১০. গৌরবের যুগে বাগদাদ

গৌরবের যুগে বাগদাদ

আরবগণ সৌন্দর্যচর্চা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলনে যেমন আত্মনিয়োগ করে, অনাচারেও তারা তেমনি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগের কিঞ্চিৎ আগে একজন বাদীর গর্ভজাত খলীফা উমাইয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন। অত্যন্ত অশুভ লক্ষণ। তাঁর পরবর্তী দুই খলীফাও বাদীর গর্ভজাত ছিলেন–আর এরাই ছিলেন উমাইয়া বংশের শেষ খলীফা। খোঁজা-প্রথা ইতিমধ্যেই পূর্ণ বিকাশ-লাভ করে এবং এই খোঁজাদের সাহায্যেই হেরেম প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব সম্ভব হয়। অপরিমিত ঐশ্বর্য ও গোলাম-বাঁদীর ছড়াছড়ি হেতু বিলাস-সম্ভোগ চরমে ওঠে। শাসকগোষ্ঠীতে খাঁটি আরব-রক্ত কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের সর্বত্র নৈতিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ে।

এই অবধাঃগতি উমাইয়া বংশকে অনেকখানি দুর্বল করে ফেলে। উত্তর ও দক্ষিণ আরবের কওমদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান আত্মকলহ উমাইয়াদের দুর্বলতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। প্রাক-ইসলামী যুগেও এমন গোষ্ঠীগত বিভেদ-প্রবণতা বিদ্যমান ছিল। এখন সেই ব্যাধি চরমে গিয়ে ওঠে এবং অনন্ত বিবাদ-বিসম্বাদ সৃষ্টি করতে থাকে। সিন্ধুনদের তীরে তীরে, সিসিলীর উপকূলে উপকূলে এবং সাহারার সীমান্তে সীমান্তে এই প্রাচীন কলহ আত্মপ্রকাশ করে। এর ফলে দুটি রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হয় : কাইস্ ও ইয়ামন। লেবানন ও ফিলিস্তিনে আধুনিক যুগ পর্যন্তও এ কলহ জীবন্ত ছিল। কারণ, অষ্টাদশ শতাব্দীতেও এ দুই দলের মধ্যে দস্তুরমত লড়াই হয়েছে।

বংশের মধ্যে কার পর কে খলীফার সিংহাসনে বসবে, তার কোন সুনির্দিষ্ট নীতি না থাকায় অনিশ্চয়তা উমাইয়া বংশকে আরো দুর্বল করে তোলে। মুয়াবীয়া তার পুত্রকে সিংহাসনের জন্য নির্বাচন করেছিলেন। আরবের সনাতন রীতি ছিল যে, সমাজের বয়োঃজ্যেষ্ঠই উত্তরাধিকারী হবে; কিন্তু এ-সত্ত্বেও শাসক পিতা স্বভাবতই তাঁর পুত্রকে সিংহাসন দিতে লালায়িত হতেন। ফলে দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে উঠত।

এ আমলের ইতিহাসে ‘জনসাধারণ বা জাতির উল্লেখ কমই মিলে। অথচ এই জনসাধারণ বা জাতির আনুগত্যই সিংহাসন লাভের একমাত্র দাবী হয়ে দাঁড়ায়। এই আনুগত্য প্রকাশ করা হত নেতাদের মারফত। জনসাধারণ শক্তির চূড়ান্ত উত্স হওয়া সত্ত্বেও এ আমলে তারা মাঝে মাঝে উচ্ছঙখল গণ-বিক্ষোভ দ্বারা গোলযোগের সৃষ্টি করত। তাদের ইচ্ছাকে শাসন-শক্তির নিকট কার্যকরী করার দিন তখনো দূরে ছিল।

উমাইয়াদের জাতি-ভাই আব্বাসীয়রা ৭৪৭ সালে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আব্বাসীয়রা মহাবীর অন্যতম পিতৃব্য আল আব্বাসের বংশধর। এই সময় আব্বাসীয়দের বিদ্রোহ সাফল্যমণ্ডিত হয় এবং উমাইয়া খান্দান ধ্বংস হয়ে যায়। জনৈক আব্বাসীয় সেনাপতি ক্ষমতাচ্যুত উমাইয়া পরিবারের আশি জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে এক ভোজে দাওয়াত করেন এবং ভোজের সময় তাদের প্রত্যেককে কেটে টুকরা করে তাদের মৃত ও অর্ধমৃত দেহের উপর চামড়ার চাদর বিছিয়ে ভোজন করেন। প্রথম আব্বাসীয় খলীফা নিজকে আস্-সাফফা (রক্তপাতকারী) বলে পরিচয় দিতেন এবং পরে এ-ই তাঁর উপনাম হয়। আস্-সাফফার এই কাজের ফল দূরগামী ছিল। নতুন রাজবংশ তাদের নীতি কাজে পরিণত করার জন্য জোর-জুলুমের উপর নির্ভর করতে শুরু করে। এ জামানার জল্লাদৃরা একটি চামড়াকে তাদের গালিচা হিসেবে ব্যবহার করত। ইসলামের ইতিহাসে এই প্রথম সেই চামড়া খলীফার সিংহাসনের পাশে তার অনুবদ্ধ হিসেবে স্থান লাভ করল। আব্বাসীয় খলীফারা কোনদিনই উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনের উপর শাসন-পরিচালনা করে নাই; কিন্তু তারা পরবর্তী পাঁচশ’ বছর পর্যন্ত মুসলিম-জগতের পূর্বাংশ শাসন করেছে। তাদের বংশের সপ্তত্রিংশ খলীফা ১২৫৮ সালে মোগলদের হাতে নিহত হন। প্রকৃতপক্ষে আব্বাসীয়দের-আমলকেই ইসলামী সভ্যতার সোনার যুগ বলা যায়। বাগদাদ আব্বাসীয় খলীফাদের সৃষ্টি। এই বংশের দ্বিতীয় খলীফা তাইগ্রিস নদীর পশ্চিম পারে এর পত্তন করেন। এইখানে প্রাচীনযুগের কয়েকটি মহাশক্তিশালী সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। খলীফা তাঁর রাজধানীর জন্য এই স্থান নির্বাচন কালে বলেনঃ “এখানে সুন্দর একটা সেনানিবাস হবে। তাছাড়া, এই তাইগ্রিস নদীর সাহায্যে আমরা সুদূর চীন পর্যন্ত বহু দেশের সংগে সংযোগ স্থাপন করতে পারব। সমুদ্রের ঐশ্বর্য যা পাওয়া যাবে, নিয়ে আসতে পারব। মেসোপটেমীয়া, আর্মেনিয়া এবং তাদের সন্নিহিত স্থান হতে খাদ্যদ্রব্য আমদানী করতে পারব। এর উপর, কাছেই আছে ইউফ্রেতিস। এর মধ্য দিয়ে সিরিয়া, আর-রাকা এবং তৎসলগ্ন স্থান হতে বহু জিনিস আমরা আনতে পারব। এ নির্বাচন বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক ছিল। এক লক্ষ কারিগর ও ওস্তাগর চার বছর ক্রমান্বয়ে কাজ করে চলে। এমনিভাবে জেগে ওঠে এ স্বপ্নের শহর।

শহরটি গোলাকার ছিল। এইজন্য এর আর এক নাম ‘গোল শহর। শহরের চারপাশে ছিল পর পর দু’টি পাকা দেয়াল। তারপরে ছিল একটি গভীর পরিখা–তার পরে ছিল ইটের আরো একটি দেয়াল–৯০ ফিট উঁচু। এই শেষ দেয়াল কেন্দ্রস্থানকে ঘিরে রাখত। দেয়ালের চারপাশে চারটি ফটক ছিল এবং সেই ফটকের ভিতর দিয়ে চারটি রাজ-পথ নির্গত হয়ে সাম্রাজ্যের চারকোণ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এইসব দেয়াল-বৃত্তের মাঝখানে অবস্থিত ছিল খলীফার প্রাসাদ। প্রাসাদের এক নাম ছিল সোনার দরজা–অন্য নাম ছিল সবুজ গম্বুজ। প্রাসাদের কাছেই ছিল বিশাল মসজিদ। দরবার-মহলের গম্বুজটি উচ্চতায় ছিল একশ’ ত্রিশ ফিট। এই গম্বুজ অনুসারেই প্রাসাদের অন্যতম নাম হয়। পরবর্তীকালের একটি উপ-কথায় পাওয়া যায় যে, এই গম্বুজের চূড়ায় দাঁড়ানো ছিল নেজা হাতে একজন অশ্বারোহী এবং বিপদের সময় নেজাটি সেই দিকে মুখ করে থাকত, যে দিক হতে দুশমনের আগমন সম্ভাবনা থাকতো। কিন্তু একজন আরব ভৌগোলিক বলেন যে, নেজাটি, বরাবর একই দিকে প্রসারিত ছিল। তাই বলে এই একই দিক হতে সর্বদা দুশমনের আগমণের আশঙ্কা আছে, মুসলমানেরা এমন আজগুবী কথা বিশ্বাস করার মতো বোকা ছিল না।

নতুন রাজধানীর এই অবস্থানের ফলে প্রাচ্য-দেশসমূহ হতে নব নব ভাবের আগমন পথ খুলে যায়। আরবের জীবনবাদ ইরানী প্রভাবের নিকট নতি স্বীকার করে। খলীফা আর আরবের শেখের মত রইলেন না; তিনি ইরানী বাদশাহর মত স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেন। ক্রমে ইরানী উপাধি ইরানী শরাব, ইরানী পত্নী ও উপপত্নী, ইরানী সঙ্গীত ও ভাবধারা প্রধান্য বিস্তার করে। তাদের প্রভাবে আদিম আরব-জীবনের রুক্ষতা দূর হয় এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান অনুশীলনের এক নব যুগের দুয়ার খুলে যায়। কেবল দুই বিষয়ে আরবরা তাদের বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে সমর্থ হয় : ইসলামী রাষ্ট্রের ধর্ম এবং আরবী সরকারী-ভাষা রয়ে যায়।

নবম শতাব্দীর শুরুতে দুইজন বিশ্ববিখ্যাত সম্রাট ইতিহাসের দিগন্তে দেখা দেন! পাশ্চাত্যে শার্লেমেন আর প্রাচ্যে খলীফা হারুনর-রশীদ। এ দুইয়ের মধ্যে হারুন নিঃসন্দেহ রকমে অধিকতর শক্তিশালী ও উন্নততর সংস্কৃতির অধিকারী ছিলেন। স্বকীয় স্বার্থের খাতিরে এঁরা দুই জন বন্ধুত্ব-সূত্রে আবদ্ধ হন। শার্লেমেন হারুনের বন্ধুত্ব কামনা করেন এইজন্য, যাতে হারুন শার্লেমেনের শত্রু বাইজেন্টাইনদের সাহায্য না করেন। আবার হারুন শার্লেমেনের বন্ধুত্ব কামনা করেন এইজন্য, যাতে শার্লেমেন হারুনের বিপজ্জনক দুমশন স্পেনের উমাইয়াদের সাহায্য না করেন। কারণ, ইতিমধ্যে উমাইয়াদের এক শাখা স্পেনে এক মহাশক্তিশালী ও সমৃদ্ধ রাজ্য গড়ে তোলেন। পাশ্চাত্য লেখকদের মতে–এই দুই সম্রাট তাদের বন্ধুত্বের পরিচয় হিসেবে নিজেদের মধ্যে দূত ও উপহার আদান-প্রদান করেন। এ আমলের একজন ফিরিঙ্গী লেখককে কেউ কেউ । শার্লেমেনের সেক্রেটারীরূপে বর্ণনা করেছেন। ইনি বলেন যে, পাশ্চাত্যের মহান সম্রাটের দূত পারস্যের রাজা হারুনের নিকট হতে বহু দামী সওগাতসহ ফিরে এলেন। এ সওগাতের মধ্যে ছিল কাপড়-চোপড়, গন্ধ-দ্রব্য ও একটি হাতী। এ বিবরণে আরও পাওয়া যায় যে, এ সওগাতের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম কাজ করা ঘড়ি ছিল। হারুন তার প্রদত্ত উপহারগুলির মধ্যে একটি অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্র দিয়ে ছিলেন বলে যে কাহিনী প্রচলিত আছে, তা বহু মনোরম কাহিনীর মত সম্পূর্ণ অলীক। মূল বিবরণে ‘ক্লেপসিড্রা’ শব্দটির ভুল অনুবাদ হতে এ কাহিনীর উদ্ভব। শব্দটির আসল মানে হচ্ছে, পানির সাহায্যে সময় পরিমাপ করার একটি কৌশল। স্বভাবতঃ ঘড়িটি সম্পর্কেই এ শব্দ প্রযুক্ত হয়েছিল। হারুন বায়তুল মোকাদ্দেসের বড় গীর্জার চাবি শার্লেমেনের নিকট পাঠিয়েছিলেন বলে যে কাহিনী শুনা যায়, তা-ও ভিত্তিহীন। এইসব উপহার ও দূত বিনিময় নাকি হয় ৭৯৭ সাল হতে ৮০৬ সালের মধ্যে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এ সম্বন্ধে মুসলিম লেখকেরা একদম চুপ। অন্য বহু দূত ও উপহার বিনিময়ের কথা তারা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু এ সম্বন্ধে একটি হরফও তারা উচ্চারণ করেন নাই।

হারুনের আমলে (৭৮৬-৮০৯) বাগদাদের বয়স পঞ্চাশেররা কম ছিল; অথচ এই স্বল্পপরিসর সময়ের মধ্যে বাগদাদ একদম শূন্য হতে মহা ঐশ্বর্যশালী ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ শহর হয়ে ওঠে। সে যুগে এই-ই ছিল বাইজানটিয়ামের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী। সাম্রাজ্যের শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী বাগদাদেরও ঐশ্বর্য-মহিমা বেড়ে চলে। বাগদাদ হয়ে ওঠে এ দুনিয়ার অতুল্য নগরী।

হেরেম, খোঁজাদের আবাস, অন্যান্য আমলাদের ইমারতসহ খলীফার প্রাসাদ ‘গোল শহরের তিনভাগের একভাগ জুড়ে ছিল। প্রাসাদের মধ্যে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ছিল, তার মোলাকাত মহল। প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ গালিচা, পরদা, সোফা ইত্যাদিতে সুসজ্জিত থাকত এ মহলটি। খলীফার বেগম ছিলেন জোবায়দা আগের সম্বন্ধে চাচাতো বোন। পরবর্তী যুগের লোকেরা খলীফার জীবনকে যে গৌরব-মহিমায় মণ্ডিত করেছে, বেগম জোবায়দা তার আংশিক অধিকারিণী। মণি-মাণিক্য খচিত সোনা-রূপার বাসনপত্র ছাড়া অন্য বাসন জোবায়দার টেবিলে স্থান পেত না। তিনিই প্রথম তার জুতা বহুমূল্য মণি-মাণিক্যে খচিত করেন। কথিত আছে, হজ্ব করতে যাওয়া উপলক্ষে তিনি ত্রিশ লক্ষ দিনার ব্যয় করেন। এই অর্থের আংশিক ব্যয়ে বিশ মাইল দূরের এক নদী হতে খাল কেটে মক্কা শরীফে পানি আনা হয়।

সৌন্দর্যে জোবায়দার প্রতিদ্বন্দ্বিণী ছিলেন হারুনের সতেলা বোন উলাইয়া । উলাইয়ার কপালে সামান্য একটু দাগ ছিল। সেই দাগ ঢাকার জন্য উলাইয়া একটি জড়োয়া ফিতা ব্যবহার শুরু করেন। অল্পকাল মধ্যেই ফ্যাশন জগতে ‘আলা-উলাইয়া নামে এই ফিতার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে।

খলিফার অভিষেক উৎসব, বিয়ে-শাদী, হজে গমন ও বিদেশী দূতদের অভ্যর্থনা ইত্যাদি বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে রাজকীয় ঐশ্বর্য ও ধূমধামের পূর্ণ আয়োজন হত। ৮২৫ সালে খলীফা মামুনের সঙ্গে তাঁর উজীর কন্যা আঠারো বছর বয়স্কা বুরানের বিয়ে হয়। এই বিয়ে উপলক্ষে এমন বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়িত হয় যে, তা সমসাময়িক আরবী সাহিত্যে অপরিমিত ব্যয়ের এক অবিস্মরণীয় কীর্তি হিসেবে স্থান পেয়েছে। নব-দম্পতি মণিমুক্তা খচিত এক সোনার পাটির উপর দাঁড়ান; একটি খাঞ্চা হতে অতুল্য আকারের এক হাজার মতি তাঁদের উপর ছিটিয়ে দেওয়া হয়। একটি বিরাট আকারের মোমবাতি রাতকে দিন করে রাখে। মেশকের বড় বড় গোলা-প্রত্যেক গোলার সঙ্গে আটকানো একটি টিকেট, সেই টিকেটে লেখা একটি জমিদারী, একটি গোলাম, কিংবা অনুরূপ মূল্যবান কোন বস্তুর নাম–আর সেই গোলা উপস্থিত শাহ্জাদা ও আমীর-রইসদের উপর বর্ষণ করা হয়। ৯১৭ সালে খলিফা মুক্তাদীর তার প্রাসাদে মহাধুমধামে সপ্তম কন্স্ট্যানটাইনের দূতগণকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। যুদ্ধবন্দীর মুক্তি-মূল্য নির্ধারণ করার জন্য এ দূতগণ এসেছিলেন বলে মনে হয়। অভ্যর্থনার জন্য খলীফার পক্ষ হতে যেসব লোক সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়, তার মধ্যে ছিল ১ লক্ষ ৬০ হাজার অশ্বারোহী ও পদাতিক, ৭ হাজার সাদা ও কালা খোঁজা এবং ৭ শ’ উচ্চপদস্থ আমলা। প্যারেডের সঙ্গে চলেছিল এক শ’ সিংহ আর খলীফার প্রাসাদে ঝুলেছিল ৩৮ হাজার পর্দা (তার মধ্যে ১২ হাজার ৫ শ পর্দা ছিল জরির কারুকার্য খচিত), আর বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল ২২ হাজার গালিচা। দূতেরা, এমন চমৎকৃত হয়ে পড়েছিলেন যে, তাঁরা প্রথমে প্রাসাদ অধ্যক্ষের কামরাকে, তারপর উজীরের কামরাকে খলীফার মোলকাত মহল বলে মনে করেছিলেন। তারা বিশেষ করে বিস্মিত হন দরাত-মহল দেখে। এই মহলে ৫ লক্ষ ড্রাম (প্রায় ২৯ মণ) ওজনের সোনা ও রূপায় তৈরী একটি গাছ ছিল। তার শাখায় শাখায় বসান ছিল সোনার তৈরী কৃত্রিম গায়ক পাখী। বাগানে গিয়ে তারা অবাক হয়ে দেখেন যে, কৃত্রিম উপায়ে কতকগুলি খেজুর গাছকে ছোট করা হয়েছে এবং তাতে থোকায় থোকায় ধরে আছে দুষ্প্রাপ্য জাতের খেজুর।

মুসলমান রাজা-বাদৃশাহদের মধ্যে হারুন অত্যন্ত বিলাসী ছিলেন। তার ও তাঁর পরবর্তী খলীফাদের অফুরন্ত বদান্যতার আকষর্ণ চুম্বকের আকর্ষণের মত রাজধানীতে কবি, বিদূষক, গায়ক, বাদক, নর্তক, লড়াইর মোরগ ও কুকুরের শিক্ষাদাতা এবং অন্যান্য নানা রকমের আনন্দ পরিবেশকরা এসে হাজির হত। কবি আবু-নুয়াস আর রশীদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং তাঁর অনেক নৈশ অভিসারের শরীক ছিলেন। তিনি এই গৌরবময় যুগের দরবারী জীবনের যে বিচিত্র বর্ণনা দিয়ে গিয়েছেন, তা অবিস্মরণীয়। আল-আগানীর গ্রন্থ এই গৌরবময় যুগের কাহিনীতে পরিপূর্ণ এবং সে কাহিনী হতে মূল সত্য উদ্ধার করা কঠিন নয়। এই কাহিনীর এক কাহিনীতে আমরা শুনতে পাই যে, হারুনর রশীদের পুত্র খলীফা আল-আমীন একদা অপরাহ্নে তার দরবারে বসে তার পিতৃব্য গায়ক ইব্রাহীমকে আবু-নুয়াসের কয়েকটি কবিতা আবৃত্তির জন্য তিন লক্ষ দিনার উপহার দেন। ইব্রাহীম খলীফার নিকট হতে ইতিপূর্বে যে ভাতা পেয়েছিলেন, এ দান তাঁর সঙ্গে যোগ করে মোট পরিমাণ দাঁড়ায়, দুই কোটি দেরহাম। কয়েকটি জিলার খাজনাতেই এ অর্থের সংকুলান হয়ে যেত। আল-আমীন তাইগ্রীস নদীতে মজলিস করার জন্য অনেকগুলি বজরা তৈয়ার করেছিলেন। এসব বজরার আকার নানারকম জীব-জন্তুর মত ছিল। একটি বজরা দেখিতে ছিল শুকোরের মত, একটি ছিল সিংহের মত, আর একটি ছিল ঈগল পাখীর মত। এর একটি তৈয়ার করতে খরচ হয় ৩০ লক্ষ দেরহাম। এই বিবরণে আমরা দেখতে পাই সারা রাত্রিব্যাপী অনুষ্ঠিত কোন একটি নাচের বিবরণ। খলীফা আল-আমীন নিজে হাজির থেকে এ নাচ পরিচালনা করেন অনেক সুন্দরী তরুণী এ নাচের উৎসবে যোগ দেয় এবং মৃদু গানের তালে তালে নাচে। উপস্থিতদের সকলেই গানে শরীক হয়। অন্য একজন গ্রন্থকার বলেন যে, আর-রশীদের ভাই ইব্রাহীম একদিন আর-রশীদকে দাওয়াত করেন। খলীফার সামনে মাছের যে পেয়ালা দেওয়া হয়, দেখা যায় সে পেয়ালায় মাছের টুকরা নেহায়েত ছোট ছোট। কারণ জিজ্ঞাসা করায় ইব্রাহীম বলেন যে, এগুলি কেবল মাছের জিভ এবং ঐ এক পেয়ালার ১৫০টি জিভ সগ্রহ করতে তার খরচ হয়েছে এক হাজার দেরহামের উপর। বর্ণনাকারীদের স্বাভাবিক অতিরঞ্জন বাদ দিলেও বাগদাদ দরবারের জাঁকজমক আমাদের গভীর বিস্ময়ের উদ্রেক করে।

বাগদাদের বহু মাইল-ব্যাপী জেটির ধারে যুদ্ধ-জাহাজ ও প্রমোদতরী সহ শত শত জলযান বাঁধা থাকত। তাদের মধ্যে চীনের জাঙ্কও দেখা যেত। আর ভেড়ার চামড়া ফুলিয়ে তৈরী ভেলাও দেখা যেত। শহরের বিভিন্ন বাজারে আসত-চীন হতে মাটির বাসন, রেশম ও কস্তুরী; ভারত হতে মসলা, খনিজ-দ্রব্য এবং রং; মালয় দ্বীপপুঞ্জ হতে লাল-পাথর ও কাপড়-চোপড়; মধ্য এশিয়ার তুর্কি-ভূমি হতে দাস-দাসী; স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও রাশীয়া হতে মধু, মোম এবং শেতাঙ্গ দাস-দাসী; পূর্ব-আফ্রিকা হতে হাতীর দাঁত, সোনা চূর্ণ এবং কৃষ্ণাঙ্গ দাস-দাসী। চীনা মালপত্র বিক্রির জন্য একটি খাস বাজার ছিল। সাম্রাজ্যের অন্তর্গত অঞ্চলসমূহ হতে জল-স্থল উভয় পথে আসত তাদের নিজস্ব উৎপন্ন দ্রব্য। মিসর হতে ধান, গম, যব এবং পট্টবস্ত্র; সিরিয়া হতে কাঁচ, ধাতব-দ্রব্য ও ফল; আরব হতে কিংখাব, মতি ও অস্ত্র-শস্ত্র এবং পারস্য হতে রেশম, আতর এবং শাক-সঞ্জী।

বাগদাদ ও অন্যান্য রানী কেন্দ্র হতে আরব সওদাগরেরা কাপড়-চোপড় জওয়াহিরাত, ধাতব আয়না, কাঁচের গুটিকা এবং মসলা নিয়ে দূরপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আফ্রিকায় চলে যেত। রাশীয়া, ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও জার্মানীর মত সুদূর উত্তরে ইদানীং যেসব আরব-মুদ্রার গুপ্তভাণ্ডার পাওয়া গিয়েছে, তা থেকে এ যুগের এবং এর পরবর্তী যুগের মুসলমানদের দুনিয়া-জোড়া সওদাগরীর পরিচয় পাওয়া যায়। আরব্য উপন্যাসে বণিক সিন্দাবাদের কাহিনীটি একান্ত সুপরিচিত। এই কাহিনীতে যে সব দুঃসাহসী কাজের বর্ণনা আছে, আরব বণিকদের বাস্তব অভিজ্ঞতাই যে তার বুনিয়াদ, এ কথা অনেক কাল হতে বহুজনে স্বীকার করে আসছেন।

বাগদাদের সমাজে সওদাগরদের একটা বিশিষ্ট স্থান ছিল। আজকের মত তখনো আলাদা আলাদা জিনিসের ব্যবসায়ীদের আলাদা আলাদা বাজার ছিল। গলী জীবনের একটানা সুর ভঙ্গ করে মাঝে মাঝে চলতো বিয়ে অথবা ত্বক ছেদনের উৎসবের শোভাযাত্রা। চিকিৎসক, উকিল, শিক্ষক, লেখক, এবং অনুরূপ শ্রেণীর অন্যান্যরা সমাজে উচ্চ স্থান দখল করতে শুরু করেন। একজন জীবনী লেখক জনৈক বুদ্ধিজীবীর দৈনিক কাৰ্যসূচীর একটা বর্ণনা রেখে গেছেন। তা দেখে মনে হয়, তৎকালীন বাজারে বুদ্ধিজীবীদের বেশ দাম ছিল। আমরা দেখতে পাই যে, এই বিদ্বান মানুষটি রোজ ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে যান, তারপর সরকারী গোসলখানায় প্রবেশ করেন। সেখানে চাকরেরা তার উপর পানি ঢেলে দেয়। গোসলখানা হতে বের হয়ে তিনি আরামের পোশাক পড়েন, একটু শরবত পান করেন, একটা বিস্কুট মুখে দেন এবং বিছানায় গড়ান; হয়তো ঘুমিয়ে পড়েন। এই দিবা-নিদ্রা অন্তে তিনি নিজ দেহকে সুবাসিত করার জন্য গন্ধদ্রব্য পোড়ান এবং মধ্যাহ্নের খানা হাজির করার হুকুম দেন। সে খানায় সাধারণতঃ থাকে রুয়া, মুরগীর বাচ্চা ও রুটি। এরপর তিনি ফের ন্দ্রিা যান। ঘুম ভাঙ্গলে উঠে পান করেন চার বোতল পুরোনো শরাব এবং সঙ্গে কখনো কখনো সিরিয়া দেশের দুই চারটে ছেব নাশপতি খান।

বিলাস-ঐশ্বর্যময় জীবন এ যুগকে ইতিহাস ও উপন্যাসের নিকট প্রিয় করে তোলে। কিন্তু এ যুগকে দুনিয়ার ইতিহাসে অমর করে রেখেছে এক জ্ঞানাত্মক জাগরণ। এ জাগরণ কেবল ইসলামের ইতিহাসে নয়–চিন্তা ও সংস্কৃতির সমগ্র ইতিহাসের মধ্যে এ ছিল এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এ জাগরণের প্রধান হেতু ছিল বিদেশী প্রভাব : কতকটা ইন্দো-পারসিক এবং সিরীয়, কিন্তু প্রধানতঃ হেলেনিক। এ নব-জীবনের সাধনার এক বিশিষ্ট লক্ষণ ছিল ফারসী, সংস্কৃত, সিরিয়াক এবং গ্রীস হতে আরবী ভাষায় অনুবাদ। আরবরা অতিসামান্য নিজস্ব সাহিত্য, বিজ্ঞান বা দর্শন নিয়ে তাদের নতুন জাতীয় জীবনে যাত্রা শুরু করে; কিন্তু তারা মরুভূমি হতে নিয়ে আসে জ্ঞানাত্মক কৌতূহলের এক সুতীক্ষ্ণ বোধশক্তি ও বহু অন্তর্নিহিত বিশিষ্ট গুণ এবং অল্পকাল মধ্যেই তারা বিজিত কিংবা লড়াইর ময়দানে পরিচিত পুরোনো ও উন্নততর সংস্কৃতিবান জাতিসমূহের উত্তরাধিকারী হয়ে বসে। সিরিয়া সভ্যতা পরবর্তী গ্রীক সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। আরবের মুসলমানরা সিরিয়ায় গিয়ে এই গ্রীক প্রভাবিত সিরীয় সভ্যতা গ্রহণ করে। তেমনি ইরাকে গিয়ে তারা ইরান প্রভাবিত ইরাকী সভ্যতা গ্রহণ করে। বাগদাদ নগর স্থাপনের মাত্র পঁচাত্তর বছরের মধ্যে আরবী পাঠক-জগত আপন আয়ত্তে এনে নেয় আরাস্তুর প্রধান প্রধান দর্শন-গ্রন্থ, বড় বড় নিও প্ল্যাটনিক ভাষ্যকারদের গ্রন্থ, গ্যালেনের অধিকাংশ চিকিৎসা গ্রন্থ এবং পারসিক ও ভারতীয় বৈজ্ঞানিক গ্রন্থাবলী।–যার বিকাশ সাধন করতে গ্রীকদের বহু শতাব্দী কেটে গিয়েছিল, আরবরা কয়েক দশকের মধ্যেই তা আত্মস্থ করে নেয়। ইসলামের মূল প্রকৃতিতে ছিল মরুর প্রভাব ও আরব জাতীয়তার পরিচয়-চিহ্ন। গ্রীক ও পারস্য সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আত্মস্থ করার ফলে ইসলাম তার আদি প্রকৃতির অধিকাংশ হারিয়ে ফেলে; কিন্তু এই পথে ইসলাম মধ্যযুগীয় সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে। এই মধ্যযুগীয় সভ্যতা তৎকালে দক্ষিণ ইউরোপ ও নিকট-প্রাচ্যের মধ্যে যোগসূত্র ছিল। মনে রাখতে হবে, এ সভ্যতার খোরাক জোগাত একটি মাত্র স্রোতধারা। এ স্রোতধারা প্রাচীন মিসর, ব্যাবিলনীয়া, ফিনিশীয়া এবং জুড়ীয়া হতে উৎপন্ন হয়ে চলে গিয়েছিল গ্রীসে এবং এই সময়ে হেলেনিজম-এর রূপ গ্রহণ করে প্রায় ফিরে আসছিল। আমরা পরে দেখতে পাব, কিরূপে স্পেন ও সিসিলীতে এই স্রোতধারা ইউরোপীয় রেনেসাঁর সূচনা করে এবং আরবরা কিরূপে স্পেন ও সিসিলীর ভিতর দিয়ে একে ফের ইউরোপে পাঠিয়ে দেয়।

প্রাথমিক যুগেই আরবের মুসলমানেরা পাক-ভারত হতে প্রচুর প্রেরণা লাভ করে। জ্ঞান, ধর্ম, সাহিত্য ও গণিতেই এ প্রেরণা বিশেষ কার্যকরী হয়। ৭৭৩ সালে একজন পাক-ভারতীয় ভ্রমণকারী বাগদাদে আসেন এবং গ্রহ বিজ্ঞান বিষয়ক একখানি গ্রন্থ খলীফার নিকট উপস্থাপিত করেন। খলীফার আদেশে আল-ফাজারী গ্রন্থখানি আরবীতে অনুবাদ করেন। অবশ্য মরুভূমিতে বাস করার কালেই গ্রহ-নক্ষত্র আরবদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে; কিন্তু এই সময়ের পূর্বপর্যন্ত তাদের মধ্যে ওসবের কোন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান শুরু হয় নাই। নামাযের কিবলা কোন্ দিকে হবে, তা ঠিকমত নির্ণয়ের জন্য ইসলাম গ্রহ-বিজ্ঞান অধ্যয়নে উৎসাহ দান করে। সুবিখ্যাত আল খাওয়ারিজমী ৮৫০ সালে ইন্তিকাল করেন। তিনি আল-ফাজারীর গ্রন্থকে ভিত্তি করে গ্রহ-বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর বহুবিশ্রুত নির্ঘণ্টগ্রন্থ প্রণয়ন করেন গ্রীক এবং পাক-ভারতীয় গ্রহ-বিজ্ঞানের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান ও তাঁর নিজস্ব অবদানে উক্ত বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেন। ইউরোপীয়রা যে সংখ্যাকে বলে আরবীয় আর আরবরা পাক-ভারতীয়, সে সংখ্যাও মুসলিম জগতে প্রবেশ করে ঐ একই পাক-ভারতীয় ভ্রমণকারীর নীত একটি গণিত গ্রন্থ মারফত। পরবর্তীকালে নবম শতাব্দীতে আরব গণিত-বিজ্ঞান–পাক-ভারতীয়দের আরো একটি অবদানে সমৃদ্ধ হয়। গাণিতিক জগতের এ অবদান হচ্ছে, দশমিক রীতি।

আরবদের ‘উর্বর হেলাল’ বিজয়কালে তাদের হাতের কাছে গ্রীসের জ্ঞানাত্মক উত্তরাধিকারই ছিল সবচেয়ে মূল্যবান ভাণ্ডার। সুতরাং, আরব-জীবনে সমস্ত বৈদেশিক প্রভাবের মধ্যে হেলেনিজমই সবচেয়ে শক্তিশালী প্রভাব হয়ে দাঁড়ায়।

আল-মামুনের আমলে এই গ্রীক প্রভাব তার চরম সীমায় গিয়ে পৌঁছে। আল-মামুনের চরিত্রে যুক্তিপ্রবণতার ঝোঁক ছিল। ধর্ম-শাস্ত্রের কথার সঙ্গে যে যুক্তির মিল থাকতে হবে, তাঁর এই মতের সমর্থনের জন্য তিনি গ্রীক-দর্শনের আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হন। ৮৩০ সালে তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘জ্ঞান-নিকেতন স্থাপন করেন। এ প্রতিষ্ঠানে পাঠাগার, তত্ত্বমূলক আলোচনার কেন্দ্র ও অনুবাদ সংঘের সমাবেশ ছিল। খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে আলেকজান্দ্রিয়ায় যে যাদুঘর স্থাপিত হয়, তারপর জ্ঞান-নিকেতনের মত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আর একটিও স্থাপিত হয় নাই। এই সময়ের আগ পর্যন্ত খৃষ্টান, মুসলমান ও নও মুসলিমরা নিজ নিজ মরজী মোতাবেক বিক্ষিপ্তভাবে কিছু বই অনুবাদ করে আসছিলেন। আল-মামুনের সময় হতে শুরু করে তার কাছাকাছি পরবর্তীদের কাল পর্যন্ত অনুবাদের কাজ প্রধানতঃ জ্ঞান-নিকেতনকে কেন্দ্র করেই চলতে থাকে। আব্বাসীয় অনুবাদ-যুগ-৭৫০ সাল হতে প্রায় একশ’ বছর পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। অনুবাদকদের বেশির ভাগেরই মাতৃভাষা ছিল আরামেইক (সিরিয়াক)। সেই জন্য অনেক গ্রীক গ্রন্থ প্রথমে আরামেইক ভাষায় অনূদিত হয়–তারপর অনূদিত হয় আরবী ভাষায়। যীশুখৃস্ট আরামেইজ ভাষায় কথাবার্তা বলতেন।

আরবীতে যারা অনুবাদ করতেন, তাঁরা সাহিত্য ও ধর্ম গ্রন্থের খোঁজ-খবর নেন নাই । গ্রীক নাটক, গ্রীক কবিতা এবং গ্রীক ইতিহাস–এসবের সঙ্গে আরব মনের কোন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপিত হয় নাই। এ ক্ষেত্রে পারস্যের প্রভাবই সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ছিল। আফলাতুন ও আরাস্তুর দ্বারা উদ্ভাবিত এবং পরবর্তী নিও-প্ল্যাটোনিস্টদের দ্বারা ব্যাখ্যাত গ্রীক দর্শন নিয়েই মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান আবিষ্কারের যাত্রা শুরু করে!

আরবরা হুনাইন ইবনে-ইসহাককে (৮০৯-৮৭৩) বলে অনুবাদকদের শেখ। ইনি সে জামানার সবচেয়ে বড় পণ্ডিত এবং চরিত্রে সবচেয়ে মহান ছিলেন। হুনাইন হীরাবাসী একজন নেস্টোরীয়ান খৃস্টান ছিলেন। যৌবনকালে ইনি এক ডাক্তারের দোকানে কম্পাউন্ডারের চাকরী গ্রহণ করেন। একদিন তার মনিব শ্লেষের সঙ্গে বলেন, হীরার বাসিন্দাদের চিকিৎসাবিদ্যার সঙ্গে কোন সম্বন্ধ নাই; তুমি বরং বাজারে গিয়ে টাকা ভাঙ্গানোর পেশা শুরু কর। বালক মনিবের এই তিরস্কারের প্রতিবাদস্বরূপ সাশ্রু-নয়নে চাকরী ছেড়ে আসেন ও গ্রীক ভাষা শিক্ষার জন্য সংকল্প করেন। কথিত আছে, হুনাইন গ্যালেন, হিপোক্রাটস্ এবং ডায়োস্ কোরাড়ীসের বই অনুবাদ করেন। এ ছাড়া, আল্লাতুলেন রিপাবলিক’ এবং আরাস্তুর ক্যাটিগরী ফিজিক্স ও ম্যাগনা মরালীয়া’রও অনুবাদ করেন। তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল, গ্যালেনের প্রায় সমস্ত বৈজ্ঞানিক গ্রন্থেরই আরবীতে অনুবাদ। গ্যালেনের দেহ-বিজ্ঞান বিষয়ক সাতখানি বইয়ের মূল গ্রীক গ্রন্থ হারিয়ে গেছে; সৌভাগ্যক্রমে তা আরবী অনুবাদে রক্ষিত হয়েছে। হুনাইন গ্রীক সেপটুয়াজিন্ট হতে আরবীতে ওল্ড টেস্টামেন্টের যে অনুবাদ করেন, তা এখন আর পাওয়া যায় না।

হুনাইন যে সুদক্ষ অনুবাদক ছিলেন, তার সমর্থনমূলক প্রমাণ আছে। তিনি এবং অন্যান্য অনুবাদকেরা মাসে ৫ শত দিনার (১২ শত ডলার বা ৪ হাজার টাকার মত) পেতেন। উপরন্তু আল-মামুন তাঁর অনূদিত গ্রন্থ ওজন করে তাকে সেই পরিমাণ সোনা দিতেন। কিন্তু কেবল অনুবাদক হিসেবে তাঁর গৌরব ছিল; তিনি তাঁর গৌরবের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেন তখন, যখন খলীফা আল-মুতাওয়াক্কিল তাকে ব্যক্তিগত চিকিৎসক নিযুক্ত করেন। একবার খলীফা তাঁর জনৈক দুশমনের জন্য হুনাইনকে একটা গোপন বিষয় তৈরি করে দিতে বলেন। হুনাইন অস্বীকার করেন। ফলে খলীফা তাঁকে এক বছর জেলে আটক রাখেন। খলীফার সামনে এনে মৃত্যুর ভয় দেখালে তিনি উত্তর দেন : মানুষের পক্ষে যা হিতকর, আমি কেবল তাই শিখেছি–অন্য কিছু শিখি নাই। খলীফা বলেন : ‘আমি কেবল তোমার সততা পরীক্ষা করছিলাম। এখন বল, কি জন্য তুমি মারাত্মক বিষ তৈরি করতে অস্বীকার করলে?’ হুনাইন উত্তরে বলেন : দুই বস্তু আমাকে এ কাজ করতে বাধা দেয় । এক-আমার ধর্ম, অন্য–আমার পেশা। আমার ধর্ম বলে যে, আমাদের শত্রুরও আমাদের উপকার করা উচিত; বন্ধুর উপকার তো আরো বেশি করা কর্তব্য। আর আমার এ চিকিৎসা পেশার প্রবর্তনই হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য তাদের রোগ আরোগ্যের কাজেই এর, কর্তব্য সীমাবদ্ধ। তাছাড়া, প্রত্যেক চিকিৎসকই প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ যে, সে কখনো কাউকে মারাত্মক বিষ দিবে না।

চিকিত্সাশাস্ত্রের একজন আধুনিক ফরাসী ঐতিহাসিকই বলেন যে, হুনাইন নবম শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম মানুষ ছিলেন।

তরজমার জামানা খতম হয়ে আসার আগে আরাস্তুর প্রচলিত প্রায় সমস্ত গ্রন্থই আরবী পাঠকদের আয়ত্তে আসে। তার নামে প্রচলিত এই সব বইয়ের । অনেকগুলি অবশ্য মেকী ছিল। এইসব যখন ঘটে, তখন ইউরোপ গ্রীক চিন্তা ও বিজ্ঞান সম্বন্ধে প্রায় সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। কারণ, যখন আর-রশীদ আর আল-মামুন গ্রীক ও পারসিক দর্শন নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত, সেই সময় তাঁদের পাশ্চাত্য সমসাময়িক শার্লেমেন ও তার লর্ডরা নাকি তাদের নাম দস্তখত শিখতে খেটে মরছিলেন। ইসলামে মানব-প্রতিমূলক অধ্যয়নের অঙ্গ হিসেবে শীঘ্রই আরাস্তুর তর্ক-শাস্ত্র বিষয়ক অর্গানন এবং পফিরীর ইসাগোণ’ আরবী-ব্যাকরণের পাশে স্থান গ্রহণ করে। আরবী অনুবাদে আরাস্তুর অলঙ্কার ও কাব্য শাস্ত্র তাঁর অরগাননের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আজ পর্যন্তও এই রীতিই চলে আসছে। নিও প্ল্যাটোনিক ভাষ্যকারদের মতে আফলাতুন ও আরাস্তুর বাণী যে মূলতঃ এক, মুসলমানরা সে অভিমত গ্রহণ করে। নিও-প্ল্যাটোনিজমের প্রভাব বিশেষ করে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে সুফী মতবাদের মধ্যে। আমরা পরে দেখতে পারব যে, আরব পণ্ডিতদের–বিশেষ করে আবু আলী সীনা ও ইবনে রুশদের মারফত আরাস্তুর ও আফলাতুনের মতবাদ ল্যাটিনে প্রবেশ লাভ করে এবং ইউরোপের মধ্যযুগীয় সূক্ষ্ম চিন্তা-ধারার উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।

আব্বাসীয় আমলের এই দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ অনুবাদ-যুগের পর আসে মৌলিক অবদানের যুগ। আমরা এর পরের এক অধ্যায়ে সে সম্বন্ধে আলোচনা করব। প্রাক-ইসলামী যুগে আরবী ছিল কবিতার ভাষা–হযরত মুহম্মদের (সঃ) পর প্রধানতঃ প্রত্যাদেশ ও ধর্মের ভাষা; দশম শতাব্দীতে একান্ত বিস্ময়কররূপে সেই ভাষা বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও দার্শনিক ভাব-প্রকাশের মোলায়েম মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। ইতিমধ্যে কূটনীতি ও সৌজন্যের ভাষা হিসেবে আরবী মধ্য এশিয়া হতে সমস্ত উত্তর আফ্রিকার মধ্য দিয়ে স্পেন পর্যন্ত নিজকে প্রতিষ্ঠিত করে। সেই সময় হতে আজ পর্যন্ত ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মিসর, তিউনিসিয়া, আলজিরিয়া ও মরক্কোর বাসিন্দারা আরবী ভাষায় তাদের মহত্তম চিন্তা প্রকাশ করে আসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *