১. মরু থেকে চুপিসারে

দ্য সেভেন্‌থ স্ক্রৌল –উইলবার স্মিথ
অনুবাদ : মখদুম আহমেদ

উৎসর্গ

সিলেটের রিয়াদ আহমেদ এবং তাঁর প্রিয় বন্ধবী নীলাঞ্জনাকে

অঘ্রানের এক রাতে তোমার কক্ষে সমস্ত আয়োজন সেরে রেখেছিলে, আমি জানতাম–আমি জানতাম–তুমি চেয়েছিলে এমনই; অথচ দেখো, আমি নিজেই কেমন হয়ে গেলাম জড়সড়ো। বহু কথা বলছিলে তুমি; অনেক উপলক্ষ্য আমার সামনে দিয়ে অতি দীর্ঘ নদীর মতন বয়ে গেল। আমি ব্যর্থতাকে সঙ্গী করে তবু তাতে ভাসলাম না।

অক্লান্ত তুমি, অনেক বলে বলে শেষমেষ কী যেনো কী খুঁজে পেলে; জানতে চাইলে, সত্যি কী আমি মুটিয়ে গেছি? আমি তোমার অবয়বে এক মুহূর্তের সহস্রভাগের এক ভাগ সময় চোখ বুলিয়ে বলতে চাইলাম, বটে; ভুলে তা হয়ে গেল, না, যে! আমার সামনে অজস্র পাকা ধান; কী আশ্চর্য, ফসল তুলতে পারলাম না।

ভূমিকা

রিভার গড-এর বাংলা সংস্করণ প্রকাশের পর থেকে প্রচুর পাঠক, শুভানুধ্যায়ী, যারা ই-মেইল, ফোন বা পত্রের মাধ্যমে নিজেদের উচ্ছ্বাসের কথা জানিয়েছেন, তাদেরকে ধন্যবাদ। যতোটা না লেখক বা অনুবাদক, তার চেয়ে বেশি পাঠক আমি। বিদেশি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার স্বাদ নেওয়ার সময় বারবারই মনে হতো, প্রাচীন মিশরের পটভূমিতে যে প্রচুর সংখ্যক ঐতিহাসিক উপন্যাস আছে, তার একটা ঝলক বাংলায় আসা উচিত। ভয়ও ছিল, বিশাল কলেবর এবং কাহিনীর ধীরগতি হয়তো পাঠকের জন্য সুস্বাদু মনে হবে না। কিন্তু রিভার গড সেই ভয় দূর করেছে। আমি ভাগ্যবান–বাংলাদেশের পাঠক আমার রূপান্তর গ্রহণ করেছেন। উইলবার স্মিথের মিশরীয় পটভূমির উপন্যাসগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়, বিশ্বের বড় বড় সব কয়টি ভাষায় তা অনুবাদিত হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের জননী, আমার বাংলায় তা কেন হবে না–এ রকমই একটা জেদ থেকে উইলবারের সাহিত্য-দূত মার্টিন পিক সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। কাকতালীয় ব্যাপার, মার্টিন সাহেব ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে ছিলেন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের পক্ষে কাজ করতেন এ ঢাকায়। তার উৎসাহ, উইলবারের সমর্থন আমার আগ্রহ আরো বাড়িয়েছে।

আগে যেমন বলেছি, অনুবাদ সময় সাপেক্ষ এবং অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য কাজ। পেশাগত ব্যস্ততা অনেক সময়েই বাধ সাধে এ কর্মে, তারই ফলে বই প্রকাশে অপ্রত্যাশিত বিলম্ব। আগের মতোই বানানরীতি রইলো এখানেও, যদিও কাহিনীটি অনেকটাই ভিন্নতর।

যারা রিভার গড পড়ে জানতে চেয়েছেন টাইটার তারপর কী হলো, তাদেরকে কেবল এতোটুকু বলি, টাইটা কিন্তু এখনো বেঁচে আমি শুনেছি, এ মুহূর্তে বিশ্বের বেশ কয়টি দেশে তার নাম তালিকার এক নম্বরে আছে, গত আগস্ট মাস থেকেই।

কেমন লাগলো দ্য সেভেন্থ স্ক্রোল, জানার আগ্রহ রইলো।

ডা. মখদুম আহমেদ
ধানমন্ডী, ঢাকা
১৪ জুলাই, ২০০৮
.

মরু থেকে চুপিসারে চলে এলো গোধূলি, সারি সারি বালিয়াড়ি ঢাকা পড়ে গেল রক্ত-বেগুনি ছায়ায়। যেনো মোটা একটা মখমলের চাদরে চাপা পড়লো সমস্ত শব্দ, আর তাই কোমল প্রশান্তি আর মৌন নিস্তব্ধতার ভেতর বিষণ্ণ সন্ধ্যে ঘনালো।

বালিয়াড়ির চূড়ায়, যেখানে ওরা দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে থেকে মরুদ্যান আর মরুদ্যানকে ঘিরে থাকা ছোট্ট গ্রামটা পরিষ্কার দেখা যায়। প্রতিটি বাড়ির সাদা ছাদগুলো সমতল। গায়ে গায়ে, প্রচুর খেজুর গাছ, মুসলমানদের মসজিদ আর কপটিক খ্রিস্টানদের গির্জাগুলো শুধু ওগুলোর চেয়ে বেশি উঁচু। ধর্মীয় বিশ্বাসের দুই স্তম্ভ লেকের দু ধারে পরস্পরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে।

হ্রদের পানি গাঢ় হচ্ছে, দ্রুত ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ, তুলে এক ঝাঁক হাঁস, নলখাগড়া ঢাকা পাড়ের কাছাকাছি নামতে ছলকে উঠে জল।

বড়ো বিপরীত একটা জোড়া ওরা। ভদ্রলোক লম্বা, একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে; অস্তগামী সূর্যের শেষ আলো খেলা করছে রূপালি চুলে। তরুণী মেয়েটার বয়স কম, ত্রিশের কোঠায় হবে, ছিপছিপে, প্রাণচঞ্চল। ঘন, কোঁকড়া কালো চুলগুলো ঘাড়ের পেছনে এক করে বাঁধা।

চলো, ফিরে যাই, আলেয়া আমাদের অপেক্ষায় বসে আছে, তরুণীর দিকে তাকিয়ে সস্নেহে হাসলেন ভদ্রলোক। তাঁর প্রথম স্ত্রী বিগত হওয়ার পর একে বিয়ে করেছেন তিনি। জীবনের সমস্ত সুখ, আনন্দ যেনো ফিরিয়ে এনেছে ও। নিজের জীবন, কাজ সবকিছু নিয়ে দারুণ সন্তুষ্ট একজন মানুষ অধ্যাপক ডুরেঈদ।

তাঁর কাছ থেকে হঠাৎ করেই সরে গেল তরুণী। চুলের ফিতে খুলে দিয়ে বালিয়াড়ির ঢাল ধরে ছুটলো, খিলখিল শব্দে হাসছে।

খানিক দূর নামার পরই তাল হারিয়ে ফেললো সে, পড়ে গেল ঢালু পথের উপর। ওর পড়নের লম্বা পোশাক উপরে উঠে যেতে দৃশ্যমান হলো একজোড়া সুগঠিত বাদামি ঊরু।

বালিয়াড়ির মাথা থেকে হাসিমুখে তাকিয়ে রইলেন ডুরেঈদ। মাঝে-মধ্যে। একেবারে শিশুদের মতো আচরণ করে মেয়েটি। অন্যান্য সময়ে শান্ত, সৌম্য একজন তরুণী সে। ডুরেঈদ এখনো নিশ্চিত নন, ওর কোন ধরনের আচরণ তিনি

বেশি ভালোবাসেন। গড়িয়ে একবারে বালিয়াড়ির নিচে গিয়ে থামলো মেয়েটা; এখনো হাসছে, মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে লাগলো বালি।

এবারে তোমার পালা! চিৎকার করে ডুরেঈদের উদ্দেশ্যে বলল রোয়েন। বয়সের কারণে ডুরেঈদের শরীরে এখন আর সেই চঞ্চলতা নেই। ধীরে, বালিয়াড়ির ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এলেন তিনি। এক হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন স্ত্রীকে। চুমো খাওয়ার ইচ্ছেটা দমন করলেন অতি কষ্টে। বাড়ির বাইরে, এমন কী প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রতিও ভালোবাসা প্রকাশ করার আরবীয় রীতি নয় এটি।

অবিন্যস্ত পোশাক ঠিক-ঠাক করে চুল বেঁধে নিল রোয়েন। নলখাগড়ার ঝোঁপ ঘেঁষে, সেচের খালগুলোর উপর স্থাপিত নড়বড়ে সেতু পেরিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে হেঁটে চললো ওরা। ক্ষেতের কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে থাকা কৃষকের দল হাত উঁচিয়ে শুভেচ্ছা জানালো। দারুণ সম্মান করে তারা অধ্যাপক ডুরেঈদকে।

আস্সালামু আলাইকুম, ডক্টর!

জ্ঞানী লোকদের সম্মান দিতে জানে এরা। বিগত বছরগুলোয় ডুরেঈদ এবং তাঁর পরিবারের সদয় আচরণের জন্য একটু বেশিই ভালোবাসে তাঁকে। গ্রামের বেশিরভাগ অধিবাসীই মুসলমান, কিন্তু তিনি খ্রিস্টান–এটা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি তাদের শ্রদ্ধা প্রকাশে।

ভিলায় পৌঁছতে, বৃদ্ধা পরিচারিকা আলেয়া, বকুনি লাগালো ডুরেঈদ আর রোয়েনকে। সবসময় দেরি করো তোমরা! কেননা বাপু, একটু নিয়ম করে চললে ক্ষতি কী শুনি? এখানে আমাদের একটা সম্মান আছে!

বুড়ি মা, ঠিকই বলেছো, বিনয়ের সাথে বললেন ডুরেঈদ, তোমাকে ছাড়া যে আমাদের কী করে চলতো! অনুচ্চ স্বরে গজগজ করতে করতে রোয়েনকে অন্দরমহলে পাঠিয়ে দিল বুড়ি।

চাতালে বসে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া শেষ করলো ওরা জলপাই, আঙুর, রুটি আর ছাগ দুধের তৈরি পনির দিয়ে। আঁধার ঘনিয়েছে ততক্ষণে। মরুর নিস্তব্ধ আকাশে মিটমিট করছে তারার দল।

রোয়েন, প্রিয়তমা, টেবিলের ওপাশে বসা স্ত্রীর হাত ছুঁলেন ডুরেঈদ। চলো, কাজ শুরু করি। উঠে দাঁড়িয়ে, চাতালের উপরে নিজের স্টাডির উদ্দেশ্যে হেঁটে চললেন তিনি।

স্টাডিতে প্রবেশ করে, লম্বা স্টীল সেফের সামনে এসে দাঁড়ালো রোয়েন আল সিমা, হাতল ঘুরিয়ে কমবিনেশন লক খুলছে। গাদা গাদা প্রাচীন বই-পুস্তক আর রাশি রাশি গুটানো স্ক্রোল বা প্যাপিরাস রয়েছে স্টাডিতে, আরো রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন মূর্তি ও আর্টিফ্যাক্ট। এ সবই তাঁর সারাজীবনের সঞ্চয় ও সংগ্রহ। এতো কিছুর মাঝখানে স্টিলের সেফটা এ ঘরে মানায় নি।

ভারী স্টীলের দরজাটা খুলে যেতে এক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকলে রোয়েন। প্রাচীন এসব পুরানিদর্শন দিনের মধ্যে যতোবারই দেখুক, সশ্রদ্ধ ভয় ও বিস্ময় মেশানো একটা অনুভূতি অবশ করে দেয় ওকে।

সপ্তম স্ক্রোল, ফিসফিস করে বলল রোয়েন, ওটা ছোঁয়ার মুহূর্তে শক্ত হয়ে উঠলো পেশী। গুটানো প্যাপিরাসে লেখা সপ্তম লিপি প্রায় চার হাজার বছরের পুরানো, লিখে রেখে গেছে সময়কে জয় করে ইতিহাস ঠাই করে নেওয়া বিশাল এক প্রতিভা। সে বেঁচে ছিল কয়েক সহস্র বছর আগে, ধুলোয় মিশে নিঃশেষ হয়ে গেছে তার অস্তিত্ব, কিন্তু তার সম্পর্কে সব কথা জানার পর রোয়েন তাকে নিজের স্বামীর মতোই শ্রদ্ধা করতে শিখেছে। তার কথা চিরন্তন ও অবিনাশী, সেসব যেনো কবর থেকে স্পষ্ট উঠে আসে রোয়েনের কানে, ভেসে আসে স্বর্গীয় উদ্যান থেকে। খ্রিস্টপূর্ব আধ্যাত্মিক ত্রিতত্ত্বে বিশ্বাস করতো সে, সেই মহান ত্রয়ী–ওসিরিস, আইসিস আর হোরাস-এর প্রতি নিবেদিত প্রাণ ছিল। রোয়েন তার সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পায়। সেও সাম্প্রতিক একটা ট্রিনিটি অর্থাৎ ত্রিতত্ত্বে বিশ্বাসী, সেও পরম ঈশ্বর, ঈশ্বরপুত্র এবং পরমআত্মার প্রতি নিবেদিত প্রাণ।

স্ক্রোলটা লম্বা একটা টেবিল নিয়ে এলো রোয়েন, ওখানে আগেই কাজ শুরু করেছেন ডুরেঈদ। টেবিলের উপর তার সামনে ওটা রাখতে মুখ তুলে তাকালেন তিনি, মুহূর্তের জন্য তার চেহারায় শ্রদ্ধা মেশানো বিস্ময় ও সমীহ ফুটে উঠতে দেখলো রোয়েন। ও জানে, দু জনেরই এ একই অদ্ভুত অনুভূতি হয়। ডুরেঈদ চান স্ক্রোলটা সারাক্ষণ টেবিলেই থাকুক, এমন কী যখন ওটার কোনো প্রয়োজন নেই, তখনও। ক্রোলের ছবি আর মাইক্রোফিল্ম আছে, কাজ করতে কোনো অসুবিধে হয় না। তবু লেখাগুলো পরীক্ষা করার সময় প্রাচীন লেখকের অদৃশ্য উপস্থিতি যেনো তাঁর খুব দরকার।

তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে নির্লিপ্ত বিজ্ঞানী হয়ে উঠলেন ডুরেঈদ। আমার চেয়ে তোমার চোখ ভালো, রোয়েন, বললেন তিনি। দেখো দেখি, এ ক্যারেক্টারটা থেকে কী বুঝলে?

কয়েক মুহূর্ত মাথা ঘামানোর পর, ডুরেঈদের হাত থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা নিল রোয়েন, ওটার ভেতর দিয়ে তাকালো আবার।

দেখে মনে হচ্ছে, আমাদেরকে ধোকায় ফেলার জন্য টাইটা নিজের তৈরি আরেকটা গুপ্তলিপি ব্যবহার করেছে এখানে, বলল ও। বলার সুরে প্রাচীন লেখকের প্রতি আদর ও ভালোবাসা ফুটল, তবে তারই সঙ্গে কৃত্রিম একটু ক্ষোভও প্রকাশ পেল; সব মিলিয়ে ভাবটা যেনো বন্ধুটি এখনো বেঁচে আছে এবং সকৌতুক চালাকি করছে ওদের সঙ্গে।

তাহলে, মাথা খাঁটিয়ে ধাঁধার জবাব বের করতে হয়, দুরেঈদের কণ্ঠে উৎসাহ। প্রাচীন এ খেলাটা তাঁর খুব পছন্দ না হলে সারাজীবন লেগে থাকতে পারতেন না।

কাজে মগ্ন হয়ে পড়ে ডুরেঈদ এবং রোয়েন। ঠাণ্ডা রাতের প্রহর কাটে নিঃশব্দে। এ সময়টাই কাজ করতে পারে ওরা। কখনো ওরা ইংরেজিতে কথা বলে, কখনো আরবিতে; দুটো ভাষাতেই সমান দক্ষ। ফ্রেঞ্চ ওদের তৃতীয় ভাষা, তবে খুব কমই ব্যবহার করার দরকার পড়ে। দুজনেই ওরা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করেছে, মাতৃভূমি এ মিশর থেকে অনেক দূরে। মাতৃভূমি এ মিশর, এটা ক্রীতদাস টাইটার প্রিয় একটা প্রকাশভঙ্গি, স্ক্রোলে বহুবার ব্যবহার করেছে সে, উচ্চারণ করতে রোয়েনেরও খুব ভালো লাগে।

প্রাচীন এ মিশরীয়র সঙ্গে কত দিক থেকেই না বিচিত্র আত্মীয়তার সম্পর্ক অনুভব করে রোয়েন। সন্দেহ নেই, টাইটার সরাসরি বংশধরও যেহেতু কপটিক খ্রিস্টান, কাজেই ওর রক্তধারা প্রাচীন সেই ফারাও আর পিরামিড যুগ থেকে প্রবাহিত। আরবরা তো মিশর জয় করেছে সম্প্রতি, চোদ্দশো বছরও হয় নি।

গ্রামের শেষ মাথায় নিজ পরিবারে ফিরে গেছেন বৃদ্ধা আলেয়া, রাত দশটার দিকে নিজেই দু কাপ কফি বানালো রোয়েন। কফির কাপে চুমুক দেওয়ার সময় টুকটাক আলাপ হলো।

রোয়েনের কাছে, তার স্বামীর সাথে সম্পর্কটা বন্ধুর মতো, তাই এমন কোনো আলোচ্য বিষয় নেই, যা নিষিদ্ধ। ইংল্যান্ড থেকে আর্কিওলজিতে ডক্টরেট নিয়ে মিশরে ফেরার পর পরীক্ষা দিয়ে ডিপার্টমেন্ট অভ অ্যান্টিকুইটিজ-এ চাকরি পেয়েছে রোয়েন। ডুরেঈদ ওই বিভাগেরই পরিচালক।

ডুরেঈদ যখন মহৎ প্রাণের উপত্যকার কবর খনন করেন, রোয়েন তখন তার সহকারী হিসেবে ছিল। ওটা ছিল রানী লসট্রিস-এর সমাধি, খ্রিস্টের জন্মের সতেরো শ আশি বছর আগেকার।

সমাধির সমস্ত জিনিস প্রাচীনকালেই চুরি হয়ে গেছে, এটা দেখে হতাশ হন ডুরেঈদ। রোয়েনও খুব কাতর হয়ে পড়ে। থাকার মধ্যে আছে শুধু দেয়াল ও সিলিং ঢাকা দেয়ালচিত্র।

স্তম্ভের পেছনের দেয়ালে রোয়েনই তখন কাজ করছিল, যেখানে এককালে দাঁড়িয়ে ছিল ভাস্কর্যশিল্প–অলংকৃত ও শিলালিপিসমৃদ্ধ পাথুরে শবাধার; দেয়ালচিত্রের ছবি তুলছে ও। এ সময় একদিকের দেয়াল থেকে পলেস্তারা খসে পড়লো, বেরিয়ে পড়লো দশটা কুলঙ্গি বা দেয়ালে তৈরি ছোট খোপ। দেখা গেল দশটা কুলঙ্গিতে দশটা তেল চকচকে স্বচ্ছ পাত্র রয়েছে। প্রতিটি পাত্রে পাওয়া গেল একটা করে প্যাপিরাস। ক্ষয় ক্ষতি কিছু হলেও, প্রায় চার হাজার বছর পর আশ্চর্য অটুট অবস্থায় আজো টিকে আছে।

কি আশ্চর্য ও বিস্ময়কর কাহিনীই না বলা হয়েছে ওগুলোয়। শক্তিশালী ও সুদক্ষ শত্ৰু-বাহিনী আক্রমণ করলো একটা জাতিকে এবং যুদ্ধে ব্যবহৃত হলো ঘোড়া এবং ঘোড়ায় টানা রথ। এর আগে মিশরীয়রা ঘোড়া দেখে নি। হিকসস বাহিনীর দ্বারা পরাজিত ও বিধ্বস্ত নীলনদের আশীর্বাদপুষ্ট মানুষ পালাতে বাধ্য হলো। নেতৃত্ব দিল ওদের রাণী, রাণী লসট্রিস; বিশাল নদী অনুসরণ করে দক্ষিণ দিকে চলে এলো মিশরের অধিবাসীরা, চলে এলো প্রায় নদীর উৎসমুখে, ইথিওপিয় ভূখন্ডে, নির্দয় পাহাড়ি এলাকার গভীরে। এখানে, প্রবেশ নিষিদ্ধ পাহাড়শ্রেণির ভেতর, রাণী লসট্রিস ও তাঁর স্বামী মামোসের মমি করা দেহ সমাধির ভেতর সংরক্ষণ করলেন। ফারাও মামোস, যুদ্ধে হিকসস বাহিনীর হাতে নিহত হন।

বহু বছর পর রাণী লসট্রিস তাঁর প্রজাদের নিয়ে উত্তর অভিযানে বেরোন, আবার ফিরে আসেন মিশরে। এবার ওঁদের কাছে নিজস্ব ঘোড়া আর রথ আছে, দুর্গম আর নিষ্ঠুর আফ্রিকার প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে দক্ষ হয়েছে যোদ্ধারা, সুদীর্ঘ নদীর তীর ধরে প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের মতো ছুটে এসে হানাদার হিকসস বা রাখাল-রাজা বাহিনীকে প্রতিআক্রমণ করে বসলো মিশরীয় বাহিনী। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে হার হলো হিকসসের, তার কবল থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো আপার ও লোয়ার ঈজিপ্ট।

এ গল্প রোয়েনের অস্তিত্বের অণু-পরমাণুতে শিহরণ জাগায়। প্যাপিরাসে বৃদ্ধ ক্রীতদাসের আঁকা চিত্রলিপি বা হায়ারোগ্লিফের অর্থ ধীরে ধীরে একটু একটু করে উদ্ধার করে ওরা, আর প্রতি মুহূর্তে মুগ্ধ বিস্ময়ে রোমাঞ্চিত হতে থাকে ও।

কায়রোর মিউজিয়ামে, সারাদিন রুটিন কাজ করার পর এ ভিলায় রোজ রাতে স্ক্রোল নিয়ে বসে ওরা। দেখতে দেখতে কয়েক বছর কেটে গেছে, তবে নিষ্ঠা আর অধ্যবসায়ের ফলও পেয়েছে, দশটা ফ্রোলের পাঠোদ্ধার করা গেছে, বাকি আছে শুধু সপ্তম স্ক্রোল। এটি আসলে হেঁয়ালিতে ভরা, লেখক গূঢ় রহস্যময় সাঙ্কেতিক ভাষায় এমন সব ঘটনার কথা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করে গেছে যে এতো কাল পর কার সাধ্য অর্থ বের করে। নিজেদের কর্মজীবনে হাজার হাজার টেক্সট স্টাডি করেছে ওরা, কিন্তু সপ্তম স্ক্রোলে টাইটা এমন সব সিম্বল বা প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করেছে যা আগে কখনো ওদের চোখে পড়ে নি। এখন ওরা দু জনেই জানে যে টাইটা চেয়েছিল তার প্রিয় রাণী ছাড়া আর কেউ যেনো এর অর্থ করতে না পারে। মনোহারিনী রাণীকে দেওয়া এগুলো ছিল তার শেষ উপহার, যে উপহার রাণী সঙ্গে করে কবরে নিয়ে যাবেন।

দু জনের এক করা মেধা, কল্পনাশক্তি আর শ্রম কয়েক বছর ধরে কাজে লাগিয়ে অবশেষে একটা উপসংহারে পৌঁছতে যাচ্ছে ওরা। অনুবাদে এখনো অনেক ফাঁক রয়ে যাচ্ছে, কিছু অংশের পাঠ সঠিক হলো কিনা সন্দেহ আছে, তবে পাণ্ডুলিপির মূল কাঠামোটা এমন ভঙ্গিতে সাজিয়েছে ওরা যে তা থেকে বক্তব্যের সারমর্মটুকু বের করে নেওয়া সম্ভব।

এ মুহূর্তে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর মাথা নাড়ছেন ডুরেঈদ, যেমন আগেও বহুবার করেছেন তিনি। সত্যি আমি ভয় পাচ্ছি, বললেন। এটা বিশাল

একটা গুরু দায়িত্ব। বছরের পর বছর রাত জেগে যে জ্ঞান আমরা অর্জন করলাম, এটা নিয়ে কী করা হবে। এ যদি মন্দ কোনো লোকের হাতে পড়ে… কথা শেষ না করে চুমুক দিলেন আবার, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এমন কী আমরা যদি ভালো কোনো লোককেও দেখাই, প্রায় চার হাজার বছরের পুরানো এ গল্প সে কী সত্যি বলে বিশ্বাস করবে?

কাউকে দেখাবার দরকার কি? রোয়েনের কথায় সামান্য হলেও ক্ষোভ বা ঝাঁঝ প্রকাশ পেল। যা করার আমরা করলেই তো পারি। মাঝে মধ্যে এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা দিলে দুজনের মধ্যে পার্থক্যটা সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ডুরেঈদের বয়েস হয়েছে, কাজেই তিনি সতর্ক ও সাবধান। আর রোয়েনের আচরণে তারুণ্যের অস্থিরতা প্রকাশ পায়।

তুমি বুঝবে না, রোয়েন, বললেন তিনি। যখনই তিনি এ কথা বলেন, অস্বস্তি বোধ করে রোয়েন। আরব পুরোপুরি পুরুষদের জগৎ, মর্যাদার সমান ভাগ মেয়েদেরকে তারা এখনো দিতে শেখে নি। অথচ আরেক জগতের সঙ্গে পরিচয় আছে রোয়েনের, যেখানে মেয়েরা সমান মর্যাদা দাবি করে এবং পায়ও দান। হিসেবে নয়, অধিকার হিসেবে। দুই জগতের মাঝখানে আটকা পড়ে গেছে রোয়েন, পশ্চিমা জগৎ আর আরব জগৎ।

রোয়েনের মা ইংরেজ মহিলা, কায়রোর ব্রিটিশ দূতাবাসে কাজ করতেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ওর বাবা মিশরীয়, কর্নেল নাসেরের সরাসরি অধীনে একজন তরুণ অফিসার ছিলেন। পরস্পরকে ভালোবাসেন ওঁরা, তারপর বিয়ে করেন। যদিও ওদের দাম্পত্য জীবনটা সুখের হয় নি।

ওর মা চেয়েছিলেন তাঁর সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে ইংল্যান্ডের ইয়র্কে, নিজের জন্মস্থানে। চেয়েছিলেন জন্মসূত্রে তাঁর সন্তানের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব থাকা চাই। মা বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর মায়ের জেদে ইংল্যান্ডে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হতে হয় রোয়েনকে। তবে প্রতিটি দীর্ঘ ছুটি কায়রোয় বাবা ও চাচার সঙ্গে কাটিয়েছে ও। ওর বাবার বিস্ময়কর পদোন্নতি হয়, শেষ দিকে তিনি মোবারক মন্ত্রীসভার সদস্য হতে পেরেছিলেন। বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসত রোয়েন, বোধহয় সেজন্যই বাবা ও আরব সমাজের প্রভাব বেশি পড়ে ওর উপর। বাল্য ও কৈশোর কাল বেশির ভাগটাই মায়ের সঙ্গে ইংল্যান্ডে কাটালেও মা বা পশ্চিমা সমাজের প্রভাব ওর উপর খুব কম।

কপটিক সমাজের ঐহিত্য হলো গুরুজনরা মেয়ের পাত্র ঠিক করবেন। মৃত্যুর আগে রোয়েনের বাবা তার জন্য পাত্র ঠিক করে দিয়েছিলেন। মনের গভীরে আপত্তি থাকলেও মৃত্যুপথযাত্রী বাবার শেষ ইচ্ছে রক্ষা করেছিল সে।

তবে ডুরেঈদের সঙ্গে ওর দাম্পত্য-জীবন সুখের হয় নি এ কথা বলা যাবে না। শুধু যদি ভালোবাসার ব্যাপারে কোনো অভিজ্ঞতা ওর না থাকতো, রোয়েন জানে, অত্যন্ত সুখের হতো ওর জীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ডেভিড বলে এক তরুণের প্রেমে পড়েছিল সে।

ভালোই চলছিল রোয়েনের জীবন। হঠাৎ একদিন নিজের বাপ-মায়ের কথা মেনে তাদেরই নির্বাচিত এক সুন্দরীর সঙ্গে বিয়ে বসে ডেভিড। ভেঙে যায় ওদের সম্পর্ক।

ডুরেঈদকে রোয়েন সম্মান করে, পছন্দও করে। শুধু কখনো কখনো গভীর রাতে ওর মনে হয়, সমর্থ কোনো তরুণ হয়তো আরো অনেক বেশি শারীরিক সুখ দিতে পারতো ওকে।

ডুরেঈদ আবার কথা বলছেন। মন্ত্রীর সঙ্গে আবার আমি কথা বলেছি, কিন্তু তিনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন বলে মনে হয় না। সম্ভবত নাহুত তাকে বুঝিয়েছে যে, আমি একটু পাগলাটে। বিষণ্ণ হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। নাহুত গাদ্দাবি তাঁর ডেপুটি, অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী তরুণ, মন্ত্রীসভায় ও প্রশাসনে তার আত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যা অনেক। মিনিস্টার আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন, ফাণ্ড পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। কাজেই আমাকে দেখতে হবে বাইরে থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়া যায় কিনা। সম্ভাব্য স্পনসর হিসেবে তালিকায় চারটি নাম রেখেছি। প্রথমেই বলা যেতে পারে গেটি মিউজিয়ামের কথা, কিন্তু বিশাল ও নিষ্পণ কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে কখনোই আমার ভালো লাগে নি। একা একজন লোকের সাহায্য পেলে খুশি হই। সিদ্ধান্তে আসাটা তাহলে সহজ হয়। এসব কিছুই নতুন নয়:রোয়েনের কাছে, তবু এ দিয়েই শুনছে ও।

তারপর ধরো, হের ফন শিলার। তার টাকা আছে, এ বিষয়ে আগ্রহও আছে, কিন্তু তাঁকে আমি এতো ভালোভাবে চিনি না যে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারি।

আর আমেরিকান ভদ্রলোক? তিনি তো বিখ্যাত একজন কালেক্টর।

পিটার ওয়ালশের সঙ্গে কাজ করা অত্যন্ত কঠিন। নিজের ভাগ বাড়াবার দিকে এতো বেশি ঝোঁক তার, তাঁকে আমার রাক্ষস বলে মনে হয়। সত্যি ভয় পাই।

তাহলে বাকি থাকলো কে? তালিকার প্রথম নামটা?

ডুরেঈদ জবাব দিলেন না, কারণ উত্তরটা দু জনেরই জানা। ওঅর্ক টেবিলের দিকে তাকালেন তিনি, জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে কত সাধারণ আর নগণ্য। পুরানো একটা প্যাপিরাস স্ক্রোল, কয়েকটা ফটোগ্রাফ আর নোট বুক, একটা কম্পিউটার প্রিন্ট আউট। বিশ্বাস করা কঠিন মন্দ লোকের হাতে পড়লে এ সামান্য কয়টা জিনিস কী বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।

তারপর হেসে উঠলেন। আমি বোধহয় একটু বেশি ভয় পাচ্ছি। হয়তো রাত জেগে কাজ করার প্রতিক্রিয়া। চলো, কাজে ফিরে যাই আবার? আগে পাজি বুড়ো টাইটার পুরো বক্তব্য অনুবাদ করি, তারপর অন্যান্য বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যাবে, কী বলো?

সামনের স্তূপ থেকে উপরের ফটোটা হাতে নিলেন। স্ক্রোলের মাঝখানের অংশ দেখানো হয়েছে এতে। ভাগ্যই খারাপ, তা না হলে ঠিক এ জায়গার প্যাপিরাস ভেঙে খসে পড়বে কেন। চোখে চশমা পরলেন। পড়ছেন রোয়েনকে শোনাবার জন্য।

সিঁড়ে বেয়ে হাপির ঠিকানায় পৌঁছতে হলে অনেকগুলো ধাপ নামতে হবে। কঠিন পরিশ্রম আর অনেক চেষ্টার পর দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছলাম আমরা। তারপর আর এগুলাম না, কারণ এখানেই রাজকুমার একটা দৈববাণী পেল। স্বপ্নের ভেতর তার বাবা, মৃত দেবতা ফারাও, দেখা দিলেন তাকে এবং জানালেন, দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এ জায়গাতেই আমি অনন্তকাল বিশ্রাম নিব।

চোখ থেকে চশমা খুলে রোয়েনের দিকে তাকালেন ডুরেঈদ। দ্বিতীয় ধাপ, বললেন তিনি।

অন্তত এ একবার স্পষ্ট একটা বর্ণনা দিয়েছে টাইটা। সে তার স্বভাবসুলভ হেঁয়ালি এখানে ব্যবহার করে নি।

এসো, স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফগুলো দেখি, বলল রোয়েন, গ্লসি শিটগুলো নিজের দিকে টেনে নিল। টেবিল ঘুরে ওর পেছনে এসে দাঁড়ালেন ডুরেঈদ। একটা গিরিখাদে ওরা বাধা পেল। খাদের ভেতর স্বাভাবিক বাধা কী হতে পারে? খানিক পরপর নদীর তলায় ঢাল থাকতে পারে, স্রোত ওখানে প্রবল হবে। কিংবা একটা জলপ্রপাত থাকতে পারে। ওটা যদি দ্বিতীয় জলপ্রপাত হয়, তাহলে এ জায়গায় ছিল ওরা- স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফের এক জায়গায় আঙুল ঠেকালো রোয়েন। ওখানে বিশাল দুই পাহাড়ের মাঝখানে সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়েছে সরু একটা নদী।

হঠাৎ মনোযোগ ছুটে গেল রোয়েনের, মাথা তুললাম। শুনছ? গলার স্বর বদলে গেছে, তীক্ষ্ণ ও সতর্ক শোনাল।

কী? ডুরেঈদও মুখ তুললেন।

কুকুর, বলল রোয়েন।

ওই ব্যাটা দোআঁশলাটা, বললেন ডুরেঈদ, ঘেউ ঘেউ করে রাতটাকে ভৌতিক করে তোলে। ওটাকে আর না তাড়ালেই নয়।

হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। অন্ধকার ঘরে বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল ওরা। পেছন দিকে পাম গাছের তলায় শেডের ভেতর জেনারেটরের নরম শব্দ থেমে গেছে। মরু রাতের স্বাভাবিক অংশ হয়ে ওঠায় শুধু থেমে গেলে ওটার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে ওরা।

চাতালের দরজা দিয়ে তারার অস্পষ্ট আলো ঢুকছে ভেতরে। উঠে গিয়ে দরজার পাশের একটা শেলফ থেকে তেল ভরা ল্যাম্পটা নামালেন ডুরেঈদ, জ্বলার পর চেহারায় কৃত্রিম বা সকৌতুক হতাশা ফুটিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালেন। যাই, দেখে আসে…

ডুরেঈদ, বাধা দিল রোয়েন, কুকুরটা!

কয়েক সেকেন্ড কান পেতে শোনার পর একটু উদ্বিগ্ন দেখালো ডুরেঈদকে। কুকুরটা একদম চুপ মেরে গেছে। ও কিছু না, বলে দরজার দিকে এগুলেন তিনি।

তেমন কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ পেছন থেকে ডাক দিল রোয়েন, ডুরেঈদ, সাবধান কিন্তু!

গুরুত্ব না দেওয়ার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালেন ডুরেঈদ, বেরিয়ে এলেন চাতালে।

বাইরে একটা ছায়া নড়তে দেখলো রোয়েন, ভাবল বাতাসে মাচার উপর কোনো লতা বা ডাল দোল খাচ্ছে। তারপর ওর খেয়াল হলো, রাতটা একদম স্থির, এতোটুকু বাতাস বইছে না। এ সময় লোকটাকে দেখতে পেল, ফ্ল্যাগস্টোনের উপর দিয়ে দ্রুত ও নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। মাছ ভর্তি পুকুরটা পাকা চাতালের মাঝখানে, ওটাকে ঘুরে এগুচ্ছেন ডুরেঈদ; লোকটা তার পেছন দিকে চলে আসছে।

ডুরেঈদ! রোয়েনের চিৎকার শুনে দ্রুত আধ পাক ঘুরলেন ডুরেঈদ, উঁচু করলেন ল্যাম্পটা।

কে তুমি? গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। এখানে কী চাও?

আগন্তুক নিঃশব্দে তাঁর কাছে চলে আসছে। গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা আলখেল্লা ফুলে উঠছে পায়ের চারপাশে, এক প্রস্থ কাপড়ে মাথাটা ঢাকা। ল্যাম্পের আলোয় ডুরেঈদ দেখলেন মাথার সাদা কাপড়ের একটা প্রান্ত মুখের উপর নামিয়ে এনে লোকটা তার চেহারা ঢেকে রেখেছে।

লোকটা রোয়েনের দিকে পেছন ফিরে রয়েছে, তার হাতের ছুরিটা তাই দেখতে পায় নি ও। তবে ডুরেঈদের পেট লক্ষ্য করে ছোরা মারার ভঙ্গিটা চিনতে পারল। ব্যথায় কাতরে উঠলেন ডুরেঈদ, কুঁজো হয়ে গেলেন। আততায়ী ছুরিটা বের করে নিয়ে আবার ঢোকালো, তবে এবার ল্যাম্প ফেলে দিয়ে তার হাতটা ধরে ফেললেন ডুরেঈদ।

খসে পড়া ল্যাম্পের শিখা দপদপ আওয়াজ করছে। আলো ও ছায়ার ভেতর ধস্তাধস্তি করছে দু জন। রোয়েন দেখতে পেল ডুরেঈদের সাদা শার্টের সামনের দিকটায় গাঢ় একটা দাগ ছড়িয়ে পড়ছে।

দৌড় দাও! চিৎকার করছেন ডুরেঈদ। যাও, রোয়েন, যাও! লোকজনকে ডাকো! ওকে আমি ধরে রাখতে পারছি না! রোয়েন জানে ডুরেঈদ নেহাতই শান্তশিষ্ট একজন ভদ্র মানুষ, জীবনের বেশিরভাগ সময় ঘরে বসে বইপত্র নিয়ে কাটিয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে লোকটার সঙ্গে তিনি পারছেন না।

যাও, রোয়েন, যাও! প্লিজ, নিজেকে বাঁচাও! গলার আওয়াজই বলে দিল রোয়েনকে, ডুরেঈদ দুর্বল হয়ে পড়েছেন, তবে এখনো তিনি আততায়ীর ছুরি ধরা হাতটা ছাড়েন নি।

আতঙ্কে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল রোয়েন, হঠাৎ সংবিৎ ফিরে ছুটলো দরজার দিকে। চাতালে বেরিয়ে এলো বিড়ালের মতো ক্ষিপ্র বেগে। আততায়ীকে ডুরেঈদ আটকে রেখেছেন, লোকটা যাতে রোয়েনের পথ আগলাতে না পারে।

নিচু পাঁচিল টপকে ঝোঁপের মাঝখানে নামলো রোয়েন, প্রায় সেঁধিয়ে গেল দ্বিতীয় লোকটার আলিঙ্গনের ভেতর। তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে মোচড় খেলো, ছিটকে সরে গিয়ে ছুটলো আবার লোকটার লম্বা করা হাতের আঙুল আঁচড় কাটলো ওর মুখে। নিজেকে প্রায় ছাড়িয়ে নিয়েছে রোয়েন, এ সময় আঙুলগুলো বাঁকা হয়ে আটকে গেল গলার কাছে ওর সুতি ব্লাউজে।

একবার লোকটার হাতে ছুরি দেখতে পেল রোয়েন, তারার আলো লেগে ঝিক করে উঠলো রূপালি একটা লম্বা আকৃতি। ওটা দেখামাত্র মৃত্যু ভয় নতুন শক্তি যোগাল ওকে। ফড় ফড় করে ছিঁড়ে গেল কামিজ, নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটছে রোয়েন-তবে তারপরও একটু দেরি হয়ে গেছে ওর ছুরির ফলাটাকে পুরোপুরি এড়াতে পারলো না। বাহুর উপর দিকটা চিরে গেছে, বুঝতে পেরে বাঁচার আকুলতা আরো তীব্র হয়ে উঠলো, সমস্ত শক্তি এক করে লোকটাকে লাথি মারল রোয়েন। লাগলো শরীরের নিচের দিকে নরম কোথাও, তবে ঝাঁকি খেলো ওর গোড়ালি আর হাঁটু। লোকটা গুঁড়িয়ে উঠে হাঁটু গাড়ল মাটিতে।

পাম বীথির ভেতর দিয়ে ছুটছে রোয়েন। প্রথম দিকে খেয়াল থাকলো না কোনো দিকে যাচ্ছে বা কী উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। ছুটছে যতক্ষণ শক্তিতে কুলায় দূরে সরে যাবার চেষ্টায়। তারপর ধীরে ধীরে আতঙ্কটা নিয়ন্ত্রণে আনল। ঝট করে পেছন দিকে তাকালো, কেউ ওর পিছু নেয় নি। লেকের কিনারায় পৌঁছে ছোটার গতি কমাল, বুঝতে পারছে তা না হলে হাঁপিয়ে যাবে। অনুভব করলো কাঁধের নিচে বাহু থেকে গরম রক্ত গড়াচ্ছে, হাত বেয়ে নেমে এসে আঙুলের ডগা থেকে ঝড়ে পড়ছে টপ টপ করে।

থামলো রোয়েন, বসে হেলান দিল একটা পাম গাছে। এক ফালি কামিজ ছিঁড়ে বাহুর ক্ষতটা বাঁধল, অক্ষত হাতটা এতো বেশি কাঁপছে যে কাজটা শেষ করতে অনেক সময় লাগলো। বাম হাত দাঁত দিয়ে ধরে গিট বাঁধল ব্যান্ডেজে, এখন আর আগের মতো রক্ত বের হচ্ছে না। কোনো দিকে যাবে বুঝতে পারছে না রোয়েন। এদিক ওদিক তাকাতে একটা জানালো দেখতে পেল, ভেতরে ল্যাম্প জ্বলছে। কাছাকাছি সেচ খালটার পাশে ওটা আলেয়ার ঘর, চিনতে পারলো ও। উঠে দাঁড়িয়ে সেদিকেই এগুলো।

একশো কদমও এগোয় নি, শুনতে পেল পাম বীথির ভেতর কে যেনো কাকে আরবিতে বলছে, ইউসুফ, মেয়েলোকটা তোমার এদিকে আসে নি তো?

সঙ্গে সঙ্গে রোয়েনের সামনের অন্ধকারে একটা টর্চ জ্বলে উঠলো, শোনা গেল আরেক লোকের গলা, না, এদিকে আসে নি।

ভাগ্যক্রমে সামনের লোকটার হাতে গিয়ে পড়ে নি রোয়েন। ঝপ করে বসে পড়লো, মরিয়া হয়ে চারদিকে তাকিয়ে পালাবার পথ খুঁজছে। ওর পেছনের পাম বীথির ভেতর থেকে আরেকটা টর্চের আলো এগিয়ে আসছে, ওর ফেলে আসা পথ ধরে। নিশ্চয়ই এ লোকটাকেই লাথি মেরেছিল, তবে এরই মধ্যে আঘাতটা সামলে নিয়েছে।

দু দিকে বাধা, কাজেই লেকের দিকে ফিরে এলো রোয়েন। রাস্তাটাও ওদিকেই। এতো রাতে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, তবে ঈশ্বর চাইলে ত্রাণকর্তা হিসেবে পেয়েও যেতে পারে কাউকে। ছুটতে গিয়ে আছাড় খেলো রোয়েন, হাঁটুর চামড়া উঠে গেল, লাফ দিয়ে সোজা হয়ে আবার ছুটলো।

দ্বিতীয়বার আছাড় খাবার পর হাতে ঠেকল কমলালেবু সাইজের একটা পাথর। আবার ছোটার সময় মুঠোয় থাকলো ওটা, অস্ত্র হিসেবে খানিকটা অভয় দিচ্ছে ওকে।

বাহুর ক্ষমতা ব্যথা করছে। ডুরেঈদের কথা ভেবে কান্না পাচ্ছে। তার আঘাত যে গুরুতর, ও জানে। বাঁচবে তো? যেভাবে হোক ডুরেঈদের কাছে সাহায্য নিয়ে ফিরতে হবে ওকে। ওর পেছনে পাম বীথির ভেতর টর্চ নিয়ে খোঁজাখুঁজি করছে লোক দু জন। ক্রমশ এদিকেই এগিয়ে আসছে তারা। খানিক পর পর পরস্পরের সাড়া নিচ্ছে।

একটা নালা থেকে অবশেষে রাস্তার উপর উঠে এলো রোয়েন। বোধ হয় স্বস্তি পাওয়াতেই পা দুটো কাঁপতে শুরু করলো, মনে হলো এ পা নিয়ে আর হাঁটতে পারবে না। তবু চেষ্টা করলো রোয়েন। গ্রামের দিকে ঘুরলো ও। হাঁটা শুরু করছে, তবে প্রথম বাঁকে এখনো পৌঁছায় নি। এ সময় গাছপালার আড়াল থেকে ধীরগতিতে এগিয়ে আসতে দেখলো একজোড়া হেডলাইটকে। রাস্তার মাঝখান ধরে গাড়িটার দিকে ছুটল রোয়েন। বাঁচান! আরবিতে চিৎকার করছে। সাহায্য করুন, প্লিজ!

বাঁক ঘুরলো গাড়িটা। হেডলাইটের আলো চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার আগে রোয়েন দেখলো গাঢ় রঙের ছোট একটা ফিয়াট ওটা। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারকে থামানোর জন্য হাত নাড়ছে ও, হেডলাইটের আলোয় রাস্তাটাকে মনে হচ্ছে

থিয়েটারের স্টেজ। সামনে থামলো ফিয়াট, ছুটে পাশে চলে এলো রোয়েন, দরজার হাতল ধরে টান দিল।

প্লিজ, বাঁচান! ওরা…

দরজা খুলে গেল, লাফ দিয়ে নিচে নেমে রোয়েনের আড়ষ্ট ডান হাতটা খপ করে ধরে ফেললো ড্রাইভার। হ্যাঁচকা টানে ব্যাক ডোরের দরজা খুলল সে। ইউসুফ! বশিত! পাম বীথির দিকে মুখ ঘুরিয়ে ডাক দিল। মেয়েটাকে পেয়েছি! ইউসুফ আর বশিত সাড়া দিচ্ছে, শুনতে পেল রোয়েন। দেখলো টর্চের আলো ঘুরে গিয়ে এদিকেই সরে আসছে দ্রুত।

ওর ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে ওকে নত করার চেষ্টা করছে ড্রাইভার,গাড়ির ব্যাক সীটে ঢোকাতে চায়। হঠাৎ খেয়াল হলো রোয়েনের, বাম হাতের মুঠোয় পাথরটা এখনো আছে। একটু ঘুরলো ও, শক্ত করলো পেশী, মুঠোয় ধরা পাথরটা সজোরে ঠুকে দিল লোকটার মাথার পাশে। শেষ মুহূর্তে খুলি বাঁচাবার চেষ্টা করলো। সে ফলে পাথরটা গুঁড়িয়ে দিল তার কপালের হাড়। বিনা প্রতিবাদে রাস্তার উপর ঢলে পড়লো লোকটা, তারপর আর নড়ল না।

পাথরটা ফেলে দিয়ে আবার ছুটছে রোয়েন। হঠাৎ খেয়াল হলো, হেডলাইটের তৈরি আলোর পথ ধরে ছুটছে সে, তার প্রতিটি নড়াচড়া আলোকিত। পাম বীথি থেকে বেরিয়ে এসে ওর পিছু নিয়েছে অপর দু লোক, চিৎকার করে কী যেনো বলছে তারা। পেছন দিকে তাকাতে রোয়েন দেখলো, দ্রুত কাছে চলে আসছে খুনীরা। বুঝতে পারল, বাঁচার একমাত্র উপায় অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া। ঘুরে রাস্তার কিনারায় চলে এলো, ঢাল বেয়ে তর তর করে নামছে। নামার গতি নিয়ন্ত্রণে থাকলো না, লেকের কোমর সমান পানিতে চলে এলো রোয়েন। আতঙ্ক ও অন্ধকারে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল, বুঝতে পারে নি রাস্তার পাকে লেকের কাছে চলে এসেছে। এখন আর ঢাল বেরিয়ে রাস্তায় ওঠার সময় নেই। তবে মনে পড়লো, সামনে প্যাপিরাস আর নল খাগড়া আছে, লুকানোর জায়গা পাওয়া যেতে পারে।

লেকের গভীরে চলে এলো রোয়েন, পায়ের নিচে মাটি পাচ্ছে না। সাঁতরাচ্ছে ও। গলায় ওড়নাটা নেই, কোথায় খসে পড়েছে বলতে পারবে না। কামিজ আর সালোয়ার খুব বেশি ঢোলা হওয়ার সাঁতার কাটতে অসুবিধে হচ্ছে। পানির উপর থাকা নিরাপদ নয় মনে করে কিছুক্ষণ ডুব সাঁতার দিল। সন্দেহ নেই, ইতোমধ্যে রাস্তার কিনারায় পৌঁছে লেকের দিকে তাকিয়ে আছে লোকগুলো।

মাথার উপর নল খাগড়া ঝোঁপ পেয়ে থামলো রোয়েন। আরো খানিকটা ভেতরে সরে এলো। পানির উপর শুধু নাকটা তুলে রেখেছে, মুখটা রাস্তার উল্টো দিকে ফেরানো। রোয়েন জানে ওর কালো চুলে টর্চের আলো প্রতিফলিত হবে না।

কান দুটো পানির নিচে থাকলেও রাস্তার উপর থেকে লোকগুলোর জোরালো গলা শুনতে পাচ্ছে রোয়েন। কিনারায় দাঁড়িয়ে নল খাগড়ার উপর টর্চের আলো ফেলছে, খুঁজছে ওকে। একবার টর্চের আলো ওর মাথার চারপাশে ঘোরাফেরা করলো, ডুব দেওয়ার জন্য বড় করে শ্বাস নিল রোয়েন। তবে না, আলোটা সরে গেল।

মাথা একটু তুললাম রোয়েন, কান দুটো পানির উপর উঠে এলো। লোকগুলো আরবিতে কথা বলছে। যে লোকটার নাম বশিত তার গলা চিনতে পারল। মনে হলো সে ওদের লীডার, কাকে কী করতে হবে বলে দিচ্ছে। ইউসুফ, যাও, বেশ্যাটাকে তুলে আনেনা।

ঢাল বেয়ে নেমে আসার আওয়াজ পেল রোয়েন। ছপ ছপ শব্দ তুলে পানিতে নামলো ইউসুফ। আরো সামনে, রাস্তা থেকে বলল বশিত। ওদিকে, নল খাগড়ার ভেতর, আমি যেখানে টর্চের আলো ফেলছি।

পানি ওদিকে অনেক গভীর। কেউ আমরা সাঁতার জানি না। তুমি না।

ওই তো, তোমার ঠিক সামনে। নল খাগড়ার ভেতর। আমি ওর মাথা দেখতে পাচ্ছি। বশিত উৎসাহ দিল তাকে। ধরা পড়ে গেছে, বুঝতে পেরে যতটা সম্ভব পানির নিচে মাথা নামালো রোয়েন।

চারদিকে প্রচুর পানি ছিটিয়ে ওর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ইউসুফ। অকস্মাৎ আল্লাহ রে, আল্লাহ বলে চিৎকার দিল সে, ঘুরে উঁচু পাড়ের দিকে পালাচ্ছে। কিছু না, নল খাগড়ার ভেতর থেকে এক ঝাঁক হাঁস ভয় পেয়ে সশব্দে ডানা মেলেছে আকাশে। রাস্তা থেকে বশিত হুমকি-ধামকি দিলেও কাজ হলো না, ইতোমধ্যে ঢালের উপর উঠে পড়েছে ইউসুফ, সে আর পানিতে নামতে রাজি নয়। ঢাল বেয়ে রাস্তায় উঠেছে সে, বলল, আসল গুরুত্ব স্কোলের, মেয়েটার তেমন গুরুত্ব নেই। স্ক্রোল ছাড়া টাকা পাওয়া যাবে না। মেয়েটাকে পরে কোথায় পাওয়া যাবে জেনে নিতে পারব।

রাস্তার কিনারা থেকে গাড়ি কাছে ফিরে গেল লোকগুলো। উঠে বসলো সবাই, গ্রামের দিকে চলে গেল গাড়ি। তারপরও ভয়ে পানি থেকে উঠছে না রোয়েন, ভাবছে অন্ধকার রাস্তায় ওরা কাউকে পাহারায় রেখে গেছে কিনা। খানিক পর ঠাণ্ডায় কাঁপুনি ধরে গেল, পানি থেকে না উঠলে মারা যেতে পারে। কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না, শরীরে শক্তি আছে বলেও মনে হলো না। মরি মরব, দিনের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত পানি ছেড়ে আমি উঠব না।

এবাবে আরো বেশ কিছুক্ষণ কাটল। আগুনের আভায় আকাশটাকে রাঙা হয়ে উঠতে দেখলো রোয়েন। পাম গাছগুলোর ভেতর কমলা রঙের শিখাও মাঝে মধ্যে দেখা যাচ্ছে। কী ঘটছে বুঝতে পেরে নিজের নিরাপত্তার কথা ভুলে গেল রোয়েন। কীভাবে শক্তি ফিরে পেল বলতে পারবে না, লেকের পাড়ে উঠে এসে কাদায়

দাঁড়িয়ে থাকলো। ঠক ঠক করে কাঁপছে, ভেজা চুলের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে, পানি গড়াচ্ছে চোখ দুটো থেকে।

ভিলায় আগুন দিয়েছে ওরা! বিড়বিড় করলো রোয়েন। ডুরেঈদ! ওহ্ গড, প্লিজ! নো, নো!

ঢাল বেয়ে উঠলো রোয়েন, জ্বলন্ত বাড়িটার দিকে ছুটছে।

*

শেষ বাঁকটা ঘোরার আগেই হেডলাইট আর ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল বশিত, ভিলার চালু ড্রাইভওয়ে ধরে গড়িয়ে এসে চাতালের নিচে থামলো ফিয়াট। পাথুরে ধাপ বেয়ে তিনজনই তারা চাতালে উঠে এলো। বশিত যেখানে ফেলে গেছে সেখানেই পুকুরের পাশে পড়ে রয়েছেন ডুরেঈদ। সেদিকে একবারও না তাকিয়ে পাশ কাটালো তারা, সরাসরি স্টাডিরূপে ঢুকলো। নাইলনের সস্তা টোট ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখলো বশিত। এরই মধ্যে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এবার তাড়াতাড়ি কাজ সারো।

দোষটা ইউসুফের, ফিয়াটের ড্রাইভার কথা বলছে, সে-ই তো মেয়েটাকে পালাতে দিল।

রাস্তায় তুমিও একটা সুযোগ পেয়েছিলে, খেঁকিয়ে উঠলো ইউসুফ। কিছু করতে পারো নি।

থামো! দু জনকেই ধমক দিল বশিত। টাকা পেতে চাইলে কোনো ভুল করা চলবে না। টর্চের আলোয় টেবিলে পড়ে থাকা স্ক্রোলটা দেখালো সে। এটাই সেটা। নিশ্চতভাবেই জানে, চিনতে পারার জন্য ক্রোলের ফটোগ্রাফ দেখানো হয়েছে তাকে। প্রতিটি জিনিস চেয়েছে ওরা–প্রতিটি ম্যাপ আর ফটো। কাগজপত্র, বই, কিছুই রেখে যাওয়া চলবে না। দ্রুত হাতে টেবিলের সমস্ত জিনিস টোট ব্যাগে ভরে ফেলা হলো। বশিত বলল, এবার ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে হয়। নিয়ে এসো তাকে।

চাতালে বেরিয়ে এলো দু জন, ডুরেঈদের গোড়ালি ধরে টেনে নিয়ে এলো স্টাডিতে। আনার সময় তাঁর মাথা পাথুরে ধাপের উপর আর দোড়গোড়ায় ঘন বাড়ি খেলো, তার রক্ত মেঝেতে লাল ও ভেজা দাগ ফেলে দিল, টর্চের আলোয় চকচক করছে। . .

ল্যাম্পটা আনো! নির্দেশ দিল বশিত। ডুরেঈদের ফেলে দেওয়া ল্যাম্পটা কুড়িয়ে আনল একজন। অনেক আগেই নিভে গেছে সেটা। কানের কাছে তুলে নাড়লো বশিত। তেলে ভর্তি হয়ে আছে, বলল সে, প্যাঁচ ঘুরিয়ে ছিপি খুলল। যাও, ব্যাগটা গাড়িতে রেখে এসো।

সবাই বেরিয়ে গেল স্টাডি থেকে। বশিত ল্যাম্পের প্যারাফিন ঢালল ইবনে আল-সিমার শার্ট আর ট্রাউজারে। কাজটা শেষ করে শেলফগুলোর সামনে এসে দাঁড়ালো সে, বাকি তেল দিয়ে বই আর পাণ্ডুলিপিগুলো ভেজাল। ল্যাম্প ফেলে দিয়ে আলখেল্লার ভেতর থেকে দিয়াশলাই বের করে জ্বালল। প্রথমে বুককেসে আগুন দিল সে। দপ করে জ্বলে উঠলো প্যারাফিন, স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখা পাণ্ডুলিপিতে আগুন ধরে গেল। ডুরেঈদের কাছে ফিরে এলো সে। দিয়াশলাইয়ের আরেকটা কাঠি জ্বেলে তাঁর প্যারাফিন আর রক্তে ভেজা কাপড়ে ফেললো।

ডুরেঈদের বুকের উপর নীল কয়েকটা শিখা নাচতে শুরু করলো। কাপড় পুড়ে যাচ্ছে, আগুন ধরছে মাংসে, সেই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে ওগুলোর রঙ। এক সময় কমলা দেখালো, মাথা থেকে স্কুল বা ভুসা ভর্তি ধোঁয়া উঠছে।

ছুটে বেরিয়ে এসে গাড়িতে চড়ল বশিত। চলে গেল ওরা।

*

অসহ্য ব্যথা জাগিয়ে দিল ডুরেঈদকে। গভীর অতল জীবনের প্রান্তসীমা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য এরকম তীব্রতারই প্রয়োজন ছিল। গুঙিয়ে উঠলেন তিনি। জ্ঞান ফেরার পর্যায়ে প্রথমেই তিনি নিজের মাংস পোড়ার গন্ধ পেলেন, তারপরই নিদারুণ যন্ত্রণা পুরো শক্তিতে আঘাত করলো তাকে। একটা ঝাঁকি খেয়ে কাঁপুনি শুরু হওয়ার পর তা আর থামছে না। চোখ মেলে নিজের দিকে তাকালেন তিনি।

কালো ছাই হয়ে যাচ্ছে কাপড়, কুঁকড়ে উঠছে। আর ব্যথা যে এতো তীব্র হতে পারে, তার কোনো ধারণা ছিল না। অস্পষ্টভাবে বুঝতে পারলেন, কামরার ভেতর তার চারপাশে আগুন জ্বলছে। ধোয়া আর উত্তাপের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে তার উপর দিয়ে, এ-সবের ভেতর দিয়ে দোড়গোড়ার আকৃতিটা কোনো রকমে দেখা গেল। যন্ত্রণার অবসান চাইছেন তিনি, মৃত্যু কামনা করছেন।

তারপর রোয়েনের কথা মনে পড়লো দগ্ধ, কালো ঠোঁট খুলে প্রিয়তমার নামটা উচ্চারণ করতে চাইছেন, কোনো আওয়াজ বের হলো না। শুধু রোয়েনের চিন্তা নড়াচড়ার শক্তি এনে দিল তাঁকে। কারণ, রোয়েনকে তিনি নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। একটা গড়ান দিলেন তিনি, সঙ্গে সঙ্গে আগুনের আঁচ ঝলসে দিল পিঠ। গুঙিয়ে উঠে আবার গড়ালেন, দরজার দিকে একটু এগুলেন।

নড়তে প্রবল ইচ্ছাশক্তি লাগছে, প্রতিটি নড়াচড়া নতুন করে বর্ণনাতীত যন্ত্রণা বয়ে আনছে। তবে গড়ান দিয়ে আবার যখন চিৎ হলেন, তাজা ও ঠাণ্ডা বাতাস পাওয়ায় একটু আরাম বোধ হলো। বাড়তি শক্তিটুকু ধাপগুলোর উপর দিয়ে ঠাণ্ডা পাকা চাতালে নেমে আসতে সাহায্য করলো তাকে।

কাপড় আর শরীরে এখনো আগুন জ্বলছে। নিস্তেজ বাড়ি মেরে শিখাগুলো নেভাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাত দুটো, জ্বলন্ত, কালো থাবা হয়ে আছে। তারপর পোনা ছাড়া পুকুরটার কথা মনে পড়লো। শরীরটাকে ঠাণ্ডা পানিতে ফেলে দেওয়ার চিন্তা আরেকটু শক্তি এনে দিল মনে। ক্রল করে সেদিকে এগুলেন, শিরদাঁড়া ভাঙা সাপের মতো।

মাংস থেকে উকটগন্ধী ধোয়া উঠছে, গলায় বেঁধে যাওয়ায় কাশি শুরু হলো, তবু মরিয়া হয়ে একটু একটু করে এগুচ্ছেন। পাথুরে মেঝের খাঁজে ফোস্কা ওঠা ত্বকের কিছুটা রয়ে গেল, শেষ একটা গড়ান দিয়ে পুকুরে পড়লেন তিনি। হিসস করে শব্দ হলো, বাষ্প উঠলো খানিকটা, ম্লান মেঘ মুহূর্তের জন্য অন্ধ করে দিল তাকে। জ্বলন্ত মাংসে ঠাণ্ডা পানির আলিঙ্গন অসহনীয় ব্যথায় জন্ম দিল, প্রায় অচেতন হয়ে পড়লেন ডুরেঈদ।

আবার যখন সচেতন হলেন, ভেজা মাথা তুলে দেখলেন শেষ প্রান্তের ধাপ বেয়ে চাতালে উঠে আসছে একটা ছায়ামূর্তি। কে চিনতে পারলেন না, তবে আসছে বাগানের দিক থেকে। তারপর জ্বলন্ত ভিলার আলো পড়লো ছায়ামূর্তির গায়ে, এবার রোয়েনকে চিনতে পারলেন তিনি। ভেজা চুল লেপ্টে আছে মুখে, ছেঁড়া ও কাদামাখা কাপড় থেকে লেকের পানি ঝরছে। ডান হাতের উপর দিকে ব্যান্ডেজ, এখনো সামান্য রক্ত চুয়াচ্ছে।

রোয়েন তাঁকে দেখতে পায় নি। চাতালের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত স্টাডিরূপের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত। ডুরেঈদ কি ওই আগুনের ভেতর? প্রশ্নটা মনে জাগতেই সামনে বাড়লো রোয়েন, কিন্তু আগুনের আঁচ নিরেট পাঁচিলের মতো, ঠেকিয়ে দিল ওকে। সেই মুহূর্তে খসে পড়লো ছাদ, গর্জে উঠে আকাশের দিকে লাফ দিল শিখাগুলো। চারদিকে টুকরো টুকরো আগুন ছড়িয়ে পড়লো। পিছিয়ে এলো রোয়েন, হাত তুলে মুখ ঢাকল।

মুখ খুলে রোয়েনকে ডাকছেন ডুরেঈদ। কিন্তু ধোঁয়ায় পোড়া গলা থেকে কোনো আওয়াজ বের হলো না। ঘুরে ছুটল রোয়েন, ধাপ বেয়ে নেমে যাচ্ছে। ডুরেঈদ বুঝতে পারলেন, লোকজনকে ডাকতে যাচ্ছে রোয়েন। ওর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য শেষ একবার চেষ্টা করলেন তিনি। কাকের মতো কর্কশ কা-কা আওয়াজ বের হলো গলা থেকে।

বন করে ঘুরে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলো রোয়েন। চিৎকারটা শুরু হলো কয়েক সেকেন্ড পর। ডুরেঈদের ঘাড়ের উপর ওটা কোনো মানুষের মাথা নয়। খুলির চুল অদৃশ্য হয়েছে, পুড়ে ছাই হবার পর বেশিরভাগই খসে পড়েছে; সিদ্ধ মাংসের ফালি ঝুলছে গাল আর চিবুক থেকে। গোটা মুখ কালো, ভেতরে কাঁচা মাংস দেখা যাচ্ছে। পিছু হটছে রোয়েন। ডুরেঈদ যেনো কুৎসিত একটা প্রাণী।

রোয়েন, আওয়াজটা এতো কর্কশ, কোনো রকমে চেনা গেল। আবেদনের ভঙ্গিতে একটা হাত তুললেন তিনি। থামল রোয়েন, আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে ছুটে এসে বাড়ানো হাতটা ধরল।

ওহ্, গড! ওহ্, গড! ফোঁপাচ্ছে রোয়েন। টেনে ডুরেঈদকে পুকুর থেকে তোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু তাঁর হাতের চামড়া চলে এলো ওর মুঠোর ভেতর, সার্জিকাল রাবার গ্লাভের মতো। চামড়া ছাড়ানো নগ্ন ও রক্তাক্ত তালু বীভৎস দেখাচ্ছে।

পুকুরের কিনারায় হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে স্থির হলো রোয়েন, ডুরেঈদকে দুহাতের ভেতর তুলে নিতে চাইছে। ও জানে, ডুরেঈদের ভারী শরীরটা তুলতে পারবে না। সে চেষ্টা করলে আরো বেশি ব্যথাও পাবেন ডুরেঈদ। এখন শুধু জড়িয়ে ধরে আরাম দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে ও। সন্দেহ নেই মারা যাচ্ছেন উনি, এভাবে পুড়ে যাবার পর কোনো মানুষ বাঁচতে পারে না।

লোকজন এখুনি ছুটে আসবে, আরবিতে ফিসফিস করছে রোয়েন। নিশ্চয়ই কেউ আগুন দেখেছে।

রোয়েনের আলিঙ্গনের ভেতর মোচড় খাচ্ছেন ডুরেঈদ। মরণঘাতি জখমের ব্যথায় আর কথা বলার চেষ্টায়। স্ক্রোল? কোনো রকমে শুনতে পেল রোয়েন। জ্বলন্ত ভিলার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো ও।

নেই, বলল রোয়েন। সব শেষ। হয় পুড়ে গেছে, নয়তো চুরি হয়ে গেছে।

হাল… ছেড়ো… না, বললেন ডুরেঈদ, শব্দের চেয়ে ফপ ফপ আওয়াজের সঙ্গে বাতাসই বেশি বের হচ্ছে গলা থেকে। এতো পরিশ্রম… এতো সাধনা…

সব শেষ, আবার বলল রোয়েন। ওগুলো ছাড়া কেউ বিশ্বাস করবে না…

না! অস্পষ্ট আওয়াজ, তবে প্রতিবাদের সুরটা তীব্র। আমার জন্য… আমার শেষ ইচ্ছে…।

এ-সব বোলো না, ডুরেঈদ! মিনতি করলো রোয়েন। তুমি ভালো… সুস্থ হয়ে উঠবে।

কথা দাও, বললেন ডুরেঈদ। কথা দাও আমাকে!

কোনো স্পনসর নেই। আমি একা। একা আমার পক্ষে এ কাজ সম্ভব নয়।

নিকোলাস! বললেন ডুরেঈদ। ঝুঁকে তার আরো কাছে সরে এলো রোয়েন, ওর কানে অগ্নিদগ্ধ ঠোঁট ঠেকল। হারপার নিকোলাস! আবার বললেন তিনি।

কঠিন মানুষ… বুদ্ধিমান মানুষ..সাহসী… এতোক্ষণে তাঁর কথা ধরতে পারলো রোয়েন। হ্যাঁ, অবশ্যই, সম্ভাব্য স্পনসরদের তালিকায় হারপার নিকোলাসের নামটা সবার আগে আছে। রোয়েন জানে, ডুরেঈদ এ হারপার নিকোলাসকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করেন। এ ভদ্রলোক যে তাঁর প্রথম পছন্দ, তা তিনি অনেকবার রোয়েনকে জানিয়েছেন।

কিন্তু কী বলব তাকে আমি? তিনি তো আমাকে চেনেনও না। কী করে তাঁকে বিশ্বাস করাবো? আসল স্ক্রোলই তো নেই!

ওর উপর আস্থা রাখবে। ফিসফিস করলেন ডুরেঈদ। ভালো মানুষ। আস্থা রাখবে… আবার ব্যাকুল আবেদন প্রকাশ পেল তাঁর কথায়, আমাকে কথা দাও!

হঠাৎ মনে পড়লো রোয়েনের। কায়রোয়, ওদের ফ্ল্যাটে, একটা নোটবুক আছে; আরো আছে টাইটা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য ভর্তি হার্ড ড্রাইভ, ওর পি.সি.-তে।, সব শেষ হয়ে যায় নি। ঠিক আছে, রাজি হলো ও। কথা দিচ্ছি, ডুরেঈদ।

শরীরের যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাতে মানবিক কোনো অনুভূতি প্রকাশ পাবার কথা নয়, তা সত্ত্বেও ফিসফিস করার সময় ডুরেঈদের গলায় ক্ষীণ সন্তুষ্টির আভাস থাকলো। মাই ফ্লাওয়ার… মাথাটা সামনের দিকে নত হলো, রোয়েনের আলিঙ্গনের ভেতর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।

গ্রামের কৃষকরা রোয়েনকে ওই অবস্থাতেই দেখতে পেল, পুকুরের কিনারায় ডুরেঈদকে জড়িয়ে ধরে আছে, কথা বলছে ফিসফিস করে। ইতোমধ্যে ভিলার আগুন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে, আগুনের আভার চেয়ে ভোরের আলো এখন আরো বেশি উজ্জ্বল।

*

মিউজিয়াম আর অ্যান্টিকুইটিজ ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র সব স্টাফই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য মরুদ্যানে হাজির হলেন। এমন কি আতালান আবু সিন, সাংস্কৃতিক ও পর্যটন মন্ত্রীও কায়রো থেকে কালো এয়ার কন্ডিশনড মার্সিডিজ নিয়ে চলে এলেন। মন্ত্রী হওয়ার সূত্রে তিনিই ইবনে ডুরেঈদের বস্।

মুসলমান, তাই গির্জার বাইরে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। নাহুত গাদ্দাবি তার মামার পাশে দাঁড়িয়ে। তাঁর মা মন্ত্রীর ছোট বোন। ডুরেঈদ প্রায়ই হাসিমুখে বলতেন, আর্কিওলজিতে ভাগ্নের সমস্ত যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতার অভাব এ আত্মীয়তার সম্পর্ক পুষিয়ে দিয়েছে। প্রশাসক হিসেবেও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। তবে সেসব প্রকাশের উচ্চারণ করতে সাহস পায় না কেউ।

গির্জার ভেতর ধূপের ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে রোয়েনের। কালো পোশাক পরা পুরোহিত বাইবেল পাঠ করছেন। ডান বাহুর ক্ষত শুকাতে শুরু করায় টান পড়ছে স্টিচে, নতুন করে শুরু হয়েছে জ্বালা-পোড়া। অলংকৃত, গিলটি করা বেদির সামনে লম্বা কালো কফিন যতবার দেখছে রোয়েন, ততবার চুলবিহীন খুলি ছাড়ানো ডুরেঈদের মাথাটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। টলে উঠছে ও, তাল সামলাবার জন্য সীটের হাতল আঁকড়ে ধরতে হচ্ছে।

অবশেষে গির্জার অনুষ্ঠান শেষ হলো। তবে রোয়েনের কাজ এখনো শেষ হয় নি। সেই একমাত্র নিকটাত্মীয়, কাজেই শব মিছিলের সামনে থাকতে হলো ওকে। তমাল বীথির ভেতর দিয়ে এগুলো মিছিল, শেষ মাথায় পারিবারিক গোরস্থানে ডুরেঈদের আত্মীয়-স্বজনরা অপেক্ষা করছে।

কায়রোয় ফিরে যাবার আগে আতালান আবু সিন রোয়েনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে এলেন। দু একটা সান্ত্বনার কথাও শোনালেন তিনি। আইন-শৃঙ্খলার কী সাংঘাতিক অবনতি! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছি। এ জঘন্য . অপরাধের জন্য দায়ী ক্রিমিনালদের অবশ্যই গ্রেফতার করা হবে। প্লিজ, যে কয় দিন ইচ্ছে ছুটি নিন আপনি।

আমি সোমবারে মিউজিয়ামে আসছি, জবাব দিল রোয়েন।

পকেট ডায়েরি বের করে পাতা ওল্টালেন মন্ত্রী, বললেন, তাহলে বিকেল চারটার সময় দেখা করবেন আমার সঙ্গে। বিদায় নিয়ে মার্সিডিজের দিকে এগুলেন তিনি।

এরপর হ্যান্ডশেক করতে এলেন নাহুত গাদ্দাবি। ফ্যাকাসে চামড়ায় অসংখ্য তিল আর চোখের নিচে কফি রঙের দাগ থাকলেও নাহুত যথেষ্ট লম্বা। মাথায় ঢেউ খেলানো চুল, দাঁতগুলো খুব সাদা। দামি স্যুট আর সেন্ট ব্যবহার করেন তিনি। তার বাড়ানো হাতটা দেখতে না পাবার ভান করলো রোয়েন। গম্ভীর ও বিষণ্ণ হয়ে উঠলেন নাহুত। ভালো মানুষরা তাড়াতাড়ি চলে যায়, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। ডুরেঈদকে আমি শ্রদ্ধা করতাম।

মাথা ঝাঁকালো রোয়েন, মুখে কিছু বলল না, জানে ডাহা মিথ্যে কথা কলছেন নাহুত। ডুরেঈদ আর তাঁর ডেপুটির মধ্যে কোনোকালে সদ্ভাব ছিল না। টাইটার স্ক্রোল নিয়ে কতবার কাজ করতে চেয়েছেন নাহুত, কিন্তু দুরেঈদ অনুমতি দেন নি। বিশেষ করে লক্ষ্য রাখতেন, নাহুত যাতে সপ্তম স্ক্রোল ছুঁতে না পারেন।

এ নিয়ে দু জনের মধ্যে কথা কাটাকাটিও হয়েছে কয়েকবার। তুমি বোধহয় ডিরেক্টর পদটার জন্য অ্যাপ্লাই করবে, তাই না, রোয়েন? ওই পদ পাবার যোগ্যতা তোমার আছে।

ধন্যবাদ, নাহুত, ইউ আর ভেরি কাউন্ড। ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো কিছু ভাবি নি আমি। তবে তুমিও বোধহয় অ্যাপ্লাই করছ, তাই না?

অবশ্যই, নিচু গলায় হেসে উঠে মাথা ঝাঁকালেন নাহুত। কে জানে, তুমি হয়তো আমার নাকের সামনে থেকে পদটা কেড়ে নেবে। তার হাসিতে সংশয় বা উদ্বেগের লেশমাত্র নেই। আরব সমাজে রোয়েন একটা মেয়ে, তার উপর খ্রিস্টান, আর নাহুত মন্ত্রী মহোদয়ের ভাগ্নে। তিনি জানেন পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণই তাঁর অনুকূলে। বন্ধুরাও পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, আমরাও তাই করব, কী বলো? তুমি আর আমি, আমরা তো পরস্পরের বন্ধুই, তাই না?

হ্যাঁ, ভবিষ্যতে অনেক বন্ধু দরকার হবে আমার, বিড়বিড় করলো রোয়েন।

ডিপার্টমেন্টের কে তোমার বন্ধু নয়? সবাই তোমাকে পছন্দ করে, রোয়েন। নাহুতের অন্তত এ কথাটা সত্যি। তোমাকে আমি লিফট দিতে পারি? আমি জানি মামা আপত্তি করবেন না।

আজই আমি কায়রোয় ফিরছি না, নাহুত, তবু ধন্যবাদ। ডুরেঈদের ব্যক্তিগত কিছু বিষয় দেখাশোনা করতে হবে আমাকে। কথাটা সত্যি নয়। আজ সন্ধ্যের দিকে কায়রোয় ওদের ফ্ল্যাটে ফিরবে রোয়েন। তবে কারণটা নিজেও ভালো জানে না, নাহুতকে ওর প্ল্যান সম্পর্কে জানতে দিতে চাইছে না।

তাহলে সোমবার বিকেলে মিউজিয়ামে আবার দেখা হচ্ছে।

আত্মীয়-স্বজন, পারিবারিক বন্ধু আর গ্রামের কৃষকদের সময় দিতে হলো, সবাই তারা রোয়েনের সঙ্গে দেখা করে শোক প্রকাশ করলো। নিঃসঙ্গ আর অবশ লাগছে নিজেকে, এতো লোকের এতো শোক আর সান্ত্বনা অর্থহীন মনে হলো রোয়েনের। সন্ধ্যের খানিক আগে ডুরেঈদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো, মনটা অশান্ত হয়ে আছে। ডান হাতটা সিঙে ঝুলছে, গাড়ি চালাতে তেমন কোনো অসুবিধে হচ্ছে না।

কায়রোর কাছাকাছি এসে ট্রাফিক জামে পড়লো রোয়েন। গির্জা-অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। ডুরেঈদের রেনোয়া আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজে রেখে এলিভেটরে চড়ে উঠে এলো টপ ফ্লোরে।

ফ্ল্যাটে ঢুকে দোরগোড়ায় থমকে দাঁড়ালো রোয়েন। সিটিংরূপ তছনছ করা হয়েছে–এমন কি কাপের্ট গুটিয়ে ফেলা হয়েছে, দেয়াল থেকে নামানো হয়েছে সব কয়টা পেইন্টিং। যেনো একটা ঘোরের মধ্যে ভাঙাচোরা ফার্নিচার আর ছড়ানো ছিটানো অর্নামেন্টের ভেতর দিয়ে হাঁটছে রোয়েন। প্যাসেজ ধরে এগোবার সময় বেডরুমের ভেতর তাকালো। বেডরুমটাও বাদ দেওয়া হয় নি। ওর আর ডুরেঈদের কাপড়-চোপড় মেঝেতে পড়ে আছে, কাবার্ডের দরজাগুলো খোলা। একটা কাবার্ডের দরজা কজাসহ খুলে ফেলা হয়েছে। বিছানাটা ওল্টানো, চাদর আর বালিশ মেঝেতে পড়ে আছে।

একই অবস্থা বাথরুমের। কসমেটিকস আর পারফিউমের বোতল সব কয়টা ভাঙা। তবে ভেতরে ঢুকলো না রোয়েন, জানে ঢুকলে কী দেখতে পাবে। প্যাসেজ ধরে বড় কামরাটার দিকে এগিয়ে গেল। ওটাই ওরা স্টাডি আর ওয়ার্কশপ হিসেবে ব্যবহার করে।

এখানেও সব ভেঙেচুরে তছনছ করা হয়েছে, তবে প্রথমেই রোয়েনের চোখ পড়লো অ্যান্টিক দাবা সেটটার উপর। ডুরেঈদের দেওয়া উপহার, ওর খুব শখের জিনিস। জেট আর আইভরি দিয়ে তৈরি বোর্ডটা ভেঙে দু টুকরো করা হয়েছে, খুঁটিগুলো অকারণে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে কামবার চারদিকে। ঝুঁকে সাদা কুইনটা তুলে নিল রোয়েন। মোচড় দিয়ে রানীর ঘাড় ভাঙা হয়েছে।

অক্ষত হাতে রানীকে নিয়ে রোয়েন যেনো ঘুমের ঘোরে হাঁটছে। জানালোর নিচে ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালো। সম্ভবত হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে চুরমার করা হয়েছে ওর পি.সি.। স্ক্রীন ফেটে চৌচির, মেইনফ্রেম চিড়ে-চ্যাপ্টা। দেখেই বোঝা যায়, হার্ড ড্রাইভে কোনো তথ্য নেই। এ কমপিউটার মেরামত করা সম্ভব নয়।

দেরাজগুলো খোলা, ভেতরের সব জিনিস মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তবে ফ্লপি ডিস্কগুলো কোথাও পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল না কোনো নোটবুক বা ফটোগ্রাফ। সপ্তম স্ক্রোলের সঙ্গে ওর সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তিন বছরের কঠিন পরিশ্রম আর সাধনা সব শেষ। এখন প্রমাণ করাই অসম্ভব যে ওগুলোর অস্তিত্ব ছিল।

ডেস্কের উপর বসে দু হাতে মুখ ঢাকল রোয়েন। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে পিঠ। রীতিমতো ধ্বংসপ্রাপ্ত কক্ষের মধ্যে কেঁদে কেঁদে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো সে।

*

সোমবার সকালের মধ্যে নিজের জীবনে খানিকটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারলো রোয়েন। ফ্ল্যাটে এসে ওর জবানবন্দি নিয়ে গেছে পুলিশ। আবর্জনা ফেলে দিয়ে ঘরগুলো একাই যতটা সম্ভব গুছিয়ে নিয়েছে। সাদা রানীর বিচ্ছিন্ন মাথাটা খুঁজে পাবার পর আঠা দিয়ে ঘাড়ে বসিয়ে দিয়েছে। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সবুজ রেনোয়ায় যখন চড়ল, ডান হাতের ক্ষতটায় প্রায় কোনো ব্যথাই নেই। মনটা খুশি, তা বলা যাবে না। তবে হতাশা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, নিশ্চিতভাবে জানে এখন কী করতে হবে ওকে।

মিউজিয়ামে পৌঁছে প্রথমেই দুরেঈদের অফিসে ঢুকলো রোয়েন। ওর আগেই ওখানে পৌঁছে গেছেন নাহুত গাদ্দাবি, দেখে বিব্রত ও অস্বস্তি বোধ করলো। দু জন সিকিউরিটি গার্ডকে কাজে লাগিয়েছেন নাহুত। তারা ডুরেঈদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সব বের করে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষোভ চেপে রেখে রোয়েন শান্ত সুরে বলল, তোমার উচিত ছিল এ কাজটা আমাকে করতে দেওয়া।

অমায়িক হেসে নাহুত বললেন, দুঃখিত, রোয়েন। ভাবলাম আমার সাহায্য পেলে তুমি খুশি হবে। মোটা টার্কিশ চুরুট কুঁকছেন। এ চুরুটের ধোঁয়া আর ঝাঁঝাল গন্ধ একদমই সহ্য করতে পারে না রোয়েন।

ডুরেঈদের ডেস্কের পেছনে এসে দাঁড়ালো ও। একটা দেরাজ খুললো। ডুরেঈদের ডে বুকটা এখানে ছিল। এখন দেখছি নেই। তুমি দেখেছ?

না, ওই দেরাজে কিছুই পাওয়া যায় নি। গার্ড দু জনের দিকে তাকালেন নাহুত, যেনো সাক্ষী দিতে বলছেন। ঘাড় ও নাক চুলকে মাথা নাড়লো তারা। রোয়েন জানে, ডে বুকে গুরুত্বপূর্ণ খুব বেশি কিছু ছিল না। গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত তথ্য রেকর্ড ও জমা করার দায়িত্ব রোয়েনের উপর দিয়ে নিশ্চিত ছিলেন ডুরেঈদ। আর রোয়েন সেগুলো যত্নের সঙ্গে ওর পি.সি-তে তুলে রাখত।

ধন্যবাদ, নাহুত, বলল রোয়েন। বাকি যা করার আমি করছি। তোমাকে আর আটকে রাখতে চাই না।

কোনো সাহায্য দরকার হলে বলবে, রোয়েন, প্লিজ। কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে সম্মান দেখিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন নাহুত গাদ্দাবি।

ডুরেঈদের অফিস খালি করতে খুব বেশি সময় লাগলো না। ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বেশিরভাগ আগেই বাক্সে ভরা হয়েছিল, গার্ডদের বলতে তারা সেগুলো রোয়েনের অফিসের ভেতর দেয়াল ঘেঁষে রেখে এলো। লাঞ্চ আওয়ারে নিজের কাজ নিয়ে বসলো রোয়েন, শেষ করার পরও দেখা গেল মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাবার আগে হাতে এক ঘণ্টা সময় আছে।

ডুরেঈদকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি যদি রক্ষা করতে হয়, দীর্ঘ একটা সময় মিউজিয়াম ছেড়ে দূরে থাকতে হবে রোয়েনকে। শ্রদ্ধেয় ফারাও আর পুরা নিদর্শনগুলোর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার একটা তাগাদা অনুভব করলো বিশাল বিল্ডিঙের পাবলিক সেকশনে চলে এলো রোয়েন।

সোমবার, কাজেই মিউজিয়ামের এগজিবিশন হলগুলো টুরিস্টে গিজগিজ করছে। তিনতলার কয়েকটা কামরায় রয়েছে তুতেনখামেন ট্রেজার, প্রচণ্ড ভিড়ে ওখানে দু মিনিটের বেশি টিকতে পাল না রোয়েন। অনেক ঠেলাঠেলি করে কোনো রকমে একবার ডিসপ্লে কেবিনেটের সামনে পৌঁছতে পারল, কেবিনেটের ভেতর শিশু ফারাও-এর সোনালি ডেথ-মাস্ক রয়েছে।

ওখান থেকে বেরিয়ে প্রাচীন রাজার কাছ থেকে বিদায় নিতে এলো রোয়েন। তিন হাজার বছর পরও দ্বিতীয় রামেসিসের সরু মুখে কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই, দেখে মনে হবে প্রশান্তচিত্তে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। তার ত্বকে হালকা চকচকে একটা ভাব আছে, মার্বেলে যেমন দেখা যায়। তাঁর চুল সোনালি, তবে হেনা বা মেহেদি দিয়ে রাঙানো। একই জিনিস দিয়ে রঙ করা হাত লম্বা, সরু এবং সুগঠিত। তবে পরনে শুধু লিনেন-এর তৈরি একটা ফালি। কবর চোররা তাঁর মমির প্যাঁচও খুলে ফেলেছিল, লিনেন ব্যান্ডেজের তলা থেকে মন্ত্রপূত কবচ আর গুবরে পোকা আকৃতির মণি পাবার লোভে, কাজেই তার শরীর প্রায় নগ্নই বলা যায়। আঠারোশো একাশি সালে এলো বাহারির পাহাড় প্রাচীরের একটা গুহায় অন্যান্য রাজার মমির সঙ্গে যখন পাওয়া গেল তাঁকে, শুধু প্যাপিরাস পার্চমেন্টের একটু টুকরো সাঁটা ছিল বুকে, ওই টুকরোটা থেকেই তাঁর বংশধারা সম্পর্কে সব কথা জানা যায়।

বংশধারা উল্লেখ করার মধ্যে এক ধরনের গৌরব তো আছেই, আরো আছে। নীতিবোধ। প্রাচীন যে-কোন মমির সঙ্গে তথ্য ও বার্তা থাকে, সেগুলো কতটুকু সত্য বা অতিরঞ্জিত নয়, সেটাই হলো প্রশ্ন। এ প্রশ্ন নিয়ে অনেক আলোচনা করেছে ওরা ডুরেঈদ-রোয়েন–লেখক টাইটা সত্যি কথা লিখে গেছে কি? তার বর্ণনামতো সত্যিই কি বহুদূর নির্দয় আফ্রিকান পাহাড়ের গভীরে সমস্ত গুপ্তধন সহ আরেকজন মহান ফারাও নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে আছেন? চিন্তাটা উত্তেজিত ও রোমাঞ্চিত করে। রোয়েনকে, গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়।

তোমাকে কথা দিয়েছি, ডুরেঈদ, ফিসফিস করে আরবিতে বলল রোয়েন, তোমার আমার সুখস্মৃতির উদ্দেশ্যে কাজটা আমি করব।

হাত পনেরো মিনিট সময় থাকতে মিউজিয়ামের মূল সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো রোয়েন। এক পাশের একটা হলে ঢুকবে ও, টুরিস্ট বা গাইডরা ওদিকে খুব কমই যায়। গেলেও শুধু আমেনহোটেপ-এর মূর্তি দেখতে।

সরু কামরাটায় ঢুকে কাঁচ মোড়া ডিসপ্লে কেসের সামনে দাঁড়ালো রোয়েন, কেসটা মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত লম্বা। ছোটখাট আর্টিফ্যাক্ট, যন্ত্রপাতি আর হাতিয়ার, কবচ, মৃৎপাত্র ও তৈজসপত্রে ঠাসা ভেতরটা এগুলো মধ্যে আছে নিউ কিংডম-এর বিশতম রাজবংশের জিনিসপত্র, এক হাজার একশো খ্রিস্টপূর্ব আমলের। আর ওল্ড কিংডম-এর জিনিসগুলো প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরানো। এ-সব সংগ্রহের ক্যাটালগ নিখুঁত নয়, অনেক জিনিসের কোনো পরিচয়ই উল্লেখ করা হয় নি।

শেষের দিকে, নিচের শেলফে, সাজানো রয়েছে অলঙ্কার, আঙটি আর সীল। প্রতিটি সীলের পাশে মোমের উপর ওই সীলের একটা করে ছাপ। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে এ আর্টিফ্যাক্টগুলোর একটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে রোয়েন। ডিসপ্লের মাঝখানে নীল ল্যাপিস ল্যাজিউলাই দিয়ে তৈরি একটা খুদে সীল। প্রাচীনকালে ল্যাপিস মূল্যবান ও দুর্লভ ছিল, যেহেতু মিশরীয় সাম্রাজ্যে জিনিসটা পাওয়া যেত না। ওই সীল থেকে মোমের উপর যে ছাপ দেওয়া হয়েছে তাতে ডানা ভাঙা একটা শ্যেন বা বাজপাখি দেখা যাচ্ছে। বাজ পাখির নিচে লেখাটা পরিষ্কার পড়তে পারলো রোয়েন : টাইটা, মহারানীর লেখক।

রোয়েন জানে, এ সেই একই লোক, কারণ স্ক্রোলে নিজেই সই হিসেবে ডানাভাঙা শ্যেন পাখি ব্যবহার করেছে সে। রোয়েন ভাবছে এ ক্ষুদে আর্টিপ্যাক্ট কোত্থেকে এখানে এলো। সম্ভবত কোনো গ্রামবাসী বৃদ্ধ লেখক তথা ক্রীতদাসের হারানো সমাধি থেকে চুরি করেছে। তবে কে সে, কবে বা ঠিক কোত্থেকে পেল, আজ আর তা জানার কোনো উপায় নেই।

তুমি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ, টাইটা? এ কি মাথা খাঁটিয়ে তৈরি করা একটা বিরাট ধাঁধা? তুমি কি তোমার সমাধি থেকে আমার উদ্দেশে হাসছ? আরো কাছে সরে এলো রোয়েন, ঠাণ্ডা কাঁচে কপাল ঠেকে গেল। তোমার সমাধি যেখানেই থাকুক, তুমি যেখানেই থাকো, আমার বন্ধু হবে? নাকি আমার প্রতিপক্ষ হওয়াই তোমার ইচ্ছে? দাঁড়িয়ে কামিজ থেকে ধুলো ঝাড়ল রোয়েন। ঠিক আছে, দেখা যাবে। তোমার সঙ্গে খেলব আমি, দেখবো কে কাকে হারাতে পারে।

*

গাঢ় রঙের চকচকে সিল্ক স্যুট পরে ডেস্কে বসে আছেন আতালান আবু সিন। তবে রোয়েন জানে আলখেল্লা পরেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন মন্ত্রী মহোদয়, স্বস্তি পান গালিচার উপর কুশনে হেলান দিয়ে বসতে। ওর চোখের কৌতুক লক্ষ করে হাসলেন তিনি; বললেন, আজ দুপুরে কয়েকজন আমেরিকানের সঙ্গে মিটিং ছিল।

রোয়েন তাকে পছন্দ করে। ওর সঙ্গে সব সময় ভালো ব্যবহার করেন তিনি, মিউজিয়ামের চাকরিটাও তাঁর ব্যক্তিগত অনুমোদন ছাড়া পেত না ও। তাঁর পজিশনে অন্য যে কোনো লোক মহিলা অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে রোয়েন আবেদন প্রত্যাখ্যান করত, বিশেষ করে স্ত্রীর আপত্তির মুখে।

ওর কুশলাদি জানতে চাইলেন তিনি হাতের ব্যান্ডেজটা দেখিয়ে রোয়েন বলল, দশ দিন পর স্টিচ খোলা হবে।

পরিবেশ একটু আড়ষ্ট হয়ে আছে, তাই ভূমিকা না করে সরাসরি নিজের কথা বলে গেল রোয়েন। ডুরেঈদকে হারিয়ে আমি এখন বুঝতে পারছি না জীবনটা নিয়ে কী করব। তাই ভাবছি দূরে কোথাও একা থাকব কিছুদিন। আমাকে ছয় মাসের ছুটি দিতে হবে। ভাবছি ইংল্যান্ডে মায়ের কাছে চলে যাব।

মন্ত্রির উদ্বেগ অকৃত্রিম মনে হলো। রোয়েনকে তিনি অনুরোধ করলেন, তবে প্লিজ, আমাদেরকে ছেড়ে বেশিদিন থাকবেন না। আপনাদের গবেষণা অমূল্য অবদান রেখেছে। ডুরেঈদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে হলে আপনার সাহায্য ছাড়া চলবে না। মুখে যাই বলুন, রোয়েনের কথায় তিনি যে স্বস্তি পাচ্ছেন সেটা পুরোপুরি চাপা থাকলো না। তিনি আশা করেছিলেন আজই তাঁর সামনে ডিরেক্টরশিপের জন্য আবেদনপত্র জমা দেবে রোয়েন। এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই ভাগ্নে নাহুত গাদ্দাবির সঙ্গে আলাপ হয়েছে তাঁর। রোয়েন আবেদনপত্র জমা দিলে সান্ত্বনাসূচক কিছু বাণী শুনিয়ে অবশ্যই সেটা বাতিল করা হতো। দু জনেই ওরা জানে ডিরেক্টরের পদটা নাহুত গাদ্দাবিই পেতে যাচ্ছেন।

বিদায় নেওয়ার সময় রোয়েনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন আতালান, ডেস্কে ঘুরে দরজা পর্যন্ত হেঁটে এলেন। এলিভেটরে চড়ে নিচে নামার সময় নিজেকে রোয়েনের বন্ধনহীন ও স্বাধীন লাগলো।

রেনোয়া নিয়ে গেট থেকে বেরুতেই কায়রো ট্রাফিক গ্রাস করলো ওকে। অলস পিঁপড়ের মতো এগুচ্ছে গাড়ি, আরোহী উপচে পড়া একটা বাস ওর সামনে, অবিরত নীল ধোয়া ছাড়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে রেনোয়া। শহরের ট্রাফিক সমস্যার যেনো কোনো সমাধান নেই। রিয়ার-ভিউ মিররে চোখ রেখে পেছন দিকে তাকালো রোয়েন। ওর ব্যাক বাম্পার থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে, ওটার পেছনে যানবাহনের ভিড় নিরেট ও সম্পূর্ণ অচল। শুধু মোটর সাইকেল আরোহীরা চলাচলের স্বাধীনতা ভোগ করছে। সেরকম একজনকে আত্মহত্যার ঝুঁকি নিয়ে ছুটে আসতে দেখলো রোয়েন। লাল তোবড়ানো একটা টু হানড্রেড সিসি হোন্ডা, গায়ে এতো ধুলো জমেছে যে রঙটা কোনো রকমে চেনা গেল। ব্যাকসীটে একজন আরোহী বসে আছে, ড্রাইভারের মতো তারও মুখের নিচের অংশ মাথায় জড়ানো কাপড় নামিয়ে আড়াল করা, ধোঁয়া আর ধুলো থেকে রক্ষা পাবার জন্য।

রঙ সাইড দিয়ে ছুটে আসছে মোটরসাইকেল, আসছে ট্যাক্সি আর ফুটপাথ ঘেঁষে পার্ক করা কারগুলোর সরু ফাঁক গলে, ফাঁকটার দু পাশে অতিরিক্ত এক ইঞ্চি জায়গাও নেই। মোটর সাইকেল আরোহীর উদ্দেশ্যে অশ্লীল একটা ইঙ্গিত করলো ট্যাক্সি ড্রাইভার, তারপর চিৎকার করে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায়, তার এ পাগলামি আর বোকামির জন্য আল্লাহ তাকে অবশ্যই নরকে পাঠাবে।

রোয়েনের রেনোয়ার পাশে চলে এসে মুহূর্তের জন্য মন্থর হলো হোন্ডার গতি, ব্যাক সীটে বসা আরোহী একটু ঝুঁকে খোলা দরজা দিয়ে ওর পাশের প্যাসেঞ্জার সীটের উপর কী যেনো একটা ছুঁড়ে দিল। পরক্ষণে গতি এমন বাড়লো, মুহূর্তের জন্য রাস্তা ছেড়ে শূন্যে উঠে পড়লো মোটরসাইকেলের সামনের চাকা। বাম দিকে সরু একটা গলি পেয়ে সঁাৎ করে ঢুকে পড়লো সেটায়, চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। অদৃশ্য হওয়ার আগে পেছনে বসা আরোহী ঘাড় ফিরিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালো একবার, আর ঠিক সেই সময় বাতাস লেগে সরে গেল তার মুখের কাপড় াৎ করে উঠলো রোয়েনের বুক। লোকটাকে চিনতে পেরেছে ও। মরুদ্যানে–একেই দেখেছিল, ফিয়াটের আলোয়। ইউসুফ!

ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে পাশের সীটে পড়ে থাকা জিনিসটার দিকে তাকালো রোয়েন। কালচে সবুজ রঙের জিনিসটা টিভির ওঅর মুভিতে অনেকবার দেখেছে ও রঙটা মিলিটারি গ্রীন। এটা যে একটা গ্রেনেড, বুঝতে পারলো রোয়েন। দেখলো, পিন খোলা। তারমানে এখুনি ওটা বিস্ফোরিত হবে।

কিছু চিন্তা না করেই দরজার হাতল ঘুরিয়ে লাফ দিল রোয়েন। খুলে হাঁ হয়ে গেল দরজা, রাস্তার উপর ছিটকে পড়লো ও। কাঁচে পা না থাকায় সচল হলো রেনোয়া সরাসরি ধাক্কা দিল স্থির দাঁড়িয়ে থাকা বাসের পেছনে।

পেছনের ট্যাক্সিটা এগিয়ে এসেছিল, সেটা দুই চাকার আড়ালে রাস্তার উপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে রোয়েন, এ সময় বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড। ড্রাইভারের দরজা দিয়ে কমলা শিখা আর সাদাটে ধোয়ার মেঘ বেরিয়ে এলো, সেই সঙ্গে প্রচুর আবর্জনা। পেছনের জানালো বিস্ফোরিত হলো বাইরের দিকে, হীরের কর্নার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো কাঁচের টুকরো। বিস্ফোরণের শব্দে রোয়েনের কানে তালা লেগে গেল, ব্যথাও করছে। বিকট আওয়াজটার পর নিথর নিস্তব্ধতা নেমে এলো, তারপরই শুরু হয়ে গেল কাতর গোঙানি আর চিৎকার-চেঁচামেচি। বসলো রোয়েন, আহত হাতটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরল। রেনোয়া ধ্বংস হয়ে গেছে, তবে দেখা গেল ওর স্লিং ব্যাগটা রাস্তার উপর নাগালের মধ্যে পড়ে রয়েছে। সেটা নিয়ে কোনো রকমে দাঁড়ালো। চারদিকে দিশেহারা মানুষ কে কী করবে বুঝতে পারছে না। বাসের ভেতর কয়েকজন আরোহী আহত হয়েছে, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছোট্ট মেয়ের কপালে শ্যাপনেল লাগায় ঝর ঝর করে রক্ত ঝরছে, মেয়ের ক্ষতে রুমাল চেপে ধরেছে মা। রোয়েনের দিকে খেয়াল নেই কারো, তবে জানা কথা এখুনি পুলিশ চলে আসবে। ও জানে, ওকে পেলে জেরা করার জন্য আটকে রাখা হবে, হয়তো কয়েক দিনই। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে আস্তে করে কেটে পড়লো ও, কয়েক পা এগিয়ে ঢুকে পড়লো সরু গলির ভেতর, যেটার ভেতর একটু আগে হোন্ডা মোটরবাইক অদৃশ্য হয়ে গেছে।

গলিটার শেষ মাথায় পাবলিক ল্যাভেটোরি, একটা কিউবিকলে ঢুকে বন্ধ দরজায় হেলান দিল রোয়েন, চোখ বন্ধ করে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করছে। ডুরেঈদ ইবনে আল-সিমার বীভৎস হত্যাকাণ্ডের আঘাত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারে নি ও, সে জন্যই নিজের নিরাপত্তার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবে নি। আজ এইমাত্র ঘটনাটা ঘটার পর ওর মনে পড়ছে, সেদিন ওকেও খুন করতে চেয়েছিল তারা। অন্ধকারে শোনা একজন আততায়ীর গলা এখন ওর কানে বাজছে, মেয়েটাকে পরে কোথায় পাওয়া যাবে জেনে নিতে পারব।

ওর প্রাণের উপর দ্বিতীয় আঘাতটা অল্পের জন্য ব্যর্থ হয়েছে। সন্দেহ নেই, এরকম আঘাত একের পর এক আসতে থাকবে। ফ্ল্যাটে ফিরে যাওয়া উচিত হবে না, উপলব্ধি করলো রোয়েন। কী করা উচিত আধ ঘণ্টা ধরে ভাবল। তারপর ওয়াশবেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ-হাত ধুয়ে চুল আঁচড়ালো, মেকআপ ঠিকঠাক করলো। রাস্তায় বেরিয়ে এসে উদ্দেশ্যহীন হেঁটে বেড়ালো কিছুক্ষণ, লক্ষ্য রাখছে কেউ পিছু নিয়েছে কিনা। তারপর একটা ট্যাক্সি থামাল।

ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার মিশরীয় পাউন্ড তুললাম রোয়েন। টাকাটা অল্পই। তবে ইয়র্কের লয়েড ব্যাংকে আরো টাকা আছে ওর। তাছাড়াও আছে মাস্টারকার্ড। এরপর সেফ ডিপোজিট থেকে একটা প্যাকেট সংগ্রহ করলো, ওটায় ওর ব্রিটিশ পাসপোর্ট আর লয়েড ব্যাংকের কাগজপত্র আছে।

কায়রোয় রোয়েনের পিতৃকুলের অনেক আত্মীয়-স্বজন আছে, তারা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গেই আশ্রয় দিবে ওকে, কিন্তু নিজের বিপদের সঙ্গে তাদের কাউকে জড়াতে চাইছে না ও। ছোটখাট একটা টু-স্টার টুরিস্ট হোটেল খুঁজে নিল, নদীর কাছ থেকে অনেকটা দূরে। এ ধরনের হোটেলে অনেক টুরিস্ট যাওয়া-আসা করে। হয় লুক্সর না হয় আসওয়ানের পথে চলছে যারা।

হোটেল রুমে নির্জনতা পেয়েই ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের রিজার্ভেশন-এ ফোন করলো রোয়েন। কাল সকাল দশটায় হিথরোর উদ্দেশে একটা প্লেন ছাড়বে। ওয়ান-ওয়ে ইকনমি সিট বুক করলো, ওদেরকে নিজের মাস্টারকার্ডের নাম্বার জানালো।

ইতোমধ্যে ছয়টা বেজে গেছে তবে ইংল্যান্ডে এখনো অফিস-আদালত খোলা। নোটবুক খুলে নম্বরটা দেখে নিল রোয়েন। লীডস ইউনিভার্সিটিতেই লেখাপড়া শেষ করেছে ও। তিনবার রিং হতে অপরপ্রান্তে সাড়া পাওয়া গেল। আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্ট। প্রফেসর ডিক্সনের অফিস। মার্জিত মহিলা কণ্ঠ সাড়া দেয়।

মিস হিগিন্স বলছেন?

হ্যাঁ। আপনি কে?

রোয়েন। রোয়ে আল সিমা, আপনি যাকে রোয়েন সাঈদ বলে চিনতেন।

রোয়েন, সত্যি তুমি? কতকাল তোমার কোনো খবর নেই! আছো কেমন?

কিছু সময় আলাপের পর প্রফেসরকে লাইনে চাইলো রোয়েন। তিনি ধরলেন ফোন।

আমার ফেভারিট স্টুডেন্ট? শুনে হাসছে রোয়েন। অনেক আগেই অবসর নেওয়ার কথা প্রফেসরের, বয়েস সত্তরের উপর। এখনো তিনি শক্ত-সামর্থ, অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী, আর সব সুন্দরী ছাত্রীকে ফেভারিট বলে মনে করেন।

. ইন্টারন্যশনাল কল, প্রফেসর, মনে করিয়ে দিল রোয়েন। আমি শুধু জানতে চাই অফারটা এখনো বহাল আছে কিনা।

মাই গুডনেস, আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করবে না।

পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। যদি দেখা হয় সব আপনাকে খুলে বলব।

অবশ্যই তোমার লেকচার আমরা শুনতে চাই। কবে নাগাদ আসতে পারবে?

কাল আমি ইংল্যান্ডে আসছি। ইয়র্কে, মায়ের কাছে থাকব। আপনি ফোন নম্বরটা লিখে রাখুন। তবে কয়েকদিনের মধ্যে আমিই আপনাকে কল করব।

ক্রেডলে রিসিভার রেখে দিয়ে বিছানায় কাত হলো রোয়েন।

দু মাস আগে রানী লসট্রিস-এর সমাধি ও স্ক্রোল আবিষ্কার এবং খনন কাজ সম্পর্কে লেকচার দেওয়ার জন্য প্রফেসর ডিক্সন আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ওকে। গোটা বিষয়টা সম্পর্কে তিনি জানতে পারেন একটা বই পড়ে, বিশেষ করে বইটার শেষে যোগ করা ফুটনোট পড়ে। বইটা প্রকাশ পাবার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন মহলে বিরাট আলোড়ন উঠেছিল। অ্যামেচার ও প্রফেশনাল, দু ধরনের ঈজিপ্টলজিস্টই খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেন। এমন কি টোকিও আর নাইরোবির মতো দূর দেশ থেকেও প্রচুর চিঠি আর ফোন আসে। সবারই একটা প্রশ্ন, উপন্যাসের কাহিনী সত্যের উপর ভিত্তি করে রচিত কিনা।

রোয়েন আসলে কোনো গল্প লেখককে ট্রান্সক্রিপসন দেখাতে একদমই রাজি হয় নি, বিশেষ করে ওগুলো তখনো সম্পূর্ণ না হওয়ায়। ওর মনে হয়েছিল, গোটা ব্যাপারটাকে সিরিয়াস অ্যাকাডেমিক সাবজেক্ট হিসেবে গণ্য করা উচিত। প্যালিয়েন্টেলজিকে স্পিলবার্গ যেমন জুরাসিক পার্কের মাধ্যমে খেলা করে ফেলেছেন, ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম।

ওর আপত্তিতে এমন কি ডুরেঈদও কান দেন নি। কারণটা অবশ্যই টাকা। বড় কোনো কাজ তো দূরের কথা, টাকার অভাবে ওদের ডিপার্টমেন্ট ছোটখাট কোনো কাজেও হাত দিতে পারছিল না। বইটার নাম রিভার গড, লেখক উইলবার স্মিথ। আগেই কথা হয়ে যায়, রয়্যালটির অর্ধেক টাকা ডিপার্টমেন্ট পাবে। সেই টাকা দিয়ে এক বছর গবেষণা আর অনুসন্ধানের কাজ চালানো সম্ভব হয়েছে। তবু লেখকের প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারে নি রোয়েন। তার কারণ, স্ক্রোলে যা লেখা আছে তার উপর রঙ চড়িয়েছেন তিনি, ঐতিহাসিক চরিত্র ও ব্যক্তিত্বকে দিয়ে এমন সব কথা বলিয়েছেন বা এমন সব কাজ করিয়েছেন, যা করা বা বলা হয়েছে কিনা প্রমাণ নেই। প্রাচীন লেখক টাইটাকে আধুনিক লেখক উইলবার স্মিথ চিত্রিত করেছেন মিথ্যে বড়াইকারী ও দাম্ভিক হিসেবে, বিশেষ করে এখানেই রোয়েনের আপত্তি।

পরে অবশ্য রোয়েনকে মেনে নিতে হয়েছে। একজন লেখক তার পাঠককে প্রাঞ্জল ভাষায় মুখরোচক গল্পের খোরাক পরিবেশন করবেন, এ তো জানা কথা। সন্দেহ নেই, সে কাজে উইলবার স্মিথ পুরোপুরি সফল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো রোয়েন। ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে, এ নিয়ে চিন্তা করলে শুধু শুধু মাথা ব্যথাই বাড়বে।

ওর বরং এখন জরুরি সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা দরকার। লীডস-এ লেকচার দিতে হলে ওর স্লাইডগুলো লাগবে, কিন্তু সেগুলো মিউজিয়ামে ওর অফিসে আছে। কীভাবে ওগুলো ওখান থেকে বের করা যায় ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো রোয়েন, কাপড় না পাল্টেই।

*

শেষে সহজ সমাধানটাই বেছে নিল রোয়েন। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিসে ফোন করে কী করতে হবে বলে দিল ও, ওই অফিসের একজন সেক্রেটারি স্লাইডগুলো নিয়ে হাজির হলো ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের চেক ইন ডেস্কে। ওকে ওগুলো দেওয়ার সময় সে জানালো, আজ সকালে অফিস খোলার পর পুলিশ এসেছিল। কথা বলার জন্য আপনাকে খুঁজছিল তারা।

বোঝাই যায়, রেনোয়ার রেজিস্ট্রেশন চেক করেছে পুলিশ। ভাগ্য ভালো যে রোয়েনের কাছে ব্রিটিশ পাসপোর্ট আছে। মিশরীয় পাসপোর্ট নিয়ে দেশত্যাগ করতে হলে সমস্যা এড়ানো যেত না। পাসপোর্ট কন্ট্রোল পয়েন্টে পুলিশ সম্ভবত রেসট্রিকশন অর্ডার দিয়ে রেখেছে। যা হোক, চেক পয়েন্টে কোনো অসুবিধে দেখা দিল না। ডিপারচার লাউঞ্জে ঢুকে নিউজ-স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো রোয়েন।

স্থানীয় সবগুলো দৈনিকে ওর গাড়িতে বোমা ছুঁড়ে মারার ঘটনাটা ছাপা হয়েছে, সেই সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে ইবনে ডুরেঈদের হত্যাকাণ্ড। রিপোর্টাররা বলতে চেয়েছে ঘটনা দুটোর মধ্যে যোগসূত্র আছে এবং কোনো দলের নাম উল্লেখ না করে মৌলবাদী ধর্মীয় গ্রুপগুলোকে দায়ী বলে আভাস দেওয়া হয়েছে। রোয়েন প্রতিটি দৈনিকেরই একটা করে কপি কিনল।

• প্লেন তখন আকাশে, নোটবুক বের করে ডুরেঈদ হাসলেন, হারপার নিকোলাস সম্পর্কে যা যা বলেছে সব লিখে রাখছে রোয়েন। লন্ডনে পৌঁছে এ ভদ্রলোককে খুঁজে বের করতে হবে, যদি তিনি ইংল্যান্ডে থাকেন।

ডুরেঈদের কাছে রোয়েন শুনেছে, ব্রিটিশ কলোনিয়াল চাকরিতে অবদানের জন্য নিকোলাসের বড়ো বাবাকে ব্যারোনেট উপাধিতে ভূষিত করেছিল রানী। তিন পুরুষ ধরেই নিকোলাসের পরিবার আফ্রিকার সঙ্গে গাঢ় হৃদ্যতা এবং যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে, বিশেষত উত্তর আফ্রিকার ব্রিটিশ কলোনি ছিল যে দেশগুলোয়, সেগুলোর সাথে মিশর, সুদান, উগান্ডা এবং কেনিয়া।

রোয়েন জানে, স্যার নিকোলাস নিজেও আফ্রিকার উপকূলে ব্রিটিশ আর্মির হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। আরবি এবং সোয়াহিলি–দু ভাষাতেই সমান দক্ষ ভদ্রলোক, একজন সৌখিন প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং প্রাণিবিজ্ঞানী। বাপ-দাদার মতো নিকোলাসও বহুবার উত্তর আফ্রিকার গহীন এলাকায় অভিযান চালিয়েছেন, সংগ্রহ করেছেন মূল্যবান নমুনা। বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নালে তার লেখা প্রকাশিত হয়, এমন কি রয়াল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটিতে লেকচার পর্যন্ত দিয়েছেন তিনি।

নিঃসন্তান বড়ো ভাইয়ের মৃত্যুর পর পারিবারিক টাইটেল এবং কুয়েনটন পার্কের এস্টেটের মালিকানা বর্তায় নিকোলাসের উপর। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয় সে। যতোটা না এস্টেট দেখাশোনার জন্য, তার চেয়ে বেশি পারিবারিক মিউজিয়াম পরিচালনার কারণে। ১৮৮৫ সালে প্রথম ব্যারন চালু করেছিলেন ওটা। আফ্রিকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য দারুণ জনপ্রিয় এ যাদুঘর; এছাড়াও প্রাচীন মিশর এবং মধ্যপ্রাচ্যের নানা আর্টিফ্যাক্টও রয়েছে এখানে।

ডুরেঈদের কথা অনুযায়ী, উদ্দাম, ক্ষেত্রবিশেষে আইনের ভয় না করা একটা সত্তা আছে নিকোলাসের। বোঝা যায়, যাদুঘরের সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনে আইনকে কাঁচকলা দেখাতে পারেন তিনি।

গাদ্দাফির লিবিয়া থেকে দুপ্রাপ্য কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ পাচার করার সময় ডুরেঈদকে তার এজেন্ট হিসেবে কাজে লাগিয়েছিল নিকোলাস। শ্রেষ্ঠ নমুনাগুলো নিজের সংগ্রহে রেখে বাদকবাকিগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয় অভিযানের খরচা ওঠানোর জন্য।

তার আরো একটা অভিযান সম্পর্কে জানতেন দুরেঈদ। সেটাও বেআইনী কাজ। গোপনে ইরাকে ঢুকতে হয়েছিল। সাদ্দাম হোসেনেরে নাকের ডগা থেকে একজোড়া পাথুরে ব্যাসরিলীফ ফ্রীজ উদ্ধার করে আনেন তিনি। ফ্রীজ হলো স্তম্ভ বা কার্নিসের মধ্যবর্তী কারুকার্যময় অংশ। ডুরেঈদ জানিয়েছেন, জোড়ার একটা নাকি পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি করা হয়েছে, এসবই কয়েক বছর আগের ঘটনা।

এখন কি নিকোলাস রাজি হবে ফারাও-এর সম্পদের অনুসন্ধানে অভিযানে যেতে? কোনো সন্দেহ নেই, ধরা পড়লে শাস্তি পেতে হবে মিশরের সম্পদ পাচারের দায়ে।

ডুরেঈদ বার বার করে বলেছেন, নিকোলাসের প্রচুর প্রভাবশালী বন্ধু-বান্ধব এবং শুভানুধ্যায়ীদের কারণেই এতো কিছু পারে সে।

সৎ ও পবিত্র থাকার একটা ঝোঁক আছে নিজের মধ্যে, রোয়েন জানে। কথাটা ভেবে আপন মনে হাসলো ও। হারপার নিকোলাস যদি ওকে সাহায্য করতে রাজি হন, সাংঘাতিক ঝুঁকি নিতে হবে তাঁকে। প্রশ্ন হলো, কোনো স্বার্থ ছাড়া কেন কেউ নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি নেবে? তাছাড়া, যে কাজটায় তাঁর সাহায্য চাইতে যাচ্ছে, সেটাও কোনো অংশে কম বেআইনী নয়। ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো রোয়েন।

এয়ার হোস্টেস ওর ঘুম ভাঙিয়ে সিট বেল্ট বাঁধার তাগিদ দিল। ওদের প্লেন হিথরোতে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে।

*

বিমানবন্দর থেকে মা-কে ফোন করলো রোয়েন। মা, আমি রোয়েন! তুই কোথায়? চির আমুদে স্বরে জানতে চান রোয়েনের মা।

হিথরোতে। তোমার সাথে কিছুদিন থাকবো। কোনো সমস্যা নেই তো?

শোনো মেয়ের কথা! সমস্যা আবার কী? ভর্ৎসনার সুরে বলেন মহিলা।

কোন্ রেলে আসবি?

সাতটার সময়। কিংস ক্রস ট্রেনে।

ঠিক আছে। আমি স্টেশনে আসবো তোকে নিতে। কী ঘটেছে রে? ডুরেঈদের সঙ্গে কোনো ঝগড়া-ঝাটি? আমি জানতাম–ওই লোকের বয়স তোর বাপের সমান!

বেশ কিছু সময় নীরব রইলো রোয়েন, এটা ঠিক ব্যাখ্যাদানের সময় নয়। দেখা হলে সব বলবো।

নভেম্বরের বিষণ্ণ শীতল সন্ধ্যায় প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় ছিলেন জর্জিনা লুমলি, রোয়েনের মা। পায়ের কাছে সধৈর্য বসে পোষা কুকুর ম্যাজিক। ঠিক যেনো মানিকজোড়। ট্রায়াল কাপে হোক, কিংবা অন্য সময়ে, ম্যাজিক জর্জিনার সঙ্গে থাকবেই। রোয়েনের মনে অদ্ভুত এক শান্তি বোধ হয়, যেনো বহুদিন পর বাড়ি ফিরেছে।

ওর গালে চুমু খেয়ে স্বাগত জানালেন জর্জিনা। কাদা মাখা ল্যান্ড-রোভারের দিকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন মেয়েকে।

ম্যাজিকও লেজে নেড়ে স্বাগত জানালো রোয়েনকে।

বেশ কিছুক্ষণ নীরবে গাড়ি চালানোর পর একটা সিগারেট ধরিয়ে জর্জিনা বললেন, ডুরেঈদের খবর বল।

কান্নায় ভেঙে পড়লো রোয়েন। এ ক-দিনের সমস্ত কান্না যেনো পথ খুঁজে পেল, দুঃখ শোক উথলে বের হলো ওর ভেতর থেকে। ডুরেঈদের শেষ কৃত্যানুষ্ঠানের বর্ণনা দেওয়ার সময় জর্জিনা মেয়েকে এক হাতে সান্ত্বনা দিলেন।

জর্জিনার কটেজে যতক্ষণে ফিরলো ওরা, সমস্ত শোক ভুলে একটু হালকা হয়েছে রোয়েন। মায়ের তৈরি খাবার দিয়ে বেশ আয়েশ করে ডিনার করলো দু জন। কবে শেষ এমন খাবার খেয়েছে, রোয়েন ভুলেই গিয়েছিল।

এখন কী করবে? গ্লাসে পানীয় ঢেলে দিতে দিতে জানতে চাইলেন জর্জিনা।

সত্যি করে বললে–আমি জানি না, মনে মনে রোয়েন ভাবে, মিথ্যে কথা বলতে গেলে কেনো যেনো সবাই এ কথাটাই বলে! মিউজিয়াম থেকে ছয় মাসের ছুটি পেয়েছি, প্রফেসর ডিক্সন ইউনিভার্সিটিতে একটা লেকচারের জন্য আয়োজন করে রেখেছেন। মোটামুটি এ তো।

ঠিক আছে। যতোদিন ইচ্ছে থাক না তুমি। চিরন্তন মাতৃস্নেহ ঝরে পড়লো জর্জিনার কণ্ঠ থেকে।

ইয়র্কে, মায়ের গ্রামের বাড়িতে লেকচার তৈরি করার জন্য স্লাইড আর নোটগুলো সাজাতে কয়েকটা দিন ব্যয় করলো রোয়েন। রোজ বিকেলে পোষা কুকুর ম্যাজিককে নিয়ে গ্রামের পথে হাওয়া খেতে বেরোয় ও। মেয়ে অভয় দিলেও, একা ওকে কোথাও যেতে দেন না জর্জিনা, তিনিও সঙ্গে থাকেন।

কুয়েনটন পার্ক চেনো তুমি? বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে একদিন জানতে চাইলো রোয়েন, মায়ের কাছে।

বেশ ভালো চিনি, উৎসুক জর্জিনা বলেন। ম্যাজিক আর আমি বছরে কম করে হলেও পাঁচ কি ছয় সিজন যাই ওখানে। দারুণ জায়গা। অনেক বুনো হাঁসের দলের দেখা মেলে। শিকারের জন্য এর চেয়ে ভালো আর হয় না। ইংল্যান্ডের সেরা পেশাদার শুটাররা যান ওখানে, পাখি শিকারে।

নিকোলাস হারপার–ওটার মালিক, ওনার সাথে পরিচয় আছে তোমার?

এমনি দেখেছি আর কি। পরিচয় নেই। জর্জিনা উত্তরে বলেন। ওর বাপের সঙ্গে জানাশোনা ছিল বিয়ের আগে। ভালো নাচতো ব্যাটা। সবসময় যে ড্যান্স ফ্লোরে নাচত–তাও নয়!

রোয়েন স্তম্ভিত।

মা!

হুম। বেশ দুরন্ত ছিলাম কিন্তু!

তুমি আর ম্যাজিক আবার কুয়েনটন পার্কে যাবে কবে?

এই তো, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে।

আমি যেতে পারি?

নিশ্চই। একজন বিটার পেলে তো ওরা বর্তে যায়। লাঞ্চ, বিয়ারের বোতল সব ওরাই দেয়। হঠাৎ থেমে পরে মেয়ের চোখে তাকালেন জর্জিনা। কী ব্যাপার বল তো?

শুনেছি বিখ্যাত ঈজিপশিয়ান কালেকশন আছে ওদের। একটু দেখতে চাই।

পাবলিকের জন্য ভোলা নয়। নিকোলাস বেশ রুক্ষ মানুষ, সবসময় আড়ালে থাকতে চান। নিমন্ত্রীত অতিথি ছাড়া কারো প্রবেশাধিকার নেই যাদুঘরে।

তুমি পারবে নাকি, আমার জন্য একটা নিমন্ত্রণপত্র যোগাড় করে দিতে?

মাথা নাড়েন জর্জিনা।

আমি না। কিন্তু প্রফেসর ডিক্সনের সঙ্গে নিকোলাসের ভালো খাতির। ওকে বলে দেখতে পারি।

*

দশ দিন পর প্রফেসর ডিক্সনের সঙ্গে দেখা হলো রোয়েনের। মায়ের গাড়ি নিয়ে লীডস-এ গেল সে। কক্ষভর্তি বই, কাগজ আর আর্টিফ্যাক্ট আনমনা করে তুললাম রোয়েনকে। দুরেঈদের মৃত্যুর খবরে দারুণ অবাক হলেন ডিক্সন, অবশ্য খুব দ্রুতই বিষয়টা পরিবর্তন করে ফেললেন তিনি। লেকচারের জন্য ওর প্রস্তুতি নিয়ে খুঁটিনাটি জানতে চাইলেন।

চলে আসার কিছুক্ষণ আগে কুয়েনটন পার্কের কথা বলল রোয়েন। সাথে সাথেই সাড়া দিলেন প্রফেসর।

তুমি এখনো ওখানে যাও নি? অবাক হলাম। দারুণ কালেকশন। একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কুয়েনটন পরিবারের সংগ্রহশালা সত্যি দেখার মতো। আগামি বৃহস্পতিবার এস্টেটে শিকারে যাচ্ছি আমি, তখন নিকোলাসের সঙ্গে কথা বলে দেখবো এখন। ও অবশ্য অনেকটা পাল্টে গেছে। বেচারার উপর দিয়ে বেশ ঝড়-ঝাপ্টা গিয়েছে। মোটর দুর্ঘটনায় স্ত্রী আর দুই মেয়ে হারিয়েছে গত বছর। নিকোলাস নিজেই চালাচ্ছিল তখন।

তো, তোমার লেকচারের অপেক্ষায় থাকলাম। মনে হয়, একশোরও বেশি শ্রোতা পাবে। ইয়র্ক শায়ার পোস্ট থেকে একজন রিপোর্টারও যোগাড় করেছি আমি। তোমার ইন্টারভিউ নিতে চায়। বলা যায়, আমাদের ডিপার্টমেন্টের জন্য সেরা পাবলিসিটি। দুই এক ঘণ্টা আগে এসো, ওদের সঙ্গে কিছু সময় কথা বলে নিও। .

আপনার সাথে এর আগেই আমার দেখা হবে, স্যার। রোয়েন জানায় বৃদ্ধকে। মা আর ম্যাজিককে নিয়ে কুয়েনটন পার্কে যাচ্ছি আমরা বৃহস্পতিবারে। বিটারের চাকরি পেয়েছি ওইদিন!

ঠিক আছে। তোমাকে খুঁজবো। ভালো থেকো।

বিদায় নেয় রোয়েন।

*

দারুণ ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল উত্তর থেকে। ঘন মেঘমালা, ধূসর, ভারী, যেনো পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়ে আছে। মায়ের দেওয়া জ্যাকেটের নিচে তিনপ্রস্থ কাপড় পরেছে রোয়েন। কিন্তু কাঁপুনি থামাতে পারছে না। এক সারিতে সমস্ত বিটারেরা এগুচ্ছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। পা দুটো কবেই বরফ হয়ে গেছে! নীলের উপত্যকার আর্দ্র-বাতাস রোয়েনের রক্ত পাতলা করে দিয়েছে।

আজকের দিনের শেষ ড্রাইভের জন্য প্রধান বিটার, জর্জিনাকে লাইনের সামনের দিকে নিয়ে এসেছেন। ওদের কাজ হবে, গুলিবিদ্ধ পাখি বা বুনোহাঁসগুলোকে সংগ্রহ করা।

দিনের শেষভাগে সবচেয়ে উত্তেজনাকর হাই লার্চে চলছে অভিযান। পাহাড়ের গা থেকে পাখিগুলো তাড়িয়ে আনার জন্য প্রচুর বিটার চাই এখানে, বিশাল ভূখণ্ড ছড়িয়ে আছে চারপাশে। তাড়া খেয়ে পাখির দল এসে পরবে উপত্যকায় তৈরি থাকা শিকারীর বন্দুকের সামনে।

বুনোহাঁস আর পাখিদের প্রতি এ বড়ো অন্যায় ব্যবহার, রোয়েন ভাবে। জর্জিনা তাকে জানিয়েছেন, যতো উঁচু দিয়ে উড়ে যাবে ওরা, যতোই কঠিন হবে শিকার, ততো বেশি খুশি শিকারীরা।

জানিস, একদিনের শুটিং-এর জন্য কতো টাকা খরচ করে এরা? জর্জিনা বলেছিলেন। এক আজকের দিনেই ১৪ হাজার পাউন্ড আয় হবে এস্টেটের। এ সিজনে বিশদিন চলবে শিকার। এবার হিসেব করে দেখ, কতো টাকার মামলা! এস্টেটের সিংহভাগ অর্থই আসে শুটিং থেকে। শুধু শুধু অবসর সময় কাটানোর চেয়ে কুকুর নিয়ে দৌড়ে আমার মতো লোকাল মানুষ কিছু পয়সা রোজগার করছে খারাপ কী?

অবশ্য, বিটারের কাজে এখন আর কোনো আমোদ পাচ্ছে না রোয়েন। ঢালু পথে হাঁটা বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে, একবার তো পরেই গিয়েছিল। গায়ে-হাতে মাটি মাখামাখি, ক্লান্তিতে একেবারে নুয়ে গেছে সে। হাতের লাঠির উপর ভর দিয়ে এগুচ্ছে। কিন্তু তার মা মোটেও ক্লান্ত নয়, চোখ চকচক করছে তার।

এই শেষ ল্যাপ, রোয়েন। বললেন জর্জিনা।

নিজের দুরবস্থায় লজ্জা পেল রোয়েন। লাঠি ফেলে, এক লাফে একটা ডোবা অতিক্রম করতে চাইলো সে। হিসেবের গড়মিল, এক হাঁটু কাদাপানিতে মুখ থুবড়ে পড়লো।

হেসে ফেললেন জর্জিনা। সামনে এগিয়ে গিয়ে এক হাতে টেনে তুললেন মেয়েকে। ধড়মড় উঠলো রোয়েন। ওদিকে প্রধান বিটার চিৎকার করছেন, বামে থেমে দাঁড়াও সবাই!

থমকে দাঁড়ালো লাইন। একজন বিটারে কাজ হলো ঝোঁপ-ঝাড়ে বসে থাকা বুনোহাঁস, পাখির দলকে ধীরে সুস্থে, একটি দুটির দলে করে উড়তে বাধ্য করা, এক ঝকে নয়। এতে করে প্রথম দুই ব্যারেল ফায়ার করার পর অপর বন্দুক তৈরি করে নেওয়ার জন্য কিছুটা সময় পায় শিকারী। কতো চমৎকারভাবে অপেক্ষারত শিকারীর বন্দুকের সামনে পাখি পাঠাতে পারে–এরই ভিত্তিতে নির্ণীত হয় একজন কীপারের মূল্য।

বুক ভরে শ্বাস টেনে চারদিকে তাকায় রোয়েন। ঝোঁপের ফাঁক গলে উপত্যকা দেখতে পারছে সে। গত সপ্তাহের তুষারপাতে পাহাড়ের পাদদেশের কিছুটা ঘেঁসো জমিন সাদা হয়ে গেছে। ওখানে, নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষায় আছে শিকারীরা।

সবাই অধীর অপেক্ষায় আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে, কখন দেখা দেয়। বুনোহাঁস।

নিকোলাস কোনজন, মা? রোয়েন শুধোয় মা-কে। শিকারীদের শেষ সারির দিকে, দেখান জর্জিনা।

ও, লম্বা ভদ্রলোক?

খড়খড় করে ওঠে ওয়াকি টকি। কীপার সবাইকে নতুন নির্দেশ দিচ্ছেন। ধীরে বামে ঘোরো। আস্তে আস্তে ঝোপে বাড়ি দাও। বাধ্যগতের মতো হাতের লাঠি দিয়ে বাড়ি মারতে থাকে বিটারেরা।

সামনে এগোন এবারে। এক ঝাঁক উড়ে গেলে থেমে দাঁড়াবেন।

ধীরে, নিরাসক্তভাবে বাতাসে ডানা মেলে বুনোহাঁসের দল।

জর্জিনা, ম্যাজিক–সবাই খুব খুশি। নিঃশব্দ হাসিতে ফেটে পড়েছে যেনো ম্যাজিক, এ কাজের জন্যই তো ওর জন্ম! তাড়া দেওয়া ওর ভারী পছন্দ।

ম্যাজিকের তাড়া খেয়ে উড়ে যায় একদল বুনোহাঁস। মেয়ে হাঁসটা সামনে, পুরুষটা পেছনে। দারুণ রাজকীয় অবয়ব তার। রক্তবর্ণ আর সবুজের মিশেল লেজটা সিনামন আর কালো রঙে সাজানো, ভীষণ লম্বা।

উড়ে যেতে যেতে ধূসর আকাশের গায়ে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে উঠে হাঁসটা। এমন। সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে পড়ে রোয়েন।

দ্যাখ, দ্যাখ, কেমন সুন্দর উড়ে যায়! উত্তেজনায় খসখসে হয়ে গেছে জর্জিনার গলা। দিনের সেরা জোড়া! বাজি রাখলাম, কোনো বন্দুক ওদের নাগাল পাবে না!

ওই তো উড়ে যাচ্ছে ওরা, মুক্ত, স্বাধীন। এখনই চলে যাবে পাহাড় পেরিয়ে। কিন্তু হঠাৎ এক পশলা গরম হাওয়া টেনে উপত্যকার দিকে নিয়ে যায় হাঁস। দম্পতিকে।

বিটারের সারি এ সময়ের অপেক্ষায় ছিল। এর জন্যই যতো কষ্ট। উড়ে গিয়ে বন্দুক ফাঁকি দিতে পারলে সবচেয়ে খুশি হয় বিটারেরা।

বাতাসে মুচড়ে উড়ছে এখনো জোড়া হাঁস। নিজে থেকেই থমকে দাঁড়িয়েছে তাড়ুয়ারা।

ওদিকে, উপত্যকার তলায় বসে থাকা শিকারীদের বন্দুকের নল ঊর্ধ্বমুখী হয়। সর্বোচ্চ গতিসীমায় পৌঁছে গেছে বুনোহাঁসের জোড়া, উত্তেজনায় অধীর শিকারীরা। ছো মারার ভঙ্গিতে এবারে নিচে নামতে শুরু করেছে।

যে কোনো বিচারেই সুকঠিন একটা টার্গেট ওরা। বারো বোর শর্টগানের আওতার শেষ সীমানায় ঝরে পড়তে থাকা বুনো হাঁসে লাগানো চাট্টিখানি কথা নয়। সবচেয়ে সেরা শর্ট হয়তো একটাকে পেতে পারে, কিন্তু একই সঙ্গে দুটো? মনে হয় না।

এক পাউন্ড বাজী ধরলাম! জর্জিনা বলে ওঠেন। দুটোই বেঁচে যাবে! কেউ অবশ্য তার সাথে বাজী লাগতে এলো না।

ধীরে, একপাশে ঠেলে দিচ্ছে বাতাস, পাখিজোড়াকে। দূরের কোণায় সরে যাচ্ছে ওরা। নড়ছে বন্দুকের নল, রোয়েন দেখতে পারছে ওর অবস্থান থেকে। এবারে, একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শিকারীরা কিছুটা সহজ অবস্থানে চলে গেছে টার্গেট।

সারির সবচেয়ে শেষের শিকারী দাঁড়িয়ে আছে গতিপথে।

আপনার শর্ট, স্যার, কিছুটা পরিহাসের সুরে এক বন্দুকধারী বলল লম্বা শিকারীকে। নিজের অজান্তেই দম আটকে ফেললো রোয়েন। অবয়বে কী এক প্রতীক্ষা!

যেনো হাঁস জোড়ার আগমন সম্পর্কে সচেতন নয় নিকোলাস হারপার। শর্টগান হাতের ভাঁজে আটকে শিথিল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সে, দীর্ঘ শরীর স্থির।

মাদী হসটা যখন তার অবস্থান থেকে ষাট ডিগ্রী মতো কোণে রয়েছে, প্রথমবারের মতো নড়ে উঠলো নিকোলাস। সহজাত ভঙ্গিতে শর্টগান ঘুরিয়ে বাতাসে বৃত্ত কাটলো, বৃত্ত পূর্ণ হওয়ার আগেই চিবুকে যখন ঠেকলো বন্দুকের বাট; গুলি করলো সে।

দূরত্বের কারণে শব্দটা দেরিতে পেল রোয়েন। বন্দুকের আঁকি, নলের সামনে থেকে ওড়া ম্লান নীল ধোয়া তার নজড়ে এলো আগে। অস্ত্র নামিয়ে রাখলো নিকোলাস। মাথা নিচু করে হঠাৎই ধরিত্রীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো মাদী হাঁসটা। কোনো পালক ছড়িয়ে পড়লো না বাতাসে, সরাসরি মাথায় লেগেছে গুলি। এ সময় আবারো গুলির শব্দ পেল রোয়েন।

ততক্ষণে সরাসরি নিকোলাসের মাথায় উপরে চলে এসেছে মদ্দাটা। এবারে, পিঠ সামান্য বাঁকিয়ে গুলি ছুঁড়লো সে, লম্বা শরীর বেঁকে গেছে। আবারো, গর্জে উঠলো বন্দুক।

একইসঙ্গে সন্তুষ্টি আর নিরাশা নিয়ে রোয়েন ভাবলো, মিস হয়েছে গুলিটা, নিজের মতো করে তখনো উড়ছে হাঁস। ওর অস্তিত্বের এক অংশ চাইছে হাঁসটা বেঁচে থাকুক, আবার আরেক অংশ চাইছে লম্বা লোকটা সফল হোক। আচমকা, পাখা ভাঁজ হয়ে এলো বুনোহাঁসের; রোয়েনের জানা নেই, ওর হৃদপিন্ডও ছিদ্র হয়ে গেছে।

মদ্দাটা মাটি ছুঁতে উল্লাসের ধ্বনি বের হলো তাড়য়াদের মুখ থেকে। এমনকি অন্য শিকারীরা সবাই সমস্বরে স্বীকার গেল দারুণ শর্ট, স্যার!

রোয়েন অবশ্য এ উল্লাসে যোগ দেয় নি, কিন্তু ওর শরীরের হিমঠাণ্ডা কেটে গেছে। একটু হলেও প্রভাবিত হয়েছে সে। ডুরেঈদের কথা ঠিক প্রথম দর্শনেই ভদ্রলোক তার প্রত্যাশা পূরণ করেছেন।

শেষ চলন শেষ হতে প্রায় অন্ধকার হয়ে এলো চারদিক। ক্লান্ত বিটার আর কুকুরগুলোকে তুলে নেওয়ার জন্য একটা ট্রাক এসে দাঁড়ালো জঙ্গলের পাশে। লম্বা বেঞ্চে বসলো সবাই কৃতজ্ঞচিত্তে। সিগারেট ধরিয়ে সবার সাথে গল্পে মেতে উঠলেন জর্জিনা।

এমন কঠিন একটা দিন শেষ হতে মনের গভীর কোথাও আনন্দ বোধ করছে। রোয়েন। ক্লান্ত, শিথিল কিন্তু আশ্চর্যরকম তৃপ্ত ও। অন্তত এক দিনের জন্য হলেও স্ক্রোল, ডুরেঈদের হত্যা আর অদেখা শত্রুদের নিয়ে ভাবে নি সে।

ঢাল বেয়ে পাহাড়ের নিচে নেমে এলো ট্রাক, এক পাশে সরে গিয়ে পথ করে দিল পেছনে আসা সবুজ রেঞ্জরোভারের। দুটো বাহন যখন পাশাপাশি, জানালো দিয়ে তাকিয়ে সরাসরি নিকোলাস কুয়েনটন হারপারের চোখে তাকালো রোয়েন। এস্টেটের গাড়ির চালকের আসনে বসে সে।

প্রথমবারের মতো কাছ থেকে লোকটাকে দেখছে রোয়েন। বয়সে তরুণ অবাক বিস্ময়ে সে ভাবে। ডুরেঈদের বয়সি কাউকে আশা করেছিল মনে মনে। সম্ভবত চল্লিশ পেরোয় নি বয়স। ট্যান করা চামড়া, বহু ঝড়-বঞা সহ্য করেছে বোঝা যায়। মোটা দ্রুর নিচে গভীর সবুজ অন্তর্ভেদি চোখ। ঠোঁটে এক টুকরো হাসি, চওড়া মুখে তবু বিষাদের ছাপ। রোয়েনের মনে পড়লো, প্রফেসর ডিক্সন কি বলেছিলেন ওকে। তাহলে পৃথিবীতে একা আমি শোকসন্তপ্ত নই!

ওর চোখে চোখ রাখলো নিকোলাস। ভাব পাল্টে যাচ্ছে ভদ্রলোকের মুখের টের পায় রোয়েন। সুন্দরী নারীর উপস্থিতিতে কার না হয়! কিন্তু মনের গভীরে শান্তি বোধ করলো না রোয়েন। ডুরেঈদের নৃশংস মৃত্যু ওর স্মৃতিতে এখনো অম্লান। সেই সাথে ব্যথাতুর। চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকালো ও। পাশ কাটিয়ে চললো রেঞ্জ রোভার।

*

লীডস ইউনিভার্সিটিতে লেকচারটা ভালোই দিল রোয়েন। ওর বাচনভঙ্গি চমৎকার, নিজের সাবজেক্টের উপর ভালো দখল আছে। রানী লসট্রিসের সমাধি খোঁড়া ও স্ক্রোল আবিষ্কারের বর্ণনা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলো শ্রোতাদের। তাদের অনেকেই বইটা পড়েছে, ফলে স্বভাবতই প্রশ্নোত্তর পূর্বে জানতে চাওয়া হলো কাহিনীর কতটুকু সত্য। এ পর্যায়ে খুব সাবধানে কথা বলতে হলো রোয়েনকে, লেখকের নিন্দা করা থেকে সযত্নে বিরত থাকলো ও।

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর জর্জিনা আর রোয়েনকে ডিনার খাওয়ালেন প্রফেসর ডিক্সন। ডিনার পরিবেশনের আগে ওয়াইন দিয়ে গেল ওয়েটার। রোয়েন খাবে না শুনে বিস্মিত হলেন প্রফেসর, তারপর ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বললেন, তুমি কী ধর্মান্তরিত হয়েছ? মানে মুসলমান হয়েছ?

হেসে ফেলে রোয়েন। বলল, আমি কপ্ট। তবে মদ না খাবার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। টেস্টটা আমার ভালো লাগে না।

আমার লাগে, বলে ওয়াইন ভর্তি গ্লাসটা ঠোঁটে তুললেন জর্জিনা।

হয়তো ওয়াইনের প্রভাবেই, নিজের জীবনের বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে বিস্তারিত বলে গেলেন ডিক্সন। কফির সময় রোয়েনের দিকে ফিরলেন তিনি।

ও, ভুলেই গেছি, হঠাৎ বললেন প্রফেসর। এই সপ্তাহের যে কোনো একদিন সন্ধ্যেয় কুয়েনটন পার্কে তোমার ভিজিট নিশ্চিত করেছি আমি। নিকোলাসের পি. এ, মিস স্ট্রিটকে ফোন করলে ও তোমার সমস্ত ব্যবস্থা করে দেবে।

*

কুয়েনটন পার্কে যাওয়ার পথটা রোয়েনের পরিচিত। কয়দিন আগে জর্জিনার সঙ্গে এসেছিল। কিন্তু এবারে ল্যান্ড রোভারে সে একা। বিশাল প্রধান ফটক কাস্ট আয়রনে তৈরি। তার একটু সামনে গেলে তিন চারটে রাস্তা চলে গেছে, প্রতিটির সামনে সাইনবোর্ড পথ নির্দেশ করছে।

যাদুঘরে যাওয়ার পথটা চলে গেছে হরিণ-পার্কের মাঝখান দিয়ে। নির্ভিক উৎসুক চোখে ইতিউতি ঘুরে ফিরছে হরিণের পাল। কুয়াশাচ্ছন্ন বাতাসের ফাঁক গলে বিশাল বাড়িটা এক আধবার দেখতে পারছে রোয়েন। প্রফেসর ডিক্সনের দেওয়া গাইডবুক পড়ে সে জেনেছে, ১৬৯৩ সালে প্রখ্যাত স্থপতি স্যার ক্রিস্টোফার রেন এর নকশা করেছিলেন। ষাট বছর পর ব্রাউন সাহেব তৈরি করেছেন বাগানটা। অসাধারণ বললে আসলে কম বলা হবে, এমনই সৌন্দর্য এর।

কপার বিচ গাছের সারির মাঝে মূল বাড়ি থেকে আধ মাইল মতো দূরে যাদুঘরের অবস্থান। বোঝাই যায়, বহুবার মেরামত করা হয়েছে বাংলোটা। দরজার কাছেই অপেক্ষাই ছিলেন মিসেস স্ট্রিট, রোয়েনকে স্বাগত জানিয়ে ভিতরে ডেকে নিলেন তিনি। ধূসর চুলের মধ্যবয়স্কা মহিলা। সোমবারে বিকেলে আপনার লেকচারে আমি ছিলাম। দারুণ হয়েছে! একটা গাইডবুক আছে মিউজিয়ামের, আমার মনে হয়, এর সংগ্রহে আপনি মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। বিশ বছর হয়ে গেল এখানে চাকরি করছি। আজ একা আপনিই ভিজিটর। নিজের মতো করে ঘুরে দেখুন, পাঁচটার আগে এখান থেকে যাচ্ছি না আমি। গলিপথের শেষ মাথায় আমার অফিস, প্রয়োজন হলে ওখানে পাবেন আমাকে।

আফ্রিকান স্তন্যপায়ী প্রাণীর ডিসপ্লে দেখে প্রথমেই মুগ্ধ হলো রোয়েন। আলোচ্য মহাদেশের সমস্ত প্রাণীই আছে সেখানে। রূপালি-ধূসর পুরুষ গরিলা থেকে শুরু করে সব রকমের বানর, কলোবাস।

যদিও কিছু কিছু নমুনা প্রায় একশ বছরের পুরোনো, তথাপি অত্যন্ত ভালো অবস্থায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই, সুদক্ষ কর্মী দ্বারা পরিচালিত হয় এ যাদুঘর। বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন এ জন্য রোয়েন ভাবে। মনের গভীরে স্বীকার যায়, পাঁচ মিলিয়ন পাউন্ড, ভালো কাজেই লেগেছে।

অ্যান্টিলোপের কক্ষে গিয়ে বিস্ময়াভূত রোয়েন তার চারপাশে তাকিয়ে দেখে সংরক্ষিত প্রাণীগুলো। একটা অভাবিত সুন্দর, অ্যাঙ্গোলান প্রজাতির দুর্লভ হরিণের স্টাফ দেখে দুঃখ বোধ হয় তার। এমন সুন্দর একটা প্রাণী মেরেছে হারপার পরিবার! ভাবা যায়! পরক্ষণেই নিজেকে প্রবোধ দেয়–শিকারীর সংগ্রহ না থাকলে আজ আর কেউ দেখতে পেতো না এ প্রজাতি।

পরবর্তী হলঘরে রয়েছে হাতির সংগ্রহ। বিশাল একজোড়া আইভরির সামনে দাঁড়িয়ে থমকে যায় রোয়েন–এতো বড়ো, বিশ্বাসই হতে চায় না কোনো জীবিত জন্তুর ওগুলো। এ যেনো ডায়ানার হেলেনিক মন্দিরের থামের মতো মোটা! থেমে পরে, ক্যাটালগ কার্ডটা পড়ে দেখে রোয়েন :

আফ্রিকার হাতির দাঁত, লক্সোডোনটা আফ্রিকানা। ১৮৯৯ সালে স্যার জোনাথন কুয়েনটন হারপার কর্তৃক মৃত। বামদিকের দাঁতের ওজন ২৮৯ পাউন্ড, ডানদিকের ৩০১ পাউন্ড। বড়ো দাঁতের দৈর্ঘ্য ১১ফুট ৪ ইঞ্চি। বেড় ৩২ ইঞ্চি। একজন ইউরোপীয় শিকারী কর্তৃক সংগৃহীত সবচেয়ে বড় আইভরি।

রোয়েনের দ্বিগুণ লম্বা ওগুলো। ওর কোমরের অর্ধেক মোটা। এরপর মিশরীয় সংগ্রহের কক্ষে ঢুকে চমৎকৃত হলো রোয়েন।

কক্ষের কেন্দ্রে ওর চোখ আটকে যায়। পনেরো ফুট উঁচু মূর্তি ওটা, ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের। দেবতা ওসিরিসের মতো করে চিত্রায়িত–পালিশ করা লাল গ্রানাইট পাথরের। দেব সম্রাট তাঁর পেশীবহুল পায়ে দাঁড়িয়ে, আঁটো জামা আর স্যান্ডল পরনে। বাম হাতে যুদ্ধ-ধনুকের অবশিষ্টাংশ বহন করছেন তিনি, বাকি অংশ ভেঙে গেছে। এতো হাজার বছরে কেবল এ সামান্য ক্ষতি ছাড়া সম্পূর্ণ অক্ষত মূর্তিটা। ডান মুঠোয় রাজকীয় বর্ণমালায় লেখা একটা সীল ধারণ করে আছেন। ফারাও।

মস্তকে দীর্ঘ দ্বিমুকুট। মুখাবয়বে প্রশান্তির ছাপ।

দেখার সাথে সাথেই চিনতে পারলো রোয়েন। কেননা, কায়রো যাদুঘরের গ্রান্ড হলে এর একটা জমজ রয়েছে। অফিসে যাওয়ার পথে প্রতিদিনই দেখতো সে।

নিজের ভেতরে উথলে ওঠা রাগের অস্তিত্ব টের পায় রোয়েন। মাতৃভূমি মিশরের অত্যন্ত মূল্যবান একটা সম্পদ ওটা। অথচ তার দেশ থেকে চুরি করে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। কারো অধিকার নেই, ওটা এখানে নিয়ে আসার। মহান নদী, নীলের তীরে এর আবাস। রাগে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে যায় রোয়েন, মূর্তির নিচে খোদাই করা হায়ারোগ্লিফিক পড়ে।

রাজকীয় অক্ষরে লেখা আছে সতর্কবাণী: আমি পবিত্র রামেসিস, দ্বিতীয়, দশ হাজার রথের প্রভু। হে মিশরের শত্রু–সাবধান! আমাকে চিনে রাখো!

রোয়েন নিজে জোরে পড়ে নি বার্তাটা, কিন্তু ওর পেছন থেকে নরম, ভারী কণ্ঠে কেউ একজন পাঠ করে বাক্যগুলো, চমকে দেয় তাকে। কাউকে আসতে শুনে নি রোয়েন, পাই করে ঘুরে দাঁড়ায় ও।

নীল কার্ডিগানের পকেটে হাত গোজা ভদ্রলোকের, এক কনুইয়ে একটা ফুটো। বহুল ব্যবহৃত ডেনিম জিন্স ওভারঅল পরনে, মনোগ্রাম করা ভেলভেট কার্পেট স্লিপার পায়ে।

দুঃখিত, আপনাকে চমকে দিতে চাই নি। আলস্যভরা মার্জিত হাসলো সে, চমৎকার সাদা দাঁতের সুন্দর হাসি। এরপরেই ওকে চিনতে পারলো।

আরে, আপনি! রোয়েন ভাবে, আমাকে চিনতে পেরেছেন ভদ্রলোক! এক মুহূর্তের জন্য দেখা হয়েছিল মাত্র! পরক্ষণেই, তার দৃষ্টির কিছু একটা বিরক্ত করলো তাকে। যা হোক, হাত মেলালো রোয়েন।

নিক কুয়েনটন হারপার, নিজের পরিচয় দিলেন ভদ্রলোক। আপনি পার্সিভালো ডিক্সনের ছাত্রী, আমি জানি। আমার মনে হয়, গত বৃহস্পতিবারে শিকারে আপনাকে দেখেছি। সম্ভবত বিট করছিলেন সেদিন।

একটু সহজ হয় রোয়েন। হ্যাঁ। আমি রোয়েন আল সিমা। আমার ধারণা, আমার স্বামী ডুরেঈদ আল সিমা আপনার পরিচিত।

ডুরেঈদ! চিনবো না মানে! মরুতে বহু সময় কাটিয়েছি দু জন একসঙ্গে। দারুণ লোক। কোথায় উনি?

ও মারা গেছে।

এমন সাধাসিধা, হৃদয়হীনের মতো বলতে চায় নি রোয়েন, কিন্তু আর কোনো জবাব এলো না মাথায়।

ওহ! বলেন কি? জানতামই না! কেমন করে ঘটলো?

এইতো, সপ্তাহ তিনেক আগে। খুন।

ওহ, মাই গড! চোখে বেদনা ফুটে উঠলো নিকোলাসের। নিখাদ ভাবাবেগ। মাত্র চারমাস হলো কায়রোতে ওর সাথে ফোনে কথা হয়েছে আমার। কতো চমৎকার ছিলেন তখনো। কারা খুন করেছে, পাওয়া গেছে?

মাথা নেড়ে রুমের চারদিকে দৃষ্টি ফেরায় রোয়েন, ওর চোখের কান্না দেখতে দিতে চায় না।

আপনাদের সংগ্রহ অসাধারণ!

বিষয়ের এ হঠাৎ পরিবর্তন মেনে নেয় নিকোলাস। সব আমার দাদার কীর্তি। কায়রোতে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে কাজ করতেন উনি।

বাধা দিয়ে রোয়েন বলে ওঠে, আমি জানি। সে সময় প্রথম আর্ল ছিলেন ব্রিটিশ কনসাল জেনারেল অব ঈজিপ্ট। ১৮৮৩ থেকে ১৯০৭। আমার দেশে একনায়কত্ব চালিয়েছেন বহুদিন।

নিকোলাসের চোখের দৃষ্টি সরু হয়। পার্সিভালো বলেছিল আপনি তার সেরা ছাত্রী। কিন্তু এটা বলেনি যে, আপনার জাতীয়তাবোধ এতো প্রখর। রামেসিসের হায়ারোগ্লিফিক অনুবাদ করার জন্য আমার সাহায্য দরকার নেই তবে।

আমার বাবা গামাল আবদেল নাসেরের বাহিনীতে ছিলেন, বিড়বিড় করে রোয়েন। রাজা ফারুকের পুতুল সরকার ভেঙে নাসেরই মিশরে ব্রিটিশ শাসনের যবনিকা টেনে দেন। সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করেন।

ওহ হো! নিকোলাস মুচকি হাসে। দুই মেরুর লোক তবে আমরা। তবে অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। আশা করি, আমি আর আপনি শত্রু নই আর!

মোটেও না, ডুরেঈদ আপনার সম্পর্কে বেশ ভালো বলতো।

আমি তাঁকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি। আবারো প্রসঙ্গ পাল্টায় নিক। রাজকীয় উশব তি, বা ছোট্ট পুতুল-এর সংগ্রহ নিয়ে আমরা বেশ গর্বিত। প্রাচীন সাম্রাজ্যের প্রত্যেক ফারাও-এর সমাধি থেকে শুরু করে টলেমি পর্যন্ত সবার আছে। চলুন আপনাকে দেখাই।

একটা দেয়াল জুড়ে সাজনো ডিসপ্লে কেস। শেলফের পর শেলফ জুড়ে শুধু পুতুল, সম্রাটের মৃত্যুর পর তার সমাধির মধ্যে একজন দাস বা ভৃত্য হিসেবে রাখা হতো ওগুলো।

চাবি দিয়ে একটা কেস খুলে সবচেয়ে সুন্দর পুতুলটা বের করে নিকোলোস। এটা হলো মায়া-র উশ তি, তুতেনখামেন, আয়ে এবং হোরেমহেব-এর শাসনামলে ভৃত্য ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪৩ সালে নিহত, আয়ে-এর সমাধি থেকে: সংগৃহীত।

পুতুলটা হাতে নিয়ে ওটার গায়ে অঙ্কিত হায়ারোগ্লিফিক পড়ে রোয়েন অনায়াসে। আমি মায়া-, দুই রাজ্যের কোষাধ্যক্ষ। পবিত্র ফারাও, আয়ে-এর হয়ে আমি জবাবদিহি করব। তিনি চিরজীবী হোন! ইচ্ছে করেই আরবিতে বলল রোয়েন। একটু পরীক্ষা করে দেখতে চায়। সাথে সাথেই সারলীল আরবিতে উত্তর দেয় নিকোলাস।

পার্সিভালো ডিক্সন দেখছি খাঁটি কথা বলেছেন। নির্ঘাত অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী আপনি।

পালা করে আরবি এবং ইংরেজিতে কথা বলে চললো ওরা। নিজেদের পছন্দমতো বিষয় পেয়ে আড়ষ্টতা কাটলো অনেকটা। প্রতিটি কেসের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ করে দেখলো।

যেনো প্রাচীনকালে ফিরে গেছে দু জন। এমন প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদের সামনে বর্তমান সময় যেনো কোনো গুরুত্ব বহন করে না। ঘণ্টা, মিনিট কেটে যেতে থাকে। মিসেস স্ট্রিট এসে চমকে দিলেন ওদের। আমি চলে যাচ্ছি, স্যার নিকোলাস। আপনি তাহলে লক্ করে এলার্ম চালু করে দিয়েন। সিকিউরিটি গার্ডেরা ডিউটিতে চলে এসেছে।

কয়টা বাজে? বলে, নিজের কবজির রোলেক্সের দিকে তাকায় নিকোলাস। পাঁচটা চল্লিশ! আজব ব্যাপার! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলে, আপনি যান, মিসেস স্ট্রিট। এতো সময় দেরি করিয়ে দেওয়ার জন্য দুঃখিত।

এলার্ম সেট করতে ভুলে যেয়েন না আবার, সতর্ক করে দিয়ে বলেন স্ট্রিট।

একদিনের জন্য অনেক আদেশ দিয়ে ফেলেছেন আমাকে। এখন যান তো! হেসে বলে নিকোলাস। এবারে রোয়েনের দিকে ফিরে বলে, ডুরেঈদের স্মৃতিবিজড়িত একটা জিনিস না দেখিয়ে আপনাকে ছাড়ছি না। সময় আছে তো?

রোয়েন মাথা নাড়ে। ওর হাত ধরতে এক হাত এগিয়েও কি মনে করে যেনো সরিয়ে নেয় নিক। আরব সমাজে ভদ্রমহিলাদের এমন কি ছোঁয়াও বারণ। একটু হলেও প্রভাবিত হয় রোয়েন।

ব্যক্তিগত নামাঙ্কিত একটা কক্ষে ওকে নিয়ে যায় নিকোলাস।

এটা হলো ইনার মিউজিয়াম। ব্যাখ্যাদানের ভঙ্গিতে বলে সে। বিশৃঙ্খল অবস্থার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী আগে আমার স্ত্রী সব গোছাতো, কিন্তু থেমে যায় নিকোলাস। দেরাজের উপর একটা পারিবারিক ছবির দিকে তাকায় এক পলক। নিকোলাস আর গাঢ় রঙা চুলের এক মেয়ে বসে কোনো এক পিকনিক পার্টিতে। মাথার উপরে বিস্তৃত ওকের শাখা। মায়ের মতো দেখতে দুটো ফুটফুটে মেয়ে আছে কাছেই, একজন নিকের কোলে; বড়টা ঘোড়ার দড়ি ধরে পেছনে দাঁড়িয়ে। আড়চোখে তাকিয়ে, নিকোলাসের চোখে সব হারানোর কষ্ট দেখতে পায় রোয়েন।

ভদ্রলোককে সামলে নিতে দিয়ে রুমের চারদারে চোখ বুলায় সে। বিশাল, আরামদায়ক কক্ষ–একজন পুরুষের, বোঝাই যায়। তবে তার দ্বৈত-চরিত্র যেনো প্রকাশ্য, বই-পত্রের পণ্ডিতির পাশাপাশি অভিযাত্রীর ছাপ বড়ো স্পষ্ট। বইয়ের সারির সঙ্গে রয়েছে ফিশিং রীল, শটগান, কার্টিজ, বাক্স, জ্যাকেট।

দেয়ালের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিগুলো চিনতে পারে রোয়েন। উনিশ শতকীয় শিল্পী ডেভিড রবার্টের আঁকা জলরঙ। আরো রয়েছে নেপোলিয়নের সঙ্গে মিশর ভ্রমণ করা শিল্পী ভিভান্ত ডেনন-এর প্রাচীন মিশরীয় স্থাপত্য চিত্র।

ফায়ারপ্লেসে কাঠখণ্ড ফেললো নিকোলাস। অর্ধেক দেয়াল ঢাকা পর্দার সামনে হাতছানি দিয়ে ডাকে রোয়েনকে। একটানে পর্দা সরিয়ে ফেলে, সন্তুষ্টির সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, কেমন লাগলো?

দেয়ালে কারুকার্জ করা বাস-রিলিফ ফ্রিজ দেখে তাক লেগে যায় রোয়েনের। কিন্তু নিজের অনুভূতি প্রকাশ পেতে দেয় না সে।

অ্যামোরাইট বংশধারায় ষষ্ঠ রাজা, হামুরাবি, খ্রিস্টপূর্ব ১৭৮০ সালের দিকের, নিপ্রাণ স্বরে বলে রোয়েন। প্রাচীন সম্রাটের নিখুঁতভাবে খোদাই করা মূর্তি পর্যবেক্ষণ করার ছল করে আবারো বলে, আসুর-এ, সম্ভবত তার প্রাসাদের স্থান, জিগুরাত থেকে আনা। দুটো থাকার কথা। কম করে হলেও পাঁচ মিলিয়ন ডলার করে এক একটি। সম্ভবত আধুনিক মেসোপটেমিয়ার শাসক, সাদ্দাম হোসেনের কাছ থেকে দুজন নীতি বিবর্জিত লোক এগুলো চুরি করে এনেছিল। আমার জানা মতে, টেক্সাসের জনৈক পিটার ওয়ালশের কাছে এর বাকিটা আছে।

অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে চেয়ে থাকে নিকোলাস। এরপর অট্টহাস্যে ফেটে পরে। ধুত্তোর! ডুরেঈদকে বলেছিলাম গোপন রাখতে। ব্যাটা বলে দিয়েছে। সেই প্রথম নিকোলাসকে হাসতে শুনলো রোয়েন। প্রাণখোলা, অবিচলিত হাসি।

হ্যাঁ, দ্বিতীয়টির মালিক সম্বন্ধে আপনার কথা ঠিক, হাসতে হাসতেই বলে নিক। কিন্তু দামটা ভুল বলেছেন; পাঁচ নয়, ছয় মিলিয়ন।

ডুরেঈদ আমাকে আরো বলেছে, আপনি শাদ এবং দক্ষিণ লিবিয়ায়ও অভিযান চালিয়েছেন।

মন্তব্য করে রোয়েন। মাথা নেড়ে পরিহাস করে চলে নিক।

দেখা যাচ্ছে, আমার কোনো গোপনীয়তা আপনার কাছে গোপন নেই! বিপরীত দিকের দেয়ালে সাজানো একটা আর্মার-এর দিকে এগোয় সে। সম্ভবত সতেরোশো শতকের ফ্রেঞ্চ জিনিস। লিবিয়া থেকে আমি এবং ডুরেঈদ এ জিনিসটা নিয়ে আসি। অবশ্য কর্নেল মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির কাছ থেকে অনুমতি ছাড়াই! চমৎকার ব্রোঞ্জের বস্তুটি নামিয়ে রোয়েনের হাতে দেয় সে। একজন মা, শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন–এমন ভাস্কর্যটি।

হানিবল, হামিলকার বারকার পুত্র। বলে চলে নিকোলাস। খ্রিস্টপূর্ব ২০৩ সালের। উত্তর আফ্রিকার ব্যাগ্রাদাস নদীর ধারের পুরোনো ক্যাম্পে পাওয়া গিয়েছিল। রোমান জেনারেল সিপিওর হাতে পরাজয়ের আগে সম্ভবত ওখান থেকেই ধরা খেয়েছিলেন হানিবল। দুশো ব্রোঞ্জের কাজ রয়েছে ওই সময়ের তার মধ্যে সেরা পঞ্চাশটি আমার অধিকারে।

বাকিগুলো বেচে দিয়েছেন? মূর্তিটা পর্যবেক্ষণ করতে করতে রোয়েন শুধায়। এতো চমৎকার জিনিস ছাড়তে ও চাইলো?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিকোলাস। ছাড়তে হলো। কিন্তু কী করব, ওই অভিযানে কম টাকা খরচ হয় নি আমার। কিছু মাল বিক্রি করে খরচ উঠিয়েছি।

ডেস্কের কাছে গিয়ে একটা হুইস্কির বোতল আর দুটো গ্লাস নিয়ে ফিরে আসে নিকোলাস।

ঢালবো আপনার জন্য?

মাথা নাড়ে রোয়েন।

ঠিক আছে। রমণীসুলভ ড্রিঙ্ক চলবে?

কোকাকোলা আছে? রোয়েন বলে।

আছে। ওটা আপনার জন্য আরো খারাপ। শুধু চিনি আর চিনি। বিষ একেবারে।

যা হোক, নিকের দেওয়া কোকের গ্লাস হাতে নেয় রোয়েন, বলে, ডুরেঈদ আমাকে সবই বলেছে। ডেস্কের বসে ভদ্রলোকের চোখে তাকায় এবারে। আসলে, ডুরেঈদের অনুরোধেই আমি আপনার কাছে এসেছি। বলতে পারেন, ওর ইচ্ছে এটা।

আহা! তবে দেখছি কোনো কিছুই দৈবাৎ নয়! মনে হচ্ছে কোনো গভীর ষড়যন্ত্রে আমি তুচ্ছ এক ঘুটি মাত্র। ডেস্কের সামনে রাখা চেয়ারে দিকে ইঙ্গিত করে নিকোলাস।

বসুন। তারপর বলুন!

গভীর অন্তর্ভেদি সবুজ চোখে রোয়েনের দিকে চেয়ে থাকে সে। মনে মনে প্রমাদ গোণে রোয়েন–এ লোকের কাছে মিথ্যে বলে পার পাওয়া সহজ নয়।

বড় করে শ্বাস নিল সে, তারপর জিজ্ঞেস করলো, আপনি নিশ্চয়ই প্রাচীন এক মিশরীয় রাণী, রাণী লসট্রিস-এর নাম শুনেছেন। আমি সেকেন্ড ইন্টারমিডিয়েট পিরিয়ডের কথা বলছি, হিকসস ইনভেশন-এর সময় বেঁচেছিলেন।

হেসে ফেললো নিকোলাস। ও, আপনি ওই বইটার কথা বলছেন, রিভার গড। সোফা ছেড়ে লম্বা একটা শেলফের সামনে চলে এলো ও। বইটা হাতে নিয়ে আবার ফিরে এলো, ডেস্কে রাখলো ওটা। বহুবার উল্টানো হয়েছে পৃষ্ঠাগুলো বোঝাই যায়।

পড়েছেন বইটা? রোয়েন জানতে চায়।

হ্যাঁ। উইলবার স্মিথের সমস্ত লেখাই আমি পড়েছি। দারুণ লাগে। এখানে, কুয়েনটন পার্কে বার দুয়েক শিকার করেছেন উনি।

তারমানে উপন্যাসে দুর্দান্ত ভায়োলেন্স আর যৌনতা পছন্দ করেন আপনি কোনো সন্দেহ নেই। চেহারা বিকৃত করে বলল রোয়েন। এ বইটার সম্পর্কে কী ভেবেছেন?

স্বীকার করছি, লেখক আমাকে বোকা বানিয়েছেন। পড়ার সময় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল নিশ্চয়ই সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করেই লেখা হয়েছে। হেসে উঠলো নিকোলাস। কিন্তু তা কি করে সম্ভব। পড়া শেষ করি, তারপর ডুরেঈদকে ফোনও করেছিলাম। বইটা তুলে নিয়ে পাতা উল্টে শেষ দিকে চলে এলো ও। লেখকের নোট সত্যি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। শেষ বাক্যটা তো আমি ভুলতেই পারি না। পড়ি, কেমন?

নীলনদের উৎসমুখের কাছাকাছি আবিসিনিয়ান পাহাড়ে কোথাও ফারাও মামোস-এর অনাবিষ্কৃত ও সুরক্ষিত সমাধির ভেতর ট্যানাস-এর মমি আছে। ..

চোখে প্রশ্ন, নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে আছে রোয়েন।

বইটা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলো নিকোলাস। পড়া শেষ হতে ভাবলাম, সত্যি হলে কি ভালোই না হত। আসলে অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেলেই নেশাটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, জানেন না, ফারাও মামোসের সমাধি খুঁজে বেরুতে পারলে কি যে খুশি হতাম! ডুরেঈদকে ফোন করি। কিন্তু তিনি যখন বললেন, এ-সব স্রেফ ভিত্তিহীন অনুমান, মনটা খারাপ হয়ে যায়।

না, ভিত্তিহীন অনুমান নয়, প্রতিবাদ করলো রোয়েন, তারপর নিজেই দ্রুত সংশোধনী আনল, মানে, অন্তত সবটুকু নয়।

কিন্তু ডুরেঈদ তো মিথ্যে কথা বলার মানুষ ছিলেন না!

ডুরেঈদ মিথ্যে কথা বলেন নি, সত্যি কথাটা বলার জন্য একটু সময় নিচ্ছিলেন। পুরো কাহিনীটা আপনাকে বলার প্রস্তুতি ছিল না তার। স্বভাবতই আপনি অনেক প্রশ্ন করতেন, কিন্তু উত্তরগুলো তার জানা ছিল না। তৈরি হওয়ার পর আপনার কাছেই আসার কথা ছিল। স্পনসরদের একটা তালিকা তৈরি করি আমরা, তাতে আপনার নামটাই ছিল সবার উপরে।

সব প্রশ্নের উত্তর জুরেঈদের জানা ছিল না, তারমানে কি আপনার জানা আছে?

স্ক্রোল আবিষ্কার মিথ্যে নয়। ওগুলোর নয়টা আছে কায়রো মিউজিয়ামের ভন্টে। রানী লসট্রিসের সমাধি থেকে আমিই ওগুলো আবিষ্কার করি। লেদার স্লিং ব্যাগ থেকে একগাদা কালার ফটোগ্রাফ বের করলো রোয়েন, একটা বেছে ধরিয়ে দিল নিকোলাসের হাতে। সমাধির পেছনের দেয়ালের ছবি। কুলঙ্গিতে রাখা চকচকে জারগুলো অস্পষ্ট হলেও দেখতে পাবেন। ছবিটা তোলা হয় আমরা ওগুলো নামানোর আগে।

ভালো ছবি, কিন্তু এটা যে-কোন জায়গায় তোলা হতে পারে।

মন্তব্যটা কানে না তুলে নিকোলাসের হাতে আরেকটা ফটো ধরিয়ে দিল রোয়েন। এটায় দশটা স্ক্রোলই দেখতে পাচ্ছেন, মিউজিয়াম ওআর্করূপে, যেখানে বসে কাজ করতেন ডুরেঈদ। বেঞ্চের পেছনে দাঁড়ানো ভদ্রলোকদের আপনি চিনতে পারছেন?

ডুরেঈদ আর উইলবার স্মিথ। নিকোলাসের চেহারায় একাধারে সন্দেহ ও কৌতুক ফুটে উঠলো। ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন বলুন তো!

এই যে, লেখক বড় ধরনের পোয়েটিক লাইসেন্স নিলেও, তিনি তাঁর বইতে যা লিখেছেন তা সত্যের উপর ভিত্তি করে লেখা। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব সপ্তম স্কোলের, ডুরেঈদের খুনীরা যেটা চুরি করে নিয়ে গেছে।

কেন ওটা বাকিগুলোর চেয়ে আলাদা? খানিক পর জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

এ জন্য যে ওটায় ফারাও মামোসকে কবর দেওয়ার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এবং, আমাদের বিশ্বাস, দিক নির্দেশনাও আছে, সেটা ধরে সমাধির সাইট খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

বিশ্বাস করেন, নিশ্চিতভাবে জানেন না?

সপ্তম স্ক্রোলের বেশিরভাগটাই এক ধরনের সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা। আমি আর ডুরেঈদ যখন কোড ভাঙার কাজটা শেষ করে এনেছি, ঠিক তখনই… ডুরেঈদকে ওরা খুন করলো।

এতো দামী জিনিস, নিশ্চয়ই আরো কপি আছে?

মাথা নাড়লো রোয়েন। সমস্ত মাইক্রোফিল্ম, আমাদের সব নোট, অরিজিনাল স্লোলের সঙ্গে চুরি হয়ে গেছে। ডুরেঈদকে যারাই খুন করে থাকুক, তারা কায়রোয় আমাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে আমার পিসি ধ্বংস করে দিয়েছে। ওই পিসিতে আমাদের গবেষণার সমস্ত তথ্য জমা ছিল।

আগুনে কয়লার টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে ডেস্কে ফিরে এলো নিকোলাস। তার মানে আপনার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। এমন কিছু নেই যা দেখে বোঝা যায় কথাগুলো সত্যি?

না, নেই, বলল রোয়েন। তবে এখানে সবই টুকে রাখা আছে। লম্বা আঙুল দিয়ে নিজের কপালে টোকা দিল সে। আমার স্মরণশক্তি খুবই ভালো।

রোয়েন থামতে নিকোলাস জানতে চাইলো, এবার বলুন, আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন?

আমি প্রস্তাব নিয়ে এসেছি ফারাও মামোসের সমাধিটা আপনি খুঁজে বের করুন!

আচমকা হাবভাব পাল্টে গেছে নিকোলাসের। দুষ্ট্র স্কুলবয়ের মতো হাসে সে। এরচেয়ে বেশি কিছু আমি আর চাই না।

সেক্ষেত্রে, আপনাকে আমার সঙ্গে এক ধরনের এগ্রিমেন্টে আসতে হবে। রোয়েন বলে তাকে। ব্যবসায়িক ভঙ্গিতে একটু ঝুঁকে বসে সে। প্রথমে, আমি বলবো, আমার কি চাই, এরপর আপনার পালা।

কয়েকটা বিষয়ে একমত হলো নিকোলাস, কিছু বিষয়ে তর্ক করলো। এভাবে সময় গড়ালো, তারপর দেখা গেল রাত বাজে একটা। ক্লান্তির কাছে রোয়েনই হার মানল প্রথম, বলল, আমি আর মাথা ঘামাতে পারছি না। ভাবছি আবার কাল সকালে শুরু করলে কেমন হয়?

নিকোলাস বলে, তাই হোক। আপনি এখানে ঘুমোতে পারেন। সাতাশটা বেডরুম আছে আমাদের।

না, ঠিক আছে। দাঁড়িয়ে পরে বলে রোয়েন। আমি বাড়ি ফিরবো।

রাস্তায় দারুণ ঠাণ্ডা, সতর্ক করে দিয়ে নিকোলাস বলে। কিন্তু রোয়েনের চোখমুখ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ঠিক আছে, আমি জোর করছি না। কাল তাহলে আসুন একবার। দশটার সময় আমার ল-ইয়ারদের সাথে মিটিং আছে, দুপুরের আগেই শেষ হয়ে যাবে। এখানে লাঞ্চ করতে পারি আমরা, তখন না হয় কথা বলা যাবে? বিকেলে যদিও শুটিং করার কথা আমার ভাবছি, বাদ দিব। যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে তাহলে।

*

পরদিন কুয়েনটন পার্কের লাইব্রেরিতে ল ইয়ারদের সাথে বৈঠকে বসলো নিকোলাস। কাঠ-কোট্টা, নীরস আলাপ। এ বছরটা বলতে গেলে একেবারে যাচ্ছেতাই যাচ্ছে তার। বছর শুরুর কথা নিক মনে করতে না চাইলেও ওর স্মৃতিতে তা চির অম্লান থাকবে। নিশুতি রাতে, তুষারপাতের মধ্যে সে নিজেই গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল; যার ফলে ঝরে গেছে তাজা কটি প্রাণ।

ওটা থেকে সামলে উঠতে না উঠতেই পরবর্তী আঘাত। লয়েডস্ ব্যাঙ্কের ইনসুরেন্স সিন্ডিকেট থেকে ফোন পেল সে। অর্ধ-শতাব্দী থেকেই ওই সিন্ডিকেট থেকে বেশ বড় অঙ্কের একটা সাহায্য পেয়ে আসছিল হারপার পরিবার। পঞ্চাশ বছরেও যা হয় নি, এবারে ঠিক তাই ঘটলো। বিরাট অর্থক্ষতির সম্মুখীন হলো সিন্ডিকেট। ২৬ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং! নিকোলাসের নিজের শেয়ার ছিল আড়াই মিলিয়ন। আট মাসের মধ্যে এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে হবে তাকে।

প্রায় একই সঙ্গে কুয়েনটন পার্কের সুগার বিট ফসলে লাগলো মড়ক। এক হাজার একর ভূমির ফসল নষ্ট হয়ে গেল।

অন্তত আড়াই মিলিয়ন পাউন্ড আমাদের প্রয়োজন এ মুহূর্তে, একজন ল ইয়ার বললেন। ওটা কোনো সমস্যা নয়–যাদুঘরে অনেক মূল্যবান সংগ্রহ আছে। কিছু জিনিস বিক্রি করলে ভালো আয় হতে পারে।

রামেসিস মূর্তি, কিংবা ব্রোঞ্জ বা হামুরাবি ফ্রিজ বিক্রির চিন্তায় আঁতকে উঠলো নিকোলাস। ও জানে, এর ফলে হয়তো দেনা মেটাতে পারবে সে, কিন্তু প্রাণের সমান প্রিয় সংগ্রহ হারিয়ে বেচে থাকতে হয়তো পারবে না।

কক্ষনো না, আচমকা বলে উঠে সে। ঠাণ্ডা চোখে তার দিকে তাকায় আইনবিদরা।

আর কী উপায় আছে, আসুন ভেবে দেখি। একগুয়ের মতো বলে নিকোলাস। ডেইরি ফার্ম তো আছে।

ওতে করে কেবল দশ লাখ পাওয়া যাবে, তাও যদি ভাগ্য ভালো হয়।

রেসের ঘোড়াগুলো বেচলে কেমন হয়? এবারে একাউন্টেন্ট বলে ওঠে।

মাত্র ছয়টা ঘোড়া আছে ট্রেনিং-এ। আরো দুইশো গ্রান্ড হলো। এর পরেও দুই লাখ বিশ হাজার পাউন্ড বাকি থাকে।

ইয়ট আছে, তরুণতম আইনবিদ বলে।

ওটার বয়স আমার চেয়ে বেশি, মাথা নাড়ে নিকোলাস। বাপের জিনিস। ওটা কি করে বিক্রি করি? কোনো দাম পাবো না। এর চেয়ে আমার শটগান বেচলে ভালো পাবো!

দু জন আইনবিদ একটা তালিকায় চোখ বুলায়। পাওয়া গেছে! এক জোড়া সাইডলক ইজেক্টর! চল্লিশ হাজার পাওয়া যাবেই।

তালিকায় আর কী কী রেখেছেন? শুষ্ক কণ্ঠে বলে নিক। আমার পুরোনো আন্ডারপ্যান্ট আর মোজা?

ওর মন্তব্য উপেক্ষা করে অন্যরা। লন্ডনে একটা বাড়ি আছে। দেড় মিয়িয়ন পাওয়া যাবে।

এই বাজারে নয়, নিকোলাস ফোড়ন কাটে। এক মিলিয়ন হতে পারে। কাগজে নোট নেয় ল ইয়ার। সম্পূর্ণ এস্টেট যেনো বেচতে না হয়, সেদিকে আমাদের লক্ষ্য আছে বটে।

কোনো রকমের সিন্ধান্ত ছাড়াই শেষ হলো সভা। দারুণ ক্লান্ত, অসহায় বোধ করছে নিকোলাস।

ল ইয়ারদের বিদায় দিয়ে ফ্যামিলি কোয়ার্টারে গিয়ে গোসল সেরে নতুন জামা পরে নেয় সে। কোনো কারণ ছাড়াই, কেনো যেনো শেভ করে একটু পরিপাটি হয়।

রেঞ্জ রোভার চালিয়ে মিউজিয়ামে পৌঁছে। ঝিরঝিরে তুষার পরছে।

মিসেস স্ট্রিটের অফিসে ওর অপেক্ষায় বসেছিল রোয়েন। দরজায় দাঁড়িয়ে তার হাসির শব্দ শুনতে পেল নিকোলাস–মিসেস স্ট্রিটের সাথে ভালোই জমেছে মেয়েটার!

মেইন হাউজ থেকে গরম খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে কুক। এমন বাজে আবহাওয়ায় এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না। বাইরে ঝড়ো হাওয়া, আগুনের পাশে বসে খেয়ে নিল ওরা।

খেতে খেতেই ডুরেঈদের মৃত্যু সম্পর্কে বিস্তারিত শুনতে চাইলো নিকোলাস। সবই বলল রোয়েন, নিজের ক্ষতের কথাও বাদ দিল না। কায়রোর রাস্তায় ওর উপর দ্বিতীয়বার হামলার কথাও মনোযোগ দিয়ে শুনলো নিকোলাস।

কাউকে সন্দেহ হয়? রোয়েনের বলা শেষ হতে বলল সে। এমন কেউ–যার কাজ হতে পারে এটা?

মাথা নাড়ে রোয়েন।

না, এমন কোনো পূর্বাভাস তো পাই নি। সে বলে।

আপন চিন্তায় ডুবে থেকে খাবার শেষ করে দু জন। কফির সময়ে এসে নিক বলে, ঠিক আছে, আমাদের এগ্রিমেন্ট নিয়ে তবে আলাপ করি, আসুন।

আবারো, এক ঘণ্টা ধরে তর্কে মেতে উঠলো দু জন।

লুটের মাল বা উদ্ধার করা আর্টিফ্যাক্ট আপনি কতটুকু পাবেন, নির্ধারণ করা সত্যি কঠিন, যতক্ষণ না আমি জানছি উদ্ধার করার পেছনে আপনার অবদান কতটুকু হবে, কফির কাপ দুটো আবার ভরার সময় বলল নিকোলাস। ভুলে যাবেন না, অভিযানের সমস্ত খরচ আমি দিচ্ছি, প্ল্যানটাও আমার তৈরি।

আপনি ধরে নিন আমার অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে, তা না হলে লুটের মাল বা উদ্ধার করা আর্টিফ্যাক্ট বলে কিছু থাকবে না। শুধু একটা ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন, এগ্রিমেন্ট না হওয়া পর্যন্ত আর একটি কথাও আপনাকে আমি বলছি না।

একটু যেনো কর্কশ লাগছে আপনাকে? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।

রোয়েনের ঠোঁটে দুষ্ট হাসি ফুটল।

আপনি যদি আমার শর্তে রাজি না হন, স্পনসরদের তালিকায় আরো তিনজনের নাম আছে, হুমকি দিল রোয়েন। অগত্যা তাদেরকেই আমার বিশ্বাস করতে হবে।

ধরা যাক, আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি হলাম, কিন্তু সমান ভাগ কীভাবে সম্ভব?

আর্কিওলজিকাল আর্টিফ্যাক্টস থেকে প্রথমে আমি বেছে নিব, বলল রোয়েন।

পরের বার বেছে নেওয়ার সুযোগ পাবেন আপনি। এভাবে চলতে থাকবে।

প্রথমে আমি বাছার সুযোগ নিলে অসুবিধে কী? একদিকের ভুরু উঁচু করে জানতে চাইলো নিকোলাস।

আসুন তাহলে টস করি, বুদ্ধি দিল রোয়েন, সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে এক পাউন্ডের একটা কয়েন বের করলো নিকোলাস।

কল! আঙুলের টোকায় কয়েনটা শূন্যে ছুঁড়ে দিল নিকোলাস।

রোয়েন চিৎকার দিল, হেডস!

ধ্যেত! কয়েকটা আলগোছে পকেটে ভরল নিকোলাস।

ঠিক আছে,–আপনিই আগে বেছে নেবেন–আদৌ যদি আর্টিফ্যাক্ট পাওয়া যায়। আপনার জিনিস নিয়ে আপনি যা খুশি করুন, আমার কিছু বলার থাকবে না। ইচ্ছে করলে সব আপনি কায়রো মিউজিয়ামকে দান করতে পারেন। তো, ডিল? নিচু টেবিলের উপর ডান হাতটা চিৎ করে রাখলো ও।

ডিল! নিকোলাসের হাতের উপর হাত রাখলো রোয়েন। পার্টনার।

এবার শুরু করুন। কোনো কিছু গোপন করা যাবে না। যা জানেন সব বলে ফেলুন।

বইটা আনুন, বলল রোয়েন। রিভার গড নিয়ে ফিরে এসে নিকোলাস দেখলো, টেবিল পরিষ্কার করে ফেলেছে রোয়েন। বইয়ের যে অংশটুকু ডুরেঈদ সম্পাদনা করেছিলেন, প্রথমে সেটার উপর চোখ বুলানো যাক। পাতা ওল্টাচ্ছে রোয়েন। এখান থেকে। এখান থেকে দুরেঈদের অস্পষ্টকরণ শুরু হয়েছে।

যা বলার সরল ভাষায় বলুন, বলল নিকোলাস। এরই মধ্যে আমি আপনার হেঁয়ালিকরণের শিকার।

রোয়েন হাসলো না। এ পর্যন্ত গল্পটা আপনি জানেন। হিকসস বাহিনীর কাছে উন্নতমানের চ্যারিয়াট বা রথ থাকায় রানী লসট্রিস হেরে গেলেন, তিনি তাঁর লোকজনসহ ঈজিপ্ট থেকে বিতাড়িত হলেন। নীল নদ ধরে দক্ষিণে গেলেন ওঁরা, পৌঁছলেন সাদা ও নীল নদের সঙ্গমে। অন্য ভাষায়, আজকের দিনের খার্তুমে। এ সবই স্ক্রোলে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলে যায়।

মনে পড়ছে। বলে যান।

ওঁদের রণতরীতে রানী লসট্রিসের স্বামী অষ্টম ফারাও মামোসের মমি করা লাশ ছিল। বারো বছর আগে, হিকসস বাহিনীর একটা তীর ফুসফুসে নিয়ে তিনি যখন মৃত্যুশয্যায়, স্বামীকে লসট্রিস কথা দিয়েছিলেন তাঁর সমাধির জন্য তিনি একটা সুরক্ষিত জায়গা খুঁজে বের করবেন, সেখানে সমাধির ভেতর লাশের সঙ্গে তাঁর বিপুল ধন-সম্পদও থাকবে। খার্তুমে পৌঁছে রানী লসট্রিস সিদ্ধান্ত নিলেন, স্বামীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনের সময় হয়েছে। তিনি তাঁর চৌদ্দ বছরের ছেলে প্রিন্স মেমননকে সমাধির স্থান খুঁজে বের করতে পাঠালেন, সঙ্গে থাকলো এক স্কোয়াড্রন চ্যারিয়ট। মেমননের সঙ্গে তার পরামর্শদাতা ছিল, অক্লান্ত অপুরুষ ইতিহাস লেখক টাইটা।

হ্যাঁ, এ অংশটুকু আমার মনে আছে। মেমনন আর টাইটা বন্দি শিলুক ক্রীতদাসদের সঙ্গে আলোচনা করে, তাদের পরামর্শেই নদীর বাম বাহু ধরে এগোয়–এ বাহুটাকেই আমরা নীল নদ বলে জানি।

মাথা ঝাঁকিয়ে আবার শুরু করলো রোয়েন, পুবদিকে চলে এলো ওরা এবং বাধা পেল ভীতিকর পাহাড়ে, এতো উঁচু যে নীল দুর্গ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত বইতে যা পড়েছেন স্ক্রোলের সঙ্গে মেলে, কিন্তু এখানে এসে, খোলা বইয়ের পাতায় টোকা দিল, ডুরেঈদের হেঁয়ালিপনা শুরু হলো। তিনি যে ফুটহিল বা পর্বতশ্রেণীর পাদদেশে দাঁড়ানো পাহাড়ের বর্ণনা দিয়েছেন…।

বাধা দিল নিকোলাস, পড়ার সময়ই ভেবেছি, বর্ণনায় ভুল আছে। ইথিওপিয়ান হাইল্যান্ডের যে জায়গা থেকে নীল নদ বেরিয়েছে সেখানে কোনো ফুটহিল বা ফুটহিলস নেই। অসংখ্য পর্বতের একটা স্তূপ হিসেবে কল্পনা করতে হবে জায়গাটাকে, শুধু পশ্চিমে খাড়া ও বন্ধুর উতরাই বা ঢাল আছে। বর্ণনাটা যে-ই দিক, নীল নদের কোর্স তার জানা নেই।

যেন মনে হচ্ছে আপনি জানেন? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন, শুনে হেসে উঠলো নিকোলাস।

কম বয়সে বোকার মতো সাহস করে মানুষ, আমিও এক আধবার করেছিলাম, বলল নিকোলাস। সবাইকে চমকে দেওয়ার জন্য লেক টানা থেকে ভাটির দিকে সুদানের রোজিরেস ড্যাম পর্যন্ত বোট নিয়ে গিয়েছিলাম অ্যাবে গিরিখাদের তলা দিয়ে। অ্যাবে হলো নীল নদের ইথিওপিয়ান নাম।

কিন্তু কেন আপনি…

আগে কেউ যেতে পারে নি, তাই। মেজর চেসম্যান, ব্রিটিশ কনসাল, ১৯৩২ সালে চেষ্টা করতে গিয়ে প্রায় মারাই পড়েছিলেন। ভেবেছিলাম অভিযানটা সফল হলে একটা বই লিখব, তা থেকে এতো বেশি রয়্যালটি পাব যে সারাজীবন আর কাজ করতে হবে না, মনের ফুর্তিতে দুনিয়াটা চষে বেড়াব। অ্যাবে নদীর পুরোটা কোর্স আমি স্টাডি করেছি, শুধু ম্যাপ দেখে নয়। একটা সেসনা ১৮০ ভাড়া করি, খাদের উপর দিয়ে উড়ে যাই, লেক টানা থেকে ড্যাম পর্যন্ত ৫০০ মাইল। আমার তখন ২১ বছর বয়স, সাংঘাতিক ডানপিটে।

কী ঘটেছিল? রোয়েন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। ডুরেঈদ এ সম্পর্কে কিছু বলে যায় নি, তবে রোয়েন জানে ঠিক এ ধরনের একটা অ্যাডভেঞ্চারেই ওদেরকে বেরুতে হবে।

স্যান্ডহার্সট কলেজ পড়ি তখন। ক্রিসমাসের ছুটিতে এ কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই, বলল নিকোলাস। সব মিলিয়ে আটজন ছিলাম আমরা। গিরিখাদের নিচের পানিকে এক কথায় হিংস্র বলব। মাত্র দু দিন টিকেছিলাম। দুনিয়ার বুকে নরকতুল্য যে কয়টা জায়গা আছে, ওই গিরিখাদ তার মধ্যে একটা। অ্যারিজোনার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ গভীর ও এবড়োখেবড়ো ওটা। পাঁচশো মাইলের মধ্যে বিশ মাইল পেরুতে না পেরুতেই ভেঙে চুরমার করে দেয় আমাদের সব কয়টা কাইয়্যাক। সমস্ত ইকুইপমেন্ট ছেড়ে আসতে বাধ্য হই আমরা, সভ্য জগতে আবার ফেরার জন্য খাদের দেয়াল বেয়ে উপরে উঠতে হয়েছিল।

চেহারা ম্লান হয়ে গেল, বিষণ্ণ সুরে বলল আবার, দুই বন্ধুকে হারাই আমরা। ববি পামার নদীতে ডুবে যায়, টিম মার্শাল পাহাড় থেকে পড়ে যায়। এমন কি আমরা ওদের লাশও খুঁজে পাই নি।

নীল নদের ওই খাদে আর কেউ নেভিগেট করতে পেরেছে? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন, দুঃখজনক স্মৃতি থেকে নিকোলাসের মনটা ফেরাতে চাইছে।

হ্যাঁ। আরো কয়েক বছর পর ফিরে যাই আমি। দ্বিতীয়বার লীডার হিসেবে নয়, অফিশিয়াল ব্রিটিশ আর্মড ফোর্সেস এক্সপিডিশন-এর জুনিয়র মেম্বার হিসেবে। নদীটাকে বশ মানাতে আর্মি, নেভী আর এয়ারফোর্সের সাহায্য নিতে হয়েছিল।

রোয়েনের এ মুহূর্তের অনুভূতি সশ্রদ্ধ বিস্ময়। নিকোলাস আক্ষরিক অর্থেই অ্যাবেতে নৌকো বেয়েছে। এ যেনো নিয়তিই ওর কাছে টেনে এনেছে নিকোলাসকে। ডুরেঈদ ঠিক কথাই বলে গেছেন। এ কাজের জন্য সব দিক থেকে উপযুক্ত লোক নিকোলাস ছাড়া আর বোধহয় নেই কেউ। তাহলে গিরিখাদটার স্বভাব-চরিত্র ভালোই জানেন আপনি। ভেরি গুড। এবার আপনাকে আমি সপ্তম স্ক্রোলে টাইটা যা বলে গেছে সে সম্পর্কে একটা ধারণা দেব। দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, স্ক্রোলের এ অংশের কিছুটা নষ্ট হয়ে গেছে, ফলে ফাঁকগুলো পূরণ করতে হয়েছে। অনুমানের উপর নির্ভর করে। আপনাকে বলতে হবে, আপনার জানার সঙ্গে বর্ণনাটুকু মেলে কিনা।

দেখা যাক।

বন্ধুর উতরাই বা ঢাল সম্পর্কে আপনি যে বর্ণনা দিচ্ছেন, টাইটার বর্ণনার সঙ্গে সেটা মেলে–খাড়া একটা পাঁচিল, ওই পাঁচিল থেকেই বেরিয়ে এসেছে নদীটা। ওরা ওদের চ্যারিয়ট ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, ক্যানিয়নের খাড়া ও এবড়োথেবড়ো এলাকায় ওগুলো চলছিল না। ভারবাহী ঘোড়া নিয়ে হাঁটা শুরু করে ওরা। কিছুক্ষণের মধ্যে খাদটা এতো গভীর আর বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, কয়েকটা ঘোড়া নিচে পড়ে যায়। ওই সময় প্রাচীন একটা পথ অনুসরণ করছিল ওরা, পাহাড়ী ছাগলের আসা-যাওয়ায় তৈরি। ঘোড়াগুলো নদীতে পড়ে গেলেও, প্রিন্স মেমননের নির্দেশে সামনে এগুতে থাকে ওরা।

জায়গাটা আমি কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছি। সত্যি ভীতিকর।

এরপর টাইটা কয়েকটা বাধার কথা লিখেছে, তার ভাষায় সেগুলো ধাপ।

আমি ও ডুরেঈদ সিদ্ধান্তে আসতে পারি নি ওগুলো আসলে কী। তবে সবচেয়ে

গ্রহণযোগ্য অনুমান, ওগুলো আসলে জলপ্রপাত।

অ্যাবে গিরিখাদে জলপ্রপাতের কোনো অভাব নেই, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল নিকোলাস।

এ অংশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। টাইটা বলছে, খাদের ভেতর দিয়ে বিশ দিন এগোবার পর তারা দ্বিতীয় ধাপ-এর সামনে পড়লো। এখানেই প্রিন্স মেমনন তার মৃত বাবার মেসেজ পায়, স্বপ্নের ভেতর–মামোস তার ছেলেকে জানান, এ জায়গাতেই তাকে সমাহিত করা হোক। টাইটা বলছে, এরপর তারা আর এগোয় নি। আমরা যদি নিশ্চিতভাবে জানতে পারি কিসে তারা বাধা পেয়েছিল, তাহলে খাদের কতটা ভেতরে তারা ঢুকতে পেরেছিল তার একটা নিখুঁত হিসেবে বেরিয়ে আসবে।

ম্যাপ আর পাহাড়ের স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ দরকার, বলল নিকোলাস। আরো দরকার আমার এক্সপিডিশন নোট ও ডায়েরি। রেফারেন্স লাইব্রেরি আপ-টু-ডেট করে রাখে ও, স্যাটেলাইট ফটো পেতে অসুবিধে হবে না।

আমার দাদার বাপ, তিনিও ইথিওপিয়ায় শিকার করতে গিয়েছিলেন গত শতকে ১৮৯০-এর দিকে ডেবরা মারকোস-এ নীল নদ পেরিয়েছিলেন তিনি। হয়তো তার নোটও আমাদের কাজে লাগবে। চেয়ার ছেড়ে আড়মোড়া ভাঙলো নিকোলাস।

কার পার্কে রাখা পুরোনো সবুজ ল্যান্ড রোভার পর্যন্ত রোয়েনের সাথে হেঁটে গেল। গাড়িতে চড়ে ইঞ্জিন চালু করলো রোয়েন, জানালো দিয়ে নিক বলল, আমার মনে হয়, আপনি এখানে, হলে থাকলে ভালো করতেন। এখান থেকে ব্রান্ডসবারী পর্যন্ত কম করে হলে তিনঘণ্টা লাগে যেতে আসতে। আফ্রিকা যাওয়ার আগে প্রচুর কাজ আমাদের।

আপনার সঙ্গে এখানে থাকছি, লোকে কী বলবে?

লোকে কী ভাবলো না ভাবলো–ওটা কোনোদিনও পাত্তা দিই নি আমি, বলল নিক। কাল কখন দেখা হচ্ছে?

ইয়র্কে একজন ডাক্তার দেখাতে হবে আমাকে। হাতের সেলাই কাটার সময় হয়ে এসেছে। এগারোটার আগে আসতে পারবো বলে মনে হয় না। জানালা দিয়ে হাত নেড়ে, গাড়ি ছেড়ে দিল রোয়েন।

বাতাসে এলোমেলো অবাধ্য চুল ছড়িয়ে পড়েছে তার মুখের উপর। গাঢ় চুলের নারী বরাবরই নিকোলাসকে আকৃষ্ট করে। ওর স্ত্রী, রোসেলিনেরও ওই পুবদেশীয় ধাঁচ ছিল চেহারায়। তুলনা চলে আসায় মনে মনে অপরাধী বোধ হতে লাগলো নিকোলাসের। কিন্তু রোয়েনকে ভুলে থাকা বেশ কঠিন।

রোসেলিনের মৃত্যুর পর এ. প্রথম কোনো নারী ওকে নাড়া দিতে পেরেছে। মেয়েটার মিশ্র রক্ত ওর মনে দোলা দিয়েছে। কিছুটা রক্ষণশীল, আবার একই সঙ্গে আধুনিকাও, চমৎকার রসবোধসম্পন্না নারী রোয়েন। এমন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেছে, যা নিকোলাসের কাছে আরাধ্য। সাধারণত পুবের মেয়েরা এমন হয় না, নিজেদের নিয়ে অল্পতেই সন্তুষ্ট হয় তারা। কিন্তু এ ললনা ভিন্ন ধাতের, বুঝতে বাকি নেই নিকোলাসের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *