৪. ভোররাতের দিকে

ভোররাতের দিকে অয়নের ঘুম ভেঙে গেল। তনুর ঘর থেকে মৃদু কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। কান্নার শব্দ যেন বাইরে থেকে কেউ শুনতে না পায়, সম্ভবত সেইজন্যই মুখ চেপে ধরে কাঁদছে তনু। তারপরও অয়নের ঘুম ভেঙে গেল। সে খাট থেকে নামতে গিয়ে আবিষ্কার করলো, সালমা বেগম খাটের ঠিক পাশেই, নিচে মেঝেতে জায়নামাজের উপর শুয়ে আছেন। অয়ন আবছা অন্ধকারেই ঘুমন্ত মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। সালমা বেগমের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, তবে তার পরনের সাদা শাড়ি আর তজবির দানাগুলো অন্ধকারেও যেন জ্বলজ্বল করছে। অয়ন আরো কিছুক্ষণ সেভাবেই বসে রইল। তার কেন যেন মনে হচ্ছে মা আজও খুব করে কেঁদেছে। তার খুব ইচ্ছে করছে মায়ের কোলের কাছে গিয়ে গুটিশুটি মেরে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে, কিন্তু সে তা করলো না।

তনুর ঘর থেকে কথা বলার শব্দ আসছে। সাথে কান্নাও। অয়ন একবার ভাবলো সে উঠে তনুর ঘরের দিকে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হলো, এত রাতে আপা দুলাভাইয়ের ঘরে যাওয়াটা কী তার ঠিক হবে? এই ভাবতে ভাবতেই ফজরের আজান দিয়ে দিলো। আজানের শব্দে সালমা বেগম ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। অয়নকে বসে থাকতে দেখে আঁতকে ওঠা গলায় বললেন, অয়ন?

অয়ন বলল, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল মা, তারপর আর ঘুম আসছিল না।

তাই বলে এভাবে বসে থাকবি? আমাকে ডাকলেই পারতি।

তোমাকে ডাকতে ইচ্ছা করছিল না মা।

কেন? ডাকতে ইচ্ছা করছিল না কেন?

অয়ন লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, তোমাকে দেখতে খুব ভালো লাগছিল মা। মনে হচ্ছিল তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলেই আর তোমাকে এভাবে দেখতে পারব না।

কী সামান্য সহজ এইটুকু কথা। কিন্তু তাতেই সালমা বেগমের বুকের ভেতরটা যেন হুহু করা হাওয়ায় কেঁপে উঠল। তিন উঠে অয়নের পাশে বসলেন। তারপর অয়নের গালে, কপালে, বুকে হাত ছুঁইয়ে বললেন, শরীর খারাপ লাগছে না তো বাবা?

না, মা। শরীর ঠিক আছে।

তাহলে?

তাহলে কিছু না মা।

খিদে পেয়েছে?

নাহ্, এই সাত সকালে কারো খিদে পায়?

সালমা বেগম বুঝতে পারছিলেন না তিনি কী করবেন। বাইরে একটা-দুটো পাখি ডাকছে। পূবাকাশ ফর্সা হয়ে উঠছে। সালমা বেগম বললেন, আমি যাই, অযু করে নামাজটা পড়ে নেই।

অয়ন মাথা নেড়ে বলল, আচ্ছা।

সালমা বেগম বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই অয়ন হঠাৎ মাকে ডাকলো, মা।

সালমা বেগম ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, কী?

অয়ন বলল, আমিও আজ তোমার সাথে নামাজ পড়ি মা?

সালমা বেগম খুবই খুশি হলেন। তিনি অয়নকে ধোয়া কাপড় এনে দিলেন। অয়ন ওজু করে এসে মায়ের পাশে বসে নামাজ পড়লো। নামাজ শেষে অয়নের মাথাটা কোলের মধ্যে নিয়ে গুনগুন করে কোরআন শরিফ পড়তে লাগলেন সালমা বেগম। ছোট্ট শিশুর মতো মায়ের কোলের ভেতর মাথা রেখেই কখন ঘুমিয়ে গেল অয়ন! চারদিকে তখন ঝলমলে আলো ফুটতে শুরু করেছে। সালমা বেগমের হঠাৎই মনে হলো, অনু এখনো উঠছে না কেন, এত বেলা অব্দি তো সে কখনো ঘুমায় না! তিনি অয়নের মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে অনুকে ডাকতে গেলেন। গিয়ে দেখলেন, অনু জানালার পাশে বসে আছে, জানালাটা খোলা! খোলা জানালা দিয়ে ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া আর ঝলমলে আলো আসছে। আজ কতকাল পর এই জানালাটা খোলা হলো? তিনি গিয়ে অনুর কাঁধে আলতো। করে হাত রাখলেন। অনু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। সালমা বেগম বললেন, আজ অফিসে যাবি না?

অনু মাথা নাড়লো, যাব মা।

কখন? বেলা হয়ে গেল তো! উঠে গোসল-টোসল কর, আমি নাস্তা দিচ্ছি।

আরেকটু পরে যাই মা।

রোজ দেরি করে অফিসে গেলে চাকরি থাকবে? আর তুইই তো বলিস, তাড়াতাড়ি বেরুতে পারলে রাস্তার জ্যামটা একটু কম থাকে!

অনু মৃদু হাসলো, কতদিন পর এই জানালাটা খুলোম বলতো মা? একটু বসি।

সালমা বেগম অনুর কথার জবাব দিলেন না। কিন্তু হঠাৎই যেন মনে পড়েছে, এমন ভঙ্গিতে গিয়ে তিনি জানালাটা বন্ধ করে দিতে দিতে বললেন, তুই কী পাগল হয়ে গেছিস অনু?

হলে তো বেশ হতো মা।

সালমা বেগম জানালাটা বন্ধ করতে গিয়ে পলকের জন্য পাশের দোতলার জানালাটা দেখে নিলেন। জানালাটা এখনো বন্ধ। তিনি আচমকা গলা নামিয়ে বললেন, ওই জানালাটা আর খোলেনি?

জানি না মা!

তোর কি হয়েছে বল তো?

আমার কিছু হয়নি মা।

কিছু একটা তো হয়েছেই, বল?

অয়ন উঠেছে? অনু প্রসঙ্গ পাল্টালো।

নাহ্। সালমা বেগম বুঝলেন, অনু আর এই বিষয়ে কথা বলতে চায় না। তিনিও আর ঘাটালেন না। অনু উঠে বাথরুমে ঢুকলো। যতই গরম পড়ক, ভোরবেলার প্রথম পানির স্পর্শটা হাড় কাঁপানো হয়। অনু মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে আয়নায় তাকালো। তাকে দেখে কী বোঝা যাচ্ছে যে তার চাকরি নেই? এখন কী করবে সে? এই মুহূর্তে বাসায় কোনোভাবেই বলা যাবে না যে তার চাকরি নেই। কিন্তু সারাদিন কী করবে সে? বাসায় থাকলে সবাই নানান প্রশ্ন করবে। কিন্তু বাইরেও বা কোথায় যাবে? অনু একটু সময় নিয়েই বাথরুম থেকে বের হলো। তার চেয়েও বেশি সময় নিয়ে বাইরের পোশাক পরলো। তারপর খেতে বসলো। অয়ন তখনো ঘুমাচ্ছে। সালমা বেগম তাড়া দিলেন, কী হলো? তুই অফিসে যাবি না আজ?

যাচ্ছি মা।

মনে আছে, কাল যে শুক্রবার?

মনে থাকার কী হলো?

সালমা বেগম গলা নামিয়ে বললেন, অয়নের নামে একটা খাসি ছদকা হবে, বেনু কিনেছে। আগামীকাল বাদজুমা মিলাদও হবে। খরচ সব বেনুই দিবে।

অনু কথা বলল না। খেয়ে উঠে দাঁড়ালো। সে ভাবছে আজ বসুন্ধরা সিটির দিকটাতে একটু যাবে। যদিও যেতে মন সায় দিচ্ছে না। সেদিন পরপর দু’বার তোহা ইকরামকে ফোন দেয়ার পরও ফোন ধরেনি সে। এমনকি পরে আর ফিরতি ফোনও করেনি। বিষয়টি নিয়ে একটা অস্বস্তি খচখচ করছিল অনুর মনে। কিন্তু এছাড়া তো আর কোনো উপায়ও দেখছে না সে। যাওয়ার আগে আরেকবার ফোন দিয়ে দেখবে কি-না ভাবছিল অনু। এই সময়ে বেনু এলো।

বড়’পু, একটু শুনবি?

হু, বল?

গতকাল রাতেও তনুকে শামীম ভাই মেরেছে।

কেন?

কেন আবার? টাকা। একটা কাজ করব বড়পু?

কী কাজ?

আমার কাছে কিছু টাকা আছে, ওটা শামীমকে দিয়ে দেই?

তুই টাকা পেলি কই? শুনলাম অয়নের জন্য খাসিও ছদকা দিচ্ছিস?

আরিফুল গ্রিস যাওয়ার আগে আমাকে কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছিল, ওগুলো খরচ হয়নি। পড়েই ছিল।

পড়ে থাকুক। আরিফুলের অবস্থা তো ভালো না। কখন কোন বিপদ আসে, তার ঠিক নেই।

কিন্তু তনুর তো এখন মহাবিপদ। শামীম বলছে কিছু টাকা হলেই না-কি ও ব্যবসাটা দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারবে।

পারবে না। আর তুই কোনো বিপদে পড়লে তখন তোকে দেখবে কে? নিজেকে বিপদে ফেলে অন্যকে উদ্ধার করার দরকার নেই।

তুইও তো তাই করছিস, করেছিস। তা করছিস কেন?

অনু আর কথা বাড়ালো না। সে তনুর ঘরে গিয়ে দেখলো তনু টেবিলে মাথা রেখে আধশোয়া ভঙ্গিতে বসে আছে। তার চোখ মুখ ফোলা। ভ্রুর উপরের দিকটা খানিকটা কেটে গেছে। অনুকে দেখেও তনু নড়লো না, বসেই রইল।

অনু পাশে গিয়ে বসলো। তারপর শান্ত গলায় বলল, শামীম কই?

তনু জবাব দিলো না। অনুই বলল, কত টাকা চায় ও?

তনু তাও কথা বলল না। তার চোখে শূন্য দৃষ্টি। অনু আলতো করে তনুর মাথায় হাত রাখলো। তারপর গালে, কপালে। তনুর গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। অনু আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বলল, আমি এখন বেরুচ্ছি। শামীম ফিরলে ওকে বলবি, ও যেন বাসায় থাকে। ওর সাথে আমার কথা আছে।

তনু তাও কোনো কথা বলল না। কেবল তার ফোলা চোখের কোল গড়িয়ে এক ফোঁটা জল পড়লো।

অনু সেদিন আর তোহা ইকরামকে ফোন দিলো না। সে সারাদিন পরিচিত, অর্ধপরিচিত মানুষজনের কাছে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ালো। সরাসরি চাকরির কথা বলতে তার সংকোচ হচ্ছিল খুব। দুয়েকজনের কাছে বললেও বেশিরভাগের কাছেই বলতে পারল না। চাকরির সরাসরি আশ্বাসও অবশ্য কেউ দিলো না। একজন খুব আফসোস করে বললেন, ইশ, এই আর কয়েকটা দিন আগে যদি বলতেন, তাহলেই হয়ে যেত। তখন কী যে একটা সুযোগ ছিল!

আরেকজন সিভি পাঠিয়ে রাখতে বললেন, সুযোগ এলে ডাকবেন। সারাদিনের এই অভিজ্ঞতা নিয়ে অনু যে হতাশ তা নয়। বরং সে আগে থেকেই জানতো, চাকরিটা এখন সহজ কিছু নয়। আর যদি কিছু জোটেও, তাতে আগের চাকরির অর্ধেক বেতনও সে পাবে না। বিজয় সরণীর কাছে এসে বাস দীর্ঘ সিগন্যালে পড়লো। ঘামে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে আছে সবাই। কী মনে হতে অনু বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলো। এ জায়গাটায় চওড়া ফুটপাত। হাঁটতে বেশ আরাম। ভিড়ভাট্টা তেমন নেই। মৃদু হাওয়া বইছে। অনু অনেকটা পথ হাঁটলো। সেদিন হাসানের সাথে রাতে বাইকে এসে যে জায়গাটায় থেমেছিল, সেখানে এসে থামলো অনু। এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে গিয়ে কী করবে! তাছাড়া এখন বাড়িতে গেলেই আবারো সেই নানান প্রশ্ন। ক্রিসেন্ট লেকের সেতুটা পার হয়ে উদ্যানে ঢুকলো সে। ফাঁকা একটা জায়গা দেখে বসলো। তার সামনে দুটো চড়ুই পাখি মাটিতে পড়ে থাকা খাবার খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। দৃশ্যটা খুব সাধারণ, কিন্তু অনু যেন তন্ময় হয়েই দৃশ্যটা দেখলো। কতক্ষণ বসে আছে অনুর খেয়াল নেই। তার তন্ময়তা কাটলো হাওয়াই মিঠাইওয়ালার ডাকে, হাওয়াই মিঠাই নিবেন আফা?

অনু হাওয়াই মিঠাই নিলো। একটা লাল আরেকটা হলুদ। তারপর হাওয়াই মিঠাই দুটো হাতে নিয়ে বসে রইল।

অনুর হঠাৎ মনে হলো, সে যে এখানে এসে একা একা বসে আছে, এর পেছনে একটা স্পষ্ট কারণ আছে। সেই কারণটা সে এতক্ষণ ধরতে পারেনি। ধরতে পারেনি বলেই পুরোটা সময় ধরে কিছু একটা খচখচ করছিল মনে। তার আসলে মাহফুজের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। ঠিক এই জায়গাটায় মাহফুজের সাথে কতবার এসে বসে থেকেছে সে! কী অদ্ভুত, সে কী তাহলে অবচেতনে মাহফুজের কথা ভাবতে ভাবতেই এখানে চলে এসেছে!

অনুর নিজের কাছেই বিষয়টা অবাক লাগল। এই এতগুলো বছর তো মাহফুজকে একরকম ভুলেই ছিল সে। আজকাল হঠাৎ হঠাৎ তাকে এমন করে মনে পড়ার কারণ কী? না-কি খারাপ সময়ে মানুষ চেতনে অবচেতনে আশ্রয় খুঁজে বেড়ায়? আচ্ছা মাহফুজ কী কখনোই তার আশ্রয় ছিল? ওই ভীরু, খানিকটা বোকা বোকা স্বভাবের সহজ ছেলেটা? অনু দীর্ঘসময় ভাবলো, কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর খুঁজে পেল না।

সে আরো কিছুক্ষণ একইভাবে বসে রইল। কত কত মানুষ তার চারপাশজুড়ে। কিন্তু এই এত এত মানুষের ভিড়েও কী নিঃসঙ্গ একা এক মানুষ সে!

একজোড়া সদ্য বিবাহিত কম বয়সি ছেলে-মেয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। মেয়েটার পরনে ভারি চকমকিওয়ালা সস্তা লাল শাড়ি। ছেলেটার পরনে ছোপ ছোপ জিন্স আর লম্বা ঢোলা শার্ট। মেয়েটা এখনো শাড়ি সামলাতে শেখেনি। সে একহাতে শাড়ির কুঁচি আর আরেক হাতে স্বামীর হাত ধরে খুব সাবধানে হাঁটছে। এত লোকের ভিড়ে বউ তাকে অমন জড়াজড়ি ধরে হাঁটছে দেখে ছেলেটা লজ্জায় ভীষণ গুটিয়ে আছে। শাড়িতে পা বেঁধে মেয়েটা আচমকা হোঁচট খেলো। শেষ মুহূর্তে ছেলেটা খপ করে বউকে ধরে ফেলল। তারা এসে বসলো অনুর ঠিক সামনেই। ছেলেটা মেয়েটাকে বকছে, বলছিলাম না, শাড়ি পরন লাগত না। না ওনার শাড়ি না পরলে চলতোই না।

মেয়েটা চাপা স্বরে বলল, আপনের মায়ই তো কইলো, শাড়ি ফিন্দা আইতে। আমি কী আইতে চাইছি?

মায় কইলেই শুনতে হইবো?

তাইলে কার কথা শুনমু?

কারো কথাই শোনোন লাগত না।

রাগ করেন ক্যা?

রাগ ক্যান করব? আমার কী রাগ আছে যে রাগ করব?

আপনের আবার রাগ নাই? আপনের প্যাট ভর্তি রাগ। মানুষ হইছেন এইটুক, রাগ হইছে আসমান জোড়া।

তুই আর কথা কইস না।

আমি কথা না কইলে কেউ কথা কইবো? ওই যে জিন্সের প্যান্ট ফিন্দা হাইট্টা যাইতেছে, ওই মাইয়ায় আইয়া কথা কইবো?

ছেলেটা কথা বলল না। সে মুখ ভার করে বসে আছে। মেয়েটা হঠাৎ বলল, আচ্ছা, আর রাগ কইরা থাইকেন না। আরেকদিন জিন্সের প্যান্ট আর ওই যে কি জানি আনছেন, ওইগুলান ফিন্দাই বাইর হইমু।

নাহ, তোর ফেন্দন লাগত না। আইজই বাসাত গিয়া ওইগুলান যদি আগুন দিয়া না পুড়ছি, তো আমার নাম আলম না।

কী তাইলে? জানে আলম? আলমের আগে একখান জান লাগাই ডাকমুনে, ঠিক আছে?

মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। ছেলেটা যেমন গম্ভীর মুখে বসে ছিল, তেমন গম্ভীর মুখেই বসে আছে। মেয়েটা হাসি থামিয়ে বলল, আপনে খালি খালি রাগেন, বোঝেন না তো কচুটাও। আচ্ছা, এহন ঘরভর্তি লোক, ময়মুরুব্বি সবাই আছে। আর বিয়াও হইলো মাত্র কয়দিন, এহনই কী সবাইর সামনে ওইগুলান ফিন্দা বাইর হওন যায়? মাইনসে কইবো গ্রামেরতন আইসাই মাইয়ার গায়ে টাউনের বাতাস লাগছে। আফনে না হয় শহরে থাহেন, আমি তো আর শহরে থাহি নাই কোনোদিন। আর লজ্জা শরম বলতেও তো একটা জিনিস আছে, না-কি?

বললাম তো, তুই তোর লজ্জা শরম লইয়াই থাক।

এইবার কিন্তু আমার রাগ লাগতেছে।

ছেলেটা তাও কথা বলল না। মেয়েটাই আবার বলল, আমার লগে ভালো কইরা কথা কন কইলাম। আমার রাগ কিন্তু খারাপ জিনিস।

ছেলেটা বিরক্ত গলায় বলল, আমি ভালো কথা জানি না।

ক্যান, ভালো কথা জানেন না ক্যান?

কারণ আমি খারাপ মানুষ।

আপনে খারাপ মানুষ হইবেন ক্যান? আমি তো খারাপ মানুষের বউ হমু না।

ছেলেটা আবারো চুপ। মেয়েটা হঠাৎ বলল, আমি এখন একটা কাণ্ড ঘটামু।

ছেলেটা মেয়েটার দিকে ঘুরে বলল, কী কাণ্ড?

আপনে যদি আমার লগে ঠিক মতো কথা না বলেন, তাইলে এহন সবার সামনে আপনেরে জাইত্তা ধইরা একখান চুমা দিয়া দিমু। গালে লাল লিবিস্টিকের দাগ লইয়া আপনে ঘুইরা বেড়াইবেন।

ছেলেটা হঠাৎ আতঙ্কিত ভঙ্গিতে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো। মেয়েটা তার আগেই হাত বাড়িয়ে ছেলেটার শার্টের কলার টেনে ধরলো। তারপর বলল, কই যান? আইজ আপনের এক দিন কী, আমার একদিন।

ছেলেটা করুণ কণ্ঠে বলল, দ্যাহো, এই মানুষের মইধ্যে এইরম কইরো না। মাইনষে কী কইবো, কও? তোমার না কোনো লজ্জা শরম নাই।

আপনের জন্য জিন্সের প্যান্ট পইরা মাইনষের মইধ্যে ঘুইরা বেড়াবো, লজ্জা শরম রাইখ্যা আর কী হইবো। আসেন চুমা দেই, চুমা।

ছেলেটা দুই হাতে মেয়েটার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। সে ভীত সন্ত্রস্ত হরিণের বাচ্চার মতো এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। কেউ দেখে ফেলল না তো!

মেয়েটা খিলখিল করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। সে বলল, আইজ আপনার মাফ নাই। গালে লিবিস্টিকের দাগ লইয়াই আইজ আপনেরে আমি ঘুরামু। কোনো মাফ নাই আপনের।

ছেলেটা শেষ পর্যন্ত নানান শর্তে রাজি হয়ে মাফ পেল। তারা দুজন এখন কুটকুট করে বাদাম খাচ্ছে। ছেলেটা বাদাম খুঁটে খুঁটে বাঁধানো বেঞ্চির উপর রাখছে। মেয়েটা একটা একটা করে বাদাম মুখে তুলে দিচ্ছে। নিজের মুখে একবার, স্বামীর মুখে একবার। অনু চোরাচোখে দীর্ঘসময় তাদের দেখলো। তারপর উঠে গিয়ে তার হাতের হাওয়াই মিঠাই দু’খানা দুজনের সামনে ধরে বলল, তোমাদের দুজনের জন্য, নেবে?

মেয়েটা ফট করে হাত বাড়িয়ে বলল, লালখান আমারে দেন।

অনু যখন ফিরে আসছে, তখন ছেলেটা আবারও মেয়েটাকে বকাঝকা শুরু করছে। মেয়েটা অপরিচিত কারো কাছ থেকে কেন হাওয়াই মিঠাই নিলো, কেন তার ভালো-মন্দ বোঝার বুদ্ধি নেই, কেন সে বুঝতে পারে না যে ঢাকা শহরে অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে কোনো কিছু নেয়া মোটেও ঠিক নয়। এমন আরো কত কী! মেয়েটা অবশ্য স্বামীর বকাঝকাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। সে। খিলখিল করে হাসছে। অবাক ব্যাপার হলো, সেই হাসি শুনতে শুনতে অনুর চোখ কেন যেন ভারি হয়ে এলো।

*

বাড়ি ঢোকার ঠিক আগে গেটের সামনে এসে দাঁড়াতেই অনুর চোখজোড়া আপনা আপনিই চলে গেল দোতলার জানালায়, জানালাটা আজও বন্ধ। তবে একটা বিষয় দেখে অনু থমকে গেল। বন্ধ জানালার স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর থেকেও জানালার পর্দাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের ফিনফিনে সাদা পর্দার বদলে আজ নতুন নীল রঙের পর্দা দেখা যাচ্ছে। জানালাটায় বহুদিন ধরে সেই একই রঙের সাদা পর্দা ঝুলছিল। বিষয়টা খুব অবাক করলো অনুকে। গত কয়েকটা দিন ঐ জানালার কথা যেন কিছুটা ভুলেই ছিল সে। আজ এই মুহূর্তে আবার সেদিন ভোরের সেই গা শিরশির করা অনুভূতিটা ফিরে এলো।

অনু যখন ঘরে ঢুকলো তখন মাগরিবের আজান হয়ে গেছে। বেনু রাজ্যের থালা বাসন এক করে মাজছে। তনু ড্রইংরুমে অয়নের বিছানাটা গোছাচ্ছে। অয়ন ঘরে কোথাও নেই। অনু বলল, তোর জ্বরটা কমলো?

তনু বিছানা ঝাট দিতে দিতেই বলল, হুম, কমেছে।

অনু টেবিলে ব্যাগটা রেখে ঝুঁকে তনুর কপালে হাত রাখলো। তনুর জ্বর এখনো কমেনি।

কই, জ্বর তো কমেনি!

এমন সিরিয়াস কিছু নয়।

ওষুধ খেয়েছিস?

হুম।

অয়ন কই?

আমার ঘরে হাফসার সাথে শুয়ে আছে।

শামীম ফিরেছে?

না ফেরেনি।

ফোন করেছিস? ফোন করে বল বাসায় আসতে। আজও যেন দেরি না। করে।

ওর ফোন বন্ধ।

বন্ধ কেন?

বৃষ্টিতে ভিজে একবার ফোনে পানি ঢুকেছিল, তারপর থেকেই যখন-তখন বন্ধ হয়ে যেত। কাল একবারে পার্মানেন্টলি বন্ধ হয়ে গেছে।

অনু আর কথা বলল না। ঘরে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়ে পোশাক পাল্টালো। তার নিজেরও শরীরটা ভালো লাগছে না। গা ব্যথা, জ্বরজ্বর ভাব। সে একগ্লাস পানি। আর একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নিলো। ড্রইংরুম গুছিয়ে তনু এলো এ ঘর। গোছাতে। অনু বলল, গায়ে এত জ্বর নিয়ে আবার এসব করছিস কেন?

কাল অয়নের মিলাদ।

শামীমের বিষয়টা কি করব বল তো?

তনু জবাব দিলো না। অনু বলল, এভাবে কতদিন সহ্য করা যায়? সহ্য না করে কী করব আপু?

এটি সেই সহজ প্রশ্নের একটি, যেটির উত্তর সবচেয়ে কঠিন। এই প্রশ্নের উত্তর অনুও জানে না। অনু বলল, অয়নের ঘটনা শামীম জানে?

ওকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না আপু। তবে কিছু যে আচ করে না তা না। ওর ধারণা, অসুখ-বিসুখ হয়েছে, সেরে যাবে। ওকে যাতে টাকা দেয়া না লাগে, সেই জন্যই যতটা না, তার চেয়েও বাড়িয়ে বলা হচ্ছে।

কাল তোর গায়ে হাত তুলেছে কেন?

তনু জবাব দিলো না। সে আলনায় এলোমেলো হয়ে থাকা কাপড় ভাঁজ। করে রাখছে। অনু বলল, ও কি রোজই তোর গায়ে হাত তোলে?

নাহ্, টাকা-পয়সা নিয়ে ঝামেলা হলে।

কাল কী হয়েছিল?

ফোনটা নষ্ট হলো, সেই নিয়ে…।

ফোন কিনে দিতে বলে?

তনু এই প্রশ্নেরও জবাব দিলো না। অনু বলল, ফোনের ব্যবস্থা না হয় করা গেল। কিন্তু তাতে কি কিছু সমাধান হবে?

তনু চুপ করেই রইল। শামীম সেই রাতে বাসায় ফিরল না। ফিরল না পরদিনও।

শুক্রবারটা নানা ঝামেলায় কেটে গেল। অনু চায়নি বাসায় অয়নের উপস্থিতিতেই দোয়া হোক। ফলে দোয়া-মিলাদ হলো মসজিদেই। রাতে অনেক ভেবে বান্ধবী অদিতিকে ফোন দিলো অনু। অদিতির সাথে কথা বলে যদি তার স্বামী তোহা ইকরামের কোনো অবস্থা জানা যায়। অদিতি কিছুটা অসুস্থ। দীর্ঘ বিরতির পর তার দ্বিতীয় সন্তান হবে। অনু ফোন দিতেই অভিমানী গলায় স্বামীর নামে একগাদা অভিযোগ করলো সে, বুঝলি অনু, বিয়ে শাদি না করে ভালোই করেছিস। বিয়ে শাদি করা মানে দাসী বান্দি হওয়া।

অনু সামান্য হাসলো। অদিতি বলল, জামাই ফকির হোক, আর জমিদার হোক, শেষ পর্যন্ত জামাই জামাই-ই। দিনরাত শুধু কাজ, কাজ আর কাজ। টাকা, টাকা আর টাকা। যেন পৃথিবীতে টাকা ইনকাম ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।

টাকারও তো দরকার আছে।

তাই বলে ঘরের বউয়ের দিকে কোনো খেয়াল থাকবে না? সারাক্ষণ এই মিটিং, সেই মিটিং। ফোন করলে ফোন পর্যন্ত ধরে না। গণ্ডারের মতো অবস্থা, সকালে ফোন করলে ফোন ব্যাক করবে বিকালে। মাঝে মাঝে তো তা-ও ভুলে যায়।

অদিতির কথা শুনে অনুর একটু স্বস্তি লাগছে। তোহা তাহলে তার ফোন দেখে ধরেনি, তা নয়। সে নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত। অনু বলল, তোহা ভাইদের নতুন প্রজেক্টগুলোর কী অবস্থা?

এইগুলা আমি জানি না অনু। এইগুলার কথা শুনলেও গা জ্বলে। এদিকে ডাক্তার ডেলিভারি ডেট দিয়ে দিয়েছে। ডিসেম্বরের শেষে ডেলিভারি। এখন সমস্যা হচ্ছে, আমি চাচ্ছি ডেলিভারিটা সিঙ্গাপুরে করাবো।

সিঙ্গাপুরে কেন?

তুই জানিস না অনু। এই দেশে কোনো চিকিৎসা নাই, সিস্টেম নাই, সেফটি নাই। এই দেশে আমি আমার বাচ্চা হওয়াবো না। কিন্তু তার এখন টাইম নাই। সে চাইছে আমি বাংলাদেশেই বাচ্চা হওয়াই। সে না-কি সিঙ্গাপুরে যাওয়ার সময় দিতে পারবে না। তার ব্যস্ততা। তুই-ই বল, এই সময়ে কেউ এই ধরনের কথা বলে, বল?

অদিতির গলা ভারি হয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে সে যে-কোনো সময় কেঁদেই। ফেলবে। অনু কী বলবে বুঝতে পারছে না। অদিতিই বলল, জীবনে টাকা পয়সাই কী সব বল? সম্পর্কে যদি মায়া, ভালোবাসা, রেসপন্সিবিলিটিই না থাকে, তাহলে সেই সম্পর্কের মূল্য কী? এই যে এত টাকার পেছনে ছুটছে, কী হবে এত টাকা দিয়ে? আমি কি টাকার পাগল? অন্য বউদের মতো আমি কী টাকা টাকা করি? এখন সে বলছে, ঢাকায়ই না-কি ভালো ভালো অনেক হাসপাতাল আছে। কিন্তু আমি আমার সন্তান এই দেশে হওয়াবো না। এটা। ফাইনাল। শুধু যে হওয়াবোই না, তা-ই না। সন্তান হওয়ার পরপরই দেশেও আসবো না।

অনু চুপ করেই রইল। এসব পরিস্থিতিতে খুব দমবন্ধ লাগে তার। অদিতি বলল, তা তোর কী অবস্থা বল তো? বিয়ে শাদির কিছু হলো? না-কি তোহাকে বলে দেখবো? ওর ছোটবেলার এক বন্ধু আছে, কারওয়ান বাজারে পাইকারি সবজির ব্যবসা। শুনে আবার মুখ ভেঙুচাস না যেন! সবজির ব্যবসা হলে কী হবে, টাকা-পয়সা মাশাআল্লাহ অঢেল। আগে বিয়ে-শাদিও করে নাই। আর পড়াশোনাটা একটু কম। সংসারের ঝামেলায় ম্যাট্রিক পাশটা কোনোভাবে করতে পেরেছিল। তারপর আর পড়ে নাই।

এসব কথা এখন থাক অদিতি?

আরে থাকবে কেন? থাকতে থাকতে তো কম থাকল না। বয়স তো আর থেমে থাকে না, বুঝলি? আমার বড় মেয়ে ক্লাস সিক্সে পড়ে, বুঝেসিস?

দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল না?

বড় হয়ে গেল মানে? শুধুই কী বড়? প্রতিমাসে তার হাত-খরচ কত জানিস? এই বয়সেই দেখি কত ফ্যাশান-ট্যাশান শিখে গেছে। রেগুলার পার্লারে যাবে। আর কতরকম যে সাজগোজ, পোশাক। দেখলে তো মনে হয় আমি বুড়িই হয়ে গেছি। আমি এখনো সেই গতবছরের আইফোন চালাই। আর তার যে কত বায়না। যুগ, বুঝলি, সবই যুগের হাওয়া। শুনেছি ওর বান্ধবীরা না-কি প্রেম-ট্রেমও করে। তুই-ই বল, ওদের বয়সে আমরা প্রেম কী জিনিস জানতাম? আরো কী কী সব যে বলে, শুনলে লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে যায়। তাও মেয়ের সাথে কোনো আড়াল রাখি না। ক’দিন পরতো বান্ধবীর মতোই হয়ে যাবে। কী বলিস?

তা তো ঠিকই।

শোন কি হয়েছে, সে আমাকে এসে বলছে, মাম, আই হ্যাভ আ ক্রাশ অন মাই টিচার। আচ্ছা, তুই-ই বল, ক্রাশ কী? ক্রাশ? এইসব জীবনে কখনো শুনেছিস? সে নাকি তার লিটারেচার টিচারের উপর ক্রাশ খেয়েছে। তুই দুধের বাচ্চা, আর সে তোর বাপের বয়সি টিচার। এইসব কী বলে বল তো? শোন। একটা কথা বলি, ক’দিন পর দেখা যাবে মেয়ে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বড়াচ্ছে, বিয়ে-টিয়েও করে ফেলছে। তখন সেই বিয়েতেও তুই আসলি জামাই ছাড়া। তখনো তোর বিয়ে হয়নি। ভাব একবার? মুখ দেখাতে পারবি কাউকে? আমিও পারব না। মেয়ে মানুষের পরিচয় শেষ পর্যন্ত তো জামাই-ই। তা সে সবজি ব্যবসায়ী হোক আর রিকশাওয়ালা তোক। টাক হোক, আর ভূরিওয়ালা হোক। তুই বললে, আমি তোহাকে বলে দেখতে পারি। বলব?

অনু সামান্য হাসলো, তোর প্রেসারটা বোধ হয় বেড়ে গেছে। এই সময়ে এমন হয়। একটু কন্ট্রোলে রাখিস।

.

অনু ফোন রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। কেন যেন তোহা ইকরামকে ফোন দেয়ার আগ্রহটা আর সে পাচ্ছে না। তবে আশ্চর্য ব্যাপার হলো পরদিন সকালে তোহা ইকরাম নিজেই অনুকে ফোন দিলেন। ফোন দেখে অনু কিছুটা ভড়কেই গেল, অদিতি উল্টাপাল্টা কিছু বলেনি তো আবার! সে ফোন ধরে সালাম দিলো। তোহা সালামের জবাব দিয়ে বললেন, আমি খুব সরি অনু। আপনার ফোনের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। গতকাল বাসায় ফিরতেই অদিতি বলল, আপনার সাথে কথা হয়েছে। আর ঠিক তখুনি মনে পড়লো।

না না ভাইয়া, ইটস ওকে। আমি জানি আপনি খুব ব্যস্ত।

ব্যস্ত তো আমরা সবাই। তারপর বলুন, কী খবর?

অনু চট করে বুঝতে পারল না, সে কীভাবে কী বলবে! তারপরও ইতস্তত করে বলল, একটা দরকার ছিল ভাইয়া, একদিন আপনার অফিসে আসতে চাই। আগেও এই বিষয়ে একদিন কথা হয়েছিল।

তোহা কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা। তা একদিন চলে আসুন না?

অনু বুঝতে পারল, এর আগে তার বন্ধুর চাকরি বিষয়ক যে কথা অনু বলেছিল, তা তোহা ভুলে গেছেন। একটা দিক থেকে এটা ভালোই হয়েছে, অনু এবার সরাসরি নিজের কথাই বলতে পারবে। সে বলল, কাল আসি ভাইয়া?

একটা মিনিট- বলে তোহা তার মিটিং শিডিউলটা দেখে বলল, আজ। বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে কী ফ্রি আছেন? তাহলে আজই চলে আসুন না? কাল। পরশু খুব ব্যস্ত যাবে।

আজ অনুর কোনো কাজ নেই। তারপরও তাকে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসা থেকে বের হতে হবে। সারাদিন বাসায় বসে থেকে সে কী করবে? তাছাড়া একটা না একটা কাজ তো তাকে জোটাতেই হবে। অনু বলল, জি ভাইয়া, আমি চলে আসবো।

অনু আজ সারাটা দিনও এখানে-ওখানে গেল। তবে খুব একটা শক্ত আশ্বাস পেল না কোথাও। দুপুরের দিকে তাকে ফোন করলো হাসান, আপনি না-কি জব ছেড়ে দিয়েছেন?

কেবল জানলেন?

অফিসিয়ালি তো এখনো জানানো হয়নি, তবে অফিসে কানাঘুষা চলছে।

কী কানাঘুষা চলছে?

না তেমন কিছু না।

কেমন কিছু না?

এইতো, আলতাফ ভাইয়ের সাথে আপনার ঝামেলা হয়েছে কোনো।

কে বলেছে এই কথা? আলতাফ ভাই নিজে?

না, তিনি কিছু বলেননি। উনি নিজেও দু’দিন ধরে অফিসে আসছেন না। কীভাবে যেন নাক কেটে গেছে।

আর কিছু?

অফিসে এডমিনে কথা হচ্ছিল, এভাবে জব ছেড়ে দেয়াটা তো অফিসিয়াল প্রসিডিওরের মধ্যে পড়ে না। সবকিছুরই তো একটা সিস্টেম আছে। আপনার রেসপন্সিবিলিটিগুলো বুঝিয়ে দিয়ে যেতে হবে। সম্ভবত অফিস থেকে আপনাকে ফোন করা হবে।

আচ্ছা।

আরেকটা কথা।

বলুন।

আমি কী আপনার সাথে একদিন দেখা করতে পারি?

পারেন, তবে এখন না।

কেন?

এখন আমার কারো সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে না।

আচ্ছা। আপনার যখন ইচ্ছে করবে, বলবেন।

অনু ফোন রাখতে যাবে, এই সময়ে হাসান বলল, অফিসজুড়ে একটা ফিসফিসানি, আলতাফ ভাইয়ের সাথে আপনার সিরিয়াস কিছু হয়েছিল?

সিরিয়াস কী?

সেটা তো জানি না।

কথা এর বেশি আর এগুলো না। অনু সন্ধ্যার দিকে তোহা ইকরামের অফিসে গেল। চাকরির কথাও বলল। তোহা জানালেন বর্তমান প্রজেক্টটাতে কাজ করার সুযোগ নেই অনুর। কারণ এই প্রজেক্টের পুরোটাই টেকনিক্যাল। তবে মাসখানেকের মধ্যে তাদের অন্য কিছু প্রজেক্ট লোক লাগবে। তখন সেখানে অনুর একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে।

বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হলো অনুর। ফিরে দেখে বাসায় রক্তারক্তি অবস্থা। তনুকে আবারো মেরেছে শামীম। অনু ঘরে ঢুকতেই সালমা বেগম তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলেন। অনু অবশ্য কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে পোশাক পাল্টে গোসল করলো, খেলো। তারপর চুপচাপ দীর্ঘসময় একা একা বসে রইল। রাত এগারোটার দিকে সে তনুর ঘরে গেল। তনুর গায়ে আবারো জ্বর। সে শুয়ে আছে বিছানায়। শামীম হাফসাকে নিয়ে খেলছে। অনু ঘরে ঢুকতেই শামীম অনুকে সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। অনু সালামের জবাব দিয়ে বসলো। শামীম বলল, আপনার শরীর ভালো আপু?

হ্যাঁ, ভালো।

অফিস কেমন যাচ্ছে?

এইতো যাচ্ছে। তোমার কী অবস্থা শামীম?

ব্যবসাটা নিয়ে খুব ঝামেলায় আছি আপু। হাতে টাকা-পয়সা নেই। তার ওপর ফোনটাও নষ্ট হয়ে গেল। কী যে করব, মাথা ঠিক থাকে না।

তনুর শরীর কেমন?

সে ভালো আছে, ঘুমাচ্ছে আপু। তার ঘুম খুব কড়া। দেখেন না, সারারাত মেয়েটা কাঁদে, আর সে মরা মানুষের মতো ঘুমায়।

তোমাদের ঘরে কোনো থার্মোমিটার আছে?

আছে আপু।

তনুর জ্বরটা মাপো তো।

একটু ঠান্ডা লেগেছে, তেমন সিরিয়াস কিছু না আপু।

তারপরও একটু মাপো।

শামীম বাধ্য ছেলের মতো তনুর জ্বর মাপলো, একশ দুই আপু।

অনু শামীমের হাত থেকে থার্মোমিটার নিয়ে দেখলো তনুর জ্বর একশ তিনেরও বেশি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না তার জ্ঞান আছে। অনু থার্মোমিটার। ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল, শুধু মুখেই মেরেছ, না-কি গায়েও?

শামীম অবাক ভঙ্গিতে বলল, কী বলছেন আপু? মারবো কেন? সে রাতে এমনভাবে ঘুমায়, হুঁশ থাকে না। সেদিন ঘুমের মধ্যে টেবিলের কোণায় ধাক্কা লেগে রক্তারক্তি কাণ্ড।

আচ্ছা। তুমি এক কাজ করো, বাইরে যাওয়ার শার্ট প্যান্ট পরো।

এত রাতে কোথাও যেতে হবে আপু?

হুম, পরো।

কোথায় যেতে হবে আপু? আপনার কিছু লাগবে?

না, তোমার জন্যই যেতে হবে।

আমার জন্য? শামীম ভারি অবাক হলো।

হুম, তোমাকে আমি থানায় নিয়ে যাব, সাথে তনুকেও। তনু তোমার নামে মামলা করবে।

শামীম অবাক ভঙ্গিতে বলল, মামলা? কিসের মামলা?

নারী নির্যাতনের মামলা। নারী নির্যাতনের মামলায় কোনো জামিন নেই। মামলা চালানোর কোনো খরচও লাগে না। মামলা চলবে সরকারি খরচে।

শামীম থতমত খাওয়া গলায় বলল, কী বলছেন আপু?

অনু শান্ত, ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, কী বলছি শোনো। এই মামলায় সর্বোচ্চ একশ আশি দিনের মধ্যে রায় হয়ে যায়। সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদণ্ড। এর কম হলেও এড়ানোর উপায় নেই, মামলায় জামিনও নেই। তাছাড়া তনুর গায়ে, মুখে কালশিটে দাগ পড়ে গেছে। অপরাধ প্রমাণের অভাব হবে না।

আপু বিশ্বাস করেন, আমি এইসব কিছু জানি না, সে ঘুমের ঘোর…।

অনু শামীমের কথা শেষ করতে দিলো না। সে বলল, তুমি না করে থাকলেও মামলা হবে। ধরো মিথ্যা মামলা হবে তোমার নামে। মামলা মিথ্যা হোক আর সত্য, শাস্তি তোমার হবেই। তুমি প্রমাণ করতে পারবে না।

শামীম কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আপু, আপনি এইসব কী বলছেন আপু? আমি কিছু জানি না।

না জানলেও হবে। তুমি রেডি হও, আমি ঘর থেকে আসছি।

শামীম ছুটে এসে অনুর পথ আগলে দাঁড়ালো, আপু, আমার ভুল হয়েছে আপু। বিশ্বাস করেন আপু…।

আমি সবকিছুই বিশ্বাস করব শামীম। তবে তার আগে তোমাকে একটা জিনিস বিশ্বাস করতে হবে।

জি আপু, আপনি যা বলবেন, সবই আমি বিশ্বাস করব আপু। আপনি বলেন আপু, বলেন।

তুমি যে এখনো সুস্থভাবে চলছ, ঘুরছ, ফিরছ, এসবই তনুর দয়ায়। তনু চাইলে তুমি এক মুহূর্তও সুস্থ স্বাধীনভাবে কিছু করতে পারবে না। তুমি ভেবো না, তোমার মেয়ের চিন্তা করে তনু তোমাকে কিছু বলছে না। তোমার মেয়ের ভরণ-পোষণের কোনো দায়িত্বই তুমি নাওনি। ভবিষ্যতে নেবে বলেও মনে হয় না। সুতরাং মেয়ের কী হবে চিন্তা করে তোমার সবকিছু মেনে নেয়া হচ্ছে, এটা ভেবো না।

শামীম কথা বলছে না। সে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনু বলল, তনু তোমাকে এতদিন কেন কিছু বলেনি, জানো? কারণ, তনু তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসে। কিছু কিছু ভালোবাসা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু মানুষ যখন সেই ভালোবাসায় পড়ে, তখন সে তা বোঝে না। আর বোঝে না বলেই অন্যজন তখন সেই ভালোবাসার সুযোগ নেয়। তুমি এতদিন সেই সুযোগটা নিয়েছ।

অনু সামান্য থেমে বলল, তনুকে ওঠাও। আমি আসছি।

শামীম হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। অনুর মন তাতে গললো না। সে ঘরে গিয়ে পোশাক পাল্টে এলো। শামীম দরজার কাছে চেয়ারে বসে আছে। অনু ঢুকতেই সটান দাঁড়িয়ে গেল। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এই একবার আমাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখেন আপু। এই লাস্ট টাইম। এমন আর হবে আপু।

অনু কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর বলল, ঠিক আছে। তবে তুমি এখন বাইরে যাবে। তনুর জন্য ডাক্তার নিয়ে বাসায় ফিরবে। কীভাবে কোথা থেকে আনবে, আমি জানি না। কিন্তু নিয়ে আসবে। এটাই তোমার সুযোগ।

শামীম আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। সে ঘরের পোশাকেই বেরিয়ে গেল। টাকা-পয়সাও কিছু চাইলো না। সে ফিরল রাত একটায়। কোনো ডাক্তার আনতে না পারলেও এক ডিসপেন্সারি থেকে তোক নিয়ে এসেছে। সেই লোক তনুকে দেখলো, ওষুধপত্র দিলো। তনুর তখনো জ্ঞান নেই।

সারারাত শামীম তার পাশে বসে রইল। সকালে ঘুম থেকে উঠে শামীমকে ওভাবে পাশে বসে থাকতে দেখে তনু আঁতকে উঠল। কিন্তু শামীম তার পাশ থেকে নড়লো না। তনু প্রচণ্ড অবাক হয়েছে, এক রাতের মধ্যে কী এমন ঘটনা। ঘটলো যে শামীম এমন রাতারাতি পাল্টে গেল! সে সারাদিন ছায়ার মতো তনুর সাথে লেগে রইল। তনুকে নিজ হাতে ভাত খাইয়ে দিলো। গোসল শেষে তনুর কাপড় কেঁচে দিলো। তনুর কী যে লজ্জা লাগছিল। কিন্তু সেই লজ্জার কোথায় যেন একটা তীব্র ভালোলাগাও। নাহ্, মানুষটাকে সে এখনো ভালোবাসে। অসম্ভব ভালোবাসে।

*

অনু জানতো এমন হবে, কিন্তু মানতে কষ্ট হচ্ছে তার। চাকরি নেই দেড় মাসেরও বেশি। এই দেড়টা মাস প্রায় প্রতিটি দিন সে পরিচিত অপরিচিত মানুষের কাছে ঘুরেছে। হাতে অল্প যা কিছু টাকা ছিল, তাও প্রায় শেষ। বাসায় এখনো কেউ কিছু না জানলেও সালমা বেগম কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছেন। অনুকে সেদিন জিজ্ঞেসও করলেন, কোনো সমস্যা অনু?

না তো মা?

তোর অফিসে কোনো ঝামেলা হয়নি তো?

কেন?

এই যে প্রায়ই লেট করে বাসা থেকে বের হচ্ছিস। ফেরারও কোনো টাইম টেবিল নাই।

ওহ্, এই কথা! অফিসের বাইরে কিছু কাজ করতে হচ্ছে তো, এই জন্য এমন হচ্ছে।

সালমা বেগম কাছে এসে দু’হাতে অনুর মুখ তুলে ধরে বললেন, কী হয়েছে, আমাকে বল?

অনু হাসার চেষ্টা করলো, কিছু হয়নি মা। ভাত আছে, ভাত দাও। ভাত খেয়ে বের হবো, জরুরি কাজ আছে।

অনু উঠে হাত মুখ ধুয়ে নিলো। আজকাল সে বাসা থেকে যতটা সম্ভব খেয়েই বের হয়, বাইরে বাড়তি খরচ যতটা কমানো যায়।

এর মধ্যে আগের অফিস থেকে ফোন এসেছিল। একদিন যেতেও হয়েছিল অনুর। সে ভেবেছিল নতুন কোনো ঝামেলা করবে অফিস। তবে সেরকম কিছু হলো না। দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হলো কেবল। তবে পুরোটা সময় অফিসের সবাই কেমন অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো। দুপুরে বাইরে খাওয়ালো হাসান। খেতে খেতে হাসানের সাথে অনেক কথাও হলো। সে সামান্য নিচু গলায় বলল, আপনি না-কি আলতাফ ভাইকে চড় মেরেছিলেন, এই কথা সত্য?

অনু বলল, এসব উদ্ভট কথা কে বলেছে?

সম্ভবত পিয়ন নাজমুল। সে না-কি তখন আলতাফ ভাইয়ের জন্য চা নিয়ে যাচ্ছিল?

নাজমুল বলেছে?

ঠিক জানি না। তবে এই কথা অফিসে এখন কম বেশি সবাই জানে। কেউ অবশ্য প্রকাশ্যে কিছু বলছে না। তবে আড়ালে-আবডালে ফিসফিসানি তো চলছেই। যা হয় আর কী!

অনু কথা বলল না। হাসান বলল, ঘটনা কী সত্য?

আমি উনাকে চড় মারতে যাব কেন?

কেন যাবেন, সেটি আপনিই ভালো জানেন। তবে ঘটনা যাই হোক, এই অভিযোগ ধোপে টিকবে না। তাছাড়া এ কথা তো উনি কোথাও কাউকে বলতেও পারবেন না।

কেন?

এমনিতেই অধস্তন এমপ্লয়ী, তার ওপর আবার মেয়ে। এমন কারো হাতে চড় খাওয়ার কথা কাউকে বলা যায়!

আপনি হলেও বলতেন না?

হাসান থতমত খাওয়া গলায় বলল, আমি কেন হবো?

আমি তো বলিনি যে হবেন, বলেছি হলে…।

মেয়েদের হাতে মার খেলে পুরুষ বলতে পারে না।

কেন? বলতে পারে না কেন?

হয়তো অহমে লাগে। তবে আপনি সবসময় বলেন না যে মেয়েদের এই অসুবিধা, সেই অসুবিধা। অসুবিধা পুরুষেরও কম কিছু নয়। এই যে লোকটা চড় খেয়েও অভিযোগ করতে পারবে না। আর করলেই সকলে সবার আগে ভাববে দোষটা তারই। সে নিশ্চয়ই এমন কিছু করেছিল যে চড় খেতে হয়েছে।

তা ভাববে কেন?

এটাই নিয়ম। সচরাচর এই ঘটনা তো ঘটে না। যখন ঘটে, তখন সবাই। ধরে নেয়, পুরুষটা নিশ্চয়ই বড়সড় কোনো অপরাধ করেছে।

কিন্তু মেয়েটাও তো করতে পারে। পুরুষ যেমন কারণে-অকারণে মেয়েদের গায়ে হাত তোলে, মেয়েরা তেমন পারে না?

এর আগে দেখেছেন এমন কাউকে?

অনু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, চড় মারা যে খুব বীরত্বের কিছু তা কিন্তু নয়, তা সে পুরুষ হোক, আর নারী। তবে আমার কী মনে হয় জানেন?

কী?

নারীর চড় হচ্ছে দুর্বলের মারের মতো। দুর্বলের মার কেউ খেতে চায় না, তাকে সবাই মারতেই চায়। আর কেউ খেলে প্রমাণ হয়ে যায় সে আরো দুর্বল। আর এই জন্যই পুরুষ তার এই দুর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না।

কিন্তু কত কত মেয়েও তো রোজ পুরুষের মার খায়। সেগুলোও তো তারা বলতে পারে না।

দুটার কারণ আলাদা। প্রথমত, খুব এক্সট্রিম কিছু না হলে নারী এমন কিছু করে না। করলে তার পেছনে হয় পুরুষের বড় কোনো অপরাধ থাকে, অথবা তার সেই অহংকার। আর অপরাধ থাকলে যে কেউই খুব স্বাভাবিকভাবেই চাইবে না যে সেটি নিয়ে নাড়াচাড়া হোক। দ্বিতীয়ত, আমাদের সিস্টেমটাই তো এমন যে পুরুষ মারবে, আর নারী মুখ বুজে সহ্য করবে।

কিন্তু দুজনই তো লুকাচ্ছে?

একজন অহংকারের কারণে, অন্যজন অধস্তনতার কারণে।

তাহলে সমাধানটা কী?

জানি না। হয়তো পুরুষের এই যে পুরুষসুলভ অহম আর নারীর যে অধস্তনতা, এই দুটোকেই বিদেয় করতে পারলে…।

তাহলে কী দুজনই দুজনের কথা মাইক ভাড়া করে সবাইকে জানিয়ে বেড়াতো? যেন খুব মজার কথা বলেছে, এমন ভঙ্গিতে হো হো হো করে হেসে উঠল হাসান।

অনু বলল, তা কেন? তখন বলার কারণগুলোই তো আর ঘটত না। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধটা থাকলে আর কিছুর দরকার হয় না। ওটাই সবচেয়ে বেশি দরকার।

খাওয়া শেষে হাসান বলল, তা কী সেই মারাত্মক ঘটনা, যার জন্য এভাবে চাকরি ছেড়ে দিলেন?

অনু হেসে প্রসঙ্গ পাল্টালো, মারাত্মক ঘটনাটা হলো আমাকে যত দ্রুত সম্ভব চাকরি পেতে হবে।

.

অনুর সেই চাকরি এখনো পাওয়া হয়নি। সময় চলে যাচ্ছে, বাড়ছে নানাবিধ সংকট, সমস্যা। তোহা ইকরামের অন্য প্রজেক্টটাও এখনো শুরু হয়নি। আজ নবীনগর ইপিজেড-এ একজনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল সে। ছোটখাট একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়তো সেখানে হয়েও যাবে। সমস্যা হচ্ছে বেতন যা পাবে, তার অর্ধেকের বেশি চলে যাবে বাস ভাড়াতেই। তার ওপর যেতে আসতে কম করে হলেও আধাবেলা লেগে যাবে। আজই যেমন ফিরতে গিয়ে খুব বিড়ম্বনায়ই পড়তে হলো। সন্ধ্যা থেকে কী কারণে রাস্তা বন্ধ। তারপর শুরু হলো অবিশ্বাস্য জ্যাম। গাবতলী পৌঁছাতে পৌঁছাতেই এগারোটা বেজে গেল। এরপর আর এই বাস যাবে না। ফলে সেখানে নেমে আবার অন্য বাস ধরতে হবে। এর মধ্যে ফোনের চার্জও ফুরিয়ে গেল। সে যখন তাজমহল রোডের মাথায় নামলো, তখন চারপাশ শুনসান। কী কারণে যেন পরপর দুটো ল্যাম্পপোস্টে আলোও জ্বলছে না। অনু বাস থেকে নেমে হেঁটেই ফিরছিল। এটুকু পথ শুধু শুধু পনেরো কুড়ি টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। অনু অন্ধকার জায়গাটা পার হচ্ছিল। একটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে মোড়ে। রিকশাওয়ালা সিটের উপর বসে সিগারেট খাচ্ছে। অনু রিকশাটার কাছাকাছি যেতেই সে বলল, যাইবেন?

অনু কথা বলল না। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে রিকশাটাকে পার হলো। রিকশওয়ালা আচমকা পেছন থেকে শিষ কেটে বলল, ভাড়া না থাকলেও পবলেম নাই, অন্যকিছু দিয়া পোষাই দিলেই হইবো।

অনু পেছনে তাকালো না। সে যেমন হাঁটছিল, তেমন হাঁটতেই থাকল। রিকশাওয়ালা রিকশায় প্যাডেল চেপে অনুর পিছু নিলো। সে এবার গলা ছেড়ে গান গাইছে, সব সখিরে পার করিতে নেবো আনা আনা, তোমার বেলা নেব সখি তোমার কানের বালা।

অনু বাসার খুব কাছাকাছি এসে গেছে। সামনে গলির মাথায় পরিচিত ছোট দোকানটা এখনো ভোলা। অনু দূর থেকেই দোকানের ছেলেটাকে ডাকলো। ছেলেটা অবশ্য খেয়াল করলো না। সে কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনছে। তবে এতে কাজ হলো, রিকশাওয়ালা মুহূর্তেই রিকশা ঘুরিয়ে আবার পেছন দিকে চলে যেতে থাকল।

অনু বাসার সামনে এসে ব্যাগ থেকে চাবি বের করলো। তার মন আর শরীরজুড়ে ভয়াবহ অবসাদ। কিন্তু সেই অবসাদ নিয়েও সে দোতলার জানালাটার দিকে তাকালো। বহুদিন পর জানালাটা আবার খোলা। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, জানালাটায় আজ কোনো পর্দাই নেই। ভেতরে আলোও জ্বলছে। তবে সেই আলোয়ও বাইরে থেকে স্পষ্ট তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না। সে জানে

কেন, তার ঘাড়ের কাছটায় সেই শিরশিরে অনুভূতিটা আবার ফিরে এলো। কলাপসিবল গেটের তালা খুলতে গিয়ে সে আবিষ্কার করলো তার হাত কাঁপছে। অনু তালাটা খুলে গেটের এক পাশটা টেনে সরালো। আর ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ একজন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। অনুর বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠল। সে ঝট করে মুখ তুলে লোকটাকে দেখলো, লোকটাকে সে চেনে। খুব ভয়ংকরভাবেই চেনে। আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগের এক সন্ধ্যায় ঘরের দরজা খুলতেই লোকটা ঠিক এভাবেই তার সামনে দাঁড়িয়েছিল। তারপর ফ্যাসফ্যাসে ঠান্ডা গলায় বলেছিল, ঘরে তো আর কেউ নাই, একা একা ভয় পাচ্ছেন কি-না তাই সঙ্গ দিতে আসলাম।

আজ অবশ্য লোকটা তেমন কিছুই বলল না। কিছুক্ষণ কেবল স্থির দৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখ টকটকে লাল। মুখভর্তি খোঁচাখোঁচা দাড়ি। প্যান্টের দুই পকেটে দুই হাত। অনু যখন তাকে শেষবার দেখেছিল, তখন মুখভর্তি এই দাড়িটা কেবল ছিল না। আর সবকিছু সেই আগের মতোই। সেই ধীর-স্থির, শান্ত ভঙ্গি। সাথে গা হিম করে দেয়া ঠান্ডা, হিংস্র চোখ। লোকটা গেটের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে পকেট থেকে বা হাত বের করলো। তারপর একহাতেই সিগারেট ধরালো। সিগারেটে লম্বা টান। দিয়ে মুখভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, আমি তো জানতাম খুব সাহসী মেয়ে। কিন্তু সেই কোন কালের ভয় এখনো কাটেনি?

অনু কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে যেমন ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে বছর তিনেক আগের সেই ভয়ংকর সন্ধ্যা। বাসায় কেউ নেই, মা আর অয়ন কী কাজে বাইরে। কলিংবেল বাজতেই তাই দরজা খুলে দিয়েছিল সে। ভেবেছিল মা আর অয়ন ফিরে এসেছে, কিন্তু দরজা খুলতেই অনুর মেরুদণ্ড বেয়ে তীব্র ভয়ের এক শীতল স্রোত বয়ে গিয়েছিল। ঠিক এই একই ভঙ্গিতে, ঠিক এই একইরকম শান্ত, ঠান্ডা অথচ হিংস্র দৃষ্টি মেলে লোকটা দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। তারপর ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলেছিল, বাসায় একা তো, সঙ্গ দিতে এলাম। অনু দু’হাতে দরজার দু’পাশের পাল্লা আগলে ধরে দাঁড়িয়েছিল। লোকটা নিস্পৃহ ভঙ্গিতে একটা পা বাড়িয়ে দিয়েছিল সামনে, যাতে চাইলেও দরজার পাল্লা আটকে দিতে না পারে অনু। আজও ঠিক একই ভঙ্গিতে কলাপসিবল গেটের মাঝ বরাবর পা রেখে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।

অনু যতটা সম্ভব গলায় সাহস ঢেলে বলল, আপনি কী চান?

লোকটা ডান হাতের পকেট থেকে তার হাতটা বের করলো। অনু প্রথম কিছুক্ষণ ভাবছিল সে ভুল কিছু দেখছে। প্রচণ্ড আতঙ্কে হয়তো তার হ্যাঁলুসিনেসন হচ্ছে। কিন্তু দৃশ্যটা বাস্তব এবং স্পষ্ট, লোকটার ডান হাতের পাঁচটি আঙুলই নখের গোড়া থেকে নেই!

সে মৃদু হাসলো। তারপর বলল, আঙুলগুলো।

অনু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তীব্র আতঙ্কে তার মাথা কাজ করছে না। একটা ঘোরের মতো মনে হচ্ছে সব কিছু। এ কী করে সম্ভব!

লোকটা বলল, করাতকলের ধারালো করাতে আঙুলগুলো কাটা। দেখেছেন, কী মসৃণ আর একদম একই মাপ!

অনুর কানে কিছুই ঢুকছে না। তার শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম নামছে, বুকের ভেতর শব্দ হচ্ছে হাতুড়ি পেটার। এই কারণেই কি-না কে জানে, সালমা বেগম আর বেনুর উপস্থিতি সে টের পেল না। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে আসতে সালমা বেগম উঁচু গলায় বলতে লাগলেন, এত দেরি করে বাসায় ফিরে আবার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কার সাথে কী কথা, হ্যাঁ? ফোনটা পর্যন্ত বন্ধ। সেই সন্ধ্যা থেকে কতবার যে এই দুইতলা সিঁড়ি বেয়ে নামলাম আর উঠলাম, সেই খেয়াল কারো আছে!

অনু লোকটার ঘাড়ের উপর দিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। সালমা বেগম পেছন থেকে উদ্বিগ্ন এবং কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছেন। অনু কিছু বলতে যাবে কিন্তু তার আগেই লোকটা বলল, আজ যাই, তবে অনেক কিছুই বাকি রয়ে গেছে। আমার হিসেব বাকি রাখতে ভালো লাগে না।

সে বড় বড় পা ফেলে অন্ধকার গলির ভেতর মিলিয়ে গেল। সালমা বেগম গেটের মুখে এসে অনুর কাঁধে হাত রেখে বললেন, কে ওটা?

অনু কথা বলল না। সে দু’পা সামনে বাড়িয়ে ভেতরের অন্ধকার জায়গাটায় ঢুকলো। এখানে আলো নেই। যেন এই অন্ধকারটায় সে লুকাতে চায়, কিংবা কোনো ছায়া চায়। সালমা বেগম কিছু একটা যেন আঁচ করতে পারলেন। তিনি আবারো বললেন, অনু? কে ও?

অনু মায়ের এক হাত শক্ত করে ধরলো। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ওয়াসিম।

.

সালমা বেগম বাকিটা সময় অনুর গা ঘেঁষে বসে রইলেন। অনু অবশ্য মার সাথে তেমন কোনো কথা বলল না। সে অন্ধকার ঘরে চুপচাপ শুয়ে রইল। বাইরের পোশাক অব্দি পাল্টালো না। হাত-মুখ ধুলো না। যেমন এসেছিল ঠিক তেমনই শুয়ে রইল। অনু জানে যা ঘটেছে তাতে তার যেমন কোনো ভূমিকা ছিল না, তেমনি সামনে যা ঘটবে, তাতেও থাকবে না। কিন্তু অস্বাভাবিক হলেও সত্য যে এর সবকিছুর ফলাফলটা শেষ অব্দি তাকেই ভোগ করতে হবে। যেমনটা পেছনেও হয়েছে।

আসলে কিছু কিছু মানুষ এমনই, যারা অন্যের জন্য জন্মায়, অন্যের জন্য বেঁচে থাকে। অন্যের অপরাধের শাস্তি ভোগ করে। যাদের প্রস্থানও হয় অন্য সকলের অভিযোগ আর আক্ষেপের বোঝা মাথায় নিয়েই। অথচ তাদের জীবন কেটে যায় এই ভেবে ভেবে যে হয়তো তাদের জন্যও এই জগতের কোথাও না কোথাও কেউ অপেক্ষায় আছে; কিছু অপেক্ষায় আছে! কিন্তু তাদের সেই চিরন্তন। অপেক্ষার গল্প শেষ হয় ভয়াবহ উপেক্ষায়।

সালমা বেগম কী মনে করে হঠাৎ উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালেন। বারান্দাটায় খুব একটা কারো আসা হয় না, তার ওপর কদিনের বৃষ্টি আর মেঘলা আবহাওয়ায় কেমন একটা সঁতসেঁতে ভাব। তিনি খুব সাবধানে দাঁড়িয়ে ডান দিকে তাকালেন। পাশের দোতলার সেই জানালাটার সবগুলো পাল্লা খোলা। জানালায় পর্দা নেই। পর্দাবিহীন জানালাটার ওপাশে আলো জ্বলছে। সেই আলোয় ওয়াসিমকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একটা বিশাল ইজি চেয়ারে বসে মৃদু দোল খাচ্ছে সে। তার মুখে সিগারেট, দৃষ্টি ছাদের দিকে নিবদ্ধ। সেখানে সিলিংফ্যান ঘুরছে। আলোর উৎস তার উল্টোদিকে হওয়ায় ফ্যানের ঘূর্ণায়মান পাখা এবং তার কম্পমান দীর্ঘ ছায়া পড়ছে পেছনের দেয়ালে। পুরো দৃশ্যটার মধ্যে কেমন একটা গা ছমছমে ভাব। সালমা বেগম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার ঘরে চলে এলেন। অয়ন ঘুমিয়ে পড়েছে। গত কিছুদিন থেকে অয়নের জ্বর আসাটা আর একদমই নেই। তিনি অনুর কাছে এসে আবার বসলেন। তারপর বললেন, মারে।

অনু মায়ের দিকে ফিরে তাকালো। সালমা বেগম বললেন, ও কী বলেছে আমাকে বলবি মা? আমার খুব ভয় হচ্ছে।

সালমা বেগম আলতো করে তার মাথাটা রাখলেন অনুর কাঁধে। তারপর এক হাত দিয়ে অনুকে জড়িয়ে ধরলেন। অনু কিছু বলল না। আরো বেশ কিছুক্ষণ যেমন ছিল, তেমনই বসে রইল। তারপর যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সালমা বেগম অন্ধকারেই কিছুটা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। অনু বাতি জ্বালিয়ে টেবিলের উপর থেকে ডেস্ক ক্যালেন্ডারটা টেনে নিয়ে মায়ের কাছে এসে বসলো। তারপর সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছু একটা দেখতে দেখতে নরম গলায় বলল, একটা কথা বলি মা?।

সালমা বেগম কিছু বললেন না, তিনি তখনো অবাক চোখেই তাকিয়ে আছেন। অনু বলল, ধরো মাঝ সমুদ্রে হঠাৎ ভয়ংকর ঝড় উঠল, তুমি একটা ডিঙি নৌকায়, তখন ভয় পেলে কী কিছু ঠিক হবে, মা? হবে না। তখন হয় যা আছে তাই নিয়েই বাঁচার চেষ্টা করতে হবে, না হলে সব ভাগ্যের হাতে ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়ে বসে থাকতে হবে। দুশ্চিন্তা করে, ভয় পেয়ে তো কিছু হবে না, হবে’ মা?

সালমা বেগম তারপরও কথা বললেন না। অনু ক্যালেন্ডার থেকে মুখ তুলে বলল, জানো? আজ যে চারমাস পেরিয়ে সতেরো দিন?

সালমা বেগম এবার স্খলিত কিন্তু ফিসফিসে গলায় বললেন, আল্লাহ, ও আল্লাহ, আল্লাগো, আল্লাহ মালিক।

অনু বলল, অয়নের জ্বরটা তো আর আসে নাই না, মা?

নাহ।

আল্লাহ চাইলে কত মিরাকলই তো ঘটে মা।

সালমা বেগম দুই হাতে বুক চেপে ধরে ফিসফিস করেই বললেন, আমি শ্বাস নিতে পারি নাগো মা। আমি কত দিন শ্বাস নিতে পারি না। আমার কলিজাটা শুধু কাঁপে আর কাঁপে, থরথর করে কাঁপে। ব্যথা, মাগো খালি ব্যথা, আর ভয় করে। কী যে ভয়রে মা।

অনু মায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে তার একটা হাত চেপে ধরে বলল, দেখি কাল আরো একবার ডাক্তারের কাছে যাব।

সালমা বেগম কথা বললেন না। তিনি উঠে ধীর পায়ে অয়নের ঘরে গেলেন। অয়ন ঘুমাচ্ছে, তার ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে। মেঘলা আবহাওয়ার। কারণেই একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। সালমা বেগম পাতলা কাঁথাটা টেনে দিলেন অয়নের গায়ে। অয়নের মাথার কাছে টেবিলে একটা সুন্দর নোট বুক পড়ে আছে। নোটবুকটার ভেতরে একটা কলম থাকায় মাঝামাঝি জায়গাটা সামান্য ফুলে আছে। তিনি টেবিলের কাছে গিয়ে সন্তর্পণে নোটবুকটার উপর হাত রাখলেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে অয়ন ডাকলো, মা।

সালমা বেগম ফিরে তাকিয়ে বললেন, শরীর খারাপ লাগছে বাবা?

না মা, আগের চেয়ে বরং ভালো লাগছে। তুমি ঘুমাওনি?

সালমা বেগম স্বাভাবিক গলায় বললেন, অনুর আসতে দেরি হলো এইজন্য জেগে আছি।

আপু কই?

ও ঘরে। তুই ঘুমা, আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেই?

অয়ন মৃদু হাসলো, দাও।

সালমা বেগম অয়নের পাশে বসে তার চুলের ভেতর বিলি কেটে দিতে থাকলেন। অয়ন হঠাৎ মায়ের হাতটা চেপে ধরে বলল, আমাকে খুব ভালোবাসো মা?

সালমা বেগম নিজেকে যেন সামলে রাখতে পারলেন না। তিনি নিচু হয়ে অয়নের কপালে চুমু খেলেন। তারপর দু’হাতে অয়নের মাথাটা বুকে চেপে ধরে বসে রইলেন। অয়ন বলল, মা, আজকাল আমার শরীরটা ভালো ঠেকছে।

সালমা বেগম ভেজা গলায় প্রায় ফিসফিস করে বললেন, আল্লাহ সাফি, আল্লাহ মাফি, রাতে জ্বরটাও তো আর আসছে না?

না মা।

সালমা বেগম অয়নকে জড়িয়ে ধরে রইলেন। অয়নের মনে হলো, মায়ের শরীর জুড়ে কী আশ্চর্য ভালো লাগার এক ওম! কী অপার্থিব অনুভূতির এক সুবাস! কিন্তু অয়ন কী জানে? মায়ের শরীরের এই সুবাস, এই উষ্ণতা সন্তান ছাড়া জগতে আর কেউ টের পায় না। না-কি মায়েদের শরীর সবার অলক্ষে খুব সযতন সতর্কতায় এই ওম আর ঘ্রাণ কেবলমাত্র তার সন্তানের জন্যই লুকিয়ে পুষে রাখে? এই ঘ্রাণ, এই আশ্চর্য ওম সে সন্তান ছাড়া আর কারো কাছে। কখনোই প্রকাশ করে না!

*

নুহা এলো সকাল নটার দিকে। ঠিক এক মাস তেইশ দিন পর নুহার সাথে দেখা হলো অয়নের। সেদিনের পর থেকে খুব একটা কথাও হয়নি আর। অয়ন অবশ্য বহুদিন ঘরের বাইরেও যায় না। মাঝখানে দু’তিনবার ফোনে কথা হয়েছিল। নুহা খুব ভেঙে পড়েছিল বলে অয়ন যতটা সম্ভব তাকে সাহস জোগানোর চেষ্টাই করেছে। এর মাঝে আরো একবার নানুবাড়ি গিয়েছিল নুহা। অনেক ঝামেলা করে হলেও আদিলের বিয়েটা আপাতত পেছানো গেছে। আদিল বাসায় জানিয়েছে, কী এক জরুরি কাজে তাকে তাড়াহুড়া করে সপ্তাহ দুয়েকের জন্য আবার আমেরিকা যেতে হচ্ছে। আমেরিকা থেকে ফিরে নতুন করে বিয়ের তারিখ ঠিক করবে। এই নিয়েও যে তুলকালাম কম হয়েছে তা নয়। পাত্রীপক্ষ। তো মানতেই চায়নি। কিন্তু আদিল নিজেই যথাসম্ভব সবাইকে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছে। নুহা এতে কিছুটা স্বস্তি পেলেও তার আশঙ্কা আর অনিশ্চয়তা তাতে এতটুকুও কমেনি। সেদিন ফোনে হাউমাউ করে কেঁদেছেও সে। অয়ন কী। বলবে! সে চুপচাপ সেই কান্না শুনেছে কেবল।

ঘুম ভেঙে নুহাকে বিছানার পাশে দেখে অয়ন রীতিমত চমকে গেল। নুহা পরেছে হলুদ রঙের কামিজ। সাথে হলুদ ওড়না আর সেলোয়ারও। তাকে দেখতে লাগছে হলুদ পাখির মতো। তবে অয়নের আজ সত্যি সত্যিই মনে। হলো, নুহার বয়স যা-ই হোক না কেন, সে কদিনেই যেন অয়নের চেয়ে হঠাৎ অনেক বড় হয়ে গেছে। সেই কিশোরী কিশোরী ভাবটাই আর নেই। পরিপূর্ণ তরুণী মনে হচ্ছে তাকে। অয়ন বলল, তুই হঠাৎ অনেক বড় হয়ে গেছিস নুহা।

নুহা গম্ভীর গলায় বলল, এতদিনে বুঝতে পারলি?

অয়ন বলল, হুম। আচ্ছা, তোর বয়স কত হলো রে?

আঠারো বছর, তিন মাস।

বিশ্বাসই হচ্ছে না! তোকে আরো বেশি লাগছে।

এটা কি প্রশংসা, না অপমান?

প্রশংসা। অয়ন মৃদু হাসলো, এতদিনে বুঝলাম, মেয়েরা সবসময় ছেলেদের চেয়ে বড়ই হয়।

গাধারা দেরি করেই বোঝে।

সেটাও বুঝে গেছি।

নুহা বলল, তুই আর কোচিংয়ে যাচ্ছিস না, বাসা থেকেও বের হচ্ছিস না, কেন? দিব্যি তো সুস্থ আছিস।

অয়ন বলল, সেদিনই না বললি, না দেখেও অনেক কিছু বোঝা যায়। তাহলে দেখেও কতকিছু বোঝা যায় না, একবার ভাব?

নুহা আচমকা গম্ভীর হয়ে গেল, তোর কী হয়েছে, সত্যি করে বলতো, অয়ন?

কিছু হয়নি, কিন্তু হতে কতক্ষণ? ধর, একদিন দেখলি টুপ করে নাই হয়ে গেছি। অয়ন কথা শেষ করতে না করতেই হা হা হা করে হেসে উঠল। যেন খুব মজার কোনো কথা বলেছে। কিন্তু অয়নের দিকে তাকিয়ে নুহার কেন যেন হাসি পেল না। বরং তার খুব অস্বস্তি হতে লাগল। সে উদ্বিগ্ন গলায় ডাকলো, অয়ন?

হুম।

নাই হয়ে যাবি মানে?

ধর, দুম করে মরেটরে গেলাম! হতে পারে না?

হুম, তা তো হতেই পারে। কিন্তু সে তো যে কেউই হতে পারে।

সেই জন্যই তো বললাম।

নুহা কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে গেল। অনু দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। সে নুহাকে দেখে যেন প্রথম চিনতেই পারল না। নুহা উঠে সালাম দিতেই অনু বলল, তুমি কত বড় হয়ে গেছ মেয়ে!

নুহা হাসলো, আপনি ভালো আছেন আপু?

অনু একহাতে নুহাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল, হ্যাঁ, ভালো। বাসার সবাই ভালো?

নুহা ঘাড় কাত করে বলল, জি আপু, ভালো।

অনু অয়নের গায়ে হাত দিয়ে উষ্ণতা দেখলো। তারপর বলল, সকালের ওষুধগুলো খেয়েছিস?

অয়ন না বোধক মাথা নাড়লো, এখনো তো বিছানাই ছাড়িনি।

যা, ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে ওষুধগুলো খেয়ে নে।

অয়ন বিছানা ছাড়তেই অনু নুহার দিকে তাকালো, পরীক্ষা তো চলেই এলো?

জি আপু।

প্রিপারেশন কেমন?

এই তো আপু মোটামুটি। নুহা উত্তরটা দিয়েই খুব সামান্য সময়ের জন্য থামলো। তারপর আবার সাথে সাথেই বলল, আচ্ছা আপু, একটা কথা, অয়নের কী কোনো সমস্যা হয়েছে?

অনু অবাক হবার ভঙ্গিতে বলল, কী সমস্যা?

সেই প্রথম দিন থেকেই অনু চায়নি অয়নের এই ব্যাপারটা বাইরের কেউ জানুক। তা সে অয়নের বন্ধু হোক বা অন্য কেউ। প্রথমত, একবার কেউ জানলে সেটা কোনো না কোনোভাবে অয়নের কান অব্দি পৌঁছাবেই, এটা অনু জানে। আর দ্বিতীয়ত, এই নিয়ে মানুষজন যে অতিরিক্ত সহানুভূতি দেখাবে বা দলবেঁধে নানা ছল ছুঁতোয় অয়নকে দেখতে আসবে এই বিষয়গুলো বরং তাদের এবং অয়নের জন্যও আরো বেশি কষ্টকরই হতো।

নুহা বলল, না আপু, আমার হঠাৎ মনে হলো।

নুহাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না অনু। চুলায় কিছু একটা পুড়ছে এমন ভান করে সে শশব্যস্ত হয়ে উঠে রান্না ঘরে গেল। অয়ন তখনো বাথরুম থেকে বের হয়নি। কী মনে হতেই নুহা রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর বলল, আপু, আরেকটা কথা বলি?

তুমি বসো, আমি আসছি। অনু রান্না ঘরে কিছু একটা কাজ সেরে আবার এসে বসলো। নুহা বলল, আপু, কিন্তু পরীক্ষার আগে আগে অয়নকে এমন একটা ফোন কিনে দিলেন!

অনু মৃদু হাসলো, ওর শখের কিছু তো কখনো দেইনি, তাই দিলাম। আমাকে একটু বের হতে হবে নুহা, আমি উঠি?

নুহা বুঝতে পারছিল, অনু তাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছে। সে আর কথা বাড়ালো না। অয়ন সামান্য কিছু খাবার খেয়ে ওষুধ খেলো। নুহা বলল, তুই বাইরে যাস না, সে ঠিক আছে। কিন্তু তোর ফোনটাও তো সেই কবে থেকে অফ। ফোন অফ কেন?

আমার ফোনে তো তেমন কেউ ফোন দেয় না। এইজন্য অফই থাকে।

কিন্তু আমি তো তোকে ফোন করলে কখনোই পাই না।

অয়ন বলল, এখন থেকেই প্র্যাকটিস কর।

কী প্র্যাকটিস?

ফোনে না পাওয়াটা।

মানে?

অয়ন কথা ঘুরিয়ে নিলো, মানে, বিয়ে হয়ে গেলে তো আর ফোন দিতে পারবি না।

নুহা কিছুক্ষণ অয়নের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। তার মুখ গম্ভীর। সে বলল, তুই এটা মিন করিসনি অয়ন!

অয়ন হাসলো, এত সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছিস কেন?

তুই আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছিস।

অয়ন মুহূর্তেই কেমন চুপ হয়ে গেল। তারপর বালিশটা দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে তাতে পিঠ ঠেকিয়ে বসে বলল, লুকানো জিনিস লুকানো থাকাই ভালো নুহা।

তুই আমাকে বলবি না? বলতে চাইলে কেউ লুকায়? আর সব লুকানো জিনিস সবাই খুঁজেও পায় না।

অয়ন হাসলো। নুহার মনে হলো ওই হাসির অন্য নাম কান্না।

.

অনুর সাথে শামীমের দেখা হয়ে গেল বাসার গলিটা ছাড়িয়ে সামনের মোড়ে। সেখানে হাতের ডানে তিনতলা অর্ধসমাপ্ত একটা বিল্ডিং রয়েছে। বিল্ডিংয়ের দোতলা পর্যন্ত কাজ শেষে হলেও তিনতলার কাজটা অর্ধেক হয়ে থেমে আছে। এলাকার বখাটে ছেলেদের আড্ডা বসে সেখানে। দোতলায় আগে একটা কোচিং সেন্টার ছিল, কিন্তু নানা অভিযোগে সেই কোচিং সেন্টার বছর তিনেক আগে বন্ধ হয়ে যায়। নিচতলায় ছোট আকারের মার্কেট রয়েছে। এখানে বই-খাতা, স্টেশনারি থেকে শুরু করে ফটোকপি, প্রিন্টিং, ওষুধসহ নানা-কিছু পাওয়া যায়। মূলত কোচিং সেন্টার আর পাশের স্কুলটিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল এই মার্কেট।

শামীমকে এখানে দেখে অনু কিছুটা অবাক হলো। এখানে যারা আড্ডা দেয় তাদের সম্পর্কে খুব একটা ভালো ধারণা বা অভিজ্ঞতা অনুর নেই। শামীম অবশ্য অনুকে দেখেই উঠে এসে সালাম দিলো। অনুর হাতে বাজারের ব্যাগ ছিল। সে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলল, আপু, আল্লাহর ইচ্ছায় ব্যবসাপাতির একটা ব্যবস্থা করে ফেলেছি।

সেইরাতের ঘটনার পর শামীম আর তনুর গায়ে হাত তোলেনি। বরং খুবই ভালো ব্যবহার করেছে। টাকা-পয়সা সংক্রান্ত বিষয় নিয়েও কোনো কথা বলেনি। ওইটুকুতেই শামীম এতটা বদলে যাবে অনু ভাবেনি। বরং অবাকই হয়েছে সে। কিন্তু আজ আবার ব্যবসার প্রসঙ্গ তুলতেই অনু কিছুটা সতর্ক হলো। সে বলল, কী ব্যবস্থা?

বাস স্ট্যান্ডের কাছে যেই স্কুলটার সামনে দোকান দিবো ভাবছিলাম, সেখানে দোকান পেয়ে গেছি আপু।

কিন্তু ওখানে দোকান পেতে তো অনেক টাকা লাগে। এত টাকা পেলে কোথায়?

ব্যবস্থা হয়ে গেছে আপু। আসলে বন্ধুবান্ধবের মতো বন্ধুবান্ধব থাকলে কোনো কিছুই আটকে থাকে না।

সেটা ঠিক আছে। কিন্তু যা-ই করো, সাবধানে ভেবে বুঝো করো শামীম। আমি জানি না, বইয়ের বিজনেস করার বুদ্ধিটা তোমাকে কে দিলো? এই সময়ে এসে বইয়ের বিজনেস খুবই রিস্কি।

জি আপু, তা জানি। কিন্তু আপু, এ ছাড়া তো আর কোনো উপায়ও দেখছিলাম না। সব বই প্রায় বাকিতে এনেই বিজনেস করা সম্ভব। অন্য কিছু তো এভাবে সম্ভব না।

আচ্ছা, ঠিক আছে, দেখো কী হয়! তবে সাবধান, আবার বড় কোনো ঝামেলায় জড়িয়ো না। শুনেছি, ওসব জায়গায় দোকান পেতে বড় নেতা ধরতে হয়, পলিটিক্যাল লবিং পর্যন্ত লাগে। তুমি কি করে এত সহজে সব ব্যবস্থা করে ফেললে জানি না। আমার আবার অল্পতেই ভয় হয় বুঝলে?

শামীম আচমকা রাস্তার মাঝখানে টুক করে ঝুঁকে পড়ে অনুর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে ফেলল। তারপর বলল, আমার আপন বড় বোন নেই আপু। কিন্তু আপনি আমাকে যে স্নেহ করেন, আদর করেন, এই যে আমার ভালো-মন্দ নিয়ে এত ভাবেন। এতে আমার বড় বোনের সেই আফসোসটা আর থাকে না।

অনু খানিক বিব্রত হলেও শামীমকে কিছু বলল না। শামীম বলল, দেখবেন আপু, বিজনেসটা দাঁড়িয়ে যাবে, আপনি শুধু একটু দোয়া…। শামীম কথা শেষ করতে পারল না, তার আগে তার ফোন বেজে উঠল। সে তড়িঘড়ি করে পকেট থেকে ফোন বের করে বলল, আপু, আমার জরুরি একটা ফোন এসেছে, এখুনি যেতে হবে। আপনি একা যেতে পারবেন?

অনু হাসলো, কোনো সমস্যা নেই। তুমি যাও।

অনু ঘরে ঢুকে দেখলো অয়ন বসে আছে। সে বাজারের ব্যাগটা রান্না ঘরে রেখে এসে বলল, তোর ফোনটা কী তুই শামীমকে দিয়ে দিয়েছিস?

অয়ন বলল, আমার তো ফোন লাগে না আপু। তেমন তো কেউ ফোনও দেয় না।

শামীম চেয়েছিল তোর কাছে?

নাহ্।

তাহলে?

এমনি আপু, ভাইয়ার ফোনটা তো কাজ করছিল না।

কবে দিয়েছিস?

অয়ন চুপ করে রইল। অনু বলল, তনুকে কী সেদিন রাতে ফোনের জন্যই মেরেছিল? তুই জেগে জেগে সব শুনেছিলি না?

অয়ন কথা বলল না, অনুও না। কিছুক্ষণ অয়নের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অনু বলল, মানুষ হতে গেলে খুব কষ্ট পেতে হয় বুঝলি অয়ন?

অয়ন ম্লান হেসে বলল, না, বুঝিনি।

.

অয়ন মারা গেল সেই রাতেই। সালমা বেগম অয়নের বিছানার পাশে মেঝেতে জায়নামাজেই শুয়ে ছিলেন। তিনি ফজরের নামাজ পড়ে প্রতিদিনকার মতোই দোয়া-দরুদ পড়ে অয়নের গায়ে ফুঁ দিলেন। তারপর অয়নের কপালে হাত দিয়ে জ্বর আছে কি-না দেখতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন, তার বুকের ভেতরটা তীব্র এক ঝাঁকুনিতে হঠাৎ শূন্য হয়ে গেছে। সেই শূন্যতা সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। তনু আর বেনু শেকড়হীন বৃক্ষের মতো আছড়ে পড়লো মেঝেতে। অনুর বড় চাচিরা এলেন। এলো আত্মীয়-স্বজন যারা ছিল কম বেশি সকলেই। এমন মৃত্যু মেনে নেয়া সকলের জন্যই কঠিন। কান্নার রোল পড়ে যাওয়া ওই স্যাঁতসেঁতে ছোট্ট ঘরের বাড়িটাতে একজন মাত্র মানুষ কাঁদলো না। কোনো শব্দ করলো না। মৃত অয়নকে এক পলক দেখতেও চাইলো না। সেই মানুষটা অনু।

সে চুপচাপ বসে রইল। তাকে কতজন ডাকলো। সান্ত্বনা দিতে এলো, কত কত কথা বলল। কিন্তু তার কিছুই যেন সে শুনলো না। সেই সারাটা দিন সে স্থির, স্তব্ধ বসে রইল। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, বড় চাচারা অয়নের লাশ দাফন করতে নিয়ে গেলেন গ্রামে। সাথে গেল তনু, বেনু আর শামীম। সালমা বেগম সংজ্ঞাহীন পড়ে রইলেন বিছানায়। শুধু অনু সেই যে বসে ছিল, ঠিক তেমনই বসে রইল। নিঃশব্দ, নিথর, নিস্পন্দন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামলো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সেই সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে রাতের মতো গাঢ় অন্ধকার আর শুনসান নিস্তব্ধতা হয়ে বসে রইল অনু।

*

অয়নের মৃত্যুর ঠিক পাঁচ মাসের মাথায় বিয়ে হয়ে গেল নুহার। তার এইচএসসির শেষ পরীক্ষাটা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিল আদিল। পরীক্ষাটা শেষ হতেই তাড়াহুড়া করে ঘরোয়াভাবে বিয়ে হয়ে গেল তাদের। আগের বিয়েটা ভাঙা নিয়ে এমনিতেই খুব ঝামেলা হয়েছিল। আর কোনো ঝামেলা বা আড়ম্বর। চায়নি কোনো পরিবারই। তার কিছুদিন বাদে নুহাকে নিয়ে আমেরিকা চলে গেল আদিল। এই সময়টায় দুম করে বদলে গেল আরো অনেক কিছুই। সবাইকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বইয়ের ব্যবসায় রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিলো শামীম। জলের মতো টাকা আসতে লাগল তার দোকান থেকে। ভেজা তুলোর মতো মিইয়ে থাকা তনু যেন ভোরের রোদে আড়মোড়া ভেঙে চনমনে হয়ে উঠল। বেনু চলে গেল মাদারীপুর। অনুর চাকরি হয়েছে নতুন। আগের মতোই ব্যস্ত হয়ে। পড়েছে সেও। সকলই কেমন বদলে গেল, কেবল বদলে গেলেন না একজন। তিনি সারাক্ষণ অয়নের বিছানায় মাথা রেখে মেঝেতে বসে থাকেন। অয়নের বিছানার চাদর, গায়ের কাঁথা, পরনের কাপড়, পায়ের জুতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে তার চারধারে। তার কেবল মনে হতে থাকে এইখানে অয়নের গন্ধ লেগে আছে, অয়নের গায়ের স্পর্শ লেগে আছে। তিনি বুক ভরে সেই গন্ধ নিতে থাকেন। তিনি জড়িয়ে ধরে সেই স্পর্শ নিতে থাকেন। আর খানিক বাদেই বিড়বিড় করে বলেন, অয়ন, তোর গায়ের জ্বরটা এখনো কমে নাই?

অয়ন তাকে জবাবও দেয়, এখন তো জ্বর নেই মা।

তাহলে শুয়ে আছিস কেন? ওঠ, ওঠ।

আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না, মা।

কেন উঠতে ইচ্ছে করছে না?

আমার তোমার কাছে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।

আমার কাছে শুয়ে থাকলে কি হয়?

সুখ হয় মা?

সুখ কী?

যেটা অসুখ না।

তাহলে কীভাবে হবে?

তোমার কাছ থেকে দূরে গেলেই আমার অসুখ করে মা। আমার অসুখকে খুব ভয় হয়।

সালমা বেগম অয়নকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরেন, তিনি অয়নকে কোথাও যেতে দেবেন না। অয়নের অসুখকে তিনিও ভয় পান। অয়নের শার্ট, গেঞ্জি, পাঞ্জাবি, বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি তাতে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিতে নিতে বলেন, তুই আজও গোসল করিসনি অয়ন?

অয়ন বলে, আজ কী ঠান্ডা পড়েছে দেখেছ মা? তুমিই না বলো ঠান্ডা লাগালেই আমার আবার জ্বর হবে।

তাহলে গরম পানি করে কর।

আমার গরম পানি করতে ইচ্ছে করে না মা।

সালমা বেগম উঠে গরম পানি করেন। তারপর সেই পানিতে অয়নের জামা কাপড়গুলোকে ডলে ডলে গোসল করান।

তোর গায়ে এত ময়লা কেন অয়ন?

তোমার মতো এমন ডলে ডলে গোসল করি না বলে।

কেন করিস না?

তুমি যে বলো আমার গায়ের গন্ধ রেখে দিতে। এভাবে গোসল করলে গায়ের গন্ধ থাকে!

সালমা বেগমের হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে আসে। তিনি ঝটপট অয়নের জামা কাপড়গুলো বালতি থেকে তুলে ফেলেন। তারপর সেই কাপড়গুলো রোদে মেলে দিয়ে বসে থাকেন। তার খুব সন্দেহ হতে থাকে, অয়নের গায়ে তার গন্ধ লেগে আছে তো? তিনি একবার উঠে গিয়ে জামা কাপড়গুলোয় নাক ডুবিয়ে গন্ধ শুঁকে দেখেন। আবার একবার নিজের জায়গায় এসে বসে পড়েন। তার একবার মনে হতে থাকে, তিনি ঠিক ঠিক অয়নের গায়ের গন্ধ পাচ্ছেন। আবার পরমুহূর্তেই মনে হয়, পাচ্ছেন না। অয়নের কাপড়গুলো নিয়ে তিনি তখন এ-ঘর। থেকে ও-ঘর ঘুরতে থাকেন। তনু, শামীম, অনু যাকেই সামনে পান জিজ্ঞেস করতে থাকেন, দ্যাখ তো, অয়নের গায়ের গন্ধ আছে কি-না? একটু দেখ না? দেখে বল?

.

অনুর চাকরি হতে মাস তিনেক সময় লেগেছে। তার চাকরি হয়েছে একটা বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পরও একদম শেষ মুহূর্তে এসে তোহা ইকরামের অফিসে তার চাকরিটি হয়নি। এই না হওয়াটা বেশ রহস্যজনক। অনু এপয়েনমেন্ট লেটারও হাতে পেয়েছিল। কিন্তু জয়েন করার মাত্র দু’দিন আগে তোহা ইকরাম তাকে ডেকে বললেন, অনু, একটা সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটা আমি আপনাকে বলতে পারব না। শুনলে আপনার ভালোও লাগবে না, আর আমার জন্যও বিষয়টা অস্বস্তিকর। আমি যদি আপনাকে অন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেই, তাতে কী আপনি মনঃক্ষুণ্ণ হবেন?

অনুর তখন মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ার মতো অবস্থা নেই। যে-কোনো একটা চাকরি তার খুব দরকার। কিন্তু এই না জানতে পারা রহস্যময় কারণটি তাকে খুব অস্বস্তি দিতে থাকল। তার চাকরি হয়ে গেল তোহা ইকরামের এক বন্ধুর নতুন বিজ্ঞাপনী সংস্থার মার্কেটিং বিভাগে। যদিও এই কাজের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা তার একদমই নেই। এমনকি সে এতদিন যে কাজ করেছে, তার সাথে এর দূরতম কোনো সম্পর্কও নেই। তারপরও যে তার চাকরিটি হয়ে গেল, তা শুধুমাত্র তোহা ইকরামের কল্যাণেই। বেতন খুব একটা বেশি না হলেও অফিসের জন্য কাজ জোগাড় করে দিতে পারলে কমিশনের ব্যবস্থাও রয়েছে। অনু জানে না, এই কাজটি সে কতটা কী করতে পারবে! তবে তোহা ইকরামের প্রতি মনে মনে একধরনের প্রবল কৃতজ্ঞতাবোধ তৈরি হয়েছে তার। যদিও অনু জানে, বেশিরভাগ মানুষের প্রতি যখনই তার কৃতজ্ঞতাবোধ তৈরি হয়েছে। ঠিক তখনই ধীরে ধীরে সেই মানুষটির প্রতি সে শ্রদ্ধাটা হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে। মানুষ কেন যেন আজকাল বিনিময়বিহীন কিছু ভাবতেই পারে না। তা সে যা-ই হোক, আর সেই বিনিময়ে সে সবসময় জিততেই চায়। এটি অনুর এই এতদিনকার ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতা। তোহা ইকরামের প্রতি মুগ্ধ এবং কৃতজ্ঞ হতে গিয়েও অনু তাই নিজেকে সামলে নিয়েছে।

অফিস শুরু করার তিন দিনের মাথায় তোহা ইকরাম ফোন করলেন অনুকে। কাজের খোঁজ খবর নিলেন। কোনো সমস্যা হলে তাকে জানাতে বললেন। কিছু ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, অনু যেন অফিসের জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে সেসব জায়গায় যায়। অনু একবার ভাবছিল তোহাকে জিজ্ঞেস করবে সেই সমস্যাটার কথা। কিন্তু তারপর আবার নানা কিছু চিন্তা করে আর জিজ্ঞেস করা হয়নি। এই নিয়ে মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি সবসময়ই ছিল। তবে মাসখানেকের মাথায় সেই রহস্য যেন কিছুটা ভাঙলো। এক রাতে তাকে ফোন দিলো অদিতি, কী রে কেমন আছিস?

অনু তখন কেবল অফিস থেকে ফিরেছে। সে ক্লান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ, ভালো। তুই?

আমার আর খবর!

কেন কী হয়েছে?

জীবনটা কেমন ঘরবন্দি হয়ে গেল। তোর মতো চাকরি-বাকরি করতে পারতাম। একটা স্বাধীন জীবন।

চাকরি-বাকরি কী স্বাধীন না-কি?

নয়তো কী? যখন যা ইচ্ছে করা যায়।

কই, আমি তো কিছুই পারি না।

তুই আবার পারিস না? আমার তো মনে হয় তুই পারিস না, এমন কোনো কাজ নেই।

এটা কেন মনে হয়?

এই যে কত কিছু করিস। সবকিছু একহাতে সামলে নিস, ম্যানেজ করে ফেলিস।

অনু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিছুই পারি না রে।

সে তো কেবল ওই বিয়েটাই পারলি না, আর সবই তো ঠিকঠাক করে ফেললি। তা ওটা না হয়ে ভালোই হয়েছে, তাহলে কী এমন যখন যা ইচ্ছে করতে পারতি? এই যে চাকরি চলে গেল, আবার কেমন কেমন করে নতুন একটা চাকরিও পেয়ে গেলি?

চাকরি চলে যায়নি, আমি ছেড়ে দিয়েছি।

অদিতি হাসলো, একবার হয়েছে কী শোন, পাশ করেই চাকরিতে ঢুকেছি, তিন মাসের প্রাইমারি কন্ট্রাক্ট। ভালো করলে পারমানেন্ট হবে। আমরা তেরোজন একসাথে ঢুকলাম। তো ওই কাজের তো আমি কিছু বুঝি না। শেষে বারো জনের কন্ট্রাক্টই রিনিউ হলো। একমাত্র বাদ পড়লাম আমি। এখন? সবাইকে কী বলব? বললাম যে ওই চাকরি আমার ভালো লাগে না। তাই অফিস কন্ট্রাক্ট রিনিউ করতে চাইলেও আমিই বাদ দিয়ে দিয়েছি।

অদিতি কথা শেষ করেই হাসলো। অনু বলল, তোর ধারণা, আমি মিথ্যে বলছি?

ধুর, আমি কী তা বলেছি না-কি? আচ্ছা, এখন নতুন চাকরি কোথায় হয়েছে?

একটা অ্যাড এজেন্সিতে, মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ।

এই বয়সে অ্যাড এজেন্সিতে, তাও আবার মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ? বুঝিস কিন্তু…।

কী বুঝবো?

মেয়েদের একটু বুঝে শুনে চলতে হয়, বুঝলি?

হুম, বুঝলাম।

তোর অবশ্য বুঝে শুনলে চললে তো হবে না, তোর হচ্ছে কাজ উসুল দিয়ে কথা। বুঝে শুনে চললে এভাবে যখন তখন জব-টবের ব্যবস্থাও তো হয়তো হতো না, তাই না?

অনুর হঠাৎ মনে হলো অদিতি তাকে কিছু ইঙ্গিত করছে। সে বলল, মানে?

কোনো এক্সপেরিয়েন্স ছাড়াই এই বয়সে এসে হঠাৎ করেই এভাবে ট্র্যাক চেঞ্জ করা তো সহজ নয়। সবাই পারে না। তুই পেরেছিস, রহস্যটা কী বলতো?

কী রহস্য?

মানে একেবারে কোনো স্ট্রং রেফারেন্স ছাড়া তো আর সম্ভব নয়। তা রেফারেন্সটা কে বলতো?

অনু কথা বলল না। অদিতিই বলল, সেদিন তোহা বলেছিলে ওর সাথে–কি তোর কথাবার্তা হয়? তা ওর অফিসেই তো একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারতো। তুই আমাকে বলতে না পারলেও ওকে তো বলতে পারতিস?

অদিতির খোঁচাটা এবার খুব বেশি সরাসরি। তার কাছে না বলে তোহার কাছে চাকরির বিষয়ে কথা বলার জন্য অদিতি বিষয়টি ভালো ভাবে নিতে পারেনি। অনু এতক্ষণে বুঝতে পারল ঘটনা। সেদিন আর তাদের কথা হলো না। অনু একবার ভাবছিল তোহার সাথে বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কথা বলবে। কিন্তু এতে অদিতির সাথে তোহার সম্পর্কটা যদি আরো খারাপ হয়ে যায়। তাছাড়া এটা একভাবে অদিতির নামে তোহার কাছে অভিযোগ করাও। এইসব সাতপাঁচ ভেবে শেষ পর্যন্ত নিবৃত রইল সে। তবে পুরো বিষয়টি খুব বাজেভাবে স্পষ্ট হলো তারও মাস দুই পরে।

সন্ধ্যাবেলা অফিসে জরুরি একটা কাজ করছিল অনু। এই সময়ে অদিতির ফোন। অনু ফোন ধরে বলল, আমি তোকে কিছুক্ষণ পরে ফোন দেই অদিতি?

অদিতি কেমন করে হাসলো, কেন? ডেটিংয়ে না-কি?

অনু আর কথা বাড়ালো না। সে ফোন রেখে যতক্ষণে কাজ শেষ করলো, ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। পরদিন শুক্রবার হওয়াতে রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম। অনু ভাবলো বাসায় গিয়ে ধীরে সুস্থে অদিতিকে ফোন করবে। জ্যাম ঠেলে বাসে করে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে গেল অনেক। গোসল, খাওয়া সেরে অদিতিকে ফোন দিতে গিয়ে রীতিমত ভড়কে গেল অনু, প্রায় কুড়িটিরও বেশি মিসড কল উঠে আছে ফোনে। বাসে থাকায় টের পায়নি সে। কিন্তু অদিতি তাকে এতগুলো ফোন কেন দিলো? অনু তড়িঘড়ি ফোন দিতেই অদিতি বলল, কী, রসলীলা ভঙ্গ হলো তাহলে?

অনু অবাক গলায় বলল, মানে কী অদিতি?

মানে কী অদিতি না? নিজের ঘর হচ্ছে না বলে এখন অন্যের ঘরও থাকবে না? এখন যাদের ঘর আছে, তাদের ঘরও ভাঙতে হবে?

অনু হতভম্ব হয়ে গেল। সে বলল, কী হয়েছে অদিতি?

এমন ভান করছিস যে কিছু জানিস না?

অনুর হঠাৎ মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে শক্ত গলায় বলল, যা বলার স্পষ্ট করে বল।

তুই দুদিন পরপর তোহাকে ফোন দিস ঘটনা কী? তোহা প্রথম প্রথম আমাকে যখন বলেছিল, তখন সাদা মনে বিষয়টিকে পাত্তা দেইনি। কিন্তু তলে তলে তুই যে এতটা এগুবি, সেটা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি। বান্ধবী হয়েও এত বড় ক্ষতি কী করে করলি?

অনুর রাগটা হঠাৎ পড়ে গেল। সে হাল ছেড়ে দেয়া মানুষের মতো হতাশ ভঙ্গিতে বলল, আমি কী কী করেছি তুই বল, আমি একটু শুনি?

এমন ভাব করছিস যেন কিছু জানিস না। তোহা যেদিন বলেছিল যে তার অফিসে তুই চাকরি চাইছিস, সেদিনই আমার মনে কামড় দিয়েছিল। জীবনে এরকম মেয়ে মানুষ তো আর কম দেখলাম না অনু। এরা সবসময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে। আর দোষ হয় পুরুষ মানুষের। এরা সুযোগ নিলে দোষ নাই, আর পুরুষ মানুষ যদি দেয়ার বদলে কিছু নিতে যায়, তখনই তাদের দোষ। সেদিনই তোহাকে পইপই করে বলে দিয়েছিলাম, ভুলেও যেন এই কাজ না করে। পরে কী না কী বদনাম উঠবে, সাবধান! আমরা তো একটা ভদ্র সমাজে বাস করি না-কি? আগের অফিসেও তো খুব নাম করে আসিসনি। কোনো কিছুই চাপা থাকে না বুঝলি, বাতাসে সবই ভাসে।

অনুর প্রচণ্ড হতাশ লাগছে। তার সম্ভবত রাগ লাগা উচিত। কিন্তু তার একটুও রাগ হচ্ছে না। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আর কিছু বলবি অদিতি? আমি ফোনটা রাখবো।

তা তো রাখবিই। আমার জামাইর মাথাটা চিবিয়ে খাওয়া তো শেষ, এখন আর আমাকে লাগবে কেন? তা নতুন চাকরি যে করছিস, সেটা কী করে বাগালি? তোহা যে দিয়ে দিয়েছে, তা তো জানি। কিন্তু বিনিময়ে তোহাকে তুই কী দিলি?

অনু নির্বিকার গলায় বলল, সব দিয়ে দিয়েছি অদিতি।

আচমকা অনুর এমন কথা নিতে পারল না অদিতি। সে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বলল, সব দিয়ে দিয়েছিস মানে? কী সব দিয়ে দিয়েছিস? তোর লজ্জা করছে না অনু? তোর মুখে কিছু আটকাচ্ছে না? আটকাবে কী করে! লজ্জা শরম থাকলে তো কেউ এমন কাজ করতে পারে না।

অনু রান্না ঘরে এসে ফিল্টার থেকে গ্লাসে পানি ঢাললো। তারপর সময় নিয়ে সেই পানি খোলো। তারপর ওড়নায় মুখ মুছতে মুছতে নির্বিকার গলায় বলল, আমি পারি।

অনুর আচরণে অদিতি রীতিমত হকচকিয়ে গেল। সে হতভম্ব গলায় বলল, তুই এখন কই? তোহা তোর সাথে? কোথায় তোরা, আমাকে বল? তোহা গত দুই দিন ধরে আমার ফোন ধরছে না। ধরলেও ঠিকমতো কথা বলছে না। বাসায় আসছে না। আমি জানি সে তোর সাথে আছে। তুই আমাকে বল, তোরা কোথায় আছিস? অনু, আমি কিন্তু পুলিশে খবর দিবো।

উঁহু।

উঁহু মানে?

পুলিশে খবর দিস না।

নাহ্, আমি পুলিশেই খবর দিবো। আমার বড় মামা রমনা থানার ওসি। আমি এখুনি তাকে ফোন দিবো, এখুনি।

তুই বরং এক কাজ কর, ডাক্তার খবর দে। তোর ইমার্জেন্সি ট্রিটমেন্ট দরকার অদিতি।

অনু ফোন রেখে দিলো। ফোন রেখে মনে হলো, বিষয়টি নিয়ে তোহা ইকরামের সাথে কথা বলা ছাড়া আর উপায় নেই। এই যন্ত্রণা আর ভালো লাগছে না তার। অয়নের বিছানাটার দিকে তাকাতে অনুর খেয়াল হলো, বাসায় আসার পর থেকে সে মাকে দেখেনি। তনুর ঘর, ড্রইংরুম কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না সালমা বেগমকে। বারান্দা এবং বাইরের দরজা খোলা। অনু প্রথমে বারান্দায় গেল, সেখানে সালমা বেগম নেই। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, পাশের বাড়ির দোতলার জানালাটা আবার বন্ধ। জানালাটার কথা সে এতদিন ভুলেই ছিল। সেই ভয়ংকর গা হিম হয়ে যাওয়া অনুভূতির কথাও। আসলে অয়নের মৃত্যুর চেয়ে বড় ভয় আর কী আছে তার জীবনে! আজকাল জীবনের আর সকল কিছুই কেমন তুচ্ছ লাগে তার কাছে। ওয়াসিমের মতো মানুষটাকে কী অবলীলায়ই না এতদিন ভুলে ছিল অনু! কিন্তু ওয়াসিমও তো এতদিনে আর একবারও তার সামনে এসে দাঁড়ায়নি! ঘরের জানালাটাও বন্ধ। ঘটনা কী?

অনু সালমা বেগমকে খুঁজতে বের হলো, কিন্তু সালমা বেগমকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। তিনি তখন মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার ছোট্ট বাস স্ট্যান্ডে বাস থেকে নামছেন। তার হাতে একটা জামা কাপড়ের পুঁটলি। সেই পুঁটলি তিনি বুকের কাছে শক্ত করে ধরে রেখেছেন। বিয়ের প্রায় চল্লিশ বছর পর এই প্রথম তিনি তার স্বামীর গ্রামে যাচ্ছেন। যদিও তিনি গ্রামের নাম জানেন না। তিনি জানেন জেলা আর উপজেলার নাম। কিন্তু কালকিনি উপজেলার এই পনেরোটি গ্রামের কোথায় তিনি তার ছেলের কবর খুঁজবেন?

সালমা বেগম বাস থেকে নামতে নামতে হেল্পারকে বললেন, বাস আর যাবে না?

না।

এইটাই লাস্ট স্টপেজ?

হ।

তিনি বাস থেকে নেমে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার হেল্পারের কাছে ফিরে এলেন। হেল্পারের নাম আক্কাছ মিয়া। আক্কাছ মিয়ার বয়স অল্প। সে সালমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনে যাইবেন কই?

সালমা বেগম কিছুক্ষণ হতবুদ্ধের মতোন মাথা চুলকে বললেন, অয়নের কাছে।

অয়ন কে?

আমার ছেলে।

সে কী করে?

সালমা বেগম অনেক ভেবেও বলতে পারলেন না সে কী করে! আক্কাছ মিয়া তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সালমা বেগম খানিক দাঁড়িয়ে থেকে আবার আক্কাছের কাছে গিয়ে বললেন, সে ঘুমায়।

আক্কাছ মিয়া মোটামুটি একটা ধাক্কা খেলো। সে অবাক দৃষ্টিতে সালমা বেগমের দিকে তাকালো। ভদ্র পোশাক আশাক পরা সুশ্রী এই নারীকে তার অসুস্থ মনে হচ্ছে না। সে হতাশ গলায় বলল, কই ঘুমায়?

কবরে।

আক্কাছ মিয়া কী বুঝলো কে জানে! সে সালমা বেগমকে নিয়ে বাস স্ট্যান্ডের ছাউনির নিচে বসালো। তারপর বলল, আপনে কই থেইকা আইছেন?

অয়নের কাছ থেকে।

কই যাইবেন?

অয়নের কাছে।

অয়ন থাকে কই?

কবরে।

কবর কই?

জানি না।

না জানলে যাইবেন কেমনে?

আমি ঘ্রাণ পাই।

কিসের ঘ্রাণ?

অয়নের। অয়নের গায়ের ঘ্রাণ আমি পাই। অয়ন আশেপাশে কোথাও আছে। সালমা বেগম চোখ বন্ধ করে অয়নের ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করছেন। আক্কাছ মিয়া বলল, খালা, আপনে এইখানে বহেন, আমি আইতাছি।

তার বাড়ি বাসস্ট্যান্ডের সাথেই। সে গিয়ে বাড়ি থেকে তার মাকে ডেকে আনলো। তার মা সব শুনে বলল, আপা, আপনে চিন্তা কইরেন না, আমরা আপনের অয়নের কবর খুঁইজা বাইর করব।

সালমা বেগম তার জীবদ্দশায় আর অয়নের কবর খুঁজে পেলেন না। তিনি অয়নের কবর খুঁজে পেলেন তার মৃত্যুর পর। সেই রাতেই তিনি ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মাকে খুঁজে না পেয়ে অনুর যতটা বিচলিত হবার কথা ছিল, ততটা বিচলিত সে হলো না। বড় চাচা তোফাজ্জেল হোসেনকে ফোন করে সে বলল, আমার ধারণা মা কালকিনিতে গেছে।

সে কালকিনিতে যাবে কী করে?

আগেও সে অনেকবার বলেছিল, কালকিনিতে অয়নের কাছে গিয়ে থাকবে। শামীমের কাছ থেকে বারবার যাওয়ার উপায় জানতে চাইছিল।

তো শামীম কী গাধা না-কি যে সে বলবে?

একদিক থেকে ভালোই হয়েছে, খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। অন্য কোথাও গেলে সহজ হতো না।

তোফাজ্জল হোসেন কালকিনিতে খোঁজ পাঠালেন সেই রাতেই। কিন্তু রাতে সালমা বেগমের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। তার খোঁজ পাওয়া গেল পরদিন সকাল নটায়, কালকিনি সদর হাসপাতালে। আক্কাছ মিয়া আর তার মা মিলে সালমা বেগমকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। কিন্তু তারা এখন ভয় পাচ্ছে, উপকার করতে গিয়ে না পাছে আবার কোনো বিপদে পড়ে যায়! সালমা বেগমকে তখন ঢাকা নেয়া সম্ভব না। দুপুর নাগাদ অনু আর তোফাজ্জল হোসেন আসলেন। মাদারীপুর থেকে আসলো বেনু। হাফসা অসুস্থ বলে তনু আসতে পারল না।

সালমা বেগম মারা গেলেন সন্ধ্যায়। তাকে দাফন করা হলো অয়নের কবরের পাশে। অনুর কেন যেন মনে হলো, সালমা বেগম আগেভাগেই তার মৃত্যুর কথা টের পেয়েছিলেন। আর টের পেয়েছিলেন বলেই তিনি ইচ্ছে করেই চলে এসেছিলেন এখানে। হয়তো তিনি চেয়েছিলেন, তার কবরটা যেন অয়নের কবরের পাশে হয়। তার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। তার কবর হয়েছে অয়নের কবরের একদম গা ঘেঁষে। অয়নের গায়ের গন্ধের জন্য তাকে আর হাহাকার করতে হবে না। তার বুক এখন থেকে ভরে রইবে অয়নের গায়ের গন্ধে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *