ফাঁদ

ফাঁদ

ফেসবুকে একটা মিম দেখেছিলাম। এক পিচ্চি করজোড়ে আল্লাহ্ কাছে দু’আ করছে। ইয়া আল্লাহ, আমাকে ধৈর্য দান করো। এখনই দাও, ঠিক এখনই, একটুও দেরি না করে ঠিক এই মুহূর্তে…। পর্নহস্তমৈথুন/চটিগল্পের আসক্তি কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর হলো ধৈর্য। অথচ অধিকাংশেরই ধৈর্যের লেভেল থাকে ওই পিচ্চির মতোই। পর্ন হস্তমৈথুন-চটিগল্পের আসক্তি কাটিয়ে উঠতে হলে আপনাকে অবশ্যই, ধৈর্য ধরা শিখতে হবে। শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। 

আল্লাহ্ কুরআনে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন শয়তান আমাদের প্রকাশ্য শত্রু।

“যে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, সে জেনে রাখুক, শয়তান অশ্লীল ও মন্দ কাজের আদেশ দেয়(প্রলুব্ধ করে)।” 

(সূরা আন-নূর; ২৪:২১) “.. আমি তাদের মানুষের জন্য তোমার সরল পথে ওঁৎ পেতে বসে থাকব। তারপর আমি { চারদিক থেকে তাদের ওপর হামলা করব, তাদের সামনে থেকেও, তাদের পেছন থেকেও, তাদের ডান দিক থেকেও এবং বাম দিক থেকেও এবং তুমি তাদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞ পাবে না। “ সূরা আল আ’রাফ; ৫:১৬-১৭)

আপনার শত্রু শয়তান প্রচণ্ড ধৈর্যশীল, অধ্যবসায়ী। সে ব্যাপক ধৈর্য নিয়ে আপনার পেছনে লেগে থাকবে। নানা ছলেবলেকৌশলে পথভ্রষ্ট করতে চাইবে। একটার পর একটা ফাঁদ পাততে থাকবে। শয়তানের সেই ফাঁদগুলো সম্পর্কে আপনার থাকতে হবে বিস্তারিত ধারণী, জানতে হবে খুঁটিনাটি সবকিছুই। না হলে পতন অনিবার্য। এ লেখায় আপনাদের চেনানো হবে শয়তানের কিছু ফাঁদ। সেই সঙ্গে আপনাকে বাতলে দেয়া হবে কীভাবে ফাঁদের জাল কেটে বেরিয়ে আসবেন মাথা উঁচু করে। 

.

এক.

কংক্রিটের রাস্তায় পড়ে থাকা কোল্ড ড্রিংকের খালি বোতলে কষে একটা লাথি মেরে রাগ আর বিরক্তি দুটোই এক সাথে ঝাড়ল রাজিব। “ধুউউর! পেটে খিদে রেখে এভাবে পার্কের বেঞ্চিতে কতক্ষণ বসে থাকা যায়?”। সেই দুপুর থেকে বসে আছে এই বেঞ্চিতে। এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল। টিফিনের পর থেকে পেটে পড়েনি দানাপানি কিছুই। সামনের বেঞ্চিতে আধাশোয়া উশকো-খুশকো চুলের গাল ভাঙা লোকটা তার ইঁদুরের মতো পিটপিটে লাল চোখ। দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্কুল ড্রেস পরা রাজিবের দিকে। রাজিব অস্বস্তিবোধ করতে শুরু করল। ওই গাঞ্জাখোর ব্যাটাটী ছিনতাইকারী না হয়েই যায় না। “গাধা কোথাকার! আমার কাছ থেকে ছিনতাই করার মতলবে আছে, আমার পকেটে তো একটা ছেঁড়া দু-টাকার নোটও নেই”, মনে মনে ভাবল রাজিব। সেই কখন দুপুরবেলায় স্কুল ছুটি দিয়েছে। কিন্তু রাজিব বাসায় যেতে ভয় পাচ্ছে। বেশ কয়েকবার বাসায় যাবার জন্য রওনা দিয়ে আবার মাঝপথ থেকে ফিরে। এসেছে। সাহসে কুলোয়নি। আজ বাসায় গেলে বাবা ওকে “বানাবেই “ । সূর্য সকালে ওঠে সন্ধ্যায় অস্ত যায়, গরু ঘাস খায় এগুলো যেমন ধ্রুব সত্য, তেমনই আজকে বাসায় গেলে ও যে বাপের হাতে ডলা খাবে সেটাও ধ্রুব সত্য। গত সপ্তাহে স্কুলের বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে ভিডিও গেম খেলার সময় বাবার হাতে ধরা খেয়ছিল রেড হ্যাঁন্ডেড–তখনো বাবা ওকে কিছু বলেননি। গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে দুপুরবেলা বাসা থেকে পালিয়ে হাজির হয়েছিল বালুর মাঠে। বীরপুরুষের মতো কাঠফাটা রোদে ক্রিকেট খেলে জ্বর বাঁধিয়ে বিছানায় পড়ে ছিল। বেশ কয়েকদিন, তখনো বাবা ওকে কিছু বলেননি। কিন্তু আজকে আর রক্ষা নেই। আজকে মিডটার্মের রেসাল্ট কার্ড দিয়েছে এবং রাজিব দু দুটো সাবজেক্টে ডাব্ব, মেরে বসে আছে। গাঁজাখোর ছিনতাইকারীর উটকো ঝামেলা থেকে বাবার হাতে পিটি খাওয়া ভালো। যা আছে কপালে, রাজিব বেঞ্চি থেকে স্কুলব্যাগটা তুলে কাঁধে নিয়ে, পানির খালি বোতলটা হাতে নিল। মক্তবের হুজুরের কাছ থেকে যত সূরা কিরাত শিখেছিল ছোটবেলায়, সব বিড়বিড় করে পড়তে পড়তে হনহন করে হাঁটা দিলো বাসার দিকে। …. প্লিয! আল্লাহ্ আজকে পার করাইয়া দাও, সামনের শুক্রবার থেকেই নামাজ ধরব, কথা দিলাম। পাক্কা। প্লিয আল্লাহ্, প্লিয। 

সুবহানআল্লাহ! মানুষের সাইকোলজিটাই এমন যে, মানুষ যখন অন্য কাউকে রাগিয়ে দেয় তখন সে তার সামনে যেতে ভয় পায়, ইতস্তত বোধ করে। শয়তান মানুষের ঠিক এ দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ফন্দি আঁটে আদমসন্তানকে তার পরম করুণাময় অসীম দয়ালু রবের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার। শয়তান আর নফসের পাল্লায় পড়ে ভয়াবহ পাপ করে ফেলেছেন–ধরুন পর্ন ভিডিও দেখে ফেলেছেন বা হস্তমৈথুন করে ফেলেছেন। উত্তেজনা কমার পর আপনার খেয়াল হলো, “হায়! হায়! আমি এ কী করলাম?” 

অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হচ্ছেন, ধিক্কার দিচ্ছেন নিজেকে। তৎক্ষণাৎ গোসল করে জায়নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন; উদ্দেশ্য তওবা করা। রঙ্গমঞ্চে আগমন হলো শয়তান। ব্যাটার। আপনাকে ওয়াসওয়াসা দিতে শুরু করল, “কিরে ভণ্ড! একটু আগে। আল্লাহর নফরমানি করে আবার এখন এসেছিস তওবা করতে? যা ভাগ! তোর। দেখি কোনো লজ্জাশরম নাই, আল্লাহর সামনে দাঁড়াচ্ছিস কোন মুখে? আল্লাহ কি তোকে মাফ করে দেবেন মনে করেছিস?” আপনি ভেবে দেখলেন, কথার মধ্যে তো বেশ যুক্তি আছে। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগা শুরু করলেন তওবা করবেন কি করবেন না, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (%) তওবা করাকে কতটা উৎসাহিত করেছেন ভুলে। গেলেন। ব্যস শয়তানের প্ল্যান সার্থক।

 “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা তাঁর কাছে বেশি বেশি তওবা করে এবং তিনি ভালোবাসেন তাদেরকে যারা নিজেদের পবিত্র রাখে।” 

(সূরা আল-বাকারা; ২:২২২)

 “যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তওবা করে, নিশ্চয় আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, আল্লাহ মহাজ্ঞানী প্রজ্ঞাময়।” 

{সূরা আন-নিসা; ৪:১৭)

 “প্রত্যেক আদমসন্তানই পাপ করে, পাপীদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম যারা তওবা করে।” 

(সুনান তিরমিযী : ২৪৯৯)

সহিহ বুখারিতে, আনাস ইবনে মালিক বর্ণনা করেন : আল্লাহ্র রাসূল বলেন, “তোমাদের কেউ মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া উট খুঁজে পেয়ে যতটা খুশি হয়, আল্লাহ্ তাঁর বান্দার তওবাতে তাঁর চেয়েও বেশি খুশি। হন।” 

(সহিহ বুখারি : ৫৯৫০) 

শয়তানের কুমন্ত্রণা একেবারেই পাত্তা দেয়া যাবে না। আপনাকে ভণ্ড বললেও, আসলে সে নিজেই ভণ্ড। যেকোনো পাপ করার পর এক মাইক্রোসেকেন্ডও দেরি না। করে, তৎক্ষণাৎ তাওবাহ করুন।

“হে মুমিনগণ, আল্লাহর সমীপে খাঁটি তওবা করো। অসম্ভব নয় যে তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন আর তোমাদের এমন উদ্যানসমূহে প্রবেশ করাবেন, যার নিম্নদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত থাকবে…” 

(সূরা আত-তাহরিম; ৬৬:৮)

কবি কত চমৎকারভাবেই-না বলেছেন : “কড়া নাড়ো, তিনি তোমায় দরজা খুলে দেবেন বিলীন হয়ে যাও, তিনি তোমায় সূর্যের মতো উজ্জ্বল করবেন লুটিয়ে পড়ে, তিনি তোমায় বেহেশতে তুলে নেবেন নিজেকে রিক্ত করো, তিনি তোমায় সবকিছু দিয়ে পূর্ণ করবেন।” শয়তান বেচারীর মন খুব খারাপ। এত চেষ্টার পরেও আপনার তওবা করা ঠেকাতে পারল না। তার ষড়যন্ত্রের বাউন্সার, দুর্দান্ত হুক করে আপনি পাঠিয়ে দিয়েছেন। মাঠের বাইরে। সে বুঝে ফেলেছে এভাবে আপনাকে তওবা করা থেকে ফেরানোর মুরোদ ওর কেন, ওর বাপ-দাদা চৌদ্দগুষ্ঠীর কারও নেই। কিন্তু এত সহজে দমে। যাবার পাত্র তো সে না। আবারও রঙ্গমঞ্চে হাজির হলো নতুন ফন্দি এঁটে–এ তওবা দিয়েই ঘোল খাইয়ে ছাড়বে আপনাকে। খেলা হবে। 

কুমন্ত্রণা দিতে শুরু করল আপনাকে–”আগে পর্ন ভিডিওটা দেখ, তারপর তওবা করে ফেললি। আরে ব্যাটা জানিস না তওবা করলে আল্লাহ কি পরিমাণ খুশি হয়? সব পাপ মাফ করে দেয়? তুইও মজা পেলি আর আল্লাহও খুশি হলো, সাপও মরল। লাঠিও ভাঙলো না!” 

ভাই এ রকম প্ল্যান করে পাপ করার পর তাওবাহ করলে, তওবা কি কবুল হবে? আল্লাহ্ খুশি হবেন? আপনিই বলুন কমনসেন্সটা কাজে লাগিয়ে? ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম, আপনি রাস্তায় কাউকে বলা নেই কওয়া নেই মনের সুখে কিল থাপ্পড় চড়-ঘুষি মেরে, মুখের জিওগ্রাফি বদলে দিয়ে, তারপর সরি বললেন, তারপর ওই বেচারা কি হাসিমুখে চেহারার রক্ত মুছতে মুছতে বলবে, ইটস ওকে ব্রো? নাকি ভাই-ব্রাদার, মামা-চাচা-দোস্ত সব্বাইকে ফোন করে শার্টের হাত গুটিয়ে আপনার দিকে তেড়ে আসবে, “তবে রে ব্যাটা!” আল্লাহ্ যে কাজ হারাম করেছেন সেই কাজ এভাবে প্ল্যান করে করলে আল্লাহ্র (%) সঙ্গে কি রসিকতা করা হয়ে যায় না? আর তা ছাড়া, পর্ন দেখা অবস্থায় বা হস্তমৈথুন করা অবস্থায় মারা গেলে কবরে বা হাশরের ময়দানে কৈমন আদর-আপ্যায়ন পাবেন সেটাও চিন্তা করা দরকার। সাবধান! শয়তান এ রকম কুমন্ত্রণী দিতে শুরু করলে বিতাড়িত শয়তান থেকে চটজলদি আশ্রয় চান আল্লাহ্ কাছে। ল্যাপটপ, ফোন (যেটাতে আপনি পর্ন ভিডিও দেখার প্রিপারেশান নিচ্ছিলেন) বন্ধ করে দিয়ে ওই জায়গী ছেড়ে চলে যান দূরে। মানুষজনের কাছে। খুব ভালো হয় সঙ্গে সঙ্গে ওজু করে দুই রাকাত সালাত আদায় করতে পারলে। আরও ভালো হয় জোরে আযান দিতে পারলে; জানেনই তৌ, আযান শুনলে শয়তান জান নিয়ে এলাকা ছেড়ে পালায়–দূর হ ব্যাটা পাঁজির পী ঝাড় শয়তান! দূর হ! দূরে গিয়ে মর… শয়তানের আরেকটা খুব কার্যকরী কৌশল হচ্ছে, “আজকেই শেষ। কাল থেকে আর পর্ন ভিডিও দেখব না বা হস্তমৈথুন করব না”–এ চিন্তাভাবনা আপনার অন্তরের মধ্যে গেঁথে দেয়া। প্রতিটি আগামীকালের আরেকটি আগামীকাল আছে; আগামীকালও যে আপনার মনে হবে না আজকেই শেষবার, এর গ্যারান্টি কে। দেবে? এটা একটা ইনফিনিট লুপ যার কোনো শেষ নেই। পর্ন দেখা বা হস্তমৈথুন করা বন্ধ করতে হবে আজকেই। যদি আজকে না পারেন তাহলে আগামীকাল পারবেন এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। 

.

দুই.

ইসলাম নিয়ে সিরিয়াস হবার পরে হাল আমলের ছেলেমেয়েরা বিয়ে নিয়ে বেশ রোমান্টিসিযমে ভুগতে শুরু করে। কোনো এক অদ্ভুত কারণে এরা বিয়ে করাকেই তাদের ধর্মীয় জীবনের একমাত্র লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য অথবা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনের প্রধান পূর্বশর্ত বানিয়ে ফেলেছে। অন্তরের অবস্থা আল্লাহই ভালো জানেন, তবে তাদের বাহ্যিক আচার-আচরণ দেখে তা-ই মনে হয়। ভাবখানা এমন, ইসলাম শুধু বিয়ে করতেই বলেছে আর কিছু করতে বলেনি। বিয়ে করে “দ্বীনের অর্ধেক পূরণে” তাদের খুব আগ্রহ, কিন্তু দ্বীনের আরও অর্ধেক যে অংশ বাকি আছে সেটা পূরণে তারা ততটা মনোযোগী না। এ বিয়ে নিয়েই শয়তান ব্যাটা খুবই মারাত্মক ফাঁদ পাতে, আর আমাদের তরুণেরা বিয়ে নিয়ে এতটাই রোমান্টিসিযমে ডুবে থাকে যে, সেই ফাঁদে পা তো দিয়ে বসেই, সেই সাথে কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও তাদের হুশ ফেরে না। 

তরুণদের কাছে বিয়েই হয়ে গেছে সকল সমস্যার সমাধান। “মন খারাপ কেন?” 

“কারণ আমার বউ নাই” 

 “রেসাল্ট খারাপ কেন?” 

“কারণ বউ নাই, মন খারাপ থাকে, পড়তে পারি না ঠিকমতো।” 

“ফজরের সালাত কাযা হয় কেন?” 

“কারণ বউ নাই, মুখে পানি ছিটিয়ে কেউ ডেকে দেয় না।” “পর্ন ভিডিও দেখা ছাড়তে পারছ না কেন? হস্তমৈথুন কেন করো?” 

“কারণ আমার বউ নাই।” বিয়ে কোনো ম্যাজিক বাটন না যে আপনি চাপ দেবেন আর আপনার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বিয়ের আগের কিছু সমস্যা হয়তো বিয়ের পর চলে যাবে, সেই সাথে আরও অনেক নতুন সমস্যার উদ্ভব হবে। চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকা, ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করা, একসঙ্গে রিকশায় ঘোরা, ফুচকা খাওয়া, শুধু এগুলোই বিয়ে না। বিয়ে মানে অনেক দায়িত্ব, অনেক কর্তব্য। “বিয়ের আগে পর্ন-হস্তমৈথুন আসক্তি কাটানো সম্ভব না, তুই চাইলেও ছাড়তে পারবি না। পর্ন-হস্তমৈথুন আসক্তি দূর করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো বিয়ে, বিয়ে করবি সব ঠিক হয়ে যাবে, এখন দুশ্চিন্তা ভুলে “চিল” কররে পাগলা।” এ রকম অজস্র মিথ্যে কথা শয়তান আপনাকে গুলে খাওয়াবে। আপনি হতাশ হয়ে পড়বেন। পর্ন-হস্তমৈথুন থেকে বিয়ে করা ছাড়াও রেহাই পাওয়া যায় সেটা আপনি মেনে নিতে চাইবেন না। আপনার চিন্তাভাবনা আবর্তিত হবে বিয়েকে কেন্দ্র করে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বিয়েকে খুব কঠিন বানিয়ে ফেলা হয়েছে। আবার দেখা যাবে বিয়ে নিয়ে সারাদিন আকাশ-কুসুম চিন্তা করলেও আসলে বিয়ে করার জন্য কোনো কংক্রিট স্টেপ আপনি নিচ্ছেন না। জীবিকার ব্যবস্থা করছেন না। আচরণে ম্যাচিউরিটি আসছে না। কাজকর্মে দায়িত্ববোধের ছাপ দেখা যাচ্ছে না। নিজের ফ্যামিলিকে বোঝানো দুরের কথা হয়তো তাঁদের সাথে এ নিয়ে কথাই শুরু করতে পারছেন না। কিন্তু দিনরাতে অনবরত বিয়ে নিয়ে চিন্তা থামছে না। বাবা-মাকে বিয়ের কথা বলতেই দেখবেন অনেক দিন লেগে যাবে। 

অনেক কাঠখড় পোড়ানোর প্রও হয়তো যখন চাচ্ছেন তখন বিয়ে করা হয়ে উঠবে না। আপনি আরও হতাশ হয়ে পড়বেন। পর্ন দেখা, হস্তমৈথুন করার পরিমাণ বাড়তে থাকবে। জীবন অসহ্য মনে হবে। অথচ আপনি যদি অন্য টিপসগুলো 

অনুসরণ করতেন, তাহলে হয়তো পর্ন-হস্তমৈথুন আসক্তি থেকে মুক্তি পেতেন। বিয়ে করলেই পর্ন-হস্তমৈথুন আসক্তি দূর হয়ে যাবে এটা ভাবলে মারাত্মক রকমের ভুল করবেন। সাময়িক সময়ের জন্য হয়তো এগুলো থেকে দূরে থাকতে পারবেন, কিন্তু তারপর যেইকে সেই। অনেক অনেক বিবাহিত ভাই ভয়ঙ্কর রকমের পর্ন হস্তমৈথুন আসক্তিতে ডুবে আছেন। অনেকের ঘর ভেঙেছে পর্ন-আসক্তি। অ্যামেরিকাতে ৫৬ শতাংশ ডিভোর্সের জন্য দায়ী পর্ন-আসক্তি। ৫৫ শতাংশ বিবাহিত অ্যামেরিকান পুরুষ স্বীকার করেছেন যে তারা মাসে একবার হলেও পর্ন ভিডিও দেখে। ২৫ শতাংশ বিবাহিত অ্যামেরিকান মহিলা স্বীকার করেছে যে, তারা মাসে একবার হলেও পর্ন ভিডিও দেখে। আর যারা মাসে একবার হলেও পর্ন দেখে এমন অবিবাহিত অ্যামেরিকান মহিলার সংখ্যা শতকরা ১৬ জন। কিন্তু কেন বিয়ে পর্ন বা হস্তমৈথুনের সম্পূর্ণ সমাধীন নী? পর্ন-আসক্তির কারণে আপনার মস্তিষ্কের গঠন বদলে যাবে। বইয়ের প্রথমাংশে আমরা এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। বাস্তব যৌনতার প্রতি আপনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। সেই সঙ্গে যৌনমিলনের সক্ষমতাও। আপনার স্ত্রী আপনাকে যৌনতার জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন না, স্ত্রীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবার চাইতে ঘরের এক কোণায় বসে পর্ন দেখাকেই আপনি উত্তেজক এবং তৃপ্তিদায়ক মনে করবেন। পর্ন দেখে দেখে আপনার মধ্যে নারীর দেহ নিয়ে যে অতিরঞ্জিত ধারণা জন্মেছিল, সেটা বুঝবেন বিয়ের পরে। আপনি হতাশ হবেন। আপনার পর্ন দ্বীরা প্রোগ্রামড় ব্রেইন আপনার স্ত্রীর চেয়ে পর্ন অভিনেত্রীদের নিটোল দেহের প্রতি বেশি আকর্ষিত হবে। আপনি আবার ফিরে যাবেন পর্নের জগতে। অন্তরঙ্গতার পুরো ব্যাপারটিই দুজন মানুষের অত্যন্ত চমৎকারভাবে কাছে আসা, যা আসলেই আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আশীর্বাদ। ভালোবাসা এবং মমতার কারণে স্ত্রী বা স্বামীকে তৃপ্তি দেয়া। নিজের চেয়ে নিজের স্ত্রীর তৃপ্তির ব্যাপারে বেশি চিন্তা করা; নিশ্চিত করা যেন পুরো সময়টুকু তার জন্য আরামদায়ক হয়, যেন তিনি কষ্ট না পান বা তাঁর সাথে বিবেচনাহীন আচরণ না করা হয়, যেন তাঁকে সম্মান দেয়া হয়। পর্নের পুরো ব্যাপারটিই অন্তরঙ্গতার বিপরীতে যায়, কারণ এখানে মুখ্য বিষয় হলে, নেয়া ও স্বার্থপরতা। নিজে তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত নিজেকে আনন্দ দেয়, নতুন কিছুর খোঁজ চালিয়ে যাওয়া। পর্ন অসিক্ত হবার কারণে অপিনি আপনার স্ত্রীর চাওয়া পাওয়ার দিকে কোনো খেয়ালই রাখবেন না। স্বাভাবিক পদ্ধতিতে তৃপ্তি না। পেয়ে আপনি অ্যানাল সেক্স, ওরাল সেক্সের দিকে ঝুঁকবেন, স্ত্রীর ওপর জোরাজুরি করবেন। স্ত্রী রাজি না হলে আপনি থেকে যাবেন অতৃপ্ত। পর্ন দেখা শুরু করবেন। আবারও। তা ছাড়া অ্যানাল সেক্স, ওরাল সেক্সে যৌনতৃপ্তির পরিমাণ কমে যায়। 

আপনি এগুলোর সুযোগ পেলেও অতৃপ্ত থেকে যাবেন। ঘুরেফিরে সেই পর্ন দেখে হস্তমৈথুন করতে হবে। বিয়ের পর পর স্বামী-স্ত্রীর সবকিছুই পরস্পরের ভালো লাগে। দুজন দুজনকে ক্রমাগত আবিষ্কার করে আর মুগ্ধ হয়। ঝড় বয়ে চলে ভালোবাসার। কিন্তু বেশ কিছুদিন পর বিশেষ করে ১০ বছরের একটা লুপের পর ভালোবাসার ঝড় থেমে যায়। অন্তরের টান, মায়া-মমতা আগের মতো থাকলেও শারীরিকভাবে আপনার স্ত্রী হয়তো আপনাকে আর আগের মতো টানবেন না। বাচ্চাকাচ্চা সামলাতে গিয়ে তিনি হয়তো আপনাকে আর আগের মতো “কোয়ালিটি টাইম” দিতে পারবেন না। হয়তো এ কারণে আপনি যৌনজীবন নিয়ে একঘেয়েমিতে ভুগবেন। তবে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানে যৌনতাই সব কিছু না; বরং বিয়ের অনেকগুলো অংশের মধ্যে এটি একটি। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, বিশ্বাস, মায়া, দায়িত্ববোধ এগুলোও বিয়ের অংশ। তাই বয়সের সাথে সাথে সব পুরুষই যৌনজীবনে একঘেয়েমিতে ভুগবেন বা ভোগেন এমন না। সমস্যাটা হলো পর্ন কীভাবে আপনার চিন্তায় প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে। পর্ন আপনাকে একজন সঙ্গিনীতে সন্তুষ্ট হতে দেবে না। যারা পর্ন দেখে অভ্যস্ত তাদের পক্ষে একজন যৌনসঙ্গিনীতে তৃপ্ত হওয়া অত্যন্ত কঠিন। পনের বৈশিষ্ট্যই হলো সাধারণ যৌনতার ব্যাপারে একঘেয়েমি সৃষ্টি করা। এমনকি পর্ন-আসক্ত ব্যক্তির কাছে একই ধরনের পর্নও একসময় একঘেয়ে লাগে। তীর আরও কড়া কিছুর প্রয়োজন হয়। সফটকোর থেকে হার্ডকোর, হার্ডকর থেকে রেইপ পর্ণ, গে পর্ন, চাইল্ড পর্ন এভাবে তার “উন্নতি হতে থাকে। নীল জগতে নিত্যনতুন অপ্সরাদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা আপনার কাছে রক্তমাংসের মানবী খুব তাড়াতাড়ি পুরোনো হয়ে যাবে, পানসে লাগবে। যৌনজীবনের একঘেয়েমি আপনাকে রাস্তা দেখিয়ে দেবে পর্ন এবং হস্তমৈথুনের। শত সহস্র মানুষ বিয়ে ছাড়াই পর্ন-হস্তমৈথুন আসক্তি থেকে মুক্তি পেয়েছে। আপনিও পারবেন ইন শা আল্লাহ্। আল্লাহ্র (এ) ওপর ভরসা করে চেষ্টা চালু রাখুন, পাশাপাশি বিয়ের জন্যও নিজেকে যোগ্য করে তুলুন। বিয়ে করতে পারছি না তাই পর্ন-হস্তমৈথুন আসক্তি থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারছি না, এসব অজুহাত দেবেন না। 

.

তিন. 

পন-হস্তমৈথুন আসক্তির কারণে জীবন অতিষ্ঠ। আপনি মুক্তি চান এগুলো থেকে। আদাজল খেয়ে, কোমরবেঁধে লেগে গেলেন, দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ মন। সবকিছুই ঠিকঠাক মতো চলছে। অনেকদিন পার হয়ে গেছে কিন্তু আপনি পর্ন-হস্তমৈথুনের ধারেকাছেও ঘেঁষেননি। খুব খুশি, স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন–যাক বাবা বাঁচা গেল…। কিন্তু হুট করেই একদিন ব্রেকডাউন হয়ে গেল পর্ন ভিডিও দেখে ফেললেন বা হস্তমৈথুন করে ফেললেন। ঠান্ডা হবার পর মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলেন। আফসোস করে হায়! হায়! এ কী করলাম আমি! এ রকম সময়ে কাটাঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার জন্য রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটে ইবলিসের। কুমন্ত্রণা দিতে থাকে, আরে ব্যাটা তুই যতই চেষ্টা করসি না কেন, পারবি না পর্ন-হস্তমৈথুন আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে। এত টিপস ফলো করলি, এত কিছু করলি, পারলি এগুলো থেকে বাঁচতে? বাদ দে এসব ন্যাকামো…” এ রকম কুমন্ত্রণা সে ক্রমাগত দিতেই থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি হতাশ হয়ে পর্ন-হস্তমৈথুন আসক্তি থেকে বাঁচার চেষ্টা বন্ধ করে দেন। হতাশ হবার কিছু নেই। পর্ন-আসক্তি প্রায় কোকেইন আসক্তির মতো ভয়াবহ ব্যাপার। এক দিনে, একবারেই সারা জীবনের জন্য পর্নোগ্রাফি বা হস্তমৈথুন আসক্তির সঙ্গে আড়ি দেয়া তো সম্ভব হবে না, সময় লাগবে কিছুটা। হতাশ হলে চলবে না। হস্তমৈথুন, পর্ন-আসক্তির যুদ্ধে বার বার পরাজিত হওয়া মানে “হেরে যাওয়া” না। আপনি হেরে যাবেন সেদিনই, যেদিন শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে হস্তমৈথুন, পর্ন-আসক্তি থেকে বাঁচার চেষ্টা ছেড়ে দেবেন। হাল ছাড়বেন না কখনোই। ধৈর্য ধরে লেগে থাকুন, আল্লাহ্র () ওপর ভরসা করে। ইন শা আল্লাহ্ আপনি বিজয়ী হবেনই। ইন শা আল্লাহ্ একদিন চমৎকার ঝকঝকে হলুদ রোদ উঠবে চারিদিকে, ঝিরি ঝিরি বাতাসে গাছের পাতাগুলো দোল খাবে, দোয়েল মিষ্টি শিস দেবে, হস্তমৈথুন, পর্ন-আসক্তির কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে আপনি ডানা মেলবেন সুন্দর ওই নীল আকাশটাতে–মুক্ত বাতাসে। সেদিন আপনার সমস্ত হতাশা, কষ্ট, দুশ্চিন্তা, দুঃখগুলো দলবেঁধে এসে দুঃখপ্রকাশ করবে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করবে যে, তারা নিতান্তই মিথ্যে ছিল। 

.

চার.

ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে হলের বারান্দায় আসতেই দিলটা “খুশ” হয়ে গেল। নিলয়ের। চমৎকার ঝকঝকে রোদ ধুয়ে দিচ্ছে চারপাশটাকে। আকাশটা ভীষণ নীল। মনে হচ্ছে কেউ যেন নীল রং ঢেলে দিয়েছে সমস্ত আকাশজুড়ে। কী অসহ্য সুন্দর! জোড়া শালিক হলুদ হলুদ পা ফেলে ঘাসের মধ্যে পোকা ধরছে। ঘাসগুলো যেন সবুজ গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। মৃদু বাতাসে তির তির করে কাঁপছে সাদা ঘাসফুলগুলো। নারিকেল, আম, জাম আর কাঁঠালের বনে দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা বাতাস উঠল হুট করে। আমের শাখাগুলো দুলছে, হাতছানি দিয়ে ডাকছে যেন নিলয়কে; আয় নিলয়, আয়… 

নাস্তা করে এসে কী করবে ঠিক বুঝতে পারল না নিলয়। ছুটির দিন আজকে। ক্লাস কিংবা ল্যাবের কোনো ঝামেলা নেই। আরেকবার সেঁটে ঘুম দেবে কি না ভাবছে, এমন সময় মনে হলো “ধুর! ঘুম দিয়ে লাভ নেই। তারচেয়ে একটা মুভি দেখি। কী জানি একটা নতুন বাংলা মুভি এসেছে শোভন বলছিল… উমম… মনে পড়ছে… ওটাই দেখি।” ইউটিউবে গিয়ে মুভি দেখা শুরু করল নিলয়। গতানুগতিক কাহিনি। একটু পরেই একটা গান শুরু হয়ে গেল। আইটেম সং। নিলয় ভদ্র ছেলে। শুক্রবার ছাড়াও মাঝে মাঝে মসজিদে যায়। আইটেম সংয়ের কাণ্ডকারখানা দেখে লজ্জা পেয়ে গেল। স্কিপ করে গেল পুরোটা। একটু পর শুরু হলো আরেকটা গান। আইটেম সং না হলেও যথেষ্টই অশ্লীল। এবার কিছুক্ষণ, কিছুক্ষণ না পুরোটাই দেখল সে। ভেতর থেকে কে যেন তাকে বলল, আরে ব্যাটা দেখ, একবার দেখলে কিছুই হয় না। পুরোটা মুভি যখন সে দেখে শেষ করল তখন ওর অবস্থা বেশ খারাপ। কান গরম হয়ে গেছে। হার্টবিট খুব বেড়ে গেছে। জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে। বাইশটা বসন্ত পার করে দেয়া তৃষ্ণার্ত শরীর জেগে উঠেছে। নিলয় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেই আইটেম সংটা (প্রথম বার এটা দেখেই সে লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলেছিল) বেশ কয়েকবার দেখল। তারপর একটা-দুইটা করে বেশ কয়েকটা দেখে ফেলল। ভেতর থেকে ওর ভালো মানুষের সত্তাটা বার বার নিষেধ করছিল। সেটাকে পাত্তা দিলো না সে একবারেই। উত্তেজনা বাড়তে থাকল। একসময় জঘন্য কাজটা করে ফেলল নিলয়। ঠান্ডা হবার পর হুশ ফিরল। গভীর অবসাদ তাকে গ্রাস করল। একটু আগেও যে সোনালি রোদ্দুরে ভরা পৃথিবীটাকে অনেক সুন্দর মনে হচ্ছিল, আল্লাহকে বার বার ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছিল সে পৃথিবীটাকেই এখন ভীষণ স্যাঁতস্যাঁতে, অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হচ্ছে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কতবার এভাবে নিজের নফস আর শয়তানের কাছে। পরাজিত হতে হবে জানে না নিলয়। এভাবেই উদ্দেশ্য গোপন করে কালে কালে, যুগে যুগে, আদম (8 হাওয়া থেকে শুরু করে তাঁদের সন্তানদের ধোঁকা দিয়ে চলেছে ইবলিস। সে কখনোই সরাসরি আপনাকে বলবে না, “যা পর্ন দেখ” বা “হস্তমৈথুন কর”।

 ধাপে ধাপে অত্যন্ত ধৈর্য ধরে অগীবে সে। প্রথম ধাপটা সে আপনার কাছে খুব আকর্ষণীয় করে রাখবে। সে কাজটা করার জন্য আপনার সামনে অনেক লজিক নিয়ে আসবে। আদম আর হাওয়াকে যেভাবে ধোঁকা দিয়েছিল ঠিক সেভাবেই। ঘটনাটা আমরা সবাই জানি। আল্লাহ্ আদম আর হাওয়াকে একটা গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন। এমনকি সে গাছের কাছে যেতেও নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু শয়তান তাদের সেই গাছের ফল খাইয়েই ছেড়েছিল। শয়তান প্রথমেই উনাদের বলেনি, “তোমরা এই নিষিদ্ধ গাছের ফল খাও।” শয়তান প্রথমে আদম অরি হাওয়াকেগিয়ে বলল, “দেখো! আমি তোমাদের বন্ধু, আমি তোমাদের উপকার করতে চাই। তোমরা যদি এই গাছের ফল খাও, তাহলে তোমরা চিরযৌবন পেয়ে যাবে। চিরকাল এই জান্নাতে থাকতে পারবে।” 

তাঁরা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আল্লাহর আদেশ অমান্য করে ফল খেলেন। চিরসুখের জান্নাত থেকে এই দুঃখ-কষ্টে ভরা দুনিয়াতে বনী আদমের যাত্রীর শুরটা এভাবেই। বনি ইসরাইলের বারসিসার ঘটনাটাও শয়তানের স্টেপ বাই স্টেপ ধোঁকার আরেকটি ক্ল্যাসিক উদাহরণ। অত্যন্ত ইবাদতগুজার বারসিসাকে শয়তান ধীরে ধীরে ধোঁকায় ফেলে এক তরুণীর প্রেমে মশগুল করে দেয়। তারপর তার সঙ্গে যিনা করিয়ে নেয়। মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হলে ইবলিস বারসিসাকে প্ররোচনা দেয় তাকে মেরে ফেলতে। সবশেষে বারসিসাকে বাধ্য করে শয়তানের উদ্দেশে সিজদাহ করতে। আপনাকে কাবু করার জন্য সে একই রকম ফাঁদ পাতবে। প্রথম স্টেপটা হবে আপাতদৃষ্টিতে খুবই সাধারণ, নিরীহ একটা বিষয়। রাস্তাঘাটে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকা, মাঝেমধ্যে মুভি দেখা, ইউটিউবে একটু ভিডিও দেখা, কোনো মেয়েকে ফেইসবুকে ফলো করা, প্রোফাইল পিকচারে লাইক দেয়া, মাঝেমধ্যে চ্যাট করা, বা “বোনের মতো”/ “জাস্ট ফ্রেন্ড” মেয়েবন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা দেয়া, হ্যাং আউট করা ইত্যাদি। এ কাজগুলো করতে আপনার মন খুঁত খুঁত করলে। হাজারটী যুক্তি খাড়া করবে সে আপনার সামনে; আরে একদিনই তো…. মাঝেমধ্যে বিনোদনেরও তো একটু দরকার আছে নাকি! ইসলাম কি এতই কঠোর? আমি তো শুধু চ্যাটই করছি, প্রেম তো আর করছি না…, মেয়ে দেখলে কী আর এমন হবে; আল্লাহ্র (ঊ) এত সুন্দর সৃষ্টি, মা শা আল্লাহ্ দেখব না কেন? আমরা ও রকম না, একসাথে বসে আড্ডা দিলেও, একই রিকশায় ঠাসাঠাসি করে বসলেও আমাদের মনে খারাপ কিছু আসে না–আমরা জাস্ট ফ্রেন্ডস… এ রকম হাজার হাজার যুক্তি। যদি শয়তানের পাতা এই ফাঁদে একবার পা দেন, তাহলেই ফেঁসেছেন। বেশ ভালো সম্ভাবনা আছে শয়তানের হাতে নাকানি-চুবানি খেয়ে নিজের জন্য জাহান্নামের গর্ত বুকিং করার। নিজের ওপর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে ভাবতে পারেন, আরে ধুর! অযথাই ভয় দেখাচ্ছেন আপনি… আমাকে কখনো শয়তান নাকানি-চুবানি খাওয়াতে পারবে না, উল্টো আমিই তাকে দৌড়ানি দেবো। ওই প্রথম স্টেপই কেবল, তারপর তো আর আগাচ্ছি না। আপনার মতোই বারসিসাও ভেবেছিল যে, “ওই প্রথম স্টেপ পর্যন্তই। তারপর তো আর আগাচ্ছি না।” কিন্তু একসময় হাঁটি হাঁটি পা পা করে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় সবগুলো স্টেপস পার করে শয়তানকে সিজদাহ করার মতো জঘন্য পাপ করে বসেছিল। অপিনার ক্ষেত্রেও যে এমনটা হবে না, তার গ্যারান্টি কী। বারসিসা ছিল খুবই বড় একজন ইবাদাত-বন্দেগী করনেওয়ালা (আবিদ)। কিন্তু শেষমেষ তারই এমন করুণ পরিণতি হয়েছিল–আমি, আপনি কোন ছার। তা ছাড়া, আল্লাহ্ আমাদের নিজেকে নিজেই ফিতনাহতে ফেলতে নিষেধ করেছেন। তিনি কিন্তু বলেননি তোমরা যিনী কোরো না, তিনি বলেছেন যিনার কাছেও যেয়ো না। কাজেই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে নিজেকে এই সব ফিতনাহর মধ্যে ফেলার কোনো মানেই হয় না। আত্মবিশ্বাস ভালো, তবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কেবল বোকাদেরই থাকে। রংবাজি করার আরও অনেক জায়গা পাবেন, এখানে না করাই ভালো। জান্নাত-জাহান্নামের প্রশ্ন এটা। বাস্তবতাটা বোঝার চেষ্টা করুন। আপনি খুব ভালো করেই জানেন কোন কোন বিষয়গুলো আপনাকে ফিতনাহর মধ্যে ফেলে। কোন ট্রিগারগুলো একটু একটু করে আপনাকে পর্ন দেখতে, হস্তমৈথুন করতে বা আসল যিনা করে ফেলতে ধাবিত করে। সে বিষয়গুলোর তালিকা করুন। ট্রাকের পেছনে লেখা থাকে, দেখেছেন না–১০০ হাত দূরে থাকুন? সেভাবেই যিনার দিকে ধাবিত করা সেই বিষয়গুলো থেকে ১০০ হাত দূরে থাকুন। ধারেকাছেও ঘেঁষবেন না। শয়তানকে কোনো সুযোগই দেবেন না। কোনো যুক্তিই মানবেন না। 

.

পাঁচ. 

গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে খুব বেশি দেরি নেই। একসময় জীবনের একমাত্র লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ছিল ভালো একটা চাকরি করে মনের মতো একজনকে বিয়ে করা। এখন চাকরির কথা মনে হলেই গা শিউরে ওঠে। চাকরি-টাকরি বাদ। ব্যবসা করব, ব্যবসা। ঘুমানোর আগে কাঁথা গায়ে দিয়ে ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে আমি ব্যবসার চিন্তা করি। মফস্বল শহরে অল্প টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করব, তারপর আস্তে আস্তে ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠবে। হেড কোয়ার্টারটা ওই মফস্বল শহরেই থাকবে, কিন্তু ব্রাঞ্চ খেলা হবে ঢাকাসহ দেশের সব বড় বড় শহরে। গাড়ি হবে, বাড়ি হবে, বউ হবে। প্রতিমাসে একবার কক্সবাজার, বছরে অন্তত একবার দেশের বাইরে টুর। ভবিষ্যতের এই সুখময় দিনের কথা ভাবতে ভাবতে আমার চোখের ঘুম কখন। হাওয়া হয়ে যায়! ভাগ্যিস আমার কাঁথাটা ছেঁড়া নী; নাহলে নিন্দুকেরা মুখ বেঁকিয়ে বলেই বসত, ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন! 

এই যে চিন্তা করতে পারা, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারা আল্লাহ্ কী বিশাল এক নিয়ামত সেটা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? কী গভীরভাবে মানুষ চিন্তা করতে পারে! কী ব্যাপক বিস্তৃত তার চিন্তাভাবনা! কত মোটাসোটা খটমটে, রসকষহীন বই সে লিখে ফেলেছে স্রেফ চিন্তা করেই! পাল্টে দিয়েছে পৃথিবীর গতিপথ! সুবহান আল্লাহ্!! চিন্তাশক্তিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই জরুরি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পর্নোগ্রাফি/হস্তমৈথুন চটিগল্পের শুরুটা কিন্তু হয় লাগামছাড়া চিন্তাভাবনা থেকেই। রাতে ঘুমানোর আগে বা কোনো অলস মুহূর্তে কোনো মেয়ের কথা মনে হলো বা মনে হলো পর্ন ভিডিওতে দেখা কোনো দৃশ্যের কথা। আপনি সেই মেয়েকে নিয়ে বা দৃশ্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করা শুরু করলেন। আপনার চিন্তাভাবনা ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠল। আপনার ভেতরের প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলল। ওই জঘন্য কাজগুলো করার জন্য প্রেশার তৈরি করল। একসময় আপনি সেই চাপের কাছে মাথানত করবেন, আত্মসমর্পণ করবেন শয়তানের কাছে। তাই চিন্তার ব্যাপারে সাবধান। আপনার পদস্খলনের জন্য শয়তানের খুবই শক্তিশালী হাতিয়ার হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত, লাগামছাড়া চিন্তী। আবারও বলছি এটা খুবই শক্তিশালী হাতিয়ার। শয়তানের এই হাতিয়ার নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারলে আপনার আসক্তি কাটানো খুবই সহজ হয়ে যাবে। কোনো মেয়েকে নিয়ে বাজে চিন্তা করা বা পর্ন অভিনেত্রীদের নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভোগীয় আনন্দ আছে, ক্ষণিকের মজা আছে। কিন্তু এর শেষ পরিণাম ভয়াবহ; জাহান্নামের লেলিহান শিখা। 

যা যা করতে পারেন :

১) কিছুক্ষণ চিন্তা করে মজা নিই, পরে আর চিন্তা করব না, এ রকম মন মানসিকতা থাকা যাবে না। বাজে চিন্তা আসামাত্রই আল্লাহ্ কাছে আশ্রয় চাইতে হবে। চিন্তার ডালপালা গজাতে দেয়া যাবে না। চিন্তার ফোকাস সরিয়ে ফেলতে হবে, মানুষজনের সাথে কথা বলতে হবে, জায়গা পরিবর্তন করতে হবে বা কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতে হবে।

২) এমন কিছু মেয়ে থাকে যাদের কথা মনে হওয়া মাত্রই আপনার ভেতরে পর্ন দেখা বা হস্তমৈথুন করার একটা চাপ তৈরি হয়। ওইসব মেয়েদের কথা মনে হওয়া মাত্রই আপনি আল্লাহ্ কাছে আশ্রয় তো চাইবেনই সেই সাথে ওইসব মেয়েদের জন্যও দু’আ করবেন, যেন আল্লাহ্ তাদের হেদায়াত দেন, তাদের হৃদয়ের ক্ষতগুলো সারিয়ে তুলে পবিত্র জীবনযাপনের তাওফিক দেন। এভাবে দু’আ করাটা খুবই কার্যকরী। এর মাধ্যমে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে। ওই মেয়েগুলো আপনার কাছে এখন আর কেবল ভোগের মাল না; বরং সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সব মানবীয় অনুভূতি নিয়ে রক্ত-মাংসের একটা জলজ্যান্ত মানুষ। ওদেরও ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে, স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে, প্রিয় মানুষটার কাঁধে মাথা রেখে জ্যোৎস্না দেখতে ইচ্ছে করে, আপনি আল্লাহর নাম স্মরণ করছেন, তার কাছে দু’আ করছেন। এ সময় শয়তান খুব। একটা সুবিধা করে উঠতে পারবে না। আপনার ফোকাস চেইঞ্জ হয়ে যাবে। আর আপনার দু’আর কারণে যদি আল্লাহ্ কাউকে হেদায়াত দিয়েই দেন, তাহলে কী বিপুল পরিমাণ পুরস্কার আপনার জন্য অপেক্ষা করবে সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।

৩) বাজে চিন্তা যেন না আসে সে ব্যবস্থা করতে হবে। জাস্ট ফ্রেন্ড, জাস্ট ফ্রেন্ড খেলা, পবিত্র প্রেম, পবিত্র প্রেম খেলা বন্ধ করতে হবে। “আমরা শুধুই বন্ধু, আমাদের মন পবিত্র, মনে কোনো পাপ নেই, আমরা ভাই বোনের মতো”, প্লিয এ ধরনের হাস্যকর দাবি করবেন না। কেন এই মিছে অভিনয় করছেন? কেন নিজেই নিজেকে বোকা বানাচ্ছেন? আপনি জানেন যে, আমিও জানি আপনি যা বলছেন তা মিথ্যে। আপনি আপনার “জাস্ট ফ্রেন্ডদের নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভোগেননি, তাদের নিয়ে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে রসালো আলাপ করেননি, তীদের ভেবে হস্তমৈথুন করেননি এইসব মিথ্যে বলবেন না। যেখানে মেয়েদের দিকে তাকানোই হারাম সেখানে তাদের সাথে প্রেম করা, বন্ধুত্ব করা, মেলামেশা করার তো প্রশ্নই আসে না। মেয়েদের সাথে অবাধ মেলামেশাও পুরুষের সেক্সয়াল মোড অন করে। পুরুষ যখন কোনো নারীর সাথে ইন্টার্যাকশানে যায় তখনো তার শরীরের ভেতর টেস্টোস্টেরোন নিঃসৃত হয় এবং তাকে সেই নারীর সাথে চূড়ান্ত পর্যায়ের অন্তরঙ্গ হবার জন্য প্রস্তুত করে। আর টেস্টোস্টেরোন নিঃসরণের মাত্রা যদি খুবই বেশি হয়, তাহলে ব্যক্তি অন্তরঙ্গ হবার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করে। আপনার “জাস্ট ফ্রেন্ড” বা প্রেমিকার সাথে তো আর ঠিক সেই মুহূর্তে অন্তরঙ্গ হতে পারছেন না, তাই বাথরুমে গিয়ে নিজেকে ঠান্ডা করছেন, ঠিক কিনা? দয়া করে এগুলো বন্ধ করুন। পর্ন/হস্তমৈথুন/চটিগল্পের আসক্তি থেকে ফিরে আসা এমনিতেই খুবই কঠিন। আপনার এ কাজগুলোর জন্য ফিরে আসা আরও কঠিন, এমনকি অসম্ভবও হয়ে দাঁড়ায়। 

৪) মাহরাম ছাড়া যত নারী আছে, তাদের সাথে পর্দা করুন। এমনকি নিকটাত্মীয়দের সাথেও। মাহরাম হচ্ছেন এমন একজন যাকে বিয়ে করা হারাম। যেমন : ছেলেদের জন্য দাদি, নানি, মা, দুধ-মা, খালা, ফুপু, বোন, দুধ-বোন, শাশুড়ি, মেয়ে, নাতনি, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়ে, ছেলের বউ হলো মাহরাম। বাকি সবাই গাইর মাহরাম। মাহরাম ছাড়া অন্য যেকোনো মহিলাদের অর্থাৎ গাইর মাহরাম মহিলাদের বিয়ে করা জায়েজ। ভাবি, চাচি, মামি, শালি, কাযিন (মামাতো বোন, চাচাতো বোন, খালাতো বোন) এরা সবাই গাইরে মাহরাম। এদের সাথে পর্দা করতে হবে। পর্ন-আসক্তি বিশেষ করে চটিগল্পের নেশা ছাড়তে চাইলে অবশ্যই অবশ্যই এদের সঙ্গে পর্দা করতে হবে। তা না হলে তাদের সঙ্গে আপনার কথোপকথন, চলাফেরা, ওঠাবসা আপনাকে চটিগল্পগুলোর কথা বা ইনসেস্ট পর্নের কথা মনে করিয়ে দেবে। চটিগল্প বা পনের বিরুদ্ধে আপনি যে প্রতিরোধ ব্যুহ গড়ে তুলেছেন, তা ভেঙে তছনছ হয়ে যাবে। আপনি বার বার ফিরে যাবেন চটিগল্প কিংবা পর্নের কাছে। শয়তান সব সময় এই সম্পর্কগুলো দিয়ে মানুষকে ধোঁকা দেয়। তাই ভুল হয়ে যাবার (আল্লাহ্ না করুক) ভালো একটা আশঙ্কা থাকে। তা ছাড়া চটিগল্প পড়ার কারণে বা পর্ন দেখার কারণে আপনার মনে তাদের নিয়ে বাজে একটা চিন্তা সব সময় ঘোরাফেরা করে, আপনি বহু কষ্টে সেটি চাপা দিয়ে রাখেন। তাদের সঙ্গে মেলামেশী, কথাবার্তায় সেই চিন্তা ফুলে ফেঁপে উঠবে, বিস্ফোরণ ঘটতে কতক্ষণ?বলা যত সহজ পর্দা করাটা তত সহজ না। সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে পর্দা মেনে চলার। একান্তই সম্ভব না হলে চেষ্টা করুন। ইন্টার্যাকশান একেবারেই কমিয়ে ফেলতে৷ কাযিন, শালি, ভাবি, মেয়ে ক্লাসমেইট গল্প করতে এলে গোমড়া মুখে থাকুন, হ্যাঁ, হু-তেই কাজ সেরে ফেলুন। দেখবেন আস্তে আস্তে ওরা দূরে সরে যাবে। সবচেয়ে ভালো টেকনিক হলো “হুজুর” হয়ে যাওয়া। দাড়ি ছেড়ে দিন, মাথায় টুপি পরতে শুরু করুন, গাইরে মাহরাম মহিলা দেখলেই চোখ নামিয়ে ফেলার চেষ্টা করুন, দেখবেন কাযিন বা শালিরা আপনার সঙ্গে আড্ডা মারতে আসছে না, ভাবি আপনাকে দেখলেই মাথায় কাপড় দিয়ে আড়ালে চলে যাচ্ছেন। এ কাজগুলো যদিও এমনিতেই করা জরুরি, তবুও যদি না করে থাকেন, অন্তত এ উসিলায় করে ফেলুন। প্রথম প্রথম আপনার মনে হতে পারে কাযিন, ভাবি বা অন্য গাইর মাহরাম মহিলাদের থেকে এ রকম দূরে দূরে সরে থাকলে ওরা আপনাকে অসামাজিক ভাববে। ভাববে আপনি আলগী ভাব মারেন। পরে একসময় বুঝবেন ব্যাপারটা ঠিক উল্টো–এই দুরে দুরে সরে থাকার কারণেই তারা আপনাকে প্রচুর সম্মান করবে, শ্রদ্ধা করবে। ভালো ছেলের উদাহরণ দিতে গেলে আপনার নামটাই প্রথমে মনে। পড়বে। 

৫) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চোখের হেফাযত করা। রাসূল বলেছেন। “নজর হচ্ছে শয়তানের তীর। শুধু এই চোখের হেফাযতের মাধ্যমে আপনি পর্ন-হস্তমৈথুন আসক্তি থেকে নিজেকে বাঁচাতে তো পারবেনই, সেই সঙ্গে আপনার জীবনটাই বদলে যাবে। এক সপ্তাহ চোখের হেফাযত করে দেখুন। পার্থক্যটা নিজেই টের পাবেন। 

রাসূলুল্লাহ বলেছেন, “মানুষের শরীরে এমন একটি গোশতপিণ্ড রয়েছে যা ঠিক থাকলে পুরো শরীর ঠিক থাকে; আর তা যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে পুরো শরীর নষ্ট হয়ে। আর তা হলো ক্বলব বা হৃদয়।” 

(বুখারি : ৫২; মুসলিম :৪১৭৮)

ক্বলব বা হৃদয় ঠিক থাকলে ঈমান-আমল সবই ঠিক থাকবে, আর ফুলব কলুষিত থাকলে ঈমান-আমলের বারোটা বেজে যাবে। শয়তান তাই প্রথমেই আপনার। হৃদয়ের দখল নিয়ে নিতে চায়, যেন আপনাকে ইচ্ছেমতো নাকে ছড়ি দিয়ে ঘোরানো যায়। চোখের দৃষ্টি হলো শয়তানের তুরুপের তাস। এর মাধ্যমে সে অতি সহজেই আপনার হৃদয়ের দখল নিতে পারে। আর একবার হৃদয়ের দখল করে নিতে পারলে সে আপনাকে দিয়ে তার ইচ্ছেমতো পাপ কাজ করিয়ে নেবে। 

এই যৌন সুড়সুড়িতে সয়লাব সমাজে কি আদৌ চোখের হেফাযত করা সম্ভব?

জ্বী, কঠিন হলেও সম্ভব। রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হবে, রাস্তার আশেপাশে, গার্লস স্কুলের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়া যাবে না। যে জায়গাগুলোতে মেয়েদের আনাগোনা বেশি বা যে জায়গীতে ফ্রি মিক্সিংয়ের সম্ভাবনা বেশি সেই জায়গাগুলো পরিত্যাগ করতে হবে। সাহাবা, তাবেঈ এবং আগের যুগের নেককার মানুষদের চোখের হেফাযত সম্পর্কে জানতে হবে। তাঁদের প্রতিযোগী হিসেবে নিতে হবে; উনারা পারলে আমি কেন পারব না… 

মুভি, নাটক, গান-বাজনা থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে, পত্রিকার বিনোদন-পৃষ্ঠা সযত্নে এড়িয়ে চলতে হবে। বেশ কার্যকরী একটা উপায় হলো, আপনি একদিনে কতবার চোখের হেফাযত করতে পারলেন না সেটা হিসাব করে রাখা। তারপর কাফফারা হিসেবে প্রতিবারের জন্য দু-রাকাত করে নফল সালাত আদায় করা। মনে করুন, আপনি কোনো একদিন মোট ১০ বার চোখের হেফাযত করতে পারলেন না, তাহলে এই ১০ বারের জন্য মোট ২০ রাকাত নফল সালাত আদায় করুন। এভাবে করতে থাকুন। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আপনি চোখের হেফাযত করতে পারেননি, কিন্তু শয়তান যখন দেখবে আপনি প্রত্যেকবার চোখের হেফাযত না করার জন্য দু-রাকাত করে সালাত আদায় করছেন, তখন সে আফসোস করবে। আপনাকে নফল সালাতের সোয়াব থেকে বঞ্চিত করার জন্য সে নিজের গরজেই আপনাকে চোখের হেফাযত করতে সাহায্য করবে। নামায আদায় করার এ টিপস শোনার পরে মনে খুবই ভালো অনুভূতি কাজ করে, “যাক বাবা! আর চোখের হেফাযত করতে সমস্যা হবে না।” কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, এই টিপসের ওপর আমল করা কষ্টকর। আপনি সারাদিন মেয়েদের দিকে ইচ্ছেমতো তাকালেন, রূপসুধা পান করলেন এই ভেবে যে, “আমি রাতে তো নামায আদায় করে নেবই কাফফারা হিসেবে”, কিন্তু শেষমেষ দেখবেন নামায আর আদায় করা হয়ে উঠবে না। আমলের ব্যাপারে আন্তরিকতা না থাকলে চোখের হেফাযত আর করা হয়ে উঠবে না। তাই কঠোর প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে ১০০ রাকাআত নামায হলেও আপনি ১০০ রাকাআত নামায আদায় করবেন। পর্ন ভিডিও দেখা, হস্তমৈথুনের দিকে ধাবিত করার উল্লেখযোগ্য আরেকটি মাধ্যম হলো ইউটিউব। আপনার মনে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই, স্রেফ একটা ভালো ভিডিও দেখার জন্য ইউটিউবে বসবেন, তারপর সাজেশান লিস্টে কিছু ভিডিও উঁকিঝুঁকি মারতে থাকবে। আপনি সেদিকে তাকাতে না চাইলেও মাঝে মাঝে চোখ চলে যাবে। আর তখনই শয়তান এসে কাঁক করে ধরবে। আর এটা বলবেন না যে, ইউটিউবে ১০ মিনিটের জন্য ভিডিও দেখতে বসে আপনি কেবল ১০ মিনিটই বসে থাকেন। একবার ইউটিউবে বসলে এক-দেড় ঘণ্টা কোন দিক দিয়ে চলে যায়, টেরও পাওয়া যায় না। শুধু শুধু সময় নষ্ট। তারচেয়ে এই সময়ে কিছুটা আঁতলামি যদি করতেন, তাহলে আপনার সিজিপিএ-টা স্বাস্থ্যবান হতো, ভালো একটা জব পেতেন আর কোনো রূপসী কন্যার বাবার মনটাও হয়তো ভবিষ্যতে গলত। 

অনেক সময় অবশ্য কোনো উপায় থাকে না। কোনো টিউটোরিয়াল দেখার জন্য বা ভালো কোনো লেকচার শোনার জন্য ইউটিউবে বসতেই হয়। পরামর্শ থাকবে বিসমিল্লাহ বলে ব্রাউযিং শুরু করুন। ভালো হয় K9 ইন্সটল করা থাকলে। চাইলেও 

আজেবাজে ভিডিওগুলোতে অ্যাক্সেস করতে পারবেন না। অবসর সময়ে কখনো ইউটিউবে বসে র‍্যান্ডমলি ভিডিও দেখবেন না (বাক্যটা কয়েকবার পড়ুন, মাথায় গেঁথে নিন)। অবসর সময়ে খুব বেশি বেশি কুমন্ত্রণী দেয় শয়তান, তার ওপর যদি আপনাকে ইউটিউবে র‍্যান্ডমলি ভিডিও দেখা অবস্থায় পায়, তাহলে তো ওর পোয়াবারো। ইউটিউবের ফাঁদ থেকে বাঁচার উপায় নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা পাবেন “বিষে বিষক্ষয়” নামক প্রবন্ধে। 

.

ছয়. 

হস্তমৈথুনে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য শয়তানের আরেকটি কার্যকর ফাঁদ হলো স্বপ্নদোষ। সে আপনাকে বোঝাবে, “দেখ, স্বপ্নদোষ ব্যাপারটা বেশ বিরক্তিকর। শীতকাল হলে তো কথায় নেই। মাঝেরাতের ঘুমভাঙা চোখ, ট্রাউজার, লেপ, কম্বল ভিজে একাকার চিটচিটে, আঠালো লিকুইডে। গা গুলোয়। পানি গরম করা, বালতি নিয়ে টানাহেঁচড়া, বাবা-মা, ভাই-বোনদের লুকিয়ে খুব সাবধানে গোসল করা। কী ভীষণ লজ্জা! বাবা-মা একটু অন্যরকমভাবে তীকালেও সন্দেহ হয়, এই বুঝি বুঝে গিয়েছে! মনে কর তুই আত্মীয়স্বজনের বাসায় বেড়াতে গেলি। রাতে তোর স্বপ্নদোষ হলো সকালে উঠে ঘরভর্তি লোকজনের সামনে গোসল করা কত ঝামেলার! তা ছাড়া স্বপ্নদোষ শরীরের জন্য খুব ক্ষতিকর। তারচেয়ে তুই বরং সপ্তাহে একবার করে হস্তমৈথুন করে নে। তাহলে আর স্বপ্নদোষ নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হবে না।” 

আমার এমন অনেক বন্ধু আছে, যারা এমনিতে হস্তমৈথুন করত না, কিন্তু শুধু স্বপ্নদোষের ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য নিয়মিত বিরতিতে হস্তমৈথুন করত। শয়তান তাঁদের ভালোই ধোঁকায় ফেলেছিল। স্বপ্নদোষ নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার। একটু বয়স হয়ে যাওয়ার পর সবাই কমবেশি সামলে নেয়, কিন্তু কৈশোরে বা প্রথম তারুণ্যে স্বপ্নদোষ খুবই ভীতিকর এক অভিজ্ঞতা। দশ-বারো বছরের বাচ্চা একটা ছেলে হুট করে যখন এক রাতে ঘুম ভাঙার পর দেখে তার প্যান্ট ভিজে গিয়েছে আঠালো লিকুইড়ে, তখন তার ঘাবড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। দেহের আকস্মিক এই পরিবর্তনের রহস্য উদঘাটনে সে শরণাপন্ন হয় বন্ধু, পাড়ার ভাই-বেরাদর, কঠিন বা নিজের ভাই-বোনদের কাছে। বাবা-মা বা অন্য কোনো গুরুজনদের সঙ্গে তার দৈহিক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করার কথা সে ভুলেও ভাবে না। কিছুটা লজ্জা আর বাকিটা জেনারেশন গ্যাপের কারণে। স্বপ্নদোষ সম্পর্কে আমাদের সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, হাতুড়ে ডাক্তার, হারবাল কোম্পানীর দৌরাত্ম্য, সঠিক তথ্যের অপ্রতুলতার কারণে একগাদা ভুলভাল তথ্যে বোঝাই হয় ছোট্ট মস্তিষ্ক। সে ঘাবড়ে যায় আরও। শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। 

অথচ মুসলিমদের এ রকমটা হবার কথা ছিল না। অপ্রয়োজনীয় লজ্জা-বিলাসিতা করা মুসলিমদের সাজে না। খোদ রাসূলুল্লাহকে মহিলা সাহাবীরা স্বপ্নদোষের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ্ সত্য প্রকাশে লজ্জিত হন না, একজন মহিলার স্বপ্নদোষ হলে তাকে কি গোসল করতে হবে?” আমরা লজ্জার দোহাই দিয়ে অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাই। গুরুজনদের এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন করাকে বেয়াদবি মনে করি। ভাবখানা এমন, আমরা রাসূলুল্লাহ আর তার সাহাবীদের চেয়েও বেশি লজ্জাশীল হয়ে গিয়েছি! আমরা তাদের চেয়েও বেশি আদব-কায়দা জানি! আফসোস! আমাদের এই ব্যাপারগুলো নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা উচিত। তার মানে আবার এটা না যে, “আমার স্বপ্নদোষ হয়েছে!” এই বলে বাজারে ঢোল পেটাব। একটু মাথা খাটালেই, শালীনতা বজায় রেখে খুবই কার্যকরীভাবে স্বপ্নদোষ নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করে সঠিক তথ্যগুলো সবাইকে জানানো যায়। মসজিদগুলোকে 

আমরা কাজে লাগাতে পারি। ইমাম সাহেব বা কমবয়সী কোনো আলিম একদিন মহল্লার সকল উঠতি ছেলেদের মসজিদে দাওয়াত করলেন। কিছু খাওয়া-দাওয়া, গল্পগুজব হলো। এরই ফাঁকে ফাঁকে পর্ন, হস্তমৈথুনের অপকারিতা, চোখের হেফাযতের গুরুত্ব, স্বপ্নদোষ, পবিত্রতা অর্জনের গুরুত্ব এবং পদ্ধতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা হলো। খুঁজলে এমন অনেক চিকিৎসক পাওয়া যাবে, যারা খুব আগ্রহের সঙ্গে এ ধরনের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করবেন। একটু আন্তরিকতা আর সদিচ্ছা থাকলেই সমাজের বিশুদ্ধতম মানুষগুলোর কাছ থেকে আমাদের কিশোরেরা এই অত্যাবশ্যকীয় জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। যৌনশিক্ষার পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালার কোনো দরকার নেই, দরকার নেই বিদেশি এনজিওর সাহায্য নিয়ে অ্যালফ্রেড কিনসি আর জন মানির মতো লোকদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ করে দেয়ার। খুব কম লজিস্টিক সাপোর্ট আর স্বল্প বাজেট দিয়েই সম্ভব কোয়ালিটি সেক্স এডুকেশন নিশ্চিত করা। আল্লাহ্র কসম! আমাদের মসজিদগুলো আজ বিরান হয়ে গিয়েছে। কুরআনের দারস নেই, হাদীসের হালাকী নেই। রোবটের মতো মানুষগুলো সিজদাহ দিয়ে নামায পড়ে, তারপর বের হয়ে আসে। মসজিদ কমিটির সদস্যদের এইগুলো নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের সব মাথাব্যথা মসজিদে এসি লাগানো, টাইলস লাগানো নিয়ে। জাতি হিসেবে কোথায় চলেছি আমরা? মসজিদে তরুণেরা কুরআনি নিয়ে বসতে ভয় পায়! হালকা করতে ভয় পায়! খতীব সাহেবেরা দ্বীনের কথা, আল্লাহর রাসূলের কথা বলতে ভয় পান! যা হোক, আক্ষেপের প্যাচাল বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি। 

স্বপ্নদোষ কী?

 স্বপ্নদোষ হলো ঘুমের মধ্যে নারী-পুরুষের অন্তরঙ্গতার স্বপ্ন দেখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যৌনাঙ্গ থেকে বীর্য বের হয়ে আসী। স্বপ্নদোষ সাধারণত রাতে হয়ে থাকে। এ কারণে একে অ্যাকাডেমিক্যালি Noctumal_Emissions বলা হয়। তবে মাঝেমধ্যে দিনেও স্বপ্নদোষ হয়ে থাকে। সব পুরুষই জীবনে অন্তত একবার হলেও এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়ে থাকেন। ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী, স্বপ্নদোষ হলো একজন বালকের প্রাপ্তবয়স্ক হবার অন্যতম একটি নিদর্শন। প্রথমবার স্বপ্নদোষ হবার পর থেকেই একজন বালককে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং শরীয়াহ তার ওপর কার্যকর হবে। সাধারণত ১২-১৩ বছর বয়স থেকে স্বপ্নদোষ শুরু হয়। ছেলেদের যেমন স্বপ্নদোষ হয়, তেমন মেয়েদেরও স্বপ্নদোষ হয়। 

কেন স্বপ্নদোষ হয়?

এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন। নির্দিষ্ট করে বলা যায় না ঠিক কোন কারণে স্বপ্নদোষ হয়। 

স্বপ্নদোষ হওয়া শুরু হয় বয়ঃসন্ধিকালে, যখন পুরুষের শরীরে টেস্টোস্টেরোন হরমোন তৈরি হওয়া শুরু হয়। এই হরমোনের প্রভাবেই পুরুষ, পুরুষালি আচরণ করে, নারী-পুরুষ একে অপরের প্রতি দৈহিক আকর্ষণ বোধ করে। টেস্টোস্টেরোন হরমোন সিমেন (বীর্য) প্রডাকশনে সাহায্য করে। টেস্টোস্টেরোনের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে গেলে পুরোনো বীর্য স্বপ্নদোষের মাধ্যমে বের হয়ে যায় এবং নতুন বীর্য তৈরি হয়। দীর্ঘ সময় ধরে যৌন নিষ্ক্রিয়তা স্বপ্নদোষের আরেকটি সম্ভাব্য কারণ। যৌননিষ্ক্রিয়তা, টেস্টোস্টেরোনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যার কারণে স্বপ্নদোষ হয়। মাত্রাতিরিক্ত ক্লান্তি, টাইট পোশাক পরে ঘুমানো, দেরি করে ঘুমানো এবং দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা, সকালে ঘুম ভাঙার পরে আবার ঘুমানো, সব সময় সেক্স ফ্যান্টাসিতে বঁদ হয়ে থাকা–এগুলোও স্বপ্নদোষের সম্ভাব্য কারণ। 

কত দিন পর পর স্বপ্নদোষ হয়?

নির্দিষ্ট করে বলার উপায় নেই। কারও কারও এক সপ্তাহ পর পর, আবার কারও কারও তিন-চার সপ্তাহ পর পর স্বপ্নদোষ হয়। 

স্বপ্নদোষ কী ক্ষতিকর?

 এটি নিয়ে আমাদের সমাজে বেশ বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা ছড়িয়ে আছে। স্বপ্নদোষ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক একটা ব্যাপার। এটা শরীরের জন্য মোটেও ক্ষতিকর না। আল্লাহ শুধু সেসব বিষয় হারাম করেছেন যেগুলো মানুষের জন্য ক্ষতিকর। যেমন ধরুন, মদ,গাঁজ। মানুষকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহ্  এগুলোকে হারাম করেছেন। স্বপ্নদোষ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক একটা ব্যাপার। এটাকে আল্লাহ্ হারাম করেননি; বরং এটাকে বানিয়েছেন সাবালকত্বের নিদর্শন। কুরআনে বলা হয়েছে : “আর তোমাদের সন্তানেরা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে (স্বপ্নদোষের মাধ্যমে)…” 

(সূরা নুর; ২৪:৫৯)

 আল্লাহ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ বলেছেন, “তিন ব্যক্তির অমিলনামা হতে কলম গুটিয়ে নেয়া হয়েছে, ১) ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম থেকে জাগ্রত হবার আগ পর্যন্ত ২) শিশুদের প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগ পর্যন্ত ৩) পাগলের হুশ হবার আগ পর্যন্ত।” 

(তিরমিযী :১৩৪৩; ইবনে মাজাহ : ৩০৩২; আন নাসাঈ : ৩৩৭৮) 

একজন ঘুমন্ত ব্যক্তি নিজেও জানে না ঘুমের ঘোরে সে কী করছে। তখন তার আমল লিপিবদ্ধ করা হয় না। স্বপ্নদোষ হয়ে থাকে ঘুমন্ত অবস্থায় এবং এটাকেও আমলনামায় লিপিবদ্ধ করা হয় না। ২৫৪ স্বপ্নদোষ যদি ক্ষতিকরই হতো, তাহলে আল্লাহ্ অবশ্যই একে হারাম করতেন এবং স্বপ্নদোষের কারণে শাস্তির ব্যবস্থা করতেন। তিনি (%) এর কোনোটাই করেননি। কাজেই আমরা মুসলিমরা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে নিতে পারি স্বপ্নদোষের কোনো ক্ষতিকর দিক নেই। চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুসারেও স্বপ্নদোষ ক্ষতিকর নয়। পানি পান করা হালাল। তবে আপনি যদি গ্লাসের পর গ্লাস পানি পান করতেই থাকেন, করতেই থাকেন, তাহলে তা অবশ্যই ভালো না। অতিরিক্ত স্বপ্নদোষও ভালো না। যদি আপনার দীর্ঘদিন ঘন ঘন স্বপ্নদোষ হয়, মনে করুন প্রতিদিন বা দু একদিন পর পর স্বপ্নদোষ হয়, তাহলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পীরেন। আই রিপিট, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। হাতুড়ে ডাক্তার না। স্বপ্নদোষ নিয়ে শয়তান আপনাকে কুমন্ত্রণী দিতে এলে একদমই শুনবেন না তার কথা। স্বপ্নদোষ হচ্ছে হোক, কিন্তু স্বপ্নদোষ থেকে বাঁচার জন্য ভুলেও হস্তমৈথুন করবেন না। 

.

সাত

পরীক্ষার ফাঁদ ভয়ঙ্কর ফাঁদ। বিশেষ করে গায়ে বাতাস লাগিয়ে বেড়ানো, ফাঁকিবাজ ছাত্রদের জন্য। এমনিতেই পরীক্ষার মধ্যে মাথার ভেতর টেনশীন থাকে, তার ওপর সারা বছর পড়াশোনা থেকে দুরে থাকলে প্রচুর প্রেশার পড়ে। এ প্রেশার সামলাতে না পেরেই অনেকে পর্ন দেখে বা হস্তমৈথুন করে। অসংখ্য তরুণের সাথে আমরা কথা বলে দেখেছি, পরীক্ষার মৌসুমে তাদের পর্ন দেখার বা হস্তমৈথুন করার মাত্রা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। আবার অনেকেই পরীক্ষার মধ্যে পর্ন দেখতে দেখতে বা হস্তমৈথুন করতে করতে আসক্ত হয়ে পড়ে। বাড়ে হতাশী, বাড়ে অস্থিরতা। ছাত্রজীবন অসাধারণ একটা সময়। এর প্রতিটি মুহূর্ত চুটিয়ে উপভোগ করা উচিত। ভাই আমার, অন্ধকার রুমে একা একা বসে পর্ন দেখে আর হস্তমৈথুন করে হতাশী আর অস্থিরতায় জীবনটা দুর্বিষহ করে তুলছ কেন? রুম থেকে একটু বের হও। দেখো কত সুন্দর একটা পৃথিবী তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দাও, দলবেঁধে ঘুরতে যাও, সবুজ ঘাসের ওপর খালি পায়ে হাঁটো, শুয়ে থেকে আকাশ দেখে, বৃষ্টিতে ভেজো, মাঠে খেলাধুলা করো, সাইক্লিং করো, দৌড়াও। খুব বেশি হতাশ লাগলে, মন খারাপ হলে মসজিদে যাও। তীক থেকে কুরআনের একটা কপি তুলে নাও। যেকোনো পেইজ বের করে পড়তে শুরু করো, দেখবে হতাশা, মন খারাপ কোথায় পালিয়ে যাবে! স্রেফ মসজিদে বসে থাকলেও দেখবে মন ভালো হয়ে যাবে। 

সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকতে হবে, পড়াশোনা করতে হবে, এটা বলছি না। ক্লাসে ফেসবুকিং করার মাঝে মাঝে লেকচারের দিকে একটা কান খোলা রাখো। ইচ্ছে হলে মাঝে মাঝে লেকচার খাতায় তুলে রাখে। উইকএন্ডের একটা দিন বা ক্লাস টেস্টের আগে টপিকগুলোতে চোখ বুলিয়ে রাখে। যে বন্ধুর কাছে তুমি পরীক্ষার আগের রাতে পড়া বুঝতে যাও, তার কাছে পরীক্ষার আগের রাতে না গিয়ে উইকএন্ডগুলোতে যাও। এই ছোট ছোট কাজগুলোই তোমাকে অনেক এগিয়ে রাখবে। পরীক্ষায় আর চাপ পড়বে না। তোমাকে অমানুষিক পরিশ্রমও করতে হবে। হতাশাও আসবে না ইন শা আল্লাহ। উত্তেজিত স্নায়ুকে শিথিল করার জন্য পর্ন দেখতে হবে না বা হস্তমৈথুনও করতে হবে না। 

.

আট.

ফেইসবুক ছুরির মতো। চিকিৎসকের হাতে থাকলে ছুরি জীবন বাঁচায়, রংবাজের হাতে থাকলে জীবন কেড়ে নেয়। ফেইসবুকও তা-ই। ভালোমতো ব্যবহার করতে পারলে আপনার জীবনের গতিপথই পালটে দেবে ফেইসবুক। আর একটু অসতর্ক হলেই জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। ফেইসবুক একসময় এমন ছিল না, জ্ঞানের প্রতিযোগিতা, সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতা, দাম্পত্য জীবনের সুখ প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা, ক্ষমতার দাপট দেখানোর প্রতিযোগিতা, নিজের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনের প্রদর্শনী ছিল না ফেইসবুকে। একবার চিন্তা করুন ফেইসবুক কতবার আপনার জীবনের স্বাদ নষ্ট করে দিয়েছে, বেঁচে থাকার ইচ্ছেকে মেরে ফেলেছে, অস্থিরতা, অশান্তি সৃষ্টি করেছে। দামি রেস্টুরেন্টে বন্ধুদের সেলফি দেখে, দেশ-বিদেশ ভ্রমণের ছবি দেখে আপনি অশান্ত, অস্থির হয়েছেন। ফেইসবুকে আপনার বন্ধুরা যখন তাদের জীবনের কাল্পনিক সুখ আর সাফল্যের ডালি সাজিয়ে বসেছে, তা দেখে আপনার অন্তর হয়েছে বিষাক্ত, পরশ্রীকাতর। হতাশীর শ্যাওলা জমেছে অপিনার মনে। দীর্ঘশ্বাস পড়েছে একের পর এক … “ধুর শালা! কিছুই হলো না জীবনে!” হতাশার শ্যাওলা আরও ঘন হয়েছে, হয়েছে আরও বেশি সবুজ। এই হতাশার মুহূর্তে কত অসংখ্যবার শয়তান আপনাকে পেয়ে বসেছে। আপনি পর্ন দেখেছেন, করেছেন হস্তমৈথুন, শেষমেষ আক্ষেপের অশ্রু ঘুম পাড়িয়েছে আপনাকে। যতটুকু পারুন, ফেইসবুকে কম সময় দিন। তবে বাধ্য না হলে একবারে ছেড়ে চলে যাবেন না। পরিমিত ফেইসবুকিং অনেক ক্ষেত্রেই খুবই উপকারী একটি বিষয়। ইসলামিক পেইজগুলো ফলো করুন, যারা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিয়ে দেয় না বা ইসলামকে পাশ্চাত্যের মনমতো ব্যাখ্যা করে না এমন হকপন্থী আলিমদের অনুসরণ করুন। এসব দিক থেকে ফেইসবুক আপনাকে অনেক সাহায্য করতে পারবে। 

আপনার যেসব বন্ধু অশ্লীল ছবি, ভিডিও ইত্যাদি শেয়ার করে তাদের আনফ্রেন্ড করে দিন। আনফ্রেন্ড করতে না চাইলে আনফলো দিন। আইডির ওপর কার্সর রাখলে following লিখাকে unfollow করে দেয়। এতে ওই আইডি আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে থাকবে কিন্তু নিউজ ফিডে শো করবে না। এতে চোখের গুনাহও হলো না, বন্ধুও রাগ করল না। মাঝখানে আপনি ফিতনাহ থেকে বেঁচে গেলেন। ফেসবুকের ডান পাশে আসা বিভিন্ন মডেলদের ফলো করার আইডি, বিভিন্ন অশ্লীল পেইজের অ্যাড ইত্যাদি দূর করার জন্য facebook paurity নামের ব্রাউযার এক্সটেনশান ব্যবহার করতে পারেন। Firefox, chrome দুটোর ব্রাউযারের জন্যই পাবেন। অশ্লীলতা ছড়িয়ে বেড়ানো অসংখ্য পেইজ আছে ফেইসবুকে। এসব পেইজ কোনোমতেই ফলো করা যাবে না। ফলো করা যাবে না নায়িকা, অভিনেত্রী, মডেল বা কোনো সেলিব্রেটিকেই। আপনার হোমপেইজ রাখতে হবে একদম পরিষ্কার। কোনো মেয়ের ছবিই যেন না আসে। ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে কোনো মেয়ের ছবি দেখে ফেললেও সেটা আপনাকে পর্ন দেখা বা হস্তমৈথুন করার ট্রিগার হতে পারে, উসকানি দিতে পারে। তাই আমাদের সাজেশন হলো মাহরাম ছাড়া আর কোনো মেয়েকেই আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে না রাখা। এমন অনেক ভাই আছেন যারা পর্ন, হস্তমৈথুন ছাড়ার জন্য আদা জল খেয়ে নামেন। কিন্তু ফেইসবুকে নারীর ফিতনাহর জালে আটকে থাকার কারণে পর্ন, হস্তমৈথুন আর ছাড়া হয় না। আজকে, এ মুহূর্তেই বিপরীত লিঙ্গের সবাইকে আনফ্রেন্ড করুন। কানিদেরও। (কাযিনদের আনফ্রেন্ড করতে না চাইলে আনফলো দিয়ে রাখতে পারেন, কিন্তু আমরা এটাকে তীব্রভাবে নিরুৎসাহিত করব। সোজা আনফ্রেন্ড করুন। হয়তো কিছু কঠিন কথা শুনতে হবে, কিন্তু আলটিমেটলি এতে আপনি উপকৃত হবেন ইন শা আল্লাহ) 

খুঁজে খুঁজে ফ্রেন্ডলিস্টের সব মেয়ে/ছেলেদের বের করে আনফ্রেন্ড করা ঝামেলার এবং সময়সাধ্য ব্যাপার। তবে এর সহজ সমাধান আছে। 

ছেলেদের জন্য :

নিচের লিংক গেলে, আপনার ফ্রেন্ড লিস্টে যাদের জেন্ডার ফিমেইল দেয়া তাদের। সব আইডি চলে আসবে ইন শা আল্লাহ্। তারপর খুব সহজে তাদের আনফ্রেন্ড করে দিতে পারবেন। https://www.facebook.com/search/females/me/friends/intersect

ওপরের লিংকে সমস্যা হলো এ লিংকটি ব্যবহার করুন:

https://m.facebook.com/search/females/me/friends/intersect

মেয়েদের জন্য :

নিচের লিংকে গেলে, আপনার ফ্রেন্ড লিস্টের যেসব আইডির জেন্ডার মেইল দেয়া তাদের সব আইডি চলে আসবে ইন শা আল্লাহ্। তারপর তাদের আনফ্রেন্ড করে দিতে পারবেন খুব সহজে। https://www.facebook.com/search/males/me/friends/intersect

 ওপরের লিংকে সমস্যা হলে : https://m.facebook.com/search/males/me/friends/intersect

বিপরীত লিঙ্গের কারও সাথে ফেইসবুকে কখনোই ইন্টার্যাকশনে যাবেন না। কখনোই চ্যাট করবেন না। মোটামুটি ইসলাম প্র্যাক্টিসিং ভাইয়েরাও এ ফাঁদে পড়ে যান। কোনো মেয়ে আপনাকে ইনবক্সে কিছু জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর দেয়ার দরকার নেই। আপনি যে ফিতনাহর ভয়ে রিপ্লাই দিতে চাচ্ছেন না এটা বলারও দরকার নেই। শয়তান আপনাকে বার বার ধোঁকা দিতে চাইবে। আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেবে দাওয়ার গুরুত্ব এবং ফযীলতা শয়তানের ধোঁকায় ভুলবেন না। কমেন্ট, ইনবক্সে দ্বীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে কখন যে দিলের দাওয়াত দিয়ে বসে থাকবেন তা টেরও পাবেন না। আপনাদের অনুরোধ করব দয়া করে ফেইসবুকে ছবি আপলোডের পরিমাণ একটু কমান। উঠতে-বসতে সেলফি তোলা আর সেটা ফেইসবুকে আপলোড দেয়া যে একধরনের অসুস্থতা, মানসিক ভারসাম্যহীনতা সেটা কেন আপনারা বোঝেন না? ফেইসবুকে ছবির পর ছবি আপলোড করে, কাল্পনিক সব স্ট্যাটাস দিয়ে আপনি যে মিথ্যে সুখের ফানুস ওড়াচ্ছেন তাতে আপনার কী লাভ হচ্ছে? আপনার কারণে কত মানুষের অন্তর বিষিয়ে যাচ্ছে! টানাপোড়েন সৃষ্টি হচ্ছে সম্পর্কে। সেই সঙ্গে চোখের “নজর” লেগে আপনার ক্ষতি হচ্ছে! আপনার ক্রমাগত সেলফি আপলোড দেয়াতে সবাই যে বিরক্ত হয়, কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কেউ বলে না এটা কেন বোঝেন না? বোনেরা আমার, আপনারা কেন বোঝেন না, আপনাদের ছবিগুলোতে প্রশংসামূলক কমেন্ট করা ছেলেগুলো আপনাদের নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভোগে? তাদের বন্ধুদের সঙ্গে আপনাদের নিয়ে কুৎসিত আলোচনা করে? আপনারা আসলেই কি চীন কোনো বিকৃত রুচির ছেলের যৌন ফ্যান্টাসি আর হস্তমৈথুনের নায়িকা হতে? ঠিক বুঝি না, বুঝতে পারি না আপনারা কেন যে নিজেরাই নিজেদের এভাবে অপমানিত করেন! কিছু প্রতারক চক্র ফেইসবুক থেকে মেয়েদের ছবি সংগ্রহ করে, তারপর এডিট করে পর্নসাইট বা চটিগল্পের পেইজে দিয়ে দেয়, অনেক সময় ব্ল্যাকমেইল করে। এ কথাও মাথায় রাখা দরকার। 

.

নয়.

শয়তানের পাতা আরেকটি মারাত্মক ফাঁদ হলো আধুনিক বয়ফ্রেন্ড/গার্লফ্রেন্ড কালচার। গার্লফ্রেন্ড নিয়ে শয়তান খুবই মারাত্মক ফাঁদ পাতে। পর্ন ও হস্তমৈথুন আসক্তি থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমাদের একটা টিপস ছিল যে, একজন খুবই কাছের বন্ধুকে সব খুলে বলে তার কাছে সাহায্য চাইতে হবে। শয়তান আপনাকে বোঝাবে, “আরে পাগলা, গার্লফ্রেন্ডের চেয়ে কাছের মানুষ কে আছে তোর? তার সাথে সবকিছু শেয়ার কর। সে কি তোর জন্য মূর্তিমান এক প্রেরণী নয়? তার চোখের দিকে তাকিয়ে, তার হাত নিজের মুঠোতে নিয়ে তুই কি নিজের মধ্যে বিশ্বজয়ের শক্তি অনুভব করিস না? তা ছাড়া বিদ্রোহী কবি বলেছেন, ‘কোন কালে একা হয়নি কে জয়ী পুরুষের তরবারী প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষী নারী’ গার্ল ফ্রেন্ডের প্রেরণাতেই তুই বিদায় জানাতে পারবি পর্ন অর হস্তমৈথুন আসক্তিকে।” প্রেম নিজেই এক মারাত্মক ফিতনাহ। পদে পদে আল্লাহর আদেশ অমান্য করা। গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে, তার দিকে তাকানোর মাধ্যমে, ডেটিং করার মাধ্যমে, স্পর্শ করার মাধ্যমে আপনি আল্লাহর আদেশ অমান্য 

 রাসুলুল্লাহ বলেছেন, তোমরা নজরলাগা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও। কেননা, নজরলাগা সত্য। ইবনু মাজাহ করে চলেছেন আর শয়তানকে সুযোগ করে দিচ্ছেন আপনার অন্তরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার। আপনার অন্তরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সে আপনাকে দিয়ে ইচ্ছেমতো পাপ কাজ করিয়ে নিচ্ছে। আপনি পর্ন দেখছেন। হস্তমৈথুন করছেন। প্রেমকে হস্তমৈথুন/পর্ন-আসক্তি থেকে মুক্তির মহৌষধ মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রেম আপনাকে খুব অল্প সময়ের জন্য পর্ন-হস্তমৈথুন থেকে দূরে রাখতে পারবে হয়তো, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান দিতে পারবে না। সে প্রেম যতই “পবিত্র”(?) হোক না কেন। অধিকাংশ ছেলেরা কী করে? নিজেই বলুন। প্রেমও করে আবার পর্ন ভিডিও দেখে, হস্তমৈথুন করে। এ হারাম সম্পর্কটা হুড তোলা রিকশী, কেএফসি, আলো-আঁধারির রেস্টুরেন্ট, স্টার সিনেপ্লেক্স পর্ব শেষে আপনাকে লিটনের ফ্ল্যাটে কিংবা “রুম ডেইটে” নিয়ে যেতে পারে। আর সেটা নিশ্চয়ই পর্ন আর হস্তমৈথুনের চেয়েও জঘন্য এক ব্যাপার। 

.

দশ.

আপনি নিজে পর্নহস্তমৈথুন/চটিগল্পের আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে চাইলে এমন সব বন্ধুদের গুডবাই জানাতেই হবে, যারা নিজেরাও ওইসবে আসক্ত। ওদের সাথে। ওঠাবসা চালিয়ে গেলে আসক্তি থেকে বের হয়ে আসা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ওরা। আপনাকে পর্ন দেখার আমন্ত্রণ জানাবে, “চল দোস্ত, আজকে একটু দেখি…”, “নতুন কালেকশন আছে। দেখবি চল…” হয়তো-বা বসে আড্ডা দিচ্ছেন। হুট করে কেউ চটিগল্প বা পর্ন ভিডিওর গল্প শুরু করে দিলো, মেয়েদের নিয়ে রসালো আলাপ শুরু করে দিলো। তাদের আলোচনায় আপনি যোগ না দিলেও অশ্লীল কিছু টার্ম, কিছু শব্দ গেঁথে যাবে আপনার মাথায়। পরে আপনার মস্তিষ্ক যখন অলস থাকবে, আপনি একা থাকবেন বা ঘুমাতে যাবেন তখন আপনার মাথায় ওই শব্দগুলো ঘুরতে থাকবে। ক্রমাগত আপনাকে জ্বালাতে থাকবে। পর্ন না দেখা পর্যন্ত, হস্তমৈথুন না করা পর্যন্ত আপনি নিস্তার পাবেন না। চিন্তার জ্বলুনি থেকে। “পিচ্চিকালের বন্ধু, ওদের ছাড়া থাকবি কীভাবে? একসঙ্গে গ্রুপস্টাডি করিস, ওদের থেকে দূরে সরে গেলে কে তোকে পড়া বুঝিয়ে দেবে, কার কাছে নোট পাবি?” এসব বলে শয়তান আপনাকে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করবে। ওর কথায় কান দিয়েছেন তো মরেছেন। আপনার জীবনটাকে ধ্বংস করে ছাড়বে এসব বন্ধুরা। আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে জাহান্নামে। 

 “হায় আমাদের দুর্ভোগ আমি যদি অমুক ব্যক্তিকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। আমার কাছে উপদেশ আসার পর সে আমাকে তা থেকে বিভ্রান্ত করেছিল। শয়তান তো এমনই চরিত্রের যে, সময়কালে সে মানুষকে অসহায় অবস্থায় ফেলে চলে 

(সূরা আল ফুরকান; ২৫:২৮-২৯) “বন্ধুবর্গ সেদিন একে অপরের শত্রু হবে, তবে খোদাভীরুরা নয়।” 

 (সূরা আয যুখরুফ ৪৩:৬৭)

আল্লাহর  জন্য বিদায় বলে দিন ওইসব বন্ধুদের। আল্লাহ্ আপনাকে এদের চেয়েও উত্তম বন্ধু মিলিয়ে দেবেন ইন শা আল্লাহ্। মানুষ একাকী থাকতে পারে না, বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবন কাটাতে পারে না। তাই আমাদের সাজেশীন হবে এ্যাক্টিসিং মুসলিম ভাইদের (সমাজের ভাষায় “হুজুর” ) সঙ্গে ওঠাবসা করুন। ইন শী আল্লাহ্ তাঁদের সাহচর্য আপনাকে সহায়তা করবে আসক্তি দূর করতো। 

.

এগারো.

যুবকদের যৌনাকাঙ্ক্ষা দমিয়ে রাখার একটি পদ্ধতি রাসূলুল্লাহর হাদিস থেকে জানা যায়। রোযা রাখা।“ প্রতি সপ্তাহে দুদিন, সোমবার আর বৃহস্পতিবার রোযা রাখী শুরু করতে পারেন। দেখবেন মাস দেড়েকের মধ্যে আপনি অনেক এগিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু শয়তান আপনাকে রোযা রাখতে দিতে চাইবে না; “এত লম্বা দিনে। কীভাবে রোযা রাখবি, ক্লাস আছে, ল্যাব আছে… পারবি না, রোযা রাখলে তুই শুকিয়ে যাবি, চেহারা নষ্ট হয়ে যাবে…” 

আল্লাহর ওপর ভরসা করে রোযা রাখা শুরু করে দিন। আল্লাহ সহজ করে দেবেন ইন শা আল্লাহ। একই কথা খাটে দান-সাদকৗহর ব্যাপারেও। প্রত্যেকবার হস্তমৈথুন করার পর বা পর্ন দেখার পর আপনি যখন পীপের কাফফারা হিসেবে দান-সাদকাহ করতে যাবেন, তখন শয়তান আপনাকে ভয় দেখাবে, “দান। করলে তো টাকা শেষ হয়ে যাবে। মাস চালাবি কী করে?” এসব ফিসফিসানিকে কোনোরকমের গুরুত্ব দেয়া যাবে না। আল্লাহ্ নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, দান করলে তিনি ধন-সম্পদ বাড়িয়ে দেন, তাই শয়তানের কথায় কান না দিয়ে দান করতে থাকুন। 

.

বারো.

 নাটক, সিরিয়াল, সিনেমা, গান, আইটেম সং এগুলো শয়তানের খুবই ভয়ঙ্কর ফাঁদ। এগুলো থেকে দূরে না থাকলে কোনোমতেই চোখের হেফাযত করা সম্ভব না। শয়তান এ ফাঁদ পেতে খুব সহজেই আপনার অন্তর দখল করে নিতে পারে। অন্তরের নিয়ন্ত্রণ শয়তানের হাতে তুলে দিলে কী হবে সেটা বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে বলিউডের আইটেম সং খুবই বিষাক্ত। একজন সুস্থ স্বাভাবিক পুরুষ আইটেম সং দেখলে কীভাবে স্থির থাকতে পারে? আপনি যদি আইটেম সং দেখা ছাড়তে না পারেন, তাহলে পর্ন-হস্তমৈথুন আসক্তি কাটানোর চিন্তা বাদ দিন। এ পর্যন্ত পড়ার পর আপনি নিশ্চয়ই আমাদের ওপর ক্ষেপে গিয়েছেন–গান শোনা যাবে না, মুভি সিরিয়াল দেখা যাবে না, প্রেম করা যাবে না, মেয়েবন্ধ থাকা যাবে না, ফেইসবুকে মেয়েদের সঙ্গে চ্যাট করা যাবে না, ইউটিউবে র‍্যান্ডমলি ভিডিও দেখা যাবে না… তাহলে করা যাবেটা কী? ইসলাম কি এতটাই কঠোর? ইসলামে বিনোদন বলে কিছু নেই? অবসরে করবটা কী? 

অবসরে কী করবেন, মুভি-সিরিয়ালের বদলে কী দেখবেন, গানের বদলে কী শুনবেন তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে আমাদের পরের লেখায়। পড়ে ফেলুন। কিন্তু তার আগে আপনার কিছু বিষয় জানা দরকার… অ্যামেরিকা! স্বপ্নের দেশ! যে দেশের আকাশে-বাতাসে সুখ আর আনন্দ ভেসে বেড়ায়। যে দেশের মানুষদের মতো হতে পারাটাই আমরা মনে করি আধুনিকতা, জীতে উঠতে পারা, জীবনের সার্থকতা। যাদের লাইফস্টাইল আমরা অন্ধের মতো অনুকরণ করি। আমাদের পরম আকাঙ্ক্ষিত সব উপাদানই আছে তাদের যাপিত জীবনে–বন্ধু, আড্ডা, গান, উদ্দাম পাটি, গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড, ফ্রি মিক্সিং, ফ্রি সেক্স, মুভি, সিরিয়াল, ড্রাগস… সবকিছুই। বিনোদনের এক মহাসমুদ্রে ডুবে আছে এরা। আমাদের চোখে জীবনে সুখী হতে হলে যা যা দরকার, তার সবকিছুই আছে এই অ্যামেরিকানদের। সুখের যে সংজ্ঞা আমরা বানিয়েছি সেটা অনুযায়ী অ্যামেরিকানদের সবচেয়ে বেশি সুখী হবার কথা। 

কিন্তু… 

কিন্তু তারপরও কেন প্রতি ১০ জনে ১ জন অ্যামেরিকান তীব্র হতাশায় ভোগে?

কেন প্রতিবছর ৪৪,১৯৩ জন অ্যামেরিকান আত্মহত্যা করে? প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১২১ জন?

কেন অ্যামেরিকার কিশোর-কিশোরীরা ব্যাপকভাবে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠছে? কেন অ্যামেরিকানদের আত্মহত্যার হার আগের চেয়ে প্রায় ২৪ শতাংশ বেড়েছে? মনে করুন আর আধঘণ্টা পর খুব কঠিন এক কোর্সের ফাইনাল পরীক্ষা। আপনি তেমন কিছুই পারেন না। তার ওপর কোর্স টিচার মারাত্মক রকমের হাড়কিপটে, নাম্বার দিতেই চান না। আর সেই সাথে তাঁর অতীত “সুনাম” আছে প্রশ্নপত্র কঠিন করে স্টুডেন্টদের সাথে “মজা” নেয়ার। নিরুপায় হয়ে পরীক্ষায় আসতে পারে এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর পিডিএফ বানিয়ে আপনি মোবাইলে নিয়ে নিলেন। কিন্তু পরীক্ষার হলে মোবাইল নিয়ে যাওয়া নিষেধ। কারও কাছে মোবাইল পেলেই তৎক্ষণাৎ সে। ছাত্রকে হল থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হবে, সেই সাথে এক বছর ড্রপ। তো এমন এক ভয়াবহ পরিস্থতিতে, আপনি পকেট থেকে আলতো করে মোবাইল বের করে টুকলিফাই শুরু করেছেন পরীক্ষার হলে। স্বাভাবিকভাবেই আপনি প্রচণ্ড অস্থিরতায় ভুগছেন। ফ্যানের নিচে থেকেও আপনার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। হার্টবিট বেড়ে গেছে। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে আছেন এই বুঝি স্যারের হাতে ধরা খেয়ে গেলেন। আপনার মন বড় অশান্ত, বড় অস্থির। সুবহান আল্লাহ্! একটু চিন্তা করে দেখুন দুনিয়ার সামান্য মানুষের বানানো আইন ভাঙার কারণে, খুব ছোট একটা অপরাধ করার কারণেই আপনার মনের শান্তি কর্পূরের মতো উবে গেছে। তাহলে আকাশ ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা, যিনি অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন সবকিছুকে, সেই মহিমান্বিত আল্লাহ্ আইন। প্রতিনিয়ত ভেঙে, প্রতিনিয়ত আল্লাহর সঙ্গে বিদ্রোহ করে আপনি কী করে অন্তরে শান্তি পাবেন? বলুন, কীভাবে শান্তি পাবেন? আল্লাহ্ আপনাকে বলেছিলেন দৃষ্টি সংযত করতে, চোখের হেফাযত করতে।

 “মুমিন পুরুষদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। এটাই তাদের জন্য উৎকৃষ্ট পন্থা। নিশ্চয় তারা যা কিছু করে আল্লাহ তা সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত আছেন।” 

 (সূরা আন-নূর; ২৪:৩০)

 আপনি প্রতিনিয়ত তাঁর সেই আদেশকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন। রাস্তায় মেয়েদের চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছেন, বন্ধুদের সঙ্গে মেয়েদের ফিগার নিয়ে থিসিস করছেন, গভীর রাতে আপনার মোবাইলের স্ক্রিন নীল হয়ে যায়, সার্ফিং করে বেড়ান এক্স রেইটেড সব ওয়েবসাইটে, পর্নস্টার আর আইটেম গার্লরা আপনার ড্রিম গার্ল, স্বপ্নের রাজকন্যা। আপনি কীভাবে শান্তি পাবেন? বন্ধু, আড্ডা, গান, জিএফ, বিএফ, সিরিয়াল, ফেইসবুকিং, সেলফি, ডিএসএলআর, কেএফসি, পিৎ হাট এগুলো নিয়েই কেটে যাচ্ছে আপনার অষ্টপ্রহর। ভাবছেন, বেশ তো! সুখেই আছি। বুকে হাত রেখে একবার সত্যি করে বলুন তো, আপনি কি আসলেই শান্তিতে আছেন, সুখে আছেন? কেন এক বিকেলে ঘুম থেকে উঠে শেষ বিকেলের মরা আলোয় অজানা কারণে আপনার মন খারাপ হয়ে যায়? গভীর রাতে কী যেন ভেবে আপনার চোখ ভিজে যায়। দলাবাঁধী কষ্টগুলো ভিড় জমায় বুকের ভেতর। অন্তরটী শূন্য মনে হয়। কী যেন নেই আপনার! কোথায় যেন একটা অপরিপূর্ণতা, অসম্পূর্ণতা! কোথায় যেন কিসের একটা অভাব! জীবনটা বড্ড বেশি জটিল মনে হয়! আইটেম গার্লদের কোমর দোলানি আর দেহের ভাঁজ দেখে আপনার মন কি অস্থির, অশান্ত হয়ে যায় না? মনের ভেতরের পশুটা কি আপনাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় না? প্রত্যেকবার পর্ন ভিডিও দেখার পর, হস্তমৈথুন করার পর আপনার কি মরে যেতে ইচ্ছে করে না? মনে হয় না কেন করলাম, কেন? কিসের নেশায় ডুবে আছেন ভাই আপনি? কিসের নেশীয়? পর্নস্টারের নিটোল দেহ, গার্লফ্রেন্ডের “মনে ঝড় তোলা চোখ”, আইটেম গার্লদের লাস্যময়ী হাসি? আপনি এদের কি একেবারে নিজের মতো করে কখনো পাবেন? পাবেন না। এরা তো মরীচিকা ছাড়া কিছুই না। এরা একদিন বুড়িয়ে যাবে। দেহে ভাঁজ পড়বে, চামড়া কুঁচকে যাবে, দাঁত পড়ে যাবে, চোখ ধূসর হয়ে যাবে, চুল পাটের শণের মতো হয়ে যাবে। সবশেষে মাটির নিচে পোকামাকড়ে খুবলে খুবলে খাবে এদের দেহ, পচে গলে দুর্গন্ধ ছড়াবে। এ নিয়েই আপনার এত আকর্ষণ! এদের কারণেই আপনি সে জাহান্নামের আগুনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন, যা অন্তর পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলবে আর যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। আপনি ভুলে যাচ্ছেন আপনার সেই “আয়তনয়না” জান্নাতি স্ত্রীর কথা, যিনি আপনার জন্য শত সহস্র বছর ধরে অপেক্ষা করে আছেন। যাঁর মাথার স্কার্ফ এ দুনিয়া এবং আকাশের মধ্যবর্তী সবকিছুর থেকেও উত্তম। প্রবাল ও পদ্মরাগ-সদৃশ জান্নাতের স্ত্রীদের সৌন্দর্যের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ্ সাটিফিকেট দিয়েছেন। ঝুম বৃষ্টিতে স্ত্রীকে নিয়ে রিকশায় বসে লক্ষ কোটি বছরের বৃষ্টিবিলাস, হাঁ করে জ্যোৎস্না গেল, শেষ বিকেলের মরে আসা নরম হলুদ আলোয় দুজন দুজনার চোখের দিকে তাকিয়ে হাজার হাজার বছর কাটিয়ে দেয়া –আপনি যা কিছু কল্পনা করতে পারেন, আর যা কিছু পারেননা, জান্নাতের সুখ ছাড়িয়ে যাবে তার সব কিছুকেই। ইচ্ছে হলে দুজনে ঘুরে বেড়াবেন জান্নাতের বাগানে। মাথার ওপর থেকে আলতো করে পড়বে গাছের ঝরা পাতা। আপনার স্ত্রী আপনার কাঁধে মাথা রেখে হাঁটবেন, আপনি তাঁকে শোনাবেন শাশ্বত প্রেমের কোন কবিতা…। এ অসীমকে এ আমরা কিসের জন্য ছুঁড়ে ফেলছি? কিসের মোহে বিকিয়ে দিচ্ছি? আমি, আপনি কত পাগল, কত পাগল! “.নারী জাতির প্রতি ভালোবাসা, সন্তানসন্ততি, রাশিকৃত সোনা-রুপা, চিহ্নিত অরাজি, গৃহপালিত জন্তু ও খেতখামার মানুষের জন্য লোভনীয় করে রাখা হয়েছে। অথচ এ সবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের কিছু ভোগের সামগ্রী মাত্র। কিন্তু স্থায়ী পরিণামের সৌন্দর্য কেবল আল্লাহরই কাছে।” 

(সূরা আলে ইমরান;)

পর্ন ভিডিওর ফ্যান্টাসি, আইটেম গার্লদের গ্ল্যামারে কোনো শান্তি নেই। এগুলো বরং আপনার অন্তরকে ক্ষত-বিক্ষত করে তোলে। শান্তি নেই ঝুমবৃষ্টিতে গার্লফ্রেন্ডের সাথে একই রিকশাতে পাশাপাশি বসে কাকভেজা হয়ে ভেজায়, চাঁদনি পসর রাতে হাঁ করে জ্যোৎস্না গেলায়। এগুলো আপনাকে ক্ষণিকের আনন্দ আর সাময়িক উত্তেজনা দিতে পারে, কিন্তু শান্তি দিতে পারে না। শান্তি আছে, আল্লাহ্র () আদেশ মেনে দৃষ্টি হেফাযত করার মধ্যে। শান্তি আছে আপনার রবকে সিজদাহ করার মধ্যে, রবের সামনে রাতে একাকী দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলাতে। নিজের নফসের অবাধ্যতা করে রবের দাসত্ব করাতে বিশ্বাস করুন এ শান্তি অমূল্য। দুনিয়ার কোনো কিছুর বিনিময়ে এই শান্তি পাওয়া যায় না। একবার এ শান্তি পেলে আপনি বার বার চাইবেন এ শান্তি পেতে। একবার চেষ্টা করেই দেখুন না। একটা সপ্তাহ আল্লাহ নাফরমানি না করে চোখের হেফাযত করে দেখুন না ফলাফল কী হয়। একবার চেষ্টা তো করে দেখুন…

“অবশ্যই আল্লাহর স্মরণে হৃদয় প্রশান্ত হয়। “ 

 (সূরা আর-রাদ; ১৩:২৮)

ফাঁদ

ফাঁদ

ফাঁদ

এ সমুদ্রে অ্যালবাট্রস পাখি নেই। তবু একটা রেস্তোঁরা-কাম-বারের নাম অ্যালবাট্রস। ভারতের পূর্ব-উপকূলে এমন চমৎকার মিষ্টি স্বভাবের টাউনশিপই বা কটা আছে? সমুদ্রও এখানে বেশ শান্ত। মার্চের দক্ষিণবায়ু দুপুরের দিকে দাপাদাপি করলেও বিকেলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ঢেউগুলো খুব আড়ষ্ট হয়ে বালির বীচে শুয়ে পড়তে চাইছে। আমার জুতোর তলা একটুখানি ভিজে যাচ্ছিল। এটাই আমাকে সমুদ্রস্নানের আনন্দ দিল। আমার বৃদ্ধ সঙ্গী বলেন, অনেকের অনেকরকম আতঙ্ক থাকে। যেমন বেড়ালের জলাতঙ্ক। জানি, উনি আমাকেই ঠাট্টা করেন। কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সমুদ্র যতই শান্ত হোক, সমুদ্র হচ্ছে সমুদ্রই। তার জল লোনা, বিশ্রী রকমের স্বাদ তার। আত্মহত্যার দরকার না হলে কখনও আমি সমুদ্রে নামব না।

যতক্ষণ বীচে জলের ধার ছুঁয়ে ছুঁয়ে হেঁটে বেড়ালুম, আড়চোখে লক্ষ্য করে গেলুম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার টুপি খুলে অ্যালবাট্রসের লনে বসে আছেন। তাঁর টাকের ওপর নারকেল গাছের ছায়ার ফাঁক দিয়ে রোদের চিরুনি চলছে–অবশ্য বৃথাই। উনি খুবই আলাপী, সদালাপী এবং গায়েপড়া–তা সত্ত্বেও এখনও কোনও আগন্তুক ওঁর পাশে বসে নেই। এতদিন বাদে ওঁকে দারুণ একলা দেখাচ্ছিল। আমার মায়া জাগছিল।

পিছনে পাহাড়ের আড়ালে সূর্য নেমে গেলে সমুদ্রে এতক্ষণে রঙের খেলা শুরু হলো। এই দৃশ্যের বর্ণনা ভাষায় দেওয়া যায় না, ছবি এঁকে খানিকটা যা অনুসরণ করা যায়। আমি না লেখক, না ছবি আঁকিয়ে–নিতান্ত সাংবাদিক। এই ব্যাপারটার রিপোর্টাজ লিখতে হলে আমার চাকরি রাখা কঠিনই হতো। আমি রিপোর্টার। আমার চিফ বলেন, জয়ন্তের মেটিরিয়াল থাকে–কলম থাকে না এবং এটাই হচ্ছে ট্রাজেডি।

মিনিট পাঁচেক ওই রঙের খেলা দেখে চোখ ব্যথা করতে থাকল। তখন ঘুরে দাঁড়ালুম এবং সঙ্গে সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য উপকূলনগরীকে রহস্যময় অন্ধকারে ডুবে থাকতে দেখলুম। চোখ পিটপিট করে সেই অন্ধকারকে তাড়াতে চাইছি, এমন সময় পাশ থেকে কে বলে উঠল–কিছু মনে করবেন না, আপনি কি বাঙালী?

বাঙালী ব্যারাম আমারও একটু-আধটু আছে। তবে সেজন্য নয়, যার প্রশ্ন তিনি এক মহিলা। এটাই আমাকে অসাধারণ ভব্য করে তুলল। রঙচমকানো চোখের অস্বচ্ছতায় একটা শাড়িপরা মূর্তি ভেসে উঠল। বললুম–আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি……

-নমস্কার। আমি…..আমি কলকাতা থেকে এসেছি। আমি একটু বিপদে পড়েছি–একটু সাহায্য পেতে পারি কি?

চোখের স্বচ্ছতা তখনও ফেরে নি। তাই মুহূর্তে মাথায় এল, নির্ঘাৎ কিছু ভিক্ষেটিক্ষে চাইবার ব্যাপার ঘটছে। তক্ষুণি গম্ভীর হয়ে বললুম–বিপদ! কী বিপদ?

–আমার স্বামীকে দুপুর থেকে খুঁজে পাচ্ছি না।

হাসি চেপে বললুম–খুঁজে পাচ্ছেন না? আপনার স্বামীকে? তার মানে?…..

–হ্যাঁ। আমরা এখানে এসেছি গতকাল সন্ধ্যায়। তারপরেই এমন কতকগুলো ব্যাপার ঘটল, খুব ভয় পেয়ে গেলুম। উনি অবশ্য গ্রাহ্য করলেন না। আজ দুপুরে খাওয়ার পর উনি আসছি বলে বেরিয়ে গেলেন। তখন প্রায় একটা বাজে। এখন পাঁচটা। দেরি দেখে সম্ভবপর সব জায়গায় খুঁজলুম, কিন্তু কোন খোঁজ পেলুম না। আমার বড় ভয় হচ্ছে……

বলেই ভদ্রমহিলা যেন কান্নার আবেগ সামলাতে থেমে গেলেন। ততক্ষণে আমার চোখ থেকে রঙের ভেলকি ফুরিয়ে গেছে। দৃষ্টি স্পষ্ট হয়েছে। দেখলুম, মহিলার বয়স তেইশ-চব্বিশের বেশি হতেই পারে না, মোটামুটি ফর্সা রঙ, হালকা গড়ন কিন্তু চেহারা মন্দ না, চোখ দুটো টানাটানা এবং দুটো শক্তিশালী ভুরুর প্রশস্তে একটু প্রগলভও বটে। বড়লোকের বউ বলে মনে হলো না। আবার গরীব বা নিম্নমধ্যবিত্তও নয়। ব্যক্তিত্ব আছে এবং তাই তাঁর বিবরণে কোনও ফাঁকি থাকতে পারে না।

রহস্যের গন্ধে চঞ্চল হয়ে উঠলুম। আড়চোখে দূরে অ্যালবাট্রসের লনে কর্নেলকে দেখে নিলুম। উনি যেন চোখ বুজে ঝিমুচ্ছেন।

বললুম–খুব অদ্ভুত ব্যাপার তো! কিন্তু আপনার স্বামী তো মাত্র চার ঘণ্টা আগে বেরিয়েছেন–কোথাও নিশ্চয় কোনও জরুরী কাজে আটকে পড়েছেন। এতে ভাববার কারণ আছে বলে তো মনে হয় না। আরও কিছুক্ষণ দেখুন না–নিশ্চয় ফিরে আসবেন। আর…ইয়ে, আপনার স্বামীর নামটা জানতে পারি?

পুলকেশ মৈত্র। আমি তৃণা মৈত্র।

–আমি জয়ন্ত চৌধুরী।…একটু ইতস্তত করে কেন কে জানে বলে ফেললুম আপনি প্রখ্যাত দৈনিক সত্যসেবকের নাম নিশ্চয় জানেন। আমি ওই কাগজের রিপোর্টার।

শুনে তৃণা মৈত্র উজ্জ্বল মুখে বলল–আপনি রিপোর্টার? জয়ন্তবাবু, প্লীজ, এ বিপদে আমাকে সাহায্য করুন একটু। এখানে এসে একজনও বাঙালী দেখতে পেলুম না। তাই বিশ্বাস করে কাউকেও কথাটা বলতে পারিনি। হঠাৎ দূর থেকে আপনাকে দেখে কেন যেন মনে হলো… ।

বাধা দিয়ে বললুম–আপনার স্বামীর বিপদ হয়েছে, একথা ভাবছেন কেন?

তৃণা বলল–ভাবতে বাধ্য হচ্ছি জয়ন্তবাবু। বললুম– না, গতকাল সন্ধ্যা থেকে এমন কতকগুলো ব্যাপার ঘটল–যাতে খুব অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলুম। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, কোনও বিপদ ঘটবে। ওকে বারবার বললুম– চলো-আমরা ফিরে যাই। ও শুনল না।

আপনারা কি এই প্রথম নীলাপুরমে এলেন? উঠেছেন কোথায়?

–হ্যাঁ। এই প্রথম। আমরা উঠেছি সি ভিউ হোটেলে।

–কোন বিশেষ কাজে, নাকি বেড়াতে?

–বেড়াতে।…বলে তৃণা ব্যস্ততার ভাব দেখাল–জয়ন্তবাবু, আপনাকে আমি সবই বলব। এখন ওকে খুঁজে বের করতে আমায় একটু সাহায্য করুন।

চিন্তিত মুখে বললুম–তাহলে একটা কাজ করা যেতে পারে। থানায় যাওয়া যাক। কী বলেন? পুলিশকে সবটা জানানো দরকার। তারপর…।

তৃণা বাধা দিয়ে বলল–না। প্লীজ! পুলিশকে আগেভাগে সব জানাতে গেলে অনেক গোলমালে পড়ে যাব।

–কিন্তু পুলিশের সাহায্য ছাড়া আমরা কতটুকু কী করতে পারি বলুন? আমিও তো এখানে নতুন এসেছি।

তৃণা আবার ব্যস্ত হয়ে উঠল। বলল নীলাপুরম জায়গাটা তো ছোট্ট। আমি একা খুঁজে বেড়াতে সাহস পাচ্ছি না। পেতুম–যদি কাল রাতে ওই ব্যাপারগুলো না ঘটত! আপনি আমার সঙ্গে থাকলে আমার একটুও ভয় করবে না। প্লীজ, জয়ন্তবাবু!

এ একটা বিচিত্র ব্যাপার সন্দেহ নেই। একলা হলে নিশ্চয় এমন সহজ শান্ত স্বরে কথা বলতে পারতুম না। উদ্বেগে অস্বস্তিতে আড়ষ্ট হয়ে পড়তুম। কিন্তু হাতে আমার তুরুপের তাস আছে রহস্যভেদী বৃদ্ধ বন্ধু। ওঁর সঙ্গেই বেড়াতে এসেছি নীলাপুরমে। অমন ধুরন্ধর সাহসী প্রাজ্ঞের ব্যাকগ্রাউণ্ডে থেকে আমি অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারি।

কিন্তু উনি আপাতত বাইরে থাকুন। দৈনিক সত্যসেবকের প্রখ্যাত ও দুঁদে রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরী কি এত নাবালক যে এক ভদ্রমহিলার হারানো স্বামীর খোঁজে বেরিয়ে পড়তে পারবে না? অবশ্য, এমনও হতে পারে যে পথেই পুলকেশ মৈত্রের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল! ব্যাপারটা চুকেও গেল।

পা বাড়িয়ে পর মুহূর্তে একটু আড়ষ্ট হলুম। কী ঘটেছিল গতরাতে? এক্ষুণি পথে যেতে যেতে নিশ্চয় জেনে নেব। সেটা কতটা বিপজ্জনক হবে কে জানে! যদি, সত্যি সত্যি তেমন কিছু হয়, তাহলে পরিণামে কর্নেলকে ডাকতেই হবে।

বীচের উপরে পাথরের চাঙড়! তার উপরে বাঁধ। বাঁধের পরে একটা পাহাড়ের ঢালু গায়ে  অ্যালবাট্রস। তার পাশ দিয়ে একফালি পিচের পথ পাহাড়ের কাঁধ বরাবর এগিয়ে ওদিকে নেমে গেছে বড় রাস্তায়। পিচের সরু পথের দুধারে বড় বড় পাথর আর ঝোপঝাড়। সাবধানে ডানদিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেলুম। কর্নেল আমাকে দেখতে পেলেন বলে মনে হল না। যতক্ষণ পাহাড়টা না পেরোলুম দুজনে কোনও কথা হলো না। বড় রাস্তার দুধারে সমতল জমিতে টাউনশিপ ও ছোট্ট বাজার। সেখানে পা দিয়ে মুখ খুললুম–দেখুন মিসেস মৈত্র, সবার আগে আমাদের একটা প্ল্যান করে নেওয়া দরকার। খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার কোনও মানে হয় না। মিঃ মৈত্রের কি এখানে পরিচিত কেউ আছে? মানে–ওঁর মুখে তেমন কিছু কি শুনেছিলেন?

তৃণা মাথা নেড়ে বলল-না।

–তাহলে খুঁজবটা কী ভাবে?

 তৃণার মুখটা করুণ দেখাল। সে বলল–চলুন না, ওইসব লোককে জিগ্যেস করে দেখি। কারো না কারো সঙ্গে নিশ্চয় দেখা হয়েছে ওর। ছোট্ট জায়গা। বাঙালী তো নেই-ই।

হাসি পেল। হাসিটা চেপে বললুম–আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে উনি এতক্ষণ হোটেলে ফিরেছেন! চলুন না–হোটেলে আপনাদের রুমটা আগে দেখে আসি।

তৃণা একটু চঞ্চল হলো। বলল–ঠিক বলেছেন। আমার মাথা ঘুরছে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে! কিছু ভাবতে পারছিনে। চলুন, চলুন! কথাটা সত্যি আমার মাথায় আসেনি।

সে ব্যস্ত হয়ে বড় রাস্তা ধরে এগোল। ‘সী ভিউ’ হোটেল পাহাড়ের উত্তর দিকে। ‘অ্যালবাট্রস’ পূর্বে। অ্যালবাট্রস থেকে ওখানে যাওয়ার পথ নেই, যদিও বাড়ির মাথা নজরে পড়ে। আমরা অবশ্য উঠেছি সরকারী ডাক বাংলোয়। সেটা সমুদ্রের ধারে আরও খানিকটা উত্তরে সমতল জমির ওপর। তার পিছনে সরকারী জঙ্গল আছে।

বাজারের মাঝামাঝি গিয়ে ডানদিকে, অর্থাৎ পূর্বে ঘুরে আগেরটার মতো সরু পিচের পথে উঠলুম। কিছু দূরে চড়াই ভেঙে উঠতে হলো। এখানে ওখানে সুদৃশ্য কিছু বাড়ি আছে। মাঝেমাঝে গাড়ি আসছে যাচ্ছে। লোকজনের ভিড় আছে। বীচের দিকে চলেছে বা ফিরে আসছে। বছরের এসময়টা সমুদ্র-বিলাসীদের ভিড় থাকে এখানে।

সী ভিউয়ের লাউঞ্জে ঢুকে তৃণা হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল রিসেপশনিস্ট মহিলাকে–গুড ইভনিং মিস আয়ার। আমার স্বামী মিঃ মৈত্র ফিরেছেন?

গোমড়ামুখী দক্ষিণভারতীয় কৃষ্ণাঙ্গী ঘাড় নাড়ল মাত্র। তারপর কি-বোর্ড থেকে চাবিটা দিলো। তৃণা চাবি নিয়ে ব্যস্তভাবে পা ফেলল। কার্পেটমোড়া সিঁড়ি। দোতালায় তের নম্বর ঘরের দরজার সামনে সে একটু দাঁড়াল। হতাশভাবে মাথাটা দোলাল। মুখে ঘামের বিন্দু লক্ষ্য করলুম। নিঃশব্দে আমার দিকে তাকাল একবার। যেন বলল–দেখলেন তো ও ফেরেনি!

দরজা বাইরে থেকে বন্ধ আছে। অতএব ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু কী যেন ভাবল তৃণা। অস্ফুটস্বরে বলল–এক মিনিটের জন্যে আসবেন? সমস্ত ব্যাকগ্রাউণ্ডটা আপনাকে আগে বলা দরকার।

সে দরজা খুলল। ঢুকে আবার বলল–আসুন!

ভিতরে ঢুকে তাজ্জব বনে গেলুম। সী ভিউ হোটেলের খ্যাতির কথা জানা ছিল। কিন্তু এই ছোট্ট নীলাপুরমের সমুদ্রতীরে কখনও পাঁচতারা মার্কা বড় হোটেলের ব্যবস্থা আশা করিনি। মৈত্র দম্পতির এই সুইটের মাঝে সবটা নকশি কার্পেটে মোড়া এবং জুতো কয়েক ইঞ্চি দেবে যায়। ড্রয়িং রুম আর বেডরুম নিয়ে রীতিমতো অ্যাপার্টমেন্ট। দেয়ালে দেশী-বিদেশী আর্ট, কোণায় কোণায় অপূর্ব সব ফুলদানি এবং দামী আসবাবপত্র। আমার এই ভাবটা আঁচ করেই হয়তো তৃণা বলল–আমার স্বামী একটু বিলাসী-প্রকৃতির মানুষ। আপনি বসুন প্লীজ।

সে পুবের ব্যালকনির দিকে দরজা খুলে দিতেই সারা সমুদ্র ভেসে উঠল। কাছাকাছি একটা সোফায় বসে পড়লুম। সেই সময় হঠাৎ মনে হল, এখনই যদি মিঃ মৈত্র ফিরে আসেন, তৃণার উদ্বেগ ঘুচবে–কিন্তু আমি পড়ে যাব অস্বস্তিতে। কোনও স্বামীই এই অবস্থায় স্ত্রীর সঙ্গে অচেনা পুরুষকে দেখে খুশি হবে না। বিশেষ করে ঘরে যখন আর কেউ নেই এবং দরজাটা বন্ধ।

তাই, এই সান্নিধ্য যতই ভাল লাগুক কিংবা পরিবেশ যত প্রীতিপদ হোক, শীগগির কেটে পড়া উচিত। বললুম–যাক গে। এবার সংক্ষেপে বলুন তো গতরাতে কী হয়েছে?

তৃণার কপালে ভাঁজ দেখা দিলো। তাকে অবশ্য চঞ্চল দেখাচ্ছিল বরাবর। সে বলল–হ্যাঁ, বলছি। গত সন্ধ্যায় আমরা এখানে এসে উঠলুম। ঘরেই ডিনার সার্ভ করার ব্যবস্থা আছে–সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। কিন্তু ও বলল–নিচের ডাইনিং হলে যাবে। চেনাজানা কেউ আছে নাকি দেখবে। ওর স্বভাবই এ রকম। সব সময় হুল্লোড় পছন্দ করে। ড্রিংক করার অভ্যেসও আছে।

তৃণা এই কথাগুলো বলার সময় পুবে সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিল। নীচে পাহাড়টা ঢালু হয়ে নেমে আবার বেমক্কা ঢেউয়ের মতো উঁচু হয়ে গেছে। ওই অংশটা পাথরের চাতালের মতো। তার নীচে খাড়া দেয়াল, দেয়াল ছুঁয়ে বালির বীচ। সে কথা থামিয়ে হঠাৎ সেদিকে কী যেন দেখতে থাকল।

হেসে বললুম–কী? মিঃ মৈত্রকে দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়?

তৃণার মুখে কিন্তু অন্য ভাব। কেমন ভয়ার্ত চাহনি। ঠোঁট কাঁপছে মনে হল। সে ঘুরে চাপাস্বরে বলল–সেই লোকটা! বাইনোকুলার চোখে দিয়ে এদিকে কী দেখছিল। এইমাত্র সরে গেল।

চমকে উঠেছিলুম। বললুম–কে? কোন লোকটা?

তারপর ব্যালকনিতে গিয়ে বাইনোকুলারওয়ালা কোন বদমাশকে দেখব বলে উঠতেই তৃণা সেদিককার দরজা বন্ধ করে দিলো। কাঁপতে কাঁপতে বললনা, না! আমার বড্ড ভয় করছে। আপনাকে মিঃ মৈত্র ভেবে যদি গুলি ছুঁড়ে বসে!

উত্তেজিত হয়ে বললুম–কেন গুলি ছুঁড়বে? ব্যাপারটা কি?

তৃণা বলল বলছি, সব বলছি। আপনি বসুন প্লীজ। একটু…একটু স্থির হতে দিন!

তার চেহারা লক্ষ্য করে ঘাবড়ে গেলুম। সে কাঁপছে, মুখটা সাদা হয়ে গেছে। টলতে টলতে সোফার কাছে এসে দাঁড়ালে বললুম–মিসেস মৈত্র! আপনি একটুও ভয় পাবেন না, অন্তত আমি থাকতে ভয় পাবার কিছু নেই। আপনি বসুন। বসে সব বলুন।

তৃণা বসল না। ভয়ার্ত মুখে আমার দিকে তাকাল শুধু।

বললুম–আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। কারণ, শুধু আমি নই–আমার সঙ্গে নীলাপুরমে যিনি এসেছেন, তার নাম আপনি শুনে থাকবেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার প্রখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার।

তৃণা বলে উঠল–তার মানে, গোয়েন্দা?

-হ্যাঁ। অ্যালবাট্রসের লনে নিশ্চয় কোনও টাকমাথা বুড়ো ভদ্রলোককে দেখে থাকবেন! মুখে সাদা দাড়ি আছে। ইউরোপীয়ান বলে ভুল হতে পারে কিন্তু।

–যেন দেখেছিলুম!..হ্যাঁ, হা–দেখেছি।

–উনিই আমার ফ্রেণ্ড ফিলসফার অ্যাণ্ড গাইড বলতে পারেন। আপনার ভয়ের কোনও কারণ নেই। এক্ষুণি ওঁকে আমি খবর দিতে পারি। দেব?

তৃণা একটু ভেবে বলল–দেখুন, আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে এত শীগগির হইচই করলে নিশ্চয় আমাদের কোনও ক্ষতি হবে। আপনি আগে সবটা শুনুন। তারপর যদি মনে হয়, তাকে জানানো দরকার–জানাব।

বেশ, বলুন।

 তৃণা নড়ে উঠল হঠাৎ। করুণ ধরনের হাসল–ওই দেখুন! আমি কী ভীষণ অভদ্র! আমার ঘরে গেস্ট-আর আমি সব ভদ্রতা ভুলে বসেছি! এক মিনিট!

বলে সে কোণার টেবিল থেকে ফোনটা তুলল। তারপর আমার দিকে ঘুরল। মুখটা আবার ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।

একটু বিস্মিত হয়ে বললুম–কী ব্যাপার?

 ফোনটা রেখে সে ব্যস্তভাবে বলল–আশ্চর্য তো! ফোনটা ডেড।

–ডেড?

–হ্যাঁ। এক মিনিট…আমি দেখছি করিডরে বেয়ারারা কেউ আছে নাকি!

 সে দরজার দিকে যাচ্ছে দেখে বললুম–কলিং বেল নেই?

–তাই তো! সরি!…বলে তৃণা কাছেই দেয়ালে সুইচ টিপল।

কোনও শব্দ শোনা গেল না। আরও কয়েকবার টিপল, তবুও না। সে আমার দিকে ফ্যাকাশে মুখে তাকাল। আমি ততক্ষণে বেশ ঘাবড়ে গেছি। বললুম–আশ্চর্য তো! আচ্ছা–দেখছি!

উঠে আলোর সুইচ টিপলুম। জ্বলল না। সেই সময় চোখে পড়ল সুইটে এয়ার কনডিশানের ব্যবস্থা আছে। হন্তদন্ত হয়ে যন্ত্রটার চাবি ঘোরাতে শুরু করলুম। কোনও সাড়া নেই। তখন ঘুরে বললুম–লোডশেডিং চলছে না তো?

তারপর দেখলুম তৃণা দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

 বাইরে রোদ মুছে গেছে ততক্ষণে। ঘরের ভিতরটা ধূসর হয়ে উঠেছে। ব্যালকনির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে তৃণার অপেক্ষা করতে থাকলুম। একটা রহস্যময় ঘটনার মধ্যে এসে পড়েছি, তাতে কোনও ভুল নেই। মনে মনে কর্নেলের উদ্দেশে বললুম–ওহে বৃদ্ধ ঘুঘু, তুমি সব সময় আমাকে অতি বুদ্ধিমান বলে ঠাট্টা করো। আমি গোয়েন্দা হলে নাকি বিস্তর ওলট-পালট কাণ্ড ঘটবে! এবার তুমি বসে বসে দেখবে, গোয়েন্দা হবার এবং রহস্যের পর্দা ফাঁস করবার মতো বুদ্ধি জয়ন্তের ঘিলুতে প্রচুর পরিমাণেই আছে। মাননীয় গোয়েন্দামহোদয়! অপেক্ষা করো এবং দেখ!

কিন্তু তৃণা ফিরছে না। পাঁচ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করেও তার কোনও পাত্তা নেই। তখন উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারি শুরু করলুম। সেই সময় একটা আইডিয়া মাথায় এল। এখন তো তদন্তের চমৎকার সুযোগ হাতে পাওয়া গেছে। এই দম্পতির ব্যাকগ্রাউণ্ডটা জানার মতো কোনও জিনিস কি সুইটে নেই?

যেমন কথাটা মাথায় আসা, অমনি বেডরুমে ঢুকে পড়লুম। চমৎকার আধুনিক উপকরণে সাজানো ঘর। সঙ্গে টয়লেট। তার দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে আছে। আলো খুব কম। কিন্তু ওই ফাঁকে স্পষ্ট একজোড়া জুতো-পরা পা দেখতে পেলুম। পাদুটো মেঝেয় শুয়ে থাকা মানুষের।

বুকের মধ্যে রক্ত শিসিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। এক লাফে এগিয়ে দরজাটা পুরো ফাঁক করতেই যা দেখলুম, তাতে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল।

সুটপরা এক ভদ্রলোক চিত হয়ে পড়ে আছেন। কপালে দুটো রক্তাক্ত ক্ষত। একপাশে একটা রিভলভার পড়ে আছে।

ওটা মৃতদেহ তাতে কোনও ভুল নেই। প্রথমে ঝোঁকের বশে রিভলভারটা তুলে নিলুম। আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলুম সেটার দিকে। কেন এমন করলুম, জানি না।…

.

অ্যালবাট্রসের লনে বেঞ্চে বসে শেষ বেলায় দরদর করে ঘামছি আর কর্নেল আমাকে প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। যন্ত্রের মতো জবাব দিচ্ছি। গোড়ায় উনি হাসছিলেন। ক্রমশ দেখলুম, ওঁর হাসিটা মিলিয়ে গেল। গম্ভীর মুখে বললেন–তাহলে রিভলভার তুমি হাতে নিয়েছিলে?

হ্যাঁ।

-কেন?

–এমনি। হঠাৎ যেন পরীক্ষা করতে ইচ্ছে হল।

 –বোকার মতো কাজ করেছ ডার্লিং!

–সে তো এখন বেশ বুঝতে পারছি।

 –আসার সময় করিডরে কেউ তোমাকে বেরিয়ে আসতে দেখেনি?

–সম্ভবত না।

–সম্ভবত কেন?

–তখন তো আমি ভীষণ ভয় পেয়ে পালিয়ে আসছি। খুঁটিয়ে দেখার মতো মনের অবস্থা ছিল না।

–সিঁড়িতে কারও সঙ্গে দেখা হয়েছে?

-হ্যাঁ। একজন বেয়ারার সঙ্গে। সে চায়ের ট্রে নিয়ে উঠছিল। আমার সঙ্গে তার একটু ধাক্কা লাগে।

কর্নেল আরও গম্ভীর হয়ে বললেন–রিসেপশনে মিসেস মৈত্রের সঙ্গে দেখা হয়নি বলছ। রিসেপশনিস্ট মেয়েটিকে ওঁর কথা জিজ্ঞেস করেছিলে?

না। তখন আমার মনের অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন।

কর্নেল আপনমনে মাথা দোলালেন। তারপর বলেলেন–খুব বোকার মতো কাজ করেছ, জয়ন্ত। তুমি এমন বোকামি করবে, তা ভাবাই যায় না। পারিপার্শ্বিক এভিডেন্সে তোমাকেই খুনী সাব্যস্ত করা এখন খুবই সহজ।

শিউরে উঠে বললুম–সর্বনাশ!

–রিভলভারে তোমার আঙুলের ছাপ রয়েছে। কাজেই জজসাহেব তোমাকে অনায়াসে ফাঁসিতে ঝোলাতে পারেন।

এই অব্দি শুনেই আঁতকে উঠে বললুম–ওরে বাবা! তাই তো!

 কর্নেল এবার উঠে দাঁড়ালেন। পা বাড়িয়ে বললেন–দেখা যাক কী করতে পারি!

দুজনে অ্যালবাট্রসের লাউঞ্জে ঢুকে সোজা রিসেপশনে গেলুম। তারপর কর্নেল ফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। আমি উদ্বিগ্ন মুখে কাচের দেয়ালের বাইরে সমুদ্র দেখতে থাকলুম। হঠাৎ চোখে পড়ল, বাঁদিকে দূরে সমুদ্রের খাড়ির উপর পাথরের চাতালে কে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখে বাইনোকুলার। সমুদ্রের দিকে পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে সে কী যেন দেখছে। তৃণা যাকে সী ভিউ থেকে দেখেছিল, নিশ্চয় ওই লোকটা সেই। ওখানেই তো পাহাড়ের পিঠে সী ভিউ হোটেলটা রয়েছে–এখান থেকে যদিও সেটা দেখা যাচ্ছে না। তৃণা বলেছিল– লোকটা গুলি ছুঁড়তে পারে। কিন্তু তৃণাই বা হঠাৎ উধাও হলো কেন?…।

কর্নেলের ডাকে সংবিত ফিরল। চাপাস্বরে বললুম– কর্নেল! এই দেখুন সেই লোকটা!

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন জয়ন্ত, থাক্। আর গোয়েন্দাগিরি, করতে যেও না। কেউ বাইনোকুলার দিয়ে কী দেখছে, তাতে আপাতত তোমার কিছু সুবিধে হবে না। এখন চলো, আমরা সী ভিউতে যাই। পুলিশ অফিসাররা এখনই সেখানে এসে পড়বেন।

ইতস্তত করে বললুম–কিন্তু আমার যাওয়া কি ঠিক হবে?

হ্যাঁ। তোমার গ্রেফতার হবার সম্ভাবনাটা তো আছেই।

 বুক ঢিপঢিপ করতে থাকল। বললুম–তাহলে আমি বরং ঘরে গিয়ে থাকি।

–মোটেও না।…বলে কর্নেল আমার ডানহাতের কবজি চেপে ধরলেন এবং বলির পাঁঠার মতো আমাকে টানতে টানতে বেরোলেন।

আগের রাস্তা দিয়ে ঘুরে আমরা সী ভিউ পৌঁছলুম। কিন্তু এখন সেখানে অন্য দৃশ্য। ছোটখাটো একটা ভিড় জমে আছে। ভিড়টা চাপাগলায় কী সব আলোচনা করছে। মাদ্রাজী রিসেপশনিস্ট মিস আয়ার শুকনো মুখে ফোন ধরে কার সঙ্গে কথা বলছে। বেয়ারারা সিঁড়িতে হন্তদন্ত হয়ে উঠছে আর নামছে। কলে মিস আয়ারকে কিছু বলার জন্যে ঠোঁট ফাঁক করছেন, এমন সময় একজন বেয়ারা আমার দিকে আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠল–এই লোকটা! এই লোকটা! মিস আয়ারও ঘুরে আমাকে দেখেই বলে উঠল-মাই গড! এই তো সেই লোক!

অমনি বেয়ারার দল তুমুল হইচই করে আমাকে ঘিরে ফেলল। দারোয়ানকেও দেখলুম এগিয়ে আসতে। আমি বিকট চেঁচিয়ে বললুম–আমি নই, আমি নই!

ভিড়সুদ্ধ পাল্টা চেঁচালো–পাকড়ো! পাকড়ো! শালা খুনীকো পাকড়া!

ভয়ে চোখ বুজে ফেললুম। মুখের সামনে অনেকগুলো হাতের মুঠো নড়ছিল। প্রচণ্ড মার আমাকে দেবেই–এই ভয়েই চোখ বুজে ফেললুম। অমনি শুনি কর্নেল তাঁর সামরিক গর্জনে সী ভিউকে যেন ফাটিয়ে দুভাগ করে ফেললেন–খবর্দার! যে যেখানে আছেন, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। যা করার, পুলিশকে করতে দিন।

মারমুখী ভিড়টা হকচকিয়ে গেল। তারপর দেখি, লন থেকে কয়েকজন পুলিশ অফিসার আর কনেস্টবল হন হন করে এগিয়ে আসছে। একজন অফিসার কর্নেলের সামনে এসেই হাত বাড়ালেন–হ্যাল্লো ওল্ড বস! এবারও দেখছি, আসামাত্র খুন খারাপি করে ফেলেছেন!

কর্নেল একটু হেসে করমর্দন করে বললেন–হ্যাঁ, মিঃ বেঙ্কটেশ! এই আমার ভাগ্য। যেখানে যাই, সেখানেই এক ইটার্নাল মার্ডারার আড়াল থেকে একটা ডেডবডি সামনে ফেলে দিয়ে তামাশা করে।

বেঙ্কটেশ বললেন–তাই বটে! চলুন, দেখি।…

বেয়ারারা আগে আগে উঠতে থাকল। তিনজন পুলিশ অফিসার, কর্নেল আর আমি তৃণা মৈত্রদের ঘরে চললুম। নীচে দুজন অফিসার আর কনেস্টবলরা রয়ে গেল। আর কাউকেও উঠতে দেওয়া হলো না।

সেই ভয়ঙ্কর ঘরে ঢুকতেই আমার দম আটকে এল। তবে একদিক থেকে আশ্বস্ত বোধ করছিলুম যে বেয়ারাদের করিডরে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওরা আমাকে ধরিয়ে দেবার জন্যে এখনও খুব ছটফট করছে নিশ্চয়। ভাগ্যিস, কর্নেল সঙ্গে আছেন।

বাথরুমে লাশটা তেমনি পড়ে আছে। কিন্তু এবার নতুন দৃশ্য চোখে পড়ল। লাশের ওপর মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে পড়ে আছে সেই তৃণা মৈত্র। বেঙ্কটেশ ঝুঁকে ওর নাড়ি দেখে নিয়ে বললেন–শক খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। মিঃ আচারিয়া! আপনি দেখুন–ডাক্তার এলেন নাকি।

একজন অফিসার তক্ষুণি চলে গেলেন। কর্নেল ও বেঙ্কটেশ তৃণাকে সাবধানে তুলে সংলগ্ন বেডরুমের খাটে শুইয়ে দিলেন। কর্নেল বললেন–জয়ন্ত। ওই গ্লাসে জল ঢালো।

কর্নেলের হুকুম তামিল করছি, সেই সময় বাথরুমে বেঙ্কটেশের কথা শুনে চমকে উঠলুম। কী আশ্চর্য। এটা দেখছি একটা খেলনা রিভলভার।

কর্নেল বললেন–টয় রিভলভার? মাই গুডনেস!

–হ্যাঁ, কর্নেল সরকার।

–ভারি অদ্ভুত ব্যাপার তো।…বলে কর্নেল আমার হাত থেকে জলের গ্লাস নিয়ে তৃণার মুখে জলের ঝাপটা দিলেন।

একটু পরেই তৃণা চোখ খুলল। অস্বাভাবিক লাল চোখ। নিষ্পলক তাকিয়ে সে কর্নেলকে দেখল। তারপর আমাকে দেখেই আর্তনাদ করে উঠল–ওই, ওই লোকটা ওকে খুন করেছে। পুলিশ! পুলিশ!

আঁতকে উঠে বললুম–ছি ছি! কী সব যা-তা বলছেন। আপনিই তো আমাকে…..

বেঙ্কটেশ ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়েছেন। কর্নেল চোখ টিপে আমাকে থামতে ইশারা করলে আমি থেমে গেছি। তৃণা দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কাঁদতে থাকল। কান্নার মধ্যে যা বলছে, তা একটু একটু বুঝতে পারছি। এখনও কেন আমাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না, এই অভিযোগ করছে সে। এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিলুম, কিন্তু এবার রাগ এসে সাহস বাড়াল। মনে মনে বললুম–—শয়তানী, এ সবই তোমার ষড়যন্ত্র। নিজের স্বামীকে এভাবে খুন করিয়ে কারও কাঁধে চাপাবার মতলব করেছিলে। সেই মতলবে তুমি সী বীচে গিয়ে উপযুক্ত লোক খুঁজছিলে। আমিও বোকার মতো তোমার ফাঁদে ধরা দিতে এসেছিলুম। রোস, তোমার মজা দেখাচ্ছি।

কর্নেল বললেন মিঃ বেঙ্কটেশ, একটু পরেই ব্যাকগ্রাউণ্ডটা আপনাকে জানাব। আপাতত আপনি আপনার কর্তব্য করতে থাকুন।….

.

সী ভিউয়ের গ্রাউণ্ড ফ্লোরে রিসেপশনের পিছনে ম্যানেজারের ঘর। ম্যানেজার ভদ্রলোক বাইরে গিয়েছিলেন। এসে সব দেখে শুনে অনবরত ঠক ঠক করে কাঁপছেন। ওঁর ঘরেই জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আমার স্টেটমেন্ট ও জেরাপর্ব চুকে যাবার পর তৃণা মৈত্রকে ডাকা হলো। তখন সাড়ে ছটা। বাইরে সমুদ্র অন্ধকারে গর্জন করছে। হোটেলের সবগুলো আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তৃণা আস্তে আস্তে মিস আয়ারের কাঁধে হাত রেখে ঘরে ঢুকল। মিস আয়ার চলে গেলে বেঙ্কটেশ বললেন বসুন মিসেস মৈত্র। খুব দুঃখিত আমি আপনার মনের অবস্থা জেনেও আপনাকে বিব্রত করা হচ্ছে। কিন্তু এটা কর্তব্য। তাই ক্ষমা করবেন।

তৃণা বসে বলল বলুন, কী জানতে চান?

–আপনারা কবে এসেছেন এখানে?

–সে তো হোটেলের রেজিস্টারে পাবেন। গতকাল সন্ধ্যা ছটা নাগাদ।

–আপনি জয়ন্তবাবুকে বলেছিলেন, আপনার আসার পর কী সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। কী ঘটনা?

তৃণা একটু ভেবে নিল যেন। তারপর বলল কাল রাতে দুবার আমাদের দরজায় কে নক করেছিল। উনি দুবারই দরজা খুললেন, কিন্তু কাকেও দেখতে পেলেন না। প্রথমবার রাত ন’টায়, দ্বিতীয়বার সাড়ে দশটায়। আজ সকালে ব্যালকনিতে দুজনে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ আমার চোখে পড়ল একটা লোক খাড়ির উপরে পাথরের চাতাল থেকে বন্দুক তাক করছে। উনিই দেখতে পেলেন। অমনি আমাকে টেনে বসে পড়লেন। সেই অবস্থায় গুঁড়ি মেরে আমরা ঘরে ঢুকলুম। উনি ভীষণ কাঁপছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করেও কোনও জবাব পেলুম না।

-বেশ। তারপর? আর কী ঘটনা ঘটল, বলুন।

নীচের ডাইনিংয়ে আজ দুজনে লাঞ্চ খেতে এসেছি, একজন বয় ওঁর হাতে একটা চিঠি গুঁজে দিল। লাউঞ্জে কে একজন তাকে নাকি দিয়েছে চিঠিটা! চিঠি পড়ে ওঁর মুখ শুকিয়ে গেল যেন। জিজ্ঞেস করলুম–কিন্তু এবারও কোনও জবাব দিলেন না। শুধু বললেন–পরে সব বলব। তারপর খুব তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলেন। লাউঞ্জে গিয়ে দেখলুম-সত্যি, এক ভদ্রলোক বসে আছেন। মিঃ মৈত্র আমাকে ঘরে যেতে বলে ওই ভদ্রলোকের কাছে গেলেন। আমি আমার স্বামীর কোনও ব্যাপারে কখনও কৌতূহল প্রকাশ করিনি। কিন্তু এবার খুব উদ্বিগ্ন বোধ করছিলুম। আধঘণ্টা পরে উনি ফিরলেন। তারপর বললেন–একটু কাজে বাইরে যাচ্ছি। শীগগির ফিরব। ভেবো না। তখন প্রায় দুটো। পাঁচটা পর্যন্ত যখন ফিরলেন না, তখন উদ্বিগ্ন হয়ে বেরিয়ে পড়লুম। তারপর ওই ভদ্রলোক–জয়ন্তবাবুর সঙ্গে দেখা হলো।….

বেঙ্কটেশ হাত তুলে বললেন–এবার, আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন। জয়ন্তবাবুকে ঘরে বসিয়ে রেখে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?

তৃণা মুখ তুলে নিষ্পলক তাকাল। বলল–আমাদের রুমের ইলেকট্রিক কানেকশান কাটা দেখে নীচে বলতে এসেছিলুম। কিন্তু লাউঞ্জে নেমেই চোখে পড়ল, সেই পাথরের চাতালে সকালের বন্দুকঅলা লোকটা আর কে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চেহারা অবিকল মিঃ মৈত্রের মতো–পোশাক একই রকম। বেশ খানিকটা দূর বলে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছিল না। তাই তক্ষুণি দৌড়ে সেদিকে গেলুম। কিন্তু আমি যেতে যেতে ওরা পাথরের আড়ালে চলে গেল। তখন কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে হোটেলে ফিরে এলুম। এসেই দেখি…

সে দুহাতে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠল। বেঙ্কটেশ বললেন–প্লীজ মিসেস মৈত্র। আমাদের আরও অনেক কিছু জানবার আছে। আপনার স্বামীর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে আপনার সাহায্য খুবই দরকার।

তৃণা ভেজা চোখ তুলে বলল–বলুন, আর কী জানতে চান।

–আপনার স্বামীর পেশা কী ছিল?

স্থায়ী কিছু ছিল না। খুব খেয়ালী মানুষ। নানারকম ট্রেডিং এজেন্সি নিয়ে থাকতেন। সম্প্রতি নতুন কোনও ব্যবসা করা কথা ভাবছিলেন।

এবার কর্নেল বললেন–মিসেস মৈত্র, আপনার স্বামী নীলাপুরমে কেন এলেন, আপনি নিশ্চয় জানেন।

তৃণা ঘাড় নাড়ল। জানি না। আমি কখনও ওকে প্রশ্ন করতুম না। এটা আমার স্বভাবও বটে–তাছাড়া প্রশ্ন করলেই উনি বলতেন–পরে বলব ‘খন। এবার হঠাৎ নীলাপুরমে আসবেন বললেন, তখন আমি কোনও প্রশ্ন করিনি।

আপনার স্বামীর কি কোনও শত্রু ছিল জানেন?

না। থাকলেও আমাকে বলেননি।

–আপনার স্বামীর নিশ্চয় বন্ধুবান্ধব ছিলেন?

–হ্যাঁ, তা ছিলেন বই কি। তবে উনি খুব ব্যস্ত মানুষ ছিলেন। আড্ডা দিতে ভালবাসতেন।

–খুব ঘনিষ্ঠ এমন কারও-কারও নাম নিশ্চয় বলতে পারবেন?

পুরো নাম আমি বলতে পারব না। যেমন এক ভদ্রলোক মাঝে মাঝে আমাদের কলকাতার বাসায় আসতেন। অবনীবাবু নাম। আরেকজন আসতেন তার নাম মিঃ রক্ষিত।

আপনারা কোন ট্রেনে এসেছেন হাওড়া থেকে?

তৃণা একবার ওঁর দিকে তাকিয়ে বলল–কেন?

–এমনি জিজ্ঞেস করছি।

–হাওড়া থেকে ডিরেক্ট আসা যায় না কোনও ট্রেনে।

সরি! বলে কর্নেল একটু হাসলেন। বিন্ধ্যাচল-অব্দি আসা যায়। বিন্ধ্যাচলে কখন নেমেছিলেন?

গতকাল তিনটে পাঁচটাচ হবে।

–আপনার স্বামীর সঙ্গে কারও দেখা হয়েছিল ওখানে?

তৃণা নড়ে উঠল। হ্যাঁ, হ্যাঁ। হয়েছিল। আমি ভুলে গেছি বলতে–মানে, ওই খাড়ির উপরকার চাতালে যে লোকটাকে দেখেছি, তারই সঙ্গে। বিন্ধ্যাচল স্টেশনে ওকে দেখেই উনি এগিয়ে গেলেন। আমাকে বললেন–তুমি এখানে একটু দাঁড়াও। আমি আসছি। পনের কুড়ি মিনিট লোকটার সঙ্গে কথা বলে ফিরে এলেন। তখন ওঁকে কেমন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল।

কর্নেল শুধু বললেন–আমার আর কোনও প্রশ্ন নেই। মিঃ বেঙ্কটেশ, ইউ প্রসিড।

বেঙ্কটেশ ঘড়ি দেখে বললেন মিসেস মৈত্র, আপাতত এই। আপনি ওখানে গিয়ে বসুন। মিঃ আচারিয়া, এবার ডাকুন বয় রণদীপকে।

রণদীপ বয়সে তরুণ। ঘরে ঢুকে সেলাম করার পরই তার চোখ গেল আমার দিকে। অমনি ওর ঠোঁটে বাঁকা হাসি উঠল। নির্ঘাৎ ও ব্যাটা আমাকে তখন বেরিয়ে আসতে দেখেছিল ঘর থেকে। সে দাঁড়িয়ে রইল। বেঙ্কটেশ তাকে বসতে বললেও সে বসল না। তখন একটু হেসে বেঙ্কটেশ বললেন–তুমি রণদীপ সিং?

জী হাঁ।

 কতদিন সী ভিউতে এসেছ?

 –তা বছর খানেক হয়ে গেল স্যার।

–গতকাল তোমার ডিউটি ছিল কখন?

 –ছটা থেকে রাত একটা।

–ওই সময়ের মধ্যে মিঃ মৈত্র ছাড়া নতুন কেউ এসেছিলেন হোটেলে?

–দুজন সাহেব এসেছিলেন, ওনারা এখনও আছে। তবে রেজিস্টার দেখলেই সব মালুম হবে, স্যার।

–ঠিক বলেছ। আচ্ছা রণদীপ, ওই সময়ের মধ্যে মিঃ মৈত্রের ঘরে–মানে তের নম্বর ঘরে কাউকেও নক করতে বা ঢুকতে দেখেছিলে?

না স্যার। আমি তো হরদম করিডরেই ঘুরি।

–আজ কখন ডিউটি তোমার?

দুপুর দুটো থেকে রাত নটা অব্দি আছে, স্যার।

–এই সময়ের মধ্যে কাউকে তের নম্বরে… বাধা দিয়ে রণদীপ আমার দিকে আঙুল তুলল। ওই যে স্যার…

না। উনি ছাড়া আর কেউ ঢোকেনি?

–ঢুকেছিলেন। কিন্তু…

 ওকে থামতে দেখে কর্নেল ঝুঁকে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন–যিনি ঢুকেছিলেন, তাকে আর নিশ্চয় বেরোতে দেখনি? তাই না?

রণদীপের ঠোঁট কাঁপছে। সে কী বলতে চায়, অথচ পারছে না–খুব অবাক আর হতভম্ব যেন।

কর্নেল বললেন–এবং যাকে ঢুকতে দেখেছিলে, তারই লাশ বাথরুমে দেখা গেল। তাই তো রণদীপ?

রণদীপ লাফিয়ে উঠল–হ্যাঁ স্যার। তাই বটে স্যার। এতক্ষণে সেটা খেয়াল হয়নি স্যার!

ঘরে সবাই নড়ে উঠেছিল–তারপর ভীষণ স্তব্ধতা। কর্নেল শুধু বললেন–মাই গুডনেস!

তারপর শুনলুম তৃণা মৈত্র চিৎকার করে উঠল–মিথ্যা! একেবারে মিথ্যা! যে খুন হয়েছে, সেই আমার স্বামী!

তারপর দেখলুম সে অজ্ঞান হয়ে কোণার সোফা থেকে মেঝেয় পড়ে গেল। কর্নেল আমাকে ডেকে বললেন–এস জয়ন্ত। বাইরে যাই। মিঃ বেঙ্কটেশ, দরকার হলে রিং করবেন কিংবা আসতেও পারেন। ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম। অ্যালবাট্রস রুম নম্বর থ্রি। অ রিভোয়া!

.

রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বললেন–জয়ন্ত, কী ভাবছ?

–ভাবছি, লাশটা তবে পুলকেশ মৈত্রের নয়?

না। তৃণার স্বামীর নয়।

–কিন্তু এর মানেটা কী?

–মানে এখনও বোঝা যাচ্ছে না। মাথাটা পরিষ্কার করা দরকার। তাই ডার্লিং, চলো–আমরা একবার ওই খাড়ির উপর পাথরের চাতালে গিয়ে কিছুক্ষণ বসি। জায়গাটা ভারি চমৎকার।

— একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। বললুম–বন্দুক আর বাইনোকুলারধারী কারো পাল্লায় পড়ব না তো?

কর্নেল হেসে বললেন–তোমার দৃষ্টিবিভ্রম নয় তো জয়ন্ত?

–মোটেও না। স্পষ্ট দেখেছি একজন নীল শার্ট পরা লোক চোখে বাইনোকুলার রেখে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য, তার হাতে বন্দুক দেখিনি।

পাহাড়ের ঢালুতে নামতে গিয়ে হঠাৎ কর্নেল বললেন বরং তার আগে একবার ওই দি সোয়ান নামে হোটেলটা থেকে ঘুরে আসি।

হঠাৎ ওখানে কেন?

নিছক বিয়ার খেতে। বিয়ার মদ নয়। অন্তত এ বেলা খাওয়া যাক।

দুজনে সোজা এগিয়ে সেই খাড়ির খানিকটা উত্তরে দি সোয়ান নামে ছোট্ট হোটেলের দিকে এগোলুম।

হোটেলটা বাংলোবাড়ির মতো। লাউঞ্জে তেমন ভিড় নেই। একপাশে বার। বারে ঢুকে দেখলুম যা ভিড় তা এখানেই। নীল আলোয় মৌমাছির মতো একঝাঁক মাতাল গুঞ্জন করছে। চাপা সুরে বিলিতি অর্কেস্ট্রা বাজছে। আমরা খালি টেবিল খুঁজতে খুঁজতে কোণায় চলে গেলুম। একটা টেবিলে একজন লোক একা বসে আছে। টেবিলের গ্লাসে রঙিন মদ। কর্নেল ভদ্রতা করে বললেন-বসতে পারি?

লোকটা ঘাড় নাড়ল মাত্র। তারপর গেলাসটা তুলে নিয়ে চুমুক দিল।

আমরা বসে পড়লুম। ওয়েটার আমাদের পেছন পেছন এসে দাঁড়িয়ে ছিল। কর্নেল বিয়ার দিতে বললেন। এই সময় আমার চোখে পড়ল তৃতীয় চেয়ারের ওই লোকটার কোমরের কাছে একটা বাইনোকুলার ঝুলছে। অমনি শিউরে উঠে কর্নেলের ঊরুতে চিমটি কাটলুম। কর্নেল কিন্তু গ্রাহ্যই করলেন না। নির্বিকারভাবে দাড়িতে হাত বুলোতে থাকলেন। তখন আমি লোকটাকে আরও ভাল করে লক্ষ্য করতে থাকলুম। দূর থেকে কম আলোয় দেখেছি, ভুল হতেও পারে। কিন্তু এর পোশাকও স্পষ্ট বলে দিচ্ছে পাথরের চাতালে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিই বটে। বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে ওর। বেশ বলিষ্ঠ চেহারা। মুখের চামড়ায় পোড়খাওয়া ভাব আছে। খাড়া নাক আর চৌকো চোয়াল দেখে সহজেই বোঝা যায় লোকটা ডানপিটে না হয়ে পারে না।

বিয়ার এসে গেল। কর্নেল বোতল থেকে গ্লাসে খানিকটা বিয়ার ঢেলে বললেন–জয়ন্ত নিশ্চয়ই এই নিরামিষ পানীয়ে সন্তুষ্ট হবে না?

কর্নেল আমার চিমটিতে সাড়া দেননি বলে ক্ষুব্ধ ছিলুম। তাই গম্ভীর হয়ে মাথাটা দোলালুম মাত্র তার মানে হ্যাঁ এবং না দুই-ই হতে পারে। কর্নেল একটু হেসে গ্লাসটা তুলে ‘চিয়ার্স’ বলে চুমুক দিলেন।

এই সময় তৃতীয় চেয়ারের লোকটা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। তারপর বেরিয়ে গেল। তখন ব্যস্ত হয়ে চাপা গলায় বললুম–যাঃ। চলে গেল যে!

কর্নেল গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন–কে গেল, ডার্লিং?

ক্ষেপে গিয়ে বললুম–ন্যাকামি করবেন না। সেই বাইনোকুলারঅলা লোকটা এতক্ষণ দিব্যি আপনার সামনে জলজ্যান্ত বসে রইল–আমি আপনাকে চিমটি কাটলুম, অথচ গ্রাহ্য করলেন না।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–তুমি কি ভাবছ বাইনোকুলার সঙ্গে থাকলেই তাকে খুনী বলে সন্দেহ করতে হবে।

–নিশ্চয়। ওই লোকটাই তো তখন খাড়ির ধারে দাঁড়িয়ে..

কর্নেল হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরে বললেন–চুপ। তারপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে চোখের তারা ঘুরিয়ে ওঁর ডান-দিকটা নির্দেশ করলেন। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি ওই টেবিলে তিনজন লোক বসে আছে। দুজন সর্দারজী, অন্য একজন ধুতিপাঞ্জাবি পরা বাঙালী ভদ্রলোক। বাঙালী ভদ্রলোকটি যে সর্দারজীদের সঙ্গে আসেননি, তা দেখামাত্র বোঝা যায়। উনি আপনমনে একটা পেন দিয়ে একটুকরো কাগজে কাটাকুটি করছেন। পাশের গ্লাসে মদ। মুখের ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝলুম, প্রচণ্ড নেশা হয়ে গেছে। কাগজের টুকরোটা বারেরই বিল মনে হলো। তার উপরে যেভাবে কলম চালাচ্ছেন, বাঙালী যে জাত কেরানী তা নির্দ্বিধায় প্রমাণ করা যায়। আমি আর হাসি চাপতে পারলাম না।

হাসি শুনেই ভদ্রলোক মুখ তুলে তাকালেন। দেখি, উনিও গদগদ হয়ে হাসছেন। মাতালের এমন হাসি আমার পরিচিত। আমি ওঁর কাজে সায় দেবার ভঙ্গিতে মাথা দোলালুম। ভদ্রলোক শুধু মাতাল নন, রসিকও বটে। অমনি দ্বিগুণ উৎসাহে কলম চালনা শুরু করলেন এবং মাঝেমাঝে মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এমন মজা পেলে ছাড়তে ইচ্ছে করে না।

ব্যাপারটা সর্দারজীদের চোখে পড়ল এতক্ষণে। একজন ভুরু কুঁচকে অস্পষ্ট কিছু বলল। মুখে বিরক্তির চিহ্ন।

হঠাৎ কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।–আমি একবার বেরুচ্ছি, জয়ন্ত। তুমি আমার জন্যে এখানেই অপেক্ষা করো। বার দশটা অব্দি খোলা। আমি সড়ে নটার মধ্যেই ফিরব।

আমাকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেলেন উনি। আমার ক্ষোভ হলো ওঁর ওপর। কিন্তু কী আর করা যাবে? ওঁর কথামতো না চললে উনিও বড্ড বিরক্ত হবেন। বিশেষ করে খুনখারাপির তদন্তের ব্যাপারে উনি তখন অন্যমানুষ। তাই বসে থাকতে হলো।

এই অবস্থায় ভদ্রলোকের সঙ্গে ভাব না জমিয়ে উপায় নেই। নিঃসঙ্কোচে বললুম–চলে আসুন না এখানে!

ভদ্রলোক যেন সেটাই চাইছিলেন। টলতে টলতে কলম কাগজ আর গেলাস নিয়ে আমাদের টেবিলে এলেন। তারপর নমস্কার করে বললেন–বাঁচলুম। আমার নাম পরিতোষ কারফর্মা। টালিগঞ্জে কাঠগোলা আছে। মশাই যে বাঙালী, তা আঁচ করেছিলুম। কিন্তু বুঝলেন? ওই দুই সর্দারজীর ভয়ে টেবিল ছেড়ে উঠতে পারছিলুম না।

-কেন বলুন তো?

–ওদের আমি মশাই ভীষণ ভয় করি। টেবিল থেকে উঠলেই যদি মেরে বসে।

হো হো করে হেসে উঠলুম। বলুলম–একা এসেছেন নীলাপুরমে?

পরিতোষবাবু বললেন–হ্যাঁ। আমি মশাই ব্যাচেলার মানুষ। দোকা-টোকা ভালবাসিনে। আপনি?

–আমিও তাই।

 বাচ্চা ছেলের মতো হি হি হেসে পরিতোষবাবু বললেন–খুব ভাল। খুব ভাল! খবর্দার স্ত্রীলোকের ছায়া মাড়াবেন না। মাড়িয়েছেন না মরেছেন। তা ব্রাদারের নামধাম?

পরিচয় দিতেই লাফিয়ে উঠে বললেন–ওরে বাবা কী আনন্দ, কী আনন্দ। তারপর হাস্যকরভঙ্গিতে শিস দিয়ে বেয়ারাকে ডাকলেন। আমার আপত্তি সত্ত্বেও হুইস্কির অর্ডার দিলেন। বললেন–আপনার মতো সঙ্গী যখন পেয়ে গেছি, আজ মশাই বারসুদ্ধ শুষে খাব।

বলুলম–উঠেছেন কোথায়?

পরিতোষবাবু ছাদ দেখিয়ে বললেন–মাথার ওপরে। এই সোয়ানেই। আপনি?

–অ্যালবাট্রসে।

–খুব ভাল, খুব ভাল।…বলে একটু ঝুঁকে চোখ নাচিয়ে জিগ্যেস করলেন ওই বুড়ো সায়েবটি কে? এখানে এসেই আলাপ হয়েছে বুঝি? আমেরিকান নয় তো? দেখবেন ব্রাদার–সি. আই. এ. ঘুরঘুর করছে সবখানে। খুব সাবধান। দেশের কোনও কথা ফাঁস করবেন না। আপনারা জার্নালিস্ট। আপনারা দেশের সব গুহ্যখবর রাখেন কি না। তাই বলছি।…

বাধা দিয়ে বললুম–না, না। উনি ভারতীয়। শুধু ভারতীয় নয়, বাঙালী।

পরিতোষবাবুর চোখের ঢেলা বেরিয়ে গেল। অ্যাঁ? উনি বাঙালী? ওরে বাবা! কী আনন্দ! কী আনন্দ! ওয়েটার। ইধার আও!..

এই আনন্দে আবার হুইস্কি এসে গেল। এমন আমুদে লোক খুব কমই দেখেছি। মেজাজ ভাল হয়ে গেল ক্রমশ। বিয়ারের পর দু পেগ হুইস্কি পেটে পড়ার ফলে নেশাও ধরে যাচ্ছিল। এর পর কীভাবে সময় কেটেছে, বলা কঠিন। যখন কর্নেল ফিরে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন, তখন আমার চোখে নানারঙের খেলা ভাসছে।…

.

রাত কীভাবে কেটেছে, মনে নেই। সকালে উঠে দেখি পাশের বেডে কর্নেল নেই। মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। তাই স্নান করলুম। বয় এসে ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল। ব্রেকফাস্ট সেরে সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে গেলুম। সকালের শান্ত সমুদ্র রোদে ঝকমক করছে। সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কর্নেল এসে গেলেন–হ্যাল্লো ডার্লিং! উঠে পড়েছ দেখছি!

একটু হেসে বললুম–মদে আমার তেমন নেশা হয় না কর্নেল!

-তাই বটে! কর্নেল মৃদু হেসে বললেন। আশা করি, তাহলে গতরাতে কীসব ঘটেছে তোমার সামনে–সব মনে আছে?

নিশ্চয় আছে।

 বলে যাও, ডার্লিং।

–পরিতোষবাবু আর আমি জমিয়ে খাচ্ছিলুম। তখন আপনি এলেন। তারপর আমরা দুজনে অ্যালবাট্রসে চলে এলুম।

কর্নেল আবার হেসে উঠলেন।

-হাসছেন যে?

হাসছি। কারণ, গতরাতে তোমার প্রচণ্ড নেশা হয়েছিল।

–প্রমাণ অনেক। তোমাকে নিয়ে সাইকেল রিকশো করে ফিরে আসছি, পথে ঝোপঝাড় আর পাথরের আড়াল থেকে একটা লোক রিভলভার থেকে গুলি ছুঁড়ল। আমাদের সৌভাগ্য, রিকশোটা জোরে যাচ্ছিল তাই লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো।

আঁতকে উঠে বললুম–সর্বনাশ!

কর্নেল বললেন–যাই হোক, আমি তৈরি ছিলাম। পাল্টা গুলি ছুঁড়ে ওর রিভলভারটা ফেলে দিলুম। হাত চেপে ধরে সে পালালো। তখন রিকশোঅলাকে বললুম– তোমাকে পৌঁছে দিতে। আর আমি সেই রিভলভারটা খুঁজে নিয়ে মিঃ বেঙ্কটেশের কাছে গেলুম। ফোরেন্সিক টেস্টে নিশ্চয় ধরা পড়ছে–ওটাই মার্ডার উয়েপন।

–এত কাণ্ড! অথচ কিচ্ছু টের পাইনি!

–পাবে কীভাবে? পরিতোষবাবু তোমাকে মাতাল করে দিতেই চেয়েছিলেন যে!

-কেন? ওঁর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?

তুমি মদে বেহুঁশ থাকলে ফেরার পথে আমাকে একা খতম করাটা খুব সহজ হবে ভেবেছিলেন!

কর্নেল, খুলে বলুন।

কর্নেল পা ছড়িয়ে বসে বললেন–জয়ন্ত, এই কেসটা ইন্সিওরেন্স-ঘটিত।

বুঝলুম না।

–পুলকেশ মৈত্রের তিনটে ইন্সিওরেন্স করা আছে তিন দেড়ে সাড়ে চার লাখ টাকার। সে মরলে টাকাটা তৃণা পায়। অতএব পুলকেশ ঠিক করেছিল, সে মরবে। আত্মহত্যার কেসে আজকাল ইন্সিওরেন্স অনেক ঝামেলা করে। কিন্তু কোথাও বেড়াতে গিয়ে খুন হলে ঝামেলা নেই। পুলকেশ ও তৃণা ঠিক করল যে নীলাপুরমে গিয়ে পুলকেশ খুন হবে। হলোও। তার মানে স্ত্রী যদি কোনও ডেড বডিকে স্বামীর বলে চালায়, অসুবিধে নেই। এবার তৃণাকে বাকিটা করতে হবে। ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে ইন্সিওরেন্সে স্বামীর টাকা ক্লেম করবে। টাকা পেয়ে যাবে। তখন পুলকেশ অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে তৃণার সঙ্গে কোনও নতুন এলাকায় পাড়ি জমাবে। আবার সে অন্য নামে, ইন্সিওর করবে। আবার খুন হবে। আবার তৃণা টাকা ক্লেম করবে–তখন সেও অবশ্য আর তৃণা নয়, অন্য নাম তাকেও নিতে হয়েছে। এটা হলো ওদের তিন নম্বর কেস। এর আগে পুলকেশ আর তৃণা ছিল অরুণ আর মাধবী।

তার আগের নাম ছিল পরিমল আর কেতকী। প্রত্যেকবারই তৃণার নির্বোধ প্রেমিকরা খুন হয়।

বাঃ! বেড়ে বুদ্ধি তো! কিন্তু এবারকার ডেড বডিটা কার?

তৃণার আরেক নির্বোধ প্রেমিক অবনী রায়ের। হাওড়াতে পুলকেশ একটা মারাত্মক ভুল করে। এ ভুল সব বুদ্ধিমান শয়তানের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। না হলে তাদের ধরা যেত না। পুলকেশ তিনটি বার্থ রিজার্ভ করেছিল একই শ্লিপে। কিন্তু এখানে পৌঁছে সে অবনীকে নিয়ে যায় দি সোয়ানে। ওখানে অবনীর নামে কিন্তু রুম বুক করা নেই। আছে পরিতোষ কারফর্মার নামে। পুলকেশ অবনীকে বলেছিল–ওর এক বন্ধু পরিতোষ কারফর্মার নামে দি সোয়ানে একটা ডাবল রুম বুক করা আছে। পরিতোষ হঠাৎ অন্য কাজে আটকে গেছে। তাই আসছে না। অতএব ওই রুমে সে থাকতে পারে। কোনও অসুবিধে হবে না। কিন্তু পরিতোষ তো একজন চাই। তা না হলে দি সোয়ান অবনীকে থাকতে দেবে কেন? অতএব পুলকেশ অবনীকে বলে–সে নিজেই বরং পরিতোষ হয়ে পরিচয় দেবে। রসিদ তো তার কাছেই আছে। এতে ব্যাপারটা দাঁড়াল বেশ মজার। পুলকেশ ধুতি-পাঞ্জাবি পরে খাঁটি বাঙালী বেশে পরিতোষ নামে দি সোয়ানে অবনীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটায়। আবার সী ভিউতে সাহেব সেজে পুলকেশ নামে স্ত্রীর কাছেও থাকে। অবনী নির্বোধ এবং তৃণার প্রেমে অন্ধ না হলে ফাঁদটা টের পেত। দি সোয়ানে তদন্ত করার পর ব্যাপারটা আমরা টের পেয়ে গেলুম।

— পুলকেশকে অ্যারেস্ট করতে পেরেছে তো পুলিশ?

–হুঁউ। গতরাতেই। দি সোয়ানে সেই ঘরটায় ব্যাটা শুয়ে কাতরাচ্ছিল। হাতে জখম। রুমাল বেঁধেও রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না। বেসিনে ডেটলের ছড়াছড়ি। তাকে অবশ্য তক্ষুণি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল।

–সব তো বুঝলুম। কিন্তু ওদের ব্যাকগ্রাউণ্ড এত শীগগির পেলেন কোথায়?

 কর্নেল অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলেন তৃণা সব কবুল করেছে।

একটু পরে বললুম–বাইনোকুলার চোখে রেখে খাড়ির ওপর যে লোকটা সী ভিউয়ের দিকে লক্ষ্য রেখেছিল, সে নিশ্চয় পুলকেশ। কিন্তু লক্ষ্য রাখত কেন?

তৃণার কাছে সংকেত পাবার জন্যে। গ্রিন সিগন্যাল পেলেই সে স্ত্রীর কাছে যেত।…..বলে কর্নেল হেসে উঠলেন।–তবেই দেখ জয়ন্ত, তোমাকে বলেছিলুম–আমার খুনের কপাল। সত্যি ডার্লিং, কোথাও বেড়াতে গিয়ে আরামে কাটাব, তার উপায় নেই। দা ইটার্নাল মার্ডারার সবসময় আমাকে অনুসরণ করে বেড়াচ্ছে।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *