৩. শান্তি পর্ব

শান্তি পর্ব

এই শেষ। শেষ, কিন্তু শুরুও বটে। ইতিহাসের এক অধ্যায়ের শেষ, আর এক অধ্যায়ের শুরু। মানুষের জন্ম আছে, আবার মৃত্যুও আছে। জন্ম-মৃত্যুর টানাপোড়েনে যেমন এক অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনই শুরু আর শেষের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক অশেষ ইতিহাস। সেই অশেষ ইতিহাসের একটা ভগ্নাংশ নিয়ে উদ্ধব দাস লিখে গিয়েছেন এই বেগম মেরী বিশ্বাস। শেষজীবনে উদ্ধব দাস আর ঘর থেকে বেরোতেন না। চব্বিশ পরগনার কান্তনগরের একটা কুঠিবাড়িতে বসে বসে নিজের মনে এই কাব্য লিখতেন। বেগম মেরী বিশ্বাস ক্লাইভ সাহেবকে বলে এই জমিটার ইজারা দিয়েছিলেন তাকে। হিন্দুস্থানে তখন ফিরিঙ্গি রাজত্ব কায়েম হয়ে গিয়েছে। মিরজাফর সাহেব তখন শুধু আর শুকনো মিরজাফরনয়, সুজা-উল-মুলক হিসাম-উ-দ্দৌলা আলি মহবৎ জঙ খ বাহাদুর। মিরনও তখন সাহাবত জঙ। এমনকী মিরজাফরের ভাই কাজেম খাঁ পর্যন্ত হেবাৎ জঙ বাহাদুর।

আর ক্লাইভ?

কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ যতদিন ইন্ডিয়ায় ছিল, ততদিন শুধু লড়াই-ই করেছে। লড়াই করেছে বাইরের সঙ্গে আর ভেতরের সঙ্গে লড়াই করেছে মুর্শিদাবাদের নবাবদের সঙ্গে আর নিজের অন্তরাত্মার সঙ্গে। নিজের অন্তরাত্মার সঙ্গে লড়াইটাই ছিল তার বড় কঠোর। সেখানে কারও সাহায্য সে পায়নি। রাত্রে যখন ঘুম হত না তখন শুধু এক দাগ ওষুধ খাইয়ে দিতে হত তাকে। সেই বিষের ওষুধ একটু বেশি খেলেই হয়তো চিরকালের মতো সব যন্ত্রণার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যেত। কিন্তু দুর্ভোগের। যে-মেয়াদ তাকে সারাজীবন সহ্য করতে হবে, তার আগে নিষ্কৃতি হবে কী করে?

মনে আছে সেদিনকার সেই দুর্যোগের কথা। দুর্যোগই বই কী। দরবার হবে চেহেলসূতুনের ভেতরে। তার আগেই সব বন্দোবস্ত ঠিক করে নিতে হবে। যেনবাব কয়েদি হয়ে আছে সেই নবাবের চেয়ে যারা নবাবকে কয়েদ করেছে, তারা আরও শয়তান।

রবার্ট ক্লাইভ বলেছিল–এই মিরজাফর, এই মিরন, এদেরও বিশ্বাস নেই–

মেজর কিলপ্যাট্রিক বলেছিল–ওরা বলছিল নাকি ওদের সোলজারদের মাইনে দেওয়া হয়নি। টাকার অভাবে।

তার মানে, যে-টাকা আমাদের দেবে বলে কনট্র্যাক্ট হয়েছে, তা দেবে না?

হয়তো ওই বলে এড়াতে চাইছে নিজেদের কথা।

ক্লাইভ বললে–তা হলে তার আগেই চেহেল্‌-সুতুনের মালখানায় ঢুকতে হবে, আর দেরি করা চলে না

মিরজাফর আলি সাহেব তখন এমনিতেই খুশি, শুধু খুশি নয়, মহাখুশি। সুজা-উল-মুলক হিসাম-উ-দ্দৌলা আলি মহবৎ জঙ খাঁ বাহাদুর। বললে–আমিও সঙ্গে যাব কর্নেল

ক্লাইভ বললে–না

কিন্তু কোথায় মালখানা তা আপনি চিনবেন কী করে কর্নেল? আমি চিনি কোথায় আছে মালখানা।

ক্লাইভ তবু অচল-অটল। বললে–না, আমি নিজেই চিনে নিতে পারব

 মিরজাফর বললে–কিন্তু যদি একবার ভুলভুলাইয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েন?

ভুলভুলাইয়া? হোয়াট ইজ ভুলভুলাইয়া, মুনশি?

মুনশি নবকৃষ্ণ বললে–হুজুর, গোলকধাঁধা।

তাতেও বুঝতে পারলে না ক্লাইভ সাহেব। গোলকধাঁধা মানে কী?

 মুনশি বুঝিয়ে দিলে। নবাব সুজাউদ্দিন এই ভুলভুলাইয়া তৈরি করিয়েছিল বেগমদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলবে বলে। ওখানে একবার ঢুকলে আর বেরোনো মুশকিল। এককালে ওই ভুলভুলাইয়াতে নবাবরা লুকোচুরি খেলত।

তা হলে আপনার সর্দার-খোজাকে সঙ্গে দিন, সে আমাদের রাস্তা দেখাবে!

তা তাই-ই ঠিক হল। আর সবাই বাইরে রইল। ভেতরে ঢুকল কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ, নবকৃষ্ণ মুনশি, খোজা সর্দার পিরালি খাঁ, ওয়াটস্ আর তার একজন মুনশি। মুনশি রামচাঁদ।

যে চেহেল সুতুনে একদিন হাসি আর কান্না, রূপ আর রুপো, যৌবন আর জঙ্ঘা উলঙ্গ হয়ে লীলারঙ্গ চালিয়েছে, সে চেহেল্‌-সুতুন তখন স্তব্ধ। সেদিন তার কোটরে কোটরে যেন শতাব্দির পর থেকে আবার মৃত আত্মারা ফিরে এসে উঁকি দিয়ে দেখছে। এ কে এল? এরা কারা? আমরা বাংলা মুলুকের মাজমুনদের রক্ত তিলতিল করে আহরণ করে এখানে জমা করে রেখেছি। এ আমাদের আজম-ই-খাস। এর শরিকানা আমাদের। এর দাখিল আমরা বাইরের কাউকে দেব না। তোমরা কৌন? কেন এখানে। এলে? দূর হটো, দূর হটো!

ক্লাইভ সাহেব চারদিকে চেয়ে দেখলে। দেখতে দেখতে তাজ্জব হয়ে গেল। এত বিলাস, এত প্রপার্টি, এত ঐশ্বর্য!

সেদিন ক্লাইভ সাহেব সেই চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে ঢুকে যেন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনে হয়েছিল, এ জীবন নয়, এই-ই মৃত্যু। এরই নাম মূর্তিমান মৃত্যু। এই মূর্তিমান মৃত্যুর গহ্বরে দাঁড়িয়েই ক্লাইভ সাহেবের হৃদয়ঙ্গম হয়েছিল যে, এ থাকতে পারে না। মানুষের দেনা-পাওনার হিসেব নেবার দিন যখন এসে গেছে তখন এই চেহেল্‌-সুতুনের অস্তিত্ব থাকা অন্যায়। বহুদিন আগে চকবাজারের খুশবু তেলের দোকানের মালিক সারাফত আলি যা বলেছিল, সেদিন ক্লাইভ সাহেবও সেই কথাই বললে।

চারদিকে অলিন্দের ফোকরে ফোকরে কয়েকটা পায়রা তখন বকবকম শব্দ করে ডেকে উঠছিল। ক’দিন কেউ নেই চেহেলসূতুনে, ক’দিন ধরে রান্না হয়নি বাবুর্চিখানায়, ঝাট পড়েনি দৌলতখানায়, বারবাগে। কদিন ধরে ভিস্তিখানায় জল তোলা হয়নি, ধোবিখানায় কাপড় কাঁচা হয়নি। সমস্ত চেহেল্‌-সুতুনটা যেন হাহাকারে খাঁ খাঁ করছে। বুড়ো সারাফত আলি বেগমদের আরক খাইয়েও যা করতে পারেনি, ক্লাইভ সাহেব সাতসমুদ্র-তেরোনদী পেরিয়ে এসে বিশ্বাসঘাতকতার রসদ জুগিয়ে যেন ন’ঘণ্টার লড়াইতেই তাই-ই করে ফেলেছে।

একে একে সব দেখা হল। খোজা সর্দার পিরালি খাঁ পাকা খিদমদগার। বেগমদের মহলগুলো দেখালে, ভুলভুলাইয়া দেখালে। কোথায় কোন মসজিদে বেগমরা নমাজ পড়ত তাও দেখালে, কোথায় নবাব সুজা-উ-দ্দিন বেগমদের নিয়ে দাবা খেলতেন তাও দেখালে। এক-একটা করে জায়গা দেখায় আর তাজ্জব হয়ে যায় মুনশি রামচাঁদ, মুনশি নবকৃষ্ণ, ওয়াটস্ আর কর্নেল ক্লাইভ।

সেদিন নবাবের খাজাঞ্চিখানায় পাওয়া গিয়েছিল এক কোটি ছিয়াত্তর লাখ রুপোর টাকা, বত্রিশ লাখ সোনার টাকা, দুই সিন্দুক ভরতি সোনার পাত, চার সিন্দুক ভরতি হিরে পান্না মুক্তো এইসব। আর দুটো ছোট সিন্দুক ভরতি শুধু জেবর–শুধু গয়না। বাংলা মুলুকের মাজমুনদের রক্ত নিংড়ে নিংড়ে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ’র আমল থেকে নবাব-নিজামতে যা-কিছু জমেছিল সবকিছুর হিসেব হল সেদিন।

কিন্তু যেটা হিসেব হল না সেটা ছিল নানিবেগমের মালখানায়। সেখানে কেউ ঢুকতে পেল না। বড় দুর্গম সে-জায়গাটা। সেখানে বাতাস বন্ধ, আকাশ সংকীর্ণ, আর অন্ধকার সেখানে বড় সজীব। এখানে কেউ এসো না। যে আসবে সে প্রাণ নিয়ে ফিরবে, কিন্তু পরমায়ু নিয়ে ফিরতে পারবে না।

মুনশি রামচাঁদ ক্লাইভের এক নম্বর মুনশি। কিন্তু মুনশি নবকৃষ্ণ উমিচাঁদ সাহেবের দেওয়া লোক। ক্লাইভ সাহেবের আরও বেশি পেয়ারের লোক।

মুনশির চোখ দুটো প্রথমে সে-অন্ধকার সহ্য করতে পারেনি। মালখানার সিন্দুকগুলো খুলতেই চোখে ধাঁধা লেগে গেল।

খোজা সর্দার পিরালি খাঁ ধরে ফেললে তাই রক্ষে। নইলে পড়েই যাচ্ছিল।

 ক্লাইভও উঁকি মেরে দেখলে হোয়াট ইজ দিস? এগুলো কী?

মুনশি বললে–সোনা হুজুর, গোন্ড! পিয়োর গোন্ড

ক্লাইভ বললে–এত?

মুনশি নবকৃষ্ণ বললে–এত কোথায় হুজুর, এ তো সামান্য

এসব কী করে নেব?

মুনশি রামচাঁদকে সঙ্গে করে আনা উচিত হয়নি। তার চোখ দুটোও যেন গোল হয়ে গেছে। এখানে এত সম্পত্তি আছে, তা আগে জানলে মুনশি নবকৃষ্ণ একনম্বর মুনশিকে আর সঙ্গে করে আনত না। তাকেও ভাগ দিতে হবে।

পিরালি খাঁ হাত দিয়ে সোনার পাতগুলো তুলতে যাচ্ছিল। ভারী জিনিস সব। পিরালি খাঁ নিজেও কখনও এসব দেখেনি। এসবের কল্পনা করতেও শেখেনি। শুধু জেনে এসেছে নবাব মানেই খোদাতালাহ। শুধু জেনে এসেছে নবাববাদশা-বেগমদের কোনওদিন কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না, কেউ তাদের কাছে কোনও জবাবদিহি চাইতে পারবে না। তারা অবাঙমানসোগোচর আল্লা, আমাদের নাগালের বাইরে।

ক্লাইভ বললে–এসব কী করে নেব মুনশি?

রামচাঁদ বললে–ওদের বললেই ওরা সব তোরঙ্গ ভরতি করে পাঠিয়ে দেবে কলকাতায়

না না না, হুজুর!

মুনশি নবকৃষ্ণর মাথায় কূটবুদ্ধিটা খুব খেলে। টপ করে বললে–না না না হুজুর, এসব ওদের দেখালে ওরাও ভাগ চাইবে হুজুর, তার চেয়ে আমরা তিনজনে ভাগ করে নিই–

তা সেই ব্যবস্থাই হল। কেউ জানল না নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার চেহেল্‌-সুতুনের গোপন মালখানায় কত সম্পত্তি ছিল, কেউ দেখতেও পেলে না। যখন বেরিয়ে এল তিনজন তখন বাইরে ওয়াটস্ পঁাড়িয়ে ছিল।

ওয়াটস জিজ্ঞেস করলে–মালখানায় কী ছিল?

মুনশি নবকৃষ্ণ বললে–কিছু ছিল না সাহেব, নবাববেটা সব সরিয়ে ফেলেছে রাতারাতি

কিন্তু বহুদিন পরে এই উদ্ধব দাসই লিখেছে মুনশি নবকৃষ্ণ আর মুনশি রামচাঁদের কথা। মুনশি রামচাঁদ পরে যখন আন্দুল রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠা করে, তখন তার মৃত্যুর সময়ে যে সম্পত্তি রেখে গিয়েছিল তার মধ্যে ছিল নগদে আর কাগজে বাহাত্তর লক্ষ টাকা, হিরে-জহরতে বিশ লাখ, আঠারো লাখ টাকার জমিদারি আর চারশো কলসি, তার মধ্যে আশিটা সোনার আর বাকি সব রুপোর। মোট সওয়া কোটি টাকার সম্পত্তি।

আর মুনশি নবকৃষ্ণ?

মাতৃশ্রাদ্ধে যিনি বারো লাখ টাকা খরচ করেছেন, তাঁর খ্যাতি আজকালকার আমরাও জানি। উদ্ধব দাসের ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’ কাব্য পড়তে পড়তেও তার প্রমাণ পেলাম।

কিন্তু ক্লাইভ সাহেব, যে ছ’টাকা মাইনের রাইটারের চাকরি নিয়ে ইন্ডিয়ায় এসে দেশে ফিরে গেল ইংলন্ডের সবচেয়ে বড়লোক হয়ে, তার কথাও লিখতে বাকি রাখেনি উদ্ধব দাস। দেশে ফিরে গিয়েও পোয়েটকে চিঠি লিখেছে কর্নেল সাহেব। ছ’মাসে একটা চিঠি আসত। বড়লোক সাহেব, কিন্তু ইন্ডিয়ার গরিব পোয়েটকে হয়তো ভুলতে পারেনি। বউ পেগির কথা লিখত, ছেলে-মেয়েদের কথা লিখত। আর লিখত নিজের কথা। দুঃখ করে অনেক কথা লিখত সাহেব। লিখত, ইন্ডিয়ায় যেক’বছর কাটিয়েছে সেই ক’বছরই বড় সুখের সময় গেছে। তার জীবনে কোনও সুখ নেই আর। দেশের লোক তার নামে মামলা করেছে। তার নামে কলঙ্ক রটিয়েছে, তাকে চোর বলে রাজার দরবারে নালিশ করেছে।

একটা চিঠিতে লিখেছিল–তোমার মতো যদি গরিব হতাম পোয়েট, তোমার মতো যদি আনসাকসেসফুল হতাম, তা হলেই হয়তো ভাল হত। কেন আমি বেঙ্গল কনকার করতে গেলাম, কেন আমি সাকসেসফুল হলাম!

আর একটা চিঠিতে লিখেছিল–আবার আমার সেই অসুখটা হয়েছে পোয়েট, আবার বিছানায় গিয়ে ঘুমোলেই সেই লোকটা আসে। সেই সাকসেস। এসে আমাকে তাস দেখায়। সেই কুইন অব স্পেক্স। সেই ইস্কাবনের বিবি। আবার সেই বিষ খেতে হয়। আমি বোধহয় আর বেশিদিন বাঁচব না শোয়েট..

সত্যিই আর বেশিদিন বাঁচেনি সাহেব। পরে তার বউয়ের চিঠিতে সে কাহিনী জানতে পেরেছিল উদ্ধব দাস। একদিন তাস খেলতে বসেছিল সাহেব। অনেকদিন ধরেই ঘুম হচ্ছিল না রাত্রে। ইন্ডিয়াতে যে-লোক ব্রিটিশ এম্পায়ার প্রতিষ্ঠা করলে তারও কিনা ঘুম হত না অশান্তিতে। অর্থের অশান্তি, খ্যাতির অশান্তি, সাকসেসের অশান্তি। সেই অশান্তিই যেন রাত্রে ঘরে ঢুকত।

কে? কে? কে তুমি? সাহেব গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠত ঘুমের মধ্যেই।

 লোকটা বলত–আমি সাকসেস

কিন্তু কী চাই তোমার? কেন আসো আমার কাছে?

এটা চিনতে পারো?

 সেই তাস। সেই ইস্কাবনের বিবি। সেই কুইন অব স্পেডস!

আর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠত সাহেব! তখন পেগি পাশের ঘর থেকে দৌড়ে আসত। এসে সেই ঘুমের ওষুধটা এক দাগ খাইয়ে দিত। সেই বিষ!

একবার ক্লাইভ সাহেবের বউ লিখেছিল–এই মেরী বেগম কে? রবার্ট মেরী বেগমের কথা প্রায়ই বলে। রবার্ট ইন্ডিয়ার যত লোকের সঙ্গে মিশেছে তাদের কারও নাম বিশেষ বলে, কেবল মেরী বেগমের নাম করে, তোমার নাম করে, আর কেবল আর-একজনের নাম করে। তার নাম কান্ত সরকার। কান্ত সরকার কে? হু ইজ হি?

এইরকম কত চিঠি লিখেছে ক্লাইভ সাহেবের বউ। একবার লিখেছিল–রবার্ট বলে, আমি গিয়েছিলাম ইন্ডিয়া কনকার করতে, মেরী বেগম আমাকেই কনকার করে নিয়েছে। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাকে আমি হারিয়েছি, কিন্তু মেরী বেগম আমাকেই হারিয়ে দিয়েছে।

সত্যিই, মেরী বেগম যে এমন করে সবাইকে হারিয়ে দেবে তা কেউ কল্পনা করতে পারেনি। হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ির নগণ্য, নফর শোভারাম বিশ্বাসের নগণ্যতর একটা মেয়ে যে এমন করে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান সব সম্প্রদায়ের লোককে হারিয়ে দেবে তা শেষপর্যন্ত কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি সেদিন। ক্লাইভ সাহেব মাদ্রাজে কাটিয়েছে, বেঙ্গলে কাটিয়েছে, আরও কত জায়গায় কত দেশে কত লোকের সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশেছে, কিন্তু এমন করে কখনও হেরে যায়নি। ক্লাইভ সাহেব নিজে দু’বার আত্মহত্যা করতে গেছে, দু’বারই পারেনি। কিন্তু তা বলে এমন করে মৃত্যু?

মেরী বেগম বলেছিল-মরতে আমি ভয় পাই না সাহেব

ক্লাইভ সাহেব বলেছিল-মরতে আমিও ভয় পাই না। কিন্তু মরতে পারি কই?

মেরী বেগম বলেছিল–মরবার সাহস চাই, সকলের তো সে-সাহস থাকে না

 ক্লাইভ বলেছিল আমার সাহস নেই বলতে চাও?

 খুন করার সাহস তোমার আছে, মরবার সাহস নেই।

ক্লাইভ বলেছিল–আমিই কি তোমার নবাবকে খুন করেছি বলতে চাও?

 তুমি খুন করেছ না তো কে খুন করেছে?

সেকী? আমি কখন খুন করতে গেলাম! সে তো মিরন করেছে। আমি তো তোমাকে কথা দিয়েছিলুম তোমার নবাবকে আমি বাঁচিয়ে দেব। শুধু নবাবকে একলা কেন, তোমার রানিবিবিকেও বাঁচিয়ে দেব, তোমার কান্তকেও বাঁচিয়ে দেব।

সত্যিই কথা দিয়েছিল ক্লাইভ! কিন্তু সেকথা শেষ পর্যন্ত রাখতে পারেনি। রাখতে না-পারার জন্যে দুঃখও ছিল প্রচণ্ড। বলতে গেলে কাউকেই বাঁচাতে পারেনি সাহেব। শেষকালে একদিন ইন্ডিয়া ছেড়ে চিরকালের মতো চলে গিয়েছিল। বহুদিন পরে দেশে ফিরে গিয়েও হয়তো শান্তি পায়নি। তারপর একদিন তাস খেলতে বসেছিল নিজের বাড়িতে। খেলতে খেলতে হঠাৎ একটা তাস পেয়েই সাহেব উঠে দাঁড়াল।

ক্লাইভের স্ত্রী জিজ্ঞেস করলে–কী হল, উঠলে যে? ক্লা

ইভ সেকথার উত্তর না দিয়ে ঘর ছেড়ে পাশের ঘরে চলে গেল।

কী হল? কোথায় যাচ্ছ?

অনেক জন্ম দেখেছে ক্লাইভ, অনেক মৃত্যুও দেখেছে। অনেক উপিন দেখেছে, অনেক পতন। অনেক শুরু দেখেছে, অনেক শেষ। কাজ করেছে সারা জীবন, কাজ করতে করতে গ্রন্থি পড়েছে। আবার সেই গ্রন্থি নিয়ে অনেক কাজ বেড়েছে। সেটা খুলতে ছিঁড়তে অনেক টানাটানি করেছে। তাতে সম্মানের চেয়ে বদনামই হয়েছে বেশি। দেশের লোকই বদনাম দিয়েছে। তাকে জাতিচ্যুত করেছে, চোর বলেছে, গালাগালি দিয়েছে, একঘরে করেছে…

কী হল? কোথায় যাচ্ছ তুমি?

পাশের ঘরে গিয়ে সেদিন বৃদ্ধ ক্লাইভ সে-ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। পেগি ক্লাইভের কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গিয়েছে! কী হল? দরজা বন্ধ করলে কেন?

হঠাৎ..

কিন্তু সে কথা এখন থাক। যে-মানুষ একদিন পৃথিবীর কোনও মানুষের প্রীতি পায়নি, কোনও মানুষের সম্মান পায়নি, কোনও দেশের সুবিচার পায়নি, তার জীবনটা ব্যর্থ হয় হোক, তার জীবনের ব্যর্থতাটাও মিথ্যে হয় হোক, কিন্তু তার জীবনের ব্যর্থতার বেদনাটা অন্তত সত্য হয়ে উঠুক, সেই বেদনার বহ্নিশিখায় বেগম মেরী বিশ্বাস’কাব্যও পবিত্র হয়ে উঠুক। উদ্ধব দাসের লেখার প্রতি ছত্রে সেই বেদনা প্রমূর্ত হয়ে উঠেছে দেখলাম।

কিন্তু না, সেকথা সত্যিই এখন থাক। কারণ তার আগে বেগম মেরী বিশ্বাসের কথা বলতে হবে, মরিয়ম বেগমের কথা বলতে হবে। মেরী বেগমের কথা বলতে হবে। মরালীর কথা বলতে হবে। মরালীর ব্যর্থতার বেদনার কথা না বললে–যে ক্লাইভের ব্যর্থতার বেদনা নিরর্থক হয়ে যাবে!

*

মেরী বেগম।

ওই ওপাশে ছিল একটা গির্জা। যেদিন মরালী এখানে এল সেদিনই চলে গিয়েছিল গির্জায়।

প্রথমে ক্লাইভ আপত্তি করেছিল। বলেছিল–তুমি কেন খ্রিস্টান হতে যাবে?

মরালী বলেছিল–একবার যখন মুসলমান হয়েছি, তখন আর খ্রিস্টান হতেই বা আপত্তি কী?

 যদি কেউ তোমার আপনার লোক আপত্তি করে?

আপনার লোক আমার কে আছে?

এই পোয়েট?

উদ্ধব দাস পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। উদ্ধব দাস সেই মুর্শিদাবাদ থেকেই সাহেবের সঙ্গে আছে। সেই–মনসুরগদিতে যখন তাকে নিয়ে গিয়েছিল, তখন থেকে। কত কাণ্ডই ঘটল তারপর। কত দুর্ঘটনা আর কত দুর্যোগই মাথার ওপর দিয়ে গেল মরালীর হাতিয়াগড় থেকে খবর এল নফর শোভারাম বিশ্বাস মারা গেছে। মরালী খবরটা শুনল। কিন্তু কাদল না।

শুধু বললে–এবার আমি কোথায় যাব?

 তোমার হাজব্যান্ড এই পোয়েট, তারই সঙ্গে যাও

তারপর উদ্ধব দাসের দিকে চেয়ে সাহেব বললে–পোয়েট, তুমি তোমার ওয়াইফকে নেবে? তোমার ওয়াইফ মুসলমান হয়েছে বলে তাকে নিতে তোমার আপত্তি আছে?

উদ্ধব দাস বললে–আমার কোনও বিকার নেই প্রভু, আমার কাছে সবই সমান। হিন্দু খ্রিস্টান মোছলমান ভেদাভেদ নাই।

হঠাৎ মরালী বলে–না, আমার আপত্তি আছে

ক্লাইভ জিজ্ঞেস করলে–তোমার আপত্তি কীসে?

মরালী বললে–আমি নষ্ট

উদ্ধব দাস বললে–মানুষের দেহ নষ্ট হলে মানুষ নষ্ট হয় না গো দেহটা তো খোলস, আত্মায় তো দাগ লাগে না। কী বলেন প্রভু? আত্মার তো লিঙ্গ নাই, মন নাই, অহংকারও নাই, আত্মা তো তোমার নষ্ট হয় নাই!

মরালীর তবু সেই এক কথা। বললেন, না আমি নষ্ট

তখন আর কোনও উপায়ই ছিল না। সাহেব বললে–তা হলে তুমি দমদমেতেই থাকো–

তা তা-ই ঠিক রইল। মরালী বললে–কিন্তু তুমি যে কথা দিয়েছিলে, সকলকে ছাড়িয়ে দেবে! রানিবিবিকে ছাড়িয়ে দেবে, নবাবকে ছাড়িয়ে দেবে, মতিঝিলের সেই মরিয়ম বেগমকেও ছাড়িয়ে এনে দেবে!

ক্লাইভ বললে–আজই চেহেল্‌-সুতুনে দরবার আছে, আজই দরবারে আমি মিরজাফর আলিকে মসনদে বসিয়ে দেব, তারপর নবাবকে ছেড়ে দিতে হুকুম দিয়ে দেব।

আর হাতিয়াগড়ের ছোট রানিবিবি?

তাদেরও খোঁজ নিয়েছি। মিরন সাহেবের বাড়িতে তাদের রাখা হয়েছিল, কিন্তু সেখান থেকে তারা নিরুদ্দেশ। নেয়ামত বলে একজন নবাবের খিদমদগার ছিল, সে তোমার ঘরের দরজা যেমন খুলে দিয়েছিল, হাতিয়াগড়ের রানিবিবির দরজাও তেমনি খুলে দিয়েছিল, নবাবের ঘরের দরজাও তেমনি খুলে দিয়েছিল। এখন সেখানে মহম্মদি বেগ বলে একজন পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু তারপর রানিবিবিদের আর কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছে না–

তুমি তা হলে নবাবকে ছাড়বার হুকুম দিয়ে দাওনা!

দেব, দরবারের পর আমি চেহেল্-সুতুনে ঢুকব। সেখানকার মালখানায় কী আছে দেখি, তারপর নবাবের সম্বন্ধে হুকুম দেব। আমি মিরজাফরকে বলে দিয়েছি যেন আমার পারমিশন না নিয়ে নবারে সম্বন্ধে কিছু না করা হয়।

মরালী বললে–কিন্তু আমি কলকাতায় চলে গেলে কি সব কথা মনে থাকবে?

ক্লাইভ সাহেব বলেছিল–নিশ্চয়ই মনে থাকবে, আমার সব কথা মনে থাকে। সব কথা মনে থাকাটাই তো আমার রোগ। আমি কিছু ভুলতে পারি না।

আর সেই, তার কী হবে?

তুমি সেই মতিঝিলের মরিয়ম বেগমের কথা বলছ তো? হাতিয়াগড়ের সেই ছোটমশাই আমার কাছে এসেছিল। তার এখনও ধারণা মতিঝিলে যে মরিয়ম বেগম কয়েদ হয়ে আছে সে তারই ওয়াইফ। আমি তার সঙ্গে আমার মেজর কিলপ্যাট্রিককে পাঠিয়েছিলাম মতিঝিলে। কিন্তু মরিয়ম বেগম সেখানে নেই–

মরালী চমকে উঠল। বললে–সেকী? কী বলছ তুমি? কোথায় গেল সে?

ক্লাইভ সাহেব বললে–বুঝতে পারছি না। শুনলাম, নানিবেগম, আমিনা বেগম, ময়মানা বেগম, ঘসেটি বেগম, লুৎফুন্নিসা বেগম, তাদের সকলের সঙ্গে মরিয়ম বেগমকেও কোথায় সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে–

কে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে?

বোধহয় মিরন। মিরজাফরের ছেলে।

মরালী বললে–তা মিরনকে তুমি গ্রেফতার করতে পারছ না? তোমার সেপাই রয়েছে, ফৌজ রয়েছে, তোমার কামান রয়েছে, বন্দুক রয়েছে, তাকে তুমি জব্দ করতে পারছ না? তা হলে তুমি কীসের কর্নেল, কীসের ফিরিঙ্গি?

ক্লাইভ হাসল। বললে–আমি খোঁজ নিয়েছি তার, কিন্তু সে পালিয়েছে—

পালিয়েছে মানে? মুর্শিদাবাদ থেকে পালিয়েছে?

 হ্যাঁ।

মুর্শিদাবাদ থেকে পালিয়েছে বলে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা? তা হলে নবাব মির্জা মহম্মদকে খুঁজে পাওয়া গেল কী করে? সে কি আকাশে উড়ে গেল? তোমরা খোঁজ নেবে না সে বেগমদের কোথায় সরিয়ে নিয়ে গেল? তাকে যে আমার খুঁজে পেতেই হবে!

ক্লাইভ বললে–আমি তো তোমাকে কথা দিয়েছি তাকে খুঁজে বার করব–

কবে? কবে খুঁজে বার করবে?

ক্লাইভ বললে–এখনই। এখনই আমি মেজরকে ডেকে পাঠাচ্ছি। তাকে তোমার সামনেই বলব সেই বেগমদের খুঁজে বার করতে। তাকেই বলব তোমাকে নিরাপদে কলকাতায় পাঠিয়ে দিতে।

তাকে খুঁজে না পেলে আমি যাব না। আমি কিছুতেই যাব না এখান থেকে।

ক্লাইভ বুঝিয়ে বললে–তুমি যাও, তোমার ভালর জন্যেই বলছি তুমি যাও এখান থেকে, তুমি এখানে থাকলে বরং তাকে খুঁজে বার করতে অসুবিধে হবে।

কিন্তু তাকে না খুঁজে পেলে আমি যাব না।

ক্লাইভ অবাক হয়ে গেল। বললে–কিন্তু সে তোমার কে?

মরালী বললে–সে?

 বলে হাসল খানিক। পাগলের হাসির মতো সে-হাসিটা শোনাল ক্লাইভের কানে। বললে–সে যে কে তা তোমরা বুঝবে কী করে? তোমার জন্যে কেউ কখনও নিজের প্রাণ দিতে গিয়েছে? কেউ কখনও তোমার জন্যে নিজের ক্ষতি হাসিমুখে সহ্য করেছে?

ক্লাইভ বললে–বলছ কী তুমি?

মরালী বললে–কতটুকু আর বলেছি তার সম্বন্ধে! কতটুকু আর জানো তোমরা! কতটুকুই বা তোমরা বুঝতে পারবে। তোমরা তো কেবল যুদ্ধ করতেই শিখেছ, ভালবাসতে তো শেখোনি।

বলতে বলতে মরালী যেন ভেঙে পড়ল। তারপর সামলে নিয়ে বলতে লাগল–ওগো, তোমরা ফিরিঙ্গি, তোমরা বুঝতে পারবে না তাকে। তোমাদের বোঝাই এমন ক্ষমতা আমার নেই–তুমি তাকে যেমন করে পারো আমার কাছে এনে দাও

কিন্তু তাকে এনে দিলে তুমি কী করবে?

কী করব জানি না। তাকে তুমি যেমন করে পারো নিয়ে এসো।

ক্লাইভ বললে–কিন্তু তাকে তো আর তুমি বিয়ে করতে পারবে না। তুমি তো মুসলমান, আর সে তো হিন্দু তোমাকে কি আর হিন্দুরা ঘরে নেবে?

মরালী বললে–আমার কোনও জাতই নেই আর। আমি হিন্দু ছিলাম, তারপর মুসলমান হলাম, এবার না-হয় খ্রিস্টানই হব–

উদ্ধব দাসের লেখায় পাচ্ছি, এরপর মেজর কিলপ্যাট্রিক মরালীকে সেদিন সেই দুর্যোগের মধ্যে লুকিয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। কেউ জানতে পারেনি, কেউ সন্দেহও করেনি, কেউ প্রশ্নও করেনি। সবাই জেনেছিল ক্লাইভ সাহেব নবাবের হারেম থেকে, নবাবের মালখানা থেকে কিছু দামি জিনিস পেয়েছে, সিন্দুকে ভরতি করে তাই কলকাতায় পাঠাচ্ছে।

সিন্দুকটা গিয়ে উঠল বজরায়।

আর সেই বজরায় গিয়ে উঠল উদ্ধব দাস।

*

এরপর দমদম! দমদম হাউস। মরালী আর উদ্ধব দাস চলে যাবার ক’দিন পরেই ফিরিঙ্গি ফৌজ মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে এসেছিল। কিন্তু যখন চেহেল-সুতুনে দরবার চলেছে, মিরজাফর আলি সাহেব ক্লাইভকে ভেট দিয়ে খোশামোদ করছে, তখন ওদিকে আর-এক কাণ্ড!

নেয়ামত মতিঝিলের পুরনো খিদমদগার। সে একদিন নবাব মির্জা মহম্মদের খেদমত করেছে। তার এ-দৃশ্য দেখে মনে বুঝি খুব কষ্ট হল। এই নবাবেরই নিমক খেয়েছে এতদিন, আবার এই নবাবকেই কয়েদ থাকতে হচ্ছে, এটা তার সহ্য হল না। মিরন সাহেব খুব হুঁশিয়ার করে দিয়ে গিয়েছিল তাকে। ঠিকমতো যেন পাহারা দেয় আসামিদের। পরপর তিনটে কামরা। একটা কামরায় নবাব, আর পাশের কামরা দুটোতে বাদিরা। আরও কষ্ট হয়েছিল তার নবাবের বেগম লুৎফুন্নিসা বিবির দশা দেখে। তাকে জলুসের মাঝপথ থেকেই মিরন সাহেব পাকড়ে নিয়ে গিয়ে মতিঝিলে তুলেছিল। তারপর তাকে কোথায় পাঠিয়ে দিয়েছিল, তার হদিস নেই।

কাছাকাছি যখন কেউ কোথাও নেই, তখন নেয়ামত একটা কামরার চাবি খুললে। ডাকলে বিবিজি

মরালী ভেতরে বসে ভাবছিল কী করবে। হঠাৎ দরজা খুলতে দেখে দরজার কাছে এল।

কে?

নেয়ামত বললে–বিবিজি, আমি নেয়ামত, আপনি বাইরে বেরিয়ে যান, কেউ কোথাও নেই, খিড়কির ফটক খুলে দিয়েছি, পালিয়ে যান

মরালী এরপর আর দ্বিরুক্তি করেনি। সোজা খিড়কি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল।

 এরপর পাশের কামরা। সেকামরার সামনে গিয়েও ওইরকম।

বিবিজি, আমি নেয়ামত, আপনারা বেরিয়ে যান, কেউ কোথাও নেই, খিড়কির ফটক খুলে দিয়েছি, আপনারা পালিয়ে যান–শিগগির–

দুর্গা নেয়ামতকে দরজা খুলতে দেখে চমকে গিয়েছিল। কিন্তু কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। এ আবার কে?

কিন্তু নেয়ামত তখন নিজের কাজ সেরে নিয়ে পাশের কামরায় চলে গেছে।

ছোট বউরানি বললেও কে রে দুগ্যা? কী বলে গেল?

দুর্গা বললে–আর দেরি নয় ছোট বউরানি, চলো খিড়কি দিয়ে পালাই

 কোথায় পালাব রে?

 চলো চলো ছোট বউরানি, আগে এখেন থেকে তো পালাই, তারপরে যে-চুলোয় যাই, তখন দেখা যাবে।

বলে আর পঁড়ায়নি সেখানে। অন্ধকার ঘর থেকে বেরিয়ে একেবারে সোজা খিড়কির দিকে চলে গিয়েছিল। খিড়কির দিক থেকে একেবারে রাস্তা। রাস্তায় তখন লোকে লোকারণ্য। অনেক মানুষের ভিড়। তখন সারা শহরে গোলমাল। সব লোক দরবার দেখবার জন্যে রাস্তায় জড়ো হয়েছিল। অনেকেই দরবারে ঢুকেছে। কিন্তু ঢুকতেও পারেনি অনেকে। ফিরিঙ্গি ফৌজের লোকরা রাস্তায় রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে। তারা নতুন শহরে এসেছে। এ-শহর এখন তাদের। তাদের শরিকানা আছে এ-শহরের সম্পত্তির ওপর।

চেহেলসূতুনের দরবারে তখন মিরজাফর ডাকছে-মরিয়ম বেগম

মরিয়ম বেগম হাজির হচ্ছে না।

মিরজাফর আলি সাহেব আবার একবার চিৎকার করে উঠল–মরিয়ম বেগম।

চুক্তি অনুসারে ক্লাইভ সাহেব পেয়েছে কুড়ি লক্ষ আশি হাজার টাকা। দশ লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা ওয়াটস। পাঁচ লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা মেজর কিলপ্যাট্রিক। পাঁচ লক্ষ টাকা ওয়াল ম্যানিংহাম আর বিচার প্রত্যেকে দু’লক্ষ আশি হাজার টাকা। কাউন্সিলের ছ’জন মেম্বর প্রত্যেকে এক লক্ষ টাকা। টাকার ছড়াছড়ি।

হঠাৎ উমিচাঁদ দাঁড়িয়ে উঠল–আমি? আমার টাকা কই? আমার ভাগ?

ক্লাইভ সাহেব এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। বললে–তোমার কীসের ভাগ উমিচাঁদ?

সেকী সাহেব, আমি যে চুক্তিতে সই করলুম। আমার কুড়ি লাখ টাকা পাবার কথা! তোমাদের সঙ্গে যে আমার রফা হল?

এই তো কনট্রাক্ট, এতে তো তোমার নাম নেই।

উমিচাঁদ কাগজখানার দিকে ভাল করে চেয়ে দেখে চেঁচিয়ে উঠল–কিন্তু সে লাল কাগজখানা কোথায়? আমি তো লাল কাগজে সই করেছি–এটা তো সাদা–এটা জাল জাল–

ক্লাইভের মুখখানা গম্ভীর হয়ে উঠল।

এটা যদি জাল তো আসল কোনটা?

আসলটা তোমরা লুকিয়ে ফেলেছ, ছিঁড়ে ফেলেছ, আমায় তোমরা ফাঁকি দিচ্ছ, আমায় ঠকাচ্ছ—

কিন্তু উমিচাঁদ জানত না যে, সেদিন সাত সমুদ্র-তেরো নদীর পার থেকে যারা এতদূরে এসে এ-দেশের সিংহাসন দখল করতে পারে তারা জাতব্যবসাদার উমিচাঁদের চেয়েও বড় ব্যাবসাদার। ব্যবসায় সততা বলে কিছু থাকতে নেই, থাকলে তা আর ব্যবসা নয়। উমিচাঁদ নিজেও তা ভাল করে জানত। কিন্তু কুড়ি লাখ টাকার লোভে তখন বোধহয় সেকথা ভুলে গিয়েছিল।

মিরজাফর সাহেব থামিয়ে দিলে। বললে–তুমি থামো উমিচাঁদ

সেকী, আমি থামব কেন?

জগৎশেঠ, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সবাই থামতে বললে–উমিচাঁদকে। মুনশি নবকৃষ্ণও উমিচাঁদকে চুপ করতে বললে। কিন্তু উমিচাঁদের তখন শুধু পাগল হতে বাকি। বললে–তুমি বলছ কী ছোকরা, আমি থামব? আমার কুড়ি লাখ টাকা খোয়া গেল, আর আমি চুপ করে থাকব?

*

দুর্গা আর ছোট বউরানি তখন পায়ে পায়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। নতুন জায়গা, জীবনে কখনও মুর্শিদাবাদে আসেনি। রাস্তার মানুষের সামনে কথা বলতেও ভয় হয়। হঠাৎ একটা বাড়ি দেখে মনে হল সেটা যেন হিন্দুর বাড়ি।

সামনের ফটকে ভিখু শেখ দাঁড়িয়ে ছিল। জেনানা দেখে একটু নরম সুরে বললে–কৌন?

দুর্গা জিজ্ঞেস করলে এটা কার বাড়ি গো পাহারাদার? হিন্দুর বাড়ি?

ভিখু শেখ বললে–হ্যাঁ, মহারাজ জগৎশেঠ বাহাদুরকা হাবেলি–

একটু অন্দরে যেতে পারব বাবা? আমরাও হিন্দু

 আর ওদিকে নেয়ামত তখন পাশের কামরার চাবিটা খুলে ডাকলে–জাঁহাপনা

কে?

মির্জা মহম্মদ বুঝি সেই অন্ধকারের মধ্যেই মুখে তুলে চাইলে।

আমি নেয়ামত জাঁহাপনা।

তুমি কেন নেয়ামত? ওরা কোথায় গেল?

 মাঝে মাঝে অন্ধকারও বুঝি কথা কয়। অন্ধকার যদি কথা কইতে পারে তো বুঝতে হবে খোদাতালাহ বলে সত্যিই কেউ আছে। যদি খোদাতালাহ বলে কেউ থাকে তো আমি তার কাছেই আমার আর্জি পেশ করছি আজ। আমি তো কারও কাছ থেকে আর কিছুই চাই না। আমার যা-কিছু ছিল সব তো ওরা কেড়ে নিয়েছে। তবু আমাকে কেন ওরা কয়েদ করে রেখেছে! আমার লুৎফাঁকে ওরা নিয়েছে, আমার মেয়েকে ওরা নিয়েছে, আমার মসনদও ওরা নিয়ে নিয়েছে। ওরা আমার চেহেল্‌-সুতুনে ঢুকে যা-কিছু আমার বলতে ছিল সব কেড়ে নিয়েছে। এবার আমাকে ওরা ছেড়ে দিকনা। আমি আমার জীবনটাকে নিয়ে যে এলোমেলো করে ব্যবহার করেছি তা আমি জানি। আমি যে কারও উপকার করিনি তাও আমি জানি।…কিন্তু…

জাঁহাপনা, আমি নেয়ামত, জাঁহাপনার খিদমদগার

না না নেয়ামত, আমি জানি তুমি নেয়ামত নও। আমি জানি আমি স্বপ্ন দেখছি। আমি জানি অন্ধকার কথা বলে। আমি জানি, আমি আমার মতিঝিলে শুয়ে নেই। আমি জানি, মিরদাউদ, মিরকাশিম আর মিরন আমায় কয়েদ করে রেখেছে। আমি জানি আমি জেগে আছি। আমি জানি আমার কেউ নেই। স্বপ্নে তুমি আমায় দেখা দিয়ো না নেয়ামত। আমাকে আশা দিয়ো না, আনন্দ দিয়ো না, আলো দেখিয়ো না।

এখানে কেউ নেই জাঁহাপনা, আপনি পালিয়ে যান, খিড়কির ফটক খুলে রেখেছি

আবার? আবার তুমি আমাকে অভয় দিচ্ছ? আমি তো বলেছি আমি হেরে গেছি, আমি লাবাগ থেকে পালিয়েছি। আমি তো স্বীকার করে নিয়েছি যে জীবন সত্য নয়, মৃত্যুই একমাত্র খাঁটি সত্য এই পৃথিবীতে। মৃত্যু যখন সত্য, মৃত্যুর আদেশ যখন সত্য, তখন পরাজয়কেই আমি চরম পরাভব বলে মেনে নিয়েছি। আর আমি কখনও বলব না যে, আমি বাঁচতে চাই, বলব না যে আমি মসনদ চাই। আমি তোমাদের সকলের সামনে প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমি কখনও বলব না যে তোমাদের পৃথিবী আমাকে ধারণ করেছে, তোমাদের সূর্য আমাকে জ্যোতি দিয়েছে, তোমাদের বাতাস আমার নিশ্বাস জুগিয়েছে। একথাও আমি কখনও বলব না যে এই মহামনুষ্যলোকে আমি অক্ষয় অধিকার লাভ করে জন্মগ্রহণ করেছি। বলব না যে এই পৃথিবী আমাকে শান্তি দিয়েছে, আরাম দিয়েছে, গৌরব দিয়েছে; শুধু বলব, আমাকে এই বিরাট বিশাল পৃথিবীর এক কোণে শুধু একটুকরো জমি দাও, আমি সেখানে সকলের অগোচরে শুধু একটু মাথা গুঁজে থাকব।

কর্নেল, কর্নেল!

অনেক রাত্রে ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল কর্নেল ক্লাইভের।

কে?

কর্নেল, আমি কিলপ্যাট্রিক! নবাব খুন হয়ে গেছে।

 খুন! মার্ডার! নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা?

ক্লাইভ তড়াক করে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠেছে।

কিন্তু আমি তো অর্ডার দিয়েছিলাম যে নবাবকে যেন কোনও পানিশমেন্ট এখন না দেওয়া হয়। আমি তার বিচার করব। কে মার্ডার করলে?

মহম্মদি বেগ।

সে কে?

কিলপ্যাট্রিক বললে–মিরনের লোক।

মিরন কোথায় এখন?

কিলপ্যাট্রিক বললে–এখনও তার কোনও ট্রেস নেই—

চলো, আমি যাচ্ছি। বলে ক্লাইভ উঠল। তারপর পোশাক পরে নিয়ে ঘরের বাইরে এল।

*

ওদিকে অশেষযাত্রার পথিক তখন নিঃসীম আকাশের দিকে চেয়ে শুধু একমনে প্রার্থনা করে চলেছে মরালী যেন মুর্শিদাবাদ থেকে দূরে চলে যেতে পারে ঠাকুর। দূরে চলে গিয়ে সে যেন শান্তি পায়। যে যেন সুখ পায়, সংসার পায়, স্বামী পায়, সন্তান পায়।

পুব থেকে পশ্চিমে, পশ্চিম থেকে উত্তরে, আবার উত্তর থেকে দক্ষিণে। এমনি মাসের পর মাস চলে গেছে। ছ’টা বজরা একবার জাহাঙ্গিরাবাদে গিয়ে কিছুদিন থামে, তারপর সেখানেই থাকে কিছুদিন। তারপর আবার নিরুদ্দেশ্যত্রা। সার সার বজরাগুলো চলে নদীর ওপর দিয়ে।

মিরন যেন কিছুতেই আর ভরসা পায় না। মেজর কিলপ্যাট্রিকের দল তার পেছনে পেছনে ঘোরে। কলকাতা থেকে কর্নেল ক্লাইভ হুকুম দিয়েছে, যেমন করে থোক মিরনকে ধরে আনা চাই। শুধু মিরন নয়। মিরনের সঙ্গে যে-বেগমরা আছে তাদেরও।

সেদিন হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি এল। বৃষ্টি এলে কান্তর বড় ভাল লাগে। তখন বড় নিবিড় করে নিজেকে নিজের মধ্যে পায়। তখন একমনে বলে মরালী যেন মুর্শিদাবাদ থেকে অনেক দূরে চলে যেতে পারে ঠাকুর। দূরে চলে গিয়ে সে যেন শান্তি পায়। সে যেন সুখ পায়, সংসার পায়, স্বামী পায়, সন্তান পায়

হঠাৎ বজরাটায় যেন একটা দোলা লাগল। পেছন থেকে চিৎকার উঠল–ফিরিঙ্গিরা এসেছে, ফিরিঙ্গিরা এসেছে, জোরসে চালাও জোরসে

.

কিন্তু জোরে চালাতে বললেই নৌকা জোরে চলে না। ভেতরে জোর না থাকলে বাইরে সে দুর্বল হয়ে পড়বেই। নবাব আলিবর্দির সময় থেকেই নবাব-নিজামত ফতুর হয়ে গিয়েছে। যেটক জোর তখনও ছিল তাও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার সময়ে। জোর পাবে কোথা থেকে যে, নৌকো চলবে!

কেউ উৎসব করে ফতুর হয়ে যায়, কেউ ফতুর হয়ে যায় অভাবের চাপে। ১৭৫৭ সালের ২৬ জুলাই নবাব-নিজামত সত্যিই ফতুর হয়ে গিয়েছিল। টাকা নেই কোথাও। ফিরিঙ্গি কোম্পানির রসদ জোগাবার জন্যে আরও টাকা চাই। কিস্তিবন্দি হিসেবে লক্ষ লক্ষ টাকা শোধ করতে হবে কোম্পানির। পরের কিস্তিতে উনিশ লক্ষ টাকা চাই, কোত্থেকে আসবে। হুগলি, কৃষ্ণনগর, বর্ধমান সব জায়গায় চিঠি গেল টাকার জন্যে। রাজকর দাও।

আর এখান থেকে ক্লাইভ কেবল চিঠি লেখে-মরিয়ম বেগমকে আমার চাই—

মিরজাফর সাহেব মসনদে পাকা হয়ে বসে দেখলে, মালখানা নিঃশেষ। তার ওপর ক্লাইভ সাহেবের তাগাদা। জগৎশেঠজিও হাত উপুড় করে না।

মরালী তাগাদা দেয়–কই, খবর পেলে কিছু?

ক্লাইভ বলে–মেজর কিলপ্যাট্রিককে পাঠিয়েছি–আর একটু সবুর করো

খবর যায় মিরনের কাছে। ইতিহাসের তাগিদে যে-লোক ইন্ডিয়ায় এসেছিল সাত সাগর-তেরো নদী অতিক্রম করে, সে অমনি অমনি আসেনি। অমনি অমনি রাজ্যের উত্থানও হয় না, পতনও হয় না। যখন উত্থানের দরকার হয় তখনই একজন আকবর বাদশার আবির্ভাবের প্রয়োজন হয়, কিংবা একজন শিবাজির। আবার যখন পতনের দরকার হয় তখনই একজন রবার্ট ক্লাইভের প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে ওঠে। একজন গড়বার জন্যে উদয় হয়, আর একজন ভাঙবার জন্যে। প্রতিদিনের ইতিহাসেও একবার আলো, একবার অন্ধকার। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠা, আর রাত্রে ঘুমিয়ে পড়া। জোয়ার-ভাটার টানাপোড়েনে ইতিহাস তার নিজের রাস্তা নিজেই করে চলেছে। ইতিহাস বলছে, আমি উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ করি না, ধনী-নির্ধন বিচার করি না, জ্ঞানী-মূর্খ তারতম্য করি না। অনাদিকাল থেকে শুরু হয়েছে আমার যাত্রা। আমার কাছে মহারাজ অশোকও যা, তার রাজ্যের নির্জন কুটিরের নিঃস্ব প্রজাটিও তাই। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই তোমায় যেতে হবে, জায়গা করে দিতে হবে নতুনকে। সে অনেক দূর থেকে আসছে। তোমার গোরুর গাড়ি, তোমার নৌকোর যুগ শেষ হয়ে এসেছে। এবার তাদের দেশ থেকে আসছে স্টিম ইঞ্জিন, কলের জাহাজ, ছাপাখানা। আসছে ধান ভাঙার কল, কাপড় বোনার মিল। আসছে নোট ছাপানোর মেশিন, আসছে গান শোনানোর গ্রামোফোন, আসছে ছবি তোলার ক্যামেরা। এবার ওদের জোয়ার এসেছে, আর তোমাদের ভাটা। ওদের সঙ্গে তোমরা পারবে কেন?

তুমি কাঁদছ? তোমার বাংলা মুলুকের নবাব খুন হল বলে তুমি কাঁদছ? কিন্তু নবাবকে যদি আজ বাঁচিয়ে রাখি তত তোমাদের ভাটার কাল যে কাটবে না। তোমাদের গোরুর গাড়ি আর নৌকোর যুগ যে শেষ হবে না!

কে?

ভাঁটার দেশের নবাব মুখ তুলে চাইলে।

 আমি মহম্মদি বেগ!

আমাকে তুমি খুন করতে এসেছ তো? কিন্তু আমি তো তেমন কোনও অন্যায় করিনি মহম্মদি বেগ। আমি যা কিছু অন্যায় করেছি, অত্যাচার করেছি, তার চেয়ে যে অনেক বেশি অন্যায় করেছে আমার পূর্বপুরুষরা, তারা গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে, বাকি খাজনার দায়ে তাদের নরকযন্ত্রণা দিয়েছে, তাদের তো কেউ খুন করোনি তোমরা?

মহম্মদি বেগের হাতের ধারালো ছোরাটা ঝকঝক চকচক করে উঠল।

আর আমাকে খুন করেই কি তুমি দুনিয়ার অন্যায় বন্ধ করতে পারবে মহম্মদি বেগ! আমাকে খুন করে যাকে আনছ সে কি তোতামাদের ওপর অত্যাচার করবে না ভেবেছ? সে যদি আবার আমার মতো বাংলা মুলুকের প্রজাদের শোষণ করে, তাদের ঘরের বউদের ধরে নিয়ে হারেমে পোরে, যদি ধরে বেঁধে খ্রিস্টান করে, যদি তাদের আঙুল কেটে দেয়, তখন কি তাকেও খুন করতে পারবে তুমি মহম্মদি বেগ?

মহম্মদি বেগরা তো ইতিহাসের খিদমদগার মাত্র। এমনি করেই মহম্মদি বেগদের হাতে বারবার একজন খুন হয়েছে, শুধু আর-একজনের আবির্ভাব সহজ হবে বলে। ভাঁটার পর জোয়ারের টান তীব্র হবে বলে।

ক্লাইভ সাহেব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই দিকে চেয়ে দেখছিল। মিরনের জাফরগঞ্জের হাবেলিতে একটা অন্ধকার ঘরের ভেতরে তখন যেন একটা পরিচ্ছেদ সমাপ্ত হল। সমাপ্ত হল একটা পতনের অধ্যায়। পৃর্ণচ্ছেদ পড়ল একটা জীবনের ওপর।

ক্লাইভ বললে–কিন্তু আমি তো হুকুম দিয়েছিলাম নবাবকে বাঁচিয়ে রাখতে

মিরজাফর সাহেব বললে–আমি কিছু জানতাম না কর্নেল, মিরন এই কাণ্ড করেছে–মহম্মদি বেগকে হুকুম দিয়েছিল নবাবকে খতম করে দিতে!

নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলার গলার কণ্ঠার ওপর একটা গর্ত দিয়ে তখনও গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। রক্তের ধারা গড়াতে গড়াতে চলেছে ঘরের কোণের একটা নর্দমার দিকে। মুখটা হাঁ হয়ে রয়েছে। চোখ দুটো স্থির হয়ে চেয়ে রয়েছে ক্লাইভের দিকে। একটু কাত হয়ে রয়েছে বাঁ দিকে। নবাবকে কুর্নিশ করবার সময় আমির-ওমরাহ যেমন মাথা কাত করত তেমনই ভঙ্গি। যেন ক্লাইভকে কুর্নিশ করছে নবাব। যেন নিঃশব্দে বলছে–সালাম আলেইকুম জনাব! সালাম তোমাকে

অন্ধকার ঘরখানার ভেতরে যেন দম আটকে আসছি ক্লাইভের। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল নতুন নবাব সুজা-উল-মুলক মিরজাফর আলি খাঁ মহবৎ জঙ আলমগির। তার পাশে জগৎশেঠজির দেওয়ানজি রণজিৎ রায়, তার পাশে নবাবের শ্বশুর ইরেজ খাঁ, তার পাশে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, তার পাশে মেহেদি নেসার। মিরদাউদ, মিরকাশিম, ডিহিদার রেজা আলি, আর তার পাশে হাতিয়াগড়ের রাজা ছোটমশাই, মেজর কিলপ্যাট্রিক, বিচার, ওয়াটস্ সবাই। সকলের মুখ যেন মূক হয়ে গেছে ইতিহাসের বিচার দেখে। আর তার পাশে বশির মিঞা।

কোথা থেকে একটা কানামাছি ভোঁ ভোঁ করতে করতে একেবারে নবাব মির্জা মহম্মদের ঘাড়ের ওপর এসে বসল। বসে পাখা নাড়তে লাগল। আর তারপর বলা নেই কওয়া নেই একেবারে ঠোঁটের ওপর। সেই ঠোঁটের ওপর বসেই মাছিটা হাত-পা ছুঁড়তে লাগল একমনে। কারও দিকে হৃক্ষেপ নেই। চারদিকে যে এত বড় বড় আমির-ওমরাহ দাঁড়িয়ে আছে, সেদিকেও খেয়াল নেই।

ক্লাইভের আর সহ্য হল না। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রুমালটা বার করে সেই দিকে দোলাতে লাগল–ভাগো, বি অফ, বি অফ অফ

সবাই মাছিটাকে লক্ষ করেছিল। কারও এমন করে মনে লাগেনি। কারও এমন করে মনে হয়নি যে, বীরের অপমান সমস্ত মানুষের অপমান। বীরকে এমন করে অপমান হতে দিলে মানুষকেই অপমান করা হয়।

মাছিটা উড়ে এসে ক্লাইভের মুখের কাছে বার দুই ভোঁ ভোঁ করলে। সেটাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে ক্লাইভ বললে–একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দাও বডিটা–

বলে মুখ ফিরিয়ে ঘরের বাইরে চলে এল। নতুন নবাব মিরজাফর সাহেবও পেছনে পেছনে এসেছে।

 কর্নেল!

 মুখ ফেরাল ক্লাইভ।

কসুর মাফ করবেন কর্নেল!

কেন? হোয়াই? কী হয়েছে?

আমি জবান দিয়েছিলুম যে, মরিয়ম বেগমসাহেবাকে দরবারে আপনার হাতে নজরানা দেব। কিন্তু আমি কথা রাখতে পারিনি।

ক্লাইভ সেকথায় কোনও কান দিলে না। যেমন চলছিল, তেমনি চলতে লাগল।

 মিরজাফর সাহেব তখনও পেছনে পেছনে আসছে!

নবাব মির্জা মহম্মদকেও আমি খুন করতে হুকুম করিনি কর্নেল। আমার হুকুম ছাড়াই মহম্মদি বেগ খুন করেছে।

তা হলে কার হুকুমে নবাব খুন হল?

ও বলছে, মিরন হুকুম দিয়েছিল।

 কোথায় গেল মিরন?

তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। সে জাহাঙ্গিরাবাদের দিকে গেছে মনে হচ্ছে বেগমদের নিয়ে। আমি তালাশ করতে লোক পাঠিয়েছি।

আর নবাবের সঙ্গে যেসব বাঁদি বেগম কয়েদ ছিল, তারা কোথায় গেল?

নেয়ামত চাবি খুলে দিয়েছিল কামরার, তারা কোথায় পালিয়েছে কেউ জানে না

আচ্ছা, আপনি যান।

মিরজাফর চলে যেতেই মেজর কিলপ্যাট্রিক কাছে এল। ক্লাইভ ললে তুমি এখনই আর্মি নিয়ে চলে যাও কিলপ্যাট্রিক, আমি মিরনকে চাই। আই মাস্ট হ্যাভ হিম। তার সঙ্গে যেসব বেগম আছে, তাদের সকলকেই চাই–মরিয়ম বেগমকেও যেমন করে তোক আমার চাই-হারি আপ

*

কিন্তু ইতিহাসের যিনি দেবতা তিনি আপন খেয়ালেই আপন সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের কাজ চালিয়ে যান। তাই মানুষের ইতিহাস কেবল এই সৃষ্টি স্থিতি আর প্রলয়ের ইতিহাস। যে-হাতিয়াগড় নবাব-নিজামতের খেয়াল-খুশির হাতিয়ার হয়ে একদিন তছনছ হয়ে গিয়েছিল, আবার সেই হাতিয়াগড়ে ছোটমশাই ফিরে এসেছে।

খবরটা আগেই পৌঁছিয়ে গিয়েছিল বড় বউরানির মহলে। ছোটমশাই আবার সেই ঘাটে এসে নামল। নায়েব-গোমস্তা-প্রজা পাইক সবাই হাজির ছিল সেখানে। ছোটমশাই বজরা থেকে নামতেই গোকুল গিয়ে সামনে দাঁড়াল।

ছোটমশাই বললে–পালকি কই, পালকি আনিসনি?

দুর্গা ছোট বউরানিকে বললে–নামো গো, এবার নামতে হবে আমাদের

ছোট বউরানির যেন তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না। এতদিন পরে আবার হাতিয়াগড়ে ফিরতে পেরেছে। তা যেন তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না। তবু যে ভালয় ভালয় আসা গেল তাও বুড়োেশিবের কল্যাণে। হাতিয়াগড়ে পৌঁছিয়েই বুড়োশিবের মন্দিরে গিয়ে পুজো দিতে হবে। অনেক দিনের মানত।

আস্তে আস্তে আলতা-পরা একটি পা বাড়িয়ে দিয়ে যাটে নামল ছোট বউরানি। দুর্গা পেছন পেছন নামল। ছোট বউরানি ঘোমটাটা ভাল করে কপালের উপর টেনে নামিয়ে দিলে। যেন বিয়ের পর নতুন বউ আসছে হাতিয়াগড়ের রাজবাড়িতে। আগে আগে চলতে লাগল ছোটমশাই। গোকুল মাথায় ছাতা ধরে চলেছে পেছনে পেছনে। জগা খাজাঞ্চিমশাই ঠিক তার পাশে।

ছোট বউরানি পালকির ভেতরে উঠতেই দরজা দুটো বন্ধ হয়ে গেল। তারপর চলতে লাগল ছাতিমতলার ঢিবির দিকে। ছাতিমতলার ঢিবি পেরিয়ে রাজবাড়ির অতিথিশালার বড় ফটক।

অতিথিশিলার বড় ফটকে মাধব ঢালি পাহারা দিচ্ছিল লাঠি হাতে করে। ছোটমশাই কাছে যেতেই দুই হাত জোড় করে মাথা নিচু করে পেম করলে।

ছোটমশাই বললে–কী রে, ভাল আছিস?

জগা খাজাঞ্চিমশাই বললে–আজ্ঞে, আপনি ছিলেন না, এতদিন সব খাঁ খাঁ করছিল

ছোটমশাই সেকথায় কান না দিয়ে যেমন চলছিল তেমনি চলতে লাগল। অতিথিশালাটা বাঁয়ে রেখে ডাইনের রাস্তা দিয়ে ভেতরবাড়ি যেতে হয়। ভেতরবাড়ির মুখেই পুকুর। শানবাঁধানো ঘাট। ঘাটের বাঁ দিকেই বুড়োশিবের মন্দির। ছোট বউরানিকে বিয়ে করে আসার পর প্রথমে বুড়োশিবের মন্দিরে প্রণাম করতে হয়েছিল।

ছোটমশাই সেই দিকেই যাচ্ছিল। পালকি থেকে নেমে ছোট বউরানিও সেই দিকে যাচ্ছিল।

 হঠাৎ ওপর থেকে বড় বউরানির গলা শোনা গেল–দুগ্যা

দুর্গা পেছন থেকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বললে–এই যে যাই বড় বউরানি—

গলার আওয়াজ শুনেই ছোটমশাই অবাক হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু বড় বউরানির গলা আবার শোনা গেল ছোটমশাইকে বল, বাড়ির অন্দরে যেন ছোট বউরানিকে নিয়ে না ঢোকে।

সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেছে বড় বউরানির হুকুম শুনে।

ছোটমশাই এগিয়ে যাচ্ছিল। একেবারে সিঁড়ির মুখে ওপর-নীচে মুখোমুখি দেখা। ছোটমশাই বললে–কী বলছ তুমি?

ওপর থেকে তেমনি গম্ভীর গলাতেই বড় বউরানি বললে–হ্যাঁ, ঠিক বলছি–ছোট বউরানিকে এ বাড়িতে আর ঢুকিয়ো না

কিন্তু এবাড়িতে ঢুকবে না তো কোথায় যাবে ও?

বড় বউরানি বললে–তা এ-বাড়ির বাইরে কি আর মাথা গোঁজবার জায়গা নেই কোনও চুলোয়–

মাথা গোঁজবার জায়গা? বড়বউ, তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না–কোথায় থাকবে ছোটবউ? ওর কি বাপের বাড়ি আছে যে, সেখানে যাবে?

বাপের বাড়ি না থাকে তো হাতিয়াগড়ের রাজবাড়িতে বার-বাড়িও তো আছে, সেখানে থাকবে!

পালকি থেকে নেমে বড় বউরানির কথাগুলো কানে যেতেই মাথাটা যেন ঘুরতে লাগল। দুর্গা ছোট বউরানিকে ধরে ফেললে, নইলে হয়তো পড়েই যেত।

বড় বউরানি তখন ওপর থেকে বলছে–ছোটর বালিশ-বিছানা অন্দরমহল থেকে বার-বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছি, আজ থেকে সেখানে শোবে ছোট।

ছোটমশাই ওপর দিকে তেমনি করে মুখে তুলে জিজ্ঞেস করলে–আর আমি?

বড় বউরানি বললে–তোমার যেখানে খুশি সেখানে শোবে! তোমাকে ভেতর বাড়িতে শুতে তো কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি?

বলে আর কথা বাড়াল না বউ বউরানি। পা বাড়িয়ে ভেতরের দিকে চলে গেল। ছোটমশাই আর কিছু উত্তর দিতে পারলে না। সেখানেই পাথরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ।

.

কিন্তু মরালীকে বেশিদিন থাকতে হয়নি দমদম হাউসে! তবু যে ক’দিন ছিল রোজ একবার করে গির্জায় যেত। বিশেষ করে যেত রবিবার দিনটায়। দমদমায় ফিরিঙ্গি পাদরি সাহেব মরালীর নাম দিয়েছিল মেরী। লোকে বলত–মেরী বেগম।

বিরাট ক্যান্টনমেন্ট। তখনও ক্যান্টনমেন্ট পুরো হয়নি। কিন্তু সাহেবের ফৌজের লোকেরা থাকত কাছেই। বিরাট বিরাট হাতি আর ঘোড়ার আস্তাবল। তারপর রাস্তার মোড় ঘুরলেই সাহেবের বাগানবাড়ি। বাগানবাড়িটাও বিরাট। সামনের ফটকে পাহারা দিত ফৌজের লোক। বিনা মঞ্জুরিতে কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিত না।

আর ক্লাইভ? ক্লাইভ সাহেবের তখন অনেক কাজ। অষ্টাদশ শতকের রাজনীতি তখন আরও জটিল হয়ে উঠেছে। মিরজাফর সাহেবের সঙ্গে তখন ঝগড়া বেধে গেছে কোম্পানির। এক-একদিন হঠাৎ ঝড়ের মতো এসে হাজির হয় সাহেব।

সাহেব ঘরে ঢুকেই যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।

 মরালী বলে–কী হল তোমার?

আবার সেই ব্যথাটা বেড়েছে! কাল রাত্তিরে ঘুমোতে পারিনি। আবার সে এসেছিল

কে?

সেই সাকসেস। ঠিক সেইরকম ভাবে ঘরে ঢুকেছিল।

তারপর? সেই ঘুমের ওষুধটা খেলে না কেন?

কে ওষুধ দেবে? কেউ তো কাছে ছিল না।

শেষকালে দেশে চলে গিয়েও রোগটা যায়নি সাহেবের। ইন্ডিয়া জয় করতে এসে ইন্ডিয়াই শেষকালে ক্লাইভ সাহেবকে জয় করে ফেলেছিল। সাহেব শেষজীবনে আফিম খাওয়া শুরু করেছিল। আফিমই তাকে শেষপর্যন্ত গ্রাস করেছিল। চিঠিতে পোয়েটকে লিখেছে, সেই আগেকার মতোই রাত্রিবেলা ঘুমের ঘোরে সেই লোকটা আসে। সেই সাকসেস। কেবল বলে সাকসেস মানেই সাফারিং। সেখান থেকেও মরালীর কথা লিখত সাহেব। দি গ্রেট লেডি। দি গ্রেট লেডি অব বেঙ্গল। সেখানে গিয়েও মরালীকে ভুলতে পারেনি সাহেব। মরালী মারা যাবার অনেক দিন পরেও চিঠি লিখত, কিন্তু একদিন আর চিঠি এল না। চিঠি এল মেমসাহেবের।

মনে আছে তখন ক’দিন খুব ভাবনায় পড়েছিল মরালী। সাহেব একবার আসে, আবার চলে যায়।

 বলে–পূর্ণিয়ায় যাচ্ছি ।

কিন্তু সেদিন আর ছাড়লে মরালী। বললে–বলল, কিছু খবর পেলে কিনা

সাহেব বললে–বলেছি তো, কিলপ্যাট্রিককে পাঠিয়েছি খুঁজতে

কিন্তু একটা মানুষকে খুঁজতে ক’দিন লাগে।

 সাহেব বললে–মিরন যে বড় শয়তান, সে যে-সব বেগমদের নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে, কেউ জানে না কোথায় রেখেছে তাদের

তা হলে তোমরা আছ কী করতে? অতগুলো মেয়েমানুষকে নিয়ে সে তো উড়ে যেতে পারে না, নিশ্চয়ই কোথাও আছে।

ক্লাইভ বললে–জাহাঙ্গিরাবাদে নেই, আজিমাবাদে নেই, পূর্ণিয়ায় নেই, হুগলিতে নেই–সব জায়গায় দেখা হয়েছে

তা হলে আর কোথায় যেতে পারে সে?

আমিও তো তাই ভাবছি।

কিন্তু সেদিন হঠাৎ এসে হাজির হল কান্ত। বাগানবাড়িটার এক কোণে তখন ঘুমিয়ে পড়েছে মেরী বেগম। দূরে, অনেক দূরে বিরাট বটগাছের ডগায় কয়েকটা বাদুড় কিচকিচ করে চিৎকার করছে। ঘণ্টা বাজিয়ে প্রহর গুনছে ক্যান্টনমেন্টের ফৌজি সেপাই। এক দুই তিন। রাত গভীর। বটগাছটার পাতা থেকে ফোঁটা ফোঁটা শিশির পড়ছে টপ টপ করে। আর কান্তসাগরের একটা কুঁড়েঘরের ভেতরে। বসে বসে খাগের কলমে ভুযো কালি দিয়ে উদ্ধব দাস একমনে লিখে চলেছে বেগম মেরী বিশ্বাস। আমি তোমাদের জন্যে রাত জেগে জেগে এই মহাকাব্য লিখে চলেছি। এমনই এক রাতে একদিন হাতিয়াগড়ের অতিথিশালায় গিয়ে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। ঠিক এমনই রাত সেদিন। তখন জীবনকে তাচ্ছিল্য করেছিলাম, মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করেছিলাম, বিবাহকেও অস্বীকার করেছিলাম। কিন্তু তারপর অনেক জীবন, অনেক মৃত্যু, অনেক বিবাহ দেখেছি। অনেক উত্থান, অনেক পতন, অনেক চক্রান্ত। অতিক্রম করেছি। আজ বুঝেছি, মৃত্যু যাঁর ছায়া, অমৃত তারই ছায়া। তাই মৃত্যু আর অমৃত তার কাছে দুই-ই সমান। বুঝেছি, যাঁর কাছে সব দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি তিনিই চরম সত্য। পাপ আর পুণ্য, অর্থ আর পরমার্থ, সম্মান আর অপযশ সমস্তই সেই চরম সত্যের কাছে গিয়ে একাকার হয়ে যায়। তার কাছে গিয়ে সব খণ্ড সত্তার বিচ্ছিন্নতা সম্মিলিত হয়ে ওঠে।

ওমা, তুমি!

হঠাৎ যেন বটগাছের ডালে বাদুড়দের কিচকিচ শব্দ বন্ধ হয়ে গেল।

 তুমি কোত্থেকে এলে? কোথায় ছিলে তুমি এতদিন? ওরা তোমায় কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল?

ওদিকে নিজের কুঁড়েঘরটার ভেতরে প্রদীপের শিখাটা আর একটু বাড়িয়ে দিলে উদ্ধব দাস। এবার শান্তি পর্ব লিখতে বসেছে। ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’ কাব্যের শেষ পর্ব। একটা যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে একটা জীবনের শেষ পর্ব, একটা যুগের অন্তিম পর্ব।

কিন্তু সাহেব যে বললে–মিরন নাকি তোমায় কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল? সেখান থেকে পালিয়ে এলে কী করে?

যদি বলে তিনি প্রেমস্বরূপ, তা হলে মানুষের পৃথিবীতে এত দুঃখ কেন, এত বিচ্ছেদ কেন? কেন বিরোধ এত আঘাত করে? কেন মৃত্যু এত হরণ করে? যদি বলে তিনি মঙ্গলময়, তা হলে মানুষের পৃথিবীতে এত অমঙ্গল কেন? তবে কি এই মন, এই বুদ্ধি, এই অহংকার, এরই জন্যে এত বিরোধ, এত মৃত্যু, এত অমঙ্গল! আমি তো সব ছেড়েছিলুম। সংসারের বন্ধনের মধ্যে আমি তো আবদ্ধ হইনি, স্বার্থের বন্ধনেও তো আমি বাঁধা পড়িনি। কামনা বাসনা-স্বার্থ সবকিছু ত্যাগ করেই তো আমি হরির দাস হয়েছিলুম। কিন্তু কই, মন বুদ্ধি আর অহংকার তো আমি ত্যাগ করতে পারিনি!

দেখো, তুমি এসেছ ভালই হয়েছে, এবার চলো আমরা দুজনে কোথাও চলে যাই, আজ তুমি যেখানে যেতে বলবে, সেখানেই যাব। আজ আমি তোমার কথা রাখব, আজকে আর আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না

লিখতে লিখতে দাঁড়ি বসাল উদ্ধব দাস। অনেক রাত হল। ক্যান্টনমেন্টের ঘণ্টা-ঘড়িতে ঢং ঢং করে চারবার বাজল।

বিছানার এক পাশে উদ্ধব দাসের স্ত্রী শুয়ে ছিল। আলোটা নেবাতেই ঘুম ভেঙে গেছে। বললে–লেখা শেষ হল?

কিন্তু উত্তর দেবার আগেই বাইরে থেকে ডাক এল–দাসমশাই, ও দাসমশাই

এত রাত্রে ফৌজি সেপাইয়ের ডাক কেন হঠাৎ?

উদ্ধব দাস বাইরে এল। সেপাইটা মশাল জ্বেলে নিয়ে এসেছে। ভাল করে ভোর হয়নি তখনও।

কী হল? ডাকো কেন?

আজ্ঞে, মেরী বেগমসাহেবা ডেকেছে আপনাকে।

কেন? এত ভোরে আমাকে কেন? সাহেব এসেছে?

সেপাইটা বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ, কর্নেল সাহেব এসেছে, কিলপ্যাট্রিক সাহেব এসেছে। মরিয়ম বেগমসাহেবা ধরা পড়েছে জাহাঙ্গিরাবাদে, তাকেও এনেছে

আচ্ছা চলো–বলে উদ্ধব দাস গায়ে চাদর জড়িয়ে নিলে।

*

সেদিন কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল। বেশ ছিল সবাই। মুর্শিদাবাদের মসনদে বসে মিরজাফর সাহেব তখন আগ্নেয়গিরির উত্তাপে ছটফট করছে। খাজাঞ্চিখানায় টাকা নেই। মুর্শিদকুলি খাঁ যা-কিছু সম্পত্তি জমিয়ে রেখে গিয়েছিল, নবাব সুজাউদ্দিন খাঁ তা সবই উড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল। তারপর নবাব আলিবর্দি খাঁ সারাজীবন বাদশাহি পেষকস দিতে দিতে আর বর্গিদের হাঙ্গামা মেটাতেই সব খরচ করে ফেলেছিল। শেষ তিন বছর অবশ্য কিছু জমেছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলা সেই জমানো টাকা মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সব খরচ করে গেছে। তারপর এসেছে কর্নেল ক্লাইভ। ক্লাইভ টাকার তাগাদায় অস্থির করে মারে। কেবল বলে–টাকা দাও, আরও টাকা দাও

তারপর মিরজাফর সাহেব দেখলে মসনদ পেয়েছে বটে, কিন্তু মুর্শিদাবাদের মসনদ চালাতে চায় ক্লাইভ। তারপর আছে ঘরের শত্রু বিভীষণ! রাজা দুর্লভরাম লুকিয়ে লুকিয়ে দল পাকায়।

আর মিরন?

তারও দেখা নেই। ক্লাইভ তাকে খুঁজে বার করবার জন্যে হুকুম পাঠায় সেখান থেকে। বেগমদের নিয়ে সে একবার যায় জাহাঙ্গিরাবাদে। সেখানে কিছুদিন লুকিয়ে থাকার পর হঠাৎ খবর আসে ক্লাইভের লোক তার পিছু নিয়েছে। তখন দুটো বজরা আবার আশ্রয় খোঁজে আর একটা ঘাটে। এক ঘাট থেকে আর-এক ঘাটে লুকোচুরি খেলে বেড়ায় নবাব-নিজামত!

সেদিন আর ঠেকানো গেল না। পদ্মর মাঝখান দিয়ে চলেছে ছ’খানা বজরা। হঠাৎ মনে হল যেন পেছন পেছন ফিরিঙ্গি ফৌজ আসছে!

মিরন চিৎকার করে উঠল–চালাও, জোরসে চালাও

দুটো বজরা তিরের বেগে ছুটে চলতে লাগল জলের স্রোতে। সামনে অন্ধকার, পেছনে অন্ধকার। অন্ধকারের সমুদ্রে জোয়ারের টান পড়ল হঠাৎ। আকাশ বাতাস উন্মাদ হয়ে উঠল। পেছনে বজরার দাড়ের শব্দ কানে আসছে।

চালাও, চালাও, জোরসে চালাও।

ফিরিঙ্গি ফৌজ ভেবেছে কী? লঙ্কাবাগের লড়াইতে জিতেছে বলে কি মুর্শিদাবাদের মসনদ তার দখলে চলে গিয়েছে? মসনদ তো মিরজাফর আলি মহবৎ জঙ আলমগিরের। তাতে তুমি শরিকানা ফলাতে আসো কেন? আমি বেগমদের নিয়ে যেখানে খুশি রাখব, যা খুশি করব, আমার ইচ্ছে হলে আমি তাদের খুন করে ফেলব।

দূর থেকে কিলপ্যাট্রিক সাহেবের গলার আওয়াজ এল-হল্ট-হল্ট

মিরন আবার চিৎকার করে উঠল জোরসে চালাও জোরসে

কিন্তু জোরে চালাতে বললেই নৌকো জোরে চলে না। ভেতরের জোর না থাকলে বাইরে সে দুর্বল হয়ে পড়বেই। নবাব আলিবর্দির সময় থেকেইনবাব নিজামত ফতুর হয়ে গিয়েছিল। যেটুকু জোর তার তখনও ছিল তাও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার সময়ে। আজ সেনবাব নেই, আজ সেইনবাব নিজামত আরও দুর্বল। আজ প্রাণপণে বইঠা ঠেললেও নৌকো চলবে না। আজ সমুদ্রের ওপার থেকে আর এক ফৌজ এসেছে। তাদের তেজ আরও বেশি, তাদের জোর আরও তীব্র, তাদের বিক্রম আরও ভয়ংকর। তারা অনেক দূর থেকে আসছে। তোমার গোরুর গাড়ি, তোমার নৌকোর যুগ শেষ হয়ে এসেছে। এবার তাদের দেশ থেকে আসছে স্টিম ইঞ্জিন,কলের জাহাজ, ছাপাখানা। আসছে ধান ভাঙার কল, কাপড় বোনার মিল। আসছে নোট ছাপানোর মেশিন, আসছে গান শোনানোর গ্রামোফোন, আসছে ছবি তোলার ক্যামেরা। এবার ওদের জোয়ার এসেছে, আর তোমাদের ভাঁটা। ওদের সঙ্গে তোমরা পারবে কেন?

তুমি কাঁদছনাকি? তোমার বাংলা মুলুকের নবাব খুন হল বলে তুমি কাঁদছ? কিন্তু নবাবকে যদি আজ বাঁচিয়ে রাখি তো তোমাদের ভাটার কাল যে আর কাটবে না। তোমাদের গোরুর গাড়ি আর নৌকোর যুগ যে শেষ হবে না কোনওকালে।

কিন্তু তখন আর কাঁদলে কী হবে। যা হবার তা তো হয়ে গেছে। তখন সেই সিরাজ-উ-দ্দৌলার মৃতদেহটাই একটা হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হচ্ছে। একবার মহিমাপুর, একবার চকবাজার, একবার মনসুরগঞ্জ, একবার জাফরগঞ্জ, আর সকলের শেষে এসে থেমে গেল চেহেল্‌-সুতুনের সামনে।

তোমরা দেখো তোমাদের মরা নবাবকে, আর কাদো। চোখ মুছতে মুছতে তোমরা ভাববা যে মুর্শিদাবাদের নবাবের এই শাস্তি কেন হল। যেনবাবকে কুর্নিশ না করলে একদিন তোমাদের গর্দান যেত, আজ ইচ্ছে করলে তার মুখে থুতুও ফেলতে পারো। কেউ গর্দান নেবে না, কেউ বাধা দেবে না, কেউ বারণও করবে না। খোদা হাফিজ!

*

শেষ সময়ে বেগমদের বড় কষ্ট হয়েছিল। নানিবেগম জীবনে কখনও এমন করে টানাপোড়েনের হাতিয়ার হননি। আমিনা বেগম, ঘসেটি বেগম, ময়মানা বেগম, সবাই নবাব আলিবর্দির আদরে মানুষ হয়েছে। তুমি কোথায় নজর আলি! তোমাকে খুঁজতে আমি চেহেতুন থেকে বেরিয়ে একদিন চকবাজারের রাস্তায় নেমেছিলাম। রাস্তায় নেমে সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানে গিয়ে উঠেছিলাম। তুমি এখন কোথায় নজর আলি?

নানিবেগম বোধহয় একমাত্র বেগম যার মুখে সেদিন কোরানের বাণী উচ্চারিত হয়েছিল। খোদাতালাহ, তোমাকে বরাবর আমি ভয় থেকে রক্ষে করতে বলেছি, বিপদ থেকে রক্ষে করতে বলেছি, মৃত্যু থেকে রক্ষে করতে বলেছি। কিন্তু কখনও তো ব্যর্থতা থেকে রক্ষে করতে বলিনি, জড়তা থেকে রক্ষে করতে বলিনি, তোমার অপ্রকাশ থেকে রক্ষে করতে বলিনি। আজ তার জন্যে তুমি আমায় শাস্তি দাও খোদাতালাহ!

উদ্ধব দাস লিখে গেছে–ছ’টা বেগমকে যখন একসঙ্গে মিরন সেই গভীর রাত্রে পদ্মার জলে ডুবিয়ে দিয়েছিল তখন কারও মাথায় বজ্রাঘাত হয়নি, কোথাও উল্কাপাত হয়নি, একটা তারাও খসে পড়েনি মাটিতে।

কিন্তু একজনের আর্তি বুঝি কেউই শুনতে পায়নি। সে কান্ত। কান্তর আর্জি মিরন শোনেনি, মেজর কিলপ্যাট্রিক শোনেনি, আকাশ বাতাস-অন্তরীক্ষ-ঈশ্বর-খোদা-গড কেউই শুনতে পায়নি। শুধু বোধহয় শুনতে পেয়েছিল মরালী। দমদম ক্যান্টনমেন্টে ক্লাইভ সাহেবের বাগানবাড়িটার একটা ছোট ঘরে শুয়ে ছিল সে। সারাদিন পরে নিজের হাতে এক মুঠো ভাত সেদ্ধ করে কোনওরকমে পেটে দিয়েছে। দূরে, অনেক দূরে বিরাট বটগাছটার ডগায় তখন কয়েকটা বাদুড় কিচকিচ করে চিৎকার করছে। ঘণ্টা বাজিয়ে প্রহর গুণছে ক্যান্টনমেন্টের ফৌজি সেপাই। এক–দুই তিন। রাত গভীর। বটগাছটার পাতা থেকে শিশির পড়ছে টপ টপ করে। আর কান্তসাগরের একটা কুঁড়েঘরের ভেতরে বসে বসে তখনও খাগের কলমে ভুযো কালি দিয়ে উদ্ধব দাস একমনে লিখে চলেছে বেগম মেরী বিশ্বাস। আমি তোমাদের জন্যে রাত জেগে জেগে এই মহাকাব্য লিখে চলেছি। এমনি এক রাতে একদিন হাতিয়াগড়ের অতিথিশালার মধ্যে ঘুমিয়ে ছিলাম। সেও ঠিক এমনই রাত। তখন জীবনকে তাচ্ছিল্য করেছিলাম, মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করেছিলাম, বিবাহকেও অস্বীকার করেছিলাম। কিন্তু তারপর অনেক জন্ম, অনেক মৃত্যু, অনেক বিবাহ দেখেছি। অনেক উত্থান, অনেক পতন, অনেক চক্রান্ত অতিক্রম করেছি। কিন্তু বুঝেছি মৃত্যু যাঁর ছায়া, অমৃতও তারই ছায়া। তাই মৃত্যু আর অমৃত তার কাছে দুই-ই সমান। বুঝেছি যার কাছে সব দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি তিনিই চরম সত্য। পাপ আর পুণ্য, অর্থ আর পরমার্থ, সম্মান আর অপযশ, সমস্তই সেই চরম সত্যের কাছে গিয়ে একাকার হয়ে যায়। তার কাছে সব খণ্ড খণ্ড সত্তার বিচ্ছিন্নতা সম্মিলিত হয়ে ওঠে।

ওমা, তুমি?

কান্তর মুখখানা যেন সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

মরালী ধড়মড় করে উঠে বসল। বললে–তোমার এরকম চেহারা হয়েছে কেন? আমি যে তোমাকে কতদিন থেকে খুঁজছি! সব জায়গায় তোমার খোঁজ করতে সাহেবের লোক গেছে। কোথায় ছিলে তুমি?

মরালীর মনে হল কান্তর চোখ দিয়ে যেন জল গড়িয়ে পড়ছে।

একী, তুমি কাঁদছ? 

মরালী আঁচল দিয়ে কান্তর চোখ দুটো মুছিয়ে দিলে। বললে–এবার আমি তোমার কথা শুনব। জানো, একদিন তুমি আমাকে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বলেছিলে, সেদিন যাইনি। কিন্তু আজ আমি তোমার সঙ্গে চলে যাব। তোমার দেশ বড়চাতরা, সেখানেই চলে যাব দুজনে। লোকে যা-ই বলুক, আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।

কান্তর মুখ দিয়ে এতক্ষণে যেন কথা বেরোল। বললে–জানো, আমার বড় কষ্ট হচ্ছে

কষ্ট? কীসের কষ্ট? এবার তুমি আমার কাছে এসে গেছ, এবার আর তোমার কোনও কষ্ট থাকবে না। এবার আমি তোমার কাছে কাছে থাকব! ওই মিরনটা বড় বদমাইশ লোক, ওরা সবাই বদমাইশ। মেহেদি নেসার, মিরন, মিরদাউদ, মিরকাশিম, রেজা আলি, মিরজাফর, সবাই বদমাইশ। আমি সাহেবকে বলে এবার সবাইকে জব্দ করব। সবাইকে মসনদ থেকে হটাব। ওরা থাকতে কারও শান্তি নেই।

কান্ত চুপকরে শুনছিল। বললে–ওদের কথা থাক এখন, শুধু তোমার কথা বলল, তুমি সুখী হয়েছ

মরালী বললে–না না, ওদের কথা থাকবে কেন? ওরা বেঁচে থাকতে কি আমাদের সুখ হবে?

তারপর একটু থেমে বললে–তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বোসো। তোমাকে খোঁজবার জন্যে আমি সাহেবকে বলে সব জায়গায় লোক পাঠিয়েছিলাম, জাহাঙ্গিরাবাদে, পূর্ণিয়ায়, আজিমাবাদে, হুগলিতে, কোনও জায়গায় খুঁজতে আর বাকি রাখেনি তারা। ভালই হল, তুমি ফিরে এসেছ। এবার চলল, আমার সঙ্গে এবার চলো

কান্ত বললে–কোথায়?

যেখানে তোমার খুশি। কিন্তু এখানে আর নয়, এ-দেশে আর নয়! যেখানে নবাব-আমির-ডিহিদার-মিরবকশি কেউ নেই, এইবার সেই দেশে চলে যাব।

যদি কেউ তোমার নিন্দে করে? যদি কেউ তোমাকে একঘরে করে?

মরালী বললে–এখন আমি কাকে আর পরোয়া করব বলো? আমি যাদের যাদের বাঁচাতে চেয়েছিলাম, তাদের কেউই রক্ষে পায়নি। নবাবকে খুন করে মেরেছে মিরন, হাতিয়াগড়ের ছোট বউরানিকেও তারপর আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কী যে সব হয়ে গেল! যাক, তবু তুমি যে শয়তানদের হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছ, এই-ই আমার ভাগ্য! এখন আমার নিন্দে রটলেই বা কী? আর তা ছাড়া, আমি তো আর এখন হিন্দু নই, এমনকী মুসলমানও নই, এখন আমি এখানকার গির্জায় গিয়ে খ্রিস্টান হয়ে গেছি, এখন কে আমাকে কী বলবে? কার অত সাহস হবে!

কান্ত বললে–তা হলে চলো

 মরালী বললে–চলো—

কোথায় যাবে?

মরালী বললে–যেখানে তোমার খুশি সেখানেই চলো—

বলে উঠে দাঁড়াতেই হঠাৎ বাইরে থেকে ডাক এল–বেগমসাহেবা, বেগমসাহেবা

আর সঙ্গে সঙ্গে মরালীর ঘুম ভেঙে গেছে। কোথায়? কোথায় গেলে তুমি? অন্ধকারের মধ্যে চারদিকে চেয়ে মরালীর চোখ দুটো অস্থির হয়ে উঠল। নেই, কোথাও নেই সে! এতক্ষণ তা হলে স্বপ্ন দেখছিল নাকি?

বাইরে থেকে আবার ডাক এল–বেগমসাহেবা–বেগমসাহেবা

তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বাইরে আসতেই মরালী দেখলে সামনের উঠোনে অনেক মানুষের ভিড়। দূরে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছে ক্লাইভ সাহেব। তার পাশে মেজর কিলপ্যাট্রিক। আর তার পাশে ওয়াট, তার পাশে ম্যানিংহাম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হোমরাচোমরা সাহেবরা সবাই এসেছে। আর সকলের পেছনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে উদ্ধব দাস। কারও মুখে টুঁ শব্দটি নেই।

মরালী সকলের মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে রইল। তোমরা আমাকে ডেকেছ কেন? কী হয়েছে। তোমাদের? তোমরা কথা বলছ না কেন? বলল, কথা বলো!

সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ নজরে পড়ল, কে যেন মাটির ওপর শুয়ে পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল মালীর। এক নিমেষে সামনে এগিয়ে গেল। কে তুমি? তুমি কে? কে? কে?

বলতে বলতে মরালী সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর তার মনে হতে লাগল যেন দূর থেকে একটা অস্ফুট প্রার্থনার বাণী ভেসে আসছে। তুমি তাকে সুখী করো ঈশ্বর। সে যেন মুর্শিদাবাদের পাপ আর পঙ্কিলতা থেকে অনেক দূরে চলে যেতে পারে। অনেক দূরে গিয়ে সে যেন শান্তি পায়। সে যেন সুখ পায়, সংসার পায়, স্বামী পায়, সন্তান পায়–

দূরে বিরাট বটগাছটার ডালে বাদুড়গুলো কিচকিচ শব্দ করতে লাগল। ক্যান্টনমেন্টের ফৌজি সেপাই ঘণ্টা-ঘড়ি পিটিয়ে প্রহর গুনতে লাগল–ঢং ঢং ঢং ঢং..

*

এর অনেক পরের কথা। আমি তখন ইউনিভার্সিটির ছাত্র।

রাস্তায় জসিমউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে একদিন দেখা। তখনও বিশ্ববিখ্যাত কবি হননি জসিম সাহেব। এম-এ ক্লাসে বাংলা পড়ি। আর জসিম সাহেব ইউনিভার্সিটির বাংলা ডির্পাটমেন্টের রিসার্চ স্কলার। কবি হিসেবে সেই সময়েই তিনি বাংলাদেশে সুবিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেনকে বাংলা পুঁথির সন্ধান দেন। কোথাও নকশাকাটা মাটির হাঁড়ি, পুতুল, কাঁথা পেলে এনে দেন দীনেশ সেন মশাইয়ের কাছে। ইউনিভার্সিটি সে পুঁথি ভাল দাম দিয়ে কিনে নেয়।

জসিম সাহেবকে একদিন বললাম একটা ভাল পুঁথির সন্ধান পেয়েছি জসিমসাহেব, আপনি দেখবেন?

কীসের পুঁথি? কী পুঁথি? নাম কী?

আমি বললাম–নাম বেগম মেরী বিশ্বাস।

জসিম সাহেব কৌতূহলী হলেন। অদ্ভুত নাম তো! মুসলমান বটে, খ্রিস্টানও বটে, আবার হিন্দুও বটে! কত বছরের পুরনো?

বললাম-মনে হচ্ছে, শ’দুয়েক বছর আগেকার। পলাশির যুদ্ধের ব্যাপার নিয়ে লেখা! কবির নাম উদ্ধব দাস। প্রায় হাজারখানেক পাতার পুঁথি!

জসিম সাহেব বললেন–জাল নয় তো? আজকাল আবার কাঠকয়লার ধোঁয়া লাগিয়ে পাতাগুলোকে পুরনো করবার কায়দা শিখেছে লোকরা।

বললাম–মনে তো হয়, তা নয়। আপনি পুঁথি এক্সপার্ট, আপনি একবার দেখলেই বুঝতে পারবেন।

কত চাইছে?

বললাম–চাইছে না কিছুই। বেচা-কেনার কথাই ওঠেনি। শুধু একবার আপনাকে দেখতে বলছি, কবে যাবেন বলুন। বেশি দূরে নয়, বাগবাজারের খালের ধারে

জসিম সাহেব সব শুনে বলেছিলেন–ঠিক আছে, যাব একদিন

সেসব কতদিনের কথা। তারপরে কত কাণ্ড হল। যুদ্ধ বাধল। বোমা পড়ল। দুর্ভিক্ষ হল। হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা বাধল। দেশ ভাগাভাগি হল। বলতে গেলে ওলটপালট হয়ে গেল সব। জসিমউদ্দিন সাহেবও পাকিস্তানে চলে গেলেন। এখন হয়তো আর সেসব কথা মনেও নেই তার।

মনে না থাকবারই কথা। কিন্তু আমি ভুলতে পারিনি। বেগম মেরী বিশ্বাসের একবারে শেষ পর্বে অর্থাৎ শান্তি পর্বে যে কাহিনী লিখে গেছেন উদ্ধব দাস, তার বুঝি তুলনা নেই প্রাচীন সাহিত্যের ইতিহাসে।

দিন পনেরো পরেই জসিমউদ্দিন সাহেবকে নিয়ে গেলাম পশুপতিবাবুর বাড়িতে।  

পথে সমস্ত গল্পটা বলতে বলতে চললাম। জসিম সাহেব খুব আগ্রহভরে শুনছিলেন। থামতেই বললেন–তারপর?

আমি তখন বেগম মেরী বিশ্বাসের পাতার মধ্যে যেন অবগাহন করে আছি।

বললাম–কোন পর্যন্ত বলেছি?

জসিম সাহেব বললেন–সেই যে মরিয়ম বেগমকে ধরে আনা হল পদ্মার ওপরে বজরা থেকে মরালী ঝাঁপিয়ে পড়ল…।

বললাম–উদ্ধব দাস এই শান্তি পর্বের মধ্যেই সমস্ত বেগম মেরী বিশ্বাস’ কাব্যের নির্যাসটুকু দিয়ে গেছেন। পুঁথিটা যদি হারিয়ে যায় কিংবা নষ্ট হয়ে যায় তো বাংলাদেশের একটা দিক লুপ্ত হয়ে যাবে চিরকালের মতো। কারণ, পুঁথির পাতা ছাড়া তার কোনও চিহ্ন আর কোথাও নেই। চেহেল্‌-সুতুন নেই। সেই জাফরগঞ্জ নেই, মনসুরগঞ্জ নেই। মিরজাফর, মিরন, মিরকাশিম, মিরদাউদ, মেহেদি নেসার, রেজা আলি কেউ নেই। এমনকী সেদিনকার সেই ক্লাইভসাহেবও নেই। দিল্লির বাদশার কাছ থেকে পাওয়া সেই উপাধি জবরদস্ত-উল-মুলক নাসেরদ্দৌলা সবত জঙ বাহাদুর কর্নেল ক্লাইভও ইতিহাস থেকে উবে গেছে। কোথায় যে তাকে সমাধি দেওয়া হয়েছিল তার চিহ্নমাত্র নেই। ১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর তারিখে তাস খেলতে বসে ক্লাইভ সাহেব কী তাস হাতে পেয়েছিল কে জানে। হয়তো কুইন অব স্পেক্স। ইস্কাবনের বিবি। সেই ইস্কাবনের বিবিটা হাতে নিয়ে পাশের ঘরে উঠে গিয়েছিল।

পেগি ডাকলে–কী হল রবার্ট? উঠে গেলে কেন? কী হল?

রবার্ট তখন পাশের ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আজ তোমরা কেউ আমার নও। আমি তোমাদের জন্যে ইন্ডিয়াতে এম্পায়ার তৈরি করে দিয়েছি। তবু তোমরা আমাকে চোর বলে ডাকাত বলে গুন্ডা বলে অভিহিত করেছ। তোমাদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছ আমাকে। আমাকে গালাগালি দিয়েছ, আমাকে শাস্তি দিয়েছ, আমাকে অসম্মান করেছ…

রবার্ট! রবার্ট!

হঠাৎ ভেতর থেকে একটা পিস্তলের আওয়াজ হল আর সঙ্গে সঙ্গে অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত মজবুত হয়ে গড়ে উঠল দুশো বছরের মতো।

এখন যেখানে ওয়েস্ট ক্যানেল রোড আর ইস্ট ক্যানেল রোড দু’ফাঁক হয়ে দু’দিকে চলে গেছে, তারই মাঝখানকার ভূখণ্ডটুকুর ওপর ছিল সেদিনকার ক্লাইভ সাহেবের জমিদারি। দমদম ক্যান্টনমেন্ট, আর সেই বিরাট দমদম হাউসের বড় বড় গোল গোল থামগুলো আজও ছাদটা মাথায় নিয়ে দু’শ বছর ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পাশ দিয়ে গেছে জোড়া জোড়া লম্বা রেললাইন। রেলে চড়ে যারা যায় তারা কেউ জানে না কেউ চেনে না ওবাড়িটাকে। তারা জানেও না যে একদিন এখানেই এসে হাজির হয়েছিল মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, নবাব মিরজাফর আলি, হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই, জগৎশেঠজি। ওর সামনে ছিল জলাজমি। এখনকার সল্ট লেক ওই দমদমের বাড়ির বারান্দা থেকে দেখা যেত দিগন্ত জুড়ে বিরাজ করছে। এখনও ওখানে সেই বিরাট বটগাছটার পাতা থেকে শিশির পড়ে টপ টপ করে। কান্তসাগর বুঝি এখন আর নেই। তার জায়গায় রেফুইজিদের বাড়ি উঠেছে সার সার। রাত্রে সেখানে এখনও জোনাকি জ্বলে, গাছের ডালে বাদুড়গুলো কিচকিচ করে, মাথার ওপর দিয়ে একটা এরোপ্লেন ঘুরে ঘুরে উড়ে যাবার সময় একটু ধোঁয়া ছেড়ে মেঘের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়।

উদ্ধব দাসের শাস্তি পর্ব থেকেই জানা যায়, সেদিন যখন ভোররাত্রে উদ্ধব দাসকে কান্তসাগরের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আসে ক্লাইভ, তখন মনসুরগঞ্জের একটা কামরার মধ্যেও ডাক এসেছিল নতুন নবাব মিরজাফর সাহেবের, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের ডাক এসেছিল কৃষ্ণনগরে আর হাতিয়াগড়েও ডাক এসেছিল ছোটমশাইয়ের। জগৎশেঠজিকে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকেছিল দেওয়ানজি রণজিৎ রায় মশাই।

কে?

জগৎশেঠজি ঘুম থেকে উঠে পড়লেন। কী খবর?

দেওয়ানজি বললে–কর্নেল ক্লাইভ খুব রেগে গেছে। আবার বোধহয় লড়াই করতে আসবে মুর্শিদাবাদে।

সেকী? কেন, আবার কী হল হঠাৎ? সব তো মিটমাট হয়ে গিয়েছিল।

দেওয়ানজি বললে–না, সেজন্যে নয়, গোলমাল বাধিয়েছে মিরন, সে ধরা পড়েছে

 মিরন ধরা পড়েছে?

ধরা পড়েনি ঠিক, কিন্তু বেগমদের নিয়ে যখন পালাচ্ছিল তখন কিলপ্যাট্রিক সাহেব তাদের তাড়া করে। মিরন তাড়াতাড়ি সবগুলো বেগমকে পদ্মায় ডুবিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে।

তারপর?

তারপর আর কী? আমাকে এখন মনসুরগদিতে ডেকে পাঠিয়েছিল মিরজাফরসাহেব। নবাব বড় ভাবনায় পড়েছে। একে চুক্তির পুরো টাকাটা দিতে পারেনি, তার ওপর এইবারের কিস্তির উনিশ লক্ষ টাকা দিতে হবে, এখন যদি আবার রেগে গিয়ে ক্লাইভসাহেব বেশি টাকা চায়–

জগৎশেঠজি বললেন–আমাকে কী করতে হবে?

নবাব বলছিল, আপনি যদি একবার ক্লাইভসাহেবের দমদমার বাগানবাড়িতে যান

আমি?

কথাটা ভেবে দেখছিলেন জগৎশেঠজি। ফরাসিদের কাছে সাত লক্ষ টাকা হাওলাত দেওয়া আছে জগৎশেঠজির। সে টাকাটা ফিরিঙ্গিদের খুশি রেখে আদায় করতে হবে। তাদের এখন চটানো ভাল নয়। বললেন–ঠিক আছে, তা হলে নবাবকে খবর দাও, আমি যাব

এমনি করে মিরজাফর সাহেব কৃষ্ণনগরেও খবর পাঠিয়েছিল। মহারাজের ঘুম ভাঙিয়ে খবর দিলেন কালীকৃষ্ণ সিংহমশাই। তিনিও তৈরি হয়ে নিলেন ক্লাইভ সাহেবের দমদমার বাগানবাড়িতে আসবার জন্যে।

হাতিয়াগড়ে জগা খাজাঞ্চিমশাইও ঘুম থেকে ডেকে তুললে ছোটমশাইকে। ছোটমশাইও তৈরি হলেন। তার বজরা তৈরি হল নদীর ঘাটে।

সবাই ভেবেছিলেন দমদমাতে গিয়ে কর্নেল সাহেবের রাগ ভাঙাতে হবে। হয়তো আরও টাকা কবুল করতে হবে। ফিরিঙ্গি মানুষ। চশমখোরের মতো। প্রায় দু’শশা নৌকো ভরতি টাকা-পয়সা-গয়না নিয়ে গিয়েছে সিন্দুক বোঝাই করে। তাতেও পেট ভরেনি। চব্বিশ পরগনার জমিদারি পেয়েও খুশি হয়নি। হয়তো আরও কিছু চায় বেটা।

কিন্তু দমদম হাউসের সামনে মাঠে গিয়ে অবাক। সেখানে অনেক ভিড় জমেছে মানুষের। আশেপাশের গাঁ থেকে পিলপিল করে দলে দলে ছেলেবুড়ো-মেয়েরা আসছে ক্যান্টনমেন্টের মাঠে। ফৌজের লোকেরা পঁড়িয়ে আছে চারদিক ঘিরে। মেজর কিলপ্যাট্রিক আছে, ওয়াটস আছে, বিচার, ম্যানিহাম আছে, আর আছে ক্লাইভ সাহেব! আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে মুনশি নবকৃষ্ণ আর রামচাঁদ।

পালকিগুলো কাছে যেতেই জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে গেল। কাকে যেন ঘিরে সবাই বিস্ময়ে শ্রদ্ধায় আতকে নিঝুম হয়ে আছে।

ক্লাইভ সাহেব জগৎশেঠজিকে দেখেই এগিয়ে এল গুড মর্নিং

জগৎশেঠজি জিজ্ঞেস করলেন–কী হচ্ছে এখানে? এত ভিড় কীসের?

ততক্ষণে মিরজাফর, কৃষ্ণচন্দ্র, ছোেটমশাই সবাই এসে পড়েছেন।

তারাও অবাক হয়ে গেছেন। বললেন–ও কে? ওখানে শুয়ে কে?

*

জসিমউদ্দিন সাহেবকে নিয়ে পশুপতিবাবুর বাড়িতে যখন পৌঁছোলাম তখন বেশ সন্ধে হয়ে গেছে। পশুপতিবাবু তখন বাড়িতে নেই। একজন ছেলে দরজা খুলে দিলে। বললে–আপনারা বসুন, বাবা এখনও আপিস থেকে ফেরেননি, তিনি এখুনি এসে পড়বেন।

আমি জসিম সাহেবকে বললাম-এইহচ্ছে পশুপতিবাবুর ছেলে। এঁরা খা-বিশ্বাস। ক্লাইভসাহেব দিল্লির বাদশার কাছ থেকে উদ্ধব দাসের জন্যে খাস-বিশ্বাস উপাধি এনে দিয়েছিল। নিজেরও নতুন উপাধি আনিয়েছিল।

কিন্তু তারপর কী হল?

বললাম–তারপর সে এক অদ্ভুত কাণ্ড। সেই ভোররাত্রে যখন উদ্ধব দাস কান্তসাগর থেকে এসে হাজির হল তখনও বিশ্বাস করেনি যে, এমন কাণ্ড ঘটবে। মেজর কিলপ্যাট্রিক সেদিন যখন পদ্মার ওপর ছ’খানা বজরা আক্রমণ করলে তখন মিরন আর কোনও উপায় না পেয়ে সবগুলো বেগমকে ডুবিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কিলপ্যাট্রিকের ফৌজের দলের লোকেরা অত সহজে ছাড়েনি তাদের। তারাও সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপ দিয়েছিল। যাদের যাদের খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল তারা কেউই বেঁচে ছিল না। শুধু কান্তর চোখের পাতা দুটো বোধহয় একটু নড়ছিল। আর সবাইকে রেখে তারা তাকেই নিয়ে এসেছিল দমদম হাউসে। কিন্তু তারও পরমায়ু তখন বুঝি ফুরিয়ে এসেছে। যেটুকু বাকি ছিল তাও রাস্তাতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। মেজর কিলপ্যাট্রিক সেই প্রাণহীন শরীরটাকেই বয়ে নিয়ে এসেছিল দমদম হাউসের উঠোনে।

ক্লাইভ প্রথমে বলেছিল কবর দিতে।

কিন্তু মরালী বললে–না, শবদাহের ব্যবস্থা করতে হবে

তা সেই ব্যবস্থাই হল শেষপর্যন্ত। কাঠ এল, পুরুতমশাইও এল। চিতা সাজানো হল। একদিন যে-মানুষ চকবাজারের রাস্তায় গণতকারের কাছে হাত দেখিয়ে ভবিষ্যৎ জানতে চেয়েছিল, তার ভবিষ্যৎ দমদম হাউসের উঠোনের ওপর আগুনে পুড়িয়ে ছাই করবা সব ব্যবস্থাই পাকা করা হল। চিতার ওপর শোয়ানো হল কান্তকে। জ্বলন্ত আগুনের শিখায় শব ভস্ম করার হিন্দু রীতি যথাযথ পালন করা হল। ক্লাইভ সাহেব কোনও কিছুর ত্রুটি রাখতে দিলে না। মরালী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে প্রত্যেকটা জিনিসের ব্যবস্থা করে দিলে। ঘি চাই, চাল চাই, ফুল, চন্দন, যা-কিছু প্রয়োজন সব সাহেবকে বলে জোগাড় করালে। তারপর চিতায় আগুন লাগাবার পালা।

হঠাৎ মেরী বেগম বললে–থামুন পুরুতমশাই, আমি আসছি

বলে বাড়ির ভেতর চলে গেল। খানিক পরে যখন ফিরে এল তখন একটা নতুন লালপাড় শাড়ি পরেছে। সিথিতে সিঁদুর দিয়েছে। পায়ে আলতা পরেছে। কপালে টিপ! আস্তে আস্তে সাজানো চিতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে ক্লাইভ সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বললে–কোথায় যাচ্ছ?

মরালী বললে–আমাকে বাধা দিয়ো না

ক্লাইভ সাহেব চমকে উঠেছে। বললে–সেকী, তুমিও চিতায় উঠবে নাকি?

মরালী বললো, হ্যাঁ আমাকে এবার আর তুমি বাধা দিয়ো না।

বলছ কী তুমি? তুমি কি হিন্দু? তুমি যে এখন খ্রিস্টান হয়েছ?

মরালী বললে–না, এবার তুমি আর আমাকে বাধা দিয়ো না। একবার অনেকদিন আগে ও দেরি করে এসেছিল, এবার ও আগে এসেছে, এবার আমাকে আর তুমি দেরি করিয়ে দিয়ো না, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে যেতে দাও, পথ ছাড়ো

সেই অস্পষ্ট ভোরবেলায় নির্জন দমদম হাউসের উঠোনে দাঁড়িয়ে ক্লাইভ সাহেবের বড় ভয় করতে লাগল। মেজর কিলপ্যাট্রিক তখন হতবাক হয়ে গেছে। মেরী বেগম সতী হবে নাকি? হিন্দু মেয়েরা যেমন মৃত স্বামীর চিতায় উঠে পুড়ে মরে, তেমনই করবে নাকি! সঙ্গের ফৌজি সেপাইরাও তখন তাজ্জব হয়ে মেরী বেগমের কাণ্ডকারখানা দেখছে।

সরো তুমি!

ক্লাইভ বললে–না, তোমাকে আমি কিছুতেই পুড়ে মরতে দেব না

মরালী এবার খানিকক্ষণ সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে রইল। তারপর বললে–তুমি আমায় বাধা দেবার কে?

কিন্তু তোমার নিজের স্বামী তো বেঁচে রয়েছে।

কিলপ্যাট্রিক সাহেব তাড়াতাড়ি একজন সেপাইকে পাঠিয়ে দিলে কান্তসাগরে উদ্ধব দাসকে ডেকে পাঠাতে। উদ্ধব দাস এসে সব শুনে চুপ করে রইল।

ক্লাইভ বললে–পোয়েট, তুমি তোমার ওয়াইফকে পুড়ে মরতে বারণ করো। তুমি বারণ করলে শুনতে পারে, আমার কথা শুনছে না–বারণ করো, বারণ করো

উদ্ধব দাস সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে হাসতে লাগল।

কী পোয়েট, তুমি বারণ করবে না? তুমি তোমার ওয়াইফকে চোখের সামনে পুড়ে মরতে দেখবে?

মরালী বললে—আমি এখন কারও বারণ শুনব না, আমাকে ছেড়ে দাও-

-কিন্তু পুড়লে তোমার জ্বালা করবে, তোমার যন্ত্রণা হবে, তখন তুমি বাঁচবার জন্যে ছটফট করবে।

মরালী হাসল-না সাহেব, জ্বালা করবে না

আগুনে পুড়লে জ্বালা করবে না? বলছ কী তুমি?

সাহেব, তুমি তা হলে আমাকে চিনতে পারেনি। তোমার সঙ্গে যে এগারোজন বেগম মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছে, আমি তাদের মতো বেগম নই, আমি তাদের থেকে আলাদা।

আলাদা তা জানি, কিন্তু তা হলেও তোমারও তো প্রাণ আছে, অন্য সকলের মতো তোমারও তো ফিলিং আছে, তোমারও তো হাঙ্গার আছে, কেটে গেলে তোমার বডি দিয়েও রক্ত পড়ে।

মরালী বললে–না, নেই!

তার মানে? আগুনে পুড়লে তোমার জ্বালা করবে না?

না! তুমি পরীক্ষা করে দেখো!

*

হঠাৎ পশুপতিবাবু ঘরে ঢুকলেন। আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেছেন। ভদ্রলোক ছাপোষা মানুষ। অফিস থেকে ফেরবার পথে একেবারে বাজার করে আনছেন। হাতে বাজারের থলি। তাতে কপি, মুলো, পালংশাক, বেগুন উঁকি মারছে।

বললাম–এঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি হচ্ছেন কবি জসিমউদ্দিন, ইউনিভার্সিটির রিসার্চ স্কলার। ওই বেগম মেরী বিশ্বাসের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন–

পশুপতিবাবু বললেন–সে এক মজার ব্যাপার হয়ে গেছে মশাই, আমি বলছি, জামাকাপড় বদলে আমি আসছি। আর আপনাদের চা-ও করতে বলি

বলে ভদ্রলোক ভেতরে চলে গেলেন। আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিরাট পরিবেশে কোথায় বুঝি এক অস্থির উন্মাদনা শুরু হল। মৃত্যুর তীর্থে তর্পণ করতে এসে বুঝি সকলেরই এমনি হয়। মনে হল, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে যেন সেদিনকার সেই অমৃতবাণী শুনতে পেলাম। মনে হল, জীবন নেই, মৃত্যুও নেই। জীবন-মৃত্যু অতিক্রম করে এক অনাদি অনন্ত লোকের অমর অস্তিত্বের সাক্ষাৎ পেলাম। যথার্থ ত্যাগের বেদনাও বুঝি সত্যিকারের মুক্তির আনন্দ। মনে হল, আর একবার আসুক সেই অসহ্য বেদনা, যে-বেদনায় কান্নার অবসান ঘটে। আমরা সহজে সুখী হতে চাই, সহজে ঐশ্বর্যের মালিকানা পেতে চাই, তাই যন্ত্রণায় আমরা ছটফট করি; কিন্তু তেমন করে মন বুদ্ধি অহংকার সবকিছু থেকে মুক্তি না পেলে কেমন করে বলব তোমাকে পেলাম তোমাকে পাওয়ার দাম না দিলে তোমাকে পাওয়া যে আমার ব্যর্থ হয়। তাই সবকিছু থেকে মুক্ত হয়েই আজ তোমার সঙ্গে আমি যুক্ত হব। দয়া করে তুমি আমাকে মুক্ত হবার শক্তি দাও।

ততক্ষণে জগৎশেঠজি, মিরজাফর সাহেব, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, ছোটমশাই সবাই এসে গেছেন। আশেপাশের গ্রামের লোকরাও খবর পেয়ে গেছে। তারাও দলে দলে ভিড় করতে আরম্ভ করেছে।

সত্যিই, পুড়লে তোমার জ্বালা করবে না?

 করবে কি করবে না, পরীক্ষা করেই না-হয় দেখো

কিলপ্যাট্রিক একটা জ্বলন্ত মশাল নিয়ে এল। দাউদাউ করে জ্বলছে মশালের শিখা। মরালী আগুনের শিখার ওপর হাত বাড়িয়ে দিলে। হাতের পাঁচটা আঙুল পড়পড় করে পড়তে লাগল। ঝলসে কালো হয়ে গেল। দুর্গন্ধ বেরোতে লাগল।

তারপর বেঁকে তেবড়ে ত্রিভঙ্গ হয়ে গেল। তবু মরালীর মুখে চোখে এতটুকু বিকার নেই।

এবার তুমি খুশি তো?

ক্লাইভের তখন আর উত্তর দেবার ক্ষমতা নেই। নির্বাক হয়ে চেয়ে আছে মরালীর মুখের দিকে। মরালীর মুখে চোখে তখন যেন অদ্ভুত এক হাসি ফুটে বেরোচ্ছে।

মরালী গিয়ে উঠল চিতার ওপর। কান্তর নিষ্প্রাণ দেহটা কোলের ওপর তুলে নিয়ে বসল। বললে–এবার আগুন জ্বালো

সঙ্গে সঙ্গে আগুন জ্বলে উঠল দাউদাউ করে। আগুন জ্বলে উঠল দমদম হাউসের উঠোনে, আর সমস্ত হিন্দুস্থানে। সে-আগুনের শিখায় দিল্লির বাদশা পুড়ে মরল, মারাঠা, শিখ, দাক্ষিণাত্য সব পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। তা যাক, কিন্তু তার বদলে এল স্টিম ইঞ্জিন, কলের জাহাজ, ধান ভাঙার কল, কাপড় বোনার মেশিন, গান শোনানোর গ্রামোফোন, ছবি তোলার ক্যামেরা।

জগৎশেঠজি, মিরজাফর, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, নবকৃষ্ণ, ছোটমশাই, মুনশি রামচাঁদ, ম্যানিংহাম, ওয়াট, বিচার, সবাই যেন সেই আগুনে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। মিরজাফরের শেষের দিকে কুষ্ঠব্যাধি হয়েছিল, নন্দকুমারের হাতে গঙ্গাজল খেয়েও রোগভোগ থেকে মুক্তি পায়নি। আর মিরন! মিরনের মৃত্যুও বড় মর্মান্তিক। বজ্রাঘাত ঠিক খুঁজে খুঁজে বেছে বেছে তার মাথা লক্ষ করেই পড়বে একথা কে ভাবতে পেরেছিল? আর উমিচাঁদকে অনেকে দেখেছে রাস্তায়। রাস্তায় প্রলাপ বকতে বকতে ঘুরত কেবল। শেষের দিকে কুড়ি লাখ টাকার শোক তার মতো কোটিপতিকেও একেবারে বিকল করে দিয়েছিল। তারপর আর তাকে দেখতে পাওয়া যায়নি।

আর এই যে আজ লালবাজারের চারদিকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান আর আরমানিদের ভিড়, এরা সেই ক্লাইভ সাহেবের নজরানা পাওয়া এগারোজন বেগমেরই উত্তরপুরুষ। বংশানুক্রমিকভাবে এরা এখানেই বাস করছে।

আর হাতিয়াগড়ের ছোট বউরানি? বার-মহলেই কেটে গিয়েছিল তার শেষ জীবনটা। বউ বউরানি শেষ বয়েসে পোষ্যপুত্র নিয়েছিল। তারাই হাতিয়াগড়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছিল। হাতিয়াগড়ের বড়-তরফ। ছোট বউরানির নিজের কোনও সন্তান হয়নি। তিনি পোষ্য নিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলমানের ছোঁয়া খাওয়ার অপরাধে সে-তরফ আজও অন্ত্যজ। হাতিয়াগড়ের রাজবংশের কোনও মর্যাদার অংশীদার তাঁরা হতে পারেননি।

*

হঠাৎ পশুপতিবাবু ঘরে ঢুকলেন। চা-ও এল।

আমি জসিম সাহেবকে বললাম ইনিই সেই উদ্ধব দাসের বংশধর। মেরী বেগম খ্রিস্টান হবার পর নিজের পছন্দ করা পাত্রীর সঙ্গে উদ্ধব দাসের বিয়ে দিয়েছিল। আমি পুঁথি পড়ে সব জানতে পারলাম উনি কিছুই জানতেন না এসব

জসিমউদ্দিন সাহেব বললেন–একবার সেখানা আনুন না, দেখি একটু

পশুপতিবাবু বললেন–সে এক মজার ব্যাপার হয়ে গেছে মশাই, আপনাকে দেখাবার পর আমি দু’-একজনকে কথাটা বলি, তারপর একজন আমেরিকান সাহেব সেদিন এসেহঠাৎ সেটা নিয়ে গেল

নিয়ে গেল মানে? আর দেবে না?

পশুপতিবাবু বললেন না, তিনি যে দেড়শো টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে গেলেন!

 সেকী? একেবারে বিক্রি করে দিলেন? সে-সাহেবের ঠিকানাটা কী?

পশুপতিবাবু বললেন–তাও তো জানি না মশাই, ছাপোষা গেরস্থ মানুষ। নগদ দেড়শো টাকা পেয়ে গেলুম, আমি আর ঠিকানাটা চাইনি–

কী আর করব। সেদিন আর কিছু করবারও ছিল না আমাদের। আমরা খালি হাতেই ব্যর্থ হয়ে চলে এসেছিলাম। কিন্তু যতবার কাহিনীটার কথা মনে পড়ে ততবার দুশো বছর আগেকার সেই কোন এক আশ্চর্য মেরী বেগমের কথা মনে পড়ে অসাড় হয়ে যাই। মনে হয়, এমন একদিন হয়তো আসবে যেদিন আমাদের আজকের এই কুটিল আর জটিল পৃথিবীর মানুষের ভিড়ের মধ্যে একজন মানুষের আবির্ভাব হবে, যে বলতে পারবে আমার মন বুদ্ধি আর অহংকার সবকিছু থেকে মুক্তি না পেলে কেমন করে বলব তোমাকে পেলাম! তোমাকে পাওয়ার দাম না দিলে যে তোমাকে পাওয়া আমার ব্যর্থ হয়। তাই সবকিছু থেকে মুক্ত হয়েই তোমার সঙ্গে আমি যুক্ত হব। দয়া করে তুমি আমাকে মুক্ত হবার শক্তি দাও।

শেষকালে উদ্ধব দাস শেষ শ্লোকে লিখে গেছে–

কোম্পানির রাজ্য হইল, মোগল হইল শেষ।
দমদম-হাউসে’ আইল ইংরেজ নরেশ ॥
কৃষ্ণভজা বৈষ্ণবেরা আতঙ্কেতে মরে।
ব্রাহ্মণ হইয়া হিন্দু যত পইতা ফেলে ডরে ॥
হিন্দু ছিল মুসলিম হইল পরেতে খ্রিস্টান।
এমন দেশেতে বলো থাকে কার মান ॥
কোন দেশেতে ঘর বা তোমার কোন দেশে বা বাড়ি।
 মরিয়ম বেগম বলে আমি অভাগিনী নারী।
 পতি থাকতে পতি নাই মোর অনাথিনী অতি।
মনের মানুষ যেখানে থাক আমি তারই সতী ॥
তার যদি বা মৃত্যু ঘটে আমি কীসে বাঁচি।
তারে কাছে লইয়া আইস থাকি কাছাকাছি।
এতেক কহিয়া সতী উঠিল চিতায়।
পতিপাশে হাস্যমুখে সুখে নিদ্রা যায় ॥
চিতা জ্বলে দাউদাউ জ্বলুক দহন জ্বলা।
তার চিতাতে আমি জ্বলি, অভাগী অবলা ॥
বসুন্ধরায় কহি মাগো তুমি সর্বসার।
 নিবেদন করি তোমায় সতীর হাহাকার
যত ব্যথা পেলাম মাগো বৰ্ষিবারে নারি।
আমার মরণ দিয়া সবার বেদনা নিবারি ॥
নারী হইয়া জন্ম হইল তোমার বুকের পর।
ঘর কইনু বাহির এবে বাহির কইনু ঘর
বেগম মেরী বিশ্বাসের অমৃত কথন।
উদ্ধবচন্দ্র দাস কহে, শোনে সর্বজন ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *