৪. টর্চের আলো

৪.

চিরঞ্জীব সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। একবার টর্চের আলো ঝলকে উঠল তার হাতে। পরমুহূর্তেই সাইকেলে উঠে, অন্ধকারে অদৃশ্য হল সে। খালধারের পথ দিয়ে এসে নামল সে একেবারে স্টেশনের অদূরে। একটি ঝাড়ালো, ঝুরি-নামা বটের আড়ালে। গাছতলা থেকে স্টেশনের সামনের প্রশস্ত জায়গাটা দেখা যায়। সেখানে কাঁচা তরিতরকারি নিয়ে গোরুর গাড়িগুলি ভিড় করেছে। হাতে-হাতে ঘুরছে লণ্ঠন। গাড়ি খালি করে ঝুড়িগুলি সব প্ল্যাটফর্মে নিয়ে তুলছে। রাত্রি বারোটার পর থেকেই প্রায় প্ল্যাটফর্মে মাল জমতে থাকে। সাড়ে চারটের প্রথম গাড়িতে কলকাতায় যাবার জন্যে।

চিরঞ্জীব দেখল, গাড়ির সিগন্যাল দিয়েছে। গাড়িটা স্টেশন ছেড়ে চলে গেলে সে নিশ্চিন্ত। কিন্তু–

হাতের মুঠি শক্ত হয়ে উঠল তার। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। সে ছিল গাছের পিছন দিকে। সহসা গাছের সামনের দিকে একটি মানুষের চকিত-ছায়া যেন দেখতে পেল সে। নড়ে উঠল, কিন্তু সরল না। যেন টের পায়নি পিছনের মানুষটাকে।

সাইকেলটা নিঃশব্দে গাছে হেলান দিয়ে রেখে, রুদ্ধশ্বাসে একবার উঁকি দেবার চেষ্টা করল চিরঞ্জীব। ঠিক দেখা গেল না। টর্চ জ্বালার উপায় নেই। আশেপাশে কোথাও কাসেম অথবা ভোলা-কেষ্টরা কেউ নিশ্চয় আছে। টের পেলে সন্দেহ করতে পারে। ভাবতে পারে নিশ্চয় তা হলে কিছু যাচ্ছে কলকাতায়। অন্যথায় চিরঞ্জীব এখানে কেন? কিংবা কাসেম ভোলা ও কেষ্টদেরই কেউ এখানে ওত পেতে আছে।

সে হঠাৎ ছায়ার সামনে পড়ে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কে?

জবাবে আপাত নির্বিকার কিন্তু উৎকণ্ঠিত গলা শোনা গেল, সরো, কাসেমকে দেখা যাচ্ছে।

চিরঞ্জীব থতিয়ে গেল। দুর্গা দাঁড়িয়ে আছে। সে স্টেশনের দিকে তাকিয়ে দেখল। কিন্তু কাসেমকে দেখতে পেল না। কেবল, স্টেশনের টিমটিমে ভুতুড়ে-আলো-অন্ধকারে, চাবুকের মতো ঝলকে উঠল টর্চের আলো। সেটাই প্রমাণ করল কাসেমের অস্তিত্ব। তা হলে ভোলা-কেষ্টও আছে। গতকাল ওকুরদের কয়েক ঝাঁকা ব্লাডার-ভর্তি মদ কাসেমই ধরেছে। আশা ছিল চিরঞ্জীবের, আজ আর কাসেম ভোর রাত্রে হানা দেবে না স্টেশনে। ভাববে, কাল যখন ধরা পড়েছে, আজ আর কেউ ঝাঁকায় মাল পাঠাতে সাহস করবে না। এই সাধারণ ভাবনারই বশবর্তী হয়ে চিরঞ্জীব আজ দুজনের সঙ্গে ব্যবস্থা করেছিল।

কিন্তু কাসেম এসেছে বোঝা যাচ্ছে। তার টর্চের আলো ঝাঁকাগুলির বুকে ছোবলাচ্ছে সাপের মতো। আর ওই ঝাঁকাগুলির কোনও দুটির মধ্যেই নিশ্চয় চিরঞ্জীবের জিনিস রয়েছে। যে ঝাঁকাটিকেই সন্দেহ হচ্ছে, তারই গায়ে ছুঁচলো লোহার শিক আমূল বিঁধিয়ে দিচ্ছে। ব্লাডার থাকলে ফেটে যাবে। বোতল থাকলে আঘাতেই টের পাওয়া যাবে।

যদিও এখনও গোরুর গাড়ি থেকে ঝাঁকা তোলা হচ্ছে প্ল্যাটফর্মে। এবং সবগুলি দেখা সম্ভব হয়ে উঠবে না কাসেমের পক্ষে। তবু শক্ত আড়ষ্ট হয়ে উঠল চিরঞ্জীব। সে বুঝতে পারল, দুর্গা তারই মুখের দিকে তাকিয়ে আছে রাগ করে।

মনের উত্তেজনা চাপবার জন্যেই চিরঞ্জীব জিজ্ঞেস করল, তুই এ সময়ে এখানে এসেছিস কী করতে!

দুর্গা মুখ ফিরিয়ে বলল, তুমি এসেছ কী করতে?

–তোকে তো আমি আসতে বলিনি।

 –তুমি না বললে আমি আসব না, এমন কী কথা!

প্ল্যাটফর্ম থেকে একজনের উঁচু গলা শোনা গেল, আরে মিয়া শিক তো গোঁজাগুজি করছ। মালগুলান যে খারাপ হচ্ছে, সেটা বোঝ? খাঁটি খাঁটি যিখেনে আছে, সিখেনে গে খোঁচাও দিনি, যাও।

দুর্গা আপন মনেই চুপি চুপি বলতে লাগল, বেশি বাড়াবাড়ি কোনওদিন ভাল নয়। কাল বিকেলে সদরে জিনিস গেছে বিচালির গাড়িতে। এখন যাচ্ছে তরকারির ঝাঁকায়। তার পরে যাবে আবার চন্দননগর মোটরগাড়িতে। একদিনেই একেবারে কারবার মাৎ। এ কখনও ধরা না পড়ে যায়?

এ সব কথা শুনতে খুব খারাপ লাগে চিরঞ্জীবের। একবার যখন পথে নেমে পড়া গেছে, ফেরার কোনও উপায় নেই, তখন এ সব কথা বলে লাভ কী? সে বলল, তুই যা না কেন, বাড়ি যা।

–আমি বাড়ি গেলেই তো আর আবগারির লোকেরা কানা হয়ে যাবে না।

তবে চুপ করে থাক।

 দূরে ট্রেনের আলো দেখা গেল। নিকটবর্তী হতে লাগল ক্রমেই। মাথায় ঝাঁকা তুলতে লাগল সবাই। দুজনেই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। গাড়ি এসে দাঁড়াতে নির্বিঘ্নেই উঠে গেল সমস্ত ঝাঁকা।

গাড়িটা চলে যাবার পরেও, দুজনে খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপরে একটি নিশ্বাস ফেলে চিরঞ্জীব বলল, তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে নাকি?

না।

তবে আমি চলি, আর দেরি করব না।

বলে সে দুর্গার দিকে তাকাল। দুর্গাও তাকিয়েছিল। চিরঞ্জীবের বুকে ও চোখে যে-আগুন সারাটা রাত্রি ধরে জ্বলেছে, সে আগুন যেন এই মুহূর্তে একবার নিভে এল। শান্ত বিষণ্ণতা দেখা গেল যেন। একটি দূর গভীর অতলতা তার চোখে। বলল, সারা রাত ঘুমোসনি বুঝি?

দুর্গা বলল, ব্যবস্থা যা করেছ, তাতে কি আর ঘুম হয়?

চিরঞ্জীব বুঝল, একই দুশ্চিন্তায় তারা দুজনেই এখানে এসেছে। যদিও এই গাছতলাতেই দুর্গা আসবে ভাবতে পারেনি।

–যা, তা হলে দাঁড়িয়ে থাকিসনে।

বলে চিরঞ্জীব দুর্গার কাঁধে হাত দিয়ে ঠেলা দিল। আর দুর্গার চোখের দিকে না তাকিয়ে, সাইকেল সরিয়ে নিল।

বাতাসে দুর্গার খোলা চুল উড়ছে। মন্থর পায়ে মাথা নিচু করে সে আস্তে আস্তে গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। তারপর যে-মুহূর্তে চিরঞ্জীব সাইকেলে উঠল, সে দাঁড়াল। ফিরে তাকাল। একটু একটু করে ভোর হয়ে আসা অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল চিরঞ্জীব!

.

অবিশ্রান্ত সাইকেল চালিয়ে চিরঞ্জীব যখন চন্দননগরে এসে পৌঁছুল, তখন আকাশ ফরসা হয়ে এসেছে। দোকানপাট খুলতে আরম্ভ করেছে। পাখির চেয়ে কাকের জটলাই যেন শহরে বেশি। সে এসে উঠল একটা ঘিঞ্জি বস্তি অঞ্চলে। গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে একটু পুবদিকের ভিতরে। যেখানে কিছু মৎস্যজীবী, কিছু বাঙালি চটকল শ্রমিকের বাস। একটি বাড়ির দাওয়ায় একজন অপেক্ষা করছিল চিরঞ্জীবের জন্যই। লোকটিকে দেখলেই বোঝা যায়, খানিকটা শহুরে ভবঘুরে। চোখে ধূর্ততা নেই, কিন্তু ঈষৎ রক্তাভ দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। ফোলা ফোলা মুখ দেখলে মনে হয়, মদ খায়।

চিরঞ্জীবকে দেখে মোটা গলায় বলল, এসো।

 চিরঞ্জীব বলল, সব ঠিক আছে তো বুধাইদা?

–ঠিক তো করবে তোমার জটাবাবু।

–জটা নেই এখানে?

কাল রাত নটায় একবার এসেছেন। বলে গেছল, পাঁচটায় আসবে। তা তুমি এসে পড়লে, তার পাত্তা নেই।

ঠোঁট উলটে বলল বুধাই, বোধহয় ঘুম ভাঙেনি?

চিরঞ্জীবের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। বলল, ঘুম ভাঙেনি মানে কী? তার তো তোমার এখানে শোবার কথা ছিল। কোথায় ও?

–ভূঁইমালি পাড়ার চপলার বাড়িতে রয়েছে বোধহয়।

–আর গাড়ি?

বলেছেন তো দক্ষিণের খালের এপারে। মানে তেলিনীপাড়ার ইদিকে, ইন্দিরের বাড়ির কাছে রাখবে।

এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে চিরঞ্জীব জিজ্ঞেস করল, চপলার বাড়ি কোনটা বলো তো?

গলিতে ঢুকে বাঁ-দিকের একতালা পাকা বাড়িটা।

 চিরঞ্জীবের দুই চোখে ক্রুর চাউনি। সে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল।

–কোথা চললে চিরঞ্জীব?

বসো, আসছি।

 চিরঞ্জীব সাইকেল চালিয়ে, কাছেই ভূঁইমালিপাড়ায় এসে উঠল। ভূঁইমালিরা কেউ কোনওকালে এপাড়ার ছিল কি না কে জানে। এখনও থাকে কি না, জানা নেই। ভুঁইমালিপাড়া বলতে বেশ্যা পল্লীই বোঝে লোকে। যদিও ভুঁই বাদ গেছে। লোকে মালিপাড়াই বলে।

বাড়িটা চিনতে ভুল হল না চিরঞ্জীবের। একতলা পুরনো বাড়িটায় ইতিপূর্বেও দু-একবার ঢুকতে দেখেছে সে জটাকে। কিন্তু সেটা কাজের অছিলায়। কারণ, চিরঞ্জীবের বরাবর বারণ ছিল, এ সব আস্তানায় একদম আসা চলবে না। শহরের এই সব আস্তানাগুলিই সবচেয়ে খারাপ। দল নষ্ট হবে, ভাঙবে তাড়াতাড়ি, ধরা পড়বে বারে বারে। কারণ পুলিশের প্রথম নজর এদিকেই পড়বে। আর এদিকে কেউ একবার ঝুঁকলে, তার কাজে মন বসবে না। দলবল সব মাথায় উঠে যাবে।

যদিও এ চিন্তাটা প্রায় সোনার পাথরবাটির মতোই। চোরা চোলাইয়ের কারবারিরা মদ খাবে না, দেহোপজীবিনীদের দরজা মাড়াবে না, এ প্রায় পশ্চিমে সূর্যোদয়ের মতো। বিশেষ জটার মতো লোক, যে এ শহরেই পেয়েছে হাতেখড়ি। তবু চিরঞ্জীব তার দলকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল নির্বিঘ্নে কাজ চালাবার জন্যে। তা ছাড়া, তার সংস্কার, তার দিদির জীবন, তাকে এ সব দিক থেকে দূরে রেখেছিল। জটারও সেই রকম শপথ ছিল তার কাছে। আর চিরঞ্জীব বিশ্বাসও করেছিল জটাকে। কারণ মাঝখানে বীণা ছিল। জটার কথা থেকে বুঝেছিল, বীণাকে সে যেন ভালবাসে। মুখে গম্ভীর থাকলেও, কেন যেন ভাল লেগেছিল চিরঞ্জীবের। মনে মনে খুশি হয়েছিল সে।

কিন্তু যতই দিন যাচ্ছিল, বীণার চালচলন তার ভাল লাগছিল না। আর বীণার চালচলনের জন্যে যে দায়ী, সেই জটার প্রতি ভিতরে ভিতরে বিক্ষোভ জমেছিল তার। সন্দেহ হচ্ছিল, টাকার লোভে জটা অন্য দলেও ভিড়েছে। সেরকম সংবাদও পাওয়া গেছে।

ভিতর থেকে দরজা বন্ধ দেখে, শিকল ধরে নাড়া দিল চিরঞ্জীব! স্বয়ং প্রৌঢ়া চপলাই দরজা খুলে দিল। চোখে বুঝি ছানি, দেহে অসুস্থতা। বলল, কে?

চিরঞ্জীব উঠোনে ঢুকে বলল, জটা আছে কোন ঘরে?

চপলা একটু রুষ্ট হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন?

-বলো না কোন ঘরে আছে। বিশেষ দরকার তাকে।

 চপলা হয়তো চেনে চিরঞ্জীবকে। তবু বারেক সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে, বারান্দায় উঠে, একটা ঘরের দরজা ধাক্কা দিয়ে ডাকল, জটিরাম, ও জটিরাম, দেখ তোমাকে কে ডাকছে বাপু এই সাতসকালে।

দরজা খুলে, উঠোনে চিরঞ্জীবকে দেখে যেন থতিয়ে গেল জটা। চোখ তার লাল। দেখলেই অনুমান করা যায়, রাতভর মদ খেয়েছে সে। এখনও তার খোয়ারি পুরোপুরি কাটেনি। লুঙ্গির মতো করে, অত্যন্ত শিথিলভাবে কাপড় পরা। বলল, তুমি?

যদিও জটা বয়সে প্রায় সমান, তবু চিরঞ্জীবের প্রতি কোথায় যেন একটু ভয় ও সমীহ আছে তার।

চিরঞ্জীব সাইকেলটা বারান্দায় হেলান দিয়ে রেখে, একেবারে ঘরের দরজায় উঠে এল। ঘরের ভিতর বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখল কে একটি মেয়ে শুয়ে আছে। পর মুহূর্তেই অবাক হয়ে দেখল, একজন নয়, দুজন মেয়ে ঘরে রয়েছে। এবং একজন তার মধ্যে বীণা।

চিরঞ্জীব জটার দিকে ফিরে বলল, এত দেরি কেন তোর?

বারান্দার ওপরেই জলের বালতি ছিল। জটা তাড়াতাড়ি চোখে জল ছিটিয়ে, ঘরে জামা ছাড়তে গেল। চিরঞ্জীবও ঘরের মধ্যে ঢুকল।

জটা বলল, মাইরি, বড় দেরি হয়ে গেছে। চল চিরো, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাই।

বীণা আর অন্য মেয়েটি একেবারে অগোছালো হয়ে ঘুমোচ্ছিল। বীণার গায়ে তবু জামা ছিল একটি। অন্য মেয়েটির শুধু শাড়ি। তাও আলুথালু। কিন্তু বীণাকে কেমন যেন অসুস্থ দেখাচ্ছিল। চোখের কোল বসা শীর্ণ-মুখ। বয়স আঠারো-উনিশের বেশি নয়। একটু রোগা, একহারা বরাবরই। কিন্তু হাস্যোচ্ছলা ছিল। গ্রামের কাছেই, রেফিউজি ক্যাম্প থেকে একে যখন প্রথম সংগ্রহ করেছিল জটা, ভয় পেয়েছিল চিরঞ্জীব। কিন্তু জটা বুঝিয়েছিল, মেয়েটা এমনিতে ভদ্রঘরের। সাজলে-গুজলে ভদ্রঘরের মেয়ে বলে মনে হবে। অনেক কাজ হবে মেয়েটাকে দিয়ে। শুধু চন্দননগরে চুঁচুড়াতেই নয়। কলকাতাতেও অনেক মেয়ে এ সব কাজ করে। এদের কাজ শুধু ট্যাক্সিতে, রিকশায় এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় মাল পৌঁছে দেওয়া।

সেদিক থেকে বীণার সাহায্য কার্যকরী হয়েছিল। ততদিনই কাজ ভালভাবে চলেছিল, যতদিন এ শহরে অচেনা ছিল বীণা। কিন্তু জটা তা থাকতে দেয়নি। আর এ শহরে, জটাকে অনুসরণ করে অনেকেই বীণার পিছনে লেগেছিল। পুলিশ তো আগেই তার পরিচয় পেয়েছিল।

বীণাকে কিছুদিন দেখেনি চিরঞ্জীব! কারণ দরকার হয় না। আজ মনে হল, যেন বহুদিন দেখেনি। মনে হল মেয়েটা যেন অসুস্থ। কিন্তু বীণাকে নিয়ে এ ভাবে বেশ্যালয়ে ঘর নিয়ে বাস করছে জটা, এতটা জানত না। আর সবচেয়ে অবাক লাগছে অন্য মেয়েটিকে দেখে। কালো মোটা মেয়েটা কেন একই ঘরে, একই বিছানায়। যে-বিছানায় জটাও নিশ্চয় শুয়েছিল। আর মেয়েটির সারা চেহারার মধ্যে কেমন করে যেন মালিপাড়ার একটি তীব্র সুস্পষ্ট ছাপ আপনা থেকেই ফুটে উঠেছে। দেখলেই চেনা যায়।

জটার অস্বস্তি হচ্ছিল চিরঞ্জীবের দিকে তাকিয়ে। বলল, চিরো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

চিরঞ্জীব বলল, হোক। যখন হোক, গাড়ি নিয়ে আমি যাব। তার আগে তোর সঙ্গে একটা ফয়সালা হয়ে যাক।

জটার কপালে কয়েকটা রেখা পড়ল। অবজ্ঞায় সে ফিরে তাকাল অন্যদিকে। বলল, ফয়সালাটা কাজের শেষে করলে হত না? তা ছাড়া ফয়সালার আছেই বা কী?

চিরঞ্জীবের দুই চোখে আরক্ত ঘৃণা। বলল, বীণাকে কতদিন বাড়ি যেতে দিসনি?

জটা বলল ওতে তোর মাথা ঘামিয়ে লাভ কী? কাজের ক্ষতি হচ্ছে কি না, সেইটে খতিয়ে দেখেনে।

প্রথম প্রথম এই জটাই খুব মানত চিরঞ্জীবকে। বলেছিল, সত্যি চিরো, ওঁচা মালদের সঙ্গে কাজ করে করে ঘেন্না ধরে গেছল। এতদিনে একটা মনের মতো লোক পেলাম। তুই আমার আসল মনিব।

চিরঞ্জীব, বলেছিল, মনিব-টনিব নয় জটা। ওকুর দের মতো দল করে লাভ নেই। আমরা খালি পয়সা চাই, ব্যস। দুনিয়ায় অনেক বড় বড় কথা শুনলুম। সব বেটিই চুরি করে, ধরা পড়ে রাধা। চোলাই রসের নদী করে ফেলব। দেখব, কোথায় কত টাকা আছে।

জটা বলেছিল, তাই তো বলছি। ওকুর শালারা মনে করে, আমরা ওদের ঘরের চাকর। ধরা পড়লে শালারা আমাদের কুকুরের মতো দ্যাখে। দশবার চোখ রাঙাবে, খিস্তি করবে মা বাপ তুলে। তারপরে জামিন দেবে। যেন ইচ্ছে করে ধরা দিই আমরা। ইজ্জত নিয়ে কাজ করব তোর সঙ্গে।

সেই জটা আজ চপলা-বাড়িউলির ঘরে দাঁড়িয়ে এইরকম উদ্ধত কথা বলছে। কথাবার্তার ভাবভঙ্গি কিছুদিন থেকেই এরকম হয়েছে। তবে মুখোমুখি যতটা নয়, আড়ালে তার চেয়ে বেশি। চিরঞ্জীবের দলটা যে আসলে তারই মুঠোয়, দলপতি যে আসলে সে-ই, এ কথা সে আজকাল সবখানে বলে বেড়ায়। বলে, যেদিন আমি সরব, সেদিন চিরো বাঁড়ুজ্জের কারবার লাটে উঠে যাবে।

কিন্তু যেহেতু, আজকের এই পরিবেশে, এরকম মুখোমুখি কোনওদিন দাঁড়াতে হয়নি সেই জন্যে চিরঞ্জীব সে সব কথা নিয়ে বিবাদ বাঁধায়নি। আজ চিরঞ্জীবের চোখ দপ করে জ্বলে উঠল। সারারাত্রি ধরে যে আগুনে সে পুড়েছে, সেই আগুন লেলিহান হয়ে উঠল তার বুকে। সে ঘুরে জটার মুখোমুখি দাঁড়াল। সামনাসামনি, গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে, জটার গায়ে গরম নিশ্বাসের হলকা ছুঁড়ে বলল যা জিজ্ঞেস করছি তার জবাব দে। বীণাকে কতদিন বাড়ি যেতে দিসনি?

জটা এক পা পিছিয়ে এসে, গলা রাশভারী করার চেষ্টা করে বলল, আমি কি বেঁধে রেখেছি নাকি? ও নিজেই ইচ্ছে করে বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।

চিরঞ্জীব বলল, কিন্তু ওকে নিয়ে বেশ্যাবাড়িতে থাকিস কেন তুই? আর জায়গা নেই?

জটা নিরুত্তর। চিরঞ্জীবের মনে পড়ে গেল দুর্গার কথা। আবার বলল সে, তুই কি ওকে এ বাড়িতে রেখে ভাড়া খাটাতে চাস নাকি? ওকে দিয়ে বেশ্যাবৃত্তি করাতে চাস?

এমন সময়ে সুদীর্ঘ হাই তোলার শব্দে দুজনেই ফিরে তাকাল। সেই কালো মোটা মেয়েটি জেগে উঠে বসেছে। ঢুলুঢুলু শ্লেষ-ভরা দৃষ্টি তার চিরঞ্জীবের ওপর।

চিরঞ্জীব একবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে, জটাকে আবার জিজ্ঞেস করল, আর এ এ-ঘরে কেন?

কালো মেয়েটিই জড়িয়ে-জড়িয়ে কিন্তু বিদ্রূপ ঢেলে বলল, অ! জটাবাবুর মনিব বুঝি? তাই এত কৈফিয়ত তলব?

জটা আবার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আমার কোনও মনিব-টনিব নেই। যা করি, তা নিজেই করি, কাউকে কৈফিয়ত দিই না।

মেয়েটিই আবার তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ও কথা আবার কেউ জিজ্ঞেস করে, এ কেন এ-ঘরে? মেয়েমানুষকে কেন দরকার হয়, তাও জানা নেই নাকি রে বাবা?

চিরঞ্জীব সহসা ঘর কাঁপিয়ে গর্জন করে উঠল, জবাব দিবি?

সমস্ত ঘরটা যেন চমকে উঠে একেবারে স্থির হয়ে গেল। কালো মেয়েটা বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে বসে পড়ল। বীণা ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। চিরঞ্জীবকে দেখে একবার খালি অস্ফুটে বলল, চিরোদা?

কিন্তু জটার শ্লেষ-ক্রুদ্ধ-স্থির চোখে যেন ছানা কেটে গেল। যদিও সে তার থতিয়ে যাওয়া ভাবটা গোপন করবার চেষ্টা করল। নির্বিকার ভাবেই যেন বলল, জবাব কী দেব? এ ভাবে কথা বলছিস কেন? শুনলিই তো।

অর্থাৎ ও মেয়েটা কেন এ ঘরে। চিরঞ্জীব তীব্র গলায় জিজ্ঞেস করল, তবে বীণা এখানে কেন? দুজনেই বুঝি তোর কাছে এক?

এইবার চপলা হামলে পড়ল দরজার কাছে, এ বাড়িতে আবার দুরকম মেয়েমানুষ কে দেখেছে? সকলেই এক। ইকি যন্তন্না বাপু সাতসকালে।

বীণা তাড়াতাড়ি উঠে এসে বলল, এ সব কথা থাক চিরোদা।

-না থাকবে না।

চিরঞ্জীব বীণার দিকে রুক্ষ চোখে তাকিয়ে আবার বলল, তুমি কেন এখানে থাকো?

বীণা মুখ নিচু করে খানিকটা পূর্ব বঙ্গীয় টানে বলল, আর আমার কোনওখানে যাবার জায়গা নাই চিরোদা।

দুর্গার কথাগুলি আবার মনে পড়ল চিরঞ্জীবের। যে সন্দেহ করেছিল দুর্গা, তা ঘটেই বসে আছে। সে বুঝল, চপলা বাড়িউলির স্থায়ী শরিকানা লাভ করেছে বীণা! পরিবর্তে চপলার টাকা নিশ্চয় কিছু এসেছে জটার পকেটে। ভালবাসা? ঠিকই বলেছিল দুর্গা, অমন ভালবাসার মুখে মারি ঝাঁটা।

চিরঞ্জীবের ক্রোধের মাত্রার ওপরে বিস্ময় ঢেউ দিয়ে উঠল। জটাকে জিজ্ঞেস করল, তবে যে তুই বলতিস, বীণাকে তুই বিয়ে করবি সংসার পাতবি?

জটা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, বিয়ে না করলে কি আর সংসার করা যায় না? না, ভালবাসা যায় না? তুই আর দুর্গাও তো আছিস।

আছিস শব্দটা যেন গরম লোহার শিকের মতো বিঁধল চিরঞ্জীবের কানে। তার চোখে মুখে, সারা শরীরে যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল বিদ্যুতের শিখা। তার চাপা গলায় একবার খালি শোনা গেল, দুর্গার কথা বলছিস তুই।

পর মুহূর্তেই জটার গালে ঠাস্ করে একটা থাপ্পড় কষাল সে– বেশ্যার দালাল কোথাকার! ভালবাসার নাম করে মেয়ে বিক্রি ধরেছিস তুই?

চপলা হাউমাউ করে উঠল। কালো মেয়েটা দৌড়ে ঘরের বাইরে গিয়ে চিৎকার করে উঠল, গুণ্ডা পড়েছে বাড়িতে। মাসি পুলিশে খবর দাও।

জটার চোখে ক্রুদ্ধ সাপের দৃষ্টি। সে দৌড়ে ঘরের এক কোণে তাকের ওপরে হাত বাড়াল। বীণাও চিৎকার করে ছুটে গেল সেদিকে, খবরদার জটাদা ওটা বার কোরো না।

চিরঞ্জীব বলে উঠল, দাও, বার করতে দাও ওকে, কী বার করতে চায়। আমি আছি, পালাব না।

জটার হাতে একটা ছুরি চকচক করে উঠল। ছুরিটা একদিন চিরঞ্জীবই কিনে দিয়েছিল জটাকে। কলকাতার ছুরিটা দেখে পছন্দ হয়েছিল জটার। বলেছিল খুনটুন নয় চিরো, এমনিতেই কখন কী দরকার পড়ে। শুধু দেখিয়েই অনেক সময় কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে।

কিন্তু চিরঞ্জীবের দিকে তাকিয়ে জটা দূরেই দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, বড় হাত চালাতে শিখেছিস, না? লিডার?

চিরঞ্জীব বলল, হাত চালানো এখনও শেষ হয়নি। আরও চালাব। তোর কী করবার আছে, আগে কর।

বীণা বলে উঠল, কিছু দেখতে হবে না চিরোদা। আপনি চলে যান। ওকে আপনার দল থেকে তাড়িয়ে দিন।

চিরঞ্জীব বলল, সে তো দেবই।

জটা বলে উঠল, তার আগে আমিই ছাড়ব। মদ-চোলাইয়ের চোরা কারবার, তার আবার শালা যুধিষ্ঠিরগিরি। কারবারের আর লোক নেই?

চিরঞ্জীব বললে, আছে বইকী। কার্তিক ঘোষ আছে তোর মনিব এখানে। ওকুর দের পা-চাটা কুকুর ছিলি। এবার কার্তিক ঘোষ। ও সব জায়গা ছাড়া তোর চলবে কেমন করে? ওরা ছাড়া বেশি দরে মেয়ে কিনবেই বা কে তোর কাছে?

বুধাই এসে দাঁড়াল ঘরের দরজায়। চিরঞ্জীবকে বলল, সব চেঁচামেচি লাগিয়ে দিয়েছে চিরঞ্জীব। চলে চল এখন। ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে।

চিরঞ্জীব জটার দিকেই চোখ রেখে আবার বলল, যুধিষ্ঠির নই। কিন্তু মদ চোলাইয়ের ব্যবসা করি বলে তোর ইচ্ছেমত মেয়ে নিয়ে কারবার করতে দেব না।

কথাটা বলেও শান্তি হল না চিরঞ্জীবের। তার বুকের মধ্যে ফুঁসছে, পড়ছে। তবু মনে হচ্ছে, জটাকে বুক ফুলিয়ে কথা বলার অধিকার যেন তার পুরোপুরি নেই। সে বীণার দিকে ফিরে বলল, তুমি বাড়ি যেতে চাও বীণা?

বীণা মাথা নিচু করে ঘাড় নেড়ে জানাল, আমি আর কোনওদিন এখান থেকে যেতে পারব না চিরোদা। বুধাই বলে উঠল, ওর এখন যাবার উপায় নেই। সব তুমি জানো না। চলো, তোমাকে আমি বলব। তবে জটাকে একটা কথা বলে দিয়ে যাও। যেন দলের সঙ্গে শত্রুতা না করে।

চিরঞ্জীব বলল, সে কথা আমি ওকে বলব না বুধাইদা। ওর যদি সাহস থাকে, ও যেন শত্রুতা করে।

বলে চিরঞ্জীব বেরিয়ে গেল ঘর থেকে! বুধাই জটার দিকে ফিরে বলল, নে ছুরি-টুরি নামা। তোকে তো অনেকদিন বলেছি, বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছে জটিরাম। এ তবু অল্পের উপর দিয়ে গেছে। ওকে তো তুই বেশ জানিস। কী করে ও ছোঁড়া এ কারবারে ঢুকল, তাই এক এক সময় অবাক লাগে ভেবে।

বলে সেও চিরঞ্জীবকে অনুসরণ করল। বাইরে এসে চিরঞ্জীব বলল, বুধাইদা, তুমি সাইকেলের সামনে বসো, চালিয়ে নিয়ে যাই।

–চলো। পাছায় একটু লাগবে, কী করা যাবে তার!

রোদ তখন ঝিলিক দিয়েছে একটু পুব আকাশে। মালিপাড়ায় যদিও লোক চলাচল শুরু হয়নি, বড় রাস্তায় হয়েছে। বুধাইকে সামনে বসিয়ে দ্রুতবেগে সাইকেল নিয়ে চালিয়ে চলল চিরঞ্জীব। একটি কথাও বলল না।

বুধাইকে লোকে জানে ট্যাক্সিওয়ালা বলে। এ শহরে যদিও মিটার-ট্যাক্সি নেই, তবু গাড়ি আছে অনেকগুলি। কোনওকালে হয়তো সে স্বাধীন ব্যবসা করত। যখন তার গাড়ি ছিল। সেই থেকে সে ট্যাক্সিওয়ালা। কিন্তু গাড়ি তার বিক্রি হয়ে গিয়েছে অনেকদিন। লোকটা অস্থিরমতি কিন্তু বাইরে থেকে বোঝা যায় না। কোথাও সে স্থির হয়ে চাকরি করতে পারেনি। কিছুদিন পরে পরেই সে চাকরি বদলায়। এখন তার উপর সকলের অবিশ্বাস এসে গিয়েছে। কাজের লোকেরা তার ওপর আস্থা রাখতে পারে না। কারণ হিসেবে জবাব তার একটিই আছে, খালি গাড়ি চালাতে আমার ইচ্ছে করে না। কী তার ইচ্ছে করে? তা সে জানে না। কিন্তু লোকটা কুঁড়ে নয়। অসুবিধেয় পড়ে কেউ গাড়ি চালাতে বললে সাময়িকভাবে যায়। রাতবিরেতে, ঝড়বৃষ্টিতেও সে পেছপা নয়। তার সুবিধে হল এই যে, তার পরিবার-পরিজন কেউ নেই। যে বাড়িতে আজ চিরঞ্জীব তার সঙ্গে দেখা করল, সেটা তার নিজের বাড়ি নয়। তবে কোন এক কালে নাকি তাদেরই বাড়ি ছিল ওটা। বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির মালিক এখন বিধবা লক্ষ্মী। এ পাড়ারই মেয়ে। এখন বয়স বোধহয় বুধাইয়ের মতো বছর চল্লিশ। বুধাইকে দাদা বলে। গুটি ছয়েক ছেলেমেয়ে আছে। দুর্নামও আছে। থাকতেই পারে, কারণ বুধাই মাসের বিশদিন ও বাড়িতেই থাকে। কিন্তু তা নিয়ে কলরব কিছু নেই এমন। যদিও বুধাই বলে, সংসারে লোকের যে মা-বোন জ্ঞান এত কম, তা জানতুম না।

মাঝে মাঝে সে চিরঞ্জীবদের কাজের জন্যও গাড়ি চালায়। তারও একটা কৈফিয়ত আছে তার। বলে, এটা শুধু গাড়ি চালানো নয়, আরও কিছু কী রকম জানো? প্রথম যখন গাড়ি চালাতে শিখেছিলুম, তখন যেন রক্ত দাপাত গাড়ি চালাতে, এ কাজটা করতে সেরকম লাগে। বেশ লাগে। তারপরে কোনদিন এ-ও মনে হবে, ধুর শালা, মেজাজ আসছে না। তখন আর এ কাজ করব না।

বোঝা যায় একটা উত্তেজনা চায় সে। সেটা হেঁকে ডেকে চেঁচিয়ে দৌড়ে নয়। বুকের মধ্যে, রক্তের মধ্যে, অন্তস্রোতে। মদ খেয়ে এখন সেটা আর তার হয় না। মেয়েমানুষের পিছনে ঘোরার কথা শোনা যায় না তার সম্পর্কে।

নির্দিষ্ট স্থানে এসে দেখা গেল ইন্দির গাড়ির সামনে বসে আছে। গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে একটু ভিতরে, ইন্দিরের মোটর-মেরামতের কারখানা এটা। লোক দেখে সে লাফ দিয়ে উঠল। বোঝা গেল, ভয় পেয়েছে, প্রথমেই বলল, সে উল্লুক কোথায়? জটা? এই লিকার-ভরতি গাড়ি এখানে রেখে গেছে। আর আমাকে বলে গেল রাত আড়াইটের সময় এসে লোক নিয়ে যাবে?

চিরঞ্জীব বলল, ও মিথ্যে কথা বলেছে। সকাল ছটায় বেরুবার কথা আমাদের।

ইন্দির বলল, আমাকে সারা রাত জাগিয়ে রাখা কেন তবে? ছটা পর্যন্ত বললেই হত, গাড়ি আমি অন্য জায়গায় রেখে আসতুম। আমি আর এ সব কারবারে নেই। তোমরা এবার থেকে অন্য জায়গায় গাড়ির চেষ্টা করো, এইবারই শেষ। ওই জটা আমাকে অনেকবার ভুগিয়েছে। আর নয়।

বুধাই তাকে বোঝাল। জটাকে তাড়িয়ে দেবার কথাও বলল। চিরঞ্জীব বলল, এইবারটা মাপ করে দিন ইন্দিরদা। এবার থেকে কথাবার্তা আমি বলব আপনার সঙ্গে।

ইন্দিরের রাগ পড়লেও, অভিযোগ গেল না। বলল, হ্যাঁ, তাই করো ভাই। তোমার ওই জটা মদ খেয়ে এসে আমাকে হুকুম করবে, ও সব আমি পারব না। ভাল কারবার করেছি। মেয়েমানুষ নিয়ে বেড়াতে যাবে, তাও এসে ফোকটে গাড়ি চাপতে চায়। এ কী রকম কথা?

বুধাইয়ের সঙ্গে একবার চিরঞ্জীবের চোখাচোখি হয়। বুধাই বলল ইন্দিরকে, গাড়িতে তেল আছে তো?

আছে।

–তবে নাও চিরঞ্জীব, ওঠো। আর দেরি নয়।

চিরঞ্জীব সাইকেলটা ইন্দিরের লোহালক্কর-ভরা মেরামতি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। পকেট থেকে কুড়িটি টাকা বের করে দিল ইন্দিরের হাতে। টাকাটা নিয়ে ইন্দিরও একটু অবাক হয়ে তাকাল চিরঞ্জীবের দিকে। তাকে সে এতটা চুপচাপ থমথমে দেখেনি কখনও। যদিও, চিরঞ্জীবের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ তার কমই হয়।

গাড়িতে এসে উঠল চিরঞ্জীব। স্টার্ট দিল বুধাই। বলল, যাক, ইন্দিরের নীলকান্ত এক ধাক্কাতেই এস্টার্ট নিয়েছে। যাত্রা তবে শুভই হবে।

রং-চটা নীল রং-এর গাড়িটাকে ওই নামেই ডাকে বুধাই।

শ্রীরামপুর পার হয়ে যাবার পর, বুধাই আর চুপ করে থাকতে পারল না। বলল, একেবারে যে কথা বন্ধ করে দিলে।

চিরঞ্জীব বলল, ভাল লাগছে না।

–কেন? জটাকে মেরেছ বলে?

না। জানিনে কেন ভাল লাগছে না। কোথাও শান্তি নেই বুধাইদা।

কথাটা নতুন নয়।

–তা জানি। নতুন কথা কে বলে জানিনে। সবাই একঘেয়ে পুরনো কথাই বলবে। তবু ওই পুরনো কথাটা সবাই বলছে। শান্তি মানে কী বুধাইদা, বলতে পারো?

-না ভাই, বলতে পারি না। শান্তি আমি কোথাও দেখিনি।

 তুমি কী দেখেছ সারা জীবনে?

–আমি?

এক হাতে হুইল ধরে, আর এক হাতে বিড়ি দেশলাই বার করল বুধাই, একটা বিড়ি আর দেশলাইটা চিরঞ্জীবের হাতে দিল। নিজে একটা ঠোঁটে নিল। চিরঞ্জীব নিজেরটা ধরাল আগে বাতাস ঠেকিয়ে। কাঠিটা নিভে যেতে নিজের জ্বলন্ত বিড়িটা দিল বুধাইকে। বুধাই বিড়ি ধরিয়ে, খানিকক্ষণ সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল।

কোন্নগর পেরিয়ে গাড়ি কোতরং-এর সীমানায় পড়েছে। রাস্তাটা একটু ফাঁকা আছে এখনও। যদিও রোদ উঠে এসেছে অনেকখানি। গঙ্গার ধারে ধারে ইটের ভাটা। ভিনদেশি কুলিকামিনরা কাজ করছে সেখানে। আর বোধহয় মাস দুয়েক। তারপরেই বর্ষা, ইট পোড়ানো বন্ধ হয়ে যাবে।

বুধাই বিড়িটা দাঁতে কামড়ে ধরে বলল, আমি দেখলুম, লোকেরা শালা মরতে চায় না।

–মানে?

–মানে, ছ্যাঁচো কোটো মারো লাথি, লজ্জা নেইকো বেড়াল জাতির। সেইরকম। যেমন করে হোক বাঁচবেই। একী কথা মাইরি, ভেবে পাই না আমি।

চিরঞ্জীবের বুকের মধ্যে কেমন যেন ধকধক করতে লাগল। কারণ, কিছুক্ষণ আগে নিজেকে নিজে সে বলছিল, কী যে জীবনের মায়া, বুঝি না। বেঁচে থাকার কেন বা এত ইচ্ছে। সে বলল, কিন্তু বুধাইদা, সবাই বেঁচে থাকতে চায়।

-হ্যাঁ। ছাল-ওঠা নেড়ি কুত্তাটাও।

–মানুষ তো কুকুর নয়।

কুকুরের মতো মানুষ তো আছে। ছলছলে চোখ, ধুঁকছে, পাতা চাটছে। নয় তো ফাঁক পেলে চুরি করে খাচ্ছে। কেন? তার চেয়ে জোয়ান লড়িয়ে কুত্তা ভাল। তেজ থাকা ভাল। তা নয়, জানলায় জানলায় ম্যাও ম্যাও, লাথি ঝাঁটা, ফাঁক পেলেই চুরি। কেন রে মামদো, কেন, এমন করে বাঁচতেই হবে কেন?

গাড়ি উত্তরপাড়ায় পড়ল। একটা বাঁকের মুখে গাড়ি দাঁড় করাল বুধাই। বলল, যাও, পিছনের সিটে গিয়ে বসো। পায়ের উপর পা তুলে সিগারেট খাও, চোখ বুজে থেকো।

চিরঞ্জীব নেমে গিয়ে পিছনে বসল। সে জানে, মাইল খানেকের মধ্যেই আবগারি তল্লাশির জায়গা আছে। রাস্তার মাঝখানে, সাদা রং পিপে বসিয়ে, পথ দিয়েছে সরু করে, বেঁকিয়ে। চিরঞ্জীব জোরে নিশ্বাস টেনে গন্ধ নেবার চেষ্টা করল। কোনও গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না।

আরও খানিকটা এগিয়ে, আবার গাড়ি দাঁড় করাল বুধাই।

–কী হল?

দাঁড়াও, আর দু একটা গাড়ি আসুক। এক সঙ্গে যাব দুটো গাড়ির মাঝখানে যেতে পারলে সবচেয়ে ভাল। সে যাকগে। যে কথাটা বলছিলুম। কেন বলো তো, এত সাধ কেন বাঁচার? ধুকে পচে হেজে পিষে না বাঁচলেই নয়?

চিরঞ্জীব চোখ বুজে এলিয়ে থেকে বলল, আমি এ কথার জবাব দিতে পারিনে বুধাইদা। তবে, আমার মাঝে মাঝে একটা ইচ্ছে হয়।

-কী রকম?

খুনোখুনি মারামারি করতে ইচ্ছে করে।

-খুনোখুনি মারামারি?

-হ্যাঁ। মাঝে মাঝে ভাবি, একটা ডাকাতের দল করলে কেমন হয়। আগুন লাগিয়ে, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে

শালা, একেবারে সোনার লঙ্কা ছারখার করে দেওয়া, তাই না?

বাধা দিয়ে বলে উঠল বুধাই। তারপর দুজনেই হেসে উঠল।

চিরঞ্জীব বলল ঠাট্টা নয়।

-জানি, ঠাট্টা নয়। কিন্তু আগুন লাগানো কি চাট্টিখানি কথা। দুটো চারটে বাড়ি জ্বালানোর ব্যাপার তো নয়, তাই নয় কি?

–হ্যাঁ, দুটো চারটে বাড়ি নয়। দুটো চারটে সিন্দুকের টাকা নয়। যাবৎ পুড়িয়ে দেওয়া।

বুধাই বলল, ওই রাগেই বুঝি শেষে এই কারবার ধরেছ?

চিরঞ্জীবের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, তা জানিনে। দেখলুম, সবাই বড় বড় কথা বলছে, কিন্তু মরণের ভয়ে সব কেঁচো। আমিও। ওই তোমার কথাটা এল শেষ পর্যন্ত। এই কাজটা আমার জেদ, কমপিটিশান বলতে পারো। লাগাও দৌড়, সে কত লাগাবে। দেখি জিততে পারি কিনা।

কাদের সঙ্গে বাজি ধরেছ?

যারা চোখ আধবোজা করে উপদেশ দিচ্ছে। যারা আমার আশেপাশে সব রকম অন্যায় করছে, তবু কাঁচকলা দেখিয়ে আরামে আছে। তাদের সকলের সঙ্গেই বাজি। লাগাও দৌড়। বুঝতে পারিনি, আরও আগে নামা উচিত ছিল। তা হলে

গলায় যেন কিছু ঠেকে গেল চিরঞ্জীবের। স্তব্ধ হয়ে গেল দিদি কমলার কথা মনে পড়ল নাকি তার? তার চোখে ধিকিধিকি আগুন। তবু একটা যন্ত্রণার ছায়া তার চোখের আগুনের ওপারে। সহসা চাপা গলায় বলে উঠল, কেন দাঁড়িয়ে আছ বুধাইদা? চালিয়ে যাও। হোক যা খুশি, মার ঠোক্কর ওই রাস্তার ওপর আবগারি পুলিশের পিপের বেড়ায়। সেপাইটার খুলি উড়ুক। আসুক ওরা আমাদের মারতে।

বুধাই মোটা গম্ভীর শান্ত গলায় বলল, পিছন ফিরে দেখ তো, যে গাড়িটা আসছে, ওটা প্রাইভেট কার নাকি?

উত্তেজিত অবস্থাতেই পিছন ফিরে দেখল চিরঞ্জীব। বলল, হ্যাঁ।

গাড়ি স্টার্ট দিল বুধাই। বলল, আর ডানদিকে তাকিয়ে দেখো তো ওই চায়ের দোকানের দিকে। শ্রীরামপুরের শম্ভুটিকটিকি না?

আবগারির স্পাই শম্ভু। তাকিয়ে দেখে বলল চিরঞ্জীব, তাই তো দেখছি।

–ও ব্যাটা এখানে এসেছে কেন?

চিরঞ্জীব কিছু বলল না। বুধাই গাড়ি এগিয়ে নিয়ে চলল আস্তে আস্তে! পিছন থেকে প্রকাণ্ড হাডসন হর্ন দিল। বুধাই স্পিড বাড়াল। আর একটা বাঁক নিতেই সামনে দেখা গেল, একসাইজ বেরিয়ার। বুধাই স্পিড কমাল। পিছনের গাড়ি আবার হর্ন দিল। বুধাই পাশ দিল না।

সামনে পিপে দিয়ে রাস্তাটাকে সরু ও সর্পিল করে দেওয়া হয়েছে। যাতে গাড়ি আপনি থেমে যায়। পিপের ঘেরাওয়ের মধ্যে রাস্তা। একজন সেপাই দাঁড়িয়ে আছে। বুধাই গাড়ি ঢুকিয়ে দিল পিপের ঘেরাওয়ে। সেপাই হাত তুলে দাঁড় করাল তাকে। মুখ গাড়ির ভিতরে এনে উঁকি দিল। চোখ বোলাল আনাচে-কানাচে। ভ্রূ জোড়া কুঁচকে উঠল সেপাইয়ের। নাকের পাটা ফোলাল। চিরঞ্জীবের চোখ-বোজা মুখের দিকে একবার তাকাল।

পিছন থেকে হাডসনের হর্ন উঠল বেজে। সেইদিকে একবার তাকাল সেপাইটি। হাত তুলে তাকে পিপের ঘেরাওয়ে গাড়ি ঢোকাতে বলল। বুধাইকে বাঁ-হাতে চলে যাবার নির্দেশ দিল। আর পিছনের হাডসনকে একবারও দেখল না। থামতে না থামতেই চলে যাবার নির্দেশ দিল।

বালি পার হয়ে বলল বুধাই, আগাম সংবাদ না থাকলে কোনও গণ্ডগোল নেই। শম্ভুটাকে দেখে ভেবেছিলুম, মরণের খোঁয়াড়েই ঢুকলুম বোধহয়। হ্যাঁ, চিরঞ্জীব, বলো কী বলছিলে তখন বলো।

চিরঞ্জীবের আগের সে উত্তেজনা আর নেই। মাঝখানে বেরিয়ারের ঢেউটা এসে, চাপা পড়ে গিয়েছে। এখন খানিকটা লজ্জাই করছে। বলল, কিছু বলছিনে বুধাইদা। কিছু ভাল লাগছে না।

বুধাই শ্লেষ্মাজড়ানো গলায় হেসে উঠে বলল, সে একটা কী গান আছে না? ভাল লাগলে দিও, নইলে নিও, ও যে কেড়ে নেবার জিনিস নয়।

চিরঞ্জীব বলল, আছে একটা গান। যাদের মন আছে, তাদের জন্য।

বুধাই বলল, মন যাদের নেই, তাদের আর ভাল মন্দ লাগার কী আছে?

–আমার মন আছে বলছ বুধাইদা?

না থাকলে অত বড় থাপ্পড়টা কষালে কেন জটাকে। একটু বেশি আছে বলেই তো আমার মনে হয়।

-নাঃ বুধাইদা। আমি কি ধর্মপুত্ত্বর যুধিষ্ঠির?

–সেই ভেবেই তো আমার অবাক লাগে।

 চোখে-চোখে তাকিয়ে দুজনেই হেসে উঠল। চিরঞ্জীব বলল, ঠাট্টা করছ বুধাইদা?

–মোটেই নয়। দাও, তোমার সিগারেট একটা দাও।

সিগারেট দিল চিরঞ্জীব। রাস্তায় ক্রমেই গাড়ির ভিড় বাড়ছে। হাওড়ার পুল দেখা দিল।

বুধাই বলল, একটা কথা বিশ্বাস করবে চিরঞ্জীব?

–বলো।

–আমারও আগুন জ্বালাতে ইচ্ছে করে। আমি আর এ ভাবে এই গাড়ির ইঞ্জিনের গোলাম হয়ে থাকতে পারি না, মাইরি। মনে হচ্ছে, এখুনি ইঞ্জিন থামিয়ে দিই দৌড়।

তারপর দুজনেই চুপ করে রইল অনেকক্ষণ। গাড়ি এসে পৌঁছুল, আপার চিৎপুর দিয়ে, বাগবাজারের কাছাকাছি গঙ্গার ধারে একটি সরু গলিতে। গলির মধ্যেই, গেট পেরিয়ে খোলা জায়গাওয়ালা একটি পুরনো বাড়ি। কোনও এক কালে হয়তো এই খোলা জায়গায় বাগান ছিল। কোনও সম্পন্ন গৃহস্থ সাজানো-গোছানো বাড়িটি ভোগ করতেন। এখন শুধু ধুলো। গোবর ছড়ানো। বেওয়ারিশ কুকুরের আশ্রয়। আর বাড়িটায় বাস করে রকমারি লোক। বোঝা যায় না, সকলেরই পরিবার পরিজন আছে কি না। তবে দোতলায় মেয়েদের দেখা যায়। ছেলেপিলের কান্নাও শোনা যায়। মেয়েদের জামা গায়ে থাকে না, কিন্তু দেহ-সৌষ্ঠব চোখে পড়ে। সাজে না, কিন্তু মোটা মোটা সোনার গহনা দেখা যায় গায়ে। অথচ পর্দানশীন একেবারেই নয়। লোক দেখলে, উঁকি মেরে হাঁ করে দ্যাখে। যেন লোক দেখেনি কোনওদিন।

নীচে একটা বড় হলঘর আছে। পুরনো ধুলো-পড়া সেকেলে চেয়ার-টেবিল আছে খানকয়েক। খান দুই-তিনেক তক্তপোশ। ওগুলিতে চাঁটাই পাতাই থাকে। লোকজন সব সময় কয়েকজন থাকেই। হয় তাস খেলে, না হয় গল্পগুজব করে। অন্তত চিরঞ্জীব যত বার এসেছে, তাই দেখেছে।

যদিও সে এসেছে খুব কম। পারতপক্ষে সে আসেই না। বোধহয়, এ বার নিয়ে বার চারেক। বুধাই জটা আর বীণা এখানে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তবে চিরঞ্জীবের খুব খাতির এখানে। তাকে যেন এরা কেমন একটা ভিন্ন নজরে দ্যাখে। সেটা কোনও মহাপুরুষ দেখার ভঙ্গিতে নয়। যেমন ছ্যাঁচড়ারা দ্যাখে কোনও নামকরা চোরকে। অন্তত চিরঞ্জীবের সেইরকমই মনে হয়।

গেট পেরিয়ে খালি জায়গায় এসে গাড়ি দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে ওপরের জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল একটি মেয়ে। মেয়ে নয়, বোধহয় বউ! কী ভাগ্যি! বউটির গায়ে জামা, এমন কী ঘোমটাও টানা আছে। ঘোমটার পাশ দিয়ে এলো চুল ছড়ানো। আর একই সঙ্গে নীচের হলঘর থেকে দুটি লোক প্রায় ছুটে এল বাইরে। বলল, জটার গাড়ি এসেছে।

কিন্তু এসে তারা হতাশ হল। একজন বলল, ধুর শালা, আসল মালের কেউ নেই রে।

বুধাই গাড়ি থেকে নামতে নামতে জবাব দিল, এর চেয়ে আর আসল মাল পাবেন কোথায় মশাই? খোদ কর্তাই তো আজ এসেছে।

দুজনেই ফিরে তাকাল চিরঞ্জীবের দিকে। দুজনেই চিরঞ্জীবের অপরিচিত। একজনের গিলে করা পাঞ্জাবি আর পায়জামা। আর একজনের ধুতি আর শার্ট। দুজনের চেহারার মধ্যেই একটি জিনিস লক্ষণীয়। তাদের জ্বরো-চোখে কেমন যেন ভ্রূটানা উদ্ধত চাউনি। চোখের কোল বসা। ঠোঁটের কোণে, শ্লেষের হাসি।

একজন বলল বুধাইকে, আপনাদের মনিব বুঝি?

 জবাবে বুধাই বলল, পরেশবাবু আছেন তো?

বলতে বলতেই লুঙ্গিপরা গেঞ্জি গায়ে লম্বা-চওড়া, বিশাল দেহ পরেশ দত্ত বেরিয়ে এল। চিরঞ্জীবকে দেখে বলল, আচ্ছা, খোদ কর্তা দেখছি। ভালই হয়েছে, অনেক কথা আছে ভায়া। ভেবেছিলুম গাড়ি আরও সকাল সকাল আসবে। জটার কী হল?

চিরঞ্জীব বলল, ও আর আসবে না।

ইতিমধ্যে পরেশের ইশারায়, তার দুই অনুচরই বেরিয়ে গেল।

পরেশ বলল, জটা আর আসবে না কেন?

–সে অনেক ব্যাপার। বলব। গাড়িটা খালাস করে ফেলুন আগে।

 পরেশ দত্ত লোকটির সর্বাঙ্গ ঘিরে, তার চোখে মুখে কথার ভাবে ও ভঙ্গিতে, একটি বিশেষ ধরনের দলপতির ছাপ। ঝুলে-পড়া পেট, বুড়ো ষণ্ডের মতো কপালের কয়েকটি ভাঁজ, রক্তাভ চোখ তাকে একটি মহিমা দিয়েছে। বলল, ভয় পাচ্ছ কেন? তোমাকে বলাই তো আছে, আমার কম্পাউণ্ডে এনে তুলতে পারলেই হল। কতটা আছে?

চিরঞ্জীব বলল, দশটা আছে পাঁচ নম্বরি। চারটে দশ নম্বরি। অর্থাৎ পাঁচ আর দশ নম্বরের ব্লাডার ভরতি আছে।

পরেশ দত্ত চেঁচিয়ে ডাকল, গুঁইরাম! এই গুঁইরাম!

 কালোমোটা লোমশ একটি লোক বেরিয়ে এলো!কী বলছ?

–গাড়ি থেকে মাল খালাস করে নে। এসো ভায়া।

ঘরে গিয়ে বসল চিরঞ্জীব। বুধাই দাঁড়িয়ে রইল বাইরে। চিরঞ্জীব দেখল, চারজন মনোযোগ সহকারে সকাল বেলাতেই ফিশ খেলছে। তাকিয়ে দেখল চিরঞ্জীবকে। একজন আর একজনকে যেন কী বলল ফিসফিস করে। তারপর আর একজনকে! পরে চারজনেই ফিরে ফিরে দেখল চিরঞ্জীবকে।

একজন বলে উঠল, দাদা তো শুনলাম, হুগলির চ্যামপিয়ান হয়ে গেছেন? কারবার আপনারই জোর। কিন্তু কোর্ট কেস্ প্রায় নেই বললেই নাকি চলে।

চিরঞ্জীব সিগারেট ধরিয়ে বলল, তাই নাকি?

–শুনি তো তাই। তবে মশাই, ছুঁড়ি একখানা যা বাগিয়েছেন! আবগারির বাবার সাধ্যি কি ওকে ধরে। বীণাকে আনেননি আজ?

পরেশ বলল, নাও হয়েছে, যা করছ তাই করো দিকিনি। এদিকে কাজ আছে আমাদের।

চিরঞ্জীবের দিকে ফিরে বলল, নালিশ আছে ভাই তোমার ওপরে।

চিরঞ্জীব বলল, কী রকম?

পরেশ বলল, টাটকা কড়া জিনিসের জন্য তোমার কাছে ছুটোছুটি। কিন্তু মালটা ভাল আসছে না। আর বড় কারবাইড ফারমেন্টেশন হচ্ছে।

যুগপৎ বিস্ময় ও সন্দেহে চিরঞ্জীবের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। বলল, কী করে বুঝলেন।

ও ভাই জহুরিরাই জহর চেনে। যারা ধরবার, তারা ঠিক ধরে ফেলেছে। কমপিটিশনের মার্কেট। এদ্দিন যারা আমার জিনিস খাচ্ছে, তারা দেশি বিলিতি মদ দোকান থেকে কোনওদিন কিনে খায় না। টাকা তাদের আছে। আমার খদ্দের বড় বড় ব্যবসায়ী, উকিল, ডাক্তার, এ অঞ্চলের সব বড় বড় নেশুড়েরা। তারাই বলেছে, পরেশ তোমার জিনিস খেয়ে এ বার দেখছি, গ্যাস হয়ে পেট ফেটেই মরে যাব। কারবাইডের গন্ধও চাপা থাকছে না। জটাকে বললে বলে, ও সব আমি কিছু জানিনে। আমাকে যেমনটি দেয়, আমি তেমনটি এখানে পৌঁছে দিয়ে যাই। ভাল না লাগে তো আমাদের মাল বন্ধ করে দিন।

চিরঞ্জীব গম্ভীর হয়ে বসে রইল চুপচাপ। পরেশ বলল, কী হল, চুপচাপ যে? চিরঞ্জীব বলল, ভাবছি। এ কারবারে দেখছি কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু, আমরা তো কোনওদিন কারবাইড দিয়ে চোলাই করিনে। আর জল মেশানোর কারবারও আমাদের নেই। জিনিস পাঠাই এক রকম, শুনছি আর এক রকম। আমি জানি এ কাজ কে করেছে।

পরেশ বলল, আমিও জানি এ কার কাজ। তোমার ওই জটা শাকরেদটি সুবিধের নয়। তার সম্পর্কেও অনেক কথা আছে। আমার এখানে দশরকম লোক আসে। সারা দিনরাত্রিই এখানে খেলা হয়। আমার এখানে নিয়ম হচ্ছে, খেলো, খাও। যত খুশি। কিন্তু মেয়েমানুষের কারবার চলবে না। ওই একটি জাত। যেখানে যাবে গণ্ডগোল পাকাবে। ওসব চাও তো পাড়ায় চলে যাও, এখানে নয়। কেউ কোনওদিন আনেনি। জটার সঙ্গে বীণা আসত। বুঝতাম সকলেরই চোখ ওদিকে। তবে দিনের বেলার ব্যাপার। বিশেষ কিছু ঘটত না। যারা খেলে জিতত, তারা সবাই বীণাকে দু এক টাকা দিত। একটু হয়তো হাতটা ধরত। কাছে বসত। ওকে কেউ বলত, টেক্কা, কেউ ইস্কাবনের বিবি। যার কাছে ও বসত, তারই নাকি জিত। আর শত হলেও মফস্বলের মেয়ে তো। বেশ্যাদের ছেনালিটা শেখেনি। তা আমার কী বলার আছে, বলো? রোজগার ব্যাপার তো নয়। আর দু চারটে টাকা যদি মেয়েটা ওই করে পেয়ে যায়, আমার আপত্তি কী? বীণাকে দেখলে কারুর কারুর হাতও দরাজ হয়ে উঠত। খাবার-দাবার আনিয়ে সে এক এলাহি কাণ্ড করে ফেলত। একটু-আধটু হল্লা যে তাতে না হত নয়। আমার খদ্দেরদের মুখ চেয়ে আমি চুপ করে যেতাম। কিন্তু আস্তে আস্তে ব্যাপারটা ঘুরতে লাগল। একদিন সন্ধেবেলা বীণাকে নিয়ে জটা এসে উপস্থিত। মাল নিয়ে কাজে আসেনি। এমনি। জটা বললে, খেলব। আমি বললুম, চন্দননগরে খেলার জায়গা পেলে না? বললে, একদিন আপনার এখানেও খেলে যাই। বললুম, কিন্তু ও মেয়েটাকে নিয়ে এসেছ কেন এখানে রাত করে? বললে, কিছুতেই ছাড়লে না। তবে ওসব কিছু ভাববেন না। ও মেয়ে কারুর সঙ্গে ঢলাতে যাবে না। ও হচ্ছে আমার। মনে মনে ভাবলুম, আমার তো বাবা, এ জুয়ার আড্ডায় তাকে এনেছ কেন? মাল পাচারের জন্য ওকে দরকার। ওই করেই ছেড়ে দাও, আবার পরেশ দত্তর এখানে কেন?

চিরঞ্জীব কথাগুলি না শুনে পারছিল না। সে এতদূর আশা করেনি। বুধাই এসে বসেছে কাছে। পরেশ দত্ত তার মোটা ভাঙা গলায়, চাপা স্বরে অবিশ্রান্ত জটা বীণা কাহিনী বলে চলেছে। তার মুখের মাংসে বড় একটা ভাব খেলে না। কথার সঙ্গে সঙ্গে শুধু চোখে সমস্ত ভাব ফুটে ওঠে।

চিরঞ্জীব বলল, তারপর?

পরেশ দত্ত বলল, তারপর, গণ্ডগোল সেই রাত্রেই। বীণাকে কোলের ওপর বসিয়ে একজন খেলা আরম্ভ করল। আর বীণা দেখলুম এর মধ্যেই ট্রেনিং পেয়েছে ভাল। তাকে এতদিন আদর করে যে দু এক টাকা করে সবাই দিত, সেটা আরও বেশি করে আদায় করার ফন্দি। আমার চোখকে ফাঁকি দেবার উপায় নেই। আড়াল থেকে জটার সঙ্গে বীণার চোখাচোখি করা দেখেই বুঝলুম। সবটাই ও ছোঁড়ার কারসাজি। তারপর হল্লা আরম্ভ হয়ে গেল। হবেই, ও শালা, জোঁকের মুখের বাটি। একবার চেপে বসলে পুরো রক্ত না শুষে সে ছাড়ে না। কোলে বসানোই আর থাকল না। এ একটা চুমো খায়, ও চেপে ধরে। টানাটানির মাঝখানে বীণা দিব্যি টাকা হাতড়াচ্ছে। ওদিকে ভয়ও আছে। কিন্তু সাহস দিচ্ছে জটা। কয়েকজন ভদ্রলোক খেলা ছেড়ে উঠে গেল। যাবার আগে আমাকে বলে গেল, দাদা সব জায়গাই দেখছি সমান। আমাদের নসিব খারাপ। জটাকে ডেকে বললুম, তোমার লাস্ট ট্রেনের সময় হয়ে গেছে, কাটো এবার। ও ছুঁড়িকে নিয়ে আর কোনওদিন আসবে না। চলে গেল, কিন্তু ও শালা বিষ্ঠা-খাওয়া কুকুর। মেয়েটাকে দিয়ে টাকা রোজগারের স্বাদ পেয়েছে, আর কখনও ছাড়ে? তার ওপরে অমন ফোকটের টাকা। শুধু হাত ধরে কোলে বসেই যদি এক একদিনে চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা রোজগার হয়ে যায়! আর জটা এটাও বুঝেছিল, আমার খদ্দেররা চায়। তাই আমাকে আর রেয়াত করতে চাইলে না। প্রায়ই আসতে আরম্ভ করলে। তবে ভাই, এটা আমি বলব, ও ছুঁড়ি জটা-অন্ত প্রাণ। ওর নিজের কোনও ছলাকলা ছিল না। যা শেখাত জটা, তাই করত। জটা ওকে মরতে বললে মরতেও পারত।

বুধাই বলে উঠল, আর তাই মরেছে মেয়েটা। একেবারে মরেছে।

পরেশ বলল, মানে?

–মানে মরা যাকে বলে। জটা ওকে মরতে বলেছে, তাই শেষ মরা মরেছে।

পরেশ বলল, দাঁড়াও, তোমাদের কথাটা পরে শুনব। আমি বলে নিই, কারণ, চিরঞ্জীব ভায়াকে আমার সব বলা দরকার। তারপর দেখলুম, বেগতিক। আশেপাশে লোক জানাজানি হচ্ছে। যাদের মাসকাবারি ঘুষ দিয়ে আমার কারবার, তারাও ঘাবড়ে গেল। ভাই, জীবনে তিনবার জুয়া খেলেছি। সোয়া লক্ষ টাকা নষ্ট করেছি। সম্পত্তি আমাদের কিছু ছিল। আর খেলিনি, খেলাই শুধু এখন। তিন পুরুষ আগের এই বাড়িটা ছাড়া আর কিছু নেই। লোকে জানে, পরেশ দত্ত নামকরা গুণ্ডা। তবে হম্বিতম্বিই করেছি। কারুর গায়ে হাত তুলিনি। কিন্তু জটাকে একদিন অন্ধকার ঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে মারতে হল। বেধড়ক মারলুম। জটা বললে, পায় পড়ি ছেড়ে দিন পরেশবাবু। ছেড়ে দিয়ে বললুম আর যেন কোনওদিন তোমাকে বাগবাজারে না দেখতে পাই। বীণা গাড়ি নিয়ে আসবে, জিনিস দিয়ে চলে যাবে। তারপর চিরঞ্জীবকে যা জানাবার তা আমি জানাব। যাও, চলে যাও। তোমাদের কিছু বলেনি জটা?

চিরঞ্জীব বলল, এ সব বললে, ফয়সালা তো অনেক আগেই হয়ে যেত। তা হলে আজ ওকে অত সহজে ছাড়তুম না। হয়তো মারতে মারতে ওর একটা অঙ্গহানি করে ছাড়তুম।

পরেশ দত্ত বলল, তুমিও মেরেছ ওকে?

বুধাই বলল, আজ ভোরেই হয়েছে। একেবারে ঘুম থেকে তুলে। আর ওই যে বললুম, ছুঁড়ি একেবারেই মরেছে। এখন পুরোপুরি ব্যবসা আরম্ভ করেছে। তবে, মেয়েটা মাস কয়েক পোয়াতি হয়েছে। জটা ঘেঁচিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছে। সেই কথাই তখন তোমাকে বলছিলুম চিরঞ্জীব, বীণা আর কোনওদিনই বাড়ি ফিরে যেতে পারবে না।

পরেশ দত্ত বলল, আরও আমার সন্দেহ হচ্ছিল, জটা শুধু তোমাদের মাল পাচার করত না। কার্তিক ঘোষের মালও তোমাদের বলে চালিয়ে দিত।

চিরঞ্জীব বলল, তা বুঝতে পারছি। এবারেও কিছু গণ্ডগোল করে রেখেছে কি না জানি না। এর পরের বার দেখবেন তো। তবে কিছুদিন আর এভাবে আসবে না। বড় বড় বিচুলির লরিতে মাল আসবে। আপনাকে লোক দিয়ে আনিয়ে নিতে হবে। ঠিকানাটা কাছেই। খালধারে যে বিচুলি কাটার কলটা আছে মধুসুদন তেওয়ারির, সেখানে আসবে। সঙ্গে আসবে গুলি। গুলিকে চেনেন তো?

–চিনি।

–আর আগের মতো নৌকোয় করেও কিছু কিছু পাঠাব। খবর পাবেন। আর একটা কথা।

বলো।

টাকা অনেক বাকি ফেলেছেন।

–অনেক নয়, বোধহয় গোটা চল্লিশ পঞ্চাশ আছে।

 –চিরঞ্জীব ভ্রূ কুঁচকে বলল, তা কেন? প্রায় দেড়শো টাকা বাকি আছে।

পরেশ দত্ত লাফ দিয়ে উঠল। হোয়াট? দেড়শো? নিয়ে এসো তোমার জটাকে, হিসেব সমঝে দিচ্ছি। আমার কাছে ওসবে গড়বড় পাবে না।

চিরঞ্জীব আর বুধাই চোখাচোখি করল। বুধাই বলল, ও টাকার আশা ছাড়ো। মনে করো, আবগারিতে মাল ধরা পড়ে গেছে। বাকিটাই উশুল হোক।

চিরঞ্জীবের চোখ জ্বলছিল। সে চুপ করে রইল সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে। পরেশ তার কাঁধে চাপড় মেরে বলল, ভাবনা ছাড়ো ভায়া। একটু চাটা হবে তো?

চিরঞ্জীবের কোনও উৎসাহ নেই। পরেশ দত্তর আদরটা তার ভাল লাগল না। বলল, হোক। কিন্তু বাকি টাকাটা আর আজকের টাকাটা এক সঙ্গে দেবেন।

–নিশ্চয়ই। খোদ কর্তা এসেছে আজ, বাকি রাখা চলে? গুঁইরাম!

গুঁইরাম কাছেই ছিল। বলল, বলো।

 –জিনিস উঠে গেছে?

–হ্যাঁ।

 –সব ঠিক আছে?

 –হ্যাঁ। ব্লাডার সব ধুয়ে তুলে দিয়েছি।

–আচ্ছা, একটু চা নিয়ে আয়।

তারপর চিরঞ্জীবের দিকে ফিরে বলল, শুনলুম, শুধু তোমাকে শায়েস্তা করার জন্যে নাকি তোমাদের ওখানে এক বাঘা আবগারি অফিসার এসেছে?

চিরঞ্জীব বলল, আমাকে শায়েস্তা করার জন্যে কি না জানিনে। তবে নতুন লোক এসেছে। তাও প্রায় এক বছর হয়ে এল। শুনলুম, আগেকার মতো এ অফিসার কোন চুক্তিতে আসতে রাজি নয়।

পরেশ বলল, তা না এসে পারে? ঠ্যালার নাম বাবাজি। অনেক অফিসার দেখলুম বাবা। তোমাদের সঙ্গে আঁতাত না করে তাদের কখনও চলে?

চিরঞ্জীব বলল, না, এ ভদ্রলোক নাকি ভীষণ কড়া আদর্শবাদী।

পরেশ দত্ত সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে অট্টহাসি হাসল। বলল, একে পুলিশ, তায় আদর্শবাদী। সে আবার কী চিজ জানিনে তো।

বুধাই বলল, বোধহয় গোরুর নাম ধেনু সেই রকম আর কী!

চিরঞ্জীব না হেসে পারল না। কিন্তু কলকাতা থেকে ফেরার পথে যখন বুধাই আবার জিজ্ঞেস করল। চুপচাপ কেন?

সেই একই জবাব দিল চিরঞ্জীব, ভাল লাগছে না।

বুধাই বলল, বেশি বোলো না। আমি গাড়ি চালাতে পারব না!

 চিরঞ্জীব বলল, আচ্ছা বুধাইদা, জটা তা হলে বীণাকে ভালবাসেনি!

বুধাই তেমনি শ্লেষ্মা-জড়ানো গলায় হেসে বলল, নিজের গোরুকে সবাই ভালবাসে। তা বলে তার দুধ বেচে না?

বিরক্ত হল চিরঞ্জীব। বলল, গোরুর কথা বলছিনে আমি। মেয়েমানুষের কথা বলছি। বুধাই বলল, গোরুর মতো মেয়েমানুষও আছে যে সংসারে, কী করব বলো? তা ছাড়া–

একটা লরির পাশ কাটিয়ে বলল বুধাই, তোমাকে তো বলেছি, যেমন করে হোক, সব বাঁচবার তালে আছে। নিজের কাছে কেউ কিছু নয়। যেমন করে হোক ভালবাসা ভালবাসিই সই, তাই বেচে মেরে দিচ্ছে। কিন্তু–

একটা গোরুর পাশ কাটিয়ে বলল, তুমি এসব ভেবে মরছ কেন? যা ভাবছিলে, ঠিকই ভাবছিলে। লঙ্কা পোড়াতে হবে, বুঝলে? এই সাজানো সোনার লঙ্কা পোড়াতে হবে।

সোনার লঙ্কা পোড়াতে হবে। কোথায় লঙ্কা, কেমন করে আগুন লাগানো যায়, কে জানে। কয়েক বছর আগে, প্রথম যেদিন বেআইনি চোলাইয়ের মনস্থ করে গ্রামে ঢুকেছিল, সেদিনও তার মনে হয়েছিল, একটা তছনছ করতে হবে। ভয়ংকর ভাবে সব ভেঙেচুরে আগুন জ্বালাতে হবে। পুড়িয়ে দিতে হবে সব কিছু। সত্য-মিথ্যা, সৎ-অসৎ, মায়া-মমতা, সব সেই আগুনেই পোড়াতে হবে।

কিন্তু তার নিজের অতীতটাই বুঝি শুধু পুড়েছে। আর কোথাও কিছু পোড়েনি।

 চন্দননগরে ফিরে, বুধাইকে নিয়ে একটা হোটেলে খেতে বসে বলল চিরঞ্জীব, বুধাইদা, কোথায় কেন আগুন লাগাতে যাব বলো দিকিনি? ও একটা রোগ বোধহয়। বেশ তো আছি, আমার অভাব কীসের?

বুধাই তার মোটা-মোটা আঙুলগুলি ভাতের মধ্যে ঢুকিয়ে বলল, ওই, শালুক চিনেছে গোপাল ঠাকুর।

কী রকম?

 -ও আগুন তোমাকে ছাড়বে না।

কী করে বুঝলে।

 নিজেকে দিয়ে। তোমাকে দেখে।

 চুপ করে ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল চিরঞ্জীব। বুধাই বলল, নাও, খেয়ে নাও। যন্তরে তেল দাও, বাঁচতে হবে তো। বলে হাসল।

ইন্দিরের কারখানা থেকে সাইকেল নিয়ে ফেরার পথে বুধাই আর ইন্দির দুজনকে বলে দিল চিরঞ্জীব, আমাদের সব লোককে জানিয়ে দিতে হবে জটার কথা। ওর সঙ্গে যেন কেউ যোগাযোগ না রাখে।

তারপর মনে মনে ভাবল কত আগে দুর্গা ওই জটাকে দল থেকে তাড়িয়ে দিতে বলেছিল। এ বার দুর্গার কথা শুনবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *