৫.২ উনপঞ্চাশ সাল

উনপঞ্চাশ সাল এলেন ঝড় বাতাস নিয়ে। পয়লা বোশেখ শুভদিনের একটা কালবৈশাখী হয়ে গেল। দোসরাও একটা ঝাপটা দিলে। তেসরা চৌঠা বাদ দিয়ে পাচুই আবার ঝড় এল বেশ। সেজেগুজে হাঁকডাক করে। দুদিন চারদিন অন্তর একটা করে ঝাপটা প্রায় নিত্যই চলতে লাগল। উনপঞ্চাশ সালে পাগলও ফিরেছে।

সায়েবডাঙার জমির বাকিটা এবার আবার কাটতে আরম্ভ করলে বনওয়ারী। সন্ধের পর চাদ যতক্ষণ ততক্ষণ কোদাল চলতে লাগল কাহারদের, এবার কারদের সঙ্গে আটপৌরেরাও যোগ দিয়েছে। পরমের জমি আট ঘর আটপৌরে ভাগ করে নিয়েছে, কেবল রমণ নেয় নি, সে। বুড়ো মানুষ, সন্তান নাই; সে-ই এখন আটপৌরেদের মাতর হয়েছে; বনওয়ারীর নিচে। অবশ্য। রমণ এখন একরকম বসেই খাচ্ছে। যোগাচ্ছে বনওয়ারী। সুবাসীর মেসো, বনওয়ারীর মেসো। রমণ বনওয়ারীর গরু-বাছুর চাষবাস দেখে—এটা-ওটা যা হয় করে। বনওয়ারী কাহারদের জন্যও জমির চেষ্টা করছে, চন্ননপুরের বাবু মহাশয়ের কাছেও গিয়েছিল। বাবু আশা দিয়েছেন।

সায়েবডাঙার জমি কাটতে কাটতেই ওই সত্যটা আবিষ্কার করলে বনওয়ারীরা। ঊনপঞ্চাশ সাল বাতাস নিয়ে ‘আইছেন লাগন’ অর্থাৎ এসেছে মনে হচ্ছে।

পাগল জমির ধারে বসে বসে তামাক খায়, আর সকলকে খাওয়ায়। ও কোদাল ধরে না। মধ্যে মধ্যে বেরিয়ে পড়ে বাউল-ফকিরের মত বেশ করে। দুদিন পাচদিন ঘুরে ঝোলার পেটটি মোটা করে ফেরে। বসে পাচ-সাত দিন খায়। বলে—এতেই চলে যাবে দিন কটা। ও কোদাল ধরবে কেন? বনওয়ারীও বলে না কোদাল ধরতে। পাগল গুণী মানুষ। গবেষণাটা শুনে পাগল বললে—তা আসবে না কেনে হে! উনপঞ্চাশ যে পবনের বছর। বুয়েচ! তারপর বললে—এবার হনুমানেরও উপদ্রব হবে, দেখো! উনিই তো পবননন্দন। পাগলের কথাটা সত্য। পবনের নন্দন। বলে নয়, ঝড় হলে গাছের ডালে বসে ভিজে হনুমানগুলির যত শীত ধরে, তত বেশি লাফালাফি করে ফেরে। ঝড়োল থামলেই উন্মত্তের মত লাফ দিয়ে বেড়াতে শুরু করে দেয়।

উনপঞ্চাশের পবনে আর পবননন্দনদের ‘বিক্যমে’ অর্থাৎ বিক্রমে কাহারপাড়ার এবার আর দুর্দশার সীমা রইল না। চালের খড় তছনছ হয়ে গেল। ঝড়ের সময় শেষ হলে তালপাতা কেটে চালে চাপালেও আর হবে না। চালে খড়ই আর নাই। থাকবার মধ্যে আছে বনওয়ারীর। কাহারপাড়ার সকলেই করে কৃষাণি। কৃষাণদের ভাগে খড় প্রাপ্য নয়, তিন ভাগের এক ভাগ ধান পাওয়াই সেই আদ্যিকালের নির্দিষ্ট নিয়ম। খড় দু-চার গণ্ডা মনিবের কাছে চেয়ে নেয়। আর মাঠ থেকে সরানো ধানগুলি থেকে কিছু খড় হয়। খড় এবার কেনাও দুঃসাধ্য। খড়ের দরে আগুন লেগেছে। কাহন বিশ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। যুদ্ধ! কাল যুদ্ধ রে!

চন্ননপুরে যাও, বুঝতে পারবে কি রকম যুদ্ধ লেগেছে পৃথিবীতে। কারখানাটা বেড়ে যেন ভীমের বেটা ঘটোৎকচ হয়ে উঠেছে। আর সে কি গর্জন! লোহার যন্ত্রপাতিগুলো ঘড়ঘড় ঘং ঘং-ঘটাং-ঘং ঘটা ঘটা ঘং—ধড়াম-ধুম শব্দ করে যেন মহামারণ লাগিয়ে দিয়েছে। মধ্যে মধ্যে আবার উ-উ-উ করে পেঁচিয়ে ওঠে। শরীরের পা থেকে মাথা পর্যন্ত শিরশির করে। সেখানে দাঁড়ালে কানে তালা ধরে যায় শব্দে। ভিতরে ঢুকলে নাকি গরমে সিদ্ধ হয়ে যায় মানুষ। দুটো চারটে লোক প্রতিদিনই জখম হচ্ছে। দু-দশ দিন অন্তর মরছেও একটা দুটো। কাউকে টেনে নিচ্ছে কলের চাকায়, কারও মাথায় খসে পড়ছে লোহার টুকরো, কেউ মরছে উপর থেকে মুখ থুবড়ে পড়ে। মরলে নাকি ক্ষতিপূরণ দেয়। সে নাকি অনেক টাকা। হোক অনেক টাকা, জীবনের চেয়ে তার দাম বেশি?

করালী সেই কারখানার ভিতর কুলি-সর্দার হয়েছে। কোট পরেছে, পেল পরেছে, জুতো পায়ে টুপি মাথায় দিয়ে হুকুম চালায়। বনওয়ারী আশ্চর্য হয়ে যায়, করালী আজও শাস্তি পেলে না কেন? বাবাঠাকুরের বিচার ন্যায়বিচার, যমদণ্ডের আঘাতে সাজা! সে সাজা কি করালীর আজও পাওয়া হয় নাই? হবে হয়ত। আজও হয়ত সময় হয় নাই, হতভাগার পাপের ভারা এখনও পূর্ণ হয় নাই। এবারে ঝড়ে সকলের ঘর উড়ল, কিন্তু করালীর ঘর প্রায় ঠিকই আছে। অবশ্য লোহার তার দিয়ে চালকে বেঁধেছে মাটির সঙ্গে, চালের উপরে আবার দড়ির জাল দিয়ে খড়ের ছাউনিকে ঢেকে বেঁধেছে, কিন্তু বাবাঠাকুরের কোপ তালগাছের মাথা ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে দেয়, পাকা রেলের পুলকে ভাসিয়ে দেয়, তার কাছে ও বাঁধন কি? ওই পাপের ভারা পূর্ণ হয় নাই— এই কথাই ঠিক।

করালীর দঙ্গলে কতকগুলো ছোঁড়াও ভিড়েছে। ভিড়ুক। ওদেরও সাজা হবে। বাবাঠাকুর আছেন।

হঠাৎ এসে দাঁড়াল ঘোষ-বাড়ির চাকর।বড়কর্তা ডেকেছেন বনওয়ারীকে।

–বড়কত্তা! এত এতে? কাল সকালে—

—না না। আজই রাত্রে যেতে হবে। তা নইলে, এই সায়েবডাঙায় আসব কেনে?

—কি, বেপার কি?

–বাড়িতে খাওনদাওন, জান তো?

—হাঁ, তার তো সব যোগাড় হয়েই যেয়েছে।

—তুমি যেয়ে, সেখানেই শুনবে সব।

চাকরটা চলে গেল।

ঘোষ-বাড়িতে প্রতি বৈশাখী সংক্রান্তিতে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা আছে। পুণ্য কর্মটির রেওয়াজ করে গিয়েছেন স্বয়ং ঘোষ মহাশয়দের মা-ঠাকরুণ। বলে গিয়েছেন—নেহাত মন্দ অবস্থা না হলে এটি বন্ধ কোরো না।

ব্ৰাহ্মণ কায়স্থ সদ্‌গোপ মহাশয়েরা ভোজন করেন। কাহারেরা প্ৰসাদ পায়, এটোকাটা সাফ করে, পাতায় পড়ে থাকা খাবার গামছায় বেঁধে বাড়ি আনে, আনন্দ করে খায় পরের দিন।

পাগল বললে—তা হলে ওঠ আজকের মত। উদিকে আকাশের গতিকও মন্দ হে। পচিমে চিকুরছে, বাতাস থম ধরেছে। আজ চার-পাঁচ দিন দেবতা হকাড় দেন নাই। আজ বোধহয় এতে আসবেন-বা!

পাগল বসে বসে ঠিক দেখেছে। পশ্চিমে মেঘ উঠেছে। মাঝ-আকাশে চাদ আছে বলে এখনও আলো রয়েছে।

বড় ঘোষ মহাশয় থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভয় পেলে বনওয়ারী। চন্ননপুরের বাবুদের কাছে জমি নিয়ে ঘোষ মহাশয়দের জমির কাজে কিছু অবহেলা তার হচ্ছে, এ জন্য বড়কর্তা। একদিন রোষ করবেন—এ অনুমান বনওয়ার কিছুদিন ধরেই করে আসছে। আজ বুঝলে খাওয়া-দাওয়ানের কোনো কর্মের খুঁত ধরে সেইটা আজ মাথায় পড়ছে। সে সভয়ে সবিনয়ে বললে—আজ্ঞে?

বড়কর্তা ফেটে পড়লেন—তোমাদের কাহারদের আমি সোজা করে দেব।

–আজ্ঞে?

—কেরোসিনের জন্যে খবরদার আসবে না তুমি। চিনির জন্যে না। কাপড়ের জন্যে না। কুইনিনের জন্যে না। খবরদার। দোব না আমি।

বড়কর্তা ইউনিয়ন-বোর্ডের মেম্বর। কাহারপাড়া জাঙলের হুকুমচিঠির ভার ওঁর উপরে। যুদ্ধের জন্য ‘কেরাচিনি’, চিনি, কাপড়, ‘কন্টোল’ না কি হয়েছে! বাজারে গিয়ে পয়সা দিয়ে মেলে না। হুকুমচিঠি পেলে, সেইটি দেখালে, তবে পাওয়া যায়। কাহারেরা ‘কেরাচিনি পায়, চিনি বড় একটা পায় না। সাত দিনে এক ছটাক দু ছটাক বরাদ্দ। তাও বন্ধ করে দেবেন। বলছেন। চিনি গেলে ক্ষতি নাই। চিনি ওরা খায় না, ওদের চিনিটা নিয়ে থাকেন ওদের মনিব মহাশয়েরা। কিন্তু কেরাচিনি’ খানিক-আধেক না হলে চলবে কি করে? ‘কুনিয়াল পিল’ ইউনিয়ন-বোর্ড দেন মেম্বরের হাতে, ম্যালেরিয়ার সময় ভাদ্র-আশ্বিন-কাৰ্তিকতখন কুনিয়াল না হলে মরণ! কিন্তু অপরাধটা কি হল?

বড়কর্তা বললেন—গলায় তোরা পৈতে নে, বুঝলি? তোদের মেয়েরা চন্ননপুরে গিয়ে–

বড়কর্তা একেবারে কাহার-মেয়েদের যত কেলেঙ্কারি প্রকাশ করে দিলেন। বড়কর্তা রেগে গিয়ে কাহারদের কথা প্রকাশ করে বললেন-কাহারেরা আর কাহার নাই, বামুন। তা পৈতে নিক কাহারেরা। শেষে একেবারে ক্ষেপে গিয়ে বললেন—এটো ভাত খাবে না, নেমন্তন্ন চাই! জুতো না-খেয়ে সব মাথায় উঠেছে।

বনওয়ারী অবাক হয়ে গেল—সে কি? এসব কথা কে বললে আপনাকে?

বড়কর্তা উঠে এলেন। বললেন—তোদর ওই করালী বলেছে। হারামজাদাকে আমি একদিন জুতো। শালার ভয়ানক বড় হয়েছে। চন্ননপুর ইস্টিশানে ছোটকা অর্থাৎ ছোট ভাই আজ বাজার করে নেমেছিল। তাদের সিধু ছিল সেখানে। সিধু জিজ্ঞেস করেছে অন্নপ্রাশনের কথা। বলেছে—আমাদিকে পেশাদ দেবেন তো? ছোটকা বলেছে নিশ্চয়ই পাবি; যাবি তোরা। তুই করালী পাখী যাবি, কাহারপাড়ার সবাই আসবে। করালী দাঁড়িয়ে ছিল কাছেই। সে বেটা বলেছে—করালী কারও এটোকাটার পেসাদ খায় না। কাহারপাড়ার ছেলে-ছোকরারাও বলছে— তারাও যাবে না। সিধুকে বলেছে—তু যদি যাস তো তোর সঙ্গেও আমরা খাব না।

অবাক হয়ে গেল বনওয়ারী। এমন স্পৰ্ধা সে কল্পনাও করতে পারেন।

বড়কর্তা বললেন–যে শালা কাহার না আসবে, তাকে দেখব আমি। আবার পাড়াতে মজলিস জুড়েছে!

***

কথাটা সত্য। সেই রাত্রেই করালীর বাড়িতে কাহার-ছোকরাদের মজলিস চলছিল। করালী তাদের সেই কথা বলছে। হেঁয়া খেলে জাত যায় না। এঁটো খেলে জাত যায়। যে কাহার পরের এঁটো খাবে সে পতিত। তার জাত নাই।

করালীর আফসোস-বুড়ো কাহারেরা এই সহজ কথাটা বুঝছে না। আফসোস তারা চন্ননপুরের কারখানায় গিয়ে একবার পরখ করে দেখছে না, সেখানে সুখ কি দুখ! সেখানে মানুষের ভাল হয় কি মন্দ হয়!

মজলিসটা জমেই উঠেছিল। বনওয়ারী এসে হাজিরও হত। কিন্তু জাঙল থেকে পথে ফিরতে ফিরতেই এল ঝড়। হাঁকডাক করে এল। গো-গেশো-শো! এ বছর এমন জোরে আসেন নাই ঠাকুর। আজ নিশ্চয় আসছেন করালীর তালগাছটার মাথা ভাঙতে। নিশ্চয়। সে আকাশের দিকে চাইলে। মেঘের নিচে চাদ এখনও দেখা যাচ্ছে। মেঘ কুণ্ডলী পাকাচ্ছে, সাদা কালো। চমকে উঠল বনওয়ারী। সেই বরন, সেই চিত্ৰবিচিত্র। তেমনি এঁকেবেঁকে পাকিয়ে পাকিয়ে ঘুরছে। জিবের মত লকলকিয়ে খেলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ। হে বাবাঠাকুর রক্ষা কর। হে বাবাঠাকুর। গাছ ভাঙছে, বাঁশে বাঁশে কটকট শব্দ উঠছে, কড়কড় করে মেঘ ডাকছে; সঙ্গে সঙ্গে নয়ানের মায়ের গলায় আজ আবার অনেকদিন পরে সাড়া জেগেছে।

ওদিকে নয়ানের মা তীব্ৰস্বরে বলে যাচ্ছে, সুচাঁদের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই বলছে—হে বাবাঠাকুর, তুমি ধ্বংস কর বাবা, যে তোমার বাহনকে মারলে, যে পরের ঘর ভাঙলে, গাঁয়ের বিধান না মেনে যে উঁচু ঘর বাঁধলে, একবার যুঁসিয়ে তার ঘর উড়িয়েছ, আবার ভেঙে দাও। মড়মড় করে ভেঙে দাও। মাথায় তাদের দংশন কর। হে বাবা! যে-যে নোক তোমার বাহনকে মারার অপরাধকে ক্ষমা করেছে, তাদের কামুড়ে মেরে ফেল। চোখ ফেটে যাক অক্তের ডেলা হয়ে; গায়ে অক্তমুখী চাগড়া চাগড়া দাগ ফুটে উঠুক। কাহারপাড়ায় যার যত অপরাধ, বিচার কর। শ্যাষ করে দাও, শ্যাষ করে দাও, শ্যাষ করে দাও। আমার নয়ানের সঙ্গী কর সবাইকে। আমাকে যেন বাঁচিয়ে একো। আমি নি-মনিষ্যি কাহারপাড়ার ঘরে ঘরে নেচে বেড়াব–কেঁদে বেড়াব পেত্নীর মত।

বনওয়ারী চুপ করে বসে রইল মেঘের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ হুড়মুড় করে শব্দ উঠল। পড়ল? করালীর ঘর পড়ল? উঠে দাঁড়াল বনওয়ারী। নয়ানের মায়ের কণ্ঠস্বর নীরব হয়েছে। ঝড় থামতেই সে বেরিয়ে পড়ল পাড়ায়।—কার ঘর পড়ল?

—নয়ানের ঘর গো।

–নয়ানের ঘর? স্তম্ভিত হয়ে গেল বনওয়ারী।

—বনওয়ারী? ব্যানো!

–কে? বিরক্ত হল বনওয়ারী; পিছনে ডাকে কে?

–আমি, পাগল।

—কি?

—খ্যাত হয়ে গেল ভাই। সৰ্বনাশ হয়েছে।

—কি তাই বল।

–করালী চন্ননপুরে যাবার পথে হেঁকে বলে গেল-বাবাঠাকুরের মুড়ো বিশ্ববিক্ষটি পড়ে গিয়েছেন।

–হে ভগবান! বাবা গো! তুমি কি করলে গো! শেষে কি তুমি আমাদের ছেড়ে গেলে? কলিকাল! অধম্মের পুরী! কাহারপাড়ায় পাপ পরিপূর্ণ করে তুললে করালী। সেই পাপ সইতে না পেরে চলে গেলে তুমি!

জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে গোটা কাহারপাড়া দেখলে। মেঘ কেটে গিয়ে উঁদ আবার উঠেছে। আকাশে। ফুটফুট করছে চাদের আলো। বনওয়ারীর হাতে লণ্ঠনও ছিল একটা। বাবাঠাকুরের বৃক্ষটি কাত হয়ে গিয়েছে।

বনওয়ারী বললে–চান কর সব।

—চান?

–হ্যাঁ, চান কর। চল, ঠেলে বিক্ষটি তুলব। ছোট বিক্ষ, গোটা কাহারপাড়ার কাঁধ, দিব্যি উঠে যাবে। তা’পরেতে ওকে বাধিয়ে দোব। ভয় নাই, পাশের বিক্ষটি ঠিক আছে।

গোটা কাহারপাড়া কাঁধ দিলে।

জয় বাবাঠাকুর! জয় কালারুদ্দু! বলো—শিবো—ধন্মরঞ্জো–! উঠেছে, উঠেছে। আবার বলো ভাই। আবার হয়েছে। হয়েছে। দাও মাটি চারিদিকে বেঁধে দাও। শক্ত করে বেঁধে দাও।

হঠাৎ তীব্র আর্তনাদ করে উঠল কেউ। শিশুকণ্ঠ। চমকে উঠল সবাই। বুক ধড়ফড় করে উঠল। বাবাঠাকুরের থানে কার কি হল?

—কি? কি হল?

–সাপ! ও বাবা, সাপ!

–সাপ! কার ছেলে রে? কে? কি সাপ? বুক চাপড়ে কেঁদে উঠল পানা—নিমতেলে পানা। ওগো—সেই গো, সেই। ঠিক সেই তিনি গো!

একটা ঝোপের মধ্যে একটা চন্দ্রবোড়া ঢুকছিল তাদের স্বভাবমন্থর গতিতে।

কাহারপাড়া স্তম্ভিত হয়ে গেল। পানার ছেলেটা মরে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই, ঠিক যেমন ভাবে মরেছিল করালীর কুকুরটা, তেমনি ভাবেই চোখ ফেটে রক্ত পড়ল, শরীরে চাকা চাকা রক্তমুখী দাগ বার হল। নাক দিয়ে মুখ দিয়ে রক্ত গড়াল। সুচাঁদ চিৎকার করে উঠল—ওরে আমি তখুনি বলেছিলাম রে! বছর পেরুলে কি হবে রে? বাবাঠাকুরের কাছে বছর নাই রে! ওরে বাবা!

নয়ানের মা ভাঙা ঘরের দাওয়া থেকে উত্তর দিল—আঃ, কে করলে বেহ্মহত্যে কার পরান গেল রে? পানী তো খুঁতো পাটার বদলে ভাল পাঁটা দিয়েছিল রে! যে ডাকাবুকো বাবার বাহনকে মেলে রে, তার কিছু হল না কেনে রে? অর্থাৎ করালীর কিছু হল না কেন? তার নিজের ঘর ভাঙায়। কোনো দুঃখ নাই, দুঃখ থাকলেও সে জন্য সে আক্ষেপ করলে না। তার আক্ষেপ পাপীর দণ্ড হল না।

পানা এবং পানার স্ত্রী ভয়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। এ সাজা বাবাঠাকুরের দেওয়া সাজা। এতে কথা বলবার নাই।

হাঁসুলী বাঁকের উপকথার বিধাতাপুরুষ কাহারপাড়ার লোকের নেকনে’ অর্থাৎ লিখনে ষষ্ঠীপুজোর দিনে তার ভাগ্যফল ‘নিকে’ দেন। গত জন্মের যেমন কাজ তেমনি ভাগ্যফল দেন। নইলে চন্দ্ৰবোড়া সাপ এখানে বিরল নয়। যথেষ্ট আছে। তার বিষে মরছেও অনেক। কিন্তু পানার ছেলের এই মরণ, এই বাবাঠাকুরের থানে, বাবাঠাকুরের গাছ পড়ল যেদিন, সেইদিনেই এই মরণ–এর কার্যকারণ সব তো স্পষ্ট প্রত্যক্ষ। পানার ঘরের কুকুরে-ধরা উচ্ছিষ্ট পাঁঠা জরিমানাস্বরূপ আদায় করে চৌধুরীবাবুরা বাবার থানে বলি দিয়েছে, শাস্তি যাবে কোথা? এ। নিশ্চয় বাবাঠাকুরের দণ্ড; ভুল নাই তাতে, কোনো ভুল নাই। এ মিত্যু বাপের পাপে বেটার মিত্যু।

বনওয়ারী মাথায় হাত দিয়ে বসল। বছর পার হয়েছে, তাতে দণ্ডকাল ফুরায় নাই। জন্মান্তরে শাস্তি হয়, যুগ পার করে শাস্তি হয়, আদিকাল থেকে হাঁসুলী বাঁকের কর্মফলে কোন শাস্তি কবে আসবে কে জানে! তবে আসবে নিশ্চয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *