২.৪ হাঁসুলী বাঁকের রাত্রির অন্ধকার

হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় দিন গেলে যে-রাত্রি নেমে আসে, তার সঙ্গে জাঙল-চন্দনপুরের রাত্রির অনেক তফাত। বাঁশবন যোগান দেয় তার তলায় লুকিয়ে-থাকা আদ্যিকালের অন্ধকার রাত্রির অন্ধকারের সঙ্গে। তার মধ্যে ঝিঝি ডাকে, হরেক রকম পোকা ডাকে, তক্ষক ডাকে টক্ট শব্দ। করে, পাঁচা ডাকে কাঁচ কাঁচ শব্দে, আবার গভীর রাত্রে ডাকে হুম-হুম পাখি। বাঁশবনে পাতা উড়িয়ে নেচে বেড়ায় ‘বা-বাউলী’ অর্থাৎ অপদেবতা। নদীর ধারে ধারে ‘দপদপিয়ে’ অর্থাৎ দপদপ করে জ্বলে বেড়ায় ‘পেত্যা’ অর্থাৎ আলেয়া। মধ্যে মধ্যে শাকচুরি ১ ত ডাক শোনা যায়। শ্যাওড়া-শিমুলের মাথা থেকে। বাঁশবনে কাঁ-ক্যাক কাঁ-ক্যাক ডাক ওঠে, কাহারেরা মনশ্চক্ষে স্পষ্ট দেখতে পায়—গেছে পেত্নী কি কোনো ছোকরা ভূত শের ডগাটা একবার মাটিতে ঠেকাচ্ছে, আবার ছেড়ে দিচ্ছে—সেটা উঠে যাচ্ছে সোজা উপরে। সেটা ওদের খেলা।

হাঁসুলী বাঁকের কাহারেরা তারই মধ্যে কেরোসিনের ডিবে জ্বেলে কত্তাঠাকুরের নাম নিয়ে কোনোমতে জটলা পাকিয়ে বসে থাকে। ছেলে-ছোকরারা ঢোল বাজিয়ে কখনও গায় ধর্মরাজের বোলান, কখনও গায় মনসার ভাসান, ভাদ্রমাসে ভাদু-আঁজোর গান, আশ্বিনে মা দশভুজার পুজোয় গায় পাঁচালি, কার্তিক থেকে মাঘ ফাল্গুন পর্যন্ত শীত-তখন গানবাজনার আসর আসে ঢিমিয়ে, ধান-কাটা ফসল তোলার সময়। চৈত্রে আবার নতুন করে আসর বসেঘেঁটুর গান, সংক্রান্তির কাছাকাছি বসে গাজনের, বোলানের গানের পালা।

মাঝে মাঝে এরই মধ্যে আসে দু-দশটা রাত্রি, যার সঙ্গে অন্য সকল রাত্রির কোনো মিল নাই। বিয়েশাদির রাত্রি, আর বার মাসে বারটা পূৰ্ণিমা কি ‘চতুকদশী’র রাত্রি, তার মধ্যে আষাঢ়-শাওন-ভাদরের ‘ডাউরী’ অর্থাৎ বাদল-লাগা পূর্ণিমা ‘চতুকশশী’ বাদ। বাকি পূর্ণিমায় জ্যোৎস্নার আলো ঝলমল করে। সেই কয়েকটা রাত্রে আমোদ লাগে, একদিকে আলো অন্যদিক অন্ধকার—বাশবনের আদ্যিকালের অন্ধকার সেই কয়েকদিন ঘুমিয়ে থাকে বাঁশতলার জটপাকানো শিকড়গুলোর মধ্যে, কত কালের ঝরা বাঁশপাতার বিছানায়।

করালী ও পাখীর বিয়েতে বাঁশবনের অন্ধকার ঘুটে-কেরোসিনের লালচে আলোর ছটায় ঘুমিয়ে থাকল কদিন। ঢোল-কাসি-সানাইয়ের বাজনা আর মেয়েলি মিহি গলার গানের কাছে হার মানলে—ঝিঝি, পাঁচা, তক্ষক, পোকামাকড়, এমনকি অপদেবতারা পর্যন্ত।

বিয়ে চুকে গেল। কেরোসিন-ভেজানো ঘুটের ছাইগুলি পর্যন্ত সাফ করে সারকুড়ে ফেলে দেওয়া হল, হাঁড়িগুলির কতক ফেরত গেল আবগারি দোকানে, কতক খালি হয়ে পড়ে রইল। উঠানের পাশে। কাহারপাড়ার লোকদের শরীর থেকে তেল হলুদ মিলিয়ে গেল—আবার অঙ্গে লাগল মাঠের ধুলো, মাথায় লাগল খড়ের কুটো। শুধু কাপড়ে এখনও ধুলো-ময়লার মালিন্যের মধ্যেও হলুদ ও লাল রঙের ছোপ লেগে আছে। বায়েনরা সঙ্গে সঙ্গেই বিদেয় হয়েছে; কাহারপাড়া প্রায় নিঝুম। শুধু নয়ানের মা আজও থামে নাই, সে গালিগালাজ দিয়েই চলেছে। তার আক্রোশ যেন বনওয়ারীর উপরেই বেশি। সে অভিসম্পাত দেয়—যে ‘ঘরভাঙাদের মাতব্বরি ঘুচিয়ে তাদের বউ কেড়ে অন্য জনাকে দিলে, পাতা ঘর ভেঙে দিলে, তার ঘরও ভাঙবে ভাঙবেভাঙবে। হে কত্তাঠাকুর! হে বাবা গোঁসাই! বিচার কর, তুমি এর বিচার কর।

মধ্যে মধ্যে বলে মনে পড়ে না! সেসব দিন মনে পড়ে না! বলতে বলতে নয়ানের মা কেঁদেও ফেলে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। জল মুছে সে আগুনের মত তপ্ত গলায় বলে আমার সব্বনাশ করতে আজ সাধু সেজেছে!

তা দিক। কাহারেরা পুরনো গালাগালিতে কোনো কালে কান দেয় না। তার উপর এসে পড়েছে কাজ। উদয়াস্ত কাজ। গম কাটা, সরষে কাটা আরম্ভ হল। ওদিকে জাঙলে শাল আরম্ভ হয়েছে। আখ কেটে মাড়াই করে গুড় তৈরি করার আয়োজন। জাঙলের সদ্‌গোপ মহাশয়দের কৃষাণ কাহারেরা, তারাই লাগিয়েছে আখ।

এ কাজ আগে রতন কাহারদের ঘরে বাধা ছিল। দিনরাত্রি আখ কাটা চলেছে, খোসা ছাড়াচ্ছে, বোঝ বাঁধছে, মাথায় বয়ে এনে ফেলেছে মাড়াই কলের সামনে। পেল্লাদ বসেছে। কলের সামনে, সে-ই কলে যুগিয়ে দিচ্ছে আখ। হুঁশিয়ারির কাজ, একটু বেশ হলেই কল আঙুল টেনে নেবে; গরু থামাতে থামাতে গোড়া পর্যন্ত আঙুল চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে কেটে পড়ে যাবে। ওই রতনের বাবার নাম ছিল ‘কলকাটা’; কলে তার চারটে আঙুল কেটে গিয়েছিল। শুধু বেঁচেছিল বুড়ো আঙুলটি। রসিক লোক ছিল রতনের বাপ। সে বলত—আঃ, বুড়ো আঙুলটা আমাকে লবডঙ্কা দেখাতে বেঁচে গেল! চার-চারটে আঙুল গেল, ডান হাতটি খোড়া হল—বেঁচে রইল বুড়ো আঙুলটি! হে কত্তাঠাকুর! ‘শ্যাষ-ম্যাশ’ এই কল্লা বাবা!

তবে কিনা মনিব মহাশয়েরা দয়ালু, ওই কত্তাঠাকুরের পরই যদি কেউ জগতে ‘রাখলে রাখতে মারলে মারতে পারেন, সে ওই মনিব মহাশয়েরা। দয়ালও বটেন আবার দণ্ডও দেন। রতনের বাপের মনিব দয়া করেছিলেন, ছেরজনম রতনের বাপকে মাসে পাঁচ শলি অর্থাৎ আড়াই মন ধান আর এক টাকা ব্যাতনে’ গরুবাছুরের সেবার তদ্বির আর চাষবাসের দেখাশুনা করতে চাকর রেখেছিলেন। রতনের বাপ অবিশ্যি ক্রমে ডান হাতের ওই বুড়ো আঙুলের জোরেই কায়দা করে কাস্তে ধরে খড়ও কাটত, অল্পস্বল্প সময়ের জন্য কোদালও চালাত; লাঙলের মুঠো বা হাতেই ধরে, তবে ডান হাত দরকার গরু চালাবার জন্য, তাও সে সুকৌশলে ওই লবডঙ্কা দেখিয়েই চালিয়ে নিত। মনিব রতনকেও রেখেছিলেন রাখাল, ক্রমে রতন বড় হয়ে সেই বাড়িতেই কৃষণি করেছে। রতনের বাপ রতনকে কলের মুখে যেতে ‘নেষেধ’ করে দিয়েছে, কত্তাঠাকুর নাকি স্বপ্নে তার বংশকে কলের কাছে যেতে বারণ করেছেন; বিশ্বকৰ্মাঠাকুর লোহা-লক্কড়ের দেবতা তার স্থানে অপরাধ করেছিল রতনের বাপ, সে পাপে তার এই শাস্তি; কবে কামারশালায় ফাল। মেরামত করাতে গিয়ে মদের ঘোরে অশুদ্ধ করেছিল বিশ্বকৰ্মার আটন। তার শাস্তিতেই রেহাই নাই-বংশের উপরেও শাপমন্যি পড়ে আছে।

রতন আছে গুড় তৈরির কাজে। গুড় তৈরির ভিয়েনে সকলের উপরে বনওয়ারী; এক হেদো মণ্ডল মহাশয় ছাড়া—জাঙল, বাঁশবাঁদি, কোপাইয়ের ওপারে গোয়ালপাড়া, রানীপাড়া, ঘোষগ্রাম, নন্দীপুর, কর্মমাঠ এই সাতখানা গ্রামে গুড় তৈরির কাজে বনওয়ারীর জুড়ি কেউ নাই। বনওয়ারীর ‘হাতে তোলা’ গুড় ঠাণ্ডা হতে হতে জমতে থাকে ঢেলা বেঁধে হয় মিছরির চাইয়ের মত, দানা হয় মোটা, স্বাদে এমন মিঠা যে চিনি ফেলে সে খেতে হয়; সবচেয়ে বড় গুণ-বছর ধরে রেখে দিলেও গন্ধ হয় না।

মস্ত বড় চুলোয় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, মাথার উপর বাঁশের কাঠামো করে তালপাতা দিয়ে আচ্ছাদন করা হয়েছে একটা। চুলোর সামনে ঢিপির উপর বসেছে বনওয়ারী। চুলোর মুখে আখের খোসা দিয়ে জ্বাল দিচ্ছে রতনের ছেলে লটবর। প্রকাণ্ড কড়াইটার মধ্যে আখের রস জ্বাল। খেয়ে উথলে উথলে উঠছে। বনওয়ারী ছাকনায় ভরে ‘গাদ’ অর্থাৎ ময়লা তুলে একটা টিনে জমা করে রাখছে। ওগুলো খাবে গরুতে। রতন আছে বনওয়ারীর পাশে। মধ্যে মধ্যে বনওয়ারী উঠে সরে দাঁড়ালে সে বসছে তার জায়গায়। মণ্ডল মহাশয়রা একপাশে বসে আছেন। হেদো মণ্ডল আছেন, আরও আছেন জনকয়েক। এবার মণ্ডল মহাশয়দের কড়া নজর গুড়ের উপর। পিথিমীতে যুদ্ধ বেধেছে। যুদ্ধ চলছে—সায়েব মহাশয়দের মধ্যে। জিনিসপত্রের নাকি দর চড়বে! ধান চাল গুড় কলাই সমস্ত কিছুরই দর উঠবে। তাই মণ্ডলেরা ‘সতর’ হয়েছেন, একটি ভাড় গুড় যেন না সরে। সরাবে আর কে? সরাতে তো কাহাররাই। বনওয়ারী মনে মনে একটু ‘বেথা’ পেয়েছে। এতে। অবিশ্যি কাহারেরা সাধু নয়, সবাই অবিশ্যি বনওয়ারী অতন পেল্লাদ নয়; চুরি খানিক আছেক’ করে আর সকলে। কিন্তু যতক্ষণ বনওয়ারী হাজির আছে শালের চালায়, ততক্ষণ কারুর ক্ষমতা নাই এক হাতা গুড় চুরি করে। এ কথা সবাই জানে। তবু বনওয়ারী থাকতে এমন নজর রাখার মানে তো বনওয়ারীকে অবিশ্বাস করা। তা করুন। বনওয়ারী আপন মনেই গুড় তৈরির কাজ করে যায়। সে ভাবে যুদ্ধের কথা।

এ দুনিয়া আজব কারখানা। বৈষ্ণব ফকির গান করতে আসে, তাদের গানে শুনেছে। বনওয়ারী—এ দুনিয়া আজব কারখানা। ফকিররাও কাহারপাড়াতে আসে। তারা বলে— আল্লাতালার আজব কারখানা। তাই বটে। বনওয়ারী মনে মনে স্বীকার করে সে কথা। বাউল আসে, বৈষ্ণব আসে, সন্যেসী আসে, সবাই ওই এক কথাই শুনিয়ে যায়। কাহারেরা শোনে, ভাবে। আগে দেহের খাঁচায় অদেখা অচেনা পরানপাখির কথা ভেবে কথাটা স্বীকার করত। মায়ের ‘গভ্যের মধ্যে বসে কারিগর খাচা তৈরি করে হাড়ের শলা দিয়ে খাচা তৈরি করে পরিপাটি চামড়ার ঘেরাটোপ দিয়ে ঢেকে দেয়, তার মধ্যে সুড়ৎ করে এসে ঢেকে একটি পরানপাখি। সে পাখি নাচে, বুলি বলে, কত রঙ্গ করে। তার পরে আবার একদিন ফুড়ৎ করে উড়ে পালায়। ভেবে ভেবে কূলকিনারা মিলত না, কাহাররা ‘পিতিপুরুষ’ক্ৰমে নীলবর্ণ আকাশের দিকে চেয়ে ‘পরানপাখি’র আনাগোনার পথের দাগ আর সেই আজব কারিগরের আস্তানা খুঁজত; খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে বাবাঠাকুরের বেলতলায় এবং ‘কালারুদ্দে’র দরবারে লুটিয়ে পড়ে বার বার বলত—অপরাধ মাৰ্জ্জনা কর বাবা! কোলের কাছে অন্ধকার, তুমি ‘অইচ’ পক্ষ দিয়ে ঢেকে, বক্ষ দিয়ে আগুলে,—আর তোমাকে আমরা খুঁজে মরছি কোথা কোন বেহ্মাণ্ডে বেহ্মাণ্ডে!

এখন কিন্তু কোম্পানির কলের গাড়িতে, ‘অ্যালের পুলে, তারে তারে টেলিগেরাপে, হাওয়া গাড়িতে—দুনিয়ার আজব কারখানা তারা যেন চোখে দেখছে। তার উপরেও আজব কাণ্ড এই যুদ্ধ! অবাক রে বাবা! কোথা কোন্ ‘দ্যাশে সাত সমুদ্র তের ‘দী’ পারে কে করছে কার সঙ্গে যুদ্ধ, এখানে চড়বে ধানের দর, চালের দর, আলু গুড় কলাই তরিতরকারির দর! জাঙলের সদূগোপ মহাশয়রা কোমর বাঁধছে-টাকা জমাবে; বলাবলি করছে—কাপড়ের দর চড়বে। আবার নাকি কোম্পানিতে যুদ্ধের জন্য চাঁদা আদায় করবে।

তবে কাহারপাড়ায় হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবনের মধ্যে যারা ছায়ার ঘেরায় বাস করে তাদের ভাবনা নাই।

ধান চাল গুড়ের দাম বাড়লে তাদের কিছু লাভ নাই। তারা মনিবের ক্ষেতে খেটে খায়; ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ পায়, তাও ছ মাস খেতে-খেতেই ফুরিয়ে যায়-বাকি ছ মাস মনিবের কাছে ‘দেড়ী’তে ধান নেয়, বেচবার মত ধান চাল তাদের নাই। বেচেও না, কেনেও না। বাড়ির কানাচে শাকপাতা হয়, পুকুরে বিলে নালায় নদীতে শামুক গুলি আছে-ধরে নিয়ে আসে। কয়লার দাম চড়ে; কাহারেরা জীবনে কখনও কয়লা পোড়ায় না, নদীর ধারে ঝোপজঙ্গল থেকে কাঠকুটো কুড়িয়ে আনে; গরুর গোবর ঘেঁটে খুঁটে দেয়, তার দু-চারখানা নিজেরা পোড়ায়-বাকি বিক্রি করে চন্দনপুরে জাঙলে। কাপড়ের দর চড়লে কষ্ট বটে। তাই-বা কখানা কাপড় তাদের লাগে? পুরুষদের তো চাষের সময় ছ মাস অর্ধেক দিন গামছা পরেই কাটে। বাকি অর্ধেক দিনছ হাত মোটা কাপড় পরে।

বছরে চারখানাতে ‘ছচলবছল’ অর্থাৎ সচ্ছল, তিনখানা হলেও চলে যায়। মেয়েরা ‘একটুকুন সাজতে গুজতে ভালবাসে, কোপাই নদীর ‘আলবোডেমি’ তাদের চিরকাল আছে, তাদের দু-একখানা মিহি ফুলপাড় শাড়ি চাই-ই। দুখানা হলেই খুব। বাইরে যাবার সময় পরে। ঘরে মোটা খাটো কাপড়েই চলে। তার জন্যেও খুব বেশি ভাবতে হয় না। ফুলপাড় মিহি শাড়ির দাম যোগাতে হয় না ঘরের কর্তাকে, মেয়েরা ও নিজেরাই রোজগার করে নেয়চন্দনপুর জাঙলে রেজা খেটে, ভদ্রজনের বাবুভাইয়ের কাছ থেকে। আর একটা যুদ্ধ দেখেছে বনওয়ারী। তেরশো বিশ একুশ সাল থেকে আরম্ভ হয়েছিল কয়েক বছরই ছিল; বেশ মনে আছে বনওয়ারীর। ছ টাকা জোড়া কাপড় হয়েছিল। ধানের দর হয়েছিল চার টাকা। এই তখনই চন্দনপুরের মুখুজ্জেবাবুরা কয়লার কারবারে কেঁপে রাজা হয়ে উঠল। বনওয়ারীর মনিব মাইতো। ঘোষ পাট কয়লা বেচে কম টাকা করে নাই। অনেক টাকা। আবার চন্দনপুরের চার-পাঁচ ঘর জমিদার-বাড়ি ভেঙে গেল, মহাল বিক্রি করলে; জাঙলের চৌধুরী-বাড়ি একেবারে ‘নাজেহাল’ হয়ে ফেল পড়ে গেল। জাঙলের সদ্‌গোপদের বৃদ্ধি ওই যুদ্ধের সময়। আগে সবাই ছিল খাটি চাষী, কাহার-কৃষাণদের সঙ্গে তারাও লাঙলের মুঠো ধরত, কোদাল ধরত, খাটো কাপড় পরত; যুদ্ধের বাজারে ধান চাল কলাই গুড় বেচে সবাই ভদ্রলোক হয়ে গেল। এবার আবার সবাই কোমর বেঁধেছে, এ যুদ্ধে যে তারা কি হবে, কে জানে। তবে তাদের মঙ্গল কামনা করে। কাহারেরা। তাদের লক্ষ্মীর বাড়বাড়ন্ত হলেই কাহারদের মঙ্গল, তাদের মা-লক্ষ্মীর ‘পাজের অর্থাৎ পদচিহ্নের ধুলো কুড়িয়েই কাহারদের লক্ষ্মী। যুদ্ধে কাহারদের কিছু যায় আসে না।

সদ্‌গোপ মহাশয়রা চট বিছিয়ে বসে যুদ্ধের কথাই বলছেন। কথা হচ্ছে—মসনের চাষে এবার জোর দিতে হবে। চন্দনপুরের বাবুদের ‘গ্যাজেটে অর্থাৎ খবরের কাগজে নাকি বেরিয়েছে মসনের তেলের দরকার হবে যুদ্ধে, ওর দরটা খুব বেশি চড়বে।

বনওয়ারী আপন মনেই সবিস্ময়ে ঘাড় নাড়তে থাকে।

আজব কারখানাই বটে রে বাবা! ধান-চাল, কলাই-পাকড়, গুড়-আলু, এসবের চেয়ে দর বাড়বে মসনের। “প্যাটের খাদ্য নয়, গায়ে মাখবার ‘ত্যাল’ নয়, পরবার কাপড়ের তুলো নয়; মসনের পুলটিস দিতে হয় এই জানে বনওয়ারী—তার ত্যাল, এ লাগবে কিসে?

ঝম্‌-ঝম্ গম্‌-গম্ ঝম্‌-ঝম্ গম্‌-গম্।

দশটার ট্রেন চলেছে কোপাইয়ের পুল পার হয়ে। মণ্ডল মহাশয়রা এইবার গা তুলবেন, বাড়ি যাবেন খেতে খেয়েদেয়ে আসবেন হেদো মণ্ডল আর যার গুড় হচ্ছে তিনি, আরও একজন। হেদো মণ্ডল পড়বেন চিৎ হয়ে—নাক ডাকবে কামারের হাপরের মত, হা হয়ে যাবে, মুখ দিয়ে ফরর ফর শব্দ হবে।

এই মণ্ডলেরা যখন থাকবেন না, তখন একবার তাদের আরামের সময়। প্রাণ খুলে তারা দু-দশটা রসবিলাসের গালগল্প করবে।

মণ্ডলেরা চলে যেতেই বনওয়ারী উঠল। উঠে এসে আরাম করে পা ছড়িয়ে ওই চটের উপর বসেই বললে, লটবর, একবার ভাল করে তামাক সাজ তো। আর অতনা ‘রসির ভঁড়টা একবার দিস। জল আনিস খানিক, হাতমুখ ধুতে হবে।

কাহারপাড়ায় এইবার ঢোলের বাজনা থামবে। এ ঢোল বায়েনদের বাজনা নয়। সন্ধ্যার অন্ধকারের সঙ্গে আদ্যিকালের অন্ধকার মিশে যে অন্ধকার নামে কাহারপাড়ায় তার প্রভাব থেকে বাঁচবার জন্য যে একঘেয়ে গানবাজনার আসর বসে ওদের, সেই গানবাজনার আসরের। ঢোল। চৈত্র মাসে আসছে ঘেটুগানের পালা। তারই উদ্যোগ পর্ব চলছে। একটা ঢোল থামল। এখনও দুটো ঢোল বাজছে। বাঁশবাঁদিতে তিনটে ঘেঁটুর দল। একটা কাহারপাড়ার পুরনো দল, একটা আটপৌরে-পাড়ার, এর উপর বছর দুই হল করালী একটা নতুন দল করেছে। করালীর দলে নসুদিদি আছে—সে নাচে কোমর ঘুরিয়ে ঝুমুর দলের মেয়ের মত। করালী একটা বাঁশের বশি কিনেছে, সে সেটা বাজায়। ও দলের এখন চলতি খুব। গান বেঁধে নিয়ে আসে চন্দনপুরের মুকুন্দ ময়রার কাছ থেকে। নতুন রকমের গান। এবার নাকি যুদ্ধ নিয়ে গান বেঁধেছে ময়রা মহাশয়।

“সায়েব লোকের লেগেছে লড়াই।
ষাড়ের লড়াইয়ে মরে উখাগোড়াই–
ও হায়, মরব মোরাই উগোড়াই।”

বনওয়ারীর আর মনে নাই। তবে শুনেছে একদিন সমস্তটা। ময়রা জানে অনেক। হাজার হলেও চন্ননপুরের ময়রা। চন্ননপুরে ডাকে ‘গ্যাজেট’ আসে, আবার ট্রেনে গ্যাজেট আসে। রোজ বেলা দুটোর সময় ছেলে-ছোকরারা ভিড় করে ইস্টিশানে আসে, গার্ড সায়েব কাগজের বান্ডিল নামিয়ে দিয়ে যায়, বনওয়ারী স্বচক্ষে দেখেছে। মুকুন্দকেও গ্যাজেট পড়তে দেখেছে সে। গানের মধ্যে অনেক কথা দিয়েছে সে। গান্ধীরাজার কথা পর্যন্ত আছে। মন্দ লাগে নাই বনওয়ারীর; ভালই লেগেছে। করালী ছোকরার নতুন দলের বিরুদ্ধে বনওয়ারীর আপত্তি অনেক দিনের। ছোকরা রেলে চাকরি করে সেখান থেকে অনেক খারাপ ব্যাপার নিয়ে আসে। এবার কিন্তু গানটি ভাল এনেছে। অনেক কথা শুনবে লোকে। ছোকরাও এবার বাগ মেনে এসেছে। ভাল করে বাগ মানাতে হবে ওকে। করালী যদি ‘ধরম’ তাকিয়ে ইজ্জত রেখে সোজা রাস্তায় চলে, তবে করালী হতে কাহারপাড়ার অনেক ‘হিতমঙ্গল’ হবে বলেই বনওয়ারীর বিশ্বাস। নইলে ও-ই উচ্ছন্ন দেবে কাহারপাড়াকে। টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলবে ওই কলকারখানার তেলকালি-ভরা আলক্ষ্মীর পুরী ধরমনাশা এলাকায়। ছেলেগুলো চাষ ছাড়বে, পালকিবহন ছাড়বে, পিতিপুরুষের কুলকর্ম জলাঞ্জলি দেবে। মেয়েগুলোও যাবে পিছনে পিছনে। বনওয়ারী তা হতে দিতে পারবে না। কখনও না। তাই সে করালীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে আদর করে তার আবদার রেখে কোলগত করে নিতে চায়। তাই তার মন খুঁতখুঁত করলেও সে নয়ানের ঘর ভেঙেও পাখীর সঙ্গে করালীর বিয়ে দিয়েছে। অবশ্য আরও একটা কারণ আছে। সে কারণটা তার মনই জানে, আর কেউ জানে না। কালোশশীকে সে যে ভালবাসে। সে ভালবাসা তার মনের মধ্যে কুলকাঠের আগুনের মত ধিবিধিকি জ্বলছেই জ্বলছেই। ওদেরও তো সেই ভালবাসাই। রতন ‘সি’ মদের ভাড়টা নিয়ে এসে কাছে বসল।

বনওয়ারী বললে, পেহ্লাদকে ডাক।

প্রহ্লাদ এসে বসল। বনওয়ারী প্রশ্ন করলে, রস ক’পাতনা হল রে?

প্রহ্লাদের হাতে ছটা আঙুল—সে বললে, এক হাত। তারপর হেসে আবার বলল, ছ। পাতনায় পড়ল।

ওরে বাপ রে! আটপৌরে-পাড়ায় এবার ঘেঁটুর ধুম দেখা যায় খুব। ঢোলের শব্দ এই রাত্রিতে জোরালো হয়ে উঠল। করালীর দলের ধুমের কথা বুঝতে পারা যায়। কিন্তু আটপৌরেপাড়ায় হঠাৎ এত ধুমের কারণ কি?

হবে। পরম এবার জমি নিয়েছে চন্দনপুরের বাবুদের কাছে, এবার ওর শরীরে বল বেঁধেছে, মনে মনে তেজ হয়েছে। হাসলে বনওয়ারী। জমি সেও নিয়েছে। পরমের চেয়ে বেশি জমিই নিয়েছ সে।

প্রহ্লাদ হেসে বললে—আটপৌরে-পাড়ায় এবার ঘেঁটুর ধুম বটে। ওদের গান শুনেছ?

–না। আসলে বনওয়ারী।

—শুনো একদিন। প্রদ উঠে গেল। কলের দাঁতওয়ালা চাকায় ক্যাঁ-কটো-কটো শব্দ উঠেছে, তেল দিতে হবে।

—আটপৌরে-পাড়ায় গান! বনওয়ারী আবার হেসে বললে, ওদের তো সেই পুরনো গান! ওদের চেয়ে আমাদের পুরনো গান অনেক ভাল। সে গান বনওয়ারীরই বাঁধা।

“তাই ঘুনাঘুন–বাজেললা নাগরী–
ননদিনীর শাসনে,–চরণের নূপুর থামিতে চায় না।
ঘরে থাকিতে মনো চায় না। ও—তাই—তাই ঘুনাঘুন।”

রতন চুপ করেই ছিল, সে এতক্ষণে বললে—এবার ওরা লতুন গান গাইছে!

—লতুন গান? বাঁধলে কে?

—তা জানি না। তবে

-–কি তবে?

–তবে, গানে করালীকে তোমাকে শাপ-শাপান্ত করেছে। মধ্যে-মাঝে—

–কি মধ্যে-মাঝে?

মৃদুস্বরে রতন বললে—বাপু, গজু-গজু ফুসু-ফুসু চলছে, ওই পানা হারামজাদা নাকি উ-পাড়ায় শুনেছে, কালোশশীকে নিয়ে–

চমকে উঠল বনওয়ারী।

একটু পরে সে বললে—এইটুকুন দেখিস তু। আমি একবার শুনে আসি কি গাইছে শালোরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *