ঋজুদার সঙ্গে অচানকমার-এ

ঋজুদার সঙ্গে অচানকমার-এ — ঋজুদা — বুদ্ধদেব গুহ

০১.

বেলা যদিও হয়েছে, কিন্তু যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম তার পুবে একটি পাহাড় ছিল। সেটি ডিঙিয়ে আসতে সূর্যের সময় লাগল প্রায় ঘণ্টাখানেক। আমরা বাংলা থেকে অনেকক্ষণ হলই বেরিয়েছি। সূর্যটা সবে উঠছে পাহাড়ের ওপাশে। এখনও এই অচানমারে শীত শীত ভাব আছে এই মার্চ মাসের মাঝামাঝিতেও।

কলকাতার মানুষ মাত্রই শীতকাতুরে। শীত বলতেও সেখানে মাত্র দেড়-দুমাস। তাও তাকে শীত বললে উত্তর ও মধ্যভারতের এমনকী বিহার, ওড়িশা, আসামের মানুষেরাও হাসেন।

কাল সন্ধেবেলাতেই আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি।

আমরা মানে, ঋজুদা, আমি আর ভটকাই। তিনজনে দাঁড়িয়েছিলাম একটা টিলার উপরে, অচানকার বনবাংলো থেকে মাইল দুয়েক উত্তরে। সামনে দিয়ে দুধলি সাপের মতন এঁকেবেঁকে চলে গেছে একটা পাহাড়ি নদী। তার বুকের নুড়িময় সাদা বুকে অতি ধীরে ধীরে পাহাড়-টপকানো সূর্যর কমলারঙা আভা লাগছে, যেমন করে স্থলপদ্মর পাপড়িতে সকালে লালের ছোপ লাগে। এমন ধীরে, যে বোঝা পর্যন্ত যায় না।

রোদ আরও জোর হলে সেই কমলাভাবটি কেটে যাবে। দুধলি অস্পষ্টতা মুছে গিয়ে নদীর জল সাদা হবে, বালির রং গেরুয়া, পাথরের কালো। তখনও রাতের শিশিরে বনজঙ্গল, দূরের ঝিকারপানির পাহাড় সব ভিজে আছে। এই বসন্তের ভোরের বন পাহাড় নদীর এক আশ্চর্য গন্ধ ও মোহ আছে। মুগ্ধতাও।

তিতির, বটের ও ছাতারে ডাকছে চারধার থেকে। টিয়া আর চন্দনার ঝাঁক শন শন করে উড়ে যাচ্ছে ঝাঁক ঝাঁক সবুজ তীরের মতন। মাথার উপর দিয়ে। এমনই ব্যস্তসমস্ত হয়ে, যেন কোনও খুবই জরুরি খবর তাদের পৌঁছে দিতে হবে এখুনি কারও কাছে।

রাতের সব পাখিরা এখন চুপ। একেবারেই চুপ। ধীরে ধীরে পাহাড়শ্রেণীর পেছনে পুবের আকাশ লাল হচ্ছে। আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে কতকিছু ঘটবার সম্ভাবনাও যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। অন্ধকার রাত পোয়ালে, সবকিছু স্পষ্ট, আলোকময় করে, রাতের সব ভয় ও অনিশ্চিতি দূর করে একটি দিন আসছে অনেক আশার বাণী নিয়ে।

আমরা দাঁড়িয়েছিলাম কতকগুলো কালো পাথরের স্কুপের পাশে। এই রকম স্তূপকেই পুব-আফ্রিকার ঘাসের দিগন্তলীন সমুদ্র, সেরেঙ্গেটিতে বলে কোপী। বানান অবশ্য Kopje।

আফ্রিকার সোয়াহিলি ভাষার ব্যাপারই আলাদা। ডাক্তারি শাস্ত্রে যেমন অনেক শব্দেরই আগে একটি করে ‘p’ যোগ করে দিতে হয়, যেমন নিউমোনিয়া এবং থাইসিসের (টি.বি.) বানান আরম্ভ হয় ‘p’ দিয়ে, তেমনই সেখানেও অনেক শব্দের আগে ‘N’ বসে। অদ্ভুতভাবে উচ্চারণ করে তারা শব্দগুলো। যেমন NGORONGORO, NDUTU, অথচ উচ্চারণ গোরোংগোরো, এবং ডুটু।

এসব কথা আমি ঋজুদা আর তিতির জানি। ভটকাই চন্দ্র তো মাত্র সেদিন ঢুকেছে আমাদের দলে। তাও আমারই লাগাতার সুপারিশে। আফ্রিকাতে তো ও যায়নি। গুগুনোম্বারের দেশে-তে অবশ্য শুধুই আমি আর ঋজুদাই গেছিলাম। তারপর ভুযুণ্ডার বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নিতে, পরে আবারও যখন রুআহাতে গেছিলাম তখন তিতির গেছিল আমাদের সঙ্গে। তাই ভাবছিলাম, ভটকাইকে আফ্রিকার কথা বলে লাভ নেই। এমনিতেই তো ওর আগবাড়ানো মাতব্বরি আর ভেঁপোমিতে আমি একেবারেই বিরক্ত। ঋজুদা যে ওকে শাসন কেন করে না জানি না। তিতির এখন দিল্লিতে পড়াশোনা করছে তাই কিছুদিন হল আমাদের সঙ্গ দিতে পারবে না।

–এটা কী নদী? ঋজুদা?

–মানে?

–মানে, নদীর নামটা কী? তুমি তো এর আগে অনেকই বার এসেছ।

ফাটা শুরু হল সাতসকালেই। ভটকাই-এর লাগাতার কথার ধানি-পটকা।

একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে আমরা মধ্যপ্রদেশের এই অচানমার-এর আশ্চর্য সুন্দর এক চৈত্ৰসকালের শান্তিতে যে ঝুঁদ হয়ে ছিলাম সেই শান্তি ছিঁড়েখুঁড়ে গেল।

ঋজুদার পাইপের ইংলিশ ‘গোল্ডব্লক’ তামাকের গন্ধে এই মিশ্রগন্ধী সকাল আরও সুগন্ধী হয়ে উঠেছিল।

পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে ঋজুদা বলল, মনিয়ারী কৈরাহা।

বাঃ।

আমি বললাম অজানিতেই। কী সুন্দর নাম। নদীর নাম মনিয়ারী কৈরাহা?

হ্যাঁ।

আর সামনে ওই যে পাহাড়টা দেখছিস ওটার নাম ঝিকারপানি।

তুমি না বললে বিন্ধ্যপর্বতমালা। ভটকাই ফুট কাটল।

তাই তো। পর্বতমালা’ মানেইতো অনেক পর্বতের সমষ্টি। পর্বতের মধ্যে কত শত পাহাড় থাকে। তাদের নামও থাকে। এই ঝিকারপানিরই মতো অসংখ্য নামও দেয় স্থানীয় মানুষেরা তাদের। আর শুধু বিন্ধ্যই তো নয়! মাইকাল পর্বতমালাও আছে ডানদিকে।

তারপর পাইপে একটা টান লাগিয়ে বলল, অমরকণ্টকের নাম শুনেছিস?

হ্যাঁ।

ভটকাই বলল।

তারপর বলল, জ্যাঠাইমা পটলাদাদাদের সঙ্গে সেখানে তীর্থ করতে গেছিলেন একবার। আমি যখন ছোট ছিলাম।

তুই এখনও ছোটই আছিস।

ঋজুদা বলল।

যদিও পেকে ঝুনো হয়ে গেছিস।

আমি বললাম।

 ঋজুদা বলল, তুই ভুল বললি রুদ্র। বল, এঁচড়ে পেকে গেছে।

ঠিক তাই।

ফুঃ! সব এঁচড়ই আজকাল পাকা। কলকাতার কোনও বাজারে জেনুইন এঁচড় কি আর পাওয়া যায়? কারবাইডে পাকানো কাঁঠালই চলে এঁচড় হিসেবে।

তাও ভাল। আমারতো মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় যে তোকে ‘কিলিয়ে কাঁঠাল পাকাই।

তার মানে?

 ভটকাই তার খরগোশের মতন বড় বড় কানদুটি তুলে আমাকে আক্রমণাত্মক প্রশ্ন করল।

মানে আবার কী? কারবাইডে না পাকিয়ে কিল মেরেমেরেও যে এঁচড়কে কাঁঠাল করা যায়, তা কি জানিস?

ভটকাই আমার দিকে একটি জ্বলন্ত চাউনি ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ঋজুদা, সকালেই আরম্ভ করেছে কিন্তু তোমার ওরিজিনাল চেলা।

বলেই বলল, আসল ব্যাপারটা কী জানো তো?

কী?

সেই নিনিকুমারীর মানুষখেকো বাঘ মারতে যাওয়ার সময়ে আমার সাহস এবং এলেম দেখার পর থেকেই ও ‘জে।

‘জে’ মানে?

আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘জে’ মানে জানো না? ‘জে ফর জেলাসি। ঈর্ষা। পিওর অ্যান্ড সিম্পল ঈষা। আরে ঈর্ষা করেই তো বাঙালি জাতটা গোল্লায় গেল। আমাকে ঈর্ষা না করে, কী করে আমার মতো ঈর্ষণীয় হতে পারিস তার চেষ্টা কর, ভাল কাজে সময় ব্যয় কর, উন্নতি হবে।

ঋজুদা বলল, চল। এদিকটা মোটামুটি দেখা হল তবে ব্রেকফাস্ট-এর পরেই সারাদিনের মতো বেরোতে হবে চারধার ভাল করে দেখার জন্যে।

ভটকাই বলল, একেই তো বলে scouting। তাই নয়?

ঋজুদা কথা না বলে, মাথা নাড়ল।

আমরা অচানকমার বনবাংলোর দিকে ফিরে চললাম।

এতক্ষণে হয়তো শিকারি দুখু গোঁন্দ এসে বসে আছে।

আমি বললাম।

 হুঁ। ঋজুদা বলল।

তারপর বলল, ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার ওসমানসাহেব ব্রেকফাস্ট করবেন আমাদের সঙ্গে। অচানমারের ম্যান-ইটিং টাইগার সম্বন্ধে পুরো ব্রিফিং করে যাবেন আমাদের। যদিও গত মাসে যখন কলিয়ারির কাজে এখানে এসেছিলাম, কনসার্ভেটর সাহেব মোটামুটি জানিয়েছেন যা জানানোর। মাত্র তিনমাসে পনেরোটি মানুষ খেয়েছে বাঘটা। অনেক মানুষখেকো বাঘ ও লেপার্ড দেখেছি। মেরেওছি কম নয়। কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে এত মানুষ আর কোনও মানুষখেকো মেরেছে বলে জানি না। আমার অভিজ্ঞতাতে অন্তত নেই।

বাঘটার কোনো Wound আছে নিশ্চয়ই। যে কারণে মানুষের মতন প্রতিরোধহীন প্রাণী ছাড়া অন্য কোনও প্রাণী শিকার করারই ক্ষমতা তার নেই।

আমি বললাম।

ঋজুদা পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে বলল, could be!

আমরা টিলা থেকে নেমে আস্তে আস্তে অচানমার বাংলোর দিকে ফিরে যেতে লাগলাম। আমরা নিরস্ত্র। শুধু ভটকাই-এর কাঁধে বারোবোরের দোনলা বন্দুক। ঋজুদার পারমিশানে আমাদের খাওয়ার জন্যে একটা মাত্র মুরগি অথবা খরগোস মারার অলিখিত পারমিট সঙ্গে নিয়ে এসেছে সে।

বন্দুকটা কিন্তু দারুণ। ইটালিয়ান বন্দুক। ব্যারেটা। ওভার-আন্ডার। মানে বন্দুকের নল দুটি পাশাপাশি নয়। উপরে নীচে। ইটালির ব্যারেটা কোম্পানিতে নিজের হাতের ও কনুইয়ের দৈর্ঘ্য, কব্জি থেকে তর্জনীর দূরত্ব, নিজের মুখের মাপ সব পাঠিয়ে Custom-built করিয়েছিল ঋজুদা এটিকে বহুদিন আগে। পয়সা অবশ্য ঋজুদা দেয়নি। আমরা হাজারীবাগের মুলিমালোঁয়ার ‘অ্যালবিনো’ রহস্য ভেদ করার পরে বিষেনদেওবাবুই ঋজুদাকে জোর করে প্রেজেন্ট করেছিলেন। তখনকার দিনেই আমাদের দেশের টাকাতে লাখখানেক টাকা দাম পড়েছিল। ওঁদের অভ্র রপ্তানির পয়সা ছিল অঢেল। বিদেশি মুদ্রাতে দিতেও কোনও অসুবিধেও হয়নি।

সকালে এক কাপ চা না খেয়ে কোনও ভদ্রলোকের পক্ষে কোথাওই যাওয়া সম্ভব নয়। ঘুম পাচ্ছে এখনও আমার।

ভটকাই বলল, ব্যাজার মুখে।

আমি হাসলাম।

 হাসির কী হল এতে? তুমিও কি সকালে চা খাও না? নাকি রবীন্দ্রনাথের মতন নিমপাতার রস খাও?

ভটকাই বলল।

না। সেজন্যে নয়। নিজেকে ভদ্রলোক বললি তো! তাই। তা ছাড়া, সারাটা জীবনই তো তুই ঘুমোলিই। ঘুম থেকে উঠলি আর কখন? কুম্ভকর্ণ Incarnated। তোকে মাধব স্যার বলতেন না স্কুলে? মনে নেই? এই যে বৎস ভটকাই, ঘুম কি ভাঙল?

তারপরই মাধব স্যার আমাদের বলতেন, ওরে, তোরা ওকে একটু চটকে দিয়ে দেখত মটকা মেরে আছে, না সত্যিই ঘুমোচ্ছে? মাধব স্যারের সেই কথা থেকেই ‘ওরে ওরে ভটকাই, আয় তোরে চটকাই এই শ্লোগানের জন্ম।

ঋজুদা বলল, তাই? শ্লোগানটা শুনেছিলাম কিন্তু প্রেক্ষাপট জানতাম না।

তারপর বলল, চল ফিরে বাংলোতে। গরম গরম পরোটা, ডিম-এর ভুজিয়া, বেগুন ভাজা লাল করে, সঙ্গে শেওতারাই এর কালা জামুন।

ভটকাই বলল, আর বিলাসপুরের বেঙ্গল সুইটস-এর সন্দেশের কথাটাই ভুলে গেলে! এস. ই. সি. এল-এর সুভাষ চৌধুরী সাহেব আনিয়ে দিলেন না?

ঋজুদা বলল, ঠিক।

আমি বললাম, ভারী গুণী মানুষ কিন্তু ভদ্রলোক। কী দারুণ ওড়িয়া এবং হিন্দী বলেন।

ঋজুদা বলল, চৌধুরী সাহেব আবার মামুলি হিন্দি নয়, একেবারে দূরদর্শনের আগমাকা হিন্দি বলেন।

কী রকম?

গতবারে আমাকে স্টেশানে তুলে দিতে এসে একজন চেকারকে বিলাসপুর স্টেশানে শুধিয়েছিলেন, বম্বে-হাওড়া মেইলকি স্থিতি ক্যা হ্যায়?

মানে?

ভটকাই বলল।

মানে, ট্রেনটার অবস্থিতি আর কি! কত লেট আছে? আদৌ লেট আছে কি না এবং দুর্গ থেকে ছেড়ে এসেছে কি না!

দুর্গ। কোথাকার দুর্গ?

ভটকাই বলল।

সকাল সকাল বাগে পেয়েই একটু কড়কে দিলাম ওকে। যাকে বলে ‘Nipped in the bud’। বললাম, ওরে মূর্খ। সাহিত্য বা বিজ্ঞান এসব তো কিছু পড়িসইনি, ভূগোলটাও কি পড়িসনি? মধ্যপ্রদেশে যে দুর্গ (দুরগ) বলে একটি বড় জায়গা আছে তাও জানিস না? জায়গাটার নাম দুর্গ, পালামৌর বেতলার দুর্গ নয়। মুর্গ-মুসল্লম্-এর মুর্গ’-এর মতো উচ্চারণ। বুঝেছিস ভোঁদাই রাম।

ভটকাই চুপ করে গেল।

.

০২.

আমরা বাংলোটির বাঁপাশ দিয়ে আসছিলাম, অচানমার বাংলোর কাছাকাছি আসতেই, দেখা গেল একটি জলপাই-সবুজ জিপ দাঁড়িয়ে আছে বাংলোর সামনে।

ঋজুদা বলল, কী হল! ডি. এফ. ও. ওসমান সাহেবের তো আসার কথা সাড়ে আটটাতে। বিলাসপুর থেকে আসবেন। এত আগে এলেন যে!

ভটকাই বলল, নিশ্চয়ই কোনও গড়বড়-সড়বর, কোনও গুবলেট হয়েছে।

ভটকাই এর বাগবাজারি ভাষাই ওরকম।

 যখন আমরা বাংলোতে গিয়ে পৌঁছলাম, তখন কিন্তু দেখা গেল ভটকাই ঠিকই ধরেছিল।

দূর থেকে আমাদের দেখেই ডি. এফ. ও. ওসমান সাহেব এগিয়ে এসে বললেন, ওয়্যারলেস-এ খবর পেয়ে আসছি। লমনির পেছনে গণিয়া বস্তীর একটি যুবতাঁকে বাঘে নিয়েছে আজই খুব ভোরে। মেয়েদের চার পাঁচজনের একটি দল মহুয়া কুড়োতে গেছিল। তার মধ্যে থেকে একজনকে নিয়েছে। এখুনি গেলে হয়তো আপনাদের পরিশ্রমের লাঘব হবে। আজই মানুষখেকো নিধন হবে।

ভটকাই এর মুখের দিকে তাকিয়ে ঋজুদা বলল, মানুষখেকো কি অত সহজে মারা যাবে? সন্দেহ আছে।

ভটকাই এর মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। ফিসফিস করে আমাকে বলল, ব্রেকফাস্ট?

কিন্তু স্যার চেষ্টা তো করতে হবে। আপনিই তো ভরসা। কনসার্ভেটর সাহেব তো তাই বলেছেন আমাদের। আপনি পারবেনই। অন্যেরা বিফল হলেও।

ওসমান সাহেব বললেন।

তারপরই বললেন, চলুন। তাড়াতাড়ি বেরিয়েই পড়া যাক। আতারিয়া বনবাংলোতে ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চ দুইয়েরই বন্দোবস্ত করতে বলেছি ওয়্যারলেস-এ।

আতারিয়া কেন? লামনিতে থাকা নয় কেন?

ভটকাই বলল।

 সাহস কম নয়! ঋজুদা থাকতে এমন মাতব্বরী! সত্যিই ভাবা যায় না!

 ভাবছিলাম আমি।

 লামনি বাংলোটা কেঁওচির দিকে যাওয়ার বড় রাস্তার ওপরে। এপথ দিয়েই তো পেন্ড্রা রোড, অমরকণ্টক, সাউথ ইস্টার্ন কোলফিল্ডস এর সুহাগপুরের সব কলিয়ারিতে যাওয়ার পথ। ঋজু বোস-এর মতন সেলিব্রিটিকে ওই বাংলোতে রাখলে জানাজানি হয়ে গেলে মিঃ বোসেরই অসুবিধে হবে। মধ্যপ্রদেশ তো এখন বাঙালি ট্যুরিস্টদের স্বর্গরাজ্য হয়ে গেছে। শিক্ষিত বাঙালিরা যদি জানতে পারে যে ঋজু বোস লামনি বাংলোতে আছেন তবে ভিড় সামলাতে পুলিশ ডাকতে হবে।

ঋজুদা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এই সবই রুদ্রর কাণ্ড। যত্ত বাজে কাণ্ডমাণ্ড সব।

তারপর আমার দিকে চেয়ে বলল, বানিয়ে বানিয়ে আরও গল্প লেখো। ঋজুদা কাহিনী। জীবনে যে কারণে সিনেমাতেই নামলাম না, তুই আমাকে নিয়ে গল্প লিখে সেই বিপদেই ফেললি শেষে। কোনও মানুষ সেলিব্রিটি হয় মানুষের সাতজন্মের পাপ থাকলে। নিজের Personal life বলে কিছু থাকবার জো আছে! ল্যাংড়া পাহান বাঘেরই মতন সকলেই আঙুল তুলে দেখিয়ে বলবে, ওই যায়! ওই যায়!

ইতিমধ্যে অচানমার বাংলোর চৌকিদার সন্তুরাম চা নিয়ে এল ট্রেতে করে। আমরা বারান্দাতে বসে এক কাপ করে চা খেয়েই আপাতত একদিনের মতন জামা কাপড় রাইফেলবন্দুক-গুলি-দূরবীন সব নিয়ে তাড়াতাড়ি জিপে উঠলাম।

ঋজুদাই বলল, এখানে সময় নষ্ট করার মানে হয় না।

অন্য সবকিছুই অচানমারে পড়ে রইল। কনসার্ভেটর সাহেব চৌকিদার সন্তুরামকে বললেন, সব ঠিকঠাক করে দেখে রেখো সন্তুরাম। সাহেবরা কখন ফিরবেন তা ওয়্যারলেস-এ তোমাকে জানিয়ে দেব।

জী সাব।

Attention-এ দাঁড়িয়ে বলল, সন্তুরাম। মধ্যপ্রদেশের বনবিভাগেও পুলিশ বিভাগের মতন নিয়মানুবর্তিতা আছে দেখে খুশি হলাম। নিয়মানুবর্তিতা, অথবা নিয়মানুবর্তিতার ভান, যাই হোক।

পৌঁছে দেখলাম, লামনি বনবাংলোটি বেশ বড়। বাইরে থেকেই দেখা গেল একটি মস্ত গামহার গাছ বাংলোর হাতাতে এবং দুটি সুপ্রাচীন বটলব্রাশ-এর গাছ। এত বড় বটল-ব্রাশ গাছ আগে কখনও দেখিনি। আমরা বাংলোর পাশ দিয়ে গিয়ে মাট্টিনালার উপরের কংক্রিটের সাঁকো পেরিয়ে আরও কিছুটা গভীর গাঢ় জঙ্গলের মধ্যের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে ডানদিকের কাঁচা রাস্তাতে ঢুকে পড়লাম। লাল মাটির পথ। হাওয়াতে তখনও মহুয়া আর করৌঞ্জ-এর গন্ধ ভাসেনি, নানা-রঙা মরা-পাতার রাশ গালচে পাতেনি প্রতি গাছের নীচে। তবে বাংলোর হাতার মধ্যে যেন আমের বোল আর কাঁঠালের মুচির গন্ধ পেলাম। পেটভরে প্রশ্বাস নিলাম। আঃ।

ভাবছিলাম, আমাদের এই সুন্দর ভারতবর্ষ দেশ হিসেবে এতই বড় ও বিচিত্র যে, একেক জায়গাতে একেক সময়ে পলাশ আর শিমুল ফোটে। মাদার, পারুল, জারুল, মহুয়া, করৌঞ্জ থেকে আম কাঁঠালও। কোথাও ফেব্রুয়ারিতেই আমের বোল আর কাঁঠালের মুচি এসে যায়, কোথাও আবার মার্চের একেবারে শেষে। এত বিচিত্র আবহাওয়া, জমি, গাছ-গাছালি বলেই আমার দেশকে এত ভালবাসি আমি। অবশ্য এই ভালবাসা শিখেছি পুরোপুরি ঋজুদারই কাছ থেকে। জানি না, ঋজুদা যখন থাকবে না তখন কী করব। কী করে এই। ভালবাসার দায় বইব। কেউই তো চিরদিন থাকে না। ঋজুদাও থাকবে না। তবে আমি কোনওদিনই চাইনি ঋজুদা বিছানাতে শুয়ে মারা যাক। অমন সাধারণ ছা-পোষা মানুষের মৃত্যু ঋজুদাকে আদৌ মানায় না।

আতারিয়া বাংলোতে পৌঁছেই দেখলাম, পাশ দিয়ে একটি সরু ছোট নদী বয়ে গেছে। গত কয়েকদিন বিন্ধ্য আর মাইকাল পর্বতশ্রেণীতে বেশ ভাল বৃষ্টি হয়েছে। তাই ঘঘালা জল চলেছে ঢল নামিয়ে।

ঋজুদা আসবে বলে কয়েকজন মানুষ অপেক্ষা করছিল সেখানে। ওসমানসাহেব একজনকে ডাকলেন। ঋজুদাকে বললেন, এর নাম চৈতুরাম পোর্তে। এই হল লামনির মুখিয়া।

লোকটার চেহারা আমার মোটেই ভাল লাগল না। অত্যন্ত ধূর্ত বলে মনে হল। কয়েকজন মেয়েও ছিল সেখানে। যারা সকালে গেছিল মহুয়া কুড়োতে। ওরা বলল, অঘটনের জায়গাটা নাকি আতারিয়া বাংলো থেকে কাছেই।

ঋজুদা বলল, তোমরা থাকো কোথায়? কোন গ্রামে?

গণিয়া।

 সেই গ্রামের আশে পাশে মহুয়া গাছ নেই?

একটা মাত্র আছে। এদিকে মহুয়া গাছ কম।

 কথাটা ঠিকই। বিহারের মতন মহুয়াগাছ সম্ভবত অন্য কোনও রাজ্যেই। নেই। বড় হতে সময়ও নেয় খুব তারা।

বাবুর্চিখানা থেকে ফার্স্টক্লাস খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে ভাজা পরোটার গন্ধ ছাড়ছিল। ভটকাই এর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

ঋজুদা লক্ষ করে একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ভটকাই তুই বাংলোতেই থাক। ভাল করে ব্রেকফাস্ট কর। বারান্দাতে বসে নদীর শোভা দেখ।

বলেই, আমাকে বলল, চল রুদ্র।

 সাধে কি আর বলে, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু!

কিন্তু ঋজু বোস-এর মুখ দিয়ে একবার কথা বেরিয়ে গেলে তা রাইফেলের নল থেকে বেরিয়ে যাওয়া গুলিরই মতন আর ফিরে আসে না।

ভটকাই রীতিমতন কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, আ… আ… আমি!

ঋজুদা বলল, যা বললাম, তাই কর ভটকাই।

 তারপর বলল, চলো, চৈতুরাম।

মেয়েদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি বয়সী, তার বয়স, এই উনিশ কুড়ি হবে, তাকে ডেকে নিল ঋজুদা চৈতুরামের সঙ্গে। ওসমান সাহেবকে বলল, আপনি চলে যান বিলাসপুরে।

চলে যাব? আপনার যদি কোনও দরকার…

কোনও দরকার হবে না। একটি ওয়্যারলেস টেলিফোন লাগানো জিপতো রেখেই যাচ্ছেন আপনি। তবে আর অসুবিধে কী? তবে আপনি যাওয়ার আগে, প্লিজ, নাস্তা করে যান। মিস্টার ভটকাই আপনাকে কম্পানি দেবে। ও খেতে খুব ভালবাসে। বলতে গেলে, ভাল-মন্দ খেতেই এসেছে ও এখানে। আমারই চেলা তো!

আমি বললাম, চেলা তো আমি! ও হল, চামুণ্ডা।

ঋজুদা হেসে বলল, ঠিক বলেছিস।

 বলেই বলল, তুই ব্যারেটা শটগানটা নে। যা যা গুলি নেবার সব নিয়েছিস তো?

বললাম, নিয়ে নিচ্ছি।

কাঁদো কাঁদো মুখে ভটকাই বন্দুক আর গুলির বেল্ট আমাকে দিল। আমি তার থেকে বেছে দুটো লেথাল বল আর চারটে এল. জি. নিয়ে আমার বুশ-শার্ট-এর দু পকেটে রাখলাম।

ঋজুদা নিয়েছে থার্টি ও সিক্স ম্যানলিকার শুনার রাইফেলটি। আর পাঁচটি গুলি। গুলিগুলি তার বুশ-শার্টের বুকের বাঁদিকের পকেটের খাঁজে গোঁজা। সব গুলিই সফট-নোজড বুলেট।

দূরবীনটাও নিয়ে নে রুদ্র।

ভটকাই-এর গলাতে জার্মানির তৈরি জাইস-এর দূরবীনটা তখনও ঝোলানো ছিল। পরানোমালার মতন। খুলে নিলাম আমি সেটাকে। ভটকাই-এর মুখের ভাবটা এমনই হল যেন আমি শুভদৃষ্টির সময়েই ওর গলার মালাটা খুলে নিলাম।

যাক। বহু বহু বছর পর ভটকাইকে বেশ মনোকষ্ট দিয়ে হেভি আনন্দ পেলাম আমি। কে জানে! মানুষকে সুখী করে যেরকম আনন্দ পাওয়া যায়, দুখী করে হয়তো তার চেয়েও অনেক বেশি আনন্দ পাওয়া যায়। পাজি মানুষেরা তাই পায় অন্তত।

তারপরই ভাবলাম, আমি কি পাজি?

ঋজুদা বলল, মড়ি নিয়ে আসা হয়েছে দাহ করার জন্যে? মেয়েটির বাড়ির লোকেরা কেউ আসেনি?

যে মেয়েটি আমাদের সঙ্গে চলল, সে বলল, তার কেউই ছিল না সাহাব। বাবা মারা গেছিল সাপের কামড়ে, তার যখন তিনবছর বয়স তখন। আর মা মারা গেছিল চীচক রোগে। ওর যখন সাত বছর বয়স তখন। তখন থেকেই সে একা।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, চীচকটা কী রোগ?

 ঋজুদা বলল, চীচক মানে বসন্তরোগ। আসল বসন্ত।

একা থাকে যদি তো থাকে কাদের সঙ্গে তা হলে? একাই থাকত বস্তিতে?

 ঠিক তা নয়।

তবে?

ঋজুদা আবার প্রশ্ন করল।

মেয়েটি একবার মুখিয়া চৈতুরামের মুখের দিকে তাকাল, তারপর বলল, থাকত মুখিয়ার বাড়িতেই। নানা কাজকর্ম করত আর তার বদলে খেতে-পরতে পেত।

ও।

ঋজুদা বলল।

আমরা আতারিয়া বাংলোর পেছন দিয়ে একটু এসে একটি পায়ে চলা পথে ঢুকে পড়লাম। যাকে বলে Game track অর্থাৎ জানোয়ারদের চলাচল করার পথ। সে পথে মানুষেরাও যাতায়াত করে। সাবধানে জানোয়ারদের খুরের বা থাবার দাগ দেখতে দেখতে এগোলাম আমরা। শুয়োর, শম্বর, কোটরা, চিতল হরিণ, শজারু, একটি মাদী চিতা এবং বাইসনের দলের দাগও দেখলাম। সম্ভবত এই পথটির একটি মুখ নদীতে আর অন্য মুখ কোনও নুনীতে আছে। নুনী অর্থাৎ Silt Lick, প্রাকৃতিক। বনের মধ্যে কোনও কোনও জায়গাতে লবণাক্ত পাথর অথবা মাটি থাকে। তৃণভোজী জানোয়ারেরা সেই নুন চাটতে আসে। আর তাদের পেছনে পেছনে আসে মাংসাশী জানোয়ারেরা।

কিছুদিন পরেই খরা পড়বে। নদী আর এমন কলরোলে বইবে না। কি আতারিয়া নদী, কি মনিয়ারী কৈরাহা আর কি মাট্টিনালা। তখন জানোয়ারেরা নদীর দিকেই আসবে বেশি করে। খরার সময়ে জঙ্গলে জল থাকবে না। জানোনায়ারেরা এখন যায় শোভাযাত্রা করে নুনীতে। আসলে শোভাযাত্রা করে কি আর যায়! একেক প্রাণী যায় তার সময় সুবিধে মতো, রাতের নানা প্রহরে। শেষ বিকেলের থেকে শেষ রাত অবধি।

আরও কিছুটা যাওয়ার পরে প্রায় কুড়ি মিনিট মতন, একটি টিলা দেখা গেল। তার চারদিকে, পায়ের কাছে, আঁচলে, নানা হরজাই গাছ, শিশু, বিজা, সাহাজ, কুর্চি, গামহার, আরও নানা গাছ অথচ টিলাটাতে কেবলই মহুয়া। খুবই প্রাচীন সব মহুয়া।

নাম কী? এই টিলার?

 মহুয়া টিলা।

 মুখিয়া বলল।

এই টিলার উপরেই ধরেছিল বাঘে মেয়েটিকে?

তা ওই মেয়েটিই বলতে পারবে।

 নাম কী তোমার?

 ঋজুদা শুধোল।

 রূপকুমারী।

তোমার বন্ধুকে বাঘে কোথায় ধরল?

তা দেখিনি।

মানে?

মানে, আমরা সকলেই মহুয়া কুড়োচ্ছিলাম। আলোতো ফুটেছিলই, সূর্যও উঠে গেছিল।

যে অঞ্চলে মানুষখেকো বাঘ এত মানুষ ধরেছে সেখানে তোমরা অন্ধকার থাকতে গ্রাম থেকে বেরোলে কোন সাহসে?

এই বাঘটাতো দিনের বেলাতেই মানুষ ধরে। রাতে তো একজনকেও ধরেনি। চিতা যদি মানুষখেকো হয়, তবে রাতে ধরে। একবার গামহারগাঁও-এ এক চিতা…

আঃ। বড় বেশি কথা বলিস তুই রূপকুমারী। সাহাব কত বড় মানুষ জানিস? দেখলি না ডি. এফ. ও. সাহাব পর্যন্ত কীরকম খাতির করলেন সাহাবকে। তোর সঙ্গে এত বেশি কথা কীসের? যা প্রশ্ন করবেন তারই ঠিকঠাক জবাব দিবি। তোর গেঁহু বাজরার গাই বলদের কিসসা শোনার সময় সাহাবের নেই।

ঋজুদা মুখিয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলল, না বললে, সব জানব কী করে! ওকে থামাবার দরকার নেই।

মুখিয়া একটু দমে গিয়ে বলল, ঠিক আছে সাহাব।

বল রূপকুমারী।

আমরা যখন সকলে মহুয়া কুড়োচ্ছি ও…

ওর নাম কী ছিল?

প্রাণকুমারী।

তারপর?

 ও ওর ঝুড়িটা মাটিতে নামিয়ে রেখে বলল, আমি একটু আসছি। বলে মহুয়াটিলার ওই পাশে একটু নেমে গেল। একটু নামতেই আমাদের চোখের আড়ালে চলে গেল সে। উত্রাই ছিল তো!

কী করতে গেছিল?

তা বলতে পারব না। জানি না।

বলেই, চোখ নামিয়ে নিল রূপকুমারী নীচে। লজ্জাতে।

আমি বুঝলাম, বাথরুম-টাথরুম করতে গেছিল নিশ্চয়ই।

তারপর?

তারপর আমাদের যখন ফেরার সময় হল তখনও ও এল না দেখে আমরা সকলে একসঙ্গে এগিয়ে নেমে গিয়েও যখন ওকে দেখতে পেলাম না তখন হঠাৎ ঝুমকি বলল, ওকে নিশ্চয়ই বাঘে ধরেছে। সে কথা শোনা মাত্রই আমরা পড়ি কি মরি করে দৌড়ে সোজা গ্রামে। তারপর মুখিয়াকে খবর দিতে সে অচানকমার-এর রেঞ্জার সাহেবকে লামনি থেকে একটি ট্রাক ধরে গিয়ে খবর দিল।

তারপর ঋজুদা বলল, টিলাটা চড়তে চড়তে, বাঘকে কেউ কি দেখেছিলে তোমাদের মধ্যে? একজনও?

না হুজোর।

 কোনওরকম আওয়াজ শুনেছিলে কেউ? ধস্তাধস্তির শব্দ-টব্দ?

না হুজৌর।

 চৈতুরাম পোর্তে একটু শ্লেষের সঙ্গেই বলল ঋজুদাকে, লোকমুখে শুনলাম, আপনি নাকি পৃথিবীর সব জঙ্গলেই শিকার করেছেন কিন্তু মানুষখেকো বাঘে বা চিতাতে যখন মানুষ ধরে তা তার পাশের মানুষও যে টের পায় না তাও কি সাহাব জানেন না? বেড়ালে পায়রা ধরলে, পায়রা তবু ডানা ঝটপট করে কিন্তু মানুষখেকো বাঘ কি চিতা যম-এর চেয়েও তো বেশি নিঃশব্দ।

ঋজুদা পূর্ণ দৃষ্টিতে চৈতুরামের মুখে একবার তাকাল।

তারপর বলল, তাই বুঝি? তা, তোমরা বনজঙ্গলেই তো চিরটাকাল থাকো, তোমরা আমার মতন শহুরে মানুষের চেয়ে বেশি জানবে বইকী। আমার জ্ঞান তোমাদের জ্ঞানের সঙ্গে তুলনীয়ই নয়।

আমি ভাবছিলাম, চৈতুরামের কথাটা তো ঠিকই। একটি ছাগলের শিং আছে, পায়ে খুর আছে। সেও আক্রান্ত হলে শিং নাড়ে, পা ছোঁড়ে। সেই তুলনাতে মানুষেরই কিছু করার নেই, মানুষই সবচেয়ে অবল।

ঋজুদা বলল, মেয়েটির মড়ি কে দেখেছে? মানে, লাশ?

সদ্য-সদ্য মানুষখেকো বাঘে-নেওয়া মানুষের লাশ দেখতে গিয়ে কে শখ করে নিজেই লাশ বনতে যাবে বলুন সাহাব? তাও যদি, যাকে নিল তার আপনজন কেউ থাকত তো অন্য কথা। মানে মা, বাবা, দাদা, বোন। ওর তো কেউই ছিল না।

কেন? তুমি তো ছিলে মুখিয়া। তোমার আশ্রয়েই তো থাকত প্রাণকুমারী।

হ্যাঃ।

তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল মুখিয়া চৈতুরাম পোর্তে।

তারপর বলল, ওই ছোট জাতের মেয়ের জন্যে নিজের জীবন বরবাদ করব এমন পাগল তো আমি নই। আমার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলাম এই ঢের। আমি না থাকলে তো ও এই এতবড়টি হয়েই উঠতে পারত না। ওর হাতে আমরা খেতামও না কখনও। ভুলুয়া কুকুর আর ওর জন্যে দুটি আলাদা থালা ছিল। জাম গাছের গোড়াতে ওদের দুজনকে একই সঙ্গে খাবার দিত আমার বউ। তার জন্যে অত দরদ তো আমার ছিল না। থাকার কথাও ছিল না। তাছাড়া বড় হতেই মেয়েটা ভারি পাজিও হয়ে গেছিল।

পাজি?

বলেই, ঋজুদা চুপ করে গেল।

 ততক্ষণে আমরা মহুয়া টিলার ওই প্রান্তে পৌঁছে গেছি।

ঋজুদা বলল, তোমরা কেউ প্রাণকুমারীকে বাঘে নিতে দেখনি, তার লাশের খোঁজও করনি। বাঘের খাবার দাগ কি ছিল? মানে, কেউ কি দেখেছিল? তোমাদের গাঁয়ের আর সব মানুষই বা গেল কোথায়?

তাদের সকলকেই খেটে খেতে হয় সাহাব। তাদের কি আপনাদের মতন। ভাল অবস্থা যে বসে থাকলেও পেট চলবে। যে যার কাজে গেছে। আমিই বলেছি যেতে।

সে কী? মেয়েটার একটা হদিস না করেই? তাকে বাঘের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে দিয়ে নিশ্চিন্তমনে চলে গেল তারা!

মুখিয়া বলল, বাঘের পায়ের দাগ ওই ঘাসের মধ্যে কী করে দেখা যাবে?

পায়ের দাগ না হলেও ঘাসের মধ্যে চিহ্ন তো থাকবে কিছু। অতবড় ভারী বিরাট একটা জানোয়ার চলা-ফেরা করলে পায়ের দাগ নাও পড়তে পারে পুরু নরম ঘাসের উপরে, শব্দও না হতে পারে কিন্তু কোনওরকম চিহ্নই পাওয়া যাবে না? এতো আশ্চর্য কথা।

আমি বললাম।

আপনারা অনেক পড়ে-লিখে বড় শিকারি সাহাব। আপনারা পেলেও পেতে পারেন। আমরা পাইনি।

হুঁ। ঋজুদা বলল, চিন্তান্বিত মুখে।

তারপর বলল, পাব কি না জানি না। চেষ্টা তো করতে হবে। মধ্যপ্রদেশ সরকার এত খরচপত্তর করে আমাদের নিয়ে এসেছেন, মেয়েটাকে বাঘে নিয়ে গেল, আর আমরা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব তাতো হয় না।

তারপরই কী ভেবে, রূপকুমারীর দিকে ফিরে তার দু চোখে নিজের দু চোখ রেখে বলল, তোমার কী মনে হয়? রূপকুমারী?

রূপকুমারী যেন ভয় পেয়ে গেল।

বলল, কীসের কী মনে হয় হুজৌর?

না,…। মানে,…।

ঋজুদা, চৈতুরাম পোর্তের দিকে ফিরে বলল, ঠিক আছে। তোমরা সকলেই এবারে যেতে পারো। তোমাদের গ্রামে তো একজনও নিষ্কর্মা লোক নেই দেখছি। এমন কাজ-পাগল গ্রাম ভারতের কোণে কোণে হোক। তা হলে দেশের সব দুর্গতিই মোচন হবে।

মুখিয়ার সঙ্গে যে আরও দুজন লোক ছিল, তারা বলল, আপনারা এ অঞ্চলে নতুন। জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে যেতে পারেন, তা ছাড়া মানুষখেকো বাঘ রয়েছে এ জঙ্গলে। আপনাদের ছেড়ে যাই কী করে?

ঋজুদা বলল, মানুষখেকো বাঘ মারবার জন্যেই তো এসেছি আমরা। মানে, আমাদের আনানো হয়েছে। বাঘকে ভয় করলে কি আসতাম! প্রাণকুমারীকে বাঘেই খেল না ঘোগে খেল তা আবিষ্কার করে তারপরেই ফিরব। আমাদের জন্যে তোমাদের কোনওই চিন্তা নেই। তোমরা যাও।

তারপর শক্ত গলায়, হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, যাও।

ওরা বেজার মুখে ফিরে যাবার জন্যে ঘুরল।

ঋজুদা মুখিয়াকে জিজ্ঞেস করল, প্রাণকুমারী যে ছোট জাতের বললে, কী জাত ছিল ওর?

 পানকা।

মুখিয়া বলল।

ঋজুদা বলল, ও, তাই?

তারপর ওরা যতক্ষণ না দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল ততক্ষণ ওই একই জায়গাতে দাঁড়িয়ে রইল ঋজুদা।

ওরা চলে গেলে বলল, জানিস রুদ্র, এই পানকাদের ছোট জাত বলল মুখিয়া অথচ এই জাতের কোনও পুরুষের সঙ্গে যদি পথে কোনও অনাত্মীয়া নারীর দেখা হয়, সে বিরাশি বছরেরই হোক কি তিন বছরের, তারা প্রত্যেককেই, হাঁটু গেড়ে বসে, দুহাত পায়ে ঠেকিয়ে প্রণাম করে। এই ওদের সংস্কৃতি। এই পানকাদের যারা ছোট জাত বলে, তারা নিজেরাই অমানুষ।

আমি ঋজুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, মধ্যপ্রদেশের এই সব অঞ্চলে কোন কোন আদিবাসী থাকে?

থাকে তো অনেকই রকম কিন্তু তাদের আর তাদের মতন থাকতে দিলাম কোথায় আমরা, এই শহুরেরা? আমাদের ভাল যে ওদের ভাল নয়, ওদের নিজেদের ভালত্ব নিয়েই যে ওরা এত হাজার বছর বেঁচে এল হেসে খেলে, এবং সবচেয়ে বড় কথা, সুখে, সে কথা আমরা মানলাম কই? মনের সুখের সঙ্গে যে বড়লোকির কোনও সম্পর্কই নেই এই কথাটা আমরা নিজেরা তো বুঝলামই না ওদেরও কলুষিত করলাম, আমাদের চাই চাই-খাই খাই সংস্কৃতি দিয়ে। আমাদের সংস্পর্শে এসেই এই সরল, ভাল, আদিবাসীরা এই চৈতুরাম পোর্তেরই মতন ধূর্ত-ধাউর হয়ে গেছে। লোকটার চোখ দুটো দেখলি? শেয়ালের মতো।

দেখেছি। আমি বললাম। প্রথম দর্শনেই তাই মনে হয়েছে আমারও।

এবারে চল। কাজে নামা যাক।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, বাঘতো অনেকই শিকার করেছি আমরা কিন্তু প্রাণকুমারীকে অচানকমারের বাঘে মেরেছে বলে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

অবাক হয়ে আমি বললাম, তবে কীসে মেরেছে?

মেরেছে যে আদৌ সে কথাও এখুনি বলতে পারছি না। তবে তুই তোর বন্দুকের দুই ব্যারেলেই গুলি পুরে রাখ। একটা বাঘ, সে মানুষখেকো হলেও তার মোকাবিলা করা সহজ। আমাদের হয়তো একই সঙ্গে একাধিক বাঘের মোকাবিলা করতে হবে। ভটকাইটাকে শাস্তি দেবার জন্যে বাংলোতে রেখে এলাম। এখন দেখছি, ও থাকলে ভালই হত। তৃতীয় Gun থাকত। কোনও Lead-ই তো নেই!

পেটুক হওয়া এত বড় অপরাধ নয় যে, ঋজুদা, তুমি বেচারিকে কলকাতা থেকে এতদূরে নিয়ে আসার পরেও সে মেক-আপ টেক-আপ নেওয়ার পরও তাকে স্টেজে নামতে দিলে না। তা ছাড়া পেটুক বদনাম হয় ওর একারই, খাই তো আমিও কম নয়।

সেটা ঠিক। অন্যায় হয়েছে আমার। তবে নাটকের এই দৃশ্যে নামেনি তো কী হয়েছে? এই মঞ্চ Revolving। কিছুক্ষণ বাদে বাদেই নতুন নতুন দৃশ্য, নতুন নতুন অঙ্ক আসবে। ওর দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। আর ভটকাই তো রীতিমত ওস্তাদ হয়ে উঠেছে আজকাল। ওস্তাদের মার শেষ রাত্রেই তো দেখানো ভাল। তাই না? দেখবি, মানুষখেকোটাকে শেষ পর্যন্ত ওই হয়তো মারবে।

মহুয়া-টিলার যেদিকে আঙুল দিয়ে রূপকুমারী দেখিয়েছিল, প্রাণকুমারী নেমে গেছে বলে, ঋজুদা সেদিকে না গিয়ে তার ডানদিকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে গেল। আর আমাকে বলল, তুই বাঁ দিকে নেমে যা। খুব ভাল করে খুঁজতে হবে। বাঘের কোনও চিহ্ন, মড়ির কোনও চিহ্ন, একটি উনিশ কুড়ি বছরের মেয়ের কোনও চিহ্ন, কোনওরকম চিহ্ন, কানের দুল, জামা বা শাড়ির টুকরো, মাথার চুল কিছু পাওয়া যায় কি না। আর সেই সঙ্গে সবসময়ে সজাগ থাকবি। কান খাড়া রাখবি। যে-কোনও মুহূর্তে বিপদ আসতে পারে।

মানুষখেকোর কাছ থেকে?

না। মানুষখেকো এ জঙ্গলে নেই।

মানে?

মানে, অচানমারে অবশ্যই আছে। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে বড় রাস্তার, মানে শেওতারাই থেকে অচানকমার এবং লামনি হয়ে যে পথটি কেঁওচি চলে গেছে তার ডানদিকে ওই বাঘ কখনও আসে না। কনসার্ভেটরের ঘরে বসে আমি ম্যাপ দেখে এসেছি। যতগুলো kill এই মানুষখেকো করেছে তার একটিও এই বড় রাস্তার ডানদিকের কোনও গ্রামেই হয়নি আজ অবধি।

কেন?

কেন তা বলা মুশকিল। তবে কারণ অবশ্যই আছে। আমার মনে হয়, বাঘটা এই পথের ডানদিকের কোনও জঙ্গলে গুলি খেয়ে থাকবে। যারা বাঘটাকে দেখেছে তারা সকলেই বলেছে বাঘটা কেমন ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে চলে।

চোট না পেলে, তার শরীরে আঘাত ও অস্বস্তি না থাকলে সে ক্রমান্বয়ে এবং এত ঘনঘন মানুষই বা মেরে চলবে কেন? বাঘটা বুড়োও নয়।

কী করে বুঝলে?

বুড়ো হলে তার এত রাক্ষসের মতন খিদে থাকত না। বাঘটা জোয়ান বাঘ। পায়ের দাগ যারাই দেখেছে তারা সকলেই বলেছে নাকি।

এরকম কি হয় কখনও? মানুষ মারছে ধড়াব্বড় আর রাস্তার ডানদিকে তার ‘No Entry’। ডানদিকটা ‘Out of Bounds’। আশ্চর্য তো!

কিমাশ্চর্যমতঃপরম। বৎস, পারকালাম। পারকালাম্। টিকে থই ধরো, সব্ব বুঝি পারিবে।

একইসঙ্গে ঋজুদার সংস্কৃত, তামিল এবং ওড়িয়া বাণী শুনে তো আমার অবস্থা কাহিল। অতএব ধৈর্য ধরা ছাড়া উপায়ও নেই।

ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার আগে ঋজুদা মহুয়াটিলার পাশে, মানে আতারিয়া বনবাংলোর দিকে একটা প্রকাণ্ড বড় কুসুম গাছ দেখিয়ে বলল, আমি বারোটার সময়ে ওই গাছটার নীচে তোর জন্যে অপেক্ষা করব। আগেই আসতে পারি। তুইও আগে আসতে পারিস তোর তদন্ত সেরে।

আশা করি কুসুম গাছটা চিনতে তোর অসুবিধে হবে না কোনও।

আমি বললাম, বসন্তবনের কুসুম গাছ চেনা আবার কঠিন কী? নতুন ফিনফিনে ফিকে-মেরুন রঙা পাতাতে তো ভরে রয়েছে গাছ। যারা জানে না, তারা মনে করে ফুলই ফুটেছে বুঝি। চলে আসব আমি ঠিক। নো প্রবলেম।

তারপরে ঋজুদা বলল, তবে একটা বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ যে, প্রাণকুমারীকে বাঘে নেয়নি। ওই চৈতুরাম পোর্তের খারাপ ব্যবহারের হাত থেকে বাঁচতেই হয়তো সে পালিয়ে গেছে। নয়তো তার অন্য কিছু হয়েছে।

মানুষখেকো বাঘ মারতেই তো আমাদের এনেছেন ওঁরা। নিরুদ্দিষ্টর তদন্ত করতে তো আনেননি। আমি বললাম।

নিমকহারামি করিস না তো! যাদের ঘাড়ে চড়ে মধ্যপ্রদেশের ছত্তিশগড়ে এলি তাদের প্রতি কিছু তো কর্তব্যবোধ থাকবে! It’s all in the game! তা ছাড়া, অচানমারের মানুষখেকো যে আমরা মারতে পারবই এমন গ্যারান্টিই বা দেব কী করে? ওড়িশার ‘নিনিকুমারীর বাঘ’-এর কথা তোর মনে নেই? আমরা তো হতাশ হয়ে ফিরেই যাচ্ছিলাম না মারতে পেরে। হাজারীবাগের ‘অ্যালবিনো’র কথাও? সাদা বাঘ মারতে গিয়ে কী গোয়েন্দাগিরিই না করতে হয়েছিল। বাব্বাঃ।

তা অবশ্য ঠিক।

আমি নেমে গেলাম। খুব সাবধানে মাটির দিকে চোখ রেখে এগোতে লাগলাম।

ঋজুদা যখন বলেছে যে, বাঘ এদিকে আসে না তখন বেদবাক্য বলেই মেনে নেওয়া উচিত ছিল কিন্তু বনজঙ্গলের নিয়মকানুন আলাদা। সে কথা ঋজুদাও জানে। বেদবাক্যই হোক কি পিতৃবাক্যই হোক বনে-জঙ্গলে এবং বিশেষ করে মানুষখেকো বাঘের বা চিতার ব্যাপারে আমি কারও কথাতেই চলতে রাজি নই। ঋজু বোস, ঋজু বোসই। কিন্তু আমার শিক্ষানবিশিও তো কম দিন হল না। এই শিক্ষা ঋজুদারই দেওয়া। ঋজুদা বলে, আমি ভগবান নই। ভুল সকলের হতে পারে। আমার কথা, বাধ্য ছেলের মতন সবসময়েই মেনে নিস না। নিজের বিচার বুদ্ধিতে চলবি, এখন তো তুইও পাকা শিকারি।

ঋজুদার শাগিদ হওয়া আরম্ভ হয়েছিল যখন আমার বয়স ছিল মাত্র দশ-এগারো। তারপর আফ্রিকার সেরেঙ্গেটি ও রুআহা, বিহারে হাজারীবাগ, ওড়িশার লবঙ্গী, মধ্যপ্রদেশের সুফকর (অবশ্য সুকর-এ শিকার করিনি, ঋজুদার মুখে সেখানের সেই মারাত্মক বাঘের গা-শিউরানো গল্প শুনেছিলাম) আরও কত জায়গাতে কত অভিজ্ঞতা হল। কথাতেই বলে, গুরু মিলে লাখ লাখ চেলা মিলে এক। যদি ঋজুদার মতন গুরু পেয়েও যোগ্য চেলা এতদিনে না হয়ে উঠতে পারি তবে সে তো গুরুরই অসম্মান!

এই চৈত্রদিনের বনের সৌন্দর্য যে কী রকম তা বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তেমন ভাষা বা বিদ্যা আমার নেই। এখন চৈত্রর মাঝামাঝি। শোভা এখনও পুরো খোলেনি। যত দিন যাবে ততই খুলবে। রঙবাহারি হবে বনভূমি। কাঁচপোকা উড়বে। নানারঙা প্রজাপতির ঝাঁক ঘুরবে। মনে হবে, বনময়, ওরা কার কথা কয় রে!

মুখ নিচু করে কোনওরকম চিহ্ন, বাঘের অথবা মেয়েটির পাওয়া যায় কি না, তা দেখতে দেখতে চলেছি। অথচ মুখ নিচু করে জঙ্গলে চলা আদৌ উচিত নয়। বিপদ উপরেও থাকে। উপরে তাকিয়ে চলার অভ্যাস নেই বলেই বাঘের মতন মহাবলী প্রাণী এবং পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিকারি, মানুষের মতন চামচিকের হাতে বেঘোরে মারা পড়ে, যেসব শিকারি মানুষ, গাছের উপরে মাচা বেঁধে বসে থাকে, সেই সব মানুষের হাতে। তাই, মাঝে মাঝে উপরেও তাকাচ্ছি। বন্দুকের বাটটা ডান বগলের নীচে ধরে আর ডান হাতের আঙুলগুলি দিয়ে স্মল অফ দ্যা বাটকে ধরে খুব আস্তে আস্তে এক পা এক পা করে এগিয়েও এখন পর্যন্ত কিছুই চোখে পড়েনি সন্দেহজনক।

প্রায় আধ-ঘন্টাটাক হেঁটেছি। পাহাড় ছেড়ে সমতলে নেমে এসেছি। রোদ এখন পুরো জঙ্গলের আনাচ-কানাচেও পৌঁছে গেছে। অনেক পর্ণমোচী গাছের পাতা ঝরে গেছে। সেসব গাছে নতুন পাতা আসেনি এখনও। অনেক গাছে। আবার এসেছে। আবার কিছু গাছ আছে আমাদের বন-পাহাড়ে, যে-সব গাছের পাতা কখনওই ঝরে না। তারা চিরসবুজ।

জঙ্গলে একা একা এমন করে হাঁটতে হাঁটতে নেশা লেগে যায় আমার এমন যে, মনেই থাকে না বন কেবল সৌন্দর্যরই নয়, সেখানে নানারকম বিপদও আছে। কিন্তু সব বিপদকেই তুচ্ছ করতে ইচ্ছে যায়। সামনেই একদল ছাতারে পাখি ছ্যা ছ্যা করছে। কতগুলো পুটুস ঝোপের নীচে। পুটুস-এ ফুল এসেছে। গাঢ় কমলা রঙা। নানারঙা পুটুসের ফুল, ফলে যদিও বিভিন্ন অঞ্চলে। এমন কী একই অঞ্চলেও। এর ইংরেজি নাম Lantana। ভারতের প্রায় সর্বত্রই এবং সমুদ্রর সমতা থেকে হাজার দেড় হাজার ফিট অবধি এই ঝাড় দেখা যায়। এই পুটুস বা Lantana-র ঝাড় চিতা বাঘ আর তিতির-বটেরের এবং খরগোশেরও খাসা আস্তানা।

ছাতারেদের ডানদিকে একটি ছোট টিলা মতো ছিল সামনে, সেটাতে উঠে ভাল করে নজর করব চারদিকে যেই ভাবলাম, ঠিক তখনই আমার চোখ পড়ল একটি পথের উপরে। পায়ে চলা পথ নয়। তার চেয়ে চওড়া। জিপের চাকার দাগও আছে। তবে সম্ভবত ট্রাক যায় না। অনেকদিন আগে যখন এই শালের জঙ্গলে Coppice Felling হয়েছিল সম্ভবত, তখন ঠিকাদারদের ট্রাক যাওয়া-আসা করত। এখন অনেক বষাতে নানা আগাছার চারা জন্মে গেছে। জঙ্গল পুনর্দখল নিয়েছে তার জমিদারির। তবে চারাগাছগুলো কোথাওই হাঁটুর চেয়ে বেশি উঁচু নয়। তা ঠেলে সহজেই জিপ যেতে পারে এবং হয়তো যায়ও। হয়তো চোরা শিকারিদের জিপ। রাতের বেলা আসে তারা চেকনাকা এড়িয়ে, ঘোরা পথে।

সেই পথে নেমে এলাম আমি আস্তে আস্তে এবং নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই চমকে উঠলাম। একটা মস্ত দাঁতাল শুয়োর, ওজনে প্রায় দেড় থেকে দুই কুইন্টাল হবে, সেই পথের উপরে শুয়ে আছে পাশ ফিরে। যেন অপেক্ষাতে আছে, কেউ তাকে জম্পেশ করে ঘুমুবার জন্যে একটি কোলবালিশ এনে দেবে বলে।

পথের সেই জায়গাটি গভীর ছায়াচ্ছন্ন। একটু স্যাঁতস্যাঁতেও। তার মানে, জল আছে কাছে পিঠে। ভাবছিলাম, খুব বড় দাঁতাল বলেই কি একা ছিল? শুয়োর তো দলেরই জীব, মানুষের মধ্যেও যারা শুয়োর তারাও যেমন সবসময়েই দল বেঁধে থাকে।

বন্দুকটা দুহাতে ধরে এগিয়ে যেতেই এক বীভৎস দৃশ্য দেখলাম। কারও রাইফেলের গুলি লেগেছিল তার পেটে। সে কতখানি পথ যে দৌড়ে এসে শেষে এখানে পড়েছে আর চলতে না পেরে, তা জানা নেই, তবে তার নাড়িভুড়ির অনেকটা পথেই পড়ে গেছে। আর কিছু জড়িয়ে-মড়িয়ে আছে এই বনপথের আগাছাতে। জায়গাটার মাথার উপরে চাঁদোয়া আছে বলেই শকুনদের নজরে পড়েনি এখনও। তারা দেখতে পেলে এতক্ষণে এখানে কামড়াকামড়ি খেয়োখেয়ি শুরু হয়ে যেত। মানুষদের মধ্যে যেমন শুয়োর আছে তেমন শকুনও আছে। সবাই যূথবদ্ধ। যারা একলা থাকে তাদের অসাধারণত্বকে ছিন্নভিন্ন করবার জন্যে তারা সদাই উদগ্রীব। একলা মাথা উঁচু করে চলা মানুষ বা একলা জানোয়ারকে তারা সহ্য করতে পারে না। হীনম্মন্যতাতে ভোগে সবসময়ই।

মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। যে-কোনও মৃত্যুই আমার মন খারাপ করে দেয়। তা সে কাঁচপোকার মৃত্যুই হোক, কি শুয়োরের!

জানি না, এই সব শিকারিরা কী ধরনের শিকারি! অত বড় দাঁতাল শুয়োরটাকে মাটিতে পায়ে দাঁড়িয়ে মারার সাহস তাদের নেই। আহত জানোয়ারের যন্ত্রণা যত কম সময়ের মধ্যে সম্ভব তা লাঘব করা যে প্রত্যেক শিকারীরই কর্তব্য তা এরা নিশ্চয়ই মানে না। এই সব শিকারিরা জানোয়ারদের চেয়েও অধম।

শুয়োরটার ওপরে, এখুনি জঙ্গলের বড় বড় নীল মাছি পড়বে। শয়ে শয়ে। ক্ষতস্থানে বসবে আর উড়বে। তাদের সকলের ডানার শব্দ দূর থেকে শুনলে মনে হবে যেন কোনও মোনো-এঞ্জিন প্লেন, টাইগার-মথ বা বনাঞ্জা উড়ছে, যে-সব প্লেন চালিয়ে ফ্লাইং ক্লাব থেকে ঋজুদা পাইলটের লাইসেন্স পেয়েছিল বহুদিন আগে।

শুয়োরটা পেরিয়ে, সেই রাস্তা ধরে, ঋজুদা যেদিকে নেমেছে সেদিকেই আর কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখলাম একটি ছোট নালা সেই বনপথটিকে আড়াআড়ি পেরিয়ে গেছে। নালাটি সম্ভবত আতারিয়া নদী থেকেই বেরিয়েছে। কালো ও খয়েরি নুড়ি, পাথর, খয়েরিরঙা কতকগুলো ফুলের ঝোপ নালাটার বুকের মাঝে মাঝে। নামেই নালা। পায়ের পাতা ভেজে না এমন জল তিরতির করে বইছে। আর মাসখানেকের মধ্যেই শুকিয়ে যাবে।

কী মনে হওয়াতে ভাবলাম, নালাটার পাশে পাশে কিছুটা এগোই। চল্লিশ পঞ্চাশ মিটার যেতেই দেখি নালাটা ডান দিকে ঘুরেছে। Right Angle turn, মানে, ঋজুদার যেদিকে বাঘ বা প্রাণকুমারীর চিহ্ন খোঁজার কথা, সেদিকে। ভাবলাম, ভালই হল, ঘড়িতেও ততক্ষণে সোয়া এগারোটা বাজে। জঙ্গলে কোনও কিছু Tracking করতে বাঘেরও যেমন সময় লাগে, শিকারিরও লাগে। এক পা থেকে আরেক পা যেতে দু তিন মিনিট কেটে যায়। একেবারে নিঃশব্দে আড়াল থেকে আড়ালে চলতে হয়। ভাবছিলাম, মহুয়াটিলা পেরিয়ে নবীন-পাতাতে ভরে-যাওয়া সেই প্রাচীন কুসুম গাছটির দিকে যাওয়ার আগেই হয়তো ঋজুদার সঙ্গে এই সমতল বনভূমিতেই দেখা হয়ে যাবে।

নালার বালিতে নানা জানোয়ারের পায়ের দাগ দেখলাম। একটি প্রকাণ্ড ময়াল সাপ খুব ধীরে ধীরে নদী পেরোল আমারই সামনে। চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমি। প্রায় চার থেকে ছ মিনিট নিল সে ওই অল্প চওড়া নালাটি পেরোতে। আবার সামনেই একটা বাঁক নিয়েছে নালাটা। সেই বাঁকের মুখে গিয়ে যখন পৌঁছেছি, ঠিক সেই সময়ে আমাকে ভীষণই চমকে দিয়ে হঠাৎ একজোড়া Red Turtle Dove সেই বাঁকের মুখ থেকে প্রচণ্ড ভয়ার্তস্বরে ডেকে উঠে, নিচু দিয়ে, প্রায় জমির সমান্তরালে উড়ে এল আমারই দিকে। পরক্ষণেই আমাকে দেখে আরও ভয় পেয়ে, ডাকতে ডাকতে অদৃশ্য হয়ে গেল পেছনে। ওই জাতের ঘুঘুদের অমন ব্যবহার করতে দেখিনি কখনও আগে আমাদের দেশের কোনও জঙ্গলেই। হতবাক হয়ে গেলাম। বাঁপাশে একটি বাদামি কালোতে মেশা লম্বা লেজওয়ালা Crow-Pheasant একা একাই এক্কা-দোক্কা খেলতে খেলতে আসছিল। সেও কিছু দেখে, হঠাই ভয় পেয়ে বাঁদিকের গভীর নলি বাঁশের জঙ্গলে ঢুকে গেল।

কেন?

কে জানে। আমার গা-ছমছম করে উঠল। হতবাক হবার আরও বাকি ছিল আমার। দেখলাম যে, বাঁকের ওপাশ থেকে নালাতে যে জল বয়ে আসছে তিরতির করে, তাতে রক্ত মিশে আসছে। ফিকে গোলাপি রঙা। তার মানে, রক্তর উৎসটা যেখানে, সে জায়গাটা দূরে। খুব কাছে হলে, জলের রং গাঢ় লাল বা লাল দেখাত।

আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখানেই সঙ্গে সঙ্গে ফ্রিজ করে গেলাম। শুধু নিঃশব্দে বন্দুকটাকে দুহাতে তুলে ধরে বুড়ো আঙুলটা সেফটি-ক্যাচ এর উপরে রেখে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঠিক সেই সময়েই খপ করে একটা শব্দ হল অথবা চপ করে।

কিছু কি খাচ্ছে কেউ?

কে খাচ্ছে?

বাঘ?

বাঘই কি?

 কিন্তু কী খাচ্ছে?

বুঝলাম, যদি বাঘই হয়, তবে সে এখন গভীর মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে। খাদক, বাঘ নাও হতে পারে। হয়তো চিতা। কিন্তু স্বাভাবিক বাঘ বা চিতা কেউই বেলা পৌনে বারোটার সময়ে সচরাচর মড়িতে যাবে না। তবে এটাও ঠিক যে কোনও বাঁধাধরা নিয়মই খাটে না বনে-জঙ্গলে। সবসময়েই ব্যতিক্রমের জন্যে তৈরি থাকতে হয়। বিশেষ করে মানুষখেকোদের বেলাতে।

ভেবে দেখলাম যে, আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেদিক দিয়ে নালার বাঁকে পৌঁছতে গেলে যে মুহূর্তে আমি বাঁকে পৌঁছব, সেই মুহূর্তেই বাঘ বা অন্য জানোয়ার আমাকে দেখে ফেলবে এবং সঙ্গে সঙ্গেই সাক্ষাৎ যমদৃত হয়ে উড়ে আসবে আমার উপরে। উল্কারই মতন। যাদের তেমন পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে, তারাই জানেন যে, সেই অভিজ্ঞতা মোটেই মধুর নয়।

কিছুক্ষণ অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে, বন্দুক রেডি-পজিশানে ধরে আমি খুবই আস্তে আস্তে পিছু হটতে লাগলাম। কিছুটা পিছু হটে এসে তারপর ডানদিকের ঘন পুটুসের ও নলি বাঁশের ঝাড়ের আড়ালে আড়ালে নিশ্বাস বন্ধ করে খুব সাবধানে এগিয়ে গেলাম এমন একটি জায়গাতে, যেখান থেকে শব্দ হয়েছিল সেই জায়গাটার দেখা পাওয়া উচিত। পিছু হটে তারপর এতটুকু পথ এক পা এক পা করে এগোতেই আমার প্রায় পনেরো মিনিট সময় লেগে গেল।

আমার আন্দাজমতন জায়গামত পৌঁছে আরও মিনিট দু-তিন দম নিলাম। তারপর একটি মস্ত শালগাছের আড়াল নিয়ে আবার শামুকের গতিতে এগোতে থাকলাম। তার আগে দেখে নিয়েছিলাম যে, রোদটা আমার উল্টোদিক থেকে আসছে। আমার ছায়া যেন বাঘ দেখতে না পায়, তাই। এদিক দিয়ে এগোলে আমার ছায়া বাঘ দেখতে পাবে না। তারপর সেখানে পৌঁছে শালগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পুরো শরীরটা লুকিয়ে রেখে শুধু চোখদুটি বের করে যা দেখলাম, তাতে আমার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেল।

একটি মেয়ে, সেই নালার ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। পুরোপুরি উদোম। পিঠময় তার চুল ছড়ানো। কিছু চুল ছিঁড়ে গেছে। ডান পাটি হাঁটু থেকে কেটে নিয়ে বাঘ তা চিবোচ্ছে। কটাং করে শব্দ হল একবার। দেখলাম মেয়েটির পেছনের বাঁদিকটাও পুরো খেয়ে ফেলেছে। সেখানে কোনওই মাংস নেই আর। দগদগে লাল ক্ষত।

কিন্তু পরক্ষণেই আরও ভয় পেয়ে গেলাম দেখে যে, বাঘ হঠাই খাওয়া থামিয়ে আমার ডানদিকে মনোযোগ দিয়ে কী যেন দেখতে লাগল। দেখলাম যে, খুব বড় না হলেও, বেশ বড় বাঘ। তার মুখে, গোঁফে মেয়েটির শরীরের লাল রক্ত লেগে রয়েছে। মনে হচ্ছে, এই মাত্র হোলি খেলে উঠেছে সে বাঘ। ওই দৃশ্য দেখে আমার গা বমিবমি করতে লাগল। তবে বাঁচোয়া এই যে, বাঘ আমার দিকে না তাকিয়ে, অন্যদিকে, অন্যকিছুর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে অথবা কোনও ভয়ে ভীত হয়েছে। তাই তার সব মনোযোগ সেইদিকেই।

আমার দিকে পুরো ব্রডসাইডে দাঁড়িয়ে আছে এখন বাঘ। আলো এসে পড়েছে ঝরোঝরো শালপাতাদের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে। বুক, গলা, মাথা সবই দেখা যাচ্ছে এবং বড়জোর বারো থেকে পনেরো মিটারের মধ্যে। বুঝলাম, এই মোক্ষম মুহূর্ত। তখন আমি বাঘের এতই কাছে চলে গেছি এবং পায়ে হেঁটে যে, হয় আমি বাঘকে মারব নয় বাঘ আমাকে মারবে। ইসপার নয় উসপার।

আর কালক্ষেপ না করে আস্তে আস্তে আমি বন্দুকটাকে তুললাম, তারপর ট্রিগারে তর্জনী উঁইয়ে যেই ট্রিগার টানতে যাব অমনি দাঁড়ানো বাঘ বসে পড়ল। ইংরেজিতে যাকে বলে Crouching Position-এ। বাঘ এবারে লাফাবে। মানে, আক্রমণ করবে ওই জায়গা থেকে অদৃশ্য কোনও লক্ষ্যর উপরে। এই মুহূর্তেই লাফাবে, আগুনের হল্কার মতন। তার লেজটা পিছনে লম্বা সোজা শক্ত হয়ে গেছে। লাফালেই সে আমার দৃষ্টির বাইরে চলে যাবে। তাই আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে ঋজুদার ওভার-আন্ডারটার যে ব্যারেলে লেথাল বল পুরেছিলাম, সেটির ট্রিগার আগে টানলাম বাঘের ঘাড়ের সঙ্গে শরীরের সংযোগ যেখানে হয়েছে সেখানে লক্ষ্য করে এবং সঙ্গে সঙ্গেই অন্য ব্যারেলের এল. জি. ও ফায়ার করে দিলাম ব্যারেলটাকে সামান্য ডাইনে ঘুরিয়ে বাঘের কান লক্ষ্য করে, বিহারে যাকে বলে, কানপার্টিয়ামে।

বাঘের লাফানো আর হল না। মনে হল, সেও যেন ফ্রিজ করে গেল। বাঘের মাথাটি তার সামনের দু-পায়ের মধ্যে নেমে এল। ধীরে ধীরে চোখ দুটি বন্ধ হয়ে এল।

গলা দিয়ে কুলকুচি করার মতন আওয়াজ উঠল মনে হল একটা। অতি সংক্ষিপ্ত। তারপর স্থির হয়ে গেল। ঠিক সেই সময়ে সেই Red Turtle ঘুঘু জোড়া যেমন করে উড়ে এসেছিল আমার দিকে, তেমন করে খুব নীচ দিয়ে উড়ে ডানার সাট-সাট শব্দ তুলে যে দিক থেকে এসেছিল সেদিকেই ফিরে গেল।

পরপর, প্রায় একই সঙ্গে হওয়া আমার বন্দুকের দুটি গুলির শব্দে বন গমগম করে উঠল। হনুমানেরা হুপ-হুপ-হুপ করে বড় বড় গাছের পাতাতে ঝুপঝুপ শব্দ করে ঝাঁপাতে লাগল। বাদামি রঙা বড় বড় হিমালয়ান স্কুইরেল উঁচু এগাছ থেকে সেগাছে পাতায় পাতায় ঝরঝরানি তুলে চিকচিক আওয়াজ করতে লাগল।

মিনিট দুয়েক পরে বাঘটা যেদিকে লাফাতে যাচ্ছিল সেদিক থেকে আমাকে প্রচণ্ড চমকে দিয়ে ঋজুদা বলল, তুই আমার প্রাণ বাঁচালি আজ রুদ্র। ওই ব্যারেটা ওভার-আন্ডারটা তোকেই দিয়ে দেব। বাঘটা তো আমাকে শেষই করে দিত আজ। আমি বোধহয় বুড়ো হয়ে গেছি।

তুমি এতক্ষণ আওয়াজ দাওনি কেন?

হতবাক হয়ে একটা পাথরে বসে পড়ে বললাম আমি।

বাঘ প্রাণকুমারীকে কোথায় ধরেছিল, তা চোখে পড়ার পরে সেই Trail-এর পিছু পিছু আসাতে ভেবেছিলাম যে বাঘকে আমিই দেখতে পাব ও আমাকে দেখার আগে। বাঘকে অথবা মড়িকে। তাই তোর বিপদের কোনওই আশঙ্কা করিনি। তোর তো এদিকে আসার কথাও ছিল না। আশ্চর্য! এত কাছে এসেও আমি বাঘটাকে দেখতে পেলাম না!

কটাং করে হাড় ভাঙার আওয়াজ পাওনি?,

না তো!

ঋজুদা হতভম্ব গলাতে বলল।

আশ্চর্য! তোমার কানটা একবার কোনও ভাল E.N.T.-কে দেখাও।

–ওটা কানের জন্যে হয়নি। যখন মৃত্যুর সময় আসে, মানুষ তখন অন্ধ এবং বধির হয়ে যায়। আমার মৃত্যু ট্যাঙ্গো নাচছিল আজ আমার সঙ্গে। তুইই বাঁচালি। সত্যিরে! আমি সত্যিই বুড়ো হয়ে গেছি!

বুড়ো না ছাই। আমি বললাম। এখনও বুড়ো-হাড়ে ভেলকি দেখাও যখন তখন!

তারপরই বললাম, আচ্ছা মেয়েটিকে বাঘ ধরেছিল কোথায়?

 ঋজুদা বলল, মহুয়া-ঘেরা টিলাটার অনেকই নীচে। বেচারির হয়তো পেটের গোলমাল হয়েছিল। নইলে, নালার দিকে আসতে যাবে কেন এতখানি নেমে। এই নালাটা আর মহুয়াটিলার মাঝামাঝি জায়গাতে আমি ওর ব্লাউজের রক্তমাখা একটা ফালি পাই। আরও একটা ভুল করেছিলাম আমি। ভেবেছিলাম, বাঘ নিশ্চয়ই মড়িতে নেই এই অবেলায়। দূরে কোথাও আছে। যেমন সব মানুষখেকো বা গোরুখেকো থাকে সচরাচর।

তা হলে কনসার্ভেটর সাহেবের থিওরিটা ভুল বলে প্রমাণিত হল। বল?

না। আমারই ভুল। কনসার্ভেটর তো বই-পড়া শিকারি। আজকালকার আর্ম-চেয়ার কনসার্ভেশানিস্টদের মতন। তাঁরা অভয়ারণ্যর প্রায়-পোষা বাঘ দেখেই ভাবেন সব জেনে গেছেন বাঘ সম্বন্ধে। যেহেতু একটিও kill পথের এ পাশে হয়নি সেইহেতু যে কখনওই হবে না, এমন ভাবাটাই পরম মূখামি হয়ে ছিল আমার পক্ষে। ওঁর মানুষখেকো বাঘের অভিজ্ঞতা না থাকতে পারে, আমার তো ছিল!

আমরা দুজনে মহুয়াটিলার দিকে ধীরে ধীরে উঠতে লাগলাম। প্রথমদিনেই যে কার্যসিদ্ধি হবে এ অভাবনীয় ছিল। নামবার সময়ে এক পা এক পা করে নেমেছিলাম। ওঠবার সময়ে কোনওরকম সাবধানতারই প্রয়োজন ছিল না তাই তাড়াতাড়িই উঠছিলাম। তা ছাড়া, সত্যি বলতে কী আমার নাকেও সকালের খাঁটি ঘি-এ ভাজা পরোটার গন্ধটা যেন উড়ে এল। খিদেও পেয়েছিল জব্বর।

ঋজুদা বলল, দুটো চার নম্বর ছররা আকাশের দিকে মুখ করে ছুঁড়ে আওয়াজ কর। ভটকাই আর ওরা পাহাড়ের ওপর থেকে ছোঁড়া এ গুলির শব্দ শুনতে পাবে। ওরা না এলে, বাঘটা কোথায় আছে তা তাদের জানাব কী করে! পাঁচ-দশ গ্রামের মানুষ দেখতে আসবে তাদের যমকে।

পরীক্ষা যেদিন শেষ হয় সেদিন যেমন হালকা লাগে, বিশেষ করে, ভাল পরীক্ষা দেবার পর আমার তেমনই লাগছিল।

গুলি করলাম মানে, ঋজুদা যেমন বলল। তারপর একটি মোটা শাল গাছে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। ঋজুদা পাইপে নতুন টোব্যাকো ভরে পাইপ ধরাল।

কতক্ষণ আমরা সেখানে বসেছিলাম জানি না। সংবিৎ ফিরল হঠাৎ বন্দুকহাতে ভটকাই আর তার পেছনে পেছনে চৈতুরাম পোর্তে এবং আরও জনা দশেক মানুষকে দেখে। তারা দৌড়তে দৌড়তে লাফাতে লাফাতে আসছিল। এমনকী রূপকুমারীও।

ঋজুদার কাছে সংক্ষেপে প্রাণকুমারীর কী হয়েছে তা শুনে মুখিয়া চৈতুরাম পোর্তে ডুকরে কেঁদে উঠল।

ঋজুদা রূপকুমারীকে বলল, তোমরা মেয়েরাই যাও ওখানে আগে, একটি শাড়ি নিয়ে। প্রাণকুমারীকে ঢাকা দিয়ে নিয়ে এসো অথবা ওখানেই দাহ করার বন্দোবস্ত করো। ওর আপনজন তো তোমরাই। ছেলেরা পরে বাঘটা বয়ে আনবে।

রূপকুমারী বলল, না না জঙ্গলে দাহ করব না। তা ছাড়া ওকে তো দাহ করা যাবেও না। অপঘাতে মৃত্যু। ওকে আমরা আমাদের কবরস্থানে কবর দেব।

ভটকাই তক্ষুনি বাঘটা দেখতে পাচ্ছিল না বলে হাত কামড়াচ্ছিল।

ঋজুদা বলল, আগে মেয়েরা যাক। মরে গেলেও কি লজ্জা যায় মানুষের! মেয়েটা ভারী লজ্জা পাবে। এখন যাস না! আমাদের নেহাৎ না গিয়ে উপায় ছিল না, তাই।

চৈতুরাম তখনও হাউ হাউ করে কাঁদছিল।

আমি ভাবছিলাম, মানুষের বাইরের চেহারা দেখে কখনও কারোকে বিচার করাটা উচিত নয়। ও হয়তো মেয়েরই মতন ভালবাসত প্রাণকুমারীকে। কিন্তু কী করবে? সমাজ। জাতপাত। ও যে আবার মুখিয়া!

এইজন্যেই আমি শুয়োরই হোক কি মানুষই হোক, কারোকেই পছন্দ তো করিই না, রীতিমত ঘেন্না করি, যারা দলে থাকে তাদের। সমাজও একটি মস্ত দল। সমাজে যারা থাকে তারাও আস্তে আস্তে তাদের অজানিতে যূথবদ্ধ জানোয়ারের মতনই হয়ে যায়।

বোধহয়।

ঋজুদা বলল, ওরে ভটকাই। আতারিয়া বাংলোয় গিয়ে বল, সব খাবার দাবার এখানেই নিয়ে আসতে। গরম করা তো প্রবলেম নয় কোনও। আজ এই মহুয়াটিলাতেই খাব। কাল তো অচানমার থেকে চলেই যাব।

কালই চলে যাব? তা হলে জঙ্গল তো দেখাই হবে না। আমার কী হবে? অচানমারের বাঘও তুমি মেরে দিলে। আমার কি কোনওই কনট্রিবিউশান থাকবে না?

থাকবে।

দাও তোমার পাটা একটু টিপে দিই ঋজুদা।

ঋজুদা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, আমার নয়, আমার নয়। পা টেপ তোর জানি-দুশমন রুদ্র রায়ের।

কেন?

বাঘটা যে ওই মেরেছে। শুধু মারেইনি, আমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছে ও আজ নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে।

নিনিকুমারীর বাঘের হাত থেকে যেমন বাঁচিয়েছিল?

ইয়েস! কিন্তু এখন তুই কী করবি?

যাই করি, বাজে লোকের পা আমি টিপব না। আমার ইনিংসও আসবে। এক মাঘে শীত যায় না!

ভটকাই বলল, ভটকাইসুলভ গলাতে।

 নানা পাখি ডাকছিল চৈত্রর আগুয়ান সকালে, চারধার থেকে। নববর্ষের সময়ে এইসব বন-পাহাড়, কচি কলাপাতা রঙা জমির শাড়িতে সেজে উঠবে। নানা রঙা পোলকা-ডট থাকবে সে শাড়িতে।

যখন আমার খুবই আনন্দ হওয়ার কথা ছিল, গর্বিত হওয়ার কথা ছিল, ঠিক তখনই প্রাণকুমারীর জন্যে মনটা দুঃখে ভরে গেল।

ভাবছিলাম, ঋজুদা, আমি আর ভটকাই কটা মানুষখেকোই বা মেরেছি বা মারতে পারব? এই জাত-পাত-এর মানুষখেকোদের যতদিন না নির্মূল করা যাচ্ছে, ততদিন হাজার হাজার প্রাণকুমারীরা আমাদের অজানিতেই নিরুপায় হয়ে নিয়তই মারা যাবে।

আর সেই সব মৃত্যুর কতই বা রকম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *