হাঙর

হাঙর

০১.

দ্য শার্কে একটি হামলা

বিকেলটা বেশ চমৎকার ছিল। সমুদ্রের লম্বা বিচে অজস্র লোক ভিড় করেছিল আজ। কদিন থেকে যা বৃষ্টি হচ্ছিল, তাতে কোনও ভ্রমণবিলাসী ঘর থেকে বেরোতে পারেনি। হঠাৎ আজ কিছুক্ষণের জন্য একটা বিকেল প্রচুল গোলাপি রোদ্দুর ছড়িয়ে খুশি করতে চাইল লোকগুলোকে। যারা বাইরে থেকে এসেছিল, প্রায় সকলেই চলে যাবার জন্যে তৈরি ছিল। কারণ বর্ষার মরসুম সত্যি সত্যি এসে গেছে এতদিনে। ভ্রমণ আর জমবার কথা নয়। কিন্তু যাবার আগের হঠাৎ পাওয়া এই সুন্দর উপহার–একটা শান্ত রোদ্দুরের বিকেল সবাই নিবিড়ভাবে ভোগ করতে চেয়েছিল। আর সমুদ্রকেও দেখাচ্ছিল প্রাচীন ব্রাহ্মণের মতো, ঢেউ-এর ফেনায় যার সাদা উত্তরীয় এবং উপবীত ঝকমক করে উঠছে ঐশ্বরিক পবিত্রতায়।

ধর্মভীরু মানুষেরা রোদ মিলিয়ে যেতে যেতে শেষবার সমুদ্র-প্রণাম সেরে নিল। দুর্বলেরা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে নুলিয়ার সাহায্যে স্নান থেকে স্বাস্থ্য নিয়ে এল। আর যারা চেয়েছিল শুধুমাত্র সৌন্দর্য, তারা বালির ওপর চেয়ারগুলোতে বসে সমুদ্রকে গিলে ফেলার ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর আস্তে আস্তে ফিরে গেল। কিছু লোক এসেছিল শিশুসুলভ বিস্ময় নিয়ে, তারাও ক্লান্ত হয়ে কেউ কেউ। ডেরায় ফিরল।

সংখ্যায় ওইসব লোকই ছিল বেশি, কোনও উদ্দেশ্য ছাড়া যারা কোনওখানে পা বাড়াতে রাজি নয়। বাদবাকি সব নিষ্কমা ও বৈহিসেবীর দল–তাদের কাছে সমুদ্র বা পাহাড় অরণ্য, অথবা কোনও প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনের বস্তুত আলাদা মূল্য নেই, আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। তারা উদ্দেশ্যহীন। তারা জানে, বছরের কোন কোন সময় কোথাও যেতে হয়। তাই তারা যায় এবং ঘুরে আসে। হয়তো ঘর তাদের সময় বিশেষে চার দেয়াল থেকে চারটে, সিলিং ও মেঝে থেকে দুটো–মোটা ছটা দাঁত বের করে বলেই দরজা গলিয়ে পালায় কোথাও। তারা এই সমুদ্রতীরে এসে ঘুরতে হয় বলেই ঘুরেছে। হল্লা করা উচিত বলেই হল্লা করেছে। এবং কেউ কেউ শুনেছিল, বিচে বসে প্রকাশ্যে মদ্যপান করায় প্রচুর স্যাডিজম আছে, তারা তাই করল বটে কিন্তু সুখ কী টের পেল, বলা কঠিন। যেমন, শেষ মরসুমের সেরা আকর্ষণ তিনটি মেয়ে আর দুটি ছেলের দলটা। তাদের কেউ কেউ তো হড়হড় করে বমি করেই ফেলল। তারপর তারা বিধ্বস্ত ফুসফুস আর অস্পষ্ট চোখে সমুদ্রকে দেখেছে প্রচণ্ড ক্লান্তির প্রতীক–একঘেয়েমির যান্ত্রিক বিক্ষোভ।

দ্বিতীয় নমুনা, আর একটি পঞ্চরত্নের দল। তারা সঙ্গিনীছাড়া তরুণ। বেলেল্লামি করা তাদের পক্ষে অনিবার্য হয়ে পড়েছিল–যেহেতু তাদের সঙ্গে কোনও মেয়ে নেই। তারা সমুদ্রকে আলাদা করে দেখেনি, বিচের নরমতা থেকে হাঁটার আনন্দ পায়নি, হঠাৎ এই খোলা বিকেলটার ভালবাসা টের পায়নি তারা কেবল বিশাল জালার গায়ে কয়েকটি পিঁপড়ের মতো ঘুরঘুর করছে এবং কুট কুট করে কামড়াতে চেয়েছে। বিস্তর মানুষকে তারা বিরক্ত করেছে। তারপর তিনটি মেয়ে ও দুটি ছেলের দলটাকে দেখতে পেয়ে শেষঅব্দি খানিকটা ঘুমো-ঘুষিও করেছে। পুলিশ দৌড়ে না এলে সে একটা দৃশ্য হত বটে! যেন বর্তমান সভ্যতাজোড়া স্যাডিজমের ঢেউ বিকেলের সমুদ্রতীরে বারবার হানা দিচ্ছিল।

তৃতীয় নমুনা, স্ন্যাকস-গারারা ইত্যাদি পোশাকপরা চারটি মেয়ে। সম্ভবত তারা এখানে এসেই প্রথম সিগারেট খেতে চেয়েছিল। চারজনের হালকা আঙুলে চারটে সিগারেট, বিচের চেয়ারে বসা সৌন্দর্যলিঙ্গু বুড়োমানুষটিকে বলেছে, দাদু, দেশলাই দিতে পারেন? বিস্ময়ের কথা, তিনি মৃদু হেসে এবং সপ্রতিভ আধুনিকতায় লাইটার এগিয়ে দিয়েছেন। তখন তারা দেখেছে, লোকটার হাতে জ্বলন্ত চুরুট রয়েছে এবং তাঁর পোশাক দস্তুরমতো বিলিতি। অমনি ধন্যবাদ বলে হাসতে হাসতে সরে গেছে তারা। কিন্তু দ্বিতীয় জায়গায় আরেক নিঃসঙ্গ বুড়োকে বেছে দেশলাই চাইলে তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলো। ভদ্রলোক মুখটা গম্ভীর করে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, নেই।তারা হেসে উঠল। এ বুড়োকে শায়েস্তা করা হয়েছে ভেবে অনেক খুঁজে আরেক বুড়োকে বের করল। ইনি কিন্তু মুচকি হেসে বললেন–দেশলাই কী হবে লক্ষ্মীমায়েরা?

সিগারেট খাবো।

মেয়েরা সিগারেট খায় নাকি? বলে পরক্ষণে মাথা দুলিয়েছেন।…হা ভুল। হচ্ছে। খায় বটে। আমাদের শহরে মনিসিপ্যালিটির ঝাড়ুদারনীরা খায় বটে। তা লক্ষ্মীমায়েরা, তোমরা কোন মুনিসিপ্যালিটিতে কাজকম্মো করো, শুনি?

পাল্টা চোট খেয়ে ওরা চটে গেল।..বুড়ো হয়েছে, ভদ্রতা করে কথা বলতে জানেন না? যত সব সেকেলে ভূত! গেঁয়ো রাবিশ! কবে যে এগুলো যাবে সব!

এবং পরে কয়েক মিনিট শিক্ষাসভ্যতা নারীধর্ম ইত্যাদি নিয়ে একতরফা বিতর্ক–তারপর হঠাৎ চারটি ফ্যাশানভূতগ্রস্ত মেয়ের পক্ষে সেই পাঁচটি সঙ্গিনীলিঙ্গু ছেলের যোগদান, দেশলাই জ্বেলে প্রত্যেকের ঠোঁটের সিগারেট ধরিয়ে দেওয়া–তারপর বুড়ো অভিমানী কম্পিত চোখে দেখলেন, নজনের দলটা নটা সিগারেটের ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে চলতে শুরু করেছে। বুড়ো সখেদে বললেন, একেই কি বলে সভ্যতা? এবং বুড়ো শালিকের মতো ঘাড়ে রোঁ নিয়ে এক দত্তকুলোদ্ভব কবির কথা ভাবতে লাগলেন।

হ্যাঁ, অভাবিত বিকেলের সমুদ্রতটে হয়তো এসব ঘটনা ও দৃশ্যও সমুদ্রচাঞ্চল্যের অন্তর্গত। তারপর কিন্তু প্রকৃতি তেমনি বিস্ময়কর তৎপরতার সঙ্গে গুটিয়ে ফেলল ঝিলমিল গোলাপি রঙের পটচিত্র! সূর্য ডুবে যেতে-না-যেতে হু হু করে সমুদ্র থেকে উঠে এল চমরী গাইয়ের মতো মেঘ। এবং তারপর আবার শুরু হলো তুলকালাম বৃষ্টি। দেখতে দেখতে ফাঁকা হয়ে গেল বিচ। নুলিয়ারা ডাঙ্গার নৌকোর তলায় গুটিসুটি ঢুকে গেল। ফেরিওয়ালারা জিনিসপত্র গুটিয়ে শস্যকণাবাহী পোকাদের মতো দৌড়ে পালাতে লাগল। বেলুনওয়ালাদের হলো সমস্যা। চারজন কাবুলিওয়ালাও গুলিখাওয়া বাঘের মতো সি-বিচের একটা হোটেলে ডিগবাজি খেয়ে ঢুকল। বুড়ো, কাচ্চাবাচ্চা আর মেয়েরা ভিজে জবুথবু হয়ে যে-যার আখড়ায় ঢুকতে বেশ দেরি করে ফেলল। কেবল মাস্তানটাইপ কিছু ছেলেমেয়েকে দফায় দফায় দেখা গেল কাকের মতো দিব্যি ভিজতে ভিজতে উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক-ওদিক চলেছে। নজনের দলটা একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে গেছে ইতিমধ্যে। পাঁচজনের দলটা হোটেলে ফিরেছে সবার আগে। বিলিতি পোশাকপরা বুড়ো রেনকোট চাপিয়ে দিব্যি ধীরে-সুস্থে সবার শেষে গেল। তারপর সমুদ্রের ধারে শুধু বৃষ্টি আর ধূসরতা ছাড়া কিছু নেই।

একটু পরেই খুব তাড়াতাড়ি রাত এসে গেল। বৃষ্টির মধ্যে কুয়াশার মতো অপরিচ্ছন্নতায় বিচের বাতিগুলো জ্বলে উঠল। দ্য শার্ক বা হাঙর নামে একটেরে ঝাউবনের ধারে যে নির্জন ছোট্ট বার কাম-রেস্তোরাঁ রয়েছে, সেখানে ভিড় কম ছিল। মদ্যপিপাসুরা আজ বিকেলে সমুদ্রের ধারে বসে সুখ চেয়েছিল। তাছাড়া, কেন যেন আজ জমেইনি এখানকার আসর। কাউন্টারের ভদ্রলোক এক মাদ্রাজী। তিনিই মালিক। বিকেলে ভালো আবহাওয়া পেয়ে মোহনপুর চলে গেছেন– বউয়ের অসুখ নাকি। তিনজন ওয়েটার, কিচেনে দুজন রাঁধুনি, দুটো কিশোর বয় এবং কাউন্টারে রোগা হাড়জিরজিরে একজন বাঙালী কর্মচারী।

এ রেস্তোরাঁয় যারা দৌড়ে ঢুকেছিল, সাতটা অব্দি কেউ কেউ বিয়ার খেয়ে ভিজতে ভিজতে কেটে পড়ল। একজন অবশ্য হুইস্কি খেয়েছে পেগ তিনেক। সেও দুলতে দুলতে চলে গেল। এক মধ্যবয়সী দম্পতি ছিলেন। তারা লাইম দিয়ে জিন খেলেন এক পেগ করে তারপর রেনকোট চড়িয়ে বেরোলেন। রাত আটটাতেও বৃষ্টি চলেছে সমানে। এবং ঘরে তখন কোণার টেবিলে কেবল দুটি মেয়ে বসে রয়েছে। একজন স্ন্যাকসপরা, অন্যজন বেলবটম। বাইশ থেকে চব্বিশের মধ্যে বয়স। একজন মোটাসোটা, একটু বেঁটে, খুব পাতলা ঠোঁট আর একবার ভাজা বেগনীর মতো সরু নাক, ছোট্ট কপাল–উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলা যায় এবং তার মাথায় ববছাঁট চুল–সে স্ন্যাকস পরেছে ক্রিমরঙা। গায়ে তাঁতের ফিকে হলুদ হাফ পাঞ্জাবি–তাতে বাটিকের কালো ছাপ, কবিজিতে চওড়া কালো বেল্টের মোটা ঘড়ি। তার পায়ে সরু দু ফিতের হালকা স্লিপার।

বেলবটপরা মেয়েটির গায়ে শুধু ধবধবে সাদা গলা-আঁটো হাফ স্পোর্টিং গেঞ্জি, তার বুকে ব্রেসিয়ার নেই, তা স্পষ্ট। তার মুখটা একটু লম্বাটে–গালের দিকটা ডিমালো, চিবুক তিনকোণা কিন্তু প্রশস্ত, বেমক্কা পুরু ঠোঁট ঠোঁটের কোণায় উদ্দেশ্যহীন হাসির আভাস আছে। তার ভোলা বলিষ্ঠ বাহু দুটো টর্চের নতুন ব্যাটারি থেকে উৎসারিত জোরাল দুটি আলোর মতো। তারও কবজিতে মোটা ঘড়ি এবং একই ব্যাণ্ড। তার পায়ে পেতলের চওড়া বকলেস দেওয়া চটি। তার গায়ের রঙ বেশ ফরসা। হঠাৎ দেখলে অবাঙালী মনে হতে পারে। তার কপাল অশোভন ভাবে চওড়া এবং ঘন কালো ভুরু পাপড়ি, ডাগর চোখ, কালো একরাশ চুল কাঁধ থেকে কয়েক ইঞ্চি নেমে গেছে। কীরকম পুরুষালি চেহারা যেন। হঠাৎ দেখলে কিম্পুরুষ মনে হয়।

হাফ-পেগ জিন নিয়ে তারা রাত আটটা অব্দি হাঙর-এর মধ্যে বসে রয়েছে। তার জন্য অবশ্য এই দুঃসময়ে হাঙরওয়ালাদের কোনও বিরক্তি নেই বরং উপভোগ্য দ্রব্য, এই ক্লান্তিকর বৃষ্টির রাতে দুটি উঁচুদরের যুবতী! তাদের শরীরে বিবিধ আয়োজন এবং ধনী গৃহস্থের বিয়েবাড়ির দরজার সামনে দিয়ে যাবার সময় নিম্নবিত্ত যেমন একবার তাকিয়ে দেখে যায়, তেমনি করে ঘুরঘুর করে যাচ্ছে। রাঁধুনি, ওয়েটারদ্বয়–এমন কি বয় দুজনও।

মেয়ে দুটি কি বৃষ্টির দরুন উদ্বিগ্ন? তা কিন্তু কারো মনে হচ্ছিল না। ডেরায় ফিরে যাবার কোনও তাড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছিল না তাদের মধ্যে। বরং যেন কী নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় সময় কাটানো আলস্যে বৃষ্টিকে উপভোগ করছিল। চাপা গলায় কথা বলছিল পরস্পর। এদিকে ক্রমশ রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যাবার নির্দিষ্ট সময় এগিয়ে আসছিল। আজ মালিক নেই, তুমুল বৃষ্টি আর নির্জনতা, তাই কাউন্টারের রোগা কর্মচারীটি হাই তুলে বারবার ঘড়ি দেখছিল। তার ইচ্ছে, নটার বেশি অপেক্ষা করা আজ অসম্ভব। মালিক আসবেন না। তাঁর স্কুটার না থেকে পুরোপুরি গাড়ি থাকলে অবশ্য অন্য কথা ছিল। তাই হঠাৎ দেখা গেল সে চাপা গলায় ওয়েটারদের কী সব বলে সাড়ে আটটাতেই অধৈর্য হয়ে বেরিয়ে গেল–দরজার কাছে ছাতা খুলল, তারপর বৃষ্টি ও কালো রাতের মধ্যে ডুব দিল।

তার পনের মিনিট পরে বেরোল দুজন ওয়েটার–আর তাদের ছাতার তলায় একজন করে ক্ষুদে বয়। আরও পাঁচটা মিনিট লম্বা পায়ে চলে গেল রাঁধুনি দুজনও একইভাবে বেরোল। তারা মেয়ে দুটোর দিকে একবার যথারীতি তাকিয়েও গেল।

এখন রইল শুধু সবচেয়ে শক্তিমান, লম্বাচওড়া গড়নের লোক তার নাম নব। নব হাঙরে রাতে একমাত্র পাহারাদার। বোঝা যায়, সেই মালিকের একমাত্র বিশ্বস্ত ও প্রশ্রয় পাওয়া কর্মী। কারণ ক্যাশবাক্সটা সে লম্বা মোটা হাতে অবহেলায় তুলে লোহার আলমারিতে ঢোকাল। চাবির গোছাটা উর্দির তলায় গাপ করল। তারপর ক্যাশ কাউন্টারে বসে মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে রইল। তার তাকানোর মধ্যে বিস্ময় বিরক্তি কিংবা প্রশ্নবোধক চিহ্ন নেই। বোঝা যায়, এই ধরনের জীবনে সে কোনও আকস্মিকতা আশা করে নাবস্তুত সব আকস্মিকতাই তার কাছে নিয়ম। এবং সেজন্যেই সে ফাঁক পেলেই বলে, এই হচ্ছে হাঙরের কানুন।

হ্যাঁ, যে-কোনও সময় কোনও আবেগবান, ভাবপ্রবণ কিংবা খামখেয়ালী খদ্দের এসে হানা দিতে পারে। দেয়ও। রাত বারোটা অব্দি তাই খুলে রাখার নিয়ম আছে দ্য শার্কের দরজা। অনেক সময় এসে পড়তে পারেন পুলিশ অফিসারদেরও কেউ। বঙ্গোপসাগরের উত্তর পশ্চিম তীরবর্তী এই উপনগরীটিতে প্রচুর রহস্যময় ঘটনা ঘটে থাকে। অনেকে জানে, নব পুলিশের একজন টাউট। এবং পুলিশ সচরাচর গভীর রাতেই আসে এখানে।

রাত নটা বাজলে এতক্ষণে মেয়ে দুটি আরও দুট হাফ-জিনের অর্ডার দিল। নব অর্ডার সার্ভ করে ফের কাউন্টারে মাছের চোখ নিয়ে বসল। বাইরে বৃষ্টির শব্দ তখনও শোনা যাচ্ছে। সমুদ্রের গর্জন কাঁপয়ে দিচ্ছে মানুষের সচেতন ইন্দ্রিয়গুলোকে। এই উপকুলে এমনিতেই সমুদ্র খুব রাফ যাকে বলে–তাতে এই দুর্যোগে তার ভয়ঙ্কর আওয়াজ অনভিজ্ঞদের অস্বস্তিতে অস্থির করে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, ঠিক দরজার সামনে ঢেউ এসে ভেঙে গেল। তিনজনের কেউ তাকিয়ে দেখে না।…

.

একটু পরেই দরজার বাইরে একটা ভিজে মানুষের মূর্তি দেখা গেল। দরজায় এসে দুটো হাত দুদিকে রেখে মাথা গলিয়ে দিল সে। মেয়ে দুটি অমনি অস্ফুট চেঁচিয়ে উঠল। বড়বড় চোখে তাকাল তার দিকে। দুজোড়া চোখে প্রচণ্ড আতঙ্ক ম্লান আলোয় ঝলমল করে উঠল।

নবও নড়ে উঠেছিল। সে সিংহের মতো গ্রীবা ঘুরিয়ে দেখছিল আগন্তুককে।

কারণ, আগন্তুকের মুখে একটা কালো মুখোশ।..

 সে এক লাফে ভিতরে এসে গেল। পরক্ষণে তার হাতে ঝলসে উঠল একটা ছোরা। অমনি স্ন্যাকসপরা মেয়েটি জন্তুর মতো অব্যক্ত একটা আর্তনাদ করে কোণের দিকে ছিটকে গেল। অসমাপ্ত গ্লাসগুলো উল্টে ঝনঝন শব্দে নিচে পড়ে ভাঙল। বেলবটমপরা মেয়েটি যেন হতবুদ্ধি হয়ে বসেছিল। আততায়ী ছোরাটা নিয়ে এক পা এগোতেই সে মুখে আঙুল পুরে গোঁ গোঁ করে উঠলতারপর কাউন্টারের দিকে দৌড়ে যেতে চেষ্টা করল। কিন্তু তার সামনে আততায়ী-তাই কিচেনের দরজার দিকে এগোল।

তাও পারল না। আততায়ী এক লাফে সেদিকে এগোলে মেয়েটি কোণে তার সঙ্গিনীর কাছে চলে গেল। দুজনেই ভীষণ কাঁপছিল।

বড়জোর কয়েকটা সেকেণ্ডের মধ্যে এগুলো ঘটল।

তখন দেখা গেল নব আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াচ্ছে। তার মুখে সংশয়। প্রস্তুতির অভাব তখনও স্পষ্ট। আগন্তুকের হাতে ছোরা রয়েছে।

দ্য শার্কের সাত বছরের জীবনে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। মারামারি বিস্তর হয়েছে কিন্তু হঠাৎ এমন দুর্যোগের রাতে নির্জন পরিবেশে মুখোশপরা কোনও লোক ছোরা হাতে ঢোকেনি। নব তাই হয়তো হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল।

আট-দশ সেকেণ্ডের মধ্যে পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। আততায়ী ছোরাটা তুলে জড়সড় বোবায়ধরা মেয়ে দুটির দিকে এগোতেই বেলবটমপরা ফরসা মেয়েটি ছিটকে সদর দরজার কাছে চলে গেছে এবং তারপর তাকে বাইরে অদৃশ্য হতে দেখা গেল।

তারপর ভয়ঙ্কর কানামাছি খেলা চলল স্ন্যাকসপরা বেঁটে মেয়েটি ও আততায়ীর মধ্যে। মেয়েটি বোবায়ধরা গলায় গোঁ গোঁ করতে করতে এদিক-ওদিক লাফ দিচ্ছে। টেবিল-চেয়ার ইত্যাদি লণ্ডভণ্ড হচ্ছে। নব সেইসময় একহাতে চেয়ার তুলে অন্যহাতে একটা বড় বোতল তাক করল। সে খুব অবহেলায় ব্যাপারটা দেখছিল।

আর সেই মুহূর্তেই দ্বিতীয় মেয়েটিও ছিটকে সদর দরজা গলিয়ে বেরিয়ে পড়ল এবং অদৃশ্য হলো। নবর বোতলটা লাগল দরজার পাশে। প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে গেল। আততায়ী তখন দরজায়। পরক্ষণে নব দ্রুত একটা সোডার বোতল তুলে। মারল। বোতলটা বাইরে বৃষ্টির মধ্যে মোটাসোটা বাচ্চার মত ধপ্ করে পড়ল মাত্ৰ-ফাটল না। লন মতো আছে ওখানটায়-ঘাস আর ফুলের গাছ রয়েছে। ঘাস আর ফুলের গাছের মধ্যে বেহেড মাতালের মতো ঘাড় গুঁজে পড়ে রইল বোতলটা।

তখন নব দুহাতে চোখ মুছল। মঞ্চে কেউ নেই।

দুঃস্বপ্ন দেখছিল না তো?

.

মোটেও না। রেস্তোরাঁর ভিতর জলজ্যান্ত ওল্টানো টেবিল-চেয়ার, ভাঙা কাচের গ্লাসগুলো, ছত্রাকার ছাইদানি ইত্যাদি-মেঝের কারপেট ভিজে গেছে ইতস্তত, একটা বোতল থেকে তখনও বগবগ করে জল পড়ছে। দরজার কাছে অজস্র কাচের .. টুকরো। একদিকের পর্দা ছিঁড়ে বেমক্কা ঝুলছে।

নব প্রথমে এক লাফে দরজায় এসে বাইরে তাকাল। কেউ কোথাও নেই। বাতিগুলি বৃষ্টির ঝাপটায় ম্লান-বিচের দিকে যেন কুয়াশার পর্দা ঝুলছে। ডাইনে বাঁয়ে উপকূলের সমান্তরাল অপ্রশস্ত রাস্তা নির্জন। ফুলগাছ কিংবা অন্যান্য সব বড় গাছগুলো বৃষ্টির মধ্যে ছটফট করছে, যেন পায়ে বাঁধা সব জন্তু-জানোয়ার।

সে দরজা ভাল করে এঁটে দিল। ডানপাশের কোনও বাড়ি বলতে বালিয়াড়িটার পিছনে কোস্টের সবচেয়ে কস্টলি হোটেল সী ভিউ। অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ হেঁটে যেতে হয় এখান থেকে। বাঁ পাশে একটা লম্বা ঝাউবন পেরিয়ে অন্তত একশো গজ দূরত্বে এক ধনী মানুষের বাংলোবাড়ি। পিছনে দেড়শো গজ পোভড়া জায়গায় কাটাতারের বেড়া এবং সরকারের লোহালক্কড়ের পাহাড়, তার পিছনে ত্রিশ গজ দূরে অবজারভেটরি। তারপর বড় রাস্তা এবং ছড়ানো-ছিটানো বসতি এলাকা, বাজার এবং সরকারী কোয়ার্টার। তারও পিছনে সরকার-লালিত অরণ্য অঞ্চল এবং কয়েকটি টিলা বা হিলক-শ্রেণীর ক্ষুদে পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় কোথাও বাংলো, কোথাও আশ্রম আর মন্দির রয়েছে।

এই ভূগোল ও প্রকৃতি-পরিবেশ ঝটপট মনে ভাসল নবর। সে খুব ক্লান্ত বোধ করল। বৃষ্টি ছাড়বার কোনও লক্ষণ নেই। সমুদ্র গর্জাচ্ছে। কোনও পুলিশ অফিসারও তো আজ আসছে না এমন রাতে! হাঙরে কোনও ফোন নেই। বড়ো হোটেলগুলোয় আছে। কিন্তু বাইরে বেরোনো অসম্ভব।

মেয়ে দুটি গতকাল সন্ধ্যায় এসেছিল হাঙরে। হাফ-পেগ জিন নিয়ে দুঘন্টা কাটিয়ে গিয়েছিল। কেমন গম্ভীর টাইপ মেয়ে যেন কম কথা বলে। কলকাতা থেকে এসেছে, সেটা বোঝাই যায়। কোথায় উঠেছে ওরা? আর, আচমকা ওই মূর্তির উদয় হলো, তাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল…কোনও মানে হয় না। এ একটা স্বপ্নই!

একটু পরে সে সিগারেট ধরাল। তারপর ধীরে সুস্থে ঘরটা সামলাতে ব্যস্ত হলো। কাচের টুকরোগুলো কুড়িয়ে টেবিলে রাখল। তারপর মেয়ে দুটি যেখানে বসেছিল, সেখানে গেল। চেয়ারগুলো ঠিকঠাক করার সময় হঠাৎ তার চোখে পড়ল কিছু কাগজের টুকরো পড়ে রয়েছে কুচিকুচি এবং দলা পাকানো। দলা পাকানো কাগজটা সে অকারণ অন্যমনস্কতায় খুলল। একটা বড় কাগজের অংশ–কিন্তু ছাপানো নয়, হাতের লেখা। সে আদৌ লেখপড়া জানে না।

নবর মনে পড়ল, এই কাগজটা বেঁটে মেয়েটির হাত থেকে নিয়ে ফরসা মেয়েটি পড়ছিল বটে। দ্বিতীয়বার সার্ভ করার সময় নব দেখেছিল, বেঁটে মেয়েটি কোলে হাত দুটো রেখেছে এবং আনমনে একটা কাগজ কুটিকুটি করেছে।

কাগজগুলো সে ফেলল না। পকেটে রাখল। নব পুলিশের ইনফরমার। তার কী করা উচিত, সে জানে।…

.

০২.

ট্রাকটারের তিন মিটার দূরে

এ অঞ্চলের মাটির জলশোষণ ক্ষমতা বেশি বলে যত বৃষ্টি হোক কাদা খুব কমই হয়। মাটিতে বালির ভাগ স্বভাবত বেশি। একসময় ফসল ফলানোর কথা ভাবাই যেত না। গত দশ বারো বছরে সরকারী যোজর কল্যাণে কোথাও-কোথাও চাষবাস লক্ষ করা যাচ্ছে। দুতিনটে আধুনিক ধাঁচের মেকানাইজড কৃষি-খামারও গড়ে উঠেছে। চন্দনপুর-অন-সীর বুকের কাছে পানিগ্রাহী এগ্রিকালচারাল ফার্ম। একটা টিলার নিচে ঊনিশ একর বেড়াঘেরা অসমতল জমি নিয়ে ফার্ম। ভুট্টা, বজরা আর মরশুমে অল্পস্বল্প বিদেশী ধান ফলে। তবে বেশিটাই গোলাপ ফুলের চাষ।  এইটাই মুখ্য।

পানিগ্রাহীরা একসময় বড় জমিদার ছিলেন। এখন বংশের একমাত্র পিদীম মদনমোহন সব জোতজমা খুইয়ে ওই ফার্মে এসে ঠেকেছেন। তবে ফার্মটা নিছক সৌখিনতা বলেই মনে হয়। ফুলের রানী গোলাপসুন্দরী। কাজেই লোকে পয়সা বা লাভালাভ দেখে না, দেখে সৌখিনতা। ফার্মের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে কিছুক্ষণের জন্য জীবনের কদর্যতা বলে কিছু আছে, তা মনে পড়ে না। তবে কেউ বিশ্বাস করে না যে ওই ফুল থেকে মদনমোহনের একেকটা ইলেকশানের সব খরচ ওঠে। হ্যাঁ, মদমমোহন পাণিগ্রাহী রাজনীতি করেন। হেরে ভুট হন, তবু ভোটে দাঁড়ান।

খামারে অবশ্য তিনি খুবই কম থাকেন। দিন পনের আগে মদনমোহন যথারীতি ফার্মে এসেছিলেন, চলেও যান এবং বলে যান, জনৈক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গে সুইডেন যাবেন। ফিরবেন ঊনিশে জুলাই। ফার্মে যদি আসেন, তো বাইশ-চব্বিশ তারিখ। আজ তেইশে জুলাই। এখন ভোর পাঁচটা। গত রাতের তুমুল বৃষ্টির বিশেষ কোনও চিহ্ন কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু খানাখন্দে কোথাও কিছু ঘঘালাটে জল আর মসৃণ কাদা থকথক করছে। তবে সমুদ্রের গর্জন বেড়েছে। বাতাস বইছে খরতর– পুবের বাতাস। টিলা ও দুরের বালিয়াড়ির ঝাউবন একটানা শনশন শব্দ করছে। সমুদ্ৰশকুনের ডানার মতো ধূসর আলোয় ক্রমশ জেগে উঠছে ভাটার চরের মতো চন্দনপুর-অন-সী। গোপালকিশোর পানিগ্রাহী ফার্মের গেটের পাশে তার ছোট্ট ঘরে জেগে বসে হাই তুলছিল।

টিনের মাঝারি সাইজের গুদামের লাগোয়া তার ঘর। পাশে একটা চালাতে কিছু কৃষি-যন্ত্রপাতি রয়েছে। সে ট্রাকটার চালায়। হার্ভেস্টার কম্বাইন তার জিম্মায়। গত একটি দিন পাণিগ্রাহীসায়েবের আশায় সে কাটিয়েছে। গোলাপক্ষেতে কী দুয়ে মড়ক লেগেছে। কিছু করা যাচ্ছে না। কর্তা ছাড়া এ কর্ম হবার নয়। মিঃ পাণিগ্রাহী এসব ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। সে উদ্বিগ্ন হয়ে তার পথ চেয়ে বসে রয়েছে।

গোপালকিশোর সিগারেট ধরাল। তারপর চটিটা পায়ে গলিয়ে বাইরে এল। আকাশ দেখল। সমুদ্রের দিকে দিগন্তে কিছু খয়েরি রঙের চাপ চাপ মেঘ রয়েছে। বাকি আকাশ পরিষ্কার। সামনে ক্ষেতের দিকে তাকাল সে। যে নএকর সমতল জমিটার চারদিকে আল রয়েছে, সেখানে ধানের চাষ হয়। ইতিমধ্যে দুবার হাল্কা ডিস্ক হ্যাঁরো বা তিন নম্বর লাঙলে চাষ পড়েছে। কিন্তু গত রাতের বৃষ্টিতে একটুও জল দাঁড়ায়নি। অজস্র ঘাস আর আগাছায় জঙ্গল হয়ে উঠেছে। বর্ষার রস পেয়ে উদ্ভিদজগত এখন বেপরোয়া। গোপালকিশোর একটু ভাবনায় পড়ল। কর্তা আসবার আগেই ওই আগাছা চাবড়াসুদ্ধ উল্টে ফেলা উচিত। পরের বৃষ্টিতে সেগুলো পচে স্বাভাবিক সারের কাজ করবে এবং জলও দাঁড়াবে।

খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল সে। ঘড়ি দেখল। এখন সওয়া পাঁচটা। মিঃ পাণিগ্রাহী আসবেনই কথামতো। কিন্তু তিনি ঘুম থেকে দেরিতে ওঠেন বরাবর। ভুবনেশ্বর থেকে রওনা দিলে সে বেলা নটার আগে নয়। অতএব গোপালকিশোর দৌড়ে গিয়ে চালাটায় ঢুকল। গেটের তালা খুলে কাঠের ফ্রেমটা সরাল। ট্রাকটারের পিছনে দুনম্বর হ্যাঁরো জুড়ল। তারপর স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে এল। সেই নিঃঝুম ধূসর, ভোরকে ট্রা-রা রা রা আওয়াজে উচ্চকিত করে তুলল সে।

উঁচু জায়গা থেকে নিচের ক্ষেতে ট্রাকটারটা পৌঁছলে গোপালকিশোর হাতলে চাপ দিয়ে পিছনের হ্যাঁরোর সার নামিয়ে দিল। চ্যাপ্টা এক সার দাঁত নরম বেলেমাটিতে বসে গেল। ঘাসগুলো কোথাও প্রায় এক ফুট থেকে দেড় ফুট উঁচু হয়ে উঠেছে। কোথাও ধনচে গাছ (ভালো সার হয়) ঝোপের মতো জাঁকিয়ে উঠেছে। গোপালকিশোর দেখল, একটা সাপ পড়ি কী-মরি করে পালাচ্ছে। তার একটা বদ্ধমূল সংস্কার আছে ছেলেবেলা থেকে। সাতসকালে প্রাতঃকৃত্যের আগে সাপ দেখে ফেললে প্রচণ্ড অমঙ্গল হয়।

মুহূর্তের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে স্টিয়ারিং ছেড়ে প্রণাম করল সে। সামনে ধনচে ঝাড়ের মধ্যে সাপটা অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর সাপটাকে খুঁজে বের করবার উদ্দেশ্যেই সে তাকাল আরও সামনের দিকে। সেই সময় তার চোখে পড়ল, জমির শেষপ্রান্তে আলের কাছে কী একটা বড়সড় পড়ে রয়েছে। প্রথমে ভাবল কাঠের গুঁড়ি, পরে মনে হলো রঙিন কিছু একটা কাপড়চোপড়ের মতো, এবং খানিকটা কালো। ঘাস ও আগাছার মধ্যে ডুবে থাকায় ত্রিশ-বত্রিশ মিটার দূর থেকে ঠিক বোঝা কঠিন। নাকি কোনও শেয়াল? উঁহু-শেয়াল অতটা জায়গা জুড়ে থাকতে পারে না। তাছাড়া শেয়াল হলে এতক্ষণ লেজ গুটিয়ে পালাত। তাহলে কি কারও গরু রাতে বেড়া গলিয়ে এসে পড়েছিল–উঁচু আল থেকে পড়ে ঠ্যাঙ ভেঙেছে?

দেখতে দেখতে ট্রাকটারটা আরও দশ মিটার এগিয়ে গেল। তখনও জিনিসটা কী বুঝতে পারছে না গোপালকিশোর। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তার। আরও পাঁচ মিটার..আরও দুই…আরও দুই…ফের দুই…একেবারে জিনিসটার সামনে সজোরে ব্রেক কষল সে। তার মুখ সাদা হয়ে গেল। কয়েকমুহূর্ত পাথরের মূর্তির মতো স্টিয়ারিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল গোপালকিশোর।

তারপর সংবিত ফিরে পেল। চকিত চোখে চারদিক দেখে নিল। কেউ কোথাও নেই।

সে লাফ দিয়ে নামল ট্রাকটার থেকে।

তার উল্টোদিকে কাত হয়ে পড়ে রয়েছে একটি মেয়ে। ববছাট চুলগুলো ঘাস ও কাদায় মাখামাখি, হলুদ ঢিলে পাঞ্জাবির ওপর কালচে জংলা নকশা আর চাপ চাপ রক্ত। পরনে ক্রিমরঙা আঁটো স্ন্যাকস। এক পায়ে দুফিতের স্লিপার রয়েছে, অন্য পা খালি–স্লিপারটা ছিটকে একপাশে পড়ে রয়েছে। ঠিক ঘুমোবার ভঙ্গিতে পড়ে রয়েছে মেয়েটি।

যাই হোক, পিঠে রক্ত ও ক্ষতচিহ্ন দিয়ে জংলা ক্ষেতে কোনও মেয়ের ঘুমোতে আসা খুব সহজ ব্যাপার নয়। গোপালকিশোরের শরীর থরথর করে কাঁপছিল। মেয়েটির মুখ ঘাসের মধ্যে কাত হয়ে ডুবে রয়েছে। বৃষ্টিতে ভেজার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে আপাতদৃষ্টে। গোপালকিশোর বিভ্রান্ত হয়ে দৌড়তে থাকল হঠাৎ।

সেই ভোরে চন্দনপুর-অনসীর নির্জন রাস্তায় বোবায় ধরা মানুষের মতো গো গোঁ করে তাকে দৌড়তে দেখলে পাগল বলেই মনে হতো। অবশ্য এখানে পাগল কদাচিৎ দেখা যায়।

গোপালকিশোর ড্রাইভার মানুষ। কিন্তু জীবনে একবারও অ্যাকসিডেন্ট না করার রেকর্ড তার আছে। কোনও খুনখারাবিও তার বেয়াল্লিশ বছরের জীবনে চাক্ষুষ করেনি। সরল, অমায়িক, সাবধানী আর হিসেবী বলে তার সুনাম আছে। আজ সকালে এই প্রথম তারই ট্রাকটারের তিন মিটার দূরে একটি রক্তাক্ত লাশ সে আচমকা আবিষ্কার করেছে এবং তার জন্যে সেই বদমাশ সাপটাই নির্ঘাৎ দায়ী।

সে উদভ্রান্তভাবে বিড়বিড় করছিল, আমি চাপা দিইনি! আমার কোনও দোষ নেই, স্যার!

কোথায় যাচ্ছিল, তার খেয়াল নেই। পীচঢালা সরু পরিচ্ছন্ন রাস্তা ধরে সে দৌড়চ্ছিল। বিড়বিড় করছিল, আমি চাপা দিইনি…আমি চাপা দিইনি…

.

০৩.

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার

সামরিক দফতরের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার কর্নেল নীলাদ্রি সরকার চন্দনপুর-অন সী-তে প্রতি বর্ষায় কিছুদিন এসে কাটিয়ে যান। এখানে তার বন্ধু ডাক্তার সীতানাথ পট্টনায়কের একটি বাড়ি রয়েছে। সেখানেই তিনি উঠেছেন। ডাঃ পট্টনায়ক ভুবনেশ্বরের লোক। মাঝেমাঝে তিনি সস্ত্রীক এ বাড়িতে এসে থাকেন। তার হালকা সবুজ একটি ল্যাণ্ডমাস্টার গাড়ি রয়েছে। এবার তার স্ত্রী মালবিকা আর মেয়ে কল্যাণীও এসেছে সঙ্গে। কর্নেল এসেছেন পরে।

খুব ভোরে উঠে একবার সমুদ্রতীরে বেড়িয়ে আসা কর্নেল সরকারের অভ্যাস। ষাট পেরিয়েছে বয়স। চুল-দাড়ি সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু ভিতরে যৌবনের প্রাণপ্রাচুর্য উদ্দাম।

আজ ভোরে কী খেয়াল হলো, কর্নেল সমুদ্রের দিকে গেলেন না। অবজারভেটরির কাছে এসে ডাইনে উত্তরের পথে চললেন। একপাশে বালিয়াড়ি, অন্যপাশে ছড়ানো-ছিটানো কিছু সুন্দর বাড়ি। চন্দনপুর-অনসী বড়লোকের জায়গা। তাই সাধারণ মানুষের কোনও জমজমাট বসতি গড়ে ওঠেনি। চারদিক ফাঁকা, খোলামেলা। কর্নেলের ইচ্ছে হলো, আজ আকাশ যখন পরিষ্কার–তখন টিলায় উঠে সূর্যোদয় দেখবেন। তিনি টিলার দিকে আস্তে আস্তে হাঁটছিলেন। সূর্য উঠতে এখনও আধঘন্টা দেরি আছে। টিলায় পৌঁছতে দশ মিনিট লাগবে মাত্র।

কাল রাত্রে পট্টনায়ক পরিবারের সঙ্গে খেতে বসে সভ্যতা ও সরলতার প্রসঙ্গ উঠেছিল। সেই কথাগুলো এখন মাথায় এল কর্নেলের। সরলতা! এখনও ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় অনেক মানবগোষ্ঠীর মধ্যে এটা টিকে রয়েছে। ঈশ্বর সরলতাকে রক্ষা করুন সভ্যতার থাবা থেকে। আরবস্তুত এই চমৎকার নির্মেঘ ভোরে আকাশ ও পৃথিবী জুড়ে সরলতা বিরাজ করছিল।

মাথার ওপর কী একটা পাখি উড়ে গেলে কর্নেল তাকে দেখার চেষ্টা করলেন। বোঝা গেল না। বার্ডওয়াচিং তার অন্যতম হবি। ভুল হয়েছে, বাইনোকুলারটা আনেননি। পাখিটার ডাক শুনে মনে হলো, দুর্লভ জাতের সেই উড-ডাক। এ অঞ্চলে উড-ডাক নাকি মাঝে মাঝে দেখতে পাওয়া যায়। কর্নেল মুখ তুলে পাখিটার মিলিয়ে যাওয়া লক্ষ করছিলেন। হঠাৎ তার কানে এল ধুপ-ধুপ শব্দ। তিনি দেখলেন, একটা হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জিপরা লোক ধুকুর-ধুকুর দৌড়ে আসছে। তার কানে এল : আমি চাপা দিইনি..আমি চাপা দিইনি! পাগল নাকি? কর্নেল কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

চন্দনপুর-অন-সী-তে এই ভোরবেলায় পাগল দেখতে পাওয়া এক দুর্লভ ঘটনা বটে! কর্নেল ভাবলেন। কাছাকাছি অনেককালের পুরনো একটা উন্মাদ আশ্রম বা লুনাটিক অ্যাসাইলাম আছে। সেকারণে এখানে প্রবাদ রটে আসছে যে চন্দনপুর অন-সীতে পাগল দেখতে পাওয়া নাকি দুর্লভ ও পরমাশ্চর্য ঘটনা এবং পাগলরা ভাল হতে অর্থাৎ পাগলামি সারাতে চায় না। তাই প্রাণ গেলেও এ তল্লাটে পা বাড়ায় না। অবশ্য এর সত্য-মিথ্যা যাচাই করা মুশকিল। অন্তত কর্নেল বহুবার এখানে এসেছেন, কোনও পাগল দেখেননি।

লোকটা সামনা সামনি আসামাত্র কর্নেল চমকে উঠলেন। আরে! এই লোকটাকে তো পানিগ্রাহী ফার্মে ট্রাকটার চালাতে দেখেছেন!

গোপালকিশোর কর্নেলকে যেন এতক্ষণে দেখল। দেখার সঙ্গে সঙ্গে হাউ-মাউ করে উঠল–স্যার, স্যার! আমার কোনও দোষ নেই–ঠাকুরের দিব্যি, আমি সবে, ক্ষেতে নেমেছি–অমনি স্যার…

কর্নেল মুহূর্তে টের পেলেন লোকটা একটা মারাত্মক কিছু দেখে ভীষণ শক্ খেয়েছে। তিনি তার সামনে দাঁড়িয়ে শক্ থেরাপি প্রয়োগ করার মতলবে ধমক দিলেন, আলবত তোমার দোষ। তুমিই তো চাপা দিয়েছ! স্বচক্ষে দেখেছি?

অমনি গোপালকিশোর কর্নেলের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।…দোহাই স্যার, বাঁচান আমাকে! আমি খুন করিনি, আমি খুন করিনি!

কর্নেলের গায়ে পেশীগুলো শক্ত হয়ে গেল। খুন! মার্ডার! কী বলছে ও? দুহাতে ওর কাধ ধরে দাঁড় করালেন। তারপর এক মুহূর্ত ওর মুখটা দেখে নিয়ে সজোরে গালে এক চড় মারলেন। এই শক্ থেরাপি প্রয়োগ ছাড়া উপায় ছিল না।

চড় খেয়ে গোপালকিশোর কাঠ হয়ে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে তার মুখে স্বাভাবিকতা ফুটে উঠল। একটা বড় নিশ্বাস ফেলে মাথাটা দুপাশে দোলাল হতাশভাবে। তারপর বলল, স্যার কি পুলিশ অফিসার?…

.

কিছু পরে অবজারভেটরিতে গিয়ে থানায় ফোন করে কর্নেল গোপালকিশোরের সঙ্গে পানিগ্রাহী ফার্মের দিকে যেতে যেতে ভাবছিলেন, এই তাঁর বিধিলিপি বলা যায়। শয়তানের সঙ্গে পাঞ্জা কষতে কষতেই তাঁর অবসরভোগী জীবনটা কেটে যাবে মনে হচ্ছে। একদণ্ড ফুরসত পাবেন না। এক চিরকালের খুনী সবসময় সব জায়গায় এমনি করে তার সামনে ফেলে দিচ্ছে একটা করে লাশ, তাকে লেলিয়ে দিচ্ছে নিজের পিছনে–এ এক বিচিত্র লুকোচুরি খেলা! রহস্যময় অন্ধকারে সেই খুনীকে খুঁজে বের না করা অব্দি তার রেহাই নেই। মাথায় জেদ চড়ে যায়। যৌবনে যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে শত্রুর সঙ্গে এমনি মরণপণ হারজিতের লড়াই করতে হয়েছে। তাকে। সেই থেকে ওই জেদের জন্ম। কর্নেল মনে মনে বলছিলেন, না ঈশ্বরনা। তুমি আমাকে পাদরি ভেবো না। আমি তোমার প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত প্রফেটও নই তাদের পায়ের নখের যোগ্যও নই। তবু কী জানি, জীবনে এ এক দুর্মর প্যাসনের পাল্লায় আমি পড়েছি যা আমাকে অনবরত একটি শক্তির বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়েছে, যে শক্তি জীবনবিরোধী। সে মৃত্যুর চেলা। এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মধ্যে সহজাত শক্তি হিসেবে সে জন্মায়–তার নাম হননেচ্ছা, হিংসার বিষাক্ত পিণ্ডের মতো তার অবচেতনায় উপস্থিতি। সুযোগ পেলে অনুকূল অবস্থা ও আবহাওয়ায় সেই পিণ্ড ডিনামাইটের মতো ফাটে ও ধ্বংস করে। সে হিসেবে প্রতিটি মানুষের মধ্যেই এই হত্যাকারী রয়েছে। অস্তিত্বের অন্ধকার চোরকুঠুরি থেকে সে দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসে। তাই ডাঃ পট্টনায়কের মতো সজ্জন ভদ্র সুসভ্য মানুষকে। যদি দেখি–প্রিয়তমা স্ত্রী অথবা কন্যাকে হত্যা করে বসেছেন, বিস্মিত হবার– কিছু নেই।…

পরক্ষণে চমকে উঠলেন।…মাই গুডনেস! এ কী ভাবছি! হঠাৎ পট্টনায়কের কথাটা মাথায় এল কেন? এই আমি নীলাদ্রি সরকারও কি হননেচ্ছা থেকে মুক্ত? কে জানে! আমরা কোন মুহূর্তে কে কী করে ফেলব, তার কোনও গ্যারান্টি নেই। সত্যি নেই। এমন কি, যে বিচারক ভারতীয় দণ্ডবিধির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, যিনি খুনীকে ফাঁসি দেন–তিনিও কি সেই সনাতন প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত? উত্তরবঙ্গের সেই বিচারক ভদ্রলোকের কাহিনী সবাই জানে, যিনি স্ত্রী ও তিন মেয়েকে খুন করে বসলেন। ….

টিলার কাছাকাছি এসে বাঁদিকে পথ ঘুরল। সামনে পানিগ্রাহী ফার্ম দেখা গেল। টিলার পশ্চিমের ঢালু গা থেকে নেমে কিছু অসমতল এবং কিছু সমতল জমি বেড়া দিয়ে ঘেরা রয়েছে। টিলার গায়ের অংশে ইউক্যালিপটাস গাছের মধ্যে একটা কাঠের বাংলোমতো বাড়ি দেখা যাচ্ছে। জমিটার দক্ষিণপ্রান্তে–সেই বাংলোর সরাসরি উল্টোদিকে ফার্মের গেট আর গুদাম। একটা চালাঘরও রয়েছে।

কর্নেল ভীষণ দুঃখিত। এই সরলতাময় ভোরবেলাটি পৃথিবীর জন্যে বয়ে। আনল এক ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ। যে চিরকালের খুনী তার এই সুন্দর দিনটি এভাবে মাটি করল, তার প্রতি ঘৃণায় ও রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। তার অন্যমনস্ক একটা হাত পকেটে ঢুকতেই একটি শক্ত বাঁকানো জিনিসের অস্তিত্ব টের পেলেন। রিভলভার! কী আশ্চর্য, আসবার সময় তাহলে কখন এটা পকেটে ঢুকিয়েছিলেন যথারীতি!

দুঃখে হাসলেন কর্নেল। বরাবর এটা হয়ে আসছে। অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে বলা যায়। বেরোলেই এটা সঙ্গে নিয়ে ফেলেন, জেনে বা না জেনেও। কেন নেন? আত্মরক্ষা! তাহলে মাই ডিয়ার ওল্ড ম্যান, তুমি সতত সতর্ক, কারণ তুমি সেই ইটারনাল মার্ডারারকে ভয় করো। তুমি ক্রমাগত দিনের পর দিন তার একটার পর একটা মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে তাকে বেআব্রু করে চলেছ–তাই তোমার এত অবচেতন ত্ৰাসনা জানি কখন সে তোমাকেই আক্রমণ করে বসে!

গোপালকিশোর ধরা গলায় রুদ্ধশ্বাসে বলল, এই যে স্যার, এই যে! আহা হা, এমন কমবয়সী মেয়ে স্যার! এত নিষ্ঠুর মানুষ থাকতে আছে–আহা হা!

দেখতে পাচ্ছি। বলে কর্নেল উঁচু আল থেকে যুবকের মতো লাফ দিয়ে নামলেন এতক্ষণে। পরক্ষণে তার নার্ভগুলো বর্তমান অবস্থার দিকে সক্রিয়তায় তৎপর হলো। অনেক হত্যাকাণ্ডের মতোই এও একটি নিছক হত্যাকাণ্ড। সূর্যের আভাস দেখা দিয়েছে দিগন্তে। একটু ঝুঁকে মেয়েটির মুখ লক্ষ্য করলেন। কোথায় যেন দেখেছেন! সম্ভবত সমুদ্রতীরেই। না, কাল বিকেলে যে চারটি মেয়ে তার কাছে সিগারেটের জন্যে আগুন চেয়েছিল, এ তাদের দলের নয়। কারণ, সেই স্ন্যাকস ও গারারাধারিনী তরুণীদের কারও গায়ে পাঞ্জাবি ছিল না।

পিঠে ছুরি মারা হয়েছে। কিন্তু ছুরিটা নেই। পিঠে মারা হয়েছে, তার একটা কারণ হতে পারে, দৌড়ে পালানোর সময় আঘাত করেছিল হত্যাকারী। কর্নেল সতর্ক চোখে আশেপাশে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন। কোথাও একবিন্দু রক্ত নেই। মাটিটা বেলে। জল শুষে নিয়েছে। কাদা হয়নি বিশেষ। ঘাসে বা আগাছার পাতায় কোথাও এক ফোঁটা রক্ত লেগে নেই। লাশটা মনে হয় বাইরে থেকে এনে ফেলা হয়েছে। কিন্তু কোথাও পায়ের দাগ নেই দেখা যাচ্ছে। নরম মাটিতে দাগ পড়া অনিবার্য ছিল। দেখা যাক, পুলিশ অফিসাররা কেউ আসুক। থানায় বলা হয়েছে ডাঃ পট্টনায়ককে সঙ্গে আনতে। পট্টনায়ক শুধু ডাক্তার নন, ফোরেনসিক-এক্সপার্টও। একসময় কলকাতায় ফেরেনসিক ইন্সটিটিউটে ইন্সট্রাক্টারও ছিলেন। সেই সূত্রে কর্নেলের সঙ্গে আলাপ হয়। শেয়ালদা স্টেশনে ট্রাকবন্দী একটা লাশের ব্যাপারে চমৎকার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন ভদ্রলোক।

গোপালকিপোর, তাহলে মেয়েটিকে তুমি চেনো না বলছ? কর্নেল এবার চুরুট ধরালেন।

আজ্ঞে না স্যার। এই প্রথম দেখছি।

কর্নেল মুখ ঘুরিয়ে জমির উত্তর-পূর্ব দিকে টিলার গায়ে সেই বাংলোটা দেখতে দেখতে বললেন, ওখানে কে থাকে?

গোপালকিশোর বলল, সায়েব যখন আসেন, থাকেন। বাকি সময় তালাবন্ধ থাকে।

কেউ থাকে না? কোনও মালী, কিংবা দাবোয়ান?

না স্যার। বাংলোটার বদনাম আছে। বলে গোপালকিশোর করুণ হাসল।

 বদনাম! ভূতের নাকি? কর্নেল হেসে উঠলেন।

আজ্ঞে সেরকমই। রাতবিরেতে মানুষের আওয়াজ পাওয়া যায় কখনো। কখনো আবছা লোক দেখা যায়। আমরা আলো নিয়ে গিয়ে দেখেছি, কেউ নেই দরজা তালাবন্ধ রয়েছে ঠিকঠাক।

তুমি নিজে কখনো দেখেছ কি?

না স্যার আমার চোখে পড়েনি। ভোমরলালরা দেখেছে।

 কে ভোমরলাল?

দারোয়ান স্যার। সে বেটা অবিশ্যি গাঁজা খায়। তবে হাসিরাম মালীও নাকি দেখেছে।

মিঃ পানিগ্রাহী এসব কথা জানেন?

না স্যার। ওনাকে এসব ফালতু কথা বলা যায় নাকি? তবে একবার…।

একবার?

সায়েব খুব বকেছিলেন এসে–শেবার ঘরের মেঝেয় কে বমি করে রেখেছিল।

বমি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। অথচ আশ্চর্য, দরজায় তালা আটকানো ছিল দিব্যি।

তুমি বমিটা দেখেছিলে নিশ্চয়?

না স্যার, হাসিরাম দেখেছিল। ওকেই সব ধুতে হয়েছিল কি না। তাহলে তোমাদের বাংলোর ভূতে বমি করে দেখছি!

এইসময় একে একে গেটের পাশের গুদাম আর ঘরগুলো থেকে কিছু লোককে এদিকে আসতে দেখা গেল। কেউ কেউ দৌড়ে আসছিল। সবার আগে যে এল, তার গোঁফগালপাট্টা ইত্যাদি দেখেই বুঝলেন, এই ভোমরলাল। সে একলাফে কাছে এসে অস্ফুট আর্তনাদ করল, হা রামজী! এ কী ব্যাপার?

অন্যেরাও এসে ভিড় করল। বিস্মিত গুঞ্জন শুরু হলো। কর্নেল গম্ভীর স্বরে বললেন, ভোমরলাল, এটা খুনখারাবির ব্যাপার। তুমি সবাইকে বলো, সরে তফাতে গিয়ে দাঁড়াক। এক্ষুণি পুলিশ এসে যাবে।

গোপালকিশোর আদেশটা ঝট করে লুফে নিল। হাঁকডাক শুরু করল সে।…তফাতে যাও, তফাতে যাও! ভোমরলালও দারোয়ানী দেখাতে ছাড়ল না। সূর্য উঠছে। লাল একটা চাকা বেরিয়ে পড়েছে। সূর্যটা দেখতে দেখতে মন বিষণ্ণ হয়ে গেল কর্নেলের। হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটা দিনের শুরু, কোথায় পৌঁছবেন কে জানে! অবাক ভয় পাওয়া লোকগুলোর মুখে সুর্যের লালচে রঙ পড়েছে। একটা মুখে গিয়ে তার দৃষ্টি আটকে গেল। কী যেন রয়েছে মুখটায়। ঠোঁট দুটো কাঁপছে। কিছু জোর করে চেপে রাখলে মানুষের মুখে একটা দম আটকানো ছাপ। পড়ে, কর্নেল দেখেছেন। সরলতা! ডাঃ পট্টনায়ক সরলতা নিয়ে তর্ক করছিলেন মেয়ের সঙ্গে। এই সেই সরলতার দ্বিতীয় নমুনা বটে! কর্নেল লোকটার কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে নরম স্বরে বললেন, তোমার নাম কী ভাই? কিছু বলবে তুমি? বলো–কোনও ভয় নেই!

লোকটি অমনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।…আমি হাসিরাম স্যার। আপনি পুলিশের অফিসার স্যার? কাল রাতে স্যার, আমি ঠিক দেখেছিলাম-সায়েবের বাংলোর মধ্যে যেন আলো জ্বলছে। এরা ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেবে বলে কিছু বলিনি স্যার। তখন বিষ্টি হচ্ছিল জোর। তারপর আলোটা যেমন জ্বলে উঠেছিল, আচমকা নিভে গেল স্যার।.।

ডিটেকশন করার ব্যাপারে ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়ার মূল্য আছে। কর্নেল সরকার চুরুট টানতে থাকলেন।..অনেক সময় ফ্যাক্টস বা বাস্তব তথ্যের চেয়েও ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া বেশি কাজ দেয়।

.

০৪.

 প্রাথমিক তদন্ত

জিপ থেকে চারজন ব্যক্তভাবে তোক নামল। পুলিশ অফিসার শ্রী সেনাপতি, ডাঃ পট্টনায়ক আর দুজন বন্দুকধারী সেপাই। তারা দৌড়ে লাশটার কাছে চলে এল। পট্টনায়কের কাঁধে একটা বড়সড় এয়ারব্যাগ আর অদ্ভুত গড়নের ক্যামেরা ঝুলছে। হাতে সেকেলে গড়নের হাতলওয়ালা আয়নার মতো কী একটা রয়েছে–গোলাকার ঢাকনা দেওয়া কাঁচ।

সেপাই দুজন তাদের কর্তব্য সেরে নিল আগে। অর্থাৎ ফার্মে লোকজনকে অন্তত পঁচিশ-ত্রিশ হাত দূরে খেদিয়ে দিল। পট্টনায়ক সশব্যস্তে বললেন, এক মিনিট মিঃ সেনাপতি। তারপর সাবধানে এগিয়ে লাশের ডানকবজিতে নাড়ি পরীক্ষা করে নিলেন। তারপর এগিয়ে পিছিয়ে নানা ভঙ্গিতে পটাপট সুইচ টিপলেন ক্যামেরার। লাশটার চারদিক থেকে কয়েকটা ছবি তুললেন। শেষে ক্লোজশটও নিলেন গোটা তিনেক। তারপর মৃদু হেসে হাত ইশারা করলেন, হ্যাঁ, মিঃ সেনাপতি–আপনি এগোতে পারেন এবার। শী ইজ কোয়াইট ডেড।

সেনাপতি হেসে বললেন, আমার এগোনো মানে তো স্যার, লাশটা উঠিয়ে মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। অবশ্য কিছু পেপারওয়ার্ক রয়েছে। ছকবাঁধা ভাষায় একটা বিবরণ লেখা।

বলে তিনি নোটবইতে ৬বি মার্কা পেন্সিল লড়িয়ে দিলেন। রুটিন ওয়ার্কস, পুলিশের ভাষায়। আইটেমগুলো ধরাবাঁধা। তবে ফিতে বের করতে হলো। যে কোনও দুদিকের মোটামুটি স্থায়ী সীমানাচিহ্ন হিসেবে কোনও গাছ দেয়াল কিংবা এ ধরনের কিছু বেছে নিয়ে লাশ থেকে তাদের দুরত্ব মাপার কাজ রয়েছে। একটা চিহ্ন হিসেবে উঁচু আলটা পাওয়া গেল উত্তরে, পুবে একটা ইউক্যালিপটাস গাছ। সেনাপতি মাপজোকের ফিতে বের করলেন। একজন সেপাই সেটার একপ্রান্ত ধরল। শেষে ট্রাকটারটা থেকে দূরত্বও মাপা হলো।

সেই সময় ডাক্তার পট্টনায়ক সতর্ক করলেন। দেখবেন, পায়ের ছাপটাপ নষ্ট হয়।

সেনাপতি এক সময় ওঁর ছাত্র ছিলেন। অনুগত প্রাক্তন ছাত্রের বিনয়ে তিনি বললেন, না স্যার–আমি জানি। তেওয়ারী, এগোও তুমি।

কর্নেল অন্যমনস্কভাবে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে চুরুট টানছিলেন। যেন এঁদের উপস্থিতি তার চেতনার বাইরে। পট্টনায়ক তার কাছে গেলেন।…এই যে কর্নেল! এ– কেসের নাম কী দেবেন, ভাবছেন বুঝি? এ মার্ডার ইন দা ফার্ম নাকি…

কর্নেল হাসলেন অভ্যাস মতো।…না। এ মার্ডার ইন দা বিগিনিং অফ এ লং ডে। দীর্ঘ দিনের শুরুতে একটি হত্যাকাণ্ড।

পট্টনায়ক বললেন, ঠিক বলেছেন। দিন লম্বাই বটে। ইস্, চন্দনপুর-অন সীর দিনগুলো যা লম্বা লাগছে, ভাবা যায় না! কী হয়েছে বলুন তো?

আপনি ব্যস্তবাগীশ মানুষ কি না। তাই অবসর কাটানো আপনার পক্ষে রীতিমতো ড্যাম বিজনেস! কর্নেল বন্ধুকে যেন সস্নেহে আদর দিলেন। তবে যাই হোক, এখন আপনি লম্বা দিন জবাই করার মতো কিছু পেয়ে গেলেন, বলব।

তাচ্ছিল্যে ভুরু কুঁচকে পট্টনায়ক জবাব দিলেন, এ একটা বাজে কেস বলে মনে হচ্ছে–যা দেখছি। মর্গ থেকে রিপোর্ট এলে দেখবেন, নিছক ধর্ষণের পর খুন। আজকাল আধুনিকতার নামে মেয়েরা যতটা সাহস দেখাচ্ছে, প্রকৃতি তাদের শরীরে তো সে-মতো শক্তি দেননি। এ একটা মারাত্মক অবিবেচনা–তাই না? বলুন!

কর্নেল চাপা হেসে বললেন, শ্রীমতা পট্টনায়ক ও তার মেয়ের সামনে এ মন্তব্য করার সাহস আশা করি আপনার আছে, মাই ডিয়ার ডক্টর পট্টনায়ক!

পট্টনায়ক একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, রিয়্যালি কর্নেল, চোখে আঙুল দিয়ে না দেখালে অনেকে কিছু দেখতে পায় না। আশা করি আমার স্ত্রী কন্যার স্বাধীনতাবোধ এই ঘটনায় কিছু চোট খাবে। কল্যাণীকে সঙ্গে আনলে ভালই করতুম। যখন তখন সে একা পায়ে হেঁটে কিংবা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গত সন্ধ্যায় বৃষ্টি না হলে ওকে আমরা দেখতে পেতুম ভাবছেন? আমার তো সব সময় ভয়, কখন কী ঘটে যায় নাকি। আজকাল সুশিক্ষিত বদমাশদের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। আমরা যাকে ক্রাইম বলি, তাই তাদের নাকি আর্ট অফ মর্ডান লিভিং! যতঃ সব!

কর্নেল বললেন, পায়ের ছাপটাপ কিছু লক্ষ করলেন?

না। সেনাপতির মাপজোক চুকে যাক। তারপর দেখব। ডাঃ পট্টনায়ক কিটব্যাগ থেকে প্লাস্টার ছাঁচ তৈরির উপকরণগুলি বের করতে ব্যস্ত হলেন। তারপর ক্যামেরার মুখে একটা বাড়তি লেন্স পরালেন। ফের বললেন, বাজে কেস। রাজ্যের মেয়ে একাদোকা ঘুরে বেড়ায় সন্ধ্যার দিকে। রাতঅব্দিও কেউ কেউ সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসে থাকে। তার ওপর মদ্যপান..ওঃ, হেল অফ ইট! আপনি দেখবেন, এই মেয়েটির পাকস্থলীতে একগাদা অ্যালকোহল বজবজ করছে।

মর্গে আমি যাচ্ছি না। বলে কর্নেল লাসটার দিকে এগোলেন।

তখন মাপজোক সেরে জিপের ইঞ্জিনের বনেটে একটা খাতা ফেলে সেনাপতি ৬বি পেন্সিলটা জোর লড়িয়ে দিয়েছেন। ডাঃ পট্টনায়ককে পাশে দেখে বললেন, আমার কাজ শেষ স্যার। আপনি এখন যেতে পারেন। ছাপটাপ কিছু তো দেখলুম না–যা ঘাস!

সেনাপতি লিখছিলেন : আজ বাইশ জুলাই ভোর ছটা তের মিনিটে কলকাতার প্রখ্যাত অপরাধ-বিজ্ঞানী কর্নেল এন সরকারের ফোন পাই। তিনি জানান, স্থানীয় অবজারভেটরি থেকে ফোন করছেন। পানিগ্রাহী ফার্মে একটা মেয়ের লাশ পড়ে আছে নাকি। তিনি ওই ফার্মের ট্রাকটার চালক শ্ৰীগোপালকিশোর দাসের কাছে খবরটা জেনেছেন বলেন। তিনি আরও বলেন, বিশিষ্ট ফোরেনসিক-বিশেষজ্ঞ ডাঃ সীতানাথ পট্টনায়ক এখন চন্দনপুর-অন-সী-তে নিজের বাড়িতে রয়েছেন–তাঁকে যেন সঙ্গে নিই। তাই তাঁকে এবং থানায় বেশি কনস্টেবল না থাকায় রামদুলাল তেওয়ারী আর অজিত মহাপাত্রকে নিয়ে অকুস্থলে চলে আসি। ফার্মের ধানী জমিতে লাশটা দেখতে পাই। লাশটার ত্রিশ মিটার দূরে দক্ষিণে একটা ট্রাকটার জমি চষতে চষতে এসে থমকে দাঁড়ায়, তার প্রমাণ পিছনে টাটকা চাষের চিহ্ন। জমিতে ধান নেই–ঘাস ও আগাছা রয়েছে। চারদিকে উঁচু আল আছে। জমিটার পরিমাণ, গোপালকিশোর বলেছে, নয় একর। জমিটার সীমানা : উত্তরে গোলাপ বাগিচা, পুবে সাত মিটার চওড়া প্রাইভেট রাস্তা, দক্ষিণে কর্মচারীদের বসবাসের ঘর, গোডাউন, যন্ত্রপাতি রাখার জায়গা, পশ্চিমে ভুট্টাক্ষেত। লাশটা রয়েছে জমির উত্তর পূর্ব কোণার দিকে। স্থায়ী সীমানাচিহ্ন উঁচু আল থেকে আনুমানিক দুমিটার এবং স্থায়ী সীমানা-চিহ্ন পূর্বে একটা ইউক্যালিপটাস গাছ থেকে আনুঃ পাঁচ মিটার দূরে। লাশটার মাথা পশ্চিমে, পা পূর্বে রয়েছে। এবং লাশটা উত্তর দিকে কাত হয়ে আছে। বাঁ হাত শরীরের নিচে চাপা পড়েছে, ডান হাত ৯০ ডিগ্রী কোণ করে কোমর থেকে হাফ মিটার দক্ষিণে লম্বালম্বি ছড়ানো–তালু চিৎ। লাশটার নিচে ঘন ঘাস আছে। লাশের সেক্স স্ত্রী। বয়স আনুমানিক কুড়ি থেকে বাইশ। রঙ-আনুঃ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। পরনে ক্রিমরঙা আঁটো নাইলন স্ন্যাকস, গায়ে হলদে খদ্দরের হাফপাঞ্জাবি কালো বাটিকের কাজ করা। চুল ববছাট। কোনও গয়না নেই। প্রকাশ্য হাত অর্থাৎ ডান হাতের কবজিতে চওড়া বাদামী ব্যাণ্ডে মোটা ঘড়ি রয়েছে(কোম্পানীর নাম : এভালান্স, অ্যামেরিকার তৈরি নং ২২৮৭৯৪ এ)। সিঁথিতে সিন্দুর-চিহ্ন নেই। ডান পায়ে স্লিপার দুফিতের–পরা অবস্থায় রয়েছে। ফিতের রঙ লাল, আনুঃ তিন সে.মি. চওড়া। বাঁ পা খালি। বাঁ পা থেকে পঞ্চাশ সে.মি. দূরে সরাসরি উত্তর দিকে এবং স্থায়ী উত্তর সীমানাচিহ্নের এক মিটার দূরে আরেকটি অবিকল একই গড়নের একটি স্লিপার পড়ে রয়েছে। চিৎ হয়ে আছে সেটা। লাশটার মাথা পা অব্দি আনুঃ মাপ দেড় মিটার। ক্ষত চিহ্ন : পিঠে-হার্টের উল্টোদিকে। জমাট থলথলে রক্ত রয়েছে। কিছু নিচেই ঘাসে পড়েছে। তাছাড়া আশেপাশে কোথাও রক্তের চিহ্ন দেখি না। ফার্মের কেউ মৃত তরুণীকে চেনে না বা দেখেনি। আশে-পাশে খুঁজে মার্ডার উইপন বলা যেতে পারে এমন কিছু পাওয়া গেল না। প্রাথমিক বিবরণ মোটামুটি এই। তদন্ত সাপেক্ষ।…

মাঝে মাঝে মুখ তুলে ও পেন্সিল কামড়ে ভাবছিলেন আর লিখছিলেন সেনাপতি। এই যথেষ্ট আপাতত। এবার কয়েকজনের সাক্ষ্য লিখতে হবে। তাদের সই করাতে হবে। লিখলেন : গোপালকিশোরের বিবরণ। তারপর তাকে ডাকলেন… এই যে গোপাল, এবার বলো। কীভাবে লাশটা তোমার চোখে পড়ল?

গোপালকিশোরের বলা শেষ হলে সেনাপতি তার সই নিলেন। তারপর কর্নেলের কাছে গিয়ে সবিনয়ে জানালেন, আপনার স্টোরিটা স্যার…

কর্নেল বললেন, অবশ্যই।…

তখন ডাঃ পট্টনায়ক লাশের ডানহাতের আঙুলের ছাপ নিতে ব্যস্ত। পরে সতর্কভাবে চারপাশের ঘাস আর আগাছায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে ঘোরাঘুরি করলেন। না–কোনও রক্তচিহ্ন নেই, কোনও পায়ের ছাপও নেই। সূত্র বলা যায়, এমন কোনও জিনিসও চোখে পড়ল না তার। কোনও সিগারেটের টুকরো বা পোড়া দেশলাই কিংবা কোনও রুমাল। অবশেষে অস্ফুট মন্তব্য করলেন, সাধারণ খুন! সম্ভবত রেপের পর মার্ডার–আগেই অনুমান করেছি।

সেনাপতি ফার্মের অন্যান্য লোকজনের প্রাথমিক সাক্ষ্য নিচ্ছেন। কর্নেল ডাক্তারের কাছে এসে বললেন, মিঃ পট্টনায়ক, দেখাশোনা শেষ হলো?

যথেষ্ট। বলে পট্টনায়ক হাঁফ ফেলার ভঙ্গিতে কাঁধে ঝোলানো জিনিসপত্রসুদ্ধ একটি আড়মোড়া দিলেন।

 কতক্ষণ আগে মারা গেছে, মনে হলো আপনার?

পট্টনায়ক হাসলেন।…দ্যাটস এ ডিফিকাল্ট কোয়েশ্চেন কর্নেল। ঠিকমতো মড়া না ঘেঁটে..।

আপনার অনুমানের ক্ষমতা অসাধারণ বলেই জানতুম।..কর্নেল সপ্রশংস স্বরে বললেন।…রাইগর মরটিস শুরু হয়েছে নিশ্চয়?

আমার অনুমানের কথা যদি বলেন, তাহলে বলব–অন্তত দশ থেকে এগারো ঘন্টা আগে মেয়েটি মারা গেছে। আপাতদৃষ্টে ইনস্ট্যান্ট ডেথ–আঘাতের সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয়েছে বলতে পারি। অবশ্য, দেয়ার আর আদার ফ্যাক্টরস।

তাহলে আপনার অনুমান অনুসারে রাত নটা থেকে দশটার মাঝামাঝি খুনের, সময়টা দাঁড়ায়। কী বলেন?

সঠিক সময় বলা কঠিন। তবে ওই সময়ের মাঝামাঝি অথবা কিছু পরেও হতে পারে।

বৃষ্টি শুরু হয় বিকেল সাড়ে ছটায়। থামে–আমার হিসেব মতে, রাত দুটোর কাছাকাছি। আমি একটা বই পড়ছিলুম। বৃষ্টি ছাড়ার পর ঘুমিয়ে পড়ি। তাহলে লাশের অবস্থা দেখে আপনার কি মনে হয় যে রাত নটা-দশটা বা তারপর থেকে বাকি বৃষ্টিটা লাশের ওপর পড়েছে?

বাধা দিয়ে ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, দ্যাট ডিপেণ্ডস। প্রথমত, যা বুঝলুম– খুনটা এখানে করা হয়নি। অন্য কোথাও খুন করার পর লাশটা এখানে এনে ফেলা হয়েছে। কারণ ঘাসে বা জমিতে কোথাও ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই। লাশের নিচে নরম মাটি চাপে বসে গেছে কিছুটা। তার মানে-ভারি কিছু পড়লে যা হয়। অর্থাৎ লাসটা বয়ে এনে ফেলেছে খুনী। কখন ফেলেছে প্রশ্ন হলে অবশ্য চোখ বুজে বলতে পারব যে আপনার কথামতো রাতে বৃষ্টি থামবার আগেই সেটা ঘটেছে। লাশের ওপর বৃষ্টি পড়ার লক্ষণ খুব স্পষ্ট।

কর্নেল বললেন, তা যদি হয়-তাহলে লাশ বয়ে আনার পথে রক্ত ধুয়ে পড়বেই। কোথাও-না-কোথাও দু-একফোঁটাও আমরা দেখতে পাব। কারণ বৃষ্টির জল গড়িয়ে যাওয়ার প্রশ্ন এ মাটিতে ওঠে না।

ঠিক বলেছেন। ডাঃ পট্টনায়ক লাফিয়ে উঠলেন।…চলুন, আরও ভালভাবে দেখতে দেখতে কিছু দূরের মাটি পরীক্ষা করা যাক।

করেছি। কিন্তু চারদিকে ফার্মের এলাকায় অন্তত কোথাও তেমন রক্তচিহ্ন আমি দেখিনি।

সে কী! তাহলে লাশটা শূন্য থেকে এখানে গজালো নাকি? অদ্ভুত তো!

রিপিট করি। এখানেই খুন হলে ধস্তাধস্তির চিহ্ন থাকতই-দৌড়ানোর চিহ্ন থাকত?

নিশ্চয়ই।

বৃষ্টির মধ্যেই কোথাও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে?

অবশ্য, অবশ্য।

বৃষ্টির মধ্যেই লাশটা এনে ফেলা হয়েছে?

 দ্যাটস রাইট।

কিন্তু কোথাও বৃষ্টি-ধোওয়া রক্তের চিহ্ন নেই মাটিতে। কোনও পায়ের দাগ নেই।

ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, যদি লাশটাকে ছাতার আড়ালে বয়ে আনা হয়– তাহলে…

কর্নেল হেসে বললেন, সম্ভব। তাহলে বলতে হয়, ছাতা ধরে একা লাশ বয়ে আনার মতো হারকিউলিসই এর হত্যাকারী!

কেন? একাধিক লোক থাকতে পারে বয়ে আনার সময়।

 কিন্তু তাদের পায়ের চিহ্ন কোথায় গেল?

মাটিতে বেশি বালি থাকায় ধুয়ে গেছে।

লাশটা ভারি স্বাস্থ্যবতী মোটাসোটা মেয়ের লাশ। নরম বালিমেশানো মাটিতে পা বসে যাবেই।

ব্যাপারটা তাই বটে। ডাঃ পট্টনায়কের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল।

কর্নেল একটু কেশে বললেন, আশা করি, ডাঃ পট্টনায়ক জমিতে মানুষের পায়ের দাগ না দেখলেও বিজন্তুর পায়ের দাগ লক্ষ করেছেন?

হ্যাঁ–তা করেছি। ক্ষেতে গরু চরার চিহ্ন স্পষ্ট। ঘাস পরীক্ষা করেও সেটা বোঝা গেছে।

খুরের দাগগুলো এখানে আসার পর আমি দেখতে পাই। গোপাল বলেছে, প্রায়ই বেড়া গলিয়ে বাইরের গরু ঢুকে পড়ে। কাজেই, বৃষ্টির মধ্যে কোনও গরু অবশ্য মোষও হতে পারে, এই ক্ষেতে ঢুকেছিল। লাশের কাছেও ওই রকম চিহ্ন রয়েছে। কিন্তু আমরা কেউ তার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছিনে কারণ, ক্ষেতে বা মাটিতে ওটা খুবই স্বাভাবিক চিহ্ন। ডাঃ পট্টনায়ক, একবার ফের লাশটার কাছে যাই, চলুন।

একটু পরিহাসের ভঙ্গিতে ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, গরু-মোষ ইত্যাদি শৃঙ্গধারী জীবের পক্ষে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড অবশ্য অসম্ভব নয়। তাড়া করার সময় পিঠে শিঙ বিঁধিয়ে মাটিতে আছাড় দিলেও দিতে পারে।

কর্নেল পরিহাসে সাড়া দিলেন না। বললেন, বিয়্যালি। অন্তত একটি কেসের বেলায় তাই সাব্যস্ত করা হয়েছিল মনে পড়ছে। বর্ধমানে এক ডেয়ারিতে পর-পর দুজন মারা পড়ে–দুজনেই একই রাতে। একটা নতুন ভাল জাতের ষাঁড় কেনা হয়েছিল সদ্য। ষাঁড়ের শিঙে রক্তের দাগ ছিল। ভারি অদ্ভুত কেস বলব।

পট্টনায়ক উৎসাহী হয়ে বললেন, অদ্ভুত কেন? যাঁড়ের গুঁতোয় বিস্তর মানুষ মরতে দেখেছি।

বলছি। আগে ব্যাপারটা ভাবুন। মাঠের মধ্যে নির্জন একটা ডেয়ারি। অবশ্য পাসেই একটা হাইওয়ে রয়েছে। ষাঁড়টা একটা বেড়াদেওয়া ফাঁকা জায়গায় বাঁধা ছিল। তার পাশেই নাগালের মধ্যে ছিল একটা খড়ের গাদা। সে দড়ি ছিঁড়ে প্রথম নম্বর শিকারের ওপর চড়াও হয়। খড়ের গাদায় ঠেসে ধরে। লোকটার হার্টে শিঙ ঢুকে যায়। দ্বিতীয় নম্বরের বেলাতেও একই পরিণতি ঘটে। মর্গের রিপোর্টে বলা হয়, তিন ইঞ্চি মোটা কোনও সূচলো কিছুর আঘাতে মৃত্যু ঘটেছে। মার্ডার উইপন হিসেবে ষাঁড়ের রক্তমাথা শিঙটাকে সাব্যস্ত করা হয়। দ্বিতীয় মত্যুর কারণও একই। যাঁড়ের ডান শিঙে রক্ত ছিল। এমন সময় দৈবাৎ ওখানেই আমার গাড়ি বিগড়ে আটকা পড়লুম। তারপর, বুঝতেই পারছেন, চেঁকির পক্ষে ধানভাবনা ছাড়া রেহাই নেই। আমার প্রশ্ন অফিসারদের চমকে দিল। ষাঁড় দুবার দুজন মানুষকে মারবার জন্য আলাদা-আলাদা শিঙ ব্যবহার করে কি না।

ডাঃ পট্টনায়ক হাসতে হাসতে বললেন, ওয়াণ্ডারফুল!

খড়ের গাদার তলা থেকে সত্যিকার মাৰ্ডর উইপন বেরোল। একটা লোহার গোঁজ সেটা। দুষ্ট প্রকৃতির গরু-মোষ বাঁধা হয় তা দিয়ে।

তারপর?

কর্নেল জবাব না দিয়ে জমিতে গিয়ে নামলেন। পট্টনায়ক তার পিছোনে এগোলেন। তারপর হাতের সেই অদ্ভুত কাঁচটা মাটির কাছাকাছি ধরে জানোয়ারের পায়ের দাগগুলো পরীক্ষা করতে থাকলেন। কর্নেল বললেন, অনেকক্ষণ থেকে আপনার হাতে ওই জিনিসটা লক্ষ করছি। নতুন কোনও ফোরেনসিক যন্ত্র বেরিয়েছে বুঝি?

ডাক্তার হাসতে হাসতে বললেন, আমারই উদ্ভাবনী ক্ষমতার নমুনা এটা। আতশ কাঁচই বলতে পারেন। তবে এর আণুবীক্ষণিক বৈশিষ্ট্য অসাধারণ। নিজে তৈরি করে নিয়েছি।

কর্নেল হাত বাড়িয়ে বললেন, একবার দেখি আপনার যন্ত্রটা।

যন্ত্র বলতে যা বোঝায়, এটা তা নয়। জাস্ট এ মালটিরিফ্লেকটর গ্ল্যাস। বলে পট্টনায়ক হাতলওয়ালা জিনিসটা কর্নেলকে দিলেন।

কর্নেল লাশের পিঠের দিকে একটু তফাতে প্রথমে ঘাসের পাতা, তারপর একহাতে ঘাস সরিয়ে ক্ষেতের তলা উদোম করলেন। দেখতে দেখতে বললেন, বেলে ধরনের মাটির একটা বৈশিষ্ট্য থাকে। দেখে যান মিঃ পট্টনায়ক! এইসব মাটিতে অজস্র লালচে ছিটে দেখতে পাওয়া যায়। আপনার রিফ্লেকটরে ছিটেগুলো এক সেন্টিমিটার চওড়া দেখাচ্ছে। লক্ষ্য করছেন?

পট্টনায়ক দেখে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ–অনেক আগেই লক্ষ্য করেছি। গুচ্ছ গুচ্ছ লাল দানা রাখা বেলেমাটির স্বভাব। ওই দেখুন, কোথাও কত বেশি চওড়া দেখা যাচ্ছে দানাগুলো। জাস্ট অ্যান ইচ্ছ।

কর্নেল লাল মোটা গুচ্ছটার ওপর রিফ্লেকটর স্থির রেখে বললেন, শুধু বেলে বা দোঁয়াশ মাটিতে এমন থাকে না, এঁটেল মাটিতেও বিস্তর লাল ছিটে দেখা যায়। একবার এক গ্রামের বিলের ধারে নাবাল জমিতে লাশ পোঁতা ছিল একটা। বিজ্ঞ অফিসারটির কোনও তুলনা হয় না–তিনি কাছাকাছি জায়গার মাটি থেকে…বাই জোভ! বলে হঠাৎ মুখ তুলে একটু হাসলেন।…ডাঃ পট্টনায়ক, আমরাও অনায়াসে সেই আদিম ও শ্রমসাপেক্ষ পদ্ধতিটি অনুসরণ করতে পারি।

পট্টনায়ক কপালের ঘাম মুছে বললেন, তাহলে তো পুরো ন একর জমি ( খুঁটে-খুঁটে লাল দানাগুলো তুলে নিতে হয়। দ্যাটস এ বিগ জব–খাটুনি ভীমস্য!

কর্নেল বললেন, আপাতত একটা ইঁদুরের খাটুনি খাটা যেতে পারে। আপনার কাছে প্ল্যাস্টিক পেপার আছে?

অবশ্যই।

তাহলে এই সবচেয়ে মোটা দানাগুলো–অন্তত ট্রাকটারের চাকা অব্দি জায়গায় যতগুলো সম্ভব তুলে নিই।

তারপর?

তারপর আপনি আপনার টেবিলের সামনে গিয়ে বসবেন। রাসায়নিক বিশ্লেষণ করবেন।

নিশ্চয়–তাতে আমি পিছপা নই।

ছুরি পেলে ভাল হতো একটা।

নিন–সবই আছে। বলে কিটব্যাগ থেকে একটা ছুরি বের করলেন ডাক্তার। এগিয়ে দিতে গিয়ে দেখলেন কর্নেল রিফ্লেকটারটা একখানে ধরে কী দেখছেন।…কী? সত্যিকার রক্ত নাকি?

না–একটা গর্ত।

খুরের দাগ ছাড়া আর কী হবে?

এটা আরও গভীর মনে হচ্ছে, মিঃ পট্টনায়ক। বলে কর্নেল লাশটার পিঠের দিকে রিফ্লেকটারটা নিয়ে গেলেন। তারপর একেবারে পা বরাবর থামলেন। তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল হঠাৎ। চোখে বিস্ময় ফুটল।–কী কাণ্ড! এদিকেও একই সাইজের একটা গর্ত। একটা মাত্র খুর দেবে বসবে–এবং দু জায়গায়? বলে তিনি আগের গর্তটা থেকে ছুরি দিয়ে দ্বিতীয় গর্ত অব্দি একটা সরলরেখা টানলেন।

ডাঃ পট্টনায়ক অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিলেন। বললেন, কী হলো?

এই সরলরেখাটা লাশের সমান্তরাল?

 তাতে কী প্রমাণ হয়?

কিছু প্রমাণ হওয়া নির্ভর করছে আপনার বিশেষজ্ঞ কার্যকলাপের ওপর। ডাঃ পট্টনায়ক, এই গর্ত দুটোর ছাপ নেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আর নিন দু একটা সাধারণ খুরের যে ছাপগুলো দেখছি, তার থেকে। আমি ততক্ষণ লাল দাগগুলো তুলে ফেলি।

কর্নেল তাই করতে ব্যস্ত হলেন। পট্টনায়ক ক্যামেরার লেন্স খুলে আরেকটা অদ্ভুত গড়নের লেন্স পরালেন। তারপর গর্ত দুটর ছবি তুললেন।

কয়েক মিনিট পরে দুজনে উঠে গেলেন সেনাপতির কাছে। সেনাপতি তখনও জাবেদা খাতায় কী সব টুকছেন। কর্নেল বললেন, জিগ্যেসপত্তর শেষ হলো মিঃ সেনাপতি?

হ্যাঁ স্যার।

তেমন কোনও বিশেষ ইয়ে পেলেন-টেলেন নাকি?

মালী হাসিরাম বলছিল, রাতে বৃষ্টির মধ্যে ওই বাংলোতে আলো দেখেছে, তারপর….

হ্যাঁ। আমাকেও বলেছে।

এখানে ওই বাংলো-ভূতের গল্প বেশ চালু আছে। বলে সেনাপতি হেসে উঠলেন।

আর কেউ ভূত দেখেছে বলেনি?

ভোমরলাল বলছিল, বৃষ্টির সময় ধুপ ধুপ শব্দ শুনেছে! বোঝা যায়–এ উদ্ভট ব্যাপার। বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়া দিচ্ছিল রাত্রে। তাছাড়া লোকটা প্রচণ্ড গাঁজা টানে।

আর কিছু?

বুধন সিং বলল যে রাতে তার ঘুম হয়নি, টাট্টি পেয়েছিল। তখন অন্ধকারে কাছাকাছি কোথাও মড়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সে হরিধ্বনি শুনেছে।

অত রাত্রে বৃষ্টির মধ্যে?

সেটাই পিকিউলিয়ার। তবে ও স্বীকার করেছে, তার কানের ভুল হতে পারে।

এবার কী করবেন মিঃ সেনাপতি?

সেনাপতি উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, রুটিন ওয়ার্কস ছাড়া আপাতত কী করা যাবে বুঝতে পারছিনে। মড়াটা তুলে মোহনপুর মর্গে পাঠাতে হবে। অ্যাম্বুলেন্স আনবার জন্য ট্রাঙ্ককল করতে পাঠিয়েছি অজিতকে। তার আগে লাশটা সনাক্ত করতে হবে। সেটাই জরুরী এখন। লোকালিটিতে খবর পাঠানো হয়েছে। সব হোটেলেও খবর গেছে। তেওয়ারীকে দায়িত্ব দিয়েছি। ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। তবে সবচেয়ে মুসকিল কী জানেন? পানিগ্রাহী সায়েবের ফার্মে লাশটা ফেলে খুনী আমাদের খাটুনি বাড়িয়েছে। তিনি পলিটিসিয়ান ভীষণ প্রভাবশালী লোক। এ খুনের হেস্তনেস্ত না করলে বিধানসভা থেকে লোকসভাঅব্দি হইচই লাগিয়ে দেবেন।

ডাক্তার পট্টনায়ক একটু হেসে বললেন, ঠিকই। বিশেষ করে ভদ্রলোকের মহিলাদের প্রতি আগ্রহ প্রচুর। তরুণী ও সুন্দরী হলে তো কথাই নেই। এই হচ্ছে ওঁর চরম ভাইটাল পয়েন্ট।

সেনাপতি বললেন, দুর্বল পয়েন্ট বলুন, স্যার।

রোদ বেড়েছে ইতিমধ্যে। আকাশের আজ সাজগোজ করার ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে না। কৌপিনপরা সন্ন্যাসীর মতো ছাইমাখা গায়ে চুপচাপ বসে রয়েছে। ইউক্যালিপটাস গাছের পাতাগুলো বাতাসের টানে মাঝে মাঝে ভয় পেয়ে চমকে ওঠা গরুর পালের মতো কান খাড়া করছে আর নামাচ্ছে। একজন-দুজন করে। লোক আসতে দেখা যাচ্ছিল। ভিড়ের অবস্থা কী হবে আঁচ করা যায়। ছোট্ট টাউনশিপ ইতিমধ্যে ছটফট করতে শুরু করেছে।

লোকজনের আসা লক্ষ করে ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো সেনাপতি, লাশ এক্ষুণি সনাক্ত হয়ে যাবে। হোটেলের লোকগুলো আসবার অপেক্ষা শুধু।

সেনাপতি সাহস পেয়ে বললেন, তাই আশা করছি। সনাক্ত হলেই খুনের মোটিভ বের করতে আমার দেরি হবে না। আর মোটিভ বেরোলেই খুনীর পাত্তা পাব।

কর্নেল সকৌতুকে বললেন, রাইট! রোগ কী জানতে পারলেই আরোগ্যের বাড়া সেটা। কী বলেন মিঃ পট্টনায়ক? আপনারা ডাক্তাররা তো তাই বলেন? ডায়গোনেসিস ইজ বেটার দ্যান কিওর কী না?

ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, অবশ্যই। কর্নেল, এবার কিন্তু আমি কেটে পড়তে চাই। ভিড় দেখলে আমার হাঁফ ধরে যায়। চলুন, এগোই।

কর্নেল বললেন, আমারও। ইয়ে–মিঃ সেনাপতি, আমরা যদি এখন ফার্মের কাউকে নিয়ে ওই বাংলোটা দেখতে যাই, আপনার কোনও আপত্তি আছে– মানে, আইদার অফিসিয়াল অর পারসোনাল?

নেভার। যান না স্যার, দেখে আসুন। বরং আপনাদের মতো দুজন জায়ান্ট হ্যাঁণ্ড পাশে পেয়ে আমি কী বোধ করছি, বোঝাতে পারব না। এই ভোমরলাল! ইধার আও। সায়েবদের বাংলো দেখিয়ে আনে। চাবি কোথায়?

— ভোমরলাল জানাল, চাবি হাসিরামের কাছে। তখন হাসিরামকে হুকুম করা হলো। হাসিরাম কর্নেল ও ডাক্তারের আগে আগে ধুকুর ধুকুর দৌড়ল।

.

বাঁদিকে গোলাপক্ষেত। একটু বিবর্ণ দেখাচ্ছে। পোকা লেগেছে সম্ভবত। কর্নেল বললেন, দিল্লীর কুতুবমিনারের পাশে যে গ্রামটা আছে–মেহেরৌলি। একবার এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে সেই গ্রামের মাঠে-মাঠে এলোমেলো ঘুরেছিলুম। ওখানেই শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কিছু জমি আছে। তাই নিয়ে সেবার খুব বিতর্ক উঠেছিল। যাই হোক, সেই বিতর্কিত জমি দেখবার আগ্রহ আমার ছিল না। আমি অজস্র গোলাপক্ষেত দেখে আনন্দ কুড়োচ্ছিলুম। এক জায়গায় গোলাপক্ষেতে ময়ূর হেঁটে গেল। ভাবতে পারেন, সে কী হৃদয়গ্রাহী ঘটনা!

ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, কর্নেল! ভাববেন না–এখানেও ময়ূর বাস করে। ওই সরকারী অরণ্যে।

হঠাৎ কর্নেল হাস্যকর ভঙ্গিতে দৌড়ে হাসিরামের কাধ ধরে ফেললেন। ডাক্তার অবাক। হাসিরাম ঘাবড়ে গিয়ে শ্লেটে বাচ্চাদের আঁকা মূর্তির মতো সর্বাঙ্গে করুণ হয়ে পড়েছে। পট্টনায়ক দৌড়ে গিয়ে রুদ্ধশ্বাসে বললেন, কী ব্যাপার?

কর্নেল হাসছিলেন।…কিছু না। হাসিরাম এবার আমাদের পিছনে থাকবে। কারণ কোনও বিশেষ চিহ্ন তার পায়ের তলায় ধ্বংস হোক, এটা বাঞ্ছনীয় নয়। এর পায়ের পাতা হাঁসের মতো চওড়া–লক্ষ করছেন? হাসিরাম, তুমি খুশি হবে কি না জানিনে, তুমি নির্ঘাৎ এই সমুদ্রে ছিলে পূর্বজন্মে।

হাসিরাম আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ছিলুম বই কি স্যার। সেজন্যেই তো ভয়ে ঘুমোতে পারিনে। যেই তন্দ্রামতো আসে, মনে হয় সমুদ্রের তলায় চলে গেছি–দম বন্ধ হয়ে যায় স্যার।

কর্নেল ওর হাত থেকে চাবির গোছাটা প্রায় কেড়ে নিয়ে বললেন, পেছন পেছন এস।

সে ঠিক তাই করতে লাগল। পথটা একটা গেট পেরিয়ে আরেকটা পথে এসে মিশেছে, গেট খুলে বেরতে হলো। টিলার ঢালু গায়ে তেমাথা সৃষ্টি হয়েছে একটা। একটু চড়াই ভাঙতে হলো। পিচ-চটা রাস্তাটা সংকীর্ণ। একটু পরেই রাস্তার পিচ হঠাৎ শেষ হলো। কাঁচা রাস্তা–দুধারে ইউক্যালিপটাস গাছ আর ঝোপঝাড়। বাঁদিকে ঘুরে আন্দাজ বিশ মিটার দূরে বাংলোর গেটে শেষ হয়েছে। কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, ডানহাতি রাস্তাটা কোত্থেকে এসেছে হাসিরাম?

হাসিরাম জবাব দিল, ওটা ফার্মের বাইরের রাস্তা স্যার। সরকারী জায়গা। ফরেস্ট বাংলোর নিচে দিয়ে চলে গেছে। একেবারে জঙ্গলে ঢুকেছে–তারপর চন্দনপুর বালেশ্বর রোডে মিশেছে।

কর্নেল কাঁচা রাস্তাটা তীক্ষ্ণদৃষ্টে লক্ষ্য করে বললেন, হুম! ডাঃ পট্টনায়ক!

বলুন কর্নেল।

এই টিলাটাও বেলে মাটিতে ভরতি। আবার জায়গায় জায়গায় বালিও যথেষ্ট দেখছি–ঘাস গজাতে পারেনি। কিন্তু..কী কাণ্ড!

কী, কী?

মোটর গাড়ির চাকার দাগ।

তাই তো বটে!

দুজনে হেঁটমুণ্ডে গেট অব্দি ঘুরে-ঘুরে দাগগুলো পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হলেন। হাসিরাম একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইল।

কর্নেল বললেন, গাড়িটা গেট অব্দি এসে ফিরে গেছে বোঝা যাচ্ছে। হুম, এখানে ঘোরানো হয়েছে। তাহলে…তাহলে এটা হচ্ছে সামনের ডান চাকা। কী বলেন?

 হ্যাঁ–তাই মনে হচ্ছে।

কিন্তু দেখুন, বা চাকার দাগ একরকম–ডান চাকার আরেকরকম?

অ্যাঁ? সে কী? ডাঃ পট্টনায়ক চমকে উঠলেন।

হ্যাঁ। আর সব দাগই একরকম। একটা করে সোজা রেখা, আর দুদিকে টানা দুসার ত্রিকোণ, মধ্যের ত্রিকোণটা বড়। কিন্তু সামনের ডান চাকার মধ্যের নকশাটা চারকোণা, টানা রেখার বদলে ফুটকি রয়েছে। আর খাজগুলো বেশ চওড়া। হুম! ডাক্তার পট্টনায়ক! এই চাকাটা নতুন কেনা হয়েছে বাকি তিনটে পুরনো। আপনি কি ছবি নেবেন অনুগ্রহ করে?

পট্টনায়ক ক্যামেরা নিয়ে বললেন, নিচ্ছি। কিন্তু কেসের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন কি? মিছেমিছি ছবি নেওয়ার চেয়ে সিওর হওয়া ভাল– তাই না?

সেই সময় হাসিরাম বলল, ফরেস্টে বেড়াতে অনেকে গাড়ি নিয়েই আসে স্যার। পাহাড়ের এদিকটা বেশ ঢালু কি না–আর রাস্তাও রয়েছে।

পট্টনায়ক বললেন, ঠিক তাই। সেজন্যেই এ অব্দি এসে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেছে কেউ। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে অত রাত্রে গাড়ি কে আনল?

কর্নেল বললেন, ছেড়ে দিন। টায়ারের নকশা আমার মনে থাকবে। ছবি নেবার দরকার নেই।

ক্লান্ত পট্টনায়ক একটা নিঃশ্বাস ফেললেন।…হ্যাঁ, ফিল্মও ফুরিয়ে গেছে দেখছি।

গেট খুলে ছোট্ট ফুলবাগিচা পেরিয়ে বারান্দায় উঠলেন ওঁরা। তারপর কর্নেল তালাটা পরীক্ষা করে খুললেন। একটা জানালার খড়খড়ি ভোলা রয়েছে দেখা গেল। কর্নেল বললেন, খড়খড়ি কি বরাবর তোলা ছিল হাসিরাম?

হ্যাঁ স্যার। সায়েবের আজকালের মধ্যেই আসার কথা। তাই সাফ করে গেছি কাল বিকেলে। ঘরে দেখছেন ভেন্দিলেটার নেই। তাই সায়েবের হুকুম আছে…

মি? পট্টনায়ক, একরকম গন্ধ পাচ্ছেন কি?

পাচ্ছি।

 কিসের বলুন তো?

কসমেটিকসের মনে হচ্ছে। এবং সেটাই স্বাভাবিক মিঃ পানিগ্রাহীর বাংলোয়? বলে একটু হাসলেন পট্টনায়ক।

জানালাগুলো খুলে দাও তো হাসিরাম।

হাসিরাম জানালাগুলো সব খুলে দিলে ঘরটা আলোয় ভরে গেল। এককোণে একটা চমৎকার সোফাসেট রয়েছে। দেয়ালে-দেয়ালে সুন্দর পেন্টিংস টাঙানো রয়েছে। একটা শোকেস ভরতি সুদৃশ্য দেশী-বিদেশী পুতুল। বুকশেলফে কিছু বই ও ম্যাগাজিন। কোণের সোফাসেটের দিকে এগোতে গিয়ে কর্নেল হাঁটু দুমড়ে বসলেন হঠাৎ….ডাঃ পট্টনায়ক, এ-ঘরে গতরাত্রে লোক ছিল! বলে তিনি আঙুল দিয়ে একটা কী দেখালেন।

পট্টনায়ক সেটা দেখতে পেয়ে বললেন, সিগারেটের টুকরো?

কর্নেল বললেন, তিনটে পোড়া সিগারেটের টুকরো। মিঃ পট্টনায়ক। আমি একটা পোড়া দেশলাই কাঠি পেয়েছি। আসুন, ভাল করে খুঁজি। তিনটে সিগারেট যখনতখন আরও দেশলাই কাঠি পাবার আশা আছে। ইয়ে-হাসিরাম, তোমার সায়েব সিগারেট খান না নিশ্চয়?

না স্যার।

তাই অ্যাশট্রে দেখছিনে কোথাও?

পট্টনায়ক বললেন, কী মুসকিল! তা বলে অতিথিদের জন্য অ্যাশট্রে রাখবেন না-কি?

কর্নেল মৃদু হেসে বললেন, এ বাংলোয় কোনও অতিথিকে আপ্যায়িত করেন মিঃ পানিগ্রাহী-তাই না হাসিরাম? অবশ্য তার প্রেমিকারা সিগারেট খান কি না জানিনে।

হাসিরাম সায় দিয়ে বলল, এ তার প্রাইভেট বাংলো স্যার। আমি ছাড়া এখানে কারো আসার হুকুম নেই। কেউ দেখা করতে এলে ওধারে ফার্মের গেটের কাছে আপিসে গিয়ে দেখা করেন।

পট্টনায়ক দেশলাই কাঠি খুঁজছিলেন। পেলেন না। বললেন, আশ্চর্য তো! আর কোথাও একটা কাঠির টুকরো নেই!

কর্নেল কাঠির টুকরো ও সিগারেটের নিটে পাফ পকেটে রেখে সোফার দিকে আরও ঘনিষ্ঠ হলেন। বললেন, হাঁটুর নিচে সোফার গায়ে সিগারেট ঘষে নেভাবার চিহ্ন দেখছি। মিঃ পট্টনায়ক! আরেকটা সিগারেট পেলুম। এটা সবে ধরানো হয়েছিল কিন্তু ঘষটে নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে কোনও কারণে?

পট্টনায়ক বললেন, সিগারেটটায় ও কিসের দাগ।

 লিপস্টিকের।

মাই গড! স্ত্রীলোক সিগারেট খাচ্ছিল?

এ থেকে ঠোঁটের ছাপ নিতে উৎসাহী হবেন নিশ্চয়?..কর্নেল সকৌতুকে বললেন, ডাঃ পট্টনায়ক, কিছু ফ্যাক্টস এখানে তাহলে পাওয়া গেল। তার থেকে দাঁড়াচ্ছে : একটি পুরুষ এবং একটি স্ত্রীলোক এখানে সিগারেট খাচ্ছিল এবং…

হাসিরাম বলে উঠল, স্যার এই দেখুন–মোমবাতি জ্বালিয়েছিল কেউ।

ডাঃ পট্টনায়ক, পুরুষটি চেইন-স্মোকার যাকে বলে। সে সিগারেটের আগুনে সিগারেট ধরাতে অভ্যস্ত। তাই আমরা একটামাত্র পোড়া দেশলাই কাঠি পেলুম। মহিলাটিকেও সে নিজের সিগারেট থেকে আগুন দেয়। মহিলাটি কয়েকটি টান দিতে সবে শুরু করেছে, তখন হঠাৎ এমন কিছু ঘটে যে সে তক্ষুনি হাঁটুর কাছে বুঝতে পারছেন? টেবিল নয়–হাঁটুর কাছে ঘষে নিভিয়ে ফেলে। তার একটাই অর্থ হয়। তার সিগারেট লুকোতে চেয়েছিল। তার থেকেও অর্থ খোঁজা যেতে পারে– এমন কেউ অভাবিতভাবে এসে পড়েছিল, যার সামনে সে সিগারেট খায় না। আপনি কী বলেন?

পট্টনায়ক বললেন, ওয়াণ্ডারফুল! কিন্তু খুনের সঙ্গে এসবের কি কোনও যোগসূত্র থাকতে পারে?

হয়তো পারে–আবার নাও পারে। বলে কর্নেল অন্যমনস্কভাবে উঠে দাঁড়ালেন। আমরা কিছু জানি না–অন্ধকারে ঘুরছি। কিন্তু আমার ধারণা যদি কারেক্ট হয়–অর্থাৎ খুনের অতীত গোপনে এখনও কাজ করে চলেছে, তাহলে..মাই গুডনেস! একটা সিগারেট-কেস! বলে টেবিলের তলা থেকে রুপোলি রঙের একটা সিগারেট-কেস দু আঙুলের কোণায় ধরে তুললেন।…কে টু এস!

.

০৫.

নীলরঙের বাসায় অসম্ভবের ছানা

 কে টু এস! ডাঃ পট্টনায়কের মুখে প্রতিধ্বনিত হলো কর্নেলের বাক্যটি। তিনি যেন হতভম্ব হয়ে পড়লেন কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে। তারপর বললেন, কই দেখি, দেখি!

কর্নেল জানালার কাছে বেশি আলোয় সাবধানে সিগারেট-কেসের একটা কোণা ধরে বললেন, হ্যাঁকে টু এস খোদাই করা আছে। আঙুলের ছাপ নিশ্চয় পাওয়া যাবে এতে। থাক, এটা বেশি নাড়াচাড়া না করাই ভাল।

পট্টনায়ক তার ব্যাগ থেকে মোড়ক বের করলেন।… কর্নেল, এখানেই আমি কাজটা সেরে ফেলতে চাই। এই টেবিলে ওটা রাখুন।

কর্নেল হাসলেন।…সব ব্যবস্থা নিখুঁত আপনার। বাঃ! তারপর কোণের টেবিলে সিগারেট-কেসটা রাখলেন।

পট্টনায়ক মোড়ক থেকে একটা সাদা পাউডার তুলে ছড়িয়ে দিলেন ওটার গায়ে। তারপর একটা সূচের মতো সরু জিনিস দিয়ে পাউডার ঝেড়ে ফেলতেই আবছা কিছু ছাপ ফুটে উঠল আঙুলের। ক্যামেরার লেন্স পাল্টে ও একটার পর একটা নতুন ফ্লাশবা জুড়ে চারটে ছবি তুললেন। তারপর বললেন, এবার ভেতরটা দেখা যাক!

কেস খুলে দেখা গেল পাঁচটা সিগারেট রয়েছে। কর্নেল দেখে বললেন, বিলিতী সিগারেট। খুব দামী ব্র্যাণ্ড। এখানে পাওয়া যায় নাকি?

পট্টনায়ক জবাব দিলেন, বলতে পারছিনে। আমি তো ও রসের রসিক নই। খোঁজ নিলেই জানা যাবে। তারপর ভিতরের দিকে একইভাবে পাউডার ছড়িয়ে ও মুছে আরও কিছু ছবি নিলেন। তখন কর্নেল মেঝেয় হাঁটু ভাঁজ করে কিছু খুঁজতে ব্যস্ত হয়েছেন।

কর্নেল বললেন, কাল রাতে বৃষ্টির সময় এ ঘরে আনাগোনার চিহ্ন প্রচুর। বালি আর কাদার টুকরো দেখতে পাচ্ছি। কার্পেটেও তা লক্ষ্য করেছি।

হাসিরাম মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার বলল, সায়েব এসে নির্ঘাৎ আমার চাকরি খাবেন, স্যার! দেখুন দিকি, কী সব করেছে ঘরের মধ্যে। আমি শুধু ভাবছি, ঢুকল কেমন করে? তালা তো ঠিকঠাক রয়েছে!

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বাইরে যাওয়ার আর দরজা নেই?

আছে। বেডরুমের দিকে। বলে হাসিরাম সেদিকে এগোল।

দুজনে ওকে অনুসরণ করলেন। বেডরুমের দরজাটা খোলা, ভারি পর্দা ঝুলছে। হলদে জমিনে বড়োবড়ো লাল ফুলের নকশা। কর্নেল বললেন, ঐ দরজাটা কি ভোলা থাকে?

হাসিরাম পর্দা তুলতে গিয়ে থেমে জবাব দিল, হ্যাঁ স্যার। তারপর ভিতরে ঢুকেই সে পিছিয়ে এল। তার মুখে প্রচণ্ড অতঙ্কের চিহ্ন। সে অস্ফুট চেঁচিয়ে উঠল, রক্ত স্যার, রক্ত!

কর্নেল প্রথমে ঢুকলেন, তারপর পট্টনায়ক। এ ঘরের জানালা বন্ধ। কিন্তু যেটুকু আলো আছে, তাতেই সব দেখা যাচ্ছিল। সারা মেঝে হলদে কার্পেটে মোড়া। এক পাশে বিছানার খাট রয়েছে। দরজার সামনা-সামনি কঁকা–অন্য পাশে সোফাসেট ও বই ভরতি সেলফ। ফাঁকা জায়গায় কার্পেটের ওপর চাপচাপ রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। বিছানার ওপর, দেয়ালে সবখানে রক্তের দাগ।

পট্টনায়ক বললেন, সর্বনাশ! এখানেই তাহলে খুন করা হয়েছে মেয়েটিকে!

 হাসিরাম, জানালাগুলো খুলে দাও। কর্নেল শান্তভাবে বললেন।

হাসিরাম জানালা খুলে পর্দাগুলো সরাল। প্রচুর আলো এল ঘরে। দেখা গেল, বিছানাটায় রাত্রে কেউ শুয়েছিল।

কর্নেল দরজা খুলে বেরোলেন ওদিকে। চওড়া বারান্দা রয়েছে। টবে অজস্র গাছ রয়েছে। বারান্দায় কয়েক জায়গায় রক্তের দাগ দেখা গেল। নিচে ছোট লনে নুড়ি বিছানো, দুধারে কেয়ারি করা লতার বেড়া আন্ধু ফুলগাছ। নুড়ি বিছানো পথটা ঘুরে বাংলোর পূর্বদিক হয়ে গেটে পৌঁছেছে। নুড়ির ওপর কোথাও রক্ত দেখা গেল না। বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে নিশ্চয়। কর্নেল অস্ফুটস্বরে বললেন, রক্তের ছিটেলাগা বিছানায় শুয়ে রাত কাটায়, সে কে? এত নির্বিকার সে?

ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, তাহলে মোটামুটি বোঝা গেল, খুনটা ওঘরে হয়েছে। তারপর এদিক দিয়ে লাশ বের করেছে খুনী। গেট পেরিয়ে আমরা যে-পথে এসেছি, সেই পথে নিয়ে গিয়ে ওই ধানের জমিতে ফেলেছে।

কর্নেল গেট ঘুরে ফের সেই সদর দরজায় গেলেন। তালাটা পরীক্ষা করে বললেন, মোমের দাগ দেখছি না। ছাপ নিয়ে ডুপ্লিকেট চাবি বানানোর চিহ্ন নেই।

হাসিরাম করুণ মুখে বলল, আমি কী করব স্যার? ঘরদোরের এ অবস্থা দেখে সায়েব ক্ষেপে যাবেন যে!

কর্নেল বললেন, হাসিরাম, কাল তুমি শেষবার কখন এখানে এসেছিলে?

বিকেলে, স্যার। বৃষ্টির আগে। সায়েব আসব আসব হয়ে আছেন। পথের দিকে চোখ রেখে আমরা কাটাচ্ছি। তাই সব ঠিকঠাক আছে নাকি দেখতে এসেছিলুম।

সব ঠিকঠাক দেখেছিলে?

হ্যাঁ স্যার।

তোমাদের সায়েব নিজের গাড়িতে না ট্রেনে আসেন বরাবর?

 নিজের গাড়িতে।

 বাংলোর ডুপ্লিকেট চাবি নিশ্চয় সায়েবের কাছে আছে?

 আছে, স্যার।

তুমি এক কাজ করো। দরজার এ তালা-চাবি আমরা নেব। তুমি আর একটা মজবুত তালা এনে দরজা আটকাও।.বলেই কর্নেল একটু ভেবে নিলেন। ফের বললেন, …থাক। মিঃ সেনাপতি বরং সে-ব্যবস্থা করবেন। বাংলোটা আপাতত পুলিশের জিম্মায় থাকাই ভাল। ডাঃ পট্টনায়ক, আপনি প্লীজ–যদি কিছু মনে না করেন, সেনাপতিকে খবর দিন। আমি আর হাসিরাম ততক্ষণ এখানে রইলুম। এস হাসিরাম, আমরা বেডরুমের দিকের খিড়কির দরজাটা এঁটে দিই। তারপর গল্পগুজব করা যাক।

ডাঃ পট্টনায়ক চলে গেলেন। কর্নেল বাংলোর সদর দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। হাসিরাম মনমরা হয়ে বলল, আমার মাথা ঘুরছে স্যার, বমি বমি লাগছে। হাওয়ায় দুদণ্ড না বসলে আর পারব না।

কর্নেল ভাবলেন, হাসিরাম চাকরি যাবার ভয়ে ঘাবড়ে গেছে, বেচারা! সে বারান্দায় বসে পড়ল। কর্নেল ভিতরে ঢুকে ফের খুঁটিয়ে সবকিছু দেখতে থাকলেন। কিছু চোখ এড়িয়ে গেছে নাকি?

তারপর বেডরুমে ঢুকলেন। ওদিকের দরজাটা ভিতর থেকে এঁটে দিলেন। দরজার কপাটে খুনীর ছাপ থাকা সম্ভব। যাকগে, সে পরের ব্যাপার। বুকশেলফ দটোর কাছে গিয়ে দেখলেন, তালা বন্ধ রয়েছে। রাজনীতি, ফার্মিং, খেলাধুলো সংক্রান্ত নীরস বই সব। কোণের দিকে একটা টুলে একগাদা ইংরেজি পত্রিকা আছে। কর্নেল পত্রিকাগুলো উল্টে চললেন। একটু পরেই তার অবাক লাগল নিজের আচরণ। পত্রিকাগুলো এভাবে নিজের অজান্তে কেন হাতড়াচ্ছেন? কী সূত্র পাবেন বলে আশা করছেন? সেই মুহূর্তে অনুভব করলেন, তিনি যেন এই হত্যাকাণ্ডরূপী রক্তফুলে ভরা গাছটার শিকড় এই বাংলোর তলায় আবিষ্কার করতে চাইছেন। বাংলোর সঙ্গে তার যোগসূত্র আছে বলে কীভাবে যেন বিশ্বাস হয়ে গেছে অবচেতন মনে। বাংলোটা শ্ৰীমদনমোদন পানিগ্রাহীর। অতএব পরোক্ষে তাই কি এই ভদ্রলোকেরই জীবনযাত্রা হাতড়াতে ব্যস্ত হলেন? কেন? এর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে? পানিগ্রাহীর নারীঘটিত দুর্বলতা, এই বাংলোয় স্ত্রীলোক নিয়ে নির্জনে একান্তে এসে, থাকা…এইগুলো হচ্ছে বাস্তব তথ্য বা ফ্যাক্টস। এই ফ্যাক্ট তাকে অবচেতনায় প্ররোচিত করেছে নিঃসন্দেহে। অমনি একটু অস্বস্তি হলো। পানিগ্রাহী তো এখনও আসেননি। সুইডেন থেকে পৌঁছেছে কি না তাও জানা নেই। সেটা খবরের কাগজ থেকে আগে জেনে নেওয়া উচিত ছিল। খামোকা বেচারাকে সন্দেহ করা ঠিক হচ্ছে না।

অথচ একটা কিন্তু ভাব থেকেই যাচ্ছে।…

কী একটা খচখচ করে বিধছে মনে।…

হঠাৎ একটা দৃশ্য মাথায় ভেসে এল। ডাঃ.পট্টনায়ক সিগারেট কৌটোটা : দেখামাত্র কেমন হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন। তার মুখের সেই বিস্ময় ও শিহরণ কর্নেলের দৃষ্টি এড়ায়নি।

বারবার মনে হলো, এটা তারই চোখের ভুল। কিন্তু…

ঠিক সেই সময় পত্রিকাটি অন্যমনস্কতার দরুন হাত থেকে পড়ে গেল। তারপর তার পাতার ফাঁকে একটা নীলরঙের খামের কোণা উঁকি মারল। খামটা বের করে নিলেন। নীল খাম। ভিতরে চিঠি রয়েছে। কোনও ডাকটিকিট নেই, পোস্টাপিসের ছাপ নেই। তার মানে হাতে-হাতে পাঠানো হয়েছে। ওপরে পানিগ্রাহীর নাম লেখা।

সাবধানে এক কোণা ধরে চিঠিটা বের করে খুললেন। পরক্ষণে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। নানা, এ অসম্ভব। এ কী দেখছেন! আর তারিখ তো গত কালকের! ২২ জুলাই!

চিঠিটা পকেটে ভরে ফেললেন। তাঁর দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে রইল কয়েক মুহূর্তের জন্যে। পৃথিবীতে বিস্ময়কর অনেক কিছু আছে কিন্তু অসম্ভব বলে সত্যি কিছু নেই। এ যেন নীলরঙা একটা বাসায় অসম্ভবের ফুটফুটে একটি ছানা। কর্নেল চুরুট। ধরিয়ে বেরিয়ে এলেন।…

.

০৬.

মুখোশ, ছুরি ও নব-র কাণ্ড

কর্নেল একজন সেপাইয়ের জিম্মায় বাংলোর ভার দিয়ে ফার্মের জমিতে গেলেন। ডাঃ পট্টনায়ককে দেখতে পেলেন না। সেনাপতি জানালেন, ডাক্তার তার বাড়িতে গেছেন–ফোরেনসিক ল্যাবের টেবিলে বসবেন গিয়ে। তার সঙ্গে বরাবর পোর্টেবল একটা ল্যাররেটরী থাকে, কর্নেল জানেন।

আরও সব সেপাই ও অফিসার এসে গেছে ততক্ষণে। সেপাইরা ভিড় হটাচ্ছে। ইউক্যালিপটাস গাছের লম্বাটে ছায়ায় একটা টেবিল ও কিছু চেয়ার পাতা হয়েছে। সেগুলো ফার্মের আপিস থেকে আনা হয়েছে।

সেনাপতি দুজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ওঁরা দৈবাৎ এসে পড়েছিলেন চন্দনপুর-অন-সী-তে। ইন্সপেক্টর শ্রী আচার্য আর কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর শ্রী শর্মা। শর্মা একটা গোপনীয় কেসের ব্যাপারে এসেছেন। কর্নেলের নাম শুনে দুজনেই লাফিয়ে উঠলেন। কারণ গর্ত শীতে কাশ্মীরে স্কি-ট্রেনিং সেন্টারের সেই জোড়া হত্যাকাণ্ড আর কর্নেলের খবর সারা ভারতবর্ষে বড়বড় কাগজগুলো ছড়িয়ে ছিল। দিল্লী রাজধানী জায়গা। সেখান থেকে কিছু প্রচারিত হলেই তা জাতীয় হয়ে ওঠে।

একটি ময়লা প্যান্ট-শার্ট পরা লোক কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকেই জিগ্যেসপত্তর করা হচ্ছিল এতক্ষণ। সেনাপতি বললেন, কর্নেল, মেয়েটির কিছু খবর এর কাছে পাওয়া গেল। এর নাম নবসুন্দর–দ্য শার্ক রেস্তোরাঁর কর্মী। আমাদের ইনফরমার। নব, কর্নেলসায়েবকে ব্যাপারটা ফের বলো তো। সে একটা রীতিমতো নাটক কর্নেল। নব, তুমি বলো।

নব গত রাত্রে ‘দ্য শার্কে’ যা-যা ঘটেছিল, সব আওড়ে গেল। এমন কি সেই কাগজের টুকরোগুলোর কথাও বলল। সেনাপতি কাগজের টুকরোগুলো একটা খাম বের করছিলেন, কর্নেল হাত তুলে তাকে থামালেন। তারপর বললেন, আচ্ছা নব, তোমার পুরো নাম কী?

শ্রীনবসুন্দর দাশ, স্যার।

বাড়ি কোথায়?

গ্রাম কাঠাপাড়া, পোঃ সুন্দরী, থানা..

থাক। শার্কে কদ্দিন এসেছ?

তা বছর তিনেক হলো, স্যার। একেবারে গোড়া থেকেই, বলতে পারেন।

শার্ক রাত্রে কতক্ষণ অব্দি খোলা থাকে?

রাত বারোটা অব্দি। তবে কোনও কোনও রাতে একটু দেরিও হয়।

 কিন্তু তোমাদের ক্যাশবাবু গতরাতে নটায় চলে গেলেন বলেছ?

হ্যাঁ স্যার। উনি তাই যান। তারপর সব আমার জিম্মায় থাকে।

মালিক থাকেন না কোনও সময়?

 থাকেন। কিন্তু তার কোন ঠিক নেই। ওঁর আরও সব ব্যবসাপত্তর আছে।

আর সব লোকেরা বারোটা অব্দি থাকে কি?

থাকে স্যার। কাল বৃষ্টি হচ্ছিল–লোক হবে না ভেবে তাদের যেতে বলেছিলুম।

কাল রাতে যে মেয়ে দুটি ছিল, তারা কটায় তোমাদের রেস্তোরাঁয় এসে ঢোকে?

বৃষ্টি শুরু হবার একটু আগে।

আন্দাজ কতক্ষণ আগে?

তা মিনিট পনের হবে–ঠিক কাঁটায় কাঁটায় বলতে পারব না স্যার।

তাদের একজন খুন হয়ে ওখানে পড়ে রয়েছে বলছ। তোমার চিনতে ভুল হচ্ছে না তো?

না স্যার, কী বলছেন! অতক্ষণ অব্দি বসেছিল শার্কে–আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল চেহারা।

তুমি একেবারে, নিশ্চিত হয়ে বলছ?

 একেবারে, স্যার। ভুল হয়নি।

 তাদের হাতে কোনও ব্যাগ-ফ্যাগ ছিল না?

না।

তোমরা কি খাওয়ার পর দাম নাও?

মদের দামটা আগে নিই, অন্য কিছু খেলে পরে নিই।

প্রথমবার হাফ-পেগ করে জিন নিয়েছিল বলেছ, তার দাম কে দিল?

ফরসা লম্বা মেয়েটি। সে বেলবটম প্যান্টের পিছনের পকেট থেকে টাকা বের করেছিল।

তার ঠোঁটে লিপস্টিক ছিল?

নব একটু ভেবে বলল, বোধ হয়, না স্যার।..না, ছিল না। কারণ, ওর ঠোঁট দুট কীরকম মোটা-সেটা চোখে না পড়ে পারে না।

কীরকম সেটা, মানে?

মানে ইয়ে…স্যার, ওরকম ঠোঁট মেয়েদের মুখে মানায় না। কেমন যেন পুরুষালি।

তার গায়ে গেঞ্জি ছিল বলেছ। চুল লম্বা ছিল, তাও বলেছ। কতটা লম্বা?

নব তার ঘাড়ের অনেকটা নিচে হাত দিয়ে দেখাল।…এতটা লম্বা হবে।

ঘাড় থেকে ছসাত ইঞ্চি?

হ্যাঁ স্যার।

 চুল খোলা ঝুলছিল?

হ্যাঁ স্যার।

নব, তুমি হিপি দেখেছ?

অনেক দেখেছি, স্যার। বিস্তর।

তার বুকে ব্রেসিয়ার ছিল না কিভাবে বুঝলে?

 নব সলজ্জ স্বরে বলল, বুকটা উঁচু ছিল স্যার।

নব, এতে লজ্জা পাবার কিছু নেই। মেয়েরা, ব্রেসিয়ার না পরে থাকলে নড়াচড়ার সময় স্তনদুটো দোলে। তুমি তেমন কিছু নিশ্চয় লক্ষ করে থাকবে?

অতটা লক্ষ করিনি। তবে বুক উঁচু ছিল, তাতে কোনও ভুল নেই।

এই সময় পুলিশ ইন্সপেক্টর আচার্য হাসতে হাসতে মন্তব্য করলেন, আজকাল ছেলেরাও মেয়ে সেজে থাকতে পছন্দ করে। মোহনপুরে একদল ইভ-টিজার ধরলুম গতকাল, দুজনকে দেখে তো বুঝতেও পারিনি যে আসলে ওরা ছেলে।

কর্নেল সায় দিয়ে বললেন, ঠিকই। আচ্ছা নব, ওদের মধ্যে কথাবার্তা নিশ্চয় হচ্ছিল?

হচ্ছিল। তবে এত চাপা গলায় যে কিছু শুনতে পাইনি।

অর্ডার দিচ্ছিল কে?

ফরসা মেয়েটিই। তবে স্যার, টেবিল ঠুকে ইশারায় অর্ডার দিচ্ছিল। আরও একদিন–না, আগের দিন তারও আগের দিন ওরা এসেছিল। রাত নটা অব্দি ছিল দুজনে। হাফ করে খেয়ে আসছিল প্রতিদিনই। শুধু গত রাতে আরেকটা হাফ পেগের অর্ডার দেয়।

দুজনকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল, না হাসি-খুশি?

দুজনেই গম্ভীর। আগের দিনও তাই দেখেছি।

 ফরসা মেয়েটির আর তেমন কোনও বিশেষ চিহ্ন বা কোনও ভঙ্গি তোমার মনে পড়ছে?

নব একটু ভেবে ঈষৎ উদ্দীপ্ত হয়ে বলল, স্যার, ফরসা মেয়েটির হাতে উল্কি ছিল।

আর কিছু?

আর কিছু…মনে পড়ে না স্যার।

কোন হাতে উল্কি ছিল?

সেটা…হ্যাঁ, হ্যাঁ–বাঁ হাতে গেলাস ধরছিল। বাঁহাতে উল্কি ছিল এখানটায়। বলে নব তার বাঁহাতের তালু চিৎ করে কবজি থেকে ছইঞ্চি দূরে একটা জায়গা দেখাল। তারপর ফের উদ্দীপ্ত মুখে বলে উঠল, স্যার! মেয়েটি বেঁয়ে। বাঁহাতে সিগারেট খাচ্ছিল, বাঁহাতে দাম দিচ্ছিল.

তার মানে লেফট হ্যাণ্ডার?

 কী বলো?

হ্যাঁ।

দুজনেই সিগারেট খাচ্ছিল?

 হ্যাঁ।

সিগ্রেটের টুকরোগুলো কোথায় ফেলছিল?

অ্যাশট্রেতে।

 অ্যাশট্রে কি সাফ করে ফেলেছ?

হ্যাঁ, স্যার। ভোরে সুইপার এসে সাফ করে প্রতিদিন।

আচ্ছা নব, দেশলাই জ্বালছিল কে?

খুন হওয়া বেঁটে মেয়েটি, স্যার। সে ধরিয়ে দিচ্ছিল–একবার লক্ষ করেছি।

ফরসা মেয়েটি বেশি সিগারেট খাচ্ছিল, না বেঁটে মেয়েটি? নাকি দুজনেই একসঙ্গে সমান খাচ্ছিল?

নব একটু ভেবে বলল, বেঁটে মেয়েটি দুএকবার–তবে ফরসা মেয়েটি বেশি।

কর্নেল কথা কেড়ে বললেন, সে নিশ্চয় নিজের সিগারেটের পোড়া টুকরো থেকে সিগারেট ধরাচ্ছিল?

হ্যাঁ, স্যার। ঠিক বলেছেন।

 সেনাপতি বললেন, তাহলে সে চেইন-স্মোকার দেখছি!.

কর্নেল বললেন, নব, এবার সেই ছোরা হাতে লোকটির কথা বলল। সে মাথায় তোমার চেয়ে ছোট, না উঁচু?

না স্যার, ছোট। রোগামতো টিঙটিঙে লোক। ময়লা রঙ। হাতে লোম ছিল।

চুল?

চুল…তখন খুঁটিয়ে দেখার মতো অবস্থা তো ছিল না স্যার। তার ওপর মুখে মুখোশ পড়া।

কোনও বিশেষ চিহ্ন বা ভঙ্গির কথা মনে পড়ছে?

না স্যার। সে আধ মিনিটেরও কম লম্ফঝম্ফ করে পালাল। তখন কিছু লক্ষ করার কথা মাথায় কারও আসা সম্ভব, স্যার?

পায়ে জুতো ছিল দেখেছ?

মনে পড়ছে না। বলছি তো–তখন যা অবস্থা চলেছে…

কিন্তু তুমি তো শক্ত-সমর্থ প্রায় পালোয়ান মানুষ, নব। বারে মাতালদের হাঙ্গামা নিশ্চয় হয়। তোমাকেও তা থামাতে হয়। কী বলো?

হয়, স্যার। আমাকে মাতাল বলে কথা নেই, আপনাদের আশীর্বাদে, ভদ্রলোক ছোটলোক সবাই বেশ ডরায়। আমি নিজেও কম মারামারি করিনি এ জীবনে। থানার স্যাররা সে-হিসট্রি সব জানেন।

অথচ নব, তুমি তখন ছোরা হাতে একটা লোককে দেখে হতভম্ভ হয়ে রইলে। কোনওরকম বাধাও দিলে না! ইচ্ছে করলে তো তুমি ওকে ছোরা কেড়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে দিতে পারতে!

নব মাথা নিচু করে কাঁচুমাচু মুখে বলল, আপনার আশীর্বাদে তা পারতুম, স্যার!

কিন্তু তা করোনি।

আমার…আমার কী যেন হয়েছিল! এখন আফসোস হচ্ছে, স্যার।

কর্নেল তার মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, নাকি তুমি মোটেও বাঁধা দিতে চাওনি?

নব লাফিয়ে উঠল। তীব্র প্রতিবাদের সুরে বলল, ছি ছি! এ কী বলছেন স্যার! চোখের সামনে একটা খুনখারাপি দাঁড়িয়ে দেখার ছেলে নব নয়। আমার পরম শত্রুকেও যদি কেউ খুন করতে চেষ্টা করে আমি সামনে থাকলে তা প্রাণ গেলেও হতে দেব না। কত বড়বড় গুণ্ডা আর বদমাশ পিটিয়ে আমি ঠাণ্ডা করেছি। বালেশ্বরের ওদিকে গিয়ে নবর নাম বললে এখনও সাপ রাস্তা ছেড়ে সরে যায়!

কর্নেল তার কথার ওপর কথা ফেললেন।…সাপও রাস্তা ছেড়ে যায়। অথচ মুখোশপরা লোকটা দিব্যি ছোরা হাতে দুটি মেয়েকে খুন করতে ঢুকেছে–আর ঢুকেছেও তোমার ঘরে বলা যায়–তুমি অমনি বোবা বনে গেলে নব?

নব ফ্যালফ্যাল করে তাকাল… আমার বুদ্ধি গুলিয়ে গিয়েছিল যেন।

তোমার বুদ্ধি সামান্য একটা–তোমারই ভাষায় রোগা টিঙটিঙে লোককে ছোরা হাতে লম্ফঝম্ফ করতে দেখে গুলিয়ে গেল? দুঃখিত নব, এটা বিশ্বাস করতে পারছিনে।

নব বিব্রত মুখে হাত কচলাতে থাকল। এইসময় সেনাপতি যেন নবর। হয়েই সাফাই দেবার ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, কর্নেল স্যার! নব আমাদের বিশ্বাসী। ও ভীষণ সাহায্য করেছে নানা ব্যাপারে। তাছাড়া ইনফরমারের গতিবিধি জানবার জন্যেও আমাদের ইনফরমার রয়েছে। নব ইজ কোয়াইট ক্লিন ইন অল রেসপেক্ট।

কর্নেল বললেন, একটা কথা মিঃ সেনাপতি। নবর ধরনের লোকেরা সচরাচর কীরকম হয়ে থাকে আমরা জানি। অতীতে সে বদমাইশি খুনোখুনি করেছে। তারপর সম্ভবত নানা ঘটনার চাপে ওর চরিত্র বা জীবনযাত্রার ধাঁচ বদলাতে বাধ্য হয়েছে সে নিজে, কিংবা হয়তো শুধু বাইরের চাপেই বদলে গেছে। সাধারণত এই ধরনের লোকই পুলিশের ইনফরমার হবার উপযুক্ত। পুলিশের কার্যকলাপের আওতায় এসে এরা কিন্তু অদ্ভুতভাবে একটা পাল্টা ভূমিকা নিতে শুরু করে। তাদের অহংবোধ উদ্দীপ্ত হয় এবং আইনের পথে প্রকাশ্যে, নিজের শক্তিকে কাজে লাগাতে পারছে দেখে তাদের পক্ষে অনেক সময়। সমাজের একটি উপকারী মানুষ হয়ে ওঠাও বিচিত্র নয়। ব্যতিক্রমও আছে নিশ্চয়। এবার আসছি, এ ধরনের লোকেদের দ্বিতীয় একটি মানসিক বৈশিষ্ট্যের কথায়। যেহেতু তাদের তীব্র অহংবোধ এখন আইনের প্রশ্রয় পাচ্ছে এমনকি সামাজিক দিকে থেকে নৈতিক প্ররোচনা ও পিঠচাপড়ানি দুই-ই পাচ্ছে এরা বেপরোয়া হয়ে গুণ্ডা বদমাশ ঠ্যাঙাতে তৎপর হয়। তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রতিদ্বন্বিতার মনোভাব। তার কাছে এখন পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম খনী বা গুণ্ডা-বদমাশ যে নস্যি, এটা দেখানোর জেদ মাথায় উগ্র হয়ে ওঠে। ভাবটা এই : আরে যা ব্যাটা পুঁচকে! অমন কত মাল পকেটে ভরেছি অ্যাদ্দিন! …আমার মনে হচ্ছে, নবর মধ্যে এইসব ভাব থাকা স্বাভাবিক।

সেনাপতি মাথা দোলালেন।…হ্যাঁ, আছে। আই এগ্রি। নিশ্চয় আছে।

আছে। অথচ সে গতরাতে হাঙরের মুখোশপরা ছোরাধারী একটা রোগা টিঙটিঙে লোককে দেখে ঘাবড়ে গেল!…

নব বাধা দিয়ে বলল, না স্যার, না স্যার। ঘাবড়াইনি। হকচকিয়ে গিয়েছিলুম। এ যে এক আজব ঘটনা স্যার!

এমন ঘটনার মুখোমুখি তাহলে কখনও হওনি বলছ! ভেবে বললো, নব।

হইনি বললে মিথ্যে বলা হবে। একবার আচমকা একটা লোক আমাকে ছোরা নিয়ে হামলা করেছিল… বলে নব সেনাপতির দিকে সায় নেবার ভঙ্গিতে তাকাল।…ঠিক না, স্যার? তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে ছুরিসুদ্ধ থানায় নিয়ে গেলুম না, স্যার?

সেনাপতি বললেন, দ্যাটস রাইট।

কর্নেল প্রশ্ন করলেন, তাহলে, নব?

নব ঘামছিল। ভারি গলায় বলল, কী বলব–কী যেন হয়েছিল তখন! খুব হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। আপসোস হচ্ছে–ইস্! আর একবার যদি ওরকমটি হতো!

কর্নেল একটু হাসলেন। তারপর বললেন, যাক্ গে, ছেড়ে দাও। যা হবার হয়েছে। এখন বলল, মুখোশটা কেমন ছিল?

এমনি একটা মুখোশ-বাচ্চারা যা পরে। বিচে বিকেলে বেচতে আসে ফেরিওয়ালারা। ভূতের মুখোশ, রাক্ষসের মুখোশকত রকম। কানে গাটার দিয়ে আটকাতে হয়। নাক ও চোখের ফুটো থাকে।

তাহলে বলছ খেলনার মুখোশ?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, আর ছোরাটা সেই রকম খেলনার নয়, আশা করি!

নব কেন যেন একটু অবাক হলো, খেলনার ছোরা?

সী-বিচে খেলনার মুখোশ আর রাঙতামোড়া ছুরি তলোয়ার তীর ধনুক বিক্রি হতে আমি দেখেছি। কর্নেল সকৌতুকে বললেন, ফের, নব, আমাদের বেশ অদ্ভুত গল্প শোনালে তাহলে!

অমনি নব এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। সে আচমকা দৌড়ে পালিয়ে গেল।

ঘটনাটা এমন আচমকা ঘটল যে সবাই হতভম্ব হয়ে পড়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্যে। নব যখন ফার্মের সদর গেট পেরিয়েছে, তখন দুজন সেপাই উপস্থিতবুদ্ধি মতে পাকড়ো, পাকড়ো শালা বদমাশকো বলে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ল। সেনাপতি, শৰ্মা, আচার্য এবার স্প্রিঙের পুতুলের মতো চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন একসঙ্গে। আচার্য বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ দিলেন, পাকড়ো শালা খুনী কো! সেনাপতি চেয়ার সরিয়ে রিভলভার খুলে বেরোবার চেষ্টা করতেই কর্নেল তার হাতটা ধরলেন। কোথায় যাবেন? বসুন। কর্নেল এতক্ষণ একটুও নড়েননি।

ওদিকে ফার্মের কিছু লোক আর ভিড় থেকে কয়েকজন মিলে দৌড়ে যাচ্ছে দেখা গেল।

 সেনাপতি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, কর্নেল, কর্নেল! আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে জেরার চোটে নবর মুখোশটা খুলে দিয়েছেন! ব্যাটা সেটা টের পেয়েই পালাল। উঃ! একটুও ভাবিনি–ও ব্যাটারই কাজ! শয়তান কখনও মানুষ হয়– না হয়েছে? চোখে ধুলো দিয়ে দিব্যি ইনফরমার সেজে কাটাচ্ছিল, একটুও টের পাইনি।

আচার্য হাঁসফাঁস করে বললেন, আমি বারবার বলেছি, ও ব্যাটা খুনে গুণ্ডা সম্পর্কে সাবধানে থাকা উচিত আপনাদের। অতটা বিশ্বাস করবেন না!

আচার্য স্থূলোদর মানুষ। তার লাল মুখ ঘেমে কালো দেখাচ্ছে। ভুড়িটা ফেটে যাবার উপক্রম হয়েছে। সেনাপতির একটা হাত ধরে কর্নেল আটকানোর চেষ্টা করছেন।

 কিন্তু কর্নেলের মুখে শান্ত হাসি। সবার মনে হচ্ছিল যে এই হাসি নবকে চরম পয়েন্টে জেরা করে ফেলার জন্যে তৃপ্তির হাসি। শর্মা বসলেন অবশ্য। বসে সিগারেট ধরিয়ে বললেন, আগাগোড়া একটা বানানো গল্প বলে ব্যাটা কেমন ভুল পথে চালানোর চেষ্টা করছিল। হুঁ! মুখোশপরা একটা লোক। নাও, এখন পৃথিবী হাতড়ে বেড়াও তার জন্যে! এই ফন্দিটা একটুও টের পাইনি আমরা।

আচার্য বললেন, আসলে ও ইনফরমার, তাই বিশ্বাস করতে হচ্ছিল।

কর্নেল বললেন, ওকে বিশ্বাস করে কোনওবার কখনও ঠকেছেন, এমন ঘটনা আছে?

না–ঠকিনি। এবার অ্যাদ্দিনে ঠকলুম। অবশ্য আমি ঠকিনি আমার বরাবর সন্দেহ ছিল গু-খাওয়া গরু। খোলভুষি খাবে কেন?

কর্নেল বললেন, বাই দা বাই, মিঃ আচার্য–আপনি কি মুর্শিদাবাদের লোক?

আচার্য অবাক হয়ে বললেন, হ্যাঁ। কেন বলুন তো?

নিশ্চয় গ্রামাঞ্চলে বাড়ি ছিল?

হ্যাঁ। কেন, কেন? কিসে বুঝলেন?

ওই গ্রাম্য প্রবাদবচনে। বলে কর্নেল হেসে উঠলেন।…! একজ্যাক্টলি! বিষ্ঠাভক্ষণকারী প্রাণীরা এমনি হয়।

.

০৭.

তামাশাবাজি ও একটা মড়া

একটু পরে দেখা গেল, থানার এ. এস. আই. বরকত আলি এক ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে ফার্মের গেট পেরোচ্ছেন। এঁরা সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। আচার্য বললেন, মিঃ সেনাপতি, বসুন! সেপাইরা গেছে, নবও গেছে–এতক্ষণ ব্যাটাকে ধরে ফেলেছে। যাবে কোথায়? নবর হাত থেকে এখন ওকে বাঁচাতে হিমশিম খাবে সেপাইরা। আপনি ব্যস্ত হবেন না–দিস ইজ নট ইওর ফল্ট। ওই দেখুন আপনারা, আলিসায়েব আসছেন কাকে নিয়ে। মনে হচ্ছে, ঘটনার জালটা বেশ ছড়ানো। নব খুন করেছে কারো টাকা খেয়ে–তা বই তো নয়! অতএব পিছনে লোক রয়েছে আই অ্যাম সিওর, মশাই। কর্নেল কী বলেন?

কর্নেল বললেন, ফ্যাক্টস। ফ্যাক্টস থেকেই তো সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব।

আলির সঙ্গের ভদ্রলোক রীতিমতো ভদ্রলোক। ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি পরা, গিলেকরা হাতা, গলায় সরু সোনার চেন, বয়সে অবশ্য প্রৌঢ়, পায়ে পাম্প-শু রয়েছে। তার হাতে মস্ত একটা বাঁধানো রেজিস্টার মতো রয়েছে। এই সব লোক দেখেই বলা যায়, ছায়ায় সারাক্ষণ থাকেন, তাই কীরকম চাপা ঘাসের মতো ফ্যাকাশে হয়ে ওঠেন। পান খান। আঙুলে অনেক আংটিও রয়েছে। আলিসায়েব এসে একটি সেলাম ঠুকে কিছু বলতে মুখ খুলছেন সবে, কর্নেল হাসিমুখে বললেন, আশা করি, ইনি কোনও হোটেলের মালিক। আসুন, আসুন! ওটা নিশ্চয় হোটেল রেজিস্টার। সী-ভিউ নিশ্চয়। খ্রিস্টার হোটেল এখানে তো ওই একটিই। বলুন স্যার, নিশ্চয় সিঙ্গল স্যুট বুক করেছিল হতভাগ্য মেয়েটি?

সবাই হাঁ করে কর্নেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ভদ্রলোকের মুখও হাঁ–ভিতরে একটা খয়েরি রঙের মাংসখণ্ড–অবশ্যই সেটি রসনা–প্রকাণ্ড বিলিতী কুকুরের মতো বসে থাকতে দেখা যাচ্ছিল–এবং গলার গর্ত ও আলজিভটাও, নজরে পড়ছিল। ভীষণ ঘাবড়ে যাওয়া মূর্তি।

আলি বললেন, হ্যাঁ স্যার। মেয়েটির নামধাম সব পাওয়া গেছে। এই যে– রেজিস্টারটা দেখুন। কই ভারতবাবু, দিন।

ভারতবাবু টেবিলে ওটা রেখে একপাশে দাঁড়ালেন। এতক্ষণে মুখে সামান্য হাসি ফুটল। কথাও।…হাঁ স্যার। যা বর্ণনা পেলুম, আর আমার লোকেরাও এসে দেখে গেছে–উনিই তিনি। কাল রাত্তির থেকে নিখোঁজ। বৃষ্টি ছাড়ল না। তাছাড়া…

কর্নেল বললেন, এক মিনিট। তারপর একফালি কাগজে চিহ্ন দেওয়া পাতাটা খুললেন। অফিসার তিনজন মুণ্ডু বাড়িয়ে দিলেন।

তন্দ্রা ভাদুড়ী। স্থায়ী ঠিকানা : ১২৩/১৭ হরি মুদী লেন, কলকাতা-১৩। এসেছে ২১ জুলাই দুপুর বারোটায়। সুইট নম্বর সি, সিঙ্গল। স্পেশাল রেফারেন্স শ্রী-মদনমোহন পানিগ্রাহী, পানিগ্রাহী ফার্ম, ..

হোয়াট! লাফিয়ে উঠলেন সেনাপতি।

কর্নেল বললেন, তার মানে কোনও বিপদ-আপদের ক্ষেত্রে শ্রীপানিগ্রাহীর সঙ্গে হোটেল কর্তৃপক্ষকে যোগাযোগ করতে হবে। তন্দ্রা তাহলে কলকাতার কোনও রেফারেন্স দেয়নি–যা স্বাভাবিক ছিল। তাহলে দাঁড়াচ্ছে : পানিগ্রাহী মেয়েটিকে ভালই চেনেন। আর…।

আলি তার পকেট থেকে দুটো চিঠি বের করে বললেন, চেনেন স্যার? এই দেখুন, ওঁর সুইট তল্লাসী করে এই চিঠিদুট খুব ইমপরট্যান্ট মনে হলো বলে সঙ্গে এনেছি। সুইটে আমাদের তালা আটকানো হয়েছে এখন।

দুটই ইনল্যাণ্ড লেটার। দুটতেই তন্দ্রা ভাদুড়ীর নাম ঠিকানা ইংরজিতে টাইপ করা। এবং দুট চিঠিরই ভাষা ইংরেজি, টাইপ করা। প্রথমটার শুরু, ডিয়ার মিস ভাদুড়ী। দ্বিতীয়টার শুরু, মাই ডিয়ার মিস তন্দ্রা। দুটোর তলায় শ্রী মদনমোহন পানিগ্রাহীর সই। চিঠি দুট পড়ে জানা গেল, শ্ৰীপানিগ্রাহী তন্দ্রাকে পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরি দিচ্ছেন।

প্রথম চিঠিটা :

বিজ্ঞাপনটি আপনার নজরে পড়েছে দেখে আমি আনন্দিত। আপনি দরখাস্ত পাঠিয়েছেন, কিন্তু কোনও ফোটো পাঠাননি। শিগগির ফোটো পাঠান। পি.এ.র পক্ষে দরকারী যোগ্যতা আপনার আছে। এবার কিন্তু বক্স নম্বরে পাঠাবেন না। আমার ঠিকানা দেওয়া হলো। বাই দা বাই, মাইনের কথা লিখেছেন। সর্বসাকুল্যে হাজার টাকা প্রায়।

এর তারিখ ২ জুলাই।

দ্বিতীয় চিঠিটা :

ফোটো পাঠানোর জন্য ধন্যবাদ। এই চিঠিটা নিয়োগপত্র বলে জানবেন। পরে ফর্মাল নিয়োগপত্র পেয়ে যাবেন এখানে এসে। আকস্মিক কারণে আমি পনের দিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি। চন্দনপুরে ফিরব বাইশ-তেইশ তারিখ নাগাদ। আপনি একুশ তারিখ রওনা হোন। এই সঙ্গে পৃথক ইনসিওর করা খামে তিনশো টাকা পাঠালাম। এটা অগ্রিম। আপনার রাহাখরচ এবং চন্দনপুরে এসে যদি আমার জন্যে অপেক্ষা করতে হয়, সেজন্য হাতখরচ বাবদ। আপনার অসুবিধে হবে না। আমার লোক হোটেল বুক করে রাখবে। সী-ভিউ-তে একটা সিঙ্গল সুইট পাবেন। মনে রাখবেন নামটাসী-ভিউ। আমার প্রেসটিজের জন্যেই আপনাকে কিছু প্রেসটিজ মেনে চলতে হবে। আমার ফার্মে গিয়ে নিজে খোঁজ নেবেন না। এখানে রাস্তার লোককে জিগ্যেস করলেও জানতে পারবেন, আমি ফিরেছি কি না। আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। আমি ফিরলেই নিজে হোটেল থেকে আপনাকে নিয়ে আসব। দিস ইজ ভেরি ইমপরট্যান্ট।…তারপর পুনশ্চ আরও কিছু নির্দেশ আপনি শীঘ্রই পাবেন। নির্দেশগুলি খুব গোপনীয়। তাই চিঠিতে জানাব কি না ভাবছি। যাই হোক, অপেক্ষা করুন।

এটার তারিখ ৭জুলাই।

আচার্য মন্তব্য করলেন, বিজ্ঞাপনটা তাহলে জুনের কাগজে বেরিয়ে থাকবে। সেনাপতি, সব বড় দৈনিকগুলোর বিজ্ঞাপন কলমে খোঁজ নিতে হবে। পেয়ে যাবেন। কলকাতায় লালবাজারে ট্রাঙ্ক করে ওঁদের বলুন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বের হয়ে যাবে।

সেনাপতি মাথা দোলালেন।

শর্মা বললেন, কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা কেমন অস্বাভাবিক লাগছে আমার। কর্নেল কী বলেন?

কর্নেল তাঁর চোখের দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে বললেন, ঠিকই বলেছেন। ভারতবাবুকে এবার কিছু জিগ্যেস করব।

ভারতবাবু বিনয়ে নত হয়ে জবাব দিলেন, একশোবার, স্যার। অবশ্যই।

মেয়েটি মানে তন্দ্রা ২১ তারিখে একা এসেছিল বলছেন তাহলে?

হ্যাঁ, স্যার। একা। দুপুর বারোটার বাসে নেমেছিলেন।

লাগেজ ছিল সঙ্গে?

হ্যাঁ–একটা বেডিং আর বড়ো একটা স্যুটকেস।

লেডিজ ব্যাগ–মানে, যাকে ভ্যানিটি ব্যাগ বলা হয়–তেমন কিছু..

ছিল স্যার। কাঁধে ঝুলছিল। তার থেকে একটা পার্স বের করে টাকা মেটালেন। ওনার চোখে গোগো চশমা ছিল। পরনে…

থাক। আচ্ছা ভারতবাবু, তন্দ্রা ওদিন হোটেল থেকে প্রথম কখন বেরোয় মনে। আছে?

তিনটেয় একটি ঢ্যাঙা মতো মেয়ে এসে ওঁর খোঁজ করলেন। সব ঘরে ফোনের ব্যবস্থা আছে। আমি ওনাকে রিং করে ভিজিটারের কথা বললুম–। উনি বললেন, কী নাম? ভিজিটারকে জিগ্যেস করলে জানালেনবলুন, মিস এস রায়। ফ্রম ক্যালকাটা। তন্দ্রাদেবী তক্ষুনি ওনাকে পাঠিয়ে দিতে বললেন। ঘণ্টাখানেক পরে দুজনে দোতালা থেকে নেমে বেরিয়ে গেলেন।

ঢ্যাঙা মেয়েটির চেহারা মনে আছে?

আছে বই কি স্যার। তারপর তো সকাল দুপুর রাত্রি সব সময় দুজনকে একসঙ্গে দেখেছি। রাত্রেও থেকেছেন ওঁর সুইটে। গেস্ট হিসেবে খাওয়া-দাওয়াও করেছেন।

এবার চেহারা বলুন।

ঢ্যাঙা, হাত দুটো বেশ ছড়ানো লম্বা, মোটা হাড়ের গড়ন বলা যায়। বাঁ হাতে উল্কি ছিল। সবসময় সাজপোষাক বদলানো অভ্যাস। পাঞ্জাবি, বেলবটম প্যান্ট, নয়তো গেঞ্জি। কেমন যেন পুরুষালি চালচলন। গলার স্বরও মোটা। ঘাড়ের কিছু নিচে অব্দি খোলামেলা চুল।

সে মেয়ে, তা কিসে বুঝলেন?

সবাই হেসে উঠলেন এ প্রশ্নে। ভারতবাবু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, না স্যার-তা কি হয়? ছেলে না মেয়ে, তা বুঝব না আবার?

আজকাল ছেলেরাও লম্বা চুল আর মেয়েদের ঢঙে পোশাক পরছে। আশা করি, বিচ-এ লক্ষ্য করেছেন।

তা ঠিক, স্যার। তবে ওনার বুক–বুক ছিল যে।

ব্রেসিয়ার ছিল? বলে কর্নেল হাসি চাপলেন–ফের বললেন, না–মানে, কেউ কারও জামা তুলে পরীক্ষা করার কথা ওঠে না। আমি বলছি, বাইরে থেকে তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছিল কি না?

ভারতবাবু লাফিয়ে উঠলেন।..স্যার, স্যার! বুক আঁটো ছিল না ওনার। আজকাল যে বিদিশী মেম-সায়েবদের দেখাদেখি অনেকে ব্রেসিয়ার পরা ছেড়েছেন! বিচে কত সব ঘুরে বেড়ান–আমার হোটেলেও ওঠেন।

তার মানে ব্রেসিয়ার ছিল না?

ঠিক স্যার।

গতকাল–মানে ২২ তারিখ কখন ওরা হোটেল ছেড়ে বের হন, মনে আছে?

আছে, স্যার। আমার নজর কড়া রাখতে হয়। বুঝতেই পারছেন, আজকাল হোটেলের আইন-কানুন সরকার কড়া করেছেন। গতকাল ওনারা বের হন, বিকেল। সাড়ে চারটে নাগাদ। সময়টা মনে আছে। কারণ, এক মন্ত্রীমশায় ওসময় চেক আউট করলেন। আপনাদের আশীর্বাদে মন্ত্রীরাও সী ভিউ-এ এসে থাকেন অনেক সময়। সরকারী অতিথিভবনে যখন আরও বড় কোনও মন্ত্রী থাকলে…

রাইট। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অতিথিভবনে থাকলে রাজ্যের মন্ত্রীদের পক্ষে হোটেল ছাড়া উপায় কী? কর্নেল মন্তব্য করলেন।…আচ্ছা ভারতবাবু, ভিজিটরদের নাম বা সই নেবার জন্যে নিশ্চয় আপনার রেজিস্টার রয়েছে?

আছে স্যার। মিস এস রায়ের প্রথমদিনকার সই আছে। পরে আর নিইনি। কারণ উনি তো দেখলুম, মিস তন্দ্রার সঙ্গেই থাকছেন-টাকছেন।

একুশ তারিখে ওরা রাতে কটায় হোটেলে ফিরেছিল?

 রাত দশটা নাগাদ।

 কোনও বোর্ডার রাতে না ফিরলে আপনারা কী করেন?

থানায় জানিয়ে দিই, স্যার।

কখন জানান?

সেটা স্যার অবস্থার ওপর নির্ভর করে। তবে–ভভারের দিকে থানায় খবর দেওয়া আমাদের রীতি। আসলে হয় কি জানেন? আকাশের অবস্থা ভাল থাকলে অনেকে সী বিচেই রাত কাটান। স্যার, বুঝতেই পারছেন, যা যুগ পড়েছে। সারারাত ড্রিঙ্ক করে তখন যে যেখানে পায়, শুয়ে পড়ে। ভোরবেলা বিচে গেলে আপনি দেখবেন–

তা দেখেছি বটে।

এমনকি মেয়েরাও স্যার–মেয়েরাও! রাত্রিবেলা আবহাওয়া ভাল থাকলে সী বিচে খুব অশ্লীল সব ব্যাপার ঘটতে থাকে আজকাল। ক্রমশ বাড়ছে এটা।

সেনাপতি বললেন, নানা, অতটা বাড়িয়ে বলবেন না মশাই। আমাদের লোক রোঁদে ঘোরে। গত বছরকার সেই রেপ কেসটার পর রাত্রে সী বিচে কড়া নজর রাখা হয়। তাছাড়া, আলো রয়েছে। কী সব যা-তা বলছেন?

ভারতবাবু ধমক খেয়ে ঘাবড়ে গেলেন–তা হয় স্যার–তবে কি না আজকাল যা যুগ পড়েছে। আজকাল ছেলে-মেয়ে বুড়োবুড়ি আইন-টাইন মানলে তো? সরকার তো নিজের ঘর সামলাতেই ব্যস্ত।

কর্নেল বললেন, তাহলে সেরকম কিছু ভেবেই তন্দ্রার ব্যাপারে থানায় জানাননি, বলতে চান? 

হ্যাঁ, স্যার। এসব আকছার ঘটে কি না।

মিঃ আলি, তন্দ্রার জিনিসপত্র সার্চ করেছে?

আলি বললেন, করেছি স্যার। তেমন সন্দেহজনক কিছু পাইনি। মানে–এই কেসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তেমন কিছু। শুধু এই চিঠি দুটোই যা পেয়েছি।

তন্দ্রার শিক্ষা-দীক্ষার সার্টিফিকেট?

আছে স্যার। বি এ সারটি…।

আর কোনও চিঠিপত্র?

কয়েকটা আছে ওর স্যুটকেসে। খুব পুরনো। মনে হলো বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজনের লেখা সব।

একটু পরে আমাকে একবার তার ঘরে নিয়ে যাবেন, মিঃ আলি।

নিশ্চয়, স্যার?

ভারতবাবুকে নিয়ে গিয়ে আপাতত লাশটা দেখান। দ্যাটস ইওর রুটিন জব।বলে কর্নেল সেনাপতির দিকে মৃদু হেসে কটাক্ষ করলেন।

সেনাপতি বললেন, ইয়েস মিঃ আলি। ভারতবাবু, যান দেখে আসুন।

ওঁরা চলে গেলেন লাশটার দিকে। কর্নেল ঘড়ি দেখলেন, নটা পনের। তারপর আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশ পরিষ্কার। শুধু পাখিদের আনাগোনা আছে। সাত মাইল দূরে একটা বার্ড স্যাংচুয়ারি রয়েছে, তাই এত পাখির আনাগোনা। বাঁহনোকুলারটা আনলে ভাল হতো। কর্নেল আকাশ দেখতে থাকলেন।…

একটু পরে ভারতবাবুরা ফিরলেন জমি থেকে। ভারতবাবুর মুখটা কালো হয়ে গেছে এবার। প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। হাঁ, স্যার, তন্দ্রা ভাদুড়ী। উঃ ভগবান! অমন জলজ্যান্ত মেয়েটা–এ এক অসম্ভব দৃশ্য স্যার! এর বিহিত হওয়া দরকার। দেশে আইন-কানুন থাকতে এসব আর চলতে দেওয়া যায় না।

সেই সময় গেটের দিকে চ্যাঁচামেচি শোনা গেল। তারপর দেখা গেল নব ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসছে। আর তার পিছনে একদল লোক তাড়া করেছে। তাদের মধ্যে লালটুপিও দেখা যাচ্ছিল। এখানে কর্নেল বাদে সবাই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেছেন আগের মতো। হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছেন।

নব প্রায় হুমড়ি খেয়ে টেবিলের কাছে পড়ল। সে প্রচণ্ড হাঁফাচ্ছিল। কর্নেল উঠে তার হাত ধরে টেনে তুললেন। ভিড়টাও এসে পড়ল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। কর্নেল সামরিক আওয়াজ দিলেন-বজ্রকণ্ঠ বলা যায়–স্টপ ইট! থামুন আপনারা।

ভিড়টাও হাঁফাতে থাকল খানিক তফাতে। নব শ্বাস-প্রশ্বাসের ফাঁকে বলে উঠল–পেয়েছি স্যার, পেয়ে গেছি! আজ সকালেই এটা পড়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হয়েছিল। ঝোপের ধারে দেখেছিলুম স্যার!

কর্নেল তার হাত থেকে দোমড়ানো চকচকে কী একটা নিলেন। তারপর হাসিমুখে অফিসারদের সামনে সেটা ধরে বললেন, এই সেই মুখোশধারীর ছোরা!

হ্যাঁ–রাঙতামোড়া খেলনার ছোরা। আচার্য বললেন, স্ট্রেঞ্জ! সেনাপতি হাঁ করে চেয়ে থাকলেন। কেবল শর্মা খিকখিক করে হাসতে হাসতে বসে পড়লেন।

কর্নেল বললেন, গত রাতে শার্কে একটা মজার নাটক অভিনীত হয়েছিল। স্রেফ নাটক বা ফার্সই বলব। খেলনার মুখোশ আর খেলনার ছোরা নিয়ে একটা রোগা টিঙটিঙে লোক ঢুকে পড়ে লম্ফঝম্ফ করেছিল। অন্য সময় এই ব্যাপারটার কী প্রতিক্রিয়া ঘটত বলা যায় না। কিন্তু কল্পনা করুন, বাইরে অশান্ত সমুদ্র ভয়ঙ্কর গর্জন করছে। তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। বিচের একপ্রান্তে নির্জন একটা বার-কাম-রেস্তোরাঁ হাঙরে ওইরকম রাত্রিবেলার বিশেষ একটা পরিবেশে কাকেও ভয় দেখিয়ে কাবু করতে এই খেলনার মুখোশ আর রাঙতার ছুরিটা যথেষ্টই। হলফ করে বলতে পারি, আমি থাকলেও একইভাবে ভয় পেতুম এবং ভুল করে বসতুম। নবও প্রথম মুহূর্তে ভুল করে বসবে–সত্যি কিছু ঘটছে ভেবে। কিন্তু নবর মত একজন অভিজ্ঞ সুদক্ষ সাহসী লোক প্রথম মুহূর্তে ভুল করে ধোঁকাবাজিতে পড়লেও পরক্ষণে তার সহজাত ক্ষমতা আর অভিজ্ঞ ইন্দ্রিয়সমূহের অনুভূতিবলে টের পেয়েছিল যে এই ঘটনার কোথাও একটা গুরুতর অস্বাভাবিকতা আছে। তার কিছুক্ষণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার কারণ ওই অবচেতন মানসিক দ্বন্দ্ব। হ্যামবর মতো লোকের পক্ষে এটা খুবই স্বাভাবিক। ভুলে যাবেন না, সে একজন নিরক্ষর মানুষ। এখনও প্রচুর সরলতা কোনও-না-কোনওভাবে প্রকৃতি তার মধ্যে টিকিয়ে রেখেছে। নবর মতো একজন খুনখারাপি মারামারিতে সিদ্ধহস্ত অভিজ্ঞ মানুষ শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতির ফলে যুক্তিজ্ঞান আয়ত্ব করলে হয়তো সে হো-হো করে হেসে উঠত। নয়তো তক্ষুনি এগিয়ে দুথাপ্পড় কষে দিত। কিন্তু তার যুক্তিজ্ঞান কিছুটা সহজাত আর প্রকৃতি অবিশ্রান্ত ঘা মেরে মেরে যেটুকু তাকে দিতে পেরেছেন, তার যোগফল মাত্র। ভুলে যাবেন না, এদিক থেকে প্রতিটি নিরক্ষর মানুষের মধ্যে যে মৃদুতম আদিম ব্যাপারগুলি রয়েছে, তা আমরা প্রাণীদের মধ্যে পুরোপুরি দেখব। হাতে ঢিল না নিয়েও কিছু ছোঁড়ার ভঙ্গি করলে কাকটা যতই দেখতে পাক যে হাত খালি, তবু ভয় পেয়ে একটু সরে যাবে। কিন্তু নব প্রাণী নয়, মানুষ। তাই সে অবচেতন দোটানায় পড়েছিল। যাক্, এত বেশি ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। আশা করি, তার তত্ত্বালীন মানসিক অবস্থা বোঝাতে পেরেছি। ছোরাটার দিকেই তার বেশিমাত্রায় চোখ পড়া স্বাভাবিক। এবং পড়েছিলও। তার নিশ্চয় কোনও সন্দেহ জেগেছিল–হয়তো সেটা অবচেতন বিহ্বলতার মধ্যে।…

নব বলল, কেমন সন্দেহ লাগছিল–ছোরাটা কেমন যেন…

হ্যাঁ। তাই শেষ অব্দি নব আর ও ব্যাপারে উৎসাহী হয়নি। আমি মার্ডার কেসে দুটো দিকে সচরাচর লক্ষ রাখি। তাই থেকে সিদ্ধান্তে আসি। প্রথমটা হচ্ছে খুবই ইমপরট্যান্ট : ব্যক্তিগত মানসিক প্রতিক্রিয়া। দ্বিতীয়টা হচ্ছে : ফ্যাক্টস। তথ্য বা বাস্তব ঘটনা। নবকে আমরা তার ওই নিষ্ক্রিয়তার জন্য আইনত কিংবা বিবেকের দিক থেকে খুব একটা দায়ী করতে পারিনে। এই সমুদ্রতীরে আজকাল যুবক-যুবতীরা প্রচুর ফার্সের অবতারণা করেন। প্রায়ই বিকেলে আমি দেখেছি, আবহাওয়া ভাল থাকলে অনেকে ছদ্মবেশের খেলা–যাকে বলে অ্যাজ ইউ লাইক গেম, খেলে থাকেন।

নব বলল, অনেকটা রাতে শুতে যাবার সময় আমি একবার ভেবেছিলুম স্যার, ওটা হয়তো ওনাদের সেই তামাশাবাজি। প্রায় দেখি, খেলনার পিস্তল নিয়ে ওনারা…।

ঠিক বলেছ, নব। তামাশাবাজি! কিন্তু আমাদের পক্ষে গুরুতর ব্যাপার হচ্ছে, সেই তামাশাবাজির পরবর্তী ঘটনা–যা এই জমিতে দেখা গেল। এখন আমাদের ভাবতে হবে, সেই নিছক তামাশাবাজির সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের কোনও যোগসূত্র আছে কি না।

আচার্য বললেন, আমার ধারণা, খুবই আছে। মেয়ে দুটিকে ওইভাবে বাইরে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল খুনীর। নিয়ে গিয়ে খুন করেছে।

শর্মা বললেন, আমার মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা তা নয়। ওটা যে তামাশাবাজি, তা আমরা এখন জানলুম। প্রমাণ পেলুম। কিন্তু আসলে খুনীর ওটা একটা শো। খুন যে মুখোশধারীই করেছে, এটা দেখানো। পুলিশকে ভুল পথে চালানো তার উদ্দেশ্য ছিল।

কর্নেল বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন, মিঃ শর্মা। ওই তামাশাবাজি ঘটে যাবার পরে–আমি প্রমাণ যা পেয়েছি, তন্দ্রা আর তার সঙ্গী পানিগ্রাহীসায়েবের বাংলোয় যায়। নিশ্চিন্তে সিগারেট খায় দুজনে। ওখানেই বেডরুমে তাকে খুন করা হয়। তারপর এই জমিতে তার লাশ ফেলে যায় খুনী। কোন পথে লাশ এনেছিল, এখনও প্রমাণ পাইনি–যদিও সোজা বাংলো থেকে এই প্রাইভেট রাস্তা দিয়ে কিংবা গোলাপক্ষেত পেরিয়ে আসা তার পক্ষে সহজ ও স্বাভাবিক ছিল।

সেনাপতি বললেন, গোলাপক্ষেতে কোনও পায়ের দাগ পাইনি স্যার।

 রাস্তাতেও পাইনি।

গোলাপক্ষেতে রক্তের কোনও চিহ্নও পাওয়া যায়নি।

রাস্তাতেও না। তাহলে লাশ কোন পথে এল?

সদর গেট দিয়ে আসতে পারে। কিন্তু গেট তো বন্ধ ছিল। ভোমরলাল!

ভোমরলাল এগিয়ে এল..বলুন স্যার!

সেনাপতি বললেন, সকালে আজ কখন গেট খুলেছ?

 আপনাদের আসার একটু আগে।

তালা বন্ধ ছিল রাত্রে?

হ্যাঁ, স্যার।

 অমনি গোপালকিশোর লাফিয়ে এল। ভোমরলাল, মিথ্যে বলো না। আমি লাশটা দেখে সদর গেট খুলেই দৌড়ে গেছি। তখন গেটের তালা খোলা ছিল ঝুলছিল কড়ায়। তুমি এখন ঢাকছ। চাকরি যাবার ভয়ে তো? ও আমি বুঝেছি।

ভোমরলাল ঘাবড়ে গেল। ঘাড় চুলকোতে লাগল।

 গোপালকিশোর বলল, ভোমরলালের এ অভ্যাস আছে স্যার। ও সন্ধ্যে থেকে নেশা চড়ায়। তারপর নেশার ঘোরে রাত্রে গেটে তালা দিতে ভুলে যায়। এজন্যে সায়েব কতবার ওকে বকেছেন। গাঁজার কল্কেয় টান দিয়ে ও খাটিয়ায় গিয়ে মড়ার মতো পড়ে থাকে। তার ওপর কাল বৃষ্টি হচ্ছিল প্রচণ্ড। বেড়াল স্যারও একটা বেড়াল! জলকে বেজায় ডরায়।

সবাই হেসে উঠল। ভোমরলাল কঁচুমাচু মুখে বসে পড়ল একপাশে।;

সেই সময় কর্নেল এগিয়ে গেলেন ভিড়ের দিকে। তারপর তার অভ্যাস মতো একটু কেশে বললেন, আপনারা আশা করি সবাই স্থানীয় বাসিন্দা?

ভিড় থেকে একবাক্যে সাড়া এল।

আপনারা কেউ বলতে পারেন, গত রাত্রেধরুন, রাত নটার পরে, আগে নয় কিন্তু কেউ হরিধ্বনি শুনেছেন? ফার্মের মালী হাসিরাম আমাকে বলেছে, কাল অনেকটা রাত্রে সে কোথাও মড়া নিয়ে যাওয়ার হরিধ্বনি শুনেছে। কেউ আপনাদের মধ্যে

একজন মধ্যবয়সী সাধারণ মানুষ এগিয়ে এল ভিড় ঠেলে। বলল, হ্যাঁ– স্যার। বৃষ্টি তখনও হচ্ছিল। আমার স্টেশনারী দোকানের ঝপ বন্ধ করতে গিয়ে দেখলুম, ভিজতে ভিজতে কারা মড়া নিয়ে যাচ্ছে। হরিধ্বনিও দিচ্ছে। তখন রাত এগারোটা প্রায়। কলকাতায় মাল আনতে তোক পাঠাবার কথা ছিল আজ সকালে। তাই স্টক মিলিয়ে লিস্ট করছিলুম।

আপনার নাম?

আজ্ঞে, হরিহর মহাপাত্র। সোনালি স্টোর্স দেখেননি স্যার? অবজারভেটরির পাশেই। বাজারে জায়গা পাইনি–তাই একটেরে দোকান করেছি।

মড়া যারা বইছিল, তাদের চেহারা কীরকম?

অতটা লক্ষ করিনি। আবছা দেখেছিলুম। সঠিক বর্ণনা দিতে পারব না স্যার।

চারজন ছিল?

চারজন? হুঁ–তাই তো থাকে স্যার। না–না, পাঁচজন–পাঁচজন ছিল।

খাটিয়া ছিল নিশ্চয়?

খাটিয়া–মানে খাট-ফাট ছিল না–সেটা দেখেছি। দুটো বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা মাচা মতো ছিল যেন।

ভেবে বলুন।

হ্যাঁ-স্যার। ভেবেই বলছি। বৃষ্টির মধ্যে তো–আবছা হলেও রাস্তার আলো ছিল। এক পলক দেখেই নিজের কাজে ব্যস্ত হলুম স্যার। রাত্রিদিন তো কত মরছে নিয়ে যাচ্ছে। দূরের সব গ্রাম থেকেও লোকেরা এপথে মড়া নিয়ে সমুদ্রের ধারে শ্মশানে আসে। কত দেখছি অ্যাদ্দিন ধরে! হরিহরবাবু নিরাসক্ত দার্শনিক ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন।

মিঃ সেনাপতি, এই ব্যাপারটা আপনি একটু খোঁজ নিন। গত রাত্রে যে মড়াটা এসেছিল, তা কোথা থেকে। শ্মশানেও লোক পাঠান। কারা বয়েছিল, তাও জানুন।

সেনাপতি অবাক হয়ে বললেন–মড়া! আচার্য আর শর্মা হেসে উঠলেন।

কর্নেল বললেন, হ্যামড়া। কাল রাত নটার পর মনে রাখবেন রাত নটার পর থেকে বৃষ্টি না থামা অব্দি অর্থাৎ রাত দুটো পর্যন্ত কোনও মড়া কারা রয়েছে, কার মড়া ইত্যাদি ডিটেলস খবর খুব জরুরী।…তিনি এবার শান্তভাবে চুরুট ধরালেন। ফের বললেন, এবার আমাকে সেই ছেঁড়া কাগজগুলো দিন।

.

০৮.

পানিগ্রাহী ও সুমন্তের বৃত্তান্ত

 এখন বেলা এগারোটা। কর্নেল, কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর ডঃ শর্মা এবং এ.এস. আই. বরকত আলি একসঙ্গে সী-ভিউ হোটেলের লাউঞ্জে পৌঁছেই ঘড়ির দিকে তাকালেন। দেয়ালে একটা বিরাট গোল ঘড়ি টকটক আওয়াজ দিচ্ছিল। আওয়াজটা আকৃষ্ট না করে পারে না।

ভারতবাবু কথামতো আগেই চলে এসেছিলেন। অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ঘড়িটার বয়স স্যার তিন পুরুষ। আমার কর্তাবাবার আমলের বিলিতী জিনিস। আজকালকার পরিবেশে মানায় না।

তিন জনে সপ্রশংসদৃষ্টে ঘড়িটা দেখে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোলেন। চারতলা বিরাট হোটেল। দোতলায় তিনটে সিঙ্গল, তিনটে ডবল সুইট রয়েছে। প্রত্যেকটাই এয়ার কণ্ডিশনড। চমৎকার আধুনিক ব্যবস্থা। অনেকটা করে কাচের দেয়াল বিশাল দামী সব পর্দা ঝুলছে। চওড়া লাউঞ্জ রয়েছে ওপরে। সামনেও কাচের গোল দেয়াল। সেখানে বসলে মনে হয়, সমুদ্রে ভেসে আছে বাড়িটা। গাছের টব আছে অগুনতি। ভারতবাবু দেখতে সেকেলে টাইপ, কিন্তু একেলে রুচি তার হোটেলের আষ্টেপৃষ্ঠে ছাপ ফেলেছে।

ওপর-নিচে দুজন করে পুলিশ প্রহরী রয়েছে। আলির ইশারায় সুইট নম্বর সি খুলে দিল একজন সেপাই। এয়ার কণ্ডিশনড চালু করলেন ভারতবাবু। বন্ধ ছিল আজ সকাল থেকে। মিছিমিছি পয়সা খরচ করার পক্ষপাতী তিনি নন। তারপর বললেন, আমার থাকার কি দরকার হবে স্যার?

কর্নেল বললেন, না–আপনি আপনার জায়গার গিয়ে বসুন ভারতবাবু। তেমন দরকার পড়লে খবর দেব।

ভারতবাবু চলে গেলেন। সিঙ্গল সুইট হলেও দুজনের শোবার ব্যবস্থা রয়েছে। একটা খাট ছাড়াও সোফা-কাম-বেড রয়েছে একপাশের দেয়ালে। খাটের বিছানা খুব সুন্দরভাবে গোছানো। কর্নেল বিছানাটা সাবধানে পরীক্ষা করলেন। বালিশের নিচে একটা লেডিজ রুমাল পাওয়া গেল, কোণে একটা গিট। অকারণ গিট–ভিতরে কিছু নেই। আর একটা কোণা পরীক্ষা করে কর্নেল বললেন, তার একটা অভ্যাসের পরিচয় পাচ্ছি। রুমালে গিট দেওয়া আর কোণা চিবুনোর অভ্যেস। সচরাচর এই অভ্যাস সরলতার প্রতীক। গোবেচারা ধরনের, ভীতু, লাজুক মেয়েদের এ অভ্যেস লক্ষ্য করা যায়।

শর্মা বললেন, ঠিক, ঠিক।

শার্কের টেবিলে বসে সে কাগজ ছিঁড়ছিল–এও ওই অভ্যাসের অন্তর্গত কিন্তু। অনেক সময় এই স্বভাবের লোকেরা নিজের অজান্তে দামী কাগজপত্র, এমনকি নোটও ছিঁড়ে ফেলে। আমি মনস্তত্ত্ব নিয়ে সামান্য নাড়াঘাটা করেছি। বলতে পারি, এই টাইপের লোকেদের জীবনে একটা চাপা কোনও দুঃখবোধ থাকে–যা নানা কারণের জন্যে হতে পারে। বাল্যে অবহেলা, কিংবা মানসিক প্রচণ্ড আঘাত পাওয়া–কোনও তীব্র সাধ না মেটা ইত্যাদি। আমার ধারণা তন্দ্রার এরকম কিছু ছিল।

বিছানায় আর কিছু পাওয়া গেল না। ওয়াড্রোব খুলে কিছু কাপড় চোপড় পাওয়া গেল। কর্নেল বাথে ঢুকলেন। বাথ টয়লেট প্রিভি একত্রে। তোয়ালে সাবান টুথব্রাশ যা যা লাগে, সবই রয়েছে। অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেলেন না কর্নেল।

ফিরে এসে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ালগুলো তন্নতন্ন খুঁজলেন। একটা চকলেটের প্যাকেট পাওয়া গেল। কিছু প্রসাধনী। আর কিছু না।

এবার স্যুটকেস ও গোটানো বেডিংটা পরীক্ষার পালা। বেডিংটা এককোণে হোল্ডলে গোটানো রয়েছে। ভোলা হলো। তন্দ্রা একটু বিলাসী মেয়ে, তার পরিচয় সবখানে রয়েছে। কিন্তু সূত্র বলতে যা বোঝায়, মিলল না।

স্যুটকেসটা আগেই আলি তালা ভেঙে দেখেছিলেন। এখনও দেখা হলো খুলে। একটা ছোট্ট ফাইলে তার শিক্ষাদীক্ষার সার্টিফিকেট পাওয়া গেল। কলকাতার একটা কলেজের ছাত্রী ছিল সে-দুবছর আগে বি.এ. পাশ করেছে। কর্নেল বললেন, এই দুটো বছর তন্দ্রা চাকরি করে থাকলে অন্তত এসব ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট থাকত–সে সঙ্গে আনত নিশ্চয়। তা যখন নেই, তখন.. বলে হঠাৎ থামলেন তিনি। স্যুটকেসে কয়েকটা ভাঁজকরা জামা কাপড়ের নিচে তলার দিকে হাত চালিয়ে একটা নীল ইনল্যাণ্ড লেটার বের করলেন।

আলি শশব্যস্তে বললেন, আমি খুব খুঁটিয়ে কিছু দেখিনি স্যার। চোখ এড়িয়ে গেছল, দেখছি। কী ওটা?

কর্নেল বললেন, তাকে লেখা পানিগ্রাহীর তৃতীয় চিঠি। এটাই আমি এতক্ষণ খুঁজছিলুম।

তিনি চিঠিটা একান্তে নিয়ে গিয়ে খুললেন–কিছু মনে করবেন না আপনারা আগে আমি দেখে নিই।

আলির মুখটা গম্ভীর দেখাল। শর্মা মুচকি হাসলেন মাত্র।

চিঠিটা পড়া হলে কর্নেল বললেন, মিঃ শর্মা, সকাল থেকে আমি মূল যে জিনিসটা হাতড়াচ্ছিলুম-খুনের মোটিভ সম্ভবত পেয়ে গেছি। মোটিভটাই ভাইটাল ব্যাপার যে-কোনও খুনের কেসে। ডাক্তাররা যেমন বলেন, রোগ ধরা পড়াটাই চিকিৎসার অর্ধেক তেমনি মোটিভ ধরা পড়লেই খুনীকে ধরা সহজ হয়ে ওঠে। যাই হোক, মিঃ শর্মা বরাবর মুখ বুজে থাকলেও চন্দরপুর-অন-সীতে যে অকারণে আসেননি–তা আমার মাথায় ছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে–মোটামুটি জানতে পেরেছি।

আলি চাপা গলায় সরল মুখে শর্মাকে প্রশ্ন করলেন ব্ল্যাকমানি কেস, স্যার?

শর্মা হাসলেন।–না, মিঃ আলি। অন্য ব্যাপার। পরে জানতে পারবেন।

কর্নেল শর্মার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, মিঃ শর্মা, এবার প্লীজ– আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিলে অনেক জটিলতা সেরে যায়।

শর্মা হেসে বললেন, অবশ্যই। বলুন, কী জানতে চান?

 প্রথম প্রশ্ন : মিঃ মদনমোহন পানিগ্রাহী এখন কোথায়?

 গভমেন্ট গেস্ট হাউসে।

উনি কবে এসেছেন?

একুশে জুলাই রাত্রে।

আপনি কবে এসেছে?

আজ সকালে।

আপনাকে উনি ডেকেছিলেন নিশ্চয়?

হ্যাঁ। গতকাল দুপুরে ট্রাঙ্ক করেন দিল্লিতে। প্লেনে কলকাতা চলে আসি। আবহাওয়া খারাপ থাকায় প্লেন দমদম পৌঁছতে তিনঘণ্টা দেরি করে। তারপর রাত বারোটায় একটা সরকারী জীপ নিয়ে একা রওনা হই। পৌঁছেছি আজ ঠিক সাতটায়। পৌঁছে পুলিশ ইন্সপেক্টর আচার্যকে ফোন করেছিলুম। তাকে গেস্ট হাউসে তক্ষুনি চলে আসতে বলেছিলুম।

পাণিগ্রাহী আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন?

হ্যাঁ। দুঃখের সঙ্গে জানালেন–সব প্ল্যান ভেস্তে গেছে। এমনকি উনিই উল্টে বিপদে পড়েছেন।

ওয়েট। কর্নেল হাত তুললেন।পানিগ্রাহী প্রকাশ্যে আসছেন না কেন?

শর্মা বললেন, আসলে হয়েছে কী জানেন? বিরোধী রাজনৈতিক দল তো ওঁর বিরুদ্ধে নানা স্ক্যাণ্ডাল বরাবর রটাচ্ছে। ওঁর ভয় হচ্ছে, এটা নিয়ে আবার কাগজে হই-চই শুরু হলে ওঁর কেরিয়ারটি খতম হয়ে যাবে। তাই উনি বলছিলেন, খুনের মীমাংসা হয়ে গেলেই বরং ফার্মে আসবেন। তার মানে প্রকাশ্য হবেন।

আমি এখনই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই, মিঃ শর্মা। খুবই জরুরী।

চলুন–আপত্তি নেই। তবে

বুঝেছি। আমরা গোপনেই যাব। ধরুন, গেস্ট হাউসে আপনার ঘরেই চলেছি।

 দ্যাটস রাইট। মিঃ আলি, প্লীজ ইট ইজ টপ সিক্রেট।

 আলি বললেন, ইয়েস স্যার।

দুজনে বেরিয়ে এসে নিচে নামলেন। ভারতবাবু সবিনয়ে এগিয়ে দিলেন লন অব্দি। হাঁটতে হাঁটতে কর্নেল বললেন, মিঃ শৰ্মা, যাবার পথে একবার শার্কের সামনে দিয়ে ঘুরে যাব।

তাই চলুন। বরং ফার্মের ওখানে খবর পাঠালে পুলিশ ড্রাইভার দিয়ে আমার জীপটা পাঠিয়ে দিত।

থাক। আমরা পায়ে হেঁটেই যাই। মেঘ করেছে–বোদ কমে যাচ্ছে। বলে কর্নেল একবার আকাশ দেখে নিলেন। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে।

 দ্য শার্ক-এর সামনে এসে কর্নেল দাঁড়ালেন। ভিতরে ঢুকলেন না। সামনের লন ও জমিটা খুঁটিয়ে দেখে পা বাড়াচ্ছেন, সেই সময় নব বেরিয়ে এল ভিতর থেকে। কর্নেল বললেন, কতক্ষণ এসেছ নব?

এইমাত্র, স্যার। আসুন, ভেতরে আসুন।

না। পরে আসবখন। শোনো নব, এসেছ ভালই হলো। তুমি তো খুব কড়া নজরের মানুষ, এস–আমরা আশপাশটা খুঁজে দেখি।

কী খুঁজতে হবে স্যার? নব হাসল।…আবার কোনও খেলনা-টেলনা নাকি?

কর্ণেল গম্ভীর হয়ে বললেন, একজ্যাক্টলি। ঠিক তাই।

মুখোশটা স্যার?

 হ্যাঁ–মুখোশ তো বটেই। আর–আর ইয়ে–ইয়ে-ধরো বেলুন।

 বেলুন!

 হ্যাঁ। একরকম বেলুন নিয়ে বাচ্চারা খেলে না? জল ভরা থাকে!

ওই তো স্যার, একটা পড়ে আছে।..বলে নব দৌড়ে গিয়ে রেস্তোরাঁর পিছন দিক থেকে একটা জলভরা বেলুন কুড়িয়ে আনল।

কর্নেল সেটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, জলটা পড়ে যায়নি। তবে সুতোটা ছিঁড়ে গেছে। নব, আরেকটা ঠিক এমনি বেলুন আমাদের দরকার।

নব লাফিয়ে উঠল।…স্যার, স্যার! ওইরকম একটা বেলুন পড়ে থাকতে দেখেছি। দাঁড়ান, এক মিনিট! আনছি। তখন দৌড়ে যেতে গিয়ে পায়ের চাপে পট করে ফেটে গিয়েছিল–ওই যে রাস্তার ওপর।

শর্মা অবাক হয়ে বললেন, বেলুনে কী আছে কর্নেল?

মিঃ পাণিগ্রাহী আপনাকে তাহলে সবটা বলেননি?

না তো–বেলুন সংক্রান্ত কোনও কথা নাঃ! ষ্ট্রেঞ্জ!

পানিগ্রাহীর সঙ্গে আজ সকালের দিকে কেউ দেখা করতে যায়নি?

না, না। তিনি তো গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। এক্কেবারে আউট অফ সারকুলেশন যাকে বলে। কেউ জানেও না, তিনি এখানে আছে–শুধু ম্যানেজার ছাড়া।

ম্যানেজার বিশ্বাসী?

 নিশ্চয়। সে আমাদের ব্যুরোর লোক। ডেপুটেড স্টাফ।

তাহলে অনেকদিন যাবৎ আপনারা চন্দনপুর অন-সীর ওপর নজর রেখেছেন?

নিশ্চয়?

সেই সময় ফাটা চুপসে যাওয়া ধূসররঙের আর একটা বেলুন নিয়ে নব দৌড়ে এল।…ফেটে গেছে বলে অসুবিধা হবে না তো স্যার?

কর্নেল সেটা নিয়ে বললেন, না। পেয়েছি, এই যথেষ্ট। আচ্ছা, চলি নব। মুখোশটা না পেলেও আমার চলবে–ওজন্যে তুমি মিছে পরিশ্রম করো না। চলুন, মিঃ শর্মা।

 দুজনে প্রায় আধ মাইল হেঁটে সরকারী অতিথিভবনে পৌঁছলেন। সারা পথ। দুজনে যা কথা হলো, তা এই কেস সংক্রান্ত নয়। আবহাওয়া, পঞ্চবার্ষিক যোজনা, আয়কর আদায় সমস্যা–এইসব। কর্নেল টের পাচ্ছিলেন–যাই করুন, তিনি আসলে একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের ভূমিকা নিয়েছেন কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর সরকারী অফিসার শ্রী শর্মা খুব সহজে তাকে কোনও সরকারী গোপনতথ্য জানাবেন না এবং সেটা বিধিবহির্ভূতও বটে।

নীচের লাউঞ্জে ম্যানেজার উঠে দাঁড়িয়ে শর্মাকে স্বাগত জানালেন। শর্মা চাপা গলায় বললেন, কোনও ভিজিটার এসেছিল আমার নাম করে?

না, স্যার।

মিঃ সত্যচরণ দত্তের কাছে?

একটি ছেলে এসেছিল স্যার। ফোনে জানাতেই মিঃ দত্ত. পাঠিয়ে দিতে বললেন।

সে কী! কীরকম ছেলে?

বছর একুশ-বাইশ বয়স হবে–ফরসা।

কর্নেল বললেন, মাথায় লম্বা চুল ছিল?

 ম্যানেজার অবাক হয়ে বলল, না তো! ছোট-ছোট চুল।

কর্নেল গম্ভীর হয়ে গেলেন। শর্মা বললেন, যাক্ গে–সে মিঃ দত্তের ব্যক্তিগত ব্যাপার। ছেলেটি কখন গেল? কতক্ষণ ছিল?

ম্যানেজার একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, মধ্যে কিছুক্ষণ ছিলুম না–স্যার। কখন গেছে, জানিনে। এসেছিল সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ। নিশ্চয় চলে গেছে।

ভিজিটরস বুকে রেকর্ড রাখা হয়েছে?

হ্যাঁ স্যার, দেখাচ্ছি।

 থাক। চলে যাওয়ার সময়ের রেকর্ড নিশ্চয় রাখেননি?

রাখিনি স্যার–পরে মিঃ দত্তের কাছে জেনে নিয়ে রাখব ভেবেছিলুম।

ভেবেছিলেন কিন্তু … ঘড়ি দেখে শর্মা বললেন–এখন পৌনে বারো। এখনও তা জেনে নেননি। এটা দায়িত্বহীনতার পরিচয় কিন্তু। অমনভাবে আপনাকে বলা হল তখন!

বলে তিনি ম্যানেজারের কৈফিয়ত শোনার গরজ না দেখিয়ে হনহন করে গিয়ে সিঁড়িতে উঠলেন। কর্নেল তাকে অনুসরণ করলেন। 

দরজায় কার্ড আটকানো ছিল : মিঃ সত্যচরণ দত্ত। দরজা খুলে দিলেন এক ভদ্রলোক–উজ্জ্বল গৌর রঙ। মাথায় টাক। পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি। বয়স পঞ্চাশ বাহান্ন। শক্ত সমর্থ গড়ন। মুখে যুবকের দীপ্তি রয়েছে। শর্মা পরিচয় করিয়ে দিলেন।… মিঃ পানিগ্রাহী।… প্রখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

কর্নেল ঘরের কোণের দিকের সোফায় তরুণটিকে লক্ষ্য করে বললেন, আশা করি–উনিই শ্ৰীমতী এস রায়?

তরুণটি কাঁচুমাচু মুখে হাসল। পাণিগ্রাহী অবাক হয়ে হাঁ করে তাকালেন কর্নেলের দিকে। বুদ্ধিমান শ্ৰী শৰ্মা হো-হো করে হেসে উঠলেন।

কর্নেল তরুণটির পাশে গিয়ে বসে বললেন, সকালেই চুল কাটা হয়েছে দেখছি! মাই ইয়ং ফ্রেণ্ড, অনেক কথা আছে। আপাতত আমি মিঃ পাণিগ্রাহীর সঙ্গে আলাপটা সেরে নিই। বাই দা বাই, এই বেলুন দুট নিশ্চয় আমার তরুণ বন্ধুটির সুপরিচিত?

ঘরে হাসির শব্দ হলো দ্বিগুণ। পানিগ্রাহী বললেন, সুমন্ত, কর্নেল সরকারের নাম তুমি জানো না সম্ভবত। তার কাছে কিছু চাপা থাকে না। যাক গে, কর্নেল আমাদের অসীম সৌভাগ্য যে এমন সময়ে আপনাকে আমরা পেয়ে গেছি। বেচারা তন্দ্রার জন্যে কিছু করতে পারার সাহস এবার এসেছে আমার মধ্যে।

কর্নেল পানিগ্রাহীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি পি. এর জন্যে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন? কোন কোন কাগজে?

কলকাতার তিনটে ইংরেজি কাগজে।

দেখুন তো তন্দ্রাকে লেখা এই তিনটে ইনল্যাণ্ড চিঠি আপনার নাকি? বলে কর্নেল চিঠি তিনটে পানিগ্রাহীর হাতে দিলেন। 

পানিগ্রাহী দ্রুত চোখ বুলিয়েই বললেন, হ্যাঁ–আমারই।

এই তিন নম্বর চিঠিটার তারিখ হচ্ছে ৮ জুলাই। যে নির্দেশ তাকে দিতে চেয়েছিলেন, তা এতে রয়েছে। আপনি সী ভিউ হোটলের মালিক ভারতবাবুর গতিবিধির ওপর চোখ রাখতে বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন, ভারতবাবুর মহিলাদের প্রতি দুর্বলতা আছে। কোন স্ত্রীলোকের সঙ্গে কীভাবে মিশনে জানাতে হবে। আচ্ছা মিঃ পানিগ্রাহী, তন্দ্রা যে এ ধরনের কাজে রাজী হবে এবং অছাড়াও ভারতবাবুর মতো ব্যবসায়ী মানুষকে পটানোর ব্যাপারে তার ক্ষমতা আছে তা আপনি কীভাবে জানলেন?

পাণিগ্রাহী একটু অপ্রস্তুত হলেন যেন।…না–মানে ওর ফোটোই ওর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলে দিয়েছিল। আমার মহিলাদের সম্পর্কে… একটু হাসলেন পানিগ্রাহী— আধুনিক মহিলাদের ব্যাপারে আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে, কর্নেল!

ফটো দেখে কী বৈশিষ্ট্য টের পেয়েছিলেন?

 সেক্সি গড়ন। বিশেষ করে চোখ দুটো। ওই চোখ আমি চিনি।

 আরও অনেক ছবি আর দরখাস্ত আপনি পেয়েছিলেন কি?

 নিশ্চয়। প্রচুর প্রচুর! আপনি দেখতে চাইলে…

থাক। তাদের মধ্যে তাকেই আপনি বেছে নিলেন?

দ্যাটস রাইট।…বলে পানিগ্রাহী একটু ইতস্তত করে ফের বললেন, থাক,

লুকোব না। এই সুমন্তর সুপারিশেই ওকে আমি নিই।

কর্নেল তার দিকে স্থিরদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, কিন্তু মিঃ পানিগ্রাহী, ভারতবাবুর কালো টাকা, নিষিদ্ধ ড্রাগের কারবার ইত্যাদি কুকর্মের ব্যাপারে নজর রাখার জন্য উপযুক্ত সরকারী কর্তৃপক্ষ রয়েছেন। আপনি তাদের জানালেই তো সেকাজ তারা সরকারী খরচ আর উৎসাহ-উদ্যমে চালাতে পারতেন। বরং আরও ভাল পারতেন তাদের সব বিশেষজ্ঞ আছেন। তা না করে আপনি নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে ব্যক্তিগত উদ্যমে সেকাজে কেন নামতে গেলেন?

পানিগ্রাহী ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। হন্তদন্ত বললেন, নামব না কী বলছেন কর্নেল? আপনি জানেন না, এর সঙ্গে আমার রাজনৈতিক কেরিয়ার আর অ্যামবিশান জড়িয়ে আছে! গত ইলেকশানে ভারতবাবু আমার বিরোধীদলের প্রতিদ্বন্দ্বীকে জেতাবার জন্যে লাখ টাকা খরচ করেছিল। সে ওদের সমর্থক। ওদের পার্টির ফাণ্ডে সে নিয়মিত মোটা টাকা দেয়। ওদের একটা জীপও দান করেছে সে। এ এলাকায় আমার নামে যত কুৎসা রটানো হয়েছে, তার মূল ওই লোকটাই–তা জানেন?

তাই বুঝি?

নিশ্চয়। আর দেখুন, মিঃ শর্মার সামনেই বলছি স্থানীয় পুলিশ বলুন, এনফোর্সমেন্ট বলুন, কাস্টমস বলুন–আমার জানা হয়ে গেছে! সব ওই ভারতের কাছে টিকি বাঁধা রেখেছে। আপনার তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা কী করবে, আমার ভালই জানা আছে। আর সেজন্যেই তো খোদ দিল্লি থেকে একেবারে সি. বি. আই. এর বড়কর্তাকে আসার জন্যে ট্রাঙ্ককল করেছিলুম। আপনার সামনেই উনি বসে আছেন। জিগ্যেস করুন ওঁকে। এর জন্যে হোম মিনিস্টারকে ধরতে হয়েছিল পর্যন্ত।..বলে উত্তেজিত পানিগ্রাহী একটু দম নিলেন। ফের বললেন, এর আগে বিস্তর চেষ্টা করেছি সরকারের লোকজনকে দিয়ে। তাদের এই এক কথা–ভারতবাবুর ব্যাপারে সন্দেহজনক কিছু নেই। বুঝুন তাহলে। অথচ আমি জানি–ভালভাবেই জানি যে লোকটা নিয়মিত ড্রাগের চোরা কারবার চালায়। হোটেল থাকায় সুবিধে হয়েছে। বিদেশী গলার হোটেলে এসে ওঠে। কোনও সন্দেহ করার উপায় নেই। লেনদেন দিব্যি চলে। আসে বিদেশী ড্রাগ এল. এস. ডি. যায় গাঁজা আর কোকেন। আসে ভেনডিটা ক্যাপসুল, যায়। আফিং। আসে…  

বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, বুঝলুম। তাছাড়া এটা নিশ্চয় রাজনৈতিক দলের বিশিষ্ট নেতা হিসেবে আপনার নৈতিক কর্তব্যও বটে।

পানিগ্রাহী সোৎসাহে বললেন, একজ্যাক্টলি, একজ্যাক্টলি!

তাহলে ভারতবাবুর ওপর চোখ রাখবার জন্যে আপনি মিস তন্দ্রা ভাদুড়ী নামে একটি সেক্সি চেহারার মেয়েকে চাকরি দিলেন এবং ভারতবাবুর হোটেলে সুইট ভাড়া করে থাকতে নির্দেশ দিলেন। মিঃ পানিগ্রাহী, ২১ জুলাই তারিখটি তন্দ্রা আসার এবং সেইসঙ্গে আপনারও আসার জন্যে কেন বেছে নিলেন? কেন ২০, ১৯, ১৮, ১৭ কিংবা অন্য কোনও তারিখ নয়?

ঠিকই ধরেছেন কর্নেল সরকার! ওই তারিখে আসতে বলার উদ্দেশ্য ছিল। আমি কোনও সুত্রে জানতে পেরেছিলুম যে ২২ তারিখ রাত্রেই ভারতবাবু একটা মোটারকমের লেনদেন করবে। কিন্তু কীভাবে শয়তানটা আমার সব প্ল্যান টের পেয়ে ভাড়াকরা খুনী লাগাল তন্দ্রার পিছনে। মুখোশ পরে খুনী ফলো করল তন্দ্রা আর সুমন্তকে। তারপর…।

কিন্তু ওটা স্রেফ ফার্স মিঃ পানিগ্রাহী!

 ফার্স? তার মানে?

কর্নেল রাঙতার ছুরির তথ্য জানালেন। পানিগ্রাহী হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললেন, তাহলে তো ব্যাপারটা ভারি রহস্যময়! আচ্ছা এমনও তো হতে পারে, তাকে ওইরকম ভয় দেখিয়ে ভারতবাবু তাড়াতে চেয়েছিল এখান থেকে?

এও হতে পারে। আই এগ্রি। কিন্তু তন্দ্রা খুন হলো সত্যি সত্যি।

হ্যাঁ–খুন হলো?

মিঃ পানিগ্রাহী, এবার আমি ফের কিছু প্রশ্ন করি।

বলুন কর্নেল?

এই ছেলেটি–সুমন্ত, একে কোথায় পেলেন?

সুমন্ত আমার অনেকদিনের চেনা ছেলে। আমি ওকে আসতে বলে এসেছিলুম কলকাতা গিয়ে। তখনই ও বিজ্ঞাপন দেবার পরামর্শ দেয়। যাই হোক, আফটার অল তন্দ্রা মেয়ে, তার একটা রিস্কের ব্যাপার ছিল। তাই ভাবলুম, তার বয়ফ্রেণ্ড হিসেবে ও যদি নিছক বেড়াতে এসে তার সঙ্গে এখানে দেখা হয়ে গেছে–এভাবে তার কাছাকাছি থাকে, তাহলে সুবিধে হয়। তন্দ্রা আর আমার মধ্যে গোপন যোগাযোগের মাধ্যম হবে সুমন্ত। আজকাল তরুণ-তরুণীদের মেলামেশার রীতি ভারতবাবু তো চোখের ওপর দেখছে। তাই সন্দেহ হবে না!

আপনার তৃতীয় চিঠিতে তারই উল্লেখ আছে বটে। কলকাতা থেকে জনৈক এস. রায় দেখা করবে তাকে। তন্দ্রা যেন তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে। তন্দ্রা সেই নির্দেশ পালন করেছিল জানতে পেরেছি। কিন্তু কেন সুমন্ত মেয়ে সাজল? বুকে এই বেলুনদুটো আটকে একেবারে মডগার্ল সেজে…

 বাধা দিয়ে পানিগ্রাহী বললেন, পরে ভেবে দেখেছিলুম, সুমন্ত সঙ্গে থাকলে ভারতবাবুকে করতলগত করতে পারবে না তন্দ্রা। বয়ফ্রেণ্ডওয়ালা মেয়ের সঙ্গে সে। মিশতে সাবধানী হয়ে উঠবে। তার চেয়ে তার মেয়েবন্ধু হয়ে থাকাটা খুব সুবিধাজনক। সুমন্ত চৌকস ছেলে। রাজনৈতিক দলে কালচারাল সুখ্যাতি আছে কর্মী। হিসেবে। সে দরকার হলে মারামারি খুনোখুনিতেও সিদ্ধহস্ত।… বলে সস্নেহে সুমন্তর দিকে তাকালেন পাণিগ্রাহী। তারপর বললেন, যাই হোক–তখন আর হাতে সময় নেই। সুমন্তকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলুম, আমি কী নামে কোথায় থাকব…

তন্দ্রাকেও কি জানিয়েছিলেন পরে–মানে, সুমন্তর মারফত?

হ্যাঁ। তা–এই গেস্ট হাউসের বেয়ারাকে দিয়ে চিঠি পাঠালুম। আপনি সেই বেয়ারাকে জিগ্যেস করলেই জানতে পারবেন।

থাক্, বলুন। সুমন্ত তখন কোথায় ছিল?

আমার বাংলোয়?

হুঁ–তাকে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়েছিলুম।

কিন্তু হাসিরাম তো একুশ তারিখ বিকেলে বাংলো সাফ করতে গিয়েছিল। সে তো কিছু বলল না।

হাসিরাম সুমন্তকে চেনে। সুমন্ত গত ইলেকশানে–এ বছর মার্চে আমার সঙ্গে বাংলোয় ছিল কয়েকদিন। তখন অবশ্য মাথায় লম্বা চুল ছিল না ওর। কিছুকাল আগে কলকাতায় ওর সঙ্গে দেখা হয়–তখন ওর মাথায় লম্বা চুল দেখেছিলুম। তাই আমার শেষ মুহূর্তে মতলব এসেছিল যে ওর যা মেয়েলি চেহারা, আনায়াসে মডগার্ল বলে চালানো যায়। অবশ্য বেয়ারার চিঠিতে আমি ওকে বুকে জলভরা বেলুন বাঁধতে লিখিনি।..হো-হো করে হাসলেন পাণিগ্রাহী। সুমও হাসল।

তাহলে হাসিরাম সুমন্তকে দেখেছিল বাংলোয়। সে আমার কাছে তাহলে কথাটা চেপে গেছে। আচ্ছা, মিঃ পানিগ্রাহী, এবার বলুন–২২ জুলাই রাত্রে আপনি কী কী করেছেন?

কথা ছিল–আমার সেই সোর্সের খবর সতি হলে সুমন্ত তক্ষুনি সোজা এখানে এসে আমাকে খবর দেবে। তাই ভীষণ উদ্বেগের মধ্যে ছিলাম। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি রেনকোট পরে বেরোলুম। তখন রাত সাড়ে দশটা। এই গেস্ট হাউসের পিছনেই একটা জংলা পথ আছে–টিলার গা ঘেঁষে আমার বাংলোয় পৌঁছেছে। আমি বেরিয়ে দোটানায় পড়লুম। সী ভিউতে যাব না, আমার বাংলোয়। সুমন্ত যদি আমাকে জানাত যে সে একুশ তারিখ রাত্রে বাংলোয় না থেকে হোটেলে তার কাছেই ছিল এবং পরের রাতেও থাকবে–তাহলে আমি বাংলোয় যেতুম না। অন্য প্ল্যান করতুম। কিন্তু আজকালকার ছেলেমেয়েদের আমি সত্যি বুঝতে পারিনে। সুমন্ত তন্দ্রার সঙ্গে রাত কাটাবে আর তন্দ্রা সব জেনেও তাতে আপত্তি করবে না–আমি ভাবিনি।

সুমন্ত চাপা স্বরে বলল, তন্দ্রা বরাবর আমার গার্লফ্রেণ্ড ছিল।

পানিগ্রাহীর স্বরে রাগ ও ভর্ৎসনা প্রকাশ পাচ্ছিল। বললেন, দা হেল অফ ইট! যা গে–আমি তখন উদ্বিগ্ন। ভাবলুম, বৃষ্টির জন্যে নির্ঘাৎ ভারতবাবুর প্ল্যান ভেস্তে গেছে-তাই তখনও কোনও খবর পাচ্ছিনে সুমন্তদের কাছ থেকে। তাই

এবার শর্মা মন্তব্য করলেন, না মিঃ পাণিগ্রাহী। এইসব রাত্রেই তাদের চমৎকার মওকা। আপনি কেন যে লোকাল থানায় মিঃ সেনাপতিকে কিছু বলে রাখেননি, সেটাই অবাক লাগছে আমার!

পানিগ্রাহী ফুঁসে উঠলেন, সেনাপতি! ও তো ভারতের লোক, মশাই! আমার সোর্স জানিয়েছিল…সেনাপতি-টেনাপতি সবাই সব জেনেও চুপ করে থাকবে।

 শর্মা বললেন, কিন্তু আপনি এলাকার রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা মিঃ পানিগ্রাহী।

পানিগ্রাহী চটে উঠলেন।…ওঁদের ওই ল্যাক অফ ভিসনের জন্যেই তো আমরা আমলাতন্দ্রের বিরুদ্ধে চেঁচাই। আপনারা মশাই বাস্তব অবস্থা কিছুমাত্র টের পান না। স্বয়ং মিনিস্টার না লাগলে আপনাদের টনক নড়ে না। আমি কোন ছার! আমি কী করতে পারি লোকাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের! যখন এম এল এ ছিলুম, তখন পারতুম। এখন এম এল এ নই স্রেফ নেতা। মিনিস্টাররাও একশোটা কথা বললে তবে একটা কথায় কান পাতেন। আমি তো মশাই যাত্রাদলের রাজা–ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার।

কর্নেল মৃদু হেসে বললেন, ফ্যাক্ট। তারপর কী হলো বলুন।

পানিগ্রাহী শান্ত হয়ে বললেন, আমি প্রথমে বাংলোয় যাওয়ার সিদ্ধান্ত করলুম। মাত্র গজ দশেক গেছি, দেখি, কে দৌড়ে আসছে। অন্ধকার ছিল–কিন্তু বিজলী চমকাচ্ছিল। সুমন্তকে চিনতে আমার ভুল হলো না। সুমন্তও আমাকে দেখতে পেয়েছিল। যাই হোক–ও আমাকে সাংঘাতিক খবর দিল। শার্কে বসে থাকার সময় কে ওদের মুখোশ পরে ছুরি নিয়ে তাড়া করে। দুজনে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আমার ফার্মে ঢুকে পড়ে। বাংলোতে যায়। সেখানে তাকে একা রেখে সে আমাকে খবর দিতে আসছিল।

একা রেখে! এই কাণ্ডের পরও? শর্মা এই প্রশ্ন করলেন।

সুমন্ত বললে, হ্যাঁ–ওকে সঙ্গে আনিনি। কারণ বৃষ্টিতে ভিজে আর এইভাবে তাড়া খেয়ে তন্দ্রা প্রায় ভেঙ্গে পড়েছিল। তাছাড়া ওর দিকেই যেন ছোরাধারী লোকটার লক্ষ দেখেছিলুম বেশি। তন্দ্রা মেয়ে। আমার পক্ষে যা সম্ভব ওর পক্ষে তা নয়। তাই ওকে রেখে এসেছিলুম। বাংলোয় সে নিরাপদে থাকবে। ভিতর থেকে ভালোভাবে দরজা আটকাতে বলে আমি তবে বেরিয়ে এসেছিলুম।

পাণিগ্রাহী বললেন, সুমন্ত আমাকে খবর দিতেই আমি আরও উদ্বিগ্ন বোধ করলুম। আমার কাছে একটা লাইসেন্সড রিভলভার আছে। আমি আর সুমন্ত তক্ষুনি ফিরে গেলুম বাংলোয়।

কর্নেল বললেন, গিয়ে দেখলেন দরজা খোলা। আর বেডরুমে তন্দ্রা রক্তাক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে।

পানিগ্রাহী ব্যস্তভাবে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ–গিয়ে সেই ভয়ানক দৃশ্য দেখলুম। সুমন্তর এ ব্যাপারে মাথা খোলে সবসময়। সে আমাকে একটা চমৎকার পরামর্শ দিল। তা না করলে এই মার্ডারের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে পড়ুক বা না পড়ুক–পড়ার চান্স তো থাকেই, প্রচণ্ড স্ক্যাণ্ডাল রটে যাবে। আমার পলিটিক্যাল কেরিয়ার নষ্ট হবে। তখন ওর কথা মতো

মড়াবওয়া লোক আর একটা খাটিয়া যোগাড় করলেন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনার বুদ্ধির প্রশংসা করছি, কর্নেল।

সুমন্ত বলল, আমি বেরিয়ে প্রথমে গেলুম সমুদ্রের কাছে শ্মশানে। শ্মশান থেকে একটা মাচান নিয়ে এলুম। অনেক খাটিয়া বা মাচান ওখানে পড়ে থাকে দেখেছিলুম। এই মাচানটা টাটকা ছিল। সেটা বয়ে সোজা নাক বরাবর ফার্মের খোলা গেটে ঢুকে বাংলোয় আনলুম। আগে গেটটা খোলা রেখেছিলুম। তারপর মাচানে তন্দ্রার লাসটা চাপিয়ে ওপাশের বারান্দায় নিয়ে গেলুমতলায় পুরনো একটা ষেক দেওয়া হয়েছিল। রক্তগুলো ধুয়ে ফেলা উচিত ছিল। কিন্তু মোমবাতির আলোয় সেটা সহজ মনে হলো না। ভাবলুম, সকালে ধুয়ে ফেলব খন। হাসিরামকে সব জানাতে হবে। যাই হোক, লাশটা দুজনে বয়ে এনে বড়ো রাস্তার ধারে একটা বটতলায় রাখলুম। তখনও বৃষ্টি থামেনি। পানিগ্রাহীদাকে এখনে সবাই চেনে। উনি চলে গেলেন। আমি গেলুম ডোমপাড়ায়। গিয়ে বললুম– পাশের গ্রামের মড়া আমারই এক আত্মীয়া। বটতলায় বৃষ্টির মধ্যে আটকা পড়েছিলুম। মড়াবওয়া লোকগুলো সব মদদ খেয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করে মড়া ফেলে পালিয়েছে। আমি ভীষণ বিপদে পড়ে গেছি। ওদের সাহায্য দরকার।…ওরা প্রথমে রাজি হলো না। সব তখন ঘুমের ঘোরে আর নেশায় টলছে তো! ওদের অনেক টাকা আর মদ খাওয়ানোর প্রস্তাবে রাজি হলো। চারজন লোক নিজেরা ঠিক করে দিল। তাদের নিয়ে পাশের খুঁড়িখানায় গেলুম। দেখি, তখনও সব মক্কেল রয়েছে। তিনটে বোতল কেনা হলো দিশী। ওরা সেখানে বসে খেল। তারপর আমার সঙ্গে বটতলায় এসে মড়া তুলল। অন্ধকার। বৃষ্টি পড়ছে। মাতাল হয়ে উঠেছে লোকগুলো। আমরা হরিধ্বনি দিতে দিতে এগোলুম।

কর্নেল বললেন, কিন্তু মড়া শেষ অব্দি শ্মশানে না নিয়ে মিঃ পানিগ্রাহীর ফার্মের জমিতে ফেললে কেন?

পানিগ্রাহী বললেন, ওটাই তো সুমন্তর অতিবুদ্ধির গলায় দড়ি!

সুমন্ত বলল, শ্মশান থেকে মাচান লুকিয়ে আনা সোজা। কিন্তু মড়া নিয়ে যে যাব, শ্মশানের রেজিস্টারের চোখ এড়াবে না। ডেথ সার্টিফিকেট চাইবে। রক্তক্ত দেখতে পাবে, তাই

কর্নেল বললেন, একথা আগে ভাবোনি তোমরা।

না স্যার। তখন দুজনেরই মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন। অতটা তলিয়ে ভাবিইনি। অন্ধকার রাতে বৃষ্টির মধ্যে ঝোঁকের বশে চলেছিলুম।

তারপর?

ফার্মের গেটের কাছে গিয়ে ঠিক করলুম–অন্য উপায় ঠিক করা যাক। আফটার অল, তা আমার গার্লফ্রেণ্ড–গভীর ভালবাসা কিছু ছিল না, কিন্তু তাহলেও স্যার–আমার মরালিটি যেটুকু আছে, তাতে বাধল। পাণিগ্রাহীদার সামনেই বলছি–আমার সন্দেহ হলো, বা রে! একটি অসহায় মেয়ে ওঁর কাজে এসেই খুন হলো। আর উনি পুলিশকে জানাবার বা খুনীকে ধরিয়ে দেবার যেন নামই করলেন না! উপরন্তু লাশটা সামলাতে বলছে! আমার বিবেকে বাধল, স্যার! আমি ঠিক করলুম–এমন কিছু করা দরকার যাতে পানিগ্রাহীদা বাধ্য হয়ে তার মার্ডারের কথা পুলিশকে জানাবেন কিংবা নিজের সম্মানরক্ষার জন্য খুনীকে ধরতে নিজের প্রভাব খাটাবেন। কিন্তু কিছুই করছেন না। তাই রাগ হলো। ওঁকে তন্দ্রার মার্ডারের সঙ্গে আমি জড়াবো ঠিক করলুম। তাই লোকগুলোকে দাঁড় করালুম। বললুম– দেখ–এখন বৃষ্টির মধ্যে লাশ চিতেয় ওঠানো অসম্ভব। রেজিস্ট্রারবাবুও হয়তো আফিং খেয়ে ঘুমোচ্ছন। সেই ভোরবেলা ছাড়া কিছু করা যাবে না। বরং এক কাজ করা যাক। লাসটা কোথাও ফেলে দিই। এত বৃষ্টির মধ্যে কী করা যাবে তোমরাই বলো? এখানটায় ফেললে মিউনিসিপ্যালিটির মেথররা তুলে কোথায় ফেলে দেবে-সঙ্কার হবে না। তার চেয়ে এই ফার্মের জমিতে ফেললে কাজ হবে। এক হোমরা-চোমরা নেতার জমি। ভোটের জন্যে ওনারা সব করেন-কী বলো? মাতাল লোকগুলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ঠিক, ঠিক। পানিগ্রাহীবাবুর জমিতেই ফেলে যাই। নির্ঘাৎ সদগতি হবে লাসটার। না করে উপায় আছে? লোকে বলবে– ওই দেখ, সামান্য খরচা করে উনি মড়াটা পোড়াতে পারলেন না! উনি আবার গরীবের হয়ে কাজ করবেন?.বুঝতেই পারছেন স্যার, মাতাল সাদাসিধে মানুষ সব। তখন ওদের দিয়ে যা খুশি করানো যায়। আমরা গেট দিয়ে ঢুকে লাশটা কোণার দিকে ফেললুম।

তোমাদের পায়ের দাগ নরম জমিতে নিশ্চয় থাকত। কিন্তু গোপালকিপোর ট্রাকটার চালিয়ে তা নষ্ট করে দিয়েছে। তবে মাচানের দুটো বাঁশের চাপে গর্ত থেকে গেছে। তোমরা মাচানের একদিক মাটিতে ঠেকিয়ে লাশটা ঠেলে ফেলে দিয়েছিলে। তাই লাশের মাথা ও পায়ের কাছে দুটো গর্ত দেখলুম। দুটো বাঁশের মাথায় চাপা পড়ে গর্ত দুটো হয়েছিল।

তাই হবে।

তারপর?

তারপর চুপিচুপি লোক চারটে চলে গেল। নিষেধ করে দিলুম ব্যাপারটা গোপন রাখতে। তা না হলে তারাও তো বিপদে পড়ে যাবে।

তুমি কী করলে।

প্রথমে আমি খাটিয়াটা নিয়ে গিয়ে শ্মশানে ফেলে দিলুম। তোষকটা আর দড়িগুলোসুষ্ঠু। তারপর ভিজতে ভিজতে ফিরলুম। তখন রাত একটা বেজে গেছে। আমি বাংলোয় গিয়ে রইলুম। আর কোন চুলোয় যাব, বলুন?… পানিগ্রাহীদার ওপর আমার খুব রাগ হয়েছিল। তাছাড়া কেমন সন্দেহও জাগতে শুরু করেছিল। ভারতবাবুর ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হচ্ছিল… ।

পানিগ্রাহী ফুঁসে উঠলেন–যা-তা কী বলছ সুমন্ত?

কর্নেল বাঁধা দিলেন।..প্লীজ। সুমন্ত, তুমি বলো।

সুমন্ত বলল, ওই বাংলোয় রাত কাটানো কী দুঃসাধ্য তখন। যে-ঘরে যে বিছানায় শুয়েছি, তার একহাত দূরে তাকে কেউ স্ট্যাব করেছেউঃ! হরিবল। ঘুম তো হলোই না। বৃষ্টি ছাড়ল শেষরাত্রে। ভোরে উঠে বেরিয়ে চলে গেলুম পাহাড়ের ওপর আশ্রমে। অনেকক্ষণ কাটালুম। মাথা ঘুরছিল। তারপর সটান গেলুম সেলুনে। কারণ, বুঝতে পারছিলুম, আমার লম্বা চুল শক্ত হয়ে উঠেছে। তারপর সব জানতে পারলুম লোকের মুখে। সমুদ্রের ধারে-ধারে ঘুরে ঠিক করলুম, পানিগ্রাহীদার কাছে কৈফিয়ত নিতেই হবে। আগাগোড়া একটা ভাওতার মধ্যে কেন উনি আমাকে আর তাকে ঘোরালেন?..

পানিগ্রাহী লাফিয়ে উঠলেন কিন্তু কর্নেল তার হাত ধরে নিবৃত্ত করে বললেন, অধৈর্য হবেন না মিঃ পানিগ্রাহী। সুমন্ত ইজ রাইট। ভারতবাবুর গতিবিধির উপর নজর রাখতে চেয়েছিলেন তার প্রমাণ আপনার এই তৃতীয় চিঠিটি। এবং…

সুমন্ত বলে উঠল, পানিগ্রাহীদার হুকুমে অনেক কাজ করেছি। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমাকে বুকে বেলুন বেঁধে মডগার্লও সাজতে হলো! এখন আমার সবটাই এত অপমানজনক মনে হচ্ছে। এর মধ্যে ওঁর কোনও পলিটিক্যাল মোটিভ নেই! সবটাই ব্যক্তিগত। নিশ্চয় ভারতবাবুর ওপর অন্য কোনও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা আছে ওঁর।

আবার দুপক্ষকে সামলাতে হলো। কর্নেল বললেন, উত্তেজিত হবেন না কেউ–প্লীজ। আমরা কেসের খুব ভাইটাল পয়েন্টে এসে গেছি।

পানিগ্রাহী বললেন, ব্যক্তিগত ব্যাপার হবে যদি, সি.বি.আই. থেকে মিঃ শর্মাকে কি ছেলেখেলা করতে ডেকেছিলুম?

সুমন্ত বলল, দ্যাটন দা শো বিজনেস; ওটা আপনার চালাকি!

কর্নেল বললেন, প্লীজ, প্লীজ! আচ্ছা মিঃ পানিগ্রাহী, এই গেস্টহাউস থেকে বেরোতে হলে নিচের লাউঞ্জ পেরোতেই হবে–আমি লক্ষ করে এসেছি। তাহলে আপনার এখানে চেক ইন করা অব্দি কবার বাইরে বেরিয়েছেন, তার রেকর্ড আমরা ম্যানেজারের কাছে পেয়ে যাব। কী বলেন?

পানিগ্রাহী বললেন, একশোবার পাবেন। নিচে চব্বিশ ঘণ্টা কেউ না কেউ কাউন্টারে থাকে। হয় ম্যানেজার, নয় কোনও ক্লার্ক। নাইট ডিউটির ব্যবস্থা রয়েছে। চেক করুন, তাহলে বুঝবেন। মাত্র একবারই আমি বেরিয়েছিলুম–গতরাত্রে। জাস্ট সাড়ে দশটায়।

কর্নেল পকেট থেকে এবার আরেকটা নীলখামের চিঠি বের করে বললেন, এই চিঠিটা আমি বাংলোয় পেয়েছি। ওপরে লেখা রয়েছে প্রাপক শ্রী মদনমোহন পাণিগ্রাহী। কিন্তু চিঠিটার লেখকও শ্রী মদনমোহন পানিগ্রাহী। তারিখ ২১ জুলাই।

হ্যাঁ–আমি ওই চিঠিতেই সুমন্তকে মেয়ে সাজবার নির্দেশ দিয়েছিলুম। প্রাপকের নাম…।

বুঝেছি। ওটা আপনার সর্তকতা। চিঠিটা দেখেই আমার অবাক লাগে। তখনই জানতে পারি, আপনি কোথাও আছেন, এই চন্দনপুর-অন-সী-তেই। সম্ভাষণ করেছেন প্রিয় এস বলে। যাই হোক, এই চিঠিটা আপনার তন্দ্রাকে লেখা তৃতীয় চিঠির পরিপূরক। বাই দা বাই, সুমন্ত একটা সবে ধরানো সিগারেট নিবিয়ে ফেলে এসেছ কি তুমি?

সুমন্ত বলল, তাকে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়েই আমি বেরিয়েছিলুম পানিগ্রাহীদার কাছে।

সবে ধরিয়ে দিয়েই বেরিয়েছিলে?

হ্যাঁ! ও সিগারেট খুব কম খেত। এই মানসিক অবস্থায় খেতে চাচ্ছিল না। আমি চলে আসার সময় ওকে বললুম–সিগারেট খাও, তাহলে ভয় করবে না। সিগারেটটা শেষ হবার আগেই আমি ফিরব। মোমবাতির আলো আছে–ভয় নেই। আর…বেডরুমে বিছানায় একটা ছোরা রেখেছিলুম। ছোরাটা সঙ্গে নিয়ে বেড়ানোর অসুবিধে ছিল–বেশ বড় ছোরা। তাছাড়া ছোরা নিয়ে বেড়ানোর কী দরকার, বুঝতে পারিনি। যাই হোক, ছোরাটা ওকে দিয়ে এসেছিলুম।

ছোরাটা বাংলোয় দেখতে পাইনি আমি।

আমরাও পাইনি স্যার। যখন তাকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখলুম, ছোরাটা খুঁজছিলুম তন্ন তন্ন করে। আমি তো জানতেই পারছিলুম, খুনী ওই ছোরাটাই মেরেছে তাকে।

 রাইট। তুমি চলে যাওয়ার পর জঙ্গলের পথে কিংবা কোথাও গাড়ি দেখেছিলে কি?

না স্যার।.. বলে একটু ভেবে নিয়ে সুমন্ত ফের বলল, তবে পানিগ্রাহীদাকে নিয়ে যখন বাংলোয় যাই, তখন জঙ্গলের দিকে পাহাড়ের পশ্চিম পিঠে একটা আওয়াজ আমার কানে এসেছিল। গাড়ির আওয়াজ বলে মনে হচ্ছিল। পানিগ্রাহীদাকে বললুম– কথাটা কিন্তু উনি বললেন–মেঘ ডাকার শব্দ।

পাহাড়ের দক্ষিণ গা দিয়ে যে-পথ, সে-পথে তোমরা এসেছ বা গেছ। কিন্তু পশ্চিম গা দিয়ে গাড়ি চলার কোনও পথ আছে কি?

আছে স্যার। তবে কোনও তৈরি রাস্তা নয়। ঝোপঝাড় বিশেষ নেই। বালিয়াড়ি মতো আছে। ইচ্ছে করলে কেউ পাহাড় ঘুরে পশ্চিম থেকে উত্তর হয়ে পুবদিকে এসে আশ্রমের পথে উঠতে পারে। তারপর এইগেস্টহাউসের পিছনের সদর রাস্তায় আসা যায়।

মিঃ পানিগ্রাহী, পিছনটা তো আপনার ঘর থেকে দিব্যি দেখা যায়। কোনও গাড়ি দেখেছিলেন রাত্রে?

পানিগ্রাহী বললেন, অসম্ভব! রাত্রের বৃষ্টি ছিল অকল্পনীয়। ওই অবস্থায় কেউ গাড়ি বের করতে সাহস পাবে না।

কিন্তু আমি বাংলোর পূর্ব গেটে গাড়ির চাকার দাগ দেখেছি। হিলের দক্ষিণ দিককার জঙ্গলের রাস্তা–মানে আপনাদের যাওয়া-আসার রাস্তা অবশ্য পাথুরে। কোনও দাগ পাইনি। যদিও ভেবেছিলুম, এই পথেই রাত্রে বৃষ্টির মধ্যে একটা গাড়ি এসেছিল এবং চলে গেছে। ভেবেছিলুম নয়–গাড়ি যাওয়া-আসা ফ্যাক্ট। কিন্তু উত্তর অংশটা খুঁজিনি। এখন মনে হচ্ছে ওদিক দিয়েই গাড়িটা এসেছিল এবং চলে গিয়েছিল।

অ্যাবসার্ড! কে অত রাত্রে গাড়ি নিয়ে যাবে–আমার বাংলোয়?

খুনী যাবে–উঁহু, গিয়েছিল। সুমন্ত চলে আসার পরেই সম্ভবত কয়েক মিনিটের মধ্যে গাড়িটা গিয়েছিল ওখানে।

তাহলে তো আলো নজরে পড়ত!

ঠিক। আলো জ্বালেনি খুনী। অন্ধকারেই গিয়েছিল।

 অসম্ভব! ওই বিপথে ঝোপঝাড় বালিয়াড়িতে

মিঃ পানিগ্রাহী, ধরুন, ওই জায়গা–তার মানে পুরো এলাকা খুনীর এত মুখস্থ যে সে বিন্দুমাত্র অসুবিধা বোধ করেনি। সে এমন লোক যে বাংলোর চারপাশের নাড়িনক্ষত্র তার জানা। তাই আলো জ্বালাতে হয়নি। আলো জ্বাললে অনেকের চোখে পড়ত। তাছাড়া চুপি চুপি আসতে চেয়েছিল সে।

কে হতে পারে সেভারতবাবু ছাড়া? নির্ঘাৎ ওই শয়তানটা। আপনার বর্ণনা অনুযায়ী এবার আমার ধারণার কথা বলি। খুনী চুপি চুপি এসে বাংলোর দরজায় নক করেছিল। উঁহু, সে সোজা তন্দ্রার নাম ধরে ডেকেছিল। বোঝা যায়, তন্দ্রা তার সুপরিচিত। তাই সে তাকে তক্ষুনি দরজা খুলে দেয়। এবং তাকে সে রীতিমতো শ্রদ্ধাভক্তি করত বলেই তক্ষুনি সিগারেটটা হাঁটুর পাশে সোফার গায়ে ঘষে নিভিয়ে ফেলে। বলতে বলতে নিজের যুক্তির শক্তিমত্তা নিজেই টের পেয়ে পানিগ্রাহী লাফিয়ে উঠলেন।…মিলে যাচ্ছে, একেবারে দুয়ে দুয়ে চার মিলে যাচ্ছে। এখানে হোটেলওয়ালা ভারতবাবু ছাড়া তার তো আর কারও সঙ্গে আলাপ ছিল না। আর ওকে সে বয়সের খাতিরে হোকনজর রাখার সুবিধে হবে বলে অন্তরঙ্গ হয়ে শ্রদ্ধাভক্তি দেখাতে চেয়েছিল নিশ্চয়। বলে যান–আমার কাছে খুনীর চেহারা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। এতক্ষণ ধারণা ছিল, তার লোক তাকে খুন করেছে। এবার বোঝা যাচ্ছে না, সে নিজেই ওকাজ করেছে। মিঃ শর্মা, তাহলে বুঝতে পারছেন তো? নিশ্চয় তন্দ্রা কিছু জেনে ফেলেছিল আঁটঘাটের খবর। তাই ভারত মরীয়া হয়ে উঠেছিল।

শর্মা বললেন, তাই দাঁড়াচ্ছে বটে। প্রথমে মুখোশপরা লোক লাগিয়ে রাংতার ছোরা দেখিয়ে ভয় পাইয়ে দেওয়া যথেষ্ট মনে হয়নি। কারণ, সেই মুখোশধারী সম্ভবত ফিরে গিয়ে বলে থাকবে যে আসামিরা ফার্মে ঢুকে পড়েছে। তার মানেই প্রতিদ্বন্দ্বী পানিগ্রাহীসায়েবের লোকের কানে যাওয়া! আরও বিপদের সম্ভাবনা এবার। কাজেই একেবারে খতম করাই ভাল। ভারতবাবুকে চেনে তন্দ্রা। কাজেই তাকে দেখল…

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, প্লীজ প্লীজ! আমাদের এখন আরও কিছু প্রমাণ সংগ্রহ বাকি আছে। সুমন্ত, এবার আমার আরও কিছু প্রশ্নের জবাব দাও।

— পানিগ্রাহী কটমট করে তাকালেন সুমন্তের দিকে। সুমন্ত গ্রাহ্য করল না। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে সপ্রতিভ মুখে বলল, বলুন স্যার?

কর্নেল বললেন, একটা কাগজ তুমি আর তন্দ্রা পড়ছিলে শার্কে বসে থাকার সময়। তারপর তন্দ্রা কাগজটা কুচিকুচি করে ফেলে দেয়। কী সেটা?

একটা উড়ো চিঠি, স্যার। দুপুরে ডাইনিং হলে খেয়ে আমি আর তন্দ্রা ওপরে স্যুটে ঢুকলুম, দেখি–চিঠি পড়ে রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে :

ডাইনি মেয়ে দুটোকে–

তোরা যদি আজই হোটেল ছেড়ে না যাস, ভীষণ বিপদ হবে। তোদের যে পাঠিয়েছে, তাকে বলিস–পাখি উড়ে গেছে চিরকালের মতো …

এই সময় পানিগ্রাহী প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, অ্যাঁ! উড়ো চিঠির কথা তো বলোনি!

কর্নেল পকেট থেকে লম্বা সরকারী খাম বের করলেন। তারপর ভিতর থেকে কয়েকটা কুচি কাগজ বের করে বললেন, এগুলো চিনতে পারছ?

সুমন্ত সোৎসাহে বলল, হ্যাঁ স্যার। ওইটাই। বড়বড় আঁকাবাঁকা হাতের লেখা। ইংরেজিতে লেখা–হ্যাঁ, ওটাই বটে।

কর্নেল পানিগ্রাহীকে প্রশ্ন করলেন, আপনি চিনতে পারছেন, এ হাতের লেখা কার?

পানিগ্রাহী একবার দেখে নিয়ে বললেন, না। তাছাড়া অমন টুকরো কাগজের লেখা চেনা অসম্ভব আমার পক্ষে। তবে বাজী রেখে বলব, ও ভারতের লেখা। এক্সপার্টের কাছে পাঠান।…তারপর সুমন্তের দিকে কটমট করে চেয়ে বললেন, তুমি একটা ওয়ার্থলেস!

কর্নেল কুচিগুলো খামে ভরে সুমন্তকে বললেন, তাহলে চিঠিটা তোমরা। গতকাল দুপুরে খাওয়ার পর পেলে। তারপর কী করলে?

সুমন্ত বলল, টের পেলুম, পানিগ্রাহীদা ঠিক জায়গায় তাক করেছে। তাকে বললুম– ভয়ের কারণ নেই। পানিগ্রাহীদা নিশ্চয় পুলিস আর নিজের লোকজন নিয়ে তৈরি হচ্ছেন। উনি বলে দিয়েছিলেন, ২২ তারিখ রাত্রেই কিছু ঘটবে। কাজেই রাত্রি আসুক আগে। আমরা কড়া নজর রাখি। কিন্তু তন্দ্রা আমাকে একটা অদ্ভুত কথা বলল।

কী কথা?

বলল–পানিগ্রাহীসায়েব ভারতবাবুর ওপর লক্ষ রাখতে বলেছেন, তার পিছনে কোকেন, এল এস ডি বা নিষিদ্ধ ড্রাগের চোরাকারবার ধরা মোটেও উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্যটা সে এবার টের পেয়ে গেছে।… সুমন্ত থামল।

পাণিগ্রাহী তেড়ে এলেন।…কী উদ্দেশ্য বলল তন্দ্রা?

কর্নেল বললেন, প্লীজ, প্লীজ! সুমন্ত তুমি বলো।

সুমন্ত বলল, ভারতবাবুর সঙ্গে এক ভদ্রমহিলার কী সম্পর্ক–তন্দ্রা বলল মিঃ পানিগ্রাহী যেন সেটাই জানতে চান আসলে। তন্দ্রা আরও বলল, তিন নম্বর চিঠিতে তাকে বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে..

কর্নেল কথা কেড়ে বললেন, হ্যাঁ–বিশেষ করে কোনও মহিলার সঙ্গে ভারতবাবুর যোগাযোগ ঘটেছে কি না।

ঠিক তাই স্যার। তা তাকে বললুম– তুমি কীভাবে জানলে যে ওটাই আসল কারণ। তন্দ্রা বলল–চিঠির নির্দেশ অনুযায়ী আমি নজর রেখে দেখলুম এ স্যুটে এক ভদ্রমহিলা আছেন। ভারতবাবু প্রায়ই তার ঘরে গিয়ে কাটাচ্ছেন। ২১ তারিখ রাত্রে আকাশ পরিষ্কার ছিল। দুজনকে বাইরে থেকে আসতে দেখেছিল নাকি তন্দ্রা–আমি ঘুমোছিলুম। তন্দ্রা বলল, সে উঁকি দিয়ে দেখল– নির্জন করিডরে ভারতবাবু আর মহিলা ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলছেন। হঠাৎ সেই সময় মহিলাটির চোখে পড়ে তার সুইটের দরজায়। অমনি ওরা সরে আলাদা হয়ে যায়। আর তন্দ্রাও দরজা বন্ধ করে। কাজেই তন্দ্রা বলল–তার ফেমিনিন ইনস্টিংক্ট অনুযায়ী নাকি মিঃ পানিগ্রাহীর আসল লক্ষ ওটাই। আমরা দুজনে সারা বিকেল ওই নিয়ে আলোচনা করলুম। ভদ্রমহিলাকে আমি দেখিইনি। যাই হোক, আমরা দুজনে সিদ্ধান্তে এলুম যে ২২ তারিখ-টারিখ কোনও ব্যাপারই নয়। আসলে ওই সময়ের মধ্যে ওই ভদ্রমহিলার আসার কথা ছিল এখানে–এটা পানিগ্রাহীদা জানতে পেরেছিলেন। তাই আমাদের গোয়েন্দা হিসেবে লাগিয়েছিলেন। আমরা দুজনেই চন্দনপুরে অচেনা বললেই হয়। গত মার্চে আমি এদিকে ইলেকসানে খেটে গেছি কিন্তু তখন তো মাথায় লম্বা চুল ছিল না আমার। আর অত মনেই বা কে রাখে! অমন কয়েকডজন কর্মী খেটেছিল।

কর্নেল বললেন, এক মিনিট! মিঃ পানিগ্রাহী, আপনার ফোনটা একবার নেব?

পানিগ্রাহী ক্লান্তভাবে বললেন, হ্যাঁনিন না। হোটেলে রিং করবেন?

না। সেনাপতিকে। বলে কর্নেল ফোন তুললেন।…একবার প্লীজ থানায় দিন।…হ্যাঁ, হ্যালো! কে বলছেন? মিঃ সেনাপতি ফিরেছেন?…কেউ ফেরেননি? ডাঃ পট্টনায়কের ওখানে গেছেন? আমি কর্নেল সরকার বলছি। ঠিক আছে। ছাড়ছি?

কর্নেল ফোন ছেড়ে সরে এলেন। হ্যাঁ, সুমন্ত, তারপর বলল।

সুমন্ত বলল, আমরা সমুদ্রের ধারে ঘুরছি, বৃষ্টি এসে গেল। তখন সামনে শার্কে ঢুকলুম। আগের দিনও ঢুকেছিলুম। বেশ সুন্দর বার-কাম রেস্তোরাঁ। তন্দ্রার ওই অভ্যাস। একবার কিছু মাথায় এলে তা নিয়ে সিরিয়াস হয়ে যাবে। আমরা হোটেলে গিয়ে সোজা পানিগ্রাহীদার কাছে গিয়ে রিপোর্টটা দেব আর সোজা জেনে নেব রহস্য–এই হলো আমাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু বৃষ্টি দেরি করিয়ে দিল। তারপর হঠাৎ ছোরা হাতে মুখোশপরা মূর্তি এসে…

কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। সুইট নাম্বার এতে মহিলাটিকে দেখেছিল তন্দ্রা?

হ্যাঁ, স্যার।

 মিঃ পানিগ্রাহী, মহিলাটি কে?

পানিগ্রাহী ভুরু কুঁচকে বললেন, ওসব সুমন্ত আর তন্দ্রার অলীক ধারণা। অবশ্য ভারতের লাম্পট্য চিরাচরিত। সবাই জানে। ওরা দুজনেই ভুল করেছিল। আসলে আমার খবর ছিল–মহিলাদের মারফতও ড্রাগ পাচার হয়। তাই ওদের মহিলাদের দিকেও লক্ষ রাখতে বলেছিলুম। তাছাড়া–কোন মহিলার সঙ্গে ভারতের কী হচ্ছে না হচ্ছে জানবার জন্যে আমি মিঃ শর্মাকেই বা কেন কষ্ট করে দিল্লি থেকে আসতে বলব? আর কেনই বা অত গাঁটের পয়সা খরচ করে দু-দুটো লোক লাগাব? বলুন–কোনও যুক্তি আছে।

কর্নেল বললেন, –আছে। যদি মহিলাটি… বলেই চুপ করে গেলেন হঠাৎ। পানিগ্রাহী ঝুঁকে এলেন।…বলুন বলুন।

থাক। আমি আগে নিশ্চিত হতে চাই–তারপর সিদ্ধান্তে আসব। আচ্ছা মিঃ শর্মা, উঠি তাহলে। আপনি বিশ্রাম করুন। মিঃ পানিগ্রাহী, চলি। সুমন্ত তুমি তুমি বরং এস আমার সঙ্গে।

পানিগ্রাহী গম্ভীর হয়ে বললেন, ও থাকবে কর্নেল। ওর সঙ্গে আমার কথা আছে।

কর্নেল হাসিমুখে সুমন্তর দিকে তাকালেন।…সুমন্ত, আমার মনে হয় পুলিস তোমার এজাহারটা দাবি করবে। সেটা শীগগির হলেই তোমার পক্ষে নিরাপদ।

সুমন্ত উঠে বলল, নিশ্চয়। চলুন কর্নেল। পানিগ্রাহীদা, পরে দেখা হবে।

সুমন্ত কর্নেলের আগেই বেরিয়ে এল। শর্মা করিডর অব্দি এসে চাপা গলায় বললেন, সবটাই ধাঁধা, কর্নেল। যাক গে, খুব ক্লান্তি লাগছে। যা জার্নির ধকল গেছে। আমি একটু জিরিয়ে নিই। ওবেলা দেখা হবে।

পানিগ্রাহী গুম হয়ে ঘরে একা বসে রইলেন।

রাস্তায় নেমে কর্নেল বললেন, বাংলোয় পাওয়া সিগারেট কেসটা…

সুমন্ত কথা কেড়ে বলল, ওটা আমাকে ডঃ পট্টনায়কের মেয়ে কল্যাণী প্রেজেন্ট করেছিল। গত ইলেকশানে এসে কল্যাণীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। একটু হৃদ্যতাও হয়েছিল।

তাহলে পট্টনায়ক-ফ্যামিলি তোমাকে ভালই চেনেন। অথচ তুমি বললে, এখানে তুমি অচেনা।

ফ্যামিলিতে বিশেষ চেনে না। চেনে শুধু কল্যাণী। সে তো কলকাতায় আছে এখন।

উঁহু, কল্যাণী এসেছে।

কল্যাণী এসেছে নাকি? বাঃ, জানতুম না। ভালই হলো। উঃ, দুটোদিন যা লুকোচুরি খেলা গেছে, কোনওকিছু ভাববার ফুরসতই পাইনি। আমি বরং তাহলে ওদের বাড়িতেই থাকব আজ রাত্তিরটা। কাল সকালে কেটে পড়বখন।

কল্যাণীর সঙ্গে তোমার আলাপ কীভাবে হয়েছিল?

বললুম– তো–এখানে এসে–মার্চ মাসে। একটা ফাংশান মতো হয়েছিল। আমি গীটার বাজিয়েছিলুম। গীটার সঙ্গে ছিল না। তাই গীটারের খোঁজ করছিলুম। তখন বউদি–মানে পানিগ্রাহীদার স্ত্রী কল্যাণীদের বাড়ি থেকে আনিয়ে দিলেন। ওই সূত্রে কল্যাণীর সঙ্গে চেনাজানা হলো। বউদির সঙ্গে কল্যাণীদের ভীষণ ভাবটাব ছিল, দেখেছিলুম।

কর্নেল অন্য কথা ভাবছিলেন। এ-যুগের ইয়ংম্যানরা ভারি আশ্চর্য। বেচারা তন্দ্রা!

.

০৯.

পথিমধ্যে বিস্ফোরণ

কর্নেল ভাবছিলেন, পাখি উড়ে গেছে–এই উড়ো চিঠির খবর পানিগ্রাহীকে সুমন্ত দেয়নি বলে তিনি যেন বিচলিত বোধ করলেন। কেন? দ্বিতীয়ত পানিগ্রাহীর নির্দেশ ছিল–ভারতবাবু সংক্রান্ত (এবং কোনও মহিলা সংক্রান্তও বটে) যা কিছু ঘটবে, সব তাকে দুজনে যেন জানায়। এই দুটো ব্যাপার কেবলই মাথায় জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সুমন্ত তেমন কোনও ভদ্রমহিলাকে লক্ষ করেনি হোটেলে। এর কারণ বোঝা যায় দুটো। এক : সুমন্ত মেয়ে সেজে থাকায় সে স্বভাবত খুব বেশি ঘোরাফেরা করেনি প্রকাশ্যে। দুই : সুমন্ত তার গার্লফ্রেণ্ড তাকে পেয়ে মেতে উঠেছিল। অন্যদিকে চোখ রাখবার স্পৃহা ছিল না। একজন তথাকথিত মড-এর পক্ষে এগুলো অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু সুমন্তের মতো ছেলের পক্ষে কতটা স্বাভাবিক?

এ সুইটের মহিলাটি কি এখনও আছেন হোটেলেঃ কর্নেল খুব জোরে পা চালিয়ে হাঁটছিলেন। কোথাও রিকশো দেখা যাচ্ছে না। রোদ নেই অবশ্য–মেঘলা দিনের বিষণ্ণতা আছে। হোটেলে যাওয়া খুবই জরুরী। কর্নেল যত এগোলেন, তত তার ধারণা দৃঢ় হলো যে, এ সুইটের মহিলাটি ভোরেই কেটে পড়েছেন সম্ভবত। নির্বোধ না হলে নিশ্চয় থেকে যাবেন।

সুমন্ত শিস দিতে দিতে হাঁটছিল। সত্যি, তার অবাক লাগে কর্নেল ভাবলেন– একালের ইয়ংম্যানদের তিনি বুঝতে পারেন না। এরা এত নির্বিকার আর তাৎক্ষণিকতাবাদী! সব ওমর খৈয়ামের চেলা একেকটি।…জীবনসুরা শূন্য হবার। আগে/পাত্রখানি নাও ভরে নাও, নিবিড় অনুরাগে।… এরা কেমন যেন নিঃসাড়, বোধশূন্য, জড়ভরত! যন্ত্রের মতো রোবোটই বলা যায়। পূর্বপুরুষদের সূক্ষ্মতম ইন্দ্রিয়গুলি এরা জন্মের সঙ্গে বয়ে আনেনি। গভীর যা কিছু তা এদের স্পর্শ করে না। বাংলায় একে বলে–গোলেমালে হরিবোল দিয়ে কাটানো।

কর্নেল! সুমন্ত ডাকল।

 হ্যাঁ সুমন্ত, বলো।

 পুলিশ আমাকে অ্যারেস্ট করবে নাকি?

কর্নেল হাসলেন।… তুমি যদি অসত্য কিছু না বলো, পুলিশ তোমাকে গ্রেফতার করবে বলে মনে হয় না।

আপনার কি মনে হচ্ছে আমি কোথাও কিছু মিথ্যা জুড়েছি।

দ্যাট ডিপেণ্ডস, মাই ডিয়ার ইয়ং ফ্রেণ্ড।

ডিপেণ্ডস অন হোয়াট? কিসের ওপর?

পানিগ্রাহীর সঙ্গে তোমার সম্পর্কের ওপর।

ওঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক শুধু টাকার। স্রেফ মানি অ্যাণ্ড নাথিং এক্স।

শার্ক থেকে তাড়া খেয়ে তুমি আর তন্দ্রা যখন বাংলোয় ঢোকো, তখন সময় কত ছিল? আমি তখন জিগ্যেস করিনি। মোটমাট ঘটনাটি জানতে চেয়েছিলুম শুধু। কিন্তু পুলিশ চায় অবজেকটিভ ফ্যাক্টস অ্যাণ্ড ফ্যাক্টরস। মাইণ্ড দ্যাট, সুমন্ত। আজকাল পুলিশের কাজকর্ম মোর সায়েন্টেফিক প্রসেসে চলে। অন্ধকারে তারা কিছু হাতড়ায় না। কটার সময় তোমরা বাংলোয় ঢুকেছিলে?

ঘড়ি দেখিনি তখন। তবে আন্দাজ সাড়ে নটা হবে।

কতক্ষণ পরে তুমি তাকে রেখে বেরিয়েছিলে?

আধঘণ্টা প্রায়–হা, ওইরকমই হবে।

ঢুকেই কি সিগারেট ধরিয়েছিলে?

 কেন স্যার?

প্লীজ সুমন্ত– নেভার স্যার! তুমি আমাকে কর্নেল বলেই ডেকো। দ্যাট আই লাইক মাচ।

সিগারেট… ।

হ্যাঁ-সিগারেট। খুব ভেবে জবাব দাও।

ঢুকে ভিজে কাপড়-জামা বদলে নিইধরুন, পাঁচ মিনিট। তন্দ্রার বদলানোর উপায় ছিল না। হা–ঢোকার মিনিট পাঁচ পরে সিগারেট ধরালুম।

কর্নেল মনে মনে হিসেব করে বললেন, ধরা যাক্ কুড়ি মিনিট। তুমি ওঠার সময় তাকে নিজের সিগারেট থেকে সিগারেট ধরিয়ে দিয়েছিলে?

হ্যাঁ। কিন্তু কুড়ি মিনিট কী বলছেন?

তুমি চেইনস্মোকার–কিন্তু বিশেষ বিশেষ সময়ে।…এটা তুমি জানো?

 সুমন্ত অবাক হলো।…না তো!

তুমি সবসময় সিগারেট খাও না, তাই না?

 হ্যাঁ। তা খাইনে বটে। খুব ভাবনা-টাবনা থাকলে খাই।

তখন চেইনস্মোক করো। অর্থাৎ নিজের সিগারেট থেকে ধরিয়ে ঘন-ঘন টানো।

সুমন্ত মাথা নাড়ল।…ঠিক বলেছেন কর্নেল।

ধরলুম–প্রতি সিগারেট পুড়তে ম্যাক্সিম্যাম সময় লাগুক পাঁচ মিনিট তোমার ক্ষেত্রে। কেমন? তাহলে বাংলোয় তুমি তিনটে সিগারেট খেয়েছিলে মোট। তার মানে বেশিপক্ষে পনের মিনিট। পাঁচ মিনিট জামা কাপড় বদলেছ। তাহলে কুড়ি হলো। তুমি বড়জোর কুড়ি মিনিট পরে বেরিয়েছিলে সুমন্ত, আধঘণ্টা নয়।

তা হতে পারে।

বাংলো থেকে গেস্ট হাউস যেতে যেখানটায় পানিগ্রাহীসায়েবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, দূরত্ব কতটা বলতে পারো?

তা-তিন-চারশো মিটার হবে।

তিন-চারশো? উঁহু–থাক। দূরত্ব মাপা তোমার কর্ম নয়। বলো–আন্দাজ কতটা সময় হেঁটে ওঁর দেখা পেয়েছিলে?

দৌড়ে যাচ্ছিলুম তো। মিনিট ছ সাত–উঁহু, মিনিট চারেরনাঃ, কর্নেল, মিনিট হিসেব করা মুশকিল। উত্তেজনার ঝেকে দৌড়োনো বৃষ্টি পড়ছিল।

ওই পথটার যা অবস্থা দেখেছি তাতে আমার ধারণা, খুব সহজে তুমি দৌড়তে পারছিলে না। পাথুরে পথ–তাছাড়া পিচ্ছিল হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। সমতলও নয়। অতএব আমার ধারণা, .. কর্নেল একটু থেমে ফের বললেন, পানিগ্রাহী বলছিলেন, ঠিক সাড়ে দশটায় উনি তোমার খোঁজে বেরোন। তাহলে সুমন্ত, বেশিপক্ষে আমি দশ-পনের মিনিট পরেই ধরে নিচ্ছি তোমারে সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল পৌনে এগারোটা নাগাদ। শার্কের নব বলেছে, সাড়ে নটায় মুখোশধারী ঢোকে। অতএব শার্ক থেকে বাংলো পাঁচ মিনিট যথেষ্ট, তারপর কুড়ি মিনিট, হলো পঁচিশ। তার মানে বাংলো থেকে বেরিয়েছিলে রাত নটা পঞ্চান্ন বা ধরো দশটা। কেমন? এবার সুমন্ত, টাইম ফ্যাক্টর গোলমেলে হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আন্দাজ কমপক্ষে আধঘণ্টা, বেশিপক্ষে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় হাতে রইল। এতটা সময় তুমি নিশ্চয় ওই রাস্তায় দৌড়োওনি! দ্যাটস অ্যাবসার্ড। তোমার কথাতেই বলি–তিন-চারশো গজ রাস্তা দৌড়োতে অতটা সময় কোনও অবস্থাতেই লাগতে পারে না। দ্বিতীয়ত তোমার পোশাক বদলানো–এটাও গোলমালে ফেলছে। বলেই কর্নেল একলাফে সুমন্তর একটা হাত ধরে ফেললেন, পালানোর চেষ্টা করো না সুমন্ত। আমি দেখতে বুড়ো হলেও পেশীগুলো বুড়ো হয়নি।

সুমন্ত ধস্তাধস্তি শুরু করল রাস্তার মধ্যে। কিন্তু কর্নেলের গায়ে অসুরের শক্তি। তারপর তিনি পকেট থেকে একহাতে রিভলভারটা বের করে ওর কাঁধে নল ঠেকালেন।…সুমন্ত, চুপচাপ আমার সঙ্গে চলল। আমি এ জীবনে কারও বেয়াদপি বরদাস্ত করিনি। হ্যাঁ–পা বাড়াও।…

.

১০.

কল্যাণীর কীর্তি

কর্নেল ওইভাবে সুমন্তকে নিয়ে ডাঃ পট্টনায়কের ঘরে ঢুকতেই সবাই চমকে উঠেছিল। ডাঃ পট্টনায়ক, মিঃ সেনাপতি, মিঃ আচার্য, পট্টনায়কের স্ত্রী মালবিকা, তার মেয়ে কল্যাণী আর একটি অচেনা যুবক বসে ছিল। কর্নেল ঢুকেই বললেন, মিঃ সেনাপতি, এই শ্রীমানটিকে এবার আপনার জিম্মায় তুলে দিতে চাই। বিহিত ব্যবস্থা করুন। এই যুবকটি অবশ্য ডাঃ পট্টনায়ক-ফ্যামিলির সুপরিচিত।

সেনাপতি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, কে ও? মার্ডারার নাকি?

ঘরসুদ্ধ নড়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। পট্টনায়করা স্বামী-স্ত্রী অস্ফুটে বললেন সুমন্ত! আশ্চর্য তো!

অচেনা যুবকটি লাফিয়ে উঠে বলল, এই সেই মুখ–বলেই অবাক হয়ে চুপ করে গেল।

কর্নেল হেসে বললেন, হ্যাঁ–ইনিই তিনি। মিস তন্দ্রা ভাদুড়ীর সঙ্গী বা সঙ্গিনী যাই বলুন। এবং তার হত্যাকারীও বটে।

 যুবকটি বলল, সর্বনাশ! এ তো দেখছি আমাদের মতোই পুরুষমানুষ। চুল কেটে ফেলেছে দেখছি। তাহলেও চিনতে ভুল হচ্ছে না। কাল বিকেলে এই আমাকে টাকা দিয়েছিল জোক করার জন্যে। হা-এই। ওই তো বাঁ-হাতে উল্কি রয়েছে।

সেনাপতি তক্ষুনি দুজন সেপাই ডেকে সুমন্তকে তাদের জিম্মায় থানায় পাঠিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, এই ভদ্রলোকের নাম প্রবীর দাশ, একজন হরবোলা–আবার মডার্ন বহুরূপীও বলতে পারেন। সী বিচে নানারকম ফান দেখিয়ে রোজগার করা এঁর পেশা। কাল বিকেলে তার সঙ্গী বা সঙ্গিনী যাই বলুন প্রবীরবাবুকে বলেছিল, শার্কে গিয়ে রাত নটার পর মুখোশ পরে ছোরা হাতে জোক করতে হবে। পেশা–তার ওপর টাকা পাচ্ছেন। তাই কিছু তলিয়ে না দেখেই প্রবীরবাবু রাজি হয়ে যান। কথা হয়–ওরা দুজন শার্কে সাড়ে নটা অব্দি থাকবে। ঝড়বৃষ্টি হোক, আর যাই হোক–প্রবীরবাবুকে এই জোক করতেই হবে।…।

প্ৰবীর বলল, হ্যাঁ স্যার। সেটা পইপই করে বলে দিলেন উনি।

কর্নেল বললেন, গল্প শুনেও কিছু সন্দেহ হয়নি আপনার?

না স্যার। ইশারায় ডেকে ফিস ফিস করে কথা বলছিলেন। মেয়েদের দিকে আপন গড বলছি স্যার…চোখ তুলে কথা বলার অভ্যাস আমার নেই। তাই অতটা লক্ষ করিনি। তাছাড়াজলজ্যান্ত বুক রয়েছে, সেটাও দেখতে পাচ্ছি।

কর্নেল পকেট থেকে বেলুন দুটো বের করে দেখালেন। সবাই অবাক হলো, তারপর হেসে উঠল। কর্নেল বললেন, বুঝে গেছি। তারপর?

একটুখানি তাড়া করে গিয়ে আমি চলে গেলুম। বৃষ্টির মধ্যে আর কতক্ষণ থাকা যায়? তার ওপর ভয় ছিল নবকে। ভাগ্যিস, নব ঝাঁপিয়ে পড়েনি কিংবা দৌড়ে পিছু নেয়নি। খুব রিস্কের কাজ স্যারনবর মতো সাংঘাতিক লোকের সামনে ছুরি হাতে লম্ফঝম্প করা চাট্টিখানি কথা নয়। শুধু কুড়িটা টাকার জন্যে রাজি হয়েছিলুম। ভেবেছিলুম, নব ধরে ফেললে না হয় পরিচয় দেব, বলব-জোক করছি। নব আমাকে চেনে, স্যার। কেন যেন তখন চিনতে পারেনি, বুঝতে পারছিনে। যাই হোক, সকালে ওই খুনের খবর শুনে দেখতে গেলুম। গিয়ে তো আমার চোখ ছানাবড়া। সর্বনাশ, এতো সেই মেয়ে দুটির একটি। অমনি ভয় পেয়ে সরে গেলুম। কিন্তু আমি গরীব হই, বা লেখাপড়া ভাল শিখিনি বটে–বিবেক হারাইনি, স্যার। মনে খুব কষ্ট হতে লাগল। অবশেষে যা আছে রাতে, বলে বড়দারোগাবাবুর সামনে গিয়ে সব জানালুম। ওনারা আমাকে আটকে রাখলেন।

 সেনাপতি বললেন, আপনাকে আটকে রাখিনি প্রবীরবাবু। তবে কোর্টের সমন পেলে যেন কেটে পড়বেন না। আপনি এখন আসতে পারেন।

না স্যার, সে কী কথা! তাহলে যেচে পড়ে বলতে আসব কেন? বলে প্রবীর চলে গেল।

কর্নেল বললেন, যাক্ গে। ডাঃ পট্টনায়ক, আপনার কাজ শেষ হয়েছে?

পট্টনায়ককে গম্ভীর দেখাল। বললেন, আমি ধাঁধায় পড়ে গেছি, কর্নেল। যে গাড়ির চাকার দাগ আমরা সকালে বাংলোর বাইরে দেখে এসেছি–আপনাকে তখন সন্দেহ হলেও বলিনি–ওটা আমারই গাড়ির। এই হলো প্রথম ধাঁধা। দ্বিতীয় ধাঁধা-ঘন্টা দুই আগে ছাপ নেওয়ার কাজ শেষ করে বেরোব ভাবলুম, গাড়ি বের করে স্টার্ট দিলুম-নিল না। ইঞ্জিনের ঢাকনা তুলে দেখি কারবুরেটারে একটা রক্তমাখা ছোরা আটকানো রয়েছে।

মার্ডার উইপন!

হ্যাঁ–তাই। কিন্তু এ কীভাবে সম্ভব হলো? তাছাড়া সবচেয়ে সাংঘাতিক ব্যাপার, ছোরার বাঁটে যার হাতের ছাপ পাচ্ছি, সেই সিগারেট কেসে তারই হাতের ছাপ রয়েছে।

ডাঃ পট্টনায়ক, আপনি সিগারেট কেসটা দেখে চমকে উঠেছিলেন কেন?

কর্নেল, ওটা আমার মেয়ে গত মার্চ মাসে উপহার দিয়েছিল সুমন্তকে। সুমন্ত তখন আমার বাড়ি প্রায়ই আসত। কল্যাণীর সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল। ও ভাল গীটার বাজায় কল্যাণীরও এ ব্যাপারে আগ্রহ আছে। তাই আমি সিগারেট কেসটা ওখানে দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েছিলুম। তবে গেটের কাছে গাড়ির চাকা সম্পর্কে আপনার সিদ্ধান্ত প্রথমে চমকে দিয়েছিল। কারণ ও-গাড়ি তো আমারই।

কর্নেল কল্যাণীর দিকে তাকাতেই সে চোখ নামাল। কর্নেল বললেন, কল্যাণী, তুমি গত রাত্রে হ্যাঁ, জাস্ট ডিনারের পর আমরা যখন শুতে গেলুম, তখন দশটা কোথায় বেরিয়েছিলে গাড়ি নিয়ে? তারপর কোত্থেকে খানিক বাদে ফিরে এলে!

মালবিকা বললেন, কল্যাণী বেরিয়েছিল? সে কী!

হ্যাঁ। আপনাদের গ্যারাজটা বাগানের কোণে একটু দূরে কিন্তু আমি যে ঘরে ছিলুম, তার জানালা থেকে দেখা যায়। দেখলুম, কেউ বেরিয়ে গেল গাড়ি নিয়ে। ডাঃ পট্টনায়ক গেলেন–ভাবলুম। কিন্তু তার গলার আওয়াজ পেলুম শোবার ঘরে। আপনার সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাহলে কল্যাণী ছাড়া আর কে হবে!

পট্টনায়ক ক্ষুব্ধভাবে বললেন, আশ্চর্য! ও কী যে করে–আমরা কিছু জানতে পারিনা।

কর্নেল বললেন, কল্যাণী, দিস ইজ ভেরি ভেরি ইমপরট্যান্ট। জবাব দাও, প্লীজ।

কল্যাণী আস্তে বলল, সুমন্ত আমাকে চিঠিতে সব জানিয়েছিল কলকাতা থেকে। জানিয়েছিল, ২২ জুলাই রাত্রে সে পানিগ্রাহীসায়েবের বাংলোয় থাকবে। আমাকে যেতে বলেছিল। কোন পথে কীভাবে যাব, তাও লিখেছিল। ২১ তারিখে চিঠিটা পাই। তারপর হঠাৎ শার্কের সামনে কাল বিকেলে ওকে মেয়ে সেজে বেড়াতে দেখি। সে ইশারায় আমাকে চুপ করতে বলে। আর বলে যে রাত দশটার পর যেন ফার্মের বাংলোয় কথামতো যাই।

তাই কথামতো তুমি গেলে। কিন্তু কোন পথে গেলে?

হিলের উত্তর দিকটা ঘুরে। দক্ষিণ ঘুরে গেলে পথ ভাল ছিল কিন্তু ওদিকে যেতে বারণ করেছিল সুমন্ত। বলেছিল, আমাকে কিছু দামী জিনিসপত্র রাখতে দেবে–তার দাম নাকি, পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা। সোজা গেলে অত রাতে ও রাস্তায় গাড়ি দেখে কেউ সন্দেহ করতে পারে–তাই উত্তর দিকের বালিয়াড়ি হয়ে যেতে হবে।

সুমন্তর ভয় ছিল পানিগ্রাহীর জন্যে। উনি ওই রাস্তাটা ব্যবহার করবেন, সে অনুমান করেছিল। তারপর?

আমি গিয়ে বাইরে গাড়ি রেখে ঢুলুম। অল্প আলো জ্বলছিল ঘরে। সুমন্ত দরজা খুলে দিল। সে আমাকে ঘরে ঢুকতেও দিল না। দরজার সামনে একটা মস্ত প্যাকেট গুঁজে দিয়ে বলল, শীগগির এটা নিয়ে যে-পথে এসেছ, চলে যাও। প্যাকেটটা লুকিয়ে রাখবে। আমি সকালে দেখা করব।

তুমি বেডরুমে তাহলে ঢোকোনি?

না। বাইরের ঘরের ভিতরই ঢুকিনি। ঢুকতে দিলে তো!

 ঘরে কোনও মেয়ে ছিল, লক্ষ করেছিলে?

পর্দা থাকায় ভিতরটা দেখতে পাইনি। তবে–তবে আমার মনে হচ্ছিল, ঘরে আরও কেউ যেন আছে। কারণ, প্যাকেট নিয়ে চলে আসবার সময় ফিসফিস কথা কানে এসেছিল যেন। বৃষ্টির মধ্যে কানের ভুল ভেবেছিলুম।

সুমন্তকে তাহলে অন্ধকারে দেখেছিলে?

হ্যাঁ। আলো ভিতরে ছিল। প্যাকেটটা দিয়ে দরজা বন্ধ করেছিল তক্ষুনি।

সুমন্তের পোশাক কি ভিজে মনে হচ্ছিল তখন? ভাল করে ভেবে বলল।

অতটা লক্ষ…না, ভিজে ছিল। কারণ, প্যাকেট নেবার সময় টের পাচ্ছিলুম, ওর হাত ভিজে। হ্যাঁ সম্পূর্ণ ভিজে অবস্থায় ও ছিল। একটু কাঁপছিল মনে হলো।

তারপর তুমি কী করলে?

বাড়ি ফিরে এলুম। গ্যারাজে গাড়ি ঢুকিয়ে প্যাকেটটা ডিকিতে রাখলুম।

সকালে এল সুমন্ত?

হ্যাঁ। তখন আটটা প্রায়। মা পাশের একটা বাড়িতে গেলেন। আমি একা ছিলুম। এসে বলল, চুল কাটতে দেরি হলো। প্যাকেটটা এবার চাই। আমার শরীরে কোল থেকে জ্বর জ্বর ভাব ছিল–এখনও একটু টেম্পারেচার। রাতে ভিজেছিলুম একটুখানি। তা, সুমন্তকে চাবি দিলুম গ্যারাজ আর গাড়ির। সে চলে গেল। খানিক পরে জানালা দিয়ে চাবির রিঙটা গলিয়ে ফেলে বলল, পরে দেখা হবে। কাকেও কিছু বলল না। ওর কাঁধে একটা কিটব্যাগ দেখলুম।

সেনাপতি বললেন, কিটব্যাগে তাহলে প্যাকেটটা ভরেছিল। আর ছোরাটা ইঞ্জিনের মধ্যে রেখে কল্যাণী বা ডাঃ পট্টনায়ককে বিপদে ফেলতে চেয়েছিল। কর্নেল, প্যাকেটটায় কী থাকতে পারে বলে আপনার ধারণা?

কর্নেল বললেন, নিষিদ্ধ ড্রাগ।

সে কী! কোথায় পেল সে?

পানিগ্রাহী ভারতকে ঢিট করতে চেয়েছিলেন। তাই নিজের ট্যাকের কড়ি দিয়ে যোগাড় যন্ত্র করে সী ভিউ হোটেলে পাচার করার মতলব ছিল। ওঁর সুইডেন যাওয়াটা আকস্মিক ব্যাপার নয়। বিদেশে চেষ্টা-চরিত্র করে ওই জন্যেই গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। মন্ত্রীর দলে গেলে কাস্টমস বেশি কড়াকড়ি করবে না, ভেবেছিলেন। এদিকে ভারতবাবু ওঁর বিরোধীদলের বিরাট ঘাঁটি বলতে পারেন!

 হ্যাঁ–সে তো সবাই জানে এখানে।

পানিগ্রাহী জনৈক মহিলাকে প্যাকেটটা ভারতবাবুর হোটেলে সুবিধেমতো জায়গায় পাচার করতে নিযুক্ত করেছিলেন সম্ভবত। হা–এখনও সবই অনুমান। তাই সুইট নম্বর এতে কোনও মহিলা ছিলেন বা এখনও আছেন কি না এখনই জানা দরকার।

সুইট নম্বর এ? আলিকে বলা আছে আমাদের তদন্ত শেষ না হওয়া অব্দি কাকেও চেক আউট করতে দেবে না। যদি সকাল সাতটার মধ্যে কেউ গিয়ে থাকে–উপায় নেই।

সব আমার অনুমান। তাকে নিযুক্ত করার কারণ, পানিগ্রাহী মহিলাটিকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার মানে মহিলাটি নিশ্চয় তাহলে তথাকথিত সোসাইটি গার্ল। পানিগ্রাহীর নির্বুদ্ধিতার মাত্রা দেখে তাক লেগে যায়। ভদ্রলোক গত ইলেকশানে হেরে গিয়েছেন তাই জেদ। অফকোর্স–দিস ইজ এ সাইকলজিকাল প্রসেস। বাজি ধরে ক্রমাগত নির্বুদ্ধিতা বাড়িয়ে চলা একটা জীবন-মরণ প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত ওঁর মতো লোকের পক্ষে। ক্রমশ জেদ বাড়ছে, ক্রমশ নির্বোধ হয়ে পড়ছেন, ক্রমশ পাগলের মতো সম্ভব-অসম্ভব পথে টাকা খরচ করে দেউলিয়া হবার পথে পা বাড়াচ্ছেন। হ্যাঁ–এই হচ্ছে পানিগ্রাহীর বর্তমান জীবন। ওইভাবে মিঃ শর্মাকে আনিয়ে অপেক্ষা করছিলেন ভদ্রলোক কখন তন্দ্রা বা সুমন্ত খবর দেবে যে পাখি ফাঁদে পড়েছে। তখন উনি শর্মাকে লেলিয়ে দেবেন। মিঃ সেনাপতি, পানিগ্রাহী প্রচণ্ড সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মানুষ–তা আমি টের পেয়েছি। যেমন–আপনাদের অর্থাৎ লোকাল পুলিশকে উনি বিশ্বাস করতে পারেন না। তাই আগেভাগে কিছু জানাননি। ভেবেছিলেন, শর্মার মাধ্যমে সে ব্যাপারটা সেটলড হবে।

আচার্য ও সেনাপতি হাসলেন।

কর্নেল বললেন, আমার ধারণা–উনি সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। মহিলাটি মাল নিয়ে কেটে পড়েন কি না ওঁর সে সন্দেহও ছিল। তাই সুমন্তর পরামর্শে তাকে লাগালেন ওয়াচডগ হিসেবে। কিন্তু তন্দ্রাও যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে! হা-হেরে যাওয়া মানুষ এইরকমই হয়ে থাকে। ভাবে, সবাই তাকে ঠকাবে। এবং সে কারণে তন্দ্রার ওপর ওয়াচডগ রাখলেন সুমন্তকে। আর সুমন্ত ওঁকে ঠকাল–সত্যি সত্যি ঠকাল। আসলে সুমন্ত তো তাই চেয়েছিল। নির্বোধ পানিগ্রাহী ওকে বিশ্বাস করে ঠকলেন। এর ফলে হলো কী জানেন? এরপর পানিগ্রাহীর অবশিষ্ট বিশ্বাসটুকুও চলে গেল মানুষের ওপর। এটা ভালই হলো।

পট্টনায়ক বললেন, কিন্তু তাকে খুন করল কেন সুমন্ত?

খুব সঙ্গত ও স্বাভাবিক মোটিভ। কল্যাণীর সাক্ষে প্রমাণ পাচ্ছি, মালটা শেষ অব্দি যে-কোনওভাবে হোক–হয়তো মহিলাটির সঙ্গে যোগসাজস করে কিংবা তার ঘর থেকে চুরি করে সুমন্ত হাতিয়েছিল। তা টের পেয়ে ওকে কিছু বলে থাকবে। তা হয়তো পানিগ্রাহীর কানে তোলার জন্যে শাসিয়েছিল। তাই ওকে সরানোর দরকার হলো সুমন্তর। কিংবা কল্যাণীর হাতে মালটা তুলে দেওয়ার পর দুজনের মধ্যে বচসা শুরু হয়ে থাকবে–যার পরিণামে আকস্মিক রাগেও ছুরি মারতে পারে সুমন্ত। ওর মতো ছেলের পক্ষে এটা খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। এখন সবটা নির্ভর করছে সেই মহিলাটি আর সুমন্তের কনফেশনের ওপর। পানিগ্রাহীর মুখ থেকে কথা বের করা কঠিন। ওঁর রাজনৈতিক অ্যামবিশান ওঁকে মরিয়া করেছে। সত্যি বলতে কী, আমাদের আজকের জীবনে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই ট্র্যাজেডি এত ব্যাপক আর গভীর, কহতব্য নয়। তার প্রমাণ আমরা প্রতিদিনই সংবাদপত্রে পাচ্ছি।

সেনাপতি বললেন, কর্নেল, ডোমপাড়ার চারজন লোক এসেছিল

কর্নেল বললেন, জানি। তারা তার লাশ বয়েছিল সুমন্তর কথায়।

লাশটা মর্গে চলে গেছে। সেনাপতি উঠে দাঁড়ালেন।…তার ঠিকানায় খবর গেছে। লালবাজারেও ওর ব্যাকগ্রাউণ্ড জানতে চেয়েছি। আজ রাতের মধ্যেই সব, পেয়ে যাব আশা আছে। তাহলে আপনি স্নানাহার সেরে নিন, আমরা সী ভিউতে গিয়ে সুইট এতে হানা দিই।

ওরা চলে গেলে কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, ডাঃ পট্টনায়ক, কল্যাণীকে বলুন–তার বন্ধু বিচ্ছেদের জন্যে যে বৃদ্ধটি দায়ী, তাকে যেন সে ক্ষমা করে।

কল্যাণী ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, বন্ধু না হাতি! ভাল হাত আছে গিটারে–তাই! ও গোল্লায় যাক! খুনী গুণ্ডা কোথাকার! বলে সে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।

ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, সত্যি, একালের ছেলেমেয়েদের আমরা বুঝতে পারিনে।

.

১১.

 স্বীকারোক্তি

সমুদ্রতীরে আবার একটা বিকেল নেমেছে আজ। কিন্তু এ বিকেল বৃষ্টিধূসর। বিচ নির্জন। আকাশভরা ঘন মেঘ। মেঘ আর সমুদ্র সমানে গর্জন করছে।

থানার বড় ঘরটিতে বসে সুমন্ত তার জবানবন্দি দিচ্ছিল। কফেশন বা স্বীকারোক্তি বলাই ভাল। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তার এক পাশে। অন্যপাশে ডাঃ পট্টনায়ক।

…পানিগ্রাহীদার ভাড়াটে মেয়ে মিস শান্তার ঘর থেকে গতকাল দুপুরে আমি ড্রাগের প্যাকেটটা হাতাই। তারপর..

কর্নেল বললেন, কিন্তু কীভাবে?

সুমন্ত চোখ তুলে নামাল। আস্তে বলল, তাহলে গোড়া থেকে ভ্যানর-ভ্যানর করতে হয়।

এটা ইমপরট্যান্ট, সুমন্ত। অবশ্য বলা না বলা তোমার খুশি। আমরা আইনত তোমাকে চাপ দিতে পারিনে, ইউ নো দ্যাট।

পানিগ্রাহীদার প্ল্যান ছিল, ২২ জুলাই রাতে কোনও একসময় প্যাকেটটা মিস শান্তা ভারতবাবুকে রাখতে দেবে। তারপর সে সুযোগ মতো শেষরাতে কেটে পড়বে। পানিগ্রাহীদাকে আমরা গিয়ে খবর দিলে উনি ব্যবস্থামতো অফিসারদের নিয়ে হানা দেবেন হোটেলে। আমি আর তন্দ্রা–দরকার হলে সাক্ষীও দেব। এদিকে তখন মিস শান্তা উধাও হয়ে যাবে ইত্যাদি সব প্ল্যান। এ হচ্ছে পানিগ্রাহীদার বরাবরকার রীতি। সব ব্যাপারে বিরাট প্ল্যান করেন। ভেস্তে যায় শেষ অব্দি। এমন অজাযুদ্ধ ঋষিশ্রাদ্ধ গোছের জবড়জং প্ল্যান করলে তাই হয়। ইলেকশানে তো ও জন্যেই হেরেছেন। নির্বোধ বহু দেখেছি, এমন আর নেই। জলের মতো টাকা খরচ করে…

তুমি নিজের কথা বলো, সুমন্ত।

এই নির্বোধ বড়লোকটার ওপর আমার বরাবর ঘৃণা ছিল। তাই ওকে ঠকিয়ে টাকা নিয়েছি সবসময়। এটা পাপ মনে করিনে।

প্লীজ, প্লীজ!

মিস শান্তা দুপুরবেলা খাওয়ার পর ঘুমোচ্ছিল। গিয়ে ঘণ্টা টিপলুম। দরজা খুলল। অমনি বের করলুম ড্যাগারটা। ড্যাগারের সামনে সে চুপ করে গেল। প্যাকেটটা তক্ষুনি বের করে দিল। তাকে বললুম– যদি এক্ষুণি না কেটে পড়ো, তো বিপদ হবে। ও ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। প্যাকেটটা নিয়ে বেরিয়ে সামনেই সি সুইটে তন্দ্রার ঘরে ঢুকে গেলুম। দরজা খোলা ছিল–কারণ, আমি একটু আগে বেরিয়েছি। তন্দ্রা ব্যস্ত হয়ে উঠল। ওর প্রশ্নে উত্যক্ত হয়ে সংক্ষেপে সব জানালুম। তারপর…

একটা কথা। শান্তা তোমাকে চিনতে পারেনি?

না। ঘরে থাকার সময় ফিতে দিয়ে আটকানো বেলুন দুটো খুলে রাখতুম। শার্ট-প্যান্ট আর মুখোশ পরে ঢুকেছিলুম শান্তার ঘরে।

সুইটের দরজায় আইহোল আছে, সুমন্ত?

হ্যাঁ–সেতো ছিল। কিন্তু আমি সুইচ টিপে একপাশে সরে দাঁড়িয়েছিলুম। শান্তা ঝটপট দরজা খুলেছিল। বয় কিংবা ভারতবাবু ভেবে থাকবে ও। ভারতবাবুর সঙ্গে খুব খাতির জমিয়েছিল তো।

রাইট। বলো।

তন্দ্রা প্যাকেটটা দেখে যেন লোভে পড়ে গেল। সে আমাকে শাসাতে থাকলটাকার ভাগ না দিলে পানিগ্রাহীর কানে তুলবে। তখন ওকথা ঠাট্টা ভেবেছিলুম। পরে ও্যখন সমানে ঘ্যানর-ঘ্যানর চালিয়ে গেল বুঝলুম ও সিরিয়াস। এক ফাঁকে একটা শাসানি চিঠি লিখে ফেলে রাখলুম দরজার পাশে।

 সেই চিঠিটা–ডাইনী মেয়েরা!

হ্যাঁ। তাতেও বিশেষ ভয় পেল না তন্দ্রা। তখন সেই বহুরূপীটাকে ঠিক করলুম গোপনে।

আর মিস শান্তা কী করল?

খুব ভয় পেয়েছিল তো। একটু পরেই কেটে পড়েছিল প্রাণ বাঁচাতে। তাছাড়া পুলিসের খাতায় ওর দাগী নামও রয়েছে। দেখলুম, ভারতবাবুর মুখটা গম্ভীর। সব শালা খচ্চর! ভারতবাবু শান্তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল–ভাবা যায়?

তারপর?

সারা বিকেল তন্দ্রা আমাকে টাকা দাবি করতে থাকল। রীতিমতো ব্ল্যাকমেইল। রাত সাড়ে নটায় শার্কের ওই কাণ্ডের পর বাংলোয় নিয়ে গেলুম ওকে–পালানোর ছলে। বললুম– ঠিক আছে–ভাগ দেব টাকার। কিন্তু তন্দ্রা প্যাকেটের অর্ধেক ভাগ দাবি করে বসল তখন। তন্দ্রার হিসট্রি আছে–সে ইচ্ছে করলে পুলিস বের করতে পারে। ও নানা ঘাটের জল খাওয়া মেয়ে। খুব সহজ নয়। জেদী। কুচুটে। খানকি তো বটেই। সেই সময় কথামতো কল্যাণী হাজির হলো। আমার প্ল্যান তো ওই গাড়োল পানিগ্রাহীদাটার মতো নয়। সিম্পল অ্যাণ্ড স্ট্রেইট। গাড়ির শব্দ হতেই পানিগ্রাহী এলেন তাহলে, এই বলে তন্দ্রা সিগারেটটা নিবিয়ে ফেলল। তক্ষুনি সবে ধরিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণে সব টের পেয়ে গেল। ওর চোখের সামনে প্যাকেটটা নিয়ে গিয়ে দরজা খুললুম। কল্যাণীকে ওটা দিয়ে দরজা থেকেই বিদায় করলুম। তারপর দরজা বন্ধ করে দেখি ও রাগে ফুঁসছে। লাফিয়ে এসে আমার চুল ধরল– কাকে দিলে, কে ওই মেয়েটি?…রিয়েলি কর্নেল, ওই ঢ্যামনামি দেখে তখন  মাথায় আগুন ধরে গেল। এমন ভাব দেখাচ্ছে, যেন আমার সাতপাকে বাঁধা বউ। ক্রমশ ও ক্ষেপে গেল। অকথ্য গালিগালাজ শুরু করল। আমার প্রেমও চায়, টাকাও চায়–সেক্সের ব্যাপারেও হিংসে, আবার টাকার ব্যাপারেও লোভ। তন্দ্রা– এই তন্দ্রাটা কী, আমি বুঝে উঠতে পারছিনে এখনও। শেষে ও করল কী জানেন?…বিশ্বাস করুন, ওকে স্রেফ মারধোর করে বেঁধে রেখেই সোজা কল্যাণীদের বাড়ি চলে যেতুম–কিন্তু হঠাৎ ও হাত বাড়িয়ে টেবিলে পড়ে থাকা আমার ছোরাটা তুলে নিল। আমার আর সহ্য হলো না। ছোরাটা কেড়ে নিয়ে ওর চুল ধরে বেডরুমে ঢোকালুম। তারপর… সুমন্ত দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল। … কিন্তু আমি সত্যি ভালবাসতুম ওকে। ও যে আমাকে স্রেফ টাকার লোভে ব্ল্যাকমেইল করে বসবে, আমি কল্পনাও করিনি।

 সুমন্ত, প্লীজ!

বলুন।

 তাহলে তুমি পোশাক বদলেছিলে–

রক্ত লেগে গিয়েছিল, তাই। ওভাবে পানিগ্রাহীদার কাছে যাওয়া সম্ভব ছিল না।

ছোরাটা টেবিলে কোত্থেকে এল?

 বেডরুম থেকে এনে রেখেছিলুম। বিছানায় রাখা ছিল বালিশের নিচে।

কেন এনেছিলে?

সুমন্ত জবাব দিল না।

সুমন্ত, কখন ছোরাটা বেডরুম থেকে এনেছিলে?

ঘরে ঢোকার পরই।

তখন মোমবাতি জ্বেলেছিলে?

না। একটু পরে সিগারেট ধরিয়ে জ্বেলেছিলুম।

তাহলে তোমার মাথায় খুনের মতলব ছিলই, সুমন্ত অস্বীকার করো না।

জানি না। যখন ওটা আনি, খুন করব বলে আনিনি। বিশ্বাস করা না করা আপনার ইচ্ছে।

বিশ্বাস করলুম না–দুঃখিত, সুমন্ত। কারণ আমি যুক্তিবাদী।…কর্নেলের, কণ্ঠস্বর গম্ভীর হলো। তার চোখদুট জ্বলজ্বল করতে থাকল।…তুমি তন্দ্রার প্রথম রিঅ্যাকশন হোটেলে লক্ষ্য করার সঙ্গে সঙ্গে খুনের সিদ্ধান্তে এসেছিলে। প্রবীর বহুরূপীকে তুমি যা করতে বলেছিলে, তার পিছনে তোমার ওই সিদ্ধান্তের চাপ ছিল। ওই শো-বিজনেস! নিছক ভয় দেখিয়ে তাকে চুপ করানোর জন্য নয়। তন্দ্রা যে অত সহজে চুপ করবে না–কিংবা তখনকার মতো করলেও পরে সুযোগ মতো মিঃ পানিগ্রাহীর কাছে সব ফাঁস করে দেবে, এই ছিল তোমার ধারণা। তাকে তো তুমি ভালই চিনতে। তাই যখনই লক্ষ্য করলে যে তন্দ্রা তোমার অসহযোগী, তুমি তোমার অভিজ্ঞতা অনুসারে ধরে নিলে, তন্দ্রা বরাবর অসহযোগী থেকে যাবে–

ডাঃ পট্টনায়ক বলে উঠলেন, যতক্ষণ না সুমন্ত ওকে ক্যাশ অর কাইণ্ডস কোনও ভাগ দিচ্ছে।

ঠিক। সেটাই হচ্ছে তন্দ্রার রিঅ্যাকশন বা অসহযোগিতামূলক মনোভাবের প্রেমিস। তুমি একা সব হাতাতে চেয়েছিলে সুমন্ত। আধুনিক সমাজের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর লোভটাকার প্রতি লোভ, যে লোভ হাঙরের মতো প্রতিটি মানুষকে গ্রাস করে চলেছে, তার খপ্পরে তুমি আর তন্দ্রা অনেক আগেই পড়েছ। তাই যে মুহূর্তে এক ভাগীদারকে আচমকা মাথা তুলতে দেখলে, তুমি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলে। এই ভাগীদারটি কতখানি বিপজ্জনক হতে পারে, তাও জানা ছিল তোমার। সুতরাং তুমি একটি নাটকীয় মোডস অপারেণ্ডির পথ ধরলে। হাঙরের রাতের ঘটনা সকালে রটতে দেরি হবে না, সবাই জানবে কোনও মুখোশপরা খুনী দুজনকে তাড়া করে নিয়ে গিয়ে একজনকে খুন করেছে। তোমার অ্যালিবাই (অজুহাত) ভীষণ শক্ত–যেহেতু নিজেও তার সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছ, দৌড়ে পালিয়েছ। চমৎকার। পরিকল্পনা! তোমার পরিকল্পনার আরও চমকপ্রদ এবং যুক্তিসিদ্ধ অংশ হচ্ছে, তোমার পরবর্তী কার্যকলাপ। পরে তুমি টের পেলে যে প্রবীর হরবোলা হচ্ছে পরিকল্পনার একটা মারাত্মক দুর্বল গ্রন্থি। তাহলে কি প্রবীরকে সরাতে হবে? কিন্তু প্রবীরের পাত্তা কখন আবার কোথায় পাওয়া যাবে, ঠিক ছিল না। সে কাজ সময়সাপেক্ষ। সেই সময় তোমার মাথায় খেলে গেল আরেক প্রকল্প। মিঃ পানিগ্রাহীর ভারতকে ঢিট করার পরিকল্পনার মতো বিশাল আশ্রয়কক্ষ থাকতে কেন ফের খুনের ঝুঁকি নিতে যাওয়া? তাই তুমি মাল নিয়ে কেটে পড়লে না তক্ষুনি। পানিগ্রাহীর সহায়তায় খুনের দায় ভারতের ঘাড়ে চাপাবে ঠিক করলে। এতে পানিগ্রাহীর লাভ আছে–ভারতবাবু ঢিট হবেন। তুমি পানিগ্রাহীর সহযোগিতায় নামলে কোমর বেঁধে। তুমি থেকে গেলে।

পট্টনায়ক বললেন, কিন্তু ছোরাটা আমার গাড়িতে রাখল কেন ও?

সুমন্ত আস্তে বলল, আপনার বাড়ি এসে থাকব ভেবেছিলুম। কর্নেলের সঙ্গে তাই আসছিলুমও। ইচ্ছে ছিল, কল্যাণীর সাহায্যে ওটা সুযোগ মতো ভারতবাবুর হোটেলে পাচার করব।

কর্নেল মৃদু হাসলেন, অ্যামবিশাস প্ল্যান! সুমন্ত পানিগ্রাহীর কাছে আজ চুলটুল কেটে খুব আশা নিয়ে গিয়েছিল, প্রথম উদ্দেশ্য : ভারতবাবুর দিকে পানিগ্রাহীকে যুক্তিগ্রাহ্য পদ্ধতিতে লেলিয়ে দেওয়া। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য : পানিগ্রাহী যদি পিছিয়ে যান, কিংবা উল্টে ওকেই সন্দেহ করে বসেন তাহলে ব্ল্যাকমেইল।–

সবাই চমকে উঠল–ব্ল্যাকমেইল!

হ্যাঁ, তাই। পানিগ্রাহীর নার্কোটিকস পাচারের প্ল্যান ফাঁস করে দেবার শাসানি মাথায় ছিল সুমন্তর। এবং দরকার হলে খুনের সম্পূর্ণ দায় তার ঘাড়ে চাপানো হতো। সুমন্ত প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হবে বলে ভয় দেখাতে পারত। সুমন্তর তখন তো তুঙ্গে বৃহস্পতি। নির্বোধ পানিগ্রাহীকে দিয়ে যা খুশি করার মওকা মিলেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রকৃতির সবকিছুতে, কী বস্তু কী প্রাণীজগতে একটা অদ্ভুত পদ্ধতি কাজ করছে। আমরা নিজের দাঁতেই নিজেদের কবর খুঁড়ি।

মিঃ আলি এবং একটি ছোটোখাটো পুলিসদল রেনকোট পরে ঘরে ঢুকল। আলির হাতে একটা বড় কিটব্যাগ। বললেন, ড্রাগের প্যাকেট, তন্দ্রার ব্যাগ, পার্স। সবকিছু এর মধ্যে রয়েছে। বাংলোর উত্তরে বটতলায় পাথরচাপা ছিল কিটব্যাগটা খুঁজতে অসুবিধে হয়নি। রক্তমাখা গেঞ্জি আর বেলবটম প্যান্টটাও ওখানে লুকানো ছিল।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, সুমন্তকে ধন্যবাদ।

সুমন্ত লাফিয়ে উঠল–গেট আউট, গেট আউট, ইউ ওল্ড ফুল! সেপাইরা তক্ষুনি ওকে ধরে ফেলল। কর্নেল আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলেন। পিছনে সুমন্তর কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন।

বারান্দায় রেনকোট আর টুপিটা পরে বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় নামলেন কর্নেল।

এখন তিনি অন্য মানুষ। বিচে এসে ভয়ঙ্কর গর্জনকারী প্রাকৃতিক শক্তিটিকে বাঁয়ে রেখে জীবনমৃত্যুময় অস্তিত্বের কোলসের তলায় নিঃসঙ্গ বিষণ্ণ এক বৃদ্ধ চলেছেন উদ্দেশ্যহীনভাবে। তিনি ভাবছেন, মানুষ প্রবৃত্তির কাছে এত অসহায়! অথচ সুমন্ত কাঁদছে। সব হত্যাকারীই কাঁদে–কেউ মনের তলায় অবচেতনায়, কেউ প্রকাশ্যে। কিন্তু তাকে কাঁদতে হয়। এটাই তার অস্তিত্বের মানুষী ভাব।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *