১.৩ কাহারপাড়ার আবালবৃদ্ধবনিতা স্তম্ভিত এবং স্তব্ধ

গোটা কাহারপাড়ার আবালবৃদ্ধবনিতা স্তম্ভিত এবং স্তব্ধ হয়ে গেল করালীর কথা শুনে আর সকৌতুক উচ্চহাসি দেখে। করালী বলে কি? কত্তার পুজোটা আমাকে দিয়ো গো! এত বড় স্পৰ্ধা তার! হে ভগবান, হে বাবা কালারুদ্র, হে বাবাঠাকুর।

বনওয়ারী স্থির দৃষ্টিতে দেখছিল করালীকে। আজই যেন সে করালীকে নতুন করে দেখলে। নোড়ার কাজের জন্যে কুড়িয়ে আনা নুড়িটাকে আলোর ছটায় জ্বলতে দেখে মানুষ যেমনভাবে সবিস্ময়ে সাগ্রহে সসম্ভ্ৰমে তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, তেমনই ভাবে দেখলে তাকে বনওয়ারী। ছোঁড়ার চেহারাটা ছেলেবেলা থেকেই মিষ্টি চেহারা আজও তাকে দেখে সেই মিষ্টি চেহারার আস্বাদই মনে জাগে, আজ বনওয়ারী তাকে দেখে নতুন আস্বাদ পাচ্ছে। গোটা কাহারপাড়াই পাচ্ছে যেন।

লম্বা দীঘল চেহারা, সাধারণ হাতের চার হাত খাড়াই তাতে কোনো সন্দেহ নাই, সরু কোমর, চওড়া বুক, গোলালো পেশিবহুল হাত, সোজা পা দুখানি, লম্বা আমের মত মুখ, বড় বড় চোখ, নাকটি খাদা; কিন্তু তাতেই চেহারাখানিকে করেছে সবচেয়ে মিষ্টি, তারও চেয়ে মিষ্টি তার ঠোঁট আর পাঁত। হাসলে বড় সুন্দর দেখায় করালীকে।

তরুণের দলের অবশ্য এ চেহারা চোখে ঠেকেছে। পাড়ার ছোকরারা মনে মনে অধিকাংশই করালীর অনুগত। কিন্তু এ চেহারা সকলের চেয়ে ভাল করে দেখেছে পাখী। করালীর দেহের রূপ। বীর্য সে দেখে মুখস্থ করে ফেলেছে। তার কাছে জীবনে সব এক দিক আর করালী এক দিক।

বনওয়ারীও দেখছিল করালীর দেহের শক্তির শোভা। হ্যাঁ, ছোকরা জোয়ান হয়েছে বটে। করালী যখন ঘরে কুকুরটার জন্যে সমাধি খুঁড়ছিল, তখন চকিতের মত যেন চোখে পড়েছিল এ চেহারা। কিন্তু বনওয়ারী তখন দেখেও দেখে নাই। আজ এই মুহূর্তে তাকে না দেখে বনওয়ারীর উপায় নাই। মনে পড়ছে বনওয়ারীর বাঁশবনে সে ঝাপিয়ে পড়ল করালীর উপর, নিষ্ঠুর ক্রোধে কাঁপিয়ে পড়ল, ইচ্ছে ছিল—বুকে চেপে বসে গলাটা টিপে ধরবে, মরে যদি যায় দেবে ফেলে ওই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে। কিন্তু বনওয়ারীর ভাল মনে পড়ছে না, কি করে হয়েছিল। বাঁশপাতায় পা পিছলে গিয়েছিল?

ধোঁয়ায় মাথা ঘুরে গিয়েছিল? হয়েছিল একটা কিছু। করালীই চেপে বসেছিল তার উপর? সে ভাবছিল, করালী হয়ত উচ্চহাসি হেসে এই সমবেত কাহারদের কাছে বলবে, বাবাঠাকুরের চেলা বনওয়ারী মুরুব্বিকেও দেখে নিয়েছি

পাখী এগিয়ে এল বনওয়ারীর কাছে। ডাকল-মামা!

বনওয়ারী তার মুখের দিকে তাকাল। তারপর হঠাৎ হেসে বললে—করালীর বুদ্ধি আছে। ও ঠিক ধরেছে।

করালী উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠল—রেললাইনের আটাশ মাইলে ঠিক এমনি হয়েছিল। বুঝেছ—আটাশ মাইলে—খুব জঙ্গল, সেখানে গেলবারে ঠিক এমনি শিস উঠত। সন্ধ্যাবেলা টলি ঠেলে আসছি, টলিতে আছে সায়েব। হাতে বন্দুক। বুঝেছ, শিস শুনেই বললে—রোখো টলি। তাপরেতে টর্চ মারতে লাগল, মারতে মারতে এক জায়গায় টর্চ পড়তেই দেখতে পেল সাপ। বাস্, বন্দুক তুলে গুড়ুম।

প্ৰহ্লাদ বললে, লে এখন সাপটাকে ভাল করে পুড়িয়ে দে। খরিস গোখরা লয়, চিতি বটে–তা বড় চিতি। বেরান না হোক, বদ্যি কায়স্থ-টায়স্থ তো বটেই। সৎকার করতে হবে তো!

নিমতেলে পানু বয়সে করালীদের বয়সী হলেও জ্ঞানবৃদ্ধ প্রহ্লাদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করে। সে সর্বাগ্রে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল—একশো বার। শুধু কি সজাত পেহ্লাদদাদা? পবীন, পবীন সাপ। তা বয়স তোমার অনেক হবেন গো।

করালী বললে না। ও আমি নিয়ে যাব। দেখুক, পাঁচজনায় দেখুক। সন্জে হতেই সব কিসের ভয়ে জুজুমানা হয়ে ঘরে খিল দিত। দেখুক।-বলে আবার সে হেসে উঠল।

নিমতেলে পানু বনওয়ারীর দিকে চেয়ে বললে—মুরুব্বি!

বনওয়ারী বললে—তা। সে বুঝতে পারলে না, কি বলা উচিত।

—কি? বল? তা বলে যে থেমে গেলা! পানু বিরক্তিভরেই বললে, শাস্ত যা বটে, তা করতে হবে? না–কি?

—তা করবে। মড়া মলে সঙ্গে সঙ্গেই তো পোড়ায় না। পাঁচজনা আসে, দেখে। বাসমড়া না হলে হল। তা এখন নিয়ে যেয়ে রাখুকতাপরে আত্তি কালে নদীর ধারে দেবে পুড়িয়ে।

খুব খুশি হয়ে উঠল করালী। বললে—এই না হলে মুরুব্বি বলবে কেনে?

বনওয়ারী বললে—তু তো মানিস না রে মুরুব্বি বলে।

করালী এবার লজ্জিত হল। সুন্দর হাসি হেসে সে বললে মানি গো খুব মানি, মনে মনে মানি। বুঝলে?

নিমতেলে পানু বললে তা আবার মানিস না। কাহারপাড়ার পিতিপুরুষের রোপদেশে নাতি মেরে মুরুরি মুখের ওপর বুড়ো আঙুল লেড়ে দিয়ে চন্দনপুরে মেলেচ্ছো কারখানায় কাজ করছিস। মেলা রোজগার করছিস

করালী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল মুহূর্তে। সে চিৎকার করে উঠল-হারামজাদা!

বনওয়ারী দুই হাত বাড়িয়ে আগলে বললে–না।

করালী থমকে দাঁড়াল। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি বনওয়ারীর মুখের উপর রেখে চেয়ে রইল।

বনওয়ারী বললে, মারামারি করতে নাই। পেনোর অন্যায় বটে। ওকে আমি শাসন করে দোব।

করালী তার অনুগতদের বললে—একটা বাঁশ আন। চাপিয়ে তুলে নিয়ে যাব।

প্ৰহ্লাদ বললে—বেশ পেশস্ত জায়গায় আখ। অ্যানেক লোক দেখতে আসবে।

এ সম্বন্ধে তাদের অভিজ্ঞতা আছে। দাতাল শুয়োর মারা এখানে তো সাধারণ ব্যাপার; এ বিষয়ে শিক্ষাও তাদের পুরুষানুক্রমিক; কখনও কখনও দু-এক জন জখমও হয় দাতালের দাতে। বছরে দু-তিনটে দাতালে মারেই, আর এখানকার লোকের স্বভাব হল—খবর পেলেই ছুটে দেখতে আসবে। দাতালটাকেও দেখে, আবার জখম মানুষটাকেও দেখে। বাঘ কি কুমির হলে তো কথাই নাই। প্ৰায় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগে একটা চিতা এসেছিল, ওই কোপাইয়ের বানে ভেসে এসে বাঁশবেড়েয় আটকে যায়। সেটা ছিল জ্যান্ত। সে বলতে গেলে বনওয়ারীর বাপের আমল। কৰ্তা ছিল তারাই। বনওয়ারী প্রহ্লাদ এদের তখন করালীর বয়স, এরা ছিল কর্মী। কর্তাদের পরামর্শে বাঘটাকে তারাই বাঁশের খাঁচা তৈরি করে ধরেছিল। শক্ত পাকা বাঁশ আধখানা করে চিরে শিকের মত গেঁথে খাঁচা তৈরি করেছিল তারা; লোহার শিক দিয়ে তৈরি খাঁচার চেয়ে সে বেশি শক্ত। সেই আঁচার মধ্যে পাঠার বাচ্চা বেঁধে বাঁশবাঁদির বনে খচা পাতা হল। এক দিন, দু দিন, তিন দিনের দিনই বাঘা বন্দি হল। তখন খুঁচিয়ে মারার ব্যবস্থা। মারার পর ভেঙে এল চাকলার লোক। ঘোষকৰ্তা আগেই এসে মরা বাঘের উপর মারলে এক গুলি। রগে নল রেখে গুলি। তারপর লোকের ভিড় দেখে জাঙল থেকে আনালেন একটা উঁচু তক্তপোশ, সেইটার উপরে রেখে দিলেন। সে কি ভিড়! কেউ বাঘটাকে ঢেলা মারলে, কেউ লাঠি দিয়ে খোঁচালে, কেউ লেজ ধরে টানলে, দু-চার জন ছোকরা তো বাই ঠুকে লাফিয়ে উপরে পড়ে মারলে দমাদম ঘুষি। কেউ-বা সেটাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েই পড়ল মনের আনন্দে। সেইসব ভেবেই চিরদিনের চলতি প্রথা অনুযায়ী কথাটা বললে প্ৰহাদ-রতনের দল। জায়গার জন্য ভাবনারও কোনো প্রয়োজন নাই। চিরকাল যেখানে নামানো হয়, সেই বনওয়ারীর খামার পড়ে রয়েছে—মস্ত ফাকা জায়গা।

কিন্তু করালীর মতিগতিই ভিন্ন। হাত ছয়েক লম্বা একটা বশের উপর সেটাকে ঝুলিয়ে আর। একজনের সাহায্যে কাঁধে তুলে বয়ে বনওয়ারীর খামার পার হয়ে চলতে শুরু করলে নিজের বাড়ির দিকে। প্রহ্লাদ রতন পানু বললে–নামা এইখানে।

করালী বললেউই। আমার বাড়িতে নিয়ে যাব আমি।

প্ৰহ্লাদ রতন পানু স্তম্ভিত হয়ে গেল করালীর স্পৰ্ধা দেখে। তারা বনওয়ারীর মুখের দিকে চাইল।

বনওয়ারী এতক্ষণে হাসলে। তাচ্ছিল্যভরেই বললে—যাক, যাক, ছেলেমানুষ। তা ছাড়া কাণ্ডটি তো ওরই বটে বাবু। তারপর করালীর পিঠে কয়েকটা আদরের চাপড় মেরে বললে–হা। বীর বেটাছেলে বটিস তুই।

করালী হাসলে। স্মিতমুখে আনন্দের হাসি হাসলে। সঙ্গে সঙ্গে একটু যেন লজ্জিত হল। মনে হল, বনওয়ারী খুড়োকে খানিকটা সম্মান দেখানোর প্রয়োজন আছে। সে বললে—তুমিও এসো কিন্তুক।

আচ্ছা। যাব, চল্‌।

 

বাড়ির উঠানে ফেলে করালী বীরদৰ্পে সকলের দিকে চাইল। মাতব্বর-মুরব্বিরা কেউ আসে নাই। অপমান বোধ না করলেও তারা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। করালী এই সুযোগে কৌতুক করে অকস্মাৎ ভান করে চমকে উঠে বলে উঠল—ওরে বাবা, লড়ছে যে!

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের দল আতঙ্কে চিৎকার করে ঠেলাঠেলি করে পিছু হঠতে লাগল। পুরুষেরা ঠেলাঠেলি লাগিয়ে দিলে। করালী অট্টহাসি হেসে উঠল। বললে—যত সব ভয়তরাসের দলভয়েই মরবে, ভয়েই মরবে।

তারপর বললে-পালাও সব, পালাও বলছি। নইলে ভাল হবে না। পালাও। পাখী, বার কর।

অর্থাৎ মদের বোতল। বিজয়ী বীর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মদ্যপান করবে। কাহারপাড়ায় তরুণদের নিয়ে তার একটি দল আছে, যে দল বাইরে বনওয়ারীর মাতব্বরি মেনে চললেও অন্তরে অন্তরে করালীই তাদের দলপতি। এদের মধ্যে রতনের ছেলে নটবরই প্রধান।

নটবর একবার বীরদৰ্পে সাপটার চারদিক ঘুরে বললে—কই, একটি করে পয়সা আন দেখি নি।–বাবা, তার বেলাতে লবডঙ্কা!

একটি মেয়ে বললে—মরণ! সাপ মেরে গিদেরে যেন কি করছে! অর্থাৎ অহঙ্কারে।

করালী বললে—ধর্‌ ওকে নটবরে, আমরা গান করব, ওকে লাচতে হবে। ধর্‌।

মেয়ের দল এইবার পালাল। চ্যাঙড়ার দলকে বিশ্বাস নাই, তার উপর মদের বোতল বেরিয়েছে। কয়েক ঢোক পেটে পড়লে হয়!

নটবর বললে—আঃ, নদিদি নাই রে আজ!

করালী ইতোমধ্যে খানিকটা খেয়েছে। সে বললেওঃ, সে থাকলে মাতন লাগিয়ে দিত। হারামজাদীর কুটুম্বিতে লেগেই আছে।

নসুবালা করালীর পিসতুতো ভাই। আসল নাম সুরাম। অদ্ভুত চরিত্র নসুরামের। ভাবে ভঙ্গিতে কথায় বার্তায় একেবারে মেয়েদের মত। মাথায় মেয়েদের মত চুল, তাতে সে খোপা বঁধে, নাকে নাকছবি পরে, কানে মাকড়ি পরে, হাতে পরে কাচের চুড়ি লাল রুলি, মেয়েদের মত শাড়ি পরে। মেয়েদের সঙ্গে গোবর কুড়ায়, কাঠ ভাঙে, ঘর নিকায়, চন্ননপুরে দুধের যোগান দিতে যায়, মজুরনী খাটতে যায়। কণ্ঠস্বরটি অতি মিষ্ট গান গায়, নাচে। গান আর নাচ এই তার সবচেয়ে বড় নেশা। ঘেঁটুর দলে নাচে, ভাঁজোর নাচনে সে-ই মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা নাচিয়ে। মেয়েদের সঙ্গেই সে ব্ৰতপার্বণ করে। করালীর ঘরে সে-ই গৃহিণী। করালী বিয়ে করে বউ তাড়িয়ে দিয়েছে, বউ তার পছন্দ হয় নি, আবার বিয়ে করবে। নসুরও বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, নসুও বউ তাড়িয়ে দিয়েছে, সে আর বিয়ে করবে না। করালীর ঘরে বোন হয়ে, করালীর বউয়ের ননদ হয়ে থাকবে—এই তার বাসনা। পাড়ার বিয়েতে নসুবালাই বাসরে নাচে, গান গায়। শুধু পাড়ায় নয়, গ্রামে গ্রামান্তরে যে কোনো ঘরে ধুমধামের বিয়ে হলেই নসুকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খবর দেয়। নসু খোপা বেঁধে, আলতা পরে, রঙিন শাড়ি পরে, কপালে সিঁদুর ঠেকিয়ে অর্থাৎ টিপ পরে রওনা হয়, আবার উৎসব মিটলে ফেরে। করালীর জন্য কিছু-না-কিছু নিয়ে আসে।

এই নসুবালার অভাবই করালী সবচেয়ে বেশি অনুভব করলে আজ।

—নসুদিদি নাই তো পাখী নাচুক কেনে? কথাটা বললে করালীর অপর অনুগত শিষ্য মাথলা। মাথলার আসল নাম রাখাল বা আখাল, কিন্তু দেহের অনুপাতে মাথাটা মোটা বলে কাহারেরা তাদের নিজস্ব ব্যাকরণ অনুযায়ী সম্ভবত ওয়ালা প্রত্যয় করে করেছে মাথলা।

কথাটা মন্দ বলে নাই মাথলা। কিন্তু তবু ভ্ৰ কুঁচকে উঠল করালীর। পাখী তাকে ভালবাসে, একদিন হয়ত তাকেই সে সাঙা করবে। সে নাচবে এই এদের সামনে?

পাখির চোখেও রঙ ধরেছে, সেও খানিকটা পাকী মদ খেয়েছে, করালীর গৌরবে তারও নাচতে মন যাচ্ছে; তবু সে করালীর মুখের দিকে চাইলে। চেয়েই সে বুঝতে পারলে করালীর মন, সে তৎক্ষণাৎ বললে–না। তোর বউকে ডাক্ কেনে?

ঠিক এই সময়েই কাছাকাছি কোথাও সুচাঁদের কর্কশ কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়ে উঠল, মুহূর্তে সমস্ত পাড়াটা চকিত হয়ে উঠল।

—ওরে বাবা রে! ওরে মা রে! আমি কোথায় যাব রে!

করালী হা-হা করে হেসে উঠল, বললে—বিত্যেব দেখ বুড়ির! অর্থাৎ ভয়ে চেঁচানি দেখ বুড়ির। তারপর সকৌতুকে বলে উঠল—নিয়ে আয়, নিয়ে আয়, ও-ই বুড়িকে নিয়ে আয়ওই নাচবে। তুর্কি নাচন নাচাব বুড়িকে। ব্যাঙ দেখে নাচে, সাপ দেখে নাচবে না?  ডাকতে হল না, এক-গা কাদা মেখে খাটো-কাপড়-পরা সুচাঁদ এসে দাঁড়াল করালীর উঠানে। তার পিছনে আরও কয়েকজন প্রৌঢ়া মেয়ে। স্থির দৃষ্টিতে সে মরা সাপটাকে কিছুক্ষণ দেখে হঠাৎ বুক চাপড়ে কেঁদে উঠল। শঙ্কাতুর অমঙ্গল ঘোষণার সুর ধ্বনিত হয়ে উঠল তার কণ্ঠস্বরে।

—ওগো বাবাঠাকুর গো! ওরে, আমার বাবার বাহন রে! ওরে, কি হবে রে! হায় মা রে! বলতে বলতে সে থরথর করে কেঁপে মাটির উপরে বসে পড়ল।

সমস্ত কাহারপাড়ার আকাশে একটা আশঙ্কার আর্তবাণী হায় হায় করে ছড়িয়ে পড়ল। করালী পাখী নটবর মাথলা সকলেই বেরিয়ে এল—কি হল?

হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবনে-ঘেরা আলো-আঁধারির মধ্যে গ্রামখানি। সে গ্রামের উপকথায় এ দেশের কতকাল আগের ব্রত-কথায় আছে, গায়ে ছিল এক নিঃসন্তান বুড়ি, ব্রত করত, ধর্মকর্ম করত, গাঁয়ের দুঃখে দুঃখ করেই তার ছিল সুখ। কারও দুঃখে কাঁদতে না পেলে বুড়ি পশু-পক্ষীর দুঃখ খুঁজে বেড়াত। এমন দিনের সকালে বসে ভাবতে ভাবতে আপন মনেই বলত—কাদি কাঁদি মন করছে, কেঁদে না আত্মি মিটছে, মহাবনে হাতি মেরেছে, যাই; তার গলা ধরে কেঁদে আসি।

হাঁসুলী বাঁকে সুচাঁদ বুড়ি বোধহয় সেকালের সেই বুড়ি। সাপটা যখন মরে তখন বুড়ি বাড়ি ছিল না। থাকলে যে কি করত, সে কথা বলা যায় না। সে গিয়েছিল ঘাস কাটতে। বাঁশবাঁদির কাহার-বুড়িরা, প্ৰবীণরা, যারা মজুরনী খাটতে পারে না, তারাও বসে খায় না—পিতিপুরুষের নিয়ম এই, যেমন গতর তেমনই খাটতে হবে। তারা দুপুরবেলা গরু-বাছুর-ছাগলের জন্য ঘাস। কাটতে যায়। কাখে ঝুড়ি নিয়ে, কাস্তে নিয়ে চলে যায় হাঁসুলীর বাঁকের ওপারে—কোপাইয়ের অপর পারে গোপের পাড়ায় মোষদহরীর বিলে ঘাস কাটতে। মস্ত বিলটার চারিপাশে প্রচুর ঘাস জন্মায়। তার সঙ্গে পানিফল তুলে আনে, কলমি শুনি শাক সংগ্রহ করে, আর দু-চারটে পাকাল মাছ—তাও ধরে আনে। তাই বুড়ি গিয়েছিল ওই মিেষদহরীর বিলে। ফিরে এসে সমস্ত কথা শুনে ছুটে এসেছে সাপটাকে দেখতে। দেখে চিৎকার করে পাড়াটাকে শঙ্কায় সচকিত করে দিলে।

সাপটার সামনে বুড়ি চোখ বিস্ফারিত করে স্তব্ধ হয়ে বসল। কিছুক্ষণ পর কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বাবাঠাকুরের থানের দিকে প্রসারিত করে। দিয়ে বললে—হে বাবা, হে বাবা, হে বাবা!

–অ্যাই বুড়ি। চিৎকার করে প্রতিবাদ করে উঠল করালী।

পাখী বললে—মরণ! ঢঙ দেখ! দোপরবেলায় কাদৃতে বসল দেখ! সাপ আবার বাবা হয়!

–হয় লো, হয়। বুড়ি কেঁদে উঠল। সুর করে কেঁদে কেঁদে বুড়ি বলে গেলও যে আমার বাবাঠাকুরের বাহন রে! ওর মাথায় চড়ে বাবাঠাকুর যে ভোমন করেন। আমি যে নিজের চোখে দেখেছি রে! দহের মাথায় বাবাঠাকুরের শিমুলগাছের কোটরে সুখে নিদ্যে যাচ্ছিলেন রে, আমি যে পরশু দেখেছি রে!

এরপর আর অবিশ্বাসের কিছু থাকে না। বাবাঠাকুরের শিমুলগাছ, দহের মাথায় প্রাচীনতম বনস্পতি, তারই কোটরে এই আশ্চর্যজনক শিস দেওয়া বিচিত্ৰবৰ্ণ বিষধর যখন থাকত, তখন বাবাঠাকুরের আশ্রিত, তার বাহন—এতে আর সন্দেহ কোথায়! সমবেত কাহারপাড়ার নরনারী শিউরে উঠল, মেয়েরা সমস্বরে বলে উঠল—হেই মা রে!

করালী শঙ্কিত হয়ে উঠল, আবার ক্রুদ্ধও হয়ে উঠল। সে অনুমান করতে পারছে, এরপর কি হবে। পাড়া জুড়ে হায় হায় রব উঠবে। তার সকল বীরত্ব ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। কিন্তু সে ভেবে পেল না, কি করবে! তার সঙ্গীদের মুখ শুকিয়ে গেছে। তারাও যেন ভয় পেয়েছে। তার ইচ্ছে হল, সে ছুটে চলে যায় চন্ননপুরে। সেখান থেকে ডেকে নিয়ে আসে তাদের ছোট সাহেবকে, যে সেদিন এমনই একটা সাপ মেরেছে রেললাইনের ধারে, যে সাহেব নিজে হাতে কোপ মেরেছে নদীর ঘাটে পেত্নীর আশ্রয়স্থল পুরনো শেওড়াগাছটায়; সে এসে মরা সাপটাকে লাঠি দিয়ে খোঁচা মারুক, গোটা কাহারপাড়াকে সায়েস্তা করে দিক।

হঠাৎ পাখী চিৎকার করে উঠল। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে সে মাতামহীর সামনে এসে বললে—এই দেখ বুড়ি, এই ভর তিন পর বেলাতে তু কাদতে লাগিস না বললাম।

কালা সুচাঁদ শুনতে পেলে না কথা। সে আপন মনেই আক্ষেপ করে চলল—সব্বনাশ হবে। রে, সৰ্ব্বনাশ হবে। ই গায়ের পিতুল নাই। আঃ আঃ হায় হায় রে!

পাখী এবার আর বৃথা চিৎকার করলে না। এসে বুড়ির হাত ধরে টেনে তাদের ঘরের সীমানা থেকে বার করে এনে চিৎকার করে বললে—এইখানে বসে কা।

হাত ধরে টানাতেও বুড়ি প্রথমটা বুঝতে পারে নাই পাখীর মনের ভাব। এবার কিন্তু বুঝতে বাকি রইল না। সে মুহূর্তে ভয়ঙ্করী হয়ে উঠল, এবং এক মুহূর্তে সে অলৌকিক লোক থেকে নেমে এল লৌকিক বাঁশবাঁদির ইতিহাসে। তা নইলে যেন পাখীকে ধরা যায় না, পাখী এবং করালীকে দেবতার ভয় দেখিয়ে মানানো যায় না। তাই সে আরম্ভ করলে পাখীর জন্মকাণ্ডের কাহিনী, তা নইলে ওর চরিত্র এমন হবে কেন?

চিৎকার করে পাখীর জীবনের জন্মকাণ্ড হতে এ পর্যন্ত যত অনাচারের কথা আছে তাকে সাতকাও করে আকাশ-লোককে পর্যন্ত শুনিয়ে দিলে। অবশেষে শাসন করে বললে হারামজাদী বেজাত—বদজাত—বদজম্মিত, এত বড় বড় তোমার? আমার বাড়ি থেকে আমাকে বার করে দাও তুমি?

তারপর সে বললে—তাই বা কেন? এত বড় স্পৰ্ধা এই পাখী ছাড়া আর কার হতে পারে? বসন্তের এই কন্যাটি ছাড়া আর কার হতে পারে? সুষ্ঠাদের নিজের কন্যা হলে কি হয়? সুচাঁদ সত্য ছাড়া মিথ্যা বলবে না। নিজের কন্যা বলে সে তার খাতির করে না। বসন্তের যে মতিগতি মন্দ; যখন ওই জাঙলে চৌধুরীবাবুর মাতাল ছেলের সঙ্গে মনে রঙ লাগায়, তখন সে জানে এর দুর্ভোগ তাকেই ভুগতে হবে। আজও পর্যন্ত বসন্ত সেই রঙের নেশায় বিনা পয়সায় বারটি মাস চৌধুরী-বাড়িতে দুধ যোগায়। তাও কিছু বলে না সে। এই হারামজাদী পাখী যখন বসন্তের পেটে এল, তখন খুঁজে খুঁজে সুচাঁদ নিয়ে এসেছিল এক জরাজীর্ণ খোড়া কাহারের ছেলেকে; এনে অনেক ঘুষ দিয়ে পাখীর পিতৃত্বের দায়িত্ব তার উপর চাপিয়ে বসন্ত এবং পাখীকে রক্ষা করেছিল। অন্যায় হয়েছিল—তার অন্যায় হয়েছিল। বসন্তকেই পথে বার করে দেওয়া উচিত ছিল। অথবা এ পাপকে ভ্রুণ অবস্থায় বিনষ্ট করতে বসন্তকে বাধ্য করা উচিত ছিল তার। এ পাপ যে এমন হবে, সে তো জানা কথা। ওই চৌধুরীদের এবং বসন্তের রক্ত তার দেহে, তার রঙের নেশা এমনই হবে যে! করালীর নেশায় পাগল হয়েছে পাপ পাখী। সেই নেশায় অন্যায়কে ন্যায়, ন্যায়কে অন্যায় দেখছে বজ্জাত বেজাত।

পাখী হঠাৎ ফোঁস করে উঠল-হারামজাদী, আমার শরীলে লয় চৌধুরীদের অক্ত আছে, তাতেই না হয় আমার নেশা বেশি। কিন্তু তোর প্যাটের মেয়ের নেশা কেনে আজও ছাড়ল না শুনি? বলি, তোর বসন্তের শরীরে কার অক্ত আছে তা বল? শুনি।

পাখীর চিৎকারে ঠিক মাথার উপরে আকাশে উড়ন্ত চিলটাও বোধ করি চমকে উঠল, অন্তত তাই মনে হল। ঠিক মাথার উপরে যে চিলটা স্থির পাখা মেলে ভেসে চলেছিল বলে মনে হচ্ছিল, সেটা এই মুহূর্তেই সজোরে পাখা আন্দোলিত করে দ্রুততর বেগে অতিক্রম করে গেল স্থানটা। সুচাঁদের কানেও একটি কথা অস্পষ্ট রইল না। সুচাঁদ স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর এদিক-ওদিক চেয়ে কিছু যেন খুঁজতে লাগল।

পাখী বললে—আমি জানি না তোমার বেবরণ, লয়? তুমি নিজে মুখে আমাকে বল নাই তোমার অঙের কথা?

সুচাঁদ ছুটে গিয়ে নিতেলে পানুর নিমতলা থেকে একগাছা বঁটা হাতে নিয়ে ছুটে এল।–তোর বিষ ঝেড়ে দোব আমি আজ।

পাখী ছুটে গিয়ে নিয়ে এল মস্ত লম্বা একখানা বাঁশের লাঠি। আয়, তু আয়। দেখি আমি তোকে।

হঠাৎ এই সময় এসে পড়ল বনওয়ারী। চিৎকার বেড়ে গেল সুচাঁদের। পাখী চিৎকার বন্ধ করে লাঠিখানা নিয়ে ঘরে ঢুকল। ব্যাপারটা হাঁসুলীর বাঁকে বাঁশবাঁদির কাহারপাড়ার অতি সাধারণ ব্যাপার। এমনিই এখানকার ধারা—এমনিভাবেই কলহ বাধে, এমনিভাবেই মেটে। দপ করে আগুনের মত যেমন জ্বলে উঠেছিল, তেমনই খপ করে নিবে গেল। বনওয়ারী এলে এমনিভাবেই ঝগড়া থামে।

বনওয়ারীর মুখ গম্ভীর। তার ভাবে ভঙ্গিতে একটি সম্পূর্ণ ব্যস্ততা, সে বললে—চুপ, সব চুপ।

সুচাঁদ চিৎকার করে উঠল আবারওরে বাবা রে—

বনওয়ারী ঝুঁকে কানের কাছে চিৎকার করে বললে—শুনব ইয়ের পরে।

–ইয়ের পরে?

–হ্যাঁ। মাইতো ঘোষ আসছেন সাপ দেখতে।

—কে আসছে?

জাঙলের মাইতো ঘোষ। আমার মনিব।

বুড়িও সন্ত্রস্ত হল। সকলে উদ্‌গ্রীব হয়ে জাঙলের পথের দিকে চেয়ে রইল। পানু পিছন থেকে হাঁকলে–সর, সর, সরে যাও। পথ দাও।

দু ফাঁক হয়ে গেল জনতা। জাঙলের ঘোষ এসে দাঁড়ালেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *