৬. বোকা বোকা লাগছে

সব শুনে নিজেকে বোকা বোকা লাগছে নয়নের। শুধু বোকা বোকই না, নিজেকে গাধা টাইপ প্রাণী মনে হচ্ছে। এই সহজ জিনিসটা তার মাথায় ঢোকে নি! অথচ সে কিনা কতকিছু ভেবে বসেছিল! আসলে আতঙ্ক মানুষকে দিশেহারা করে ফেলে। এই জন্যই বোধহয় বলা হয়, রজ্জুতে সর্পভ্রম। ভয়ে দড়িকেও মানুষ সাপ ভেবে ভুল করে। পরদিন সন্ধ্যাবেলা নয়ন একটা ভীত সন্ত্রস্ত শিশুর মতো মায়ের ঘরে গিয়েছিল। মায়ের ঘর অন্ধকার। কোহিনূর তখন কেবল মাগরিবের নামাজ পড়ে অন্ধকারে জানালার পাশে বসেছিলেন। নয়ন চুপচাপ গিয়ে মায়ের পাশে বসে রইল। কোহিনূর হঠাৎ আলতো করে নয়নের মাথার চুলে হাত রেখে বললেন, কি হয়েছে?

নয়ন সাথে সাথে জবাব দিতে পারল না। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। কিন্তু সে নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করেছে, এই কান্নার প্রবণতাটা তাকে ছাড়তে হবে। আজকাল কোনোকিছু হলেই তার কেবল কান্না পায়। সে মানুষ হিসেবে যথেষ্টই শক্ত। বয়সও কম হয়নি তার। এই বয়সে এমনটা মানায় না। তাছাড়া, আগে আর কখনোই এমন ছিচকাদুনে স্বভাবের ছিলও না সে। কিন্তু আজকাল কি জানি কী একটা তার হয়েছে! যা তাকে ভেতরে ভেতরে ক্রমশই দুর্বল করে দিচ্ছে। হয়তো এমন কোনো একটা কিছু সে বুকের ভেতর পুষে বেড়াচ্ছে, যার ভার বহন করবার ক্ষমতা তার একার নেই। কিন্তু সেটি সে কাউকে বহন করতে দিতেও পারছে না। ফলে প্রতিমুহূর্তে একটু একটু করে দুর্বল হয়ে পড়ছে সে। ভেঙে পড়ছে। এটা দুর্বল মানুষের লক্ষণ। সে মোটেই দুর্বল মানুষ হতে চায় না। কিন্তু তার চারপাশের পরিবেশ, পরিস্থিতি, ঘটনা তাকে ক্রমশই দুর্বল করে ফেলছে!

কোহিনূর স্বাভাবিক গলায় বললেন, রাতে ঘুমের মধ্যে খুব দুঃস্বপ্ন দেখিস আজকাল?

নয়ন অন্ধকারেই ঝট করে মায়ের দিকে তাকাল। তারপর বলল, তুমি কি করে জানলে?

কোহিনূর বললেন, প্রায় প্রতিরাতেই ঘুমের ঘোরে তোর চিৎকার শুনি। কয়েকদিন বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েও থেকেছি।

নয়ন কোনো কথা বলল না। কোহিনূর বললেন, স্বপ্নে কি দেখিস তুই?

নয়ন বলল, একটা বৃদ্ধ লোক।

কোহিনূর বললেন, আর?

নয়ন বলল, মানুষটার খুঁতনিতে দাঁড়ি আছে। কিন্তু চোখ আর নাক নেই। শুধু মুখ আছে।

কোহিনূর বললেন, মানুষটা কি করে?

নয়ন বলল, তার মুখ থেকে সরু লম্বা একটা জিভ বের হয়ে আসে। লকলকে সাপের মতো। আমি মানুষটার থেকে বহুদূরে কিন্তু তার সেই জিভ বড় হতে হতে অনেক বড় হয়ে যায়। তারপর সে তার সেই সাপের মতো জিভটা দিয়ে আমার গালে ছোবল দিতে আসে। আমি তার জিভের স্পর্শ স্পষ্ট টের পেয়েছি। গালের উপর একটা শিরশিরে অনুভূতিও।

নয়নের শরীর কাঁপছে। কোহিনূর তার এতদিনের চেনা ছেলেকে দেখে ভারি অবাক হয়েছেন। তিনি আলতো করে নয়নের কাঁধে হাত রাখলেন। তারপর বললেন, এর চেয়েও ভয়ঙ্কর স্বপ্ন মানুষ দেখে। আমিও দেখি। স্বপ্ন নিয়ে এত ভয় পাওয়ার কি আছে?

নয়ন বলল, মা তুমি জানো না, এরপর কী ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে?

কোহিনূর বললেন, কি ভয়ঙ্কর ঘটনা?

নয়ন বলল, আমি ঘুম থেকে জেগে দেখি আমার গাল ভেজা। গালে সেই জিভ থেকে ঝরে পড়া ঠান্ডা আঠালো ভেজা জিনিসটা।

কোহিনূর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, তুই কাত হয়ে ঘুমিয়েছিলি?

নয়ন বলল, সেটা তো মনে নেই। তবে আমি তো কাত হয়ে ঘুমাতে পারি না।

কোহিনূর বললেন, কেন কাত হয়ে ঘুমাতে পারিস না জানিস?

নয়ন বলল, ছোটবেলা থেকে অভ্যাস।

কোহিনূর বললেন, আরো একটা ব্যাপার আছে। তুই কাত হয়ে ঘুমাতে পারতি না ছোটবেলা থেকেই। কারণ কাত হয়ে ঘুমালেই তোর মুখ থেকে ঠোঁট বেয়ে লালা গড়িয়ে পড়ত। এমন অনেক বাচ্চাদেরই ছোটবেলা হয়। বড় হয়ে গেলে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়। কারো কারো হয় না। তোর ঠোঁটের কোণা, গাল, বালিশ ভিজে যেত। যেদিন দুঃস্বপ্ন দেখলি, সেদিন সম্ভবত প্রচণ্ড ক্লান্ত ছিলি, আর কাত হয়ে শুয়ে পড়েছিলি। তারপর ঠোঁটের কোল বেয়ে লালা ঝড়ে পড়েছে তোর গালে, বালিশে। আর স্বপ্নে এমন তো হয়ই। ধর তুই দেখলি যে বৃষ্টি হচ্ছে, সেই বৃষ্টির পানির ফোঁটা পড়ছে তার গালে। তুই ঘুম ভেঙে চোখ মেলে দেখবি কেউ একজন তোর ঘুম ভাঙানোর জন্য তোর গায়ে পানি ছেটাচ্ছে। এমন হয় না? ওইদিন তুই কোনো কারণে কাত হয়ে শুয়ে পড়েছিলি, আর অমনি তোর ঠোঁট গড়িয়ে লালা ঝড়ছিল, আর সেটা তুই স্বপ্নে দেখেছিস ওইভাবে। তাপর ঘুম ভেঙেই দেখলি তোর গাল ভেজা। দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে গেল। কোনো কারণে মনে মনে খুব কষ্ট পাচ্ছিলি। সাথে বাজে একটা স্বপ্ন, আর ঘুম ভাঙতেই দেখলি গাল ভেজা। সব একদম মিলে গেল। এই মুহূর্তগুলা আর কিছু ভাবার সুযোগই দেয় না। আপনাআপনিই সব ধরে নেয়। মিলিয়ে নেয়।

নয়নের বিশ্বাস হচ্ছে না, তার দেখা সেই গা শিউড়ে ওঠা স্বপ্নের ব্যাখ্যা এত সহজ, এত সাধারণ! কিন্তু সে তার মায়ের কথা শুনে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছে। মায়ের ব্যাখ্যাটা অতি সহজ সাধারণ হলেও এই ব্যাখ্যা সে ফেলেও দিতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে, মায়ের কথায় যুক্তি আছে এবং আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, তার এখন মনে হচ্ছে, আসলেই সে সেদিন কাত হয়ে শুয়েছিল। আর সেই ঠান্ডা তরলটা তার মুখের লালাই ছিল। কিন্তু গালের ঘায়ের ব্যাপারটা?

নয়ন উঠে গিয়ে আলো জ্বাললো। তারপর মায়ের কাছে গিয়ে বলল, এই দেখো। সকাল থেকেই সেই গালটাই এমন লাল হয়ে ঘা হতে শুরু করল।

কোহিনূর অনেক সময় নিয়ে নয়নের গাল দেখলেন। তারপর বললেন, তুই না ডাক্তার? ওষুধ লাগাসনি কেন?

নয়ন বলল, আমি জানি না মা। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি। প্রচণ্ড ভয়। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। কিছু কাজ করছে না। তুমিই বলল, তাহলে গালে এই দাগটা কীভাবে এলো?

কোহিনূর খানিক চুপ করে থেকে মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, বুঝেছি। পরশু সকালে বুয়া তোর ঘর ঝাড় দিতে গিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করে শেষ!

নয়ন অবাক গলায় বলল, কেন?

কোহিনূর তার হাতের মধ্যম আঙুলখানা দেখিয়ে বললেন, এই সাইজের একটা বিছা পেয়েছে তোর ঘরে। আমাদের গ্রামে এই বিছাকে বলে ছ্যাঙ্গা। দেখতে বীভৎস! তুই তো জানিসই, এগুলো বিষাক্ত। যেখানে ছোয়, ঘা হয়ে যায়। ওটা সম্ভবত তোর গালে লেগেছিল। বললি না, স্বপ্নের মধ্যে মনে হচ্ছিল গালে সুরসুরানি হচ্ছে! এইজন্যই ঘা হয়েছে।

মায়ের কথা শুনে নয়নের নিজের উপর এত বিরক্ত লাগতে লাগল। পুরো বিষয়টাকেই এখন হাস্যকর লাগছে তার কাছে! সাথে নিজেকেও। এই সামান্য বিষয়টাকে ভয়ের মাথায় সে কি-ই নাকি ভেবেছিল! তবে মায়ের দিকে তাকিয়ে মায়ের এমন নির্বিকার স্বাভাবিক মুখ দেখে নয়নের এই প্রথম মনে হতে লাগল, ফতেহপুর নামের সেই অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নেয়া এই মেয়েটি সাধারণ কোনো মেয়ে নয়। সে আসলেই সেই গাঁয়ের আর সকলের চেয়ে আলাদা ছিল। আর জন্যই অন্যদের কাছে সে ক্রমশই হয়ে উঠেছিল অস্বাভাবিক এক মানুষ। কিন্তু ভুল সময়ে, ভুল জায়গায়, ভুল পরিস্থিতিতে জন্মেছিলেন এই মানুষটা। মায়ের প্রতি এক অন্যরকম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় যেন সে নতুন দৃষ্টি মেলে তাকাল। এই মাকে যেন সে এতদিন দেখেনি। দেখেছে অন্য কোনো মাকে। বা এই মাকে পেতে হলে যে আবিষ্কার করতে হয়, তা যেন সে জানতোই না। আজ মায়ের সামনে তার নিজেকে মনে হচ্ছে ছোট্ট এক শিশু। এই অনুভূতিটা মা তাকে দিয়েছেন, হঠাৎ করেই আবিষ্কার হওয়া তার বিশালত্বে। মা তাকে আজ পুরোপুরি চমকে দিয়েছেন। কিন্তু তখনও আরো চমকে যাওয়া বাকি ছিল নয়নের।

কোহিনূর নয়নের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, এই পৃথিবীতে মানুষের কাজ কি জানিস?

নয়ন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে আজ আর কিছু বলতে চায়। না। আজ সে শুধু শুনতে চায়, দেখতে চায়। তার সামনে এই এত এত বছর। ধরে অনাবিষ্কৃত হয়ে থাকা অপার রহস্যের আঁধার এই মানুষটাকে আজ সে যতটা সম্ভব আবিষ্কার করতে চায়।

কোহিনূর বললেন, এই পৃথিবীতে মানুষের কাজ তার প্রিয় মানুষকে খুশি করা। ভালো রাখা। ধর বাবা-মার কাছে সন্তান যতটা প্রিয়, সন্তানের কাছে কিন্তু বাবা আবার ঠিক ততটুকু প্রিয় না। একটু কমবেশি আছে। সন্তানদের হয়তো বয়স কম হবার কারণে মনোযোগ দেয়ার আরো অনেক কিছু থাকে। কিন্তু বাবা মায়ের মনোযোগের পুরোটাই কিন্তু সন্তান। তো বাবা-মা কি করেন? তারা তাদের সবটা সাধ্য দিয়ে সন্তানদের খুশি করার চেষ্টা করেন। ভালো জামা, খাবার, শখ পূরণ করা। যে যেভাবে পারেন। আবার সন্তান হয়তো তার স্ত্রী বা প্রেমিকার জন্য করে। বা তারপর তার সন্তানদের জন্য। এইটাই জগতের নিয়ম। এইটাই এই পৃথিবীতে মানুষের কাজ।

কোহিনূর থামলেন। নয়ন কোনো কথা বলল না। সে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সে বোঝার চেষ্টা করছে, এসব মা কেন বলছেন!

কোহিনূর বললেন, পৃথিবীতে এই সাধারণ জিনিসটার বাইরে আর বেশিকিছু ভাবার দরকার নেই। তাহলে সবকিছু জটিল হয়ে যায়।

কোহিনূর থামলেও নয়ন কথা বলল না। কোহিনূরই বললেন, তুই আসমার বিষয়টা নিয়ে খুব মানসিক যন্ত্রণায় আছিস তাই না?

নয়নের মনে হলো, সে এই মুহূর্তেই মাকে তার বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা সকল কথা বলে দিবে। কথাগুলো মায়ের জানা দরকার এবং এই কথা বলার এর চেয়ে ভালো সময় সুযোগ আর হবে না। সে বলল, মা, আসমার বিষয়ে একটা কথা তোমাকে আমি লুকিয়েছিলাম।

কোহিনূর সেই একই নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, জানি।

নয়ন আবারো চমকে উঠল। সে বলল, কি জানো তুমি!

কোহিনূর বললেন, জানি মানে আন্দাজ করতে পারি। ওর পেটে কি বাচ্চা টাচ্চা কিছু ছিল?

নয়ন এবার ভয় পেয়ে গেল। খানিক আগের মাকে আচমকা তার আবার কেমন অদ্ভুত লাগছে! আবার সেই আসমার মুখে শোনা ফতেহপুর গ্রামের রহস্যময় বালিকা কোহিনূর মনে হচ্ছে! নয়ন কাঁপা গলায় বলল, তুমি কীভাবে জানো মা?

কোহিনূর সেই আগের মতোই নির্বিকারভাবে বললেন, আমার বাড়ি ফতেহপুর বলে জানি। আমার নাম কোহিনূর বলে জানি। আমার জায়গায় আর যে কেউ হলে সেও জানত।

কোহিনূর সামান্য থেমে হাত বাড়িয়ে জানালার পাল্লাটা টেনে দিলেন। তারপর বললেন, আসমা এখান থেকে বাড়ি গেল। যাওয়ার পরপরই তাকে সাপে কাটল। তার বিষ নামাতে আসল আব্দুল ফকির নামে এক ওঝা। আমি আসমার বাবার সাথে কথা বলছি, আব্দুল ফকির তিন-দিন তিন-রাত ধরে নাকি তার বিষ নামিয়েছে। তার দুই-তিন মাস পর সে গ্রামে থেকে আসল। তখন থেকেই আসমার কিছু কিছু আচরণে আমার একটা সন্দেহ হয়েছিল। ভাবছিলাম, একদিন আসমাকে নিয়ে বসব। নিশ্চিত হওয়ার একটা বিষয় ছিল। কিন্তু সেটা নিশ্চিত হলাম সে আত্মহত্যা করার পর। আব্দুল ফকিরকে যারা খুব কাছ থেকে চেনে। তার আসল রূপ যারা জানে, তাদের জন্য এটা বোঝা এমন কোনো কঠিন ব্যাপার না।

নয়ন চুপ করে রইল অনেকটা সময়। কোহিনূরও। মাকে আরো একটা কথা বলার আছে নয়নের। তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন এবং বীভৎসতম কথাটা। কথাটা মা জানে। কিন্তু কথাটা যে নয়ন নিজেও জানে, সেটা মাকে জানানো দরকার। কিন্তু এই প্রায় চার-পাঁচ মাসেও কথাটা বলার শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি নয়ন। কাউকেই। সে প্রতিটি মুহূর্তে নিজের সাথে যুদ্ধ করে গেছে। প্রতিটি মুহূর্তে হেরে গেছে। বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এক প্রাণোচ্ছল, বুদ্ধিমান, স্বপ্নবাজ তরুণ থেকে রোজ একটু একটু করে ক্ষয়ে ক্ষয়ে ক্রমশই একটা জীবন্ত মমি হয়ে গেছে! কথাটা তার বুকের ভেতর থেকে থেকে ঘূণ পোকার মতো তাকে খেয়ে চলেছে। সে জানে, এই জনমে এর থেকে মৃত্যুর আগ অবধি তার আর নিস্তার নেই। কিন্তু এই সত্যটা নিয়েও সে কারো সামনে দাঁড়াবার শক্তি অর্জন করতে পারেনি। সেই শক্তি অর্জন করতে গত পাঁচটা মাস সে নিজের সাথে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু পারেনি।

কিন্তু আজ এই মুহূর্তে সে অবশেষ যেন সেই সাহসটুকু করতে পারল। সেই বীভৎস সত্যটা নিয়ে তার মায়ের সামনে দাঁড়ানোর সাহস! সে ঠান্ডা কিন্তু স্থির গলায় মাকে বলল, আমি তোমাকে আরেকটা কথা বলতে চাই মা!

কোহিনূর সাথে সাথে জবাব দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ঠিক আগের সেই নির্বিকার গলায়ই বললেন, তুই কি বলবি সেটা সম্ভবত আমি জানি নয়ন।

এই কথাটুকু বলতে নিজেকে প্রাণপণে শান্ত রাখতে গিয়েও কি শেষ অবধি গলাটা সামান্য কেঁপে উঠল কোহিনূরের?

নয়ন বলল, তুমি কি করে সব জানো মা? তুমি কি করে জানো যে আমি কি বলব?

কোহিনূর চান না তার ভেতরে কি চলছে, তা নয়ন দেখুক। তিনি যতটা সম্ভব তার গলা স্বাভাবিক রেখে বললেন, আমি প্রত্যেকটা দিন তোর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি। তুই যে কষ্ট পাচ্ছিস, তা আমি দেখেছি। আমি প্রত্যেকটা রাত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোর কান্না শুনি। তুই দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠিস, সব আমি তোর জানালার পাশে বসে শুনি। আমার কি যে কষ্ট হয়, কি যে কষ্ট! কিন্তু আমি কষ্টটা পেতে চাইতাম। কষ্ট তুই একা কেন পাবি! যেভাবেই হোক, তোর এই অসহ্য কষ্টের পেছনে কোনো না কোনোভাবে আমিও তো দায়ী। কিন্তু কি করব আমি! এতটা বছর এই ভয়াবহ মিথ্যেটা চেপে রেখে আমি তোর সামনে কীভাবে যাব? পৃথিবীর আর সব কাজ করার সাহস আমার আছে, শুধু এই একটা কাজ করার সাহস আমার নেই।

নয়ন হঠাৎ হাত বাড়িয়ে মায়ের হাতটা তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। কোহিনূরের হাতখানা কাঁপছে। কোহিনূর বললেন, তুই যে আমার লেখা খাতাগুলো পেয়েছিস তা আমি জানতে পেরেছি অনেক পরে। ওই খাতাগুলার কথা আমি ভুলেই গেছিলাম। তারপর যখন বুঝলাম তুই সব জেনে গেছিস…

কোহিনূর আর কথা বলতে পারলেন না। প্রবল কান্নায় তার গলা বুজে এলো। কিন্তু তিনি কাঁদলেন না। যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে তিনি বললেন, কিছুক্ষণ আগে বললাম না, পৃথিবীতে মানুষ বাঁচে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলোরে খুশি করার জন্য? আমার প্রিয় মানুষ কিন্তু খুব বেশি একটা ছিল না। কিন্তু পুরাপুরি চেষ্টা করেও আমি তাদের কাউরেই এতটুকু খুশিও করতে পারি নাই। আর আমার একটা প্রিয় জিনিস ছিল, খুব প্রিয়, সেইটাও আমি আমার প্রিয় মানুষদের জন্য ছাড়ছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু হয় নাই। কিছু না।

নয়ন কি বলবে? কার কাছে থেকে সে এতদিন পালিয়ে বেরিয়েছিলে! এই মানুষটার থেকে পালিয়ে বেরানোর ক্ষমতা কি কারো আছে? যদি না তিনি নিজে কারো থেকে পালিয়ে বেড়ান। হয়তো এই জন্যই তিনি দীর্ঘ জীবন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ফতেহপুর থেকে। তার প্রিয় বাবার কাছ থেকে। মার কাছ থেকে। শৈশবের স্মৃতি থেকে।

নয়ন ডাকল, মা!

কোহিনূর শান্ত গলায় বললেন, আমাকে মা ডাকতে খারাপ লাগে তোর?

নয়ন আবার ডাকল, মা। মা। মা।

কোহিনূর নয়নের দিকে তাকালেন না। তবে নয়নের মাথাটা টেনে তার কাঁধের উপর নিলেন। তারপর চেপে ধরে রাখলেন তার গলার সাথে। নয়ন হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, আমাকে তোমার ঘৃণা হয় মা? তোমার কখনো মনে হয় যে আমি একটা মানুষের লালসার ফসল? তুমি আমাকে চাওনি? তোমার আমাকে দেখলে ঘিনঘিন হয় মা?

নয়ন কাঁদছে না। কিন্তু তার গলার প্রতিটি শব্দ যেন অদৃশ্য কান্না ফোঁটা ফোট জলে লেখা। কোহিনূর কথা বললেন না। চুপ করে রইলেন। নয়ন বলল, আমাকে এই একটা মাত্র সত্যি কথা বলো মা। এই একটা মাত্র সত্যি কথা। তোমার কি আমাকে দেখে ঘিনঘিন লাগত? মনে হতো, আমি একটা নোংরা সৃষ্টি। আমি একটা পাপ। একটা ঘিণঘিনে জীব?

নয়ন তার কথা আর রাখতে পারল না। সে কাঁদল। ঝরঝর করে কাঁদল। কান্নায় তার গলার শব্দ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মিশে যাচ্ছে কান্নার শব্দের সাথে। কোহিনূর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে স্থির গলায় বললেন, প্রথম যেদিন তোর মুখটা দেখি, তার আগ পর্যন্ত আমি নিতে পারতাম না। নিতে পারার কথাও না। আমার কত কিছু মনে হতো! এটা একটা মেয়ে ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। কেউ না। কিন্তু তোর মুখটা দেখার সাথে সাথে আমার মনে হলো আমি এই একটামাত্র কারণে বেঁচে থাকতে পারি।

নয়ন বলল, কিন্তু আমি যখন তোমার পেটে ছিলাম, তখন আমাকে তোমার খুব ঘেন্না হতো তাই না মা? মনে হতো আমাকে যদি কোনোভাবে তুমি শেষ করে দিতে পারতে! বা আমার জন্যই তোমার নিজেকেই তুমি শেষ করে দিতে পারতে! এমন মনে হতো তাই না মা?

কোহিনূর কোনো কথা বললেন না। মূর্তির মতো স্থির বসে রইলেন। নয়ন আচমকা মায়ের পাশ থেকে সরে গেল। তারপর পাগলের মতো চিৎকার করে কেঁদে উঠল। তারপর চিৎকার করেই বলতে লাগল, আই ওয়ান্ট টু ডাই মা। আই ওয়ান্ট টু ডাই। আই কান্ট টেক দিস পেইন এনিমোর। আল্লাহ, আল্লাহ। ও আল্লাহ। ও আল্লাহ…।

কোহিনূর কোনো কথা বললেন না। একবার নয়নের দিকে চোখ তুলে তাকালেন না অবধি। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে নয়নকে বুকের সাথে চেপে ধরে কাঁদতে। কিন্তু তিনি পারলেন না। কোহিনূরকে কেউ কখনো কাঁদতে দেখেনি। আজও দেখল না। কোহিনূর কাঁদে না।

কিন্তু কেউ কি জানে, এই জগতে কেউ কেউ অকারণে কেঁদে বুক ভাসায়। পান থেকে চুন খসলেই অশ্রুর বন্যা বইয়ে দেয়। আবার কারো কারো সারাটা জীবন কেটে যায় অশ্রুবিহীন। জীবন জুড়ে এক ফোঁটা চোখের জলও সে ফেলতে পারে না। অথচ তার বুকের ভেতর জমে থাকে সহস্রবছরের কান্না। সহস্র জনমের অশ্রু। এই সত্য কোহিনূরের চেয়ে বেশি আর কে জানে!

*

সুকুমার স্বর্ণকার খুন হয়েছে। তার লাশ পাওয়া গেছে বিলকুড়ানির নদীতে। খবর শোনার পর থেকে ফজু অস্থির হয়ে আছে। সে জানে এই খুন কে করছে! নিজেরে বোকামির জন্য নিজেকেই এখন তার শাস্তি দিতে ইচ্ছে করছে। আশেপাশের কোনো দোকানে গয়না বেচতে যাওয়াটাই ভুল হয়েছে তার। কিন্তু একটা বিষয় সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে না। সুকুমার কর্মকারকে খুন করতে হলো কেন? তাকে নিশ্চিত করেই খুন করা হয়েছে ফজুর বিক্রি করা গয়নার কারণে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যদি কেউ জেনেই থাকে যে তার কাছে গয়না রয়েছে, তাহলে তো সেই গয়না কে বিক্রি করেছে, তা তো সহজেই বোঝার কথা!

তার চেয়েও বড় চিন্তার কথা, তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তাকে ডেকেছেন। তিনি আছরের আজানের পর ফজুর সাথে খাঁ-বাড়ির দহলিজ ঘরে বসবেন। ফজু জানে না, আজ সেখানে কি হবে! তবে এই মুহূর্তে আব্দুল ফকিরের সাথে দেখা হলে খুব ভালো হতো! কিছু বুদ্ধি পরামর্শ তিনি দিতে পারতেন। অবশ্য বড়সড় একটা সমস্যাও আছে। সুকুমার স্বর্ণকারের মৃত্যুর খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এই খবর আব্দুল ফকিরের কানে না যাওয়ার কথা না। কে জানে, ঘটনা শোনার পর তার প্রতিক্রিয়া কি হয়!

আছরের নামাজের পর খাঁ-বাড়ির দহলিজ ঘরে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সাথে দেখা হলো ফজুর। তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে দেখে সে কিছুটা অবাক হয়েছে। এই ক’দিনেই মানুষটা যেন সত্যি সত্যি আশি বছরের বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মানুষটা অসুস্থ। তিনি থেকে থেকে কাশছিলেনও। ফজু বলল, দাদাজানের শইলডা কি খারাপ নাকি?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ গম্ভীর গলায় বললেন, এত তাড়াতাড়ি আমি মরব না ফজু। সেই আশা কইরা লাভ নাই।

ফজু তোতলানো গলায় বলল, কি যে কন দাদাজান! আপনেরে দেইখ্যা মনে হইল আপনের শইলডা খারাপ।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এই বিষয়ে আর কথা বললেন না। তিনি মনিরকে ডাকলেন। তারপর সরাসরি কথায় চলে গেলেন। তিনি এতটা সরাসরি কথা বলবেন, এটা কেউই ভাবেনি। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে সোনার গয়না দু’খানা বের করলেন। তারপর বললেন, তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তো এহনও বাইচ্যা আছে ফজু। তুই তো হেইদিনের দুধের ছাও। তুই যদি আমার লগে দোতারি কাটানোর খেলা খেলস, তাইলে সেইটা আমার জন্য লজ্জা না?

ফজু কোনো কথা বলল না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আমি তো জানিই এই গয়না তুই পাইছস। তা সেইটা যদি আমি জানি, আমি কি করব? অনেক কিছু করব। তার মইধ্যে একটা হইছে, এই গয়না তুই যাতে আশেপাশে কোনোহানে ব্যাচতে নিলেই ঘটনা আমার কানে আসে, সেই ব্যবস্থা করন। কি? কথা কি ঠিক কইছি?

ফজু এবারও চুপ করে রইল। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ অবশ্য ফজুর জবাব আশাও করেননি। তিনি বললেন, সুকুমার কর্মকাররে খুন করনের কোনো ইচ্ছাই ছিল না। কিন্তু খুনডা হইয়া গেছে মাথা গরম করনের কারণে। আশেপাশের সকল অঞ্চলের স্বর্ণকারের দোকানে মনির বইলা দিছিল যে, এইরম পুরোনো গয়না কেউ বেচতে আনলে যেন আমাগো জানায়। সবার মতো সেও কথা দিছিল যে জানাইব, কিন্তু সে জানায় নাই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মনিরের হাত ধরে তাকে সামনে নিয়ে এলেন। তারপর ফজুকে বললেন, সুকুমার স্বর্ণকাররে খুন করছে মনির। এইটাই মনিরের প্রথম খুন। যদিও আমি চাই নাই, খুনটা মনির করুক। সুকুমার কর্মকার আমাগো জানায় নাই, লুকাইছে, এইটা অপরাধ। কিন্তু এইটা খুন করনের মতো অপরাধ না। কোনহানে মাথা ঠান্ডা রাখন লাগব আর কোনহানে মাথা গরম করতে হইব, এইটা সবার আগে শিখতে হইব। তারপরও আমি ব্যাজার না। আমি খুশিই। কারণ শাসন করতে হইলে সকলের আগে সাহস লাগে। মানুষ সাহসরে ভয় পায়। মনিরের সাহস আছে। তার বাপের সেইটা আছিল না। এইজইন্য খাঁ বংশের ভবিষ্যত নিয়া আমি খুব দুশ্চিন্তায় আছিলাম। আইজ সেই দুশ্চিন্তা আমার কাটল।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মনিরকে ঠেলে আবার পাশে সরিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, তুই যে আব্দুল ফইররে দিয়া কি সব চাইল-বাইল শুরু করছস। তোর কি ধারণা, তোর ব্যাপারী বংশ আব্দুল ফইর চালাইব? আব্দুল ফইররে তুই চেনস না? আর তোর এই বুদ্ধি লইয়া কি বংশের হাল ধরন যায়?

ফজু একদম চুপ। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আজ যেন কেবল কথা শোেনানোর জন্যই ফজুকে ডেকেছেন। তিনি বললেন, শোন, একখান কথা বলি। আব্দুল ফইরের পাছা ছাড়। আব্দুল ফইর যদি কারো বন্ধু হয়, তাইলে তার আর শত্রু লাগে না। তার উপর তুই আবার খায়-গোও শত্রু বানাইতেছস। এটুক এক পুঁটি মাছ হইয়া যদি তুই সব আইড় বোয়ালের লগে খেলাধুলা করতে আহস। তাইলে খেলা কি জমব? জমব না। তার উপর শুনলাম, এইহানে সেইহানে যত আত্মীয়-স্বজন আছে, সব খবর দিয়া আনাইতেছস? কী? চর দখলের লাহান, জমিন দখল করবি? না গ্রাম?

ফজু মিনমিনে গলায় বলল, এতবড় দুঃসাহস আমার নাই দাদাজান। আপনে কিছু ভুল হুনছেন।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হাত উঁচু করে ফজুকে থামালেন। তারপর এস্কান্দারকে হাতের ইশারায় ডাকলেন। এস্কান্দারের হাতে সেই দু’নলা বন্দুক। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ঠান্ডা গলায় বললেন, আমার চালাকি পছন্দ না ফজু। আমার বুদ্ধিমান মানুষ পছন্দ, চালাক মানুষ না। চালাক মানুষ হইলে আমি দুইখান কাজ করি। এক পারলে তারে আর আমার চৌক্ষের সামনে রাখি না। সরাইয়া দেই। আর দুই, আমি তার চৌক্ষের সামনে যাই না। আব্দুল ফইর হইল দ্বিতীয় দলের লোক। এইজইন্য তার চৌক্ষের সামনে আমি যাই না। সে ধুরন্ধর লোক। কিন্তু তুই ধুরন্ধর না। তোরে কিন্তু আমি চৌক্ষের সামনে থেইক্যা সরাই দিব।

ফজুর ধারণা ছিল তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আজ তাকে ভয় টয় দেখাবেন। এই নিয়ে তার একটা মানসিক প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু চোখের সামনে বন্দুক আর তৈয়ব উদ্দিন খাঁর এই রাখঢাকহীন সরাসরি চেহারা দেখে সে আতঙ্কিত হয়ে গেল। সে বলল, দাদাজান, আপনে আমার কথা হুনেন আগে। একখান কথা।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, কোনো কথা নাই ফজু। যা বলনের আমি বলি। তুই শোন। তোর বাপেরে আমি খুন করছি। বুইঝা করি আর না করি। করছি তো। এহন আবার এই বুড়া বয়সে তোরেও খুন করতে আমার হাত একটু কাপব। তুই একখান কাম কর। গয়নার কলসখান মনিরের ধারে দিয়া দে। তোরে কুড়ি বিঘার জমি লেইখ্যা দেওনের ব্যবস্থা করতেছি। তোর বাড়িতে একখান ঘরও তুইল্যা দিব। নগদ কিছু টাকাও দিব। একটা ব্যবসা-ট্যাবসা কিছু কর। কথা পরিষ্কার?

ফজু কথা বলল না এবারো। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ অবশ্য ফজুর কথার অপেক্ষাও করলেন না। তিনি বললেন, আরেকখান কথা ফজু। তুই হয়তো ভাবতেছেস, গয়নার খবর তুই না দিলে, আমি কি করব? তোরে মাইরা ফেললে তো আর গয়নার কথা আমি জানতে পারব না। গয়নার সংবাদ জানতে হইলে তো তোরে আমার বাঁচাইয়াই রাখতে হইব। তাই না? একখান কথা বলি শোন। আমার হাতে সময় বেশি নাই। এহন দরকার পরলে সবকিছু পাওনের চিন্তা আমারে বাদ দিতে হইব। আমি গয়নার চিন্তা না হয় বাদই দিলাম। তুই গয়নার খোঁজ না দিলে তোর খোঁজও আর রাখব না আমি ফজু। ভালো একখান প্রস্তাবও থাকল, আর খারাপটাও। এহন সিদ্ধান্ত তোর। আর সবকিছু গুছানোর সময়ও আমার নাই। আমার হাতে সময় বেশি নাই। যা করনের তাড়াতাড়ি করতে হইব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হয়তো আরো কিছু কথা বলতেন। কিন্তু তার আগেই ফজু হঠাৎ তৈয়ব উদ্দিন খাঁর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল। তারপর তার পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,দাদাজান, একখান ভুল হইয়া গেছে। বড় একখান ভুল হইয়া গেছে দাদাজান।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কপাল কুঁচকে ফজুর দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। ফজুই বলল, আপনের কথাই ঠিক দাদাজান, আব্দুল ফইর যার বন্ধু হয়, তার আর শত্রুর দরকার হয় না। তার কাছে দিছিলাম গয়না রাখতে। সে এহন অস্বীকার করতেছে কাকু। সে এহন স্বীকার করতেছে না কাকু। নিজেই নিজের সর্বনাশটা করছি কাকু। এই দুইন্যায় আমার আর কিছু থাকল কাকু। কিছু না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ স্থির, নিষ্কম্প চোখে ফজুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ফ্যাসফেসে কঠিন গলায় বললেন, মনে হইতেছে না তুই সত্য কথা বলতেছস। তয় তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সন্দেহের শ্যাষ রাখে না। আরেকটা কথা, আব্দুল ফইরের লগে এমনিতেই আমার একটা শ্যাষ দেখা হওন দরকার আছিল। তো সেইটা তো হইতোই। তুইই না হয় সেইটার উছিলা হইলি।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ উঠে ঘরে গেলেন। সেইদিন তিনি আর কারো সাথে কথা বললেন না। তার শরীরটা খুব দুর্বল লাগছিল। মাঝরাতে তিনি এস্কান্দারকে ডেকে বললেন বাথরুমে যাবেন। সেইরাতে আরো দুইবার তিনি বাথরুমে গেলেন। শেষরাতের দিকে বমিও করলেন। পরদিন দুপুর নাগাদ তার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ল। কিন্তু তিনি ডাক্তার কবিরাজ কিছুই ডাকতে দিলেন না। সন্ধ্যাবেলা খবির খাঁকে ডেকে পাঠালেন তিনি। তারপর বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বললেন, জীবন যতই বড় হোক। তার শ্যাষ আছে। এইটা মানতে কষ্ট হয়, কিন্তু উপায় নাই। আমি কেউরেই এতদিন কিছু জানাই নাই। জানাইতে চাই নাই। আমার শরীলডা বহুদিন থেইক্যাই খারাপ। নিজেরে নিজেই একটু বুঝতে চাইছি। কিছু দিক গুছানোর বিষয় আছিল। সব পারি নাই। কিছু পারছি। মনিররে কিছু জিনিস বুঝাই দিয়া যাইতে চাইছি। আমার ধারণা সে সবকিছু দেইখ্যা শুইন্যা রাখতে পারব। তয় মনিরের মাথাডা বেশি গরম। তোর মাথাডা আবার বেশি ঠান্ডা। এইজইন্যই তোরে ডাকলাম। কহন কি হইয়া যায়, বলন তো আর যায় না। মনিরের দিকে খেয়াল রাহিস। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অর বিয়ার ব্যবস্থা করিস।

খবির খাঁ অনেকক্ষণ চুপচাপ বাবার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আগামী কিছুদিন আমি খুব একটা বাড়ির বাইর হব না। আমি অসুস্থ এই জিনিস কাউরে জানানোর দরকার নাই। এহন যা, তোর ছোট মায়রে গিয়া বল যে আমি ডাকি।

কিন্তু খবির খাঁ গেলেন না। তিনি বাবার পাশে দাঁড়িয়েই রইলেন। সম্ভবত তার এই ষাট বছরের জীবনে এই প্রথম তিনি ইচ্ছে করে তার বাবার অবাধ্য হয়েছেন। কিন্তু সেই অবাধ্যতার ভাষা যে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বোঝেননি, তা নয়। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এই মুহূর্তটাকে বুঝলেন। তিনি হাত বাড়িয়ে খবির খাঁকে কাছে ডাকলেন। খবির খাঁ ধীরে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হাত বাড়িয়ে পুত্রের হাতখানা ধরলেন। তারপর আস্তে করে টেনে পাশে বসিয়ে বললেন, আমার উপর তোর অনেক রাগ না?

খবির খাঁ কোনো কথা বললেন না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আমার উপর রাগ রাখিস না। আমি মানুষ হিসাবে ভালো না হইতে পারি। বাপ হিসাবে আমি খারাপ না।

খবির খাঁ তার মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। তারপর ধরা গলায় বললেন, আমারে নিয়া আপনের অনেক আফসুস না বাজান?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ একটা হাত ছেলের পিঠের উপর দিয়ে কাঁধে নিয়ে রাখলেন। তারপর বললেন, এই কথা কেন বলতেছস?

খবির খাঁ বললেন, আমরা দুই ভাই, আপনের সন্তান। কিন্তু কোনোদিন আপনের মতো হইতে পারি নাই। আপনে সব সময়ই সাহস, বুদ্ধি এইগুলান। পছন্দ করতেন। কিন্তু আমাগো দুই ভাইর মইধ্যে তার কিছুই আছিল না। এই জইন্য সারাটা জীবন আপনের আফসুস আছিল বাজান। দবির তো ছোটবেলা থেইকা কেমন পাগল পাগল। আপনের আশা আছিল আমার উপর। কিন্তু সেই আশাও আমি জীবনে কোনোদিন পূরণ করতে পারি নাই বাজান। চেষ্টা যে করি নাই, তা না বাজান। সারা জীবন খালি এই একখান জিনিসই চাইছি, আপনেরে যাতে খুশি করতে পারি। আপনের মন জোগাইতে পারি। কিন্তু পারি নাই বাজান। আল্লাহর ধারে নামাজ পইড়া যে কত কানছি। একটা দিনের লইগ্যাও যাতে আপনেরে সন্তষ্ট করতে পারি। কিন্তু কোনোদিন পারি নাই। এর চাইতে বড় আফসুস আর কি আছে বাজান? কিছু নাই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ছেলের মাথাটা টেনে নিজের বুকের উপর রাখলেন। খবির উদ্দিন খাঁর কি যে হলো! এই ষাট বছরের এক বৃদ্ধ তিনি। কিন্তু তিনি মনে করতে পারছেন না এমন করে আর কখনো পিতার আদর তিনি পেয়েছিলেন কিনা! তিনি হঠাৎ যেন হয়ে গেলেন বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমানো ছোট্ট এক শিশু। তার বুকের ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সেখানে কত কত দুঃখ, অভিমান, কান্না। কিন্তু তিনি সেসব আগলে রাখলেন বুকের ভেতর।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তোগো মা যহন মারা যায়। তহন তোরা কতটুকু? এইটুক গ্যাদা গ্যাদা দুইখান ছাও। আমি সেই ছাও দুইখানরে পক্ষীর ছাওয়ের লাহান পালছি। ঠোঁটে তুইল্যা খাওয়াই দিছি। কোলে কইরা নাওয়াইছি। কাউরে কোনোদিন ধরতে দেই না। তোগো জানি কোনোদিন মায়ের দুঃখ বোঝন না লাগে, সেইরম মানুষ করছি। সৎ মা আইলে, কিনা কি করে, এই জইন্য কুড়ি বছর পর বিয়া করছি। কেন জান? কারণ তোরা আমার রক্ত। দুনিয়ায় মাইনষের সবচাইতে বড় মায়া কিসের মায়া জানস? রক্তের মায়া। রক্তের মায়ারতন বড় মায়া আর নাই। এই যে তুই আমার লগে লাইগ্যা রইছস। আমি রক্তের ঘ্রাণ পাইতেছি। আমার রক্তের ঘ্রাণ। আমার ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ ছাইড়া যাওনের খুব কষ্টরে বাজান। খুব কষ্ট। এইজইন্যই তো মানুষ মরণরে এত ডরায়। নিজের ঘ্রাণ ছাইড়া যাওনের ডর।

খবির উদ্দিন খাঁ হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। অশীতিপর এক বৃদ্ধ পিতার বুকে মাথা রেখে কাঁদছেন তার ষাট বছর বয়সের পুত্র। পুত্রের স্খলিত কণ্ঠের কান্নায় বাবার বুকে ভেসে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে ধবধবে সাদা বুকের পশম। শিথিল হয়ে যাওয়া চামড়া। কে জানে, হয়তো সেই চামড়ার আড়ালে ভেসে যাচ্ছে লৌহকঠিন এক মানবের বুকের ভেতর সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখা কোমলতম এক পিতৃহৃদয়ও।

*

নুরুন্নাহারকে নিয়ে পারুলের ঢাকা যাওয়ার তারিখ ঠিক হয়েছে। লতার মামা সপ্তাহখানেক আগেই লঞ্চে বড়োসড়ো দেখে দু’খানা কেবিনও বুক করে রেখেছেন। সেই থেকে পারুলের কী যে একটা আনন্দ হচ্ছে বুকের ভেতর। সারাক্ষণ শুধু মনে হচ্ছে সে ফুড়ফুড়ে হাওয়ার মতো উড়ে উড়ে যাচ্ছে। তুলোর মতো পলকা হয়ে আছে তার শরীর মন। পারুল নিজেকেই নিজে আজও বুঝতে পারে না। এই তার মনে হয় সে চড়ুই পাখির মতো। এখানে-সেখানে কোথাও দু’দণ্ড ভালো লাগে না। কাউকে সহ্য হয় না। কারো জন্য মায়া হয় না। কেবল কী এক অচিনপুরের ভাবনা মাথার ভেতর, বুকের ভেতর ভেসে বেড়ায়। কী এক অজানা সুবাসে বুঁদ হয়ে থাকে সে। এই সময়গুলোতে সে হুটহাট প্রেমে পড়ে যায়। এমন কতজনের প্রেমে যে সে এই অবধি পড়েছে, তা কেবল সেই জানে! কত পাগলামিও যে করেছে! অবশ্য সেই সব পাগলামি খুব একটা থাকেনি তার। দুম করে যেমন আসে, তেমনি দুম করেই চলে যায়। কিন্তু সেই ডাক্তার ছেলেটার জন্য তার বুকের ভেতরটা কি এখনও একটু কেমন কেমন করে!

পারুল ঠিকঠাক বোঝে না। কেমন একটা ভুলভাল ব্যাপার আছে কোথাও। সে টের পায় না, বা পায়। এই যে সে মাকে নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। আচ্ছা, এই সিদ্ধান্তের কোথাও কি সেই ডাক্তার ছেলেটার সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার ভাবনাটা অতি সামান্য হলেও আছে! যদি দেখা হয়ে যায়? এমন হয় না? নিশ্চয়ই হয়। তার মোবাইলে বহু সিনেমায় এমনটা হতে পারুল দেখেছে। সিনেমায় হয় বলে বাস্তবে হতে পারে না, এমন তো কোনো কথা নেই। একদম নেই। দেখা গেল সে মাকে নিয়ে যেই হাসপাতালে গেল, ঠিক সেই হাসপাতালেরই ডাক্তার সে। এমনও তো হতে পারে, সে-ই মাকে দেখেছে! তাহলে? তখন কি করবে পারুল? এই অবধি ভেবে পারুলের কেমন দম আটকে আসে। আর ভাবতে পারে না সে। বড্ড ছটফট লাগে তার। আরো সাতদিন! সাত সাতটা দিন। কি করে কাটাবে সে? দিন যে আর কাটেই না তার।

ঢাকা যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে কত কিছু যে করেছে পারুল! নতুন জামা বানাতে দিয়েছে। ব্যাগ কিনেছে। ভেবেছিল এই প্রথম রায়গঞ্জের বিউটিপার্লার থেকে সে চুল কাটাবে। সিনেমার নায়িকাদের মতো → ছাটবে। কিন্তু লতা বলল, ওসব ঢাকা গিয়েই করতে। সেখানে কত ভালো ভালো পার্লার আছে! কিন্তু পারুলের আর তর সইছে না। সদরঘাট লঞ্চঘাট নামতেই ঢাকা! রায়গঞ্জ থেকে বিকেলে লঞ্চে ওঠার পর রাতখানাই যা দেরী। তারপরই ঢাকা! ভাবতেই কেমন গায়ের নোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কত স্বপ্নের শহর তার। এই এতগুলো বছর হয়ে গেল, সে কখনো ঢাকার শহর যায়নি। কী লজ্জার কথা! কী লজ্জার কথা!

শহরটা দিনরাত লাল, হলুদ, নীল আলোয় ঝলমল করে। তারাবাতি জ্বলে। কত কত গাড়ি। কত কত রং। আহা! অথচ এই ইলেকট্রিসিটি বিহীন নোংরা কাদা পানির গা ঘিনঘিনে গ্রামেই সে পড়ে রয়েছে। কত কী যে দেখার বাকি রয়ে গেল তার। ঢাকা গেলে সে মুহূর্তের জন্য চোখের পলকও ফেলবে না। যত দেখে নেয়া যায়। যত বেশি। পারুল গত কিছুদিন ধরে রোজ লতার সাথে বসে বসে শুদ্ধ করে কথা বলার চেষ্টা করে। তা একটু-আধটু শুদ্ধ হচ্ছেও বটে। কিন্তু তাতে পারুলের মন ভরে না। তার ধারণা ঢাকা গিয়ে দিন দশেক থাকতে পারলে, এর চেয়ে ঢের বেশি শিখে ফেলতে পারবে সে।

এসব ভাবতে ভাবতে যে পারুল মায়ের কথা ভুলে যায়, মোটেও তা না। সে বরং রোজ মায়ের সাথে গল্প করে। কত কত কথা যে সে বলে! মা আজকাল খুব ভয় পান। আগে এমনটা হতো না। সে গেলেই কেমন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে তাকায়। পারুল কত বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয় না। তবে, যেদিন থেকে সে জেনেছে, ঢাকায় নিয়ে তার চিকিৎসা হবে, সেদিন থেকে তার ভয় যেন কমছে। এই বাড়ি থেকে সে বের হতে পারবে, এই আনন্দটা তার চোখ মুখ দেখে বোঝা যায়। তার মধ্যেও কেমন একটা ছটফটানি। ভাব। পারুলের আজকাল মায়ের জন্য কী যে মায়া হয়। মায়া হয় বাবার। জন্যও। সে মাঝে-মধ্যে ভাবে, বাবাকে নিয়ে সবাই যা ফিসফিস করে, তার কোথাও না কোথাও একটা ভুল তো আছেই। মস্তবড় ভুল। এমন একটা মানুষ, অথচ সবাই কী সব ভাবে তাকে নিয়ে। হ্যাঁ, মানুষ বলে দোষ-ক্রটি তারও আছে। হতে পারে অন্যদের চেয়ে কিছু বেশিই। তা কম-বেশি সকলেরই থাকে। লোকের ভাবখানা এমন যে তার বাবা ছাড়া আর সকলে ধোয়া তুলসি পাতা।

সেদিন বাবা তাকে একদম চমকে দিয়েছেন। শুধু সেদিনই কেন? পরদিন রাতে বাবা এসে বললেন, মা রে, চেষ্টা করছিলাম আরো কিছু টাকার ব্যবস্থা করতে। পারি নাই। তাও হাজার পাঁচেক টাকার ব্যবস্থা করছি। কওন তো যায় না, বিদেশের বাড়ি। কহন কি লাইগ্যা বসে। তহন কার কাছে হাত পাতবা? আর তোমারে তো মা ভালো কিছু, শখের কিছু কোনোদিন কিন্যা দিতে পারি নাই। তা কেমনে পারব? এই গাঁওগ্রামে কিছু পাওন যায়? যায় না। তুমি পারলে ঢাকারতন নিজের লইগা কিছু কিন্যা আইনো।

পারুল বাবার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিছু বলতে পারেনি। আব্দুল ফকির যেতে গিয়েও আবার ফিরে এসে বললেন, সেইবার বিলকুড়ানির হাটেরতন তুমি আমারে কি জানি এক স্নো আনতে বলছিলা মা। কাগজে লেইখ্যাও দিছিলা। সেই কাগজ তো আমি হারাই ফেলছিলাম। নিয়াইছিলাম অন্য স্নো। এইবার তুমি ঢাকারতন সেই স্নো বেশি কইর‍্যা নিয়াইসো।

পারুলের এত মায়া হচ্ছিল মানুষটা জন্য! তার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, মানুষটাকে সে অনেকক্ষণ আব্বা আব্বা বলে ডাকে। ডাকতেই থাকে। তারপর তিনি যদি বলেন, কি? এত আব্বা আব্বা করো ক্যান মা?

সে তখন ফিক করে হেসে দিয়ে বলবে, আপনে আমার আব্বা। আপনেরে আব্বা আব্বা বইলা ডাকব না তো কারে ডাকব? আপনেরে আব্বা আব্বা বইলা ডাকতে আমার ভালো লাগে। আব্বা আব্বা আব্বা।

আব্দুল ফকির আরো একটা বিষয়ে পারুলকে চমকে দিয়েছেন। গতকাল রাতে একটু আগে ভাগে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। ফিরেই পারুলকে ডাকলেন। তার চেহারা অন্যদিনের চেয়ে ঝলমলে। তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, মা রে। একটা ভালো সংবাদ।

পারুল বলল, কি সংবাদ আব্বা?

আব্দুল ফকির বললেন, কইছিলাম না, তোমাগো লগে আমিও ঢাকায় যাইতে পারি কিনা দেহি! নানান কাজ কামের জইন্য নিশ্চিত দিয়া কইতে পারতেছিলাম না। আইজ খবর আইছে মাদারীপুর কোর্টের দুইটা কাম আরো মাস খানেক পিছাইব। আমি তাইলে মা, তোমাগো লগে যাইতে পারব। তোমাগো দুইজনরে এমনে ছাইড়া দিতে ভরসা হইতেছিল না মা। নানান দুশ্চিন্তা মনের মইধ্যে।

পারুল যে কি খুশি হয়েছে! সে চায় বাবা তাদের সাথে যাক। পেছনে কি হয়েছে, সে আর মনে করতে চায় না পারুল। মা যদি আল্লাহর ইচ্ছায় সুস্থ হয়ে যান, তাহলে আর কী! এই সুযোগে বাবা-মায়ের যদি কোনো সমস্যা থেকেও থাকে, পারুল তাও মিটিয়ে ফেলতে চায়। অসম্ভব বলে কিছু নেই। সে চায় তাদের সংসারটাও আর সবার মতো হোক। এই জীবন তার আর ভালো লাগে না।

এইসব ভেবে ভেবেই পারুলের দিন রাতগুলো যায় কচ্ছপের গতিতে। খুব কষ্টে। টগবগে ঘোড়ার গতি আর উত্তেজনা বুকে চেপে কচ্ছপের গতিতে হাঁটার চেয়ে কষ্ট আর কিছুতে নেই।

আজ দুপুরে লতা এলো। পারুল বলল, আব্বাও যদি আমাগো লগে যায়, কোনো সমস্যা হইবো না তো লতা?

লতা বলল, কী সমস্যা?

পারুল বলল, লঞ্চে কেবিন তো দুইটা?

লতা বলল, কোনো সমস্যা নাই। আমি, তোর মা, আর তুই থাকব এক কেবিনে। আর আরেকটায় তারা দুইজন।

পারুল বলল, আরেকখান কথা।

লতা বলল, কী কথা?

পারুল বলল, তোর মামার বাসায় যদি জায়গা কম হয়? শুনছি, ঢাকার শহরে মাইনষে দশ বেলা খাইতে দিতে চায়। কিন্তু একবেলা থাকতে দিতে চায় না।

লতা খিলখিলিয়ে হেসে বলেছিল, কি আর করা? তোর আব্বারে বলবি একখান বালিশ আর একখান কথা লইয়া লইতে। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটে আমাগো গ্রামের মতো কাদা পানি নাই। শুকনা খটখটা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সে চাইলে কাথাখান বিছাইয়া রাস্তায়ই ঘুমাই পড়তে পারব। তয় মশারিও লাগব। ঢাকা শহরে মশার বড় সমস্যা।

লতার কথায় পারুলও হাসল। তারপর বলল, ঢাকার শহর কোনোদিন যাই নাই বইল্যা টিটকারি মারস? দাঁড়া, এইবার ঢাকার শহর গিয়া একদম বিয়া-শাদিই কইরা আসব।

লতা বলল, ঢাকা শহর বিয়া-শাদি কইরা আবার এই গ্রামে আসবি ক্যান?

পারুল বলল, তোরে দেখতে আসব। তুই এই কাদা পানির জঙ্গলে কেমন আছস সেইটা দেখন লাগব না?

লতা আর পারুল হাসাহাসি করেই দিনটা কাটাল। তার পরের দুটো দিন নানান কাজেকর্মে কেটে গেল পারুলের। আব্দুল ফকিরও যেহেতু চলে যাবেন তাদের সাথে, সেহেতু বাড়ি-ঘর একটু গুছিয়ে রেখে যাওয়া দরকার। জুলফিকার আর রতনকে এটা-সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বুঝিয়ে দিলো পারুল। তাবারনের সাথে বসেও নানান বিষয় ঠিক করল। তাবারনের আবারও যেন কি সমস্যা হয়েছে! আজকাল আর সে আগের মতো কান্নাকাটি করে না। তার চেয়েও বড় কথা, কান্নাকাটির সাথে সাথে তার কথাবার্তাও থেমে গেছে। সে সারাক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। কেউ কিছু করতে বললে করে। না বললে করে না। এক মনে উঠানের পাশে বসে থাকে। পারুল তাকেও নানান কিছু বোঝাল।

কিন্তু তার এই বোঝানো শেষ অবধি খুব একটা কাজে লাগল না। কারণ আব্দুল ফকির তাদের সাথে যেতে পারলেন না। অতি জরুরি প্রয়োজনে যাত্রার দুই দিন আগে গভীর রাতে তাকে বাড়ি ছাড়তে হলো। তাকে যেতে হলো ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারি থানার এক ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িতে। চেয়ারম্যানের মেয়েকে সাপে কেটেছে। চেয়ারম্যান নদী পথে স্পিডবোট ভাড়া করে তোক পাঠিয়েছেন আব্দুল ফকিরকে নিয়ে যেতে। মেয়ের জীবন মরণ সমস্যা। এমন সমস্যা এড়ানো যায় না। আব্দুল ফকির তারপরও সেই রাতে পারুলকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। তারপর পারুলের কাছে অনুমতি চাইলেন। তিনি বললেন, মা রে, আল্লায় এ কী কঠিন পরীক্ষার মইধ্যে ফালাইলো আমারে!

পারুল বলল, আব্বা, কোনো সমস্যা নাই। আপনে যান। আমি এইদিক দেখতেছি। আপনে কোনো চিন্তা কইরেন না। আমি মায়রে ঠিক ঠিক ডাক্তার দেখাইয়া নিয়া আসব।

আব্দুল ফকির তারপরও যেন নিশ্চিত হতে পারলেন না। তিনি পারুলকে নানান বুদ্ধি পরামর্শ দিলেন। পারুলের মাথায় দোয়া পড়ে ফুঁ দিলেন। তারপর সেই গভীর রাতে এক কাপড়ে বেরিয়ে গেলেন। কাপড়-চোপড় খুঁজে সময় নষ্ট করবার মতো সময় তার হাতে নেই।

পরের দিনটা পারুল শেষ প্রস্তুতিটুক নিলো। ব্যাগগুলো গোছগাছ করল। প্রয়োজনীয় কিছু ফেলে যাচ্ছে কিনা, তা বারবার পরীক্ষা করল। নুরুন্নাহারের জন্য কিছু কাপড়-চোপড় কিনেছিল, সেগুলো গোছাল। রাতে সে মায়ের ঘরে এলো। পরদিন ভোরে তারা রায়গঞ্জ যাবে। সেখানে লতার নানা বাড়িতে বিকেল অবধি থেকে সন্ধ্যায় লঞ্চে উঠবে।

পারুলকে দেখেই নুরুন্নাহার উঠে বসলেন। বিছানার ওপরই তার রাতের খাবার ঢাকা দিয়ে রাখা। সম্ভবত রতন বা তাবারন দিয়ে গেছে। কিন্তু নুরুন্নাহার তখনও খাননি। পারুলকে দেখে নুরুন্নাহার সুস্থ মানুষের মতো বলে উঠলেন, সারাদিন কই থাহোস? ঘর থেইক্যাও বাইর হইতে দেস না। আবার তুইও আসোস না। তোরে দ্যাখতে মন চায় না আমার?

পারুল বলল, এহন রাইত কত হইছে? তুমি এহনও ভাত খাও নাই ক্যান মা?

নুরুন্নাহার বললেন, সইন্ধ্যা বেলা নাইকোলের নাড় দিছিল। এহন খিদা পায় নাই, আরেকটু রাইত হোক তহন খামু।

পারুল আর কথা বলল না। সে বিছানার উপর থেকে খাবারের প্লেট গ্লাস সরিয়ে রেখে মায়ের পাশে বসল। পারুল বসতেই নুরুন্নাহার বললেন, তুই না আমার জইন্য নতুন সোন্দর কাপড় কিনছস? একখান কাপড় দে। একটু পিন্দি। কতদিন হয় নতুন কাপড়ের বাস পাই না!

পারুল বলল, কাইল বেয়ানে পিন্দো মা।

নুরুন্নাহার বললেন, আমার কি মাথার ঠিক আছে? কাইল বেয়ান হইতে দেখা গেল আমার মাথা খারাপ। তহন নতুন কাপড় পিন্দা কি করব?

পারুল বলল, এহন কাপড় পিনলে কাপড়ের ভাঁজ ভাইঙা যাইব মা।

নুরুন্নাহার বললেন, ভাঙব না। তুই আমার প্যাটে হইছস, না আমি তোর প্যাটে হইছি? ভাঁজ না ভাইঙা ক্যামনে কাপড় পরতে হয়, সেইটা আমি জানি।

পারুল বলল, এত রাইতে ত্যক্ত কইরো না তো মা। তুমি কহন পাগল থাহে, আর কহন ভালো থাহো, সেইটা এহন আর বুঝি না। এহন এই এত রাইতে পাগলামি বন্ধ করো। কাইল বেয়ানে তোমারে ভালো কইরা নাওয়াইয়া বোয়াইয়া কাপড় পরাব। নতুন কাপড়। কয়দিন নাওয়া-ধোওয়া করো না? তোমার শইলের যা অবস্থা!

নুরুন্নাহার তারপরও অনুনয়-বিনয় করলেন। কিন্তু পারুল তাতে পাত্তা দিলো না। নুরুন্নাহার তখন বললেন, তাইলে আমারে একটু দেখতে দে, কি রঙের কাপড় আনছস? আমার গায়ে কিন্তু লাল রঙ ভালো ফোটে। এহন তো গায়ে রঙ নাই। আগে আমার গায়ের রঙ আছিল দুধের লাহান। বাজান সব সময় আমার জইন্য লাল রঙের জামা আনত। আর কোলে লইয়া কইত এইটা আমার রাঙা মা।

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, পারুলও নুরুন্নাহারের জন্য রঙিন একখানা শাড়িই কিনেছে। দু’খানা সাদাসিধে কাপড়ের সাথে একখানা খুব সুন্দর রঙিন শাড়ি। কেনার সময় অবশ্য লতা খুব করে নিষেধ করেছিল। এই ধরনের রঙের কাপড় নাকি এখন আর নুরুন্নাহারের পরনে মানায় না। কিন্তু পারুল লতার কথা শোনেনি। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল মার জন্য একখানা রঙিন শাড়ি কিনতে। কিন্তু এখন এই এতরাতে সে সেই কাপড়খানা নষ্ট করতে চায় না।

নুরুন্নাহার বললেন, কই? কাপড়গুলান দেহা?

পারুল বলল, মা, এহন না বেয়ান বেলা দেইখো।

নুরুন্নাহার ভারি মন খারাপ করলেন। তিনি তার পরনের শাড়ির ছেঁড়া আঁচলখানা আঙুলে টেনে দেখাতে দেখাতে বললেন, শ্যাষ কবে আমারে একখান কাপড় কিন্যা দিছস? এই দ্যাখ, আমার কাপড়, ছায়া, ব্লাউজ এই দ্যাখ। কামের মাইনষেরেও তো মানুষ এরতন ভালো কাপড় পিন্দায়। আমি পাগল মানুষ বইল্যা কি আমারে ছেঁড়া কাপড় পিন্দাইয়া রাখবি?

এই বলে নুরুন্নাহার তার পরনের কাপড়খানা টেনে ছিঁড়তে শুরু করলেন। পারুলের মন খারাপ হয়ে গেল। একই সাথে আবার বিরক্তও লাগতে লাগল। সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নুরুন্নাহারের জন্য কেনা রঙিন কাপড়খানা সে রেখেছে ব্যাগের একদম নিচের দিকে। ভেবেছিল ঢাকায় গিয়ে সে এইখানা পরাবে নুরুন্নাহারকে। কিন্তু এখন আবার সব জিনিসপত্র অগোছালো করে সবার নিচ থেকে তাকে কাপড়খানা বের করতে হবে! কিন্তু মায়ের মন খারাপ দেখে তার ভালোও লাগছে না। সে রাজ্যের বিরক্তি নিয়েই কাপড়খানা বের করে নুরুন্নাহারের ঘরে গেল। কিন্তু গিয়ে দেখে নুরুন্নাহার ভেতর থেকে দরজা আটকে দিয়েছেন। পারুল দরজায় আওয়াজ করে মাকে ডাকল। নুরুন্নাহার ভেতর থেকে অভিমানী গলায় বললেন, লাগব না তোর কাপুড়। তোর ওই কাপুড় আমি পিনমু না। জীবনেও পিনমু না।

পারুলের এবার রাগ লাগছে। সে বলল, না পিনলে কাইল বেয়ানে ঢাকা যাবা কি পিন্দা?

নুরুন্নাহার বললেন, আমার পিন্দনের এই ছিড়া কাপুড় পিন্দাই যাব। আমি পাগল-ছাগল মানুষ, আমার আর ছেঁড়া-ভালো কি! একটা পিনলেই হইল। লেংটা না গেলেই হইল।

পারুল মাকে আরো কিছুক্ষণ ডাকল। কিন্তু নুরুন্নাহার পারুলের ডাকে আর সাড়া দিলেন না। পারুলের কী যে রাগ হতে লাগল মায়ের উপর! সব সময় এমন ছেলেমানুষি, পাগলামি তার আর ভালো লাগে না। সে নিজেও তো একটা মানুষ নাকি! তারও তো ধৈর্যের একটা সীমা আছে।

সে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে রইল। তার বিছানার উপর ছড়ানো-ছিটানো সব জিনিসপত্রের মাঝখানে শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়েই সে কালকের পরিকল্পনা আবার ঝালাই করে নিতে লাগল। সারাদিনের উত্তেজনাটা আবার ফিরে আসছে। রাতে লঞ্চে নিশ্চিত করেই সে একফোঁটাও ঘুমাবে না। সে শুনেছে, লঞ্চ পদ্মা-মেঘনার মতো বড় নদীতে পড়তেই রাতের অন্ধকারে চারপাশে শত শত লঞ্চের আলো দেখা যায়। মনে হয় অন্ধকারের বিশাল সমুদ্রে বড় বড় জোনাক পোকা আলো জ্বেলে যাচ্ছে। পারুলের খুব অস্থির লাগতে লাগল। সে সেই অস্থিরতা নিয়েই কখন ঘুমিয়ে পড়ল টেরই পেল না।

পারুলের ঘুম ভাঙল ফজরের আজানের শব্দে। অদ্ভুত ব্যপার হলো সে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছিল যে তারা লঞ্চে। তাদের লঞ্চ সদরঘাট পৌঁছে গেছে। ভোঁ শব্দে ভেঁপু বাজাচ্ছে লঞ্চগুলো। আশেপাশের সকলেই লঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছে। কেবল তারাই নামছে না। পারুল বার কয় তাড়া দিলো সবাইকে। কিন্তু কেউই তেমন গা করছে না। এই মুহূর্তে বিকট শব্দে আবার ভেঁপু বাজাল লঞ্চ। আর সাথে সাথেই ঘুম ভেঙে গেল পারুলের।

সে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নিলো। তারপর গেল নুরুন্নাহারের ঘরে। নুরুন্নাহারকে সবার আগে গোসল-টোসল করিয়ে গুছিয়ে রেখে তারপর সে নিজে যাবে নিজের গোছগাছ করতে। কিন্তু বারকয়েক ডাকার পরও নুরুন্নাহার দরজা খুললেন না। এবার ভারি রাগ হতে লাগল পারুলের। কিন্তু নিজেকে সামলালো সে। ঘর থেকে গিয়ে রঙিন শাড়িখানা নিয়ে এলো। তারপর মাকে ডাকল, মা, এহন আর পাগলামি কইরো না। দুয়ার খোলো। সময় বেশি নাই।

নুরুন্নাহার কোনো সাড়া দিলেন না। পারুল দরজায় ধাক্কা মেরে বলল, তোমার লাল কাপুড় আনছি মা। কত্ত সোন্দর শাড়ি, তুমি খালি একবার দেহে। দুয়ার খোলো। শাড়ি দেহনের পর দেখব তোমার রাগ কই থাহে! খোলো, দুয়ার খোলা।

নুরুন্নাহার দরজা খুললেন না। পারুল অপেক্ষা করতে লাগল। নানা অনুনয়-বিনয় করল। রাগ করল। কিন্তু কোনোকিছুতেই কিছু হলো না। নুরুন্নহার দরজা খুললেন না। সাড়াও দিলেন না কোনো।

নুরুন্নাহারকে বের করতে হলো দরজা ভেঙে। কিন্তু সেই ভাঙা দরজার ঘর থেকে নুরুন্নাহার বের হলেন না। বের হলো নুরুন্নাহারের লাশ। পারুল মায়ের লাশের দিকে তাকিয়ে রইল। সে কাঁদল না। চিৎকার-চেঁচামেচি করল না। শান্ত, স্থির দৃষ্টিতে সে মায়ের লাশের দিকে তাকিয়ে রইল। দুপুর নাগাদ সে তেমনই মায়ের পাশে বসে রইল। কারো সাথে কোনো কথা বলল না। একটা শব্দও না। তার হাতে মায়ের জন্য কেনা রঙিন শাড়িখানা। দুপুরের পর পারুল সেই শাড়ি হাতে উঠে দাঁড়াল। তারপর জুলফিকারকে ডেকে সে শান্ত স্বাভাবিক গলায় বলল, জুলফিকার ভাই, মায়রে গোসলের ব্যবস্থা করান। আমি রাইতে মায়রে কইছিলাম তারে বেয়ান বেলা গোসল করাইয়া নতুন শাড়ি পিন্দামু। মায়রে গোসলের ব্যবস্থা করান। আমি আমার মায়রে গোসলের পর শাড়ি পিন্দামু।

লাশ গোসল করানোর জন্য তিনজন মহিলা এসেছেন। তারা নুরুন্নাহারের লাশ গোসল করালেন। গোসল করানো শেষে তাকে কাফনের কাপড় পরানো হবে। কিন্তু বাধ সাধল পারুল। সে শান্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাদের কাছে গেল। গিয়ে তার হাতের কাপড়খানা তাদের একজনের হাতে দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, আমার মায় কাফনের সাদা কাপড় পরব না। সে পরব এই রঙিন কাপুড়। তারে এই কাপুড়খান পরান।

মহিলা তিনজন ভয় এবং বিস্ময়মিশ্রিত দৃষ্টিতে পারুলের দিকে তাকিয়ে রইল। পারুল বলল, কি? আমার কথা আপনেগো কানে যায় না? বোঝেন না আমার কথা? আমার মায়রে এই কাপুড় পরান। এক্ষণ পরান। এক্ষণ।

পারুলের পাগলামি শুরু হলো এর পর। সে তার মাকে এই কাপড় না পরিয়ে কবর দিতে দেবে না। কিছুতেই দিবে না। চারপাশে লোক জমে গেল। কিন্তু পারুলকে সামলানো গেল না। সে পাগলের মতো হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করল। তার তীব্র চিৎকারে যেন আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হতে লাগল। পারুলকে জোর করে তার ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে আটকে রাখা হলো। কিন্তু তার চিৎকার তাতে থামল না। তার বাবা আব্দুল ফকিরের খোঁজ করার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু আব্দুল ফকিরকে কোথাও পাওয়া গেল না। আব্দুল ফকির কোথায় আছেন, কবে ফিরবেন, কেউ জানে না। ফলে স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদও তিনি পেলেন না। তাকে না জানিয়েই কবর দিয়ে দেয়া হলো নুরুন্নাহারকে।

পারুল তখন রঙিন একখানা শাড়ি হাতে নিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে।

*

নয়ন সোফায় বসে আছে। তার সামনে একদম মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে হেমা। নয়নের বসার ভঙ্গিটা অদ্ভুত। সে বসে থাকলেও সামনের দিকে ঝুঁকে উবু হয়ে তার মাথাটা গুঁজে রাখা আছে হেমার কোলে। হেমা দু’হাতে শক্ত করে নয়নের মাথা চেপে ধরে বসে আছে। কিন্তু তাতেও নয়নের কম্পন থামছে না। তার ভাঁজ হয়ে থাকা পিঠ, গুঁজে রাখা মাথা, আর সেই মাথা চেপে ধরে রাখা হেমার হাত সকলই কাঁপছে। হেমা যে নয়নের দিকে তাকিয়ে আছে, তা নয়। দু’হাতে নিজের কোলের ভেতর নয়নের মাথা চেপে ধরে রাখলেও সে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। সেখানে ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে। হেমা সেই ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, হেমা গভীর আগ্রহ নিয়ে ফ্যানের ঘুরন্ত পাখাগুলো দেখছে। কিন্তু ফ্যানের পাখা ঘোঘারার মধ্যে দেখার কিছু নেই। সে অবশ্য তা দেখছেও না। সে আসলে কিছুই দেখছে না। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। ডিসেম্বরের শেষ দিকের এইসময়ে ঢাকায় ভালোই শীত পড়ে। অথচ সেই শীতে ফুল স্পিডের ফ্যানের নিচে বসেও দরদর করে ঘামছে হেমা।

নয়ন পাগলের মতো দেখা করতে চাইছিল হেমার সাথে। সে দেখা করতে চেয়েছে নির্জন একা কোথাও। সবচেয়ে ভালো হয় বাসা হলে। হেমা শুনে প্রথম খানিক অবাক হয়েছিল। খানিক কৌতূহলীও। দুষ্টুমি করে নয়নকে ইঙ্গিতপূর্ণ টিপ্পনিও কেটেছিল। কিন্তু সেসবে কান দেয়নি নয়ন। সে বলেছিল, আমি শুধু তোমার সাথে একটু দেখা করতে চাই। একটু কথা বলতে চাই। একা। তারপর আর কোনোদিন তোমার সাথে দেখা করতে চাইব না আমি। কথা বলতেও চাইব না।

নয়নের গলায় কিছু একটা ছিল। হেমা আর দুষ্টুমি করেনি। নয়নকে সে তার আগের বাসায় নিয়ে এসেছে। বাসাটা এখন একদম ফাঁকা। কেউ নেই। সকালে বাসায় ঢোকার পর তার নিজেরই কেমন গা ছমছম করছিল। নয়ন আসার আগ অবধি হেমা একা একা বসেছিল বারান্দায়। গত কয়েকদিন ধরে হেমার মনটাও তেমন ভালো নেই। নতুন বাসায় মায়ের সাথে থাকতে গিয়ে বেশ কিছুদিন খুব ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। রেণু যেহেতু এই বাসা থেকে কিছুই নেননি, সেহেতু ফার্নিচার থেকে শুরু করে নানান জিনিসপত্র কিনতেই গেল প্রথম ক’দিন। তারপর ঘর গোছানো। বাজার করা। ডিসের লাইন, ইন্টারনেট, আরো হাজারটা জিনিস। ভয়াবহ অবস্থা।

হেমা আসার ঘণ্টাখানেক পরে এসেছে নয়ন। নয়নকে দেখে হেমা থমকে গেছে। নয়নের গালে কিসের এক দাগ, তার চেহারা এলোমেলো। দেখে মনে হচ্ছে ভয়াবহ কোনো ঝড়ের মধ্য দিয়ে এসেছে সে। নয়নের এই অবস্থা অবশ্য আজকাল নতুন নয়। বেশ কিছুদিন ধরেই এমন বিধ্বস্ত অবস্থা তার। কিন্তু আজ যেন সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে। সে দরজা খুলতেই নয়ন তার সামনে কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কেমন আবোল-তাবোল বকতে লাগল। হেমা বলল, কি হয়েছে নয়ন?

নয়ন খানিক্ষণ এটা-সেটা নানান কিছু বলতে চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুই তার মুখ দিয়ে বের হলো না। হেমা নয়নের হাত ধরে টেনে তার বেডরুমে নিয়ে এলো। সেখানে ছোট্ট একটা সোফা, নয়ন সেই সোফার উপর ধপ করে বসে পড়ল। তারপর ঝুঁকে নিজের দুই উরুর উপর মাথা দিয়ে বসে রইল। হেমা বুঝতে পারছিল খারাপ কিছু ঘটেছে! কিন্তু সে তো গত কয়েক মাস ধরে ঘটেই চলেছে। আর কি খারাপ ঘটবে? বরং হেমা মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, নয়ন যদি আজ তাকে আবারো কোনো খারাপ ঘটনার কথা বলে, তাহলে সেও তার বাবা-মায়ের ডিভোর্সের ঘটনা তাকে শোনাবে। নয়নের বোঝা উচিত সবার জীবনেই খারাপ ঘটনা ঘটে। কিন্তু তা নিয়ে এভাবে ভেঙে পড়লে চলে না। তার আরো শক্ত হওয়া উচিত। সে দিন দিন দুর্বল মানসিকতার মানুষ হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু নয়নের কথা শোনার পর থেকে আর হেমার মাথা কাজ করছে না। তার মনে হচ্ছে তার নাক দিয়ে, কান দিয়ে গরম ভাপ বের হচ্ছে। সে দরদর করে ঘামতে লাগল। নয়নকে কি শান্তনা দিবে হেমা? কি বোঝাবে সে? সে তো তার নিজেকেই আর বোঝাতে পারছে না।

সোফায় বসে ঝুঁকে থাকা নয়নের পিঠ কাঁপছিল। হেমা তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল, কি হয়েছে আমাকে বলো নয়ন?

নয়ন চোখ তুলে তাকাল। সেই না ঘুমানো টকটকে লাল চোখ। হেমা বলল, বলো।

নয়ন বলল, আই এম আ বাস্টার্ড!

হেমা নয়নের কথাটা ঠিকঠাক বুঝল না। সে নয়নের সামনে মুখোমুখি হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর বলল, হোয়াটস রং উইথ ইয়ু নয়ন?

নয়ন বরফের মতো শীতল গলায় বলল, আই এম আ বাস্টার্ড। আমি একটা জারজ হেমা। আমি একটা শতভাগ জারজ সন্তান। দ্য ম্যান হুম আই নোন অ্যাজ মাই ফাদার ইজ নট মাই ফাদার। ফখরুল আলম ইজ নট মাই ফাদার। আই এম নট হিজ সান। আই এম আ বাস্টার্ড চাইল্ড।

হেমা বুঝতে পারছিল গুরুতর কিছু ঘটেছে। কিন্তু কি ঘটেছে সেটি নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিল সে। তার ধারণা ছিল, কোনো বিষয় নিয়ে নয়ন প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে, আহত হয়েছে, এইজন্য রাগের মাথায় সে এসব বলছে। হেমা নরম গলায় বলল, ছিঃ নয়ন। এসব বলতে হয় না। কি হয়েছে তোমার বলো তো? কোনো কারণে রেগে আছে কারো উপর? বাবা কিছু করেছেন? মা?

নয়ন জবাব দিলো না। সে নিস্পৃহ চোখে হেমার দিকে তাকিয়ে আছে। হেমা বলল, রেগে গেলেই এই নোংরা কথাগুলো বলতে হবে?

নয়ন হঠাৎ কেঁদে ফেলল। শিশুর মতো শব্দ করে, ভাঙা কাঁচের মতো ঝরঝর করে ভেঙেচুরে ছড়িয়ে যাওয়া কান্না। সে দু’হাতে হেমার হাত চেপে ধরে বলল, আমি নোংরা হেমা। আই এম দ্যাট শিট। আই এম দ্যাট বাস্টার্ড শিট।

হেমা কিছুই বুঝতে পারছে না। সে হাতের মুঠোয় নয়নের দুই হাত চেপে ধরে রেখেই বলল, কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো।

নয়ন কাঁদছে। কাঁদছেই। কিন্তু এই কান্না শব্দহীন জলের কান্না। তার দু’গাল গড়িয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রু। হেমা আচমকা নয়নের হাত ছেড়ে দুই হাতে শক্ত করে তার গাল চেপে ধরল। তারপর বলল, নয়ন!

নয়ন জড়ানো গলায় বলল, এই কথাটাই আমি গত পাঁচ-ছটা মাস ধরে বলতে চেয়েছি হেমা। এই কথাটাই গত পাঁচ-ছটা মাস ধরে আমি নিজের ভেতর লুকিয়ে রেখেছি। গত পাঁচ-ছটা মাস ধরে এই কথাটাই আমি জানি। কিন্তু আমি কাউকে বলতে পারি নাই। সেই সাহস আমি করতে পারি নাই। নিজের সাথে প্রত্যেকটা সেকেন্ড আমি যুদ্ধ করেছি। ভেঙে না পড়তে চেষ্টা করেছি। নিজে নিজে ফেস করার চেষ্টা করেছি। ফতেহপুর চলে গিয়েছি। ঢাকায় ফিরে এসেছি। রাতের পর রাত ঘুমাইনি। দুঃস্বপ্ন দেখে একা একা বাচ্চাদের মতো কেঁদেছি। কিন্তু আমি পারিনি হেমা। আমি কাউকে বলতে পারিনি। প্রত্যেকটা দিন আমি ভেতরে ভেতরে ধ্বংস হয়েছি। দুর্বল, ভিতু, হিনমন্য হয়ে গেছি।

নয়ন হাউমাউ করে কাঁদছে। হেমা উঠে একটা চেয়ার এনে নয়নের সামনে একদম মুখোমুখি বসল। নয়ন কান্নাজড়ানো গলায় ফিসফিস করে বলল, ডু ইউ নো, হু ইজ মাই ফাদার? ডু ইউ নো? আমার সত্যিকারের বাবা কে তুমি জানো? তুমি জানো আমার আসল বাবা কে? জানো না।

হেমা কি বলবে! সে বলার কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে সে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। এখুনি তার ঘুম ভেঙে যাবে, আর সাথে সাথে সে দেখতে পাবে তার সামনে নয়ন বলে কেউ নেই। এই ধরনের কোনো ঘটনাও কখনো ঘটেনি।

নয়ন বলল, আব্দুল ফকির। হি ইজ মাই টু ফাদার। হি ইজ! যেই মানুষটার কারণে আসমা সুইসাইড করেছে। আজ থেকে বহুবছর আগে ঠিক একই কারণে আমার মা যদি সুইসাইড করতেন। তাহলে আমার জন্ম হতো না। সে ঠিক একইভাবে আমার মায়ের পেটে আমাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমি একটা নোংরা, জঘন্য মানুষের তীব্র লালসার ফল। এই সত্যিটা জানতে আমাকে এতগুলা বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে হেমা। এতগুলা বছর। এখন। আমি কি করব হেমা? আমার নিজেকে ঘিনঘিন লাগে। নিজের জন্য নিজের বমি পায়। মনে হয়, আমি একটা মরা পচা গলা উঁদুর। আমাকে দেখে সবাই ঘেন্নায় নাক চেপে ধরে।

হেমার মনে হচ্ছে তার মাথায় কিছু ঢুকছে না। সে কিছু বলতেও পারছে না নয়নকে। সে জানে না, এমন মুহূর্তে কাউকে কি বলতে হয়! সে কেবল নয়নের যন্ত্রণাটা বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই যন্ত্রণা কি অন্য কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব? সম্ভব না। এই মাত্র কদিন আগেই বাবা যখন মায়ের সাথে তার বিয়ের ঘটনাটা খুলে বললেন। আর সেই ঘটনা বলতে গিয়ে তিনি যখন বলেছিলেন যে হেমার জন্মটা আসলে হয়েছিল রেণুর সাথে তার সম্পর্কটা স্বাভাবিক করার জন্য। তখন হেমার নিজেকে কী যে অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হচ্ছিল! কি যে অনভিপ্রেত মনে হচ্ছিল! ভেতরে ভেতরে কষ্ট-অভিমানে তার মরে যেতে ইচ্ছে। হয়েছিল। আর নয়নের কেমন লাগছে? এই এত এত বছর পর যে সত্য সে আবিষ্কার করেছে? যে সত্য আবিষ্কার করার পর থেকে গত পাঁচ-ছ’টা মাস সে যে নরক যন্ত্রণা ভোগ করেছে, তাকে অন্য কেউ কি করে বুঝবে?

নয়ন যেন খানিকটা স্থির হলো। সে বলল, আমি চেষ্টা করেছি হেমা। অসংখ্যবার তোমাকে বলতে চেষ্টা করেছি। সাহস হয়নি। মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছি। সাহস করতে পারিনি। আমার কেবল মনে হতো কি করব আমি? কি যে যন্ত্রণা হেমা। কি যে যন্ত্রণা!

হেমা তারপরও নয়নের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে নরম করে বলল, আমাকে একটু খুলে বলবে নয়ন? কি হয়েছিল আমাকে একটু বলবে? প্লিজ?

নয়ন চোখ বন্ধ করে, হাত মুঠো করে ফেলল। তারপর অনেক সময় নিয়ে চোখ খুলে হেমার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল, মা’র তখন কত হবে বয়স? পনের বা ষোল। এক রাতে আসমার মতোই সাপে কেটেছিল মাকে। নানাজান তখন বাড়িতে ছিলেন না। আর তখন আব্দুল ফকির নামের লোকটা ঠিক একইভাবে বিষ নামাতে এসেছিল।

হেমা যেন সাথে সাথেই বুঝে ফেলল ঘটনা কি ঘটেছিল। সে আঁৎকে ওঠা গলায় বলল, আর তখন ঠিক একইভাবে সে…!

নয়ন স্থির গলায় বলল, হ্যাঁ। আব্দুল ফকির চলে যাওয়ার পরও পুরো একটা দিন চেতনা ছিল না মায়ের। ঘুমিয়েই ছিল সে।

হেমা রুদ্ধশ্বাস গলায় বলল, তারপর?

নয়ন বলল, নানাজান বাড়ি ফিরলেন কুড়ি দিন পর। নানীজান ঘটনা বুঝতে পারলেন তারও মাসখানের পর। নানাজানকে ভয়ে ভয়ে ঘটনা জানালেন তিনি। নানাজান বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি রাগলেন না। কিছু বললেন না। মানুষে জানাজানির ভয় ছিল। তিনি একটা ভালো সমাধান খুঁজছিলেন। আর ঠিক তখুনি বাবা গিয়েছিলেন ফতেহপুর তার ফুপুর বাড়িতে বেড়াতে। একদিনের নোটিশে বাবার সাথে বিয়ে হয়ে গেল মার। সেইদিনই বাবার সাথে মাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন নানাজান। পঁচিশ বছর। মা আর কখনোই ফতেহপুর যাননি।

হেমা বলল, কিন্তু তোমার নানাজান তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিলেন? উনি তো এমন মানুষ না!

নয়ন বলল, না। নানাজান এমনি এমনি ছেড়ে দেয়ার মানুষ না। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন সবার আগে মায়ের একটা ব্যবস্থা করতে। নানাজান চাননি, এই ঘটনা জানাজানি হোক।

নয়ন থামল। হেমা নিস্পলক চোখে তাকিয়ে আছে নয়নের দিকে।

নয়ন বলল, মা’র ব্যবস্থা করে নানাজান চেষ্টা করেছিলেন আব্দুল ফকিরকে শাস্তি দিতে। সবাই জানে, নানাজান কী ভয়ঙ্কর এক মানুষ। নিজের বংশ মর্যাদা, মান-সম্মান নিয়ে তিনি কি রকম সতর্ক, তাও সবাই জানে। মাকে ঢাকা পাঠিয়ে দিয়েই নানাজান যেন উন্মাদ হয়ে গেলেন। তিনি আব্দুল ফকিরকে খুন করতে চাইলেন। কিন্তু সরাসরি নিজের মেয়ের অজুহাত তুলে তো এত বড় ঘটনা ঘটানো যায় না। লোকে জানাজানির ভয় থাকে। এইজন্য নানাজান একটা যুতসই অজুহাত খুঁজছিলেন।

হেমা বলল, তারপর? লোকটা তো এখনও বেঁচেই আছে!

নয়ন বলল, হু। আছে। কিছুদিন পরেই নানাজান অজুহাত পেয়ে গেলেন অন্য এক ঘটনায়। ঠিক একইভাবে অন্য একটা মেয়ের বিষ নামাতে ওঝা হয়ে গিয়েছিলেন আব্দুল ফকির। আর সেখানেও একই ঘটনা। মেয়ের পরিবার দরিদ্র। নানাজান ঘটনা জনালেন মেয়ের পরিবারের কাছে। সেই মেয়ের অজুহাতে নানাজান আব্দুল ফকিরকে খুন করতে গেলেন। রাতের অন্ধকারে তাকে খুন করে নিয়ে এলেন। কিন্তু…

হেমা বলল, কিন্তু কি?

নয়ন পরের ঘটনা যতটা সম্ভব খুলে বলল। সে বলল, দুই দুই বার, এভাবে দুই দুইবার নানাজান তাকে খুন করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু পারেন নাই। প্রতিবারই আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গেছে সে। লোকে এমনিতেই বিশ্বাস করে আব্দুল ফকিরের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা আছে।

হেমা বলল, হু। আসমাও এমন অনেক কিছুই বলেছিল।

নয়ন বলল, হ্যাঁ। নিজের চারপাশে সব সময় একটা রহস্য, একটা ধোঁয়াশা তৈরি করে রাখে সে। তুমি জানো না, কি অসম্ভব ভয় পেতে শুরু করেছিলাম তাকে আমি। সবাই তাকে ভয় পায়। তীব্র ভয় পায়। দুই দুইবার চেষ্টা করেও নানাজান তার কিছু করতে পারলেন না। দুবারই বলতে গেলে অস্বাভাবিকভাবেই বেঁচে গিয়েছিল সে। তারপর থেকে নানাজানের ভেতরেও একটা ভয় দেখা দিলো। তারও মনে হতে লাগল, আব্দুল ফকিরের কোনো একটা ব্যাপার আছে।

হেমা বলল, উনিও এসব বিশ্বাস করেন?

নয়ন বলল, সবাই করে। এই যে আমি, এই আমিও করতে শুরু করেছিলাম। এখনও করি কিনা জানি না। আর নানাজান ছোটবেলা থেকেই এমন পরিবেশে বড় হয়েছেন, এমন অসংখ্য বিশ্বাস নিয়ে যে বিষয়গুলো ভাবনায় ঢুকে যায়। তা সে যত সাহসিও হোন না কেন! এই অতিপ্রাকৃত ব্যাপারটা উনাদের মাথায় থেকেই যায়। তাছাড়া আব্দুল ফকির নানাভাবে এই ভয়টা তৈরি করেছিলেন। হি হ্যাঁজ দ্যাট পাওয়ার টু কনভিন্স পিপল।

হেমা বলল, তারপর?

নয়ন বলল, নানাজান আব্দুল ফকিরের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। সবাই তাই করেছে। কেউ তাকে ঘাটায়নি। কেউ এড়িয়ে চলে, কেউ ভয় পায়। কিন্তু ওই জঘন্য, ভয়ঙ্কর মানুষটা এখনও তেমনই আছে। একদম তেমন। হি ইজ সিক। হি ইজ আ পারভার্ট। হি ইজ আ প্যাশেন্ট অফ হাইপার সেক্সয়াল ডিজঅর্ডার।

নয়ন আবার মাথা চেপে ধরল দু’হাতে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ভেতরে ভেতরে সে আর মানুষ নাই। একটা পশু হয়ে গেছে। সমস্যা আছে পশু হলে তুমি তাকে বাইরে থেকে দেখলেই চিনতে পারবে যে এ পশু। এর ধরালো দাঁত, নখ, গর্জন আছে। চোখে-মুখে হিংস্রতা আছে। একটা ব্রুটাল ব্যাপার আছে। তুমি দেখেই সতর্ক হতে পারবে। কিন্তু এই মানুষটাকে দেখলে তা বোঝার উপায় নেই। তাকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে অতি সাধারণ চেহারার একজন সাদাসিধে, সহজ সরল মানুষ।

মা বলল তারপর

নয়ন চুপ করে গেল। সে এখন দু’হাতে মুখ ঢেকে আছে। হেমাও চুপ করে রইল খানিক। তারপর বলল, তুমি এই এত এত জিনিস জানলে কীভাবে? এই এতকিছু, এতবছর পর?

নয়ন বলল, তুমি জানো মার একটা লেখালেখির অভ্যাস ছিল। তার লেখা অনেকগুলো খাতা আমি পেয়েছি। ওই সময়টা ভয়াবহ ডিপ্রেশন যাচ্ছিল মার। অনেকবার সুইসাইড করার কথাও ভেবেছিল। সারাদিন ঘর থেকে বের হতো না। কারো সাথে কথা বলত না। ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুধু ঘুমাত আর লিখত। সবকিছু লিখে রাখত সে। মা কিছুটা অদ্ভুত প্রকৃতির ছিল। এমনিতেই কারো সাথে খুব একটা কথাবার্তা বলত না। মিশত না। একা একা থাকত। এই সময়টায় এসে আরো গুটিয়ে ফেলল নিজেকে। সেই সময় আসলে সে কথা বলত একা একা। আর তার সঙ্গী ওই খাতাগুলো। দিনের পর দিন, পাতার পর। পাতা সে শুধু লিখেই গেছে। শুধুই লিখে গেছে। যখন যা মন চেয়েছে সব লিখেছে। এই কথাগুলো, এই কষ্টগুলো বলার তো আর কেউ ছিল না তার। কি কষ্ট একটা মানুষ যে পেয়েছে। তুমি জানো না হেমা, আমি যতটা দিন মার পেটে ছিলাম, মার শুধু মনে হতো তার পেটভর্তি বমির মতো নোংরা ঘিনঘিনে কিছু। তার আমাকে বমি করে উগড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হতো হেমা। হেমা, ও সময়টা জুড়ে মা কেবল তার এইসব অনুভূতির কথাই লিখেছে। মার তো দোষ নেই। কিন্তু হেমা, আমার নিজেকেই নিজের ঘিনঘিন লাগে। বমি বমি লাগে। আমি নিজেকে আর সহ্য করতে পারি না। মনে হয় আমার ভেতরে বাইরে সবটাই একটা নোংরা, সবটাই একটা ল্যাদল্যাদে বিশ্রি ঘেন্নার জিনিস। আমার ভাবতেই বমি পায় হেমা।

নয়নের শরীর দুমড়ে মুচড়ে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যেন বমি উঠে আসছে। নয়ন দু’হাতে তার পেট চেপে ধরে বীভৎস শব্দ করল। কিন্তু বমি হলো না তার। হেমা নয়নের মাথা টেনে নিলো। তারপর দুহাতে চেপে ধরে রাখল তার কোলের উপর। তারপর তাকিয়ে রইল মাথার উপরে ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে। নয়ন চুপ করে গেল। থেকে থেকে ঝাঁকুনি খাচ্ছে তার শরীর। নয়নের কষ্টটা হেমা বুঝতে পারছে। পুরোটা না হলেও বুঝতে পারছে। কিন্তু নয়নকে কি বলবে সে!

দীর্ঘ সময় কেটে গেল অসহনীয় নৈঃশব্দ্যে। নয়নের শরীরটাও শান্ত হয়ে এসেছে। হেমা আস্তে আস্তে দু’হাতে নয়নের মাথা তুলল। নয়ন বলল, একটা কথা বলি হেমা?

হেমা বলল, বলো?

নয়ন বলল, আমি এখন কি করব?

হেমা বলল, কিছুই করবে না। ঠিকঠাক পড়াশোনা করবে। যেমন ছিলে তেমন থাকবে। এই ঘটনায় তোমার কোনো দায় নেই।

নয়ন বলল, কিন্তু ওই মানুষটা? ওই মানুষটার কিচ্ছু হবে না?

হেমা বলল, কিচ্ছু হবে কিনা জানি না। তবে একটা কথা বিশ্বাস করি। মানুষ তার পাপের শাস্তি পায়ই।

নয়ন বলল, ও তো মৃত্যুর পরের কথা। কিন্তু বেঁচে থাকতে?

হেমা বলল, আমার বিশ্বাস, সে পাবে। নাথিং ইজ আনপেইড, ইউ নো।

নয়ন বলল, কিন্তু কীভাবে? শুড আই কিল হিম? আমার কি মনে হয় জানো, আমি ওকে খুন করে ফেলি। তারপর নিজেকে!

হেমা আবারো নয়নের মাথায় হাত রাখল। তারপর বলল, এটা সিনেমা না নয়ন। মাথা ঠান্ডা রাখো। একটা কথা বলি? মাথা ঠান্ডা রেখে শুনবে?

নয়ন কোনো জবাব দিলো না। তবে তাকিয়ে রইল। হেমা বলল, সবার আগে নিজেকে নোংরা ভাবাটা বাদ দিতে হবে। তোমার জন্মের উপর তোমার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কারো জন্মেই তার নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তাহলে? যেখানে কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সেখানে সে দোষী কেন হবে? আর পৃথিবীর কোনো জন্মই কিন্তু নোংরা না। একটা জিনিস ভাবো তো, তোমার জন্মের আগে তোমার মা কত কিছু ভেবেছিলেন। কিন্তু তোমাকে দেখার পর মুহূর্তের মধ্যে সেই ভাবনাটা তার বদলে গেল। তোমার এই অসম্ভব ক্ষমতাটা তুমি দেখবে না?

নয়ন বলল, কিন্তু ওই মানুষটা? ওর কিচ্ছু হবে না?

হেমা বলল, হবে। নিশ্চয়ই হবে।

নয়ন বলল, কি হবে? কিচ্ছু হবে না। এই এত এত দিনেও ওর কিছু হয়নি। ওর সবচেয়ে বড় শাস্তি হবে আমি যদি কিছু করি। তার পাপের হাতে তার মৃত্যু।

হেমা বলল, শান্ত হও। একটু স্থির হও।

নয়ন হঠাৎ বলল, তুমি কি জানো, আমি আর কক্ষণো তোমার কাছে আসব না। কোনোদিন না!

হেমা বলল, কেন?

নয়ন বলল, আমাকে তোমার ঘেন্না হবে। তুমি হয়তো ঘেন্নাটা করতে চাইবে না, কিন্তু তোমার অবচেতন মন এই ঘেন্নাটা করবে। আমাকে ভালোবাসতে গেলে মুহূর্তের জন্য হলেও সে তোমাকে এই ফিলিংটা দেবে যে আই এম আ বাস্টার্ড। আমাকে স্পর্শ করতে গেলে তোমার মধ্যে সামান্যতম সময়ের জন্য হলেও দ্বিধা তৈরি হবে। আমার সন্তানের মা হতে গেলে তোমার অবচেতন মন তোমাকে ভাবাবে, তুমি কি ঠিক করছ? কী অসহ্য! কী যন্ত্রণাময় এক জীবন। হেমা, হেমা! আমি আর পারি না। আমার মাথার ভেতর অসংখ্য পোকা সারাক্ষণ যেন খুটে খুটে খাচ্ছে।

হেমা বলল, আমার কিচ্ছু হবে না নয়ন। কিচ্ছু হবে না। মুহূর্তের জন্যও না।

নয়ন বলল, হবে হেমা। হবে। আমি জানি হবে। তুমিও আমার মতো, আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই একটা মানুষ। এই অনুভূতি থেকে তুমি ভেতর থেকে বের হতে পারবে না। প্রিটেন্ড করতে পারবে। চেষ্টা করতে পারবে। কিন্তু বীভৎস একটা অনুভূতি সময়ে-অসময়ে এসে অদৃশ্য কিন্তু তিক্ষ্ণ এক কাঁটা হয়ে থাকবে। তোমার সাথে আমার সম্পর্ক কখনো খারাপ হলে, ঝগড়া হলে, তুমি সবার আগে আমাকে আমার এই দুর্বল জায়গাটাতে আঘাত করবে। এমন হয় হেমা। তখন প্রচণ্ড রাগ হয়। আর রাগের মাথায় আমরা আর কোনো সঙ্কোচ রাখি না। সব সত্যি কথাগুলো বলে ফেলি। কিন্তু আমি সেটা নিতে পারব না হেমা।

হেমা ডাকল, নয়ন!

নয়ন বলল, আমাকে কিছু বুঝিও না হেমা। আর কিছু না। আমি সব বুঝি, সব। আমি কাউকে আমার সত্যিকারের পরিচয় দিতে পারব না। কারো কাছেই না। তোমার বাবা মার কাছেও না।

হেমা বলল, তোমার সত্যিকারের পরিচয় কি?

নয়ন কথা বলল না। কী বলবে সে! আব্দুল ফকিরকে সে বাবা বলে উচ্চারণ অবধি করতে চায় না।

হেমা বলল, বাবা-মা কেন হয় জানো? মমতা আর ভালোবাসায়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মমতা আর ভালোবাসা যাদের সৃষ্টি করে, তাদের নাম বাবা আর মা। যেই মানুষটাকে এতদিন বাবা বলে জেনে এসেছ, কোনো একদিন কি ঘুণাক্ষরেও মনে হয়েছে যে এই মানুষটা তোমার বাবা নন?

নয়ন কথা বলল না। হেমা বলল, বাবার কত কত গল্প তুমি করেছ! কত কত গল্প। মনে আছে? তুমি সেন্টমার্টিন ট্যুরে গেলে। হঠাৎ করেই কি এক ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস। চার নম্বর বিপদ সঙ্কেত। একটা গোটা দিন ধরে তোমার কোনো খবর নেই। তোমার বাবা পাগলের মতো হয়ে গেলেন। তিনি গিয়ে আবহাওয়া অফিসের সামনে বসে রইলেন। আবহাওয়া অফিস থেকে যাকেই বের হতে দেখছেন, তার কাছে গিয়েই হাউমাউ করে কেঁদে হাতজোড় করে বলছেন, আমার ছেলে সেন্টমার্টিন গেছে, আপনারা বিপদ সঙ্কেতটা কমায়ে দেন। আপনারা বিপদ সঙ্কেতটা কমায়ে ঝড়টা নামায়ে দেন। একবার ভাবো তো! বিপদে ঘণ্টাকয়েক মাত্র ছেলের খবর নেই বলে একজন বাবা কেমন হয়ে যেতে পারেন! একবার ভাবো তো!

নয়ন বলল, আমি জানি হেমা। আমি সব জানি। তার সাথে আমি ঠিক মতো কথা বলি না। তাকে এতটুক সময় দেই না। কিন্তু তিনি যেন সব সময় একটা ছায়া হয়ে আমার আশেপাশে থাকেন।

হেমা বলল, এই ছায়াটাকেই আমরা চিনতে পারি না। কারণ ছায়াটা আমাদের সকল কিছু থেকে আগলে রাখে, ঢেকে রাখে। এইজন্য এদের আমরা দেখতে পাই না। ছায়ার ভেতর থাকি বলেই এই ছায়ামানবদের আমরা দেখতে পাই না, সবচেয়ে বেশি উপেক্ষা করি।

নয়ন বলল, কিন্তু এই সত্যটা কি উনার কাছে লুকানো আমার ঠিক হচ্ছে? আমি কি করব? আমার কি উনার কাছে গিয়ে বলা উচিত না যে, তুমি আমার বাবা নও। আই এম নট ইওর সান। বাট আমি বিশ্বাস করি তুমিই আমার বাবা। আমি তোমাকে বাবা ছাড়া আর কিছু কখনোই ভাবিনি। আমার কি উনাকে এটা খুলে বলা উচিত না? যেই মানুষটা আমাকে এত ভালোবাসেন তার কাছে এই ভয়ঙ্কর সত্যটা কি আমার লুকিয়ে রাখা উচিত হেমা?

হেমা এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। এই প্রশ্নের জবাব হেমার কাছে। নেইও। সে চুপ করে রইল। নয়ন ঝট করে উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, আমাকে একটা পলাতক মানুষের জীবন কাটাতে হবে হেমা। আই উইল হ্যাভ টু লিড মাই হোল লাইফ অ্যাজ অ্যান এসকেপিস্ট। হোল থু মাই লাইফ। আমি যখন কারো কাছে আমার বাবার নাম বলব, লিখব, প্রতিটি মুহূর্তে এই ঘটনা আমার মনে পড়বে। আমার মধ্যে দ্বিধা কাজ করবে। ঘেন্না কাজ করবে। মনে হবে আমি একটা সত্যকে লুকাচ্ছি। মনে হবে সেই সত্যটা প্রকাশ করার সাহস, ক্ষমতা আমার নেই। কারণ আমি একটা কুৎসিত সত্য। তুমি ভাবতে পারছ হেমা? আমি জানি না, কখনো হবো কিনা, কিন্তু আমি যদি কখনো সন্তানের বাবা হই, আমি আমার সন্তানদের অবধি তাদের গ্র্যান্ডফাদারের নাম বলতে পারব না। বলতে গেলে আমার গলা কাঁপবে। আমার বিশ্বাস কাঁপবে। আমার আবার নিজেক অচ্ছুৎ, অপবিত্র মনে হবে। কী ভয়ঙ্কর অসহনীয় যন্ত্রণার ব্যাপার তুমি জানো হেমা?

হেমা জানে, বোঝেও। কিন্তু কি করবে সে? নয়ন হঠাৎ ছুটে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। হেমা ডাকল, নয়ন?

নয়ন শুনল না। পেছন ফিরে তাকাল না অবধি। হেমাও নয়নের পেছন পেছন দরজা অবধি ছুটে এলো। নয়ন বলল, আমি যাই হেমা।

হেমা বলল, কোথায় যাচ্ছ?

নয়ন বলল, জানি না।

হেমা বলল, বাসায় যাচ্ছ না?

নয়ন বলল, আমি সত্যি জানি না।

হেমা বলল, এমন করো না।

নয়ন হঠাৎ বলল, একটা কথা বলি হেমা?

হেমা বলল, বলল।

নয়ন বলল, জানি, বললে তুমি মেনে নিতে চাইবে না। তোমার চোখে আমায় নিয়ে একটা স্পষ্ট দ্বিধা। একটা স্পষ্ট সঙ্কোচ।

হেমা বলল, কি বলছ!

নয়ন বলল, আমি ঠিক বলছি হেমা। মাকে গতরাতে আমি বলেছি যে এই ঘটনাগুলো আমি জেনে গিয়েছি। তারপর এসেছি তোমার কাছে। কেন এসেছি জানো? আমার জীবনে আমি তোমার মতো এত স্থির আর গভীর কাউকে দেখিনি। তুমি বয়সের তুলনায় অনেক বড়, অনেক গভীর একটা মানুষ। তুমি আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসো। তোমার চোখে আমার এই নতুন পরিচয়টা দেখা আমার জন্য তাই সবচেয়ে বেশি জরুরি ছিল। তাহলে পৃথিবীর আর সকল মানুষের ভাবনা বোঝাটা আমার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে।

হেমার হঠাৎ কেমন রাগ লাগতে লাগল। সে বলল, তারপর? আমাকে দেখে তুমি কি বুঝলে নয়ন?

নয়ন ম্লান হাসল। তারপর বলল, তুমি এইটুকু সময়েই নিজের সাথে যুদ্ধ করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছ। এটা আমার চোখ এড়ায়নি হেমা। গত কিছুদিন থেকে আমিও তো নিজের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ করছি! বিষয়টা আমার জন্য বোঝা খুব কঠিন কিছু নয়।

হেমার কী সব বলতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু সে তার কিছুই গুছিয়ে আনতে পারল না। তার শরীর আর মস্তিষ্ক জুড়ে কেমন একটা অস্থিরতা শুরু হয়েছে। কিন্তু নয়ন তাকে এভাবে ভুল বুঝে চলে যেতে পারে না। সে নয়নকে ভালোবাসে। আগের মতোই ভালোবাসে।

নয়ন খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, শোনো। তুমি চাইলেও আমি আর কখনো আসতাম না হেমা! আমি নিজেই নিজেকে মেনে নিতে পারি না। সেখানে অন্যরা কেন নেবে? এই যে যতটুকু মুহূর্ত আমি তোমার কাছে ছিলাম। এই প্রতিটি মুহূর্তে আমি তোমার স্পর্শ বোঝার চেষ্টা করেছি। এই স্পর্শের ভাষাটা আমি এখন বুঝি হেমা। এইটুকু সময়েই তোমার স্পর্শগুলো একটু একটু করে দ্বিধান্বিত হয়েছে। আমাকে ছুঁতে গিয়ে আগের প্রতিবারের তুলনায় পরের প্রতিবার দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছে। শিথিল হয়েছে। আমি আজকাল এসব টের পাই হেমা।

হেমার এত মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এত কান্না পাচ্ছে। নয়ন এসব কী বলছে তাকে! সে কী করবে? সে কি নয়নকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলবে, তুমি যা ভাবছ, সব ভুল নয়ন। সব ভুল। আমি সেই হেমা। সব সময়ই একই আছি! সে কী বলবে এখন? নাকি আরো গভীর কোনো স্পর্শে সে নয়নকে বুঝিয়ে দেবে যে নয়ন যা ভাবছে তা ভুল।

নয়ন খুব সঙ্কোচ মাখা গলায় বলল, আরেকটা কথা বলি? হেমা বলল, হুম।

নয়ন বলল, এই জগতে তুমি ছাড়া আমার নিজের বলতে কিছু কখনোই ছিল না। আর কখনো হয়তো থাকবেও না। কিন্তু সেই নিজের বলতে মানুষটার কাছে আমি আর কখনোই হয়তো আসব না। তোমার জন্য না। আমার জন্যই আমি আর আসব না। তোমাকে পাবার জন্য যে সাহসটা দরকার, যে শক্তিটা দরকার, সেটা আমার নেই। কেবল ভালোবাসা সব পারে না। পারলে, আমি এভাবে চলে যেতাম না। তুমিও না।

হেমা বলল, আমি কোথাও চলে যাইনি নয়ন।

নয়ন কান্নার মতো করে মৃদু হেসে বলল, আচ্ছা, মেনে নিলাম, তুমি কোথাও চলে যাওনি। কিন্তু আমিই যাচ্ছি।

নয়ন ঘুরে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। হেমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল নয়নকে ডেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত আলিঙ্গনে নয়নকে পিষে ফেলতে। তার খুব ইচ্ছে করছিল, নয়নের ঠোঁটের ভেতর ঠোঁট ডুবিয়ে দিতে। তারপর তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, দেখেছ? তুমি ভুল। তুমি মস্ত বড় ভুল। তোমাকে স্পর্শ করতে আমার কোনো দ্বিধা নেই, কোনো সঙ্কোচ নেই। কিছু নেই।

কিন্তু হেমা কেন যেন তার কিছুই করল না। সে যেমন ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। নয়ন বেরিয়ে গেল খোলা দরজা দিয়ে। হেমা দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়েই রইল। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই তার হঠাৎ মনে হলো, নয়নকে সে। অমন করে জড়িয়ে ধরতে পারল না কেন? অমন তীব্র ইচ্ছে হবার পরও কেন সে নয়নকে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁটের ভেতর ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলতে পারল না ভালোবাসি। কেন? কোনো ভয়, সঙ্কোচ, বাঁধা তো কোথাও ছিল না। তাহলে? তাহলে কেন পারল না সে?

আর ঠিক তখুনি হেমার মনে হলো, তার ভেতরে কোথাও যেন তার অবচেতনেই কি একটা ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। তার অজান্তেই তার বুকের ভেতর কোথাও যেন ঘনিয়ে আসছে তীব্র এক ঝড়।

সেই ঝড়ের নামই দ্বিধা কিনা কে জানে!

*

নুরুন্নাহারের মৃত্যুর মাস পেরিয়েছে। দিন পনেরো কুড়ি যেন থমকে ছিল বাড়িখানা। তারপর সবকিছু আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। আসলে মৃত্যুকে মানুষ যত বড় ক্ষত বা শূন্যতা হিসেবে দেখে, জগতে আর কোনো ক্ষত বা শূন্যতাকেই মানুষ তত বড় করে দেখে না। কিন্তু একমাত্র সময় জানে তার কাছে ছোট-বড় কিছু নেই। সকলই সমান। সে আর সকল ক্ষত বা শূন্যতার চেয়ে মৃত্যুকে আলাদা করে দেখে না। জগতের আর সকল ক্ষতর মতোই সে একসময় ভুলিয়ে দেয় মৃত্যুর ক্ষতকেও।

ক্ষতের যন্ত্রণা যত তাড়াতাড়ি যায়, স্মৃতি তত তাড়াতাড়ি যায় না। স্মৃতি থেকে যায় দীর্ঘ সময়। কিন্তু সেই স্মৃতিতে একসময় আর যন্ত্রণা থাকে না। হয়তো কাছের মানুষদের কিছু দীর্ঘশ্বাস থাকে। নুরুন্নাহার এই বাড়িতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিলেন না যে তার মৃত্যুর ক্ষত শুকিয়ে গেলেও কেউ তার স্মৃতি পুষে রাখবে। ফলে তিনি হারিয়ে গেলেন অতি দ্রুত। তার মৃত্যুর ক্ষত যত দ্রুত শুকিয়ে গেল, তার স্মৃতি মুছে গেল তার চেয়েও দ্রুত। প্রথম দেড়-দুই সপ্তাহ পারুল যেন হয়েছিল পাথরের মূর্তি। সারাক্ষণ নিসাড় হয়ে বসে থাকত। খাওয়া নেই, নাওয়া নেই, ঘুম নেই। কারো সাথে কথা নেই। দিন চারেক বাদে আব্দুল ফকির যখন এলেন। তখন এই বাড়িতে আবার নতুন করে শোকের মাতম উঠেছিল। স্ত্রীর জন্য আব্দুল ফকিরের কান্নায় চারপাশ ভারি হয়ে উঠেছিল। স্বজন-প্রতিবেশীরা ছুটে এসেছিল আবার। কিন্তু তাতেও যেন সামান্যতম বিকার হয়নি পারুলের। সে ছিল তার মতো একা। বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মতো। তারপর ধীরে ধীরে সব যেন স্বাভাবিক হয়ে যেতে লাগল। এমনিতেও বেশিরভাগ সময়ই নিজের ঘরে একপ্রকার বন্দি হয়েই থাকতেন নুরুন্নাহার। ফলে আলাদা করে তার অনুপস্থিতি আর কাউকেই স্পর্শ করল না।

নুরুন্নাহারের মৃত্যুর সংবাদে সবচেয়ে বেশি হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন আব্দুল ফকির। সকলেই ভেবেছিল দীর্ঘ সময় ধরে অপ্রকৃতস্থ হয়ে থাকা স্ত্রীর প্রতি আর সকল স্বামীর মতো আব্দুল ফকিরেরও প্রবল অনাসক্তি রয়েছে। তাছাড়া আব্দুল ফকিরের সামনে না হোক, তার অগোচরে হলেও তাকে নিয়ে একটা ফিসফিসানি তো ছিলই। সবকিছু মিলিয়ে অভাগার গরু মরে, ভাগ্যবানের বৌ, এই তত্ত্বে আব্দুল ফকির খুশি হবেন বলেই সকলে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে হলো উল্টো। আব্দুল ফকির যেন হয়ে গেলেন অন্য এক মানুষ। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকেন। কোনো কাজে-কর্মে যান না। মাঝে মধ্যে পারুলের সাথে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করলেও পারুল সাড়া না দেয়ায় সেই চেষ্টাও খুব একটা ফলপ্রসূ হলো না। তবে মাসখানেকের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠলে একদিন পারুলের সাথে কথা বলতে বসলেন আব্দুল ফকির। তিনি বললেন, মারে, তোমার জইন্য একখান বিয়ার সম্বন্ধ আসছে। ছেলে ভালো। রায়গঞ্জে চাউলের বড় আড়ত আছে।

পারুল বলল, আব্বা, আপনের কি ধারণা আমি ভাত বেশি খাই?

আব্দুল ফকির বললেন, এইটা কি কথা বলো গো মা? এইটা আমি কেন ভাবব?

পারুল বলল, ভাত বেশি না খাইলে চাউলের আড়তদারের লগে বিয়া ঠিক করতেছেন কেন?

আব্দুল ফকির থতমত খেয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ছেলে ভালো মা। পুরা পাঁচ হাত লম্বা। দেখতে শুনতে ভালো। গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা।

পারুল বলল, টাউনে বাড়ি এমন ছেলে দেহেন আব্বা। আমি টাউনের ছেলে ছাড়া বিয়া করব না।

আব্দুল ফকির বললেন, টাউনের ছেলে আমি কই পাব মা? আর চিনি না, জানি না এমন ছেলের সাথে তোমার আমি বিয়া দিব না মা।

পারুল বলল, চেনন-জানন লাগব না। টাউনের ছেলে দেখেন। বিয়ার পর আমি চিইন্যা-জাইন্যা নিব।

আব্দুল ফকির কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই পারুল বলল, মায় মরতে না মরতেই আমার বিয়ার লইগ্যা এমন পাগল হইয়া গেলেন ক্যান আব্বা? মায়র কবরের মাটি একটু শুকাক।

আব্দুল ফকির নরম গলায় বললেন, মারে, তোমার বিয়ার বয়স হইছে আরো অনেক আগেই। তোমার মায়ের কথা চিন্তা কইরাই আমি এতদিন বিবেচনা করি নাই। তুমি চইল্যা গেলে তোমারে মায়রে দেখব কে! এহন বয়স যদি আরো বাড়ে, মাইনষে পাঁচ কথা ছড়াইব। সম্বন্ধ আসব না। তোমারে বিয়া দিয়া এই বাড়িতে আমি একলা কেমনে থাকব মা? সেই কথা ভাবলেই তো পরান খাঁ খাঁ করে।

পারুল বলল, তাইলে যেইটা করছি, সেইটা করেন। টাউনের ছেলে দেখেন।

আব্দুল ফকির আর কোনো কথা বললেন না। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে এই একটা পরিবর্তন পারুলের হয়েছে। সে কথা বলার সময় খুব মেজাজ দেখায়। মাকে নিয়ে তার কোনো কান্না নেই। কোনো বিষাদ নেই। কিছুদিন সে ছিল পাথরের মূর্তি হয়ে। আর তারপর সে যেন হয়ে উঠেছে মেজাজী এক মানুষ।

লতার ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। সে আবার ব্যস্ত হয়ে গেছে তার জীবনে। সেদিন লতার মা আর বাবা যাচ্ছিলেন লতার নানাবাড়ি রায়গঞ্জে। পারুল হঠাৎ তাদের পথ আগলে দাঁড়াল। তারপর বলল লতাকে দেখতে তার মনটা কেমন ছটফট করছে। সেও তাদের সাথে রায়গঞ্জ যেতে চায়। তারা আপত্তি করলেন না। আপত্তি করলেন না আব্দুল ফকিরও। পারুল সেজেগুজে রায়গঞ্জ গেল। মাত্র দিন পঁচিশেক পরে আবার লতার সাথে দেখা হলো তার। কিন্তু লতাকে দেখে কী যে ভালো লাগল পারুলের! মনে হলো বহুকাল পর সে লতাকে দেখেছে। তেষ্টায় শুকিয়ে থাকা তার বুকের ভেতরটা যেন ঠান্ডা জল পেয়ে জুড়ালো।

সেই রাতে লতার সাথে রাজ্যের কথা হলো পারুলের। লতার চোখে-মুখে কি একটা আনন্দের ঝিলিক! পারুল বলল, কী হয়েছে তোর? এত আনন্দে ঝলমল করতেছিস কেন?

লতা বলল, প্রায় তিন মাসেরও বেশি সময় পর আশিক আসতেছে!

আশিকের কথা শুনলেই পারুলের কেমন মন খারাপ হয়ে যায়। সে বলল, তুই বিয়ে করে ফালাস না কেন লতা?

লতা বলল, আমি তো পারলে আজই করি। কিন্তু আশিকই তো এখন বিয়ে করতে চাচ্ছে না। ওর যে কত কথা, তা যদি শুনতি! বলে, আগে প্রেম করে নেই। পরে বিয়ে। বিয়ের পর সংসার, বাচ্চা-কাচ্চা, আত্মীয়-স্বজন কতকিছু যে সামলাতে হয়। তখন আর প্রেম থাকে না।

বাচ্চা-কাচ্চার কথা বলতে গিয়ে লতার মুখখানা যেন আরক্ত হয়ে উঠল। পারুল কোনো কথা বলল না। তার মন আবার খারাপ হয়ে যাচ্ছে। লতা বলল, আর তোরে না বললাম, আশিক চায় আমি ইন্টার পরীক্ষায় আগে পাশ করি, তারপর বিয়ে। তার আগে না।

পারুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বিয়ার পরে ঢাকার শহর গিয়া কি আমারে মনে পড়বে লতা? আমার তো আর এই জনমে ঢাকা যাওয়া হলো না।

লতা এবার পারুলের মাথায় আলতো হাতে চাটি মেরে রহস্যময় গলায় বলল, ভাবছিলাম তোরে এহনই বলব না। সামনাসামনি সারপ্রাইজ দিব। কিন্তু তোর মুখোন যেমন আষাঢ় মাসের আকাশ করে ফালাইছিস, এখন আর না বলে পারছি না।

পারুল কৌতূহলি গলায় বলল, কী?

লতা বলল, আশিকের সাথে তো তোরে নিয়া অনেক কথাই হয়। সে আইজ থেইক্যা না। একদম প্রথম থেকই্যাই। তোর কত গল্প যে তারে আমি বলি! তুই শুনলে আসমান থেইক্যা পড়বি।

পারুল বলল, কী কথা বলিস? ভালো কিছু তো আর জীবনেও বলবি না।

লতা বলল, তোর তো আমারে খালি শত্রুই মনে হয় পারুল। এতদিনেও আমি তোর বন্ধু হইতে পারলাম না।

লতা এবার সত্যি সত্যিই মন খারাপ করল। পারুল অবশ্য বুঝতে পারেনি যে সে এত সহজে মন খারাপ করে ফেলবে। পারুল দু’হাতে লতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বান্ধবী। আমি তো মজা কইরা বলছি। বল না কী বলছস আমার কথা!

লতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, এই তোর দুঃখের কথা, কষ্টের কথা। তোর মা থাইকাও নাই সেই সব কথা। তোর স্বপ্নের কথা। তোর পছন্দ, অপছন্দ, ইচ্ছা। তোর মা মারা যাওনের পুরা ঘটনা বলছি। আশিক তো ঘটনা শুইন্যা প্রায় কাইন্দা দেয় দেয় অবস্থা। এত নরম ওর মনডা জানস। কি যে ভালো একটা ছেলে।

পারুল বলল, এইসব কথা তারে বলতে গেলি ক্যান? সে কি মনে করল। বল তো?

লতা বলল, উদ্দেশ্য তো একটা আছিলই পারুল। তোর কোনো ক্ষতির জন্য কিছু বলি নাই। ভালোর জন্যই বলছি।

পারুল তখন থেকে শুনে যাচ্ছে যে লতা তার ভালোর জন্য বলেছে, ভালোর জন্য বলেছে। কিন্তু কি ভালোর জন্য বলেছে, তা সে বলছে না। পারুল খানিকটা অস্থির গলায়ই বলল, সেই ভালোটাই তো শুনতে চাইতেছি লতা।

লতা কিছুক্ষণ সময় নিলো। তারপর বলল, আশিকরে বলছিলাম, যে আমরা দুই বান্ধবী সেই একদম ছোট্টবেলা থেইকাই একসাথে থাকি। এহন আমার যদি বিয়া-শাদি হইয়া যায়, আর আমি যদি ঢাকার শহর চইল্যা যাই। তাইলে তুই এই গাঁও গ্রামে একলা পইড়া থাকলে আমার যেমন তোর জইন্য মন কানবো, তোরও আমার জইন্য মন কানবো। আর তোর গ্রামে বিয়া করনের মতও নাই। আশিকের যদি কোনো ভালো বন্ধু-বান্ধব থাহে, বিয়ার উপযুক্ত, ভালো চাকরি-বাকরি করে। ভালো ফ্যামিলি, তাইলে একবার কথা বলতে তো দোষ নাই। কথা বলনের পর দুইজনের যদি পছন্দ হয়, তাইলে ফ্যামিলিতে কথাবার্তা হইতে পারে।

লতা একটু থামল। সে থেমে পারুলের অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করল। পারুলের মুখে কেমন অদ্ভুত একটা লজ্জা লজ্জা ভাব। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে যেন তার চেহারায় কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ না পায়। কিন্তু পারছে না। তার মুখ দেখে লতা তাকে ভোলা বইয়ের মতো পড়ে ফেলল। পারুল উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করছে ঘটনার বাকি অংশ শুনতে।

পারুল বলল, আশিক তো আমার কাছে শুইনা শুইনা তোর সম্পর্কে একটা ধারণা আগেই পাইছে। তোরে আশিকের খুব পছন্দ। সে তখন বলছিল তার একটা বন্ধু আছে, খুবই নাকি ভালো ছেলে। দেখতে শুনতেও ভালো। তার নাকি বিয়ার কথা চলতেছে। মাইয়াও দেখছে অনেক। কিন্তু কাউরেই পছন্দ হয় নাই। তার নাকি শহরের মেকাপ সুন্দরী, প্লাস্টিক মাইয়াগো পছন্দ না। তার নাকি গাঁয়ের লাজুক লতা বালিকা বধূ পছন্দ। হা হা হা।

লতা কথা পুরো শেষ না করেই পারুলের গাল টিপে দিয়ে হেসে ফেলল। পারুল তাতেই লজ্জায় যেন গলে গেল। লতা বলল, আমি আশিকরে বলছিলাম যে বললেই তো আর হইয়া যায় না। বিয়া-শাদির ব্যাপার। তুমি একদিন তারে নিয়া আসো। আগে ছেলে-মেয়েরা নিজেরা নিজেগো দেখুক। কথা বলুক। তারপর পছন্দ হইলে না হয় ফ্যামিলি পর্যন্ত আগান যাইব। আশিক বলছিল, সে তার বন্ধুর লগে কথা বইলা জানাইব।

লতা থামল। কিন্তু পারুল সাথে সাথে বলল, তারপর?

বলেই সে বুঝল ভুল করে ফেলেছে। লতা এবার তাকে নিয়ে ইচ্ছেমতো হাসাহাসি করবে। কিন্তু তার ভাগ্য ভালো লতা কিছুই করল না। সে বলল, আমাগো যহন ঢাকায় যাওনের কথা হইছিল, তহনই প্লান আছিল, ঢাকায় তোর সাথে ওর সেই বন্ধুর দেখার ব্যবস্থা করা হইব। তারপর যদি দুইজনের দুইজনরে পছন্দ হয়, তাইলে আর কি! তোর বাপ-মা তো লগেই থাকব। সবাই রাজি থাকলে, তহনই একটা কিছু হইয়া যাইব।

পারুলের মুখখানা কেমন বিষাদে ছেয়ে গেল। লতারও। লতা একহাতে পারুলকে তার কাঁধের সাথে চেপে ধরে বলল, মন খারাপ করিস না। হায়াত, মউত, বিয়া- এই তিন আল্লাহর হাতে। আল্লায় যেইহানে চাইব, সেইহানেই হইব। আল্লাহ যার হায়াত যতদূর রাখছে, সে ততদূরই বাঁচব। যার বিয়া যেইহানে রাখছে, তার বিয়াও সেইহানেই হইব। আশিকের লগে আমার আবার কথা হইছে। তোর মায়র ঘটনা শুইন্যা তো সে খুব কষ্ট পাইছে। খুব। এহন সে বলছে, আগামী মাসের কোনো একদিন সে তার বন্ধুরে নিয়া আইব। মানে তোর যদি কোনো আপত্তি না থাহে। আমি কিন্তু বইলা দিছি যে আমার বান্ধবীরে দেখলে এক পলকেই কাইত হইয়া যাইব। তহনই জানি আবার বিয়া কইরা লইয়া যাওনের জইন্য টানাটানি লাগে না। বিয়া হইব বড় অনুষ্ঠান কইরা। তারা তো কি কমুনিটি সেন্টারে বিয়া করে। গ্রামের বিয়ার মজা তারা বুঝব কি! তাইলে বান্ধবী, ভালো কইরা নিজের যত্ন-উত্ন করো। ছেলে জানি দেইখ্যা ফিট খায়। দরকারে আমরা না বইলা দিব। তারা জানি না বলতে না পারে। আগামী মাসেই কিন্তু। বেশিদিন বাকি নাই। রেডি হও বান্ধবী। বিয়া তোমারে আমি টাউনেই দিব।

ঘটনা শুনে প্রবল কৌতূহল হচ্ছিল পারুলের। আনন্দও হচ্ছিল। আনন্দে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে জানে না, কেন যেন সেই আনন্দটা তার আর থাকল না। লতার কথা শুনে তার আনন্দে প্রজাপতির মতো ওড়ার কথা। সেই যেদিন সে প্রথম এক বাজারের দোকানে দাঁড়িয়ে আঁড় চোখে একখানা সিনেমা দেখেছিল। সিনেমায় এক প্রেমিক জুটি রিকশায় যেতে যেতে গান গাইছিল। পরক্ষণেই আবার তারা রাতের ঢাকার লাল-নীল আলোতে গানের তালে তালে হেসে খেলে বেড়াচ্ছিল। তার পরপরই মেয়েটা যখন একখানা ঝা চকচকে বাসায় কোমড়ে আঁচল খুঁজে অদ্ভুত সুন্দর একটা রান্নাঘরে ছেলেটার জন্য রান্না করছিল। সেইদিনের সেই মুহূর্তে থেকে তার জীবনের একটামাত্র স্বপ্ন, সে শহরে যাবে। ঢাকার শহরে। তার অমন একটা বাসা হবে। অমন সুন্দর করে কথা বলা একজন স্বামী হবে। তারা অমন লাল-নীল আলোতে ছুটে বেড়াবে। অমন অদ্ভুত সুন্দর রান্নাঘরে সে কোমড়ে আঁচল জড়িয়ে রান্না করবে।

লতার মোবাইল ফোনের বদৌলতে পারুলের সেই ইচ্ছেরা রোজ একটু একটু করে বেড়েছেই। সে মুহূর্তের জন্যও কখনো ভাবেনি, সে সারাটাজীবন এই গ্রামে থাকবে। এখানে কোনো এক গেঁয়ো ছেলেকে সে বিয়ে করবে। কিন্তু আজ এই মুহর্তে এমন একটা অসাধারণ সম্ভাবনার কথা শুনেও শেষমেষ এসে পারুলের আনন্দটা যেন আর পালে হাওয়া পেল না। এর কারণটা পারুল স্পষ্ট বুঝতে পারল না। কিন্তু লতা তার জন্য এত কিছু ভাবে, এই ভাবনাটা পারুলকে। খুব আনন্দ দিল। সে লতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বান্ধবী, তুই এত ভালো। কেন?

লতা পারুলের পেটে খোঁচা দিয়ে বলল, আগে সবকিছু ভালোয় ভালোয় হোক, তারপর যা বলার বলিস। আগেই সব ভাইব্যা রাহিস না। তয় ছেলেটারে আমার খুবই ভালো লাগছে পারুল। দুইদিন আমিও তার লগে ফোনে কথা বলছি। সহজ-সরল ভালো মানুষ টাইপের ছেলে। আরেকখান কথা, সে কিন্তু একদম শুদ্ধ কইরা কথা বলে। আশিকের মতো খাইছি, ঘুমাইছি, করছি, পরছি না। সে বলে খেয়েছি, ঘুমিয়েছি, করেছি, পরেছি। হা হা হা। তোর শুদ্ধ কথা শেখন এহন ওয়ান টু’র ব্যাপার। বিয়ার প্রথম তিন-চাইর মাস ওইগুলান কিছু করবি না, খালি শুদ্ধ কথা শিখবি। হা হা হা।

লতা শরীর দুলিয়ে হাসছে। পারুলের দেখতে কি যে ভালো লাগছে। এই প্রথম তার মনে হলো, লতা মেয়েটা তার সত্যিকারের বন্ধু। সে এতদিন তাকে। ভুল বুঝে এসেছে বা ঈর্ষান্বিত হয়ে তার সবকিছুকে অন্যভাবে দেখেছে। কিন্তু মেয়েটা সত্যি সত্যি তার ভালো চায়। তাকে ভালোবাসে। এমন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

জীবনে এই প্রথমবারের মতো পারুলের নিজেকে অসম্ভব ভাগ্যবতী মনে হতে লাগল।

*

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর শরীর আরো দুর্বল হয়ে পড়েছে। তিনি বেশিরভাগ সময়ই তার ঘরে শুয়ে বসে কাটান। তার ধারণা, তার এই দীর্ঘ জীবনের সমাপ্তি রেখাটা খুব কাছে চলে এসেছে। কিন্তু এই কাছাকাছি চলে আসা সমাপ্তি রেখাটা কি মানুষ দেখতে পায়? তার যে বয়স, তাতে সমাপ্তি রেখাটা আলাদা করে দেখার কিছু নেই। সেটি তার কাছাকাছিই ছিল সব সময়। যে-কোনো সময় সেটি স্পর্শ করার অপেক্ষামাত্র। তবে একটা বিষয়, তাহলো অপ্রস্তুত অবস্থায় তিনি মরতে চান না। চান না বলেই শেষ নিঃশ্বাসের আগ অবধি যতটুকু সময় পান, সেই সময়টুকু জুড়ে তিনি যতটা সম্ভব সবকিছু গুছিয়ে রেখে যেতে চান।

সেদিন মাঝরাতে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙা সেই রাতে তার মাথায় কত যে এলোমেলো চিন্তা এলো। তার হঠাৎ করেই মনে হলো, তিনি এত বৈষয়িক মানুষ কেন? এই বয়সে এসে তার উচিত মৃত্যুচিন্তায় ভীত থাকা। তিনি ধর্মবিশ্বাসী মানুষ। তার এখন ধর্মকর্ম নিয়েই থাকা উচিত। কিন্তু পুরোটা সময়ই তার মাথায় থাকে ইহলৌকিক নানান চিন্তা। তার বংশ মর্যাদা, তার পরিচয়, তার উত্তর-পুরুষের ভবিষ্যৎ। এর কারণ কি? তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। ভেবে দেখেছেন, এর কারণ আসলে অমরত্বের লোভ। মানুষ মরতে চায় না। সে বেঁচে থাকতে চায় অনন্তকাল। অমরত্ব চায়। কিন্তু সেটি সম্ভব নয় বলেই তারা তাদের অস্তিত্ব রেখে যায়। মানুষ চায়, তার মৃত্যুর পর তার জন্য কেউ কাঁদুক। তার অনুপস্থিতি কেউ অনুভব করুক। দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী তাকে কেউ মনে রাকুক। কিন্তু সে সৌভাগ্য সকলের হয় না, কারো কারো হয়। যাদের হয়, তারা সকলেই আবার একই দৈর্ঘ্যের মরণোত্তর আয়ু পান না। পান তাদের রেখে যাওয়া কর্মের বিস্তৃতি আর প্রভাব অনুসারে।

তাহলে কি তৈয়ব উদ্দিন খাঁও তার মৃত্যুর পর দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে চান? তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এই প্রশ্নের উত্তর জানেন না। তবে তিনি ভেবে দেখেছেন, মানুষ যখন তাকে ভয় পায়, সম্মান করে, বহু দূর-দূরান্তের মানুষও যখন তাকে এক নামে চেনে, খাঁ-বাড়ির কথা জানে, তখন তার ভেতরে একটা আনন্দ হয়। এই আনন্দটা নেশার মতো, কেবল ভালো লেগেই শেষ হয়ে যায় না। আবারো পেতে ইচ্ছে করে। বারবার পেতে ইচ্ছে করে। না পেলে উশখুশ লাগে। সবচেয়ে বড় কথা, এই আনন্দটা কখনোই একঘেয়ে লাগে না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ শুয়ে আছেন বিছানায়। ভালো ঠান্ডা পড়েছে এবার। এই দুপুর বেলাও তিনি হাতে-পায়ে মোজা পরে খাটে কাত হয়ে শুয়ে আছেন। বাইরে তেরছা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সরু নারকেল গাছটার পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়েছে উঠানে। শীতের দুপুরের এই ওমটা যে কী আদুরে! ওই রোদে শরীর মেলে দিলেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর খুব ইচ্ছে করছিল ওই রোদে গিয়ে শরীর মেলে দিয়ে শুয়ে থাকতে। কিন্তু তিনি গেলেন না। এই বয়সে যখন তখন করা সকল ইচ্ছেকে গ্রাহ্য করলে চলে না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মনে হয়, জীবনে প্রবল হয়ে ওঠা ইচ্ছেগুলোকে যত অগ্রাহ্য করা যাবে, জীবন দীর্ঘ হবার সম্ভাবনাও তত বাড়বে। এখন কে কি বেছে। নেবে, সেটি তার ইচ্ছে। কেউ কেউ ইচ্ছে মতো জীবন কাটিয়ে টুপ করে সটকে পড়ে, কেউ কেউ ইচ্ছে অগ্রাহ্য করে জীবন পেলে-পুষে রাখে দীর্ঘ সময়।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন না তিনি আসলে কোন দলে? তার বেশিরভাগ ইচ্ছেকেই তিনি যেমন অগ্রাহ্য করেছেন, আবার তেমনি তার হাতে গোনা দু’চারটি ইচ্ছেকে তিনি অগ্রাহ্যও করতে পারেননি। বরং আর সকল কিছুর চেয়ে এই ইচ্ছেগুলোকে তিনি সবচেয়ে বেশি শক্ত হাতে ধরেও রেখেছেন।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মনিরকে ডাকলেন। আজকাল আর তার সামনে এলে মনির সেই আগের মতো নেতিয়ে থাকে না। সে আজকাল মুখে মুখে কথা বলে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কোনো একটা পরিকল্পনার কথা শুনে সে আর আগের মতো জ্বে দাদাজান, জ্বে দাদাজান বলে মাথাও নোয়ায় না। বরং সেই পরিকল্পানার নানান খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে সে তার মতামত দেয়। কখনো কখনো সেই পরিকল্পনা তার পছন্দ না হলে তাও জানায়। বিষয়টা যে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর খারাপ লাগে তা নয়, বরং তিনি মনে মনে আনন্দিত হন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর নাতির গলার স্বরে বুলন্দ আওয়াজ হবে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর রক্ত তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। এই স্বপ্নটা তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সব সময় ছিল। কিন্তু সন্তানদের নিয়ে সেই স্বপ্ন দেখার ন্যূনতম সাহস তিনি পাননি। মনিরকে নিয়েও যে সেই স্বপ্ন দেখার কোনো সুস্পষ্ট কারণ ছিল তা নয়। তবে মনিরের সহজ-সরল হাবভাবেই কী যেন কী একটা ছিল, আর তৈয়ব উদ্দিন খাঁর পাকা জহুরি চোখ তা দেখে নিতে ভুল করেনি।

মনির এসে বলল, দাদাজান, শরীল এহন কেমন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, শরীল ভালো। তয় শরীলের চাইতেও মন ভালো থাহন বেশি দরকার। মন ভালো না।

মনির বলল, কি হইছে দাদাজান?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, ফজুর আর কোনো খবর তো আমারে দিলি না। এহনই যদি আমারে পাশ কাটাস, তাইলে কেমনে হইব? আগে তো মরি, তারপর…।

মনির বলল, দেওনের মতো কোনো খবর তো এহনো পাই নাই দাদাজান।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আব্দুল ফইরের লগে আমার একবার দেহা হওন দরকার।

মনির বলল, ফইর সাবের স্ত্রী মারা গেছে। এইজইন্য আর তারে খবর পাঠাই নাই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তার স্ত্রী মারা যাওনের লগে খবর না পাঠানোর সম্পর্ক কি?

মনির বলল, সে তার স্ত্রীর মরনে খুব ভাইঙা পড়ছে দাদাজান। সব কাজ কাম ছাইড়া দিছে।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, ঘটনা তো সুবিধার মনে হইতেছে না মনির।

মনির অবাক গলায় বলল, এইহানে ঘটনা সুবিধা-অসুবিধার কী আছে দাদাজান?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আছে। এই জইন্যই চৌখ খোলা রাখতে হইব। শীতকালে বিষ্টি হইলে বুঝতে হইব আবহাওয়ায় গণ্ডগোল আছে।

মনির কথা বলল না। সে এই মানুষটাকে নানানভাবে বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, স্ত্রী মারা যাওনের শোকে আব্দুল ফইরের দুই চাইরদিন ঝিম মারা থাকন ঠিক আছে। কিন্তু সেই জইন্য সে কাজ-কাম ছাইড়া দিব, এইটা ঠিক নাই। যাই হোক, ওইটা আমাগো দেহনের বিষয় না। তারে খবর পাঠা। আমি তারে ডাকছি।

মনির বলল, জ্বে দাদাজান।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আর কোনো কথা বললেন না। তবে মনিরই আবার বলল, দাদাজান, আরেকখান কথা। আপনের অনুমতি না নিয়াই পুরা ফতেহপুর তন্নতন্ন কইরা ফালাইছি। কিন্তু ফজু কাকুর গয়নার কলসির খবর কোনোহানে পাই নাই। আপনে কইছিলেন ওই গয়নার কলসি নাকি সে গ্রামের বাইরে নেয় নাই। কারণ ওই জিনিস সে নিজের ছাড়া অন্য কারো ধারে রাখতে পারব না। তায় বাইরে না নিলে, গয়নার কলসি গেল কই?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, সে তো বলল, আব্দুল ফইরের ধারে।

মনির বলল, এই কথা আপনে বিশ্বাস করেন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, বিশ্বাসও করি না। আবার অবিশ্বাসও করি না।

মনির বলল, আরো একখান কথা দাদাজান। আপনে কেমনে নিবেন জানি। তয় কথাখান বলন জরুরি।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মুখ তুলে মনিরের দিকে তাকালেন। তবে কথা বললেন না। মনির বলল, কথাখান দাদীজানের বিষয়। এইজইন্যই বলতে সাহস পাইতেছিলাম না। দাদীজানের লগে ফজু কাকু গো একটা কোনো আলাদা বিষয় আছে। ফজু কাকুরে আপনে যেইদিন ডাকলেন, সেইদিন দেখছি ফজু কাকুর লগে তার বৌও আইছিল। ফজু কাকু যহন বাইরের ঘরে আমাগো লগে আছিল, তহন তার বৌ আইছিল ভিতর বাড়িতে। দাদীজানের লগে কি কথাবার্তা হইল। আমি দাদীজানরে জিগাইলাম, দাদীজান বলল তারা ফরাজিগো বাড়ির ডিপ টিউবয়েলের পানি খাইত, সেইটা নকি নষ্ট হইয়া গেছে, এইজন্য সে আমাগো কলের পানি নিতে আইছিল।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এতে সন্দেহের কি আছে? তোর দাদীজান আমাগো শত্রু নাকি?

মনির এই কথার কোনো জবাব দিতে পারল না। তবে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মনিরকে বিদায় দিয়ে আমোদি বেগমকে ডাকলেন। আমোদি বেগমের মুখে কেমন একটা আনন্দ ঝলমল ভাব। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আমি যে অসুস্থ। একবার তো খোঁজও নাও না আমোদি বেগম।

আমোদি বেগম বললেন, যেই মানুষ সারাক্ষণ থাকছে রাজার লাহান, তারে প্রজার লাহান দেখতে তার শত্রুরও ভাল্লাগে না। আপনের লগে ওই বিছনায় শুইয়া মরার মতো পইড়া থাকন মানায় না। এইজইন্য আসি না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হাসলেন। বললেন, এইটাই জীবন। শুরু আর শেষ এক জায়গায়। একখান চক্করের মতো ব্যাপার। গোল চক্কর। ঘুইর‍্যা ফিইর‍্যা সেই এক জায়গা।

আমাদি বেগম বললেন, আপনে আমারে ডাকছেন কেন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, কহন না কহন মইরা যাই, তার ঠিক-ঠিকানা নাই। এইজইন্য ডাকছি। তোমার লগে আমার কিছু কথা আছে।

আমোদি বেগম বললেন, কোহিনূরের বিষয়? কি মাফ চাইবেন? শেষ বিদায়ের আগে শেষ মাফ?

আমোদি বেগমের কথায় তৈয়ব উদ্দিন খাঁর রাগ লাগার কথা। কিন্তু তার কেন যেন রাগ লাগছে না। তিনি বললেন, আমার জীবনের একটা বড় ভুল কি জানো?

আমোদি বেগম বললেন, আমারে বিবাহ করা?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, না। তোমারে আরো আগে বিবাহ না করা। আমার উচিত আছিল তোমারে আরো আগে বিবাহ করন। তাইলে তোমার মইধ্যে এই যে এহন যেই আগুন আমি দেখতেছি, সেই আগুন আরো আগে দেখতে পাইতাম। সারাকালই আমার ম্যাদমেইদ্যা জিনিস ভাল্লাগে নাই। কিন্তু তুমি আছিলা ঠান্ডা পোতাই যাওয়া মুড়ির লাহান। মেদমেইদ্যা। গত কিছুদিন ধইর‍্যা তোমারে দেইখ্যা আমার মনে হইতেছে, তোমার পেটে আর কয়টা পোলাপান হওনের দরকার আছিল। তাইলে খা বংশ রক্ষা নিয়া আমার চিন্তা করন লাগত না। কিন্তু তহন আমার সব সময় মনে হইত পোলাপান যদি আরো হয়, আর সেইগুলান যদি তোমার লাহান মেদমেইদ্যা আর বলদ হয়, তাইলে বিপদ। এই ভুলটা আমার হইছে। দুনিয়ার সব মানুষ চিনতে পারলাম, ঘরের মানুষ চিনতে পারি নাই।

আমোদি বেগম বললেন, আমি আপনের ঘরের মানুষ আছিলাম?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এই কথার জবাব দিলেন না। তিনি বললেন, এতবছরেও কয়েকটা বিষয় আমি তোমারে বলি নাই। আজ খোলাশা করতে চাই। এক, তোমার মতো বংশের কোনো মাইয়ারে আমার বিয়া করনের কথা না। কারণ বংশের বিষয়ে সব সময়ই একটা নাক উঁচা স্বভাব আমার। তাও আমি তোমারে বিয়া করছি। এইটার একমাত্র কারণ তোমার চেহারা আর গায়ের রং। খবির আর দবিরের মায়রে বিয়া করছিলাম তার বংশ দেইখ্যা। বড় বংশ তারা। কিন্তু তার চেহারা আছিল অতি জঘন্য। আমার চেহারা সুরত, গায়ের রংও সুবিধার না। খবির দবিরের চেহারা সুরতও তেমনই হইছে। এই লইয়া আমার মনে খুব দুঃখ আছিল। আমি চাইছিলাম তোমার ঘরে আমার পোলা মাইয়া যাই হোক, চেহারা সুরত দেইখ্যাই জানি মাইনষে বলতে পারে, খাঁ-বাড়ির পোলা মাইয়া দেখতে যেন চান্দের লাহান। আমার এই কথা কেউ শুনলে হাসব। কিন্তু এইসব জিনিস আমার মইধ্যে আছে। কিন্তু তোমার চলন-বলন, হাব-ভাব আমার পছন্দ আছিল না। আমার সব সময় ডর আছিল পোলাপান হইলে না আবার তোমার হাবভাব পায়। কিন্তু কোহিনুররে দেইখ্যা আমার পরান জুড়াই গেল। তার হাবভাব নিয়া নানানজনে নানান কথা বলছে। কিন্তু সে আছিল আমার মনের মতো। তয় আমার ডর আছিল, তোমার আশেপাশে বেশি থাকলে সে না আবার তোমার ওইসব হাবভাব পায়। তোমার হাবভাব বদলানোর জন্য আমি নানান চেষ্টা করছি, তোমারে মাইর-ধইরও করছি। কোহিনূর ছোট আছিল, ওর সামনে বইসাও তোমারে আমি মারছি। এইটারও একটা কারণ আছিল, আমি চাইছিলাম, ও বুঝুক, তোমার ওই হাবভাব আমার কত অপছন্দ। এই কারণেই হোক, আর যেই কারণেই হোক, ও হইল একদম অন্যরকম। কারো সাথে কথা বলত না। হাসত না। অনেক উল্টাপাল্টা করত। সবাই ডরাইতো। কিন্তু আমার তার সবকিছুই ভালো লাগত।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ একটু থামলেন। একটানা কথা বলতে গিয়ে সামান্য হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি। তারপর বললেন, কিন্তু একখান বড় সমস্যা হইয়া গেল তহন। তার তোমার প্রতি একটা মায়া জন্মাই গেল। সেই মায়া আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল। কিন্তু জিনিসটা সে কাউরে ধরতে দেয় নাই। কোহিনূরের বুদ্ধি আছিল খুব। সে বুইঝা ফালাইছিল যে আমি চাই না, সে আমার চাইতে তোমারে বেশি পছন্দ করুক। সে জানত, এতে তোমার উপর আর রাগ আরো বাড়ব। এইজইন্য সে তোমার ধারেই যাইত না। কোনোসময় বুঝতেই দিত না যে তোমার উপরে তার এত মায়া। সে সব সময় আমার পাশে ঘুরঘুর করত। কথা যেইটুক বলত, খালি আমার লগেই। আসলে তার উদ্দেশ্য থাকত, আমি যেন তোমার গায়ে হাত না তুলি। এই জিনিস আমি বুঝতে পারছি অনেক পরে। এই দুনিয়ায় কোহিনুরের চাইতে দামী আর কিছু আমার কাছে আছিল না। এহনও নাই। জিনিসটা আমি মাইন্যা নিতে পারি নাই আমোদি বেগম। আমার পরানডা ছারখার হইয়া গেছে।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর চোহারায় একটা অস্থিরতা, একটা অসহায়ত্ব প্রকট হয়ে উঠেছে। এই এতবছর পরেও যে কোহিনূরের প্রতি তার সেই অনুভূতির সামান্যতমও বদল হয়নি তা যেন স্পষ্ট পাঠ করা যাচ্ছে তার মুখ দেখেই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আর কোহিনূররে একদিনের মইধ্যে আমি বিয়া দিয়া ঢাকা পাঠাই দিছি। এই কাজ আমি কেন করছি, তা তুমি জানো। তহন কোহিনূররে অমনে পাঠাই দেওন ছাড়া আর কোনো পথ আমার সামনে খোলা আছিল না। এইদিকে কোহিনূরের সেই মাস্টার একসিডেন করছে। সে চাইছে শেষ দেহা করতে। তোমার উপর আমার যেই জইন্য রাগ, সেই মাস্টারের উপরও আমার একই কারণে রাগ। সমস্যা হইল, কোহিনূর বলল, এই বিয়া সে বসব না, সে ঢাকাও যাবে না। সে যাবে তার ছাররে দেখতে। তুমি তারে চেনো, সে যদি একবার কিছু বলে, সেইটা পাল্টানোর সাইধ্য কারো নাই। তহন জীবনে প্রথম আমি তার সাথে রাগছি। তারে বলছি, সে যদি বিয়ায় আতঙ্ক না হয়, আর সেই মুহূর্তে ঢাকায় না যায়, তাইলে এর ফল ভোগ করবা তুমি। শাস্তি পাবা তুমি। কারণ যে সর্বনাশটা ঘটছে, তার পুরা দায়ভার তোমার। তুমিই আব্দুল ফইররে খবর দিয়া আনাইছিলা। রাগে তহন আমার হাত-পা কাঁপতেছিল। কোহিনূর কিছুক্ষণ একটা কথাও বলে নাই। তারপর বলছে, আব্বা, আপনে মায়ের গায়ে আর কোনোদিন হাত দিবেন না। আমি অমল ছাররে ছাড়ছি, লেখা ছাড়ছি, এহন মায়রেও ছাড়লাম। এইসব কিছুই ছাড়ছি আপনের জইন্য। তয় এইজইন্য আপনেরেও একটা জিনিস ছাড়তে হইব। সেইটা হইছে আমি। এই জীবনে আপনে আর আমারে দেখবেন না। এইটা আপনের শাস্তি। আপনে সেই ছোড থেইক্যা মায়রতন আমারে দূরে রাখছেন, আমারতনও অনেক কিছু দূরে রাখছেন। আমি জানি, আপনে আমারে কত পছন্দ করেন। এইজন্যই এই শাস্তিটা আপনেরে আমি দিব। প্রিয় জিনিস দূরে সরাই রাখনের শাস্তি। এই শাস্তির চেয়ে বড় শাস্তি আর দুনিয়ায় নাই। সেই শাস্তিটা আপনেরে আমি দিব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ থামলেন। যেন বুকের ভেতর বয়ে চলা তুমুল জলোচ্ছ্বাসের বিশাল ভাঙন থেকে তিনি নিজেকে সামলালেন। তারপর বললেন, সে আছিল আমার কইলজার টুকরা। আমরা কইলজাড়া পুইড়্যা ছারখার হইয়া গেছে আমোদি বেগম। তোমরা দেহ পঁচিশটা বছর কাটছে, আমি দেহি, আমি কাটাইছি পঁচিশ হাজার বছর।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ শেষের দিকে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। কিন্তু তাতে আমোদি বেগম বিচলিত হলেন বলে মনে হলো না। তিনি বললেন, আপনে যে সারাজীবন খামখেয়ালি কইরা গেছেন, এইটা আপনে বোঝেন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বলেন, বুঝি আমোদি বেগম। বুঝি। আমি অনেক কিছুই বুঝি। কিন্তু তোমরা বোঝো না। এই দুনিয়ায় সবচাইতে বড় কষ্ট কি জানো? ভালোবাসা না পাওনের কষ্ট। আমারে মাইনষে সম্মান করে, শ্রদ্ধা ভক্তি করে, মাইন্য গইন্য করে। কিন্তু ভালোবাসে না। এইসব করে ডরে। আমারে মানুষ ডরায়। সামনে বইস্যা সালাম দেয়। কিন্তু পিছে গিয়া মনে মনে গালি দেয়। তারা ভাবে সেই গালি আমি শুনি না। কিন্তু আমি শুনি আমোদি বেগম। তাগো চেহারা দেখলেই আমি বুঝি। কেউ আমারে ভালোবাসে নাই আমোদি বেগম। পছন্দ করে নাই। এইটার যে কি কষ্ট!

আমোদি বেগম বললেন, মানুষ যে আপনেরে ভালোবাসব, পছন্দ করব, সেইটার জইন্য যা করন লাগে, তাকি আপনে কোনো দিন করছেন? আপনে আপনের উদ্দেশ্য হাসিলের জইন্য সব সময় গায়ের জোর খাটাইছেন। ডর দেহাইছেন। তো মানুষ তারপরও আপনেরে ভালোবাসব? কোনোদিন কোনো মাইনষের লগে উদ্দেশ্য ছাড়াই দুইডা ভালো কথা বলছেন? দুইডা নরম কথা বলছেন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হঠাৎ অসহায়ের মতো বলে উঠলেন, আমি চেষ্টা করছি আমোদি বেগম। খুব চেষ্টা করছি। কিন্তু পারি নাই। এইডা আমার দোষ না আমোদি বেগম। আল্লায় আমারে এইরম কইর‍্যা বানাইছে।

আমোদি বেগম বললেন, আল্লায় কাউরে খারাপ মানুষ কইরা দুনিয়াতে পাঠায় না। মানুষ নিজে নিজে খারাপ হয়। একটা সময় আর বোঝে না, কেমনে হইল। সেইটা থেইক্যা আর বাইরও হইতে পারে না। অভ্যাস হইয়া যায়। আরেকখান কথা কি জানেন, কেউ যদি সব সময় খালি মনে করে যে সে যেইটা চাইব, সেইটা যেমনেই হোক তার পাইতেই হইব। তাতে অন্য একজনের ক্ষতি হইলেও, অন্য কেউ ঠকলেও, কষ্ট পাইলেও, তাইলে আপনেই বলেন, তহন আর মানুষ তারে কেমনে পছন্দ করব?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই আমোদি বেগম বললেন, এই যে ফজুর বাপ বজু, বজলু ব্যাপারী। তারে আপনে খুন করলেন। ভুলে করছেন, বা যেই কারণেই করছেন, খুনডা তো আপনে করছেন। তারপর আপনের দায়িত্ব আছিল কি? তার পোলাপানগুলানের দায়িত্ব নেওন। তাগো সাহায্য করন। তাগো কাছে মাফ চাওন। যেই ক্ষতি আপনে করছেন, তার কোনো পূরণ আছে? নাই। কিন্তু আপনে কি করলেন? উল্টা তাগো জমিজমা দখল করলেন। একদম পথের ভিখারি কইরা ছাড়লেন। এহন তারা আপনের নামে পূজা দিব? নাকি অভিশাপ দিব? গালি দিব? সামনে পারে না আপনের ডরে, কিন্তু পিছনে তো ঘেন্না করতে পারে, মনে মনে দুইডা গালি দিয়া ঝাল মিটাইতে পারে। কি, পারে না?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হঠাৎ করেই যেন আবার শক্ত হয়ে উঠলেন। বললেন, ও। তুমি তাইলে এই জইন্যই তলে তলে তাগো লগে আছ? তাগো জমিন ফিরাইয়া দেওনের তালে আছ?

আমোদি বেগম বললেন, সেই ক্ষমতা থাকলে বহু আগেই দিতাম। কিন্তু আল্লাহয় সেই ক্ষমতা আমারে দেয় নাই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, শোনো আমোদি বেগম। দুনিয়া হইল যুদ্ধের ময়দান। এইহানে যে যুদ্ধ কইরা টিক্যা থাকতে পারব, সে বাঁচব। যে পারব না সে বাঁচব না, এইটাই দুনিয়ার নিয়ম। এইহানে কেউ কাউরে মাথায় তুইল্যা বাঁচাইব না।

আমোদি বেগম বললেন, আপনে আর কিছু বলবেন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, শুনলাম, তোমার লগে নাকি আইজকাইল সালেহার লগে খুব মাখামাখি? ঘটনা কি? সে নাকি নিয়মিত আমাগো বাড়ি আসে?

আমোদি বেগম বললেন, নিয়মিত আসে না। ফরাজিগো চাপকল নষ্ট হইছিল, তহন দুইদিন পানি নিতে আইছিল। ঠিক হইয়া যাওনের পর আর আসে নাই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তুমি কি জানো যে আমি জীবনে কহনো হারি নাই? এই শেষ মুহূর্তে আইস্যা তুমি আমারে হারাইতে চাও?

আমোদি বেগম বললেন, কোনটা হারন আর কোনটা জেতন সেইটা আপনে জানেন? আমি কি বলি শোনেন, আপনে জীবনে কোনোদিন কোনোকিছু জেততেই পারেন নাই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হেসে বললেন, কি জিতি নাই আমি? এই খাঁ বংশ যে আইজকের খ বংশ এইটা দুনিয়ার তোক জানে, এইটা তৈয়ব উদ্দিন খাঁর বংশ। সে এইটা নিজের হাতে গড়ছে।

আমোদি বগেম বললেন, এই খাঁ বংশ একদিন থাকব না। আইজ হোক আর কাইল। এইহানে অন্য কোনো বংশ আসব। দফাদাররা যেমন এককালে আছিল, ব্যাপারীরা আছিল, এহন খায় রা। এরপর অন্য কেউ। কিন্তু আসবই। কেউ চিরকাল থাহে না বড় খাঁ সাব। থাহে মাইনষের কাম আর নাম। যে যেমন। কাম করছে, তার তেমন নাম থাহে। এই নাম থাহে মাইনষের মনে মনে। সেই মনটাই তো আপনে জিততে পারেন নাই। ধরেন আইজ কোনোবাড়িতে একটা সন্তান হইছে। যেদিন থেইক্যা ওই সন্তান ঘর থেইক্যা বাইর হইব, বুঝতে শিখব, সেইদিন থেইক্যাই তার বাপ-মা আপনেরে দেখাইয়া বলব, ওইটা হইল তৈয়ব উদ্দিন খাঁ, এর চাইতে খারাপ মানুষ আর এই দুনিয়ায় নাই। তারপর তার সাথে আপনে কি করছেন, অন্য একজনের লগে কি করছেন, কার উপর কত অন্যায় করছেন, সেইসব সে তার মনে ঢুকাইয়া দিব। বলব, ওই যে বড় খাঁ-বাড়িটা দেখেতেছ, ওইটা হইল আমাগো সবাইরে জুলুম কইরা, ঠকাইয়া বানাইন্যা। এই গল্প সেই ছেলে বড় হইয়া তার ছেলেরে বলব। এইভাবে চলতেই থাকব। এইহানেই তো আপনে হাইরা গেছেন। এর চাইতে বড় হার আর কিছু আছে কন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আমোদি বেগমের চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তিনি কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি কি সত্যি সত্যিই হেরে গিয়েছেন? তিনি তো বেঁচেই থাকতে চেয়েছিলেন। খাঁ-বাড়ির প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে মৃত্যুর পরও দীর্ঘ সময় তিনি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন তার সত্যি সত্যি মনে হচ্ছে, তিনি হয়তো তার মৃত্যুর পরও দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকবেন। কিন্তু সেই বেঁচে থাকা হবে পরাজিতের বেঁচে থাকা। হেরে গিয়ে বেঁচে থাকা।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, তার হেরে যাওয়া তো শুরু হয়ে গেছে! আর তা শুরু হয়ে গেছে একদম তার ঘর থেকেই। এই যে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমোদি বেগম, যাকে তিনি কখনো কোনোদিন সামান্যতম মূল্যও দেননি, বিন্দুমাত্র গুরুত্বও দেননি। সব সময় ভেবেছেন ছোটবংশের অভব্য আচরণের এক নিকৃষ্টতম প্রাণী, সেই আমোদি বেগমও যেন আজ এসে নতুন রূপে ধরা দিয়েছেন তার কাছে। এই নতুন আমোদি বেগম যেন সবদিক থেকেই তার চেয়ে ঢের বেশি উৎকৃষ্ট এক মানুষ।

এই নতুন আমোদি বেগমকে দেখে তার মধ্যে একধরনের হীনমন্যতাবোধ তৈরি হয়েছে। মনুষ্যত্ববোধহীনতার হীনমন্যতা। এই হীনমন্যতার চেয়ে বড় হার আর কি আছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *