০৬-১০. জেলখানার সি ব্লকে

৬.

জেলখানার সি ব্লকে সাতজন মহিলা কয়েদী ছিল। ট্রেসিকে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। দীর্ঘ যাত্রার সমাপ্তি ঘটে গেল।

সেলটার মধ্যে চারটে বাঙ্ক। ভাঙা আয়না বসানো ছোট্ট টেবিল। চারটে ছোটো ছোটো লকার। কোণের দিকে মুখ খোলা একটি কমোড।

ট্রেসির সেলের সঙ্গীরা হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পুয়োর্তোরিকোর মেয়েটি প্রথমে বলল–একটা নতুন মিষ্টি জিনিস পেলাম বলে মনে হচ্ছে।

মেয়েটাকে দেখতে খুব একটা খারাপ নয়। কিন্তু কপাল থেকে গলা অব্দি একটা দগদগে কালো দাগ। দেখতে বাচ্চা-বাচ্চা।

মাঝবয়েসী মোটাসোটা মেক্সিকান মহিলাটি গায়ে পড়ে আলাপ করতে চাইছে। সে বলল, তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। আহা, কী জন্য তুমি এখানে এসেছ বাছা? ধর্ষণ নাকি খুন? কী অভিযোগ তোমার বিরুদ্ধে?

ট্রেসি উত্তর দিতে পারছে না। তৃতীয় কয়েদীটি একজন নিগ্রো, ছ ফুট লম্বা, চোখ কুতকুতে মুখে সবসময় শয়তানীর মুখোশ আঁটা। মাথাটা কামানো। সে বলল, ওই কোণের বাঙ্কটা তোমার।

ট্রেসি এগিয়ে গেল। গদিটা নোংরা, কোনোদিন কাঁচা হয় না। ধুলো আর নানা ধরনের দাগে ভর্তি।

ট্রেসি চিৎকার করে বলল–এখানে আমি শুতে পারব না।

এই প্রথম মেক্সিকান কয়েদিটির চোখে একটা অদ্ভুত হাসির চাউনি ফুটে উঠল। হাসতে হাসতে সে বলল––কে তোমাকে ওখানে শুতে বলেছে সোনা মেয়ে, তুমি তো আমার সঙ্গে শোবে।

ওদের চোখের দিকে তাকাতেই বিদ্যুৎ খেলে গেল ট্রেসির সমস্ত শরীরে। কয়েদি তিন জন যেন ট্রেসিকে নগ্ন করে দেখছে। তখন সে বুঝতে পারল, টাটকা মাংস এই শব্দদুটোর অন্তরালে কোন্ অর্থ লুকিয়ে আছে। একটা অজানা ভয় তখন ক্রমশ ট্রেসিকে গ্রাস করছে। তার মেরুদণ্ড দিয়ে হঠাৎ প্রবাহিত হল শীতল শিহরণ।

কোনোরকমে সাহস এনে সে বলল–পরিষ্কার তোষক পেতে হলে কার সঙ্গে দেখা করতে হবে?

নিগ্রো মহিলাটি ঠোঁট উল্টে বলল–ঈশ্বর, তবে কিছুদিন হল ঈশ্বরকে আমরা ধারে কাছে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।

–ট্রেসি বুঝতে পারল, এখন তাকে এই অবস্থার সঙ্গে আপোস করতেই হবে। বৃথা চোখের জল ফেলে কী লাভ? সে ভাবল, এবার বোধহয় পাগল হয়ে যাবে। এখানে এই নরকের পরিবেশে আমি কিছুতেই থাকতে পারব না।

তার মনের কথা হয়তো বুঝতে পেরেছিল ওই কালো নিগ্রো মহিলাটি। সে বলল স্রোতে গা ভাসিয়ে দাও খুকুমণি। তাহলে দেখবে আর জলের ঝাঁপটা তোমাকে আঘাত করতে পারছে না।

ওয়ার্ডেনও এই ধরনের কথা বলেছিলেন। কৃষ্ণকায় মেয়েটি আবার বলল–আমি আর্নেস্টাইন লিটল চ্যাপ। মুখে কাটা দাগওয়ালাকে দেখিয়ে আবার সে বলল–ও হল লোলা, পুয়ের্তোরিকো থেকে এসেছে। আর ওই মুটকি মাগীটার নাম কী জানো তো? সে হল পাউলিটা। তুমি কে? তোমার নাম কী? দেখেতো মনে হচ্ছে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে পারো না। অথচ তোমাকে কিনা পনেরো বছর এখানে থাকতে হবে। আহা, মুখ দিয়ে চুকচুক করে একটা শব্দ করল নিগ্রো মেয়েটি।

–আমি ট্রেসি হুইটনি, আমার অপরাধ? জানি না? ট্রেসি অনেক কিছু বলতে চাইল, কিন্তু তার কেবলই মনে হল, সে তার সত্তাকে হারিয়ে ফেলেছে। সে যেন দুঃস্বপ্নের জগতে বিচরণ করছে।

মোটা মেয়েটি জানতে চাইল, তুমি কোথা থেকে এসেছ?

এখন কোনো কথা বলতে ভালো লাগছে না ট্রেসির। নোংরা তোষকের একপাশে বসে পড়ল সে। স্কার্ট দিয়ে কোনোরকমে কপালের ঘাম মুছল। ওয়ার্ডেনকে বলা উচিত ছিল, ওর পেটে বাচ্চা আছে। তা হলে হয়তো ও একটা ভালো সেলে জায়গা পেতে পারত।

বাইরের বারান্দাতে কার পায়ের শব্দ? উৎসুক চিত্তে ট্রেসি ছুটে গেল গরাদের কাছে। মেট্রন আসছেন, শুনছেন, ট্রেসি চিৎকার করে বলতে চাইছে, ওয়ার্ডেন ব্রানিগানের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।

–এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি, ঘাড় না ঘুরিয়ে মেট্রন উত্তর দিলেন।

চাপা কান্নাকে কোনো রকমে আটকে রেখে বাঙ্কে ফিরে এল ট্রেসি। তারপর তার ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিল নোংরা তোষকের ওপর।

দশ বছরের জন্মদিনের কথাটা বারবার মনে পড়ে যায় ট্রেসির। বাবা বলেছিলেন, আজ আমরা আঁতোয়ানেতে ডিনার খাব।

আঁতোয়ানেত খুব নাম করা রেস্টুরেন্ট। বড়োলোকদের ব্যাপার। ওখানে যেতে গেলে অনেক পয়সা খরচ হবে। ট্রেসি জানত, অত টাকা বাবার নেই। খরচের কথা উঠলে, বলা হত, আসছে বছর হবে। আর তারা কিনা যাচ্ছে আঁতোয়ানেতে খেতে? ট্রেসির মা সুন্দর সবুজ একটি ফ্রক তাকে পরিয়েছিল।

বাবা ঠোঁট ফুটিয়ে বলেছিলেন, কী সুন্দর দেখতে দুজনে, তাকিয়ে দেখার মতো।

নিউ অর্লিয়েন্সের দুজন সুন্দরী আমার সঙ্গে চলেছে। পথ চলতি সবাই তো আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকাবে।

আঁতোয়ানেত সম্পর্কে ট্রেসি মনে মনে যা কল্পনা করেছিল, তা বর্ণে বর্ণে মিলে গেল। সেখানে গিয়ে ট্রেসির মনে হয়েছিল, সে বুঝি সত্যি সত্যি রূপকথার জগতে ঢুকে পড়েছে। প্লেটগুলোতে সোনার অক্ষরে রেস্টুরেন্টের নাম লেখা। এক সময় নাকি রাজারানিরা এখানে ডিনার খেতে আসতেন। ট্রেসি তখনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, বড়ো হলে সে রোজরাতে এখানে এসে রাতের খাবার খাবে। মা বাবাকে তার সঙ্গে আনবে।

বার্থডে কেক কাটার সময় ওয়েটাররাও হ্যাপি বার্থডে বলে গান গেয়েছিল। যারা এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিলেন, তারাও সকলে আনন্দে হাততালি দিয়েছিলেন। সবুজ ফ্রক পরা ট্রেসিকে মনে হচ্ছিল, সবুজ এক উড়ন্ত জলপরী। রাস্তা দিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে যাচ্ছিল একটা গাড়ি। ট্রেসি সেই শব্দটাও শুনতে পেয়েছিল।

সেই ঘণ্টাধ্বনি কি এখনো বেজে চলেছে?

লিটলচ্যাপ বলল খাবার ঘণ্টা পড়ল। ট্রেসির স্বপ্নের ঘোর কেটে গেল। শব্দ করে সেলের দরজা খুলে গেছে। সবাই বেরোচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ট্রেসিকে এখন বাইরে বেরোতে হবে। কিন্তু, সে চোখ বন্ধ করল। এতটুকু খিদে নেই তার। নাঃ, এখানে বসে সে খেতে পারবে না।

পুয়ের্তোরিকোর সেই কমবয়সী মেয়েটা ট্রেসিকে টানতে টানতে বলল–এই খাবার সময় হয়েছে চল।

–খিদে নেই, খাওয়ার কথা চিন্তা করতেই বমিটা চাপ দিয়ে উঠল।

–খিদে পাক বা না পাক, তোমাকে খেতে যেতেই হবে। মেক্সিকান মহিলা পাউলিটা বলল।

ঘরের বাইরে তখন সকলে লাইন দিতে শুরু করেছে।

লিটলচ্যাপ ট্রেসিকে সাবধান করে দিয়ে বলে–ওঠো, চলো, না হলে চাবকে পাছার ছাল-চামড়া ছাড়িয়ে নেবে।

যাব না, এখানেই থাকব। ট্রেসি মনে মনে বলল।

হঠাৎ মেট্রনকে চোখের সামনে দেখতে পেল সে। মেট্রন চিৎকার করে বললেন–এই ঘণ্টা শুনতে পাওনি। যাও, লাইনে দাঁড়াও।

–না, আমার খিদে নেই মেট্রন।

মেট্রনের চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সেলের মধ্যে ঢুকে ট্রেসির সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। বললেন, নিজেকে কি মনে করেছিস ঘুড়ি। ঘরে খাবার পাঠিয়ে দেবে? যা, লাইনে দাঁড়া। একবার রিপোর্ট করলে মজা বুঝবি, তখন দেখবি, কত ধানে কত চাল।

ট্রেসি কোনোরকমে লাইনে এসে দাঁড়াল। বলল, কেন আমি যদি—

লিটলচ্যাপ বলল–চুপ, লাইনে কথা বলবে না কেউ।

খাবার ঘরটা বিরাট। লম্বা টেবিল পাতা, দুদিকে কাঠের চেয়ার। কাউন্টার থেকে খাবার এনে টেবিলে বসে খেতে হয়। খাবার মুখে ভোলা যায় না। ফ্যাকাশে কাস্টার্ড আর জলের মতো কফি।

ট্রেসি নিজের প্লেটে খাবার নিল। এবার কী করতে হবে সে জানে না। আর্নেস্টাইন লিটলচ্যাপ গেল কোথায়? তাকে তো ধারে কাছে কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। অগত্যা লোলা আর পাউলিটার পাশে বসে পড়ল। ওখানে প্রায় কুড়ি জন বসে থালা খালি করছে। নিজের থালার দিকে তাকিয়ে বমি এসে গেল ট্রেসির। সঙ্গে সঙ্গে থালাটা সে পাশে সরিয়ে দিল।

পাউলিটা ওর থালার খাবারগুলো গোগ্রাসে গিলতে শুরু করেছে।–তুমি যদি একান্ত না খাও, তাহলে এগুলোর সদগতি আমিই করি, কী বলে?

লোলা ট্রেসিকে বলল–এরকম করো না ট্রেসি, কদিন তুমি না খেয়ে থাকবে বলো?

ট্রেসি ভাবল, না খেয়ে খেয়ে মরে গেলে কেমন হয়? এই মেয়ে মানুষগুলো কীভাবে জীবন কাটাচ্ছে তা সে ভাবতেই পারছে না। বুক থেকে চাপা কান্না বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কোনোরকমে দাঁতে দাঁত চেপে সে কান্নাটাকে চাপল।

পাউলিটা বলল ওরা যদি দেখে ফেলে তুমি খাচ্ছো না তাহলে তোমাকে বিং-এ পাঠিয়ে দেবে।

–বিং কী? বোকার মতো ট্রেসি জানতে চাইল।

–বিং মানে কী জানো না? সেটা একটা গর্ত, সেখানে তোমাকে একেবারে একা থাকতে হবে।

কথাটা বলতে বলতে পাউলিটা ট্রেসির মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল খোয়াড়ে তুমি নতুন এসেছ, তাই একটা উপদেশ দিয়ে রাখি। আর্নেস্টাইন লিটলচ্যাপের সঙ্গে সব সময় ভালো ব্যবহার করবে। আমরা সকলে তার খুব অনুগতা। এখানে তার মুখের কথাই কিন্তু আসল আইন।

তিরিশ মিনিট বাদে আবার ঘণ্টা পড়ল। সবাই একলাফে লাইনে এসে দাঁড়াল। খাওয়া হয়ে গেছে। এখন বিকেল চারটে বাজে। আলো নিভবে রাত নটায়। এই পাঁচ ঘণ্টা নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে সকলকে।

সেলে ফিরে এসে দেখল লিটলচাপ বসে আছে। খাবার সময় তাহলে সে ছিল কোথায়? ট্রেসির পেটটা এবার গুলিয়ে উঠেছে। কোণের দিকে যে খোলা কমোডটা আছে, ওটা এখন ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এদের সামনে সে এটা ব্যবহার করবে কেমন করে? আলো নিভুক, তারপর না হয় দেখা যাবে।

লিটলচ্যাপ জানতে চাইল, তুমি নাকি আজ খাওনি। এরকম বোকামি ভবিষ্যতে আর কখনো করো না। কেউ তোমাকে দেখতে আসবে না।

ও কী করে খবরটা এর মধ্যে পেয়ে গেল? ওর মাথাব্যথা কেন? মনে মনে ভাবল ট্রেসি। তারপর জানতে চাইল, আচ্ছা ওয়ার্ডেনের সঙ্গে দেখা করতে হলে কী করতে হবে?

–দরখাস্ত দিতে হয়। গার্ডরা ওটা নিয়ে পায়খানায় যায়। আর যারা ওয়ার্ডেনের সঙ্গে দেখা করতে চায়, ওরা তাদের একেবারেই সুনজরে দেখে না।

লিটলচ্যাপ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল–এখানে নানা ধরনের ঝঞ্ঝাট হয়। তোমার দরকার সত্যিকারের একজন ভালো বন্ধু, যে তোমার সব অভাব অভিযোগগুলো বুঝতে পারবে।

লিটলচ্যাপ ট্রেসির কাঁধে হাত রেখে একটুখানি হাসল। তার সোনা বাঁধানো দাঁত ঝকঝক করে উঠল। ট্রেসির মনে হল লিটলচ্যাপের মাথাটা বুঝি একলাফে ছাদ ছুঁয়েছে। এত লম্বা মেয়ে মানুষ সে জীবনে কখনো দেখেনি।

–ঐ লম্বা জানোয়ারটা কী বাবা?

–ওটা জিরাফ। অদ্রুবন পার্কে বাবার সাথে ছোটোবেলায় বেড়াতে যেত ট্রেসি। লিটলচ্যাপকে দেখে তার সেই ছোটোবেলার গল্পটাই মনে পড়ে গেল।

প্রত্যেক ছুটির দিন ট্রেসি মা আর বাবার সঙ্গে কোথাও না কোথাও যেত। চিড়িয়াখানাতে গিয়ে তার মনটা খারাপ হয়ে যেত। খাঁচার মধ্যে পশুপাখিদের দেখে ভীষণ-ভীষণ কষ্ট হত তার। একবার বাবার কাছে জানতে চেয়েছিল, আচ্ছা বাবা, খাঁচায় থাকতে ওদের কষ্ট হয় না?

বাবা হেসে বলেছিল–নারে, ওরা বেশ আরামে থাকে। সব সময় ভালো মন্দ খাবার পায়। প্রাণের ভয় থাকে না।

বাবার এই কথাটা ট্রেসির একদম ভালো লাগেনি। সে জীবনে কোনোদিন খাঁচায় থাকবে না, এমন একটা প্রতিজ্ঞা করেছিল।

আর আজ? জীবনের পনেরোটা বছর তাকে এই বদ্ধ কুঠুরির মধ্যে কাটাতে হবে। এটা ভাবতে গিয়ে তার মনটা কেমন যেন হয়ে গেল।

রাত পৌনে নটার সময় ঘণ্টা পড়ল। ট্রেসির সেলের সঙ্গিনীরা দিনের পোশাক ছেড়ে রাতের পোশাক পরতে শুরু করেছে। ট্রেসি চুপচাপ বসে আছে দেখে লোলা বলল, সময় । কিন্তু মাত্র পনেরো মিনিট। তার মধ্যে পোশাক পরে নিতে হবে। এবার শুতে যেতে হবে।

মেট্রন বাইরে থেকে দেখতে পেলেন ট্রেসি বসে আছে। লিটলচ্যাপকে বললেন–ও বসে কেন? ওকে বলোনি, কী করতে হবে?

–হ্যাঁ বলেছি।

মেট্রন ট্রেসিকে লক্ষ্য করে বললেন, যারা ঝঞ্ঝাট পাকাতে চায় তাদের কীভাবে শায়েস্তা করতে হয় তা আমার জানা আছে।

পাউলিটা বলল–ও যা বলে, তা করা খুকুমণি। ওর নাম আমরা দিয়েছি পুরোনো লোহার প্যান্ট। এক নম্বর কুত্তির বাচ্চা।

ট্রেসি ধীরে ধীরে উঠে গেল। এক কোণে গিয়ে ওদের দিকে পিছন ফিরে জামাকাপড় খুলে ফেলল। জাঙ্গিয়াটা খুলতে পারল না। মোটা খসখসে কাপড়ের নাইট গাউনটা মাথা দিয়ে গলিয়ে নিল। বুঝতে পারল, বাকি তিনজন ওর নগ্ন শরীরটা যেন গিলে ফেলতে চাইছে।

পাউলিটা মন্তব্য করল, তোমার শরীরটা খাসা।

লোলা বলল–সত্যি, দারুণ সুন্দরী তুমি।

ট্রেসির সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। লিটলচাপ এখন ট্রেসির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। লিটলচ্যাপ কোনোরকমে বলছে, আমরা তোমার বন্ধু। তোমার দেখাশোনা আমরা তিনজন ভালো ভাবেই করব।

এক ধাক্কায় নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল ট্রেসি। আমাকে একলা থাকতে দাও। আমি তোমাদের মতো নই।

লিটলচ্যাপ হাসতে হাসতে বলল–আমরা যেমনটি বলব, তেমনটি হতে হবে তোমাকে। চিৎকার করলেও কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।

পাউলিটা বলল–আরে ছেড়ে দাও, প্রথম রাত ওকে একটু ধাতস্থ হবার সময় দাও। রাত তো অনেক বাকি।

আলো নিভে গেল।

আশঙ্কায় আর ভয়ে ট্রেসির সমস্ত শরীরটা তখন কাঠ হয়ে গেছে। খাটের ধারে কোনোরকমে বসেছিল সে। ভাবছিল, এই বোধহয় তিনজন শয়তান কুত্তি ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ট্রেসি আবছা আবছা শুনেছে যে, এদের মধ্যে ঢালাও ভাবে সমকামিতা চলে। ওদের কথাবার্তাগুলোর মধ্যে তার আভাস ইঙ্গিত পেয়েছে সে। কিন্তু, ওরা যদি কিছু করার চেষ্টা করে, তাহলে ট্রেসি কী করবে। ট্রেসি চিৎকার করবে? গার্ড ছুটে আসবে। জেলে এসব হতে দেওয়া ঠিক নয়।

রাত বাড়তে থাকল। অথচ, ওরা তেমন কিছু করছে না কেন? অন্ধকারের মধ্যে ট্রেসি বুঝতে পারল, ওরা তিনজন পরপর বাথরুম সেরে নিয়েছে। একটু বাদে নিজের সেই অবস্থা হয়েছে। সে কমোডটার কাছে গিয়ে চেন টানল। চেন কাজ করছে না। কোনোরকমে নাক, টিপে বাথরুম সারল।

কাল সকালে ওয়ার্ডেনের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। ওয়ার্ডেনকে বলতে হবে, তার পেটে বাচ্চা আছে। ওয়ার্ডেন নিশ্চয়ই তাকে অন্য কোথাও সরিয়ে দেবেন। আজ রাতটা সে ঘুমোত পারবে না। জেগে জেগেই সমস্ত রাত কাটিয়ে দেবে।

বসে থাকতে থাকতে কোমরের ব্যথায় খাটে শুয়ে পড়েছে টেসি। রাত তিনটের পর ও আর জেগে থাকতে পারল না। ঘুমে চোখের দুটি পাতা তখন এক হয়ে এসেছে।

ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল ট্রেসির। বেশ বুঝতে পারল, কে যেন ওর মুখ চেপে ধরেছে। অন্য কেউ একজন ওর বুকে হাত দিয়েছে।

ট্রেসি উঠে বসার চেষ্টা করল। পারল না, ওরা ওর নাইট গাউন আর প্যান্টিটা টেনে টেনে খুলে ফেলেছে। ট্রেসি তখন মরীয়া হয়ে লড়াই করতে শুরু করেছে। ফিসফিস করে কে যেন বলছে–ট্রেসি, ছিঃ এরকম করে না। সহজভাবে সব ব্যাপারটা নাও। নাহলে এখানে থাকবে কেমন করে?

শব্দটা লক্ষ্য করে ট্রেসি পা চালিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সেই কণ্ঠস্বরটা একেবারে পাল্টে গেছে। সেখানে এখন একটা কর্কশ আওয়াজ ফুটে বেরোচ্ছে।

কুত্তিটা বড় বাড়াবাড়ি করছে। এবার, একে মেঝেতে ফেল।

মুখে আর পেটে দমাদম দুটি ঘুসি পড়ল। কে যেন পেটের ওপর চেপে বসেছে। প্রচণ্ড ভাবে চড়চাপড় লাগাচ্ছে। একটা অস্থির হাত ট্রেসির দেহের সমস্ত গোপন অঙ্গে খেলা করছে।

মুহূর্তের মধ্যে ট্রেসির সমস্ত অঙ্গ শিথিল হয়ে গেল। সেই সুযোগে কে যেন ওর মাথাটা লোহার গরাদে দুম করে ঠুকে দিল। ওকে ইতিমধ্যেই মেঝেতে চিৎ করে ফেলা হয়েছে। কেউ ওর হাত পা দুটোকে চেপে ধরে রেখেছে। তিন জনের সঙ্গে একা ও পারবে কেন? হিমশীতল হাত দিয়ে কে যেন ওর সারা শরীরকে পিষছে। গরম জিভ দিয়ে ওকে পালাক্রমে চাটা হচ্ছে। তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা। কে একজন একহাত দিয়ে ওর গলা চেপে ধরল। ট্রেসি চিৎকার করে দাঁত বসিয়ে দিল।

একটা চাপা আর্তনাদ ভেসে এল।–কুত্তি মাগি।

মুখে ঘুষির পর ঘুষি পড়ছে। ট্রেসি ব্যথা অনুভব করছে। শেষ অব্দি সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

ঘণ্টার কর্কশ শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল বেচারী ট্রেসির। দেখতে পেল সম্পূর্ণ নগ্নিকা হয়ে সিমেন্ট বাঁধানো ঠাণ্ডা মেঝের ওপর নিজেকে শুয়ে থাকতে। সেলের সঙ্গিনী তিনজন নিজেদের বাঙ্কে শুয়ে আছে।

বাইরের বারান্দাতে লোহার প্যান্ট চিৎকার করতে করতে আসছিলেন উঠে পড়ো, উঠে পড়ো। সকাল হয়েছে। এবার সবাইকার ঘুম ভাঙাতে হবে।

ট্রেসিদের সেলের সামনে এসে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। রক্তের মধ্যে ট্রেসি পড়ে আছে। মুখে চোখে মারের চিহ্ন, একটা চোখ ফুলে গিয়ে বন্ধ হবার জোগাড়।

দরজা খুলে মেট্রন ভেতরে ঢুকলেন–এখানে আবার কী হাঙ্গামা হল?

পা দিয়ে ট্রেসির পাঁজরে খোঁচা মেরে বললেন–এই হতভাগী মাগি, এবার তোর ঘুম ভাঙবে কিনা দেখছি।

ট্রেসির মনে হল, অনেক বছরের ওপার থেকে কে যেন কথা বলছে। না, আমাকে উঠতেই হবে। এখানে আমি থাকতে পারব না। মনে মনে কঠিন শপথ উচ্চারণ করল সে। কিন্তু উঠতে পারল না। সমস্ত শরীরে অসহ্য ব্যথা।

কাঁধ চেপে ধরে মেট্রন সোজা দাঁড় করিয়ে দিলেন ট্রেসিকে। মনে হচ্ছিল, ট্রেসি এবার মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।

মেট্রন জানতে চাইলেন, কী হয়েছিল?

একটা চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। অন্য চোখটা আধখোলা। ট্রেসি দেখতে পেল, মেট্রন তার জবাবের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন।

–আমি-আমি, ট্রেসি তোতলাতে থাকে। সত্যি কথাটা কীভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। ভবিষ্যত বিপদের আশঙ্কা করছে সে। সে বলল, আমি বাঙ্ক থেকে পড়ে গিয়েছিলাম।

মেট্রন ধমক দিয়ে বললেন, বেশী চালাকি আমি মোটেই পছন্দ করি না। গর্তে কিছুদিন থাকলে তুমি ভদ্র হতে শিখবে।

এ যেন এক বিস্মৃতির জগত। মনে হচ্ছে সে বুঝি মাতৃগর্ভে ফিরে গেছে। চারপাশে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। কোথায় কোনো আসবাবপত্র নেই। মেঝেতে একটা হোেষক, কোণের দিকে একটা গর্ত, বেসমেন্টের একটা ছোট্ট সেল, তাই বোধ হয় ওটাকে গর্ত বলা হয়।

শরীরের ওপর যে পাশবিক অত্যাচার হয়ে গেছে, এখনো তার ধকল চলছে। ট্রেসি ভাবল, আমি তো বাঙ্ক থেকে পড়ে গেছি, মা নিশ্চয়ই আমাকে দেখবে। ওর গলা দিয়ে কয়েকটা ভাঙা ভাঙা শব্দ বেরিয়ে এল, মা, মাগো, কোনো উত্তর পেল না সে। আবার ঘুমের অতল তলে তলিয়ে গেল।

প্রায় দুদিন একটানা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল ট্রেসি। মানসিক যন্ত্রণা অনেকখানি কমে এসেছে। নিজের অবস্থাটা বোঝবার চেষ্টা করল সে। হাজার রকমের চিন্তা তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ওর বেশ মনে হল, ডাক্তারের কাছে ওকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন- একটা পাঁজর ভেঙেছে, কবজির হাড় ভেঙেছে। কাটা জায়গার জন্য চিন্তা করে লাভ নেই। পেটের বাচ্চাটি মারা গেছে।

ট্রেসি ডুকরে কেঁদে উঠল, আমার বাচ্চাকে ওরা মেরে ফেলেছে। ওর কান্না আর থামতে চাইছে না।

ঠান্ডা তোষকের নীচে শুয়ে আকাশ পাতাল নানারকম চিন্তা করছিল ট্রেসি। তখন তার মনে শরীরে কোথাও দুঃখের চিহ্ন মাত্র নেই। তার কেবলই মনে হচ্ছে, ঈশ্বরের কোনো এক অদৃশ্য আশীর্বাদে তার সব কষ্ট দুঃখের অবসান হয়ে গেছে। তার সমস্ত শরীরে তখন দাউদাউ আগুন জ্বলছে। সে আগুন প্রচণ্ড ঘৃণার। মনে হচ্ছে, এখনই তাকে প্রতিশোধ নিতে হবে। শেষ পর্যন্ত এই চিন্তাটাই তাকে আচ্ছন্ন করল। সেলের ওই তিনজন মেয়ে কয়েদির বিরুদ্ধে তার অনেক রাগ আছে, একথাটা সত্যি, কিন্তু ওরাও তো তারই মতো ভাগ্যবিড়ম্বিতা পরিস্থিতির শিকার হয়ে এই জেলে এসেছে। না, এদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়ে কোনো লাভ নেই। কিন্তু ওই পুরুষগুলো? সভ্যতার মুখোশ আঁটা ওই পুরুষগুলোর জন্যই তো আজ আমাদের এই অবস্থা?

জো রোমানো, তোমার বুড়ি মাটা আমার সাথে টক্কর দিতে চেয়েছিল কিন্তু একথা বলেনি, তোমার মতো একটা শাঁসালো রসালো সোথ মেয়ে আছে তার। জো রোমানো, অ্যান্টনি ওরসেত্তি নামে একজনের হয়ে কাজ করে। ওরসেত্তি যে গোটা অর্লিয়েন্স শহরটাকে চালায়। পেরী পোপ–দোষ স্বীকার করে নিয়ে বিচার চালানোর খরচ থেকে আপনি সরকারকে বাঁচাবেন।

জজ হেনরি লরেন্স–আগামী পনেরো বছর তোমাকে জেলখানায় থাকতে হবে।

ট্রেসি অন্ধকারের দিকে তাকাল, অনেকগুলি নাম তখন ভেসে চলেছে। এই চারটে লোক ট্রেসির আসল শত্রু? এছাড়া আছে চার্লস, ট্রেসির কথা সে শুনতেই চায়নি। উল্টে বলেছে, টাকার এত দরকার তুমি আমাকে খুলে বলোনি কেন? তোমার পেটের বাচ্চা? তুমি যা ভালো বুঝবে, তাই করবে

হ্যাঁ, শাস্তি ওদের পাঁচজনকে পেতেই হবে। প্রত্যেককে আলাদা-আলাদা ভাবে শাস্তি দেবে ট্রেসি। কিন্তু এভাবে? না, এখন আকাশ পাতাল ভেবে কোনো লাভ নেই। আজ : অথবা আগামীকাল একদিন প্রতিশোধের স্পৃহা পূর্ণ করবে ট্রেসি। অবশ্য যদি সত্যি সত্যি তার হাতে সময় ও সুযোগ আসে।

.

৭.

এই অন্ধকূপে সময় এগিয়ে চলেছে আপন গতিতে। মাঝে মাঝে ট্রেসির মনে হয়, এখানে। সময়ের কোনো মূল্য নেই। দিন না রাত, কিছু বুঝতে পারে না সে। এই মাটির তলার সেলে জীবনের কতগুলো দিন কেটে গেছে, ট্রেসি তার খবর রাখে না। রোজ দরজার তলা দিয়ে ঠান্ডা খাবার ঠেলে দেওয়া হয়। জোর করে সেগুলো গিলে ফেলে ট্রেসি। পাউলিটার কথাটা সে মনে মনে আবৃত্তি করে এখানে বাঁচতে হলে খেতেই হবে। একটা কথা ট্রেসি বুঝতে পেরেছে। ও যা চায়, তাই করতে হলে শরীরটাকে নীরোগ রাখতে হবে। ওর জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো এতদিনে হতাশায় ভেঙে পড়ত। দীর্ঘ পনেরো বছর তাকে জেলখানায় থাকতে হবে। টাকা পয়সা নেই, আত্মীয় বন্ধু বলতে কেউ নেই। একমাত্র প্রেমিক বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তার চারপাশে শুধুই শূন্যতা। কিন্তু হৃদয়ের গভীর থেকে একটা সাহসের উৎসার অনুভব করল। একটা অজানা শক্তি প্রতি মুহূর্তে তাকে আরো বেশী শক্তি দিচ্ছে। বলছে, শত্রুদের মোকাবিলা করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। আত্মার সাহস ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্র নেই। তার দেহে ইংরেজ এবং আইরিশের রক্ত প্রবাহিত। এই দুই জাতের সব কটি গুণকে সে অধিকার করেছে। তার আছে ইচ্ছা শক্তি এবং আকাশ ছোঁয়া সাহস। সে জানে, তার পূর্বপুরুষরা দুর্ভিক্ষ, প্লেগ এবং বন্যার সঙ্গে অসম লড়াই। করে শেষ পর্যন্ত বেঁচে গিয়েছিল। তাকে বিপদ সঙ্কুল এমন একটা পথের পথিক হয়ে বাঁচতে হবে।

কিন্তু এই জেলখানা থেকে সে কেমনভাবে পালাবে? জেল থেকে পালাবার ফন্দিফিকির নিয়ে ভাবতে শুরু করল ট্রেসি।

শরীরটাকে ঠিক রাখতে হবে। দুর্বল হলে কোনো পরিকল্পনাই সফল হবে না। সেলটি এত ছোটো যে, এখানে কেউ কোনো ব্যায়াম করতে পারবে না। তবে চীনা সন্ন্যাসীদের মতো চিচুয়ান অভ্যাস করা চলে। এই ব্যায়ামের জন্য সামান্য জায়গা লাগে। এতে শরীরের প্রতিটি পেশীর ব্যায়াম হয়ে যায়। ট্রেসি খাড়া হয়ে দাঁড়াল। প্রথম ধাপ থেকে শুরু করতে হবে। প্রত্যেকটা আসনের জন্য একটা নির্দিষ্ট নিয়ম নীতি আছে।

প্রত্যেকটিকে আলাদা নামে ডাকা হয়ে থাকে। প্রথমটি হল দৈত্যকে ঘুষি মারা। তারপর আলো সংগ্রহ করা। হাত-পা, শরীরের গতি খুব স্বাভাবিক হবে। রাজকীয় ভঙ্গিতে সে একবার সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এবং পরক্ষণেই পেছনের দিকে আসবে। প্রত্যেকটি ভঙ্গি এবং অঙ্গ সঞ্চালনের উৎস হচ্ছে তানকিন অর্থাৎ মনকেন্দ্র। ট্রেসির মনে হল, সে বোধহয় তার গুরুর জলদ গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে–তোমরা বি-কে প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত করো। শুরু হবে পর্বত পরিমাণ ভার নিয়ে, শেষ হবে পালকের মতো হাল্কা ভাবে।

ট্রেসি বুঝতে পারল, তার সমস্ত শরীর ঘিরে একটা আশ্চর্য শক্তি প্রবহন শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে এই শক্তিটাকে হৃদয়ের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করতে চেষ্টা করল ট্রেসি।

পাখির লেজ চেপে ধরো, সাদা সারস পাখি হয়ে যাও। বাঁদরকে প্রতিহত করো। বাঘের মুখোমুখি হও। তোমার হাত দুটো হবে মেঘ, জীবনের জলপ্রবাহকে তুমি দুহাত দিয়ে মথিত করবে। গুরুর গলা তখন গমগম করছে চারপাশে।

গুরু আরো বলেছিলেন সাদা সাপকে বশীভূত করো। বাঘের পিঠে চড়ে বসো। আঘাত হানো বাঘের ওপর। তোমার চি-কে আবার গুটিয়ে নাও। নিজের তানকিন অর্থাৎ মনঃকেন্দ্রে চলে যাও।

এক ঘণ্টা ধরে ট্রেসি পুরো ব্যায়ামটা করল। ক্লান্তি নেমেছে তার সমস্ত শরীরে। এই ভাবে প্রত্যেক দিন ধরে তার সাধনা এগিয়ে চলেছে। ক্রমশ তার শরীর এবং মন সাড়া দিতে শুরু করল। সে যে একটা দারুণ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছে সেটা বুঝতে পারল। শরীরের ব্যায়াম করার সময়টুকু বাদে অন্য সময় কী করে? সে একমনে মনের ব্যায়াম করে। অন্ধকারের মধ্যে বসে সে মনে মনে জটিল অঙ্কের সমাধান করতে পারে। ব্যাঙ্কের কমপিউটারে প্রতিটি ফ্লপিতে কী আছে, তা মনে করার চেষ্টা করে। অন্ধকারের মধ্যেই সে বিখ্যাত কবিদের কবিতা আবৃত্তি করে। কবে কী নাটক করেছে তার কথা স্মরণ করে। ভিন্নভিন্ন সুরে কথা বলার অভ্যাস করে। চালর্সের কথা মনে এলেই সে জোর করে চার্লসের ছবি মনের অ্যালবাম থেকে ছিঁড়ে ফেলত। তার জীবনের ওই দিকের দরজাগুলিকে সে চিরকালের মতো বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও আমরা দরজা বন্ধ করলে কি বসন্ত বাতাসের আগমনকে প্রতিহত করতে পারি? মাঝে মাঝে চার্লসের মুখচ্ছবি মনে পড়ে যায়। বিশেষ করে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে। উদভ্রান্তের মতো সে অজানা অন্ধকারের মধ্যে তাকিয়ে  থাকত, আর ভাবত, চালর্সকে আমি কি ক্ষমা করতে পারব?

শত্রুদের কীভাবে খতম করবে? প্রত্যেককে শাস্তি দিতে হবে। ওরা আমার জীবনের আলো কেড়ে নিয়েছে। আমি ওদের চোখের সামনে অন্ধকার পৃথিবী রচনা করব।

এই অন্ধকূপে থাকলে সমস্ত কয়েদির মনোভাব একেবারে গুঁড়িয়ে যায়। সপ্তম দিনে ট্রেসির সেলের দরজা খুলে গেল। এক ঝলক আলোতে তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। গার্ড বলল, ওঠো, তোমাকে ওপরে যেতে হবে।

ট্রেসিকে উঠে দাঁড়াবার জন্য সাহায্য করার কাজে এগিয়ে এল পাহারাদার। আগে যাদের রাখা হত, তারা দুমড়ে মুচড়ে যেত। নিজে থেকে দাঁড়াতে পারত না। অথবা উন্মাদ হয়ে চিৎকার করত। ট্রেসি কিন্তু এ দুটোর একটাও করল না। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল সে। গটগট করে বাইরে চলে এল। জেলের আবহাওয়ার মধ্যে এমন গর্বিত এবং অহঙ্কারী ভাব মানায় কি?

ট্রেসির এমন ব্যবহার দেখে পাহারাদার অবাক হল। এমন মেয়েমানুষ সে জীবনে দেখেনি। একটু সাফসুতরো করে নিলে ভালোভাবে ভোগ করা যাবে। সে ট্রেসিকে বলল, তোমার মতো সুন্দরী মেয়ের পক্ষে এমন শাস্তি পাওয়া কি উচিত? তুমি আর আমি যদি বন্ধু হয়ে যাই, তাহলে তোমাকে আর কখনো সেলে পচে মরতে হবে না।

ট্রেসি গার্ডের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ট্রেসির চোখ দিয়ে আগুন ঝরে পড়ছে। পাহারাদার ওকে দেখে ভয়ে সিটকে গেল।

ওপরে মেট্রনের ঘরে যেতে তিনি চিৎকার করে বললেন–তোমার গা দিয়ে বিশ্রী ঘামের গন্ধ বেরোচ্ছে। আগে চান করে এসো।

খুব ভালো করে চান করল ট্রেসি। প্রাণ ফিরে পেল সে। ওকে বলা হল ওয়ার্ডেনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। প্রথমবার এরকম ডাক পেয়ে সে ভেবেছিল, সে বুঝি ছাড়া পেয়ে যাবে। কিন্তু এখন বুঝতে পারল, এটা নেহাতই একটা নিয়ম।

ওয়ার্ডেন ব্র্যানিগান পিছন ফিরে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ট্রেসি ঢুকতেই ইনি বললেন–বসো।

ট্রেসি একটা চেয়ারে বসল। উনি বললেন, একটা কনফারেন্সে যোগ দেবার জন্য আমি ওয়াশিংটন চলে গিয়েছিলাম। আজ সকলে সেখান থেকে ফিরে তোমার রিপোর্টটা পড়লাম। তোমাকে এভাবে সেলে রাখাটা মোটেই উচিত হয়নি।

ট্রেসি ভাবলেশহীন মুখে বসে রইল। ওয়ার্ডেন টেবিলের ওপর রাখা রিপোর্টটা আবার দেখলেন। রিপোর্টে লেখা আছে, ট্রেসির সেলের সঙ্গীরা তার ওপর শারীরিক অত্যাচার চালিয়েছে।

সহানুভূতির সঙ্গে তিনি সব কিছু জানতে চাইলেন। ট্রেসি প্রত্যেকবার কিছু অস্বীকার করল।

ওয়ার্ডেন জানতেন এমন একটা সাজানো উত্তর ভেসে আসবে ট্রেসির কণ্ঠস্বর থেকে। তিনি ঘাড় নাড়লেন–তোমার ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা আমি বুঝি। কয়েদিরা জেলের মধ্যে যা খুশী তাই করবে এটা আমি হতে দেব না। যারা তোমার ওপর অত্যাচার করেছে, তাদের শাস্তি আমি দেবই তবে তার জন্য তোমার স্বীকারোক্তি চাই। তোমাকে বাঁচানোর দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার। বলো, কারা কারা এ কাজ করেছে?

ট্রেসি ওয়ার্ডেনের চোখের দিকে চোখ রেখে বলল, বাঙ্ক থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। ওয়ার্ডেনের চোখে হতাশার চিহ্ন ফুটে উঠল। তিনি বললেন–ভেবে চিন্তে কথা বলছো তো?

–হ্যাঁ, স্যার।

–মত পাল্টাবে না তো আর?

–না, স্যার।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্র্যানিগান বললেন–ঠিক আছে, এটাই যদি তোমার সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে তোমাকে অন্য সেলে বদলি করে দেব।

–বদলি হতে চাই না। ওয়ার্ডেন চমকে উঠলেন তার মানে? তুমি আবার ওই সেলেই থাকবে?

–হ্যাঁ, স্যার।

ট্রেসির এই কথা শুনে ওয়ার্ডেন অবাক হয়ে গেলেন। অনেক দিন ধরে তিনি জেলখানার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এমন অদ্ভুত স্বভাবের মেয়ে এর আগে তাঁর চোখে পড়েনি। মেয়েটাকে তিনি কি চিনতে ভুল করেছেন? নাঃ বুঝতে পারছি না। মেয়ে কয়েদিগুলোকে ঠিক মতো চেনা যায় না। স্ত্রী আর বাচ্চা মেয়ে অ্যানির জন্য এখানে পড়ে আছেন ব্রানিগান। ওয়ার্ডেনের বাড়িটা চমৎকার। চারপাশে অনেকখানি জমি আছে। নিজের হাতে ফুলের বাগান তৈরী করেছেন তিনি। জেলখানার ক্ষেত আছে পেছন দিকে। পুকুর আছে। শহরে থাকলেও গ্রামাঞ্চলের ষোলো আনা সুখ পাওয়া যায়। সব ভালো কিন্তু এই ক্ষ্যাপা মেয়ে কয়েদিগুলির সঙ্গে সব সময় কাটাতে হয়–এটা মোটেই ভালো লাগে না তার। অনেকবার তিনি ভেবেছেন, অন্য কোনো জেলে বদলি হয়ে যাবেন। কিন্তু তা আর হল কই?

ট্রেসির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তিনি বললেন–ঠিক আছে, তবে দেখো ভবিষ্যতে যেন। কোনো ঝাটে জড়িয়ে পড়ো না।

–আচ্ছা স্যার।

এবার সব থেকে কঠিন কাজটা ট্রেসিকে করতে হবে। সাতদিন বাদে আবার তাকে পুরোনো সেলে ফিরে আসতে হবে। ভেতরে পা দিয়ে তার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। সঙ্গীরা কেউ নেই কেন? কিছুক্ষণ নিজের বাঙ্কে শুয়ে শুয়ে সে কী যেন চিন্তা করল। তারপর বাঙ্কটাকে আগা পাছতলা খুঁজল। কয়েক ইঞ্চি লম্বা একটা লোহার পাত জোগাড় করল। তোষকের তলায় সেটিকে লুকিয়ে রাখল। সকাল এগারোটাতে খাবার ঘণ্টা পড়েছে, ট্রেসি সবার আগে গিয়ে লাইনে দাঁড়াল।

দরজার কাছাকাছি একটি টেবিলে লোলা আর পাউলিটাকে দেখা গেল। আর্নেস্টাইন লিটলচ্যাপকে ধারে কাছে দেখা গেল না।

অন্য একটা টেবিলে বসে ট্রেসি কোনোরকমে অখাদ্যগুলোকে গিলে ফেলল। পৌনে তিনটে নাগাদ ফিরল লোলা। পাউলিটা তার সঙ্গে। সেখানে আর্নেস্টাইনকে দেখা গেল।

পাউলিটা ট্রেসিকে দেখে চমকে উঠল। সেঁতো হাসি হেসে বলল–তাহলে আবার তুমি আমাদের কাছেই ফিরে এলে খুকুমনি, সেদিন তাহলে ভালোই লেগেছিল কী বলে?

লোলা বলল–ভালো, এখানে থাক। আরো অনেক আরাম পাবে।

ট্রেসি যেন ওদের ঠাট্টা ইয়ার্কি শুনতেই পায়নি। ওর মাথায় খালি লিটলচ্যাপের চিন্তা। ওর জন্যই সে এই সেলে ফিরেছে। ট্রেসি লিটলচ্যাপকে একদম বিশ্বাস করে না। কিন্তু ওকে এখন ভীষণ দরকার।

নিউ অর্লিয়েন্স থেকে চলে আসার সময় একটা মেয়ে কয়েদি বলেছিল–একটা খবর দিচ্ছি। আর্নেস্টাইন লিটলচ্যাপই ওখানকার সর্বেসর্বা।

সেই রাতে পনেরো মিনিটের ঘণ্টা পড়ল। ট্রেসি রাতের পোশাক পরে নিল। এখন আর তার মনের মধ্যে লজ্জা সঙ্কোচের বালাই নেই। ওর নগ্ন শরীরটা দেখে পাউলিটা মুখের ভেতর দু আঙুল পুরে ছেলেদের মতো শিস দিল।

আধঘণ্টা বাদে পাউলিটা আর লোলা বাঙ্ক থেকে নেমে পড়ল। অশ্লীল ভাষায় ট্রেসিকে ডাকল।

সাড়া পেল না। দুজনে কাছে এগিয়ে এল। ট্রেসি এবার ওই লোহার ফলাটা বের করল। একজনের মুখ লক্ষ্য করে চালিয়ে দিল। দ্বিতীয়জনকে লক্ষ্য করে একখানা লাথি বাড়াল। দুজনেই চাপা আর্তনাদ করে মেঝেতে লুটিতে পড়ল।

হিসহিসিয়ে ট্রেসি বলল, কাছে এলেই খুন করে ফেলব।

–কুত্তি কোথাকার?

অন্ধকারের মধ্যে ট্রেসি বুঝতে পারল, ওরা দুজন আবার তার দিকে এগোচ্ছে। হঠাৎ লিটলচ্যাপের কথা শোনা গেল। ওকে ছেড়ে দে, যথেষ্ট হয়েছে।

–আর্নি, আমার মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে, ওটাকে আমি খতম করব।

–যা বলি তাই কর। লিটলচ্যাপ ধমকে উঠল। কিছুক্ষণ পরে পরিবেশ শান্ত রইল। ট্রেসি উত্তেজনায় টানটান হয়ে বসে আছে।

–তোর সাহস আছে দেখছি খুকুমনি, লিটলচ্যাপ বলল।

ট্রেসি নিরুত্তর?

–ওয়ার্ডেনকে সত্যি কথাটা বলিস নি শুনলাম।

লিটলচ্যাপ যে হাসছে, এটা ট্রেসি বুঝতে পারল। যদি বলতিস, তাহলে এতক্ষণে তুই একতাল মাংস হয়ে যেতিস।

ট্রেসি তার কথাটা অবিশ্বাস করতে পারল না।

–অন্য সেলে গেলি না কেন?

তাহলে একথাটাও লিটলচ্যাপের কানে এসেছে।

ট্রেসি বলল–আমি নিজেই এখানে ফিরে আসতে চেয়েছি।

–তাই তো দেখছি, কিন্তু কেন? লিটলচ্যাপ বুঝতে পারছে না ওর কথা।

এই মুহূর্তটির জন্যই যেন ট্রেসি অপেক্ষা করছিল। সে বলল–আমি এখান থেকে পালাতে চাইছি। আমি জানি, তুমি ছাড়া কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবে না।

.

৮.

মেট্রন এসে ট্রেসিকে খবর দিলেন–তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে।

ট্রেসির মাথায় নানা প্রশ্নের ভিড়। কে দেখা করতে আসবে? হঠাৎ চার্লসের কথা মনে হল তার, কিন্তু চার্লস আসবে কি? তাহলে কি আমাদের সেই বুড়ো ফোরম্যান? না, উনি আসবেন কেন?

ভিজিটার রুমে গিয়ে ট্রেসি দেখল, এক অজানা মানুষ বসে আছে। এমন বিশ্রী চেহারার মানুষকে ট্রেসি কোনোদিন আগে দেখেনি। অসম্ভব বেঁটে, শরীরটা পাকানো সরু খাড়া নাকটা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। নাকের ডগাটা ভীষণ ছুঁচালো। ঠোঁটের ভঙ্গিমাটা দেখে মনে হল, সে বুঝি পৃথিবীর সকলকে ঘেন্না করে। কপালটা সামনের দিকে ঠেলে এসেছে। উঁচু কপাল, চোখের তারা বাদামী। সাপের মতো তীক্ষ্ণ। চোখে মোটা কাঁচের চশমা থাকাতে তাকে আরো কুৎসিত দেখাচ্ছে।

লোকটা বসে বসেই বলল–আমার সাথে আপনার পরিচয় হয়নি, আমার নাম ড্যানিয়েল কপার। ওয়ার্ডেনের অনুমতি নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।

ট্রেসি জানতে চাইল কী ব্যাপার?

–আমি ইপার গোয়েন্দা, মানে বীমা কোম্পানীর তরফ থেকে আসছি। আমাদের এক মক্কেলের বীমা করা একটা ছবি চুরি হয়েছে। রেনোয়ার আঁকা সেই ছবিটি। জোসেফ রোমানোর বাড়ি থেকে চুরি গেছে।

–সেই ছবি? ট্রেসি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কোনো সাহায্যই করতে পারব না। আসলে ছবিটা আমি চুরি করিনি।

কথাটা শেষ করে ট্রেসি ফিরে যার জন্য পা বাড়াল।

–তা আমি জানি, কুপারের এই কথাটা শুনে আবার ফিরে আসতে বাধ্য হল সে।

–ওটা কেউই চুরি করেনি। আপনাকে মিথ্যে অভিযোগে ফঁসানো হয়েছে, মিস হুইটনি। ট্রেসি চেয়ারে বসে পড়ল।

এবার ওই লোকটা বলতে শুরু করেছে।

.

ওই সপ্তাহের গোড়ার দিকে ড্যানিয়েল কুপারের হাতে কেসটা এসেছিল। ম্যানহাটানে ইপার সদর দপ্তর। বীমা কোম্পানীর বড় কর্তা জে. জে. রেনল্ডস কুপারকে ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন।

রেনল্ডস বলেছিলেন–তোমার জন্য একটা কাজ আছে ড্যানিয়েল। আমি জানি, তুমি ছাড়া কেউ এ কাজটা ঠিক মতো করতে পারবে না।

রেনল্ডস আরো বলেছিলেন–সংক্ষেপেই বলছি, বীমা কোম্পানীর বাকি সকলের সঙ্গে ভাব থাকলেও রেনল্ডস কুপারের সামনাসামনি হলে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করেন। কুপার একটা অদ্ভুত ধরনের মানুষ। কোথায় থাকেন, কেউ জানে না। বিয়ে করেছেন কিনা, সে খবরও কারো জানা নেই। জীবনে চলার পথে একলা চলতে ভালোবাসেন। কারোর সঙ্গে মেলামেশা করেন না। কুপারকে দেখলে অশরীরী মানুষ বলে মনে হয়। তবে একটি মাত্র কারণে রেনল্ডস কুপারকে সহ্য করেন, তা হল নিজের কাজে অসামান্য প্রতিভার পরিচয়। দিয়েছেন কুপার। ভদ্রলোক একেবারে কাজ পাগল। ওর হাতে যে কোনো জটিল সমস্যা তুলে দিলেই হল, সমাধান উনি বের করবেনই। লোকটাকে দেখলে একটা বুলডগ বলে মনে হয়। মাথাটা যেন কমপিউটার। চুরি হয়ে যাওয়া বীমা করা জিনিস উদ্ধার করতে অথবা বীমা করে জোচ্চুরির চেষ্টা করা, এসব ব্যাপারে কোম্পানির যতগুলি গোয়েন্দা আছে, তার মধ্যে কুপার এক নম্বর, একথা বলাই বাহুল্য। রেনল্ডস ওনার ফেলে আসা দিনযাপনের কথা জানতে চেয়েছেন, কিন্তু পারেন নি।

রেনন্ডস বললেন, আমাদের এক মক্কেল পাঁচ লাখ ডলারের একটা ছবি বীমা করিয়েছিলেন।

–রেনোয়ার, নিউ অর্লিয়েন্স, জো রোমানো। ট্রেসি হুইটনি নামের একটা মেয়ের পনেরো বছরের জন্য জেল হয়েছে। ছবিটা উদ্ধার করা যায়নি–গড়গড় করে বলে গেল কুপার।

–কুত্তার বাচ্চা, মনে মনে বললেন রেনল্ডস। অন্য কেউ হলে ভাবতাম, দাঁও মারার চেষ্টা করছে। মুখে বললেন, হ্যাঁ তাই, ওই হুইটনি মেয়েটি ছবিটি কোথা থেকে কোথায় সরিয়ে ফেলেছে। তা আমরা ফেরত চাই। যাও, কাজে লেগে পড়ো।

কুপার বেরিয়ে গেল একটাও কথা না বলে। তার কুঁজো পিঠের দিকে তাকিয়ে রেনল্ডস মনে মনে বলেছিলেন–একদিন আমি বের করবই। এই লোকটা কী করে কাজ করে।

বড়ো হলঘরে পঞ্চাশজন কর্মচারী যে যার কাজে ব্যস্ত। কুপার তাদের পাশ দিয়ে আপন মনে হেঁটে চলেছে।

একজন মন্তব্য করল–শুনলাম, রোমানোর কাজটা তোমার হাতে গেছে।

কোনো উত্তর না দিয়ে কুপার সামনের দিকে এগিয়ে গেল। এই লোকগুলো কেন। অকারণে ওকে বিরক্ত করে? ওতো কারোর সঙ্গে যেচে কথা বলে না। আসলে অহেতুক এই বকবকানিতে মোটেই মন নেই তার।

অফিসের লোকগুলো অবশ্য ওর সঙ্গে লাগবে, কুপারের এই আপাত গাম্ভীর্যের আড়ালে কী রহস্য আছে, ওরা তো ভেদ করবেই।

–শুক্রবার কোথায় ডিনার সারবে ড্যান?

–তোমার বিয়ে যদি না হয়ে থাকে, আর আমার জানা দারুণ একটা মেয়ে আছে। লোকগুলো কি জানে না। এসব কথা বলার কোনো অর্থ নেই।

–চলো না, একটু মদ খাওয়ালেই চলবে।

এই ফাঁদেও কুপার-ধরা দেবে না। সে জানে, প্রথমে মদ দিয়ে শুরু হবে। তারপর ডিনারের আসরে নেমন্তন্ন, তারপর বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব হওয়া মানে তোমার গোপন ঘর তুমি আমাকে উজাড় করে বলে দেবে। আর আমি আমার গোপন খবর তোমাকে জানাব। সে ভারী বিপদজনক ব্যাপার, ড্যানিয়েল কুপার একজন গোয়েন্দা। গোয়েন্দার জীবন কথা কারো জানতে নেই।

একটা ভয় সব সময় কুপারকে তাড়া করে। সেটা হল তার অন্ধ অতীত। সে জানে, আজ অথবা আগামীকাল তার অন্ধ অতীতের কথা সকলে জানতে পারবে। তখন কী হবে?

ড্যানিয়েল কুপার যদি তার মনের কপাট মনোবিজ্ঞানীর কাছে খুলে দেয়, তাহলেও হয়তো সুরাহা হবে না। সে কারোর কাছে মনের কথা খুলে বলতে পারবে কি? বহুদিন আগে ঘটে যাওয়া একটা ভয়াবহ ঘটনার নথি তার কাছে আছে। কী নথি? পুরোনো হলদে হয়ে যাওয়া খবরের কাগজ থেকে কেটে নেওয়া একটি খবর। তবে এমন জায়গাতে সেটা লুকোনো আছে যে, কেউ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাবে না। প্রত্যেকটি অক্ষর সে মুখস্থ করেছে, নিজেকে শান্তি দেবার জন্য মাঝে মধ্যে সে হলুদ কাগজের টুকরোটা বের করে এবং একা একা পড়তে থাকে।

দিনে দু-তিনবার চান করাটা তার অনেক দিনের অভ্যেস। এতখানি শুচিবাইগ্রস্ত হওয়াতেও মাঝে মধ্যে নিজেকে অশুচি বলে মনে হয় তার। নরকের আগুনে পুড়ে মরার কথা সে বিশ্বাস করে। সে জানে, মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে অনুশোচনা এবং প্রায়শ্চিত্ত করা। প্রথমে সে নিউইয়র্ক পুলিশে চাকরি নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করে, কিন্তু উচ্চতা মাত্র চার ইঞ্চি কম হওয়াতে ওই চাকরি সে পায়নি। তাই বেসরকারী অফিসে তদন্তকারী গোয়েন্দার চাকরি বেছে নিয়েছে। ওর ধারণা পাপী বা অন্যায়কারীকে শাস্তি দিলেই তার মুক্তি তাড়াতাড়ি হবে। প্লেন ধরার আগে একবার চান ওকে সারতেই হবে।

এবার সে গেল নিউ অর্লিয়েন্সে। সমস্ত দিন শহরটার এখানে ওখানে ঘুরল। যা কিছু জানার দরকার সব জেনে নিল। আর্থার জো রোমানো, অ্যান্টনি ওরসেত্তি, পেরী পোপ, জজ হেনরি লরেন্স–সকলের অনেক খবর জোগাড় করল। ট্রেসি হুইটনির বিচারের কাগজপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে নিল। পুলিশের কাছ থেকে খবর নিল, ট্রেসির মা কেন আত্মহত্যা করল। অটো স্মিটের সঙ্গে দেখা করল। সে জানতে চাইল, কীভাবে ট্রেসি হুইটনির মায়ের কোম্পানীটিকে ডোবানো হয়েছিল। এত তথ্য জোগাড় করার পরে সে ভাবল এবার লিখতে বসবে কিনা। সবকিছু লেখা হয়ে তার মাথার ভেতর ভর্তি আছে। ট্রেসি কোনো অপরাধ করেনি, এই সরল সত্যটা সে বুঝতে পারল। কিন্তু সে কি গোয়েন্দা নাকি পুলিশ? সে এখন কী করবে? এখান থেকে সে যাবে ফিলাডেলফিয়াতে। ব্যাঙ্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্লারেন্স ডেসমণ্ডের সঙ্গে আলোচনা করতে। চার্লস স্ট্যানহোপ তৃতীয় তার সঙ্গে দেখাই করলেন না।

এই মুহূর্তে ট্রেসির সামনে বসে কুপারের ধারণাটাই শতকরা একশো ভাগ সত্যি বলে মনে হল। এই মেয়েটা ছবি চুরি করেনি। এবার রিপোর্ট লিখে ফেলতে হবে। মিস হুইটনি, রোমানো আপনাকে ফাঁসিয়েছে। আজ না হয় কাল ছবিটা চুরি যাবার অভিযোগ ও তুলতোই। আপনি খুব তাড়াতাড়ি ওর পাতা ফাঁদে পা দিয়েছেন।

ট্রেসির হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। তার মানে, এই লোকটা জানে সে অপরাধী নয়। হয়তো জো রোমানোর বিরুদ্ধে ওর কাছে ভালো প্রমাণ আছে। ট্রেসি ছাড়া পাবে। ওয়ার্ডেনকে বলবে, গভর্নরকে দরখাস্ত করতে। তাহলে আপনি আমায় সাহায্য করুন।

ড্যানিয়েল কুপার হতভম্ব হয়ে গিয়ে বলল–আপনাকে সাহায্য?

–হ্যাঁ, যাতে আমি ছাড়া পেতে পারি।

–না, না, ওসব কাজ আমার দ্বারা হবে না।

কুপারের কথাটা বুঝি তার দুগালে চড় মেরেছে। সে বলল–সাহায্য করবেন না কেন? আপনি তো জানেন, আমি কতখানি নিরপরাধী?

মনে মনে ভাবল কুপার, মানুষ এত বোকা কি কোনোদিন হয়? সে বলল, আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে।

হোটেলে ফিরে প্রথমেই চান সারল কুপার। তারপর রিপোর্ট লিখতে বসল–

জে. জে. রেনল্ডস সমীপে,

প্রেরক–ড্যানিয়েল কুপার

বিষয়–রেনোয়ার ক্যানভাসের তৈলচিত্র।

আমার অভিমত এই যে, ট্রেসি হুইটনি ছবিটি চুরি করেনি। জো রোমানো ছবিটাকে বীমা করিয়েছিল এই উদ্দেশ্য নিয়ে যে, ছবিটা চুরি যাবার একটা মিথ্যে গল্প রটনা করবে সে। বীমার টাকা আদায় করবে এবং গোপনে ছবিটা বিক্রি করে দেবে। আমার ধারণা, ছবিটা সুইজারল্যাণ্ডে পাচার হয়ে গেছে। সেখানে সরল বিশ্বাসে না জেনে চোরাই মাল কিনলে শাস্তি হয় না।

সুপারিশ রোমানোর বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ করা সম্ভব নয়। বীমার টাকাটা আমাদের দিতে হবে। ট্রেসি হুইটনির কাছ থেকে কিছুই আদায় করা যাবে না–ছবি বা ক্ষতি পূরণ, তাছাড়া তাকে পনেরো বছর জেলে থাকতে হচ্ছে।

লেখা শেষ হয়ে গেছে। ড্যানিয়েল কুপার ট্রেসির কথা চিন্তা করল। মেয়েটা সুন্দরী, কিন্তু পনেরো বছর ধরে জেল খেটে পচে মরলে তার চেহারার কী দশা হবে? যাক এসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার কিছু নেই তার।

রিপোর্টের তলায় কুপার সই করল। এবার ভাবল, আর একবার স্নান করবে কিনা।

.

৯.

পুরোনো লোহার প্যান্ট ট্রেসিকে দিয়েছিল ধোবীখানার কাজ। জেলখানার কয়েদীদের পঁয়ত্রিশ রকমের কাজ করতে হয়। তার মধ্যে সব থেকে খতরনাক হল ওই ধোবীখানার ডিউটি।

সকাল থেকে বিকেল অবধি অনবরত ঘড়ঘড় শব্দ করে মেসিন চলে। মেঝে তেতে আগুনের মতো হয়ে যায়। কাজের কোনো শুরু এবং শেষ নেই।  

সকাল ছটা থেকে কাজ শুরু হয়। দুঘণ্টা অন্তর দশ মিনিটের বিশ্রাম। রোজ নঘণ্টা করে কাজ করতে হয়। কাজ করার পর বেশির ভাগ কয়েদীর শরীরের সমস্ত ক্ষমতা একেবারে শেষ হয়ে যায়। হাঁটতে চলতে পারে না সে। ট্রেসি কিন্তু তখনও ফুরফুরে থাকে। তার এই অনন্ত শক্তির উৎস কোথায়? তার পাশাপাশি যারা কাজ করে তারা ওকে দেখে অবাক হয়ে যায়।

কাজ করতে করতে মাথার ভেতর নানা ধরনের বুদ্ধির খেলা খেলতে থাকে সে। কি করে, এই অন্ধকূপ থেকে পালানো যেতে পারে, এই মুহূর্তে সেটাই তার একমাত্র চিন্তা।

আর্নেস্টাইন লিটলচ্যাপ ট্রেসির এই কাজের খবরটা পেয়ে খুবই খুশি হয়েছে। তবে খুশির ভাব মুখে প্রকাশ করছে না। বরং বলেছে–পুরনো লোহার প্যান্ট তোমার পেছনে লাগলো কেন?

ট্রেসি বলল–ও কিন্তু আমাকে মোটেই বিরক্ত করে না। আমি এক মনে আমার কাজ করি, এতে ও কিছুই বলে না।

লিটলচ্যাপ খুব অবাক হল, তিন সপ্তাহ আগে জেলখানার ভেতর যে বাচ্চা ভীতু মেয়েটা ঢুকেছে, এত সহজে সে নিজেকে পাল্টে ফেলল কেমন করে? এর অন্তরালে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে, সেটা জানতে ভীষণ ভীষণ ইচ্ছে হল তার।

ধোবীখানায় আটদিন কাজ করতে হল ট্রেসিকে। একদিন সকালে পাহারাদার এসে তাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। সে খবর পেল তার কাজে খুশি হয়ে কর্তৃপক্ষ তাকে রান্নাঘরে বদলী করেছে। জেলখানায় যত রকমের কাজ আছে তার মধ্যে এটাই হল সব থেকে লোভনীয়।

জেলখানায় দুধরনের রান্না হয়, কয়েদীদের জন্য এক ধরনের খাবার–সেগুলো সঙ্গত কারণেই মুখে দেওয়া যায় না। পুলিশ আর কর্মচারীদের জন্য ভালো খাবার রান্না হয়। তাদের জন্য মাছ, মুরগী, ফল, পুডিং এসব তৈরি করে পেশাদার বাবুর্চিরা। সেখানে। কয়েদীদের প্রবেশ নিষেধ। তবে যেসব কয়েদী রান্নাঘরে কাজ পায় তাদের দিকে মাঝে মধ্যে ওইসব খাবারের টুকরো ছুঁড়ে দেওয়া হয়, খুশি হয়ে গৃহবধূ যেমন মোটা বেড়ালটার দিকে মাছের কানকো ছুঁড়ে দেয় তেমনটি আর কি!

রান্নাঘরে গিয়ে ট্রেসি লিটলচ্যাপকে দেখতে পেল। তাকে দেখে এতটুকু অবাক হল

সে। জেলখানার নিয়মনীতিগুলো ইতিমধ্যেই সে বুঝে নিয়েছে। ট্রেসি হাসতে হাসতে তার কাছে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইল–ধন্যবাদ, তুমি আমাকে কি করে নিয়ে এলে এখানে?

লিটলচাপ তাকে দেখে মুখে কোনো শব্দ করেনি। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ও আর এখানে নেই।

–কোথায় গেল, কী হয়েছে ওর?

–আমাদের এই জেলখানায় একটা ছোটো কায়দা আছে। যদি কোনো পাহারাদার আমাদের পেছনে লাগে তাহলে তাকে অন্যত্র সরাবার ব্যবস্থা করা হয়।

–কীভাবে?

–সোজা ব্যাপার, যে পাহারাদারকে ভাগাতে চাই তার কাজের সময় কয়েদীদের মধ্যে গাঁজা আর চরস আসতে থাকে। অভিযোগ বাড়তে থাকে। আরেকজন কয়েদী পুরনো লোহার প্যান্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলো। সে বলল ওই মেট্রন নাকি তার সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করেছে। অন্য একজন অত্যাচারের কথা বলল। একজন রেডিও চুরির গল্প ফাঁদলো। সেটা পাওয়া গেল পুরনো প্যান্টের ঘরে। তাই ওকে চলে যেতে বলা হয়েছে। জেলখানাটা ওরা চালায় না, এই আমরা চালাই বুঝলে!

–তুমি এখানে এলে কেন? ট্রেসি প্রশ্ন করল লিটলচ্যাপকে।

–বিশ্বাস করো আমার কোনো দোষ ছিল না। মেয়েদের একটা গোটা দল নিয়ে আমি ব্যবসা করতাম।

ট্রেসি একটু ইতস্তত করে জানতে চাইল, তার মানে?–বেশ্যা!

লিটলচ্যাপ হাসলোনা, বেশ্যা ছিল না ওরা, বড়োলোকের বাড়িতে ঝি-এর কাজ করতো। কাগজে ভালো ভালো বিজ্ঞাপন দিতাম। ঝি-চাকরানীর দরকার হলে যেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কথাবার্তার পর মেয়েগুলো যেত কাজ করতে। সময় বুঝে মালিকেরা কেউ বাড়িতে যখন থাকতো না তখন রূপোর বাসন পত্র, গয়নাগাটি চুরি করে আমার কাছে নিয়ে আসতো। এতে আমার দারুণ লাভ হতো। বুঝতে পারছো ব্যাপারটা, মূলধন বলতে কিছুই লাগতো না, ঝক্কি অনেক কম, অথচ মাসের শেষে কাড়ি কাড়ি টাকা আসতো, আমার হাতে।

লিটলচ্যাপের এই কথা শুনে ট্রেসি একেবারে অবাক হয়ে গেল। মানুষকে ঠকাবার কত কিছুই না চালু আছে এই পৃথিবীতে, বেচারী ট্রেসি তার খবর রাখে না। রাখবে কেমন করে? নেহাত ভাগ্য বিপর্যয় না হলে সে কি এই অন্ধকারায় আসতে পারতো কোনো দিন?

ট্রেসি জানতে চাইল উৎসুক দুটি চোখে অজস্র প্রশ্ন এনেধরা পড়লে কি করে?

–কপাল খারাপ ছিল। মেয়রের বাড়িতে ভোজসভা বসেছে। সেখানে আমাদের একটা মেয়ে কাজ করছিল। ডিনার খেতে আসা একটা বুড়ি মেয়েটাকে চিনে ফেলে। ওই মেয়েটা কয়েক মাস আগে বুড়ির বাড়িতে কাজ করতে করতে অনেক দামী মাল নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। পুলিশ মেয়েটাকে এমন ধোলাই দেয় যে সে বাধ্য হয়ে দলের সব কথা বলে দেয়, তার ফলেই আজ আমাকে এখানে থাকতে হচ্ছে। জানো তো, পাপ কখনও চাপা থাকে না।

একটা বড়ো উনুনের ধারে দাঁড়িয়ে দুজনে কথা বলছিল। ট্রেসি বলল–এখানে আমি থাকতে পারছি না, বাইরে আমার কয়েকটা জরুরী কাজ আছে। তুমি কি আমাকে এখান থেকে পালাবার জন্য সাহায্য করবে–বলো না?

ট্রেসির কণ্ঠস্বরে আকুল আহ্বান ঝড়ে পড়ছে। সেই দিকে একবার তাকালো ওই মেয়েটি, তারপর বলল–পেঁয়াজগুলো কেটে ফেল, রাতের স্টু তৈরি করতে হবে।

এই কথা বলে লিটলচ্যাপ কোথায় যেন চলে গেল।

এখানকার ব্যাপার স্যাপার সত্যিই অদ্ভুত, চারপাশে নিরাপত্তার শক্ত বেষ্টনী কিন্তু সব খবর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে যায়। ট্রেসি বেশ বুঝতে পেরেছে, এখানে লিটলচ্যাপের যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি আছে। এখুনি সবার কাছে এই খবরটা পৌঁছে দেবে যে ট্রেসি আছে তারই ছত্রছায়াতে, তাই কেউ তার সঙ্গে লাগতে সাহস করবে না। ট্রেসি আশা করছিল লিটলচ্যাপ যেন তার দিকে আরও ভালো করে দৃষ্টিপাত করে, লিটলচ্যাপের সাহায্য না হলে ওই পাঁচিল ডিঙিয়ে কখনই সে বাইরে আসতে পারবে না।

সরকারী নিয়মকানুনের সূত্রগুলো ছাপা হয়েছে দশ পাতার একটা ছোট্ট বইতে। এখানে ৭ নম্বর দফায় নির্দেশ দেওয়া আছে যে কোনো ধরনের যৌনতা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। একটা কারাকক্ষে চারজনের বেশি বন্দিনী কখনও থাকবে না। একটা বাঙ্কে একজনের বেশি বন্দিনীকে শুতে দেওয়া হবে না।

বাস্তবে কিন্তু এর বিপরীত ঘটনাটাই ঘটে। এই নির্দেশ-পুস্তিকাটির কথা কেউ মনে রাখতে চায় না। বরং সব বন্দিনীরা একে নিয়ে হাসাহাসি করে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যায়, নিত্য নতুন মাছ অর্থাৎ নতুন বন্দী জেলখানায় ঢোকে। হাবাগোবা মেয়েদের পেছনে মুরগী এই চিহ্নটা ছাপ মেরে দেওয়া হয়। জীবনে প্রথম অপরাধ করে যারা এখানে আসে এবং যারা আগে সুস্থ স্বাভাবিক যৌন জীবন যাপন করেছে তাদের কোনো সুযোগ দেওয়া হয় না। তাদের মন সবসময় দুর্বলতায় ঢাকা। তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে ওই মেয়েমর্দরা। একটি সুন্দর নাটকের দৃশ্যপট উন্মোচিত হয়। প্রথমে ওই মেয়েমর্দরা নবাগতাকে সহানুভূতির সঙ্গে সম্ভাষণ জানায়। এই শত্ৰুপুরীতে আমাকে একা থাকতে হচ্ছে না, নতুন মেয়েটি এমনই বুঝতে পারে। তারপর শিকারকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বিনোদন কক্ষে। সেখানে টিভি আছে, মদ্দা মেয়েটি তার শিকারকে নিয়ে পাশাপাশি বসে। এক ফাঁকে তার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। ধীরে ধীরে হাতের তেলোতে আঙুলের ডগা দিয়ে কারুকাজ আঁকতে থাকে। শিকার বাধা দেবার কথা চিন্তা করতেও পারে না। একে সম্পূর্ণ অপরিচিত এই পরিবেশ, তায় অন্য বন্দিনীরা তার সাথে খারাপ ব্যবহার করছে, এখন এই মোটাসোটা চেহারার মেয়েটি তার কাছে একমাত্র মরুদ্যান।–নতুন বন্দী হঠাৎ লক্ষ্য করে বিনোদন কক্ষে উপস্থিত বাকি সবাই ধীরে ধীরে ঘর থেকে চলে যাচ্ছে। তখন সে ওই মদ্দার প্রতি আরও নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। এই নির্ভরশীলতা অতি দ্রুত অন্তরঙ্গতায় রূপান্তরিত হয়। মদ্দাকে খুশী করার জন্য তখন নতুন মেয়েটি নিজের জীবন পর্যন্ত হাসতে হাসতে দিতে পারে। মদ্দার নানা ধরনের আদর আবদার সে হাসি মুখে সহ্য করে।

যারা আপত্তি করে তাদের জোর করে ধর্ষণ করা হয়। প্রথম ত্রিশজনের মধ্যে শতকরা নব্বই ভাগ নবাগত বন্দিনী স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় সমকামিতায় লিপ্ত হয়। ওদের কথা । যতই ভাবে ট্রেসি ততই তার মাথাটা ঘুরপাক খেতে থাকে। চিন্তারা আচ্ছন্ন হয়ে যায়। কীভাবে এইসব নিরপরাধ মেয়েদের সামনে নতুন পথের দিশা দেখানো যেতে পারে, নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে বেচারী ট্রেসি!

ট্রেসি একদিন আর্নেস্টাইন লিটলচ্যাপের কাছে জানতে চেয়েছিল কর্তৃপক্ষ সব জেনে কেন মুখ বুজে বসে আছে?

লিটলচ্যাপ বুঝিয়ে বলেছিল–সব জেলখানাতেই একই রকম নিয়ম। বারোশো মেয়ে মানুষকে কি দীর্ঘদিন শুখাভুখা অবস্থায় রাখা যেতে পারে? তারা কোনো না কোনো ভাবে যৌন সংসর্গ করবে। যৌনতা মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম। আমরা যৌনসুখ পাবার জন্য ধর্ষণ করি না। নিজের ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তি জাহির করার জন্যই এটা করে থাকি। দেখাতে চাই চার দেওয়ালের মধ্যে আমার কথাই শেষ কথা। যদি এখানে বেঁচে থাকতে চাও তাহলে আমার সঙ্গে সহযোগিতা করতেই হবে। নতুন মুরগী জালে পড়লেই আমরা তাকে গণধর্ষণ করার চেষ্টা করি। তবে যদি সে কোনো মদ্দার খদ্দের হয়ে যায় তাহলে গণ ধর্ষণের হাত থেকে বেঁচে যাবে। ওটা হয়ে গেলে অন্য কেউ তাকে কখনও বিরক্ত করবে না। এখন তুমি ভেবে দেখো ট্রেসি, তুমি কোন্ পথের বাসিন্দা হবে? তুমি কি চাইবে সকলে মিলে তোমার শরীরটা খামচে খুবলে নিক? নাকি তুমি একটা মদ্দার প্রতি থাকবে অনুগতা? হ্যাঁ আমি স্বীকার করছি, ওই মদ্দা হয়তো তোমাকে এমন কিছু কাজ করতে বলবে যাতে তোমার গা-টা ঘৃণাতে রি রি করবে, তবু তুমি তো নিরাপদ জীবনের সন্ধান পাবে। এখানে যত বন্দিনী আছে তাদের সাথে তুমি কথা বলতে পারো, দেখবে তাদের সবাই স্বেচ্ছায় দ্বিতীয় পথটি বেছে নিতে চাইবে। কিন্তু বেশির ভাগের ক্ষেত্রে এমন সৌভাগ্য হয় না, তাদের সকলে মিলে গণধর্ষণ করে। দিনের পর দিন তাকে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে কাটাতে হয়।

লিটলচ্যাপের এই কথাগুলো শুনে ট্রেসির তৃতীয় নয়নের দৃষ্টি খুলে গেল। এতদিন সে লিটলচ্যাপকে হৃদয়হীন এক মদ্দা মেয়েমানুষ হিসেবেই ভেবে এসেছিল। কিন্তু লিটলম্যাপের মনের মধ্যে যে এত সুন্দর চিন্তা-ভাবনার স্ফুরণ আছে তা ট্রেসিকে অবাক, করে দেয়। সত্যিই কী বিচিত্র মাটির নীচের এই জগৎ। পৃথিবীর বাসিন্দারা এই জগতের কোনো খোঁজ রাখে না, রাখা সম্ভব নয়।

লিটলচ্যাপ বলতে লাগল–শুধু যে বন্দিনীরাই এমন কাজ করে তা যেন ভেবো না খুকুমণি, পাহারাদাররাও কম যায় না। টাটকা মাংস দেখলে ওদের মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ে। ধরো নতুন কোনো কয়েদীর নেশা করার অভ্যেস আছে, মেট্রন তাকে নিয়মিত নেশার ট্যাবলেট সাপ্লাই দেবে, কিন্তু তার বদলে মেট্রন চাইবে ওই নবাগতার শরীরের ওপর একটু স্পর্শ সুখের আরাম পেতে। অনেক মেট্রনই এই কাজে এক নম্বরের বদমাইশ। পুলিশগুলো আরও ভয়ংকর। ওরা সেলের চাবি যোগাড় করে রাখে। রাতের বেলায় গারদের দরজা খুলে সোজা সেলের মধ্যে ঢুকে পড়ে। নিজেদের যৌন ক্ষুধা মেটায় বিনা পয়সাতে। অনেক সময় মেয়েদের পেটে বাচ্চা এসে যায়। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় পুলিশ রক্ষীরা। তারাই অ্যাবরসনের ব্যবস্থা করে। ধরো তোমার কিছু দরকার, সিগারেট অথবা চকোলেট, তুমি একটা পুরুষ পাহারাদারের বউ হয়ে যাও, দেখবে তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, তুমি কোনো ছেলে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চাও, ওই পুলিশদের সাথে বোঝাঁপড়া করে নাও দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাবতে অবাক লাগে জেলখানার ভেতর কী বিচ্ছিরি একটা নিয়মনীতি চালু আছে।

–কী বীভৎস ব্যাপার! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

–আরও কদিন এখানে থাকো। তাহলে সব ব্যাপারটা আস্তে আস্তে বুঝতে পারবে। বিদ্যুতের আলো পড়লো লিটলচ্যাপের কামানো মাথার ওপর, মাথাটা চিকচিক করে উঠেছে–জেলখানার ভেতর রেপ কেস দেওয়া হয় না তা জানো কি?

–না।  

–মেয়েরা তালার গর্তে সেগুলো ঢুকিয়ে দেয়, তাই সেখানে চাবি ঢোকে না। সেই সুযোগ নিয়ে কয়েদীরা অন্য ঘরে চলে যায় নতুন মেয়েদের ভোগ করবে বলে। আমরা নিজেদের নিয়ম নিজেরাই গড়ে নিই। কেউ মুখ খোলে না, সকলে যোবা সেজে থাকে।

 জেলখানায় চার দেওয়ালের মধ্যে প্রেম পর্ব চলে অদ্ভুত ধারাতে। প্রেমিক প্রেমিকারা নিজেদের গড়া নিয়মনীতি কঠোর ভাবে মেনে চলে। এই অস্বাভাবিক পরিবেশে মদ্দা মেয়েরা এবং তাদের স্ত্রীরা কেমন সুখী দাম্পত্য জীবন কাটাচ্ছে। মদ্দারা নিজেদের নাম পাল্টে পুরুষদের নাম নিয়ে নেয়। যেমন আর্নেস্টাইন লিটলচ্যাপ হয়ে গেছে আর্নি, ট্রেসি হয়েছে। ট্রেব, বারবারা বব আর ক্যাথলীন কেলী। এই ষণ্ডামার্কা মেয়েরা চুল ছোটো করে, কেউ আবার মাথা কামিয়ে নেয়, কেউ কোনো কাজ করে না। তাদের তথাকথিত স্ত্রীরা সমস্ত কাজ করে দেয়, ইস্ত্রি করা থেকে সেলাই করা সবকিছু তাদের কাজ। একসময় লোলা আর পাউলিটা লিটলচ্যাপের নজরে পড়ার জন্য নিজেদের মধ্যে জোর লড়াই চালিয়ে ছিল। সেই লড়াই মাঝেমধ্যে হাতাহাতিতে রূপান্তরিত হতো।

ঈর্ষার রূপ এখানে ভয়ংকর, প্রায়ই প্রচণ্ড মারামারি হয়। যদি কোনো স্ত্রী অন্য কোনো মদ্দা মেয়ে মানুষের দিকে তাকায় বা উঠোনে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে গল্পগুজব করে তাহলেই আর রক্ষা নেই। দুই মদ্দার মধ্যে তখন দারুণ ঝগড়া শুরু হয়। এছাড়া জেলখানায় আরেকটি জিনিস ট্রেসিকে অবাক করে দিয়েছে। তাহল এখানে প্রেমপত্র চালাচালি হয়। চিঠিগুলোকে মুড়ে মুড়ে ছোট্ট ত্রিভুজের আকারে নিয়ে আসা হয়। কোড ল্যাঙ্গুয়েজে লেখা। তাই ব্রেসিয়ারের মধ্যে বা জুতোর মধ্যে সেগুলোকে লুকিয়ে রাখা সহজ। ট্রেসি দেখেছে খাবার ঘরে ঢোকার সময় বা কাজ করতে যাবার সময় সকলের চোখের সামনে কেমনভাবে ওই ছোট্ট চিরকুট এর হাত থেকে ওর হাতে চলে যাচ্ছে।

ট্রেসি এটাও লক্ষ্য করেছে কয়েদীরা অনেক সময় পুলিশের প্রেমে পড়ে যায়। অথবা পুলিশের অনুগত হয়ে যায়। জীবনের প্রতি প্রচণ্ড হতাশা থেকেই তাদের মনে এই বোধের জন্ম হয়। জেলখানার সবকিছু নির্ভর করে ওই পুলিশদের ওপর। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তারাই একমাত্র সেতুবন্ধন। ট্রেসি অবশ্য সে ধরনের মানসিকতা দেখায়নি। আসলে বাইরের পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যার সঙ্গে দেখা করতে সে উদগ্রীব। একমাত্র যে ছিল সে হল চার্লস, তাকে এখন ধীরে ধীরে স্মৃতির দৃশ্যপট থেকে মুছে দিয়েছে ট্রেসি। এখন শত চেষ্টা করলেও চার্লসের মুখখানি আর তার মনের দর্পণে ভেসে ওঠে না।

একদিন রাতে ট্রেসি একটা অবাক করা দৃশ্য দেখতে পেল। দেখতে পেল লিটলচ্যাপ একটা প্যাকেট থেকে ডালের পাঁপড় ভাজার টুকরো দরজা দিয়ে বারান্দায় ছড়িয়ে দিচ্ছে।

ট্রেসি জানতে চাইল–এটা কি হচ্ছে?

তাকে এভাবে প্রশ্ন করতে দেখে লিটলচ্যাপ খুবই চটে যায়। সে বলে–চুপ করে থাক, আমি কি করছি তা নিয়ে তোর মাথাব্যথার কারণ কী? বেশি বকবক করবি না, মেজাজটা আজ আমার মোটেই ভালো নেই।

একটু পরে আরেকটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। একটা ঘর থেকে নারীকণ্ঠের আকুল আর্তনাদ ভেসে এলনা না দয়া করে আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে একলা থাকতে দাও, কিন্তু কে কার কথা শোনে? ধীরে ধীরে কণ্ঠস্বর অনেক ঝিমিয়ে এল। ট্রেসি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে, সে নীরবে কাঁদতে থাকলো। সকালে লিটলচ্যাপ বলল, আমরা কেন পাঁপড় ভাজা ছড়িয়ে রাখি বলতো? পুলিশরা এলে শব্দ হবে, তখন আমরা সাবধান হয়ে যাব।

তার মানে কাল রাতে কোনো একটি একলা মেয়েকে পুলিশ জোর করে ধর্ষণ করছিল? হায় ঈশ্বর, চোখের সামনে এ কোন নরক দর্শন করালে আমাকে?–কিছুদিনের মধ্যে ট্রেসি আরও অভিজ্ঞ হয়ে উঠল, সে এখন অনেক গোপন শব্দের আসল অর্থ শিখে গেছে। জেলখানা যাওয়াকে কেন কলেজে যাওয়া বলে তাও সে জেনেছে। পৃথিবীতে যত রকুমের পাপের কথা চিন্তা করা যায় সেইসব পাপের ওস্তাদ কারিগররা এখানে বসবাস করে। ওস্তাদেরা একে অন্যের কাছে গুপ্তবিদ্যা জাহির করে। বুদ্ধির মারপ্যাঁচে তারা পরস্পরকে টেক্কা দিতে চায়।

একদিন সকালে খেলার মাঠে ট্রেসি একটা অবাক করা দৃশ্য দেখল। এক মেয়ে ওস্তাদ পকেট মারার নিয়মনীতি শেখাচ্ছে। একদল কম বয়েসী মেয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক ফেলার আগে ওই মেয়ে ওস্তাদ পকেট সাফ করার কায়দা জানে, আড়াই হাজার ডলার ফী দিলে কলম্বিয়ার কোন স্কুলে পকেট মারার গুপ্ত বিদ্যা শেখানো হয় তাও সে বলছে গড়গড় করে। শিলিং থেকে পুরো পেপাশাক পরা একটা নকল মানুষ ঝোলানো থাকে, তার পায়ে লাগানো থাকে অনেকগুলি ঘণ্টা, বেকায়দায় ছুঁলে ঘণ্টাগুলো ঝনঝন শব্দ করে বাজতে থাকে। যদি কোনো শিক্ষার্থী ঘণ্টা না বাজিয়ে পকেটের মানিব্যাগ তুলতে পারে তখনই তার শিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এবার মেয়েটিকে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়, অবশ্য নাম এবং ঠিকানা পাল্টে, বোঝ যায় এখন সে চড়ে খেতে পারবে।

লোলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–আমি একটা লোকের সঙ্গে ছিলাম, ভীড়ের মধ্যে সে ।

লোকটা ওভার কোট পড়ে দু-হাত ঝুলিয়ে পথ হাঁটতে, সেই ফাঁকে লোকের পকেট মেরে সাফ করতো।

–কিন্তু করতো কি করে?

–ওর ডান হাতটা ছিল কৃত্রিম, লোকে সেটা বুঝতে পারতো না।

টিভি ঘরটাতেও এমন অনেক শিক্ষাদানের পালা চলতো। ট্রেসি একদিন শুনলো লকার থেকে মালপত্র চুরি করা এক কয়েদীর সব থেকে প্রিয় কাজ। কাজটা খুবই সহজ, ধরা পড়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। এর জন্য বড়ো বড়ো স্টেশনে ঘুরে বেড়াতে হয়। যখন কোনো বুড়ি সুটকেস বা বড়ো প্যাকেট নিয়ে নড়তে চড়তে না পারে তখন। তার দিকে এগিয়ে আসতে হয়। সাহায্য করার জন্য প্রাণ আকুল হয়ে ওঠে। মালটা লকারে রেখে চাবিটা তুলে দিতে হয় ওই বুড়ির হাতে। ব্যস কেল্লা ফতে।

–কী করে সম্ভব? ট্রেসি অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল।

–যে চাবিটা বুড়ির হাতে তুলে দেওয়া হবে সেটা অন্য একটা ফাঁকা লকারের। আসল লকারটা খোলা অবস্থাতেই থেকে যাবে। বুড়ি চলে গেলে চট করে মাল সরিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়তে হবে। অবশ্য এর জন্য লকার মালিকদের সাথে ভালো বন্দোবস্ত করতে হবে। আমি ষোলো আনা আয় করলে তোমাকে চার আনা দেবো, তা নাহলে জমজমাট ব্যবসা চলবে কেমন করে?

ট্রেসি একদিন নতুন দুটো মেয়ে কয়েদীর দেখা পেল, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা শরীরের ব্যবসা করে এবং তারই অন্তরালে হেরোইন বিক্রি করে। দুজনের মধ্যে একজন দারুণ সুন্দরী, সতেরো বছরের এক ছটফটে তরুণী।

অভিজ্ঞ এক আধ বুড়ি কয়েদী সহানুভূতির সুরে সেই সপ্তদশীকে বলছে–যখনই কোনো পুরুষের সঙ্গে দর কষাকষি করবি, দেখবি লোকটা খোচর কিনা। আদর করার ভান করে তার বুকে পিঠে হাত দিবি, দেখবি লুকোনো অস্ত্র আছে কিনা। আরেকটা কথা মনে রাখিস ছুঁড়ি, নিজে থেকে কোনো প্রস্তাব দিবি না। দেখবি লোকটা তোর কাছ থেকে কী চাইছে, পরে যদি জানা যায় যে খদ্দেরটা পুলিশ, তাহলেও আইন তোকে কিছু করতে পারবে না। তুই পরিষ্কার বলবি লোকটাই তোকে ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিল।

এইভাবেই জেলখানার রুটিন এগিয়ে চলে নিজস্ব গতিতে। সকাল ৪টে বেজে ৪০ মিনিটে ওয়ার্নিং বেল বাজে, রাত নটায় আলো নিভে যায়, তারই মাঝে প্রহরগুলো কীভাবে কাটে। এক অদ্ভুত গতানুগতিকতার মধ্যে। সব কয়েদীকে একই সঙ্গে খেতে যেতে হয়, লাইনে দাঁড়িয়ে কেউ কারো সঙ্গে কথা বলতে পারে না। পাঁচ রকমের বেশি প্রসাধন দ্রব্য রাখার নিয়ম নেই। সকলকে প্রাতঃরাশের আগে বিছানা গুছিয়ে রাখতে হয়।

ট্রেসি অতি দ্রুত এক আদর্শ কয়েদী হয়ে উঠল। কখনও সে কোনোরকম আইন ভাঙার চেষ্টা করে না। তার শরীরটা জেলখানার মধ্যে আটকে রয়েছে একথা সত্যি কিন্তু মন চলে গেছে অনেক দূরে।

বন্দীরা বাইরে কোথাও টেলিফোন করতে পারে না। তবে মাসে দুটো করে পাঁচ মিনিটের। ফোন আসে তাদের কাছে। একদিন অটো স্মিট ট্রেসিকে ফোন করেছিল।

–ভেবেছিলাম তুমি নিশ্চয় জানতে চাইবে ওই ব্যাপারটা, শোনো, মায়ের অন্ত্যেষ্টি খুব ভালো ভাবেই শেষ হয়েছে। টাকা পয়সা যা দরকার সব আমি দিয়ে দিয়েছি।

–ধন্যবাদ অটো, অশেষ ধন্যবাদ, এর বেশী কথা বলা সম্ভব ছিল না দুপক্ষের, অতএব ছোট্ট একটি নীরবতা এবং তারপর ক্রিং করে শব্দ। টেলিফোনের লাইন কেটে গেছে।

ট্রেসির মনের আকাশে তখন একরাশ ভাবনার কালো মেঘ। হায়, আর কোনো টেলিফোন সে পাবে না তার দীর্ঘ বন্দী জীবনে?

লিটলচ্যাপ ট্রেসিকে বলেছিল–শোন, বাইরের কথা একেবারে ভুলে যা, সেখানে তোর জন্য কেউ চোখের জল ফেলবে না, বরং আমাদের সঙ্গে আরও বেশি বন্ধুত্ব কর, আমি তোর সমস্যা বুঝতে পারবো, তুই আমার দুঃখে কেঁদে উঠবি। একদিন দেখবি এই জগতটাকে তুই ভালোবেসে ফেলেছিস!

লিটলচ্যাপ ভুল বলছে, ট্রেসি মনে মনে ভাবলো, হেসে উঠল নিজের মনে। বাইরে অনেকে আছে, জনারণ্যে মিশে আছে তারা। এক-এক করে তাদের সবাইকে বের করতে হবে, তারা কে? জো রোমানো, পেরী পোপ, বিচারক হেনরি লরেন্স, অ্যান্টনি ওরসেত্তি এবং অবশ্যই চার্লস স্ট্যানহোপ তৃতীয়।

একদিন খেলার মাঠে বিগবার্থার সঙ্গে ট্রেসির দেখা হয়ে গেল। খেলার মাঠটা একটা বড়ো আয়তক্ষেত্রের মতো। এক পাশে জেলখানার উঁচু পাঁচিল, অন্য তিনটি দিকে নীচু পাঁচিল। প্রত্যেকদিন সকালে এখানে কয়েদীদের আসতে হয়। এখানে ইচ্ছেমতো কথা বলা চলে, সবাই এখানে প্রাণ খুলে গল্প করে। প্রথম দিন যখন ট্রেসি এখানে এসেছিল তখন তার মনটা আনন্দে ভরে উঠেছিল। মাথার ওপর অনেকখানি ভোলা নীল আকাশ, ঝকঝকে সূর্য গনগনে আগুন ছড়াচ্ছে।

কে যেন বলে উঠল-ওগো মেয়ে, আমি তো হন্যে হয়ে তোমাকেই খুঁজছিলাম।

ট্রেসি মুখ ঘুরিয়ে দেখল এ সেই সুইডিশ মেয়ে মানুষটা, জেলে আসার প্রথম দিন তার সঙ্গে ছোট্ট একটা ধাক্কাধাক্কি হয়েছিল ট্রেসির।

শুনলাম তুমি নাকি একটা কার্ফি ষাঁড়কে বেছে নিয়েছো? কেন গো সুন্দরী? তুমি কি পেছনে লাগা পছন্দ করো নাকি?

ওই কথাটার মধ্যে একটা অশ্লীল ইঙ্গিত আছে, পেছনে লাগা মানে বিপরীত বিহার, ট্রেসি জেনে ফেলেছে। ট্রেসির ভালো লাগছে না, সে বিগবার্থাকে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করল কিন্তু বিগবার্থা তার সাঁড়াশীর মতো শক্ত হাতে ট্রেসিকে চেপে ধরলো। সে এক নিঃশ্বাসে বলতে লাগল–কেউ আমাকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।

তারপর হঠাৎ গলার স্বরটা একটু নরম করল সে। সে বলল–এখানে তো তোমাকে, অনেক বছর থাকতে হবে সুন্দরী, কেন মিছিমিছি আমার সঙ্গে লাগছো? আমার সঙ্গে একটু ভালো ব্যবহার করে দেখোনা; আখেরে লাভই হবে। চল, একটু ওদিকে চল, তোমার সঙ্গে গোপন কথা আছে।

এই কথা বলতে বলতে বিগবার্থা তার বিশাল শরীরটা দিয়ে ঠেলতে থাকলো ট্রেসিকে, ঠেলতে ঠেলতে তাকে দেওয়ালের দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করল।

ট্রেসি বাধা দেবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সে বেশ বুঝতে পারছে শারীরিক কসরতে বিগবার্থার সঙ্গে সে পেরে উঠবে না। তবুও বলল, আমার এখন মন ভালো নেই, আমাকে একটু একা থাকতে দাও।

ট্রেসির এই কথা শুনে হা হা করে হেসে উঠল বিগবার্থা। তার পৃথুলা শরীরের সবখানে হাসির ঢেউ লাগে। সে বলল–তোমাকে শায়েস্তা করতে হবে মনে হচ্ছে, শুনে রাখো তোমাকে আমি দখল করবো, বিগবার্থা যা মনে করে কাজে তা করে দেখায়। তোমার বেলাতেও আমি হার স্বীকার করবো না।

হঠাৎ পেছন থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল–মাগী, তোর বড় বড় বেড়েছে, ওর গা থেকে এখনই হাত সরা।

ট্রেসি পেছন ফিরে তাকাল, লিটলচ্যাপ ঘুষি পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কামানো মাথায় সূর্যের আলো চিকচিক করছে।

তাকে দেখে বিগবার্থা একটু হেসে বলল–লিটলচ্যাপ, তোর হাতে একটা ভালো মেয়ে পড়েছে, কিন্তু তুই এর উপযুক্ত মরদ নোস। তুই একটিবার আমার হাতে ট্রেসিকে ছেড়ে দে, আমি ওর সুন্দর শরীরটা থেকে সব রস নিংড়ে বের করবো।

চোখের সামনে এসব দৃশ্য দেখে ট্রেসি অবাক হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে দুই মদানীর মধ্যে শুরু হয়েছে তুমুল তর্ক বিতর্ক। এখুনি সেটা শারীরিক সংঘাতের দিকে পৌঁছে যাবে, ট্রেসি বেচারী বুঝতে পারছে কিন্তু সে কী করবে?

লিটলচ্যাপ গর্জন করে বলল–আমিই তোর উপযুক্ত মরদ, একদিন রাতে আসিস আমি দেখিয়ে দেব কত ধানে কত চাল। আর যদি কখনও ট্রেসিকে বিরক্ত করিস তাহলে তোর পাছা ভেজে খাব আমি।

পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। শেষপর্যন্ত ট্রেসি ভাবল সে মধ্যস্থতা করবে কিনা। লিটলচ্যাপের একটা কথা তার মনে পড়ে গেল। একদিন কথায় কথায় লিটলচ্যাপ বলেছিল–শোনো ট্রেসি, তুমি তো এখানে নতুন এসেছে, এখানকার নিয়মনীতি সব বুঝতে পারোনি, আস্তে আস্তে সব শিখবে, জেলখানাতে যে আগে আক্রমণ করে শেষ পর্যন্ত সেই জিতে যায়। কেউ দেখে না সে অন্যায় করেছে কিনা। এখানে সবসময় তোমাকে জমি শক্ত রাখতে হবে। একটু নরমভাব দেখালেই আর রক্ষে নেই, শিয়াল কুকুরে এসে তোমাকে কামড়া কামড়ি করবে।

শেষ পর্যন্ত বিগবার্থা পিছিয়ে গেল। অবশ্য আচরণের মধ্যে পরাজয়ের ছবি আঁকলো না সে, হাসতে হাসতে সে বলল–ঠিক আছে, ট্রেসি, তোমার সঙ্গে আমার বোঝাঁপড়াটা আগামী কালের জন্য ভোলা রইল। তুমি তো আরও অনেকদিন এখানে থাকবে। তখন দেখবো ওই ভেড়ুয়া লিটলচ্যাপ তোমাকে কীভাবে বাঁচায়।

বিগবার্থা চলে যাবার পর লিটলম্যাপ ট্রেসির দিকে তাকিয়ে বলল–বদ স্বভাবের মেয়েমানুষ এই বিগবার্থা। শিকাগোতে নার্সের কাজ করতো, সায়ানাইড খাইয়ে রোগীদের মেরে ফেলতো। ওই করুণাময়ী তোমাকে দেখে মজে গেছে। দেখো ট্রেসি, ভালো চাও তো তাড়াতাড়ি একটা মরদ জুটিয়ে নাও, তা নাহলে কাক শকুনে তোমাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে।

লিটলচ্যাপের এই ব্যবহারে মাঝেমধ্যে ট্রেসি অবাক হয়ে যায়। প্রথম রাত্রির কথা বার বার তার স্মৃতির সমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে ফিরে আসে। পাউলিটা এবং লোলা ছাড়া এই লিটলচ্যাপও তার সঙ্গে অশালীন আচরণ করেছিল। কিন্তু লিটলচ্যাপকে চটালে চলবে না, ট্রেসি ইতিমধ্যেই বুঝে গেছে লিটলচাপ যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, শরীরে অসুরের শক্তি আছে। তার। জেলখানার দেওয়াল ভেঙে বাইরে আসতে হলে লিটলচ্যাপের সাহায্য নিতেই হবে।

ট্রেসি জানতে চাইল-শোনো, আমি যদি জেলখানার পাঁচিল ভেঙে পালাতে চাই তুমি, কি আমাকে সাহায্য করবে?

সময় ও সুযোগ পেলেই ট্রেসি এই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়। আসলে বাইরের পৃথিবীতে যাবার জন্য তার মন ছটফট করছে।

লিটলচ্যাপ কিছু বলতে গিয়েছিল, কিন্তু তখনই খাবার ঘণ্টা পড়ে গেল।

সেই রাতে নিজের বাঙ্কে শুয়ে ট্রেসি অনেক কথাই ভাবছিল। দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা মাস কেটে গেল এই জেলখানার ভেতরে। বাইরের পৃথিবীতে কে কোথায় কেমন আছে তা ভাববার চেষ্টা করল।

প্রত্যেকদিন দুপুরবেলা লাঞ্চের পর বিনোদন কক্ষে সবাই একঘণ্টা কাটাতে পারে। সেখানে টেলিভিশন আছে, মেয়ে কয়েদীরা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজস্ব চ্যানেল দেখে। অনেকে ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ মেলে দেয়। একদিন দুপুরে ম্যাগজিনে একটি ছবি দেখে ট্রেসি অবাক হয়ে গেল, তার মন চলে গেল কয়েক বছর আগের পৃথিবীতে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে চার্লস স্ট্যানহোপ তৃতীয় হাসিমুখে নববধূকে নিয়ে গির্জা থেকে বেরিয়ে আসছে। তলায় সুন্দর একটা ক্যাপশান। এই ছবিটা দেখে প্রথমে ট্রেসি ভীষণ ভেঙে পড়েছিল। তার মন ব্যথাতুর হয়ে উঠেছিল। পরমুহূর্তে তার সমস্ত যন্ত্রণা তীব্র ঘৃণায় রূপান্তরিত হল। এই মানুষটিকে সে একদা ভালো বেসেছিল অথচ বিপদের দিনে এই মানুষটি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। এমনকি চার্লসের দুর্ব্যবহারের ফলেই আজ ট্রেসির সন্তান মারা গেছে, ট্রেসি কোনদিন চার্লসকে ক্ষমা করবে না।

ম্যাগাজিনটা ছুঁড়ে ফেলে দিল ট্রেসি, ভাবলো, কবে তার এই স্বপ্নটা সফল হবে।

যেদিন কয়েদীদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করার কথা থাকে সেদিন তারা সাজগোজ করে। লিটলচ্যাপ ভিজিটরস রুম থেকে যখন ফিরে আসে তখন কিছুক্ষণের জন্য তাকে খুব হাসি খুশি দেখায়।

একদিন লিটলচ্যাপ ট্রেসিকে বলল–আমার অ্যাল এসেছিল, ভাবতে অবাক লাগে আমার জন্য এখনও অ্যাল অপেক্ষা করে আছে। জানো কেন? আমার জন্য ও পাগল।

ট্রেসি জানতে চাইল–তোমার জন্যে?

–হ্যাঁ কেন নয়, এখানে তোমরা যে লিটলচ্যাপকে দেখতে পাচ্ছ সে কিন্তু আসল লিটলচ্যাপ নয়, আমি একটা মেয়েমানুষ, একটু স্নেহের স্পর্শ পাবার জন্যে আমার মন কাতর হয়ে অপেক্ষা করে। বাধ্য হয়েই আমি অপকর্মগুলি করি! যখন ছাড়া পাব তখন। আমার নিজস্ব স্বপ্নজগত গড়ে তুলবো।

লিটলচাপ দাঁত বের করে হাসলো। তার মুখ থেকে ছিটকে আসা ওই কথাগুলো শুনে ট্রেসি তখন অবাক হয়ে গেছে। সত্যিই তো, প্রত্যেকটি মেয়ের মধ্যে কি এমন একটি স্বপ্নের জগত থাকে?

ট্রেসি বলল, লিটলচ্যাপ তুমি সবসময়ে আমাকে বিপদের হাত থেকে আড়াল করতে চাও কেন বলো তো?

কাঁধ কঁকিয়ে লিটলচাপ বলল–বাঃ বুদ্ধিমতী মেয়ে, এই ভাবে সেন্টুতে সুড়সুড়ি দিয়ে আমার পেট থেকে আসল কথা বের করতে চাইছো তো?

–হ্যাঁ সত্যি আমি জানতে চাইছি, আর সকলে অর্থাৎ যারা তোমার বন্ধু তারা তোমার সমস্ত কথা কেন মেনে চলে।

–শুনতেই হবে, তা নাহলে ওদের পাছায় আমি লাথি ঝাড়বো।

–কিন্তু আমার বেলায় তো তা হয় না। আমি প্রথম থেকেই তো তোমাকে অগ্রাহ্য করেছি।

–এটা কি তোমার কৌতূহল না অভিযোগ?

–না না জানতে ইচ্ছে করছে।

লিটলচ্যাপ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, তারপর বলল–শোনো সব কথা বলছি, না না তুমি যা ভাবছো তা নয়, আমি যা চাই তাই পাই। তুমি একটু আলাদা মেয়ে। নামকরা ফ্যাশনেবল ম্যাগাজিনে যে সমস্ত মেয়েদের ছবি ছাপা হয় তুমি তাদের মতো শান্ত ভদ্র নিরীহ। তুমি ওদের জগতের লোক। তুমি আজ দুর্ভাগ্যের কবলে পরে এই অপরাধের জগতে এসে পড়েছে। মনে হয় কেউ তোমাকে ফাঁসিয়েছে। শোনো, আমি ভদ্র সুন্দর কোনো কিছুরই সংস্পর্শে এ জীবনে খুব কমই এসেছি। তুমি ওই শ্রেণীর মানুষ।

তারপর হঠাৎ মুখটা অন্য পাশে ঘুরিয়ে লিটলচ্যাপ বলল–তোমার বাচ্চাটার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। আসলে আমি…

সেই রাতে আলো নেভার পর ট্রেসি ফিসফিস করে লিটলচ্যাপকে বলল–আর্নি, আমাকে এখান থেকে পালাতেই হবে, তুমি কি বুঝতে পারছো?

–আমি এখন ঘুমোবার চেষ্টা করছি, যিশুর দোহাই এখন আর বকবক করে আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিও না।

এবার লিটলচ্যাপ ট্রেসিকে জেলখানার ভাষা শেখাতে শুরু করল। কয়েকদিনের মধ্যে সে বিভিন্ন কোড শব্দ বুঝে গেল।

লিটলচ্যাপ আর বিগবার্থার মধ্যে পরের দিন ঘটে গেল সেই বিস্ফোরণটা। মাঠে সফট বল খেলা হচ্ছিল। পাহারাদাররা কড়া নজর রেখেছে সবার ওপর। বিগবার্থা ব্যাট করছিল, মাঠের শেষ সীমানাতে, ট্রেসি দাঁড়িয়ে বল ধরছিল। হঠাৎ তার দিকে জোর করে বল ছুঁড়ে মারল বিগবার্থা, রান নেবার অছিলাতে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মাটিতে ট্রেসিকে ফেলে দিল, ময়দা ঠাসার মতো ঠেসতে লাগল তাকে। তার মুখ দিয়ে তখন সপিনীর হিস হিসানি শব্দ বেরিয়ে আসছে। সে বলল–আজ পর্যন্ত আমার মুখের ওপর কেউ কথা বলার সাহস করেনি বুঝলি হারামজাদী, তোর সমস্ত গুমোর আজ আমি ভেঙে দেবো। আজ রাতে আমি তোর বাঙ্কে আসবো, দেখি কে তোকে বাঁচায়!

ট্রেসি নিজেকে বিগবার্থার কবল থেকে ছাড়িয়ে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল কিন্তু পারবে কেন? সে যদি একটা ছোট্ট খরগোশ হয়ে থাকে তাহলে বিগবার্থা মোটা শূকরী। হঠাৎ মনে হল কে যেন বিগবার্থাকে হ্যাঁচকা মেরে তার শরীর থেকে ওপর দিকে তুলে নিয়েছে। সে তাকিয়ে থাকল লিটলচ্যাপের দিকে, লিটলচ্যাপ বিগবার্থার টুটি চেপে ধরেছে।

–রাস্তার কুত্তী কোথাকার, তোকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম আমার ট্রেসির গায়ে হাত দিবি না।

বড়ো বড়ো নখ দিয়ে বিগবার্থার মুখ রক্তাক্ত করে দেওয়া হল।

–আমার চোখ গেলে দিল, এই কথা বলতে বলতে বিগবার্থা লিটলচ্যাপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মেয়ে পুলিশরা ছুটে এল। পাঁচমিনিট প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি হল। ইতিমধ্যেই দুজনে দারুণ জখম হয়েছে। তাদের ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া হল।

গভীর রাতে লিটলচ্যাপ ফিরে এল। লোলা আর পাউলিটা তার সেবাযত্ন করলো পালা করে।

ট্রেসি ফিসফিস শব্দে জানতে চাইলো–তুমি ঠিক আছে তো?

–চমৎকার আছি, মুখে বললেও গলার জড়ানো শব্দ শুনে ট্রেসি বুঝতে পারলো যে লিটলচ্যাপ ভীষণ জখম হয়েছে।

–আমি শিগগিরি প্যারোলে ছাড়া পাচ্ছি। কিছুদিনের জন্য আমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। তখন তুমি বিপদে পড়বে ট্রেসি, বিগবার্থা কিন্তু তোমাকে ছাড়বে না। ও ভয়ংকর, ইচ্ছে হলে তোমাকে মেরে ফেলতেও পারে, এই অপরাধের জন্য পৃথিবীর কোনো আদালতে কোনো শাস্তি হবে না।

লিটলচ্যাপের কথাগুলো শুনে ট্রেসির ঘুমের দফারফা শেষ। অনেকক্ষণ সে শূন্য দৃষ্টিতে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর লিটলচাপ হঠাৎ বলল–এই নরকে যাতে তোমাকে থাকতে না হয়, এবার বোধহয় সেই আলোচনাটা করতে হবে।

চারপাশের আলো নেভাননা, কিন্তু লিটলচ্যাপের কথা শুনে ট্রেসির মনের আকাশে তখন হাজার সূর্যের রোশনাই!

.

১০.

ওয়ার্ডেন ব্র্যানিগান স্ত্রীকে খবরটা দিলেন কাল থেকে তোমার বাচ্চা দেখা ঝিটাকে বোধহয় আর পাওয়া যাবে না।

সু এলেন ব্র্যানিগান ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন কেন? জুডি তো অ্যামিকে খুবই যত্ন করে।

–কিন্তু ও ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে, কাল সকালেই ওর ছুটি।

ওয়ার্ডেন ব্র্যানিগান এবং তাঁর স্ত্রী কথাবার্তায় ব্যস্ত ছিলেন। জেলখানার লাগোয়া সুন্দর একটি কটেজে তখন নেমে এসেছে সুন্দর একটি সকাল। ওয়ার্ডেন হিসাবে ব্র্যানিগান পেয়েছেন একজন রাঁধুনীকে, কাজের একটি মেয়ে আছে তার সংসারে, আছে ড্রাইভার আর মেয়ের জন্য গভর্নের্স। বিনা পয়সায় এতজনকে পাওয়া গেছে, স্বভাবতই মনটা খুশি মাখা ব্র্যানিগানের।

ওয়ার্ডেন সাহেবের একটি মাত্র মেয়ে, তার নাম অ্যামি, বয়স মাত্র পাঁচ বছর। স্বামী, স্ত্রী আর ছোট্ট মেয়ে জমজমাট একটা সুখী সংসারের খণ্ড চিত্র। কিন্তু এখানে এসে সু প্রথম প্রথম খুবই নিরাপত্তার অভাব বোধ করতেন। জেলখানার চৌহদ্দির মধ্যে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার। এখানে যারা কাজ করে তারা সবাই কয়েদী, ভয়ংকর অপরাধ করে তবে জেলখানায় ঢুকেছে, এই চিন্তাও সুকে আচ্ছন্ন করে রাখতো। মাঝেমধ্যে সু জানতে চাইতেন তার স্বামীর কাছে মাঝরাতে ওরা যদি আমাদের খুন করে তাহলে কী হবে? বিশেষ করে আমি আমার ছোট্ট মেয়েটার কথা ভাবছি।

স্ত্রীর গায়ে হাত দিয়ে আদর করার ভঙ্গীতে ওয়ার্ডেন বলেছিলেন–ওরা যদি সেরকম কিছু বলে তাহলে ওদের শাস্তি দেবার ক্ষমতা আমার আছে। এ নিয়ে তুমি কিছু চিন্তা কোরো না।

ব্র্যানিগানের মুখের কথায় মন ভরেনি সু এলেনের কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল সু এলেনের এই আশঙ্কা আদৌ ঠিক নয়। যে সমস্ত কয়েদীরা ভালোভাবে কাজ করে তারাই শেষ পর্যন্ত ওয়ার্ডেনের ঘরে ঢোকার অনুমতি পায়, শুধু কি তাই? ওয়ার্ডেনের হাতে অসীম ক্ষমতা। তিনি চাইলে সাজার পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারেন।

এবার সু এলেনের গলায় নানা অভিযোগের সুর ঝমঝম করে বেজে ওঠে–অ্যামিকে জুডির হাতে ছেড়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত থাকতাম। গভর্নের্স হিসাবে জুডি চমৎকার। কিন্তু এবার কে আসবে তা তো জানি না। অচেনা মানুষেরা বাচ্চাদের সঙ্গে কত রকমের খারাপ কাজ করে সবকিছু জানা আছে আমার।

–জুডির জায়গায় তুমি কাকে নেবে বলে ঠিক করেছো?

কিছুদিন ধরেই ওয়ার্ডেন এ বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছেন। ডজনখানেক মেয়ে কয়েদীর কথা ভেবে রেখেছেন, প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা আলাদা কথা বলেছেন, তবে ট্রেসি হুইটনিকেই এই পদে নিযুক্ত করতে হবে। ওই মেয়েটার দুঃখজনক ঘটনা এখনও তার মনকে বিচলিত করে। পনেরো বছর ধরে অপরাধ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা নিয়ে গভীরভাবে পড়াশোনা করে আসছেন ওয়ার্ডেন সাহেব। এ বিষয়ে তার একটা চাপা অহংকার আছে। বন্ধু বান্ধবেরা বলে থাকেন, তিনি নাকি এক মনস্তত্ত বিশারদ হয়ে উঠেছেন। বেশ কিছু অপরাধী আছে যারা হল দাগী আসামী, জেল থেকে ছাড়া পেলে সুযোগ বুঝে আবার ওই একই অপরাধ করবে। অপরাধের জন্য তাদের মনে কোনোরকম অনুশোচনা নেই। অন্যরা সাময়িক উত্তেজনার বশে অপরাধ করে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোভের বশবর্তী হয়েও মানুষ প্রথম অপরাধে হাতেখড়ি করে।

ট্রেসি হুইটনিকে এর কোনো শ্রেণীতে ফেলা সম্ভব নয়। সব অপরাধীদের মতো ট্রেসিও নিজের অপরাধ স্বীকার করেনি। ওয়ার্ডেন চিন্তা করেন সেইসব মানুষদের জন্য যারা ষড়যন্ত্র করে ট্রেসিকে জেলে পাঠিয়েছে। কিছুদিন আগে নিউ অর্লিয়েন্সের গভর্নর ওয়ার্ডেন ব্র্যানিগানকে নিউ অর্লিয়েন্সের নাগরিক কমিশনের সদস্য করেছিলেন। ব্র্যানিগান রাজনীতি সম্পর্কে মোটেই উৎসাহিত নন, এতে তিনি মাথা ঘামান নি। কিন্তু কমিশনের তদন্তর সময় তিনি ওই লোকগুলো সম্পর্কে অনেক গোপন খবর জেনে ফেলেছিলেন। জো রোমানো একজন মাফিয়া, অ্যান্টনি ওরসেত্তির এজেন্ট, অ্যাটর্নি পেরী পোপ রোমানোদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা পায়। এমনকি জজ হেনরি লরেন্সকেও জো কিনে ফেলেছেন। ট্রেসির এই সাজা হবার পেছনে ওই মাথাগুলো একটা চক্রান্ত করেছে, এই বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই।

স্ত্রীর কথার জবাবে ওয়ার্ডেন বললেন–হ্যাঁ, একজনের কথা চিন্তা করে রেখেছি।

জেলখানার রান্নাঘরের এক কোণে ছোট্ট একটি খাবার টেবিল পাতা রয়েছে, চারদিকে চারটি চেয়ার। এখানে একটু আড়াল করা জায়গা। দশ মিনিটের বিরতির সময় ট্রেসি আর লিটলচ্যাপ সেখানে বসে কফি খাচ্ছিল।

–বল, তুমি কেন এত তাড়াতাড়ি জেল থেকে পালাতে চাইছো?

লিটলচ্যাপ উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে আছে ট্রেসির দিকে। ট্রেসি চকিতে একবার লিটলচ্যাপকে দেখে নিল, এই কমাসে সে অনেক বেশি অভিজ্ঞ হয়ে গেছে। আগে হলে হুড়হুড় করে পেটের কথা বলে দিতো। এখন বুঝে সমঝে কথা বলে, লিটলচ্যাপকে কি বিশ্বাস করা যায়?

–কয়েকজন লোক আমার পরিবারের ভয়ংকর ক্ষতি করেছে। আমাকে বদলা নিতেই হবে।

–তোমার কি ক্ষতি করেছে ওরা?

–ওরা আমার মাকে খুন করেছে, ধীরে ধীরে কেটে কেটে শব্দগুলোকে হাওয়ার সমুদ্রে ভাসিয়ে দিল ট্রেসি।

–ওরা কারা?

–নাম শুনলে তুমি কি চিনতে পারবে? তুমি ওদের কাউকেই চেনো না। জো রোমানো, পেরী পোপ, হেনরি লরেন্স আর অ্যান্টনি ওরসেত্তি।

এই শব্দগুলো শুনে লিটলচ্যাপের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত সে চীৎকার করে বলল–হ্যায়, আমি কি ঠিক শুনেছি?

লিটলচ্যাপের আচরণের এই পরিবর্তনে ট্রেসিও অবাক হয়েছে। ট্রেসি বলল–তুমি এদের চেনো?

–রোমানো আর ওরসেত্তির কথা কে না জানে? নিউ অর্লিয়েন্সে ওরাই হল আসল। নেতা। তোমাকে শেষবারের মতো সাবধান করে দিচ্ছি ট্রেসি, তুমি ওদের বিরুদ্ধে লড়তে যেও না, তুমি ওদের সঙ্গে পারবে না। তোমাকে ওরা একেবারে শেষ করে দেবে।

লিটলচ্যাপের এই সাবধান বাণী ট্রেসির মনের মধ্যে কোনো ভাবান্তর আনতে পারলো না। নিস্পৃহ গলাতে ট্রেসি বলল–আমার আর কি শেষ করবে বলো তো? শেষ তো আমি হয়েই গেছি?

লিটলচ্যাপ চারপাশে একবার তাকালো, আড়ি পেতে কেউ ওদের কথা শুনছে কি? জেলখানার এই একটা বিপদ, দুজন বন্দিনী অন্তরঙ্গ কথা বললেই তৃতীয় একজনের কান সেখানে পৌঁছে যায়। অতি দ্রুত খবর চলে যায় এঘর থেকে ওঘরে।

–হয় তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে অথবা তুমি একটা অদ্ভুত স্বভাবের মেয়ে ছেলে। ওইসব পুরুষদের কথা তুমি মুখে আনছো কি করে আমি তো বুঝতেই পারছি না। ট্রেসি, তুমি আমার ছোটো বোনের মতো, আমি বলি কি, আমার কথা শোনো, ওদের কথা ভুলে যাও। অন্যভাবে বাঁচবার চেষ্টা করো।

–না সম্ভব নয়, যদিও আমাকে মরতে হয় তাহলেও আমি প্রতিশোধের কথা ভাববো। বলল, তুমি কি এখান থেকে আমাকে বের করতে পারবে?

বেশ কিছুক্ষণ দুজন চুপচাপ বসে রইল। তারপর লিটলচ্যাপ বলল–মাঠে কথা হবে।

এবার দুজনে মাঠের এককোণে দেখা করল।

–এই জেল থেকে এর আগে বারো জন পালাবার চেষ্টা করেছিল,.দুজন কয়েদীকে গুলি করে মারা হয়।

লিটলচ্যাপের এই কথা শুনে ট্রেসি কিছু বলল না। ট্রেসি জানে এখান থেকে পালানোটা খুব একটা সহজ নয়, কিন্তু ওই ভয়ংকর কাজটা তাকে করতেই হবে। পনেরো বছর ধরে সে জেলখানার অন্ধকুঠুরির মধ্যে পচতে পারবে না।

–চারকোণে চারটে টাওয়ার আছে, সেখানে চব্বিশঘণ্টা পাহারাদাররা থাকে, ওদের হাতে থাকে মেসিনগান। ওরা কুত্তীর বাচ্চার মতো শয়তান। কয়েদী পালালে ওদের চাকরি চলে যাবে, কেউ যদি পালাবার সামান্যতম চেষ্টা করে তাহলে ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুঁড়ে দেয়। জেলখানার চারদিকের পাঁচিলে আছে কাটা তার। যদি বা কোনোভাবে মেসিনগান আর কাঁটাতারের বেড়া পার হতে পারে তাহলেও তুমি নিশ্চিন্ত নও যে বাইরের পৃথিবীতে পা রাখতে পারবে। এরপর আছে ভয়ংকর আকৃতির কালো শিকারী কুকুরের দল। কয়েক মাইল দূরে ন্যাশনাল গার্ডের কেন্দ্র আছে, তুমি পালিয়ে গেছ এই খবর প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তারা হেলিকপ্টার নিয়ে তোমাকে অনুসরণ করবে, তোমাকে মৃত অথবা জীবিত অবস্থায় ধরে আনবেই। তবে ওরা একেবারে মেরে ফেলতে চায় না, এতে অন্যদের শিক্ষা দেওয়া যায় না।

ট্রেসি তখনও বলছে–তবুও তো মানুষ চেষ্টা করে, চেষ্টা করার মধ্যে কোনো দোষ আছে কি?

যারা পালাতে চায় তারা বাইরে থেকে লোক নেয়। বাইরে তাদের বন্ধু-বান্ধব থাকে, খরচ করার মতো অগুণতি টাকা থাকে। বাইরের বন্ধুরা বন্দুক পাঠিয়ে দেয়, পোশাক পাঠায়। এমন কি বাইরে গাড়ির বন্দোবস্ত করে রাখে। এত সব করার পরেও কিন্তু শেষ পর্যন্ত কয়েদীকে ধরা পড়তে হয়। আর তুমি তো একটা অসহায় মেয়েমানুষ, বাইরে তোমার কিছু নেই, ভেতর থেকে তুমি পালাবার ফন্দি-ফিকির করবে কেমন করে?

নিজের ওপর অগাধ আস্থা এনে ট্রেসি বলল–ওরা আমাকে ধরতে পারবে না।

তখনই একজন মেট্রন ওদিকেই আসছিলেন, ওরা চুপ করে গেল। ট্রেসিকে ডেকে মেট্রন বললেন–ওয়ার্ডেন ব্র্যানিগান তোমাকে ডাকছেন, দৌড়ে যাও।

ওয়ার্ডেন ট্রেসিকে বললেন–আমার বাচ্চা মেয়েটাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন মেয়ে দরকার, তুমি কি সেই কাজটা করবে? অবশ্য তোমাকে আমি জোর জবরদস্তি করছি না, তুমি শান্ত স্বভাবের ভদ্র মেয়ে বলেই আমি তোমার কাছে এই প্রস্তাবটা রেখেছি।

অতি দ্রুত চিন্তা করল ট্রেসি, সে বুঝতে পারলো এটা ঈশ্বরের অভাবিত একটা পুরস্কার। ওয়ার্ডেনের বাড়িতে কাজ করতে করতে জেলখানা সম্পর্কে আরও অনেক গোপন খবর সে অনায়াসে জানতে পারবে।

এক লহমার মধ্যে সে তার উত্তর দিল–হ্যাঁ করবো।

জর্জ ব্র্যানিগান খুশি হলেন। এই মেয়েটাকে যে করেই হোক সাহায্য করতে হবে–এমন একটা অদ্ভুত ধারণা তাকে পেয়ে বসে আছে।

উনি বললেন–বেশ প্রতি ঘণ্টায় ৬০ সেন্ট করে পাবে। মাসের শেষে হিসেব করে ওই টাকাটা তোমার নামে জমা করে রাখা হবে।

এখানকার নিয়ম হল কয়েদীদের হাতে কোনো কঁচা পয়সা দেওয়া হবে না, ছাড়া পাবার সময় সব একসঙ্গে দেওয়া হয়।

একমাস বাদে আমি এখানে থাকবো না, ট্রেসি মনে মনে ভাবল, তুমি কাল সকাল থেকে কাজ করতে পারো, হেড মেট্রন তোমাকে সব কিছু বুঝিয়ে দেবে।

–আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ ওয়ার্ডেন সাহেব।

এই খবর শুনে লিটলচ্যাপ কি যেন চিন্তা করতে থাকে। সে বলল, এর মানে ওরা। তোমাকে ট্রাস্টি করতে চাইছে।

–ট্রাস্টি মানে কি?

–ট্রাস্টি মানে তুমি একজন ভালো কয়েদী। এতে তোমার পালানোর পথটি সুগম হবে।

–কী করে?

–তিন রকম উপায় আছে এখান থেকে বের হবার। এক–পাঁচিল ডিঙিয়ে পালিয়ে যাওয়া। দুই পিস্তল দেখিয়ে কোনো একজন কর্মচারীকে শায়েস্তা করা। তৃতীয়, পথ হল ওয়ার্ডেনের বাড়িতে কাজ করতে করতে এক ফাঁকে পালিয়ে যাওয়া, তবে কোনোটিই শেষপর্যন্ত কার্যকর হবে বলে মনে হয় না।

–কিন্তু আমি চেষ্টা করবো, করবোই, মনে মনে একটা অদ্ভুত প্রতিজ্ঞা করল ট্রেসি। পরের দিন সকালে ওয়ার্ডেন ব্র্যানিগানের বাড়িতে ট্রেসিকে নিয়ে যাওয়া হল। সেদিন জেলখানাতে তার একশো পঞ্চাশতম দিবস। অর্থাৎ একটি একটি করে পাঁচটি মাস কেটে গেছে। ওয়ার্ডেনের স্ত্রী এবং তার মেয়ের সাথে দেখা হবে ভেবে ট্রেসি কেমন যেন নার্ভাস হয়ে উঠলো।

গোলাপী রঙের হাউসকোট পরা এক মহিলা দরজা খুলে বললেন–গুড মর্নিং।

–সুপ্রভাত।

মহিলাটি হয়তো আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু কি যেন চিন্তা করে চুপ করে রইলেন। সু এলেন ব্রানিগান দেখতে খুবই সুন্দরী, বয়স ৩৪ কিংবা ৩৫ হবে। এই পৃথিবীতে এমন কিছু মেয়ে আসে যারা সুগৃহিণী হতে ভালোবাসে, সু সেই দলভুক্ত, তবে একটু রোগা, স্বভাবের মধ্যে একটু খিটখিটে ভাব আছে, জেল কয়েদীকে কাজের মেয়ে হিসেবে পেলে তার সঙ্গে কি ধরনের ব্যবহার করতে হবে সেটা বুঝতে পারেন না, তাই কথা বলতে বলতে মাঝেমধ্যে চুপ করে যান। তিনি ধন্যবাদ জানাবেন না হুকুম করবেন? ভদ্র ব্যবহার করবেন নাকি মেয়ে কয়েদীর সঙ্গে যেমন ব্যবহার করা উচিত তেমন করবেন? নেশাগ্রস্ত, চোর, ধর্ষক ও খুনীদের মধ্যে বসবাস করার অভিজ্ঞতা এর আগে তার হয়নি।

–আমি মিসেস ব্র্যানিগান, আমার অ্যামির বয়স ৫ বছর, তুমি তো জানো এই বয়সের ছেলেমেয়েরা কত চঞ্চল হয়। সবসময় অ্যামিকে চোখে চোখে রাখতে হবে।

সু এলেন কথাগুলো বলতে বলতে ট্রেসির বাঁহাতের দিকে তাকালেন। নাঃ, অনামিকাতে বিয়ের আংটি নেই। তবে নীচু ঘরের মেয়েরা আজকাল ওসব আংটি পরে না।

উনি জানতে চাইলেন–তোমার ছেলেমেয়ে আছে কি?

অঙ্কুরে নষ্ট হওয়া ছেলেটির কথা চকিতে মনে পড়ে গেল ট্রেসির। ট্রেসি বলল–না।

ট্রেসিকে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেছেন সু এলেন। কয়েদি মেয়েদের মধ্যে এই আভিজাত্য সহসা দেখা যায় না।

–অ্যামিকে নিয়ে আসছি, বলে সেই যাত্রায় তিনি রণে ভঙ্গ দিলেন।

এই অবসরে ট্রেসি তার বড়ো বড়ো চোখ মেলে দিল চারপাশে। ছিমছাম সাজানো সুন্দর একটি কটেজ, সর্বত্র পরিচ্ছন্নতার ছাপ, জেলখানার পাশে যে এমন একটা স্বর্গ আছে, কখনও ট্রেসি তার খবর রাখেনি। আসলে অনেক দিন সে কোনো ভদ্র পরিবেশের মধ্যে আসেনি।

একটা বাচ্চা মেয়ের হাতে হাত রেখে সু ফিরে এলেন।

–অ্যামি এই হল…সু আবার কথা হারিয়ে ফেলেছেন। কয়েদিদের নাম ধরে ডাকা উচিত নাকি পদবী ধরে ভেবে তিনি ঠিক করতে পারলেন না।

শেষ পর্যন্ত বললেন, এই হল ট্রেসি হুইটনি, ও তোমাকে দেখাশোনা করবে।

–হাই, অ্যামি বলল, তার বাদামী চোখে দুষ্টুমির ছাপ। দেখতে খুব একটা সুন্দরী নয়, মায়ের রোগা ভাবটা পেয়েছে, কিন্তু আচরণের মধ্যে একটা শান্ত সরলতা লুকিয়ে আছে। এই ধরনের মেয়েকে দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ট্রেসি মনে মনে শপথ নিল, কিছুতেই সে ওই মেয়েটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করবে না।

–তুমি কি আমার নতুন ম্যানি হবে?

অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইল ছোট্ট মেয়েটি।

–হ্যাঁ, তোমাকে দেখাশোনা করবো, তোমার মা-কে সাহায্য করবে এই আর কি।

সু জানতে চাইলেন-জুডি প্যারোলে ছাড়া পেয়ে চলে গেছে তুমি কি ওর মতো চলে যাবে নাকি?

ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে কোনো মতে ট্রেসি বলল–না, আমাকে আরও অনেক বছর এখানে থাকতে হবে।

ট্রেসির এই উত্তরে স্বভাবতই খুশি হলেন সু, তার মানে আগামী কয়েকবছর নিশ্চিন্তি। এর মধ্যে মেয়েটাও তো তরতর করে বড় হয়ে উঠবে।  

ট্রেসিকে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে সু এলেন কি কি করতে হবে তা বোঝাতে শুরু করে দিলেন–তুমি নিশ্চয়ই অ্যামির সঙ্গে খাবে। সকালের জলখাবার তুমি তৈরি করবে, তারপর অ্যামির সঙ্গে খেলা করবে। কাজের মেয়েটি দুপুরের রান্না করবে, দুপুরে খাবার পর অ্যামি কিছুক্ষণ ঘুমোবে। বিকেলে খামারের বাগানে ঘুরে বেড়াবে, ও গাছ-পালার সঙ্গে ভাব জমাতে খুবই ভালোবাসে। আশা করি এ ব্যাপারে তোমারও আগ্রহ আছে।

সু এলেন কথা বলে চলেছেন আর ট্রেসি মনে মনে একটা কঠিন যোগবিয়োগের অংক কষছে। অনেকটা সময় সে বাগানে ঘুরতে পারবে, এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চয় জেলের মতো নিচ্ছিদ্র নয়। তার মানে? পাঁচিল ডিঙিয়ে পালাবার একটা পথ প্রশস্ত হল কি?

কুড়ি একর জমিতে নানাধরনের তরকারি আর ফলের গাছ, এগুলো দেখাশোনা করে ট্রাস্টি অর্থাৎ বিশ্বস্ত কয়েদীরা। পাথরের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা একটা মস্ত বড়ো কৃত্রিম পুকুরও আছে সেখানে।

পাঁচটা দিন ভীষণ ভালো কাটল ট্রেসির, মনে হল বদ্ধ জগৎ থেকে সে যেন মুক্তির মঞ্চে এসে পৌঁছেছে। এই ভিন্নতর পরিবেশে তাজা হাওয়াতে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল সে। অবাধে ঘোরাঘুরি করতে পারছে, এখানে রক্ষীদের রক্ত চক্ষুর ভয় নেই, এই ব্যাপারটা ট্রেসিকে আরও উৎফুল্ল করে তুলল। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে সে পালাবার চিন্তা করছে। অ্যামির দেখাশোনার কাজ না থাকলে ট্রেসিকে নিজের সেলে ফিরে যেতে হতো। রাতে অবশ্য তাকে বাঙ্কে থাকতে হয়, কিন্তু সকালের ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সে ওয়ার্ডেন সাহবের বাংলোতে চলে আসে। নিত্য নতুন ধরনের রান্না করে, চার্লসদের সঙ্গে থাকতে থাকতে ও নানা রেসিপি শিখে ফেলেছিল। কিন্তু অ্যামি সাধারণ খাবার খেতে বেশি পছন্দ করে, তারপর শুরু হয় দৈনন্দিন জীবনযাত্রা। অ্যামির সঙ্গে ছেলেমানুষী খেলায় অংশ নিতে হয়, কিংবা ছড়ার বই থেকে ছড়া শোনাতে হয়।

অ্যামির সঙ্গে খেলতে খেলতে মাঝে মধ্যে ট্রেসি তার হারানো শৈশব দিনে ফিরে যেত। বাবাও ঠিক তার সঙ্গে এমনই খেলা খেলতো, আজ পরিবেশটা কেমন পাল্টে গেছে।

অ্যামি পুতুল পছন্দ করতো, ট্রেসি ওয়ার্ডেন-এর ছেঁড়া মোজা দিয়ে একটা সুন্দর ভেড়া তৈরি করল, অবশ্য সেট-ভেড়া হল না। হল শেয়াল আর হাঁসের মাঝামাঝি কিম্ভুতকিমাকার অদ্ভুত একটা জন্তু। সেটা পেয়ে অ্যামির কি আনন্দ। ট্রেসি মনে মনে আবার প্রতিজ্ঞা করল, নাঃ কিছুতেই সে এই মেয়েটাকে ভালোবাসবে না, ভালোবাসা প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। আজ অথবা আগামীকাল তাকে জেল থেকে পালাতেই হবে।

বিকেলে বাগানে বেড়াতে বেড়াতে ট্রেসি নজর রাখতো কোন দিয়ে পালানো যায়। সান্ত্রীরা কোথায় দাঁড়ায়, কখন তাদের ডিউটি বদল হয়। সবকিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করতো সে। সে বুঝতে পারল লিটলচ্যাপের সঙ্গে যতগুলো পন্থা নিয়ে আলোচনা করেছে তার কোনোটাই এখানে কার্যকরী হবে না অর্থাৎ তিনটি পন্থার সবগুলি ভেস্তে যাবে। চতুর্থ একটা পন্থা অবশ্যই তাকে বের করতে হবে।

ট্রেসি একবার জানতে চেয়েছিল–জেলখানাতে ট্রাকে করে যেসব খাবার জিনিসপত্র আসে, তাতে চেপে কেউ কখনও পালাবার চেষ্টা করেছে কি?

লিটলচ্যাপ বলেছিল–ঢোকবার আর বের হবার সময় গেটের প্রত্যেকটি গাড়িতে তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করা হয়। তাই খুকুমনি, ওই স্বপ্নটা মাথা থেকে তাড়িয়ে দাও!

একদিন সকালে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে অ্যামি হঠাৎ ট্রেসিকে বলল–আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমার মা হবে?

এই কথা শুনে ট্রেসির মনের মধ্যে একটা ব্যথার গুমরানো অনুভূতি জাগল। সে বলল–একজন মা-ই তো যথেষ্ট, দুজন মা হলে আবার ঝগড়া বেঁধে যাবে।

–হ্যাঁ দরকার আছে, আমার বন্ধু স্যালি অ্যানের বাবা আবার বিয়ে করেছে, স্যালির তো দুটো মা।

একটু ধমকে ট্রেসি বলল–তুমি স্যালি নও, তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর।

অ্যামির মুখ ভার হয়ে গেল–আমার খিদে নেই।

–ঠিক আছে চল বই পড়বো।

ট্রেসি বই পড়ছে হঠাৎ কোলের ওপর নরম হাতের ছোঁয়া পেল।

–তোমার কোলে বসবো?

মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন যেন হু হু করে উঠল বেচারী ট্রেসির। সে মুখে বলল–না। মনে মনে বলল–নিজের পরিবারের লোকের কাছ থেকে আদর চেও, আমি আমার সঙ্গে তোমাকে জড়াতে চাইছি না। তুমি কি জান আমার কেউ নেই, ভবিষ্যতে কেউ কখনও আমার আপন হবে না?

মেয়েটাকে এত কথা বলে ট্রেসির মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ট্রেসি রাতে আর সেলের মধ্যে থাকতে পারছে না। অন্য সেল থেকে আসা নতুন কয়েদীদের আর্তনাদ শুনে তার মন ছটফট করে ওঠে। কি করে পালাবে এই কথা ভাবতে ভাবতে রাতের পর রাত কেটে যায়। পালানোর জন্যে কোন কোন কাজ করতে হবে তার একটা আগাম পরিকল্পনা ঠিক করল ট্রেসি। প্রথমেই তাকে দেখতে হবে কোনো ফাঁক-ফোকর পাওয়া যায় কিনা। পাহারাদার বা পুলিশরা কখন ডিউটি পাল্টায় সে ব্যাপারটাও জানতে হবে। চোখ বন্ধ করে ট্রেসি মুক্ত স্বাধীন জীবনের কথা চিন্তা করে। বাইরের পৃথিবীতে গিয়ে তার প্রথম কাজ হবে ওই শয়তান লোকগুলোর সাথে বোঝাঁপড়া করা। একেবারে শেষে আসবে চালর্স-এর পালা।

বিগবার্থাকে সে আর এড়িয়ে চলতে পারছে না। ট্রেসি জানে যেখানেই সে থাকুক না কেন, বিগবার্থার দুটি চোখ সবসময়ে তার ওপর নজর রেখেছে। ট্রেসি যেখানেই যায়, কয়েকমিনিটের মধ্যে বিগবার্থা সেখানে পৌঁছে যায়।

একদিন বিগবার্থা সরাসরি ট্রেসির কাছে একটা আবদার করে বসলদারুণ সুন্দর লাগছে তোমাকে আজ মাইরি। তোমাকে না পেলে আমার আর চলছে না।

–আমার কাছে ঘেঁষার চেষ্টা কোরো না, কণ্ঠস্বরে আগুন ঢেলে ট্রেসি বলেছিল।

–তোমার মরদটা তো বাইরে চলে যাচ্ছে। ওই কালা কুত্তিটা ছাড়া পাচ্ছে, তখন আমি তোমাকে আমার সেলে বদলী করে নিয়ে আসবো। তুমি সেই ভয়ংকর রাতটার জন্যে মনে মনে তৈরি হও কেমন?

ট্রেসি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল বিগবার্থার দিকে। বিগবার্থা বলল–হ্যাঁ আমি ওটা, করাতে পারবো, তুমি কি জান আমি কত শক্তিশালী?

.

বুনো ফুলে ভরা-মাঠে ঘুরে বেড়াতে ভীষণ ভালোবাসে অ্যামি, কাছেই ওই বিশাল পুকুরটা, পুকুর পাড়ে উঁচু পাথরের দেওয়াল।

একদিন ঘুরতে ঘুরতে অ্যামি বলল–চল না ট্রেসি সাঁতার কাটি।

–এখানে সাঁতার কাটা হয় না, ক্ষেতে জল দেবার জন্যে এই পুকুরটাকে ব্যবহার করা হয়।

টলটলে জল দেখে ট্রেসির মনটা কেমন উথাল পাথাল হয়ে ওঠে। ছোট্টবেলায় বাবার সঙ্গে জলে নেমে ডুবে গিয়েছিল সে, সেই ভয়ংকর স্মৃতিটা আবার তাকে আলোড়িত করল।

শেষ পর্যন্ত খবরটা শুনে ট্রেসিকে চমকে উঠতে হয়েছিল।

–এই শনিবারের পর এক সপ্তাহের মধ্যে আমার ছুটি হয়ে যাচ্ছে।

লিটলচ্যাপ কেটে কেটে বলেছিল। ট্রেসির মনে হল তার শরীরের সমস্ত রক্ত বুঝি জল হয়ে গেছে। এবার কী হবে? ওয়ার্ডেনকে সব কথা সে কি জানাবে? কিন্তু জেলে তো একটা অন্য নিয়ম আছে। এখানকার নিয়ম হল হয় তোমাকে মরতে হবে কিংবা মারতে হবে। তাহলে? আমি কি মারবো নাকি? অর্থাৎ লড়াইয়ের আসরে অবতীর্ণ হবো নাকি?

পালাবার পরিকল্পনা নিয়ে নানারকম আলোচনা হচ্ছে। বাইরে থেকে সাহায্য না পেলে সে কখনও পালাতে পারবে না অথচ সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকা চলবে না। বিগবার্থা ক্রমশ আরও অহংকারী হয়ে উঠবে। আরও বেশি প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে উঠবে তার মনের মধ্যে।

রোববার সকালে ট্রেসিকে রান্না ঘরে কাজ করার জন্য যেতে হল। মিসেস ব্র্যানিগান অ্যামিকে নিয়ে নিউ অর্লিয়েন্সে গেছেন। কদিন বাদে লিটলচ্যাপ-এর ছুটি হয়ে যাবে।

লিটলচ্যাপ জানতে চাইল–নতুন কাজ কেমন লাগছে?

–মন্দ নয়, উদাস গলায় ট্রেসি উত্তর দিল।

–দেখো আমি তো চলে যাচ্ছি, আর কখনও ফিরবো না, তবে একটা কথা বলে যাই বাইরে থেকে অ্যালবা. আমার সাহায্যের প্রয়োজন হলে…

লিটলচ্যাপ-এর কথা শেষ হবার আগে একটা মোটা ভারী কর্কশ পুরুষ কণ্ঠের শব্দ শোনা গেল–ভেতরে আসছি।

ট্রেসি ঘুরে দাঁড়াল, ধোবীখানার নোক একটা মস্ত বড় ঠ্যালাগাড়ি নিয়ে ঢুকেছে, তার ওপর স্তূপাকারে রয়েছে ময়লা কাপড় জামা, পুলিশদের উর্দি, ঠ্যালাগাড়ি নিয়ে নোকটা বেরিয়ে গেল। ট্রেসি এক দৃষ্টিতে ব্যাপারটা লক্ষ্য করল।

–হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম, অ্যাল এবং আমি তোমাকে সাহায্য করবো, বাইরে থেকে আমরা-আমরা অনেক কাজ করতে পারি যা ভেতরে বসে করা সম্ভব নয়।

–লিটলচ্যাপ, ধোবীখানার গাড়ি এখানে কেন আসে?

–এগুলো পাহারাদারদের উর্দি। জেলখানার ধোবীখানায় আগে কাঁচতে দিতো, দেখা গেল বোম থাকতো না একটাতেও। ইচ্ছে করেই বোম ছেঁড়া হত। জামাতে খারাপ কথা লেখা থাকতো, তারপর থেকে নতুন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কি লজ্জার ব্যাপার বলো তো?

লিটলচ্যাপ-এর বকবকানি ট্রেসির কানে ঢুকছে না, এতদিন বাদে সে মুক্তিপথের সন্ধান পেয়েছে। তার মুখখানা তখন নতুন আশার আলোতে একেবারে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।