২.১৭ রাজমহলের ঘাটে দুর্গা

রাজমহলের ঘাটে দুর্গা তখন মুখ হাত-পা ধুয়ে নিয়ে খাবার বন্দোবস্ত করেছে। রাজমহল থেকে নৌকো ছেড়ে আবার যাত্রা করতে হবে। এখান থেকে ছেড়ে হাতিয়াগড়ে পোঁছোতে আর বেশি সময় লাগবে না।

তবু ছোট বউরানি তাগাদা দিয়েছে দুর্গাকে। বলেছেওরে দুর্গা, ওরা দেরি করছে কেন? কখন নৌকো ছাড়বে?

দুর্গা বললে–দাঁড়াও গো ছোট বউরানি, একটু জিরোতে দাও, সারারাত নৌকো বেয়েছে, একটু জলটল খেয়ে নেয় ওরা? ওরাও তো মানুষ, না কী।

আর যেন তর সইছে না ছোট বউরানির। সেই কবে বেরিয়েছে হাতিয়াগড় থেকে, মনে হয় যেন কত বছর। এমন করে যে বিপদ কাটবে, কে জানত।

হঠাৎ পাশের নৌকোর ঝিঈ দুর্গার কাছে এল। বোরখা-পরা মূর্তি মুখের ঢাকনাটা তুলে বললে–মা, তোমাদের কাছে একটু দুধ হবে?

দুধ? দুধ কী হবে বাছা?

ঝি-টা বললে–আমার বিবির ছোট মেয়েটার খিদে পেয়েছে, একটু দুধ,পেলে ভাল হত তাই জিজ্ঞেস করছি।

তোমার মালিক কে? কোথায় যাচ্ছে?

আমার মালিক পলাশপুরের তালুকদার।

তা রাজমহলেই নামবে নাকি?

না মা, এখান থেকে যাবে আজিমাবাদে। সেখানে ফকিরের দরগায় দোয়া মানতে যাচ্ছে।

 তা সঙ্গে ছোট মেয়ে রয়েছে, দুধ আনতে হয় তো। দুধ আমরা কোথায় পাব?

ঝি-টা আর দাঁড়াল না। ডাঙার ওপর পলাশপুরের তালুকদার আর তার বিবি ছোট মেয়েটাকে কোলে করে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই দিকেই চলে গেল।

আসলে জায়গাটা রাজমহল নয়। নৌকো দুটো ভিড়েছিল রাজমহলের উলটো দিকের ঘাটে। বড় নিরিবিলি জায়গাটা। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র উপযুক্ত লোকের হাতেই ছোট বউরানিদের পাঠিয়েছিলেন। কথা ছিল হাতিয়াগড়ে পৌঁছিয়ে দিয়েই তারা আবার যথাসময়ে ফিরে আসবে। তবু দিনকাল বড় খারাপ। চারদিকে অরাজক অবস্থা। তাই মহারাজ যাত্রার আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন–চারদিক বুঝেসুঝে তবে যাবে, অনেক দূরের রাস্তা, কাউকে বিশ্বাস করবে না

কিন্তু একটা আশা ছিল এই যে লড়াই থেমে গিয়েছে। নবাব মুর্শিদাবাদ শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। নিজামতের বিষদাত ভেঙে গিয়েছে। এখন আর অত্যাচারের প্রকোপটা সাময়িকভাবে বাইরের প্রজাদের ওপর গিয়ে পড়বেনা। সেই সুযোগে ছোট বউরানিরা নির্বিবাদে নিজের দেশে গিয়ে হয়তো পৌঁছোত পারবে।

মহারাজা সকলকে পাঠাতে পেরে নিজের মনে কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। মানুষের সমাজে বা রাষ্ট্রে যখন দুর্যোগ আসে তখন ব্যক্তির সমস্যা দেশের কর্ণধারের কাছে ছোট হয়ে আসে। তখন মনে হয় বৃহত্তর মানুষের সমাজের মঙ্গল হবে কেমন করে। নবাব যে পালিয়ে গেল, এত অত্যাচারের স্রোতে বাংলাদেশের মানুষকে ভাসিয়ে দিয়ে গেল, তার শাস্তি তো হল না।

শাস্তি! শাস্তি কথাটা মনে পড়তেই মহারাজের মনে হল–কীসের শাস্তি? পাপের শাস্তি? ইতিহাসে আগে কি আর কোনও নবাব অত্যাচার করেনি? তাদের পাপের শান্তি কে দিয়েছে? বাব মুর্শিদকুলির পাপের শাস্তি কি হয়েছে? বাদশা আওরঙ্গজেবের পাপের শাস্তি কে ভোগ করেছে? কিংবা হয়তো পাপ পুণ্য বলে কিছুই নেই। ইতিহাসের চাকার তলায় পড়ে একজন খুঁড়িয়ে যায়, আবার কেউ একজন উঠে দাঁড়ায়। তাই-ই যদি হবে, তা হলে এ-পৃথিবী কোন আইনের সূত্র ধরে চলবে?

বাচস্পতি মশাইকে কথাটা একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন মহারাজ।

বাচস্পতি মশাই বলেছিলেন–পাপের শাস্তি তো সময় নগদ পাওয়া যায় না মহারাজ।

কিন্তু নগদ না-পাওয়া গেলে আমার প্রজাদের আমি কী বলে প্রবোধ দেব? তারা চাইবে ফলাফল। পুণ্যের ফলাফলও যেমন দেখতে চাইবে, পাপের ফলাফলও তেমনি দেখতে চাইবে। না দেখাতে পারলে সবাই যে শেষকালে অধার্মিক হয়ে উঠবে। রসাতলে যাবে সংসার। রাজ্য অরাজক হয়ে উঠবে।

বাচস্পতিমশাই বলেছিলেন সেই জন্যেই তো মহারাজ ঈশ্বরকে অদৃষ্ট বলা হয়েছে–আমরা সেই ঈশ্বরকেই ডাকব। ডেকে বলব–হে ঈশ্বর, তুমি আমাদের পাপ ক্ষমা করো

না বাচস্পতিমশাই, যে ক্ষমা চায় সে দুর্বল, সে ভীরু! ক্ষমা চাইলে সে প্রার্থনা ঈশ্বরের কানে গিয়ে পৌঁছোবে না। বলতে হবে, আমাদের পাপ মার্জনা করো।

সত্যিই সেদিন যখন মহারাজ কৃষ্ণনগর ছেড়ে মুর্শিদাবাদের দিকে যাচ্ছিলেন তখন চারদিকের অবস্থা দেখে সেই কথাগুলোই মনে হচ্ছিল। সবেমাত্র তিন দিন আগে লড়াই শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু নদীর দু’পাশের ধানখেতগুলো খা খন্মছে, লাঙল পড়েনি। দু’পাশের গায়ের কুঁড়েঘরগুলোফাঁকা। এই পথ দিয়েই নবাবের ফৌজ একদিন লাবাগে গিয়েছিল, আবার এই পথ দিয়েই ফিরিঙ্গিদের সেপাইরা পেছনে পেছনে এসেছে।

তা একেই হয়তো বলে প্রায়শ্চিত্ত। পৃথিবীর পাপ যখন পাকার হয়ে ওঠে তখন তার প্রায়শ্চিত্তের বিধান হয়তো এই রকমই। যেখানে যত কিছু পাপ আছে, অত্যাচার আছে, অশান্তি আছে, অকল্যাণ আছে, এইরকম করেই হয়তো ঈশ্বর তা মার্জনা করেন। কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত মানুষই যে এক। তাই একজনের পাপ অন্য জনের প্রায়শ্চিত্ততে তার প্রতিবিধান হয়। পিতার পাপ পুত্রকে বহন করতে হয়। প্রবলের পাপ দুর্বলকে সহ্য করতে হয়। মানুষের একজনের পাপ সকলকেই ভাগ করে নিতে হয়।

জগৎশেঠজির বাড়িতে বসে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সেই কথাই বলছিলেন।

জগৎশেঠজির দুশ্চিন্তা কদিন ধরে কম ছিল না। এক-একদিন এক-এক রকম খবর এসে সমস্ত ওলটপালট করে দিচ্ছিল। যার টাকা আছে তারই চুরির ভয় থাকে, যার রাজ্য আছে তারই অরাজকতার ভয় থাকে। অথচ সমস্ত মুর্শিদাবাদের লোকরা কেন শহরময় অত ভিড় করছে? তাদের ভাবনা কীসের? জগৎশেঠজি একবার দিল্লিতে লোক পাঠিয়েছেন, আবার কাছারিতে গিয়ে বসেছেন। কিছুতেই শান্তি পাননি মনে। খবরটা তিনিও পেয়েছিলেন যে, ক্লাইভ এক-একটা কাজের জন্যে এক-একবার লোক পাঠাচ্ছে মুর্শিদাবাদে। ওটা ছুতো। ওটা অজুহাত। মরিয়ম বেগম নামে কোনও বেগমসাহেবা চেহেল্‌-সুতুনে আছে কিনা তা জানবার জন্য এত কৌতূহল সাহেবের নেই। আসলে জানতে চায় মুর্শিদাবাদের হাঁড়ির খবর। জানতে চায় ক্ষমতা নিয়ে ঝগড়া বেধে গেছে কিনা ভেতরে ভেতরে। ইয়ার লুৎফ খাঁ, মিরজাফর আলি, রাজা দুর্লভরাম–এদের মধ্যে ঝগড়া বাধার গুজবটা সত্যি কি না।

মহারাজ বললেন–আমি ভুল করেছিলাম জগৎশেঠজি, আমার মনে হচ্ছে ক্লাইভ সাহেবের মতলব খারাপ। বোধহয় নিজেই মসনদে বসতে চায় এখন

জগৎশেঠ বললেন–আশ্চর্য নয়, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম লোকটা চালাক

তা চালাক তো বটেই। নইলে কাজ শেষ হবার আগেই টাকা চেয়ে বসে! ভাবছে এখানে এলে যদি সবাই মিলে আমরা রুখে দাঁড়াই।

জগৎশেঠজি বললেন–সেই জন্যেই আমি খবর পাঠিয়েছি যেন এখুনি মুর্শিদাবাদে না এসে পড়েন, তাতে খুন হয়ে যাবার ভয় আছে। লিখে দিয়েছি ক্লাইভকে খুন করবার জন্যে শহরে ষড়যন্ত্র চলছে বলে খবর পেয়েছি।

কিন্তু এমন করে ক’দিন আর অপেক্ষা করে থাকবে সাহেব?

জগৎশেঠজি বললেন–তা জানি না। তবে আমি দিল্লিতে তোক পাঠিয়েছি, তার কাছ থেকে খবর পাবার আশায় বসে আছি

কিন্তু সে তো তিন মাস লাগবে সেখান থেকে খবর আসতে।

হঠাৎ বাইরে ভিখু শেখের গলার আওয়াজ পেয়ে দুজনেই অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। কেউ এল নাকি? আজকাল যে-কোনও মুহূর্তে যে-কোনও ঘটনা ঘটতে পারে। কখন যে ফৌজের লোকরা বিদ্রোহ করে ওঠে বলা যায় না। নবাব নেই, সব লুঠপাট করে ফেলতে পারে। খবর রটে গেছে যে, মেহেদি নেসার চেহেল্‌-সুতুনের মালখানা লুঠ করতে গিয়েছিল। নানিবেগমসাহেবা বাধা দিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। মালখানার ভেতরে এখনও অনেক সোনা হিরে মুক্তো আছে। একবার মালখানা লুঠ করতে পারলে আর কোনও ভাবনা নেই।

আর তা ছাড়া এই-ই তো সুযোগ। এই সময়ে নবাব নেই, পাহারাদার নেই। কিছুই নেই বলতে গেলে। নিয়ম করে আর ইনসাফ মিঞা নহবতও বাজায় না। তারাও ভয় পেয়ে গেছে। মাইনে পাবে কি না তারই তো কোনও ঠিকঠিকানা নেই।

নানিবেগমসাহেবা সারারাত পাহারা দেয়। পিরালি খাঁ-কে হুশিয়ার করে দেয়। বলে খুব হুশিয়ার পিরালি। আমার মালখানার দিকে যেন কেউ না আসে। কেউ এলে তার গর্দান নিয়ে নেবে, তার পরে কথা।

পিরালি খাঁ,নজর মহম্মদ,বরকত আলি, তারা সবাই প্রহরে প্রহরে টহল দেয়। বেগমমহলের ফটকে ফটকে গিয়ে চিৎকার করে হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার হো

যারা ঘুমোয় তারা হুড়মুড় করে জেগে ওঠে ভয় পেয়ে। কী হল? আবার কী হল? আবার মালখানা লুঠ করতে এল নাকি?

তারপর যখন বুঝতে পারে তখন গালাগালি দেয় মনে মনে। বলে–মরণদশা আর কী! একটু ঘুমোতেও দেবে না ছাই

সমস্ত চেহেল্‌-সুতুনটাই এমনি ভয়ে ভয়ে শিউরে ওঠে সারারাত। দিনের বেলাটা তবু কোনওরকমে কাটে। কিন্তু রাত হলেই সকলের ভয় করে। কখন কী হয় কেউ বলতে পারে না।

কিন্তু সেদিন সত্যি-সত্যিই আর কারও ঘুম এল না। বাইরে যেন খুব গোলমাল হতে শুরু করেছে। আবার কি মালখানা লুঠ করতে এসেছে মেহেদি নেসার সাহেব? আবার বুঝি নানিবেগমসাহেবার সঙ্গে ঝগড়া বাধবে।

পেশমন বেগম নিজের মহলের ফটকের সামনে এসে উঁকি মারল। লোকজন ছুটোছুটি করছে।

সাহস করে পেশমন বেগম একজনকে জিজ্ঞেস করলে-কী হল রে বরকত?

বরকত আলির তখন বোধহয় আর সময় নেই কথা বলবার। দৌড়োত দৌড়োতে ছুটল নানিবেগমসাহেবার মহলের দিকে।

গুলসন কথাটা শুনতে পেয়েছিল। একটু ফুরসুত পেতেই জিজ্ঞেস করলে–কী হয়েছে রে ভাই? এত হল্লা আবার কীসের?

পেশমন বললে–কী জানি, মুখপোড়ারা আবার কী করেছে

আর কাউকে জিজ্ঞেস করো না।

তুই জিজ্ঞেস কর ভাই। আমার ভয় করছে।

হয়তো ফিরিঙ্গি ফৌজ আসছে।

পেশমন বললে–ফিরিঙ্গি ফৌজ এলে তো বাঁচি–এ আর ভাল্লাগে না ছাই। রোজই একটা-না-একটা হুজ্জত ।

পাশের ফটক থেকে তক্কি বেগমসাহেবা জিজ্ঞেস করলে–কী হয়েছে রে ভাই? হল্লা হচ্ছে কেন?

ওই দেখ, সব্বাই জেগে উঠেছে।

জেগে তো উঠবেই। কেউ কি আর ঘুমোতে পারছে একদিন? খাওয়া নেই, ঘুম নেই, শান্তি নেই মনে!

তক্কি বেগম বললে–ফিরিঙ্গি ফৌজ আসছে নাকি রে?

পেশমন বললে–হ্যাঁ, তোর তো আরাম, নতুন নতুন নাগর পাবি। একটু তবু মুখ বদলাতে পারবি

আহা মুখ বদলিয়ে আর কাজ নেই লো। সে বয়েস গেছে।

তা হলে মক্কায় গিয়ে হজ করে আয়। ফিরিঙ্গিরা তোকে হজ করিয়ে নিয়ে আসবে।

 তক্কি বেগম রেগে গেল। বললে–তা তোদের তো বয়েস আছে, তা হলেই হল।

পেশমন খোঁটা দিয়ে উঠল–মর তুই, আমরা মরছি প্রাণের ভয়ে, তোর এখন নাগরের শখ! এত নাগর পেয়েও তোর রস ঝরে না লো?

কথাটা বোধহয় আরও বাড়ত। কিন্তু বাধা পড়ল। পিরালি খাঁ ওদিক থেকে আসছিল। সামনে আসতেই যে-যার মহলের ফটক বন্ধ করে আড়ালে মুখ লুকিয়েছে।

পিরালি খাঁ যেতে যেতে বলতে লাগল–হুশিয়ার হো-হুঁশিয়ার

 তারপর একেবারে সোজা নানিবেগমসাহেবার মহলের সামনে গিয়ে হাজির বরকত আলি।

 নানিবেগমসাহেবা বলতে গেলে জেগেই ছিল। ডাক শুনে উঠে পড়ল–কৌন? পিরালি?

আমি বরকত, নানিবেগমসাহেবা!

ক্যা খবর?

ততক্ষণে পিরালি খাঁ-ও দৌড়োত দৌড়োতে এসে পড়েছে। নানিবেগমসাহেবা সজাগই থাকে সবসময়। কিন্তু সেদিন বুঝি একটু তন্দ্রা এসেছিল। তার মধ্যেই যেন স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্ন দেখছিল, নবাব আলিবর্দি খাঁ এসে দাঁড়িয়েছে সামনে।

একী, তুমি আলি জাঁহা!

হ্যাঁ, আমি এলাম। মির্জার বিপদের দিনে আমি না এসে পারি?

তা ভালই করেছ, তুমি এসেছ। জানো, সবাই মিলে মির্জাকে আমার হয়রান করে দিচ্ছে। সে বেপাত্তা হয়েছে। যাবার সময় আমাকে একবার বলেও যায়নি। আমি আর একলা সামলাতে পারছি না চেহেল্‌-সুতুন।

আর একলা সামলাতে হবে না, আমি তো এসেছি।

কিন্তু আমার মির্জার কী হবে?

হবে আবার কী? কিছুই হবে না।

জানো, মির্জার ইয়ারবকশিরা আমার মালখানা লুঠ করতে এসেছিল, আমি তাদের গালাগালি দিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছি–এখন কী হবে? তারা যদি ফিরিঙ্গিদের ফৌজ নিয়ে এসে চেহেল্-সুতুনে হামলা করে? তারা যদি আমাদের কোতল করে?

কেঁদোনা। কান্না তোমায় মানায় না। তুমিনা নানিবেগম! তোমার মুখ চেয়ে না চেহেল্‌-সুতুনের বেগমরা বসে আছে? তোমায় কাঁদতে দেখলে তারা কী ভাববে তা একবার ভাবো তো? আর মির্জার কথা বলছ? মির্জা কি পালাবার মতো নাতি তোমার? মির্জা ফিরিঙ্গিদের ভয়ে পালাবে, তোমার নাতি কি সেই রকম?

ওগো, তুমি জানো কোথায় গেছে সে? সত্যি জানো?

জানি জানি। জানি বলেই তো তোমাকে বলতে এসেছি

বলো না সে কেমন আছে? কোথায় আছে? কখন আসবে?

আসবে আসবে, দু’দিন সবুর করো। সে হাতির পিঠে চড়ে মুর্শিদাবাদে আসবে।

সত্যি বলছ আসবে?

হ্যাঁ হ্যাঁ, সে আসবে! দু’দিন পরেই আসবে।

কিন্তু তা হলে সে পালাল কেন? অমন করে চোরের মতো রাজধানী ছেড়ে পালাল কেন?

নবাব আলিবর্দি খাঁ হা হা করে হাসলেন সেই আগের দিনের মতো। বললেন–নবাবি রাখতে গেলে যেমন লড়াই করতে হয়, তেমনি আবার লড়াই থেকে পালাতেও হয়। আমি পালাইনি? ভাস্কর পণ্ডিতের ভয়ে আমি পালিয়ে আসিনি? তোমার মনে নেই সে-সব দিনের কথা?

কিন্তু লড়াই থেকে পালানো আর চেহেল সুতুন থেকে পালানো কি এক কথা?

একই কথা। দরকার হলে তোমার মির্জা আজিমাবাদ থেকে লড়াই করবে। কিংবা জাহাঙ্গিরাবাদ থেকে

তুমি তা হলে বলছ ওই কথা? তুমি তা হলে অভয় দিচ্ছ?

হ্যাঁ হ্যাঁ, অভয় দিচ্ছি। তোমার কোনও ভয় নেই, সে মুর্শিদাবাদেই আসছে। একেবারে হাতির পিঠে চড়ে আসছে….

বলতে বলতে কী যেন একটা শব্দ হল আর সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল।

কৌন?

আমি পিরালি খাঁ, নানিবেগমসাহেবা।

নানিবেগমসাহেবা ধড়মড় করে উঠে ফটক খুলে দিয়েছে।

কী হয়েছে পিরালি খাঁ? কেউ মালখানা লুঠ করতে এসেছে?

না নানিবেগমসাহেবা। নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা মুর্শিদাবাদে আসছেন।

মির্জা আসছে? তোকে কে বললে?

আনন্দে উৎকণ্ঠায় নানিবেগমসাহেবার গলা যেন বুজে এল।

বল শিগগির, কে তোকে বললে? বল

শহরে খবর এসেছে। আজিমাবাদ থেকে ফরাসি মিরবকশি ল’সাহেবের সঙ্গে ফৌজ নিয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে আসছে।

নানিবেগমসাহেবা কী করবে বুঝতে পারলে না। হাতের কাছে কাউকে যেন ডাকতে ইচ্ছে হল, কারও কাছে যেন কথাটা বলে তৃপ্তি পেতে ইচ্ছে হল। ওরে, তোরা কোথায় গেলি? ওরে পেশমন, ওরে গুলসন, বন্ধু, তকি, আমিনা, ময়মানা–

তারপর হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেছে। পিরালিকে বললে–ওরে, তা হলে, নহবতখানায় খবর দে পিরালি, নবত বাজাতে বল–মির্জা আসছে, বল যেন ভাল করে নবত বাজায়–ওরা নবত বাজাচ্ছে না কেন? ওরে যা, শিগগির কর–

সেদিন মনসুরগঞ্জের হাবেলিতেও খবর পৌঁছে গেল। মিরন ক’দিন থেকেই রাত্রে ঘুমোচ্ছ না। মিরজাফর আলি হবে সুজা উল মুলক হিসাম-উ-দ্দৌলা বাহাদুর মহবত জঙ। আর মিরন নিজে হবে। সুজা উল মুলক শহবত জঙ।

হঠাৎ মনসুরগঞ্জের ভেতরেও গোলমাল শুরু হল।

শেষরাত্রের দিকে আবার কী হল? কীসের গোলমাল? মিরন বাইরের দিকে চেয়ে দেখলে। ভোর হয়ে আসছে।

বাপজান?

তাড়াতাড়ি মিরজাফরের ঘরের সামনে গিয়ে ডাকাডাকি শুরু করে দিলে মিরন। নীচেয় সদর ফটকে কারা এসেছে। আবার ফিরিঙ্গি সাহেব এল নাকি? বারবার একটানা-একটা ফরমাশ! মরিয়ম বেগম তো আছে চেহেল্‌-সুতুনে। আবার কীসের খবরদারি!

কী হল? ডাকছিস কেন?

 মিরজাফর সাহেবের কানেও আওয়াজটা গেছে।

নীচেয় বোধহয় আবার সেই ওয়ালস সাহেব এসেছে।

মিরজাফর সাহেব বিরক্ত হল। একটু ভেবে নিয়ে বললে–আসলে এটা হল ফিকির। কেবল এসে এখানকার হালচাল জেনে যাচ্ছে–

কিন্তু না। এসেছে মেহেদি নেসার। আর সঙ্গে আছে রেজা আলি।

শুনলাম নবাব ফিরে আসছে মুর্শিদাবাদে।

ক্যা?

নবাব ফিরে আসছে শহরে। জোর গুজব। আজিমাবাদ থেকে জেনারেল ল’সাহেব ফৌজ নিয়ে নাবের সঙ্গে আছে!

হঠাৎ সমস্ত মুর্শিদাবাদের মুখখানার ওপর কে যেন কালি লেপে দিলে। একদিন যে মুর্শিদাবাদ ফিরিঙ্গি ফৌজের ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল, এই নতুন খবরটা পেয়ে তার যেন বাকরোধ হয়ে এল। অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই অরাজক রাজধানী আগেও অনেকবার অরাজকতা দেখেছে, কিন্তু এমন করে কখনও আতঙ্কে শিউরে উঠে নিশ্চল হয়ে যায়নি। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে যেন রোমাঞ্চের খোরাক জুগিয়ে গেছে ইতিহাস। যারা সেদিন শহর ছেড়ে দূরে চলে গিয়েছিল তারাও খবর শুনে জেগে উঠে বসল। এদের এতদিনের সমস্ত ভবিষ্যৎবাণী মিথ্যে হয়ে গেল রাতারাতি; আবার তা হলে নবাব আসবে? আবার তা হলে যে-যার নিজের নিজের ভিটেয় গিয়ে গৃহদেবতা শালগ্রাম শিলার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে?

ক্লাইভ সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা সেরে শেষরাত্রের দিকে রওনা দিয়েছিল উমিচাঁদ সাহেব। রাত্রের অন্ধকারে রাজধানীতে পোঁছোনোই ভাল। কিন্তু পথেই খবরটা পেয়ে পালকি থামাতে বললে।

কী বললে রে লোকটা?

 একটা পালকি-বেহারা বললে–হুজুর, বললে–নবাব নাকি আবার আসছে

আবার আসছে মানে?

আজিমাবাদ থেকে ফৌজ সেপাই নিয়ে মুর্শিদাবাদে লড়াই করতে আসছে।

কথাটা শুনে কিছুক্ষণ থমকে চুপ করে রইল উমিচাঁদ সাহেব। একবার দাড়িতে হাত বুলোল। পালকিটা আবার চলতে আরম্ভ করেছিল। দু’কোটি কুড়ি লাখ টাকা চেয়ে পাঠিয়েছিল সাহেব, তাও জগৎশেঠজি দিলে না? আরে, টাকাটা তো তোমার জলে যাচ্ছে না। তুমি টাকাটা দিয়ে দেবে এখন, তারপর যখন নবাবের মালখানার ভেতরে ঢুকে হিসেব-নিকেশ হবে তখন তো তোমার আসল টাকা পেয়ে যেতে। শুধু আসল টাকাটাই পেতে না, সঙ্গে সঙ্গে সুদও পেয়ে যেতে। সুদখোর মানুষ তো, তাই দিতে ভরসা হল না।

এই, রোখকে রোখকে

পালকিটা চলতে চলতে হঠাৎ সাহেবের হুকুম পেয়ে থেমে গেল মাঝপথে।

পালকি ঘোরা। যেদিক থেকে এসেছিলি, সেই দিকেই ফিরে চল–

আজ্ঞে, আবার ময়দাপুরে যাব?

হ্যাঁ!

পালকিটার মুখটা আবার ঘুরল। আবার উলটো দিকে চলতে লাগল পালকি। হুজুরের যেমন মর্জি, তেমনি করতে হবে। সেই কবে কলকাতা থেকে বেরিয়েছে। বেরিয়ে পথে কাজ সেরেছে, কোথাও দুদিন থেমেছে, আবার চলতে আরম্ভ করেছে। সাহেবের মতিগতি বোঝবার উপায় নেই কারও। কখন কোথায় যাবে, কোথায় থামবে তারও আগে থেকে কোনও হদিস দেবে না।

তা হোক, তারা তো জানে না যে, উমিচাঁদ সাহেব নিজেই জানে না কখন কোথায় থামতে হবে। সারাজীবন ধরে একদিকে স্থির লক্ষ্যে চলা হয়নি উমিচাঁদের। শুধু টাকাটার দিকেই নজর ছিল। সেই টাকার জন্যে কখনও বাঁয়ে হেলেছে, কখনও ডাইনে। কখনও এদলে কখনও ও দলে। যতদিন নবাব আলিবর্দি বেঁচে ছিল ততদিন তাকে ভুলিয়ে খুশি রেখেছে। নবাবকে খুশি রেখে কাজ হাসিল করেছে নিজের। কিন্তু তার পরে যেনবাব এল তার হাত উপুড় হতে চায় না। কথায় কথায় বলে, টাকা নেই। আরে টাকা যখন তোমার নেই তখন আমিও নেই। যাদের টাকা আছে আমি তাদের দলেই থাকব।

পালকিটা চলতে চলতে প্রায় কাশিমবাজারের কাছে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে আবার ময়দাপুর ফিরতে প্রায় ভোর হয়ে গেল। ল’সাহেব যদি আবার ফিরে আসে তো তারও কিছু বন্দোবস্ত করতে হবে।

নবাব মির্জা মহম্মদ ফিরেই আসুক আর ক্লাইভ সাহেবই জিতুক, তাতে উমিচাঁদ সাহেবের কিছু এসে যায় না। তোমাদের দুজনের মধ্যে যে জিতবে আমি তার দলে। তোমার টাকা যদি থাকে তো থাকুক, আমি সেদিকে নজর দেব না। কিন্তু আমার হাতযশ যদি থাকে তো সে টাকা আমার হাতে চলে আসবেই! আমি উমিচাঁদ। একদিন নিঃসম্বল হয়ে এই বাংলা মুলুকে এসেছিলাম পাঞ্জাব থেকে। সেদিন পথে পথে দুটো ভাতের জন্যে ঘুরে বেড়িয়েছি, কেউ ভিক্ষে দেয়নি। আজ আমার টাকা হয়েছে, কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছি, চুরি করব, ডাকাতি করব, ঠকব, কিন্তু ভিক্ষে আর করব না। জীবনে সার বুঝে নিয়েছি ভিক্ষের চেয়ে চুরি ভাল!

হঠাৎ যেন কিছু শব্দ কানে এল! এত সকালে কীসের শব্দ? ময়দাপুর এসে গেল নাকি?

 কাছে যেতেই ছাউনির সেপাইরা ঘিরে ধরেছে।

হুজুর আপনি?

সেপাইরা এত ভোরেই উঠে পড়েছে। এত কীসের কাজ?

হ্যাঁ, জরুরি খবর আছে, সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

কিন্তু পথে ওদিকে কোনও মেয়েছেলেকে দেখলেন?

মেয়েছেলে?

সেপাইটা বললো, কর্নেলসাহেব একজন মেয়েছেলে স্পাইকে ধরে রেখে দিয়েছিলেন, তাকে আবার শাড়িও কিনে দিয়েছিলেন, সে হঠাৎ পালিয়েছে

পালিয়েছে?

 সর্বনাশ হয়েছে। এই খবর এসেছেনবাব আসছে আর এই সময়েই কি নবাবের চর পালিয়ে গেল।

কী করে পালাল?

ওদিক থেকে নবকৃষ্ণ এসে হাজির হল। এই যে, আবার ফিরে এলেন হুজুর? এদিকে সর্বনাশ কাণ্ড বেধে গেছে। একজন মেয়েমানুষ চর পালিয়ে গেছে সাহেবের ঘর থেকে।

উমিচাঁদ বললে–চলো, কর্নেলসাহেবের কাছে চলল। চর পালাক, ওদিকে আরও জবর খবর দিতে হবে সাহেবকে

*

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ভাল লোকই দিয়েছিলেন সঙ্গে। নৌকো ঘাটে লাগতেই তারা গাছতলায় রান্নাবান্না আরম্ভ করে দিয়েছিল। সঙ্গে কাঠও ছিল, হড়িকুড়ি-বাসন-তৈজস সবই এনেছিল সঙ্গে।

এতক্ষণ দেখতে পায়নি ওরা। বোরখা-পরা বউটা আর তার ঝি আবার কাছে এল।

বউটা বললে–আপনারা কি রান্নাবান্না করছেন?

দুর্গা বললে–তা তোমরাও রান্নাবান্না করো না

বউটা বললে–আমাদের সঙ্গে যে বাসনটাসন কিছু নেই

তা এত দূরের রাস্তায় যাচ্ছ, সঙ্গে বাসনকোসন নেই, এ কী রকম রীতি তোমাদের বাছা? সঙ্গে কে তোমার? ভাতার?

বউটা বুঝলে। বললো –হ্যাঁ

তা তোমার ভাতারেরই বা কী রকম আক্কেল বাছা যে, সঙ্গে বাসনকোসন আনে না।

বউটার স্বামী তখন একটা গাছতলায় চুপ করে হেলান দিয়ে বসে আছে।

তা হলে খাবে কী?

বউটা বললে–সেই কথাটা তো বলতে এসেছি। সঙ্গে আমাদের কিছু নেই।

তা আমরা যে হিন্দু, তোমাদের ছোঁয়া তো আমরা খাইনে। আমাদের ছোঁয়া কি তোমরা খাবে?

তা খেতে পারি! আমার জন্যে আমি ভাবি না। আমার এই ছোট মেয়েটা আর ওঁর জন্যে ভাবছি।

দুর্গা বললে–তা এখানে যদি তোমাদের কোনও স্বজাতি থাকে তাদের বাড়ি যাও না, সেখানে গেলে তোমাদের ভাত রান্না করে দিতে পারে–

অনেকক্ষণ ধরে দু’জন লোক এদিকে চেয়ে দেখছিল। তারা আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কী যেন বলছিল।

একজন বললে–আমার মালুম হচ্ছে লোকটা নবাবজাদাটাদা কেউ হবে।

কী করে বুঝলেন?

 দুধের জনো একটা মোহর দিয়ে দিলে, এ তো যে-সে কেউ নয়, আর পায়ের জরিদার চটি দেখছিস, নবাবজাদা ছাড়া ওরকম চটি কে প্রবে?

যে-লোকটার চটির কথা হচ্ছিল তার তখন কোনও দিকে খেয়াল নেই। খোলা আকাশের দিকেই। তখন সে উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আল্লাহ খোদাতালা, তোমার কাছে আমি আজ ক্ষমাও চাইব না। ক্ষমা চাইবার হিম্মৎ আজ আর আমার নেইও। কিন্তু ওদের তুমি দেখো। ওরা কোনও পাপকরেনি, আমার পাপের ফল ওরা কেন ভোগ করবে! ওদের তুমি দেখো আল্লাহ

খানিকক্ষণের মধ্যেই বেশ ঘনিষ্ঠতা জন্মে গেল দুটো দলে। ভোরাত্রে দুটো পরিবার দুটো নৌকোয় এসে একই ঘাটে জুটেছিল। তারপর আস্তে আস্তে সূর্যের আলো ফুটল। কৌতূহল অদম্য হয়ে উঠল দুদলের মনে। এরা ভাবলে–ওরা কারা। ওরাও ভাবলে–এরা কারা। বিপদের সময় মানুষ আশেপাশের কারও সহানুভূতি চায়, কাউকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়।

তা মুর্শিদাবাদের নবাব পালিয়ে গেছে, তা শুনেছ তো বাছা?

কথাটা শুনেই বউটা যেন চমকে উঠল। সেই জুন মাসের ভোরবেলায় হঠাৎ বজ্রাঘাত হলে যেমন হয়, ঠিক তেমনি হয়ে উঠল বউটার মুখের ভাব। তাড়াতাড়ি ছোট মেয়েটাকে কোলে টেনে নিলে। যেন অভিশাপ লাগবে কারও!

বউটি বললে–আমি উঠি ভাই

দুর্গা বললে–ওমা, উঠবে কেন, বোসো না–

দুর্গা ছাড়লে কিছুতেই। জোর জবরদস্তি করে বসিয়ে দিলে। দূরে মানুষটা তখনও গাছে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার যেন কোনও দিকেই খেয়াল নেই। আল্লার বিচিত্র খেয়াল কারও বুঝবার উপায় নেই। একদিন এই রাজমহল, এই মুর্শিদাবাদ, এই বাংলা মুলুক, এখানকার সবাই নবাবকে দেখতে পেলে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে কুর্নিশ করত। হিন্দু মুসলমান ফিরিঙ্গি সবাই নবাবের সামনে আসতে ভয় পেয়েছে। আজ তাদের সেই নবাব গাছতলায় চুপ করে বসে আছে, কেউ তার দিকে চেয়েও দেখছে না, কেউ কুর্নিশও করছে না। কেউ বুঝতেই পারছে না, তাদেরই নবাব আজ এখানে তাদের মর্জির ওপর নির্ভর করে রাস্তার ধুলোয় তার মসনদ পেতেছে।

ছোট বউরানি বললে–অমন নবাবের মুখে আগুন, অমন নবাব থাকলেই বা কী, আর গেলেই বা কী!

দুর্গা বললে–তা তোমরাও তো পলাশপুরের তালুকদার, তোমাদের কিছু হেনস্থা করেনি নবাব?

এসব কথার জবাব দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল না লুৎফার। সেই ভোরবেলা থেকে পাশাপাশি একসঙ্গে কাটিয়ে একটু ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল। একসঙ্গে খানিকক্ষণ থাকলেই তো পরস্পরের খবর দেওয়া-নেওয়া চলে। তোমরা মুসলমান, তা হোক। কিন্তু এক দেশেরই তো মানুষ। আমাদের হাতিয়াগড়েও অনেক মুসলমান প্রজা আছে।

দুর্গা বললে–আমাদের ছোটমশাইকে সবাই রাজার মতো ছেদ্ধা-ভক্তি করে। ছোটমশাই হাতিয়াগড়ের রাজা–তা ওই যে এক হতচ্ছাড়া নবাব হয়েছে, তার জ্বালায় কি আর শান্তিতে থাকতে পারে কেউ? নবাবি গেছে বেশ হয়েছে

কথা শুনতে শুনতে লুৎফার যেন কেমন ভয় করতে লাগল। এরা যদি জেনে ফেলে? এরা যদি চিনতে পারে? চিনতে পারলে যে জানাজানি হয়ে যাবে?

তা তোমার কর্তা অমন চুপচাপ বসে আছে কেন গো? কী হয়েছে?

লুৎফা বললে–মন ভাল নেই

তা মন তো আমাদেরও ভাল ছিল না এতদিন। এতদিন যে কী কষ্টে দিন গেছে! কোথায় কোথায় দিন কাটিয়েছি, রাস্তায়ঘাটে যেখানে পেরেছি থেকেছি। তেমন কষ্ট শত্ত্বরেও যেন না পায়।

কেন? কী হয়েছিল আপনাদের?

ওই যে বললুম, হতচ্ছাড়া নবাব। হতচ্ছাড়া নবাবের জন্যে কি দেশে বউ-ঝি নিয়ে কেউ শান্তিতে থাকতে পারত। আমার এই ছোট বউরানির ওপরে যে নবাবের বিষনজর পড়েছিল বাছা! মুখপোড়া নবাব এখন গেছে এখন বেঁচেছি–

লুৎফা বললে–এই ছোট বউরানির ওপর নজর পড়েছিল?

তা শুধু কি বাছা এই ছোট বউরানির ওপর? কত মেয়ের সব্বনাশ করেছে তার কি ঠিক আছে? তুমি কি মনে করেছ তাদের শাপ লাগেনি? নবাবের এখন হয়েছে কী? এখন তো সবে কলির সন্ধে। মাথার ওপর ভগবান বলে তো একজন আছে, তার নজর তো এড়াবে না বাছা!

সত্যি বলুন-না, কী হয়েছিল? কেন এত গালাগালি দিচ্ছেন?

ছোট বউরানি বললে–তুই থাম না দুগ্যা, যা হয়ে গেছে তা নিয়ে এখন আর কেন বলছিস?

বলব না? এখন কাকে ভয় করব শুনি?

লুৎফা বললে–না না, বলুন-না কী হয়েছিল?

যে-লোকটা এতক্ষণ গাছতলায় হেলান দিয়ে বসে ছিল, সে-লোকটা তখন উঠে দাঁড়িয়েছে।

দুর্গা দেখতে পেয়েছে। বললে–ওই যে তোমার কর্তা কোথায় যাচ্ছে গো, খুব খিদে পেয়েছে বোধহয় মানুষটার, আহা, সকাল থেকে তোমাদের কিছু খাওয়া হয়নি।

লুৎফা ফিরে তাকাল।

দুর্গা বললে–কী রকম আক্কেল বাছা তোমাদের, তোমরা যাচ্ছ পিরের দরগায়, আর সঙ্গে চাল-ডাল কিছু নাওনি

প্রথমে রান্না হয়েছিল দুর্গাদের। কৃষ্ণনগর থেকে সবই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। রান্না-খাওয়া হবার পর তখন আলাদা করে রান্না চড়েছিল লুৎফাঁদের। শিরিনা রান্না করছিল খিচুড়ি। জীবনে কখনও এমন করে এমন অবস্থায় পড়তে হয়নি লুৎফাঁকে। খিদে যে এমন জিনিস, তাও কখনও এমন করে বুঝতে হয়নি। খোলা আকাশের তলায় এমন করে বসে খাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারেনি। টাটা করছে রোদ। তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ডাকলে ওগো

মির্জা মহম্মদ মুখ ফেরাল।

কোথায় যাচ্ছ? খিচুড়ি বানিয়েছে যে শিরিনা—

অ্যাঁ? এতক্ষণে বাস্তব জগৎটা যেন মির্জা মহম্মদের চোখের সামনে ধরা পড়ল।

কোথায় যাচ্ছিলে? তুমি যে বললে–খুব খিদে পেয়েছে তোমার?

আমার কিছু ভাল লাগছে না আর। খুকু কোথায়?

ঘুমোচ্ছে! চলল, খাবে চলো।

ওরা কারা? কাদের সঙ্গে কথা বলছিলে এতক্ষণ?

 হাতিয়াগড়ের হোটরানি!

হাতিয়াগড়! নামটা শুনেই মরিয়ম বেগমসাহেবার কথা মনে পড়ল। মরিয়ম বেগমসাহেবা এখানে এসেছে নাকি! মির্জা মহম্মদ নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা খানিকক্ষণের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। চেহেসতুনের কথা মনে পড়ল। আবার একবার দেখতে ইচ্ছে করল মরিয়ম বেগমসাহেবাকে। চেহেল্‌-সুতুন ছেড়ে আসবার সময় একবার শেষবারের মতো দেখা করবার ইচ্ছে হয়েছিল।

ওরা এখানে কী করতে এসেছে?

ওরা হাতিয়াগড়ে ফিরে যাচ্ছে।

তা হলে স্বামীর কাছেই শেষপর্যন্ত ফিরে যাচ্ছে বেগমসাহেবা! ভালই হয়েছে। একদিন যখন অশান্তির যন্ত্রণায় ছটফট করেছে, যখন অনিদ্রায় ক্লান্তিতে শরীর-মন অবশ হয়ে এসেছে, তখন ওই মরিয়ম বেগমসাহেবাই দিনরাত পাশে বসে সান্ত্বনা দিয়েছে নবাবকে।

বললে–ওরা জানে আমি এখানে এসেছি?

না, আমি কখনও তাই বলি? আমি বলেছি আমি পলাশপুরের তালুকদার সাহেবের বউ, আজিমাবাদের ফকিরের দরগায় দোয়া চাইতে যাচ্ছি–

মির্জা মহম্মদ বললে–খিচুড়ি তৈরি হয়েছে?

আর একটু সবুর করো, এখনই হবে। আমি দেখে আসছি

দাঁড়াও, আমিও যাব।

কোথায়?

ওদের সঙ্গে দেখা করব।

লুৎফা ভয় পেয়ে গেল। বললে–না না, তুমি যেয়ো না, ওরা চিনে ফেলবে

 মির্জা মহম্মদ বললে–না না, মরিয়ম বেগমসাহেবা চিনতে পারলে কিছু ক্ষতি নেই

ওগো না, ও মরিয়ম বেগম নয়, ও অন্য, ওরা নবাবকে গালাগালি দিচ্ছে, ওরা তোমার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। নবাব পালিয়ে গেছে শুনে ওরা এতদিন পরে হাতিয়াগড়ে ফিরে যাচ্ছে। ওখানে তুমি যেয়ো না–

বলতে বলতে লুৎফার চোখে জল এসে গেল। বললে–সবাই তোমার শত্রু তা জানো, কেউ তোমার ভাল দেখতে পারে না।

মির্জা মহম্মদ থমকে দাঁড়াল খানিকক্ষণ! সবাই তার শত্রু! সবাই তার খারাপ চায়। সবাই তার অমঙ্গল কামনা করে! এই মুর্শিদাবাদ থেকে এত দূরে এসেও মানুষের শত্রুতার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া গেল না!

কেঁদো না তুমি!

 মির্জা মহম্মদ লুৎফার চোখের জল দেখে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে গেল!

 কিন্তু কেন তোমাকে কেউ দেখতে পারে না? হাতিয়াগড়ের ছোটরানিরও তুমি ক্ষতি করতে চেয়েছিলে? কেউ তোমার হয়ে একটা ভাল কথা বলে না কেন?

ও আমার নসিব লুৎফা। ও নিয়ে তুমি আর এখন দুঃখ কোরো না। তুমি যদি এমন করে এখন কাঁদো তো আমাদের সকলের বিপদ ডেকে আনবে। আমার বিপদ ডেকে আনবে, তোমার নিজের বিপদ ডেকে আনবে, তোমার মেয়ের বিপদ ডেকে আনবে–চুপ করো, চোখের জল মোছ

লুৎফা বলতে লাগল–দেখো, আমি এ নিয়ে তোমাকে কখনও কোনওদিন কিছু বলিনি, আজও বলতাম না, কিন্তু তোমার নিন্দে শুনলে আমার যে বড় কষ্ট হয়।

সেও তোমার নসিব।

ততক্ষণে শিরিনার রান্না হয়ে গেছে। খিচুড়ির হাড়িটা নিয়ে সে গাছতলায় এনে রাখলে। ধুধুকরছে বালি চারদিকে। একটা আবরু নেই, একটা আড়াল নেই। একটা খিদমদগার নেই, একটা পেয়াদাবরকন্দাজ কিছু নেই। মাথার ওপর কেউ পাখার বাতাস করতে এল না। পাশে কেউ খাবার জলের গাগরি নিয়ে হুকুমে হাজির রইল না। মোরগ-মশল্লামের গন্ধে বাতাস ভুরভুর করে উঠল না। শুধু চালে-ডালে মেশানো খিচুড়ি। তারই সামনে বসল নবাব। আর পাশে লুৎফা।

তুমিও সঙ্গে খেতে বসলে কেন?

 তুমি আগে খাও, তারপর আমি খাব—

কিন্তু হঠাৎ দূর থেকে যেন একটা শব্দ কানে এল। অনেক দূর থেকে। মির্জা মহম্মদ চেয়ে দেখলে। লুৎফাও চেয়ে দেখলে অনেক দূরে যেন ধুলো উড়ছে। ঘোড়া ছুটিয়ে কারা যেন আসছে।

তখনও খিচুড়িতে হাত দেওয়া হয়নি।

কারা আসছে এদিকে? ফৌজের নোক নাকি?

লুৎফা মুখখানা বোরখায় ঢেকে ফেললে। মির্জা মহম্মদ খানিকক্ষণ চেয়ে রইল সেই দিকে। তবে কি জেনারেল ল’সাহেব আসছে? টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আজিমাবাদের খাজাঞ্চিখানা থেকে। এতদিনে বোধহয় টাকা পৌঁছেছে সাহেবের হাতে। তাই ফৌজ নিয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে যাচ্ছে। তুমি তো খুব লোক হে, এত দেরি করে আসতে হয়? আমি তো তোমাদের ভরসাতেই ঢাকার জাহাঙ্গিরাবাদে না গিয়ে আজিমাবাদের দিকে যাচ্ছি। আমি জানি তোমরা এই পথ দিয়েই আসবে! তা এত দেরি করে এলে কেন? তোমরা তো জানো ইংরেজদের। তোমাদের চিরকালের শত্রু। তোমরাই আমাকে কথা দিয়েছিলে তোমরা ইংরেজদের সঙ্গে লড়বে! তা এখন এত দেরি করে আসতে হয়?

কী হল, উঠলে যে?

মির্জা মহম্মদ বললে–জেনারেল ল’ আসছে, এখন কি আমার খাবার সময় আছে লুৎফা! এখন একেবারে মুর্শিদাবাদে গিয়ে খাব। আর একদিন না খেলে কীই বা ক্ষতি!

ঘোড়ার খুরের আওয়াজে তখন দুর্গা, ছোট বউরানি তারাও ভয় পেয়ে গেছে। আবার কাদের ফৌজ আসছে এখানে। নৌকোর মাঝিমাল্লা তারাও তখন খেতে বসেছিল। ফৌজের আসার শব্দ শুনে তারাও সেই দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল।

*

ময়দাপুরে একটা রাত কেটেছিল মরালীর। ছাউনির সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখনও মরালী জেগে জেগে ভাবছিল। বাইরে নিঝুম রাত। হাতিয়াগড়ে এমনি নিঝুম রাতে সেই ছোটমশাইয়ের রাজবাড়িতেও মরালী এমনি করে জেগে কাটিয়েছিল। সেই সিঁড়ির তলার ঘরখানাতে বসে বসে অন্ধকারে কত রাত আকাশ-পাতাল করেছে। মাঝরাত্রে শুধু এক-একবার দুর্গা এসে দরজা খুলে খবর। নিত লুকিয়ে লুকিয়ে।

তারপর কত দিন কেটে গেল, আরও কত বিচিত্র মানুষদের মধ্যে জীবন কাটাতে হল। কত বিভিন্ন সমাজ, কত বিচিত্র পরিবেশ। কোথায় হাতিয়াগড়, সেখান থেকে রানিবিবি সেজে চেহেল্‌-সুতুন, চেহ্নে-সুতুন থেকে পেরিন সাহেবের বাগান, সেখান থেকে হালসিবাগান, তারপর সেখান থেকে মতিঝিল। তারপর মতিঝিল থেকে এই ময়দাপুরের ফিরিঙ্গিদের ছাউনি।

সন্ধেবেলা ক্লাইভ সাহেব হঠাৎ ঘরে এসেছিল।

 কিছু খবর পেলেন?

ক্লাইভ সাহেব বলেছিল–হ্যাঁ, তোমার কথাই ঠিক, চেহেল্‌-সুতুনেও আর একজন মরিয়ম বেগমসাহেবা আছে।

তা আপনি কি ভেবেছিলেন আমি মিথ্যে কথা বলেছিলাম?

কিন্তু দু’জন মরিয়ম বেগমসাহেবা কী করে হল? সে-ই বা কে, আর তুমিই বা কে?

মরালী বলেছিল–আমিই আসল মরিয়ম বেগম

আর সে?

 সে আমার চেনা লোক।

চেনা লোক মানে?

সে আমার নিজের কেউ নয়। কিন্তু আমার নিজের লোকের চেয়েও আপন।

স্পষ্ট করে বলো! তোমাদের দুজনের নাম এক হল কী করে?

তার নাম মরিয়ম বেগম নয়, আমার নামও আসল মরিয়ম বেগম নয়।

তুমি দেখছি এখনও আমার সঙ্গে চালাকি করতে শুরু করেছ। বলল, তুমি কে? তোমার আসল নাম কী?

আমার আসল নাম বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে সাহেব। অত কথা শোনবার সময় হবেনা আপনার। আমি কেন যে নবাবের চেহেলসূতুনে এসেছি, কেন আবার সেখান থেকে পালিয়েছি, কেন আমার বদলে আর একজন মরিয়ম বেগম সেজে চেহেল্‌-সুতুনে রয়ে গেল, সব বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। আপনারও সে শুনতে হয়তো ভাল লাগবে না। তাই, আপনি শুধু আমার একটা উদ্ধার করুন, মুর্শিদাবাদে গেলে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে আনবেন–

সাহেব বলেছিল। কিন্তু আমি যে মুর্শিদাবাদে যাব তা তোমায় কে বললে?

আপনি মুর্শিদাবাদে যদি না যাবেন তো এত কাণ্ড করতে গেলেন কেন?

 তুমি তা হলে টের পেয়েছ যে নবাব পালিয়েছে?

শেষপর্যন্ত নবাব যে পালাবেন তা আমি জানতুম। নবাবের ভাল কেউ চাইত না। নবাবকে কেউ ভালবাসত না। নবাবের নিজের মা-মাসি তারাও নবাবের সর্বনাশ চাইত।

আর তুমি?

আমি তো বলেছি, আমার কথা আলাদা।

কেন, তোমার কথা আলাদা কেন?

চেহেল্‌-সুতুনে না এসে আমার কোনও উপায় ছিল না। চেহেল্‌-সুতুন ছাড়া আমার কোনও গতিও ছিল না।

তা হলে কেন সেদিন তুমি আমার দফতর থেকে আমার চিঠি চুরি করেছিলে?

চুরি করেছিলাম, কারণ আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। আমি দেখতে পেয়েছিলাম নবাবের অনেক শত্রু। ভেবে দেখেছিলাম নবাবের যদি ক্ষতি হয় তো চেহেল্‌-সুতুনেরও ক্ষতি হবে। আর চেহেলসূতুনের যদি ক্ষতি হয় তো আমি কোথায় থাকব? কিন্তু শেষপর্যন্ত আমি তা পারিনি, আমি চেহেলসুতুনকে বাঁচাতে পারিনি!

তা হলে এখন কোথায় যাবে বলে বেরিয়েছিলে?

হাতিয়াগড়ে!

হাতিয়াগড়? হাতিয়াগড়ে তোমার কে আছে?

মরালী বললে–আমার বাবা। জানি না এতদিন আমার বাবা বেঁচে আছে কিনা। কিন্তু বাবা ছাড়া আমার আর কেউ নেই পৃথিবীতে, যার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারি আমি–

ক্লাইভ যেন কী ভাবলে। তারপর বললে–তুমি হিন্দু?

আগে হিন্দু ছিলাম, মুসলমান হয়েছি।

তোমার হিন্দু বাবা তোমাকে ঘরে নেবে?

নিলে নেবে, না নিলে আবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ব!

ক্লাইভ বললে–সত্যি কথা বলছ তো? তোমাকে বিশ্বাস করতেও ভয় হয়।

কিন্তু আজকেই তো আমার কথা যাচাই করে দেখলেন, এখনও বিশ্বাস হয়নি?

তা হলে তোমার বাবার নাম বলল, আমি লোক পাঠিয়ে খবর নিয়ে আসছি।

মরালী বললে–আমার বাবার নাম শোভারাম বিশ্বাস।

আর তোমার নাম?

মরালীবালা দাসী!

নামটা বলবার সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভ সাহেব লাফিয়ে উঠেছে।

মিথ্যে কথা! মরালীবালা দাসী কক্ষনও তোমার নাম নয়। মরালীবালা দাসীকে আমি চিনি। আমার পেরিন সাহেবের বাগানের ছাউনিতে তারা ছিল। আমার দিদি ছিল তার সঙ্গে। তারা খুব ভাল লোক। তাদেরও বাড়ি হাতিয়াগড়ে। তার বিয়ে হয়েছিল একজন পোয়েটের সঙ্গে। সে-পোয়েটটা খুব ভাল গান গায়। সে ওয়ার্লড সিটিজেনতুমি আমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলছ তুমি লায়ার, মিথ্যেবাদী।

মরালী বললে–না সাহেব, আমি মিথ্যেবাদী নই, তারাই মিথ্যেবাদী!

 কী? তারা মিথ্যেবাদী? তারা নিজেরা আমাকে বলেছে আর তুমি বলছ তারা মিথ্যেবাদী?

হা সাহেব, আমিও তাদের চিনি। তারা প্রাণের দায়ে মিথ্যে কথা বলেছে।

 তা হলে অ্যাডমিরাল ওয়াটসন যা বলে তাই-ই ঠিক? ইন্ডিয়ানরা সবাই মিথ্যেবাদী?

মরালীর মুখ দিয়ে হাসি বেরোল এবার। বললে–সাহেব, তুমি জানো না কিছু, আমি সব কথা খুলে বললে–তখন সব বুঝতে পারবে। আমরা কেউই মিথ্যে কথা বলিনি। কিন্তু মিথ্যে কথা না বললে–আমাদের সর্বনাশ হত, তাই প্রাণের দায়ে আমরা মিথ্যে কথা বলতে বাধ্য হয়েছি

কিন্তু সেই পোয়েট? তার সঙ্গে কার বিয়ে হয়েছিল? তোমার না তার?

আমার।

তোমার? তোমার বিয়ে হয়েছিল পোয়েটের সঙ্গে?

মরালী বললে–সাহেব, তুমি নতুন এ-দেশে এসেছ, তাই তুমি কিছু জানো না। আর কিছুদিন থাকলে সব জানতে পারবে। এ-দেশে মেয়েমানুষ হয়ে জন্মানো এক পাপ। সুন্দরী হয়ে জন্মানো আরও বড় পাপ।

সাহেব বললে–আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

তুমি কিছু বুঝতে পারবেও না। আমাদের দেশে মেয়ে হয়ে জন্মালে তুমি বুঝতে পারতে।

 নিশ্চয় বুঝতে পারব। আমি এতগুলো কেল্লা জয় করলাম। ফ্রেঞ্চদের হারালাম,নবাবকে হারালাম, আর তোমার সামান্য কথা বুঝতে পারব না?

এই পর্যন্ত কথা হয়েছিল, তার পরেই বুঝি বাইরে কে ডেকেছিল সাহেবকে। সাহেব বাইরে চলে গিয়েছিল। তার সঙ্গে কথা বলে ফিরে এসেছিল যখন তখন অন্য চেহারা। এতক্ষণ যে-লোকটা তার সঙ্গে সহজভাবে কথা বলেছিল তখন যেন আর সে-মানুষ নয়। মরালীর মনে হয়েছিল বাইরে যেন ফৌজের লোকেরা সবাই দলে দলে জড়ো হয়েছে। তখুনি যেন তারা লড়াই করতে যাবে কোথাও।

সাহেব বলেছিল তোমাকে আমি এখন ছাড়ব না,নবাব আবার মুর্শিদাবাদে আসছে আমি নিয়ে, এখনই খবর পেলাম

তা হলে আমি কী করব?

সাহেব বলেছিল–এখানকার কাউকে জানতে দিতে চাই না যে, তুমি এখানে আছ। তোমাকে আমি এখান থেকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দেব

কোথায়?

কলকাতা। দমদম-হাউসে। তোমার কোনও ভয় নেই। আমার লোকের সঙ্গে তুমি চলে যাও। আমি এখন মুর্শিদাবাদ অ্যাটাক করব। তারপর কলকাতায় ফিরে গিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করব। ততদিন তুমি সেখানে একলা থাকবে।

এখানে কেউ যদি আমার কথা জিজ্ঞেস করে আপনি কী বলবেন?

বলব তুমি নবাবের চর, আমার হেফাজত থেকে পালিয়ে গিয়েছ। তুমি তৈরি হয়ে থাকো। আমরা শেষরাত্রের দিকে রওনা দেব। তার আগেই তোমাকে আমি লোক দিয়ে এখান থেকে পাঠিয়ে দেব।

তারপর রাত যখন অনেক হয়েছিল ঠিক সেই সময়ে ক্লাইভ সাহেব মরালীকে ডেকে দিয়েছিল। সাহেবের সঙ্গে কেউ ছিল না। রাত তখন ক’প্রহর কেউ জানে না। ময়দপুরের আকাশে কয়েকটা তারা শুধু সাক্ষী ছিল সেই যাত্রার। একটা নৌকো হাজির ছিল সাহেবের ছাউনির নীচেই। আর দুজন মাঝি। ছাউনির অন্য সব লোক যখন অন্যদিকে লড়াইতে যাবার তোড়জোড় করছে তখন মরালী ঘোমটা ঢাকা দিয়ে গিয়ে উঠেছিল নৌকোর ভেতরে।

দমদমার যে বিরাট বাড়িটা ক্লাইভ সাহেব বানিয়েছিল, সেটা তখনও পুরো হয়নি। তার জায়গায় ছিল একটা ছোট বাড়ি। বেগম মেরী বিশ্বাসকে যারা জানত তারা দেখেছে সেই বাড়িটা। একদিন শেষরাত্রির দিকে সেখানেই মরালীকে নিয়ে এসে থেমেছিল একটা পালকি। কেউ টের পায়নি, কেউ জানতেও পারেনি কে সে, কোথা থেকে এসেছে, কেন এসেছে।

কিন্তু সে অনেক পরের কথা।

মরালীর শুধু একটা কথা মনে আছে, আসবার সময় ক্লাইভ সাহেব বলেছিল–চেহেল্-সুতুন থেকে তোমার মরিয়ম বেগমকে আমি উদ্ধার করব। তুমি কিছু ভেবো না।

তার পরেই নৌকোটা ছেড়ে দিয়েছিল।

*

মুর্শিদাবাদের সেদিনকার কথাও উদ্ধব দাস সবিস্তারে লিখে গেছে। সমস্ত শহরময় সবাই সেদিন খবর পেয়ে লাফিয়ে উঠেছিল–নবাব এসে গেছে–নবাব এসে গেছে

কিন্তু নবাবের সেই আসা যে এমন মর্মান্তিক আসা হবে, তাই-ই বা কে জানত? জেনেছিল শুধু রাজমহলের ফৌজদার মির দাউদ খাঁ।

ঘোড়সওয়ারের দল কাছে আসতেই নবাব চমকে উঠেছিল–ফৌজদার মিরদাউদ।

হ্যাঁ, আমি।

কিন্তু মিরদাউদের চোখের দৃষ্টি দেখে প্রথমে তেমন বুঝতে পারেনি। পেছনের একজনকে দেখে আরও চমকে উঠেছিল-মিরকাশেম আলি, তুমিও!

হ্যাঁ, আমি।

আশেপাশে সকলের দিকে চেয়ে তখন আর ভুল হবার কথা নয়। সুৎফা তখন বোরখার ভেতরে গয়নার বাক্সটা আঁকড়ে ধরে আছে। যে-লোকটা ফৌজদার সাহেবকে খবরটা দিয়েছিল সে তখন পেছনে আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল। সে জরিদার চটি দেখেছে, দুধ কেনবার জন্যে মোহর দেওয়া দেখেছে। এখন তার সন্দেহ ঠিক হওয়াতে তারই আনন্দটা বেশি। লোকটার একমুখ দাড়ির ভেতর থেকে দাঁতগুলো বেরিয়ে এল। হাসি আর ধরে না।

হঠাৎ সামনের দিকে নজর পড়তেই চেঁচিয়ে উঠল–ভাগ ভাগ হিয়াসে—

একটা কুকুর এই সুযোগে খিচুড়িটা চেটে চেটে খেতে লেগেছে

ভাগ ভাগ

মিরকাশেম সাহেবের নজর সব দিকে। লোকজন নিয়ে ততক্ষণ নবাবের দলের সবাইকে ঘেরাও করে ফেলেছে।

দুর্গা বললে–ওগো, আমরা কী দোষ করলুম–আমাদের ধরছ কেন?

ছোট বউরানিও তখন ভয়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে

আর শুধু কি তাই, কেউই সেদিন জানতে পারলনা যে সেদিন সেই নির্জন রাজমহলের বালির চরের ওপর যেনবাবকে মিরকাশিম সাহেব গ্রেফতার করলে, সে শুধু তুচ্ছনবাবইনয়, তুচ্ছ হেবাৎ জঙ মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা আলমগির বাহাদুরই নয়। সেনবাব বাংলাদেশ। সেদিনকার সেই বাংলাদেশের অনেক উত্থান-পতনের প্রতিভূ সেইনবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা। বাংলা মুলুকের ঘৃণার মানুষ সিরাজ-উ-দ্দৌলা, আবার বাংলা মুলুকের গৌরবের মানুষও সেই সিরাজ-উ-দ্দৌলা। মানুষের ভাল-মন্দ বিচার করবার সময় নেই ইতিহাসের। আজ যা ভাল কাল তা খারাপা আজকের ভাল-খারাপের সঙ্গে কালকের ভাল-খারাপের মেলে না। আজ তুমি দল বেঁধে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করো, বিদ্রোহ করে সিংহাসন অধিকার করে, তখন তোমাকে আমরা ফুলের মালা গলায় দিয়ে তোমাকে দেবতা করে তোমার পূজা করব। মানুষের লেখা ইতিহাসের পাতায় তোমাকে প্রাতঃস্মরণীয় বীর বলে অভিহিত করব। কিন্তু যদি হেরে যাও? যদি তুমি ধরা পড়ো? তখন আবার তোমাকেই গ্রেফতার করে তোমার ফাঁসি দেব। তোমার মুখে থুতু দেব। তোমার মুখে চুনকালি মাখিয়ে তোমার নাম কেটে দেব ইতিহাস থেকে।

এ-সব জানত রবার্ট ক্লাইভ। রবার্ট ক্লাইভ জানত আসলে চাই সাকসেস। সাকসেস চাইলেই সব পাওয়া যায়। সাকসেসের সঙ্গে বন্ধু আসে, অর্থ আসে, প্রতিষ্ঠা আসে, খ্যাতি আসে। আমি হারব না। আমি হারলে আমার সব গুণ ধুয়ে মুছে নিঃশেষ হয়ে যাবে।

রাত্রেই টের পেয়েছিল মরালী। সেই রাত্রের অন্ধকারে যখন ঘুম আসছে না তার তখন হঠাৎ একটা শব্দ এসেছিল। কে? কীসের শব্দ পাশের ঘরে? ক্লাইভ সাহেব যেন পাশের ঘরে কথা বলছে! কিন্তু এত রাত্রে কার সঙ্গেই বা কথা বলছে?

 আবার এসেছ? বি অফ, বেরিয়ে যাও!

চমকে উঠে বিছানায় খানিকক্ষণ চুপ করে বসে ছিল মরালী। ময়দাপুরের সেই ফিরিঙ্গি ফৌজের ছাউনির ভেতরে শুয়ে সেদিন প্রথম-প্রথম একটু ভয় পেয়েছিল। কিন্তু তখন তো মরালী জানত না যে রাত্রের অন্ধকারে স্বপ্ন দেখে সাহেব চেঁচিয়ে ওঠে? তখন তো জানত না, স্বপ্নে কে একজন সাহেবের ঘরের মধ্যে ঢোকে আর সাবধান করে দেয়।

সেদিন শুধু মনে হয়েছিল, সাহেবের বোধহয় কোনও রোগ আছে।

মনে আছে, মরালী খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল প্রথম। তারপর দরজা খুলে পাশের ঘরে গিয়ে দেখেছিল বিছানার ওপর ছটফট করছে সাহেব। আর মুখ দিয়ে কী যেন বিড়বিড় করে বলছে। প্রথমে মনে হয়েছিল অসুখ হয়েছে কিছু। কাছে গিয়ে ডেকেছিল–সাহেব, সাহেব

একটু ডাকতেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সাহেবের। তারপর সামনে মরালীকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল।

তোমার কী হয়েছিল? তুমি চিৎকার করে উঠলে কেন?

সেদিন ক্লাইভ সাহেব লজ্জায় একটু জড়োসড়ো হয়ে পড়েছিল। তাড়াতাড়ি উঠে বসেছিল। সারা ম্যাড্রাস, সারা চন্দননগর, সারা বেঙ্গল কনকার করার পর তার দুর্বলতা ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জা! বলেছিল–ও কিছু না

বলে ক্লাইভ সাহেব বিছানার ওপর উঠে বসতে যাচ্ছিল।

 মরালী বললে–না না, উঠতে হবে না, শুয়ে থাকো আমি যাচ্ছি

কিন্তু ঘর থেকে চলে যেতে গিয়েও চলে যেতে পারেনি৷ সাহেবের যদি সত্যি-সত্যিই অসুখ হয়ে থাকে তো তাকে একলা ছেড়ে চলে যাওয়াটা কি উচিত?

তোমার ওই চাকরটাকে ডেকে দিয়ে যাব?

ক্লাইভ বলেছিল–না, ও ঘুমোচ্ছে এখন, ঘুমোক–

কিন্তু তোমার কি শরীর খারাপ?

ক্লাইভ বলেছিল–না–তুমি যাও, আমার কিছু হয়নি।

হয়নি মানে? মুখ দেখে বুঝতে পারছি শরীরটা খারাপ তোমার! দেখি, জ্বর হয়েছে নাকি?

 বলে ক্লাইভের কপালটা হাতের পাতা দিয়ে ছুঁলে।

ক্লাইভ বললে–না, জ্বর নেই, তুমি বরং ওই ওষুধটা দাও আমাকে, ঘুমের ওষুধ, ওর থেকে এক দাগ ঢেলে দাও

ঘরের কোণের দিকে ওষুধের শিশি ছিল একটা। তার পাশেই একটা পাত্র। মরালী এমন ওষুধ আগে কখনও দেখেনি। বিলিতি ওষুধ। ওষুধটা নিতে গিয়ে ভাবছিল, আশ্চর্য, এই ফিরিঙ্গি মানুষটারও ঘুম হয় না? বাইরে থেকে মনে হয় কত বড় নিষ্ঠুর লোক। নাম শুনেই ভয় পায় কত লোক। এমনি করে মুর্শিদাবাদের নবাবেরও বদনাম আছে কত। অথচ সেই নবাবকেও তো মরালী কতবার ঘুম পাড়িয়েছে।

বেশি ঢেলো না যেন, বিষ ওটা। বিষ?

বিষ?

কথাটা শুনেই চমকে উঠেছিল মরালী। বিষ খাওয়াবে নাকি সে সাহেবকে?

এক দাগ খেলে বিষ নয়, কিন্তু একটু বেশি খেলে সে-ঘুম আর ভাঙবে না। আমাদের ডাক্তার সাবধান করে দিয়েছে।

মরালী ওষুধের শিশিটা নামিয়ে রেখে দিলে। বললে–তা হলে থাক—

কী হল? ওষুধ দিলে না?

মরালী বললে–কিন্তু আমার হাতে তুমি খাবে এ-ওষুধ?

কেন? খাব না কেন?

 যদি আমি বেশি দিয়ে ফেলি?

ক্লাইভ হো হো করে হেসে উঠল। বললে–ভাবছ তোমার হাতে বিষ খেতে ভয় হচ্ছে কিনা? না, সে ভয় নেই। তা হলে তোমাকে আমি ওষুধ দিতে বলতুম না ।

কিন্তু আমি তো তোমাকে বিষ খাওয়াতেও পারি! আমি নবাবের বেগম, নবাব তোমার শত্রু, আমাকে এত বিশ্বাস করা কি ভাল?

ক্লাইভ বললে–না, সে-ভয় আমার নেই–দাও, ওষুধটা ঢালো

না-হয় আর একবার ভাল করে ভেবে দেখো, তোমার চাকরটাকেই ডাকো।

 না না, তাকে ডাকলে আগেই ডাকতুম, তোমাকে বলতুম না। আর তা ছাড়া আমি এতগুলো দেশ জয় করলুম, এর পরেও মানুষ চিনতে পারব না?

তখনও মরালী চুপকরে দাঁড়িয়ে ছিল, কী করবে বুঝতে পারছিল না। একদিন মুর্শিদাবাদের নবাবও তাকে এমনি করে বিশ্বাস করেছিল। আবার এই সাহেবটাও তাকে তেমনি করে বিশ্বাস করছে। তা হলে কি দুজনেই এক রকম। কোনও তফাত নেই এদের মধ্যে।

বললে–তোমার ঘুম হয় না কেন?

ক্লাইভ বললে–ঘুম হয় আমার, কিন্তু স্বপ্ন দেখি আমি

স্বপ্ন তো সবাই দেখে।

সেরকম স্বপ্ন নয়, আমার ঘরে কে যেন ঢোকে ঘুমের ঘোরে, ঢুকে আমাকে একটা তাস দেখায়, কুইন অব স্পেডস, ইস্কাবনের বিবি! তাসটা দেখিয়ে সাবধান করে দেয়-আজকেও সে এসেছিল–

কে সে? কে এসেছিল?

কী জানি। সে বলে তার নাম সাকসেস

মরালী সেই-ই প্রথম জেনেছিল সাহেবের রোগের কথা। এ এক অদ্ভুত রোগ। এত প্রভাব, এত প্রতিপত্তি, এত প্রতিষ্ঠা, এত ক্ষমতা নাকি ভাল নয়। দূর দেশ থেকে সাত টাকা মাইনের চাকরি করতে এসে একেবারে ফিরিঙ্গি কোম্পানির মাথায় উঠে বসা, এটা আবার নাকি একটা রোগ।

ক্লাইভ সাহেব সেই রাতে গড়গড় করে সব কথা বলে গিয়েছিল মরালীকে। লোকে জানে ক্লাইভ সেন্ট ফোর্ট ডেভিডের কম্যান্ডার, লোকে জানে ক্লাইভ চন্দননগরের কনকারার, কিন্তু আমি আসলে এখানে এসেছিলাম মরতে। আমি দু’বার মরতেই চেয়েছিলাম, কিন্তু দেখেছি মরাই সবচেয়ে শক্ত। আমার স্ত্রী আছে, ছেলে-মেয়ে আছে, বাবা আছে, মা আছে, তবু পৃথিবী আমার কাছে পর। আমার আপন বলতে কেউ নেই–

কথাগুলো শুনতে শুনতে সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিল মরালী। ময়দপুরের সেই ফিরিঙ্গি ছাউনিতে ক্লাইভ সাহেবের আর-এক রূপ দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। কত রকম মানুষই যে আছে পৃথিবীতে, কত রকম মানুষই যে দেখলে মরালী। সেই হাতিয়াগড় থেকে শুরু করে চেহেতুন হয়ে এই ময়দাপুর পর্যন্ত সারি সারি যেন মানুষের মিছিল চলেছে। কেউ নবাব, কেউ আমির, কেউ মিরবকশি, কেউ খিদমদগার, কেউ বেগম, কেউ বাঁদি! তাদের বাইরেটাই শুধু আলাদা, ভেতরে সবাই যেন এক। সবাই একাকার হয়ে যেন অখণ্ড রূপ নিয়ে মরালীর জীবনে আবির্ভূত হয়েছিল।

সেরাত্রের মতো সেই-ই শেষ। খানিক পরে মরালী নিজের ঘরে ঘুমোত চলে এসেছিল। কিন্তু ঘুম কি অত সহজে আসে। আর আশ্চর্য, খানিক পরে সাহেবও তার ঘরে এসে তাকে ডেকেছিল। বলেছিল–তোমাকে কলকাতায় যেতে হবে।

তা সেই থেকেই বলতে গেলে মরালীর মেরী হওয়া শুরু। কেমন করে যেন ফিরিঙ্গি মানুষটার আসল পরিচয় পেয়েছিল সে সেইদিনই রাত্রে।

সাহেব বলেছিল-আমি এখানকার সকলকে বলব তুমি পালিয়ে গেছ

 মরালী বলেছিল–আমি পালিয়ে গিয়েছি বললে–কি তোমার সুবিধে হবে?

হ্যাঁ, সুবিধে হবে। তোমাকে আমি আমার ক্যাম্পে রেখেছি এটা এখানকার কেউ পছন্দ করছে না। অথচ তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে, তোমাকে দূরে পাঠাতেও ইচ্ছে করছে না

মরালী জিজ্ঞেস করেছিল–কী কথা?

সেকথা কলকাতাতে গিয়েই বলব।

তবু শুনি কী কথা?

জিজ্ঞেস করতে চাই, দু’জনের নাম এক হল কী করে? তা ছাড়া পোয়েটের সঙ্গে বিয়ে হবার পর তুমি কেমন করে চেহেসতুনে গেলে। আবার তোমার নাম যদি মরালীবালা দাসী হয় তো সেই মরালীবালা দাসী কে? আমি ইন্ডিয়াতে এসে পর্যন্ত তোমাদের দেখে কেবল অবাক হয়ে যাচ্ছি। এ এক বিচিত্র দেশ তোমাদের

তখন আর বেশি কথা বলার সময় ছিল না। একটু থেমে সাহেব বলেছিল–তারপর মুর্শিদাবাদ থেকে ফিরে তোমাকে তোমার বাবার কাছে আমি ফিরিয়ে দিয়ে আসব

.

অন্ধকার চারদিক। নদীর জল চিকচিক করছে। নৌকোর ভেতরে মরালী চুপ করে বসে ছিল। সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে সাহেব। কোনও অসুবিধে হবার কথা নয়। আসবার সময় সাহেব ঘাটে নেমে বলেছিল–চেহেসতুনের কথা আমার মনে আছে, তুমি কিছু ভেবো না ।

একজন মাঝি বললে–বেগমসাহেবা, আপনি শুয়ে পড়ুন, আমরা সময়মতো আনাকে ডেকে দেব–

মরালী মনে মনে হাসল। এই মাঝিরা পর্যন্ত তাকে মরিয়ম বেগম বলেই জানে! সাহেব হয়তো তাদের কাছে সেই পরিচয়ই দিয়েছে। তা দিক, এক-একটা করে নতুন নতুন পরিচয়েই তাকে চিনুক সবাই। কেউ জানুক সে মরিয়ম বেগম। বেঁচে থাকলে আরও কত নতুন নাম তার হবে, কে জানে!

*

মিরদাউদ রাজমহলের ফৌজদার। মিরজাফর আলির ভাইও বটে। তারই হুকুম তামিল করত মিরকাশিম সাহেব। ফৌজদারের ফৌজের কর্তা। মিরদাউদের দাদার জামাই। নিকট সম্পর্ক।

কিন্তু শুধু ফৌজদার হয়ে সুখ নেই। মিরজাফর সাহেব নবাবের বিষনজরে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মিরজাফরের যারা রিস্তাদার তাদের ওপরেও নবাবের বিষনজর।

রাজমহলের ফৌজদারের হাবেলিতে বসে আফশোস করত মিরদাউদ। আর শুনত মিরকাশিম।

 মিরদাউদ সাহেব বলত–খোদাতালার দুনিয়ায় আসলি চিজের কোনও কদর নেই ভাই

 মিরকাশিম বলত–খাঁটি বাত বলেছেন জনাব

 শ্বশুর-জামাইয়ের খেদ খোদাতালার কানে পৌঁছোত কি না কে জানে। দুনিয়ার মানুষের সব খেদ যদি খোদাতালার কানেই পৌঁছোবে তো খোদাতালা মিছিমিছিই খোদাতালা হয়েছে। হাজার মানুষের হাজার আর্জি, হাজার ফরিয়াদ। সব খেদ শুনতে গেলে কি খোদাতালাগিরি চলে?

কিন্তু দেখা গেছে দৈবাৎ এক-একটা আর্জি খোদাতালার কানে পৌঁছেও যায়।

যখন চারদিকে লোক ছুটেছে নবাবকে খোঁজবার জন্যে তখন মিরদাউদ সাহেবের কাছেও খবরটা গেছে। কিন্তু তখন কে জানবে কোন সড়ক দিয়ে নবাব পালিয়েছে? সড়ক তো আর একটা নয়। মুর্শিদাবাদ থেকে সোজা হাটাপথে ভগবানগোলার দিকে যাওয়া যায়। সেখান থেকে পদ্মা নদী ধরে। একেবারে জাহাঙ্গিরাবাদে। যদি পালিয়েই গিয়ে থাকে নবাব তো এদিকে আসবে কেন? এই রাজমহলের দিকে, যেখানকার ফৌজদার মিরজাফর সাহেবের ভাই, যেখানকার মিরবকশি মিরজাফর সাহেবের জামাই? অত দোয়া কি খোদাতালা করবে? তবু চেষ্টা করতে কসুর করলে চলবে না। চেষ্টা চলল খুব। কিন্তু নবাবের পাত্তা নেই।

শেষকালে একদিন দুপুরবেলা খবর এল। জোর খবর। মানুষটা ফকির। রাজমহলের ঘাটের কাছে একটা মসজিদ বানিয়ে থাকে।

বললে–আমার হুজুর সন্দেহ হচ্ছে লোকটা নবাব

মিরদাউদ খাঁ জিজ্ঞেস করলে-কীসে সন্দেহ হচ্ছে?

হুজুর, লোকটার পায়ে সোনার জরিদার চটি

জরিদার চটি তো খানদানি সওদাগররাও পরতে পারে।

হুজুর, দুধ কিনতে একটা মোহর দিলে মবলক

তাও রেইস আদমিরা দিতে পারে। সঙ্গে কে কে আছে?

ফকিরটা বললে–আজ্ঞে বিবি আছে, লেড়কি আছে, বহিন আছে, বাঁদি আছে দুজন, মাঝিমাল্লা আছে দুটো নৌকোয়। দুটো নৌকোই ঘাটে বাঁধা আছে লাগোয়া। সবাই খিচুড়ি বানিয়ে খাচ্ছে–আমি দেখে এসেছি ।

মিরকাশিম সাহেবও শুনছিল। বললে–চলুন না জনাব, দেখে আসি খোদাতালার মর্জি থাকলে মাল মিলতেও পারে

তা এই-ই হল সূত্রপাত। সামান্য সন্দেহ, সন্দেহ থেকে একেবারে গ্রেফতার। আর তারপর থেকেই হুলস্থুল কাণ্ড বেধে গেল মুর্শিদাবাদে। খবরটা যখন মনসুরগঞ্জ হাবেলিতে গিয়ে পৌঁছোল তখন সবাই চমকে গিয়েছে। এই খবর এল নবাব আসছে ল’সাহেবকে নিয়ে, আবার এই উলটো খবর এল।

কেমন উলটোপালটা সব খবর। চেহেল্‌-সুতুনে যখন খবর এল ফৌজ নিয়ে নবাব মুর্শিদাবাদের দিকে আসছে, তখন ধরপাকড়ের পালা শুরু হয়ে গেছে। সারা মুর্শিদাবাদে তখন শোরগোল চলেছে। নবাবের সেরা ভক্ত মোহনলাল। মোহনলাল লঙ্কাবাগ থেকে এসে নিজের বাড়িতেই ছিল। কোথাও বেরোচ্ছিল না, কারও সঙ্গে দেখা করছিল না। কথাটা তার কানেও গিয়েছিল যে নবাব আসছে।

সেখানেও মিরজাফরের লোক গিয়ে হাজির।

মহারাজ কোথায়?

বাড়ির লোক বেরিয়ে এসে বললে–মহারাজ বাড়িতে নেই—

আলবাত বাড়িতে আছে।

বলে সেপাইরা জোর করে বাড়িতে ঢুকে পড়ল। তন্ন তন্ন করে দেখলে সব ঘর, সব গলিখুঁজি। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না মোহনলালকে। তা হলে মোহনলালও কি নবাবের মতো পালিয়েছে?

মিরজাফরের লোক তাকেও খুঁজতে বেরোল মুর্শিদাবাদের বাইরে। যাবে কোথায়? বাংলা মুলুক ছেড়ে যেখানে যাবে সেখানেই বিশ্বাসঘাতকরা ওত পেতে আছে। দুনিয়ায় বিশ্বাসঘাতকের কখনও অভাব হয়েছে, ইতিহাসে এমন নজির কোথাও পাওয়া যায়নি।

ততক্ষণে মিরনের লোক চেহেলসূতুনেও ঢুকে পড়েছে। পিরালি খাঁ’র ওপর হুকুম হয়ে গেল। নজর মহম্মদ,বরকত আলির ওপরেও হুকুম হয়ে গেল। সব বেগমসাহেবাদের নজরবন্দি করে রাখতে হবে।

মরিয়ম বেগমসাহেবা! মরিয়ম বেগমসাহেবা!

কান্তর তন্দ্রা এসেছিল একটু। কদিন থেকে নিজের মহল থেকে বেরোয়নি একবার। মেহেদি নেসার সাহেব সেই যে তাকে মতিঝিল থেকে এনে এখানে পুরে রেখেছে সেই থেকে নিজের ঘরের মধ্যে বসে বসেই দিন কাটিয়েছে, রাত কাটিয়েছে। বাইরে যাবার ক্ষমতাও নেই, অন্ধকার ঘরের ভেতরে বসে একমনে শুধু প্রার্থনা করেছে, যেন মরালী আরও দূরে চলে যেতে পারে। বারবার ভগবানকে ডেকেছে। বিশ্বভুবনের সমস্ত দেবতাকে উদ্দেশ করে তার অন্তরের আকুতি জানিয়ে বলেছে–মরালীকে তুমি দেখো ভগবান, সে যেন নিরাপদে থাকে, সে যেন এই পাপের ছোঁয়াচ থেকে অনেক দূরে থাকে, সে যেন সুখী হয়, সে যেন শান্তি পায়…

মরিয়ম বেগমসাহেবা, মরিয়ম বেগমসাহেবা!

ঝনঝন করে দরজায় শেকল খোলার শব্দ হল।

কান্ত বললে–কে?

আমি নজর মহম্মদ, বেগমসাহেবা। আমার সঙ্গে চলুন। মিরন সাহেবের হুকুম!

 কোথায়?

নজর মহম্মদ বললে–মিরনসাহেব হুকুম দিয়েছে, সব বেগমসাহেবাদের গ্রেফতার করে মতিঝিলে নজরবন্দি রাখতে হবে। নানিবেগমসাহেবা, ঘসেটি বেগমসাহেবা, আমিনা বেগমসাহেবা, ময়মানা বেগমসাহেরা, সবাইকে নজরবন্দি করে রাখবে।

কেন

? নজর মহম্মদ বললে–মোহনলালজি মুর্শিদাবাদ ছেড়ে পালিয়েছে। ওদিকে নবাব ফৌজ নিয়ে মুর্শিদাবাদ হামলা করতে আসছে…

আর কোনও কথা নয়। বোরখা পরাই ছিল। সেই অবস্থাতেই মহল থেকে বেরিয়ে আসতে হল কান্তকে। অন্ধকারের মধ্যে পালকি দাঁড়িয়ে ছিল। একটা পালকি নয়। সার সার অনেকগুলো পালকি। দু’পাশে কোতোয়ালের লোক। কান্ত একটাতে উঠতেই দু’পাশের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তারপর দুলতে দুলতে চলতে লাগল বাইরের দিকে। নানিবেগমসাহেবার পালকি, ঘসেটি বেগমসাহেবার পালকি, তক্কি বেগম, বব্বু বেগম, পেশমন বেগম, গুলসন বেগম, আর মরিয়ম বেগমের পালকি। পালকিগুলো চেহেল্‌-সুতুনের ফটক পেরিয়ে সোজা রাস্তায় গিয়ে পড়ল। তারপর সোজা চলতে লাগল মতিঝিলের দিকে।

*

উমিচাঁদ সাহেবকে দেখে ক্লাইভের মুখখানা লাল হয়ে উঠল। কিন্তু সেটা সামলে নিয়ে বললে–কী, তুমি?

আজ্ঞে, সাহেব, জবর খবর শুনেছ?

শুনেছি। নবাব আর্মি নিয়ে মুর্শিদাবাদ অ্যাটাক করতে আসছে

আর শুনছি নাকি মহারাজ মোহনলালও পালিয়ে গিয়েছিল, সেও নবাবের সঙ্গে আছে। ল’সাহেবের ফৌজ আছে সঙ্গে।

ক্লাইভ বললে–তা তুমি কি আমাকে সেজন্যে ভয় পাওয়াতে চাও?

উমিচাঁদ বললে–সেকী কথা সাহেব! ভয় পাবে তুমি? তুমি কি ভয় পাবার ছেলে? তা নয়, তুমি জিতলে তো আমারই লাভ সাহেব। আমার তিরিশ লাখ টাকা পাওনার কথা আমি ভুলে যেতে পারি কখনও?

আর কিছু কথা আছে? আমি এখনই আমি নিয়ে মুর্শিদাবাদে যাচ্ছি, আমার এখন সময় নেই

 উমিচাঁদ বললে–তা তো যাওয়াই উচিত। কিন্তু এদিকে শুনলাম নাকি একটা মেয়েমানুষ চরকে তুমি ধরে রেখেছিলে, সে হঠাৎ পালিয়ে গেছে?

ক্লাইভ বললে–হ্যাঁ

সর্বনাশ! তা হলে তো মহা মুশকিল হল? কিছু কাগজপত্র চুরি করে নিয়ে গেছে নাকি আবার? তোমার যেমন মেয়েমানুষের ওপর লোভ?

ওদিকে তখন সোলজাররা মাঠে বেরিয়ে পড়েছে। তারা তৈরি। বিউগল বেজে উঠল। নবকৃষ্ণ মুনশি দাঁড়িয়ে ছিল পেছনে। সে বললে–আমার মাইনের কথাটা মনে করিয়ে দিননা উমিচাঁদসাহেব

ক্লাইভ সাহেব চলে যাচ্ছিল ভেতরে। তার তখন দাঁড়াবার সময় নেই।

 উমিচাঁদ বললে–তা হলে আমিও তোমার সঙ্গে যাব নাকি সাহেব?

তুমি আর কী করতে যাবে?

বাঃ বাঃ, কী যে বলেন, যখন মালখানার টাকার হিসেব হবে তখন আমাকে থাকতে হবে না? টাকাকড়ি ভাগাভাগির সময় আমি না-থাকলে চলবে কেন?

তা চলো।

নবকৃষ্ণ এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। সে বললে–আমিও যাব হুজুর?

উমিচাঁদ সাহেব খেঁকিয়ে উঠল–তুমি আবার কী করতে যাবে শুনি? তোমার তোভারীছ’টা টাকা, আর আমার যে লাখ লাখ টাকার ব্যাপার

ক্লাইভ বললে–না, মুনশিও যাবে আমার সঙ্গে

 কিন্তু আর কিছু কথা হবার আগেই একজন ঘোড়সওয়ার দৌড়োতে দৌড়োতে এসে হাজির। ঘোড়া থেকে নেমেই কর্নেলকে কুর্নিশ করলে। তারপর একটা চিঠি এগিয়ে দিলে ক্লাইভের দিকে। চিঠিটা ফার্সিতে লেখা। চিঠিখানা মুনশির দিকে বাড়িয়ে দিলে ক্লাইভ।

নবকৃষ্ণ চিঠিখানা নিয়ে পড়তে লাগল। চিঠি লিখেছে মিরজাফর সাহেব।

পড়তে পড়তে নবকৃষ্ণর মুখখানা হাসিতে ভরে গেল।

বললে–হুজুর, নবাব ধরা পড়েছে—

কোথায়? হোয়ার?

রাজমহলে। নবাবের সঙ্গে আরও তিন-চারজন জেনানা ছিল চেহেল্‌-সুতুনের, তাদেরও ধরেছে রাজমহলের ফৌজদারসাহেব। আর এদিকে ভগবানগোলার কাছে মহারাজ মোহনলালও পালাচ্ছিল, তাকেও বন্দি করে রাখা হয়েছে রায় দুর্লভজির বাড়িতে।

আর কী লিখেছে?

আর লিখেছে চেহেল্‌-সুতুনের যত বেগম আছে সকলকে ধরে পুরে রেখেছে মতিঝিলে।

 সকলকে?

হ্যাঁ, হুজুর, সকলকে।

মরিয়ম বেগমকেও ধরেছে?

 নবকৃষ্ণ বললো, হুজুর, সব, সবাইকে ধরে মতিঝিলে পুরে রেখেছে, আপনাকে উপহার দেবার জন্যে।

রবার্ট ক্লাইভ নিজের মনেই একবার নিজের দায়িত্বের কথাটা ভেবে নিলে। শুধু নিজের দায়িত্ব নয়, সকলের দায়িত্ব। আর্মির দায়িত্ব, কোম্পানির দায়িত্ব। একদিন নিজের মাইনে এক টাকা বাড়লেই নিজেকে ভাগ্যবান মনেকরত যে-লোক, প্রতিষ্ঠা আর প্রতিপত্তি বাবার সঙ্গে সঙ্গে সকলের সব দায়িত্ব তার মাথাতেই এসে পড়ল। এখন শুধু আর নিজের দায়িত্বটার কথা ভাবলেই চলে না। কোম্পানির প্রফিট আর লস এর কথাও ভাবতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে হয় আর্মির এতগুলো লোকের সেফটির কথা। এমনকী ওই নবকৃষ্ণ মুনশির কথাও ভাবতে হয়। আর উমিচাঁদ?

উমিচাঁদের দিকে চেয়ে ঘৃণায় কুঁচকে এল চোখ দুটো।

অলরাইট, চলো মুর্শিদাবাদ!

আর বিশেষ করে যখন মিরজাফর আলি আছে। সব ব্যবস্থাই করে রেখেছে তারা, বলেছে–কোনও ভয় নেই, আপনি এখানে এলে সবাই আপনাকে শাঁখ বাজিয়ে ওয়েলকাম করবে। দেখবেন, নবাব ধরা পড়েছে শুনে সবাই কত খুশি হয়েছে। আর শুধু নবাব নয়, নবাবের গ্রেটেস্ট ফ্রেন্ড মহারাজ মোহনলালও ধরা পড়েছে।

মেজর কিলপ্যাট্রিকও সামনে এসেছিল। সেও সব শুনল।

উমিচাঁদ খবরটা পেয়েই লাফিয়ে উঠেছে। আমি বলেছিলুম সাহেব, আমি বলেছিলুম তোমাদের হেলপ করব। আমি কথা রেখেছি

কিলপ্যাট্রিক বললে–যদি আমরা নবাবের মালখানা খুলে টাকা পাই তখন সকলের সব শেয়ার আমরা দিয়ে দেব

উমিচাঁদ বললে–দেখবে সাহেব, কোটি কোটি টাকা তোমরা পাবে

কোটি টাকা পাই আর লাখ টাকাই পাই, তোমার যা শেয়ার তোমাকে তাই দেব।

আমার শেয়ার তো তিরিশ লাখ টাকা।

ক্লাইভের মুখ-চোখ দিয়ে আগুন বেরিয়ে আসছিল তখন! স্কাউড্রেলটা জানে না যে আমরা এখানে এসেছি পাউন্ড-শিলিং-পেন্স উপায় করতে, চ্যারিটি করতে আসিনি। আমরা দোকানদার, দরকার হলে ইনভেস্ট করব, দরকার হলে লোকসান দেব। যখন আবার দরকার পড়বে তখন প্রফিট করব। দরকার হলে আমরা শত্রুর সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ করব! এ কি ভেবেছে আমরা এই মশা আর জলাজমির দেশে এসেছি মরে যেতে? এই বদমাশদের হাতে প্রফিটের শেয়ার দিতে?

আচ্ছা, ঠিক আছে, তোমার সঙ্গে তো আমার কনট্র্যাক্ট হয়ে গেছে।

উমিচাঁদ বললে–না, তা তো আছে, তবু একবার তোমায় মনে করিয়ে দিচ্ছি সাহেব, শেষকালে যেন ভুলে যেয়ো না

যখন আর্মি মুর্শিদাবাদের দিকে যাচ্ছিল তখন উমিচাঁদের কথাগুলো মনে পড়ছিল ক্লাইভের। ময়দাপুরের ছাউনি তুলে দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফৌজ চলেছে। দূর থেকে গাঁয়ের লোক রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। ভয়ে আনন্দে বিস্ময়ে তারা হতবাক হয়ে দেখছে ফিরিঙ্গিদের দিকে চেয়ে। তাদের যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। এরাই কি সেই ফিরিঙ্গি? এরাই কি সেই সাহেব, যারা সাত সাগর-তেরো নদী পেরিয়ে এই বাংলাদেশে ব্যাবসা করতে এসেছে? কী সব অদ্ভুত চেহারা এদের। লাল লাল মুখ। কাশিমবাজার কুঠিবাড়ির কাছে যারা থাকে তারা দেখেছে আগেই। মোমের মতন নরম আর আলতার মতো লাল চেহারা। মেমসাহেবদের দেখতে আরও ভাল। কটা কটা চোখ। চোখের মণি আর চোখের পাতা ভাসা-ভাসা। আগে সবাই ফিরিঙ্গিদের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাত। যদি ধরে নিয়ে যায়? যদি ছুঁয়ে দেয়!

হাতির ওপর থেকে বসে বসে ক্লাইভ সব দেখছিল। পাশেই কিলপ্যাট্রিক চলছে। পেছনে পেছনে হাঁটতে হাঁটতে আসছে মুনশি নবকৃষ্ণ। কিন্তু সামনে চলেছে কয়েকটা কামান। লক্কাবাগের লড়াইতে কামান কটা ফেলে পালিয়েছিল নবাবের সেপাইরা।

কাশিমবাজার কুঠির কাছে আসতেই দেখা গেল ভাঙা বাড়িটা হাঁ হয়ে পড়ে আছে। ক্লাইভ সেইদিকে চেয়ে দেখলে। এই কাশিমবাজার কুঠি। এখান থেকেই নবাবের সঙ্গে যত কিছু ঝগড়া শুরু হয়েছিল।

হঠাৎ বড় গর্ব হল মনের ভেতর। এই সমস্ত লোক যারা দাঁড়িয়ে আছে, তারা সবাই তাকে দেখছে। ক্লাইভ আজ তাদের সকলের কাছে তাদের ভাগ্যবিধাতা।

কিন্তু মুর্শিদাবাদের কাছে আসতেই মনে হল যেন সামনে মানুষের সমুদ্র। উলু দিচ্ছে, শাঁখ বাজাচ্ছে সবাই।

মেজর কিলপ্যাট্রিকের দিকে চেয়ে দেখলে ক্লাইভ। কিলপ্যাট্রিকও চাইলে ক্লাইভের দিকে।

দেখা গেল দূর থেকে মিরজাফর আলি আসছে। পেছনে তার ছেলে মিরন। তার পেছনে আরও অনেক ঘোড়সওয়ার।

মুনশি!

 মুনশি নবকৃষ্ণ সাহেবের ডাক শুনেই কাছে এল–হুজুর!

ওরা ওরকম করছে কেন মুনশি?

মুনশি কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সামনে মিরজাফর সাহেব এসে পড়ায় যেন একটু স্বস্তি পেলে সাহেব মনে মনে। এই এরাই এদের নবাবকে তাড়িয়েছে। অথচ শেষপর্যন্ত ক্লাইভের সঙ্গে স্পষ্ট কথা বলেনি। কিন্তু মনে মনে ক্লাইভ নিজেকেই তারিফ করতে লাগল। মানুষ চিনতে ভুল করেনি ক্লাইভ। ইয়ার লুক্ত খা, দুর্লভরাম আর মিরজাফরের মধ্যে মিরজাফরকে চিনে নিতে ভুল করেনি। আমার চোখের সামনেই দাঁত বার করে হাসছে। এত বড় ট্রেটর, এত বড় নিমহকারাম। এত বড় স্কাউড্রেল কি ভেবেছে আমি তাকে বিশ্বাস করব? যে-লোক নিজের রিলেটিভদের সঙ্গে নিমকহারামি করেছে, সে যে আমার সঙ্গেও নিমকহারামি করবে তা কি বুঝতে পারি না মনে করেছে ও?

সেলাম আলেকুম কর্নেল!

গুড মর্নিং জেনারেল!

মুনশি দাঁড়িয়ে ছিল পাশে। এ-সুযোগ সে ছাড়লে । বললে–আলেকুম সেলাম মিরজাফরসাহেব

মিরজাফর চোখ ফিরিয়ে দেখলে নবকৃষ্ণের দিকে।

আমাকে চিনতে পারছেন না মিরবকশিসাহেব, আমি কর্নেল সাহেবের মুনশি। আপনার যত চিঠি সব তো আমিই তর্জমা করে বুঝিয়ে দিই সাহেবকে। কেমন আছেন?

ক্লাইভ জিজ্ঞেস করলে কী খবর মিরজাফর?

মিরজাফর বললে–সব ঠিক আছে কর্নেল।

নবাব কোথায়? তোমার প্রিজনার?

তাকে আনা হচ্ছে মুর্শিদাবাদে। সঙ্গে তার বেগম আছে, বাঁদিরা আছে, সবাই আসছে। রাজমহলের ফৌজদার মিরদাউদ আর আমার জামাই তাদের ধরে আনছে, আমিও এখান থেকে ফৌজ পাঠিয়েছি।

আর, দ্যাট জেনারেল মোহনলাল?

তাকেও গ্রেফতার করেছি। রায় দুর্লভের হাবেলিতে তাকে আটক করে রাখা হয়েছে। বেগমদেরও সবাইকে গ্রেফতার করে রেখেছি মতিঝিলে। আর কোনও ভয় নেই।

মেজর কিলপ্যাট্রিক বললে–আর মুর্শিদাবাদ সিটি? সিটিতে কোথাও গোলমাল নেই তো?

না মেজর। কোনও গোলমাল নেই। সবাই খুব খুশি। দেখছেন না চারদিকে কত লোকের ভিড়।

ওরা ওরকম শব্দ করছে কেন? হোয়াট ডু দে মিন?

আজ্ঞে, কাফেররা ওইরকম করে। ওদের যখন খুব আনন্দ হয় তখন ওইরকম শব্দ করে। উলু দেয়, শাঁখ বাজায়। আপনি এসেছেন তাই ওদের খুব আনন্দ হয়েছে

ক্লাইভ মুনশির দিকে চাইলে। মুনশি মাথা নাড়তে লাগল। বলতো হুজুর, মিরবকশিসাহেব ঠিক বলেছে। আমিও তোত কাফের, আমরাও ওইরকম করি

আর তারপর? তারপর যখন প্রথম মুর্শিদাবাদে ঢুকল সে এক দৃশ্য! ফিরিঙ্গিরা এসেছে, ফিরিঙ্গিরা এসেছে। চকবাজার থেকে মহিমাপুর পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে লোকে লোকারণ্য! ক্লাইভ চারদিকে চেয়ে দেখতে লাগল। লন্ডনের মতোই যেন মুর্শিদাবাদ শহরটা চারদিকে ছড়িয়ে আছে। লন্ডনের মতোই বড় বড় বাড়ি। বড় বড় রাস্তা। লন্ডনের মতোই শহরের কাছ দিয়ে নদী চলে গেছে একটা।

যেন নিজের কাছেও নিজের কীর্তিটা বিশ্বাস হচ্ছিল না ক্লাইভের। সত্যিই কি ক্লাইভ নিজের ফৌজ নিয়ে আজ মুর্শিদাবাদে হাজির হয়েছে? চারদিকের এই এত লোক কি সবাই তাকে দেখতেই এসেছে। তার জন্যেই এত শাঁখ বাজানো? এত উলু দেওয়া।

কিন্তু সবাই যদি একটা করেও ঢিল ছোড়ে তাদের দিকে। সঙ্গে তো মাত্র নিশো দিশি সেপাই, আর দু’শো ইংরেজ। মোটমাট পাঁচশো জন সোলজার তার দলে।

চেহেল্‌-সুতুনের সামনে আসতেই তার কানে ভেসে এল একটা বাজনা।

ওটা কী মুনশি?

আজ্ঞে হুজুর, আপনি এসেছেন বলে নহবত বাজছে নহবত-মঞ্জিলে! আপনাকে ওয়েলকাম করছে।

ইনসাফ মিঞা তখন নহবত-মঞ্জিলে জয়জয়ন্তী ধরেছে নিজের মনে। হুকুম পাঠিয়েছিল মিরজাফর সাহেব। বলে দিয়েছিল–ফিরিঙ্গি সাহেব আসবার সঙ্গে সঙ্গে যেন নহবত বাজে

ছোটে শাগরেদের ইচ্ছে ছিল না। বলেছিল–না ওস্তাদজি, মাত বাজাইয়ে, ও কৌন হ্যায়? মিরজাফরসাহেব হামারা কৌন হ্যায়? নবাব না নৌকর?

ইনসাফ মিঞার কথাটা ভাল লাগেনি। অনেক দিন ধরে দুনিয়াদারি দেখে আসছে ইনসাফ মিঞা। নবাবের নানা বড়েনবাবকেও দেখেছে ইনসাফ মিঞা। তারও আগে সরফরাজ খাঁ, আর তারও আগে নবাব সুজাউদ্দিন খাঁ-কেও দেখেছে। ইনসাফ মিঞা বুঝে নিয়েছে এরই নাম দুনিয়াদারি। এমনি করেই দুনিয়া চলে। এমনি করেই দুনিয়া চলবে। একজন ওঠে, আর একজন পড়ে। এ নিয়ে গোসা করতে নেই, এ নিয়ে মান-অভিমান করতে নেই। আজ যে নবাব কাল সে খিদমদগার।

ইনসাফ মিঞা বললে–দুর, যে মসনদে বসবে সেই নবাব। আমরা তো নৌকর, হুকুমের তামিলদার। নে, তবলা ধর

তারপর জয়জয়ন্তী রাগ ধরেছে ইনসাফ মিঞা অন্যবারের মতো। নবাব সিরাজউদ্দৌলা যেবার আজিমাবাদ থেকে শওকত জঙকে খুন করে শহরে ফিরে এসেছিল, সেবারও সে জয়জয়ন্তী বাজিয়েছিল। যখন আলিবর্দি খাঁ সাহেব সরফরাজ খা-কে খুন করে প্রথম মুর্শিদাবাদের মসনদে বসতে এসেছিল তখনও ইনসাফ মিঞা এইরকম করে জয়জয়ন্তী রাগ বাজিয়েছিল। ছোটে শাগরেদ ছেলেমানুষ, এখনও দুনিয়াদারি শেখেনি, দুনিয়াদারি জানে না। নে, তবলা ধর

ফিরিঙ্গি ফৌজ তখন আরও এগিয়ে গেছে। চকবাজারের সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানের সামনে আসতেই হঠাৎ ক্লাইভের নজরে পড়ল।

মুনশি

 হুজুর

ওই যে পোয়েট যাচ্ছে পোয়েট! পোয়েটকে একবার ডাকো তো!

পোয়েট?

মুনশি নবকৃষ্ণ বুঝতে পারলে না। বললে–কার কথা বলছেন হুজুর? পোয়েট? কবি? কবিয়াল?

হ্যাঁ, ওই যে একমাথা ঝাকড়া চুল, ওই তো পোয়েট।

উদ্ধব দাস ওই ভিড়ের মধ্যেই আপন মনে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিল। সাহেব ঠিক দেখতে পেয়েছে। কিন্তু তার কোনও দিকে খেয়াল নেই। একবার হাতিয়াগড়, একবার কেষ্টনগর, একবার মুর্শিদাবাদ। এমনি করেই তার দিন কাটে। এবার মোল্লাহাটি থেকে বেরোবার পথে হঠাৎ কী খেয়াল হল চলে এল মুর্শিদাবাদের দিকে। কিন্তু এখানে যে এমন কাণ্ড চলেছে তা কী করে জানবে।

হঠাৎ পেছনে কার হাতের ছোঁয়া লাগতেই পেছন ফিরেছে। কে?

তুমি কবি নাকি গো?

উদ্ধব দাস অবাক হয়ে গেল। বললে–তুমি কে প্রভু? তোমায় তো চিনতে পারছিনে?

 সাহেব তোমায় ডাকছে।

কোন সাহেব?

মুনশি নবকৃষ্ণ তাজ্জব হয়ে গেল। সাহেবকে চেনে না লোকটা। এত লোক যাকে দেখবার জন্য রাস্তায় ভিড় করেছে, সেই ক্লাইভ সাহেবকেই চেনে না?

হঠাৎ ক্লাইভ সাহেবের দিকে নজর পড়তেই উদ্ধব দাস অবাক হয়ে গেল। আরে, ক্লাইভসাহেব এখানে কী করতে? সেই বাগবাজারের পেরিন সাহেবের বাগান ছেড়ে এখানে এসেছে তোমার সাহেব? তুমি সাহেবের কে প্রভু? মাথায় মস্ত বড় টিকি রেখেছ কেন?

আরে, আমি তো ক্লাইভসাহেবের মুনশি

আমিও তো হরির মুনশি, আমি তো টিকি রাখিনি।

মুনশি নবকৃষ্ণ উদ্ধব দাসের কথায় আরও অবাক হয়ে গেল। কিন্তু সেকথার উত্তর না দিয়ে বললে–চলো, সাহেব তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়, চলো

উদ্ধব দাস ভিড় ঠেলে এগিয়ে চলতে লাগল। নহবত-মঞ্জিলে তখন জয়জয়ন্তীর রাগ উদারা ছাড়িয়ে মুদারা অতিক্রম করে তারায় গিয়ে ঠেকেছে—

*

যে-মেয়ে একদিন অষ্টাদশ শতাব্দীর কাব্যের নায়িকা হবে, যাকে নিয়ে উদ্ধব দাস তার মহাকাব্য লিখবে, সে তখন নৌকোর ভেতর অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ময়দাপুরের ফিরিঙ্গি ছাউনি থেকে নৌকোয় উঠে খানিকক্ষণ বাইরের অন্ধকারের দিকে হা করে চেয়ে দেখেছিল। তারপর মাঝিরা যখন তাকে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে বলেছিল তখন ঘুমিয়েছে।

বুড়ো মাঝি নয়, জোয়ান মাঝি। বলেছিল–বেগমসাহেবা, আপনি শুয়ে পড়ুন, আমরা সময়মতো আমাকে ডেকে দেব

কোথায় কলকাতা। অথচ এককালে যখন হাতিয়াগড়ে থাকত তখন কলকাতার নাম শুনেছিল। তখন কলকাতা দেখবার আগ্রহ হয়েছিল। তারপরে এমন করে শুধু কলকাতা নয়, সমস্ত বাংলা মুলক দেখা হবে তা কল্পনাও করতে পারেনি তখন।

ঘুমোতে যাবার আগে মরালী মনে মনে হেসেছিল। এই মাঝিরা পর্যন্ত তাকে মরিয়ম বেগম বলে জানে। ক্লাইভ সাহেব হয়তো তাদের কাছে তার সেই পরিচয়ই দিয়েছে। তা দিক, এক-একটা করে নতুন নতুন পরিচয়েই চিনুক তাকে সবাই। কেউ জানুক সে রানিবিবি, কেউ জানুক সে নবাবের চর, কেউ জানুক সে মরালী, আবার কেউ জানুক সে মরিয়ম বেগম। বেঁচে থাকলে আরও কত নতুন নাম তার হবে, কে জানে।

হঠাৎ হাঁকাহাঁকিতে ঘুম ভেঙেছে মরালীর।

কে?

আমি, বেগমসাহেবা, আমি!

আমি কে?

আমি গোলাম মোল্লা। সাহেবের নায়ের মাঝি।

নৌকোটা যেন ভীষণ দুলে উঠল বার দুই। তারপর অনেক লোকের হল্লা শোনা গেল।

মরালী দরজার পাল্লাটা খুলতেই গঙ্গার হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগল তার গায়ে। একেবারে হু হু হাওয়া, ঝড়ের মতো সব ওলটপালট করে দিলে।

সব্বনাশ হয়েছে বেগমসাহেবা, মিরদাউদসাহেব হামলা করেছে আমাদের নৌকোর ওপর।

 মিরদাউদ সাহেব কে?

আজ্ঞে রাজমহলের ফৌজদার। নবাব, বেগম, বাদি সবাইকে পাকড়েছে রাজমহলে। সঙ্গে মিরকাশেমসাহেব ভি আছে মুর্শিদাবাদ যাচ্ছে ওরা

তা আমাদের কাছে কী চায়?

 গোলাম মোল্লা বললে–আমাকে জিজ্ঞেস করলে নায়ে কে আছে, আমি বলেছি মরিয়ম বেগমসাহেবা, তখন আপনাকে ডেকে দিতে বললে–

তা তুমি বললে–না কেন যে, আমরা ক্লাইভসাহেবের লোক।

 বলেছি আজ্ঞে, কিন্তু শুনলে না কিছুতেই, ওই দেখুন না ফৌজের সেপাইরা দুখানা নৌকো ভরতি হয়ে ঘাটে লাগিয়েছে–

অল্প অল্প ঝাপসা অন্ধকারে মরালী চেয়ে দেখলে সেইদিকে। দুটো নৌকো পাশাপাশি লাগান। আর তার চারপাশে ফৌজের লোক দাঁড়িয়ে আছে।

মরালী জিজ্ঞেস করলে সামনে ও কে?

ওই তো রাজমহলের ফৌজদারসাহেব।

আর পাশে বুঝি মিরকাশিমসাহেব?

গোলাম মোল্লা বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ—

মরালী বললে–ঠিক আছে, তুমি বলে দাও, আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি

মানুষের জীবনে এক-একটা সময় আসে যখন তাকে সন্ধিক্ষণ বলা চলে। সেই সন্ধিক্ষণে তার জীবন-মৃত্যু-উন্নতি-অবনতি-অ্যুদয়-পরাভব সবকিছু ওলটপালট হয়ে গিয়ে জীবনের অন্য একটা ভিন্ন অর্থ দাঁড়ায়। যে-অর্থ কোনওদিন কল্পনাও করেনি সে, তখন সেই অর্থই তার শেষ অর্থ হয়ে পড়ে। মরালীরও সেদিন সেই গভীর রাত্রে বোধহয় তাই-ই হল। মরালীর জীবনের সেইটেই হল মহা সন্ধিক্ষণ। ভাল করে তাকে ভাবতে সময়ও দিলে না কেউ। একটা মূহুর্ত মাত্র। সেই মুহূর্তের মধ্যেই ভেবে নিতে হবে তুমি কী করবে। তুমি গঙ্গার স্রোতে ঝাঁপ দিয়ে অতলে তলিয়ে যেতে পারো। আর নাহয় মিরদাউদের আর মিরকাশিমের হাতে ধরা দিতে পারো। দুটো পথ খোলা আছে তোমার সামনে।

কিন্তু সেদিন মরালীর মরতে ইচ্ছে হল না। মরতে ইচ্ছে করলে সে-পথও তার ভোলা ছিল। কিন্তু মরবেই যদি তবে সে আগে মরেনি কেন? যে-দিন হাতিয়াগড়ের বাড়িতে তার সঙ্গে উদ্ধব দাসের বিয়ে হল সেই দিনই তো মরতে পারত। তার পরে চেহেলসতুনে এসে সারাফত আলির তৈরি আরক খেয়েও তো সে মরতে পারত। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে মরালী ঠিক করে নিলে সে বাঁচবে।

আর মরালী সেদিন বাঁচার পথ বেছে নিয়েছিল বলেই তো উদ্ধব দাস এমন করে ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’ কাব্য লিখতে পারলে।

.

তারপর মরালী এক মুহূর্তেই ঠিক করে নিলে যে তাকে বাঁচতে হবে, তাকে জীবন দেখতে হবে। যে-জীন চেহেল্-সুতুনে ঢুকেও শেষ হল না, সেই জীবনেরও শেষটা দেখতে হবে।

একদিন বাংলা মুলুকের একটা কোণে এক মেয়ের জন্ম হয়েছিল ঘর-সংসার রান্নাঘর দেখতে আর সন্তানের জন্ম দিতে। কিন্তু সে-মেয়ে নিজের চেষ্টাতেই একটা সাম্রাজ্যের পতন নিজের চোখে দেখে নিলে। দেখে নিলে আর একটা সাম্রাজ্যের উত্থান। উত্থান-পতনের সাক্ষী হয়ে, দর্শক হয়ে, একেবারে সেই উত্থান-পতনের কেন্দ্রস্থলে গিয়ে হাজির হল।

মিরদাউদ খাঁ জানত সফিউল্লা সাহেবের খুন হওয়ার কথা। জানত মরিয়ম বেগমসাহেবার ওপর নবাবের দুর্বলতার কথা। মেহেদি নেসার সাহেবের কাছ থেকে অনেকবার সে কথা শুনেছে খাঁ সাহেব। তাই যখন মাঝিদের কাছে নৌকোর ভেতর মরিয়ম বেগম রয়েছে শুনলে, তখন হাজার উপরোধ-অনুরোধেও কান দিলে না।

মিরকাশিম বললে–ওকে ভি নিয়ে চলুন জনাব

সত্যিই বড় জ্বালিয়েছে মেয়েটা। মেয়েটা জেনেছে যে নবাব পালিয়েছে, তাই সঙ্গে সঙ্গে নিজেও চেহেলসূতুন থেকে পালাবার চেষ্টা করেছে।

গোলাম মোল্লা বলেছিল–না হুজুর, আমরা ক্লাইভসাহেবের লোক, ক্লাইভসাহেব বেগমসাহেবাকে নিয়ে কলকাতার দমদমের বাগানবাড়িতে পৌঁছিয়ে দিতে হুকুম দিয়েছে আমাদের।

মিরকাশিম সাহেব ধমক দিয়ে উঠল–ফিন ঝুট বাত?

ভেতরে একটা নৌকোতে তখন নবাব মির্জা মহম্মদ নীরব নিথর হয়ে ভাগ্যের পরিহাসের কথা ভাবছিল। এই মসনদ। এই মসনদের জন্যেই তাকে এতদিন এত লোক কুর্নিশ করেছে, আর আজ এই মসনদের জন্যেই এতগুলো মানুষের এই দুর্দশা। হায় আল্লাতালাহ্, তুমি আমাকে অনেক দিয়েছ, আবার অনেক দিয়েও অনেক কেড়ে নিয়েছ। তোমার দেওয়ারও যেমন কোনও মর্যাদা আমি দিইনি, তোমার কেড়ে নেওয়ার জন্যেও তোমাকে আজ আমি দোষ দেব না। আমাকে সুখ দাওনি বলে আমি অনেক অভিযোগ করেছি, আজ চরম দুর্দশা দিয়েছ বলে যদি অভিযোগ করি তা হলে কি তুমি শুনবে? একদিন তোমাকে আমি অস্বীকার করেছি, সে-অপরাধ আমার ক্ষমা করো। তারপর যখন কোরান পড়েছি তখন আমি সুখ না পাই শান্তি পেয়েছি। আমি মসনদ পেয়ে যা না পেয়েছি, কোরান পড়ে তাই পেয়েছিলাম। কিন্তু যদি শান্তিই দিলে তো মসনদ কেড়ে নিলে কেন? আর মসনদ যদি কেড়েই নিলে তো এমন করে মসনদের নীচে মাটির ধুলোয় নামিয়ে দিলে কেন? কোন পাপের প্রায়শ্চিত্তের এমন। বিধান যে মসনদ পেলেই তাকে অপমানের নরকে নেমে যেতে হবে? যদি সে আমার অপরাধ হয় তো আমি তার শাস্তি মাথা পেতেই নেব। কিন্তু যদি আমার মসনদের অপরাধ হয় তো আর কোন নবাব ইতিহাসে এমন করে প্রায়শ্চিত্ত করেছে?

রাজমহল থেকে নৌকো দুটো ছেড়েছিল। দিন পেরিয়েছে, রাতও পেরোচ্ছে, হঠাৎ এক জায়গায় এসে নৌকোটা যেন ঠোক্কর খেল।

মিরদাউদ একটা সেলাম পর্যন্ত করেনি। না করুক। মসনদের সঙ্গে সঙ্গে কুর্নিশ পাওয়ার অধিকারটুকুও যে হারিয়েছি তা জানি। তবু তো একদিন আগেও আমি বাংলা মুলুকের নবাব ছিলাম। এমন করে রাতারাতি সব গৌরব মুছে যায় নাকি?

তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ মিরদাউদ?

মিরদাউদ গম্ভীর গলায় বলেছিল–মুর্শিদাবাদে।

মুর্শিদাবাদে নিয়ে গিয়ে কী করবে? আমাকে বন্দি করে রাখবে? ফাটকে পুরে রাখবে? কোতল করবে?

কোনও উত্তর দেয়নি মিরদাউদ এ-কথার। মিরকাশেমের দিকেও চেয়েছিল নবাব।

আচ্ছা মিরকাশিম, আমি যদি তোমাদের টাকা দিই তোমরা আমাকে ছেড়ে দেবে?

এর পরে মিরদাউদ আর মিরকাশিম ভেতরে আসেনি। দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল। যেন নবাব পালিয়ে না যেতে পারে। যেন নৌকো থেকে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরুদ্দেশ না হতে পারে। তা তোমরা কি চাও আমি তোমাদের পায়ে ধরে তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব? এই যে তুমি রাজমহলের ফৌজদার হয়েছ, এ তো আমিই তোমাকে এ-চাকরি করে দিয়েছি। আমি সিলমোহর না করলে তো তুমি এ-চাকরি পেতে না। তোমাদের পায়ে ধরে আমি কী করে ক্ষমা চাই মিরদাউদ! আমারও তো একটা মান-মর্যাদা, মান-অভিমান আছে। তোমরা না-হয় বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাকে লড়াইতে হারিয়ে দিয়েছ, কিন্তু আসলে তো বাংলার নবাব এখনও আমিই। এখনও তো মুর্শিদাবাদে আমার মসনদ আমারই রয়েছে।

পাশে এক কোণে লুৎফা চুপ করে বসে ছিল। শুরু থেকে একটা কথাও বলেনি সে। মিরকাশিম যখন তার হাত থেকে গয়নার বাক্সটা কেড়ে নিয়েছিল তখনও একবার চিৎকার করেনি।

জানো, ওরা কেউ আমার কথা শুনলে না।

 মির্জা মহম্মদ আবার বললে–তুমি কথা বলছ না যে?

যেন লুৎফা কথা বললে–সমস্ত দুঃখ ঘুচে যাবে নবাবের। তবে আজকেই না-হয় কথা বলছে না লুৎফা, কিন্তু কবেই বা সে কথা বলেছে? কবে কথা বলবার জন্যে এমন করে পীড়াপীড়ি করেছ তুমি? সেদিন তো তোমার মনে ছিল না? সেদিন তো তুমি ডেকে খবর নাওনি লুৎফার?

মির্জা মহম্মদ আবার জিজ্ঞেস করলে হাতিয়াগড়ের রানিবিবিরা কি আমাদের সঙ্গেই আছে বেগমসাহেবা?

লুৎফা ছোট করে জবাব দিলো হ্যাঁ

 কোথায়? পাশের নৌকোয়?

 লুৎফা আবার তেমনি করে বললে–হ্যাঁ।

তা তুমি কি আমার সঙ্গে কথা বলবে না ঠিক করেছ?

লুৎফা বললে–কী কথা বলব?

কোনও কথাই কি তোমার বলতে ইচ্ছে করছে না? কথা বলবার জন্যে যে আমার প্রাণটা ছটফট করছে। একটা কিছু কথা বলো, নইলে মনে হচ্ছে আমার যেন কেউ নেই

তবু লুৎফা কিছু কথা বললে–না। তেমনি চুপ করেই রইল।

মির্জা বলতে লাগল জানো লুৎফা, সত্যিই এখন দেখছি আমার কেউ নেই। এতদিন যারা আমায় কুর্নিশ করেছে, যারা আমার কাছ থেকে মাইনে নিয়েছে, তারা দেখলাম সবাই পর। এখন গলা ছেড়ে ডাকলেও কেউ আর সাড়া দেবে না। এমন হবে আমি ভাবিনি লুৎফা

হঠাৎ বাইরে যেন মিরদাউদের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। মিরকাশিমও যেন কার সঙ্গে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে।

ওদিকে মরালীও তখন তৈরি হয়ে নিয়েছে। মিরদাউদ খাঁ সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পাশেই মিরকাশিম সাহেব। মিরকাশিম সাহেব একটু সামনের দিকে এগিয়ে এল। বোধহয় দেখতে চাইছিল বেগমসাহেবার কাছে কোনও গয়নার বাক্স আছে কিনা।

আপনিই মরিয়ম বেগমসাহেবা?

মরালী বললো –হ্যাঁ

আপনি কোথায় চলেছেন চেহেল্‌-সুতুন ছেড়ে?

মরালী বললে–চেহেল্‌-সুতুন নয়, ক্লাইভসাহেবের ময়দাপুরের ছাউনি থেকে আসছি।

মিরদাউদ খাঁ চাইলে মিরকাশিমের দিকে। অর্থাৎ বেগমসাহেবা মিথ্যে কথা বলছে। ক্লাইভ সাহেবের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, মরিয়ম বেগমসাহেবাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে নৌকো করে।

আপনার সঙ্গে কী কী আছে?

কিছুই নেই।

লোকের সন্দেহ হবে বলে কিছুই আনেননি সঙ্গে করে?

 মরালী বললে–আমার কিছুই নেই তাই সঙ্গে কিছু আনিনি।

কিন্তু বেগমসাহেবা, ভেবেছিলেন পোশাক বদলালে কেউ আপনাকে চিনতে পারবে না, সহজেই লোকের চোখ এড়িয়ে যাবেন, না?

মরালী সেকথার উত্তর না দিয়ে বললে–আপনারা কি আমাকে ধরে নিয়ে যেতে চান?

 মিরকাশিম সাহেব বললে–নবাবকে যখন ধরেছি, তখন তার বেগমসাহেবাকে তো ছেড়ে দিতে পারি না। আমাদের সঙ্গে যেতে হবে আপনাকে।

কোথায় নিয়ে যাবেন আমাকে?

মুর্শিদাবাদে।

কিন্তু এর জন্যে ক্লাইভসাহেবের কাছে আপনাদের জবাবদিহি করতে হবে, তা বলে রাখছি

সেকথা মিরজাফর আলি সাহেবকে বলবেন, তিনিই তার জবাব দেবেন।

কিন্তু যদি আমি না যাই?

মিরদাউদ খা’র হাতের তরোয়ালটা জলের ছায়া লেগে চকচক করে উঠল।

 চলুন, কোথায় নিয়ে যাবেন চলুন, আমি যাচ্ছি।

*

পাশের নৌকোর ভেতরে তখন দুর্গা আর ছোট বউরানি চুপ করে সব শুনছিল। তাদেরও ঘুম নেই সারারাত। সেই আগের দিন দুপুরবেলা তাদের নৌকোর ভেতর ঠেসে পুরে দিয়েছে। এক ফোঁটা জল। পর্যন্ত কারও মুখে পড়েনি। ছোট বউরানি কেবল কেঁদেছে আর দুর্গা সাহস দিয়েছে। আর সাহস দিয়েই বা কী করবে। আর স্তোক দিয়ে কতদিনই বা বোঝাবে তাকে। একদিন-দুদিন তো নয়, মাসের পর মাস চলে গেছে। এক ঘাট থেকে আর-এক ঘাটে ঘুরে বেড়িয়েছে কেবল। হাতিয়াগড়ের মানুষ বোধহয় ধরে নিয়েছে তারা মরে গেছে। হয়তো ছোটমশাই আবার ফিরে গেছে হাতিয়াগড়ে। সেখানে ফিরে গিয়ে হয়তো আবার নতুন করে একটা বিয়ে করেছে।

দুর্গা বলেছে–তুমি থামো তো, ছোটমশাই তেমন বেটাছেলে নয়

কিন্তু ছোট বউরানির সেকথায় বিশ্বাস হয় না। পুরুষমানুষ যে কী জিনিস, তা জানতে ছোট বউরানির বাকি নেই। যখন যেখানে তখন সেখানে।

আর ছোট বউরানিরই বা দোষ কী? দুর্গাও তো সেকথা জানে। দুর্গা যেমন জানে, তেমনই দুর্গার মা, মাসি, ঠাকুমা, দিদিমা সবাই জানত। পুরুষমানুষকে বিশ্বাস নেই। তারা মেয়ে পেলেই বিয়ে করে বসে। আর বাংলাদেশও যে মেয়ের দেশ। বাড়িতে বাড়িতে পাল পাল মেয়ে। আর যারা ইরান-তুরান থেকে এসেছিল এই হিন্দুস্থানে, তারাও তো কিছুটা এসেছিল এখানকার মেয়েমানুষের লোভেই। পৃথ্বীরাজকে হারিয়ে যে-মহম্মদ ঘোরি দিল্লি দখল করেছিল, সে তো আর দেশে ফিরে গেল না। হিন্দুস্থানের মতো এমন মজার দেশ কোথায় পাবে? এখানকার গাছের ফল, মাঠের ধান, গোয়ালের গোরু, আর পুকুরের মাছ, এ যে স্বর্গ! তার ওপর আছে এখানকার মেয়েরা! এত মিষ্টি, এত নরম, এত বাধ্য, এত সুন্দর বেগম আর কোথায় পাব? সূতরাং থাকো এখানে। এই দেশটাকেই নিজের দেশ বানিয়ে নাও। এমনি করেই চলছিল বাদশা আওরঙ্গজেব পর্যন্ত। তোমরা যে-যার এলাকায় স্বাধীন হয়ে রাজ্য চালাও, গ্রাম-পঞ্চায়েত গড়ো, লাঠি-সড়কি-বন্দুক-গোলাবারুদ নিয়ে চোর-ডাকাত-মারামারি ঠেকাও, আমাকে বিরক্ত কোরো না। আমি দিল্লির তকত-তাউসে বসে আয়েশ করে বেগমখাদি নিয়ে ফুর্তি করি। কিন্তু সাম্রাজ্য অত সহজ জিনিস নয় জাঁহাপনা। সম্পত্তিও অত সহজ জিনিস নয়। সম্পত্তি থাকলেই তোমার রাতের ঘুম আর দিনের বিশ্রাম গেল। তাই ওদিক থেকে উঠল মারাঠি আর শিখ। তারা বাদশা আওরঙ্গজেবের ঘুম কেড়ে নিলে, বিশ্রাম কেড়ে নিলে। আর বাদশা যখম মারা গেল, তারপর থেকে আগুন জ্বলে উঠল চারদিকে। সবাই স্বাধীন তখন। তুমি দিল্লির নবাব, কিন্তু আমিও হায়দরাবাদের নিজাম, আমিও হায়দার আলি; আর বাংলা মুলুকের নবাব আমিই। আমার নাম মুর্শিদকুলি খাঁ। পাঁচ-পাঁচবার মুর্শিদাবাদের নবাবি মসনদ হাত বদলাল, তবু হিন্দুস্থানের মানুষের দুঃখ ঘুচল না। তারা বললে–ফিরিঙ্গি, ফিরিঙ্গিই সই, ফিরিঙ্গিরাই যদি নবাবের হাত থেকে আমাদের বাঁচায় তো আমরা না-হয় ফিরিঙ্গিই হব, আমরা জাত দেব, জাত গেলেও জান তো তবু বাঁচবে।

হঠাৎ সামনে কাকে দেখে থমকে গেল দুর্গা। অন্ধকারে ভাল করে চেনাও যায় না। ওমা, কে তুমি? কাদের মেয়ে?

মূর্তিটা ততক্ষণে ঢিপ করে দুর্গার পায়ে একটা পেন্নাম ঠুকে দিয়েছে। ছোট বউরানির পা ছুঁয়েও মাথায় ঠেকিয়েছে। বললে–আমি মরালী, দুগ্যাদিদি

ওমা, মুখপুড়ি তুই? তুই কোত্থেকে এখেনে এলি? তুই তো মোছলমান হয়েছিস? মরিয়ম বেগম নাম হয়েছে তো তোর?

মরালী বললে–কেমন আছ ছোট বউরানি?

দুর্গা বললে–মরতে এখন ছুঁয়ে দিলি তো, রাত-বিরেতে এখন কাপড় কাঁচতে হবে আবার

ছোট বউরানি বললে–এখন কী হবে আমাদের রে, আমরা যাচ্ছিলম হাতিয়াগড়ে–কেষ্টনগরের মহারাজা আমাদের লোকজন সঙ্গে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল, হঠাৎ এ কী বিপদ হল বল দিকিনি

দুর্গা বললে–নবাবকেও ধরে রেখেছে পাশের কোঠাতে হারামজাদাকে ধরেছে বেশ করেছে, কিন্তু আমরা কী দোষ করলুম মা?

কিন্তু দুগ্যাদি, তোমাদের বাঁচাবার জন্যেই আমি এত কাণ্ড করলুম, এবার দেখি তোমাদের জন্যে আর কী করতে পারি?

তুই আর কী করবি এখন? তোর নবাবকে তো এখন ধরে রেখেছে।

না দুগ্যাদি, তুমি আমাকে যেকরে বাঁচিয়েছ, তোমাদের জন্যে আমি সব করতে পারি, তুমি কিচ্ছু ভেবো না। আমি নবাবের সঙ্গে দেখা করে আসছি

বলে বাইরে যেতেই ফৌজদারের সেপাইরা আটকাল।

মরালী বললে–আমি নবাবের নৌকোতে যাব, আমি নবাবের বেগম

মিরদাউদ সাহেবের কানে কথাটা গেল। মিরকাশিম সাহেবও পাশে ছিল। বললে–যানে দেও—

নবাবের নৌকোটা পাশে আসতেই মরালী লাফিয়ে সেই নৌকোতে গিয়ে উঠল।

*

সেদিন মুর্শিদাবাদ শহরে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। একদিন এই মুর্শিদাবাদেই নবাব লড়াইতে ফিরিঙ্গিদের হারিয়ে বুক ফুলিয়ে ঢুকেছিল। তাও বেশিদিন আগের কথা নয়। আর আজ সেই ফিরিঙ্গিরাই আবার মুর্শিদাবাদ শহরের রাস্তা দিয়ে বুক ফুলিয়ে হাঁটছে। সঙ্গে দিশি সেপাই আর ফিরিঙ্গি ফৌজের লোক। শহরের লোকেরা উলু দিয়েছে, শাঁখ বাজিয়েছে। তবু যেন তাদের আশ মেটেনি। বারবার দেখতে চায় ক্লাইভ সাহেবকে। মনসুরগঞ্জের হাবেলির সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

পাহারাদাররা এক-একবার তাড়া দেয় আর তারা দৌড়ে দুরে পালায়। কিন্তু আবার আস্তে আস্তে সামনে সরে আসে। আবার হাঁ করে উঁচু অলিন্দটার দিকে চেয়ে থাকে। যদি একপলক দেখা যায় সাহেবকে।

কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে উড়ো খবর এসে পৌঁছোল নবাব এসেছে রে, নবাব এসেছে–

কেউ বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করতে যেন ভরসা হয় না কারও। দুর, নবাব কেন আসতে যাবে? নবাব কেমন করে আসবে?

আরে, দেখে আয় গিয়ে গঙ্গার ঘাটে, মিরদাউদ সাহেব নবাবকে হাতকড়া পরিয়ে নৌকো থেকে নামাচ্ছে!

কথাটা যেন চাবুকের মতো বিঁধল সকলের মনে।

একজন বললে–তামাশা করার আর জায়গা পাওনি দাদা

যে-লোকটা কথাগুলো বললে, সে ততক্ষণ এগিয়ে গিয়েছে। তার আর তখন উত্তর দেবার সময় নেই। কদিন ধরে শহরে ঝাড়ু পড়ছে না, রাস্তায় আলো জ্বলছে না। কদিন ধরে চেহেল সূতুনের নহবত-মঞ্জিলে নহবত বাজছে না। ক’দিন ধরে বাজারে কেনা-বেচা হচ্ছে না। সকালবেলা এক রকম খবর আসে, আবার বিকেলবেলা সে-খবর উলটে যায়।

হঠাৎ যেন তুমুল ঝড় উঠল। মানুষের ভিড় চকবাজারের রাস্তা পেরিয়ে স্রোতের মতো এগিয়ে চলল গঙ্গার ঘাটের দিকে।

ও দাদা,কী হল? কোথায় যাচ্ছ?

সামনে যাকে পায়, তাকেই জিজ্ঞেস করে সবাই।

শোনোনি,নবাবকে গ্রেফতার করেছে যে!

 ঠিক বলছ?

শুনছি তো, তাই দেখতে যাচ্ছি

 ঊর্ধ্বশ্বাসে সবাই ছুটছে সেই দিকে। কথা বলবার সময় নেই কারও। মনসুরগঞ্জের ফটকের সামনের লোকগুলোও তখন দৌড়োতে আরম্ভ করেছে। নবাবকে গ্রেফতার করেছে। নবাবের হাতে হাতকড়া দিয়েছে। এমন তাজ্জব কাণ্ড আর কখনও দেখেনি কেউ। বাপ-খুডোর চোদ্দোপুরুষও এমন ঘটনার কথা কানে শোনেনি! চলল ইয়ার, জলদি চলো

বাংলা মুলুকের একদিন যারা মালিক হবে, আর শুধু বাংলা মুলুকই বা কেন, সারা হিন্দুস্থানের মাথায় উঠে বসবে, তারা সেদিন মুর্শিদাবাদের মনসুরগঞ্জ গদির ভেতরে চুপ করে বসে ছিল। এক এক করে সব খবরই কানে এসেছে। সবাই এসে দেখা করে গেছে। জগৎশেঠজি এসে ক্লাইভ সাহেবের সঙ্গে কথা বলে গেছে। পাশে বসে ছিল উমিচাঁদ সাহেব, আর নবকৃষ্ণ মুনশি।

খানিক পরে উমিচাঁদকেও উঠে যেতে বললে–ক্লাইভ। বললে–তুমি এখন যাও উমিচাঁদ—

উমিচাঁদ বললে–আমার কী হবে তা হলে সাহেব?

ক্লাইভ বললে–যা হবে, তা দেখতে পাবে। টাকা তো এখনও পাইনি।

শেষকালে কলা দেখাবে না তো সাহেব?

কলা? হোয়াট ইজ কলা?

 বলে মুনশির দিকে চাইলে ক্লাইভ। নবকৃষ্ণ বুঝিয়ে দিলে। বললে–হুজুর, কলা মানে প্ল্যানটেন

 ও, ব্যানানা? তা ব্যানানা আমি কোথায় পাব?

নবকৃষ্ণ বললে–না, হুজুর, উমিচাঁদসাহেব তা বলছেন না। বলছেন ওকে ফাঁকি দেবেন না তো আপনি?

ক্লাইভ বললে–ফাঁকি দেব কেন আমি? দলিলে যদি লেখা থাকে তো নিশ্চয়ই টাকা পাবে তুমি!

লেখা নেই মানে?

 ক্লাইভ বললে–ঠিক আছে, আমি যখন চেহেল্‌-সুতুনে যাব, তখন দেখা যাবে; এখন তুমি যাও এখান থেকে, আমার মুনশির সঙ্গে আর্জেন্ট কথা আছে।

ঠিক আছে। আমি তোমার মুনশিকে জোগাড় করে দিলাম, আর এখন আমি কেউ নই, মুনশি নবকৃষ্ণই হল তোমার সব! ঠিক আছে। আমার টাকা নিয়ে সম্পর্ক! ফেলো কড়ি মাখো তেল, তুমি কি আমার পর?

রাগে গজরাতে গজরাতে উমিচাঁদ ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল। বাইরে বেরিয়েই লম্বা বারান্দা। বাইরে ফিরিঙ্গিদের ফৌজের লোকজন ঘোরাফেরা করছে। বিরাট হাবেলি। ফৌজের লোকের মধ্যে দিশি-বিলিতি সবাইকে মিরজাফর এই বাড়িতে থাকতে দিয়েছে।

উমিচাঁদ মিরজাফর সাহেবের মহলের দিকে গেল। মহলের বাইরে পাহারা দিচ্ছিল সেপাই।

 কোথায়, মিরজাফরসাহেব কোথায়?

 বাইরে গেছে হুজুর!

 ও, তা তার ছেলে মিরনসাহেব? মিরনসাহেব কোথায় গেল?

আজ্ঞে, কেউ নেই হাবেলিতে।

 দুর ছাই, সবাই যে-যার কাজে বেরিয়ে গেছে। সবাই টাকার ধান্দায় বেরিয়েছে হয়তো।

নন্দকুমারকে সেইজন্যেই একদিন উমিচাঁদ বলেছিল–যা পারো টাকা কামিয়ে নাও নন্দকুমার, লড়াইতে কে জেতে কে হারে ঠিক নেই, দু’দলের কাছেই টাকা খাও। শেষে যার জিত হবে, তার দলেই ভিড়ে যাবে

বারান্দা দিয়ে চলতে চলতে গুরু নানকের উদ্দেশে একটা নমস্কার করে নিলে উমিচাঁদ সাহেব। জয়। গুরুজি, গুরুজি কি ফতে!

বলে আর দাঁড়াল না সেখানে। সামনের দিকে এগোতেই বাইরের ফটকের দিক থেকে একটা আওয়াজ এল। সকাল থেকেই সেখানে ভিড় জমেছিল মানুষের। ক্লাইভ সাহেব এখানে আসবার সঙ্গে সঙ্গেই। এখন আবার নতুন করে কীসের আওয়াজ এল!

কীসের আওয়াজ? কে?

কে একজন যাচ্ছিল, তাকে ডেকে উমিচাঁদ সাহেব জিজ্ঞেস করলে।

লোকটা ফৌজের দলের। বললে–নবাবকে ধরে এনেছে গ্রেফতার করে

তাই নাকি?

হঠাৎ যেন উমিচাঁদ সাহেবের রক্ত চনমন করে উঠল। জয় গুরুজি, তা হলে গুরুজিকে নমস্কার করার ফল হাতে-হাতেই ফলল সত্যি সত্যি! এই মনসুরগদি তো নবাবেরই তৈরি। বাংলা মুলুকের মানুষের কাছ থেকে আবওয়াব আদায় করে এই গদি নবাব আলিবর্দি খাঁ সাহেব মির্জা মহম্মদের জন্যে বানিয়ে দিয়েছিলেন। আর তারই ভেতরে আজ বসে আছে ফিরিঙ্গি সাহেব রবার্ট ক্লাইভ! জয় গুরুজি, এ সবই তোমার মেহেরবানি, এ সবই তোমার মর্জি!

ক্লাইভ সাহেব বললে–এবার দরজাটা বন্ধ করে দাও মুনশি, নইলে উমিচাঁদ আবার ঢুকে পড়বে কোন সময়

মুনশি নবকৃষ্ণ উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এল। তারপর সাহেবের পায়ের কাছে এসে বসল। বললে–হুজুর, আমার একটা আর্জি আছে হুজুরের শ্রীচরণে।

ক্লাইভ বললে—বলো

নির্ভয়েই বলি হুজুর, আমি গত মাসের মাইনে পাইনি!

কেন? মাইনে পাওনি কেন? কত টাকা মাইনে তোমার?

নবকৃষ্ণ বললে–হুজুর, মাত্তর ছটাকা

ক্লাইভ হাসল। বললে–মুনশি, একদিন আমারও মাইনে ছিল তোমার মতো ছ’ টাকা। কিন্তু আজ আমি ইস্ট-ইন্ডিয়া-কোম্পানিতে সবচেয়ে বেশি মাইনে পাই। কী করে এমন হল জানো?

মুনশি বললে–হুজুরের গুণপনার জন্যে! হুজুরের গুণের কি সীমা আছে?

ক্লাইভ বললে–না, তা নয় মুনশি। এই সবকিছু হয়েছে তোমাদের জন্যে! তোমরাই আমার মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছ মুনশি। তোমাদের জন্যেই আমি আজ কর্নেল!

মুনশি কৃতার্থ হয়ে সাহেবের পা ছুঁয়ে মাথায় ঠেকাল। বললে–কী যে বলেন হুজুর

না, আমি ঠিক বলছি মুনশি। তোমরা যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করতে তো আমি কোথায় থাকতুম? তোমাদের ছটাকা কেন, ছ’হাজার টাকা করে দিলেও কোম্পানি তোমাদের বিশ্বাসঘাতকতার দেনা শোধ করতে পারবে না। টাকার জন্যে তুমি ভেবো না মুনশি, তুমি কত টাকা পেলে খুশি হবে?

বড় মুশকিলে পড়ল নবকৃষ্ণ। কী বলবে বুঝতে পারলে না।

ক্লাইভ আবার বললে–তুমি কত টাকা পেলে খুশি হবে বলো?

নবকৃষ্ণ বললে–টাকার লোভ আমাকে দেখাবেন না হুজুর, আমি আপনার শ্রীচরণের সেবা করতে পারলেই খুশি হব, আর কিছু চাই না

ক্লাইভ সাহেব বললে–ঠিক আছে, টাকার কথা আমি বুঝব; এখন একটা অন্য কথা বলি, যে-খবরটা আনতে বলেছিলুম, সে-খবরটা কিছু পেলে?

হ্যাঁ হুজুর। চেহেল্‌-সুতুনে কোনও বেগমসাহেবা নেই। সকলকে ধরে মতিঝিলের মধ্যে গ্রেফতার করে রেখেছে মিরনসাহেব।

ক্লাইভ বললে–সে আমি জানি। কিন্তু মরিয়ম বেগমসাহেবা’ বলে কোনও বেগমসাহেবা তার মধ্যে আছে কিনা, তা খোঁজ নিয়েছ?

নিয়েছি হুজুর, আছে।

দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে?

না হুজুর, দেখা করিনি। আপনি যদি মঞ্জুরি দেন তা দেখা করতে দেবে। তাকে গিয়ে কী বলতে হবে হুকুম করুন।

দরজার বাইরে কড়া নাড়ার শব্দ হল। ক্লাইভ সাহেব বললে–ওই বোধহয় আবার উমিচাঁদটা এসেছে, বলো এখন দেখা হবে না

নবকৃষ্ণ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখলে উমিচাঁদ সাহেব নয়। দু’জন অন্য লোক।

চিনতে পারলে ক্লাইভ। সেই গোলাম মোল্লা আর তার সঙ্গী।

হুজুর, সব্বনাশ হয়েছে। ভয়ে ভয়ে লোক দু’জন কাঁপতে লাগল ক্লাইভ সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে। তারপর অচেনা মুখ দেখে কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল।

ক্লাইভ সাহেব আড়ালে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলে কী হয়েছে বলো? বেগমসাহেবাকে কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে এসেছ?

না হুজুর।

 কেন?

 নফরগঞ্জের কাছে মিরদাউদ সাহেব বেগমসাহেবাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে!

হোয়াই? কেন?

আমরা কবুল করলুম হুজুর, ইনি কর্নেল সাহেবের লোক, তবু কথা শুনলে না। সঙ্গে মিরকাশিমসাহেবও ছিল, ওনাকে ধরে নিয়ে গেল।

আচ্ছা তোমরা যাও

ক্লাইভ নিজের জায়গায় ফিরে এসে গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ বসে রইল। মুনশি সাহেবের মুখের দিকে

চেয়ে বললে–কিছু বিপদ-আপদ হয়েছে নাকি হুজুর?

ক্লাইভ বললে–আচ্ছা মুনশি, তোমাকে সেই যে পোয়েটকে ডাকতে বলেছিলাম, সে তো কই এল না। কখন আসবে সে?

মুনশি বললে–হুজুর, সে একটা বদ্ধ পাগল মানুষ, আমাকে বলে কিনা আমার মাথায় টিকি কেন? দেখুন তো তাজ্জব কথা। হিন্দুর ছেলে টিকি রাখব না? আমি কি মোছলমান?

তা হোক পাগল, তুমি এক্ষুনি একবার তাকে ডেকে নিয়ে এসো, আমার জরুরি দরকার, এখন রাস্তায় কিংবা ঘাটে কোথাও নিশ্চয়ই আছে, যাও। আমি ততক্ষণ একটু রেস্ট নিই–

জগৎশেঠজির বাড়ির ভেতর দেওয়ানজি রণজিৎ রায় তখন খবরটা দিলে গিয়ে। জগৎশেঠজিরও কদিন ধরে ঘুম হচ্ছে না। আসলে জগৎশেঠজি জানতেন, এ সমস্তকিছুর দায় এসে পড়বে তাঁরই মাথায়। টাকার দরকার হলেই তাঁর কাছে হাত পাততে হবে সবাইকে। সাত লাখ টাকা ফরাসিদের কাছে লগ্নি করা ছিল, সে টাকাটার আর কোনও আশা নেই। সেটা বেবাক জলে গেছে।

খবরটা শুনে জগৎশেঠজি বললেন–নবাবকে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে আসছে?

 রণজিৎ রায় মশাই বললো হ্যাঁ

খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন জগৎশেঠজি।

দেওয়ানজি বললে–আমার একটু মায়া হল দেখে, হাজার হোক নবাব তো? অনেকে দেখলাম কাঁদছে। সঙ্গে আরও ক’জন বেগমসাহেবাও রয়েছেন। তারাও হেঁটে আসছেন পেছন পেছন

আর নবাব?

দেওয়ানজি বললেন–নবাব মুখ নিচু করে হেঁটে হেঁটে আসছেন, কোনও দিকে দৃষ্টি নেই, হাতকড়া বাঁধা–

জগৎশেঠজি উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন–তা নবাবের জন্যে পালকির ব্যবস্থা করলে কী এমন লোকসানটা হত? এ কি মিরজাফরের হুকুম, না মিরদাউদের বদমায়েসি? ৭১২

কথাটা বলে জগৎশেঠজি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তার চোখের সামনে দিয়ে পুরনো দিনগুলোর ছবি ভেসে যেতে লাগল। সেই ছোট বয়েসের নবাবজাদার দুষ্টমিটাও মনে পড়ল। আস্তে আস্তে সে বড় হল। নবাব আলিবর্দি কতদিন দরবারে বসে বলতেন–জগৎশেঠ, আমার নাতিটাকে নিয়েই ভাবনা, ওর কথা ভেবে মরে গিয়েও আমি সুখ পাব না

সেদিন জগৎশেঠজি নবাবকে আশা দিয়েছিলেন, সান্ত্বনা দিয়েছিলেন কিছু ভাববেন না নবাব, আমি তো আছি

বুড়ো নবাব আলিবর্দি জগৎশেঠজি কথা শুনে বোধহয় শেষ জীবনে ভরসা পেয়েছিলেন। কিন্তু সেকথা জগৎশেঠজি রাখেননি। রাখতে পারেননি।

হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন–লোকে কাঁদছিল?

দেওয়ানজি বললেন–হ্যাঁ, সবাই নয়, অনেকেই কাঁদছিল।

জগৎশেঠজি বললেন–দেখুন দেওয়ানজি, এই এরাই সকালবেলা ক্লাইভসাহেবকে দেখে শাক বাজিয়েছে, উলু দিয়েছে, আবার এরাই এখন নবাবকে দেখে কাঁদছে–আশ্চর্য! অথচ আমি কী করতে পারি। আমি আলিবর্দি খাঁ-কে কথা দিয়েছিলাম তার মির্জা মহম্মদকে আমি দেখব। আমি কথা রাখতে পারলাম না। আমার কী দোষ!

না না মহারাজ, আপনিই বা কী করবেন?

সত্যিই হাতকড়া লাগিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে আসছে নবাবকে?

শুধু নবাব নয়, মহারাজ, সকলকে। সঙ্গে বেগমদেরও হাঁটিয়ে নিয়ে আসছে মিরদাউদসাহেব। চারপাশে সেপাইরা ঘিরে রয়েছে।

জগৎশেঠজি বললেন–কোথায় রাখবে নবাবকে? মতিঝিলে, না মনসুরগদিতে?

 রণজিৎ রায় বললেন–মতিঝিলে তো বেগমদের সবাইকে নজরবন্দি করে রেখেছে, সেখানে কি আর রাখবে? মিরনসাহেব যেখানে বলবে সেখানেই রাখবে।

এখন বুঝি মিরনই সর্বেসর্বা?

দেখছি তো তাই। লক্কাবাগের লড়াইয়ের পর থেকে তো দেখছি সব ব্যাপারে হুকুম চালাচ্ছে। মিরজাফরসাহেব তো এখন কেবল নিজের টাকাকড়ি-লাভ-লোকসান নিয়ে পাগল, চেহেল্‌-সুতুনের মালখানাতে কত টাকা আছে, তাই নিয়েই ব্যস্ত

কত টাকা পেয়েছে?

সে জানবার উপায় নেই। ক্লাইভসাহেব হুকুম দিয়ে সেখানকার ফটকে সিলমোহর করে দিয়েছে।

জগৎশেঠজি খানিকক্ষণ ভেবে বললেন–আপনি একবার যান সেখানে, গিয়ে আমার নাম করে বলুন, নবাবকে যেন রাস্তা দিয়ে সকলের চোখের সামনে হাঁটিয়ে না নিয়ে আসে

কিন্তু মিরন কি আমার কথা শুনবে মহারাজ?

আপনার কথা না শুনুক, আমার কথা তো শুনবে, আমার নাম করে গিয়ে বলুন।

দেওয়ানজি বললেন–আপনি যখন বলছেন আমি নিশ্চয়ই যাব, তাতে আমাদের লাভটা কী হবে?

দেখুন দেওয়ানজি, সূর্য চব্বিশ ঘণ্টা আকাশে থাকে না, একসময় তাকে অস্ত যেতেই হয়, কিন্তু পরদিন ভোরবেলা আবার সে ওঠে, তখন নতুন করে নতুন তেজ নিয়ে সে উদয় হয়।

কিন্তু, নবাব কি বলতে চান আবার উঠতে পারবে? এর পরেও নতুন করে চেহেল্‌-সুতুনের মসনদে বসতে পারবে?

জগৎশেঠজি বললেন–এ নবাব না বসুক, অন্য কেউ বসবে। সিংহাসন কখনও খালি পড়ে থাকে না তা জানি, কিন্তু নবাবকে অপমান করলে যে সিংহাসনকেই অপমান করা হয়। মির্জা মহম্মদকে ওরা যত খুশি অপমান করুক, নবাবকে অপমান করতে নেই, তাতে মসনদের গৌরবকে খর্ব করা হয়। আপনি গিয়ে বলুন মিরনকে–

দেওয়ানজিকে চলে যেতেই হল। জগৎশেঠজির হুকুম। বৃদ্ধ মানুষ, মুর্শিদাবাদের অনেক নবাব দেখেছেন, অনেক নবাবকে কুর্নিশ করেছেন। অনেক নবাবের নিমক খেয়েছেন। সেই নবাবের এমন অপমান সহ্য করতে পারছেন না। রণজিৎ রায় মশাই বেরোলেন। মহিমাপুরের রাস্তায় মানুষের সমুদ্র বয়ে চলেছে। নবাবকে হাতকড়া পরিয়ে রাস্তা দিয়ে হটিয়ে নিয়ে আসছে, এমন ঘটনা রোজ রোজ ঘটে না। এ-দৃশ্য না দেখলে জীবনই ব্যর্থ। বাড়ির ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে ঘোমটার আড়াল দিয়ে উঁকি মারছে বুড়ি মেয়েমানুষরা। ঘুলঘুলি দিয়ে উঁকি দিচ্ছে কমবয়েসি মেয়েরা। ওই যে! ওই যে আসছে। ওই যে রে সামনের লোকটার খালি মাথা, ওই-তো নবাব! পেছনে পেছনে বেগম বাদির দল!

নবাবকে আগে অনেকবার দেখেছে সবাই। সে এ নবাব নয়। তার মাথায় তাজ ছিল, গায়ে জরির সাজপোশাক ছিল। হাতির পিঠে চড়ে আসত। সামনে কাড়া-নাকাড়া বাজাতে বাজাতে যেত বাজনাদাররা, তারপরে নবাবের সেপাইদের সর্দার, তারপর নবাব। সামনে-পেছনে সে-জাকজমক দেখে বোঝা যেত মুর্শিদাবাদের নবাব চলেছে। কিন্তু এবার তো সাধারণ মানুষ। তার মাথায় তাজ নেই, গায়ে জরির সাজপোশাক নেই। এর দু’হাত লোহার হাতকড়া দিয়ে বাঁধা। রোদের মধ্যে মাথা নিচু করে হাঁটছে।

ওরে, দেখছিস নবাব কাঁদছে?

না না, কাঁদছে না

ওই তো কাঁদছে, দেখছিস না টপ টপ করে জল পড়ছে বুকের ওপর

না না, ও তো ঘাম–রোদ লেগে ঘামছে

তা সত্যিই তখন মাথার ওপর রোদ ঝাঁঝাঁ করছে। ঘেমে নেয়ে উঠেছে সবাই। রাস্তার দুপাশে সারবন্দি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পঁড়িয়ে ঝুঁকে দেখছে। মিরদাউদ সাহেব সামনে আসছে বুক ফুলিয়ে। তার পাশে মিরকাশিম সাহেব। কড়া নজর তার চারদিকে। আর সেপাইরা ঘিরে রেখে দিয়েছে সকলকে। আসামি না পালিয়ে যায়।

মিরন সাহেবেরই সর্দারিটা বেশি। একবার পেছনে যাচ্ছে, একবার সামনে। খুব হুঁশিয়ার। খবরটা পেয়েই সেপাই তৈরি রেখেছিল মুর্শিদাবাদের ঘাটে। তারপর নিজেই সব তদারক করছে। নিজেই ভিড় সরাচ্ছে, নিজেই হুশিয়ার করে দিচ্ছে সকলকে। একদিন এই মিরন নবাবের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহস পায়নি। একদিন এই মিরনকেই অপমান করে তাড়িয়ে দিত দরবারের খিদমদগার। ভাগিয়ে দিত মতিঝিলের ফটকের পাহারাদার! আর আজ সেই মিরন সকলের ওপর হুকুম চালাচ্ছে। আর দুদিন বাদে আবার এই মিরন সাহেবকে কুর্নিশ করে তবে দরবারে মিরজাফর সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। এই হচ্ছে নসিবের খেল। এই হচ্ছে তকদির।

আর এসেছে বশির। বশির মিঞা। বশির মিঞার হাঁক-ডাক দেখে কে! কোথা থেকে একটা লাঠি জোগাড় করেছ। বলে–হটো, হটো হিয়াসে।

যারা বশির মিঞার ইয়ার তারা ভেবেছিল, এই সময়ে বশিরের কাছ থেকে একটু খাতির পাবে। কিন্তু কোথায় কী। তাদের চিনতেই পারে না বশির মিঞা। বলে, সরকারি কাজে খাতিরটাতির নেই ইয়ার যাও যাও, হটো

কিন্তু ওদিক থেকে জগৎশেঠজির দেওয়ান আসতেই ভিড় একটু রাস্তা করে দিলে।

কে?

হুজুর, জগৎশেঠজির দেওয়ানজি আপনার সঙ্গে বাত করতে এসেছেন

মিরনের যেন তবু গ্রাহ্যই নেই। বললে–বলল, এখন ফুরসত নেই আমার

আজ্ঞে, জরুরি কাম।

মিরন বললে–বলল, এটা আরও জরুরি কাম–এখন ফুরসত হবে না—

কিন্তু রণজিৎ রায় মশাই এ রকম উত্থান-পতন অনেক দেখেছেন। বললেন–আমি দেখা করবই—

বলে একেবারে সোজা এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে।

অন্য সময় দেওয়ানজি কথা বললে–মিরন কৃতার্থ হয়ে যায়। কিন্তু আজ যেন অন্য রকম। বললে–তা আমি কী করতে পারি?

দেওয়ানজি বললেন–জগৎশেঠজি বলছেন সকলের চোখের সামনে এভাবেনবাবের লাঞ্ছনা করা কি ভাল?

নবাব? নবাব কাকে বলছেন জনাব? মির্জা মহম্মদ কি এখনও মুর্শিদাবাদের নবাব আছে?

তবু বুঝলে না, একদিন তো নবাব ছিলেন উনি। নবাবকে অপমান করলে মুর্শিদাবাদের মসনদকে যে অপমান করা হয়।

হা হা করে হাসিতে ফেটে পড়ল মিরন সাহেব।

বশির মিঞা হাসি শুনে কাছে সরে এল। বললে–কী হয়েছে হুজুর?

এই দেখ না বশির, দেওয়ানজি কী বলছেন।

 দেওয়ানজি বললেন–আমি বলিনি মিরন, জগৎশেঠজি যা বলে পাঠিয়েছেন তাই আমি তোমাকে বলছি

মিরন হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল। বললে–তা আমি জগৎশেঠজির হুকুম মানব, না আমার বাবার হুকুম মানব? কোনটা মানব আপনিই বলুন?

বশির মিঞা বললে–না না হুজুর, আপনি মিরজাফর সাহেবের হুকুম মানুন। মিরজাফরসাহেবই তো নবাব হচ্ছেন হুজুর।

তুমি থামো! তুমি কে?

বশির মিঞা একটু থিতিয়ে গেল বকুনি খেয়ে। কিন্তু জবাবটা দিলে মিরন সাহেব। বললে–ওকে অমন করে বলবেন না দেওয়ানজি, ও আমার লোক–

কথাটায় অপমান বোধ হল দেওয়ানজির। ওসম্বন্ধে আর কিছু কথা বললেন না। আসল প্রসঙ্গ টেনে এনে বললেন–যা ভাল বোঝে করো মিরন, কিন্তু কাজটা ভাল হল না

ভাল হল কি খারাপ হল সে আপনি বাবাকে গিয়ে বলুন।

এর পর আর কোনও কথা বলা চলে না। দেওয়ানজির মুখটা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। এমন করে দেওয়ানজিকে কেউ আগে অপমান করতে সাহস পায়নি। দেওয়ানজিকে অপমান করা মানেই জগৎশেঠজিকে অপমান করা। দেওয়ানজি আর সেখানে দাঁড়ালেন না। পালকিতে উঠে আবার চলতে লাগলেন।

মিছিল তখন এগিয়ে চলেছে। একেবারে চকবাজারের রাস্তায় সারাফত আলির দোকানের সামনে এসে পড়েছে। মিরদাউদ সাহেব এদিক-ওদিক চেয়ে দেখছে। দেখুক সবাই, ভাল করে চেয়ে দেখুক।

কিন্তু হঠাৎ কে যেন মিরন সাহেবকে ডাকলে। বশির মিঞাই প্রথমে শুনতে পেয়েছে। কে? কে ডাকে?

যে ডাকতে এসেছে সে একেবারে দৌড়োতে দৌড়োতে এসেছে। হাঁফাচ্ছে তখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। অত ভিড়ের মধ্যে একেবারে মিরন সাহেবের সামনে মুখোমুখি গিয়ে কথা বলতে পারেনি।

কাছে আসতেই বশির মিঞা চিনতে পেরেছে। আসগর আলি! আসগর আলি মিরজাফর খাঁ সাহেবের খাস খানসামা।

আসগর, তুমি?

মিরনসাহেবকে ডাকতে এসেছি। সাহেব এত্তেলা দিয়েছে।

 তোমার সাহেব? মিরজাফর খাঁ সাহেব?

বশির মিঞা আর দাঁড়াল না। মিরন সাহেবকে গিয়ে খবরটা দিলে। মিরন সাহেব তখন ব্যস্ত। ভিড় সামনে এগিয়ে আসছে। তাদের সামলাতে সামলাতে তখন গলদঘর্ম। ঠিক সেই মুহূর্তে খবরটা পেতেই চমকে উঠল। আবার বাধা? ভাল কাজ একটা করতে গেলেই কোনও-না-কোনও বাধা এসে পড়ে।

ঠিক আছে। মিরন মাথার পাগড়িটা খুলে ফেলে ঘামটা মুছে ফেললে। তারপর মিরদাউদ সাহেবকে ডাকলে।

বললে–ফৌজদারসাহেব, কর্তার তলব এসেছে, আমি যাচ্ছি

কর্তা ডেকেছে? কোনও গলত নাকি?

কী জানি! একটু আগে জগৎশেঠজির দেওয়ান এসেছিল, বলছিল নবাবসাহেবকে রাস্তা দিয়ে হটিয়ে নিয়ে যাচ্ছি কেন! আরে বেত্তমিজ, নবাব যখন মসনদের ওপর বসত তখন আমাদের তকলিফ দেয়নি? কী বলল মিরদাউদসাহেব, তকলিফ দেয়নি?

আলবাত দিয়েছে। একশো বার, হাজার বার তকলিফ দিয়েছে। বেশ করেছি হটিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

তবে? সেসব কথা কি আমি ভুলে গেছি?

তারপর চারদিকে দেখে নিয়ে বললে–আমি চললাম, দেখি কর্তার কী হুকুম হয়!

মিরদাউদ বললে–যদি কর্তা বলেন নবাবকে পালকিতে উঠিয়ে আনতে, তাহলে যেন রাজি হবেন না মিরনসাহেব।

না না, বাবার ভয়-ডর আছে বলে আমি তো ডরপোক আদমি নই, আমি বাঘের বাচ্চা, আমি কাউকে পরোয়া করি না ফৌজদারসাহেব!

বলে মিরন চলে গেল। যাবার আগে বলে গেল একটু ভাল করে নজর রাখতে বলবে ফৌজদারসাহেব, যেন আসামিরা না ভাগে

তখন জলুস আরও এগিয়ে চলেছে। আরও ভাল করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সবাই আসামিদের। ইতিহাসের পরিহাসে একদিনের নবাব আজ ইনসানের দরবারে আসামি হয়ে দাঁড়িয়েছে হাতে হাতকড়া পরে। তোমরা সবাই আমার প্রজা ছিলে এতদিন, আজ আর-একনবাবের প্রজা হতে চলেছ। তোমরাই ফিরিঙ্গিদের শাঁখ বাজিয়ে উলু দিয়ে এই শহরে অভ্যর্থনা করেছিলে, আর এখন আমাকে অভ্যর্থনা করছ। চোখের জল দিয়ে। ভাইসব, তোমরা এক বিচিত্র জীব। আজ আমাকে হাতকড়া দিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে দেখেও তোমরা একবার মুখের কথাতেও প্রতিবাদ জানাচ্ছ না। তোমরা যদি একটু প্রতিবাদ করতে, একটু বিদ্রোহ করতে, তা হলে আর আমাকে এমন রাস্তার ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যেত না ওরা। পালকিতে করে তুলে নিয়ে গিয়ে কোথাও বন্দি করে রাখত। কিন্তু কেনই বা তোমরা প্রতিবাদ করবে? আমি তো কোনওদিন তোমাদের কোনও উপকার করিনি। উপকার করবার সুযোগ পেলে তোমাদের উপকার করতাম কি না তাও তোমরা ভেবে দেখোনি। আমি হেরে গেছি, সেইটেই আমার বড় অপরাধ। সেই অপরাধেই তোমরা আমাকে অপরাধী করেছ। যে হেরে যায়, তার দলে কে থাকে বলো? কে এমন নির্বোধ আছে দুনিয়ায়? যে জেতে তারই তো জয়জয়কার। এ সংসারে বিজয়ীর গলাতেই তো সবাই জয়মাল্য দেয়। সেই জয়মাল্য দেবার সময় তো ন্যায়-অন্যায় বিচার করতে নেই। তাই ভাইসব, ন্যায়-অন্যায়ের কথা আজ আমি তুলছি না। আমি একটা কথা শুধু বলি, তোমরা চোখের জল ফেলে আমাকে আর হাসিয়ো না। আমি তোমাদের চিনে নিয়েছি। তোমরা চোখ মুছে ফেলল। যদি পারো আর একটু এগিয়ে গিয়ে আমার মনসুরগদির সামনে গিয়ে আরও জোরে উলু দাও, আরও জোরে শাঁখ বাজাও

ওদিকে মনসুরগদির ভেতরে তখন মিরন সাহেবের মাথা গরম হয়ে গেছে। হাবেলির ভেতরে ফিরিঙ্গি ফৌজের দলের পাঁচশো সেপাই হইহল্লা করছে। তাদের সকলকে খাওয়ানো, তাদের তদারক করা সোজা কথা নয়। একটা কোনও ত্রুটি হলে ক্লাইভ সাহেব রেগে যাবে। তাদের জামাই আদরে রাখতে হয়েছে। হড় হড়া পোলাউ রান্না হচ্ছে, হড় হড়া গোস রান্না হচ্ছে।

মিরজাফর সাহেব বললে–না, এটা তোমাকে করতেই হবে। ক্লাইভসাহেব কড়া হুকুম দিয়েছে আমাকে–

কিন্তু মিরদাউদ শুনবে কেন? সে বেগমসাহেবাকে পাকড়ে নিয়ে এসেছে। ছেড়ে দিতে হয় আপনি ছাড়বেন। ক্লাইভসাহেব কে? এখন নবাব তো আপনি!

চুপ কর, বেল্লিকের মতো কথা বলিসনি। যা বলছি তাই কর তুই।

কিন্তু নবাব এখন আপনি না ফিরিঙ্গিবাচ্চা ক্লাইভ?

চোপরাও!

মিরন খানিকক্ষণের জন্যে চুপ করে রইল। তারপর একটু পরে মাথা উঁচু করে বললে–মরিয়ম বেগমসাহেবার ওপর কি ক্লাইভসাহেবের নজর পড়েছে?

নজর পড়লে তোর কী? তুই কেন গোঁসা করছিস? তোর বিবির ওপরে কি সাহেব নজর দিয়েছে?

তাও তো বটে! ফিরিঙ্গিবাচ্চা! যদি নবাবের বেগমের খুবসুরত জওয়ানির দিকে চেয়ে সাহেবের নজর বিগড়ে গিয়ে থাকে তো মিরনের কী আর নুকসান। নুকসান বেগমসাহেবাদের আর ক্লাইভ সাহেবের। সব তো ঝুটো মাল। ওদের আর কিম্মত কী?

আর শোন, আজ দরবারে ক্লাইভসাহেবের কাছে ইনাম দিতে হবে। সোনা চাদি হিরে মতি পান্না চেহেল-সুতুনের যা-কিছু আছে মালখানায় সব সাহেবদের সামনে বার করতে হবে। বেগমসাহেবাদের ভি নজরানা দিতে হবে

বেগমসাহেবাদের?

হ্যাঁ হ্যাঁ, উজবুগ! ফিরিঙ্গি সাহেব লক্কাবাগের লড়াই ফতে করে এসেছে। এখানে আমার মেহমান, নজরানা দিতে হবে না? ক’টা বেগম আছে?

মিরন বললে–গুনে দেখিনি। অনেক আছে–সবাইকে মতিঝিলে কয়েদ করে রেখেছি

 সবগুলোকে সাহেবের সামনে নজরানা দিতে হবে।

নানিবেগমকে ভি নজরানা দেব?

দূর বেল্লিক, বুড়ি নিয়ে কী করবে সাহেব? মির্জার, বহ্নি, মাসি যারা আছে তাদের বাদ দিবি। ওদের নিয়ে ফিরিঙ্গি সাহেব কি ঘাস কাটবে? ওদের নজরানা দিলে যে সাহেব আমার মুখে থুতু দেবে রে!

ঠিক আছে। যেমন হুকুম হবে, তেমনই করতে হবে। নবাব যখন বাবা, তখন তার কথা শুনতেই হবে। ঘরের বাইরে আসতে আসতে মিরনসাহেব সেই কথাই ভাবছিল। নবাব হয়েও বাবার বড় ভয়। অত ডরপোক আদমি হলে কি নবাবি করা চলে!

সামনেই মেহেদি নেসার আর রেজা আলির সঙ্গে দেখা। মেহেদি নেসার আর ডিহিদার রেজা আলি সাহেব দু’জনেই আজ খুব ব্যস্ত। দুশো ফিরিঙ্গি আর তিনশো দিশি সেপাইদের খাওয়া-থাকার তদারকি করতে হচ্ছে সব কাজ ছেড়ে। সামনে মিরনসাহেবকে দেখে এগিয়ে এল।

কী সাহেব? নবাবকে তা হলে মিরদাউদসাহেব কয়েদ করেছে?

মিরন সাহেবের মুখের চেহারা দেখে ডিহিদার রেজা আলি সাহেব অবাক হয়ে গেল কী জনাব, মুখ গোমড়া করে আছ কেন? আজ তো তোমার ফুর্তির দিন,নবাব মির্জা মহম্মদ হেবাৎ জঙ আলমগির কয়েদ হয়েছে, আজ কি অমন মুখ করতে আছে?

মিরন বললে–আরে ভাইসাহেব, নবাব যে কে তারই এখনও ফয়সালা হয়নি, ফরমাশ দিচ্ছে সব ফিরিঙ্গিবাচ্চা ক্লাইভ।

ক্লাইভসাহেব? কেন?

আরে ভাইসাহেব, ক্লাইভসাহেব ফরমাশ দিয়েছে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে খালাস করে দিতে হবে।

মরিয়ম বেগমসাহেবা? তার ওপর নেকনজর পড়ল কী করে ফিরিঙ্গিবাচ্চার?

কী জানি ভাইসাহেব, মরিয়ম বেগমসাহেবাকে নিয়ে নবাব মির্জা মহম্মদ পালাচ্ছিল, রাজমহলে সবাইকে পাকড়েছে, বাঁদি-বেগম সবাইকে। আভি হুকুম হয়েছে ফিরিঙ্গিবাচ্চার, ওই মরিয়ম বেগমসাহেবাকে ছেড়ে দিতে হবে

মেহেদি নেসার তাজ্জব হয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে বললে–মরিয়ম বেগমসাহেবা? তুমি ঠিক শুনেছ জনাব?

আরে, তাই শুনেই তো মেজাজ বিগড়ে গেছে আমার।

 তা মরিয়ম বেগমসাহেবাকে মির দাউদ পাকড়েছে কে বললে তোমাকে?

আরে, এই তো বাবার কাছে শুনে আসছি। ক্লাইভসাহেব খবর পেয়েছে যে মির্জা মহম্মদের দলে মরিয়ম বেগমসাহেবাও আছে–

গলত, গলত! গলত বাত। সব ভুল।

মিরন অবাক হয়ে গেল-ভুল?

আরে হ্যাঁ জনাব, মরিয়ম বেগমসাহেবা তো মতিঝিলে! সব বেগমদের তো মতিঝিলে কয়েদ করে রাখা আছে। মরিয়ম বেগমসাহেবা ভি ওখানে আছে। কিন্তু ক্লাইভসাহেবের নেনজর ওই বেগমসাহেবার ওপর পড়ল কী করে?

তা তো আন্দাজ করতে পারছি না ভাইসাহেব!

তা হলে এক কাজ করো জনাব, সবাইকে মতিঝিল থেকে হটিয়ে দাও।

 মিরন বললে–হটিয়ে দেব কী করে? নবাবের যত বেগমসাহেবা আছে সকলকে যে ফিরিঙ্গিবাচ্চার কাছে নজরানা দিতে হবে। আবার জওয়ানি-বেগম ছাড়া যে ক্লাইভ সাহেব ছোঁবে না। আর হটাবই বা কোথায়?

কেন? জাহাঙ্গিরাবাদে! ঢাকায়।

মিরনের যেন কথাটা বড় পছন্দ হল। হাঁ করে চেয়ে রইল মেহেদি নেসার সাহেবের দিকে। বুদ্ধিটা তারিফ করবার মতো!

হাঁ করে দেখছ কী জনাব, সব হটিয়ে দাও। নানিবেগম, ঘসেটি বেগম, আমিনা বেগম, ময়নামা বেগম সবাইকে। ওই মরিয়ম বেগমসাহেবাকে ভি দুরে হটিয়ে দাও, ফিরিঙ্গিবাচ্চার এক্তিয়ারের বাইরে।

মরিয়ম বেগমসাহেবাকেও?

মেহেদি নেসার বললো জনাব, হ্যাঁ, মরিয়ম বেগমসাহেবা কি সোজা চিজ নাকি? ওই-ই তো সফিউল্লা সাহেবকে খুন করেছিল, ইয়াদ নেই?

মনে পড়ল মিরন সাহেবের।

ওই মরিয়ম বেগমসাহেবাই তো কলকাতার পেরিন সাহেবের বাগানে গিয়ে ক্লাইভসাহেবের দফতর থেকে উমিচাঁদ সাহেবের চিঠি চুরি করে নবাব মির্জা মহম্মদকে দেখিয়েছিল ওকে আগে হটাও

মিরনের কানে সব কথা যাচ্ছিল এতক্ষণ, কিন্তু তবু যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। বললে–তুমি ঠিক জানো ভাইসাহেব, মরিয়ম বেগমসাহেবা মতিঝিলে আছে?

আরে হ্যাঁ জনাব, হ্যাঁ, আমি জানি না? আমি নিজে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে কয়েদ করে রেখেছি। আমি জানব না তো কে জানবে।

কী জানি, এত বেগম এত বদি, কে হিসেব রাখে ভাইসাহেব, কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে বলো?

তারপর একটু থেমে বললে–চলো না, মতিঝিলে যাই, বেগমূসাহেবাদের নিয়ে সবাইকে জাহাঙ্গিরাবাদে পাঠিয়ে দিই। লেকেন, যা করতে হবে, আজই করতে হবে–

মেহেদি নেসার কী যেন ভাবলে। ডিহিদার রেজা আলিরও ভারী আগ্রহ। দু’জনেই দুজনের দিকে চাইলে। মিরন সাহেবেরও অনেক কাজ। ওদিকে নবাব আসছে চকবাজারের রাস্তা দিয়ে জুলুস করে। তারও একটা হিল্লে করতে হবে। কিন্তু তার আগে বেগমসাহেবাদেরও একটা কিছু ব্যবস্থা করতেই হবে। শুধু তাদের কয়েদ করলেই হবে না। একেবারে পদ্মা পার করে জাহাঙ্গিরাবাদে পাঠিয়ে দিলেই নিশ্চিন্ত। নানিবেগমসাহেবা, ঘসেটি বেগমসাহেবা, সকলের সব আশা নির্মূল করে দিতে হবে। যাতে আর কখনও কেউ মুর্শিদাবাদের মসনদের ওপর হাত বাড়াতে না পারে।

তারপর তিনজনেই মনসুরগঞ্জ থেকে বেরোল। বড় শক্ত কাজ। শুধু জাহাঙ্গিরাবাদে পাঠালেই হল । নৌকোর ব্যবস্থা করতে হবে, বজরার ব্যবস্থা করতে হবে। সব বেগমসাহেবাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে পটিয়ে-পাটিয়ে পাঠাতে হবে।

চলো, জনাব, তাই চলো। ও রোগের জড় না রাখাই ভাল।

.

মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে সে একদিন গেছে বটে। সে এক মহা দুর্দিন। হাটে দোকানিরা আসেনি। দোকানপাট বন্ধ করে রাস্তায় তামাশা দেখতে বেরিয়েছে। তামাশাই বটে। রাষ্ট্র নিয়ে তামাশা, জীবন মৃত্যু নিয়ে তামাশা। একদিন সামান্য একটা ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ কেমন করে কোন ফাঁকে উড়ে এসে পড়েছিল মুর্শিদাবাদের নবাবি মসনদে, আর সেইটুকুই সেদিন সকলের অজ্ঞাতে হঠাৎ দাউদাউ করে সারা শহরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

মিরন সাহেব সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিল। কোথায় নবাব মির্জা মহম্মদকে এনে রাখা হবে, কোথায় তার বেগম বাদিদের রাখা হবে তারও ব্যবস্থা আগে থেকে করে রেখেছিল মিরন সাহেব। ভারী পাকা লোক মিরজাফর আলি সাহেবের ছেলে। অনেকদিন পরে সুযোগ এসেছে এমন। এমন সুযোগ দৈবাৎ কখনও আসে আল্লার দোয়ায়। আল্লা সুযোগ দেয়, কিন্তু বুদ্ধিমানেরা সে-সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। যে সদ্ব্যবহার করে সেই-ই পুরুষসিংহ। চুপ করে ঘরে বসে থাকলে কেউ তোমার মুখে ভাত তুলে দেবে

এতদিন পরে সেই সুযোগই এসেছে।

বিকেলবেলা দরবার বসবে চেহেলসূতুনে। সেখানে মুর্শিদাবাদের আমির-ওমরাওরা সব আসবে। লোক পাঠিয়ে সব খবর দেওয়া হয়ে গেছে। ক্লাইভ সাহেব তৈরি হয়েই ছিল। অনেকবার মিরজাফর সাহেবের কাছে তোক গেছে খবরটা আনতে। শেষকালে আর থাকতে পারলে না। আবার লোক পাঠালে। সেবার মিরজাফর সাহেব নিজে এসে হাজির।

আমি ছেলেকে পাঠিয়েছি হুজুর, ছেলে ফিরে আসেনি।

ক্লাইভ বললে–সেই মরিয়ম বেগমসাহেবার কী হল?

মিরজাফর বললে–তার ব্যবস্থা করতে বলেছি

কী ব্যবস্থা?

বলেছি তাকে ছাড়িয়ে এনে আপনার কাছে হাজির করতে।

ক্লাইভ বললো, হ্যাঁ তাকে আমার কাছে এনে হাজির করা চাই-

-শেষকালে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে করেও যখন মরিয়ম বেগমসাহেবার কোনও খবর এল তখন আর অপেক্ষা করা চলল না। ক্লাইভের মনে হল নিশ্চয় এদের কোনও মতলব আছে। শুধু মতলব নয়, একটা কিছু ষড়যন্ত্রও হয়তো চলছে তার বিরুদ্ধে। মেজর কিলপ্যাট্রিক এসেছিল একবার। তাকেও জিজ্ঞেস করলে–কী রকম হালচাল বুঝছ কিলপ্যাট্রিক?

কিলপ্যাট্রিক বললে–আমি কিছু বুঝতে পারছি না–

তা হলে যদি তেমন বোঝো তুমি তৈরি হয়ে থাকো। দরকার হলে আমাদের আর্মিকেও রেডি রাখতে হবে। মিরজাফরকে বিশ্বাস নেই। ওর ছেলেটা আরও শয়তান, সে মনে করে আমরা বুঝি ওদের কান্ট্রিতে ট্রেসপাস করেছি, ওদের থ্রোন কেড়ে নিতে এসেছি

কিন্তু অতটা সাহস কি হবে ওদের?

কাইভ জিজ্ঞেস করলে চেহেল্‌-সুতুনের হারেমের মালখানার চাবিটা কোথায়? মিরন তোমায় দিয়েছে?—

কিলপ্যাট্রিক বললে–হ্যাঁ, এই যে

চাবিটা নিজের কাছে রেখে দিলে ক্লাইভ। তারপর বললে–দেখো, এখন কাউকেই বিশ্বাস নেই। সবাই জেনে গেছে যে, মঁসিয়ে ল’ আর্মি নিয়ে রাজমহল পর্যন্ত এসেছিল, তারপর যখন দলে যে, নবাব অ্যারেস্টেড হয়ে গেছে, তখন আবার ফিরে গেছে। উমিচাঁদ কোথায়?

কিলপ্যাট্রিক বললে–আমার কাছে এসেছিল, টাকা চাইছিল

বেশি আমল দিয়ো না ওকে। লোকটা স্কাউড্রেল। আমি ঘর থেকে বার করে দিয়েছি। তোমার স্পাইদের বলে দাও যেন জগৎশেঠ, ইয়ার লুৎফ খাঁ আর দুর্লভরামের বাড়ির সামনে নজর রাখে।

কিলপ্যাট্রিক চলে যাচ্ছিল। ক্লাইভ আবার ডাকলে। বললে–মুনশি আসছে না কেন? মুনশি কোথায় গেল একবার টাউনে খোঁজ নিতে লোক পাঠাও তো? তাকে একটা কাজে পাঠিয়েছি–

হঠাৎ বাইরে মুনশির গলা শোনা গেল। মুনশি এসেছে। একগাল হাসিমুখে।

কী হল? তোমার কথাই এইমাত্র বলছিলাম।

মুনশি বললে–আমার কথা ভাবছিলেন? তা হলে অনেক দিন বাঁচব হুজুর। পাগলটাকে অনেক কষ্টে খুঁজে বার করেছি–

বলে বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে–এসো হে

উদ্ধব দাস ঢুকল। ক্লাইভ বললে–কী হল পোয়েট, তোমাকে খবর পাঠালাম, তুমি আসবে বললে, তবু যে এলে না?

উদ্ধব দাস বললে–আজ্ঞে আপনার বাড়ির প্রহরীরা যে ঢুকতে দেয় না। আপনাদের কাছে আসা বড় ল্যাঠা হুজুর, আমার হরির সঙ্গে দেখা করতে গেলে এত ঝামেলা নেই, হরির দেউড়িতে দারোয়ান থাকে না

ক্লাইভ সেকথায় কান না দিয়ে নবকৃষ্ণের দিকে চেয়ে বললে–তুমি এখন একটু বাইরে যাও তো, পোয়টের সঙ্গে আমার একটা প্রাইভেট কথা আছে

মুনশি বাইরে যেতেই ক্লাইভ হেসে বললে–আচ্ছা পোয়েট, তুমি তোমার ওয়াইফের সঙ্গে দেখা করবে? তোমার বউ?

আমার বউ?

 হ্যাঁ, মরালীবালা দাসী! সে এখন এখানে আছে

উদ্ধব দাস হাসল। বললে–এখানেই থাকুক আর যেখানেই থাকুক, সে কি আমার সঙ্গে দেখা করবে হুজুর? আমাকে তো সে দেখতে পারে না প্রভু।

সে দেখতে পারুক আর না-পারুক, আমি তার সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দেব পোয়েট।

 উদ্ধব দাস বললে–তাতে আপনার কী লাভ প্রভু?

 লাভ? পোয়েট, লাভ-লোকসান জানি না, কিন্তু তোমাকে আমার এত ভাল লাগে কেন জানো? তোমাতে-আমাতে একটা মিল আছে।

সে কী বলছেন প্রভু? আমি তো একজন বাউন্ডুলে মানুষ।

ক্লাইভ বললে–তা হোক, এই তুমি যেমন ভালবাসা না পেয়ে পোয়েট হয়েছ, আমি তেমনই সকলের ঘৃণা পেয়ে পেয়ে সোলজার হয়েছি। আসলে তুমি আমি এক। আমার ইচ্ছে তুমি এবার একটু ভালবাসা পাও

তাতেই বা আপনার কী লাভ?

লাভ আছে বই কী পোয়েট। তোমার ওয়াইফের সঙ্গে যেমন তোমার দেখা হয় না, আমার ওয়াইফের সঙ্গেও আমার অনেকদিন দেখা হয় না। তুমি যদি তোমার ওয়াইফের ভালবাসা পাও তা হলে আমি আমার ওয়াইফকে চিঠি লিখব। লিখব, ইন্ডিয়াতে এসেও আমি আমার ওয়াইফকে কাছে পেয়েছি

উদ্ধব দাস বললে–কিন্তু তা হলে ছড়া লিখব কী করে? কাব্য লিখব কী করে?

তা তোমার পোয়েট্রিই তোমার কাছে বড় হল

? তা আপনার কাছে এই যুদ্ধও কি বড় হয়নি? কেন এ-দেশে লড়াই করতে এসেছেন প্রভ?

হঠাৎ অর্ডার্লি এসে খবর দিলে, একজন জমিদার দেখা করতে চান সাহেবের সঙ্গে।

 কে? তার নাম কী?

অর্ডার্লি বলল–হাতিয়াগড়ের রাজা, হিরণ্যনারায়ণ রায়।

আচ্ছা, ভেতরে নিয়ে এসো।

ছোটমশাই ঘরে ঢুকল। দেখলে সেই পাগলটা বসে আছে। প্রথমে তার সামনে কথা বলতে একটু দ্বিধা হল। কিন্তু ক্লাইভ সাহেব অভয় দিলে। বললে–আপনাকে আমি আগে একবার দেখেছি

ছোটমশাই বললে–একবার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে আপনার কাছে গিয়েছিলাম। তখন আপনাকে আমার স্ত্রীর কথা একবার বলেছিলাম মনে আছে নিশ্চয়ই

আছে, বলুন?

এখন জগৎশেঠজির কাছে গিয়েছিলাম, তিনি আপনার কাছে আমাকে পাঠালেন। শুনছি, আজকের দরবারে যত বেগম আছে সকলকে আপনার কাছে নজরানা দেওয়া হবে।

কিন্তু আমি তো কিছু শুনিনি। কেন, নজরানা দেওয়া হবে কেন?

ছোটমশাই বললে–সেইটেই নবাবি কানুন, কিন্তু মতিঝিলে যে-সব বেগমসাহেবারা আছেন তার মধ্যে আমার সহধর্মিণীও আছেন, তার নাম এখানে মরিয়ম বেগম, আপনি তাকে উদ্ধার করে দিন

কিন্তু আপনি ঠিক জানেন যে, মরিয়ম বেগম আপনার ওয়াইফ?

আজ্ঞে হ্যাঁ সাহেব, আমি খুব ভাল রকম জানি!

আপনি আপনার ওয়াইফকে চিনতে পারবেন তো?

নিশ্চয় চিনতে পারব। আমি নিজের সহধর্মিণীকে চিনতে পারব না। আজ এত মাস ধরে আমি তার জন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি চারদিকে

ক্লাইভ কিলপ্যাট্রিককে ডাকলে। ডেকে বললে–এঁকে মিরজাফর সাহেবের কাছে নিয়ে যাও, নিয়ে গিয়ে বলল মতিঝিলে এর ওয়াইফ আছে, তার নাম মরিয়ম বেগম, এর হাতে যেন তাকে তুলে দেয়, বলো এটা আমার হুকুম

ছোটমশাইকে নিয়ে মেজর কিলপ্যাট্রিক বাইরে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *