২. ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট

ফোনে আগেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে, পরিচিত ডাক্তারের কাছে রোয়েনকে নিয়ে যাচ্ছেন জর্জিনা, ওর হাতের সেলাই কাটতে হবে। ব্রেকফাস্ট সেরেই নিজেদের কটেজ থেকে বেরিয়ে পড়লো মা ও মেয়ে, সঙ্গে কুকুরটাও রয়েছে।

গ্রামের রাস্তায় বাঁক ঘোরার সময় রোয়েন বিরাট একটা ট্রাক দেখতে পেল, পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তবে ওটাকে নিয়ে আর কিছু ভাবল না। গ্রাম ছেড়ে ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে আসার পর কুয়াশা দেখতে পেল ওরা, কোথাও কোথাও বেশ গাঢ়, ত্রিশ গজের বেশি দৃষ্টি চলে। জর্জিনা জোরে গাড়ি চালাতে অভ্যস্ত, কুয়াশা থাকলেও গ্রাহ্য করছেন না। ল্যান্ড রোভার ফুল স্পীডে ছুটছে। তবে পুরানো হওয়ায় গাড়িটা সম্ভবত ঘণ্টায় ষাট মাইলের বেশি ছুটতে পারে না, আন্দাজ করলো রোয়েন।

পেছনের রাস্তা চেক করার জন্য ঘাড় ফেরাল ও দেখতে পেল সেই ট্রাকটা ওদের পেছনে রয়েছে। নিচের দিকে কুয়াশা জমে থাকায় ট্রাকের শুধু ক্যাব দেখা যাচ্ছে। রোয়েন তাকিয়ে রয়েছে, হঠাৎ পুরো ট্রাকটাই কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেল। ঘাড় সোজা করে মায়ের সাথে কথা বললো রোয়েন।

তুমি কী সত্যি একটা লেবার গভর্নমেন্ট চাও? মাথা নাড়লো ও।

আমি চাই থেচার ফিরে আসুক।

সীটে একটু সরে বসে পেছনের জানালো দিয়ে আবার তাকালো রোয়েন। ট্রাকটা এখনো ওদের পেছনে কুয়াশার মধ্যে ভেসে রয়েছে। আগের চেয়ে অনেক কাছাকাছি চলে আসায় এখন ল্যান্ড রোভারের নীলচে ধোয়াও খেতে হচ্ছে ড্রাইভারকে। হঠাৎ সেটার গতি আরো বাড়লো। মামি, ট্রাকটা বোধহয় তোমাকে পাশ কাটাতে চাইছে, মৃদু গলায় বলল ও।

ওদের রিয়্যার বাম্পার থেকে ট্রাকের প্রকাণ্ড বনেট মাত্র বিশ ফুট দূরে। ট্রাকের রেডিয়েটর ক্রোম লোগগা দিয়ে সাজানো, ক্যাপিটাল লেটারে পাশাপাশি তিনটে শব্দ–এমএএন। লোগোটা ল্যান্ড রোভারের ক্যাব-এর চেয়ে বেশি লম্বা, কাজেই রোয়েন যেখানে বসে আছে সেখান থেকে ড্রাইভারের চেহারা দেখা যাচ্ছে না।

সবাই আমাকে পাশ কাটাতে চায়, অভিযোগ করলেন জর্জিনা। সংক্ষেপে এটাই আমার জীবনকাহিনী। জেদের বশে সরু রাস্তার মাঝখানটা দখল করে রাখলেন তিনি।

আবার পেছন দিকে তাকালো রোয়েন। একটু একটু করে আরো কাছে চলে আসছে ট্রাক। পেছনের জানালো পুরোপুরি ঢেকে দিল ওটা। ক্লাচ ছেড়ে দিয়ে দৈত্যাকৃতি ইঞ্জিনের আবর্তন বাড়াল ড্রাইভার, ভীতিকর গর্জন শোনা গেল। পথ ছাড়লে ভালো করবে, মাকে বলল রোয়েন। লোকটা মনে হচ্ছে রেগে গেছে।

অপেক্ষা করুক, ঠোঁটের এক কোণ থেকে কথা বলছেন জর্জিনা, আরেক কোণে সিগারেট ঝুলছে। ধৈর্য একটা সদগুণ। তাছাড়া, এখানে ওকে পথ ছাড়া সম্ভব নয়। সামনে সরু একটা পাথুরে ব্রিজ আছে। এদিকের রাস্তা-ঘাট খুব ভালো চিনি আমি।

ট্রাক ড্রাইভার এতো কাছে থেকে ইলেকট্রিক হর্ন বাজাল, কানে তালা লেগে গেল রোয়েনের। পেছনের সিটে লাফালাফি আর চিৎকার শুরু করলো ম্যাজিক।

স্টুপিড বাস্টার্ড! তিক্ত গলায় গাল দিলেন জর্জিনা। উলুকটা ভেবেছে কি? রোয়েন, ওর নাম্বার প্লেট লিখে রাখো। ইয়র্ক পুলিশকে রিপোর্ট করব আমি।

প্লেটে কাদা, পরিষ্কার পড়া যাচ্ছে না, তবে মনে হচ্ছে কন্টিনেন্টাল : রেজিস্ট্রেশন। সম্ভবত জার্মান।

যেন জর্জিনার প্রতিবাদ শুনতে পেয়েই ট্রাকের গতি সামান্য কমাল ড্রাইভার, ধীরে ধীরে দুই গাড়ির মাঝখানের দূরত্ব বিশ গজে দাঁড়ালো। ঘাড় ফিরিয়ে এখনো পেছন দিকে তাকিয়ে আছে রোয়েন।

হুঁ-হুঁ, হুন ব্যাটা ভদ্রতা শিখছে, সন্তুষ্টচিত্তে বললেন জর্জিনা। কুয়াশার ভেতর দিয়ে সামনে তাকালেন তিনি। ওই দেখা যায় ব্রিজ…

এই প্রথম ট্রাকের দেখতে পাচ্ছে রোয়েন। ড্রাইভার এমন একটা হেলমেট পরে আছে, চোখ আর নাকের ফুটো ছাড়া মুখের সবটুকুই নীল উলে ঢাকা। হেলমেটটা তার চেহারায় অশুভ আর শয়তানি একটা ভাব এনে দিয়েছে। সাবধান! সর্বনাশ! অকস্মাৎ চিৎকার শুরু করলো রোয়েন। ট্রাক সোজা আমাদের উপর উঠে আসছে! ইঞ্জিনের আওয়াজ বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে দাঁড়ালো, ওদেরকে যেনো ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সাগরের গর্জন গ্রাস করে ফেলেছে। চকচকে ইস্পাত ছাড়া এক মুহূর্ত কিছুই দেখতে পেল না রোয়েন। তারপরই ট্রাকেই সামনের অংশ ল্যান্ড রোভারের পেছনটা চুরমার করে দিল।

ধাক্কা খেয়ে সিটের পিঠে রোয়েনের অর্ধেক শরীর উঠে এলো। কোনো রকমে তাল সামলে সোজা হলো ও, দেখলো ট্রাকটা ওদেরকে শিয়ালের চোয়ালে আটকানো পাখির মতো তুলে নিয়েছে। চকচকে ক্রোম রেডিয়েটর স্টীল বুল বার দিয়ে সুরক্ষিত, বারগুলো প্রায় তুলে নিয়েছে ল্যান্ড রোভারকে, ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। সামনে।

হুইলের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছেন জর্জিনা, নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন।পারছি না! ব্রিজ… সরে যেতে চেষ্টা করো…

সেফটি বেল্টের কুইক রিলিজ বাকলে টান দিয়ে ডোর হ্যাঁন্ডেলের দিকে হাত বাড়াল রোয়েন। ব্রিজের পাথুরে পাঁচিল তীর বেগে ছুটে আসছে ওদের দিকে। রাস্তার উপর আড়াআড়ি হয়ে যাচ্ছে ল্যান্ড রোভার, পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

রোয়েনের হাতের ধাক্কায় কিছুটা খুলে গেল দরজা, কিন্তু পুরোটা খুলল না, কারণ ব্রিজ শুরু হওয়ার আগে পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের দু সারি স্তম্ভের মাঝখানে পৌঁছে গেছে ল্যান্ড রোভার।

গাড়ি চ্যাপ্টা হতে শুরু করায় মা ও মেয়ে একযোগে চিৎকার দিচ্ছে, ধাক্কা খেয়ে দু জনেই ছিটকে পড়লো সামনের দিকে। পাথুরের স্তম্ভে বাড়ি খেয়ে চুরমার হয়ে গেল উইন্ডস্ক্রীন, ল্যান্ড রোভারের বডি এমব্যাঙ্কমেন্ট ধরে নেমে যাবার সময় ডিগবাজি খেতে শুরু করলো।

একটা গড়ান দিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ছিটকে বাইরে পড়লো রোয়েন। ঢালের মধ্যে পড়ায় শরীরটা স্থির থাকলো না, তা থাকলে হাড়গোড় সব গুঁড়ো হয়ে যেত। পড়ার পর গড়াতে শুরু করলো, কিনারা থেকে খসে পড়লো ব্রিজের নিচে ঠাণ্ডা হিম স্রোতের মধ্যে।

পানির নিচে মাথাটা ডুবে যাবার আগে উপরে আকাশ আর ব্রিজ দেখতে পেল রোয়েন। গর্জন তুলে বিদায় নেয়ার আগে ট্রাকটাকেও দেখতে পেল। একজোড়া বিশাল কার্গো ট্রেলার টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওটা। ট্রেলার দুটোর লম্বা বডিওঅর্ক ব্রিজের গার্ড রেলকে ছাড়িয়ে উঁচু হয়ে আছে।

দুটো ট্রেলারই গাঢ় সবুজ নাইলন তারপুলিন দিয়ে মোড়া। কাছাকাছি ট্রেলারের এক পাশে কোম্পানির লাল ট্রেডমার্ক দেখতে পেল রোয়েন, কিন্তু নামটা পড়ার সময় পাওয়া গেল না, তবে আগেই পানির নিচে তলিয়ে গেলও।

আবার যখন পানির উপর মাথা তুললাম, দেখলো ভাটির দিকে খানিকটা সরে এসেছে। তীরে উঠে এসে কাদার মধ্যে শুয়ে কাশছে রোয়েন। কাশির সঙ্গে প্রচুর পানি বেরিয়ে এলো, হালকা লাগলো শরীরটা। কোথায় আঘাত লেগেছে পরীক্ষা করছে, এ সময় উল্টে পড়া ল্যান্ড রোভারের দিক থেকে জর্জিনার যন্ত্রণাকাতর চিৎকার ভেসে এলো।

কাদা, তারপর ঘাসের উপর দিয়ে ছুটল রোয়েন। এমবেঙ্কমেন্টের গোড়ায় চিৎ হয়ে রয়েছে ল্যান্ড রোভার। বডিটা শুধু তোবড়ায় নি, ভেঙে বা ছিঁড়ে গেছে কয়েক জায়গায়। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে, তবে ফ্রন্ট হুইল এখনো ঘুরছে। মামি! মামি, তুমি কোথায়? ফুঁপিয়ে উঠলো রোয়েন। আহত পশুর মতো জর্জিনার গোঙানি থামছে না। তোবড়ানো বডি ধরে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে রোয়েন, গোঙানির উৎসেব দিকে এগুচ্ছে, জানে না কী দেখতে হবে।

জর্জিনা ভিজে মাটিতে বসে আছেন, ল্যান্ড রোভারের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে। পা দুটো সরাসরি সামনের দিকে সোজা করা। তবে তার বাম পা হাঁটুর কাছাকাছি মোচড় খেয়ে আছে, ফলে জুতো পরা গোড়ালি বাঁকা হয়ে কাদার দিকটা নির্দেশ করছে। সন্দেহ নেই ওই পা-টা হাঁটু বা হাঁটুর খুব কাছাকাছি ভেঙে গেছে।

গোঙানোর বা বিলাপ করার সেটা কারণ নয়। জর্জিনা বসে আছেন ম্যাজিককে কোলে নিয়ে। শোকে আকুল ভঙ্গিতে কুকুরটার উপর ঝুঁকে রয়েছেন তিনি, লাশের গায়ে হাত বুলাচ্ছেন আর দোল খাচ্ছেন, বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে আহাজারি। কুকুরটার বুক ইস্পাত আর মাটির মাঝখানে পড়ে গুঁড়িয়ে গেছে। মুখের কোণ থেকে বেরিয়ে এসেছে জিভের ডগা, গোলাপি ওই ডগা থেকে এখনো ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরছে। নিজের স্কার্ফ দিয়ে তা মুছে ফেলছেন জর্জিনা।

পাশে বসে মায়ের কাঁধ দুটো একহাতে জড়িয়ে ধরল রোয়েন। মাকে আগে কখনো কাঁদতে দেখে নি ও। আদরের হাত বুলিয়ে জননীকে সান্ত্বনা দিতে চাইছে, কিন্তু জর্জিনার বিলাপধ্বনি থামছে না।

এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে বলতে পারবে না রোয়েন। তবে এক সময় বাঁকা হয়ে থাকা মায়ের অবশ পা দেখে আঁতকে উঠলো, সেই সঙ্গে ভাবল কাজটা শেষ করার জন্য ট্রাক ড্রাইভার আবার ফিরে আসতে পারে। ক্রল করে ঢালের মাথায়, সেখান থেকে রাস্তার মাঝখানে চলে এলো রোয়েন, ব্রিজে উঠে আসা প্রথম গাড়িটাকে থামাবে।

*

এগারোটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট, দু ঘণ্টা পর বেলা একটার দিকে উদ্বিগ্ন নিকোলাস ইয়র্ক পুলিশকে ফোন করলো। ভাগ্য ভালো যে ল্যান্ড রোভারের লাইসেন্স প্লেটটা গত রোববারে লক্ষ্য করেছিল। পুলিশ স্টেশনের মহিলা কনস্টেবল কমপিউটর চেক করে জানালো, দুঃখিত, স্যার। ল্যান্ড রোভারটা আজ সকালে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। ড্রাইভার ও প্যাসেঞ্জার ইয়র্ক হসপিটালে…

হাসপাতালে পৌঁছতে চল্লিশ মিনিট লাগলো। রোয়েনকে পাওয়া গেল মেয়েদের সার্জিকাল ওয়ার্ডে, মায়ের বেডের পাশে বসে আছে। অ্যানেসথেটিকের প্রভাব এখনো কাটে নি, জর্জিনা সচেতন নন। নিকোলাসকে দেখে মুখ তুলে তাকালো রোয়েন। আপনি সুস্থ তো? কী ঘটল?

মা… মায়ের পা ভেঙে গেছে। সার্জেনকে বাধ্য হয়ে উরুতে একটা পিন আটকাতে হয়েছে।

আপনি কেমন আছেন?

এখানে সেখানে কেটে-ছিড়ে গেছে। সিরিয়াস কিছু না।

কীভাবে ঘটল?

একটা ট্রাক… ঠেলে রাস্তা থেকে ফেলে দিল আমাদেরকে। পুরো ঘটনাটা বর্ণনা করলো রোয়েন।

পরিষ্কার মেরে ফেলার চেষ্টা, বলল নিকোলাস। বিচলিত হওয়া ওর স্বভাব নয়, চেহারায় কাঠিন্য ফুটে উঠলো পুলিশকে জানিয়েছেন?

আরো সকালে পুলিশকে রিপোর্ট করা হয়েছিল ট্রাকটা চুরি গেছে–ঘটনাটা ঘটার অনেক আগে। লিটেল শেফ কাফের সামনে থেমেছিল ড্রাইভার, তখন। লোকটা জার্মান, ইংরেজি জানে না।

এবার নিয়ে ওরা তিনবার আপনাকে খুন করার চেষ্টা করলো, বলল নিকোলাস। কাজেই আপনার নিরাপত্তার দিকটা এখন আমাকে দেখতে হবে।

হাসপাতালের ওয়েটিং রুপে এসে কাউন্টির চীফ কনস্টেবলকে ফোন করলো নিকোলাস। হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গেও ওর পরিচয় আছে।

ওয়ার্ডে ফিরে এসে দেখলো জর্জিনার জ্ঞান ফিরেছে। এখনো একটু আচ্ছন্ন বোধ করছেন তিনি, তবে কোনো রকম কষ্ট পাচ্ছেন না। নিকোলাস যেমন আয়োজন করেছে, চাকা লাগানো বেডে শুইয়ে জর্জিনাকে প্রাইভেট ওয়ার্ডে নিয়ে আসা হলো। কয়েক মিনিট পর অর্থোপেডিক সার্জেন ঢুকলেন কেবিনে।

হ্যালো, নিকোলাস, এখানে তুমি কী করছ? সার্জেন বললেন। রোয়েন অবাক হয়ে ভাবছে, কত মানুষই না চেনে ওকে। জর্জিনার দিকে ফিরলেন সার্জেন, বললেন, কেমন লাগছে এখন? কিছু না, সত্যি ভাঙেনি–শুধু ফেটে গেছে। আবার আমরা জোড়া লাগিয়ে দিয়েছি, তবে আমাদের সঙ্গে অন্তত দশ দিন থাকতে হবে আপনাকে।

আপনার আপত্তি আমি গ্রাহ্য করছি না, জর্জিনা ঘুমিয়ে পড়ার পর রোয়েনকে নিকোলাস নিজের গাড়িতে তুলে নিয়েছে, হল-এ আমার হাউজ কিপার একটা কামরা রেডি রেখেছে আপনার জন্য। পরেরবার কে, কখন আপনাকে ধরে মেরে ফেলবে, ঠিক আছে?

তর্ক করার মতো অবস্থায় নেই তখন রোয়েন। ক্লান্ত ভঙ্গিতে রেঞ্জ রোভারে উঠে বসে সে। প্রথমে তার হাতের সেলাই কেটে, কুয়েনটন পার্কের উদ্দেশ্যে চললো নিকোলাস। পৌঁছানোর সাথে সাথে রোয়েনকে বেডরুমে পাঠিয়ে দিল সে।

কুক আপনার ডিনার পাঠিয়ে দেবে। ডাক্তারের দেওয়া ঘুমের ওষুধটা খেয়ে নিয়েন। মায়ের কটেজের চাবিটা দিলে মিসেস স্ট্রিট আপনার কাপড়-চোপড় নিয়ে আসতে পারতো। এর মধ্যে, টুথব্রাশ আর নাইটগাউন যোগাড় করে রেখেছে। হাউজকিপার। আগামি সকালের আগে আর কোনো কথা নয়।

অনেক দিন পর নিজেকে নিরাপদ লাগলো রোয়েনের। ঘুমের ওষুধটা টয়লেটে ফ্লাশ করে ফেলে দিল সে।

বালিশের উপর যে নাইটড্রেসটা রাখা, লম্বা একটা লেস দেওয়া সিল্কের পোশাক ওটা। সম্ভবত, ওগুলো নিকোলাসের স্ত্রীর ছিল, চিন্তাটা ওর মনে মিশ্র একটা অনুভূতি এনে দিল।

অপরিচিত আরামদায়ক পরিবেশে কিছু সময়ের মধ্যেই ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেল রোয়েন।

*

সকাল হতে, একজন পরিচারিকা এসে দি টাইমস পত্রিকা আর এক কাপ আর্ল গ্রে টি দিয়ে গেল রোয়েনকে। কিছু সময় পর ওর হোল্ডঅলটা নিয়ে ফিরে এলো সে।

ডাইনিং রুমে আটটা ত্রিশের দিকে স্যার নিকোলাস আপনার সঙ্গে নাস্তা সারবেন। জানিয়ে গেল মেইড।

বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালো রোয়েন, সুযোগ পেয়ে ছয় ফুট লম্বা আয়নায় নিজের নগ্ন শরীরটা পরীক্ষা করে নিল। বাহুর ক্ষতটা এখনো ভেজা ভেজা, পুরোপুরি শুকায় নি, ঊরু আর পাঁজরের এক পাশে গাঢ় দাগ ফুটে আছে, কার অ্যাক্সিডেন্টের অবদান। হাঁটুর নিচেও এক ইঞ্চি লম্বা একটা সরু দাগ, চামড়া উঠে গেছে। কাপড়-চোপড় পাল্টে ডাইনিং রুমে আসার পথে খেয়াল করলো, একটু খোঁড়াচ্ছে।

ডাইনিং রুমের দোরগোড়ায় এসে রোয়েন দেখলো নিকোলাস পত্রিকা পড়ছে। হাতছানি দিয়ে ওকে ডেকে টেবিলের নাস্তার দিকে ইঙ্গিত করলো সে। চেয়ারে বসে, ডিম পোঁচে চামচের ঘা দিয়ে শুরু করলো রোয়েন।

ভালো ঘুম হলো? উত্তরের অপেক্ষা না করে বলে চলে নিকোলাস, পুলিশকে ফোন করেছিলাম। ওরা এমএএন ট্রাকটা খুঁজে পেয়েছে, হারোগেটের কাছে। পরিত্যক্ত ওটা। যদিও তদন্ত চলছে, তবে পুলিশ খুব একটা আশাবাদী নয়। ঘাগু লোকের পাল্লায় পড়েছি আমরা।

হাসপাতালে একবার ফোন করা দরকার।

মুখ তুললাম নিকোলাস। করা হয়েছে। দু বার। জর্জিনা ভালো আছেন। তাকে জানিয়েছি, এ সন্ধ্যায় ওকে দেখতে যাবেন আপনি।

সন্ধ্যা, এতো দেরি কেনো?

তার আগে পর্যন্ত আপনাকে আমি ব্যস্ত রাখতে চাই। আপনার কথায় এতোগুলো টাকা আর সময় খরচ করব, জানতে হবে না কিসের পেছনে ছুটছি? একটু থেমে কাজের কথা শুরু করলো নিকোলাস। মরুভূমিতে আপনাদের ভিলায় প্রথম হামলাটা হলো। আততায়ীরা জানত কী চায় তারা, জানত কোথায় খুঁজতে হবে। বেশ। এবার দ্বিতীয় হামলার প্রসঙ্গে আসি। কায়রোয় আপনার গাড়ির ভেতর হ্যান্ড গ্রেনেড ছোঁড়া হলো। সেদিন বিকেলে আপনি মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছেন, এ খবর কে জানত? মন্ত্রী ভদ্রলোক ছাড়া?

মুখভর্তি খাবার নিয়ে কিছু সময় ভাবলো রোয়েন।

ঠিক মনে নেই। সম্ভবত ডুরেঈদের সেক্রেটারিকে বলেছিলাম, আর হয়তো বলেছিলাম রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টদের একজনকে।

ভুরু কুঁচকে মাথা নাড়লো নিকোলাস। তারমানে তো মিউজিয়ামের অর্ধেক স্টাফই আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা জানত। ঠিক আছে, এবার বলুন কে জানত আপনি মিশর ত্যাগ করছেন? কাকে বলেছেন ইংল্যান্ডে এসে আপনি আপনার মায়ের কটেজে উঠবেন?

অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের একজন ক্লার্ক আমার স্লাইডগুলো এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেয়।

তাকে আপনি জানিয়েছিলেন কোন ফ্লাইট ধরবেন?

কেন জানাব।

কাউকেই জানান নি?

না… হ্যাঁ, ইন্টারভিউয়ের সময় শুধু মিনিস্টারকে বলেছিলাম, ছুটি চাওয়ার সময়। কিন্তু তিনি… না, অসম্ভব! প্রতিবাদ করলেও রোয়েনের চেহারায় আতঙ্ক ফুটে উঠলো।

কাঁধ ঝাঁকালো নিকোলাস। দুনিয়াটা বড় বিচিত্র জায়গা, রোয়েন। আপনি আর ডুরেঈদ সপ্তম স্ক্রোলের উপর কাজ করছিলেন, এ বিষয়ে মিনিস্টার সবই জানতেন, তাই না?

বিশদ জানতেন না, তবে জানতেন আমরা কী নিয়ে ব্যস্ত।

ঠিক আছে, পরবর্তী প্রশ্ন–চা, না কফি? রোয়েনের কাপে কফি ঢাললো নিকোলাস, তারপর আবার শুরু করলো, আপনি বলেছেন সম্ভাব্য স্পনসরদের একটা তালিকা ছিল। সন্দেহভাজনদের সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য ওটা কাজে লাগতে পারে।

গেটি মিউজিয়াম, বলল রোয়েন, শুনে হাসলো নিকোলাস।

তালিকা থেকে বাদ দিন ওটা। কায়রোর রাস্তায় গ্রেনেড ফাটিয়ে বেড়ানো ওদের কাজ নয়। তালিকায় আর কে ছিল?

হের ফন শিলার।

হ্যামবুর্গ। হেভী ইন্ডাস্ট্রি। মেটাল ও অ্যালয় রিফাইনারি। বেস মিনারেল প্রোডাকশন। মাথা ঝাঁকালো নিকোলাস। তালিকার তৃতীয় লোকটা কে?

পিটার ওয়ালশ, বলল রোয়েন। টেক্সান।

আরেক বিলিওনেয়ার। ফোর্ট ওয়ার্থে বাস করেন। গোটা আমেরিকার জুড়ে ফাস্ট ফুডের ব্যবসায়, কারখানায় দশ হাজার লোক খাটে। মেইল অর্ডার রিটেইল। কালেক্টর হিসেবে রাক্ষস বলা হয় তাঁকে। আর্কিওলজিক্যাল এক্সপ্লোরেশনে অঢেল টাকা খাটান। যারা আর্টিফ্যাক্ট কালেক্টর তাদের উপর বিশেষ নজর রাখতে হয়। নিকোলাসকে। সব মিলিয়ে সংখ্যায় দুই ডজনের বেশি হবে না তারা। বিভিন্ন নিলাম অনুষ্ঠানে ঘুরে-ফিরে দেখা-সাক্ষাৎও হয়। দু জনেই এঁরা চোখ বোজা ডাকাত। পছন্দ হয়ে গেলে এঁরা তাঁদের সন্তানকেও খেয়ে ফেলতে পারেন। এঁদের পথে আপনি যদি বাধা হন, কী করবেন এঁরা? বইটা ছাপা হওয়ার পর দু জনের। কেউ ডুরেঈদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন কিনা জানেন?

জানি না, করতেও পারেন।

ধরে নিতে হবে ডুরেঈদ কী করছিলেন ওঁরা তা জানতেন। সন্দেহের তালিকায় দু জনই থাকছেন। এবার চলুন, মিউজিয়ামে যাই। দেখা যাক, মিসেস স্ট্রিট কী ব্যবস্থা করেছেন।

নিকোলাসের স্টাডিতে ঢুকে বিস্ময়ের একটা ধাক্কা খেলো রোয়েন। সন্দেহ নেই এতো সব আয়োজন করতে হওয়ায় রাতে নিকোলাস ঘুমায় নি। কামরাটাকে মিলিটারি টাইপ হেডকোয়ার্টার বানিয়ে ফেলেছে ও। কামরার মাঝখানে বড় একটা ইজেল ও ব্ল্যাকবোর্ড দাঁড়িয়ে আছে, গায়ে একটার উপর একটা পিন দিয়ে আটকানো স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ। কাছাকাছি এসে সেগুলো দেখলো রোয়েন, তারপর অন্যান্য জিনিসের দিকে তাকালো।

প্রথমেই দৃষ্টি কেড়ে নিল একটা লার্জ-স্কেল ম্যাপ, স্যাটেলাইট ফটোগুলোর মতো দক্ষিণ-পশ্চিম ইথিওপিয়ার একই এরিয়া কাভার করেছে। ম্যাপের পাশেই নাম-ঠিকানা, ইকুইপমেন্ট আর রসদের তালিকা–বোঝা গেল, এগুলো নিকোলাস ওর আগের আফ্রিকান অভিযানে ব্যবহার করেছে। দূরত্বের মাপজোক ও হিসাবসহ একটা শিটও দেখলো রোয়েন। অপর একটা শিটে ধারণা দেওয়া হয়েছে সম্ভাব্য খরচের, ওটাকে বাজেট শিট বলা যেতে পারে। ব্ল্যাকবোর্ডের মাথার দিকে লেখা হয়েছে–ইথিওপিয়া জেনারেল ইনফরমেশন। নিচে গায়ে গায়ে সাঁটানো টাইপ করা পাঁচটা ফুলসক্যাপ শিট। পুরো শিডিউল পড়লো না। রোয়েন, তবে নিকোলাসের প্রস্তুতির বহর দেখে মুগ্ধ হলো।

হাতে স্টিক নিয়ে বোর্ডের পাশে দাঁড়ালো নিকোলাস, ইঙ্গিতে সামনের একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলল রোয়েনকে। ক্লাসে শৃঙ্খলা থাকতে হবে। বোর্ডে পয়েন্টারের বাড়ি মারল। আপনার প্রথম কাজ আমাকে বিশ্বাস করানো কয়েক হাজার বছর আগে মুছে যাওয়া টাইটার পায়ের ছাপ আবার আমরা অনুসরণ করতে পারব। আসুন সবচেয়ে আগে অ্যাবে গিরিখাদের জিয়োগ্রাফিকাল দিকগুলো বিবেচনা করি।

পয়েন্টার দিকে স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফে নদী কোর্স ব্যাখ্যা করলো নিকোলাস। এই সেকশন ধরে নদীটা এগিয়েছে কালো আগ্নেয় শিলায় তৈরি মালভূমি ডুবিয়ে দিয়ে। পানি থেকে ওঠা পাহাড়-প্রাচীর কোথাও কোথাও একদম খাড়া, দুদিকে চারশো থেকে পাঁচশো ফুট উঁচু। আরো কঠিন সিস্ট শিলার স্তর যেখানে, প্রবাহে সেখানে সুবিধে করতে পারে নি। কাজেই নদীর চলার পথে বিশাল আকারে বেশ কিছু ধাপ তৈরি হয়েছে। টাইটার ধাপ যে আসলে জলপ্রপাত, আপনাদের এ ধারণা সম্ভবত সত্যি।

টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো নিকোলাস, কাগজের অনেকগুলো বান্ডিল পড়ে রয়েছে উপরে, সেগুলোর ভেতর থেকে একটা ফটোগ্রাফ তুলে নিল। ব্রিটিশ আর্মড ফোর্সের এক্সপিডিশনের সময় এ ছবিটা তুলি আমি। খাদের ভেতর জলপ্রপাতগুলো কী রকম, সে সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারবেন।

সাদা-কালো ছবি, দু পাশে আকাশে ছোঁয়া পাহাড়-প্রাচীর দেখা যাচ্ছে, নিচে অর্ধনগ্ন ক্ষুদে কিছু মূর্তি ও বোট, তাদের উপর আকাশ থেকে নেমে আসছে বিপুল জলরাশি। রোমহর্ষক একটা দৃশ্য। আমার কোনো আইডিয়া ছিল না! এরকম দেখতে! হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলো রোয়েন।

জায়গাটা কি রকম দুর্গম আর নির্জন, ছবি দেখে আপনি ধারণা করতে পারবেন না, বলল নিকোলাস। একজন ফটোগ্রাফারের দৃষ্টিতে, ওখানে দাঁড়াবার এমন একটা জায়গা নেই যেখান থেকে খাদ বা জলপ্রপাতের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ক্যামেরায় বন্দি করা যায়। তবে এটুকু অন্তত বুঝতে পারবেন যে উজানের দিকে পায়ে হেঁটে আসা মিশরীয় একদল অভিযাত্রীকে কীভাবে থামিয়ে দেবে ওই জলপ্রপাত। সাধারণত জলপ্রপাতের পাশে কোনো না কোনো ধরনের পথ তৈরি হয়, হাতি বা অন্য কোনো বন্য প্রাণী আসা-যাওয়া করায়। তবে, এ ধরনের জলপ্রপাতকে পাশ কাটানোর মতো কোনো পথ বা উপায় থাকে না।

মাথা ঝাঁকাল রোয়েন। আমরা তাহলে একমত হলাম একটা জলপ্রপাতই আরো সামনে এগুতে বাধা দেয় ওদেরকে পশ্চিম দিক থেকে যেতে দ্বিতীয় জলপ্রপাতটা।

স্যাটেলাইট ফটোয় নদীর কোর্স পয়েন্টার দিয়ে অনুসরণ করলো নিকোলাস, সেন্ট্রাল সুদানের গাঢ় গোঁজ আকৃতির রোজিরেস ড্রাম থেকে। সীমান্তের ইথিওপিয়ান দিকটায় বন্ধুর উতরাই বা ঢল আরো উঁচু হয়েছে, মূল গিরিখাদ শুরু হয়েছে ওখান থেকেই। ওদিকে কোনো রাস্তা বা শহর নেই, বহুদূর উজানের দিকে শুধু দুটো ব্রিজ আছে। পাঁচশো মাইলের মধ্যে কিছুই নেই, আছে নীল নদের খরস্রোত প্রবাহ আর ভয়ালদর্শন কালো ব্যাসল্ট শিলা। খাদের গভীরে প্রধান জলপ্রপাতগুলো স্যাটেলাইট ফটোয় চিহ্নিত করে রেখেছি আমি। পয়েন্টার তুলে সেগুলো দেখালো নিকোলাস, লাল মার্কার পেন দিয়ে তৈরি বৃত্তের ভেতর প্রতিটি।

রোয়েন গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে ও দেখছে।

এখানে দ্বিতীয় জলপ্রপাত, সুদানিজ বর্ডার থেকে একশো বিশ মাইল উজানে। তবে আমাদেরকে আরো অনেক ফ্যাক্টর বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমন, টাইটা ওদিকে গেছে আজ থেকে চার হাজার বছর আগে, ইতোমধ্যে নদী তার কোর্স বদলে থাকতে পারে।

কিন্তু ক্যানিয়নটা চার হাজার ফুট গভীর, ওটার ভেতর থেকে নদী পালাবে কী করে? রোয়েনের প্রশ্নের মধ্যে প্রতিবাদের সুর।

নীল নদ যতই বেয়াড়া হোক।

ঠিক, কিন্তু নদীর তলা যে বদলেছে এটা নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া যায়। বন্যার মরশুমে প্রবাহের বিপুলতা ও শক্তি ব্যাখ্যা করা যায়, এমন ভাষার উপর আমার দখল নেই। সাইড ওয়ালের বিশ মিটার পর্যন্ত ফুলে ওঠে নদী, ছোটে ঘণ্টায় দশ নট গতিতে।

নদীর ওই ভরা মাসে আপনি দাঁড় টেনেছেন? রোয়েনের গলায় সন্দেহ।

আরে না, বন্যার মরশুমে না। ওই সময় কিছুই ওখানে টিকবে না।

ছবিটার দিকে এক মিনিট চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো ওরা, সমস্ত আক্রোশ নিয়ে ফুলে-ফেঁপে থাকা বিপুল জলরাশির আস্ফালন কল্পনা করতে গিয়ে আতঙ্ক অনুভব করছে।

তারপর নিকোলাসকে মনে করিয়ে দিল রোয়েন দ্বিতীয় জলপ্রপাত।

সেটা এখানে, উপনদীগুলোর একটা যেখানে অ্যাবের মূল প্রবাহে এসে মিলিত হয়েছে। ওটার নাম ডানডেরা নদী, বারোশো ফুট অলটিচ্যুড পর্যন্ত উঠে এসেছে, চোক রেঞ্জের সানসাই পাহাড় চূড়ার নিচে, গিরিখাদের একশো মাইল উত্তরে।

আপনার মনে আছে, ঠিক কোনো স্পটে ওটা অ্যাবের প্রবাহে মিলিত হয়েছে?

সে অনেক বছর আগে কথা। তাছাড়া, ওই খাদের তলায় প্রায় এক মাস ছিলাম তো, অসংখ্য দুঃস্বপ্নের মধ্যে নির্দিষ্ট একটাকে স্মরণ করা মুশকিল। মাইলের পর মাইল একঘেয়ে পাহাড়-প্রাচীর আর দেয়ালের বন-জঙ্গল স্মৃতিগুলোকে ঝাপসা করে দিয়েছে। প্রচণ্ড গরম আর পোকা-মাকড়ের অত্যাচারে আমাদের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। বিরতিহীন বৈঠা চালাবার কথা মনে আছে, আর কানে এখনো লেগে আছে পানির অন্তহীন গর্জন। তবে অ্যাবে আর ডানডেরার মিলিত হওয়ার জায়গাটা দুটো কারণে মনে আছে আমার।

ইয়েস? ব্যগ্র ভঙ্গিতে সামনের দিকে ঝুঁকলো রোয়েন, কিন্তু নিকোলাস মাথা নাড়লো।

ওখানে আমরা একজনকে হারাই। দ্বিতীয় অভিযানের একমাত্র বলি। রশি ছিঁড়ে যায়, একশো ফুট নিচে পড়ে যায় বেচারা। পাথরের একটা স্তূপের উপর পিঠে দিয়ে পড়ে।

দুঃখিত। আর কী কারণ?

ওখানে কপটিক খ্রিস্টান সন্ন্যাসীদের একটা মঠ আছে, পাথরের অবয়বে তৈরি, নদীর সারফেস থেকে চারশো ফুট উপরে।

গিরিখাদের ওই গভীরে? অবিশ্বাসে ভুরু কোঁচকাল রোয়েন। ওখানে তারা মঠ বানাতে গেল কেন?

ইথিওপিয়া সবচেয়ে পুরানো খ্রিস্টান দেশগুলোর মধ্যে একটা। দেশটায় নয় হাজারেরও বেশি চার্চ আর মঠ আছে। দুর্গম পাহাড়ে, পৌঁছনো যায় না এমন মাঠের সংখ্যা অনেক। ডানডেরা নদীর উপর এ মঠটা সেন্ট ফুমেনটিয়াস-এর সমাধি ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত। তৃতীয় শতাব্দী তিনি ইথিওপিয়ায় খ্রিশ্চানিটির পত্তন করেছিলেন, বাইজেন্টাইন সম্রাট কনস্টেনটিনোপোলের কাছ থেকে। কথিত আছে, লোহিত সাগরের তীরে এসে তার জাহাজ ধ্বংস হয়ে গেলে আকসুম পৌঁছেন তিনি, ওখানেই ইজানা সাম্রাজ্য পাল্টে দেন।

আপনি ওই মঠে গেছেন?

অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত ছিলাম, যাই কি করে! মঠ বলতে নদী থেকে আমরা শুধু দেখতে পেয়েছি পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে পাথর কাটা গহ্বর, আলখেল্লা পরা সন্ন্যাসীরা সারি সারি গুহার মুখে বসে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আমাদের আত্মহত্যা করার প্রচেষ্টা লক্ষ করছিলেন। আমাদের কেউ কেউ শুভেচ্ছা জানিয়ে হাতও নাড়েন, কিন্তু পাল্টা সাড়া না পেয়ে অভিমান করেন।

কিন্তু নদীর যে ভয়ঙ্কর ছবি দিচ্ছেন, ওই স্পটে আমরা পৌঁছব কীভাবে?

এরই মধ্যে হতাশ? হাসলো নিকোলাস। দাঁড়ান, আগে ওখানকার মশককুলের সঙ্গে পরিচিত হোন। ওরা আপনাকে তুলে নেবে, উড়িয়ে নিয়ে যাবে নিজেদের আস্তানায়, তারপর সমস্ত রক্ত শুষে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলবে।

ধ্যেত, সিরিয়াস হোন। সত্যি, ওখানে যাবে কীভাবে?

সন্ন্যাসীদের খাবার যোগান দেয় গ্রামবাসীরা, ওরা বাস করে গিরিখাদের উপর হাইল্যান্ডে। পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে বুনো ছাগলের তৈরি ট্রাক আছে। ওদের কাছ থেকে জেনেছি, গিরিখাদের কিনারা থেকে ওই ট্র্যাক ধরে ওখানে নামতে তিন দিন লাগে।

পথ চিনে আপনি নামতে পারবেন?

না, তবে এ বিষয়ে মাথায় কয়েকটা আইডিয়া আছে, পরে আলোচনা করা যাবে। তার আগে প্রথম প্রশ্ন, চার হাজার বছর পর ওখানে পৌঁছে ঠিক কী পাবার আশা করব আমরা। নিকোলাসের চোখে প্রত্যাশা। এবার আপনার পালা। কনভিন্স মি। রূপোয় মাথা মোড়া পয়েন্টারটা রোয়েনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লো ও, ভাঁজ করা হাত বাঁধল বুকে।

প্রথমে আপনাকে বইটার কাছে ফিরে আসতে হবে, পয়েন্টার রেখে দিয়ে রিভার গড তুলে নিল রোয়েন। গল্পের ট্যানাস চরিত্রটির কথা আপনার মনে আছে?

রানী লসট্রিসের অধীনে মিশরীয় আর্মির কমান্ডার ছিলেন, টাইটেল ছিল মিশরের সাহসী সিংহ। হিকসস তাড়া করায় লসট্রিস বাহিনীকে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে মিশর থেকে সরিয়ে নিয়ে যান।

ট্যানাস সেই সঙ্গে রানীর গোপন প্রেমিকও ছিলেন। এবং, আপনি যদি টাইটার বক্তব্য বিশ্বাস করেন, রানীর বড় ছেলে প্রিন্স মেমননের পিতাও বটে।

আরকুন নামে এক ইথিওপিয়ান রাজাকে শায়েস্তা করতে গিয়ে দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় মারা যান ট্যানাস, মমি করা তার লাশ রানীর কাছে ফিরিয়ে আনে টাইটা, গল্পের আরো খানিক অংশ স্মরণ করলো নিকোলাস।

এ থেকে আরেকটা সূত্রে চলে আসা যায়, ডুরেঈদ আর আমি বহু কষ্টে উদ্ধার করেছি।

সপ্তম স্ক্রোল থেকে? বুক থেকে হাত নামিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকলো নিকোলাস।

না কোনো স্ক্রোল থেকে নয়, রানী লসট্রিসের সমাধিতে পাওয়া দেয়াল লিপি থেকে। ব্যাগ থেকে একটা ফটোগ্রাফ বের করলো রোয়েন।

এটা সমাধিকক্ষে পাওয়া দেয়ালচিত্রের আংশিক ছবি, এনলার্জ করা। দেয়ালের ওই অংশ পরে ভেঙে পড়ে, হারিয়ে যায় চিরকালের জন্য। জারগুলো তখনই পাই আমরা। ডুরেঈদ ও আমার বিশ্বাস, টাইটা এ লিপি সম্মানজনক জায়গায় রেখেছিল এবং এটার বিশেষ তাৎপর্য আছে। সম্মানজনক জায়গা বলছি এ জন্য যে, স্ক্রোল যেখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল তার ঠিক উপরেই ছিল এ লিপি।

ছবিটা নিয়ে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে পরীক্ষা করলো নিকোলাস।

হায়ারোগ্লিফিক নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে নিকোলাস, রোয়েন বলে যাচ্ছে, বইটা থেকে আপনি জেনেছেন, হেঁয়ালি করতে ভালোবাসত টাইটা, শব্দ নিয়ে কৌতুক করতে বা খেলতে পছন্দ করত। বহু জায়গায় নিজের বুদ্ধির তারিফ করেছে সে। বলেছে, সেই শ্রেষ্ঠ বাও খেলোয়াড়।

চোখ থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস সরিয়ে নিকোলাস বলল, হ্যাঁ। বাও সম্ভবত দাবারই প্রাচীন সংস্করণ। মিশর ও আফ্রিকার দক্ষিণ থেকে পাওয়া কিছু বোর্ডও আমার মিউজিয়ামে আছে।

বাও খেলা হয় রঙিন পাথর দিয়ে, প্রতিটি পাথরের আলাদা পদমর্যাদা। সে যাই হোক, আমরা জানি ধাঁধা তৈরি করার নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে উত্তর-পুরুষকে জানাবার একটা ঝোঁক ছিল টাইটার মধ্যে। নিজেকে বুদ্ধিমান বলে দাবি করার ভঙ্গিটায় কিন্তু গর্বের ভাব নেই, বরং যেনো সতর্ক করে দেওয়ার চেষ্টা। তার প্রমাণ, ফারাও-এর সমাধিতে ইচ্ছে করেই অনেক সূত্র রেখে গেছে সে। শুধু স্ক্রোলে নয়, মিউরালেও। টাইটা আমাদের বলছে, সে তার প্রিয় রানীর সমাধিতে দেয়ালচিত্রগুলো নিজের হাতে এঁকেছে বা রঙ চড়িয়েছে।

এটা ওই সূত্রগুলোর একটা বলে আপনার ধারণা? ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ফটোটার উপর টোকা দিল নিকোলাস।

পড়ন না, বলল রোয়েন। আমি তো বলি ক্ল্যাসিকাল হায়ারোগ্লিফিকস–তার দুর্বোধ্য কোডের তুলনায় কঠিন নয়।

থেমে থেমে অনুবাদ করছে নিকোলাস, রাজপুত্রের জনক, যিনি কিনা জনক নন–নীল দাতা, যে নীল তাকে খুন করেছে–হাপির সঙ্গে হাতে হাত ধরে অনন্ত কাল পাহারা দিচ্ছেন পাথুরে শেষ ইচ্ছাপত্র, যে ইচ্ছাপত্রে আভাস দেওয়া হয়েছে রাজপুত্রের জনককে কোথায় রাখা হয়েছে, যিনি কিনা জনক নন, রক্ত এবং ছাই দাতা। মাথা নাড়লো নিকোলাস, না, কোনো অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বোধহয় অনুবাদে ভুল করছি।

হতাশ হবেন না। এ তো সবে টাইটার সংস্পর্শে এলেন। এটা নিয়ে আমরা কয়েক সপ্তা মাথা ঘামিয়েছি। ধাঁধাটা ধরতে হলে রিভার গডে ফিরে যেতে হবে। মানে ট্যানাস প্রিন্স মেমননের জনক নন, তবে রানীর প্রেমিক হিসেবে তার বায়োলজিক্যাল ফাদার। মৃত্যুশয্যায় তিনি মেমননকে নীল তলোয়ার উপহার দিয়েছিলেন, এ নীল তলোয়ারের আঘাতেই তিনি গুরুতর জখম হন, আরকাউনকে শায়েস্তা করতে গিয়ে, আরকাউনের দ্বারাই। বইটায় যুদ্ধের বিশদ বর্ণনা আছে।

হ্যাঁ, বইটা পড়ার সময় আমি ভেবেছিলাম নীল তলোয়ারটা নিশ্চয়ই ওই ব্রোঞ্জ যুগে একটা বিস্ময়কর বস্তু ছিল। কাজেই রাজপুত্রকে দেওয়ার মতো একটা উপহার হতেই পারে। তাহলে, রাজপুত্রের জনক, যিনি কিনা জনক নন, আসলে ট্যানাস? বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করলো নিকোলাস। আপাতত আপনার করা অর্থ আমি মেনে নিলাম।

ধন্যবাদ। ফারাও মামোস নামেমাত্র মেমননের জনক ছিলেন, রক্তসম্পর্কিত বাবা নন। এখানেও আবার বলা হচ্ছে, রাজপুত্রের জনক, যিনি কিনা জনক নন। মামোস, প্রিন্সকে ঈজিপ্টের, দ্বৈত মুকুট দান করে যান, উচ্চ এবং নিম্ন রাজ্যে রক্ত ও ছাই।

এটুকু হজম করতে তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। বাকিটুকু?

এবার আসুন, হাতে হাতে ধরে। প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় এর অর্থ হতে পারে কাছাকাছি, অথবা দৃষ্টিসীমার ভেতর। হাপি হলেন নীল নদের উভলিঙ্গ দেবতা বা দেবী, তিনি কখন কি জেন্ডার গ্রহণ করবেন তার উপর নির্ভর করে। স্ক্রোলের সব জায়গায় নদীটার বিকল্প নাম হিসেবে হাপিকে ব্যবহার করেছে টাইটা।

তাহলে সপ্তম স্ক্রোল আর রাণীর সমাধিতে পাওয়া দেয়াললিপি এক করলে পুরো বক্তব্যটা কী দাঁড়াচ্ছে? জানতে চাইলো নিকোলাস।

সংক্ষেপে এই–দ্বিতীয় জলপ্রপাতের কাছাকাছি কোথাও অথবা দৃষ্টিসীমার ভেতর কোথাও ট্যানাসকে করব দেওয়া হয়েছে। তাঁর সমাধির বাইরে বা ভেতরে কোথাও একটা মনুমেন্ট অথবা লিপি আছে, যাতে মামোসের সমাধিতে যাওয়ার পথনির্দেশ পাওয়া যাবে।

দাঁতের ফাঁক দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো নিকোলাস। লাফ দিয়ে শূন্য থেকে অর্থ লুফে নিচ্ছি, ফলে আমি ক্লান্ত। আমার জন্য আর কী সূত্র রেখেছেন আপনি?

আর কোনো সূত্র নেই।

কী বলছেন! আর কোনো সূত্র নেই মানে? নিকোলাস হতভম্ব।

সত্যি নেই।

আসুন ধরা যাক, নদীটা চার হাজার বছর পরও আকৃতি ও নকশায় একই রকম আছে। আরো ধরা যাক, টাইটা আসলেও ডানডেরা নদীর দ্বিতীয় জলপ্রপাতের দিকটা নির্দেশ করছেন। ওখানে পৌঁছে তাহলে আমরা ঠিক কী খুঁজবে? যদি শিলালিপি থাকে, তা কি অটুট অবস্থায় পাব? নাকি স্রোত আর রোদ বৃষ্টির অত্যাচারে ক্ষয়ে গেছে সব?

রোয়েন বলল, হাওয়ার্ড কার্টারের কাছেও এরকম অস্পষ্ট ও দুর্বল একটা সূত্র ছিল। মাত্র এক টুকরো প্যাপাইরাস, তা-ও সেটার অথেনটিসিটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় নি। অথচ ওই সূত্রই আমাদেরকে তুতেনখামেনের সমাধিতে পৌঁছে দিয়েছে।

হাওয়ার্ড কার্টারকে শুধু ভ্যালি অভ দ্য কিংস সার্চ করতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও দশ বছর লেগে যায় তাঁর। আর আপনি আমাকে ইথিওপিয়া দিচ্ছেন, আকারে ফ্রান্সের দ্বিগুণ। কতদিন লাগবে আমাদের, ধারণা করতে পারেন?

ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়লো রোয়েন। ক্ষমা করুন আমাকে। এখানে আর থাকার কোনো অর্থ হয় না, শুধু শুধু সময় নষ্ট করছি। বরঞ্চ, হাসপাতালে মায়ের কাছে যাই।

এখন তো ভিজিটিং আওয়ার নয়।

নিজের একটা রুম আছে ওনার, রোয়েন বলে।

চলুন, আমি পৌঁছে দিয়ে আসি, ভদ্রতা করে নিকোলাস বলল।

কোনো প্রয়োজন নেই। ট্যাক্সি নিয়ে নিতে পারবো আমি। শীতল স্বরে বলে উঠলো রোয়েন।

এক ঘণ্টা লাগবে ট্যাক্সিতে করে যেতে। কাজেই, অনিচ্ছাসত্ত্বেও, সবুজ রেঞ্জ রোভারে উঠলো রোয়েন।

পনেরো মিনিট কাটলো নিঃশব্দে। কেউ কোনো কথা বলছে না। এক মনে গাড়ি চালাচ্ছে নিকোলাস। শেষমেষ সে মুখ খুলে। মাপ চাইতে খুব একটা অভ্যস্ত

নই আমি। সত্যি দুঃখিত–যদি রুঢ় ব্যবহার করে থাকি। একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম।

রোয়েনের নীরবতা না ভাঙতে, নিকোলাস ফের বলে, দেখুন, যদি কথাবার্তা বলেন, তবে তো চিঠি লিখে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। অ্যাবে গিরিপথে সেটা বেশ ঝামেলার ব্যাপার হবে।

আমার তো মনে হলো–ওদিকে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা আপনার নেই। সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে বলল রোয়েন।

আমি হলাম গে এক নাছোড়বান্দা, নিকোলাস হাসছে, রোয়েন না হেসে পারে না।

সত্যি, এ ব্যাপারে আমাকেও একমত হতে হচ্ছে। আপনি একজন বর্বর নাছোড়বান্দা।

কাজেই, এখনো আমরা পার্টনার আছি–তাই না? নিকোলাস বলে।

এই মুহূর্তে এক আপনি ছাড়া আর কোনো বর্বর নেই কাছেপিঠে। কাজেই আপনিই আমার পার্টনার!

হাসপাতালের প্রবেশপথে রোয়েনকে নামিয়ে দেয় নিকোলাস। তিনটার দিকে ওকে তুলে নেবে, এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইয়র্কের শহরতলীর পথে রওনা হয় সে।

ইয়র্ক মিনিস্টারের কাছে সেই ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময় থেকেই একটা ফ্ল্যাট আছে তার। কেইম্যান আইল্যান্ড কোম্পানির নামে বরাদ্দ ওই অফিসে একটা আনলিস্টেড এবং নিরাপদ ফোন আছে। কেউই এ নম্বর ট্রেস করতে সক্ষম হবে না। রোসেলিনের সঙ্গে পরিচয়ের আগে এখানে অনেকটা সময় ব্যয় করতো সে। এখন অবশ্য কেবল গোপনীয় কাজের জন্য জায়গাটা ব্যবহার করে থাকে নিকোলাস। লিবিয়া এবং ইরাক অভিযানের সময়ও এখান থেকেই গোটা পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

বহুবছর ব্যবহার করা হয় নি। ভ্যাপসা একটা গন্ধ বাড়িতে। কেতলিতে পানি চড়িয়ে দুটো ফোন লাগালো নিকোলাস। একটা জার্সিতে অবস্থিত ব্যাঙ্কে, অপরটি কেইম্যান আইল্যান্ডে।

ওদের পরিবারে একটা কথা প্রচলিত ছিল–বুদ্ধিমান হঁদুরের অনেকগুলো পথ খোলা থাকে। এ ধরনের হঠাৎ প্রয়োজনের জন্য একটা টাকা সরিয়ে রেখেছিল নিকোলাস। এ মুহূর্তে অভিযান চালাতে হলে টাকা চাই।

একাউন্ট নং, পাসওয়ার্ড দিয়ে ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে টাকা পাঠানোর অনুরোধ করলো সে। সত্যি, টাকা থাকলে সব কাজ কতোই না সহজ হয়ে যায়!

ঘড়ি দেখলো নিকোলাস। ফ্লোরিডাতে এখনো ভোররাত। কিন্তু দ্বিতীয়বার রিং হতেই ধরলো অ্যালিসন। সোনালি চুলো এক সেক্স বোম্ এ মেয়ে–পৃথিবীর দুর্গমতম জায়গায় সাফারি আয়োজন করে থাকে।

নিকোলাস, তুমি তো দেখছি আমাদের কথা একদম ভুলেই গেছ!

না, ঠিক ভুলি নি। একটু ব্যস্ত ছিলাম। কেমন করে মানুষকে বলবে সে, ওর স্ত্রী আর দুই মেয়ে মারা গেছে?

ইথিওপিয়ায়? জিজ্ঞেস করলো অ্যালিসন, গলার আওয়াজ একটু ম্লান শোনালো। কবে যেতে চাও?

এই ধরো আগামি সপ্তায়।

ঠাট্টা করছ নাকি? ওখানে আমরা মাত্র একজন হান্টার গাইডকে দিয়ে কাজ করাই, দু বছরের জন্য বুক হয়ে আছে সে।

আর কেউ নেই? বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই ঢুকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাকে।

শিকার কী হবে, পর্বত নায়ালা? মেনেলিকের বুশবাক?

মিউজিয়ামের জন্য এটা হবে আমাদের কালেকটিং ট্রিপ, অ্যাবে নদীপথে, এর বেশি আর কিছু বলতে প্রস্তুত নয় নিকোলাস।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অ্যালিসন। আগেই বলে রাখছি, এতে আমাদের সায় নেই। এতো অল্প সময়ে নোটিশে মাত্র একজন গাইডকে তুমি পেতে পারো, তবে আমি জানি না নীল নদে তার কোনো ক্যাম্প আছে কিনা। লোকটা রাশিয়ান, তার বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগও শোনা গেছে। কেউ কেউ বলে সাবেক কেজিবি-র লোক, মেনজিসটুর পাণ্ডাদের একজন।

মেনজিসটুকে কালো স্টালিন বলা হয়, উৎখাত করার পর বুড়ো সম্রাট হাইলে সেলাসিকে হত্যা করেন। ষোলো বছর মার্কসিস্ট শাসনে ইথিওপিয়াকে নতজানু অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর স্পনসর ছিল সোভিয়েত রাশিয়া, ওখানে কমিউনিজমের পতন ঘটার পর মেনজিসটুকে উৎখাত করা হয়, দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি। আমার খুব ঠেকা, যে কোনো একজন গাইড হলেই চলে। কথা দিচ্ছি, পরে অভিযোগ করব না।

ঠিক আছে, তবে মনে থাকে যেন। নিকোলাসকে আদ্দিসআবাবার একটা ফোন নম্বর দিল অ্যালিসন।

আবার ডায়াল ঘোরাল নিকোলাস। আদ্দিসের লাইন পাওয়া এতো সহজ হবে ভাবে নি নিকোলাস, একবার ডায়াল করতেই অপরপ্রান্ত থেকে ইথিওপিয়ান বাচনভঙ্গিতে মিষ্টি একটা নারীকণ্ঠ সাড়া দিল। নিকোলাস বোরিস ব্রুসিলভকে চাইতেই মেয়েটা ভাষা বদলে ইংরেজিতে কথা বলল।

বর্তমানে তিনি সাফারিতে আছেন, বলল সে। আমি তাঁর স্ত্রী, ওইজিরো টিসে। নিকোলাস জানে, ইথিওপিয়ার মেয়েরা স্বামীর নাম উচ্চারণ করে না। ওইজিরো টিসে শব্দের অর্থ নারী সূর্য, চমৎকার নাম।

আপনি যদি সাফারি সম্পর্কে কিছু জানতে চান, আমি জবাব দিতে পারব। নারী সূর্য বলে ওঠে।

*

হাসপাতালের বাইরে থেকে রোয়েনকে রেঞ্জ রোভারে তুলে নিল। নিকোলাস। কেমন আছেন জর্জিনা? জানতে চাইলো ও।

পায়ের অবস্থা ভালো, কিন্তু ম্যাজিকের জন্য এখনো খুব কাতর।

ওরকম একটা ছানা কালই কিনে দিন। তারপর নিকোলাস জিজ্ঞেস করলো, আমরা যদি আফ্রিকায় যাই, মায়ের কাছ থেকে আপনি বিদায় নিতে পারবেন?

হেসে ফেললো রোয়েন। বলতে পারেন বিদায় আমি নিয়ে রেখেছি। চার্চ গ্রুপ থেকে একজন মহিলা থাকবেন ওর সঙ্গে, মাম্মির কোনো অসুবিধে হবে না। সীটে একটু ঘুরে বসে নিকোলাসের দিকে সরাসরি তাকালো রোয়েন। সারাদিন কোথায় ছিলেন? আপনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটেছে।

আরবীয় কায়দায় শয়তানের বিপরীতে চিহ্ন আঁকলো নিক। আল্লাহ আমাকে শয়তান ডাইনির হাত থেকে রক্ষা করুন!

আরে, ধ্যাত! কী করেছেন, বলুন তো?

আগে মিউজিয়ামে ফিরি, তারপর।

যাদুঘরে ফিরে মিশরীয় সংগ্রহের হলঘর পেরিয়ে আফ্রিকার স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংগ্রহশালায় এসে ঢুকলো নিকোলাস। একটা অ্যান্টিলোপ হরিণের ডায়োরামার সামনে এসে থামালো রোয়েনকে। ছোট্ট এবং মাঝারি গড়নের প্রাণী এগুলো ইম্পালা, থম্পসন এবং গ্রান্টের গ্যাজেল, জেরেনুক প্রভৃতি।

কোণার দিকের ছোট্ট একটা প্রাণীর উদ্দেশ্যে ইঙ্গিত করে নিকোলাস। ম্যাডোকাওয়া হারপারি, এটাকে বলা হয় হারপারস ডিক-ডিক, ডোরাকাটা ডিক ডিক হিসেবেও পরিচিত।

প্রাণীটির তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, আকারে বড় একটা খরগোশের মতো। কাঁধ আর পিঠের ব্রাউন চামড়ার উপর চকলেট রঙের ডোরা, নাকটা এতো লম্বা যে শুড় বলে মনে হয়। নিকোলাসের চেহারায় গর্বের ভাব দেখে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকলো রোয়েন, শুধু বলল, এটার কি বিশেষ কোনো তাৎপর্য আছে?

তাৎপর্য নেই মানে? এ প্রজাতির এটাই সম্ভবত শেষ নমুনা। এতোই দুর্লভ, জুলজিস্টরা সন্দেহ করে এটা একটা কাল্পনিক প্রাণী, কোনো কালেই অস্তিত্ব ছিল না। ছবি দেখে তারা কি বলেছিল জানেন? সাধারণ একটা ডিক-ডিকের কাঠামোয় বেজির চামড়া পরানো হয়েছে। এর চেয়ে জঘন্য অভিযোগ কখনো শুনেছেন?

আমি হতভম্ব, এরকম অন্যায় কেউ করতে পারে! হেসে উঠলো রোয়েন।

ঠাট্টা নয়, বলল নিকোলাস। পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষা করতে আবারো একটা ডিক-ডিক শিকারে আফ্রিকা যাচ্ছি আমরা।

ঠিক বুঝলাম না।

আসুন, আমার সঙ্গে, সব বুঝিয়ে দিচ্ছি। নিজের স্টাডিতে রোয়েনকে নিয়ে চলে নিক। লাল চামড়ায় বাঁধানো একটা নোটবুক তুলে নেয়। অত্যন্ত পুরোনো নোট বুকটা–স্থানে স্থানে ক্ষয়ে গেছে মলাট।

বুড়ো দাদা জোনাথন-এর শিকার বিষয়ক বর্ণনা। লেখার ফাঁকে ফাঁকে হলুদ কালিতে আঁকা ছবিও রয়েছে। পাতার মাঝে পুরোনো ফুল, গাছের পাতা ইত্যাদি। শিরোনাম পড়লো নিকোলাস:

২ ফেব্রুয়ারি, ১৯০২। অ্যাবে নদীর ক্যাম্প থেকে। আজ সারাদিন বিশাল দুটো হাতিকে ধাওয়া করি, কিন্তু নাগালের মধ্যে পেলাম না। সাংঘাতিক গরম। হাল ছেড়ে দিয়ে ক্যাম্পে ফিরে এলাম। ফেরার পথে দেখি ছোট একটা হরিণ নদীর তীরে ঘাস খাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে রাইফেল তুলে ফেলে দিলাম ওটাকে। তারপর কাছ থেকে পরীক্ষা করে দেখি, এটা আসলে জীনাস মাডুকা-র সদস্য। এ প্রজাতিটা আগে কখনো দেখি নি আমি। সাধারণ ডিক-ডিকের চেয়ে আকারে এটা বড়, গায়ে ডোরা আছে। এটা সম্ভবত নতুন একটা আবিষ্কার।

কাগজটা থেকে মুখ তুললাম নিকোলাস। অ্যাবে গিরিখাদে যেতে হলে আমাদের একটা অজুহাত দরকার ডিক-ডিক সেটা এনে দিচ্ছে।

হ্যাঁ, আমিও এ বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলাম। ইথিওপিয়া সরকার অনুমতি দেবে তো?

আমাদের উদ্দেশ্য জানতে পারলে অবশ্য দেবে না, বলল নিকোলাস। সেজন্যই তো ডিক-ডিককে ব্যবহার করব আমরা। অনুমতি নিয়ে বহু সাফারি কোম্পানি ইথিওপিয়ায় অপারেশন। চালাচ্ছে। প্রয়োজনীয় পারমিট, সরকারের নো অবজেকশন সার্টিফিকেট, যানবাহন, ক্যাম্পিং ইকুইপমেন্ট, আইনগত পরামর্শ ইত্যাদি সবই তাদের আছে। এ অভিযানের প্ল্যান আয়োজন যদি আমরা করি, কয়েক মাস সময় লেগে যাবে। সাফারি কোম্পানির সীল-ছাপ্পড় ছাড়া গেলে লোকাল জঙ্গী গ্রুপগুলোও হুমকি হয়ে দেখা দেবে।

তাহলে ডিক-ডিক শিকারী হিসেবে যাব আমরা, যাব একটা সাফারি কোম্পানির অধীনে?

একজন সাফারি অপারেটরের সঙ্গে আদ্দিসআবাবায় এরই মধ্যে যোগাযোগ করেছি আমি, অন্তত প্রথম পর্যায়ে আমরা তার সাহায্য নেব, বলল নিকোলাস। প্রয়োজনীয় সূত্র হাতে এলে দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হবে, তখন আমরা নিজেদের লোকজন আর ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করব। তৃতীয় পর্যায়টা হবে ইথিওপিয়া থেকে লুটের মাল বের করে আনা। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কাজটা সহজ হবে না।

সত্যিই তো, বের করব…

জিজ্ঞেস করবেন না, কারণ এ মুহূর্তে জবাব দিতে পারব না।

কবে রওনা হচ্ছি আমরা?

তার আগে আরেকটা প্রসঙ্গ। টাইটার ধাঁধার যে অর্থ আপনারা বের করেছেন, ভিলা থেকে চুরি যাওয়া আপনার নোটে সেটা লেখা ছিল?

হ্যাঁ, ছিল। সব কিছুই হয় নোটে নয়তো মাইক্রোফিল্মে ছিল। দুঃখিত।

তার মানে আমরা যা জানি প্রতিপক্ষও তাই জানে।

হ্যাঁ।

তাহলে আমার সিদ্ধান্ত ঠিক আছে, বলল নিকোলাস। অ্যাবে গিরিখাদে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছতে চাই আমি প্রতিপক্ষ পৌঁছবার আগেই। ওরা আপনার ধারণা ও উপসংহার চুরি করেছে প্রায় এক মাস হয়ে এলো। কে জানে, হয়তো এরই মধ্যে . রওনা হয়ে গেছে।

কবে? আবার জিজ্ঞেস করলো রোয়েন।

নাইরোবি হয়ে আদ্দিসআবাবায় যাচ্ছি, শনিবারে। প্লেনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। ওখান থেকে এয়ার কেনিয়া ফ্লাইট ধরে আদ্দিসে যাবো আমরা, সোমবার দিনের মধ্য ভাগে নামবো সেখানে। আজ সন্ধ্যাতেই লন্ডনে গিয়ে রাতটা আমার ফ্ল্যাটে পার করে, কাল রওনা হবো। ইয়েলো ফিভার আর হেপাটাইটিস ইনজেকশন নেওয়া আছে?

আছে, কিন্তু নিজের মাল-সামান কিছুই তো কায়রো থেকে নিয়ে আসতে পারি নি।

ওটা লন্ডনে গিয়ে দেখা যাবে। কী কী দরকার, কিনে নিব। ইথিওপিয়ায়। ভয়াবহ গরম।

নিজের হাতের লিস্টিতে এক এক করে দাগ দিচ্ছে নিকোলাস।

এখন থেকেই ম্যালেরিয়ার প্রতিরোধমূলক টেবলেট খেতে শুরু করব আমরা। এমন এক এলাকায় যাচ্ছি, যেখানে ক্লোরোকুইন রেজিস্টেন্ট ফ্যালসিপেরাম মশা আছে, কাজেই

তালিকায় দ্রুত চোখ বুলাচ্ছে নিকোলাস।

কায়রো থেকে সবেমাত্র এসেছেন, কাজেই আপনার পাসপোর্ট ঠিক আছে। ইথিওপিয়ার ভিসা লাগবে আমাদের, তবে জানাশোনা লোক আছে, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পেয়ে যাব।

হাতের কাজ শেষ হতেই রোয়েনকে তার জিনিসপত্র প্যাক করার জন্য রুমে পাঠিয়ে দিল নিক।

যতক্ষণে কুয়েনটন পার্ক থেকে বের হচ্ছে ওরা, আঁধার ঘনিয়েছে ততক্ষণে। ইয়র্ক হাসপাতালে কিছু সময় থেমে মা-কে বিদায় বলল রোয়েন। দেখা-সাক্ষাত শেষ করে আবারো সবুজ রেঞ্জ রোভারে চড়লো সে।

নিকোলাসের শরীরের পুরুষালি সৌরভ, আর তার উপস্থিতির নিরাপত্তার ভেতর গাড়ির মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো রোয়েন।

*

নিকোলাসের লন্ডনের বাড়িটা নাইটসব্রিজে। কুয়েনটন পার্কের মতো অভিজাত নয়, কিন্তু এখানে বরঞ্চ স্বস্তি অনুভব করলো রোয়েন। এ যেনো তার বাড়ির মতো হোক না, মাত্র দু দিনের জন্য থাকা। এ সময়টাতে খুব কমই নিকোলাসের দেখা পেল সে। শেষ মুহূর্তের টুকিটাকি ব্যস্ততায় দম ফেলার ফুরসত নেই তার। হোয়াইট হলে, সরকারি ভবনে যেতে হলো কয়েকবার। পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত এবং দূতাবাসের উদ্দেশ্যে লেখা সরকারি কাগজ নিয়ে ফিরে এলো নিকোলাস।

ইংরেজরা আসলেই সুবিধা আদায় করে নিতে সবচেয়ে পটু মনে মনে রোয়েন ভাবে। নিকোলাসের ব্যস্ততার সময়টাতে তালিকা মিলিয়ে কিছু কেনাকাটা সেরে নিল ও। পথে প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কায় কাটালো, কখন কোন্ দিক থেকে কে আবার আক্রমণ করে বসে। কেউ অনুসরণ করছে কি না–তাও নিশ্চিত হয়ে নিল রোয়েন। নিজেকেই অবশ্য চোখ রাঙালো এমন ছেলেমানুষি ভয় করছে বলে।

প্রতি সন্ধ্যাতেই, নিকোলাসের আগমনের সময়টার জন্য উৎকণ্ঠা ভরে অপেক্ষায় থাকলো রোয়েন–যদিও নিজের কাছে স্বীকার গেল না, ভদ্রলোক কাছে থাকলে আলাদা একটা নিরাপত্তাবোধ ঘিরে রাখে তাকে।

*

শনিবার সকালে হিথরোর চার নম্বর টার্মিনালে পৌঁছে লাগেজগুলো পরীক্ষা করলো নিকোলাস। রোয়েনের কাঁধে একটা স্লিং ব্যাগ, আর নিয়েছে নরম একটা ক্যানভাস ব্যাগ। নিকোলাসের হান্টিং রাইফেলটা লেদারে মোড়া, আলাদা একটা প্যাকেটে রয়েছে একশো রাউন্ড অ্যামুনিশন। ওর সঙ্গে আর শুধু একটা লেদার ব্রীফকেস রযেছে। মাথায় পানামা হ্যাঁ, চেক-ইন কাউন্টারে থেমে বসে থাকা মেয়েটার উদ্দেশে মুচকি হাসলো।

প্লেন ছাড়ার পর দাবার খুঁটি সাজালো নিকোলাস, বোর্ডটা খোলা হয়েছে দুই সীটের মাঝখানের আর্ম-রেস্টে। কেনিয়ার জোমো কেনিয়াত্তা এয়ারপোর্টে যখন প্লেন নামছে, তৃতীয় গেমটা তখনো শেষ হয় নি। দু জনেই একটা করে জিতেছে, শেষটা অমীমাংসিত থেকে গেল। যদিও রোয়েন এগিয়ে ছিল শেষ খেলাটায়।

নাইরোবির নরফোক হোটেলে একজোড়া গার্ডেন বাংলো বুক করেছে নিকোলাস। রোয়েন বিছানায় উঠেছে দশ মিনিটও হয় নি, পাশের বাংলো থেকে নিকোলাসের ফোন পেল। আজ রাতে ব্রিটিশ হাই কমিশনে ডিনার খাচ্ছি আমরা। পুরানো বন্ধু। নরমাল ড্রেস পরলেই চলবে। আটটার দিকে বেরুতে পারবেন তো?

এ লোকের সঙ্গে সফরে বেরিয়ে আলস্যে ভেসে যাওয়ার কোনো উপায় নেই মনে মনে ভাবলো রোয়েন।

*

নাইরোবি থেকে আদ্দিসআবাবা অতটা দূরে নয়, তবে নিচের প্রকৃতি একের পর এমন সব বিচিত্র শোভা মেলে ধরছে যে এয়ার কেনিয়া ফ্লাইটের জানালার সঙ্গে আঠার মতো সেঁটে থাকলো রোয়েন। মাউন্ট কেনিয়ার চূড়াটাকে অনেক বছর পর মেঘমুক্ত দেখলো নিকোলাস, তুষার মোড়া জোড়া শৃঙ্গ রোদ লেগে চকচক করছে। তারপর শুরু হলো মরুভূমি, মরুভূমি শেষ হতে ইথিওপিয়ান মালভূমি দেখা গেল। আফ্রিকায় ইথিওপিয়ার চেয়ে পুরানো সভ্যতা শুধু মিশর, রোয়েনকে বলল নিকোলাস। আমরা, পশ্চিমারা যখন নেংটি পরে ঘুরতাম, তখনো এরা ছিল অত্যন্ত সভ্য; এদের দেব-দেবীর বিপরীতে আমরা করতাম প্যান এবং ডায়ানার পুজো।

হ্যাঁ। চার হাজার বছর আগে টাইটা যখন এ পথ দিয়ে গেছে এ এলাকার লোকজন তখনো সভ্য ছিল। এদের খুব প্রশংসা করেছে স্লোলে, বলেছে, তার কালচারের মতোই এদের কালচার উন্নত। এটা একটা ব্যতিক্রমই বলব, কারণ অন্য প্রায় সব জাতিকে নিকৃষ্ট বলে উল্লেখ করেছে সে।

আকাশ থেকে আদ্দিস যে কোনো আফ্রিকার শহরের মতোই। নতুন এবং পুরোনোর মিশ্রণ; ঐতিহ্যবাহী এবং রূপময় স্থাপত্যরীতি–দুই-ই আছে এখানে। আছে ইটের বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে পাতায় ছাওয়া বাড়ি-ঘর।

জমিনের উল্লেখযোগ্য ব্যাপার বলতে লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছের সারি। জ্বালানি কাঠ যোগায় এ গাছ। দরিদ্রস্য দরিদ্য এ জনপদে এ কাঠই একমাত্র জ্বালানি। চিরকাল যুদ্ধবিধ্বস্ত ইথিওপিয়া। আগে হানাদার বর্বরেরা অত্যাচার করতো, এখন করে অপরিচিত রাজনৈতিক মতাদর্শ।

এতো উচ্চতার কারণে ইথিওপিয়ার বাতাস অত্যন্ত শীতল, মিঠে রাগলো রোয়েন এবং নিকোলাসের কাছে।

প্লেন থেকে নেমে টার্মিনাল বিল্ডিঙে চলে এলো ওরা।

স্যার… নিকোলাস! দু জনেই ওরা লম্বা এক তরুণীর দিকে ঘুরে দাঁড়ালো, ওদের দিকে এস্ত পায়ে এগিয়ে আসছে, হাঁটার ভঙ্গিতে নৃত্যশিল্পীর মনকাড়া সমস্ত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। একেই বোধহয় কলঙ্কবিহীন ত্বক বলে, গাঢ় মধুর মতো রঙ, লাবণ্যে ভরপুর। মেয়ে হাসতেও জানে, যেনো কতদিনের পরিচয়। ঐতিহ্যবাহী

পূর্ণদৈর্ঘ্য স্কার্ট পরে আছে, হাঁটার সময় ফুলে উঠছে।

আমার দেশ ইথিওপিয়ায় স্বাগতম, স্যার নিকোলাস। আমি ওইজিরো টিসে। কৌতূহল আর আগ্রহ নিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালো সে। আপনি নিশ্চয়ই ওইজিরো রোয়েন। রোয়েনের দিকে ডান হাত বাড়ালো সে। নিকোলাস লক্ষ করলো, প্রথম দর্শনেই মেয়ে দু জন পরস্পরকে পছন্দ করছে।

ওদের পাসপোর্ট নিয়ে চলে যাচ্ছিল টিসে, ফিরে এসে একটা খবর দিল। আপনারা ভিআইপি লাউঞ্জে বিশ্রাম নিন। ব্রিটিশ এমব্যাসির এক ভদ্রলোক ওখানে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করেছেন। জানি না কীভাবে খবর পেল ওঁরা।

ভিআইপি লাউঞ্জে মাত্র একজন লোককে দেখা গেল, ট্রপিকাল স্যুট পরা ব্রিটিশ, ডোরাকাটা স্যান্ডহার্সট টাই পরনে। নিকোলাসকে দেখেই সোফা ছেড়ে এগিয়ে এলো সে। নিকি! কেমন আছো, বন্ধু? ভাবিনি এতো থাকতে এখানে তোমার সঙ্গে দেখা হবে। প্রায় বারো বছর পর, তাই না?

হ্যালো, জিওফ্রে। জানতাম না এখানে চাকরি করছ তুমি।

মিলিটারি অ্যাটাশে। হিজ এক্সেলেন্সি নাইরোবি থেকে খবর পান তুমি আসছ। আমাকে জানালেন, কারণ উনি জানেন তুমি আমার পুরানো বন্ধু, স্যান্ডহার্সট কলেজের। আগ্রহ চেপে রাখতে পারছে না, বারবার রোয়েনের দিকে তাকাচ্ছে। খানিকটা হতাশ ভঙ্গি করে তার সঙ্গে রোয়েনের পরিচয় করিয়ে দিল নিকোলাস।

জিওফ্রে টেনেন্টে। আপনাকে একটু সাবধানে থাকার পরামর্শ দিব। বিষুব রেখার উত্তরে সবচেয়ে নামকরা প্লেবয়। ওর আধ মাইলের মধ্যে কোনো মেয়েই নিরাপদ নয়।

হয়েছে, এতোটা বাড়িয়ে বলতে হয় না! নিকোলাস তার যে পরিচয় দিল, তাতে জিওফ্রেকে গর্বিত ও তৃপ্ত মনে হলো। প্লিজ, এ লোক যা বলছে তার একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না, ডক্টর আল সিমা। কুখ্যাত একজন নিন্দুক।

নিকোলাসকে টেনে একপাশে সরিয়ে আনল জিওফ্রে। রাজধানীর বাইরে দেশের অবস্থা সম্পর্কে ভীতিকর একটা ধারণা দিল সে।

হিজ এক্সিলেন্সি একটু উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে গোজাম-এর ওদিকে শয়তানদের বসবাস। উনি চান না আর রোয়েনকে নিয়ে ওদিকে যাও তুমি। আমি অবশ্য বলেছি, নিজেকে তুমি রক্ষা করতে জানো।

খুব অল্প সময়ের ভেতর কাজ সেরে ফিরে এলো ওইজিরো টিসে। আপনাদের লাগেজ, ফায়ার আর্মস আর অ্যামুনিশনের কাস্টমস ক্লিয়ার্যান্স পাওয়া গেছে। এটা আপনাদের সাময়িক পারমিট, ইথিওপিয়ায় যতোক্ষণ থাকবেন সঙ্গে রাখতে হবে। পাসপোর্টগুলোও রাখুন, ভিসায় সীল মারা হয়েছে। এক ঘণ্টা পর লেক টানা ফ্লাইট, কাজেই হাতে কিছুটা সময় আছে।

যদি কখনো চাকরি পেতে অসুবিধে হয়, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, মেয়েটার দক্ষতার প্রশংসা করলো নিকোলাস।

ওদের সঙ্গে ডিপারচার গেট পর্যন্ত হেঁটে এলো জিওফ্রে। বিপদ হলে আমরা আছি। জন্মেছি নেতৃত্বদানের জন্য!

জন্মেছি নেতৃত্বদানের জন্য–কথাটার মানে কী? অপেক্ষমাণ বিমানের পথে যেতে যেতে রোয়েন শুধায় নিকোলাসকে।

স্যান্ডহার্সট কলেজের আপ্তবাক্য। নিকোলাস ব্যাখ্যা করে বলে।

দারুণ, সত্যি, নিকি!

আমার কাছে নিকোলাস নামটাই বেশি অভিজাত আর সুন্দর শোনায়!

তা ঠিক। তবে নিকি, বেশ সুইট লাগছে শুনতে!

*

টুইন অটার বিমান ওদেরকে সুউচ্চ গগনে তুলে আনলেও নিচের জমিন এতো কাছে যে গ্রাম আর খেতগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এর কারণ পাহাড়ি এলাকার উপর রয়েছে প্লেন। তারপর নিচে একটা মালভূমি দেখা গেল, হঠাৎ সেটার সামনে মুখ ব্যাদান করে থাকতে দেখা গেল বিশাল এক গিরিখাদকে, আকারে এতোই বড় যে কল্পনাকেও যেনো হার মানায়। অ্যাবে নদী! সিট থেকে। সামনের দিকে ঝুঁকতে হলো রোয়েনকে নিকোলাসের কাঁধে টোকা দেওয়ার জন্য।

খাদটার কিনারা বা ধার খাড়া ও স্পষ্টভাবে কাটা, আর তারপরই ত্রিশ ডিগ্রি কোণ সৃষ্টি করে নেমে গেছে ঢাল। মালভূমির ফাঁকা ও নিঃস্ব সমতল জমিন জায়গা ছেড়ে দিয়েছে ঘন বন-জঙ্গলে আচ্ছাদিত খাদের পাঁচিলগুলোকে। এখানে সেখানে জঙ্গল ভেদ করে মাথাচাড়া দিয়ে আছে বাতিদানে সাজানো লম্বা মোমের মতো পাথরের বিশাল সব স্তম্ভ, একেকটা পাঁচ সাত তলা বাড়ির মতো বড়। কোথাও কোথাও ধসে পড়েছে পাঁচিল, সেখানে শুধু কোটি কোটি টন আলগা পাথর ছড়িয়ে আছে। পাঁচিলের গায়ে ব্লাফ তৈরি হয়েছে, সেগুলোর বিস্তার ক্রমশ উপর দিকে, মাথার দিকে কোনটার চেহারা সূচের মতো, কোনোটা আবার প্রকৃতির তৈরি ভাস্কর্য শিল্প, ঠিক যেনো মানুষের আকৃতি।

ঢল নেমেছে তো নেমেছেই, যেনো কোনো শেষ নেই, তারপর দুই ঢাল যেখানে দৃষ্টিভ্রমের কারণে মিলিত হয়েছে বলে মনে হলো, এক মাইল বা আর বেশি গভীরে, সেখানে চিকচিক করতে দেখা গেল সাপের মতো আঁকাবাঁকা নদীটাকে। কুপি বা চিমনি আকৃতির উপরের পাঁচিল দ্বিতীয় একটা কিনারা তৈরি করেছে নীল • নদের পানি থেকে পাঁচশো ফুট উপরে, এ অংশটাকে উপখাদ বলা যেতে পারে। উপখাদের পাঁচিলগুলো একদমই খাড়া, মাঝখানে লাল স্যান্ডস্টোনের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে নদী। কোনও কোথাও খাদটা চল্লিশ মাইল চওড়া, আবার কোথাও মাত্র দশ। তবে পুরো দৈর্ঘ্য জুড়েই ভীতিকর গাম্ভীর্য আর অশেষ নির্জনতা বাসা বেঁধে আছে। মানুষের কোনো চিহ্ন চোখে পড়ে না।

ওখানেই আপনারা নামতে যাচ্ছেন, ভয় ও শ্রদ্ধা মেশানো কণ্ঠস্বর, ফিসফিস করলো ওইজিরো টিসে। নিকোলাস রোয়েন কথা বলছে না। এ ধরনের আদিম, রোমহর্ষক ও রহস্যময় প্রকৃতির মুখোমুখি হলে সব ভাষাই হারিয়ে যায়।

প্রায় স্বস্তির সঙ্গে দেখলো, ওদের নাগাল পাওয়ার জন্য উঠে আসছে উত্তরের পাঁচিল, দীর্ঘ নীল আফ্রিকান আকাশের গায়ে মাথা তুলে দাঁড়ালো চোক রেঞ্জের সারি উঁচু পাহাড়, ওদের খুদে ও ভঙ্গুর বিমানের চেয়ে অনেক ওপরে।

বাঁক ঘুরে সেই পবর্তশ্রেণীর ভেতর ডাইভ দিল বিমান। স্টারবোর্ড উইংটিপের দিকে হাত তুললাম টিসে।

লেক টানা, বলল সে। চওড়া পাত্রে ঢালা পারদের মতো টলটল করছে লেকের পানি। টানা লেক লম্বায় পঞ্চাশ মাইল, এখানে সেখানে মাথা তুলেছে কয়েকটা দ্বীপ, প্রতিটিতে একটা করে মঠ বা প্রাচীন চার্চ আছে। ল্যান্ড করার জন্য লেকের উপর দিয়ে শেষবার ওড়ার সময় প্যাপারাসের তৈরি খুদে বোটে সাদা আলখেল্লা পরা পাদ্রীদের দেখতে পেল ওরা, এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যাচ্ছে।

লেকের পাশে মেঠো স্ট্রিপে ল্যান্ড করলো অটার, পেছনে ধুলোর মেঘ উঠলো। তাল পাতার গায়ে রঙিন নকশা করা কয়েকটা ঘর, এটাই এখানকার টার্মিনাল বিল্ডিং। রোদ এতো উজ্জ্বল যে খাকি জ্যাকেটের পকেট থেকে সানগ্লাস বের করে পরতে হলো নিকোলাসকে। প্লেন থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে ও। সাদা ও নোংরা টার্মিনাল ভবনের গায়ে বুলেটের গর্ত দেখা গেল, রানওয়ের কিনারায় ঘাসের উপর পড়ে রয়েছে একটা রাশিয়ান টি-তারটিফাইভ ব্যাটল ট্যাংকের পোড়া খোল। নিকোলাসকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে অন্যান্য আরোহীরা বেরিয়ে এলো, বিল্ডিঙের পাশে ইউক্যালিপটাস গাছের ছায়ায় তাদের অস্থির আত্মীয় স্বজনরা দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে একটাই মাত্র গাড়ি, বালি রঙের টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার। ড্রাইভারের দরজায় বড় বড় হরফে লেখা ওয়াইল্ড চেস্ সাফারি।

মেয়ে দু জনকে নিয়ে নিচে নামলো নিকোলাস। গাড়ি থেকে নেমে অপেক্ষা করছে ড্রাইভার। তার পরনে রঙচটা বুশ সুট। লম্বা সে, রোগা না হলেও গায়ে চর্বি নেই, হাঁটার সময় সামান্য ঝাঁকি খায় শরীর।

নিকোলাস আন্দাজ করলো চল্লিশের কাছাকাছি বয়েস হবে। কটা রঙের চুল ছোট করে ছাঁটা, চোখ নিপ্রভ ও নীলচে। মুখে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন আছে, নাক ছুঁয়ে দেওয়ায় সেটা বিকৃত দেখাচ্ছে।

টিসে প্রথমে তার সঙ্গে রোয়েনের পরিচয় করিয়ে দিল।

রোয়েন করমর্দন না করায় ভুরু কুঁচকে বাউ করলো লোকটা। এরপর টিসে নিকোলাসের পরিচয় দিল। ইনি আমার স্বামী, অল্টো বোরিস। বোরিস, ইনি অল্টো নিকোলাস।

আমার ইংলিশ ভালো নয়, বলল বোরিস।ফ্রেঞ্চ খানিকটা ভালো।

কোনো অসুবিধে নেই, ফ্রেঞ্চ ভাষায় জবাব দিল নিকোলাস। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। হাত বাড়ালো ও।

হ্যান্ডশেকের অজুহাতে নিকোলাসের হাতটা মুচড়ে দিতে চেষ্টা করলো বোরিস। সতর্ক ছিল নিকোলাস, এ ধরনের আধ-বুড়ো শয়তানদের চেনা আছে, মুঠোয় এতোটা জোর ছিল যে সুবিধে করতে পারলো না বোরিস। নিকোলাসের ঠোঁটে অলস হাসি। প্রথমে ঢিল দিতে হলো বোরিসকে, ক্ষীণ হলেও শ্রদ্ধার ভাব ফুটল নীলচে চোখে।

আপনি তাহলে ডিক-ডিকের খোঁজে এসেছেন? প্রশ্ন তো নয়, প্রায় খেঁকিয়ে উঠলো লোকটা। অথচ লোকের আমার কাছে আসে বড় হাতি শিকার করার জন্য।

হয় পর্বত নায়ালা।

বড় হাতিকে ভয় পাই, হাসলো নিকোলাস।

ডিক-ডিক আমার জন্য মানিয়ে যায়।

খাদে আগে কখনো নেমেছেন?

স্যার নিকোলাস ১৯৭৬ সালে নদী এক্সপিডিশনের জন্য ওখানে নেমেছিলেন। জবাব দিল রোয়েন, দু জনের মাঝখানে নীরব উত্তেজনা অনুভব করতে পারছে ও।

স্ত্রীর দিকে ফিরল বোরিস। আমার অর্ডার মতো সমস্ত রসদ আনা হয়েছে?

হ্যাঁ, কেমন যেনো ভয়ে ভয়ে জবাব দিল টিসে। প্লেনে আছে সব।

টয়োটার সামনের সিটে বসলো পুরুষরা, অসংখ্য প্যাকেট আর রসদ নিয়ে মেয়েরা বসলো পেছনে। ঘুরে ফিরে সব কিছু তাহলে দেখার ইচ্ছে নেই আপনাদের? নিকোলাসকে জিজ্ঞেস করলো বোরিস, গলার আওয়াজ হুমকির মতো শোনালো।

মানে?

লেকের আউটলেট, পাওয়ার স্টেশন, খাদের উপর পর্তুগাল ব্রিজ, নীল নদের উৎসমুখ দেখার জিনিস অনেকই আছে। দেখতে চাইলে সন্ধ্যের আগে ক্যাম্পে ফেরা সম্ভব নয়।

ধন্যবাদ, বলল নিকোলাস। তবে এ সব আগেই দেখা আছে আমার।

সারি সারি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে রাস্তাটা। এলাকাটার নাম গোজাম, রাস্তার ধারে প্রচুর লোকজন দেখা গেল। সবাই খুব লম্বা, ছাগল বা ভেড়া চরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পুরুষ ও নারী সবাই প্যান্ট পরা, তবে মেয়েদের ব্লাউজের উপর উলেন শাল আছে। ইথিওপিয়ার সব এলাকার মতো গোজামের লোকজনও দেখতে খুব সুন্দর। মেয়েরা কালো হলে কী হবে, রূপ যৌবন যেনো উথলে পড়ছে। পুরুষরা বেশিরভাগই সশস্ত্র। একে ফরটিসেভেন অ্যাসল্ট রাইফেল তো আছেই, আরো আছে দু ধারি তলোয়ার।

গ্রামের কুঁড়েগুলো গোল দেয়ালের তুকুল-ইউক্যালিপটাস অথবা সাইসল। গাছের নিচে।

চোক রেঞ্জের চূড়ায় লালচে-বেগুনি মেঘের তুমুল আলোড়ন শুরু হলো। চাদির তৈরি সিকির মতো বৃষ্টির ফোঁটাগুলো, কিছুক্ষণ ঝরেই থেমে গেল। তাতেই কাদায় থকথকে হয়ে উঠলো রাস্তা।

খানিক পর শুরু হলো পাথুরে খানা-খন্দ। এমনকি ফোর-হুইল ড্রাইভ টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজারের পক্ষেও এ সব বাধা পেরিয়ে এগোনো সম্ভব নয়। ঘুরপথ ধরতে হলো, মাঝে মধ্যে গাড়ি এগুচ্ছে হাঁটা গতিতে, তা সত্ত্বেও অনবরত ঝকি খাচ্ছে। আরোহীরা।

কালাদের জানোয়ার বললেই হয়, বোরিসের গলায় ঘৃণা। রাস্তা মেরামত করার কথা চিন্তাও করে না। কেউ কিছু বলছে না, তবে রিয়ার ভিউ মিররে চোখ রেখে মেয়ে দুটোকে দেখলো নিকোলাস। দুজনেই নির্লিপ্ত।

সামনে আরো খারাপ রাস্তা পড়লো। ভারী যানবাহন চলাচল করায় চাকার ঘর্ষণে দীর্ঘ নালা তৈরি হয়েছে।

মিলিটারি ট্রাফিক? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

কিছু কিছু, জবাব দিল বোরিস। এদিকে শুফতাদের তৎপরতা খুব বেশি। শুফতা হলো ডাকাত সরদার আর দলত্যাগী সমর নায়ক। প্রসপেক্টিং কোম্পানির ট্রাকও আসা-যাওয়া করে। বড় একটা মাইনিং কোম্পানি গোজামে কনসেশন পেয়েছে, ড্রিলিং করার জন্য পৌঁছে গেছে তারা।

আমরা কিন্তু এখনো কোনো সিভিলিয়ান ভেহিকল দেখি নি, বলল রোয়েন। এমন কী পাবলিক বাসও না।

ব্যাখ্যা দিল টিসে, এক সময় ইথিওপিয়াকে আফ্রিকার রুটির ঝুড়ি বলা হত, কিন্তু মেনজিসটু ক্ষমতায় এসে ইকোনমির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। খাদ্য এখানে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মোটর কিনবে এমন সঙ্গতি হাতে গোনা মাত্র কয়েকজনের আছে। ছেলেমেয়েদের কী খাওয়াবে, এ চিন্তাতেই পাগল হয়ে আছে সবাই।

আদ্দিস ইউনিভার্সিটি থেকে ইকোনমিক্সে ডিগ্রি নিয়েছে টিসে, কর্কশ হাসির সঙ্গে বলল বোরিস। সব কিছু জানে সে, একটু বেশিই জানে! স্ত্রীর প্রতি এটা তার ধমকও বলা যায়, বিদ্রূপও বলা যায়। টিসে আর কোনো কথা বলল না।

বিকেলের দিকে ম্লান সূর্য উঠলো। ফাঁকা একটা এলাকার মাঝখানে গাড়ি থামাল বোরিস। আঙুল মটকাবার বিরতি। পানি ছাড়ার সময়।

মেয়ে দু জন ট্রাক থেকে নেমে বোল্ডারের আড়ালে চলে গেল। ফিরে এলো কাপড় পাল্টে। ঢোলা প্যান্টের উপর ব্লাউজ পরেছে, ব্লাউজের উপর উলের চাদর। এগুলো টিসে আমাকে ধার দিয়েছেন, নিকোলাসকে বলল রোয়েন।

কাজের জন্য এগুলোই ভালো, মন্তব্য করলো নিকোলাস।

ট্রাক যখন আরেকটা পাথুরে উপত্যকায় নেমে যাচ্ছে, দিগন্তে নেমে আসছে সূর্যও। পাশেই একটা নদী, পাড় হয়ে গেছে। নদীর উপর একটা চার্চ, নল খাগড়া আর পাতায় ছাওয়া ছাদের উপর কাঠের কপটিক ক্রস বসানো হয়েছে, দেয়ালগুলো সাদা। গ্রামটা দাঁড়িয়ে আছে চার্চকে ঘিরে।

ডেবরা মারিয়াম, বলল বোরিস। ভার্জিন মেরীর পাহাড়। আর নদীর নাম ডানডেরা। বড় একটা ট্রাকে আমার লোকজনকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি। ক্যাম্প রেডি করে অপেক্ষা করছে তারা। আজ রাতে এখানেই আমরা ঘুমাব, কাল ভাটি ধরে এগোব, যতক্ষণ না খাদের কিনারায় পৌঁছাই।

গ্রামের ঠিক সামনে ক্যাম্প ফেলা হয়েছে। দ্বিতীয় তাবুটা আপনাদের, নিকোলাসকে জানালো বোরিস।

ওটা রোয়েনের জন্য, বলল নিকোলাস। আমার নিজের একটা আলাদা তাঁবু দরকার।

ডিক-ডিক শিকার করতে এসে আলাদা তাঁবু? বোরিসের চোখে নগ্ন বিস্ময়। আপনি আমাকে তাজ্জব করলেন, স্যার! চেঁচামেচি করে লোকজনকে ডাকলো সে, আরেকটা তাঁবু টাঙাবার নির্দেশ দিল। দ্বিতীয়টার পাশেই টাঙানো হলো সেটা। রাতে আপনার সাহস বাড়তে পারে। চাই না বেশি দূর হাঁটতে হোক আপনাকে।

বু গাম গাছের নিচু ডালে একটা ড্রাম ঝোলানো হয়েছে, ড্রামের নিচে শুকনো পাতার তৈরি অসংখ্য ফুটোয়লা দেয়াল, উপরে ছাদ নেই–এটাই ওদের বাথরুম বা শাওয়ার। প্রথমে ব্যবহার করলো রোয়েন, বেরিয়ে এলো তাজা চেহারা নিয়ে, মাথায় ভিজে তোয়ালে জড়ানো, মুখে হাসি। আপনার পালা, নিকোলাস! নিকোলাসের তাঁবুকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় সময় হাঁক ছাড়লো। পানি খুব গরম!

নিকোলাসের শাওয়ার সেরে কাপড় বদলাতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। সোজা হেঁটে এসে ডাইনিং তাঁবুতে ঢুকলো, আগেই এখানে জড়ো হয়েছে সবাই। আগুনের চারপাশে ফেলা হয়েছে ক্যাম্পচেয়ারে, একটাতে বসলো নিকোলাস। মেয়ে দুটো বসেছে উল্টো দিকে, কথা বলছে নিচু গলায়। হাতে গ্লাস নিয়ে নিচু টেবিলে পা তুলে দিয়েছে বোরিস। নিকোলাস বসতেই ইঙ্গিতে ভদকার বোতলটা দেখালো। বাস্কেটে বরফ আছে।

কথা না বলে মাথা নাড়লো নিকোলাস। গলাটা অবশ্য শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে, মনে মনে ভাবল বিয়ার পেলে মন্দ হতো না।

গোপন একটা কথা বলি, নিকোলাসকে বলল বোরিস। আজকাল ডোরা কাটা ডিক-ডিক বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। আদৌ কোনো কালে ছিল কিনা তা-ও আমার সন্দেহ আছে। আপনি টাকা আর সময় অপচয় করতে এসেছেন।

অসুবিধে কী, বলল নিকোলাস। ওগুলো তো আমারই।

কোন্ এক বুড়ো ভাম কবে কী মেরেছিল–এসবের কোনো বিশ্বাস আছে? দশ দিন আগে তিনটে হাতির ছাপ দেখেছি, মদ্দা হাতি, বলল বোরিস। একেকটা দাঁত একশো পাউন্ডের কম নয়।

কথা কাটাকাটি চলছে, বোরিসের ভদকার বোতল নীল নদ থেকে বন্যা নেমে যাবার মতো দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে। টিসে যখন বলল ডিনার রেডি, বোতলটা সঙ্গে নিয়ে চেয়ার ছাড়লো সে। টেবিলের দিকে এগুবার সময় টলতে দেখা গেল তাকে। খেতে বসে টিসেকে কথায় কথায় ধমক দেওয়া ছাড়া আর কোনো অবদান রাখলো না।

ভেড়ার মাংস সিদ্ধ হয় নি কেন? কুকের উপর চোখ রাখো নি কেন? ওরা তো কুত্তার বাচ্চা, তুমি জানো।

আপনার মাংস কি সিদ্ধ হয় নি, স্যার নিকোলাস? স্বামীর দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো টিসে। বললে কুককে দিয়ে সিদ্ধ করে আনাই।

একদম নিখুঁত রান্না হয়েছে, আশ্বস্ত করলো নিকোলাস। তুলোর মতো নরম মাংস আমি পছন্দ করি না।

ডিনারের শেষ দিকে দেখা গেল বোরিসের বোতল খালি হয়ে গেছে। টকটকে লাল হয়ে উঠেছে তার চেহারা, মনে হলো ফুলেছেও। টেবিল থেকে উঠে কারো সঙ্গে কথা বলল না, নিজের তাঁবুর দিকে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি আমি। এ শুধু সন্ধ্যের দিকে ঘটে। দিনের বেলা একদম শান্ত ভদ্রলোক। ভদকা ওদের রাশিয়ান ঐতিহ্য। উজ্জ্বল হাসি দিল টিসে, শুধু চোখ দুটোয় বিষাদের ছায়া লেগে থাকলো। নিস্তব্ধতা ভারী হয়ে উঠতে চার্চ পর্যন্ত হেঁটে আসার প্রস্তাব দিল সে। ওরা রাজি হতে একজন চাকরকে ডেকে লণ্ঠন আনালো।

হাতে লণ্ঠন নিয়ে আগে আগে চললো চাকর ছেলেটা। গোলাকার ভবনের সামনে প্রাচীন এক পুরোহিত অভ্যর্থনা জানালেন দলটাকে। অসাধারণ একটা ক্রুশ হাতে ওদের হাসিমুখে স্বাগত জানালেন তিনি।

হাঁটুগেড়ে বসে আশীর্বাদ চাইলো রোয়েন আর টিসে। হাতের ক্রুশ ওদের কপালে চুঁইয়ে অ্যামহারিক ভাষায় কিছু বলল পাদ্রী। এরপর হাতছানি দিয়ে ভেতরে ডেকে নিল ওদের।

মৌলিক রঙে আঁকা অসাধারণ দেয়ালচিত্রে ভরপুর প্রার্থনালয়। লণ্ঠনের আলোয় মণিমুক্তোর মতো জ্বললো। বাইজেন্টাইন প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট চিত্রগুলোতে দেবতার চোখ বিশাল, মাথায় সোনালি মুকুট। বেদীর উপরে ভার্জিন মেরী শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, নিচে বসে ফেরেশতারা এবং তিন ম্যাজাই। পোলারয়েড ক্যামেরা বের করে ছবি তুললাম নিকোলাস।

ছবি তোলা শেষ হতে, এক জায়গায় বসে প্রার্থনারত টিসে এবং রোয়েনের দিকে দেখলো সে।

এমন বিশ্বাস আমার যদি থাকতো! অনেকবারের মতো নিকোলাস ভাবে। কঠিন সময়ে এর থেকে সহায়তা পাওয়া যায়। রোসেলিন আর মেয়েদের জন্য এমন প্রার্থনা যদি করতে পারতাম কখনো। চার্চে থাকা বেশ কঠিন হয়ে উঠলো তার জন্য। বেরিয়ে এসে রাতের তারাভরা আকাশ দেখতে থাকে নিকোলাস।

ধীরে, এ খারাপ ভাবটা চলে যায় ওর। সত্যি, আফ্রিকার তুলনা হয় না।

মেয়ে দু জনের প্রার্থনা শেষ হতে পুরোহিতকে ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু টাকা এবং পোলারয়েডে তোলা তার একটা ছবি দিল নিকোলাস। দারুণ খুশি বুড়ো ভদ্রলোক।

ফেরার পথে নিঃশব্দে পাহাড়ের ঢাল ধরে নেমে চললো ওরা।

*

নিকি! নিকোলাস! উঠুন, প্লিজ! ধাক্কা দিয়ে নিকোলাসের ঘুম ভাঙালো রোয়েন। উঠে বসে টর্চ জ্বাললো ও, দেখলো ঢোলা প্যান্ট আর ব্লাউজের উপর উলের ওড়না পরেছে রোয়েন।

কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস, তবে রোয়েন জবাব দেওয়ার আগেই বোরিসের কর্কশ গর্জন আর খিস্তি শুনতে পেল, রাতের নিস্তব্ধতাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে তার তাঁবু থেকে ভেসে আসছে। আরো একটা রোমহর্ষক শব্দ পেল নিকোলাস, শক্ত মুঠো দিয়ে মাংস ও হাড়ে আঘাত করলেই শুধু এ ধরনের আওয়াজ হতে পারে।

মেয়েটাকে মারছে, রাগে কেঁপে গেল রোয়েনের গলা। যেভাবে পারেন থামান আপনি।

প্রতিটি আঘাতের পর ব্যথায় চিৎকার করছে টিসে, তারপর ফোঁপাচ্ছে। ইতস্ত ত করছে নিকোলাস। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় শুধু একজন বোকা নাক গলায়, এবং সাধারণত পুরস্কার হিসেবে তার কপালে জোটে অকস্মাৎ ঐকমত্যে পৌঁছনো স্বামী স্ত্রীর কঠোর নিন্দা।

কিছু একটা করুন, নিকোলাস! প্লিজ!!

অনিচ্ছাসত্ত্বেও কট থেকে নামলো নিকোলাস। শুধু শর্টস পরে রয়েছে ও। জুতো খোঁজার ঝামেলায় গেল না, বেরিয়ে এলো তাঁবু থেকে। রোয়েন ওর পিছু পিছু আসছে, ওর পা-ও খালি।

ওদের তাঁবুর ভেতর লণ্ঠন জ্বলছে এখনো, ক্যানভাসের দেয়ালে বড় আকৃতির ছাড়া নড়াচড়া করছে। নিকোলাস দেখলো বোরিস তার স্ত্রীর চুল ধরে হিড়হিড় করে মেঝের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, গর্জন করছে রুশ ভাষায়।

বোরিস! মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তিনবার চিৎকার করতে হলো নিকোলাসকে। টিসেকে ছেড়ে দিয়ে তাঁবুর ফ্ল্যাপ তুললাম বোরিস। শুধু আন্ডারপ্যান্ট পরে আছে সে। শরীরে কিলবিল করছে পেশী, তবে বুকটা চ্যাপ্টা ও লোহার মতো শক্ত মনে হলো, কোঁকড়ানো সোনালি চুলে ঢাকা। তার পেছনে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে টিসে, উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফোঁপাচ্ছে। সম্পূর্ণ উলঙ্গ মেয়েটা, তার শরীরের সমতল অংশগুলো সাপের চামড়ার মতো মসৃণ।

রাত দুপুরে এ-সব কী? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস, অনেক কষ্টে রাগ চেপে রাখছে। শান্ত সরল একটা মেয়ের এ অপমান সহ্য করার মতো নয়।

কালো বেশ্যাটাকে ভদ্রতা শেখাচ্ছি, খেঁকিয়ে উঠলো বোরিস। আপনার কোনো ব্যাপার নয়, মিস্টার। তবে আপনিও যদি ঝাল মাংসের খানিকটা ভাগ চান, সেটা আলাদা কথা। হেসে উঠলো সে, আওয়াজটা শুনে গা ঘিন ঘিন করে উঠলো নিকোলাসের।

আপনি সুস্থ, ওইজিরো টিসে? আমাদের সাহায্য দরকার থাকলে বলুন। কথাগুলো বলার সময় বোরিসের দিকে তাকিয়ে আছে নিকোলাস, নগ্ন শরীরটার দিকে তাকিয়ে টিসেকে আরো অপমান করতে ইচ্ছুক নয়।

কোনো রকমে উঠে বসলো টিসে, ভাঁজ করা হাঁটু তুললাম বুকের সামনে, নগ্নতা ঢাকার জন্য সে দুটোকে হাত দিয়ে আলিঙ্গন করলো। আমি ভালো আছি, স্যার নিকোলাস। ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার চেয়ে আপনারা চলে যান, প্লিজ। তার নাক থেকে গড়ানো রক্ত ঠোঁট ভিজিয়ে দিচ্ছে, লাল হয়ে উঠছে সাদা দাঁতগুলো।

আমার স্ত্রী তোমাকে নিজের চরকায় তেল দিতে বলছে, ইউ ইংলিশ বাস্টার্ড! ভাগো, যাও! তা না হলে এমন শিক্ষা দিব…। টলতে টলতে এগিয়ে এলো। বোরিস, ঘুসি তুললাম নিকোলাসের বুক লক্ষ্য করে।

সাবলীল অনায়াস ভঙ্গিতে সরে গেল নিকোলাস, বোরিসকে ঠেলে দিল যেদিকে তার এগোবার ঝোঁক। ভারসাম্য হারিয়ে তাঁবুর সামনে খোলা জায়গায় আছাড় খেলো সে, পড়ার সময় একটা ক্যাম্প চেয়ারকেও সঙ্গে নিল।

প্লিজ, এসব করবেন না! এখনো ফোপাচ্ছে টিসে।

ও রেগে গেলে মানুষ থাকে না। আপনার সঙ্গে যদি পেরে না ওঠে, দেখবেন কারো না কারো ক্ষতি করবে।

রোয়েন, টিসেকে আপনার তাঁবুতে নিয়ে যান, নরম সুরে নির্দেশ দিল নিকোলাস। ছুটে তাঁবুতে ঢুকলো রোয়েন, কট থেকে চাদর তুলে এনে জড়িয়ে দিল টিসের গায়ে, তারপর তাকে দাঁড় করালো।

টিসেকে নিয়ে নিজের তাঁবুর দিকে এগুচ্ছে রোয়েন, এ সময় উঠে দাঁড়ালো বোরিস। হুঙ্কার ছাড়লো সে, উল্টে পড়া ক্যাম্প চেয়ার হাতে নিল। মাটিতে আছাড় মেরে চেয়ারের একটা পা ভাঙল সে, সেটা নিয়ে এগিয়ে এলো নিকোলাসের দিকে।

খেলতে চাও, তাই না, ব্যাটা ইংরেজ? এসো তাহলে, হয়ে যাক! ধেয়ে এলো নিকোলাসের দিকে, নিনজা ব্যাটনের মতো হাতের কাঠ ঘোরাল। বাতাসে শিস কেটে নিকোলাসের মাথার দিকে ছুটে এলো পায়াটা।

ঝট করে মাথা নিচু করলো নিকোলাস, লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার পায়াটা এরপর ওর বুক বরাবর নামিয়ে আনল বোরিস। লাগলে পাঁজরের হাড় গুঁড়িয়ে যেত, তবে শেষ মুহূর্তে মোচড় খেয়ে সরে গেল নিকোলাস।

একটা বৃত্ত ধরে ঘুরছে ওরা, তারপর আবার হামলা করলো বোরিস। ভদকা খাওয়ায় তার রিফ্লেক্স ভোতা হয়ে গেছে, তা না হলে এরকম শক্ত ও অভিজ্ঞ প্রতিপক্ষের সঙ্গে লাগতে যাবার আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা করত নিকোলাস। বোরিসের পায়াটা আরেকবার বাতাসে শিস কেটে ছুটে এলো ওর মাথার দিকে, এবারও ঝট করে নিচু হয়ে আঘাতটা এড়ালো সে। তারপর সোজা হলো, কষে একটা ঘুষি মারল বোরিসের তলপেটে। হুসস করে বাতাস বেরিয়ে এলো, ফুসফুস খালি হয়ে গেল বোরিসের। হাত থেকে ছিটকে পড়লো, কুঁজো হলো শরীরটা, তারপর পড়ে গেল মাটিতে। হেঁটে এসে তার সামনে দাঁড়ালো নিকোলাস। তোমাকে প্রথম ও শেষবার সাবধান করে দিচ্ছি, বোরিস ব্রুসিলভ। মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া চলবে না।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রোয়েনের উদ্দেশ্যে নিক বলল, মেয়েটাকে আপনার তাঁবুতে নিয়ে রাখুন। আঙুল দিয়ে কপালের উপরে এসে পড়া ভেজা চুলগুলো সরায়। আর, কোনো সমস্যা না থাকলে একটু ঘুমোই, কেমন?

*

ভোর রাতের দিকে বৃষ্টি শুরু হলো বেশ। ক্যানভাসের তাঁবুতে যেনো বাদ্য বাজালো ঝরঝর জলরাশি। হঠাৎ হঠাৎ নীলচে বৈদ্যুতিক শিখায় কেমন অপার্থিব রকম আলোকিত হয়ে উঠলো চারদিক। অবশ্য, সকালের নাস্তার সময় হতে দেখা গেল, মেঘ কেটে গেছে, উজ্জ্বল রোদে ঝকমক করছে চরাচর। মৃদুমন্দ বাতাসে মাটির সোঁদা গন্ধ।

নাস্তার টেবিলে পরম বন্ধুর মতো নিকোলাসকে অভ্যর্থনা জানালো বোরিস। গুড মর্নিং, স্যার নিকোলাস! কাল রাতে খুব মজা করলাম আমরা, কী বলেন? মনে পড়লে এখনো আমার হাসি পাচ্ছে। সাম গুড জোকস! আর এক দিন ভদকা খেয়ে ওই খেলাটা আমরা আবার খেলবো, কেমন? এ যে, নারী সূর্য, তোমার নতুন বয়ফ্রেন্ডকে নাস্তা খেতে দাও! কাল রাতে ওরকম খেলাধুলোর পর ওঁর খুব খিদে পেয়েছে।

টিসে নির্লিপ্ত ও বিষণ্ণ, চাকরদের নাস্তা পরিবেশন তদারক করছে। একটা চোখ ফুলে প্রায় বন্ধ হয়ে আছে, নিচের ঠোঁট কাটা। নিকোলাসের দিকে সে একবারও তাকাচ্ছে না।

আমরা আগে রওনা হব, কফি খাবার সময় ব্যাখ্যা করলো বোরিস। ক্যাম্প তুলে বড় ট্রাকে চড়ে পিছু নেবে চাকররা। ভাগ্য ভালো হলে আজ রাতে খাদের কিনারায় ক্যাম্প ফেলতে পারব। নামতে শুরু করব কাল।

ট্রাকে ওঠার সময় বোরিসের কান বাঁচিয়ে দু একটা কথা বলল টিসে। ধন্যবাদ, অল্টো নিকোলাস। তবে কাজটা আপনি ভালো করেন নি। আপনি ওকে চেনেন না। আপনাকে এখন থেকে সাবধান থাকতে হবে। ও ভোলে না, ক্ষমাও করে না।

ডেবরা মারিয়াম গ্রাম থেকে একটা শাখা পথ ধরে এগুলো ওরা, ডানডেরা নদীর পাশ দিয়ে এগিয়ে ছ। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তার অবস্থা খুবই করুণ, ট্রাক ঠেলার জন্য বারবাৰ কাদায় নামতে হলো নিকোলাসকে। বড় ট্রাকটা এক সময় ধরে ফেললো ওদেরকে। বোরিস সারাক্ষণ গজগজ করছে। আমার কথা শুনলে এ ভোগান্তির মধ্যে প্যতে হতো না। রাস্তা নেই, শিকারো নেই, তবু যাব!

বিকেলে লাঞ্চ খাবার জন্য নদীর ধারে থামলো ওরা। হাত-পা থেকে কাদা ধোয়ার জন্য পানিতে নামলো নিকোলাস, পিছু নিয়ে রোয়েনও নেমে এলো। নদীর পানি হলুদ হয়ে আছে, বৃষ্টি হওয়ায় ভরাট হয়ে গেছে। ডোরা কাটা ডিক-ডিকের গল্প বোরিস বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয় না, নিকোলাসকে সাবধান করে দিল রোয়েন।

টিসে বলছেন, আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ আছে তার। বুক আর বাহু ধোয়ার সময় নিকোলাসের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকলো ও। যেখানে রোদের ছোঁয়া পরেনি–ত্বক অত্যন্ত সাদা এবং মসৃণ। বুকের গাঢ় লোমগুলো কোঁকড়া। অসাধারণ শরীর।

লাগেজ হাতড়াতে পারে, বলল নিকোলাস। আপনার লাগেজে কোনো কাগজ-পত্র বা নোট নেই তো?

শুধু স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ আছে আর নোটবুকে যা আছে তার সবই শর্টহ্যান্ড–বোরিস বুঝবে না।

টিসের সঙ্গে কথা বলার সময় সাবধান।

তিনি খুব সরল। কারো ক্ষতি করবেন না।

বোরিস তাঁর স্বামী, ভুলে যাবেন না। অনুভূতি যা-ই বলুক, দু জনের কাউকেই বিশ্বাস করার দরকার নেই। শার্টটা ধুয়ে নিল নিকোলাস, ভিজেই পরল। চলুন।

ট্রাকের কাছে ফিরে ওরা দেখলো, সাউথ আফ্রিকান হোয়াইট ওয়াইনের বোতল খুলছে বোরিস। নিকোলাসকে একটা টাম্বলার ভরে দিল সে। টিসে ওদেরকে ঠাণ্ডা চিকেন রোস্ট আর হাতে তৈরি ইনজেরা রুটি পরিবেশন করলো। খাওয়া শেষ হতে নিকোলাসের পাশে ঘাসের উপর শুয়ে দাড়িওলা এক শকুনের দূর নীলিমায় ভেসে যাওয়া দেখলো রোয়েন। যাবার সময় হতে রোয়েনের হাত ধরে দাঁড় করালো নিকোলাস। শারীরিক সংস্পর্শ দুর্লভ একটা মুহূর্ত, নিকোলাসের আঙুলগুলো প্রয়োজনের চেয়ে এক কি দু সেকেন্ড দেরি করে ছাড়লো রোয়েন।

রাস্তার অবস্থা ভালো হওয়া তো দূরে কথা, আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। অতি কষ্টে একটা চড়াই পেরিয়ে এসে উতরাই ধরে নামতে শুরু করলো ট্রাক। অর্ধেক দূরত্ব নামার পর চুলের কাঁটার মতো বাঁক পড়লো। বাঁকটা ঘুরতেই দেখা গেল বিশাল একটা ট্রাক, প্রায় ট্রাক জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুনেছে বটে এ পথে প্রচুর ভারী যানবাহন চলাচল করে, তবে এ প্রথম একটাকে দেখলো ওরা। খুব সাবধানে ও কৌশলে ট্রাক আর উঁচু পাড়ের মধ্যবর্তী সরু ফাঁক গলে সামনে বাড়লো বোরিস।

পেছনের সীটে বসেছে রোয়েন, জানালো দিয়ে প্রকাণ্ড ডিজেল ট্রাকটা দেখতে পেল। সবুজের উপর লাল রঙে লেখা হয়েছে কোম্পানির নাম, লোগোটাও একই রঙের। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো ওর। মনে হলো, এ লোগো কিছুদিন আগে দেখেছে। অথচ মনে করতে পারছে না ঠিক কবে বা কোথায়।

বাকি পথ চুপচাপ গম্ভীর হয়ে থাকলো রোয়েন। বারবার শুধু মনে হচ্ছে ডানাওয়ালা ঘোড়ার লোগো আগেও কোথাও দেখেছে। লাল লোগগার উপর কোম্পানির নাম লেখা পেগাসাস এক্সপ্লোরেশন।

দিনের শেষে ট্র্যাকের পাশে একটা সাইনপোস্ট দেখলো ওরা। পোস্টের পায়াগুলো কংক্রিটে গাঁথা, লেখাগুলো প্রফেশনাল কারো হাতের কাজ। বোর্ডের মাথায় একটা তীরচিহ্ন আঁকা, নির্দেশ করছে বুলডোজার দিয়ে সমান করা নতুন একটা রাস্তা, বাঁক ঘুরে ডান দিকে চলে গেছে। তার নিচের লেখাগুলো পড়লো রোয়েন–

পেগাসাস এক্সপ্লোরেশন
বেস ক্যাম্প–ওয়ান কিলোমিটার
প্রাইভেট রোড
অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ।

লাল ঘোড়া পেছনের পায়ে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে আছে, ডানা দুটো দু দিকে মেলা।

ঝট করে মনে পড়ে গেল রোয়েনের! একই ট্রাক! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেও, মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। আতঙ্কের একটা ধাক্কা খেয়েছে বুকে। এ ট্রাকটাই ইয়র্কে ওর মায়ের ল্যান্ড রোভারকে ব্রিজ থেকে ঠেলে নিচে ফেলে দিয়েছিল। অসম্ভব, একই কোম্পানির ট্রাক ইথিওপিয়ার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় চলে আসাটা কাকতালীয় কোনো ঘটনা হতে পারে না!

আরো কয়েক মাইল এগিয়ে খাদের খাড়া কিনারায় এসে থামলো ওরা।

আজ এ পর্যন্তই, বোরিস ঘোষণা করে। আগামীকাল পায়ে হেঁটে খাদে নামবো আমরা। ক্যাম্প ফেলল।

নিচে নেমে নিকোলাসের হাত ধরে টান দিল রোয়েন। কথা আছে, ফিসফিস করলো ও। নদীর ধারে চলে এলো দু জন।

পা ঝুলিয়ে একটা পাথরের উপর পাশাপাশি বসলো ওরা। পাশের ফুলে ওঠা নদী আভাস দিচ্ছে ওদের সামনে কী অপেক্ষা করছে। ঠাণ্ডা পাহাড়ি জলরাশি অসংখ্য পাথরের মাঝখান দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে। ওদের নিচে পাহাড়-প্রাচীর পাথরের খাড়া দেয়াল, প্রায় এক হাজার ফুট গভীর। ওরা এতো উপরে রয়েছে যে সন্ধ্যের আলোয়-ছায়া আর জলপ্রপাত থেকে ছড়িয়ে পড়া জলকণার ভেতর নিচের অন্ধকারো রহস্যময় লাগছে। নিচে তাকাতেই মাথাটা ঘুরে উঠলো রোয়েনের, নিজের অজান্তেই নিকোলাসকে আঁকড়ে ধরল। ধরার পর বুঝতে পারলো কী করছে, তাড়াতাড়ি আবার ছেড়ে দিল।

কিনারা থেকে হঠাৎ লাফ দিয়েছে ডানডেরা নদীর ঘোলাটে পানি। আশ্চর্যের ব্যাপার, পড়ার পথে চকচক করছে সূর্যালোকে। রঙধনুর সাত রঙ অবয়বে। নিচের কালচে পাথরে আছড়ে পড়ছে সশব্দে–অতল খাদে উড়ছে সাদাটে মেঘ।

নিকোলাস, আপনার মনে আছে, ইয়র্কে একটা ট্রাক মামির ল্যান্ড রোভারকে ব্রিজ থেকে ফেলে দিয়েছিল?

কেন মনে থাকবে না! রোয়েনের দিকে তাকালো নিকোলাস। আপনাকে আপসেট লাগছে। কী ব্যাপার?

ট্রাকটার গায়ে কোম্পানির নাম আর লোগো ছিল। নামটা আমি পড়তে পারি নি, তবে লোগোটা লক্ষ করেছিলাম। আজ বিকেলে ঠিক ওই একই ধরনের একটা ট্রাককে আমরা পাশ কাটিয়ে এসেছি। লোগা লাল আর সবুজের একটা ঘোড়া। কোম্পানির নাম পেগাসাস এক্সপ্লোরেশন।

আপনার ভুল হয় নি?

না!

একই কোম্পানির ট্রাক ইয়র্কশায়ার আর গোজামে? মেনে নেওয়া যায়?

কোম্পানি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করে যে তাদের ট্রাক চুরি গেছে। এটা হয়তো তাদের সাজানো ব্যাপার, চুরি যাবার ঘটনা ঘটেনি, মিছিমিছি রিপোর্ট করেছে।

অসম্ভব নয়।

ডুরেঈদকে খুন করার পরও আমার উপর দু বার হামলা করেছে ওরা, বলল রোয়েন। বোঝাই যায়, বড় ধরনের আয়োজন করার ক্ষমতা রাখে তারা। মিশর আর ইংল্যান্ডে যারা আয়োজন করতে পারে, তাদের পক্ষে ইথিওপিয়ায়ও সেটা করা সম্ভব। সবচেয়ে বড়ো কথা, সপ্তম স্ক্রোল তাদের দখল রয়েছে, সেসব দেখে তারা জেনেছে অ্যাবে নদীই তাদের গন্তব্য।

হঠাৎ পাথর থেকে নেমে পড়লো নিকোলাস। আসুন।

কোথায়? রোয়েন হতভম্ব।

পেগাসাস বেস ক্যাম্পে। চলুন সাইট ফোরম্যানের সঙ্গে কথা বলি।

ওদেরকে টয়োটায় উঠতে দেখে বাধা দেওয়ার জন্য ছুটে এলো বোরিস।

আমার অনুমতি না নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?

চারদিকটা দেখতে, বলে ক্লাচ ছেড়ে দিল নিকোলাস। এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসব।

কী বলে… না! আমার ট্রাক! ধরার জন্য ছুটছে বোরিস, কিন্তু টয়োটার গতি বেড়ে যাওয়ায় পিছিয়ে পড়লো সে।

বিল করবেন। রিয়ার-ভিউ মিরবে তাকিয়ে হাসলো নিকোলাস।

সাইনপোস্ট দেখে বাঁক ঘুরলো ওরা, সাইড ট্র্যাক ধরে একটা রিজ পেরুল। চূড়ায় উঠে ব্রেক করলো ও, সামনের দৃশ্যটার উপর চোখ বুলাচ্ছে।

দশ একরের মতো জায়গা পরিষ্কার ও সমতল করা হয়েছে। জায়গাটা কাঁটাতারের উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা। ভেতরে ঢোকার একটা মাত্র গেট। সবুজ ও লাল রঙ করা তিনটে প্রকাণ্ড ডিজেল ট্রাক বেড়ার ভেতর পার্ক করা রয়েছে। ছোট আরো কয়েকটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে, আর রয়েছে একটা লম্বা মোবাইল ড্রিলিং রিগ। উঠানের আরেক অংশ দখল করে রেখেছে প্রসপ্রেক্টিং ইকুইপমেন্ট। একদিকে স্তূপ করা হয়েছে ড্রিলিং রড আর ইস্পাতের কোর বক্স, স্পেয়ার পাটস ভর্তি কাঠের বাক্স, ডিজেল ভর্তি চুয়াল্লিশ গ্যালনের কয়েকটা ড্রাম। এতো সব জিনিস, অথচ তারপরও উঠানে প্রচুর জায়গা পড়ে আছে, এর কারণ প্রতিটি জিনিস সামরিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। গেটের ঠিক ভেতরে দশবারোটা ঘর, করোগেটেড শিট দিয়ে তৈরি। বড় একটা আউটফিট, বলল নিকোলাস। নিজেদের কাজ বোঝে ওরা। চলুন দেখা যাক চার্জে কে আছে।

গেটে দু জন গার্ড, ইথিওপিয়ান আর্মির ক্যামোফ্লেজ ইউনিফর্ম পরা। অচেনা ল্যান্ড ক্রুজার দেখে বিস্মিত হয়েছে তারা। নিকোলাস হর্ন বাজাতে একজন এগিয়ে এলো, সন্দেহে কুঁচকে আছে ভুরু, হাতে বাগিয়ে ধরা এ কে ফরটিসেভেন রাইফেল।

এখানকার ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে চাই, আরবিতে বলল নিকোলাস, বলার সরে কর্কশ কর্তৃত্ব থাকলো, সেন্ট্রিদের অনিশ্চিয়তা ও অস্বস্তির মধ্যে ফেলাটাই উদ্দেশ্য।

অপেক্ষা করতে বলে সঙ্গীর কাছে ফিরে পরামর্শ করলো সেন্ট্রি, তারপর টু ওয়ে রেডিওর হ্যান্ডসেট তুলে মাইক্রোফোনে কথা বলল। কথা বলার পর পাঁচ মিনিট পেরিয়েছে, কাছাকাছি একটা ঘরের দরজা খুলে একজন শ্বেতাঙ্গ বেরিয়ে এলো।

তার পরনে খাকি কভারাল, মাথায় নরম বুশ ক্যাপ। চোখ দুটো আয়না লাগানো সানগ্লাসে ঢাকা। শক্ত লেদারের মতো গায়ের চামড়া, আকারে প্রকাণ্ড না হলেও শক্ত-সমর্থ, আস্তিন গুটানো হাতে পেশী ফুলে আছে। গার্ডের সঙ্গে দু একটা কথা বলে টয়োটার দিকে এগিয়ে এলো সে।

কী চাই? কেন আসা হয়েছে? কথার সুরে টেক্সাসের বাচনভঙ্গি স্পষ্ট, না ধরানো চুরুটটা দু সারি দাঁতের মাঝখানে আটকে রেখেছে।

আমি হারপার নিকোলাস। ট্রাক থেকে নেমে এগিয়ে এলো ও, হাত বাড়াল। হাউ ডু ইউ ডু?

আমেরিকান লোকটা ইতস্তত করলো, তারপর এমন ভঙ্গিতে হাতটা ধরল তাকে যেনো একটা ইলেকট্রিক ঈল মোচড়াতে দেওয়া হয়েছে।হেল, বলল সে।

জ্যাক হেলম্। অ্যাবিলিন, টেক্সাস থেকে। আমিই এখানকার ফোরম্যান। লোকটার হাতে সব কয়টা শিরা ফুলে আছে, শুকনো কয়েকটা ক্ষতচিহ্নও লক্ষ করলো নিকোলাস। নখের ভেতর গ্রিজ, কালো হয়ে আছে।

বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। দেখুন না, হঠাৎ ট্রাকটা বেঁকে বসেছে। ভাবলাম এখানে যদি কোনো মেকানিক পাই, দেখাব। হাসলো নিকোলাস, তবে বিনিময়ে লোকটা কোনো রকম উৎসাহ দেখালো না।

উটকো ঝামেলায় জড়ানো কোম্পানির পলিসি নয়। মাথা নাড়লো লোকটা।

টাকা লাগলে দিতে রাজি আছি…।

একবার তো বললাম, না! দাঁত থেকে চুরুট নামিয়ে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করছে হেলম্।

আপনাদের কোম্পানি পেগাসাস। বলতে পারেন হেড অফিস কোথায়? ম্যানেজিং ডিরেক্টরের নাম কী?

আমি খুব ব্যস্ত মানুষ। আপনি আমার সময় নষ্ট করছেন। ঘুরে দাঁড়াতে গেল হেলম্।

শিকার করতে এসেছি, কয়েক সপ্তা এদিকে গুলি ছুঁড়ব। আমি চাই না ভুল করে আপনার কর্মচারীদের কারো গায়ে লাগুক। একটা ধারণা দিতে পারেন, কোনোদিকে আপনারা কাজ করবেন?

এখানে আমি একটা প্রসপেক্টিং আউটফিট চালাচ্ছি, মিস্টার। গতিবিধি সম্পর্কে খবর ফাঁস করতে পারি না। যান! ঘুরে সোজা নিজের অফিস-ঘরে চলে গেল হেলম্।

ছাদে স্যাটেলাইট ডিক্স, মন্তব্য করলো নিকোলাস। ভাবছি এ মুহূর্তে কার সঙ্গে কথা বলছে হেলম্।

টেক্সাসে কারো সঙ্গে? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন।

নাও হতে পারে, বলল নিকোলাস। পেগাসাস নামকরা মাল্টিন্যাশনাল। হেলম্ টেক্সান, তার মানে এ নয় যে তার বসও তাই হবে। ইউ টার্ন নিল টয়োটা। পেগাসাসের কুৎসিত কেউ যদি এ ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত থাকে, আমার নামটা তার চেনা চেনা লাগবে। আমরা আমাদের হাজিরা নোটিশ দিয়েছি, দেখা যাক কী জবাব পাওয়া যায়।

*

ডানডেরা নদী ও জলপ্রপাতের কাছে ফিরে এসে ওরা দেখলো ইতোমধ্যে ক্যাম্প ফেলা হয়েছে, ওদের জন্য চা বানাতে বসে গেছে শেফ। সন্ধ্যের মধ্যে পুরো আধ বোতল ভদকা শেষ না করা পর্যন্ত মুখ হাঁড়ি করে থাকলো বোরিস। তারপর সে জানালো, ঘোড়া আর গাধার বাচ্চা এখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করার কথা। এখানকার মানুষগুলোও তাই, খচ্চর; সময়ের কোনো মূল্য দেয় না। ওরা না পৌঁছলে খাদে আমরা নামতে পারব না।

এতে করে, অন্তত আমার রাইফেল নিয়ে বেরুনোর সুযোগ পাওয়া গেল, নিকোলাস বলে। আফ্রিকায় ধৈর্য ধারণের জন্য কেউ পয়সা দেয় না অবশ্য।

সকালে নাস্তা খাবার পরও যখন খচ্চরগুলো পৌঁছল না, নিজের রাইফেলটা হাতে নিল নিকোলাস। ওর কাছ থেকে সেটা চেয়ে নিয়ে পরীক্ষা করলো বোরিস। মনে হচ্ছে পুরানো একটা রাইফেল? জিজ্ঞেস করলো সে।

১৯২৬ সালে তৈরি। আমার দাদা নিজ হাতে বানিয়েছিলেন।

তখনকার লোকজন জানত কীভাবে রাইফেল বানাতে হয়? প্রশংসা করলো বোরিস। শর্ট মাউজার ওবানডর্ফ ডাবল স্কয়্যারব্রিজ অ্যাকশন বিউটিফুল! তবে নতুন করে ব্যারেল লাগানো হয়েছে, ঠিক বলি নি?

অরিজিন্যাল ব্যারেল কেটে ফেলে দিয়েছি, বলল নিকোলাস। নতুনটা লাগানোয় এখন আমি একশো কদম দূর থেকে একটা মশার ডানা উড়িয়ে দিতে পারি।

ক্যালিবার সেভেন ইন্টু ফিফটিসেভেন, ঠিক?

টুসেভেনটিফাইভ রিগবি, তার ভুলটা ধরিয়ে দিল নিকোলাস।

একই কার্টিজ, আপনারা কায়দা করে অন্য নাম দিয়েছেন। হাসছে বোরিস। একশো পঞ্চাশ গ্রেন বুলেট প্রতি সেকেন্ডে দু হাজার আটশো ফুট গতি পাবে। সত্যি খুব ভালো রাইফেল, সেরাগুলোর মধ্যে একটা।

ধন্যবাদ, বলল নিকোলাস। আপনার প্রশংসার আমি মূল্য দিই।

ইংরেজ মানুষদের রসবোধ!

টার্গেট প্র্যাকটিস করার জন্য ক্যাম্প ত্যাগ করলো নিকোলাস, ওর সঙ্গে রোয়েনও এলো। নদীর তীরে এসে দুটো ক্যানভাস ব্যাগের সাদা বালি ভরল ওরা। এটা পাথরের উপর ব্যাগ দুটো রাখা হলো, রাইফেলের রেস্ট হিসেবে কাজ করবে। ব্যাক-স্টপ হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে খোলা হিলসাইড। দুশো গজ এগুলো নিকোলাস, ওখানে একটা কার্ডবোট কার্টুন সেট করলো, তার উপর টেপ দিয়ে আটকাল একটা বিসলে-টাইপ টার্গেট। পাথরটার পেছনে ফিরে এলো আবার, এখানে রোয়েন আর রাইফেলটা অপেক্ষা করছে।

গুলির প্রথম আওয়াজটাই ঘাবড়ে দিল রোয়েনকে। রাইফেলটা দেখতে এতো নিরীহ, তা থেকে এরকম বিকট আওয়াজ বেরুতে পারে, ভাবা যায় না। মনে হলো রোয়েনের কানে যেনো ভোঁ বাজছে। টার্গেটের তিনি ইঞ্চি ডানে আর দু ইঞ্চি নিচে লেগেছে বুলেট। কী ভয়ানক জিনিস! আপনি নিরীহ প্রাণীগুলোকে এ ভয়ঙ্কর বন্দুক দিয়ে মারবেন? রোয়েনের কথায় প্রতিবাদ ও আপত্তির সুর।

বন্দুক নয়, রাইফেল। নিকোলাস ঠিক করে দেয়। কম পাওয়ারের একটা রাইফেল দিয়ে যদি মারি; অথবা লাঠি দিয়ে তাতে কী আপনি সন্তুষ্ট হবেন?

টেলিস্কোপে সাইট অ্যাডজাস্ট করলো নিকোলাস। পরবর্তী শট বুলসআইনের মাত্র এক ইঞ্চি উপরে লাগলো।

একজন খাঁটি শিকারী যতো দ্রুত এবং পরিষ্কারভাবে শিকার মারতে মারবেন ততো নিপুণ তার দক্ষতা।

বন্দুকই হোক বা রাইফেল–কেমন করে স্রষ্টার সৃষ্টি আপনারা মারতে পারেন? রোয়েন বলে।

ওটা আপনাকে বুঝিয়ে বলা শক্ত, আবারো, গুলী করে নিকোলাস। এবারে, টার্গেটে লেগেছে।

এ হলো পুরুষের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। আর, শিকার কেন উচিত নয়? ঈশ্বর তো ওগুলো আমাদেরকে দান করেছেন। আপনি তো বিশ্বাসী। উদ্ধৃতি শোনান আমাকে–অ্যাক্টস টেন ভার্সেস টুয়েলভ অ্যান্ড থারটিন।

দুঃখিত, মাথা নাড়লো রোয়েন। আপনি শোনান।

শুনুন–…জগতের সমস্ত চতুষ্পদী প্রাণী, বন্য প্রাণী, হামা-দিয়ে চলা জীব, আকাশের যতো খেচর, অনুরোধ রক্ষা করছে নিকোলাস, তোমার প্রতি নির্দেশ, পিটার; জাগো এবং মারো। খাবার গ্রহণ করো।

আপনার উকিল হওয়া উচিত ছিল। কৃত্রিম হতাশায় গুঙিয়ে মতো উঠলো রোয়েন।

অথবা পুরোহিত! এগিয়ে গিয়ে টার্গেট নিয়ে আসে নিকোলাস। আদর করে হাত বোলায় রাইফেলে।

আধ ঘণ্টা পর কেসে ভরা রাইফেল নিয়ে ক্যাম্পে ফিরছে ওরা, কাছাকাছি এসে। দাঁড়িয়ে পড়লো নিকোলাস। মেহমান! বলে চোখে বাইনোকুলার তুললাম। বাহ্, নোটিশে তাহলে কাজ হয়েছে! ওখানে পেগাসাসের একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে, রোয়েন। চলুন দেখা যাক কী ঘটছে।

ক্যাম্পের আরো কাছাকাছি এসে ওরা দেখলো দশ কি বারোজন ইউনিফর্ম পরা সৈনিক লাল-সবুজ পেগাসাস ট্রাকের পাশে জড়ো হয়েছে, সবাই ভারী অস্ত্রে সজ্জিত। ডাইনিং তাঁবুর ফ্ল্যাপ তোলা, ভেতরে ক্যাম্প চেয়ার পেতে বসে রয়েছে জ্যাক হেলম, একজন ইথিওপিয়ান আর্মি অফিসার ও বোরিস। গভীর আলোচনায় মগ্ন।

নিকোলাস ভেতরে ঢুকতেই চশমা পরা ইথিওপিয়ান আর্মি অফিসারের সঙ্গে পরিচয় করিতে দিল বোরিস। ইনি কর্নেল টুমা নগু, সাউদার্ন গোজাম এলাকার মিলিটারি কমান্ডার।

কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

কর্নেল কঠিন সুরে বলল, আপনার পাসপোর্ট আর ফায়ার আর্মসের লাইসেন্স দেখান। তার চেহারা থমথম করছে। পাশে বসা জ্যাক হেলমের চোখে নগ্ন উল্লাস, নিভে যাওয়া চুরুট চিবাচ্ছে।

নিজের তাঁবু থেকে কাগজপত্র নিয়ে এলো নিকোলাস। টেবিলের উপর সেগুলো মেলে ধরে বলল, আমি জানি, ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারির দেওয়া আমার পরিচয় পত্রটাও দেখতে চাইবেন আপনি। আর এটা হলো আদ্দিসআবাবা থেকে দেওয়া ব্রিটিশ অ্যামব্যাসাডরের প্রশংসাপত্র। আর এ যে, এটা দেখছেন, লন্ডনে ইথিওপিয়ার অ্যামব্যাসাডর ভদ্রলোক দিয়েছেন। আরেকটা, এটাই শেষ দিয়েছেন আপনাদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, জেনারেল সাইয়ি আব্রাহা।

অলঙ্কৃত অফিশিয়াল লেটারহেড আর সরকারি সীল ছাপ্পড়ের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলে কর্নেল নগু। সোনালি ফ্রেমের চশমার ভেতর তার চোখ দুটোয় প্রায় বিহ্বল দৃষ্টি। স্যার! লাফ দিয়ে চেয়ার ছাড়লো সে, কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে স্যালুট করলো। আপনি আগে বলেন নি কেন? জেনারেল আব্রাহার বন্ধু আপনি? জানতাম না, আমি জানতাম না! কেউ আমাকে বলে নি। বিরক্ত করার জন্য সত্যি আমি দুঃখিত, স্যার!

আবার স্যালুট করলো সে, বিব্রত বোধ করায় আনাড়ি ও আড়ষ্ট লাগছে তাকে। আমি শুধু আপনাকে বলতে এসেছিলাম যে পেগাসাস কোম্পানি এলাকায় ড্রিলিং ও ব্লাস্টিং অপারেশন চালাচ্ছে। বিপদ ঘটতে পারে। প্লিজ সাবধান থাকবেন। তাছাড়া, এলাকায় অসংখ্য ডাকাত আর শুফতা আছে, সেদিক থেকেও সাবধান থাকতে হবে আপনাকে। উত্তেজনায় হাঁপিয়ে গেছে সে, দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। বুঝতেই পারছেন, পেগাসাস কোম্পানিয় এমপ্লয়ীদের জন্য এসকর্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি এখানে আমরা। যে কোনো রকম বিপদে আমাকে শুধু একটা খবর দিলেই হবে, আপনার সাহায্যে হাজির হয়ে যাব আমরা।

ধন্যবাদ, কর্নেল।

আপনাকে আর বিরক্ত করব না, স্যার। তৃতীয়বার স্যালুট করে পেগাসাস ট্রাকের দিকে পিছু হটছে কর্নেল, টেক্সান ফোরম্যানকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে। জ্যাক হেলম্ এ পর্যন্ত একটা শব্দও উচ্চারণ করে নি, কোনোরকম বিদায় সম্ভাষণ জানিয়েই চলে যাচ্ছে সে। ট্রাক চলতে শুরু করার পর ক্যাব জানালো থেকে চতুর্থ ও শেষ স্যালুটটা করলো কর্নেল নগু।

স্যালুটের উত্তরে অলসভঙ্গিতে একবার হাত নাড়লো নিকোলাস, রোয়েনকে বলল, সব মিলিয়ে বোঝা গেল, মি. পেগাসাস চান না এদিকে আমরা থাকি। সন্দেহ করছি শিগগির আবার তিনি সার্ভিস দিতে আসবেন।

ডাইনিং টেবিলের কাছে ফিরে এসে বোরিসকে নিকোলাস বলল, এখন শুধু আপনার খচ্চরগুলো এলেই হয়।

গ্রামে লোক পাঠিয়েছি। এসে পড়বে।

*

খচ্চরগুলো পৌঁছল পরদিন সকালে। ছয়টা শক্ত-সমর্থ জানোয়ার, প্রতিটির সঙ্গে খাকি শর্টস আর সাদা হাফশার্ট পরা একজন করে চালক। সকাল দশটার মধ্যে ওগুলোর পিঠে মালপত্র চাপিয়ে খাদে নামার প্রস্তুতি নিয়ে ফেললো ওরা। পথের শেষ মাথায় থামলো বোরিস, গলা লম্বা করে ঢালের দিকে তাকালো। তার মতো লোককেও অন্তত এ একবার খাদের সীমাহীন পতন ও দূরতিগম্য বিভীষিকা সন্ত্রস্ত ও নার্ভাস করে তুললাম।

আপনারা ভিন্ন এক জগতের ভিন্ন এক সময়ের ভেতর ঢুকতে যাচ্ছেন, প্রায় দার্শনিক ভঙ্গিতে বলল সে। ওরা বলে, ট্রেইলটা দু হাজার বছরের পুরানো, যিশুর বয়েসি। ডেবরা মারিয়াম গির্জার কালো পুরোহিত গল্প শোনায়, যিশু ক্রুশবিদ্ধ হবার পর ইসরায়েল থেকে পালাবার সময় ভার্জিন মেরী এ পথ ধরেই গিয়েছিলেন। মাথা নাড়লো সে। তবে কথা হলো, এখানকার লোকেরা সত্যি-মিথ্যে সবই বিশ্বাস করে। ট্রেইলে পা ফেললো সে।

পাহাড়-প্রাচীরকে জড়িয়ে আছে ওটা, নেমে গেছে এমন তির্যক ভঙ্গিতে, আর পাথরের ধাপগুলো পরস্পরের কাছ থেকে এতো দূরে, যে প্রতিটি পদক্ষেপে হাঁটু ও পেটের শিরা, পেশী ও চামড়ায় প্রবল চাপ পড়ে, ঝাঁকি খায় শিরদাঁড়া। ট্রেইলের পতন আরো বেশি খাড়া ও কর্কশ যেখানে, পাথর ধরে ঝুলে পড়তে হলো ওদেরকে, কিংবা ক্রল করে এগুতে হলো।

দেখে মনে হলো অসম্ভব ব্যাপার, ভারী বোঝা নিয়ে খচ্চরগুলো ওদেরকে অনুসরণ করতে পারবে না। ওগুলো যে কিরকম সাহসী, না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। পাথরের এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে লাফ দিল, পড়ার পর সামনেই দুই পা ভাঁজ হয়ে গেল, পেশী শক্ত করে তৈরি হলো পরবর্তী ধাপে লাফ দেওয়ার জন্য। ট্রেইলটা এতো সরু যে পেটমোটা বোঝা একদিকের পাথরের পাচিলে ঘষা খাচ্ছে, অপরদিকের সীমাহীন অধোগতি ফাঁক লোভীর মতো হাঁ করে আছে।

ট্রেইল যখন বেঁকে গেছে, খচ্চরগুলো লাফ দিয়ে বাক নিতে পারছে না বা একবারের চেষ্টায় এগুতে পারছে না। পিছিয়ে এসে ট্রেইলটা স্পর্শ দিয়ে অনুভব করতে হচ্ছে, পাঁচিলে গা ঘসে থেমে থেমে প্রতি বার একটু একটু করে এগুচ্ছে, ঘন ঘন দেখে নিচ্ছে খাদের কিনারা, আতঙ্কে ঘুরে গিয়ে বেরিয়ে আসছে চোখের সাদা অংশ। কর্কশ হুঙ্কার ছেড়ে, ওগুলোর গায়ে চাবুক মারছে চালকরা।

কোথাও কোথাও ট্রেইলটা পাহাড়ের ভেতর ঢুকে পড়েছে। কয়েকবার ভেতরে ঢোকা অসম্ভব মনে হলো, সরু প্রবেশমুখের দু পাশে সূচের মতো ধারালো হয়ে আছে পাথর। কোথাও আবার মুখটা এততাই সরু যে বোঝাসহ খচ্চর ভেতরে ঢুকতে পারবে না। অগত্যা পিঠ থেকে সব নামাতে হলো, খানিক দূর এগিয়ে তুলতে হবে আবার।

দেখুন! অবাক বিস্ময়ে চিৎকার দিল রোয়েন, হাত তুলে ফাঁকা দিকটা দেখালো। যাদের গভীরতা থেকে বিশাল ডানা মেলে উঠে এলো কালো একটা শকুন, ভেসে গেল প্রায় ওদের দুই হাত দূর দিয়ে, লালচে নগ্ন মাথা ঘুরিয়ে কালো চোখে তাকালো ওদের দিকে।

পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে জড়িয়ে থাকা ট্র্যাক ধরে সারাদিন এগুলো ওরা, বিকেল শেষ হয়ে আসছে অথচ এখনো অর্ধেক দূরত্বও পেরোয় নি। আরো একবার পুরোপুরি উল্টোদিকে ঘুরে গেল ট্রেইল, সামনে থেকে ভেসে এলো জলপ্রপাতের গর্জন। প্রকাণ্ড একটা ঝুল-পাথরের দিকে এগুচ্ছে ওরা, আওয়াজটা সেই সঙ্গে বাড়ছে। কোণ ঘুরে ওটাকে পেরিয়ে আসতেই বিপুল জলরাশির পতন পুরোপুরি দৃষ্টিসীমার ভেতর চলে এলো।

প্রবল বর্ষণে ঝড়ের মতো গতি পেয়ে গেছে বাতাস, মনে হলো ওদেরকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে, পাহাড়-প্রাচীরের গর্তের কিনারা আঁকড়ে ধরে কোনো রকমে ঝুলে থাকতে হলো। ওদের চারদিকে রাশি রাশি জলকণা বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, ভিজিয়ে দিচ্ছে উঁচু করা মুখ, কিন্তু ইথিওপিয়ান গাইড থামার সুযোগ না দিয়ে সোজা এগিয়ে নিয়ে চলল। এক সময় মনে হলো বর্ষণের তোড়ে উপত্যকায় ভেসে যাবে ওরা, এখনো কয়েকশো ফুট নিচে সেটা।

তারপর, যেনো মন্ত্রবলে, ভাগ হয়ে গেল বিপুল জলরাশি, স্বচ্ছ নিবিড় পতনশীল পর্দার পেছনে পা ফেলে ঢুকে পড়লো শ্যাওলা ঢাকা ও ভেজা চকচকে পাথরের গভীর ফোকরে হাজার বছর ধরে পানির তোড়ে পাহাড়-প্রাচীর ক্ষয়ে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে। গাঢ় ছায়াময় এ জায়গায় আলো আসছে শুধু জলপ্রপাত ভেদ করে, তার রঙ সবুজাভ, ফলে গা ছমছমে রহস্যময় একটা আবহ তৈরি হয়েছে, ওরা যেনো সাগরের তলায় একটা গুহার ভেতর রয়েছে।

আজ রাতে এখানে আমরা ঘুমাব, জানালো বোরিস, ওদের বিস্ময় উপভোগ করছে সে। গুহার পেছনে জ্বালানি কাঠের বান্ডিলগুলো ইঙ্গিতে দেখালো, পাশেই পাথরের তৈরি ফায়ারপ্লেস, উপরের দেয়াল ধোয়া লেগে কালো হয়ে আছে। খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে মঠ সন্ন্যাসীদের জন্য খাবার নিয়ে যায় গ্রামবাসীরা, এ জায়গা তারা কয়েকশো বছর ধরে ব্যবহার করছে।

গুহার আরো ভেতরে চলে আসায় জলপ্রপাতের শব্দ ক্রমশ ভোঁতা হয়ে এলো, পায়ের নিচে এখন শুকনো পাথর। চাকররা আগুন জ্বালার পর রোমান্টিক যদি না-ও হয়, আরামদায়ক আশ্রয় হয়ে উঠলো জায়গাটা। এক কোণে স্লিপিং ব্যাগের ভাঁজ খুলল নিকোলাস, স্বভাতই ওর পাশে রোয়েনও। দু জনেই খুব ক্লান্ত, স্লিপিং ব্যাগের ভেতর লম্বা হয়ে পেশীতে ঢিল দেওয়ার চেষ্টা করলো, গুহার ছাদে লাল-গোলাপি প্রতিফলন দেখছে।

ভাবুন একবার! ফিসফিস করলো রোয়েন। কাল আমরা স্বয়ং টাইটার পায়ের ছাপে পা ফেলব।

ভার্জিন মেরীর কথা না হয় বাদই দিলাম। হাসলো নিকোলাস।

আপনি অসহ্যরকম বিশ্বনিন্দুক, দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোয়েন। আমার আরো ধারণা, আপনার নাক ডাকে।

আজ রাতেই সেই ফয়সালা হয়ে যাবে! কিন্তু পথের ক্লান্তিজনিত কারণে আগেই ঘুমিয়ে পড়লো রোয়েন, নাক-ডাকার শব্দ শোনা হলো না। ওর শ্বাস-প্রশ্বাস হালকা, প্রবাহমান পানির শব্দ ছাপিয়ে সামান্যই শোনা যায়। কতোকাল আগে একজন রূপসী নারীকে পাশে নিয়ে শুয়েছিল নিকোলাস! রোয়েন ঘুমিয়ে গেছে। নিঃসন্দেহ হওয়ার পর ঝুঁকে পরে ওর গাল ছুঁলো সে।

শুভরাত্রী, ছোট্ট সোনা, ফিসফিস স্বরে বলল নিক। খুব ধকল গেল আজ। নিজের ছোট্ট মেযেটাকে এমন বলেই ঘুম পাড়াতো ও।

*

ভোর হওয়ার আগেই নড়াচড়া শুরু করলো খচ্চর চালকরা। পায়ের সামনেটা দেখা যায়, এরকম আলো ফুটতেই আবার ওরা রওয়ানা হলো। পাহাড়-প্রাচীরের উপরের অংশে সকালের প্রথম রোদ লাগলো যখন, তখনও ওরা উপত্যকার মেঝে থেকে এতো উঁচুতে রয়েছে যে নিচের গোটা এলাকার উপর চোখ বুলানো সম্ভব হলো।

রোয়েনকে কাছে টেনে নিল নিকোলাস, বাকি ক্যারাভানকে থাকতে দিল ওদের সামনে। বসার একটা জায়গা খুঁজে নিচে প্যাচানো স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ খুলল ও। নিচের দৃশ্য থেকে প্রধান প্রধান চূড়া আর বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিহ্নিত করলো ওরা, ফলে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গেল কোথায় ওরা রয়েছে। এখান থেকে অ্যাবে নদী আমরা দেখতে পাব না, বলল নিকোলাস। সেটা এখনো উপ-খাদের গভীরে লুকিয়ে আছে। দেখতে পাব সম্ভবত সরাসির ওটার উপরে পৌঁছবার পর।

যেখানে আছি বলে হিসাব করলাম তাতে যদি ভুল না হয়, একজোড়া হাঁসুলিবাঁক ঘোরার পরই নদীটা দেখতে পাবার কথা–সম্ভবত ওই খাড়া পাঁচিলটার ওদিকেই বাক দুটো পাওয়া যাবে।

বোধহয়, সায় দিল নিকোলাস। আর ডানডেরা নদী অ্যাবের সঙ্গে মিলিত হয়েছে ওদিকের ওই পাঁচিলগুলোর নিচে। বুড়ো আঙুলের গিঁট ব্যবহার করলো আনুমানিক দূরত্ব মাপার জন্য। এখান থেকে প্রায় পনেরো মাইল।

দেখে মনে হচ্ছে হাজার বছরের মধ্যে কয়েকবারই গতিপথ বদল করেছে ডানডেরা। আমি অন্তত দুটো নালার আভাস পাচ্ছি, দেখতে প্রাচীন রিভার বেডের মতো। হাত তুলে দেখালো রোয়েন। ওখানে, আর ওদিকে। এখন অবশ্য জঙ্গলে ঢাকা পড়ে গেছে। নিচে আরেকবার চোখ বুলিয়ে দম আটকাল ও। কি বিশাল এলাকা! আর কি জটিল! এ দুর্গম পাথরের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা সমাধির প্রবেশপথ কীভাবে খুঁজে পাব আমরা?

সমাধি? কোন সমাধির কথা বলা হচ্ছে? পেছন থেকে সাগ্রহে জানতে চাইলো বোরিস। ওদের খোঁজে ট্রেইল ধরে পিছিয়ে এসেছে সে। তার পায়ের আওয়াজ ওরা শুনতে পায়নি। কি, চুপ হয়ে গেলেন কেন? কার সমাধি খুঁজছেন আপনারা?

কার আবার, নিরুদ্বিগ্ন নিকোলাসের ঠোঁটে হাসি লেগে থাকলো, সেন্ট ফুমেনটিয়াসের সমাধি।

মঠটা না সেন্টের নামে উৎসর্গিত? ফটোগ্রাফ পেঁচিয়ে রাখার সময় বোরিসের দিকে ফিরে রোয়েনও হাসলো।

হ্যাঁ। হতাশ দেখালো বোরিসকে, যেনো আরো ইন্টারেস্টিং কিছু শুনবে বলে আশা করেছিল। হ্যাঁ, সেন্ট ফুমেনটিয়াস। তবে ওরা আপনাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না। সন্ন্যাসীরা ছাড়া ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই কারো। ক্যাপ নামিয়ে মাথা চুলকাল সে, তার চুল তারের মতো, সুখের ঘষায় প্রায় ধাতব শব্দ উঠছে। এ সপ্তায় তিমকাত উৎসব হবে। আনন্দ-উত্তেজনার বন্যা বয়ে যাবে ওখানে। বাইরে থেকে দেখে মজা পেতে হবে, ভেতরে ঢুকতে পারবেন না।

চোখ কুঁচকে সূর্যের দিকে তাকালো সে। চলুন যাওয়া যাক। দেখে মনে হচ্ছে কাছে, কিন্তু অ্যাবেতে পৌঁছতে আরো দুদিন লেগে যাবে আমাদের। নিচে আরো কঠিন পথ, এমন কি ডিক-ডিক শিকারীর জন্যও। নিজের কৌতুকে হেসে উঠে ঘুরে দাঁড়ালো সে, ট্রেইল ধরে এগুলো।

পাহাড়-প্রাচীরের যতই নিচে নামছে ওরা ট্রেইল ততই মসৃণ হয়ে উঠছে, ধাপগুলো আগের চেয়ে অগভীর, পরস্পরের সঙ্গে দূরত্বও বাড়ছে। সহজে এগোেননা যাচ্ছে, তাই গতিও বেড়ে গেল। তবে বাতাসের মান ও স্বাদ বদলে গেছে। পাহাড়ী ঠান্ডা বাতাস উধাও হয়েছে, তার বদলে স্থান দখল করেছে শক্তিহীন নিস্তেজ বাতাস, তাতে সীমা না মানা জঙ্গলের স্বাদ ও গন্ধ লেগে আছে।

গরম! বলে উলেন শালটা গা থেকে খুলে ফেললো রোয়েন।

দশ ডিগ্রী বেশি, আন্দাজ করলো নিকোলাস। পুরানো আর্মি জার্সিটা মাথা গলিয়ে খুলে আনল, এলোমেলো হয়ে থাকলো এক রাশ কালো চুল নিচে আরো গরম লাগবে। অ্যাবেতে পৌঁছবার আগে আরো তিন হাজার ফুট নামতে হবে।

এরপর বেশ খানিকদূর ডানডেরা নদী ঘেঁষে এগিয়েছে ট্রেইল। মাঝে মধ্যে দেখা গেল নদীটা থেকে কয়েক শ ফুট উপরে রয়েছে ওরা, আবার খানিক পরই নেমে আসতে হলো কোমর সমান পানিতে, তীব্র স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যাবার ভয়ে খচ্চরের পিঠে চাপানো বোঝা আঁকড়ে ধরে আছে।

তারপর ডানডেরা নদী খাদ এতো গভীর আর খাড়া হয়ে উঠলো যে অনুসরণ করা সম্ভব নয়, পাহাড়-প্রাচীর সটান দাঁড়িয়ে আছে পানির উপর। কাজেই নদী ছেড়ে আঁকাবাঁকা ট্র্যাক ধরল ওরা, ভাঙাচোরা পাহাড় আর লাল পাথুরের ব্লাফের মাঝখান দিয়ে এগিয়েছে।

ভাটির দিকে এক কি দু মাইল এগোবার পর আবার ওরা অন্য এক মেজাজের ডানডোরার সঙ্গে মিলিত হলো, নদী এখানে ঘন ও নিবিড় বনভূমির ভেতর দিয়ে কলকল শব্দে ছুটে চলেছে। লতানো গাছের ডগা পানি ছুঁয়ে আছে, ওদের মাথায় গাছের শ্যাওলা লেগে গেল। ওদেরকে দেখে ডালে ডালে খুব লাফালাফি আর চেঁচামেচি করছে কয়েক ঝক বাঁদর। একবার নিচের ঝোঁপ ভেঙেচুরে ছুটল বড় আকৃতির একটা জানোয়ার। ঝট করে বোরিসের দিকে তাকালো নিকোলাস।

মাথা নাড়লো রুশ গাইড, হাসছে। না, ডিক-ডিক নয়। কুডু।

সারাটা দিন আঁকাবাঁকা ট্রেইল ধরে এগুলো ওরা, শেষ বিকেলে ক্যাম্প ফেললো নদীর খানিকটা উপরে, ফাঁকা একটা জায়গায়। এখানে আগেও অনেকবার ক্যাম্প ফেলা হয়েছে, লক্ষণ দেখে বোঝা গেল। ট্রেইল যেনো এখানে দুই সময়শাসিত পর্যায়ে বিরক্ত–জলপ্রপাতের মাথা থেকে মঠে নামতে ট্যুরিস্টদের পুরো তিন দিন লাগে, সবাই তারা এ একই জায়গায় ক্যাম্প ফেলে।

দুঃখিত, এখানে কোনো শাওয়ার নেই, মক্কেলদের জানালো বোরিস। হাত মুখ ধুতে চাইলে উজানের দিকে প্রথম বাঁক ঘুরলে নিরাপদ একটা পুল আছে।

রোয়েনের চোখে আবেদন, নিকোলাস, ঘামে একদম ভিজে গেছি। এমন কোথাও পাহারা দেবেন, ডাকলে যাতে শুনতে পান?

বাঁকটার ঠিক নিচেই শ্যাওলা ঢাকা তীরে শুয়ে থাকলো নিকোলাস; কাছাকাছি, তবে দৃষ্টিসীমার বাইরে থেকে ভেসে আসা রোয়েনের পানি ছিটানো আর মৃদু হাসির শব্দ শুনছে। একবার মাথা ঘোরাবার পর উপলব্ধি করলো স্রোত নিশ্চয়ই রোয়েনকে ভাটির দিকে টেনে নিয়ে এসেছে। কারণ, গাছপালার ফাঁকে এক পলকের জন্য নগ্ন পিঠ দেখা গেল, তারপর নিতম্বের ভাঁজ–মাখনের মতো, ভেজা ও চকচকে। অপরাধবোধ জাগায় তাড়াতাড়ি চোখ ফেরালো নিকোলাস।

খানিক পর ভাটির দিকে থেকে তীর ধরে এগিয়ে আসতে দেখা গেল রোয়েনকে, কোমল সুরে গুন গুন করছে, চুলের পানি মুছছে তোয়ালে দিয়ে। আপনার পালা, নিকোলাস। যান আমি পাহারায় থাকি?

আমি এখন বড় হয়েছি। মাথা নাড়লো নিকোলাস, তবে রোয়েন পাশ কাটানোর সময় তার চোখে রক্তিম লজ্জা আর সেই সঙ্গে কৌতুকের ক্ষীণ ঝিলিক দেখতে পেল। হঠাৎ নিকোলাস ভাবল, রোয়েন কি জানে স্রোতের টানে কতটা ভাটির দিকে চলে এসেছিল সে, তার কতটুকু দেখে ফেলেছে ও? চিন্তাটা রোমাঞ্চিত করে তুললাম ওকে।

গোসল করার জন্য উজানে চলে এলো নিকোলাস। কাপড় খোলার সময় উপলব্ধি করলো রোয়েন ওকে কতটা উত্তেজিত করে তুলেছে। একটু যেনো অপরাধবোধের খোঁচা লাগলো–রোসেলিনের পর আর কোনো নারী ওকে জাগিয়ে তুলে নি এমন করে।

ঠাণ্ডা পানি উপকারে আসবে, বিড়বিড় করলো ও, তারপর ডাইভ দিল নদীতে।

*

সন্ধ্যার পরপরই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ক্যাম্পফায়ারের সামনে বসে আছে ওরা হঠাৎ মুখ তুলে কান পাতলো নিকোলাস। কিসের একটা আওয়াজ হচ্ছে না?

ঠিক ধরেছেন, হেসে উঠে বলল টিসে। আপনি গান শুনতে পাচ্ছেন। আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে মঠের পুরোহিতরা আসছেন।

ঠিক তখনই আগুনের লাল শিখা দেখতে পেল ওরা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে উঠে আসছে মশালমিছিল, গাছপালার ভেতর দিয়ে ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসায় মিটমিট করছে আলোগুলো। খচ্চর চালক আর চাকর-বাকরেরা ভিড় করে সামনে বাড়লো, ছন্দোবদ্ধ গানের সঙ্গে তালি দিচ্ছে, স্বাগত জানাচ্ছে সম্মানিয় মঠ প্রতিনিধিদের।

ভারি ও গভীর পুরুষকণ্ঠ ক্রমশ চড়ছে, তারপর আবার ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে অস্পষ্ট ফিসফিসানি, তবে বাতাসে মিলিয়ে যাবার আগেই আবার চড়ছে, এভাবে বারবার। গানের কথাগুলো বোঝা গেল না, তবে সম্মিলিত কণ্ঠের প্রলম্বিত সুর হৃদয়কে দোলা দিয়ে যায়, আপনা থেকে ভক্তির একটা ভাব চলে আসে মনে। নিকোলাসের শরীর শিরশির করে উঠলো, হিম রোমাঞ্চ নেমে এলো শিরদাঁড়া বেয়ে।

তারপর দেখা গেল পুরোহিতদের সাদা আলখেল্লা, মশালের আলোয় দেওয়ালি পোকার মতো লাগছে, উঠে আসছে ট্রেইল ধরে। ক্যাম্পের সামনে খোলা জায়গায় সাধুদের দেখামাত্র ক্যাম্প সার্ভেন্টরা জমিনে হাঁটু গাড়ল। সামনের সারিতে রয়েছে অধস্তন তরুণ উপাসকরা, খালি পায়ে, খালি মাথায়। তাদের পিছু নিয়ে এলেন। সন্ন্যাসীরা, পরনে দীর্ঘ আলখেল্লা ও লম্বা পাগড়ি। কয়েক সারিতে এলেন তারা, তবে দু পাশে সরে গিয়ে পেছনটা ফাঁক করে দিলেন। সন্ন্যাসীরা আসলে এ মুহূর্তে মর্যাদাপূর্ণ প্রহরীর ভূমিকা পালন করছেন, তাঁদের ঠিক পেছনেই রয়েছেন নকশাদার আলখেল্লা ও অলঙ্কার পরিহিত যাজক বা পুরোহিতরা।

তাঁদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে ভারী কপটিক ক্রস, বসানো হয়েছে। রূপোয় মোড়া একটা দণ্ডের মাথায়। পুরোহিতদের সারিটাও দু পাশে সরে গেল আবেগমথিত সুরে এখনো তারা গানের মাধ্যমে ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন করছেন, সরে গিয়ে চাঁদোয়া ঢাকা.পালকিটাকে সামনে এগোবার পথ করে দিলেন। চারজন তরুণ উপাসক বয়ে নিয়ে এলো সেটা; নামিয়ে রাখলো ক্যাম্পের ঠিক মাঝখানে। মশাল ও ক্যাম্প লণ্ঠনের আলোয় লাল আর হলুদ সিল্ক পর্দা ঝলমল করছে।

মোহন্তকে অভ্যর্থনা জানাতে সামনে এগুতে হবে, ফিসফিস করলো বোরিস। তাঁর নাম জালি হোরা। পালকির কাছাকাছি চলে এসেছ ওরা নাটকীয় ভঙ্গিতে। পর্দা সরিয়ে দীর্ঘকার এক ব্যক্তি মাটিতে পা রাখলেন।

রোয়েন ও টিসে সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে জমিনে হাঁটু গাড়ল, হাতজোড়া করলো বুকে। তবে নিকোলাস ও বোরিস নড়ল না। নিকোলাস বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে মোহন্ত বা প্রধান পুরোহিতের দিকে।

জালি হোরা কঙ্কাল বললেই হয়। তার আলখেল্লা ঢোলা হলেও তেমন লম্বা নয়, হাঁটুর নিচে পা, পাগড়ির মতো সুরু ও কালো, মোচড় খাওয়া পেশি ফুলে আছে, হাড়ের উপর ফুটে আছে আকা-বাঁকা শিরা। আলখেল্লাটা সবুজ ও সোনালি, তার উপর সোনার তৈরি সুতো দিয়ে নকশা করা হয়েছে, চকচক করছে আগুনের আভায়। মাথায় লম্বা হ্যাঁ, চূড়াটা সমতল, গায়ে এমব্রয়ডারি করা নক্ষত্র ও ক্রস চিহ্ন।

মোহন্তের মুখ গাছের শুকনো শিকড়ের সমষ্টি বলে মনে হবে, অসংখ্য ভাঁজ আর বালরেখা কলের ছাপ ফেলেছে। কুঞ্চিত ও ফাটা ঠোঁটের ভেতর এখনো কয়েকটা দাঁত অবশিষ্ট আছে, প্রত্যেকটি ভাঙাচোরা ও হলুদ। রূপালি-সাদা দাড়ি, চোয়ালে যেনো সাগর তীরের ফেনা জমে আছে। একটা চোখ পিকাল অপথ্যালমিয়ায় আক্রান্ত, অস্বচ্ছ নীল, সম্ভবত কিছুই দেখতে পান না; তবে অপর চোখ শিকারী চিতার মতোই তীক্ষ্ণ ও চকচকে।

চড়া, কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বললেন তিনি। আশীর্বাদ দিই; বাছাদের মঙ্গল হোক! কনুই দিয়ে নিকোলাসকে পুঁতো মারল বোরিস, দু জনেই ওরা সামান্য মাথা নত করলো। প্রধান পুরোহিত সুর করে গান করছেন বা মন্ত্র আওড়াচ্ছেন, তিনি থামলেই কোরাস ধরছে সমবেত পুরোহিতরা।

আশীর্বাদ পর্ব শেষ হতে এক একে চারদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাতাসে ক্রসচিহ্ন আঁকলেন মোহন্ত, এ সময় চারজন কিশোর চারটে রূপোর ধূপদানি ঘোরাতে শুরু করলো দ্রুতবেগে, সবগুলো থেকে ধূপ-ধুনার ধোঁয়া বের হচ্ছে।

এরপর মেয়ে দু জন মোহন্তের সামনে এসে হাঁটু গাড়ল। ওদের দিকে ঝুঁকলেন তিনি, রূপোর ক্রস দিয়ে হালকা ভাবে প্রত্যেকের গাল স্পর্শ করলেন সুর করে আওড়ালেন বিশেষ আশীর্বাদ।

ফিসফিস করলো বোরিস, লোকে বলে এঁর বয়েস একশো দশ বা তারও বেশি।

সাদা আলখেল্লা পরা দু জন তরুণ উপাসক আফ্রিকান কালো আবলুস কাঠের তৈরি একটা টুল বয়ে নিয়ে এলো, ডিজাইনটা এতো সুন্দর যে লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো নিকোলাস। ধারণা করলো, সম্ভবত কয়েক শতাব্দী ধরে মঠপ্রধানরা ওটা ব্যবহার করছেন। উপাসক দু জন জালি হোরার কনুই ধরল, ধীরে ধীরে যত্নের সঙ্গে বসিয়ে দিল তাঁকে টুলের উপর। এরপর পুরোহিতবৃন্দ ও সাধু সন্ন্যাসীরা ঘিরে বসলো তাকে, তাদের কালো মুখ তার দিকে উঁচু হয়ে আছে।

তাঁর পায়ের কাছে বসে আছে টিসে, স্বামীর কথা ইথিওপিয়ার অফিশিয়াল ভাষা অ্যামহারিক-এ অনুবাদ করছে। আপনাকে আবার অভ্যর্থনা জানাবার সুযোগ পেয়ে নিজেকে আমি ধন্য মনে করছি, হোলি ফাদার।

বৃদ্ধ প্রধান পুরোহিত মাথা ঝাঁকালেন। বোরিস আবার বলল, আমি বিশিষ্ট এক ভদ্রলোককে সেন্ট ফুমেনটিয়াস ভিজিট করাবার জন্য নিয়ে এসেছি। উনি আপনাকে, সন্তুষ্ট করবেন।

এ কি! প্রতিবাদ করলো নিকোলাস, কিন্তু দেখা গেল সাধু-সন্ন্যাসী আর পুরোহিতবৃন্দ প্রত্যাশায় চকচকে চোখ নিয়ে ওর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। অগত্যা বাধ্য হয়ে ফিসফিস করে প্রশ্ন করতে হলো, এখন কী করতে হবে আমাকে?

বুঝতে পারছেন না, এতোটা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কেন এসেছেন উনি? শয়তানি হাসি ফুটল বোরিসের ঠোঁটে, সে-ও ফিসফিস করছে উপহার চান! টাকা!

মারিয়া থেরেসা ডলার? জানতে চাইলো নিকোলাস, ইথিওপিয়ার এ মুদ্রা কয়েক শতাব্দী ধরে চলছে।

তা না হলেও ক্ষতি নেই। সময় বদলেছে, জালি হোরাকে এখন মার্কিন ডলার বা ব্রিটিশ পাউন্ড দিয়েও সন্তুষ্ট করা যায়।

কত?

আপনি বিশিষ্ট ভদ্রলোক। তাঁর উপত্যকায় শিকার করবেন। কমপক্ষে পাঁচশো ডলার।

ব্যাগ আছে খচ্চরের পিঠে, উঠে গিয়ে সেখান থেকে টাকা নিয়ে আসতে হলো নিকোলাসকে। ইতোমধ্যে হাত পেতেছেন পুরোহিতপ্রধান, তাতে নোটগুলো ধরিয়ে দিল ও।

হাসলেন মোহন্ত, ভাঙা ও হলুদ দাঁত বেরিয়ে পড়লো। তারপর তিনি কথা বললেন। অনুবাদ করলো টিসে, সেন্ট ফুমেনটিয়াস ও তিমকাত উৎসবে স্বাগতম। অ্যাবের তীরে আপনার শিকার অভিযান সফর হোক।

সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য খসে পড়লো। নড়েচড়ে বসলো সবাই, হাসাহাসি শুরু করলো। মোহন্ত বোরিসের দিকে তাকালেন, দৃষ্টিতে প্রত্যাশা। তাঁর কথা ভাষান্তর করলো টিসে, প্রধান পুরোহিত বলছেন, এতোটা পথ আসতে তাঁর গলা শুকিয়ে গেছে।

বুড়ো শয়তান ব্র্যান্ডি খেতে চাইছেন! হাসছে বোরিস হাঁক ছেড়ে ক্যাম্পবাটলারকে ডাকলো। একটু পরই ব্র্যান্ডির একটা বোতল মোহন্তের সামনে ক্যাম্প টেবিলে রাখা হলো, তার পাশেই থাকলো বোরিসের ভদকা। পরস্পরের স্বাস্থ্যপান করলো তারা। ব্র্যান্ডিতে কিছু মেশালেন না মোহন্ত, ঢোক গেলার পর সুস্থ চোখটা থেকে পানি বেরিয়ে এলো। বোতলটা অর্ধেক খালি করার পর খসখসে গলায় একটা প্রশ্ন করলেন, রোয়েনের দিকে তাকিয়ে।

টিসে বলল, ওইজিরো রোয়েন, উনি আপনাকে জিজ্ঞেস করছেন, ও আমার কন্যা, কে তুমি, কোত্থেকে এলে? মানবজাতির ত্রাণকর্তা যিশুর পথে কে তোমাকে নিয়ে এলো?

আমি একজন মিশরীয়, প্রাচীন ধর্মে বিশ্বাসী, জবাব দিল রোয়েন।

মাথা ঝাঁকাল মোহন্ত, পুরোহিতরাও সবাই প্রশংসাসূচক হাসি দিল। খ্রিস্টধর্মে সবাই আমরা ভাই-বোন, মিশরীয় ও ইথিওপিয়ানরা, মোহন্ত ওকে বললেন। এমন কি কপটিক শব্দটাও গ্রিক ভাষায় মিশরী। ষোলোশো বছরেরও বেশি দিন ধরে কায়রোর প্রধান গির্জার পুরোহিত ইথিওপিয়ার বিশপকে নিয়োগ দান করেছেন। ১৯৬০ ষালে সম্রাট হাইলে সেলাসি নিয়মটা বাতিল করেন। তবু আমরা সবাই যিশুর সত্যিকার পথ অনুসরণ করব। আপনাকে স্বাগতম, প্রিয় কন্যা।

ব্র্যান্ডির বোতল দ্রুত খালি হয়ে গেল। ইঙ্গিতে সেটা বোরিসকে দেখালেন মোহন্ত। বোরিস ইংরেজিতে বলল, শালার ব্যাটা এতো জায়গা পাচ্ছে কোথায় যে শুধু ঢেলেই চলেছে?

তার এ কথাও অনুবাদ করতে যাচ্ছিল টিসে, হঠাৎ খেয়াল হতে মাথাটা নিচু করে নিল সে। তারপর নিকোলাসের দিকে মুখ তুলে বলল, মোহন্ত জানতে চাইছেন, উপত্যকায় কি শিকার করতে চাইছেন আপনি?

নিজেকে শক্ত করলো নিকোলাস, তারপর জবাব দিল সাবধানে। অবিশ্বাসে দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলল না। নিস্তব্ধতা ভাঙলেন প্রধান যাজক, খলখল করে হেসে উঠলেন তিনি। দেখাদেখি বাকি সবাইও হাসতে শুরু করলো। ডিক-ডিক? আপনি ডিক-ডিক শিকার করতে এসেছেন? কিন্তু তাহলে মাংস পাবেন কোত্থেকে?

পাহাড় চূড়ায় দাঁড়ানো ডোরাকাটা ডিক-ডিকের একটা ফটো নিয়ে এসে তাঁর সামনে শ্যাম্প টেবিলের উপর রাখলো নিকোলাস। এটা সাধারণ কোনো ডিক-ডিক নয়। এটা একটা পবিত্র ডিক-ডিক। ইঙ্গিতে টিসেকে অনুবাদ করতে বলল ও। গল্পটা বলছি আমি।

ভালো একটা গল্প শোনার আশায় চুপ হয়ে গেল সবাই, এমন কি মোহস্তের হাতের গ্লাসও মাঝপথে থেমে গেছে। ওটা তিনি দ্বিতীয় বোতল থেকে ভরেছেন।

জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট খাদ্যের অভাবে মরুভূমিতে মারা যাচ্ছেন, শুরু করলো নিকোলাস। ত্রিশটা দিন ও ত্রিশটা রাত পেরিয়ে গেছে, এককণা খাবারও জোটেনি তাঁর। সেইন্টের নাম শুনে বুকে ক্রসচিহ্ন আঁকল কয়েকজন পুরোহিত। শেষে প্রভু তার ভৃত্যের প্রতি সদয় হলেন, ছোট একটা হরিণ আটকে দিলেন অ্যাকেইশা গাছের ডালে ও কাটায়। তারপর সেইন্টকে তিনি বললেন, তোমার জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করেছি, কাজেই তুমি মরবে না। এ মাংস নিয়ে খাও তুমি। জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট যখন ছোট্ট প্রাণীটিকে স্পর্শ করলেন, ওটার পিঠে তার আঙুলের ছাপ পড়ে গেল চিরকালের জন্য।

সবাই চুপ। এতোই প্রভাবিত হয়েছে যে চোখের পাতা ফেলতেও ভুলে গেছে।

ফটোটা আরেকবার প্রধান পুরোহিতকে দেখালো নিকোলাস। দেখুন, সেইন্টের আঙুলের ছাপ আছে।

ফটোটা সশ্রদ্ধভঙ্গিতে হাতে নিলেন জালি হোরা, ভালো চোখটার সামনে তুললেন। বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর বিস্মিত গলায় বললেন, কথাটা সত্যি! সেইন্টের আঙুলের ছাপ পরিষ্কারই চেনা যায় ফটোটা তিনি পুরোহিতদের দেখার জন্য নিলেন। প্রত্যেকে দেখলেন, এবং প্রধান পুরোহিতের মন্তব্য পুনরাবৃত্তি করলেন।

আপনারা কেউ এ প্রাণীটিকে দেখেছেন কখনো? উত্তরে এক এক করে সবাই মাথা নাড়লেন। পুরোহিতদের দেখা শেষ, এখন সেটা তরুণ উপাসকরা দেখছে।

হঠাৎ তাদের একজন তড়াক করে সোজা হলো, ফটো হাতে লাফাচ্ছে আর উত্তেজনায় চিৎকার করছে। আমি দেখেছি, দেখেছি আমি! যিশুর ফিরে, পবিত্র এ প্রাণীরূপে দেখা দিয়েছে আমাকে! খুবই কম বয়েস তার, কিশোরই বলতে হবে।

বাকি সবাই নিন্দা করছে তার, কেউ বিশ্বাস করতে রাজি নয়।

মাথামোটা ছেলে, মাঝে মধ্যে শয়তান ভর করে, অভিমান সুরে বললেন জালি হোরা, দুঃখে কাতর দেখালো তাকে। ওর কথায় গুরুত্ব দেবেন না। বেচারা তামের!

ইতোমধ্যে তামেরের হাত থেকে ফটোটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। উপাসকদের হাতে হাতে ঘুরছে সেটা, আর ফিরে পাবার জন্য ছুটাছুটি করছে সে। সবাই তার সঙ্গে কৌতুক করছে। কিন্তু তামের সাংঘাতিক উত্তেজিত, তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। বাধা দেওয়ার জন্য এগুলো নিকোলাস, দুর্বলচিত্তের এক কিশোরকে নিয়ে এ খেলাটা নিষ্ঠুর মনে হলো ওর। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে কিশোরের মনে কি ঘটল কে জানে, সটান পড়ে গেল সে জমিনের উপর, যেনো কেউ তার মাথায় মুগুরের বাড়ি মেরেছে। পিড়ানো ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গেল, হাত-পা মোচড় ও ঝাঁকি খাচ্ছে, চোখের মণি উল্টে গিয়ে অদৃশ্য হলো খুলির ভেতর, শুধু সাদা অংশটুকু দেখা যাচ্ছে, ঠোঁটের কোণ বেয়ে গড়িয়ে নামছে সাদা ফেনা।

তার কাছাকাছি নিকোলাস পৌঁছবার আগেই চারজন উপাসক চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গেল তাকে। রাতের অন্ধকারে তাদের হাসির শব্দ মিলিয়ে গেল। বাকি সবার আচরণ দেখে মনে হলো অস্বাভাবিক কিছু ঘটে নি। জালি হোরা ইঙ্গিতে একজন তরুণকে আবার গ্লাসটা ভরে দিতে বললেন।

বেশ দেরী করে বিদায় নিলেন জালি হোরা, কয়েকজনের সহায়তায়। অর্ধ সমাপ্ত ব্রান্ডির বোতলটা এক হাতে আঁকড়ে ধরে রাখলেন।

আপনার ওপর সে খুশি হয়েছে, ইংরেজ, বোরিস বলল। জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট এর গল্পটাতো বটেই, আপনার ডলার তার আরো বেশি পছন্দ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *