২.১৬ নানিবেগমসাহেবা

নানিবেগমসাহেবার শরীরে বিশ্রাম নেই, চোখে ঘুম নেই। সেই যে শেষ রাত্রের দিকে মতিঝিলে গিয়েছিল মরিয়ম বেগমকে দেখতে, তারপর মির্জা এসেছে। কিন্তু মির্জার সঙ্গে ভাল করে কথা বলবার আগেই সে চলে গিয়েছিল খাস-দরবারে। তারপর হঠাৎ পিরালি খাঁ’র কাছ থেকে খবর পেয়েই দৌড়ে এসেছিল মালখানার ঘরে। সত্যিই, পিরালি খাঁ যা বলেছে তাই।

তুই? তুই এখানে?

 নিজের পেটের মেয়ে আমিনা। মির্জারই মা। সেই আমিনারই কিনা এই কাণ্ড?

আমিনা বেগম প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়েছিল। মালখানার চাবি কোথা থেকে জোগাড় করে একেবারে সিন্দুকটা খুলে ফেলেছিল। এ টাকা কি শুধু তার ছেলের? শুধু মুর্শিদাবাদের নবাবের? নবাবের নিজামতেরই টাকা এগুলো? এর ভেতরে যা কিছু সম্পত্তি আছে সব তো বেগমদেরই। বেগম, চেহেলসূতুন, সবকিছুর জন্যেই মুর্শিদাবাদের নবাবরা জমিয়ে রেখে গেছে এই মালখানায়।

অনেকগুলো জিনিসই আস্তে আস্তে সরিয়ে ফেলেছিল আমিনা। কেউ জানতে পারেনি।

হঠাৎ পেছন থেকে নানিবেগমসাহেবার গলা পেয়ে চমকে উঠে চুপ করে দাঁড়াল।

একী, তুই? তুই এখানে? মালখানার চাবি পেলি কোত্থেকে?

নানিবেগমসাহেবা নিজের চোখ দুটোকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না।

এ তুই কী করেছিস আমিনা? মির্জার জিনিস তুই চুরি করেছিস? তোর পেটের ছেলের জিনিসে হাত দিচ্ছিস?

কিন্তু আমিনাও চিৎকার করতে জানে!

 ছেলে? আমার পেটের ছেলে? আমার ছেলে তার মার দিকে কখনও ফিরে দেখেছে?

বলছিস কী তুই? তুই যে আমাকে অবাক করলি আমিনা? তুই বলছিস কী? মির্জা তোর পেটের ছেলে নয়?

আমিনাও গর্জে উঠল–মির্জা যদি আমার পেটের ছেলে হবে তো সে তার মা’র দিকটা দেখেছে। কখনও? মা’র সুবিধে-অসুবিধের কথা কখনও ভেবেছে?

সেকী রে? সে তোরও সুবিধে-অসুবিধে দেখেনি কখনও? তুই মির্জার মা হয়ে এই কথা বলতে পারলি?

আমিনা বললে–বলব না? জানো, তোমার মির্জা আমার কত টাকার লোকসান করিয়েছে? আমার আশি হাজার টাকার সোরা সমস্ত আটকে গেল মির্জার জন্যে। এখন ওই সোরা আমি কার কাছে বেচব?

নানিবেগমসাহেবা গালে হাত দিলে তা হারে, মির্জার এই বিপদের দিনে তোর আশি হাজার টাকার সারাটাই বড় হল? মির্জা কিছু নয়? মির্জা কেউ নয়?

দেখতে দেখতে বুঝি আরও কয়েকজন বেগম ধারেকাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। তারাও মা-মেয়ের ঝগড়া শুনতে লাগল। চেহেসতুনের বাঁদি খোজারাও এসে হাজির হল। মা আর মেয়ে যত গলা চড়ায় ততই ভিড় জমে যায় মালখানার সামনে।

হঠাৎ ঠিক সেই সময়েই গোলমাল শুনে খাসদরবার থেকে মির্জা মহম্মদ সেখানে এসে হাজির। হয়েছিল।

নানিবেগমসাহেবা প্রথমে বুঝতে পারেনি। কেমন করেই বা বুঝবে। নিজের মায়ের কাণ্ড দেখে হয়তো হতবাক হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্যে। নবাবি যার মাথার ওপর তার বুঝি মুখে কিছু বলতে নেই। মুখে কিছু বললেই সব অপরাধ তারই ঘাড়ে পড়ে।

শুধু বলেছিল–নানিজি, আমার বুকের ওপর আজ ছুরি বসিয়ে দিতে পারো তুমি?

 নানিবেগম আঁতকে উঠেছিল কথাটা শুনে।

আহা, তুই কী বলছিস মির্জা? তোর মুখে কি কিছু আটকায় না?

মির্জা বলেছিল–আমি ঠিক কথাই বলছি নানিজি! জগৎশেঠজির কী দোষ, মিরজাফর সাহেবের বা উমিচাঁদজির কী দোষ, ফিরিঙ্গির বাচ্চা ক্লাইভেরই বা কী দোষ। সব দোষ আমার নানিজি, সব দোষ আমারই। আমার বুকে ছুরি বসিয়ে দিলেই এখন আমি শান্তি পাই

নানিজি মির্জাকে দুই হাতে ধরে ঠেলে দিয়ে বলেছিল–তুই তোর মহলে যা মির্জা। তোর মাথায় এখন সব গোলমাল হয়ে গেছে, তোর মতির ঠিক নেই এখন

মির্জা বলেছিল–ঘরে বাইরে কোথাও আমার জন্যে এতটুকু শান্তি নেই নানিজি! কোথাও গিয়ে আমি শান্তি পাব না–এতক্ষণ বোধহয় ক্লাইভ মুর্শিদাবাদে আসবার জন্যে রওয়ানা দিয়েছে। আমি কী করি নানিজি? আমি কী করি?

কেন? জগৎশেঠজি তোকে টাকা দিলে না?

মির্জা বললে–না। বললে–অত টাকা এখন দিতে পারবে না।

তারপর হঠাৎ নিজেকে নানিজির হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলে। বললে–ঠিক আছে, নানিজি, আমি কারও দয়া-মায়া চাই না। কারও কাছে জীবনে কখনও ভিক্ষে চাইনি। কেউ আমাকে ভালবাসেনি, আমি কারও কাছ থেকে ভালবাসা চাইওনি। কেউ যখন আমার নয় আমিও কারও নই। কারও জন্যে আমি ভাবব না। আমার যা খুশি তাই করব

বলে তাড়াতাড়ি বাইরের দিকে চলে গেল।

নানিজি পেছন থেকে ডাকলে–মির্জা, মির্জা, ওরে শোন, শোন মির্জা

কিন্তু মির্জা তখন চেহেল্‌-সুতুন পেরিয়ে বাইরে চলে গেছে।

নানিবেগম হঠাৎ চারদিকে চেয়ে চিৎকার করে উঠল–তোরা এখানে কী দেখছিস দাঁড়িয়ে? তোরা কী দেখছিস? যা এখান থেকে সবাই, বেরিয়ে যা সামনে থেকে যা, বেরিয়ে যা

পেশমন বেগম, তক্কি বেগম, বব্বু বেগম, শিরিনা, সাকিনা, মামুদা, জবিন, সবাই সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

তারপর আমিনার দিকে চেয়ে নানিবেগম বললে–পোড়ারমুখি, তুই ডাইনি, আমার পেটে তুই ডাইনি জন্মেছিলি। কেন তুই মরলি না? কেন তুই মরতে পারলি না মেঘনার দরিয়াতে? তোর মুখ দেখলেও পাপ হয়। মা হয়ে তুই ছেলের মরা-মুখ দেখতে চাস, তোর মরণ হয় না? তুইকী? তুই মানুষ না জানোয়ার?

আমিনাও কম নয়। আমিও কিছু একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল। হঠাৎ পিরালি খাঁ দৌড়োতে দৌড়োতে এল।

নানিবেগমসাহেবা, নবাব খাজাঞ্চিখানায় গেল।

কেন রে, সেখানে কী করছে?

নবাব মোহরার সাহেবকে হুকুম দিয়ে দিয়েছে নিজামতে যার যত টাকা বকেয়া পাওনা আছে, সব দিয়ে দিতে। চকবাজারের রাস্তায় পেয়াদারা চাড়া পিটিয়ে দিতে গেছে।

কথাটা শুনে নানিজির যেন বাকরোধ হয়ে গেল। আর কোনও কথা বেরোল না মুখ দিয়ে। সত্যিই তখন চকবাজারের রাস্তার মানুষরাও অবাক হয়ে গেছে তাড়া পেটানোর শব্দ শুনে।

কী গো? কী বলছে পেয়াদারা?

যে-যেখানে ছিল, সবাই দৌড়ে কাছে এল।

নবাব মির্জা মহম্মদ হেবাৎ জঙ সিরাজ-উ-দ্দৌলা আলমগিরের হুকুমনামা

কী হুকুমনামা হে–কী হুকুমনামা?

 যার যা বকেয়া পাওনা আছে, নিজামতের খাজাঞ্চিখানায় গেলেই আজ সব পাওনা শোধ হবার হুকুমনামা বেরিয়েছে। খাজাঞ্চিখানা খোলা আছে, মুর্শিদাবাদের মানুষজন সেখানে হাজির হয়ে পাওনা-গন্ডা বুঝিয়া লইবা…

আধা বাংলা আধা-উর্দুতে সকলের বোধগম্য করে পেয়াদারা চিৎকার করছে আর ডিম ডিম করে ঢোলসহরত দিচ্ছে।

ঢোলসহরত শুনে মানুষজন আর বাগ মানে না। সবাই ছুটল খাজাঞ্চিখানার দিকে। নিজামতের খাজাঞ্চিখানার ক’জনই বা লোক। হাজার হাজার লোক গিয়ে হাজির হয়েছে সেখানে। যে যা পারছে টাকা বুঝে নিচ্ছে। না থাক পাওনা, মুফত টাকা যখন পাওয়া যাচ্ছে তখন নিয়ে নাও। ফিরিঙ্গি ফৌজ তো আসবেই। তার আগে কিছু টাকা নিয়ে যেদিকে দুচোখ যায় সেই দিকেই পালাব।

যারা মুর্শিদাবাদ ছেড়ে দূরে পালিয়ে যাচ্ছিল, পালিয়ে যাবার জন্যে নৌকোয় উঠেছিল, তারাও নেমে পড়ল। টাকা দিচ্ছে, নিতে হবে না? টাকা যে জীবনের চেয়েও দামি গো।

মানুষের লোভ, মানুষের পাপ, মানুষের প্রবৃত্তি সব যেন সেদিন সহস্রবাহু হয়েই গ্রাস করেছিল মুর্শিদাবাদকে। একদিন যারা বর্গির অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্যে নিজামতের মুখের দিকে চেয়ে আশায় বুক বেঁধেছিল, সেদিন তারাই আবার নিজামতের মুখে পদাঘাত করতে দ্বিধা করলেন। তাদের কাছে নিজামতও যা, ফিরিঙ্গি-কোম্পানিও তাই। কেউ আমাদের আপন নয়। রাজার যেদিন সুদিন ছিল তখন আমাদের কথা ভাবেনি, এখন রাজার দুর্দিনে আমরাই বা তার কথা ভাবব কেন? আমরা সাধারণ প্রজা, আমাদের নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আমাদের নিজেদেরই দেখে নিতে হবে। আর নবাবের সুখসুবিধে? সেটা নবাব নিজেই বুঝুক। তুমি কি আমাদের কথা কখনও ভেবেছ? আমাদের দুঃখকষ্ট কখনও দূর করবার চেষ্টা করেছ?

রাত যখন চার প্রহর তখনও খাজাঞ্চিখানায় মানুষের ভিড় কমে না। দাও, আমাকে আগে দাও। পেছন থেকে আর একজন বলে আমাকে আগে! তারপর সবাই একসঙ্গে বলে ওঠে আমাকে আগে! এমন দিন হয়তো আর আসবে না। এমন রাতও হয়তো ইতিহাসে কখনও পুনরাবৃত্তি হবে না। খাজাঞ্চিখানার টাকা ও প্রজাদেরই টাকা। ওতে আমার আর এতটুকু অধিকার নেই। আমি তোমাদের নবাব। তোমাদের দুঃখের দিনে আমি তোমাদের দেখিনি। আমি অন্যায় করেছি। কিন্তু এখন আমাকে একটু ন্যায় করতে দাও। তোমাদের দান করে একটুখানি পুণ্যসঞ্চয় করতে দাও। তারপর আমার। যা-কিছু আছে, সব তোমাদের দেওয়া শেষ হয়ে গেলে আমি এই মসনদ ছেড়ে চলে যাব। তোমাদের আশীর্বাদ চাই না, তোমাদের করুণাও চাই না, তোমাদের স্নেহ-ভালবাসা-মমতা, কিছুই আমি চাই না। হালিশহরের সেই এক কবি ছিল, সে আমাকে যে-গান শুনিয়েছে, সেই গান শোনার পর থেকেই আমি সব ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলাম। আজকে আমার সেই যাবার দিন এসেছে। তোমরা যত খুশি নিয়ে নাও, যার যত খুশি। খাজাঞ্চিখানার দরওয়াজা তোমাদের জন্যেই আমি খুলে রেখেছি। কেউ বোলো না যে আমি পাইনি, আমার কিছু পাওয়া হয়নি, নবাব আমাকে কিছুই দেয়নি।

হঠাৎ চেহেল্-সুতুনের ভেতরে সে রাত্রে একটা পেঁচা ডেকে উঠল।

নবাব চারদিকে চাইলে। লুৎফার বোধহয় একটু তন্দ্রা এসেছিল। গায়ে হাত লাগতেই জেগে উঠেছে।

একী, তুমি?

আমি চললুম।

একলা কোথায় যাবে?

যেদিকে পথ খোলা পাব।

 কিন্তু তোমাকে আমি একলা ছেড়ে দিতে পারব না। আমি তোমার সঙ্গে যাব।

কেন তুমি আমার সঙ্গে যাবে? আমি তো তোমাকে কোনওদিন ভালবাসিনি। আমি তো রাত্রে কোনওদিন তোমার ঘরেও শুতে আসিনি। আমি তোমার কাছ থেকে বরাবর মুখ ফিরিয়ে রেখেছি। তোমাকে স্ত্রীর মর্যাদাটুকু পর্যন্ত আমি দিইনি!

লুৎফা বললে–তা হোক, আমি যাই তোমার সঙ্গে। তুমি মানা কোরো না

তা হলে চলো!

টিমটিম করে একটা তেলের আলো জ্বলছিল চেহেল্‌-সুতুনের একটা ছোট্ট কুলুঙ্গিতে। তার সামনে একটা ছায়া নড়ে উঠতেই পিরালি খাঁ চমকে উঠেছে–কৌন হ্যায়?

আমি।

পিরালি গলা শুনেই কুর্নিশ করলে। নবাব।

মরিয়ম বেগম কোন মহলে?

পিরালি বললে–মরিয়ম বেগমকে আজ সকালবেলা মেহেদি নেসার সাহেব মতিঝিল থেকে ধরে এনে এখানে নজরবন্দি করে রেখেছে সঁহাপনা!

একবার আমাকে নিয়ে চলো তো মরিয়ম বেগমসাহেবার কাছে?

 পিরালি বললে–দরজায় তালা দেওয়া আছে। নজর মহম্মদের কাছ থেকে চাবি এনে খুলে দিচ্ছি। জাঁহাপনা

বলে দৌড়ে অন্ধকারের মধ্যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু তখনই আবার মনে হল, কেন আবার তাকে কষ্ট দেওয়া। হিন্দুর বউ সে, হিন্দুর মেয়ে। নিজের জীবনের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে কেন আবার তাকে জড়াবে! আমি চলে গেলেই যদি মুর্শিদাবাদে শান্তি আসে তো আসুক। আমিই তো আসল পাপী, তাই আমিই চলে যাচ্ছি। তোমরা ওদের কষ্ট দিয়ো না মিরজাফর আলি সাহেব। ওদের কোনও দোষ নেই। ওরা আমার বেগম ছিল। আমার অপরাধের জন্যে ওদের তোমরা শাস্তি দিয়ো না। আল্লার নাম করে বলছি আমি চিরকালের মতো দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি, আর কখনও ফিরে আসব না, ফিরে আসতে চেষ্টাও করব না।

কান্ত ঘরের ভেতরে চুপ করে শুয়ে ছিল। ঘুম আসছিল না। হঠাৎ দরজার তালা খোলার শব্দে উঠে বসেছে। কে?

কোনও উত্তর নেই।

কান্ত আবার বললে–কে?

আর কোনও সাড়া-শব্দ নেই।

শুধু অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে মনে হল যেন কয়েকটা ফিসফিস শব্দ, কতকগুলো খসখস পায়ের আওয়াজ ঘরের পাশ দিয়ে কোথায় দূরে গিয়ে মিলিয়ে গেল। আর খানিক পরেই আবার একটা পেঁচার ডাক। চেহেল্-সুতুনের ভেতরেও পেঁচা আছে নাকি?

*

মুর্শিদাবাদ ঘাট থেকেই নৌকো নিয়েছিল সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ। কিন্তু সহজে কি নৌকো পাওয়া যায়। মাঝিরা বলে দিনমানে নৌকো ছাড়লে কেউ সন্দেহ করবে, রাতের বেলায় ছাড়ব–

সচ্চরিত্র বলেছিল–কেন, সন্দেহ করবে কেন?

মাঝিরা বলেছিল–আজ্ঞে মিঞাসাহেব, নিজামতের চরেরা সন্দেহ করবে, ভাববে সোনাদানা নিয়ে পালাচ্ছে। চার দিকে বড় চর লেগেছে

তা তাই-ই সই। সেই রাত্রের দিকেই নৌকোটা ছেড়েছিল। হাতিয়াগড়ের দিকে যেতে হবে। একটু তাড়া আছে। তার বেশি কিছু খুলে বলেনি সচ্চরিত্র। নৌকোটা ছপাত ছপাত করে দাঁড় বেয়ে বেয়ে চলেছে। মরালীর মুখে কথা নেই। একটার পর একটা গ্রাম ছেড়ে চলেছে আর কেবল মনে পড়েছে কান্তর কথা। কোথায় রইল সে। কোথায় কে তাকে ধরে রাখলে? এতদিনের সম্পর্কটা দিনে দিনে বড় জটিল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আজ চলে যাবার মুখে যে এতটা টান পড়বে তা বুঝতে পারেনি আগে।

সচ্চরিত্র একবার শুধু বললে–তুমি একটু ঘুমোতে চেষ্টা করো না মা

মরালী বললে–ঘুম যে আসছে না

সচ্চরিত্র বললে–চেষ্টা করলেই ঘুম আসবে। আর বাবাজির জন্যেই ভেবেই বা কী করবে, ভগবানের যদি ইচ্ছে থাকে তো বাবাজির মঙ্গলই হবে। বাবাজি তো কোনওদিন কারও ক্ষতি করেনি।

হঠাৎ একটা জায়গায় আসতেই মনে হল কে যেন চিৎকার করে উঠল।

 হল্ট-হল্ট

 মরালী ভয়ে চমকে উঠেছে।

 ও কী বলছে ঘটকমশাই? ও কারা?

 নৌকোটার মাঝিরা অতটা খেয়াল করেনি। তারা চালিয়েই যাচ্ছিল।

আবার পাড়ের ওপর থেকে চিৎকার এল হল্ট হল্ট

.

চারদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে। দুর্যোগের সময় নৌকোতে আলো জ্বালতে বারণ করেছিল সচ্চরিত্র। আগেই বলে দিয়েছিল–একটু সাবধানে নিয়ে যাবে বাবা আমাদের দিনকাল ভাল নয়–

দিনকাল যে ভাল নয় তা মুর্শিদাবাদের মাঝিরাও জানত। কদিন থেকেই কোনও সোয়ারি নেই। আর মাল আসা-যাওয়া তো বন্ধই হয়েছে আগে থেকে। ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই বাধবার সময় থেকে। যারা কারবার করে, তাদের মাল কেনবার খদ্দের নেই। যারা খদ্দের, তারাও মাল কিনে ঘরে তুলতে ভরসা পায় না। মাল শুধু তো কিনলেই চলবে না, তাকে আবার বেচতেও হবে। কিন্তু কাকে বেচবে? যারা বেশি মুনাফা করবে বলে মাল লুকিয়ে রেখেছে, তারাও ভরসা পাচ্ছে না বেচতে। যদি দাম পড়ে যায়! আরও কিছু দাম বাড়ক, তখন বেচব। আবার তা ছাড়াও, আজ নাহয় নবাব সরকার আছে, কিন্তু ফিরিঙ্গিরা যদি হঠাৎ এসে পড়ে এখানে, তখন টের পেলে মাল কেড়ে নিতেও পারে। তখন দামও পেলাম না, মুনাফাও পেলাম না, অথচ মালও খোয়া গেল।

তাই মাঝিরা রাত্রে যাতায়াতের সময় আলো নিবিয়ে দিয়ে অন্ধকারে চলাফেরা করছিল।

কিন্তু এমন যে হবে, তা আগে কল্পনা করা যায়নি।

ওপর থেকে তখনও শব্দ আসছে–হল্ট

এ তো ফিরিঙ্গিদের গলা। এ ভাষাও তৌফিরিঙ্গিদের।

সচ্চরিত্র ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মাঝিদের দিকে চেয়ে বললে–নৌকো ঘোরাও গো তোমরা, নৌকোর মুখ ঘোরাও–

মাঝিরা কথার মানে বুঝতে পারেনি।–কী বলছে ওরা খসাহেব? কে ওরা?

সচ্চরিত্র বললে–মানে কি আমিই বুঝেছি? নৌকো ঘোরাও ফিরিঙ্গি-ঘাঁটি ওটা—

মাঝিরা বললে–নৌকো ঘুরিয়ে কোন দিকে যাব? আবার সেই মুর্শিদাবাদ?

তা, কী আর করা যাবে? মরলে নবাবের হাতেই মরা ভাল। ফিরিঙ্গিদের হাতে মরতে যাই কেন বুড়ো বয়সে।

মরালী এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছিল। বললে–না, নৌকো ঘোরাতে হবে না, পাড়ে ভেড়াও

সচ্চরিত্র বললে–কেন মা, নৌকো পাড়ে ভেড়াতে বলছ কেন? শেষকালে যে ফিরিঙ্গি বোম্বেটেদের হাতে পড়ব?

মরালী বললে–তা হোক ঘটকমশাই, এখন পালাতে গেলে বিপদ হবে। আমার মনে হচ্ছে আমরা ফিরিঙ্গি সেপাইদের হাতে পড়েছি।

ফিরিঙ্গি সেপাই! কথাটা শুনেই সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ মশাই ভয়ে শিউরে উঠল।

মরালী মাঝিদের জিজ্ঞেস করলে–এটা কোন জায়গা, তোমরা জানো?

মাঝিরা বললে–বাবু, এ তো ময়দাপুর।

তা হলে মরালী যা ভেবেছিল তাই-ই ঠিক হয়েছে। ক্লাইভ সাহেব ফৌজ নিয়ে তো এখানেই ঘাঁটি করে রয়েছে। কথাটা চকবাজারের রাস্তার লোকের মুখেই তো শুনে এসেছে সে।

সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ মশাই তখন থরথর করে কাঁপছে। মরালী বুড়োমানুষকে এক হাত দিয়ে ধরলে।

বললে–আপনি কিছু ভাববেন না ঘটকমশাই, আমি তো আছি। ভয় কী?

সচ্চরিত্র বললে–আমি তো তোমার জন্যেই ভাবছি মা। যদি ওরা জানতে পারে তুমি মেয়েমানুষ, তা হলে কি আর বেটারা ছেড়ে কথা বলবে?

মরালী বললে–সে জানতে পারবে না ঘটকমশাই।

মাঝিরা তখন নৌকো পাড়ে ভেড়াচ্ছিল। পাড়ের ওপর অনেকগুলো লোক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। তারাও আস্তে আস্তে নদীর কিনারায় নেমে আসছে।

সচ্চরিত্র বললে–ওরা যদি তোমার গায়ে হাত দেয়, তা হলে কিন্তু আমি সহ্যি করব না, তা বলে রাখছি মা–

মরালী বললে–আপনি উত্তেজিত হবেন না। আপনি বেশি কথাও বলবেন না। ঠান্ডা হয়ে থাকবেন, যা বলবার আমিই বলব।

সচ্চরিত্র বললে–তুমি ওদের চেনো না মা, তাই অমন কথা বলছ। ওদের বিশ্বাস নেই, ওরা গোরু-শোর খায়, তা জানো?

মরালী বললে–হ্যাঁ তা জানি, ক্লাইভ সাহেবের সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে

জানাশোনা আছে মানে?

মরালী বললে–একবার আমি বরানগরে ক্লাইভ সাহেবের ছাউনিতে গিয়েছিলাম। লোকটা ভাল।

ভাল মানে? তুমি বলছ কী?

মরালী বললে–ভাল মানে ভাল। বাইরে থেকে যা শোনা যায়, তার সবটুকু সত্যি নয়। হাজার হোক ফিরিঙ্গি হলেও লোকটা মানুষ তো বটে!

তুমি ওকে মানুষ বলো? ফিরিঙ্গিরা দেশের কত ক্ষেতি করেছে, তা জানো?

সব জানি বলেই ওই কথা বলছি ঘটকমশাই। বুদ্ধিতে আমার সঙ্গে পারবে না। একবার ওর দফতর থেকেই ওরই সামনে থেকে একটা জরুরি চিঠি চুরি করে এনেছিলাম। দেখুন না, আমাকে দেখলে কী বলে?

সচ্চরিত্র বললে–কিন্তু মা, তোমাকে চিনতে পারবে কী করে? তুমি তো এখন বেটাছেলে সেজে আছ?

মরালী বললে–না চিনতে পারলে তো ভালই, কিন্তু চিনতে পারলেও ক্ষতি নেই—

কেন?

ওই ক্লাইভ সাহেবের ছাউনিতেই হাতিয়াগড়ের ছোটরানি অনেকদিন ছিল, ওদের খুব যত্নে রেখেছিল সাহেব। ওদের মুখেই আমি সাহেবের প্রশংসা শুনেছি

ততক্ষণে কতকগুলো ফিরিঙ্গি নৌকো ঘাটে ভিড়তেই সামনে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

 হ্যান্ডস আপ! হ্যান্ডস আপ

সচ্চরিত্র মানে বুঝতে পারলে না।

হাত উঠাও, হাত উঠাও-হাত উপরে উঠাও

মরালী নিজের দুটো হাত ওপরে উঁচু করে তুলল। সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ তার দেখাদেখি হাত ওঠাল। মাঝিরাও উঠে হাত তুলে দাঁড়াল।

তারপর সেপাইরা সামনে বন্দুক উঁচু করে ধরে বললে–ওঠো, ওপরে চলো

আগে মরালী—

তার পেছনে সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ।

আর তার পেছন পেছন মাঝিরা।

সবাই সেই অন্ধকারের মধ্যে পা ফেলে ফেলে উঁচু পাড় ভেঙে ডাঙার ওপরে উঠতে লাগল।

*

জগৎশেঠজির হাবেলির ভিখু শেখ সেদিন একটু বেশি গরম হয়ে গিয়েছিল। কদিন ধরে যেন সব নিয়মমাফিক চলছে না। যে-সময়ে হাবেলিতে লোক আসা নিয়ম, সেসময়ে আসছে না। যে-হাবেলিতে ভিখু শেখ পাহারাদার, সে যে-সে হাবেলি নয়, এইটেই ছিল তার ইজ্জত। সেই ইজ্জতেই যেন কদিন থেকে আঘাত লেগেছে।

কৌন হ্যায়? কৌন?

তারপর যখন দেখেছে মিরজাফর সাহেব, তখন মাথা নিচু করে কুর্নিশ করেছে।

আবার খানিক পরেই আর একজন।

কৌন হ্যায়? কৌন?

তারপর যখন দেখেছে রাজা দুর্লভরাম, তখন মাথা নিচু করে কুর্নিশ করেছে।

এমনি করে লোক আসার যেন আর বিরাম নেই। এক এক করে সারা মুর্শিদাবাদের তামাম রেইস আদমি এসে হাজির হয়েছে মহিমাপুরে। কেউ আর পাঞ্জা দেখায় না। পাঞ্জা দেখাবার কিংবা পাঞ্জা দেখবার দরকারই হয় না। আর শহর মুর্শিদাবাদও হয়েছে তেমনি। শহরে যত বেকার আদমি সব বিলকুল রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। ক্যা হুয়া? হুয়া হ্যায় ক্যা?

ভিখু শেখ নিজের মনে নিজেকেই প্রশ্ন করে। সবাই কি পাগল হয়ে গেল? সবাই দিমাগ হারিয়ে ফেললে?

কৌন হ্যায়?

চারদিকে যেন সবাই দিওয়ানা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোক দেখেই নেশার ঘোরে ভিখু শেখ চিৎকার করে ওঠে–কৌন হ্যায়?

ওটা যেন ওর বুলি। বলতে বলতে মুদ্রাদোষে পঁড়িয়ে গেছে। মানুষের ছায়া দেখলেও বলে, মানুষের গন্ধ পেলেও বলে। কোথা থেকে হঠাৎ এত মানুষের আমদানি হল শহরে, তা সে বুঝতে পারে না। ভোররাত থেকে আসা-যাওয়া শুরু হয়েছে, তা তখনও থামেনি।

এই মহিমাপুর-মহারাজার হাবেলির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ভিখু শেখ তার জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বুঝতে পারেনি যে, তার চোখের আড়ালে এই দুনিয়াটা কত তাড়াতাড়ি আসমান-জমিন বদলে যাচ্ছে। বুঝতে পারেনি যে, শুধু বন্দুক দিয়ে পাহারা দিলেই সবকিছু নিরাপদ থাকে না। বুঝতে পারেনি যে তার দৃষ্টি আর তার বন্দুকের আড়ালে আর-একটা দুনিয়া আছে, যেখানে আর-একজন অদৃশ্য ভিখু শেখ আরও কঠোর আরও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে মানুষের মনের হাবেলির সব ফটকগুলো পাহারা দিচ্ছে। ভিখু শেখ সেই ভিখু শেখকে চেনে না বলে জগৎশেঠজির হাবেলির ফটক পাহারা দেয়, আর চিৎকার করে বলে–কৌন হ্যায়?

কিন্তু না-জানাই বোধহয় ভিখু শেখদের পক্ষে মঙ্গল। জানলে অমন বিশ্বস্ত হয়ে আর পাহারাও দিত না। অমন কথায় কথায় চেঁচাতও না। জগৎশেঠজির বাস্তব-সংসারটাও ভিখু শেখদের অভাবে অচল হয়ে যেত। ভিখু শেখরাও চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুলুকে ফিরে গিয়ে উপোস করে মরত।

কিন্তু এসব কথা ভিখুদের শেখানোও হয় না; ভিখু শেখরাও এসব কথা শিখতে চায় না। ভিখ শেখরা বলে তুমি আমার মালিক, আমি তোমার সেবা করেই জীবন সার্থক করব। আমার চোখের সামনে আমার গাফিলতিতে হাবেলির মালিক বদলিয়ে যাবে, তা আমি সহ্য করব না।

তবু ইতিহাসের অমোঘ পরিহাসে এক-একবার ভিখু শেখদের চোখ খুলে যায়। তারা দেখে, তাদের পাহারা দেওয়া সত্ত্বেও হঠাৎ কখন রাজ্যপাট বদলে গেছে, হঠাৎ কখন মসনদ জগৎশেঠজির হাতছাড়া হয়ে গেছে।

১৭৫৭ সালের ২৫ জুন সেই ঘটনাই ঘটল।

সকালবেলা মিরজাফর আলি শহরে ফিরে এসেই খবর পেলে, জগৎশেঠজিকে ডেকে পাঠিয়েছে নবাব। রাজা দুর্লভরামও আর দেরি করেনি। সবাই জগৎশেঠজির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

চেহেল্-সুতুনের আমদরবার থেকে ফিরতেই ভিখু শেখ এক লাফে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ ঠুকেছে।

কে কে আছে ভেতরে?

দেওয়ান রনজিৎ রায় বললে–রাজা দুর্লভরাম, মিরজাফর আলি সাহেব আর হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই

সেই যে দরবার বসেছিল তাদের, সে আর খতম হয় না। ভিখু শেখ সেই তখন থেকেই ফটকে পাহারা দিচ্ছে। তারপর দুপুর হল, বিকেল হল, একসময়ে সন্ধেও হল। পুবদিকে সূর্যটা উঠে আবার পশ্চিম দিকে ডুবেও গেল। কিন্তু দরবার শেষ হল না।

সন্ধের অন্ধকারে এল মিরন। আর তারপরে এসে হাজির হল ফিরিঙ্গি ফৌজের ওয়াটস্ আর তার সঙ্গে আর-একজন।

জগৎশেঠজি চিনতে পারলেন না তাকে। জিজ্ঞেস করলেন–ইনি কে?

ওয়াটস্ বললে–ইনি মিস্টার ওয়ালস, কম্যান্ডার ক্লাইভের সেক্রেটারি

ক্লাইভ কখন আসবেন?

আমাদের কাছ থেকে সিটির হালচাল কী রকম শুনে তবে আসবেন, তিনি এখনও ময়দাপুরে ক্যাম্প করে আছেন। আমরা গিয়ে সব রিপোর্ট দেব। রাজধানীর কী অবস্থা এখন? রাস্তায় রাস্তায় তো গোলমাল দেখলাম। একটা দোকানের সামনে একটা বুড়ো লোকের ডেডবডি পড়ে থাকতে দেখলাম–কে ও?

কোথায় কে মরে পড়ে আছে, তার খবর রাখবার তখন সময় নেই কারও।

আর নবাব? নবাব কী করছে? কী মতলব নবাবের?

জগৎশেঠজি বললেন–আমাকে নবাব ডেকে পাঠিয়েছিল, ফৌজ তৈরি করবার জন্যে। আমার কাছে টাকা চাইছিল, আমি বলেছি, আমার কাছে টাকা নেই এখন!

ওয়াটস্ সাহেব বললে–কর্নেলসাহেব আমাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে তার কিছু টাকা দরকার–হাতে কিছু টাকা নেই, লড়াইতে সব টাকা ফুরিয়ে গেছে

মিরজাফর সাহেব জিজ্ঞেস করলে–কত টাকা দরকার?

দু’কোটি কুড়ি লক্ষ টাকা।

জগৎশেঠজির মুখখানা গম্ভীর হয়ে গেল কথাটা শুনে।

ওটা নবাবের কাছ থেকে দিলেই চলবে। ওই টাকাটা পেলে তবে কর্নেল সিটির দিকে আসবেন।

 মিরজাফর আলি বললে–কিন্তু টাকাটা পরে দিলে চলবে না?–নবাবকে গ্রেপ্তার করার পর আমি আদায় করে দেব।

রাজা দুর্লভরাম এতক্ষণে কথা কইলে! বললে–এত টাকা নবাবের সিন্দুকে নেই

সেকী? মুর্শিদাবাদের নবাবের কাছে দু’কোটি কুড়ি লাখ টাকা নেই?

থাকলে তো নবাব এখনই ফৌজ বানিয়ে আবার লড়াই শুরু করে দিত!

 কিন্তু টাকাটা যে চাই-ই কর্নেলের। একটু তাড়াতাড়িই চাই। নইলে আপনাদেরই ডেঞ্জার। মঁসিয়ে ল হয়তো দু-একদিনের মধ্যেই এসে যাবে এখানে।

মিরজাফর আলির ভয় হয়ে গেল কথাটা শুনে। ল’সাহেব আসছে?

তাড়াতাড়ি জগৎশেঠজির দিকে চেয়ে বললে–আপনি টাকাটা দিয়ে দিন জগৎশেঠজি, আমি নবাব হলে সব টাকা আপনার শোধ করে দেব, আপনাকে কথা দিচ্ছি–

রাজা দুর্লভরাম বললে–আর যদি টাকা না দিতে পারি আমরা তো কর্নেল মুর্শিদাবাদে আসবেন না?

ওয়ালস্ বললেন –না

ছোটমশাই এতক্ষণ একপাশে বসে ছিল। বললে–জগৎশেঠজি, টাকাটা আপনি দিয়েই দিন, আমার নিজের টাকা থাকলে আমি দিয়ে দিতাম

জগৎশেঠজি তখনও চুপ করে আছেন। মনে মনে ভাবছিলেন, একজন নবাব লড়াইতে হেরে টাকা চাইছে তার কাছে, আর-একজন লড়াইতে জিতে টাকা চাইছে। এই এরই কাছে একদিন সবাই দরবার করেছে নবাবকে জব্দ করবার জন্য। এই একেই তারা সবাই মিলে বাংলা মুলুকে ডেকে এনেছে। এরও চাই টাকা!

ওয়াটস্ আর ওয়ালস উঠল।

বললে–তা হলে স্যার আমরা উঠি

জগৎশেঠজি রূঢ় গলায় বললো, হ্যাঁ উঠুন আপনারা

 মিরজাফর আলি জগৎশেঠজির কাছে সরে এসে বললে–জগৎশেঠজি, আমি কথা দিচ্ছি, আমি নবাব হয়ে আপনাকে সব টাকা শোধ করে দেব, আপনি টাকাটা দিয়ে দিন

ছোটমশাইও বললে–হ্যাঁ জগৎশেঠজি, আপনি টাকাটা দিন নইলে ল’সাহেব এসে পড়লে আবার যে কে সেই অবস্থা হবে

জগৎশেঠজি পাথরের মতো নির্বিকার হয়ে তখনও চেয়ে আছেন। চেয়ে আছেন না ভাগ্যের পরিহাসের কথা ভাবছেন, কে জানে! এই এঁদেরই তিনি বাংলা মুলুকের ভাগ্যনিয়ন্তা করে ডেকে এনেছেন এত আদর করে। মিরজাফর সাহেব এই এঁদেরই পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছে।

বাইরে ভিখু শেখ হঠাৎ চিৎকার করে উঠেছে–কৌন হ্যায়?

রাত নয়, অন্ধকার নয়, কিছু নয়। তবু এত হুশিয়ারি ভাল লাগে না বশির মিঞার।

বশির মিঞা রেগে বললে–আমি রে বাবা, আমি। বাঘ নই, ভাল্লুক নই, আমি বশির মিঞা

 পাঞ্জা হ্যায়?

অর্থাৎ ভেতরে ঢোকবার মঞ্জুরি আছে কিনা!

বশির মিঞা বললে–এই দেখ বাবা, এই দেখ, পাঞ্জা দেখ–খাস নিজামতের মোহরার মনসুর আলি মেহের সাহেবের মঞ্জুরি

ভিখু শেখ আর কিছু বললে–না। কুত্তিকা বাচ্চারাও আজকাল পাঞ্জা আনছে সঙ্গে করে। দুনিয়া বেহেঁশ হয়ে গেছে। যা, অন্দর যা ভাগ

তারপর সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ভিখু শেখ দুনিয়াদারির বেহাঁশি দেখে তাজ্জব হয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল।

আর ভেতরে তখন সবাই মনসুর আলি মেহের সাহেবের চিঠি পড়ে আরও তাজ্জব হয়ে গেছে।

মোহরার সাহেব লিখছে–নবাব খাজাঞ্চিখানার তহবিল থেকে সব টাকা দান-খয়রাত করবার হুকুমজারি করেছে। যে এসে চাইছে, তাকেই টাকা দেওয়া হচ্ছে। তহবিলের টাকা দেওয়া আরম্ভ হয়েছিল বিকেলবেলা, এখনও দেওয়া শেষ হয়নি। আর ঘড়ি দুই পরে তহবিলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। আপনাকে সংবাদটা জানালাম, কিংকর্তব্য জানাবেন

ওয়াটস্ আর ওয়ালস্ কিছুই বুঝতে পারেনি এতক্ষণ।

জিজ্ঞেস করলে–কী হয়েছে?

মিরজাফর তখনও চিঠিটা বারবার পড়ছে।

হঠাৎ কী করবে যেন মাথায় কিছু এল না। সব টাকা উড়িয়ে দিয়ে তবে কি পালিয়ে যেতে চায় নবাব?

ওয়াটস্ আবার জিজ্ঞেস করলে কী হয়েছে জেনারেল?

মিরজাফর বললে–নবাব সব টাকা বিলিয়ে দিচ্ছে সকলকে, যত টাকা আছে নিজামতে সব দান-খয়রাত করে দিচ্ছে

এতক্ষণে যেন বুঝতে পারলে তারা। তা হলে মুর্শিদাবাদ ক্যাপচার করে তাদের বেনিফিট কী হবে?

কিছুই না। একেবারে ফাঁকা সিন্দুক পড়ে থাকবে। যদি পারো এখনই হামলা করতে বলো কর্নেল সাহেবকে। আর যেন দেরি না করেন।

সত্যিই দু’জন ফিরিঙ্গি তখন ভাবনায় পড়েছে।

বশির মিঞা বললে–সবাই টাকা-মোহর নিয়ে নৌকো করে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে পালাচ্ছে হুজুর, আমি দেখে এসেছি–

তখন আর কোনও বুদ্ধি মাথায় আসছে না কারও। সমস্ত পরিকল্পনা যেন গোলমাল হয়ে গেছে। যাও, এখনই চলে যাও সাহেব। এখনই কর্নেলকে গিয়ে বলো যেন আর দেরি না করে। রাস্তায় যাকে পাবে, তাকেই যেন গ্রেফতার করে। নদীতে নৌকো দেখলেই ধরতে হুকুম দাও। সবাই নিজামতের টাকা নিয়ে পালাচ্ছে। আর দেরি কোরো না, যাও–যাও

ওয়াটস্ আর দেরি করেনি। সঙ্গে ওয়ালও তাড়াতাড়ি ঘোড়ায় উঠে সোজা দৌড় দিয়েছে কাশিমবাজারের দিকে। কাশিমবাজার পেরিয়েই ময়দাপুর।

কিন্তু সমস্ত রাস্তাটাই লোকে-লোকারণ্য। দলে দলে সমস্ত লোক মুর্শিদাবাদ ছেড়ে হাঁটা-পথে রওনা দিয়েছে। সঙ্গে যে যা পেরেছে নিয়ে চলেছে। ছোট ছেলেমেয়ে পোঁটলা-পুঁটলি কাঁধে। হরিনামের মালা জপছে। আর বুকের মধ্যে নিয়েছেনারায়ণশিলা। ম্লেচ্ছরা আসছে আবার। দেশ-ডুই উচ্ছন্নে যাবে। সেই ভোরবেলা থেকেই তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে। এত রাত হয়েছে, তখনও রাস্তায় লোকের বিরাম নেই। সবাই চলেছে পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটে ছেড়ে।

ক্লাইভ তখনও অপেক্ষা করছিল।

ওয়াটস্ যেতেই ক্লাইভ বললে–কী খবর?

ওয়াটস্ বললে–টাকা দেবে না জগৎশেঠ।

দেবে না?

ওয়াট বললে–না, জগৎশেঠজি বললে–অত টাকা তার কাছে নেই।

ক্লাইভ বললে–তা হলে কোম্পানির যে এত টাকা খরচ হল, এ কীসের জন্যে? কাদের জন্যে? এ-টাকার দায় নেবে কে? কোম্পানি না বাংলার নবাব?

ওয়াটস্ বললে–সে কথা আমরা বলেছি, কিন্তু টাকা ওদের নেই

ক্লাইভ বললে–ওদের না থাকতে পারে কিন্তু লোন দিক, নবাবের ক্যাশ পেলে তখন আমি সব লেন মিটিয়ে দেব

ওয়াটস্ বললে–কিন্তু নবাবের কাছেও আর কিছু নেই। নবাবের যা-কিছু টাকা ছিল, সমস্ত চ্যারিটি করে দিয়েছে

সেকী?

ওয়াটস বললো, হ্যাঁ মিরজাফর আলি বলে দিয়েছে, টাকাকড়ি নিয়ে যারা পালাচ্ছে, তাদের যেন আমরা আটকাই–প্রত্যেকটা নৌকো যেন আমরা সার্চ করি, প্রত্যেককে যেন আমরা গ্রেফতার করি তাদের ধরলে আমরা অনেক টাকা পাব

পরের দিন থেকে সেই হুকুমই হল। হাঁটা-পথে, নদী-পথে নৌকোয় যারাই যাবে, তাদেরই চ্যালেঞ্জ করা হবে। কাউকে ছাড়া হবে না। নবাবের টাকা দেবার তো রাইট নেই। নবাবের টাকা তো কাস্ট্রির টাকা–

তখন থেকেই সকাল-সন্ধেরাত নৌকো গেলেই নদীর ওপর থেকে সেপাইরা চ্যালেঞ্জ করতে লাগল-হ–হল্ট–

রাস্তার লোকদেরও থামিয়ে দিয়ে গ্রেফতার করা হতে লাগল। বডি সার্চ করে টাকাকড়ি যা-কিছু পাওয়া গেল কেড়ে নেওয়া হল। তারপর সব কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দিতে লাগল। যাও, এবার খালি হাতে যাও যেদিকে চোখ যায়, চলে যাও

সমস্ত রাত ধরে পাহারা বসল গঙ্গার ধারে। অন্ধকারে নৌকো আসতে দেখলেই সেপাইরা চিৎকার করে উঠতে লাগল-হল্ট-হল্ট

কিন্তু সেদিন ভোরবেলা যখন মিরন এসে খবরটা দিয়ে গেল যে, নবাব মুর্শিদাবাদ ছেড়ে পালিয়ে গেছে, তখন কর্নেল ক্লাইভ পরামর্শ করবার জন্যেই মেজর কিলপ্যাট্রিককে ডেকে পাঠিয়েছিল।

কিলপ্যাট্রিক আসতেই ক্লাইভ বললে–শুনেছ মেজর, নবাব মুর্শিদাবাদ ছেড়ে পালিয়ে গেছে?

ঠিক সেই সময়েই হঠাৎ সেন্ট্রি-গার্ড এসে খবর দিলে কর্নেল, রাত্রে একটা নৌকো ধর পড়েছে

ক্লাইভ বললে–কত টাকা পাওয়া গেছে তাদের কাছ থেকে?

গার্ড বললে–টাকা পাওয়া যায়নি, কিন্তু মনে হচ্ছে তারা স্পাই, নবাবের স্পাই–

স্পাই?

 গার্ড বললে–হা কর্নেল, ফিমেল স্পাই–পুরুষের পোশাক পরে ছদ্মবেশে পালাচ্ছিল—

ফিমেল স্পাই?

মুনশি নবকৃষ্ণও কথাটা শুনে অবাক হয়ে গেল। মেয়েমানুষ-চর! পুরুষমানুষের পোশাক?

 ক্লাইভ বললে–নিয়ে এসো আমার কাছে

 খানিক পরেই যে সামনে এসে দাঁড়াল, তাকে দেখে অবাক হয়ে গেল কর্নেল ক্লাইভ। একটু তী নজর দিয়ে দেখলে। এমনিতে তো বোঝা যায় না যে ফিমেল। ঠিক বাঙালি পুরুষদের মতোই পোশাক। পরেছে। গায়ে আবার চাদর ঢাকা।

গার্ড বললে–এ পুরুষ নয় কর্নেল, ফিমেল। মেয়েমানুষ। এর বডি সার্চ করতে গিয়ে টে পেয়েছি

ক্লাইভ উঠে দাঁড়িয়ে সামনে গেল। তারপর চাদরটা মাথা থেকে খুলে দিলে। যেন চেনা চেনা মুখট মনে হল।

ক্লাইভ বললে–তোমাকে কোথায় দেখেছি বলো তো? হোয়ার? হু আর ইউ? তুমি কে?

মরালী বললে–সকলের সামনে বলতে পারব না সাহেব। আড়ালে বলব—

আড়ালে? বেশ আড়ালেই চলো

 গার্ড বললে–ওর সঙ্গে আর একটা বুড়োমানুষ আছে কর্নেল

ক্লাইভ বললে–তা থাক, পরে দেখব

 বলে পাশের ঘরের দিকে গেল। মরালীও সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর ঢুকল।

 দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ক্লাইভ বললে–এখন বলল কে তুমি?

মরালী বললে–সত্যিই আমাকে চিনতে পারছেন না?

না।

মরালী বললে–আমিই পেরিন সাহেবের বাগানে আপনার দফতর থেকে একদিন আপনার চিঠি চুরি করেছিলাম

সেকী? তুমি… তুমি মরিয়ম বেগম?

মরালী বললো হ্যাঁ।

*

কৃষ্ণনগরে অনেক রাত্রে মহারাজ তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। হঠাৎ গৃহিণী ডাকলেন। সামান্য ডাকেই উঠে পড়েছেন মহারাজ।

বললেন–কী? কী হল?

গৃহিণী বললেন–এই দেখো, হাতিয়াগড়ের বড়রানির কাছ থেকে চিঠি নিয়ে লোক এসেছে, বি দিয়ে গেল এখনই, বললে–জরুরি চিঠি। লোকটা বলছে নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা নাকি মুর্শিদাবাদ থেকে পালিয়েছে রাস্তায় শুনে এসেছে

মহারাজের তন্দ্রাটা ভেঙে গেল।

বললেন–দেখি চিঠিটা—

গৃহিণী বললেন চিঠি তোমার নামে নয়, লিখেছেন আমাকে

.

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সন্ধেবেলাই মুর্শিদাবাদের খবর পেয়েছিলেন। দেওয়ান কালীকৃষ্ণ সিংহমশাইয়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ আলোচনাও করেছিলেন।

বলেছিলেন–আমি তখনই বলেছিলাম দেওয়ানমশাই, মতলব ভাল নয় ক্লাইভ সাহেবের। ওদের লড়াইয়ের খরচ আমরা কেন দিতে যাব?

দেওয়ানমশাই বলেছিলেন–ক্লাইভ সাহেবের লোক সেখানে ছিল, সে বললে–দু’কোটি কুড়ি লাখ টাকা তাদের দিতেই হবে। আসলে লড়াইটা করেছে তো আমাদেরই জন্যে। আমরাই তো তাকে ডেকে এনেছি

তা তো ডেকেছি। কিন্তু এর জন্যে এত টাকা? তা ছাড়া, কাজটা তো এখনওই শেষই হল না। এরা তো দেখছি পাকা কারবারি জাত। কাজ ফতে হবার আগেই টাকা চায়। তা খবর পেয়েছ আর কে কে ছিল?

কালীকৃষ্ণ সিংহ বললে–সব খবর পাওয়া যায়নি। আমাদের উকিল তো আর সেখানে ছিলেন না। খবরটা যা লোকমুখে শুনেছেন, তাই জানিয়েছেন।

আর ক্লাইভসাহেব?

সে তো সেই ময়দাপুরেই ছাউনি করে আছে।

তা শহরের ভেতরে ঢুকছে না কেন?

ভয়ও তো আছে। মিরজাফর সাহেবকে তো এখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না।

 আর নবাব? নবাবের শেষ খবরটা কী?

দেওয়ানমশাই বললে–নবাব আর একবার চেষ্টা করছে যদি সৈন্য-সামন্ত জোগাড় করে ফৌজ তৈরি করতে পারে। তা তত টাকাও আর নেই, আর জগৎশেঠজিও সোজা বলে দিয়েছেন, তার অত, টাকা দেবার ক্ষমতাই নেই

এই পর্যন্তই কথা হয়েছিল রাত্রে। তারপর খাওয়াদাওয়া করে শুতে গেছেন অন্দরমহলে। মাথার মধ্যে কদিন ধরেই দুশ্চিন্তা ছিল। দুশ্চিন্তা ছিল রাজধানী নিয়ে, লড়াই নিয়ে, লড়াইয়ের ফলাফল নিয়ে। ভেবেছিলেন লড়াইটা মিটে গেলে দুশ্চিন্তাটা কাটবে। কিন্তু আরও যেন জটিল হয়ে গেল জিনিসটা। মসনদের ব্যাপারটা মিটল না, তবু আগে থেকেই টাকা দিতে হবে! এ তো বেশ আবদার!

দেওয়ানমশাইকে বলে রেখেছিলেন–রাত্রে যদি কিছু খবরটবর পান আমাকে ডাকনে। আমি ঘুমিয়ে থাকলেও আমাকে জানাবার ব্যবস্থা করবেন। আমি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে রইলাম।

শোবার আগে গৃহিণীকেও বলে রেখেছিলেন–রাত্রে যদি কেউ এসে ডাকে তো আমাকে জাগিয়ে দিয়ো

গৃহিণী বলেছিলেন–তোমার অত কষ্টের ঘুম, না-হয় ভোরে ঘুম থেকে উঠেই শুনো–

মহারাজ বলেছিলেন–না, হাজার হাজার লোক আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে, আমি যদি ঘুমোই তো তাদের কথা কে ভাববে?

এরপর আর বেশি কথা হয়নি। নিঃশব্দে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু গৃহিণীর ডাকে উঠে পড়েই সব ব্যাপারটা শুনলেন। হাতিয়াগড়ের বড়রানির পাঠানো চিঠিটাও পড়লেন। বহুদিন ধরে ছোটমশাইয়ের কোনও খবর পাননি। মহারানির কাছে লিখেছেন, তিনি যদি কিছু সংবাদাদি দিতে পারেন।

সেই রাত্রেই আবার শোবার ঘর ছেড়ে নীচে এলেন। দেওয়ানমশাই আগেই এসে বসে ছিল। হাতিয়াগড় থেকে আসা লোকটাও এসেছিল।

তা তুমি কী করে জানলে যে নবাব রাজধানী ছেড়ে চলে গেছে?

আজ্ঞে, মহারাজ, আমি নৌকোর মাঝিদের কাছে শুনলাম।

কখন পালিয়েছে নবাব?

তা ঠিক বলতে পারিনে হুজুর। নৌকোর মাঝিরা বলছিল মুর্শিদাবাদের ঘাটে অনেক নৌকো যেতে

দেখেছে, তাতে নাকি মেয়েছেলে ছিল, বোধহয় বেগমসাহেবা-টাহেবা কেউ হবেন। সঙ্গে লোকশকর, পেয়াদা ছিল, দেখে নবাব বলেই মনে হয়েছে তাদের।

আর কী বললে–তারা?

আর বলছিল ময়দাপরে আসবার পথে ফিরিঙ্গি সাহেবরা হাঁটা-পথে নৌকো-পথে যাকে দেখছে তাকেই ধরছে, ধরে ধরে সবাইকে তল্লাশি করছে। যার কাছে যা টাকাকড়ি আছে সব কেড়ে নিচ্ছে। একজন বেগমসাহেবাকেও নাকি ধরেছে।

চেহেল্‌-সুতুনের বেগমসাহেবা?

আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর। বেটাছেলের সাজপোশাক পরে যাচ্ছিল, তাকেও নাকি ধরে তল্লাশি করতে গিয়ে জানা গেছে তিনি চেহেলসূতুনের বেগমসাহেবা।

এরপর সব শুনে মহারাজ বললেন তুমি অতিথিশালায় গিয়ে থাকো আজকে, তোমার চিঠির জবাব নিয়ে যাবে রানিমার কাছ থেকে।

লোকটা চলে যাবার পর মহারাজ দেওয়ানমশাইকে বললেন–তোমার কী মনে হচ্ছে দেওয়ানশাই, কথাগুলো সত্যি?

আমার তো সত্যি বলেই মনে হচ্ছে।

মহারাজ বললেন–দেখো, সত্যি হলে সত্যিই হবে। কিন্তু সত্যি না-হলেই মঙ্গল।

 কেন?

 মনে হচ্ছে শেষপর্যন্ত এত টাকা উসুল হবে কার কাছ থেকে। কোটি কোটি টাকার ব্যাপার তো সহজে মিটবে না। হয়তো আমার ঘাড়েই এই সমস্ত দেনাটা বরাত দেবে।

তারপর উঠে দাঁড়ালেন। বললেন–তুমি শোও গে যাও দেওয়ানমশাই, আমার আর আজ ঘুম আসবে না। আমি চললুম

.

হয়তো রাত শেষ হতে আর বাকি ছিল না। দুর্গা ভোরবেলাই উঠেছে। ছোট বউরানি তখনও ঘুমোচ্ছিল। হঠাৎ দুর্গার ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল।

ও বউরানি ওঠো, ওঠো–বড় বউরানির চিঠি এসেছে গো।

 তাড়াতাড়ি ধড়মড় করে উঠেছে বউরানি। বললে–কোথায়? কার কাছে চিঠি এসেছে

দুর্গা বললে–শয়তান নবাবটা মরেছে গো, এখনই রানিমা বললে–

কোন শয়তান? কার কথা বলছিস? নবাব? মুর্শিদাবাদের নবাব?

দুর্গা বললে–হাতিয়াগড়ের লোক এসেছে চিঠি নিয়ে। জগা খাজাঞ্চিবাবু পাঠিয়েছে–

কে লোক? কে?

 দুর্গা বললে–তা জানিনে বউরানি, শুনছি হাতিয়াগড় থেকে বউরানির চিঠি নিয়ে এসেছে সেই কথাটা আমি তোমাকে বলতে এলাম আমি এখনই আবার যাচ্ছি দেখা করতে

রাজবাড়ির অতিথিশালায় তখন বেশ ভিড়। হাতিয়াগড়ের লোকটা রাত্রের অন্ধকারের মধ্যেই এসে ঢুকেছিল সেখানে। তখন কাউকেই দেখতে পায়নি। কিন্তু ভোরবেলাই দেখে, উদ্ধব দাস এক কোণে চুপ করে বসে আছে।

কাছে গিয়ে বললে–কী গো, দাসমশাই, তুমি? তুমি এখেনে কী করতে?

উদ্ধব দাসও চিনতে পেরেছে। বললে–গোকুল যে! তুমি কী করতে?

গোকুল বললে–আমি এসেছি রাজকার্যে। আর তুমি? তোমার শ্বশুর সেই শোভারাম, পাগল হয়ে গেছে শুনেছ তো? মেয়ের শোকে একেবারে মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। তা তোমার বউয়ের আর কোনও খবর পাওনি?

উদ্ধব দাস বললে–পেয়েছি। এখানেই আছে—

এখানে?

হ্যাঁ গো, অ্যাদ্দিন কলকাতায় সাহেবের বাগানবাড়িতে ছিল, সাহেব লড়াই করতে চলে যাবার পর এখানে এসে উঠেছে।

গোকুল অবাক হয়ে গেছে। বললে–এখানে? এই রাজবাড়িতে?

হ্যাঁ গো, হ্যাঁ, কতবার বলব তোমাকে? তুমি আজকাল কালা হয়েছ নাকি? কানেও শুনতে পাও না? তা ছোটমশাইয়ের হুকুম তামিল করো কী করে?

 গোকুল সেকথায় কান না দিয়ে বললে–তা বউ তোমার কী বলছে? সেদিন পালিয়ে গিয়েছিল কেন?

আরে, কথাই বলে না আমার সঙ্গে।

কথা বলে না? আচ্ছা, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেব। শোভারামের মেয়ে তো, ওকে আমি ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসছি। তোমার সঙ্গে কথা বলবে না কেন সে? তুমি কী অপরাধ করেছ?

উদ্ধব দাস বললে–আমি যে বাউন্ডুলে মানুষ, আমাকে কি পছন্দ হয় কারও?

তা না হয় না হল, কিন্তু তোমার সঙ্গে তো তার বিয়ে হয়েছে, তুমি তো তার সোয়ামি হলে?

 উদ্ধব দাস বললে–না না, জোর করে কি পিরিত হয়? না জোর করে হরিভক্তি হয়? এ তো জোর-জবরদস্তির ব্যাপার নয় গো। তার চেয়ে আমি গান বেঁধে ঘুরে বেড়াই, সে ঢের ভাল। সে সুখী হলে আমি আর কিছু চাইনে! সুখ বড় দুর্লভ বস্তু গো! ওই সুখ নিয়েই আমি একটা ছড়া বেঁধেছি, শুনবে নাকি?

গোকুল হেসে ফেললে। বললে–তোমার আর পাগলামি গেল না দেখছি। এখনও তুমি সেইরকম আছ দাসমশাই। পৃথিবীতে কত কী কাণ্ড হল, সব অদলবদল হয়ে গেল, তোমার কিন্তু বদল নেই

হঠাৎ সেরেস্তার একজন লোক এসে গোকুলকে ডেকে নিয়ে গেল ভেতরে। বললে–তোমাকে একবার দেওয়ানমশাই ডাকছেন–এসো

উদ্ধব দাসকে বসতে বলে গোকুল লোকটার সঙ্গে একেবারে দেওয়ানজির কাছারির ঘরে গিয়ে হাজির।

গোকুল যেতেই কাছারি-ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলেন কালীকৃষ্ণ সিংহ মশাই।

বললেন–রাত্রে কোনও অসুবিধে হয়নি তো? ঘুম হয়েছিল বেশ?

গোকুল বললে–হ্যাঁ হুজুর, কোনও কষ্ট হয়নি। অতিথিশালায় আমার চেনা লোক বেরিয়ে পড়ল, তার সঙ্গেই এতক্ষণ গল্প করছিলাম। সে বলছিল তার বউ নাকি রাজবাড়িতে লুকিয়ে আছে–

কে? কার কথা বলছ?

আজ্ঞে ওই যে দাসমশাই। ও তো আমাদের চেনা লোক, আমাদের হাতিয়াগড়ের অতিথিশালাতেও গিয়ে ওঠে কিনা–

ওকে তুমি তোমার কাজের কথা বলেছ নাকি? কী জন্যে তুমি এসেছ টেসেছ, এইসব?

আজ্ঞে না হুজুর, কিচ্ছু বলিনি!

আর ওর সঙ্গে দেখা কোরো না। তোমায় একটা কাজ করতে হবে। সেই জন্যেই ডেকেছি। কাউকে কিছু বলবে না, কারও সঙ্গে আর দেখা করবে না। তোমার থাকার জন্যে আমি আলাদা বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। তোমার বড় বউরানির হয়তো জানা নেই, তোমাদের ছোট বউরানি আমাদের এই রাজবাড়িতেই আছেন।

আমাদের ছোট বউরানি?

হ্যাঁ, তোমাদের ছোট বউরানি, যাকে খোঁজবার জন্যে তোমার ছোটমশাই এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করছেন।

তা হলে তার সঙ্গে একবার দেখা করে পেন্নাম করে আসি।

দেওয়ানমশাই বললেন না, এখন থাক, চারদিকে এখনও নবাবের চর ঘোরাগুরি করছে। তুমি বলছ বটে যে নবাব পালিয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের কাছে এখনও পাকাপাকি খবর কিছু আসেনি। ছোট বউরানি হাতিয়াগড়ে ফিরে যাবার জন্যে বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আমি লশকর-পেয়াদা-সেপাই সঙ্গে দেব, তুমি তাঁকে নিয়ে বড় বউরানির কাছে গিয়ে পৌঁছে দেবে–পারবে তো?

কেন পারব না আজ্ঞে?

তা হলে সেই কথাই রইল। নবাব যখন নেই তখন আর কোনও বিপদ-আপদ কিছু নেই। তবু সাবধানের মার নেই। তুমি এখন আমার সেরেস্তার লোকের সঙ্গে অন্দরে যাও। আর অতিথিশালায় যেতে হবে না। সেখানেই তোমায় যা খবর পাঠাবার তা পাঠাব। যাও–

দেওয়ানজিরও বোধহয় তখন অনেক কাজ ছিল। গোকুল সেরেস্তার লোকের সঙ্গে ভেতরবাড়িতে চলে গেল। ভেতরে যেতে যেতে গোকুলের মনে হল এ কত বড় রাজবাড়ি! কোথায় যে কে থাকে, কোথায় সদর কোথায় অন্দর কোথায় সেরেস্তা কোথায় অতিথিশালা, বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না।

তারপর আরও বেলা হল। সেরেস্তার কাছারিতে আরও লোকের ভিড় বাড়ল। অতিথিশালায় আরও কিছু নতুন লোক এসে ঢুকল। মুর্শিদাবাদে অত বড় কাণ্ড ঘটে গেছে, তার ঢেউ এসে লাগল কৃষ্ণনগরে, বর্ধমানে, নাটোরে, হুগলির ফৌজদারের দফতরে। সর্বত্র। সেই শেষরাত থেকেই মহারাজ আর ঘুমোতে পারেননি। মহারাজার লোক গেল মুর্শিদাবাদের উকিলের কাছে, বর্ধমানের মহারাজার কাছে, নাটোরের মহারানির কাছে, নবদ্বীপের বাচস্পতি মশাইয়ের কাছে।

শুধু উদ্ধব দাস বারকয়েক খোঁজ করলে গোকুলের। যাকেই দেখে তাকেই জিজ্ঞেস করলে–হ্যাঁগো প্রভু, গোকুল কোথায় গেল?

কে গোকুল?

ওই যে হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইয়ের নফর!

কিন্তু কে কার খবর রাখে অতিথিশালাতে!

বেলা যখন পড়ো পড়ো তখন একটা ঝালর-ঢাকা পালকি রাজবাড়ির খিড়কির দরজা দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল উত্তর দিকপানে। পালকিটা হাঁটা-পথে গিয়ে পৌঁছোবে শিবনিবাসের ঘাটের কাছে। সেখানে মহারাজার নিজের বজরা তৈরি থাকবে। তাতেই গিয়ে উঠবেন হাতিয়াগড়ের ছোট বউরানি আর দুর্গা। ওখান থেকে নৌকোয় উঠলে বিশেষ জানাজানি হবে না।

গোকুল আগে থেকেই সেই ঘাটে আর একটা নৌকোয় তৈরি হয়ে বসে ছিল। তঙ্গে পাইকবরকন্দাজ। তারা একেবারে হাতিয়াগড়ে বউরানিকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসবে।

গোকুলের হাতে একটা চিঠিও দিয়ে দিলেন দেওয়ানমশাই। চিঠিটা সিলমোহর করা। মহারাজার গৃহিণীর জবানিতে লেখা ছিল–আদার সনি শ্ৰীমতী রাসমণিকে আজ লোজন-পাইক পেয়াদা বরকন্দাজ সহ হাতিয়াগড়ে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিলাম। পৌঁছ সংবাদ দিবেন। কিন্তু আনার স্বামীর কোনও সন্ধান পাইনাই বলিয়া সে সম্বন্ধে কিছুই জানাইতে পারিলাম না। সন্ধানের ব্যবস্থা মহারাজ করিবেন বলিয়া স্থির করিয়াছেন। সন্ধান পাইলে যথাসত্বর জানাইব। ইতি

ছোট বউরানি আর দুর্গা অন্য বজরার ভেতর উঠতেই দুটো নৌকোই পাশাপাশি চলতে লাগল।

শুধু রাজবাড়িতে উদ্ধব দাস তখনও দু’-একজনকে জিজ্ঞেস করছে ওগো, ও প্রভু, আমাদের গোকুল কোথায় গেল গো?

কে গোকুল?

গোকুলকেই চিনতে পারে না তারা কেউ। তবুউদ্ধব দাসের মনে হতে লাগল গোকুল তো লোক ভাল। সে তো কথা দিয়ে কথা খেলাফ করবার লোক নয়। কিন্তু গেল কোথায়?

গোকুল যে কোথায় উধাও হয়ে গেল, শেষপর্যন্ত তা আর জানা হল না উদ্ধব দাসের।

হাতিয়াগড়ের ছোট বউরানিকে পাঠাবার সমস্ত বন্দোবস্ত করার পরেও কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। দেওয়ানমশাইকে পাঠিয়ে দিলেন মুর্শিদাবাদে। বললেন আপনি একবার নিজে যান মুর্শিদাবাদে। খবরাখবর সব জেনে আসুন–

কিন্তু দেওয়ানমশাই বেরিয়ে গিয়েও মাঝপথ থেকে ফিরে এলেন।

মহারাজ দেওয়ানমশাইয়ের ফিরে আসার খবর পেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বললেন–কী হল, ফিরে এলেন যে?

দেওয়ানমশাই বললেন–উকিলবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল রাস্তায়, তিনি নিজেই আসছিলেন আপনাকে খবরাখবর দিতে–তাই তার সঙ্গেই ফিরে এলাম। তিনি বললেন, মুর্শিদাবাদে হুলস্থুল কাণ্ড বেধে গেছে

কী রকম?

খানিক পরে সারদাবাবু নিজেই এলেন। সবিস্তারে সব বর্ণনা করলেন।

বললেন–ক্লাইভ সাহেবকে খুন করবার জন্য ষড়যন্ত্র করেছে রাজা দুর্লভরাম।

সেকী? খুন করবে? কেন?

দু’কোটি কুড়ি লক্ষ টাকা ক্লাইভসাহেব চেয়েছে বলে। টাকার কথায় জগৎশেঠজি পর্যন্ত চটে গেছেন। সবচেয়ে চটেছে দুর্লভরাম, মিরন আর খাদেম হোসেন। মিরজাফর সাহেবের ইচ্ছে ছিল টাকাটা দিয়ে দিতে। কিন্তু আর সবাই অরাজি।

আর নবাব পালিয়ে গেছে সেখবর সত্যি?

সত্যি বলেই তো আমি শুনেছি। তবে কোনও প্রমাণ পাইনি। রাস্তায় লোকজনের ভিড়, চকবাজারে সব দোকানপাট বন্ধ। সারাফত আলি বলে একজন গন্ধতেলের দোকানদার ছিল, তাকে দেখলাম কে খুন করে রাস্তার ওপর ফেলে রেখে গেছে। তারপর আরও সব খবর শুনলাম, সত্যি-মিথ্যে বিশ্বাস হয় না। নবাব নাকি নিজের মাকে টাকা চুরি করেছিল বলে গালে চড় মেরেছে। তারপর থেকে সমস্ত রাত খাজাঞ্চিখানার টাকা সকলকে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে ফিরিঙ্গিদের হাতে না পড়ে। ওদিকে ময়দাপুরে ক্লাইভসাহেব যাকে রাস্তায়-ঘাটে পাচ্ছে তাকেই ধরছে। তাদের কাছ থেকে টাকাকড়ি কেড়ে নিচ্ছে

কৃষ্ণচন্দ্র বললেন আমি জানতুম এরকম হবে।

তারপর জিজ্ঞেস করলেন কিন্তু নবাব যদি পালিয়েই থাকে তো কোথায় পালিয়েছে? কোথায় পালাতে পারে?

সারদাবাবু বললেন–তা কেউ বলতে পারছে না। কখন পালালও তা-ও কেউ জানে না। আসলে পালিয়েছে কিনা তারও তো ঠিক নেই। সবটাই তো আমার শোনা কথা। সমস্ত মুর্শিদাবাদ এখন নানারকম গুজবে ছেয়ে গেছে। আপনি এখনই একবার চলুন, আপনাকে নিয়ে যাবার জন্যেই এসেছি

কৃষ্ণচন্দ্রও বুঝলেন এসময়ে মুর্শিদাবাদে তার নিজের একবার যাওয়া উচিত। এ-সময়ে যদি কিছু ভুল পদক্ষেপ হয়ে যায় তো সে-ভুলের খেসারত তাঁকেও দিতে হবে।

তিনি উঠলেন। বললেন আমি এখনই রওনা হচ্ছি

*

আর সত্যিই সেদিন মুর্শিদাবাদে আইন-শৃঙ্খলা বলে বুঝি কিছুই ছিল না। মসনদ একদিনের জন্যে শূন্য হয়ে গেছে। নিজামত বন্ধ। কাছারি বন্ধ, খাজাঞ্চিখানা বন্ধ। কে হুকুম দেবে, কে হুকুম মানবে, তারও কিছু হদিশ নেই। যারা ফিরিঙ্গি ফৌজের ভয়ে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছে, তারা অনেকে রাস্তাতে ফিরিঙ্গি ফৌজের হাতে ধরা পড়েছে। তাদের যথাসর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে তারা। সেই ওয়াটস্ আর ওয়াল চলে যাবার পর থেকেই যেন গণ্ডগোলটা বাড়ল। জগৎশেঠজির বাড়ি থেকে মিরজাফর সাহেব চলে গেল। মিরন চলে গেল, দুর্লভরাম চলে গেল। একে একে সবাই চলে যাবার পর ছোটমশাই একলা বসে ছিল। শেষকালে একসময় জগৎশেঠজিও চলে গেলেন। রণজিৎ রায় মশাইও হোমশাইয়ের বন্দোবস্ত করে দিয়ে নিজের কাজে চলে গিয়েছিল। তারপর ভোরাত্রের দিকে খবর এসেছিল যে, নবাব নাকি চেহেল্‌-সুতুন ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছে।

আর বাড়ির ভেতরে থাকতে পারলে না ছোটমশাই। একবার গেল মতিঝিলের দিকে। রাস্তায় গিজগিজ করছে লোক। তারই সামনে মনসুরগঞ্জ হাবেলি। সেখানে মিরজাফর সাহেব উঠেছে। তার বাড়ির সামনে তখন পাহারা বসে গেছে।

আবার ফিরে এল ছোটমশাই। কী যে করবে বুঝতে পারলে না। চকবাজারে সেই খুশবু তেলের দোকানের সামনেও একবার গেল। সেই বুড়ো লোকটা তখনও সেই রাস্তার ওপরেই মরে পড়ে আছে।

ফিরে আসতেই জগৎশেঠজির সঙ্গে দেখা হল। বড় উত্তেজিত ভাব জগৎশেঠজির।

ছোটমশাই জিজ্ঞেস করলে কিছু খবর পেয়েছেন?

জগৎশেঠজি বললেন–পেয়েছি। কিন্তু বড় খারাপ খবর। মিরন, দুর্লভরাম, খাদেম হোসেন সবাই ঝগড়া বাধিয়ে বসেছে। নবাব কে হবে তাই নিয়ে ঝগড়া। এখন যদি ফৌজের লোকেরা খেপে গিয়ে এ-ওর বিরুদ্ধে লাগে তা হলেই সব গোলমাল হয়ে যাবে–ওদিকে মিরজাফরের জামাই আছে। মিরকাশিম, সেও এর মধ্যে জুটেছে

তা হলে আপনি কী করবেন ঠিক করেছেন?

কিছুই এখনও ঠিক করিনি। ভাবছি ক্লাইভকে একটা চিঠি লিখে দিই যে, তিনি যেন এখন এখানে না আসেন। কেউ-না-কেউ খুন করতে পারে তাকে।

 কিন্তু খুন করতে যাবে কেন ক্লাইভকে?

ক্ষমতার লড়াইয়ের জন্যে। ক্লাইভের হাতে নবাব করবার ক্ষমতা রয়েছে যে। ক্লাইভ যাকে মসনদে বসাবে সে-ই তো নবাব হবে কিনা।

ছোটমশাই বললে–কিন্তু যে-ইনবাব হোক, তার আগে আমার একটা ব্যবস্থা করে দিন, আমি আর এই গণ্ডগোলের মধ্যে মুর্শিদাবাদে থাকতে চাই না

আপনার কীসের ব্যবস্থা?

ছোটমশাই বললে–আপনাকে যে সেই বলেছিলাম আমার সহধর্মিণীর কথা। আমি গিয়েছিলাম সেই চকবাজারের সারাফত আলির দোকানে। সেখানে খুনোখুনি কাণ্ড দেখে ফিরে এসেছি। দেখলাম সারাফত আলিকে কে খুন করে রাস্তায় ফেলে রেখে দিয়ে গেছে

তারপর?

 তারপর শুনলাম মরিয়ম বেগম নাকি ওইসব গণ্ডগোল দেখে সোজা গিয়ে ঢুকেছে চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে। আমি একবার চেহেল্-সুতুনে গিয়ে মরিয়ম বেগমের সঙ্গে দেখা করতে চাই

চেহেল্-সুতুনে আপনি কী করে যাবেন? সেখানে কি বাইরের কাউকে ঢুকতে দেয়? তার ওপর আপনি পুরুষমানুষ।

ছোটমশাই বললে–এখন না হোক, রাত্তিরের দিকে

রাত্রের দিকেই বা আপনি যাবেন কী করে?

ছোটমশাই বললে–শুনেছি তো ঘুষ দিলে নাকি সবই সম্ভব হয় চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে। সবাই তো তাই-ই বলে! আর তা ছাড়া এখন তো নবাবই নেই। এখন কি আর অত কড়াকড়ি চলছে? ওই তো মতিঝিল থেকে সব খিদমদগার পালিয়েছে, একটা জনপ্রাণীও নেই মতিঝিলে।

জগৎশেঠজি খানিকক্ষণ কী যেন ভাবলেন। বললেন–আপনি ঠিক জানেন মরিয়ম বেগমই আপনার সহধর্মিণী?

ছোটমশাই বললে–আমার দৃঢ় ধারণা তাই।

জগৎশেঠজি বললেন–তা হলে দেওয়ান মশাইকে বলুন, উনি একটা কিছু ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন কিনা আপনার জন্যে

সত্যিই তখন জগৎশেঠজির মাথায় রাজ্যের ভাবনা। তিনি যে ওইটুকুই করেছেন তাই-ই যথেষ্ট। কিন্তু রণজিৎ রায় দেওয়ানজি সব ব্যবস্থা করে দিলেন। সন্ধে হবার পর লোক দিয়ে ছোটমশাইকে পাঠিয়ে দিলেন চেহেসতুনের ফটকে। সমস্ত অগোছালো ব্যবস্থা। রাস্তার টিমটিমে আলোগুলোও আজ জ্বলছে না। জ্বালাবার লোকই গরহাজির। ফটকের আলোলোও জ্বলেনি। খুব সাবধানে কাজ শেষ করতে হবে। কেউ যেন দেখতে না পায়। ঘুষ পেয়ে খোঁজাটার চোখ দুটো অন্ধকারের মধ্যেও জ্বলজ্বল করে উঠল।

তোমার নাম কী?

খোজা নজর মহম্মদ, হুজুর।

এই বাবুজিকে একবার মরিয়ম বেগমসাহেবার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে পারো?

মরিয়ম বেগমসাহেবার নাম শুনে কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল নজর মহম্মদ। বশির মিঞা খুব সাবধানে রাখতে বলে দিয়েছে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে। যদি শেষকালে কিছু গড়বড় হয়?

কিন্তু হাতের মুঠোর মধ্যে তখনও আসরফিটা ফুটছে তার। একবার একটু দ্বিধা করেই নজর মহম্মদ তখুনি বললে–আচ্ছা, আইয়ে হুজুর

তারপর বললে–জরা সামহালকে–

সত্যিই ভেতরটা অন্ধকার। সুড়ঙ্গের মতো রাস্তা। ছোট ঘোট ইটের গাঁথনি। এই পথ দিয়েই একদিন কান্ত ভয়ে ভয়ে মরালীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। আবার এই পথ দিয়েই আজ ছোটমশাই চোরের মতো পা টিপে টিপে চলেছে। হয়তো এইটেই নিয়ম। ইতিহাসের পথ হয়তো চেহেল্‌-সুতুনের মতোই এমনই অন্ধকার, এমনই রহস্যময়। ইতিহাসও বোধহয় এমনি করে নিঃশব্দে পা টিপেটিপে অস্পষ্ট পথে পা বাড়িয়ে দেয়। তারপর যখন কেউ টের পায় না, কেউ জানতেও পারে না, তখন গন্তব্যস্থানে পৌঁছে একদিন হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করে। তখন সবাই অবাক হয়ে যায়, সবাই চমকে ওঠে।

কান্তও চমকে উঠেছিল।

কে? কৌন?

খিড়কিবন্ধ ঘরের মধ্যেও নজর মহম্মদের গলাটা চিনতে পেরেছে কান্ত।

মরিয়ম বেগমসাহেবা, মরিয়ম বেগমসাহেবা।

কান্ত বুঝতে পারলে না জবাব দেওয়া ঠিক হবে কি না। এই সময়ে কেনই বা নজর মহম্মদ ডাকছে। তাকে তাও বুঝতে পারলে না।

আমি নজর মহম্মদ, বেগমসাহেবা।

কান্ত খিড়কির ভেতর থেকেই বলে–কী দরকার?

 নজর তেমনিই বাইরে থেকে বললে–একঠো বাত আছে বেগমসাহেবা, একবার খিড়কিটা খুলুন।

কী কথা আছে তোমার?

নজর মহম্মদ বললে–একবার মেহেরবানি করে খিড়কিটা খুলুন না

কান্ত ভাল করে বোরখা দিয়ে নিজের সর্বাঙ্গ ঢেকে নিয়ে দরজাটা খুলে দিলে।

*

হঠাৎ সেই অন্ধকার আবহাওয়া যেন অনেক মানুষের পায়ের শব্দে বিচলিত হয়ে উঠল। কয়েকদিন ধরেই চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে সমস্ত নিয়মকানুনকায়দা বেসামাল হয়ে পড়েছিল। নবাব যেদিন হঠাৎ এখানে এসে পড়েছিল, সেই দিন থেকেই। তারপর নজর মহম্মদের দল আর কোনও দিক সামলাতে পারছে না। যে সে এসে ঢুকে পড়ছে চেহেসতুনের ভেতরে। নবাব যে চেহেলসতুন ছেড়ে চলে গেছে, সে-খবরটাও আর চাপা থাকেনি।

পায়ের আওয়াজ পেতেই নজর মহম্মদ চমকে উঠেছে। আবার এখন কে এল?

খোজাসর্দার পিরালি খাঁ সাহেব কাল থেকেই হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। আসলে পিরালি খাঁ নয়, নানিবেগমসাহেবারই হুকুম। যে-সে এসে ঢুকে পড়বে ভেতরে–খুব হুঁশিয়ার সে রহনা পিরালি। কত মোহর, কত টাকা, কত জড়োয়া ছড়ানো আছে চারদিকে। এই সময়েই তো চুরি হয়ে যায় সব।

বাবুজি, আপনি একটু তফাত যান।

কেন? কী হল?

নজর মহম্মদ বললে–কার যেন পায়ের আওয়াজ শুনছি, হালচাল ভাল মালুম হচ্ছে না–

ছোটমশাই বললে–কোথায় তফাত যাব?

আপনি আসুন, আমার সঙ্গে আসুন।

 বলে ছোটমশাইকে নজর মহম্মদ একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললে–এইখানে থাকুন আপনি, আমি আপনাকে পরে ডেকে নিয়ে যাব

তখন আর সময় নেই। নজর মহম্মদ এক নিমেষের মধ্যে সোজা এসে আবার নিজের জায়গায় দাঁড়িয়েছে। তার আগে মরিয়ম বেগমসাহেবার ঘরের দরজাটা বন্ধ করতে বলে দিয়ে সাবধান হয়ে নিলে। আবার কি তবে নবাব ফিরে এল নাকি?

সামনে সামনে আসছিল পিরালি খাঁ। আর পেছনে আরও কয়েকজন। ভারী ভারী পায়ের আওয়াজ। সার আবার কাদের নিয়ে এল এখন।

কিন্তু গলার শব্দেই চেনা গেল মেহেদি নেসার সাহেব। আরও একটু কাছে আসতেই অন্য লোকদেরও চেনা গেল। মেহেদি নেসারের সঙ্গে আছে ডিহিদার রেজা আলি সাহেব। তার সঙ্গে বশির মিঞা। নজর মহম্মদ মাথা হেলিয়ে সেলাম করলে সকলকে।

মেহেদি নেসার জিজ্ঞেস করলে–এ কে?

 হুজুর, এ আমার শাগরেদ, খোজা নজর মহম্মদ!

 মেহেদি নেসার সাহেব তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে দেখলে নজর মহম্মদকে। ভাল করে দেখা গেল না অন্ধকারে। কিন্তু তা হোক, তবু হুঁশিয়ার করে দিলে।

বললে–তোমার শাগরেদকে হুশিয়ার করে দিয়েছ তো পিরালি। খুব হুঁশিয়ার থাকে যেন।

তারপর আরও অনেক কথা বললে। সব কথাগুলোর সারমর্ম এই যে, এখন চারদিকে অরাজক শুরু হয়ে গেছে। এই সময়ে যেন ভাল করে চেহেল্‌-সুতুনে পাহারা দেয় তারা। বাইরের কোনও আদমি যেন ভেতরে না ঢোকে। নবাব বেপাত্তা, সুতরাং নবাবের দুশমনরা নানান ছুতোয় ভেতরে এসে ঢুকবে। কেউ আসবে চেহেল্‌-সুতুনের বেগমদের লোভে, কেউ আসবে টাকাকড়ি-দৌলতের লোভ। দুনিয়ার যত মতলববাজ মানুষের এই হচ্ছে ফুরসত। এই সময়ে চুরি-রাহাজানি-বাটপাড়ি চলছে শহরে। শহরময় খুনখারাপি হচ্ছে। সেই জের চেহেল্‌-সুতুনের অন্দরেও আসতে পারে!

বলতে বলতে মেহেদি নেসার সাহেব এগিয়ে যেতে লাগল আরও ভেতরের দিকে।

ডিহিদার রেজা আলি সাহেব বললে–জনাব, আর সেই মরিয়ম বেগমসাহেবা, যার কথা আমি বলেছিলাম জনাবকে?

মেহেদি নেসার সাহেব বললে–তাকে আমি নজরবন্দি করে রেখেছি। পিরালি, বেগমসাহেবরা যেন কেউ না পালায়!

না হুজুর, আমার খোজারা নজর রাখছে

আর ঘসেটি বেগমসাহেবার দিকেও নজর রাখবে। পেশমন বেগম, তক্কি বেগম, বব্বু বেগম, গুলসন বেগম, যত বেগম আছে, সকলের দিকে নজর রাখবে। আমিনা বেগমসাহেবা কোথায়?মালখানার চাবি খুলতে গিয়েছিল আমিনা বেগমসাহেবা, সেই আমিনা বেগমসাহেবাকে দেখেছ তো?

জি হুজুর। নানিবেগমসাহেবা তাকে খুব কড়া হুকুম দিয়েছে। নিজের কাছে মালখানার চাবি রেখে দিয়েছে।

খুব হুঁশিয়ার, আমি আজকে মালখানায় তালার ওপর তালা লাগিয়ে যাব। চলো–

বলে আরও সামনে এগিয়ে যেতে লাগল। পিরালি খাঁ শশব্যস্ত হয়ে চলতে লাগল। পেছনে ডিহিদার রেজা আলি, বশির মিঞা, তারাও চলেছে। নজর মহম্মদের ভয় করতে লাগল। মালখানার তালার ওপর তালা লাগিয়ে দেবে মেহেদি নেসার সাহেব। কিন্তু নানিবেগমসাহেবা যদি বাধা দেয়।

ভেতরে পেশমন বেগমসাহেবার ঘরের অন্দরে তখন আলো জ্বলছিল। মেহেদি নেসার সাহেব এমন করে বুক ফুলিয়ে কখনও চেহেল্-সুতুনের ভেতরে চলে না। যখন আসে তখন নানিবেগমসাহেবার ভয়ে নরম হয়ে মাথা নিচু করে আসে। কিন্তু আজ নবাব নেই, তাই বেপরোয়া হয়ে গেছে নেসার সাহেব।

পিরালি খাঁ মালখানার বাইরের তালা খুলে দিতেই মেহেদি নেসার, ডিহিদার রেজা আলি, বশির মিঞা সবাই ভেতরে ঢুকল।

হঠাৎ নানিবেগমসাহেবার গলা শোনা গেল। সর্বনাশ, কেউ হয়তো নানিবেগমসাহেবাকে খবর দিয়ে দিয়েছে। দৌড়াতে দৌড়োতে একেবারে সামনে এসে হাজির হয়েছে নানিবেগমসাহেবা।

কৌন? মেহেদি নেসার? তুমি? ক্যা কর রাহা হ্যায়?

মেহেদি নেসার কিন্তু অন্যবারের মতো দমল না নানিবেগমসাহেবাকে দেখে। বললে–মালখানায় তালা লাগিয়ে দিচ্ছি নানিবেগমসাহেবা।

আশ্চর্য, নজর মহম্মদ আজ নানিবেগমসাহেবাকে কুর্নিশ পর্যন্ত করলে না।

 লেকন, চেহেল্‌-সুতুনের মালখানায় তালা লাগাবার তুমি কে?

মেহেদি নেসার তেমনি গম্ভীর গলাতেই জবাব দিলে শুধু চেহেল্‌-সুতুন নয় নানিবেগমসাহেবা, তামাম নিজামতের মালিক এখন আমরা।

মালিক তোমরা? তোমরা?

নবাব চেহেল্‌-সুতুন ছেড়ে চলে গেছে, এখন নিজামতের সবকিছুর জিম্মাদার আমরা।

আমরা মানে কারা?

মেহেদি নেসার বললে–আমরা মানে নবাবের যত আমির-ওমরা, তারা।

নানিবেগমসাহেবা গলা চড়িয়ে দিলে খবরদার, যতক্ষণ আমি জিন্দা আছি ততক্ষণ আমির-ওমরা কেউ কিছু নয়, মনে রেখো নেসার, আমি এখনও বেঁচে আছি। আমি যতক্ষণ আছি এখানে, ততক্ষণ কেউ মালখানায় হাত দিতে পারবে না। চেহেল্‌-সুতুনের দৌলত আমার দৌলত, আমিই সবকিছুর জিম্মাদার–

নজর মহম্মদ দেখলে ব্যাপার অনেক দূর গড়াবে। এ সহজে মেটবার নয়। তাড়াতাড়ি আবার ছোটমশাইয়ের কাছে ফিরে এল–বাবুজি, বাবুজি

ছোটমশাই এতক্ষণ অন্ধকারের মধ্যে চুপ করে বসে ছিল। শেষকালে কি এমনি করে নিজেরও বিপদ ঘটাবে, ছোট বউরানিরও বিপদ ঘটিয়ে দেবে!

বাবুজি, আপনি বেরিয়ে যান, সব গড়বড় হয়ে গেছে।

কিন্তু মরিয়ম বেগম? মরিয়ম বেগমসাহেবার কী হবে?

কিছু হবে না বাবুজি। বেগমসাহেবাদের কারও সঙ্গে আর মুলাকাত করা যাবে না। মেহেদি নেসার সাহেব কড়া হুকুম জারি করে দিয়েছে।

মেহেদি নেসার সাহেব? মেহেদি নেসার সাহেব অন্দরে এসেছে নাকি?

জি, বড় জবরদস্ত ওমরাহ মেহেদি নেসার সাহেব।

ছোটমশাইয়ের যেন একটু আশা হল। মেহেদি নেসার তো জগৎশেঠজির দলে। জগৎশেঠজি একটু চেষ্টা করলেই তো তা হলে ছোট বউরানিকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়!

বাবুজি, আপনাকে আমি বাইরে নিয়ে যাচ্ছি, চলুন–আর দেরি করবেন না, চলুনচলুন–

ছোটমশাইকে কোনওরকমে তাড়াতাড়ি বাইরে বার করে দিয়ে এসেই আবার নজর মহম্মদ মালখানার সামনে হাজির হল। মালখানার সামনে তখন নানিবেগমসাহেবার সঙ্গে নেসার সাহেবের তুমুল তকরার চলেছে। মেহেদি নেসারের গলা যেন অন্যদিনের চেয়ে আরও বেশি চড়েছে। নবাব নেই বলে তার যেন ভয়ও নেই আগেকার মতো।

নানিবেগম বলছে–কে বললে–এসব টাকাকড়ি মির্জার? এসব আমার! আমিই চেহেলসুতুনের নানিবেগম। দেখি কী করে তুমি আমার মালখানায় তালা দাও–

আমি তালা দেবই, আপনি সরুন নানিবেগমসাহেবা, আমি মিরজাফর সাহেবের মঞ্জুরি নিয়ে এসেছি।

রেখে দাও তোমার মিরজাফরসাহেব! ঢের ঢের অমন মিরজাফরসাহেব দেখেছি। তাকে ডেকে নিয়ে এসো দিকি আমার কাছে! দেখি তার কেমন মুরোদ।

মেহেদি নেসার সাহেব একটু যেন দ্বিধা করতে লাগল। তারপর বললে–তা হলে আপনি তালা লাগাতে দেবেন না?

নানিবেগম বললে–না।

এই আপনার শেষ কথা?

হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি তো বলে দিয়েছি এই আমার শেষ কথা।

কিন্তু এর ফল ভাল হবে না নানিবেগমসাহেবা।

তার মানে?

মানে কালকেই বুঝতে পারবেন।

সমস্ত চেহেল্ সুতুনটা যেন গমগম করে উঠল মেহেদি নেসার সাহেবের গলার আওয়াজে। চেহেল সুতুনের আনাচেকানাচে যে-যেখানে ছিল সবাই ততক্ষণে এসে হাজির হয়েছে কাছাকাছি। সবাই এমনই একটা ঘটনার ভয়ই করছিল কাল থেকে। সবাই ভাবছিল একটা কিছু ঘটবে! এ যেন তারই পূর্বাভাস। নজর মহম্মদ কাঠ হয়ে শুনছিল সমস্ত, দেখছিল সমস্ত

হঠাৎ নানিবেগমসাহেবা ফেটে চৌচির হয়ে গেল বেরিয়ে যাও তুমি এখান থেকে বেরিয়ে যাও

মেহেদি নেসারও হটবার পাত্র নয়। বললে–কে বেরিয়ে যায় সেইটেই দেখতে হবে। আমি না আপনি?

কেন আমি বেরিয়ে যাব? আমার চেহে সুতুন, আমি এখানে থাকব। কে আমাকে এখান থেকে তাড়াতে পারে দেখি? কার এত হিম্মত!

মেহেদি নেসার বললে–ঠিক আছে, কালই এর প্রমাণ হবে, এ চেহেল্‌-সুতুন কার। কালই আপনাকে মিরজাফর আলি সাহেবের হাতে-পায়ে ধরতে হবে। তখন বোঝা যাবে!

বলে মেহেদি নেসার সাহেব চলে গেল বাইরের দিকে। পেছন পেছন ডিহিদার রেজা আলি আর বশির মিঞা, তারাও চলে গেল।

*

পাওয়া আর না-পাওয়ার মধ্যে যতখানি ব্যবধান, সুখ আর দুঃখের মধ্যে ততখানি ব্যবধান কি আছে? পাওয়ায় যদি সুখ কিছু থাকে, তার অনেকখানি অংশ না-পাওয়ার মধ্যে ছড়িয়ে থাকে। আমি তোমাকে পেলাম, কিন্তু তোমাকে পাওয়া আমার ফুরিয়ে গেল না, তবেই তো আসল পাওয়া। নদী যেমন সমুদ্রকে পায়, সে পাওয়া তার ফুরিয়ে যায় না বলেই তার পাওয়া শেষ হয় না। সে কেবল সমুদ্রকে পেতেই থাকে। প্রতি দিন প্রতি রাত্রে প্রতি মূহুর্তে পেতে থাকে। সে-পাওয়াই তো সার্থক পাওয়া।

কান্ত সেই অন্ধকার চেহেল্‌-সুতুনের বন্ধ মহলের মধ্যে কেবল নিজের মনেই বলতে লাগল–তোমাকে নাই বা পেলাম মরালী, কিন্তু তোমাকে পাইনি বলেই তো এমন করে প্রতি মুহূর্তে তোমাকে পাচ্ছি। এই পাওয়াই তো আমার না-পাওয়ার চেয়ে বড় পাওয়া। তুমি যত দূরেই থাকো, যেখানে যেমন ভাবেই থাকো, আসলে তুমি আমার কাছে রয়েছ। যখন আমি থাকব না, তখনও তুমি আমার কাছে। কাছে থাকবে। তখন আমি তোমাকে পেয়েও পাব, হারিয়েও পাব। আমার জীবনে তুমি সব পাওয়া না-পাওয়ার উর্ধ্বে, সব চাওয়া-না-চাওয়ার বাইরে এক পরম পাওয়া হয়ে রইলে। আমার এই দেহ একদিন ধ্বংস হবে, আমার এই অস্থি-মাংস-মজ্জা একদিন নিশ্চিহ্ন হবে, কিন্তু সেদিনও তুমি আমার নিজের হয়েই থাকবে। তুমি আমার হতে চাও আর না-চাও, আমি তা নিয়ে মাথা ঘামাব না; তুমি আমার আর আমি তোমার, এই স্বপ্ন নিয়েই তোমার সঙ্গে আমি একাকার হব। এই-ই তো ভাল মরালী!

ওধারে চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে হঠাৎ যেন কীসের একটা গোলমাল উঠল।

চেহেল্‌-সুতুনের মধ্যে অমন গোলমাল হয়ই। কান্ত এই চেহেল্‌-সুতুনে অনেকবার এসেছে, এমন গোলমাল অনেকবার শুনেছে। কে যে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তা ভাবার আর দরকার নেই। খাটের ওপর শুয়ে শুয়ে চোখ বুজে শুধু মরালীর কথাই ভাবতে ভাল লাগল কান্তর। বাইরে যখন ইতিহাসের মোড় ফিরছে, তখন একজন পুরুষের এ-চিন্তার কোনও দাম নেই তাও কান্ত জানে। সে। জানে নবাব হয়তো এতক্ষণ মসনদ ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে, হয়তো ফিরিঙ্গি ফৌজ এসে যাবে এখনই। সে জানে তার আগেই হয়তো কেউ এসে তাকে কোতল করবে। শুধু তাকে একলা নয়, এই সমস্ত বেগমকেই হয়তো কোতল করবে। কিন্তু এও তো এক সান্ত্বনা যে তারা মরিয়ম বেগমকে কেউ খুঁজে পাবে না, মরালীকে কেউ খুঁজে পাবে না। মরালী যদি নিরাপদে থাকে তো আর যেখানে যা-কিছু হয় তোক। তুমি আরও দূরে চলে যাও মরালী, আরও অনেক দূরে। তুমি যত দূরে চলে যাবে, তত আমি তোমাকে কাছে পাব।

গোলমালটা যেন হঠাৎ সামনে এল। তারপর মনে হল যেন মেহেদি নেসার সাহেবের গলা, ডিহিদার রেজা আলির গলা। এখন বশির মিঞার গলাও কানে এল। হয়তো মুর্শিদাবাদের শহরের ভেতরে বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে। হয়তো লুঠপাট আরম্ভ হয়েছে চেহেল্‌-সুতুনে।

তা হোক, তা নিয়ে কান্তর কিছু ভাবনা করবার দরকার নেই। কান্ত চোখ বুজে স্বপ্ন দেখতে লাগল। স্বপ্ন দেখতে লাগল, মালদা থেকে রাজমহল; রাজমহল পেরিয়ে পদ্মা; পদ্মা পেরিয়ে সমুদ্র। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই শুধু জল আর জল। আরও এগিয়ে যাও মরালী, আরও দূরে চলে যাও। তুমি দূরে চলে গেলে তবে আমি তোমাকে কাছাকাছি পাব। আরও দূরে চলে যাও, নৌকো থামিয়ো না

কিন্তু কান্ত সেদিন জানত না রাজমহলের দিকেই ঠিক আর একটা বজরা যাচ্ছিল। বজরার ভেতর আর একটা মানুষ ঠিক কান্তর মতোই অমনি করে ভাবছিল ওই কথাগুলোই। আরও দূরে চলো, আরও দূরে। যেখানে কেউ আমাকে চিনতে পারবে না, সেই দিকে চলো।

যে-মানুষটা একদিন ঘুমের জন্যে মাথা খুঁড়ে মরেছে, সেই মানুষটাই আবার সে-দিন চোখ দুটো খুলে সামনের অন্ধকার জলের দিকে চেয়ে ঠায় বসে ছিল এক ভাবে। কোথায় রইল মতিঝিল, কোথায় রইল মনসুরগঞ্জ, আর কোথায় বা রইল তার চেহেল সুতুন। এমনি করেই একদিন সবাইকে সব ছেড়ে চলে যেতে হয়। তেমন যাওয়া তো একদিন যেতেই হবে, তবে দুঃখ কেন? মসনদের জন্যে? লক্কাবাগের সেই খিদমদগারটা সেদিন খুব বেত খেয়েছিল নবাবের সোনার কলকে চুরি করার জন্যে। আসবার সময় তাকে সামনে পেলে মসনদও দিয়ে দিত মির্জা মহম্মদ। বলত–নে, আমার সোনার কলকেটা তো ছোট জিনিস, আমার মসনদটা পারিস তো নিয়ে নে।

কী ভাবছ?

লুৎফা এমনিতে কথা বলে না বেশি। ছোট মেয়েটাকে নিয়ে ঘুমোচ্ছে পাশেই। জানে না তো যে, নবাবের সঙ্গে বিয়ে না হলে তাকে এমন করে চোরের মতো চেহেল্‌-সুতুন ছেড়ে পালাতে হত না। নবাবের অসংখ্য প্রজাদের মধ্যেই যদি কারও বউ হত লুৎফা তো তা হলেও এত দুর্ভোগ সহ্য করতে হত না।

ঘুমোবে না?

তোমাকে আমি আসবার সময় কোনও খবর দিয়ে এলাম না মরিয়ম বেগমসাহেবা। ইচ্ছে করেই খবর দিলাম না। আমার পরে যারা চেহেলসূতুনে আসবে তারা হয়তো দয়া করে তোমার স্বামীর কাছে তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসবে, কিংবা হয়তো তোমাকে জারিয়া করে রাখবে। তোমাকে দিয়ে তারা তাদের পা টেপাবে। তোমাকে দিয়ে বাঁদির কাজ করাবে। তা হোক, তবু এর চেয়ে সে অনেক ভাল বেগমসাহেবা। তোমাদের সেই কাফের সাধুর গানটা আমার মনে পড়ছে কেবল, জানো! আমি কোথায় ছিলাম, কোথায় এলাম, কোথায় যাব নেই ঠিকানা। সত্যি, আমার সঙ্গে এলে তুমি অনেক কষ্টে পড়তে। কাল আমরা কোথায় থাকব, কী খাব, তারই ঠিক নেই। আমার জন্যে তুমি কেন কষ্ট করবে মরিয়ম বেগমসাহেবা। তুমি আমার কে? আসলে তুমি তো আমার কেউ নও!

রাত ভোর হয়ে এল, একটু ঘুমিয়ে নাও না।

মির্জা বললে–তুমি ঘুমোও, আমি জেগে থাকি

দুদিন ধরে তো জেগেই আছ, শরীর খারাপ হবে যে না ঘুমোলে

শরীরের কথা ভাববার আমার সময় নেই এখন। তুমি ঘুমোচ্ছ, ঘুমোও

লুৎফা বললে–তুমি না ঘুমোলে আমি কেমন করে ঘুমোই?

তা হলে ঘুমিও না। কে তোমাকে ঘুমোতে বলছে? আর কে-ই বা তোমাকে এত কষ্ট করে আমার সঙ্গে আসতে বলেছিল? তোমরা সঙ্গে না এলে তো আমি আরও ভাল করে জাগতে পারতুম।

লুৎফা চুপ করে রইল।

 মির্জা মহম্মদ বললে–কাঁদছ? হ্যাঁ, খুব ভাল করে কাদো, খুব ভাল করে আমাকে জ্বালাও। এমন করে আমাকে না জ্বালালে আমার বউ হয়েছিলে কেন? খুব কাদো, খুব জোরে গলা ছেড়ে কাদো। লোকে যাতে জানতে পারে যেনবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা মুর্শিদাবাদ ছেড়ে পালাচ্ছে, জানতে পেরে যাতে সবাই চারদিক থেকে এসে গ্রেফতার করে সেই ব্যবস্থা করো–

তারপর একটু থেমে নিজের মনেই বলতে লাগল–মানুষের কাছে আমি অপরাধ করেছি, আল্লার কাছেও আমি অপরাধ করেছি, আমার শাস্তি হবে না তো কার হবে? পৃথিবীতে জন্মানোই আমার অপরাধ হয়েছে। কিন্তু আমি কী করব বলো? আমি কি এমন করে পালিয়ে আসতুম? জেনারেল ল’ সাহেবকে দশ হাজার টাকা পাঠালুম, এখনও পর্যন্ত এসে হাজির হল না। ল’ সাহেব এলে কি এমন করে চোরের মতো পালাতে হত আমায়? মিরজাফর, দুর্লভরাম, ইয়ার লুৎফ খাঁ যতই নিমকহারামি করুক, আমার একদিকে মোহনলাল আর একদিকে ল’ সাহেব থাকলেই আমি ফিরিঙ্গি বাচ্চাদের দেখিয়ে দিতুম!

তারপর হঠাৎ লুৎফার দিকে চেয়ে বললে–তুমি কিছু বলছিলে?

 লুৎফা কোনও উত্তর দিলে না।

কই, তুমি কিছু কথা বলছ না যে?

তবু লুৎফা কিছু জবাব দিলে না।

 কিছু কথা বলো! কিছু কথা বলেও তো উপকার করতে পারো আমার? সেটুকুও তোমার দ্বারা হবে? তা হলে কেন আসতে গেলে আমার সঙ্গে? শুধু ঘাড়ের ওপরে বোঝা হবার জন্যে?

লুৎফার রাগ-অভিমান-অনুরাগ কিছুই যেন থাকতে নেই।

ঠিক আছে, কথা বোলো না। আমি একাই কথা বলব। আমার আমির নেই ওমরাহ নেই, আমার মসনদ নেই, সনদ নেই, আমার উজির, খিদমদগার, বাঁদি, বেগম, বন্ধু কেউই নেই। আমি দুনিয়ায় একলা এসেছি, একলাই থাকব। কারও ভালবাসারও দরকার নেই আমার। এরপর যদি আমি মারা যাই তো কেউ যেন না কাঁদে। কারও কাদবার অধিকার নেই আমার মরার পর, এই আমি বলে রাখলুম।

হঠাৎ লুৎফা নবাবের মুখে হাত চাপা দিলে।

তুমি যে কী! তোমার মুখে কি কিছুই আটকায় না?

পেছন থেকে হঠাৎ বাধা পড়ল। বুড়ো মাঝি বললে–হুজুর, রাজমহলে এসে গিয়েছি—

রাজমহল। ভালই হয়েছে। এখান থেকে সোজা আজিমাবাদে যাওয়ার রাস্তা। জেনারেল লর এইদিক দিয়েই আসবার কথা। দশ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে তাকে পূর্ণিয়ায় ফৌজদারের হাত দিয়ে। এলে এই পথেই দেখা হবে।

মির্জা মহম্মদ বললে–এইখানেই নৌকো বাঁধো বুড়ো মিঞা

লুৎফাও উঠে পড়েছিল। মির্জা মহম্মদ বললে–দেখো, হয়তো এখানে তোমার মেয়ের জন্যে দুধ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু খুব সাবধান। যেন জানতে না পারে কেউ আমাদের। যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে তো কী বলবে?

লুৎফা বললে–বলব আমরা পলাশপুরের লোক, আজিমবাদে ফকির সাহেবের দরগায় যাচ্ছি। দোয়া নিতে।

বাইরে তখন অল্প অল্প সকাল হয়েছে। ঘাটে তখন আর একটা বজরা বাঁধা রয়েছে। সে-নৌকোর ভেতরে দুর্গা তখন ঘুম থেকে উঠেছে। আর একটা নৌকো এসে লাগতেই দুর্গা ছোট বউরানিকে ডাকলে।

ও ছোট বউরানি, ওই দেখো, কাদের আবার একটা নৌকো এসে লাগল।

কাদের?

দুর্গা বললে–কে জানে কাদের! মনে হচ্ছে মোছলমানদের

ছোট বউরানিও চেয়ে দেখলে জানালা দিয়ে।

বউটা খুব সুন্দর, না রে দুর্গা? ওমা, একটা ছোট মেয়েও রয়েছে সঙ্গে। কোথায় যাচ্ছে বল তো?

মাঝিকে ডেকে দুর্গা জিজ্ঞেস করলে–হ্যাগো বাছা, ওরা কারা এল গো?

মাঝিটা বললে–ওরা পলাশপুরের লোক, আজিমবাদে ফকির সাহেবের দরগায় দোয়া নিতে যাচ্ছে। মোছলমান মা ওরা

ও, তাই বলো!

তারপর চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। বউটা সুন্দরী বটে। পায়ের গোড়ালিটা একেবারে দুধে-আলতায় ধপধপ করছে। সঙ্গের বেটাছেলেটার চেহারাও বেশ। মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বউটা স্বামীর সঙ্গে ডাঙায় উঠল।

*

ক্লাইভ সাহেব বাইরে আসতেই মুনশি নবকৃষ্ণ বললেও কে, হুজুর?

ক্লাইভ সাহেব বললে–সে তোমার জেনে দরকার নেই মুনশি, তুমি এখন যাও এখান থেকে

নবকৃষ্ণ বুঝতে পারলে ব্যাপারটা। আস্তে আস্তে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল। তারপর সাহেব অর্ডার্লিকে ডাকলে। বললে–ওই যে বুড়োমতন একটা লোককে ধরা হয়েছে, ওর নাম ইব্রাহিম খাঁ, ওকে ছেড়ে দিতে বল।

অর্ডার্লি চলে যাচ্ছিল, ক্লাইভ সাহেব আবার ডাকলে–শোন, আরময়দপুরে যদি কোনও ততির বাড়ি থাকে, সেখান থেকে দু’চারটে শাড়ি কিনে আনতে বলে দে। বেশ ভাল কোয়ালিটির শাড়ি, খুব তাড়াতাড়ি যা

ক্লাইভ সাহেব ঘরের ভেতরে এল আবার। মরালী তখনও তেমনি করে দাঁড়িয়েই আছে।

সাহেব বললে–তারপর?

মরালী বললে–আমি তো আপনাকে সব কথাই বললুম। এখন আপনার যা ইচ্ছে তাই করুন। ওই ইব্রাহিম খাঁ না থাকলে আমি হয়তো চেহেলসুতুন থেকে পালাতেই পারতুম না। কিন্তু মরিয়ম বেগম সেজে সেই কান্ত এখনও সেই চেহেল্-সুতুনেই হয়তো আছে। আমার ইচ্ছে আপনি তাকে উদ্ধার করে আনুন।

কিন্তু মুর্শিদাবাদে যেতে তো আমার দেরি হবে।

 কেন?

 জগৎশেঠজি আমাকে চিঠি দিয়েছে যে কয়েকজন আমাকে খুন করবার মতলব করেছে। আমি স্পাই লাগিয়েছি, তারা কী খবর দেয় তাই জানবার জন্যে এখানে কিছুদিন থাকব ঠিক করেছি। আমি তোমার জন্যে এখানকার তাঁতিদের বাড়ি থেকে শাড়ি কিনে আনতে বলেছি, তোমার কিছু ভাবনা নেই।

কিন্তু কেউ যদি আমাকে চিনতে পারে? চিনতে পারলে যে সবাই ছিঁড়ে খাবে–

ক্লাইভ সাহেব বললে–সে-ভয় তোমার নেই। আমার নাম রবার্ট ক্লাইভ।

মরালী ভাল করে চেয়ে দেখলে। আগের বারে যখন বাগবাজারে পেরিন সাহেবের বাগানে দেখেছিল তখন অন্য চোখ ছিল মরালীর। এখন এতদিন পরে মরালীর চোখও বদলে গেছে, ক্লাইভ সাহেবের চোখও বদলে গেছে। ক্লাইভ সাহেবও আজ যেমরিয়ম বেগমকে দেখছে এ সে মরিয়ম বেগম নয়।

ক্লাইভ বললে–লড়াইতে যারা ধরা পড়ে তাদের কী করা হয় তা জানেন তো বেগমসাহেবা?

আপনারা তো আমাকে বন্দিই করেছেন।

হ্যাঁ, বন্দিই করেছি। তবু আপনি বেগমসাহেবা বলে আপনার জন্যে আমি শাড়ি সালোয়ার কামিজ যা পাওয়া যায় আনতে হুকুম দিয়েছি। আপনার কথায় আমি আপনার সঙ্গের লোকটাকেও ছেড়ে দেবার হুকুম দিয়েছি।

তার জন্যে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার জন্যে তো আমি ভাবছি না। আমার যা হয় হোক, আমাকে আপনি খুশি হলে ফাঁসিও দিতে পারেন, আমার কোনও ক্ষোভ থাকবে না। কিন্তু চেহেল্‌-সুতুনের মরিয়ম বেগমকে আপনি দয়া করে উদ্ধার করে আনুন

ক্লাইভ অবাক হয়ে গেল।

মরিয়ম বেগম? আপনি নিজেই তো মরিয়ম বেগম, চেহেল্‌-সুতুনে কি আরও একজন মরিয়ম বেগম আছে?

হ্যাঁ!

আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে আপনি আবার সেবারের মতো আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছেন। কিন্তু বেগমসাহেবা, আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, আপনার যদি মনে হয়ে থাকে যে মেয়েদের ওপর আমার উইকনেস আছে, তা হলে আপনি ভুল করেছেন। আমি যেমন নরম হতে পারি তেমনি আবার পাথরের মতো শক্তও হতে পারি। আমি যদি এখনই হুকুম করি তো আমার সোলজাররা। এখনই আমার চোখের সামনে আপনার মাংস ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে খাবে, আমার তাতে কোনও কষ্ট হবে না। তাই চান আপনি?

মরালী চুপ করে রইল।

পেছনে আর্দালিটা বাইরে থেকে ডেকে শাড়িগুলো এনে দিলে। ক্লাইভ শাড়ি নিয়ে বললে–আপনি এটা পরুন, আমি আবার আসব। কিন্তু খবরদার, পালাবার চেষ্টা করবেন না। তাতে আদারই ক্ষতি হবে।

বলে বাইরে এসে মেজর কিলপ্যাট্রিককে ডেকে পাঠালে। বললে–মুর্শিদাবাদে ওয়ালসকে পাঠাও–সে যেন খবর নিয়ে আসে মুর্শিদাবাদের নবাবের হারেমের ভেতরে মরিয়ম বেগম বলে কোনও বেগম আছে কিনা

*

শুধু তো বাংলা মুলুকের মসনদ নয়। একটা দেশের উত্থান-পতনের সঙ্গে সে-দেশের প্রত্যেকটি মানুষের সমস্যাও যে জড়িয়ে থাকে তা ক্লাইভ সাহেবের জানা ছিল। ওই যারা নদীতে নৌকো চালায়, যারা খেতমজুরি করে, যারা তাঁতে কাপড় বোনে, যারা বাড়ি-ঘর বানায়, গোরুর গাড়ি চালায়, তাদের সকলের সমস্যার সঙ্গে নবাবের স্বার্থ, কোম্পানির স্বার্থ, ক্লাইভের স্বার্থ জড়িয়ে আছে।

ওয়ালস্ জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু সেবেগম নবাবের কে?

 নবাবের নিজের উওম্যান।

কিন্তু নবাব তো পালিয়ে গেছে। নবাব যখন পালিয়ে গেছে তখন নবাবের উওম্যানদের নিয়ে আমাদের কী দরকার? তারা তো সবাই নেটিভ মেয়েমানুষ। ইউরোপিয়ান বেগম কেউ আছে নাকি?

ক্লাইভ বলেছিল সেসব তোমার জানার দরকার নেই ওয়ালস্–আমি শুধু একটা খবর জানতে চাই, হারেমের ভেতরে মরিয়ম বেগম বলে কোনও বেগম এখনও আছে কি না–

ওয়ালস কথাটা বুঝতে পারলে না। মিরজাফর খাঁ টাকা দিতে রাজি হচ্ছেনা, জগৎশেঠ পর্যন্ত তাদের বিশ্বাস করছে না। সেই কথাটাই আগে ভাবা দরকার। তা নয়, কোথাকার হারেমের মধ্যে কোন মেয়েমানুষ রয়েছে, খবর এত কীসের জরুরি হল কর্নেলের কাছে।

সামনেই মুনশি বসে ছিল। ওয়ালস্ সাহেবকে আসতে দেখেই দাঁড়িয়ে উঠল। বললে–কী হল সাহেব, মালিক কী বললে?

ওয়ালস জিজ্ঞেস করলে–তুমি এখনও বসে আছ?

মুনশি বললে–বা রে, মালিক কি আমাকে চলে যেতে বলেছে যে চলে যাব? টাকাকড়ির কী ব্যবস্থা হল? এমাসের মাইনেটা যে এখনও পেলুম না।

মাইনে? খেপে গেল যেন ওয়ালস্ সাহেব! মাইনে বুঝি তুমি একলাই পাওনি, আর আমরা বুঝি পেয়েছি ভেবেছ?

মুনশি অবাক হয়ে গেল আপনারাও পাননি হুজুর?

আরে না, আমরা কেউই পাইনি। পাব কোত্থেকে? আসছে মাসেও পাও কিনা তাই দেখো মুনশি। কোম্পানির ভাঁড়ারে যা কিছু টাকাকড়ি ছিল সমস্ত তো লড়াইয়ের পেছনে খরচ হয়ে গেছে।

তা নবাবের টাকা তো আসছে। শুনলাম যে নবাবের টাকা পেলে সকলকে কড়ায়-গভায় মিটিয়ে দেওয়া হবে?

সে টাকা কি আছে ভেবেছ? নবাব কি আর তা ফেলে রেখে গেছে? যা-কিছু ছিল তাও তো যাকে পেরেছে তাকে দুহাতে বিলিয়ে দিয়ে গেছে।

কিছু নেই?

অনেক আশা করেছিল নবকৃষ্ণ। এই মাইনেটার জন্যেই বলতে গেলে অত দূর থেকে এখানে এসেছিল। কিন্তু তাও যদি না পাওয়া যায় তো কী হবে! টাকার জন্যেই সাহেব কোম্পানির চাকরিতে ঢোকা। টাকার জন্যেই ম্লেচ্ছদের ছোঁয়া খাওয়া। টাকাই তো সব মা! মা, তুমি তো স্বপ্ন দিয়েছিলে আমি অনেক টাকার মালিক হব, অনেকে আমায় হাত দেখেই তাই বলেছে। কিন্তু কোথায় টাকা? টাকার নামগন্ধও যে দেখতে পাচ্ছি না।

ওদিকে সেপাইদের ছাউনি। ক’দিন ধরে বড় ধকল গেছে সকলের। তাই সবাই গড়িমসি করছে। মুনশি একবার সেদিকে গেল। সেপাইরা সবাই চেনে মুনশিকে। মুনশির মাথার টিকি ধরে টানে মাঝে মাঝে। বলে–এটা কী গো মুনশি?

মুনশি বলে–ওতে হাত দিয়ো না বাবারা, ওতে হাত দিয়েছ কী তোমাদের পাপ হবে।

পাপ? পাপ মানে?

পাপ মানে পাপ! যাকে বলে পাতক। তোমরা তো বাবা অনেক পুণ্য করেছ তাই ফিরিঙ্গি হয়ে জন্মেছ, আর আমরা হিন্দু হয়ে জন্মে ভুগে ভুগে মরছি। এই দেখোনা, কোথায় সুতোনুটি, সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছি দুটো টাকার জন্যে। এটা পাপ নয়? উটি ছুঁলে তোমাদেরও বাবা আমার মতন টাকার জন্যে হা-হতোশ করতে হবে!

হঠাৎ ওদিক থেকে একটা পালকি আসার হুমহাম শব্দ হল। সবাই হাঁ করে চেয়ে রইল। পালকি করে আবার কে আসে? কে?

বেশ চটকদার পালকি বটে! খানদানি লোক হবে কেউ! আট বেহারার পালকিটা একেবারে সোজা কর্নেলসাহেবের ঘরের দিকে যাচ্ছিল।

মেজর কিলপ্যাট্রিক সাহেব দেখতে পেয়েই দৌড়ে এসেছে।

কে?

পালকিটা থামল। ভেতর থেকে নামল উমিচাঁদ সাহেব। মেজর সাহেবকে দেখে জিজ্ঞেস করলে কর্নেলসাহেব কোথায়?

ক্যাম্পে আছেন।

তা হলে একবার যে খবর দিতে হবে আমি এসেছি। ওদিকের সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। তোমাদের কোনও ভাবনা নেই। তবু একবার দেখা করতে এসেছি। নইলে তোমাদের কর্নেল ভাববে আমাদের গাছে তুলে দিয়ে গিয়ে শেষকালে মই কেড়ে নিলে উমিচাঁদসাহেব। আমি সেরকম লোক নই হে, সেরকম লোকনই। নইলে আমাকে আর এতদিন কারবার করে খেতে হত না।

মেজর বললে–ওদিকের খবর কী?

কোনদিকের? শুনেছ তো নবাব পালিয়ে গেছে?

সেটা করলে কে? আপনি?

সে-খবরও এখনও পায়নি কর্নেল? এই উমিচাঁদকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তোমরা তো শুধুলড়াই করেই খালাস। কিন্তু শুধু বন্দুককামান দেগেই তো লড়াইতে জেতা যায় না, তার সঙ্গে সঙ্গে কূটনীতি চালাতে হয়। এ কদিন অনেক খাটাখাটনি গেছে। এ কদিন নাওয়া-খাওয়া বন্ধ ছিল আমার। এখন সব শেষপর্যন্ত ভালয় ভালয় চুকল, তাই কর্নেল সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এলাম,নইলে আবার মনে মনে ভাববে–

হঠাৎ মুনশিকে দেখতে পেলো নবকৃষ্ণ ততক্ষণে একেবারে উমিচাঁদ সাহেবের পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে ফেলেছে।

কী গো, নবকেষ্ট কেমন আছ? চাকরি কেমন চলছে?

আজ্ঞে, আপনার কৃপায় ভালই আছি। কিন্তু…

 কিন্তু আবার কী?

আজ্ঞে, এমাসের মাইনেটা পাইনি, তাই মালিকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, আপনি যদি একটু বলে দেন–

উমিচাঁদ যেন রেগে গেল–আরে, তোমার ভারী ক’টা টাকা মাইনে, তার জন্যে আবার ভাবনা করছ? সাহেব কি পালাচ্ছে? এই সবে লড়াই মিটল, এরপর নবাবের সম্পত্তির বিলিব্যবস্থা হোক, তবে ততা! তোমার তো সবে ওইটা টাকা পাওনা, আমার যে লাখ লাখ টাকা পাওনা পড়ে রয়েছে, আমার কথাটা ভাববা দিকিনি একবার!

মুনশি বললে–আজ্ঞে, শুনছি নাকি নবাব সব টাকাকড়ি নিয়ে পালিয়েছে

উমিচাঁদ হো হো করে হেসে উঠল–আরে তুমিও যেমন পাগল,নবাবের অত টাকা সব কি সঙ্গে নিয়ে পালানো যায়? অত টাকা বইতে গেলে কুড়িটা হাতি লাগবে, তা জানো?

তবে যে ওয়ালসাহেব ফিরে এসে বললেন টাকা নেই কিছু! মিরজাফরসাহেব বলেছে। সব টাকাকড়ি যা ছিল সব নাকি যাবার আগে হরির লুঠ করে দিয়ে চলে গেছে নবাব।

মেজর সাহেব পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। উমিচাঁদ তার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলে-তাই নাকি?

 মেজর বললে–হ্যাঁ

স্রেফ বাজে কথা! আমার কথায় বিশ্বাস করো, সব স্রেফ বাজে কথা। তা হলে আমি আমার এই নাক কান কেটে ফেলব, এই বলে রাখলুম। অন্তত নবাবের চেহেলসূতুনের মালখানা খুললে তার ভেতরে কুড়ি কোটি টাকা পাওয়া যাবে!

কিন্তু কর্নেল যুদ্ধের খরচা হিসেবে মিরজাফরের কাছে এখনকার মতো দু’কোটি কুড়ি লক্ষ টাকা চেয়ে পাঠিয়েছিল। মিরজাফর বলে পাঠিয়েছে টাকা নেই। এমনকী লোন হিসেবেও টাকাটা যদি জগৎশেঠজির কাছে পাওয়া যায় তাও বলে দিয়েছিল কর্নেল, তাতেও জগৎশেঠজি দিতে রাজি হয়নি।

ঠিক আছে, উমিচাঁদ সাহেব বললে–ঠিক আছে, কুছ পরোয়া নেই, কর্নেলসাহেব বুঝি সেই ভাবনায় অস্থির হয়েছে? আচ্ছা, আমি নিজে গিয়ে সাহেবকে অভয় দিয়ে আসছি, কুছ পরোয়া নেই। নবাবের টাকা তো সাহেবের একলার টাকা নয়, আমারও তো ভাগ আছে সে টাকাতে। সাহেবের সঙ্গে কড়ার আছে তিরিশ লাখ টাকা আমার পাওনা, নইলে আমি যে মারা যাব রে বাবা

বলে ক্লাইভ সাহেবের ঘরের দিকে এগিয়ে চলল। মেজর কিলপ্যাট্রিক তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে উমিচাঁদের খবরটা দিতে গেল কর্নেলকে।

নবকৃষ্ণ তাড়াতাড়ি গিয়ে ধরল উমিচাঁদ সাহেবকে।

 হুজুর, একটা কথা ছিল

উমিচাঁদ চলতে চলতে থেমে গেল। পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে বললে–কী?

একটা কাণ্ড শুনেছেন? সাহেবের কাণ্ড! সাহেব এখানে এসেও একটা মেয়েমানুষের ফাঁদে পড়েছেন!

সেকী? সে-রোগ এখনও আছে? মেয়েমানুষটা কে?

কে জানে হুজুর! পেরিন সাহেবের বাগানে যে ছিল সে নয়। এ আলাদা। আজকে এসেছে। নতুন আমদানি হয়েছে। বেটাছেলের মতন জামাকাপড় পরা ছিল, আসলে মেয়েমানুষ।

কিন্তু মেয়েমানুষটা কে? নাম কী? কোথাকার?

তা জানি না হুজুর। ঘরের মধ্যে রয়েছে। তার জন্যে আবার তাঁতিপাড়া থেকে শাড়ি কিনিয়ে অনালেন এখন সাহেব।

উমিচাঁদ ভাবনায় পড়ল। এই ফাঁকা মাঠের মধ্যে সেপাইদের ছাউনিতে আবার মেয়েমানুষ কোত্থেকে এল।

ততক্ষণে মেজর কিলপ্যাট্রিক ওদিক থেকে ডাকলে–আসুন উমিচাঁদসাহেব, আসুন

*

মূল কথা কিন্তু মেয়েমানুষ নয়। মূল কথা সেই টাকা। দু’কোটি কুড়ি লক্ষ টাকা না পেলে যেন ফিরিঙ্গি কোম্পানির সমস্ত পরিশ্রম, সমস্ত ক্ষয়-ক্ষতি উসূল হবে না। ১৭৫৭ সালের সেদিনকার সেই বাংলা মুলুকেও চরম প্রশ্ন হল টাকা। নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাকে টাকার প্রয়োজনেই ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াইতে নামতে হয়েছিল, আবার টাকার প্রয়োজনেই ফিরিঙ্গি কোম্পানিকে সাত সমুদ্র-তেরো নদী পেরিয়ে এসে বাংলা মুলুকের মসনদ কেড়ে নিতে হয়েছিল। উমিচাঁদ নন্দকুমার থেকে শুরু করে বশির মিঞার মতো খুদে চুনোখুঁটিটাও এই টাকার জন্যেই দল বেঁধে নবাবকে ছেড়ে ফিরিঙ্গিদের দলে ভিড়েছিল।

মনসুরগঞ্জ হাবেলির সামনে নতুন পাহারাদারের আস্তানা বসেছে। তাদের বলে দেওয়া আছে সবাইকে যেন মিরজাফর আলি সাহেবের কাছে না ঢুকতে দেওয়া হয়।

মিরন হুঁশিয়ার ছেলে। আসলে সেই কদিন ধরে খুব মাতব্বরি করছে। মিরজাফর সাহেব নবাব হলে তারই মাতব্বরি করার কথা! পাহারাদাররাও তাই জেনে নিয়েছে।

কিন্তু পুরোপুরি সাহস তখনও হয়নি। রাজা দুর্লভরাম রয়েছে, ইয়ার লুৎফ খাঁ-ও রয়েছে। তারপর ঢাকায় সরফরাজ খাঁর ছেলে আমানি খা রয়েছে। তারপরনবাব মির্জা মহম্মদ কোথায় গিয়ে কী ষড়যন্ত্র করছে তারও ঠিক নেই। যদি আজিমাবাদের দিকে গিয়ে থাকে তো বিপদ। সেখানে জেনারেল ল’ সাহেবকে নিয়ে আবার যদি হুড়মুড় করে এসে পড়ে তখন কী হবে তা বলা যায় না।

স্বপ্ন দেখতে দোষ কী?

মিরন জিজ্ঞেস করে–টাকার কী হবে বাপজান?

মিরজাফর সাহেব বলে–টাকা দেব না

কিন্তু ক্লাইভসাহেবকে যে টাকা দেবার চুক্তি হয়েছে?

মিরজাফর সাহেব বলে একবার নবাবি পেলে তখন দেখা যাবে। এখন টাকা কোথায় পাব?

তা বটে।কথাটা মনে লাগল মিরনের। একবার নবাবি পেয়ে গেলে তখন কি কেউ চুক্তির কথা মনে রাখে? তার চেয়ে অন্য কথা ভাবা ভাল। দরজা-জানালা বন্ধ মনসুরগঞ্জ হাবেলির মধ্যে রাত্রে শুয়ে শুয়ে মিরজাফর আলি সাহেব আর মিরন সাবধানে রাত কাটায়। বড় অশান্তিতে কাটছে কদিন। ফিরিঙ্গিদের এক কোটি টাকা দিতে হবে। আরমানিদের দিতে হবে সওর লক্ষ।

বাপজান।

রাত্রে বিছানায় শুয়েও ঘুম আসে না মিরনের। হঠাৎ মাথায় একটা ভাবনা আসতেই আবার উঠে আসে বাবার কাছে। মিরজাফর সাহেবও তখন শুয়ে শুয়ে ভাবছে।

কী?

হঠাৎ যেন মুর্শিদাবাদের রাস্তায় চিৎকার ওঠে–আল্লা-হো-আকবর

মনে হয় যেন লক্ষ লক্ষ লোক একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল। তবে কি খেপে উঠল সবাই? নাকি ইংরেজ ফৌজ এসে হাজির হল। কখনও চিৎকার ওঠে মতিঝিলের দিক থেকে, কখনও চকবাজারের দিক থেকে, কখনও আবার মহিমাপুরের দিক থেকে।

মিরজাফর বলে–তুই ঘুমো গে যা

ঘুম যে আসছে না।

সেই ২৪ জুন থেকেই ছেলে আর বাপের ঘুম নেই। আর শুধু তাদেরই বা কেন, সারা চেহেল্‌-সুতুনেরই ঘুম নেই। বলতে গেলে সারা মুর্শিদাবাদেরই ঘুম নেই। চারদিকে চর ছুটছেনবাবকে খুঁজতে। ঢাকাতেও লোক পাঠিয়েছে আমানি খা’র খবর আনতে। আজিমাবাদের দিকেও লোক গেছে। জেনারেল ল’সাহেব আসছে নাকি? জগৎশেঠজির কাছেও আর্জির সীমা নেই। টাকাটা দিয়ে দিলেই হয়। কেউ এসে পড়বার আগেই একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলে হয়।

সুজা উল মুলক হিসাম-উ-দ্দৌলা মিরজাফর আলি খাঁ বাহাদুর মহবত জঙ।

খেতাবটা শুনতে ভাল। মিরজাফর আলি খেতাব নিয়েছে মহবত জঙ, আর মিরন খেতাব নিয়েছে শাহামত জঙ!

ফটকের পাহারাদাররা দেখা হলেই সেলাম করে। আগেও সেলাম করত, কিন্তু এখন মনে হয় ভিখু শেখ যেমন করে জগৎশেঠজিকে সেলাম করে তেমনি করে এরাও সেলাম করছে মিরনকে।

সেদিন হঠাৎ খবর এল, ক্লাইভসাহেব আসছে।

তুই কী করে জানলি?

আমি যে দেখলুম ঘোড়ায় চড়ে একটা ফিরিঙ্গি সাহেব আসছে।

দুর বেল্লিক, ক্লাইভ সাহেব কি আর এলে একলা আসবে? তার সঙ্গে ফৌজ আসবে। সেপাই লাশকর সবাই আসবে।

সেদিন মেহেদি নেসার, ডিহিদার রেজা আলি সবাই এসে হাজির। মিরজাফর সাহেবের সঙ্গে সবাই পরামর্শ করতে এসেছে। শহরে কাজকর্ম সব বন্ধ, রাস্তাঘাট পরিষ্কার হয় না। মেথররা কেউ খানাখন্দ পরিষ্কার করে না। দুর্গন্ধ জমছে নর্দমায়। শেষকালে মড়ক শুরু হবে।

নবাবের কিছু খবর পাওয়া গিয়েছে?

মেহেদি বললে–আমি চর পাঠিয়েছি সব জায়গায়

চেহেল্‌-সুতুনের খবর কী?

মালখানায় তালা-চাবি দিতে গিয়েছিলাম, তাতে নানিবেগমসাহেবা আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলে। বললে–চেহেলসতুনের মালখানার টাকাও আমার

তুমি কী বললে?

মেহেদি বললে–আমি শাসিয়ে এলাম। বললাম–মিরজাফরসাহেবকে গিয়ে আমি সব বলছি। কিন্তু নানিবেগমসাহেবাকে তো কিছু বলতে পারি না। শেষে হয়তো মালখানা লুঠপাট করে সব টাকাকড়ি সকলকে বিলিয়ে দেবে

মিরন বললে–আগে মালখানাটা আমাদের নিতে হবে! ওতে অনেক টাকা আছে

মিরজাফর বললে–আগে ক্লাইভসাহেব আসুক, এখন কিছু কোরো না

ফটকের বাইরে তখন ওয়ালস্ সাহেব এসেছে। খবর পেয়েই মিরুন দৌড়ে নীচেয় গেছে।

আসুন হুজুর, আসুন।

 মিরজাফর সাহেবও দাঁড়িয়ে উঠল। চার দিন পরে একটা খবর অত পাওয়া যাবে। সাহেব সামনে আসতেই হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলে–কী খবর? কর্নেলসাহেব কেমন আছে? খয়রিয়ত তো?

ওয়ালস বললে–আমি একটা খবর নিতে এসেছি। কর্নেলসাহেব জানতে পাঠিয়েছে।

মিরন বললে–আমরাও তো বসে আছি ক্লাইভ সাহেবের জন্যে। তিনি আসতে এত দেরি করছে কেন? টাকা পাঠানো হয়নি বলে গোঁসা করেছেন নাকি?

মিরজাফর বললে–আমরা তো বলেছি টাকা দেব। তিনি নিজে এলে সব ব্যবস্থাই হবে।

ওয়ালস্ বললে–না, সে জন্যে নয়, কর্নেল আমাকে জানতে পাঠিয়েছে চেহেল্‌-সুতুনে মরিয়ম বেগম বলে কোনও বেগমসাহেবা আছে কিনা

মরিয়ম বেগম? আগে ছিল, এখন তো নেই!

 নেই?

মেহেদি নেসার এতক্ষণে কথা বললে। বললে–মরিয়ম বেগম? মরিয়ম বেগম সাহেবার খবর চেয়েছে ক্লাইভসাহেব? কেন?

ওয়াল বললে–তা জানি না। জরুরি খবর চেয়েছে কর্নেল।

মিরজাফর সাহেব মেহেদি নেসারের দিকে চাইলে। বললে–তুমি তো চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরের খবর রাখো? মরিয়ম বেগম বলে কেউ আছে?

ডিহিদার রেজা আলি বললে–আছে, আমি জানি

ওয়ালস বললে–আছে? তা হলে আমি সেই কথা কর্নেলকে গিয়ে বলি?

ওয়ালস আর দাঁড়াল না। কিন্তু সে চলে যাবার পরেই মিরজাফর আলি সাহেবের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। কর্নেল সাহেব এই সেদিন টাকা চেয়ে পাঠিয়েছিল, এখন আবার বেগম সাহেবার খবর চেয়ে পাঠাল কেন? নিশ্চয় কোনও মতলব আছে। মরিয়ম বেগমসাহেবা কে?

মেহেদি নেসার বললে–আমি বুঝেছি।

কী বুঝেছ?

মরিয়ম বেগম হচ্ছে হাতিয়াগড়ের জমিদারের বউ। নবাব তাকে হাতিয়াগড় থেকে চেহেল্‌-সুতুনে এনেছিল। আমার মনে হয় হাতিয়াগড়ের জমিদার এর মধ্যে আছে।

মিরন বললে–ঠিক আছে, আমি তার ব্যবস্থা করছি

কী ব্যবস্থা করবে?

মেহেদি নেসার বললে–আমি তার ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছি, আমি তাকে চেহেলসূতুনে নজরবন্দি করে রেখেছি

মিরজাফর সাহেব বললে–তা যদি কর্নেলসাহেব মরিয়ম বেগমসাহেবাকে পেলে খুশি তো শুধু মরিয়ম বেগমসাহেবা কেন, চেহেল সুতুনে মির্জা মহম্মদের যত বেগম আছে সকলকে দিয়েই কর্নেলকে খুশি করব

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *