবোর্ড কাবার্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন মিস্টার ডিসুজা, তাকে অনুসরণ করছে বাকিরা।

কাবার্ড খুলে ভিতর থেকে বহু-পুরনো একটা মামুলি খাতা বের করলেন তিনি, সেটা দেখে মোটেও মিশরীয় মনে হয় না। মলাট উধাও খাতাটার, প্রথম পৃষ্ঠায় ফরাসি ভাষায় কিছু লেখা।

লেখাগুলো ফ্রেঞ্চ বলে এই খাতা আর ঘাঁটাঘাঁটি করেনি গুণ্ডারা, বললেন ডিসুজা। ওরা ফরাসি ভাষা জানে না। উল্টেপাল্টে খাতার ভিতর থেকে বের করলেন একটা চিঠি। যে-জাহাজে, নিজের মালসামান তুলে দিয়েছিলেন এটিন, সেটার ক্যাপ্টেন, জনৈক অ্যাডমিরাল, লিখেছিলেন এই চিঠি এটিনকে। ফরাসি ভাষায় লেখা, অনুবাদ পড়ে শোনাচ্ছি আপনাদের।

গলা পরিষ্কার করে পড়তে লাগলেন:

প্রিয় বন্ধু এটিন, আপনার চিঠি পেয়ে খুব খুশি লাগছে। ব্যাটল অভ দ্য নাইলের পর ট্রাফালগারের যুদ্ধেও হার হয়েছে ফ্রান্সের; কোনওটাতেই অংশ নিইনি আমি। হারানো সম্মান কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে, ভাবছিলাম।

ব্যাটল অভ দ্য নাইলে ফেঁসে গিয়েছিলেন আপনি, শত্রুপক্ষের হাতে আরেকটু হলে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন; আপনাকে উদ্ধার করি আমি, আমার জাহাজে করে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাই। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ যা পাঠিয়েছেন আমার কাছে, ঠিক করেছি সেটা নিয়ে যাব নেপোলিয়নের কাছে। বিনিময়ে বিশেষ কিছু চাইব।

জানি, আমাকে দেখামাত্র আমার মাথা কাটার নির্দেশ দেবেন সম্রাট, তারপরও বিশেষ সেই অস্ত্র…যার সন্ধান দিয়েছেন আপনি আমাকে…নিয়ে যাব তাঁর কাছে। আমার বিশ্বাস, আমার দুই গালে চুমু খাবেন নেপোলিয়ন, পুরস্কৃত করবেন নিঃসন্দেহে।

কথা দিচ্ছি, প্রাপ্য পুরস্কার যাতে যথাযথভাবে আপনার কপালেও জোটে, সে-ব্যবস্থাও করব। তবে তার আগে সব কথা গোপন রাখতে হবে আমাদের দুজনকে।

আরেকটা কথা। কালো কুয়াশায় যখন লুটিয়ে পড়বে আমাদের শত্রুরা, তখন আমরা যাতে নিরাপদে থাকি সেজন্য প্রস্তুত রাখতে হবে জীবন কুয়াশা। ইতি… পড়া থামালেন ডিসুজা, তাকালেন রানার দিকে।

চিঠিতে কোনও দিন-তারিখ আছে? জিজ্ঞেস করল রানা।

মাথা ঝাঁকালেন ডিসুজা। অগাস্ট সতেরো, আঠারো শ পাঁচ। …এটিনের ডায়েরিটা হাতে থাকলে আরও অনেককিছু দেখাতে পারতাম। ওটাতে বিভিন্নরকম হায়ারোগ্লিফস-এর ড্রইং ছিল, বিভিন্ন শব্দের মানে বুঝবার জন্য ছোট্ট একটা ডিকশনারিও ছিল।

শেষপর্যন্ত কি পুরস্কৃত হয়েছিলেন এটিন? জিজ্ঞেস করল রানা।

খাতা ঘেঁটে আরেক তা কাগজ বের করলেন ডিসুজা। এটা আঠারো শ পাঁচ সালেরই একটা প্রত্যাখ্যানপত্র–এটিন মিশরে গিয়ে নিজের স্টাডি চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে, ওরা মানা করে দিয়েছিল। ততদিনে মিশর দখল করে নিয়েছে ইংরেজরা, যাদেরকে হটিয়ে দেশটা দখল করেছে তাদের কাউকে সেখানে মেনে নিতে পারে না ওরা।

অফিশিয়াল লেটারহেড প্যাডে লেখা চিঠিটা হাতে নিল রানা। প্রত্যাখ্যানের কারণ হিসেবে যে-যুক্তি দিয়েছিল ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সেটা পড়ল। তারপর তাকাল ডিসুজার দিকে। কোথায় যেতে চেয়েছিলেন এটিন?

জানি না।

পরে কখনও মিশরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি আর? জিজ্ঞেস করল রানা।

না। আসলে সুযোগ পাননি। চিঠি চালাচালির কয়েক মাসের মধ্যে মারা যান তিনি আর সেই অ্যাডমিরাল।

কীভাবে? জিজ্ঞেস করল সোহেল।

এটিনের মৃত্যু স্বাভাবিক। এখানে, মানে মাল্টায়, একরাতে মারা যান তিনি ঘুমের মধ্যে। আমার ধারণা হার্টঅ্যাটাক হয়েছিল। আর ওই অ্যাডমিরাল মারা যান ফ্রান্সে, মাসখানেক পর। সাতবার ছুরি চালানো হয়েছিল লোকটার বুকে। তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, আত্মহত্যা।

আত্মহত্যা! তাজ্জব হয়ে গেছে লামিয়া। মেডিকেল রিপোর্ট দিয়েছিল যে-লোক, সে গাঁজা খেয়েছিল নাকি?

ইংল্যাণ্ডের পত্রপত্রিকা ঠাট্টা-তামাশা করেছিল ব্যাপারটা নিয়ে, বললেন ডিসুজা।

নেপোলিয়নের সঙ্গে দেখা করেছিলেন অ্যাডমিরাল? জিজ্ঞেস করল রানা।

করেছিলেন। কয়েকজন ইতিহাসবিদ মনে করেন, দেখা করাটাই কাল হয়েছিল অ্যাডমিরালের জন্য। তাঁকে আসলে কখনোই ক্ষমা করতে পারেননি নেপোলিয়ন।

অ্যাডমিরালকে যা পাঠিয়েছিলেন এটিন, অ্যাডমিরালের মৃত্যুর পর কী হলো সে জিনিসের?

জানি না। তবে কোনও জাদুঘরে দেননি মনে হয়, কারণ কপর্দকহীন অবস্থায় মারা গেছেন তিনি। আর যদি নেপোলিয়নকে দিয়ে থাকেন, সম্রাট স্রেফ চেপে গেছেন।

আমার মনে হয় নেপোলিয়নকে দেননি তিনি ওসব, বলল লামিয়া। কারণ যে-লোক অ্যাডমিরাল হয়েও যুদ্ধ না করে প্রাণ বাঁচানোর ধান্দা করে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু হাতে পেয়েই সওদা করার ফন্দি আঁটে, সে-লোক নিজের জন্য যা চায় তা পাওয়ার আগে… মাথা নাড়ল। তা ছাড়া নেপোলিয়ন কখনও ব্যবহার করেননি কালো কুয়াশা।

তারমানে, মুখ খুলল সোহেল, অ্যাডমিরালের কথা বিশ্বাস করেননি নেপোলিয়ন। এবং তার পর থেকে হুসাইন আখতার আবির্ভূত হওয়ার আগপর্যন্ত আর জীবন কুয়াশা গায়েব হয়ে ছিল।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বলল লামিয়া, কী পাঠিয়েছিলেন এটিন অ্যাডমিরালের কাছে? এবং কী হলো সেগুলোর?

জানি না, মাথা নাড়লেন ডিসুজা। তবে ফ্রান্সের কোথায় শেষ থেকেছেন অ্যাডমিরাল তা বলতে পারি।

ঠিকানা লিখে দিলেন তিনি।

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল রানা। একসঙ্গে না থেকে ভাগ হয়ে যেতে হবে আমাদেরকে। একদল যাব মিশরে, জানার চেষ্টা করব আসলে কী এবং এখন কাদের দখলে আছে। অ্যাডমিরালের ঠিকুজি সন্ধানে আরেকদল যাবে ফ্রান্সে।

আমরা বুড়ো-বুড়ি যেতে পারি ফ্রান্সে, প্রস্তাব দিলেন ডিসুজা।

দুঃখিত, বলল রানা। আপনাদেরকে বিপদে ফেলতে চাই না আর। …লামিয়া, তুমি বরং ফ্রান্সে যাও।

লামিয়ার মোবাইলে মেসেজ এসেছে, ওটা দেখছিল সে; রানার কথা শোনামাত্র মুখ তুলে তাকাল। কপালের উপর নেমে-আসা চুল সরাল একঝটকায়, কুটি করে বলল, নিজেরা যাবে মিশরে, ঝাঁপিয়ে পড়বে বিপদের মুখে, আর আমাকে পাঠাতে চাইছ ফ্রান্সে যেখানে হয়তো ঘোরাঘুরি করা ছাড়া আর কোনও কাজই থাকবে না? তাড়াতে চাইছ? জীবনেও যাব না আমি ফ্রান্সে!

মুখ চাওয়াচাওয়ি করল রানা আর সোহেল।

আমাকে জোর করলে তোমাদের দুজনকেই ফ্রান্সে পাঠিয়ে আমি একা যাব মিশরে, বলল লামিয়া। মনে রেখো, এই মিশনে আমিই ডেকে এনেছি তোমাদেরকে

ঠিক। তুমি সাহায্য না চাইলে আমরা এসবে জড়াতাম না। ভাবছ, এখন ইচ্ছে করলেই বিদায় করে দিতে পার আমাদের? নরম গলায় বলল সোহেল।

না, তা ঠিক নয়। তোমাদের দেশের স্বার্থও যেহেতু জড়িত, আমি বিদায় করবার কেউ না।

মনে হচ্ছে, আলাদা কাজ করতে পারলেই ভালো হতো, তাই না? মধুর হাসি হাসল সোহেল, তা হলে এখন থেকে আমরা দুজন আলাদাই হয়ে যাই, কী বলো?

একথা বলেছি আমি? আমি প্যারিসে গিয়ে লুভর দেখব না–এই হচ্ছে সোজা কথা। তোমাদের সঙ্গে ইজিপ্ট যাচ্ছি।

রানা বা সোহেলের কেউ কিছু বলল না।

 তেজ একটু কমল লামিয়ার। দুটো ক্লু পেয়েছি।

 কৌতূহল ফুটল সোহেলের চোখে। কী?

আমাদের সঙ্গে গোলাগুলিতে মারা পড়েছে যেসব গুণ্ডা, তাদের একজনের পরিচয় জানতে পেরেছে ইন্টারপোল।

কে লোকটা?

মোবাইলের মেসেজের দিকে আবার তাকাল লামিয়া। ছত্রখান হয়ে-যাওয়া একটা ইজিপশিয়ান-স্পেশাল-ফোর্সের সদস্য। হোসনি মুবারাকের শাসনামলে সক্রিয় ছিল ফোর্সটা। শেষদিকে মিশরের একটা অপরাধচক্রে পর্যবসিত হয়।

তারমানে মিশরই এখন আমাদের প্রধান টার্গেট, বলল রানা। দ্বিতীয় ক্লুটা কী?

তোমার-দেয়া হুসাইন আখতারের স্যাটেলাইট ফোন নম্বর। ট্রেস করা গেছে ওটা। পুলিশ নিশ্চিত, মাল্টায় একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে ওটা, এবং এই মুহূর্তে কায়রোয় ব্যবহৃত হচ্ছে।

একটু আগে মোবাইল নিয়ে কী যেন করছিলে। পাল্টা মেসেজ দিয়েছ নাকি?

হু, আমার টিমকে। ওরা কাজ শুরু করে দিয়েছে। মিশরে যাচ্ছি আমি। তোমাদের ইচ্ছা হলে আমার সঙ্গে এসো, না হলে… কথা শেষ না করে মানে বুঝিয়ে দিল লামিয়া।

মুচকি হাসল রানা। আমরাও যাচ্ছি মিশরে, কিন্তু তোমার সঙ্গে নয়। দুই দলে কাজ করলে ভালো এগোনো যাবে।

তা হলে ফ্রান্সে যাবে কে? জিজ্ঞেস করল লামিয়া।

আসিফ আর তানিয়া।

আসিফ-তানিয়া? ওরা কারা?

আমাদের টিম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *