২.১৪ লক্কাবাগের আমবাগান

লক্কাবাগের আমবাগানে তখন আরও আলো ফুটেছে। কিন্তু বড় মেঘলা আবহাওয়া। এক লাখ আমগাছের বাগান। বড় বড় সমস্ত গাছ। সার সার দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো। যে আমগাছগুলো পুঁতেছিল। সে বড় শৌখিন লোক ছিল বোধহয়। এখন আর আম নেই, সবই পেকে ঝরে গেছে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এই আমবাগানের তলায় এসে পলাশি গাঁয়ের লোক কত আম কুড়িয়ে নিয়ে গেছে। এটাও জ্যৈষ্ঠ মাস। কিন্তু যেকটা আম এই সেদিন পর্যন্ত ছিল তাও আর নেই এখন। ভাগীরথীর তীরে এসে ব্যাপারীরা এই বাগান থেকেই নৌকোয় আম বোঝাই করে সহরে সদরে জেলায়-জেলায় নিয়ে গেছে। এখন আর বাগানে আমের বাহার নেই। শুধু পাতা, কচি কচি পাতাগুলো কালচে-সবুজ হয়ে মোটা হয়ে গেছে।

এই বাগানের ধারেই নবাব কতবার এসেছে শিকার করতে। নবাব মির্জা মহম্মদও কতবার ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে এখানে এসে ওই বাড়িটাতে ফুর্তি করে রাত কাটিয়েছে। নবাবের ছাউনি থেকে ওটা দেখা যায়। ওই বাড়িটাতেই ফিরিঙ্গিরা এসে উঠেছে।

নবাব মির্জা মহম্মদ ছাউনির ঘুলঘুলি দিয়ে সেই দিকে চেয়ে দেখলেন।

রাত্রেই নজরে পড়েছিল জায়গাটা। খবর দিয়েছিল মেহেদি।

মেহেদি বলেছিল–আমরা আর একটু আগে এলে আর ওরা এই বাড়িটা দখল করতে পারত না। আলি জাঁহা

আলি জাঁহা, আলি জাঁহা, আলি জাঁহা! এই আলি জাঁহা ডাকটা বড় ভাল লাগত মির্জার। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে দাদুকে সবাই ওই নামে ডাকত। তখন মনে হত কবে আমাকে ডাকবে সবাই।

কতদিনকার সব সাধ। সব সাধ মিটে গেল এই পনেরো মাসের মধ্যে। রাতের-পর রাত জাগা, দিনের-পর-দিন ফুর্তি করা। সব হিসেব সব নিকেশ ঠিক ঠিক মিলে গেল। মানুষের জীবনে কত আর । সাধ থাকে? আর ক’টা সাধই বা কার মেটে। কোরান পড়ার পর থেকেই যেন এইসব ভাবনাগুলো। মাথার মধ্যে ঢুকে সমস্ত গোলমাল করে দিচ্ছে। আগে ঘুম আসত না। তখন হকিম ডেকেছে ইলাজের। জন্যে। কিন্তু মরিয়ম বেগমই প্রথম বলেছিল–এই মুর্শিদাবাদের মসনদের চেয়ে আরও বড় মসনদ নাকি আছে। তারপর সেই রামপ্রসাদ। রামপ্রসাদের গান-মাগো আমার এই ভাবনা। রামপ্রসাদের যা ভাবনা, নবাব মির্জা মহম্মদেরও যেন সেই একই ভাবনা। রামপ্রসাদ নবাবের ভাবনাটা জানতে পারলে কী করে? নবাব তো কাউকে নিজের মনের কথা বলেনি! নানিবেগমও জানত না, মা-ও জানত না। কেউ-ই তো নবাবের মনের কথা জানতে চায়নি। সবাই কেবল বলেছে–আরও দাও, আরও দাও। একজন মানুষ ক’জনকে দিয়ে খুশি করতে পারে?

তোমার কথা আজ মনে পড়ছে নবাব! তোমার সঙ্গে এমনি করে কতবার লড়াই করতে গিয়েছি! তোমার সঙ্গে কাটোয়ায় গিয়েছি, আজিমবাদে গিয়েছি, উড়িষ্যায় গিয়েছি। সেদিন তোমার মিরবকশিরা লড়াই করেছে আর তুমি তাবুর ভেতরে বসে তাদের তালিম দিয়েছ, মদত দিয়েছ। কখনও ধমক দিয়েছ। কখনও আবার গালাগালি দিয়েছ। আজ সব মনে পড়ছে। আবার কখনও তুমি তাদের খোশামোদও করেছ। তোমার কাছেই তো আমি শিখেছিলুম নবাব যে, লড়াই করতে গিয়ে কোনও নীতি মানতে নেই। তুমিই তো আমায় শিখিয়েছিলে নবাব, লড়াইয়ের নীতির সঙ্গে জিন্দগির নীতির কোনও মিল নেই। তুমিই বলেছিলে–ইনসান যখন জবাব দেবে তখন খোদাতালাহও তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। আমার যা কিছু শিক্ষা সে তো তোমার কাছ থেকেই শেখা। কিন্তু তুমিও যা শেখাওনি তা শিখিয়েছে আমাকে মরিয়ম বেগমসাহেবা। হোক সে কাফের মেয়ে, কিন্তু ইনসানের বয়েত কাফেররাও জানে। তাদের কাছ থেকেও আমি অনেক শিখেছি নবাব। এখন যদি তুমি একবার কবর থেকে উঠে এসে আমাকে দেখো তো তোমারও চিনতে কষ্ট হবে। আমি অনেক বদলে গিয়েছি। তুমি জানো না তো আমি কোরান পড়ি আজকাল। তোমাকে বলে রাখি নবাব, এবার আমি ফিরিঙ্গিদের চিরকালের মতো হটিয়ে দেব। যদি এবার ফলতায় গিয়ে জাহাজ নোঙর করে তো সেখানে গিয়েও হামলা করব। এবার আর আমি ওদের বিশ্বাস করব না নবাব। ওদেরও বিশ্বাস করব না, আমার ওমরাওদেরও আর বিশ্বাস করব না। আমি এবার বুঝেছি, কাফের হলেই কেউ খারাপ হয় না, মুসলমান হলেই কেউ আবার ভাল হয় না। আমি বুঝেছি কোরানের জন্যে ইনসান নয়, ইনসানের জন্যেই কোরান।

খোদাবন্দ!

 কে? নেয়ামত?

একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলুম বোধহয়। নেয়ামত ভেবেছে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। ভেবেছে আমি ভয় পেয়েছি। কিন্তু ভয় যদি সত্যিই পেতুম তো তুমি কি আজ বেঁচে থাকতে মিরজাফরসাহেব? আর জগৎশেঠজি, তোমাকেও আমি এবার চিনে নিলাম। আমার বিপদের দিনে যদি তুমি আমাকে মদত না দেবে তো তোমাকেই বা আমি মদত দেব কেন? আজ যখন সব সেপাইরা বাকি তলব না পেলে লড়াইতে আসবে না বললে, তখন তুমি মনে মনে হেসেছিলে, তা আমি বুঝতে পেরেছি। তোমাকে আমি দেখে নেব। শুধু তোমাকে নয়, সবাইকে দেখে নেব। এবার বাংলা মুলুক থেকে ফিরিঙ্গিদের তাড়িয়ে দিয়ে ফিরে এসে তোমাদের সকলকে দেখিয়ে দেব কার নাম মির্জা মহম্মদ আলি।

মিরমদন এসে কুর্নিশ করে দাঁড়াল।

ওদের কত ফৌজ, গুণে দেখেছ মিরমদন

মিরমদন বললে–দেখেছি আলি জাঁহা। ও-নিয়ে খোদাবন্দ কিছু ভাববেন না, আমাদের ফৌজ ওদের ফতে করে দেবে

তারপর হাত বাড়িয়ে একটা চিঠি দিলে।

 কার চিঠি? ল’ সাহেবের?

তাড়াতাড়ি লেফাফাখানা খুলে পড়তে লাগলেন নবাব। ফরাসি জেনারেল সাহেব চিঠি লিখেছে। একবার দু’বার তিনবার চিঠিটা পড়লেন। আর পাঁচ দিন! পাঁচ দিনের মধ্যেই এসে পড়ছে ল সাহেব।

লিখেছে–আমরা নবাবের অনুগত, নবাবের বিপদের দিনে আমরা সফৌজ নবাবের সাহায্যার্থে যাইতেছি। দুশ্চিন্তা করিবেন না। ইংরাজ আমাদের চিরকালের শক্র। ইংরাজদের আমরা কুকুরের অপেক্ষাও ঘৃণা করি। আমরা গিয়া ইংরাজদের সমূলে নিধন-সাধন করিব। রওয়ানা দিলাম। ইতি

চিঠি থেকে মুখ তুলতেই দেখলেন মিরমদন চলে গেছে। ভালই করেছে। অথচ মিরমদন, মোহনলাল এরা তো কাফের।

কাল রাত্রে সবাই মিলে এই তাবুর মধ্যে পরামর্শ করতে এসেছিল। কোথায় কোন দিকে কার ফৌজ কেমন করে সাজানো হবে তারই পরামর্শ। মিরমদন শেষ পর্যন্ত ছিল। আর ছিল মেহেদি।

মিরমদন চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ পেছন থেকে নবাব ডেকেছিলেন–মিরমদন, শোনো।

মিরমদন ফিরে দাঁড়িয়ে আবার কুর্নিশ করেছিল।

আচ্ছা মিরমদন, তুমি তো কাফের?

 জি খোদাবন্দ!

তুমি গীতা পড়ছ? তোমাদের কাফেরদের গীতা আছে, তুমি তা পড়েছ?

লড়াই করতে এসে এ কী অদ্ভুত প্রশ্ন! মিরমদন খানিকটা অবাক হয়ে গিয়েছিল প্রশ্নটা শুনে। এমন কথা নবাবের মুখ থেকে শুনবে আশা করেনি মিরমদন।

বললে–না খোদাবন্দ, আমি গীতা পড়িনি

আচ্ছা, তুমি যাও আর আজিমাবাদের দিকে ঘোড়সওয়ার পাঠাও, লসাহেব আসছে কি না তাড়াতাড়ি খবর এনে দেবে

মিরমদন হুকুম শুনে চলে গেল কুর্নিশ করে।

 মেহেদি অবাক হয়ে গিয়েছিল নবাবের প্রশ্ন শুনে।

মির্জা জিজ্ঞেস করেছিল–দেখছ তো মেহেদি, মিরমদন গীতাও পড়েনি

কেন আলি জাঁহা, ওকথা জিজ্ঞেস করলেন কেন ওকে?

জানো মেহেদি, আমি মরিয়ম বেগমসাহেবার কাছে শুনেছিলুম কাফেরদের গীতাতে নাকি আছে, আত্মীয়স্বজনদের খুন করলে কোনও গুনাহ হয় না। তুমি আমি দরকার হলে মুলুকের ভালর জন্যে নিজের ভাইকেও খুন করতে পারি–একথা লেখা আছে নাকি কাফেরদের গীতাতে

মেহেদি নেসার একথাগুলো ঠিক বুঝতে পারেনি। খানিক পরে মেহেদিও চলে গিয়েছিল তাবু ছেড়ে। তারপর সমস্ত রাতটাই একা কেটেছে। শুধু নেয়ামত এক-একবার উঁকি মেরে দেখে গেছে নবাব ঘুমিয়েছে না ঘুমোয়নি। তারপর ওই আমগাছগুলোর পাতায় পাতায় যেন একটা অদ্ভুত শব্দ শুরু হয়েছে। সে এক অদ্ভুত শব্দ। সমস্ত রাত নবাব সেই এক শব্দ শুনেছে কান পেতে। আর নেয়ামত বারবার কেবল তামাক সেজে দিয়ে চলে গেছে। ওদিকে ভাগীরথী দাদপুর থেকে এঁকেবেঁকে রামনগর হয়ে একেবারে পলাশির গা বেয়ে লম্বা চলে গেছে। রামনগরের কাছে ইংরেজরা ছাউনি গেড়েছে। আর তাদের সামনেই কয়েক শো সেপাই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিনফ্রে সাহেব। লোকটা ভাল। যতদিন না ল’সাহেব আসে ততদিন সিনফ্রে ঠেকিয়ে রাখৰে ইংরেজদের। তার বাঁ-হাতি জায়গাটায় আধা-গোল হয়ে চাঁদের রেখার মতো দাঁড়িয়ে আছে সেপাইদের দল। রাজা দুর্লভরাম, ইয়ার লুৎফ আর মিরজাফর। আলি খা। আর দু’দলের মাঝামাঝি মোহনলাল আর মিরমদন।

তামাক টেনে টেনে গলাটা শুকিয়ে এসেছিল নবাবের।

ডাকলে–নেয়ামত।

এই নেয়ামতই বরাবর আমার সঙ্গে সব জায়গাতে গেছে। সেবারে গিয়েছিল পুর্ণিয়াতে, তার আগের বারে কলকাতার হালসিবাগানে। সেবার হঠাৎ হালসিবাগানে নানিবেগম আর মরিয়ম বেগমসাহেবা এসে পড়েছিল। এবারও যদি আসে?

নেয়ামত এসে কুর্নিশ করলে। করে সামনে দাঁড়াল।

কী জন্যে নেয়ামতকে ডেকেছিল তা আর তখন মনে নেই।

 হঠাৎ নবাব বললে–তামাক দে

ওদিক থেকে আর একটা কামানের আওয়াজ এল কানে। সিনফ্রে কাজের লোক। হুঁশিয়ার লোক। কিন্তু মিরজাফর আলির দিক থেকেও আর কোনও সাড়া শব্দ নেই। ইয়ার লুৎফ খাঁ’র দিক থেকেও নয়। রাজা দুর্লভরামও কি চুপ করে আছে?

নেয়ামত তামাক দিয়ে গেল কলকেতে।

নবাব বললে–মেহেদি সাহেবকে এত্তেলা দে তো নেয়ামত

ওদিকে লড়াই চলেছে আর এদিকে খালের অনেক এপাশে তাবু পড়েছে নবাবের। তার পেছনে খানসামা, বাবুর্চি, মশালচি, জমাদার, পেয়াদা, নফর–সকলের তাবু। ফিরিঙ্গিদের দিক থেকে কামান ছুড়লেও এখানে এত দূরে এসে পড়বার ভয় নেই।

মেহেদি নেসার সাহেব এখানে নেই খোদাবন্দ।

 কোথায় গেল সে? ডেকে আন!

আবার যেন কয়েকবার কামান দেগে উঠল। এ মোহনলাল আর মিরমদনের কামান। সাবাস মোহনলাল, সাবাস মিরমদন। আকাশের খোদাতালাহ আজ সাক্ষী রইল ইয়ার, আমি তোমাদের কথা ভুলব না। তোমাদের আমি আরও বড় ওমরাহ করে দেব।

চারদিকে শব্দ। লড়াইয়ের মধ্যে এই শব্দটাই প্রথম মনে পড়ে। আর সব শব্দ ডুবে যায় এই কামানের শব্দের মধ্যে। এ শব্দ না-থাকলেও খারাপ লাগে। আবার থামলেও কষ্ট হয়। অথচ শব্দই যদি না হল তো বেঁচে আছি বুঝব কী করে? আমার ইন্দ্রিয় আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাজ করছে কিনা অনুভব করব কী করে? যারা সাধারণ, যারা বাংলা মুলুকের প্রজা, তারাই কেবল শান্তি চায়। তারা এত শান্তির ভক্ত বলেই তাদের নবাবকে এত অশান্তির সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হয়। দশজনের শান্তির জন্যে একজনকে সংসারের সব অশান্তির মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। সব অশান্তিকে নির্বিবাদে গ্রাস করতে হয়। আর তা ছাড়া এসব না থাকলে কী নিয়েই বা থাকত মুর্শিদাবাদের নবাব?

হঠাৎ একটা শব্দে পাশ ফিরল নবাব।

কে? নেয়ামত?

কে যেন তাঁবুর মধ্যে নিঃশব্দে ঢুকে আবার বেরিয়ে গেল।

কে? কে? কৌন?

 কেউ সাড়া দিলে না। যে ঢুকেছিল সে আর সাড়া দিলে না। হয়তো কেউই ঢোকেনি। হয়তো মির্জা মহম্মদের মনের ভুল। চারদিকের শব্দের মধ্যে হয়তো একটা শব্দকে পায়ের শব্দ বলে ভুল করেছিল।

বাইরের দিকে দেখতে দেখতে মির্জা মহম্মদ আবার গড়গড়ার নলটা টানতে লাগল। কিন্তু হঠাৎ মনে হল কলকের আগুন যেন নিভে গেছে। নেয়ামত তো একটু আগেই কলকের আগুন বদলে দিয়ে গেছে। তবে হঠাৎ নিভে গেল কেন? মির্জা মহম্মদ আরও জোরে জোরে নলটা টানতে লাগল।

কৌন ব্যায়?

চারদিক থেকে চার-পাঁচ জন খিদমদগার ছুটে এসেছে। নবাবের মেজাজ বিগড়ে গেলে যেন তাদের গর্দানের ওপর আর মাথা থাকবে না।

আমার গড়গড়ার কলকে কোথায় নিয়ে গেলি তোরা?

আশ্চর্য! সবাই অবাক হয়ে দেখলে কলকে নেই। নবাবের খাঁটি সোনার কলকেতে একটু আগেই নেয়ামত আগুন ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। সেটা নেই। কোথায় গেল? কে নিয়ে গেল? নবাবের চোখের সামনে থেকে কে চুরি করে নিয়ে গেল সোনার কলকেটা! ওই কলকেতেই একদিন তামাক খেয়েছেন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ, নবাব সুজাউদ্দিন, নবাব সরফরাজ খাঁ, আর নবাব আলিবর্দি খাঁ। অত যুগের উত্তরাধিকার নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার কাছে এসে অদৃশ্য হয়ে গেল! ভয়ে আতঙ্কে বিস্ময়ে সকলের যেন বাকরোধ হয়ে গেছে।

মির্জা মহম্মদ হাতের যত জোর ছিল সব দিয়ে রুপো জড়ানো নলটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলে।

তোরা বেরো এখান থেকে, বেরো, নিকাল যা–নিলো ইহাসে

সবাই ভয় পেয়ে সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। নবাব শূন্য তাঁবুর মধ্যে আবার বিছানার ওপর হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল।

তোরা কি সবাই মিলে আমাকে মেরে ফেলতে চাস? আমি কি মরে গিয়েছি? মরে যাবার আগেই কি তোরা আমাকে কবর দিতে চাস?

কথাগুলো স্বগতোক্তি! কিন্তু সামনে তখন কেউ থাকলেও যেন ওকথা তাদের বলতে নবাবের বাধত না। সেইখানে সেই ফাঁকা ছাউনির ভেতরে শুয়ে শুয়েই নবাবের মনে হতে লাগল, এরই নাম হয়তো মসনদ। এই মসনদের জন্যেই হয়তো তার এত দুর্গতি। এই মসনদের জন্যেই হয়তো আজ সবাই তার ওপর বিরূপ!

কিন্তু বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব তখনও জানত না, ইতিহাস তখন আর একবার পাশ ফেরবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। মানুষের বিধাতা যদি ইতিহাস হয় তো সেই ইতিহাস-বিধাতাও মানুষের মতোই একবার উঠে দাঁড়ায়, একবার চলে, আবার একবার ঘুমিয়ে পড়ে। মানুষের মতোই জাগবার আগে একবার পাশ ফিরে যায়। তখন দেশ-কাল রাজ্য-রাজানবাব-বাদশা সব একাকার হয়ে যায় ইতিহাসের চোখে। নবাব তখন জানত না সেই ইতিহাসের পাশ ফেরার সময় আবার এতকাল পরে ফিরে এসেছে। এতকাল পরে আবার জবাবদিহি দিতে হবে নবাবকে। নবাবকে সকলের সামনে হাত-জোড় করে বলতে হবে আমাকে তোমরা মেরো না। আমাকে আর কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখো। আমি মসনদ চাই না, আমি মুর্শিদাবাদ চাই না, আমি চেহে–সুতুন চাই না, আমি সম্মান শ্রদ্ধা ভালবাসা স্নেহ প্রীতি মুহব্বত, কিচ্ছু চাই না, আমি শুধু বাঁচতে চাই। খোদাতালা তাল্লালাহর দুনিয়ায় আমি শুধু একজন সাধারণ মানুষ হয়ে পৃথিবীর এককোণে থেকে দুদণ্ডের শান্তি পেয়ে বাঁচতে চাই।

ওদিকে ফিরিঙ্গিদের ফৌজের দিক থেকে আর একটা কামানের গোলা এসে হঠাৎ মিরমদনের সেপাইদের ওপর পড়ল। আর বিরাট একটা কানফাটানো শব্দে নবাবের নিঃশব্দ কান্না ভেঙেচুরে ছারখার হয়ে গেল।

*

মোল্লাহাটির কাছে বজরাটা আসতেই মরালী বললে–থামাও, থামাও, এইখানে বজরা থামাতে বলল ওদের

কান্ত বললে–সেকী? এই এত রাত্তিরে এখানে কোথায় নামবে? এ যে মোল্লাহাটি।

মরালী বললে–তা হোক, এ মোল্লাহাটিই হোক আর যে-জায়গাই হোক, আমি এখানেই নামব। তুমি আমাকে এখানেই নামিয়ে দাও

কিন্তু তোমাকে আমি একলা ছেড়ে দেব কোন সাহসে? কার কাছে থাকবে? কে দেখবে তোমাকে? কোথায় যাবে তুমি?

মরালী বললে–যেখানেই যাই, তোমার ভাববার দরকার নেই। আমি বাঁচি মরি তার জন্যে তোমায় ভাবতে হবে না। ছোট বউরানিকে যখন নিরাপদ জায়গায় একবার পৌঁছিয়ে দিয়েছি তখন আমি নিজের কথা আর ভাবব না।  

কান্ত বললে–তুমি না-হয় আমায় ভাবতে বারণ করছ, কিন্তু আমি না-ভেবে কী করে থাকি তাই বলো?

মরালী বললে–তুমি পুরুষমানুষ, তোমার আবার কীসের ভাবনা? তুমি যেমন করে যেখানে আছ, সেখানেই থাকো গে–

তারপর নিজেই মাঝিদের দিকে চেয়ে বললে–ওগো, তোমরা বাঁধো এখনে বজরা, বাঁধো। আমি নামব

হঠাৎ সবাই দেখলে অনেক দূরে যেন আর-একটা বজরা সাঁ সাঁ করে এইদিকেই আসছে।

কান্ত বললে–মরালী, আমার কথা শোনো, তুমি অবুঝ বোয়ো না, শেষে কী হতে কী হবে তখন তোমাকে আর বাঁচাতে পারব না

তবু মরালী কথা শুনলে না। বজরাটা ঘাটে লাগতেই কান্ত মরালীর হাতটা জোরে চেপে ধরলে।

 মরালী এক ঝটকায় কান্তর হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে বললে–ছাড়ো, তোমার এতটুকু সাহস নেই, তুমি কি একটা পুরুষমানুষ? তুমি জানোয়ারেরও অধম। এতই যদি আমাকে ভয় তো তখন বললেই পারতে? কেন লুকিয়ে লুকিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে চেহেল সুতুনে আসতে?

মরালী-মরালী

কিন্তু মরালী তখন এক লাফে বজরা থেকে ঘাটে নেমে পড়েছে

ওদিকে অন্ধকারের বুক চিরে দূরের বজরাটা তখন একেবারে পেছন বরাবর এসে পড়েছে।

 কান্ত আবার ডাকলে–মরালী–মরালী!

.

এক-একটা যুগে এক-একটা দেশে একই ঐতিহাসিক কারণে জাতি-ক্ষয়ের লক্ষণ প্রকাশ পায়। যে-জাতি চিরকালের মতো বিলুপ্ত হয়ে যায়, সে-জাতিও একদিনে নিঃশেষ হয় না। নিঃশেষ হবার আগে তার সমাজে, তার রাজনীতিতে, তার অর্থনীতিতে পচন ধরে। তখন দেশের মানুষের ধর্মবিশ্বাস শিথিল হয়ে যায়, তখন দেশের মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে স্বার্থসিদ্ধির নেশায় ডুবে থাকে। সততা, ভক্তি, ভালবাসা, স্নেহ তখন তাদের কাছে ঘৃণ্য। মানুষের মনুষ্যত্ব কথাটা তখন তাদের কাছে হাসির উদ্রেক করে। তখন তাদের কাছে সতোর চেয়ে সার্থকতা বড় হয়। তুমি হিন্দু না মুসলমান, তুমি দয়ালু না নিষ্ঠুর, তুমি স্বার্থপর না ত্যাগী সন্ন্যাসী তা আমি দেখব না। তোমার পদমর্যাদার জন্যেই আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করব। তুমি ওমরাহ, তুমি নবাবের প্রিয়পাত্র সেই-ই তোমার বড় সার্টিফিকেট।

যখন রাষ্ট্র-বিপ্লব হয় তখন কি শুধু রাজারই উত্থান-পতন হয়? রাজ্যের ছোট বড় প্রত্যেকটি মানুষেরই উত্থান-পতন ঘটে। ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে তখন ভূগোলেরও উত্থান-পতন ঘটে। একজন ওঠে আর একজন পড়ে–তারই নাম রাষ্ট্র বিপ্লব। নতুন করে তখন আবার ম্যাপের রং বদলায়। পুরনো জনপদ ধ্বংস হয়ে আবার সেখানেই নতুন জনপদ নতুন হয়ে গজিয়ে ওঠে। পুরনোর শ্মশানের। ওপর আবার নতুন করে ভবিষ্যৎ-ধ্বংসের চিতা সাজানো হয়।

উদ্ধব দাস বলত–তোমরা জানো না গো তোমরা কী ভুল করছ

লোকে জিজ্ঞেস করত–কী ভুল করছি?

 উদ্ধব দাস বলত–তোমরা টাকার জন্য হরির নাম ভুলছ

 লোকেরা বলত-হরির নাম করে কি আর পেট ভরবে গো? তার চেয়ে নবাবের নাম করা ভাল–নবাব তবু খেতাব দেবে

না গো না, খেতাবে কিস্যু হয় না। হরির নামে কী হয় শুনবে? হরির নামের তুল্য আর কিছু নেই–শোনো হরির তুল্য কী রকম–

পরমাণু তুল্য সূক্ষ্ম, হিংস্রক তুল্য মূর্খ,
ভিক্ষা তুল্য দুঃখ।
সাধন তুল্য কর্ম, দয়া তুল্য ধর্ম,
মানব তুল্য জন্ম ॥
মাহেন্দ্র তুল্য যোগ, স্বর্গ তুল্য ভোগ,
কুষ্ঠ তুল্য রোগ ॥
বট তুল্য ছায়া, সন্তান তুল্য মায়া,
কার্তিক তুল্য কায়া ॥
দৈব তুল্য বল, আম্র তুল্য ফল,
গঙ্গা তুল্য জল ॥
পূর্ণিমা তুল্য রাতি, ব্রাহ্মণ তুল্য জাতি।
মৃদঙ্গ তুল্য বাদ্য, ধৃত তুল্য খাদ্য ॥
দূর্বস্ব তুল্য ঘাস, অগ্রহায়ণ তুল্য মাস।
সর্বস্ব তুল্য পণ, বিদ্যা তুল্য ধন ॥
 দাতা তুল্য যশ, গান তুল্য রস।
উদ্ধার তুল্য জয়, মরণ তুল্য ভয় ॥
গোলক তুল্য ধাম, তেমনই হরির তুল্য নাম ॥

চারিদিকের সেই জাতি-ক্ষয়ের যুগে একমাত্র উদ্ধব দাসই বোধহয় অতগুলো লোকের মধ্যে নিজের বিবেকটাকে সজাগ রাখতে পেরেছিল। অন্তত তার বেগম মেরী বিশ্বাস’ কাব্য পড়ে সেইটুকুই বোঝ যাচ্ছে। যখন নবকৃষ্ণ মুনশি, মহারাজ নন্দকুমার, উমিচাঁদ, জগৎশেঠ, এমনকী গ্রামের সাধারণ লোক পর্যন্ত লোভ-হিংসা-পাপের মধ্য দিয়ে স্বার্থচিন্তাতে ব্যস্ত, তখন ওই একটা লোকই শুধু কিছুই চায় না। উদ্ধব দাস বাড়ি চায় না, পালকি চায় না, খ্যাতি চায় না, খেতাব চায় না, ভাল-মন্দ খেতে চায় না, এমনকী নিজের বউয়ের ওপরেও তার কোনও অনুরাগ নেই। এ অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই অস্থির যুগের পক্ষে একটা বিরাট ব্যতিক্রম।

কিন্তু মেহেদি নেসার এসব তত্ত্ব জানত না। আর এসব যদি জানবেই তো সেই সেদিন ১৭৫৭ সালের জুন মাসের ২৩ তারিখে সেই রাষ্ট্রবিপ্লব হবে কেন? নইলে ইতিহাস ঘুমোতে ঘুমোতে পাশ ফিরবে কী করে? জেগে উঠবে কী করে?

প্রথম যখন ত্রিবেণীর ঘাটে এসে মরিয়ম বেগমের পাত্তা পাওয়া গেল না তখন রেগে আগুন হয়ে উঠেছিল মেহেদি নেসার সাহেব। কিন্তু, রাগলে আখেরে কোনও ফয়দা হয় না সেটা মেহেদি নেসার জানে। তাই চুপ করে ছোটমশাইয়ের বজরার ভেতরে গিয়ে শুয়েছিল। বশির মিঞা বাইরে বসে বসে মাঝিদের সঙ্গে তখন বিড়ি টানছে।

ছোটমশাই ঘাটে এসে অবাক।

 জিজ্ঞেস করলে কে? কে তুমি?

পাছে কেউ টের পায় তাই ত্রিবেণীতে বজরা বেঁধে ছোটমশাই হাঁটা পথেই কলকাতায় গিয়েছিল। এই নিয়ে এখানে আসা-যাওয়া অনেকবারই করতে হয়েছে ছোটমশাইকে। কিন্তু দুর্ভোগ যার কপালে লেখা থাকে, তার এ নিয়ে অভিযোগ করা চলে না। আর অভিযোগ করলেও যখন তার প্রতিকার নেই তখন অভিযোগ করেই বা কী হবে! ছোটমশাই জানত বড়মশাইয়ের যুগ চলে গেছে। সে-যুগ আর আসবে না। নবাবের সামান্য একজন ডিহিদার, সেও আজকাল জমিদারদের চোখ রাঙিয়ে কথা বলে। যখন-তখন যা-তা দাবি করে। বাবা বেঁচে থাকলে এসব তিনি সহ্য করতেন না। কিন্তু এখন ন্যায়-অন্যায় বলে কোনও কথা নেই, আইনকানুন বলেও কোনও কথা নেই। বিচার বলতে আছে কাজির বিচার। সেই সব কথা ভাবতে ভাবতেই কলকাতার পেরিন সাহেবের বাগান পর্যন্ত গিয়েছিল ছোটমশাই। অথচ পরিশ্রমই সার। যার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে এত দূর থেকে আসা সেই ক্লাইভ সাহেবই নেই।

বশির মিঞা দাঁড়িয়ে উঠল। ভেতরে মেহেদি নেসার সাহেবকে উদ্দেশ করে বললে–জনাব, ছোটমশাই এসেছেন

জীবনে অনেকবার অনেক রকম অন্যায় অপমান সহ্য করতে হয়েছে হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই হিরণ্যনারায়ণকে। মুর্শিদাবাদে নতুন নবাব হওয়ার পর থেকেই সেটা বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেদিন যে-ঘটনা ঘটল তার যেন আর তুলনা নেই।

ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল যে-লোকটা সে যে মেহেদি নেসার তা প্রথমে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি।

কিন্তু ছোটমশাইয়ের কপালে বুঝি তখন আরও অনেক দুঃখ আছে।

কই? কোথায়? কে? কার কথা বলছিলে?

 ছোটমশাই বললে–বৃন্দাবন, আমার বজরাতে এরা ঢুকেছে কেন? কারা এরা?

বৃন্দাবন আগে থেকেই ভয়ে ভয়ে কাঁপছিল। তার মুখ দিয়ে আর কোনও উত্তর বেরোল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্য-পাদে ইতিহাস যখন সন্ধিস্থলে এসে থেমে গেছে, যখন পন-অ্যুদয়ের চিরন্তন বন্ধুর পথের মাঝখানে এসে ইতিহাস আর একবার থমকে দাঁড়িয়েছে, ঠিক সেই সময়েই ছোটমশাই হঠাৎ মেহেদি নেসার সাহেবকে চিনতে পারলে। আর সঙ্গে সঙ্গে মেহেদি নেসারের চোখের চাউনিতে বুঝতে পারলে, এবার আর একবার ন্যায়-অন্যায়ের মুখোমুখি তাকে দাঁড়াতে হবে।

তুমি অত্যাচারী হতে পারো, তুমি ন্যায়-অন্যায়ের আইন কানুনের বহির্ভূত হতে পারো, কিন্তু আমি আমার সামর্থ্য দিয়ে শক্তি দিয়ে মনোবল দিয়ে তোমাকে পরাজিত করব। আজকের আমার এই দুর্দশার কারণ তুমিই, আর কেউ নয়। পশুশক্তিতে তুমি আমার চেয়ে প্রবল হতে পারো, কিন্তু আমিও হীনবীর্য নই। তুমি যদি আমাকে আঘাত করো সে-আঘাত দ্বিগুণ হয়ে তোমার বুকে গিয়েই বাজবে। মৃত্যুই যদি আমার অনিবার্য পরিণতি ধার্য হয়ে থাকে তো সে-মৃত্যুর আগে তোমার সঙ্গে আমি শক্তি পরীক্ষা করে নেব।

বৃন্দাবন, এদের বার করে দে বজরা থেকে; এ আমার বজরা! না বলে ওরা আমার বজরায় ওঠে কেন?

বৃন্দাবনকে লক্ষ্য করে কথাগুলো বলার অর্থ বোঝবার মতো বুদ্ধি আর কারও না থাক, মেহেদি নেসার সাহেবের আছে।

আপনি অত গোঁসা করছেন কেন জনাব, আমরা আপনার মেহমান!

ছোটমশাই কেমন নরম হয়ে এল। মেহেদি নেসার যা তোক তার পক্ষে তো এত নরম হওয়া স্বাভাবিক নয়।

এদিকে নিজামতের কাজ নিয়ে এসেছিলুম, ঘাটে বজরা না পেয়ে আপনার বজরায় উঠেছি। মেহমানদের সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয় তা হাতিয়াগড়ের জমিনদার ছোেটমশাইকে তো আর শিখিয়ে দিতে হবে না। আপনি হয়তো আমাকে চিনতে পারছেন না জনাব আমার নাম মেহেদি নেসার।

মেহেদি নেসারের নাম শুনেও ছোটমশাইয়ের কোনও ভাবান্তর হল না।

মেহেদি নেসার আবার বললে–আসুন, জনাব, ভেতরে আসুন, এ তো আপনারই বজরা, আমরা শুধু সওয়ার, শুধু আপনার বজরায় আমরা ওপার পর্যন্ত যাব, তারপরে আপনার বজরা আপনারই থাকবে

ছোটমশাই আস্তে আস্তে বজরায় উঠল। তারপর নিজের ঘরের ভেতরে ঢুকল। বিছানায় বসে হুকুম দিলে–বৃন্দাবন, বজরা ছেড়ে দে–

মেহেদি নেসারও সামনে এসে বসল। বসে হাসতে লাগল দাঁত বার করে।

 বললে–মরিয়ম বেগমসাহেবাকে কোথায় রেখে এলেন জনাব?

মরিয়ম বেগমসাহেবা? কে মরিয়ম বেগমসাহেবা?

হঠাৎ যেন বিছেয় কামড়ানোর মতো আঘাত পেয়ে চিৎকার করে উঠেছে ছোটমশাই।

হা হা করে হেসে উঠেছে মেহেদি নেসার সাহেব।

আপনি গোঁসা করছেন জনাব! কিন্তু গোসা করবেন না মেহেরবানি করে। আমার নাম মেহেদি নেসার। আমি মুর্শিদাবাদের নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজউদ্দৌলার ইয়ার। আমার কাছে লুকোতে কোশিস করবেন না, তাতে আপনারও খারাপ হবে মরিয়ম বেগমসাহেবারও খারাপ হবে–

ছোটমশাই বললে–কিন্তু মরিয়ম বেগমসাহেবা যে আমার স্ত্রী! কোথায় তাকে দেখেছেন বলুন। বলুন শিগগির

বাঃ বাঃ, জনাব মরিয়ম বেগমসাহেবাকে লুকিয়ে রেখে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন আমি কোথায় দেখেছি তাকে? বলুন, তাকে কোথায় রেখে এলেন?

ছোটমশাই চিৎকার করে উঠল–শয়তান

মেহেদি নেসার কিন্তু রাগতে জানে না! ডাকলে–বশির মিঞা

বশির মিঞা ভেতরে এল।

জনাব তো বড় বেশরম জাঁহাবাজ! তুই বজরার ভেতরে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে দেখেছিলি?

জি হাঁ জনাব, আমি দেখেছি বেগমসাহেবা বজরার ভেতরে ছিল, আর বাইরে বসে ছিল কান্তবাবু।

আমাদের নিজামতের জাসুস!

ছোটমশাই আর থাকতে পারলে না। চিৎকার করে উঠল–বৃন্দাবন, বজরা থামা, বজরা ডাঙায় ভেড়া

চোপরাও!

বজ্রপাতের মতো গম্ভীর গলায় শব্দ করে উঠল মেহেদি নেসার। আর সঙ্গে সঙ্গে ছোটমশাই দেখলে, মেহেদি নেসারের মুখের চেহারাটা বাঘের মুখে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।

ছোটমশাইয়ের সমস্ত অন্তরাত্মা রেগে আগুন হয়ে উঠল। আমার স্ত্রীর সম্বন্ধে আমারই মুখের ওপর এমন করে বলবে, আর আমি কিছু বলতে পারব না! আমরা অনেক সহ্য করেছি, তাই সাহস ওদের এত বেড়ে গেছে। হঠাৎ সোজা হয়ে উঠে বসল ছোটমশাই।

বললে–বলুন, কোথায় আমার স্ত্রীকে রেখেছেন আপনারা, বলুন?

জনাব, আমরা আপনার বিবিকে আবার কোথায় রাখব, আপনিই কোথায় তাকে লুকিয়ে রেখে এলেন তাই বলুন! আমরা এই বজরাতে আপনার বিবিকে থাকতে দেখেছি।

তারপর বশির মিঞার দিকে চেয়ে বললে–কী রে, দেখিসনি?

বশির মিঞা বললো জনাব, আমি দেখেছি মরিয়ম বেগমসাহেবাকে—

তা হলে? কোথায় তাকে রেখে এলেন বলুন?

ছোটমশাই গলা চড়িয়ে বললে–আমি যদি আমার স্ত্রীকে লুকিয়েই রেখে থাকি তো বেশ করেছি, আমার নিজের স্ত্রীকে আমি যেখানে খুশি লুকিয়ে রাখব, আমার স্ত্রীকে নিয়ে আমি যা-খুশি তাই করব–

কে বললে–মরিয়ম বেগম আপনার আওরত? মরিয়ম বেগম নবাবের জেনানা, চেহেল সুতুনের সম্পত্তি, নিজামতি মাল

সঙ্গে সঙ্গে একটা চড় গিয়ে পড়ল মেহেদি নেসারের গালে। ছোটমশাই গায়ের যত জোর ছিল সমস্ত জোর দিয়ে চড়টা মেরেছিল। মেহেদি নেসার চড়টা সামলে নিতে একটুখানি সময় নিলে বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বশির মিঞাকে বললে–বশির, কাছি আন–শিগগির বজরার কাছিটা আন। বেত্তমিজকে বাঁধ, বেঁধে ফেল শিগগির। আমি বেওকুফকে দেখাচ্ছি মজা।

বশির আর দেরি করেনি, লম্বা কাছিটা আনতেই ছোটমশাই দাঁড়িয়ে উঠে বাধা দিতে গিয়েছিল, কিন্তু তার আগেই দুজনে মিলে আচ্ছা করে কষে বেঁধে ফেলেছে ছোটমশাইকে।

আরও জোরে বাঁধ, শালা জমিদার বাচ্চাকে আমি কুত্তা দিয়ে খাওয়াব–বাঁধ বাঁধ–আরও জোরে বাঁধ

বৃন্দাবন তখন সবই দেখেছে। মাঝিমাল্লারা সবাই এতক্ষণ সব দেখছিল। এবার তাদের দিকে নজর পড়ল মেহেদি নেসারের।

বললে–মুর্শিদাবাদে গিয়ে ওদেরও বেঁধে কুত্তা দিয়ে খাওয়াতে হবে–জোরসে চালাও, জোরসে

গঙ্গার স্রোতের ওপর বৃন্দাবনরাও ভয়ে ভয়ে আরও জোরে দাঁড় বাইতে লাগল। ছোটমশাই তখন নিজের বিছানার ওপর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। কথা বলবারও ক্ষমতা নেই। মুখের ভেতরে কাপড় গুঁজে দিয়ে বশির মিঞা তার বাকরোধ করে দিয়েছে।

*

লক্কাবাগের ভেতরে পাঁচিলটার ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তখন চারদিক দেখছিল কর্নেল ক্লাইভ। এককালে এখানেই শিকার করতে আসত নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা। এইখানে এসেই কত রাত কাটিয়ে গেছে দলবল নিয়ে। সেদিন নবাব কল্পনাও করতে পারেনি, একদিন এখানে এসে টেন্ট খাঁটিয়ে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করতে হবে।

হঠাৎ ফ্লেচার এসে হাজির।

কী খবর ফ্লেচার?

খবর ভাল কর্নেল।

মিরজাফরসাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছে? কোনও নিউজ আছে নতুন?

ফ্লেচার বললে–না কর্নেল, ওদিকে যাইনি, পাছে কেউ ডাউট করে। এখন নবাবের টেন্টের নিউজ আনতে গিয়েছিলাম। সেখানে খুব কমোশন চলছে

কেন? হোয়াই?

নবাবের পার্সোন্যাল স্টাফ যারা তারাও নবাবের এগেনস্টে।

কী করে জানলে?

 ফ্লেচার বললে–নবাবের সোনার একটা কলকে ছিল, ভেরি ভ্যালুয়েবল থিঙ, কস্টলি প্রপার্টি, সেটা কে নাকি চুরি করে নিয়েছে। নবাব অর্ডার দিয়েছে সবাইকে বেত মারতে

তারপর?

তারপর সমস্ত স্টাফ রিভোল্ট করবে বলছে।

কখন রিভোল্ট করবে? আজকে?

তা জানি না কর্নেল, কিন্তু তারা বলছে নবাবের চাকরি তারা করবে না। দে আর অল এগেনস্ট নবাব

আচ্ছা তুমি যাও, আর যদি কোনও নিউজ পাও, আমাকে ইমিডিয়েটলি জানিয়ে যাবে, আই অ্যাম হিয়ার

ফ্লেচার চলে গেল। হঠাৎ ফ্রেঞ্চ-আর্মির দিক থেকে একটা কামানের গোলা এসে পড়ল কাছাকাছি। ল্যাসিংটন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। শব্দটার সঙ্গে সঙ্গে দু’কানে হাত চাপা দেওয়ার চেষ্টা করতে গেল। কিন্তু তার আগেই গোলার একটা টুকরো এসে তার গায়ে লাগতেই সে নীচেয় পড়ে গেছে।

ক্লাইভ চিৎকার করে উঠল–ব্যাটালিয়ন

তারপরে চারদিকের শব্দে আর কান পাতা গেল না। শব্দটা কমতেই চারদিকে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। ফ্রেঞ্চ-আর্মি কামান ছোঁড়া থামিয়েছে কিছুক্ষণের জন্যে। মেজের আয়ার কুট দৌড়ে এসেছে। কর্নেলের কাছে।

কর্নেল কোথায়? হোয়ার ইজ কর্নেল?

কেউ বলতে পারে না কোথায় গেল কর্নেল! আয়ার কুট ছটফট করতে লাগল। হোয়ার ইজ কর্নেল? হোয়ার ইজ কর্নেল? এখানে দাঁড়িয়ে নবাবের হিউজ আর্মির সামনে আর ফাইট করা উচিত নয়। আমরা স্ম্যাশড হয়ে যাব। আমাদের আর্মির একজন সোলজারও আর বাঁচবে না। মেজর আয়ার কুট এখানে-ওখানে সবাইকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল–হোয়ার ইজ কর্নেল? হোয়ার?

কর্নেল তখন ল্যাসিংটনের ডেডবডিটার সামনে দাঁড়িয়ে। নবাবের শিকার করবার ঘরের ভেতরে গিয়ে স্ট্রেচারে করে ল্যাসিংটনকে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে।

সবাই বেরিয়ে যাও, বি অফ বি অফ ইউ অল

সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তখন। ক্লাইভ একলা পঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টে। তুমিও ছটাকার রাইটার ল্যাসিংটন। আমি তোমাকে ওয়ার্ড দিয়েছিলাম তোমার প্রমোশনের ব্যবস্থা করব আমি। তুমি অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের সই জাল করেছ, আমার জন্যে তুমি সব করেছ। কিন্তু তুমি আমার কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেলে। তবু আমি আমার কথা রাখব ল্যাসিংটন। আমি তোমাকে প্রমোশন দেব। পস্তুমাস প্রমোশন। সে প্রমোশনের ফল ভোগ করবে তোমার ওয়াইফ, তোমার সান, তোমার ডটার

কর্নেল!

মেজর আয়ার কুট ঘরের ভেতর ঢুকেই অবাক হয়ে গেছে। কর্নেল ক্লাইভের চোখ দিয়ে জল পড়ছে। ভেরি স্ট্রেঞ্জ, ভেরি স্ট্রেঞ্জ ইনডিড–

আয়ার কুট আর দাঁড়াল না সেখানে। নিঃশব্দে আবার ঘরের বাইরে চলে গেল। ফ্রেঞ্চ জেনারেল ল’ পলাশিতে আসছে আর্মি নিয়ে, সেই খবরটা দিতে এসেছিল। কিন্তু ক্লাইভের চোখের জলের সামনে তার সমস্ত মিলিটারি জ্ঞান মিলিটারি ম্যানোভার ধুয়ে ভেসে চলে গেল।

ক্লাইভ তখন ল্যাসিংটনের ডেডবডির সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাত বুকের ওপর ক্রস করে বলছে আমেন…

.

মেহেদি নেসার আর বশির মিঞা তখন বজরার বাইরে বসে আছে। বৃন্দবনরা জোরে জোরে দাঁড় বাইছে। ভেতরের ঘরে ছোটমশাই দড়িবাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে চিতপাত হয়ে।

হঠাৎ বশির মিঞা চেঁচিয়ে উঠেছে–ওই দেখুন জনাব, ওই দেখুন

অন্ধকার রাত। অন্ধকারের মধ্যে ভাল করে দেখা যায় না কিছু। কিন্তু বশির মিঞার দৃষ্টি এড়ানো শক্ত।

বললে–ওই দেখুন জনাব দেখেছেন?

মেহেদি নেসার জিজ্ঞেস করলে–এ কোথায় এলাম আমরা? এ কোন গাঁও?

জনাব, এই-ই তো মোল্লাহাটি। হাঁটাপথে এই মোল্লাহাটি দিয়েই তো হাতিয়াগড়ে যেতে হয়।

হঠাৎ যেন বশির মিঞা একেবারে লাফিয়ে উঠেছে।

জনাব, ওই দেখুন একটা আওরত বজরা থেকে ডাঙার ওপর ঝাঁপ দিলে।

মেহেদি নেসারও দেখছিল। অন্ধকার হলেও চোখ দুটোকে তীক্ষ্ণ তীব্র করে দিয়ে দেখলে বশির মিঞা ঠিকই বলেছে। একটা বজরা মোল্লাহাটির ঘাটের ওপর বাঁধা রয়েছে। একজন মেয়ে লাফিয়ে পড়ল ডাঙার ওপর।

ওই দেখুন জনাব, আর একজন আদমিও পেছন-পেছন লাফিয়ে পড়ল।

মাঝিদের ডেকে বশির মিঞা তাগাদা দিতে লাগল–চলো চলো ভাইয়া, জোরে জোরে বাও, সামনে বজরার পাশে গিয়ে ভেড়াও জলদি

সামনের বজরাটার কাছে আসতেই বশির মিঞা চিনতে পারলে–জনাব, এই তো আমাদের মরিয়ম বেগমসাহেবা আমাদের কান্তবাবু…

নামটা শুনেই মেহেদি নেসারও লাফিয়ে উঠল–মরিয়ম বেগমসাহেবা! তোব তোবা! পাকড়ো উসকো, পাকড়ো–

এ-ঘটনা যখন ঘটছে তখন মোল্লাহাটিতে রাত। রাতের অন্ধকারেই নিজামতের কানুন কায়েম হওয়া নিয়ম। কোনটা কানুন আর কোনটা বেকানুন তার কোনও সীমা নির্দেশ করা নেই আইন-ই-আকবরিতে। বাদশা আকবরের সঙ্গে সঙ্গেই আইন-ই-আকবরি বাতিল হয়ে গিয়েছিল। আসলে তখন বেকানুনের রাজত্ব। আর কোন কানুনই বা মানব? রাজা কি একটা, না বাদশা একজন? হিন্দুস্থানের সব জায়গায় তখন এক-একজন বাদশা বাদশাগিরি করতে শুরু করে দিয়েছে। বাংলা মুলুকের নবাবের কাছে তখন বাংলা মুলুকটাই হিন্দুস্থান।

মেহেদি নেসার সাহেব সেই বাংলা মুলুকের নবাবের ইয়ার। সুতরাং তামাম হিন্দুস্থানের বাদশার ইয়ার। মেহেদি নেসারের হুকুমই তখন মুর্শিদাবাদের নবাবের হুকুম।

বশির মিঞা মেহেদি নেসার সাহেবের হুকুম পেয়েছে, সুতরাং মুর্শিদাবাদের নবাবের ফার্মান পেয়ে গেছে।

সেই মোল্লাহাটির ঘাটের ওপরেই মরিয়ম বেগমসাহেবার হাতটা ধরে ফেললে বশির মিঞা।

 মেহেদি নেসার বললে–ওকে এখানে আন

আর আশ্চর্য, মরালীও কোনও প্রতিবাদ করলে না। কোনও আপত্তি করলে না।

 কান্ত কিন্তু রেগে গেল।

বললে–ছাড় ওকে ছেড়ে দে ও মরিয়ম বেগমসাহেবা!

বলে বশিরকে ধরতে গেল। কিন্তু মরালী বললেন, না, আমাকে ধরুক ও

‘মেহেদি নেসার সাহেব এতক্ষণ বজরার বাইরে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল, সব শুনছিল।

চেঁচিয়ে বললে–ওটাকেও ধর বশির ও কে?

জনাব, এরই নাম তো কান্তবাবু।

ওকেও ধরে নিয়ে আয়।

পাশাপাশি দুটো বজরা। বাইরে নিঃসীম অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যেও যে বশির মিঞা কেমন করে দূর থেকে চিনতে পেরেছিল সেইটিই আশ্চর্য। হয়তো অন্ধকারের মধ্যে চরের কাজ করে করে চোখ দুটো তার প্রখর হয়ে উঠেছিল। নইলে মেহেদি নেসার একলা থাকলে একাজ এত সহজে সিদ্ধ হত না। নিজামতি কাজে বশির মিঞার মতো লোকের এই জন্যেই এত খাতির। বাইরে কোতোয়াল আছে, কাজিসাহেব আছে, সেপাই, মিরবকশি সবই আছে। কিন্তু নিজামতি আসলে চালায় বশির মিঞারা।

অন্য বজরার ভেতরে ছোটমশাই কিছুই জানতে পারলে না। শুধুহাত-পা বাঁধা অবস্থাতেই মনে হল বাইরে যেন কী সব গোলমাল চলছে। কাদের যেন চেঁচামেচি হচ্ছে, আরও মনে হল যেন কারা মেহেদি নেসারের ষড়যন্ত্রের জালে জড়িয়ে পড়ল। আর তাদেরই ধরে নিয়ে যেন তাদের দুটো বজরা পাশাপাশি চলেছে।

একবার মনে হল প্রাণপণ শক্তিতে ডাকে–বৃন্দাবন-বৃন্দাবন

মেহেদি নেসার একবার পেছন ফিরে দেখলে শুধু, মুখে কিছু বললে–না। এবজরাতে তদারকি করছে মেহেদি নেসার আর ওবজরাতে বশির মিঞা। দুটো বজরা জোড়া লাগিয়ে পাশাপাশি চলেছে।

ভেতরে মরালীকে হাত-পা বেঁধে রেখে দিয়েছিল বশির মিঞা। আর বাইরে পড়ে ছিল কান্ত। কাও নড়তে-চড়তে পারছে না।

কান্ত এক ফাঁকে বললে–আমাকে তুই না-ছাড়িস বশির, মরিয়ম বেগমসাহেবাকে ছেড়ে দে ভাই। তোর ভাল হবে, দেখবি

বশির মিঞা বললে–চুপ কর, মেহেদি নেসার সাহেব পাশের বজরায় রয়েছে। শুনতে পাবে।

কান্ত বললে–আমি চুপি চুপি বলছি, কেউ শুনতে পাবে না–তুই একটু দয়া কর ভাই! আমাকে তুই যা-খুশি শাস্তি দে, আমায় তুই ইচ্ছে হলে খুন করে ফেল; কিন্তু মরিয়ম বেগমসাহেবাকে ছেড়ে দে তুই, আমি তোর পায়ে পড়ছি

বশির মিঞা জিজ্ঞেস করলে-মরিয়ম বেগমসাহেবার জন্যে তোর এত টান কেন বল তো ইয়ার? ও কি তোর পেয়ারের আওরত?

কান্ত বললে–না, তা কেন? কিন্তু তুই তো জানিস ওর কোনও দোষ নেই, আমিই হাতিয়াগড় থেকে রানিবিবিকে একদিন সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলুম।

তুই নিয়ে এসেছিস তাতে কী? তা বলে নিজামতের কানুন খেলাপ করবি? চেহেল সুতুনের কানুন খেলাপ করবি? তুই আগে বল মরিয়ম বেগমসাহেবা আর তুই দুজনে মিলে কোথায় যাচ্ছিলি? কী মতলব ছিল তোদের?

কান্ত বললে–তোকে সত্যি বলছি আমাদের কোনও মতলব ছিল না—

তা হলে কেন চেহেল্‌-সুতুন থেকে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে বের করে নিয়ে এলি?

আমি বের করে নিয়ে এলুম, কে বললে?

এখনও তবু মিথ্যে কথা বলছিস? তুই যদি বের করে না নিয়ে আসিস তো কে বের করে নিয়ে এসেছে? মরিয়ম বেগমসাহেবা কি হাওয়া হয়ে উড়ে এল এখানে? কে তোকে চেহেল্-সুতুনে ঢুকতে পাঞ্জা দিলে? আমি তো ক’দিন ধরে বেগমসাহেবার তাঞ্জামের পেছন পেছন ঘুরছি, তবু আমার চোখে তুই ধুলো দিলি কী করে? সত্যি কথা বল, আমি তোকে ছেড়ে দেব

কান্ত বললে–আমি ছাড়া পেয়ে দরকার নেই, তুই দয়া করে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে ছেড়ে দে, তা হলেই আমি আর কিছু চাই না

না বললে–আমি বেগমসাহেবাকে ছাড়ব না।

কান্ত বললে–তুই যা চাইবি আমি তাই-ই দেব; তুই যদি মোহর চাস তো তাই-ই দেব, আসরফি চাইলে তাও দেব।

মোহরের কথা শুনে বশির মিঞা যেন কেমন নরম হয়ে এল।

বললে–আসরফি কোথায় পাবি তুই?

সে যেখানে পাই যেমন করে পাই, তুই যত আসরফি চাস আমি দেব।

কোথা থেকে আসরফি পাবি তুই?

তোর আসরফি পেলেই তো হল। সে যেখান থেকে পারি আমি জোগাড় করব।

তারপর বশির মিঞার বোধহয় লোভ হতে লাগল। মাঝিমাল্লারা তখন প্রাণপণে পঁাড় টানছে। তাদের দিকে একবার চেয়ে দেখলে। তারপর হাত-পা বাঁধা কান্তর কাছে এসে সরে বসল।

বললে–সত্যি বলছিস তুই আসরফি দিবি আমাকে?

কান্ত বললে–সত্যি দেব, তুই আমার পুরনো বন্ধু, তোর কথায় আমি বেভারিজ সাহেবের নোকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি। তুই সেদিন আমার উপকার না করলে আমি উপোস করতুম। তোকে কি মিথ্যে কথা বলতে পারি?

কত দিবি?

তুই যত চাইবি। মুর্শিদাবাদে আমার একজন লোক আছে, আমার উপকারের জন্যে সে যত আসরফি চাইব তত দেবে। সে আমায় খুব ভালবাসে

দেখ–বশির মিঞা আরও কাছে সরে এসে বসল। বললে–দেখ, তুই আমার প্রাণের দোস্ত, কিন্তু ভাই, আমার টাকার বড় টানাটানি চলছে, আমার দুটো বিবি, আমি তাদের ভাল তরিবত করতে পারি না টাকার অভাবে। তার জন্যেই তোর কাছ থেকে টাকা নিচ্ছি। শালা নিজামতে নোকরি করে যা পাই তাতে চলছে না। অথচ নিজামতের কাজে আমি কত খাঁটি তা তো দেখছিস নিজের ফুপা সে-ও আমাকে গালাগালি দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দেয়, আর ওই যে মেহেদি শালা হারামজাদা বসে আছে, ও কি কম শয়তান ভেবেছিস?নবাবের সঙ্গে দোস্তি করে নবাবের কম নেমকহারামি করেছে। সব শালা চোর জুটেছে নিজামতে! তাই তো বলছি এ-নিজামত আর বেশিদিন চলবে না!

চলবে না? চলবে না মানে?

কান্তর কেমন আশা হল যেন। যদি না চলে তো মরালী তো ছাড়া পাবে?

বশির মিঞা বললে–চুপ, অত জোরে কথা বলিসনি। শালা শুনতে পাবে। তুই তঅ জানিস লক্কাবাগের মাঠে লড়াই শুরু হয়ে গেছে!

লড়াই? কীসের লড়াই?

ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে নবাব তো লড়াই করছে এখন। সেখান থেকেই তো আসছি আমরা। মুর্শিদাবাদে তোদের সবাইকে রেখে মেহেদি শালা আবার সেখানে যাবে! জবর লড়াই শুরু হয়ে গেছে সেখানে রে। সেই লড়াইতেই তো সব ফয়সালা হয়ে যাবে!

কী ফয়সালা হবে?

সে-সব তোকে বলব না। সব বানচাল হয়ে যাবে। দেখছিস না মেহেদি শালা বসে বসে কেবলই তাই ভাবছে, ওর এদিকে তেমন মন নেই। ওবজরায় রয়েছে হাতিয়াগড়ের রাজা, আর এবজরায় রাজার আওরত! ছোটমশাই জানেও না তার রানিবিবিকে আমরা ধরে নিয়ে চলেছি।

ছোটমশাই? ছোটমশাই রয়েছে ওই বজরাতে?

বশির মিঞা কান্তর মুখ চাপা দিয়ে দিলে। বললে–আবার চিল্লাচ্ছিস? বলছি না শালা মেহেদি নেসার সাহেব রয়েছে ওখানে, শুনতে পাবে যে!

সারা রাস্তাটাই বশির মেহেদি নেসারকে গালাগালি দিতে দিতে চলতে লাগল। সেই হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কান্ত শুধু শুনতে লাগল বশিরের কথাগুলো শুনতে শুনতে বড় অবাক লাগল। এই নিজামত, এর পেছনে এত ষড়যন্ত্র! তা হলে কোথাও সুখ নেই। সবাই নবাবের বিপক্ষে! তা হলে এই যে মেহেদি নেসার সাহেব ছোটমশাইকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, মরালীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, এদের কী করবে? কে এদের বিচার করবে? কে শাস্তি দেবে? কী শাস্তি দেবে? নবাবই যদি না থাকে তো তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেন?

বশির মিঞা বললে–একটু কষ্ট করে থাক এখন, মেহেদি নেসার সাহেব চলে গেলেই তোর রশি আলগা করে দেব

কান্ত বললে–আমার জন্যে আমি ভাবছি না, ভাবছি মরিয়ম বেগমসাহেবার জন্যে

 বেগমসাহেবার রশি আমি খুলতে পারব না।

ভোরবেলার দিকে বজরা দুটো মুর্শিদাবাদের ঘাটে এসে লাগতেই ডাঙায় নামতে হল। ঘাটে তখন লোকজন কেউ নেই। চেহেল্‌-সুতুনের নহবতখানা থেকে তখন ইনসাফ মিঞা টোড়ি রাগ ধরেছে। ওদিকে লড়াই বেধেছে কোথাকার লঙ্কাবাগে, আর ইদিকে ইনসাফ মিঞা তার নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ করে যাচ্ছে। কান্ত সেই অবস্থাতেই চুপ করে সেখানে পড়ে রইল। বশির মিঞা গিয়ে দুখানা পালকি নিয়ে এল। আর একখানা পালকিতে উঠবে মেহেদি নেসার সাহেব।

ভোরের ঝাপসা আলোয় বোরখা-পরা মরিয়ম বেগমসাহেবাকে নিয়ে গিয়ে একটাতে তুলল। তুলে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল। তারপর ছোটমশাই। কান্ত চেয়ে দেখলে ছোটমশাইয়ের দিকে। কখনও আগে দেখেনি ছোটমশাইকে। কিন্তু যতটা দেখা গেল তাতে মনে হল বেশ সুন্দর দেখতে। গম্ভীর মানুষটি। বাদ নেই প্রতিবাদ নেই, মেহেদি নেসারের পেছন-পেছন সোজা গিয়ে উঠল আর একটা পালকিতে। তারপর তিনটে পালকিই চলতে লাগল সার বেঁধে!

আমি?

বশির বললে–তুই আমার সঙ্গে যাবি। কিন্তু তার আগে মাঝিমাল্লাদেরও পাকড়াবার হুকুম দিয়ে গেছে মেহেদি নেসার সাহেব। ওদের না-পাকড়ালে ওরা সব বলে দেবে।

তারপর মাঝিমাল্লাদের সকলকে ডেকে বললে–চল, চল সব–সঙ্গে চল

একটা পেয়াদা নেই, পাহারা নেই। সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে বশির মিঞার সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল। ভয়ে সবাই থরথর করে কাঁপছে। বজরা দুটো সেখানেই পড়ে রইল। সেদিকে আর দেখবার সাহস নেই কারও। জানে যদি বেঁচে থাকে তো বজরার কেয়ার কথা পরে ভাববে!

চকবাজারের কাছে আসতেই কান্ত বশীরকে জিজ্ঞেস করলে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে কোথায় রাখা হবে রে?

কেন, তোর জেনে কী ফয়দা?

বল না। আমার জানতে বড় ইচ্ছে করছে।

তুই আসরফি কখন দিবি বল?

আমাকে ছেড়ে না দিলে দেব কী করে? আমার কাছে তো আসরফি নেই, আমাকে তো জোগাড় করে আনতে হবে?

কখন জোগাড় করে আনবি?

তুই যখন ছেড়ে দিবি তখনই এনে দেব। এখন যদি ছেড়ে দিস আমাকে তো দু’প্রহর পরেই এনে দেব।

বশির মিঞা চলতে চলতে কী যেন ভাবতে লাগল। তারপর বললে–না, তোকে ছাড়তে পারব না, মেহেদি নেসার সাহেব জানতে পারলে আমার গর্দান নিয়ে নেবে। আমাকে হুকুম দিয়ে দিয়েছে। তোদের সকলকে নিয়ে ফাটকে পুরতে, কোতোয়ালির ফাটকে–

তা হলে কী হবে?

বশির মিঞা বললে–তুই এখনই নিয়ে আয়, কিন্তু কোথা থেকে আনবি?

কান্ত বললে–আমি যে দোকানে থাকি, সেইখান থেকে। সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকান থেকে। কিন্তু তুই মরিয়ম বেগমসাহেবাকে ছেড়ে দিবি তো ঠিক? মেহেদি নেসার সাহেব কিছু বলবে না তো? কথা দিচ্ছিস তো?

হ্যাঁ হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি। আসরফি পেলে আমি সব করতে পারি। আরও বেশি আসরফি দিলে আমি তোকেও ছেড়ে দিতে পারি। দেনা তুই? এক হাজার আসরফি দে তুই আমাকে, তোকেও ছেড়ে দিচ্ছি।

কান্ত বললে–আমার দরকার নেই। আমি ছাড়া পেতে চাই না। আমার মরে যাওয়াই ভাল।

ততক্ষণে সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানটার কাছে আসতেই বশির মিঞা বললে–আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি, তুই গিয়ে নিয়ে আয়–

কান্তর হাতের কাছি খুলে দিলে বশির। তারপর বললে–বেশি দেরি করিসনি, যা, আমি দাঁড়িয়ে আছি এদের নিয়ে

কান্ত ছাড়া পেয়ে দোকানটার পেছন দিকের দরজায় গিয়ে আস্তে আস্তে টোকা দিলে–বাদশা ও বাদশা

অনেক ডাকাডাকির পর বাদশা উঠল। ভেতর থেকে দরজা খুলে কান্তবাবুকে দেখেই অবাক হয়ে গেছে।

কান্তবাবু আপনি? কোথায় ছিলেন অ্যাদ্দিন?

কান্ত তখন হাঁফাচ্ছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। আসরফির কথাটা কেমন করে পাড়বে তা-ই ঠিক করতে পারছে না। সারাফত আলি সাহেব যদি টাকা না দেয়? বাদশার নিজের তো টাকা নেই, সারাফত আলি সাহেবে কাছে টাকা চাইতে হবে। বুড়ো যদি না দিতে চায়! যদি জিজ্ঞেস করে কীসের টাকা? কীসের জন্যে এত টাকা দরকার? তা হলে কী উত্তর দেবে কান্ত? কান্ত তো সারাফত আলির কোনও সাধ মেটায়নি! হাজি আহম্মদের বংশ তো এখনও নষ্ট হয়নি। এখনও তো চেহেল্‌-সুতুনের মধ্যে পাপের আর দাসত্বের আর কলঙ্কের লীলা চলেছে। সারাফত আলির আরকে তো কোনও কাজ হয়নি। নবাব সুজাউদ্দিনের আমলে যা চলছিল, আলিবর্দির আমলেও যা চলছিল, যেমন করে চলছিল, তেমনি করেই তো সব এখনও চলছে! তা হলে কেন বুড়ো টাকা দেবে তাকে?

কী হল আপনার কান্তবাবু? শির গোলমাল হল নাকি?

কান্ত বললে–সারাফত আলি সাহেব কোথায়?

সাহেব তো ঘুমোচ্ছ। সাহেবকে ডাকব? কিছু দরকার আছে?

না, আমিই সাহেবের কাছে যাচ্ছি।

কান্ত আস্তে আস্তে সারাফত আলির শোবার ঘরের দিকে গেল। কী বলবে সে? কী বলে টাকা চাইবে আলি সাহেবের কাছ থেকে? মরিয়ম বেগমসাহেবার জন্যে টাকার দরকার বললেই বুড়ো জিজ্ঞেস করবে, মরিয়ম বেগমসাহেবার অত টাকা কী হবে! জিজ্ঞেস করবে মরিয়ম বেগমসাহেবা কান্তর কে? আরও জিজ্ঞেস করবে মরিয়ম বেগমসাহেবা আরক খায় কিনা। সব কথার ঠিক ঠিক উত্তর না দিতে পারলে কেন তাকে অত টাকা দেবে? টাকা দিলে কি হাজি আহম্মদের বংশের সর্বনাশ হবে?

মিঞাসাহেব।

 কোনও উত্তর নেই। পেছনে বাদশা দাঁড়িয়ে ছিল। সে বললে–আরও জোরে চিল্লান

রাত্রে নেশা করে শুয়েছে, সামান্য ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙবার কথা নয়। তাই সেও আবার ডাকলে–মিঞাসাহেব, মিঞাসাহেব

এতক্ষণে সারাফত আলি চোখ মেলে চাইলে। লাল লাল একজোড়া চোখ। সেই চোখের দিকে চেয়ে কান্তর ভয় লেগে গেল। আলি সাহেব যেন সেই চোখ দিয়েই বলতে চাইলে কৌন বেত্তমিজ আমার ঘুম ভাঙিয়ে দেবার সাহস করলে? কৌন?

কিন্তু কিছু বলবার আগেই আর একটা কাণ্ড হল। বাইরে যেন হল্লার মতো শব্দ হতে লাগল। এত ভোরে হল্লা কীসের? যেন অনেক লোক রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। এমন তো হয় না এই সময়ে। সবাই মিলে দোকানের বাইরে জড়ো হচ্ছে আর গোলমাল করছে। ওদিকে চেহেলসূতুনের মাথায় ইনসাফ মিঞার নহবত হঠাৎ থেমে গেল। কী হল? এমন তো হয় না। সারাফত আলি, বাদশা, কান্ত, সবাই সেই ঘরের মধ্যেই থমকে দাঁড়িয়ে রইল। কার সঙ্গে কে কী কথা বলতে এসেছিল সবাই তা ভুলে গেল। বাদশা হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। সারাফত আলি অন্যমনস্ক হয়ে বললে–বাহার মে হল্লা কেঁও হো রহা হ্যায়?

ততক্ষণে গোলমাল আরও বেড়ে উঠেছে। কাও ভাবনায় পড়ল। বশির মিঞা কি মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে ঝগড়া আরম্ভ করে দিলে।

কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে আসতেই অবাক হয়ে গেল। দলে দলে সব লোক বেরিয়ে পড়েছে। এলোমেলো আবহাওয়া। বশির মিঞাও নেই। সঙ্গের মাঝিমাল্লারাও সব কোথায় চলে গিয়েছে। কিন্তু কান্ত কিছু বুঝতে পারলে না। এসব কী করছে এত লোক? শহরে যেন অরাজক অবস্থা। এরা সব কোথায় চলেছে? বশির মিঞা গেল কোথায়? লোকগুলো যেন খুব ভয় পেয়ে গেছে মনে হচ্ছে। কী বলছে ওরা? গুজগুজ ফিসফিস করে সব কথা। যেন মহা বিপর্যয় ঘটে গেছে কোথাও।

একজনকে পাশে দেখে কান্ত জিজ্ঞেস করলে ক্যা হুয়া হ্যায় ভাইয়া?

লোকটা কান্তর দিকে চাইলে একবার ভাল করে। তারপর হয়তো কান্তকে সন্দেহ হল, কিন্তু কিছু না বলে অন্য দিকে চলে গেল।

কান্ত চকবাজারের রাস্তা দিয়ে আরও এগিয়ে চলল। এ-সময়ে অন্যদিন এ রাস্তার এ-চেহারা থাকে না। সব যেন ছন্নছাড়া। যাকেই জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে, সে-ই সন্দেহ করে। কোতোয়ালির সামনেও অন্যদিনকার মতো পাহারাদার নেই। ইনসাফ মিঞার নহবত থেমে গেছে। আরও ওদিকে মেহেদি নেসার সাহেবের হাবেলি। ছোটমশাই আর মরালীকে নিয়ে গিয়ে কোথায় তুলল মেহেদি নেসার সাহেব?আরও ওদিকে মহিমাপুর। কান্ত সেইখানে গিয়ে দাঁড়াল। সূর্যের আলো একটু একটু করে ফরসা হচ্ছে। সমস্ত মুর্শিদাবাদটা যেন হঠাৎ বড় ফিকে হয়ে গেছে।

কিন্তু বশির মিঞাই বা কোথায় গেল? টাকার লোভ ছাড়বার পাত্র তো বশির মিঞা নয়। তা হলে হঠাৎ কী এমন হল যার জন্যে তাকে না নিয়ে বশির মিঞা চলে গেল? আর চলেই যদি গেল তো কোথায় গেল?

শহরের মধ্যে তখন আরও জোরে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। সবাই সবাইকে জিজ্ঞেস করছে-ক্যা হুয়া হ্যায় ভাইয়া?

ভিখু শেখ যে ভিখু শেখ, সারা রাত পাহারা দেয় মহিমাপুরের মহাপজির ফটকে, সেও কেমন যেন চনমন করে উঠল। বললে–ক্যা হুয়া?

শুধু মুর্শিদাবাদে নয়, শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা হিন্দুস্থানেই এখন ওই প্রশ্ন উঠেছে–ক্যা হুয়া? শিখ, মারাঠা, ফরাসি, ডাচ, সবাই ১৭৫৭ সালের ২৪ জুন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই বাইরের হল্লা শুনে। কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করেছে-ক্যা হুয়া। হোয়টস আপ?

*

খবরটা ক্লাইভ সাহেবের কাছে আগেই এসেছিল। কিন্তু তখনও বিশ্বাস হয়নি। নবাব কি এত বোকা হবে?

তখন ল্যাসিংটনকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কর্নেল নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে কবর দিয়ে এসেছে। কিন্তু কাদার সময় পরেও আসবে। ওয়ার আগে, তার পরে ইমোশন। বাইরে এসে দাঁড়াতেই আকাশের সূর্য নজরে পড়ল। পুরো মনসুন।

যে-যুদ্ধ ঘটাবার জন্যে বহুদিন ধরে ইতিহাস ষড়যন্ত্র করে আসছে, এমন করে যে তার শুরু হবে সেকথা কে ভেবেছিল। কে ভেবেছিল সাতসাগর তেরোনদী পেরিয়ে এসে কোথাকার কোন একত্রিশ বছর বয়েসের একটা ছেলেকে এই লক্কাবাগের আমবাগানে এসে নিজের সমস্ত ইমোশনের গলা টিপে এমন করে সূর্যের দিকে চেয়ে হত্যা করতে হবে।

সামনে আয়ার কুট দাঁড়িয়ে ছিল।

কর্নেল হঠাৎ যেন তখন তাকে এই প্রথম দেখতে পেলে।

বললে–চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কী চাও?

আয়ার কুট বললে–আমার সেপাইরা বলছে, তারা এবার রেস্ট নেবে–বিশ্রাম করবে

 হোয়াই? কেন?

 নবাবের অত বড় আর্মির সঙ্গে লড়াই করতে তাদের ভয় লাগছে। বলছে ওরা এখানে মরতে আসেনি, যুদ্ধ করতে এসেছে!

কর্নেল ক্লাইভ চিৎকার করে উঠল যুদ্ধ করা আর মরা কি আলাদা জিনিস? তুমি নিজেও কি মরতে ভয় পাও?

আয়ার কুট বললে–আমি আমার কথা বলছি না কর্নেল, আর্মি সেপাইদের কথা বলছি–তারা নাম্বারে কম!

তুমি যখন মিলিটারিতে ঢুকেছিলে তখন কি জানতে না যে যুদ্ধ করা মানেই মরা?

 আমি বলছি কর্নেল, ওটা আমার কথা নয়, আমার সোলজারদের কথা!

ক্লাইভ বললে–চলল, আমি নিজে শুনতে চাই কে ওকথা বলছে। যারা মরতে ভয় পাচ্ছে আমি তাদের শুট করব, আমি তাদের গুলি করে মারব–চলো–

আয়ার কুট তখনও দাঁড়িয়ে ছিল।

 ক্লাইভ বললে–চলো

ক্লাইভের গলার আওয়াজে থরথর করে কেঁপে উঠল আয়ার কুট। তারপর চলতে লাগল। কর্নেল তখন হাতের রিভলভারটা আরও বাগিয়ে ধরেছে।

বললে–চলো, কুইক, তাড়াতাড়ি চলো–

আর লক্কাবাগের আর-একদিকে নবাবের ছাউনির ভেতর মির্জা মহম্মদ তখন চিৎকার করে ডাকলে–নেয়ামত।

বাইরে যেন কোথায় গোলমাল হচ্ছে। এ গোলমাল যুদ্ধের গোলমাল নয়। ওদিকে মিরমদন আর মোহনলালের সেপাইরা কামান ছুঁড়ে চলেছে একটার পর একটা। গোলমাল পেছন দিক থেকে আসছে।

আবার ডাকলে–নেয়ামত!

খোদাবন্দ!

অত গোলমাল হচ্ছে কীসের? ওরা কারা?

নেয়ামত কী বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল।

 বল, কী বলছিলি, বল?

খোদাবন্দ, খিদমদগারদের বেত মারা হচ্ছে!

বেত মারা হচ্ছে? কেন?

ওরা খোদাবন্দের সোনার কলকে চুরি করেছিল।

 সোনার কলকে চুরি করেছিল বলে বেত মারতে কে বলেছে?

ইয়ারজান সাহেব!

নবাব মির্জা মহম্মদ খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। বাইরে থেকে খিদমদগারদের আর্তনাদ কানে আসছে। সপাং সপাং শব্দগুলো বাতাসের বুক চিরে এসে লাগছে তাবুর দেয়ালে। মির্জা মহম্মদের মনে হল ও যেন বেত মারার শব্দ নয়, ও যেন বাংলা মুলুকের আত্মার আর্তনাদ। বহু দূর শতাব্দী থেকে যত। আত্মা বেহেস্তে গেছে, যত লোক নবাবদের হাতে জান দিয়েছে, চেহেল্‌-সুতুনে যত বেগম যত খোঁজা আত্মহত্যা করেছে, সবাই যেন একযোগে আজ লঙ্কাবাগের লড়াইয়ের মাঠে এসে তার জবাবদিহি চাইছে। আমি জবাবদিহি দেব কী করে? আমি কেন অন্যের পাপের উত্তরাধিকারী হব? মির্জা মহম্মদ নিজের মনেই যেন নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়ে শান্ত হল। তা, তো বটেই! আমি যেমন উত্তরাধিকারসূত্রে তোমাদের সোনার কলকের উত্তরাধিকারী হয়েছি, তেমনই উত্তরাধিকারী হয়েছি তোমাদের পাপেরও। পাপ সম্বন্ধে তো আমার কোনও জ্ঞান ছিল না আগে। তুমিই তো আমাকে শেখালে মরিয়ম বেগমসাহেবা! কেন শেখাতে গেলে? তুমি না শেখানো পর্যন্ত আমি তো বেশ ছিলাম। আমার রাত্রে ঘুম আসত না, তা না আসুক। কিন্তু এ যে আরও মর্মান্তিক। এ যে আরও কষ্টের। এতদিন তো জানতে পারিনি আমার এই অন্তরাত্মার মধ্যেই তুমি আছ। তোমাকে এতদিন অস্বীকার করেছি বলেই তো আজ আমাকে এই এদের সকলকে নিয়ে লঙ্কাবাগে আসতে হয়েছে। আমি এদের ভাগ্যবিধাতা আর নই, একথা তুমিই তো জানিয়ে দিলে মরিয়ম বেগমসাহেবা। তুমিই জানিয়ে দিলে দেশের ভাগ্যবিধাতার ওপরেও আর একজন ভাগ্যবিধাতা আছে–সে দুনিয়ার মানুষের ভাগ্যবিধাতা!

মেহেদি নেসার সাহেব কোথায়?

তিনি তো এখানে নেই খোদাবন্দ! তাকে খুঁজেছিলাম

তা হলে ইয়ারজান সাহেবকে ডাক! বল, ওদের বেত মারতে হবে না। লড়াই খতম হয়ে গেলে আমিই সকলকে বেত মারব।

নেয়ামত কুর্নিশ করে চলে যাচ্ছিল।

মির্জা মহম্মদ হঠাৎ ডাকলে–শোন

নেয়ামত ফিরে দাঁড়াল। নবাব মির্জা মহম্মদ গদি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এমন কখনও হয়নি আগে। নবাব যাকে যা হুকুম দিয়েছে, বরাবর তখনই সে তা তামিল করেছে। আজ কিন্তু নবাবের মনে হল নবাব আজকে নিজেই যাবে।

মির্জা মহম্মদ উঠে বাইরের দিকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আবার মনে পড়ল। জড়োয়ার তলোয়ারখানা কোমরে ঝুলিয়ে নিয়ে বললে–চল, আমি নিজেই যাচ্ছি–

বলে তাঁবু থেকে বেরোল। পেছন পেছন নেয়ামত চলতে লাগল।

*

সেদিন কেষ্টনগরের রাজবাড়ির অতিথিশালার ভেতর থেকেই উদ্ধব দাসের গান শোনা গেল

আমি রব না ভব-ভবনে।
শুনো হে শিব শ্রবণে ॥
যে-নারী করে নাথ,
পতিবক্ষে পদাঘাত…

রান্নাবাড়ির লোকজন যে-যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত।

 বলে-ওই গো, দাসমশাই এয়েচে—

রসুই বামুন হাতা-খুন্তি ফেলে এল। উদ্ধব দাস তখন পুঁটুলিটা নামিয়ে রেখে হাত-পা ধুচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে।

রসুই বামুন বললে–কী গো দাসমশাই, অ্যাদ্দিন কোথা ছিলে?

উদ্ধব দাস সেকথায় কান না দিয়ে বললে–মুগের ডাল রেঁধেছ?

 রসুই বামুন বললে–কোন মুগের ডাল খাবে তুমি বলো না, ঘোড়া মুগ না সোনা মুগ?

উদ্ধব দাস বললে–আমার কাছে সবই সমান, আমার ঘোড়ারও দরকার হয় না, সোনারও না। ওসব নিয়ে রাজা-মহারাজা নবাবদের কারবার।

পথে যুদ্ধ দেখে এলে নাকি দাসমশাই?

উদ্ধব দাস বললে–পথে একটা ধাঁধা বানিয়েছি গো, ওই যুদ্ধ নিয়ে, শুনবে?

বলেই আরম্ভ করল-বলো তো এর কী উত্তর হবে?

উভয় পক্ষের রাজা হয়ে ক্রোধমন।
সম্মুখ সংগ্রামে দেহে দিল দরশন ॥
উভয় পক্ষের সৈন্য সংহার হইল।
এক বিন্দু রক্ত কিন্তু ভূমে না পড়িল ॥
এ হেন অদ্ভুত যুদ্ধ কেবা দেখিয়াছে।
পদাতিক জয়ী হলে সেনাপতি বাঁচে ॥

হঠাৎ সরখেল মশাই ঢুকে পড়ল। উদ্ধব দাস জিজ্ঞেস করলে–কী গো প্রভু, মুখটা অত উদ্বিগ্ন কেন?

সরখেল মশাই রেগে গেল। বললে–তুমি থামো, ঘর-সংসার তো করলে না! তোমার ধাঁধা শুনলে আমার পেট ভরবে?

আজ্ঞে প্রভু, সংসারটাই তো ধাঁধা!

 দুর আহাম্মক, সংসারটা করলি কবে যে বলছিস সংসার ধাঁধা। সংসার করলে বুঝতিস এ ধাঁধা নয়, গোলকধাঁধা!

বলে রসুই বামুনের দিকে চেয়ে বললে–কী রে, দেওয়ানমশাই ইদিকে এয়েচে দেওয়ানমশাই গেলেন কোথায়?

বলতে বলতে আর সেখানে দাঁড়াল না সরখেল মশাই। সোজা আবার বাইরের দিকে চলে গেল।

উদ্ধব দাস হাহা করে হেসে উঠল। বললে–গোলকধাঁধা আমাকে চেনাতে এসেছে, দেখলে তো?

বলে আবার গান আরম্ভ করে দিলে:

হরি হে, গোলক ধাঁধায় ঘুরে ঘুরে মরি।
এবার তরী ভিড়াও ঘাটে ভবসাগর তরি ॥

ওদিকে দেওয়ানমশাই তখন বলছেন–দেখাই পেলিনে? তা বাইকে জিজ্ঞেস করলিনে কেন ছোটমশাই কোথায় গেছেন?

আজ্ঞে, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেউ বলতে পারলে না।

তা হলে দাঁড়া, আমি মহারাজকে বলে আসছি।

সরখেল মশাই বললে–আজ্ঞে, ছোটমশাই সেই এক মাস আগে হাতিয়াগড় থেকে মুর্শিদাবাদে যাবার নাম করে বেরিয়েছেন, তারপর আর তার পাত্তা নেই–জগা খাজাঞ্চিবাবু খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন–

কালীকৃষ্ণ সিংহমশাই বললেন–আচ্ছা তুই যা, আমি মহারাজকে গিয়ে বলছি

বলে দেওয়ানখানা থেকে বেরিয়ে রাজবাড়ির দিকে চলতে লাগলেন।

*

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তখন গৃহিণীর সঙ্গে কথা বলছিলেন অন্দরমহলে।

গৃহিণী বলছিলেন তোমার হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে দেখলাম। মেয়েটা ভাল, একেবারে গোবেচারা মানুষ, কিন্তু ওর সঙ্গের ঝি-টা হাবাজ মাগি। আমাকে বলে কিনা বশীকরণ জানে উচাটন জানে, বাটি-চালা নল-চালা সব জানে। আরে, অতই যদি জানবি তুই তো ওই ফিরিঙ্গি সাহেবটাকে উচাটন করলেই পারতিস!

মহারাজ হেসে বললেন–তা ঝিরা একটু জাঁহাবাজই হয়।

ঝিরা জাঁহাবাজ হলেই হল? কই, আমার তো পদ্মকে দেখেছ তুমি, সে অমনি করে আঁহাবাজি করুক দিকি আমার কাছে। আমি ঝামা দিয়ে তার নাক ঘষে দেব না! কিন্তু যাই বলল, রানিবিবি কিন্তু সোয়ামি বলতে অজ্ঞান।

মহারাজ বললেন–ওই হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইও তাই। যে-দিন থেকে স্ত্রী নিরুদ্দেশ সেই দিন থেকেই একেবারে দিশেহারা হয়ে গেছেন। একবার হাতিয়াগড়, একবার মুর্শিদাবাদ, কেষ্টনগর, আর একবার সুতোনুটি করছেন। ওঁদের খাওয়াদাওয়ার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?

গৃহিণী বললেন–আমি তো ওদের ছুঁই না

 কেন? ছোঁও না কেন?

ফিরিঙ্গি সাহেবের খানা খেয়েছে, জাত-জন্ম আছে নাকি ওদের যে ছোঁব?

তা হলে ওঁরা কার রান্না খাচ্ছেন? বাবুর্চি খানসামার রান্না?

না, তা কেন, ওই যে ঝি-টা আছে, ওই-ই নিজে রান্না করে নেয়। ওরা তো মুখে বলে ফিরিঙ্গির ছোওয়া খায়নি। কিন্তু মুখের কথায় বিশ্বাস করে তো আর ওদের রান্নাবাড়িতে ঢুকতে দিতে পারা যায় । তাই তো আর বেশিদিন থাকতে চাইছে না এখানে। তা হ্যাঁগো, ওদের কবে পাঠাবে হাতিয়াগড়ে?

মহারাজ বললেন–হাতিয়াগড়ে তো পাঠালেই হল না। অনেক ভেবেচিন্তে তবে পাঠাতে হবে। সেই জন্যেই তো ছোটমশাইকে কেষ্টনগরে ডেকে পাঠিয়েছি। সরখেল গেছে আমার চিঠি নিয়ে। ওদিকে নবাবও আবার ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করতে গেছে।

গৃহিণীর যেন এতক্ষণে একটা জরুরি কথা মনে পড়ল।

বললেন–হ্যাঁ গো, আমিও শুনছিলুম পদ্মর কাছে, কোথায় নাকি যুদ্ধ হচ্ছে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে? কীসের যুদ্ধ? এত যুদ্ধ করে কেন তোমাদের নবাব? খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই নাকি নবাবের?

মহারাজ বললেন–পদ্ম যুদ্ধের কথা জানলে কী করে?

ওমা, পদ্ম জানবে না তো কে জানবে? পদ্মর যে মেসোর বাড়ি ওখানে।

 কোথায় মেসোর বাড়ি?

ওই পলাশি গাঁয়ে। যুদ্ধু লাগবার সঙ্গে সঙ্গে পদ্মর মেসোরা যে সংসার তুলে সব ওর কাছে এখেনে এসে উঠেছে।

এখেনে উঠেছে মানে?

এখেনে মানে আমাদের অতিথশালায়। তা আমার ঝি, আমাদের এখানে উঠবে না তো বড়দির বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠবে? তুমি যে কী বলে? তাই ওর কাছেই শুনছিলুম, ভোরবেলা ফিরিঙ্গি পল্টনদের দেখেই ঘরদোর ছেড়ে সবাই পালিয়ে এসেছে। মাচার কুমড়ো, মাঠের ধান কিছু সঙ্গে আনতে পারেনি

মহারাজের মুখটা খানিকক্ষণের জন্যে গম্ভীর হয়ে গেল।

গৃহিণী বললেন–কী হল? পদ্মর মেসো এখেনে এসেছে বলে তোমার আবার রাগ হল নাকি?

মহারাজ হাসলেন। বললেন–তুমি বুঝবে না ছোটগিন্নি, আমি যে গম্ভীর হয়েছি কেন তা দু’দিন বাদে বুঝতে পারবে।

তার মানে? স্পষ্ট করে খুলে বলল, আমি এত হেঁয়ালি বুঝিনে–

মহারাজ বললেন–শুধু পলাশি গাঁ নয়, আমাকেও বোধহয় একদিন কেষ্টনগর ছেড়ে অন্য লোকের আশ্রয়ে গিয়ে উঠতে হবে। দিনকাল এমনই আসছে। আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি তার আভাস। তুমি ভাবো আমি দিনরাত কাব্যচর্চা করি আর ভাঁড়ামি শুনি গোপালবাবুর কাছ থেকে। কিন্তু মাথার মধ্যে সবসময় আমার ওই কথা ঘুরছে। আমি ঘুমিয়ে পর্যন্ত শান্তি পাই না, খেয়ে পর্যন্ত তৃপ্তি পাই না।

তা অত কথা ভাবো কেন তুমি?

ভাবব না? আমি না ভাবলে কে ভাববে? কাল রাত্রে তুমিও তো ঘুমিয়েছ। কিন্তু যদি জেগে থাকতে তো দেখতে পেতে আমি ওই সামনের ছাদে পায়চারি করেছি।

কেন গো? শরীর ভাল আছে তো তোমার?

শরীরের কিছু হয়নি। কিন্তু কেবল ভেবেছি, এ ভাল করলুম না খারাপ করলুম!

কী ভাল করলে? খারাপই বা কী করলে তুমি?

মহারাজ বললেন–এই যে তোমার ঝি পদ্মর মেসোরা গ্রাম ছেড়ে অতিথিশালায় এসে উঠল, এই যে তিয়াগড়ের রানিবিবি আমার অন্দরমহলে এসে উঠলেন, এই যে লক্কাবাগের মাঠে ফিরিঙ্গি পল্টনরা এসে কামান দাগতে শুরু করেছে, এর পেছনে তো সেই আমিই!

তুমি! তুমি মানে?

মহারাজ বললেন–হ্যাঁ, আমি, আমি! ছেলেদের কাউকে বলিনি সে কথা। বলবার মতো মতিগতিও নেই এখন! কেবল ভাবছি কেন আমি করতে গেলুম এসব!

গৃহিণী বললেন–তা কবিরাজমশাইকে না-হয় ডাকো চ্যবনপ্রাশ খেলে তো পারো

মহারাজ বললেন–তোমাকে এত কথা বলতে যাওয়াই দেখছি আমার ঘাট হয়েছে। তুমিই যদি এত কথা বুঝবে তা হলে…।

বলতে গিয়েও থেমে গেলেন মহারাজ। বললেন–যাই, নীচেয় যাই

তা তো যাবেই, আমার কাছে থাকতে তো তোমার ভাল লাগে না।

মহারাজ বললেন–দেখো, এখন রাগ-অভিমান-অনুরাগের সময় নয়। একদিন এই আমিই ফিরিঙ্গি ক্লাইভসাহেবকে নবাবের বিরুদ্ধে তাতিয়ে দিয়ে এসেছি। একদিন এই আমিই ভেবেছি, ক্লাইভসাহেব এসে নবাবকে যুদ্ধ করে হারিয়ে দিলে আমার ভাল হবে–

গৃহিণী বললেন–ক্লাইভ সাহেব! যে-সাহেবের কাছে এই এরা এতদিন আটক হয়েছিল? সে তো খুব ভাল লোক!

ভাল লোক? কে বললে–ভাল লোক? কে বলেছে তোমায় ক্লাইভসাহেব ভাল লোক?

গৃহিণী বললেন–ওই তো ওরাই বলছিল। ওই হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইয়ের বউ। ওরা বলছিল এতদিন ছিল ওরা পেরিন সাহেবের বাগানে, একদিনও ওদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি। ওদের জন্যে সাহেবও নাকি মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল, গোরুর মাংস মুরগির মাংস পর্যন্ত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল–ওদের ঝি-টাকে দিদি’ দিদি বলে ডাকত–

মহারাজ হাসলেন–তাই দিয়ে মানুষকে বিচার করতে নেই।

ওমা, মানুষকে আবার তবে কী দিয়ে বিচার করব?

তুমি ওদের কী জানো শুনি? কতটুকু জানো? ওরা এদেশে এসেছে ব্যাবসা করতে, ব্যাবসা করে টাকা উপায় করতে, ওরা তো ভাল ব্যবহার করবেই। ব্যাবসাদার মানুষরা কড়া করে কথা বললে–তাদের ব্যাবসা চলে? ওরা হাসলেই তো ভয় হবার কথা। ওই হাসি দেখিয়েই তো আমাদের সকলের মন ভুলিয়েছে ওই সাহেবরা। আমরা কৃতার্থ হয়ে গিয়েছি

তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।

মহারাজ বললেন–তোমার বুঝেও দরকার নেই। বুঝলে আর তুমি মেয়েমানুষ হয়ে জন্মাতে না। আমি যাই, নীচেয় যাই

গৃহিণী বললেন–তা সারা দিন-রাত নীচেয় তোমার বিষ্ণুমহলেই থাকলে পারো? ওপরে আমার ঘরে কী করতে আসো? এরপর থেকে পদ্মকে বলব আমার একলার বিছানা করতে

বলে রাগ করে গৃহিণীই চলে যাচ্ছিলেন। মহারাজ হাতটা ধরে ফেললেন।

বললেন–রাগ কোরো না। রাগ করতে নেই আমার ওপর। যেদিন সমস্ত কেষ্টনগর জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে সেদিন রাগ কোরো আমার ওপর। মনে কোরো না আমি পাগল হয়ে গিয়েছি। নবাবের ওপর রাগ করে আমরাও তোমার মতন নবাবের পাশ থেকে সরে এসেছি। জানো, নবাবের আজকে কেউ নেই।

নবাবের কথা ভাববার সময় নেই আমার, আমার কথা কে ভাবে তার ঠিক নেই, আমার ভাবতে বয়ে গেছে নবাবের কথা!

মহারাজ বললেন–তুমি না-ভাবলেও আমাকে ভাবতেই হবে!

কেন, নবাব কি তোমাকে খাওয়ায় না পরায়? আমাদের জমিদারি আছে, জমিদারির আয় থেকে আমরা খাচ্ছি। নবাব মরল কি বাঁচল তা নিয়ে ভারী তো আমাদের মাথাব্যথা

মহারাজ বললেন–তুমি জানো না বলেই ওকথা বলছ! দেশের নবাবের সঙ্গে আমরা যে সবাই জড়িয়ে গিয়েছি

তা নবাব মারা গেলে আবার একজন নবাব হবে। নবাবের মসনদ তত খালি থাকবে না

মহারাজ বললেন–এবার তো আর তা নয়। আলিবর্দি খাঁ মারা গেলে সিরাজ-উ-দৌলা নবাব হয়েছিল। এবার সিরাজ-উ-দ্দৌলা মারা গেলে আর তা হবে না। এবার ফিরিঙ্গিরা নবাব হবে।

বলো কী?

তুমি যাও, কিছু মনে কোরো না, আমি নীচেয় যাচ্ছি। এতদিন আমিও সকলের মতো ভাবতুম, সিরাজ-উ-দ্দৌলা মারা গেলেই বা ক্ষতি কী! মারা তো একদিন সবাই-ই যাবে। মসনদে তার বদলে আর একজন নাহয় বসবে, হয় মেহেদি নেসার, নয়তো মিরজাফর সাহেব, নয়তো তার ছেলে মিরন, কিন্তু রকমসকম দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছি

কেন?

সে তুমি বুঝবে না বলে নীচেয় চলে গেলেন মহারাজ। সিঁড়ি দিয়ে যাবার পথে সদর-মহলের মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল কালীকৃষ্ণ সিংহমশাই।

কী খবর দেওয়ানমশাই? শশী আর কিছু খবর দিয়েছে?

দেওয়ানমশাই সেই খবর দিতেই আসছিল। আজকাল ঘনঘন দেওয়ান মশাইকে দেখা করতে হয় মহারাজের সঙ্গে। কখন কোন খবরটা আসে, কখন কে কী খবর পাঠায়, তার সবটা জানাতে হয় মহারাজকে। সেই অনুযায়ী নির্দেশ পাঠাতে হয় মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদাবাদের নিজামতে কে কী ভাবছে, কে কী করছে, তার ওপর নির্ভর করে কেষ্টনগরের রাজত্ব।

মিরমদনসাহেব মারা গেছে হুজুর! এইমাত্র খবর এল।

কথাটা শুনে মহারাজের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল। মিরমদন! মিরমদন মারা গেছে।

তুমি ঠিক শুনেছ?

হ্যাঁ, ঠিক শুনেছি।

তা হলে নবাবের এখন কী রকম অবস্থা? মিরজাফরসাহেব কী করছে?

অত খুঁটিনাটি কিছু জানাতে পারেনি।

ওদের ফিরিঙ্গিদের কী মতলব? লড়াইতে জিততে পারলে কি মুর্শিদাবাদের মসনদ নিয়ে টানাটানি করবে নাকি?

সেইরকমই তো হালচাল মনে হচ্ছে। মিরজাফর সাহেব সেই জন্যেই হাত গুটিয়ে বসে আছে। উচ্চবাচ্য করছে না। ফিরিঙ্গিদের বিশ্বাস করতে পারছে না

মহারাজের হঠাৎ যেন কথাটা মনে পড়ে গেল। বললেন–হ্যাঁ, ভাল কথা, সরখেল এসেছে?

 হ্যাঁ, ছোটমশাইয়ের কোনও পাত্তা নেই হাতিয়াগড়ে। কেউ জানে না তিনি কোথায় আছেন।

তা হলে জগৎশেঠজিকে একবার চিঠি লিখে পাঠাও, যদি জগৎশেঠজির বাড়িতে লুকিয়ে উঠে থাকেন–

ওদিকে মহারানি অন্দরমহলের সিঁড়ি পেরিয়ে নীচেয় আসতেই পদ্ম বললে–রানিমা, তোমাকে ওরা ডাকছে

কারা রে?

ওই হাতিয়াগড়ের রানিবিবি!

কেন, আমাকে আবার কী জন্যে ডাকে? চল, দেখে আসি–

অতিথিশালায় তখন বেশ গুলজার চলেছে। অনেকদিন পরে উদ্ধব দাস এসেছে। শুধু উদ্ধব দাসই নয়। লক্কাবাগের আশেপাশের গায়ের কিছু কিছু লোকও পালিয়ে এসে জুটেছে। উদ্ধব দাস সকলকেই চেনে। সবাই মিলে তাকে গান গাইতে ধরেছে।

উদ্ধব দাস বললে–রসের গান গাইব?

সবাই বললে–না না, তোমার একটা খেদের গান আছে, সেইটে গাও

কোনটা খেদের গান?

 সেই যে তোমার বউ পালিয়ে যাবার পর যে-গানটা বেঁধেছিলে?

 আর বলতে হয় না। উদ্ধব দাস ডান হাতটা কানে লাগিয়ে সুর করে আরম্ভ করে

আমি রব না ভব-ভবনে
শুনো হে শিব শ্রবণে।
যেনারী করে নাথ
হৃদিবক্ষে পদাঘাত
তুমি তারই বশীভূত
আমি তা সব কেমনে।
পতিবক্ষে পদ হানি
 সে হল না কলঙ্কিনী
মন্দ হল মন্দাকিনী।
ভক্ত হরিদাস ভনে–
আমি রব না ভব-ভবনে।

কোথা থেকে সব লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে এসেছে, কিন্তু উদ্ধব দাসের গান শুনে আর দুঃখকষ্ট কারও মনে থাকে না। সবাই বাহবা দেয়। বলে বেশ বেশ দাসমশাই বেশ

কিন্তু ছোট বউরানির কানেও গেছে গানের সুরটা।

বললে–ওরে দুগ্যা, ওই

দুর্গার কানেও গেছে। আবার সেই বাউন্ডুলেটা এখানেও এসেছে নাকি? পদ্মকে ডেকে বললে–তোমার রানিমাকে ডাকো তো

কেন? রানিমা কী করবে?

দুর্গা বললে–তুমি ডাকো না

রানিমা আসতেই দুর্গা বললে–দেখুন রানিমা, ছোট বউরানি বড্ড ভয় পেয়ে গেছেন

কেন, কী হল?

দুর্গা বললে–ওই যে বাইরে গান গাইছে, ও কোথায় গাইছে? এদিকে আসবে নাকি ও?

 মহারানি বললেন–কেন বলো তো?

আজ্ঞে, ও নোকটা খারাপ।

খারাপ? তা ও কে? কী করে চিনলে ওকে তোমরা?

দুর্গা বললে–পেরিন সাহেবের বাগানে যখন আমরা ছিলাম তখন ও আমাদের বড় জ্বালাত ক্লাইভ ওকে খুব ভালবাসত।

কেন?

ওই ছড়া কাটত কেবল, আর ছোট বউরানির সঙ্গে দেখা করতে চাইত।

মহারানি অবাক হয়ে গেলেন। বললেন–তা তোমার ছোট বউরানির সঙ্গে দেখা করতে চাইত কেন?

ও বলত ছোট বউরানি নাকি ওর বউ।

 ওমা, সেকী কথা? ছোট বউরানি ওর বউ হতে যাবে কী করতে! ওর কি মাথা খারাপ?

দুর্গা বললে–না রানিমা, ছোট বউরানি তো মরালী নাম নিয়ে ক্লাইভসাহেবের ছাউনিতে ছিল, সেইজন্যে। ওর বউয়ের নামও তো মরালী কিনা–ওর বউ যে বিয়ের রাত্রেই পালিয়ে গিয়েছিল

এতক্ষণে মহারানি ব্যাপারটা সব বুঝলেন।

দুর্গা বললেও এদিকে আসবে নাকি?

মহারানি বললেন–না না, ও লোকটা তো এখানে আমাদের অতিথিশালায় প্রায়ই আসে আর গান। গায়। কিছুদিন থাকে আবার চলে যায়–এদিকে ও আসবে কী করতে?

ওদিক থেকে তখনও উদ্ধব দাসের গানের আওয়াজ আসছে

আমি রব না ভব-ভবনে।
শুনো হে শিব শ্রবণে।

পদ্ম মহারানির কাছে এল। বললে–রানিমা, মহারাজা এসেছেন, আপনাকে ডাকছেন

*

লক্কাবাগের লক্ষ আমগাছের বাগানে তখন ভারত-ভাগ্যবিধাতার এক কঠিন সংগ্রাম চলেছে। একদিকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নির্বীর্য মোগল-আধিপত্যের ধ্বংসস্তূপ, আর একদিকে ভাবীকালের বণিক সভ্যতার প্রতীক কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ। পৃথিবীর ইতিহাসে যতবার অতীতকালের সঙ্গে ভাবীকালের লড়াই বেধেছে, ততবারই রাষ্ট্রবিপ্লব হয়েছে রক্তক্ষরণের পথে। ততবারই শান্তিপ্রিয় মানুষ বারবার বলেছে-না না, এ রাষ্ট্রবিপ্লব হয় হোক, কিন্তু সে যেন হিংসার পথ ধরে না আসে। সকলের অগোচরে হিংসা তখন আপন মনেই কেবল হেসেছে। রক্তপাত যা হবার হয়েছে, ধ্বংস যা হবার হয়েছে, রাষ্ট্রবিপ্লব যতটুকু হবার তাই-ই হয়েছে। কিন্তু হিংসা তা বলে থেমে থাকেনি। মানুষের বাইরের সভ্যতার মুখোশ খুলে দিয়ে হিংসা বারবার মুখব্যাদান করে অট্টহাসি হেসেছে। বলেছে–আমি আছি। কখনও যিশুখ্রিস্টের বাণী, চৈতন্যদেবের বাণী, মহম্মদের বাণী মানুষকে হতাশায় সান্ত্বনা দিয়েছে, শোকার্তকে আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু তারই পাশাপাশি আবার চেঙ্গিস খাঁ, তৈমুর লঙ, আলেকজান্ডারের আর্মি স্রোতের মতন জনপদের পর জনপদ আক্রমণ করে মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু শ্মশানভূমিতে রূপান্তরিত করে ছেড়েছে। একদিকে অত্যাচার, আর একদিকে বরাভয়-এই হল মানব সভ্যতার ইতিহাস। যখন কোনও দিক থেকে মানুষ সত্যের সন্ধান পায়নি তখন আকাশের তারায়, গ্রহনক্ষত্রে এই অনন্ত রহস্যের সন্ধান করেছে। বলেছে–হে অদৃশ্য দেবতা, উত্তর দাও, আমার চিরন্তন প্রশ্নের সমাধান করো। কিন্তু কেউ-ই তার সেই চরম আর পরম প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। মাঝখান থেকে ইতিহাস তার নিজের খেয়ালে এগিয়ে গিয়েছে–সত্য-অসত্য, সৎ-অসৎ, অত্যাচার-সান্ত্বনা সবকিছু একাকার করে দিয়ে অনাদি অনন্ত মহাকালের লক্ষ্যে পৌঁছোবার সাধনায় নির্বিকার চিত্তে সবকিছু ওলোটপালোট করে দিয়ে সামনে এগিয়ে গেছে। আর মানুষও তেমনি করে অনন্তকাল ধরে আকাশের দিকে চেয়ে প্রার্থনা করে গেছে বলো কোনটা সত্য-সূর্য না রাত্রি? বলো কোনটা ধ্রুব, শিব না অশিব? বলো কোনটা শাশ্বত, হিংসা না অহিংসা?

নবাব সেই কথাই একদিন জিজ্ঞেস করেছিল মৌলবি সাহেবকে।

নিজামতের মৌলবি সাহেব। বরাবর নিজামত থেকে মাসোহারা পেয়ে নিজের নোকরি বজায় রেখেছে পুরুষানুক্রমে। কখনও কল্পনাও করেনি যে, একদিন আবার মুর্শিদাবাদের নবাবের কাছে তার বিদ্যে বুদ্ধির পরীক্ষা দিতে হবে। উত্তর দিতে গিয়ে ঘন দাড়ির ভেতর বুঝি কথাটা আটকে গিয়েছিল। কিন্তু নবাবের বুঝতে ভুল হয়নি। হিসেবনবিশকে তখনই বরখাস্ত করবার হুকুম দিয়ে অব্যাহতি দিয়েছিল সেই মৌলবি সাহেবকে।

হয়তো সেই মৌলবি সাহেব সেদিন আর সকলের মতোই অভিশাপ দিয়েছিল নবাবকে। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই অভিশাপ দিয়েছিল। তা দিক। অভিশাপের ফল যদি ফলেই তো সে মৌলবির বরখাস্তের জন্যে নয়। সে ফলবে ইতিহাসের অভিশাপের ফলে। ইতিহাস যাকে অভিশাপ দেয়, তাকে সে বড় নিষ্ঠুরভাবে অভিশাপ দেয়। তাকে শুধু সে ধ্বংস করে না, নিশ্চিহ্ন করে তবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। যেমন করেছে সরফরাজ খাঁ-কে।

তাঁবুর বাইরের দিকে যেতে যেতে এই কথাগুলিই মনে হচ্ছিল নবাবের। হঠাৎ ইয়ারজান সাহেব সামনে কুর্নিশ করে দাঁড়াল।

আমাকে ডেকেছিলেন আলি জাঁহা?

 কোথায় থাকো তোমরা? কাউকে ডেকে পাওয়া যায় না। মেহেদি কোথায়?

ইয়ারজান বললে–সে তো আলি জাঁহার দুশমনের সঙ্গে মোকাবিলা করতে গেছে

 নবাব রেগে গেল।

আমার দুশমন? আমার দুশমনের কি কমতি আছে যে মোকাবিলা করতে দূরে যেতে হবে? এখানে-সেখানে আশেপাশে যত লোক আছে, সব তো আমার দুশমন! নবাবের দুশমনের অভাব কে বললে? নবাবের দোস্তের মোকাবিলা করতে দূরে গেলে তবু তার একটা মানে থাকত। ওই যে মিরজাফর, ইয়ার লুৎফ, দুর্লভরাম দাঁড়িয়ে রয়েছে ওখানে, ওরাই কি আমার দুশমন নয়?

ইয়ারজান বললে–সেই জন্যেই তো আলি জাঁহা, আমি দুশমনির প্রতিশোধ নিচ্ছিলাম এতক্ষণ

কী করে প্রতিশোধ নিচ্ছিলে শুনি? চাবুক মেরে? যারা আমার সোনার কলকে চুরি করেছে তাদের চাবুক মেরে তুমি আমার দুশমনি দূর করবে?

হ্যাঁ, আলি জাঁহা, শালারা বড় বেইমান।

কিন্তু আর একটু দেরি করে প্রতিশোধ নিতে পারলে না? আর একটু দেরি করে প্রতিশোধ নিলে কী ক্ষতিটা হত?

প্রতিশোধ নিতে কি দেরি করা উচিত আলি জাঁহা? বেইমানরা যে আশকারা পেয়ে যাবে তা হলে। ভাববে, নবাবের ক্ষমতা নেই: ভাববে, নবাব ভীরু, নবাব কম-জোর–

হঠাৎ দূরে নজর পড়ল, সার সার তাবুর সামনে সবাইকে দাঁড় করানো হয়েছে। নবাবেরই খানসামা

বাবুর্চি খিদমদগার সব। সবাইকে মাইনে দিতে পারেনি নিজামত। তবু সবাই শাস্তির ভয়ে এখানে নবাবের সঙ্গে এসেছে। সঙ্গে এসে নবাবের খেদমত করছে। তারাই সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। পেছন। থেকে সকলের হাত বাঁধা। একজন সেপাই তাদের পিঠে সপাং সপাং করে বেত মারছে

মির্জা মহম্মদ আর থাকতে পারলে না। চিৎকার করে উঠল–থামো–থামো

পাশে দাঁড়িয়ে ছিল ইয়ারজান সাহেব আর নেয়ামত। নবাবের গলার শব্দে তারাও চমকে উঠেছে।

থামো, থামো

মির্জা মহম্মদ আবার চিৎকার করে উঠল। তারপর আর দাঁড়াল না সেখানে। যেন চাবুকগুলো তার নিজের পিঠের ওপরেই পড়ছিল এতক্ষণ।

ইয়ারজান সাহেব পেছন পেছন আবার তাঁবুর ভেতরে এল।

আলি জাঁহা, আমি যদি কসুর করে থাকি তো আমাকে মাফ করুন

মির্জা গর্জে উঠল–তুমি কী রকম মানুষ ইয়ার, এই সময়েই ওদের চাবুক মারতে হয়? ঠিক এই সময়েই আমাকে এমন করে বিপদে ফেলতে হয়? তোমার একটা আক্কেল নেই?

মির্জা মহম্মদ তাকিয়ার ওপর নিজের মাথাটা গুঁজে দিলে।

আমার কসুর হলে আমাকে মাফ করুন আলি জাঁহা।

আবার মাফ চাইছ তুমি? জানো, এখন আমার চারদিকে দুশমন, তার ওপর তুমি আরও দুশমন বাড়াচ্ছ। আর একদিন পরে চাবুক মারতে পারতে না? আর একদিন আমাকে রেহাই দিতে পারতে না!

আলি জাঁহা, আপনার ভালর জন্যেই ওদের শায়েস্তা করছিলাম!

আর ভাল করতে হবে না আমার। মেহেরবানি করে ওদের ছেড়ে দাও, মেহেরবানি করে আমাকে একটু শান্তি দাও ইয়ারজান, আর একটা দিন সবুর করো। আর একদিন পরেই জেনারেল ল’ আসছে–তারপর আমি আর কিছু বলব না

ইয়ারজান এবার চুপ করে রইল। কোনও কথা বললে না।

 তুমি যাও, আমার সামনে থেকে চলে যাও ইয়ারজান, আমি আর কাউকে এখানে চাই না

খোদাবন্দ!

নবাব এতক্ষণে আবার মুখ তুলল।

কে?

মিরমদন মারা গেছে।

নবাব মির্জা মহম্মদ সোজা হয়ে উঠে বসেছে। মোহনলাল এসেছে। কথাটা যেন তবু বিশ্বাস হল না। ঘোলাটে চোখ দিয়ে মোহনলালের দিকে চেয়ে দেখতে লাগল।

মোহনলাল আবার বললে–আমার পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করছিল মিরমদন, সে মারা গেছে। খোদাবন্দ!

তবু নবাবের মুখে কোনও কথা নেই। নবাবের যেন বাকরোধ হয়ে গেছে।

মিরজাফর, ইয়ার লুৎফ খাঁ, রাজা দুর্লভরাম কেউ কামান ছুড়ছে না।

তবু নবাব নির্বাক।

খোদাবন্দ, আপনি কিছু হুকুম দিন। আপনি হুকুম দিলে আমি ফৌজ নিয়ে এগিয়ে যাই, আমি আর সিনফ্রে দু’জন ওদের হঠিয়ে দেব, আপনি শুধু হুকুম দিন খোদাবন্দ!

এতক্ষণে নবাবের মুখে যেন কথা ফুটল।

বললে–জেনারেল ল’র কোনও খবর আছে মোহনলাল?

তা জানি না জাঁহাপনা, জেনারেল ল’র আসতে দেরি হবে, তার আগেই আমরা লড়াই ফতেহ্ করে দেব। আপনি একবার শুধু হুকুম দিন খোদাবন্দ!

হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি এল আকাশ ভেঙে। সকলেই বাইরের দিকে চেয়ে দেখলে। বর্ষাকালের বৃষ্টি। বৃষ্টির জল লক্কাবাগের গাছপালা তাঁবু সবকিছু যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে

গোলাবারুদ সব বাইরে আছে, খোদাবন্দ, সব ভিজে যাবে, আমি গিয়ে দেখে আসি।

কিন্তু মিরজাফরসাহেব? মিরজাফরসাহেব কোথায়? কামান ছুড়ছে না কেন? আমাকে যে কোরান ছুঁয়ে কসম খেয়েছিল। তা হলে তার কথা রাখছে না কেন?

ঝমঝম করে চারদিকে বৃষ্টি পড়ছে। কারও মুখে কোনও কথা নেই। ওকথার কে উত্তর দেবে? কে বলবে এত ফৌজ, এত হাতি, এত সেপাই, এত কামান থাকতে মিরবকশি মিরমদন কেন হঠাৎ মারা যায়। ওই মিরমদনকেই তো কিছু আগে মির্জা মহম্মদ জিজ্ঞেস করেছিল, সে গীতা পড়েছে কিনা। গীতা পড়েনি কাফের মিরমদন। কাফেররা গীতা পড়বে না, মুসলমানরাও কোরান পড়বে না, অথচ লড়াই করতে এলে কামানের গোলা লেগে মারা যাবে। মারা যাবার আগে বেচারা মিরমদন জানতেও পারলে, কেন তার পয়দা হয়েছিল এই দুনিয়ায়, কেনই বা মারা গেল আর মারা যাওয়ার পর কোথায় যাবে সে! তাজ্জব!

হঠাৎ সিনফ্রে ঘরে ঢুকেছে-ইয়োর একসেলেন্সি, ইংরেজদের সব গোলাবারুদ বৃষ্টির জলে ভিজে গেছে, তারা সেগুলো সরিয়ে ফেলছে

তা ফেলুক, কিন্তু জেনারেল ল’ আসতে এত দেরি করছে কেন সিনফ্রে?

আপনি কিছু ভয় করবেন না ইয়োর একসেলেন্সি, আমি তো আছি। আই মাস্ট ফাইট দেম আউট। ইংরেজরা বিস্ট, ইংরেজরা সব ব্যাস্টার্ড

একবার মিরজাফরসাহেবকে আমার কাছে ডাকো তো মোহনলাল। মিরজাফর আসুক। তাকে আমি জিজ্ঞাসা করব–আপনি আপনার কথার খেলাপ করছেন কেন মিরজাফরসাহেব? আপনি না কোরান ছুঁয়ে আমার কাছে কসম খেয়েছিলেন, আপনি আমাকে মদত দেবেন? আপনি না আমার রিস্তাদার? আপনি না আমার আত্মীয়? আপনি যদি এই বিপদের সময়ে আমাকে না দেখেন তো কে দেখবে মিরজাফরসাহেব?

মোহনলাল সেই বৃষ্টির মধ্যেই ছুটে বেরিয়ে গেল।

তখন লক্কাবাগের মাঠে নতুন বর্ষার ঝমঝমকরা বৃষ্টি একভাবে পড়ে চলেছে।

*

তাঞ্জামটা সেদিন যখন মতিঝিলে প্রথম এসে পৌঁছেছিল তখন ঝাপসা ভোর। সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ মশাই চিরকাল ভোরবেলাই ঘুম থেকে ওঠে। সেদিনও ঘুম থেকে উঠেছিল। খুব ভোরে। মতিঝিলে সবাই দেরি করে ওঠে। কিন্তু চিরকালের অভ্যেস সচ্চরিত্রের একদিনে বদলানো যায় না।

হঠাৎ সদর ফটক দিয়ে তিনটে পালকি ঢুকতে দেখে কেমন অবাক হয়ে গিয়েছিল। এত ভোরে তো পালকি আসে না কারও। নবাব যখন ছিল তখন মরিয়ম বেগমসাহেবার পালকি যখন-তখন আসত, যখন-তখন যেত। কিন্তু এখন তো নবাব নেই। এখন তো নবাব লড়াইতে।

পালকি তিনটে চবুতরায় এসে থামল।

একটা থেকে নামল মেহেদি নেসার। আর একটা থেকে হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই। আর একটা থেকে বোরখা-পরা একজন মেয়েমানুষ।

মেয়েমানুষ দেখে আরও অবাক হয়ে গেল সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ। মেয়েমানুষটার হাত দুটো নৌকোর কাছি দিয়ে বাঁধা। তাকে টানতে টানতে মেহেদি নেসার মতিঝিলের ভেতরে নিয়ে গেল। তারপর ফিরে এসে ছোটমশাইকেও. ভেতরে নিয়ে গেল। তারও হাত দুটো রশি দিয়ে বাঁধা।

সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ অনেক তাজ্জব ব্যাপার দেখেছে মতিঝিলে। এতদিন চাকরি করছে এখানে, কিছু দেখতে আর বাকি নেই। কিন্তু এমন ঘটনা কখনও দেখেনি।

আর তার খানিকক্ষণ পরেই মেহেদি নেসার সাহেব যেমন এসেছিল তেমনই আবার পালকিতে চড়ে মতিঝিলের সদর ফটক দিয়ে বাইরে চলে গেল।

আর ঠিক তার পরেই চেহেল্‌-সুতুনের মাথা থেকে ইনসাফ মিঞার নহবতটা বাজতে বাজতে হঠাৎ মাঝপথে থেমে গেল। কী হল হঠাৎ? এমন তো হয় না। আর তারপর চকবাজারের রাস্তায় যেন লোকের আনাগোনা বাড়তে লাগল। এত সকালে কী হল? কেয়া হুয়া? কেন এত লোকের জটলা? কী। হয়েছে ওখানে?

সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ হতবাক হয়ে সেখানে দাঁড়িয়েই ভাবতে লাগল–কী হল হঠাৎ?

হঠাৎ পাশের দিকে চেয়ে দেখলে, কান্তবাবু। একী বাবাজি, তুমি?

 আপনি মরিয়ম বেগমসাহেবাকে এখানে আসতে দেখেছেন পুরকায়স্থমশাই?

 সচ্চরিত্রর চোখ দুটো ছলছল করে উঠল।

বললে–তুমি আবার আমাকে পুরকায়স্থমশাই বলে ডাকছ কেন বাবাজি? ওনামে তো আমাকে কেউ আর ডাকে না। তুমি আমাকে ইব্রাহিম বলে ডাকবে এখন থেকে

কান্ত বললে–তা হোক, আমার কাছে আপনি সেই আগেকার পুরকায়স্থমশাই

না বাবাজি, ওনামে ডাকলে আমার যে সব আগেকার কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় আমি ঈশ্বর ইন্দীবর ঘটকের পুত্র, ঈশ্বর কালীবর ঘটকের পৌত্র। আমার পরিবার ছেলেমেয়ে সকলের কথা যে মনে পড়ে যায় বাবাজি–আমার যে কান্না পায়–

কান্ত এবার সোজাসুজি চাইলে পুরকায়স্থ মশাইয়ের দিকে। লোকটা যেন আরও বুড়ো হয়ে গেছে এই কদিনেই।

বললে–আপনাকে আমি ওই মুসলমানি নামে ডাকতে পারব না পুরকায়স্থমশাই, আপনি আমার কাছে এখনও হিন্দুই আছেন–আমি জাত মানি না।

পুরকায়স্থ মশাই বললে–”না বাবাজি, জাতটা মেনন, আমার নিজের জাত চলে গেলেও তোমাকে আমি বলছি বাবাজি, ওটা মেনো–ওতে তোমার পূর্বপুরুষের আত্মা পরকালে তবু একফোঁটা জল পাবে। আমি ঈশ্বর ইন্দীবর ঘটকের অধম ছেলে, আমার পিতা পরকালে জল না পেয়ে হা হা করে বেড়াচ্ছেন, আমি বুঝতে পারছি বাবাজি

ওসব কথা থাক পুরকায়স্থমশাই, আমি অন্য কাজে এসেছি। শোভারাম বিশ্বাস মশাইয়ের মেয়ে মরালীবালার সর্বনাশ হয়ে গেছে, আপনি তা জানেন?

সচ্চরিত্র বললে–শোভারাম বিশ্বাস মশাইয়ের মেয়ে? কী সর্বনাশ?

কান্ত সচ্চরিত্রর হাত দুটো ধরে ফেললে। বললে–পুরকায়স্থমশাই, আমার একটা উপকার করতে হবে আপনাকে। বলুন করবেন?

সচ্চরিত্র বললে–তোমার আমি যে সর্বনাশ করেছি বাবাজি, তার আর শেষ নেই। আমার জন্যেই তোমার বিবাহে বাধা পড়ল, তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। তা কি আমি ভুলে গেছি ভেবেছ?

সে যা হবার হয়েছে, তার জন্যে আমার আর দুঃখ নেই। সেই মরালীবালাকে মেহেদি নেসার এখানে ধরে এনে রেখেছে শুনলাম। এখন আপনি তাকে বাঁচান।

সেকী বাবাজি? সে যে নষ্টা মেয়ে। সে যে এখন মরিয়ম বেগমসাহেবা হয়ে গেছে। সে যে নবাবের সঙ্গে রোজ শোয়। তাকে কেন ধরতে গেল?

খবরদার!

হঠাৎ কান্ত চিৎকার করে উঠল।

খবরদার বলছি, মরালীর নামে অমন কথা বলবেন না! আপনি নিজের চোখে শুতে দেখেছেন যে বলছেন?

সচ্চরিত্র বললে–না না, এখনকার কথা বলছিনে। এখন তো নবাব ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেছে। কিন্তু এককালে তো শুত। যখন নবাব এখানে ছিল তখন তো শুয়েছে।

কান্ত বললে–আপনি নিজের চোখে শুতে দেখেছেন? আপনি বুকে হাত দিয়ে বলুন তো?

 না না, তা কী করে দেখব? আমি আমার কাজকর্ম ছেড়ে কি তাই দেখতে গেছি, না কেউ তা আমাকে দেখতে দেবে? নেয়ামত কি তেমনি লোক? নেয়ামতকে দেখেছ তো তুমি? সে এখানকার খোদ খিদমদগার। সে গেছে নবাবের সঙ্গে লড়াইতে। সে এখানে থাকলে দেখাতাম তোমাকে।

কান্ত বললে–না দেখে অমন কথা বলবেন না আপনি মরালীর সম্বন্ধে!

সচ্চরিত্র বললে–তা না-হয় বলব না বাবাজি, ভাল হলেই তো ভাল। আমি কি চাইনা যে মেয়েটার চরিত্র ভাল থাকুক? এই আমারই দেখো না, আমার বাবা আমার নাম রাখলে সচ্চরিত্র, আমি নিজেও কত চেষ্টা করলুম, কিন্তু চরিত্রটা কি ঠিক রাখতে পারলুম? নিজের অনিচ্ছেয় তো আমাকে ম্লেচ্ছ-মাংস খেতে হল? জাত তো আমি খোয়ালুম! আর এই বুড়ো বয়েসে এখন তো এই মদের গন্ধের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। এতে আর চরিত্রের কি কিছু থাকে?

হঠাৎ সচ্চরিত্র বললেও গোলমালটা কীসের বাবাজি? এমন তো হয় না? কী হয়েছে, তুমি কিছু জানো?

কান্ত বললে–ওসব কথা থাক, আপনি বলুন আমার একটা উপকার করবেন?

কী উপকার, বলো বাবাজি?

 কান্ত বললে–শোভারাম বিশ্বাস মশাইয়ের মেয়েকে ওরা এখানে যে আটকে রেখেছে, আমার মনে হয় ওকে ওরা কোতল করবে

কেন বলো তো? কোতল করবে কেন? কী করেছে ও?

তা জানি না, মেহেদি নেসার ভেবেছে, ও মেয়েটাই সব সর্বনাশের গোড়া। জানেন তো, একবার মরালী সফিউল্লা সাহেবকে খুন করেছিল? সেই থেকেই রাগ আছে ওর ওপর। এখন নবাব গেছে লড়াই করতে, এই সুযোগে ওকে কোতল করতে চায়।

মেহেদি নেসার লোকটা বড় খারাপ বলে মনে হয় বাবাজি!

খারাপ তো বটেই, নইলে মরালীকে ওইরকম গ্রেফতার করে রাখে? আপনাকে ওকে ছাড়িয়ে দিতেই হবে।

পুরকায়স্থ মশাই কী যেন ভাবলে একটু। তারপর বললে–তুমি ওধারে একটু দাঁড়াও বাবাজি, আমি দেখে আসছি মেয়েটাকে কোথায় রেখেছে।

কান্ত চুপ করে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। পুরকায়স্থ মশাই সোজা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। বুড়ো মানুষ। বিশেষ করে চকবাজারের রাস্তায় হাতির ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাবার পর থেকেই শরীর আর বইছে না। কিন্তু মেয়েটার কথা শোনা পর্যন্ত মনটা কেমন ছটফট করছিল। সচ্চরিত্র পুরকায়স্থর নিজেরও তো মেয়ে ছিল। তাদের কথা মনে পড়ে গেল। তাদের সেখানে কী হচ্ছে কে জানে!

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে সামনের ঘরটাই নবাবের আম-দরবার। আশেপাশে জেনানামহল। এক পাশে আমির-ওমরাওদের বিশ্রাম করবার মহল।

সচ্চরিত্র আরও এগিয়ে গেল। ছোটমশাইকে এখানে কোথাও রেখেছে। জেনানামহলের দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল সচ্চরিত্র।

কে? কে ওখানে? কে তুমি?

কোথা থেকে শব্দটা আসছে বোঝা গেল না। নেয়ামত খাঁ নেই তাই রক্ষে। অন্য খিদমদগাররাও নবাবের তরিবত করতে নবাবের সঙ্গে লড়াইতে গেছে।

এতক্ষণে দেখতে পেলে সচ্চরিত্র। একটা মহলের ফটকের বাইরে থেকে তালাচাবি দেওয়া। ফটকের ওপরে চৌকোনো জায়গাটুকু কাটা। তার ফাঁক দিয়ে একখানা মুখ তার দিকে চেয়ে আছে।

কৌন হ্যায় তুম?

আজ্ঞে, বেগমসাহেবা, আমি ইব্রাহিম খাঁ।

আশ্চর্য, শোভারাম বিশ্বাসের মেয়ে আজ সচ্চরিত্র পুরকায়স্থকেও প্রথমে চিনতে পারেনি। তারপরই গলার সুর একেবারে বদলে গেল।

তুমি সচ্চরিত্র পুরকায়স্থমশাই?

পুরকায়স্থ মশাই বললে–মা, তুমি শান্ত হও মা, আমি তোমাকে দেখতে পেয়েই এসেছি।

আমাকে এরা হাত-পা বেঁধে এখানে ধরে নিয়ে এসেছে পুরকায়স্থমশাই, এখনই একবার নানিবেগমসাহেবাকে খবর দিতে পারো? বলবে, মরিয়ম বেগমসাহেবাকে মতিঝিলের ভেতরে জেনানামহলে গ্রেফতার করে রেখেছে

কিন্তু তোমাকে ওরা ধরলে কেমন করে মা?

সে কথা পরে শুনো তুমি, আগে নানিবেগমসাহেবাকে খবরটা দিয়ে এসো, তারপরে আমি দেখব মেহেদি নেসারের কী করতে পারি। নবাবকে বলে আমি মেহেদি নেসারকে চাবুক খাওয়াব। তুমি এক্ষুনি খবরটা দাও গিয়ে।

সচ্চরিত্র নীচেয় চলে আসছিল। কিন্তু মরালী আবার ডাকলে ছোটমশাইকে এখানে কোথায় রেখেছে তুমি জানো?

না মা, আমি তো জানি না তা!

আর ওই অত হল্লা-চিৎকার হচ্ছে কেন, জানো? ও কীসের চেঁচামেচি?

তাও জানি না মা। আমিও তো শুনছি কেবল। আমি যাচ্ছি, চেহেলসুতুনে গিয়ে পিরালি খাঁ-কে খবর দিয়ে আসছি।

কান্ত নীচেয় তখনও দাঁড়িয়ে ছিল একটা থামের আড়ালে। আস্তে আস্তে ভোর হচ্ছে ঝিলের ওপর। কিন্তু যত আলো হচ্ছে আকাশে, ততই কান্তর ভয় পাচ্ছে। যদি কেউ এখনই এসে পড়ে এখানে! যদি কেউ দেখতে পায়। যদি কেউ সমস্ত বানচাল করে দেয়।

পেছন দিকে হঠাৎ যেন তাঞ্জামে হুমহায় শব্দ হল। পেছন ফিরতেই কান্ত দেখলে সর্বনাশ! নানিবেগমসাহেবার তাঞ্জাম আসছে। সামনে দুটো হাতি, পেছনেও দুটো।

কান্ত থামটার আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে রইল।

নানিবেগমসাহেবা তাঞ্জাম থেকে নামবার সঙ্গে সঙ্গে, ওদিক থেকে আবার আর একটা পালকি এসে হাজির। নানিবেগমসাহেবা বোরখার ভেতর থেকে পেছন ফিরে দেখলে।

কে?

পেছনের পালকি থেকে নেমে মেহেদি নেসার সাহেব নানিবেগমসাহেবাকে নিচু হয়ে লম্বা কুর্নিশ করলে-বন্দেগি নানিবেগমসাহেবা!

মেহেদি, মরিয়ম বেগমসাহেবাকে তুমি মতিঝিলে গ্রেফতার করে রেখেছ, শুনলাম?

আমি গ্রেফতার করে রেখেছি? কে বললে–সেকথা নানিবেগমসাহেবাকে? আমি গ্রেফতার করবার কে নানিবেগমসাহেবা? আমি তো কেউ নই, আমি তো আলি জাঁহার খিদমদগার স্রেফ

তা হলে কে গ্রেফতার করলে?

মেহেদি নেসার বললে–মুর্শিদাবাদের নবাব শা কুলি খান মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌল্লার হুকুমে গ্রেফতার করেছি নানিবেগমসাহেবা!

নানিবেগমসাহেবা গম্ভীর গলায় বললে–আমি হুকুম দিচ্ছি ওকে ছেড়ে দাও তুমি মেহেদি

লেকন নানিবেগমসাহেবা, আলি জাঁহার হুকুম আমি কেমন করে খিলাপ করব?

আমি আলি জাঁহার নানি, আমার হুকুম কি মির্জা মহম্মদের হুকুমের চেয়ে বড় নয়? চেহেল্‌-সুতুনের বেগমদের ওপর আমার হুকুমই তো সকলের ওপরে।

আপনি যখন বলছেন নানিবেগমসাহেবা, তখন আমার বলবার কিছু নেই।

হঠাৎ সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ ঠিক এই সময়ে চবুতরায় এসে হাজির হতেই নানিবেগমসাহেবা দেখতে পেয়েছে।

এ কৌন?

 মেহেদি নেসার বললে–এ ইব্রাহিম খা–সরাবখানার খিদমদগার!

সচ্চরিত্র তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে কুর্নিশ করে পাশে সরে দাঁড়াল।

নানিবেগমসাহেবা তার দিকে না চেয়ে মেহেদি নেসারের দিকে চেয়ে বললে–আমাকে তুমি মরিয়ম বেগমসাহেবার কাছে নিয়ে চলো মেহেদি, ওকে আমি চেহেলসূতুনে নিয়ে যাব।

কিন্তু নবাব মির্জা মহম্মদ যদি গোঁসা করে নানিবেগমসাহেবা, তো আমার যে কোতল হয়ে যাবে!

তখন আমি আছি মেহেদি। আমার বাত মির্জা ঠেলতে পারবে না। চলো।

 মেহেদি নেসার তবু বোধহয় একটু দ্বিধা করতে লাগল।

চলো–

একটু ভাল করে সোচবুঝ করে দেখুন নানিবেগমসাহেবা।

সোচবুঝ করবার কিছু নেই মেহেদি। আমি খবর পেয়েই দৌড়ে এসেছি। হাতিয়াগড়ের জমিনদারকেও তুমি গ্রেফতার করে এনেছ তাও শুনেছি, তা তার ব্যাপার মির্জা নিজে এসে ফয়সালা করবে। এখন তুমি মরিয়ম বেগমকে ছেড়ে দাও, আমি সঙ্গে করে চেহেল্-সুতুনে নিয়ে যাই।

কিন্তু তা হলে সব দায়িত্ব নানিবেগমসাহেবাই নিলেন তো?

হ্যাঁ, নিলাম নিলাম, তোমার ভয় নেই মেহেদি। আমার মরিয়ম মেয়ে এমন কিছু করতে পারে না যাতে মির্জা তাকে গ্রেফতার করবার হুকুম দেবে। কী এমন করেছে ও শুনি?

নানিবেগমসাহেবা, ফিরিঙ্গি সাহেব ক্লাইভের কাছে গিয়ে মরিয়ম বেগমসাহেবা নিজামতের ফৌজি খবর ফাঁস করে দিয়েছে। চেহেল্-সুতুন থেকে পালিয়ে গিয়ে বেগমসাহেবা এতদিন সেই ফিরিঙ্গি সাহেবের কাছেই ছিল।

মরিয়ম বেগম যে ফিরিঙ্গিদের কাছে ছিল তার প্রমাণ আছে? কেউ দেখেছে?

হ্যাঁ নানিবেগমসাহেবা। সবাই জানে মরিয়ম বেগমসাহেবা সেখানে ছিল। বশির মিঞা নিজে দেখেছে, দেখে এসে নবাবকে খবর দিয়েছে।

কে বশির মিঞা?

বশির মিঞা নিজামতের জাসুস, অনেক দিনের পুরনো জাসুস। সে মিথ্যে কথা বলতে যাবে না।

নানিবেগমসাহেবা যেন রেগে গেল।

বললে–মিথ্যে কথা বলবে না নিজামতের জাসুস? তুমি আমাকে শেখাচ্ছ মেহেদি? ভেবেছ আমি নিজামতের কিছুই জানি না? মিথ্যে কথা দিয়েই তো নিজামত চলছে। মিথ্যে কথার জন্যেই তো আজ নিজামত ভেঙে পড়তে চলেছে! মিথ্যে কথা কে না বলে এখানে মেহেদি? তুমি মিথ্যে কথা বলো না? তোমরা যদি সবাই সত্যি কথা বলতে তো আজ আমার মির্জার এই দুর্দশা হয়? তোমরা যদি সত্যি কথা। বলতে তো আজ এমন করে চেহেল্-সুতুন ছেড়ে আমাকে এখানে আসতে হয়? তোমরা যদি সবাই সত্যি কথা বলতে তো আজ কলকাতার ফিরিঙ্গিরা নিজামতের সঙ্গে লড়াই করতে ভরসা পায়?

বলতে বলতে নানিবেগমসাহেবা যেন হাঁফাতে লাগল।

তারপর একটু দম নিয়ে বললে–চলো, কোথায় আমার মেয়েকে রেখেছ, চলো, আমি তাকে চেহেল্‌-সুতুনে নিয়ে যাব চলো

মেহেদি নেসার বলতে গেল কিন্তু আলি জাঁহা…

নানিবেগম বোমার মতো ফেটে উঠল–আলি জাঁহা আমার নাতি, তার সম্বন্ধে তোমায় কিছু ভাবতে হবে না। সে আমি বুঝব। মির্জা যখন লক্কাবাগ থেকে ফিরবে তখন এ-সম্বন্ধে আমি তার সঙ্গে বোঝাঁপড়া করব। তুমি কে? তুমি তো মির্জার নোকর তুমি বার করে দাও মরিয়ম বেগমকে, চলো–

সমস্ত মতিঝিলটা সেদিন নানিবেগমসাহেবার গলার শব্দে গমগম করে উঠেছিল–

মেহেদি নেসার সাহেবের মুখে তখন আর কথা নেই। আস্তে আস্তে নানিবেগমসাহেবার সঙ্গে ওপরে উঠতে যাচ্ছিল, হঠাৎ এক কাণ্ড ঘটল।

নানিবেগমসাহেবা!!!

খোজা বরকত আলি দৌড়োতে দৌড়োতে এসে তখনও হাফাচ্ছে। একটু সামলে নিয়ে বললে–নবাব চেহেল্‌-সুতুনে ফিরে এসেছেন নানিবেগমসাহেবা

নবাব? আমার মির্জা? ফিরে এসেছে?

মেহেদি নেসারও যেন আকাশ থেকে পড়েছে–নবাব? আলি জাঁহা? ফিরে এসেছে? কখন?

জি হাঁ, আবভি।

এক মুহূর্তে যেন ওলোটপালোট হয়ে গেল সমস্ত পৃথিবীটার। এক মুহূর্তে যেন পৃথিবীর মুখখানাই আমূল বদলে গেল। পৃথিবীর মুখখানা এক মুহূর্তে সাদা ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে এল। দিনদুনিয়ার নবাব শা কুলি খান বাহাদুর মির্জা মহম্মদ আলমগির লড়াই করতে করতে ফিরে এসেছে, এ যেন সকলের কাছে বিস্ময়। নানিবেগমসাহেবা সেই অবস্থাতেই আবার তাঞ্জামে গিয়ে উঠল। আবার সামনে পেছনে জোড়া হাতি উলটো দিকে চেহেল্‌-সুতুনের পথে চলতে শুরু করল। শোহনাল্লা রসুল আল্লা! খোদাতালাহ, তোমার দোয়া বান্দা চিরকাল স্মরণ করবে। তুমি শুধু আমারই আল্লাতালাহ খোদাতালাহ নও। তুমি মুর্শিদাবাদের নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দৌল্লারও খোদাতালাহ। তোমার বহুত বহুত মেহেরবান। তুমি আমাকে দেওয়ান-ই-খালসা করে দিলে, এদয়া আমি আমার জিন্দগিতে কখনও ভুলব না।

মেহেদি নেসারও খানিক অন্যমনস্ক থেকে পালকিতে চড়ে বসল। আর তারপর মতিঝিলের সদর ফটকের বাইরে বেরিয়ে সেপালকি চকবাজারের রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

এতক্ষণে সচ্চরিত্রর যেন সংবিৎ ফিরেছে। কান্তও থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল।

 কী হল পুরকায়স্থমশাই? নবাব ফিরে এল কেন?

কিন্তু সে প্রশ্নের উত্তর তখন কে দেবে? মানুষের জয়যাত্রার সামনে তখন নবাবের মনদ টলমল করতে শুরু করেছে। মুর্শিদাবাদের চকবাজারের রাস্তায়, অলিতেগলিতে তখন ভীত-জাগ্রত মানুষ প্রথম প্রশ্ন করতে শুরু করেছে-নবাব ফিরে এল কেন? কী হয়েছে? ক্যা হুয়া হায়? হোয়াটস আপ?

*

এ তো ১৭৫৭ সালের ২৪ জুনের সকালের ঘটনা। কিন্তু ২৩ জুন তারিখে লঙ্কাবাগের যুদ্ধ প্রান্তরে এর শুরুটাও এই সঙ্গে বলা উচিত। একদিকে সংহত শক্তির উদগ্র মনোবল, আর একদিকে চুরি, বিশ্বাসঘাতকতা, ষড়যন্ত্র আর বিলাসিতা। যুদ্ধের সময় কি বিলাস পেশায়?কিন্তু তখনও সোনার কলকে চাই, জড়োয়ার তলোয়ার চাই। তখনও চাবুকের অত্যাচার, তখনও আমির-ওমরাহমিরকশির বিশ্বাসঘাতকতা।

মিরমদন গীতা পড়েনি, কিন্তু লড়াই করতে করতে জান দিয়েছে। সে জান দিয়ে তার জবান রেখেছে। সামনে যখন দুশমন সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে তখন তো এদের চাবুক মারা উচিত হয়নি। একথা বোঝবার মতো বুদ্ধি তোমার নেই ইয়ারজান। তোমরা আমাকে না জিজ্ঞেস করে কেন এমন করতে গেলে? এরা যদি সবাই এখন আমার দুশমন হয়ে যায়? হয়তো দুশমন হয়েই গেছে। এরা দুশমনি করলে এসময়ে কী করব আমি?

মিরজাফর আলি সাহেব।

বড় আদরের সুর মির্জা মহম্মদের গলায়। এ-আদর তো তখন ছিল না আলি জাঁহা। তখন তো তুমি তোমার মিরবকশি মোহনলালকে সেলাম করতে হুকুম দিয়েছিলে। সেদিন তো তুমি ভাবোনি একদিন তোমারও বিপদ আসতে পারে, একদিন তোমারও দুর্দিন আসতে পারে!

সকাল পর্যন্ত বেশ ছিল। কাল রাত থেকেই নবাবের সব কথা মনে পড়ছিল। সেই আলিবর্দি খাঁর কথাগুলো। সেই হোসেন কুলি খর কথা, ঘসেটি বেগমসাহেবার কথা। রাত্রেও ভাল ঘুম হয়নি। তারপর সকালবেলাতেই সোনার কলকেটা চুরি হয়ে গেল। তার মিরমদনের অপঘাত মৃত্যু।

মিরমদনের মৃতদেহটা নিজের তাঁবুর মধ্যে আনতে হুকুম দিয়েছিল নবাব।

মিরমদনের মরা মুখখানার দিকে চেয়ে দেখলেব। সত্যিইবাবের জন্যে জান দিয়ে মিরমদন বুঝিয়ে দিয়ে গেল যে, সেনবাবকে ভালবাসে। কেন আমাকে তুমি ভালবাসতে মিরমদন? আমার তো কোনও গুণ নেই। আমি তো তোমাদের কাউকে উপযুক্ত সম্মান দিতে পারিনি। আমার যে টাকা ছিল না রিমন। বিশ্বাস করো এখনও আমার টাকা নেই। আমি মহঅ জগজির কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সকলের মাইনে মিটিয়ে দিয়েছি। আমি চরিত্রহীন, লট নবাব তোমাদের। আমার জন্যে তোমার জান দেওয়া ঠিক হয়নি মিরমদন। তুমি ভুল করেছ মিরমদন, আমি কাছি তুমি ভুল করেছ।

হঠাৎ বোধহয় খেয়াল হল সবাই চারপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এ চেহেল্‌-সুতুলও নয়, মতিঝিলও নয়। এমনকী এ মুর্শিদাবাদও নয়। লক্কাবাগ।

মিরজাফর আলি সাহেব কোথায়?

নেয়ামত বললে–আমি গিয়ে ডেকে এসেছি জাঁহাপনা

তা আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন?আমার হুকুম কি মানতে চায় না মিরজাফর আলি? আমি কি মুর্শিদাবাদের নবাব নই? কী মনে করেছে মিরজাফর আলি? আবার এত্তেলা দে–যা

হঠাৎ চারদিক থেকে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। বর্ষাকালে বৃষ্টি নামা নতুন নয়। কিন্তু এমন সময় কেন বৃষ্টি এল?নবাব মির্জা মহম্মদ বাইরে আকাশের দিকে চাইলে।

ইয়ারজান বললে–বৃষ্টি এল আলি জাঁহা

নবাব বললে–জেনারেল ল’ কবে এসে পৌঁছোবে ইয়ারজান?

রওনা দিয়েছে, কাল এসে পৌঁছোবে নিশ্চয়। জেনারেল ল’ এলে আর কোনও ভাবনা নেই আলি জাঁহা, সঙ্গে হাজার হাজার সেপাই আছে তার

পাশেই মিরমদনের মৃতদেহটা পড়ে রয়েছে। মির্জা মহম্মদ সেই দিকে একবার চাইলে। তারপর বললে–দেখলে তো ইয়ারজান, এতবার ডেকে পাঠালাম মিরজাফর আলিকে, তবু একবারও এল না। আমি কি তার পায়ে ধরে সেধে আনতে যাব সে মনে করেছে? সে নবাব না আমি নবাব, ইয়ারজান?

আপনিই নবাব আলি জাঁহা!

মির্জা মহম্মদ বললেন, না আমি রাগব না ইয়ারজান। এই সময়ে রাগারাগি করা ঠিক নয়। এই সময়ে সবাইয়ের সঙ্গে মিষ্টি কথা বুলতে হয়। এখন দেখাতে হয় যেন সবাইই আমার প্রিয়জন। কিন্তু ইয়ারজান, আমি তোমাকে বলে রাখছি, এই লড়াইয়ের পর আমি কাউকে রেহাই দেব না। এখন আমি সবাইকে চিনে নিয়েছি, কে দোস্ত আর কে দুশমন সব চিনে নিয়েছি–আমি কাউকে রেহাই দেবনা–

অত জোরে জোরে কথা বলবেন না আলি জাঁহা, কেউ শুনতে পাবে।

কে শুনতে পাবে? মিরমদন? মিরমদন তো মারা গেছে। জানো ইয়ারজান, খোদাতালার এক তাজ্জব কানুন। মরে গেলে কেউ আর কিছু জানতে পারে না। একদিন আলিবর্দি খাঁ মারা গেছে, একদিন সুজাউদ্দিন খাঁ মারা গেছে, আর একদিন আমিও মারা যাব। এখন আমি এখানে এই যে লঙ্কাবাগে বসে ফিরিঙ্গদের সঙ্গে লড়াই করছি, আলিবর্দি খাঁ এসব জানতেও পারছে না। আবার একদিন আমি মরে গেলেও জানতে পারব না আমার মসনদে কে বসল। জিন্দগিটা বড় তাজ্জব চিজ ইয়ারজান

আলি জাঁহা, এখন আপনি ওব কথা নাই বা ভাবলেন।

আচ্ছা ইয়ারজান, এত কথা থাকতে মরে যাওয়ার কথাই বা আমার মনে আসছে কেন বলো তো? আমি কি ভয় পেয়েছি?

ইয়ারজান বললে–আপনি ভয় পাবেন একথা কে বিশ্বাস করবে আলি জাঁহা।

আচ্ছা, ফিরিঙ্গি কর্নেল ক্লাইভ আমাকে ভয় করে?

নিশ্চয় ভয় করে আলি জাঁহা।

কিন্তু তা হলে কোন সাহসে আমার সঙ্গে লড়াই করতে এসেছে সে? আমার মিরবকশি তো ইচ্ছে করলেই ওদের গুঁড়ো করে দিতে পারে।

ইয়ারজান বললে–বোধহয় ওর মরবার সাধ হয়েছে আলি জাঁহা।

মির্জা মহম্মদ হা হা করে হেসে উঠল। কথাটা খুব ভাল লেগেছে নবাবের। বললে–খুব ভাল কথা বলেছ ইয়ার, খুব ভাল কথা বলেছ!

তারপর একটু থেমে বললে–কিন্তু কেউ কি সাধ করে মরতে চায় দুনিয়ায়? এমন কেউ আছে যার সাধ হয় মরতে?

কেন হবে না আলি জাঁহা। ফিরিঙ্গি কর্নেলটা তিনবার মরতে গিয়েছিল পিস্তল দিয়ে, আমি শুনেছি।

সেকী?

মির্জা মহম্মদের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। মরতে গিয়েছিল? আত্মঘাতী হতে গিয়েছিল? কেন?

তা জানি না আলি জাঁহা।

কথাটা শুনে পর্যন্ত মির্জা মহম্মদের মুখটা যেন গম্ভীর হয়ে গেছে। যে-লোক নিজের হাতে নিজে মরতে যায়, সে তো সোজা লোক নয়। সে তো সব পারে।

আচ্ছা ইয়ারজান, আগে তুমি ওকথাটা বলোনি কেন?

কোন কথাটা আলি জাঁহা?

ওই যে ফিরিঙ্গি কর্নেল বাচ্চা তিনবার গুলি করে আত্মহত্যা করতে গিয়েছল? আগে জানলে আমি অন্য ব্যবস্থা করতাম। ওরা খুব খারাপ লোক হয় জানো ইয়ারজান, যারা আত্মহত্যা করতে যায়

জানি আলি জাঁহা!

আমি কিন্তু কখনও আত্মহত্যা করব না ইয়ারজান। যারা আত্মহত্যা করে তারা হেরে যায়, অ জানো তুমি? আমি আলিবর্দি খাঁ’র মতো জিন্দগির লড়াই করে তবে মরব, তার আগে মরব না আমি। আমি যখন বুড়ো হব, যখন আলিবর্দি খাঁর মতো বুড়ো হব, তখনও লড়াই করব। লড়াই করতে করতে আমি মরব

হঠাৎ আবার মিরজাফরের কথাটা মনে পড়ে গেল।

আচ্ছা, ইয়ারজান, তুমি একবার যাও তো, তুমি নিজে একবার মিরজাফর আলির কাছে যাও তো। আমি যে তাকে গালাগালি দিয়েছি তা যেন বোলো না। গিয়ে বলো–মিরমদন মারা গেছে, তাইনবাব একবার আপনাকে ডাকছে–যাও, নেয়ামতকে দিয়ে ডেকেছি কিনা, তাই হয়তো আসছে না আর খবর নিয়ে এসো তো জেনারেল ল’ কখন আসছে সে-খবর এসেছে কিনা

সেই বৃষ্টির মধ্যেই ইয়ারজান বাইরে বেরিয়ে গেল। ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে। সামনেই মোহনলালের ফৌজ, তার সামনে সিনফ্রে। আর আরও খানিক এগিয়ে, রাজা দুর্লভরাম, ইয়ার লুঙ্ক খাঁ, আর তারও ওদিকে একেবারে শেষ প্রান্তে মিরজাফর আলির ফৌজ। বৃষ্টিতে সমস্ত ছত্রখান হয়ে গেছে। ফিরিঙ্গিদের দিক থেকে কামান ছোঁড়া খানিকক্ষণের জন্যে বন্ধ আছে। হাতির পিঠের ওপর বসে আছে। মিরজাফর।

ইয়ার জানকে দেখে মিরজাফর সাহেব হাতির পিঠ থেকে নেমে এল।

আলিসাহেব, আমাকে আবার নবাব পাঠালে আপনার কাছে!

মিরজাফর আলি সাহেব বললে–সে তো বুঝতে পাচ্ছি। মিরমদনটা তো খতম হয়েছে। আমাকে আবার ডাকছে কেন?

নবাব খুব ভয় পেয়ে গেছে আলিসাহেব, তাই আপনার সঙ্গে একটু কথা বলে সাহস পেতে চায়।

কী কথা হচ্ছিল এতক্ষণ?

ইয়ারজান বললে–কেবল মরার কথা

 মিরজাফর সাহেব শুনে অবাক হয়ে গেল।

 মরার কথা মানে?

ওই মিরমদন সাহেবের মুর্দাটা সামনেই পড়ে রয়েছে তো, সেইজন্যে সেইসব কথাই হচ্ছিল এতক্ষণ। মারা যাবার পর মানুষ কোথায় যায়, এইসব। মানে খুব ভয় পেয়ে গেছে নবাব

মিরজাফর বললে–পাক পাক, একটু ভয় পাওয়া ভাল। ভয়ের এখন হয়েছে কী? আমি আরও ভয় পাইয়ে দেব। এবার মোহনলালটা মরলে আর একটু সুবিধে হয়। বেত্তমিজটা অনেক কামান ছুঁড়েছে, ফিরিঙ্গিদের অনেকগুলো সেপাই মারা গেছে। ক্লাইভসাহেব খুব গোঁসা করেছে আমার ওপর বুঝতে পারছি

জেনারেল ল’ সাহেব কবে আসবে জিজ্ঞেস করছিল নবাব।

বলে দাও কালই আসবে, তা হলে সেই আশায় বসে থাকবে মির্জা।

আর বলছিল লড়াই থেকে ফিরে গিয়ে কাউকে রেহাই দেব না। সব দুশমনদের খতম করে ছাড়বে!

 মিরজাফরের মুখ দিয়ে একটা গালাগালি বেরোল–আমি খতম করতে দিচ্ছি! ওই দেখো না, বৃষ্টিতে বারুদটারুদ সব ভিজে গেছে, ওরা ঢাকা দিচ্ছিল, আমি বারণ করেছি। ভিজুক, সব বারুদ ভিজে যাক–

ইয়ারজান বললে–আপনি একবার চলুন আলিসাহেব, নেয়ামতকে আগে পাঠিয়েছিল, এবার আমাকে পাঠালে। আপনি না-গেলে আমাকে মাঝখান থেকে সন্দেহ করবে নবাব

না না, সন্দেহ করলে আমাদের সব মতলব ফাস হয়ে যাবে, চলো যাই

 বৃষ্টিটা যেন আরও জোরে নামল। মিরজাফর আলি ইয়ারজানকে সঙ্গে নিয়ে মির্জা মহম্মদের তাবুর দিকে চলতে লাগল।

*

কিন্তু ওদিকে তখন কর্নেল ক্লাইতে ক্যাম্পে দুর্ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে সবাই। এই বৃষ্টির সময়ে যদি হঠাৎ হামলা করে বসে নেটিভরা। যদি এই গোলাবারুদ সবার সময় হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে আমাদের লাইনের ভেতরে। ভাবতেই হৃদকম্পহল মেজর আয়ারকুটের। ল্যাসিংটন মারা গেছে। আর ল্যাসিংটনের মতো আরও কত সেপাই সার সার মরে পড়ে আছে এপাশে-ওপাশে। ঘাই হাল ছেড়ে দিয়েছে। সেপাইরা যেন আর চাইছে না যে যুদ্ধ হোক। কেউ-ই চাইছে না। মনে মনে গজরাচ্ছে সবাই।

আমরা কি টাকার জন্যে প্রাণ দিতে এসেছি নাকি এখানে?

কোথায় যেন একটা চাপা আক্রোশ’ গর্জন করে উঠছে সকলের মনে। কেউ লড়াই করবে না। সকলেরই জীবনের দাম আছে। টাকার জন্যে কেউ প্রাণ দিতে পারবে না।

ততক্ষণে জামা-প্যান্ট সব ভিজে জ্যাবজেবে হয়ে গেছে ক্লাইভের। ছাদের ওপর থেকে নীচে নেমে এল কনেল।

কে যুদ্ধ করবে না? কে? কারা?

হাতের পিস্তলটা বাগিয়ে নিয়ে সামনের দিকে উঁচু করে বললে–কে? কারা?

আশেপাশে, সামনে যারা ছিল তারা সবাই স্থাণুর মতো চুপ হয়ে গেল। আর কারও মুখে কথা নেই।

বৃষ্টি হয়েছে তাতে কী হয়েছে? বৃষ্টিতে ভিজলে মানুষ মরে যায়? আর মরতেই তো সবাই ফাইট করতে এসেছ তোমরা। কেউ বাঁচবার জন্যে যুদ্ধ করতে আসে? একদিন তো মরতেই হবে। কে চিরকাল বেঁচে থাকতে এসেছে পৃথিবীতে? কে? নাম বলল। আমি তাদের গুলি করে মারব। নাম বলো? তুমি? তুমি? ইউ?

কেউ উত্তর দেয় না।

ক্লাইভ আবার বলতে লাগল–সবাই লেকের ধারে যাও, ইন এ বডি গিয়ে ট্রেঞ্চ খোঁড়ো, ওখান থেকে এনিমি লাইনের দিকে ফায়ার করো। যাও-কুইক

আর অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গে সেপাইগুলো যেন মেশিনের মতো খালের ধারে চলে গেল। সেখান থেকে সবাই নবাবি ফৌজের দিকে ফায়ার করতে লাগল।

ফায়ার, ফায়ার

ক্লাইভের শরীরের ভেতরে তখন যেন দশটা ক্লাইভ ঢুকে পড়েছে। একটা মানুষের বুকে এত সাহসও থাকে। একটু ভয়-ডরও নেই মানুষটার। একলা এতগুলো সেপাইয়ের সমানে মওড়া নিয়েছে। সকাল থেকে খাওয়ার সময় পায়নি। বৃষ্টিতে ভিজেছে। সর্দিকাশির ভয়ও কি নেই?

পাশেই আয়ার কুট দাঁড়িয়ে ছিল।

 ক্লাইভ জিজ্ঞেস করলে জেনারেল ল’ কখন আসছে? কিছু খবর পেয়েছ?

না কর্নেল!

 যদি জেনারেল ল’ এসে পড়ে তো তুমি মরবার জন্যে তৈরি থাকবে। এখান থেকে এক পা কেউ পেছোতে পারবে না। নবাবের হাতে বন্দি হওয়ার চেয়ে আমরা বরং সবাই মরব, সেও ভাল। কিন্তু কোম্পানির নামে ডিসগ্রেস দিতে দেব না–ফায়ারফায়ার–

হঠাৎ নজরে পড়ল দূরে নবাবের আর্মি ডানদিকে সরে যাচ্ছে। কমান্ডার মিরজাফরের ফৌজ ওটা।

কুট, ওরা ওদিকে যাচ্ছে কেন? কী মতলব?

আয়ার কুটও বুঝতে পারছে না। হতবাক হয়ে দেখতে লাগল সেই দিকে।

ওরা কি আমাদের এনসার্কেল করতে আসছে নাকি?

কুট বললে–না কর্নেল, তা কী করে হয়? মিরজাফর যে আমাদের ওয়ার্ড দিয়েছে। ও তো আমাদের বিট্রে করবে না

ক্লাইভ বললে–কিছু বলা যায় না,নবাবের ওমরাহদের বিশ্বাস নেই। ওরা সব করতে পারে। ওরা ওদের গডকে পর্যন্ত বিট্রে করতে পারে, বি কেয়ারফুল!

কিন্তু না, মিরজাফরের আমি এক ফার্লং সরে গিয়ে আবার হল্ট করল। কী মতলব কে জানে। গোড়া থেকেই ক্লাইভ ওদের সন্দেহ করে এসেছিল। ওদের কথার ওপর নির্ভর করে এত দূরে এসে এত ঝুঁকি নেবার মানুষ নয় ক্লাইভ।

ক্লাইভ বললে–আই অ্যাম রেডি–ওরা যদি আমাদের ঘিরে ফেলে তো আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব ওদের ওপর।

কুট বললে–কিন্তু ওদের সঙ্গে আমরা পারব কেন কর্নেল? ওদের আর্মি আর আমাদের আর্মি? আমাদের তো গুঁড়িয়ে পিষে ফেলবে।

যুদ্ধ কি নাম্বার দিয়ে হয় কুট?

আয়ার কুট ক্লাইভের কথাটা বুঝতে পারলে না। ক্লাইভ আবার বললে–নাম্বারই যদি আসল হত তো আমি সেন্ট ফোর্ট ডেভিড জয় করতে পারতুম না। যুদ্ধ জেতে কূটনীতি দিয়ে, ডিপ্লোমেসি দিয়ে। আমি যদি এ-যুদ্ধ না জিততে পারি তো এতদিন মিছিমিছি বেঙ্গলে এসেছি, এতদিন মিছিমিছি বেঙ্গলিদের সঙ্গে মিশেছি–

কিন্তু কর্নেল, বাঙালিদের বিশ্বাস করা উচিত নয়, তারা লায়ার!

ক্লাইভ বললে–তোক লায়ার, ইউরোপিয়ানরা লায়ার নয়? সবাই ভাল? ক্লাইমেটের জন্যে দেশে দেশে মানুষ বদলায়। সে বাইরের বদলানো, ভেতরটা সবার এক। গুলি করলে ওদের গা দিয়েও রক্ত পড়ে, আমাদেরও রক্ত পড়ে। ওদের মায়েরা ছেলেদের আমাদের মায়ের মতোই ভালবাসে। ওরাও কূটনীতি জানে, আমরাও জানি। নবাব কি ডিপ্লোমেসি জানে না বলতে চাও? ওই যে ওরা ফায়ার করছে না, কেন করছে না?

কুট বললে–কারণ জেনারেলরা নবাবের এগেনস্টে–

ভুল, ভুল। সব তোমার ভুল। নবাব চায় ওয়ারটা প্রোলংকরতে। যুদ্ধটা যাতে আরও বেশিদিন টেনে নিয়ে যেতে পারে সেই চেষ্টা করছে। ওদের আর্মি আছে, ওদের মেটিরিয়্যালস আছে, ওদের ফুড আছে, আর ওদেরই কাস্ট্রি এটা। বেশিদিন যুদ্ধ চললেই তো নবাবের লাভ। ততদিনে জেনারেল ল’ এসে যাচ্ছে

কিন্তু কর্নেল, মিরজাফর আলির কী মতলব তা তো বুঝতে পারছি না। ও কি এমন করে আমাদের কথা দিয়ে এখন কথার খিলাফ করবে?

কর্নেল বললে–কূটনীতিতে কথার খিলাফ বলে কোনও কথা নেই। যখন যেমন সিচুয়েশান, যখন যেমন অবস্থা, সেইভাবে কাজ করাই ডিপ্লোমেসি। কিন্তু এখন দেখতে হবে, ও বড় ডিপ্লোম্যাট না আমি বড় ডিপ্লোম্যাট। মিরজাফরও নিজের স্বার্থ দেখছে, আমিও আমার স্বার্থ দেখছি, এখন কে কূটনীতিতে জেতে তাই দেখতে হবে

হঠাৎ ফ্লেচার এসে হাজির হয়েছে।

কী খবর, ফ্লেচার?

 ফ্লেচার বললে–মিরমদন মারা যাবার পর থেকে নবাব খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছে

 ভেরি গুড। জেনারেলরা কী বলছে?

মোহনলাল বলছে এখনই সকলকে একসঙ্গে ফাইট করতে। রাজা দুর্লভরাম, ইয়ার লুৎফ খাঁ আর মিরজাফর আলি ফায়ার করছে না বলে নবাবের কাছে কমপ্লেন করেছে।

তারপর? সেই সোনার কলকেটা পাওয়া গেল?

না কর্নেল। নবাবের ফ্রেন্ড খিদমদগারদের সবাইকে বেত মারবার অর্ডার দিয়েছিল, নবাব গিয়ে সে অর্ডার বাতিল করে দিয়েছে।

কেন?

নবাব ভয় পেয়ে গেছে। বলছে এ-সময়ে বেত মারলে ওরা রিভোল্ট করতে পারে। আমাদের আমিকে হারিয়ে তারপরে সবাইকে বেত মারা হবে।

একথা তুমি জানলে কী করে?

নবারে ফ্রেন্ড ইয়ারজান সব কথা মিরজাফর আলিকে বলে দিয়েছে। মিরজাফর আলি সাহেবই আমাকে এসব কথা জালে।

মিরজাফর আলি সাহেবের খবর কী? তার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

হ্যাঁ কর্নেল। এই লেটারটা দিয়েছে আপনাকে বলে একটা চিঠি এগিয়ে দিলে ক্লাইভের দিকে। দিয়ে বললে–মিরজাফর আলি এখনই নবাবের সঙ্গে দেখা করতে গেল–

ক্লাইভ তাড়াতাড়ি এনভেলাপটা খুলে চিঠিটা পড়তে লাগল।

ডিয়ার কর্নেল, তুমি শুনে খুশি হবে, বৃষ্টিতে আমাদের গোলাবারুদ সব ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। এখন ওগুলো না শুকোলে আর গুলি ছোঁড়া যাবে না। সব অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। তোমাকে আমি যে কথা দিয়েছিলাম সে কথা বর্ণে বর্ণে রাখছি। আমি, ইয়ার লুৎফ খা, কিংবা রাজা দুর্লভরাম কেউই তোমাদের ফৌজের ওপর ফায়ার করিনি, নবাব পাছে সন্দেহ করে তাই আমগাছগুলোর ডালের দিকে লক্ষ করে কয়েকটা গুলি ছুঁড়েছি। তোমাদের কুড়িজন সেপাই মারা গেছে শুনে খুব দুঃখিত। ল্যাসিংটনও মারা গেছে শুনলাম। কিন্তু আমাদের আরও অনেক বেশি লোক মারা গেছে। জখমও হয়েছে অনেক। তুমি শুনে খুশি হবে আমাদের মিরমদন মারা গেছে তোমাদের গুলিতে। খুব সুখবর। আমি আমার ফৌজি সেপাইদের এদিক-ওদিক নড়িয়েছি, নইলে নবাবের সন্দেহ হত। চারদিকের এই অবস্থার মধ্যে নবাব খুব ভয় পেয়ে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। মিরমদন মারা যাবার পর এখন নবাবের আমি ছাড়া আর কোনও গতিই নেই। দেখি আমি কী করতে পারি। ইতি–

ক্লাইভ চিঠিটা ভাজ করে বললে–লোকটা দেখছি রিয়্যাল স্কাউড্রেল, কথা রাখছে

পাশে আয়ার কুট দাঁড়িয়ে ছিল। সে অবাক হয়ে গেছে।

 বললে–রিয়্যাল স্কাউড্রেল বলছ কেন কর্নেল?

রিয়্যাল স্কাউড্রেল নয়।নবাব যতগুলো লোকের ওপর নির্ভর করছে সবগুলো স্কাউড্রেল। নবাবের ভাগটাই খারাপ দেখছি। সবাই, সবাই নবাবের এগেনস্টে! ওই জগৎশেঠ থেকে শুরু করে উমিচাঁদ, মিরজাফর, সবাই। ইন্ডিয়ার সত্যিই ব্যাড লাক।

কুট তবু বুঝতে পারলে না। বললে–কিন্তু তাতে তো আমাদেরই ভাল কর্নেল। তা হলে তো আমরাই জিতব

ক্লাইভ হাসল শুধু কথাটা শুনে। কিছু বললে–না মুখে। নিশ্চয়ই আমাদের ভাল। তা হলে তো আমরাই জিতব! তুমি, আমি, আমরা সবাই যা আছি তাই-ই থাকব কুট। কেউই জিতবে না। জিতবে শুধু কোম্পানি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররাই শুধু জিতবে। তারা মোটা ডিভিডেন্ড পাবে। তারা বাড়ি করবে, গাড়ি চড়বে, মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করবে। আর আমরা বউ-ছেলেমেয়ে ফ্যামিলি সব দূরে রেখে এখানে এই মশা-মাছি-জঙ্গল সাপ সব নিয়ে কেমন করে আরও ভাল করে মানুষ খুন করা যায় তারই মহড়া দেব। আর দরকার হলে ল্যাসিংটনের মতো বেঘোরে মরব।

ক্লাইভ সেখান থেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল-ফায়ার-ফায়ার

.

এ-ঘটনার বহুদিন পরে কর্নেল ক্লাইভ বিলেতে ফিরে গিয়ে এই সব কথাই ভুলতে চেষ্টা করত। সবাই জানত লর্ড ক্লাইভ শুধু লর্ডই নয়, ইংলন্ডের সবচেয়ে বড়লোক। বিরাট টাকার মালিক, বিরাট খেতাব, বিরাট সম্পত্তি, প্রতিপত্তি, প্রতিষ্ঠা।

স্ত্রী এসে জিজ্ঞেস করত–কী ভাবছ? হঠাৎ যেন চমক ভেঙে যেত লর্ড ক্লাইভের। বেঙ্গলের সেই ব্যাটল-ফিল্ডের কথা মনে পড়ত। মনে পড়ত নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার কথা। মিরজাফর, উমিচাঁদ, জগৎশেঠ, নবকৃষ্ণের কথা। আর মনে পড়ত বেগম মেরী বিশ্বাসের কথা।

তাস খেলবে?

তাস?

এক একদিন দমদমার বাগানবাড়িতে বারান্দায় বসে তাসও খেলেছে লর্ড। সামান্য একটা মেয়ে। বেগম মেরী বিশ্বাস তার সব লাইফ হিস্ট্রিটা বলেছিল লর্ড ক্লাইভকে। চারদিকে ঝিঁঝিপোকার ডাক। দুরে মিলিটারির আর্মি ব্যারাক। হাতি-ঘোড়া-উট। তার ওপাশে আর্মির লোকেরা মদ খেয়ে হইহই করছে।

হাতি-উটের পিলখানা পেরিয়ে কেবল বড় বড় গাছ। তাস খেলতে খেলতে একবার ওইদিকে চোখ পড়লে দেখতে পেত একটা কৃষ্ণচূড়া গাছে অসংখ্য লাল ফুল ধরেছে। বেঙ্গলিরা বলত কৃষ্ণচূড়া ইংরেজরা বলত-ক্লেম অব দ্য ফরেস্ট। বনের আগুন। বনের আগুনের শিখা। ক্লাইভের নিজের জীবনের আগুনই যেন সহ-শিখা হয়ে ওই গাছটার মাথায় ডালে ডালে জ্বলে উঠত। আর ইন্ডিয়া? ইন্ডিয়াও তখন আগুন। সমস্ত ইন্ডিয়াতেই তখন ফ্লেম অব দ্য ফরেস্ট।নবাব সিরাজউদ্দৌলা, তারপর মিরজাফর আলি, তারপর মিরকাশিম…

তাস খেলবে?

ক্লাইভ বললে–না, এখন আর ভাল লাগছে না তাস খেলতে

বেগম মেরী বিশ্বাসও বলত-না, এখন আর ভাল লাগছে না তাস খেলতে

তারপর সোজা সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে চেয়ে থাকত বেগম মেরী বিশ্বাস। এখন তো আর কোনও ভয় নেই। তখন কোনও ভয়ই আর ছিল না মরালীর। একদিন কোন এক দুর্যোগের লগ্নে ইন্ডিয়ায় গিয়ে হাজির হয়েছিল রবার্ট ক্লাইভ, আর সমস্ত দেশটা লন্ডভন্ড করে দিয়ে তবে যেন তার নিবৃত্তি হয়েছিল।

বেগম মেরী বিশ্বাস এক-একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত।

কী হল? কাঁদছ কেন?

না, কিছু না বলে বেগম মেরি বিশ্বাস চোখ দুটো মুছে ফেলত নিজের শাড়ি দিয়ে।

 কিন্তু ক্লাইভ জানত সব। এক-একটা করে প্রত্যেকটা কাহিনী যেমন উদ্ধব দাস শুনত, তেমনি ক্লাইভও শুনত। উদ্ধব দাস কাব্য লিখবে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের মতো। আর ক্লাইভ? রবার্ট ক্লাইভ তখন বলতে গেলে একাই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব-সুবাদার–ফৌজদার সবকিছু। রবার্ট ক্লাইভের এক হুকুমে তখন রাজ্য ওঠে আর রাজ্য পড়ে। কিন্তু সেইক্লাইভ সাহেবের বিধাতাপুরুষেরও তখন এমন ক্ষমতা নেই যে বেগম মেরী বিশ্বাসের দুঃখ ঘোচায়।

আমি জন্মেছিলাম এক মফসসলের জমিদারের চাকরের ঘরে। কিন্তু ভাগ্যের কোন বিধানে আমি আজকে আবার রাজরানি হয়েছি। আমারই সঙ্গে কত বেগম ছিল চেহেল্‌-সুতুনে। গুলসন বেগম, পেশমন বেগম, তক্কি বেগম, বব্বু বেগম, নানিবেগম, লুৎফুন্নিসা বেগম। তারা সব কোথায় গেল, আর আমিই বা কোথায়? তখন টাকা ছিল না, এখন টাকা হয়েছে..।

কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে মেরী বেগম চিৎকার করে উঠত। বলত–কেন তুমি খুন করতে গেলে নবাবকে? নবাব তোমার কী ক্ষতিটা করেছিল? তাকে পৃথিবীর এককোণে একটু বাঁচতে দিলে তোমাদের কোম্পানির এমন কী সর্বনাশটা হত?

একবার তো কোনও উত্তর নেই, তাই রবার্ট ক্লাইভ চুপ করে থাকত। কোনও জবাব দিত না। আর জবাবই বা দেবে কী? ক্লাইভ নিজেই কি জানত অমন হবে? নিজেই কি জানত মানুষের হিংসা অমন করে তার প্রতিশোধের পিপাসা পরিতৃপ্ত করবে।

আর অমন করে প্রতিশোধের পিপাসা পরিতৃপ্ত না হলে মরালীকেই কি এখানে এসে এই ক্লাইভের বাগানবাড়িতে বেগম মেরী বিশ্বাস নাম নিতে হত। না কান্তকেই অমন করে…

কিন্তু কান্তর কথা ভুলে যাওয়াই ভাল। তার কথা এখন থাক।

আর শুধু কান্তই নয়, কান্ত, ঘসেটি বেগম, আমিনা বেগম, নানিবেগমসাহেবা, সকলের কথাই এখন থাক। ইতিহাসের যখন বিপ্লব ঘটে, তখন কে আপন কে পর, কে দূর কে নিকট, কে আত্মীয় কে শত্রু, সে বিচার থাকে না। নির্বিচারে মানুষের প্রতিশোধের স্পৃহাকে চরিতার্থ করেই যে সে কৃতার্থ হয়। কান্না পরের কথা, অনুতাপ পরের কথা, সকলের আগে ইচ্ছার পরিপূরণ। ইচ্ছা পরিপূরণ করেই ইতিহাস তার গতিপথ সুগম করে তোলে।

নইলে ঠিক সেই ভোরবেলাই বা হাতিয়াগড়ের ডিহিদার রেজা আলি মুর্শিদাবাদে আসবে কেন?

সেই ২৪ জুন ভোরবেলা। সারা শহরে যখন হইচই হট্টগোল চলেছে, যখন রাস্তায় রাস্তায় নোকজন বেরিয়ে পড়েছে, যখন সবাই সবাইকে জিজ্ঞেস করছে ক্যা হুয়া, ঠিক সেই সময়েই কি আসতে হয় ডিহিদার রেজা আলিকে?

রেজা আলি এলেমদার লোক। সোজা আঙুলে যে ঘি বেরোয় না, এটা রেজা আলির মতো সেযুগে আর কেউ অমন করে জানত না। নোকরিতে সবাই-ই উন্নতি চায়। খোশামোদ করে থোক, কাজ দেখিয়ে হোক, পায়ে ধরে ভিক্ষে করে থোক, চাকরিতে উন্নতি হয়ই। কিন্তু যে-উপায়টা অত্যন্ত অব্যর্থ সেই উপায়টাই রেজা আলি সাহেব চিরকাল অবলম্বন করে এসেছে। সেটা হচ্ছে ওপরওয়ালাকে খুশি করা। ওপরওয়ালাকে খুশি করতে হলে জানা চাই ওপরওয়ালার দুর্বলতাটা কী। সেই দুর্বলতার জায়গাটার সন্ধান জানতে পারলে আর চাই কী? সেইখানটায় সুড়সুড়ি দিলেই তোমার কার্য সিদ্ধি!

মেহেদি নেসারই হল রেজা আলি সাহেবের ওপরওয়ালা। আর সেই মেহেদি নেসারের দুর্বলতার জায়গাটা হল মেয়েমানুষপ্রীতি।

হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইয়ের দ্বিতীয় পক্ষের রানিবিবিকে চেহেল্‌-সুতুনে পাঠিয়ে দিয়ে রেজা আলি ভেবেছিল এবার উন্নতি একটা অবধারিত।

কিন্তু দিন যায় মাস যায় বছর যায়, উন্নতির কোনও সাড়াশব্দ নেই।

শেষকালে টনক নড়ল। নিজামতের এত বড় একটা উপকার করল রেজা আলি, অথচ উন্নতি হল তার। তখন মনে হল নিশ্চয়ই কোথাও কিছু গোলমাল আছে। তখন থেকেই লেগে-পড়ে ছিল রেজা আলি। হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ির আশেপাশে চর লাগল। চর কিছু করতে পারলে না। অনেক ভেবে ভেবে অনেক খোঁজ করে ব্যাপারটা একদিন জলের মতন পরিষ্কার হয়ে গেল। রাজবাড়িতে রানিবিবি নেই। তা হলে শোভারামের মেয়েটা কোথায় গেল? শোভারামের মেয়েটাকেই যদি বদল করে দিয়ে থাকে তো রানিবিবি কোথায় গেল? কোথায় তাকে লুকিয়ে রাখা হল।

এই ভাবনাই দিনরাত পাগল করে তুলল রেজা আলিকে।

তারপর একদিন পাগলাটার সঙ্গে দেখা।

পাগলা উদ্ধব দাস। পাগলা মানুষ, গান গায় আর দুটি খায়। সেই উদ্ধব দাসই খবরটা দিলে।

রেজা আলি এমনিতে কারও খাতির করে না। কিন্তু উদ্ধব দাসকে খুব খাতির করলে সেদিন। পান জর্দা কিমাম দিলে।

জিজ্ঞেস করলে তুমি ঠিক জানো?

উদ্ধব দাস বললে–আমি ঠিক জানব না তো কে জানবে প্রভু?

রেজা আলি জিজ্ঞেস করলে–তারপর?

উদ্ধব দাস বললে–তারপর প্রভু, আমার বউ আমাকে তাড়িয়ে দিলে

তোমার নিজের বউ তোমাকে তাড়িয়ে দিলে?

আজ্ঞে, আমার নিজের বউ আমাকে তাড়াবে কেন? আমার বউয়ের সঙ্গে তো আমাকে দেখাই করতে দিলে না মাগিটা। সাহেব কত করে বললে–মাগিটাকে। ক্লাইভসাহেব যে লোকটা খুব ভাল প্রভু।

সাহেব দেখা করতে দিতে চেয়েছিল?

 হ্যাঁ  প্রভু, মাগিটাই যে সব্বনাশী

সে মাগিটা কে?

আজ্ঞে প্রভু, সে আমার বউয়ের ঝিউড়ি। আমার বউকে দেখাশোনা করে। মাগিটা খাভারনি মেয়েমানুষ! আমাকে দেখলে মারতে আসে তেড়ে!

কী রকম চেহারা বলো দিকিনি?

উদ্ধব দাস যে-চেহারার বর্ণনা দিলে তার সঙ্গে হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ির ঝি দুর্গার চেহারা অবিকল মিলে গেল।

রেজা আলির চোখ খুলে গেল সেইদিনই। এতদিন ডিহিদারি করছে রেজা আলি, অথচ এমন বোকা কখনও বনেনি। সোজা চর পাঠালে কলকাতার বাগবাজারে পেরিন সাহেবের বাগানে। সেখান থেকে চর সন্ধান নিয়ে এসে জানাল যে কেউ নেই সেখানে। সবাই চলে গেছে। ক্লাইভ সাহেবও ফৌজটৌজ নিয়ে যুদ্ধ করতে গেছে নবদ্বীপের দিকে।

তারপর অনেক হয়রানি গেল কয়েকদিন। শেষকালে খবর পাওয়া গেল কৃষ্ণনগর থেকে।

অতিথিশালার ভিড়ের মধ্যে রেজা আলির চর হিন্দু সেজে উঠেছিল। সেখানে দেখল, উদ্ধব দাস রয়েছে। আর একদিন থাকতে থাকতেই খবর পেয়ে গেল, রাজবাড়ির অন্দরেও কোথা থেকে দু’জন কোথাকার জেনানা এসেছে। তাদের জন্যে আলাদা খাবার-থাকবার বন্দোবস্ত হয়েছে। ক্লাইভ সাহেব যেদিন যুদ্ধ করতে নবদ্বীপের দিকে গেছে সেইদিনই জেনানা দু’জন এসে রাজবাড়িতে উঠেছে। রাজবাড়ির রসুইখানা থেকেই সব খবর আদায় করে চর খবরটা দিলে রেজা আলি সাহেবকে।

রেজা আলি মুখে কিছু বললে–না। শুধু ছুঁচোলো গোঁফের দুটো দিক আরও ছুঁচোলো করতে করতে বললে–তওবা তওবা

তারপর যা করণীয় তা করলে পরদিনই। এবার আর লোক মারফত নয়। নোকরিতে উন্নতি করতে হলে খবরটা মেহেদি নেসার সাহেবকে নিজে গিয়ে দিতে হবে। রাত থাকতেই বেরিয়ে পড়ল রেজা আলি ফিরিঙ্গি’র পিঠে। নবাব যেখানেই থাকুক, তাতে কিছু হরজা নেই। মেহেদি নেসার সাহেব থাকতে পারে। তার চেলা মনসুর আলি মেহের মোহরার থাকতে পারে। দফতর ফেলে আর কোথায় যাবে সবাই মিলে।

ভোররাত থাকতে থাকতে মুর্শিদাবাদে পৌঁছে অবাক! এত হল্লা কেন? এত গোলমাল কীসের? চকবাজারের রাস্তায় এত ভোরে তো এত লোক বেরোয় না!

বশির মিঞাও তখন সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানের সামনে পঁড়িয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিল। এত হল্লা কীসের? ক্যা হুয়া?

মাঝিমাল্লারা পাশেই দাঁড়িয়ে ভয়ে কঁপছিল। একবার যখন মেহেদি নেসারের চরের কবলে পড়েছে তখন আর তাদের রেহাই নেই জেনেই নিয়েছে।

ওদিকে কান্ত সারাফত আলির কাছ থেকে মোহর আনতে গিয়েছে।

কিন্তু বশির মিঞা আর দাঁড়াতে পারলে না। আস্তে আস্তে একটু একটু করে পায়ে পায়ে এগোতে লাগল। তবে কি নিজামত বরবাদ হয়ে গেল। ফিরিঙ্গি ফৌজ কি মুর্শিদাবাদের চকবাজারে এসে হাজির হবে নাকি?

ক্যা হুয়া হ্যায় ভেইয়া?

একজন বললে–শুনা হ্যায় নিজামত পালট গয়া

দুর বেওকুফ!

বেওকুফ না বেওকুফ! নিজামত পালটে যাবে মানে? নবাব কি মারা গেছে? মেহেদি নেসার সাহেব কি পটল তুলেছে? বলছিস কী তুই বেল্লিকের মতো? নাকে ঘুষি মেরে মুখ চ্যাপটা করে দেব তোর!

কথাটা মনে মনে বললে–বটে বশির মিঞা, কিন্তু অবস্থাটা দেখে ভাল মনে হল না! পায়ে পায়ে আরও এগিয়ে গেল। দুঃসংবাদ বোধহয় বাতাসের চেয়েও জোরে ছোটে। তবে কি সত্যি সত্যিই দুঃসংবাদ এসে গেছে!

রাস্তায় চলতে চলতে হঠাৎ পেছনে কার গলা শুনে বশির মিঞা মুখ ফিরিয়ে দেখলে ডিহিদার রেজা আলি সাহেব–

আরে বশির মিঞা, তুই?

বশির মিঞা সেলাম করলে সেলাম আলেকুম জনাব রাজধানীতে কী মনে করে?

হাতিয়াগড়ে হলে বশির মিঞাকে আমলই দিত না রেজা আলি সাহেব। কিন্তু মুর্শিদাবাদে অন্যরকম। রাজধানীর লোক, তার ওপর মনসুর আলি মেহের মোহরার সাহেব বশির মিঞার ফুপা।

ফিরিঙ্গি’র পিঠে বসে বসে বললে–মেহেদি নেসার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, সাহেব আছে তো শহরে?

বশির মিঞা বললো হ্যাঁ জনাব, সাহেব তো আছে শহরে, লেকিন বড়ি মুশকিলমে আছে।

 কেন? কী হল?

বশির মিঞা বললে–সে অনেক বাত জনাব। মেহেদি সাহেব এখন আপনার সাথে মুলাকাত করতে পারবে না। অনেক কাম সাহেবের।

রেজা আলি সাহেব বললে–অনেক কম হলে কী হবে, আমার ভি অনেক কামের কথা আছে সাহেবের সঙ্গে

তারপর চারদিকে চেয়ে বললে–এত হল্লা হচ্ছে কীসের রে?

কে জানে জনাব! বলছে, নিজামত পালট গয়া।

সেকী রে? পালটে গেছে মানে? লোকগুলো বেল্লিক নাকি? তা সে যা বলুক, আমার কামটা যে খুব জরুরি।

কী রকম?

তুই বলবি না তো কাউকে? বড় বেওকুফি করে ফেলেছি রে বশির। আসলি রানিবিবি বলে যাকে চেহেল্‌-সুতুনে সেবার পাঠিয়েছিলুম, সে সাচ্চা রানিবিবি নয় রে।

বশির মিঞা অবাক হয়ে গেল। বললে–সেকী জনাব?

হ্যাঁ রে বশির, বড় বেওকুফি করে ফেলেছি। চেহেল্-সুতুনে যাকে পাঠিয়েছি সে হল আসলে হাতিয়াগড়ের নওকরের লেড়কি। আর আসলি রানিবিবি কেষ্টনগরের রাজা কৃষণচন্দরের হাবেলিতে লুকিয়ে আছে।

বশির মিঞার মাথার উপর যেন সত্যিই বাজ পড়ল।

 রেজা আলি বললো রে, আমার চর নিজের চোখে দেখে এসেছে রানিবিবিকে।

তা হলে মরিয়ম বেগম বলে কাকে মেহেদি নেসার সাহেব গ্রেফতার করলে? সে কে? সে কি রানিবিবি নয়?

আপনি বলছেন কী জনাব, রানিবিবিকে যে আজ মেহেদি নেসার সাহেব গ্রেফতার করে মতিঝিলে বন্দি করে রেখেছে। এই একটু আগে!

রেজা আলি অবজ্ঞার হাসি হাসল–আরে দুর, সে রানিবিবি নয়, সে হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ির নওকর শোভারামের লেড়কি মরালী! আসলি রানিবিবিকে তো মহারাজার কেষ্টনগরের হাবেলিতে লুকিয়ে রেখেছে

লেকিন, হাতিয়াগড়ের রাজা ছোটমশাইকে তো গ্রেফতার করেছে মেহেদি নেসার সাহেব।

 তাজ্জব বাত তো!

বশির মিঞা বললে–চলুন জনাব, মতিঝিলের দিকে যাই, সাহেবকে পাত্তা করি, চলুন—

তারপর সেই ভিড়ের মধ্যে দিয়েই চলতে লাগল দুজনে। রেজা আলি ঘোড়ার পিঠে, আর বশির মিঞা।

কিন্তু হঠাৎ ওদিক থেকে দুটো তাঞ্জাম আসতে দেখা গেল। চেহারা দেখে বোঝা গেল সামনেরটা নানিবেগমসাহেবার আর পেছনেরটা মেহেদি নেসার সাহেবের। সামনে দিয়ে তাঞ্জাম দুটো চলে গেল। বশির মিঞা কিছু বুঝতে পারলে না। এত ভোরে নানিবেগমসাহেবা কী করতে এসেছিল মতিঝিলে? আবার চলেই বা যাচ্ছ কেন?

কিন্তু পেছনেই দৌড়োত দৌড়োতে পিরালি খাঁ চলেছে।

বশির তাকে ডাকলে–পিরালি খাঁ, কী হয়েছে? নানিবেগমসাহেবা কোথায় যাচ্ছে?

চেহেল-সূতুনে!

কেন? রাত্রে মতিঝিলে এসেছিল কেন?

তা মালুম নেই।

চেহেল্-সুতুনে কী হয়েছে? এত হল্লা হচ্ছে কেন চারদিকে?

পিরালি খাঁ বললে–নবাব লড়াই থেকে ওয়াপাস এসেছে

 বলে আর সেখানে দাঁড়াল না। তাঞ্জাম দুটোর পেছন পেছন চেহেল্‌-সুতুনের দিকে দৌড়োতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *