৫.২ বে-আইনি চোলাই

কিন্তু যতটা সহজ ভেবেছিল বলাই, তা হল না। প্রথম কিছুদিন মনে হল, এদেশে বে-আইনি চোলাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কুমোরের মাটির হাঁড়ির বোঝা, তরকারির ঝাঁকা, মাছের চুপড়ি, বিচুলির গাড়িগুলি তন্ন তন্ন করে দেখলেও অবাক হতে হয়। মনে হয়, এ দেশে কোনওদিন বেআইনি চোলাই বোধহয় ছিল না। যাও বা দু-চারটে ধরা পড়ল, সবই অন্য লোকের। চিরঞ্জীবের দলের কেউ নয়। হলে চিরঞ্জীব জামিন দিতে আসত। সে হিসেবে চিরঞ্জীব আদর্শ দলপতি।

কিন্তু সিক্রেট রিপোর্ট অন্য কথা বলছে। বিশেষ করে চিরঞ্জীবের বিষয়েই খবর পাওয়া গিয়েছে, তার লোকেরা এদিক ওদিক থেকে প্রায় পনেরো মন গুড়, দশ বারো মন কয়লা কিনেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে কম করে, বিশ বার (bar) পাকিস্তানি ছাপ মারা নিশাদলগুলিকে বহন করতে দেখেছে কৃষক সমিতির লোকেরা। সংবাদ তারাই দিয়েছে। অথচ কোথায় জাওয়া বসছে, কোন পথে স্মাগল হচ্ছে, কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না! ওদিকে অখিলবাবু থেকে শুরু করে, এখানকার গোটা আবগারি বিভাগ চিরঞ্জীবের দলের ওপর চোখ রাখছে। বিশেষ অখিলবাবু আর ইনফর্মার ভোলা-কেষ্ট তো অধিকাংশ সময় বাগদিপাড়াতেই আছে, যদিও অখিলবাবুর ভাবসাব কেমন যেন ভাল লাগছে না বলাইয়ের। দুর্গার উঠোনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবার দাবি করছেন ভদ্রলোক। দুর্গার কাছে চা খেতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। আশ্চর্য! তবু ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে চুপ করে আছে বলাই।

কিন্তু ক্রমেই তার বুকের মধ্যে একটা অসহায় জ্বালা বাড়ছে। এ কি শুধুই ভেলকি? না কি বলাইরাই অপদার্থ। এর আগে ভিন্ন হাতে হলেও চিরঞ্জীবের মাল ধরা পড়ছিল। কোথায় গেল তারা। কেমন করে অদৃশ্য হল?

কেবল কয়েকটি ব্যাপারে, একটি নতুন আশার আলো দেখতে পেয়েছে বলাই। সনাতন ঘোষকে জব্দ করেছে চিরঞ্জীব। সে নিজে, সনাতনের বসানো জাওয়া খুঁজে খুঁজে বার করেছে। নিজের হাতে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে, খুঁচিয়ে সেই জাওয়া ভেঙেছে। সনাতন দলবল নিয়ে মারামারি করতে গিয়েও থমকে গিয়েছে। হাত তুলতে সাহস করেনি। চিরঞ্জীব পরিষ্কার নাকি জানিয়েছে, প্রাণের মায়া না থাকে তো গায়ে হাত তুলবে। কিন্তু প্রতিশোধ নেবই। আমার জাওয়া যারা আবগারিকে ধরিয়ে দিতে পারে, তাদের জাওয়া আমি নিজের হাতেই ভাঙব। পুলিশের কাছে গিয়ে টিকটিকির মতো বলে আসতে পারব না।

সেই ভাঙা জাওয়া বিনয় আর কাসেম গিয়ে দেখে এসেছে। শুধু তাই নয়। যে উড়ানখোলার জঙ্গলে চিরঞ্জীবের জাওয়া ধরা পড়েছিল, সেখানেই ইয়াসিনের একটি জাওয়া নিজের হাতে ভেঙেছে চিরঞ্জীব। ইয়াসিনকে লোকে জানে কৃষক-সমিতির লোক বলে।

ইয়াসিন বলেছিল চিরঞ্জীবকে, তুই কি আবগারির লোক, যে নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছিস।

চিরঞ্জীব জবাব দিয়েছে, না, আইনের লোকেরা তোমাদেরই হাতে। তোমরা সেখানে গিয়ে কলকাঠি নেড়ে আসো। এটা আমার আইন। তোমার একটা জাওয়া ভাঙলুম, আর একটা ভাঙব। তোমার বাড়িতে বসালেও ভাঙব। আর সনাতন ঘোষেরও আর একটা ভাঙব। তোমরা আমার দুটো জাওয়া ধরিয়ে দিয়েছ। তোমাদের চারটে যাবে। পথে ইয়ে করবে আবার চোখ রাঙাবে, তত মগের মুলুক পাওনি। এবার ডেকে নিয়ে এসো শ্রীধরবাবুকে যদি সাহস থাকে। আর এ বৃত্তান্ত পোস্টারে লিখে, সেঁটে দিয়ে এসো হাটে। না হয় বলো তো আমিই দেব।

শ্রীধরের নাম শুনেই বোধহয়, ইয়াসিন কেমন যেন চুপসে গিয়েছে। পোস্টারের কথায় আরও। জোর গলায় সে কথা বলতে পারেনি।

বলাই বুঝতে পারল, চোলাই মদের ব্যাপারটা এতদিন রাজনৈতিক দলাদলির মধ্যে আসেনি। কিন্তু শ্রীধর দাসের এক বক্তৃতায়, ব্যাপারটার মোড় ঘুরে গিয়েছে। যে-সনাতন আর ইয়াসিন দলের ব্যাপারে পরস্পরের অনেক দূরে, প্রায় মুখ দেখাদেখি নেই, তাদেরই শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে একজন। ইয়াসিন যদি কৃষক-সমিতির প্রতি বাধ্য থাকে, তবে তাকে এ সব বিষয় থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। সনাতনের সঙ্গে লড়তে হবে চিরঞ্জীবকে! কারণ একবার যখন সনাতন ঘা খেয়েছে, সে শোধ নেবে। শাসনের ওপর-মহলে তার গতিবিধি আছে। হয় সে চিরঞ্জীবকে কোনও অপরাধে জড়িয়ে চালান করবে। অন্যথায় সনাতনকেই আর দশজনের সামনে বার বার অপমানিত হয়ে চোলাইয়ের পথ ছাড়তে হবে।

এই দুটিই চায় বলাই। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চায় সে। আর এটাই ঘটবে বলে মনে হয়। কারণ, ইয়াসিন খুব সম্ভবত সরবে শ্রীধরবাবুর নির্বাচনী প্রচারে ইতিমধ্যেই নেমেছে। তিন মাসের মধ্যেই নির্বাচন। কৃষক-সমিতি কোনও কালেই চোলাইয়ের ব্যাপারটাকে এত বড় করে তোলেনি। তোলবার কথাও নয়। চিরঞ্জীবকে ঘায়েল করতে গিয়ে, শুধু এ অঞ্চলেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। ঠিক হয়েছে। ভূমিহীন দরিদ্র কৃষকেরা যদি সঙ্গে দাঁড়ায়, দারিদ্র্যের সুযোগে যদি তাদের টেনে না আনা যায়, তা হলে বেআইনি চোলাই বন্ধ হতে বাধ্য। শ্রীধর দাস নিজে যাদের জন্য বারে বারে জামিন দিতে আসেন, তাদের তিনি সরিয়ে নিতেই চাইবেন নিশ্চয়।

কিন্তু আপাতত চিরঞ্জীব। সে রাত্রের ঘুম কেড়েছে, সমস্ত শান্তি ছিনিয়ে নিয়েছে বলাইয়ের। মামলা তুচ্ছ, কিন্তু চিরঞ্জীবকে ধরাই যাচ্ছে না। যেন বুকের ওপর বসে আছে বলাইয়ের। যখনই সে চিন্তা করে, তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে চিরঞ্জীবের মুখ। ঠোঁটের কোণে বাঁকা বিদ্রূপ হাসি। প্রতি মুহূর্তে উপহাস করছে বলাইকে। চিরঞ্জীব যেন হাসতে-হাসতে আগুন উসকে দিচ্ছে বুকের। শুধু আবগারির লোক নয়। নিশ্চয় সনাতন-ইয়াসিনদের চোখকেও ফাঁকি দিচ্ছে সে। নইলে তারা বলে দিত।

ঠাট্টা করে শুধু মলিনা। হেসে বলে, তুমি যে বাইরের ঝড় ঘরে টেনে আনলে? নাওয়া-খাওয়া অনিয়মিত, আমার সঙ্গেও কথা বলবার অবসর পাও না। এক আসামিকে ধরাতেই এত ব্যাপার।

বলাই বলে, এক আসামি-ই! মলিনা, এ গোটা অঞ্চল থেকে বেআইনি চোলাই হয়তো তুলে দিয়ে যাব আমি।

মলিনা খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে, তুমি নিজে বিশ্বাস করো এ কথা?

এত তীব্র অবিশ্বাসের সামনে বলাই যেন কেমন থমকে যায়। তখন মনে হয়, বিশ্বাস করতে তার ইচ্ছা করে। কিন্তু পারে না। মনে হলেই, অক্ষম রাগে সে আরও জোর দিয়ে বলে, নিশ্চয় করি।

মলিনার হাসির শব্দটা থেমে আসে। সে বুঝতে পারে বলাই রেগে উঠেছে। তারপর সে গম্ভীর হয়ে বলে গোটা অঞ্চল থেকে তোলা যাবে কি না জানিনে। কিন্তু আমার ইচ্ছে করে ওদের দুজনকে গিয়ে আমি কিছু বলে আসি।

অর্থাৎ চিরঞ্জীব আর দুর্গাকে। অপরাধ-বিজ্ঞান সম্পর্কে এমনি ধারণা মলিনার! রক্ত-খাওয়া বাঘকে মিষ্টি কথায় পোষ মানানোর মতো। সেই এক পুরনো পচা ভালবাসার বুলি। মলিনার মতে সেটা সংসারের সব কিছুর সবচেয়ে বড় রক্ষা কবচ। তখন বলাই বলে, তোমার এই সাহায্যটুকু আমার বাকি আছে।

বলে সে সরে যায়। জানে, মলিনা আঘাত পায়। তবু একটি নিটোল ভালবাসার কল্পনায় বিভোর হয়ে থাকে। মানুষের কি এমনি হয়? কোথাও বড় রকমের একটি অভাব থাকলেই, মনে মনে সে একটি কল্পনার জগৎ তৈরি করে শান্তি পেতে চায়?

কিন্তু বলাইয়ের মন শান্ত হয় না। বুকে তার দাহ। সর্বশক্তি দিয়ে একটা আঘাত হানবার জন্য ফুঁসতে থাকে। আঘাতের জায়গাটা পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ অল্প কয়েক বছরের চাকরিতে, অনেকগুলি রিয়োয়ার্ড সে পেয়েছে। শুধু শিলিগুড়িতে নয়। এখানেও। কিছুদিন আগেও, গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ওপর সে একটি প্রাইভেট ডজগাড়ি আটকেছিল। রীতিমতো উর্দিপরা ড্রাইভার। যাত্রীটি পোশাকে পুরোপুরি সাহেব। পরে পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল, বিহারের অধিবাসী, ব্যবসায়ী কলকাতার। সাধারণত দ্বারভাঙার উত্তর সীমান্ত নেপালের জয়নগর অঞ্চল থেকে গাড়িটা গাঁজা বহন করে থাকে। এটা বলাইয়ের ধারণা। কিন্তু ডজের এই নতুন মডেলের বিরাট ঝকঝকে। গাড়িটাকে সন্দেহ করা কঠিন। চ্যালেঞ্জ করতে সাহস না হবারই কথা। করবার আগে একশোবার ভেবেও সংশয় থেকে যায়। কিন্তু বলাই সাহস করেছিল। কারণ, গাড়িটাকে মাস কয়েক আগে, রাত্রি আটটার সময় মহকুমা শহরের বেশ্যাপল্লিতে একদিন দাঁড়ানো অবস্থায় দেখেছিল। এত বড় গাড়ি মফস্বলের বেশ্যাপল্লিতে কেন? ও গাড়ির মালিক নিশ্চয় ওরকম জায়গায় প্রমোদ করতে আসবে না। একমাত্র মালিকের চোখ ফাঁকি দিয়ে ড্রাইভারের পক্ষেই তা সম্ভব। কিন্তু ড্রাইভার বসেছিল নিজের জায়গায়। গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে পাড়ার চারদিকে চোখ বোলাচ্ছিল।

সঙ্গে সঙ্গে, মহকুমা শহরের আবগারির একজন ইনফরমারকে সে পাঠিয়েছিল খোঁজ নেবার জন্য। খবর পেয়েছিল, একটি নতুন অবাঙালি মেয়ে ও-পাড়ায় উঠেছে। লোকটি তার ঘরেই উঠেছে। এবং ও-পাড়ায় লোকটি একেবারে অচেনা নয়। তবে আবগারির কোনও গন্ধ নেই। কিন্তু লোকটাকে ভয় করার কোনও কারণ নেই, এটা বুঝেছিল বলাই।

তারপরেও দু-একবার গাড়িটাকে চোখে পড়েছে। সেই ছোট্ট ত্রিকোণ পার্কের, ডেনিস স্মৃতিফলকের কাছে, পুরনো কামানের মুখোমুখি একদিন বেলা তিনটের সময় দেখেছিল।

যেদিন গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ওপর সে চ্যালেঞ্জ করেছিল, সেইদিন মাত্র একটি ব্যাপারই সাহস জুগিয়েছিল তার। প্রথমে দূর থেকে সে লক্ষ করেছিল, পিছনের সিটে বসে লোকটি গাড়ির বাইরে মুখ বাড়িয়ে সামনে কিছু নিরীক্ষণ করছে। বলাইকে দেখামাত্র মুখ সরিয়ে নিয়েছিল। ড্রাইভার গাড়ির স্পিড় দিয়েছিল বাড়িয়ে। মুহূর্তে একটা ঝোঁক চেপে বসেছিল বলাইয়ের মনে। দাঁড় করিয়েছিল সে গাড়িটাকে।

যাত্রীটি চোখ পাকিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করেছিল, এ সবের মানে কী?

বলাই বলেছিল, আপনাকে আমি জানি। গাড়িটা আমি সার্চ করব।

লোকটি শুধু তার বিমূঢ় বিস্ময় চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করেছিল, আমাকে জানেন?

বলাই বুঝেছিল, লোকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার সঙ্গে ছিল জমাদার বিনয় আর একজন সেপাই। সার্চ করবার অনুমতি দিয়ে সে বলেছিল, এখুনি বলব আপনাকে কবে থেকে জানি।

ড্রাইভার বলেছিল, পিছে বহোত গাড়ি জাম্ হো রহে, জেরা সাইড করনে দিজিয়ে।

 বলাই আর গাড়িটাকে স্টার্ট নিতে দেয়নি। বলেছিল, গাড়ি জাম হোক, সাইড করবার দরকার নেই।

বলাই সন্দেহ করেছিল, গাঁজা অথবা আফিম। না থাকলেও, তার ভয় ছিল না। লোকটা ভাল নয়, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু ধরা পড়েছিল বাইশ বোতল মদ। একলা বলাই দেড় হাজার টাকা রিয়োয়ার্ড পেয়েছিল সরকার থেকে। বিনয় এবং সেপাইটিও বাদ যায়নি।

কিন্তু কোথায় গেল চিরঞ্জীবের দল? তারা যে থেমে নেই, কোনও সন্দেহ নেই তাতে। ভোলা আর কেষ্টর ধারণা, কবিরাজের মেয়েরা চোলাই মদ চালান দিচ্ছে। ভাবতেও সংকোচ হয়। বিশ্বাস করা আরও কঠিন। যদিও ভোলা-কেষ্টর যুক্তি আছে। ও-বাড়ির মেয়েরা বাইরে বড় একটা বেরুত না। আজকাল প্রায়ই এদিক-ওদিক যাতায়াত করছে। এবং কবিরাজের বাড়িতে দুর্গাকে যাতায়াত করতে দেখা গিয়েছে অনেকবার। সেখানে যে চোলাই হয়, সে সংবাদও পাওয়া গিয়েছে। তবু বলাই তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুমতি দিতে পারেনি। অন্তত মেয়েদের ব্যাপারে পুরোপুরি স্থিরনিশ্চয় না হয়ে, কিছুতেই তা সম্ভব নয়। কারণ বলাইয়ের একটি সুনিশ্চিত সংস্কার আছে। আর যাই হোক, কবিরাজ মশায়ের মেয়েদের সে দুর্গার পর্যায়ে ফেলতে পারে না।

তবু দুর্গারই হাসি যেন শুনতে পায় বলাই মলিনার হাসির মধ্যে। তারই ঘরে, তারই পাশে মাঝে মাঝে যেন দুর্গারই ছায়া ফুটে ওঠে। এ ব্যাপারে মন নিয়ে এতখানি গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়া নিজেরই ভাল লাগে না বলাইয়ের। কিন্তু উপায় নেই। চিরঞ্জীব আর দুর্গা তার প্রত্যহের নিয়মিত কাজ ও শান্তি ছিনিয়েছে।

এ অবস্থায় একদিন সে অফিসের কাছেই গুলিকে দেখতে পেল। তার ভিতরের জ্বলুনি মুহূর্তে যেন একটি নিষ্ঠুর বিদ্যুৎ কশা হানল। কাসেমকে হুকুম করল সে গুলিকে ডাকতে। না এলে জোর করে ধরে নিয়ে আসতে।

এ বিষয়ে কাসেম হুকুমের আগে ছুটতে জানে। গুলিকে ধরে নিয়ে এল সে ; বলাই টের পেল, গুলি ভয় পেয়েছে। অবাকও হয়েছে। সে মনে মনে ভাবল, ধৈর্য ধরে ভদ্র ব্যবহার করবে সে গুলির সঙ্গে।

গুলি কাসেমের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে বলল, আমি কী করেছি যে আমাকে ধরে নিয়ে এসেছেন?

বলাই বলল, কিছুই করোনি?

গুলি বলল, না, কিছু করিনি।

বলাই এক মুহূর্ত গুলির চোখের উপর চোখ রেখে বলল, গত সপ্তাহের বুধবারে তুমি কতগুলি নিশাদলের বাট নিয়ে যাচ্ছিলে, মনে পড়ে?

গুলি জোর দিয়ে বলল, কে বললে? কই, না তো।

বলাই শান্ত গলায় বলল, যেই বলুক। মিছে বোলো না। কিন্তু কোথায় নিয়ে গেছলে সেগুলি? খালি এইটুকু বললেই আমি ছেড়ে দেব।

গুলি বোধ হয় একটি চকিত-মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল। তারপরে বলল, আমি কোনও নিশাদলের কথা জানি না।

কথা শেষ হবার আগেই বলাই টেবিলের ওপর ঘুষি মেরে গর্জন করে উঠল, আলবত জানিস, তাড়াতাড়ি বল।

বলতে বলতে সে উঠে এল চেয়ার থেকে। অবিশ্বাস্য হলেও, বলাইয়ের দুচোখে রক্ত উঠে এসেছে। কঠিন নিষ্ঠুর দেখাচ্ছে তার মুখ।

গুলি মাথা নামিয়ে বলল, আমি জানি না।

ঠাস করে তার গালে একটা চড় দিল বলাই। চাপা ক্রুদ্ধ গলায় হিসিয়ে উঠল, জানি না! জানাচ্ছি।

ধৈর্য রাখতে পারল না বলাই। ইঁদুর লুফে-নেওয়া বেড়ালের মতো জামার কলার ধরে গুলিকে টেনে নিল সে। কষে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কোথা থেকে এসেছিল সেই নিশাদল, আর কোথায় নিয়ে গেছিলি, বল।

নাড়া খেয়ে গুলির আলবাট বিস্রস্ত। সে বলাইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে, মাথার চুলটা হাত দিয়ে সরিয়ে দিল।

বলাই আবার ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, চুল পরে ফেরানো যাবে। আগে বল।

গুলি আর একবার তাকাল বলাইয়ের দিকে। ততক্ষণে তার চাউনি সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। অসহায় বিদ্বেষ তার চোখে। সে আবার বলল, আমি জানি না।

বলাই রুদ্রমূর্তি ধরে, সজোরে আঘাত করল আবার গুলিকে। মুখে পিঠে আঘাত করে, চুল টেনে সে ঘরের একটা কোণে নিয়ে ফেলল গুলিকে। গুলি একটা আর্তনাদ করে মেঝের ওপর বসে পড়ল।

বলাই চাপা গলায় গর্জে উঠল, রাসকেল, এখনও জানি না। এর মধ্যেই খুব বড় দরের স্মাগলার হয়ে গেছ, না? মনে করেছ, কিছু জানি না? সংবাদ রাখি না? ভেবেছিস চিরঞ্জীব বাঁড়ুজ্জে আর ওই বাগদি ছুঁড়ি তোকে রক্ষা করবে?

ইতিমধ্যে কাসেম ছাড়াও কয়েক জন সেপাই এসে পড়েছিল ব্যাপার দেখতে। কাসেমের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, স্বীকারোক্তি আদায়ের এই প্রহারটা সে নিজের হাতে চাইছিল।

বলাই সবুট লাথি তুলে বলল, কোথায় নিয়ে গেছিলি সেই নিশাদল?

গুলির ঠোঁটের কশে রক্ত। গালে আঙুলের ছাপ ফুলে ফুলে উঠেছে! সে অন্য দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলল, আমি জানি না।

বলাই সঙ্গে সঙ্গে গুলির কোমরে লাথি মারল। চুলের মুঠি ধরে আবার তুলে ধরল। বলল, কৃষক-সমিতির নেতার কাছে শিক্ষা পেয়েছিস বুঝি? লোচ্চা! বল শিগগির।

গুলির সর্বাঙ্গ তখন বেঁকে পড়েছে। হাত দিয়ে চেপে ধরেছে কোমর। সে কোনও কথা বলল না। এবং বলাই অনুভব করল, তার সমস্ত উত্তেজনার জোয়ারে একটা শৈথিল্যের ভাঁটা আসছে যেন।

কাসেম বলল, মরে যাবি। বলে ফ্যাল।

 গুলি নীরব। বলাই আবার ঝাঁকুনি দিল গুলিকে। বল। মুখ তোল।

 বলে চিবুক তুলে ধরল গুলির। ঠোঁটের কশ থেকে বেয়ে-পড়া রক্ত লেগে গেল বলাইয়ের আঙুলে। তার উত্তেজনা আরও হ্রাস পেল।

গুলি নিশ্চুপ।

বলাই তাকে একটা ধাক্কা দিয়ে দেয়ালের দিকে ঠেলে দিল। বলল, দাঁড়া, কেমন করে স্বীকার করতে হয়, দেখাচ্ছি। কাসেম, বেত।

কাসেম ছুটল বেত আনতে! দেয়ালে ঝোলানো থ্রি পয়েন্ট থ্রি জিরো রাইফেল কটার ঠিক নীচেই, গুলি হেলে দাঁড়াল। তার মুখ গিয়েছে ফুলে। চোখে দু ফোঁটা জল। হাত দিয়ে সে রক্ত মুছে নিল কশ থেকে।

কিন্তু বলাই বেরিয়ে গেল। উঠোনের মাঝখানেই কাসেমকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এদিকে এসো।

কাসেম বেত নিয়ে বলাইয়ের সঙ্গে বলাইয়ের নিজস্ব অফিসঘরে গেল। চেয়ারে বসে বলল বলাই, আর মার নয়! কী করবে? ওকে ধরে রাখবে না ছেড়ে দেবে?

কাসেম বলল, একটা কেস না ঝুলিয়ে দিলে কী করে হয় স্যার? নইলে চিরঞ্জীব পালটা নালিশ করতে পারে।

বলাই ঠোঁট কামড়ে এক মুহূর্ত ভাবল। বলল, না, সেটা তো মিথ্যে কেস সাজাতে হবে। আমরা তো ওকে বামাল ধরিনি। খানিকক্ষণ আমাদের গারদে আটকে রাখো। জলটল খেতে চাইলে দিয়ো। ছেড়ে দিয়ো ঘণ্টা দুয়েক বাদে। অবশ্য আর একবার জিজ্ঞেসাবাদ কোরো। মেরো না যেন। আর চিরঞ্জীব যদি ক্ষেপে যায় ভালই হয়। ও আমার এগেনস্টে একটা কেস করুক, আমি তাই চাই।

কাসেম যেন থমকে গেল। বলল, ছেড়ে দেবেন?

-হ্যাঁ।

কাসেম ঘাড় নেড়ে বলল, আচ্ছা। তবে চিরঞ্জীবের ব্যাপার তো। বদলা নিতে ছাড়বে না। আমাদের একটু সাবধানে ঘোরাফেরা করতে হবে।

বলাই বলল, তা হোক। চিরঞ্জীবকে যদি ফৌজদারিতেও আটকানো যায়, তাও আমাদের চেষ্টা করতে হবে। ও শোধ নেবে। এটাই আমি চাই।

কাসেম ভক্তিভরা বিস্ময়ে তাকাল বলাইয়ের দিকে। মনে মনে তারিফ করল সে। বুঝল, কেন গুলিকে মেরেছেন বড়বাবু। শুধু চিরঞ্জীবদের রাগিয়ে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্যে।

কাসেম বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বলাই উঠে দাঁড়ায়। ঢাকা-দেওয়া জলের গেলাসটা নিয়ে তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে ফেলল। যদিও গুলির রক্তের দাগটা সে আগেই গুলির জামাতেই মুছে ফেলেছিল, তবু বারে বারে ঘষে ঘষে আঙুলটা ধুয়ে ফেলল সে। কিন্তু বসতে পারল না। তার ঘরের উত্তর দিকে বেশ খানিকটা খোলা জমি। অখিলবাবু সেখানে বাগান করেছেন। তারপরেই পুকুর। আশেপাশের অনেক মেয়ে এবং পুরুষেরা সেখানে স্নান করছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সাঁতার কাটছে। তাদের মধ্যে বড় মেয়ে পুরুষও দু-একজন আছে। হাসি, উফুল্ল কলরব, বড়দের বকবকানিতে ঘাট ও পুকুর মুখরিত। বাতাসে গাছপালা দুলছে। মাঝপুকুরে, একটি আলতা-পরা পায়ের ঘায়ে জল চলকে উঠল রুপোলি ছটায়। একটি বারো-চোদ্দো বছরের ছেলে ঘাট থেকে চিৎকার করে বলল, দিদি, ডুব-সাঁতারে যাব তোর কাছে। মেয়েটি মুখ থেকে জল ছুঁড়ে দিল।

কোথায় যেন একটা কাঁটা টাটাতে লাগল বলাইয়ের বুকে। তার মনে হল, জানালার বাইরে একটি স্বচ্ছন্দ মুক্ত জীবন ছলছলাচ্ছে। পরমুহূর্তেই তার মনে পড়ল গুলির রেকর্ডটা। গুলি কে, কী তার অতীত জীবন। বোধ হয় সব চিন্তাটা দেড় মিনিটের। জানালার গারদ ধরে বলাই মনে মনে বলে উঠল, আমি কী? একজন একসাইজ ইনস্পেক্টর ছাড়া কিছু তো নয়। এর চেয়েও বেশি মারধর করতে দেখছি অনেককে। আমি নিশ্চয়ই তাই করব। আমি জানি, আমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কেবল সনাতন ঘোষালকে ধরতে পারব না। তার পরিবর্তে…। কিন্তু মলিনা…কিন্তু দুর্গার কথা। আমার ভাবার কথা নয়…কিন্তু চিরঞ্জীবকে আমি শেষ করে ছাড়ব…।

কেমন একটা এলোমেলো অসহায় মন নিয়ে যেন বলাই প্রলাপ বকার মতো ভাবতে লাগল। আরও জোরে সে গরাদ চেপে ধরল।

এমন সময় মলিনার গলা শোনা গেল, আসতে পারি বড়বাবু? দোতলার সিঁড়ি থেকে কয়েক ফুটের মধ্যেই বলাইয়ের অফিস-ঘর। ইচ্ছে করেই সে এটি নির্বাচন করেছিল। যেন যখন খুশি মলিনা আসতে পারে।

বলাই যেন থতিয়ে গেল। দেখল, মলিনা হাসছে।

 বলাই বলল, এসো।

মলিনা ঢুকেই বলল, কী, কনফেস করল?

ভ্রূ কুঁচকে উঠল বলাইয়ের। কিন্তু গম্ভীর শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, কী করে জানলে?

মলিনা তেমনি হেসেই বলল, দেখছিলাম, কাসেম ধরে নিয়ে আসছে ছেলেটাকে।

-ও! না পাওয়া গেলে বোধহয় খুশি হও। কিন্তু কীসের জন্য? তুমি কি চাও অসামাজিক নোংরা লোকেরা সমাজে বুক ফুলিয়ে বাঁচবে?

মলিনা বলল, না, শাসন করতে হবে।

বলাই দৃঢ় গলায় বলল, শাসনের যখন কিছু বোঝ না, তখন এ বিষয়ে কৌতূহল না-ই বা রাখলে।

মলিনা চকিতে গম্ভীর হল। পরমুহূর্তেই আবার হাসল। বলল, আচ্ছা বলব না। আমি এ বিষয়ে শুধু তোমাদের সরকারি পদ্ধতির কথাই বলতে চাই।

বলাই বলল, সেটাও শাসনের অন্তর্গত বিষয়।

বলাই নিজেও বোধহয় অবাক হচ্ছিল তার নিজের রূঢ়তায়। এই তো একটু আগেই, গুলিকে মেরে এসে, পুকুরের দিকে তাকিয়ে তার বুকের মধ্যে কেমন করে উঠেছিল।

মলিনা বলল, আচ্ছা, আর বলব না। তুমি রাগ কোরো না।

মলিনার গলার স্বর যেন রুদ্ধ শোনাল। বলাইয়ের মন আবার শান্ত হয়ে এল। সে অনুতপ্ত হয়ে চোখ তুলে কিছু বলবার আগেই মলিনা দরজার কাছে চলে গিয়েছে। বললে, অনেক দেরি হয়েছে, খেতে এসো। তোমাকে ডাকতে এসেছিলাম।

মলিনা অদৃশ্য হল। বলাই কী বলতে গিয়ে আবার মুখ নামিয়ে নিল। তার শুধু মনে হল কেউ কাউকে বোঝে না।

.

গুলিকে দেখেই প্রথমে চমকে উঠেছিল চিরঞ্জীব, কোথায় ছিলি সারাদিন? যেদিন গুলি মার খেয়ে ফিরে এসেছিল। পরমুহূর্তেই তার চোখে পড়েছিল গুলির মুখটা। ফোলা ঠোঁট, যদিও তখন তার রক্ত ছিল না। কিন্তু গালে ছিল কালশিরা। হাঁটছিল একটু টেনে টেনে। গুলি কোনও জবাব দিতে পারেনি। সংসারে গুলিদের মতো দুর্বিনীত অসামাজিক ছেলেদের চোখেও জল লুকিয়ে থাকে। উচ্ছৃঙ্খল জীবনের কোথাও গোপনে থমকে থাকে কান্না। চিরঞ্জীবকে দেখামাত্র তার চোখ ফেটে জল এসেছিল।

চিরঞ্জীবকে যা কোনওদিন দেখা যায়নি, ভাবাও যায়নি। বোধহয়, তাই হয়েছিল। সে দু হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল গুলিকে।

–কে মেরেছে? কে মেরেছে তোকে এমন করে?

ফুঁসে উঠতে গিয়েও চিরঞ্জীবের বুকের মধ্যে অসহ্য ব্যথায় টনটনিয়ে উঠেছিল। তার গলার স্বর যেন টিপে ধরেছিল কেউ। কান্না বোধহয় তারও থমকে ছিল কোথাও।

গুলি ফিসফিসিয়ে বলেছিল, বড়বাবু।

চিরঞ্জীব গর্জে উঠেছিল তারপরেই, বড়বাবু? বলাই সান্যাল? কেন?

-এমনি। কথা আদায়ের জন্যে।

 আগুন জ্বলে উঠেছিল চিরঞ্জীবের চোখে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল, বাঁশঝাড়ের ওপারেই, বটতলায় ভোলা-কেষ্টর মূর্তি। তার মনে হয়েছিল, ঘণ্টা বেজে উঠেছে। যুদ্ধ ঘোষণার ঘণ্টা। চুপিচুপি অন্ধকারে, ছলচাতুরির খেলা শেষ হয়েছে। এবার খোলাখুলি মাঠে-ঘাটে শারীরিক আঘাত করে, ওরা ডাক দিচ্ছে লড়তে। সেই ভাল। লড়াই হোক। হয় চিরঞ্জীব থাকুক না হয় বলাই সান্যাল থাকুক।

বটতলার দিকে ছুটতে উদ্যত হয়ে সে চিৎকার করে হাঁক দিয়েছিল, নন্দদা, লাঠি নিয়ে এসো।

বিমলাপুরের সেই কুখ্যাত লাঠিবাজ ডাকাত হানিফ আর নন্দ। নন্দ সারাদিন থাকত দুর্গার বাড়িতে। লোকে বলত, দুর্গার জন্য দারোয়ান রেখেছে চিরো বাঁড়ুজ্জে। মধ্যবয়সী লোহার মতো শক্ত পেটানো শরীর, ছোট ছোট পলকহীন সাপের মতো চোখ ও ভাঙা চ্যাপটা নাক নন্দও হেঁকে –উঠেছিল, চলো।

ঘরের মধ্য থেকে তাড়াতাড়ি দুর্গা বেরিয়ে এসে আগে টেনে নিয়েছিল গুলিকে। হাত চেপে ধরেছিল চিরঞ্জীবের। উদ্বেগে ভেঙে পড়েনি সে। ব্যাকুল হয়ে বাধা দেয়নি। তার নিশিন্দা পাতার আয়ত চোখ দুই টুকরো অঙ্গারের মতো জ্বলে উঠেছিল। স্থির দৃঢ় চাপা তীক্ষ্ণ গলায় বলেছিল, না, যেয়ো না ছোট্‌ঠাকুর। বলাইবাবু খ্যাপা কুকুর হয়েছে। তুমি খেপো না।

চিরঞ্জীব হিসিয়ে উঠেছিল, শোধ নেব না? ছেড়ে দেব?

দুর্গা বলেছিল, তুমি একলা শোধ নেবে? আমরা নেব না? ওই বড়বাবু আর ছোটবাবুরা হারছে বলেই তো হাতে মেরে শোধ নিতে চাইছে। ওদের আরও খেপতে দাও।

চিরঞ্জীব মাথা নেড়ে বলেছিল, তুই বুঝিসনে দুর্গা। আজ ওরা গুলিকে মেরেছে। কাল গজেন-সতীশকে মারবে। তারপর আমাকেও মারতে আসবে?

–তোমাকে মারবে?

 ছুটে-যাওয়া হাউয়ের মতো শিসিয়ে উঠেছিল দুর্গার গলা। বলেছিল, তত সাহস যদি কোনওদিন ওদের হয়, সেদিন জানব ওদের মরার সাহসও আছে। কিন্তু এখন হাঙ্গামা কোরো না ছোট্‌ঠাকুর। মাথা গরম কোরো না। চাদ্দিকের হাওয়াটা কেমন একবার ভেবে দেখো।

চারদিকের হাওয়ার কথাটা শুনে শান্ত হয়ে এসেছিল চিরঞ্জীব। শান্ত নয়, অসহায়, খাঁচায়-আবদ্ধ পশুর মতো মাথা নত করে নিতে হয়েছিল। গুলির দিকে সেদিন সে আর ভাল করে তাকাতে পারেনি। নিজেকে যেন তার অপরাধী মনে হয়েছিল। তার মনে হচ্ছিল, চারদিক থেকে একটা লৌহ-বেড়ি ক্রমে ঘনিয়ে আসছে। ঘিরে ধরছে তাকে সদলে।

না, নিজের কাছে কোনও ন্যায়ের যুক্তি ছিল না চিরঞ্জীবের। সে জানত, সে আর তার দলের সবাই জোর করে বেআইনি ভাবে বেঁচে আছে এ সংসারে। বাঁচবার অধিকার তাদের কারুরই স্বীকৃত নয়। সমাজ তাদের অস্বীকার করেছে।

কিন্তু সে বিশ্বাস করে, এ সমাজের হাতে ন্যায় বলে কিছু নেই। এ দেশে আইন যাদের হাতে আছে, তারা সবাইকে গোলাম মনে করে। ন্যায় নিষ্ঠা সব মিথ্যা। ছলনা। বলার জন্য বলা। দেয়ালে-দেয়ালে উপদেশ বাণী বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রাখার মতো। শুধু গৃহের শোভা, মনুষ্যত্বের বিজ্ঞাপন! যার জোর আছে, যে অন্যায় করতে পারে, এ দেশে ও সমাজে তারাই বাঁচছে বুক ফুলিয়ে! এদের শাসন মানবে না চিরঞ্জীব। কারণ ন্যায়-অন্যায়ের সংঘাত নেই কোথাও। শুধু স্বার্থের সংঘাত। এই সংঘাতকে বড় বড় বুলির ছদ্মবেশ পরিয়ে দিয়েছে তারা যারা আইন দিয়ে অন্যায়ের অধিকার পেয়েছে।

ন্যায় বুঝি আছে শুধু শ্রীধরদাদের পক্ষে। তিলে তিলে মরণের ন্যায়। অপমানের বোঝা বয়ে বয়ে, কোনও এক সুদূর ভবিষ্যতের ন্যায়ের জন্য। হয়তো সে ভবিষ্যৎ নিশ্চিত, কিন্তু অনিশ্চিত কালের অন্ধকারে। শুধুই বিশ্বাস করে পলে পলে মরা। সংবাদপত্রের শিরোনামায় একটি অপমানকর মৃত্যুসংবাদের নায়ক হওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।

সে দেখতে পাচ্ছিল, তাকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিল সবাই। দুর্গার চারদিকের হাওয়া সেই কথাই বলতে চেয়েছিল। চিরঞ্জীব দেখছিল, তার বিরুদ্ধে সকলে একত্র হয়েছে। তাকে সবাই মিলে মারতে চাইছে। এখানকার স্থানীয় মন্ত্রীর দলের লোক সনাতন ঘোষ। বিরুদ্ধ দল, কৃষক-সমিতির লোক শ্রীধরা। পুলিশ আর পুলিশের সুহৃদ অরেরা। এরা সবাই শুধু চিরঞ্জীবের বিরুদ্ধে হাত মিলিয়েছে।

একটা তীব্র জ্বলন্ত হাসি ফুটে উঠেছিল চিরঞ্জীবের ঠোঁটে। এই ব্যহ-রচনাকারী শত্রুদের প্রতি অন্ধ বিদ্বেষে আরও জ্বলে উঠেছিল। যতই ওদের সাঁড়াশি ব্যুহ ছোট হতে হতে টুটি টিপে ধরছিল, ততই সে মরিয়া হয়ে উঠেছিল।

সোলেমানকে চোলাই চিরদিনের জন্যই ছাড়তে হয়েছে। অন্তত শ্রীধরের কাছে ও সমিতির কাছে সেই রকমই কসম খেতে হয়েছে তাকে। অন্যথায় সমিতি থেকে বহিষ্কার। এমনকী সে নিজের খাবার জন্যও বাড়িতে চোলাই করতে পারবে না।

কিন্তু সোলেমান হয়তো ভবিষ্যতে কথা রাখবে না। সমিতি ছেড়ে চলে যাবে। কারণ সোলেমান বড়লোক কৃষক। এখন শুধু সে চোলাই বন্ধ রেখেছে। এক ঢিলে দুই পাখি মারবে সে। ইলেকশনের প্রচার শুরু হয়েছে। গ্রামে-গ্রামে এখন নতুন জ্বর। উত্তাপ বাড়ছে প্রতিদিনই। এখন চোলাই না করাই ভাল। এ হল সোলেমানের ছদ্মবেশ। আসলে চিরঞ্জীবের দলকে ধরিয়ে দেবারই চক্রান্ত। তাই সরে দাঁড়িয়েছে।

চিরঞ্জীব জানে, এ অঞ্চলের প্রায় সবাই চোলাই বন্ধ রেখেছে। এমনকী স্থানীয় মন্ত্রীর চোখের মণি সনাতন ঘোষও। উদ্দেশ্য একই। চিরঞ্জীবদের সকলের সামনে প্রকাশ করা। ধরিয়ে দেওয়া। অক্রূরও তাই।

ন্যায়দণ্ড সকলের হাতে। শুধু সেই ন্যায়দণ্ডের আঘাত চিরঞ্জীবেরই মাথায়। সে জানত, শুধু ভূমিহীন গরিব কৃষকেরাই শ্রীধরদার ন্যায়ে বিশ্বাস করে। অভাবের দায়ে চুপ করে থাকতে পারে না সব সময়। নিজেরাও নেশা করে ফেলে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা লাগিয়ে দেয় নিজেদের মধ্যে।

তারাই মানবে শ্রীধরদাকে। কারণ তাদের অনুশোচনা আছে। ভাল করে খেয়ে পরে কিছু জমির স্বত্ব নিয়ে বাঁচবে এই স্বপ্ন চিরদিন ধরে দেখতে ভালবাসে। এদের উপর বিদ্বেষ আসে না। বুক জ্বলে তার, শ্রীধর দাস, সনাতন ঘোষ, আর পুলিশের ঐক্য দেখে। ন্যায়ের ঐক্য! কিন্তু সাহস নেই সোলেমান সনাতন অরদের, তার সঙ্গে লড়ে। সমাজের এইসব সজাগ চোরেরা বুক ফুলিয়ে বেড়াবে, হয়তো একদিন মন্ত্রী হবে, অ্যাসেম্বলির প্রতিনিধি হবে। শুধু অসামাজিক থাকবে চিরঞ্জীব।

না, কোনও শাসন মানবে না চিরঞ্জীব। কারুর শোধন মন্ত্র চায় না।

অনেক কথা ভেবেছিল সেদিন চিরঞ্জীব। তবু গুলির মারের শোধ নিতে পারেনি। তাকে চুপ করে থাকতে হয়েছিল। যদিও তার সন্দেহ ছিল, ওরা চুপ করে থাকবে না। যতই বুঝতে পারবে, তাদের দল ঠিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, অথচ ধরা যাচ্ছে না, ততই খেপে উঠতে থাকবে। শ্রীধরদার এক ডাকে হয়তো একদিন শত শত লোক তার, দুর্গার, সকলের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবে। সেইটিই বাকি। জীবনের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ দেখবে চিরঞ্জীব। কারণ মঙ্গল মন্ত্র কারুর হাতে নেই।

সে বুঝতে পারছিল, নির্বাচনে শ্রীধরদারই জয় সুনিশ্চিত। নির্বাচনের পর শ্রীধরা নতুন করে লাগবে তার পিছনে। সনাতনরাও ছেড়ে কথা কইবে না। আসুক সেই দিন। সেই দিনটিরই প্রতীক্ষা। কারণ, বিশ্বাস করার এবং বিশ্বাস করে পাবার কিছুই নেই এ সংসারে।

.

তবু একদিন মার খেল ভোলা। বাগদিপাড়ারই একজনের হাতে একদিন থাই থাপ্পড় খেল সে। পাড়ায় দাঁড়িয়ে নাকি অকথা কুকথা বলছিল। নন্দ সামনে ছিল। কিন্তু না রাম না-গঙ্গা কিছুই। বলেনি। পরে বুঝেছিল চিরঞ্জীব, নন্দরই কারসাজি সেটা।

এর পর, কয়েকদিনের মধ্যে অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল।

সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে পায়ে পায়ে ঝোপঝাড়ের গা থেকে। শেয়াল ডেকে উঠল ঘরের পিছনে। তবু মাতি মুচিনী বুড়ি আর তার ভাইঝি গানির ফিসফাস গজ গজ শেষ হয় না।

এতদিন গানি কাসেমের রক্ষিতা থাকা সত্ত্বেও কোনওদিন চোলাইয়ের সংবাদ তাকে দেয়নি। দিতে রাজি হয়নি। কাসেমের রক্ষিতা হতে পারে, তা বলে গাঁয়ের ভিতরের কথা বলবে কেন। কিন্তু এবার সে রাজি হয়েছে। তাও নাকি একবারটির জন্যে। কেবল চিরো ঠাকুরকে কিংবা দুর্গাকে ধরিয়ে দিলেই হবে। গানিকে পয়সা দিয়েছে কাসেম মাতিকে দেবার জন্য। তার বিশ্বাস, মাতি ধরিয়ে দিতে পারে।

সেই নিয়েই গানির সঙ্গে কথা হচ্ছিল মাতির। অন্ধকার দেখে গানি বলল, পিসি আমি যাই, আঁধার হল। তুই বাতি দেখা তুলসীতলায়।

মাতি আঁচলে পয়সা বেঁধে একগাল হাসল। দাঁত অনেকগুলি নেই। বুড়ির মুখ ভরতি রেখা। রেখার ভাঁজে ভাঁজে হেসে বুড়ি তার সেই মান্ধাতা আমলের ভাঙা চিমনি হ্যারিকেনটা ধরল। বাতির সামনে চিমনির কালির অন্ধকার। পিছনে মাতির নিজের ছায়া। তবু একটি টিমটিমে বাতির ইশারা।

বুড়ির এক ছেলে আছে। বাড়িতে আসে না, থাকে না। শহরে কাজ করে, থাকে। পাপের ভিটেতেই আছে গানি। হয়তো সে এখন সেজে-গুজে কাসেমের কাছে যাবে!

মাতির তুলসীগাছ মরে গিয়েছে অনেকদিন। কিন্তু মাটির একটা ছোট ঢিপি আছে। চোখ বুজলে তুলসীগাছ একটি দেখতে পায় সে।

মাতি বাতি নিয়ে তুলসীতলায় এসেই থমকে দাঁড়াল। থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে, প্রাণপণ জোরে সে চিৎকার করে উঠতে গেল। পারল না। শুধু দেখল, সামনে একটি সাদা কঙ্কাল। মটমট শব্দে তার হাতটা ক্রমেই মাতির দিকে উঠে আসছে। মাতি শুধু বলতে পারল, রাম রাম! রাম রাম! হে ভগবান!

তারপরেই মাটিতে পড়ে গেল।

এমন সময় গানি আবার এল বোধহয় কিছু বলতে। সে সামনে এই মূর্তি দেখেই চিৎকার করে ছুটে পালাল, অ গো মা গো, সর্বনাশ গো!

তাড়াতাড়ি লোকজন এল ছুটে। বাতি এল কয়েকটা। এসে দেখল, মাতি তখন প্রায় নিথর। উদ্দীপ্ত চক্ষু। ঠোঁটের কশে ফেনা। হ্যারিকেনটা পড়ে আছে উপুড় হয়ে। কিন্তু আর কোথাও কিছু নেই।

যমুনা চিৎকার করে ডাকল, অ বটঠাকুরঝি, বটঠাকুরঝি, কী হয়েছে? কী দেখেছ? কথা বলল।

 মাতির কথা বলার লক্ষণ দেখা গেল না। সর্বাঙ্গে থেকে-থেকে একটা চকিত আক্ষেপের চমক। চোখের তারা স্থির। মুখ থেকে ওঠা গ্যাঁজলার সঙ্গে রঙের ছোপ দেখা দিল।

ইতিমধ্যে কয়েকজনকে একসঙ্গে জাপটে ধরে গানি এল। দু চোখে তার মৃত্যু-ত্রাস। সেও কেঁপে-কেঁপে উঠছে। তুলসীতলার দিকে আঙুল দেখিয়ে দেখিয়ে বারে বারে বলল, অইখানে, অইখানে গো, অইখানে দেখেছি তাকে আমি। হেই মা গো, জয় বাবা মহাদেব, জয় বাবা অযুধ্যেরাজ, আমাকে ক্ষমা করো গো। আমি আর কোনও পাপ করব না গো।

কয়েকজন একসঙ্গে ধমকে উঠল, আরে কী মুশকিল, বলবে তো কী দেখেছ? দুর্গাও এসেছে। নন্দ একটু দূরে দাঁড়িয়ে। আশেপাশেই কোথাও বোধহয় ভোলা-কেষ্ট ছিল। তারাও এসেছে মাতির উঠানে।

দুর্গা বলল, বলবি তো গানি কী দেখেছিস?

গানি অমনি ছুটে এল দুর্গার কাছে! তার হাত আর কাপড় চেপে ধরে বলল, হ্যাঁ বলব, বলব দুগগা, তোকে সব বলব আমি। আমি পিসির কাছেই ছিলুম এতক্ষণ। তাপরে ঘরে গে জামাকাপড় পরে বেরুবার আগে, মাসিকে বলতে আসছিলুম, কাঠে আঁচ থাকলে রেখে দিয়ে। ওবেলার তরকারিটুকুনি গরম করে নেব। উঠোনে পা দিয়েই দেখলুম

বলে আর একবার তুলসীতলার দিকে দেখে কেঁপে উঠল গানি। বলল, দেখলুম এ্যাটা মস্ত বড় কঙ্কাল দেঁড়িয়ে আছে গো তুলসীতলায়। হে ভগবান, মিছে বললে আজ রাতে আমার মুখ দে রক্ত উঠে যেন মরি। সে যে কত বড়, সে হাত দে পিসিকে আমার ধরতে আসছে, আর হাড়ে হাড়ে কী কড়মড় কড়মড় শব্দ!

মুহূর্তে একটা গা-ছমছমে স্তব্ধতা নেমে এল। কেউ তুলসীতলার দিকে তাকাল না। সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। কথা বলবার ছল করে পরস্পর ঘন হল আরও। কিন্তু কথা বলতে পারল না। অবিশ্বাস করবার ক্ষমতাও কারুর নেই। মাতি মুচিনী জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ পড়ে রয়েছে।

শুধু দুর্গা হেসে উঠল খিলখিল করে। কী যে বলিস তুই গানি!

সবাই তাকিয়ে দেখল দুর্গাকে। তখনও দুর্গার চুল বাঁধা হয়নি। তার সর্বাঙ্গে হাসির দমক দেখে, সবাই যেন অশরীরী মায়া দেখতে লাগল। ভোলা-কেষ্টও।

গানি একেবারে ভেঙে পড়ল দুর্গার পায়ের কাছে। ডুকরে-ডুকরে বলল, তুই সত্যিকারের মা দুগগা, এ তোমার লীলা।

দুর্গা আরও হেসে উঠল, দুলে-দুলে উঠল বেতসলতার মতো। বলল আ রে দূর। সর, এখন দ্যাখ। বুড়ির কী হাল।

সকলের গলায় যেন একটু-একটু স্বর ফুটল। কেউ কেউ বলল, একজন রোজা বদ্যি ডাকা দরকার। আর ফেলে রাখা চলে না।

দুর্গা বলল, আগে জল দাও দিকিনি মুখে মাথায়।

 কিন্তু মাতি তখন মারা গিয়েছে। গানি পিসির বুকের ওপর পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। যেন মনে হল, চারদিকের অন্ধকারে, গাছের ঝুপসি-ঝাড়ে কঙ্কালের রাশি রাশি হাত ঘুরছে।

কে যেন বলে উঠল, কই তুলসীতলায় একখানি তুলসীগাছও তো নেই। মানুষগুলি সবাই মিলে যেন একটা হয়ে গিয়েছে। একটা দেহ একটা মুখ। শুধু অনেক জোড়া ভয়ার্ত চোখ। অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে এল। বোধহয় বাতাসে রোগের গন্ধ পেয়ে একটা কুকুর আউ আউ করে ডেকে উঠল।

একজন বলল, দূর হ দূর হ!

 শুধু দুর্গা ভ্রূ কুঁচকে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল।

 ভোলা-কেষ্ট তাকিয়েছিল পরস্পরের দিকে। এই দুই নির্ভয় নিশাচরদের চোখেও যেন একটি ভয়ার্ত প্রশ্ন থমকে আছে। বোধহয়, জীবনে এই প্রথম, দুর্গা কাছে থাকতেও তারা তাকাতে ভুলে গেল।

ভোলা বলল, চল যাই।

 কেষ্ট বলল, চল।

 দুজনে গা ঘেঁষে-ঘেঁষে চলতে লাগল।

ভোলা বলল, বিশ্বেস করতে মন চায় না।

কেষ্ট বলল, কিন্তুন গানি বলছে যে?

–দিষ্টি বেবভোম হতে পারে।

দুজনারই?

হ্যাঁ। এ পাড়ায় সারারাত কাটিয়েছি কালকেও। কই, কোনওদিন কিছু দেখি নাই তো?

কেষ্ট বলল, তা তো বটেই। কঙ্কাল? তাও কখনও সম্ভব?

ভোলা বলল, হ্যাঁ, এটটু মাল খাইগে বাজারে গে। ও সব চিন্তা চলে যাবে।

–হ্যাঁ, তাই চল।

 কিন্তু সমস্ত ঘটনাটা ভোরবেলার মধ্যেই চারদিকে রটনা হয় গেল। অনেক আলোচনা, কূট তর্ক উঠল ঘাটে মাঠে, হাটে-বাজারে। থানার পুলিশ এসেও একবার দেখে গেল জায়গাটা। মাতি মুচিনীর দেহটা অবশ্য টেনে নিয়ে যায়নি মর্গে। মুখে অবিশ্বাস থাকলেও, সর্বত্রই ভিতরে ভিতরে একটা ভয়ের লক্ষণ দেখা গেল। গানি তো পাড়া ছেড়ে একেবারে বাজারে গিয়ে উঠেছে। কাসেম ব্যবস্থা করে দিয়েছে মাছের বাজারের সামনে একটি চালাঘর। শুধু একটি কাজ কিছুতেই করে উঠতে পারেনি গানি, পিসির আঁচল থেকে কাসেমের দেওয়া টাকা দুটি নিতে পারেনি। ভয় পেয়েছে। হয়তো ওই জন্যেই পিসি রোজ সন্ধ্যাবেলায় ধরনা দিত। কিন্তু শ্মশানের বেদো নিশ্চয় ছাড়েনি।

অখিলবাবু রাত্রে কয়েকদিন একলা একলাই টহল দিয়ে গেলেন বাগদিপাড়ায়। ভোলা-কেষ্ট বড় একটি লোহার ডাণ্ডা নিয়ে বাগদিপাড়ায় নজর রাখল। ডাণ্ডা তো বটেই! লোহাটা নাকি কাছে থাকাও ভাল।

কিন্তু বাগদিপাড়ার বাতাসে আর তেমন যেন ঝেড়ে নিশ্বাস ফেলা যায় না। আড়ষ্টতা থেকেই গেল। লোকজন রাতবিরেতে একলা আর বেরুতেই চায় না।

দিন কয়েক পরে, রাত্রি প্রায় এগারোটার সময় ভোলা আর কেষ্ট খালপারের দিক থেকে বাগদিপাড়ার দিকে আসছিল। দ্বিতীয়া কি তৃতীয়ার সামান্য একটুকরা চাঁদ বোধহয় আকাশে ছিল। তাতে অন্ধকার ফিকে হয়নি। একটা কুহেলিকার সৃষ্টি হয়েছিল। অল্প অল্প কুয়াশাও ছিল। মাঘ মাসের আকাশ একটু ঝাপসা।

প্রথমে ভোলারই চোখে পড়ল। সে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে তার হাত থেকে লোহার ডাণ্ডাটা পড়ে গেল। কেষ্টর চোখে পড়ল এক পা এগিয়ে। বুড়ো অশ্বত্থের তলায়, সাদা ধবধবে কঙ্কাল। পা নাড়াচ্ছে আর মড়মড় শব্দ উঠছে! হাতে একটা মোটা হাত দুই লম্বা লাঠির মতো যেন কী রয়েছে।

ভোলা মুহূর্তে পিছন ফিরেই চিৎকার করে দৌড় দিল। কঙ্কালের হাতের লাঠিটা সজোরে এসে পড়ল কেষ্টর ঘাড়ে। সেও চিৎকার করে দৌড়বার আগেই, চোখের ওপর ধাঁই করে একটা ঘুষি পড়ল। কেষ্টর মনে হল যে অন্ধ হয়ে গিয়েছে। সে চিৎকার করে উঠল। পায়ে পড়ি, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও।

বলতে বলতে সে, জঙ্গল মাড়িয়ে, গাছে ধাক্কা খেয়ে, ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ল।

চিৎকার শুনে আশেপাশের লোকজন সাড়া দিল। অখিলবাবুও এসেছিলেন বাগদিপাড়ার দিকে। তিনি টর্চলাইট নিয়ে চিৎকার লক্ষ করে ছুটলেন। কেষ্টকেই দেখতে পেলেন আগে। চিৎকার করে ডাকলেন, এই কেষ্টা, এই, কী হয়েছে?

কিন্তু কেষ্টর অন্ধ আতঙ্ক তখনও যায়নি। তার মনে হল, ছোটবাবুর বেশ ধরে, এ হয়তো সেই কঙ্কালেরই ছলনা। অখিলবাবু টর্চের আলো ফেলে আরও জোরে চিৎকার করে উঠলেন, এই কেষ্ট, দাঁড়া। আমি রে, আমি। আমি ছোটবাবু।

কেষ্ট দাঁড়াল এবার। অখিলবাবু কাছে যেতেই, তার হাত চেপে ধরল কেষ্ট। আতঙ্কে তার চোখ উদ্দীপ্ত। একটা চোখের কোল ফুলে উঠেছে। গলার স্বর ভেঙে গিয়েছে তার। রুদ্ধ ভয়ার্ত গলায় বলল, কঙ্কাল ছোটবাবু, অশ্বত্থের তলায়, জলজ্যান্ত ছোটবাবু। কোনও রকমে পাণে বেঁচে এয়েছি।

অখিলবাবুর ভ্রূ কুঁচকে উঠল। টর্চের আলোটা জ্বালিয়েই রাখলেন। কিন্তু কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন এই জঙ্গলে ও চারপাশের অন্ধকারে। তবু বললেন, কঙ্কাল?

–হ্যাঁ ছোটবাবু অব্যত্থ কঙ্কাল, সাদা ধপধপে। এই দেখুন, আমার কাঁধ ভেঙে দিয়েছে। হাড়ের হাত তো। চোখে কেমন ঘুষি মেরেছে, দেখুন।

টর্চের আলো ও কথাবার্তা শুনে দু-চারজন এসে পড়ল এদিকে হ্যারিকেন নিয়ে। তবু একটা সন্দেহ হল অখিলবাবুর। কেষ্টর মুখের কাছে মুখ নিয়ে শুকলেন। না, মদ তো খায়নি।

কেষ্ট নিজেই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, বিশ্বেস করুন ছোটবাবু, এক ফোঁটা, কিছু পেটে পড়ে নাই। আমি আর ভোলা রোজ যেমন আসি তেমনি আসছিলুম। খালধার থেকে পাড়ায় ঢুকছিলুম। ঠিক সেই সময় অশ্বত্থের তলায়

সকলের চোখের সামনে একটি জীবন্ত বীভৎস কঙ্কাল ভেসে উঠল।

একজন জিজ্ঞেস করল, কিন্তু, ভোলা কোথা গেল?

কেষ্ট বলল, পালিয়েছে। ও আগে দেখেছিল। আমি পালাতে পারি নাই। হাড়ে মড়মড় করে শব্দ হল, আর একখান গাছের ডাল দে আমার কাঁধে মারল। তাপরেই চোখে একখানি মনকে ওজনের ঘুষি।

কে একজন জিজ্ঞেস করে উঠল, উনি মুখ ফুটে কিছু বললেন তোমাকে? মানে, এ পাড়ায় কেন ভর করেছেন, কেন লজর পড়ল, সে সব কিছু বললেন?

কেষ্ট ঘাড় নেড়ে বলল, না, মুখে সাড়া-শব্দ নাই। নিশ্বেসের শব্দ পর্যন্ত নাই!

অস্বস্তি বোধ করলেও অখিলবাবু সমবেত সবাইকে বললেন, চল তো একবার অশ্বত্থতলায় ঘুরে দেখে আসি, ব্যাপারটা কী?

কেউ রাজি হয় না। একজন বলল, ওখেনে গে কী হবে ছোটবাবু। সে কি আর আছে? সে এখন হাওয়ায় ভাসছে।

আর সেই হাওয়া যে এখানেও খেলছে, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। সকলেই ঘরমুখো হল হারিকেন নিয়ে। অখিলবাবু বললেন, আচ্ছা চল, অফিসে যাই আগে। বলাইবাবুকে নিয়ে আসা যাবে।

অফিসে এসে দেখা গেল, ভোলা আগেই সেখানে পৌঁছেছে। তার কথা শুনে বলাইয়ের ঠোঁটের কোণে একটি বাঁকা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠেছে। কিন্তু ভ্রূর খোঁচায় ক্রোধ সূচাগ্র হয়ে আছে। অখিলবাবুকে দেখে সে বলল, কী অখিলবাবু, আপনিও কঙ্কাল-ভূত দেখলেন নাকি?

অখিলবাবু কিন্তু উপহাস করতে পারলেন না। বললেন, দেখিনি। কিন্তু ব্যাপারটা ইগনোর করা যাচ্ছে না।

বলাই বলল, তা তো বটেই। গুলিকে মারার শোধটা খুব ভালভাবে নিল চিরঞ্জীব। মাতি বুড়ি মরার পরেই আমাদের সাবধান হওয়া উচিত ছিল।

অখিলবাবু একটু আমতা-আমতা করে বললেন, তা-ই কী?

বলাই বলল, নিশ্চয়। আপনারও সন্দেহ আছে নাকি? মাতি যেদিন মরে, সেদিন থেকেই মাতি আমাদের ইনফর্মারের কাজ নিয়েছিল। কিন্তু চিরঞ্জীবের প্রশংসা করতে ইচ্ছে করে না। ভয় দেখিয়ে বুড়িকে একেবারে প্রাণে-মেরে ফেলাটা ঠিক হয়নি তার।

ভোলা-কেষ্টকে দেখিয়ে বলল, আর এদিকে যা দেখছি তাতে তো মনে হচ্ছে, এ দুই শ্ৰীমানকে রাতে আর ওপাড়ায় পাঠানো যাবে না। তবে, আমাদের যে-কজন আর্মড-পুলিশ রয়েছে, তারা থাকুক। আমি কালকেই আমাদের থানার ও সি-কে জানিয়ে কয়েকজনকে নিয়ে আসব। বাগদিপাড়ায় এখন থেকে তারাই থাকবে। কঙ্কাল দেখামাত্র গুলি চালাবার হুকুম থাকবে তাদের ওপর। নইলে দেখছি কোনওদিন কঙ্কাল এই অফিসে এসে হাজির হয়ে আমাদের পিটতে শুরু করবে।

বলাই অবাক হচ্ছিল কাসেমকে চুপ করে থাকতে দেখে। কাসেমের ওপর একটু বেশি ভরসা তার। জমাদার বিনয়ের চেয়েও সাহসী সে। বলল, কাসেম কী বলে?

কাসেম বলল, হাঁ, ব্যাপারটা তো বড়বাবু খুবই গোলমেলে। কঙ্কালটা সাজানো বলেছেন আপনি?

বলাই বলল, তবে কী? কঙ্কাল কি চলাফেরা করতে পারে নাকি? তা হলে তো মেডিকেল কলেজে কঙ্কালের হাট বসে যেত রোজ রাত্রে।

কেষ্ট বলে উঠল, কিন্তুন বড়বাবু, তার হাড়ে কী কড়কড় মড়মড় শব্দ! মানষের কি অমন হয়?

বলাই বলল, করতে জানলেই হয়। চলো দেখি তুমি আমার সঙ্গে কোথায় দেখেছিলে তাকে। ভোলা চলো। অখিলবাবুও চলুন।

অখিলবাবু বললেন, চলুন।

বলাই বাইরে যেতে বলল, এক মিনিট, আসছি।

ওপরে এসে ড্রয়ার থেকে রিভলবারটা বার করে নিল সে। মলিনা যে অন্ধকার দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল, লক্ষ করেনি। রিভলবারটা লোড করা আছে কি না দেখে, চোখ তুলতেই মলিনাকে দেখতে পেল।

মলিনা বলল, কী হয়েছে? এত রাত্রে রিভলবার নিয়ে কোথায়?

 বলাই বেল্টের সঙ্গে রিভলবার বেঁধে নিতে নিতে বলল, কঙ্কালের সন্ধানে।

কঙ্কালের সন্ধানে?

–হ্যাঁ, যে কঙ্কাল দেখে মাতি বুড়ি মরেছে, সে কঙ্কাল আজ আমাদের এক ইনফর্মারকে মেরেছে। জানিনে, তোমার হিরো কত খেলা দেখাবে।

বলে মলিনার চিবুক ধরে একটু নাড়া দিয়ে চলে গেল বলাই। মলিনা দাঁড়িয়ে রইল তেমনি অন্ধকারে। কেন যেন তার বার বার মনে হতে লাগল কোথায় একটা সর্বনাশ চুপিচুপি ঘনিয়ে আসছে।

কিন্তু নিঝুম অন্ধকার অশ্বত্থের তলা। ঝিঁঝির ডাক। টর্চের আলো ফেলে গাছতলায় পায়ের দাগ খুঁজল বলাই। কিছুই বোঝা গেল না। শুধু এই নির্জন অশ্বত্থের গায়েও একটি হাতে-লেখা পোস্টার লাগানো রয়েছে, কৃষক-সন্তান শ্রীধর দাসকে কৃষকেরা ভোট দিন।

ফিরে যাবার পথে, অখিলবাবু বললেন, একটু ওই দিক হয়ে যাওয়া যাক।

 বলাই বলল, কোন দিক?

বাগদিপাড়া।

বলাই বুঝল, অখিলবাবু দুর্গার বাড়ির কথা বলেছেন। আজকাল অখিলবাবু আর তেমন স্পষ্ট করে দুর্গার নাম করেন না। সে বলল, চলুন।

দুর্গার বাড়ি অন্ধকার, নিঝুম। কিন্তু মোটা গলার স্বর ভেসে এল, কে রে ওখানে?

কেউ কোনও জবাব দিল না। গলাটা নন্দর সে ঠিকই বুঝেছিল, কারা যাচ্ছে। তবু সে আবার বলল, মুখে যে বাক্যি নেই? জিজ্ঞেস করছি যে, কে?

বলাই বলল, তুমি কে?

–আমি নন্দ।

–আমি বলাই সান্যাল।

নন্দ বলল, অ! তাই জিজ্ঞেস করছি, এত রাত্রে কে যায়?

বলাই জিজ্ঞেস করল, দুর্গা কোথায়?

–ঘুমোচ্ছে।

বলাই দাঁড়াল না। অখিলবাবু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, একবার দেখে গেলে হত।

কেষ্টও সায় দিয়ে উঠল, হ্যাঁ, আমিও তাই বলছিলুম।

বলাইয়ের মতামত পাবার আগেই, উঠোনে ঢুকে পড়লেন অখিলবাবু। অখিলবাবুর গা ঘেঁষে কেষ্টও। ভয়টা তার যায়নি। তবু একবার দুর্গাকে দেখার লোভ সামলানো যায় না।

নন্দ রুষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হল আবার। বাড়ির মধ্যে কেন?

অখিলবাবু বললেন, দুর্গা কোথায়?

 নন্দ কিছু বলবার আগেই দুর্গা বলে উঠল, এই যে দাওয়ায় আছি। কেন, কী দরকার?

অখিলবাবুর টর্চের আলো তীরের মতো ছুটে গেল দাওয়ায়। নন্দ বলে উঠল, আঃ, কেমনধারা লোক আপনারা। রাত করে পাড়ায় ঢুকে, মেয়েমানুষের গায়ে ব্যাটারির আলো মারছেন? কী হয়েছে কী?

অখিলবাবু বললেন, তবে যে তুমি বললে, ঘুমোচ্ছে?

 দুর্গা বলল, না হয় শুয়েই আছি! আপনার কী দরকার? কঙ্কাল দেখতে এয়েছেন এখানে?

টর্চের আলো সরাতে হল অখিলবাবুকে। সোজা দুর্গার গায়ে আলো না ফেলে, দূরে ফেললেন। দুর্গার অবয়বটি পরিষ্কার দেখা যায়। দুর্গার এলিয়ে বসে থাকা, কোমরের ওপর দিয়ে নামিয়ে নিয়ে আসা পা চেপে ধরা, চুড়ি পরা পুষ্ট বলিষ্ঠ হাত আর জামাহীন কাঁধের ওপর দিয়ে এলিয়ে পড়া আঁচল।

অখিলবাবুর হাতের একটি বিশেষ জায়গায়, তার প্রৌঢ় রক্ত দপদপিয়ে উঠল। নিতান্ত ক্ষণিকের জন্য হলেও দুর্গার দেহের একটা স্পর্শ তাঁর হাতে লেগে আছে। হাত থেকে দপদপানি চোখে উঠল অখিলবাবুর। অন্ধকারে চোখ খাবলার মতো তীব্র ও অপলক দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি দুর্গার দিকে। তবু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল তাঁর বুক থেকে। কেষ্টও তাকিয়েছিল। কঙ্কালের মার-খাওয়া ফোলা চোখে তার আজ নেশা ধরল যেন।

অখিলবাবু বললেন, কঙ্কালের সন্ধানেই আছি। তবে এবার আর চোখে দেখা নয় শুধু। দেখামাত্র গুলি করে মারা হবে।

নন্দ বলে উঠল, সেই ভাল বাবু! গুলি করে যদি ভূত মারা যায়, লোকের এ্যাটটা পেত্যয় হবে যে ও সব কিছু লয়। দেখুন না কেন, কাল থেকে নিকি গাঁয়ে সংকেত্তন করবে সব। তাপরে অষ্টমপোহর লাগাবে।

অখিলবাবু ফিরে গেলেন। কেষ্টও গেল সঙ্গে সঙ্গে। বাড়ির বাইরে এসে দেখা গেল, বলাই চলে গেছে। নন্দ অন্ধকারে খানিকটা অনুসরণ করল তাদের। ফিরে এল আবার পা টিপে টিপে।

নন্দ দাওয়ার সামনে এসে দাঁড়াল।

 দুর্গা বলল, চলে গেছে?

নন্দ বলল, হ্যাঁ। আর কেউ একলা থাকে এ পাড়ায়?

দুর্গা বলল, তোমার গল্পটা এবার শেষ করো নন্দদা। তাপরে কী দেখলে?

নন্দ দাওয়ার সিঁড়িতে বসে বলল, তাপরে সেই ঘুরে ঘুরে বেড়াই। তা কলকেতা শহর, কে কাকে চেনে? ভিক্ষে করতেও শিখিনি তখন। এ্যাটটা জোয়ান মদ্দ, ভিক্ষে চাইলেই কি আর লোকে দেয়? তার জন্যে কত কাঁদুনি শিখতে হয়, গল্প ফাঁদতে হয়। কিন্তুন কলকেতা কেন যেতে গেলুম, সে কথা তো বলা হল না। শালার আকাশ তো ছেদা হয়ে গেছে, খালি বৃষ্টি আর বৃষ্টি। গোটু গাঁয়ে আপন মাসির কাছে গে ছিলুম কদিন। সেও বুঝল, এ আপদ বোনঝির জমি-জিরেত নেই, মাঠে কাজও নেই, বসে বসে খাবে। পষ্ট জানিয়ে দিলে, গাঁয়ে ফিরে যাও, এত বড় ছেলেকে আমি বসিয়ে খাওয়াতে পারব না। সদরের শহরে চলে গেলুম। মাসির একখানি পেতলের ঘড়া চুরি করে নে গেছলুম। কিন্তু তাতে কদিন চলে? গাঁয়ে থাকবার জায়গা নেই, শহরেও নেই। তার ওপরে বৃষ্টি। তা শহরের ব্যাপার তো। কত রকম লোক যে আছে। দিন তিনেক ত্যাখন পেটে কিছু পড়েনি। একজন বললে, বিনা টিকিটে কলকেতা যাও। পুলিশে ধরবে, ধরলে পোড়া হোক, পচা হোক কিছু খেতে দেবে। ধুর! কেউ ধরলে না। হাওড়া ইস্টিশানে বাবুরা দুটো কী বুজুর বুজুর করে গালাগাল দিলে, গায়ে ধাক্কা দে ছেড়ে দিলে। পাথর গো কলকেতা। কী বলি কাকে। লোকগুলোন তো আমাদের দেশের মতন নয়। কেমন যেন আড়মাতলা, নিজের খেয়ালেই আছে। তা কী ভাগ্যি, বৈকুণ্ঠের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সেই যে বড়াতে ডাকাতি হয়েছেল, খুন হয়েছিল আগুরি বাড়ি হেতু রায়, সে কীর্তি তো বৈকুণ্ঠেরই। সে ত্যাখন ফেরার। সে নে গেল এক জায়গায়। দেখলুম, সেখানে বৈকুণ্ঠ ঘর নে থাকে। তবে জায়গাটা ভাল না। বেবুশ্যে টেবুশ্যে আছে সব ঘরে। অনেকদিন খাইয়েছিল বসিয়ে বসিয়ে। তাপর হাতেখড়িও দিয়েছিল। তবে শহরে নয় গাঁয়েই। চুরি নয় ডাকাতি।

দুর্গা বাধা দিয়ে বলল, জীবনে কতবার ডাকাতি করেছ নন্দদা? নন্দ বলল, তা বড় ডাকাতি বার-পাঁচেক করেছি।

কটা খুন করেছ?

–মা কালীর দিব্যি করে বলছি, এ্যাটটাও না। কুক পাড়লে যেখেনে পেটের ছেলে খসে যায়, সেখানে খুনখারাপি হয় নিকি? ডাকাতে যে খুন করে সেটা ভয়ে করে, দিদি, বুঝলে।

–ভয়ে?

–হ্যাঁ, ভয়ে। যদি ধরা পড়ি কিংবা মরি, এ ভয় যাদের বেশি হয় তারা খুন করে। রক্ত দশশন করে তাদের সাহস বাড়ে। কালীপুজোর পাঁঠা বলির মতন। ওটা ভাল নয়। এ আমি দেখলুম দিদি, মানুষ দু কারণে খুন করে। এ্যাটুটা তোমার ভয়। তা সে তোমার যেমন ভয়ই হোক। আর মারে ইজ্জতের জন্য। যার ইজ্জত জ্ঞান বেশি, সে তার ইজ্জত বাঁচাবার জন্যে খুন করতে পারে। হ্যাঁ, যা বলছিলুম

দুর্গা আবার বলল, কবার জেল খেটেছ?

–তিনবার। একবার পাঁচ বছর, তারপরে দু বছর আর একবার আড়াই বছর। এই আড়াই বছর চলছে এখনও বাইরে আছি।

বলে হঠাৎ একটা নিশ্বাস ফেলল নন্দ। বলল, হানফে (হানিফ) ডাকাডাকি করে। এদিকে কিছু করে না। হরিপালের ওদিক দে হাওড়ার দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে ডাকাতি করে আসে। শুনি নিকি, সোবেদালির বেধবা মেয়েটাকে নিকে করবে। মেয়েটার তো দুটো ছেলেমেয়ে রয়েছে। তা হানফে নিকে করবে বলে জমি কিনবে, সোমসার টোমসারও করবে। কিন্তুন তা কি কখনও হয়? মা। বিয়োল পরের জমিতে। ডাকাতি করে নিজে জমি কিনে ভোগ করব? সে কখনও সয় না। এ জন্মোটা এমনি গেল। আবার জন্মালে পরে দেখা যাবে। তবে, মন বলে এ্যাক্টা কথা আছে। ইচ্ছে কি আর করে না? কিন্তুন সোসারে সব জিনিস সকলের সাজে না। তবে আজকাল এ্যাটটা কী হয়েছে, শরীলে আর মনে কেমন জুত পাই না। সেই দলবল নে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, আর ইচ্ছে করে না। তবে, নিজের চরিত্তিরটা তো জানা আছে। কখন বেরিয়ে পড়ব, আবার হয়তো জেলে চলে যাব।

কিন্তু দুর্গা চুপ করেই ছিল। তার মনটা খারাপ হয়ে উঠছিল। কেবলই ঘুরে ফিরে একটা কথা কানে বাজতে লাগল, সোমসারে সব জিনিস সকলের সাজে না! মনে হল, নন্দর কথাগুলির সঙ্গে, কোথায় যেন নিজের জীবনের একটি প্রত্যক্ষ মিল আছে।

শীতটা ক্রমেই বাড়তে লাগল। ঘন হতে লাগল কুয়াশা। আকাশে তারাগুলি অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে আরও।

নন্দ গায়ের চাদরটা মাথাসুদ্ধ জড়িয়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁ যা বলছিলুম

দুর্গাও বলল, হ্যাঁ সেইটে বল।

নন্দ বলল, ওই বৈকুণ্ঠের সঙ্গেই একদিন রাত্রে কলকেতায় প্রতিমা দেখতে বেরিয়েছি। ত্যাখন দুর্গা পুজো লেগেছে। সব মণ্ডপেই সব নানান রকমের সাজগোজ, গান-বাজনা। এক জায়গায় দেখলুম, অনেক লোক ভিড় করে আছে। ভিড় ঠেলে, সামনে তাকিয়ে থ মেরে গেলাম। দেখলুম, বাঁশ দে ঘেরা এ্যাটটা জায়গায় একখান মরা গাছ সাজিয়েছে। সেটা ঠাহর করে দেখতে হয়। অন্ধকার তো, আর সেই মরা গাছে এ্যাটটা কঙ্কাল উঠছে আর নামছে। মড়মড় শব্দ হচ্ছে তার হাত-পা নাড়ায় চলায় ফেরায়। আর থেকে থেকে হি হি করে হাসি। এ আবার কী খেলা রে বাবা! একেবারে সত্যি কঙ্কালের মতন। বৈকুণ্ঠ বললে, খেলাটা তো জানতেই হবে। কাজে লাগবে অনেক। লোকে লোকারণ্য হয়ে সে খেলা দেখছে। কঙ্কাল হাসলে, কলকেতা শহরের লোকেরা পর্যন্ত কাট হয়ে যায়! বৈকুণ্ঠ নড়ল না। রাত বারোটা পর্যন্ত বসে রইল। মণ্ডপ ফাঁক হয়ে যাবার পর বাবুদের সে বললে, বাবু, আমাদের গাঁয়ে এ খেলাটা আপনাদের দেখাতে হবে। ছেলেছোকরা। বাবুরা হেসেই বাঁচে না। বলে, ও আবার খেলা কী হে। ও তো তুমিও গাঁয়ে গে দেখাতে পারো। বাবুরা গেঁয়ো মানুষ পেয়ে খুব একচোট হাসাহাসি করলে। পর নিজেরাই কঙ্কাল সেজে দেখিয়ে দিলে। সেই দেখলুম, ছাতার কালো কাপড়, মানষের মাপে মাপে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাপটি খাওয়া জামা। তার দু পিঠে সাদা রং দে কঙ্কাল আঁকা। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলে খালি সাদা। রংটাই দেখা যায়। বৈকুণ্ঠ বলল, বাবু আমাকে একখানি তোয়ের করে দিতে লাগবে। বাবুরা বললে, পুজো যাক তাপরে এসো। কিন্তু পুজোর পরেই হয়নি। এক মাস ঘুরে ঘুরে টাকা দিয়ে একখান তোয়ার করে এনেছিল। তা কী বলব, যেদিনে আনলে, সিদিনেই কলকেতার সেই পাড়ায় একজনকে ভয় দেখাল। এ্যার্টটা মেয়েমানুষকে। বেটি দাঁত কপাটি লেগে পড়ে গেল।

দুর্গা হেসে উঠল। বলল, বেঁচেছিল?

হ্যাঁ বেঁচেছিল। ওই মাতি বুড়ির মতন

দুর্গা বাধা দিয়ে বলে উঠল, ওটা তা বলে তোমার ঠিক হয়নি নন্দদা।

নন্দ বলল, কী করে জানব বলো। বুড়ি যে একেবারে পটল তুলবে, তা জানতুম না। তালে আগে গানির দরজায় গে দাঁড়াতুম। ওকে আমি শুধু পরখ করতে গেছলুম গো দিদি। লাগে তাক লাগে তুক। সে থাকগে—

বলে অন্ধকারে একবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল নন্দ। তারপর কেশো গলায় হেসে বলল, কিন্তুন ভোলা-কেষ্টারও যে এমন দুগতি হবে ভাবি নাই, সত্যি বলছি। ভোলাকে দৌড়তে দেখে হেসে মরে যাই। শালা লোহার ডাণ্ডা ফেলে চোঁ চা। কেষ্টটা বলে উঠল, পায়ে পড়ি, ছেড়ে দাও।

শীতার্ত অন্ধকার রাত্রি দুর্গার খিলখিল হাসিতে শিউরে উঠল যেন।

পর পর দুটি ঘটনায় পাড়াটা সিটিয়ে আছে ভয়ে। আজ বোধহয় কেউ হাজার দরকার পড়লেও বাইরে বেরুবে না। তার ওপরে দুর্গার এই হাসি কানে গেলে হয়তো ঘরের মধ্যেই অনেকে ভিরমি যাবে।

নন্দ বলল, কঙ্কাল না হয়ে এখন যদি ভোলা-কেষ্টর সামনে ওই যন্তরটি দে কড়কড় শব্দ করা যায়, তা হলেই শালারা দৌড়ে পালাবে।

দুর্গা বলল, তা তো বুঝলুম। ওদিকে অখিলবাবু কী বলে গেল শুনলে তো?

–শুনেছি। গুলি চালাবে। সে রকম দেখলে অবিশ্যি সরে আসতে হবে। তুমি যেন কার কথা বলছিলে আরও?

–ওকুর দের কথা। পুলিশের গা-চাটাটাকে একদিন ভয় দেখাতে পারো?

–তা দেখানো যাবে কেন? দু ঘা দেয়াও যাবে। ভাবছি বিমলাপুরে গে ওই সোলমান আর সনাতন ঘোষকেও একদিন ঝেড়ে আসব। শালারা এখন সাধু সেজে ভোটের নড়ায়ে নেমেছেন।

দুর্গা তেমনি খিল খিল করে হেসে বলল, কঙ্কালের গুঁতো খেলে বুঝি আবার চোলাই করতে নামবে?

নন্দ বলল, না, চোলাই ওরা করবে না এখন। জানে, এমনিতেই চিরো বাঁড়ুজ্জে তা লষ্ট করে দেবে। এখনও দুজনের দুটো জাওয়া ভাঙা বাকি আছে না? তবে সোলেমান কী করবে জানি না। সনাতন আবার চোলাই করবে, তার আগে চিরো ঠাকুরকে ধরিয়ে দিতে চায়। শালা জানে, পুলিশে আমাকে কিছু করতে পারবে না, চিরো ঠাকুরই ঢিট করবে। তাই যত আকোচ চিরো ঠাকুরের ওপর। কিছু না হোক, কঙ্কাল দেখলে ঘরের বার হবে না রাতে।

দুর্গার কেবলই হাসি পায় কঙ্কালের কথা শুনলে। নন্দ বলল, হ্যাঁ দিদি, ও জিনিস এমন মনে গেঁথে যায় দশজনে হাজার সাহস দিলেও পাণ আঁইঢাই করে।

হাসতে হাসতে দুর্গা খোলা চুল এলো খোঁপা করে বাঁধতে গেল। কী যেন পড়ে গেল তার কোমর থেকে। শব্দ হল ঠকাস করে একটু ঝকমকিয়ে উঠল।

নন্দ বলল, কী ওটা?

খুবই নির্বিকার গলায় বলল দুর্গা, ওই দেখো না, ছোটঠাকুরের কীর্তি। অস্তর দিয়েছে একখানা সব সময়ে কাছে কাছে রাখতে। গুপ্তি নিকি বলে। বলেছে, তাই রেখে দিয়েছি।

নন্দ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ভাল করেছ দিদি, দরকার রাখা। কিন্তুন কোনওদিন টের পাই নাই তো যে ওটা তোমার কাছে থাকে?

দুর্গা কিছু বলল না। এই শীতেও সে জামা গায়ে দেয়নি। আঁচলটিই জড়িয়ে নিল ভাল করে।

নন্দ আবার বলল, কিন্তুন আর কত রাত করবে। আমাকে তো খাইয়ে দিলে। তুমি খেয়ে নাও এবারে?

দুর্গা বলল, খাব। ছোট্‌ঠাকুরের রান্না করেছি। সে এসে খেয়ে নিক আগে। কিন্তুন, আজ যেন বড্ড দেরি করছে। রাত একটা তো বুঝি বাজল। গুলিটাও তো আসে না।

নন্দ বলল, এসে পড়বে দুজনেই।

একটু চুপ করে থাকার পর নন্দর গলায় হাসির মতো শব্দ শোনা গেল।

দুর্গা বলল, হাসছ যে?

নন্দ বলল, তোমার দুশ্চিন্তে দেখে। এ নাইনে এত চিন্তে করলে চলে?

দুর্গা বলল, সেই জন্যেই বলি ছোট্‌ঠাকুরকে, তাকে ঘরে বসিয়ে আমি সব করে আসতে পারি। তাইতে আমার মনে শান্তি থাকে।

নন্দর ছোট ছোট অপলক চোখের বিস্ময় অন্ধকারে দেখা যায় না। সে দুর্গার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সহসা একটি নিশ্বাস চেপে বলে, তা তুমি পারো। লইলে রাত দশটায় আদাড়বাদাড় ভেঙে শ্মশানে যেতে পারতে? তা চিরো ঠাউর কি তোমাকে অদ্দূর পাঠাতে পারে? ওই নিয়ে তোমাদের রোজ বিবাদ হয় দেখি। সে তোমাকে যেতে দেবে না।

দুর্গা যেন রুষ্ট গলায় বলল, দেখো না, শুধু ভেবে মরি বসে বসে।

 নন্দর গলার স্বরটা যেন হাসি ভরা গোঙানির মতো শোনাল, সে বলে, তুমি যাবে না ; তুমি বলো সে যাবে না, হেঁ হেঁ হেঁ…। বড় বেমানান লাগে।

দুর্গা বলল, বেমানান?

হ্যাঁ। সোমসারেতে জনে জনের নানান জায়গা। এখানটায় তোমাদের বেমানান লাগে।

দুর্গা বুঝতে পারল, কী বলতে চায় নন্দ। সে বলল, কে আর মানানসই জায়গায় আছে বলো নন্দদা। কাউকে তো দেখি না। তুমি কি মানানসই জায়গায় আছ?

নন্দ হেসে বলল, আমাদের কোনও জায়গাই নাই। জোর করে এ্যাটটা জায়গা লিয়েছি। লোকে জানে খুনি ডাকাত হয়েছি। জেল-খাটা আসামি। ওতে বেমানান কিছু হয় নাই।

দুর্গা বলল, সে তো আমার বেলাতেও নন্দদা। লোকে বলে মদ চোলাই করা নিকি আমার রক্তের মধ্যে আছে। চোলাই করে খাই। সবাই বলে, বাঁকা বাগদির মেয়ে আইবুড়ো বেলায় লোক ধরেছে। সেও সত্যি কথা। এখন যা আছি, এর চেয়ে আর আমার মানান কী থাকবে। জায়গা আমারও ছিল না, জোর করে এ জায়গায় পত্তনি নিয়েছি।

বলে হাসল দুর্গা।

নন্দ বলল, সে যারা বলে, তারাও জানে দিদি তোমার সত্যিকারের জায়গা কোথা। আমি জানি। তুমি সেটা বুঝবে না।

দুর্গা বলল, আমি বুঝি না, লোকে বোঝে, তা হয় না নন্দদা। লোকে আমাকে বুঝতে দেবে না। বাবা মরার পরে লোক তো আমি কম দেখলুম না। মানানসই জায়গায় যাবার হদিস আমাকে কেউ দেয়নি। বুড়ো আঙুল দেখাবে বলে সব তোয়ের হয়ে ছিল নন্দদা, বুঝলে। দেখাতে পারেনি, তাই রাগে বাঁচছে না তারা। তবে আমারও জেদ, পাপ বলো, অন্যায় বলল, আমি হটব না। নতুন রক্ত যখন কেউ দিতে পারলে না, ত্যাখন বাপের রক্ত-ই কাজ করবে।

নন্দ বুঝল, দুর্গা রেগে উঠেছে। তার নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। নন্দর মুখের হাসিটা গেল না। কিন্তু আপন মনে মাথা নাড়াতে লাগল সে। মনে মনে বলল দুর্গাকে উদ্দেশ করে, এ তোমার ভিতরের কথা নয় দিদি। আজ বুঝবে না, একদিন বুঝবে। দশ বছর আগে, ও সোমসারের ওপর আমারও বড় রাগ ছিল, অভিমান ছেল। সবাই এ সোমসারের মানুষ, আমি শুধু ভেসে এসেছি? বাপ-মা নাই, এটটু জমিজমা নাই, তাই কি অমন হতচ্ছেদ্দা করে ফেলে দেবে? দাও দিকিনি? তোমাদের ভুলতে দেব না আমি আছি। ঘুমন্ত আমার কথা মনে পড়বে। কিন্তু, এখন কেন মনে হয়, আমি যেন হেরে গেলুম, সোমসারটা হারে নাই। দুর্গা-দিদি, বেমান জায়গায় থাকবে বলে জেদ করে আছ, তবু একজনের পথ চেয়ে তোমার রাত কেটে যায়। মুখে ভাত তুলতে পারো না। কোমরে গুপ্তি গুঁজে রাখো।

সহসা দুজনেই চমকে উঠল। স্টেশনের ওপারে, দূরের থানার ঘণ্টার স্তিমিত শব্দ এখন পরিষ্কার শোনা গেল। ঢং ঢং করে দুটো বাজল।

নন্দ নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, একবার যাব নিকি নিল্লায়?

 দুর্গাও উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, তুমি কি চেনো হিদে গোয়ালার বাড়ি। তোমাকে না চিনলে হয়তো কেউ কিছু বলবেই না। আমিই বরং যাই।

নন্দ বলল, তা হয় না। তোমার জন্যেই আমার থাকা এখানে। একবার গে শ্মশানে ঘুরে, কবরেজের বাড়ি হয়ে এয়েছ, সেই আমার কাজের খেলাপ হয়েছে চিরো ঠাউরের কাজে। এখন তুমি নিল্লায় গেলে, আমাকে আর রক্ষে রাখবে না সে। আর হিদে গোয়ালার বাড়িও চিনি, গয়লাপাড়াটাও জানি।

বলতে বলতেই নন্দ লাঠিগাছটি তুলে নিল। বলল, সাবধানে থেকো। যত তাড়াতাড়ি পারি চলে আসব।

দুর্গা কী যেন ভেবে বলল, আচ্ছা এসো। তুমি এলে আমি বেরুব নন্দদা। যদি তুমি সাড়ে চারটার মধ্যে না আসতে পারো, তবে ঘরের ভিতরে খিলটা সেই ভাবে খুলে নিয়ো। আমি বেরিয়ে যাব। কবরেজবাড়ি যাব।

নন্দ বলল, আর সে এসে যদি জিজ্ঞেস করে, কোথা গেছে?

সে অর্থে চিরঞ্জীব।

বলো কবরেজমশায়ের বাড়ি গেছে। সাবধানে যেয়ো, কেউ যেন পিছু না নেয়।

নন্দ বলল, না, আজ পাড়া ফাঁকা আছে, কেউ আসেনি।

নন্দ নিল্লায় ঢোকার মুখে এসে চারদিক একবার দেখে নিল। নিল্লার বাতাস যেন থমথমিয়ে আছে মনে হল। যেন গন্ধ পায় নন্দ। এই বিশেষ অনুভূতিটা তার রক্তের মধ্যে আছে। তার ভিতর থেকে যেন কেউ বলে উঠল কিছু একটা ঘটেছে। এ কথা মনে হতেই একটা টর্চের আলো ঝলকে উঠল দূরে। একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে দাঁড়িয়েছিল নন্দ। সে আড়াল নিল। পরমুহূর্তেই সে বুঝতে পারল, আলোটা এদিকেই আসছে।

.

রাস্তাটা পুবে-পশ্চিমে লম্বা। উত্তরে ধান কাটা মাঠ। দক্ষিণে জঙ্গল। জঙ্গলের শেষে নিল্লার চুনুরিপাড়া। তারপরেই কানা নদী। নন্দ রাস্তা পার হয়ে জঙ্গলে ঢুকল। জঙ্গল দিয়ে ঘুরে ঘুরে চুনুরিপাড়ায় এল। নিস্তব্ধ চারিদিক। পুবে দুলেপাড়া। তারপরে একটা বড় বাগান। বাগানের ওপারে গয়লাপাড়া। সেখানে এসে যখন হিদের বাড়ির সামনে দাঁড়াল, মনে হল ঘুমন্ত পুরী, কারুর কোনও সাড়াশব্দ নেই। নন্দ দরজায় টোকা মারার আগেই গুলির গলার স্বর শুনতে পেল, কে? নন্দদা?

–হ্যাঁ। গুলি নিকি?

 গুলি অন্ধকার ফুঁড়ে বেরুল যেন।

–হ্যাঁ। এলে কী করে এখানে? গাঁ তো পুলিশে ঘিরে ফেলেছে।

 –কেন?

–গোকুল স্যাকরার বাড়িতে নাকি ডাকাতি হবার কথা ছিল, তাই। আমরা বেরুতে পারছি না। চলে এসো তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গে।

পাশাপাশি অনেকগুলি বাড়ি। মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। কিন্তু এবাড়ি-ওবাড়ি যাবার রাস্তা আছে। খড় আর গোবরের গন্ধ চারিদিকে। একটি উঠোনে এসে, অন্ধকারে দু-একটি লোকের ছায়া দেখা গেল। উঠোনটি প্রায় জেলখানার চত্বরের মতো। চারিদিকেই ঘরবাড়ি। নন্দ একলা হলে নিশ্চয় এখানে আসতে পারত না।

অন্ধকার থেকেই চিরঞ্জীবের রুষ্ট গলা শোনা গেল, তুমি আবার এখানে এলে কী করতে?

নন্দ বলল, তোমার দেরি দেখে। নইলে তো দিদিই আসতে চাচ্ছিল।

চিরঞ্জীব বলল, এখন কেমন করে যাবে যেয়ো। আমাদের তো তবু একরকম। তোমাকে আজ এ গাঁয়ে পেলে ছাড়বে ভেবেছ? ডাকাতির খবর পেয়ে সদরের পুলিশসাহেব পর্যন্ত গাঁয়ে এসে লুকিয়ে আছে। এসো, ঘরে এসো।

অনুমান মিথ্যে হয়নি নন্দর। চিরঞ্জীব ঠিকই বলেছে। কোনও প্রমাণ থাক বা না থাক, আজ নিল্লায় গেলে তাকে কিছুতেই ছাড়বে না।

যে-ঘরে ঢুকল সে চিরঞ্জীবের সঙ্গে, সে ঘরে টিমটিমে আলোয় দুজন লোক কাজে ব্যস্ত। কাঠকয়লার আগুন জ্বালিয়ে রং-ঝালাইয়ের কাজ চলছে। আপাতত যদিও সেটা দুধের টব, আসলে চোলাই মদেরই পাত্র। সোয়া দুই ফুট উঁচু প্রায় তিরিশ সের দুধের টব। টবের নীচে থেকে এক ফুট উঁচুতে আবার টিনের পাত দিয়ে সিল করা। সেই পাতের ওপর সরু ছিদ্র দিয়ে আগে মদ ঢেলে নিয়েছে। ছিদ্র একেবারে ঝালাই করে বন্ধ। তার ওপরে বাকি সোয়া ফুটের যতটা ধরে ততটাই দুধ ঢেলে নেওয়া। বোধহয় এখনও এটাই এ-অঞ্চলে শেষতম পন্থা। আবগারি বিভাগের যেটা অনাবিষ্কৃত। কলাপাতা কিংবা বিচুলি ডুবিয়ে বাঁকের দোলায় ছলছলিয়ে শুধু দুধের টব নিল্লা থেকে চলে যায় নিরাপদে। খোলা টব, তাতে কোনও ঢাকাটুকি নেই।

এ অঞ্চলের মধ্যে নিল্লা থেকেই সবচেয়ে বেশি দুধ যায় কলকাতায়। নিল্লা স্টেশন থেকে সদর শহরের জংশন স্টেশনে। সেখান থেকে হাওড়ায়, হাওড়া থেকে গন্তব্যে। সেখানে দুধ ঢেলে নিয়ে, ঝালাইয়ের সিল ছিদ্র করে মদ খালাস করে দিতে হবে।

রোজ যায় না। সপ্তাহে তিন দিন নিল্লায় দুধের সঙ্গে স্মাগল করে চিরঞ্জীব। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সে সব করে যায়। প্রয়োজন হলে, ভিন্ন পথে, সদর পর্যন্ত চলে যায়। এক সময়ে সে ভেবেছিল, হাওড়ার ভিতর দিয়ে চালান করবে। কিন্তু চোলাইয়ের জগতের এলাকার সীমানা আছে। সে-সীমানা পরস্পরের মেনে নেওয়াই নিয়ম। না মানলে সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। চিরঞ্জীব তা চায়নি। নিজের সীমানার মধ্যেই এ নতুন পন্থা তাকে আবিষ্কার করতে হয়েছিল। সে দেখেছিল দুধের টবগুলি পড়ে থাকে, পুলিশ তরকারির ঝাঁকা আর বাক্স-প্যাঁটরা ঘেঁটে দেখে। দুধের টব যদি কাজে লাগানো যায়, আর সেটা নিল্লার গোয়ালাদের সঙ্গে ব্যবস্থা করা যায় তবেই, কৃতকার্য।

কৃতকার্য হয়েছে চিরঞ্জীব। কিন্তু তার সমস্ত চেহারাটার মধ্যে একটি অতৃপ্তি, একটা বিক্ষোভ কোথায় কী ভাবে ফুটে রয়েছে। চোখের কোলের গভীর পরিখার মধ্যে দৃষ্টিতে যেন আগুনের ধার। একটু লক্ষ করলেই টের পাওয়া যায়, কেমন একটা অশান্ত অস্থিরতা তার মনের মধ্যে। তাকে কৃশ দেখাচ্ছে, তীক্ষ্ণ মনে হচ্ছে। বয়সের চেয়েও গম্ভীর ভারী দেখাচ্ছে তাকে। সমাজের এই নীচের গুহা অন্ধকারেও বোঝা যায়, তার ব্যক্তিত্বের কাছে দলের সকলেই নমিত, আজ্ঞাবহ, ভক্ত। হয়তো ভয়ও পায়।

চিরঞ্জীবকে আজকাল হাসতে দেখা যায় কম। কথা কম শোনা যায় তার মুখ থেকে। যেন রেগে আছে, রুদ্র হয়ে আছে। কখন ফুঁসে উঠবে, গর্জে উঠবে। কেন?

চিরঞ্জীব নিজেও জানে না। অধিকাংশের ধারণা, চিরো এই রকমেরই। তাই কেউ কিছু বলে না। কিন্তু দুর্গা তো জানে। দুর্গা থেকে থেকে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে তোমার? মাথা নাড়ে চিরঞ্জীব। কিছু নয়। দুর্গার দিকে তাকিয়ে তার চোখের জ্বলুনি যায়, শান্ত হয়। একটা ব্যাকুল আবেগে দুর্গাকে বুকে টেনে নেয় সে। যেন অবগাহন করে। দুর্গা যেন অথই শীতল জল। চিরঞ্জীব স্নান করে।

তবু, একদিন যে-রাগ ও ঘৃণা নিয়ে সে এ পথে এসেছিল, সেই আগুন ক্রমে যেন বাড়তেই থাকে তার। দুর্গা বলে, গুলি যেদিন মার খেয়ে এল, সেদিন থেকে তোমার যেন কী হয়েছে ছোট্‌ঠাকুর। এত রাগছ কেন? এত জ্বলছ কেন?

বলতে পারে না কিছু চিরঞ্জীব। বোঝাতে পারে না ঠিক। কারণ সে নিজে বোঝে না। এর মধ্যে দুদিন শ্রীধরদার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে এখন সব সময় লোকজন থাকে। শ্রীধরদা জ্বলন্ত বিদ্রূপের হাসি নিয়ে তাকিয়ে দেখেছেন। কথা বলেননি। সঙ্গের লোকেরা বিদ্রূপ করে কথা বলেছেন, কী হে চোরা শুঁড়ি লিডার, চালান যাচ্ছে কেমন? নিষ্ঠুর জবাব দিয়েছে চিরঞ্জীব, তোমরা যে পরিমাণ টানো, সেই পরিমাণই চালান হচ্ছে। কথায় ও জবাবে পরস্পরের চোখে রক্ত উঠে এসেছে। গরম হয়ে উঠেছে হাওয়া। যদিও কোনও রকম দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়নি। কিন্তু ইঙ্গিত থেকেছে, নির্বাচনের পরেই চিরঞ্জীবকে তারা ঢিট করবে। আর এও নিশ্চিত, শ্রীধরদাই এবারও নির্বাচিত হবেন।

এই কারণেই কি এত বিক্ষোভ তার? কিন্তু এ তো নতুন নয়। আছেই, থাকবেও। কেবল পরস্পরের বিবাদ তীব্র হয়েছে আরও।

এ নয়। আরও কিছু। যেন একটি কোণঠাসা পশুর মরিয়া হয়ে ওঠা। দুবার ভয়ংকর কিছু করতে ইচ্ছে করছে তার। চন্দননগরের ড্রাইভার বুধাইদা হলে হয়তো বলতে পারত কিছু। বুধাইয়ের কাছে আর যায় না চিরঞ্জীব। চন্দননগরের সমস্ত পাট সে চুকিয়ে দিয়েছে প্রায়। সেটা এ কাজের সহায় বলেই বোধ হয়। এক পথে, এক ধরনে বেশি দিন চলা উচিত নয়। বুধাইকে পেলে হয়তো সে ওই পুরনো কথাটা আবার বলত। চেঁচিয়ে, চিৎকার করে বলত, ভাল লাগে না। আমার ভাল লাগছে না। তার সঙ্গে শুধু একটি কথা নতুন করে যোগ করত, কেবল দুর্গাকে ছাড়া। আমি কি জানতুম, দুর্গাকে ছাড়া আমি আর একমুহূর্ত বাঁচতে পারি না। আমি জানতুম না, দুর্গার পরিমণ্ডলের মধ্যে আমার সব মন আমার প্রতিটি রক্তবিন্দু লাট-খাওয়া ঘুড়ির মতো পাক খেয়ে মরছিল। দুর্গার সর্বনাশ হবে, এই ভয়ে আমি মিথ্যে লুকিয়ে ছিলাম। আজ আমি সব ভাললাগার বাইরে নিজেকে আবিষ্কার করেছি দুর্গার অন্তরে, তার দেহে, তার রক্তে। কিন্তু আবিষ্কার করে আমার জ্বালা বাড়ল। ওরাই বাড়াল। সমাজের শাসন-শৃঙ্খলার চোখরাঙানি, অক্ষম নীতি ও নৈতিকের ধমকানি। না, মাথা নত করে ফিরে যাব না এ সমাজ ও শাসনের কাছে। এ আমার মরণের পণ। আর সে মরণ যেন দুর্গার কোলে শুয়ে হয়। এই এক ছাড়া আর কোনও বাসনা নেই।

তারপর নিজেরই বলা সেই কথাটি তার মনে হয়, একটা ভয়ংকর কিছু করতে ইচ্ছে করে বুধাইদা, প্রলয়ঙ্কর একটা কিছু।

কপাল থেকে উশকো-খুশকো চুলগুলি সরিয়ে সিগারেট ধরাল চিরঞ্জীব। অপলক চোখে মদপূর্ণ মস্ত বড় টবটার দিকে তাকিয়ে রইল। ইচ্ছে হল গণ্ডুষ ভরে পান করে সমস্ত অনুভূতিটাকে মেরে টিপে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। কিন্তু অদ্ভুত অনাসক্তি তার। জীবনে দু-একবার যে না খেয়েছে তা নয়। একটুও উপভোগ করতে পারেনি, আকর্ষণ অনুভব করেনি।

উঠে বাইরে চলে গেল সে। নন্দর মতো সাহসী লোকও দুর্গার ভোর সাড়ে চারটেয় বাইরে যাবার কথাটা বলতে পারল না।

দু মিনিটের মধ্যেই আবার ঘরে এল চিরঞ্জীব। বলল, বড্ড গন্ধ বেরুচ্ছে। মদ আর ঝালাইয়ের গন্ধ। তাড়াতাড়ি কর।

তারপরে নন্দর দিকে না তাকিয়ে বলল, আজও নাকি কঙ্কাল বেরিয়েছিল গাঁয়ে?

 নন্দর মুখে হাসি ফুটল। বলল, খবর পেয়ে গেছ?

অনেকক্ষণ। কেষ্ট নাকি মরতে মরতে বেঁচে গেছে।

 বলে চিরঞ্জীব নন্দর চোখের দিকে তাকাল। নন্দ বলল, হ্যাঁ দেখলুম তো চোখের কোলটা ফুলে উঠেছে। কাঁধে নাকি গাছের ডাল দে মেরেছে।

যারা টবে মদ ভরে সিল করেছিল, তাদের হাতের কাজ বন্ধ হয়ে গেল। একজন বলে উঠল, সত্যি, কী ব্যাপার বলো তো? মনে হলে তো অন্ধকারে ঘরের বার হতে পারব না।

নন্দ নির্বিকার গলায় বলল, কঙ্কাল লোক বুঝেই ধরে। তোমাকে আমাকে ধরতে যাবে কেন শুধু শুধু? ওরা নিশ্চয় কিছু পাপ করেছেল। চিরঞ্জীব তাকিয়েছিল নন্দর মুখের দিকে। চোখাচোখি হতে নন্দ একটু হাসল। চিরঞ্জীব বলল, বড় সেয়ানা কঙ্কাল। খুন-টুন করে ফেলে শেষটায় না কঙ্কালেরই হাতে কড়া পড়ে।

নন্দর আগেই একজন বলে উঠল, কঙ্কালের আবার হাত আছে নাকি যে কড়া পরাবে। কী যে বলো তুমি চিরোঠাকুর, তার ঠিক নেই। যে দেখে, সে দেখে, পুলিশ কি তাকে দেখতে পাবে নাকি?

আর একজন বলল, শুনেছি অপদেবতাকে বশ মানিয়ে অনেকে অনেক কাজ করিয়ে নেয়। ওদের দিয়ে মাল এসমাগল করতে পারলে ভাল হত।

চিরঞ্জীবের ঠোঁটের কোণে একটু বাঁকা হাসি দেখা গেল। বলল, তা বটে।

নন্দর দিকে ফিরে বলল, নাও, আর দাঁড়িয়ে কেন? এখন আর যেতে পারছ না। ভোরবেলা যদি পুলিশ গাঁ ছেড়ে চলে যায়, তবে একে একে ফিরব সব। ধরা পড়লে, সন্দেহবশত আমাদেরই চালান করে দেবে। এখন ভাবছি, কাউকে ফিরতে না দেখে দুর্গা না এসে উপস্থিত হয়।

তবু নন্দ দুর্গার কথাটা বলতে পারল না। আশঙ্কা হল, বললেই একটা অনর্থ হবে। শুধু বলল, না। আমি তাকে বুঝিয়ে বলে এসেছি।

চিরঞ্জীব সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বলল, তুমি বুঝিয়েছ আর দুর্গাও বুঝেছে। শালুক চিনেছে গোপাল ঠাকুর।

বলে স্যান্ডেলের তলায় সিগারেটের শেষাংশ চেপে দিল। তারপর আপন মনে বলল, আমরা খারাপ, কিন্তু আমার ভয় করে জানোয়ারেরা কখন দুর্গার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

কিন্তু দুর্গার প্রাণে কিছুমাত্র ভয় নেই। সাড়ে চারটের আগেই বাইরে থেকে দরজার হুড়কো বন্ধ করলে সে। রাত্রি এখনও বেশ বড়। মনে হয় গভীর রাত এখনও। অন্ধকারের সঙ্গে কুয়াশা আরও ঘন হয়েছে। কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই।

কয়েক মুহূর্ত দাওয়ার ওপরে দাঁড়িয়ে রইল দুর্গা। চারদিকে দেখল তীক্ষ্ণ চোখে। দেখে, ঘরের পিছনে জঙ্গলের পথ ধরে নিঃশব্দে এগুল। কিন্তু নিঃশব্দে যাবার উপায় নেই। এর মধ্যেই গাছগুলির পাতা ঝরতে আরম্ভ করেছে। শুকনো পাতার ভিড় পায়ের নীচে। মড়মড় শব্দ হয়। গিরগিটি পতঙ্গ চোখখাবলারা হয়তো চমকায়। শেষ প্রহর ঘোষণা করার আগে শেয়ালেরা ঝোপঝাড়ের অন্ধকার থেকে হয়তো তাকিয়ে দেখে দুর্গাকে।

সাত-আট মিনিটের মধ্যেই কবিরাজের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল। পাকা দোতলা বাড়ি, ভাঙা, জীর্ণ। নোনা ইটে শেওলা আর ফাটলে অশ্বত্থের আক্রমণের ছায়ায়, নিঃশব্দে প্রতীক্ষার শিকারী নাগের কল্পনা আসে। ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। চত্বরটাও জঙ্গলে ভর্তি। বাড়ির পিছন দিকে বাগান ছিল এককালে। এখন বিঘে দুয়েক পোড়ো জমি ছাড়া কিছু নেই। গোটা বাড়িসহ বাগান ও পাঁচিল ঘেরা ছিল। এখন পাঁচিল নানা জায়গায় ভেঙে গিয়েছে। কবিরাজবাড়ির বাগানের ওষুধি গাছ লতাপাতা বিনাশ হয়েছে অনেক দিন।

দুর্গা প্রথমে বাড়ির পিছন দিকেই গেল। ভাঙা পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে, গোরুর গাড়িটার ঢোকার কথা বাগানেই। দেখল, গোরুর গাড়ি রয়েছে। তৈরিই রয়েছে। ছই-দেওয়া গোরুর গাড়ির দুদিকের মুখছাট খালি খোলা।

দোতলার জানলা থেকে মেয়ে গলায় চাপা স্বর ভেসে এল, এই দুগগা, ওপরে আয়।

বাগানের দিক থেকে ফিরে, বাড়ির পিছনের দরজার কাছে এল দুর্গা। অন্ধকারে দেখা যায় না। কিন্তু দরজার ওপরেই দাঁড়িয়েছিল সুশীলা, কবিরাজের মেজো মেয়ে।

দুর্গা বলল, গাড়োয়ান কই?

সুশীলা বলল, এই তো, এ ঘরে। চল ওপরে চল, আচি তৈরি আছে।

ভাঙা সিঁড়ি, অচেনা লোকের পক্ষে বিপজ্জনক। দোতলার ঘরের মেঝেরও কোনও কোনও জায়গা টালি খসে বড় গর্ত হয়েছে। উঁকি দিয়ে নীচের ঘরের সবই দেখা যায় তাতে। দুর্গার অসুবিধে নেই। এ বাড়ির প্রত্যেকটি আনাচকানাচ তার নখদর্পণে। কিন্তু গাড়োয়ানটিকে একবার দেখতে ইচ্ছে হল তার। সুশীলা একলাই গাড়ি আর গাড়োয়ান ঠিক করেছে।

দুর্গা বলল, বাতি কোথা?

–ওপরে আছে।

সুশীলার সঙ্গে দুর্গা ওপরে গেল। সিঁড়ির শেষে, ওপরে দুদিকে দুটি ঘর। এক ঘরে কবিরাজমশায় স্বয়ং। অঘোর কবিরাজের পেশাই শুধু নষ্ট হয়নি। এখন প্রত্যহ প্রতি মুহূর্তে মরণের প্রতীক্ষায় আছেন। গৃহিণী সেই মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করার জন্যই যেন সর্বক্ষণ আছেন স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে। ওই ঘরে কোনওদিন ঢোকেনি দুর্গা। দূর থেকে উঁকি মেরে দেখেছে। গৃহিণী বেরিয়ে এসে কথা বলেন।

এই সেই বাড়ি, যে বাড়িতে ভিষকরত্ন, ভিষকশাস্ত্রীর অভাব ছিল না। লোকে বলত ধন্বন্তরীর বাড়ি। যাঁদের চিকিৎসাশাস্ত্র প্রায় রূপকথার তুল্য ছিল। যাঁদের খেত-খামার বিশেষ ছিল না। কিন্তু খেয়ে না ফুরাবার মতো ঐশ্বর্য ছিল। কালের থাবায় এখন শেষ খাবি খাওয়ার পালা চলেছে। মেয়েরা নেমেছে পয়সা রোজগারের অন্ধকার রাস্তায়। তবু আশা আছে, দুই অরক্ষণীয়া মেয়ের একদিন বিয়ে হবে। কবিরাজমশায় মারা গেলে তাঁর শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণভোজন হবে। গিন্নি দৌহিত্র নিয়ে আদর করবেন। কারণ পৌত্রের আশা শেষ হয়েছে। পুত্র আর কোনওদিন আসবে না। সে ভীরুটা বউ সুদ্ধ না খেয়ে মরার ভয়ে পালিয়ে গিয়েছে।

এখনও কবিরাজ-গিন্নির সামাজিক ভয় অনেক। মেয়েদের বাইরে যেতে দিতে চাননি। একবার ধরা পড়লে, জানাজানি হলে, আর কে বিয়ে করবে ও-মেয়েদের? মেয়েরা যখন সে কথা শোনে, তখন মহাকালের হয়ে বোধ হয় তারা নিজেরাই খিলখিল করে হেসে ওঠে মায়ের মুখের ওপর।

দুর্গা ওপরে এল। টিমটিমে আলোয় দেখল, সাদা বোরখা পরা মূর্তি। শুধু মুখের ঢাকনা খুলে দাঁড়িয়ে আছে অচলা। টিপে টিপে হাসছে।

দুর্গা বলল, বোরখা খোলো, দেখি বিবির সাজ ঠিক হয়েছে কি না।

বোরখা খুলে অচলা দাঁড়াল। এরা বুঝি মধ্যবয়সী মেয়ে। ত্রিশের কম নয়। স্বাস্থ্য বলতে বিশেষ কিছু নেই। শক্ত হাড়সার চেহারা। রংটা ফরসা। এর মধ্যেই আঁট করে চুল বেঁধেছে। সিঁথিতে দিয়েছে সোনালি রং। চোখে কাজল, কপালে কালো টিপ। পায়ে আলতা আর পায়ের পাতায় দুটি আলতার স্বস্তিকা। পায়ের আঙুলে রুপোর আংটি। হাত ভরতি কাঁচের চুড়ি। মুসলমান চাষির বিবি বলে মানিয়েছে পুরোপুরি।

অচলা বলল, অত দেখছিস কী দুগগা? তুই যেন মেয়ে দেখতে এলি?

সুশীলা বলে উঠল, ওরে আচি, মা বলছিল, আজ আবার আমাদের দেখতে আসবে।

কথা শেষ হবার আগেই দুই বোন হেসে উঠল খিলখিল করে।

দুর্গা বলল, চুপ করো তোমরা, বাইরে কেউ শুনতে পাবে।

কিন্তু সুশীলা অচলা চুপ করতে পারে না। চুপ করতে হয়তো চায়, কিন্তু হাসির দমকটা ওদের থামতে চায় না কিছুতেই। সিদ্ধি খাওয়া নেশার মতো, হাসি একবার উঠলে রক্ষে নেই। দু বোনের এ হাসি দেখলে দুর্গা রাগ করতে পারে না। হাসতে গেলেও কোথায় যেন আটকে যায়। এক এক সময় তার সন্দেহ হয়, এরা দুজনেই পাগল হয়ে গিয়েছে। সেই হাসিটিই মুহূর্তে হিংস্র গর্জনে রূপান্তরিত হয়ে, কামড়াকামড়ি মারামারি শুরু করবে হয়তো।

হাসির দমকা একটু কমলে, অচলা বলল, কখন আসবে বলেছে?

সুশীলা বলল, বিকেলে।

বলেই আবার হেসে উঠতে যাচ্ছিল দুজনে। দুর্গা বলে উঠল, দোহাই বড়দি, তুমি আর হেসো না। বেরিয়ে পড়ো। মনে আছে সব কথা?

অচলা বলল, হ্যাঁ। সোয়ামির সঙ্গে সদরের কোর্টে যাচ্ছি, মামলা আছে। আমি একজন সাক্ষী। নাম আনোয়ারা বিবি। জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে দাঙ্গা হয়েছিল, আমি তার সাক্ষী। হয়েছে?

দুর্গা বলল, হ্যাঁ, কিন্তু যাচ্ছ কোথা?

চন্দননগরে, ইস্টিশনের পুবে, মুরারীবাগানের তিলি পাড়ায়–থতিয়ে গেল অচলা। কী যেন সেই বুড়ির নাম? খালি সেই লোকটার নামই মনে পড়ে, জগদীশ পাল। মা গো! আমাকে দেখেও লোকটা মাইরি রাক্ষসের মতো তাকিয়ে থাকে।

পুরুষেরা তার দিকে তাকালে অচলা এখন অবাক হয়। হাসি পায় তার।

 দুর্গা ঠোঁট টিপে হেসে বলল, তাক্কে থাকলে ক্ষতি নাইকো। কিন্তুন কথাটথা যেন বলতে যেয়ো না। আগে পাগল ছিল লোকটা। ওই বুড়ি ভগবতীরই ছেলে ওটা।

অচলা বলল, ভগবতী, হ্যাঁ, ভগবতী বুড়ির বাড়ি।

দুর্গা বলল, হ্যাঁ, সেখেনে জিনিস খালাস করে, জামা কাপড় বদলে, মুখ মাথা ঘষে, রেলগাড়িতে করে চলে এসো। গাড়োয়ানটাকে একলা পাটঠে দিয়ো, বুঝলে?

অচলা চোখ পাকিয়ে, ভ্রূ কুঁচকে বলল, গাড়োয়ান বলছিস কেন লো। আমি আনোয়ারা বিবি আর ও ফকির আলি না? আমার সায়েব তো!

এবার তিনজনেই হেসে উঠল। এই পুরনো ভাঙা বাড়িটার অভ্যন্তরে যেন প্ৰেতনীরা হাসছে। মাঘের কুয়াশা-ঘন শেষ রাতের বদ্ধ বাতাসে এ হাসির কোনও মুক্তি নেই।

দুর্গা বলল, তা তোমার ফকির আলিকে একবারটি ডাকো দেখি।

অচলা বলল, যা সুশীলা ডেকে নিয়ে।

সুশীলা আলোটা নিয়ে নীচে নেমে গেল। দুর্গা বলল, তোমাদের চেনা লোক তো?

অচলা হাসতে হাসতেই বলল, ওর বাপ-ঠাকুরদাকে সুদ্ধ চিনি।

–ওর নিজেরই গাড়ি?

 –হ্যাঁ।

–ভেঙে বলেছ সব?

বলেছি। লোকটা ভিতু একেবারে। খালি বলে, পারব না ঠাকরুন। বলে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মানে, বিশ্বাস করতে পারছিল না, সে এক কারণ। এদিকে কবরেজ বাড়ির মেয়ে, পেছুতেও পারছিল না। সাতদিন ঘোরাঘুরি করে রাজি হয়েছে। তবে ওই, মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। কেন বল তো, এখনও তাকিয়ে থাকবার কী আছে?

সে জবাবের আগেই টিমটিমে আলোয়, সুশীলার পিছনে ফকির আলিকে দেখা গেল। নিরীহ চেহারা। কালো লম্বা অচলারই বয়সী হবে। মাথায় ছোট ছোট চুল, চিবুকে কিছু কালো দাড়ি। একটি জামা, আর গামছাখানি মাফলারের মতো গলায় বাঁধা।

অচলা বলল, এই দেখো আমার

 বলেই হেসে উঠল। ফকির আলি দুর্গাকে দেখল একবার। তারপরে, তিনটি মেয়ের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তার দুই চোখে অপরিসীম বিস্ময়। তার সঙ্গে ভয়ও আছে।

দুর্গা জিজ্ঞেস করল, বাড়ি কোথা?

 ফকির আলি মাথা নিচু করেই বলল, বড়া।

পারবে তো?

ফকির আলি ঘাড় কাত করল।

–আচ্ছা যাও, নীচে গে বসো।

ফকির আলি চলে যাবার পর দুর্গা বলল, ভালই তো মনে হচ্ছে।

অচলা বলল, বড় মুখচোরা। কথা বলতে পারে না। ওদিকে তোর যা দুই পাণ্ডা আছে ভোলা আর কেষ্টা। একটা মাছিও ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গাঁ থেকে বেরুতে পারে না।

দুর্গা বলল, কেষ্টা আজ বোধহয় থাকবে না। কঙ্কাল বেরিয়েছিল কাল রাতে—

অচলা সুশীলা দুজনেই হামলে পড়ল, হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনেচি! মাইরি, গায়ে কাঁটা দেয়। তোদের পাড়ার দিকেই নাকি দেখা গেছে?

–হ্যাঁ। কেষ্টাকে ধরেছিল। মেরেছে খুব।

 সুশীলা বলল, ভূতের মার খেয়েও বেঁচে আছে?

দুর্গা হেসে উঠল। বলল, তোমাদের কি ভয় করছে নিকি গো মেজদি?

সুশীলা প্রায় ভীত গলায় বলল, কী বলিস লো দুর্গা, ভয় করে না? অমন জ্যান্ত কঙ্কালের কথা কেউ কখনও শুনেছে?

বোঝা গেল, দলের অনেকের কাছেই কঙ্কালের রহস্য গোপন আছে। দুর্গা গম্ভীর হয়ে বলল, ভাবছি মেজদি, কঙ্কালটাকে আমি পুষব।

সুশীলা বলল, কঙ্কাল পুষবি?

অচলা এতক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়েছিল দুর্গার মুখের দিকে। এবার দুর্গার চিবুকে হাত দিয়ে, মুখ তুলে ধরে বলল, ব্যাপার কী বল তো?

দুর্গা হেসে উঠে বলল, কী আবার। জ্যান্ত কঙ্কাল পুষব।

অচলা বলল, এখনও পোষা আছে বল।

দুর্গা হেসে উঠল। অচলা চেপে ধরল, বল কী ব্যাপার?

 দুর্গা বলল, পরে বলব। এখন বেরিয়ে পড়ো। জিনিসপত্র গাড়িতে সব তোলা হয়েছে?

–গাড়িতে বিচুলি তলায় দিয়ে একেবারে বিছানা পেতে ফেলা হয়েছে।

ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে অচলা থেমে বলল, সুশী, কখন দেখতে আসবে বলেছিলি?

–বিকেলে।

 অচলা দুর্গার দিকে ফিরে বলল, আজ আমাকে আট আনা পয়সা ফাউ দিতে হবে দুগগা।

–কেন?

–যে মিনসেরা আসবে দেখতে, তারা এ গাঁয়ের পাঁচু ময়রার খাবার না খেয়ে বিদেয় হবে নাকি? খেতেই তো আসে।

আবার একটা হাসির চাপা উদ্দাম ফেটে পড়ল। তারপর তিনজনেই, নীচে নেমে এল। পুবের আকাশ প্রায় ফরসা হয়ে এসেছে। ফকির আলি ছইয়ের পিছনে মুখছাট বেঁধে দিল। সামনে একটা শাড়ি ঝুলিয়ে দিল দু ভাঁজ করে। অচলা ভিতরে গিয়ে বসল।

দুর্গা বলল ফকির আলিকে, আগে রেল গেট পার হবে। তাপরে সোজা উত্তরের রাস্তা ধরে যাবে।

ফকির আলি বলল, জানি।

গাড়ি বেরিয়ে গেল ভাঙা পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে। ঘুরে গিয়ে, রাস্তায় পড়বে। সুশীলা বলল, তুই চলে যাচ্ছিস দুর্গা?

দুর্গা বলল, হ্যাঁ, বনের মধ্যে দে আমি রেল লাইন তক দেখে আসি।

দুর্গা সামনের দরজা দিয়ে অদৃশ্য হল। প্রথমে এল বাড়িতে। চিরঞ্জীবেরা কেউ ফেরেনি এখানে। যে-পথে ন্যাড়াকালীতলায় যায়, সেই পথে হেঁটে গেল সে। অন্ধকারের চেয়ে কুয়াশা বেশি। খানিকদূর গিয়ে, স্টেশনের কাছে, ভাঙা শিবমন্দিরের জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। সেখান থেকে স্টেশন দেখা যায়। গোরুর গাড়ির রাস্তাটাও সামনেই। কিন্তু কুয়াশায় কিছুই দেখা যায় না।

দুর্গা পায়ে-পায়ে রাস্তার ওপরে এসে দাঁড়াল। স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে গেল স্টেশনের দিকে। সবজির গাড়িগুলি ইতিমধ্যেই স্টেশনের চত্বরে ভিড় করেছে।

সোজা স্টেশনে না গিয়ে, বাঁ দিকে, হাটের হাঁড়ি কলসির দোকানগুলির ভিতর গলি দিয়ে এগিয়ে গেল। দোকানগুলির শেষে সেখানে দামেভরা ময়লা পুকুরটা দেখা যায়, সেখান থেকে রেলগেটটা চোখে পড়ে।

দোকানিরা এখনও জাগেনি কেউ। জাগবার কথাও নয়। শীতের ভোর একটু দেরিতেই হয়। পুকুরের ধারে যেতে না যেতেই চোখে পড়ল ফকির আলির গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকা দেখে চমকে উঠল দুর্গার বুকের মধ্যে। পরমুহূর্তেই চোখে পড়ল ভোলাকে। গাড়িটা প্রদক্ষিণ করছে সে। দুর্গা দোকানের আড়াল নিল।

অখিলবাবু এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবে গাড়ি। ফকির আলি বলল, কোর্টে।

–কোর্টে?

এঁজ্ঞে মকরদমা আছে!

–গাড়িতে কী আছে?

–এঁজ্ঞে মেয়েছেলে আছে, মকরদমার সাক্ষী।

 অভাবনীয় নতুন কিছু ব্যাপার নয়। রেলগাড়িতে যাওয়ার চেয়ে, সচরাচর কৃষকদের সোজা গোরুর গাড়ি নিয়েই যেতে দেখা যায়।

অখিলবাবু বললেন, হুঁ। খুব সকাল সকাল বেরিয়েছ দেখছি।

দুর্গা দেখল, ভোলা নাকের পাটা ফুলিয়েছে। গন্ধ নেবার চেষ্টা করছে। নেকড়ের মতো তাকিয়ে আছে ফকির আলির মুখের দিকে।

ফকির আলি বলল, তা বাবু জানোয়ারের মর্জির ওপর যাওয়া। উকিলবাবু বলে দিচ্ছেন, লটার মধ্যে হাজির হতে।

অখিলবাবু বললেন, যাও।

 গাড়ি এগিয়ে গেল।

ভোলা বলল, গাড়ির ভেতরখান দেখলেন না ছোটবাবু?

অখিলবাবু মুখ বিকৃত করে বললেন, তোর তো ওই এক চিন্তা, বাঁকার মেয়ে আছে কি না দেখবি। তা সব কিছুর একটা সম্ভব অসম্ভব আছে তো।

ভোলা বলল, দুগগার কাছে কিছু অসম্ভব লয় ছোটবাবু।

রাত্রি-জাগা ফোলা ফোলা মুখ অখিলবাবুর। একটা সিগারেট ধরিয়ে দমকা নিশ্বাস ফেলে বললেন, তাই তো এ্যাদ্দিন ধরে বলছিস। ছুঁড়িকে ঘায়েল তো করতে পারলিনে। তার ওপরে এখন আবার ভূতের ভয় হয়েছে।

ভোলা বলল, বড়বাবু বলে, ও ভূতটা দুগগার দূত। আমারও তাই মনে লেয় ছোটবাবু।

–কেন?

কী জানি ছোটবাবু, আমারও মনে লেয়। দুগগা নিশ্চয় কিছু জানে ও বিষয়ে। সত্যি কি অমন ভূত হতে পারে?

–তবে তখন ভয় পেয়েছিলি কেন?

 ভোলা চুপ করে রইল। বোঝা গেল, দুজনেই ফিরে চলেছে স্টেশনের দিকে। অখিলবাবুর বিরক্ত গলা শোনা গেল। বল না, তখন ভয় পেয়েছিলি কেন?

ভোলার জবাব শোনা গেল না। দুর্গা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল। ভাবল, দোকানিরা উঠে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে কিছু ভাববে। সে আর একটা গলি দিয়ে, হাটের মধ্যে চলে এল। নিঃশব্দ ফাঁকা চালা ঘর। কোনওটারই ঝাঁপ নেই। মনিহারি কাপড় আর মুদি দোকানগুলি বন্ধ। দুর্গা নিশ্চিত ছিল, ভোলা আর অখিলবাবু স্টেশনে গিয়েছে। এ সময়ে সবজির ঝাঁকাগুলি দেখবে ওরা।

সে তেঁতুলের তলা দিয়ে রাস্তার দিকে এগুল। হাটের মধ্যে তিনটি বড় বড় তেঁতুলগাছ পাশাপাশি রয়েছে যেখানটায়, সেইটাই তে-তেঁতুলতলা।

কিন্তু রাস্তার ওপর পড়তেই থমকে গেল দুর্গা। কয়েক হাত আগেই ভোলা। বোধহয় অফিসে ফিরে যাচ্ছিল। ভোলা ফিরে তাকাল। তাকিয়েই, সোজা একেবারে দুর্গার পায়ের কাছে এসে পড়ল।

–দুগগা না?

দুর্গা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, দেখতে পাচ্ছ না? রাস্তা আটকে গায়ের ওপর কেন? পথ ছাড়ো।

এই প্রথম ভোলা দুর্গার হুকুম মানল না। কেমন একটা অস্বাভাবিক গলায় বলল, পথ তো বরাবরই ছেড়ে দিই। আটকে রাখতে পারি না কোনওদিন। তা এ ঠাণ্ডায় এত ভোরে কোথা গেছলে?

দুর্গা বলল, যেখানেই হোক, তোমাকে বলতে যাব কেন? সরে দাঁড়াও।

বেশ চেঁচিয়েই বলল দুর্গা। রাস্তাটা এখনও ফাঁকা। যদিও অদূরে স্টেশনের কাছেই লোকজন কেউ কেউ আছে। দু একটা চায়ের দোকানও খুলেছে। অখিলবাবু স্টেশনেই রয়ে গেছেন।

ভোলা হেসে উঠল গুঙিয়ে গুঙিয়ে। তার নিশ্বাস লাগল দুর্গার গায়ে। যেন গোঁ ধরা শান্ত ভাবে বলল, সরেই তো আছি।

তার কথা শেষ হবার আগেই দুর্গা তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল, তুই সরবি? হকচকিয়ে গেল এবার, সরতে হল ভোলাকে। দুর্গার গলার স্বর যেন কেটে বসে গেল তার চামড়ায়। যেন সম্বিত ফিরে পেল ভোলা।

কিন্তু দুর্গার চোখে দপদপে আগুন। সে ঘাড় কাত করে তাকিয়ে আবার বলল, বড় যে মরণ বাড় দেখছি, অ্যাঁ?

ভোলার লাল চোখ দুটি অপলক। দুর্গার দেহের দিকে তার দৃষ্টি। সুরহীন গলায় বলল, আমার মরণ বাড় আজ দেখলে? মরণের সোময়টা কবে আসবে, তাই ভাবি।

দুর্গার হাত তখন কোমরের আঁচলে ঢাকা পড়েছে। বলল, দেখে শুনে তো মনে হচ্ছে আর বেশি দেরি নাইকো। মরার বড় সাধ দেখছি?

বলে দুর্গা পায়ে-পায়ে অগ্রসর হল। পিছনে ভোলা যেন একটা কিংকর্তব্য শুয়োরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। গলার স্বরটা তার চড়ল না। প্রায় আপন মনেই বলল, হঁ দুগগা, মরার সাধ অনেক দিনের হে।

দুর্গা ততক্ষণে অনেক দূর। ভোলা যেন মাতালের মতো টলতে লাগল দাঁড়িয়ে। দুর্গার যাবার পথের দিকে তাকিয়ে, সে আবার উলটো দিকে ফিরে, স্টেশনের পথে গেল। কেষ্ট কাঁধের ব্যথা নিয়ে ওখানেই আছে। ওকে বলতে হবে। ছোটবাবু আর কাসেমকে বলতে হবে।

বলতে হবে, তবু তার রক্ত যেন কী একটা নেশায় দাপাতে লাগল। অথচ নেশার খোয়ারিতে যেন নিঝুম হয়ে যেতে লাগল সে।

.

অপরাহ্নের আকাশ জুড়ে, কথাগুলি লাউডস্পিকারে উচ্চারিত হচ্ছিল। মাঘের শেষের বাতাসে ভর করে ছড়িয়ে পড়ছিল সারা গ্রামে। মায়ের ওপর পুত্রের অধিকারের মতোই জমির ওপর কৃষকের অধিকার স্বীকার করে নিতে হবে। জমির ওপরে তার বর্তমান মালিকানা বজায় চাই, ফসলের ন্যায্য দর চাই, অন্যান্য ট্যাকস-এর বোঝা থেকে মুক্তি চাই। না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের লড়াই থামবে না।

কণ্ঠস্বর চেনা। বারোয়ারিতলার সভায়, শ্রীধরদা বলছিলেন। দুর্গার দাওয়ায় বসে কেমন যেন বিহ্বলভাবে কথাগুলি শুনছিল চিরঞ্জীব। আর দুর্গা ঘরের ভেতর থেকে দেখছিল ছোট্‌ঠাকুরকে। নিল্লায় যাবে বলে উঠতে যাচ্ছিল সে। সেই সময়েই কথাগুলি ভেসে এল। চিরঞ্জীব যেন অবাক হয়ে গেল। থতিয়ে গেল, থমকে বসে রইল। যাত্রাদলের সেই বিবেকের গান শোনা রাজার মতো।

চিরঞ্জীব নিজেও জানে না, কেন সহসা তার পদক্ষেপ স্তব্ধ হল। হয়তো, কেউ তার সামনে থাকলে, কারুর সঙ্গে কথাবার্তায় ব্যস্ত থাকলে, হঠাৎ এমন অন্যমনস্ক হত না সে। দুর্গাও ঘরে ছিল। কিছুক্ষণ আগেই দুর্গার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল তার। কারণ, সে টের পেয়েছে দুর্গা তার বারণ মানেনি। লুকিয়ে কবিরাজের মেয়েদের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। চিরঞ্জীব বুঝতে পারে, যে। আগুনে সে জ্বলছে, সেই আগুনেই জ্বলছে দুগ। তাই দুর্গা স্থির থাকতে পারে না। সে বলে, তবে আমাকে তোমার সঙ্গে নে চলো ছোট্‌ঠাকুর। ঘরে বসে আমি থাকতে পারি না। দুর্গা নিল্লায় যেতে চায়। সঙ্গে থাকতে চায়। চিরঞ্জীব জানে, যদি সে নিজে ঘরে থাকত তবে দুর্গাও থাকতে পারত। জীবনের খুঁটিটা যেখানে পোঁতার কথা ছিল দুর্গার, সেখানে পোঁতা হয়নি। তাই এক সময়ে বাপের চলে যাওয়ায় বাপের সঙ্গে ঝগড়া করেছে। আজ, একজন চলে গেলে তার ঘরে বাইরের সব খাঁ খাঁ করে। জ্বলতে থাকে, আর সর্বনাশে মেতে যায়।

কিন্তু কোনওদিন কোনও কারণে তো বুকের মধ্যে কাঁপেনি চিরঞ্জীবের? দুর্গার বেলায় কেন এত দুশ্চিন্তা আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে? যত আচ্ছন্ন হয়, তত রাগ হয় তার। দুর্গাকে সে থামিয়ে রাখতে চায়।

দুর্গা বলেছিল, তবে আমাকে নিয়ে চলো নিল্লায়।

সে কথার কোনও জবাব দেয়নি চিরঞ্জীব। সে রাগ করে ঘরের বাইরে এসে বসেছিল গুম হয়ে। যেমুহূর্তে উঠতে যাচ্ছিল, সেই মুহূর্তেই কথাগুলি ভেসে এল।–সমবেত ভদ্রমণ্ডলী কৃষিজীবী বন্ধুগণ—

থেমে গেল চিরঞ্জীব কথাগুলি শুনতে শুনতে সে যেন তার পূর্বজন্মের কোন এক পরিত্যক্ত দূরলোকে ফিরে গেল। তার ঠোঁট নড়ে উঠল। সে নিঃশব্দে উচ্চারণ করল, সামন্তপ্রথা লড়াই। চাষির হাতে জমি আমাদের জয়…। এমনি একটা ঘোরের মধ্যেই এক সময়ে দিদির চেহারাটা। ভেসে উঠল তার সামনে। আর সেই মুহূর্তেই তার তীব্র ঘূর্ণিলাগা চেতনার মধ্যে, তীরের মতো এসে বিধল মাইকের বজ্রনির্ঘোষ, এ প্রায় বাতুলের প্রলাপ যে, দু একজন অসামাজিক বে-আইনি মদ চোলাইকর শয়তানকে শায়েস্তা করার জন্য গ্রামের মধ্যে সশস্ত্র প্রহরী মোতায়েন করতে হয়। আবগারি বিভাগ এবং থানার থেকে এ কথাই বলা হয়েছে। তার চেয়ে আশ্চর্য গ্রামবাসী নাকি কঙ্কাল ভূতের ভয়ে জড়সড় হয়ে আছেন, আর সেই ভূতকে ধরবার জন্য গ্রামের সশস্ত্র পুলিশ টহল দিচ্ছে। এ কঙ্কালের বিষয়ে আমার কিছুমাত্র বিশ্বাস নেই। যদি কেউ ভয় দেখিয়ে থাকে আমি বলব, পুলিশকে আমন্ত্রণ করবার জন্যেই সে এ কাজ করেছে। কয়েকদিনের মধ্যেই নির্বাচন, এ সময়ে সশস্ত্র পুলিশের যখন তখন গ্রামে টহল দেওয়ায় লোকে ভয় পাচ্ছে। পুলিশ এ মুহূর্তে উঠিয়ে নিতে হবে। যদি কোনও বে-আইনি চোলাইকর এ সবে লিপ্ত থাকে সে সাধারণ মানুষের ও কৃষকের শত্রুকে গ্রামবাসীরা ধরে শাস্তি দিন। তাকে গ্রামছাড়া করুন, দলবলসহ তাদের ধরিয়ে দিন।…

ধনুকের মতো বেঁকে উঠল চিরঞ্জীবের ঠোঁট। সে কল্পনা করতে পারছে, শ্রীধরদার চোখে এখন কার মূর্তি ভাসছে। কে সেই শয়তান, অসামাজিক, সাধারণ মানুষ ও কৃষকের শত্রু। সে আপন মনে বিদ্রূপ করে বলে উঠল, সাধারণ মানুষ! গ্রামবাসী! কৃষক! শালুক চিনেছে গোপালঠাকুর।

অবশ্য এ কথা ঠিক, থানা থেকে নতুন কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশ আনা হয়েছে। আবগারির যারা ছিল, তারা আর এরা মিলে, দিনে রাত্রে পাহারা দিচ্ছে। যদিও দিনের চেয়ে রাত্রেই বেশি। আর কঙ্কালের ব্যাপারটা বহুদূর অবধি রটনা হয়েছে। খবরের কাগজে পর্যন্ত সংবাদ গিয়েছে, হুগলি জেলার গ্রামে ভূতের উপদ্রব (?) জীবন্ত কঙ্কাল! কয়েকদিন ধরেই হরিসংকীর্তনও হয়ে গেল। কিন্তু কঙ্কালকে আর দেখা যায়নি।

চিরঞ্জীবের চোখের ওপর থেকে মুহূর্তে অপসারিত হল অতীতের সেই দূরলোক। চকিতে ডুবে গেল ঘূর্ণির গহনে। সে উঠে দাঁড়াল। মনে মনে বলল, সেই একই কথা। সেই সৎ সাধারণ মানুষ, তারা বলিষ্ঠ। তারা পাপী নয়। তাদের কোনওদিন দরজা বন্ধ ঘরে, চিরঞ্জীব বাঁড়ুজ্জেকে ধরে মারার মতো মারা যায় না।…

সে দাওয়া থেকে নেমে আবার থমকে দাঁড়াল। বাগদিপাড়ার রাস্তা যদিও খুব সরু নয়, তবু এই বোধহয় প্রথম জিপগাড়ির গর্জন শোনা গেল পাড়ায়। আর গাড়িটা এসে ব্রেক কষল এ বাড়িরই চিতে-বেড়ার ধারে। গাড়িটার সামনে শ্রীধরদাদের দলের নিশান। একটা মোটা গলার ডাক ভেসে এল, চিরো আছ নাকি?

বলতে বলতেই, দাঁতে বিড়ি কামড়ে ধরা, বুধাইয়ের সহাস্য মুখ ভেসে উঠল বেড়ার উপর দিয়ে। চিরঞ্জীব অবাক হয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল, তুমি?

বুধাই একেবারে কাছে চলে এল চিরঞ্জীবের। হেসে বলল, খুব অবাক হয়ে গেছ তো? আরে ভাই আসতেই পারি না। দেখলাম শ্রীধরদা ব্যস্ত আছেন, দিলাম চম্পট। জানলে তো আর তোমার এখানে আসতে দেবেন না। তারপর খবর কী বলল।

চিরঞ্জীব কৌতূহল দমন করে, নিরাসক্ত গলায় বলল, খবর ভাল। কিন্তু শ্রীধরবাবু রাগ করবেন জেনেও এলে যে?

বুধাই হাত উলটে দিয়ে বলল, তা কী করব। একটা অন্যায় করে ফেললাম। বকেন বকুনি শুনব।

–কিন্তু আমি একটা শয়তান। অসামাজিক

বুধাই বলে উঠল, ও-সব আমি জানি টানি না চিরো। সে আমি শ্রীধরদাকে বলে দিয়েছি, ও-ছেলেকে আমি মন থেকে ছাড়তে পারব না।

বলতে বলতেই তার চোখ পড়ল দুর্গার দিকে। দুর্গা বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। একসময়ে বুধাই প্রায়ই আসত এখানে। আলাপ পরিচয় ছিলই। তা ছাড়া দুর্গার ভাল লাগত বুধাইকে। চোখাচোখি হতে, বুধাই যেন হকচকিয়ে গেল। অবাক হল। বলল, ভাল আছ?

দুর্গা বলল, আছি। দাঁড়িয়ে কেন, বসো বুধাইদা। অমন তাককে রইলে যে?

 বুধাই বলল, কী জানি ভাই, তোমাকে যেন কেমন একটু নতুন নতুন লাগছে। কী হয়েছে বলো তো?

বলে বুধাই দুর্গা আর চিরঞ্জীব, দুজনের দিকেই তাকাল। চিরঞ্জীব অস্বস্তি বোধ করল। দুর্গা লজ্জা পেল। কোনও কিছু বোঝা গেল না। বুধাই যেন আর একটু পরিষ্কার করল। দুর্গার দিকে তাকিয়ে বলল, বেড়ে চেহারাটি করেছ। আগের থেকে তোমাকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে।

লাউডস্পিকারে বক্তৃতা তখনও সমান তালে চলেছে। বুধাই দাওয়ায় উঠে বসল। কিন্তু এ বুধাই সে বুধাই নয়। এ বুধাই সেই পুরনো গদাইলস্করি চালের লোক নয়। একটু বেশি নড়াচড়া করছে। কথা বলছে বেশি, স্বরও উচ্চ।

চিরঞ্জীবের ঠোঁটে বক্রতাটুকু ছিলই। বলল, তারপর? তুমি হঠাৎ এ লাইনে কী করে?

বুধাই বলল, আর বলল কেন, মনের কলে। লোকে বলে, ভগবানের কলকাটিতে। আসলে তো ওটা মনের কলকাটি। নেমে পড়লাম একদিন।

কী রকম?

বুধাই বলল, ওই রকম। বসেছিলাম চুপচাপ। গাড়ি চালানো একদম বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

 চিরঞ্জীব বলল, সে তো জানি। আমি যাও-বা দু একবার ওদিকে কাজের চেষ্টা করেছি, তুমি গাড়ি চালাবে না বলে দিলে।

–আরে সেকি শুধু তুমি নাকি। ও লাইনের সবাই এসে ধরাধরি করতে লাগল। দূর! তারপরে একদিন জটা এসে উপস্থিত ওঁয়ার মাল নিয়ে আমাকে কলকাতায় যেতে হবে। বলে দিলুম গাড়িটাড়ি চালাই না আর। তা বলে কী, চিরোর বেলায় তো এ সব বলো না, তখন তো ঠিক চালাও। বাস, রাগ হয়ে গেল। বললাম, তোমার সঙ্গে চিরোর তুলনা? মর্জি হয়েছিল, তাই চালিয়েছিলাম। তোমারটা চালাতে যাব কেন? তুমি তো চিরোর এঁটো হে। খুব রাগারাগি। সে তড়পানি দেখে কে? বলে দিলাম, যা যা, মিছামিছি চটাসনি। মান নিয়ে পালা।

বলে বুধাই হাসল। আবার মুখটা বিকৃত করে বলল, জটার খবর জানো তো? সেই মেয়েটি, কী নাম?

চিরঞ্জীব বলল, বীণা।

–হ্যাঁ, বীণা। সে তো কোন হাসপাতালে যেন ছিল। একটা মরা বাচ্চা বেরিয়েছিল পেট থেকে। চেহারাটি হয়েছে এখন বেশ্যা কাট। ঘর নিয়েছে একটা বড় রাস্তার ওপরেই, দোতলায়, কেষ্টবালা বাড়িওয়ালির বাড়িতে। বয়সে এখনও ছেলেমানুষ, ও-মেয়ে বেশিদিন ধকল সইতে পারবে না। তার ওপর জটার অত্যাচার তো আছেই। রোজ গিয়ে হামলা করে বীণার কাছে, পয়সা দাও। মাঝে জটা কিছুদিন জেলও খেটেছে, তাও চুরির দায়ে। এখন দেখি একখানি লুঙ্গি আর ছেড়া জামা সম্বল। কোথাও পাত্তা পাচ্ছে না। তবে বাবা, মেয়েমানুষের কিছু বুঝলাম না আজ অবদি। ঝগড়া করুক, লোকজন ডেকে বিদায় করুক, গালাগাল দিক, তবু ওই বীণাই বোধহয় এখন খাওয়াচ্ছে জটাকে।

দুর্গা বলে উঠল, পড়ত তেমন মেয়ের পাল্লায়

বুধাই হেসে উঠল হো হো করে। বলল, ও ভাই তোমাদের মুখ মন বোঝা দায়। বলতে নেই, জটার বেলায় এরকম বলছ, চিরোর বেলায় এই তুমিই হয়তো অন্যকম বলতে। হা হা হা…।

দুর্গা সহসা জবাব দিতে পারল না।

চিরঞ্জীব বলল, যাক। জটার তো হল এই হাল। কিন্তু তোমার কথাটা তো শেষ হল না।

বুধাই বলল, হ্যাঁ সেইটেই বলি। হঠাৎ একদিন পীতাম্বর ডাক্তার দলবল নিয়ে হাজির। পীতাম্বর ডাক্তারকে চেনো তো? লিডার হে, লিডার। এম.এল.এ, সেই মস্ত বড় বাড়ি, ইটকাঠের গোলাওয়ালা ; নিত্যি নতুন গাড়ি হাঁকে। সেই যে ননী হালদারকে বড় কন্ট্রাক্ট পাইয়ে দিতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল, সব বে-নামী ব্যাপার

চিরঞ্জীব মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি। তার চেয়ে বলো না কেন, যার ভাইয়ের গাড়িতে একবার মেলাই বে-আইনি বিদেশি মাল পাওয়া গেছল।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই পীতে ডাক্তার। এসে একদিন বললে, বুধাই গাড়ি চালাতে হবে। ইলেকশন এসে পড়েছে, এবার তোমাকে সাহায্য করতে হবে। মাইরি কী বলব তোমাকে চিরো, মনে হল ভগবান আমার পেছনে লেগেছে, সত্যি। সেই যেমন পাগলকে ছেলেমানুষ খোঁচায় সেই রকম। কদিন থেকেই মন মেজাজ খারাপ ছিল। গাড়ি চালাবার কথা ভাবলে ঘেন্না হচ্ছিল। ভাবছিলাম, কোনও একটা ধান্দা নিয়ে বেরুতে হবে। কিন্তু ওই স্টিয়ারিং হুইল? ছোঁব না। আরে? গাড়ি চালাতে শিখেছি বলে আমাকে খালি ওই করতে হবে? তার ওপর পীতে ডাক্তারকে দেখে পিত্তি জ্বলে গেল। বলে দিলাম, গাড়ি আর চালাই না ডাক্তারবাবু। সে ছাড়বে না কিছুতেই। কেন, কী বিত্তান্ত, সাত সতের কথা। মোটা টাকা মাইনে দেবে। আখের দেখালে। যত বলে, ততই, (হেসো না যেন) কেবলি আমার মনে হতে লাগল, কে যেন আমার পেছনে বসে হাসছে। তার কোনও শরীর নাই। একটা মাখন-মাখন ফোলা ফোলা মুখ, লালচে রোঁয়াওলা গোঁফ, আর ময়লা হলদে দাঁত। খুব হাসছে। তারপর রেগে বলে দিলাম, কেন বিরক্ত করছেন মশাই। দেশে ডেরাইভারের অভাব আছে নাকি? দেখে নিন গে না। চলে গেল। যেন রাজরোষ দেখিয়ে গেল। কিন্তু আমার মাথা থেকে সেই গা-জ্বালানে হাসি যায় না। সারা রাত যেন আমাকে নিয়ে খেলা জুড়ে দিলে। কে এটা? কে?

চিরঞ্জীব আর দুর্গা অবাক হয়ে বুধাইয়ের মুখে রেখার খেলা দেখছিল আর শুনছিল। যেন রাগে ফুঁসছে বুধাই।

বুধাই বলে চলেছে, ও! ওই মুখটা আমাকে ভগবানগিরি দেখাচ্ছে? নিয়তিপনা ফলানো হচ্ছে? তোমার ওই কথাটা মনে পড়ল। সেই, একটা ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ড করতে ইচ্ছে হয় বুধাইদা। তা চিরো, সত্যি বলি, তোমার মতো বুকের আগুন তো আমার নেই! সক্কাল বেলাই ঘুম থেকে উঠে, পীতে ডাক্তারের বিরুদ্ধে যে আছে, ধীরেন চ্যাটার্জি, চলে গেলাম তাঁর কাছে। চেনেন তো আগে থেকেই। উনিও তো ডাক্তার, ভাবলেন অসুখ করেছে। বললেন, সাত সকালেই যে? অসুখ কার? বললাম, আমার।

কী অসুখ? বললাম, কাল ব্যাধি ডাক্তারবাবু। গাড়ি চালাতে চাই। বললেন, গাড়ি? আমার তো গাড়ি নেই। বললাম, না, তা নয়। ইলেকশনে গাড়ি চালাব আপনাদের। পয়সাকড়ি লাগবে না। দুবেলা দুটো খেতে দিলেই হবে। ডাক্তারবাবু মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপরে বললেন, শুনছিলাম, তোমার মাথার ঠিক নেই, গাড়ি চালাতেই চাও না। তা কী হল হঠাৎ? বললাম, তা জানি না। রাতভর ভাবলাম, তারপরে ঠিক করলাম গাড়ি যদি চালাতেই হয়, মন যেখনে যায় সেখেনেই যাব। ডাক্তারবাবু কী যেন ভাবলেন। তারপরে বললেন, আমাদের এখানে তো লোক আছে। তোমাকে আমি একটা চিঠি দিয়ে দিচ্ছি। নিয়ে যাও। সেখানে তোমাকে কাজ দেবে। তারপরেই তো এখানে এলাম। তাও মাসখানেক হয়ে গেল।

চিরঞ্জীব প্রায় শূন্য চোখে তাকিয়েছিল বুধাইয়ের মুখের দিকে। দুর্গা তাকিয়ে রইল অবোধ চোখে। বুধাই উঠে দাঁড়াল। লাউডস্পিকারে অপরের বক্তৃতা শোনা যাচ্ছে এখন।

চিরঞ্জীব বলল, কিন্তু বুধাইদা এ তো এখানকার হাল। ভোটের পর হাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। তখন কী করবে?

বুধাই বলল, আরে এটা তো শুরু। শেষ কী হবে, আমি কী জানি?

পরমুহূর্তেই তার গলার স্বরটা মোটা আর চাপা শোনাল। প্রায় চুপিচুপি বলল, আমি লেখাপড়া জানি তোমাদের মতো? আমি খালি বুঝছি একটা ভাঙচুর হওয়া দরকার, এই সোঁত জীবনটারই একটা ভাঙচুর হওয়া দরকার। ভেঙে, একটা মনের মতো কিছু করি নয় মরি, যাঃ শালা ল্যাটা চুকেবুকে যাক। এ্যাই, বুঝলে? ভোটের পরেও যেখেনে ওইটি পাব, সেখেনেই যাব।

তার কথা শেষ হবার আগেই কয়েকজনের গলা একসঙ্গে শোনা গেল বাড়ির বাইরে। কে একজন চেঁচিয়ে উঠল, ও বুধাইদা, তুমি যে মালখানায় ঢুকে পড়েছ। টেনেছ নাকি? 

সবাই সমিতির নোক এবং চিরঞ্জীবের পরিচিত। কথাগুলি শোনা মাত্র তার চোখে আবার আগুন দেখা গেল। এদের মধ্যে দু-একজন তার দলেও ছিল।

কে একজন জবাব দিল, মালখানা কী বলছিস, রসের কারখানা বল। শিগগির এসো বুধাইদা, শ্রীধরা রেগে গেছে ভীষণ।

বুধাই চেঁচিয়ে বলল, আচ্ছা সে আমি বুঝব। তোমরা থামো দিনি। বলে চিরঞ্জীবের দিকে ফিরে বলল, চলি ভাই, রাগ কোরো না। চলি দিদি।

আবার যেন কে বলে উঠল, যুগল মূর্তি রয়েছে দেখছি।

আর একজন বলল, টাটের ঠাকুর। ভোটটা মিটতে দে, তারপরে–।

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ফিরে ছুটতে যাচ্ছিল চিরঞ্জীব। দুর্গা চাপা গলায় বলে উঠল, পায়ে পড়ি ছোট্‌ঠাকুর, যেয়ো না ওদের কাছে।

গাড়িটা গর্জন করে পিছুতে লাগল। সবাই হাসতে হাসতে, কোলাহল করতে করতে, চলে গেল সেই সঙ্গে। এক রাশ আগুন রেখে গেল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। যে-আগুন চিরঞ্জীব আর দুর্গার গায়েও লেগেছে। অথচ চিরঞ্জীব নিশ্চিত, ভোটের পরে এদের মধ্যেই কাউকে চেলা করে হাটের মাঝে গোরুর গাড়ির চাকার তলে পড়ে থাকতে দেখা যাবে। চোলাইয়ের কারবারেও নেমে যাবে হয়তো কেউ। শ্রীধর দাসের সাধারণ বলিষ্ঠ মানুষ, ভূমিহীন কৃষক।

বাড়ি থেকে বেরুতে যাচ্ছিল চিরঞ্জীব। দুর্গা বাধা দিল। বলল, এটটু দাঁড়িয়ে যাও ছোটঠাকুর।

–কেন?

–হ্যাঁ, আমি বলছি।

 বলে দুর্গা সামনে এসে হাত ধরল চিরঞ্জীবের। বলল, পাঁচ মিনিট বসে যাও।

দপদপে চোখ তুলে চিরঞ্জীব তাকাল দুর্গার চোখের দিকে। দুর্গার আয়ত চোখ দুটিতে যেন কী আছে। শুধু চোখে নয়। কিছু নিগূঢ়, অনুচ্চারিত, বোধ হয় এ জীবনে যে কথা বলবার সাহস তাদের পরস্পরেরই কখনও হবে না, তেমনি কিছু কথাভরা চোখ। চিরঞ্জীবের চোখের রক্ত সরে গেল। চাউনি হল অসহায়। শুধু বুকের মধ্যে জ্বলতে লাগল দাউ দাউ করে। সে দুর্গার হাত ছাড়িয়ে ঘরের ভিতরে গিয়ে, বেড়ায় হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল।

দুর্গা এল পিছু পিছু। সেও বসল কাছে। চিরঞ্জীবের হাঁটুতে চিবুক রেখে, তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে। দুহাত দিয়ে জড়িয়ে রইল হাঁটু।

প্রায় রুদ্ধশ্বাস গলায় বলল চিরঞ্জীব, কী দেখিস দুর্গা এমন করে?

 দুর্গাও নিচু স্বরে বলে, তোমার খ্যাপামি। কেন এত জ্বলছ? তুমি ওদের জানোনা?

 চিরঞ্জীব বলল, জানি। কিন্তু দুর্গা, পুতুপুতু করে বাঁচবার জন্যে কি আমি এ পথে এসেছি। তা আসিনি। বেঁচে থাকার ঘেন্নায় এসেছি! তবে? তবে মরব যদি, দেরি কেন? তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি, আরও তাড়াতাড়ি মরি না কেন? আমার আবার দিনক্ষণ কীসের? আমার আবার কীসের আঁটঘাট বাঁধা!

দুর্গা হাত বাড়িয়ে চিরঞ্জীবের কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিল। বলল, জানি ছোট্‌ঠাকুর।

চিরঞ্জীব দুর্গার হাতটা টেনে নিল। বলল, জানিস?

দুর্গা বলল, জানি না ছোটঠাকুর? খুব জানি। কেড়ে ছিনিয়ে জোর করে বুকে বসে বাঁচলুম, বুকে বসে মরব। বুড়ো হয়ে, এক ঘর লোকের মধ্যে, রোগে শোকে ধীরে সুস্থে যারা মরে, তারা মরে। ও সব ভাবিনাকো। যেমন বাঁচলুম, তেমন মরব।

কথার শেষে সুরটা তবু কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে থাকে। চিরঞ্জীব দুর্গার চিবুক ধরে মুখটি তুলে ধরে এক মুহূর্ত দেখে, দুর্গাকে কাছে টেনে বলে, দুর্গা তোকে মারতে চাইনি।

দুর্গা আরও ঘন হয়ে বলল, তুমি মারতে চাইবে কী গো। তুমি না বাঁচলে?

–না, না দুর্গা। নিজের মরণের খোঁটাটার সঙ্গে তোকে বেঁধে নিয়ে এলুম। আমার তো কোনও ভয় ছিল না। আমি তো কোনও দিকে ফিরে চাইব না ভেবেছিলুম। এখন যেন কেমন লাগে।

–কেন গো? কীসের ভয় তোমার?

চিরঞ্জীব দুহাতে দুর্গাকে আঁকড়ে ধরে বলল, নিল্লায় আর যেতে চাসনে দুর্গা। আর বাইরে যাসনে। এবার আমার খুঁটির পাক খোল। সর, সরে যা।

-ইস! ইস!

দুর্গা শিসিয়ে উঠল। চিরঞ্জীবের বোতাম-খোলা বুকের ওপর হাত রেখে বলল, মিছে কথা গুলোন এমন করে বোলো না ছোটঠাকুর। একফোঁটা ভয় দেখাতে পারবে না আমাকে। তুমি আমাকে জড়ালে? তুমি আমাকে মারতে নে এলে?

দুর্গা খিলখিল করে হেসে উঠল। খয়েরি শাড়ি আর এলো চুলগুলি চিরঞ্জীবের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে যেন বাঘিনী ফুলে ফুলে উঠল। হাসি থামিয়ে বলল, বাঁচতে গেলেও মরতে হয়, বোঝ না? যে-মরা আমাকে আগে মরতে হত, তার চে এ মরণে তবু মরণের সুখটুকু কেউ কাড়তে পারবে না।

মরণে আবার কী সুখ দুর্গা?

-এই যে, এই যে এমনি করে বসে আছি, এই যে হাত দুখান আমাকে ধরে রেখেছে, এই তো আমার সুখ। আমার তপিস্যের মরণ গো। লোকে বলবে ছুঁড়ি অনাচার করে মরেছে। বলুক। এমন মরণ পাবে কোথা? মরব, মরব, মরব…

বলতে বলতে দুর্গার সর্বাঙ্গে যেন আগুন লাগল। আয়ত খর চোখ দুটিতে যেন বিশ্বধ্বংসের লীলায় দাউ দাউ করে উঠল। বলল, ছোট্‌ঠাকুর, তুমি মরবে তাড়াতাড়ি, আমি বসে থাকব? তার আগে তুমি হুকুম দাও, আমি আগুন জ্বালাই সারা গাঁয়ে। এই ভাল মানুষের সমাজকে নিষ্টেপিষ্টে মারি, যারা মারতে চেয়েছিল, তাদের রক্তে আমার পা ধুই।

দুর্গার চোখ ফেটে জল এল। কিন্তু চোখের আগুন বাড়ল শতগুণ। নাকের পাটা উঠল ফুলে ফুলে। উত্তাল ঢেউয়ের মতো বুক ওঠানামা করতে লাগল।

চিরঞ্জীব সেই অঙ্গার মুখখানি ধরে যেন উৎকণ্ঠিত গলায় ডাকল, দুর্গা।

—অ্যাঁ?

দুর্গার দৃষ্টি পড়ল চিরঞ্জীবের চোখের দিকে। হঠাৎ যেন লজ্জা পেল সে। প্রায় চুপিসাড়ে যেন বলল, যারা ঘর থেকে তাড়িয়ে বনে নে গেল, তারাই খুঁচিয়ে মারতে এসেছে। যেচে, ওদের পায়ে ধরে বাঁচতে চাই না ছোট্‌ঠাকুর

দুর্গার গলার স্বর সহসা রুদ্ধ হল। বুকে মুখ চেপে, ভাঙা গলায় বলল, কিন্তুন তোমাকে আগলে মরার বড় সাধ।

চিরঞ্জীব কোনও কথা বলতে পারল না। দুর্গার কম্পিত শরীরটা চেপে ধরে রইল।

 সন্ধ্যার ঘোর-লাগা আকাশে বারোয়ারিতলার সমবেত শ্লোগান উচ্চকিত হয়ে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *