৬. অনু আজও থানায়

অনু আজও থানায় এসেছে। তবে আজ তাকে ফোরকান আলী খবর দিয়ে আনেননি, সে এসেছে নিজে থেকেই। ফোরকান আলী তাকে দেখে অবাক হলেও কিছু বললেন না। অনুই বলল, আমি বাসাটা ছেড়ে দিতে চাই।

বাসা তো এখন ছাড়া যাবে না। একটা ইনভেস্টিগেশন চলছে আর আপনি জানেন, আপনাকে সেখানে দরকার।

সেটা জানি বলেই তো আপনার কাছে অনুমতি নিতে এসেছি।

বাসা ছাড়তে হবে কেন?

এই মুহূর্তে এত বড় বাসা এফোর্ড করার মতো অবস্থা আমার নেই।

কেন আগে তো করতেন?

তখন আমার জব ছিল।

এখন নেই?

না।

নেই কেন?

ছেড়ে দিয়েছি।

কেন ছেড়ে দিয়েছেন? না মানে এই মুহূর্তে জবটা যেহেতু আপনার খুব দরকার, তো অন্য একটা না পেয়েই ছেড়ে দিলেন কেন?

পার্সোনাল কিছু প্রবলেম ছিল।

কী প্রবলেম?

অনু জবাব দিলো না। চুপ করে রইল। ফোরকান আলীই বললেন, আচ্ছা, বলতে চাইলে থাক। এনিওয়ে, কোথায় জব করতেন?

অনু বুঝে ফেলল সে নিজে সেধে সেধে আরো একটা নতুন ঝামেলা তৈরি করেছে। তাকে এখন তার চাকরি জীবনের বিশদ ফিরিস্তি দিতে হবে। সে যতটা পারল সংক্ষেপে ঘটনা বলল। ফোরকান আলী বললেন, আপনার জীবনে দেখি গল্পের অভাব নেই।

কারো জীবনেই গল্পের অভাব থাকে না।

না, মানে আপনার গল্পগুলো একটু অন্যরকম। ফোরকান আলী থেমে সিগারেট ধরালেন, তারপর বললেন, আচ্ছা, এর আগে আপনি একটি এনজিওতে চাকুরি করতেন?

জি।

সেটাও কী ছেড়ে দিয়েছিলেন?

জি।

কেন?

কারণটা বলতে ইচ্ছে করছে না।

ফোরকান আলী হাসলেন, মানুষ খুব ইন্টারেস্টিং প্রাণী বুঝলেন? সে বেশিরভাগ সময়েই জানে না সে কি করছে! করার পর মনে হয়, কাজটা কেন করলাম? ধরেন, বেশিরভাগ খুনিই খুন করার সময় বুঝতে পারে না যে সে খুন করছে। খুনটা করে ফেলার পর তার মনে হয়, আরে, এ কী করলাম!

অনু কথা বলল না। ফোরকান আলী হাসতে হাসতেই আবার বললেন, আপনি যে অফিসের বড় স্যারদের সাথে এখানে সেখানে লম্বা ট্যুরে যেতেন, এই ঘটনা কি সত্যি?

অনু চমকালো না, যেন এই প্রশ্নটা শোনার জন্যই সে প্রস্তুত ছিল। তবে জবাবও দিলো না সে। ফোরকান আলী চোখ সরু করে তাকালেন, আপনি এসেছেন, ভালোই হয়েছে, দুয়েকদিনের মধ্যে আমিই আপনাকে ডাকতাম। আপনি আলতাফ হোসেন নামে কাউকে চেনেন?

জি চিনি।

উনার সাথে আপনার সম্পর্ক কী ছিল?

উনি আমার বস ছিলেন।

এটুকুই?

জি।

উনার সাথে আপনার বিষয়ে আমাদের কথা হয়েছে।

অনু অধৈর্য হয়ে উঠল, সে বলল, একটা কথা বলি ফোরকান সাহেব?

জি বলুন।

আপনার কী সত্যি মনে হচ্ছে যে জায়েদের খুনের সাথে বা এই আর কী কী সব বিজনেস টিজনেসের কথা বলছিলেন, এগুলোর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে?

আমার মনে হওয়ায় কী যায় আসে? ঘটনা সত্যি কি-না, সেটা হলো আসল।

যদি এটাই সত্যি মনে হয়, তাহলে আপনি আমাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পুলিশ কাস্টোডিতে এনে রাখতে পারেন। বিষয়টা আমি আর নিতে পারছি না, প্লিজ। আমার ধারণা সেটা বরং আমার জন্য একটা ফেভার হবে। কিছুদিন অন্তত। নিশ্চিন্তে থাকতে পারব।

ফোরকান আলী হেসে প্রসঙ্গ পাল্টালেন, বাসা ছেড়ে দিয়ে উঠবেন কোথায়?

কোনো হোস্টেলে।

কেন? ঢাকায় আর কোনো রিলেটিভ নেই?

নাহ্।

আপনার বড় চাচা, মামা?

ওনাদের সাথে থাকার মতো সম্পর্ক নেই।

ও আচ্ছা। আপনি বরং এক কাজ করুন, এই মাসের পর হোস্টেলেই উঠে যান। তবে ওঠার আগে ঠিকানাটা মনে করে দিয়ে যাবেন প্লিজ।

পরের মাসের শুরুতেই অনু বাসা ছেড়ে দিলো। সে উঠল ফার্মগেটের কাছে মণিপুরি পাড়ার এক কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে। বাসার জিনিসপত্র বেশিরভাই বিক্রি করে দেয়াতে হাতে বেশ কিছু নগদ টাকাও এলো। কিন্তু ওই শূন্য বাড়িটাতেই সবকিছু রেখে নিজেই যেন পুরোপুরি শূন্য হয়েই এসেছে সে। প্রথম ক’টা দিন কী তীব্র হাহাকার যে ভেসে বেড়ালো বুকের ভেতর! হোস্টেল ভর্তি এত এত মেয়ে, এত এত গল্প, কলরোল। কিন্তু তার কিছুই তাকে মুহূর্তের জন্যও স্পর্শ করলো না। যেন অজস্র পাখির তুমুল কলকাকলির ভিড়েও একা এক নিঃসঙ্গ, নিঃশব্দ ডানা ভাঙা পাখি সে। সারাক্ষণ চুপচাপ জানালার পাশে বসে থাকে। এই একটা দিক অবশ্য ভালো, এখানে চার তলার উপরের এই জানালাটা সারাক্ষণ খুলে রাখতে পারে সে। এখান থেকে আকাশ দেখা যায়। চাইলেই একা একা কথাও বলা যায় আকাশের সাথে।

এখানে প্রতি রুমে দুজন করে থাকার ব্যবস্থা। তবে দিনভর একা একাই থাকে অনু। হোস্টেলের বেশিরভাগ মেয়েরাই কাকভোরে কাজে বের হয়ে যায়। সেদিন দুপুরে একা বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ করেই অয়নের নোটবুকটার কথা মনে পড়লো অনুর। উঠে গিয়ে ব্যাগ থেকে নোটবুকটা নিয়ে এলো সে। আজ এতদিন পর এই নির্জন একলা দুপুরে অয়নের সাথে কথা বলতে কী যে ইচ্ছে করলো অনুর!

অনুর হাতের আঙুলগুলো যেন তিরতির কাঁপছে। সে দমবন্ধ অনুভূতি নিয়ে প্রথম পাতাটা ওল্টালো, তারপর দ্বিতীয় পাতা, তারপর তৃতীয় পাতা। কিন্তু কোথাও কিছু লেখা নেই। অনু একের পর এক পাতা ওল্টাতে থাকল। তার বুকের ভেতর হঠাৎ করেই কেমন ফাঁকা হয়ে যেতে থাকল। এই এতটা দিন যেন অয়ন তার সাথেই ছিল। সে ভেবেছিল, সে চাইলেই হয়তো যখন তখন অয়নের সাথে কথা বলতে পারবে, অয়নের কথা শুনতে পারবে। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তার মনে হলো, অয়ন কোথাও নেই। কোথাও না।

অয়ন অবশ্য ফিরে এলো নোটবুকটার শেষের দিকে গিয়ে। আগস্ট মাসের তেরো তারিখের পৃষ্ঠায় অয়নের লেখা খুঁজে পেল অনু। একটা পৃষ্ঠার প্রায় পুরোটা জুড়ে কাটাকুটি। অনেক কিছু লিখতে গিয়েও শেষ অব্দি যেন কী লিখবে, তা-ই মনস্থির করতে পারছিল না অয়ন। পরের পৃষ্ঠায় সে গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছে, আচ্ছা, কেউ যদি আচমকা জেনে যায়, তার মৃত্যু আর কয়েকদিন পরই, তাহলে কেমন লাগবে তার? সবার প্রথম সে কী ভাববে?

এই কয়েকটা মাত্র শব্দ, কিন্তু অনু যেন তার ভার বহন করতে পারছিল না। তার সারা শরীর কাঁপছিল, অয়ন তাহলে আগেভাগেই জেনে গিয়েছিল? অথচ কাউকে সে ঘুণাক্ষরেও তা বুঝতে দেয়নি! আসলেই তো, কেমন লাগবে তার?

অনু নিষ্পলক তাকিয়েই রইল। যেন কত কত কালের কত কত ব্যথা সেই শব্দগুলোর বুকের ভেতর জমে ভার হয়ে আছে। অনু হাত বাড়িয়ে আলতো করে শব্দগুলো ছুঁয়ে দিলো। তারপর পাতা ওল্টালো, আবার কাটাকুটি। কাটাকুটি শেষে আবার লেখা,

রাতটা যে কী বিশ্রী! একটুও ঘুম হয় না, অথচ সারাটা রাত ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকতে হয়। সন্ধ্যা নামতেই অপেক্ষায় থাকে, কখন আমি ঘুমাবো! ঘুমালেই পা টিপে টিপে এসে মাথার কাছে বসে থাকে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমি তখন মায়ের বুকের শব্দ টের পাই। মা কি টের পায় যে আমি ঘুমের ভান ধরে জেগে আছি? মনে হয়, পায় না।

মার ধারণা, শেষ অব্দি কোনো একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটে যাবে। সেদিন মাঝরাতে শুনি মা বেনুকে ডেকে ফিসফিস করে কী বলছে! অনেক কষ্টে কান পেতে শুধু বাবর শব্দটা শুনলাম, কিন্তু বাবর কে? সেই বাকিটা রাত আমি বাবর কে ভাবতে ভাবতে ভাবতে কাটিয়ে দিলাম। আমাদের চেনা পরিচিত কারো মধ্যে তো বাবর নামের কেউ নেই, তাহলে? একটা সুবিধা অবশ্য হয়েছে, রাতটা কাটিয়ে দেয়ার এটা একটা ভালো উপায়। বাবরের কথা চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম আমি!

মা প্রায় রাতেই বিছানার পাশে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত জায়গাজুড়ে অসংখ্যবার পায়চারি করতে থাকে। আমি কিছুক্ষণ গুনতেও চেষ্টা করি, মা কতবার হাঁটলো! কিন্তু শেষে সব এলোমেলো হয়ে যায়। আমার ধারণা ছিল, এভাবে গুনতে গুনতে একসময় আমার ঘুম এসে যাবে, কিন্তু আসে না। শেষ রাতের দিকে মা জায়নামাজে বসে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদে। আমার প্রায়ই ইচ্ছে হয়, মাকে ডেকে বলি, মা, তুমি এমন কাঁদলে আমার কষ্ট হয়। খুব কষ্ট।

তারপর আবার মনে হয়, থাক। মা হয়তো ওই কান্নার মধ্যেই একটা কোনো আশা খুঁজে পায়। ভাবে তার কান্না শুনে আল্লাহ যদি সবকিছু ঠিক করে দেয়! মানুষ তো আশা নিয়েই বাঁচে। আমারও মাঝেমধ্যে ভাবতে ইচ্ছে হয়, কোনো একটা অলৌকিক ঘটনা যদি ঘটে, আর আমার অসুখটা যদি ঠিক হয়ে যায়।

বাবরের রহস্যটা আজ উদ্ধার হলো। মা সম্ভবত মোগল সম্রাট বাবর আর তার পুত্র হুমায়ুনের ঘটনাটা সেদিন বেনুকে বলছিল। গল্পটা ছোটবেলায় পড়েছিলাম বলে মনে করতে পারছিলাম না। পুত্র হুমায়ুনের অসুখ নিজের শরীরে নিয়ে পিতা মারা গেলেন। বেঁচে রইল পুত্র। মার ধারণা ঠিকঠাক চাইতে পারলে আল্লাহ হয়তো বাবরের মতো মার জীবনের বিনিময়েও আমাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে!

অনু আচমকা নোটবুকটা বন্ধ করে ফেলল। সে তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে বাইরে। ঝা ঝা দুপুর রোদে একটা মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। তার হাতে ঝকঝকে একটা টিনের মগ বা কিছু। সেই মগে রোদ পড়ে চকচক করছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না। চোখ জ্বালা করছে।

অনুর রুমমেট মেয়েটার নাম নাবিলা। নাবিলার ফিরতে বেশ দেরি হয়। প্রথম দু’তিন দিন দুজনের পরিচয়। আগে কী করতো, এখন কী করবে, এইসব নিয়ে অল্পবিস্তর কিছু গল্প হয়েছিল। কিন্তু তারপর মেয়েটা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আর কথা হয়নি। আজ সে ফিরেই বলল, সারাদিন একা একা কী করেন আপু?

রিকশা গুনি।

কতগুলো গুনলেন?

গুনে মনে রাখতে পারি না। মাঝখানে এসে এলোমেলো হয়ে যায়।

আপনি তো হিসেবে কাঁচা আপু। মেয়েদের হিসেবে কাঁচা হলে হয় না।

অনু হাসলো, পাকা হলেও কিছু হয় না।

কেন?

কারণ মেয়েদের হিসাবেরও হিসাব থাকতে হয়।

মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনার কথাটা পছন্দ হয়েছে আপু।

আপনি কোথায় জব করেন?

একটা প্রাইভেট ফার্মে।

কী করে ওরা?

মূলত: প্রিন্ট আর প্রিন্টিং ম্যাটেরিয়ালসের কাজ, সাথে প্রিন্টিং মেশিনও করছে নতুন করে। আগে বাইরে থেকে মেশিন হায়ার করে কাজ চলত। কিন্তু এখন নিজেরাই দুটো মেশিন কিনেছে।

অফিস কোথায়?

ফকিরাপুল।

এত দূর থেকে কীভাবে যান?

হেঁটে খামার বাড়ি চলে যাই, ওখান থেকে বাস। একটু ঝামেলা হয়, বাট ম্যানেজ হয়ে যায়।

অনু সরাসরিই বলল, কোনো কাজের সুযোগ থাকলে আমাকে জানিয়েন তো!

আমি আপু ওখানে প্রায় চার বছর ধরে আছি, এইজন্য বেতন যা পাই, মোটামুটি চলে যায়। কিন্তু এমনিতে বেতন খুব কম, আর যে ধরনের কাজ, আপনার হয়তো পছন্দ হবে না।

কী ধরনের কাজ?

এই প্যাকেজিং ট্যাকেজিং, এছাড়া ক্লায়েন্ট সার্ভিস আছে, ডিজাইনিং আছে।

এর আগে একটা এজেন্সিতে কিছুদিন ক্লায়েন্ট সার্ভিসের কাজ আমি করেছি।

আচ্ছা আপু, আমি দেখি, কিছু করা যায় কি-না!

রাতে অনু জেগে রইল দীর্ঘসময়। সকালে উঠতে হয় বলে নাবিলা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। অনুকেও তাই লাইট নিভিয়ে অন্ধকারে বসে থাকতে হয়। নাবিলা অবশ্য বলেছিল, আলোতে ঘুমাতে তার সমস্যা হয় না। মশারির উপর একটা কিছু দিয়ে আড়াল করে নিলেই হয়। কিন্তু অনু তাও লাইট জ্বালায় না। বরং অন্ধকারই তার ভালো লাগে। আর পড়বে না, পড়বে না করেও অনু বালিশের তলা থেকে নোটবুকটা বের করলো। সামান্য খোলা জানালায় বাইরে থেকে আবছা আলো আসছে, তারপরও মোবাইল ফোনের আলোটা খানিক আড়াল করে জ্বেলে নিলো সে। তারপর পাতা ওল্টালো। অয়ন লিখেছে

আজকাল ঘুমের ভান ধরে থাকতেও ভীষণ ভয় হয়, মনে হয় চোখ বুজলে যে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, সেই অন্ধকার থেকে যদি আর কখনো ফিরে আসতে না পারি! এই ভয়টা খুব খারাপ। সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায়, কিন্তু তারপরও মা’র জন্য সন্ধ্যার পরই ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকতে হয়। মা সারাটা দিন অপেক্ষায় থাকে, কখন আমি ঘুমাবো, আর সে আমার পাশে এসে মোনাজাতে বসবে। কী অদ্ভুত এক লুকোচুরি খেলা যে আমরা সবাই মিলে খেলছি! আমার কাছ থেকে সবাই যেটি লুকিয়ে রাখছে, সেটি আমি জানি। অথচ আমি যে জানি, সেটিও আমি সবার থেকে লুকিয়ে রাখছি!

আচ্ছা, মরে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কী আমি বুঝতে পারব, যে আমি মারা যাচ্ছি? অনেক কষ্ট হবে তখন? মাঝেমধ্যে ভাবি, দূর, সবাইকেই তো একদিন না একদিন মরে যেতে হবে। এত ভয়ের কী আছে! কিন্তু পরক্ষণেই কী তীব্র এক ভয়, সবকিছু মুহূর্তেই শূন্য হয়ে যায়। অথচ এটা কাউকে বলতে পারছি না। এর চেয়ে কষ্টকর কিছু কী আর পৃথিবীতে আছে? ছোটবেলা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলে মা দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিতো, আর সাথে সাথেই ভয়টা কোথায় উধাও হয়ে যেত! মাকে তখন কেমন অন্যরকম মনে হতো, মনে হতো মায়ের বুঝি অলৌকিক কোনো ক্ষমতা আছে, জাদুটাদু কিছু জানে! এখনো খুব ইচ্ছে করে, মাকে যদি বলতে পারতাম, মা আমার মরে যেতে খুব ভয় হয়, তোমাদের ছেড়ে একা একা আমি থাকতে পারব না মা। আমার প্রচণ্ড ভয় হয়। আমাকে জড়িয়ে ধরে দোয়া পড়ে একটা ফুঁ দিয়ে দাও মা। আমার খুব নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে একটু ঘুমাতে ইচ্ছে করে। ঠিক ছোটবেলার দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে কেঁদে-কেটে জড়সড় হয়ে যাওয়া সেই ছেলেটার মতো আমাকে একটু ফুঁ দিয়ে ঘুম পারিয়ে দাও। প্লিজ মা, আমার ভয়টা একটু দূর করে দাও।

কী আশ্চর্য! এসব কেবল ভাবি-ই। অথচ, কাউকে কিছু বলতে পারি না। কাউকে কিছু বলতে পারব না!

ভয় পেলে মানুষ তার প্রিয় মানুষ, আপন মানুষ, সবচেয়ে নির্ভরতার মানুষলোকে খোঁজে। তাদের জড়িয়ে ধরে আশ্রয়, সাহস পেতে চায়। অথচ কী এক অদ্ভুত হিসাব, এই প্রচণ্ড ভয় নিয়েও আমি কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারছি না, সাহস খুঁজতে পারছি না। কাউকে বলতেও পারছি না, এর চেয়ে বেশি কষ্ট কী আর কিছুতে হয়? আমি জানি না। আমার যে কী ভীষণ কান্না পায়, কী ভীষণ! কিন্তু আমি কার কাছে গিয়ে কাঁদবো?

আমার চারপাশজুড়ে সবাই আমার প্রিয়তম মানুষ, তারা সারাক্ষণ আমার চারপাশে ঘুরছে, অথচ এই সবার মাঝে থেকেও কী প্রচণ্ড একা একটা মানুষ আমি, কী অবর্ণনীয় আতঙ্ক বুকে পুষে কাটিয়ে দিচ্ছি দীর্ঘতম একেকটি মুহূর্ত..।

আগেভাগে মৃত্যুর কথা জেনে যাওয়ার মতো এমন ভয়ংকর কিছু কী আর পৃথিবীতে আছে!

আজ নুহার কথা খুব মনে পড়ছে। সেদিন নুহা যখন আদিল ভাইয়ের কথা বলল, আমার অমন কেন লাগল? নুহা ঠিকই বলে, আমি একটা গাধা। গাধা না হলে এমন কখনো হয়? এই এতটা দিন, এতগুলো বছরেও ওকে আমি একটুও বুঝতে পারিনি, নুহাও আমাকে না। অথচ আমি ভাবতাম, আমরা আমাদের সবটুকু বুঝি! অবশ্য আমি নিজেকেই তো কত দেরি করে বুঝলাম, নুহার আর দোষ কী! আচ্ছা, আমি মরে যাওয়ার পর নুহা কী করবে? আমার খুব ইচ্ছে করছে, নুহাকে ভালোবাসি বলে যেতে। এমন করে কাউকে ভালোবাসলে তাকে জানিয়ে কী মরে যাওয়া উচিত? তাহলে ভালোবাসাটা আর থাকল কই?

একটা খুব বিদঘুঁটে ইচ্ছে হচ্ছে, যদি মরে যাওয়ার পরও ঠিক ঠিক দেখা যেত, সবাই কেমন করছে? আচ্ছা, নুহা কি করবে তখন? কাঁদবে? নিশ্চয়ই কাঁদবে। একটু হলেও তো আমায় ভালোবাসে ও। অন্যরকম ভালোবাসা না। হোক, বন্ধুর মতো তো ভালোবাসে। ও যেখানেই যাক, আমাকে ভুলে থাকবে কী করে! যখন রোজ কোচিংয়ে যাবে, যখন বৃষ্টি নামবে, যখন রিকশায় উঠতে গিয়ে পানির তেষ্টা পাবে, তখন ভুল করে একবারও কী বলে বসবে না, অয়ন, একটা কনকনে ঠান্ডা দেখে পানির বোতল এনে দে না! অবশ্য আদিল ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেলে ও তো আর রিকশাতেই চড়বে না। তখন নিশ্চয়ই ওদের দামি গাড়ি হয়ে যাবে। আর ও তো তখন দেশেই থাকবে না। তাই বলে আমাকে একদম ভুলে যাবে? এইজন্যই আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয় না, মরে গেলে সত্যি সত্যি আর কিছু দেখা যায় না?

আচ্ছা, আমার কবরটা কোথায় হবে? ঢাকায়? আজিমপুর গোরস্থানে কবর হলে না-কি সেই কবর কিছুদিন পর আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কবরের ওপর কবর হতে থাকে। মা, আপুরা কেউ আর তখন আমার কবরের কাছে যাবে না? মৃত্যু জিনিসটা কেমন যেন, কিছুই স্পষ্ট না। কেউ যদি আমার কবরের কাছে যায়, আমি কী তা বুঝতে পারব?

নুহাকে মাথা থেকে তাড়ানো দরকার। কী বিশী একটা ব্যাপার, মরে যেতে থাকা একটা মানুষও সারাক্ষণ অন্য একটা মানুষকে মাথা থেকে তাড়াতে পারে না। মানুষ এমন কেন? না-কি আমি একাই এমন? গতরাতে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম, আমার কবর হয়েছে কোনো এক গ্রামে। চারপাশে জঙ্গল, বিশ্রী গন্ধ। বৃষ্টি হয়েছে বলে নিচের মাটি জল কাদায় মাখামাখি। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, সেই অবস্থায়ও আমি নুহাকে দেখতে পাচ্ছি। সে ঝকমকে এক রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বারবার আমার নাম ধরে ডাকছে। কিন্তু আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। রাস্তার দু’ধারে গাছ, গাছে রংবেঙের পাতা। দেখতে কী যে ভালো লাগছে! নুহা আমাকে খুঁজছে বলে আমার হঠাৎ অভিমান হতে লাগল। আমি ভাবলাম, নুহার ডাকে আমি সাড়া দেব না। আমি চুপচাপ অভিমান নিয়ে রয়ে যাব। কিন্তু আমার হঠাৎ খুব কষ্ট হতে লাগল। নুহা একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছে না। সে হঠাৎ গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করলো। আমি এবার তাকে ডাকলাম, সে শুনতে পেল না। তার কানে হেডফোন। আমি গলার স্বর উঁচু করে ডাকলাম, নুহা! সে তাও শুনতে পেল না। আমার কী যে কষ্ট হচ্ছিল, কী যে কষ্ট! আমি চেষ্টা করছিলাম নুহার দিকে কিছু একটা ছুঁড়ে মারতে, নুহা যাতে আমাকে দেখতে পায়। আমার সামনেই একটা মাটির ঢেলা। কিন্তু হাত তুলতে গিয়ে দেখলাম, আমি হাত তুলতে পারছি না, হাত দুটো কেমন যেন অসাড় হয়ে আছে। শরীর নাড়াতে গিয়ে দেখলাম শরীরও নাড়াতে পারছি না। আমার কষ্ট হতে থাকল, অবর্ণনীয় কষ্ট। আমি নুহাকে চিৎকার করে ডাকতে থাকলাম, উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করতে থাকলাম। কিন্তু কিছুতেই শরীরের সামান্য একটা অংশও নাড়াতে পারছিলাম না। এই মুহূর্তে আমি আদিল ভাইকে দেখলাম। আদিল ভাই নুহার জন্য ফুল নিয়ে এসেছে, নুহা আদিল ভাইকে দেখে দৌড়ে ছুটে গেল। সে আসলে এতক্ষণ আদিল ভাইয়ের অপেক্ষায় ছিল! আমার আচমকা কান্না পেল। কিন্তু কান্না আটকে আমি নুহাকে চিৎকার করে ডাকতে থাকলাম। আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছিল আমি দম আটকে মারা যাব। সেই মুহূর্তে আমার মনে হলো, আমি তো মৃতই! মৃত মানুষের আবার দুঃখ-কষ্টের অনুভূতি কী? আমার কবরের মেঝেতে বৃষ্টির কাদাজলে আমার পিঠ ভিজে গেছে। আমার ঘুম ভেঙে গেল। দেখি মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘামে আমার শার্ট, পিঠ, বিছানা ভিজে জবজব করছে। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, অয়ন, দুঃস্বপ্ন দেখেছিস বাবা? আমি কোনো জবাব দিলাম না। আমার সেই মুহূর্তে কেন যেন মনে হলো, আমার সত্যি মত্যিই মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।

অনু নোটবুকটা বন্ধ করে নিঃসাড় শুয়ে রইল। দূরে কোথাও সাইরেন বাজছে, অনু জানে না, সাইরেনটা কিসের। কিন্তু রাতের নিস্তব্ধতাকে সূক্ষ্ম সুতোয় মিহি করে কাটার মতো তীক্ষ্ণতায় চিড়ে দিচ্ছে সেই বিষণ্ণ শব্দ। অনুর মনে হলো, তার বুকের কোথাও সেই বিষণ্ণ শব্দ যেন মিহি সুতোর মাথায় গাঁথা সুইয়ের মতো বিধে বিধে যাচ্ছে।

*

শামীম চুপচাপ বসে আছে। তার সামনে অনেকগুলো টাকার বান্ডিল হাতে বসে। আছে আজম। আজম বলল, শামীম ভাই, প্রথম যেদিন আপনার সাথে দেখা হইছিল, সেদিনের কথা মনে আছে?

শামীম বলল, আছে।

আপনে সন্ধ্যার পরপর আপনের শ্বশুরবাড়িরতন বাইর হইয়া মোড়ের চায়ের দোকানের ওইখানে আসলেন। আমি গিয়া আপনেরে ফোন দিলাম, আপনে পকেট থেইকা ফোন বাইর করতেই আমি গিয়া জিগাইলাম, শামীম ভাই? আপনে বললেন, হ্যাঁ। আমি হ্যান্ডশেক করতে করতে বললাম, আমি আজম। মনে আছে?

থাকবে না, কেন?

থাকবে না। কারণ, এই লাইনটা অবিশ্বাসের। এইখানে কেউ কাউরে বিশ্বাস করতে চায় না। আপনার হাত যখন আমি ধরলাম, আমি কিন্তু তখনই টের পাইছিলাম, আপনের হাত থরথর কইরা কাঁপতেছিল। আপনি ভয়ে পুরা রিকশায় কোনো কথা বলেন নাই।

ভয়তো পাবারই কথা।

হুম। তো মাঝখানে দেড় বছর না দুই বছর? এর মধ্যেই আপনে চাইতেছেন, এখন আপনের ভয়ে আমি তেমনে থরথর কইরা কাঁপবো?

আজম ভাই, তা তো বলি নাই। আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। ওয়াসিম ভাই আমাকে ডাকছিলেন। উনি নাই, এই মুহূর্তে সব হিসাব-নিকাশ, মার্কেটের অবস্থা, পুলিশি হয়রানি এমন আরো নানান বিষয়াদি নিয়া উনি চিন্তিত। ঠিকঠাক মতো অনেক হিসাব-নিকাশও পাইতেছেন না। এই জন্য একটু নাখোশ দেখলাম। এখন যেভাবেই হোক, বিষয়টা উনি আমাকে দেখতে দিছেন, এটা তো আমার দায়িত্ব তাই না?

আজম কোনো কথা বলল না। শামীম বলল, একসাথে যখন কাজ করছি, মিলেমিশেই তো করতে হবে। এখন এই দায়িত্বটা যেহেতু আমারই বুঝিয়ে দিতে হয়, এইজন্যই তো আপনাদের সাথে আমার ঠোকাঠুকি হচ্ছে। এর আগে কখনো হয়েছে?

আজম গম্ভীর গলায় বলল, আমরা চাই নাই বইলা, হয় নাই। চাইলেও হওনের মতো অনেক ব্যাপারই আছিল। এতবছর ধইরা বসের সাথে কাজ করি, আর আপনে শুকুরে শুকুরে আষ্ট দিন হয় আইসাই আমাগো সবাইর উপরে তাবেদারি শুরু করছেন। বিষয়টা এত সহজে মাইনা নেওনের বিষয় না শামীম ভাই। যাউকগা, এইখানে গত দুই মাসের টাকা আছে। আর বাকি দুইমাসের টাকাও দিয়ে দিবো।

শামীম কোনো কথা বলল না। সে টাকাগুলো গুনে ব্যাগে ভরে নিলো।

.

রাতে বাসায় ফিরে কিছু খেলোনা শামীম। তনু বলল, খাবে না?

উঁহু।

কেন?

এমনি।

এমনি কেন?

শামীম হঠাৎ রেগে গেল। তোমার কাছে সবকিছুর জবাবদিহি করতে হবে, হা? তোমার কাছে আমার সবকিছুর কৈফিয়ত দিতে হবে?

তনু কথা বলল না। শামীমের বাইরে থেকে এসে খুলে রাখা পোশাক ভাঁজ করে সে আলনায় রাখলো। তারপর গোসলের গরম পানি দিলো। শামীম রাগী গলায় বলল, আমি গোসল করব না।

তুমি তো কখনো বাইরে থেকে এসে গোসল না করে থাকো না।

এখন থেকে থাকব।

কী হয়েছে আমাকে বলবে?

শামীম এবার কোনো জবাব দিলো না। গভীর রাতে তনু হঠাৎ শামীমের একটা হাত টেনে এনে তার নিজের পেটের ওপর রাখলো। শামীম প্রথমে হাতটা সরিয়ে নিতে চাইলেও তনুর কারণে পারল না। তনু তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখলো পেটের ওপর। শামীম চুপচাপ শুয়ে রইল। কিন্তু দীর্ঘসময় ধরেও সে বুঝতে পারল না তনুর পেটের ভেতর কিছু নড়ছে কি-না, কোনো শব্দ হচ্ছে কি-না।

তনু হঠাৎ নরম গলায় বলল, তুমি রোজ রাতে জেগে থাকো?

শামীম জবাব দিলো না। তনু বলল, একটা রাতও ঠিকঠাক ঘুমাও না তুমি?

তোমাকে কে বলল?

আমি টের পাই।

কী টের পাও?

তুমি যে সারারাত জেগে থাকো। আর খুব অস্থির হয়ে থাকো।

শামীম জবাব দিলো না। তনু বলল, আরো একটা জিনিস টের পাই।

কী?

তুমি যে রাতে চুপি চুপি চোরের মতো আমার পেটে হাত দাও!

শামীম এবারও কথা বলল না। তনুই বলল, হাফসার সময়ও তুমি এই কাজটাই করতে। কিন্তু হাফসা হওয়ার আগে আগে যখন আমাকে মা’র বাসায় চলে যেতে হলো, তারপর থেকেই তুমি কেমন হয়ে গেলে! সেই তোমাকে আমার চেনা মনে হতো না। আমি জানি, তুমি ওই সিচুয়েশনটা মেনে নিতে পারো না। অনেক ভয় পাও।

শামীম চুপ করেই রইল। তনু পাশ ফিরে শামীমের দিকে সামান্য ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল, কিন্তু তোমার সন্তানদের ভালো রাখতে গিয়ে তুমি যদি ভয়ংকর কোনো বিপদে পড়ে যাও তাহলে সেই বিপদে তো আমরা সবাই-ই পড়বো, তাই না? তোমার কোনো ক্ষতি হয়ে গেলে, আমরা তখন কই যাব বলো?

তনু একটু থামলো। তারপর আবার বলল, বড়’পু একটা কথা বলেছিল, তোমাকে বলতে ভয় হচ্ছে, তাও বলি। বড়পু বলছিল, মার একটা ডিপিএসের কিছু টাকা জমেছিল। বড়পু টাকাটা আমাদের দিয়ে দিতে চায়। ও বলেছে, আমরা যেন তোমাদের গ্রামের দিকে চলে যাই। ওখানে ওই টাকায় কিছু একটা করা যাবে। বড়’পু আমাদের নিয়ে খুব ভয় পাচ্ছে।

শামীম তনুর পেটের ওপর থেকে ধীরে হাতটা সরিয়ে নিয়ে পাশ ফিরে শুলো। তনু বলল, আমার খুব ভয় হচ্ছে শামীম। ওয়াসিম খুব খারাপ মানুষ, আমার মনে খুব কু ডাক ডাকছে। মনে হচ্ছে, তুমি খুব বড় ধরনের কোনো একটা ঝামেলায় জড়িয়ে যাবে।

কিসের ঝামেলা?

কিসের ঝামেলা আমি জানি না। কিন্তু এইসব কাজ যারা করে, তাদের সবসময় বিপদের মুখেই থাকতে হয়। পুলিশের বিপদ, নিজেদের মধ্যে বিপদ। তারপর আবার জায়েদের খুনের ঘটনা নিয়ে পুলিশের এইসব সন্দেহ। তুমি বুঝতে পারছ না শামীম।

শামীম হঠাৎ শক্ত গলায় বলল, আমার টাকা দরকার, টাকা ছাড়া ওই সময়টাতে আমি আর ফিরে যেতে পারব না। টাকার জন্য বিপদ হলেও ওই অবস্থাটার চেয়ে অন্তত ভালো থাকব। তুমি দয়া করে এই মাঝরাত্রিতে আর ফ্যাচফ্যাচ করো না।

তনু হাত বাড়িয়ে শামীমকে নিজের দিকে ঘোরাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু শামীম শক্ত হয়ে পাশ ফিরেই শুয়ে রইল। তনু বলল, তুমি সত্যি করে বলো তো, তুমি নিজে বিষয়টা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছ না?

না।

আমার কাছে মিথ্যে বলো না শামীম। তোমার চেহারা আমি চিনি, তুমি ভয় পাচ্ছ। কিন্তু তুমি টাকার লোভটা ছাড়তে পারছ না।

শামীম ঝটকা মেরে তনুর হাতটা তার শরীর থেকে সরিয়ে দিলো। সেই সারাটা রাতও শামীম ঘুমাতে পারল না। শেষ রাতের দিকে তার খুব ভয় হতে লাগল। সে চায় না, তার এই সন্তানটিও পৃথিবীতে এসে হাফসার মতো কষ্ট করুক। সে হাফসাকেও আর কষ্ট করতে দেখতে চায় না। সে জানে, পিতা হয়ে। সন্তানের প্রয়োজন কিংবা চাহিদাগুলো নিজ হাতে পূরণ করতে না পারাটা কী ভীষণ কষ্টের। নিজের এই অক্ষমতাটা সে বিন্দুমাত্র মেনে নিতে পারে না। কিন্তু তার ভেতর ক্রমশই একটা ভয়ও জাঁকিয়ে বসছে। যদি তার কিছু হয়ে যায়, সে যদি কোনো বিপদে পড়ে যায়, তাহলে হাফসা, তনু আর তার অনাগত সন্তানের। কী হবে!

.

শামীম দোকানে বসেছিল, এই মুহূর্তে একটা পুলিশের ভ্যান এসে তার দোকানের সামনে থামলো। গাড়ি থেকে ফোরকান আলী একা নেমে এলেন। তার হাতে একটা ওয়াকিটকি। তিনি ওয়াকিটকিতে কারো সাথে কথা বলছিলেন। ফোরকান আলীকে দেখে শামীম উঠে দাঁড়ালো। পুলিশের অন্য কিছু অফিসার কিংবা কনস্টেবলদের সাথে কথাবার্তা হলেও এই লোকের সাথে শামীমের আগে কোনো কথা হয়নি। ফোরকান আলী দোকানের সামনের টুলটাতে বসে চোখ থেকে রোদ চশমাটা খুলে শামীমের সামনের টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, কফি আনান, বড় এক মগ, আগুন গরম। সাথে ডাল পুরি, বড় সাইজের দুইটা।

শামীম অবাক হয়ে ফোরকান আলীর দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ ডালপুরির সাথে কফির অর্ডার দিতে পারে, এটা তার ধারণা ছিল না। ফোরকান আলী ওয়াকিটকিতে জরুরি কী সাংকেতিক কথাবার্তা বলছিলেন। তিনি কথা বলতে বলতেই শামীমকে আবার চোখের ইশারায় খাবার আনাতে বললেন।

ফোরকান আলী কফির মগে ডালপুরি ডুবিয়ে কামড় দিতে দিতে বললেন, ব্যবসাপাতি না-কি খুব ভালো যাচ্ছে আজকাল?

শামীম বুঝতে পারছিল না সে কী বলবে! ব্যবসাপাতি বলতে ফোরকান আলী কোন ব্যবসার কথা বলছেন, এটা নিয়ে শামীম কিঞ্চিৎ দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লো। সে একগাল হেসে বলল, এই তো স্যার, চলে যাচ্ছে কোনো মতে।

কোনো মতে চললে হবে? তাহলে আমাদের কী হবে?

শামীম যেন ফোরকান আলীর কথা বুঝতে পারল না। সে বলল, জি স্যার?

আরে বুঝলেন না? পুলিশের চাকরি, যা দু’পয়সা বেতন পাই, তাতে কী ঘর সংসার, ছেলেপুলে নিয়ে চলে? চলে না। টুপাইস যা আসে, তা তো। আপনাদের কাছ থেকেই। তা আপনাদের ব্যবসাপাতি ভালো না চললে হবে?

কী যে বলেন না স্যার? শামীম লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল। ঠিকই বলি। ছেলে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, মেয়ে কলেজে। এতকিছু কেমনে সামলাই পুলিশের চাকরি করে? সম্ভব না। এইজন্য আপনারাই হলেন শেষ ভরসা। হা হা হা।

শামীমও বিনীত ভঙ্গিতে ফোরকান আলীর হাসিতে যোগ দিলো। ফোরকান আলী বললেন, তা আপনাদের বড় ভাইর খবর কী?

তার খবর তো স্যার আপনাদের কাছে। আমরা চুনোপুঁটি মানুষ, তাদের খবর আমরা কী জানবো?

কেন? টেকনাফ যে গেলেন? দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই? না-কি এখন থেকে। আপনি নিজে নিজেই টেকনাফ থেকে মাল আনার কাজ করেন?

শামীম থতমত খেয়ে গেল। সে যে টেকনাফ গিয়েছিল ওয়াসিমের সাথে দেখা করতে, এবং এই ঘটনা যে পুলিশ অব্দি জানে, এটা সে ভাবতে পারেনি। ফোরকান আলী বললেন, বড় ভাই আসবেন না?

সেটা তো স্যার আমি বলতে পারব না।

ফোরকান আলী খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর শামীমের কাঁধে মৃদু চাপড় মারতে মারতে বললেন, ইউ আর আ গুড চয়েস ফর হিম। এই বিজনেসে আপনার মতো বিশ্বাসযোগ্য লোক খুব দরকার, বুঝলেন? বড় ভাই মানুষ চিনতে ভুল করেন নাই।

.

সেই রাতেও শামীম ঘুমাতে পারল না। একটা মানসিক ট্রমার মতো যেন হয়ে যাচ্ছে তার। সারারাত মাথায় এলোমেলো অসংখ্য চিন্তা ঘুরে বেড়ায়। সহজে ঘুম আসে না। আর খানিক ঘুমালেও বারবার দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে। সেদিন স্বপ্ন দেখেছে পুলিশ তাকে রায়ের বাজার বদ্ধভূমির পেছনে নিয়ে দিন দুপুরে গুলি করে ফেলে রেখেছে। সে তখনো মারা যায়নি। তবে যে-কোনো সময় মারা যাবে। তার পাশে বসে তনু কাঁদছে। তনুর পাশে ধুলোয় গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদছে ছোট হাফসাও। তবে অবাক ব্যাপার হলো, তনুর কোলে ছোট্ট ফুটফুটে এক শিশু। শিশুটা ছেলে না মেয়ে চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে না। সে হঠাৎ শামীমের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। ফোকলা মুখের সেই হাসি। দেখে শামীমের কী যে ভালো লাগল! সে শিশুটার দিকে এগুতে চেষ্টা করলো। কিন্তু পারল না। শরীরে যেন একরত্তি শক্তি নেই তার। ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। এই মুহূর্তে শিশুটি তাকে ডাকলো, বাবা! শামীমের বুকের ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠল! সে তাকিয়ে শিশুটিকে দেখতে চেষ্টা করলো। কিন্তু পারল না। বারবার সে চেষ্টা করছে, লাভ হচ্ছে না। কোনোভাবেই চোখ খুলে তাকাতে পারল না সে।

সেই থেকে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ছিল শামীম। আজকের ঘটনায় তার অস্থিরতা আরো বাড়লো। ফোরকান আলীর সাথে কথা বলার পর থেকে সে আর একটুও স্বস্তি পাচ্ছে না। শামীম এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছে, তাকে চব্বিশ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সে কখন কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, সব কিছুই আড়াল থেকে নজর রাখা হচ্ছে। তনু যা বলেছে, তা একটুও বাড়াবাড়ি নয়। বিষয়টা জানার পর থেকে শামীম অসুস্থ অনুভব করছে। তার মনে হচ্ছে কেউ একজন সবসময় তার কণ্ঠনালী চেপে ধরে রেখেছে।

ভোর রাতে সে তনুকে ঘুম থেকে ডেকে চিন্তিত গলায় বলল, আমি তো ওর কোনো নড়াচড়া টের পাই না।

তনু আচমকা ঘুম ভাঙা গলায় বলল, কার নড়াচড়া?

শামীম তনুর পেটের দিকে আঙুল তুলে ইঙ্গিত করে বলল, ওর।

তনু হাসলো, আরো কিছুদিন যাক, তখন স্পষ্ট পাবে।

শামীম আর কথা বলল না। সে বারান্দায় চলে গেল। ভোরের আলো না ফোঁটা অব্দি সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। তনু শুয়ে শুয়ে এই অদ্ভুত মানুষটাকে দেখতে লাগল। মানুষ চেনা মানুষের পক্ষে কখনোই সম্ভব না। এক ছাদের নিচে, এক বিছানায়, একটা জীবন কাটিয়ে দিয়েও না। আসলে মানুষ তার নিজের কাছেই তো জীবনভর রয়ে যায় অচেনা, সে অন্য মানুষ চিনবে কী করে!

*

দুপুরবেলা ওয়াসিমের ফোন দেখে শামীম অবাক হলো। ওয়াসিম বলল, কী অবস্থা শামীম? সব ঠিকঠাক তো?

শামীম বলল, জি-না ভাই, একটু সমস্যা মনে হচ্ছে।

কী সমস্যা, আবারো দলের কেউ ঝামেলা করছে? আমি তো সবাইকে বলেই দিয়েছি, তোমাকে যেন কো-অপারেট করে।

না ভাই, দলের কোনো সমস্যা না। তাহলে?

পুলিশের সমস্যা। গতকাল ফোরকান আলী নামের এক অফিসার এসেছিল দোকানে, লোকটার কথাবার্তা একটু কেমন লাগল।

তোমাকে তো একবার বলেছিই যে পুলিশ নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। ওটা আমি দেখবো। তুমি বিজনেস নিয়ে চিন্তা করবে শুধু। আর শোনো?

জি ভাই।

আমি এখন কক্সবাজারে, এখানে ঢাকা থেকে আমাদের কমিশনার সাহেব এসেছেন। ওনার সাথে আজ কথা বলে দেখবো, ঢাকার কী অবস্থা, কবে নাগাদ ফিরতে পারব। উনি আমার ফেরার সব ব্যবস্থা করে রাখবেন। পুলিশ কিছু করতে পারবে না, তুমি এত টেনশন করো না।

জি ভাই।

তোমার বড় আপার ঘটনা কী জানতে পেরেছ? কাহিনি কী?

জায়েদ মল্লিকের খুনের ব্যাপারে বড় আপাকে পুলিশ থানায় নিয়েছিল।

কী! ওয়াসিম ভীষণ অবাক হলো এই কথায়, তাকে কেন?

পুলিশের ধারণা এখানে কোনোভাবে তারও কোনো যোগসূত্রতা থাকতে পারে। মানে আপনার সাথে তার আগের কোনো ঘটনা ছিল। সেই ঘটনার সাথে সম্ভবত জায়েদ মল্লিকের ইনভলভমেন্টও পুলিশ খুঁজে বের করেছে।

শামীম কৌশলে তার নিজের বিষয়টি এড়িয়ে গেল। তাকে নিয়ে পুলিশ অফিসার যে কথাগুলো অনুকে বলেছিলেন, তার কিছুই সে ওয়াসিমের কাছে বলল না। পুলিশ পুরোপুরি নিশ্চিত যে, খুনটা আপনিই করেছেন। কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে তো কোনো স্ট্রং এভিডেন্স তাদের কাছে নেই। এইজন্য তারা চাইছে কোনো একটা সূত্র বের করতে। আর সেই সূত্র খুঁজতে গিয়েই এত কিছু!

ওয়াসিম ভারি চিন্তিত হয়ে পড়লো। অনুকে পুলিশ ডেকে নিয়েছে, বা অনু সেখানে কী বলেছে, সেটি নিয়ে ওয়াসিম খুব একটা চিন্তিত না। সে চিন্তিত পুরো ঘটনাটা নিয়েই। পুলিশ কেন এই বিষয়টা নিয়ে এত সিরিয়াস হয়ে উঠল, সেটিই সে বুঝলো না। এই বিষয় নিয়ে পুলিশ বা প্রশাসনের কোনো উচ্চবাচ্য করার কথা ছিল না। তাকে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে বলা হয়েছিল। সে গা ঢাকা দিয়েই আছে।

মিনিট ত্রিশেকের মাথায় তার সাথে কথা হলো কমিশনার আব্দুল ওয়াহাবের সাথে। তিনি ঢাকা থেকে এসেছেন। এই হোটেলে তার নিয়মিত আসা-যাওয়া। রাজনৈতিক নানান ঝুট-ঝামেলায় ক্লান্ত হয়ে গেলেই তিনি এখানে আসেন। কিছুদিন থেকে আনন্দ বিনোদন নিয়ে ঝরঝরে হয়ে আবার ফিরে যান। ওয়াসিম খবর পেয়ে টেকনাফের দুর্গম এলাকা থেকে ছুটে এসেছে। আব্দুল ওয়াহাব বললেন, কী খবর ওয়াসিম?

খবর তো আপনার কাছে ওয়াহাব ভাই। আমি ঢাকায় কবে ফিরতে পারব?

একটু ধৈর্য ধরো মিয়া। এত অস্থির হলে হয়!

ধৈর্য তো কম ধরলাম না ভাই। দিন তো কম হলো না। এদিকে ঢাকায় আমার ব্যবসাপাতির অবস্থাও ভালো না। নানান সমস্যা হচ্ছে।

একটা মার্ডার তো আর ডাল ভাত না ওয়াসিম। তাও আবার যে সে মানুষ না। জায়েদ মল্লিককে আর দশজন মানুষ চেনে।

কিন্তু এটা তো কথা ছিল না ভাই। কথা ছিল কাজটা জাস্ট করে ফেললেই হলো। তারপর আর কোনো ঝামেলা হবে না। আর কাজ যে আমি করেছি, তার তো কোনো প্রমাণও নেই। তাহলে আমাকে কেন এভাবে লুকিয়ে থাকতে হবে?

একটু ঝামেলা হয়ে গেছে ওয়াসিম। আমি নিজেও তো বুঝিনি যে এটা এমন জটিল হয়ে যাবে। সমস্যা হচ্ছে বিরোধী দল এটাকে একটা ইস্যু করে ফেলছে। এখন আমাদের দলের কেউ চায় না এই মুহূর্তে এটা নিয়ে সরকার কোনো ঝামেলায় পড়ক। এই জন্য সবাই চাইছে এর একটা সুষ্ঠু তদন্ত হোক, বিচার হোক। কারণ এরসাথে সরকারি দলের বড় কোনো প্রফিট নাই। তো তারা এই ব্লেমটা কেন নেবে? বুঝেছ?

আপনি কি সরকারি দলের বাইরে ভাই?

তা না, কিন্তু দলের মধ্যেই তো আমার শত্রু আছে। তারা এই কাজটাকে দলের স্বার্থে কেন দেখবে? এটা আমার পারসোনাল ডিল ছিল।

এই প্রথম ওয়াসিম বিপদটা পুরোপুরি আঁচ করতে পারল। কিন্তু ভাই, আপনি বলছেন বলেই কাজটা আমি করেছি। না হলে এত বড় ঝুঁকি আমি কিন্তু নিতাম না।

ভুল কথা ওয়াসিম। এটা তুমি করতেই। মাঝখান থেকে জায়েদ না থাকলে আমার কিছু পলিটিক্যাল ইন্টারেস্ট ছিল। সেই সুবিধাটাও তুমি নিয়েছ।

ওয়াসিম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নরম গলায় বলল, কিন্তু ভাই ঘটনা তো ঘটছে। আপনারও লাভ হয়েছে, আমরও জেদ মিটছে। এই হাতটা তো আপনাকে আমি দেখিয়েছি। সেই ঘটনা আমি ভুলতে পারি নাই। সে করাতকলের করাতে আমার আঙুলগুলো কাটছে, আপনি একবার চিন্তা করেন।

তখন তার দল ক্ষমতায়, তুমি কোন সাহসে তার গায়ে হাত তুলছিলে?

কোথাকার কোন এক মেয়ে, তার কথা শুনে সে এসে আমাকে শাসিয়ে গেল। আমি কী সেই মেয়েকে রেপ করেছিলাম? সে আমার ব্যবসাপাতি পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে চাইছিল। আপনিই বলেন, এটা তার বাড়াবাড়ি ছিল না?

ক্ষমতায় থাকলে মানুষ একটু বাড়াবাড়ি করেই। আর তুমি তো দুই দল থেকেই সুবিধা নিয়েছ। জায়েদের দল ক্ষমতা থাকা অবস্থায়ও তুমি বিজনেস করছ, করো নাই? কারণ তোমার সবদলেই আমার মতো বড় ভাই আছে। কিন্তু কখনো কখনো তো কম্প্রোমাইজ করতে হয়, তাই না? সেটা তো তুমি করোনি।

জানেনই তো বড় ভাই, আমার মাথাটা যে একটু গরম। তার ওপর এই ঘটনার পর একটা বছর এলাকায় ঢুকতে পারিনি। এখন ভাই, আপনি যা বলবেন তাই।

তুমি একটু শান্ত থাকো। অস্থির হয়ো না। আগেও তুমি আমার কাজে লেগেছ, ভবিষ্যতেও লাগবে। সুতরাং তোমাকে এই বিপদে আমি একা ছেড়ে যাব না, এটা নিশ্চিন্ত থাকো। তবে সিচুয়েশন ঠান্ডা হতে একটু সময় লাগবে। আর শোনো, এই ঘটনা যদি তুমি নাও ঘটাতে, তারপরও পুলিশ সবার আগে তোমাকেই সাসপেক্ট করত। আর এখনো তাই-ই করছে। তোমার বিরুদ্ধে কোনো তথ্য প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও প্রথমেই কোপটা তোমার উপরই পড়ত। এই জন্যই আমি তোমাকে গা ঢাকা দিতে বলছি। ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার অপেক্ষা করো। তারপরে দেখা যাক কী হয়!

আব্দুল ওয়াহাব সামান্য থেমে আবার বললেন, আর তোমার জন্য আমি কিছুই করছি না, এটা ভেবো না। তুমি কোথায় আছ, এসব তো পুলিশের অজানায় নয়। সবকিছু জেনেবুঝে, এত প্রেসারের পরও যে পুলিশ কিছু করছে না, তা কার জন্য? এটুকু তো অন্তত বোঝো? বোঝো না?

ওয়াসিম মৃদু কণ্ঠে বলল, জি ভাই বুঝি, বুঝব না কেন! তারপরও ভাই, একটু অস্থির তো লাগেই। এমন হবে তা তো ভাবি নাই।

আব্দুল ওয়াহাব ওয়াসিমের কাঁধে হাত রেখে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করো না। আরেকটা কোনো গরম ইস্যু তৈরি হতে দাও, ব্যস। দেখবে এটা দুম করে চাপা পড়ে যাবে। বুঝেছ?

ওয়াসিম মাথা নাড়লো। সে হোটেল থেকে বের হয়ে শামীমকে ফোন দিয়ে বলল, শোনো, আমার মনে হয় সহজে ঢাকা ফেরা হবে না। একটু ঝামেলা হচ্ছে, ঝামেলাটা ঠিক হতে সময় লাগবে।

শামীম উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কোনো সমস্যা ভাইয়া?

নাহ, তেমন কিছু না। একটু সাবধানে কাজ করো।

আজমের সাথে গভীর রাত অব্দি নানা পরামর্শ চলল শামীমের। পরদিন দুপুরে ফোরকান আলী আবার আসলেন। এবার আর তিনি বসলেন না, দাঁড়িয়ে থেকেই বললেন, বড় ভাইয়ের আপডেট কী?

জি স্যার, উনি ভালো আছেন।

কথা হয়েছে?

জি স্যার।

কী কথা হলো? এই তো উনি কিছু দিনের মধ্যেই চলে আসবেন।

আবারো মিথ্যা কথা বললেন শামীম সাহেব? বসেন বইয়ের দোকানে, বেচেন ইয়াবা, বলেন মিথ্যা কথা। এভাবে করলে হবে?

জি না স্যার।

তাহলে কী করতে হবে?

সত্যি কথা বলতে হবে।

তা বলেন, সত্যি কথাটা, শুনি?

শামীম খানিক চুপ করে থেকে বলল, স্যার, উনি খারাপ থাকলেও সেটা কী আমাকে বলার কথা?

ফোরকান আলী চোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, না, তা বলার কথা না।

জি স্যার।

শোনেন শামীম সাহেব, আপনার বড় ভাই ভালো নেই। তিনি বিপদে আছেন, কঠিন বিপদে। পাশার দান উল্টে গেছে। সে বিপদে পড়া মানে আপনাদেরও বিপদে পড়া। কথা বুঝেছেন?

শামীম শুকনো গলায় বলল, জি স্যার।

আপনি আমার সাথে একটু থানায় চলেন। আজ তো কফি, পুরি কিছু খাওয়ালেন না, আমার সাথে চলেন, ফার্স্টক্লাস কফি পুরি খাওয়াবো। চেখে আসবেন, কফি পুরির আসল টেস্ট।

শামীমের গলা শুকিয়ে এলো। সে এই থানা পুলিশ বিষয়টিতে খুব একটা স্বচ্ছন্দ না। সে বলল, থানায় কেন স্যার?

কেন আবার? নাস্তা পানি খেতে। এ ছাড়া থানায় আর কাজ কী?

ফোরকান আলী হাসলেন। তার হাসি দেখে শামীমের গলা শুকিয়ে এলো।

.

থানায় ঢুকে শামীম চমকে গেল। টেবিলের পাশে অনু বসে আছে। সে অনুকে দেখে সালাম দিলো। ফোরকান আলী বললেন, এনাকে চেনেন না-কি শামীম?

জি স্যার।

কীভাবে চেনেন?

উনি আমার স্ত্রীর বড় বোন।

আচ্ছা, তা ওনার সাথে আপনার বড় ভাই ওয়াসিমের যে একটা বড় ধরনের বাজে ঘটনা ঘটেছিল, সেটি কী আপনি জানতেন?

শামীম এই প্রশ্নের কী উত্তর দিবে জানে না। সে বুঝতে পারছে না, কোন উত্তর দিলে সে বিপদে পড়ে যাবে। কিন্তু এখানে উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। ফোরকান আলী বললেন, কী, জানতেন? না জানতেন না?

জি না জানতাম না।

আপনারা একই বাসায় দিনের পর দিন থেকেছেন, উনি আপনার স্ত্রীর বড় বোন। তাদের ঘরে সেই অর্থে কোনো পুরুষ মানুষ ছিল না। সেক্ষেত্রে দায়িত্বটা অনেকাংশে আপনার উপরও বর্তায়। আর আপনি এই ঘটনার কিছুই জানতেন না?

শামীম কাঁচুমাচু মুখে বলল, সত্যিই জানতাম না।

আপনার স্ত্রী এই ঘটনা কখনো আপনাকে বলেননি?

জি না স্যার।

ফোরকান আলী গলা বাড়িয়ে কাউকে ডাকলেন। অনু আর শামীম অবাক চোখে দেখলো একজন নারী কনস্টেবল দরজায় দাঁড়ানো। তার সাথে হাফসাকে কোলে নিয়ে তনু দাঁড়িয়ে আছে। তনুর চোখেমুখে তীব্র ভয়ের ছাপ।

ফোরকান আলী তাকে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। তনু সন্ত্রস্ত পায়ে বসতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার হাজবেন্ডকে আপনি কখনো বলেননি যে আপনার বড় বোনের সাথে ওয়াসিম কী করেছিল?

তনু মাথা নাড়লো। ফোরকান আলী বললেন, কেন?

তনু ভয়ার্ত গলায় বলল, কারণ এই ঘটনা আমিই জানতাম না।

ফোরকান আলী বিস্মিত গলায় বললেন, কেন? আপনি জানতেন না কেন? এই ধরনের ঘটনা ঘটলে বোনদের জানাটা তো খুবই স্বাভাবিক। না-কি আপনাদের মধ্যে কোনো কারণে সিরিয়াস কোনো সমস্যা ছিল?

এই ঘটনা যখন ঘটে, তখন আমি এখানে ছিলাম না। শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম।

আপনার মা, বা অন্য কেউ আপনাকে জানাননি? বা আপনি আসার পরও না?

তখন আমার সাথে কারো কোনো কথা হতো না। আসা যাওয়াও ছিল না।

কেন?

তনু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আমি পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। এই নিয়ে ঝামেলা ছিল।

বড় বোন আপনাদের জন্য এত কষ্ট করলেন, আর আপনি তাকে রেখে পালিয়ে বিয়ে করলেন, তার বিয়ে ভবিষ্যতের কথা ভাবলেন না?

তনু জবাব দিলো না। চুপ করে রইল। ফোরকান আলী সাথেসাথেই আবার বললেন, এনিওয়ে এটা আপনাদের পার্সোনাল ইস্যু। যদিও পার্সোনাল বহু কিছুই খুঁড়ে দেখতে গেলে দেখা যায়। তা আর পার্সোনাল থাকে না। তার মানে আপনার হাজবেন্ড অনুর ঘটনা কিছুই জানতো না?

না।

আপনি হাজবেন্ডকে এই বিজনেসে ঢুকতে আপনি বাঁধা দেননি?

আমি জানতাম না।

কী জানতেন না?

সে যে ওয়াসিমের সাথে ড্রাগসের বিজনেস করে।

এখন জানলেন কী করে? আমি তো আপনাকে কিছু বলিনি!

বড়’পু বলেছে।

আচ্ছা, কিন্তু আপনি তার আগে বুঝতে পারেননি?

নাহ্।

এই যে হঠাৎ এত টাকা আসতে শুরু করলো, তারপরও না?

ও বলতো ওর বইয়ের বিজনেস থেকে টাকা আসছে।

আর আপনি তা বিশ্বাস করতেন?

তনু এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না। সে চুপচাপ বসে রইল। ফোরকান আলী অনুকে বললেন, আপনি নতুন চাকরির ব্যবস্থা করে ফেলেছেন?

হুম।

প্রিন্টিং কোম্পানি?

জি।

ওখানে আপনার কাজ কী?

আপাতত তেমন কিছু না। তবে ভাবছি ডিজাইনিং টিজাইনিং কিছু একটা শিখবো।

আচ্ছা। আর সব কিছু ঠিকঠাক? ওয়াসিমের সাথে যোগাযোগ হয়েছিল?

নাহ।

ফোরকান আলী সেদিনের মতো তিনজনকেই বিদায় দিলেন। তবে বিদায়ের আগে বলে দিলেন, প্রয়োজনে যে-কোনো সময়ে আবার তাদের ডাকতে পারেন। সুতরাং কেউ যদি দুয়েকদিনের বেশি সময়ের জন্য কোথাও যায়, তবে অবশ্যই তাকে জানিয়ে, তার অনুমতি নিয়েই যেতে হবে।

*

অনু শেষ অব্দি নাবিলার প্রিন্টিংয়ের অফিসটাতেই ছোট একটা কাজে জয়েন করেছে। বেতন খুব বেশি না হলেও সময়টা কেটে যাচ্ছে। তার কাজটা ঠিক মাস ভিত্তিতেও না। দশ বা পনেরো দিনের একেকটা প্রজেক্টের ভিত্তিতে। সে যে ক’দিনের কাজ করবে, সে কদিনের বেতন পাবে। এর মধ্যে একদিন হাসানের সাথে দেখা। হাসান বলল, আপনাকে ফোন দিলে ধরেন না কেন?

ইচ্ছে করে না।

এভাবে কেউ বলে?

তাহলে কীভাবে বলে?

কী মুশকিল, আপনি তো দেখি দিনদিন আরো কঠিন হয়ে উঠছেন।

আমি কী আগে কঠিন ছিলাম না-কি?

অবশ্যই ছিলেন। আর শোনেন, ফোন ধরতে ইচ্ছে না করলেও সৌজন্যতা দেখিয়ে বলতে হয়, ফোন দিয়েছিলেন? কবে? দেখিনি তো। খেয়াল করিনি হয়তো। বা, ইশ, হাসান ভাই সরি। দু’বারই ব্যস্ত ছিলাম, পরে আর ব্যাক করা হয়নি, ভুলে গিয়েছিলাম। সরি।

আজকাল ক্লান্ত লাগে এসব করতে।

আপনাকে দেখে অবশ্য ক্লান্তই মনে হচ্ছে।

অনু ম্লান হাসলো, আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন…।

হাসান বলল, একটা কথা বলি?

হুম।

এভাবে কী জীবন চলে?

জীবন সবভাবেই চলে। মানে চলে যায় আর কী! জীবনকে বরং কোনোভাবেই আটকে রাখা যায় না।

আপনার হতাশ লাগে না?

লাগে।

তাহলে?

ভেবে নেই, ভালো লাগা, মন্দ লাগার মতো হতাশ লাগাটাও একটা অনুভূতি।

আপনার বিষয়ে অফিসে পুলিশ খোঁজখবর নিতে এসেছিল বেশ আগে, তখনই আপনাকে ফোন দিয়েছিলাম, ঘটনা কী জানার জন্য।

জানতে পেরেছিলেন?

যা পেরেছিলাম, সে সব তো আর জানা নয়।

কেন?

আজেবাজে সব কথা। আপনি তো জানেনই, মানুষের মেন্টালিটি কী জঘন্য।

মানুষ ঠিকই আছে, ঘটনাগুলো জঘন্য।

কী হয়েছে, বলবেন?

উঁহু।

কেন?

বলতে ইচ্ছে করছে না দেখে। আচ্ছা হাসান ভাই, এই যে বললেন, আমার সম্পর্কে পুলিশ তথ্য চাইছে বলে মানুষ আমাকে নিয়ে জঘন্য, আজেবাজে সব জিনিস ভাবছে, এই ভাবাভাবিটা কিন্তু অস্বাভাবিক না। হয়তো তাদের জায়গায় থাকলে আমিও তাদের মতো করেই ভাবতাম। কারণ এমন একটা মেয়ে, এভাবে অফিস ছেড়ে চলে গেল, একটা রিউমার তো ছিলই। তারপর আচমকা তার সম্পর্কে পুলিশ খোঁজখবর নেয়া শুরু করলো। বিষয়টা নিয়ে আজেবাজে কিছু ভাবা কী অস্বাভাবিক?

অবশ্যই অস্বাভাবিক না।

তাহলে আপনিও নিশ্চয়ই ভেবেছেন। কিন্তু সামনে বলে ফেলতে পারছেন না, তাই না?

একদমই না।

আপনি ভাবেননি? নাহ্।

কেন?

কারণ সম্ভবত আপনাকে আমি ভালোবাসি। হাসান কথাটা বলে নিজে নিজেই থতমত খেয়ে গেল। অনু অবশ্য কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ভালোবাসলে জঘন্য ভাবার জিনিস জঘন্য ভাববেন না?

অনু এমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলবে হাসান ভাবেনি। সে বলল, ভালোবাসা তো একটা অনুভূতি তাই না?

হুম।

তো এই অনুভূতিগুলো কেমন জানেন? এগুলো হলো ধরুন বিভিন্ন রঙের কাঁচের পাত্রের মতো। একটা লাল রঙের কাঁচের পাত্রে যদি আপনি পানি রাখেন, দেখবেন পানিটাকে লাল মনে হচ্ছে। হলুদ রঙের কাঁচের পাত্রে পানি রাখলে পানিটাকে লাগবে হলুদ। অনুভূতিটাও এমন, আপনি যদি কাউকে ঘৃণা করেন, অপছন্দ করেন, সে যা-ই করবে, আপনার কাছে তাই অপছন্দ লাগবে। সে ভালো কিছু করলেও আপনি সেখানেও তার খুঁত বা উদ্দেশ্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন। আবার কাউকে সত্যি সত্যি ভালোবেসে ফেললে, সে যা-ই। করুক, আপনার তা-ই ভালো লেগে যাবে। এমনকি সে বড় ধরনের কোনো অপরাধ করে ফেললেও আপনি সহসা তাকে ঘৃণা করতে পারবেন না। বরং নানা যুক্তিতর্ক দিয়ে তার সেই অপরাধটিকেও বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করবেন।

তার মানে আপনি আমাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসেন?

হাসান এবার আর জবাব দিলো না। সে মাথা নিচু করে বসে রইল। অনু বলল, তার মানে আপনি জানেন যে আমি কোনো অপরাধ করেছি। কিন্তু আপনি আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসেন বলেই আমার সেই অপরাধের স্বপক্ষে নানান ধরনের যুক্তি দিয়ে আমাকে আপনার নিজের কাছে নিরপরাধ প্রমাণ করেছেন?

হাসান তড়িঘড়ি করে বলল, না না। তা না। আমি জানি আপনি কোনো অপরাধ করেননি।

কী করে জানেন?

হাসান হঠাৎ কেমন নরম হয়ে গেল। সে ভেজা, গাঢ় গলায় বলল, আমি জানি না, কীভাবে জানি। কিন্তু আমি জানি, এবং এই জানায় কোনো মিথ্যে নেই।

অনু মুহূর্তকাল থমকালো, হাসানের এইটুকু কথায় কিছু একটা ছিল, যা সে আগে কখনো দেখেনি।

.

থানার ঘটনার পর থেকেই তনু ভীষণ জড়সড় হয়ে আছে। ভয়টা সে কোনোভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না। দিন তিনেক বাদে হঠাৎ শামীমের সামনে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল সে। শামীম অবাক গলায় বলল, কী হয়েছে?

আমি আর এই বাসায় থাকব না। তুমি আমাকে প্রয়োজনে রাস্তায় রেখে আসো, কিন্তু আমি আর এখানে থাকব না।

কেন?

আমার ভয় হয়, সারাক্ষণ ভয় হয়। মনে হয়, এই বুঝি পুলিশ এলো।

পুলিশ আসবে কেন?

তনু হঠাৎ রুদ্রমূর্তি ধারন করলো, তুমি জানো না পুলিশ আসবে কেন? তুমি জানো না? পুলিশ আসবে তোমার জন্য। তোমার জন্য পুলিশ আসবে, তারপর তোমাকে না পেয়ে তোমার বউ বাচ্চাকে ধরে নিয়ে যাবে। তোমার বাচ্চার জন্ম হবে জেলখানায়। তোমার বাচ্চা বড় হবে জেলখানায়। তুমি জানো না পুলিশ কেন আসবে? তুমি কিছু জানো না?

শামীম তনুর চেহারা দেখে ভড়কে গেছে। এই সময়ে তার যতটা সম্ভব। শান্ত থাকা দরকার। কিন্তু সে হয়ে আছে অস্থির, অসহিষ্ণু। মানসিকভাবে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। শামীম কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই তনু আবারো কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে পড়ল। সে আচমকা শামীমের পা জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি চলো, কালই তুমি আমাদের নিয়ে গ্রামে চলো। এখানে আমি আর থাকব না। আমি বড়পুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিবো। তারপর চুপচাপ গ্রামে চলে যাব। আর কোনোদিন ঢাকায় আসবো না। আমার ভয় করছে শামীম। আমার খুব ভয় করছে।

শামীম তার পা থেকে তনুর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলল, চাইলেই তো আমি চলে যেতে পারি না তনু। তুমি এটা বুঝতে পারছ না কেন? এখানে ঢোকা সহজ, যাওয়া এত সহজ না। তাছাড়া থানা থেকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, তাদের না জানিয়ে কোথাও যাওয়া যাবে না, তুমি শোনননি?

তনু আবারো খেপে গেল, আমি আগেই বলেছিলাম, আগেই। তুমি তখন শোনো নাই। এখন কেন বলছ? এখন কেন বলছ? আমি কিছু শুনতে চাই না, তুমি আমাদের নিয়ে চলো। আজ, এক্ষুণি চলো।

শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় তনুর গলা জড়িয়ে এলো। শামীম কী বলবে বুঝতে পারছে না। কী করবে তাও না। আরো একটি নিঘুম রাত কাটলো তার।

.

হাসানের সাথে আরো কয়েকবার দেখা হলো অনুর। সেদিন রাতে রুমে ফিরে অনু হঠাৎ ভাবতে লাগল, হাসানের সাথে এই যে তার প্রায়ই দেখা হচ্ছে, এর কারণ কী? সেকি হাসানের সঙ্গ উপভোগ করে? কিন্তু কোনো পুরুষ সঙ্গ উপভোগের এই ব্যাপারটা দীর্ঘদিন তার ভেতর ছিল না। বরং পুরুষ মানেই তার কাছে ছিল ভয়ংকর আতংকের কোনো অভিজ্ঞতা। কিন্তু হঠাৎ করে কী এমন হলো যে হাসানের সাথে কথা বলতে, তার সাথে ঘুরতে কিছুটা হলেও তার ভালো লাগে! এই ভাবনাটা অনুকে কয়েকদিন খুব তাড়িয়ে বেড়ালো। সেদিন শেষরাতের দিকে তার আচমকা মনে হলো, হাসানকে সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। দীর্ঘদিন সে কোনো পুরুষকেই বিশ্বাস করতে পারেনি। না পারার নানান যথাযথ কারণও ছিল। আর এই কারণেই গত তিন বা চারটা বছর হাসান যে নীরবে কিংবা সরবে তাকে ভালোবেসে গেছে, সেটা সে আলাদা করে কখনোই খেয়াল করেনি। বা খেয়াল করলেও এড়িয়ে গেছে, গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এখন আচমকা কী এমন হলো যে সে হাসানের প্রতি এভাবে খানিকটা হলেও হেলে পড়ছে? কেন তার মনে হচ্ছে, হাসান আর দশটা পুরুষের মতো সুযোগসন্ধানী নয়, সে তার পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইছে না! অথচ তার জন্য এটা আরো বেশি স্বাভাবিক।

হাসান হয়তো বয়সে অনুর চেয়ে খানিক ছোটই হবে, হয়তো বছর খানেকের বা তার চেয়ে কিছু কম বেশি। তারপরও কেন এমন হচ্ছে? তাহলে কী এই যে দীর্ঘসময় ধরে হাসান বিরামহীনভাবে নীরবে তার জন্য অপেক্ষা করে গেছে, এই ব্যাপারটি অনুকে অবচেতনভাবেই স্পর্শ করেছে, একটা আস্থার জায়গা তৈরি করেছে? তার এই নীরব অপেক্ষা আর নিরবিচ্ছিন্ন চাওয়াই কী তাহলে এই অবচেতন অনুভূতির অবাক উৎস!

তবে চিরকালীন সতর্ক অনু জানে, হাসান আর সে চাইলেও তাদের বিশেষ কোনো সম্পর্কের পারিবারিক পরিণতি সহজ নয়। এমনিতেই তাকে মেনে নেয়াটা যে-কোনো পরিবারের জন্য খানিকটা হলেও কঠিন। যদিও মা আর অয়ন নেই বলে আগের মতো এখন আর অতিরিক্ত আরেকটা পরিবার বয়ে বেড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে কাউকে ভাবতে হবে না। কিন্তু তারপরও এমন একটি মেয়ে যদি ছেলের চেয়ে বয়সে বড় হয়ে যায়, তবে তা নিশ্চিত করেই আবার একটি নতুন জটিলতা তৈরি করবে, অনু তা জানে।

.

শুক্রবার বিকেলে হাসান এলো। অনু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটু সাজলোও যেন। এই একটু ঠোঁটে লিপস্টিক, একটু পাউডারের পাফ বুলিয়ে নিলো মুখে। একটা ছোট টিপ, আর খোলা চুল। আয়নার সামনে নিজেকে আরেকবার দেখে চলে আসতে গিয়ে আচমকা থমকে গেল সে। তারপর নিজের দিকে দীর্ঘসময় তাকিয়ে রইল। কেমন অচেনা লাগছে নিজেকে। আচ্ছা, এই মেয়েটাকে কী সে চেনে? দেখেছে আগে কখনো? অনুর হঠাৎ মনে হলো, এই মেয়েটা তার অচেনা নয়। সে এই মেয়েটাকে চেনে, খুব ভালোভাবেই চেনে। কিন্তু এই মেয়েটাকে সে বহুবহু বছর ভুলে ছিল। কিংবা জোর করে লুকিয়ে রেখেছিল বুকের ভেতর। আজকাল আস্তে আস্তে করে সেই মেয়েটাই যেন একটু একটু করে জেগে উঠছে। কিন্তু সেই জেগে ওঠা মেয়েটার কোথায় যেন কিছু একটা অন্যরকম, সে ধরতে পারছে না।

অনু আয়নার সামনে থেকে সরে এসে ঘরের দরজার কাছটায় আসতেই তার অকস্মাৎ মনে পড়ে গেল ধরতে না পারা সেই বিষয়টা। তার আসলে মাহফুজের কথা মনে পড়ছিল। কত কত বছর, কত কত দিন রাত্রি, ঘটনা, অথচ আজ এই মুহূর্তে মাহফুজ যেন ঠিক সেই আগের অনুভূতিটা নিয়ে ফিরে এসেছে। সে যেন অনুর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে গেল, তুমি শেষ অব্দি খোলা চুলে বের হচ্ছ?

অনু আবার ঘরে ঢুকলো। তারপর ভোলা চুল খোঁপা করে বেঁধে ঘর থেকে বের হলো। সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে তার আচমকা মন ভার হয়ে গেল। সেই সারাটা বিকেল তার মন আর হালকা হলো না। মেঘলা আকাশের মতো থমথমে মুখ নিয়ে হাসানের সাথে ঘুরে বেড়ালো। হাসান বলল, মন খারাপ আপনার?

উঁহু।

মিথ্যে কেন বলছেন?

মিথ্যে বলছি, কে বলল?

চোখ।

চোখ মিথ্যে বলতে পারে?

সত্য মিথ্যে দুটোই বলতে পারে, কেবল পড়তে জানতে হয়।

আপনি পড়তে পারেন?

সবারটা পারি না, আপনারটা পারি।

তাহলে চোখের কাছেই জিজ্ঞেস করুন।

হাসান হঠাৎ ভরাট গলায় আবৃত্তি করলো, মেঘের মতো ভার হয়ে রয় বুক, মেঘের মতো থমথমে কী ব্যথা, মেঘ তো তবু বৃষ্টি হয়ে ঝরে, আমার কেবল জমছে আকুলতা।

অনু মুখ ঘুরিয়ে বলল, বাহ্! সুন্দর তো! কার লেখা?

হাসান লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, আমার।

আপনি কবিতা লেখেন জানতাম না তো!

আপনি কবিতা পড়েন জানতাম না তো!

হাসানের অবিকল অনুকরণ দেখে অনু হেসে ফেলল। অনু বলল, মেঘেরই আনন্দ, জল জমে ভারি হয়ে গেলেই বৃষ্টি হয়ে কেঁদে ফেলতে পারে।

হাসান বলল, মানুষও পারে।

উঁহু, পারে না। খুব কম মানুষ কাঁদতে পারে। বেশিরভাগ মানুষই কাঁদতে পারে না।

তাহলে কী করে তারা?

হাসে।

দুঃখ পেলেও?

হুম।

তাহলে তাদের দুঃখগুলো অন্যরা কী করে বোঝে?

বোঝে না। জগতে হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা কান্না পড়তে পারা মানুষের খুব অভাব!

কী ছোট্ট একটা কথা! অথচ হাসানের বুকের ভেতরটা তিরতির করে কেঁপে উঠল। কেমন তোলপাড় হয়ে গেল গোটা বুকের এপাড়-ওপাড়। সে হাত বাড়িয়ে অনুর হাতটা ধরলো। অনু প্রথমে কিছুক্ষণ বুঝতে পারল না। তারপর হঠাৎ আবিষ্কার করলো তার শরীর কাঁপছে। সে খুব অবাক হলো, কোনো পুরুষের স্পর্শ যে তাকে আর কখনো এমন করে কাঁপিয়ে দিতে পারে, অনু তা কল্পনাতেও ভাবেনি। বরং পুরুষের স্পর্শের কথা ভাবলেই তার কেবল গা ঘিনঘিনে বিশ্রী এক অনুভূতি হতো। আজ এই মুহূর্তে সেই বিশ্রী অনুভূতিটা কী করে এমন অপার্থিব, অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে গেল, অনু জানে না।

*

শামীম আজ একটু আগেভাগেই দোকান বন্ধ করছে। তনুর শরীরটা খারাপ করেছে হঠাৎ। সে দোকানের শাটার টেনে তালা লাগাতে যাবে, এই মুহূর্তে ফোনটা বাজলো। ওয়াসিমের ফোন। শামীম ফোন ধরে সালাম দিলো। ওয়াসিম অবশ্য সালামের জবাব দিলো না। সে বিড়বিড় করে বলল, সব ঠিক আছে শামীম?

জি ভাই।

কোথাও কোনো ঝামেলা হচ্ছে না তো!

না ভাই।

পুলিশ?

আর ঝামেলা করেনি ভাই।

আচ্ছা। আরেকটা কথা, টাকার হিসাবে একটু ঝামেলা হচ্ছে মনে হয়।

কোন টাকার হিসাব?

আমার একাউন্টে জমা হওয়া টাকার হিসাব। এখান থেকে তো রেগুলার চেক করার সুযোগ নেই। তারপরও মনে হলো, ঠিকঠাক নেই।

একটু ঝামেলা হচ্ছে জানেনই তো ভাই। আর আজম ভাই ছাড়া অন্যরা তো টাকা সেভাবে নিয়মিত দিচ্ছেও না। তাই যখন যা দেয়, ভাবি, একসাথে জমা করে দেবো।

আচ্ছা, ঠিক আছে। শোনো, হাতি বিপদে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে, এই হচ্ছে জগতের রীতি বুঝলে? সমস্যা নেই, বিপদ যেমন আসছে, বিপদ যাবেও। সবার হিসেব তখন কড়ায়-গণ্ডায় আদায় হবে।

জি ভাইয়া, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আর আজম ভাই এদিকটা দেখছি।

তাড়াতাড়ি ভাবলেও শেষ পর্যন্ত বাসায় ফিরতে গভীর রাতই হলো শামীমের। পথে আজমের সাথে দেখা হয়ে গেল। আজম তাকে কী এক বিশেষ কাজে নিয়ে গেল মহাখালী। সেখান থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা। তনুর শরীর যথেষ্টই খারাপ। খারাপ হাফসার শরীরও। সে সম্ভবত কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। শামীমের মা বাসায় নেই। তনু দরজা খুলে দিয়ে শামীমের জন্য ভাত বাড়তে গেল। কিন্তু গোসল করে এসে শামীম আর খেতে বসলো না। সে তনুকে ঘরে ডেকে নিয়ে জানালাগুলো ভালো করে বন্ধ করে দিয়ে বলল, তুমি, মা আর হাফসা, পরশু শুক্রবার গ্রামে চলে যাবে।

শামীমের বলার ভঙ্গি দেখে তনু ভয় গেল। শামীম সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যেটা বলি সেটা শোনো। তোমরা যাবে আমার ছোট ফুপুর গ্রামের বাড়ি। ফুপুর ছেলে মেয়ে কেউ নেই। বয়ষ্ক মানুষ একা একা থাকে। তার বাড়ি কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত এক চরে। ঠিকানা না জানলে কারো সাধ্য নেই, ওখানে গিয়ে কাউকে খুঁজে বের করে। বর্ষাকালে তো নদী হয় সমুদ্রের মতো। আর খরার মৌসুমে অবস্থা আরো খারাপ, মাইলের পর মাইল ধূ ধূ বালু চর। গরু-মহিষের গাড়ি ছাড়া আর কোনো যানবাহনও চলে না।

তুমি কী করবে? তুমি যাবে না?

আমি যাব। পুলিশ নিয়ে তো আমার কোনো ভয় নেই, আসল ভয় ওয়াসিম। এই বিজনেস হঠাৎ করে ছেড়ে তো চলে যাওয়া যায় না। তাছাড়া তার ব্যবসার অনেক গলিখুঁজি, গোপন ব্যাপার-স্যাপার তো আমি জানি। সে এখন যদি জানে, আচমকা আমি চলে গেছি, তাহলে সন্দেহ করতে পারে। আর এমনিতেও বিজনেসে নানা ঝামেলাটামেলা হচ্ছে, এর মধ্যে আমি পালিয়ে গেলে সে আমাকে যেভাবেই পারুক, খুঁজে বের করবেই।

তুমি কখন যাবে তাহলে?

আমি সময় মতোই যাব। তুমি চিন্তা করবে না, আমি চিন্তাভাবনা করেই কাজ করছি। সব ঠিক হয়ে যাবে।

বড়’পুকে জানাবো না?

একদম কাউকে না, কাকপক্ষীও যেন না জানে।

আমার ডেলিভারির ডেট কিন্তু কাছাকাছি চলে আসছে। ওই চরে গিয়ে থাকলে কখন কি বিপদ আপদ হয়ে যায়, ডাক্তার, হাসপাতাল কোথায় পাবো?

সব ব্যবস্থা করা হবে, তুমি টেনশন নিও না। আগামী দুই দিনের মধ্যে গোছগাছ করে নাও। বেশি জিনিসপত্র নেয়ার দরকার নেই। ওখানে সবকিছুর ব্যবস্থা করা হবে। পাকা ঘরও তোলা হবে।

তনু ঝট করে মাথা তুলে বলল, এত টাকা তুমি কই পাবে?

তুমি তোমার কাজ করো। একবার তো বলছি, তোমার এত কিছু ভাবতে হবে না। তুমি শুধু আমি আসার আগ পর্যন্ত আমার বাচ্চা দুটো দেখে রাখবে। বৃহস্পতিবার শেষ রাতে শামীম আগেভাগে ঘুম থেকে উঠে গেল। তারপর তনুকে ডেকে ওঠালো। তনুর হাতে একটা চামড়ার ব্যাগ দিয়ে বলল, এটার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা আছে। টাকাটা হাফসার কাপড়ের ব্যাগটার ভেতর ঢোকাও। কোনো টেনশন করবে না, খুব নরমালি যাবে। কুড়িগ্রাম সদরে গিয়ে কোনো দোকানের ফোন নম্বর থেকে এই টিএন্ডটি নম্বরে ফোন দিয়ে আমাকে চাইবে। শামীম কাগজে লেখা একটা টিএন্ডটি নম্বর দিলো তনুকে, তারপর আমাকে জানালেই হবে যে তোমরা পৌঁছে গেছ।

কেন, তোমার ফোন নম্বর?

আপাতত আমার ফোন নম্বরে ফোন দেয়ার দরকার নেই। আর তুমি যে গ্রামে যাচ্ছ, ওখানে নেটওয়ার্ক আছে বলেও মনে হয় না।

কিন্তু এত টাকা তুমি কই পেলে? এই টাকা আমি নেবো না শামীম। এই টাকার সাথে কোনো একটা বিপদ আছে। বড় বিপদ। আমি টের পাচ্ছি শামীম।

শামীম ঠান্ডা গলায় বলল, চুপ, একদম চুপ। যা বলেছি, তার উপর আর কোনো কথা না। আমি যত শীঘ্রই পারি চলে আসবো।

শামীম টাকার ব্যাগটা হাফসার কথা কাপড়ের বড় ব্যাগের ভেতর ঢোকাতে লাগল, আর তনু তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

.

ফোরকান আলী বসে আছেন শামীমের দোকানের সামনে। আজ তার সামনে কফি আর সিঙ্গারা। তিনি সিঙ্গারায় কামড় বসিয়ে কফিতে চুমুক দিলেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে আরামে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। শামীম বলল, স্যার, সিঙ্গারা আরেকটা আনাবো?

লাভ নাই শামীম সাহেব।

কিসের লাভ?

নির্দেশ অমান্য করে বউকে যে রাতের অন্ধকারে গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন, এখন যত যা-ই করেন, লাভ নাই। সিঙ্গারা, পুরি যা খাওয়ান, কোনো লাভ নাই।

শামীম গলে যাওয়া কণ্ঠে বলল, অন্যভাবে নিবেন না স্যার। আমার বউ প্রেগন্যান্ট, এই সময়ে ঢাকায় কেউ নেই, তাই তাকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। আমি একা এখানে তাকে নিয়ে এইসময়ে কী করতাম, বলেন!।

কিন্তু আপনার বউ তো আপনার গ্রামে যায় নাই, সে গেছে অন্য কোথাও। যদিও অন্য কোথায় গেছে, সেই খবর এখনো বের করতে পারিনি। আপনি বড় ধুরন্ধর মানুষ।

ফোরকান আলী কফিতে আবারো চুমুক দিয়ে বললেন, শোনেন, আপনার বউকে নিয়ে আমার আগ্রহ নেই, আমার আগ্রহ আপনার বড় ভাইকে নিয়ে। তার বিপক্ষে কেউ কোনো স্টেটমেন্ট দিলো না। কোনো স্ট্রং এভিডেন্স নেই, অথচ সবাই জানি কাজটা সে-ই করছে। অন্য কেউ হলে জেলে ঢুকিয়ে দু’দিন। প্যাদানি দিলেই সব বেরিয়ে আসতো। কিন্তু তার খুঁটি শক্ত, এইজন্য অকাট্য প্রমাণ হাতে না নিয়ে তাকে ধরতেও পারছি না, কী মুশকিল বলুন তো!

শামীম স্নান গলায় বলল, খুনটা তো উনি নাও করতে পারেন।

ফোরকান আলীও হাসলেন, তাহলে কে করেছে, আপনি? চলেন, থানায় চলেন তাহলে।

ফোরকান আলী শামীমকে নিয়ে থানায় গেলেন। থানা থেকে শামীম বের হলো সন্ধ্যায়।

.

তনুর ফোন বন্ধ দেখে অনু চিন্তিত হয়ে পড়লো। শামীমকে এই সময়ে সরাসরি ফোন করতে চাইছিল না। বাধ্য হয়ে সেদিন সন্ধ্যায় শামীমকে ফোন করলো সে। শামীম অবশ্য ফোন ধরলো না। সে ফিরতি ফোন করলো গভীর রাতে, সরি আপু, একটা কাজে ব্যস্ত ছিলাম।

তনু কই? ওকে ফোনে পাচ্ছি না।

ওর ফোনটা হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেছে আপু।

বাসায় আর কেউ নেই, যার সাথে ফোনে কথা বলা যেতে পারে?

মাও তো নেই। আমার ছোটবোনকে নিয়ে বড় খাঁলার বাসায় গেছে।

কিন্তু এই মুহূর্তে কী ওকে এভাবে একা রাখা ঠিক?

আপনি টেনশন নিয়েন না আপু। আমি দুয়েকদিনের মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে ফেলছি।

অনু ফোন রেখেও চিন্তামুক্ত হতে পারল না। তার কেন যেন মনে হলো, শামীম তার সাথে মিথ্যে কথা বলেছে!

.

অনু পরদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে বের হতেই দেখলো হাসান দাঁড়িয়ে। চকিতে চারপাশটা একবার দেখে নিতে গিয়ে ভাবলো, এত মানুষের ভিড়ে কে তাকে চিনবে! তাছাড়া চিনলেই বা কী? কেউ একজন তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে, এটা নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কী আছে! বরং খুশি হবার মতো ব্যাপার। কিন্তু অনু কেন। যেন খুশিটাকে লজ্জার আড়াল থেকে পুরোপুরি বের করে আনতে পারল না। তার বরং অবাক লাগছে, এই কদিন আগেও হাসানের সাথে কী নিরেট, রসকষহীন মানুষের মতো কথা বলেছে সে। অথচ মাত্র কয়েক মাসেই সেই মানুষটাকে দেখলেই তার কেমন অন্যরকম লাগে। কথা বলতে গেলে একটা অন্যরকম অনুভূতি টের পায়। হাসান বলল, আমার কাছে একশ কবিতা আছে।

বই বের করবেন?

হুম।

বইয়ের নাম কী হবে?

অনুর জন্য অণুকাব্য।

নাম সুন্দর, কিন্তু মানুষ এই বই পড়বে না।

পুরো পৃথিবীর মানুষ না পড়লেও আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু একজন মাত্র মানুষ না পড়লে আমার অনেক কিছু যায় আসে!

এই কথাগুলো কী খুব বেশি তরল হয়ে যাচ্ছে? অন্য কোনো সময় এমন কথা শুনলে অনু কী করত? কিন্তু অনুর কথাগুলো শুনে তরল মনে হচ্ছে না। বরং কথাগুলো কানে শুনতে যত তরল লাগছে, ভেতরে যেতে যেতে কখন যেন তা ছড়িয়ে যাচ্ছে গাঢ় ধোয়ার মতো। তারপর একটা আবেশে ঢেকে ফেলছে তাকে। এ এক অদ্ভুত রহস্যময় ব্যাপার। আচ্ছা, এমন করে কী আর কেউ তাকে কখনো কিছু বলেছে? এমন করে কী আর কখনো কেউ তার জন্য দাঁড়িয়ে থেকেছে?

অনুর আচমকা মন খারাপ হয়ে গেল। এই মুহূর্তগুলোতে তার মাহফুজের কথা মনে হয়। মাহফুজ তখন ঘন ভারি মেঘের মতো হয়ে যায়। সে ঝড়ের বেগে এসে তার হাসিমুখ সূর্যটাকে ঢেকে দেয়। অনু কী এখনো মাহফুজের এমন যখন তখন চলে আসা চায়? কোথায় সে? অনু জানে না। কিন্তু তার এমন সর্বগ্রাসী হয়ে নিমেষেই চলে আসাটা সে টের পায়।

.

হাসান রিকশায় বসে অনুকে বলল, আমার একটা নেশা আছে।

সিগারেটের? সমস্যা নেই। আপনি সিগারেট ধরাতে পারেন।

উঁহু।

তাহলে?

সুবাসের।

কিসের সুবাস।

চুলের।

মানে? অনু আঁতকে ওঠা গলায় মাহফুজের দিকে তাকালো। মাহফুজ বলল, আপনার চুলের গন্ধ। কতদিন আমি লুকিয়ে-চুরিয়ে ওই চুলের সুবাস নিয়েছি। আমার যেন নেশা হয়ে গেছে। মনে হয় এই নেশায় আমি ডুবে মরে যেতে পারি।

খুবই সস্তা ধরনের কথা। অনু মুখ ফিরিয়ে কথাটাকে পাত্তা না দেয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার শরীর বেয়ে, মন বেয়ে কথাটা যেন ছড়িয়ে যেতে থাকল, জলের ভেতর রং ছেড়ে দিলে রং যেমন ছড়িয়ে যায়, ঠিক তেমন। ধীরে ধীরে পুরোটা জুড়ে ছড়িয়ে গিয়ে রঙিন করে দিতে থাকল।

হাসান ফিসফিস করে বলল, এই যে বাতাস, এই যে শহর, এর কোথাও এমন সুবাসবিহীন বেঁচে থাকার মানে আছে, অথচ সেই সুবাসের উৎসটা যখন। আমার এত কাছে, এত?

অনু একটা অবাধ্য অনুভূতির কাছে হেরে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে সে তার চুলগুলো মেলে দিক। তারপর এই বেপরোয়া হাওয়ায় সেই চুল উড়ে গিয়ে ঢেকে দিক হাসানকে। হাসান ডুবে যেতে থাকুক সুবাসে। সব মেয়েই কী চায়, তার সুবাসে কোনো পুরুষ ডুবে থাকুক?

অনুর সেই কত কত কাল পর নিজেকে আবার আর সকল মেয়ের মতো মনে হতে থাকল। যার ভালোবাসতে পারার সময় আছে, বুকের ভেতর তিরতির করে কেঁপে উঠে সুবাস ছড়িয়ে দেয়ার মতো মন আছে। প্রবল বিশ্বাসে, আস্থায় কারো স্পর্শে আন্দোলিত হবার মতো সুখ আছে। খানিকটা স্বপ্ন দেখারও কী? একটা ঘরের, একটা বারান্দার, একটা বিছানা, দুটো বালিশ আর নিজের একা একটা মানুষের?

তখন রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো জ্বলে উঠেছে। তারা হাতিরঝিলে একটা বেঞ্চির পাশে বসলো। হাসান অনুর হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কী জানেন?

উঁহু।

এই যে আপনার বুকের ভেতর জমে থাকা এত এত দিনের শক্ত বরফটা কিছুটা হলেও গলিয়ে দিতে পেরেছি।

অনু কথা বলল না। হাসানই বলল, আমি জানতাম, আপনি একদিন না একদিন বুঝতেই পারবেন, দেয়ার ইজ সামওয়ান ফর ইউ। সে আর দশজনের মতো নয়।

কিন্তু আমার তো বোঝার কথা ছিল না। আমার বরং জগতটাকেই কেমন বিষাক্ত মনে হতো। মনে হতো সবাই কেমন সুযোগের অপেক্ষায় ওঁত পেতে আছে।

এই জন্যই তো আমি ছিলাম।

কিন্তু আমি যদি বুঝতেই না পারতাম? যদি বুঝতে অনেক দেরি হয়ে যেত?

আমি অপেক্ষায় থাকতাম।

কতদিন?

যতদিন আপনি বুঝতে না পারতেন?

কেন?

ওই যে বললাম ভালোবাসি বলে।

ভালোবাসলেই সবাই অপেক্ষায় থাকে?

হুম থাকে। কেউ সরবে, কেউ নীরবে। সারা জীবনের জন্য হারিয়ে ফেলা মানুষের জন্যও মানুষ নিজের অজান্তেই অপেক্ষায় থাকে।

কিন্তু সে হয়তো তখন অন্যের?

পুরোপুরি পাওয়ার জন্য হয়তো নয়, এক চোখ দেখার জন্য হলেও।

কিন্তু নিজে যদি অন্যের হয়ে যায়, তারপরও অপেক্ষায় থাকে?

হুম, থাকে। কারো সাথে কাটিয়ে দেয়া জীবনজুড়েও বুকের ভেতর নীরবে সেই অন্য মানুষটাকে পুষে রেখে দেয়। এই কথা সে ছাড়া এই জগতে আর কেউ জানে না।

কথাটা অনুর বুকে গিয়ে লাগল! সেও কি তার বুকের ভেতর এমন করেই কাউকে পুষে রেখেছে? যার কথা সে কখনো কোনোদিন কাউকে বলতে পারেনি, পারবেও না কোনোদিন। থাকুক না কিছু কষ্ট নিজের একার, কিছু অনুভূতি খুব গোপন। এই অনুভূতিগুলো আসলে মন খারাপের মুহূর্তের সঞ্চয়। তখন বুকের ভেতরের গোপন কুঠুরি থেকে আলগোছে এই অনুভূতিগুলো বের করে ছুঁয়ে দেখা যায়। সেই ছোঁয়াছুঁয়ি আরো একটা রুক্ষ্ম দিন মমতায় বেঁচে থাকায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *