২১-২৫. পার্ক স্ট্রিট এলাকায়

জেফের কাছে থেকে টাকা পয়সা বুঝে নিয়ে ট্রেসি এবার এলো পার্ক স্ট্রিট এলাকায় একটা ছোট্ট হোটেলে। কারো কাছে সে নিজের আসল পরিচয় দিতে ইচ্ছুক নয়। এই জায়গাটা মনোমত, ট্রেসির খুশি এখন আকাশছোঁয়া।

দ্বিতীয় দিন হোটেলের বেয়ারা এসে একটা হাতে লেখা চিঠি রাখলো তার সামনে।

লেখা আছে–একজন সাধারণ বন্ধু জনিয়েছেন আমরা পরস্পরের পরিচিত হলে, দুজনেরই লাভ হবে। আজ বিকেল ৪টের সময় রিৎজ হোটেলে আমার সঙ্গে চা খেতে আসতে পারবেন কি? লাল কারনেশন ফুল পরে থাকবো আমি। সইয়ের জায়গায় লেখা আছে গান্থার হারটগ।

এই নামটা কোনদিন শোনেনি ট্রেসি। শেষপর্যন্ত সে হোটেল রিৎজে পৌঁছে গেলো। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দর চেহারার বছর ষাটের এক মানুষ, দামী স্যুট, কোটের বুকে লাল কারনেশন ফুল গোঁজা।

ট্রেসি ওর টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।

ভদ্রলোক বললেন–আমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করার জন্য আমি ধন্য।

ট্রেসি বলল–কিন্তু আপনি অন্য কারোর সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলেন নি তো?

–আপনার অতীত সম্পর্কে যেটুকু শুনেছি, তাতে পৃথিবীতে একজনই ট্রেসি হুইটনি। থাকার কথা।

এই কথা শুনে ট্রেসির বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল। তার অতীত খুব একটা সুবিধার নয়, তবু সে আমতা আমতা করে বলল কী শুনেছেন আপনি?

চা খেতে খেতে কথা হল। কোনরাড মরগানের কথা উঠল। কোনরাড নাকি ট্রেসির প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

গার হারটগের জন্ম জার্মানীর মিউনিখে। বাবা ছিলেন ব্যাঙ্কার, ছোটবেলা থেকে ছবি আর প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য বস্তু জোগাড় করাই তার প্রধান সখ, মা ছিলেন ইহুদী। স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে রাজী না হওয়াতে হিটলারের ফতোয়া অনুসারে বাবা ভিখিরী হয়ে গেলেন। যুদ্ধের বোমায় দুজনে মারা যান। বন্ধু বান্ধবেরা তাকে সুইজারল্যান্ডে পাচার করে দেয়। যুদ্ধের শেষে লন্ডনে বাসা বেঁধেছেন হারটগ। প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য বস্তুর একটা দোকান আছে তার। ট্রেসি যদি ওই দোকানে আসে তাহলে তিনি খুবই খুশি হবেন।

বিল মেটাবার পর হারটগ বললেন, হ্যাঁম্পশায়রে একটা ছোট্ট বাড়ী আছে আমার। শনি-রোববার কয়েকজন বন্ধু সেখানে যাচ্ছেন, আপনি কি যাবেন?

শেষ পর্যন্ত ট্রেসি অনেক কিছু ভেবে ঠিক করলো দেখাই যাক না ওখানে গিয়ে।

দারুণ কাটলো শনি আর রোববার। ছোট্ট বাড়ি বলতে দেড়শো বিঘের ওপর একটা প্রাচীন জমিদার বাড়ি। বিপত্নীক হারটগ মাঝেমধ্যে এখানে এসে থাকেন।

অতিথিরাও কম সুন্দর নন, সস্ত্রীক একজন মন্ত্রী এসেছেন, একজন আর্ল-এর সঙ্গে পরিচয় হল। বান্ধবী নিয়ে এসেছেন একজন সেনাপতি। মোরভির মহারানী এসেছেন, সোনালী জরির কাজ করা লালপাড় শাড়ি পড়েছেন তিনি, তার ব্যবহার খুব মিষ্টি।

ফিরে আসার আগে হারটগ ট্রেসিকে বললেন–আমরা দুজন একসঙ্গে কাজ করলে কেমন হয়? ট্রেসি বলল, আপনার দোকানে?

–না, তোমাকে সেলসগার্ল হতে হবে না, তোমার যা বুদ্ধি আর ব্যক্তিত্ব, তুমি অন্য কাজ করতে পারবে।

–দেখুন হারটগ, অতীতটাকে আমি পেছনে ফেলেই চলেই এসেছি।

–কিন্তু সামনের কথা চিন্তা করেছো তো? টাকা একদিন ফুরিয়ে যাবে, আমরা দুজন পার্টনার হয়ে কাজ করতে পারি না কি? আমি বড়লোকদের নানা অনুষ্ঠানে যাতায়াত করি, শিকারে যাই, নৌকোয় করে পিকনিকে যাই। ওদের গতিবিধি আমার জানা আছে। তোমার কাজ হল আমার কাজ থেকে খবর নিয়ে দামী ঘড়ি আর গয়নাগুলো সরিয়ে নিয়ে আসা। আধাআধি বখরা কি বলো? প্রস্তাবটা কিন্তু ফেলে দেবার মতো নয়।

–আমি রাজী নই।

একদৃষ্টে ট্রেসির মুখের দিকে তাকিয়ে হারটগ বললেন–বুঝেছি, তবে যদি কোনোদিন মত পাল্টায় তাহলে দেখা কোরো।

–আমার মত কোনোদিন পাল্টাবে না।

সন্ধ্যের দিকে ট্রেসি লন্ডনে ফিরে এল। এই শহরটাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু গান্থার হারটগ ঠিকই বলেছিল, যত টাকাই থাকুক না কেন, একদিন তা ফুরিয়ে যাবেই। অতএব ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে।

আরও কয়েকটা শনি-রোববার ট্রেসি ঘুরে এলো হারটগের গ্রামের বাড়ি থেকে। এক রোববার এক পার্লামেন্ট সদস্য বললেন–আমি খাঁটি টেক্সাসবাসী কাউকে দেখিনি, কেমন হয় ওরা?

টেক্সাসের ধনবতী অহংকারী বিধবাকে নকল করে ট্রেসি সকলকে খুব হাসালো।

ট্রেসিকে হারটগ বললেন–এই নকল করার কায়দাটা কাজে লাগিয়ে কিছু রোজগার করছো না কেন?

–আমি অভিনেত্রী নই।

–নিজেকে এত ছোটো করে দেখছো কেন? লন্ডনে একটা বড়ো গয়নার দোকান আছে–পার্কার অ্যান্ড পার্কার। ওরা তোমাদের মার্কিনী ভাষার খদ্দেরদের লুফে নেয়, আমরাও তাকে জিতে নেবো।

মুখে না বললেও মনে মনে উত্তেজিত হয়ে উঠলো ট্রেসি। বুদ্ধির খেলায় অনেককেই সে হারিয়েছে, আরেকবার চেষ্টা করলে ক্ষতি কি?

অক্টোবর মাস পড়ে গেছে, লন্ডনে তখনও বেশ গরম। রাস্তায় পথিক আর টুরিস্টদের ভীড়। একটা সাদা ডেমলার গাড়ী এসে দাঁড়ালো পার্কার অ্যান্ড পার্কার জুয়েলারী শপের সামনে। চড়া মেকআপ নেওয়া স্বর্ণকেশী এক যুবতী লাফিয়ে নামলো। কোট গায়ে, দামী ভেড়ার লোমের কোট। এই গরমে কেউ কোট পড়ে না।

যুবতী প্রশ্ন করলো–এই জোড়াতালি দেওয়া জায়গাটায় ঢোকার পথ কোনদিকে? তার কণ্ঠস্বরে টেক্সাস অঞ্চলের উচ্চারণ।

–ও দিকে, সোফার জানালো। যুবতী টকটক করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। দারোয়ান দরজা খুলে সরে দাঁড়ো। তাচ্ছিল্যের ভাব দেখিয়ে কাউন্টারের সেলসম্যানকে জিজ্ঞাসা করলো, এখানে নকল পাথরের গয়না ছাড়া আর কিছু বিক্রি হয় কি?

নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলো সে।

ঠাট্টাটা গায়ে না মেখে সেলসম্যান জানতে চাইলো–কি চাই তার?

–আমার ওল্ড পি জে আমার জন্মদিনে একটা পান্না কিনতে বলেছে। ভালো কিছু আছে কি তোমাদের এখানে?

–এদিকে আসুন।

ট্রে ভর্তি পান্না বের করে কাউন্টারে রাখলো সে।

–ধুস্ এগুলো তো খোকা পান্না। এদের মা-বাবাদের সন্ধান কোথায় পাবো? সেলসম্যানের ঘাড় শক্ত হয়ে উঠল–এগুলোর দাম ত্রিশ হাজার ডলারের মতো।

–আমার হেয়ার ড্রেসারকে ওই টাকাটা বকশিস দিই। এই নুড়িগুলো নিয়ে গেলে ওল্ড পি জে অপমানিত বোধ করবে। সেলসম্যান মনে মনে কল্পনা করল টাক মাথা, ভুড়িওলা একটা লোক এই সুন্দরীর স্বামী। ধনকুবেররা অল্প বয়েসী মেয়েদের বিয়ে করে।

–কেমন দামের মধ্যে চাইছেন যদি একটা আন্দাজ দেন, বিনীতভাবে সেলসম্যান বলল।

–লাখখানেক থেকে শুরু করলে দোষ কি?

বোকার মতো তাকিয়ে রইল সেলসম্যানটি। পরে আমতা আমতা করে বলল–অত  বেশি টাকার লেনদেন আমাদের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর নিজেই করেন।

খবর দিতেই ম্যানেজিং ডাইরেক্টর গ্রেগরী হ্যালস্টন নিজেই এলেন। তিনি তার খাসকামরায় যুবতীটিকে নিয়ে গেলেন।

যুবতীটি বলল–আমি হলাম মেরী লাও বেনেক। ওল্ড পি. জে. কে চেনো? প্রথম দর্শনে তুমি বলাতে মনে মনে চটে গেলেন হ্যালস্টন।

শোকেসে ট্রে ভর্তি দামী পাথর। একটা বড়ো পাথর দেখিয়ে যুবতী বলল–ওটা বের করো।

-ম্যাডামের রুচির প্রশংসা করতে হয়, এটা দশ ক্যারেট ওজনের ঘাস-সবুজ কোলম্বিয়ান পান্না।

–পান্না কখনো নিখুঁত হয় না। হ্যালস্টন থতমত খেয়ে গেলেন–তা ঠিক। তবে কিন…। এই প্রথম হ্যালস্টন লক্ষ্য করলেন যে যুবতীর দুটি চোখ পান্নার মতো সবুজ।

অন্য আরও কিছু দেখবেন?

এটাই নেবো সোনামনি, যুবতীর বেহায়াপনায় লজ্জা পেলেন ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না।

–দামটা পড়বে একলাখ ডলার। দামটা কিভাবে দেবেন?

–চেকে। আমার এখানে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে, পরে ওল্ড পি. জে. র কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে দেবো।

–ঠিক আছে ম্যাডাম, আমি পাথরটা পরিষ্কার করে কাল আপনাকে ডেলিভারী দিয়ে দেবো।

অচেনা লোকের হাতে এত দামী পাথরটি কখনই দেবেন না, তাছাড়া ঠকতে তিনি রাজী নন, আজ পর্যন্ত তাকে কেউ ঠকাতে পারেনি।

কোন হোটেলে পাথরটা ডেলিভারী দিতে হবে তা হ্যালস্টন জেনে নিলেন। যুবতী খসখস করে চেক লিখে দিয়ে চলে গেলেন।

সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কে ফোন করলেন হ্যালস্টন, মিসেস মেরী লাও বেনেকের নামে কোনো অ্যাকাউন্ট আছে কিনা? থাকলে কত টাকা আছে?

ব্যাঙ্ক জানালো লাখ ডলারের অনেক বেশী টাকা জমা আছে অ্যাকাউন্টে। এই খবর পেয়ে নিশ্চিন্ত হলেন হ্যালস্টন।

সকালে চেকের টাকা তোলা হল, পান্না পৌঁছে গেল হোটেলে।

বিকেলে মিসেস বেনেক আবার পৌঁছলেন গ্রেগরী হ্যালস্টনের কাছে। এই মার্কিন মেয়ে মানুষগুলো একেবারে বাজে, বিশেষ করে টেক্সাসের, তিনি ওই পান্নাটা ফেরত দিতে এসেছেন। উপায় নেই, মুখে হাসি ফুটিয়ে সেলসম্যান বললো, আপনার স্বামী বোধহয় পান্নাটা পছন্দ করেন নি তাই তো?

–তোমার ধারণাটাই ভুল গঙ্গারাম, ওল্ড পি. জে পাথরটা দেখে পাগল হয়ে গেছে।

এবার সরাসরি হ্যালস্টনের ডাক পড়লো। তিনি এসে বললেন, কি ম্যাডাম, আমি আপনাকে কি ভাবে সাহায্য করতে পারি?

–আমাকে ওই ধরনের আরেকটি পান্না দিতে হবে।

–দুঃখিত ম্যাডাম, ওটার জোড়া নেই।

–ওসব কোনো কথা শুনতে চাই না, জোড়া থাকতে বাধ্য, সেটা আমার চাই-ই। দাম যা লাগে ওল্ড পি. জে. দেবে। আগামী শনিবার আমার জন্মদিন। ওইরকম পান্নার দুল পড়তে হবে। যদি সেটার জন্য দুলাখ তিন লাখ ডলার লাগে তাও দিতে আপত্তি নেই।

যুবতীয় কথায় হ্যালস্টনের চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। দু-লাখে বিক্রি করতে পরলে কোম্পানীকে একলাখ দিয়ে তিনি একলাখ পকেটে পুরবেন।

হ্যালস্টনকে ইতস্ততঃ করতে দেখে যুবতী বলল–কাগজে বিজ্ঞপন দিন, আমরা সাড়ে তিন লাখ ডলার পর্যন্ত উঠবো।

মিসেস বেনেক চলে গেলেন, অনেকক্ষণ পর্যন্ত হ্যালস্টন চেয়ার থেকে উঠতে পারছিলেন । রাতারাতি বড়োলোক হবার সুযোগ আজ তার হাতে এসেছে। এক লাখ কোম্পানীর তহবিলে জমা দিলে তঞ্চকতাও করা হল না আবার আড়াই লাখ ডলার তার পকেটে চলে আসবে।

 কিন্তু এই ধরনের পাথর কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে? শেষপর্যন্ত লন্ডন টাইমস আর ফাইন্যান্সিয়্যল টাইমস এ বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে চিঠি পেল শত শত। কিন্তু কোনোটাই আগের মতো নয়।

থেকে থেকে মিসেস বেনেক ফোন করে বিরক্ত করছে হ্যালস্টনকে। শুক্রবারে ফোন করে সে জানালো কাল আমার জন্মদিন। তার মধ্যে পাথরটা পাওয়া যাবে নিশ্চয়। তা

হলে পান্নাটা ফেরৎ দেবো। একটাতে আমার কোনো কাজ হবে না। মিস্টার হ্যালস্টন ঘামতে শুরু করে দিলেন। বললেন–আমরা দেখছি।

–দেখা দেখির কিছু নেই। ওল্ড পি. জে. চার লাখ পর্যন্ত দেবে কিন্তু কালকের মধ্যে চাই।

চারলাখ? তার মানে তিন লক্ষ ডলার সরাসরি লাভ হবে। হ্যালস্টনের পাগল হবার জোগাড়। সকাল থেকেই ফোন বেজে চলেছে।–

–হ্যালো। মিষ্টি গলার এক মহিলা অভিবাদন জানালেন ফোনে। কথার টানে বোঝা গেল ইনি ইতালীয়ান।

–বিজ্ঞাপনে দেখলাম আপনি একটা পান্না খুঁজছেন?

–হ্যাঁ চাই।

–আমার কাছে পারিবারিক সূত্রে পাওয়া একটা দামী পান্না আছে। সিনর আপনি তো দশ ক্যারেটের পান্না খুঁজছেন?

–হ্যাঁ।

–আমার কাছে যেটা আছে সেটা ঘাস-সবুজ রঙের কোলাম্বিয়ান পান্না।

হ্যালস্টন নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না, ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন তিনি, কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করা চলবে না।

মহিলা একজন ইতালীয় কাউন্টেস। শেষপর্যন্ত হ্যালস্টন নিজেই ছুটলেন কাউন্টেসের হোটেলে।

ট্যাক্সিতে বসে আকাশকুসুম কল্পনা করতে লাগলেন তিনি। পাথরটা যদি ঠিক হয় তাহলে তিন লাখ ডলারের মুনাফা কে আটকাবে? ভালো জায়গাতে বাড়ি কিনবেন অথচ কেউ ধরতে পারবে না, একটা পালতোলা নৌকো তার চাই। হ্যালস্টন ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন, অথচ এই মুহূর্তে ভগবানের নাম জপ করতে থাকলেন।

নম্বর মিলিয়ে দরজায় টোকা দিলেন, কিছুক্ষণ বাদে জমকালো চেহারার এক মহিলা সামনে এসে দাঁড়ালেন। বয়েস ৫০-এর কোঠায়, কালো চুলে সোনালী ফিতে, মুখে বয়েসের চিহ্ন।

ভারী মিষ্টি গলা মহিলার। তিনি বললেন–বসুন।

–আমি গ্রেরী হ্যালস্টন। আপনি আমাকে টেলিফোন করেছিলেন।

–হ্যাঁ, আমি কাউন্টেস মারিয়া। আপনি ভিতরে আসুন সিনর।

হ্যালস্টনের আর তর সইছে না, বসতে বসতেই বললেন, পান্নাটা কোথায়?

–বসুন দয়া করে। আমি আবার ভালোভাবে ইংরেজী বলতে পারি না।

–না না আপনি সুন্দর ইংরাজী বলেন, এবার অবান্তর কথা থামাতে চাইছেন হ্যালস্টন। বৃদ্ধা বলেই চলেছেন; কোথা থেকে পান্নাটা পেয়েছেন, স্বামীর অত্যন্ত আপত্তি কিন্তু তিনি এটাকে বিক্রি করবেন। স্বামীর বিপদের দিনে স্ত্রী-তে সাহায্য করবেই।

–পান্নাটা আছে কোথায়?

–এই যে, পকেট থেকে টিসু কাগজে মোড়া পান্নাটা বের করলেন কাউন্টেস। চোখ ঠিকরে গেল হ্যালস্টনের। তিনি বুঝতে পারলেন, এটা ওই পান্নাটার জোড়া, দারুণ চোখ

আছে তার, অন্য কেউ হলে হয়তো ভাবতো ওই পাথরটাই এখানে এসে গেছে।

–আমার এক বন্ধুর স্ত্রীর কাছে এই রকম একটি পাথর আছে। তাই তার জোড়াটা কেনবার জন্য তারা পাগল। এর জন্য যাট হাজার ডলার পর্যন্ত দিতে রাজী।

কাউন্টেস দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন–৬০ হাজারে বিক্রি করলে আমার দিদিমা কবর থেকে উঠে এসে আমাকে ভয় দেখাবেন।

হ্যালস্টন ধীরে ধীরে বাড়তে চান, বেশি লোভ দেখিয়ে ফেললে মুশকিল।

–দরকার পড়লে এক লাখ পর্যন্ত উঠবে।

–কিন্তু তাতেও আমার সমস্যা মিটবে না, আমার স্বামী একটা ব্যবসা করতে যাচ্ছেন, কমপক্ষে আড়াই লাখ ডলার লাগবে।

হ্যালস্টন উঠে পড়লেন, না, অতো দিতে পারবো না।

–দুঃখিত, আপনি এত কষ্ট করে এলেন।

শেষ অবধি বাধ্য হয়েই আড়াই লাখে কিনলেন। তাতেও দেড়লাখ লাভ থাকবে।

চেক লেখা হয়ে গেলে পাথরটা নিয়ে বিজয়ীর গর্বে হোটেল থেকে বেরিয়ে দোকানে এলেন হ্যালস্টন। মিসেস বেনেককে ফোন করতে হবে।

মিসেস বেনেকের হোটেলে ফোন করে জানতে পারলেন তারা সকলেই চলে গেছেন এবং কোথায় গেছেন তার ঠিকানা জানিয়ে যাননি। তখন হ্যালস্টনের মাথাটা ঘুরে গেল।

তাড়াতাড়ি কাউন্টেস মারিয়াকে ফোন করলেন। পান্না ফেরৎ দিতে হতে পারে। হোটেলের ক্লার্ক জানালো একটু আগে বিল মিটিয়ে উনি চলে গেছেন।

এবার ব্যাঙ্কে ফোন করে আড়াই লাখের চেকটাকে আটকাতে হবে, কিন্তু ফোন করে । জানতে পারলেন একটু আগে চেকের পেমেন্টটাও হয়ে গেছে।

এবার হ্যালস্টন বুঝতে পারলেন যে পান্নাটা উনি এক লাখে বিক্রি করেছিলেন, সেটাকেই আবার আড়াই লাখে কিনেছেন। পার্কার ব্রাদার্সকে কি বলবেন সেটা ঠিক করতে না পেরে ঘামতে শুরু করলেন মিঃ হ্যালস্টন।

.

২২.

এবার নতুন জীবন শুরু হয়েছে ট্রেসির। ৪৫ নং ইটন স্কোয়ারে পুরনো দিনের একটি জর্জিয়ান বাড়ি কিনেছে সে। সামনে পেছনে বাগান, গান্থার হারটগের সাহায্য নিয়ে বাড়িটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছে।

হারটগ ট্রেসির পরিচয় দিয়েছে একজন ধনী বিধবা হিসাবে, যার স্বামী ছিল বড়ো ব্যবসাদার। ট্রেসি ধীরে ধীরে সকলের মন জয় করে ফেলল। নানা আসরে তার নিমন্ত্রণ আসছে।

অবসর সময়ে ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ইটালী ঘুরে এল। প্রত্যেকটি সফর শেষে ট্রেসি আর হারটগ লাভবান হতে লাগলো।

হারটগ ট্রেসিকে নানা জিনিস শেখাতে শুরু করল। নানা রকম ছদ্মবেশ ধারণ করা শিখলো সে, তার ইতিমধ্যে আধ ডজন পাসপোর্ট করানো হয়েছে। আয়ের অংক বাড়তে সিডনি সেলর্ডন রচনাসমগ্র লাগলো হু হু করে, একটা তহবিল গড়ে তুলে বিভিন্ন মহিলা কয়েদীদের সাহায্য করছে সে।

অটো স্মিটকে মাসোহারা পাঠানোও ছিল তার অবশ্য কর্তব্য। বুদ্ধিমান লোকদের বার বার বোকা বানাতে সে খুবই ভালোবাসতো। কিন্তু নিরপরাধ লোকদের সে কোনো ক্ষতি করতো না।

সমস্ত ইউরোপের খবরের কাগজে তখন ট্রেসি হয়ে উঠেছে মূল আকর্ষণ। কেউ তার আসল পরিচয় জানে না। কিন্তু কীভাবে একটির পর একটি অবিশ্বাস্য অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, কোনো কিনারা হচ্ছে না। ট্রেসি বিভিন্ন ছদ্মবেশে কাজ করত বলে পুলিশের ধারণা হয়েছিল, নানা অপরাধী কাজগুলো করছে। অবশেষে ইন্টারপোলকে নাক গলাতে হল।

–দারুণ সমস্যায় পড়েছি আমরা। ইউরোপের বহু মক্কেল আমাদের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে মেয়েদের একটা দল ও দেশে দারুণ ঝামেলা পাকাচ্ছে। দলটাকে ধরতে হবে। ইন্টারপোল আমাদের সাহায্য করবে। তোমার ওপর দায়িত্ব দিলাম। কাল সকালে তোমাকে প্যারিস ছুটতে হবে।

লন্ডনের একটা ছোটো হোটেলে বসে হারটগ আর ট্রেসি ডিনার খাচ্ছিল।

–ম্যাক্সিমিলিয়ান পিয়ের পন্তের নাম শুনেছে ট্রেসি?

নামটা শোনা শোনা লাগলো। হ্যাঁ মনে পড়েছে জেফ স্টিভেন্স, কুইন এলিজাবেথ। জাহাজের খুব ধনী লোক তাই না?

–ভীষণ নিষ্ঠুর, ওর কাজই হল বড়ো বড়ো কোম্পানী কেনা এবং সেগুলোকে চুষে • নিয়ে ফিরয়ে দেওয়া।

জো রোমানো ব্যবসাটা নিয়েছিল, পুরনো লোকদের ছাঁটাই করে দিয়ে নিজের লোকদের নিয়ে এল। তারপর কোম্পানীটাকে আঁঝরা করে ফিরিয়ে দিয়েছে। শেষে সব নিয়েছে, ব্যবসা, বাড়ী, তোমার মার গাড়ীটাও।

অটো স্মিটের কথাগুলো মনে পড়ে গেল ট্রেসির।

–ট্রেসি, তুমি কি অসুস্থ বোধ করছো?

–না, ঠিক আছে। এই ম্যাক্সিমিলিয়ানের কথা আরও খুঁটিয়ে বলল, আমাকে।

–তৃতীয় স্ত্রীকে ডিভোর্স করেছে। এখনও বিয়ে করেনি। এর সঙ্গে আলাপ জমালে কিছু একটা হবে বলে আমরা বিশ্বাস। ম্যাক্সিমিলিয়ান আগামী শুক্রবার ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের মতো বিখ্যাত ট্রেনে চেপে লন্ডন থেকে ইস্তামবুল যাবে।

–ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস? আমি সেটাতে কখনও চড়িনি। একবার যাব।

–বেশ বেশ, ম্যাক্সিমিলিয়ানের দামী রত্নের কালেকশন একমাত্র লেনিনগ্রাডের হারমিটেজ যাদুঘরের পরেই। কুড়ি কোটি ডলার দাম আছে তার। তার থেকে কয়েকটা যদি আনতে পারো।

ট্রেসি হাসি মুখে বলল–দেখি।

ম্যাক্সিমিলিয়ান যদি সুবিধার না হয় তাহলে আরও দুজন যাচ্ছে, ইতালীর বিখ্যাত চিত্র-তারকা অভিনেত্রী সিলভানা লুয়াডি। তাকে চেনো তো?

–সকলেই চেনে তাকে।

–অভিনেত্রী সিলভানা আলবের্তো ফোরনাতিকে বিয়ে করেছে। ফোরনাতি বিখ্যাত ছবির প্রযোজক। সে টাকার লোভ দেখিয়ে পরিচালকদের কজা করে। লাভের টাকা নিজের পকেটে ঢালে। আর সব টাকা দিয়ে বৌকে গয়না গড়িয়ে দেয়।

আশা করি এদের তোমার ভালো লাগবে।

ট্রেসি একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, দেখা যাক কি হয়?

শুক্রবার, সকাল ১১টা বেজে ৪০ মিনিট। লন্ডন ভিক্টোরিয়া স্টেশন থেকে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ছাড়ে। যায় ইস্তামবুল। মাঝে মাত্র ৫টা স্টেশন–বুলো, প্যারিস, লাউসানে, মিলান এবং ভেনিস।

দুজন লম্বা চওড়া চেহারার উর্দি পরা লোক প্ল্যাটফর্মে একটা লাল কর্পেট বিছিয়ে দিল। দীর্ঘদিন বাদে আবার ওই ঐতিহ্যবাহী ট্রেনটি নতুন করে চালু হয়েছে। ১৯২০ দশকের মতো করেই একে সাজানো হয়েছে, খাঁটি ব্রিটিশ প্রথায় রেস্টুরেন্ট, বার-সেলুন সবই আছে। সমুদ্রনীল উর্দি পরা দুজন কুলী ট্রেসির সামনে ছোট্ট সুটকেসটা নিয়ে হাঁটছিল। ট্রেসির ছোট্টা কামরায় পৌঁছে দিয়ে তারা চলে গেল।

ঠিক সময়ে ট্রেন ছাড়ল। দুপুর ১টা বেজে ১৫ মিনিটে কোকস্টোন বন্দরের যাত্রীরা ওই ট্রেন ছেড়ে স্টীমারে উঠল। তারা ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে বুলো পৌঁছালো। আরেকটা ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে চাপলো।

ট্রেসি একজন অ্যাটেনডেন্টকে জিজ্ঞাসা করলো–শুনেছি এই-ট্রেনে ম্যাক্সিমিলিয়ান পিয়ের পন্ত যাচ্ছেন? তার সঙ্গে আমার একটু দেখা করতে হবে।

মাথা নেড়ে ছেলেটি বলল–কেবিন বুক করাই ছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি আসেন নি।

ট্রেসি হতাশ হল, তাহলে বাকি রইল সিলভানা লুয়াডি আর তার স্বামী ফোরনাতি।

বুলোতে নতুন ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে একই রকম কামরা পেল ট্রেসি। সারাদিন ধরে পরিকল্পনা ভাবতে লাগল। অত্যন্ত দামী গাউনের সঙ্গে ম্যাচ করা মুক্তোর নেকলেস পড়েছে। শেষ বারের মতো আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল সে। চোখে মুখে কিশোরীর সারল্য। এবার চারপাশটা দেখলো। তালাগুলো দেখে নিল ভালোভাবে। একটা ইয়েন তালা অন্যটা ইউনিভার্সাল।

ট্রেনে তিনটা ডাইনিং কার, তিনটিই সাজানো। প্রথমটিতে কয়েকটা সিট খালি ছিল। ট্রেসির চোখ কাউকে বোধহয় খুঁজছে। তৃতীয় ডাইনিং কারটাতে সে এল। একটা টেবিলের কাছে এসে বলল মাফ করবেন, এখানে কি একটু বসতে পারি?

পুরুষটি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল–বসুন, আমি হলাম আলবের্তো ফোরনাতি আর এই আমার স্ত্রী সিলভানা লুয়াডি।

বসতে বসতে ট্রেসি নিজের নাম জানালো।

–আহ…আমেরিকান, আই স্পিক দি একসেলেন্ট ইংলিশ।

আলবের্তো ফোরনাতি বেঁটে, মোটা, মাথায় টাক আছে। সিলভানা লুয়াডি যে কেন একে বিয়ে করলেন, বারো বছর ধরে দাম্পত্য জীবন কাটচ্ছেন কী করে তা সব সাংবাদিকদের কাছে বিস্ময়ের বস্তু। ওই অভিনেত্রী অপরূপা সুন্দরী। হাজার হাজার শব্দ খরচ করেও তার সৌন্দর্যের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। একবার অস্কার এবং একবার রুপোর। পাত্র পুরস্কার পেয়েছেন। গায়ে দামী গয়না, হারটনের কথা মনে পড়ে গেল ট্রেসির।

ফোরনাতি অনেক মজার গল্প শুরু করে দিলেন। জানতে চাইলেন ট্রেসির পরিচয়। ট্রেসি নিজেকে ট্যুরিস্ট হিসাবে পরিচয় করালো। সিলভানার এসব কথাবার্তা ভালো লাগছিল না। কথা বলতে বলতে ফোরনাতি এমনভাবে হাত নাড়ালেন যে সসের পাত্রটা তার স্ত্রীর কোলে গিয়ে পড়ল। এত দামী গাউনটা বিশ্রীভাবে নোংরা হয়ে গেল। সিলভানা খুবই রেগে গেলেন, ডাইনিং কার থেকে বেরিয়ে গেলেন। ট্রেসির বুঝতে বাকি রইল না এ হল ফোরনাতির ইচ্ছাকৃত ব্যাপার।

–ছিঃ ছিঃ, এটা কি হল বলুন তো?

–ছেড়ে দিন, ফোরনাতি আবার তার বউকে দামী গাউন কিনে দেবে, বলতে বলতে টেবিলের তলায় হাত বাড়িয়ে ট্রেসির উরুতে হাত বোলাতে লাগেন ফোরনাতি।

–মেয়েরা ফোরনাতিকে ভীষণ পছন্দ করে, আর যারা ফোরনাতিকে পছন্দ করে, ফোরতিও তাদেরকে পছন্দ করেন-বার বার নিজের নামটা এই তালিকাতে ঢোকানোর জন্য ট্রেসি অধীর হয়ে উঠলো, আপনি খুব ভালো, ট্রেসির কথা শেষ হবার আগেই উচ্ছ্বসিত। হয়ে উঠলো ফোরনাতি।

–আজ রাতের বেলায় যাব, তোমার কেবিনে আলোচনা করতে, ইতিমধ্যে আপনি থেকে সম্বোধন তুমিতে নেমে এসেছে। কথায় কথায় ট্রেসি জেনে নিল যে ৭০ নম্বর কেবিনে ফোরনাতি আছে।

অন্ধকারের বুক চিরে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ছুটে চলেছে। কখন প্যারিস ছেড়ে গেছে কেউ জানে না। সবাই নিজস্ব পাসপোর্ট জমা দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছ।

রাত তখন প্রায় সাড়ে তিনটে, ট্রেন এবার সুইজারল্যান্ডের সীমান্ত অতিক্রম করবে, ভোর ৫টা বেজে ২১ মিনিটে লাউসানে পৌঁছাবে, সওয়া-নটার সময় পৌঁছাবে ইতালীর মিলান শহরে।

ট্রেসির হাতে একটা স্পঞ্জ ব্যাগ, মনের ভেতর যে উত্তেজনার পারদ মাত্রা চড়চড় করে চড়ছে সেটাকে দমন করে সে এগিয়ে চলেছে। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে বাথরুমে যাচ্ছে। ভোর রাত, পাহারাদাররা সবাই নিদ্রামগ্ন।

৭০ নম্বর কেবিনে পৌঁছে ট্রেসি স্পঞ্জের ব্যাগ থেকে শিশি আর সিরিঞ্জ বের করল। ঠিক দশ মিনিট বাদে নিজের কেবিনে ফিরে এল সে, ঠোঁটে হাসি, তারপর সে ঘুমিয়ে পড়লো।

সকাল সাতটা, মিলানে পৌঁছবার দুঘন্টা আগে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে ভীষণ চীৎকার শোনা গেল। সবাই ছুটে গেল ৭০ নম্বর কেবিনে। কনডাকটর গার্ডকে দেখে সিলভানা লুয়াডি পাগলের মতো চেঁচিয়ে উঠলেন, আমার সব গয়না চুরি হয়ে গেছে। এই হতভাগ্য ট্রেনটা চোরে ভরতি।

অনেক সাধ্য সাধনা করে তাকে শান্ত করার পর জানা গেল যে তার দশলাখ ডলারের গয়না লোপাট হয়ে গেছে। কিন্তু তা কী করে সম্ভব?

ফোরনাতি কিছুতেই মানতে রাজী হলেন না। তার ঘুম খুব পাতলা, কেউ ঢুকলে তিনি নিশ্চয় জানতে পারবেন।

কন্ডাক্টর এর মধ্যে সব কিছু বুঝে ফেলেছেন। সিরিঞ্জ করে তালার ফুটোর মধ্যে অজ্ঞান করার ইথার ঢুকিয়ে দিয়ে চুরি করা হয়েছে। এই পদ্ধতি নতুন নয়, আগেও এই ধরনের চুরি হয়েছে। তবে এবারের কেসটা আলাদা, ট্রেন থামার আগে চুরি হয়েছে অর্থাৎ চোর এই ট্রেনের মধ্যেই আছে। তাড়াতাড়ি মিলান পুলিশের কাছে খবর গেল।

কুড়িজন পোশাক পরা পুলিশ মিলান প্ল্যাটফর্ম পাহারা দিচ্ছিল। ভারপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টারের নাম লুইগ রিক্কি। ট্রেন থামতেই সে চলে এল ফোরনাতির কেবিনে। জুয়েল বক্সটা নেড়েচেড়ে দেখলো। চাবির গর্তে নাক লাগিয়ে শুঁকতেই ইথারের গন্ধ পাওয়া গেল। যদিও খুব ক্ষীণ, তবু বুঝতে পারলো চোরকে ধরা সম্ভব।

প্রত্যেকটা প্যাসেঞ্জারকে স্টেশনের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে তল্লাসী করা শুরু করা হল। তাদের কেবিন তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতে লাগল পুলিশরা। রিকি স্বপ্ন দেখল এই চুরি কিনারা সে করবেই, তার ফলে একটা বড়ো প্রমোশন তার বাঁধা।

ট্রেসির কেবিনেও তল্লাসী করা হল। পুরো চারঘন্টা ধরে তল্লাসীর পর কয়েক প্যাকেট ম্যারিজুয়ানা, পাঁচ ভোলা কোকেন, একটা বড়ো ছুরি আর বিনা লাইসেন্সের একটা পিস্তল পাওয়া গেল।

আবার তল্লাসী শুরু হল, যাত্রীরা সবাই ক্ষেপে গেলেন। ট্রেন আর কতক্ষণ আটকে থাকবে? শেষপর্যন্ত বোঝালেন চোর গয়নাগুলো কোনো স্টেশনের জানলা দিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছে। সেখানে হয়তো তার সাকরেদ আগে থেকেই দাঁড়িয়েছিল। সে লুফে নিয়েছে। ব্যস, এভাবেই চুরির কেসটা সমাধান করা হল।

করিডরে ট্রেসির সঙ্গে আবার ফোরনাতির দেখা হল।

–না না এতে দুঃখের কি আছে, ফোরনাতির কাছে এটা এমন কোনো ক্ষতি নয়, ভেনিসের কথাটা মনে আছে তো? আমি তোমাকে ভেনিস ঘুরিয়ে দেখাবো।

সলজ্জ ভঙ্গিতে ট্রেসি বলল–সে কথা ভুলি কেমন করে? আমি তো ভীষণভাবে উদগ্রীব হয়ে আছি।

ভেনিসে সবাই গাড়ি থেকে নামলো। ট্রেসি তার সামান্য সুটকেসটা নিয়ে এয়ারপোর্টে চলে গেল। তারপর লন্ডনে, সঙ্গে আছে সিলভানার সমস্ত গয়না। এ খবর শুনে গান্থার হারটগ নিশ্চয়ই খুশি হবে।

.

২৩.

প্যারিস থেকে ছমাইল দূরে একটা পাহাড় ঘেরা জায়গাতে আমরা চলে এসেছি। এখানেই ইন্টারপোলের সাততলায় হেড অফিসটা অবস্থিত। দারুণ সুরক্ষিত, সর্বত্র ক্লোজ-সার্কিট টিভি ফিট করা আছে। ঘড়ির কাঁটা ধরে কড়া পাহারা চলে।

এখানে পৃথিবীর আড়াই কোটি অপরাধীর খুঁটিনাটি বিবরণ সমেত ফাইল সংরক্ষিত আছে। মে মাসের সকালের দিকে এখানকার ইনচার্জ ইন্সপেক্টর আঁদ্রে ট্রিগনান্টের ব্রিফিং হচ্ছিল। বয়েস ৪০-৪৫ এর মধ্যে, সুন্দর চেহারা, নির্মেঘ ছবি, চোখে বুদ্ধিমত্তার ছাপ। তার সামনে বসেছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলিজিয়াম আর ইতালীর ডিটেকটিভরা।

ট্রিগনান্ট বলতে শুরু করলেন–ইউরোপে এক বিশেষ ধরনের অপরাধ ঘটে চলেছে। বিভিন্ন পদ্ধতিতে মানুষকে প্রতারণা করা হচ্ছে এবং চুরি হচ্ছে। খবরে প্রকাশ কয়েকজন নারী এর পেছনে আছে।

এবার ট্রিগনান্ট সুইচটিপে স্লাইডের মাধ্যমে ছবি দেখতে লাগলেন। প্রথমেই সোনালী চুলের এক মহিলার মুখ ভেসে উঠলো। কারোর বা লাল চুল, কারুর চুল কালো, কেউ যুবতী, কেউ বৃদ্ধা, কেউ ইংরেজ অথবা কেউ ফরাসী। কেউ টেক্সাসের লোক। এরা কিন্তু কোথাও খুন জখম করেনি অথচ নিখুঁতভাবে কাজ করে চলেছে। ওইসব অপরাধীদের সম্পর্কে সামান্যতম সূত্র ইন্টারপোলের হাতে আসছে না।

ঠিক তখন দ্য গল এয়ারপোর্টে প্লেন থেকে নামল ড্যানিয়েল কুপার। ট্রিগনান্টের লোক ছিল, সেখান থেকে ড্যানিয়েল কুপারকে জর্জ ফিফথ হোটেলে নিয়ে আসা হল।

ড্যানিয়েল কুপার কিন্তু ফ্রান্সে আসতে চায়নি, প্রায় জোর করেই তাকে এখানে পাঠানো, হয়েছে।

হোটেলের ঘরে ঢুকে সে প্রথমে বাথরুমে গেল। তারপর সুটকেসের তলায় সুটের মাঝখানে রাখা একটা সরু বাক্স ছিল, সেটাকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। বাক্সটা থেকে বের করল, হলদে হয়ে যাওয়া বিবর্ণ এক টুকরো খবরের কাগজের অংশ।

সেখানে কি লেখা আছে? লেখা আছে খুনের বিচারে বালকের সাক্ষ্য। ফ্রেড জিমারের বিচারে সাক্ষ্য দিয়েছে। জিমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ সে ড্যানিয়েল কুপারের মাকে ধর্ষণ করার পর হত্যা করেছে। বালকটির সাক্ষ্য অনুসারে সে স্কুল থেকে ফেরার সময়ে দেখে পাশের বাড়ির প্রতিবেশী ফ্রেড জিমার হাতে ও মুখে রক্ত মাখা অবস্থায় তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির মধ্যে ঢুকে ড্যানিয়েল দেখতে পায় তার মা বাথরুমে পড়ে আছেন। দেহে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন এবং সেখান থেকে হু হু করে রক্ত বের হচ্ছে।

জিমার ড্যানিয়েল কুপারের মায়ের সঙ্গে অবৈধ প্রেমের কথা স্বীকার করেছে কিন্তু তার বক্তব্য সে খুন করেনি। ছেলেটিকে তার পিসীর তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে।

কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটাকে ভাজ করে আবার বাক্সের মধ্যে পুরে রাখলো ড্যানিয়েল কুপার, চোখ বন্ধ করলো, আবার চোখ খুলল। বাথটবের রক্তলাল জলে তার মায়ের নগ্ন মৃতদেহ ভাসছে, মাথা ঘুরে যেতেই কোনোরকমে মেঝেতে বসে পড়লো ড্যানিয়েল। তারপর? নেমে পড়লো রক্তের উষ্ণতায় ভরা সেই বাথটবের মধ্যে।

ইন্সপেক্টর ট্রিগনা বলছিলেন–আমি আপনাকে আগে থেকেই বলে রাখতে চাই মিঃ কুপার, আপনার এইভাবে আসাটা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। আপনি পুলিশ দপ্তরের লোক নন।

বীমা কোম্পানীর নিযুক্ত একজন ডিটেকটিভ মাত্র। তবুও সকলের বিশেষ অনুরোধে এই ব্যাপারে আপনাকে আমি সহযোগিতা করব।

ড্যানিয়েল কুপার উত্তর দিল না। বলল–বেশ কিছু মক্কেল আমাদের সমিতির কাছে নালিশ জানিয়েছেন কিন্তু আপনারা এখনও পর্যন্ত কোনো সূত্র পাননি।

মাথা নাড়লেন ইন্সপেক্টর ট্রিগনান্ট।

ইন্সপেক্টর ট্রিগনান্টকে একধিক প্রশ্ন করলেন ড্যনিয়েল কুপার। ট্রিগনান্ট বুঝতে পারলেন, লেকাটাকে দেখে বোকাসোকা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তার মাথায় বুদ্ধির কারখানা।

শেষ পর্যন্ত ট্রিগনান্ট ড্যানিয়েলের কাছে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের গয়না চুরির কথাটা বললেন। চুরিটা কীভাবে হয়েছে, সেটা কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি।

ড্যানিয়েল বার বার বলল আসল লোকের মালপত্র তল্লাসী করা হয়নি। চোর ভালোভাবেই জানতো সবার মালপত্র তল্লাসী হবে, হবে না শুধু তারই যার জিনিস চুরি গেছে। আমার মনে হয় চোরের কাছে সিলভানা লুয়াডির সুটকেসের মতো কোনো সুটকেস ছিল। ভেনিসের প্ল্যাটফর্মে নিজের সুটকেসের সাথে ওই সুটকেসটা সে পাল্টে নিয়েছে।

ইন্সপেক্টর ট্রিগনান্ট ফোরনাতিকে ফোন করলেন। জানতে চাইলেন–ওইদিন আপনাদের মালপত্রে কিছু অস্বাভাবিকত্ব দেখা দিয়েছে কি?

–হ্যাঁ, কেন বলুন তো? বাড়িতে ফিরে দেখি আমার স্ত্রীর একটা সুটকেসে খালি বাজে কাগজপত্র পোরা। আসল সুটকেসটা আপনারা পেয়েছেন নাকি?

–না, স্যার, পেলে জানাবো। টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে গুম হয়ে গেলেন ট্রিগনান্ট, এই ড্যানিয়েল কুপার লোকটা দেখতে কুৎসিত, কিন্তু এর মাথাটা এত পরিষ্কার হল কি করে?

.

২৪.

ইটন স্কোয়ারের ট্রেসির বাড়িটা দেখলে একটা স্বর্গ বলে ভুল হতে পারে। লন্ডনের কাছেই অভিজাত এলাকার বাসিন্দা হতে পেরে সে মনে মনে ভাগ্যকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিল। এখানে সবই ভালো, মানুষজন পরিবেশ সবকিছু। ব্যাঙ্কে মোটা অর্থ জমিয়েছে ট্রেসি। ইউরোপের বেশির ভাগ শহরের ব্যাঙ্কে টাকাটা ছড়িয়ে দিয়েছে। সবই আছে তার, নেই ভালোবাসার মানুষ, সুখের সংসার, নরম চেহারার শিশু। তার অতীত এবং বর্তমান নিশ্চয় তাকে এই ধরনের নিরাপত্তার পরিপূর্ণ জীবনের সন্ধান দেবে না। ঠিক আছে এই নিঃসঙ্গতার মধ্যেই জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দেবে সে।

ভেনিস থেকে ফেরার পর সে আগামীকাল সন্ধ্যেবেলা একটা ককটেল পার্টি দেবে।

হারটগ বেশ হাসিমুখে বলল–তুমি ঠিক পথেই এগোচ্ছ ট্রেসি, কাল কারা কারা আসছে?

–অনেকেই।

এই অনেকের মধ্যে একজন হলেন অল্প বয়সী, সুন্দরী, ধনী ব্যারনেস হাওয়ার্থ। ট্রেসি মুখে হাসি ফুটিয়ে তকে অভ্যর্থনা জানালো। কিন্তু ব্যারনেসের সঙ্গীটিকে দেখে তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সে হচ্ছে জেফ স্টিভেন্স।

–ট্রেসি তোমার সঙ্গে স্টিভেন্সের পরিচয় নেই বলে মনে হচ্ছে, আর ইনি হলেন মিসেস ট্রেসি হুইটনি, আমরা এরই অতিথি।

জেফ এগিয়ে এসে ট্রেসির সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বলল–মিসেস হুইটনি, আমি আপনার স্বামীর বন্ধু। আমরা একসঙ্গে ভারতে ছিলাম।

–তাই নাকি, ভারী মজার ব্যাপার, ব্যারনেস খুশি হয়ে উঠলেন।

–কি আশ্চর্য, ওর মুখে কখনও আপনার নাম শুনিনি? ট্রেসি নিস্পৃহ গলায় বলল।

–তাই নাকি? ভারী ভালো মানুষ ছিল, অবশ্য পরিণতিটা…

–কেন কি হয়েছিল? ব্যারনেস জানতে চাইলেন।

ট্রেসি উদাসীন হয়ে বলল–তেমন কিছু না।

–তেমন কিছু না মানে, বেচারাকে ভারতে ফাঁসী দিয়েছিল, জেফ অনুযোগের ঘুরে বলল।

ট্রেসি সঙ্গে সঙ্গে গলার সুর কঠিন করে বলল, ভারত নয় পাকিস্তানে, এবার মনে পড়েছে, আমার স্বামী আপনার নাম করতেন মাঝেমধ্যে।

এই খবর শুনে ব্যারনেসের মুখে লাল ঝলক। ব্যারনেস তাকালেন জেফের দিকে।

–তুমি তো কখনও বলনি যে তুমি বিবাহিত।

–সিসিলির সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে।

ট্রেসি মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বলল–আমি কিন্তু রোজ-এর কথা জিজ্ঞাসা করছিলাম। ব্যারনেসের মুখ এবার গম্ভীর হয়ে গেল–তুমি দু-দুবার বিয়ে করেছিলে।

–ওটা ছোটোবেলার ব্যাপার। বিয়েটা এমনিতেই নাকচ হয়ে গেছে।

জেফ আর সেখানে দাঁড়াতে চাইছে না, আবার ট্রেসি কোন্ দুষ্টুমি ভরা খেলায় মেতে উঠবে কে জানে?

–আর যমজ বাচ্চা দুটো।

ট্রেসি চেঁচিয়ে প্রশ্ন করল।

–যমজ? ব্যারনেস দিশেহারা।

–ওরা ওদের মায়ের সঙ্গে থাকে, বলেই জেফ ব্যারনেসকে নিয়ে এগোতে এগোতে বলল–আপনি নিশ্চয়ই ব্যস্ত।

পরদিন একটা দোকানে লিফটের দরজা যখন বন্ধ করছে তখন ট্রেসি দেখল ভেতরের জেফ, ট্রেসি জিজ্ঞাসা করল–কালকে এরপর কি ঘটেছিল?

জেফ দাঁতে দাঁত পিষল–

সে রাতে ট্রেসির ঘুম আসছিল না। জেফের সঙ্গে ব্যারনেসের কি সম্পর্ক থাকতে পারে? পরমুহূর্তেই সে ভাবলো, সে জেফকে ইতিমধ্যেই চিনে নিয়েছে, তারা কোনো দিন বিয়ে করে সুখী হতে পারবে না।

হারটগ ফ্রান্সে একটা কাজ নিয়েছে, সেই কথা চিন্তা করতে করতে ট্রেসি ঘুমিয়ে পড়ল।

প্যারিসে নিজের হোটেলে বসে ট্রিগনান্টের দেওয়া রিপোর্ট পড়ছিলো ড্যানিয়েল কুপার। রাত তখন প্রায় চারটে, কাদের কাজ এগুলো কিছুতেই বুঝতে পারছে না সে।

এখনও তিনটে ফাইল বাকী। ব্রাসেলসে লেখা ফাইলটা নিয়ে চোখ বোলাতে লাগল। কুড়িলাখ ডলারের গয়না চুরি গেছে জনৈক মিঃ ভ্যান রুইসেনের ভিলার আয়রন সেফ থেকে। ভদ্রলোক বেলজিয়ামের বিখ্যাত ধনী ব্যবসাদার, আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে একাধিক বার অভিযুক্ত হয়েছিয়েছিলেন।

তিনি ছুটি কাটাতে অন্যত্র গিয়েছিলেন। এমন সময় চুরিটা হয়। হঠৎ অ্যালার্ম ঘন্টা বেজে ওঠাতে পুলিশ ছুটে আসে। সদর দরজাতে দেখা হয়ে যায় জালের মতো পাতলা নাইটি পরা এক যৌবনবতী নারীর সঙ্গে। তার মুখে পুরু করে ক্রীম মাখানো। উনি নাকি মিঃ রুইসেনের অতিথি, পুলিশ বিশ্বাস করে চলে যায়, পরে বাড়ীর মালিকের কাছ থেকে খবর এসেছে ওই ধরনের অতিথি তার থাকার কথা নয়।

ড্যানিয়েল কুপার ফাইলটা নামিয়ে রাখল, যুক্তি আর যুক্তির সরণীতে সে এখন হাঁটবে। ইন্সপেক্টর ট্রিগনান্টের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে, ভুল করছেন আপনি। আমি বলছি একজন মহিলার পক্ষে এতগুলো অপরাধ করা কখনই সম্ভব নয়।

–পরীক্ষা করে দেখা দরকার, ড্যানিয়েল কুপার বলল।

–কী ভাবে?

–প্রথমতঃ কোথায় কবে চুরি হয়েছে সেগুলোর তারিখ ঠিক করুন। ওইসব তারিখ মিলিয়ে বিদেশীদের আসার লিস্টে দেখুন মার্কিন মহিলা কজন আছে। জাল পাশপোর্ট থাকা অসম্ভব নয়। তবে মাঝেমধ্যে স্বনামে সে আসতে বাধ্য।

এবার ট্রিগনান্ট পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারল। শেষপর্যন্ত সবার ওপরে নাম পাওয়া গেল ট্রেসি হুইটনি।

এই প্রথম একটা সঠিক সূত্র পাওয়া গেছে, ইন্টারপোল উঠে পড়ে লাগল। ট্রেসি হুইটনি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য এমন কি জেলখানা থেকে ফটো পর্যন্ত চলে এল প্যারিসে। ড্যানিয়েল কুপারের এই আচরণে রেনল্ডস পর্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন, অথচ কিছুই করার নেই, লোকটা অসম্ভব ধূর্ত এবং নিজের কাজ ভালোভাবে করতে জানে।

.

২৫.

পঁচিশ প্রত্যেক বছর জুন মাসের প্রথম শনিবার কাউন্ট দ্য মাতিগনি প্যারিসের শিশু হাসপাতালের জন্য একটা চ্যারিটি ম্যাচের আয়োজন করে থাকেন। এখানে প্রবেশ করতে গেলে এক হাজার ডলার মূল্য দিতে হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বড়ো লোকেরা ওইদিন পাগলের মতো প্যারিসে ছুটে আসেন।

মাতিগনির প্রাসাদের মতো বাড়িটি ফ্রান্সের এক দর্শনীয় স্থান। পঞ্চদশ শতাব্দীর বাড়ি। সমানের সুন্দর বাগান। নাচের দিন বিশাল নাচঘর খুলে দেওয়া হয়। প্রাসাদ সংলগ্ন ছোট নাচঘরে দামী দামী পোশাক আর গয়না পরা ধনী নরনারীর ভিড় দেখা যায়। উর্দিপরা বেয়ারারা ঘুরে ঘুরে পানীয় পরিবেশন করছে। খাওয়া দাওয়ারও এলাহী ব্যবস্থা করা হয়।

সেদিন সাদা লেসের অত্যন্ত দামী গাউন পরেছে ট্রেসি, চুলটা উঁচু করে বেঁধেছে, সেখানে একটা হীরের টায়রা, সে নাচছিল গৃহকর্তা কাউন্ট মাতিগানের সঙ্গে। কাউন্টের বয়স ছেষট্টি বছর, স্ত্রী মারা গেছে, বেঁটে খাটো, স্বাস্থ্য ভালো। হারটগের কথা মনে পড়ে গেল ট্রেসির–শিশু হাসপাতালের জন্য কাউন্ট যে নাচের পার্টি দেন সেটা একধরনের জালিয়াতি। চাঁদার টাকার মাত্র দশভাগ দেন হাসপাতালে, বাকিটা কাউন্টের পকেটেই চলে যায়।

কাউন্ট নাচতে নাচতে বললেন–আপনি অসাধারণ নাচছেন তো?

ট্রেসি হাসতে হাসতে উত্তর দিল–আপনার মতো পার্টনার পেয়েছি বলে।

–আচ্ছা আমাদের আগে দেখা হয়নি কেন?

–দক্ষিণ আমেরিকাতে ছিলাম। আমার স্বামীর কয়েকটা খনি আছে ব্রাজিলে।

স্বামী আসতে পারেনি শুনে কাউন্ট আরও একটু জোরে ট্রেসির কোমর জড়িয়ে ধরলো। ঠিক সেই সময় মাথা তুলতেই ট্রেসি দেখলো জেফ একটা দারুণ সাজগোজ করা মেয়ের সঙ্গে নাচছে। মেয়েটা ওকে খিমচে ধরেছে। দুজনের মধ্যে চোখাচোখি হতেই দুজনেই হেসে ফেলল।

ট্রেসি ভাবলো ও ব্যাটার হাসার অধিকার আছে, গত দুটো কেসে জেফ ওর মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নিয়েছে। এবার এখানে এসেছি, বেজন্মার বাচ্চাটা এখানেও পৌঁছে গেছে।

নাচতে নাচতে জেফ আর তার সঙ্গীনি কাউন্টের কাছে এল। পরিচয়ের পালা সারা হতেই খাওয়ার ঘন্টা পড়লো। কাউন্ট ব্যস্ত হয়ে চলে গেলেন অতিথিদের সামলাতে। জেফ তার সঙ্গিনীকে বলল–মাথা ধরেছে একটা অ্যাসপিরিন দাও তো।

মেয়েটা আড়াল হতেই জেফ তাড়াতাড়ি ট্রেসির খুব কছে এসে বলল–এখানে চুরির চেষ্টা কোরো না, আমার মনেও ইচ্ছে ছিল, কিন্তু পাহারার ব্যবস্থা দেখে পিছিয়ে এসেছি। রাতের বেলায় খুনী কুকুর পাহারা দেয়। প্রত্যেকটি দরজা জানলায় ইলেকট্রিক কানেকশান করা আছে। তাছাড়া যেখানে দামী জিনিসগুলো আছে, সেখানে অদৃশ্য ইনফ্রারেড রশ্মির ছড়াছড়ি।

মুখ টিপে হেসে ট্রেসি বলল–আমি সবকিছুই জানি।

–তাহলে নিশ্চয় এটা জানো রশ্মির মধ্যে যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ কিছু হবে না, বেরিয়ে এলেই ঘন্টা বেজে উঠবে। শরীরের তাপের সঙ্গে কী একটা সম্পর্ক আছে।

এটা ট্রেসি জানতো না তুমি এসব কথা আমায় জানাচ্ছো কেন?

–আমি চাই না তুমি ধরা পড়ো।

জেফের সঙ্গিনী অ্যাসপিরিন নিয়ে আসছে দেখা গেল।

দারুণ ভোজ হল। সবই বাছা-বাছা খাবার। ডিনারের পর কাউন্ট মাতিগান ট্রেসিকে বললেন–তুমি আমার ছবির গ্যালারী দেখবে বলছিলে না?

বিশাল হলঘরে পৃথিবী সমস্ত সেরা শিল্পীদের ছবি সাজানো আছে। ছবিগুলোর মূল্য হিসাব করা যায় না।

কাউন্টকে প্রশ্ন করলো ট্রেসি–পাহারার ভালল বন্দোবস্ত নিশ্চয়ই রেখেছেন।

–হ্যাঁ, তিনবার চুরির চেষ্টা হয়েছিল, প্রথমজনকে প্রাণ দিতে হয়েছে আমার ডোবারম্যান কুকুরের হাতে। দ্বিতীয়জন সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে। তৃতীয়জন জেল খাটছে। এটা একটা দুর্গ বলতে পারো।

ট্রেসি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার ভান করে বলল–যাক আমাকে নিশ্চিন্ত করলেন।

বাইরে তখন আতসবাজীর উৎসব শুরু হয়ে গেছে। সেই সুযোগে বাড়ির চারপাশটা ট্রেসি ঘুরে ঘুরে দেখে নিলো। দোতলায় কাউন্টের শোবার ঘরে কুড়ি লাখ ডলারের গয়না আর দুটো অত্যন্ত দামী ছবি আছে, তার মধ্যে একটি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির।

পরদিন প্রায় নিঃশব্দে একটা ভাড়াটে গাড়ী এসে দাঁড়াল কাউন্টের বাড়ির পিছনের উঁচু দেয়াল ঘেঁষে। আকাশে কালো মেঘ জমেছে, কনকনে ঠান্ডা। কালো রঙের পোশাক পরেছে ট্রেসি, হাতে দস্তানা। দেওয়ালে হাত রাখতেই ভেতর থেকে চাপা আর ভয়ংকর গর্জন শোনা গেল।

ট্রেসি পিছন ফিরে শিস দিতেই গাড়ী থেকে বেরিয়ে এল একটি মাঝবয়সী পুরুষ। সঙ্গে একটা মাদী ডোবারম্যান, সেই কুকুরটি ঋতুমতী।

দেওয়াল টপকে মাদীটিকে ভিতরে ফেলে দিতেই গর্জন, কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পর সব চুপচাপ।

ট্রেসি তার সঙ্গীকে বলল–চলো ঢোকা যাক।

সঙ্গীটির নাম জাঁ লুই। জীবনের বেশির ভাগটাই সে জেলে কাটিয়েছে। খুব একটা চালাক চতুর নয়। কিন্তু তালা খোলা আর অ্যালার্ম কাটার ব্যাপারে সে সিদ্ধহস্ত।

দড়ির সিঁড়ি বেয়ে দুজনে ঢুকলো। আই ভি লতা বেয়ে। তারা ছাদে পৌঁছলো। জাঁ লুই খুব সহজেই স্কাই লাইটের কঁচটা কেটে ফেলল। অ্যালার্ম ঘন্টার বৈদ্যুতিক তারগুলো সঙ্গে আনা হুক লাগানো তারের সঙ্গে জুড়ে দিল।

হলঘরে ঢুকে ট্রেসি ব্যাগ থেকে দুটো ইনফ্রায়েড লেন্স লাগানো চশমা বের করলো। চশমা পড়তেই দেখতে পেল কীভাবে রশ্মিগুলি এক প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ছড়ানো আছে। দুজনে সেটা এড়িয়ে ধীরে ধীরে কাউন্টের বেডরুমের কাছে পৌঁছলো। কাউন্ট এখানে নেই, গতকাল তিনি বন্ধু-বান্ধব নিয়ে একটা নির্জন দ্বীপে বেড়াতে চলে গেছেন। ট্রেসি টর্চ মেরে দেখলো দেওয়ালে ঝোলানো লিওনার্দোর ছবি, কিন্তু এখানেও ইনফ্রা-রেড রশ্মি। ট্রেসি আর লুই একসঙ্গে রশ্মির মধ্যে ঢুকলো। তারপর লুই একা বেরিয়ে গেল, ট্রেসি নড়লো না। ফলে অ্যালার্ম বাজলো না। মিনিট দশেকের মধ্যে তারা তালা খুলে বিশলাখের জড়োয়া গয়না আর লিওনার্দোর ছবি নিয়ে নিচে নেমে এল। এবার রশ্মি ছেড়ে পালাতে হবে।

রশ্মি থেকে যতটা সম্ভব পিছিয়ে এসে দুজনে দৌড়ল। তারা স্কাই লাইটের দিকে ছুটছে। রশ্মি থেকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে তীব্র শব্দ হতে শুরু করল।

কোনো রকমে দড়ির মই বেয়ে বাইরে এসে ভ্যানে বসে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। গাড়ি ছুটছে রাস্তা দিয়ে, হেড লাইটের আলো পড়ল পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটা গাড়ির ওপর। ড্রাইভারের আসনে জেফ, পাশে একটা ডোবারম্যান।

ট্রেসি মনে মনে উল্লাসে ফেটে পড়ল। যাক, আরও একটা অভিযানে সে সফল হয়েছে। দূর থেকে শোনা গেল পুলিশের গাড়ির সাইরেন!