৯. ছাতাটা নিয়ে যা

রেণু বললেন, ছাতাটা নিয়ে যা, যা রোদ।

হেমা বলল, প্লিজ মা। ডোন্ট বি মাই মাদার।

রেণু বললেন, এটা কি ধরনের কথা? ডোন্ট বি মাই মাদার মানে কি? আই অ্যাম অলরেডি ইওর মাদার।

হেমা বলল, ইটস অলরাইট। ইউ আর জেনেটিকালি মাই মাদার। বাট তুমি কখনো মা ছিলে না। অপরিচিত মহিলার মতো ছিলে। এখন মা হবার চেষ্টা করছ।

রেণু বললেন, একটা ছাতা নিয়ে যেতে বলার সাথে এতকিছু বলার মানে কি?

হেমা বলল, কোনো মানে নেই মা। আমার ছাতা নিয়ে হাঁটতে ভাল্লাগে না। পাহাড়ে যাচ্ছি, ছাতা মাথায় দিয়ে ঘোরার জন্য?

রেণু বললেন, ওকে যাস না।

হেমার ট্যুর যে আজ বা কালই, তা না। এখনো দিন পনেরো বাকি। কিন্তু রেণু প্রতিদিনই বিভিন্ন কথার ছলে এটা-সেটা দিয়ে যাচ্ছেন। সেদিন দিয়ে গেলেন একটা সানস্ক্রিন। বললেন, পাহাড়ে যাবি, অনেক রোদ। এটা মুখে, হাত পায়ে একটু মেখে নিস।

হেমা কথা বলেনি। সে চুপচাপ ক্রিমটা রেখে দিয়েছে ব্যাগে। তারপর দিন দুটো চমৎকার ওয়াটার বটল কিনে নিয়ে এসেছেন রেণু। সাথে এক বক্স স্যালাইন। বললেন, অনেক ডিহাইড্রেশন হবে,এগুলো সাথে রাখিস।

হেমা মৃদু হেসেছে। কিছু বলেনি। রোজই এমন টুকটাক চলতেই থাকে। আজ ছাতা। হেমা বলল, তোমাকে একটা কথা বলি মা?

রেণু বললেন, বল।

হেমা বলল, তোমার কি খুব একা লাগছে আজকাল?

রেণু বললেন, কেন? একা লাগবে কেন?

হেমা বলল, এই যে আমার এত যত্ন করছ!

রেণু বললেন, আগে কখনো করতাম না?

হেমা বলল, করতে না, তা না। কিন্তু এত তো করতেই না। তোমার কি মনে হচ্ছে, আমাকে আদর ঘুষ দিয়ে বাবার কাছ থেকে আটকে রাখবে? লাভ নেই মা। বাবা নতুন বিয়ে করছে। মেয়েটাকে আমি দেখেছি। বাবার জন্য খুব কেয়ার। রিকশায় বসা দুজনের সে কি হাসাহাসি! বাবা সম্ভবত আইসক্রিম খেয়ে গালে মাখিয়ে ফেলেছিল, মেয়েটাকে দেখলাম কী যত্ন করেই না শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে!

রেণু কথা বললেন না। তিনি হাতের কি কাজ করছিলেন। সেটি নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হেমা বলল, শোনো মা। বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে। বাবার বিয়েটা এ মাসেই হতো। কিন্তু আমি বলেছি, আমি ছাড়া যেন বিয়েটা না হয়। আমি সাজগোজ করে বিয়েতে যেতে চাই। কি পরে যাব বলো তো মা? শাড়ি? না সালোয়ার কামিজ?

রেণু যেন হেমার কথা শুনতেই পাননি। তিনি টুক করে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। হেমা আড়চোখে তাকিয়ে মায়ের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। আজ আবার মাঝরাতে নিজের ঘর ছেড়ে মার ঘরে গেল হেমা। রেণু তখনও জেগে। হেমা বলল, মা আমাকে বিয়ে দেবে না?

রেণু হাসলেন। বললেন, এত রাতে বিয়ের কথা কেন?

হেমা বলল, আমার মাথায় একটা প্রশ্ন এলো মা। আচ্ছা মানুষ বিয়ে করে কেন বলো তো?

রেণু বললেন, শুধু শুধু আমাকে জিজ্ঞেস করছিস। উত্তর না নিয়ে যে তুই আসিসনি, সে তো আমি জানিই।

হেমা বলল, আমি উত্তর নিয়ে আসলে সেটি তো আমার উত্তর। তোমার উত্তর কি সেটি বলল।

রেণু বললেন, এর কোনো স্পেসিফিক উত্তর নেই। একেকজনের কাছে একেকরকম। সবাই একই কারণে বিয়ে করে না।

হেমা বলল, একটা কারণ আছে মা। সবার এক।

রেণু বললেন, কি?

হেমা বলল, নিরাপত্তার জন্য। এই নিরাপত্তা নানানরকম হতে পারে। খাবার-দাবারের নিরাপত্তা থেকে আইডেনিটিটির নিরাপত্তা। সঙ্গীর নিরাপত্তা। ধরো, আমাদের দেশে তো একটা বয়সের পরই মেয়েদের কেন বিয়ে দেয়া হচ্ছে না, জামাই নেই কেন? কার জামাই কি করে, এই ধরনের নানান প্রশ্ন। তারপর ধরো বয়স হয়ে যাওয়ার পরও কোনো মেয়ে বিয়ে করল না, বা হচ্ছে, সাথে সাথেই সেই মেয়েটা এক ধরনের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পড়ে যাবে। অনিরাপদ হয়ে যাবে। মানে তার একটা বিয়ে দরকার পরিচিতির জন্য যে শি হ্যাঁজ আ হাজবেন্ড। রাইট? তবে একটা বিষয় কি জানো, সবচেয়ে ইম্পর্টান্ট সম্ভবত নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য। মানুষের বয়স যত বাড়ে, মানুষ তত নিঃসঙ্গ হতে থাকে। তার গণ্ডি তত ছোট হতে থাকে। এই সময়টা তার বন্ধু থাকে না। তখন তার বন্ধু হয়ে যায়, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী, এইসব। সে জানে, এরা যত দূরেই যাক, বা ভুলেই যাক, কোনো না কোনোভাবে তারা বাঁধা। সেটা হচ্ছে সম্পর্কের বন্ধন। সেটা উহ্য হলেও আছে। আর বুড়ো হতে থাকা মানুষগুলো তাদের নিঃসঙ্গতায় এই সম্পর্কের সঙ্গ খোঁজে।

রেণু বললেন, এই মাঝরাতে কী সব আবোল-তাবোল লেকচার শুরু করে দিলি।

হেমা বলল, কথাগুলো কেন বললাম জানো মা?

রেণু বলল, কেন?

হেমা বলল, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, তুমি এই ইনসিকিউরিটিতে ভুগছ। তুমি মন খারাপ বা রাগ করো না। তোমাকে কিছুদিন থেকে আমি খুব বুঝতে চাইছি। কেন বুঝতে চাইছি জানো? আমার নিজেকে বোঝার জন্য। তুমিও একটা বিশেষ অবস্থা পার করছ। আমিও। দুটো ভিন্ন হলেও, কোথাও একটা শক্ত মিল আছে। চাইলে মেলানোও যায়। এইজন্যই আমি তোমাকে বুঝতে চাইছলাম মা।

রেণু বললেন, তারপর কি বুঝলি?

হেমা বলল, তুমি এই এতদিনে এসে এখন নিঃসঙ্গতার ভয়ে ভীত হয়ে পড়ছ। তুমি নিজেই হয়তো বুঝতে পারোনি। কিন্তু হচ্ছ। ধরো, এতদিন বাবা, আমি, তুমি আমরা একসাথে থাকতাম। আমাদের মধ্যে তেমন কথাবার্তাও হতো না। কিন্তু তারপরও তোমার মনে হতো উই আর আ ফ্যামিলি। উই আর ইন আ রিলেশনশিপ এবং এটা শেষদিন পর্যন্ত এমনই থাকবে। মানে সেটাকে আলাদা করে কখনো খেয়াল করার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু সম্পর্কটা যখন ভেঙে গেল তখন কিন্তু একটা ইনসিকিউরিটি তৈরি হলো। যেমন ধরো, তোমার কি খুব করে মনে হচ্ছে না, আমি চলে গেলে তুমি খুব একা হয়ে যাবে? তোমার খুব নিঃসঙ্গ লাগবে। খারাপ লাগবে।

রেণু জবাব দিলেন না। হেমাই বলল, এই যে আমি এতদিনের দীর্ঘ ট্যুরে যাব, তোমার কি একা একা লাগবে না বাসায়? তারপর ধরো আমি এসে যদি বাবার বাসায় উঠে যাই?

রেণু এবারও কোনো জবাব দিলো না। হেমা বলল, মা, তুমি যে আমায় এত এত কেয়ার করছ, এই যে ধরো, আমার ট্যুরে যাওয়া নিয়েও। এটা নিয়ে আমার মধ্যে আলাদা কোনো অনুভূতি হচ্ছে না জানো? আমার কেবল মনে হচ্ছে, আমার মা তো কখনো এমন ছিল না। সে তো আগে কখনো কোনোদিনও এমন কিছু করেনি। খেয়ালও রাখেনি কখনো। সে সব সময় তার নিজের পৃথিবী নিয়ে ব্যস্ত ছিল। নিজের কষ্ট নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু সে কখনোই তার চারপাশের আর কারো কষ্টটা দেখার চেষ্টা করেনি। একটা মানুষের কাছে যখন তার নিজের কষ্টটাই সবচেয়ে বেশি বড় হয়ে ওঠে, তখন বুঝতে হবে তার মধ্যে স্বার্থপরতা প্রবল মা। এইজন্য তোমার হঠাৎ আমাকে এমন যত্ন করা, ভালোবাসা, এটা আমার কাছে এক ধরনের স্বার্থপর আচরণ মনে হয়েছে। কথাটা তোমাকে না বললেও পারতাম। কিন্তু আমার মনে হলো, তোমার জানা। দরকার আমি কি ভাবছি। ধরো এই যে এতটা বছর কেবল নিজের কষ্টটা নিয়েই ভাবলে, একবার বাবার কথাও তো ভাবতে পারতে, একবার আমার কথাও তো ভাবতে পারতে? আমাদের সবার কথা?

হেমা সামান্য থামল। তারপর বলল, আমি খুব একা মা। আমার কোনো বন্ধু নেই। নিজের একজন মানুষ ছিল, সেও নেই। বাবা-মা নেই। আমি ভেবেছিলাম, একা একা দিব্যি একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। আমি খুব শক্ত হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার এখনই খুব ভয় লাগছে মা। আমি একা, নিঃসঙ্গ, আমার মন খারাপ হলে শক্ত করে আমার ধরবার জন্য কেউ নেই। আমার আহ্লাদ করতে ইচ্ছে করলে, সেই আহ্লাদ দেখে কেউ বলবে না, কি ন্যাকামিই না পারে মেয়েটা! বরং সে সেটা দেখে মুগ্ধ হবে। আমার কাঁদতে ইচ্ছে করলে কেউ কাঁধ পেতে দিবে। কেউ নেই, অসহায় লাগলে জড়িয়ে ধরে বলবে, আমি আছি, আমরা আছি। অভিমান করলে নানান কিছু সেই অভিমান ভাঙাবে। আমার এমন কেউ নেই মা। এটা ভেবে আমার কেন যেন খুব ভয় হচ্ছে, অসহায় লাগছে।

রেণু হাত বাড়িয়ে হেমাকে কাছে টানলেন। কিন্তু হেমা এলো না। সে যেমন শুয়ে ছিল, তেমনই শুয়ে রইল। তারপর হঠাৎ বলল, একটা বাচ্চাদের মতো আবদার করি মা? রেণু বললেন, কি?

হেমা বলল, আমার মন কেমন করছে। কেমন অস্থির লাগছে। আমি শক্ত হতে গিয়ে বোধহয় আরো দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। রোজ রাতে অনেক আজেবাজে স্বপ্ন দেখি। আমি দুর্বল হতে চাই না মা। এই ট্যুরটা নিয়েও যে কি বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি সব স্বপ্ন দেখছি, চিন্তাও করতে পারবে না। মনে হচ্ছে, ট্যুরটাতে না যাই। কিন্তু আমি যাব মা। দুর্বল মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখে বেশি। আমি দুঃস্বপ্নও দেখতে চাই না। আমি এই ভয়টা জয় করতে চাই।

রেণু বললেন, আমারও মন কেমন করছে, তুই যাস না।

হেমা হাসল। বলল, তোমার মন কেমন করছে অন্য কারণে মা। তোমার সাবকনশাস মাইন্ড বলছে, আমি চলে গেলে এই বাসায় তোমার খুব একা লাগবে। তার চেয়ে আমাকে কোনোভাবে রেখে দিতে পারলে ভালো।

রেণু কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। হেমা চুপ করে রইল। তারপর বলল, মা, আমি যদি তোমাদের দুজনের সাথে একদিন বাইরে কোথাও রাতের খাবার খেতে চাই, তোমরা কি যাবে?

হেমা প্রশ্নটা শেষ করে রেণুর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল। কিন্তু রেণু কোনো কথা বললেন না। সেই সারা রাতেও না। পরদিনও না। হেমাও আর। মাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। বাবা-মাকে সে কখনোই তার ইচ্ছেয় বা তার জন্য জোর করে এক করতে চায়নি। এখনো চায় না। বরং মনটা হঠাৎ ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ায়ই এই পাগলামিটা সে করল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সে খুবই বাচ্চাদের মতো অপরিপক্ক একটা কাজ করেছে। কাজটা করা তার ঠিক হয়নি। সে আসলাম সাহেবকেও জানিয়েছিল। তিনি বলেছেন, তার কী কী সব কাজ পড়ে গেছে এই পুরো মাসটা। শেষ অবধি অবশ্য রেণু আর আসলাম সাহেব দুজনই রাজি হলেন। হেমা যাবে শনিবার। তারা সময় দিলেন শুক্রবার সন্ধ্যা ছটায়। সেদিন মহিলা পরিষদে পরপর দুটো প্রোগ্রাম আছে রেণুর। আসলাম সাহেবেরও অফিসের ইমার্জেন্সি কিছু মিটিং আছে। কিন্তু তারপরও তারা হেমাকে সময় দিলেন।

এই প্রথম বাবা-মায়ের কাছে নিজেকে আলাদা করে গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো হেমার। সে পাঁচটা থেকে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে রইল। হেমার মধ্যে কেমন যেন একটা ছেলেমানুষি ব্যাপার চলে এসেছে। সে রেস্টুরেন্ট থেকে উঠে গিয়ে কিছু রঙিন কাগজ কিনে নিয়ে আসলো। তারপর সেগুলো ছোট ছোট টুকরোয় ভাগ করে তাতে রেণু আর আসলাম সাহেবের নানান বৈশিষ্ট্য লিখল। দোষ-গুন, ভালো-মন্দ সবই। আজ বাবা-মা এলে, একজনের সম্পর্কে লেখা কাগজ আরেকজনকে পড়তে দিবে সে। ভাবতেই কেমন ছটফট লাগছিল হেমার। এমন ছেলেমানুষি টাইপের বিষয়গুলো তার সাথে যায় না। কিন্তু আজ যেন খুব বাচ্চা হয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে হেমার। আদুরে আহ্লাদি বাচ্চা। হয়তো বাবা-মাকে একসাথে এই তার শেষ পাওয়া। কে জানে, হতে পারে এ কারণেই তার। অবচেতন মন তাকে এই সময়টুকু শিশুর মতো করে কাটাতেই প্রলুব্ধ করছে! ঘড়ির কাঁটা যেন আর নড়ছে না। হেমার অস্থির লাগতে লাগল। কিন্তু ছটা পেরিয়ে সাড়ে ছ’টা হলো, কেউই এলেন না। সাড়ে ছটা থেকে সাতটা। কেউ নেই।

হেমা মাকে ফোন দিলো। রেণু ধরলেন না। বাবাকে ফোন দিতেই ফোন। কেটে দিলেন আসলাম সাহেব। সাড়ে সাতটায় রেণু মেসেজ পাঠালেন, আমার একটু দেরি হবে। মন্ত্রী এসেছেন বলে প্রোগ্রামটায় আটকে গেছি। তবে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যাব।

হেমা বসে রইল রাত দশটা অবধি। একা একা। একা একাই তো? নাকি তার সঙ্গে কেউ ছিল? হয়তো ঘড়ির কাঁটা, সময় আর রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। হয়তো তার সঙ্গে ছিল অভিমান আর চাপা কান্নাও। কিন্তু সে তো অভিমানী হতে চায় না। বরং সব সময় সদা সতর্কতায় সকল অভিমান আলগোছে সরিয়ে রেখেছে দূরে। কিন্তু আজ যেন পারল না সে।

আসলাম সাহেবের ফোন বন্ধই ছিল বাকিটা সময়। হেমা বাসায় ফিরল রাত সাড়ে দশটা। রেণু ফিরলেন বারোটায়। রেণু নানানভাবে দুঃখ প্রকাশ করলেন। হেমা অবশ্য কিছুই হয়নি, এমনভাবেই হাসি হাসিমুখেই কথা বলল রেণুর সাথে। তবে রাতে তার ঘুম হলো না। সারারাত বুকের ভেতর কেমন একটা চিনচিনে ব্যথা! শেষ রাতের দিকে গিয়ে হেমার বাঁধ ভাঙল। নয়নের সাথে এত কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল হেমার! এত ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু সে তো নয়নকে ডাকবে না। সে চুপি চুপি অপেক্ষায় থেকে যাবে। প্রয়োজনে অনন্ত অপেক্ষায়। কিন্তু সে নিজ থেকে কখনোই তাকে ডাকবে না। হেমা সারাটা রাত অন্ধকারে মাথা ডুবিয়ে বসে রইল। তার শেষরাতের দিকে কি যে হলো হেমার! সে যেন নিজের অজান্তেই নয়নকে ফোন দিয়ে ফেলল। কিন্তু স্ক্রিনে ফোন ডায়াল হতে দেখেই হেমার আবার মনে হলো, না, সে তো নয়নকে আর কখনোই ফোন দিবে না, তাহলে? সে যত শক্ত হতে চাচ্ছিল, তার চেয়ে তো আরো বেশি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে! হেমা তড়িঘড়ি করে ফোন কাটতে গিয়ে দেখল নয়নের নাম্বার বন্ধ। ঠিক সেই মুহূর্তে হেমার মনে হলো, জগতের কোনো। ভালোবাসাময় অনুভূতিই তার জন্য নয়। সে তারপরও জোর করে সেগুলোকে কেবল তাড়া করতে চেয়েছে। এই চেষ্টাটা সে আর করবে না। কখনো না।

পরদিন বারোটায় ফ্লাইট হেমাদের। ঢাকা থেকে প্রথমে দিল্লি। সেখানে সপ্তাখানেক থেকে তারপর নেপাল। কিন্তু হেমা বাসা থেকে বের হয়ে গেল খুব ভোরেই। রেণু তার সাথে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হেমা কী সব কারণ দেখিয়ে একাই বের হয়ে গেল। প্রচণ্ড গরম পড়া শুরু হয়েছিল। আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে। বৃষ্টি নামবে কিনা, কে জানে! হেমার হঠাৎ খুব বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে হেমার মনে পড়ল কাঠমান্ডু থেকে ফেরার সময় তাদের দু’দিনের জন্য চেরাপুঞ্জি যাবার কথা। পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ শহরের একটা চেরাপুঞ্জি। হেমা যেন চোখ বন্ধ করেই দেখতে পেল গভীর সবুজ এক সুউচ্চ পাহাড়ের কাঠের তৈরি কোনো বাংলোর খোলা বারান্দায় বসে আছে সে। তার সামনের দিগন্ত মিশে গেছে প্রবল বৃষ্টিতে। সে একা, একাকী এক মানুষ, প্রবল নিঃসঙ্গতা বুকে চেপে বৃষ্টি দেখছে। তার মনে হচ্ছে, এই বৃষ্টি এমন করেই ঝরে যাচ্ছে তার নিঃসঙ্গ বুকের ভেতরও। এই বৃষ্টি যেন আর কখনো থামবে না।

এই বৃষ্টি যেন এক অন্তহীন কান্নার গল্প।

*

আমোদি বেগম মারা গেলেন ভোর রাতে।

তার মৃত্যু নিয়ে খাঁ-বাড়ির কারোই যে আলাদা কোনো বিশেষ অনুভূতি রয়েছে, তা নয়। তারপরও সকলেই যেন চমকে গেল। এই চমকে যাওয়ার অবশ্য কারণও রয়েছে। সকলেই মনে মনে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিল। দিন পনেরো ধরে তার অবস্থা শোচনীয়। তিনি বিছানায় পায়খানা-প্রসাব করেন। প্রথম প্রথম একজন কাজের লোক এসে বারকয়েক তা পরিষ্কারও করেছিল। কিন্তু দিন দুই চার যেতেই সেই আসা কমতে লাগল। তারপর বন্ধই হয়ে গেল। তার ঘরে কেউই ঢুকতে পারছে না। ভয়াবহ দুর্গন্ধে পেট গুলিয়ে বমি আসে।

এস্কান্দারকে বেশিরভাগ সময়ই থাকতে হয় উত্তরের বিলে। সেখানে নতুন পরিকল্পনা করছে মনির। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বলশালী লোক দরকার। মাঝখানে একদিন এসে তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে দেখে গেছে সে। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছে এস্কান্দার। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নির্বিকার তাকিয়ে থেকেছেন। তিনি যেন সর্বংসহা এক মানুষ। মানুষ ইচ্ছে করে সর্বংসহা হয় না, হয় বাধ্য হয়ে। অসহায় হয়ে। এককালের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী তৈয়ব উদ্দিন খাঁর চেয়ে অসহায় আর কে আছে! তৈয়ব উদ্দিন খাঁ অবশ্য কাঁদেন না, মনে মনে হাসেন আর তাকিয়ে থাকেন। নিজেকে আজকাল গাছের মতো মনে হয় তৈয়ব উদ্দিন খাঁর। গাছ স্থির দাঁড়িয়ে নির্বিকার সকলই দেখে যায় শুধু। কেউ এসে মজার ছলে তার ডাল ভেঙে নিয়ে যায়। কেউ এসে পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যায়। ঝড় এসে শেকড়সহ উপড়ে ফেলে। হয়তো ওই উপড়ে যাওয়াতেই বৃক্ষের আনন্দ। সকল অনুভূতি বুকে পুষে জড়, অথর্ব হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে কষ্টকর আর কী হতে পারে! তিনি এখন কেবল ওই একটা ঝড়ের অপেক্ষায়ই আছেন। শেকড়সহ উপড়ে যাবার অপেক্ষায়।

আজকাল তাকে নিয়ম করে খাবারও দেয়া হয় না। মনির বলে দিয়েছে, তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে সারাদিনে খাবার দেয়া হবে একবার। যাতে তার পায়খানা প্রসাব কম হয়। বারবার এই জিনিস পরিষ্কার করবে কে! তার কারণে খাঁ বাড়িতে ঢোকা যায় না। দুর্গন্ধে সারা বাড়ি ছেয়ে আছে। কোনো দ্র মানুষ আর এই বাড়িতে ঢুকতে পারে না। তা তৈয়ব উদ্দিনও চেষ্টা করেন না খেতে। তার। নিজেরও খুব ভয়। এই বুঝি কলকল করে সকল বাধ ছুটে গেল। লুঙ্গির ভেতর ঘিনঘিনে আধা তরল চিটচিটে অনুভূতিটা শরীরের কিছু অংশে তিনি টের পান। গা গুলিয়ে আসত প্রথম প্রথম। কিন্তু ওই যে সর্বংসহা। আজকাল তিনি সর্বংসহা হয়ে গেছেন। এই কদিনে একবারও তাকে আমোদি বেগম দেখতে আসেননি ভেবে ভেতরে ভেতরে ভারি অবাক হয়েছিলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। তবে কষ্ট পাননি। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আর কোনো কিছুতেই কষ্ট পাবেন না তিনি। কষ্টের, লজ্জার, অপমানের কিছু ঘটলেই তিনি মৃত্যুর কথা চিন্তা করবেন। আহা, মৃত্যু, আরাধ্যতম মুক্তির মৃত্যু। এই তো এলো বলে! হয়তো আজ সন্ধ্যায়, না হয় রাতে, না হয় মাঝরাতে বা শেষ রাতে। ভোরে বা দুপুরে। এই তো মৃত্যু এলো বলে। মৃত্যুর কথা ভাবলেই তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মন ভালো হয়ে যায়। আনন্দে ঝলমল করে ওঠে চোখের দৃষ্টি। আহা, মৃত্যু, আহা!

কিন্তু আমোদি বেগমের মৃত্যুর কথা শুনে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। আমোদি বেগমকে তার খুব ঈর্ষা হয়ে গেল। সারাটা জীবন তিনি ভেবেছেন, তিনি আমোদি বেগমকে ঠকিয়েছেন, তাকে বঞ্চিত করেছেন। আর নিজে জিতেছেন। কিন্তু এই শেষ জীবনে এসে তিনি দেখলেন, আসলে প্রতিটি জায়গায় হেরেছেন তিনি নিজে। জিতেছেন আমোদি বেগম। এই মৃত্যুর ক্ষেত্রেও! কী অদ্ভুত। মৃত্যুর মতো এমন পরম প্রার্থিত বিষয়টাও আমোদি বেগম তার আগেই নিজের করে নিলেন। এই জীবনে নিজেকে এত দুর্ভাগা আর কখনোই লাগেনি তৈয়ব উদ্দিন খাঁর। মৃত্যুর মতো এমন পরম প্রার্থিত আর কিছুই যেন নেই এই মানবজন্মে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মনে হতে থাকে, মৃত্যুবিহীন এই মানবজনম কী ভয়ঙ্কর রকমেরই না বীভৎস!

আমোদি বেগমের মৃত্যুর খবর কোহিনূরকে জানানো নিয়েও কারো কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। দিনেদিনেই তার দাফন হয়ে গেল। মনিরের বিয়ের তোড়জোড় চলছে। কন্যার বাড়ি মাদারীপুর শহরে। তার বাবার টিন, রড, লোহা, সিমেন্টের বিশাল ব্যবসা রয়েছে। তারা পাত্র, পাত্রের বাড়ি ঘর দেখতে আসবে। বিয়ের ঘটকালি করছেন আব্দুল ফকির। এই নিয়ে বাড়িতে একটা সাজ সাজ রব। খাঁ-বাড়ি যেন ওলটপালট করে সাজানো হচ্ছে। আগের দিন সকাল বেলা হঠাৎ মনির এসে তার ছোটচাচা দবির খাঁকে ডেকে বলল, কাকা, একখান কথা।

দবির খাঁ বললেন, কি কথা?

মনির বলল, কত বড় বিরাট বংশের লোক তারা জানেন? আমাগো আছে জমিজমা। তাগো আছে নগদ পয়সা। আইজকাইল জমিজমা কিচ্ছু না। আসল হইলো ব্যবসা-বাণিজ্য। নগদ টাকা-পয়সা। এহন সেই বংশের মানুষ আইব বাড়ি ঘর দেখতে। এই সময় যদি দাদাজান এই অবস্থায় এইহানে থাহে, তাইলে একটা বেইজ্জতি না? তার উপর কি গন্ধটাই না ছোটে কাকা। আপনেই কন?

দবির খ কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন। মনির বলল, এক কাম করেন কাকা। দাদাজানরে আপনের ওই নতুন বাড়িতে লইয়া যান। দাদাজান তো হুকুম দিছিল, আপনে ওই বাড়িতে যাইতে পারবেন না। আমি বলতেছি, আপনে ওই বাড়িতে যান। বিয়া করছেন আপনে, তাতে কার কি! আপনে যান কাকা। আর দাদাজানরে একটু নিয়া যাওনের ব্যবস্থা করেন। এই দুইটামাত্র দিন। তারপর আবার লইয়া আসব।

দবির খা কোনো কথা বললেন না। যে কারণেই হোক, তিনি বরং তার স্ত্রী পুত্রের কাছে যেতে পেরে খুশি। তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে সেই রাতেই রাতের অন্ধকারে নিয়ে যাওয়া হলো দবির খাঁর স্ত্রী আর পুত্রকে রাখা ছোট্ট ছনের ঘরখানাতে। মনির বলেছিল দিন দুই বাদে সে তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে নিয়ে আসবে। কিন্তু তিনদিন পেরুলেও সেই নিয়ে আসা আর হলো না। দবির খার বউ ভয়েও কখনো সামনে আসে না তৈয়ব উদ্দিন খাঁর। যা করার করেন দবির খাঁ নিজেই।

সেদিন রাতে হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। সেই বৃষ্টি আর থামল না। ছনের ঘরের চালা ছুটে প্রথমে টুপটুপ করে, তারপর ছলছল করে বৃষ্টি ঝরতে লাগল। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা টের পাচ্ছিলেন তার বুকের উপর। খুব সরে যেতে চাইছিলেন। কিন্তু পারছিলেন না। কাউকে যে ডাকবেন, সে উপায়ও নেই। অন্ধকারেই অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। বৃষ্টির ফোঁটা ক্রমশই অনাবিল ধারার মতো ঝরে যেত থাকল তৈয়ব উদ্দিন খাঁর বুকে। তার শক্ত বিছানায়। পিঠের তলায়। প্রচণ্ড ঠান্ডায় যেন জমে যেতে থাকল তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কোঁচকানো চামড়ার ভাঁজ পড়া জীর্ণ শরীর। তিনি অসহায় শূন্য চোখে নির্বিকার তাকিয়ে রইলেন নিকষ অন্ধকারে। আহারে, জীবন! আহারে!

সেই অন্ধকারের মধ্যে একটা ছায়ার মতো এগিয়ে এলো কে যেন! তারপর চুপি চুপি ফিস ফিস করে বার কয় তাকে শব্দ করে ডাকল। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ স্পষ্ট শুনতে পেলেন, দবিরের স্ত্রী। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ দেখলেন, আবছা অন্ধকারে সে এগিয়ে আসছে তার দিকে। তারপর তার পাশে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল সে। বারকয়েক চোখের কাছে, নাকের কাছে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল তিনি জেগে আছেন কিনা! নাকি বেঁচে আছেন কিনা? তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নিশ্চিত না। তবে তিনি এটি নিশ্চিত, কোনো উদ্দেশ্য আছে মেয়েটার। তাকে অপমানের শোধ নিতে এসেছে সে? জগতে অপমানের কথা কেউ ভোলে না। সে ছোট হোক আর বড়! সুযোগ পেলে তার শোধ নিতেও ছাড়ে না মানুষ। কী অনাচারই মেয়েটার প্রতি করেছিলেন তিনি! কি ভয়াবহ অপমান, শাস্তি। তার ছেলেটা চোখের সামনে দুটো ভাতের জন্য কেঁদেছিল অবধি। অথচ তিনি…।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আর এসব ভাবতে চান না। কিছুই না। তিনি জীবন জুড়ে যা কিছু করেছেন, এ সকল যদি তার প্রায়শ্চিত্ত হয়ে থাকে, তবে তিনি তা মেনে নিচ্ছেন। অবশ্য মেনে না নিয়েই বা তার উপায় কি! হয়তো এইজন্য অন্তত মানসিকভাবে হলেও তিনি প্রস্তুত। যে কোনোকিছুর জন্যই প্রস্তুত।

এই এতরাতে দবির খার বউ কি করবে? এই সুযোগে আব্দুল ফকিরের মতো সেও কি তাকে চড় থাপ্পড় মারবে? কিন্তু দবির খাঁর স্ত্রীর হাত দু’খানা নিজের গলার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। মেয়েটা কি তাহলে তাকে গলা টিপে মারবে? তৈয়ব উদ্দিন খাঁ খানিক অবাক হলেও মনে মনে খুশিই হলেন। এই মৃত্যুটাই তো তার কাছে প্রার্থিত ছিল। তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন। দবির খাঁর স্ত্রীর হাত এসে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর বুকের উপরের দিকটায় ঠেকল। তারপর হাত দুখানা চলে গেল তার গলার কাছে। দু’হাতে গলার দু’পাশে ধরে খানিক চাপ বাড়াল হাতখানা। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুত করে ফেললেন। আহা, মৃত্যু! অবশেষে সেই প্রার্থিত মৃত্যু। তিনি চোখ বন্ধ করে অপেক্ষায় রইলেন সেই ভয়ঙ্করতম কিন্তু একইসাথে প্রার্থিততম মৃত্যু যন্ত্রণারও। কিন্তু মেয়েটা তার গলা চেপে ধরল না। তার হাত সরে গেল তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মাথার কাছে। সে তার দু’হাতে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মাথা ছুঁয়ে দেখল। তারপর হঠাৎ ফ্যাসফ্যাসে গলায় ডাকল, ও শিমুলের বাপ। শিমুলের বাপ। পইড়্যা পইড়া ঘুমাইতে আছেন। আর এইদিকে দেইখ্যা যান, মানুষটা বিষ্টিতে ভিজ্যা জবজইব্যা হইয়া গেছে। ও শিমুলের বাপ।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার নাতির নামটাও জানতেন না। নাতির নাম তাহলে শিমুল! কিন্তু মেয়েটা এ কী করছে! খানিক বাদে দবির খা উঠে আসলেন। তারপর রাতের বাকি সময়টুকুতে তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে সরিয়ে তাদের বিছানায় নিয়ে যাওয়া হলো। তার গা মুছে দিয়ে তাকে শুকনো কাপড় পরানো হলো। হারিকেনের আলোয় ভাপ দেয়া কাপড়ে তার বুকে উত্তাপ দেয়া হলো। তিনি মরার মতো চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন। তার ভয় হতে লাগল, পাছে তিনি চোখ মেলে চাইলে ভয়ে মেয়েটা উঠে চলে যায়! এই হাতের স্পর্শ, এই মমতার স্পর্শ দূরে চলে যায়। তৈয়ব উদ্দিন মৃত মানুষের মতো পড়ে রইলেন। দবির খাঁ স্ত্রী হঠাৎ বললেন, বাজানরে একটু গরম সাগু খাওয়াইতে পারলে ভালো হইতো! দেহেন না একটু সাগুর ব্যবস্থা করতে পারেন কিনা!

দবির খাঁ বললেন, এই রাইতে এহন সাগু পাব কই?

দবির খাঁর স্ত্রী বললেন, বেয়ান হইলে একটু দেইখেন।

দবির খাঁ বলল, দেখব নে। আর একখান কথা, তুমি কিন্তু যহন-তহন তারে বাজান বইল না।

দবির খাঁর স্ত্রী বলল, যহন-তহন তো ডাকি না। এহন তার চেতন নাই দেইখ্যা ডাকছি!

দবির খাঁ বললেন, মনে থাহে জানি। সে জানি না শোনে।

দবির খাঁর স্ত্রী বলল, না, তারে শোনাইয়া বলব না। আমি তো তার ধারেই আহি না।

দবির খ বললেন, আবার যে এইসব খাওয়াইবা, যদি প্যাট ছাইড়া আবার বিছনা নষ্ট করে।

দবির খার স্ত্রী বলল, মাখলে মাখবো। বুড়া মানুষ। সে তো এহন এইরমই করব। এইটা নিয়া এত চিন্তার কি আছে! আল্লায় এহন পর্যন্ত আমার হাত তো রাখছে। যতবার মাখব, ততবার পরিষ্কার করব।

দবির খাঁ বললেন, হ। মেথরের মাইয়া তো। এইগুলানে ঘিন কিয়ের?

দবির খার স্ত্রী বললেন, মেথরের মাইয়া হইছি বইলা এইগুলান কোনো দিন হাত দিয়া ধরি নাই। আমার বাজান কোনদিন আমাগো দিয়া এই কাম করানির কথা ভাবেও নাই। জীবনে প্রথম কোনদিন এই প্রসাব-পায়খানা ছানছি, হাত দিয়া ধরছি জানেন? যেইদিন মা হইছি, সেইদিন। আমার শিমুলের হাগা মুতা। তা দুইন্যার কোন মানুষটা এইগুলান করে নাই? এমন কেউ আছে? নাই। এমন কেউ নাই। তায় এত ঘিন কিয়ের। এই বুড়া মানুষটা আর আমার সেই দুইদিন বয়সের শিমুল, কোনো ফারাক তো আমি দেহি না শিমুলের বাপ। আপনে দেহেন?

দবির খাঁ কোনো কথা বললেন না। হারিকেনের আলো মুখে পড়ছে বলেই কিনা কে জানে, দবির খাঁর স্ত্রী তার শাড়ির আঁচলখানা দিয়ে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মুখটা ঢেকে দিলেন। সেই আঁচলখানা বিছিয়ে আছে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মুখে, চোখে, চিবুকে, গলায়, কপালে, নাকে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর হঠাৎ মনে হতে লাগল, এই আঁচলখানা তিনি চেনেন। এই আঁচলখানা তিনি বছরের পর বছর ধরে চেনেন। কিন্তু বহুবছর এই আঁচলখানা যেন হারিয়েছিল তার স্মৃতি থেকে, তার অনুভূতি থেকে। তিনি এই আঁচলের কথা ভুলে ডুবে ছিলেন জগতের আর সকল কথায়, আর সকল চিন্তায়, অনুভূতিতে। তিনি হঠাৎ ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন। তার সেই নিঃশ্বাসের সাথে টেনে নিতে লাগলেন সুবাস। সেই শ্বাসের সাথে টেনে নিতে লাগলেন ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ এই জগতের না। এই ঘ্রাণ অন্য কোনো জগতের। এই সুবাস জুড়ে মায়া। সেই মায়া জুড়ে মা। মা, মাগো, ও মা। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কথা বলতে পারলেন না। কিন্তু তার বুকের ভেতর তড়পাতে লাগল কত কত বছর আগে মরে যাওয়া তার মা। মায়ের আঁচল। আঁচলের ঘ্রাণ। ঘ্রাণভর্তি মমতা। সেই মমতা জুড়ে মা। ও মা। মা। মাগো। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কাঁদতে লাগলেন। তার গাল ভেসে যাচ্ছে জলে। সেই জলের ভেতর জীবন।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কাঁদছেন। সেই সাথে কিছুটা বিরক্তও হচ্ছেন। মেয়েটা তাকে আর বাজান বলে ডাকছে না কেন? কেন ডাকছে না? কেন?

*

কোহিনূর যেদিন তার মায়ের মৃত্যুর পুরনো সংবাদটি পেল, সেইদিন সারা বাংলাদেশের মানুষ পেল একটি তরতাজা সংবাদ। মাদারীপুরের হোসনাবাদ গ্রামের আব্দুল ফকির নামের প্রখ্যাত এক সাপুড়ে খুন হয়েছেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো তিনি খুন হয়েছেন নিজের মেয়ের হাতে। তার মেয়ে তাকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। হত্যার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, মেয়ের বান্ধবীকে সাপের বিষ নামানোর কথা বলে ধর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন আব্দুল ফকির।

সংবাদটি মোটামুটি আলোচনা তুলে ফেলল দেশব্যাপী। কিছু কিছু সংবাদপত্রে লিড নিউজ হয়েছে সংবাদটি। তবে বেশিরভাগ সংবাদপত্রেই বক্স আকারে সেকেন্ড লিড নিউজ করেছে এটি। সাথে আব্দুল ফকিরের নানান কুকীর্তির খবরও ছাপা হয়েছে। মেয়ের ছবিও ছাপা হয়েছে। ছবি ছাপা হয়েছে আব্দুল ফকিরের লাশেরও। তবে তার লাশের ছবি এতটাই বীভৎস যে সেটিকে পুরোপুরি ছাপা সম্ভব হয়নি। বাবার লাশ কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে তার মেয়ে।

আমোদি বেগমের মৃত্যুর খবর শুনে নয়ন আর কোহিনূর ফতেহপুর ফিরছিল। তারা ফিরছিল বাসে। প্রথমে ফরিদপুর হয়ে মাদারীপুরের মোস্তফাপুর এসে নামবে তারা। সেখান থেকে নানান ঝামেলা করে পৌঁছাতে হবে ফতেহপুর। কোহিনূর কত কত বছর পর ফতেহপুর ফিরছেন। কিন্তু সেটি নিয়ে তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বাসযাত্রার পুরোটা সময় তিনি বসে রইলেন নির্বিকার, নিশ্ৰুপ। আরিচা ফেরি ঘাটে এসে সেদিনের সংবাদপত্রটা কিনল নয়ন। পত্রিকার ভাজ খুলে প্রথম পাতায় চোখ রাখতেই পুরো পাথরের মতো জমে গেল সে। পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় করে পারুলের ছবি, তার পাশে আব্দুল ফকিরের লাশের ঝাপসা ছবি। নয়ন এক নিঃশ্বাসে সংবাদটা পড়ল। তারপর ছুটে এলো বাসে। কিছুক্ষণ মায়ের পাশে বসে রইল সে। তারপর আস্তে করে মায়ের হাতে পত্রিকাটা দিলো। কোহিনূর রাজ্যের অনাগ্রহ নিয়ে পত্রিকাটা দেখলেন। সংবাদটাও পড়লেন। তারপর পত্রিকাটা ফেরত দিয়ে দিলেন নয়নকে। কোনো কথা বললেন না। কোনো কৌতূহল দেখালেন না।

নয়ন ভারি অবাক হলো কোহিনূরের আচরণে। তারা মোস্তফাপুর এসে নামল দুপুরবেলা। এখান থেকেই ফতেহপুরের কষ্টকর যাত্রা। কিন্তু নয়নকে চমকে দিয়ে কোহিনূর বললেন, তিনি যাবেন মাদারীপুর শহরে। নয়ন কারণ জিজ্ঞেস করলেও তিনি কোনো জবাব দিলো না। তারা মাদারীপুর শহরে পৌঁছালো তারও ঘণ্টাখানেক পর। কোহিনূর মাদারীপুর কোর্টে গিয়ে তার অমল স্যারের বন্ধু সুবিমল উকিলকে খুঁজলেন। কোহিনূর জানেন এই এতবছর পরেও সুবিমল উকিলকে খুঁজে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে মাদারীপুর শহরে তার পরিচিত আর কেউ নেই। সুবিমল উকিলের সূত্রে যদি পরিচিত কাউকে পেয়ে যান তিনি! কোহিনূরের ভাগ্য ভালো, সুবিমল উকিলের ছেলে অঘোর এখন মাদারীপুর কোর্টের নামকরা উকিল। তিনি কোহিনূরকে চিনলেন। অপ্রত্যাশিত রকমের আদর-আপ্যায়নও করলেন।

সেই রাতে কোহিনূর থেকে গেলেন তার বাসাতেই। সেখানে তারা থাকলেন আরো দু’দিন। যে করেই হোক পারুলের সাথে একবার দেখা করতে চান কোহিনূর। পারুল এখন আছে মাদারীপুর জেল হাজতে। তার সাথে। কোহিনুর দেখা করতে চানই চান। সুবিমল উকিলের ছেলে শেষ অবধি পারুলের সাথে কোহিনুরের দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে পারলেন। পারুল জেলখানার গরাদের ভেতর দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কোহিনূরের দিকে। দেখা করার সময় অতি সামান্য। এর মধ্যেই কথাবার্তা যা বলার বলে ফেলতে হবে। কোহিনূর বললেন, আমারে তুমি চেনো? আমার নাম কোহিনূর।

পারুল বলল, আপনেরে কহনো দেহি নাই। তয় আপনের নাম শুনছি।

কোহিনূর বললেন, আর কিছু শোনন নাই?

পারুল সাথে সাথে কথার জবাব দিলো না। মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। কোহিনূর এক হাতে নয়নকে টেনে কাছে নিয়ে এলো। তারপর বলল, এরে চেনো নাই?

পারুল এবার ধীরে মাথা তুলল। তার দৃষ্টি অভিব্যক্তিহীন। সে বলল, আমি জানি।

কোহিনূর বললেন, সারাজীবন এই একটা ইচ্ছা আমি নিজের মধ্যে চাপা দিয়ে রাখছিলাম পারুল। আমি পারি নাই। আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি যদি তারে তোমার মতো ওই দাওখান দিয়া কোপাইতে পারতাম পারুল!

কোহিনূরের হাত, মুখ, মুখের প্রতিটি শিরা-উপশিরা অবধি টানটান হয়ে আছে। কোহিনূর বললেন, আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে, নিজের মেয়ে যখন তার প্রথম কোপটা দিলো, তখন তার কেমন লাগছে? নিজের সন্তান। তখন সে কি বলছে? সে কেমনে তাকাইছে? সে কি করছে? আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে পারুল। খুব।

পারুল কোনো কথা বলল না। সে চুপচাপ তাকিয়ে আছে কোহিনূরের মুখের দিকে। কোহিনূর বললেন, আল্লাহ তারে সবচেয়ে বড় শাস্তিটাই দিছে। এর চেয়ে বড় আর কি শাস্তি সে পেত? এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কিছু তার জন্য ছিল না। আমি একটু তোমার পায় হাত দিয়া সালাম করতে চাই পারুল।

পারুল যেমন ছিল, তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। জেলখানার গরাদের এপার থেকে পারুলকে ছুঁয়ে দেয়া সম্ভব না। কিন্তু কোহিনূর তারপরও হাঁটু গেড়ে বসলেন। তারপর নিচে পায়ের দিকের লোহার গরাদ হাতে ছুঁয়ে বসে রইলেন। তারপর বললেন, আমি জানি না, তোমার সাজা কি হবে। কিন্তু আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব তোমার মামলা চালাতে।

পারুল কোনো কথা বলল না। কোহিনূরদের দেখা করার সময় শেষ হয়ে এসেছে। বার দুয়েক তাদের এসে তাড়া দিয়ে গেছে কারা পুলিশ। কোহিনূর বললেন, তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?

পারুল খানিক সময় নিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, না।

কোহিনূর আর কিছু বললেন না। তিনি নয়নকে নিয়ে ঘুরে বের হয়ে যাবেন, এই মুহূর্তে পারুল ডাকল, ভাইজান।

প্রথমে কোহিনূর আর নয়ন কেউই যেন ঠিকভাবে বুঝতে পারল না, পারুল কাকে ডাকল। কিছুটা সময় লাগলেও নয়ন পেছন ফিরে পারুলের দিকে তাকাল। পারুল বলল, ভাইজান, আমারে আপনে মাফ কইরা দিছেন তো?

নয়ন কি বলবে? পারুল হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তারপর বলল, ভাইজান, এই দুনিয়ায় আপনে ছাড়া আমার আর কেউ নাই। আপনের হাতে আমি একটা জিনিস দিয়া যাব ভাইজান। আমার ফাঁসি হইলেও এই জিনিসটারে আপনে দেইখ্যা রাখবেন।

নয়ন অবাক চোখে পারুলের দিকে তাকিয়ে রইল। পারুল বলল, আইজ। আপনে আরেকদিন আমারে দেখতে আইবেন। সেইদিন আমি আপনারে বলব ভাইজান।

পারুল কাঁদছে। নয়নের খুব ইচ্ছে হচ্ছে পারুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সেটা সম্ভব না। কে জানে, সেই কারণেই কিনা, নয়ন লোহার শিকগুলো দুহাতে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে রইল।

.

এক ভয়াবহ শূন্যতা বুকে চেপে ফতেহপুরে পৌঁছাল নয়ন আর কোহিনূর। মাঝখানে বার দুই বৃষ্টিতেও ভিজল তারা। ফতেহপুর নদীর ঘাটে যখন তারা পৌঁছাল তখনও গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতে নয়ন তার ব্যাগ থেকে দিন তিনেক আগে কেনা পত্রিকাখানা বের করে মায়ের মাথা মুড়িয়ে দিলো। বাড়ি অবধি পৌঁছাতে পৌঁছাতে পত্রিকাখানা ভিজে চুপসে গেছে। ভিজে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে কতকত অক্ষর, সংবাদ। পারুলের ছবি, আব্দুল ফকিরের ছবি। আর কত কি!

সেই সাথে মুছে গেছে আরো একটি সংবাদ। যেই সংবাদটি এই কদিনে কারোই চোখে পড়েনি। নয়নেরও না। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীবাহী একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছে। তাতে মারা গেছেন এক ছাত্রীসহ তিনজন। আহত হয়েছেন প্রায় সকলেই। নয়ন যদি জানত যে হেমাও তখন চেরাপুঞ্জি এবং সংবাদটা যদি সে দেখতে পেত, তাহলে হয়তো পারুলের খবরটার মতোই প্রবল আগ্রহ নিয়েই সংবাদটা পড়ত সে। হয়তো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখত সেখানে লেখা আছে হেমার নামও। দেখে কি করত নয়ন? হেমাকে কি তার এই কয়েকদিনে মুহূর্তের জন্যও মনে পড়েছে? বা ওই ছোট্ট খবরের শিরোনাম দেখলে কি হেমার কথা তার মনে পড়ত? তারপর যদি সে সংবাদটা পড়ত, তাহলে কি করত?

কি করত সেটা জানা গেল না। কারণ অক্ষর মিশে গেছে জলে। কে জানে সেই জল কেবলই বৃষ্টির কিনা! নাকি সেখানে রয়ে গেছে ফোঁটা ফোঁটা কান্নার জলও। সেই কান্নার জল হয়তো অভিমান। সেই অভিমান চেরাপুঞ্জির কোনো এক সুউচ্চ পাহাড়ের কোনো এক কাঠের বারান্দায় বসে থাকা কোনো এক নিঃসঙ্গ মেয়ের বুকের সকল দুঃখ বয়ে এনে ঝরে পড়ছিল বৃষ্টির জল হয়ে। সেই জল হয়তো চায়নি এই অক্ষর নয়ন পড়ক। সেই জল হয়তো চেয়েছে অক্ষরে নয়, এই ফোঁটা ফোঁটা জলের ভেতর লেখা থাকুক মানবজনম!

*

কোহিনূর খাঁ-বাড়িতে আসার দু’দিন হয়ে গেল। এই দুদিনে তার সাথে কারোই কোনো কথাবার্তা তেমন হয়নি। সে এসে উঠেছে তার আগের সেই ঘরেই। ঘরখানা সে যেমন রেখে গিয়েছিল, চেষ্টা করা হয়েছে তেমনই রাখতে। হয়তো তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ভেবেছিলেন, কোনো একদিন কোহিনূর ফতেহপুর আসবেন। আর এসে তিনি যেন তার রেখে যাওয়া ঘরখানা তেমনই পান। তা ঘরখানা তেমনই আছে, কোহিনূর ঘর দেখে চমকেও গিয়েছেন। কুড়ি-পঁচিশ বছর তো কম সময় নয়! যদিও ঘরের এখানে-সেখানে কিছু কাজও করতে হয়েছে, তারপরও ঘরখানা দেখে কোহিনূর হকচকিয়েই গেলেন। যদিও বাড়ির আর কোনো কিছুই আর আগের মতো নেই। প্রথম দুইদিন কোহিনূর বাড়ি থেকে বের হলেন না। খাঁ-বাড়িতে যে একটা বড় ধরনের ওলটপালট ঘটে গেছে, তা কোহিনূর স্পষ্টই বুঝতে পেরেছেন। সকলের মধ্যেই একটা থমথমে ভাব। দবির খার ঘটনাও কোহিনূর শুনেছেন। শুনেছেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কথাও। কিন্তু কোনোকিছু নিয়েই কোনো আগ্রহ দেখাননি তিনি। জন্মের পর মনিরকে বছর দশেক আগে একবার দেখেছিলেন কোহিনূর। কী এক কাজে তার বাসায় গিয়েছিল সে। সেই তাদের প্রথম আর শেষ দেখা। সেই মনিরকে নিয়ে যে খা বাড়িতে একটা গা ছমছমে ব্যাপার। তা কোহিনূর স্পষ্ট টের পেয়েছেন। টের পেলেন সেদিন বিকেলে গ্রাম দেখতে বের হয়েও। পুরো গ্রামটাই পাল্টে গেছে। কিন্তু কীভাবে পাল্টে গেছে তা কোহিনূর জানেন না।

তিনি হাঁটতে গিয়ে হুটহাট অনেক বাড়িতেই ঢুকে পড়লেন। কিন্তু তাকে বলতে গেলে কেউ সেভাবে চিনল না। আরো অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, যারা তাকে চিনল তাদের প্রায় কেউ তার সাথে আগ্রহ নিয়ে কথা বলল না। তবে তাতে যে কোহিনূরের মন খারাপ হয়েছে তা নয়। বরং প্রবল ভালো লাগা নিয়েই তিনি গ্রাম ঘুরে দেখলেন। এই ঘুরে দেখায় একটা অদ্ভুত আনন্দও রয়েছে। তিনি কিছু একটা দেখলেই চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে আজ থেকে বহুবছর আগের কোনো একটি দিনের কথা মনে করার চেষ্টা করছেন। যেই দিন তিনি এখান দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন এবং অবাক ব্যাপার হচ্ছে তিনি টুপ করে সেই দিনের ছবি একদম স্পষ্ট করেই মনে করতে পারছেন। তারপর আবার চোখ মেলে তিনি মিলিয়ে নিচ্ছেন এই মুহূর্তে তার সামনের ছবিটির সাথে। খেলাটি খেলে কোহিনূর আনন্দ পাচ্ছেন। প্রবল আনন্দ। বহু বহু দিন পর কোহিনূর যেন নির্জলা আনন্দময় সময় কাটালেন।

কোহিনূরের সাথে আছে এস্কান্দার আর তার বড় ভাই খবির খাঁ। হাঁটা পথে নানান কথা হলো তাদের। কিন্তু একবারও বাবার কথা কিছু জিজ্ঞেস করলেন না কোহিনূর। তিনি বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন ফজু ব্যাপারীর বাড়ি। কোহিনূর বাড়িতে ঢোকামাত্রই একটা সাজ সাজ রব পড়ে গেল সেই বাড়িতে। ফজু তাকে বসতে দিলো উঠানের মাঝখানে। তাকে ঘিরে চারপাশে বসল ব্যাপারী বাড়ির সকল গৃহস্তরা। তারা সকলেই উৎসুক হয়ে আছে কোহিনূরের কাছ থেকে কিছু শোনার জন্য। কোহিনূর জানেন তারা কি শুনতে চায়। তার এই আসার অপেক্ষায়ই হয়তো অসংখ্য দিন রাত গুনে কাটিয়েছে তারা। ফজুর ভাই নজু তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে। কোহিনূর তার সাধ্যমত চেষ্টাও করেছিলেন তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করার। কিন্তু বছরের পর বছর তার বাবা তৈয়ব উদ্দিন খাঁ যে অন্যায় তাদের উপর করেছেন, তার কতটুকুরই বা ক্ষতিপূরণ তিনি দিতে পেরেছেন? অথচ, কোহিনুরের সব সময়ই মনে হয়েছে, ব্যাপারীদের এই ভয়াবহ অবস্থার পেছনে কোনো না কোনোভাবে দায় রয়েছে তারই। তার কারণেই খুন হয়েছেন বজলু ব্যাপারী। তারপর একের পর এক তাদের জমি দখল করেছেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। অনেককে ভিটেমাটি ছাড়া করেছেন। আর আজ সেই তিনিই যেন তাদের কাছে আশার শেষ এক চিলতে আলো।

কোহিনূর চুপ করে বসে সকলের মুখের অব্যক্ত ভাষা বোঝার চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, মামলা-মোকদ্দমার কী অবস্থা?

নজরুল বলল, আপনে তো জানেনই সব। মামলা-মোকদ্দমা আর সম্ভব না। যা আছিল সব তো হারাইলাম। আপনের বুদ্ধিমতো আপনের মায়ের ধারেই রাখতে দিছিলাম। কিন্তু সেই জিনিসও গেল, আপনের মায়ও মরল। আব্দুল ফইরও নাই। আমাগো এহন তুমি ছাড়া আর কোনো আশা নাই। চাইয়া দেহো, তোমার সামনের মানুষগুলানের মুখের দিক। সবাই এই এত বছর তোমার আশায়ই অপেক্ষা করছে।

ফজু ব্যাপারী বলল, এতদিন ভাবতাম তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কবে মরব। তারপর হয়তো আমাগো একটু আছান হইব। কিন্তু সে নিজেই তো আমাগো উপর আছান হইছিল। বলছিল কিছু জমিন লেইখ্যা দিব। দেওনের ব্যবস্থাও করছিল। সেইটা দেইখ্যা মনির তো পারলে তহনই আমাগো জানে খুন কইরা ফালায়। এহন আমাগো অবস্থা হইছে বাঘের মুখেরতন দুইট্টা সিংহের মুখে পড়ছি। মনির তো আর মানুষ নাই কোহিনূর, সে তো আস্তা দজ্জাল হইয়া গেছে। সে এহন কি করছে জানো?

কোহিনূর কথা বললেন না। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন ফজুর দিকে। ফজু বলল, তোমার বাপের জবান বন্ধ হইয়া যাওনের কয়েকদিন পর এক রাইতে সে লোজন নিয়া আইছিল। আইসা বইলা গেছে কলসির খোঁজ যদি তারে আমরা না দেই, তাইলে সে ভিটা মাটি ছাড়া করব সবাইরে। এই গ্রামেই থাকতে দিব না। ঘরে ঘরে আগুন লাগাই দিব। কিন্তু সেই জিনিস এহন আমরা কই পাব? তোমার মায় নাই, সে সেই জিনিস কি করছে, তা তো আমরাও জানি না।

কোহিনুর সাথে সাথে জবাব দিলেন না। খানিক চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আপনাদের যত জমি জোর করে ভোগদখল হয়েছে, তার সব আপনারা ফেরত পাবেন। আমি চেষ্টা করব এই এতবছরের ক্ষতিপূরণ দিতেও। এই জিনিস ফিরাই না দিয়ে আমি যাব না।

কোহিনূরের এইটুক কথাই যেন শুকনো মুখগুলোতে প্রাণের সঞ্চার করল। যদিও সকলেরই ভয় মনিরকে নিয়ে। সেই শঙ্কার কথা অনেকে বললও। কিন্তু কোহিনূর সে বিষয়ে কোনো কথা বললেন না। তিনি বাড়ি ফিরে এলেন সন্ধ্যার আগে আগে। তারপর একা একা গিয়ে আমোদি বেগমের কবরের সামনে দীর্ঘ সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। কোনো কান্নাকাটি না, কোনো কথা না। একদম নিশ্ৰুপ, নিস্তব্ধ, নিথর এক মানুষ। কে জানে তার এই নিথর নীরবতা জুড়েই হয়তো অবিরাম বয়ে যাচ্ছিল গভীরতম প্রার্থনা।

.

রাতে কোহিনূরের ঘরে আসল মনির। তার চেহারায় চাপা এক বুনো হিংস্রতা। তাকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বহু চেষ্টা করেও সেই হিংস্রতা সে লুকিয়ে রাখতে পারছে না। যতটা সম্ভব নরম গলায়ই সে কোহিনূরের সাথে এটা সেটা নানান কথা বলার চেষ্টা করল। তারপর হঠাৎই বলল, ফুপু, আপনে নাকি ফজু ব্যাপারীর বাড়ি গেছিলেন?

কোহিনূর রোদে শুকাতে দেয়া কাপড় ভাঁজ করছিলেন। তিনি সেই কাপড় ভাঁজ করতে করতেই বললেন, হুম।

মনির বলল, আপনে তাগো কি বইলা আসছেন?

কোহিনূর বললেন, কত কিছুই তো বলেছি। তুই কোনটা শুনতে চাস?

মনির বলল, জমিজমা ফিরাই দেওনের বিষয়ে।

কোহিনূর বললেন, জমিজমার বিষয়ে শুনে তুই কি করবি?

মনির খানিক উত্তেজিত গলায় বলল, আমি কি করব মানে? আমি না করলে কে করব?

কোহিনূর বললেন, তোর বয়স কত?

মনির বলল, কেন? বয়স দিয়া কি করবেন আপনে?

কোহিনূর কাপড় ভাঁজ করা রেখে সোজা দৃষ্টিতে মনিরের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, তুই কি মেয়ে-ছেলে নাকি? বয়স বলতে সমস্যা কী? ছেলেরা তো বয়স লুকায় না, বয়স লুকায় মেয়েরা। তুই মেয়ে মানুষের মতো বয়স লুকাচ্ছিস কেন?

মনির এবার রীতিমতো ক্ষেপে গেল। সে উঁচু গলায় বলল, আপনে কিন্তু বেশি বেশি করতেছেন ফুপু। আমি যেইটা বলছি, আপনে সেইটার জবাব দেন।

কোহিনূর বললেন, আমি বেয়াদব ছেলে পছন্দ করি না মনির। তুই আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হ। ভদ্রভাবে কথা বলতে পারার আগে আমার চোখের সামনে আসবি না। যা।

মনির হতভম্ভ হয়ে গেল। গত কিছুদিনে সে এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল যে তার সাথে এইভাবে কেউ কথা বলতে পারে এটা তার কল্পনায়ও ছিল না। সে বলল, ফুপু, আপনে কিন্তু বেশি…

কোহিনূর হঠাৎ ধমকে উঠলেন, চুপ। থাপড়ায়ে আমি তোর দাঁত ফেলে দেব। বেয়াদব জানি কোথাকার। বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটাও তোকে তোর বাবা-মা শেখায় নাই? যা, এক্ষণ গিয়ে তোর আব্বাকে ডেকে নিয়ে আয়। খাঁ-বাড়ির ছেলেপেলেদের কি বেয়াদব বানানো হচ্ছে নাকি। যা। আমার চোখের সামনে থেকে যা।

মনির কি করবে ভেবে পেল না। সে অনেক কথাই বলার চেষ্টা করছে, ভাবছে। কিন্তু কোনো কথাই সে গুছিয়ে আনতে পারছে না। কোহিনুর গলা চড়িয়ে এস্কান্দারকে ডাকলেন। তারপর বললেন, উকিল বাবুরে যে খবর দিতে বলছিলাম, খবর দিছ এস্কান্দার?

এস্কান্দার বলল, জ্বে ফুপুজান। খবর পাঠানো হইছে। সে কাইল বেয়ান বেয়ান চইলা আসব।

মনির বলল, কিয়ের উকিল? উকিল কেন?

কোহিনূর ঠান্ডা গলায় বললেন, এস্কান্দার, এই বেয়াদবটাকে আমার চোখের সামনে থেকে সরাও। এক্ষুণি সরাও।

মনির স্তব্ধ হয়ে গেছে কোহিনূরের আচরণে। কোহিনূরের প্রখর ব্যক্তিত্বের সামনে তার নিজেকে মনে হচ্ছে একটা ভড়। তবে সে ভয়ও পেয়ে গেছে। এস্কান্দারের ভাবগতিক সুবিধার মনে হচ্ছে না। দেখে মনে হচ্ছে সে যে-কোনো সময় তার শরীরে হাতও তুলে ফেলতে পারে। ফণা তুলেও ছোবল না মারতে পারা সাপের মতো ফোঁসফোঁস করতে করতে বের হয়ে গেল মনির।

পরদিন ভোরে সুবিমল উকিলের ছেলে অঘোর উকিল আসলেন ফতেহপুর। তিনি খাঁ-বাড়ির কাছারি ঘরে কোহিনূরের সাথে বসেছেন। তার সাথে বসেছেন খবির খাঁ ও দবির খাও। খায়েদের জমিজমার সকল কাগজপত্র মনিরের কাছে। কাগজপত্রের জন্য সেই সাতসকালে মনিরের কাছে পাঠানো হয়েছে এস্কান্দারকে। কিন্তু মনির আসছে না। সে আসলো আরো খানিক পর। এসেই হম্বিতম্বি শুরু করল। তাকে ছাড়া খাঁ-বাড়ির জমিজমার হিসেব নিয়ে বসার ফল ভালো হবে না, সে এসবের শেষ দেখে ছাড়বে। রক্ত বইয়ে দেবে খাঁ-বাড়ির উঠানে। এমন নানান কথা। খবির খাঁ ছেলেকে থামাতে গেলেন। কিন্তু কোহিনূর তাকে হাত ধরে বসালেন। তারপর মনিরকে নরম গলায় বললেন তাদের সাথে বসতে।

তা মনির বসলও। তবে তখনো সে সাপের মতোই ফোঁসফোঁস করছিল। কোহিনূর শান্ত ঠান্ডা গলায় বললেন, তোকে আমি কিছু কথা বলব। মন দিয়ে শুনবি। এই মন দিয়ে শোনাটা দুইভাবে হতে পারে। এক, তুই আপোষে ইচ্ছা করে শুনবি। দুই, তোকে শুনতে বাধ্য করা হবে। এখন বল কোনটা করবি?

মনির আবারো উত্তেজিত হয়ে উঠল। তার সাথের ছেলে দুটি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তারা ছুটে এলো ঘরে। কোহিনূর এস্কান্দারকে ডেকে বললেন, এদের বাইরে নিয়ে যাও এস্কান্দার। প্রথমে বল এক ঘণ্টার মধ্যে এরা যেন ফতেহপুর ছেড়ে চলে যায়। না হলে এদের কোমড়ের ঠিক উপরে দুটা দুটা চারটা গুলি করবি।

মনির চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখল এস্কান্দারের হাতে একটা বন্দুক। সে বন্দুক দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। ছেলে দুটি মনিরকে অসহায় অবস্থায় রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। কোহিনূর বললেন, এবার চুপচাপ বসে পড়। আমি না বলতে বলা পর্যন্ত একটা কথাও বলবি না। মনে থাকবে?

মনির তাও শুনল না। সে লম্ফঝম্ফ চিৎকার চেঁচামেচি করতেই থাকল। কোহিনূর আবারো এস্কান্দারকে ডাকলেন। মনির অবশ্য তাতেও দমল না। বরং তার চিৎকার-চেঁচামেচি আরো বাড়ল। এস্কান্দারকে কোহিনূর ইশারায় কি বললেন কে জানে, সে আচমকা বিরাশি শিক্কার একটা থাপ্পড় বসাল মনিরের গালে। মনির ছিটকে পড়ল ঘরের দেয়ালে। তার মাথা বনবন করে ঘুরছে। সে চোখে অন্ধকার দেখছে। কোহিনুর ইশারায় এস্কান্দারকে বললেন মনিরকে তুলে চেয়ারে বাসিয়ে দিতে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কোহিনূর বললেন, খাঁ-বাড়ির সব সম্পত্তির আইনগত মালিকানা কার? তৈয়ব উদ্দিন খাঁর। সে এখনো জীবিত আছে। ফলে এখনো এই সকল সম্পত্তির মালিক সে। সে যদি মারা যায় তবে তার এই সম্পত্তির মালিকানা হবে তিনজনের। বড় ভাই, ছোট ভাই আর আমি। আমি মেয়ে হিসেবে যা পাব, তারা ছেলে হিসেবে পাবে তার দ্বিগুন। এটা হলো মুসলিম সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন। তোর বাপ খবির খাঁ যদি মারা যায়, তারপর তার সম্পত্তির দুটা সমান ভাগ হবে। এক ভাগ পাবে তোর বড় ভাই। আরেক ভাগ তুই। এখন তুই আমাকে বল, কেউ কি এখনও মারা গেছে? তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বা খবির খাঁ? যায় নাই। তাহলে তুই এই খা বাড়ির সম্পদ নিয়ে এত হম্বিতম্বি করতেছিস কেন? মাথায় যদি বুদ্ধি না থাকে, তাইলে গায়ে শক্তি দিয়ে কাজ হয় না। আর গায়ে শক্তি না থাকলেও, মাথায় বুদ্ধি থাকলেই দুনিয়া জয় করা যায়। তোর মাথায় তো এক আনা বুদ্ধিও নাই। খালি আছে গোয়ার্তুমি আর শক্তি। আর মানুষরে ভয় দেখিয়ে সব ঠান্ডা করার গাধামি। এইখানে বড়রা মিলে খাঁ-বাড়ির দীর্ঘদিনের কিছু হিসেব-নিকেশ নিয়ে বসছে। তুই বাচ্চা মানুষ। এইগুলার মধ্যে তোর থাকার দরকার নেই। তবে তোর একটা কাজ আছে, লোকজন নিয়ে গিয়ে ছোট ভাইর বউকে, আর বাবাকে ওই বাড়ি থেকে আনার ব্যবস্থা কর। আমি এখান থেকে বের হয়ে যেন দেখি, তাদের এনে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। যা।

মনির আর একটা কথাও বলল না। সে যেন এই এতদিনে একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। কিন্তু এস্কান্দারের বিরাশি শিক্কার থাপ্পড় আর কোহিনূরের এই কয়েক মুহূর্তের বয়ান যেন তার সেই ঘোর কাটিয়ে দিয়েছে। সে যেন আবার তার সেই আগের চিরাচরিত মনিরকে তার ভেতরে টের পাচ্ছে।

প্রায় দুপুর অবধি জমিজমার হিসেব-নিকেশ চলল। আরো কিছু কাগজপত্র দরকার ছিল। সেসবের ঝামেলা মেটাতে কোহিনূরকে প্রায় মাসখানেক থাকতে হলো ফতেহপুর। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর টিপসই নিয়ে জমিজমার ভাগ বাটোয়ারাও হয়ে গেল ঠিকঠাকভাবে। নিজের ভাগের জমিজমায় কোহিনূর কম পেলেন না। তিনি তার পুরোটাই দিয়ে দিলেন ব্যাপারীদের। ফতেহপুর ছেড়ে যাবার আগের। রাতে কোহিনূর দেখা করলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সাথে। পিতা-কন্যা একে অপরের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন দীর্ঘ সময়। কারো কোনো কথা নেই, শব্দ নেই। নীরব নৈঃশব্দ্যের অন্তহীন সময়। কোহিনূর এক সময় তার দু’হাতের ভেতর বাবার হাত দু’খানা মুঠো করে ধরল। ধরে বসে রইল। কোহিনূরের হাতের ভেতর কাঁপছে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর হাত। কোহিনূরের হাত জোড়াও কি থেকে থেকে কেঁপে কেঁপে উঠছে! কে জানে, হয়তো এই দু’জোড়া হাত গভীরতম স্পর্শে তাদের অজস্র দিনের জমানো অজস্র অব্যক্ত কথা বলে যেতে লাগল পরস্পর।

.

পরদিন বিকেলে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন কোহিনূর। লঞ্চ ধরতে রায়গঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার ঠিক আগমুহূর্তে দবির খাঁর স্ত্রী চুপি চুপি কোহিনূরকে আলাদা ডেকে নিলো। যদিও কোহিনূরের বড় ভাইয়ের স্ত্রী হবার সুবাদে কোহিনূরকে তার তুমি করেই বলার কথা। কিন্তু সে তাকে আপনি করেই বলে। দবির খাঁর স্ত্রী কোহিনূরকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, আপা, আপনের সাথে একখান গোপন জরুরি কথা আছে।

কোহিনূর বললেন, আপনের গোপন জরুরি কথাখান মনে হয় আমি জানি। মায় কি মরনের আগে গয়নার কলসিটা আপনার কাছে দিয়ে গিয়েছিল? ওই বাড়িতে?

দবির খাঁর স্ত্রী ভারি অবাক হলো। সে বলল, জ্বে। উনি বলছিলেন আমারে গোপন কইরা রাখতে। কেউ তো আর চিন্তাও করব না যে ওইটা আমার বাড়িতে! কিন্তু উনি তো আর জানতেন না যে অমনে মইরা যাইবেন। এহন আমি পড়ছি বিপদে, ওই কলসি আমি কি করব! কার কাছে দিব!

কোহিনূর ভেতরে ভেতরে খুব অবাক হয়েছে। চমকে গিয়েছে ভীষণ। কিন্তু সে তা প্রকাশ করল না। সে বলল, কলসিটা এহন কই আছে?

দবির খাঁর স্ত্রী বলল, ওই বাড়িতে মাটির চুলা বানানির আগে চুলার নিচে গর্ত কইরা সেইহানে রাখছি। এহন ওই জিনিস কি করব আপা?

কোহিনূর বললেন, এক কাজ করেন, ফজুকে ডেকে দিয়ে দেন। ওকে বলেন, ও চাইলে মাদারীপুর শহরে গিয়ে অঘোর উকিলের মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কোনো কর্মকর্তার কাছে জমা দিয়ে দিতে পারে।

দবির খাঁ স্ত্রী বলল, আইচ্ছা আপা। আমি আইজকাই বলব।

কোহিনূর বিদায় নিয়ে চলে গিয়েও কি মনে করে আবার ফিরে এলো। তারপর দবির খাঁর স্ত্রীকে হঠাৎ দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মেয়েটা তাকে চমকে দিয়েছে। ভীষণ চমকে দিয়েছে।

*

পারুলের কি ফাঁসি হবে?

পারুল তার স্বল্পজ্ঞানে যা বোঝে, তাতে সে জানে খুন করলে ফাঁসিই হয়। তবে খুনি যে খুন করেছে তা প্রমাণে আদালতে দুই পক্ষের উকিলদের নানান যুক্তি তর্ক, তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে হয়। কিন্তু পারুল এসবের কিছুই চায় না। তাছাড়া এসবের দরকার আছে বলেও তার মনে হয় না। পারুল যে খুন করেছে, সেটা অনেকটা প্রকাশ্যেই এবং তা সে স্বীকারও করেছে। যে রাতে তাকে সাপে কাটল, সে রাতে পারুল বাড়িই ছিল। তাকে খবর দিলো রতন। খবরটা পেয়েই পারুলের বুকের ভেতর ধক করে উঠল। সেদিন রাতে তাদের বাড়ি থেকে লতা যে হঠাৎ চলে গেল, তারপর সে আর আসেনি। বিষয়টি নিয়ে পারুলের মনটা কেমন খচখচ করছিল। কিন্তু নিজে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল বলেই এই নিয়ে তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি পারুল। তারপর এই গতকালই লতাদের বাড়িতে গিয়েছিল পারুল। এ কথা সে কথার পর পারুল সেদিনের ঘটনা জানতে চাইল। লতা অবশ্য সাথে সাথেই বলল না। দীর্ঘ সময় সে চুপ করে রইল। তারপর হঠাৎ পারুলকে ধরে কেঁদে ফেলল লতা। ঘটনা শুনে পারুল স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। তার মনে হচ্ছিল সামনে পেলে সে এই মুহূর্তে আব্দুল ফকিরকে খুন করে ফেলতে পারে। পারুল কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিল না। যে একটা মানুষ কতটা জঘন্য, কতটা বিকৃত মস্তিষ্কের হলে নিজের মেয়ের বান্ধবীর সাথে এমনটা করতে পারে। সেই থেকে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিল পারুল।

লতার সাপে কাটার খবর শুনে প্রথমেই তাই তার মাথায় ঢুকে গেল আব্দুল ফকিরের কথা। নিশ্চিত করেই আব্দুল ফকিরই যাবেন লতার বিষ নামাতে। এরপরের ঘটনা পারুল আর ভাবতে পারছিল না। ভেতর ভেতর যে রাগটা এই এতদিনে নানান ঘটনায় একটু একটু করে জমছিল, সেদিন এসে তা যেন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি হয়ে টগবগ করে ফুটতে লাগল। সে এক কাপড়ে ছুটে গেল লতাদের বাড়িতে।

লতাকে সাপে কাটার ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। সে রান্নাঘরে কুপির আলোয় রান্না করছিল। চুলার একপাশে শুকনো খড়ি স্তূপ করে রাখা। লতা খানিকটা আনমনা হয়েই ছিল। না চাইলেও তার মাথায় সারাক্ষণ আশিকের স্মৃতিই ভাসে! চুলায় খড়ি ঠেলে দিতে দিতে সে খেয়াল করল খড়ি শেষ। সে বা দিকে হাত বাড়িয়ে স্তূপ করে রাখা খড়ি থেকে একটা খড়ি টেনে বের করল। খড়িটা টেনে বের করার সময়ই সে টের পেয়েছে কিছু একটা প্রচণ্ড তীক্ষ্ণতায় তার হাত ছুঁয়ে গেছে। কিন্তু সে তখনও তাকিয়ে ছিল চুলার দিকেই। আনমনা লতা। আরেকখানা খড়ি টেনে বের করতে গিয়েই হঠাৎ কি ভেবে তাকাল! আর ঠিক তখনই সে সাপটাকে দেখতে পেল। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, সাপটা দ্বিতীয়বারের মতো ছোবল মারল তার হাতে। ঘটনা বুঝতে সামান্য সময় লাগল লতার। সাপটা তখনও ফণা তুলে ফুসছিল। ভয়াবহ আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিল লতা। লতার মা বাড়িতে নেই। তিনি গিয়েছেন রায়গঞ্জে। চিৎকার শুনে দৌড়ে ছুটে এসেছেন তার বাবা। তিনি এসে দেখলেন লতা সাপ সাপ বলে চিৎকার করছে। এবং সাপটা তখন রান্না ঘরের বেড়ার নিচ দিয়ে হিশহিশ শব্দ তুলে বের হয়ে যাচ্ছিল। ঘটনা আব্দুল ফকির অবধি পৌঁছাতে সময় লাগল না। তিনি ছুটে এলেন চোখের পলকে।

তারপরের ঘটনাগুলো আরো অনেক ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। লতাকে কালসাপ কেটেছে বলে বিষ নামানোর জন্য ঢোল-বাদ্য নিয়ে উঠানে বিশাল আয়োজন। শুরু হলো। লতার মাথা তখনও ঝিমঝিম করছিল। সে চোখে ঝাপসা দেখছিল। মনে হচ্ছিল তার বাঁ-হাতখানার ওজন অনেক বেড়ে গেছে। প্রচণ্ড ভারি হাতখানা সে যেন তুলতে পারছিল না। কিন্তু তার মস্তিষ্কের আরেকটি অংশ তখন ভাবছিল অন্য কথা। আব্দুল ফকির তার বিষ নামাতে এসেছে, এবং তাকে উঠানের পাশে দুই দিন দুই রাত থাকতে হবে শোনামাত্রই লতার চোখে ভেসে উঠেছিল সেই রাতের অন্ধকারে পারুলদের পুকুর ঘাটের ঘটনা। আর সাথে সাথেই তার কেন যেন মনে হলো, এ সকলই আব্দুল ফকিরের সাজানো কোনো ঘটনা নয়তো? আব্দুল ফকির সম্পর্কে নানান সময় নানান কথাবার্তা তার কানেও এসেছে। এমনটাও ফিসফাস শোনা যায় যে আব্দুল ফকির তার পোষা। বিষদাঁতহীন সাপও নাকি অনেকের বাড়ি ঘরে ছেড়ে দিয়ে আসেন। কিন্তু পারুলের বাবা বলেই সে সকল কথায় এতদিন কখনোই কান দেয়নি লতা।

তাছাড়া চোখের সামনে অমন ভয়ালদর্শন সাপ কামড়ালে তা নিয়ে সন্দেহ। করার দুঃসাহসই বা কে দেখায়! প্রচণ্ড আতঙ্কে লতার যেমন মূৰ্ছা যাওয়ার মতো অনুভূতি হচ্ছিল, একইসাথে তার মনে হচ্ছিল সাপটি আব্দুল ফকিরের অমন কোনো পোষা নির্বিষ সাপ নয়তো! হয়তো সেই রাতের শোধ নিতেই তিনি অন্ধকারে ওই মুহূর্তেই সাপটা ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তাদের রান্না ঘরে!

লতার হাতে শক্ত করে বাঁধ দেয়া হয়েছে। তার মাথা কোলে নিয়ে বসে আছে পারুল। লতা হঠাৎ পারুলের দু’হাত খামচে ধরে কেঁদে ফেলল। পারুল অবশ্য কিছুই বলল না। কিন্তু সেই সারাটা রাত সে জেগে রইল উঠানে। ঘটনা ঘটল দ্বিতীয় দিন শেষ রাতে। হোগলা পাতায় ঘেরাও দেয়া ঘরখানা ধূপের ধোঁয়ায় ভরে গেল। সেই ধোয়ার সাথে বিকট গন্ধও ভেসে আসছিল। পারুল যেন লতার গোঙানিও টের পাচ্ছিল। বাড়ির আর সকলেই তখন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ঘুমে ঢুলুঢুলু। পারুল জানে না কেন, সে দৌড়ে রান্না ঘর থেকে খেজুর গাছ কাঁটার লম্বা দা খানা নিয়ে এসে ঢুকে পড়ল ঘরে। লতার মুখে একখানা গামছা ঢোকানো। তার হাত দুখানা বাঁধা। তার উর্ধাঙ্গে কাপড় থাকলেও নিম্নাঙ্গের কাপড় অর্ধেকটা নামানো। পাশেই একটা ডালা খোলা বাক্স। সেই বাক্সের ভেতর থেকে ফণা তুলে আছে একটা সাপ। পারুল যেন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। মুহূর্তেরও ভগ্নাংশ সময়ে তার মাথায় খুন চেপে গেল। তারপরের ঘটনা পারুল নিজেও বলতে পারবে না। সে যখন রক্তমাখা দা-খানা নিয়ে ঘর থেকে বের হলো ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটেছে। শরীর থেকে মাথাটা আলাদা হবার আগ অবধি পারুল মুহূর্তের জন্যও থামেনি। সে যখন পেছন থেকে আব্দুল ফকিরের ঘাড়ে প্রথম কোপটা বসাল, আব্দুল ফকির তখন হতবুদ্ধ অবস্থায় পেছন ফিরে তাকিয়েছিলেন। তার চোখভর্তি তখন আতঙ্কের চেয়েও বেশি অবিশ্বাস। তিনি একটামাত্র শব্দ উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন, মাগো…। পারুল পরের কোপটা বসিয়েছিল তার মুখে। ওই মুখে সে আর কোনোদিন মা ডাকটা শুনতে চায়নি।

দুপুর নাগাদ লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল তাদের বাড়ি। পুলিশ, সাংবাদিকে ভরে গিয়েছিল উঠান। এই পুরোটা সময় পারুল রক্তমাখা শরীরে বসেছিল। পারুলই যে আব্দুল ফকিরের খুনি, তা হাজার হাজার মানুষ দেখেছে, সাংবাদিকরা দেখেছেন। ফলে আলাদা করে প্রমাণের কিছু নেই। পারুল অবশ্য তার ফাঁসি নিয়ে ভীতও নয়। তবে সে একটা আশা নিয়ে অপেক্ষায় আছে, রাজীব কি তাকে একবারের জন্যও দেখতে আসবে না? সে জানে, এই সংবাদ দেশের সব মানুষ জানে। নিশ্চয়ই রাজীবও জানে। সে কি আসবে না পারুলকে দেখতে? পারুলের দৃঢ় বিশ্বাস রাজীব তাকে দেখতে আসবে, আসবেই। আজ, অথবা কাল, অথবা পরশু। সে আসবেই। এই অপেক্ষায়ই পারুলের দিন কাটে।

এর মধ্যে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। মহিলা বিষয়ক বেসরকারি একটি আইনি সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান পারুলের মামলাটি ঢাকায় স্থানান্তরিত করার জন্য উচ্চ আদালতে রিট করল। এই বিষয়ে তারা উচ্চ আদালতের বিশেষ দৃষ্টি কামনা করছে। তাদের মতে এই খুনের পেছনের ঘটনাগুলো যথাযথভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। শুধু তাই-ই নয়, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আব্দুল ফকির সম্পর্কে নানান অনুসন্ধানী চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন একের পর এক প্রকাশ হতে লাগল। বিষয়টি নিয়ে সকল মহলেই একটা আলাদা কৌতূহল তৈরি হলো। বেসরকারি সংস্থাটির মতে পারুলের মানসিক সুস্থতা এবং এর পেছনে ঘটা নানান ঘটনার সঠিক তদন্তে মামলাটি ঢাকায় স্থানান্তরিত করা জরুরি। সংস্থাটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত মামলাটি ঢাকায় স্থানান্তরের জন্য রুল জারি করল। ২০১৫ সালের ১৯ নভেম্বর পারুলকে প্রিজন ভ্যানে ঢাকায় নিয়ে আসা হলো।

পারুল শেষ অবধি ঢাকায় এলো। তার আজন্ম স্বপ্নের শহর ঢাকা। ঢাকা শহরে তখন নিয়ন আলো জ্বলছে। লাল-নীল রঙের আলোয় ঝলমল করছে সুউচ্চ শপিংমল। রিকশায় টুংটাং শব্দ তুলে চলে যাচ্ছে প্রেমিক প্রেমিকারা। ঠিক সেই মুহূর্তে পারুলের স্বপ্ন সত্যি হলো। প্রিয়তম ঢাকা, স্বপ্নের ঢাকা, আজন্মের আরাধ্যতম শহর ঢাকায় শেষ অবধি পারুল এলো। কিন্তু প্রিজন ভ্যানের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সুউচ্চ জানালা দিয়ে সেই ঢাকা দেখার সুযোগ পারুলের হলো না।

*

পারুলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের তরফ থেকে মামলা দায়ের করা হলো। যদিও চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ড এবং তার এই মামলা নিয়ে নানা মুখে নানান কথা ছড়াতে লাগল। পত্রিকা-টেলিভিশন বেশ কিছুদিন এই নিয়েই সরব হয়ে রইল। কিন্তু একদম চুপ হয়ে রইল যে, তার নাম পারুল। সে এই নিয়ে কোথাও কিছু বলল না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে সে জবাব দেয় না। নিজ থেকেও কোনো কথা বলে না। আইনি সহায়তা প্রদানকারী বিভিন্ন সংগঠন পারুলকে আইনি সহায়তা দিতে চাইলে পারুল নিয়েও কোনো আগ্রহ দেখাল না। সে এই মামলা লড়তে চায় না। তবে তার কিছু বিশেষ কথা রয়েছে। সেই এই কথা বলতে চায় নয়নকে। নয়নের সাথে পারুলের দেখার ব্যবস্থাও করা হলো। পারুলের সাথে দেখা করতে এসে প্রথমদিনই পারুলের মুখ থেকে নয়ন যে সত্যটি আবিষ্কার করল, তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে নয়ন শেষ শেষ অবধি পারুলকে বুঝিয়ে সুজিয়ে আইনি সহায়তা নিতে রাজি করিয়ে ফেলল। আইনি সহায়তা দিলো নারী বিষয়ক আইনি সহায়তা প্রদানকারী সেই প্রতিষ্ঠানটিই। এই নিয়ে শেষ ক’টা মাস দিশেহারা হয়ে রইল নয়ন। তবে সেই দিশেহারা সময়েও পারুলের মুখ থেকে শোনা কথাটিকে মুহূর্তের জন্যও মাথা থেকে তাড়াতে পারল না নয়ন। পারুল অন্তঃসত্ত্বা! পারুল নয়নের কাছে কিছু লুকায়নি। রাজীবের সাথে পরিচয় থেকে শুরু করে পুরো ঘটনাই সে খুলে বলেছে নয়নকে।

ঘটনা শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল নয়ন। বাসায় ফিরে সেদিন আর কোনো কাজে মন বসাতে পারেনি সে। হাজারটা উদ্ভট চিন্তা গিজগিজ করতে থাকল মাথায়। রাতে ঘুমাতে গিয়ে অন্ধকার ঘরে নয়নের কেন যেন মনে হতে লাগল, এই জগৎ আসলেই একটা চক্রের মতো। সেই চক্র ঘুরে ফিরে আবার একই জায়গায় ফিরে আসে। মাঝখানে শুধুই সময়ের ব্যবধান। সময় ছাড়া আর সকলই এক ও অভিন্ন। সময় চলে গেলেও এই জগতের গল্পরা কোথাও চলে যায় না। তারা থেকে যায়। সকল গল্পরা কোনো না কোনোভাবে একইরকম থেকে যায়। সেই তো ঘুরে ফিরে আনন্দ আর দুঃখের গল্প। ভালোবাসা আর ঘৃণার গল্প। পাপ আর পূণ্যের গল্প। ঠকানো এবং ঠকে যাওয়ার গল্প। গল্পের উপস্থাপন আর চরিত্ররা কেবল সময়ভেদে বদলায়। গল্প বদলায় না।

এই যে পারুল, এই যে নয়ন, হেমা, রেণু, নুরুন্নাহার, লতা, আসলাম সাহেব, এই যে কোহিনূর, তৈয়ব উদ্দিন খাঁ, আব্দুল ফকির, নিখোঁজ হয়ে যাওয়া রাজীব কিংবা পারুলের গর্ভে বেড়ে ওঠা এক মানবণ, এরা ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র, কিন্তু এদের জীবনের গল্পে এরা যেন কেউ না কেউ, কোনো না কোনোভাবে অন্য কারো প্রতিচ্ছবি।

নয়নের মনে হয়, পারুলের গর্ভের ওই মানব ভ্রুণের সাথে সে যেমন তার মিল খুঁজে পায়, তেমনি মিল খুঁজে পায় খবির খাঁ কিংবা দবির খার সাথেও। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মতো একজন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পিতার সন্তান হয়েও সারাজীবন যেন তারা হয়েছিলেন নয়নের মতোই পিতৃপরিচয়হীনই। নিজের রক্তের হওয়া সত্ত্বেও তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নিজেই যেন কখনোই তাদের তার নিজে সন্তান বলে স্বীকার করে নেননি। কোহিনূর, রেণু, নুরুন্নাহারের জীবনের গল্পগুলোও কোথাও না কোথাও গিয়ে এক। বরং এই সকল গল্পে আলাদা করেই আলো ছড়ান যেই মানুষটা, তিনিই রয়ে যান সবচেয়ে আড়ালে। ফখরুল আলমের দিকে তাকালে নয়নের ভারী অবাক লাগে। কী গভীর, কী নিঃশব্দ, কী নিঃসংশয়!

সময় যে জীবনের চক্রে বয়ে চলে মানুষের গল্প, তাতে কি পাপ-পুণ্যের হিসেব হয়? কর্ম কি ফল হয়ে ফিরে আসে পার্থিব জীবনেই? নয়ন জানে না, যদি তাই হয়, তবে কি আঙ্গুল ফকিরের কর্ম ফিরে এলো পারুলের জীবনের গল্পে? কিন্তু তা কেন হবে? এ ভারি অন্যায়! নয়ন হিসেব মেলাতে পারে না। কোহিনূর, হেমা, লতা কিংবা নুরুন্নাহারের জীবনের গল্পে ফিরে এসেছে কার গল্প? আমরা কি তবে জীবন জুড়েই তবে পুরনো খেরোখাতার হিসেব মেটাই? পরিচয়ের হিসেব? কর্মের হিসেব? নাকি সবই বিভ্রম? সবই শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় এক অর্থহীন যাত্রা?

এ বড় অদ্ভুত হিসেব-নিকেশ। এ মেলাতে যাওয়া বড় কষ্টের। তবে নয়নের শেষ অবধি মনে হয়, জীবনের গল্পগুলো জুড়ে কেবলই আত্মপরিচয়ের সংকট। সেই পরিচয় সংকট কারো জন্মের, কারো বংশের, কারো নিজ বা অন্যে’র, কারো ধর্মের, কারো কষ্ট বা আনন্দের, কারো প্রাপ্তি বা হারানোর। কারো ঘৃণা কিংবা ভালোবাসার। কেবলই পরিচয় সংকট। এ জীবন যেন কেবলই পরিচয় সঙ্কটে দিশেহারা মানুষের পরিচয় খুঁজে বেড়াবার গল্প।

মাঝখানে কেবল সময়ের ব্যবধানে এই গল্পগুলোই ঘুরে ফিরে চলতে থাকে। সেই একই গল্প। অবিরাম অনন্তকাল। কিন্তু সেই সকল গল্পই সকলের জানা থাকে না। একেকজন কেবল তার নিজের জীবনের গল্পগুলোই জানে। বাদবাকি মানুষের কষ্টের, অপ্রাপ্তির, সঙ্কটের গল্পগুলো তার কাছে রয়ে যায় অজানা। আর এই বাদবাকি গল্পগুলো অজানা রয়ে যায় বলেই, জগতের সকল মানুষই তার নিজেকেই ভাবে সবচেয়ে দুঃখী, সবচেয়ে বড় পরিচয় সঙ্কটে ভোগা, ভাগ্যাহত মানুষ। অথচ সে জানে না, তার ঠিক পাশের মানুষটিই কি অনন্ত দুঃখগাঁথা বুকে বয়ে বেড়ায়।

এমন করেই জগতের কত কত গল্প যে রয়ে যায় আড়ালে-আবডালে! সেই সকল গল্পগুলো কেবল থেকে যায় সেই একজন কিংবা দু’জন মানুষের বুকের ভেতর সঙ্গোপনে।

পারুল জেলখানার নিয়ম-কানুন জানত না বলেই তার ভয় ছিল, তার সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখবার আগেই তার ফাঁসি হয়ে যাবে না তো! নয়ন অবশ্য তাকে আশ্বস্ত করেছে, এমন কিছুই হবে না। পারুল খুব করে কেঁদেছে নয়নের সামনে। কতবার যে সে ক্ষমা চেয়েছে! হাতজোড় করে অনুনয় বিনয় করেছে। নয়ন মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারে না। কী যে অসহায় লাগে তার!

নয়নের মাঝে-মধ্যে মনে হয়, এই খুনটা তো পারুলের না, তার নিজের করার কথা ছিল। কিন্তু খুনটা করল পারুল। পারুল যেন তার হয়েই খুনটা করে দিলো। তাহলে পারুল কেন ফাঁসিতে ঝুলবে? ফাঁসিতে ঝোলার কথা তো তার। এই একই কথা মনে হয় কোহিনূরেরও। এই খুনটা হয়তো করার কথা ছিল তারও। কিংবা কে জানে, হয়তো আরো অসংখ্য মানুষের! কিন্তু সেই অসংখ্য মানুষের হয়ে খুন করে পারুল একা কেন শাস্তি ভোগ করবে!

কোহিনূর দিনরাত এখানে-সেখানে ছুটলেন। ছুটল নয়নও। দিনের পর দিন। এর মধ্যে পারুল আইন সহায়তাকারী সংস্থাটিকেও জানাল তার গর্ভে সন্তান থাকার কথা। সন্তানের পিতার পরিচয়ে সে রাজীবের বিষয়ে কিছু জানাল না। পারুল চায় না রাজীবকে জোর করে কেউ খুঁজে বের করুক। তার দৃঢ় বিশ্বাস রাজীব একদিন সত্যি সত্যিই ফিরে আসবে। রাজীব নিশ্চয়ই এখন জানে, পারুল কোথায় আছে? কারণ পারুলকে নিয়ে দিনের পর দিন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। পারুলের ধারণা, তার ফাঁসির আগ মুহূর্তে হলেও রাজীব ফিরে আসবে। একবারের জন্য হলেও সে আসবে। সে পারুলের সাথে দেখা করবেই।

পারুল অবশ্য তাদের জানিয়েছে, সন্তানের বাবা মধ্যপ্রাচ্যে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ। এই অবস্থায় তার সন্তানের সকল দায়িত্ব সে দিয়ে যেতে চায় নয়নকে। পারুল এবং নয়ন, তাদের দুজনেরই ধারণা ছিল, বিষয়টি নিয়ে নিশ্চয়ই বড় ধরনের কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। বরং সংস্থাটি পারুলের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দিলো এবং বিষয়টি তারা যথাযথ নিয়মানুসারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও জানাল। কর্তৃপক্ষ জানাল বাবা যেহেতু নিখোঁজ, মা চাইলে নির্ভরযোগ্য যে কারো কাছেই তার সন্তানের দায়িত্ব দিতে পারেন।

*

রেণু রোজ হেমাকে ডাকেন। প্রথমে নিঃশব্দে। তারপর ফিসফিস করে। তারপর সশব্দে। তিনি হেমার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে ডাকেন, হেমা, মাগো। ও মা। মারে।

হেমা অবশ্য মায়ের ডাকের জবাব দেয় না। সে কেবল ঘুমায়। একটানা নিসাড় ঘুম। এই ঘুম সে গত চারমাস ধরে ঘুমাচ্ছে। ডাক্তারী পরিভাষায় এই ঘুমকে বলে কোমা। এই ঘুমের মধ্যে মানুষের কোনোরকম অনুভূতি থাকে না। শরীরে প্রাণ থাকলেও তার মস্তিষ্ক হয়ে যায় অচেতন। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, কোমায় চলে যাওয়া মানুষের মস্তিষ্ক আবার চেতনা ফিরে পেতেও পারে। চেরাপুঞ্জির ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় হেমার মৃত্যু হয়নি, তবে যা হয়েছে তা মৃত্যুর চেয়ে কম কিছু নয়। ভারত থেকে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে তিন মাস পর। কিন্তু আসলেই কি হেমাকে নিয়ে আসা হয়েছে? নাকি নিয়ে আসা হয়েছে অন্য কাউকে?

ডাক্তারদের মতে, এই অবস্থা থেকে হেমার ফিরে আসার সম্ভাবনা যে একদমই নেই, তা নয়। তবে তা অনেকক্ষেত্রেই নির্ভর করছে দৈবের উপর। তাছাড়া তার শ্বাস-প্রশ্বাস এবং রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়াও স্বাভাবিক রয়েছে। যদিও ডাক্তাররা বলেছেন, কোমা হলো এমন একটি শারীরিক অবস্থা যার উপরের মেডিকেল সায়েন্সের পুরোপুরি কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে তাদের পক্ষে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলাও সম্ভব নয়।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস বলে, বছরের পর বছর কোমায় থেকে অনেক রোগী শেষ অবধি পুরোপুরি মৃত্যুবরণ যেমন করেছেন, তেমনি কেউ কেউ আবার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বেঁচেও উঠেছেন। তবে এই অনির্দিষ্ট সময়ের অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিতে পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রাণঘাতী ইনজেকশনের মাধ্যমে কোমায় থাকা রোগীর পুরোপুরি মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। এক্ষেত্রে অবশ্য রোগীর আত্মীয়-স্বজনের পূর্ণ অনুমতি থাকতে হয়। আসলাম সাহেব হেমাকে নিয়ে আসলেন দেশে। দুর্ঘটনার খবর শুনে তিনি আর রেণু ছুটে গিয়েছিলেন ভারতে। দেশে ফিরে আসলাম সাহেব দুম করে তার বাড়িটা বিক্রি করে দিলেন। তিনি জানেন, তার এই মুহূর্তে টাকা দরকার। অনেক টাকা।

আসলাম সাহেব শান্ত, ধীর স্থির। তিনি কারো সাথে এই নিয়ে খুব একটা কথাবার্তা বলেন না। রেণুর মতো পাগলপ্রায় আচরণও তিনি করেন না। তিনি সারাক্ষণ একদৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। রেণু মাঝে-মধ্যে যখন পাগলামীর সীমা ছাড়িয়ে যান, তখন আসলাম সাহেবকে খানিক সচল হয়ে উঠতে দেখা যায়। তখন তিনি শক্ত হাতে রেণুকে বুকের সাথে চেপে ধরে হেমার বিছানার পাশে বসে থাকেন। রেণু একনাগাড়ে কাঁদতে থাকেন। অঝোরে, অক্লান্ত, বিরামহীন সেই কান্না নিঃশব্দ।

দৃশ্যটি অদ্ভুত! ডিভোের্স হয়ে যাওয়া এক দম্পতি তাদের মৃতপ্রায় অচেতন সন্তানের পাশে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকেন। পঁচিশ বছরের সুদীর্ঘ দূরত্ব, সুদীর্ঘ সময় সকলই যেন ঘুচে গেল এক মুহূর্তেই। সেইসব সময়ের অজস্র চেষ্টার গল্প, অজস্র বিনিদ্র রাত্রির অপেক্ষার গল্প, ঘৃণা, ভালোবাসা, আকুলতার সকল গল্প ব্যর্থ করে দিয়ে তারা যখন কাগজ-কলমে সই করে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন, তখন এই একটিমাত্র অপেক্ষা, এই একটিমাত্র ব্যাকুলতা তাদের কাছে নিয়ে এলো। কিংবা মাতৃত্ব আর পিতৃত্বের ব্যাখ্যাতিত এক অনুভূতি যেন সব ছাড়িয়ে হয়ে উঠল একমাত্র সত্য।

গত পঁচিশ বছরের আর সকল কিছু অর্থহীন হয়ে গিয়ে তাদের সামনের এই একটিমাত্র মানবজন্মই শেষ অবধি হয়ে উঠল সবচেয়ে বেশি অর্থময়। হেমার এই মৃতপ্রায়, অচেতন, নির্জীব মানবজন্মটিই কেমন করে বাঁচিয়ে তুলল পঁচিশ বছর ধরে মৃত, অচেতন, নির্জীব হয়ে পচে গলে শেষ হয়ে যাওয়া একটি সম্পর্ককে।

কী অদ্ভুত এই হিসেবের গল্প, কী রহস্যময় এই জীবন, কত কত মৃত্যুর মধ্যেও লেখা থাকে কত কত পুনরুজ্জীবনের গল্প।

আসলাম সাহেবের মাঝে-মধ্যে মনে হয়, হেমা সব টের পাচ্ছে। সে সব বুঝতে পারছে। তিনি বারকয়েক ডাক্তারের কাছে জিজ্ঞেসও করেছেন। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন, হেমা কিছু শুনতে পায় না। কিছু বুঝতে পারে না। হেমার ফিরে আসার বিষয়েও তারা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। কিন্তু আসলাম সাহেব ডাক্তাদের এই কথা বিশ্বাস করেন না। তার ধারণা হেমা সুস্থ হয়ে উঠবে। নিশ্চিত করেই সুস্থ হয়ে উঠবে। তিনি রোজ সংবাদপত্র, ইন্টারনেট খুঁজে খুঁজে কোমা থেকে ফিরে আসা মানুষদের খবর বের করেন। সেদিন জিজাস আপারিচো নামের এক স্প্যানিশ কিশোরের খবর বের করলেন। ছেলেটি ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে কোমায় চলে গিয়েছিল। ডাক্তাররাও বলে দিয়েছিলেন, এই কিশোর আর কখনো এই কোমা থেকে ফিরবে না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে এগারো বছর পর সে সেই কোমা থেকে ফিরে এসেছে এবং এখন সুস্থ মানুষের মতই জীবনযাপন করছে।

শুধু তাই-ই না, দীর্ঘ চল্লিশ বছর পরও কোমা থেকে জেগে উঠেছে, এমন ঘটনাও রয়েছে। একটা দুটা না, আসলাম সাহেব এমন অসংখ্য সংবাদ খুঁজে বের করেছেন। তিনি যে শুধু এই সংবাদগুলো খুঁজে বের করেছেন তাও না। তিনি এগুলো প্রিন্ট করে যত্ন করে একটা ফাইলে রেখে দিয়েছেন। কেউ আসলেই তিনি সেই ফাইল খুলে একটা একটা করে সংবাদ দেখান। তারপর পড়ে পড়ে শোনান। তারপর বলেন, আমার হেমা ভালো হয়ে যাবে। আমার হেমা ভালো হয়ে যাবে। একদম সুস্থ হেমা।

এইসময় আনন্দে তার মুখ ঝলমল করে ওঠে। চোখ চকচক করে ওঠে। অভ্যাগতরা আসলাম সাহেবের মুখের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকেন। আসলাম সাহেবের হাসি-হাসি মুখ হঠাৎ মলিন হয়ে যায়। তিনি খানিক স্তিমিত গলায় বলেন, কী? আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তো? আমার কথা আপনাদের বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখুন, এই দেখুন, এইখানে কি লেখা আছে, দেখুন।

সকলেই আসলাম সাহেবের হাতের প্রিন্ট করা কাগজের দিকে তাকান। কিন্তু ওই তাকানো অবধিই। তাদের চোখের দৃষ্টিতে কোনো আগ্রহ থাকে না। আসলাম সাহেব আবারো উচ্চঃস্বরে পড়তে থাকেন। কিন্তু তার সেই পড়া কেউ শোনে বলে মনে হয় না।

ডাক্তাররা বলেছেন, আসলাম সাহেব চাইলে হেমাকে বাসায়ও নিয়ে যেতে পারেন। হাসপাতালের কেবিনে রেখে রেখে গুচ্ছের টাকা খরচ করার কোনো মানে নেই। এখানে হেমার আলাদা কোনো চিকিৎসারও দরকার নেই। সে এক গভীর ঘুমে। এই ঘুমের মধ্যে তাকে সময়মতো নল দিয়ে খাওয়াতে হয়, আর বিশেষ ব্যবস্থায় বাথরুম করাতে হয়। এইটুকুই যা ঝক্কি। বাদবাকি সময়টা সে পড়ে থাকে মৃতের মতো। কিংবা গভীর ঘুমে ডুবে থাকা মানুষের মতো। এখন শুধু অপেক্ষার সময়। হয়তো কোনো একদিন সে তার এই অচেতন অবস্থা থেকে জেগে উঠতেও পারে। তবে সে সম্ভাবনা নিয়ে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারেন না ডাক্তাররা। এমন অবস্থা থেকে ফিরে আসার ঘটনা খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু আসলাম সাহেব ডাক্তারদের কথা শোনেননি। তিনি হেমাকে রেখে দিয়েছেন হাসপাতালের কেবিনেই। তার দৃঢ়বিশ্বাস, হেমা ফিরে আসবে, আসবেই।

রেণু যখন তখন কাঁদেন। এই সময়ে আসলাম সাহেব রেণুকে নানান কথা বলে শান্ত্বনা দেন। তবে সবচেয়ে বেশি যেটি করেন, তা হলো তিনি তখন খুব আগ্রহ নিয়ে রেণুকে পত্রিকার সংবাদগুলো পড়ে শোনান। রেণু কাঁদতে কাঁদতে সেই সংবাদ শোনেন। শুনতে শুনতে তার মনে হয়, হয়তো কাল সকালেই হেমা সুস্থ হয়ে উঠবে। সে ঘুম থেকে উঠে বলবে, মা বাইরে নিশ্চয়ই আকাশ কালো করে বৃষ্টি নেমেছে। আমি এখনই বাসায় যাব। আমাকে কড়া করে এক কাপ কফি বানিয়ে দিবে। আমি বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখব। বৃষ্টি দেখতে দেখতে কফি খাবো। আচ্ছা মা, সজনে গাছটার পাতাগুলো কি বৃষ্টি পড়লে এখনো আগের মতো সবুজ হয়?

রেণু এই সময়ে মনে মনে হেমার সাথে কথা বলেন। কথা বলতে গিয়ে তিনি নানান মিথ্যে কথাও হেমাকে বলেন। হেমাকে তিনি এখনও একবারও বলেননি যে তার বাবা তার চিকিৎসার খরচ চালাতে বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছেন। এই কথা তিনি হেমাকে বলবেনও না। রেণু মনে মনে ঠিক করে রেখছেন, হেমা সুস্থ হয়ে উঠলেই তারা তাদের আগের ফ্ল্যাটটাই নতুন বাড়ির মালিকের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে নিবেন। হেমাকে তিনি ঘুণাক্ষরেও জানতে দিবেন না যে এই বাড়িটা আর তাদের নেই।

.

নয়ন যেদিন হেমাকে দেখতে এলো, সেদিন সত্যি সত্যিই তুমুল বৃষ্টি। সে সেই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই এলো। নয়ন দাঁড়িয়ে ছিল ভেজা কাপড়ে। আসলাম সাহেব অনেকক্ষণ নয়নের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, এতদিনে এলে?

নয়ন আসলাম সাহেবের কথার কোনো জবাব দিলো না। সে ঘোরগ্রস্তের মতো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখ নিবদ্ধ হয়ে আছে ঘরের ভেতর হেমার ঘুমন্ত মুখের ওপর।

আসলাম সাহেব বললেন, আগে কাপড়টা পাল্টে নাও।

নয়ন এই কথায়ও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। সে দরজার কাছটাতে যেমন দাঁড়িয়ে ছিল, তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। একটা কথাও কাউকে জিজ্ঞেস করল না। নয়ন এলো পরদিনও। সেদিনও সে তেমনই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কারো সাথে কোনো কথা বলল না। না সেই দিন, না তার পরদিন। না তারপরের দিন। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করে না নয়ন। কিন্তু সে রোজ আসতে লাগল। খুব ভোর বেলা এসে সে বাইরের বারান্দায় একটা বেঞ্চি আছে, সেই বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে থাকে। আর রাত হলে যায়। আসলাম সাহেব তাকে কত কিছু জিজ্ঞেস করেন, কিন্তু সে কোনো কথারই জবাব দেয় না। বসে থাকতে থাকতে তার একটা ঘোরের মতো হয়। সে সেই ঘোরের ভেতর রেণুর মতই হেমার সাথে কথা বলে। হেমা তাকে বলে, তুমি কেন এসেছ?

নয়ন বলে, তুমি যে আসতে বললে!

হেমা বলে, কই? না তো!

নয়ন বলে, হ্যাঁ।

হেমা বলে, কবে?

নয়ন বলে, মনে করে দেখো।

হেমা খানিক চুপ করে ভাবে। তারপর বলে, কই? আমার তো মনে পড়ছে!

নয়ন বলে, কেন, তুমি যে বলেছিলে, তুমি আমার অপেক্ষায় থাকবে!

হেমা এবার চুপ করে যায়। নয়ন বলে, আমি এসেছি, এবার ওঠো।

হেমা কথা বলে না। নয়ন বলে, কই? ওঠো।

হেমা বলে, আমি তো উঠতে পারি না নয়ন! আমার কি যে ইচ্ছে করে। উঠতে! কিন্তু আমি উঠতে পারি না।

নয়ন বলে, একটু চেষ্টা করে দেখো। তুমি ঠিক উঠতে পারবে।

নয়ন দেখে, হেমা উঠতে চেষ্টা করছে। কিন্তু তার হাত-পা, চোখের পাতা, মাথা সকলই যেন অদৃশ্য এক দড়িতে বাঁধা। এই বাঁধন ছেড়ে সে উঠতে পারছে না। কিন্তু সে সব শুনতে পাচ্ছে। সে সব বুঝতে পারছে। এই সময়টায় হেমার। জন্য নয়নের খুব কষ্ট হয়। তার মনে হয় সে গিয়ে যদি ওই অদৃশ্য বাঁধনটাকে খুলে দিয়ে আসতে পারত। কিন্তু সে হেমার কাছে যায় না। সে দূর থেকে উঁকি দিয়ে খানিক দেখে। তারপর আবার বাইরের এই বেঞ্চিতে এসে বসে থাকে। তারপর মনে মনে হেমার সাথে কথা বলে।

হেমা তাকে মাঝে-মধ্যে বলে, তুমি সারাক্ষণ এখানে বসে থাকো কেন নয়ন?

নয়ন বলে, তোমার জন্য।

হেমা বলে, আগে তাহলে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে কেন?

নয়ন বলে, তোমার কাছে আসার জন্য।

হেমা বলে, কাছে আসার জন্য ফিরিয়ে দিতে হয়?

নয়ন বলল, হ্যাঁ হয়। কাছে আসার জন্য দূরে যেতে হয়।

হেমা বলল, কতটা দূরে?

নয়ন বলে, যতটা দূরে গেলে কাছে আসা যায়। দূরে না গেলে কাছে আসা যায় কি করে?

হেমা বলে, কিন্তু সব দূরত্ব থেকে তো কাছে আসা যায় না নয়ন। কিছু কিছু দূরত্ব আছে, যেখানে গেলে সেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না।

এই কথায় নয়ন থমকে যায়। সে বলে, তুমি অতটা দূরে যেও না প্লিজ।

হেমা বলে, আমি যেতে চাই না তো! আমার খুব কষ্ট হয়। বাবা-মার জন্য কষ্ট হয়। তোমার জন্য কষ্ট হয়।

নয়ন বলে, তাহলে ফিরে এসো তুমি।

হেমা বলে, পারছি না তো! আমি চেষ্টা করছি, খুব চেষ্টা করছি নয়ন। খুব।

নয়ন বলে, চেষ্টাটা কখনো ছেড়ো না। কখনো না।

হেমা বলে, আমি ছাড়ব না। কিন্তু যদি অনেক অনেক সময় লেগে যায়? অনেক অনেক বছর? যদি তখন আমি বৃদ্ধ হয়ে যাই?

নয়ন বলে, আমি অপেক্ষায় থাকব।

হেমা বলে, সত্যি সত্যি থাকবে তো?

নয়ন বলে, হ্যাঁ। থাকব।

হেমা বলে, কিন্তু আমার মতো হয় যদি? আমি বলেছিলাম আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকব। কিন্তু দেখো, তুমি তো সেই এলে, কিন্তু আমিই তো নেই। আবার আমি এসে যদি দেখি তুমি নেই?

নয়ন এই সময়টায় ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে। সে ফিসফিস করে বলে, আমি থাকব হেমা। সারাজীবন থাকব। তুমি শুধু এসো। একবার এসো। প্লিজ, এসো। একবার।

করিডোরে হেঁটে যাওয়া নার্স, ডাক্তার, রোগী আরো কত কত মানুষ নয়নের দিকে ফিরে ফিরে তাকায়! একটা মানুষ এমন অদ্ভুতভাবে একা বসে বসে রোজ রোজ কাঁদে! কিন্তু কারো সাথে সে কথা বলে না। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করে না। ওই এক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বসে থাকে। আর কখনো কখনো। বিড়বিড় করে কি সব বলে! তারপর কাঁদে।

.

নয়নের মনে হয়, একদিন ঠিক ঠিক হেমা জেগে উঠবে। কিংবা জেগে উঠবে সে নিজে। তার কেন যেন মনে হয়, হেমার ওই অমন করে ঘুমিয়ে থাকা, তার এই এমন করে হেমার জেগে ওঠার অপেক্ষায় রোজ বসে থাকা। কিংবা পারুলের ওই জেলের ভেতর বন্দি হয়ে রাজীবের অপেক্ষায় থাকা। কিংবা তার বাবা ফখরুল আলম জীবনভর তার মা কোহিনূরকে সত্যি সত্যি নিজের করে পাবার জন্য যে অপেক্ষা করেছেন সেই অপেক্ষা, এর কোনো কিছুই আসলে বাস্তবে ঘটা কোনো ঘটনা নয়। এর সকলই যেন একটা ঘোর, একটা দুঃস্বপ্ন। হয় এই দুঃস্বপ্ন সে নিজে দেখছে। না হয় পারুল দেখছে, না হয় হেমা দেখছে। না হয় দেখছে অন্য কেউ। একজনের স্বপ্নে বাদ বাকি আর সকলেই কেবলমাত্র সুনির্দিষ্ট চরিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছে। কেউ একজন এই ঘুম থেকে জেগে উঠলেই তারা আর সকলেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।

নয়ন খুব ভাবে। সারাটাক্ষণ ভাবে। মানবজনমটিই তো এমন, তাই নয় কি? এমন একেকটা স্বপ্নের মতোই তো। হতে পারে না? এই যে সে, এই যে চারপাশের পৃথিবী, এই যে এত এত মানুষ, সম্পর্ক, মায়া, অনুভূতি এর সকলই কি আসলে একেকটা স্বপ্ন হতে পারে না? এই জগতে ঘুম ভেঙে গেলে যেমন স্বপ্ন ভেঙে যায়, স্বপ্নের সব চরিত্ররা মিলিয়ে যায়। কে জানে, কোনো একদিন হয়তো সে দেখবে, তার ঘুম ভেঙে গেছে, আর সেই ঘুম ভেঙে সে হয়তো দেখবে এই মানবজনমের এই এত এত ঘটনা, এত এত গল্প এর পুরোটাই ছিল আসলে একটা স্বপ্ন। হতে পারে না এমন? এমনও তো হতে পারে, মৃত্যু মানেই এই মানবজন্মের ঘুম ভেঙে অন্য কোনো জন্মে জেগে ওঠা। যেমন এই জন্মে মানুষ যখন স্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠে তখন তার স্বপ্নে দেখা মানুষগুলোর কি হয়? কোথায় যায় তারা? নাকি তারাও মানুষের মতো, স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার মুহূর্তে তাদেরও মৃত্যু ঘটে সেই স্বপ্নের জগতে?

আচ্ছা এই মানবজনম যদি সত্যি সত্যিই স্বপ্ন হয়, তখন কি এই মানবজন্মের এই এত এত মানুষ, এত এত সম্পর্ক, অনুভূতি, এদের জন্য তার খারাপ লাগবে? নিশ্চয়ই লাগবে। স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলেও তো তার রেশ থেকে যায়। মৃত্যু কি তবে এই মানবজন্মের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে অন্য কোনো জন্মে জেগে ওঠা? সেখানে কি তাহলে রয়ে গেছে অন্য কোনো জনম? সেই জনমের নাম কি?

নয়ন জানে না। সে কেবল জানে, স্বপ্ন হলে হোক, তারপরও তার এই মানবজন্মের একটামাত্র প্রার্থনা। সেই প্রার্থনার নাম হেমা।

হেমার সাথে গত কিছুদিন নয়ন কথা বলতে পারে না। চেষ্টা করলেও পারে না। হেমা আর জবাব দেয় না। নয়ন চেষ্টা করেছে। কিন্তু লাভ হয়নি। তার মস্তিষ্ক যেন একই সাথে দুজন মানুষের ভূমিকা পালন করতে করতে ক্লান্ত। নয়ন অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, তার মস্তিষ্কে থাকা হেমার প্রতি তার অভিমান হচ্ছে। কী অদ্ভুত, হেমা বলতে তো কিছু নেই, যে ছিল, তা তার মস্তিষ্কেরই একটি বিশেষ কল্পনা। কিন্তু সেই কল্পনাটিকে গত কয়েকদিন থেকে সে সজীব করতে পারছে না। আর পারছে না বলেই তার এই অদ্ভুত অভিমান।

সেদিন হঠাৎ করেই আবার সেই হেমা যেন কথা বলে উঠল। সে বলল, কত দিন হলো এভাবে অপেক্ষা করছ?

নয়ন বলল, জানি না তো!

হেমা বলল, কেন? জানতে হবে তো! আমায় এর শোধ করতে দেবে না?

নয়ন বলল, অপেক্ষার কোনো শোধ হয় হেমা?

হেমা বলল, হয় না?

নয়ন বলল, না।

হেমা বলল, তাহলে?

নয়ন বলল, তাহলে কি?

হেমা বলল, আমি তোমার এই অপেক্ষার মুহূর্তের অসহ্য কষ্টগুলো মুছে দেবো কীভাবে?

নয়ন হাসল। তারপর একা একাই ফিসফিস করে বলল, ভালোবেসে।

হেমা যেন খানিক চমকালো। তারপর বলল, আর আমি যদি কখনোই ফিরে আসতে না পারি?

নয়ন বলল, পারবে।

হেমা বলল, কীভাবে?

নয়ন বলল, এই যে এখন যেভাবে ফিরে এসেছ।

হেমা বলল, এই আমি তো সত্যি সত্যি ফিরে আসিনি নয়ন। এই আমি তো তোমার কল্পনা।

নয়ন বলল, কে জানে, কোনটি সত্যি, আর কোনটি কল্পনা?

হেমা বলল, এ কেমন কথা?

নয়ন বলল, এটিই কথা হেমা। আমরা কেউ জানি না, কোনটি সত্যি আর কোনটি কল্পনা। আমরা যখন স্বপ্নের ভেতর মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে দৌড়াই তখন তো আমরা জানি না যে আমরা স্বপ্ন দেখছি। তখন মনে হয়, ওটাই সত্যি। কী প্রাণপণ সেই দৌড়। তাই না? কিন্তু ঘুম ভেঙে গেলে দেখি ওটি ছিল স্বপ্ন। তাই না? কে জানে, হয়তো ঘুম ভাঙা আমি মানুষটাও অন্য কারো স্বপ্ন। অন্য কারো কল্পনা। হতে পারে না?

হেমা চুপ করে রইল। নয়ন বলল, তুমি ভয় পেয়ো না, আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব। রক্তমাংসের মানুষের অস্তিত্বে আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। তো, কিংবা কল্পনার মানুষের অস্তিত্বের সাথে বসবাসের অভ্যেস নেই তো, হয়তো এইজন্যই সত্যিকারের তুমি বলে যাকে ভাবি, সেই মানুষটাকেই আমার বেশি দরকার। খুব বেশি দরকার।

হেমা বলল, তোমার আমাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে না?

নয়ন বলল, খুব।

হেমা বলল, তাহলে? তাহলে তুমি তো এই আমাকে ছুঁয়ে দেখতে পারবে না!

নয়ন বলল, এটাও অভ্যেস। আমরা হয়তো এই ছোঁয়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি হেমা। এই তোমাকে হয়তো অন্য কোনোভাবে ছোঁয়া যায়। যা আর সকল ছোঁয়ার ছেয়ে গভীর। আর সকল ছোঁয়ার চেয়েও আনন্দের।

হেমা এবার আর কথা বলল না। চুপ করে রইল। নয়নও।

*

ফখরুল আলম বসে আছেন বাড়ির ছাদে। পাশের মাঠে ক্রিকেট খেলছে ছেলেপুলেরা। লাল টেপ পেচানো একটা টেনিস বল হঠাৎ ছুটে এলো তার দিকে। তিনি ডানে সরবেন না বামে সরবেন ভাবতে ভাবতেই বলটা তার চশমায় ঠুকে গেল। চশমার বা চোখের ডাটটা ভেঙে চোখের পাশে খানিক কেটেও গেল। ফখরুল আলম অবশ্য খেয়াল করলেন না। নিচ থেকে ছেলেপুলেগুলো চেঁচামেচি করছে। তিনি চশমা ছাড়া তেমন একটা চোখে দেখেন না। তাছাড়া বলটা তার কপালে লেগে ছাদের কোথায় গিয়ে যে পড়েছে, তাও তিনি ঠিকঠাক ঠাহর করে উঠতে পারছেন না। তিনি উঠে বলটা খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু নিচ থেকে চেঁচামেচি বাড়তেই লাগল। খানিক সময় লাগলেও বলটা খুঁজে পেয়ে তিনি ছুঁড়ে মারলেন নিচে। কিন্তু সামনের ইলেকট্রিকের তারে লেগে বলটা গিয়ে পড়ল ময়লার ড্রেনে। এতক্ষণ নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে ছোঁকড়াগুলো এবার যেন খেদিয়ে উঠল, কানা নাকি আপনে? চোখে দ্যাখেন না?

কথাটা শুনে ফখরুল আলমের কেমন মন খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ হবার মতোই ঘটনা। কিন্তু এমন তো তার সাথে রোজই ঘটে। কই তখন তো তার মন খারাপ হয় না। বরং সরি টরি বলে ঝামেলা এড়িয়ে তিনি চলে আসেন। তাহলে আজ? আজ কেন এমন হচ্ছে?

ফখরুল আলমের চেহারা বা আচরণটাই যেন একটু কেমন! হয়তো এজন্যই রোজ বাসে-পথে, অফিসে এমন দুয়েকটা কথা তাকে শুনতেই হয়। শুনতে শুনতে এসবে তার অভ্যাসই হয়ে গেছে। কিন্তু আজ তাহলে এমন মন। খারাপ হয়ে গেল কেন? ফখরুল আলম অনেকক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইলেন। আজকের সন্ধ্যাটাও যেন কেমন একটা মন খারাপ করে দেয়া সন্ধ্যা।

ফখরুল আলমের সামনে দিয়ে কতগুলো পাখি উড়ে গেল সার বেঁধে। সামনের ইলেক্ট্রিকের তারের উপর বসে ডানা ঝাঁপটালো একটা কাক। কোথাও আলাদা কিছু নেই। অথচ তারপরও ফখরুল আলমের কি যে মন খারাপ হয়ে যেতে লাগল। তার কেমন একা একা লাগতে লাগল। সারাজীবন তো তিনি একাই। কিন্তু এমন আলাদা করে কখনো তো একা মনে হয়নি!

ফখরুল আলম হঠাৎই কারণটা ধরতে পারলেন। কারণটা হচ্ছে ওই লাল টেনিস বলটা। টেনিস বলটা দেখে তার নয়নের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেছে। নয়ন একবার বল মেরে তার চশমার ডাট ভেঙে দিয়েছিল। আজ টেনিস বলটা আর ছেলেগুলোকে দেখে তার সেই ছোট্ট নয়নের কথাই মনে হচ্ছিল। হয়তো সে কারণেই এত মন খারাপ হয়ে গেছে! অন্ধকার নেমে আসতে আরও খানিক সময় লাগবে। একটা ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। কিন্তু সেই হাওয়া জুড়েও যেন তীব্র মন খারাপের ছোঁয়া।

ফখরুল আলমের মনে হলো, তার কাঁধে যেন সেই ঠান্ডা হাওয়া জমাট বেঁধে আটকে আছে। তিনি ডান হাত বাড়িয়ে কাঁধের জমাট অনুভূতির স্পর্শটুকু ঝেড়ে ফেলতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। হাত বাড়াতেই চমকে গেলেন তিনি। ঘাড় ঘুরে পেছনে তাকাতেই দেখলেন কোহিনূর দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, কোনো দরকার?

কোহিনূর বললেন, হ্যাঁ,

তিনি বললেন, কি? বুয়া আসেনি?

কোহিনূর বললেন, না, এসেছে।

তিনি বললেন, তাহলে? বাজার নেই?

কোহিনূর বললেন, না, আছে।

তিনি বললেন, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?

কোহিনূর বললেন, না।

তিনি বললেন, নয়নের কোনো সমস্যা?

কোহিনূর বললেন, না।

তিনি বললেন, তাহলে?

কোহিনূর কথা বললেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তার মুখখানা যেন ভার। চোখ জোড়া যেন ফুলে আছে। ফখরুল আলম বললেন, কার কি হয়েছে?

কোহিনূর বললেন, আমার হয়েছে।

ফখরুল আলম ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি আতঙ্কিত গলায় বললেন, কি হয়েছে?

কোহিনূর হঠাৎ কিশোরী মেয়ের মতো সলজ্জ কণ্ঠে বললেন, আপনাকে আমার খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।

ফখরুল আলম হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার ধারণা তিনি ভুল কিছু শুনছেন। তিনি থতমত গলায় আবারো জিজ্ঞেস করলেন, কি ইচ্ছে করছে?

কোহিনূর বললেন, আপনাকে আমার খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কেন জানি লজ্জাও হচ্ছে। আপনি কি আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন?

ফখরুল আলম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন! কি হয়েছে কোহিনূরের? মাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো! তিনি কোহিনূরকে ভয় পান। যথেষ্টই ভয় পান। কোহিনূরের মেজাজমর্জি বুঝে চলার চেষ্টা করেন। পারতপক্ষে তার সামনে যান না। কোহিনূরও অবশ্য তাকে নিয়ে কখনো কোনো আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু এখন তিনি কি করবেন? সন্ধ্যাবেলা আশেপাশের বাড়ির ছাদেও লোকজন রয়েছে। কোহিনূরকে এই অবস্থায় তাকে সত্যিসত্যি জড়িয়ে ধরতে বলেছেন? ফখরুল আলমের ধারণা তিনি কোহিনূরের কথা বুঝতে পারেননি। কোহিনূর বলেছেন একটা, তিনি বুঝেছেন আরেকটা।

তিনি বললেন, তুমি রাগ করো না কোহিনূর। আমি না তোমার কথা বুঝতে পারছি না।

কোহিনূর ফখরুল আলমের বুকের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে এলেন। তারপর প্রগাঢ় আবেশমাখা গলায় বললেন, আপনি কি একটু আমাকে জড়াই ধরবেন? শক্ত করে?

ফখরুল আলম বিব্রত ভঙ্গিতে এদিক-সেদিক তাকালেন। তারপর দ্বিধাজড়িত গলায় বললেন, আশেপাশের ছাদে লোকজন। তারা সব দেখছে কোহিনূর।

কোহিনূর বললেন, আমি আপনার বিয়ে করা বউ না? তারা দেখলে কি সমস্যা?

ফখরুল আলম বললেন, তোমার কিছু হয়েছে কোহিনূর? কোনো সমস্যা?

কোহিনূর বললেন, হ্যাঁ। হয়েছে।

ফখরুল আলম বললেন, কি হয়েছে?

কোহিনূর হঠাৎ ফখরুল আলমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তারপর তার বুকের সাথে মুখ ঘষতে ঘষতে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ফখরুল আলম কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর হাত বাড়িয়ে কোহিনূরকে শক্ত করে বেষ্টন করলেন। বললেন, কি হয়েছে কোহিনূর? শরীর খারাপ লাগছে? অসুস্থ লাগছে?

কোহিনূর জবাব দিলেন না। তিনি কাঁদতেই লাগলেন। চারদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলো। সেই অন্ধকারে ফখরুল আলমের বুকের ভেতর মিশে গিয়ে কোহিনূর ফিসফিস করে বললেন, আপনে কি জানেন, এই দুনিয়ায় সবচেয়ে হতভাগী মানুষটা আমি!

ফখরুল আলম কথা বললেন না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কোহিনূর ফিসফিস করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, কেন এই দুনিয়ার সবচেয়ে হতভাগী মানুষটা আমি জানেন?

ফখরুল আলম তাও জবাব দিলেন না। তিনি আসলে জানেন না। এই জগতের কতটুকুই বা তিনি জানেন?

কোহিনূর বললেন, কারণ, এই দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো মানুষটা আমার। কিন্তু কোনোদিন তারে আমি আমার ভাবতে পারি নাই। কোনো দিন না। আমি কত বড় হতভাগী আপনি বুঝছেন?

ফখরুল আলম আসলে বোঝেননি। এত ভারি ভারি কথা তিনি বোঝেন। তিনি সহজ মানুষ, সহজ কথা বোঝেন। কোহিনূর বললেন, বাকি জীবনটা আমি আর আপনারে পর ভাবতে চাই না। আমি আপনারে আমার নিজের চেয়েও আপন ভাবতে চাই। আপনি দিবেন? আপনি আমারে আপনারে একটুখানি দিবেন?

ফখরুল আলম বুঝতে পারছেন না তিনি তাকে কীভাবে কোহিনূরকে দিবেন? কোহিনূর এসব কি আবোল-তাবোল বকছে! তিনি এও বুঝতে পারছেন না, কোহিনূরের এসব আবোল-তাবোল শুনে তার কান্না পাচ্ছে কেন! তার গাল বেয়ে পানি নামছে! ফখরুল আলম কোহিনূরকে ছেড়ে দিয়ে হন্যে হয়ে এ পকেট থেকে ও পকেট রুমাল খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু রুমাল কোথাও পেলেন না। কী লজ্জার কথা। তিনি এই ছাদে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। কেউ দেখলে কি বলবে? আচ্ছা, তিনি কি কোহিনূরের শাড়ির আঁচল দিয়ে তার চোখ মুছবেন? কোহিনূর কিছু বলবে না তো?

ফখরুল আলম সাহস করে কোহিনূরের শাড়ির আঁচলের দিকে হাত বাড়ালেন।

*

হেমাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো নয় মাস পর। তার অবস্থার অবশ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন, হাসপাতালে রেখে আলাদা কোনো চিকিৎসার সুযোগ নেই। তার চেয়ে হেমার পরিচর্যার জন্য একজন নার্স রেখে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসাটাই ভালো। আসলাম সাহেবও শেষ অবধি ভেবে দেখলেন, সে-ই ভালো। রেণুর কথামতো আগের ফ্ল্যাটটিই তারা ভাড়া নিয়েছেন। কিন্তু হেমাকে বাসায় নিয়ে আসাতে ধকল পোহাতে হলে আরো অনেক। এতদিন কোনো বিপদে-আপদে দেখা না পাওয়া আত্মীয়-স্বজনরা হঠাৎ হই হই করে তেড়ে আসলেন। তাদের প্রধান আপত্তি, স্বামী-স্ত্রী না হয়েও এভাবে এক ছাদের নিচে তো বসবাস করতে পারেন না রেণু আর আসলাম সাহেব! বিষয়টি অবশ্য রেণু বা আসলাম সাহেব, কারো মাথাতেই ছিল না। শেষ অবধি নিয়ম-কানুন মেনে নতুন করে আবার বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারতে হয়েছে তাদের।

.

নয়নকে অবশ্য বহুদিন আর কোথাও দেখা গেল না। আসলাম সাহেব কয়েকবার নয়নের খোঁজ করার চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু পাননি। নয়নের দেখা মিলল দীর্ঘ আড়াই বছর পর। সে দাঁড়িয়ে আছে একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে। ল্যাম্পপোস্টটার মাথার উপরে ডালপালা ছড়ানো একটা সবুজ সজনে গাছ। সজনে গাছের সবুজ পাতার গা ঘেঁষে একটা ভোলা বারান্দা। বারান্দার ওপাশের দেয়ালে একটা দরজা। সেই দরজার ওপাশে যে ঘরখানা রয়েছে, সেখানে একখানা খাট। সেই খাটে তখনও ঠিক দুইবছর আগে যেভাবে শুয়েছিল, ঠিক একইভাবে শুয়ে আছে হেমা। একটা জড় খাট, কিংবা একটা চেয়ার, টেবিল, কিংবা একখানা ছবির ফ্রেমের মতো। জড়, অসাড়। এই বাড়ির আর কোনো কিছুই বদলায়নি। সারাদিনের কাজ শেষে রোজ রাতে, এই ঘরখানা হয়ে ওঠে অদ্ভুত এক জগৎ। রেণু ফিসফিস করে হেমার সাথে কথা বলেন। ডাকেন, মা, মারে। ও মা। মা, মাগো।

সেই ডাক হেমা শুনতে পায় কিনা বোঝা যায় না। তবে আসলাম সাহেব শুনতে পান। তিনি আলতো করে রেণুর কাঁধে হাত রাখেন। রেণু সেই হাত সরিয়ে দেন না। তিনি হাত তুলে তার কাঁধের উপর রাখা আসলাম সাহেবের হাতখানা ধরেন। তারপর ফিসফিস করে বলেন, আল্লাহ কি সত্যি সত্যি জীবনের বিনিময়ে জীবন ফিরিয়ে দেন?

আসলাম সাহেব রেণুর প্রশ্নের জবাব দেন না। তিনি শক্ত করে রেণুর হাত চেপে ধরেন। রেণু বলেন, ম্রাট বাবরের জীবনের বিনিময়ে আল্লাহপাক তার সন্তান হুমায়ূনের জীবন ফিরিয়ে দেননি?

আসলাম সাহেব কী জবাব দিবেন? রেণু বললেন, আমি আমার জীবনের বিনিময়ে আমার মেয়ের জীবন ফিরে পেতে চাই।

আসলাম সাহেব ডাকলেন, রেণু!

রেণু বললেন, আমাকে কি করতে হবে তুমি বলো।

আসলাম সাহেব এবার কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, আমি জানি না, রেণু। আমি জানি না। আমি কিছু জানি না।

তিনি দু’হাতে রেণুকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। এই কান্নার গল্পরা চলতেই থাকে। রোজ রাতের গভীর অন্ধকারে এই কান্নার জলে লেখা হতে থাকে জগতের তীব্রতম কষ্টের গল্প। সেই গল্প এই চিরবঞ্চিত, চির দুঃখী দুজন বাবা-মা ছাড়া জগতের আর কেউ জানে না। কেউ না। নাকি জানে? হয়তো জানে। জানে রাতের এই গভীর কালো অন্ধকার আর দুর্ভেদ্য দেয়াল। কিন্তু সেই অন্ধকার আর দুর্ভেদ্য দেয়ালের কি সাধ্য আছে এই গল্প বোঝার?

নয়নের সাথে আড়াই তিন বছর বয়সের ছোট্ট ফুটফুটে এক মেয়ে এসেও মাঝে-মধ্যে ওই সজনে গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটার নাম অপেক্ষা। অপেক্ষার নাম রেখেছে তার মামা নয়ন। তার মা পারুলেরও অবশ্য নামটা ভীষণ পছন্দের। পারুলের মামলার রায় হয়েছে। শেষ অবধি তার ফাঁসি হয়নি। তার সাজা হয়েছে যাবজ্জীবন।

বয়সের তুলনায় অপেক্ষা খানিক বেশিই চুপচাপ। খানিক গম্ভীরও। সে কিছু কথাও বলতে পারে। তবে তা কেবল তার মর্জি হলেই। না হলে নয়। সে নয়নকে মাঝে-মধ্যে ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে জিজ্ঞেস করে, আমরা এখানে কি করি?

নয়ন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, অপেক্ষা।

অপেক্ষা তার মধ্যাঙ্গুলি উঁচু করে নিজের দিকে ইশারা করে নিজেকে দেখিয়ে বলে, আমি?

নয়ন বলে, হু।

অপেক্ষা নয়নের কথা বুঝতে পারে না। তবে সে মুখ ফুটে আর কিছু বলেও না। সেও নয়নের মতো চুপচাপ তাকিয়ে থাকে তার মাথার উপরের বারান্দাটার দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার ঘাড় ব্যথা হয়ে যায়। ঘুম পেয়ে যায়। সে ঘুমিয়েও পড়ে। ঘুমন্ত অপেক্ষাকে বুকে চেপে নয়ন সারা শহর ঘুরে বেড়ায়। তার একটুও কষ্ট হয় না। সে একটা জিনিস আবিষ্কার করেছে, আজকাল অপেক্ষাকে ছাড়া হাঁটতে তার কষ্ট হয়। মনে হয় তার শরীরের একটা কোনো অংশ বোধহয় তার সাথে নেই। নিজেকে কেমন অপরিহার্য কোনো অঙ্গহীন মানুষ মনে হয় তার।

মাঝে-মধ্যে অপেক্ষাকে নিয়ে পারুলের সাথে দেখা করতে যায় সে। কিন্তু পারুলের প্রতি অপেক্ষার আগ্রহ তেমন নেই। সে নয়নের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকায়। নয়ন পারুলকে হাতের ইশারায় দেখিয়ে বলে, মা। মা।

অপেক্ষা পারুলের দিকে খানিক তাকিয়ে থাকে। তারপর নয়নের দিকে মুখ ফিরিয়ে নয়নের শরীরের সাথে মিশে যেতে যেতে আহ্লাদি গলায় বলে, মামা?

নয়ন মা দুটোকে ভেঙে আলাদা করে দিয়ে বলে, মা…। এইটা তোমার মা।

অপেক্ষা আবার একইভাবে পারুলের দিকে তাকায়। তারপর আবার একইভাবে নয়নের দিকে মুখ ফিরিয়ে তার শরীরের সাথে মিশে গিয়ে আহ্লাদি গলায় বলে, মামা।

পারুল অবশ্য এতে মন খারাপ করে না। সে বরং মুগ্ধ চোখে তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। আচ্ছা, আজ থেকে কুড়ি বছর পর, এই মেয়েটা কত বড় হবে? সে যখন যাবজ্জীবনের সাজা শেষ করে জেল থেকে বের হবে, তখন কি তার মেয়ে তাকে চিনবে? নাকি এমন করেই মুখ ফিরিয়ে নেবে? পারুলের ধারণা, নেবে না। জগতে মায়ের কষ্ট সবচেয়ে বোঝে মেয়েরা। তার মেয়েও নিশ্চয়ই তার কষ্ট বুঝবে। কিন্তু রাজীব? রাজীব কি সত্যি সত্যিই কখনো আসবে না? না আসলে না আসুক। এই যে তার মেয়ে, এই এক অপেক্ষা আছে। সে আবার আসবে। তাকে এক চোখ দেখার অপেক্ষা নিয়েই পারুলের সপ্তাহ কেটে যায়। মাস কেটে যায়। বছর কেটে যায়। তবে পারুলের বিশ্বাস, রাজীব একদিন না একদিন আসবেই। সে সবাইকে চমকে দিয়েই চলে আসবে। পারুলের আজকাল খুব অস্থির লাগে। সে শুনেছে, জেলখানার বছরের হিসেব বারো মাসে হয় না, হয় নয় মাসে। আর যাবজ্জীবন সাজাও সেই অর্থে যাবজ্জীবন নয়। নানান হিসেব-নিকেশ শেষে তা বছর কুড়িতে এসে ঠেকে। ইশ কুড়িটি বছর যদি এক ছুঁয়ে চলে যেত তার!

কিন্তু যায় না। সময় কারো অপেক্ষায় যেমন থাকে না। তেমনি কারো অপেক্ষায় সে চলেও যায় না। সে যায় তার নিজের মতো।

সেদিন রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল নয়ন। একটা বিশাল নদী। নদীর ধারে বিশাল বটগাছ। বটগাছের শেকড় ছড়িয়ে গিয়ে নদীর জল ছুঁয়েছে। ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ। সেই ঢেউয়ের ভেতর একখানা ছোট্ট নাও। নাওয়ের ডগায় বসে আছে অপেক্ষা। অপেক্ষাকে দেখতে লাগছে অনেক বড়। সে তাকিয়ে আছে জলের ভেতর। নয়নকে দেখে অপেক্ষা অবিকল তার মায়ের কণ্ঠে বলল, মামা, একটা মেয়ে না নৌকা থেকে লাফিয়ে পানিতে পড়ে গেছে।

নয়ন বলল, নৌকা থেকে লাফিয়ে কে পানিতে পড়বে?

অপেক্ষা ভয়ার্ত গলায় বলল, আমি তো জানি না মামা।

নয়ন বলল, না জেনে কথা বলবে না। এই নৌকায় তো আর কেউ ছিল না যে পানিতে লাফিয়ে পড়বে।

অপেক্ষা বলল, ছিল মামা। তুমি দেখতে পাওনি।

নয়ন বলল, কে ছিল?

অপেক্ষা বলল, একটা মেয়ে মামা। সে নৌকার মেঝেতে শুয়ে লুকিয়ে ছিল। তোমাকে আসতে দেখেই সে লাফিয়ে পড়েছে পানিতে। তুমি তাকে বাঁচাও মামা।

নয়ন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে অপেক্ষাকে বলল, আমি কি করে তাকে বাঁচাব?

অপেক্ষা বলল, তুমি পানিতে নামো মামা। নেমে তাকে পানি থেকে তোলো।

নয়ন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে খানিক হতবুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর হঠাৎ ঝাঁপ দিয়ে পানিতে নামল। কিন্তু পানিতে নেমেও নয়ন মেয়েটিকে কোথাও খুঁজে পেল না। কোথাও না। সে পানির নিচে ডুবে গিয়ে অবধি মেয়েটাকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু পেল না। কোথায় মেয়েটি?

এই মুহূর্তে নয়নের মনে হলো মেয়েটি পানিতে ভেসে উঠেছে। সে চিৎকার করে নয়নকে ডাকছে। নয়নের উচিত এখনই পানির উপরে ভেসে উঠে মেয়েটিকে তুলে ধরে তাকে নৌকায় বা তীরে উঠিয়ে নেয়া। কিন্তু নয়ন তা পারল না। এই এতক্ষণ পর নয়ন তার পানির নিচে ডুবে যাওয়ার কারণ খুঁজে পেল। তার হঠাৎ মনে হলো, সে তো আসলে সাঁতারই জানে না। সে সাঁতার না জেনেই অপেক্ষার কথা শুনে দুম করে পানিতে নেমে গিয়েছিল। এখন? এখন সে কি করবে? নয়ন আবিষ্কার করল তার দম ফুরিয়ে এসেছে। শরীর অসাড় হয়ে আসছে। সে প্রাণপণে চেষ্টা করল নিঃশ্বাস নিতে। কিন্তু পারল না। গল গল করে নাক আর মুখ দিয়ে পানি ঢুকে গেল। তার অসহ্য কষ্ট হতে লাগল। বুকের ভেতরটা হাঁসফাঁস করতে লাগল একটু বাতাসের জন্য। একটু তাজা হাওয়ার জন্য। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য। কিন্তু নয়ন পারল না। সে ক্রমশই নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকল। মৃত্যু! আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু তাকে গ্রাস করে নেবে। নয়ন চিৎকার করার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। তার হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। নয়ন চোখ বন্ধ করে ফেলল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সে দেখল, মাছের মতো সহজ, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সাঁতার কেটে কেটে একটা মেয়ে তার কাছে চলে এলো। তারপর আলতো হাতে তার হাত ছুঁয়ে দিলো। তারপর কি অদ্ভুত মিষ্টি করেই না হাসল! নয়ন সেই মুহূর্তে মেয়েটাকে চিনতে পারল, হেমা! হেমা বলল, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে নয়ন?

নয়ন বলল, হু।

হেমা বলল, আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে নয়ন।

নয়ন বলল, কিন্তু তুমি তো হাসছ!

হেমা বলল, আমি তো এমনই নয়ন।

নয়ন বলল, কেমন?

হেমা বলল, এই যে সারাটাজীবন বুকের ভেতর কষ্ট পুষেও হেসে যাওয়া মানুষ।

নয়ন বলল, তোমার এত কষ্ট কেন?

হেমা বলল, মানুষ বলে।

নয়ন বলল, মানুষ হলেই বুকের ভেতর কষ্ট পুষে রেখে হাসতে হয়?

হেমা বলল, হ্যাঁ হয়। জগতে আর কোনো প্রাণী তার রাগ, কষ্ট, ক্রোধ লুকিয়ে হাসতে পারে না। একমাত্র মানুষই পারে। নিজের ভেতরের অনুভূতি লুকিয়ে অন্যরকম অভিনয় করে বাঁচতে।

নয়ন বলে, কিন্তু আমি যে পারি না?

হেমা বলে, তুমিও পারো।

নয়ন বলে, কই? তোমার জন্য এই যে আমার এত কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু আমি তো কখনোই সেগুলো লুকিয়ে রাখতে পারি না।

হেমা বলে, জগতের সব মানুষ তো এক হয় না নয়ন।

নয়ন বলল, কিন্তু আমি তোমার মতো হতে চাই। তোমার মতো।

হেম বলল, আমি চাই না তুমি আমার মতো হও নয়ন। আমার মতো হওয়া অনেক কষ্টের।

নয়ন বলল, কষ্ট হলো হোক। তারপরও আমি তোমার মতো হতে চাই। শান্ত, স্থির, গভীর।

হেমা আবারো মিষ্টি করে হাসল। তারপর হাত বাড়িয়ে আলতো করে নয়নের গাল ছুঁয়ে দিলো। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই নয়নের মনে হলো তার শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক আবেশ ছড়িয়ে যাচ্ছে। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসতে লাগল। ঘুম, ঘুম, ঘুম। নয়ন তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

নয়নের ঘুম ভাঙল পরদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেলে। হেমার সুস্থ হয়ে ওঠার খবরটা সে পেল তারও দু’দিন বাদে। চার বছর এক মাস তেরো দিন পর হেমা কোমা থেকে উঠল। তাকে নিবিড় পরিচর্যায় রাখা হয়েছে হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালে থাকতে তার আর ভালো লাগছে না। তার খুব বাসায় যেতে ইচ্ছে করে। তারপর তার সেই একলার বারান্দাটায় চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করে। সজনে গাছগুলো কি পাতা ছেড়েছে? ঝুম বৃষ্টিতে সেই পাতাগুলো এখন নিশ্চয়ই গাঢ় সবুজ হয়ে উঠেছে। হেমার বুকের ভেতরটা কেমন তড়পায়। এত ভেবেও নিজেকে কেন সে অনুভূতিহীন করতে পারে না? মানুষ এমন কেন? একটা পাতার জন্য, একটা ফুলের জন্য, এক ফোঁটা শিশিরের জন্য, একটা কল্পনার নদী, খানিক মেঘ, একটা পাহাড়, খানিক বৃষ্টি, খানিক স্মৃতি, খানিক স্পর্শ কিংবা ভুলে যাওয়া একটা গোটা মানুষের জন্যও কেন তার মন কেমন করে!

মানুষ হয়ে জন্মানোর এই এক কষ্ট! সকলই কেমন বুকের ভেতর ডুবে ডুবে লুকিয়ে থাকে। তারপর সুযোগ পেলেই ভেসে ভেসে ওঠে। তারপর বানের জলের মতো সকল কিছু ভাসিয়ে দেয়।

.

নয়নের সাথে হেমার দেখা হলো তারও কিছুদিন পর। নয়নকে দেখে হেমা হাসল। অবিকল স্বপ্নে দেখা সেই হাসির মতো। তাদের মধ্যে কথাবার্তা হলো খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। নয়ন বলল, তুমি কি এখনো আমার ওপর রাগ করে আছ?

হেমা বলল, হু। রাগ করে আছি।

নয়ন বলল, এখনো?

হেমা বলল, হু।

নয়ন বলল, আমি রাগ ভাঙাতে কি করব?

হেমা বলল, কোনো এক নিকষ কালো বৃষ্টির দিনে আমার বারান্দাটার নিচে ভ্যানভর্তি করে কদমফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।

নয়ন বলল, আর কিছু?

হেমা বলল, হু।

নয়ন বলল, আর কি?

হেমা বলল, আমাকে একটা পুকুর কিনে দিবে। পুকুরের চারধার জুড়ে থাকবে অজস্র হিজল আর কদমফুলের গাছ। আমি সেই হিজল আর কদম ফুলের গাছের তলায় বসে থাকব। কোনো এক হিজল ফুলের দিনে পুকুর ভর্তি ভেসে থাকা হিজল ফুলের ভেতর পা ডুবিয়ে বসে আমি তোমাকে ডাকব। তারপর বলব, চলো বিয়ে করি ফেলি।

নয়ন বলল, এত সব আমি কই পাব? আর পেলেও, অতদিন পর্যন্ত আমি দেরি করতে পারব না। আগে বিয়ে করি ফেলি? তারপর না হয় খুঁজে দিব।

হেমা বলল, কিন্তু তুমি যদি তখন তোমার কথা না রাখো?

নয়ন বলল, রাখব।

হেমা বলল, কি করে বুঝব?

নয়ন বলল, বুঝবে।

হেমা হাসল। নয়নও।

.

তারপর কোনো এক তুমুল বৃষ্টির অন্ধকার দুপুরে হেমা হঠাৎ বারান্দায় নিচে তাকিয়ে চমকে গেল। নয়ন দাঁড়িয়ে আছে নিচে। তার পাশে একটা ভ্যান। ভ্যানভর্তি অসংখ্য কদম ফুল। কদমফুলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট ফুটফুটে এক মেয়ে। সে তাকিয়ে আছে হেমার দিকে। হেমার চোখে চোখ পড়তেই সে হাত ইশারা করে হেমাকে ডাকল। একবার, দুইবার, তিনবার। হেমা হঠাৎ পাগলের মতো ঘরে ঢুকল। তারপর তার সেই গাঢ় নীল শাড়িটা সে ঝটপট পরে ফেলল। তারপর পাগলের মতো সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো নিচে। ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। হেমা তার হাত ধরে ভ্যানের মাঝখানটায় উঠে বসল।

তুমুল বৃষ্টিতে অদ্ভুত সুন্দর এক দৃশ্য! নীল শাড়ি পরা অদ্ভুত সুন্দরী এক তরুণী বসে আছে খোলা ভ্যানে। তার পাশে বসে আছে ফুটফুটে পরীর মতো এক শিশু। তাদের চারপাশ ছেয়ে আছে অজস্র শুভ্র হলুদাভ কদমফুলে। এক অদ্ভুত তরুণ ঘোরগ্রস্তের মতো সেই ভ্যান চালিয়ে নিচ্ছে। সে মাঝে-মধ্যেই মাথা ঘুরিয়ে পেছন ফিরে চাইছে। পেছনে তাকাতেই তার চোখ পড়ে যাচ্ছে তরুণীর চোখে। তরুণী মিষ্টি করে হেসে বলছে, ভেজা শাড়ির মেয়েদের দিকে অমন করে তাকাতে নেই জানো না?

তরুণ লজ্জা পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তার খুব ইচ্ছে করছে তরুণীর পাশে গিয়ে বসতে। তার হাতখানা হাতের ভেতর মুঠোবন্দি করে এই তুমুল বৃষ্টিতে ভেসে যেতে। কিন্তু সাহস করে এই কথা সে তরুণীকে বলতে পারছে না। এত সাহস তার নেই। সে কী তরুণীকে ভয় পায়? হয়তো পায়। আর পায় বলেই সে ডাকাত হতে পারে না, সে হয় চোর। সে চোরের মতো চুরি করে বারবার তরুণীর দিকে তাকাচ্ছে। তার আশা, তরুণী যদি হঠাৎ করেই তাকে ডাকে। ডেকে যদি বলে, এসো।

নয়ন হেমার সেই ডাকের অপেক্ষায় আছে। সে উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষায় আছে হেমার ছোট্ট সেই ডাকটির। তারা শহর ছাড়িয়ে চলে এসেছে খানিক নির্জন জায়গায়। এখানে চারধারে খোলা মাঠ। বিস্তৃত আকাশ। আকাশ জুড়ে মেঘ। মেঘ জুড়ে বৃষ্টি। চরাচর ভাসিয়ে নেয়া বৃষ্টি। নয়নের হঠাৎ মনে হলো, হেমা তাকে ডাকছে। নয়ন ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে হেমা মিষ্টি করে হেসে নয়নের দিকে হাত বাড়ি তাকে ডাকল, এসো।

নয়নের হঠাৎ মনে হলো তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তার যে কেমন লাগতে লাগল! মনে হলো বুকের ভেতর হাজারটা প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে। ফুরফুরে হাওয়ারা আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে বুকের গহীন। সে রাস্তার পাশে ভ্যানখানা থামাল। তারপর নেমে এলো ভ্যান থেকে। তার সামনে তখনও হাত বাড়িয়ে বসে আছে বৃষ্টিভেজা নীল শাড়ির এক অপরূপ রূপবতী তরুণী। এই তরুণীর নাম হেমা। সে হেমার দিকে এগুতে লাগল। প্রবল বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে দষ্টি। সেই ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টির বৃষ্টিতে নয়ন হেমার হাত ছুঁয়ে দিলো। হেমা শক্ত করে নয়নের হাতখানা ধরে ফেলল। নয়নের আচমকা মনে হলো, এই দৃশ্য সত্যি তো? সত্যিই হেমা তার পাশে বসে আছে তো? সত্যিই কি সে শক্ত করে তার হাত ধরে এই তুমুল বৃষ্টির বিকেলে তার পাশে বসে রয়েছে? এই এত এত কষ্ট, এত এত দুঃসহ দিন রাত্রির অবর্ণনীয় অপেক্ষার কি সত্যি সত্যিই অবসান ঘটেছে? নাকি এর সকলই স্বপ্ন? নাকি এর সকলই মিথ্যে কল্পনা? নাকি আরো একবার এই সকল কিছুই তার মস্তিষ্কের কষ্ট কল্পিত কোনো সৃষ্টি? নাকি সকলই বিভ্রম?

বিভ্রম? নয়ন জানে না। জানে না কেউই।

কে জানে, হয়তো এই বিভ্রম আর অপেক্ষার নামই মানবজনম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *