ঋজুদা এবং ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ে

ঋজুদা এবং ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ে — ঋজুদা — বুদ্ধদেব গুহ

০১.

ঋজুদার বিশপ লেফ্রয় রোডের ফ্ল্যাটে আমাদের সকলের নিমন্ত্রণ ছিল। ভারত মহাসাগরের স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জে জলদস্যুদের পুঁতে রাখা গুপ্তধনের মালিকানা নিয়ে যে খুনের পর খুন হয়েছিল তারই কিনারা করে আমরা ফিরে আসার পরই এই জমায়েত, আমাদের সাকসেস সেলিব্রেট করার জন্যে। তিতির যদিও আমাদের সঙ্গে যেতে পারেনি স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জে, কারণ সে তখন দিল্লিতে ছিল, ও এসেছিল সেই সন্ধ্যাতে ঋজুদার বাড়িতে বিশেষ অতিথি হিসেবে।

আজ রাতের মেনুতে গদাধরদার করণীয় কিছুই নেই। হাজারিবাগের আঙ্গু মহম্মদ তার বাবুর্চিসমেত হাজির। আজ মোগলাই খানা। মাটন বিরিয়ানি, মধ্যে বটি কাবাবের গোল গোল বটিকা। গুলহার কাবাব, চিকেন চাঁব, পাঁঠার তেলের চৌরি, লাব্বা, পায়া আর কবুরার চচ্চড়ি। মাটন রেজালা, সিনা ভাজা। এক এক পদ খাবার শেষ হতে না হতে হামদর্দ দাবাইয়া কোম্পানির এক এক বটি পাঁচনল। সমস্ত গুরুপাক খাদ্য নিমেষে হজম করানোর জন্যে।

বিরিয়ানির হাণ্ডি বসেছে রান্নাঘরে। উমদা বিরিয়ানি রান্না করাটাই শুধু আর্ট নয়, সেই বিরিয়ানি হাঁড়ি থেকে পরতে পরতে বের করাও, যাকে বলে হাণ্ডি নিকালনা একটি বিশেষ আর্ট।

গদাধরদার ওসব অ-হিন্দু রান্নাবান্নাতে ঘোর আপত্তি। সে রান্নাঘরের বাইরের দিকে বারান্দাতে হাওড়া স্টেশনের কুলিরা ট্রেন না-থাকলে যেমন করে কোমর, আর মাটি থেকে তোলা দু’পায়ে গামছা কষে বেঁধে বসে আরাম করে, যেমন করে বসাকে শ্রীমান ভটকাই নাম দিয়েছেন ‘পোর্টার আসন’ (যোগাসনের তালিকায় তার বতম অবদান) তেমন আসনে বসে প্রচণ্ড বিরক্তির সঙ্গে দু’ঠ্যাং দোলাচ্ছে। আর গুনগুন করে রামায়ণের কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড, সুরে গাইছে এবং তারই মাঝে মাঝে গুণ্ডি পানের লাল তরলিমা পাশের পিকদানিতে পিচকিরির রঙের মতনই ছুড়ছে।

আমরা সব ঋজুদাকে ঘিরে বসে গল্প করছি। তিতির আফসোস করছে স্যেশেলস-এর সুন্দর দ্বীপপুঞ্জে আমাদের সফল অ্যাডভেঞ্চার এবং রহস্য উদঘাটনের সঙ্গী হতে পারেনি বলে।

ভটকাই যেন তিতিরের জ্যাঠামশাই, এমনি করে বলল, শুধু কেতাবি বিদ্যেই সব নয় জীবনে, বুঝেছ তিতির দেবী, স্কোয়ার হতে হয়, স্কোয়ার। এ স্কোয়ার পেগ ইন এ রাউন্ড হোল।

আমরা সকলেই ভটকাই-এর কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলাম।

ভটকাই বোকার মতন বলল, কী হল? তারপর তার দু’কান লাল হয়ে গেল। সে বলল, ভুল বললাম?

আমি বললাম, নিশ্চয়ই। কোনও স্কোয়ার খোঁটা কি গোল গর্তে পোঁতা যায়? আর স্কোয়ার হওয়ার সঙ্গে স্কোয়ার পেগ-এরই বা সম্পর্ক কী?

ভটকাই বলল, সরি সরি ভুল হয়ে গেছে।

 ওর ক্ষমা চাওয়ার কায়দাতে আমরা আবারও হেসে উঠলাম।

 তিতির বলল, তা ছাড়া ভটকাই, ইংরেজিতে ‘এ’ বললে যাঁরা ইংরেজ, অথবা যাঁরা ইংরেজি জানেন, তাঁরা বুঝতেই পারবেন না। ‘এ’ হচ্ছে বাঙালি ইংরেজি, A’র উচ্চারণ সবসময়েই ‘আ’। এটা মনে রাখবে।

ভটকাই নিজের অপ্রতিভতা কাটিয়ে উঠে বলল, ও ঋজুদা! মোগলাই খানা খাওয়ার নেমন্তন্ন করে এনে স্পোকেন ইংরেজির ক্লাসে ঢুকিয়ে দেবে জানলে আমি আসতামই না।

আমি বললাম, শেখার আবার স্থল-অকুস্থল কী রে! যার শেখার ইচ্ছে আছে সে চিতাতে উঠতে উঠতেও শেখে।

ঋজুদা আজ্জু মহম্মদকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের সীমারিয়ার সেই ডাকাতরবিনহুড পিপ্পাল পাঁড়ের বাবা-মা কেমন আছে? তার দলের লোকেরা কি তাদের দেখাশোনা করে?

তা করে বইকি। বহত পড়ে-লিখে মানুষদের চেয়ে ওই ডাকাত-টাকাতদের মধ্যে ইনসানিয়াৎ অনেকই বেশি।

তিতির এতক্ষণে মুখ খুলল, বলল, ঋজুকাকা, এই পিপ্পাল পাঁড়ে লোকটি কে? এর কথা তো আগে শুনিনি।

এসব অনেকদিন আগের ঘটনা। যখন আমি আর আমার জঙ্গলের বন্ধু গোপাল নিয়মিত হাজারিবাগে যেতাম, তোরা হয়তো তখন জন্মাসইনি, সেই সময়কার ঘটনা।

ইসস। আমাদের সঙ্গে দেখা হলে কী ভালই না হত।

তিতির বলল।

আজ্জু মহম্মদ, হাজারিবাগের মহম্মদ নাজিমের বড় ছেলে, বলল, ক্যা বোল রহি হ্যাঁ বহিন? জানসে বাঁচ গ্যয়ি তুম যো পিপ্পল পাঁড়েসে নেহি ভেটিন। ইকফে হামকো মিলাথা পুরানা চাতরাকি রাস্তেমে। ইয়া আল্লা! চার পায়েরসে সাইকিল চালাকর বহুত মুশকিলসে জান বাঁচাকর পিচ রোডমে আকর পৌঁছা। আভভি ভি ইয়াদ আনেসে জি ঘাবড়াতা হ্যায়।

তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কখনও ঋজুকাকা?

 তিতির শুধোল।

 নেহি ভেটনেসে ডাকু পিপ্পাল পাঁড়েকো…

তাহলে আমাদের বলো না ঋজুকাকা, ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের সঙ্গে তোমার প্রথম। দেখা হওয়ার কথা।

এমন করে বলছ তিতির যেন ঋজুদার সঙ্গে ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের বিয়েই হয়েছে। যেন শুভদৃষ্টি!

ভটকাই-এর ইয়ার্কিতে আমরা সকলে তো হেসে উঠলামই, আজ্জু মহম্মদও হেসে উঠল জোরে। তার মুখে জরদাপান ছিল। সুগন্ধি পানের রস ছিটকে গিয়ে লাগল ভটকাই-এর কপালে। আমরা ওর হেনস্থা দেখে আরেকবার হেসে উঠলাম।

আজ্জু মহম্মদ লজ্জা পেয়ে বলল, আমি একটু বাওয়ার্চিখানাতে যাচ্ছি। আজমল বাবুর্চি বলেছিলাম আগে ফিরনিটা বানিয়ে রাখবে, দেখি, গিয়ে কী করল!

তিনি হিন্না আতরের গন্ধ ঘরে রেখে চলে গেলেন রান্নাঘরে। আর সঙ্গে সঙ্গে আমরা চেপে ধরলাম ঋজুদাকে।

পাইপটা ধরিয়ে, ঋজুদা বলল, কী যে বলব! এতে বাহাদুরির কী আছে জানি না।

আহা! বলোই না।

আমরা সমস্বরে বললাম।

ঋজুদা মিনিট দুতিন ফিল করা পাইপটাতে টান লাগিয়ে বলল, তখন তো আমরা ছাত্র। হাজারিবাগের বরহি রোডে গোপালদের ছবির মতন বাড়িতে আছি। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝির কথা। হাজারিবাগ শহর থেকে যে লালমাটির পথটা চলে গেছিল গোরস্থান, বনাদাগ, গোন্দা বাঁধ, টুটিলাওয়া, সীমারিয়া হয়ে বাঘড়া মোড়, সেই পথে তখন ঝুণ্ডকে ঝুণ্ড ময়ূর দেখা যেত। তিতির বটেরের তো গোন-গুনতি ছিল না। তা ছাড়া ভাল্লুকেরও আজ্ঞা ছিল সে অঞ্চলে। কেন? তা বলতে পারব না।

ময়ূর না ন্যাশনাল বার্ড! মারা তো বারণ।

ন্যাশনাল বার্ড ডিক্লেয়ার্ড হয়েছিল ষাটের দশকের গোড়াতে অথবা পঞ্চাশের দশকের শেষে। তখন মারাটা বে-আইনি ছিল না। ওই পথটা ছিল করোগেটেড টিনের মতো। প্রতি দু ইঞ্চি বাদে বাদে ঢেউ উঠেছিল পথে। সাইকেলে বা গাড়িতে সে পথে যাওয়া বিস্তর অসুবিধার ছিল। তাই আমরা আগের দিন বিকেলের বাসে বন্দুক কাঁধে করে চড়ে পড়ে, টুটিলাওয়াতে নেমে পড়ে, গোপালের বন্ধু ইজহারুল হক-এর ডেরাতে গিয়ে পৌঁছলাম। ইজহারুল নিজেও খুব শৌখিন মানুষ ছিল এবং ভাল শিকারিও। থাকত অবশ্য হাজারিবাগে কিন্তু টুটিলাওয়াতে অনেক জমিজমা ছিল। জোতদার যাকে বলে।

বাস থেকে নামতে নামতে সন্ধে। নাজিম সাহেব খিচুড়ির ইন্তেজাম করে ফেললেন। ফার্স্ট ক্লাস খিচুড়ি, সঙ্গে ইজাহারের খিদমদগারের জোগাড় করা খাঁটি ঘি, বেগুনের ভাত্তা, কাঁচালঙ্কার আর পেঁয়াজের কুচি দেওয়া, আলুরও ভাত্তা। উপাদেয়। এই সব আজমল-ফাজমল নাজিম সাহেবের ধারেকাছে আসত না বাওয়ার্চি হিসেবে, আজ নাজিম সাহেব বেঁচে থাকলে।

ভটকাই নাকটা উপরে তুলে ল্যাব্রাডর গান-ডগ-এর মতন গন্ধ শুকল বার তিনেক। তারপর স্বগতোক্তি করল, আমাদের আজমল মিঞাতেই চলবে ঋজুদা। বিরিয়ানির যা খুশবু ছেড়েছেনা! আহা। এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভাল।

আমরা সকলেই হেসে উঠলাম ওর কথা শুনে।

তিতির বলল, ভটকাই বড় ইন্টারাপট করে। বলল তো ঋজুদা।

হ্যাঁ। পরদিন অন্ধকার থাকতে থাকতে আমরা আমাদের বন্দুক আর গুলির বেল্ট নিয়ে, মাথায় টুপি চড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম তিনজনে তিনদিকে। কথা হল যে, সকাল আটটাতে যেখানে টুটিলাওলা থেকে চাতরাতে যাওয়ার পুরনো পথটা বেরিয়ে গেছে, সেই মোড়ে এসে জমায়েত হব। সেখানে নিজামুদ্দিনও উপস্থিত থাকবে তার দলবল নিয়ে। শিকার করা পশু ও পাখি, যদি পাওয়া যায়, কুড়িয়ে নিয়ে আসবে বনে গিয়ে।

নাজিম সাহেব বললেন আমাকে চাতরার পুরনো পথে যেতে, কারণ সেখানে ভালুক বাবাজির সঙ্গে মোলাকাত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। একজোড়া অতিকায় ভাল্লুক নাকি সেই পথে মৌরসি-পাট্টা গেড়ে আছে। তবে বহতই খতরনাক তারা। যদিও সে পথ এখন পরিত্যক্ত কিন্তু যদি কেউ কখনও যায় কোনও কাজে, ছোটখাটো ঠিকাদার, ফরেস্ট গার্ড, জঙ্গলের কৃপকাটনেওয়ালা, তবে তাদের কারও নাক, কারও কান, কারও চোখ খুবলে নেয়, কখনও কখনও বিনা নোটিসে ‘রে রে’ করে তেড়ে এসে কুস্তিও লড়ে। যতই ‘খেলব না’ ‘খেলব না করে কেউ চেঁচাক, আদৌ শোনে না। যার সঙ্গে কুস্তি লড়ে তাদের সর্বাঙ্গ ফালা ফালা হয়ে যায়। প্রাণ থাকে না।

নাজিম সাহেব বললেন, বহত সামহালকে যাইয়েগা উঁওড়া-পুত্তানলোগ।

আরে তখন আমার যা বয়স আর যা শরীর তাতে স্বয়ং যম কুস্তি লড়তে এলেও তাকে কাবু করে দেবার হিম্মত রাখি। ভয় ব্যাপারটা শিশুকাল থেকেই আমার চরিত্রানুগ নয়। তাই বললাম, বে-ফিক্কর রহিয়ে।

নাজিম সাহেব তখন বললেন, আপকি বত্রিশ ইঞ্চি ব্যারেলকা গ্রিনার বন্দুক হ্যায় ঔর আপকি নিশানা ভি বঁড়িয়া। ভাল্ কি লিয়ে কুছ ভি ফিক্কর নেহি। মগর ইস রাস্তাহিকি আসপাস ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ে আভভি ছিপা হুয়া হ্যায়।

সে আবার কে? পিপ্পাল পাঁড়ে?

ইয়া আল্লা! দশদিন হল হাজারিবাগে এসেছেন অথচ ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের নাম শোনেননি?

না তো!

আমি আকাশ থেকে পড়লাম।

আজিব বাত।

তারপরই বললেন, যোভি হো। সামহালকে রহিয়ে গা। বহতই খতরনাক হ্যায় উ ডাকু। পুলিশ কুছ নেহি কর পায়া হ্যায়। বহতই আদমিকো জান সে মার ডালা।

নাজিম মিঞার মুখে সে কথা শোনার পর আমার ভাল্লুক শিকারের শখ টিমে হয়ে গিয়ে পিপ্পাল পাঁড়ে শিকারের সাধটা চেগে উঠল।

তারপর? তিতির বলল। ছওড়া-পুত্তান মানে কী?

মানে যে ঠিক কী, তা আজও আমি জানি না। তবে নাজিম সাহেব আমাকে আর গোপালকে ওই বলে ডাকতেন আদর করে।

তখনও অন্ধকার ছিল। বেশ ঠাণ্ডা। তখন হাজারিবাগ জেলার ঠাণ্ডা যে কেমন ছিল তা আজ তোরা বুঝবি না। আজ থেকে কত বছর যে আগের কথা। বনজঙ্গল ছিল নিবিড়। ভারতে তখন গিনিপিগ-এর মতন মানুষের বংশবৃদ্ধি হয়নি।

ভটকাই বলল, তোমরা তখন কত বড়?

কত আর বড়। তোরা এখন যত বড় তার চেয়ে সামান্যই বড় হয়তো।

কী দুঃসাহস!

তিতির স্বগতোক্তি করল।

ভটকাই বলল, কী ওয়ান্ডারফুল বাবা-মা পেয়েছিলে ভাবো একবার। দুধের ছেলেদের একে ভাল্লুক তায় ডাকাতের মুখে ছেড়ে দিয়েও তাঁরা নির্বিকার। আমাদের আর কী হবে! রবীন্দ্রনাথ সেই বলেছিলেন না? রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি, সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী।

উলটো বললি।

আমি বললাম।

ওই হল। সোজা করে নে তাহলেই তো হল, না কি!

তারপর? বলল ঋজুদা।

এই ভটকাই, শাট-আপ।

 তিতির ধমক দিল।

ইয়েস। বলল, ভটকাই, শাটিং-আপ।

আলো ফুটছে আস্তে আস্তে পুবের আকাশে। তবে তখনও কুয়াশা আছে ভারী। দিনের পাখিরা জাগছে একে একে। থ্রাশার, ব্যাবলার, কপারস্মিথ, টিয়া, টুই, মুনিয়া, মিনিটে।

বনমোরগের ডাকে চারদিক তো সরগরমই। তিতিরের টিটর-টিটর, ময়ুরের কেঁয়া-কেঁয়া, কালি তিতিরের টিউ-টিউ। তারও আগে জেগেছে, বনমোরগেরও আগে, র‍্যাকেট টেইলড ড্রঙ্গোরা, কাঁচের বাসন ভাঙার মতন স্বর নিয়ে। সারারাত বন-পাহারা সেরে রেড-ওয়াটেলড ল্যাপউইঙ্গ টিটিটি-হুঁট-টিটিটি-হুঁট-হুঁট-হুঁট করে ডাকতে ডাকতে চলে যাচ্ছে মানুয়ানা টাঁড়ের দিকে।

যদিও খুব শীত, তবু কিছুটা চলতেই শরীর গরম হয়ে উঠল। আমার গায়ে একটি ছাই-রঙা ফ্লানেলের জার্কিন। আস্তে আস্তে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দু’দিকে নজর রাখতে রাখতে চলেছি কারণ এই সময়েই মাংসাশী প্রাণীরা, যেমন বাঘ, চিতা রাতের টহল সেরে নিজের নিজের ডেরায় ফেরে।

এমন সময়ে আমার থেকে বেশ কিছুটা সামনে মানুষের গলার স্বর পেলাম। তবে দেখা যাচ্ছিল না কিছুই। একে আধো অন্ধকার, তায় পথটা কিছুটা সামনে গিয়েই বাঁক নিয়েছে বাঁদিকে। এখন বসন্তও নয়, গ্রীষ্মও নয় যে, মেয়ে ও শিশুরা মহুয়া কুড়োতে আসবে জঙ্গলে, ভোররাতে। আধো-অন্ধকারে কারওরই জঙ্গলের গভীরের এই পরিত্যক্ত, দিনমানেই নির্জন পথে আসার কথা নয়, আমাদের মতন শিকারি অথবা ডাকাত-টাকাত ছাড়া। তাই কৌতূহলী হয়ে থেমে পড়ে পথের বাঁ পাশের একটা ঝাঁকড়া আমলকী গাছের পেছনে আড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুনতে পেলাম, যারা কথা বলছে তাদের গলার স্বর ক্রমশই চড়ছে। তারপরই একটা আর্তচিৎকার শুনলাম এবং পরক্ষণেই ধ্বপ ধ্বপ করে মানুষের দৌড়ে আসার আওয়াজ এদিকে।

আমি তাড়াতাড়ি বন্দুকের ডানদিকের ব্যারেলে একটি বল ও বাঁদিকের ব্যারেলে একটি এল.জি. পুরে নিয়ে গাছটার আড়াল নিয়ে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম বন্দুক রেডি-পজিশনে রেখে।

পাঁচ সেকেন্ডও কাটেনি, এমন সময় একটি তীব্র আর্তচিৎকার কানে এল এবং একটি অট্টহাসি। মনে হল কেউ কাউকে জোরে লাথি মারল বা ধাক্কা দিল আর মুখে বলল, যা, যা, কামিনা, তুরন্ত ভাগ তেরা জান লেকর! আজ স্রিফ তুহর কান ঔর নাকই কাট লিয়া, ফিন কভভি বদতমিজি কিয়াতো জানহি লে লুঙ্গা।

দুটি লোক, ধুতি-পরা, গায়ে সাদা কালো দেহাতি কম্বল জড়ানো, পায়ে নাল লাগানো নাগরা জুতো, মাথাতে বাঁদুরে টুপি, তোরা যাকে ইংরেজিতে বলিস ব্যালাক্লাভা’, তাই পরে, মরি-কি-পড়ি করে দৌড়ে আসছে। তার মধ্যে একজন মাথার টুপিটা খুলে ফেলেছে আর যেখানে তার কান থাকার কথা সেখানে একটি সাংঘাতিক ভয়াবহ রক্তাক্ত ক্ষত। পেছনের জন নাকে হাত দিয়ে দৌড়ে আসছে। আর ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে তার নাক থেকে।

তাকে দেখা যাচ্ছিল না কিন্তু সেই বাঁকের আড়াল থেকে কেউ একজন খুব জোরে জোরে হো হো করে হাসছে যেন ফুলে ফুলে আর বলছে, আজ স্রিফ তু দোনোকো কান ঔর নাকহি কাটকে ছোড় দিয়া। যা, মহল্লামে যাকর ঘর-ঘরমে দিখা। ঔর বোল যো ডাকু পিপ্পাল পাঁড়েনে আজ নাক ঔর কানকি সবজি বানাকে মংগকি ডাল কি সাথ খায়েগা দোপেহরমে। যোভি হামে পাকড়ানেকি লিয়ে আয়েগা, উসলোগোঁকি হাল অ্যাইসিই হোগা।

নাক কান কাটা লোকদুটোর জামাকাপড় বেশ দামি। তারা পেছনে না-তাকিয়েপ্রাণভয়ে দৌড়ে আমি যেখানে আড়াল নিয়ে ছিলাম, তারই সামনে এসে দাঁড়াতেই তাদের হেনস্থার রকমটা পুরোপুরি জানা গেল।

ওরা আমাকে দেখতে পায়নি। এ অন্যর রক্তাক্ত মূর্তির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠছে আর হিক্কা তোলার মতন শব্দ করছে। আয়না তো নেই যে, নিজেদের ছিরি নিজেরা দেখবে! দেখলে, অবশ্য ওইখানেই অজ্ঞান হয়ে চিতপটাং হত।

একজন বলল, আমার বন্দুকটাও কেড়ে নিল।

নাককাটা, নাকি সুরে খোনার মতো বলল, চালানা নেই আতা তো তু শালে বন্দুক পাকড়কে আয়াথা কিউ?

ঔর তুমহারা ক্যা চাকু চালানা আতা? উওভি তো লে লিয়া!

হায়! হায়! বলে কেঁদে উঠল খোনা।

বলল, হামারা আমরিকান চাক্কুয়া। আমরিকান। হু।

লোকদুটো চলে গেলে আমি আস্তে আস্তে বেরিয়ে ডাকু যেদিক থেকে এসে পথে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে অট্টহাসি হাসছিল সেই দিকে বন্দুক রেডি-পজিশনে ধরে এগিয়ে চললাম পথের একেবারে বাঁদিক ঘেঁষে।

বলেই, ঋজুদা নামিয়ে রাখা পাইপটা তুলে নিয়ে পাইপটা ধরাল।

তুমি কি সেইদিনই ধরলে ডাকু পিপ্পাল পাঁড়েকে?

ভটকাই প্রশ্ন করল।

 ঋজুদা মাথা নাড়িয়ে জানাল, না রে না।

 বলো, বলো ঋজুদা।

তিতির বলল।

ঋজুদা বলল, পুরোটাই যদি আজই শুনে ফেলিস তাহলে বিরিয়ানির হান্ডি যে কাঁদবে। এদিকে রান্না তো হয়ে গেছে। ওই দ্যাখ পেছনে চেয়ে ভগ্নদূত দাঁড়িয়ে।

আমরা একই সঙ্গে পেছনে চেয়ে দেখি গদাধরদা এসে ব্যাজার মুখে দাঁড়িয়েছে। আমরা মুখ ফেরাতেই বলল, সেই মিঞায় শুদোতিচে যে হাড্ডি নিকলাবে কি না? কতার মাতা মুণ্ডু তো কিছুই বুইঝতেছি না।

ঋজুদা আমাদের দিকে নীরব ভর্ৎসনার চোখে চেয়ে গদাধরদাকে বলল, গদাধরদা, কথাটা হাড্ডি নিকলানো’ নয়, হাণ্ডি নিকালনা।

বিরক্ত গদাধরদা বলল, ওই হল্লো। মানেটাতো বইলবে।

গল্পটা এখুনি-এখুনি না শুনলে তো রেশ কেটে যাবে ঋজুদা। আমি বললাম।

আর এখুনি-এখুনি না খেলে যে বিরিয়ানিটাই মাঠে মারা যাবে।

 ভেতর থেকে আজ্জু মহম্মদ বেরিয়ে এসে বলল, বিলকুল ঠিক।

ঋজুদা বলল, হবে, পরে হবে। এখন ছোট্ট করে শুনলে তো। পরে পুরোটা শোনাব।

মোচলমান তারই খাস রান্নাঘরে মৌরসি-পাট্টা গেড়ে বসে এক বিরাট হাণ্ডিতে বিরিয়ানি রান্না করছে, মধ্যে আবার গোল গোল ছোট ছোট বটি কাবাব মিশিয়ে দিয়েছে। কাবাব-টাবাব করতে গদাধরদা নিজেও জানে কিন্তু এই বটি কাবাবের নাম সে বাপের জম্মে শোনেনি। গুলহার কাবাবও বানিয়েছে। পার্ক সার্কাস থেকে বড়কা চর্বিওয়ালা খাসি নিয়ে এসে তার চাঁব আর রেজালাও বানিয়েছে। কিন্তু…

রান্নাঘরটাকে একেবারে নোংরা করে দিয়েছে। মনোকষ্টে গদাধরা গিয়ে একেবারে রান্নাঘরের লাগোয়া বারান্দার রেলিং ধরে উদাস চোখে নীচের পথের দিকে তাকিয়ে থাকছে, নইলে পরক্ষণেই ভটকাই এর নাম দেওয়া ‘পোর্টার’ আসনে বারান্দাতে বসে গুণ্ডিপান খাচ্ছে নয়তো রেগেমেগে কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড আবৃত্তি করছে।

যাই হোক, জম্পেশ করে কবজি ডুবিয়ে বটি কাবাব দেওয়া বিরিয়ানি, চাঁব আর রেজালা খেয়ে ওঠার পর আমরা ঋজুদাকে ধরে পড়লাম ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের গল্পটি বলবার জন্যে। আজ্জু মহম্মদও এসে বসল আমাদের সঙ্গে, নিজে খেয়ে, আজমল বাবুর্চিকে ও গদাধরদাকে খাবার পরিবেশন করে।

গদাধরদা নাকি দাড়িওয়ালা বিহারি মোচলমানের রান্না খেতে আপত্তি করছিল। ঋজুদা তাকে ডেকে বলল, দেখো গদাধরদা, আমাদের হিন্দু ধর্মের মতো মহান, গভীর ধর্ম নেই। হয়তো এমন উদার ধর্মও পৃথিবীতে আর নেই। কিন্তু এর এই জাতপাতের বিচার, মানুষকে মানুষ-জ্ঞান না করার শিক্ষার জন্যেই এই ধর্মের এত দুর্দশা। তুমি কি একথা জানো যে, কত নমঃশূদ্র, আর অন্যান্য নিম্নবর্ণের মানুষ তোমাদের এই ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে মুসলমান অথবা ক্রিস্টান হয়ে গেছে? মানুষে মানুষে কোনও ভেদ নেই। কে কোন দেবতা বা নিরাকারকে পুজো করে না করে তাতে কী আসে যায়? সব মানুষেরই তো একই চেহারা। তাদের সকলের খিদে-তেষ্টাও এক। তুমি আমার গদাধরা হয়ে, আমার বাড়িতে থেকে এমন ব্যবহার করে অতিথিকে অপমান করতে পারো না।

ভটকাই বলল, গদাধরদা, তুমি জানো না কি যে ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই?

আমরা হেসে উঠলাম ভটকাই-এর কথা শুনে।

ঋজুদা বলল, বেচারা গদাধরদা যদি অতই জানত তবে তোর স্কুলের মাস্টারমশাই হত। আমার লোকাল গার্জেন হয়ে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন ‘ড্যাগ-মাস্টারি’ করত না।

তারপর বলল, যাও গদাধরদা, আজমল ভাইয়ের সঙ্গে বসে ভাল করে খাও। আর বিরিয়ানি আর বটি কাবাব কী করে রাঁধে, ভাল করে শিখে নাও। গুলহার কাবারটাও শিখে নিও।

আমি বললাম, রেজালা আর চাঁব কি দোষ করল?

আমি তো কিছুই জানি না রাঁধতে। বলেই, গদাধরদা চলে গেল।

 তিতির বলল, ঋজুদা এবারে পাইপে তিনটে টান দিয়ে তোমার রকিং-চেয়ারে একটু চোখ বন্ধ করে দুলে নিয়ে শোনাও আমাদের ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ে আর তোমার এনকাউন্টারের গল্পটা।

তারপর বলল, আজ্জুবাবু বলছিলেন…

আজ্জুবাবু নয়। হয় বলবি জনাব আজ্জু মহম্মদ, নয় বলবি আজ্জু মিঞা।

তাহলে আজ্জু মিঞা বলছিলেন, ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ে নাকি তোমায় শাসিয়েছিল যে তোমার আর তোমার বন্ধু গোপালকাকুর খুপরি উড়িয়ে দেবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম।

ঋজুদা একটু হেসে বলল, লোকে আমাদের সম্বন্ধে যত জানে, আমরা নিজেরাই তত জানি না। হয়তো বেচারি পিপ্পালও জানত না।

ভটকাই বলল, আরে এ তো একেবারে ‘শোলে’র গব্বর সিং। ইয়ে দুশমনি বড়া মাঙ্গা পড়েগি ঠাকুর।

মাঙ্গা নয়, ম্যাহেঙ্গা।

 তিতির বলল।

 ওই হল্লো। মানেতো বুঝেছ?

 ঋজুদা চুপ করেই ছিল।

 আজ্জু মহম্মদ বলল, হ্যাঁ বলিয়ে ঋজুবাবু। ম্যায় ভি শুন লেতে হ্যায় জারা। হামারা ভি তো কভভি শুননে কা মওকা নেহি না মিলা!

কাহে? তুমহারা আব্বা কভভি বাতায়া নেহি?

আব্বা থোরি হামলোগোঁসে বাত-চিত করতেঁ থে। আপ যব আতেথে তব তো বাঁতোকা ফোয়ারা খুল যাতা থা। হামলোগোঁনে থোরি উনকি ইয়ার থে। বাত-চিত যো হোতা থা সো আম্মাকি সাথ হি। হামলোগোঁনে থোরি শুনতা থা কিসসা?

ঋজুদা চেয়ারটা হেলিয়ে দিয়ে বলল, খ্যয়ের, অব তো শুনলো ইয়ে বদমাসলোগোঁকি সাথ।

বলিয়ে ঋজুবাবু। হাম শুনলেনেসে হাজারিবাগ, টুটিলাওয়া ঔর সীমারিয়াকি বহতই আদমিকো শুনায়েঙ্গা হাজারিবাগ লওট যা কর।

বাংলা, আজ্জু মিঞা বুঝতে পারবে?

ভটকাই বলল।

হাঁ হাঁ। বিলকুল সমঝ যাবে। সমঝ তো লেতা হ্যায়, মগর বাংলা বোলি ইতনা আতি নেহি।

ঠিক্কে হ্যায়। যো লজ তুম সমঝমে না পাওগে মুঝকো বাতানা, ম্যায় তুমকো হিন্দুস্থানিমে সমঝা দেগা।

ঋজুদা বলল।

নাও এবার শুরু করো। ব্যারেল গরম করতেই করতেই বেলা গেল, তা বন্দুক ছুড়বেটা কখন?

ভটকাই বলল।

ঋজুদা বলল, তোরা ভটকাই-এর মুখে সেলোটেপ এঁটে দে। নইলে আমি কিছুই বলব না।

তিতির বলল, আজ তুমি আর একটাও কথা বলেছ তো খুব খারাপ হবে ভটকাই।

ঋজুদা বলল, আরে আঙ্গু, তুমহারা পান-সিগারেট সব মজুত তো হ্যায় না?

 হিয়াকা পান ঋজুবাবু, জমতা নেহি। হাজারিবাগ যেইসা উতনা আচ্ছা মঘাই মিলতা কাঁহা! হুয়া তো পটনা সে আতা না!

ক্যা বাত করতা হায় তু আম্মু? কলকাত্তামে বাঘ কি দুধ মাঙ্গো উ ভি মিলেগা। মঘাই পান কা কেয়া কম্মি?

বলেই বলল, ভটাকাই, যাতো, মাধবকে বলে আয় জগুবাবুর বাজারে গিয়ে পণ্ডিতজির দোকান থেকে ষোলো খিলি মঘাই পান সেজে আনতে। চমন বাহার দেবে। শফ, কাথা, চুনা, আর কালি-পিলি পাত্তি জরদা।

কী জরদা?

কালি-পিলি-পাত্তি।

পয়সা দিয়ে আসব?

আরে মাধবকে তুই কি পয়সা দিবি? ওই তো আমার ক্যাশিয়ার। কলকাতার বড়লোকদের দেখে দেখে আমিও নিজে হাতে খরচ করা ছেড়ে দিয়েছি। মাধবই খরচ করে, সেই হিসেব রাখে। ক্রেডিট কার্ড রাখি সঙ্গে গোটা তিনেক অবশ্যই কিন্তু ক্যাশ রাখি না। ওটাই এখন ফ্যাশন। বিড়লা-গোয়েঙ্কা-টোডি-সরকার কেউই নিজের টাকা ছোঁয় না হাতে।

সরকার? কওনসি সরকার?

আজ্জু মহম্মদ জিজ্ঞেস করল।

বড়ে সরকার। কলকাতামে বড়ে সরকার তো একই পরিভার হ্যায়। আনন্দবাজারকি সরকার।

হাঁ?

 হাঁ জনাব। ঋজুদা বলল।

আগে বাড়িয়ে। আজ্জু মহম্মদ বলল।

ভটকাই সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, আমি ফিরে না আসা অবধি যদি এক পাও আগে বাড়ো তবে কিন্তু পরে তোমার নিজের পায়ের শুশ্রূষা করতে হবে।

ঋজুদা হেসে বলল, তাড়াতাড়ি আয়। তুই না-আসা অবধি আরম্ভ করব না।

 প্রমিস?

প্রমিস।

বেশ কিছুক্ষণ পাইপ খেয়ে ঋজুদা বলল, হাজারিবাগে তোরা তো কেউই যাসনি।

আমি গেছিলাম।

আমি বললাম।

.

০২.

ও হ্যাঁ। অ্যালবিনো বাঘ শিকারের নেমন্তন্ন পেয়ে যখন গেছিলাম গাড়িতে মুলিমালোয়াতে।

হাজারিবাগ জেলাতেই গেছিলি। শহরে তো আর থাকিনি।

তা অবশ্য থাকিনি। পাস করেছিলাম।

 হাজারিবাগ শহরের মতো সুন্দর শহর ছোটনাগপুরে বেশি নেই। সুন্দর এখনও আছে, তার কারণ রেললাইন এখনও পৌঁছয়নি সেখানে। পুব দিক থেকে হাজারিবাগ রোড স্টেশনে নেমে সারিয়া হয়ে নবাব শের শাহর গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড পৌঁছে, বগোদর হয়ে হাজারিবাগে আসা যাবে গাড়িতে বা বাসে। আর কোডারমা স্টেশনে নেমে, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের বরহি থেকে ঝুমরি-তিলাইয়া ও তিলাইয়া ড্যাম হয়ে হাজারিবাগ ন্যাশনাল পার্ক-এর পাশ দিয়ে, পদ্মার রাজার বাড়ির পাশ দিয়েও এসে পৌঁছনো যায়। ওপথে দূরত্ব খুবই কম। আবার রাঁচি হয়েও আসা যায়। রাঁচি-হাজারিবাগ রোড হয়ে, রামগড় পেরিয়ে। ওপথে দূরত্ব অবশ্য বেশি পড়ে। কিন্তু তা হলেও, একবার পৌঁছতে পারলে সব পথকষ্ট উশুল।

হাজারিবাগের তিনদিকে তিন পাহাড়। কানহারি, সিলওয়াড় আর সিতাগড়া। এই সিতাগড়াতে যখন মানুষখেকো বাঘ বেরিয়েছিল তখন আমি, গোপাল আর সুব্রত, নাজিম সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে সেই বাঘ মারার জন্যে অনেক হরকৎ করেছিলাম। বাঘটা অবশ্য মেরেছিল সুব্রতই আমরা হাজারিবাগ থেকে কলকাতাতে চলে আসার পরে। একটা গোরু মেরেছিল বাঘটা। সুব্রত আর ইজাহারুল হক দু’জনে শাল গাছে মাচা বেঁধে বসেছিল দিনে দিনেই। সেই বাঘ মারার গল্প আছে ‘সিতাগড়ার মানুষখেকো’তে।

যা বলছিলাম, আমি গোপাল আর নাজিম সাহেব, আঙ্গুর বাবা নাজিম সাহেব, ইজাহারুল-এর জমিদারি টুটিলাওয়াতে গেছিলাম শিকারে। সেবারে গিয়ে শুনলাম পুরো এলাকা জুড়ে একজন ডাকাত দৌরাত্ম্য করছে গত দু’মাস ধরে। তার বাড়ি নাকি গয়া জেলার হান্টারগঞ্জে। টোপি-পরানো গাদা বন্দুক দিয়ে সে শিকার করে বেড়াত হান্টারগঞ্জ জৌরি-সিজুয়াহারা থেকে ওদিকে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড-এর উপরের ডোভি আর তার থেকে এদিকে চাতরা, এমনকি বাঘড়া মোড় পর্যন্ত।

এত জায়গার নাম বললে যে, সবই গুলিয়ে গেল।

আমি বললাম।

 আচ্ছা দাঁড়া, ওই প্যাডটা আন, একটা ম্যাপ এঁকে বুঝিয়ে দিচ্ছি।

ভটকাই টেবল থেকে ঋজুদার নিজের আঁকা লেটারহেড সমেত চিঠি লেখার প্যাডটা নিয়ে গেল আর কলমদানিটা। ঋজুদার কলমদানিতে রোজ কলম বদল হয়, ফুলদানিতে যেমন ফুল। কম করে গোটা দশেক নানারকম নানাদেশি কলম থাকলে এক লাইনও লিখতে পারে না ঋজুদা। চিঠিও না। পৃথিবীর সব কলমই আছে ঋজুদার কাছে। ইংলিশ ওয়াটারম্যান, আমেরিকান পাকার এবং শেফার্স, জাপানি পাইলট, সুইস সারানডাশ, যুগোশ্লাভিয়ান হার্টিগ, জার্মান পেলিকান এবং ম ব্লাঁ। তবে ম ব্লাই সবচেয়ে প্রিয় ঋজুদার। কলমদানি থেকে মেরুন-রঙা একটি ম ব্লা কলম তুলে নিয়ে মোটা নিব দিয়ে ঋজুদা লম্বা লম্বা টানে একটা ম্যাপ এঁকে নীচে নীচে জায়গাগুলোর নাম লিখে আমাদের দিকে এগিয়ে দিল।

ততক্ষণে ভটকাই ফিরে এসেছে নীচে ঋজুদার ড্রাইভার কাম-ম্যানেজার কাম-ক্যাশিয়ার মাধবদাকে পান আনতে বলে দিয়ে। ভটকাইও দেখল ম্যাপটা মনোযোগ দিয়ে। তারপর আজ্জু মিঞার দিকে এগিয়ে দিল। ঋজুদা হেসে ফেলল। বলল, আঙ্গুর এসব জায়গা নখদর্পণে। ও নাজিম মিঞার ছেলে। বাবার সঙ্গে সাত বছর বয়েস থেকে ও শিকারে যাচ্ছে।

ভটকাই লজ্জিত হয়ে বলল, সরি, সরি, মিঞাসাহেব।

এবারে বলো। ম্যাপ দেখা হয়েছে আমাদের। তিতির বলল।

 ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের বয়স তখন পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। আমার আর গোপালের বয়সও তখন কুড়ির নীচে। গোপাল আর সুব্রত আমার চেয়ে এক দেড় বছরের বড় ছিল। সুব্রতর বাবা শ্রী সত্যচরণ চ্যাটার্জি তখন হাজারিবাগ জেলার পুলিশ সাহেব। চেহারাও তেমন ছিল। লম্বা-চওড়া, ইয়া-ইয়া গোঁফ। তখন ঘোড়ায় চড়ে ইনসপেকশানে যাবার দিন চলে গেছে। জিপে করেই যেতেন। তখন হাজারিবাগ জেলার এলাকা ছিল বিরাট। পুরোটাই জঙ্গল-পাহাড়ময়।

এ কথা শুনে আমরা খুবই উত্তেজিত হলাম যে আমাদের চেয়ে বয়সে সামান্য বড় একটা দেহাতি ছেলে পুরো জেলা কাঁপিয়ে দিয়েছে ডাকাতির পর ডাকাতি করে। আর শুধু হাজারিবাগ জেলাই তো নয়, গয়া জেলাতেও তার আধিপত্য। এমনকি যার নামে বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খায়, সেই চ্যাটার্জি সাহেব এস. পি. ও লবেদম হয়ে যাচ্ছেন ওইটুকু পুঁচকে ছোঁড়াকে ধরতে।

আমরা যদি পিপ্পাল পাঁড়েকে ধরতে পারি তো পটনার সব কাগজে ছবি পর্যন্ত বেরোবে এবং সরকার থেকে ইনাম তো মিলবেই।

গোপাল উত্তেজিত হয়ে বলল।

ইনাম মানে কী?

ভটকাই বলল।

 আরে! হিন্দি ছবির পোক ইনাম মানেও জানো না?

তিতির বলল।

পোক মানে? কী সব খারাপ ভাষা ব্যবহার করছ মেয়ে হয়ে!

 পোক মানে, পোকা।

অ। তবে আমি জানি ইনাম মানে কী।

তবে জিজ্ঞেস করলে যে?

রুদ্র জানে কিনা পরখ করছিলাম।

আমি বললাম, আবার শুরু করলি ভটকাই।

এমন সময়ে মাধবদা পান হাতে এসে ঢুকল। চালু ভটকাই পাছে আবার উঠতে হয় দরজা খুলতে তাই দরজাটা ভেজিয়েই রেখেছিল।

আরে গদাধরকে পানটা দাও মাধব। রুপোর রেকাবিতে একটু আতরজল ছিটিয়ে এনে দেবে। ওপরে ভিজে মলমল-এর ঢাকনিও দিয়ে দেয় যেন। নইলে পান তো শুকিয়ে যাবে। সব পান তো আর এখুনি খাবে না আজ্জু।

হায়! হায়! ইন্তেজামকি কোঈ কম্মি নেহি।

আজ্জু মহম্মদ, তারিফ করা গলাতে বলল ঋজুদাকে।

ঋজুদা পাইপে এক টান লাগিয়ে বলল, না হোগা কেইসে? ম্যায় তো তুমহারা আব্বাকা চেলাই না হ্যায়। ইয়ে সব খাতিরদারি তারিকা তো উনোনেই শিখলায়া হামলোগোঁকো। আহ! ক্যা জিন্দাদিল, মনমৌজি আদমি থে তুমহারা আব্বাজান। তুমলোগোঁনে কুছ নেহি হো উনকি সামনা।

ম্যায়নে থোরি বোলা কভভি যো, ম্যায় আব্বাকি বরাবর হু।

 বলল, মিঞাসাহেব।

বলো ঋজুদা, থামলে কেন?

 ভটকাই ডিরেইলড ট্রামকে লাইনে ফেরাল।

আমরা পৌঁছবার পরদিন বিকেলে সুব্রতও এসে পৌঁছল। পুলিসের জিপে করে। সঙ্গে আজাহারও। আজাহার ওরও বন্ধু ছিল। গোপালের তো ছিলই।

নাজিম সাহেব, তাঁর ডিপারে-দেওয়া হেডলাইটের মতো বড় বড় চোখ দুখানি জ্বেলে দিয়ে বললেন, লাও! আভভি তো খাই বন গ্যয়া।

কেন?

তিতির জিজ্ঞেস করল ঋজুদাকে।

আরে! ডাকাত যদি একবার জানতে পারে যে, পুলিশসাহেব, যিনি ডাকাতের খুপড়ি নিজে হাতে উড়িয়ে দেওয়ার জন্যে প্রায়ই চাঁদমারিতে গিয়ে রিভলভারের হাত আরও ভাল করছেন, তাঁরই বড় ছেলে এই জঙ্গলে ডাকুর সঙ্গে টকরাতে এসেছে, তাহলে সুরবোহোর দারুণই বিপদ। সঙ্গে আমাদেরও। আমরা যদি বলি যে, আমরা ভাল্লুকের আর বাঘের সঙ্গে খেলতে এসেছি, ওর সঙ্গে খেলব না তবে কি ও ছাড়বে? বলবে, ফিক্সচারে এ ম্যাচ থাক আর না থাক খেলতেই হবে। ইয়ে তো সাচমুচহি খাতরা কি বাত ইয়ার! সুরবোতোকে যদি ও ধরে নিতে পারে তবে তো কেল্লা ফতে। ওকে জানে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে স্বয়ং পুলিশ সাহেবকে পর্যন্ত একেবারে ল্যাজেগোবরে করে দিতে পারবে তখন পিপ্পাল পাঁড়ে।

সুরবোতোটা আবার কে?

তিতির জিজ্ঞেস করল।

 আজ্জু মহম্মদ বলল, খোকাবাবুই থা সুরবোতো বাবুকি ঘরওয়ালা নাম।

 আমরা হেসে উঠলাম।

ঋজুদা বলল,হাসবার কী আছে? ওরা বাপ-বেটাতে প্রথম দিন থেকেই সুব্রতকে সুরবোতোবাবু বলে। তিতিরের ছোট মামি যেমন উত্তেজিত হলেই দরজাকে দজরা জরদাকে ‘জদরা’ বলে। কী? বলে না?

তিতির হাসল। বলল, হ্যাঁ। ঠিক বলেছ। বলে।

তারপর?

 ভটকাইও বলল, তারপর?

প্রথম দিন সারা সকাল আমি আর গোপাল টুটিলাওয়ার চারপাশের জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করে নালার বালিতে, পথের লাল ধুলোতে কোন কোন জানোয়ারের পায়েদাগ দেখা যায়, তা খুঁজে বেড়ালাম। টুটিলাওয়া যেন পাখিরই স্বর্গরাজ্য। ময়ূর, তিতির, বটের, কালি-তিতির, আসকল, পাকা বটফল খেতে-আসা ঝাঁকে ঝাঁকে বুনো সবুজ-পায়রা বা হরিয়ালে পুরো এলাকাটা ভর্তি। উড়ো-পাখিদের পায়ের দাগ অবশ্য মাটিতে পাওয়া যায় না, ময়ুর বটের বা তিতিরের যেমন পাওয়া যায়। কালি-তিতিরও ঝোপে বসে থাকে, মাটিতে অধিকাংশ সময়েই থাকে না। পায়ের দাগেই বুঝলাম মস্ত একদল শুয়োরও আছে। ধাড়ি-মাদিবাচ্চা মিলিয়ে প্রায় দেড়শো-দুশোর দল।

কাড়ুয়া আর আসোয়া দুই ভাই জঙ্গলের অন্য দিকটা সার্ভে করে ফিরে এসে বলল, শম্বর, নীলগাই, চিতল হরিণ, কোটরা তো আছেই তবে ভাল্ অর্থাৎ ভাল্লুকেরই আড্ডা ও জায়গাটা। সবসময়ে সাবধানে জঙ্গলে ঢুকবেন। তা ছাড়া চিতাও আছে এক জোড়া, বেশ বড়। আর বড় বাঘ একটা।

সুব্রত জিজ্ঞেস করল, কত বড়?

কাভুয়া বলল, মনে হচ্ছে সীতাগড়া বাঘের মতোই বড় হবে। বলেই নিজের কোমরের কাছে ডান হাতের পাতা ঠেকিয়ে বলল, বড়কা বাঘোয়া বাবু, ডাবল বাঘোয়া।

আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। কিংকর্তব্য? যে জঙ্গলে বাঘের হদিশ পাওয়া গেছে সে জঙ্গলে অন্য জানোয়ারের খোঁজ কোনও শিকারিই করে না।

তবে?

কাড়ুয়া বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেসে বলল আমাকে, একঠো বড়কা শুয়ার পিটা দে ঋজুবাবু। মজা আয়ে গা।

গোপাল বলল, বানায়গা কাঁহা। মানে, রাঁধবে কোথায় শুয়োর?

কাহে? হিয়াই।

সুব্রত ধমকে বলল, ভ্যাট।

 তারপর বলল, নাজিম সাব ঔর ইজাহার সাব ক্যা হারাম খাইয়ে গা?

সঙ্গে সঙ্গে ভুল বুঝতে পেরে, জিভ কেটে বলল কাতুয়া, তব জঙ্গলহিমে বানা লেগা। গাঁওওয়ালা ভি সব খায়েগা।

এই গ্রামে অধিকাংশই মুসলমানের বাস তবে হিন্দু একেবারেই নেই, তা নয়। মুসলমানেরা সব জায়গাতেই সংখ্যাতে জিওমেট্রিক প্রগ্রেশনে বাড়ে। তাই এতদিনে এখন হয়তো মুসলমান আর হিন্দুর অনুপাত ৪:১ হয়ে গেছে। কেয়ারে আজ্জু ভাই?

ঋজুদা শুধোল আজ্জু ভাইয়াকে।

সো, হোনে ভি শকতা।

আজ্জু মহম্মদ বলল।

কাড়ুয়া বলল, আর যদি কেউ নাও খায় তবে আমরাই রাম-লক্ষণ (কাতুয়া-আসোয়া) দু’ভাইয়ে সেঁটে দেব। পুরো শুয়োর।

কেন? আমরা কী দোষ করলাম? আমরা শুয়োর খেলে তো আর আমাদের হারাম’ হবে না।

গোপাল বলল।

তাই তো। রামচন্দ্রও তো বন্য বরাহ খেতেন। তা ছাড়া, জঙ্গলের শুয়োর ফল-মূল-জঙ্গলি কচু এসব খায়। তারা তো আর ধাঙ্গর বস্তির শুয়োরের মতো গু খায় না।

ভটকাই ফুট কেটে বলল।

ল্যাঙ্গোয়েজ! ল্যাঙ্গোয়েজ!

 তিতির বলল।

গু-এর ইংরিজি কী? গু কে গু বলব না, তো কী বলব তবে?

 জিনিসটাকে আরও নাড়িয়ে দিয়ে বলল, হতভাগা ভটকাই।

বাথরুম বললি না কেন?

আমি বললাম।

 ইডিয়ট। বাথরুম কি খাওয়ার জিনিস? তোর তো বুদ্ধিই ওরকম।

ভটকাই রিটৰ্ট দিল।

তিতির বলল ভটকাইকে, বলতে পারতে পার্জিংস।

ফর্জিং? সে কি? সে তো হাওড়ার ঢালাই কারখানাতে হয়। ডাবু ধরে বসে থাকে একদল আর অন্য দল লোহা গলিয়ে ঢালে।

ভটকাই বলল অবাক হয়ে।

 ধ্যাৎ। বললাম, পার্জিংস purgings শুনলি ফরজিং। তিতির বলল।

তারপরে বলল, বলতে পারতে night soil

নাইট-সয়েল মানে বুঝি গু?

আঃ ভটকাই। চেঞ্জ দ্য সাবজেক্ট।

 ঋজুদা ধমক দিয়ে বলল।

তারপর গোপাল বলল, তাই হবে। আমরা জঙ্গলেই ক্যাম্প ফায়ার করে নদনদে চর্বি-ভরা সাকলিং-পিগ-এর বার-বি-কিউ করব। আর পরদিন pork vin daloo রাঁধব। বাজরার রুটির সঙ্গে জমে যাবে একেবারে।

বাঃ। বাঃ। ফাসক্লাস।

আমি বললাম। মানে, তোদের ঋজুদা বলল আর কী!

ঋজুদা তারপর একটুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে চুপ করে রইল। বোধহয় অনেক পুরনো কথা মনে পরে গেল তার। তারপর বলল তারিফের গলাতে, গোপালটা রাঁধত ভারি ভাল। আর দারুণ দারুণ সব মনগড়া নাম দিত ওর সব রান্নার। আমি ছিলাম দলের মধ্যে সবচেয়ে বড় অকর্মা। শুধু খেতে পারতাম আর তারিফ করতে পারতাম।

সেটাও তো খুবই দরকার। প্রশংসা না পেলে কোনও কাজই কি কারও করতে ইচ্ছে করে? না, ভাল লাগে?

তা অবশ্য ঠিক। প্রশংসাই হচ্ছে আসল উদ্দীপক ব্যাপার।

তা যাই হোক, আমরা সকাল থেকে বারোটা অবধি জঙ্গল চষেছিলাম। পা ব্যথা করছিল। তাই গোপাল কাড়ুয়ার হাতে তার বন্দুকটা দিয়ে আর দুটি অ্যালফাম্যাক্স-এর পৌনে তিন ইঞ্চি এল.জি. দিয়ে বলল, কাড়ুয়া, যেমন চেহারার শুয়োর খেতে ইচ্ছে করে তেমনই মেরে নিয়ে আয়। বিকেল-বিকেল।

দুটি গুলি দিলেন যে!

একটি শুয়োর মারার জন্য আর অন্যটা শুয়োর যাতে তোদের টু না মারতে পারে সে জন্যে।

আমরা হেসে উঠলাম।

 ও ও। আমি ভেবেছিলাম দুটো মারার জন্যে বুঝি দুটো দিলেন।

 ঠিক আছে। তাই হবে। তোমাদেরটা তোমাদের মতো মেরো, আমরা যেটা খাব সেটা যেন ছোট এবং চর্বিনদনদে হয়। নইলে ভাল বার-বি-কিউ হবে না।

বে-ফিক্কর রহিয়ে হুজৌর। পাক্কা চার বাজি নিকলেগা ঔর সুরজ বুড়তে বুড়তেহি লেকর আয়েগা।

ওরা চলে গেলে, নাজিম সাহেব এবং ইজহারুল কনফারেন্সে বসলেন আমাদের সঙ্গে। ঠিক হল, বাঘের হদিশ যখন পাওয়া গেছে ওখান থেকে দু’মাইল গভীরে ওল্ড চাতরা রোডের ওপাশে তখন কাল সকালে একটা হাঁকা করলে কেমন হয়?

ইজাহার বলল, হাঁকাতে শম্বর যদি বেরোয়, তবে একটা শম্বর মেরে দিলে বস্তির গরিব মানুষেরা আনন্দ করে খেতে পারে। অবশ্য বাঘ মারার পরেই। ওরা তো আর হাটে পাঁঠা কিনে খেতে পারে না। মুরগিও পায় না খেতে। প্রোটিন বলতে তো ওদের এই শিকারই একমাত্র প্রোটিন।

ঠিক আছে।

 আমরা তিনজনে একসঙ্গে বলে উঠলাম।

সেই মতো প্ল্যানও হয়ে গেল। দুপুরের খাওয়ার পরে শীতের রোদের মধ্যে বেতের চেয়ার পেতে বসে একটা ছকও করে নিলাম। নিজামুদ্দিন এবং তার চেলাদেরও ডাকা হল। তাদের নাম, একরাম আর বুধাই। যেসব জায়গাতে বাঘ দিনের বেলা শুয়ে থাকতে পারে তার একটা আন্দাজ দিল কাভুয়া। সেই পাহাড়টার উলটোদিক থেকে হাঁকোয়া করলে বাঘ ঘুম ভেঙে পাহাড়ের ওই পাশ দিয়ে নেমে এসে নীচের মহুলান-নালা পেরিয়ে এদিকে আসার খুবই সম্ভাবনা। যেখান দিয়ে বাঘের নদী পেরুবার সম্ভাবনা প্রবল সেইখানেই ষাট গজ মতো দূরে দূরে চারটে মাচা বানাতে হবে। আর দু’পাশে স্টপার’ রাখতে হবে, যাতে বাঘ ডানদিকে, বাঁদিকে চলে যেতে চাইলে তারা গাছে বসে আওয়াজ করে বাঘকে মাচা যেদিকে বাঁধা, সেদিকেই যেতে বাধ্য করে।

ইজাহার বলল, সে নিজামুদ্দিনের সঙ্গে থাকবে হাঁকাওয়ালাদের ঠিক মতো চালনা করার জন্যে। শিকারিদের মাচাতে বসবে না। ইজাহার পাহাড়ের মাথায় একটা মস্ত শিমুল গাছের নীচে দাঁড়াবে যাতে তাকে নদীর দিক থেকে এবং পাহাড়ের ওদিক থেকেও দেখা যায়। মানে, আমরাও দেখতে পারি আর নিজামুদ্দিনরাও দেখতে পারে। ইজাহারের গায়ে লাল-রঙা জ্যাকেট থাকবে, যাতে সহজেই তাকে দেখা যায়। কাঁধে থাকবে থ্রি-সেভেন্টি-ফাইভ ম্যাগনাম রাইফেল। তবে ইজাহার সত্যিই চায় যে, বাঘটা আমি, গোপাল এবং সুব্রত আমাদের তিনজনের মধ্যে একজনই মারি। নাজিম সাহেব বসবেন মধ্যের মাচাটায়। বাঘ মারার জন্যে যতটা নয়, আমাদের (উনি আমাদের ছওড়াপুত্তান’ বলে ডাকতেন) দেখভাল করার জন্যে এবং যৌবনের মস্তি’তে যাতে আমরা বাহাদুরি করতে গিয়ে প্রাণ না হারাই তাও দেখতে। ফাদার-মাদার কি দোয়া’ ইন গ্রেট কোয়ানটিটি, সঙ্গে করে, উনি সশরীরে আমাদের যম-এর যম হয়ে স্বমহিমায় মধ্যিখানে একেবারে বিরাজ করবেন।

রাতে নাজিম সাহেব, সকালে নিজেরই শিকার করা বনমোরগের মাখা-মাখা ঝোল, আর তিতিরের কাবাব বানালেন। পটনা থেকে আনানো বাখরখানি রোটি, মোটা কাপড়ে মুড়ে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। তাই দিয়ে খেলাম। আহা! কী স্বাদ! সঙ্গে পুদিনার চাটনি। সীমারিয়া থেকে লোক পাঠিয়ে বালুসাহিও আনিয়েছিল ইজাহার। সুইট-ডিশ হিসেবে। কাড়ুয়া, আসোয়ারা গ্রামেই খাবে মহাভোজ। তাদের শিকার করা শুয়োরটিকে কাটাকুটি তারা জঙ্গলেই করেছে। আমাদেরটা গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। শেয়াল কুকুর হায়না বা চিতার হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে। আমরা কাল বার-বি-কিউ করব। শুনলাম যে,কাড়ুয়াদের শুয়োরটা দাঁতাল এবং মস্ত বড়। কাল মহুয়া খাওয়া হবে, শুয়োরের মাংসের ঝোল দিয়ে গোঁনি বা সাঁওয়া ধানের ভাত খাওয়া হবে তারপর ওরা সারারাত নাচ-গান করবে। তার উপরে বাঘ যদি মারা পড়ে, তবে তো কথাই নেই। আমাদের কাছ থেকে মোটা বখশিস পেয়ে ওদের আনন্দ আরও ভরাট হবে।

রাতের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে। বাইরে যাওয়াই যায় না এমনই ঠাণ্ডা। হাজারিবাগ, রাঁচি আর গয়া জেলাতে তখন এমন ঠাণ্ডা পড়ত যে, তা বলার নয়। তবু জঙ্গলে এসে ক্যাম্পফায়ারের পাশে বসলে মন খারাপ হয়ে যায়। তখন তো আমরা ছাত্র। শীতের ভাল জামাকাপড়ও তেমন ছিল না। কিন্তু টগবগে যৌবন ছিল। যা থাকলে, শীতকে শীত, গরমকে গরম, মনেই হয় না। কোনও কষ্টকেই কষ্ট বলে মনে হয় না তখন।

ক্যাম্পফায়ারের সামনে বসে আছি আমরা তিনজনে। জুতোসুদ্ধ পা আগুনের কাছে রেখে। ফুটফাট করে আগুনে কাঠ পুড়ছে আর ফুলকি উঠছে কাঠ নাড়া দিলেই। আগুনের শিখার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ কেমন যেন আটকে যায় আগুনে। ঘোর লেগে যায়। আগুনের মধ্যে সূর্যের সাতরং খেলা করে আর তা দেখতে দেখতে মন চলে যায় কোথায় না কোথায়। কত বিচিত্র সব ভাবনা আসে।

ভাবছিলাম, কাল বাঘটা কি বেরোবে হাঁকাতে? না বেরোলে এত মানুষের এত শ্রম এবং আমাদের অর্থদণ্ডও বৃথা যাবে। হাঁকাওয়ালাদের তো রোজ’-এর টাকা দিতে হবে। সে আমরাই দিই আর ইজাহারই দিক। তবে যাঁরাই কখনও শিকার করেছেন তাঁরাই জানেন যে, ‘নিশ্চিত’ বলে কোনও ব্যাপার নেই শিকারে। Failures are the pillars of success! জেঠুমনি বলতেন। এই কথাটা শুধু শিকারের বেলাতেই প্রযোজ্য নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রেই এই কথাটি প্রযোজ্য। শিকার করতে করতে এমন এমন জিনিস শিখেছি যা আমার পরবর্তী জীবনের পাথেয় হয়েছে। পেছন ফিরে তাকালে খুবই ধন্য মনে করি নিজেকে। সেই সব রাত ও দিনের প্রতি গভীর এক কৃতজ্ঞতার বোধও নড়েচড়ে ওঠে।

এখন কৃষ্ণপক্ষ। একফালি চাঁদ উঠবে। তাও সেই মধ্যরাতে। চারদিকে ফুটফুটে অন্ধকার। তবে আকাশভরা তারা আছে। দুটো পেঁচা ঝগড়া করছে উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে, কিচি-কিচি-কিচর-কিচর-কিচর। পাশে ঝাঁটিজঙ্গলের উপরে ঘুরে ঘুরে ডিড-উ-ডু-ইট পাখি ডাকছে: ডিড-উ-ডু-ইট? ডিড-উ-ডু-ইট? ডিড-ড্য-ডু-ইট?

কে যে কী করেছে তা আমরা জানি না। কাকে যে সারারাত ওই হাড়কাঁপানো শীতের রাতে ওরা উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে এই প্রশ্ন করে যায়, বড় জানতে ইচ্ছে করে। বন-পাহাড়ে এমন অনেক রহস্য চিরদিনই ছিল, আছে, এবং থাকবেও যার উত্তর সম্ভবত কেউই পাবে না কোনও দিনই।

জনাব ইজাহারুল হক, নাজিমুদ্দিন এবং হাঁকাওয়ালাদের নিয়ে পুবের আকাশ লাল হওয়া মাত্রই বেরিয়ে গেছে। গভীর জঙ্গলে জঙ্গলে দু’ মাইল যাবে তারপর মহুলান-নালা পেরিয়ে পাহাড় ডিঙিয়ে হাঁকাওয়ালারা পাহাড়ের ওপারে নেমে যাবে। আর ইজাহার কাছিম-পেঠা পাহাড়টার শিরদাঁড়ার উপরের সেই প্রাচীন শিমুল গাছের নীচে বড় বড় কালো পাথরের যে স্তূপ আছে, তার উপরে তার লাল-জ্যাকেট পরে বসে থাকবে। মাচায়-বসা আমাদের কাছ থেকে রেডি আছি’ এই সংকেত পেলে, সে তার লাল রুমাল নেড়ে পাহাড়তলির হাঁকাওয়ালাদের সঙ্গে থাকা নিজামুদ্দিন আর তার দুই চেলা একরাম আর বুধাইকে নির্দেশ দেবে যাতে হাঁকা শুরু করে ওরা।

ওরা রওয়ানা হয়ে যাবার ঘণ্টাখানেক পরে আমরা চা আর বিস্কিট খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ওদের এক ঘণ্টার lead দিলাম এই জন্যে যে, হাঁকাওয়ালারা খুব তাড়াতাড়ি হাঁটলেও ওদের পাহাড়ের ওপারে গিয়ে পৌঁছতে কমপক্ষে ঘণ্টা দেড়েক লাগবেই। আমরা আধঘণ্টার মধ্যে মহুলান-নালার পাশে বাঁধা মাচাতে পৌঁছে যাব।

চেলা বুধাইকে রেখে গেছে নিজামুদ্দিন আমাদের মাচাতে নিয়ে যাবার জন্যে। ওরাই গতকাল বিকেলে গিয়ে মাচা বেঁধেছে। কাড়ুয়া আর আসোয়া ইজাহারের সঙ্গেই গেছে। ইজাহারের গান-বেয়ারার হয়ে গেছে আসোয়া।

আর কাড়ুয়া থাকবে নিজামুদ্দিনের সঙ্গে। অত্যন্ত অভিজ্ঞ আর ভাল শিকারি কাভুয়া। যদি কোনও বিপদ হয়, যদি বাঘ হাঁকাওয়ালাদের লাইন ভেঙে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করে, তাই হাঁকাওয়ালাদের সঙ্গেও এক বা একাধিক ভাল শিকারির থাকাটা খুবই প্রয়োজন। কাড়ুয়া সঙ্গে তার টোপিওয়ালা মুঙ্গেরি গাদা বন্দুকটি তো এনেইছে–উপরন্তু নিজামুদ্দিনের একনলা লাইসেন্সড বন্দুকও আছে ম্যানটন কোম্পানির।

ইজাহারের বাড়ি ছাড়ার দশ মিনিটের মধ্যে আমরা ঘন হরজাই জঙ্গলে পৌঁছে গেলাম গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে, কুলথি আর কিতারির ক্ষেত পেরিয়ে। এদিকে বেশিই অসন গাছ। পন্নন, করম, প্রাচীন জংলি আম, ঢওটা, ডিটোর, কুসুম, পইসার, মহুয়া, শিমুল ইত্যাদিও আছে। মহুলান গাছ হয় উঁচু পাহাড়ে। মহুলান গাছের পাতা চালান যায় দক্ষিণ ভারতের মন্দিরে মন্দিরে। দোনা’ বানাতে লাগে নাকি! এখানে একটাও নেই। অথচ নালার নামটা যে কেন মহুলান হল তা বোঝা গেল না।

নালাতে পৌঁছে আমরা মাচাতে উঠে বসলাম। একটা কাঠের মই বানিয়ে রেখেছিল ওরা। সেটা দাঁড় করানো ছিল মধ্যের মাচা বাঁধা গাছের সঙ্গে, যেটাতে নাজিম সাহেব বসবেন। নাজিম সাহেবের সঙ্গে তাঁর নতুন-কেনা আমেরিকান .৪০৪ জেফরি রাইফেল। সুব্রতর .৪০৫ আমেরিকান উনচেস্টার রাইফেল। আন্ডার লিভার। দুটিই সিঙ্গল ব্যারেল। সুব্রতর রাইফেলে প্রতিটি গুলি ছোঁড়ার পর ঘটা-ঘং-ঘটা-ঘং আওয়াজ করে ম্যাগাজিনে গুলি রিচার্জ করতে হয়। বাঘ মারতে ওই রাইফেল নিয়ে যাওয়া সত্যিই বিপজ্জনক। যদি প্রথম গুলিতেই বাঘ অক্কা না পায় তবে বাঘ রাইফেল রিচার্জ করার শব্দ শুনে শিকারি কোথায় আছে তা সঙ্গে সঙ্গে জেনে যেতে পারে এবং আক্রমণও করতে পারে।

গোপাল আর আমার তখন কোনও রাইফেল-টাইফেল ছিল না। আমার ছিল ডাবল ব্যারেল গ্রিনার বন্দুক। ডাব্লু-ডাব্লু গ্রিনার বত্রিশ ইঞ্চি ব্যারেল। আর গোপালের আঠাশ ইঞ্চি ব্যারেলের ম্যানটন বন্দুক। ডাবল ব্যারেল। দু’জনের ১২ বোরের। গোপাল আমার চেয়ে দৈর্ঘ্যে অনেকই কম ছিল। বত্রিশ ইঞ্চি ব্যারেলের বন্দুক ওর পক্ষে কায়দা করা মুশকিলও ছিল।

বুধাই বসল নাজিম সাহেবের সঙ্গে। আমরা সবাই ঠিকমতো মাচায় বসে গেলে এবং একে অন্যের অবস্থান ঠিকমতো দেখে নেবার পর নাজিম সাহেব তাঁর গলার লাল-সবুজ চেক-চেক মাফলার নাড়িয়ে পাহাড়ের টঙে বুড়ো শিমুলের নীচে কালো পাথরের তূপে বসে থাকা ইজাহারকে সংকেত দিলেন। ইজাহারও সংকেত পাওয়া মাত্র দাঁড়িয়ে উঠে পেছন ফিরে ওদিকে লাল রুমাল নাড়ল নিজামুদ্দিন একরাম আর কাড়ুয়াকে নির্দেশ দিয়ে যে, হাঁকোয়া শুরু করো।

মাচাতে বসার আগে নাজিম সাহেব আমাদের বলেই দিয়েছিলেন যে, যে আগে বাঘকে রৈঞ্জের মধ্যে এবং সুবিধেমতো পাবে সেই অন্যের জন্যে অপেক্ষা না করে গুলি চালাবে। বাঘ যদি আহত হয়, সঙ্গে সঙ্গে না-পড়ে গুলি খেয়ে, তাহলে তারপরই অন্যরা তাদের রেঞ্জের মধ্যে এলে গুলি করতে পারে। তবে কোনও ক্রমেই রেঞ্জের বাইরে থাকলে এবং ভালভাবে মারার সুযোগ না থাকলে, দূর থেকে গুলি করবে না।

হাঁকোয়া শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তেজনা বাড়তে থাকে। হাতের পাতা ঘেমে ওঠে। নিশ্বাস দ্রুত হয়ে যায়।

আমরা কেউই কারওকে দেখতে পাচ্ছিলাম না কিন্তু কে কোন দিকে এবং কতদূরে আছে তা জানতাম।

কথা বলা বারণ। অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হলে পাখির ডাকের মতো কু’ শিষ দিয়ে তা করতে হবে। এবং কোনওমতেই হাঁকোয়া শেষ না হয়ে যাওয়া অবধি, হাঁকাওয়ালারা মাচা-বাঁধা গাছের একেবারে নীচ অবধি না এলে মাচা থেকে নামা চলবে না।

অভিজ্ঞ শিকারি মাত্রই জানেন যে, বাঘ অথবা চিতা অনেক সময়ে হাঁকাওয়ালাদের একেবারে সামনে সামনে হেঁটে আসে এবং হাঁকোয়া যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, যখন হাঁকাওয়ালাদের দেখা যাচ্ছে, তখনই তারা শিকারিকে সমূহ বিপদে ফেলে আড়াল থেকে বেরোয়। তখন হাঁকাওয়ালাদের বাঁচিয়ে মুহূর্তের মধ্যে বাঘ বা চিতাকে গুলি করা না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যন্ত ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের অভিজ্ঞ মানুষের পক্ষেই সম্ভব। আমাদের মাথা গরম, তার উপরে ছেলেমানুষ।

সুব্রত বসেছিল বাঁদিকের শেষ মাচাতে। তারপরে গোপাল। তারপরে নাজিম সাহেব ও বুধাই এবং ডানদিকে সবচেয়ে শেষে আমি। চারটি মাচার দূরত্ব ছিল ষাট গজ মতো করে। তার মানে, সুব্রত আমার থেকে প্রায় আড়াইশো গজ দূরে ছিল।

হাঁকা আরম্ভ হয়ে গেছে। তুমুল চিৎকারে অদৃশ্য শত্রু ও স্ত্রীর ভাইকে যথেচ্ছ এবং যাচ্ছেতাই গালাগালির সঙ্গে ক্যানেস্তারা বাজিয়ে, শিঙে ফুঁকতে-ফুঁকতে এবং টাঙ্গির হাতল দিয়ে গাছের কাণ্ডতে বাড়ি মারতে মারতে হাঁকাওয়ালারা পাহাড়ে উঠে আসছে। বাঘ তখন পাহাড়ের ওদিকের ঢালে না এদিকের ঢালে আছে, তা কেউই জানে না।

স্টপার ছিল চারজন, নদীর ওপারের গাছে আমার এবং সুব্রতর ডাইনে ষাট গজ দূরে। বাঘ যদি আমাদের মাচার দিকে না এসে ডাইনে বাঁয়ে ভাগলবা হবার চেষ্টা করে তাহলে তারা গাছের ডালে টাঙ্গি দিয়ে ঠকঠক করে আওয়াজ করবে অথবা হাততালি দেবে, অথবা কাশবে, যাতে বাঘ বিরক্তি এবং ভয়ে, যাত্রাপথ বদলে আমাদের দিকেই আসে।

হাঁকাওয়ালারা পাহাড়ের মাথাতে উঠে এসেছে। এবারে দেখা যাচ্ছে তাদের। তার মানে, বাঘ ওদিকের ঢালে ছিল না। কাড়য়া আর আসোয়ার খবর যদি ঠিকই হয় তাহলে বাঘ এদিকের ঢালের কোথাও আছে। পাহাড়ের এদিকের গায়ের মাঝখানে একটা খাঁজ। তার মধ্যে একটা ঘন জঙ্গলাবৃত গিরিখাত। এবং সেই খাতটা এসে ঠেকেছে মহুলাননালাতে। ওই গিরিখাতের মুখের সামনেটাকে পুরো ঘিরে মাচা বাঁধা হয়েছে এমনই মনে করে যে, বাঘ তাড়া খেয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে ওই গিরিখাতের আশ্রয়ে পৌঁছে সেখান দিয়ে এগিয়ে এসেই ওই ঝামেলার পাহাড়কে ত্যাগ করতে চাইবে। এবং পাহাড় ছেড়ে যাবার সময়ে সে যখন কালো পাথর-ভরা মহুলান-নালাটি পেরুবে তখনই সেই সামান্য জল থাকা, অপেক্ষাকৃত ন্যাড়া জায়গাতে বাঘকে আমরা দেখতে পাব এবং সুবিধেমতো গুলি করব।

প্ল্যানে কোনও খুঁত ছিল না। এখন বাঘটা এলে হয়।

 বাঘ শিকারে এই অলিখিত নিয়ম চালু আছে চিরদিনই যে, যে-শিকারি সবচেয়ে আগে বাঘের শরীর থেকে রক্তপাত ঘটাবে সে বাঘ তারই। মানে, যদি কোনও আনাড়ি শিকারিও বাঘের ল্যাজে বা অন্য কোনও বাজে জায়গাতে গুলি করে তাকে আহত করে তাকে সাক্ষাত যম-এ রূপান্তরিত করে এবং তার দোসর অন্য শিকারি প্রাণ বিপন্ন করে–এমনকি নিজের প্রাণ দিয়েও সেই আহত বাঘকে পায়ে হেঁটে গিয়ে মারে, তবুও সেই বাঘ, বাঘের শরীরের প্রথম রক্তঝরানো শিকারির বাঘ বলেই গণ্য হবে।

হয়তো এই নিয়মের কোনও মানে নেই। আবার আছেও। sportsmanship বলতে অনেক কিছুই বোঝায়। এই শব্দটি আগে ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, শিকার ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই অত্যন্ত সম্মানের ছিল। একজন sportsman-কে সকলেই sportsman বলেই শ্রদ্ধা করতেন। ক্রিকেটের মাঠে ক্রিজ-এ দাঁড়িয়ে যদি ব্যাটসম্যান বোলারের কোনও মারাত্মক বলে পরাজিত হতেন কিন্তু দৈবক্রমে আউট হওয়া থেকে বেঁচে যেতেন, তখন তিনি আঙুল তুলে বোলারকে সম্মান জানাতেন। ব্যাটসম্যানও যদি কোনও কঠিন বলকে মুন্সিয়ানার সঙ্গে খেলে বাউন্ডারি পার করতেন তখন বোলার তাঁকে অভিনন্দন জানাতেন। sport ব্যাপারটা আনন্দের ছিল, আদর্শের ছিল, চরিত্র-গঠনের ছিল, মারামারি আর টাকা রোজগারের কল ছিল না। বিজ্ঞাপনদাতাদের হইহই ছিল না সেই সব ক্ষেত্রে, ছিল sponsor-দের রবরবা। এখন কোনও sports-ই আর sport নেই। মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলেও বাঙালি খেলোয়াড় ক্রমশ কমে আসছে। এখন যেন-তেন-প্রকারে জিততে হবে, কি খেলার মাঠে, কি জীবনে, তা চুরি-জোচ্চুরি করেই হোক, কি যে ভাবেই হোক–ইংরেজিতে যাকে বলে by hook or by crook! এবং এখন জীবনের সব ক্ষেত্রেই nothing succeeds like success!

 এই অবধি বলেই, ঋজুদা চুপ করে গেল। মনে হল ঋজুদার মন খারাপ হয়ে গেল এই অপ্রিয় প্রসঙ্গ এনে ফেলে। মুখ নিচু করে পাইপের ছাই ঝেড়ে অ্যাশট্রেতে ফেলতে লাগল প্রয়োজনের চেয়ে বেশিক্ষণ ধরে।

তিতির বলল, ক্ষমা করে দাও এখনকার এই তথাকথিত টাকা-সর্বস্ব খেলার মাঠের ‘সৈন্যদলকে। আর শহর ছেড়ে আবার ফিরে চলো টুটিলাওয়াতে। আমরা যে হাঁকাওয়ালাদের হল্লা-গুল্লা শুনতে পাচ্ছি, বাঘটা যে এখুনি বেরিয়ে পড়বে তোমাদের সামনে। এখন পাইপ খেলে কি চলে?

মনে হচ্ছে তোমার চা চাই ঋজুদা। কটায় দিতে বলব গদাধরদাকে?

না না এখুনি কি? এক ঘণ্টা তো মোটে হল খেয়ে উঠেছি। গদাধরদাকে বলে আয় ঠিক চারটের সময় দেবে।

তারপরই বলল, একটু পরই যা না বাবা। বেচারা এত আপত্তি সত্ত্বেও বাবুর্চির রান্না বিরিয়ানি খেয়ে মুষড়ে আছে, হয়তো একটু ঘুমোচ্ছে, কেন বিরক্ত করবি এখন।

দাঁড়াও না, কেসটা কী একটু দেখি আসি।

 বলেই ভটকাই উঠে গেল। গেল, আসলে পরিবেশটাকে হালকা করতে।

 একটু পরই ফিরে এসে বলল, একেই বলে স্পোর্টসম্যানশিপ!

 কেন?

আরে দুজনে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে যা গল্পটা করছেনা। টেপ-রেকর্ডারটা দাও না ঋজুদা, টেপ করে রাখি।

ভাগ। গদাধরা হিন্দি-উর্দুর হ’ও জানে না ‘উ’ও জানে না।

আরে সেইটাই তো হচ্ছে মজা। একজন হাজারিবাগী হিন্দি চালাচ্ছে অন্যজন দোকনো বাংলা। আহা!

কীরকম?

গদাধরদা–একটো মদনটাকি পাকি চেল, বুজেচো আজমল ভাই, তা লৌকো ডাঙ্গাতে ভিড়িয়ে আমি তো দেগে দিনু বন্দুক তার উপরে।

আজমল মিঞা–হাঁ! বন্দুকোয়া চালা দিয়া আপনে গদা ভাইয়া? মগর উও জানোয়ার থাকেয়া? বাঘোয়াসে ভি খতরনাক? মদনটাকি কি বারেমে ম্যায় তো কভভি শুনা নেহি। বহতই জঙ্গলমে খানা পাকায়া আজতক। ইয়া আল্লা! মগর মদনটাকি পাকি কি নাম তো কভভি শুনা নেহি।

গদাধরদা–আরে মরণ! শুনবে কেমন কইরে। মদনটাকি কি আমাদের সোঁদরবন ছাড়া অন্য জায়াগাতি দেকা যায় না কি! আরে কি বলো কিগো ওই দাড়িওয়ালা বাঘোয়া-ফাগোয়া। বাঘের কতা বলতিচি নাকি? কোতায় বাঘ আর কোতায় মদনটাকি। গোবিন্দ। গোবিন্দ।

আমরা ভটকাই-এর অঙ্গভঙ্গী সহকারে গদাধরদা আর আজমল ভাই-এর কথোপকথনের বয়ান শুনে হেসে গড়াগড়ি খেলাম। আম্মু ভাই হয়তো পুরোটা বুঝতে পারল না কিন্তু হাসির বেলাতে পুরাই হাসল।

হাসি থামলে, বলল, ভটকাই ভাইয়া, পানকি রেকাবি জারাসে লাও ইধর।

 ঋজুদা পাইপে দু’টান লাগিয়ে দিল, হাসির হররা থামলে।

তিতির বলল, এবার আবার ব্যাক টু টুটিলাওয়া।

ঋজুদা আজ্জু মহাম্মদকে বলল, দেখা আজ্জু? কৈইসা সব চেলা বানায়া?

 হাঁ ঋজুবাবু। স্রিফ চিলাই তো নেহি। চেলি ভি হ্যায়।

বিলকুল।

বলল, ভটকাই ঋজুদার পক্ষে।

ঋজুদা বলল, হাঁকাওয়ালারা সব কাছিম-পেঠা পাহাড়টার শিরদাঁড়াতে পৌঁছনোর পর নিজামুদ্দিন, একরাম আর কাড়ুয়ার সঙ্গে আজাহার আর আসোয়াও দলে ভিড়ল। তারপর মেদিনী কাঁপিয়ে রণহুংকার দিতে দিতে তারা নেমে আসতে লাগল পাহাড় বেয়ে।

এতক্ষণ ময়ূর, বনমোরগ আর তিতিরের ডাকে বন সরগরম হয়েছিল। এবার সেই গিরিখাত থেকে একবার বাঘ ডাকল। সমস্ত বন-পাহাড় গমগম করে উঠল। হাঁকাওয়ালাদের চিৎকার চেঁচামেচি সব স্তব্ধ হয়ে গেল এক মুহূর্তে। পাখিরাও থেমে গেল। বাঘকে বনের রাজা এমনি এমনি বলে না। সে যে সত্যিই রাজা তা তার রাজত্বে গিয়ে তাকে দেখলে বা ডাক শুনলে তবেই বোঝা যায়। চিড়িয়াখানার বাঘের খাঁচার লোহার শিক-এর ফাঁক দিয়ে ছাতা গলিয়ে যে সব মাখন-মাখন জামাইবাবু শালির কাছে নিজেকে অসমসাহসী বলে প্রমাণ করতে চায়, তাদের এই রকম জঙ্গলে এনে ছেড়ে দিতে হয়।

ভটকাই বলল, এমনি ছাড়লে হবে থোরি। গোটা ছয়েক একস্ট্রা পায়জামা দিয়ে তবে না ছাড়তে হবে।

চুপ কর ভটকাই।

আমি বললাম। তারপর?

বাঘটা একবার বিরক্তির ডাক ডেকেই থেমে গেল। কিন্তু বাঘ ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই দুড়দাড় শব্দ করে একদল শম্বর ঝোপঝাড় ভেঙে ওই গিরিখাত থেকেই উঠে এল। এসে নদী পেরোল আমাদের সামনে দিয়ে পাঁচটা ডো এবং একটা স্ট্যাগ।

সে সব আবার কী জানোয়ার?

 ভটকাই ইন্টারাপট করল।

আরে পুরুষ হরিণকে বলে stag আর হরিণীকে বলে doe. তাও জানিস না? তুই জানিসটা কী?

আমি বললাম।

doe, a deer, ray, a drop of golden sun… শোনননি Sound of Music-এ?

 তিতির বলল।

 হ্যাঁ তো। মনে পড়েছে। আমি খালি ভুলে যাই সব।

ভটকাই বলল, অ্যাপলজেটিকালি।

সরি ঋজুদা, বলো।

 তিতির বলল।

স্ট্যাগটা আমার মাচার সামনে বেরোল। কিন্তু বাঘ মারতে এসেছি, তাই গুলি করলাম না।

কেন?

বাঃ গুলির শব্দ শুনে বাঘ সাবধান হয়ে যাবে না।

ও। তাই তো।

শম্বরগুলোর পরে এক জোড়া মস্ত ভাল্লুক ধীরে সুস্থে বেরিয়ে এল। ভাল্লুক, বাঘকে কেয়ার করে না। গায়ে বাঘের মতো জোর সব ভালুকের না থাকলেও গোঁয়ার্তুমিতে কম যায় না। সাহসেরও অভাব নেই তাদের। বাঘও ওদের ঘাঁটায় না, যদি না বাঘের মারা পশুর মড়ির কাছে এসে ওরা ঝামেলা করে।

যে ডাকটা বাঘ ডাকল সেটা রাগের চিৎকার নয়, ব্যথার চিৎকারও নয়, শুধু বিরক্তিতে আমরা যেমন আঃ করে উঠি সেই আওয়াজ। তাতেই গোপাল যেদিকে বসেছিল সেই দিকের একটা মস্ত তেঁতুলগাছ থেকে গোটা কয় ছোট বাঁদর ভয় পেয়ে ধ্বপাধ্বপ করে মাটিতে পড়ে গেল ডাল ছেড়ে হাত ফসকে। মাটিতে পড়েই পড়ি-কি-মরি করে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড় লাগাল। দুটো তো বাঘ যেদিকে, সেদিকেই দৌড়ে গেল অন্ধর মতো।

এদিকে হাঁকাওয়ালাদের মিলিত চিৎকার আর আওয়াজে কান ফাটার উপক্রম হল আমাদের। কিন্তু বাঘটা যেখানে আছে, সেখানে হাঁকাওয়ালারা নামতে পারবে না। আত্মহত্যা করার ইচ্ছে না থাকলে সেই ঘোরান্ধকার নিচ্ছিদ্র খাদে কোনও শিকারিও যাবে না। সেই খাদের অন্য কোনও মুখ যদি থেকে থাকে তবে বাঘ সেদিক দিয়ে বেরিয়ে চলেও যেতে পারে।

আসলে নিজামুদ্দিন, একরাম আর বুধাই অথবা বাঘটাও এই অঞ্চল যত ভাল জানে, কুসুমভা থেকে আসা কাতুয়া আর আসোয়া অত ভাল চেনে না। অথচ থাবার দাগ দেখে তার হদিশ করেছিল তারাই। মাচাগুলো যদি নিজামুদ্দিনের সঙ্গে পরামর্শ করে করা হত এবং বাঘ-এর ‘রাহান-সাহান’আরও ভাল করে নজর করে দু’-একদিন পরে বাঁধা হত, তবে হয়তো ভাল হত। কিন্তু ডাকু পিপ্পাল পাঁড়েই সব গোল পাকাল। সেও তো বাঘ। এই বাঘকে শিকার করার পরেই না সেই বাঘের পেছনে যাওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

এই সব ভাবছি, এমন সময়ে হঠাৎ বাঘ এসে নদীর অফফ-হোয়াইট বালি আর কালো পাথরের মাঝখানে তিরতির করে বয়ে যাওয়া জলের সামনে দাঁড়াল। বাঘের মতো বাঘ বটে। তাকে দেখে, আমার অবস্থাও গাছ থেকে পড়ে-যাওয়া বাঁদরের মতোই হল। অতবড় বাঘ যে এখনও পৃথিবীতে আছে সে সম্বন্ধে কোনও ধারণাই ছিল না আমার। ক্যামেরাটা বাঁদিকে আর বন্দুকটাকে ডানদিকে রেখেছিলাম। কিন্তু বাঘকে দেখে এমনই ‘থ’ বনে গেলাম যে, না পারলাম বন্দুক ওঠাতে, না ক্যামেরা। অথচ বাঘ আগে দেখিনি বা মারিনি, তা তো নয়!

বাঘটা দাঁড়িয়েছিল আমার আর নাজিম সাহেবের মাঝামাঝি জায়গায়। দু’জনের মাচা থেকেই তিরিশ গজ মতো দূরত্বে। গুলি করলে এবং গুলি জায়গা মতো লাগলে বাঘ হয়তো ওখানেই পড়ে যেত। বাঘ মারার মতো কঠিন কাজ যেমন নেই, তেমন সোজা কাজও নেই।

সারারাত শিশির পড়াতে গাছেদের পাতা তখনও ভিজে রয়েছে একটু একটু। সোনার মতো রোদ এসে পড়েছে সেই চকচকে পাতাদের গা থেকে পিছলে। হাজারিবাগ জেলার বাঘেদের গায়ের রং একটু পাটকিলে হয়। পাটকিলের ওপর কালো ডোরা। মুখের নীচে একটু দাড়ি মো। রোদের মধ্যে তার কানের সাদা গোল দাগ দুটো আর মাথা আর চোখের নীচের সাদা অংশ চমৎকার দেখাচ্ছে। বাঘটা জেনেছে যে, কিছু লোক ঝামেলা করতে এসেছে কিন্তু ও জানে না যে গাছের উপরে পরপর চারজন শিকারি বসে আছে এই সুন্দর সকালে তাকে মারবার জন্যে। এবং তাকে যুদ্ধ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়েই।

পায়ে দাঁড়িয়ে যদি আমরা তাকে মারতে চাইতাম তবেই না বোঝা যেত! পৃথিবীতে কোনও প্রাণী যে তারও বিপদ ঘটাতে পারে, এক বুনোকুকুরের দল ছাড়া, বা তারও ভয় পেতে হবে এমন কোনও প্রাণী যে আছে আদৌ, একথা বাঘ ভাবতে পর্যন্ত পারে না। তাই সে কোনও সংকোচ, ভয় বা দ্বিধা না করে নদীতে এসেই পেছনে যে শোরগোল তা বুঝতে পেরেই একটা বড় কালো পাথরের আড়াল নিয়ে ওদিকে ঘুরে তাকাল। গোলমালটা এবার কাছে চলে এসেছে।

হঠাৎ নাজিম সাহেব তার নতুন .৪০৪ রাইফেল দিয়ে গুলি করলেন, বাঘের গায়ে নয়, বাঘের থেকে দশহাত সামনে জলের উপরে। আর সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে। উঠলেন, কোঈভি গোলি মত চালাইয়েগা।

বুধাই ওঁর চেয়েও গলা চড়িয়ে আমাদের নাম ধরে ধরে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ঋজুবাবু, গোপালবাবু, সুরবোতোবাবু গোলি মত চালানা। কিন্তু বাঘ বুধাই-এর বাণী শোনার জন্যে দাঁড়াল না। তার যা দেখার ও বোঝর সে বুঝে নিয়েছে। এক লাফে সে আমার সামনে দিয়ে স্টপারদের লাইনের ডানদিকের গভীর জঙ্গলে চলে গেল। সেই জঙ্গল একটি পাহাড়ের পায়ের কাছে। বাঘ যে সেই পাহাড়েই আপাতত যাবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। তাকে মারতে চাইলে এখুনি উলটোদিক থেকে সেই পাহাড়ে হাঁকা করলে তাকে আবারও মারার সুযোগ পাওয়া যাবে।

ততক্ষণে ইজাহারুল হক নদীতে নেমে এসেছে। সে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, ঈ কা বাত নাজিম মিঞা? বাঘোয়া মারনাহি নেহি থা তো হামলোগোঁকো ইতনা জারমে সুব্বে সুব্বে অ্যায়সি পরিসান কাহেলা কিয়া আপনে? আজিব আদমি হ্যায় আপ।

ইজাহারের চেয়েও বেশি বিরক্ত হয়েছিল নিজামুদ্দিন, একরাম, কাড়ুয়া আর আসোয়া। হাঁকাওয়ালারা খুশিই ছিল কারণ অতবড় বাঘকে আহত করলে বাঘ যদি হাঁকাওয়ালাদের লাইন ভেঙে পেছনে চলে যেতে চাইত তবে তাদের মধ্যে একাধিক জন আহত তো হতই মরেও যেতে পারত। বাঘ তো কোনও ট্রাফিক পুলিশের হাত মানে না। সে কখন যে কোন দিকে যাবে, তা শুধু সে নিজেই জানে।

মাচা থেকে আগে নাজিম সাহেব নামলেন। তারপরে একে একে আমরা। সকলে একসঙ্গে হলে নাজিম সাহেব একটা গোল পাথরে বসে পকেট থেকে সিগারেট পাকানোর কাগজ বের করে পাকাতে লাগলেন। ক্যাপস্টান টোব্যাকো কাগজে পাকিয়ে খেতেন উনি। সিগারেটটা পাকানো হলে, লাইটার জ্বেলে কুটুং করে আগুন ধরালেন।

বত ক্যা হ্যায়?

বাঁ হাতের তিনখানা আঙুল নেড়ে গভীর বিরক্তির সঙ্গে বলল, গোপাল।

নাজিম সাহেব বললেন, জী তো খুশ হো গ্যয়া? বাঘ দিখকর? ক্যা? হুয়া ক্যা নেহি?

হাঁ উতো হুয়া, মগর…

মগর-ফগর নেহি। শিকারি হো কর দুসরা শিকারিকো ইজ্জত দেনা চাহিয়ে। ঈয়ে শের মারনেকা লিয়ে নেহি থা। সালাম করনেকো লিয়ে থা। হামলোগোঁনে সালাম বাজায়া। ইনশাল্লাহা! উসকি উম্মর হাজার সাল বনে। ইয়ে শের হিন্দুস্তাঁকা ঘামণ্ড হ্যায়। আপলোগোঁকি বালবাচ্চা-পোতা-পোতিকো দেখনে কি লিয়ে ইসকো বাঁচাকে রাখনাহি চাহিয়ে বন্দুক রাইফেল কি ঘোড়া দাবানেমেহি শিকারি নেহি বন পাতা ইনসান। যযা ইনসান জানতি হ্যায়, ঘোড়া কব দাবেগা, ঔর কব নেহি, শিকারি ওবহি হ্যায়।

বলেই চুপ করে গেলেন নাজিম সাহেব।

এটুকু বলেই ঋজুদা অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। সেদিনের সেই টুটিলাওয়ার জঙ্গলের শীতের সকাল যেন তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল।

বুঝলাম না।

বলল, ভটকাই।

আমরাও যে খুব ভাল বুঝলাম এমন নয়।

ঋজুদা বলল, তোদের একটু আগে স্পোর্টসম্যানশিপ-এর কথা বলছিলাম, এই হল সেই স্পোর্টসম্যানশিপ। যদি সম্মান করার মতো প্রতিপক্ষ হয় তবে তাকে সম্মান জানানোই প্রকৃত স্পোর্টসম্যানের লক্ষণ।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, দ্যাখ, আজকে বাঘ বাঁচাবার জন্যে কত কিছু হরক হচ্ছে, অভয়ারণ্য, বাঘ-প্রকল্প, ওয়ার্ল্ড-ওয়াইল্ডলাইফ-ফান্ড ইত্যাদি কত কি হয়েছে। তখন তো বাঘের সংখ্যা ছিল অগণ্য। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। কিন্তু তখন শিকারিদের মধ্যে যদি নাজিম সাহেবের মতো অনেক শিকারি থাকতেন তবে বাঘেদের সংখ্যা এমন ভাবে কমে যেত না। না। সরকার মাথা ঘামিয়েছে তখন এ নিয়ে, না শিক্ষিত শিকারিরা। আর দ্যাখ, আজ্জু মহাম্মদের বাবা নাজিম সাহেব তো ইংরেজি-মিডিয়াম স্কুলে লেখাপড়া করেননি, কলেজেও যাননি। অথচ কত বড় শিক্ষিত মানুষ ছিলেন তিনি!

তা নাজিম সাহেব গুলিটা করেছিলেন কেন?

 বাঃ। বাঘকে ভয় পাওয়াতে। মাচা চেনাতে। শিকারিরা যে গাছে বসে থাকে অমন লুকিয়ে, তা জানাতে। যাতে ভবিষ্যতে অমন ভুল সে আর না করে।

বাঘটার অত বয়স আর এটুকুও শেখেনি!

তিতির বলল।

তা কী আর করা যাবে। বাঘটা হয়তো তোর মতো ভাল স্কুলে পড়েনি। সবাই কি আর সবই জানে। তুই এই বয়সেই যা জানিস অনেকে বুড়ো বয়সে পৌঁছেও তা জানে না। কিন্তু বাঘটা বুড়ো একেবারেই ছিল না। অভিজ্ঞও ছিল না। কৈশোর আর যৌবনের চৌকাঠে পৌঁছেই তার ওই চেহারা। তাহলে বোঝ, সে কেমন বাবার ছেলে ছিল।

ভটকাই বলল, বাঘকা বেটা, সিপাহিকো ঘোড়া, কুছ নেহি তো থোড়া ঘোড়া, বাপ’কে ‘বাঘ’ বানিয়ে দিয়ে।

বাঘটা যে বয়স্ক নয় তা তোমরা বুঝতে পেরেছিলে?

তিতির জিজ্ঞেস করল ঋজুদাকে।

আমরা থোড়াই বুঝেছিলাম। বুঝেছিলেন, নাজিম সাহেব। অনেক ছেলেমানুষকেই বুড়ো মনে হতে পারে দেখে, আবার অনেক বুড়োকে ছেলেমানুষ।

অনেক এঁচড়ে পাকাও থাকে। ছেলেমানুষ হয়েও যারা বুড়ো।

 কীরকম?

 যেমন ভটকাই।

আমি বললাম।

 তিতির বলল, টুটিলাওয়ার বাঘের গল্প তো শেষ হল এবার ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের গল্পটা বলল। সেটাই তো আসল।

সবই আসল। আজমল-এর বটিকাবাব দেওয়া বিরিয়ানি আর গুলহার কাবাব আর চাঁব আর রেজালা যা খেয়েছি না! একেবারে আইঢাই করছে শরীর। তোমরা সব এখানে বসে গল্প করো, চা খাও, সঙ্গে টা, আমি গিয়ে একটু শুয়ে নিই। আজ্জু মিঞাও শোবে না কি?

না। আমি বরং একটু নাখুদা মসজিদ ঘুরে আসি। আজকে একবারও নামাজ পড়া হল না অথচ আজ জুম্মাবার। মগরিব-এর নামাজটা অন্তত পড়ে আসি। আব্বা বেঁচে থাকলে রাগ করত খুব।

নিশ্চয়ই যাবে। দিনের মধ্যে ঈশ্বর বা আল্লাকে বেশিবার মনে করতে পারলে তো ভালই, একবার অন্তত তো করাই উচিত মনে মনে। যাও ঘুরে এসো। মাধবকে নিয়ে যাও। তোমার পানও নিয়ে যাও।

তারপরই বলল, ও ভাল কথা, রাতে কী খাবে?

আজ্জুভাই উঠে নাগরা জুতোতে পা গলাতে গলাতে বলল, কুচ্ছো নেহি। স্রিফ চারবটি পাঁচনল, হামদর্দ দাবাখানা কি।

সে কি! তা বললে হয়! রাবড়ি একটু খেতেই হবে। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। এই সৈন্যদলের জন্যে মুরগির ফিশ-ফাশ করবে গদাধরদা। তোমার আজমলকেও তো ভাল করে খাওয়াবে গদাধরদা। সে কি এতই অভদ্র?

আমরা কিন্তু কালই যাব ঋজুবাবু ভেস্টিবিউলে। কোডারমাতে নেমে, বাসে যাব হাজারিবাগ। আজকাল তাতেই সুবিধা। তো,অব চলে হাম।

যাও।

 কিন্তু আজমলকে দেখিয়ে আনবে না কলকাতার নাখুদা মসজিদ?

সাহি বাত। ঠিকই তো। আবার কবে আসবে কলকাতায়!

 ভটকাই বলল, আমি ডেকে আনছি।

ওরা চলে গেলে ঋজুদা সত্যি সত্যিই শুতে চলে গেল। আজকাল ঋজুদা যেন কেমন বুড়ো হয়ে যাচ্ছে।

ঋজুদা শুতে গেলে ভটকাই বলল, কান খুলে মন দিয়ে শোনো ‘ওড়াপুত্তানেরা। তোমরা আমার কথার মধ্যে একটাও কথা বোলো না আমি তোমাদের ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের সঙ্গে আমার এনকাউন্টারের গল্পটা বলছি।

.

০৩.

গত শনিবারে আজ্জু মহম্মদের বিরিয়ানি পার্টির আগে যেখানে থেমেছিল ঋজুদা, সেখান থেকে এই শনিবারে শুরু হল। ঋজুদা বলল, টুটিলাওয়ার জমিদার ইজাহারুল হক-এর বাড়ি থেকে যখন আমরা বেরোলাম চারজনে তখন চারটে বাজে। নাজিম সাহেবের দোয়াতে দুপুরের খাওয়াটা খুবই বেশি হয়ে গেছিল। তিত্বরের কাবাব, হরিণের চাঁব, সীমারিয়ার পাঁঠার কলিজা ভাজা, মুরগির কারি আর বাসমতি চাল-এর ভাত। মুসলমানেরা কখনওই টক খায় না। কেন খায় না, তা আরও বড় হবার পরে জেনেছিলাম।

সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। শীতের বিকেলের বন থেকে এক আশ্চর্য মিশ্র গন্ধ ওঠে। মিশ্র বলছি এই জন্যে যে, তাতে মিষ্টি, তিক্ত, কটু, কষায় সব রকমের গন্ধ মিশে থাকে। পথের ধুলোর মিষ্টি গন্ধ তাতে যোগ হয়। আমাদের দেশের মাটির গন্ধ, ভারতবর্ষের গন্ধ, এমন গন্ধ কোনও দেশের মাটিরই নেই।

সূর্যটা ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কার অদৃশ্য হাত যেন দুটি কানের পেছনে বরফের পুলটিস লাগিয়ে দেয়। মনে হয়, সেই হাত দুটি ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ে যেমন করে সেদিন সকালে সেই অচেনা লোক দুটোর কান এবং নাকও কেটে নিয়েছিল, তেমনি করেই আমাদের নাক ও কানও বুঝি কেটে নেবে।

সীমারিয়ার দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে চাতরা যাবার পুরনো অব্যবহৃত পথটার সামনে এসে আমরা দু’দলে ভাগ হয়ে গেলাম। এই পথেই গতবারে দূর থেকে ডাকু পিপ্পাল পাঁড়েকে দেখেছিলাম আমি।

সুব্রতকে নিয়েই বিপদ বেশি। কারণ তার বাবাই তখন পুরো হাজারিবাগ জেলার পুলিশ সাহেব, অর্থাৎ এস.পি.। আর তখনকার হাজারিবাগ জেলা ছিল মস্ত বড়। এখন তো কোডারমাটোডারমা আরও কত জেলা হয়েছে। তখন ছোটনাগপুরের মধ্যে ছিল মাত্র চারটি জেলা রাঁচি, হাজারিবাগ, সিংভূম আর পালাম। যে-অঞ্চলে ডাকাতি করে মানুষ খুন করে বেড়াচ্ছে ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ে গত ছ’মাস হল, যে-অঞ্চলে অন্তত বার চারেক সশস্ত্র পুলিশের বিরাট বাহিনীর সঙ্গে পিপ্পাল পাঁড়ে ও তার দলবলের সংঘর্ষ হয়েছে এবং তাতে চারজন পুলিশ নিহত হয়েছে এবং পনেরোজন আহত, পাঁচজন ডাকাতও নিহত হয়েছে, আহত কত হয়েছে জানা যায়নি, কারণ তারা আহত সঙ্গীদের ফেলে যায়নি, নিয়ে গেছিল সঙ্গে করে।

চাতরার এক ডাক্তার, পুলিশের গুলিতে আহত ডাকাতদের চিকিৎসা করবেন না বলাতে তাঁকে গুলি করে মেরে দেয় পিপ্পাল পাঁড়ে। সেই এম.বি.বি.এস. ডাক্তার, নামধারী দুবে, নাকি গরিবদের উপরে খুবই অত্যাচার করত। তাই তাকে মেরে দেওয়ায় পিপ্পাল পাঁড়ের শাপে বর হয়েছে। চাতরার সব গরিব পিপ্পাল পাঁড়ের দলে চলে গেছে। সরকার থেকে ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের মাথার জন্যে দশ হাজার টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। পঞ্চাশের দশকের দশ হাজার টাকা আজকের দশ লাখ টাকার সমান।

এই প্রকৃত গরিব-দরদি গুণটি আছে বলেই পিপ্পাল পাঁড়েকে পুলিশ সহজে কবজা করতে পারছে না। সে ডাকাত বটে কিন্তু সে নিজের জন্যে ডাকাতি করে না। ডাকাতি করে অত্যাচারীদের বাড়িতে, খুন করে অন্যায়কারীদের। এবং লুটের মাল সব গরিবদের মধ্যেই বিলিয়ে দেয়, অস্ত্রশস্ত্র কিনতে ও নিজেদের খাওয়া-দাওয়ার জন্যে যে টাকা লাগে, তা রেখে। তাই স্থানীয় কোনও মানুষের কাছ থেকে পিপ্পাল পাঁড়ে বা তার দলবলকে ধরবার জন্যে পুলিশ কোনও সাহায্য পায় না। তা ছাড়া পুলিশ চিরদিনই আমাদের দেশে গরিবদের উপরেই অত্যাচার করেছে আর বড়লোকদের সেলাম ঠুকেছে। তাই গরিবের সমর্থন তারা পায় না।

এই অবধি একটানা বলেই, ঋজুদা নিভে-যাওয়া পাইপটা ধরিয়ে বলল, তোরা কি কেউ বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তর দপ্তর’ পড়েছিস? না পড়ে থাকলে অবশ্যই পড়বি। আর পড়বি ‘আনন্দমঠ’। যে উপন্যাস থেকে আমরা বন্দেমাতরম’ মন্ত্র আর গান পেয়েছি।

তা কমলাকান্তর দপ্তরে কী আছে?

বঙ্কিমচন্দ্র, যিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, তিনি সেখানে এক চরিত্রের মুখ দিয়ে বলাচ্ছেন, আইন! সে তো তামাশামাত্র! বড়লোকেরাই পয়সা খরচ করিয়া সে তামাশা দেখিতে পারে।

বঙ্কিমচন্দ্রের সময় থেকে কত বছর হয়ে গেছে কিন্তু আইন আজও তাই আছে বলতে গেলে। যার পয়সা নেই, সে বিচার পায় না। আইন নিজের হাতে নেওয়াটা বে-আইনি। একথা সকলেই জানে। কিন্তু যেখানে আইন গরিবদের দেখে না, ভিন্ন মত ও দলের মানুষদের কাছে আইনের দরজা যখন বন্ধ, তখনই সমাজে পিপ্পাল পাঁড়েদের আবির্ভাব হয়, প্রাচীন ইংল্যান্ডের রবিনহুড-এর মতো, অথবা আজকের ভারতের নকশালদের মতো। যা কিছুই ঘটে, তার পেছনে কারণ থাকেই। ক্রিয়া হলেই প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য। তাই আইনের চোখে ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ে জঘন্যতম অপরাধী হলেও তার সম্বন্ধে সবকিছু জানাশোনার পর তার প্রতি আমার এক দুনিবার আকর্ষণ জন্মে গেছিল। তাকে গুলি করে মারার চেয়েও তাকে জানার এক অদম্য ইচ্ছা জেগেছিল মনে।

তা তো হল কিন্তু তোমার বন্ধু সুব্রত চ্যাটার্জির কথা কী যেন বলতে গিয়ে অন্য পথে চলে গেলে কেন?

ঋজুদা হাসল।

বলল, বয়স হচ্ছে যে, তা বেশ বুঝতে পারছি। কথার খেই হারিয়ে যায়। তা ছাড়া এই সব কথা তো আজকেরও নয়। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকের কথা। সব কথা ঠিকমতো মনেও নেই।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, সুব্রত যেহেতু হাজারিবাগের পুলিশ সাহেবের ছেলে, তাকে যদি পিপ্পাল পাঁড়ে একবার ধরে ফেলতে পারে তাহলে সারা পুলিশ ফোর্সকে চরম বেইজ্জতি করা হবে। তারপর সুব্রতকে খুন করার হুমকি দিয়ে তার যেসব সঙ্গী পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে তাদের ছেড়ে দেবার দাবিও জানাতে পারে। ভরসার কথা এই যে, সুব্রত, নাজিম সাহেবের খোকাবাবু, যে হাজারিবাগের এস. পি. মিস্টার সত্যচরণ চ্যাটার্জির বড় ছেলে তা ইজাহারের খিদমদগারেরা আর কাড়য়ারা ক’ভাই ছাড়া কেউই জানে না। কিন্তু পিপ্পাল পাঁড়ের চর তো সবজায়গাতে ছড়ানো আছে। কথাটা তার কানে যাওয়াটা আশ্চর্যের নয়। হাঁকোয়া শিকারে আশেপাশের নানা গ্রামের যে সব মানুষেরা হাঁকোয়া করছে তাদের কারও কানে কথাটা গেলেও বিপদ ঘটতে পারে।

এই অবধি বলেই, থেমে গিয়ে ঋজুদা রিমোট কন্ট্রোল কলিং বেল-এর সুইচটা টিপল।

কী হল আবার?

দুঃসাহসী ভটকাই জিজ্ঞেস করল ঋজুদাকে।

 গদাধরদা এসে দাঁড়াতেই ঋজুদা বলল, আরেক কাপ করে চা খাওয়াবে না গদাধরদা আমাদের?

নিঃচ্চয়।

বলল গদাধরদা। বলেই, চলে যাচ্ছিল। ঋজুদা বলল, শোনো, সঙ্গে একটু চিজ-ও দিও। হট-ব্রেড থেকে এনেছিলাম যে সকালে। ওদের জন্যই তো এনেছিলাম।

গদাধরদা বলল, আর চিকেন পেটিস?

 ঋজুদা। তুমি চেপে যাচ্ছিলে।

দুঃসাহসী অসভ্য ভটকাই আবার বলল।

ঋজুদা হেসে বলল, আমার কী? আজেবাজে জিনিস খেয়ে পেট ভরা। তোদের জন্য আজ গদাধরদা কী রাঁধছে জানিস ডিনারে?

কী?

তোরাই জিজ্ঞেস কর।

আমি বললাম, কী গো গদাধরদা! খোলসা করে বলবে তো। আগে তো আমরা আসতেই নিজেই গড়গড় করে মেনু বলে দিতে।

সে তোমরা দু’জনে যখন আসতে, মানে তুমি আর তিতির। এই ভটকাই দাদা তো একাই সব কথা বলে, অন্যে কী বলবে।

ভটকাই বলল, ছিঃ। ছিঃ। উ্য টু বুটাস!

 গদাধরদা বলল, চিকেনের মোমো, ভেটকি স্যালাড, হোয়াইট সস দিয়ে, আর পর্ক-এর গুলাশ।

এখানকার শুয়োর নয়। অস্ট্রেলিয়া থেকে আমার বন্ধু স্টিভ পাঠিয়েছে জাহাজে করে। গুলাশটাও হাঙ্গেরিয়ান স্টাইলে রান্না। হাঙ্গেরিয়ান কনসাল অমিয়দার কুক-এর কাছে গিয়ে শিখে এসেছে তোদের খাওয়াবে বলে। গুলাশ’ অবশ্য বিফ-এরই ভাল হয়। তা হিন্দুর ছেলেমেয়েদের জাতটা গদাধরদা নিজে হাতে মারতে রাজি নয়।

কে অমিয়দা? ঋজুদা?

আরে অমিয় গুপ্ত। কলকাতার শেরিফ ছিলেন না? বেঙ্গল ইনিসিয়েটিভ-এর চেয়ারম্যান।

ও।

মহা বিজ্ঞর মতো বলল, ভটকাই।

কোন স্টিভ ঋজুদা? স্টিভ ওয়া?

 তিতির বলল।

আজ্ঞে না। ওয়া নয়। স্টিভ হলেই কি ওয়া হতে হবে?

 গদাধরা চলে গেলেই আমি আর তিতির বললাম, ঋজুদা শুরু করো আর ভটকাই দয়া করে চুপ করো।

হ্যাঁ। সেই কারণেই নাজিম সাহেব সুব্রতকে নিয়ে তিতিরবটের মারার জন্যে উলটোদিকের টাঁড় আর ঝাঁটিজঙ্গলের দিকে চলে গেলেন। আমি আর গোপাল গিয়ে ঢুকলাম ওল্ড চাতরা রোড-এ, যেপথে সেবারে কাক-ভভারে পিপ্পাল পাঁড়ের দেখা পেয়েছিলাম আমরা।

ছাড়াছাড়ি হওয়ার সময়ে গোপাল বলল, আমাদের ফিরতে রাত হবে। খাসির উমদা বিরিয়ানি, মধ্যে বটি কাবাব দেওয়া আর তিতিরের রোস্ট যেন রেডি থাকে নাজিম সাহেব। আমরা ডাকাত শিকারে যাচ্ছি। বহতই পরিশ্রম করে ফিরব।

আর না ফিরলে?

আমি বললাম, শোকসভার বন্দোবস্ত করবেন। ইয়াগারির।

বলেই, আমি আর গোপাল ওই রাস্তাতে ঢুকে পড়লাম। গোপাল বন্দুকের ক্ল্যাম্পে টর্চটা ফিট করে নিল। আমার টর্চটা জার্কিনের বাঁ পকেটে ছিল। ডান পকেটে ছ’টা গুলি। সবই এল. জি। দু’ ব্যারেলে দুটো পোরা আছে। আমরা কিছুই শিকার করব না। বাঘই দেখি আর হরিণ কি পাখি, গুলির শব্দ করব না। আমরা পিপ্পাল পাঁড়ের খোঁজেই যাচ্ছি। মনে মনে আমি আর গোপাল ঠিক করেছিলাম।

তারপর? বলল ঋজুদা। আমার শুনতেই হাত ঘেমে যাচ্ছে। ওই বয়স থেকেই তুমি আর তোমার বন্ধুরা কীরকম ডেয়ার-ডেভিল ছিলে। ভাবলেও ভয় করে।

তিতির বলল।

ঋজুদা বলল, কেন? তোরাই বা কি কম ডেয়ার-ডেভিল? স্কুলে পড়তে পড়তেই তো রুদ্র, তুই আর ভটকাইও আমার সঙ্গে দেশ-বিদেশ কম জায়গাতে জীবন বিপন্ন করিসনি? যারা পারে, তারা পারে প্রথম থেকেই।

বলল, তারপরে।

আমি বললাম।

সেই রাস্তাটা ব্যবহার হয় না। গাড়ি বা বাস কিছুই চলে না। কখনও-সখনও চোরাশিকারিরা জিপ নিয়ে এসে ঢেকে রাতে। তাও ডাকাতের ভয়ে আজকাল তারাও আসে না। প্রাণ যাবার ভয় তো আছেই, বন্দুক-রাইফেলও বেহাত হয়ে যাবে। বন্দুক-রাইফেল বেহাত হওয়ার হ্যাঁপা প্রাণ যাওয়ার হ্যাপার চেয়েও অনেকই বেশি।

মাঝে মাঝেই ঘাস গজিয়ে গেছে। জঙ্গল দখল নিয়েছে। পথের দুপাশ থেকে জঙ্গল এগিয়ে আসছে পথকে গ্রাস করে। উপরেও গাছগাছালির ডালপালার চাঁদোয়া। তারই ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে বিদায়ী সূর্যের আলোতে লাল হয়ে-যাওয়া আকাশের টুকরো-টাকরা দেখা যাচ্ছে। একটা কোটরা হরিণ খুব ভয় পেয়ে ডাকতে ডাকতে ডানদিকের জঙ্গলের গভীরে দৌড়ে গেল। ময়ূর ডেকে উঠল কেঁয়া-কেঁয়া করে, বুকের মধ্যে চমক তুলে। দুর থেকে বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটে হুতুম প্যাঁচা দুরগুম দুরগুম দুরগুম করে ডেকে উঠল। আস্তে আস্তে পাখ-পাখালির স্বর, কলকাকলি, স্তিমিত হয়ে আসছে। অন্ধকার নেমে আসছে, আর সঙ্গে সঙ্গে শীতের প্রকোপই বাড়ছে।

টর্চ না-জ্বালিয়ে যেতে পারলেই ভাল ছিল। টর্চ জ্বাললেই দূর থেকে তা দেখা যাবে। কোথায় পিপ্পাল পাঁড়ের পাহারাদার বা স্নাইপার ঘাপটি মেরে আছে তা কেজানে!

আধমাইলটাক যেতেই বনের মধ্যে থেকে মনে হল যেন সামনে জঙ্গল কিছুটা জায়গাতে ফাঁকা হয়ে এসেছে। হয়তো কখনও বনবিভাগ কপিস-ফেলিং করেছিল। অন্ধকার সুড়ঙ্গর বাইরের দিকে এগোলে যেমন আলোর আভাস চোখে পড়ে প্রথমে, তারপর ক্রমশ আলো বাড়তে থাকে, সেই সুড়ঙ্গেরই মতো অন্ধকার পথের মধ্যে দিয়ে যথাসাধ্য নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে যেতে তেমনই মনে হল আমাদের।

অপেক্ষাকৃত ফাঁকা এলাকাতে পৌঁছবার আগে আমরা গাছের নীচের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সামনে এবং ডাইনে-বাঁয়ে ভাল করে নজর করে দেখলাম। তেমন কিছুই চোখে পড়ল না। তবুও আমরা পথের দুপাশে দু’জনে অন্ধকারেই দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখ যখন দেখে না, তখন কান শুনলেও শুনতে পারে।

মিনিট তিন-চার অমন দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ যেন শুনতে পেলাম যে দূরে একজন মানুষ খুব জোরে জোরে কাশছে। অনেকক্ষণ ধরে কাশল মানুষটি। এদিকে কোনও গ্রাম আছে বলে শুনিনি। দেখাও যাচ্ছে না কোনও গ্রামের চিহ্ন। এই গভীর জঙ্গলে পরিত্যক্ত পথের পাশে একলা মানুষ কী করতে আসতে পারে সবরকম জানোয়ারে-ভরা এই গভীর জঙ্গলে? আর ডাকাত তো আছেই!

গোপাল আর আমি ফিসফিস করে পরামর্শ করে আরও মিনিট দশেক ওখানে অপেক্ষা করব ঠিক করে পথের পাশের একটি শিলাস্তৃপের পাথরের উপরে বসলাম। পাথর নয়তো বরফের চাঙর। পেছন জমে গেল। ইতিমধ্যেই শিশির পড়তে শুরু করেছে।

আরও দশ মিনিট অপেক্ষা করলে কেন?

তিতির জিজ্ঞেস করল।

করলাম, কারণ তখনও পশ্চিমাকাশে যদিও লাল মুছে গেছিল, অস্পষ্ট সাদাটে ভাবটা ছিল, পিপ্পাল পাঁড়ের কোনও স্কাউট কোনও গাছের উপরে মাচাতে যদি বসে থাকেও, পুরো অন্ধকার হয়ে গেলে সে বা তারা আমাদের অত সহজে দেখতে পাবে না। আমরাও তো শিকারি। সবরকম সাবধানতা নিয়েই আমরা এগোব। যে ঝুঁকি এড়ানো যায়, তা এড়ানো গেলে, এড়ানোই ভাল। জেঠুমনি সবসময়েই বলতেন।

গাঢ় অন্ধকার নেমে এলে আমরা দুজনে ছাড়াছাড়ি হয়ে খুব সাবধানে এক পা এক পা করে, যেদিক থেকে কাশি শুনেছিলাম সেই দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। খুবই আস্তে আস্তে। শিশির পড়তে শুরু করেছে তাই শুকনো পাতার উপরে পা পড়ায় তখন আর মচমচানি উঠছে না।

তারপরে?

 তিতির বলল।

ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ মিটার এগিয়ে যাওয়ার পরে এক বিপদের সূত্রপাত হল। একটি ল্যাপউইঙ্গ, এদিকে ইয়ালো-ওয়াটেলড ল্যাপউইঙ্গই বেশি, অন্ধকারে তো আর ডানার রং চেনার উপায় ছিল না, হট্টিটি-হুঁট, হট্টিটি-হুঁট করে আমাদের মাথার ওপরে ডাকতে ডাকতে উড়তে লাগল। জঙ্গলের মধ্যে বা ফাঁকা জায়গাতে মানুষ বা শ্বাপদ চলাচল করলেই ওরা এমন করে ডেকে বনের প্রাণীদের সাবধান করে যে দেয় তা তো তোরা জানিসই। বনের প্রাণীদের সাবধান করে করুক কিন্তু পিপ্পাল পাঁড়েও যে সাবধান হয়ে যাবে, সেই ছিল বিপদ।

তারপর? তোমরা কী করলে?

 আমরা থেমে গেলাম। কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে গেলাম যেখানে যে ছিলাম।

মনে হল, যেদিক থেকে কাশির শব্দ শুনেছিলাম সেদিক থেকে একাধিক মানুষের অস্পষ্ট কথাবার্তাও ভেসে আসছে। আরও একটু এগোতেই বোঝা গেল ওই দিকে একটি দোলা মতো জায়গা আছে। সেখানে জলও নিশ্চয়ই আছে। সেখানে আগুন জ্বালিয়েছে কারা যেন।

আমরা খুব সাবধানে সেদিকে এগোতে লাগলাম লেপার্ড-ক্রলিং করে। ওই শীতেও পরিশ্রমে আর উত্তেজনায় আমাদের জামা ও মাথার চুল ভিজে গেল।

আরেকটু এগোতেই দেখি পাঁচ-ছ’টি মোষ এক জায়গাতে শুয়ে-বসে জাবর কাটছে আর একজন মানুষ তাদের সামনে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করছে। পাছে বাঘ এসে হামলা করে। এই আগুন মোষেদের নিরাপত্তার জন্যে।

আর যাই হোক, এরা সম্ভবত ডাকাত নয়, মনে হল আমাদের।

লোকটি জড়ো করা শুকনো ডালে আগুন জ্বালতেই সেই আগুনে সে আমাদের দুই মূর্তিমানকে দেখতে পেল। পেয়েই, ভয়ের চোটে চেঁচিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় জনাদশেক মানুষ আমাদের দিকে এগিয়ে এল। তাদের দুজনের হাতে জ্বলন্ত কাঠ ছিল, অন্য সকলের হাতেই টাঙ্গি। মশালের মতো জ্বলন্ত কাঠ হাতে করে তারা এগিয়ে এল। টাঙ্গির ইস্পাতের ফলাগুলো মশালের আগুনে ঝকঝক করে উঠল।

আমাদের হাতে বন্দুক দেখে তারা অবশ্য একটু ঘাবড়ে গেল। ভাবল হয়তো, বাঘের রাজ্যে এই ঘোগরা আবার কারা?

তারপর?

গোপালই তাড়াতাড়ি বলল, বুদ্ধি করে, তিতির মারতে ঢুকেছিলাম টুটিলাওয়াসীমারিয়ার সড়ক ছেড়ে এই বনে। পথ ভুলে গেছি। টুটিলাওয়াতে যাব কোন পথে?

ওরা বলল, আইয়ে আইয়ে খোকাবাবুলোগ, জারা বৈঠকে যাইয়েগা। ঠাণ্ডা বহতই হ্যায়।

তারপর বলল, আমরা তো এখানে থাকি না। আমরা থাকি চান্দোয়া-টোড়িতে। কাল থেকেই গাছ কাটব। আমরা সব কাঠুরে। কাঠ কেটে টুকরো করে মোষের গাড়িতে লাদাই করে চান্দোয়া-টোড়িতে নিয়ে যাব। সেখানে ঠিকাদারের কাঠ-চেরাই কল আছে। আবার ফিরে আসব। আজই আমরা এসে পৌঁছেছি। কালকে পাতার ঘর বানিয়ে নেব। আজ রাতটা আগুনের পাশে বসেই কাটাতে হবে।

তারপর বলল, আপনারা কি খাবেন কিছু?

কী খাব?

 আমরা গরিব লোক বাবু। রাতে আমরা শুখা-মহুয়া সেঁকে খাব একটু নুন দিয়ে।

 একজন বলল, আমার কাছে একটু ছাতু আছে। চানার ছাতু।

তোমরা দিনে ক’টাকা মজুরি পাও?

একট টাকা হুজৌর। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অবধি কাজ। যাদের মোষের গাড়ি আছে তারা গাড়ি ভাড়া পাবে চব্বিশ ঘণ্টাতে দু’ টাকা। তাদের গাড়ি চালানো ও কাঠ লাদাই করার মজুরিও তারই মধ্যে।

তোমাদের এই ঠিকাদারের নাম কী?

তাঁর নাম মালদেও পাণ্ডে। তিনি মস্ত বড়লোক হুজৌর। চান্দোয়া-রাঁচি-ডালটনগঞ্জ লাইনে তাঁর বাস চলে। ঘোড়া আছে। রংদার দোতলা মোকান।

এখানে যে ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের রাজত্ব তা কি তোমরা জানো?

তা জেনেই তো আসা! যদি পাঁড়েজির সঙ্গে মোলাকাত হয়ে যায় তো আমাদের কপাল ফিরে যাবে।

কেন?

পাঁড়েজির বড় দয়া গরিবদের উপরে। নিজেও তো গরিবেরই ছেলে। অত্যাচারিত। দেখা হলেই উনি আমাদের অনেক টাকা-পয়সা দেন। আমাদের অভাব-অভিযোগের কথা মন দিয়ে শোনেন।

তোমাদের ঠিকাদার মালদেও পাণ্ডে পিপ্পাল পাঁড়ের কথা জানে কি?

জানে বইকী। জানে বলেই তো নিজে না এসে আমাদের লাগিয়েছে। জানে বলেই তো জান-এর ভয়।

তোমরাও তো ডাকু বনে যেতে পারো। ভাল খাবে, ভাল পরবে।

আমি বললাম।

ওদের মধ্যে বয়স্ক যে নেতা গোছের মানুষটি, সে হাসল। বলল, হাঃ! আমাদের কি সেই হিম্মৎ আছে বাবু! ডাকু কি ইচ্ছে করলেই কেউ হতে পারে! ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের বয়স মাত্র পঁচিশ-ছাব্বিশ। এইরকম মালদেও পাণ্ডেরই মতো এক জঙ্গলের ঠিকাদার তার বাপকে খুন করেছিল, দিদিকে আর মাকে পুড়িয়ে মেরেছিল। তারপরই না, পালিয়ে বাঁচা পিপ্পাল পাঁড়ে ডাকু হয়ে যায়। তার মাথার উপরে দশ হাজার টাকা ইনাম। তবু সরকার তাকে ধরতে পারছে না। তবে একদিন তো ধরা সে পড়বেই। জ্যান্ত আর মৃত। কতদিন লড়বে সরকারের বিরুদ্ধে?

ধরাই যদি পড়বে তবে ডাকু হল কেন?

হল, আমাদের মতো জন্মদুখি মানুষদের চোখে একটু স্বপ্ন জাগাতে, যুগ যুগ ধরে এই সব অত্যাচারী জমিদার আর পয়সাওয়ালাদের এই গোলামি করা যে ঠিক নয়, সেই কথা বোঝাতে।

আরেকজন বলল, আমরা তো মানুষ নই হুজৌর। আমরা জানোয়ার। নইলে এত কষ্ট সয় আমাদের! পিপ্পাল পাঁড়ে কী করে মাথা উঁচু করে মানুষের মতো বাঁচা উচিত তাই শিখিয়ে দিল আমাদের। আমরা যদি নাও পারি এই দাসত্বর বাঁধন ছিঁড়তে, আমাদের ছেলেমেয়েরা হয়তো ভবিষ্যতে পারবে। এই বা কম কী!

তোমরা পিপ্পাল পাঁড়েকে দেখেছ?

দেখব না কেন? সে তো আমাদেরই ছেলে। বাচ্চা ছেলে। কিন্তু আমাদের প্রণম্য। আমরা প্রার্থনা করি ভগবানের কাছে যে আমাদের ঘরে ঘরে একজন করে পিপ্পাল জন্মাক।

তারপর ওদের মধ্যে একজন বলল, আপনারাও তো ছেলেমানুষ, খোকাবাবু, আপনারাও দেখছি বহুত হিম্মৎদার। এই বয়সি ছেলেদের এমন জঙ্গলে রাতের বেলা ঘুরে বেড়াতে দেখিনি কখনও, যদিও আমরা জঙ্গলেরই মানুষ। অবশ্য আমাদের কাছে তো বন্দুক থাকে না।

গোপাল বলল, অত্যাচারের নানা রকম হয় চাচা। শহরেও আমাদের উপরে অত্যাচার করার লোকের অভাব নেই। গরিব বড়লোক শব্দগুলোর মানেও এক এক জায়গাতে একেক রকম। অত্যাচার, অন্যায়, সব জায়গাতেই আছে, থাকে, তবে তাদের চেহারা আলাদা আলাদা এই যা।

আমি বললাম, তা ছাড়া হিম্মৎ ব্যাপারটা তো পিপ্পাল পাঁড়ের কাছ থেকে শেখবারই। আমাদের আপনারা একবার তার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে পারেন?

ওরা একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল।

তারপর সেই সর্দার-মতো মানুষটি বলল, তার রাহান-সাহান সে যে নিজেই জানে না। খোঁজ লাগাতে হবে। আপনারা কোথায় আছেন?

আমরা উঠেছি ইজহারুল হক-এর বাড়ি টুটিলাওয়াতে।

ওরা এবার চনমনে হয়ে উঠল।

একজন বলল, তাঁরাও তো বহতই অত্যাচারী।

আরেকজন বলল, ইজাহার সাহেব মানুষ ভাল। তাঁর পূর্বপুরুষেরা খারাপ ছিলেন। তারপর বলল, ওখানেই নাকি হাজারিবাগের পুলিশ সাহেবের ছেলে এসে উঠেছিল। আপনারা, মানে আপনাদের মধ্যে কি…।

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, না না, আমরা কলকাতা থেকে এসেছি। আমার এই বন্ধুর বাবার বাড়ি আছে হাজারিবাগ শহরে, গয়া রোডে। পুলিশ সাহেবের ছেলে এসেছিল ঠিকই, তবে সে তত আজই বিকেলে চলে গেছে ফিরে।

এই সরল মানুষগুলোর কাছে মিথ্যেকথা বলতে ভারী ঘোট লাগছিল নিজেকে। কিন্তু কী করা যাবে। সুব্রতকে তো বাঁচাতে হবে।

যদি চলে গিয়ে থাকেন তো বেঁচে গেছেন হুজৌর। আমরা শুনেছি যে পিপ্পাল পাঁড়ে পুলিশ সাহেবকে ‘শিখলাবার জন্যে তাঁর ছেলেকে গুম করে দেবে বলে, ঠিক করেছিল। তা করলে, আমাদের সকলেরই বিপদ হত হুজৌর। পিপ্পালের তো কিছু হবে না।

কেন? তোমাদের কীসের বিপদ?

তার কাছে ঘেঁষা তো পুলিশের কর্ম নয়। পুলিশ পড়বে হাতিয়ারহীন, গরিব, অসহায় আমাদেরই উপরে। কত রকম অত্যাচার যে হবে! পিপ্পাল আর কতজনকে বাঁচাবে? তাই আমরা সেই কথাই আলোচনা করছিলাম। পুলিশ সাহেবের বেটা যত তাড়াতাড়ি পুলিশ সাহেবের বাংলোতে ফিরে যায়, ততই তার মঙ্গল, আমাদেরও মঙ্গল।

গোপাল বলল, সে চলে গেছে।

তারপর বলল, কালকে আমরা আবার আসব. দিনের বেলাতেই। পিপ্পাল পাঁড়ের সঙ্গে দেখা কি হবে?

আপনারা মানে?

 মানে, আমরা দুজন।

কাল এলে কী করে হবে? খোঁজ তো লাগাতে হবে। সে তো কখনওই দু’রাত কোনও এক জায়গাতে থাকে না।

কাল ছেড়ে পরশু আসুন বরং দিনের বেলাতে। তবে খালি হাতে আসবেন।

বন্দুক-টন্দুক নিয়ে আসবেন না। আর একথা কারওকে বলবেন না। কারওকেই। তাহলে কিন্তু পিপ্পাল আমাদেরই খতম করে দেবে।

আমি বললাম, আমরা অত নীচ নই। তাই আসব আমরা পরশু, দিনের বেলাতে।

গোপাল ন্যাকামি করে বলল, এখন পথ চিনে ফিরে যাই কী ভাবে?

সেই সর্দার একজনকে বলল, এই গাঙ্গেয়া, একটা জ্বলন্ত কাঠ হাতে নিয়ে খোকাবাবুদের পথটা দেখিয়ে দিয়ে আয়।

বারবার খোকাবাবু বলাতে আমাদের রাগ হয়ে যাচ্ছিল।

লোকটার গায়ে একটা ছেঁড়া ফতুয়া, পরনে মোটা খেটো ধুতি। পায়ে টায়ার-সোলের চটি। একবেলা খেতে পায়। এই আমার দেশের গড়পড়তা মানুষ। আর আমাদের ফুটানির শেষ নেই। তাও আমাদের আরও চাই, আরও চাই।

ভাবছিলাম, আমি।

তারপরে?

ভটকাই আর তিতির সমস্বরে বলল।

 আর কী? পথ তো আমরা জানতামই। গাঙ্গেয়া আমাদের সঙ্গে কিছুটা আসার পরই আমরা বললাম, বুঝতে পেরেছি। আমাদের সঙ্গে টর্চ আছে, ঠিক চলে যাব। তোমার কাঠ নিভে গেলে এই বাঘের জঙ্গলে তোমারই ফিরতে অসুবিধে হবে তুমি ফিরে যাও।

ও বলল, পররনাম হুজৌর।

আমি আমার মানিব্যাগ খুলে, জন্মদিনে জেঠুমনির দেওয়া যে একশো টাকার নোটটি সযতনে ইনস্যুরেন্স-এর মতো রেখে দিয়েছিলাম গত ন’মাস ধরে, সেটা গাঙ্গেয়ার হাতে দিয়ে…

দিতেই সে ভীষণ প্রতিবাদ করে উঠল।

আমি বললাম, আগামীকাল তোমরা সকলে ডাল আর ভাত খেয়ো।

গাঙ্গেয়ার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল খুশিতে।

বলল, সকালে ফরেস্ট-গার্ড আসবে মার্কামারা গাছ দেখিয়ে দিতে। তারপরই কাজ শুরু হবে। সকালে নয়, আমরা রাতে খাব। মাটির হাঁড়িতে ডাল-ভাত ফুটিয়ে নেব। শুধু ডাল-ভাতই নয় মহুয়াও খাব, নাচব, গাইব। আপনারা কি আসবেন?

গোপাল বলল, দেখি।

 গাঙ্গেয়া ফিরে গেলে আমরা টর্চ জ্বেলেই চাতরার পুরনো পথ দিয়ে ফিরে যেতে লাগলাম। অনেকক্ষণ কোনও কথা সরল না আমাদের মুখে।

আমি বললাম, ওরা কি রোজ ভাত খায় না?

রোজ? কী বলল তুমি! বিয়ে-চুড়োতে খায়।

 আর ডাল?

ডালও তো বিলাসিতা। বাজরা বা মকাই-এর রুটি খায়। সরগুজার তেল দিয়ে কখনও কিছু তরকারি রাঁধে। বনের মূল ও ফল খায়। শুকনো মহুয়া। পশুর জীবনের সঙ্গে ওদের জীবনের বিশেষ তফাত নেই ঋজু।

আমি চুপ করে পথ চলতে লাগলাম।

ফিরে গিয়ে কী কী উমদা খাবার খাব আমরা, তাই ভাবছিলাম।

ভাবছিলাম, একশো টাকা দিয়ে একদিন ডাল-ভাত খাওয়ালেই এদের সমস্যার কোনও সুরাহা হবে না। যেদিন আমার দেশের সব মানুষ দু’বেলাই ডাল-ভাত খেতে পারবে, সেদিন যত তাড়াতাড়ি আসে, ততই ভাল। এদের জন্যে অশিক্ষিত ডাকু পিপ্পাল পাঁড়েও যেমন ভাবছে, আমাদের সকলেরও ভাবতে হবে। আমরা দেশের কতজন? এরাই তো আসল দেশ, আসল ভারতবর্ষ। যতদিন এদের অবস্থা না ফিরছে ততদিন দেশ একটুও এগোতে পারবে না।

গোপাল বলল, সুব্রতকে আজ রাতারাতিই হাজারিবাগে ফেরত পাঠাতে হবে।

আর আমরা?

 আমরা থেকে যাব। দেবদর্শন করে দেবতাকে প্রণাম করে তারপরই ফিরব।

অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।

কথাটা আমার মনে পড়ে গেল। জেঠুমনি প্রায়ই বলতেন এই লাইন দুটি, গায়ত্রী মন্ত্রেরই মতো।

ভটকাই বলল, তাতো হল কিন্তু তুমি তো বাঘটার কথা আর কিছুই বললে না, তাকে টপকে চলে গেলে ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের কাছে। অতবড় বাঘটা মারতে না পেরে আপসোস হচ্ছিল না।

হচ্ছিল। আবার হচ্ছিলও না। বাঘটা কেন মারলাম না তাতো তোদের বলেইছি। সব শিকারিদের দলেই একজন করে মহম্মদ নাজিম থাকলে দেশ থেকে। আজ কি বাঘ লোপ পেতে বসত!

.

০৪.

ঋজুদা পাইপটা অ্যাশট্রে থেকে তুলে নিয়ে নতুন করে টোব্যাকে ভরল। তিতির বলল, বলল ঋজুকাকা, তারপর কী হল? তবু বাঘটার কথা আরেকটু বলো।

হবে আর কী? আমাদের মন সত্যিই খুবই খারাপ হয়ে গেছিল। অতবড় বাঘ কি আর মারার সুযোগ পাব?

তখন অবশ্য আমাদের কারওরই জানা ছিল না যে, তার কয়েক বছর পরেই সুব্রত আর ইজাহার দু’জনে মিলে সীতাগড়া পাহাড়ে যে মানুষখেকো বাঘটা অত্যাচার শুরু করেছিল, পিজরাপোলের এবং সীতাগড়া পাহাড়ের নীচের গ্রামগুলির গোরু-মোষ এবং মানুষ মেরে, সেই বাঘটাকেই মারবে। সে বাঘ, এই বাঘের চেয়েও অনেকই বড়। দশ ফিট ছ ইঞ্চি ছিল।

বিটউইন দ্য কার্ভস?

তালেবর ভটকাই জিজ্ঞেস করল।

না। বিটউইন দ্য পেগস।

ঋজুদা বলল।

 ঋজুদার গল্প শেষ হতে হতে আজ্জু মহম্মদ ফিরে এসেছিল নাখুদা মসজিদ থেকে মগরিব-এর নামাজ সেরে। আমাদের পাশে চেয়ার পেতে বসে গল্প শুনছিল। ঋজুদার এ সব গল্প, আমাদের চেয়ে তার তো আরও বেশি ভাললাগার কথা। কারণ, তার বাবা মহম্মদ নাজিম ওই সব নাটকের প্রধান ভূমিকাতে ছিলেন এবং ওই সব বনাঞ্চল তার জন্মভূমি হাজারিবাগেরই কাছে। অথচ তার বাবার মুখে এই সব গল্প শোনার সৌভাগ্য থেকে সে বঞ্চিত ছিল।

ঋজুদা, এই সব পুরনো দিনের গল্প বলতে বলতে প্রায়ই থেমে যায় আজকাল। মাঝে মাঝে বলে, দুসস্ এসব কথা মনে করতেও আর ভাল লাগে না। সবাই যে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে, কে ভেবেছিল!

ঋজুদার বন্ধু গোপাল সেন হঠাৎই সেরিব্রাল স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাক-এ চলে গেছেন কিছুদিন আগে। তার অল্পদিন পরেই সুব্রত চ্যাটার্জি বা নাজিম সাহেবের সুরবোতো বাবুও, ব্লাড ক্যানসারে। আর নাজিম সাহেব নিজে তো গেছেন আরও আগেই।

ঋজুদা তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, এই সব গল্পগুলো তুই কিন্তু লিখিস রুদ্র। আমারও কবে কী হয়ে যাবে। এই সব গল্প বলার তো আর কেউই থাকবে। যারা তোদের ঋজুদার গল্প শুনতে তোরই কল্যাণে ভালবাসে, তারা, তোর লেখার মাধ্যমে অন্তত পড়তে পারবে। পড়ে, আনন্দিত হবে।

তিতির বলল, আজেবাজে কথা বলো না তো ঋজুকাকা! তোমার বন্ধুরা আগে আগে চলে গেছে বলে তোমাকেও যেতে হবে তার কী মানে আছে?

না, কোনও মানে নেই। তবে মানুষের জীবন তো! ঈশ্বর মানুষকে অনেকই জ্ঞানগম্মি দিয়েছেন কিন্তু কোন মুহূর্তে যে কাকে যেতে হবে, সেই খবরটুকুই জানতে দেননি। এই মুহূর্তেই হয়তো যমদূত আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনছে আর মিটিমিটি হাসছে।

তারপরই তিতিরের দিকে ফিরে বলল, আচ্ছা তিতির, তুই কি টলস্টয়ের সেই বইটা পড়েছিস?

আমাদের মধ্যে তিতিরই পড়াশুনোতে ভাল বলে ঋজুদা সবসময়ে ওকেই জিজ্ঞেস করে এসব। তাতে আমাদের খারাপ যে একটু লাগে না, তা নয়। তবে

কথাটা তো সত্যিই যে তিতির আমাদের চেয়ে অনেকই বেশি জানে-শোনে।

তিতির বলল, কোন বইটার কথা বলছ ঋজুকাকা?

 টলস্টয়ের ‘হোয়াট মেন লিভ বাই’। একটি চটি বই। একটা বড় গল্পই বলতে গেলে।

তিতির মাথা নাড়ল।

ভটকাই বলল, আমি পড়েছি। যদিও আমাকে তুমি জিজ্ঞেস করোনি, করেছ তিতিরকেই, তবুও নির্লজ্জের মতোই বললাম।

পড়েছিস! তুই! বলিস কী রে ভটকু? কে তোকে পড়তে দিল? আমাকে আর কে কী পড়তে দেয়! তোমারই মতো তো সকলেরই ধারণা যে আমি একটা হাঁদা ছেলে!

তবে ওই বই পেলি কোথায়?

আমাদের পাশের বাড়ির গোপেন মেসোমশাই মারা গেলেন গতমাসে, মিনিবাস চাপা পড়ে। তখন বেঁটে কাকা এই বইটি গোপেন মেশোর স্ত্রী, মানে মণিকাকিমাকে এনে দেন পড়বার জন্যে। কিন্তু মণিকাকিমা কৃষ্ণভামিনী স্কুলে ক্লাস ফাইভ অবধি পড়েছে মোটে। ইংরেজি বই পড়ে মানে বুঝলে তো? তবে বাংলা-নভেল-এর পোকা একেবারে। সুনীল গাঙ্গুলি, নিমাই ভট্টাচার্য, শংকরের বই গোগ্রাসে গেলে। তাই আমাকেই একদিন মণিকাকি বলল, বাবা ভটকু, তোর বেঁটে কাকা বইটা এনে দিল একটু পড়ে গল্পটা আমাকে বলে দিবি না? ইংরেজি যে!

তা, তোর বেঁটে কাকাকেই তো বলতে পারতেন উনি।

আমি জিজ্ঞেস করলাম।

দুসস। কী যে বলিস!

ভটকাই বলল, এমন ভাবে। যেন আমি জলের সঙ্গে তেল মিশাতে বলেছি।

 কেন? দুসস্ কেন?

আরে বেঁটে কাকার সঙ্গে পাড়ার মেয়ে মণিকাকিমার ‘লভ’ ছিল ছেলেবেলাতে। পাড়ার সকলেই জানে। বেঁটে কাকার দুপুরবেলা একা মণিকাকিমাকে এ গপ্পো পড়ে শোনানোতে বিস্তর অসুবিধে ছিল। তাই তো অগতির গতি আমি!

ঋজুদা বলল, কার সঙ্গে কার ‘লভ’ ছিল তা আমাদের না জানলেও চলবে। কিন্তু আমি জানতাম যে, তোদের পাড়াতে তুইই সবচেয়ে কম শিক্ষিত। এখন দেখছি তোর চেয়েও….

ইয়েস। আমার চেয়েও কম শিক্ষিত অনেকেই আছে।

তা যাই হোক ভটকাই। ওই গল্পটা পড়েছিস যখন তুই, তিতির আর রুদ্রকে একসময়ে গল্পটা শুনিয়ে দিস।

তারপরে বলল, যে-মানুষেরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না তাদের সকলেরই পড়া উচিত ওই গল্প। ঈশ্বরের ধারণার সঙ্গে যে বিজ্ঞানের বা যুক্তির কোনওরকম ঝগড়া নেই, তোরা আরও বড় হলে, আরও অনেক পড়াশুনো করলে, জানতে পারবি। যাদের পড়াশুনো কম, তারাই পুঁটি মাছের মতো অল্প জলে ফরফর করে। যারা সত্যিই জ্ঞানী, তাদের চলা জলের গভীরে, গহনে, জলের উপরে চেয়ে বোঝা পর্যন্ত যায় না তা।

আমি বললাম, আবার ফিরে চলো ঋজুদা টুটিলাওয়াতে। আমরা ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের গল্প শুনতে চাই।

হ্যাঁ। সেদিনই রাতে, খাওয়া-দাওয়ার পরে সুরবোতো বাবুকে হাজারিবাগে পাঠিয়ে দিলেন নাজিম সাহেব ইজাহারের সঙ্গে। খোলা জিপে।

খোলা জিপে কেন?

তা না হলে পিপ্পাল জানবে কী করে যে সুব্রত সেই জিপে নেই। জিপে সুব্রতর রাইফেল নিয়ে ইজাহার আর নাজিম সাহেবের রাইফেল নিয়ে ইমতিয়াজ বডিগার্ড হিসেবে সঙ্গে গেল। ইজাহার জিপ চালাবে, পাশে গুলি ভরা রাইফেল শুইয়ে রেখে। সুব্রতকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে এস. পি. সাহেবের বাংলোতে, ওরা আবারও রাতেই ফিরে আসবে এবং এখানেই খাওয়া-দাওয়া করবে।

সুব্রতকে বর-রওয়ানা করিয়ে দেওয়ার মতো করে উলু দিয়ে রওয়ানা করিয়ে দেওয়া হল। তারপর আমি আর গোপাল বললাম নাজিম সাহেবকে এবার আমরা দু’জনে একটু ঘুরে আসি।

কোত্থেকে?

 দু চোখ ডিপার করে বললেন, নাজিম সাহেব।

দেখি, পিপ্পাল পাঁড়ের সঙ্গে দেখা হয় না কি? কে যেন বলছিল যে ঠিকাদারের লোকেরা ওল্ড চাতরা রোডের পাশে আজই বিকেলে এসে ডেরা করেছে। গাছ কাটার জন্যেই ওরা এসেছে। ঠিকাদারের হয়ে। সবাই তো স্থানীয় লোকই। ওদের সঙ্গে একটু মিলে-মিশে দেখে আসি পিপ্পাল পাঁড়ের রাহান-সাহান জানা যায় না কি?

নাজিম সাহেব বললেন, একদিনে অনেকই ধকল গেছে। তা ছাড়া, রাতে আপনাদের আমি পিপ্পাল পাঁড়ের সঙ্গে টকরাতে যাবার জন্যে কখনওই ছাড়ব না। এ সখের শিকার নয় খোকাবাবুরা। এতে, জানকি খাতরা।

গোপাল রাগের গলাতে বলল, খোকাবাবুকো খোকাবাবু বলিয়ে গা। হামলোগোঁনে খোকাবাবু না হ্যায়।

তা বাঘ শিকারে কি জানকি খাতরা নেই?

আমি বললাম।

নাজিম সাহেব আমাকে ভেঁটে দিয়ে বললেন, আরে বাঘ তো ফাস-ক্লাস জেন্টিলম্যানই না হ্যায়! কিন্তু পিপ্পাল কী করতে পারে আর কী পারে না, তা কেউই বলতে পারে না। না, না। এক খোকাবাবুকে তো চালান করে দিলাম। কিছু একটা হয়ে গেলে আপনাদের মা-বাবাকে আমি কী বলব গিয়ে? খরগোস আর তিতির মারার নাম করে এসে ডাকাতের সঙ্গে টকরানো! ওই সব বদতমিজি করতে হয় তো নিজেরা একা একা এসে নিজেদের দায়িত্বে করবেন। নাজিম মিঞা উপস্থিত থাকতে ওই রকম দুঃসাহস বরদাস্ত করবে না। সাহস ভাল ছওড়াপুত্তান। দুঃসাহস কখনওই ভাল নয়। জবরদস্ত পুলিশসাহেব চ্যাটার্জিসাহেবের এতবড় ফোর্সই চোখের-জলে নাকের-জলে হয়ে গেল আর আপনারা তো বাচ্চা ছেলে। চালিয়ে, কাল হামলোগোঁনে ভি লটকে যায়েগা।

গোপাল মুখ গোঁজ করে বসে রইল। আমাদের না হল বাঘ মারা, না ডাকাতের সঙ্গে মোলাকাত।

তারপর?

তারপর আর কী? সেই যাত্রা হাজারিবাগ হয়ে কলকাতা ফিরে আসতে হল।

আমরা সবাই হতাশ হলাম ঋজুদার গল্প শুনে।

 এ আবার গল্প হল নাকি!

 ভটকাই বলেই ফেলল আমাদের সকলের মনের কথাটা।

হল না?

না। অ্যাকশান হল না, গুলি চলল না, কারওর খুপড়ি উড়ল না, গুলিতে হাত-পা খোওয়া গেল না একজনেরও, তো কীসের গল্প হল? ধ্যাত। সময়টাই নষ্ট হল আমাদের।

ঋজুদা হাসছিল।

বলল, সে যাত্রা দেবদর্শন হল না বলে কি পরেও আর কখনও হল না।

আমাদের এমন টেনশনে না-রেখে বলেই ফেলো না পুরোটা ঋজুকাকা!

তিতির বলল।

আরে ঘটনা যেমন যেমন ঘটেছিল আমি তো তেমন তেমনই বলব…না কী? আশ্চর্য তো!

আমি বললাম, আরে ধৈর্য ধরো না, হবে।

এমন সময়ে গদাধরদা চাকা-লাগানো ট্রলির ওপরে, চা-এর পেয়ালা পিরিচ আর চকোলেট-ক্রিম বিস্কিট নিয়ে এল। চা-এর পটে চা, দুধের পটে দুধ, চিনির পটে চিনিও নিয়ে।

আসা মাত্র তিতির কাজে নেমে পড়ল।

চা খাওয়া হলে ঋজুদা বলল, তখন আমার আর গোপালের ক্লাস টেন। টেস্ট পরীক্ষা দিয়েই অল্প ক’দিনের কড়ারে গেছিলাম। কলকাতা ফিরতেই স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষার আগে কোথাওই যাওয়া চলবে না বলে ফতোয়া জারি হল। অ্যাডিশনাল ম্যাথস পরীক্ষা যেদিন শেষ হল সেদিনই গোপালদের বাড়ির উলটোদিকে একটা মাদ্রাজি কফির দোকানে বসে দোসা আর কফি খেতে খেতে আমরা ঠিক করলাম, চাতরাতে যাব সোজা। সেখানে গোপালের বাবার বিড়িপাতার এক মস্ত ব্যবসাদার মক্কেল আছে। তার কাছে গিয়ে ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করব। আমি বললাম, নাজিম সাহেব প্রায়ই একটা কথা বলেন না, ‘গুরু গুড় চেলা চিনি। আমরা এবারে প্রমাণ করব যে প্রবাদটা সত্যিই।

আরও আগে বাড়ো ঋজুদা। সোজা চাতরাতে।

হ্যাঁ।

রেজাল্ট বেরোবার অনেকই দেরি। দু’জনে তো বন্দুক কাঁধে করে রাঁচি এক্সপ্রেস-এ চড়ে পড়লাম। তখনও হাটিয়াতে হেভি এঞ্জিনিয়ারিং-এর কারখানা হয়নি। রাঁচিতে নেমে রাতু রোড বাসস্ট্যান্ডে এসে চাতরার বাস ধরলাম। বিজুপাড়া হয়ে, কুরু হয়ে, চাঁদোয়া-টোড়ি হয়ে বাঘড়া বা জাবড়া মোড় হয়ে আমরা যখন চাতরাতে লগনপ্রসাদ অ্যান্ড কোং-এর গদিতে গিয়ে পৌঁছলাম তখন প্রায় সন্ধে হয় হয়। তখন তো আজকালকার মতো দ্রুতগামী বাস ছিল না। পথঘাটও ভাল ছিল না।

মাঝবয়সি লগনবাবু আমাদের খুব খাতির করে তাঁর অতিথিশালাতে ওঠালেন। ট্রেনে রাত জেগে এসেছি এবং সারাদিন বাসে এসেছি বলে গায়ে ব্যথা হতে পারে ভেবে দু’জনের জন্য দু’জন খিদমদগার ঠিক করে দিলেন। পুরি-সবজি তৈরি হতে লাগল। খাঁটি ঘিয়ের গন্ধে ভুরভুর করছিল চারদিক।

আমরা যে ডাকাতের সঙ্গে এনকাউন্টার করতে এসেছি তা তো আর ওঁকে বলিনি। বললে, গোপালের বাবা জেনে যেতেন। বলেছিলাম, শিকার করতেই যাচ্ছি।

লগনবাবু বললেন, আমি তো জৈন হচ্ছি, জীবনে মোশা ভি মারিনি মোশয়, শিকারের কিছু জানি না। আমি সফর আলির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব আর সঙ্গে দিয়ে দেব লটকাকে। ওদের নিয়ে যান আপনারা দু’জনে। আর একজন নোকর দিয়ে দেব রান্না-বান্না খিদমদগারি করার জন্যে। মিলিটারি ডিসপোজালের জিপটা নিয়ে যান। আপনারা দু’জনেই তো গাড়ি চালাতে জানেন।

ব্যস! ব্যস্! আর কিছুরই দরকার নেই।

আমরা একসঙ্গে বললাম।

 রাতে খাওয়াটা জোর হল। নানারকমের আচার, আলুর চোকা, বেগুন ভাজা, কুলের চাটনি, তারপর রসগোল্লা আর রাবড়ি। তখন দুধ খাঁটি ছিল। আর চাতরার মিষ্টির খুব নামও ছিল। ঠিক হল, নাস্তা করেই আমরা বেরিয়ে পড়ব। বাঘড়া মোড় হয়ে সীমারিয়াতে গিয়ে সেখানে লগনবাবুর ব্রাঞ্চ অফিসেই থাকব।

বিড়ি হয় কেন্দু পাতা দিয়ে। জঙ্গলের কাজ শুরু হবে কিছুদিনের মধ্যে। তখন জঙ্গলের মধ্যে মধ্যেও নানা জায়গাতে ওঁদের ক্যাম্প পড়বে কেন্দু পাতা সংগ্রহর জন্যে।

.

০৫.

এখানে দেখতে দেখতে হয়ে গেল তিনদিন। মানে, সীমারিয়াতে।

সফর আলি মানুষটার বয়স হবে চল্লিশ। বেঁটে-খাটো, শক্ত সমর্থ। কট্টর মুসলমান, দিনে পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ে। ফজিরের নামাজ থেকে শুরু করে ডিমান্ডউইচমন আর, ঈশার নামাজ অবধি। চোখের দৃষ্টি খুব প্রখর। যদিও চোখ দুটো কুতকুতে। তার চোখের দিকে চেয়ে কথা বলা যায় না। মাথায় সাদা ফুলকাটা টুপি। একটু তোতলা। কাঁধে একনলা মুঙ্গেরি বন্দুক। সম্ভবত বেপাশি।

আর লটকা মানুষটির বয়েসও ওই রকমই। বেজায় মোটা। কালো ভুচুং। পরনে, ঢোলা, লালচে-হয়ে-যাওয়া পায়জামা আর হাতা-গোটানো সাদা খদ্দরের পাঞ্জাবি। পায়ে চটি। তা থেকে গোড়ালির দিকের আধখানা পা বাইরে বেরিয়ে থাকে। হাতে একটি রোগা লাঠি। মুখে সবসময়ে পান-জরদা। কপালে সিঁদুরের টিপ। সকালে চান করে উঠেই সে কালীপুজো করে। কানে একটি জবাফুল গোঁজে। আর মেটে সিঁদুরের টিপ পরে। আর কথায় কথায় বলে, লেহ্ লটকা।

একজন গোঁড়া মুসলমান আর একজন গোঁড়া হিন্দুর মধ্যে আমরা দুজনে একেবারে স্যান্ডউইচড হয়ে আছি।

ডিম মুরগি খাব, আবার শিকার করা মাংসও খাব। তাই আমাদের প্রথম দিনই দুপুরের নিরামিষ খাবারের পরে ডাকবাংলোতে পাঠিয়ে দিয়েছে চন্দনমল পুগালিয়া। লগনবাবুর সীমারিয়ার ডিপোর কর্মচারি। সফর আলি, লটকা এবং আমাদের খিদমদগার রামখিলাওন সকলেই আমরা সীমারিয়ার ডাকবাংলোতেই আছি। জিপটা আমাদের সঙ্গেই আছে। চন্দনমল, পেট্রল পাম্পে আমাদের নিয়ে গিয়ে মালিকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে। বলেছে, যখনই তেল লাগবে বা অন্য যা কিছু লাগবে তা যেন দিয়ে দেন উনি লগনচাঁদ অ্যান্ড কোম্পানির। অ্যাকাউন্টে খরচ লিখে। এও বলেছে যে, কোম্পানির অডিটর এরা। কলকাতা থেকে শিকারে এসেছেন। দেখবেন, যেন কোনও অসুবিধা না হয়।

আমি ঋজুদাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, মুলিমালোঁয়া থেকে সীমারিয়া কত দূর? আমরা যখন ‘অ্যালবিনো’র রহস্য ভেদ করার জন্যে গেছিলাম মুলিমালোঁয়াতে তখন কি সীমারিয়াতেও গেছিলাম?

হ্যাঁ! সীমারিয়ার উপর দিয়েই গেছিলাম। এখন তো সব ভিড়ে-ভিড়াক্কার হয়ে গেছে। পিপ্পাল পাঁড়ের সঙ্গে যখন আমাদের টক্কর হয়েছিল সে তো চল্লিশ বছর আগের কথা। তখন সীমারিয়া বা টুটিলাওয়া খুবই শান্তির জায়গা ছিল। পৃথিবীর সব জায়গাতেই শান্তি ছিল। মানুষ বেড়ে গিয়ে, জনসংখ্যা গিনিপিগ-এর মতো বেড়ে গিয়েই সব কিছু শেষ হয়ে গেল। মানুষের বাসের যোগ্য আর রইল না। জঙ্গলও সব শেষ হয়ে গেল।

তা ঠিক। তিতির বলল।

অথচ জনসংখ্যা কমাবার জন্যে কারও কোনও মাথাব্যথাই নেই।

অশিক্ষিত, অভুক্ত মানুষ যত বাড়ে, ততই তো রাজনৈতিক দলেদের সুবিধা। ততই তো তাদের একটা ধুতি দিয়ে, চারটে রুটি দিয়ে, এক বোতল দিশি মদ দিয়ে, দশটা-বিশটা টাকা দিয়ে পাঁচবছর অন্তর ভোট কিনতে সুবিধা। দেশের মানুষ সবাই শিক্ষিত এবং সচ্ছল হয়ে গেলে তো ধোঁকা দিয়ে ভোট পাওয়াটা অসুবিধের হয়ে যাবে। দেশে প্রকৃত উন্নতি হয়ে যাবে যে! আর তা হলে ঋজুদার বন্ধু সুব্রতদার ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, এই ধড়িবাজ মানুষগুলোর কী হবে? রাজনীতিই যাদের একমাত্র পেশা।

ভটকাই বলল।

 ও বাবা। তুই দেশের জন্যও এত ভাবিস ভেটকু?

ঋজুদা বলল।

 ভাবা তো সকলেরই উচিত ঋজুদা, তাইনা? তা ছাড়া দেশকে ভালবাসতে তো। তোমার কাছ থেকেই শিখেছি। দেশ তো আমাদের প্রত্যেকেরই সম্পত্তি। আর আমাদের বলে মনে করলে ভাল তো বাসতে হয়ই!

তিতির বলল, ঠিক বলেছ ভটকাই!

তারপর, বলল ঋজুদা।

আমি বললাম।

হ্যাঁ। ভোরবেলা বেরিয়ে একটু আধটু শিকার করি আমাদের সকলের খাওয়ার জন্যে, তিতির, বটের, ময়ূর, শুয়োর, কোটরা হরিণ, বন-মুরগি। হাঁটা হয় বেশ কয়েক মাইল। সঙ্গে সফর আলিও যায়। লটকা বাংলোতে থেকে ম্যানেজারি করে। স্যালাড বানায়। সীমারিয়ার কালুর দোকান থেকে বালুসাহি আনিয়ে রাখে, এবং রাবড়ি, বানোয়ারির দোকান থেকে মিষ্টি পান। রোজই ‘বিনিপয়সার ভোজ। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ঘুম লাগাই লম্বা তারপর সন্ধে লাগার আগে আগেই বানোয়ারির পানের দোকানের সামনের বেঞ্চে গিয়ে বসি দু’জনে। উলটো দিকের লালুর দোকান থেকে চা আনিয়ে খাই আর বানোয়ারির দোকানের পান।

কলেজে ওঠার আগেই তোমরা পান খেতে?

তিতির বলল।

আরে, পান খাওয়ার জন্যে কি আর যেতাম। প্রত্যেক ছোট জায়গায় পানের দোকানই হচ্ছে ‘গসিপ-সেন্টার। কত লোক আসছে যাচ্ছে। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ বাসে, কেউ বা সাইকেলে, ক্কচিৎকদাচিৎ কেউ গাড়িতে বা জিপে। পরচর্চার এমন জায়গা আর হয় না। অনেক কাপ চা আর পান না খেলে কোন অছিলাতে আমরা সেখানে বসে থাকি! তা ছাড়া, আমরা যে পরদেশি কোকিল তা তো স্থানীয় সকলেই জানে। নানা কথা, নানা আলোচনা কানে আসে। তার মধ্যে পিপ্পাল পাঁড়ের নতুন কীর্তিও ডালপালা বিস্তার করে আসে৷ যারা দোকানে আসে, তাদের মধ্যে পিপ্পাল পাঁড়ের চরও নিশ্চয়ই থাকে। নইলে তারাও বা খবর পাবে কী করে? কোন বড়লোকের বাড়িতে বিয়ে আসছে, কে গেজেতে করে বিস্তর টাকা নিয়ে গোরু কিনতে যাচ্ছে কোন হাটে, কে জঙ্গল ডাকতে যাচ্ছে হাজারিবাগের ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসারের অফিসে, যেখানে জঙ্গলের নীলাম ডাকা হবে, সেখানে বিস্তর ক্যাশ টাকা ডিপোজিট দিতে। এই সব খবর না পেলে, ডাকাতি করে পাবে কী? কখনও বা কোনও জমিদার বা বানিয়া কার ওপরে কী অত্যাচার করল তারও বৃত্তান্ত চুঁইয়ে আসে বানোয়ারির এই পানের দোকানে।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা বানোয়ারির পানের দোকানে বসে থাকতে থাকতে রাত কত হয়েছে তার খেয়ালই ছিল না স্থানীয় মানুষদের গল্প-গাছাতে এমনই মগ্ন হয়ে উঠেছিলাম আমরা। ইতিমধ্যে দেখি, সফর আলি গুটি গুটি আসছে দোকানের দিকে। পরনে নীল-সাদা খোপ-খোপ লুঙ্গি তার ওপরে নীলরঙা ফুল শার্ট, মাথায় সাদা টুপি, পায়ে নাল লাগানো মোষের মোটা চামড়ার জুতো।

বানোয়ারির দোকানটা ছিল মস্ত একটা সাগুয়ান গাছের নীচে, চাতরা, হাজারিবাগ আর বাঘড়া মোড়-এর রাস্তার চৌমাথাতে। সফর আলি এসে বলল, লটকা আপলোগোঁকি আনেকি লিয়ে বোলিন। খানা বন গ্যয়া। ঠাণ্ডা হো রহা হ্যায়।

সফর আলি যখন আমাদের সঙ্গে কথা বলছে তখনি সাইকেলে করে একটি লোক এল চাতরার দিক থেকে। এসেই দুটো দিয়ে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে বলল, দো পান। কালি-পিলি জরদা দে কর। ছিপছিপে লোক। বয়স চল্লিশ হবে। পরনে দেহাতি খদ্দরের একটা হলদে পাঞ্জাবি আর পায়জামা।

বানোয়ারি তাড়াতাড়ি পান দিল। তাকে যেন একটু নার্ভাস দেখাল।

পিচিক করে কিছুটা পানের পিক ফেলে, আর কিছুটা খুশবুদার জরদা দেওয়া পিক গিলে, সফর আলিকে সে বলল, আররে!মিঞাসাব তু এথিক্যা করলথু হো?

লোকটা আসতেই সবাই চুপ করে গেছিল। এবং বানোয়ারির তড়িঘড়ি পান দেওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিকতা ছিল। লোকটা যে দুগগি-তিগগি কেউ নয়, তা তার চোখ দুটোই বলে দিচ্ছিল। আর ব্যক্তিত্বও।

সফর আলি লোকটাকে দেখে চমকে উঠল মনে হল।

বলল, ম্যায় মেহেমান লোগোঁকা সাথ আয়া।

কাঁহাসে আয়া তুমহারা মেহমান লোগোঁনে?

 কলকাত্তা সে। কম্পানিকি অডিটর সাবকি লেড়কা ঔর উনহিকি দোস্ত।

তবতো বহত পয়সাওয়ালা আদমি হোগা। তু ইসি লিয়ে চামচাগিরি করলথু। ক্যা অডিট করনে কি লিয়ে আয়া ই ওড়াপুত্তান লোগ?

আমাদের খুব রাগ হয়ে গেল। নাজিম সাহেব আমাদের উঁওড়াপুত্তান বলেন সেটা অন্য ব্যাপার। এমন আনজান লোক আমাদের এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে?

সফর আলি প্রতিবাদ করে বলল, ম্যায় ক্যা ঊরু? শেঠনে ভেজা, তবহি না আয়া। ম্যায়তো নোকরিহি না করতা হ্যায়।

লোকটা বলল, সাচ্চি বাত। মগর কওন হ্যায় তুমহারা শেঠ? কাঁহাকি শেঠ?

চাতরাকি। ঔর কাঁহাকি শেঠ মিলেগা মুঝে। ম্যায়তো চাতরামেই না রহতা হ্যায়।

নামতো বাতাও মেহেরবানি করকে, তুমহারা শেঠকি।

শেঠ লগনচাঁদ মালপানি।

আচ্ছি বাত।

তো হিয়া ঠাহরা হ্যায় কাঁহা? চন্দনমলকি ডিপোমে?

নেহি। ডাকবাংলা মে।

আচ্ছা বাত। তো অডিটর লোগোঁনে ক্যা অডিট করনেকে লিয়ে আয়া হিয়া?

শিকার খেলনেকে লিয়ে আয়া। ইনলোগোঁনে তো পড়তা হ্যায় কলিজমে। অডিটর থোরি বন গিয়া।

বলেই, আমাদের দুজনের আলাপ করিয়ে দিল সফর আলি, লোকটার সঙ্গে। আমাদের বলল, ঈভি বহতই ভারি শিকারি হ্যায়। পইলে গিরিডিমে অভ্রকি খাদানমে কাম করতা থা…

ইয়েভিতো বোলো মিঞা, যো তুমভি কাম করতা থা ওহি খাদানমে…

বলতেই, সফর আলি যেন মিইয়ে গেল।

 বলল, ছোড়ো পিপ্পাল সব পুরানা বাঁতে।

আমি আর গোপাল চমকে উঠলাম ‘পিপ্পাল’ শুনে। এই কি তবে ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ে?

লোকটি বলল, ম্যায় থোড়ি ভুলনে শকতা মিঞা। সব কুছহি মেরি ইয়াদ রহতা হ্যায়। ভুলনা ইতনা অ্যাহসান তো নেহি না হ্যায়!

সফর আলি যেন খুবই ভয় পেয়ে গেল।

বলল, চালিয়ে চালিয়ে খোকাবাবুলোগ।

উঁওড়াপুত্তানলোঁগ হিয়া কওনসি শিকারকি লিয়ে আয়া হুয়া হ্যায়? পাণ্ডুক কি শিকার?

এই কথাতে দোকানসুদ্ধ লোক চাপা হাসি হেসে উঠল।

গোপাল আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, সব গাঁওয়ার। কোনও ভদ্রতা জানে না।

পাণ্ডুক মানে কী?

 তিতির জিজ্ঞেস করল।

 পাণ্ডুক মানে, ঘুঘুপাখি।

 গোপাল দোকানসুদ্ধ লোককে হাসতে দেখে গলাতে সামান্য তেতো মিশিয়ে লোকটাকে বলল, চিবিয়ে চিবিয়ে, আউর করে ক্যা? হিয়া পাণ্ডুক ছোড়কর কুছ হ্যায়ই নেহি। না জংগলমে, না বস্তিমে।

অ্যায়সি বাত?

সেই লোকটা মানে, পিপ্পাল, বলল। মনে হল, জায়গা মতোই বিধিয়েছে গোপাল।

জি হাঁ। অ্যায়সি হি বাত।

গোপাল বলল, তার ইয়ার্কির জবাবে গম্ভীর হয়ে।  

আপলোগোঁনে কওনসা হাতিয়ার সে খেলিয়ে গা শিকার?

আবারও প্রশ্ন করল, লোকটা।

আমারও ততক্ষণে রাগ হয়ে গেছে। আমি বললাম, স্রিফ হাঁতোসে।

 লোকটা বলল, হাঁতোমে বহতই তাগৎ হোগা আপলোগোঁকি।

জি হাঁ। সিরিফ হাঁতোমেহি নেহি। প্যায়েরোমেভি কাফি তাগৎ হ্যায়।

 গোপাল বলল।

বহতই খুশি কি বাঁতে, বহতই খুশি কি সন্দেশ হ্যায় ঈ। হিন্দুস্তাঁ কি ঘর-ঘরমে এইসি নওজোয়ানোকি জরুরৎ পড়ি হ্যায় আজ।

তারপরই সাইকেলটা টেনে নিয়ে, লাল কালো চেক-চেক মাফলারটা গলাতে ভাল করে জড়িয়ে, সফর আলিকে হাত তুলে বলল, খুদাহ হাফিজ। ইনশাল্লা; ফিন মিলেঙ্গে। মিলনাতো হোগাই ইকদফে। কমসে কম।

তারপর, আমাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, নমস্তে খোকাবাবুলোঁগ। জি খোলকর পাণ্ডুক মারিয়ে। ক্যা জঙ্গলমে, ক্যা বস্তিমে। হিয়াতো স্রিফ পাণ্ডুক হি পাণ্ডুক ঔর ক্যা?

গোপাল বলল, শুনাতো থা যো বাঘোয়াভি হ্যায়। মগর মিলা স্রিফ পাণ্ডুক ঔর খরহা।

আচ্ছা?

বলেই, নোকটা সাইকেলে উঠে চলে গেল।

লোকটা চলে যেতেই সফর আলি বানোয়ারির দোকানের সামনের বেঞ্চে থপ করে বসে পড়ে বানোয়ারিকে বলল, ইক প্যাকেট কেঞ্চি সিগারেট লানা ভাই।

চলে-যাওয়া লোকটার জ্বলজ্বলে চোখ দুটো তখনও যেন চিতাবাঘের চোখেরই মতো আমাদের দিকে চেয়েছিল।

কেঞ্চি সিগারেটটা আবার কী জিনিস?

ভটকাই বলল।

সে তোরা দেখিসনি। আমাদের ছেলেবেলাতে ওই সব সিগারেটই পাওয়া যেত। Scissors বা কাঁচি, পাসিংশো। ভাল সিগারেট বলতে গোল্ডফ্লেক, ফাইভ-ফাইভ-ফাইভ।

 তারপর বলো।

ভটকাই বলল। থামলে কেন ঋজুদা?

হ্যাঁ। ঋজুদা বলল, দোকানি বানোয়ারি সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল, গিরিডিমে ক্যা হিসাব-কিতাব থা পিপ্পালসে তুমহারা মিঞা? লাগতা হ্যায় কি, পিপ্পাল কী কুছ হিসাব পড়ি হ্যায়। উধার-শুধার লিয়া থা ক্যা রুপাইয়া?

উধার মানে কী? উধার-শুধার?

 তিতির বলল।

উধার মানে, ধার। উধার-শুধার মানে ধার-টার।

সফর আলি বলল, পিপ্পাল আভভিইনা বহত রহিস আদমি বনা। উসটাইম মে উসকো ম্যায় বহতই পিটতা থা অভ্র খাদানমে।

উসকো পিটতা থা? কাহে লা?

 সমবেত পরচর্চাকারীরা অবাক হয়ে সমস্বরে শুধোলেন।

 বদমাস থা ইক নাম্বারকি। ঔর হামারা মালিক বোলতা থা উসকো পিটনে কি লিয়ে। হামারা মালিক ভি আচ্ছা আমি নেহি থা। উসকা দুসরা হিসাব কিতাব ভি থা।

পানের দোকানি বানোয়ারি উৎকর্ণ হয়ে জিজ্ঞেস করল।

উস বাদই তো পিপ্পালকি পিতাজি গিরিডি ছোড়কর ঝুমরি তিলাইয়া চলে গ্যয়ে। উসকি বাদ হাজারিবাগ জিল্লামে আয়া হোগা। মুঝে পতা নেহি থা।

শুধু বানোয়ারিই নয়। অন্য অনেকেই বলল, জারা সামহালকে রহনা চাহিয়ে মিঞা। নেহিতো তুমকো সীমারিয়া ছোড়কর চলা যানা চাহিয়ে জলদি। বাঘড়া মোড় সে লেকর সীমারিয়া, টুটিলাওয়া বনাদাগ হোকর ইকদম হাজারিবাগ তক পিপ্পালকি রাজ হ্যায়।

আমি বললাম, কিউ? ক্যা হোগা?

 বহত কুছ হোনে শকতা খোকাবাবু। পিপ্পাল করনে নেহি শকতা এইস্যা কোঈ কামই নেহি হ্যায়। সামহালকে রহিয়েগা। আপ দোনোঁকোভি উ গুম কর দেনে শকতা হ্যায়। বহতই কামিনা আদমি হ্যায়।

গোপাল বলল, কাহে? হামলোগোঁসে উসকি ক্যা মতলব?

 গুম কর দেকে বহতই মোটা রুপাইয়া মাগো আপলোগোঁকি পিতাজিসে। ঔর ক্যা?

আমি বললাম, রুপাইয়া নেহি মিলনেসে?

নেহি মিলনেসে আপলোগোঁকি লাশ লেনেকে লিয়ে আনে পড়েগা উনলোগোঁকি কলকাত্তাসে।

আমি বললাম, যেন খুবই ভয় পেয়েছি এমনই ভাব দেখিয়ে, আরে! ইতো বড়ি খাতরা বন গ্যয়া।

জী খোকাবাবুলোঁগ। আভভি খাতরা বনা নেহি, মগর বননে শকতা।

আমি আরও ভয় পেয়েছি ভাব করে বললাম, কাল হি সুব্বে ভাগেগা হামলোগ হিয়াসে।

ঐসাহি করনা। নেহিতো কমসে কম ঈ মিঞাকো চাতরাওয়ালা সুব্বেকি বাসমে বৈঠা দিজিয়ে।

সফর আলি বলল।

গোপাল বলল, দেঁখে, ক্যা করে! শোচেগা।

তারপর আমরা তিনজন হেঁটে ডাকবাংলোর দিকে এগোলাম।

তারপর?

ভটকাই বলল।

একটু থেমে, পাইপে কুটি টান দিয়ে ঋজুদা আবার শুরু করল।

 সপ্তমী কী অষ্টমী হবে। শুক্লপক্ষর রাত। চাঁদটা উঠেছে। এপ্রিলের প্রথম। কিন্তু তখনও সন্ধের পরে বেশ ঠাণ্ডা। রাতে একটা কম্বল লাগে। পথের লাল ধুলোয় আর পথপাশের গাছগাছালির গায়ের থেকে একটা মিশ্র গন্ধ উঠছে। দুটো পেঁচা ঝগড়া করতে করতে আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়তে উড়তে, যেন আমাদেরই পাইলটিং করে নিয়ে চলতে লাগল। দূরের বস্তি থেকে একসঙ্গে তিনচারটে কুকুর ডেকে উঠল। আমরা ওঠার পর পরই বানোয়ারির দোকানের বাইরের বাঁশ থেকে ঝোলানো হ্যাঁজাকটা নিভে গেল।

দোকানের ঝাঁপও বন্ধ হল। সাইকেলে বা পায়ে হেঁটে পরচর্চা করনেওয়ালারা। একে একে যার যার বাড়ির দিকে চলে গেল।

রাত সাড়ে আটটাতে জঙ্গলের মধ্যের ছোট্ট জায়গাতে অনেকই রাত। বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ডালটনগঞ্জ, রাঁচি আর হাজারিবাগ থেকে দিনে তখন। সবসুন্ধু গোটা দশেক বাস যেত-আসত। ট্রাক তখন ছিলই না বলতে গেলে। মোষের বা গোরুর গাড়িতেই বেশি মাল যেত-আসত। ওই সময়ে সীমারিয়া বা টুটিলাওয়াতে সাইকেল রিকশা ছিল না কোনও। চড়বে কে? অত বড়লোক কজন সেখানে?

সফর আলি বলল, আপলোঁগ ইতনা দের নেহি করনেসে তো হামকো পান দুকানমে যানা নেহি পড়তা থা। ঘড়িভিতে আপনোগোঁকি হাতোমে বান্ধা হুয়া হ্যায়, মগর ওয়াক্ত কিতনা হুয়া উও দিখনেমে হুরজা ক্যা থ্যা?

আমি বললাম, গলতি হো গ্যয়ে।

ওয়াক্ত মানে কি ঋজুকাকা?

তিতির বলল।

ওয়াক্ত উর্দু শব্দ। ওয়াক্ত মানে সময়, টাইম।

গোপাল বলল, খ্যয়ের, যো হুয়া সো আচ্ছাই হুয়া।

 কাহে?

কাঁচি সিগারেটে এক জব্বর টান লাগিয়ে সফর আলি বলল।

আরে দেরি না করলে চাচা তুমিও আসতে না আর আমাদেরও ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের সঙ্গে মোলাকাত হত না। আমার ছেলেবেলা থেকেই অনেক ডাকাতের গল্প শুনেছি কিন্তু চোখে কখনও দেখিনি ডাকাত। এই প্রথম।

চেহারা দিয়ে কী বোঝা যায়। অনেক মানুষ আছে, ডাকাতের মতো দেখতে কিন্তু অতি সজ্জন। আবার অনেক ডাকাত আছে পির-এর মতো দেখতে। মানুষের বাইরের চেহারাটা কিছুই নয়, ভিতরের চেহারাটাই আসল। তবে ওকে আমি দোষ দিইনা কোনও, বরং ওকে সমর্থনই করি। ও আমাদের মতো লক্ষ লক্ষ অত্যাচারিত গরিব মানুষের আশা। ওকে এ অঞ্চলের মানুষে পুজো করে। এত অন্যায় অত্যাচার সয়েছে মানুষ, জমিদার, ক্ষমতাবান, পয়সাওয়ালাদের হাতে, পোলিটিকাল পাটির ক্যাডারদের হাতে, মুখ বুজে, যুগের পর যুগ, যে, পিপ্পাল-এর মধ্যে তারা সকলেই তাদের অপমান অসম্মানের প্রতিশোধের ভাষা খুঁজে পায়।

তুমি তো মুসলমান সফর চাচা। আর পিপ্পাল তত হিন্দু ব্রাহ্মণ।

তাতে কী? ওসব জাত-পাত সবই ফালতু। পৃথিবীতে জাত মাত্র চারটে।

 মাত্র চারটে?

 মানে?

আমি, তিতির আর ভটকাই একই সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম ঋজুদাকে।

ঋজুদা হেসে বলল, আমি আর গোপালও ঠিক এমনি করেই তোদেরই মতো একই সঙ্গে সফর আলিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।

তো কী বলল? সফর আলি?

ভটকাই বলল।

ভটকাই, বেশ অনেকক্ষণ একটানা শোনা হয়েছে গল্প আবার তুই শুরু করলি। চুপ কর।

আমি বললাম।

ভটকাই নিজেই ডানহাতের তর্জনি নিজের ঠোঁটে চুঁইয়ে রেখে চুপ করে গেল।

 সফর আলি বলল, চারটে জাত। একটা হল ক্ষমতাবান অত্যাচারী, সেই ক্ষমতা অর্থ থেকে, পদ থেকে, বা রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকেও আসতে পারে। আর দ্বিতীয় হল অত্যাচারিত।

আর?

গোপাল বলল।

আর খারাপ এবং ভাল।

তারপর বলল এই চারটি জাত ছাড়া পৃথিবীতে কোনও জাত-পাতই নেই! আর সবই বানানো। গা-জোয়ারি জাত।

একটু চুপ করে থেকে ঋজুদা বলল। আজও মনে পড়ে, সীমারিয়ার সেই রাতটির কথা। শুক্লাসপ্তমীর নির্মেঘ চাঁদভাসি নীলকাশে অগণন স্নিগ্ধ তারারা ফুটে আছে। একটা মস্ত শিরিষ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদটা দেখা যাচ্ছে, আধখানা ডিমের কুসুমের মতো। শেষ চৈত্রের হালকা হিমেল রাত। আমের বোল-এর আর মহুয়ার গন্ধ ছমছম করছে নিবাত পরিবেশে।

এই রে! নিবাত শব্দটা কি হিন্দি ঋজুকাকা?

তিতির বলল, মুশকিলে পড়ে।

 ঋজুদা হেসে বলল, এই সব সাহেব-মেমসাহেবদের নিয়ে পারি না।

তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, এই যে লেখকমশাই মিস্টার রুদ্র রায়, আপনি একটু সাহায্য করুন না আমাকে।

আমি বললাম, বাত মানে যে শুধুমাত্রই গেঁটে বাতই তা ভেবো না। বাত মানে কথা, সংবাদও…

বাতিয়া বানাও নেহি বার বার মুসে

ভটকাই গেয়ে উঠল হঠাৎ।

ঋজুদা বলল, বাঃ! তুই দেখি রুদ্রকে সব ব্যাপারেই হারাতে চাস।

ভটকাই গম্ভীর গলাতে বলল, তুমিই সবসময়ে বলল যে, জীবনে যাই করবি তাতেই এক নম্বর হওয়ার সাধনা করবি।

তা বলে, তুই সেমসাইডে গোল করবি?

 আমরা সকলেই হেসে উঠলাম।

হ্যাঁ। বাত মানে কথা, বাত মানে গেঁটে বাত, বাত মানে হাওয়াও।

হাওয়া?

 তিতির অবাক হয়ে বলল।

ইয়েস। নির্বাত সংস্কৃত শব্দ। তা থেকে নিবাত। কেন তোরা কি পড়িসনি কোথাও? বঙ্কিমচন্দ্রও পড়িসনি? বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিককে? ‘নিবাত, নিষ্কম্প’ অনেক জায়গাতে ব্যবহার করেছেন উনি।

এবারে বলো ঋজুদা। ডাকাত ছেড়ে ব্যাকরণে ঢুকে পড়ছ তুমি। ব্যাকরণকে আমরা ডাকাতের চেয়েও বেশি ভয় পাই।

হ্যাঁ।

তারপর গোপাল বলল, ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ে যে সাইকেলে চড়ে বানোয়ারির দোকানে এসে জরদা পান খেয়ে আড্ডা মেরে গেল। কেউ কোতোয়ালিতে এই খবর দেবে না? পুলিশের চর নেই এখানে?

আছে। নিশ্চয়ই আছে। তারা পুলিশের কাছ থেকে পয়সাও নেয় আবার পুলিশকে ভুল খবরও দেয়। কারণ, মনে মনে ওরা সকলেই পিপ্পাল পাঁড়ের দলে।

এটা কি উচিত? মানে পয়সা নিয়ে কাজ না করা?

গোপাল বলল, এটা কি অসততা নয়?

সততা, ইমানদারি, এসব কথা তো ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে অভিধান থেকে বড়খোঁকা।

সফর চাচা আমি লম্বা চওড়া বলে আমাকে বড়খোঁকা আর গোপালকে ছোটখোঁকা বলছে। গোপাল যদিও বয়সে আমার চেয়ে এক বছরের বড়ই। এতে চটছেও গোপাল। কিন্তু আমি কী করব!

সফর আলি তারপরে বলল, সততা, ইমানদারি আর বোকামির মতলব এখন একই হয়ে গেছে।

আমরা আর কথা না বলে সীমারিয়ার ডাকবাংলোর দিকে এগিয়ে চললাম।

 দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল বাংলোর ফটকের বড় শিমুল গাছটাকে। শিমুলের ফুল পড়ে পড়ে লাল গালচের মতো দেখাচ্ছে জায়গাটা আর আমেরিকান আর্মির ডিসপোজাল থেকে কেনা জিপের বনেটটার উপরে চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছে।

লটকা। হো লটকা।

 সফর আলি চেঁচিয়ে ডাকল।

রামখিলাওন বাবুর্চিখানা থেকে উত্তর দিল, বহত জাদা ভাঙ পি লিয়া আজ লটকা বাবু। আপলোঁগ নহি রহেনেসেই এইসা হি করতা হ্যায় উনোনে।

ভাবলাম, ভাল লোকাল গার্জেনদের খপ্পরেই পড়লাম দেখছি। এক মিঞা ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের জানি দুশমন’ আর অন্য জন মহাদেবের জানি চেলা।

সফর আলি বলল, আপনারা খেতে বসে পড়ুন খোকাবাবুরা। আমি উজু করে, এশার নামাজটা পড়েই আসছি।

গোপাল বলল, লটকা বোধহয় আজকে আর খাবে না। সে এতক্ষণ ভাঙ-এর কল্যাণে রম্ভা-মেনকার নাচ দেখছে স্বপ্নে, মন্দাকিনী নদীর তীরে।

.

০৬.

ভোর তখনও হয়নি। তবে পুবের আকাশ সাদা হয়েছে সবে। এখনও রাতে একটু একটু শিশির পড়ে এই জঙ্গুলে জায়গাতে। আমি আর গোপাল তৈরি হয়ে বারান্দাতে এসে দাঁড়ালাম। জিপটার বনেটের ওপরে শিশির পড়ে রয়েছে। সিটের কোনাগুলোও ভিজে রয়েছে।

আমি বললাম, গোপাল তুমি দেখো, ওরা তৈরি হল নাকি। আমি ততক্ষণে জিপটা স্টার্ট করি।

একটু পরেই লটকা আর সফর চাচা তৈরি হয়ে বাইরে এল। সফর চাচার মাল বলতে লাল-সবুজ লুঙি-মোড়া কাপড়-চোপড় আর একটি পেতলের বদনা।

বদনা মানে কী?

 তিতির আবারও বলল।

বদনা বা গাডু আমাদের ঘটিরই মতো। কিন্তু মুখটা ঘটির চেয়ে ছোট এবং সরু শুড় থাকে, যার মধ্যে দিয়ে জল বেরোয়। মুসলমানেরা হিন্দুদের চেয়ে অনেকই বুদ্ধিমান। কারণ, বদনা, ঘটির চেয়ে অনেক বেশি ভাবনা চিন্তা করে বানানো হয়েছে।

বলেই বলল, তোরা ‘গলতাকিয়া’ কাকে বলে জানিস?

‘গলতাকিয়া’?

আমরা সমস্বরে বিস্ময় প্রকাশ করলাম।

হ্যাঁ। গলতাকিয়া। আবদুল হালিম শরর সাহেবের পুরাতন লক্ষ্মৌ বলে একটি বই আছে। তার বাংলা অনুবাদও পাওয়া যায়। বইটা পড়বি। পড়লেই জানতে পারবি।

তারপর বলল, আমরা যখন বালিশের উপরে পাশ ফিরে শুই তখন আমাদের গালের নীচেটা ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকে না কেমন?

ঠেকেই তো।

ভটকাই বলল।

লক্ষৌ-এর নবাবেরা ছোট্ট-ছোট্ট খুব পাতলা গোল-গোল বালিশ ব্যবহার করতেন গালের নিচে দিয়ে শোবার জন্যে। বালিশের বা তাকিয়ার উপরে এই ছোট ছোট গাকিয়া’ ব্যবহার করতেন, সিল্কের ওয়াড় পরানো, আতর মাখানো।

জীবনে কী করে বাঁচতে হয়, তা ওরা জানে।

তিতির বলল।

কী করে মরতে হয়, তাও জানে। ভোগের চরম করতেও যেমন ওদের ফালতু লজ্জা নেই, ত্যাগের চরম করতেও মুসলমানেরা দু’বার ভাবে না। ওরা জিতলে যেমন উল্লসিত হয়, হারলেও তেমন বিমর্ষ হয় না। আমার তো অন্তত তাই মনে হয়।

ঋজুদা বলল।

ভটকাই জোরে জোরে তিনবার বলল। গলতাকিয়া! গলতাকিয়া! গলতাকিয়া!

 মুখস্থ করে রাখ। আমি কাল সকালেই আমাদের পাড়ার পদ্মা বেডিং স্টোর্স-একটা গলতাকিয়ার অর্ডার দেব।

দিলে, একটা কেন দিবি? দু’গালের জন্য দুটো দিবি। আমি বললাম।

ঠিক বলেছিস।

হ্যাঁ। এবার বলল, ঋজুকাকা। তা সফর আলি তার জামাকাপড় নিল কেন সঙ্গে?

রাতেই আমরা ঠিক করেছিলাম যে সফর আলির মনে যখন মৃত্যুভয়ই জেগেছে তখন আমরা নিজেরাই ওকে চাতরা পৌঁছে দিয়ে আসব।

মৃত্যুভয়? মৃত্যুভয়ের কথা বলেছিল নাকি?

 তিতির বলল।

হ্যাঁ। রাতে পানের দোকান থেকে আসতে আসতে বলছিল, পিপ্পালের, আমার উপর অনেকই রাগ আছে। নানা কারণে। সে সব কথা আমি আপনাদের বলতে পারব না। অথচ যা কিছুই আমি করেছিলাম তা আমার মালিকেরই নির্দেশে। চাকরদের যে কী জ্বালা, তা চাকরেরাই জানে।

তখন আমরা বললাম যে, এ কথা জানার পর তো চাচা আপনাকে একা ছাড়া যাবে না। লটকাও চলুক আমাদের সঙ্গে। আমরা ফেরার সময়ে ওল্ড চাতরা রোড দিয়ে ফিরে এসে টুটিলাওয়ার কাছে উঠে তারপর সীমারিয়াতে আসব। পথে কিছু শিকার যদি মিলে যায়। জঙ্গল তো সে পথে গভীর খুবই।

পথে সফর আলি বলল, আপনারা ছেলেমানুষ, ওই পথে আপনাদের আমি একা ছাড়ব না। তাহলে চলুন! সকলে মিলেই যাব। ভোরেভোরে বেরিয়ে ওই পথ দিয়েই চাতরা পৌঁছব। জিপ রয়েছে সঙ্গে, কার তো নয়, পথ অব্যবহৃত হলেও পৌঁছে যাবে। ভয় একটাই। ওই পথেরই ডানদিকে বাঁদিকে কোথাও পিপ্পাল পাঁড়ের আস্তানা আছে। আস্তানা গেড়ে যখন আছে তখন দেখবেন আজকালের মধ্যেই কাছাকাছি কোনও বড় শেঠ-এর বাড়িতে বা গদিতে ডেকাইতি হবে।

আমরা যেন পিপ্পাল পাঁড়ের সঙ্গে দেখা হোক, তা মোটেই চাই না এমন ভাব দেখিয়ে চিন্তিত হবার ভান করে বললাম, তাহলে তো চিন্তার কথা হল। তার সঙ্গে যদি মোলাকাত হয়ে যায়?

গোপাল বলল, সে হতে পারে কিন্তু অব্যবহৃত বলেই তো ওল্ড চাতরা রোডে শিকারও পাওয়া যায় খুব। ইজাহার বলছিল না সেবারে। কাল একেবারে ভোরেভোরে বেরোব আমরা। আজকে একটু শিকারই খেলা যাক।

লটকা তখন বলল, আমি তো বসে বসে খেয়ে খেয়ে আরও মোটা হচ্ছি। শিকার খেলতে এসে শিকার খেলাই দেখলাম না। আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব। রামখিলাওন একা থাকুক, রান্নাবান্না করে রাখবে। আজকে সীমারিয়ার হাট আছে। কচি পাঁঠা কাটবে। পাঁঠার মাংস, ভাল করে ঘি গরমমশলা ফেলে আর ডুমো ডুমো করে আলু ফেলে দিয়ে রান্না করবে আর ঘি-ভাত। সঙ্গে মুচমুচে করকে আলুভাজা। মেটের বহতই ঝাল চচ্চরি। তারপর রাবড়ি আর প্যারা তো আছেই।

গোপাল বলল, সফর চাচা হয়তো ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের হাতে মরলেও মরতে পারে কিন্তু তুমি লটকা দাদা, মরবে খেয়েই।

লটকা দু’হাত দু’দিকে তুলে বলল, লেহ্ লকা। তারপর বলল, জিতা রহো গোপালবাবু। ঐসা মওতহিতো মুঝে চাহিয়ে। ইস দেশমে সব্বেত ভুখাহি মরতা হ্যায়। ম্যায়নে জি-খোলকর খা কর মরেগা, এক ঝটকামে লেহ্ লটকা।

লটকার ওজন প্রায়, দু’মণ হবে। যখন হাঁটে, দুটি উরু দুটি ঊরুর সঙ্গে লেগে যায়। যখন কথা বলে, তার লাল মোটা জিভটা মুখের ভিতর থেকে কোটরের মধ্যের সাপের মাথার মতো মাঝে মাঝেই বেরিয়ে আসে।

রওয়ানা তো হওয়া গেল দুর্গা দুর্গা করে।

লটকা দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে বলল, জয় মাতাজি কি জয়।

 তার ইতিমধ্যেই ধুঁয়ো-ওঠা ঠাণ্ডা জলে চান হয়ে গেছে। পুজোও হয়ে গেছে। কপালে মেটে-সিদুরের ফোঁটা। কিছুটা চুঁইয়ে নাকের ওপরে পড়েছে। বাঁ কানে একটি জবাফুল গোঁজা। কোত্থেকে যত্র তত্র জবাফুল পায়, কে জানে! কিন্তু পেয়ে যায়।

গোপাল এই প্রশ্ন করাতে জবাবে কাল বলেছিল, মাতাজি কি দয়া রহনেসে বাঘোয়াকা দুধভি মিলতা হ্যায় ঔর ইয়ে ফুল কওসি বড়ি বাত হ্যায়।

সফর আলি চান সারেনি কিন্তু ফজিরের নামাজ সেরে নিয়েছে।

লটকার হাতে একটা বাঁশের কঞ্চি। ওর যা চেহারা, তাতে আস্ত বাঁশ নিলেও মানিয়ে যেত। কঞ্চিটাকে ওর হাতে দেখে, গোপাল বলল, লরেল অ্যান্ড হার্ডি।

টুটিলাওয়ার কাছে ওল্ড চাতরার পথের মোড়ে আমরা যখন পৌঁছলাম তখন রোদ সবে উঠেছে। শিশির ভেজা পাতায় পাতায় ঝিলমিল করছে রোদ আর সেই হাওয়াটা ছেড়েছে, মহুয়া, করৌঞ্জ আমের মুকুল আর শালফুলের গন্ধ বয়ে নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ যে হাওয়া নিয়ে গান বেঁধেছিলেন বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া।

আমি জিপ চালাচ্ছিলাম। আমার বন্দুকের শুধু গুলি ভরিনি। বন্দুকটা পাশেই শোয়ানো ছিল। গোপাল আর সফর আলি গুলি পুরে নিয়েছিল তাদের বন্দুকে। আমার বুশশার্ট-এর উপরে ক্রস-বেল্টে গুলি গোঁজা ছিল। প্রয়োজনে বন্দুকটা তুলে নিয়ে গুলি ভরতে পনেরো সেকেন্ড লাগবে।

গতবার আমি আর গোপাল যে জায়গাটাতে সেই কাঠুরেদের দেখেছিলাম, সে জায়গাটা পেরিয়ে এলাম। আমি ইংরেজিতে বললাম গোপালকে, ক্যান উ্য প্লেস দিস স্পট?

সার্টেনলি আই স্যু।

গোপাল বলল।

লটকা বলল, হামলোঁয়োকা আংরেজি আতা নেহি। আংরেজি বাত-চিত মত কিজিয়ে গা। সমঝমে নেহি আতা। গালি দে রহা ক্যা আপলোঁগ হামলোঁগোকি?

আমি হেসে বললাম, নেহি নেহিজি। খ্যয়ের ঠিকে হ্যায়। ঔর ইংরেজি বোলি নেহি বোলেগা হামলোঁগ।

হ্যাঁ। ঐসাহি কিজিয়েগা।

বাঁদিকের জঙ্গল থেকে একদল ময়ূর বেরিয়ে জিপের সামনে দিয়ে পথ পেরোল ধীরেসুস্থে। সফর আলি বন্দুক উঠিয়ে ছিল। গোপাল বন্দুকের নল হাত দিয়ে সরিয়ে দিল।

কাহে লা?

সফর আলি বলল।

আরে ইস জঙ্গলমে ডাকু রহনেসে খাতরা না বন যায়েগা। ঔর খাতরাতো আপহিকি না হ্যায়। আভূভি হিয়া গোলিকা আওয়াজ নেহি না করনা চাহিয়ে।

সফর আলি বাঁ হাতটা দাড়িতে বুলিয়ে বলল, সাহি বাত।

আরও মিনিট পনেরো যাবার পরে পথ একেবারে সরু হয়ে এল। দু’পাশ থেকে জঙ্গল পথটাকে গলা টিপে মারার মতলব করেছে। পথের মধ্যে মধ্যে পুটুস-এর ঝাড় জন্মে গেছে। পথ, জায়গায় জায়গায় ভেঙে গিয়ে খোয়াই-এর মতো হয়ে গেছে। এই জঙ্গল হরজাই জঙ্গল। ফলে, সেগুন কম। পন্নন, পাঁইসার, গামহার, শিরিষ, জংলি আম, তেঁতুল, সালাই হলুদ, পলাশ এবং আরও নানারকম নাম না জানা জ্বালানি কাঠ-এর গাছ আছে। মনে হল, জিপ নিয়ে বুঝি এই বৈতরণী আর পেরুনো যাবে না।

জিপটা দাঁড় করিয়ে স্টার্ট বন্ধ করে গোপালকে ফিসফিস করে বললাম, আমি স্টিয়ারিং-এ বসে আছি। তুমি আর সফর আলি পায়ে হেঁটে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখো, জিপ নিয়ে আর এগুনো যাবে কি না?

লটকা আমাকে বলল, এ বাবু, হাম না উতরায়েব।

সফর আলি চাপা স্বরে বলল, কাহে লা?

 ইতনা সরু রাস্তেমে হামারা তোঁদ ফাঁস যায়েগা।

আস্তে হলেও, আমরা হেসে উঠলাম।

 এই বাক্যটির মানে কী হল ঋজুদা? তোঁদ মানে কী?

তিতির বলল।

ঋজুদা বলল, লটকা ছিল রসিক চূড়ামণি। সে বলল, আমি ওই সরু পথ দিয়ে হেঁটে যেতে গেলে আমার ভুড়ি জঙ্গলে আটকে যাবে। তাই, আমি জিপেই আছি।

আমি তর্জনী ঠোঁটে চুঁইয়ে কথা বলতে বারণ করে সিটে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলাম। সেখানে জঙ্গল এমনই গভীর যে, শেষ চৈত্র আর প্রথম বৈশাখের পর্ণমোচী বনের মধ্যেও আলো যেন ঠিকমতো পৌঁছচ্ছে না।

গোপালরা গেল তো গেলই। ফেরার নাম নেই। সামনে কিছুটা দেখে এসে তো বলবে যে, এগোব কী না! প্রায় দশ মিনিট যখন হয়ে গেল তখন আমার চিন্তা হতে লাগল। ভাবলাম, আমিও গিয়ে দেখি, কী ব্যাপার হল। যেই জিপ থেকে ডান পাটা বের করেছি অমনি লটকা পেছন থেকে তার শালপ্রাংশু কালো বাহু দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মুঝে একেলা ছোড়কর মত যানা বাবু। ডরকে মারে ম্যায় রো পড়ে গা।

মানে কী হল?

ভটকাই বলল।

আরে একটুও বুঝতে পারলি না? যেওনা বাবু। তুমি আমাকে একা রেখে গেলে, আমি ভয়ের চোটে কেঁদে ফেলব।

তিতির বলল।

আমরা সবাই হেসে উঠলাম।

তারপর?

তারপর আর কী? আমি হাসব না কাঁদব ভেবে পেলাম না। লটকার যা চেহারা, যেমন লম্বা, তেমন চওড়া, তার উপর দু’মণ ওজন। বড় বাঘের সঙ্গে নির্জন পথে তার দেখা হলে বাঘই ভয়ে হার্ট ফেইল করে মারা যাবে আর সে বলে কিনা ভয়ে কেঁদে ফেলবে।

তারপর?

 ইতিমধ্যে গোপাল আর সফর আলি হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসছে দেখা গেল। পথের সামনেই বাঁদিকে একটি বাঁক তাই ওদের আগে দেখতে পাইনি। ওরাও এসে পৌঁছল আর পথের ওপাশ থেকে মানুষের গলার শব্দ পাওয়া গেল। বোঝ গেল যে, একটি বয়েল গাড়ি অর্থাৎ ষাঁড়ে-টানা গাড়ির ষাঁড়দের গাড়োয়ান তার নিজস্ব ভাষাতে তাদের লেজ মুলতে মুলতে কিছু বলছে। গাড়িটা ঘোরাচ্ছে পথের উপরে। এমন সময়ে চিহাঁ-হ-হ-হ করে একটা ঘোড়ার হ্রেষা রব শোনা গেল। কে যেন উঁচু থেকে বলল, আররে, এ ফাগুরা! ঘঘাড়ে চিল্লাতা কাহে লা? তুমহিকো দিখকর?

জি হাঁ।

 গাড়োয়ান বলল।

তারপরই প্যাঁক-এক, প্যাঁ-এ-এক আওয়াজ করে কতগুলো রাজহাঁস একসঙ্গে ডেকে উঠল।

লটকা তার ডান হাতের পাতা গোল করে বলল, বড়কা বড়কা আণ্ডা হোগা। ওমলেট বড়িয়া বনে গা বাবু। ঔর বড়া বওককি রোস্টোয়া।

অর্থাৎ বড় বড় ডিম দিয়ে ওমলেট খুব ভাল হবে আর বড় হাঁসের রোস্ট যা হবে, তার জবাব নেই।

আমি ভাবছিলাম, জঙ্গলের মধ্যে ঘোড়া এল কোথা থেকে?

গোপাল এসে বলল, পিপ্পাল পাঁড়ের আস্তানাতে এসে পৌঁছে গেছি আমরা। পাঁচ ছটা ঘোড়া বাঁধা আছে নীচে। দূরে পাতায়-ছাওয়া তিন চারটে অস্থায়ী ঘর। রান্না বসেছে। উনুন থেকে ধুয়ো উড়ছে। একটা মস্ত মহুয়া গাছের মাঝামাঝি ডালে বেশ বড় একটা মাচার উপরে দু’জন লোক বসে আছে। একজন ডানদিকে, মানে পুবে মুখ করে, অন্যজন পশ্চিমে মুখ করে। দু’জনের মধ্যে একজন গাছের ডালে হেলান দিয়ে হুঁকো খাচ্ছে।

ওই বয়েল-গাড়িটা?

সফর আলি বলল, সম্ভবত সীমারিয়া থেকে কাল বিকেলের দিকে ওদের রসদ নিয়ে এসেছিল। আজ ভোর হতেই ফিরে যাচ্ছে। বাঘের ভয়ে, রাতের বেলা যায়নি।

তার মানে ওখান থেকে জঙ্গলে জঙ্গলে সীমারিয়াতে যাবার কোনও পথ আছে। যে পথ দিয়ে বয়েল-গাড়ি আরামে যেতে পারে। পথের এই দিকটাই একেবারে অব্যবহার্য হয়ে গেছে তাই পিপ্পাল ডেরা করেছে এখানে।

কথাবার্তা আমরা খুব আস্তে আস্তেই বলছিলাম।

সফর আলি আমাদের মুখের দিকে চেয়ে বলল, ক্যা কিজিয়েগা?

জঙ্গলেই যাব। কেন আমাদের কাল ‘পাণ্ডুক’ শিকারি বলে খুব ঠাট্টা করেছে বারবার, খোকাবাবু! খোকাবাবু! বলেছে। ওর সঙ্গে টক্কর দিয়ে তবেই যাব। হাতে বন্দুক থাকলে যমকেও ভয় করার কিছু নেই।

গোপাল বলল, তাহলে রাত নামার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। দিনের আলোতে তো এগোনোই যাবে না। ওই মাচানের লোক দুটোর কাছে বন্দুক আছে। ওরা স্কাউট। আমাদের দেখতে পেলেই দূর থেকে কড়াক-পিউ করে দেবে। জিপও স্টার্ট করে এই পথে ব্যাক গিয়ারে ফেলে ঘুররাতে, তারপর ফাস্ট গিয়ারে গেলে প্রচুর শব্দ হবে। আসার সময় শব্দ হয়তো ওরা পায়নি। হাওয়াটা ওদিক থেকে এদিকে বইছে।

লটকা বলল, হায় রাম। দিনভর হিয়ের বৈঠ রহনা হোগা?না দানা, না পানি। তবিয়ৎ হামারা সুখ যায়ে গা।

আমি ভাবলাম, ওই শরীর শুকোতে একমাসের উপোস লাগবে।

গোপাল বলল, এক কাজ করা যাক। তুমি স্টিয়ারিং-এ বোসো, আমরা তিনজনে ঠেলছি। গিয়ার নিউট্রাল করে দাও। ঠেলে, পেছনে নিয়ে, আবার ঠেলে সামনে নিয়ে, আরও কিছুটা ঠেলে এগিয়ে গিয়ে চলো স্টার্ট করে সীমারিয়া ফিরে যাই। তারপর বেলা পড়লে আবার আসব। সফর আলির এমন বিপদ। তা ছাড়া, আমাদেরও এমন অপমান-এর একটা ফয়সালা তো করতে হবে।

মনে হল, আমাদের কথা শুনে সফর আলি একটু অবাকই হল। তার জীবনের ভয়ের কারণে আমরা এত বড় ঝুঁকি নিতে যাচ্ছি দেখে তার অবাক না হয়ে উপায়ও ছিল না। আমাদের পাণ্ডুক মারা’ শিকারি বলতে যেটুকু অপমান হওয়ার কথা, আমাদের তার চেয়ে অনেক বেশিই হয়েছে বলেই বুঝতে তার অসুবিধে হল একটু। তাকে চিন্তান্বিতও দেখাল।

আমরা যে আসলে শিকারে আসিনি, ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের সঙ্গেই টুকরাতে এসেছি, এ কথা তো আর কারওকে বলতে পারছি না। গোপালের বাবা অথবা তাঁর মক্কেল বা অন্য কেউও এ কথা ঘুণাক্ষরে জানলে আমাদের আসতেই দিতেন না।

সফর আলি শুধু একবার ক্ষীণ প্রতিবাদ করে বলল, আপলোগ বাঁচ্চে হ্যায়। কলকাত্তা কি বড়ে খানদান কি আওলাদ হ্যায়, আপলোঁগ শিকারকি সঁখ বিতানেকি লিয়ে হিয়া আয়া, আপনোগোঁনে কাহে হামারি মামলে মে ফাঁসিয়েগা ঝুঠঠো।

মানে, আপনারা ছেলেমানুষ, কলকাতায় বড় ঘরের ছেলে, শিকারের সঁখ মিটাতে এসেছেন, আপনাদের কী দায় পড়েছে আমার জন্যে এই বিপদে মিছিমিছি জড়াতে।

গোপাল বলল, দায় না পড়লেও তো মানুষকে শুধুমাত্র মনুষ্যত্বের কারণেও কিছু কিছু কাজ করতে হয় আলি সাহেব। নইলে আমরা মানুষ কীসের?

এমন ভাবেই গোপাল ডায়ালগটা ঝাড়ল উর্দু-মিশ্রিত হিন্দিতে যে আমার মনে হল যেন হিন্দি সিনেমার হিরোই কথা বলছে।

জিপটা ঠেলে ব্যাক করে তারপরেও ঠেলে বেশ কিছুটা এগিয়ে নিয়ে স্টার্ট করতেই লট্রা বলল, লেহ্ লা আভি আভূভিতো জান বাঁচ গ্যয়া। সামমে হাম ঔর নেহি আবেগা। ভুখভি লাগলথু জোর।

তারপরই সুর করে দু’লাইন গান গেয়ে দিল হাতে তাল দিয়ে, দুদু মুঠি চুড়াহ দিহ, তানি তানি দহি দিহ, ঝাচামাচা! ঝাচামাচা! ঝাচামাচা!

বুঝলাম যে, ঝাচামাচা’টা করতাল-এর আওয়াজ-এর ধ্বনির অনুকরণ।

সফর আলি বন্দুকটি কাঁধে শুইয়ে খোদার কাছে দোয়া মাঙ্গার মতো করে দুটি হাত উপরে তুলে, মির সাহেবের শের আবৃত্তি করলেন,

মুদ্দয়ি লাখ বুঢ়া চাহে তো ক্যা হোতা হ্যায়?
ওবহি হোতা হ্যায় যো মঞ্জুরে খুদা হোতা হ্যায়।

মানে কী হল?

ভটকাই বলল।

 মানে হল, লাখো লাখো শত্রু তোমার খারাপ চাইলে কী হবে, খোদা তোমার জন্যে যা মঞ্জুর করে, মানে, বরাদ্দ করে রেখেছেন, তাই হবে, তাই হবে।

এটা কেন বললেন?

তিতির বলল!

বললেন, কেন না তাঁর ব্যক্তিগত বিপদের সঙ্গে ছেলেমানুষ, কলকাতা থেকে আসা আমরা যে এমন করে স্বেচ্ছায় জড়িয়ে পড়ব এ তো খোদারই দোয়া। এবং আশীর্বাদ। অর্থাৎ, ঈশ্বর তোমার সহায় হলে তোমার কোনও ভয় নেই।

লটকা বলল, এ বাবু, ওয়াক্ত কিতনা হুয়া আভভি?

কাহে?

নেহি, সীমারিয়ামে গিরধরকি দুকান মে সাড়ে সাত বাজিমে বড়ি আচ্ছা হিংকি কচৌরি ঔর চানা কি ডাল বনতা হ্যায়, সাথমে বড়ি মিঠি কালাজামুন! বড়হি ভুখ লাগলথু বাবু!

গোপাল হেসে বলল, চলো, ভুখ সব্বেকি লাগা হ্যায়।

আমি জোরে অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিয়ে একেবারে ‘টিকিয়া-উড়ান’ ছোটালাম জিপ। খিদে আমাদের সকলেরই লেগেছিল। খিদের চেয়েও যেটা বেশি পীড়িত করছিল আমাকে, তা রাতের বেলার ক্রিয়া-কৌশল। ভগবান করলে আমরা আজই পিপ্পাল পাঁড়েকে ধরব। ভাবছিলাম, ধরতে পারলে সুব্রতর বাবা, হাজারিবাগের পুলিশ সাহেব মেসোমশাই আমাদের নিয়ে কী করবেন। আর তা না দেখে, আমাদের জিগরি দোস্ত সুরবোতো বাবু আর গার্জেন-ফিলসফার নাজিম সাহেবই বা কী বলবেন আমাদের।

.

০৭.

গিরধর-এর দোকানে হিং-এর কচুরি, ছোলার ডাল আর কালাজামুন খেতে গিয়েই জানা গেল যে, কাল মাঝরাতে পিপ্পাল পাঁড়ে এবং তার দলবল শেখ রমজান মিঞার বাড়িতে হামলা করেছিল। রমজান মিঞার ছাগলের ব্যবসা এবং সুদের ব্যবসা ছিল। সে বহু দূর দূর ট্রাকে করে ছাগল পাঠাত। তা ছাড়া অনেক জমি ছিল। কোঠা বাড়ি, জিপ গাড়ি। অনেক গরিবকে খরার সময়ে টাকা ধার দিয়ে প্রচণ্ড চড়া সুদ লাগিয়ে তাদের জমি-জিরেত, গয়নাগাঁটি, গোরু-মোষ সব কবজা করে আসছে সে বহুদিন হল। তার উপরে তার দুটো সেয়ানা ছেলে ইমরান আর আক্রাম গরিবের উপরে নানারকম অত্যাচারে তার বাবারও উপর দিয়ে যায় নাকি। রমজান মিঞার সর্বস্ব তো লুটে নিয়েইছে পিপ্পাল, লোহার সিন্দুক ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে তার থেকেও সবই নিয়ে গেছে। তার বড় ছেলের ডান কান আর ছোট ছেলের বাঁ কানটা কেটে নিয়ে গেছে।

পিপ্পাল পাঁড়ে কি কানের লতির চচ্চড়ি খায় নাকি?

আমি বললাম।

গোপাল বলল, হতে পারে। আমরা কচুর লতির তরকারি খাই আর ও কানের লতির চচ্চড়ি খেতেই পারে, কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা আর হলুদ দিয়ে। তা ছাড়া, তার বিবি ও দুই পুত্রবধূরই সামনে রমজান মিঞার লুঙ্গিটাও খুলে নিয়েছে। তার মধ্যে সোনা-রুপোর সব গয়না বেঁধে নিয়ে গেছে। যতক্ষণ না সব কাজ শেষ হয়েছে, ততক্ষণ রমজান মিঞাকে দু’কান হাতে ধরিয়ে উদোম করে মেয়েদের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। অন্য কোনও শারীরিক ক্ষতি করেনি তার। শুধু যাবার সময়ে, পেছনে এক লাথি আর মাথায় একটা উড়নচাঁটি মেরে চলে গেছে।

আমি আর গোপাল যতই পিপ্পাল পাঁড়ের কথা শুনছি ততই তার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। একটা ওরিজিনাল লোক বটে। এরকম ডাকুর সঙ্গে টক্কর দিয়েই তো আরাম।

তিতির বলল, ঋজুকাকা, তোমরা সেবারে স্কুল-ফাইন্যাল পরীক্ষা দিলে সবে। এখনকার মা-বাবারা তো স্কুল-ফাইন্যাল পাশ ছেলেদের নিয়ে পুতুপুতু করে নিজেরাই গাড়ি বা ট্যাকসিতে করে তাদের ভর্তি করাতে নিয়ে যায়। খোকাবাবুরা কী করবে, কী পরবে, কী খাবে সেই চিন্তাতেই তো তাদের ঘুম চলে যায় চোখের আর তোমরা ওই বয়সেই এমন ডেয়ার-ডেভিল হলে কী করে।

ডেয়ার-ডেভিল যারা, তারা ছেলেবেলা থেকেই হয়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সাহস বরং কমে আসে।

গোপাল বলত, আমার বাবাও যদি জেঠুমনির মতো হতেন। জেঠুমনি আমার আদর্শ পুরুষ।

কেন অমন বলত গোপালকাকা?

বলত, কারণ জেঠুমনি বলতেন, শুধু পড়াশোনা করে কিছু হবে না। সব কিছু করতে হবে। স্কোয়ার হতে হবে জীবনে। শুধু বাঙালি মায়েরাই ছিলেন এমন আগে। এখন বাবারাও তেমন হয়েছেন।

কেমন?

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন না? সাতকোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ। বাঙালি করে, মানুষ করোনি’। তখন সাত কোটি ছিল সাতশো কোটি হতে বেশি দেরি নেই। তবে পুতুপুতু করে খোকাদের আঁচলের তলায় আগলে রাখার দিন চলে গেছে। আমার এক বন্ধু ছিল বিনোদানন্দ ঝা। সে বলত, আররে ঋজু, বাঙালি, আদমি বনতা বাঙালকা বাহার যা কর’। কথাটা বোধহয় মিথ্যে বলত না। যে সব বাঙালিরা প্রবাসে আছেন, বাংলার বাইরে চাকরি, ব্যবসা ও শিল্প করেছেন, তাঁরা অধিকাংশই সফল। তোদর এখন এই সব নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে।

তুমি এবার নিজেই ডিরেইলড হচ্ছ ঋজুদা, লাইনে ফেরো।

ভটকাই বলল।

 হ্যাঁ। আসল কথাটা তো বলা হয়নি তোদের।

কী কথা?

আরে গিরধর-এর দোকানে নাস্তাপানি করে যখন বানোয়ারির দোকানে পান খেতে গেছি, তখনই ব্যাপারটা জানা গেল।

আর কত পান খাবে?

সে কথা আর বলিস না। দেড়মাস লেগেছিল পানের লাল ছোপ দাঁত থেকে ওঠাতে আর ঠোঁটদুটো ফেটে চৌচির হয়ে গেছিল।

এবারে বলো, কী তোমার কথা।

হ্যাঁ। যে পিপ্পাল-এর সঙ্গে গতরাতে আমাদের দেখা হয়েছিল, সে পিপ্পাল ডাকু নয়।

মানে?

হ্যাঁ। তার নাম পিপ্পালপ্রসাদ। সে লোকটা গুণ্ডা প্রকৃতির। কথায় কথায় হাত চালিয়ে দেয়, তিরিক্ষি তিরিক্ষি কথা বলে, বিনা কারণে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে। তবে সে ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ে আদৌ নয়। ডাকুর নাকি ছোটখাটো চেহারা, মানে রোগা-পাতলা। নিরামিষ খায়। লম্বাতে নাকি গোপালের মতো হবে। ভারি মিষ্টি ব্যবহার, মিতভাষী কিন্তু কেউ ত্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই কি বেগড়বাই করলে তার রাইফেল বা রিভলবার থেকে গুলি চালিয়ে খুপরি উড়িয়ে দিতে এক মুহূর্ত দেরি করে না।

শুনে তো আমরা থ! আমার তখনই মনে পড়ল, সেই কাক-ভোরে দেখা তার চেহারাটার কথা।

সফর আলি স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলল বানোয়ারিকে, তুম ঠিকে বোল রহা হ্যায় ভাইসাব?

আররে! পান এগিয়ে দিতে দিতে বানোয়ারি বলল, যো ডাকু কি শরপর দশ হাজারি ইনাম লাগা হুয়া হ্যায় তার এমন বোকামি হবে যে নিরস্ত্র অবস্থায় সাইকেল চড়ে এবং একা একা আমার দোকান থেকে পান খেতে আসবে? তা ছাড়া ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ে পান খায়ই না। সে খুব ধার্মিক লোক। সকাল সন্ধে মা দুর্গার পুজো করে। কখনও দুর্বল বা নিরপরাধীর উপরে অত্যাচার, এমনকি খারাপ ব্যবহারও করে না। পিপ্পালপ্রসাদ অভ্র খাদানে যা পয়সা করেছে তার চেয়ে বেশি করেছে গোমোবারকাকানা লাইনে ওয়াগন ভেঙে কয়লা চুরি করে। তারপরে যেখানে রেললাইনই নেই ধারেকাছে, সেই সীমারিয়াতে এসে মস্ত বাগানওয়ালা বাড়ি করে থেবড়ে বসেছে। চাতরার দিকে তার মস্ত ভাণ্ডারও আছে। বড়লোক খুব। কিন্তু অত্যন্তই অসভ্য। ওর সঙ্গে ডাকুর কোনও তুলনাই চলে না।

পিপ্পাল পাঁড়ের মাথার উপরে দশ হাজার ইনাম কেন?

ওর নামে পঁচিশটা খুন, পঞ্চাশটা ডাকাতির মামলা ঝুলছে। পঁচিশটার মধ্যে পাঁচটা খুন পুলিশ। তিনজন কনস্টেবল, একজন জমাদার আর একজন এ.এস.আই।

বানোয়ারি বলল।

কোথাকার এ.এস.আই?

বারিয়াতুর। তাই তো যে পিপ্লালকে জ্যান্ত বা মৃত হাজির করতে পারবে কোতোয়ালিতে তাকেই দশ হাজার টাকা দেওয়া হবে। পরে। বিশেষ অনুষ্ঠান করে। টাকাটা দেবেন চিফ-মিনিস্টার সত্নারায়ণ সিনহা।

.

০৮.

পান খেতে খেতে বাংলোতে ফিরে দেখি, রামখিলাওন বসে মশলা বাটছে মাংস রান্না করবে বলে। কিন্তু আমরা যেতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ইক খাত আয়া হুজৌর।

চিঠি?

কে আমাদের চিঠি লিখতে পারে?

কলকাতার চিঠি নয়তো?

গোপাল চিন্তিত মুখে বলল।

 চাতরা সে শেঠনে ভেজিন ক্যা?

লটকা জিজ্ঞেস করল রামখিলাওনকে।

রামখিলাওন বলল, নেহি লটকা বাবু। ইক আনজান আদমি ঘোড়ে পর আয়াথা ইয়ে খাত লেকর। খাত দেকর তুরন্ত ঘোড়েপর চল দিয়া। ঔর ঈ দেখিয়ে লাড়ু দেকে গিয়া আপলোঁগোকি লিয়ে।

লাড্ডু! ম্যায় আভভি খায়গা। বলেই, লটকা বলল, কাঁহা, রাখখা কাঁহা?

 সফর আলি হাঁ হাঁ করে উঠল। বলল, খেয়ো না। নিশ্চয়ই বিষ মিশানো লাড্ডু।

রামখিলাওন বলল, আমি তো তোমার জন্যে জলখাবার করিনি। আমি তো আপনাদের অনুমতি ছাড়াই চারটে খেয়ে নিয়েছি। চমৎকার লাড্ড। বিষটিষ তো মেশানো নেই!

দিয়েছে কে?

 চিঠি আছে। আমি কি লেখাপড়া জানি। ওই যে, টেবিলের উপরে আছে পড়ে দেখুন।

সফর আলি চিঠিটা তুলে নিয়ে খাম খুলে পড়ল। কোনও সম্বোধন নেই, কারও নাম নেই। তুলোট কাগজে দোয়াতের কালিতে কলম ডুবিয়ে লেখা।

পররনাম!

গতবছর শীতে আপনারা এই জঙ্গলেই কাঠুরেদের একশো টাকা দিয়ে গেছিলেন। সেই রাতে খাওয়া-দাওয়া নাচ-গান খুব হয়েছিল। আমিও এসেছিলাম। তখন আপনারা এলে দেখা হত।

এবারে আবার এ জঙ্গলে এসেছি সাতদিন হল। সকালে অত কষ্ট করে ওই পথ দিয়ে এলেন কেন? একটা শর্টকাট আছে টুটিলাওয়া থেকে তিনমাইল আগে। একটা মস্ত শিমুল গাছের পাশ দিয়ে গোরুর গাড়ির চাকার দাগ আর ঘোড়ার খুরের দাগ দেখতে পাবেন। ওই পথ দিয়ে আজ সন্ধেবেলাতে আসুন। আলাপ তো হবেই, তার সঙ্গে হরিণের মাংসও থাকবে শুখা-শুখা। আমি যদিও নিরামিশাষী।

বন্দুক নিয়েই আসবেন। ভয় নেই। আমি কেড়ে নেবে না। বন্দুক রাইফেলের অভাব নেই আমার। তবে করণপুরা থেকে কী করে একটা বড় দাঁতাল হাতি এসেছে এই জঙ্গলে। বোধহয় দল থেকে বিতাড়িত। মাঝে মাঝে ওই পথটি আগলে দাঁড়িয়ে থাকে। আমাদের ঘোড়াগুলো খুবই ভয় পায়। ওই হাতির জন্যই আনতে বলছি বন্দুক। যদি পথে ঝামেলা করে।

সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা একজন নিরস্ত্র অনুচর ওই সিমুল গাছটির নীচে আপনাদের অপেক্ষাতে দাঁড়িয়ে থাকবে। তার নাম শিউপূজন। ওকে জিপে তুলে নেবেন, তাহলে চিনে আসতে অসুবিধে হবে না। যদি চা খান তাহলে সঙ্গে করে চায়ের পাতা একটু নিয়ে আসবেন। আমাদের চা-পাতা ফুরিয়ে গেছে।

আশা করি আজ সন্ধেতে দেখা হবে।

চাতরা থেকে একটু লাড্ড এনেছিলাম। আপনাদের জন্য পাঠালাম।

পররনাম ইতি–শ্রী পিপ্পাল পাণ্ডে।

 তারপর? বলো ঋজুদা। তীরে এসে তরী ডুবিয়ো না।

ভটকাই বলল।

 আজ্জু বলল, আব্বা জানতে থে কি আপলোঁগোকি ইসব হরককি বারে মে?

জরুর। মগর বাদমেহি না জানা উনোনে।

 অজিব বাত হ্যায়। কভি হামলোগোঁকি বতায়া নেহি থে।

তারপর একটি মিটিং বা কনফারেন্স যাই বলল, হল। লটকা এবং রামখিলাওন বলল, আপলোগোঁকি কানসে ভুজা বনাকর খায়েগা পিপ্পাল। মত যাইয়ে মরনেকে লিয়ে।

গোপালেরও ইচ্ছা ছিল না যাবার। ভয়ে নয়। গোপাল ভিতু ছিল না। ও বলল, কী দরকার! হেরে তো আমরা গেছিই। আমরা কোথা দিয়ে গেছি, এঞ্জিন বন্ধ করে, ঠেলে গাড়ি ব্যাক করে দূরে এসে এঞ্জিন স্টার্ট করেছি, কখন এসেছি, কখন গেছি সবই সে জানে। ইচ্ছে করলে তখনই সে এবং তার দলবল আমাদের মেরে দিতে পারত। বন্দুকগুলো নিয়ে নিতে পারত। কিন্তু তা না করে সে আন্তরিকভাবে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। লাড্ড পাঠিয়েছে। গতবার তুমি যে একশো টাকা দিয়েছিলে কাঠুরেদের সে কথা উল্লেখ করেছে। সে রাতে নাজিম সাহেব আমাদের আটকে না দিলে, মোলাকাত হয়েই যেত। আবার গিয়ে কী হবে! সে যে আলতু-ফালতু ডাকাত নয়, হাজারিবাগ-এর রবিন হুড তা তো বোঝাই গেছে।

তবুও যে ডাকাতের মাথার উপরে দশ হাজার টাকার পুরস্কার ঝুলছে তার সঙ্গে মুখোমুখি আলাপ করাও তো একটা অভিজ্ঞতা!

আমি বলেছিলাম।

লটকা বলল,কাহেলা ঝুঠঠো জানকি খাতরে মে ফাঁসিয়েগা? চালিয়ে, ম্যায় আজ রাতমে আপলোঁগোকি লিয়ে ছাত্ৰুকি লিট্টি পাকায় গা। সাথমে নই আমকি খাট্টা-ধনিয়া-পাত্তি ঔর হারা-মিরচা ডালকর। খাসিকি মাস-ভিতো রহিবেই করে গা। রাবড়ি ভি তো হ্যায়। ঔর চাহিয়ে ক্যা?

সফর আলি রেগে বলল, ম্যায় আভি যাকর চন্দনবাবুকি বাতাতা যো তুম হিয়া আকর মেহমানলোঁগোকি তংক কর রহ্যাঁ হ্যায়।

তারপর বলল, তোর মতো পেটুক আমি জন্মে দেখিনি। আরও যদি খাওয়া-দাওয়া করিস তো তোর পেটটাই ফাঁসাবো একদিন।

গোপাল বলল, পেট না ফাঁসালেও প্যাংক্ৰিয়াটাইটিস হতে পারে যে কোনও সময়ে।

লটকা বলল, লেহ লটকা। ক্যা টাইটিস বোলা খোকাবাবু আপনে?

প্যানক্রিয়াটাইটিস।

সফর আলির দিকে চেয়ে মুখে আরও দুটো পান আর একমঠো কালি-পিলি জরদা ফেলে লটকা বলল, বহত কিসিমকি বিমারিকি কা বারেমে শুনা মগর এইসি টাইটিসকি নাম কভূভি নেহি শুনা।

গোপাল বলল, সন্ধেবেলা চলো, পিপ্পাল পাঁড়ের জন্যে ভাল মিষ্টি-টিষ্টি কিনে নিয়ে।

তাহলে? যাবে না বলছিলে যে?

যাব নাই তো।

মানে?

মানে, ওই শিমুলতলিতে ওই লোকটির হাতে মিষ্টি দিয়ে চলো চলে যাই হাজারিবাগ। কতদিন চমনলাল-এর খিচুড়ি খাই না, নাজিম সাহেবের হাতের বিরিয়ানি আর চাঁব আর পায়া আর লাব্বা। ওখানে গিয়ে জিপ ছেড়ে দেব। আলি সাহেব এবং লটকা রাতটা আমাদের অতিথি হয়ে হাজারিবাগেই কাটিয়ে কাল সকালে ফিরে এসে রামখিলাওনকে তুলে নিয়ে ফিরে যাবেন চাতরা।

বাঃ। জিপটা চালিয়ে আসবে কে?

তাহলে চন্দনমনলবাবুকে বলে একজন ড্রাইভার নিতে হয়। তাহলে ওঁদের হাজারিবাগ অবধি যেতেও হবে না। ড্রাইভার আমাদের হাজারিবাগ ছেড়ে রাতেই না হয় ফিরে আসবে এখানে। তারপর কালকে আলি সাহেব, লটকা আর রামখিলাওন চাতরা ফিরে যেতে পারবেন বাস-এ। কিন্তু.

আবার কিন্তু কী?

গোপাল বলল।

এমন একটা সুযোগ হাতছাড়া করা কি ঠিক হবে? যাকে বলে এক্সপিরিয়েন্স অফ আ লাইফ টাইম।

গোপাল বলল, আমরা তো তাকে ধরে নিয়ে যেতে বা মারতেই এসেছিলাম। মন থেকে তা যখন করতে সায় পাচ্ছি না, অথবা অন্যভাবে বললে বলতে হয়। সাহসও পাচ্ছি না তার অতন্দ্র প্রহরা দেখে, তখন মিছিমিছি দেখা করতে গিয়ে লাভ কী? তার মহত্ত্ব সম্বন্ধেও তো আমাদের কারও কোনও সন্দেহ নেই। তা ছাড়া সে যা করছে তাকে নীতিগতভাবে আমরা সমর্থন করলেও আইন নিজের হাতে নেওয়াটা তো দণ্ডনীয় অপরাধ অবশ্যই। যে পঁচিশটা খুন করেছে, সে খুন যে উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকুক না কেন, আইনের চোখে সে তো অপরাধী বটেই। তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু শুধুমাত্র দেখা করতে যাওয়ার কি কোনও মানে হবে?

ওরা তিনজনেই গোপালের মতেই সায় দিল। আমি একা হয়ে গেলাম।

তাহলে চলো, চন্দনমলবাবুকে বলে আসি ড্রাইভারের জন্যে। আমরা কয়েকদিন হাজারিবাগে থেকে, কুসমভাতে শিকার করে, মোরব্বা ক্ষেতে তিতির-খরগোস মেরে সারিয়া হয়ে ট্রেনে ফিরে যাব কলকাতা।

চন্দনমলবাবুর কাছে লটকা বা সফর আলি তো যেতে পারবে। যদি এখানে আর নাই থাকা হয়, এই সারাদিনটা এই সীমারিয়ার ডাকবাংলোতে আলসে-বিলাসে কাটানো যাক, গাছের ছায়াতে, চড়াইদের লড়াই দেখে।

মন্দ বলোনি ঋজু।

গোপাল বলল।

আমরা সফর আলিকে বলে দিলাম যে, ফেরার সময়ে গিরধরের দোকানে বলে আসতে, ভাল মিষ্টি, ভাল করে প্যাক করে যেন রাখে, কালাকাঁদ আর গোলাবজামুন চার চার করে আট কেজি। আমরা সন্ধের সময়ে টাকা দিয়ে তুলে নিয়ে যাব।

সফর আলি বলল, চল রে লটকা। হামারা বাত গিরধর সায়েদ মানেগা নেহি। ইতনা আচ্ছা তো জানতা নেহি না মুঝকো।

গোপাল দুটো দশ টাকার নোট দিয়ে বলল, ঈ লিজিয়ে চাচা। অ্যাডভান্স দে দিজিয়ে গা। রুপাইয়াসে জাদা জান-চিন ঔর কওন চিজ সে হোতা বানিয়ালোগোঁকো ইস দুনিয়ামে।

ঈ বাত তো সাহি।

লটকা বেঁচে গেল নড়াচড়া করার হাত থেকে।

সে বলল, আনেকা ওয়াক্ত, জারা কালি-পিলি জরদা লেকর আনা চাচা। পান কাফি হ্যায়, জরদা খতম হোনেওয়ালা হ্যায়।

.

সন্ধের মুখে মুখে সফর আলি আর লটকার এবং রামখিলাওন-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গিরধর-এর দোকান থেকে মিষ্টি উঠিয়ে হাজারিবাগের দিকে যাব বলে বেরোলাম। জিপের এঞ্জিন স্টার্ট করার আগে সফর আলি হাত মিলিয়ে বললেন, সত্যি করে বলুন তো খোকাবাবুরা আপনারা কি শিকার খেলতেই এসেছিলেন, না ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের সঙ্গে টক্কর দিতে?

গোপাল বলল, শিকার করতেই তো এসেছিলাম, কিন্তু..

সফর আলি বুঝি-হাসি হাসলেন একটু। তারপর দুজনের সঙ্গেই হাত মিলিয়ে বললেন, খুদাহ হাফিজ। ইনশাল্লা, ফিন ভেট হোগা।

জরুর।

আমরা বললাম।

লট্‌কা, বাঘের দুই থাবার মতো দু’হাত জড়ো করে বলল, পররনাম খোকাবাবু লোগ। এইসা হিম্মৎদার খোকাবাবু হাম কভূভি না ভেটিন।

মানে, এমন সাহসী খোকাবাবু আমি কখনও দেখিনি। রামখিলাওনও বলল, পররনাম বাবু। ফিন আইয়েগা।

.

শিমুলতলিতে ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের লোকটি কিন্তু ঠিক দাঁড়িয়েছিল। আমরা জিপ দাঁড় করিয়ে জিপ থেকে নেমে তাকে ভাল করে বুঝিয়ে ব্রুকবণ্ডের রেড-লেবেল চা পাতার একটা বড় প্যাকেট এবং মিষ্টির হাঁড়ি দিয়ে বললাম, পিপ্পালবাবু যেন আমাদের ক্ষমা করেন। আমাদের সোজা হাজারিবাগ চলে যেতে হচ্ছে। একজন বন্ধুর অসুখের খবর পেয়ে। পরের বার এলে অবশ্যই দেখা হবে।

তারপরে বললাম, এতগুলো জিনিস একা নিয়ে যাবে কী করে?

ও বলল হাতের লাঠি দেখিয়ে, এটাতে বাঁকের মতো ঝুলিয়ে নেব।

হাতি পড়ে যদি পথে।

পড়লে পড়বে বাবু। আমাদের তো হাতি, বাঘ, পুলিশকে নিয়েই ঘর করতে হয়। অত ভাবলে কি আমাদের চলে।

ভাল করে বুঝিয়ে বলবে তো?

জরুর। তবে পিপ্পাল খুব আশা করেছিল আপনাদের। নিজের হাতে খিচুড়ি রাঁধছে সে বিকেল থেকে ইন্তেজাম করে।

আমরা বললাম, মাপ করো ভাই।

গোপাল একটা দশ টাকার নোট দিয়ে বলল। খইনি খেয়ো।

না। পিপ্পাল শুনলে খুব রাগ করবে।

ভালবাসার জিনিস কখনও ফেরাতে নেই।

হাজারিবাগে রাত সাড়ে আটটারও আগে পৌঁছে যাওয়া উচিত। কিন্তু টুটিলাওয়া ছাড়িয়ে মাইল পাঁচ সাত যাবার পরই পুলিশের ট্রাকের একটা কনভয় পাস করল বলে জিপ সাইড করে দাঁড়াতে হল। দশ ট্রাক ভর্তি আর্মড পুলিশ। আমাদের সঙ্গে বন্দুক দেখে একজন অফিসার, কোতোয়ালির ঘোট দারোগা হবেন, নেমে এসে আমাদের চ্যালেঞ্জ করলেন।

গোপাল বলল, আমরা এস. পি. চ্যাটার্জি সাহেবের ছেলে সুব্রতবাবুর দোস্ত। হাজারিবাগে নিজেদের বাড়িতে যাচ্ছি।

শুনেই তক্ষুনি ছেড়ে দিলেন ছোট দারোগা আমাদের।

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। পিপ্পাল পাঁড়ে কি জানতে পেরেছিল যে মস্ত বড় ফোর্স আসছে তার মোকাবিলা করতে? তাই কি আমাদের হোস্টেজ হিসেবে ধরে রেখে সে পুলিশের সঙ্গে দরকষাকষি করত?

গোপালও সে কথাই ভাবছিল, মুখ দেখে মনে হল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না।

সাড়ে আটটার আগেই গয়া রোডের উপরে গোপালদের ছবির মতো বাড়ি পূর্বাচল-এ পৌঁছে গেলাম আমরা। তারপর ড্রাইভারকে বকশিস দিয়ে বললাম, তুমি রাতটা এখানেই থেকে যাও না।

ও বলল, চন্দনমলবাবু জানেন, যে রাতেই ফিরব। চিন্তা করবেন। চলেই যাই।

যা ভাল মনে করো।

চমনলাল আমাদের দু’জনকে অনেকদিন পরে একসঙ্গে দেখে খুব খুশি হল।

গোপাল অর্ডার দিল, মুঙ্গকা ডালকি খিচড়ি বানানা।

 তারপর বলল, কপালে নেই ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের নিজহাতে বানানো খিচুড়ি খাওয়া, তার কী আর হবে!

আমি বললাম, গোপালবাবু, কপালে গোপাল করে!

গরম জলে স্নান করে, গল্প-টল্প করে, খেয়ে-দেয়ে শুতে শুতে এগারোটা বাজল।

.

০৯.

সকালে উঠে আমরা বাইরের বারান্দাতে বসে আছি, চমনলাল চায়ের পট, দুধ, চিনির পট সব ট্রেতে করে সাজিয়ে এনে রাখল টেবল-এর উপরে। চায়ের ব্যাপারে গোপাল খুবই শৌখিন। ছিল। সব ব্যাপারেই সে শৌখিন ছিল খুবই।

চা ঢালছে কাপে গোপাল এমন সময়ে করম মালি এল, গেট খুলে।

সে বলল, নমস্তে বাবু।

আজকে এত দেরি করে এলে করম? আমরা যে আসব তা অবশ্য তুমি জানতে না। গোপাল বলল।

না বাবু। আমি তো রোজই ছটার সময়েই আসি। নইলে কি আর বাগান এত সুন্দর থাকত?

তবে আজ দেরি করলে বড়?

কোতোয়ালিতে সারা শহর ভেঙে পড়েছে বাবু। তাই দেখে এলাম আমিও।

কী দেখে এলে?

ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ে আর তার আটজন সঙ্গীর লাশ। ভোর তিনটের সময় এসেছে লাশ। হাজারিবাগ কোতোয়ালি থেকে দশ ট্রাক রাইফেলধারী পুলিশ গেছিল। আর চাতরা থেকে এসেছিল পাঁচ ট্রাক। দু’ ট্রাক এসেছিল চান্দোয়া-টোড়ি থেকে। উনিশটা গুলি লেগেছে শরীরে। গোলিসে বিলকুল ভুঞ্জ দিয়া। তিনদিক, থেকে পিপ্পালকে ঘিরে ফেলে গুলি করে মেরেছে পুলিশ। রাত একটার সময়ে খোদ পুলিশ সাহেব জিপে করে গেছিলেন।

কোথায় লড়াই হল?

 সীমারিয়া আর টুটিলাওয়ার মধ্যের জঙ্গলে। ডাকুর ডেরাতে।

পাঁচজন পুলিশও মারা গেছে। কোতোয়ালির ঘোট দারোগা গজানন ঝাঁও মারা গেছেন।

আমি দেখলাম, ডান হাতে চা ঢালতে থাকা গোপালের হাতটা কেটলিসুদ্ধ কাঁপছে।

আমি চুপ করে রইলাম।

গোপাল বলল, তোমারটা তুমি ঢেলে নাও ঋজু।

বৈশাখের ভোরের ফুলগন্ধবাহী হাওয়া বইছিল গোপালদের পূর্বাচল’-এর উক্যালিপটাস গাছেদের সুগন্ধি ঝরা-পাতা আর নানা ফুল আলতো হাতে ঝাঁট দিয়ে।

চায়ের কাপ মুখ দিয়েও নামিয়ে রাখলাম। সম্ভবত আমাদের দেওয়া চাটা খাওয়ার অবকাশ আর হয়নি পিপ্পালের। ভাবছিলাম, পুলিশের চোখে, সমাজের চোখে সে জঘন্য অপরাধী কিন্তু হাজার হাজার গরিব, মূক, সহায়হীন অত্যাচারিতদের কাছে সে ছিল আশার আলো। এই পৃথিবীতে সে জঘন্য অপরাধীদের কলঙ্ক গায়ে মেখে মরল বটে কিন্তু স্বর্গের দ্বারে তার জন্যে মঙ্গলধ্বনি বাজছে এতক্ষণে।

গোপাল হঠাৎ বলল, কত মানুষ জন্মাচ্ছে, মরে যাচ্ছে, কে তাদের খোঁজ রাখে। কিছু কিছু মানুষ, খুব কমই মানুষ, কোনও বিশেষ কাজ নিয়ে পৃথিবীতে আসে। তারা নিজেদের জন্যে বাঁচতে আসে না এখানে, অন্যদের জন্যে মরতে আসে। এরাই তো মানুষের মতো মানুষ। কী বলে?

আমি আর কী বলব। আমার গলা বন্ধ হয়ে এসেছিল। কিছুই না বলে আমি লালমাটির প্রান্তর পেরিয়ে দূরের সবুজ মোরব্বা ক্ষেতের দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইলাম। দু’জনের চায়ের পেয়ালাই পড়ে রইল।

চমনলাল এসে বলল, চায়ে তো ঠাণ্ডা হো গ্যয়ে। ফিন লা রহা হ্যায়।

গোপাল তার বাঁ হাতের পাঁচখানা আঙুল দেখিয়ে মুখে কোনও কথা না বলে, তাকে ইশারাতে বলল, পরে।

ঋজুদার ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের গল্প শেষ হয়ে যাবার পরে হাজারিবাগের সেই দুঃখভরা বৈশাখী সকালটি যেন আমাদের সকলেরই বুকের মধ্যে উঠে এল।

আমরা সকলেই চুপ করে বসে রইলাম।

এমনকি নাজিম সাহেবের বড় ছেলে আজ্জু মহম্মদও।

 ঋজুদা বলল, অনেকই কথা, অনেককেই বলার জন্যে ভিড় করে এল আমাদের দু’জনেরই বুকের মধ্যে। কিন্তু আমরা নীরবেই বসে থাকলাম।

গোপাল বলল, আমাদের যাওয়া উচিত ছিল ওর কাছে। মরে যাবার সময় কী ভাবল পিপ্পাল পাঁড়ে আমাদের? ছিঃ!

আমি বললাম, ভাবল, আমরাই বিশ্বাসঘাতক! ভাবল আমরাই খবর দিয়েছি হাজারিবাগের কোতোয়ালিতে, ওর ডেরার হদিশ জানিয়েছি।

গোপাল ভারি গলাতে বলল, জানো ঋজু, এর চেয়ে ওর পাশে থেকে পুলিশের সঙ্গে লড়াই করে মরে যাওয়াই ভাল ছিল আমাদের। মরতে তো একদিন সকলকেই হবে কিন্তু কে কী ভাবে, কোন বিশ্বাস বুকে নিয়ে মরল, সেটাই আসল কথা।

আমি চুপ করে রইলাম।

 কী বলব! কাকে বলব!

 যাকে অনেক কথাই বলার ছিল, সে তো তখন শব হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *