২.১১ গঙ্গার বুকে

গঙ্গার বুকে তখন অনেক রাত। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বজরার ভেতরে বড় আসর বসেছে। অনেকদিন পরে রামপ্রসাদ সেনকে পাওয়া গিয়েছে। সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন কালীঘাটে। রামপ্রসাদ দরাজ গলায় গান ধরেছে

মা গো, আমার এই ভাবনা।
 আমি কোথায় ছিলাম কোথায় এলাম
কোথায় যাব নাই ঠিকানা।
আমার দেহের মধ্যে ছ’জন রিপু
তারা দেয় মা কুমন্ত্রণা…

গানের মধ্যে হঠাৎ বাধা পড়ল। বজরার বুড়ো মাঝি হঠাৎ গানের মধ্যেই ভেতরে ঢুকে বললে–মহারাজ, নবাব আসছেন-বজরা থামাতে বলছেন

ছোটমশাই পাশে ছিলেন। বললেন–সেকী?

 ভারতচন্দ্র বললেন–অ্যাঁ? কার কথা বললে?

গোপালবাবু বললে–মহারাজ, নিশ্চয় কেউ ভাঁড়ামি করতে চায় আমাদের সঙ্গে

বুড়ো মাঝি বললে–না মহারাজ, নবাব হুকুম পাঠিয়েছেন আমাদের বন্ধুরায় আসবেন। তিনি কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদে ফিরে যাচ্ছেন সেনমশাইয়ের গান শুনে জানতে পেরেছেন, মহারাজ এই বজরায় আছেন

মাঝরাত্রের গঙ্গা বড় সর্বনেশে গঙ্গা। বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝরাত্রির গঙ্গা। ওই মাঝরাত্রের গঙ্গায় কত সর্বনাশ যে ঘটে গেছে, তারিখ ইউসুফি বা মুতাক্ষরিনেও তা লেখা নেই। চল্লিশ দাঁড়ের নবাবি বজরা এসব জানত।

অত রাত্রেও মরালীর ঘুম ছিল না। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার ঘুম না এলে মরিয়ম বেগমের ঘুম আসে কী করে?

মরালী বলেছিল–ঘুম আসবে আলি জাঁহা, ঘুম আসবে–আর একটু চেষ্টা করুন।

কিন্তু বেগমসাহেবা, কী করে ঘুম আসবে? চেষ্টার তো কসুর নেই আমার

উমিচাঁদ, নন্দকুমার আর মুনশি নবকৃষ্ণ পেছনে আর একটা বজরায় রয়েছে। তারা কিন্তু অঘোরে ঘুমোচ্ছে তখন। যারা অনিদ্রার কারণ, তাদের বন্দি করেও বাংলা মুলুকের মালিকের চোখে ঘুম নেই। আর কাদের বন্দি করবে নবাব, আর ক’জনকে বন্দি করবে? আর ক’জনকে বন্দি করলে মূলকের মালিক নিরাপদ হবে, নির্ভয় হবে?

জানো বেগমসাহেবা!

মরালী কাছেই ছিল। বললে–বলুন আলি জাঁহা—

চেহেল্‌-সুতুনে একবার আমাকে আরক দিয়েছিল এক বেগমসাহেবা–

কোন বেগমসাহেবা?

নবাব বললে–তা আমার মনে নেই, সব বেগমদের নাম আমার মনে থাকেও না, কিন্তু বড় ম হয়েছিল আমার সেই আরক খেয়ে। আমার বড় ঘুম এসেছিল–

মরালী বললে–সে আরক আমি জানি আলি জাঁহা

 তুমি জানো? তুমি সে আরক খেয়েছ?

না আলি জাঁহা, আমার তা খাবার দরকার হয়নি। আমি গরিব মেয়েমানুষ, ঘুমের জন্যে আমার অত কষ্ট করতে হয় না, ঘুম আমার এমনিতেই আসে!

নবাব বললে–আমার সেইরকম গরিব হতে ইচ্ছে করে। এককালে মসনদ চেয়েছিলুম, এখন আর তাই তা চাই না

না আলি জাঁহা, মসনদে বসেও গরিব হওয়া যায়!

 কী করে তা সম্ভব বেগমসাহেবা? মসনদের জন্যেই তো আমার এত অশান্তি

তা ঠিক নয় আলি জাঁহা, মহাভারত পড়লে আপনি জানতে পারতেন, হাফিজ পড়লে আপনি তা জানতে পারতেন, কবীর পড়লেও আপনি তা জানতে পারতেন!

তুমি বুঝি সব পড়েছ?

মরালী বললে–না আলি জাঁহা, সব পড়তে হয় না। সব না পড়লেও জানা যায়। আমাদের মহাভারতে যা আছে, আপনাদের কোরানেও তাই-ই আছে–

কোরান পড়লেই আমার ঘুম আসবে বলতে চাও?

মরালী বলেছিল–নানিবেগমসাহেবা তো ওই জন্যেই কোরান পড়ে, আলি জাঁহা–

আমার দরবারে কত মৌলবিসাহেব কোরান নকল করবার জন্যে টাকা পায় বেগমসাহেবা, তারা কেতাব তৈরি করে, কিন্তু আমি তা কখনও পড়িনি–

এবার পড়ে দেখবেন আলি জাঁহা, দেখবেন ঘুম আসবে—

আর তোমার যে কে এক কবি আছে বলছিলে!

ভক্ত হরিদাস?

 হ্যাঁ হ্যাঁ, ভক্ত হরিদাস, তার গান শোনাতে পারো না? তার গান শুনলে আমার ঘুম আসবে না?

ঠিক এই সময়েই দূর থেকে একটা সুর ভেসে এসেছিল। এই সর্বনেশে মাঝরাত্রের গঙ্গায় কে এন করে গান গায়?

অস্পষ্ট আওয়াজ, কিন্তু ভারী সুরেলা।

ওই শুনুন আলি জাঁহা—

গানটা তখন আরও কাছাকাছি এসেছে

মা গো, আমার এই ভাবনা।
আমি কোথায় ছিলাম কোথায় এলাম
কোথায় যাব নাই ঠিকানা

মরালী গানের মানেটা বুঝিয়ে দিলে। মহাজীবনের এপার-ওপার থেকে যেন অপার শান্তির ঠান্ডা হাওয়া এসে নবাবের মেজাজটা ঠান্ডা করে দিয়ে গেল।

নবাব নাওদারকে ডাকলে! কান্ত এসে কুর্নিশ করে দাঁড়াল।

ও কে গান গাইছে? কার বজরা ওটা?

কান্ত বাইরে গিয়ে খবর নিয়ে এল। বললে–জাঁহাপনা, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বজরা যাচ্ছে কলকাতায়, গান গাইছে রামপ্রসাদ

নবাব জিজ্ঞেস করলে–রামপ্রসাদ? কৌন হ্যায় উও?

মরালী উত্তর দিলে–হালিশহরের কবি, আলি জাঁহা, সাধক কবি

তুমি এত জানলে কী করে বেগমসাহেবার কোথায় হালিশহর, কোথায় হাতিয়াগড়, কোথায় মুর্শিদাবাদ

মরালী বললে–আমরা যে সবাই ও-গান গেয়েছি আলি জাঁহা। আমাদের দেশের চাষারা চাষ করতে করতে ও-গান গায়, গেরস্ত ঘরের বউ-ঝি-ঠাকুমা-দিদিমা সবাই ওই গান গায় যে–

তামাম বাংলার নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা অবাক হয়ে গেল। বাংলার মসনদের ওপর বসে যে মানুষ সারা দেশের মালিক হয়েছে, যাকে দেখলে সব মানুষ মাথা নিচু করে কুর্নিশ করে, মসনদ না পেয়েও তেমনই আর একজন মানুষকে সবাই আর এক মসনদে বসিয়ে দিয়েছে? এ কেমন করে হয়?

এ বাদশার খেলাত পেয়েছে?

না, আলি জাঁহা।

জায়গির?

তাও না, হুজুর!

তা হলে? তা হলে কীসের এত খাতির? কীসের এত তারিফ? তা হলে তো একে দেখতে হয়। হুকুম হয়ে গেল নবাবের। সেই মাঝরাত্রে গঙ্গার বুকেই মহারাজার বজরা থামাও। বাংলা মুলকের নবাব আর-এক মসনদহীন নবাবকে দেখবে।

নবাবের হুকুমনড়বার নয়। নবাব গিয়ে উঠল মহারাজার বজরায়। কান্তও সঙ্গে সঙ্গে গেছে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র চার কামরাওয়ালা বজরা থেকে বেরিয়ে এসেছে। ভারতচন্দ্র, গোপালবাব, ছোটমশাই তারাও বেরিয়ে এসেছে। কোথাও কোনও গলদ হয়েছে নাকি? কোনও গাফিলতি? আবওয়াব দিতে দেরি হয়েছে? মাথট পিলখানা দিতে খেলাপি হয়েছে?

গান গাইছিল কে মহারাজ?

এতক্ষণে যেন আশ্বস্ত হল সবাই। টাকা নয়, সম্মান নয়, দণ্ড নয়, শাস্তি নয়, কিছু নয়। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা মাঝরাত্রে গান শুনতে এসেছে?

আমি আর একটা গান শুনব ওর, মহারাজ!

একজন সাধারণ সাদাসিধে ভদ্রলোক। দাড়ি-গোঁফে মুখ ভরতি। মাথায় বড় বড় চুল। গায়ে একটা চাদর। বাবু হয়ে বসে আছে। মাথায় একটা সিদুরের ফোঁটা শুধু। হাসি হাসি মুখ।

কী গান গাইব জাঁহাপনা, হুকুম করুন!

 যে-গান খুশি!

রামপ্রসাদের গলা আবার গেয়ে উঠল

সেঁইয়া গেও পরদেশ
সখিরি, ক্যা করু ম্যয়

নবাব বাধা দিলে। বললে–না না, ও-গান নয়–যে-গান গাইছিলে, ওই গান।

কোন গান?

ওই যে মা মা করে গান করছিলে!

রামপ্রসাদের চোখ দুটো এবার বুজে এল আবার। গান গাইতে গাইতে চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল। একমনে গেয়ে চলেছে

মা গো, আমার এই ভাবনা।
 আমি কোথায় ছিলাম, কোথায় এলাম,
কোথায় যাব নাই ঠিকানা।
আমার, দেহের মধ্যে ছ’জন রিপু
তারা দেয় মা কুমন্ত্রণা।
আমি মনকে বলি ভজ কালী
তারা কেউ কথা শোনে না

অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যপাদে এসে সেদিন বাংলার ইতিহাস যেন নতুন দিকে মোড় ফিরল। আর মাঝরাত্রের গঙ্গার বুকে নতুন করে আবার এক নতুন সর্বনাশ ঘনিয়ে উঠল।

*

তারপর?

মরালী বললে–তারপর সর্বনাশটা হয়েছিল পর দিন।

দমদমার বাগানবাড়িতে পুঁথি বগলে করে নিয়ে এসে উদ্ধব দাস গল্প শুনত আর লিখত। উদ্ধব দাস নিজেই লিখে গেছে সে-সব কাহিনী। তখন বড় দুর্দিন চলেছে কর্নেল ক্লাইভ সাহেবের। কোম্পানির সিলেক্ট কমিটির সঙ্গে ঝগড়া চলছে। মনমেজাজ খারাপ। বেগম মেরী বিশ্বাস এক এক করে সব কাহিনী বলে যায়, আর উদ্ধব দাস লিখে নেয় পুঁথির পাতায়। উদ্ধব দাস সোজা কথা সোজা করে লেখেনি। সমস্ত বাংলাদেশটা ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে তখন বুড়ো হয়ে পড়েছে। কান্তসাগরে ক্লাইভসাহেবের কাছ থেকে তালুক পেয়েছে। সেখান থেকে রোজ হেঁটে হেঁটে আসে আর বেগম মেরী বিশ্বাসের সামনে বসে থাকে।

এ একেবারে বেগম মেরী বিশ্বাসের শেষের দিকের কথা। বলতে গেলে শেষ সর্গ।

মরালীর তখন আর সে-চেহারা নেই। কোথায় গেছে সেই কাঁচা সোনার মতো গায়ের রং, সেই মেহেদিপাতার রঙে রাঙানো হাতের নখ। সেই ওড়নিও নেই, সেই জরির চুড়িদার সালোয়ার কামিজও নেই।

নবাব বড় ভক্ত হয়ে গিয়েছিল মরিয়ম বেগমের। যে-মানুষ মতিঝিল থেকে কখনও চেহেলসূতুনে আসত না, যে-মানুষ মতিঝিলের মধ্যেই দরবার বসাত রোজ, আর দরবারের নাম করে মতিঝিলের মধ্যেই রাত কাটিয়ে দিত, সেই মানুষকেই হঠাৎ সেদিন চেহেসতুনের মধ্যে আসতে দেখে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল।

নবাব বলেছিল–লোকে বলে মুর্শিদাবাদের মসনদ চালায় নাকি মরিয়ম বেগম

আলি জাঁহা কি বিশ্বাস করেন নাকি সেকথা?

নবাব বহুদিন পরে প্রাণ খুলে সেদিন হেসেছিল। আশ্চর্য, আকবর বাদশা থেকে শুরু করে বাদশা সাজাহান, সুজাউদ্দিন, সরফরাজ খাঁ, এমনকী আলিবর্দি খাঁ পর্যন্ত কে মসনদ চালাতে পেরেছে বেগমদের সাহায্য ছাড়া! নানিবেগম না থাকলে নানানবাবই কি মসনদ চালাতে পারত!

পেশমন বেগম বলেছিল–তুই কী করে জাদু করলি ভাই নবাবকে?

ঘরের মধ্যে কেউ আসতে পারেনি। কারও আসার হুকুম ছিল না। বহুদিন পরে নবাব আরাম করে ঘুমিয়েছিল সেদিন। বোধহয় সেই রামপ্রসাদের গানের জন্যে। রামপ্রসাদের গানই বোধহয় সেদিন নবাবকে বুঝিয়েছিল যে, ঐশ্বর্য-বিলাস-আড়ম্বর ও-সব কিছুনয়। একদিন যেমন নবাব সুজাউদ্দিন গেছে তেমনই তুমিও যাবে। একদিন যেমন নবাব আলিবর্দি খাঁ চলে গেছে, তেমনই তুমিও চলে যাবে, আলি জাঁহা। মাঝখানের এই কটা দিনের কিছু যন্ত্রণা নিয়ে মানুষের যেমন জীবন, নবাবেরও তেমনই তাই। অহংকার করতে নেই, অত্যাচার করতে নেই, অনিয়ম করতে নেই। রিপুর কুমন্ত্রণা শুনো না। ও তোমায় অশান্তি দেবে, অনিদ্রা দেবে, অন্তরায় দেবে। এই যা দেখছ, এ সবকিছুই অনিত্য, এ সবকিছুই অসার। সার যদি কিছু থাকে তো সে ভালবাসা। ভালবাসতে শেখো আলি জাঁহা, এই দুনিয়ার সবকিছুকে সব মানুষকে ভালবাসতে শেখো। তাতেই তোমার নিদ্রা আসবে, তাতেই তোমার শান্তি আসবে।

কিন্তু ওদের আমি শাস্তি দেব না? ওই যারা আমার দুশমনি করেছে?

নিশ্চয় শাস্তি দেবে আলি জাঁহা! পালনও করতে হবে, আবার শাসনও করতে হবে। পালন না করলে শাসন করবার অধিকার তোমার নেই!

কিন্তু আমি কি প্রজাপালন করি না বলতে চাও?

না।

তা হলে আমি কী করেছি এতদিন?

তোমার পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, বৃদ্ধ প্রপিতামহ যা করে এসেছে, তুমিও তাই করেছ। নারীকে তুমি ভোগ করেছ, ভূমিকে তুমি অপহরণ করেছ, যৌবনকে তুমি অপব্যয় করেছ। ঠিক যেমন করে তোমার পূর্বপুরুষ করেছে, তেমনি করেই অপব্যয় করেছ। কিন্তু এখন ইতিহাস বদলে গেছে, এখন ইতিহাস উজানে বইছে। এখন মানুষ আর-এক ধাপ এগিয়ে গেছে। এখন সভ্যতা এক জনপদ থেকে আর-এক জনপদে ছড়িয়ে পড়ছে। সে আজ তোমার কাছে তোমার পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহের পাপের জবাবদিহি চাইছে। তোমাকে আজ সেই সমস্ত পূর্বপুরুষদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে?

কেন? তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি করতে যাব কেন? আইন-ই-আকবরিতে তো সেকানুন নেই

নেই, কিন্তু ইতিহাসের আইন-ই-আকবরির তাই-ই কানুন।

 তা হলে আমি কী করব?

 তোমার জীবন বলি দিতে হবে।

হঠাৎ চোখের সামনে একটা ধারালো ছোরা চকচক করে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা নিষ্ঠুর আর্তনাদে নবাব মির্জা মহম্মদের ঘুম ভেঙে গেল। ইনসাফ মিঞা তখন ভৈঁরো ঠাটের আলাপ ধরেছে। নহবতে। মীড় আর মূৰ্ছনা, গমক আর তান সমস্ত কিছু মিলিয়ে একটা কথাই হেলেদুলে বলতে চাইছে ভোর হল, এবার ওঠো নবাব, পুবের আসমানে আপতা তুলু হয়েছে, এবার ধুপ উঠবে, নতুন দিনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে তোমার কিসমত পরীক্ষা হবে। দেখব কেমন করে তুমি নতুন সর্বনাশের মুখোমুখি হও। দেখব রামপ্রসাদের গান শুনে তুমি যে শিক্ষা পেলে কেমন করে তুমি তা কাজে লাগাও!

মতিঝিলের দরবারে সবাই সেদিন নবাবের চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেল। এমন মর্জি এমন মেজাজ বহুদিন কেউ দেখতে পায়নি। মুনশি নবকৃষ্ণ, উমিচাঁদ, হুগলির ফৌজদার নন্দকুমার, তারা হাজির।

নবাব তাদের তিনজনকে লক্ষ্য করেই বললে–তোমাদের সবাইকে ছেড়ে দিলাম উমিচাঁদ-

-তিনজনেই মাথা নুইয়ে মনের কৃতজ্ঞতা জানালে।

ভেবো না তোমাদের অপরাধের বদলা আমি নিতে পারতাম না। কিন্তু কসুর আমিও করেছি–

সবাই নবাবের আত্মদোষ স্বীকার শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল।

হ্যাঁ, কসুর আমিও করেছি। শুধু আমি একলা করিনি। আমার পিতা, আমার পিতামহ, আমার প্রপিতামহ, আমার বৃদ্ধ-প্রপিতামহ, সবাই কসুর করেছি। শাস্তি যদি কাউকে নিতেই হয় তো সে-শাস্তি তোমাদের সঙ্গে আমাকেও নিতে হবে। আমিও সেই শাস্তির হকদার। সে শাস্তি আমি নেবই। যেদিন তোমাদের শাস্তি দেব, সেদিন তোমাদের সকলের সঙ্গে আমিও সে-শান্তি নেব। ঐশ্বর্য-বিলাস-আড়ম্বর ওসব কিছু নয় উমিচাঁদ। একদিন যেমন নবাব সুজাউদ্দিন চলে গেছে, তেমনই আমিও চলে যাব। একদিন যেমন নবাব আলিবর্দি চলে গেছে, তেমনই একদিন আমিও যাব। মাঝখানের এই কটা দিনের যন্ত্রণা নিয়ে যেমন তোমাদের সকলের জীবন, তেমনই আমারও জীবন। অহংকার করতে নেই, অত্যাচার করতে নেই, অনিয়ম করতে নেই। রিপুর কুমন্ত্রণা শুনোনা উমিচাঁদ, ও তোমায় অনিদ্রা দেবে, অশান্তি দেবে, অন্তরায় দেবে। এই যা দেখছ, এ সবকিছুই অনিত্য, এ সবকিছুই অসার। সার যদি কিছু থাকে তো সে মুহব্বত। এই দুনিয়ার সমস্ত কিছুকে মুহব্বত করতে শেখো উমিচাঁদ, তাতেই তোমার শান্তি আসবে, তাতেই তোমার নিদ্রা আসবে–

বাইরে বেরিয়ে ফৌজদার সাহেব উমিচাঁদের দিকে তাকাইলে।

 নবাব হঠাৎ তাজ্জব বাত বলতে লাগল কেন আজ?

মুনশি নবকৃষ্ণও অবাক হয়ে গেছে। বললে–নবাব লোকটা তো তেমন বদ মানুষ নয় ফৌজদারসাহেব!

উমিচাঁদ হাসল।

 বললে—নবাব-বাদশাদের অমন পাগলামি হয় মাঝে মাঝে। ও-সব শয়তানি। বাদশা ওরঙ্গজেবের ওইরকম হত। শয়তানি করে আমির-ওমরাওদের সামনে মক্কায় চলে যাবে বলে ভয় দেখাত

শুধু উমিচাঁদ নয়, নন্দকুমার, নবকৃষ্ণই নয়–মতিঝিলের সমস্ত কর্মচারীও ভাবতে শুরু করেছিল–নবাবের আজ এ কী হল? নবাব তো কোনওদিন এমন করে হাসে না। হেসে কথা কয় না! এমন করে মতিঝিলে এসে ঘুমোয়ও না। এ কী হল নবাবের?

মরালী ডেকে পাঠাল কান্তকে। এতদিনের পর আবার কান্ত মুর্শিদাবাদে এসেছে। কিন্তু তবু খুশবু তেলওয়ালা বুড়ো সারাফত আলির সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। কখন আবার কীসের জন্যে ডাক পড়ে কে বলতে পারে। নবাব ঘুমোচ্ছে জেনে ভাবছিল একবার খুশবু তেলের দোকানে গিয়ে সারাফত আলির সঙ্গে দেখা করবে। সবে মতিঝিল থেকে বেরিয়েছে, এমন সময় ডাক এল মরিয়ম বেগমসাহেবার কাছ থেকে।

কান্ত দৌড়ে গেল। বললে–কী?

মরালী বললে–তোমাকে একটা কাজ করতে হবে

বলো না কী কাজ?

সেই তাকে একবার ডাকতে হবে।

 কাকে? ঠিক বুঝতে পারলে না কান্ত, কার কথা বলছে মরালী!

সেই যে গান বাঁধে, ছড়া বাঁধে! আমার কথা কিন্তু বোলোনা কিছু। বোলো যে নবাব তার গান শুনতে চেয়েছে।

কান্ত অবাক হয়ে গেল। বললে–উদ্ধব দাস? উদ্ধব দাসের কথা বলছ? কিন্তু তাকে আমি কোথায় পাব? সে কি এখন মুর্শিদাবাদে আছে?

তা আমি জানি না। যেখান থেকে পারো তাকে ডেকে আনতে হবে। সারা বাংলাদেশে যেখানে হোক, একজায়গায় না এক-জায়গায় তাকে পাবেই–

হঠাৎ এতদিন বাদে কেন যে মরালী নিজের স্বামীকে ডাকতে বললে–বোঝা গেল না। কিন্তু মরালীর হুকুম না মানলেও চলে না। অবাক হয়ে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল মরালীর মুখের দিকে। তারপর। বললে–আচ্ছা যাচ্ছি

কিন্তু সেদিন তখনও কি কান্ত জানত যে মরালীর সে-ইচ্ছে ওলোটপালোট হয়ে যাবে অমন করে? মুর্শিদাবাদের ইতিহাস অমন করে অন্য দিকে মোড় ফিরবে? বাংলা মুলুকের কপালে অমন করে। সর্বনাশ ঘনিয়ে আসবে?

নবাব ঘুম থেকে উঠেই খিদমদগারকে ডাকলে।

খিদমদগার কাছে যেতেই নবাব বললে–নকলচিকো বোলাও

নকলচি! কে নকলচি! কোথাকার নকলচি!

 নবাব বললে–যারা দরবারে কোরান নকল করে, তাদের বোলাও

কোরান নকল করে! নবাব অনেকবার অনেক রকম তাজ্জব হুকুম করেছে। কিন্তু কখনও কোরান নকলচিদের ডেকে পাঠায়নি আগে।

ইব্রাহিম খাঁ সরাবখানার মধ্যে চুপ করে বসে ছিল। কখন কোন ওমরাহ আসে, কখন মেহেদি নেসার, ইয়ারজান সাহেব এসে সরাব চেয়ে পাঠায়, তারই অপেক্ষায় হাঁ করে মুহূর্ত গুনছিল, হঠাৎ নবাবের অদ্ভুত খেয়ালের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। কোরান পড়বে নাকি নবাব!

এ এক অবাক ঘটনা মতিঝিলে। সরাবের হুকুম হয়েছে, তওয়ায়িফের হুকুম হয়েছে, ওস্তাদের হুকুম হয়েছে, টাকার হুকুম হয়েছে, পাপের হুকুম হয়েছে। কিন্তু কখনও কোরানের হুকুম হয়েছে বলে কেউ শোনেনি। নবাব কোরান চোখে দেখেছে কিনা সন্দেহ। একবার শুধু নবাব হাত দিয়ে কোরা ছুঁয়েছিল। নবাব আলিবর্দি খাঁর মৃত্যুর সময়ে নবাবকে কোরান ছুঁয়ে শপথ করতে হয়েছিল, জিন্দগিভর কখনও মদ খাবে না। ব্যস, সেই পর্যন্ত। তারপরে কোরানেরও আর কখনও নবাবকে দরকার হয়নি, নবাবেরও আর কখনও কোরানকে দরকার হয়নি।

কিন্তু খিদমদগার নকলচিকে নিয়ে ফিরে আসবার আগেই আর এক খবর নিয়ে এল খিদমদগার।

 খোদাবন্দ, মিরবকশি মোহনলাল দরবারে হাজির।

 ক্যা?

 দু’বার করে জবাব দিতে হল তবে যেন নবাবের কানে গেল কথাটা। বললে–দরবারে নিয়ে এসো

তারপর মোহনলাল যে-খবর নিয়ে এল তা যেমন মর্মান্তিক তেমনই উত্তেজক। ইংরেজ ফৌজ হামলা করেছে চন্দননগরে। লড়াই ফতে হয়ে গিয়েছে। কর্নেল ক্লাইভ ফরাসডাঙার কেল্লার নিশেন নামিয়ে দিয়ে তার ওপর ইউনিয়ন জ্যাক উড়িয়ে দিয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে নবাব লাফিয়ে উঠেছে। সাতাশ বছরের পাঠানি রক্ত যেন টগবগ করে উঠল। তা হলে হুগলির ফৌজদার কোথায়? উমিচাঁদ কোথায়? মুনশি নবকৃষ্ণ কোথায়? তাদের কে যেতে দিলে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে? মিরজাফর আলি সাহেব কোথায়? ডাকো তাকে আমার সামনে। আমি সকলকে কোতল করব। দিল্লির বাদশার সনদ পাওয়া নবাব আমি, মেরা হুকুম কেঁউ বদল কিয়া উস লোগে নে? আর, কাশিমবাজার কুঠির ওয়াটস? মঁসিয়ে ল? উন লোগে কো ভি আবভি বোলাও

চেহেলসূতুনেও খবরটা পৌঁছোল। মরালী একটু নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু খবরটা পেয়েই পিরালি খাঁ-কে ডেকে পাঠাল–মেরা তাঞ্জাম তৈয়ার করো, ম্যায় মতিঝিল যাডঙ্গি–আবভি

মরালীর বাঁদিও হঠাৎ হুকুম পেয়ে বেগমসাহেবার পেশোয়াজ বার করে দিলে, ওড়নি বার করে দিলে, কঁচুলি, ঘাগরা পৈজেঁড় বার করে দিলে। হুলস্থুল পড়ে গেল চেহেল্‌-সুতুনেআবার মরিয়ম বেগমসাহেবা নবাবের কাছে যাবে। রাত্রে একসঙ্গে কাটিয়েও তার গরম কাটেনি বুঝি রে!

*

হালিসহরের কবির গান শুনতে শুনতে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র যখন ত্রিবেণীর ঘাটে গিয়ে পৌঁছোল, তখন খবর এসে পৌঁছোল ইংরেজ ফৌজ ফরাসডাঙার কেল্লা দখল করে নিয়েছে।

ছোটমশাই অনেক আশা করেছিল কলকাতায় গিয়ে এবার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে নিয়ে ক্লাইভ সাহেবের কাছে যাবে। ক্লাইভ সাহেব চেষ্টা করলেই নবাবের হারেম থেকে ছোট বউরানিকে উদ্ধার করে দিতে পারে।

মহারাজ বলেছিল কিন্তু এর পরেও কি বউমাকে ঘরে ফিরিয়ে নিতে পারবেন আপনি ছোটমশাই!

ছোটমশাই বলেছিল–সে লোকে যা বলে বলুক, না-হয় প্রায়শ্চিত্তই করব, ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ডেকে যা বিধান দেন তারা তাই-ই না-হয় করব!

মহারাজ সব শুনে বলেছিল–যা শুনছি তাতে তো মনে হয় বউমাকে মোল্লারা একেবারে জাদু করেছে

কী রকম?

মুর্শিদাবাদের মসনদ তো এখন বউমাই চালাচ্ছে। বউমার কথায় নাকি নবাব ওঠেন বসেন! দেখলেন তো নবাবের শ্যামাসংগীত শোনবার বহরটা। দেখেছিলেন, রামপ্রসাদের গান শুনতে শুনতে নবাবের চোখ দিয়ে কেমন ঝরঝর করে জল পড়ছিল? একটা উর্দু গজল পর্যন্ত শুনতে চাইলে না, শুধু শ্যামাসংগীত! বউমা না হলে এ আর কারও সাধ্যি ছিল।

গোপালবাবু বললে–তা হলে মোল্লারা আর কী করে জাদু করলে মহারাজ, আমাদের ছোট বউরানিই তো মোল্লাদের জাদু করেছে মনে হচ্ছে

মহারাজ বললে–না গোপালবাবু, মনে হচ্ছে মোল্লারাই বউমাকে জাদু করেছে। নইলে বউমার কানে তো গিয়েছিল যে তার স্বামী আমার বজরায় আছেন, তবু কেন গান শোনবার ছল করে নবাবের সঙ্গে এলেন না?

ছোটমশাই বললে–না মহারাজ, বেগম হয়ে কী করে আপনার বজরায় আসে সে? আসলে তো জাত গেছে। ভেবেছে আমি বুঝি তাকে আর গ্রহণ করব না

সত্যিই তো, আপনিই বা তাকে গ্রহণ করবেন কী করে?

ছোটমশাই বললে–আপনি পথ বলে দিন আমি তাকে কেমন করে গ্রহণ করব? আপনি হলেন নবদ্বীপের মহারাজ, পণ্ডিতদের বিধানদাতা। আপনি যা বলবেন আমি তাই করতেই রাজি। যদি বলেন তো আমি না-হয় মুসলমানই হব বউয়ের জন্যে

খবরটা ঠিক এই সময়েই এসে পৌঁছোল। ইংরেজরা ফরাসডাঙা দখল করে নিয়ে নিয়েছে।

মহারাজ খবরটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে–আচ্ছা, আগে তো কালীঘাটে যাওয়া যাক, তারপর ভেবে দেখা যাবে কী করব—

.

চন্দননগর যখন ফরাসডাঙা ছিল এ সেই তখনকার কথা। একদিন ১৬৬৮ সালে ফরাসিরা জাহাজে করে এসেছিল ওই ফরাসডাঙায়। প্রথমে জলাজমি ছিল, তারপর বসতি হল। পাকা বসতবাড়ি হল, কেল্লা উঠল। ডুপ্লের আমলে সেই চন্দননগরের বাড়বাড়ন্ত দেখে কে! তখন কলকাতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে চন্দননগর। দেখে ইংরেজরা কপালে চোখ তুলেছে। হিন্দুস্থানে অমন ভাল ভাল বাড়ি কোথাও আছে নাকি! ফরাসিদের জাহাজ নানা দেশ থেকে মাল কিনে নিয়ে আসে। জেদ্দা মক্কা, বসোরা, চায়না, পেগু সব জায়গা ঘুরে ঘুরে হুগলি নদীতে এসে থামে জাহাজগুলো।

তা গোলাবারুদ কামান সবকিছু গিয়েছিল জাহাজে। আর হাজার হাজার সেপাই গিয়েছিল হাঁটাপথে। ফোর্ট ডি’অরলিনস্ শুধু কেল্লা নয়, ফরাসি ক্ষমতার প্রতীক ফোর্ট ডি’অরলিন খোঁজা ওয়াজিদ ফরাসিদের সঙ্গে কারবার করে মোটা মোটা টাকা উপায় করছে তখন। জগৎশেঠজি ফরাসিদের সাড়ে সাত লাখ টাকা ধার দিয়ে মোটা সুদ আদায় করছেন। ফরাসিদের সঙ্গে ইংরেজদের লড়াই হলে তাদেরও তো মোটা লোকসান।

কিন্তু যুদ্ধ যখন বেধে গেলই, তখন আর তা হজম করা ছাড়া উপায় নেই।

যতই দিন যেতে লাগল, ততই বড় খারাপ খবর কানে আসতে লাগল। কেউ বলে, ইংরেজদের বোমা লেগে ফরাসিদের কেল্লা একেবারে গঙ্গায় ধসে পড়েছে

কেউ বলে, ইংরেজদের গুলিতে ফরাসিরা মরে গঙ্গায় ভাসছে।

 যারা ওদিকে নৌকো নিয়ে মাল বেচা-কেনা করতে যায় তারা যেসব খবর আনে তা শুনে লোকে চমকে ওঠে। তবে কি ইংরেজ আর ফরাসিতে লড়াই মারামারি করে বেটারা কুপোকাত হবে নাকি?

লোকে ঘাটে গিয়ে মাঝিমাল্লা দেখলেই জিজ্ঞেস করে–ফরাসডাঙার খবর কিছু জানো নাকি গো তোমরা?

আসলে কে কার খবর রাখে? আর খবর রেখেই বা লাভ কী? ততক্ষণ গাঁয়ের হরিসভায় গিয়ে হরিনাম শুনলেই পরকালের কাজ হয়। তুমি আমি খবর রেখে তো কিছু উপকার করতে পারব না হে কারও। নিজেরও উপকার করতে পারব না, পরেরও নয়। তার চেয়ে এই-ই ভাল। এই চাষবাস করে, গান গেয়ে আর কাঁসি বাজিয়ে। কাশিমবাজারে ফরাসডাঙা থেকে দলে দলে সব ফরাসিরা এসে উঠেছে। কুঠিতে। সঁসিয়ে ল’ তাদের কাছে সব গল্প শোনে। পুরো ফরাসডাঙাটাই নাকি একেবারে গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে গেছে। অত বড় কেল্লা ফোর্ট ডি’অরলিনস–তার একখানা ইটও নাকি আর আস্ত নেই।

ওয়াটস এসে উঠেছিল নিজেদের কুঠিতে; ইংরেজদের কুঠি থেকে খুব বেশি দূর নয় ফরাসিদের কুঠি। ওয়াটস চুরোট খায় নিজের কুঠিতে বসে আর খবরগুলো শোনে। কিন্তু পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা। রাখে দিনরাত। ফিরিঙ্গি সেপাইরা দিনরাত বন্দুক নিয়ে পাহারা দেয় কুঠির সামনে! মঁসিয়ে ল’কে বিশ্বাস নেই। কবে কী মতিগতি হয় কে জানে?

রাত্তিরবেলা সব চুপচাপ থাকে। গঙ্গায় এদিক-ওদিক থেকে নৌকো বজরা-বোট যাতায়াত করে। সেদিকে ওয়াটস সাহেবের পাহাদারদের কড়া নজর থাকে। কোন দিক থেকে কখন কে এসে অ্যাটাক করে ঠিক নেই। চন্দননগরের পালিয়ে আসা ফরাসিদের নবাব শেলটার দিয়েছে, এটা ভাল কাজ হয়নি।

সেদিন অনেক রাত্রে কুঠিতে এসে হাজির হল ফ্লেচার।

ফ্লেচার কর্নেলের লোক। এখানে-ওখানে খবর নিয়ে আসা-যাওয়া করে। অনেক দূর থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে এনেছে। কুঠিতে ঢুকেই হাঁপাতে লাগল।

কিন্তু ওয়াটস্ সাহেবের সামনে এসে বেশ খুশি হয়ে কথা বলতে লাগল।

কী খবর ফ্লেচার? কর্নেলের খবর কী?

সব ভাল খবর স্যার। চন্দননগর কার করে ফেলেছি আমরা।

কর্নেল ক্লাইভের ম্যাড্রাস ফিরে যাবার কথা ছিল। ওয়াটও সেই কথা জানত। বেচারি রাইটার হয়ে এসেছিল ইন্ডিয়ায়। অনেক দিন আছে। গড়গড় করে বাংলা বলে, ফারসি বলে। হিন্দুস্থানিও বলে। গোড়া থেকে ইন্ডিয়ায় থেকে থেকে অনেক কিছু শিখেছে। তাই ওয়াটসের ওপর লন্ডনের অনেক আস্থা। বাংলার নবাবের নাড়িনক্ষত্র জেনে ওয়াটস্ এইটুকু বুঝেছে যে নবাবের যারা আমির-ওমরাহ, যারা নবাবের মিনিস্টার, তারা কেউ নবাবের ফেবারে নয়। ওই আড়াই হাজারি মনসবদার ইয়ার লুৎফ খা, কিংবা মিরজাফর আলি খাঁ, কিংবা জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, সবাই নবাবকে হটিয়ে নবাব হতে চায়। আসল কাজ যখন হয়ে গেছে, যখন চন্দননগরের ফোর্ট অকুপাই করা হয়ে গেছে, তখন কর্নেলের আর বেঙ্গলে না-থাকলেও ক্ষতি নেই। এখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেফ। এখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আস্তে আস্তে নবাবকে হাতের মুঠোর মধ্যে পুরে ফেলতে পারবে! ফ্রেঞ্চ নেই, ডেনরা নেই, ডাচরা নেই, পর্তুগিজরাও নেই। থাকলেও তাদের কোনও পাওয়ার নেই।

কিন্তু ফ্লেচার যা বললে–তা উলটো কথা।

কর্নেল ক্লাইভ আর্মি নিয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে এগিয়ে হুগলির মাঠে ক্যাম্প করে রয়েছে।

 কেন?

ফ্লেচার বললে–সেই কথা বলতেই আমি এসেছি স্যার–যদি নবাব ইংরেজদের অ্যাটাক করে তার জন্যে রেডি থাকতে হবে! হিয়ার ইজ দি লেটার ফ্রম কর্নেল

ওয়াট চিঠিটা নিয়ে পড়লে। পড়ে খানিকটা হাসলে মনে মনে।

তারপর বললে–কিন্তু নবাবকে ভয় পাবার এত কী দরকার? কর্নেল কি জানে না যে নবাবের। ওয়ার করবার ইচ্ছেই নেই?

তা হলে স্যার রাজা দুর্লভরাম কেন আর্মি নিয়ে পলাশিতে ওয়েট করছে?

সে তো নবাবের বেগমের পরামর্শে!

 নবাবের বেগম?

ওয়াটস বললে–হ্যাঁ, সে আমি খবর পেয়েছি। নবাব যেদিন চন্দননগর অ্যাটাকের খবর পেলে সেই দিনই মরিয়ম বেগম মতিঝিলে গিয়েছিল। আমি সব খবর পেয়েছি। নইলে নবাব তো আমাদের টার্মস অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের কিছু টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে–

তা হলে আপনি ওই কথাটা লিখে দিন স্যার কর্নেলকে। কর্নেল শুনে খুশি হবে!

ওয়াটস বললে–আমি লিখে দিচ্ছি, কিন্তু তুমি মুখে তাকে বোলো এইসব কথা। বোলো, নবাবকে আর আমাদের ভয় করবার দরকার নেই। শুধু মরিয়ম বেগম নবাবকে তাতাচ্ছে–ওই মরিয়ম। বেগমকে শায়েস্তা করলেই কাজ হাসিল হয়ে যাবে এই দেখো না, নবাবের চিঠির কপি তো আমার কাছেও রয়েছে

বলে নবাবের চিঠির কপিটাও দেখালে। কপিতে লেখা আছে–আমি অঙ্গীকৃত টাকা প্রায় শোধ দিয়াছি, সত্বরই অবশিষ্ট প্রদত্ত হইবে। আমি সন্ধির নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করিতেছি, কিন্তু আপনাদের পক্ষে সেরূপ দেখি না। ইংরেজ সৈন্যের উৎপাতে হুগলি, হিজলি, বর্ধমান ও নদীয়া ত্রস্ত হইয়াছে। কালীঘাট কলিকাতার জমিদারি বলিয়া দাবি করা হইয়াছে। এ সমস্ত যে আপনার জ্ঞাতসারে হইয়াছে, তাহা আমার বিশ্বাস হয় না। যাহা হউক, পরস্পরের মধ্যে যে বন্ধুভাবের অঙ্কুর হইয়াছে তাহার পোষণ করাই কর্তব্য। শুনিলাম ফরাসিরা আপনাদের সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য দক্ষিণাপথ হইতে ফৌজ পাঠাইয়াছে। কিন্তু তারা আমার রাজ্যে বিবাদ উপস্থিত করিবার ইচ্ছা করিলে আমাকে লিখিবামাত্র সিপাহি-সৈন্য পাঠাইয়া তাহাদিগকে নিরস্ত করিব।

ফ্লেচার বললে–কিন্তু এই লেটার লেখার পরেও কেন নবাব আর্মি পাঠালে রাজা দুর্লভরামের সঙ্গে?

ওই তো বললুম, মরিয়ম বেগমের পরামর্শে!

 তা মরিয়ম বেগম কি লড়াই চায় কোম্পানির সঙ্গে?

চায় বলেই তো মনে হচ্ছে।

তা হলে তো কর্নেল ঠিকই করেছেন। এখন তো কর্নেলের ম্যাড্রাস যাওয়া চলে না।

ওয়াটস চুরোটের ধোঁয়া ছেড়ে বললে–না, সে-ভয় নেই

কেন?

কর্নেল বোধহয় জানে না। মরিয়ম বেগম আর বেশি দিন নেই।

তার মানে?

ওয়াটস্ বললে–আমি সেই জন্যেই আজ সব বন্দোবস্ত করতে যাচ্ছি। আজ মিডনাইটে আমি আড়াই হাজারি মনসবদার ইয়ার লুৎফ খাঁ’র বাড়িতে যাচ্ছি–

ইয়ার লুৎফ খাঁ সাহেব কি আমাদের ফেবারে?

ওয়াটস্ সাহেব বললে–টাকা দিলে সব ইন্ডিয়ান আমাদের ফেবারে। সবাই টাকা চায়–টাকা দিলে সবাই আমাদের জন্যে সবকিছু করতে পারে। নন্দকুমার যেমন আমাদের চন্দননগরের ব্যাপারে নিউট্রাল থেকেছে, তেমনই আরও বেশি টাকা দিলে যে-কেউ মরিয়ম বেগমকে মার্ডার পর্যন্ত করতে পারে!

ফ্লেচার চমকে উঠল-ইয়ার লুৎফ খাঁ কি নিজেই মার্ডার করবে বেগমসাহেবাকে?

সে-সব কথা এখন বলব না ফ্লেচার। আজ নাইটটা তুমি কুঠিতে থাকো, কাল আর্লি মর্নিংয়ে তোমায় বলব। কর্নেলের চিঠিও তোমার হাতে দিয়ে দেব সেই সঙ্গে

*

ওদিকে তখন মতিঝিলের ভেতর গোলাপি আতরের গন্ধে নবাবের মেজাজ অনেকদিন পরে খুশ হয়েছে। মরিয়ম বেগমসাহেবা নিজের হাতে ধূপ জ্বেলে দিয়েছে দরবার-ঘরে। বড় ভাল লাগছে গন্ধটা।

নবাব বললে–ভাল করেছ বেগমসাহেবা, ধূপের গন্ধটা আমার খুব ভাল লাগে

তা জানি আলি জাঁহা দেখবেন আজকেও আপনার ঘুম আসবে

নবাব বললে–আজ কদিন ধরেই তো খুব ঘুমোচ্ছি বেগমসাহেবা। অনেক দিন পরে এমন করে রাত্রে ঘুমোতে পাচ্ছি–তুমি আমার কাছে থাকলেই আমার ঘুম আসে–

আমি রোজ ধূপ জ্বেলে দিতে বলব খিদমদগারকে।

নবাব বললে–ধূপ জ্বেলে দিক, কিন্তু তোমাকে আমার সঙ্গে এখানে থাকতে হবে বেগমসাহেবা।

মরালী এক-পা পিছিয়ে এল। বললে–ছিঃ, আলি জাঁহা কি অত ছোট?

কেন বেগমসাহেবা? আমি ছোট নই একথা তোমাকে কে বললে? আমি তো লম্পট

 লম্পট আর যে বলে বলুক, আমার কাছে আপনি অনেক বড় আলি জাঁহা

নবাব চোখ দুটো বড় করে বললে–বেগমসাহেবা, তুমি দেখছি আমাকে ভালবাসছ? তুমি যে আমাকে অবাক করে দিলে গো!

কেন, আপনি কি কারও ভালবাসা পাননি আলি জাঁহা?

নবাব বললে–ভালবাসা? হয়তো পেয়েছি হয়তো পাইনি। কিংবা হয়তো পেলেও তা জানতে পারিনি। ভেবেছি, আমার টাকার জন্যেই হয়তো সবাই আমায় ভালবাসে!

মরালী বললে–আর আমি? আমি বুঝি আপনার টাকা চাই না?

তুমি?

 নবাব কী যেন ভাবলে। তারপর বললে–তা-ও তো বটে! সবাই-ই যখন আমাকে আমার টাকার জন্যে ভালবাসে তখন তুমিই বা অন্যরকম হতে যাবে কেন! তুমিই বা আমায় কী দেখে ভালবাসবে? আমার তো কোনও গুণ নেই। আমি লম্পট, আমি নীচ, আমি গোঁয়ারগোবিন্দ! একমাত্র টাকা ছাড়া আমার দেবার মতো আর কী-ই বা আছে বলো?

মরালী এবার আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। নবাবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললে–আলি জাঁহা যদি সত্যিই ভালবাসার এত কাঙাল তো এটা কি জানেন না যে, ভালবাসা পেতে গেলে ভালবাসা দিতেও হয়?

নবাব বললে–তা হলে তোমাকে সত্যি কথাই বলি বেগমসাহেবা, ভালবাসা যে কী জিনিস তা আমি জানি না। ছোটবেলা থেকে ভালবাসা কেউ আমাকে শেখায়নি। তুমি বিয়ে করেছ, তুমি তোমার স্বামীকে ভালবেসেছ, তোমার স্বামীও তোমাকে নিশ্চয় ভালবেসেছে–ভালবাসার ব্যাপারটা তুমি আমার চেয়ে হয়তো বেশি জানো। বলো তো, ভালবাসা কাকে বলে!

মরালী বললে–একটা কথা বলুন তো আলি জাঁহা, আপনি আপনার মসনদকে ভালবাসেন তো?

তা বাসি। কিন্তু সে তো অন্যরকম।

যে রকম ভালবাসাই হোক, মসনদ ছাড়তে তো আপনার কষ্ট হয়। কেউ যদি আপনার মসনদ কেড়ে নেয় তো আপনার মনে তো দুঃখ হয়। হয় না?

নবাব বললে–তা হয়।

তা হলে আপনি যত মেয়েকে কেড়ে নিয়ে এসে চেহেল-সুতুনে পুরেছেন, সেই মেয়েদেরও যে স্বামীকে ছেড়ে আসতে কষ্ট হয়, তা তো বোঝেন?

নবাব চাইলে মরালীর দিকে। বললে–তা হলে তোমাকেও কি খুব কষ্ট দিয়েছি বেগমসাহেবা? তুমি কি এখনও তোমার খসমকে ভুলতে পারোনি হলে?

মরালী বললে–আপনি সে বুঝবেন না আলি জাঁহা।

কেন বুঝব না বেগমসাহেবা? তুমি বলো না, তুমি বুঝিয়ে দিলেই আমি বুঝব!

মরালী বললে–সে-সব-শুনলে আজ রাত্তিরে তা হলে আর আপনার ঘুম আসবে না।

না না, তুমি বলো বেগমসাহেবা, বলো তুমি! আমি শুনব।

 মরালী বললে–আমরা মেয়েমানুষ, আমরা দু’বার ভালবাসতে পারি না।

নবাব খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে–আমায় ক্ষমা করো বেগমসাহেবা, আমি তোমার ওপর খুব জুলুম করেছি। আমাকে তুমি মাফ করো।

মরালী বললে–ছিঃ আলি জাঁহা, আপনি না বাংলার নবাব—

তোমার কাছে আমি নবাব নই বেগমসাহেবা, এই এখন আমি আর নবাব নই।

তা হোক, আপনার মসনদ সকলের আগে, তারপর আমি।

না না বেগমসাহেবা, মসনদ টসনদের কথা এখন আর আমাকে মনে করিয়ে দিয়ো না। এখন আর ওসব কথা শুনতে ভাল লাগছে না। এখন শুধু তুমি তোমার কথা বলল। আমি আর কোনও কথা শুনব না। বলো, আমি তোমার জন্যে কী করব? কী করলে তুমি আবার খুশি হবে?

মরালী বললে–কেন আলি জাঁহা ওসব কথা তুলছেন?

কেন তুলবনা বেগমসাহেবা? আমি যদি অন্যায় করে থাকি তো সেকথা তুলতে দোষটা কী? আমি যদি পাপ করে থাকি তো সে-পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে আপত্তি কী?

মরালী বললে–কেউ যদি আপনার কথা এখন এই সময়ে শুনতে পায় আলি জাঁহা?

শুনলে ভাববে নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা শুধু নবাবই নয়, নবাব মানুষও বটে!

তা শুনলে আপনার লোকসান হবে আলি জাঁহা! লোকে আপনাকে আর ভয় করবে না!

নবাব বললে–ভয় না করুক, ভাল তো বাসবে। আমি তো এখন থেকে ভালবাসাই চাই বেগমসাহেবা!

তারপর একটু থেমে বললে–কিন্তু তুমি আমার কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছ বেগমসাহেবা, বলল, কী করলে তুমি খুশি হবে বেগমসাহেবা।

মরালী বললে–আমাকে খুশি করা আলি জাঁহার সাধ্য নয়।

কী বলছ তুমি বেগমসাহেবা? জানো, আমি বাংলার নবাব, আমি হুকুম করলে বাংলার এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্ত এখনই কেঁপে উঠবে!

তা হোক, আমি তাতে খুশি হব না আলি জাঁহা। খোদাতালারও সাধ্য নেই আমাকে খুশি করে!

কী বলছ তুমি বেগমসাহেবা? তোমার এত কষ্ট?

মরালী বললে–হ্যাঁ আলি জাঁহা

নবাব কিছুক্ষণ চেয়ে রইল মরালীর দিকে। তারপর বললে–তা হলে আমি তোমার এত বড় ক্ষতি করেছি বেগমসাহেবা–আমি তোমাকে এত কষ্ট দিয়েছি?

মরালীর চোখ দিয়ে তখন ঝরঝর করে জল পড়ছে। নবাব তাড়াতাড়ি মরালীর ওড়নি দিয়ে তার চোখ দুটো মুছিয়ে দিতে যেতেই মরালী মুখটা ঘুরিয়ে নিজেই নিজের চোখ দুটো মুছতে লাগল।

নবাব উঠে বসে মরালীর সামনে ঝুঁকে পড়ল।

বললে–জানো, বেগমসাহেবা, তুমিই আমার সামনে প্রথম কাঁদতে পেলে? এই প্রথম কেবল তোমাকেই আমার সামনে কাঁদতে দিলুম–

আমার কসুর মাফ করুন আলি জাঁহা! আমি আর কখনও কঁদব না, এই আমি হাসছি–এই হাসছি–

নবাব বলতে লাগল–এতদিন তোমার সব কথা শুনে এসেছি বেগমসাহেবা। তুমি যা বলেছ তাই করেছি। তোমার কথাতে আমি রাজা দুর্লভরামকে দিয়ে ফৌজ পাঠিয়েছি পলাশিতে তোমার কথাতেই আমি কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠি রাখতে দিয়েছি। কারণ তুমিই প্রথম আমাকে ঘুম পাড়িয়েছ! কিন্তু কেন আবার আমার মন খারাপ করে দিলে? কেন আমার সামনে তুমি কাদলে? আজ কি আর আমার ঘুম আসবে?

মরালী বললে–আপনি নিজের ঘুমের কথাই ভাবছেন, কিন্তু আর কেউ ঘুমোয় কিনা তা কি কখনও ভেবেছেন? কখনও কি জানতে চেষ্টা করেছেন আপনার চেয়েও আরও বড় দুঃখ কারও আছে কিনা?

নবাব বললে–আমি তো তাই বলছি আমি প্রায়শ্চিত্ত করব। তোমার ওপর যত অত্যাচার হয়েছে আমি তা দূর করব! বলল, আমি কী করলে তুমি খুশি হবে!

মরালী বললে–আমি তো বলেছি আলি জাঁহা, আমাকে খুশি করা আপনার সাধ্য নয়

কিন্তু আমিই তো তোমাকে তোমার স্বামীর কাছ থেকে চুরি করে এনে চেহেল্‌-সুতুনে পুরেছি!

 চেহেল্‌-সুতুনে এনে আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন আলি জাঁহা!

নবাব অবাক হয়ে গেল। সেকী?

হ্যাঁ, আলি জাঁহা। আপনি না নিয়ে এলে আমার আরও কষ্ট হত। এখানে এনে আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন!

কিন্তু এ কথা তো এতদিন আমাকে বলোনি? আমি তা হলে তোমার ক্ষতি করিনি?

মরালী বললে–না

তা হলে কি তোমার উপকার করেছি?

 হ্যাঁ!

 নবাব আরও অবাক হয়ে গেল। মরালী বললে–আপনি আমাকে এখানে না নিয়ে এলে আমার সর্বনাশ হয়ে যেত আলি জাঁহা। আপনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন বলেই আমি বেঁচে গিয়েছি। নইলে হয়তো এতদিনে আমায় গলায় দড়ি দিতে হত। আমাকে কেউ দেখতে পেত না আর! আমি তো ভেবেছিলুম গলায় পাথর বেঁধে নদীতে ঝাঁপ দেব, নয়তো আগুনে পুড়ে মরব–

সেকী? তা হলে তুমি কি তোমার স্বামীকে ভালবাসতে না?

মরালী বললে–আমার পোড়া কপালে আরও অনেক দুঃখ আছে আলি জাঁহা—

সত্যিই তুমি ভালবাসতে না তোমার স্বামীকে?

 মরালী বলে–ভালবাসতে পারলে তো বেঁচে যেতুম আলি জাঁহা! কিন্তু আমার যে পোড়া কপাল। আমার কপালে যে ছাই লেখা আছে–

কী বলছ তুমি বেগমসাহেবা! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না—

মরালী বললে–আমার কথা কেউই বুঝবে না আলি জাঁহা। বিয়ে হয়েও আমি স্বামী পেলুম না, স্বামী পেয়েও আমি তার বউ হতে পারলুম না–

নবাব বললে–তুমি আমাকে অবাক করলে বেগমসাহেবা, আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না–

শুধু আপনি কেন আলি জাঁহা, কেউ আমার কথা বুঝতে পারবে না। আমার বিয়ে হয়েছে তবু আমি কারও স্ত্রী হতে পারিনি, আমি স্ত্রী হয়েছি তবু কেউ আমার স্বামী হতে পারেনি

নবাব অনেকক্ষণ পরে বললে–তুমি কি জাদু জানো বেগমসাহেবা?

কেন অমন করে বলছেন আলি জাঁহা!

নইলে কেন এমন করে আমাকে ভুলিয়ে দাও? কেন এমন করে লোভ দেখাও? আমি তো সকলের সব কথাতেই রাজি হচ্ছি, আমি তো সকলের সব অপরাধই ক্ষমা করছি। উমিচাঁদকেও ক্ষমা করেছি, নন্দকুমারকেও ক্ষমা করেছি। তাদের সব অপরাধ ভুলে গিয়ে আমি তাদের ছেড়ে দিয়েছি। ভেবেছিলাম এবার থেকে ভালবেসে দেখব কেউ আমাকে ভালবাসে কিনা। কিন্তু তুমি তো আমার সব গোলমাল করে দিলে বেগমসাহেবা!

মরালী বললে–কেন আলি জাঁহা? আমি আপনার কী করলাম?

তুমি? তুমিই তো আমাকে রামপ্রসাদ সেনের গান শোনালে! তুমিই তো আমাকে কোরান পড়ালে! আমি যে তোমাকে ভালবাসতে আরম্ভ করেছিলাম।

মরালী বললে–আমার ভয় হচ্ছে আলি জাঁহা, আজকে বোধহয় আপনার আর ঘুম আসবে না–

না আসুক, ঘুম না-আসা আমার নতুন নয়।

মরালী বললেন আলি জাঁহা, আপনার ঘুম না এলে যে আমার ঘুম আসবে না।

 নবাব বললে–তুমি যাও বেগমসাহেবা। চেহেল্‌-সুতুনে চলে যাও, সারাফত আলির আরক খেয়ে ঘুমোও গে, যাও। আর তা ছাড়া তোমার ঘুম না এলে আমার কী! তুমি তো আমাকে ভালবাসোনা

মরালী বললে–মেয়েমানুষ কি দু’বার ভালবাসে আলি জাঁহা? দুবার ভালবাসতে পারে?

নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার চোখ দুটো যেন সেকথা শুনে একটু ছলছল করে উঠেছিল। অনেকক্ষণ কিছু কথা বলেনি। মরালী বলেছিল–আপনি শুয়ে পড়ুন আলি জাঁহা–

নবাব বলেছিল–না, আমি ঘুমোব না–তুমি যাও, চলে যাও এখান থেকে

মরালী তবু বলেছিল–অমন করে রাগ করতে নেই আলি জাঁহা, বাংলার নবাবের রাগ করলে চলে না–সামান্য একটা মেয়েমানুষের ওপর রাগ করা তার মানায় না–

তবু নবাব শুতে যায়নি। বলেছিল–তুমি যাও, আমার যা খুশি তাই করব, আমি কালই মঁসিয়ে ল’কে ডেকে কাশিমবাজার থেকে তাড়িয়ে দেব আমি বলব ফরাসিরা আমার কেউ নয়, ইংরেজরাই আমার বন্ধু, ইংরেজরাই আমার সব! আমি তোমার কোনও কথা শুনব না–তুমি যাও

হায় রে! সব পুরুষমানুষই কি একরকমের হতে হয়। ও নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাও যা, ওই কান্তও তাই। ওই উদ্ধব দাসও তাই, ওই কর্নেল ক্লাইভও তাই। একবার তুমি মুসলমান করে নেবে, একবার তুমি খ্রিস্টান করে নেবে, আবার একবার হিন্দুর মেয়ের মতো পতি-ভক্তি চাইবে, তা কী করে হয়! তোমরা তোমাদের নিজেদের দিকটাই দেখলে শুধু, আমার কথা তো তোমরা কেউই ভাবলে না! আমার যেন মনের বালাই থাকতে নেই। আমার যেন নিজের বাছবিচার বলে কিছু থাকা অপরাধ! আমি যেন পাথর, আমি যেন পাহাড়, আমি যেন মেয়েমানুষ নই!

মতিঝিল তখন অন্ধকার নিঝুম। মরালী রোজকার মতো নবাবকে ঘুম পাড়িয়ে মতিঝিল থেকে চেহেল্‌-সুতুনে যাচ্ছিল। বাদিটা আগে আগে যাচ্ছিল। পেছনে মরালী। নীচেয় চবুতরে তাঞ্জাম তৈরি।

হঠাৎ গলার আওয়াজে একেবারে চমকে উঠেছে মরালী।

কে? কৌন হ্যায়?

বাঁদিটা পেছন ফিরতেই দেখলে মরিয়ম বিবি থমকে দাঁড়িয়েছে। কান্ত এতক্ষণ এই সুযোগটুকুর জন্যে বাইরে অপেক্ষা করছিল।

সামনে এসে বসলে তোমার বাঁদিটাকে একটু সরে যেতে বলল, একটা কথা আছে–

বাঁদিটা আড়ালে সরে গেল।

 মরালী বললে–এবার বলো কী কথা? তাকে পেলে?

কাকে?

কাকে মনে নেই? তোমাকে অত করে বলে দিলুম–নবাব তার গান শুনতে চেয়েছে, তবু তোমার মনে থাকে না।

কান্ত বললে–তাকে খুঁজতেই তো গিয়েছিলুম মরালী। কিন্তু পাওয়া কি অত সোজা। এই তো এখন অনেক খুঁজে ফিরছি!

তা হলে পাওয়া যাবে না?

আবার যাব। কিন্তু একটা খবর শুনে তোমাকে বলতে এলুম। এই একটু আগে কাশিমবাজারের ওয়াট সাহেব আমাদের মনসবদার ইয়ার লুৎফ খা’র বাড়িতে গিয়ে ঢুকল।

ঢুকল তা কী?

না, এত রাত্তিরে পালকি চড়ে একজন বোরখা পরে ঢুকল দেখে খুব সন্দেহ হল। ভাবলাম মনসবদার সাহেবের বাড়িতে এই অসময়ে কে ঢোকে। আমিও ভাব করলাম সেপাইটার সঙ্গে। সেপাইটা বশির মিঞার খুব বন্ধু। শুনে বড় ভয় হল মরালী। শুনলাম তোমাকে খুন করবার জন্যে নাকি ওরা ষড়যন্ত্র করছে। কী হবে?

মরালী বললে–আমাকে খুন করবে?

হ্যাঁ মরালী, সেপাইটা ভেতরে গিয়ে চুপি চুপি শুনে এসে তাই বললে!

কিন্তু আমি কী করেছি যে আমাকে ওরা খুন করবে?

কান্ত বললে–তুমি যে সেদিন ক্লাইভ সাহেবের বাড়ি থেকে চিঠি চুরি করেছিলে! তোমার ওপর যে তাই ওদের রাগ। তোমার কথাতেই তো নবাব পলাশিতে রাজা দুর্লভরামকে দিয়ে ফৌজ পাঠিয়েছে। তোমার কথাতেই তো কাশিমবাজারের ফরাসিদের কুঠিতে নবাব সব ফরাসি উদ্বাস্তুদের থাকতে দিয়েছে। তোমার জন্যেই তো সকলের এত হেনস্থা! সব যে জানে সবাই!

মরালী আবার জিজ্ঞেস করলে–কী করে খুন করবে আমাকে? বিষ খাইয়ে?

কান্ত বললে–তা জানি না। মনসবদার সাহেব টাকা পেলে সব করতে পারে মরালী, ও সব করতে পারে! তুমি রোজ যে মতিঝিল থেকে রাত্তিরবেলা চেহেল্‌-সুতুনে যাও তা সবাই জানে। রাস্তায় যদি কোনওদিন কেউ কিছু করে ফেলে? আমার বড় ভয় করছে মরালী, তাই তোমাকে বলতে এলুম

ওয়াটস্ সাহেব কি এখনও মনসবদার সাহেবের বাড়িতে আছে?

কান্ত বললে–হ্যাঁ, বোধহয় আছে, আমি তো এই সেখান থেকেই আসছি

মরালী বললে–ঠিক আছে, তুমি যাও

বলে মরালী এগিয়ে গেল! কান্ত বললে–কোথায় যাচ্ছ?

মরালী বললে–মনসবদার সাহেবের বাড়িতে

 বলে বাঁদির সঙ্গে মরালী তাঞ্জামে গিয়ে উঠল। কান্ত সেইখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। চেয়ে দেখলে তাঞ্জামটা ফটক দিয়ে বেরিয়ে ডান দিকে না গিয়ে বাঁ দিক বরাবর চলতে লাগল।

*

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের এই-ই প্রথম কালীঘাটে আসা নয়। তিনি কালীক্ষেত্রে এলে হালদারবংশে হুড়হুড়ি পড়ে যায়। এবার রামপ্রসাদ সেন সঙ্গে এসেছেন। নাটমন্দিরে একেবারে গানের বন্যা বয়ে গেছে। লোকে গান শুনে কেঁদে আর কুল পায়নি। বলেছে–আরও গান শুনব সেনমশাইয়ের

তা সেনমশাইকে বলতে হয় না কাউকে। তিনি ভক্তির আতিশয্যে গেয়ে গেয়ে বিভোর হয়ে ওঠেন। দূর দূর থেকে লোকে গান শুনে ভিড় জমাতে আসে। শুধু লোক নয়, ভিখিরিদের ভিড় জমে ওঠে। তারা প্রসাদ পায়, ভিক্ষেও পায়। পুজোরি বামুনরা সিধে পায়, দক্ষিণেও পায়। আবার কবে মহারাজ আসবেন, কে বলতে পারে। সে কালীঘাট তো আর নেই এখন। এখন ফিরিঙ্গি কোম্পানি আসার পর থেকে যাত্রী বেড়েছে বটে, আগের চেয়ে আয়ও ভাল হচ্ছে বটে, কিন্তু যে রকম দু’দুটো লড়াই হয়ে গেল, তারপর আর কি কারও বিশ্বাস থাকে! সারা কলকাতাটা তো একবার পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। আগুনটা আর একটু দক্ষিণ ঘেঁষে লাগলেই একেবারে মায়ের মন্দিরে আঁচ লাগত।

তারা বলে সেবারে মা-ই বাঁচিয়ে দিয়েছেন মহারাজ

একজন বলে এবারেও অনখ কাণ্ড বাধত মহারাজ, লড়াই করতে করতে নবাবের ফৌজ একেবারে ওই ঢাকুরে পর্যন্ত হটে গিয়েছিল

মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন–তারপর?

তারপর এই মা-ই আমাদের বাঁচিয়ে দিলেন। আমরা সব হালদাররা মিলে মা মা বলে ভ্রাহিম্বরে ডাকতে লাগলাম। বললাম–মা, এবার তুমি ঠেকাও তোমার ছেলেদের মা আর থাকতে পারলেন না, আমাদের ডাক শুনে মায়ের ত্রিনয়ন দিয়ে আগুন ঠিকরে বেরোতে লাগল

একজন ভক্ত বললে–তা তো বেরোবেই, ওদুটোই তো যবন, ওই কোম্পানির ফিরিঙ্গিরাও যবন, ওই নবাবও যবন। দুটো দলের একটাও হিন্দু হলে তবু কথা ছিল

কদিন মহা ধুমধামেই কাটল মহারাজের। ছোটমশাই কিন্তু ছটফট করছিলেন প্রথম থেকেই। বহুদিন পরে এবার সবাই একসঙ্গে কালীক্ষেত্রে এসেছেন। রায়গুণাকর রামপ্রসাদের গান শোনেন আর বলেন–মা, মা

গোপালবাবু বললে–এবার প্রসাদের সন্দেশে চিনির ভাগটা বেশি মহারাজ

মহারাজ বললেন–কী করে বুঝলে?

 গোপালবাবু বললে–দেখছেন না পিঁপড়েগুলো সেবারে কত মোটা ছিল, এবারে কত রোগা হয়ে গেছে

তা চিনি বেশি থাকলে কি পিঁপড়েরা রোগা হয়ে যাবে?

গোপালবাবুবললে–তা রোগা হবে না? আপনি গুড়-খাওয়া পিঁপড়ের সঙ্গে ছানা-খাওয়া পিঁপড়ের লড়াই লাগিয়ে দিন, দেখবেন গুড়-খাওয়া পিঁপড়ে হেরে যাবে, ওদের তাকত কম–

রায়গুণাকর শুনছিলেন। বললেন–গোপালবাবুর যেমন কথা

গোপালবাবু বললে–আমারও তো মহারাজ প্রথমে বিশ্বাস হত না। আমার নিজের বাড়িতে পিঁপড়েগুলো আগে খুব মোটা মোটা ছিল, খুব কামড়াত। আমি তখন রাবড়ি খেতাম, ছানা খেতাম, দুধ খেতাম

মহারাজ হাসছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন–তারপর?

গোপালবাবু বললে–তারপর আপনি যখন আমার জমি দখল করে নিলেন, মাসোহারা কমিয়ে দিলেন, তখন হঠাৎ দেখি, পিঁপড়েগুলো রোগা হয়ে গেছে সব

কেন? তোমার মাসোহারা কমানোতে পিঁপড়েগুলো রোগা হয়ে গেল কী করে?

আজ্ঞে, গুড় খেয়ে খেয়ে। তখন আর আমার রাবড়ি খাবার পয়সা নেই। গাই-গোরু বেচে দিতে হল, শুধু গুড় খাই। ঘরে গুড়ের নাগরি ছিল, সেই নাগরির গুড় খেয়ে খেয়ে পিঁপড়েগুলো সব রোগা হয়ে গেল

মহারাজ বললেন–তা তুমি নিজে রোগা না হয়ে পিঁপড়েগুলো রোগা হল কেন?

গোপালবাবু বললেন–আজ্ঞে, পিঁপড়ের জান আর আমার জান? আমি পিঁপড়ে হলে আমিও রোগা হয়ে যেতুম–

কালীকৃষ্ণ সিংহী মশাই বললে–মহারাজ, গোপালবাবু কী বলছে বুঝতে পারলেন তো?

 মহারাজ বললেন–গোপালবাবু, তোমার জমির বন্দোবস্ত করে দিলে আবার দুধ-ঘি খাবে তো,না কেবল নেশা-ভাঙ করবে

নেশা-ভাঙ করতে গেলেও তো দুধ-ঘি লাগে মহারাজ, দুধ-ঘি না হলে কি নেশা জমে?

 রায়গুণাকর বললেন–নেশা-ভাঙ কেন করেন গোপালবাবু? ওতে কী ফায়দা?

গোপালবাবু বললে–সে আপনি বুঝবেন না রায়গুণাকর, আপনি তো কাব্যসরস্বতীর পায়ে মাথা মুড়িয়ে বসে আছেন। আপনার ওসব দরকার নেই। কিন্তু ভাবুন তো আমার কথা। ভাবুন তো আমার পেশার কথা! আমার দুঃখ থাকতে নেই, আমার অসুখবিসুখ থাকতে নেই, আমার চোখে জলও থাকতে নেই। আমার চোখে যদি কোনওদিন মহারাজ জল দেখতে পান তো আমার চাকরি গেল! ভাবতে পারেন আমার ছেলেটা যে-দিন মারা গেল, সেদিনও আমায় মহারাজের সভায় এসে নিয়মমাফিক হাসাতে হয়েছে, নিয়মমাফিক মহারাজার দুর্ভাবনা ভোলাতে হয়েছে… আমার ছেলের মৃত্যুর খবর কেউ জানতে পারেনি দু’দিন, আমি বউকে কাঁদতে বারণ করে এসেছিলাম রায়গুণাকর, পাছে মহারাজের কানে গেলে মহারাজ কষ্ট পান

মহারাজ বললেন–সেই জন্যেই তো তোমাকে এত ভালবাসি গোপালবাবু, তোমার ছেলের মৃত্যুর খবর সেইদিনই আমার কানে এসেছিল, কিন্তু আমি তোমায় বলিনি

আপনি আগেই জানতেন?

গোপালবাবু মহারাজের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল!

 সাধে কি তোমার চাকরি রয়েছে গোপালবাবু, আমি তোমাকে অনেক পরীক্ষা করেছি। তুমি জানতেও পারোনি। তোমার জমি কেড়ে নিয়ে দেখেছি, তোমার মাইনে কমিয়ে দিয়ে দেখেছি। মানুষকে কি সহজে চেনা যায়! সীতাকে কি বাল্মীকি অত সহজে ছেড়েছিলেন? তাকে অনেক পরীক্ষার মধ্যে ফেলে তবে তাকে সতী করে তুলেছিলেন। বাচস্পতি মশাইকেও তোমার মতো পরীক্ষা করে তবে তাকে সভাপতি করেছিলাম। এই ভারতচন্দ্রকে অনেক পরীক্ষা করে তবেই রায়গুণাকর করেছি–আর তাই-ই যদি না করব তো এতদিন এই রাজত্বে রাজ্য চালাচ্ছি কী করে?

কদিন ধরেই এইরকম আসর বসত। ছোটমশাই থাকত সঙ্গে। সবাই হাসত, গল্প করত। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের এই-ই ছিল নিয়ম। বাইরের কেউ বুঝতে পারত না মহারাজের মনের মধ্যে কী ঝড় চলছে।

একদিন ডেকে বললেন–কী হল? অত মুখভার করে থাকেন কেন হোমশাই?

ছোটমশাই আর থাকতে পারছিলেন না। ক’দিন ধরে দেখছিলেন, মহারাজ হাসি-রসিকতা নিয়েই ব্যস্ত। অথচ চন্দননগর দখল করে ক্লাইভ সাহেবের ফিরে আসার কথাও শোনা হয়ে গেছে। প্রথম দিকে মহারাজের ভয় হয়েছিল হয়তো নবাব আবার ফৌজ নিয়ে ক্লাইভের সঙ্গে লড়াই করতে আসবে। কিন্তু কিছুই হল না। কলকাতা থেকে কিছু লোক পালিয়ে গিয়েছিল গঙ্গার ওপারে। কিছু লোক কালীঘাটের মন্দিরের আশেপাশে এসে উঠেছিল। কয়েক দিনের মধ্যেই কালীঘাটে লোকজনের ভিড় বেড়ে গেল। হালদারদের আয় বেড়ে গেল, ভিখিরিদের তবিল ফুলে উঠল।

মহারাজ আবার বললেন–আমি নবদ্বীপেরও মহারাজা ছোটমশাই, কিন্তু জানেন, আমি আমার নিজের স্ত্রীকেও শায়েস্তা করতে পারিনি, নিজের স্ত্রীকেও বশে আনতে পারিনি

ছোটমশাই কথাটা শুনে অবাক হয়ে গেল।

হ্যাঁ ছোটমশাই, তবে শুনুন গল্পটা। কেউ জানে না, আপনাকেই বলি। আপনি তো জানেন, আমি দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছি, এবং যার পাণিগ্রহণ করেছি, সে উচ্চকুলের মেয়ে। আমার সঙ্গে সে-কন্যার বিবাহ দিতে ইচ্ছে ছিল না আমার শ্বশুরের। কিন্তু আমার অর্থ প্রতিভা প্রতিপত্তি দেখে পর্যন্ত লোভও সংবরণ করতে পারেনি। আমি ফুলশয্যার রাত্রে আমার বউকে জিজ্ঞেস করলাম–কেমন লাগছে বলো? আমার সঙ্গে বিয়ে না হলে কি এইরকম রুপোর খাটে শুতে পারতে? তা শুনে আমার গৃহিণী কী বললে–জানেন? বললে–আর কয়েকশো বিঘে দূরে বিয়ে হলে আমি সোনার খাটে শুতে পারতাম।

বলে মহারাজ হোহো করে হাসতে লাগলেন।

তার মানে নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার সঙ্গে শুলে সোনার খাটে শুতে পারত, এইটেই বলতে চাইলে আর কী! উত্তরটা শুনে মনে প্রথমে একটু কষ্ট হয়েছিল বই কী। সেরাত্রে ভাল করে ঘুম হল না। ভাবলাম, সারা বাংলাদেশের মহারাজ হয়েও আমি আমার সহধর্মিণীকে সুখী করতে পারিনি, আমার কীসের অহংকার? আমার কীসের গর্ব?

তারপর? তারপর কী করলেন?

তারপর আর কী করব? স্ত্রীর সামনে হাসিমুখে অপমানটা হজম করে নিলাম। কিন্তু মনের মধ্যে খচখচ করে কাটা বিধতে লাগল। আমার এত অগাধ সম্পত্তিও তো আমার গৃহিণীকে আকর্ষণ করতে পারলে না। মনে হতে লাগল–তা হলে আমার এই সিংহাসনও তো আমার গৃহিণীর কাছে তুচ্ছ। তা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেও মনের অশান্তি ঘুচল না। ডেকে পাঠালুম গোপাল ভাঁড়কে। ভাবলাম, ওকে পরখ করে দেখি। ওর বন্দোবস্তি জমি কেড়ে নিলুম, ওর মাসোহারা কমিয়ে দিলাম। ওর একমাত্র ছেলে একদিন মারা গেল। আমার কানে সে-খবরও এল। ওকে আমি কিছুই বললুম না। কিন্তু তখনও দেখলম-ও সেই রকমই হেসে কথা কইতে লাগল, ঘুণাক্ষরেও নিজের ছেলের মৃত্যুর খবরটা বললে–না। রোজ যেমন হেসে ভাঁড়ামি করে যায়, সেদিনও তাই করে গেল। ভাবলাম–গোপালবাবু সত্যিই মহাপুরুষ! দুঃখ তো এ-সংসারে আছেই ছোটমশাই, কিন্তু সেই দুঃখকে এড়িয়ে গিয়ে যে তার উর্ধ্বে উঠতে পারে, যে শ্মশানে বসে জীবনের জয়গান গাইতে পারে, তাকেই তো লোকে বলে গোপাল ভাড়। লোকে গোপালবাবুকে ভাড় বলেই জানে, ভাড় বলেই চিরকাল জানবে। কিন্তু আমি জানি ও মহাপুরুষ। ওই বাচস্পতি মিশ্র, রায়গুণাকর, ওঁদের মতোই গোপালবাবু একজন সিদ্ধ মহাপুরুষ।

তারপর?

তারপর তো আজ শুনলেন। রামপ্রসাদ সেন মশাইকে ডেকে তাই তো আজ এমন করে গান শুনছি। হাহুতাশ করে লাভ কী? নবাবের হাহুতাশ নেই? আপনার সহধর্মিণীকে নিয়ে নব যে চেহেসতুনে তুলেছে, ভাবছেন নবাবই কি সুখী? নইলে রামপ্রসাদের গান শুনতে নবাব কখনও আমার বজরায় আসে? আর ওই যে ক্লাইভ। ওই ফিরিঙ্গিবেটার কথাই ধরুন না কেন। নিজের দেশে বউ ছেলেমেয়ে ফেলে রেখে এখানে এই বন-জঙ্গল, মশা-মাছির মধ্যে পড়ে আছে। পড়ে আছে কেন? আপনি কি ভাবছেন লড়াই করে বাংলাদেশ লুঠ করবার জন্যে? তা না-ও হতে পারে? হয়তো আপনার আমার মতো ওর মনের কোনও জ্বালা আছে, কোনও যন্ত্রণা আছে। লোকে যা-ই বলুক, কিন্তু আমি বুঝতে পারি, আমাদের মতো বেটার মনে কিছু কাটা বিধছে, নইলে এইরকম করে ওই ক’টা সেপাই নিয়ে নবাবের সঙ্গে কেউ লড়াই করতে পারে? কেউ কেউ বলবে দৈব ক্ষমতা। কিন্তু আমি বলব, ওই জ্বালা-যন্ত্রণা, ওইটেই হল দৈব ক্ষমতা। ওই দৈব ক্ষমতাটাই মানুষকে মহামানুষ করে। ওটা কাউকে করে বীর, কাউকে করে কবি, কাউকে আবার ভড়। ওরা সবাই-ই মহাপুরুষ! আমি নিজে মহাপুরুষ নই, কিন্তু মহাপুরুষ চিনতে পারি। মহাপুরুষদের চিনতে পারাটাও একটা ক্ষমতা। আমার সে-ক্ষমতা আছে ছোটমশাই! আমার তো অন্য কোনও গুণ নেই, আমার শুধু টাকা আছে। আমি টাকা দিয়ে তাই মহাপুরুষ পুষেছি। ওই রায়গুণাকরকেও যেমন পুষেছি, তেমনই আবার গোপাল ভাঁড়কেও পুষেছি। উপায় থাকলে আমি ওই ক্লাইভটাকেও পুষতুম–ও-ও একটা মহাপুরুষ!

ছোটমশাই এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল।

খানিকক্ষণ থেমে বললে–তা হলে আমি কী করব বলুন? আমি অনেকদিন হাতিয়াগড় ছেড়ে রয়েছি, আমার বড় গৃহিণী একলা আছেন, তিনিও তো চিন্তিত হয়ে আছেন। ৪৭২

মহারাজ বললেন–আর কিছুদিন সবুর করুন ছোটমশাই, আমি এবার এসেছি ক্লাইভের সঙ্গে দেখা করতে, সে তো আপনি জানেন লোকের কাছে শুধু বলেছি, কালীঘাটে মাকে দর্শন করতে এসেছি ঠিক তা তো নয়।

ছোটমশাই বললে–কিন্তু আর কতদিন এখানে থাকব?

মহারাজ বললেন–আপনার জন্যেই তো আমি এখানে রয়েছি, ক্লাইভসাহেব রয়েছে হুগলিতে ছাউনি করে। ওদিকে দুর্লভরামও পলাশির মাঠে সেপাই-সামন্ত নিয়ে ঘাটি আগলে বসে আছে

তা হলে?

আমি হুগলি যেতে পারতুম। কিন্তু সেখানে আমি গিয়ে ক্লাইভসাহেবের সঙ্গে দেখা করলে আবার নবাবের চরের নজরে পড়ব, সেই ভয়ে যাচ্ছি না। শুনছি আজকালের মধ্যেই নাকি সাহেব ছাউনি তুলে দিয়ে পেরিন সাহেবের বাগানে আসবে

পেরিন সাহেবের বাগানে কেন?

মহারাজ বললেন–তা বুঝি জানেন না? ওখানে যে আবার সাহেব একটা এদিশি মেয়েমানুষ পুষেছে–

সে তো শুনেছিলাম। সে সেই পাগলাটার বউ। যে-পাগলাটা ছড়া লেখে

মহারাজ বললেন–বেটারা গোরু-শুয়োর খায় তো, তাই বেটাদের গায়ে গরম খুব। মেয়েমানুষ না থাকলে ওরা রাত কাটাতে পারে না।

ছোটমশাই বললে–তা বলে পরের বউ নিয়ে থাকাটা কি ভাল মহারাজ?

আরে মেয়েটাও যে খারাপ জাতের। সে সোয়ামির কাছেই যাবে না। সোয়ামিকে দেখতেই পারে । সোয়ামির নাম পর্যন্ত শুনতে পারে না। এ কী রকম স্বভাব?

আজ্ঞে, লোকটা যে বাউন্ডুলে। অমন স্বামীটার সঙ্গে থাকেই বা কী করে?

মহারাজ বললেন–যাক গে, ওসব নিয়ে আমাদের দরকারটা কী? যারযার স্বভাব নিয়ে লোকে পৃথিবীতে আসে। লোকটার জ্বালা-যন্ত্রণা আছে, ওই নিয়েই ভুলে থাকতে চাইছে। আসলে কী জানেন? দু’রকম তন্ত্রসাধক আছে পৃথিবীতে–এক রকম বীরাচারী, আর-এক রকম পশ্বাচারী, ক্লাইভসাহেব হল পশ্বাচারী সাধক

তারপর বললেন–আর এই দেখুন না আমাদের সেনমশাইকে সেই যে নাটমন্দিরে গিয়ে গান গাওয়া ধরেছে, আর ছাড়ছে না যে যাতে আনন্দ পায়

হঠাৎ হালদারবাড়ির এক পাণ্ডা ঘরে ঢুকল।

কী খবর হালদারমশাই?

 একজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে

মহারাজ বুঝতে পারলেন। বললেন–ছোটমশাই, এবার আপনি একটু ও-ঘরে বসুন গিয়ে

 ছোটমশাই উঠে যেতেই শশী ঘরে এল। মহারাজ বললেন–কী খবর, শশী?

খবর সব নিয়ে এসেছি মহারাজ

আগে মুর্শিদাবাদের খবর বলল। সেই মরিয়ম বেগমের খবর কিছু আছে?

তারই খবর এনেছি। বেগমসাহেবা নবাবকে একেবারে হাতের মুঠোয় করে ফেলেছে মহারাজ। আমি তো আরও অনেক খবর আনতে পারতাম, কিন্তু বেগমসাহেবা কান্তকে আমার সঙ্গে কথা বলতে বারণ করে দিয়েছে যে

কেন?

আমাকে সন্দেহ করছে কেবল। বলেছে–ওর সঙ্গে কথা বোলো না। আমি প্রথম প্রথম তার কাছ থেকেই তো খবর আদায় করতুম। বলতুম আমি গরিব লোক, ফৌজের দল থেকে নাম কাটা গেলে উপোস করব, এই বলে খুব পটিয়েছিলুম, কিন্তু তারপর আর কথা বলত না আমার সঙ্গে এখন অন্য পথ ধরেছি

কী পথ?

এখন ফকির সেজে মুর্শিদাবাদের রাস্তায় ঘুরে বেড়াই। আর সারাফত আলি বলে এক খুশবু-তেলওয়ালা আছে, তার একটা চাকর আছে, তার নাম বাদশা। সেই বাদশার সঙ্গে থাকি আর খবর আদায় করি। খুশবু-তেলওয়ালা আমাকে খেতে দেয়। সে-ই আমাকে মরিয়ম বেগমের খবর দিলে।

কী খবর?

বললে, মরিয়ম বেগমসাহেবাকে খুন করবার চেষ্টা করছে ওরা।

কারা?

ওই উমিচাঁদ, নন্দকুমার আর ক্লাইভসাহেবের মুনশি নবকৃষ্ণ। ওদের সবাইকে যখন মরিয়ম বেগমসাহেবা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তখন ওখানে একজন লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের কথা শুনেছিল।

মহারাজ সব শুনলেন মন দিয়ে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন–আর এদিকের খবর কী? হুগলির?

আজ্ঞে, ওদিককার ছাউনি উঠিয়ে দিয়ে ক্লাইভসাহেব কলকাতায় আসছে—

আসছে?

হ্যাঁ, সেপাইরা একদল তাবুর খুঁটি খুলছে দেখে এলুম। দেখে আমি আর দাঁড়াইনি সেখানে। সোজা চলে এসেছি।

মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন–ঠিক জানো তো?

 আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ, ঠিক জানি।

 মহারাজ বললেন–ঠিক আছে, তুমি যাও, মুর্শিদাবাদে গিয়ে কতদূর কী হল খবর পাঠিয়ো

শশী চলে যেতেই মহারাজ ছোটমশাইকে ডেকে পাঠালেন। বললেন–চলুন ছোটমশাই, এবার যা হোক কিছু একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে, ক্লাইভসাহেব কলকাতায় এসে গেছে।

ছোটমশাইয়ের তবু যেন সন্দেহ গেল না। বললে–খবর পেয়ে গেছেন? কে খবর দিলে?

আমার লোক আছে ছোটমশাই। তার জন্যেই এতদিন অপেক্ষা করছিলাম এখানে, চলুন।

 আমি যাব?

 হ্যাঁ, আপনিও থাকবেন আমার সঙ্গে, আপনি সব কথা খুলে বলবেন।

সেবার তো বলেছিলাম সব। কিন্তু হঠাৎ গোলাগুলি চলতে লাগল, আমি ভয়ে চলে গেলাম। কিন্তু আপনার সঙ্গে গেলে কিছু ভাববে না তো?

মহারাজ বললেন–আমার রায়গুণাকর লিখেছে দেখেননি, বড়র পিরিতি বালির বাঁধ, ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণেকে চাঁদ।তা সে হতে পারে কর্নেল ক্লাইভ, আমিও তো মহারাজা। দেখা যাক না কী হয়–চলুন, তৈরি হয়ে নিন

*

পেরিনসাহেবের বাগানে এসেই ক্লাইভসাহেব খোঁজ নিয়েছে। দিদি রয়েছে সেখানে, দিদির বউ রয়েছে। মনটা ছটফট করছিল কয়েকদিন ধরেই।

দিদি!

দুর্গারও প্রাণটা যেন হাঁফিয়ে উঠছিল। দেখা সাক্ষাৎ নেই কিছু নেই, কেমন করে দিন কাটে। হরিচরণকেও যানয়-তাই বলে বকাঝকা করেছে।

বলেছে–তোমার সাহেব কী রকম লোক বাছা? আমাদের বলে গেল ক’দিন পরেই আসবে, আর আজ একমাস হয়ে গেল একেবারে আসার নামগন্ধও নেই, একটা খবর পর্যন্ত দেয় না ।

হরিচরণ বলেছে–যুদ্ধ করতে গেলে কি কিছু জ্ঞান থাকে দিদি, কোনও দিকেই খেয়াল থাকে–

তা খেয়াল যদি না থাকে তো আমাদের কেন কথা দেওয়া? তুমি বাপু আমাদের বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিয়ে এসো আমরা এখানে আর থাকতে নারব না

আর ঠিক সেইদিনই দলবল নিয়ে সাহেব এসে হাজির।

বললে–খুব রাগ করেছ তো আমার ওপর?

দুর্গা বললে–তা রাগ করব না? তোমার নাহয় মাগ-ছেলে সাত-সুমুদ্র পারে রয়েছে, আমাদের জন্যে তোমার ভেবে লাভ কী? আমরা তোমার কে বলো না যে, আমাদের কথা ভাবতে যাবে তুমি?

ক্লাইভ বললে–সেকী? আমি তোমাদের কথা ভাবছি না কে বললে?

 হঠাৎ ওদিক থেকে হরিচরণ এসে খবর দিলে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এসেছে সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে

সাহেব একটু অবাক হয়ে গেল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র! মহারাজ অব নদিয়া?

অলরাইট, ডাকো তাকে, আমার ড্রয়িংরুমে বসাও

হরিচরণ বললে–সঙ্গে আর একজন ভদ্রলোক রয়েছেন

তাকেও ডাকো, দু’জনকেই বসাও, আমি যাচ্ছি দিদির সঙ্গে কথা বলে হরিচরণ চলে গেল।

.

দুর্গা ক্লাইভ সাহেবের মুখের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখলে আবার। যখন তার সঙ্গে কথা বলে তখন এক রকম চেহারা, আবার যখন অন্য লোকের সঙ্গে কথা বলে তখন সে চেহারা একেবারে বদলে যায়। কিন্তু দূর্গা তো জানে না কাকে বলে রাজনীতি। তোমরা তো বেশ আছ দিদি, কোথা থেকে চাল-ডাল-তেল-নুন-ঘি আসছে কিছুই জানতে চাইছ না। তোমাদের নিজেদের বাড়িতেও তোমরা তার খবর রাখে না। খবর রাখে তোমাদের মেন-ফোক। আমাদের দেশে আমার ওয়াইফ পেগিও তোমাদের সেই আসল আমিটার খবর রাখে না। এই যে আমি এখানে কত কষ্ট করে কোম্পানির এম্পায়ার তৈরি করতে চেষ্টা করছি, আমার সিলেক্ট কমিটিও তার কোনও খবর রাখে না। নবাবের বেগমরাই কি খবর রাখে নবাবের মনের কথার? যদি রাখত তা হলে যে পৃথিবী চলত না। তাই তোমাদের সামনে আমি হাসি, তোমাদের সঙ্গে আমি গল্প করি। নবাবরাও তাই বাইরে গান বাজনাফুর্তি করে, শিকার করে, আর ভেতরে তারাও ঠিক আমার মতন। তারাও আমার মতো বাইরে এক রকম, ভেতরে আর-এক রকম। তোমরা তো রাত্রে ঘুমোও। আমি কতদিন দেখেছি তোমরা আরাম করে রাত্রে ঘুমোচ্ছ। কিন্তু আমি? তোমরা জানতেও পারোনি যে, আমার ঘুম নেই রাত্রে। আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ি তা হলে যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও ঘুমিয়ে পড়বে। আর নবাব? গিয়ে দেখে এসো মুর্শিদাবাদের মতিঝিলে। ঘুমের জন্যে নবাবকে কত কসরত করতে হচ্ছে তা বেঙ্গলের মানুষ জানতেও পারছে না।

চন্দননগর থেকে ফিরে এসেই ক্লাইভের যেন আর শান্তিতে থাকা চলছিল না। কোথায় যেন সব গোলমাল পাকিয়ে উঠছিল। কাউকে তো বিশ্বাস করবার উপায় নেই ইন্ডিয়াতে। হুগলির ফৌজদার নন্দকুমার একটা স্কাউড্রেল। উমিচাঁদটা একটা বিস্ট। অথচ তাদের কাছ থেকেই হেল্প নিতে হবে। তাদের ডিসরিগার্ড করা চলে না। খবরটা ঠিক সময়েই ফ্লেচার দিয়ে গিয়েছিল যে, নবাবের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে গেছে তিনজনে। মুনশি নবকৃষ্ণ তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়েসি।

ক্লাইভ তাকে জিজ্ঞেস করেছিল–নবাব তোমাদের হঠাৎ ছেড়ে দিলেই বা কেন? হোয়াই?

 নবকৃষ্ণ মুর্শিদাবাদ থেকে একেবারে সোজা সাহেবের কাছে এসে হাজির।

বললে–হুজুর, আসলে শয়তানি

শয়তানি মানে? নবাব তোমাদের সঙ্গে শয়তানি করেছে বলতে চাও?

হুজুর, উমিচাঁদসাহেব বললে–এরকম খেয়াল নবাব বাদশাদের হয় মাঝে মাঝে। কেউ কেউ মক্কায় চলে যাবার ভয় দেখায়। বাদশা আওরঙ্গজেব তাই করত। ও শুনে আপনি আশ্বস্ত হবেন না। ভেতরে ভেতরে নবাব আপনাদের হিন্দুস্থান থেকে তাড়াবার মতলব করেছে

সেকী? কে বললে–তোমাকে?

 আজ্ঞে, আমি নিজেই মুর্শিদাবাদ থেকে সব শুনে এলুম। সকলের সঙ্গেই যে দেখা করে এলুম। জগৎশেঠের সঙ্গে দেখা করলুম, দোহাজারি মনসবদার ইয়ার লুৎফ খাঁ’র সঙ্গে দেখা করলুম, আমি সবাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছি হুজুর আপনার জন্যে।

কিন্তু সেই চিঠিটা? যে-চিঠিটা মরিয়ম বেগম স্মাগল করে নিয়ে গিয়েছিল? সেটা আদায় করতে পারলে?

তা আপনিই বা কী রকম ল্যালাখ্যাপা লোক হুজুর। অত ভাল লোক হলে সংসারে চলে? আপনি একটু ঘুঘু হোন না যেমন কুকুর তেমনই মুগুর। ভাল মানুষের আর কাল নেই তা জানেন? এই যে আমি। আমাকে দেখছেন তো! আমি ভালমানুষ বলেই এতদিন বসে বসে ভুগছি–এত হেনস্থা আমার

তুমি যে বলেছিলে মরিয়ম বেগমের কাছ থেকে তুমি চিঠিটা আদায় করবে যেমন করে হোক?

সেই তো বলেছিলাম, আর সেই জন্যেই তো তোড়জোড় চলছে। উমিচাঁদসাহেব খুব খেপে গেছে হুজুর। খ্যাপবার তো কথাই। কোথাকার কোন মেয়েছেলে নবাবের বেগম হয়েছে বলে একেবারে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে, আমাদের কাউকে একেবারে মানুষ বলেই মনে করে না। মনে হয়েছে চিরকাল বুঝি ওর এমনিই যাবে!

ক্লাইভ বললে–কিন্তু মুনশি, শুনেছি ওই মরিয়ম বেগম নাকি হাতিয়াগড়ের রাজার সেকেন্ড ওয়াইফ? হাতিয়াগড়ের রাজা একবার এসেছিল আমার কাছে, তার কাছেই শুনেছি

মুনশি বললে–তা যখন ছিল তখন ছিল, এখন যে আজ্ঞে, নবাবের সঙ্গে শুচ্ছে—

শুচ্ছে মানে?

 শুচ্ছে মানে শুচ্ছে, স্লিপিং। সেম বেড!

সত্যি?

সেকী হুজুর? আপনি অবাক হয়ে যাচ্ছেন? এরকম কত মেয়েমানুষের সঙ্গে নবাব শোয়! নবাবের কি মেয়েমানুষের অভাব আছে ভেবেছেন? আমার পয়সা নেই তাই অত বিয়ে করতে পারি না। আমাদের হিন্দুদের মধ্যে হুজুর যারা কুলীন তারা দেড়শোদুশো মেয়েমানুষের সঙ্গে স্লিপ করে। সেসব আপনি বুঝবেন না। মরিয়ম বেগম নবাবের সঙ্গে শুয়ে শুয়ে খুব মজা পেয়েছে তো, গায়ে ভাল ভাল জড়োয়া গয়না পেয়েছে, বাঁদি-ঝি পেয়েছে, তাই সোয়ামিকে একেবারে ভুলে গিয়েছে। মেয়েজাতের যে মজাই ওই৷ যখন যেখেন, তখন সেখেনে৷ তাই তো বলি আজ্ঞে, তুই এত নেমকহারাম মাগি রে? একবার সোয়ামির কথা ভাবলিনে?

ছেলেমেয়ে আছে নাকি মুনশি?

নেই, তবে ছেলে থাকলেও অমনি করত। কত মেয়েমানুষ যে ছেলেমেয়ে ফেলে রেখে চেহেলসূতুনে গিয়ে রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই হুজুর। একদিকে যেমন দেখবেন বিধবা মেয়েরা সোয়ামির চিতার ওপর আগুনে পুড়ে মরছে, তেমনই আবার সোয়ামিকে ছেড়ে পরপুরুষের ঘর করছে, তাও দেখতে পাবেন! সেই জন্যেই তো হুজুর আমাদের হিন্দুশাস্ত্রে মেয়েমানুষকে নরকের দ্বার বলেছে। মনু বলেছেন, মেয়েদের দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে শেকল দিয়ে রাখবে। একটু ঢিলে দিয়েছ কি পুরুষের কাছে পালাবে।

ক্লাইভ শুনছিল। মুনশির কথাটা শুনে একটু ভাবল। তারপর বললে–কিন্তু দেশে আমারও তো ওয়াইফ আছে, সে তো আমাকে ছেড়ে কোথাও যায় না। আমি তো তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখিনি–আমি তো তাদের সেখানে রেখে দিয়ে এত দূরে পড়ে আছি–

মুনশি বললে–কী বলছেন আপনি হুজুর? আপনার সঙ্গে আমাদের তুলনা? আপনারা হলেন গিয়ে দেবতার জাত। হিন্দু শাস্ত্রে আপনাদের বলেছে শ্বেতদ্বীপের মানুষ। আমরা যে আপনাদের চেয়ে নিচু জাত হুজুর

কিন্তু

ক্লাইভ বললে–কিন্তু আমার এই বাগানবাড়িতে দু’জন হিন্দু লেডি আছে মুনশি, তারা তো খুব ভাল। একজন উইডো আর একজন ম্যারেড। তারা তো খুব ভাল লোক মুনশি! তারা ড্রিঙ্ক করে না, বিফ খায় না, ফাউল খায় না।

মুনশি বললে–তা তো হল, কিন্তু তার হাজব্যান্ডের কাছে যায় না কেন, সেইটে আগে বলুন

তার হাজব্যান্ডটা খুব বড় পোয়েট মুনশি! খুব ভাল পোয়েট্রি বানায় কিছুতেই তার কাছে যাবে এরা।

তবেই বুঝুন! কেন যায় না?

 ক্লাইভ বললে–সত্যি বলো না মুনশি, যায় না কেন?

 মুনশি বললে–যায় না কেন, বলব?

বলো!

মুনশি বললে–যায় না, শুধু লোকটা বাউন্ডুলে বলে! পোয়েট্রি দিয়ে তো পেট ভরবে না হুজুর। পেপায়েট্রি শুনতে ভাল, পোয়েট্রি সুর করে গাইতেও ভাল, কিন্তু পোয়েট্রি দিয়ে তো গয়না হয় না, পোয়েট্রি দিয়ে তো শাড়ি হয় না, ভাত হয় না। অমন জিনিস নিয়ে কী হবে হুজুর? সেই জন্যেই তো হুজুর আপনার পায়ের তলায় পড়ে আছি যে, প্রাণ ভরে আপনাকে সেবা করব।

ক্লাইভ বললে–আমি আর তোমার.কী করতে পারব মুনশি, আমার টাকা কোথায়?

মুনশি বললে–এখন টাকা নেই, কিন্তু পরে তো টাকা হবে, তখন যেন দাসানুদাসকে মনে রাখেন

ক্লাইভ বললে–পরে কী করে টাকা হবে? আমি তো কোম্পানির চাকরি করি, কোম্পানি আমাকে মাইনে দেয়

আপনার টাকা হবে হুজুর, আমি বলছি আপনার টাকা হবে। ভগবান আপনাকে দেবে। আমি তো আমার গডেস সিংহবাহিনীর কাছে তাই প্রে করি হুজুর যে, সাহেবকে আমার অনেক টাকা পাইয়ে দাও–আপনার টাকা হলেই আমার টাকা হবে!

কিন্তু টাকা আমার কী করে হবে, তাই বলো না?

মুনশি বললে–মুর্শিদাবাদের নবাবের কি কম টাকা আছে ভেবেছেন?

মুর্শিদাবাদের নবাবের টাকা আমি কী করে পাব? নবাব আমাকে দেবে কেন?

 মুনশি বললে–টাকা কি কেউ কাউকে দেয় হুজুর? আপনি চাইলেই পেয়ে যাবেন।

চাইলে পাব কেন?

ভয় পেয়ে আপনাকে নবাব দিয়ে দেবে।

নবাব আমাকে ভয় পাবে কেন?

ভয় না পেলে আমাদের তিনজনকে ছেড়ে দিলে কেন তাই বলুন? সবাই তো আমাকে বললে, নবাব ক্লাইভসাহেবকে ভয় পায় বলে আপনাদের ছেড়ে দিলে। ইয়ার লুৎফ খাঁ সাহেব তাই বললে, মিরজাফরসাহেব তাই বললে, জগৎশেঠজিও তাই-ই বললেন।

সবাই নবাবের এগেনস্টে?

হ্যাঁ সায়েব, সব্বাই। এতদিন অন্য লোকের মুখে শুনে এসেছেন, এবার আমার মুখে শুনলেন। আমি তো আর আপনাকে মিথ্যে কথা বলব না। মিথ্যে কথা বলা বড় পাপ হুজুর, যে মিথ্যে কথা বলে সে নরকে যায় হুজুর, সে রৌরব নরকে গিয়ে পচে মরে–

ক্লাইভ সাহেব মুনশির কথা শুনে খানিকক্ষণ ভাবতে লাগল। মুনশি তখনও বলছে–এই যে আপনি চন্দননগর দখল করলেন, আগে কত ভয় পেয়েছিলেন, আগে কত সন্দেহ করছিলেন, কিন্তু কিছু হল? নবাব কিছু করতে পারলে? পারবে কী করে? ওদিকে দিল্লি থেকে পাঠান আহমদ শা আবদালি বাংলাদেশের দিকে তো আসছে, তখন কত দিকে যুদ্ধ করবে? কে মদত দেবে? নবাবের দলে তো কেউ নেই।

কেন, ফরাসিরা? জেনারেল বুশি? মঁসিয়ে ল?

আজ্ঞে, ফরাসিরা আর আপনারা? আপনার বুদ্ধির কাছে ফরাসির বুদ্ধি? নবাব কি ভাবছেন জানে না আপনার বুদ্ধির কথা?

ক্লাইভ বললে–বুদ্ধির কথা বলছ বটে, কিন্তু মরিয়ম বেগমের তো আরও বুদ্ধি–আমার চেয়েও বুদ্ধি, নইলে আমাকে ঠকিয়ে যায়?

মুনশি বললে–তার কথাই তো হচ্ছে, এবার দেখুন না কী হয়, তাকে কী করি–

কী করবে? মার্ডার?

 মুনশি বললে–সে যখন হবে, তখনই শুনতে পাবেন–

এসব কথা আগেই হয়ে গিয়েছিল। সেই হুগলিতে ক্যাম্প করে থাকবার সময়। তারপর সেখান থেকে ওয়াটসের চিঠি এসেছে। ফ্রেঞ্চদের সঙ্গে ঝগড়া বাধবার কথাও জানিয়েছে। রাত্রে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে তখন ক্লাইভ আবার বিছানা থেকে উঠল। নবকৃষ্ণকে ডাকালে।

নবকৃষ্ণ সামনে আসতেই ক্লাইভ বললে–মুনশি, নবাবের খাজাঞ্চিখানায় কত টাকা আছে?

 মুনশি বললে–কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হুজুর।

তবু আন্দাজ কত?

তা আজ্ঞে এত টাকা যে, আপনি এক হাতে বইতে পারবেন না। আপনি আমি দুজনে মিলেও বইতে পারব না–পুরুষানুক্রমে জমে আসছে কিনা। আসলে সে টাকার হিসেব নেই। নবাব নিজেও জানে না কত টাকা আছে। বেগমরাও জানে না

ক্লাইভ বললে–যদি নবাবের সঙ্গে ঝগড়া বাধাতেই হয় তো ভাল করেই বাধুক। এই দেখো, নবাব কী চিঠি লিখেছে পড়ে দেখো

মুনশি পড়তে লাগল–“আমি কোম্পানির কাছে যে টাকা দিবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তাহার প্রায় সবটাই শোধ করিয়াছি। আমি সন্ধির শর্তও অক্ষরে অক্ষরে পালন করিতেছি। কিন্তু আপনাদের পক্ষে সেরূপ দেখি না। ইংরেজ সৈন্যর অত্যাচারে হুগলি হিজলি বর্ধমান ও নদিয়া ত্রস্ত হইয়াছে। এসমস্ত যে আপনাদের জ্ঞাতসারে হইতেছে, ইহা আমার বিশ্বাস হয় না। শুনিলাম ফরাসিরা আপনাদের সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য দক্ষিণাপথ হইতে ফৌজ পাঠাইয়াছে। তাহারা আমার রাজ্যে বিবাদ উপস্থিত করিবার ইচ্ছা করিলে আমাকে লিখিবামাত্র সিপাহি-সৈন্য পাঠাইয়া তাহাদিগকে নিরস্ত করিব।

ক্লাইভ জিজ্ঞেস করলে–চিঠি পড়ে তোমার কী মনে হয় মুনশি?

 মুনশি বললে–মনে হচ্ছে এর পেছনে মরিয়ম বেগমের হাত আছে হুজুর

 কেন?

 নবাবকে মরিয়ম বেগম বুদ্ধি দিয়েছে। বলেছে, একটু নরম সুরে চিঠি লিখলে কাজ হাসিল হবে। নইলে নবাব তো এরকম নরম সুরে চিঠি লেখবার লোক নয়! আপনি এ-চিঠির উত্তরে কড়া করে জবাব দিন হুজুর বেশ কড়া। আপনি নরম হবেন না

তা হলে কী লিখব বলে দাও

মুনশি কলম নিয়ে বসল। তারপর লিখলে আপনার পত্ৰ পাইয়াছি। কিন্তু কাশিমবাজারের ফরাসিগণকে উচ্ছেদ করিবার সম্মতি না দিলে ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের যে সদ্ভাব আছে তাহা প্রমাণ হইবে না। আপনি অবিলম্বে কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠি উঠাইয়া দিন।

চিঠিটা পড়ে ক্লাইভ নীচেয় নিজের নাম সই করে দিলে।

সই করার পর মুনশি চিঠিটা নিয়ে মুর্শিদাবাদের দরবারে পাঠানোর বন্দোবস্ত করতে গেল। যাবার আগে বললে–আপনি আর এক কাজ করুন হুজুর, কাশিমবাজারের ওয়াটসাহেবকে লিখে দিন যেন এখনই একবার ইয়ার লুৎফ খাঁ সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন–

ক্লাইভ বললে–তাতে তো সবাই জেনে যাবে মুনশি?

আজ্ঞে, জানবে কী করে? মেয়েমানুষের মতো বোরখা পরে অনেক রাত্রে দেখা করতে বলবেন। পালকিতে করে যেতে বলবেন, তা হলে কেউ আর সন্দেহ করবে না। ইয়ার লুৎফ খাঁ-কে যদি নবাব করে দেন হুজুর তো তিনি আপনাদের হয়ে সবকিছু করবেন

এরপর সেই চিঠিও লেখা হয়েছিল। মুনশি নবকৃষ্ণের যা কাজ তা সে করেছিল। এখন তোমার হাত-যশ আর আমার ভাগ্য। নিজের দেশের লোকেরা যা করেনি আমার, তা-ই তুমি করে দেবে। এতদিন তোমাকে ডেকেছি মা, তুমি শোনোনি। এবার হিরের কানবালা গড়িয়ে দেব মা তোমার কানে, জড়োয়া গয়না দিয়ে মুড়ে দেব তোমার সর্বাঙ্গ, তুমি সদয় থাকলে এই মুনশি নবকৃষ্ণ তোমার জন্যে সবকিছু করবে। আমার ওপর একটু দৃষ্টি দিয়ো মা  

তা তার পরদিনই বাগানে এসে পৌঁছেছিল ক্লাইভ সাহেব। কতদিন পরে আবার আসা।

দুর্গা বললে–তোমার সঙ্গে যে একটু কথা বলব ধীরে-সুস্থে বাবা, তারও উপায় নেই–ও কারা এল তোমার সঙ্গে দেখা করতে

ওদের তুমি চিনবে না দিদি। ওরা নিজের নিজের মতলব হাসিল করতে আসে আমার কাছে।

যাকে-তাকে তুমি আমল দাও কেন বাবা? তোমারও কাজকর্মের ক্ষেতি, ওদেরও ক্ষেতি–

ক্লাইভ বললে–তা বললে–কি চলে দিদি! আমরা এখেনে পরের দেশে এসেছি, সকলের সঙ্গে আমাদের ভাব রাখতে হয়, নইলে কোনদিন তাড়িয়ে দেবে যে

দুর্গা বুঝতে পারত না এসব কথা। বলত–তা যাকেই আসতে দাও বাপু, সেই পাগলটাকে যেন আসতে দিয়ো না–আমার বউকে নিয়ে হয়েছে এক জ্বালা। এ সোয়ামির কাছেও যাবে না, নিজের বাড়িতেও যেতে পারবে না তোমাদের যুদ্ধ কি আর থামবে না বাপু? আমরা কাজকম্ম আর করতে পারব না?

ক্লাইভ বললে–এই তো সবে এলুম দিদি ফরাসডাঙা থেকে। এইবার যেখানে বলবে সেখানেই পাঠিয়ে দেব।

দূর্গা বললে–তা নবাব শায়েস্তা হল? না, এখনও তেমনই পরের মেয়েমানুষের দিকে নজর দিয়ে দিয়ে বেড়াচ্ছে?

ক্লাইভ বললে–এখন নবাব মরিয়ম বেগমের কথায় উঠছে বসছে দিদি

সে কে? সে কোন বেগম?

হাতিয়াগড়ের রাজার সেকেন্ড ওয়াইফ–দ্বিতীয়পক্ষের বউ। তার নাম এখন হয়েছে মরিয়ম

 দুর্গার পা থেকে মাথা পর্যন্ত শিউরে উঠল। সেই মরালী নাকি? সেই মরালীই মরিয়ম বেগম হয়েছে? তার এত ক্ষমতা হয়েছে। তার এত প্রতিপত্তি হয়েছে?

ক্লাইভ সাহেব বললে–আমি তা হলে আসি দিদি, ওরা বসে আছে অনেকক্ষণ

 সাহেব চলে যেতেই দুর্গা ভেতরে গিয়ে ডাকলে ও বউরানি, মুখপুড়ির কাণ্ড শুনেছ? মুখপুড়ি ভাতারকে ছেড়ে চেহেল্‌-সুতুনে গিয়ে নবাবকে হাত করে ফেলেছে গো!

সব শুনে ছোট বউরানিও অবাক।

 দুর্গা বললে–আমি এতদিন তাই ভাবছি, সে মুখপুড়ি সেখানে গিয়ে কী করছে! আমি তার জন্যে ভেবে ভেবে মরছি। ভাবছি, শোভারামের মা-মরা মেয়েটাকে আমরা জলে ফেলে দিলাম গো। আর সে মেয়ে কিনা সেখানে পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে আরাম করে নবাবের সেবা করছে?

ছোট বউরানি বললে–তা এক কাজ করলে হয় না দুগ্যা? একবার খবর পাঠালে হয় না মরালীকে যে, আমরা এখানে কষ্ট করে পড়ে আছি, আমাদের যাতে নবাব আর কিছু না করে?

কী করে খবর পাঠাই বউরানি? সায়েবকে বললে–সায়েব যদি কোনওরকমে খবরটা পাঠাতে পারে।

আর নয় তো খুলে বললে–হয় সায়েবকে সমস্ত। বললে–হয় যে, আমরা আসলে কে! খুলে বললেই হয় যে, আমি হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইয়ের বউ?

দুর্গা ভাবতে লাগল। বললে–দাঁড়াও বাপু, অত তাড়াহুড়ো কোরো না, শেষকালে কী করতে কী হয়ে যাবে, অনখ কাণ্ড বাধবে তখন। তখন তোমাকে আমি আর সামলাতে পারব না। আমাকে একটু ভাবতে দাও

ছোট বউরানি রেগে গেল। বললে–ভাবতে ভাবতেই যে তোর বছর কাবার হয়ে গেল দুগ্যা, আর কত ভাববি? এদিকে আমি তো আর থাকতে পারছিনে–

দুর্গা বললে–না বউরানি, আর একটু ধৈর্য ধরে থাকো বাপু, শেষকালে কোনদিন জানাজানি হয়ে গেলে নাকালের একশেষ হয়ে যাবে

হঠাৎ ওদিক থেকে হরিচরণ আসতেই কথা বন্ধ হয়ে গেল দুর্গার।

*

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বললেন–এই বাংলাদেশের কপালে অনেক দুঃখভোগ গেছে সাহেব। দিল্লির কথা ছেড়ে দিন, দক্ষিণাপথের কথাও ছেড়ে দিন। সে অনেক দূরের দেশ। তবু যেটুকু কানে আসে তাতে বুঝতে পারি, দিল্লির বাদশার ক্ষমতা সব দক্ষিণাপথে চলে গেছে। হিন্দুস্থানের ক্ষমতার কেন্দ্র এখন দক্ষিণাপথ। বাদশা আওরঙ্গজেব তা বুঝেছিলেন বলেই শেষজীবনে আবার নিজের ক্ষমতা ফিরে পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যা হবার নয়, তা কেমন করে হবে? এখন আবার হিন্দু রাজত্ব ফিরে আসছে। বাজিরাও, সিন্ধিয়া, হোলকার, গাইকোয়াড়, তাদের ওপরেই আমাদের এতদিন ভরসা ছিল। এখন এসেছে বালাজি রাও

ক্লাইভ সব শুনছিল মন দিয়ে। জীবনে এই প্রথম দেখলে এই কিংটাকে। সঙ্গের লোকটা চুপ করে বসে ছিল।

বললে–দেখুন মহারাজ, আমরা এসেছি ব্যাবসা করতে।

তা তো জানি সায়েব। আপনারা তো আর থাকতে আসেননি এখানে

আর আমরা তো চলেই যাচ্ছিলাম ইন্ডিয়া ছেড়ে। তিন হাজার টাকা ইয়ার্লি পেশকস দিয়ে আমরা ব্যাবসা করবার সনদ পাই এখানে, কিন্তু কোম্পানির কিছুই প্রফিট থাকে না তাতে–সেসব পুরনো। ইতিহাস। আজকে যখন লাভ হতে শুরু করেছে তখন নবাব আমাদের চলে যেতে বলছে

কৃষ্ণচন্দ্র বললেন–আপনারা যাবেন না, মোগল বাদশার দিন শেষ হয়ে গেছে, মারাঠারাও নিজেদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়েছে। আসলে পাপের রাজ্য থাকে না সাহেব। পাপ করলে তার প্রতিফল পেতেই হয়। আমরা হিন্দুরা জন্ম থেকেই তা বিশ্বাস করি। নইলে বাদশা আওরঙ্গজেব মরবার সময় কী বলেছিলেন জানেন তো?

না। কী বলেছিলেন?

মহারাজ বললেন–অত বড় বাদশা, মরবার সময় তার হয়তো হুশ হয়েছিল। বলে গেছেন–আমি সংসারে আসবার সময় কিছুই সঙ্গে করে আনিনি, কিন্তু যাবার সময় পাপের বোঝা সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। ভগবানের দয়ার ওপর বিশ্বাস আমার রয়েছে, কিন্তু আমি যা পাপ করেছি তার কথা ভেবে। মন আমার অস্থির। এখন যা হয় হোক, আমি অকূল সমুদ্রে জীবনতরী ভাসিয়ে দিলাম

ক্লাইভ বললে–দেখছি, আপনাদের ইন্ডিয়াতে মহারাজা থেকে আরম্ভ করে পথের ভিখিরি পর্যন্ত সব্বাই ফিলজফার মহারাজা

এ আমাদের বোধহয় মাটির গুণ সায়েব।

ক্লাইভ বললে–ফিলজফারদের রাজনীতি করতে না-আসাই ভাল মহারাজ। ফিলজফারদের বিয়ে করাই উচিত নয়

মহারাজ বললেন–তা তো বটেই! সেই জন্যেই তো আমি আমার রাজসভায় সবরকম লোক পুষেছি। কেউ আমার পাঁজি লেখে, কেউ কুস্তি শেখায়, কেউ কাব্য লেখে, কেউ যুদ্ধ করে, কেউ আবার শুধু ভাড়ামি করে

সাহেব বললে–আমার এই বাগানের কুঠিতে একটা হিন্দু বউ আছে মহারাজা, তার হাজব্যান্ডটা ফিলজফার। সে বলে সমস্ত পৃথিবীটাই নাকি তার দেশ–সে পোয়েট, সে গান লেখে–

মহারাজ বললেন কিন্তু তাকে আপনি কেন রেখেছেন এখানে?

 সাহেব বললে–কী করব? সে যে হাজব্যান্ডের কাছে যাবে না।

 তা হলে কে আছে তার বাপের বাড়িতে? সেখানে পাঠিয়ে দিন।

সাহেব বললে–কী করে পাঠাব? আপনি তো জানেন নবাবকে। পাঠাতে গিয়ে যদি নবাবের স্পাইদের নজরে পড়ে যায়। মরিয়ম বেগমকে তো ওইভাবেই নবাব নিজের হারেমে নিয়ে গিয়ে তুলেছে।

এই তো, মরিয়ম বেগম তো এঁরই স্ত্রী সায়েব। এঁর কথা বলতেই তো আপনার কাছে এসেছি।

ক্লাইভ বললে–আমি জানি। জানেন, আপনার ওয়াইফ খুব ক্লেভার লেডি!

ছোটমশাই বললে–চালাক? কিন্তু তেমন চালাক তো নয়।

না না, ভেরি ক্লেভার।

কিন্তু আমার কাছে যতদিন ছিল ততদিন স্বভাব ভাল ছিল। খুব মিষ্টি স্বভাবের স্ত্রী। একটুতেই কেঁদে ফেলত, একটুতেই অভিমান করত। অনেক ভাগ্য করলে তবে অমন স্ত্রী হয় মানুষের, সাহেব। আপনি আমার স্ত্রীকে যেমন করে তোক উদ্ধার করে দিন

ক্লাইভ বললে–কিন্তু জানেন, আপনার স্ত্রী আমার এখান থেকে ইম্পর্ট্যান্ট লেটার চুরি করে নিয়ে গেছে! আপনার স্ত্রী আমাকে ব্ল্যাকমেল করেছে? মিলিটারি সিক্রেট চুরি করলে তার কী শাস্তি হয়, তা আপনি নিশ্চয় জানেন?

ছোটমশাই বললে–আপনি ভুল করছেন সাহেব, আমার স্ত্রী তেমন কাজ করতেই পারে না। আমার স্ত্রী সতী

আপনার স্ত্রী নবাবের সঙ্গে চেহেলসূতুনে রাত কাটায়, তবু বলছেন আপনার স্ত্রী সতী?

আমার স্ত্রীকে আমি চিনি না সাহেব! আপনি চেনেন? আমার স্ত্রী প্রাণ দেবে, তবু নবাবের সঙ্গে চেহেল্‌-সুতুনে রাত কাটাবে না।

ক্লাইভ বললে–আমি ইন্ডিয়ান নই, আমি ইংলিশম্যান, আমি আপনাদের হিন্দু ম্যারেড লাইফ সম্বন্ধে কিছু জানি না। তবে আমার ধারণা ছিল হিন্দু ওয়াইফরা খুব ভাল। আমার এখানে যে লেডি আছে তাকে তো দেখছি, শি ইজ ভেরি গুড। ড্রিঙ্ক করে না, বিফ খায় না, ফাউল খায় না

ছোটমশাই বললে–আমার স্ত্রীও ওসব কিছুই খায় না–

ক্লাইভ বললে–কিন্তু উমিচাঁদসাহেব আমাকে বলেছে আপনার স্ত্রী ওসব খায়, আরক খায়, নেশা। করে

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বললেন–যাক গে, ওসব নিয়ে তর্ক করে লাভ কী! নবাবের হারেমে ঢুকলে ওসব খেতেই হবে-না খেয়ে থাকতে পারবে না–

ছোটমশাই বললে–যদি খায়ও তাতেও আমার কোনও আপত্তি নেই, এখনও যদি আমার স্ত্রীকে আমি পাই, আমি তাকে ঘরে তুলে নেব।

 কিন্তু সে তো মুসলমান হয়ে গেছে, তাকে আপনি নেবেন কী করে? আপনার জাত যাবে না?

ছোটমশাই মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দিকে চাইলে। বললে–তা হলে কী হবে মহারাজ? আপনি বিধান দিন আমাকে। বলুন আমি কী করব?

মহারাজ সে কথার উত্তর না দিয়ে ক্লাইভের দিয়ে চেয়ে বললেন–আপনি বোধহয় এবার কিছু বিধান দিতে পারবেন সাহেব

ক্লাইভের হাসি এল। বললে–আপনাদের দেশ বেঙ্গল, আপনি নিজে একজন মহারাজা, আপনি বিধান চাইছেন আমার কাছে? আমরা তো ব্যাবসা করতে এসেছি এখানে।

মহারাজ বললেন–দেশ আমাদের, কিন্তু দেশের মানুষ তো সে কথা ভাবে না। আপনারা কোম্পানির স্বার্থ দেখছেন এখানে এসে, আর আমরা দেখছি নিজের স্বার্থ দেশটা যে কাদের সেটাই এখনও ঠিক হয়নি যে!

কিন্তু এ-দেশ তো আপনাদের ব্যর্থপ্লেস! আমরা তো ফরেনার

মহারাজ বললেন–আসলে আমরাও যা আপনারাও তাই। এ আমারও নিজের দেশ নয়, নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলারও নিজের দেশ নয়, এমনকী দিল্লির বাদশারও নিজের দেশ নয়, বাদশা। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে আমরা সবাই একাকার হয়ে গেছি আমরা, আপনারা, ফরাসিরা, পাঠানরা, মোগলরা, হিন্দুরা, সবাই

ক্লাইভ সব শুনে কিছুক্ষণ ভাবলে। তারপর বললে–আমি কোম্পানির চাকর, কোম্পানির মত না নিয়ে আমি কিছু করতে পারি না, কোম্পানিকে আমি চিঠি লিখব। তখন আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন?

ছোটমশাই বললে–আমি আপনাকে সাহায্য করব, আমার যা কিছু আছে সব দিয়ে কোম্পানিকে সাহায্য করব।

ক্লাইভ মহারাজকে জিজ্ঞেস করলে–আজ যদি নবাবকে আমরা ফাইট করে হারিয়ে দিই, তখন কাকে মসনদে বসাব আপনি বলতে পারেন?

ছোটমশাই বললে–নবাব হবার লোকের অভাব হবে না সাহেব।

কিন্তু যাকে-তাকে তো নবাবি করতে দেওয়া যায় না। আপনি হবেন?

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র চমকে উঠলেন–আমি?

 হ্যাঁ, আপনি!

কিন্তু আমি যে হিন্দু!

হিন্দু হলে কী হয়েছে? মারাঠারাও তো হিন্দু

ভেতরের ঘরে ছটফট করছিল দুর্গা। মরালীটার যদি নবাব-দরবারে এত ক্ষমতা তো তাকে একবার খরবটা দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। খবরটা কাকে দিয়েই বা তাকে দেওয়া যায়!হরিচরণকে ডাকলে দুর্গা। বললোগা, বলি তোমার সায়েব কাদের সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলছে? কে ওরা? হিন্দু, না মোছলমান?

হরিচরণ বললে–তা জানিনে দিদি

তা ওদের কাজকম্ম নেই, কেবল কথা বলে বলে তোমার সাহেবের সময় নষ্ট করছে? তুমি ওদের চলে যেতে বলো না–তখন থেকে বসে বসে কী সব ভাজোর ভ্যাজোর করছে এত?

হরিচরণ বললে–সায়েবের কাজের সময় কাছে গেলে রাগ করবে সায়েব, আমি ওখানে যেতে পারব না দিদি

তা হলে আমি যাই? আমি গেলে তো আর রাগ করবে না!

আপনি গেলে সায়েব আপনাকে বকবে না, কিন্তু পরে আমাকে বকবে। বলবে, তুই দেখছিলি আমি ওদের সঙ্গে কথা বলছি, তা হলে কেন দিদিকে আসতে দিলি?

দুর্গা বললে–তা তোমার সায়েব কি ভেবেছে সায়েবের যেমন কাজকম্ম কিছু নেই, তেমনই আমাদেরও কিছু নেই? আমাদের এখানে পড়ে থাকলে চলবে?

হরিচরণ বললে–তা সায়েব তো বলেছে দিদি, এবার লড়াই থেমে গেছে, এবার তোমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে!

না বাপু, সায়েব বকুক আর যা-ই করুক, এই আমি যাচ্ছি

 হরিচরণ ব্যস্ত হয়ে বললে–অত চেঁচিয়ে কথা বোলো না দিদি, সায়েব…

 দুত্তোরি তোমার সায়েবের নিকুচি করেছে।

দোহাই তোমার দিদি, তুমি সায়েবকে চেনো না। হেসে কথা বলে বলে সায়েবের রাগ নেই ভেবো না! সাহেবের রাগ তো দেখোনি তোমরা, রাগলে সায়েব একেবার লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দেয় ।

তা আমরা কি তোমাদের মতো সায়েবের চাকর যে, কথা বলতে ভয় পাব? রাগ অমনি করলেই হল?

বলে আর দাঁড়াল না সেখানে। পেছন থেকে ছোট বউরানি বললে–ওখানে বেটাছেলেরা কথা বলছে, তুই ওখানে কেন যাচ্ছিস দুগ্যা? শেষকালে তোকে কেউ দেখে ফেলে যদি?

তা দেখুক না, কী দেখবে আমার? কী দেখবে?

শেষকালে অনত্থ বাধতে পারে তো! ভাল করে মাথায় ঘোমটাটা টেনে দিয়ে যানা–

হরিচরণ বাধা দিলে আর একবার। বললে–তোমার পায়ে পড়ি দিদি, যেয়ো না, পইপই করে কথা বললেও তুমি শুনবে না? আর নয়তো, আমি সায়েবকে ডেকে নিয়ে আসি, তোমার কী বলবার আছে এখানে মুখোমুখি বলো।

তা ও মুখপোড়ারা কি সারাদিন এখেনে বসে আড্ডা দিতে এসেছে?

বলতে বলতে দুর্গা হনহন করে উঠোন পেরিয়ে ক্লাইভের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।

*

মধুসূদন কর্মকারের দোকানে তখন উদ্ধব দাস বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। অনেক দিন দেখা যায়নি উদ্ধব দাসকে।

মধুসূদন বললে–কী গো দাসমশাই, বলি কোথায় ছিলে অ্যাদ্দিন? কেষ্টনগরে গিয়ে বুঝি খুব মুগের ডাল খাচ্ছিলে? এদিকে তোমাকে নবাবের লোক খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে যে

আমি কারও চাকর নই গো!

 মধুসূদন বললে–যখন পরোয়ানা দিয়ে ধরে নিয়ে যাবে, তখন বুঝবে মজাটা—

উদ্ধব দাস হাসতে লাগল। বললে–পরোয়ানা তো একদিন সকলেরই আসবে কর্মকারমশাই, সে-পরোয়ানা যখন আসবে তখন যেতেই হবে। তার আগে কাব্যটা শেষ করতে হবে যে। এখন নবাবের পরোয়ানা নেবার সময় নেই আমার। দাও, বড় গরম পড়েছে, গুড়-জল দাও একটু, খেয়ে তোমার এখেনে একটু গড়াই

নিজেই গাড়ু থেকে জল ঢেলে নিয়ে মুখ-হাত-পা ধুয়ে নিলে। তারপর পোঁটলাটা খুলে গামছা বার করলে। বললে–একটু ধীরেসুস্থে যে পুঁথি লিখব তারও উপায় নেই। যেদিকেই যাই কেবল কামান বন্দুক নিয়ে সেপাই সান্ত্রিরা চলেছেএত লড়াই করে কী লাভ হয় বলো তো কর্মকারমশাই?

মধুসূদন বললে–সবাই তো তোমার মতো বাউন্ডুলে হতে পারে না! তোমার নিজের মাগ ছেলে নেই বলে কি আর কারও থাকতে নেই?

তা আমি কি বউকে ছেড়ে এসেছি কর্মকারমশাই, বউই তো আমায় ছেড়ে গেল! বউ থাকলেও আমি অত ঝামেলার মধ্যে যেতাম না, খেতাম দেতাম আর পুঁথি লিখতাম

তারপর পোঁটলার ভেতর থেকে পুঁথির কয়েকটা পাতা বার করে বললে–পুঁথিটা একটু শুনবে কর্মকারমশাই, প্রথমে আদিপর্ব, একেবারে বন্দনা দিয়ে আরম্ভ করেছি

মধুসূদন বললে–কী রকম শুনি?

 উদ্ধব দাস পড়তে লাগল–

প্রথমে বন্দনা করি দেব গণপতি।
তারপর বন্দিলাম মাতা বসুমতী ॥
পুবেতে বন্দনা করি পুবের দিবাকর।
পশ্চিমেতে বন্দিলাম পাঁচ পয়গম্বর ॥
উত্তরেতে হিমালয় বন্দনা করিয়া।
দক্ষিণেতে বন্দিলাম সিন্ধু দরিয়া…

মধুসূদন বললে–বাঃ বাঃ, বেশ হচ্ছে দাসমশাই

উদ্ধব দাস উৎসাহ পেয়ে গেল। বললে–বেশ হচ্ছে না? রায়গুণাকরের চেয়ে ভাল হচ্ছে না?

 কিন্তু বেশিক্ষণ পড়া হল না। ওদিক থেকে হঠাৎ কান্ত এসে হাজির। উদ্ধব দাসকে দেখেই বললে–দাসমশাই, আপনি এখেনে? আমি যে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি–

উদ্ধব দাস বললে–আমাকে? আমাকে কেন হে বট?

আজ্ঞে, আপনাকে খুঁজতে কেষ্টনগরে গিয়েছিলাম। কলকাতায় গিয়েছিলাম। আগে এই কর্মকারমশাইয়ের দোকানেও এসেছিলাম একবার

কেন, আমি কি মহা তালেবর লোক হয়ে গিয়েছি নাকি?

কান্ত বললে–আপনাকে একবার মুর্শিদাবাদে যেতে হবে, মতিঝিলে গিয়ে নবাবকে গান শোনাতে হবে!

উদ্ধব দাস রেগে গেল। বললে–কেন? আমি যাব কেন? নবাব আসতে পারে না? আমার গান যদি নবাবের শুনতে এতই ইচ্ছে তো নবাব এখানে আসতে পারে না কেন? আমি কি তোমাদের নবাবের চাকর হে?

আপনি রাগ করছেন কেন?

কেন, রাগ করব না কেন? নবাব রামপ্রসাদের গান শুনতে পরের বজরায় যেতে পারে আর আমার কাছে আসতে পারে না? আমি কি ফেলনা?

কিছুতেই যেতে চায় না উদ্ধব দাস। মধুসূদন বললে–আহা, নবাব আদর করে ডেকে পাঠিয়েছে, যাও না–

একটু যেন মনটা ভিজল উদ্ধব দাসের। বললে–আমাকে আদর করে ডেকেছে? তা হলে চলল। কিন্তু যদি হুকুম করে ডাকে তা হলে যাব না। আমি হরি ছাড়া আর কারও হুকুম মানিনে, তা জানো? তুমি ঠিক বলছ আমাকে আদর করে ডেকেছে?

কান্ত বললে–আচ্ছা দাসমশাই, তোমার বউয়ের কথা তোমার মনে পড়ে?

উদ্ধব দাস চলতে চলতে অবাক হয়ে গেল কথাটা শুনে। বললে–বউকে নিয়ে একটা কাব্য লিখছি, তা জানো না?

কান্ত বললে–ওসব কথা থাক, তুমিও তো মানুষ, তোমারও তো রক্ত-মাংস আছে, রক্ত-মাংসের খিদে আছে, তুমি তো আর পাথর নও। বউয়ের জন্যে তোমার মনকেমন করে না বলতে চাও?

উদ্ধব দাস সজাগ হয়ে উঠল। বললে–তুমি যে এত কথা বলছ, তুমি বিয়ে করেছ?

কান্ত বললে–আমার বিয়ে হয়ে গেছে দাসমশাই

বিয়ে হয়ে গেছে? তা বউ কোথায়?

কান্ত বললে–আমার কথা থাক, তোমার কথা বলো। তোমার নিজের বউ কোথায় আছে, তা জানো তুমি?

উদ্ধব দাস বললে–আমার বউ তো ক্লাইভসাহেবের বাগানবাড়িতে

তোমার বউ সেখানে পড়ে থাকে কেন? তুমি জোর করে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে পারো না?

 উদ্ধব দাস হাসল। বললে–তুমি বিয়ে করেছ আর এই কথাটা জানো না? হরি আর বউ দুজনেই একরকম। ডাকলে কেউই আসে না। কত লোক তো মন্দিরে গিয়ে গলা ফাটিয়ে হরিনাম করছে, কত লোক মসজিদে গিয়ে নমাজ পড়ছে, তাতে হরি আসছে? বলো না গো, চুপ করে রইলে কেন? হরি আসছে তাদের কাছে?

কান্ত বললে–তা হলে কী করলে হরি আসে?

উদ্ধব দাস বললে–হরিকে ডাকলে হরি আসে না। হরির নাম করে জীবন ভাসিয়ে দিতে হয়—

কী রকম?

 উদ্ধব দাস বললে–তবে শোনো ভায়া একটা ছড়া বলি

বলে ছড়া আরম্ভ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু কান্ত বাধা দিয়ে বললে–ছড়া বলতে হবে না, তোমার গান আর ছড়া এখন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে গেছে। সবাই গায় তোমার গান। নবাবের কানেও গেছে। তাই তো নবাব তোমার গান শুনবে বলে ডেকে পাঠিয়েছে।

তা তুমি বুঝি নবাবের চাকরি করো?

কান্ত বললে–দেখো, নবাবকে যদি খুশি করতে পারো তো তুমি খেলাত পাবে, জায়গির পাবে, টাকা পাবে

উদ্ধব দাস বললে–সে-লোভ দেখাও গে তুমি রায়গুণাকরকে, নবাবের নামে পুঁথি লিখে দেবে! আমি পুঁথি লিখব আমার বউকে নিয়ে। আমার বউকে তুমি চেনো না। হাতিয়াগড়ের রাজাবাবু ছোটমশাইয়ের নফর শোভারাম বিশ্বাসের মেয়ে, খুব উঁদরেল মেয়ে। আমাকে পছন্দ হয়নি বলে রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে।  

তা যেবউ পালিয়ে গেছে, তাকে নিয়ে কী লিখবে?

উদ্ধব দাস বললে–সে বউ তো তোমাদের মতো বউ নয় গো। খুব উঁদরেল বউ। তোমাদের বউ কেবল রাঁধে বাড়ে আর ছেলে জন্ম দেয়। আর তো কিছু করে না। আর আমার বউ ঠিক আমার মতো বাউন্ডুলে। একবার এখানে যায়, একবার সেখানে। এখন গিয়ে ক্লাইভসাহেবের বাগানে উঠেছে। কিন্তু সেখানেও কি থাকবে ভেবেছ? সেখানেও থাকবার মেয়ে নয় সে। সেখান থেকেও পালাবে। এই আমি যেমন এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াই, সে-ও তেমনই।

দু’জনে রাস্তা দিয়ে চলছিল। মোল্লাহাটি থেকে বেরিয়েছে সেই কোন সকালে, তারপর আকাশের সূর্যটা একেবারে মাথার ওপর গিয়ে উঠেছে। খেয়াঘাটের কাছে আসতেই কান্ত বসল গাছতলায়। নৌকোটা তখন ওপারে। মাথার ওপর দিয়ে এতক্ষণ চড়া রোদ গিয়েছে। সামনের দিকে চেয়ে চেয়ে কেমন মাথাটা ঘুরে গেল কান্তর। কান্তর নিজের জীবনটাই যেন ঠিক এইরকম কেবল ঘোরাঘুরি করে কেটে গেল। কিন্তু এই উদ্ধব দাসও তো ঘুরে বেড়াচ্ছে সারাজীবন। এর তো ক্লান্তি লাগে না। পাশের দিকে চাইতেই দেখলে, উদ্ধব দাস সেই মাটির উপরেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। হাতের পোঁটলাটা মাথায় দিয়েছে, আর নাক দিয়ে বড় বড় নিশ্বাস পড়ছে। ওপারের দিকে চেয়ে দেখলে কান্ত। নৌকোটা ওদিক থেকে ছেড়েছে।

হঠাৎ উত্তর দিকে যেন কীসের শব্দ শোনা গেল। কান্ত মাথাটা ফিরিয়ে দেখলে, অনেক দূরে যেন ধুলোর পাহাড় এগিয়ে আসছে সামনের দিকে। কালবোশেখি শুরু হল নাকি? এই তো কালবোশেখির সময়! তাড়াতাড়ি উদ্ধব দাসকে ডাকতে লাগল–দাসমশাই ওঠো, ওঠো, ঝড় আসছে, ওঠো

কিন্তু উদ্ধব দাসের ঘুম বড় কড়া।

কান্ত আবার চেয়ে দেখলে। না, ঝড়বৃষ্টি নয়, কিছু নয়। নবাবের ফৌজ আসছে। নবাবের ফৌজ তো লক্কাবাগে গিয়েছিল। হঠাৎ ফিরে আসছে কেন? হেরে গেল নাকি লড়াইতে!

ততক্ষণে ফৌজের দল কাছে এসে পড়েছে। সামনে হাতির দল। তারপর ঘোড়া। তারপর সেপাইরা কামান টানতে টানতে আসছে। বিরাট সব লম্বা মাপের কামান। কান্ত আড়াল থেকে দেখতে লাগল। এরা সবাই চেনে কান্তকে। এদের অনেকের সঙ্গে কান্ত হালসিবাগানে অনেক দিন একসঙ্গে কাটিয়েছে। ফৌজের দল দেখে আশেপাশের গ্রাম থেকে ছেলে-মেয়ে বুড়োবুড়ির দল খেয়াঘাটে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের ভিড়ের মধ্যে কান্তকে অতটা কেউ লক্ষ করে দেখলে না। ফৌজের দল যখন সবই চলে গেছে, প্রায় শেষ হব হব, তখন হঠাৎ শশী দেখতে পেয়েছে তাকে।

কী রে, তুই? তুই আবার কবে ঢুকলি ফৌজে?

শশীর মালকোঁচা বাঁধা কাপড়। সে-ও বললে–তুই এখানে কী করছিস?

কান্ত বললে–আমি কাজে এসেছিলুম, কিন্তু তোরা ফিরে আসছিস কেন? লড়াইতে হেরে গেলি?

না, লড়াই হল না। নিজামত থেকে হুকুম এসেছে ফিরে যেতে

তা হলে লড়াই হবে না আর?

শশী একটু মুচকে হাসলে। কান্তকে কাছে ডাকলে। বললে–আয়, আমার কাছে আয় বলছি

 তারপর কান্তর কানের কাছে মুখ এনে বললে–লড়াই হবে রে, খুব জবর লড়াই হবে ভেতরে ভেতরে সব ষড়যন্ত্র চলছে

কান্ত কী রকম অবাক হয়ে গেল। এই তো মুর্শিদাবাদে দেখে এল, নবাব বেশ চুপচাপ আছে। বেশ আরাম করে মতিঝিলে ঘুমোচ্ছে, এর মধ্যে হঠাৎ আবার কী হল?

জিজ্ঞেস করলে–তা হলে তোর চাকরি থাকবে?

 থাকবে ভাই থাকবে। এবার আর ভয় নেই।

 কিন্তু কী করে বুঝলি আবার লড়াই হবে? কে বললে–তোকে?

শশী বললে–আমি খবর পেয়েছি। সবাই ক্লাইভসাহেবের কাছে গিয়েছিল।

কে কে গিয়েছিল?

সবাই। আমি লক্কাবাগ থেকে ছুটি নিয়ে একদিন কালীঘাটের মন্দিরে গিয়েছিলাম। আমি গিয়ে মাকে ডালা দিলুম। বললুম–মা, যেন যুদ্ধ হয় মা, আমার চাকরি যেন যায় না মা।

কান্ত বললে–কিন্তু কে কে ক্লাইভ সাহেবের কাছে গিয়েছিল, তাই বল না?

কে কে আবার, সবাই। ইয়ার লুৎফ খাঁ, আমাদের মনসবদার সাহেব থেকে আরম্ভ করে, সব্বাই।

কিন্তু কেন গিয়েছিল?

শশী বললে–সকলেরই তো রাগ আছে বেগমসাহেবার ওপর।

কোন বেগমসাহেবা রে? নানিবেগমসাহেবা?

শশী বললে–আরে না। ওই যে হিন্দু বেগমসাহেবাটা। মরিয়ম বেগমসাহেবা। যে আমাদের হালসিবাগানে এসেছিল। তার ওপরই তো রাগ সকলের। ক্লাইভসাহেবেরও তো খুব রাগ। তুই জানিস না, ওই বেগমই তো ক্লাইভসাহেবের দফতরে ঢুকে উমিচাঁদের চিঠি চুরি করে নিয়েছিল। ওই বেগমসাহেবাই তো এখন সমস্ত মতলব দিচ্ছে নবাবকে। নবাবকে একেবারে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলেছে

শশী আবার বললে–তুই কিছু শুনিসনি? সবাই যে জানে–

কথা বলতে বলতে কান্ত ফৌজের সঙ্গে অনেক দূর চলে এসেছিল। কিন্তু এবার ফিরল কান্ত। শশী যেন খুব খুশি হয়েছে মনে হল। যুদ্ধ হবার খবর শুনে এত আনন্দ! আশ্চর্য, মরালীর ওপর সকলের এত রাগ! অথচ মরালী তো সকলের ভালই চায়। মরালী তো চায় নবাব ভাল হোক, নবাব সকলের ভাল করুক। মরালীর কথা শুনেই তো নবাব বদলে গেছে। নবাব এখন রোজ কোরান পড়ে। নবাবকে রোজ মরালী মহাভারত পড়িয়ে শোনায়। কাকে বলে ভাল রাজা, কাছে বলে ভাল নবাব, কেমন করে প্রজা-পালন করতে হয়, সব তো নবাব মন দিয়ে শোনে। মরালীর কথাতেই তো উমিচাঁদ, নন্দকুমার, নবকৃষ্ণকে ছেড়ে দিলে নবাব। তবু সকলের এত রাগ! তা হলে কি সেই আগেকার মতো ব্যবহার করলেই ভাল হত!

কান্তর বুকটা দুরদূর করে কাঁপতে লাগল। যদি সত্যিই মরালীর কিছু হয়! কিছু বিপদ! তখন কান্ত কী করবে! কী করে মরালীকে বাঁচাবে? আর মরালীই যদি না বাঁচে তো কান্তরই বেঁচে থেকে লাভটা কী?

তখনও উদ্ধব দাস অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

কান্ত ঠেলতে লাগল ও দাসমশাই, দাসমশাই, ওঠো ওঠো

উদ্ধব দাস উঠল। বললে–উঃ, এত শব্দ হচ্ছিল কীসের গো, একটু আরাম করে ঘুমোচ্ছিলাম, তাও ঘুমোতে দেবে না

কান্ত বললে–খেয়া নৌকো এসে গেছে, চলো—

উদ্ধব দাস অনিচ্ছের সঙ্গে উঠল। তারপর পুঁথিটা বগলে নিয়ে ঘাটের দিকে চলতে লাগল।

*

ইতিহাসের শিক্ষা বড় কঠোর শিক্ষা। সে-শিক্ষা যে গ্রহণ করতে পারে না সে অন্ধ। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করে দিয়েছে যে, ষড়যন্ত্র রাজনীতির ব্রহ্মাস্ত্র। তুমি আলেকজান্ডার হতে পারো, নেপোলিয়ন হতে পারো, কিংবা ক্রমওয়েল হতে পারো, কিন্তু সাম্রাজ্যস্থাপন করতে পারেনি বলে ইতিহাস তোমাদের নাম বড় গলা করে প্রচার করেনি। যদি সাম্রাজ্য রাখতে চাও কি সাম্রাজ্য সৃষ্টি করতে চাও তো ষড়যন্ত্রের ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করতে হবে। তোমরা তা পারোনি। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাও তা পারেনি। পেরেছে শুধু ফেট (ডভিডের কম্যান্ডার কর্নেল ক্লাইভ।

উদ্ধব দাস বলত–কলিই কলিকালের অধিষ্ঠাতৃ দেবতা–

লোকে জিজ্ঞেস করত–কেন?

উদ্ধব দাস ব্যাখ্যা করত তখন। ক্রোধের ঔরসে তার বোন হিংসার গর্ভে কলির জন্ম। কলিও নিজের বোন দুরুক্তিকে বিয়ে করল। দুটো সন্তান হল। ছেলেটার নাম ভয়, মেয়েটার নাম মৃত্যু। সেই ভয় আর মৃত্যু দিয়েই কলিকাল আরম্ভ হল।

নাদির শা যখন হিন্দুস্থানে হামলা করেছিল, তখন দিল্লির একটা মসজিদের ওপর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিরীহ মানুষের নিষ্ঠুর মৃত্যু দেখে সে আনন্দে উত্তেজনায় ফৌজের লোকদের বারবার। উৎসাহিত করেছিল। সে কাহিনী দিল্লি ছাড়িয়ে মানুষের মুখে মুখে সমস্ত জনপদে ছড়িয়ে গিয়েছিল। ভয় আর মৃত্যুর প্রতাপের যে-চিত্র সেদিন থেকে মানুষের মনে আঁকা ছিল তা তখনও মোছবার অবকাশ পায়নি। খেয়ে সুখ নেই, ঘুমিয়ে শান্তি নেই, কেবল ভয় হত ওই বুঝি মৃত্যু আসে

ছোটবেলায়, খুব ছোটবেলায় মরালী এসব শুনেছে। ঘুমোতে ঘুমোতে হঠাৎ নয়ানপিসি ডেকে দিয়েছে–ওরে ওঠ ওঠ–

ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠেছে সবাই। উঠে বড়মশাইদের রাজবাড়ির ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে। শুধু তারা নয়, গ্রামসুদ্ধ লোক এসে জুটেছে সেখানে। অত লোক একখানা রাজবাড়িতে ধরবে কেন। অতিথিশালা, পূজার দালান, শিবের মন্দির, কাছারিবাড়ি সমস্ত গিসগিস করছে লোকে। ছাদের ওপর থেকে মাধব ঢালি কামান দাগত। বড়মশাই দোতলার ওপর উঠে সব দেখতেন। বাড়ির চারদিকের গড়ে জল ভরতি করা হত। তার চারদিকে আগুন লাগিয়ে দিতেন খড়ের গোয়ালে। সে-আগুন দেখে বর্গিরা হয়তো ভয় পেয়ে যেত। সকাল হলে যে-যার বাড়ি চলে যেত আবার।

এই-ই ছিল তখনকার হাতিয়াগড়ের জীবন। মরালী এ-সব দেখেছে। লোকে আলো না করত আটচালায়, চণ্ডীমণ্ডপে, পেঁকিশালে, বারোয়ারিতলায়। সেসব কথা শুনেছে মরালী! কখনও বলত মোগলদের তাড়িয়ে দিয়ে পাঠানরা আসছে, কখনও বলত পাঠানদের তাড়িয়ে দিয়ে বর্গিরা আসছে।

লোকে বলত-মুর্শিদাবাদের নবাব খালি হারেমে বসে বসে মদ খায় আর বেগমদের নিয়ে মহফিল করে–

তখন থেকেই রাগটা ছিল মরালীর। নবাবদের কথা মনে পড়লেই একটা ছবি কেবল চোখের সামনে ভেসে উঠত। যখন সত্যি সত্যিই সেই নবাবি হারেমে আসা অবধারিত হল, তখনও মনে মনে খুব রাগ। হয়েছিল তার। লুকিয়ে লুকিয়ে পেট কাপড়ের তলায় একটা হাতিয়াগড়ের কামারের তৈরি ছুরি। এনেছিল সঙ্গে করে। ভেবেছিল তেমনই যদি কিছু ঘটে তো হয় নিজের বুকে বসাবে নয়তো নবাবের। কিন্তু হারেমের ভেতরে ঢুকে তাজ্জব হয়ে গেল। কই; এরা তো তাকে কিছু বলছে না। নানিবেগমকে দেখে আরও অবাক হয়ে গেল। ঠিক যেন নয়ানপিসির মতন। নবাবকেও একদিন দেখলে। কই, নবাব তো হারেমে আসে না। নবাব তো কই মদ খায় না!

তারপর যত দিন যেতে লাগল ততই অবাক অবাক ঘটনা ঘটতে লাগল। অতি সাধারণ একটি গ্রামের মেয়ের জীবনে এর চেয়ে বেশি আর কী ঘটতে পারে! একদিন বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে এতদিন। হয়তো একটা ছেলেমেয়ে হয়ে যেত। রোজ রাত্রে শুতে হত স্বামীর সঙ্গে, আর চেঁকিশালে ধান ভেঙে সেই চাল রান্না করতে হত সংসারের জন্যে। সে উদ্ধব দাসের সংসার করলেও যা করত, ওই কান্তর সঙ্গে বিয়ে হলেও তাই-ই করতে হত। কোনও তফাত হত না।

উদ্ধব দাসকে নিয়ে ভাবনা ছিল না, কিন্তু ওর জন্যে কষ্ট হত। ওই কান্ত!

ও চুপ করে থাকে, কিছু বলে না, কিছু চায়ও না। যা হুকুম করে তাই-ই তামিল করতে পারলে যেন কৃতার্থ হয়। তার জন্যেই কান্ত ছায়ার মতো নবাবের পাশে পাশে থেকেছে, তার জন্যেই কোথায় কোথায় ঘুরে মরছে। তার একটু ক্ষতি হলে ও যেন ভয়ে কেঁপে ওঠে।

ও বলে–তোমাকে সবাই খুন করবার মতলব করছে মরালী

যেন মরালী খুন হয়ে গেলে কান্তর সর্বনাশটাই সবচেয়ে বেশি।

ইয়ার লুৎফ খাঁ সাহেবের বাড়ির দিকে যেতে যেতে সেই কথাটাই বারবার মনে পড়েছিল। পালকি বেহারারা জানে কোন দিকে কোন বাড়িটা মনসবদার সাহেবের। রাত তখন অনেক। সমস্ত মুর্শিদাবাদ শহরটা ঘুমিয়ে পড়েছে। আরও ওদিকে জগৎশেঠজির বাড়ি। মরালী পালকির ফাঁক দিয়ে চেয়ে দেখলে বাইরের দিকে। ঝাঝা করছে অন্ধকার।

একটা বাড়ির সামনে এসে থামল তাঞ্জাম। থামতেই মরালী নিজের পেট কাপড়ের তলায় ছুরিটা সামলে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। তারপর বোরখা দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢেকে দিলে নিজেকে।

কিন্তু চকবাজারের রাস্তার একটা অন্ধকার কোণ বেছে নিয়ে বশির মিঞা চুপ করে বসে ছিল তখন। দূর থেকে রাস্তাটার যতদূর নজরে পড়ে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। শাহিসড়কের নকশা সোজা সাদাসিধে। দিনেরবেলা যত ভিড়ই থাক, রাত্রে সে রাস্তায় নোক হাঁটে না। কোতোয়ালির পাহারাদাররা অন্য সময় পাহারা দেয় বটে, কিন্তু চারদিকে যখন সব শান্ত, কোথাও কোনও ঝামেলা নেই তখন একটু ঢিলে দেয়।

একবার মনে হয় যেন তাঞ্জামটা আসছে। অন্ধকারের মধ্যে ঝাপসা ছায়ার মতো চেহেল সুতুনের দিকে এগিয়ে আসছে। আবার মনে হয়, না, মনের ভুল।

একলা বশির মিঞার ওপর ভার নয়। খানিক দূরেই আরও চারজন লুকিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে।

বশির মিঞা কখনও কাঁচা কাজ করে না।

বসে থাকতে থাকতে বশির মিঞার কোমর ব্যথা হয়ে গেল। পকেট থেকে একটা বিড়ি বার করে ধরালে। মুঠোর মধ্যে আগুনটা লুকিয়ে ধোঁয়া টানতে লাগল। শালার ঝকমারির কাজ এই জাসুসিগিরি। দিন নেই রাত নেই, কেবল ছায়ার পেছনে ঘোররা। হুকুম করতে তো কড়ি খরচ লাগে না। মোহরার মনসুর আলি মেহের সাহেব তো হুকুম করে দিয়ে আরামে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে এখন। যদি হুকুম হাসিল না হয় তো তখন বশির মিঞার ওপর তম্বি হবে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর রাতগুলো বড় বিশ্রী রাত। এইসব রাত্রের অন্ধকারেই সরীসৃপের মতো ষড়যন্ত্রীরা দিল্লি থেকে শুরু করে তামাম হিন্দুস্থানের অলিতে গলিতে চরতে বেরোত। কোথায় কে কার রাজ্য কেড়ে নেবে, কখন কে কার বিরুদ্ধে চর লাগিয়ে দেবে, কে একদিন নিঃশব্দে দুনিয়া থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, তারই ফুসমন্তর আওড়ানো হত এইসব রাতগুলোতে। এমনি এক রাত্রেই হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ি থেকে একদিন ঐশ্বর্য লক্ষ্মী নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করেছিল। এমনই এক রাত্রেই মরালী চেহেসতুনে এসে ভাগ্যলক্ষ্মীর পায়ে লাথি মেরেছিল। এমনই এক রাত্রেই ওয়াট ছদ্মবেশে এসে ঢুকেছিল দো-হাজারি মনসবদার ইয়ার লুৎফ খাঁ’র বাড়িতে।

সেদিন সমস্ত রাত ঘুম হয়নি নানিবেগমসাহেবার।

একবার চোখ দুটো বুজে এসেছে আর ধড়মড় করে জেগে উঠেছে।

অথচ কেউ নয়। চেহেল্‌-সুতুনের মধ্যে জেগে থাকলে অমন অনেক অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়। কত পুরুষ ধরে কত খুনখারাপি চলে আসছে, কত নিঃশব্দ আত্মবিসর্জনের অর্তনাদ এখানকার কুঠুরির মধ্যে চাপা পড়ে আছে, রাত্রের অন্ধকারেই বুঝি সেই সব অদৃশ্য আত্মারা আবার কবর থেকে উঠে আসে। সেই আত্মারা বুঝি আবার ঘাগরা পরে, পেশোয়াজ পরে, কাঁচুলি পরে, আবার পায়ে ঘুঙুর বাঁধে, আবার আরক খায়, আবার হাসতে শুরু করে, কাঁদতে শুরু করে, নাচতে শুরু করে। আবার যেন গুলসন বেগমের মতো গাইতে শুরু করে–যো হোনেকা থি উও তো হো গয়ি, আব উসকি ক্যা পরোয়া’–

নানিবেগমসাহেবা এসব জানে। কিন্তু তবু সন্দেহ যায় না। মরিয়ম বেগম ফিরে এসেছে তো মতিঝিল থেকে? মসজিদে নমাজ পড়বার সময় হল নাকি? ভিস্তিখানায় পানি দেওয়া হয়েছে নাকি?

তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠল নানিবেগম। উঠে ডাকলে–পিরালি খাঁ

চেহেল্-সুতুনে এক বোধহয় পিরালি খাঁ’রই ঘুম নেই। সেই মুর্শিদকুলি খাঁ’র আমল থেকে সে জেগে আছে। জেগে জেগে সে এই চেহেল্‌-সুতুনের উত্থান আর পতন, অভ্যুত্থান আর অবনতি দেখে আসছে। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে যে-অবক্ষয় শুরু হয়েছে তার নিঃশব্দ সাক্ষী বুঝি সে একলাই। সে মুর্শিদকুলি খা-কে দেখেছে, সুজাউদ্দিন খাঁ-কে দেখেছে, দেখেছে সরফরাজ খাঁ-কে, দেখেছে আলিবর্দি খাঁ-কে। এখন আবার দেখছে আর এক নবাবকে। এনবাব আবার ঘুমোতে ভালবাসে, এনবাব আবার কোরান পড়তেও ভালবাসে। এও এক তাজ্জব নবাব! এ দেখবার জন্যেও পিরালি খাঁ-কে এত বছর বেঁচে থাকতে হল।

নানিবেগমসাহেবার ডাক শুনেই হাজির হয়েছে সামনে।

কুর্নিশ করে বললে–বন্দেগি বেগমসাহেবা

হ্যাঁরে, মরিয়ম বিবি ফিরেছে?

 জি নেহি!

 নানিবেগমের মনটা ছটফট করতে লাগল। এত দেরি তো করে না মেয়ে কখনও। নবাবকে ঘুম পাড়িয়ে সোজা চলে আসে চেহেল্‌-সুতুনে। তবে কি মির্জা তাকে আটকে রেখেছে মতিঝিলে? তবে কি আবার মির্জার রাত্রে ঘুম আসেনি? তবে কি…

নানিবেগমসাহেবা আস্তে আস্তে গোসলখানার দিকে চলে গেল।

এইসব রাত্রেই কাশিমবাজার কুঠির দফতরে ওয়াটস সাহেব বসে বসে কনফিডেনশিয়াল ডেসপ্যাঁচ লেখে কলকাতার কাউন্সিলে। নিজামতের সব কনফিডেনশিয়াল খবর। কোথায় কে কে কনস্পিরেসিতে হেলপ করবে। জগৎশেঠ কোন দিকে হেলছে। ফ্রেঞ্চ কুঠির দিকে না ব্রিটিশ কুঠির দিকে। আর জগৎশেঠ যদি একবার আমাদের দিকে থাকে তো আর কাকে কেয়ার করব?

আর এইসব রাত্রেই জগৎশেঠজির বাড়িতে লুকিয়ে লুকিয়ে কুঠির মেসেঞ্জার আসে। এইসব রাত্রেই মহিমাপুরের বাজবাড়ির সদরে পাঠান ভিখু শেখ কড়া নজর রাখে বাইরের দিকে।

 ছায়া দেখলেই ভিখু শেখ চিৎকার করে ওঠে–ভাগ শালা কুত্তাকে বাচ্চা

যেদিন উমিচাঁদ আসে সেদিন আরও কড়া নজর রাখবার হুকুম আসে মালিকের কাছ থেকে। সেদিন ভিখু শেখের তেজ দেখে কে!

ভাগো শালা ইধারসে!

 পাঠান ভিখু শেখ সেদিন নিজের ক্ষমতার সিংহাসনে একেবারে খোদাতালাহ হয়ে বসে। সে জানে না কে উমিচাঁদ, কে ওয়াটস, কে-ই বা ইয়ার লুক্ত খাঁ। সে শুধু জানে হিন্দুস্থানের মালিক মহতাপচাঁদ জগৎশেঠ বাহাদুরকে। খোদাতালাহ মালিককে বাঁচিয়ে রাখলেই তবে বরাবর তার রুটি মিলবে।

জগৎশেঠজি দেখলেন। বললেন–দেখি

ওয়াটস্ সাহেব খখানা দেখালে৷ ইয়ার লুৎফ খাঁ লিখেছে–নবাব সিরাজউদ্দৌলা শীঘ্রই আহমদ শা আবদালিকে ঠেকাইবার জন্য আজিমাবাদে যাইতেছে। সেই কারণেই ইংরাজদের সঙ্গে তিনি এখন বন্ধুত্ব রাখিবার ভান করিতেছেন। আজিমাবাদ হইতে ফিরিয়া আসিয়াই ইংরাজদের হিন্দুস্থান হইতে তাড়াইয়া দিবার প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন। পাত্র-মিত্র আমির-ওমরাহ সকলেই নবাবকে অন্তরের সহিত ঘৃণা করে। একজন উপযুক্ত নেতা পাইলেই সকলেনবাবের বিরুদ্ধে যাইতে প্রস্তুত। নবাবের অনুপস্থিতি ইংরেজ পক্ষের মুর্শিদাবাদ আক্রমণের প্রকৃত সুযোগ আমাকে নবাব করিলে রায় দুর্লভরাম, জগৎশেঠ প্রভৃতি সকলেই যোগ দিবেন। লক্কাবাগ হইতে সৈন্যসামন্ত সরাইয়া আনিয়া নবাব আপনাদের বিশ্বাসভাজন হইতে চান। আসলে ইহা ধাপ্পাবাজি মাত্র। এই অবস্থায় আপনারা যা চান আমি তাহাই করিতে প্রস্তুত।

ওয়াটস্ জিজ্ঞেস করলে-মনসবদার সাহেব যা লিখেছে সব সত্যি?

জগৎশেঠজি বললেন–আর মিরজাফর সাহেব?

ওয়াটস্ সাহেব বললে–মিরজাফর সাহেব লিখে দেয়নি কিছু মুখে বলেছে

কী বলেছে?

পাশেই উমিচাঁদ সাহেব বসে ছিল। উমিচাঁদ সাহেব বললে–আমাকে লিখে দিয়েছেন মিরজাফরসাহেব। এই চিঠি আমার কাছে রয়েছে। আমি এই চিঠি নিয়ে নিজে কর্নেল ক্লাইভসাহেবের কাছে যাব–

জগৎশেঠজি জিজ্ঞেস করলেন–আমাকে দেখাতে আপত্তি আছে?

উমিচাঁদ সাহেব বললে–আপনাকে দেখাতে কী আপত্তি থাকবে জগৎশেঠজি! আপনি তো আমাদের দলে। এই শুনুন

বলে উমিচাঁদ সাহেব পড়তে লাগল:

ঈশ্বর এবং পয়গম্বরের নামে শপথ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছি; যতদিন আমি জীবিত থাকিব ততদিন এই সন্ধিপত্রের নিয়ম পালন করিব

(১) নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার সহিত ইংরাজদের যে সন্ধিপত্র স্থিরীকৃত হইয়াছে তাহার সমস্ত শর্ত পালন করিতে আমি সম্মত।

(২) হিন্দুস্থানের বা ইয়োরাপের যে-কেহ ইংরাজদের শত্রু, সে আমারও শত্রু বলিয়া বিবেচনা করিব।

(৩) জিন্নেৎ-উল-বেলাৎ এই বঙ্গভূমিতে এবং বিহার ও উড়িষ্যার মধ্যে ফরাসিগণের যে সমস্ত কুঠি আছে তাহা ইংরাজদের অধিকারে আসিবে। ফরাসিদের আর এ-দেশে বাস করিতে দিব না।

.

বশির মিঞা অনেকক্ষণ ধরে চকবাজারের রাস্তায় বসে ছিল। টেনে টেনে চারটে বিড়ি শেষ করে ফেললে। তখনও মরিয়ম বেগমসাহেবার তাঞ্জামের দেখা নেই। আস্তে আস্তে আর একজন ইয়ারের কাছে গেল। বললে–তোরা দাঁড়া রে, আমি তালাস করে আসি

আবার গেল মতিঝিলের সদর ফটকে।

ফটক-পাহারাদার তখনও পাহারা দিচ্ছে। বশির মিঞা জিজ্ঞেস করলে কী মিঞাসাহেব, বেগমসাহেবার তাঞ্জাম এখনও বেরোয়নি?

পাহারাদার বললে–কেন, তোর এত বেগমসাহেবার খোঁজ কেন?

না, এমনি পুছছি, বেগমসাহেবা বুঝি আজকাল নবাবের সঙ্গেই শুচ্ছে মিঞাসাহেব?

 মিঞাসাহেব রেগে গেল। বললে–নবাব যার সঙ্গে খুশি শোবে, তাতে তোর বাপের কী রে?

বশির মিঞা হো হো করে হেসে উঠল। রাগ করলে তো বশির মিঞার চলবে না। কাজ হাসিল করতে হবে।

বললে–রাগ করছ কেন মিঞাসাহেব? রাগের বাত আমি বলেছি?

বেশ করব রাগ করব, তোর বাপের কী?

বশির মিঞা তবু হাসতে লাগল। বললে–আমার বাপকে গালাগালি দিচ্ছ মিসাহেব, কিন্তু আমার বাপ কবে মরে ভূত হয়ে গেছে–শালা বাপও মরেছে আমার, আমাকেও পথে বসিয়ে গিয়েছে–

ভাগ, ভাগ এখান থেকে ভাগ তুই!

বশির মিঞা ভেতরে চেয়ে দেখলে মতিঝিলের ঝুল বারান্দার নীচে বেগমসাহেবার তাঞ্জাম নেই। তবে কোথায় গেল? চলে গেল? কিন্তু চেহেল সুতুনে যাবার তো আর কোনও রাস্তা নেই।

সেই রাত্রেই হাঁটতে হাঁটতে একেবারে ফুপার বাড়িতে গেল।

ডাকলে-ফুপাজি, ফুপাজি–

মোহরার মনসুর আলি মেহের সাহেব প্রথম রাত্রে ঘুমোয় না। দফতরের পর যেতে হয় মেহেদি নেসার সাহেবের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে নোকরির খাতিরে একটু তদবির করতে হয়। মেহেদি নেসার। সাহেব বাড়িতে না থাকলেও তার গদি ফরাশে একটু বসতে হয়। পান-তামাক খেতে হয়। সাহেব। বাড়িতে থাকলে আরও বেশিক্ষণ জি হ’ বলতে হয় সব কথায়। তারপর পাঁচ বিবি মনসুর আলি সাহেবের আজ এর সঙ্গে শুলে, কাল ওর সঙ্গে শুতে হবে। বিবিদের মর্জি-মেজাজ বজায় রেখে তখন সরাবে চুমুক দিয়ে গড়গড়া টানতে টানতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুম আসতে মাঝরাত পুইয়ে যায়।

বশির মিঞার ডাক শুনে কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল মোহরার সাহেবের।

শালা, শুয়ারকা বাচ্ছা কহিকা চিল্লাচ্ছিস কেন?

ফুপাজি, তাঞ্জাম তো মিলল না!

কার তাঞ্জাম? কোন হারামজাদির তাঞ্জাম?

ঘুমের ঘোরে সব ভুলে গিয়েছিল মোহরার সাহেব।

তারপর ভাল করে জ্ঞান হতে আরও রেগে গেল। বললে–বেত্তমিজ, বেওকুফ, বেআদব কাহিকা, তাঞ্জাম মিলল না তার আমি কী জানি? খুঁজে দেখ কোথায় গেল! তাঞ্জাম কি আসমানে উড়ে যাবে? মুর্শিদাবাদ শহর খুঁজে দেখ! দেখতে না পেলে তোর নোকরি খতম করে দেব বেল্লিক কহিকা

এর পর আর সাহস হয়নি বশির মিঞার। ফুপার তাড়া খেয়ে আবার দেখতে বেরোল।

জগৎশেঠজির দরবার-ঘরের ভেতরে তখন মিরজাফর সাহেবের সন্ধিপত্র পড়া হচ্ছে। ৪৯০

জগৎশেঠজি বললেন–তারপর?

উমিচাঁদ সাহেব পড়তে লাগল কলিকাতার ইংরেজ অধিবাসীদের যে সমস্ত দ্রব্যাদি লুণ্ঠিত হইয়াছে তাহার ক্ষতিপূরণের জন্য পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দিতে স্বীকার করিতেছি এবং দেশীয়গণের লুষ্ঠিত দ্রব্যের ক্ষতিপূরণের জন্য কুড়ি লক্ষটাকা…

হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল।

জগৎশেঠজি নিজেই উঠে দরজা খুলে দিলেন। এসব সময়ে বাইরের লোকদের ঘরে ঢুকতে দেওয়া উচিত নয়।

সামনেই দাঁড়িয়ে ভিখু শেখ।

 একটা তাঞ্জাম এসেছে হুজুর।

এত রাত্তিরে কার তাঞ্জাম?

হুজুর, এক জেনানা?

জেনানা! জগৎশেঠজি অবাক হয়ে গেলেন। একটু কৌতূহলও হল। এত রাত্রে কে জেনানা তার বাড়িতে আসবে! দরজাটা বন্ধ করে দরবার-ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। প্রথমটা বুঝতে পারেননি। বোরখা-পরা চেহারা দেখে আরও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।

জিজ্ঞেস করলেন–কৌন হ্যায় আপ?

বোরখা-পরা মূর্তিটা সামনে এগিয়ে এল। তারপর চারদিক ভাল করে পরীক্ষা করে নিয়ে মুখখানা বার করলে। তবু চিনতে পারলেন না জগৎশেঠজি। তখন মেয়েটি বোরখা খুলে ফেলে বললে–আমাকে আপনি চিনতে পারবেন না জগৎশেঠজি! আমিও আপনার মতো হিন্দু। আমি হিন্দু মেয়ে। আমি হাতিয়াগড়ের রাজার দ্বিতীয় পক্ষের বউ

সত্যিই অবাক হয়ে গেছেন জগৎশেঠজি!

আমাকে এখানে চেহেল্‌-সুতুনে সবাই মরিয়ম বেগম বলে ডাকে। কিন্তু আসলে আমার নাম অন্য। আমি খুব বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি জগৎশেঠজি। আমাকে আপনি বাঁচান!

বোসো বোসো, আমি শুনেছি তোমার কথা। তোমার কী বিপদ?

জগৎশেঠজি নিজে বসলেন। কিন্তু মরালী বসল না।

মরালী বললে–সে অনেক দুঃখের জীবন আমার। সব কথা বলতেই আপনার কাছে এসেছি। আমার সংসার ছিল, আমার সব ছিল। আপনাদের এই নবাব একদিন আমাকে জোর করে এনে নিজের হারেমে পুরেছে।

জগৎশেঠজি বললেন আমি শুনেছি; তোমার স্বামী একদিন এসে আমাকে সব বলে গেছেন।

আমি ক’দিন থেকে আপনার এখানে আসব বলে ভাবছি। ইয়ার লুফ খাঁ সাহেবের বাড়িতেও যাব ভেবেছিলাম, কিন্তু সেখানে গিয়েও যেতে পারিনি। রোজ রাত্তিরে বেরোই, আপনার পাঠান পাহারাদার দেখে ভয় করে। কিন্তু আজ আর থাকতে পারলাম না। সাহস করে ঢুকে পড়লাম।

জগৎশেঠজি বললেন, তুমি তো কলকাতায় ক্লাইভসাহেবের কাছেও গিয়েছিলে?

 মরালী বললে–যখন যার কাছে সুবিধে পাচ্ছি তার কাছেই যাচ্ছি–কী করব বলুন! আমি মেয়েমানুষ আমার কতটুকু ক্ষমতা?

শুনেছিলাম ক্লাইভসাহেবের দফতর থেকে তুমি নাকি কী একটা চিঠি চুরি করেছিলে?

আমি? চুরি করব? ক্লাইভসাহেবের দফতর থেকে চিঠি চুরি করব? কীসের চিঠি? কী জন্যে চুরি করব? ক্লাইভসাহেব আমার কী ক্ষতি করেছেন?

কথা বলতে বলে মরালীর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল।

জগৎশেঠজি বললেন–কেঁদো না বলো, তুমি কী বলছিলে, বলো

হয়তো আমার কপালে আরও অনেক দুঃখ আছে, নইলে আপনার মতো লোক আমাকে অবিশ্বাস করবে কেন? এতকাল ধরে আমি কেবল চেষ্টা করছি কেমন করে আমি নবাবের প্রতিশোধ নেব, আর আমার নামের এই কলঙ্ক! আমার স্বামীর কানে এসব কথা গেলে তিনি কী ভাববেন বলুন তো? নিশ্চয় আমার কোনও শত্রু এমন কথা বলেছে আপনাকে।

জগৎশেঠজি বললেন–তা হতে পারে। কিন্তু আমি তোমার কী করতে পারি।

মরালী বললে–আপনি আমার সব করতে পারেন জগৎশেঠজি! আমি এতকাল আছি। চেহেল্‌-সুতুনে, আমি কেবল ভাবছি কী করে পালাব সেখান থেকে। কতদিন নবাব আমাকে নিয়ে তার পাশে শুতে চেয়েছে, আমি তাকে আরক খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছি–

আরক? কীসের আরক?

মরালী বললে–চকবাজারে সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকান আছে, সে লুকিয়ে লুকিয়ে বেগমদের জন্যে আরক বিক্রি করে। আমি তাই খাওয়াই নবাবকে। এক-একদিন ভেবেছি নবাবকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলব, কিন্তু নেয়ামতের জন্যে তা পারিনি।

নেয়ামত? নেয়ামত কে?

মতিঝিলের খিদমদগার। সে কড়া নজর রাখে। মতিঝিলে নেয়ামত আর চেহেল্‌-সুতুনেনানিবেগম।

জগৎশেঠজি বললেন–লোকে যে বলে মুর্শিদাবাদের মসনদ চালাচ্ছ তুমি। সেকথা কি তা হলে মিথ্যে?

তবে দেখবেন?

 বলে মরালী পট করে নিজের পেশোয়জ খুলে ফেললে। কঁচুলির আধখানা বার হতেই জগৎশেঠজি বললেন–কী দেখাচ্ছ?

না দেখালে আপনি বিশ্বাস করবেন না, ওরা আমাকে লোহার শিক পুড়িয়ে কী করে সেঁকা দিয়েছে–

জগৎশেঠজি বললেন–আমি বিশ্বাস করেছি, থাক—

কিন্তু আমি আর ফিরে যাব না জগৎশেঠজি ওখানে। আপনি আমাকে এখানে লুকিয়ে রাখুন। যেমন করে থোক আমাকে হাতিয়াগড়ে পাঠিয়ে দিন! আপনি এত বড় মানী লোক, আপনি একজন অবলা মেয়েমানুষকে বাঁচাতে পারবেন না, তার ইজ্জত রক্ষে করতে…

কথা বলতে বলতে মরালী হঠাৎ থেমে গেল।

বললে–পাশের ঘরে কাদের গলা শুনছি, ওখানে কেউ আছে নাকি?

হ্যাঁ!

মরালী চমকে উঠল।

তা হলে কী হবে? আমার কথা তো ওরা শুনতে পেয়েছে? কে ওরা?

জগৎশেঠজি বললেন–না, ওরা আমারই দলের। উমিচাঁদ আর ওয়াটস। তোমার কোনও ভয় নেই। তুমি এখানে বোস, আমি ও-ঘরে একটু যাচ্ছি, ভেবে দেখি আমি তোমার কী করতে পারি

বলে জগৎশেঠজি পাশের ঘরে চলে গেলেন।

বশির মিঞা যা ভেবেছে তাই। ফুপার বাড়ি থেকে বেরিয়ে মনসবদার সাহেবের বাড়িতে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে শুনলে তাঞ্জামটা সেখানে গিয়েছিল কিন্তু ফিরে চলে গিয়েছে। তারপর মহিমাপুরে আসতেই দেখলে, জগৎশেঠজির বাড়ির ফটকে তাঞ্জামটা রয়েছে।

ভাগ শালা, কুত্তিকা বাচ্চা কাহিকা, ভাগ হিয়াসে।

বশির মিঞা বললে–একটা বিড়ি দাও না মিাসাহেব, অত চটছ কেন? আমি কী করেছি?

এবার ভিখু শেখ বন্দুকটা নিয়ে তাক করে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। বশির মিঞা তাড়াতাড়ি দূরে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইল।

শালা, কুত্তিকা বাচ্চা, উল্ল কা পাঠঠা!

 পাঠান ভিখু শেখ ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে রাগে আপন মনেই গজগজ করতে লাগল।

*

ভোরবেলা সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানের পেছন দিকে কান্ত এসে ডাকলে–বাদশা, ও বাদশা

সারাফত আলির মতন বাদশার ঘুমও বড় গাঢ়। এক ডাকে ঘুম ভাঙে না। অনেক ডাকাডাকিতে তবে উঠল। ভেতর থেকে বললে–কে?

আমি কান্তবাবু, দরজা খোলো।

বাদশা দরজাটা খুলে দিলে। কান্তবাবুর পাশে আর একজনকে দেখে জিজ্ঞেস করলে–এ কৌন হ্যায়?

এর নাম উদ্ধব দাস গো। যার গান রাস্তার ভিখিরিরা গায়। সেই উদ্ধব দাস। সেই যে আমি রব না ভব-ভবনে

উদ্ধব দাস বললে–আমার আর একটা নাম আছে, ভক্ত হরিদাস–

তারপর কান্তর দিকে ফিরে বললে–এইখানেই থাকো বুঝি তুমি? বেশ ঘর পেয়েছ তো! বেশ ঘর। এর নাম বাদশা? বাদশাই বটেক তুমি। দিল্লির বাদশা না দুনিয়ার বাদশা, কী তুমি?

উদ্ধব দাস তখন যেন বেশ মজা পেয়েছে। বাদশা অবাক হয়ে গেল। বললে–ইনি কে কান্তবাবু? কাকে ধরে নিয়ে এলে?

উদ্ধব দাস বললে–আমি হরির দাস গো—

হরি কে?

আরে, এ যে হরিকেই চেনে না দেখছি! হরির নাম শোনোনি তুমি? তবে শোনোতবে শোনো তার কথা–

বলে উদ্ধব দাস গাইতে শুরু দিলে–

হরির নামে যায় না দুঃখ
কার এমন দুর্ভাগ্য!
কান কাটিলে করে না রাগ
কার এমন বৈরাগ্য ॥
কার এমন সামগ্রী আছে
দামোদরের ক্ষুধা হরে।
কার এমন ওষধি আছে।
ব্রহ্মশাপে মুক্ত করে ।
শ্যামের বাঁশির নিন্দা করে।
কার এমন সুরব।
দেহ-ধারণে দুঃখ পায় না।
কার এত গৌরব।
সুমেরুকে ক্ষুদ্র করে
কার বা এমন বুদ্ধি।
ব্রহ্ম নিরূপণ করে
কার বা এত সাধ্যি।
গর্ভের কথা মনে পড়ে
কার বা এমন মন।
কার বা হেন শক্তি।
খণ্ডে কপালের লিখন ॥

বাদশা অতশত বোঝে না। লোকটার হঠাৎ গান গেয়ে ওঠা দেখে থতমত খেয়ে গিয়েছিল। কান্তই থামিয়ে দিলে। বললে–তুমি থামো, এমন যখন-তখন গান গাইলে লোকে ভাববে কী বললো তো

বলে টানতে টানতে নিজের ঘরখানার ভেতরে নিয়ে এল।

তারপর বললে–যাকে-তাকে কেন অমন করে গান শোনাও বলো তো দাসমশাই? সবাই কি তোমার মর্ম বুঝবে? তোমার মর্ম বুঝতে পারে নবাব। নবাবের কাছে গান শোনালে তুমি বাহবা পাবে!

উদ্ধব দাস হাসতে লাগল কথাটা শুনে।

বললে–না গো, আমি নবাবের বাহবা চাইনে, নবাব তো দু’দিনের, নবাবের বাহবাও দু’দিনের। আমি চাষাভুষোর বাহবা চাই

উদ্ধব দাসের সেই কথাটা কান্তর বহুদিন মনে ছিল। উদ্ধব দাস হয়তো চেয়েছিল একদিন সে রামপ্রসাদ হবে। রামপ্রসাদের মতোই তার গান চাষাভুষো সবাই গাইবে। হয়েছিলও তাই। উদ্ধব দাস সারা মুলুক ঘুরে ঘুরে বেড়াত পুঁথি বগলে করে, আর যেখানে-সেখানে গান গাইত। সেই গান মুলুকের লোকের মুখে মুখে ফিরত। লোকে বলত–উদ্ধব দাসের গান। উদ্ধব দাসের গান হলেই লোকে নড়েচড়ে বসত। মন দিয়ে শুনত। বলত–উদ্ধব দাসের গান আর একটা গাও

তা ক’দিন ধরে কান্ত ছিল না মুর্শিদাবাদে। একটু বেলা হতেই উদ্ধব দাসকে রেখে সোজা মতিঝিলে চলে গেল।

ইব্রাহিম খাঁ কান্তকে দেখেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।

কী খবর পুরকায়স্থমশাই!

ইব্রাহিম খাঁ বললে–তুমি আর আমাকে পুরকায়স্থমশাই বলে ডেকো না কান্তবাবু, আমার চাকরি চলে যাবে।

কিন্তু কে আর শুনতে পাচ্ছে আমার কথা! কেউ তো এখানে নেই!

পুরকায়স্থমশাই বললে–আজকাল সব ওলোটপালট হয়ে গেছে কান্তবাবু। সেসব দিন আর নেই। এখন আমার চাকরি থাকে কিনা সন্দেহ

আশ্চর্য! তুমি হিন্দু থেকে মুসলমান হলে, তবু তোমার চাকরি থাকবে না?

কান্ত অনেকবার ইব্রাহিম খাঁর কথাও ভেবেছে। বেচারি হয়তো মরেই যেত না-খেতে পেয়ে। তবু প্রাণটা টিকে আছে ধর্মের বিনিময়ে। যেন ধন চেয়ে প্রাণটা বড় হল তার কাছে। কিন্তু প্রাণটা বড় নয়ই বা কেন? দুটো খেতে পাওয়ার তাগিদেই তো কান্ত একদিন চাকরি নিয়েছিল বেভারিজ সাহেবের সোরার গদিতে। সেখান থেকে চাকরি যাওয়ায় ওই পেটের তাগিদেই চাকরি নিতে হয়েছিল নিজামত কাছারিতে। আর তারপর কোথা থেকে কেমন করে জড়িয়ে গেল মরালীর সঙ্গে। মরালীর জীবনের সঙ্গে একবার জড়িয়ে যাবার পর আর তার কোথাও গতি হবে না, কোথাও তার শান্তি হবে না। সে একেবারে একাত্ম হয়ে গেছে এখানে, এই মরিয়ম বেগমের সঙ্গে।

ওপরে উঠতে গিয়ে নেয়ামতের সঙ্গে দেখা।

নেয়ামত বললে–মরিয়ম বেগমসাহেবা এখানে তো নেই হুজুর

এখানে নেই তো কোথায় গেলেন তিনি?

তা জানিনে, আপনি চেহেল্‌-সুতুনে গিয়ে খোঁজ নিন!

 কান্ত বললে–কিন্তু, নজর মহম্মদ যে বললে–চেহে-সুতুনে নেই।

চেহেল-সুতুনে থাকবেন না তো কোথায় আবার যাবেন হুজুর! নিশ্চয় চেহেল-সুতুনে আছেন। ভোররাত্তিরে তো রোজ চলে যান চেহেল্‌-সুতুনে, আজও চলে গেলেন।

আশ্চর্য। সত্যিই আশ্চর্য হয়ে গেল কান্ত। কোথায় গেল মরালী! কোথায়ই বা যেতে পারে? আর গেলে তো তাঞ্জামে করেই যাবে। একলা তো আর রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেতে পারবে না।

মতিঝিল থেকে চকবাজারের রাস্তায় পড়তেই দেখল মহিমাপুরের দিক থেকে একটা তাঞ্জাম আসছে। একী, মরালী শেষরাত্রে মহিমাপুরে কোথায় গিয়েছিল? জগৎশেঠজির বাড়িতে নাকি? তাঞ্জামটা কাছে আসতেই ভাল করে চেয়ে দেখলে কান্ত। ঝালরদার তাঞ্জাম। চারদিক ঢাকা। তাঞ্জামের ভেতরে কে আছে বোঝা যায় না।

হঠাৎ পেছন থেকে একটা হাত গায়ে পড়তেই কান্ত মুখ ফিরিয়ে দেখলে, বশির মিঞা।

 কী রে, তুই? তুই অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলি?

বশির মিঞা সে-কথার উত্তর না দিয়ে বললে–কী দেখছিস? ভেতরে মরিয়ম বিবি!

কান্ত জিজ্ঞেস করলে–তুই কী করে জানলি?

বশির মিঞা বললে–তুই তো বেগমসাহেবাকে একেবারে হাতের মুঠোয় করে ফেলেছিস,কী করে এমন করলি রে?

কান্ত বললে–সে কথা থাক, বেগমসাহেবা মহিমাপুরে কোথায় গিয়েছিল রে?

আবার কোথায়, জগৎশেঠজির কোঠিতে! শালা দুশমনি শুরু হয়েছে, তাই খবর আনতে গিয়েছিল শায়েদ।

কার সঙ্গে কার দুশমনি?

বশির মিঞা বললে–সে তোকে এখন বলব না। তুই তো মরিয়ম বেগমসাহেবার লোক। তোকে আমি মোকরি দিলাম নিজামতে, আর তুই কিনা নবাবের লোক হয়ে গেলি! এখন তুই কিনা আমার সঙ্গে দুশমনি করিস?

আমি তোর সঙ্গে দুশমনি করি? কী বলছিস তুই?

দুশমনি না করলে মরিয়ম বেগমসাহেবা কেন জাসুসি করছে আমাদের ওপর? বেগমসাহেবা কি মনে করেছে আমাদের সঙ্গে পারবে? আমাদের দলে কে কে আছে জানিস?

কে কে?

সবাই আছে, মনসুর আলি মেহের সাহেব, মিরজাফর খাঁ সাহেব, উমিচাঁদসাহেব, হুগলির ফৌজদারসাহেব, জগৎশেঠজি, সবাই আছে। তুই কি আমাদের সঙ্গে দুশমনি করে পারবি ভেবেছিস? তোর মরিয়ম বেগমসাহেবা পারবে?

তাঞ্জামটা ততক্ষণে চেহেল্-সুতুনের দিকে চলে গেছে। কান্ত সেই দিকে চেয়ে দেখেই বললে–আমি যাই ভাই, আমার খুব জরুরি কাজ আছে, তোর সঙ্গে পরে দেখা করব

বলে কান্ত চলে গেল।

বশির মিঞাও আর দাঁড়াল না। শালা কাফেরটা বেইমান! দাঁড়াও, আমিও জানি বেইমানির জবাব কী করে দিতে হয়। বলে সোজা আবার মোহরার মনসুর আলি মেহের সাহেবের হাবেলির দিকে চলতে লাগল।

*

সেরাত্রে সত্যিই মরিয়ম বেগমসাহেবার বড় ভয় হয়েছিল। একেবারে বাঘের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল সে। কোথায় জগৎশেঠজির বাড়ি তাও জানত না। সে বাড়ির ভেতরেও কখনও ঢোকেনি, তবু যেন কোথা থেকে বুক-জোড়া সাহস এসে তার বিচারবুদ্ধি সব একেবারে কানা করে দিয়েছিল।

জগৎশেঠজি ঘরের ভেতরে আসতেই উমিচাঁদ জিজ্ঞেস করলে–কে? কে এসেছে জগৎশেঠজি, কে?

ওয়াটস্ সাহেব কী একটা সন্দেহ করেছিল। তাড়াতাড়ি কাগজপত্র সব গুটিয়ে লুকিয়ে ফেলেছিল।

 জিজ্ঞেস করেছিল–হু? হু ইজ ইট? কে এসেছে?

জগৎশেঠ বললেন–চুপ, আস্তে কথা বলুন, মরিয়ম বেগমসাহেবা–

উমিচাঁদ ওয়াটস দু’জনেই চমকে উঠল। বললে–এখানে কী করতে?

জগৎশেঠজি বললেন–না, আপনাদের ভয় পাবার দরকার নেই, চেহেল্‌-সুতুন থেকে মরিয়ম বেগমসাহেবা পালিয়ে এসেছে

পালিয়ে এসেছে মানে?

পালিয়ে এসেছে মানে, আমাকে বলছে ওর হিন্দু স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দিতে।

 উমিচাঁদ বললে–সত্যি?

হ্যাঁ, পিঠের দাগ দেখালে আমাকে। বললে–চেহেল্‌-সুতুনে নাকি লোহার শিক পুড়িয়ে ওর পিঠে সেঁকা দিয়েছে, তাই দেখাচ্ছিল।

আপনি পিঠ দেখলেন? পেশোয়াজ খুলেছিল আপনার সামনে?

জগৎশেঠজি বললেন–খোলেনি, খুলতে যাচ্ছিল, আমি বারণ করলাম। খুব কান্নাকাটি করছে, বলছে, প্রাণ গেলেও আর চেহেল্‌-সুতুনে ফিরে যাবে না–

আপনি কী বললেন?

 আমি ওকে বসিয়ে রেখে আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে এলাম।

 এখনও ও-ঘরে বসে আছে নাকি বেগমসাহেবা?

হ্যাঁ।

জগৎশেঠজি বললেন–কিন্তু আমার মনে হল নবাবের হাত থেকে ছাড়া পেলে উনিও বেঁচে যান। খুব কষ্ট হচ্ছে ওঁর। হাজার হোক হিন্দুর মেয়ে তো! স্বামীর ঘর ছেড়ে কতদিন বাইরে থাকতে পারেন।

তা হলে কী করবেন?

কী করব সেই পরামর্শ করতেই ওকে বসিয়ে রেখে এসেছি এখানে। হাতিয়াগড়ের রাজা একবার আমার কাছে এসেছিলেন তার স্ত্রীর কথা বলতে। যখন সেই সফিউল্লা সাহেবকে খুন করেছিল ছুরি দিয়ে।

উমিচাঁদ বললে–আপনি বিশ্বাস করলেন নাকি বেগমসাহেবার কথা? জানেন, ওই বেগমসাহেবা একবার ক্লাইভসাহেবের দফতরে ঢুকে আমার চিঠি চুরি করেছিল।

জগৎশেঠজি বললেন কিন্তু আমার তো বিশ্বাস হয় না উমিচাঁদজি!নবাবের কাছে থেকে নবাবের হুকুম না মেনে উপায় কী বলুন! আসলে বোধহয় মহিলাটি ভাল

কীসে বুঝলেন?

 জগৎশেঠজি বললেন–খুর কাঁদতে লাগলেন আমার সামনে

মেয়েরা অমন কথায় কথায় কাঁদতে ওস্তাদ, জগৎশেঠজি!

জগৎশেঠজি বললেন কান্নারও রকমফের আছে উমিচাঁদজি! এ-বেগমসাহেবা আমার বাড়িতেই থাকতে এসেছেন যে৷ বলছেন, আর চেহেল্‌-সুতুনে ফিরে যাব না।

আপনি কী বললেন?

আমি বেগমসাহেবাকে কী করে আমার হাবেলিতে রাখি তাই ভাবছি। বেগমসাহেবা আমার এখানে আছেন এ-খবর নবাবের কানে গেলে কি আর রক্ষে থাকবে! আমাদের সব চেষ্টা পণ্ড হয়ে যাবে।

ওয়াটস্ সাহেব বললে–আপনি ওকে ভাগিয়ে দিন জগৎশেঠজি!

 উমিচাঁদ বললো জগৎশেঠজি, ওকে বিশ্বাস করবেন না—

কিন্তু হাতিয়াগড়ের রাজাকে আমি কী বলব? তিনি যদি আবার এসে আমার কাছে দরবার করেন? তখন আমি তাকে কী বলব? কী বলে কৈফিয়ত দেব? তার স্ত্রীকে নিজের আশ্রয়ে পেয়েও তার কোনও উপকার করিনি এ জেনে তো তার কষ্ট হবে। তিনি বড় ভাল লোক যে

কিন্তু এত রাত্তিরে তাকে পাবেন কোথায়?

জগৎশেঠজি বললেন–তাঁকে আজই খবর পাঠাতে হয়!

 খবর পাঠাতে, তার এখানে আসতেও তো দু-তিন দিন সময় লাগবে। ততদিন কোথায় রাখবে বেগমসাহেবাকে?

জগৎশেঠজি বললেন–তাই তো ভাবছি

তারপর ভেবে পরামর্শ করে কিছুই কিনারা পাওয়া গেল না।

জগৎশেঠজি বললেন–আপনারা বসুন, অনেকক্ষণ ওকে বসিয়ে রেখে এসেছি, একবার পাশের ঘরে যাই, ওকে বুঝিয়ে বলি–

কী বলবেন?

আপনারাই বলুন না কী বলব?

উমিচাঁদ বললে–এখন ক্লাইভসাহেবের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা চলছে, এই সময়ে কি বেগমসাহেবাকে নিয়ে এই ঝুঁকির মধ্যে যাওয়া ভাল? নবাব বেশ চুপচাপ আছে, খুঁচিয়ে ঘা করে লাভ কী?

ঠিক আছে আমি আসছি

বলে জগৎশেঠজি আবার দরজা খুলে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

*

উঠোন পেরিয়ে দুর্গা তখন সোজা একেবারে ক্লাইভ সাহেবের দফতরে গিয়ে হাজির। কিন্তু অবাক কাণ্ড! সাহেব কোথায়? এই তো হরিচরণ বললে–সাহেব নিজের দফতরে কার সঙ্গে গল্প করছে। কিন্তু দফতর ফাঁকা!

হরিচরণ, ও হরিচরণ, কোথায় গো, তোমার সাহেব কোথায়?

হরিচরণও দৌড়োতে দৌড়োতে কাছে এল। বললে–সাহেব নেই?

না, তোমার সাহেবের দফতর তো ফাঁকা। তুমি বললে–দু’জন লোক এসেছে, সাহেবের সঙ্গে কথা বলছে, কই, কেউ তো নেই ঘরে হরি

হরিচরণও জানত না সাহেব কখন বেরিয়ে গেছে। সত্যিই সাহেব বেরিয়ে গেছে কিনা দেখতে গেল দফতরের দিকে। হরিচরণও গিয়ে দেখলে সত্যিই সাহেবের ঘর ফাঁকা। সাহেব কখন বেরিয়ে গেছে তাকে বলেও যায়নি। হরিচরণও অবাক হয়ে গেল। কোথায় গেল সাহেব তা হলে? এমন তো হয় না। এমন তো না বলে সাহেব কখনও চলে যায় না।

দুর্গা এবার খেপে উঠল সাহেবের ওপর। হাতের কাছে সাহেবকে না পেয়ে যত তার রাগ হরিচরণের ওপর গিয়ে পড়ল। যেন সাহেব তাদের কোনও উপকারই করেনি। এতদিন সাহেব যে তাদের জন্যে নিজেদের দলের সাহেবদের সঙ্গে ঝগড়া করেছে, তাদের জন্যে এত টাকা খরচ করে বসিয়ে বসিয়ে খাইয়েছে, তাও যেন দুর্গার আর মনে পড়ল না। মুখে যা এল তাই বলে গালাগালি দিতে লাগল।

বললে–হারামজাদা সায়েব কি ভেবেছে আমাদের কিনে রেখে দিয়েছে? তুমি বলতে পারো না যে, আমরা তার কেনা বাঁদি নই?

হরিচরণ বললে–তুমি ওকথা বলছ কেন দিদি? কেউ কি তোমাকে বলেছে তোমরা কেনা বাঁদি?

বলব না? হাজার বার বলব। কেন তোমাদের সায়েব আমাদের এখানে আটকে রাখে শুনি? আমরা কিছু বলিনে বলে? লড়াইফড়াই সব চুকেবুকে গেল, এখনও কেন ছুতো করে আমাদের আটকে রেখেছে এখেনে? আমরা আজই চলে যাব, চলো, এখনই আমাদের নিয়ে চলো–

বলে তরতর করে উঠোন পেরিয়ে একেবারে অন্দরমহলে চলে গেল। ছোট বউরানিও দুর্গার গলার আওয়াজ পেয়ে এদিকে আসছিল।

বললে–কী হল রে দুগ্যা?

 দুর্গা বললে–দেখো না, আমাদের এখেনে আটকে রেখে সাহেব গেল আড্ডা মারতে। চলো, এখুনি আমরা চলে যাব এখান থেকে। আমাদের কি বাড়ি-ঘর-দোর নেই? আমাদের কি আপনার মানুষজন নেই? ওসায়েব ভেবেছে কী?

ছোট বউরানি বললে–কোথায় যাবি? কে নিয়ে যাবে?

যেখানে হোক যাব। জাহান্নমে যাব, চুলোয় যাব। যাবার কি জায়গার অভাব আছে নাকি? ভেবেছে আমি তোমাকে নিয়ে চলে যেতে পারিনে? নাও, কাপড়চোপড় গুছিয়ে নাও। আর এক দণ্ডও এখেনে থাকছিনে।

হরিচরণ পেছন পেছন এসেছিল। বললে–তুমি একটু বুঝিয়ে বলো তো বউরানি। সাহেব ফিরে না এলে কি চলে যাওয়াটা ভাল হবে?

ছোট বউরানি বললে–তা তুমি আমাদের পৌঁছে দাও না গা–আমরা চলে যাই–

হরিচরণ বললে–আমি তো পৌঁছে দিতে পারি, কিন্তু সাহেব ফিরে এসে যদি আমাকে বকাঝকা করে?

বকবে কেন? বকবে কেন শুনি?

 দুর্গা চেঁচিয়ে উঠল। আমরা কি এখানে চেরকাল থাকতে এইচি? আমরা কি তোমার মতো সায়েবের চাকর?

হরিচরণ আর তর্কের মধ্যে গেল না। বললে–তা কোথায় নিয়ে যেতে হবে বলো না, আমি নিয়ে যাচ্ছি; আমি কি বলেছি আমি নিয়ে যাব না? তোমাদের দেখাশোনা করবার জন্যেই তো সাহেব আমাকে রেখেছে। বলো, কোথায় যাবে তোমরা?

দুর্গা চাইলে ছোট বউরানির মুখের দিকে। অর্থাৎ কোন দিকে যাওয়া যায়। কিন্তু কারওই তখন মনস্থির নেই। একদিন কেনগরের দিকে যাত্রা করবে বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল দু’জনে। সেদিন কী তিথি ছিল তা দেখা হয়নি। তখন যে অবস্থা তাতে তিথি-নক্ষত্র দেখবার সময় ছিল না। শুধু কোনওরকম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়াটাই ছিল সমস্যা। তখন কি জানত এই মাসের-পর-মাস আটকে থাকতে হবে পথে! তখন কি জানত এইরকম এক ম্লেচ্ছ সাহেবের সঙ্গে এক বাড়িতে একসঙ্গে রাত কাটাতে হবে!

তখন আড়ালে দুর্গা বলত–মুখে আগুন অমন সায়েবের! নিজের মাগ ছেলে কোথায় পড়ে রইল, এখেনে এসেছে লড়াই করতে! তা লড়াই-ই যদি করবি বাপু তো লড়াই করে নবাবকে খুন করে ফেলতে পারছিসনে? তা হলে তুই কীসের সায়েব শুনি? ও পাষণ্ডটাকে মেরে কবরে পুরতে পারছিসনে?

আবার যখন সাহেবের কথায় মনটা ভিজে যেত তখন আবার খুব মিষ্টি কথা বেরোত দুর্গার মুখে।

আহা গো, সারাদিন ভেবে ভেবে মুখটা শুকিয়ে গেছে বাছার!

দুর্গা বুঝতে পারত সাহেব যেন খুব ভাবনায় পড়েছে। কিন্তু ছোট বউরানির মুখখানার দিকে চাইলেই ছোটমশাইয়ের কথাটা মনে পড়ে যেত। আহা, যে-মানুষ বউরানি বলতে পাগল সেমানুষটা সেখানে কী রকম করে দিন কাটাচ্ছে কে জানে! কত ফুল দিয়ে বউরানির খোঁপা বেঁধে দিত দুর্গা। বিকেলবেলা বউরানির গা ধুইয়ে দিয়ে পায়ে আলতা পরিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখত। একদিন খোঁপা বাঁধা খারাপ হলে ছোটমশাই আবার রাগ করত। সেই মানুষ কি আর বউরানিকে দূরে পাঠিয়ে দিয়ে শান্তিতে আছে। তারও প্রাণটা সেখানে ধড়ফড় করছে। এখানে এই পেরিন সাহেবের বাগানে ছোট বউরানি রাত্রে শুয়ে শুয়ে কাঁদে। বলে–আমার গলাটা টিপে আমাকে তুই মেরে ফ্যাল দুগ্যা, আমি মরে যাই, আমার আর বেঁচে থাকতে ভাল লাগছে না।

কতদিন পাশের বাদাম গাছটা থেকে বাদুড় ডাকার শব্দে বউরানি ভয় পেয়ে চিৎকার করে ডেকেছে–দুগ্যা, দুগ্যা

দুর্গা বলেছে–কী বউরানি?

বউরানি বলত–কে যেন কেঁদে উঠল না রে?

অথচ এখান থেকে বেরিয়ে গেলেই যে একেবারে শান্তি, তারও তো কোনও ঠিক নেই। আবার ভাসতে ভাসতে কোথায় গিয়ে কার ডেরাতে ঠেকবে কে বলতে পারে! ৪৯৮

হরিচরণ বলছিল–তা বেশ তো, কেষ্টনগরে যদি যেতে চাও তো সেখানেই তোমাদের পৌঁছিয়ে দিচ্ছি–

তখন বিকেল হয়ে গেছে। ছোট বউরানি লম্বা একটা ঘোমটা দিয়ে নৌকোয় গিয়ে উঠল। সাহেব নেই, না-থাক। সাহেবকে বলে গেলে হয়তো যেতেই দিত না। হয়তো আরও কিছুদিন ঠেকিয়ে রাখত। নানা ছলছুতো করে আটকে রাখত তাদের। কিন্তু লড়াই যদি কোনওদিন না থামে তো চিরকাল কি তোমার বাড়িতে পড়ে থাকব নাকি?

কাপড়ের একটা পোঁটলা ছাড়া আর তো কিছু নেই সঙ্গে। সেই পোঁটলাটাই নৌকোর ভেতরে উঠিয়ে রাখলে হরিচরণ।

সাহেব কিন্তু এসে রাগ করবে খুৰ দিদি!

দুর্গা বললে–রাগ করুক গে। সায়েব কি আমার একেবারে সাতপুরুষের ভাতার, রাগ করলে আমার একেবারে সব্বনাশ হয়ে যাবে।

ছোট বউরানি বললে–তা সায়েব তোমার গেলই বা কোথায় হরিচরণ? আমাদের তো বলে যেতে হয়!

হরিচরণ তখন নৌকোর গলুইতে উঠে বসেছে। বললে–সায়েবের কি মাথার ঠিক আছে বউরানি, এই তো সবে ফরাসডাঙা থেকে ফরাসিদের তাড়িয়ে দিয়ে এল, এরই মধ্যে আবার বোধহয় কাজ পড়েছে

কাজ পড়েছে না ছাই! কাদের সঙ্গে গপ্পো করতে বেরিয়েছে। কারা এসেছিল, জানো তুমি?

হরিচরণ বললে–কত কাজের লোক আসে সাহেবের কাছে, আমি.কি সকলকে চিনি দিদি?

ততক্ষণে গঙ্গার স্রোতে নৌকোয় টান ধরেছে। তরতর করে ভেসে চলেছে উত্তর দিকে। বরানগরের ঘাট পেরিয়ে যতদূর চাও কেবল গাছপালা আর জঙ্গল। বিকেলের নরম সূর্যের আলোয় জলের ঘোট ছোট ঢেউ সোনার মতো চিকচিক করে উঠছে। পেরিন সাহেবের বাগানটা আর নজরে পড়ে না। বাগানের ছাউনির সেপাইরা যারা টের পেয়েছিল, তারা একবার দূর থেকে চেয়ে দেখছিল। কিন্তু এদিকে তাদের ভাল করে দেখা নিষেধ। কর্নেল সাহেব কাউকেই এদিকে আসতে দিত না। বরানগর পেরিয়ে নৌকো বড়গঙ্গায় পড়ল। বড়গঙ্গার এপার ওপার অনেক দূর।

বউরানি হঠাৎ বললে–মরালীকে খবর দেওয়ার কী করলি রে দুগ্যা?

দুর্গা বললে–তোমাকে আগে কেষ্টনগরের রাজবাড়িতে তুলি, তারপর দেখি কী করতে পারি।

সে কি এখন আর আমাদের চিনতে পারবে রে!

মুখপুড়ি চিনতে না পারলে তার মুখ আরও পুড়িয়ে দেব না! আমি সেদিন না বাঁচালে মুখপুড়ি থাকত কোথায় শুনি! আজ নবাবের সঙ্গে শুয়ে কি একেবারে সাপের পাঁচ পা দেখেছে?

তা হরিচরণকে বললে–হয় না আমাদের খবরটা একবার মরিয়ম বেগমকে দিতে?

 দুর্গা বললে–তুমি থামো বউরানি, শেষকালে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। তার চেয়ে কেষ্টনগরের মহারাজাকে বলে যদি কিছু সুরাহা করতে পারি।

শেষকালে যখন নৌকোটা একেবারে মোহানার মুখোমুখি এসে পড়ল তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। বনজঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে দু-একটা আলো জ্বলতে আরম্ভ করেছে টিমটিম করে। মাঝগঙ্গার ওপর থেকেও বউরানির গা-টা ছমছম করতে লাগল।

হঠাৎ হরিচরণ দরজার কাছে এসে বললে–দিদি, আলোটা নিবিয়ে দিচ্ছি

কেন হরিচরণ, কী হল?

পেছনে কাদের একটা বজরা আসছে!

 বজরা? কাদের বজরা? কারা আসছে?

 হরিচরণ বললে–কী জানি দিদি, মনে হচ্ছে নিজামতের। নিজামতি ঝালরদার বজরা–

সঙ্গে সঙ্গে আলোটা নিবিয়ে দিলে হরিচরণ। আর চারদিকের অন্ধকারটা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। দুর্গা বউরানির আরও কাছে ঘেঁষে এসে দুই হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে রইল।–ভয় পেয়ো না। বউরানি, এই তো আমি রয়েছি। আমি যতক্ষণ আছি, ততক্ষণ কাউকে তোমার গা ছুঁতে দেব না–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *