৫. পারুলকে দেখতে

পারুলকে দেখতে এসেছে লতা। পারুল শুয়ে আছে বিছানায়। লতা বলল, সেইদিনই আমি ভয় পাইছিলাম, যেইদিন সন্ধ্যায় তাবারন খালার ঘরের দুয়ার খুলতে গেছিল তোর মায়। তুই সাহস কইরা ধারে যাওয়া ধরছিলি। তোর মা’র চোউখ দেখলেই তো বোঝন যায় সে আর সে নাই। যে কোনোসময় যে কেউরে খুন করতে পারে!

পারুলের ব্যথা অনেকটাই কমে গেছে। তবে ঘা শুকাতে সময় লাগবে। লতার কথার প্রত্যুত্তরে পারুল কিছু বলল না। সে বলল অন্য প্রসঙ্গে। প্রসঙ্গ আশিক। আশিকের হঠাৎ উধাও হওয়া নিয়ে লতা ভারি ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু আশিকের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল দিন দুই বাদেই। তার মোবাইল ফোনে হঠাৎ কী এক সমস্যা হয়েছিল! পারুল বলল, আশিক ভাইর খবর কি ভালো?

লতা গলায় খানিকটা ঝাঁঝ মিশিয়ে বলল, তুই আর কথা কইস না পারুল। সেইদিন তোর কথায় আশিকরে নিয়া কিনা কি সন্দেহ করছিলাম!

পারুল বলল, হিংসা কইরা কইছিলাম লতা।

লতা বলল, কিয়ের হিংসা?

পারুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোর মতো কপাল না হওনের হিংসা।

লতা বলল, তোর কপাল আমার চাইয়াও ভালো।

পারুল হাসল। বলল, আয়, কাছে আয়। আমার কপাল দিয়া তোর কপালে একখান ঘষা দেই। নিজের কপাল ভালো হইলে কাছের বান্ধবীরেও একটু ভাগ দেওন লাগে।

লতা হাসল। কিন্তু পারুল হাসল না। এই কৌতুকের ভঙ্গিতে বলা কথাটুকুর কোথায়ও যেন মন খারাপের কী এক গভীর বিষাদ লুকিয়ে ছিল। সে বলল, আমার কপালখান আসলেই ভালোরে লতা। ভালো কপাল না হইলে এইরম একখান ঘরে, এইরম এক মায়ের প্যাটে জন্মাই? হা হা হা। কী কপালখান আমার, আরেকটু হইলে মায়ের হাতে মরণ হইত! কী ভালো হইত, নারে লতা? আহারে মা। মারে!

পারুলের বুক চিড়ে যেন দীর্ঘশ্বাসের তপ্ত বাতাস বের হয়ে এলো। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল দুজনেই। তারপর কথা বলল লতা, তুই জানি কেমন হইয়া যাইতেছস পারুল! আগে কেমন চঞ্চল আছিলি। সারাক্ষণ হাসি-ঠাট্টা করতি। তোরে দেখলে মনে হইত একটা মানুষ সব সময় এত ফূর্তিতে থাহে কেমনে?

পারুল মুহূর্তেই আবার হাসল। বলল, বয়স হইছে না? বয়স হইলে একটু ভার-ভারতিক হইতে হয়। নাইলে নাকি বিয়ার সম্বন্ধ আহে না।

লতা বলল, এই কথা কেডা কইছে?

পারুল বলল, মায় কইছে।

লতা বলল, আর কি কি কইছে তোর মায়?

পারুল বলল, সব কথা কওন যাইব না। তয় আমার মায় কইছে আমার নাকি হাচা হাচাই শহরের পোলার লগে বিয়া হইব।

পারুলের মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। লতা অবাক চোখে পারুলের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েকে বোঝা বড় মুশকিল! এই সামান্য ঘটনায় কেঁদে কেটে অস্থির। আবার পরক্ষণেই তার চেয়েও সামান্য ঘটনায় আনন্দে ঝলমল।

পারুল বলল, আমার শহরে যাওনের খুব শখ। ঢাকা শহরে। তয় একলা না। জামাইর লগে। বিয়ার সাজে শহরে যাব। তোরে কহনো সত্য কথাটা ঠিক কইরা কই নাই। আইজ কই শোন। তোর যে আশিক ভাইর লগে প্রেম, এইটা দেখলে আমার অনেক হিংসা হয়। হিংসায় শরীল জ্বলে। তুই ভাবছস আমি মজা। কইরা কইছি? মজা কইরা কই নাইরে! ঘটনা সত্য। আমারো কত শখ, এইরম ঢাকার শহর থাহে, শুদ্ধ কইরা, সুন্দর কইরা কথা কয়, এইরম একটা মানুষ আমারও থাকব। কিন্তু কপাল। কপালে জুটল না। এইজইন্য আমি কত দিন একলা একলা কানছি। ওই ডাক্তার মানুষটারে ওইদিন উঠানে দেইখ্যা এক পলকেই কী যে হইয়া গেল! সবাই মনে করে আমি চালাক মাইয়া। আসলে কিন্তু আমি চালাক মাইয়া না। আমি হইলাম বলদ। বড় রকমের বলদ। বলদ না হইলে এক পলক দেইখাই কারো প্রেমে পড়ে! আমি পইড়া গেলাম। তারে আমি চিনি না, জানি না, কিছু না। তুই-ই ক, রাইন্ধা বাইরা খাওন পর্যন্ত লইয়া গেলাম। কান্নাকাটি কইরা বুক ভাসাইলাম, বলদ না হইলে এমনে কেউ করে!

লতা বলল, সে তো দেখতেও মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর।

পারুল বলল, সেইটা তো আছেই। কিন্তু ওই যে ধর, সুন্দর তো আরো কত মানুষই আছে। এই যে তোর লগে রায়গঞ্জ যাই, এইহানে সেইহানে যাই, সুন্দর পোলার অভাব আছে? নাই। কিন্তু কই? কেউরে তো আমার দুই পয়সার দামও দিতে মন চায় না। ভালোই লাগে না কেউরে। আমার আসলে এই গাঁও গ্রাম ভালো লাগে না। সাইজাগুইজা শহরের বাড়িতে থাকব। দিন শেষে জামাই আইব অফিস থেইকা। দুইজন মিল্যা কত কিছু করব। সুন্দর কইরা কথা বলব। সারাদিন টিভি দেখব, নাটক দেখব। জীবনটাও নাটক সিনামার লাহান হইব। আহা, শান্তির জীবন।

লতা বলল, ওই নাটক সিনামাই তোর মাথাটা খাইল পারুল। কয়টা দিন, কতটুক আর নাটক সিনামা দেখছস? তাইতেই তোর মাথার এই অবস্থা?

পারুল বলল, তুই যা-ই কস। আমার গ্রাম ভাল্লাগে না। গ্রামের পোলাপানও না। বিয়া-শাদি যদি করতেই হয়, টাউনের পোলার লগেই করব। এইটাই আমার এক কথা।

লতা বলল, ডাক্তারের খবর কি? ঢাকা থেইকা আর আহে নাই? তোর বাটি ফেরত দিছে?

পারুল বলল, আমারে জিগাস ক্যান? তুই-ই না কইলি, আমার কপাল ভালো। নে, আমার কপালরে জিগা।

লতা বলল, আমি যদি বিয়া-শাদি কইরা ঢাকা চইল্যা যাই, তোর খুব কষ্ট লাগব না?

পারুল সাথে সাথে কথা বলল না। লতার এই সামান্য কথাটুকুই যেন তার বুকে কোথায় গিয়ে বিঁধেছে! একটা প্রবল হাহাকার! সে মুহূর্তেরও ভগ্নাংশ সময়ে কত কী যে দেখে ফেলল! সে দেখল, লতা সুন্দর একখানা শাড়ি পরে, শাড়ির আঁচল কোমড়ে জড়িয়ে একটি ঝা চকচকে ঘরে তার বরের জন্য খাবার তৈরি করছে। আর ঠিক সেই সময়ে পারুল বসে আছে গ্রামের এক উঠানের খোলা চুলার পাশে। সেখানে স্তূপ করে রাখা শুকনো খড়ি, গাছের পাতা। চুলা থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। সেই ধোঁয়ায় তার চোখ মুখ জ্বালা করে উঠছে। তার স্বামী দুটা গরু নিয়ে বাড়ি ঢুকেই চেঁচিয়ে বলছে, দুপুর বেলা পার হইয়া যায় যায়, এহনও ভাত রান্ধন হয় নাই? সারাদিন বাড়ি বইস্যা করস কি? চাউলের লগে ডাইল মিশাইয়া আবার বাইচ্ছা আলাদা করস?

পারুলের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কিন্তু সে হাসল। তারপর বলল, সত্য কথা বলব?

লতা বলল, মিছা কথা বলবি ক্যান?

পারুল বলল, কষ্ট যতটা লাগব, হিংসা লাগব তার চাইতেও বেশি। তোর লগে আর কোনোদিনই আমার দেহা হইব না। আমিই আর তোর সামনে কোনোদিন যামু না। মুখই দেহামু না তোরে। তয় একখান কথা। আমারও যদি শহরে বিয়া হয়, তাইলে তোর লগে আমার এইরকমই খাতির থাকব। সারাজীবন।

লতা বলল, তুই একটা পাগল পারুল।

পারুল বলল, পাগল না হইলে বাইচ্যা থাকতে পারতাম না রে লতা।

লতা বলল, আশিক আর আমি ভাবছি বাড়িতে ঘটনা খুইলা বলব। বিয়া যত তাড়াতাড়ি করন যায় ততই ভালো। তয় আশিক চায় আমার ইন্টার পরীক্ষাটা শ্যাস হোক। বোঝসই তো। শিক্ষিত পোলা। বন্ধু-বান্ধবের কাছে একটা মান-ইজ্জতের ব্যাপার আছে না?

লতা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই কথাটি বলল। কিন্তু কথাটির কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম, ইচ্ছাকৃত খোঁচা রয়েছে। পারুল এটা টের পায়। লতা প্রায়ই এই কাজটি করে। পারুল অবশ্য ধরা দিলো না। সে বলল, এইটা ঠিক বলছে। জামাই শিক্ষিত হইলে আর বউ অশিক্ষিত বা কম শিক্ষিত হইলে সমাজে চলন যায় না। তুই তাড়াহুড়া করিস না। পড়াটা শেষ কর।

খানিকবাদে লতা বাড়ি চলে গেল। লতা চলে যাওয়ায় পারুলের খুব একা একা লাগতে লাগল। আবার সেই একা একা বসে থাকা। তার মন খারাপ হয়ে গেছে। তীব্র মন খারাপ। সে পড়াশোনায় কখনোই তেমন ভালো ছিল না। তাছাড়া চঞ্চল হোক, খেয়ালি হোক, সেই এতটুকু বয়স থেকেই, এই ঘর সংসারের দায়িত্ব তারই। মাকে তেমন আলাদা করে কখনোই সে সময় দেয়নি, দেখাশোনা করেনি, এটি যেমন সত্যি, তেমনি এটিও সত্যি যে সে ছিল বলেই মা কোনো অঘটন ঘটাতে পারেনি।

পারুল ভেবেছিল সে ঘর থেকে বের হবে না। কিন্তু সে বের হলো। উঠানে দাঁড়িয়ে কিছু করছিল রতন। পারুল রতনকে ডেকে বলল তাকে ধরে একটু পুকুর ঘাটে দিয়ে আসতে। পুকুর ঘাটে বসে পারুল আবিষ্কার করল বেশ কিছুদিন ধরেই একটু একটু করে পানি নেমে যাওয়া শুরু করছিল। এই কিন্তু শেষ তিন চার দিনে যেন আচমকা পানি নেমে গেছে। শুধু তাই-ই না। এই দুপুর না গড়ানো বিকেলেই চারধারে একটা মিহি শাদা আস্তরণ খেয়াল করা যাচ্ছে। কার্তিক মাস শুরু হয়ে গেছে। তার মানে হেমন্ত চলে এসেছে। গ্রাম গঞ্জে প্রবল গরম ছাড়া আর সব ঋতুর ছোঁয়াই আগেভাগে চলে আসে। বিশেষ করে শীত। আগামী কয়েক মাস যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব কষ্টের হবে। সব জায়গার পানি শুকাবে না। নদীতে নৌকা-ট্রলার ঠিকই চলবে। কিন্তু সমস্যা হবে বিলের মাঝখান দিয়ে চলা পায়ে হাঁটা রাস্তাগুলোর। এই রাস্তাগুলো বেশ কিছুদিন কাদা মাটি হয়ে থাকবে। শুকিয়ে যুতসই পায়ে হাঁটার পথ হতে সময় লাগবে বেশ।

তাবারন এসেছে ঘাটে পানি নিতে। পারুলের ঘটনার পর থেকে সে আবার কাজকর্মে মন দিয়েছে। কিন্তু কোনো একটা সমস্যা হয়েছে তার, যেটি সে কাউকে বলতে পারছে না। পারুল নানানভাবে জানার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কিছুতেই মুখ খুলছে না সে। পারুল খেয়াল করেছে আড়ালে-আবডালে বসে একা একা কাঁদে তাবারন। কিন্তু কারণটা বের করতে পারেনি পারুল।

পারুল তাবারনকে দেখে বলল, মায়রে কিছু খাইতে দিছেন?

তাবারন বলল, রতনরে দিয়া পাঠাইছিলাম। তয় তোমার মায় কিছুই খায় নাই।

সেই ঘটনার পর দুই-তিন দিন কেটেও গেছে। কিন্তু মা’র ঘরে আর যায়নি পারুল। কারো কাছে মা’র খবরও জিজ্ঞেস করেনি সে। মায়ের সেই চেহারাটা পারুল ভুলতে পারছে না। তার প্রতি কি এক ভয়ঙ্কর রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধে তার বুকের ভেতরটা পাথর হয়ে আছে। এই পাথর সে আর ভাঙতে পারেনি। আজ প্রথম মা’র কথা জানতে চাইল সে। পারুল বলল, বেয়াল বেলা কি খাইছে?

তাবারন বলল, কিছুই খায় নাই।

পারুল বলল, রাইতে?

তাবারন বলল, প্রথম দেড় দুইদিন ফইর সাব তারে খাওন দিতে দেয় নাই। পানিও না। এরপর একটু পানি খাইছিল। আর একটু ভাত। তারপর থেইকা আর খায় নাই কিছুই।

পারুল এই ঘটনা জানত না। সে উঠে রতনকে নিয়ে হেঁটে মার ঘরের সামনে এলো। তারপর তালা খুলে ঘরে ঢুকল। ঘরখানা আবার সেই আগের মতো নোংরা, দুর্গন্ধময় হয়ে উঠেছে। নুরুন্নাহার শুয়ে আছেন চিৎ হয়ে। এই দু তিনটে দিনেই যেন শুকিয়ে তার পেট মিশে গেছে পিঠের সাথে। আবছা অন্ধকারে পারুল হেঁটে গিয়ে মায়ের পাশে বসল। নুরুন্নাহার কি বিড়বিড় করে কিছু বলছেন! পারুল কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। চৌকির বাইরে নুরুন্নাহারের একখানা হাত বেঢপ ভঙ্গিতে ঝুলে রয়েছে। পারুল সেই হাতখানা ধরে চৌকির উপর উঠিয়ে দিতে গেল। কিন্তু হাতখানা ধরতেই চমকে গেল সে। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে নুরুন্নাহারের গা। পারুল বারকয়েক মাকে ডাকল। কিন্তু নুরুন্নাহার তাতে সাড়া দিলেন না। পারুল রতনকে ডেকে বালতিতে করে পানি আনাল। তারপর একনাগাড়ে মাথায় পানি ঢালতে লাগল নুরুন্নাহারের।

নুরুন্নাহার সাড়া দিলেন গভীর রাতে। আচমকা চোখ মেলে তাকালেন তিনি। তারপর কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন পারুলের দিকে। পারুল কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই নুরুন্নাহার হঠাৎ পারুলের হাত দুখানা ধরে ঝড়ঝড় করে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বললেন, আপনে আমারে যা বলবেন, আমি সব শুনমু। আর কোনোদিন আমি কাউরে কিছু বলব না। কোনো দিন বলব না। আমি আপনের পায়ে ধরি, আমারে মাফ কইরা দেন। আর লোহার ছ্যাকা দিয়েন না। আমার জানটা বাইর হইয়া যাইব। আমার জানটা বাইর হইয়া যাইব। আমারে আর মাইরেন না। আমি আর কাউরে কোনোদিন কিছু বলব না।

এমন করুণ গলায় কাউকে কখনো কাঁদতে দেখেনি পারুল। এমন ভয়াবহ আর্তনাদও কখনো শোনেনি সে। সে আলতো করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মায়ের। মাথায় রাখল। তারপর বলল, ও মা। তোমারে কেডা মারব?

নুরুন্নাহার বললেন, আপনে আমারে মারবেন না? আমি আপনার পায় ধরি। আপনে যা বলবেন সব আমি শুনব। আপনে আমারে আর মাইরেন না। আমি আপনের পাও ধইরা বইস্যা থাকব। আপনে যা বলবেন সব শুনব। আমারে আর মাইরেন না। আর তইজ্জ্যা দিয়েন না।

নুরুন্নাহার ঝড়ঝড় করে কাঁদছেন। পারুল মায়ের মাথাটা একহাতে চেপে ধরে বলল, ও মা, আমি পারুল। তোমার মাইয়া। আমি তোমারে মারব কেন?

নুরুন্নাহারের হঠাৎ কি হলো! তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত ছোট্ট এক শিশুর মতো পারুলের গা ঘেঁষে জড়োসড়ো হয়ে মিশে গেলেন। তারপর সেই প্রাণপণ আকুতিতে বলতে থাকলেন, আপনে তাইলে আমারে মারবেন না? ছ্যাক দিবেন না? তাইলে ফইর সাবে দিব? ফইর সাবে? আপনে আমারে বাঁচান মা। আমারে আপনে বাঁচান।

পারুল মায়ের মাথাটা কোলে টেনে নিলো। নুরুন্নাহারকে দেখে তার মনে হচ্ছে প্রচণ্ড ভয়ে কাঁপতে থাকা ভীত-সন্ত্রস্ত অসহায় এক শিশু। সেই শিশুর সে ছাড়া এই জগতে আর কেউ নেই।

নুরুন্নাহার দুইহাতে শক্ত করে পারুলের কোমড় জড়িয়ে ধরল। তারপর জান্তব গোঙানির স্বরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, ও মাগো, ও মা, মাগো। আমারে আপনে বাঁচান মা, মাগো। ও মা, মা, মাগো।

পারুল আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিল না। তার ডান হাত নড়াতে কষ্ট হচ্ছিল খুব তবুও দুইহাতে সে মাকে ধরে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখতে চাইছিল। কিন্তু নুরুন্নাহার হঠাৎ তীব্র চিৎকারে কেঁকিয়ে উঠলেন, মাগো, বুকটা ফাইট্টা যাইতেছে মা। গরম লোহার ছ্যাক মাগো। দগদইগ্যা ঘাও মারে। ও মা। মারে। বুকটা ছিড়া যাইতেছে। ও মাগো, ও মা, মাগো। ও বাবা। বাবাগো।

কান্নায় তার গলা বুজে আসছে। পারুল কিছুই বুঝল না। সে আলতো করে নুরুন্নাহারকে ধরে আবার শুইয়ে দিলো। আর ঠিক সেইমুহূর্তে সে দাগটা দেখল। নুরুন্নাহারের গলার নিচে বুকের কাছটায় একটা দগদগে ঘা। সে খুব সাবধানে মায়ের বুকের উপর থেকে কাপড়টা সরাল। আর তখনই দেখতে পেল তার খোলা বুক। নুরুন্নাহারের দুই বুকের মাঝখানের জায়গাটিতে একটা বীভৎস ক্ষত! দাগটা কিসের বুঝতে মুহূর্তকাল সময়ও লাগল না পারুলের। সেদিন রাতে তার বাবা আব্দুল ফকিরের হাতে একটা চ্যাপ্টা মাথার কুচকুচে কালো মোটা লোহার রড সে দেখেছিল। সেই রড আগুনে পুড়ে নুরুন্নাহারের বুকে ছ্যাকা দিয়েছেন তিনি!

পারুলের স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন সেই রডখানা দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন নুরুন্নাহার। তাহলে কি মাকে আরো আগেও ওই রড দিয়ে শাস্তি দিয়েছিলেন তিনি? পারুল নুরুন্নাহারের পেটের উপর থেকে কাপ

কোথাও নেই। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কী মনে হতে পারুল উরু অবধি মায়ের কাপড় তুলে ফেলল। তারপর হঠাৎ স্থির হয়ে গেল তার দৃষ্টি। সেখানে উরুর আরো উপরে, ঠিক জঙ্ঘার কাছে শুকিয়ে আছে একইরকম পুরনো আঘাতের চিহ্ন। এই এতদিনে পারুলের কাছে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেল, নুরুন্নাহারকে ভয়াবহ সব আঘাত করেছেন তার বাবা। কিন্তু সেই আঘাতগুলো এমনভাবে করা হয়েছিল, এমন জায়গায় করা হয়েছিল, যা তিনি যেন কখনোই কাউকে দেখাতে না পারেন। কিন্তু তারপরও বুকে এর আগের আর কোনো আঘাতের চিহ্ন পারুল দেখেনি। তাহলে এবার কেন? পারুলের হঠাৎ মনে হলো, তাহলে কি তাবারনের বুক পুড়িয়ে দেয়ার শোধ?

এই প্রথম পারুলের মনে হলো তার বাবা আব্দুল ফকির নামের সাদাসিধে চেহারার মানুষটার আড়ালে রয়েছেন একটা নির্মম মানুষ। অমন মমতাময় পিতার আড়ালে রয়েছেন একজন নিষ্ঠুর স্বামী। কিন্তু এই এতদিন ধরে এসব তিনি কেন করলেন?

*

হেমার কাছে ফোনটা আসল অপরিচিত নম্বর থেকে। ফোন করেছেন তার বাবা আসলাম সাহেব। বাবার কণ্ঠ হেমার না চেনার কথা না। কিন্তু সে প্রথম কিছুক্ষণ বাবার কণ্ঠ চিনতে পারল না। আসলাম সাহেব বলার পরও হেমা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, তোমার কী ঠান্ডা লেগেছে বাবা?

আসলাম সাহেব বললেন, ছাতা ছাড়া বেরিয়েছিলাম। অসময়ে চট করে বৃষ্টি। ভিজে যা তা অবস্থা। অথচ এই সময়ে শীত পড়ে যাবার কথা। কিন্তু এখনও কী যে বিশ্রি ভ্যাসপা গরম পড়ছে! আ হরিবল ইফেক্ট অফ ক্লাইমেট চেঞ্জ।

হেমা কিছু বলল না। আসলাম সাহেবই একটু বিরতি দিয়ে বললেন, চেঞ্জ হয়ে উপায় কি? মানুষ ন্যাচারটা ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই যে এতবড় শহর। ঢাকা, কোথাও কোনো সবুজ আছে? আশেপাশে যাও কিছু গাছপালা ছিল, তাও কেটেকুটে সাফ করে ফেলা হচ্ছে!

হেমা বলল, তুমি কী খুব বিশেষ কিছু বলবে বাবা?

আসলাম সাহেব বললেন, কেন? যা বলছি, তা কি ইম্পর্ট্যান্ট কিছু না?

হেমা বলল, অবশ্যই ইম্পর্ট্যান্ট। তুমি কি এই ইম্পর্ট্যান্ট বিষয়টা নিয়েই কথা বলার জন্য আমাকে ফোন করেছ?

আসলাম সাহেব বললেন, এই যে এতগুলো দিন আমার কোনো খোঁজ নেই? একবারও মনে হয়নি যে বাবাকে একটা ফোন দেই?

হেমা বলল, তোমার ফোন বন্ধ বাবা! তুমি এই যে এখন ফোন দিয়েছ, তাও একটা অপরিচিত নম্বর থেকে!

আসলাম সাহেব বললেন, ও।

তারপর ফোনের দু’ প্রান্তে দুজনই চুপ। অনেকক্ষণ বাদে হেমা বলল, তুমি কি খুব জরুরি কিছু বলতে চাও? কিন্তু কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছ না?

আসলাম সাহেব বললেন, না বলতে পারার কি আছে? তুই তো আমার স্কুলের হেডমিস্ট্রেস না!

হেমা বলল, বাবা, তুমি ডিভোর্স নিচ্ছ মার কাছ থেকে। কিন্তু তাতে কিন্তু তুমি আমার সৎ বাবা হয়ে যাচ্ছ না। তুমি আমার আপন বাবাই থাকচ্ছ। আগে। যেমন ছিলে, এখনও তেমনই আছ, মার সাথে ডিভোর্সের পরও থাকবে। কিন্তু তোমার আচারণ দেখে মনে হচ্ছে তুমি অলরেডি আমার সৎ বাবা হয়ে গেছ!

আসলাম সাহেব যেন থতমত খেয়ে গেলেন। তিনি বললেন, আমি কি তোর সাথে খুব খারাপভাবে কথা বলে ফেলেছি?

হেমা বলল, হয়তো খুব খারাপভাবে বলোনি। ঠিকই বলেছ। কিন্তু আগে কখনো এমন করে আমার সাথে কথা বলোনি তো, হয়তো এইজন্যই আমার এমন লাগছে।

আসলাম সাহেব মৃদু কণ্ঠে বললেন, সরি।

হেমা বলল, এখন বলো, তুমি কি আমাকে বিশেষ কোনো কথা বলতে চাইছ?

আসলাম সাহেব চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, তুই কি আমার সাথে একটু দেখা করতে পারবি?

হেমা বলল, কেন পারব না? অবশ্যই পারব। তুমি বরং বাসায় চলে এসো। বাসায় চলে আসলেই আমাদের দেখা হয়ে যাবে। তোমার সাথে অনেকদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করি না। কফি খাই না। তুমি চলে এসো।

আসলাম সাহেব বললেন, ওই বাসায় আমি আর ঢুকব না। আমার দমবন্ধ হয়ে আসে।

হেমা বলল, বাসাটা তো তোমার। তুমি ডিভোর্স নিলেও মাকেই বরং বাসাটা ছেড়ে চলে যেতে হবে। তুমি তো তোমার বাসাতেই থাকবে। তুমি বাইরে বাইরে ঘুরছ কেন?

আসলাম সাহেব কথা বললেন না। হেমাই বলল, তোমাদের ডিভোর্সের পর আমাকেও কি মার সাথে এই বাসা ছেড়ে চলে যেতে হবে? বাবার প্রপার্টিতে সন্তানের একটা রাইট তো থাকেই। আমি এই বারান্দাওয়ালা বাসাটা ছাড়তে চাই না। এটা তোমার প্রোপার্টিতে আমার একমাত্র রাইট।

আসলাম সাহেব বললেন, কিসব আবোল-তাবোল বকছিস? তুই আবার কই যাবি?

হেমা বলল, ধরো তুমি আবার বিয়ে করে ফেললে, তখন আমার সেই নতুন মা তো আমাকে পছন্দ নাও করতে পারে। তাছাড়া নতুন বিয়ের পর একটা প্রাইভেসির ব্যাপার থাকে। আমার মতো এত বড় একটা মেয়ে তখন বাসার মধ্যে ঘোরাঘুরি করবে, এটা এক্সট্রা একটা পেইন।

আসলাম সাহেব বললেন, তুই আমাকে পিঞ্চ করার চেষ্টা করছিস।

হেমা বলল, সরি বাবা। কিন্তু আমি তেমন ভেবে বলিনি।

আসলাম সাহেব বললেন, আমার ওই বাসাটায় আর ঢুকতে ইচ্ছে করছে না। তোর মার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমি আর ওই মানুষটার মুখ মনে করতে চাই না। আমার জীবনটা সে চেরতার রসের মতো তিতা বানিয়ে ফেলেছে।

হেমা বলল, আচ্ছা। কোথায় দেখা করতে চাও বলো।

আসলাম সাহেব একটা রেস্টুরেন্টের ঠিকানা দিলেন। হেমা পৌঁছাতে পৌঁছাতে খানিক দেরী হয়ে গেল। সে পৌঁছে দেখল বাবা আগে ভাগেই চলে এসেছেন। খাবার দাবার নিয়ে খুব একটা কথা হলো না তাদের। হেমা সরাসরি বলল, বাবা, একটা কথা বলি?

আসলাম সাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। হেমা গম্ভীর গলায় বলল, কখনো ভান করো না বাবা। নিজের যেটা ভালো লাগে, সেটা করো। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যদি তোমার মনে হয়, এই কাজটি করলে অন্যরা তোমাকে খারাপ ভাববে। সুতরাং এই অন্যরা যাতে খারাপ না ভাবে, এই জন্য সেই কাজের পেছনে মিথ্যে কোনো অজুহাত দাঁড় করিয়ো না। সবচেয়ে বড় কথা অন্য কারো উপর দোষ চাপিয়ো না।

আসলাম সাহেব বললেন, তোর ধারণা, আমি মিথ্যে অজুহাত দাঁড় করিয়েছি? তোর মার উপর মিথ্যে দোষ চাপাচ্ছি?

হেমা বলল, আমার ধারণা নিয়ে তুমি ভেবো না বাবা। তুমি তোমার ধারণা নিয়ে ভাবো। অন্যরা কি ভাবছে, সেটি ভাবতে গিয়ে তুমি তোমার ভালো লাগাটা, অনুভূতিটা নষ্ট করো না।

আসলাম সাহেব বললেন, আমি আমার ফাইনাল ডিসিশনটা নিয়ে নিয়েছি। আই কান্ট টেক ইট এনিমোর।

হেমা বলল, তুমি কি সিওর? নাকি এখনো কনফিউজড?

আসলাম সাহেব সামান্য সময় নিয়ে বললেন, সিওর।

হেমা বলল, কারণটা খুঁজে পেয়েছ?

আসলাম সাহেব বললেন, কিসের কারণ?

হেমা বলল, এই যে প্রায় পঁচিশ বছরের একটা সম্পর্ক ভেঙে দিচ্ছ। তার কারণ।

আসলাম সাহেব বললেন, তোকে আমি সব বলেছি হেমা। আমি আর নিতে পারছি না। ক্লান্ত হয়ে গেছি। দিন শেষে প্রত্যেকটা মানুষের একটা যাওয়ার জায়গা দরকার। তার মন খারাপ হলে কথা বলার একটা মানুষ দরকার। তার দুঃসময়ে তার পাশে এসে দাঁড়ানোর, শক্ত করে তার হাত ধরবার একজন মানুষ দরকার। মানুষ কতদিন বাঁচে? এ সময়টা জুড়ে সে কেবল ভালো কিছু মুহূর্ত চায়, ভালো কিছু স্মৃতি চায়। আর চায়, তার যেন কখনো অসহায় মনে না হয়। তার যেন মনে হয়, তার পাশে কেউ একজন আছে! কিন্তু সেই না থাকাটা খুব কষ্টের। যার দিন শেষে ঘরে ফেরার পর একটু যত্ন করার কেউ নেই, খারাপ সময় এলে দুটো কথা বলে ভরসা দেবার কেউ নেই, তার চেয়ে। দুর্ভাগা আর কে আছে! এর চেয়ে কষ্টের কিছু নেই, এর চেয়ে শূন্যতার কিছু নেই।

আসলাম সাহেবেরে গলা ভারি হয়ে এসেছে। হেমা বাবার চোখের দিকে তাকাল না। বাবা হয়তো কাঁদছেন। সে টেবিলের উপর রাখা বাবার হাতখানা শক্ত করে ধরল। বাবার হাত থরথর করে কাঁপছে। হেমা মৃদু গলায় বলল, আমি জানি বাবা। বুঝি। তোমার মতো করে সবটা না বুঝলেও অনেকটাই বুঝি। আর বুঝি বলেই আমি তোমাকে একবারের জন্যও দোষ দেইনি। এখনও দিচ্ছি না।

আসলাম সাহেব হাতের মুঠোয় মেয়ের হাতখানা শক্ত করে ধরলেন। তিনি চেষ্টা করেও আটকাতে পারলেন না। টুপ করে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল পিতা কন্যার শক্ত করে ধরে রাখা হাতের পাশেই। হেমা বলল, বাবা, আমি তোমার কষ্টটা পুরোপুরি বুঝতে পারছি। সমস্যা হচ্ছে, মার কষ্টটাও আমি উপেক্ষা করতে পারছি না। আমি অনেকবার মা’র জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখেছি, আমি পারিনি বাবা। আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। হ্যাঁ, এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতিও হয়তো অনেক মেয়েই মেনে নেয়। নেয় বলেই তাদের কষ্টের তীব্রতাটা বোঝা যায় না। সবাই ভুলে যায়। মাও যদি মেনে নিত, তাহলেও হয়তো কেউ তার কষ্টটাও বুঝত না। তুমিও না। আমিও না। কখনো জানতামই না হয়তো। মনেও থাকত না কারো। কিন্তু মা মেনে নিতে পারেনি বলেই তার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি। একটা মানুষ কি অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে!

আসলাম সাহেব যেন হেমার হাতধরা তার হাতখানা সামান্য শিথিল করে দিলেন। তারপর নিস্তেজ গলায় বললেন, আমি আমার সবটা সাধ্য দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছুই বদলাতে পারিনি।

হেমা বলল, বাবা, হয়তো মা’ও সব কিছু মেনে নিতে চেষ্টা করেছে। তার সাধ্যের সবটা দিয়েই করেছে। কিন্তু সেও হয়তো শেষ অবধি কিছুই মেনে নিতে পারেনি। তোমার চেষ্টাটা মা দেখেছে বলেই হয়তো তুমি ভাবছ, এতকিছুর পরও মা নিজেকে বদলাতে পারেনি। কিন্তু মা’র চেষ্টাটা হয়তো মা তোমাকে কখনো দেখাতেই পারেনি। তার চেষ্টাটা ছিল তার মনের সাথে। আর মনের সাথে করা চেষ্টাটা সে তোমাকে দেখাবে কি করে!

আসলাম সাহেব চুপ করে রইলেন। চুপ করে রইল হেমাও। তারপর আসলাম সাহেব বললেন, কিন্তু তাতে তো কিছু বদলায়নি। একটা সম্পর্কহীন সম্পর্ক। বছরের পর বছর। একই ছাদের নিচে পাশাপাশি দুজন মানুষ। কিন্তু কেউ কারো কাছাকাছি নয়। কী দুর্বিষহ জীবন।

হেমা বলল, এই দুর্বিষহ সম্পর্কটা এত বছর কেন টেনে নিয়ে এলে বাবা?

আসলাম সাহেব বললেন, সব সময় মনে হতো যদি ঠিক হয়! আরেকবার চেষ্টা করে দেখি, যদি ঠিক হয়!

হেমা বলল, এখন তাহলে চেষ্টা ছেড়ে দিচ্ছ কেন?

আসলাম সাহেব বললেন, আর পারছি না। ক্লান্ত হয়ে গেছি।

হেমা বলল, কিন্তু যদি এমন হয়, মার চেষ্টাটা এখনো ভেতরে ভেতরে চলতেই থাকে! আর কোনো একদিন সে পেরে যায়?

আসলাম সাহেব বললেন, সেটি কোনোদিন সম্ভব না।

হেমা বলল, যদি হয়?

আসলাম সাহেব আবারো সামান্য সময়ের জন্য চুপ করে রইলেন। তারপর হঠাৎ দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, তাতে কিছু যায় আসে না। আই কান্ট টলারেট হার। এনিমোর। আর সহ্য করতে পারছি না আমি। ওকে আমার চোখের সামনেই। আর দেখতে ইচ্ছে হয় না আমার।

হেমা এবার শান্ত, স্থির গলায় বলল, এই এত এতকাল, এত এত বছর পর এসে কেন আর দেখতে ইচ্ছে করছে না, ভেবেছ কখনো?

আসলাম সাহেব কিছু একটা বলতে গিয়েও আর বললেন না। চুপ করে রইলেন। হেমা বললেন, বাবা, আমি তোমাদের মেয়ে। আমি বড় হয়েছি। সন্তান কখনো কখনো বন্ধুও হয়ে যেতে পারে। তুমি আমাকে এই এত এত কথা নাও বলতে পারতে। কিন্তু এই যে বলেছ, এতে আমি নিজেকে আর আট দশটা সন্তানের চেয়ে আলাদা ভাবতে পারছি। আর পারছি বলেই তোমাকে আমি এই এত এত কথাও বলতে পেরেছি।

হেমা সামান্য থামল। তারপর বলল, সবচেয়ে বড় কথা, আমি নিজেও চাই, এইরকম কোনো সম্পর্কে কেউ থাকুক। তোমরা আমার বাবা-মা বলেই যে আমি কেবল ভাবব আমার জন্য হলেও তোমরা থেকে যাও। এটা আমি কখনোই করব না। আমি জানি, কী ভয়ঙ্কর একটা জীবন তোমরা কটিয়েছ, কাটাচ্ছ। কিন্তু বাবা, ওই যে বললাম, কেন চলে যাচ্ছ, সেটি অন্তত নিজের কাছেই স্পষ্ট হওয়া দরকার। কেবলই কী সম্পর্কটা আর বইতে পারছ না বলেই। চলে যাচ্ছ, নাকি সেখানে অন্য আর কোনো কারণও রয়েছে।

আসলাম সাহেব ঝট করে হেমার মুখের দিকে তাকালেন। হেমা বলল, ভয় পেয়ো না বাবা। তেমন কিছু হলেও আমি কিছু মনে করব না। এমন হতেই পারে। ভালোবাসা, যত্ন, সাপোর্ট এমন প্রয়োজনীয় এবং একইসাথে লোভনীয় বিষয় যে এর জন্য মানুষ সবকিছু ছাড়তে পারে। আর সেখানে এই অনুভূতিগুলোর জন্য সারাজীবন কাঙাল হয়ে থাকা একটা মানুষ যদি হঠাৎ করে এমন কারো দেখা পায়, যে তাকে সেই অনুভূতিগুলো দিয়েই কানায় কানায় পূর্ণ করে দিচ্ছে, তাহলে সে তো সবকিছু ছেড়ে সেখানে যাবেই। এতে তো দোষের কিছু নেই বাবা!

আসলাম সাহেব ধীরে ধীরে হেমার মুখ থেকে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। বাইরে। বাইরে বিকেলের শহর। সেখানে ক্রমশই ধেয়ে আসছে সন্ধ্যা। অন্ধকার তাড়াতে টুপটাপ জ্বলে উঠছে সড়ক দ্বীপের সোডিয়াম লাইট।

হেমা বাবার হাতখানা আবার ধরল। তারপর আচমকা বলল, আমি সম্ভবত মেয়েটিকে দেখেছি বাবা। মেয়েটি দেখতে সুন্দরী। তোমরা দোয়েল চত্বরের ওখানে আমার ঠিক সামনের রিকশাটায় ছিলে।

আসলাম সাহেব কোনো সাড়া দিলেন না। চোখ ফেরালেন না। যেন হেমার সামনে থেকে এই মুহূর্তে তিনি পালিয়ে যেতে চান। হেমার চোখে চোখ রাখার সাহস যেন আর নেই তার। হেমা ডাকল, বাবা।

আসলাম সাহেব জানালার বাইরে থেকে চোখ ফেরালেন। কিন্তু সেই চোখ তুলে হেমার দিকে তাকালেন না। তিনি মুখ নিচু করে তাকিয়ে রইলেন তার পায়ের দিকে। হেমা আবারো ডাকল, বাবা।

আসলাম সাহেব বসে রইলেন নির্বাক, নিরুত্তর : হেমা বলল, এই কথাটিই আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম বাবা। এই এতটা বছর এই সম্পর্কটাকে তুমি প্রচণ্ড কষ্ট করেও শেষ অবধি বয়ে নিয়েই গেছ। কিন্তু এখন আর বয়ে নিয়ে যেতে চাইছ না। এই না চাওয়ায়, এই সম্পর্কটার দায় নিশ্চয়ই আছে। অনেক বেশিই আছে। কিন্তু অন্য একটা খুব শক্তিশালী কারণও তো রয়েছে। সেই কারণটাকে তুমি অস্বীকার করো না বাবা।

হেমা থামল। তারপর ওয়েটারকে ডেকে সামান্য যে খাবারের বিল হয়েছে। তা নিজেই দিলো। আসলাম সাহেব চোখ তুলে মেয়ের দিকে তাকালেন। হেমা বলল, চলো, বাইরে খানিক হাটি। এখানে ভালো লাগছে না।

বাপ-মেয়ে দীর্ঘ সময় হটলো পাশাপাশি। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলল না। একটা সময় হেমা বলল, তুমি কী ল’য়ারের সাথে কথা বলে ফেলেছ?

আসলাম সাহেব এই প্রসঙ্গে কোনো কথা বললেন না। তিনি বললেন অন্য কথা। বললেন, তুই আমাকে খুব খারাপ ভাবছিস তাই না?

হেমা বলল, একটুও না বাবা।

আসলাম সাহেব বললেন, কেন ভাবছিস না? আমি তো খারাপ মানুষ। আমি তোর বাবা। আর সে কিনা তোর মাকে রেখে অন্য একটা মানুষের কাছে চলে যাচ্ছে!

হেমা বলল, ভাবতাম। যদি মা তোমাকে ডেকে বলত, যেও না। যদি তোমার চলে যাওয়ার জন্য তার একা হয়ে যেতে হতো। যদি তোমরা পরস্পরের কাছে সামান্য হলেও কোনো অর্থ বহন করতে। তাহলে হয়তো ভাবতাম। কিন্তু যেখানে তুমি চলে যাওয়া বা থাকায় মার বা তোমার কিছু যায় আসে না। বরং চলে গেলে অন্তত একজন মানুষ তো ভালো থাকবে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার তোমার এই ভালো থাকায়, মা’র তো আলাদা করে কোনো খারাপ থাকা হচ্ছে না। সে যেমন ছিল তেমনই থাকবে। কিংবা কে জানে, হয়তো সেও ভালোই থাকবে! তাহলে খারাপ ভাবব কেন তোমায়?

আসলাম সাহেব বললেন, তোর নিজের জন্য? নিজের জন্য খারাপ লাগবে না?

এই প্রথম হেমা কথা বলল না। সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল একটা হলুদ সোডিয়াম লাইটের নিচে। দাঁড়িয়ে গেলেন আসলাম সাহেবও। হেমা দীর্ঘ সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর খুব ধীরে, খুব মৃদু গলায় বলল, লাগবে বাবা। খুব খারাপ লাগবে। কিন্তু আমি কখনোই চাইনি, আমার ভালো লাগা, মন্দ লাগার জন্য অন্য কারো ভালো থাকা, মন্দ লাগা প্রভাবিত হোক।

আসলাম সাহেব মেয়ের আরো খানিকটা কাছে এসে দাঁড়ালেন। হেমা বলল, তবে আমার যদি ক্ষমতা থাকত। ধরো জাদু টাদু কিছু জানতাম, তবে ফুঁ দিয়ে তোমাদের দুজনের মনের ভেতর থেকে অতীত মুছে দিতাম। তোমরা। তখন কেবল আমার বাবা-মা হয়েই থাকতে। আর সকল কিছু হাওয়ায় মিলিয়ে যেত।

আসলাম সাহেব বললেন, চল তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

হেমা বলল, আমি এখন যাব না বাবা। তুমি যাও। আমি কিছুক্ষণ এখানে ফুটপাতে বসে থাকব একা। সোডিয়াম লাইটের নিচে একা একা বসে থাকার একটা আলাদা ব্যাপার আছে। তুমি যাও।

আসলাম সাহেব কি করবেন বুঝতে পারছেন না। অবশ্য হেমা যেহেতু বলেছে, সে এখানে বসে থাকবে, সে বসেই থাকবে। কিন্তু হেমাকে এখানে এভাবে একা রেখে যেতে তার মন চাইছে না। তিনি হেমার পাশে দাঁড়িয়েই রইলেন। হেমা হঠাৎ বাবার হাত ধরে বলল, আমরা আসলে দিন শেষে সবাই কেবল নিজে নিজেই ভালো থাকতে চাই বাবা। এই যে দেখো, খানিক আগে আমি বললাম না, আমার যদি ক্ষমতা থাকত, তাহলে আমি তোমাদের অতীত মুছে দিয়ে তোমাদের কেবল আমার বাবা মা-ই বানিয়ে দিতাম। কিন্তু দেখো, তোমরা হয়তো তোমাদের অতীত স্মৃতি মুছে দিতে নাও চাইতে পারো। মা হয়তো তার সেই অতীত স্মৃতিগুলো নিয়ে ঠিকই আছে। কিন্তু আমার ক্ষমতা থাকলে আমি আমার জন্যই কেবল তোমাদের চাইতাম। তোমাদের আলাদা চাওয়া-পাওয়ার কথা মোটেই ভাবতাম না।

আসলাম সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, আমি সরি মা।

হেমা বলল, সরি কেন বাবা?

আসলাম সাহেব বললেন, আমি জানি না আমি কেন সরি। বাট আই ফিল গিল্টি।

হেমা বলল, এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে এই ফিলিংটা রেখো না। এই ফিলিংটা এই নতুন সম্পর্কটাকেও নষ্ট করে দেবে বাবা। নিজে পুরোপুরি দ্বিধামুক্ত হও। সামান্যতম দ্বিধা রেখেও কিছু করো না। আমি জানি না, সেই মেয়েটা এই সম্পর্কে কেন এসেছে। নিশ্চয়ই সেও একটা আশ্রয়ের জন্যই আসছে। কিছুটা শান্তির জন্য এসেছে। এখন তুমি কোনো দ্বিধা বা অপরাধবোধ নিয়ে সম্পর্কটায় ঢুকলে তাকেও ঠকানো হবে। এটা করো না।

আসলাম সাহেব আর কিছু বললেন না। তবে সোডিয়াম লাইটের সেই হলদে আলোর নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তিনি নির্ণিমেষ তাকিয়ে রইলেন। এই মেয়েটা সেই ছোট্ট তুলতুলে পুতুলের মতো কথা জড়ানো, সেই হাঁটি হাঁটি পা পা করে সারাক্ষণ তার গা ঘেঁষে লেগে থাকা মেয়েটা! তার সেই মেয়েটা চিন্তায়-ভাবনায় এতটা পরিণত হয়ে গেল কখন তিনি এই এত এতদিনে তা যেন কখনো টেরই পাননি! আসলাম সাহেবের হঠাৎ মনে হতে লাগল, এই মুখটা তিনি বহু বহু আগে আরো একবার দেখেছিলেন। ঠিক এই যে এই মুহূর্তে এই সোডিয়াম লাইটের হলদে আলোর নিচে দাঁড়িয়ে থাকা গভীর চোখের মমতাময়ী মুখখানা। বহু বহু বছর আগে। যেই মুখখানা দেখলে মুহূর্তেই তার বুকের ভেতরটা ডুবে যেত মমতার ঘ্রাণে। সেই মুখখানাই যেন এই এত এত বছর পর তিনি আবার তার চোখের সামনে দেখলেন। সেই মুখ। মায়ের মুখ।

*

ভোরের আলো তখনও ফোটেনি। ফজরের আজানের সময়ের এখনও কিছু বাকি আছে। এই অদ্ভুত সময়ে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ দাঁড়িয়ে আছেন সলিমুদ্দি দফাদারের বাড়ির সামনে। সলিমুদ্দি দফাদারের বাড়িখানার প্রথমে রাস্তা থেকে দীর্ঘ উঠান। তারপর একখানা টিনের পরিত্যক্ত দহলিজ ঘর। তারপর আবার বিস্তৃত উঠান। তারপর পরিত্যক্ত বসতঘর। তারপর আবার দীর্ঘ উঠান। তারপর মজা পুকুর। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত পড়ে থাকায় বাড়িখানা ঘাস-লতাপাতার জঙ্গল হয়ে আছে। বর্ষার সময়ে এই ধরনের বাড়িগুলো হয় বিষাক্ত সাপের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। আশেপাশের মাঠ, জঙ্গল, গর্ত পানিতে ডুবে যাওয়ায় সাপেরা সেসব আশ্রয় ছেড়ে এই ধরনের বাড়ির শুকনো ভিটে মাটিতে এসে বসত গাড়ে। এখানে ইঁদুর, ছুঁচো থেকে শুরু করে নানান খাবারও পাওয়া যায়।

পারতপক্ষে এইসময়ে কেউ এই ধরনের বাড়ির আশেপাশে ঘেঁষে না। কিন্তু এই শেষরাতের সুনসান নিস্তব্ধতায় সেই বাড়িতে এসেছেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। তার সাথে আছে এস্কান্দার আর মনির। সামনের উঠানে পায়ের গোড়ালি ডুবিয়ে হাঁটু অবধি তেড়ে আসা ঘাস। খুব সাবধানে তারা সেই ঘন ঘাসের উঠান পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। দহলিজ ঘরের দরজায় মস্ত তালা ঝোলানো। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ দহলিজ ঘরখানাকে বাঁ পাশে রেখে চলে এলেন বাড়ির ভেতর দিকের উঠানে। তারপর কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ। চারপাশে একটানা পোকামাকড়ের ডাক। সাপখোপের ভয়ঙ্কর বিপদ মাথায় নিয়ে এই নিশুতি রাতে এখানে আসার কারণ রয়েছে। চাইলে তিনি দিনের আলোতেও এই বাড়িতে আসতে পারতেন। কিন্তু সলিমুদ্দি দফাদারের পরিত্যক্ত বাড়িতে হঠাৎ তৈয়ব উদ্দিন খাঁর আগমন এই নিস্তরঙ্গ গ্রামে বড়োসড়ো খবর। এই খবর মুহূর্তেই পাঁচকান হয়ে যাওয়ার কথা। ঘটনা দেখতে চারপাশে উৎসুক জনতার ভিড়ও লেগে যাওয়ার কথা। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এটি চাননি। আর চাননি বলেই তার এত গোপনীয়তা।

মনিরের হাতে সরু লম্বা চার্জার লাইট। এই লাইট আনা হয়েছে বিলকুড়ানির হাট থেকে। ফতেহপুরে ইলেক্ট্রিসিটি না থাকায় এখানে কারো ঘরেই এই ধরনের লাইট দেখা যায় না। কিন্তু আজ বিশেষ প্রয়োজনে এই লাইট নিয়ে আসা হয়েছে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এহন বলি এইহানে এই রাইতে ক্যান আইছ।

মনির বলল, দাদাজান, আপনে আইজ সন্ধ্যা রাইতে বলনের পরই সেইটা আমি বুঝছি।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আমার সন্দেহ ফজু গয়নার কলসিখান এইহানে লুকাইয়া রাখছে। এই কথা বাড়িতে বইসা তোগো বলতে চাই নাই সাবধান থাহনের লইগ্যা। আইজকাল যা অবস্থা দাঁড়াইছে, দেখতেছি দেওয়ালেরও কান গজাইতেছে! কোনো কথা কারো প্যাটে থাহে না।

মনির বলল, একখান কথা কই দাদাজান?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, কী কইবি আমি বুঝছি। কইবি তো এত জায়গা থাকতে এইহানে ক্যান ফজু ওই জিনিস লুকাইতে আইব?

মনির অন্ধকারে অনুচ্চ স্বরে শব্দ করল, হুম।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আমি এহনও নিশ্চিত না। তয় অনেকগুলা কারণও আছে। প্রথম কথা, ও যহন কলসিখান পাইছে, তহন বাইস্যাকাল। ওই কলসি রাখতে ও যাইব কই? বাইরে কোনোহানে মাটির তলায় রাইখা মাটি চাপা দিলে সেই মাটি শুকাইতে সময় লাগব। তার উপর বৃষ্টিতে মাটি ধুইয়া যাইতেছিল। কোন সময় কোনখানের মাটি ধুইয়া গিয়া কলসখান আবার মাটির তলা থেইকা বাইর হইয়া যায়, এইটা একটা ডরের বিষয়। জানাজানি হওনের ডরে কারো কাছে রাখতে দিতেও পারব না। তার উপর বাইস্যাকাল হওনে চাইরপাশে পানিতে ভরভরন্ত। কেলাগাছের ভেলা, তালের ডোঙ্গা, ডিঙ্গি নাও থেইকা শুরু কইরা নানান ধরনের নৌকায় সারাদিন লোকজন সবজায়গায় ঘোরাফেরা করে। বাড়ির ভিটা পর্যন্ত যহন তহন যে কেউ চইল্যা আসে। বিপদ থাইক্যাই যাইত। তাইলে জিনিস সে কই রাখব? এমন জায়গায় রাখব, যেইহানে বৃষ্টি বাদলার ডর নাই, লোকজন সহজে আসে না। আবার ওর বাড়ির ধারেই। চাইলে সেইহানে সময় সুযোগমতো ও রাইতও কাটাইতে পারব। কিন্তু বাইরে থেইকা কেউ ওরে দেখবও না। এইরম জায়গা তো এই একটা ছাড়া আর দেহি না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সামান্য থেমে কান পেতে যেন কিছু একটা শোনার চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, আরেকটা ব্যাপার হইল বেয়ান বেলা নামাজ পড়া শেষ কইরা হাঁটতে বাইর হইয়া দুই দিন তারে আমি এইদিকে দেখছি। হয়তো এমনেই আইছিল। কিন্তু সবকিছু ভাইবা মনের মধ্যে একটা কামড় মারছে। এই জইন্যই এইহানে আইলাম। মনে কিছু সন্দেহ হইলে, সেইটা অগ্রাহ্য করতেও নাই, পুইষাও রাখতে নাই। হেস্তনেস্ত করন দরকার।

মনির অস্ফুটে বলল, আচ্ছা দাদাজান। আমরা দেখতেছি।

তারপরের কিছুটা সময় বাড়ির সম্ভাব্য সকল জায়গায় আলো ফেলে খুঁজে দেখল এস্কান্দার আর মনির। মূল দরজায় মস্ত তালা ঝোলানো থাকলেও সবগুলো ঘরের দরজা জানালারই এখানে-সেখানে ভাঙা। সেই পথে দহলিজ ঘর থেকে মূল ঘর, ঘাসের উঠান থেকে রান্নাঘর অবধি তারা আলো জ্বেলে দেখল। কিন্তু কোথাও সম্ভাব্য কোনো চিহ্ন পর্যন্ত দেখা গেল না। ফজরের আজান হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই নামাজ। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তখনো। গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন উঠানে। কতটা সময় সেখানে স্থির দাঁড়িয়ে থেকে কিছু একটা ভাবলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। তারপর বাড়ি থেকে বের হতে গিয়েও হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন তিনি। মনিরকে ডেকে বললেন তার সাথে সাথে বসতবাড়ির পেছন দিকে মজা পুকুরটার দিকে যেতে। পুকুরটাতে বহুকাল কেউ নামে না। পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটখানা লতাপাতায় ঢেকে আছে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সেই ঘাটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর আচমকা মনিরের কাছ থেকে লাইটখানা নিয়ে ঘাটের বেদির আশেপাশের জঙ্গল, ঘাস, লতাপাতা সরিয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন। বেশিক্ষণ অবশ্য খুঁজতেও হলো না। ঘাটের শরীর ঘেঁষেই ঘন ঝোঁপঝাড়ের ভেতর একখানা বড়োসড়ো গর্তের মুখ দেখা গেল। বাঁধানো ঘাটের বেদির পাশ থেকে মাটি খুঁড়ে চলে যাওয়া হয়েছিল একদম বেদির নিচ অবধি। সেখানে গর্তের উপরে ছাদের মতো কাজ করছিল শান বাঁধানো ঘাট। যাতে বৃষ্টি বাদলায়ও কোনো ক্ষতি না হয়। নিচের দিকে বিছিয়ে রাখা হয়েছিল প্লাস্টিকের বস্তা। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর দীর্ঘ সময় সেখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার ধারণা ভুল ছিল না। ফজু ব্যাপারী এখানেই রেখেছিল সেই গয়নাভর্তি কলসি। কিন্তু কয়েক দিন আগেই কোনো কারণে এখান থেকে তা সে সরিয়ে নিয়েছে।

.

রায়গঞ্জ বন্দরের সুকুমার কর্মকারের দোকানের পেছন দিকের অন্ধকার ঘরে বসে রয়েছে সালেহা। তার হাতে দুইখানা সোনার গয়না। একখানা হাসুলি আর একখানা রত্নচূড়। গয়না দুইখানা দেখে সুকুমার কর্মকার তাকে বাইরের ঘর থেকে ভেতরের ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। গয়না বেচতে আসতে ভয়ই করছিল সালেহার। কিন্তু আর তো কোনো উপায় নেই। আব্দুল ফকির বলেছেন, জমির কাগজপত্রের ব্যাপারে জরুরি টাকা-পয়সা দরকার। কিন্তু এই মুহূর্তে এই গয়না বিক্রি ছাড়া নগদ টাকা-পয়সা কই পাবে তারা? ফজু ব্যাপারী অনেক ভেবে চিন্তে সালেহাকে পাঠিয়েছে গয়না বিক্রি করতে। সালেহার সাথে সেও রায়গঞ্জ এসেছে। কিন্তু সে দোকান অবধি আসেনি। বসে আছে নৌকায়। রায়গঞ্জে কেউ কেউ তাকে চিনলেও সালেহাকে কারো চেনার কথা না। তাছাড়া পুরুষ মানুষের তুলনায় মেয়ে মানুষ গয়না বিক্রি করতে আসলে মানুষ সন্দেহ করে কম। পুরুষ মানুষ গয়না বিক্রি করতে আসলেই ভাবে নিশ্চয়ই কিছু গড়বড় আছে। হয় চুরি না হয় অন্যকিছুর মাল। ফজু ব্যাপারী অবশ্য এখুনি গয়না বিক্রি করতে চায়নি। সে চেয়েছিল ধীরে-সুস্থে অনেক দূরে কোনো জায়গায় নিয়ে গিয়ে এই গয়না বিক্রি করতে। কারণ এই জিনিস দেখেই স্বর্ণকারদের ঘটনা বুঝে যাওয়ার কথা! কিন্তু সেই সুযোগ আর হলো না। তার আগেই জরুরি দরকার হয়ে পড়ল।

সুকুমার কর্মকার লোক ভালো। লোকমুখে শোনা যায়, স্বর্ণকাররা নাকি নিজের মায়ের গয়না বানাতেও ঠকায়। এই ক্ষেত্রে সুকুমার কর্মকারের বেশ সুনাম। তিনি আসলেন খানিক বাদে। এসেই সালেহার হাত থেকে গয়না দু’খানা নিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখতে লাগলেন। তারপর চোখ সরু করে বললেন, এমন আর কয়খান আছে মা জননী?

সালেহা বলল, আর নাই। এই দুইখানই আছিল। আমার মার। তারে দিছিল আমার নানী।

সুকুমার কর্মকার সামান্য হাসলেন। তারপর বললেন, হ। পুরোনো জিনিস। এমনে না পাইলে আর কেমনে পাইছেন?

সালেহা কথা বলল না। সুকুমার কর্মকার বললেন, এই জিনিস অন্য কারো কাছে না নিয়া ভালো করছেন। নানান হাঙ্গামা করত। আপনেরে পুলিশে দেওনের ডর ভয় দেহাইয়া কম দামে কিন্যা রাখত।

সালেহার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। সে বলল, পুলিশে দিব কেন? আর জিনিস আমি বেচতে পারব না?

সুকুমার কর্মকার হাসলেন। বললেন, পারবেন না কেন? অবশ্যই পারবেন। তারপরও, থাহে না, কত দুষ্টু মানুষ! শোনেন মা জননী, এই জিনিস সাধারণ সোনার জিনিস না। এই জিনিসের যা দাম, তা আমি আপনেরে দিতে পারব না। আমার দোকান ঘোট। ব্যবসা ছোট। আমিও আপনেরে ঠকাব। কিন্তু একটা জিনিস হইল, আমি তাও আপনেরে কিছু পয়সা-পাতি দিব। কিন্তু অন্য কেউ হইলে নানান ঝামেলা করব। বলব, বাকি জিনিস কই? সেইগুলানও বেচতে হইব, না হইলে পুলিশ টুলিশে জানাই দিব। এইসব ঝামেলা কইরা, ডর-ভয় দেহাইয়া সব হাতানোর চেষ্টা করব। আর পুলিশ জানলেও দেশের কোনো লাভ নাই। দুই-চাইরখান ছাড়া বাদ বাকি সব তারাই ভাগবাটোয়ারা কইরা নিয়া যাইব। আপনেরে দেইখ্যা মনে হইতেছে গরীব মানুষ। যদি এই। জিনিস বেচনের কয়টা টাকায় আপনের উপকার হয়, তাইলে আমার ক্ষতি কি?

সালেহা বলল, এই দুইখানের দাম কত দিবেন?

সুকুমার কর্মকার বললেন, আমি আপনেরে এক লক্ষ টাকা দিব। কিন্তু এই দাম এই জিনিসের আসল দামের এক কণাও না। আসল দাম শুনলে আপনে হার্টফেল করবেন!

সালেহা আসল দাম শুনে হার্টফেল করবে কি! এই দাম শুনেই তার দম বন্ধ হবার উপক্রম। কিন্তু সে তা বাইরে প্রকাশ করল না। গম্ভীর ভাব নিয়ে বসে রইল। তারপর সুকুমার কর্মকারের হাত থেকে গয়না দুইখানা নিয়ে বলল, এত কম দামে এই জিনিস আমি বেচবো না।

সুকুমার কর্মকার মৃদু হেসে বললেন, আপনে না বেচলে আমি জোর করব না মা জননী। আমার সাইধ্য থাকলে আমি আপনেরে ঠকাইতাম না। কিন্তু আমার সাইধ্য নাই। আর এহন গয়নার মার্কেটও ভালো না। এই জিনিস এইরকম বেচতে গেলে আমারও অনেক ঝামেলা পোহান লাগব। নানান ঝামেলা। আর যদি গলাইয়া বেচতে যাই, তাইলে আবার দাম পাব না। এই হইল সমস্যা।

কিন্তু সুকুমার কর্মকারের এত কথায়ও সালেহা আতঙ্ক হলো না। সে গয়না নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। সালেহার ধারণা ছিল সুকুমার কর্মকার তাকে পেছন থেকে ডাকবে। তারপর দাম বাড়ানো নিয়ে কথা বলবে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। সুকুমার কর্মকার তাকে ডাকল না। সালেহা ধীরে সুস্থে হেঁটে গিয়ে নৌকায় উঠল। ঘটনা শুনে ফজু তাকে আবার ফেরত পাঠাল। গয়নার দাম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও ফজু আন্দাজ করতে পারে যে এই ধরনের গয়নার ব্যবহার মূল্যের চেয়ে ঐতিহাসিক মূল্য অনেক বেশি। কিন্তু এই মুহূর্তে তার সামনে আর কোনো উপায় খোলা নেই। সালেহা গয়না বিক্রির নগদ টাকা নিয়ে ফিরল। আর দামাদামি না করলেও সুকুমার কর্মকার এক লক্ষ টাকা বলেও গয়নার দাম দিয়েছে দেড় লক্ষ টাকা। বিষয়টা নিয়ে সালেহা দারুণ খুশি হলেও ফজু ব্যাপারী কেন যেন খুশি হতে পারল না। বরং তার মনের মধ্যে কেমন খচখচ করতে লাগল।

*

নয়নের সাথে হেমার দেখা হলো বেশ কিছুদিন বাদে। হেমার ধারণা ছিল সেদিনের পর থেকে নয়ন আবার স্বাভাবিক আচরণ করবে। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটেনি। বরং নয়নের বাসা থেকে আসার পর থেকেই নয়নের ফোন আবার টানা বন্ধ। তার সাথে কিছুতেই যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। বিষয়টাতে হেমা খুব অবাক হয়েছিল। যেমন অবাক হয়েছিল সেদিন নয়নের অমন অস্বাভাবিক আচরণে। এই দীর্ঘ সম্পর্কে নয়নকে আর কখনোই অমন করতে দেখেনি হেমা। বিষয়টা নিঃসন্দেহে তাকে হতভম্ব করে দিয়েছিল। স্পর্শ করেছিল তুমুলভাবে। একটা অদ্ভুত ভালো লাগায় বেশ কিছুদিন ডুবিয়ে রেখেছিল তাকে। কিন্তু সেটি কেটে যেতেও সময় লাগেনি খুব একটা।

অবশ্য নিজের জীবন নিয়েও নানান অশান্তিতে থাকায় শেষ অবধি আর নয়নকে ঘাটায়ওনি হেমা। বাবা-মায়ের এই ঘটনাটা তার কেন যেন নয়নকে বলতে ইচ্ছে করছিল না। বরং পৃথিবীর আর সকল বিষয়ে নিজের ভেতর ক্রমশই কেমন একটা নির্লিপ্ততা চলে আসছিল। এই সময়টায় গিয়েই তার মনে হলো, নয়নের ভেতরে ভেতরেও নিশ্চয়ই এমন ভয়ানক কোনো অস্থিরতাই চলছে। সে চেষ্টা করেও হয়তো তাই নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছে না।

তারা বসে আছে ক্রিসেন্ট লেকে। এই জায়গাটা হেমার খুব পছন্দ। নয়ন চুপচাপ। হেমাও। একজন চাওয়ালা এলো। এলো একজন সিগারেট ওয়ালা, বাদামওয়ালা। প্রত্যেকেই বারকয়েক ডেকেও গেল। কিন্তু দুজনের কেউ কোনো সাড়া দিলো না। নিজেদের আলাদা ভাবনার জগতে পুরোপুরি নিমগ্ন দুজন মানুষ বসে আছে একদম পাশাপশি। হাত বাড়ানো স্পর্শের দূরত্বে। অথচ কত দূরে!

নীরবতা ভাঙল নয়ন। সে বলল, কোনো কারণে কি তুমি আপসেট?

হেমা প্রথমে শুনতে পেল না। তারপর মাথা তুলে তাকিয়ে মৃদু হাসল। বলল, একটু।

নয়ন বলল, কি নিয়ে?

হেমা বলল, বলতে ইচ্ছে করছে না।

নয়ন বলল, শোধ নিচ্ছ?

হেমা বলল, কিসের?

নয়ন বলল, আমি যে আমার অনেক কথাই তোমাকে বলি না।

হেমা আবারো হাসল। সেই মৃদু হাসি। তারপর বলল, বলো না, নাকি বলতে চেয়েও পারো না?

নয়ন এবার আর কথা বলল না। হেমাই বলল, কিছু কথা থাকে না, বলতে চেয়েও পারা হয়ে ওঠে না। মনে হয়, থাকুক নিজের ভেতর। নিজের বলতে খুব আলাদা তো সবারই কিছু থাকে। সেই নিজেকে কি পুরোপুরি অন্যের কাছে মেলে দেওয়া যায়?

নয়ন বলল, আর ধরো যদি এমন হয় যে নিজেকে লুকিয়ে রাখার কারণ হয় অপরাধবোধ? নিজের ভেতরের কথাগুলো সে এই কারণে লুকিয়ে রাখে যে সে চায় না তার এই কথাগুলো জেনে কেউ দূরে সরে যাক।

নয়নের এই কথাটা শুনে হেমা যেন খুব কৌতূহলী হয়ে উঠল। সে বলল, তুমিও কি তাই করছ? অপরাধ লুকাচ্ছ?

নয়ন কিছু সময় কি ভাবল! তারপর বলল, অপরাধ কিনা জানি না। তবে বলতে যে সাহসটা দরকার, সেটা সঞ্চয় করতে পারছি না। অনেক দ্বিধা, ভয়, জড়তা।

হেমা বলল, অপরাধ হলেও না বলায় ক্ষতি নেই। কিন্তু সেই না বলাটা যেন কারো ঠকার কারণ না হয়। তোমার কিছু না বলা কারো ঠকার কারণ হলে সেটা ক্ষতি।

নয়ন বলল, যদি বুঝতেই না পারি যে এই না বলাটা কাউকে ঠকানোর কারণ কিনা?

হেমা খানিক চুপ করে রইল। তারপর হঠাৎ হেসে ফেলল। বলল, তুমি কিন্তু তোমাকে নিয়ে আমার ভেতর সন্দেহ ঢুকিয়ে দিচ্ছ। কারো প্রেমে পড়েছ। নাকি?

নয়নও হাসল। শুকনো হাসি। সে বলল, নাহ।

হেমা বলল, তাহলে?

নয়ন বলল, মৃত্যুর সময় আসমা প্রেগন্যান্ট ছিল।

সম্ভবত এই মুহূর্তে মাথায় বাজ পড়লেও এতটা অবাক হতো না হেমা, নয়নের কথা শুনে সে যতটা অবাক হয়েছে। হাঁটুর ওপর দুহাতে ভর রেখে বা দিকে ঘাড় কাত করে নয়নের সাথে কথা বলছিল হেমা। সে ঠিক সেভাবেই তাকিয়ে রইল নয়নের দিকে। কিন্তু সে নয়নকে দেখছে না। তার দৃষ্টি নয়নকে ঝাপসা করে দিয়ে চলে গেছে দূরে। বহুদূরে। সেখানে ক্রিসেন্ট লেকের সেতুর ওপরের অর্ধচন্দ্রাকার সিলিংয়ের উপর লাল সূর্য ডুবছে। দুটি কাক উড়ে গেল। দুটি শিশু লাফিয়ে পড়ল লেকের জলে। সেই জল ঢেউ তুলে ছিটকে উঠল পাড়ে। অনেকগুলো বৃত্ত কেঁপে কেঁপে বিস্তৃত হয়ে ক্রমশই মিলিয়ে গেল দূরে। হেমার মনে হলো তার চিন্তা করার শক্তিও অমন অসংখ্য বৃত্ত হয়ে কেঁপে কেঁপে দূরে গিয়ে ক্রমশই মিলিয়ে যাচ্ছে।

নয়ন ডাকল, হেমা।

হেমা জবাব দিলো, হু।

কিন্তু নয়নের মনে হলো হেমা যেন দূর কোনো অচেতন ঘোরের জগৎ থেকে জবাব দিলো। নয়ন আবার ডাকল। তারপর আলতো করে হেমার পিঠে হাত রাখল সে। হেমা যেন মুহূর্তেই সেই দূর অচেতন ঘোরের জগৎ থেকে ফিরে এলো। সে নয়নের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে কি ঘটনাটা খুলে বলবে?

নয়ন বলল, হ্যাঁ বলব।

হেমা বলল, আমার ধারণা ছিল, আমি আর আট-দশজন মানুষের চেয়ে খানিকটা হলেও আলাদা করে ভাবি। অন্তত ভাবতে চেষ্টা করি। সবচেয়ে বেশি যেটি চেষ্টা করি, তাহলো দুম করে কোনো কিছু নিয়ে সিদ্ধান্তে না পৌঁছে যেতে! কিন্তু আসলে কি জানো, আমরা সকলেই কোনো না কোনোভাবে এক। আমি তোমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস না করেই এইটুকু সময়ে কতকিছু যে ভেবে ফেললাম!

নয়ন বলল, কি কি ভাবলে?

হেমা বলল, সেটা আমি তোমাকে বলতে পারব না।

নয়ন বলল, কেন?

হেমা বলল, লজ্জায়।

নয়ন বলল, লজ্জার কিছু নেই। তোমার জায়গায় থাকলে আমিও হয়তো একই কাজ করতাম।

হেমা বলল, আছে। লজ্জার অনেক কিছুই আছে। একটা মানুষকে আমি এতদিন ধরে এতটা কাছ থেকে চিনি, তার সম্পর্কে এইটুকু বিশ্বাস আমার থাকবে না!

নয়ন বলল, মানুষ সারাটা জীবন ধরে নিজেকেই চিনতে পারে না। যে কাজটি সে কখনো করবে বলে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি, কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে হয়তো সেই কাজটিও সে করে ফেলতে পারে। পারে না?

হেমা বলল, তা পারে।

নয়ন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর যতটা সম্ভব আসমার ঘটনা খুলে বলল। ঘটনা শুনে হেমা অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। যেমন ছিল, তেমনই বসে রইল নিশ্ৰুপ। কে জানে, তার বুকে হঠাৎ আটকে যাওয়া ভারি পাথর হাল্কা হতে খানিক সময় নিলো কিনা! তারপর ভীষণ অসহায় ভঙ্গিতে নয়নের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার বাসায় এই ঘটনা আর কেউ জানে না?

নয়ন বলল, হয়তো জানত! আমিই বলতাম। কিন্তু পরিস্থিতিটা তেমন ছিল না। আমার শেষ পরীক্ষাটা সামনে। তার মধ্যে দু’দিন আগে আসমার ওই ঘটনা শুনে ভেতরে ভেতরে পাগলের মতো অবস্থা আমার! আসমা চাইছিল না, মা বা। বাবা কেউ জানুক। ওর হয়তো ভয় ছিল যে তাহলে হয়তো গ্রামেও সবাই জেনে যাবে। আমিও ভাবলাম পরীক্ষাটা শেষ হোক। মাত্র তো দু’ তিনটে দিন। কিন্তু ও সুইসাইড করে ফেলল। কারণটা কেউ জানে না। সবাই নানান কিছু ভাবছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি তখন যেটা মাথায়, সেটা হচ্ছে পুলিশ। সুইসাইডের কথা পুলিশ জানাজনি হলে নানান সমস্যা। একবার ভাবো, তখন যদি এটা রিভিলড হতো যে শী ইজ প্রেগন্যান্ট! আমি তখন কিছু ভাবতে পারছিলাম না। বাবা মাকে বললাম, সুইসাইড যে করেছে, এটাই কাউকে জানানোর দরকার নেই। ভাগ্যও ভালো ছিল, কোনো ঝামেলা হয়নি। লাশ বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হলো।

হেমা বলল, তারপর?

নয়ন বলল, তারপর আর কিছু নেই। আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। এই কথা এখন বললে কেউ বিশ্বাসই করবে না। বরং সন্দেহটা হবে উল্টো। ইউ নো, হোয়াট আই মিন।

হেমা বোঝে। কিন্তু নিজের ভেতরটা কেমন খচখচ করছে। সে বলল, তোমার উচিত বিষয়টি নিয়ে তোমার মায়ের সাথে কথা বলা। দ্যাট কালপ্রিট শুড বি পানিশড!

নয়ন কথা বলল না। চুপ করে রইল। হেমা হঠাৎ বলল, তুমি কি ভাবছ, সব শুনে আন্টি যদি তোমাকেই জিজ্ঞেস করে বসেন যে, তুমি আগে কেন তাকে জানাওনি? বা ধরো, উল্টো তোমাকেই যদি সন্দেহ করে বসেন, এই ভয় পাচ্ছ?

নয়ন আচমকা চিৎকার করে উঠল। সে দু’হাতে তার মাথার দু’পাশের চুল মুঠি করে ধরে চিৎকার করে বলল, আমি জানি না। আই রিয়েলি ডোন্ট নো।

হেমা নয়নের আচরণে অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করল না। সে নয়নের পিঠে আলতো হাত রেখে বলল, শান্ত হও নয়ন। তিনি তোমার মা। তিনি তার ছেলেকে চেনেন। আর সবার চেয়ে ভালো করেই চেনেন। আ আমি শিওর, উনি এমন কখনোই ভাববেন না। তুমি আমাকে বিশ্বাস করে বলতে পেরেছ। আমার প্রতি তোমার এই বিশ্বাসটুকু আছে যে আমি তোমাকে সন্দেহ করব না। আর তার উপর নেই? শী ইজ ইওর মাদার! তার চেয়ে ভালো আর তোমাকে কে চেনে?

নয়ন চাপা রাগে ফুঁসতে থাকা কণ্ঠে বলল, আমি সেটা ভাবছি না হেমা। আমি সেটা ভাবছি না। আমি তার চেয়েও বেশি কিছু ভাবছি। সামথিং হরিবল হেমা!

নয়নের সারা শরীর কাঁপছে। তাকে দেখতে লাগছে হিস্টিরিয়ার রোগীদের মতো। হেমা উঠে তার মুখোমুখি দাঁড়াল। তারপর দু’হাতে নয়নের মাথা চেপে ধরে বলল, কি হয়েছে নয়ন? আমাকে বলো। এমন করছ কেন? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?

নয়ন দু’হাতে হেমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে হেমা। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি এই যন্ত্রণা আর নিতে পারছি না।

হেমার ধারণা ছিল নয়ন কাঁদবে। কিন্তু নয়ন কাঁদল না। সে স্থির মূর্তির মতো বসে রইল। সন্ধ্যা নামার পরও দীর্ঘ সময় তারা বসে রইল সেই একই জায়গায়। কিন্তু বাকিটা সময় জুড়ে আর একটা কথাও বলল না নয়ন।

হেমা বিভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল নয়নের দিকে। নয়ন বসে আছে শান্ত, স্থির। তার নিষ্পলক চোখের দৃষ্টি সামনে। কিন্তু সেই নিস্পলক চোখে সে কিছু দেখছে বলে মনে হলো না হেমার। তার কেবল মনে হলো, আপাতদৃষ্টিতে শান্ত স্থির এই মানুষটা তার বুকের ভেতর বয়ে বেড়াচ্ছে আস্ত একখানা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি।

*

দিনের প্রথম ক্লাসটা নিয়ে নিজের রুমে কেবল বসেছেন রেণু। আর তখনই বুকের ভেতর কেমন অস্থির লাগতে শুরু করল। দোতলায় তার রুমের বা দিকটায় বড় একটা জানালা। জানালার বাইরে অন্ধকার করে দিয়ে ঝাকড়া এক আমগাছ। সেখানে একটা চড়ই। চড়ইটা লাফিয়ে এসে জানালার গ্রীলে বসল। তারপর আরেকটা চড়ই। তাদের একজনের ঠোঁটে ছোট্ট এক পোকা। সে পোকাটা খাচ্ছে না। সাথের চড়ইটার ঠোঁটের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে খেতে চাইতেই টুক করে ঠোঁট সরিয়ে নিচ্ছে। বার তিন চারেক এমন করার পর সাথের চড়ইটা আর ঠোঁট বাড়াল না। যেন সঙ্গী চড়ুইর এমন খুনসুঁটিতে বড্ড অভিমান হয়েছে তার। সে লাফিয়ে পাশের গ্রীলে সরে গেল। আগের চড়ইটাও তার পিছু নিলো। কিন্তু সঙ্গীর অভিমান তাতে কিছু কমল না। বরং সে আবার সরে গেল। আগের চড়ইটাও পিছু ছাড়ল না একদম। তাদের এই মান-অভিমান খুনসুটি চলতেই লাগল। রেণু দীর্ঘ সময় সেই চড়ই জুটির খুনসুটি, মান অভিমান দেখলেন। তারপর উঠে গেলেন দ্বিতীয় ক্লাসটা নিতে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ক্লাসের পুরোটা সময় জুড়েই তার মাথায় ঘুরতে লাগল সেই জানালার গ্রীল আর চড়ই জুটি। তিনি ক্লাসের ফাঁকেই বারকয়েক ক্লাসরুমের জানালায় তাকালেনও, যেন সেই চড়ই জুটিকে এখানেও দেখা যাবে!

ক্লাস শেষ করে রেণু তড়িঘড়ি করে তার রুমে ফিরলেন। তারপর চুপচাপ বসে রইলেন অনেকটা সময়। এই চড়ইজুটির বিষয়টা নিয়ে তিনি কিছুটা বিরক্ত। এরকম দৃশ্য নিশ্চয়ই রোজই প্রচুর দেখা যায়। কিন্তু কখনোই হয়তো খেয়াল করা হয়ে ওঠে না। অথচ আজ বিষয়টা তার মাথায় ঢুকে গেছে। তিনি বহু চেষ্টা করেও বিষয়টা মাথা থেকে তাড়াতে পারছেন না। শরীরটা হঠাৎ ভালো লাগছে না। আজ আরো একটা ক্লাস তার নেয়ার কথা। কিন্তু ইচ্ছে করছে না। রেণু উঠে ব্যাগ গোছাতে শুরু করলেন। কিছু পরীক্ষার খাতা দেখতে হবে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আজ ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে দেখবেন বলেনিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু কিছুই হলো না। তিনি ব্যাগ গুছিয়ে রুম থেকে বের হতে যাবেন। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে তিনি দরজার দিকে না গিয়ে গেলেন জানালাটার কাছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। নাহু, পাখি দুটি কোথাও নেই। তিনি একই সাথে বুকের ভেতরে খুব সূক্ষ্ম ধরতে না পারা মন খারাপ আর ধরতে পারা রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে রুম থেকে বের হলেন। সামান্য চড়ই পাখির জন্য এমন করার কোনো মানে হয়!

বাসায় ফিরে খাতা দেখতে বসেছিলেন রেণু। কিন্তু অনেকক্ষণ বসে থেকেও মনোযোগ বসাতে পারলেন না। মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে। এক ধরনের অবসাদ শরীর জুড়ে। খানিক ঘুমও পাচ্ছে। টেবিল থেকে খাতাগুলো নিয়ে তিনি চলে এলেন বিছানায়। বুকের নিচে একটা বালিশ দিয়ে আবার খাতা দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। ঘুম ঘুম ভাবটা প্রবল হচ্ছে। তারপর কখন যে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়লেন, টেরই পেলেন না। লম্বা ঘুম। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার পর। বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। বাথরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠল। প্রেসারটা সমস্যা করছে বোধ হয়! তিনি ঘরে ঢুকে প্রেসার মাপার যন্ত্রটা খুঁজলেন। পেলেন না। ওষুধের বাক্সটা খুঁজলেন। পেলেন না। মাথা ব্যথাটা ক্রমশই অসহ্য হয়ে উঠছে। তিনি দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বসে রইলেন। কিন্তু মনে হচ্ছে চারপাশের পৃথিবীটা ভনভন করে ঘুরছে।

প্রয়োজন না হলে হেমা সাধারণত খুব একটা মায়ের ঘরে আসে না। ক্লাস শেষে সন্ধ্যার আগে আগে সে বাসায় এসেছে। তারপর গোসল করে এক মগ কফি নিয়ে বারান্দায় বসেছে। রাহাত তাকে নতুন একটা গান পাঠিয়েছে। সে গান টান করে। নিজে নিজে লেখে, নিজে নিজেই সুর দেয়। তারপর গিটার বাজিয়ে গেয়ে ফেলে। একবার কি একটা অ্যালবামও বেরিয়েছিল তার। কিন্তু তারপর আর আগ্রহ দেখায়নি সে। তবে মাঝে-মধ্যেই সে গান গেয়ে মোবাইল ফোনে রেকর্ড করে হেমাকে পাঠায়। সেসব গান বেশিরভাগ সময়ই খুলেও দেখা হয় না হেমার। কিন্তু আজ কি মনে করে সে গানটা ছাড়ল। তরল প্রেমের গান।

তোর জন্য কান্না পাচ্ছে খুব, তোর জন্যই কান্না চেপে রাখা,
আমার অশ্রু ভাসায় যদি তোকে, তাই তো এমন অশ্রু চেপে থাকা।
তোর জন্য ঘুমের ঘরে খিল, তোর জন্যই ভীষণ রাত্রি জাগা,
তবুও চোখ সানগ্লাসটায় ঢেকে, তোর জন্যই আমার ভালো থাকা।
তোর জন্য কষ্ট হচ্ছে খুব, তোর জন্যই কষ্ট চেপে রাখা,
আমার কষ্ট কাঁদায় যদি তোকে, তাই তো এমন কষ্ট চেপে থাকা।

কী সব অসহ্য কথাবার্তা! রাহাত কবে থেকে এমন হয়ে গেল। হেমা গানটা বন্ধ করে দিলো। সে তাকিয়ে রইল বাইরে। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে সে মাথা থেকে গানটা বের করতে পারছে না। আরো অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তারও কিছুক্ষণ বাদে সে আবিষ্কার করল, গুনগুন করে সে গানটা গাইছে, তোর জন্য কান্না পাচ্ছে খুব, তোর জন্যই কান্না চেপে রাখা, আমার অশ্রু ভাসায় যদি তোকে, তাই তো এমন অশ্রু চেপে থাকা।

সে নিজের উপর ভারি বিরক্ত হলো। এই ধরনের অতি প্রেম প্রেমভাব গান, সিনেমা, বই তার ভালো লাগে না। হেমা বারান্দা থেকে ঘরে চলে গেল। তারপর বাতি বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে রইল। শুয়ে থাকতে থাকতেই সে গানটা আবার চালু করল। গানের কথা যা-ই হোক, সুরটা অদ্ভুত মন কেমন করা!

তোকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব, তোর জন্য ইচ্ছে চেপে রাখা,
আমার ইচ্ছে পোড়ায় যদি তোকে, তাই তো এমন ইচ্ছে চেপে থাকা।
তোর জন্য আকাশ ছেড়ে দিয়ে, আমিই না হয় বেছে নিলাম খাঁচা,
তোর জন্য কান্না বুকে রেখে, আমার এমন হাসি মুখে বাঁচা।

হেমা গানটা শুনল। একবার, দুইবার, তিনবার। সে তার পরের কয়েক ঘণ্টা একটানা বারবার গানটা শুনল। তার হঠাৎ মনে হতে লাগল, এই কথাগুলো রাহাতের এবং রাহাত তাকে ভেবেই কথাগুলো লিখেছে! কী তীব্র অনুভূতি নিয়েই না কথাগুলো রাহাত লিখেছে! কিন্তু রাহাতের এই অনুভূতিগুলো সে কখনোই স্পর্শ করতে পারেনি। কোনোদিন হয়তো পারবেও না। গানটা হেমা যতবার শুনেছে, তার কেবল নয়নের কথা মনে হয়েছে। ঠিক এই অনুভূতিগুলোই সে তার বুকের ভেতর সযতনে নয়নের জন্য পুষে রাখে। কিংবা তার আরো কারো কারো কথা মনে পড়েছে। বাবা? মা? হেমা চুপচাপ অন্ধকারে বসে রইল। রাহাতের জন্য তার খুব মায়া হচ্ছে। এই মায়াটা অদ্ভুত। তার জন্য রাহাতের যে কষ্টটা, সেই কষ্টের কথা ভেবে তার মায়া হচ্ছে। কিন্তু সেই মায়াও রাহাতের জন্য তার ভেতরে বিশেষ কোনো ভালোবাসা তৈরি করতে পারছে না। রাহাতের প্রতি তার তীব্র এক ধরনের সহানুভূতি তৈরি হচ্ছে। সেই সহানুভূতি জুড়ে হয়তো ভালোবাসাও রয়েছে। তবে সেই ভালোবাসা আর নয়নের জন্য তার ভালোবাসা এক নয়। হেমা জানে, এই জগৎ যেমন ঘৃণার জগৎ। তেমনি ভালোবাসারও জগৎ। কিন্তু এখানে সকল ঘৃণা এক হলেও, সকল ভালোবাসা এক নয়। এখানে সম্পর্ক ও মানুষভেদে ভালোবাসা আলাদা।

হেমা রাতে খেতে গিয়ে দেখে খাবার টেবিলে কোনো খাবার নেই। মায়ের ঘরের বাতি জ্বলছে। সে দরজার পর্দা ফাঁক করে দেখল, রেণু কেমন অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। তার চোখ বোজা, কিন্তু পা দু’খানা বিছানার বাইরে বিকটভাবে ভাঁজ হয়ে মেঝে ছুঁয়ে আছে। সে ছুটে এসে মায়ের পাশে বসল। রেণুর সারা শরীর ঘামে ভিজে জবজব করছে। হেমা হাত বাড়িয়ে ফ্যানটা ছাড়ল। তারপর ডাকল, মা।

বার দুই ডাকের পর চোখ মেলে তাকালেন রেণু। তারপর বুঝে উঠতে যেন খানিক সময় নিলেন যে তিনি কোথায় আছেন! হেমা বলল, তোমার শরীর খারাপ লাগছে?

রেণু ডানে-বায়ে মাথা নেড়ে মৃদু হাসার চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, না। ঠিক আছি।

হেমা বলল, মিথ্যে কেন বলছ মা? কি হয়েছে?

রেণু বললেন, এই মাথা ব্যথা হচ্ছিল। সম্ভবত প্রেসারটা একটু বেড়েছে।

হেমা বলল, মেপেছ?

রেণু বললেন, মেশিনটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

হেমা বলল, ওষুধের বাক্সের সাথে থাকে না?

রেণু বলল, থাকে তো। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না।

হেমা উঠে বাক্সটা খুঁজল। আলমারিতে, টেবিলের ড্রয়ারে, তাকে। নেই। কোথাও নেই ওষুধের বাক্সটা।

হেমা মার পাশে এসে বসে বলল, কোথায় থাকে ওটা? রাখো কোথায় মনে করতে পারো না?

রেণু কি বলতে গিয়েও আচমকা চুপ করে গেলেন। হেমা বলল, কোথায় রাখো সব সময়?

রেণু মৃদু গলায় বলল, আমি তো রাখি না।

হেমা বলল, তাহলে কে? বুয়া? তোমার এত প্রেসারের সমস্যা, প্রয়োজনীয় জিনিসগুলা কই থাকবে, তুমি জানবে না? বুয়াকে ফোন দিব?

রেণু বলল, না। বুয়াও জানে না।

হেমা বলল, তাহলে? কে জানে? তুমিও না। বুয়াও না।

রেণু খানিক চুপ করে থেকে অস্ফুট স্বরে বললেন, তোর বাবা।

হেমা আচমকা যেন বুঝতে পারেনি। সে বলল, কে? বাবা!

রেণু বললেন, হু। এসবের খবর সব তার কাছেই থাকত।

হেমা বলল, তাহলে? তোমার এমন হুটহাট প্রেসার হলে, মাথা ব্যথা হলে তখন পেতে কি করে? বাবার কাছে চাইতে?

রেণু বলল, না। ও নিজ থেকেই দিত।

হেমা বলল, বুঝত কি করে যে তোমার কখন কি দরকার?

রেণু বলল, কী জানি কীভাবে বুঝত! কিন্তু দিত তো!

খুব ছোট্ট ঘটনা। কিন্তু হেমা কেমন চমকে গেছে। সে বলল, বাবা না থাকলে?

রেণু বলল, দরকারি জিনিসগুলো কোথায় কি আছে, কাগজে লিখে বালিশের তলায় বা টেবিলে রেখে যেত। মোবাইল ফোনে মেসেজও দিয়ে যেত কখনো কখনো।

হেমা বলল, কই? দেখি তোমার মোবাইল ফোনটা?

রেণু বালিশের তলা থেকে তার মোবাইল ফোনটা বের করে দিলেন। কিন্তু ফোনে বাবার নাম কোথাও খুঁজে পেল না হেমা। সে বলল, বাবার নাম কি নামে সেভ করা মা?

রেণু বললেন, সেভ করা নেই।

হেমা কিছু বলল না। সে বাবার মুখস্ত নম্বরে ডায়াল করে মেসেজ খুঁজে বের করল। কোনো মেসেজই খুলে দেখা হয়নি। সব আনরিড হয়ে আছে। তবে মেসেজ না খুললেও নম্বরের নিচে প্রতিটি মেসেজের প্রথম লাইনটা দেখা যায়। সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেসেজের ভেতরে আর কি কি আছে! হেমা দীর্ঘ। সময় মার পাশে বসে বাবার পাঠানো মেসেজগুলো পড়ল। একটার পর একটা মেসেজ খুলছে সে, আর কী যে অবাক হচ্ছে! একের পর এক মেসেজ পাঠিয়ে। গেছেন বাবা। কিন্তু কোনো একটি মেসেজও মা খুলে দেখেননি। রিপ্লাইও। করেননি।

বাবার পাঠানো মেসেজগুলোতে অবশ্য তেমন কিছু নেইও। সেই মেসেজগুলো ভর্তি কেবল রেণুর ওষুধের বাক্স কোথায় রাখা আছে তার খোঁজ, জরুরি মোবাইল ফোনের কার্ড, পুরনো মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট, প্রেসক্রিপশন, প্রেসার মেশিন, জরুরি ডাক্তারদের ফোন নম্বর, পাসওয়ার্ডসহ ডেবিট কার্ডের খোঁজ, শুকনো খাবার, অতিরিক্ত কলম-কাগজের পাকেটসহ কত কত জিনিসের যে খোঁজ! এইসবগুলো জিনিসই রেণুর জরুরি প্রয়োজনের। বাবা যে এই সকল কিছুর খোঁজ একবারে একটি মেসেজেই দিয়েছেন, তা না। মেসেজগুলো তিনি দীর্ঘদিন পরপর পাঠিয়েছেন। মেসেজ পাঠানোর তারিখগুলো দেখেই হেমা বুঝল, বাবা যখন অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যেতেন এই মেসেজগুলো তখনকার।

মা সব সময়ই খানিকটা অগোছালো, সারাক্ষণ নিজের ভেতর ডুবে থাকা মানুষ। কিন্তু সেই মানুষটাকে এত যত্ন করে খেয়াল করতেন বাবা! হেমা বাবার মেসেজ থেকেই ওষুধের বাক্স খুঁজে বের করল। তারপর মাকে বলল, বাবার মেসেজ দেখলেই তো ওষুধের বাক্সটা খুঁজে পেতে!

রেণু বলল, ওগুলো কখনো খুলে পড়া হয়নি আমার।

হেমা বলল, কেন পড়া হয়নি মা?

রেণু এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। হেমাও আর কথা বলল না। সেই রাতটা আবার প্রবল অস্থিরতায় কাটল হেমার। সারারাত সে ঘুমাতে পারল না। বাবার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল হেমার। কষ্ট হচ্ছিল মার জন্যও। তবে মার জন্য হওয়া এই কষ্টটা আগের কষ্টের মতো না। এই কষ্টটা বাবার এমন প্রবল ভালোবাসা, এমন গভীর যত্ন পেয়েও তা গ্রহণ না করার কষ্ট। প্রবল নির্লিপ্ততায় এমন গভীরতম অনুভূতিকে উপেক্ষা করে নিজেকে বঞ্চিত করার কষ্ট।

*

রাহাতের আজকাল ঘুমে খুব সমস্যা হচ্ছে। রাত জেগে হলের ছাদে বসে একা একা গিটারে টুংটাং করে সে। সিগারেটের পর সিগারেট খায়। সারাক্ষণ বুকের ভেতর কী জানি কী এক অস্থিরতা। বিষয়গুলোকে প্রথম কয়েকদিন সে পাত্তা দিতে চায়নি। এসব কেন হচ্ছে তা সে জানে। এই ভয়টা ভেতরে ভেতরে তার ছিল। কিন্তু কখনোই গ্রাহ্য করতে চায়নি সে। হেমাকে রাহাত ভালোবাসে। সব জেনেশুনেই ভালোবাসে। হেমার সাথে থাকা প্রতিটি মুহূর্ত তার কাছে অপার্থিব অনুভূতির মনে হয়। যতক্ষণ হেমার সাথে সে থাকে না, ততক্ষণ হেমাকে নিয়ে ভাবতে তার ভালো লাগে। শাহবাগ মোড়ে ফুলের দোকান দেখলে তার হেমার কথা মনে পড়ে। রিকশায় কোনো মেয়েকে হুড তুলে এলো চুল উড়িয়ে যেতে দেখলে তার হেমার কথা মনে পড়ে। লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুরের বাস দেখলে, বিলবোর্ডে মন ভালো করে দেয়া হাসিমুখের কোনো মেয়ের ছবি দেখলে, আকাশে মেঘ দেখলে তার হেমার কথা মনে পড়ে। আকাশে মেঘ না দেখলেও তার হেমার কথা মনে পড়ে। তখন তার মনে হয়, আকাশে মেঘ নেই কেন? বৃষ্টি নেই কেন?

হেমার প্রতি তার এই ভালোবাসাটা একপাক্ষিক সে জানে। কিন্তু সে সব সময়ই বিশ্বাস করত, এতে তার কিছু যায় আসে না। তার কেবল এই ভালোবাসাতেই আনন্দ। এই অদ্ভুত সম্পর্কটার নামও সে জানে না। হেমা তার

প্রেমিকা, না বন্ধু। তবুও এই অসংজ্ঞায়িত, স্বার্থহীন, প্রাপ্তির প্রত্যাশাবিহীন সম্পর্ক নিয়েও সে কখখানেই বিব্রত বোধ করেনি। লুকায়ওনি কখনোই। না হেমার কাছে, না অন্যদের কাছে। কিন্তু আজকাল সেই প্রত্যাশাবিহীন সম্পর্কের ভাবনারা তাকে আর স্থির থাকতে দিচ্ছে না। কোথায় যেন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রাপ্তির বাসনারা তাকে ক্রমশই অস্থির করে তুলছে। হেমার জন্য আজকাল সারাটা ক্ষণ তার মন কেমন করে!

সেদিন প্রথম সে হেমার জন্য কাঁদল। কী যে দেখতে ইচ্ছে করছিল। হেমাকে। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার যেটা, হেমাকে তার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে

করছিল। বুকের ভেতর হেমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল তার। মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতর একটা হু হু করা শূন্যতা, কেবল হেমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারলেই বুঝি সেই শূন্যতারা মুহূর্তেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠবে। কিন্তু এই অনুভূতির কথাগুলো সে কোনোভাবেই হেমাকে জানতে দিতে চায় না। কোনোভাবেই না। সে জানে, কতটা গভীরভাবে নয়নকে ভালোবাসে হেমা!

কিন্তু সেই রাতে হেমার জন্য তার এই তেষ্টা, এই ব্যাকুলতাই যেন গান হয়ে এলো। সে লিখে ফেলল, তোর জন্য কান্না পাচ্ছে খুব, তোর জন্যই কান্না চেপে রাখা, আমার অশ্রু ভাসায় যদি তোকে, তাই তো এমন অশ্রু চেপে থাকা। গুনগুন করে সুর দিয়ে গেয়েও ফেলল। তারপর হেমাকে গানটা পাঠিয়েও দিলো সে। রাহাত জানত না, হেমা গানটা আদৌ শুনবে কিনা! এর আগেও এমন কতকিছু সে হাসির ছলে হেমাকে পাঠিয়েছে। কিন্তু হেমা তার কিছু নিয়েই আর কখনো কথা বলেনি। তার মানে সেসব হেমা কখনো শোনেইনি।

গানটা পাঠানোর পর থেকেই কেমন অস্থির হয়ে ছিল রাহাত। সেই সন্ধ্যা থেকে সারারাত সে বসে রইল ছাদে। ঢাকা শহরের কেবল এই ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসটাতেই এ সময় শীত টের পাওয়া যায়। আর কোথাও না। খোলা ছাদে গভীর রাতে সেই শীতটা যেন কাঁপুনি হয়ে আসে। সে শীতে কাঁপছিল। তার কেন যেন বারবার মনে হচ্ছিল, হেমা হয়তো তাকে একটা ফোন দিবে। হেমা ফোন না দিলে সে আর হেমাকে ফোন দিবে না। এই অভিমানটুকুও নতুন। এমন আর কখনোই হয়নি রাহাতের। দিনের পর দিন সে হেমাকে ফোন করে যায়, মেসেজ পাঠিয়ে যায়, হেমা সেইসব ফোন না ধরলেও, না রিপ্লাই করলেও রাহাত তাতে কখনোই কিছু মনে করে না। সে পরদিন আবার ফোন দেয়। হেমা ধরলে ভালো, সে খুশি হয়, কথা হয় খানিক, না ধরলেও সমস্যা নেই। সে পরদিন তো আবার ফোন দিবেই! কিন্তু আজকের এই যে অভিমান, এই অভিমানটুকুকেও ভয় পায় রাহাত। কিন্তু সে এই অভিমানটা কাটাতে পারে না। তার বুকের ভেতরটা কেমন ভারি হয়ে যেতে থাকে। রাত যত ফুরাতে থাকে, তার তত কান্না কান্না লাগে। সে কাঁদেও। সেই সদা হাস্যোজ্জ্বল রাহাত, রাতের এই গভীর অন্ধকারে নিঃসীম আকাশের নিচে বসে একা একা কাঁদে। তার এই কান্না দেখার কেউ নেই। নেই বলেই হয়তো সে কাঁদে। জগতে কিছু কিছু মানুষ থাকে, যাদের জন্ম একা একা কাঁদার জন্য। যারা হাসলে জগতের সবাই দেখে, কিন্তু কাঁদলে কেউ দেখে না। এই জগতে তাদের কান্না দেখার কেউ থাকে না। রাহাত হয়তো তাদের একজন।

হেমার ফোনটা এলো শেষ রাতের দিকে। ফোন দেখে রাহাতের প্রথম বিশ্বাস হয়নি যে এটা হেমার ফোন। এতরাতে হেমার ফোন দেয়ার কথা নয়। তার ঘুমিয়ে থাকার কথা। রাহাত ফোনটা ধরল। কিন্তু কোনো কথা বলল না। কী বলবে হেমা?

হেমা চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুই এখনো ঘুমাসনি?

রাহাত স্বাভাবিক গলায় বলল, বাই এনি চান্স, তুই কি আমাকে স্বপ্নের ভেতর ফোন করেছিস?

হেমা বলল, ফাজলামো করিস না রাহাত। আমার মন খারাপ।

রাহাত বলল, কেন? মন খারাপ কেন?

হেমা আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, আচ্ছা ধর, কেউ কাউকে অসম্ভব ভালোবাসে। সেই মানুষটার একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সে করেনি এমন কোনো কাজ নেই। কিন্তু তারপরও কোনোদিন একমুহূর্তের জন্যও সে সেই মানুষটার এতটুকু ভালোবাসাও সে পায়নি। তখন কি করা উচিত তার?

হেমার কথা শুনে রাহাতের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। হেমা কি তার কথা বলছে? রাহাত সামান্য চুপ করে থেকে বলল, ভালোবাসা কি কিছু করে হয় হেমা? আমার তো মনে হয় ও আপনাআপনি হয়ে যায়। যার হয়, তার কিছু না করেই হয়। আর যার হয় না, তার বহু কিছু করেও হয় না।

হেমা বলল, মানুষ তাহলে মানুষকে ভালোবাসে কেন?

রাহাত বলল, ওই যে ভালোবাসতে ভালো লাগে বলে।

হেমা বলল, তাহলে কি মানুষ কেবল নিজের অনুভূতিটাকেই মূল্য দিচ্ছে? সে কি খুব স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে না? একটা মানুষ তাকে ভালোবেসে দিনের পর দিন কতকিছু করে যাচ্ছে। তার কিছুই তাকে স্পর্শ করবে না?

রাহাত হেমার কথায় খুব অবাক হচ্ছে। আজ এসব কেন বলছে হেমা! সে বলল, এই স্পর্শ জিনিসটা বড় রহস্যময়। কেউ কাউকে সারা জনম চেষ্টা করেও স্পর্শ করতে পারে না। আবার কেউ কাউকে কিছু না করেও একমুহূর্তেই স্পর্শ করে ফেলতে পারে।

হেমা কথা বলল না। চুপ করে রইল। রাহাতও। তারপর হেমা আচমকা বলল, তোর গানটা আজ শুনলাম। কী যে ভালো লিখেছিস! একদম বুকের ভেতরটা খামচে ধরে যেন!

রাহাত হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলল, কার জন্য খামচে ধরে?

হেমা বলল, ভালোবাসার জন্য।

রাহাত বেপরোয়া গলায় বলল, এই ভালোবাসাটা কে?

হেমা কিছুক্ষণ কি ভাবল। তারপর বলল, আমরা বেশিরভাগ সময়ই ভালোবাসা বলতে দেখি মানুষ। কিন্তু ভালোবাসা হচ্ছে একটা পূর্ণতার অনুভূতি। ফিলিং অফ ফুলফিলনেস। ধর, কোনো একটা ফুল, একটা পাখি, একটা প্রজাপতি দেখে হঠাৎ মন ভালো হয়ে গেল। একটা পূর্ণতার অনুভূতি হলো, ওটাও ভালোবাসা। আবার কোনো মানুষকে দেখে যখন অমন ফুলফিলনেসের অনুভূতি হয়, ওটাও ভালোবাসা। আসলে ভালোবাসার রকম এত ভিন্ন, এত বেশি যে ভালোবাসাকে এক কথায় ডিফাইন করা সম্ভব না। তবে এই প্রত্যেকটা ভালোবাসার জন্যই আমাদের একটা কমন ফিলিং হয়। সেটা হলো, পেলে পূর্ণ মনে হয়, না পেলে শূন্য। তোর গানটা শুনে আমার সত্যি সত্যি কান্না পাচ্ছিল। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম আমার বোধহয় নয়নের জন্য কান্না পাচ্ছে। তার কিছুক্ষণ পর মনে হলো, হ্যাঁ নয়নের কথা আমার মনে পড়ছে ঠিক, কিন্তু আমার বাবার কথাও মনে পড়ছে। বাবার জন্যও কান্না পাচ্ছে আমার। তার কিছুক্ষণ পর মনে হলো আমার মার কথাও মনে পড়ছে। শেষ অবধি মনে হলো আমার আসলে বাবা-মা, নয়ন এদের তিনজনের কথাই মনে পড়ছে। তুই জানিস না বোধহয়, বাবা আর মার ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। এই বিষয়টা আমার ভেতর একটা শূন্যতা তৈরি করছে। এটা কিন্তু ভালোবাসা। তারা একসাথে থাকলে কিন্তু আমার একটা ফুলফিলনেসের ফিলিং হবে। দ্যাট ইজ লাভ। আমার বাবা-মাকে একসাথে দেখতে ইচ্ছে করছিল। এই জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল, কান্না পাচ্ছিল। তুই জানিস না তুই কি অদ্ভুত সুন্দর একটা গান লিখে ফেলেছিস।

রাহাত কথা বলল না। হেমার বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে শুনে সে ভারি অবাক হয়েছে। কিন্তু এই বিষয় নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে তার ইচ্ছে করছে না। হেমাই বলল, চুপ করে আছিস কেন?

রাহাত মৃদু গলায় বলল, এমনি।

হেমা হঠাৎ গাঢ় গলায় বলল, এমনি না। রাহাত একটু অবাক হলো। তারপর বলল, তাহলে?

হেমা বলল, আমি অনেক কিছু টের পাই রাহাত। কিন্তু সব সময় সবকিছু ধরা দিতে ইচ্ছে হয় না। ভালো লাগে না। ক্লান্ত লাগে। বেশ কিছুদিন ধরে আমাকে নিয়ে তোর খুব সমস্যা হচ্ছে এটা আমি খুব বুঝতে পারি। তোর জন্য আমার মায়া হয়। কিন্তু সেটা ভালোবাসা না।

রাহাত বলল, জগতের সকল মায়ার মধ্যেই ভালোবাসা থাকে। ভালোবাসা ছাড়া মায়া হয় না।

হেমা বলল, একদম ঠিক। কিন্তু ওই যে বললাম, সেই ভালোবাসার ধরন থাকে। তুই যেই ভালোবাসাটা চাইছিস, এই মায়ায় সেই ভালোবাসাটা নেই রাহাত। তোর জন্য আমার কষ্টও হয়। জগতের সকল কষ্টেও ভালোবাসা থাকে। কিন্তু তোর জন্য আমার কষ্টে যে ভালোবাসাটা আছে, সেটা সেই ভালোবাসাটা না রাহাত।

রাহাত চুপ করে আছে। হেমা বলল, খুব কষ্ট হচ্ছে?

রাহাত হাসল। সেই হাসি কান্নার চেয়ে কম কিছু নয়। সে বলল, নাহ্। কষ্ট হবে কেন?

হেমা বলল, আমি জানি হচ্ছে। তুই আমায় বল তো, আমি কি করব? আমার একটা সময় অবধি মনে হতো, তোর সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। কিন্তু তুই-ই বললি সেটা আরো বেশি কষ্টের। সেটা আরো বেশি খারাপ হবে। তাছাড়া উই আর সেম ব্যাচ, সেম ডিপার্টমেন্ট। চাইলেই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া যায় না। আমাদের রোজ ক্লাসে দেখা হবে। তাহলে? তোর কষ্টটা আমি নিতে পারছি না। এখন তোর যেটা হচ্ছে, এই আশঙ্কাটা আমি আগেই করছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, তুই যতই হালকাভাবে নিস না কেন, কোনো এক্সপেক্টেশনই না রাখিস। কিন্তু এই নিয়মিত যোগাযোগ, কথা বলা, এগুলো ধীরে ধীরে তোকে ডুবিয়ে দেবে। একটা প্রত্যাশা তৈরি করবে। এটা হুট করে ধরা যায় না রাহাত।

রাহাত বলল, আচ্ছা, আমি অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারি না কেন, বল তো? চেষ্টা যে করিনি তা কিন্তু না, চেষ্টা করেছি। কিন্তু আই কান্ট। কী যে অসহ্য লাগে। আমি সাবকনসাসলি তোর সাথে কম্পেয়ার করি।

হেমা বলল, তুই অন্যদের মাঝে আমাকে খুঁজলে তো হবে না। তোকে যে যেমন, তাকে তেমন করেই ভালোবাসতে হবে।

রাহাত বলল, তুই তো কন্ডিশন দিয়ে দিচ্ছিস। এভাবে কন্ডিশন দিয়ে কি হয়?

হেমা বলল, তুইও কিন্তু একটা কন্ডিশনই দিয়ে দিচ্ছিস। যে মেয়েটাকে তুই ভালোবাসবি, তাকে আমার মতো হতে হবে।

রাহাত বলল, আমি পারি না তো। আমি কি করব!

এই প্রশ্নে হেমার খুব অসহায় লাগতে লাগল। কি বলবে সে রাহাতকে! সে কিছুই বলতে পারল না। সবচেয়ে ভালো হয় রাহাতের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখতে পারলে। কিন্তু সেটি এখনই সম্ভব নয়। আচ্ছা, সে কি কখনো মুহূর্তের জন্য হলেও রাহাতকে অন্য কোনোভাবে প্রশ্রয় দিয়েছে? এমনটা হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না হেমা। কিন্তু সে অনেক ভেবেও তেমন কোনো ঘটনার কথা মনে করতে পারল না। কখনোই বিন্দুমাত্র প্রশ্রয়ও সে রাহাতকে দেয়নি। তাছাড়া রাহাত তার আর নয়নের সম্পর্কের আদ্যোপান্ত জানে।

ভোর হয়ে এসেছে প্রায়। ফজরের আজান হচ্ছে। হেমা বলল, তোকে একটা কথা বলি?

রাহাত বলল, হু।

হেমা বলল, তোর গান নিয়ে সিরিয়াস হওয়া উচিত।

রাহাত কথা বলল না। হেমাই বলল, আমি তোর গানে প্রচণ্ড মুগ্ধ। আজ কতবার যে গানটা শুনেছি। বোঝাতে পারব না। একটা কথা বলি শোন। কিছুক্ষণ আগে বললাম না, আমরা ভালোবাসা বলতে শুধু মানুষ বুঝি। কিন্তু ভালোবাসা হলো ফিলিং অফ ফুলফিলনেস। পূর্ণতার অনুভূতি। তোর এই গানটা আমাকে সেই অনুভূতিটা দিয়েছে। এটা কিন্তু তোর গানের প্রতি আমার ভালোবাসা। প্রথম প্রথম তোর সাথে আমার যখন পরিচয়। এই গান নিয়ে তোর কত কত স্বপ্ন ছিল। কী ভালোবাসা ছিল। কিন্তু সেসব তুই হারিয়ে ফেললি। কেন?

রাহাত এবারও জবাব দিলো না। হেমা বলল, আমার জন্য? তোর সব ভাবনার, ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেলাম আমি। এটা আমার জন্য কষ্টের। এটা অনেকটা ড্রাগসের মতো, তাই না? আর সবকিছুকে যে তুচ্ছ করে ফেলে। কিন্তু তুই-ই বল, এটা ভাবতে আমার কেমন লাগে? আমি একটা মানুষকে ধ্বংস করে দিচ্ছি। তার স্বপ্নগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছি। কি জঘন্য এই অনুভূতিটা একবার ভেবে দেখ তো!

রাহাত এবারও কথা বলল না। হেমা বলল, মানুষের যখন মন খারাপ হয়, তখন সে তার প্রিয় সঙ্গীকে কাছে চায়। তার সঙ্গ চায়। এই সময়ে যারা মানুষের কাছে থাকে, শক্তি হয়ে থাকে, তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি বলতে তার জীবনে আর কিছু নেই। আমিও চাই তোর এই অদ্ভুত সুন্দর সব কথারা গান হয়ে আমার মন খারাপের সঙ্গী হোক। আমার দুঃসময়ের সঙ্গী হোক। তারা আমার মন ভালো করে দিক। আমি তোর অনেক অনেক গান শুনতে চাই। অনেক।

হেমা থামলেও রাহাত কথা বলল না। হেমা আবার বলল, ভেবে দেখ। তো, আমার মতো এমন কত কত মানুষ তোর গান শুনে মন ভালো করবে। আনন্দে কাঁদবে। তার প্রিয়জনকে বলবে, এই গানটা শুনে দেখো তো, ছেলেটা একদম আমাদের কথা বলেছে। শুনলেই মন ভালো হয়ে যায়। এই অনুভূতির চেয়ে বড় আর কি আছে! এই ভালোবাসার চেয়ে বড়? কিছু কিছু মানুষ কারো একার জন্য হয় না। সে হয় সকলের। তুই তাদের একজন। তুই যদি কারো একার জন্য হয়ে যাস, তবে আর সবার প্রতি সেটা একটা অন্যায়। তুই জানিস না, কী অবিশ্বাস্য শক্তি তোর ভেতর আছে। এটা জানা তোর জন্য খুব দরকার।

রাহাত জানে, হেমা তাকে তার এই অবস্থা থেকে বের করতে চেষ্টা করছে। সে তাকে তার গান নিয়ে উৎসাহিত করতে চাইছে। তাকে কোনো একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত করতে চাইছে। হয়তো এই ব্যস্ততা তাকে হেমার প্রতি তার এই দুর্নিবার আকর্ষণ থেকে ধীরে ধীরে বের করে আনবে। কিন্তু সে হেমার প্রতি তার এই প্রবল ভালোবাসা থেকে বের হতে চায় না। সে এভাবেই থাকতে চায়। হেমাকে ভালো না বেসে সে থাকতে পারবে না।

রাহাত চুপ করে রইল। হেমাও। অনেকটা সময়। তারপর রাহাত হঠাৎ একটা অদ্ভুত বিষয় আবিষ্কার করল, এই সবকিছু বোঝার পরও হেমার কথাগুলো তাকে উদ্দীপ্ত করছে। তার মনে হচ্ছে, সে চাইলে আবার গানটাকে ভালোবাসতে পারে। হেমাকে নিয়েই তো তার কত কত কথা, গল্প, গান। এইসব সে তো হেমাকে কখনোই বলেনি। বলতে পারবেও না। কিন্তু সে চাইলে তার সকলই গান হয়ে যেতে পারে। হেমা শুনবে। নিশ্চয়ই শুনবে। আর হ্যাঁ, অন্যরাও শুনুক। চারপাশে মানুষ আজকাল কেবল ঘৃণার কথা বলে, ঘৃণার কথা শোনায়, সে না হয় তার অনুচ্চারিত অন্তহীন ভালোবাসার কথা শোনাবে।

হেমা ডাকল, রাহাত?

রাহাত সাড়া দিলো, হু?

হেমা বলল, আমাকে আবার গানটা একটু শোনাবি?

রাহাত কথা বলল না। তবে সে সেই ভোরের অদ্ভুত আলোয় হেমাকে গানটা শোনাল,

তোর জন্য কান্না পাচ্ছে খুব, তোর জন্য কান্না চেপে রাখা,
আমার অশ্রু ভাসায় যদি তোকে, তাই তো এমন অশ্রু চেপে থাকা।
তোর জন্য কষ্ট হচ্ছে খুব, তোর জন্য কষ্ট চেপে রাখা,
আমার কষ্ট কাঁদায় যদি তোকে, তাই তো এমন কষ্ট চেপে থাকা।
তোর জন্য একা একা এই, একা একা আমি একা কথা কই,
তোর জন্যই হাজার ভিড়েও রয়ে যাই আমি একা। তোর জন্য কান্না চেপে রাখা।

রাহাত কাঁদছে। কিন্তু রাহাতের সেই কান্না হেমা দেখতে পাচ্ছে না। কে জানে হেমাও কাঁদছে কিনা! খুব ধীরে ভোরের আলো ফুটছে। শুরু হচ্ছে আরো একটি নতুন দিন। সেই নতুন দিনের অদ্ভুত আলোয় ভেসে যেতে যেতে রাহাতের হঠাৎ মনে হলো এই কান্নার সবটা জুড়ে কেবল কষ্টই নেই। এই কান্নার কোথাও যেন খুব স্পষ্ট করেই রয়ে গেছে আনন্দ। নতুন সৃষ্টির আনন্দ। নতুন জন্মের আনন্দ। সেই জন্মে সে প্রেমিকই হবে। তবে সেই প্রেম হবে স্রষ্টা ও সৃষ্টির। জগতে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির প্রেমের চেয়ে বড় কোনো প্রেম নেই।

*

ফজু ব্যাপারীর বড় ভাই নজরুল গ্রামে এসেছে। তবে তার স্ত্রী-পুত্রদের সে আনেনি। ফজু হোসনাবাদ এসেছে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে। তারা বসে আছে আব্দুল ফকিরের বাড়ির বাইরের ঘরে। আব্দুল ফকিরকে কুড়ি হাজার টাকা দিয়েছে ফজু। ব্যাপারী।

আব্দুল ফকির টাকা গুনে জুলফিকারের কাছে দিতে দিতে বললেন, কুড়ি হাজার টাকায় কি হইব ফজু? একখান দলিল-পর্চার পিছে একবার খোঁজ লাগাইতেই যায় দুই তিন হাজার টাকা। দুইজন মাইনষের যাওন আসনের খরচ আছে। মাঝে-মইধ্যে থাকন লাগে। তহন হোটেল ভাড়া, খাওন খরচ। তারপর আছে দালাল ধরন। পেশকার, তহশিলদার, উকিলের লগে একখান কথা কইতে গেলেও পয়সা লাগে। পয়সা ছাড়া একখান কথা কেউ কয় না। তারপর ধর, আমি এই যে আর সব কাজ কাম বাদ দিয়া দৌড়াইতেছি। আমারও তো একখান সংসার আছে। খরচাপাতি আছে! এই কয়টা টাকায় তো পানি গরমও হয় না।

ফজু ব্যাপারী বলল, ফইর কাকু, এহন তো আর দিতে পারব না। ভাই ঢাকারতন কিছু পয়সা লইয়া আইছে বইলাই দিতে পারলাম। তয় আপনে চিন্তা কইরেন না। টাকার আরো ব্যবস্থা হইতেছে। আপনে এহন কাম চালান, ইনশাল্লাহ, টাকা-পয়সার সমস্যা হইব না।

আব্দুল ফকির বললেন, এই কাম বড় ঝামেলাররে ফজু। এহননা তো খা’য়রা কিছু করন শুরু করে নাই। তারা শুরু করলে পয়সা লাগব দ্বিগুন। কারণ তারাও তো ঘুষ দিব। যারা বেশি দিতে পারব, তাগো কাম হইবো আগে।

ফজু বলল, তাড়াতাড়ি করনের কোনো উপায় নাই কাকু?

আব্দুল ফকির গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, তাড়াতাড়িই হইতেছে। জমিজমার কাম বছরের পর বছর চইল্যা যায়, তারপরও মেটে না। আর সব জমিন হইছে খা’য়গা দখলে। এই দখল একটা ব্যাপার বুঝছস!

ফজু বলল, আপনেই ভরসা কাকু। আপনে তো সবই জানেন। যত বছর লাগুক, এই জমিনের পাই টু পাই হিসাব আমরা চাই।

ফজু তার ভাইয়ের কাছ থেকে আরো হাজার দুই টাকা নিয়ে আব্দুল ফকিরের হাতে দিয়ে বলল, এইটা দিয়া আপনে চা পান খাইয়েন কাকু।

আব্দুল ফকির টাকাটা পকেটে রেখে বললেন, আর একখান কথা ফজু। তোর বাড়িতে শুনলাম ডাকাতি হইছে। তায় তোর বাড়িতে ডাকাতি হওনের ঘটনা তো বুঝলাম না? ডাকাইত কি তোর ছনের ঘরের বেড়া নিতে আইছিল?

ফজু বলল, সেইটা এক রহস্য কাকু। আমিও বুঝতে পারলাম না ঘটনা। তয় একখান কথা, আমরা সবাই মিল্যা হাজার দশেক টাকা জমাইছিলাম। সেই টাকা আছিল ঘরে। ডাকাইত সেই টাকাটা কিন্তু লইয়া গেছে। তয় আমরা সেইটা বাইরে হুনান দেই নাই। ধরেন এইটা বাইরের মাইনষে জানল, সাথে সাথেই তো বড় খাঁ সাব আমারে ডাইক্যা নিয়া জিগাইব, এত টাকা আমি কই পাইছি? কি করব? এইজন্য কেউরে কিছু কই নাই।

আব্দুল ফকির ফজুর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, তোরে আমি যতটা ভ্যাবলা ভাবছিলাম। তুই কিন্তু আসলে তত ভ্যাবলা না ফজু। তোর মাথায় কিন্তু বুদ্ধি আছে।

ফজু বলল, কি যে কন না কাকু! মাথায় যদি বুদ্ধিই থাকত, তাইলে কী আর যার বাপ-দাদারা থাহে সওদাগর, জমিদার, তাগো বংশ হইয়া আমরা হই ফহির-মিসকিন? কথায় কয় না, বুদ্ধি থাকলে ঘরজামাই থাহন লাগে না! আমাগো অবস্থা তো হেই বলদ ঘরজামাইর চাইতেও খারাপ। নিজেগো ঘরেই আমরা ঘরজামাইর চাইতেও অধম।

আব্দুল ফকির হাসলেন, তুই তো দেহি কথাও শিখ্যা গেছস ফজু। নাহ। তোরে আর ভ্যাবাচ্যাবা ভাবন যাইব না। তোর বাইরে সদরঘাট হইলেও, তুই কিন্তু ভিতরে ভিতরে ফিটফাট।

ফজু কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই আব্দুল ফকির বললেন, একখান কথা বলি ফজু। আমি বাতাসে ঘ্রাণ পাই। আন্দাজও পাই। ঘটনা যে উড়া উড়া কিছু আমার কানে আহে নাই তা না। ঘটনা আমার কানেও আইছে কিছু। যাই। হোক এইসব জিনিস একলা একলা ভোগ করলে কিছুই ভোগ করন যায় না। ভাগশাক করতে হয়। আর আপন মাইনষের কাছে গোপন করলে তো বিপদরে ফজু। ডাক্তারের ধারে রোগ লুকাইলে হয়? তহন বিপদ হইলে বাঁচাইব কেডা?

ফজু আর বেশি কথা বাড়াল না। তবে আব্দুল ফকিরের কথাগুলোও তার ভালো লাগল না। তার হঠাৎই কেন যেন মনে হলো, সে আব্দুল ফকিরের একটা চক্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এই চক্র তৈয়ব উদ্দিন খাঁর চক্র থেকে কম বিপদের নয়। কিন্তু মাথা গরম করলে হবে না। বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। সে আজকাল বুঝে-শুনে কথা বলার চেষ্টা করছে। সে এখন জানে, কোথায় কতটুকু কথা বলতে হবে এইটা বোঝা খুব জরুরি! তার ভাই নজরুলও অবশ্য খুব একটা কথাবার্তা বলেনি। সে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে।

ফজু চলে যেতেই আব্দুল ফকির জুলফিকারকে নিয়ে বসলেন। বললেন, ঘটনা কি বুঝলি জুলফিকার?

জুলফিকার বলল, কোন ঘটনা কাকু?

আব্দুল ফকির বললেন, ফজুর ঘটনা। পোলা তো দেহি মারাত্মক পাকনা। তার ঘরের ডাকাতি লইয়া আমি সন্দেহ করব, এই জইন্য আমারে বুঝ দিয়া গেল!

জুলফিকার হাসল। তবে কথা বলল না। আব্দুল ফকির বললেন, টাকা বাইর হওয়া শুরু হইছে। কিন্তু আসল জিনিস বাইর হয় নাই এহনও। সকলের আগে আসল জিনিস বাইর করতে হইব।

জুলফিকার বলল, আসল জিনিস কি কাকু?

আব্দুল ফকির বললেন, গয়নার কলসি। এই কলসির কথা বহু আগে শুনছিলাম। তারপর আর মনে পড়ে নাই। সেইদিন রাইতে ফজুর টাকা-পয়সার কথা চিন্তা করতে গিয়া আচুক্কা মনে পড়ল। তয় ঘটনা যে কিছু একটা আছে, সেইটা তো বুঝতে পারতেছি। এইটাও কম না। হঠাৎ কইরা এত আটঘাট বাইন্ধা জমিন লইয়া নামছে, বিষয়টা এত সহজ না। খালি সহজই যে না, তাও না। জটিল, খুবই জটিল।

জুলফিকার আর কথা বললেন না। আব্দুল ফকির তিন-চারদিন পরে বাড়িতে ফিরেছেন রাতে। তার সাথে এখনও পারুলের দেখা হয়নি। ভোর বেলা পারুল গেছে তাদের বাড়িতে। আব্দুল ফকির ভেতর বাড়িতে গেলেন। তাবারন ঘর ঝাড় দিচ্ছিল। আব্দুল ফকির তাবারনকে দেখে বললেন, তোরে আমি কি কইছিলাম তাবারন?

তাবারন আব্দুল ফকিরের কথার জবাব দিলো না। সে একমনে ঝাড় দিতে থাকল। আব্দুল ফকির সামান্য গলা চড়িয়ে বললেন, আমার কথা তোর কানে যায় না? আমি কিন্তু কথা কেমনে কানে যায়, সেইটা জানি!

তাবারন ঝাড়টা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু তার মুখ নিম্নমুখি। আব্দুল ফকির বললেন, এক কথা আমার বারবার কইতে ভাল্লাগে না তাবারন। আরো ভাল্লাগে না কেউ আমার কথা না শুনলে। আর কেউ না চেনলেও তুই তো। আমারে চেনস? আব্দুল ফইর কেডা?

তাবারন হঠাৎ আব্দুল ফকিরের পায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি এহন কই যাব? আমার তো যাওনের আর কোনো জায়গা নাই। আপনে আমারে খেদাই দিয়েন না।

আব্দুল ফকির এদিক-সেদিক তাকিয়ে হিসহিসে কণ্ঠে বললেন, পায়ের উপরতন ওঠ তাবারন। এহনি ওঠ কইতেছি।

তাবারন বলল, আপনে আগে কন, আমারে খেদাই দিবেন না। আমি তো এই বাড়ি তো দাসী বান্দির মতোই আছি। দাসী বান্দির মতোই থাকব।

আব্দুল ফকির বললেন, এক কথা বারবার বলন আমার পছন্দ না। তুই এইহানে আর থাহোস- এইটা আমার পছন্দ না।

তাবারনের কান্না যেন এবার বেড়ে গেল। সে বলল, আমার কি এই দুইন্যায় আর কোনো যাওনের জায়গা আছে? আপনেই কন? আছে কোনো জায়গা? আপনে আমার জীবন ধ্বংস করছেন! এহন আর কি চান আপনে আমার কাছে?

আব্দুল ফকির বললেন, আমি তোর কাছে আর কিছু চাই না।

তাবারন যেন খানিক শক্ত হলো। সে বলল, হ। এহন আর চাইবেন ক্যা? এহন তো আর কিছু দেওনের নাই। এহন আমার গতর পোড়ছে, বুক নষ্ট হইছ, আমার শইল ভাঙছে, এহন আর আমারে চাইবেন ক্যা? আমার জীবনডা লণ্ডভণ্ড কইরা এহন অন্য কেউরে আবার বিচরাইবেন।

আব্দুল ফকির বললেন, তাবারন। বেশি কথা বলন আমি পছন্দ করি না। নুরুন্নাহারের অবস্থা দেইখ্যাও তোর শিক্ষা হয় নাই? পায়ের উপর থেইক্যা ওঠ কইলাম।

তাবারন ঝট করে পায়ের উপর থেকে উঠে বসল। আব্দুল ফকির চকিতে তাবারনের পেট বরাবর সজোরে লাথি বসালেন। তাবারন কোঁৎ শব্দ করে নেতিয়ে পড়ল মেঝেতে। আব্দুল ফকির অবশ্য সেদিকে ফিরেও তাকালেন না। তিনি গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন উঠান পেড়িয়ে।

.

লতার কলেজে লম্বা ছুটি চলছে, সেই ছুটিতেই সে বাড়িতে এসেছে। আর এই সুবাদে সারাক্ষণ পারুলের সাথে সময় কাটছে তার। তাদের বাড়ি থেকে পারুল ফিরল সন্ধ্যাবেলা। তার সাথে এলো লতাও। রাতে খেতে গিয়ে আব্দুল ফকিরের সাথে দেখা হলো পারুলের। সেদিন মায়ের ঘরের ঘটনার পর থেকে আর বাবার সাথে সেভাবে কথা হয়নি পারুলের। কিছুদিন থেকে খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন আব্দুল ফকির। বাড়িতে বলতে গেলে থাকেনই না। মাঝে-মধ্যে আসলেও সে ওই মাঝরাতে। আবার ভোরবেলা বের হয়ে যান।

রাতে খেতে বসেও মায়ের বিষয়ে বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না পারুল। সে রোজকার মতো স্বাভাবিক গলায়ই বাবার সাথে কথা বলল। বাইরে বাইরে ঘুরে আব্দুল ফকিরের শরীর স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে দেখে পারুল তার শরীর স্বাস্থ্যের খবর নিলো। সে বলল, আপনের শরীলডা তত দিন দিন খারাপ হইয়া যাইতেছে আব্বা।

আব্দুল ফকির বললেন, একটু দৌড়াদৌড়ির মইধ্যে আছিরে মা।

পারুল বলল, এই বয়সেও এত দৌড়াদৌড়ি করতে আপনের ভাল্লাগে আব্বা?

আব্দুল ফকির বললেন, জীবনটাই তো দৌড়াদৌড়ির। মরনের পর তো সব বন্ধ। এইজন্য দুনিয়ায় যতটুক পারন যায়, দৌড়াদৌড়ি কইরা নেওন ভালো।

পারুল বলল, এহন আপনে কি নিয়া ব্যস্ত আব্বা? বহুকাল আপনে কোনো বাড়িতে জ্বিন পরী ছাড়াইতে যান না। সাপের বিষ নামাইতেও যান না।

আব্দুল ফকির বললেন, আইজকাল আর ওইগুলানে প্যাট চলে না রে মা। এই এত বড় সংসার। কতগুলান মাইনষের খাও পরন। সবকিছুর চিন্তাই তো করন লাগে।

পারুল বলল, তাইলে অন্য কোনো কাম ধরছেন?

আব্দুল ফকির বললেন, দেহি কি হয়! বয়স তো আর কম হইল না। এহনো আল্লায় শরীলে তাগত রাখছে দেইখ্যা খাইট্টা খাইতে পারি। কোনদিন বিছনায় পইর‍্যা যাব, তহন চলব কেমনে? এইজন্য চেষ্টা করতেছি কিছু পুঁজিপাতির ব্যবস্থা করনের। নগদ বেশি কিছু টাকা-পয়সার ব্যবস্থা হইলে নিশ্চিন্ত থাহন যাইব।

পারুল বলল, নগদ বেশি টাকার ব্যবস্থা করনের উপায় কি আব্বা?

আব্দুল ফকির বললেন, তোমার আব্বায় পয়সাপাতিতে গরীব হইতে পারে, নামে ধামে গরীব না। তারে আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষজনে চেনে। দশজনে শ্রদ্ধা ভক্তি করে। সে চাইলে একটা না একটা ব্যবস্থা হইয়াই যাইব।

পারুল বলল, তারপরও শরীলের দিকে একটু খেয়াল রাইখেন আব্বা। আপনের শরীলটা খুব খারাপ হইয়া গেছে। দেখলে মায়া লাগে আব্বা।

আব্দুল ফকির মেয়ের এই সামান্য কথায় খুবই আপুত বোধ করলেন। ভাত খেতে গিয়ে তার গলাটা কেমন আটকে গেল। এই দুনিয়ায় এই তার একমাত্র মায়া, একমাত্র দুর্বলতা। এই মেয়ের জন্য তিনি এই পৃথিবী ওলটপালট করে দিতে পারেন। একবার মেয়ের জলবসন্ত হলো, মেয়ে কিছু খেতে পারে না। যা খায়, তাই বমি করে ফেলে দেয়। রাতভর কাঁদে। দিন সাতেক বিছানার সাথে মিশে ছিল মেয়েটা। এই সাতদিন তিনি রাতে ঘুমাননি। সারারাত মেয়ের পাশে বসে থাকতেন। দিনের বেলা ঘণ্টাখানেক ঘুমালেও ঘুম ভেঙে জেগে উঠেই সবার আগে মেয়ের মুখ দেখতে চাইতেন। জোর করে তাকে সামান্য খাবার গেলানো যেত। কিন্তু মেয়ের জন্য তার বুকটা সারাটাক্ষণ যেন এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যেতে থাকল। সেই মেয়েটা এমন মায়া করে একটা কথা তাকে আগে কোনোদিন বলেনি। মেয়েটা তাকে কতটুকু ভালোবাসে, কতটুকু মায়া করে, তা আব্দুল ফকির কখনোই বুঝতে পারেননি। বুঝবেন কি করে, মেয়েটা তো কখনো তার সাথে ভালো করে কথাই বলেনি। কেমন একটা দূরত্ব ছিল সব সময়।

আব্দুল ফকির মনে করতে পারেন না, তিনি কখনো কেঁদেছেন কিনা! অথচ আজ এই সামান্য কটা কথায় আব্দুল ফকিরের গলা ধরে এলো। এই খেতে বসে, মেয়ের বান্ধবীর সামনে বসে, এই অবস্থায় চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লে, তা ভারি বিশ্রি একটা ব্যাপার হবে। আব্দুল ফকির যেন নিজেকে ব্যস্ত রাখতেই সামনের জগ থেকে পানি ঢেলে ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি খেয়ে ফেললেন।

মেয়েটা দেখতে দেখতে কেমন বড় হয়ে গেল! এই সেদিন মেয়েটাকে নিয়ে কাঁধে করে ঘুরতেন তিনি। আর সেই মেয়ের নাকি বিয়ের বয়স হয়ে গেছে! অনেকদিন থেকেই আশেপাশের লোকজন মেয়ের বিয়ের জন্য নানান সম্বন্ধও নিয়ে আসছেন। সেসব শুনে আব্দুল ফকিরের যে কি রাগ হয়! কিন্তু তিনি নিজেও বোঝেন, মেয়ে বড় হয়েছে, মেয়ের বিয়েও দেয়া দরকার। কিন্তু পারুলের বিয়ে হয়ে গেলে এই বাড়িতে তিনি পারুলকে ছাড়া থাকবেন কি করে! তিনি যেখানেই থাকেন, যতদূরেই থাকেন, দিন শেষে তার একটা কথাই শুধু মনে হয়, বাড়ি ফিরলেই মেয়ের মুখটা তিনি দেখতে পাবেন। এইটুকু ভাবলেই তার সকল ক্লান্তি, সকল কষ্ট নিমেষেই দূর হয়ে যায়।

পারুল বলল, আব্বা, এহন আপনের হাতে টাকা-পয়সা কেমন আছে?

আব্দুল ফকির মুখ তুলে মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, টাকা পয়সা দিয়া কি করবা মা?

পারুল বলল, রৌদে রৌদে ঘুইর‍্যা আপনের জামা-কাপড়ের অবস্থা দেখছেন? আপনের জইন্য আমি নিজে পছন্দ কইর‍্যা দুইখান পাঞ্জাবি বানাব।

আব্দুল ফকিরের বুকের ভেতর যেন টুপ করে এক ফোঁটা হিম শীতল শিশির ঝড়ে পড়ল। সেই শিশিরের স্পর্শে তিনি অবর্ণনীয় এক অনুভূতিতে অবশ হয়ে রইলেন। তিনি বললেন, তোমার টাকা লাগলে তুমি নিও মা। আমি নানান কাজ কামে থাকি, অনেক কিছুই খেয়াল করি না। তোমার জামা, কাপড়, স্নো, পাউডার লাগলেও কিন্যা নিও। ওই লতারে লইয়া রায়গঞ্জ যাইয়ো।

আব্দুল ফকির ভাত খাওয়া শেষে জুলফিকারকে দিয়ে মেয়ের জন্য টাকা পাঠালেন। সেই রাতে বহুকাল পর তিনি পরিপূর্ণ আনন্দ নিয়ে ঘুমাতে গেলেন।

দিন চারে বাদে আবার আব্দুল ফকিরের সাথে দেখা পারুলের। পারুলের হাতে দু’খানা পাঞ্জাবি। সে আব্দুল ফকিরের সামনে পাঞ্জাবি দু’খানা রেখে বলল,

আব্বা, একটু গায় দেন দেহি। দেহি আপনেরে কেমন দেয়। আমি নিজে লতারে লইয়া রায়গঞ্জ গিয়া কাপুড় কিন্যা আনছি। তারপর ছাইদুল খলিফারে দিয়া বানাইয়া আনছি।

আব্দুল ফকির জামা গায়ে দিবেন কি! সেই জামা ধরেই তার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। তিনি অতি কষ্টে গলা স্বাভাবিক রেখে বললেন, আমি পরে গায় দিব মা। গায় দিয়া তোমারে দেহামু।

পারুল অবশ্য বাবাকে জোর করল না। তবে বাবার সামনে থেকে চলে যাবার আগ মুহূর্তে হঠাৎই সে বলল, আরেকখান কথা আব্বা। কথাখান। জরুরি।

পারুলের বলার ভঙ্গিতে কিছু একটা ছিল। আব্দুল ফকির ঝট করে মেয়ের দিকে তাকালেন। পারুল বলল, আমার আরো কিছু টাকা লাগব আব্বা।

আব্দুল ফকির যেন ফোঁস করে বুকে আটকে রাখা দম ছেড়ে নির্ভার হলেন। পারুল কী এক অদ্ভুত, শীতল, রহস্যময় গলায় যে বলেছিল আরেকখান কথা আব্বা!

তিনি মানুষ চড়িয়ে খান। মানুষের গলার স্বর, কথার ভঙ্গিমা তাকে চিনতে হয়। ওই কথাটুকুর ভেতর কিসের এক পূর্বাভাস যেন ছিল। কিন্তু পারুল টাকার কথা বলতেই আব্দুল ফকির যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি বললেন, তোমার কিছু লাগব মা?

পারুল স্বাভাবিক গলায় বলল, জ্বে আব্বা।

আব্দুল ফকির বলল, কত টাকা লাগব মা?

পারুল বলল, টাকার পরিমাণটা একটু বেশি। তয় এহন এইরমই লাগব। পরে আরো লাগলে তহন দেহা যাইব।

আব্দুল ফকির বললেন কত টাকা?

পারুল আগের মতোই নির্বিকার স্বাভাবিক গলায় বলল, এহন হাজার পনেরো টাকা দিলেই হইব আব্বা। বাকিটা পরে লাগব।

আব্দুল ফকির বুঝতে পারছেন না তিনি কি বলবেন! হাজার পনেরো টাকা দিয়ে পারুল কি করবে! তিনি যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললেন, এতটাকা দিয়া তুমি কি করবা মা?

পারুল বলল, মায়ের চিকিৎসা করাব। আপনে তো বহুবছর ধইর‍্যা মায়ের উপর থেইক্যা জ্বীনের আছড় ছাড়াইতে পারলেন না। আপনের মতো এত বড় ওঝা যদি এত বছরেও না ছাড়াইতে পারে, তাইলে আর কোন ওঝায় পারব? কেউ পারব না। এই জন্য আমি চিন্তা করছি, মায়রে ঢাকা নিয়া বড় ডাক্তার দেহামু। লতার কলেজ পনেরো-কুড়ি দিন বন্ধ। ও অর মামার লগে ঢাকা যাইব। তার লগে আমার কথা হইছে। সে কইছে আমি যদি আমার মায়রে লইয়া যাই, কোনো সমস্যা হইব না। লতার মামার পরিচিত বড় ডাক্তার আছে, সেইহানেই দেহানোর ব্যবস্থা করান যাইব।

আব্দুল ফকির মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। পারুলের কথা শুনে তিনি বুঝতে পারছেন না তার কি প্রতিক্রিয়া দেখানো দরকার। কিন্তু পারুল যে এই কথাটি বলার জন্যই গত ক’টা দিন তার সাথে এমন অস্বাভাবিক আচরণ করেছিল, তা তিনি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি। শুধু তাই-ই না, বরং তা দেখে তিনি প্রবলভাবে আবেগতাড়িতও হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই কথা ভেবে আব্দুল ফকিরের নিজেকে হঠাৎ কেমন অসহায় আর অপাংক্তেয় লাগছিল। কেমন সব হারানো নিঃস্ব একজন মানুষ মনে হচ্ছিল নিজেকে।

পারুল বলল, আব্বা, মায়ের লগে মনে হয় কোনো জ্বিন-টিন নাই। থাকলেও এইজন্য মায়র মাথা খারাপ হয় নাই। মায়র মাথায় বড় বড় আঘাতের দাগ। মায়ের বড় চুলের জন্য এতদিন খেয়াল করি নাই। শুনছি মাথায় খারাপভাবে আঘাত লাগলে নাকি মাইনষের মাথা খারাপ হইয়া যাইতে পারে। মায়র শরীলেও অনেক আঘাত। হইতে পারে এইগুলান মায় নিজে একলা একলাই করছে। সারাদিনই তো নিজের মাথাটা ঘরের বেড়ার লগে ঠোকে। সেই থেইক্যাও মাথায় অত বড় বড় আঘাতের দাগ হইতে পারে। আপনে যদি বেরাজি না হন, তাইলে মায়রে লইয়া আমি একটু ঢাকায় ডাক্তারের ধারে যাইতে চাই আব্বা!

পারুল ধীরে-সুস্থে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামল। এই কথাগুলো বলার জন্য সে দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েছিল। সেদিন নুরুন্নাহারকে দেখার পর হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল পারুল। মায়ের লম্বা, ঘন চুলের ভেতর মাথাটা দেখে সে আঁৎকে উঠেছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময় ভেবেও বের করতে পারেনি কি করবে সে! প্রথমে ভেবেছিল, বাবার মুখোমুখি দাঁড়াবে সে। কিন্তু পরে তার হঠাৎ মনে হলো, তাতে মায়ের কি লাভ হবে! মায়ের কাছ থেকে বাবার কিছু কিছু গল্প সে শুনলেও, সে সকল এতদিন বিশ্বাস করতে চায়নি পারুল। কিন্তু সেইদিন তার মনে হলো, মায়ের কাছ থেকে আরো অনেক অনেক গল্প শোনা তার বাকি আছে! কিন্তু তার আগে মাকে নিয়ে একটা শেষ চেষ্টা সে করে দেখতে চায়। কিন্তু বাবাকে ছাড়া সেটি সম্ভব নয়। পারুল জানত, বাবা কিছুতেই এই প্রস্তাবে রাজি হবেন না। শুধু তাই-ই নয়, তিনি হয়তো ভয়ঙ্করভাবে খেপে যাবেন। খুব। বাজেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন। কিন্তু আব্দুল ফকির তার কিছুই করলেন না। পারুল আব্দুল ফকিরকে যতটা চমকে দিয়েছে, আব্দুল ফকির তার চেয়ে বহু বহুগুণ বেশি চমকে দিলেন পারুল কে। তিনি উঠে গিয়ে কোথাও থেকে একটা চটের ব্যাগ নিয়ে আসলেন। তারপর ব্যাগ থেকে অনেকগুলো নগদ টাকা বের করলেন।

পারুলের সামনে বসেই তিনি ধীর-স্থির ভঙ্গিতে সেই টাকাগুলো গুনতে লাগলেন। তারপর মুখে একটা সৌম্য স্নিগ্ধ ভাব ফুটিয়ে বললেন, এই নেও মা। এইহানে কুড়ি হাজার টাকা আছে। বিদেশের বাড়িতে গেলে গোনা টাকা লইয়া যাওন যায় না। লইয়া যাইতে হয় আগোনা টাকা। কহন কোনহানে কোন খরচ লাইগ্যা যায়, আগেরতন তো কওন যায় না। হাতে কয়টা বেশি টাকা থাকলে ভরসা থাহে।

পারুল হাত বাড়িয়ে বাবার হাত থেকে টাকাগুলো নিলো। কিন্তু তার হতভম্ব ভাব এখনো কাটছে না। আব্দুল ফকির বললেন, আমারই তোমাগো লগে যাওন লাগত। কিন্তু জরুরি কিছু কাজে আটকাই গেছি। তারপরও কও দেহি মা, তোমরা কবে যাইবা? আমিও যদি যাইতে পারি। নিজের ঘরে নিজের স্ত্রী বছরের পর বছর এমনে পইরা থাকলে কার ভালো লাগে কও মা! এই বুদ্ধিটা এতদিনেও আমার মাথায় আহে নাই। এই জইন্যই তো আল্লায় তোমারে আমার ঘরে দিছে। আমার মারে আবার আল্লায় আমার ঘরে তোমার রূপ ধইর‍্যা পাঠাইছে।

কথা বলতে বলতে আব্দুল ফকিরের গলা ভারি হয়ে এলো। চোখ ভিজে এলো। তিনি কোনোমতে তার কান্না সংবরণ করলেন। পারুল বিস্ময়াভিভূত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সে জানে না সে কি বলবে! এই মানুষটাকে নিয়ে তার মা যা বলেছে, সে যা ভেবেছে, তার সবটাই সত্যি! আসলেই সত্যি? পারুল আর ভাবতে পারছে না। কোথাও বড় ধরনের কোনো সমস্যা আছে! কিন্তু সমস্যাটা কি তা সে জানে না। পারুল বলল, আমি আপনেরে তারিখটা জানাই দিব আব্বা।

সে আব্দুল ফকিরকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ দিলো না। ঘুরে দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব অস্বস্তি লাগছিল পারুলের। খুব অপরাধী লাগছিল। নিজের ঘরে ফিরেও পারুলের কিছুতেই ভালো লাগছিল না। কিছুতেই নিজেকে স্বস্তি দিতে পরছিল না। সেই রাতে ঘুমও হলো না পারুলের। বিছানার তলায় কুড়ি হাজার টাকা রেখেও, এতকাল পরে মায়ের চিকিৎসার নিশ্চিত ব্যবস্থা করেও, সেই সারাটি রাত পারুলের কেটে গেল বীভৎস বিভ্রান্তিতে, বিপুল ছটফটানিতে।

*

আজকাল বেশ ঘুমের সমস্যা হচ্ছে রেণুর। সামান্য শব্দ কিংবা আলোর আভাস পেলেই ঘুম ভেঙে যায়। মাঝরাতে তাই বিছানা থেকে উঠে দেয়াল ঘড়ির ব্যাটারি খুলে রাখতে হয় তার, জানালার পর্দার উপর বিছানার চাদর মেলে দিতে হয়। না হলে দেয়াল ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ, জানালার পর্দা গলে আসা রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের সামান্য আলোতেও তার ঘুম ভেঙে যায়। আজও ঘুম ভেঙে গেল রেণুর। তিনি অভ্যাসমতো মাথার কাছের টেবিলে হাত বাড়াতে গিয়েও সরিয়ে নিলেন। গত ক’দিন ধরে এই ভুলটা তিনি বারবার করছেন। রাতে ঘুমানোর আগে তার পানি খাবার অভ্যাস। ঘুম থেকে উঠেও দাঁত ব্রাশ করার আগে খালি পেটে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নেন তিনি।

আগে আসলাম সাহেব রোজ ঘুমানোর আগে পিরিচে ঢেকে একখানা ঝকঝকে কাঁচের গ্লাস আর একটা জগ রেখে যেতেন রেণুর মাথার কাছে। রেণু। মনে করতে পারেন না, গত পঁচিশ বছরে এই ঘটনার অন্যথা কখনো হয়েছে। কিনা। তিনি অবচেতনেই জানতেন, তার মাথার কাছে হাত বাড়ালেই তিনি গ্লাসটা পাবেন। জগটা পাবেন। এ এক অভ্যাস। দিনকয় আগে প্রথম যেদিন তিনি মাথার কাছে হাত বাড়িয়ে জগ আর গ্লাসটা পেলেন না, বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন করে উঠল! সেই কেমন করাটা রেণুকে ভারি অস্বস্তি দিয়েছে। তিনি বুঝতে পারছিলেন না, এই কেমন করে ওঠাটা কার জন্য? নাকি কিসের জন্য?

তার কি কোনো মানুষের জন্য কেমন করে উঠেছে? নাকি গ্লাস আর জগের যে অভ্যস্ততাটা ছিল, সেই অভ্যস্ততার জন্য? তিনি অনেকক্ষণ ভেবেছেন। ভেবে ভেবে কোনো উত্তর তিনি খুঁজে পাননি। তবে একটা বিষয়ে তিনি নিশ্চিত, মানুষটার কথা তার একবারও মনে পড়েনি। মানুষটার অভাবও না। তার যা হয়েছে তা হলো, কিছু অভ্যাস হুট করে বদলে গেছে। দীর্ঘদিন একটা অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে মানুষ গেলে, হুট করে যদি সেই অভ্যাসের কিছু বদলে যায়, তবে বিষয়টা নিয়ে খানিক অস্বস্তি তো তৈরি হয়ই। রেণু জানেন, এর চেয়ে বেশি কিছু তার হচ্ছে না। তিনি বাসাটা ছেড়ে দিবেন। তার কিছু জমানো টাকা আছে ব্যাংকে। এতদিন খুব একটা দরকার পড়েনি বলে খোঁজ নেয়া হয়নি। আজ তিনি খোঁজ নিয়েছেন। টাকার অঙ্ক শুনে তিনি অবাক হয়েছেন। অবশ্য অবাক। হবারও কিছু নেই। চাকরি তো আর তিনি কম দিন ধরে করছেন না। দিনের পর দিন বেতনের টাকা, বোনাসের টাকা, বিভিন্ন সেমিনার এলাউন্স, পরীক্ষা আরো কত কী যে আছে! এই সব টাকাই তো জমেছে। আপাতত একটা ফ্ল্যাট খুঁজছেন তিনি। সমস্যা হচ্ছে এই বয়সে এসেও একা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া পাওয়া ভারী মুশকিল। বিষয়টা দেখে রেণু অবাক হয়েছেন। দিন দুই ক্লাস শেষ করে একা একা বাসা খুঁজেও এসেছেন তিনি। কিন্তু পাননি। রেণুকে বয়সের তুলনায় দেখতে একটু ভারি লাগে। কিন্তু তারপরও চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছরের একজন কলেজের শিক্ষিকারও ঢাকা শহরে একা একটা বাসা ভাড়া নিতে এত ঝক্কি পোহাতে হতে পারে, এটা রেণু ভাবেননি।

এই বাসার কিছু ফার্নিচার তার কেনা। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এসবের কিছুই তিনি নিবেন না। ডিভোর্সের সময় নানান ঝামেলার কথা তিনি শুনেছেন। আইন-কানুনের নানান ব্যাপার-স্যাপারও রয়েছে। তিনি এই বিষয়টাকে এড়িয়ে যেতে চান। তার কোনো কিছু চাই না। তিনি একা একাই চলে যেতে যান। তার কিছু দরকার নেই।

এই পর্যন্ত এসে তার মনে হলো, তিনি হেমার কথা ভুলে যাচ্ছেন। অবশ্য জীবন জুড়েই কী অস্বাভাবিকভাবেই না তিনি হেমার কথা ভুলেই ছিলেন। হেমাকে কি তিনি কখনো মাতৃস্নেহ দিয়েছেন? রেণু আলাদা করে কিছু মনে করতে পারলেন না। অবশ্য এর কারণ এই না যে হেমার প্রতি তার স্নেহ, ভালোবাসা নেই। এর কারণ বলতে যা, সেটি তার আর আসলাম সাহেবের এই সম্পর্কহীন সম্পর্কের সকলক্ষেত্রেই একমাত্র কারণ। তিনি কোনো কিছুতেই আসলাম সাহেবের কাছাকাছি যেতে চাইতেন না।

হেমা জন্মের পর থেকেই হেমাকে যেন চোখের মণি করে ফেলেছিলেন। আসলাম সাহেব। খাওয়ানো থেকে ঘুম পাড়ানো, বাথরুম করানো থেকে গোসল, এমন কিছু নেই যে তিনি করতেন না। ফলে ইচ্ছে হলেও আসলাম সাহেবের সাথে অযথা অতিরিক্ত কথা বলতে হবে বলে, তার সাথে একটা আলাদা যোগাযোগ তৈরি হবে বলে, তিনি যতটা সম্ভব নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। তবে এই দূরে বসেও যে তিনি হেমাকে খেয়াল করেননি, তা নয়। বরং হয়তো কোনো না কোনোভাবে আসলাম সাহেবের চেয়ে বেশিই খেয়াল রেখেছিলেন। কিন্তু ওই যে, মানুষ কেবল চোখে যা দেখা যায় তাই দেখে, মনে যা দেখা যায় তা দেখে না। রেণু ভেবে দেখেছেন, তার জীবনটাই এমন। এক অদ্ভুত অস্পৃশ্যতায় পরিপূর্ণ জীবন।

তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে বাতি জ্বালালেন। একটা টিকটিকি কোথাও শব্দ করছে। বা ফ্যানের বাতাসে কোথাও একটা কাগজ নড়ছে। সেই সামান্য শব্দেও তার ঘুম হচ্ছে না। তিনি উঠে কোনো টিকটিকি খুঁজে পেলেন না। তবে কাগজ পেলেন। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এই কাগজটাও আসলাম সাহেবের লেখা! বিভিন্ন সময় এমন বহু চিরকুট তিনি এখানে-সেখানে রেখে যেতেন। তাতে প্রয়োজনীয় বিষয় ছাড়া কখনোই কোনো অযথা কথা লেখা থাকত না। রেণু অবশ্য সেসব খুব একটা পড়ে দেখেছে বলে মনে করতে পারেন না। কাগজগুলো বেশিরভাগই ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিতেন তিনি। কিন্তু আজকের এই কাগজটা কোত্থেকে এলো! সম্ভবত হেমা সেদিন যখন ওষুধ খুঁজেছিল, তখন কোথাও থেকে বের করেছিল। তারপর রয়ে গিয়েছিল। কাগজটা তুলে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন কাগজটার নিচের দিকে একটা ছোট্ট কথা লেখা আছে। কাগজটা ফেলে দিতে দিতেও তিনি থমকে দাঁড়ালেন। তারপর দেখলেন কাগজে লেখা

আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি। ফিরতে সপ্তাহখানেক লাগবে। এ সপ্তাহের বাজার করে রেখে গেলাম। মাছ কুটিয়ে আনা হয়েছে। তোমার ওষুধগুলো টেবিলের নিচের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছি। আর গতকাল দেখলাম, তোমার চশমার কাঁচে অসংখ্য স্ক্র্যাচ। ডান চোখেরটার নিচের দিকে সামান্য ভাঙাও। একটা নতুন চশমা বানাতে দিয়ে এসেছি। ওরা কাল দিয়ে যাবে। তোমার চোখের পাওয়ার তো আগেরটাই, নাকি? আমি খুঁজে বহু পুরনো একটা প্রেসক্রিপশন পেয়েছিলাম। সেটা দেখেই বানাতে দিয়ে এসেছি। প্রেসক্রিপশনটাও নিচের ড্রয়ারে রাখা আছে। একটু দেখে নিও। ওটা না হলে ওদের ফোন নম্বরে জাস্ট ফোন করে এখনকার পাওয়ারটা বলে দিও। ওদের কার্ডটাও ড্রয়ারে রাখা আছে। ওখানেই নম্বরটা পাবে। তোমার মাথার দিকে বিছানার নিচে কিছু টাকা রাখা আছে। দু’দিন ধরে খেয়াল করছি তুমি ঠান্ডা পানিতে গোসল করছ। ডাক্তার কিন্তু একদম নিষেধ করে দিয়েছিল। বারকয়েক বলতে গিয়েও সাহস হয়নি। একটু মনে রেখো। তোমার বাথরুমের গিজারটা তো দেখলাম ঠিকই আছে!

বিঃদ্রঃ একটা অদ্ভুব ব্যাপার কি জানো? এই এত বছরেও আমি জানি না, আমার নম্বরটা তুমি জানো কিনা! তোমার ফোনে আমার নাম, নম্বর সেভ নেই, সেটা জানি, কিন্তু মুখস্ত আছে কিনা, সেটা জানি না। শুধুই যে জানি না, তাই না। আমার তোমাকে জিজ্ঞেস করতেও সাহস হয় না। আমি জানি তুমি ফোন দিবে না। তারপরও আমার নম্বরটা এখানে লিখে দিলাম।

নিচের এই অংশটুকু সবুজ কালিতে লেখা। তার নিচে বড় বড় করে ফোন নম্বরটা দেয়া। মূলত এই লেখাটুকু দেখেই রেণু থমকে গিয়েছিলেন। কিন্তু এটুকু পড়তে গিয়েই পুরো চিরকুটটাও পড়ে ফেলতে হলো তাকে। চিরকুটটার কোথাও তারিখ দেয়া নেই। ফলে তিনি বুঝতেও পারলেন না চিরকুটটা কতদিন আগের। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, চিরকুটটা ফেলতে গিয়েও রেণু শেষ অবধি ফেললেন না। তার পড়ার টেবিলের উপরের দিকের ড্রয়ারে অবহেলা ভরে রেখে দিলেন। আর তখুনি একটা অদ্ভুত চিন্তা মাথায় এলো রেণুর। আচ্ছা, আসলেই কী মানুষটার ফোন নম্বরটা তার মুখস্ত নেই? তিনি অবশ্য কখনো কোনোদিন আলাদা করে নম্বরটা মনে রাখার চেষ্টাও করেননি। খেয়ালও করেননি। কিন্তু এত এত মেসেজ মানুষটা পাঠিয়েছেন! ফোনও যে একদমই করেননি, তাও না। ফলে আপনাআপনিই নম্বরটা মুখস্ত হয়ে যাওয়ার কথা! রেণু তার ফোন বের করে মনে থাকা নম্বরগুলো ডায়াল করে মেসেজ বক্সে গিয়ে দেখলেন নম্বরটা তার মনে আছে! মনে না থাকার অবশ্য কারণও নেই।

তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকটা মেসেজও পড়ে ফেললেন। সমস্যা হচ্ছে এই মেসেজ পড়তে গিয়েই তার আচমকা মনে হলো, এই এত এত দিন পর এই পুরনো অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাওয়া মেসেজগুলো তিনি কেন পড়ছেন? বিষয়টা তার কাছে ভালো ঠেকল না। তিনি ফোনটা রেখে বাতি নিভিয়ে আবার শুয়ে পড়লেন। দীর্ঘ সময় চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন রেণু। কিন্তু তার ঘুম এলো না। বহুদিন মানুষটার সাথে এক বিছানায় থাকা হয় না তার। শুধু এক বিছানায়ই না, এক ঘরেও থাকেন না তারা। রেণুর পাশের ঘরটাতেই থাকতেন আসলাম সাহেব। দুটি ঘর একদম লাগোয়া। দুই ঘর মিলিয়ে একটা অবিচ্ছেদ্য টানা বারান্দাও রয়েছে। দুই ঘরের দরজা খুলেই বারান্দাটায় যাওয়া যায়। রেণুর ঘুম আসছে না। তিনি নানান চেষ্টা করলেন ঘুমাবার, কিন্তু পারলেন না। তিনি হঠাৎ নাকে সিগারেটের তীব্র গন্ধ পেতে লাগলেন। এই গন্ধটা পাওয়ার পর থেকে তিনি আরো ঘুমাতে পারলেন না। এমন গন্ধ নিয়ে ঘুমানো সম্ভব না। কিন্তু এতরাতে এই ঘরে সিগারেটের গন্ধ কোথা থেকে আসবে! হেমা কি সিগারেট টিগারেট খায় নাকি! আজকালকার ছেলে-মেয়েদের দিয়ে বিশ্বাস নেই! কলেজে, রাস্তাঘাটে এমন কত কত উদ্ভট জিনিস যে তিনি দেখেন!

রেণু প্রবল অস্বস্তি নিয়ে আবার উঠলেন। উঠে বাতি জ্বালিয়ে পা টিপে টিপে হেমার ঘরের দিকে গেলেন। হেমার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা। তিনি দরজায় কান পেতে খানিক বোঝার চেষ্টা করলেন, হেমা জেগে আছে কিনা! কারো সাথে ফোনে কথা বলছে কিনা! কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ পেলেন না। আবার নিজের ঘরে এসে বিছানায় বসলেন রেণু। সাথে সাথেই যেন সিগারেটের গন্ধটা আবার টের পেলেন তিনি। ভারি বিদঘুঁটে লাগছে ব্যাপারটা।

রেণু অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। তার ধারণা সিগারেটের গন্ধটা আসছে বারান্দা থেকে। তিনি উঠে বারান্দায় গেলেন। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই তার বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠল। তার ডান দিকে বারান্দার শেষ প্রান্তে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে! রেণুর পুরো শরীর যেন অবশ হয়ে গেল! এই রাতে মানুষটা এইখানে! এইখানে দাঁড়িয়ে তিনি সিগারেট খাচ্ছেন! এই ঘটনা অবশ্য নতুন কিছু না। আগেও বহুবার এমন হয়েছে। রেণু গভীর রাতে সিগারেটের গন্ধ পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন। তারপর বারান্দায় এসে উঁকি দিয়ে দেখেছেন মানুষটা অবিকল ওই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন। কিন্তু আজ, এখানে কীভাবে? তবে কি দিনের বেলা রেণু যখন কলেজে ছিলেন, তখন এসেছিলেন! রেণু কি করবেন এখন! তার ভয় হচ্ছে, আবার কেমন অবাকও লাগছে! রেণু কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। বুঝতে পারছেন নাকি করা উচিত। তিনি বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। আর তারপরই রেণুর হঠাৎ মনে হলো, ওখানে কোনো মানুষ দাঁড়িয়ে নেই। বারান্দায় টানানো দড়িতে হ্যাঁঙ্গার ঝোলানো। সেই হ্যাঁঙ্গারে একখানা পাঞ্জাবি ঝুলছে। পাঞ্জাবিটা কবে শুকাতে দেয়া হয়েছিল, কে জানে! কেউ আর সরায়নি। বুয়াটাও আজকাল যা ফাঁকিবাজ হয়েছে! বলে না দিলে নিজ থেকে কোনো কাজই করে না। রেণু প্রচণ্ড বিরক্তবোধ করছেন নিজের উপর। একই সাথে প্রচণ্ড দ্বিধান্বিতও। আসলেই কি সিগারেটের গন্ধ-টন্ধ কিছু পেয়েছিলেন তিনি? নাকি পুরোটাই তার অস্থির মস্তিষ্কের কল্পনা?

রেণু ঘুমাতে গেলেন ফজরের নামাজ পড়ে। ঘুম ভেঙে দেখেন একটা ক্লাস এর মধ্যেই মিস করে ফেলেছেন তিনি। বিষয়টা ভাবতেই নিজের উপর নিজের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। খুবই অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি হচ্ছে তার। এসবের কোনো মানে হয়! তিনি তড়িঘড়ি করে কলেজে এলেন। কলেজে এসে শোনেন কিসের জন্য যেন ছাত্র ধর্মঘট চলছে, আজ কোনো ক্লাস হবে না। বিষয়টা জানার পর আরো মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। খবরটা আগেভাগে জানতে পারলে আজ আর বাসা থেকেই বের হতেন না তিনি। রাতে ভালো ঘুম হয়নি বলে শরীরটাও কেমন লাগছে! রাজ্যের বিরক্তি আর মেজাজ খারাপ নিয়ে রেণু তার রুমে একা একা বসে রইলেন। এই মুহূর্তে জানালার গ্রিলে সেই চড়ইটাকে দেখতে পেলেন তিনি। কিন্তু চড়ইটা আজ একা। রেণু কৌতূহলি চোখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। চড়ইটার জন্য অপেক্ষা করলেন। কিন্তু চড়ইটা আর এলোই না। কিছু কিছু দিন থাকে এমন। এই দিনে যা-ই করা হয়, সবকিছুই হয় প্রত্যাশার চেয়ে উল্টো। অস্বাভাবিক রকম বাজে। রেণুর আজ তেমনই বাজে একটা দিন।

প্রিন্সিপাল ম্যাডামের রুম থেকে তার ডাক এসেছে। তিনি প্রিন্সিপাল ম্যাডামের রুমে ঢুকতেই রুমের আর সকলে বের হয়ে গেল। বিষয়টার কিছুই বুঝলেন না রেণু। প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সাথে তার আলাদা করে কোনো যোগাযোগ বা গুরুতর কোনো মিটিংও নেই। তিনি ক্লাস নেয়ার বাইরে কলেজের আর কোনো কিছুর সাথেই যুক্ত নন। তাহলে হঠাৎ প্রিন্সিপাল ম্যাডামের এমন জরুরি ডাক কেন? বিষয়টায় খানিক অবাকই হয়েছেন রেণু। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম অনেকক্ষণ রেণুর খোঁজ-খবর নিলেন। হেমার খবর নিলেন। মেয়ের প্রেম ট্রেম আছে কিনা জানতে চাইলেন। মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে রেণু কি ভাবছেন জানতে চাইলেন। তার হাতে কানাডা প্রবাসী ভালো পাত্র আছে, সে কথাও বললেন।

কিন্তু রেণু বুঝতে পারছিলেন, এ সকলই আসলে আসল কথা বলার আগের ভূমিকা। অবশেষে আসল কথাটা বললেন তিনি। এদিক-সেদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, শুনলাম, আপনার হাজবেন্ড নাকি আবার বিয়ে করেছে? তা আপনাকে কি ঘটনা জানিয়েছে? না, না জানিয়েই?

রেণু এই প্রশ্নের কি উত্তর দিবেন! তিনি মৃদু গলায় বললেন, না তেমন কিছু না।

প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম বললেন, একদম লুকাবেন না! স্বামী যদি স্ত্রীকে না। জানিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে, তাহলে লজ্জাটা কার? স্ত্রীর? না স্বামীর? লজ্জাটা স্বামীরই হওয়া উচিত। আমাদের দেশের মহিলাদের এই এক সমস্যা। তারা ভাবে, হাজবেন্ড পরকীয়া করলে, আরেকটা বিয়ে করলে এটা তাদের কারণে করেছে। এটা তাদের সমস্যা। লজ্জায় বিষয়টা ধামাচাপা দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। এই যদি হয় দেশের নারী সমাজের অবস্থা, তবে সেই দেশে নারীমুক্তি কি করে হবে বলেন তো! হবে? হবে না। নারীকে শক্ত হতে হবে। আপনি মামলা করবেন। নারী নির্যাতন মামলা। সাথে থাকবে শারীরিক নির্যাতন। কত ধানে কত চাল, এইটা তার বোঝা দরকার। ঘরে বউ রেখে পরকীয়া না! একদম টলারেট করবেন না। পুরুষ জাতির ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতিতে চলবেন। একটু টলারেট করবেন কি দেখবেন, মাঝরাতে কাজের বুয়ার সাথে শোবে। সুযোগ যখন পেয়েছেন, পুরোপুরি উসুল করে নেন। আর দেনা পাওনার বিষয়টাও দেইখেন। টাকা-পয়সা একটা ভাইটাল ইস্যু। আপনার নামে কোনো প্রোপার্টি করে নাই? ফ্ল্যাট বা জমি?

রেণু কথা বললেন না। তিনি প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের দিকে তাকাতে পারছেন না। প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম বললেন, একদম লজ্জা পাবেন না। নেভার বি শাই। ওই লজ্জা নারীর ভূষণ, এই কথা পুরুষতন্ত্রের তৈরি। এইটা বলে বলে নারীদের অবলা বানিয়ে রেখেছে। যাতে নারী লজ্জায় ঘর থেকে বের না হয়, কথা না বলে, বুঝেছেন? এই করে করেই তো প্যাট্রিয়ার্কির উত্থান। একদম লজ্জা পাবেন না। আর কিই বা আপনার বয়স বলুন? দেখতে শুনতে ভালো। আজকাল এমন অহরহ হচ্ছে। আমার এক বান্ধবীই তো পঞ্চাশে এসে পঁয়ত্রিশ বছরের হাঁটুর বয়সি এক ছেলেকে বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেল। আরে, ভালো লেগেছে করেছে, তাতে কার কি! জোর করে তো আর করেনি। কিন্তু দেখেন তাদের কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমেরিকা চলে যেতে হয়েছে। কারণ দেশে থাকলে মানুষকে মুখ দেখাতে পারবে না! বুড়ো হাবড়া পুরুষগুলা রাস্তাঘাটে বাচ্চাবাচ্চা মেয়েদের সেক্সয়াল হ্যারাজমেন্ট করে দাঁত বের করে হাসবে, তাতে দোষ হয় না। আর নিজের বয়সের কম এক ছেলেকে বিয়ে করেছে বলে একদম জাত গেল জাত গেল রব উঠে গেল। দিস ইজ হোয়াট প্যাট্রিয়ার্কি মেড। একদম আপোস করবেন না।

রেণু বলল, আমি আজ উঠি?

প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম বললেন, উঠবেন মানে? আপনাকে তো চা দেয়া হয়নি। অন্তত চা খেয়ে যান। আরেকটা কথা, নো কম্প্রোমাইজ। সারাজীবন শুধু আমরাই কম্প্রেমাইজ করে যাব? নো, নেভার।

রেণু কথা বলল না। তিনি তার জীবনের সবচেয়ে বিস্বাদ চা-টা খেয়ে চেয়ার থেকে উঠলেন। প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম এই মুহূর্তে আবার বললেন, আরেকটা কথা।

রেণু বললেন,জ্বি?

প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম বললেন, শুনলাম, ইকনোমিক্সের মাস্টার্সের একটা ছেলের সাথে আপনার বেশ একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে। ঘটনা নাকি অনেক দূর এগিয়েছেও? আর এইজন্যই নাকি আপনার হাজবেন্ড ডিভোর্স চাইছে। ঘটনা খুলে বলেন তো? নো ওরিজ। আমি আছি। যে কারো যে কাউকে যে কোনো সময় ভালো লাগতে পারে! বয়সটা ফ্যাক্ট না, ফ্যাক্ট হলো আন্ডারস্ট্যান্ডিং। আন্ডারস্ট্যান্ডিং না হলে বয়স ধুয়ে কি পানি খাবেন!

রেণু আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না। তিনি প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের ঘর থেকে বের হয়ে সোজা বাসায় চলে এলেন। বাসায় এসে তিনি হড়বড় করে বমি করলেন। এত বছরে এই প্রথম তার মনে হলো এই সমাজে একটা মেয়ের জন্য স্বামী কত প্রয়োজনীয়! এখনো কিছুই হয়নি, তাতেই এই অবস্থায় দিন কয় গেলে আর কী কী অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে ভাবতেই রেণুর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

*

গত কিছু দিন থেকে নয়ন সবচেয়ে বেশি যাকে নিয়ে ভেবেছে, তার নাম আব্দুল ফকির। মানুষটার প্রতি তার ঘৃণা যতটা রয়েছে, ততটা ঘৃণা বোধহয় এই জগতে কারো প্রতি কারো থাকে না। তবে সেই ঘৃণার সাথে একটা সমীহ মিশ্রিত ভয়ও রয়েছে। এটি খুবই দ্বান্দ্বিক একটা অনুভূতি। অমন সাদাসিধে চেহারার, গ্রামীণ বয়স্ক একজন মানুষ কি করে এমন বিকৃত মানসিকতার হতে পারে নয়ন তা ভেবে পায় না! তাকে দেখে ঘুণাক্ষরেও বোঝার উপায় নেই যে এই মানুষটার ভেতর লুকিয়ে আছে এমন ভয়াবহ যৌন বিকৃতি লালন করা একটা মানুষ।

নিজে ডাক্তার হবার সুবাধে এমন নানান অস্বাভাবিক ঘটনার সাথে অল্প বিস্তর জানাশোনা নয়নের হয়েছে। কিন্তু একটা মানুষ জীবনভর একের পর এক এই জঘন্য কাজগুলো করে যাচ্ছে, কেউ তাকে ধরতেও পারছে না, কোনো অভিযোগও নেই, ভাবতেই কেমন গা গুলিয়ে ওঠে নয়নের। মানুষটার বয়স এখন কত হবে? ষাট বা কাছাকাছি? কিন্তু এই বয়সে এসেও তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বরং দিন দিন আরো যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন তিনি।

নয়ন সাধারণত পেপার-পত্রিকা খুব একটা পড়ে না। কিন্তু সেদিন ভোরে কি মনে করে সে পত্রিকাটা ধরল। এবং অবাক হয়ে আবিষ্কার করল একদিনেই পত্রিকার পাতাভর্তি অনেকগুলো ধর্ষণের সংবাদ। এই ধরনের সংবাদ পড়লে কেমন একটা গা ঘিনঘিনে ভাব হয় নয়নের। বিষয়টা সে নিতে পারে না। কিন্তু আজ সংবাদগুলো সে খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ল। ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে ধর্ষণের এই সংবাদগুলোর বেশিরভাগই ঘটেছে স্কুলগামী বাচ্চা-বাচ্চা মেয়েদের ক্ষেত্রে। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্ষকের বয়স অনেক অনেক বেশি। বিষয়টা নয়নের মাথা থেকে গেল না। হঠাৎ করেই এই বিষয়ে জানার আগ্রহ হতে লাগল নয়নের। কিন্তু পুরনো পত্রিকা ঘেটে এই ধরনের সংবাদ বের করা ঝামেলাপূর্ণ কাজ। তারপরও বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করল সে। প্রতিদিনই কিছু না কিছু সংবাদ আছেই। সমস্যা হচ্ছে বাসায় একটামাত্র পত্রিকা রাখা হয়। তার আরো খবর চাই। আরো কিছু খবর। রাতে ঘুমাতে গিয়ে নয়নের মনে হলো, আজকাল সব পত্রিকারই ইন্টারনেট ভার্সন রয়েছে। সে চাইলে এ ধরনের সংবাদগুলো খুব। সহজেই ইন্টারনেট থেকে সগ্রহ করতে পারে।

সেই সারাটা রাত ইন্টারনেটেই কাটল নয়নের। নয়ন অবাক হয়ে আবিষ্কার করল এইসব সংবাদে সয়লাব ইন্টারনেট দুনিয়া। শুধু তা-ই নয়। নয়ন পেয়ে গেল বীভৎস, অবিশ্বাস্য সব ঘটনাও। একবছর বা তার চেয়েও কম বয়সের শিশু থেকে শুরু করে পঞ্চাশোর্ধ নারী অবধিও রয়েছেন ধর্ষণ বা যৌন নিগ্রহের তালিকায়। তবে এত কিছুর পরও একটা সংবাদে চোখ আটকে গেল নয়নের। সংবাদের ওপরে বড় করে লেখা, ছাত্রীকে ধর্ষণ করল ওঝা। বরিশালের। ঝালকাঠিতে সপ্তম শ্রেণির এক মেয়েকে সাপের বিষ নামানোর কথা বলে ধর্ষণ করেছে পঞ্চাশোর্ধ বয়সের এক ওঝা। এরপর এই সংক্রান্ত একের পর এক সংবাদ দেখতে লাগল সে। জ্বিন, ভূতের আছড় ছাড়ানো থেকে শুরু করে সাপের বিষ নামানোসহ এমন অসংখ্য ঘটনায় এইধরনের সংবাদের ছড়াছড়ি।

তবে সেই সকল সংবাদেও আলাদা করে নয়নের দৃষ্টি কাড়ল চাঁদপুরের রসু খাঁ নামের এক ব্যক্তির খবর। সংবাদে বলা হয়েছে ষাট বছর বয়সের এই ব্যক্তি শেষ আড়াই বছরেই এগারোজন নারীকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। শুধু তা-ই নয়, গ্রেপ্তারের পর সে আদালতে দাঁড়িয়ে নির্বিকার গলায় বলে, তার ইচ্ছে ছিল একশ একজন নারীকে ধর্ষণ করে হত্যা করার। কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ায় মাত্র এগারোতেই থেমে যেতে হলো তাকে। এবং এই এতগুলো ধর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ড করার পরও তার মধ্যে কোনো অপরাধবোধই নেই।

সংবাদটা পড়ে নয়নের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এই রসু খাও বাংলাদেশের কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামেরই মানুষ। সে নিজে আত্মস্বীকৃত ধর্ষক এবং সিরিয়াল কিলার! আব্দুল ফকিরের সাথে রসু খার পার্থক্য আসলে কোথায়? আব্দুল ফকির বেশিরভাগ সময়ই ধর্ষণ করেন মেয়েগুলোকে চিকিৎসার নামে অচেতন বা নেশাগ্রস্ত করে। তিনি খুন করেন না। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর দুই মানুষের মধ্যে আদতে পার্থক্য কতটুকু?

সেদিন রাতে আব্দুল ফকিরের সাথে ঘটা ঘটনার কথা মনে পড়তেই গা শিউড়ে উঠল নয়নের। সেই হাসি, সেই কথা বলার ভঙ্গি, সেই কণ্ঠ, মনে পড়লেই বুকের ভেতরটা ভয়ে হিম হয়ে আসে। অথচ বিলকুড়ানির হাটের সেই অত অত মানুষের ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা আব্দুল ফকির যেন অন্য এক অতি সাধারণ মানুষ। সহজ সরল জীবনের পরোপকারী এক বৃদ্ধ। যিনি সকলের বিপদে আপদে নিঃসঙ্কোচে ছুটে আসেন। পাশে দাঁড়ান। যাকে সকলেই শ্রদ্ধা করে।

এতদিন এমন অনেক বিকৃত খুনী ও ধর্ষকের ঘটনা নয়ন বিদেশি পত্রিকায় পড়েছে, সিনেমায় দেখেছে। সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্ব’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি করা একটি সিনেমায় এন্থনি হপকিন্সের কথাও মনে পড়েছে তার। বিশ্বখ্যাত পত্রিকা রিডার্স ডাইজেস্টেও এমন কত ঘটনা যে সে পড়েছে! কলম্বিয়ার লুইসা গারাভি তো, চারশর বেশি মানুষকে খুন করেছে সে ইতিহাসের এই জঘন্যতম সিরিয়াল কিলার এবং এর মধ্যে বেশিরভাগ নারীকেই খুন করার আগে ধর্ষণ করেছে সে। ইংল্যান্ডে জ্যাক দ্যা রিপার নামে পরিচিত ভয়ঙ্কর এক খুনীর কথাও এই রিডার্স ডাইজেস্টেই পড়েছে নয়ন। এই খুনি নারীদের সাথে যৌন সম্পর্কের সময় তাদের গলা টিপে হত্যা করত সে। নয়ন আরো কিছুক্ষণ ইন্টারনেট-এ খুঁজল। এর পরের তথ্যগুলো সে হজম করতে পারল না। একে এক বেরিয়ে আসতে থাকল অবিশ্বাস্য, গা শিউড়ে ওঠা সব বিকৃত ধর্ষক ও খুনীদের নাম। জন ওয়েসি গেসি, জেফরি ডেহম, গ্যারি রিজওয়ে, রিচার্ড ট্রেন্ট, হেনরি লি লুকাসসহ এমন কত কত ভয়ঙ্কর খুনীর কথা যে রয়েছে! হেনরি লি লুকাস আদালতে স্বীকারোক্তি অবধি দিয়েছিল যে সে ছয়শ’র বেশি তরুণী নারীকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করেছিল। এই খুনিকে নিয়ে হলিউডে পোর্ট্রেট অফ আ সিলিয়ার কিলার নামে সিনেমাও হয়েছিল।

নয়ন চুপচাপ দীর্ঘ সময় বসে রইল। আচ্ছা, এই মানুষগুলোর মনস্তত্বে কী কাজ করে? একটা মানুষকে যখন তারা ধর্ষণ করে, নৃশংস উপায়ে ঠান্ডা মাথায়, হাসিমুখে খুন করে তখন তাদের ভাবনার জগতে কী চলে! নয়ন জানে না। তবে একটা বিষয় তার কাছে পরিষ্কার, এরা সকলেই ভয়াবহ রকমের যৌন বিকৃতিসম্পন্ন মানুষ। এরা প্রত্যেকেই নারীদের খুন করার আগে ধর্ষণ করত। কিন্তু আব্দুল ফকির হয়তো খুন করেন না, কিন্তু এই বিকৃতিতে তিনি এদের কারো চেয়েই কম কিছু নন। বরং আপাদমস্তক সহজ, সরল, সাধারণ গ্রাম্য বয়স্ক এক মানুষের বেশ ধরে এই এতটা বছর নিজেকে আড়াল করে রেখে যেভাবে তিনি একের পর এক তার বিকৃত লালসা মিটিয়ে গেছেন, অথচ তার বিরুদ্ধে কেউ প্রকাশ্যে কোনো অভিযোগ করেনি। কোনো পত্রিকায় তার এই খবর প্রকাশ হয়নি। কোনো থানায় তার নামে কোনো মামলা হয়নি। দিব্যি ভালো মানুষটি সেজে বছরের পর বছর তিনি প্রবল প্রতাপের সাথে কাটিয়ে দিয়েছেন। নয়নকে বরং উপরের ওই মানুষগুলোর তুলনায় আব্দুল ফকিরকে ঢের বেশি কৌশলী, ঢের বেশি চতুর, ঢের বেশি ভয়ঙ্করই মনে হচ্ছে!

নয়নের গা গোলাতে লাগল। এখন তার মনে হচ্ছে, কি এক অবিশ্বাস্য ভয়ঙ্কর মানুষের সাথে সেই রাতের সেই অন্ধকারে অমন এক নৌকায় সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করে কটিয়েছে! তারপর কয়েকদিন প্রচুর পড়াশোনা করল নয়ন। এই ভয়ানক যৌন বিকৃতি নিয়ে মেডিকেল সায়েন্স কি বলে? বইপত্র কি বলে?

এগুলো আসলে হাইপার সেক্সয়ালিটি (Hypersexuality)। বিষয়টাকে হাইপার সেক্সয়াল ডিজঅর্ডারও বলা হয়। এই ধরনের মানসিকতার মানুষ প্রায় সব সময়ই তীব্র যৌন চাহিদা অনুভব করে, আবার কারো কারো ক্ষেত্রে হঠাৎ করে যৌন চাহিদা খুব বেশি বেড়ে যায়। নারীদের ক্ষেত্রে এই সিন্ড্রোম বা লক্ষণকে বলা হয় নিম্ফোম্যানিয়া (Nymphomania)। যাতে বলা হয় এই ধরনের নারীরা অস্বাভাবিক যৌনাকাঙ্ক্ষায় কাতর থাকে। এই আকাঙ্ক্ষা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। যা তাদের নানান ধরনের যৌন বিকৃতির দিকে নিয়ে যায়।

আর পুরুষের ক্ষেত্রে এই অবস্থাকে বলা হয় স্যাটিরিয়াসিস (Satyriasis)। যাকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, Uncontrollable or excessive sexual desire in a man। ম্যারিয়াম ওয়েবস্টার ডিকশনারিতে এর অর্থ বলা হয়েছে, Excessive or abnormal sexual craving in the male. অর্থাৎ পুরুষের অতিরিক্ত, নিয়ন্ত্রণের অযোগ্য বা অস্বাভাবিক যৌন কাতরতা। এই ধরনের পুরুষরাই যুক্ত হয়ে পড়ে ভয়ঙ্কর সব যৌন অপরাধের সাথে।

.

নয়ন পরপর বেশ কয়েক রাত এই নিয়েই কাটাল। কিন্তু তাতে তার অস্থিরতা কিছু দূর হলো না। বরং বাড়ল। সে প্রতিরাতেই ঘুমের ঘোরে বীভৎস সব স্বপ্ন দেখতে লাগল। সেইসব স্বপ্নের বেশিরভাগই আব্দুল ফকিরকে নিয়ে। আব্দুল ফকির তার স্বপ্নে বিচিত্র বিচিত্র সব বেশ ধরে আসেন। নয়নের জানাশোনা ওই সকল ভয়ঙ্কর অপরাধীদের বেশেও তাকে দেখা যায়। দেখা যায় বিকৃত, বীভৎস সব কর্মকাণ্ড করতেও। প্রায় রাতেই এইসব স্বপ্ন দেখে নয়নের ঘুম ভেঙে যায়। আজ রাতে একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। নয়ন স্বপ্নে দেখল, সে শুয়ে আছে তার বিছানায়। কিন্তু বিছানায় শুয়ে শুয়েও সে আব্দুল ফকিরকে দেখতে পাচ্ছে। আব্দুল ফকির একটা খোলা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে দূর থেকে যতক্ষণ দেখা গেছে, ততক্ষণ নয়ন স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু সে অস্বাভাবিক হয়ে গেল তখন, যখন সে দেখল আব্দুল ফকিরের মুখখানা ক্রমশই তার কাছাকাছি চলে আসছে! তখন প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল নয়ন। সমস্যা হচ্ছে সে জানে যে সে শুয়ে আছে তার ঘরে তার বিছানায়, কিন্তু তারপরও ওই অত দূরে গ্রামে থাকা আব্দুল ফকিরের ভয়ে সে দৌড়ে পালাচ্ছে কেন! সে স্বপ্নের মধ্যেই নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করল এবং একটু সময় সে নিজেকে বোঝাতে সক্ষমও হলো। সে এবার তার বিছানায় চুপচাপ শুয়ে রইল। তার রুমে একটা বড় টেলিভিশন। সে শুয়ে শুয়ে সেই টেলিভিশনে কিছু একটা দেখছিল। আচমকা নয়ন আবিষ্কার করল, সেই টেলিভিশনের ভেতরেও আব্দুল ফকির। তার থুতনিতে সামান্য দাড়ি। কিন্তু তার মুখমণ্ডলে কোনো চোখ এবং নাক নেই। স্রেফ সমতল মাংসপিণ্ড। তবে মুখের জায়গায় সামান্য একটা ছিদ্র রয়েছে! আব্দুল ফকিরের সেই চেহারা দেখে আতঙ্কে নয়নের হাত-পা অবশ হয়ে এলো। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর ব্যাপার, হঠাৎ করেই সে দেখল আব্দুল ফকিরের সেই ছোট্ট ছিদ্রের মুখ থেকে একটা লকলকে সরু জিভ বের হয়ে আসছে। সেই জিভ থেকে ঘন আঠালো তরল ঝরে পড়ছে।

আতঙ্কে জমে যেতে যেতে নয়ন হঠাৎ দেখল, আব্দুল ফকিরের সেই জিভখানা সাপের মতো ভঙ্গিতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে সরে যেতে চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। তার মনে হচ্ছে তীব্র আতঙ্কে বুকের ভেতর থেকে তার কলিজাটা বের হয়ে আসবে। সে বারবার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে দৃশ্যটা সে টেলিভিশনের পর্দায় দেখছে। কিন্তু আব্দুল ফকিরের সাপের মতো লকলকে জিভখানা টেলিভিশনের পর্দা ভেদ করে বেরিয়ে এলো। নয়নের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। সে নড়তে পারছে না। আব্দুল ফকিরের জিভটা আরো এগিয়ে এলো। আরো। একদম নয়নের মুখের কাছে। আর একটু হলেই ওই আঠালো তরল ঝরানো জিভটা নয়নের গাল ছুঁয়ে দেবে। নয়ন প্রচণ্ড আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিন্তু জিভটা তারপরও এগিয়েই আসছে। বন্ধ চোখের ভেতর দিয়েই জিভটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নয়ন। সাপের মতো। জিভটা আরো এগুলো। তারপর নয়নের গালে ছোবল বসানোর ঠিক আগ মুহূর্তে আচমকা থেমে গেল জিভটা। কিন্তু নয়নের আতঙ্ক তাতে এতটুকু কমল না। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে সরে যেতে, কিন্তু পারছে না।

জিভের ডগা বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় তরল ঝরে পড়ছে তার গালে। সেই সাথে জিভের আগাটা কেমন সুরসুর করে স্পর্শ করছে তার গাল। ঘুমের মধ্যেও গালের সাথে জিভের ডগার স্পর্শটা টের পাচ্ছে নয়ন। সে হাত বাড়িয়ে পাগলের মতো সেই সুরসুরির অনুভূতিটা সরিয়ে দিতে চেষ্টা করল। প্রথমবার পারল না, তবে দ্বিতীয়বার পারল। জিভটা যেন সরে গেল মুহূর্তের জন্য। সুরসুরির অনুভূতিটাও। নয়ন তীব্র চিৎকারে ঘুম থেকে জেগে উঠল। তার হাত পা তখন থরথর করে কাঁপছে। এত জীবন্ত, এত বীভৎস কোনো স্বপ্ন হয়! নয়ন কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তার বুক হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে। সে কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। সে হঠাৎ আবিষ্কার করল, তার গাল বেয়ে, তার ঠোঁটের কোল বেয়ে তখনও গড়িয়ে। পড়ছে ঘন আঠালো তরল। নয়ন বাঁ হাতে তার গাল ছুঁলো। সেখানে তখনও লেগে আছে ঠান্ডা, আঠালো, হিমশীতল তরল!

সেই রাতে নয়নের আর ঘুম হলো না। সে ঘরের সবকটা বাতি জ্বালিয়ে বসে রইল। একটা বিষয় নয়ন স্পষ্ট টের পাচ্ছে, সে তার চিন্তাভাবনা যতই সে গুছিয়ে আনতে চাইছে, ততই সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সে একজন শিক্ষিত, তরুণ ডাক্তার, কুসংস্কার বা অতিপ্রাকৃত ব্যাপরটা তার ভাবনার সাথে যায় না। আর গেলেও সেই ঘটনাগুলো হতে হবে কোনো ধরনের যুক্তিতে ব্যাখ্যা করা যায় না এমন। কিন্তু খানিক আগে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার কি ব্যাখ্যা সে দেবে? নয়ন তার গালে হাত দিয়ে বসে রইল। এখনো তার গালটা ভেজা। ঘন তরলে আঠালো হয়ে আছে গালের ত্বক। এর কোনো ব্যাখ্যাই সে খুঁজে পেল না। এই প্রথম নয়নের মনে হলো, সেদিনের সেই নৌকায় আব্দুল ফকির তার কথায়, তার আচরণে, তার ভঙ্গিতে নয়নের অবচেতন মনে একটা তীব্র আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। যা নয়ন এই এতদিনেও স্পষ্ট বুঝতে পারেনি। তবে মাঝে-মধ্যেই সে তার প্রতি একটা সমীহ টের পেত। গত কয়েকদিন স্বপ্নের ভেতর সেটি আরো প্রকট হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু আজ কি হলো! আব্দুল ফকিরের কি আসলেই কোনো অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা রয়েছে? সে কি টের পাচ্ছিল যে নয়ন তাকে নিয়ে এত কিছু ভাবছে? এত কিছু করছে! আসমার কাছে আব্দুল ফকির সম্পর্কে এমন অনেক গল্পই শুনেছে নয়ন। তার শত্রু হতে যাওয়া মানুষকে তিনি নানান উপায়ে ভয় দেখান। তাহলে নয়নকেও কি তিনি তেমন করেই ভয় দেখালেন! আসলেই কি তার অতিপ্রাকৃত কোনো ক্ষমতা আছে? নয়ন কিছুতেই এটি বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু এই যে স্বপ্ন, আর স্বপ্নের পর তার গালে লেগে থাকা এই যে ভেজা আঠালো তরল, এর কোনো ব্যাখ্যা নয়ন খুঁজে পেল না।

নয়নের মনে হলো, সে পুরোপুরি পাগল হয়ে যাচ্ছে। তার মাথায় কাজ করছে না। সে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আসমার কাছেই শুনেছে, আব্দুল ফকির তার স্ত্রীকেও নাকি পাগল করে রেখেছেন। সেও কি তাহলে তেমন কোনো উপায়েই পাগল হয়ে যাচ্ছে? এইজন্যই এই তীব্র ভয়? নয়ন ভেবে দেখল, শুধু তা-ই কেন, তার নানা তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মতো অমন ডাকসাইটে লোকও ভেতরে ভেতরে আব্দুল ফকিরকে ভয় পান। ভয় পায় আরো অসংখ্য মানুষ! এ সকলই। কি এমনি এমনি! নিশ্চয়ই না। নয়নের হঠাৎ মনে হলো, সে তার মাকে সব খুলে বলবে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, একমাত্র তার মা-ই পারেন, তাকে এই ভয় থেকে, এই তীব্র মানসিক চাপ থেকে, এই ভয়ানক অস্থিরতা থেকে মুক্তি দিতে! নয়ন ঘুমাল ভোরের আলো ফোঁটার পর। লম্বা ঘুম। তার ঘুম ভাঙল। বিকেলে। ঘুম থেকে উঠেই তার মনে হলো তার সারা শরীর জুড়ে অস্বস্তি। তার মুখ গাল ঘাড়ে অস্বস্তিকর ব্যাথা। সে বিছানা থেকে উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আর তখুনি তার শরীর বেয়ে এক তীব্র ভয়ের শীতল স্রোত নেমে গেল। সে আয়নায় তাকিয়ে দেখল, তার গালের মাঝ বরাবর লাল একটা দাগ। পরদিন সকাল নাগাদ সেই লাল দাগ আরো লাল হলো, তারপর ছেয়ে গেল দগদগে কাঁচা ঘায়ে!

*

রেণুর সাথে হেমার সম্পর্কটা কি বদলাচ্ছে? এতদিনকার অদৃশ্য আঁড় ভেঙে সম্পর্কটা যেন একটু একটু করে স্বাভাবিক মা-মেয়ের সম্পর্ক হয়ে উঠছে। রেণুর ধারণা, এই স্বাভাবিক হয়ে ওঠাটা হয়তো আরো আগেই হতো, যদি মাঝখানে মেয়েকে অমন নিজের একান্ত সম্পদ বানিয়ে না রাখতেন আসলাম সাহেব। সেদিন হেমা এসে মার পাশে বসল। কলেজের ঘটনাটা নিয়ে রেণুর প্রচণ্ড মন। খারাপ ছিল। হেমা এসে বলল, মা ছাদে যাবে?

রেণু না বলতে গিয়েও কি মনে করে মত পাল্টালেন। বললেন, আমার কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। কিন্তু চাদর-টাদর যে কোথায় রেখেছি! সেই গত বছর শীতের পর তো আর চাদর লাগেনি।

হেমা মায়ের কপালে হাত দিলো। একটু জ্বর জ্বর ভাব। সে বলল, কই আর রাখবে তুমি? নিশ্চয়ই বাবা কোথাও রেখেছে।

রেণু এই কথার জবাব দিলেন না। হেমা খানিক তরল গলায় বলল, বাবার অমন চিরকুট আর নেই? যেখানে চাদরের কথা, কম্বলের কথা লেখা আছে?

রেণু বললেন, তোর বাবার ঘরের আলমারি বা ওয়ার্লোবে খুঁজে দেখ তো।

হেমা বাবার রুমে খুঁজল। কিন্তু পেল না। সে মার সামনে বসেই বাবাকে ফোন দিলো। আসলাম সাহেবের ফোন খোলা। প্রথমবার রিং হতেই তিনি ফোন ধরলেন। হেমা বলল, বাবা কেমন আছ?

আসলাম সাহেব বললেন, হ্যাঁ, ভালো। তবে অফিসে খুব চাপ যাচ্ছে।

হেমা বলল, তুমি কি আলাদা বাসা ভাড়া নিয়েছ, নাকি কারো বাসায় থাকছ?

আসলাম সাহেব বললেন, তোর মলি ফুপুর বাসায়।

আসলাম সাহেবের আপন কোনো ভাই-বোন নেই। মলি তার খালাত বোন। হেমা বলল, তোমাকে একটা প্রয়োজনে ফোন করেছি। মার শীতের কাপড়গুলো কই? চাদরটা খুব লাগত। তোমার আলমারি আর ওয়ার্লোবেও খুঁজলাম। কোথাও নেই। আর শীত পড়ে যাচ্ছে তো। কম্বলগুলোও তো লাগবে।

আসলাম সাহেব বললেন, ওহ্। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। গতবছর শীত শেষ হবার পর সেই যে লন্ড্রিতে দেয়া হয়েছিল, আর তো নেয়া হয়নি রে।

হেমা বলল, এতদিনেও আনা হয়নি? ওকে, নো প্রবলেম। আমি আনিয়ে নেবো। তুমি কাজ করো। পরে কথা হবে।

আসলাম সাহেব বললেন, আচ্ছা।

রেণু একটা ভারি দেখে ওড়না পড়ে ছাদে এলেন। ছাদে একটা মৃদু হাওয়া। সেই হাওয়ায় যেন ঠান্ডাটা খানিক বেশিই লাগছে রেণুর। হেমা বলল, তোমাদের ডিভোর্সের পর আমি কার সাথে থাকব মা?

রেণু বললেন, তোর যার সাথে থাকতে ভালো লাগবে।

হেমা হেসে বলল, আমার তো দুজনের সাথেই থাকতে ভালো লাগে।

রেণু কথা বললেন না। হেমা আবার বলল, আচ্ছা, ধরো এমন হলো, তোমার বাসায় আমার একটা ঘর থাকল, আর বাবার বাসায়ও আমার একটা ঘর থাকল। আমি যখন যেখানে ইচ্ছে এসে থাকলাম।

রেণু এবারও কোনো জবাব দিলো না। হেমা মার গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়ে বলল, আমার রুমটা ছেড়ে কোথাও যেতে আমার একটুও ইচ্ছে করে না মা। ওই বারান্দা আর সজনে গাছটা রেখে।

রেণু এবার কথা বললেন। তিনি বললেন, সব মেয়েকেই যেতে হয়। বিয়ে হয়ে গেলে তো চলে যেতেই হবে!

হেমা বলল, কেন? যেতে হবে কেন? ধরো তোমাদের তো আর কোনো ছেলেপুলে নেই। আমার যার সাথে বিয়ে হবে, তাকে না হয় ছেলে বানিয়ে বাসায়ই রেখে দিলে। আর আজকালকার যুগে ঘরজামাই পাবার সৌভাগ্য কজনেরই হয় বলল।

রেণু চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছেন দূরে। হেমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এই দেখো, আবার তোমাদের কথা বলছি। তোমরাই তো আর নেই। তোমরা না থাকলে, তোমাদের ঘর থাকল কই? আর ঘরজামাইর জন্যও তো ঘর লাগে। তাই না?

এই মুহূর্তে হেমার ফোন বাজল। আসলাম সাহেব ফোন করেছেন। হেমা ফোন ধরে বলল, হ্যাঁ বাবা, বলল।

আসলাম সাহেব বললেন, আমি লন্ড্রিতে ফোন করে দিয়েছি। ওরা আজ রাতেই কাপড়গুলো বাসায় দিয়ে আসবে।

হেমা বলল, আচ্ছা।

আসলাম সাহেব খানিক কি ভেবে মৃদু গলায় বললেন, তখন বললি, তোর মা’র চাদর লাগবে। হঠাৎ চাদর কেন? এখনও তো তেমন ঠান্ডা পড়েনি? জ্বর টর নয় তো?

হেমা বলল, না বাবা। তেমন কিছু না। সামান্য ঠান্ডা লেগেছে বোধহয়।

তারপর বাপ-মেয়েতে আরও কী কথাবার্তা হলো, রেণু তার পুরোটা শুনলেন না। তবে একটা ব্যাপার খেয়াল করে তিনি অবাক হয়েছেন। হেমা তার। বাবার সাথে কি নিয়ে কথা বলছে, তা শোনা বা বোঝার জন্য তিনি উৎকর্ণ হয়েছিলেন। বিষয়টা তার জন্য অবাক করার মতোই বটে!

বাবার সাথে কথা বলার পর মা-মেয়েতে আরো কিছুক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে রইল। রাতে খাবার টেবিলে বহুকাল পরে দুজন একসাথে খেতে বসেছেন। রেণু আর হেমা। রেণু হঠাৎ বললেন, আমি যত শিঘ্রী বাসাটা ছেড়ে দিতে চাই।

হেমা বলল, কেন মা? বাবা কি ছেড়ে দিতে বলেছে?

রেণু বললেন, কারো ছেড়ে দিতে বলার অপেক্ষায় তো আমি থাকব না।

হেমা বলল, কিন্তু আমি শুনেছি এই ডিভোর্স-টিভভার্সে প্রচুর আইনি ঝামেলা আছে। দেনা-পাওনার ব্যাপার আছে। টাকা-পয়সার বিষয়ও আছে। তুমি দেখো বড়লোক হয়ে যাবে।

হেমার মুখে মৃদু হাসি। হাসিতে দুষ্টুমি। কিন্তু রেণু যেন খানিকটা কঠিন হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, আমি কিছু চাই না।

হেমা বলল, কেন মা? দিস ইজ ইওর রাইট?

রেণু বললেন, কিসের রাইট?

হেমা বলল, রাইটস বাই ল। এটা তোমার আইনি অধিকার। সম্পর্কের অধিকার।

রেণু বললেন, আমার তো মনে হয় না আইন সকল ধরনের অধিকার দেয়ার ক্ষমতা রাখে!

এইটুকু বলেই রেণু থেমে গেলেন। হেমাও চুপ করে গেল। এই কথাটার ওজন সে বোঝে। বোঝে অর্থও। আসলেই তো, আইন কি কখনো মানুষের মনের ওপর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে? পারে না। এই এত এত বছরের বিয়ের সম্পর্কটা তো সেই আইনের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত। পারলে এতদিনে সেই আইনের বিয়েটাই তো পরস্পরের মনের ওপর পরস্পরের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে পারত। কিন্তু কই? পারেনি তো! দুজনের শরীর নিঃসৃত সম্পর্ক থেকে একটা রক্ত মাংসের সন্তান অবধি রয়েছে! কিন্তু তারপরও তো কারো মনের উপর এতটুকু অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি!

পরদিন মায়ের সাথে বাসা দেখতে বের হলো হেমা। তারা ঝিগাতলা, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডিতে বাসা খুঁজে বেড়ালো। এবং কয়েকটা বাসা পেয়েও গেল। সম্ভবত হেমা বিশেষ কোনো কায়দায় কথা বলার কারণেই বাড়িওয়ালারা খুব একটা ঝামেলা করল না। কিন্তু রেণু যেন বাসাগুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। পরে জানাবেন বলে বাসায় ফিরে এলেন তারা। রেণু কলেজ থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছেন। ফলে তার হাতে বেশ সময় আছে! শরীরটা একটু কেমন লাগছে বলে সন্ধ্যার পরপরই শুয়ে পড়েছিলেন তিনি। এই মুহূর্তে তার ফোন বাজল। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নম্বরটা দেখেই কেমন একটা অনুভূতি হলো রেণুর! বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এই প্রথম ফোন দিয়েছেন আসলাম সাহেব।

রেণু ধরবে না ধরবে না করেও ফোনটা ধরলেন। আসলাম সাহেব বললেন, তোমার শরীর এখন কেমন?

রেণু বললেন, আমার শরীর তো খারাপ ছিল না।

আসলাম সাহেব বললেন, হেমা যে কাল বলল, ঠান্ডা লেগেছে!

রেণু বললেন, আপনি যেটা বলার জন্য ফোন দিয়েছেন, বলুন।

আসলাম সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, তুমি নাকি বাসা খুঁজছ?

রেণু বললেন, হু।

আসলাম সাহেব বললেন, কেন?

রেণু বললেন, বাসাটা আপনার। তাছাড়া আমি যত তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারব, আপনি তত তাড়াতাড়ি আপনার বাসায় ফিরে আসতে পারবেন।

আসলাম সাহেব বললেন, বাসাটা যাতে তোমার থাকে, সেই ব্যবস্থা আমি করছি।

রেণু বললেন, আপনাকে কোনো ব্যবস্থা করতে হবে না। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসা ছেড়ে দিচ্ছি। আরেকটা কথা, আপনি কি কোনো লিগ্যাল প্রসিডিওর শুরু করেছেন? আমি এখনও কোনো নোটিশ পাইনি। আমার কিছু করার থাকলে জানাবেন। আই উইল ডু ইট।

আসলাম সাহেব বললেন, তুমি এত তাড়াহুড়া কেন করছ?

রেণু বললেন, চারপাশে মানুষ নানান কথা বলছে। এটা সেটা ছড়াচ্ছে। নানান নোংরামি। এটা এভাবে ঝুলে থাকলে সেগুলো আরো বাড়তেই থাকবে। নোংরামি সব সময় গন্ধ ছড়ায়। আমি চাই না এগুলো আরো ছড়াক। যতদ্রুত সম্ভব বিষয়টা ক্লোজ করা উচিত।

আসলাম সাহেব কথা বললেন না। রেণুও খানিক চুপ করে থেকে বললেন, আমি একটা কলেজে পড়াই। প্রচুর মানুষের সাথে আমাকে মিশতে হয়। একটা মেয়ের জন্য বিষয়টা কতটা বাজে সেটা পুরুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব না।

আসলাম সাহেব ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আচ্ছা।

রেণু বললেন, এভাবে আচ্ছা বলে থমকে থাকবেন না। যেটা করতেই হবে, সেটা যত দ্রুত করা যায়, তত ভালো।

আসলাম সাহেবকে আর কিছু বলতে না দিয়েই ফোনটা কেটে দিলো রেণু। তারপর অন্ধকার ঘরে চুপচাপ বসে রইল একা। তিনি জানেন না কেন, আসলাম সাহেবের প্রতি প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল তার। কিন্তু এই রাগের কারণটা রেণু জানেন না। আসলাম সাহেব তো নতুন করে কিছু করেননি। বা করলেও তার সাথে কখনোই রাগের সম্পর্ক রেণুর ছিল না। এই রাগ মানেই তো অধিকার। অনুভূতির অধিকার। সেই অনুভূতিটাই তো কখনো ছিল না।

রেণু বাসা ছেড়ে দিলেন পরের মাসেই। দু’রুমের ছোট্ট ছিমছাম ফ্ল্যাট। আগের বাসার কাজের বুয়াটাও চলে এসেছে। সাথে এসেছে হেমাও। আপাতত সে কিছুদিন মায়ের সাথেই থাকবে। খবর শুনে আসলাম সাহেব কিছু বলেননি। দীর্ঘক্ষণ চুপ করে ছিলেন। হেমা জিজ্ঞেস করেছিল, বাবা, এখন কি করবে?

আসলাম সাহেব বলেছিলেন, কিছু একটা তো করতেই হবে।

হেমা বলেছিল, তুমি কি প্রসিডিওর শুরু করেছ?

আসলাম সাহেব বললেন, প্রসিডিওরের তো কিছু নেই। সিম্পল ব্যাপার। কিন্তু আমি জানি না কেন, আমি যেন কিসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম!

হেমা বলেছিল, তুমিই তো চট করে বাসা থেকে চলে গিয়েছিলে!

আসলাম সাহেব বলেছিলেন, তা ঠিক। আমিই চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু কে জানে, সেই যাওয়ার পেছনেও অন্য কোনো ভাবনা কাজ করেছিল কিনা!”

হেমা বলেছিল, বাবা! তুমি অন্য একজনকে ভালোবাসো। তার সাথে কমিটেড! কি বলছ এইসব?

আসলাম সাহেব বলেছিলেন, মানুষ নিজেকেই সবচেয়ে কম চেনে। একটা জীবনের প্রায় পুরোটই সে খরচ করে ফেলে, অন্যকে চিনতে চিনতেই। এই জন্যই বোধহয় শেষ পর্যন্ত সে নিজের কাছেই নিজে রয়ে যায় সবচেয়ে বেশি অচেনা।

হেমা আর কথা বলেনি। কথা বলেননি আসলাম সাহেবও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *