৪. কিছু সময়

মানুষের জীবনে কিছু সময় আসে, এই সময় সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে হয়। নয়নেরও সেই ইচ্ছেটা হচ্ছে। সে রাতের পর রাত ঘুমাতে পারে না। ঘুমালেও অর্থহীন, এলোমেলো, বীভৎস সব স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায়। তারপর বাকি রাত কাটে নিঘুম। এই সময় জুড়ে কত কত ভাবনা যে সে ভাবে! আসমার মৃত মুখটাও অনবরত ভাসতে থাকে চোখের সামনে। তার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, ঠা ঠা রোদের দুপুরে সে ক্লাস থেকে ফিরেছে। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে চৌচির। আসমা জানে, এ সময়টা কনকনে ঠান্ডা এক গ্লাস লেবুর শরবত চাই নয়নের নয়ন ঘরে ঢোকামাত্রই রোজ সে শরবতের গ্লাস নিয়ে দরজায় হাজির হয়। কিন্তু সেদিন বারকয়েক ডেকেও কোনো সাড়া পেল না। নয়ন। খানিক বাদে কোহিনূর এলেন। নয়ন বলল, আসমা কই মা?

কোহিনূর নয়নের হাতে শরবতের গ্লাস দিতে দিতে বললেন, ওর মা খুব অসুস্থ। বাড়ি থেকে ওর বাবা এসেছিল ওকে নিয়ে যেতে। কিছুক্ষ আগে বেরিয়ে গেছে।

নয়ন বলল, ও।

ব্যস এইটুকুই। কিন্তু দিন দুই যেতে না যেতেই নয়নের মনে হতে লাগল, বাড়িটা খুব বেশি ফাঁকা। আসমা এ বাড়িতে এসেছে কম দিন হয়নি। চার-পাঁচ বছর তো হবেই! তারপর থেকেই নয়নের সাথে একটা ভাই-বোন ভাব হয়ে গেল তার। একা বলে নয়নও যেন বাড়িতে একটা বোন বা ওরকম কারো অভাব অনুভব করত। তাছাড়া নয়নের নানান এক্সপেরিমেন্ট, ফুট-ফরমায়েশ খাটা, রাগ-বকাঝকা শোনা কিংবা গল্প বলারও একটা মানুষ হয়ে উঠেছিল আসমা। বাড়িতে ঢুকতেই নয়ন সবার আগে চেঁচিয়ে আসমাকে ডাকত। আসমা নয়নের ব্যাগ নিয়ে রেখে দিত জায়গা মতো। নয়নের নেলকাটার থেকে শুরু করে জুতো, মানিব্যাগ, ঘড়ি, খাতা, কলম এমনকি খুচরো কয়েন- সকল কিছুই ছিল আসমার নখদর্পণে। একটা বিশাল নির্ভরশীলতাও তৈরি হয়ে গিয়েছিল অগোচরে।

তারপরের কয়েকদিন কেটেছে প্রবল বিরক্তিতে। নয়ন জুতো পায় তো মোজা পায় না, মানিব্যাগ পায় তো টাকা পায় না। অতিষ্ঠ হয়েই সে মাকে বলল, আসমা আসছে না কেন?

কোহিনূর জবাব দিতে পারলেন না। আসলে আসমার কোনো খবর তার। কাছে নেইও। এই সময়টায় নয়ন রোজ বাড়ি ফিরেই হয় ছাদের চিলেকোঠায় চলে যেত। না হয় ঘরে ঢুকে দরজা জানালা বন্ধ করে দিত। এর কয়েক মাস আগে থেকেই সে কোহিনূরের আত্মকথা লেখা খাতাগুলো পেয়েছিল। আগে যতটুকুই পড়েছে, আসমা না থাকায় আসমাকে পড়াতে বসানো, তার সাথে এটা সেটা গল্পগুজব করা, টিভি দেখার সময়গুলোও বেঁচে যেতে থাকল। এই সময়ে। নয়ন পুরোপুরি ডুবে গেল সেই খাতাগুলোতে। দিনের পর দিন কত কষ্ট করে যে সে একেকটা লাইন পড়ে তার অর্থোদ্ধার করেছে, তা কেবল সে-ই জানে।

আসমা ফিরল প্রায় তিন মাস পর। তাকে দেখে সকলেই হতভম্ব হয়ে গেল। বাড়ি যাওয়ার সময় যে রক্তমাংসের মানুষটা গিয়েছিল, সেই মানুষটাই যেন ফিরে এলো আস্ত একটি কঙ্কাল হয়ে।

.

আসমাকে দেখেই স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে নয়ন বলেছিল, ভালোই হলো, এবার আর আমার কঙ্কাল কিনতে হবে না। কঙ্কালের কাজটা তোকে দিয়েই চালিয়ে দেয়া যাবে।

আসমা অবশ্য কোনো জবাব দিলো না। শুধু এই কথায় না, সে মোটামুটি কোনো কথায়ই, কারো সাথেই একদম প্রয়োজন না হলে কোনো কথা বলে না। বিষয়টা নয়নকে খুব অবাক করেছিল। সে নানাভাবে আসমাকে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টাও করেছিলে। অসংখ্যবার জিজ্ঞেসও করেছিল কি হয়েছে তার, কিন্তু একটি কথাও মুখ থেকে বের করেনি আসমা। এমনকি তাকে যে সাপে কেটেছিল সে কথাও কাউকে নিজ মুখে বলেনি সে। আসমাকে দিয়ে যেতে। এসেছিল তার বাবা, সে-ই যা বলার বলে গিয়েছিল ফখরুল আলমের কাছে। আসমাকে সাপে কাটার ঘটনা তাই বাবার কাছেই শুনেছিল নয়ন। কিন্তু সাপে কাঁটার কথা শুনে সবার আগে নয়নের যার কথা মনে হলো, সে হলো আব্দুল ফকির। আসমার কাছে তার বহু গল্প নয়ন শুনেছে। সে আসমাকে দুম করে বলে বসল, কী রে, তোর বিষ কে নামাল? সেই যে মুর্দা লাশ যে জিন্দা করে, সেই আব্দুল ফকির?

আসমা তাও কোনো কথা বলল না। তবে তার মুখ যেন তীব্র আতঙ্কে নীল হয়ে গেল। সেদিন রাতে আসমাকে নিয়ে বসল নয়ন। দীর্ঘ সময় ধরে আসমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করল সে। কিন্তু আসমা তাতে খুব একটা সাড়া দিলো না। যাও কিছু কথাবার্তা হলো, তাও কেমন অসংলগ্ন মনে হলো নয়নের কাছে। নয়ন একবার ভাবল, মার কাছে বিষয়টা খুলে বলে! কিন্তু পরে আর বলল না। তার মা কোহিনূর এমনিতেই কোনো কিছু নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখান না। সারাক্ষণ একা একটা ঘরে কাটিয়ে দেন। খুব প্রয়োজন না হলে সেই ঘরে কাউকে ঢুকতে দেন না। কারো সাথে কথা বলেন না। সুতরাং তাকে এসবে যুক্ত করা অর্থহীন।

এর পরের কয়েকটা দিন আসমাকে খুব চোখে চোখে রাখল নয়ন। সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করল প্রায়ই একা একা কাঁদে আসমা। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করতেই এড়িয়ে যায়। কী হয়েছে তার? কী হয়েছে তার, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নয়নের ডাক্তারী চোখ যেন কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেলল। কিন্তু সেই আবিষ্কার বিশ্বাস করার মতো সাহস নয়নের ছিল না। এদিকে মেডিকেলে তার ফাইনাল প্রফ শুরু হয়ে গেছে। এই সময়টা মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জগৎ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সময়। নয়নও বিচ্ছিন্ন। হয়ে গিয়েছিল। আসমার কথাও প্রায় ভুলে যেতে বসেছিল। কিন্তু শেষ দুটো পরীক্ষার আগের এক গভীর রাতে অনেকক্ষণ ধরে কারো বমির করার শব্দ পেয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রান্নাঘরের পাশেই আসমার ঘর। তার বাথরুমটা অনেকটাই দূরে। রান্নাঘরের বেসিনটা সে তুলনায় কাছে। আসমার শরীরটা সম্ভবত এ কদিনে বেশ খারাপ করেছে। নয়ন উঁকি দিয়ে দেখল দেয়ালে হেলান দিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে বমি করার চেষ্টা করছে আসমা। খুব অস্বাভাবিক কোনো দৃশ্য নয়। কিন্তু নয়নের মনটা কেমন খচখচ করতে লাগল। পরের পরীক্ষাটা দিয়েই সে আসমাকে নিয়ে আবার বসল। কথার মাঝখানে আসমা হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, আমারে বাঁচান ভাইজান। আমারে বাঁচান।

নয়ন আসমার মাথায় হাত রেখে বলল, আমাকে খুলে বল কি হয়েছে!

আসমা বলল। তার সাপে কাটা থেকে আব্দুল ফকিরের বিষ নামানোসহ পুরো ঘটনাই সে খুলে বলল। কিন্তু এখন সে কি করবে? ঘটনা শুনে নয়ন হতভম্ব হয়ে গেল। এত অবাক সে বোধকরি আর কখনো হয়নি। গ্রাম-গঞ্জের ওঝা ফকিরদের এমন নানা ঘটনার কথা সে বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় পড়েছেও। কিন্তু সে সকল কথা ওই পত্রিকা অবধিই, এর বাইরে কখনো চিন্তা করতে পারেনি নয়ন। তার সামনে বসে থাকা আসমা যেন সেই পত্রিকা থেকে বের হয়ে আসা একটা চরিত্র! আসমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ সময় কথা বলতে পারেনি নয়ন। তারপর বলেছিল পরীক্ষাটা শেষ হলেই তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে। আর একটামাত্র পরীক্ষাই বাকি। কিন্তু সেই সুযোগটা তাকে আর দিলো না। নিজেই নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলল আসমা।

আসমার সেই মুখটা নয়ন তাড়াতে পারছে না তার সামনে থেকে। একটা অবর্ণনীয় কষ্ট। নয়নের মনে হচ্ছিল, আব্দুল ফকিরকে পেলে সে খুন করে ফেলবে! কিন্তু সেটি সম্ভব নয়। আসলে তার পক্ষে সম্ভব নয় কিছুই। সে বহুকাল ফতেহপুর যায় না। সেখানে কিছু চেনে না, জানে না। আব্দুল ফকিরকেও না। সে শুনেছে খুবই দুর্গম এলাকা। তাছাড়া আব্দুল ফকিরকে মানুষ ভয় পায়, মান্যগণ্য করে। সেখানে গিয়ে কী করবে সে? তার নানাজান তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে কি ঘটনা খুলে বলবে সে? নয়ন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও নিজেকে নিস্তারও দিতে পারছিল না সে। যেন এক ভয়ঙ্কর আগুনের পিন্ডে অবিশ্রান্তভাবে পুড়ে যাচ্ছিল। পরীক্ষা শেষ হতে খানিকটা অবসর। সেই অবসর সময়ে মায়ের খাতাগুলো নিয়ে আবার বসল নয়ন। নিজেকে যেন আসমার ঘটনা থেকে সরিয়ে নিতে চাইছিল সে। ডুবে থাকতে চাইছিল তার মায়ের অদ্ভুত কৈশোরের রহস্যময় গল্পে। কিন্তু সেই গল্পও তাকে এতটুকু বিরাম দিলো না। বরং এক গভীর রাতে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন হয়ে আসমার গল্পখানা আরো প্রকট হয়ে উঠল তার সামনে। সেই দুঃস্বপ্ন থেকে নয়ন যেন কোনোমতেই আর বের হয়ে আসতে পারল না। প্রচণ্ড দিশেহারা, বিভ্রান্ত, অসহায় লাগতে লাগল তার। নয়ন ভেবে পাচ্ছিল না সে কি করবে! একটা দীর্ঘ দিন, দীর্ঘ রাত একাকী এক অন্ধকার ঘরে নিজের সাথে সীমাহীন যুদ্ধ করে নয়নের হঠাৎ মনে হলো সে নিজ চোখে সেই ভয়ঙ্কর মানুষটাকে দেখতে চায়। দেখতে চায় মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আব্দুল ফকির নামের মানুষটার সত্যিকারের মুখ ও মানস।

.

এমবিবিএস শেষ করে যখন অন্য সবাই উচচতর ডিগ্রীর জন্য আটঘাট বেঁধে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করছে, নয়ন তখন একটা অদ্ভুত কাজ করল। সে সকলের সাথে যোগযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে চলে গেল ফতেহপুর নামের এক অজপাড়া গাঁয়ে। তার মোবাইল ফোন বন্ধ, ফেসবুক বন্ধ, যোগাযোগের বিকল্প আর কোনো উপায়ও নেই। ফতেহপুরে দীর্ঘ সময় কাটাল নয়ন। এই সময়টা সে সেখানে কী করেছে, কেন করেছে এই নিয়ে তার নিজের কাছেই যেন স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে একটা বিষয় সম্পর্কে নয়ন নিশ্চিত, তা হলো যে ভয়াবহ মানসিক দশার ভেতর দিয়ে সে যাচ্ছে, তাতে এই সময়টা ঢাকায় থাকার চেয়ে ফতেহপুর থাকাটা তার জন্য অনেক বেশি ভালো ছিল।

আব্দুল ফকির নামের মানুষটার প্রতি অবিশ্বাস্য ক্রোধ আর ঘৃণা নিয়েই নয়ন ফতেহপুর গিয়েছিল। কিন্তু সে জানত না, এই ঘৃণা বা ক্রোধে সে আব্দুল ফকিরকে কতটুকু আঘাত করতে পারবে, কতটুকু আহত করতে পারবে! নাকি মানুষটাকে কেবল দেখতেই চেয়েছিল সে? নয়ন জানে না। তবে আব্দুল ফকিরের সাথে তার দেখা এবং কথোপকথন তার প্রতি নয়নের ঘৃণাকে আরো বহুগুণ বাড়িয়েই দিয়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এই ঘৃণার সাথে সাথে আব্দুল ফকিরের উপর একটা ভয়মিশ্রিত সমীহও তৈরি হয়েছে নয়নের।

.

একটা প্রবল দ্বিধা নিয়েই আবার হঠাৎ করেই ঢাকায় ফিরে এসেছে নয়ন। আগামী দিনগুলোতে কি করবে, এই নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না সে। সে কি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিবে? নাকি এই মুহূর্তে এই সকল হিসেব নিকেশ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবে? আজ ভোরে সেই সিদ্ধান্তহীনতা থেকে নিজেকে মুক্তি দিলো নয়ন। আপাতত পড়াশোনা সংক্রান্ত বিষয়টা নিয়ে আর ভাববে না সে। তার মস্তিষ্ক জুড়ে একটা বিশাল শূন্যতা। এই মুহূর্তে এই মস্তিস্ক কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতে পারছে না।

তার সিদ্ধান্ত নিয়ে অবশ্য মা তাকে কিছু বলেননি। বাবা ভোরে ফজরের নামাজ শেষ করে তার ঘরে গেলেন। গিয়ে দেখেন নয়ন মশারীর ভেতর বসে আছে। ফখরুল আলম কিছুটা অবাক হলেও কিছু বললেন না। তিনি খুব যত্ন করে নয়নের মশারি সরিয়ে খাটে বসলেন। তারপর মোলায়েম গলায় বললেন, এখনো জেগে আছিস?

নয়ন বলল, হু।

ফখরুল আলম বললেন, শরীর খারাপ?

নয়ন বলল, না।

ফখরুল আলম বললেন, তাহলে?

নয়ন বলল, কিছু না।

ফখরুল আলম ছেলের পিঠে আলতো করে হাত রাখলেন। তারপর বললেন, কি হয়েছে বাবা?

নয়ন হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, মেয়ে মানুষের মতো এত প্রশ্ন করছ কেন? এত প্রশ্ন করছ কেন? যাও। এক্ষুণি আমার ঘর থেকে বের হও।

ফখরুল আলম অত্যন্ত অবাক হলেন। কিন্তু জায়গা থেকে উঠলেন না। নয়ন আবার চোখ বুজে ছাদের দিকে মুখ উঁচু করে মশারীর মধ্যে বসে রইল। তার চোখজোড়া টকটকে লাল। মাথার চুল উস্কোখুস্কো। ফখরুল আলম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, চা বানিয়ে আনি? একটু চা খেলে ভালো লাগবে।

নয়ন এবার আর কথা বলল না। সে যেমন বসে ছিল তেমন করেই বসে রইল। ফখরুল আলম ধীরে ধীরে ছেলের খাট থেকে নামলেন। তারপর দীর্ঘ সময় নয়নের মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি নয়নের আচরণে কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছেন। এর আগে তো নয়ন কখনোই তার সাথে এমন আচরণ করেনি! অবশ্য এতে তিনি যে মন খারাপ করেছেন, এমন না। নয়নের প্রতি তার কোনো অভিযোগও নেই। নিশ্চয়ই কোনো বিষয় নিয়ে ছেলেটা চিন্তিত। তাছাড়া সারারাত জেগে থাকলে মেজাজ একটু-আধটু খিঁচড়েই থাকে।

ফখরুল আলম রান্না ঘরে গিয়ে ছেলের জন্য যত্ন করে চা বানালেন। বাজারে নতুন এক ধরনের নোনতা টোস্ট বিস্কুট এসেছে। এই বিস্কুটটা চায়ে ভিজিয়ে খেতে ভারি সুস্বাদু। তিনি চা বানানো শেষে সেই বিস্কুটের ক’খানা একটা পিরিচে সাজিয়ে নয়নের জন্য নিয়ে এলেন। নয়নের খাটের সাথেই টেবিল। তিনি টেবিলের কোণায় চায়ের কাপ আর পিরিচখানা রাখলেন। তারপর মশারিটা তুলেলেন। জানালার পর্দাগুলোও সরিয়ে দিলেন। বাইরের আলো মুহর্তেই ঘরটাকে আলোকিত করে তুলল। ফখরুল আলম নয়নের পাশে এসে বসে আলতো করে নয়নের কাঁধে হাত রেখে বললেন, একটু চা খেয়ে নে। আর নতুন বিস্কুটটা দেখ, বেশ ভালো বানিয়েছে ওরা।

নয়ন কোনো কথা বলল না। স্থির বসে রইল যেমন ছিল। ফখরুল আলম এবার টেবিল থেকে চায়ের কাপ আর পিরিচখানা নিয়ে নয়নের সামনে রাখলেন। তারপর বললেন, একটা চুমুক দিয়ে দেখ…

তিনি তার কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই নয়ন চায়ের কাপ আর বিস্কুট সমেত পিরিচখানা ছুঁড়ে মারল মেঝেতে। ভোরের নিস্তব্ধতায় কাপ আর পিরিচ ভাঙার শব্দটা বড় বেশি কানে বাজল। নয়ন তার চেয়েও জোরে চিৎকার করে বলল, তোমাকে বলেছি না, আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। এক্ষুণি যাও। এক্ষুণি। বের হও।

ফখরুল আলম এবার যেন ভয় পেয়ে গেলেন। তবে সেই ভয়ের ভেতরেও একটা বিস্ময়! হঠাৎ কি হলো ছেলেটার? সে জানে, হেমা নামে একটা মেয়ের সাথে নয়নের সম্পর্ক রয়েছে। তা হেমার সাথে কোনো ঝামেলা হলো না তো! খুব মায়া হতে লাগল তার নয়নের জন্য। কিন্তু কি আর করা?

ফখরুল আলম আবারো ধীর পায়ে উঠলেন। তারপর মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপ-পিরিচের ভাঙা টুকরোগুলোকে একটা একটা করে কুড়িয়ে জড় করলেন। তারপর সেগুলোকে রান্নাঘরে রেখে এসে ঘরের মেঝেটা যত্ন করে বাড় দিয়ে পরিষ্কার করলেন। ঝাড় দেয়া শেষে আবার নিজের হাতের তালু ঘষে পরখ করে দেখলেন, কোনো সূক্ষ্ম ভাঙা টুকরোও মেঝেতে রয়ে গেছে। কিনা!

নয়ন যেমন ছিল তেমনই বসে রইল। সে ঘর থেকে বের হলো দুপুরেরও পর। ফখরুল আলম আজ অফিসে যাননি। তার রান্নার হাত ভালো। তিনি আজ রান্না করেছেন। রান্না শেষে সারাটাক্ষণ বসে ছিলেন নয়নের ঘরের বাইরে দরজার সামনে। ছেলেটা এখন অবধিও কিছু খায়নি! নয়ন খায়নি বলে তিনিও খাননি। তার অম্বলের সমস্যা আছে। বারকয়েক পেট গুলিয়ে টক পানি উঠে এসেছিল গলা অবধি। তাও তিনি খাননি। একবার ভেবেছিলেন কোহিনূরের ঘরে গিয়ে কোহিনূরকে ডেকে আনবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহসে কুলাতে পারেননি। কোহিনূরকেও তিনি যথেষ্টই ভয় পান। নয়ন দরজা খুলতেই নয়নের চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন জড়োসড়ো হয়ে গেলেন তিনি। নয়নের চোখ টকটকে লাল। নয়নের প্রিয় কয়েক পদ রান্না করেছিলেন। ভেবেছিলেন, নয়নকে খাবার কথা বলবেন। কিন্তু নয়নের এই চেহারা দেখে খাওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো কিছু বলতে আর সাহস হলো না তার। নয়ন বাবাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। ফখরুল আলম বললেন, একটা কথা বলি বাবা?

নয়ন শান্ত এবং কঠিন গলায় বলল, না।

ফখরুল আলম বললেন, কিছু খেতে বলব না বাবা। অন্য একটা কথা?

নয়ন ঠিক একই গলায় বলল, না।

ফখরুল আলম কাতর গলায় বললেন, তোর কষ্ট হলে আমার অস্থির লাগে। আমি খেতে পারি না যে বাবা। আমাকে একটু বলবি, তোর কি হয়েছে?

নয়ন এবার আগের চেয়েও কঠিন গলায় বলল, না।

ফখরুল আলম ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলেন। নয়নের চোখের ভাষা, ভয়ঙ্কর। তিনি ভীত সন্ত্রস্ত হরিণ শাবকের মতো গুটিয়ে গিয়ে বললেন, ঠিক আছে বাবা।

ফখরুল আলম জড়োসড়ো ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে বড় কোনো অপরাধ করে ধরা খাওয়া অসহায় মানুষের মতো। নয়ন খানিক বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ ধপ করে ফখরুল আলমের পায়ের কাছে বসে পড়ল সে। তারপর দু’হাতে ফখরুল আলমের দুই পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ফখরুল আলম কিছুই বুঝলেন না। তিন দাঁড়িয়ে রইলেন হতভম্বের মতো।

নয়ন বাবার পা জড়িয়ে ধরে একটা ছোট্ট শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, আমাকে মাফ করে দাও বাবা, আমাকে মাফ করে দাও। ও বাবা। বাবা। আমাকে মাফ করে দাও। ও বাবা। ও বাবা। বাবা, আমাকে মাফ করে দাও।

ফখরুল আলম কিছুই বুঝতে পারছেন না। নয়ন একসাথে তার দুই-পা জড়িয়ে ধরে আছে বলে তার দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন না নয়ন কাঁদছে কেন? এই মুহূর্তে তার কি করা উচিত। তিনি নয়নকে কি বলবেন এখন? আচ্ছা, নয়ন তার কাছে মাফ চাইছে কেন? তিনি কি জিজ্ঞেস করে দেখবেন?

ফখরুল আলম নয়নকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন তার গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কী অদ্ভুত! ফখরুল আলমের চোখ বেয়ে গলগল করে পানি বের হচ্ছে। কী বিপদ! তিনি নিজে কাঁদছেন কেন? তার আবার কান্নার কি হলো? তিনি এদিক-সেদিক তাকিয়ে চোখ মোছার কিছু খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু পেলেন না। এই কান্না কেউ দেখে ফেলে ভারি লজ্জার ব্যাপার হয়ে যাবে। কী করবেন তিনি এখন? তিনি হন্যে হয়ে এদিক-সেদিক কিছু খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু কিছুই পেলেন না। তার চোখ আটকে গেল বাঁ পাশের বারান্দার শেষ মাথার ঘরের দরজায়। সেখানে দাঁড়িয়ে পিতা-পুত্রের এই দৃশ্য দেখছেন কোহিনূর। কিন্তু তার চোখের ভাষা ফখরুল ইসলাম আজও পড়তে পারলেন না। এই জীবনের কোনোদিন পড়তে পারেনওনি। সেই সুযোগটিই তো কোহিনূর তাকে কখনো দেননি। কী এক অলঙ্ঘনীয় অদৃশ্য দেয়াল তুলে রেখেছেন মাঝখানে।

*

তাবারনের ঘা শুকিয়েছে। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও পরিচর‍্যা না হওয়ায় তার বুকে স্থায়ী ক্ষত রয়ে গেছে। পারুল দেখেছে, তাবারনের দুই স্তনের বেশিরভাগ জায়গাতেই বীভৎস পোড়া দাগ। তবে তাবারন আজকাল আবার কাজকর্ম শুরু করেছে। ফলে পারুলের এখন আবার অনেকটাই অবসর সময়। এই সময়টা তার কাটে নয়নকে ভেবে। তবে পারুল। একটা বিষয় খেয়াল করেছে, সে আসলে একটা ছটফটানি চড়ুই পাখি। কোনো কিছু নিয়েই খুব বেশিদিন একনাগাড়ে ভাবতে পারে না সে। পারুলের ধারণা সে আসলে জানে না, কোনো জিনিসে তার আগ্রহ? সেই আগ্রহের পরিমাণ। কতটুকু? আর তার ভালো লাগা-মন্দ লাগা হঠাৎ হঠাৎ খুব ওঠানামা করে। তবে। এটা সত্যি যে, নয়নকে ভাবতে তার ভালো লাগে। যদিও এমন আগেও অনেকবার হয়েছে তার। দুম করে কাউকে ভালো লেগে গেলে সেই ভালো লাগার মানুষটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই তার দিনমান কেটে যায়।

ভাদ্র মাস শেষ হয়ে আশ্বিনেরও পনের দিন চলে গেছে। এখন শরৎকাল। বৃষ্টি বাদলা তেমন একটা নেই। তবে গ্রামের চারপাশ জুড়ে প্রকৃতিতে কেমন একটা ঝকমকে ভাব। বিশেষ করে নদীর দু’ধার জুড়ে শুভ্ৰফুলে হেঁয়ে যাওয়া কাশবন দেখলেই বুকের ভেতরটা কেমন তড়পায়। এমনই এক শরতের বিকেলে লতা এলো। তার প্রচণ্ড মন খারাপ। দু’দিন ধরে আশিকের ফোন বন্ধ। তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। পারুল বলল, আশিক ভাইর কোনো বন্ধুর নাম্বারে ফোন দে।

লতা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমার কাছে তো আর কারো নাম্বার নাই।

পারুল বলল, তার ঠিকানায় চিঠি লেখ?

লতা এবার কেঁদেই দিলো। সে বলল, আমার কাছে তো কোনো ঠিকানাই নাই।

পারুল আঁতকে ওঠা গলায় বলল, কি বলস?

লতা পারুলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বুক ভাসাল। পারুলের মনে তখন অন্য চিন্তা। সে হঠাৎ লতার চুল ধরে টেনে কাঁধ থেকে তার মুখখানা তুলল। তারপর এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, ওই ছ্যামড়ি, সবকিছু ঠিকঠাক তো?

লতা ভেজা গলায় বলল, কি ঠিকঠাক?

পারুল বলল, কত জায়গায় দুইজনে গেছ, লঞ্চের কেবিনেও আছিলা। কিছুই কি হয় নাই তোমাগো মধ্যে?

লতা মাথা নিচু করে ফেলে বলল, এগুলান জিগাস কেন?

পারুল বলল, কেন জিগাই বুঝস না?

লতা এবার আর জবাব দিলো না। পারুল বলল, শহরের পোলা পোলা কইরা মরি। কিন্তু তাগো তো চিনি-জানি না। এই কথাখান একবারও ভাবি নাই তো! তারা বহুত চালাক। মৌমাছির মতো, মধু খাওয়া শ্যাষ, উড়াল দিয়া যাইব গিয়া। আর খুঁইজাও পাইব না। এমন কিছু হয় নাই তো?

লতা জোর গলায় বলল, আশিক এমন না। তুই তারে চেনস না। আশিকের মতো মানুষ হয় না। ওর কোনো বিপদ হয় নাই তো পারুল?

পারুল আর কিছু বলল না। সেও চায় আশিক ঠিকঠাক ফিরে আসুক। লতার প্রতি তার সূক্ষ্ম একটা ঈর্ষার ব্যাপার রয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সে লতার খারাপ কিছু চায়। তবে লতা প্রায়ই আশিকের সাথে লঞ্চে যেত, এটা সে জানে। আশিক ঢাকা থেকে লঞ্চের কেবিন ভাড়া করে সকালে আসত। সেই কেবিনেই আবার বিকেলে ফিরে যেত। ফলে সে যদি সেই কেবিনে লতাকে নিয়ে গিয়ে দরজা আটকায়, কে কি বলবে! বিষয়টা নিয়ে সে বারকয়েক লতাকে সতর্কও করেছিল। কিন্তু হঠাৎই কলেজের ছাত্রী হয়ে যাওয়া লতা কেন ম্যাট্রিক ফেল পারুলের কথা শুনবে!

লতার মন ভালো করতেই তারা গেল নদীর পাড়ে ঘুরতে। ঘুরতে গিয়ে সত্যি সত্যি তাদের মন ভালো হয়ে গেল। বড় খোলা একখানা নৌকায় জুলফিকার আর আব্দুল ফকিরকে দেখা গেল। পারুলকে দেখেই আব্দুল ফকির জুলফিকারকে নৌকা ভেড়াতে বললেন। নৌকা ভেড়াতে পারুলের বায়না, আব্বা, আমাগো দুইজনরে একটু নৌকায় ঘুরান। আইজ নদীখান মাশাল্লাহ খুব সুন্দর লাগতেছে।

আব্দুল ফকির বললেন, একটা জরুরি কাজ আছিল যে মা?

পারুল বলল, জরুরি কাজ তো আপনের সব সময়ই থাকে। আইজ তার চাইতেও জরুরি কাজ আছে। আমার বান্ধবীর মন খারাপ। আইজ সব কাজ বন্ধ আব্বা। আমাগো উঠাইয়া নৌকা ছাড়েন।

আব্দুল ফকির এক পলক তাকিয়ে লতাকে দেখলেন। মেয়েটার মুখ শুকনা। কিন্তু সেই শুকনা মুখ জুড়েও একটা আলাদা ব্যাপার রয়েছে। ভারি মায়া মায়া চেহারা। নৌকা যেখানে ভিড়েছে, সেখানে সামান্য খাড়া ঢাল। পারুল ছোট্ট লাফে ঢাল পেরিয়ে নৌকায় চলে এলেও লতা পারল না। জুলফিকার নাওয়ের অন্য প্রান্তে বৈঠা ধরে আছে বলে তাকে নৌকায় উঠাতে যেতে হলো আব্দুল ফকিরকেই। আব্দুল ফকির দেখতে টিনটিনে শুকনো মানুষ হলেও তার শরীরে ভালো শক্তি। তিনি তাকে ধরে ঢাল পার করালেন। তারপর খানিকটা তুলে নৌকায় উঠালেন। নদীর দুইধারে শুভ্র কাশফুল। আকাশে নীল সাদা মেঘ। ফুরফুরে হাওয়ায় ভারি আনন্দ লাগছিল পারুলের। সে গুনগুন করে গানও গাইছিল। কিন্তু লতা বসে আছে চুপচাপ। বারদুয়েক তাকে কিছুটা আমোদিত করার চেষ্টা পারুল করেছিল, কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি।

তারা বড় নদী থেকে ঢুকে গেল সরু একখানা খালে। খালে তুমুল স্রোত। বিলের পানি নামার সময় হয়ে গেছে। এই খাল ধরেই পানি নেমে আসছে। সাথে মাছও। ফলে খালের এখানে-সেখানে গ্রামে তৈরি মাছধরার নানান রকমের ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে। এরমধ্যে একটা ফাঁদের নাম রয়েছে গড়া। খালের এপার থেকে ওপার অবধি পানির সামান্য নিচে বেড়ার মতো করে এই বাঁশের তৈরি গড়া পাতা হয়। গড়ার নিচের অংশ যেখানে মাটির সাথে পুঁতে রাখা হয়েছে, সেখানে মাছ চলাচলের সুবিধার্থে ছোট ছোট ছিদ্র করে দেয়া। আর সেই ছিদ্রপথে পেতে রাখা হয় আরেক ফাঁদ, চাই। খালের এপার থেকে ওপার অবধি দেয়া বেড়ার কারণে মাছ পার হতে পারে না বলে তারা বের হওয়ার পথ খুঁজতে খুঁতে চলে আসে একদম নিচের দিকে মাটির কাছাকাছি। সেখানে হঠাৎ ছিদ্রপথ পেয়ে টুপ করে ঢুকে পড়ে মাছ। আর অমনি ধরা পড়ে যায় চাইয়ে।

গড়ার উপরের দিকের যে অংশটা পানির ওপরে উঠে থাকে আড়াআড়ি খালের এপার থেকে ওপার অবধি, সেই অংশের মাঝখানটা নৌকা চলাচলের জন্য কেটে দেয়া হয়েছে। তিনটে গড়া পার হয়ে এসেছে আব্দুল ফকিরের নাও। চতুর্থ গড়াটার পর থেকেই শুরু ফতেহপুরের তৈয়ব উদ্দিন খাঁর উত্তর কান্দির বিশাল চর। সেই চরের গা ঘেঁষে যে গড়াটা রয়েছে, তার কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ থমকে গেল জুলফিকার। থমকে গেল নৌকার আর সকল মানুষও। প্রবল আতঙ্কে যেন শরীরের রক্ত হিম হয়ে এলো। সামনের গড়ার বাঁশের বেড়ায় পানিতে ভেসে আটকে আছে একটা মানুষের লাশ! লাশটা পানি খেয়ে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। তার মুখখানা বীভৎস ভঙ্গিতে হা করে রয়েছে।

লতা হঠাৎ চিৎকার দিয়ে পারুলকে জড়িয়ে ধরল। তার শরীর কাঁপছে। স্থির হয়ে গেছে পারুলও। প্রথমবার আপনাআপনি চোখ পড়ে গিয়েছিল বলে লাশটা দেখতে পেয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার আর চোখ তুলে তাকাল না সে। লতাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল সে। আব্দুল ফকির লাশটা দেখে সামান্য সময় বসে রইলেন। তিনি মানুষটাকে চেনেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর উত্তর কান্দির বিলের ফসল দেখাশোনা করতো মানুষটা। চরের মাঝখানে মাটি কেটে উঁচু ঢিবি করে সেখানে তাকে একখানা বাড়িও করে দিয়েছিলেন খবির খাঁ। কিন্তু শোনা যাচ্ছিল বেশ কিছু দিন ধরে ঠিকঠাক ফসলের হিসেব দিচ্ছিল না সে।

আব্দুল ফকির মুহূর্তেই পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলেন। তারপর হঠাৎ জুলফিকারের দিকে তাকিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি নাও ঘোরা জুলফিকার।

জুলফিকার বলল, লাশের বিষয়ে কি করবেন কাকু?

আব্দুল ফকির মুখে আঙুল চেপে ইশারা করে বললেন, চুপ। একদম চুপ। এই লাশ এইখানে দেখছস, এই কথা কাউরেই বলন যাইব না। বললেই বিপদ। মহা বিপদ। আমার নামে মাডার কেস হইয়া যাইব।

জুলফিকার কিছুই বুঝল না। কিন্তু সে নাও ঘুরিয়ে নিলো। তারা বাড়ি ফিরল মাগরিবের আজানের আগে আগে। লতা তার বাড়িতে বলেই এসেছিল যে সে আজ এই বাড়িতে থাকবে। পারুল আর সে, দুজন ভেতরের ঘরে চুপচাপ বসে রইল। চোখের সামনে এমন করে মৃত মানুষের ভেসে থাকা লাশ তারা আগে কখনো দেখেনি। সেদিন অন্ধকারটা নামল কেমন এক চাপা আতঙ্ক নিয়েই। সেই আতঙ্ক জুড়ে যেন কিসের এক অশনিসঙ্কেতও। এই অশনিসঙ্কেত সবচেয়ে স্পষ্ট যিনি বুঝতে পেরেছেন তিনি হলেন আব্দুল ফকির।

আব্দুল ফকির খানিক সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন বাহির ঘরের দরজার সামনে। তার মাথার ভেতর ঝড়ের গতিতে নানান হিসেব চলছে। এই হিসেবের ফলাফল ভুল হবার কথা না। তিনি বুঝে গিয়েছেন, শেষবারের মতো তিনি তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মুখোমুখি পড়ে গিয়েছেন। এই লাশ এমনি এমনি উত্তকান্দির চরের খালে পড়ে থাকেনি। এই লাশ তৈয়ব উদ্দিন খাঁর তরফ থেকে আব্দুল ফকির এবং ফজু ব্যাপারীকে সুস্পষ্ট এক বার্তা। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সাথে যুদ্ধে আগের সব ক’বারই আব্দুল ফকির জিতে ফিরেছেন, কিন্তু এবারই সম্ভবত এই যুদ্ধের শেষ অধ্যায়। তবে যুদ্ধটা সরাসরি আব্দুল ফকিরের সাথে না। কিন্তু ঘটনাচক্রে আব্দুল ফকিরও এই যুদ্ধে জড়িয়ে গেছেন। অবশ্য তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মতো মানুষের সাথে হেরেও আনন্দ। আব্দুল ফকির বুদ্ধিমান, সাহসী মানুষ পছন্দ করেন। সমস্যা হচ্ছে বেশিরভাগ সাহসী মানুষই হয় বোকা। কিন্তু তার দেখা সবচেয়ে সাহসী অথচ একই সাথে বুদ্ধিমান মানুষের নাম এই তৈয়ব উদ্দিন খাঁ!

খানিকটা গাঢ় করে অন্ধকার নামতেই আব্দুল ফকির বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। বাড়ি রইল লতা, পারুল, রতন, তাবারন আর নুরুন্নাহার। রতনকে যদি পুরুষ মানুষ ধরা হয়, তবে এই মুহূর্তে সেই বাড়িতে রতন ছাড়া আর কোনো পুরুষ মানুষ নেই। কিন্তু সব সময় হাসিঠাট্টায় মেতে থাকা, তরল স্বভাবের, আপাতদৃষ্টিতে দায়িত্বজ্ঞানহীন পারুলের ভেতর কেমন এক অদ্ভুত ব্যাপার রয়েছে। সে হঠাৎ হঠাৎ পরিস্থিতি এলে মুহূর্তেই নিজেকে বদলে নেয়। খাপ খাইয়ে নেয়। হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকা এক চঞ্চলা চপলা গ্রাম্য কিশোরী মুহূর্তেই যেন হয়ে ওঠে অন্য এক মানুষ।

আব্দুল ফকির তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও পর্যবেক্ষণ শক্তির মানুষ। তার কন্যার এই বিশেষ গুন তার চোখ এড়িয়ে যায়নি। আর যায়নি বলেই তিনি কন্যাকে যেমন সমীহ করেন, তেমনি এমন বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে কন্যার প্রতি অবলীলায় আস্থাও রাখেন। সন্ধ্যার অন্ধকার নামতেই আব্দুল ফকির জুলফিকার আর বাহির ঘরে থাকা আরো তিন যুবককে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। যদ্রুত সম্ভব তাকে পৌঁছাতে হবে ফতেহপুরের বজলু ব্যাপারীর বাড়ি। তার ধারণা সেই বাড়িতে আজ রাতেই কোনো একটা অঘটন ঘটবে। যদিও তিনি এখনও নিশ্চিত নন, কি ঘটবে! কিন্তু তারপরও দেরী হয়ে গেলে সর্বনাশ। আব্দুল ফকির একখানা কুচকুচে কালো চাদর পরে নিলেন। ঝকঝকে আকাশ দেখেও সাথে নিয়ে নিলেন একখানা কালো ছাতা।

মাঝরাতে তারা ফতেহপুরের নদী থেকে গাঁয়ের দিকে ঢোকা সরু খালখানাতে ঢুকলেন। খালে নৌকা ঢাকার সামান্য সময় পরই নৌকার মাঝি বদলে নেয়া হলো। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আব্দুল ফকিরদের যেতে হবে খা বাড়ির সামনে দিয়ে। নৌকার মাঝি ছাড়া আর সকলেই নৌকার ভেতরে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। নৌকার সকল আলো নিভিয়ে সন্তর্পণে নৌকা বেয়ে যাচ্ছে মাঝি। কিন্তু খাঁ-বাড়ির সামনে কিছুই ঘটল না। কেউ নেই কোথাও। নৌকা খাঁ-বাড়ি পেরিয়ে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সকলে। খা বাড়ির ঘাটের কিছু পরই খাঁ-বাড়ি জামে মসজিদের বাঁধানো ঘাট। খালের পানি অনেকটাই নেমে যাওয়ায় মসজিদের শান বাঁধানো ঘাটের দু’তিন খানা সিঁড়ি জেগে উঠেছে। তারা সেই সিঁড়ি পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। মূল রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে খাঁ-বাড়ি থেকে যতটুকু পথের দূরত্বে ফজু ব্যাপারীর বাড়ি, খাল ধরে গেলে তার অর্ধেকেরও কম পথ। আর সামান্য দূরত্ব সামনে। সকলের মধ্যেই একটা বিপদ কাটানোর স্বস্তি। কেবলমাত্র নৌকার মাঝি তখনও টানটান উত্তেজনায় সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছেন চারপাশে।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই নৌকার সামনে একদম নাকের ডগায় একসাথে জ্বলে উঠল প্রায় দশ-পনেরোখানা হারিকেন। অন্ধকার আর তাড়াহুড়ায় আব্দুল ফকিরের নৌকার আর কেউ খেয়ালই করেনি যে তাদের সামনেই পুরো খাল জুড়ে আড়াআড়ি দু’খানা নৌকা রেখে পথরোধ করা আছে। সেই নৌকায় খাঁ বাড়ির প্রায় দশ-পনেরোটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সকলের হাতেই একেকখানা করে হারিকেন। সমস্যা হচ্ছে আব্দুল ফকিরের নৌকাখানা তারপরও থামল না। সরাসরি গিয়ে আঘাত করল সামনের আড়াআড়ি পথরোধ করে ভেসে থাকা নৌকা দু’খানাকে। গতি কম ছিল বলে তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও হৈহৈ করে উঠল খ-বাড়ির ছেলেরা। চারপাশ আলোয় আলোকিত। খবির খাঁ মসজিদের শান বাঁধানো ঘাট বেয়ে নেমে এলেন। তারপর বাজখাই গলায় বললেন, এই নাও কার? এত রাইতে এই নাও এইহানে কি?

আব্দুল ফকিরের নাওয়ের ভেতর থেকে জুলফিকার বেরিয়ে এলো। সে বের হয়ে খবির খাঁকে আদবের সাথে সালাম দিয়ে বলল, চেয়ারম্যান সাব, গ্রামে এক রুগীরে সাপে কাটছে। তারে নিয়া যাইতে আসছি। ফইর সাবে আছেন দক্ষিণ রূপাতলী তার এক সাগরেদের বাড়িতে। ফইর সাবের শইলডাও খারাপ, এইজন্য তিনি আসতে পারেন নাই। আমরাই রুগী নিয়া রূপাতলী যাইতেছি।

খবির খাঁ প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সাথেই এসেছেন। তিনি নিশ্চিত জানেন আব্দুল ফকির এই নাওয়েই আছেন। খানিক আগেও এই খবর তিনি পেয়েছেন। তিনি এই খবরও পেয়েছেন যে আব্দুল ফকির কোনো একটা পরিকল্পনা করার জন্য যাবেন ফজু ব্যাপারীর বাড়ি। কিন্তু জুলফিকারের কথা শুনে তিনি রীতিমত বোকা বনে গেলেন। সামান্য ঝুঁকে উঁকি দিয়ে দেখলেন নৌকার ভেতর আব্দুল ফকির আছে কিনা! কিন্তু নৌকায় আব্দুল ফকিরকে কোথাও দেখা গেল না। অথচ এই কিছুক্ষণ আগেও তিনি খবর পেয়েছেন, মূল নদী থেকে নৌকা যখন সরু খালে ঢুকেছে, তখনও নাওয়ে আব্দুল ফকিরকে দেখা গিয়েছে। খালে ঢোকার পর নৌকা আর কোথাও ভেড়েও নাই। তার মানে আব্দুল ফকির এখনও নৌকায়ই আছেন। তিনি নৌকায় না থেকে পারেনই না। খবির খাঁ একটা হ্যাঁজাক লাইটসহ দুজন মানুষ নিয়ে নৌকায় উঠলেন। নৌকার মেঝেতে একটা আঠারো, কুড়ি বছর বয়সের ছেলে শুয়ে আছে। তার পা হাঁটুর নিচ থেকে শক্ত করে বাধা। সে পড়ে আছে মৃত মানুষের মতো। তার মুখের কোষ বেয়ে ফেনা গড়িয়ে পড়েছে। তার মানে এই ছেলেটিকেই সাপে কেটেছে। এর তো ভয়াবহ। অবস্থা!

ছেলেটিকে খবির খাঁ চেনেন না। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন একে দ্রুত আব্দুল ফকিরের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার। তবে সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো, নৌকায় আব্দুল ফকির কোথাও নেই! কোথাও না! মানুষটা কোনো জাদুর বলে অদৃশ্য হয়ে গেল নাকি! খবির খাঁ দীর্ঘ সময় তল্লাশি করেও এর কোনো উত্তর খুঁজে পেলেন না। কিন্তু রোগীকে নিয়ে এরা এই পথে কই যাচ্ছে?

খবির খাঁ সম্ভবত জুলফিকারের প্রথম কথাটি শুনতে পাননি। জুলফিকার প্রথমেই বলেছিল যে আব্দুল ফকির বাড়ি নেই, আর তিনি রয়েছেন দক্ষিণ রূপাতলী। তো দক্ষিণ রূপাতলী যাওয়ার সবচেয়ে সহজ পথ এটিই। খবির খাঁর মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল। একটা অজানা আশঙ্কাও কাজ করছে তার। মধ্যে। মনির নিজ চোখে দেখে এসে দৌড়ে খবর দিয়েছে তাকে। সে নাকি দেখেছে যে, বড় নদী থেকে খালের মুখে ঢোকার মুহূর্তেও আব্দুল ফকিরকে নৌকায় দেখেছে সে। কিন্তু তাহলে? তাহলে এই এইটুকু পথে সে কই হাওয়া হয়ে গেল?

সবচেয়ে বেশি যেই বিষয়টি নিয়ে খবির খাঁ চিন্তিত, তা হলে তার বাবা তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। আব্দুল ফকিরকে ফজু ব্যাপারীর সাথে বিশেষ কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবার এই ঘটনা একদম হাতে নাতে ধরতে চেয়েছিলে তিনি। শুধু তা-ই না, একইসাথে এই মাঝরাতে আব্দুল ফকিরকে যদি চার পাঁচজন মানুষসহ নদী বা খালে নাও নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখে আটকে ফেলা যেত, তবে উত্তরকান্দির চরের খুনের দায়টাও তার ঘাড়েই চাপানো যেত! এই পুরো ভাবনাটাই তৈয়ব উদ্দিন, খার। কিন্তু আরো একবার পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ হলেন খবির খাঁ। আব্দুল ফকির কোথাও নেই!

এখন কি করবেন তিনি? এমন মুমূর্ষ রোগী নিয়ে তাদের আটকে রাখাও ঠিক হবে না। খবির খাঁ নাও ছেড়ে দিতে বললেন। নাওখানা ফজু ব্যাপারীর বাড়ির পাশে না ভিড়ে বাড়ি ছাড়িয়ে চলে গেল আরো দূরে। কিন্তু আব্দুল ফকির ভোজবাজির মতো কোথায় উধাও হলেন?

আব্দুল ফকির তখন ফজু ব্যাপারীর বাড়ির পাশের নলখাগড়ার বনের অন্ধকারে বসে কথা বলছেন ফজু ব্যাপারীর সঙ্গে। আব্দুল ফকিরের সারা শরীর কালো চাদরে ঢাকা। তার গা, মাথা বেয়ে টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে পানি। কিছুটা পথ সাঁতরে আসতে হয়েছে তাকে। মূল নদী থেকে এই সরু খালে নৌকা ঢোকার সময়ই আব্দুল ফকির মাঝিকে সরিয়ে নিজেই মাঝির আসনে বসে পড়েছিলেন। আগে থেকেই কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিলেন তিনি। কালো চাদরে আবৃত আব্দুল ফকির খাঁ-বাড়ির ঘাট পার হতেই হঠাৎ চারপাশে অস্বাভাবিক কিছু শব্দ, নড়াচড়া টের পেয়েছিলেন। মসজিদের ঘাটের সামনে আসতেই সামনের অন্ধকারে নৌকার ছায়মূর্তিগুলোকে দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। আর দেখামাত্র নিঃশব্দে নৌকা থেকে পানির মধ্যে নেমে গিয়েছিলেন তিন। তারপর দীর্ঘ এক ডুবে পেরিয়ে এসেছিলেন সামনের নৌকাগুলোকেও। সকলেই তখন আব্দুল ফকিরের নৌকা নিয়ে ভীষণ উত্তেজিত থাকায় আব্দুল ফকিরকে কেউ খেয়ালই করেনি। তিনি ততক্ষণে খালের স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে দিয়ে সাঁতরে চলে এসেছেন ফজু ব্যাপারীর বাড়ি।

আব্দুল ফকির নিচু গলায় বললেন, সামনে সময় খুব খারাপ ফজু।

ফজু বলল, কেন? খারাপ কেন কাকু? কি করব সে?

আব্দুল ফকির বললেন, কি করব সেইটা এখনও বলন যায় না। তয় একখান কথা বলি, আমার ধারণা কোনো কারণে বড় খাঁ সন্দেহ করতেছে।

ফজু বলল, কি সন্দেহ করতেছে?

আব্দুল ফকির বললেন, তুই জমিজমা নিয়া কিছু করতেছস। আর লগে আমিও আছি।

ফজু বলল, এইটা আইজ হোক, কাইল হোক, সে তো জানতোই।

আব্দুল ফকির চিন্তিত গলায় বললেন, তা জানত।

ফজু বলল, এইজইন্যই তো আপনের উপর ভরসা কাকু। আপনে ছাড়া আর কেউ তার লগে সেয়ানে-সেয়ানে টক্কর দিতে পারব না।

আব্দুল ফকির বললেন, তোর লইগ্যা আমি সেয়ানে-সেয়ানে টক্কর দিলে তোর সব গোপন খবর তো আমার জানন লাগব।

ফজু বলল, আমার তো কোনো গোপন খবর নাই কাকু। যা বলনের সব তো আপনেরে বইলাই দিছি! আর তো বলনের কিছু নাই।

আব্দুল ফকির কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর হঠাৎ অন্ধকারেই তার মুখখানা ফজু ব্যাপারীর মুখের কাছে নিয়ে এলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, আব্দুল ফইর যে বাতাসে ঘ্রাণ পায়, জানস?

ফজু হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল। সে আব্দুল ফকিরের এই রূপের সাথে সরাসরি পরিচিত না। আব্দুল ফকির বললেন, তুই কিছু একটা আমার কাছে গোপন করতে আছস ফজু। খুব বড় কিছু। ঘটনাটা আমার জানন দরকার। আমি না জানলে সেই জিনিস তুই তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কাছেরতনও বাঁচাইতে পারবি না। কথাটা মনে রাখিস।

ফজু কাঁপা গলায় বলল, আল্লাহর কছম ফইর কাকু। যা বলনের সব আপনেরে বলছি। আপনেরে না বললে আর কারে বলব? আপনে ছাড়া এই বিপদে আমাগো আর কেডা আছে?

আব্দুল ফকির বললেন, তোগোর বিপদ কিয়ের রে ফজু?

ফজু প্রসঙ্গ বদলাতে পেরে যেন খানিক স্বস্তি বোধ করল। সে বলল, এই যে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ, খবির উদ্দিন খাঁ, পুরো খাঁ বংশ আমাগো শক্ত হইয়া উঠতেছে।

আব্দুল ফকির বললেন, খা বংশের কি এহন আর তোগো শত্রু হওনের সময় আছে? ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম। ব্যাপারীগো কী আছে যে তাগো লগে খাঁ বংশের নতুন শতামি শুরু হইব?

ফজু বলল, এই যে নতুন কইরা আবার পুরোনো জমিনের খোঁজ শুরু করছি। কাগজপত্রে ওই জমিন তো ব্যাপারীগো কাকু। আপনে তো সবই জানেন।

আব্দুল ফকির বললেন, জানি দেইখাই তো জিগাইতেছি। এত বছর তিন ওক্ত ভাত জোটে নাই, আর আচুক্কা সেই ব্যাপারীরা তাগো পুরোনো জমিনের হিসাব লইয়া খায়গো লগে টক্কর লাগতে যাইতেছে, ঘটনা এত সহজ ফজু? আসল ঘটনা বল? না বললে তুই-ই পস্তাইবি। আমি তোর শত্রু না। খায়রা তোর যেমন শত্রু, আমারো শত্রু। আর শত্রুর শত্রু সব সময় বন্ধু হয়। আপন হয়। তাইলে তুই আর আমি তো আপনই।

ফজু বলল, এই জইন্যই তো আপনের ধারে গেছি কাকু। আপনে ছাড়া তো আমাগো আপন আর কেউ নাই।

আব্দুল ফকির বললেন, তাইলে আসল ঘটনাখান খুইলা বল। আচুক্কা এত পয়সাপাতি কই পাইলি?

ফজু বলল, হেইদিনই তো আপনেরে বললাম কাকু, সবাই মিল্যা দিতাছি। আমার ভাইয়েরাও ঢাকারতন পাঠাইতেছে। এতদিন ধইরা জমাইছে। ব্যাপারী বংশের আর যারা যেইহানে আছে, সবাইই চায় ব্যাপারীগো জমিন ফির‍্যা আসুক। এইজইন্য যে যা পারে দিতেছে।

আব্দুল ফকির কথা বললেন না। কিন্তু অন্ধকারে তার চোখজোড়া ভয়ঙ্কর কোনো শিকারী জন্তুর মতো ধকধক করে জ্বলতে লাগল।

*

ঘটনা ঘটল পরদিন রাতে। ফজু ব্যাপারীর বাড়িতে ভয়াবহ ডাকাতি হলো। সমস্যা হচ্ছে ডাকাতরা ফজু ব্যাপারীর বাড়ি থেকে কিছুই নিয়ে যায়নি। নেয়ার মতো কিছু অবশ্য ফজু ব্যাপারীর বাড়িতে নেইও। কিন্তু ডাকাতদের ডাকাতি চেষ্টার ধরনে এটি স্পষ্ট যে তারা বিশেষ কোনো কিছুর খোঁজে এসেছিল। ফজু ব্যাপারী ও তার স্ত্রীর হাত মুখ বেঁধে রেখে তারা সারা ঘর তন্ন তন্ন করে কিছু খুঁজেছে। শুধু খুঁজেই যে তারা ক্ষ্যান্ত হয়েছে তা না। ফজুব ব্যাপারীর ঘরের মেঝে, চৌকির তলা, উঠানের মাটি অবধি তারা খুঁড়েছে। সকাল বেলা এই খবর নিয়ে ফজু ব্যাপারী নিজেই গেল খাঁ-বাড়ি। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এই গাঁয়ের মাথা। এতবড় ঘটনা তাকে জানানো অতি আবশ্যক। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সব কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর খবির খাঁকে ডাকলেন। খবির খাঁ বললেন, খুবই চিন্তার বাজান। ফজুর ঘরে কে ডাকাতি করতে যাইব? তার ঘরে ডাকাতি করনের কি আছে?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ গম্ভীর গলায় বললেন, এইটাই তো চিন্তার বিষয়। ফজু, বল তো, তোর লগে কারো কোনো শত্রুতা নাই তো?

ফজু মিনমিনে গলায় বলল, আমি গরীব মানুষ। দিন আনি দিন খাই। আমার লগে কার শত্রুতা থাকব?

তৈয়র উদ্দিন খাঁ বললেন, গর্দভের মতো কথা বলিস না ফজু। একখান কথা মনে রাখবি, বন্ধু চেননের আগে শত্রু চেনন অতি জরুরি। বন্ধু না চেনলেও ক্ষতি নাই। কারণ বন্ধু কোনোদিন ক্ষতি করে না। কিন্তু শত্রু চেনন জরুরি। শত্রু না চেনলে সে ক্ষতিটা করতে পারে সহজে।

ফজু বলল, আমি তো কিছুই বোঝতে পারতেছি না। কার কথা কী বলব?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার বড়পুত্র খবির খাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, খোঁজ খবর নে। আমি বাইচ্যা থাকতে আমার গ্রামে এইসব ঘটনা চলব না। এই ঘটনা দূরের কোনো মানুষ করে নাই। করছে কাছের কোনো মানুষ। ফজুর লগে কথা বল। অগো বাড়ির অন্যগো লগে কথা বল। ও যাগো লগে কাজ কাম করে তাগো লগে কথা বল। এই কাজ কে করছে, এইটা বাইর করন কঠিন কিছু না।

খবির খাঁ বললেন, জ্বে বাজান।

ফজু চলে যেতেই খবির খাঁকে আবার ডাকলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। তারপর বললেন, ঘটনা কিছুই টের পাইছস?

খবির খাঁ চিন্তিত গলায় বললেন, কি ঘটনা বাজান?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ফজু আগেই জানত তার ঘরে রাইতে ডাকাতি হইব।

খবির খাঁ তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি ভড়কে যাওয়া গলায় বললেন, কী বলেন বাজান? সে জানব কেমনে?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, কাইল রাইতে কারে কারে পাঠাইছিলি অর বাড়ি?

খবির খাঁ একে একে নাম বললেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এদের মধ্যেই কেউ ফজুরে আগেভাগে জানাই দিছে যে রাইতে তার বাড়িতে লোকজন। যাইব। ঘরে দামী জিনিসপত্র কিছু থাকলে সে যেন সরাই ফেলায়। যে বলছে, সে এই কথাও জানে, ফজুর ঘরে আমরা কি খুঁজতে লোক পাঠাইছি।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কথা শুনে খবির উদ্দিন খাঁ এতটাই অবাক হয়ে গেলেন যে তিনি সাথে সাথে কোনো কথা বলতে পারলেন না। নিজেকে আজকাল সত্যি সত্যিই তার বোকা মনে হচ্ছে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সব কিছু পইপই করে শিখিয়ে দেওয়ার পরও তিনি একের পর এক ব্যর্থ হচ্ছেন। কোনোকিছুই ঠিকঠাক করতে পারছেন না।

গতকাল ভোরে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তাকে ডেকে বললেন যেন রাতের অন্ধকারে কয়েকজন লোক পাঠিয়ে ফজু ব্যাপারীর ঘরে আচমকা তল্লাশি চালানো হয়। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, ফজু ব্যাপারী সেই গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছে! আর খুঁজে পেয়েই সে তার পূর্বপুরুষের জমিজমা উদ্ধারে উঠে পড়ে লেগেছে। খবির খাঁর উচিত সবার আগে সেই মহামূল্যবান গুপ্তধন হস্তগত করা। সুতরাং এই তল্লাশি এমনভাবে করতে হবে যাতে কেউ বুঝতে না পারে কে করেছে! ফজুর ঘরের প্রতি ইঞ্চি জায়গা খুঁজতে হবে, প্রয়োজনে সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে মাটি খুঁড়েও দেখতে হবে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কথামতো সব কাজই খবির খাঁ করিয়েছেন। কিন্তু কোথাও কিছু পাওয়া যায়নি। আর এখন তিনি বলছেন ফজু ব্যাপারী আগে থেকেই সবকিছু জেনে গিয়েছিল! এইজন্যই তাহলে সে আসল জিনিস সরিয়ে ফেলেছিল? কিন্তু ফজু ব্যাপারী কি করে জানল? আর ফজু ব্যাপারী এই ঘটনা আগে থেকেই জেনে গিয়েছিল, সেটিই বা আবার তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কি করে জানলেন?

খবির খাঁর মাথা কাজ করছে না। তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ভীত গলায় বললেন, বাজান, আপনে কেমনে বোঝলেন যে ফজু এই কথা আগেই জানত?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, ফজুর কথাবার্তা শুইনা, ভাবভঙ্গি দেইখা বোঝস নাই? কারো বাড়িতে এমন ঘটনা ঘটলে তার মইধ্যে যেই ভাব থাকনের কথা, ফজুর মইধ্যে তার কিছুই দেখছস? তার মইধ্যে তার কিছুই ছিল না। তারে দেইখ্যা আরো মনে হইছে, সে আগে থেইকাই রেডি আছিল যে ঘটনা ঘটার পর বেয়ান হইলেই সে আমার কাছে নালিশ লইয়া আসব। আর এই ঘটনায় তার। আমার কাছে আসনের কথা না। আসনের কথা তোর কাছে। সে আসলে জানত, সবকিছু হইছে আমার বুদ্ধিতে। এইজন্য সে সরাসরি আমার কাছে আসছে এইটা বুঝাইতে যে, সে ঘটনা নিয়া যারপরনাই ভয় পাইছে। এহন এর বিচার জানি আমি করি। এতে কইরা এই ঘটনা যে সে আগেই টের পাইছে। এইটাও যাতে আমি ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ না করি!

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কথা খুব মনোযোগ দিয়েই শোনার চেষ্টা করলেন খবির খাঁ। কিন্তু তারপরও কিছুই যেন পুরোপুরি বুঝতে পারলেন না তিনি। কিছুক্ষণ বাবার সামনে নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকার পর খবির খাঁ বললেন, এহন কি করব বাজান?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, একখান কাজ কর। ফজু ব্যাপারীর লগে ওঠা-বসা বেশি, অর লগে রেগুলার কাম কাইজ করে এমন। দুই-তিনজনরে খুঁইজা বাইর কর। তাগো সন্দেহ করস বইল্যা সালিশ বসা। সালিশে আমারে ডাকিস না। এলাকার আর যারা ময়মুরুব্বী আছে, তাগো নিয়া একটা কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা কর।

খবির খাঁ এবার আর অবাক হলেন না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর চিন্তা ভাবনা যে তিনি এই জনমে বুঝবেন না, এটা তিনি মেনে নিয়েছেন। তিনি বাবার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই রইলেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, গত দুই তিন বছর যারা যারা বর্গা জমিনের ফসল ঠিকঠাক মতো না দিয়া নানান সময় উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলছে, এমন উঠতি দুয়েকজন মাতবররেও এই সন্দেহের দলে যোগ কর। শালিসে বিচার যেন কড়া হয়। কিন্তু শাস্তি দেওন দরকার নাই। শাস্তি দেওনের আগে আমার কাছে পাঠাবি। আমি মাফ কইরা দিব। কথা বুঝছস?

খবির খাঁ বললেন, জ্বে বাজান।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হঠাৎ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, কিচ্ছু বুঝস নাই। কিচ্ছু না।

খবির খাঁ স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন। এবার আর কোনো শব্দই উচ্চারণ করলেন না তিনি। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, ক্ষমতা রাখতে হইলে শক্ত যেমন হওন লাগে, তেমন নরমও হওন লাগে। ক্ষমতায় কঠিন শাস্তি দিয়া নিজের শক্তি যেমন প্রমাণ করন লাগে। তেমনে আবার কোনো কোনো সময় শাস্তি না দিয়া দয়া মায়াও দেহান লাগে।

খবির খাঁ এবারও কোনো কথা বললেন না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, উত্তরকান্দির বিলের মতি মেয়ার লাশ নিয়া কিছু হইছে?

খবির খাঁ বললেন, এহনো কেউ কোনো খবর দেয় নাই বাজান।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এস্কান্দাররে তো খুন করতে বলা হয় নাই। তারে বলা হইছিল কঠিন শাস্তি দিতে। খুন ছাড়া কি কঠিন শাস্তি দেওন যায় না। নাকি? সেও হইছে তোর মতো একটা গাধা। আমার চারপাশ গাধায় ভরপুর। আমি চোউখটা বুজব আর সাথে সাথে এই খাঁ বংশটারে বারো ভূতে লুইটা পুইটা খাইব। খাঁ-বাড়ির উঠানে ঘাস গজাইব। লাঙ্গলের ফলা পড়ব। তারা আনন্দফূর্তি কইরা ধান ফলাইব!

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কপালের শিরা কাঁপছে। তাকে এমন রাগতে সচরাচর দেখেননি খবির খাঁ। তিনি রীতিমতো আতঙ্কিত বোধ করছেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, তুই এহন যা। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ।

খবির উদ্দিন খাঁ যত দ্রুত সম্ভব ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তীতে শান্তি পেলেন না। তার মাথায় তখন অন্য চিন্তা। তার ঘরের এই গোপন ঘটনা ফজু ব্যাপারীকে আগেভাগে জানিয়েছে কে? এ খুবই ভয়ঙ্কর ঘটনা। ঘরের ইঁদুরে বাঁধ কাটলে ঘরের বেড়া রাখা যায় না। এই ইঁদুরকে তাকে অতিসত্বর খুঁজে বের করতে হবে। করতেই হবে।

সে রাতে আবার ঘুম হলো না তৈয়ব উদ্দিন খাঁর। তিনি সারারাত জেগে জেগে ভাবলেন। কিন্তু অনেক ভেবেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলেন না। ফজরের আজান হলে তিনি নামাজে গেলেন। নামাজ শেষ করে সেদিন ভোরে আর হাঁটতে বের হলেন না তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। এস্কান্দার এসেছে তাকে ডাকতে। তিনি এস্কান্দারকে বললেন তার সকালের খাবার দিতে। খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। তার মাথার বাম দিকটায় চিনচিন করে কিঞ্চিৎ ব্যথা হচ্ছে। তিনি ব্যথাটাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না। এস্কান্দারকে ডেকে পান খেতে চাইলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। কিন্তু সেই পান তিনি খেতে পারলেন না। পান মুখে দেয়ার আগেই হড়বড় করে বমি করলেন তিনি। এস্কান্দার ছুটে এসে তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে ধরতে গেল। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হাত তুলে নিষেধ করলেন।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর নিষেধ অমান্য করার সাহস এস্কান্দারের নেই। সে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তারপর আরো বার দুই বমি করলেন। বমি করা শেষে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। তারপর নিজে নিজেই টেবিল থেকে পানির জগ টেনে নিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। জানালার বাইরে ভোরের আলোয় ঝলমলে দিন। খাঁ-বাড়ির নানান কাজের মানুষদের পদচারণায়, কোলাহলে মুখরিত উঠান। কার এক ছোট্ট শিশু আদুল গায়ে বসে আছে উঠানে। তার সামনে একখানা বাটিতে কিছু মুড়ি। কিন্তু শিশুটি মুড়িগুলো খাচ্ছে না। সে মুঠো করে মুড়ি ছিটিয়ে দিচ্ছে উঠানের মাটিতে। সেখানে ভিড় করেছে অনেকগুলো মুরগির ছানা। ছানাগুলি খুটে খুটে মাটি থেকে তুলে মুড়ি খাচ্ছে। শিশুটি তার চোখভর্তি আনন্দ নিয়ে সেই দৃশ্য দেখছে। আর খানিক পরপর মুড়ি ছুঁড়ে মারছে।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মুখে পানি নিয়ে বারকয়েক কুলি করলেন। তারপর এস্কান্দারের কাছে জগটা দিয়ে তেমন দাঁড়িয়েই রইলেন। শিশুটির দিকে তাকিয়ে থাকতে তার ভালো লাগছে। কী আনন্দ নিয়েই না সে মুরগির বাচ্চাগুলোকে খাবার দিচ্ছে। খানিক বাদে বাদে খিলখিল করে হাসছে শিশুটি। আর চোখেমুখে রাজ্যের আনন্দ নিয়ে দেখছে।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর হঠাৎ মনে হলো জগতে মানুষ আসলে এই দেখতেই আসে। জীবন জুড়েই মানুষের সবচেয়ে বড় পিপাসার নাম দর্শন। সে সকল কিছুই দেখে নিতে চায়। দেশ-বিদেশ ঘুরে দেখতে চায়। প্রিয় জায়গা, প্রিয় মানুষ, প্রিয় জিনিস দেখতে চায়। সে দেখতে চায় তার চারপাশে মানুষ তাকে ভয় পাচ্ছে, ভালোবাসছে, সম্মান করছে। রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে সে দিনের আলো দেখতে চায়, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত দেখতে চায়, জোছনা রাত, বৃষ্টির দিন দেখতে চায়। জীবন জুড়ে এই দেখাদেখির প্রবল ইচ্ছা মানুষকে বেঁচে থাকতে লোভ দেখায়। হয়তো এইজন্যই মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায়। কারণ মৃত্যু তার কাছে এক অন্ধকার জগতের নাম। যেই জগতে সে আর কিছুই দেখতে পায় না। বা সে নিশ্চিত করে জানে না, আসলে সেখানে সে কী দেখবে!

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার কাছ থেকে সরে এলেন। তার মধ্যে অবচেতনেই প্রবলভাবে মৃত্যুচিন্তা কাজ করছে। বিষয়টা তিনি সাধারণত গ্রাহ্য করেন না। কিন্তু আজ কেন যেন গ্রাহ্য না করে পারছেন না। তার বয়স হয়েছে, মৃত্যুচিন্তা অতি স্বাভাবিক। কিন্তু এত বয়স হলেও তিনি সাধারণত মৃত্যুচিন্তা করেন না। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসলেন। এস্কান্দার একজনকে ডেকে ঘরের নোংরা মেঝে পরিষ্কার করালো। বিছানার চাদর বদলে দিলো। তারপর এসে দাঁড়াল তৈয়ব উদ্দিন খাঁর পাশে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এস্কান্দারের তিকে তাকালেন না। তবে খুব ধীরে সময় নিয়ে কথা বললেন। তিনি বললেন, এ বমির খবর কাউরে বলিস না।

এস্কান্দার মাথা কাত করে বলল, জ্বে, বলব না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, জীবনরে নিয়া কহনো ভাবছস এস্কান্দার? এই যে জীবন, মৃত্যু?

এস্কান্দার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বলল, কোনো জীবন দাদাজান? ধলপারের জীবন মাতুব্বর? সে তো মরে নাই। তারেও কী খুন করন লাগব?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আর কথা বললেন না। মাঝে-মধ্যে তিনি অবাক হয়ে যান, চারপাশে এমন সব মাথামোটা গর্দভ নিয়ে তিনি এখনও সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো বেঁচে আছেন কীভাবে?

এস্কান্দারই বলল, উত্তর কান্দির চরের মতি মেয়ারে কিন্তু আমি খুন করতে চাই নাই দাদাজান। আপনের কথার উল্টা কিছু করনের সাহস আমার নাই। কিন্তু ঘটনা ঘইট্যা গেছে। লাখিখান মারছিলাম তলপ্যাটে, দম আটকাইয়া মইরা গেল। তয় একখান কথা দাদাজান, আপনে বাজানের এত কেরছা-কাহিনি শুনাইছেন, মনে মনে দুই চাইরখান খুন করনের বাসনা আমারও হইছিল। ইচ্ছা কইরা না করলেও, একখান বাসনা কিন্তু পূরণ হইয়া গেল। খুন একখান নেশার লাহান। একবার করলে বারবার করতে ইচ্ছা হয়। আপনে বললে, জীবন মাতবররে খুনটা আমি করতে চাই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ঘাড় ঘুরিয়ে এস্কান্দারের দিকে তাকালেন। আপাতঃদৃষ্টিতে দেখতে বোকাসোকা, নিরীহ এই মানুষটার ভেতরও কী ভয়ানক এক খুনি ওঁত পেতে বসে আছে, ভাবতেই অবাক লাগে তার। মানুষ এমন করে রোজ কত কিছু তার ভেতরে লুকিয়ে রাখে? এই লুকিয়ে রাখাটাও আসলে মৃত্যুর মতো। প্রতিটা মানুষের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলার মতো দূরত্বে লুকিয়ে থাকে মৃত্যু। কেউ জানে না সে কখন তাকে গ্রাস করে নেবে। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ ঘর থেকে এক পা বাইরে ফেলে দ্বিতীয় পা ফেলার আগেই এই মৃত্যু তাকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। আবার মৃত্যুশয্যায় শুয়ে প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকা কারো জীবনেও বছরের পর বছর মৃত্যু নাও আসতে পারে। কী অদ্ভুত!

.

আবারো ঘুরে ফিরে সেই মৃত্যুচিন্তায়ই ঢুকে গেলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। আজ কি হয়েছে তার! খানিক আগের ওই হঠাৎ চিনচিনে মাথাব্যথা, তারপর বমি আর তারপর থেকেই এই ক্রমাগত মৃত্যুচিন্তা এ সকল কী কিছুর ইঙ্গিত?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আবারো কথা বললেন। তিনি বললেন, শোন এস্কান্দার, জীবন হইল সময়। ধর তুই এক থেইকা একশ বছর বাচলি, এইটা কি? এইটা আসলে আর কিছুই না, সময়। ধর নদীভর্তি পানি থেইকা তুই এক কলসি পানি আনলি, নদীর পানি কিন্তু কমলো না। কারণ ওই নদীভর্তি পানি হইল গিয়া সময়ের মতো। জীবন শেষ হইয়া যায়, সময় কিন্তু শেষ হয় না। সময়ের কোনো শেষ নাই। আর ওই যে এক কলসি পানি আনলি, ওইটুক হইল জীবন। ওই কলসির পানি প্রত্যেকদিন একটু একটু কইরা ঢাললেও শেষ হইতে থাকে। কলসি যতই বড় হোক না কেন, একসময় ওই পানি শেষ হইবোই। জীবনও। তুই যত বছরই বাচস না কেন, তোর আয়ু একদিন না একদিন শেষ হইবোই।

এস্কান্দার এই মুহূর্তগুলোর সথে পরিচিত। সে জানে, তৈয়ব উদ্দিন খাঁ প্রায়ই এমন কিছু কথা বলেন, যেগুলো বোঝার সাধ্য তার নাই। কিন্তু এই সময়গুলোতেও সে খুব মন দিয়ে তার কথা শোনার ভান ধরে থাকে। যদিও সে নিজেও জানে, তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এই কথাগুলো তাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন না, তিনি বলছেন মূলত নিজেকেই। এই কাজটি তিনি মাঝে-মধ্যে করেন। নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলেন। তবে এই সময়ে এস্কান্দার হয়ে ওঠে তার কথা বলার উপলক্ষ মাত্র। এস্কান্দার বরাবরের মতো এবারো মৃদু গলায় বলল, জ্বে, দাদাজান।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ খানিক চুপ করে থেকে বললেন, জীবনে সকলেই সহজ কাজ করনের চেষ্টা করে। কিন্তু সহজ কাজ করনে কোনো আনন্দ নাই, আনন্দ কঠিন কাজ ঠিকঠাক করনের মইধ্যে। মানুষ খুন করন কোনো কঠিন কাজ না, এইটা হইলো সহজ কাজ। কঠিন কাজ হইলো মানুষ বাঁচাই রাখন।

এস্কান্দার বলল, জ্বে দাদাজান।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আমার ওযুর পানি দে, আমি নামাজ পড়ব।

এস্কান্দার অবাক গলায় বলল, এহন কোন ওয়াক্তের নামাজ দাদাজান?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এস্কান্দারের কথার জবাব দিলেন না। তার মাথায় কোনো একটা বিশেষ চিন্তা ঘুরছে। তিনি সেই চিন্তাটাকে ধরতে পারছেন না। ঘরে ঢুকে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ গায়ের জামা বদলালেন। লুঙ্গী বদলালেন। তারপর জায়নামাজ পেতে নামাজে বসলেন। নামাজ শেষ করে সালাম ফিরাতে গিয়ে তার হঠাৎ মনে হলো তিনি চিন্তাটা ধরতে পেরেছেন। খাটের নিচে একটা ধেড়ে ইঁদুর আঁতিপাঁতি করে কিছু খুঁজছে। নামাজে সালাম ফিরাতে গিয়ে তার চোখ পড়েছে সেই ইঁদুরের উপর। সাথে সাথেই তার মনে হলো তিনি চিন্তাটা ধরতে পারছেন। গতকাল ফজু ব্যাপারীকে কে তার ঘরের খবর আগেভাগে পৌঁছে দিয়েছে সেটি তিনি ধরতে পেরেছেন। তিনি প্রবল বিস্ময় নিয়ে ইঁদুরটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, এতকাল ধরে এমন করেই তার ঘরেই একটা ইঁদুর তিনি পেলে পুষে রেখেছেন, ভাবতেই কেমন অস্বস্তি হতে লাগল তৈয়ব উদ্দিন খাঁর!

*

হেমার শরীর এখন খানিকটা ভালো। মাঝখানে আসলাম সাহেব ফোন করেছিলেন। তিনি বলেছেন, আপাতত কিছুদিন তিনি সকল কিছু থেকে দূরে থাকতে চান। হেমার জন্য তার খুব চিন্তা হচ্ছে, কিন্তু এই মুহূর্তে সকল কিছু থেকে একটা দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা তার প্রয়োজন। মাঝে-মধ্যেই তিনি হেমাকে ফোন করে খোঁজ-খবর নেবেন। হেমার টাকা-পয়সা দরকার হলে কি করতে হবে, সেটিও তিনি বলে দিয়েছেন। বলেছেন, বাবাকে নিয়ে হেমা যেন দুশ্চিন্তা না করে। তার ফোন বন্ধ থাকলেও চিন্তার কিছু নেই। হেমা অবশ্য বাবাকে কিছু বলেনি। এমনকি তার অসুস্থতার কথাও না। ফোনের কথোপকথনের পুরোটা সময় জুড়ে আসলাম সাহেবই কথা বলে গেছেন, হেমা খুব একটা কথাবার্তা বলেনি। এই সময়টায় আসলাম সাহেবের কণ্ঠ বেয়ে প্রবল দুঃখী, বঞ্চিত, আহত এক মানুষের হাহাকার ভেসে এসেছে।

কিন্তু ফোনটা রাখার পরপরই হেমার মনে হলো তার বাবার গলায় একটা চাপা আনন্দ ছিল। তিনি অনেক চেষ্টা করেও সেই আনন্দটা লুকাতে পারেননি। তার এই আনন্দটা মুক্তির আনন্দ।

মানুষ জগতের আর সকল আনন্দ লুকাতে পারলেও মুক্তির আনন্দ লুকাতে পারে না।

বাবা কি তবে এই সংসার, এই সম্পর্ক থেকে নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত করে ফেলতে পেরেছেন? তার কি একটুও মায়া হচ্ছে না? মানুষ যদি কোনো বন্দিখানায় বছরের পর বছর বন্দি থাকার পর মুক্তি পায়, তারপরও দীর্ঘ সময় অবধি সেই বন্দিখানার জন্য তার মন কেমন করে। হয়তো সেই বন্দিখানার কোনো আনন্দের স্মৃতি তার নেই। হয়তো তার পুরোটা জুড়েই রয়েছে অসহনীয় সব কষ্টের গল্প। তারপরও একটা মন কেমন করা অনুভূতি তার হয়। একটা। মায়া হয়। এই মায়ারা থাকেই, থেকেই যায়। সেই বন্দিখানার কঠিন গরাদে, কংক্রিটের শক্ত মেঝেতে, অসংখ্য আঁকিবুকির দেয়ালে, অখাদ্য খাবারের জীর্ণ প্লেটে সেই মায়ারা থেকেই যায়। এই মায়া কাটানো সহজ নয়। এই জীবনটাই তো একটা মায়া। কিন্তু এই সংসার আর সম্পর্কটা কি সেই বন্দিখানার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু ছিল বাবার কাছে?

বাবার এই এত বছরের ভয়ঙ্কর দুঃসহ জীবনটাকে যে হেমা একটুও অনুভব করতে পারে না তা নয়। বরং অনেক বেশিই পারে। কিন্তু সে জন্য এতবছর পর এসে বাবা, এই সিদ্ধান্তটা নিচ্ছেন? বাবার জীবনের এই অসহনীয় অনুভূতি হেমাকে প্রবলভাবেই স্পর্শ করে, কিন্তু তারপরও কেন যেন মাকেও সে পুরোপুরি অভিযুক্ত করতে পারছে না। বরং বাবার জন্য যে কষ্টটা তার হচ্ছে, মা’র জন্যও তার চেয়ে কম কষ্ট তার হচ্ছে না। একটা মানুষ বছরের পর বছর কী অব্যক্ত, অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটিয়েছে। বুকের ভেতর পুষে রেখেছে অন্য একটা মানুষের স্মৃতি। অন্য একটা মানুষের গভীরতম স্পর্শের অনুভূতি। অবিশ্বাস্য কষ্টের বিচ্ছেদ। যাকে সে সম্পূর্ণ পেয়ে, সম্পূর্ণের চেয়েও বেশি হারিয়েছে। অথচ তাকে কাটাতে হয়েছে সেই মানুষটাকে যাকে সে ঘৃণা করে। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। কী ভয়ানক যন্ত্রণাময় এক জীবন!

বারার যন্ত্রণাটাও মোটেই কম কিছু নয়। প্রতিটি মুহূর্ত তিনি চূড়ান্ত রকমভাবে উপেক্ষিত হয়েছেন। যেই মানুষটাকে ভালোবেসে মুগ্ধ করার। প্রাণান্তকর চেষ্টা করে গেছেন অবিরাম, সেই মানুষটা প্রবল নির্লিপ্ততায় তা উপেক্ষা করে নিঃশব্দে ভালোবেসে গেছেন অন্য একজনকে। একই বিছানায় পাশাপাশি ঘুমিয়েও রাতের পর রাত তাদের মাঝখানে বয়ে গেছে যোজন যোজন ব্যবধানের অলঙ্ঘনীয় এক সমুদ্র।

কী অসহ্য কষ্টের এক জীবন!

আচ্ছা, বাবার জীবনে কি কেউ এসেছে? যার সান্নিধ্য তাকে প্রখর খরতাপে পুড়ে যেতে থাকা অন্তহীন মরুভূমিতে হঠাৎ করেই সবুজ সতেজ এক নতুন জীবনদায়ী মরুদ্যান দেখিয়েছে? তেষ্টায় ফেটে যেতে থাকা বুকের ভেতর হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি নামিয়ে দিয়েছে? হেমা জানে না, তবে তার কেন যেন মনে হচ্ছে, তার বাবা এমন কোনো অনুভূতিতেই আচ্ছন্ন। এমন কিছু হয়ে থাকলে কি বাবাকে। দোষ দিতে পারবে হেমা? সে নিজে বাবার জায়গায় থাকলে কি করত? এমন। পরিস্থিতিতে এই সময়ে এসে কেউ যদি তাকে প্রবল মমতায়, ভালোবাসায়, যত্নে আগলে রাখতে চাইত, তাহলে কি সে সেই ডাকে সাড়া না দিয়ে পারত! একজনমের এইটুকু ভালোবাসার স্পর্শের জন্যই হয়তো মানুষ উন্মুখ হয়ে থাকে। একটু মমতা আর সান্নিধ্যের তেষ্টায়ই হয়তো তৃষিত হয়ে থাকে হৃদয়!

হেমার আজকাল যেন বিষণ্ণতার অসুখ হয়েছে। তার কোনো কিছুই ভালো লাগে না। সারাটাক্ষণ কেবল মনে হয়, আজ মন খারাপের দিন। আজ ঘরে বসে বিষাদময় মৌনতায় কাটিয়ে দেয়ার দিন। আর একটা বিষয় হয়েছে, সেটি হচ্ছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা একা বসে সে কেবল ভাবে, ভাবে আর ভাবে। রাজ্যের বিষয় নিয়ে ভাবে। এই ভাবনার যেন আর শেষ নেই। এই ভাবনারা বুড়ো অশ্বথের বিস্তৃত ডালপালার মতো। ক্রমাগত একটা ডাল থেকে আরেকটা ডাল পাতা বেরোতেই থাকে, বেরোতেই থাকে।

কিন্তু এই মুহূর্তে তার হঠাৎ মনে হলো ঘরের ভেতর থেকে থেকে সে ক্রমশই বিষণ্ণতায় ডুবে যাচ্ছে। বহুদিন ইউনিভার্সিটিতে যায় না সে। বেশিরভাগ সময়ই ফোন বন্ধ করে রাখে বলে বন্ধুদের সাথেও খুব একটা যোগাযোগ হয় না। নয়নের সাথেও কথা হয়নি আর। হেমা বারকয়েক ভেবেছিল নয়নকে ফোন দিবে। কিন্তু তারপর আবার কি ভেবে নিজেকে সামলে নিলো। হেমা কখনো অভিমানী মেয়ে হতে চায়নি। কথায় কথায় যারা গাল ফুলিয়ে অভিমান করে তাদের খুব একটা পছন্দও করে না সে।

তার ধারণা, যারা কথায় কথায় অভিমানে গাল ফোলায়, তারা একরকমের প্রচণ্ড আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বার্থপর মানুষ। এরা যুক্তি বুঝতে চায় না, বাস্তবতা বুঝতে চায় না। এরা যে কারণে যে মানুষটার প্রতি অভিমানী হয়ে ওঠে, সেই মানুষটির সেই কারণটির পেছনের ঘটনাটি হয়তো এরা কখনোই জানতেই চায় না, বুঝতেই চায় না। এই কথায় কথায় অভিমানী হয়ে ওঠা শ্রেণি যা বোঝে, তা হলো কেবল নিজের প্রাপ্তি, নিজের আনন্দ। সেই প্রাপ্তি কোনোভাবে অর্জিত না হলেই তারা অভিমানে গাল ফোলায়। কিন্তু হেমা তার আশপাশটা বুঝতে চেয়েছে। যতটা সম্ভব অভিযোগবিহীন থাকতে চেয়েছে।

অনেকদিন হলো, নয়ন হঠাৎ করেই হেমার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। অবশ্য তাদের সম্পর্কটা যে খুব বেশি মাখামাখির ছিল, তাও না। তবে একজন আরেকজনকে ধারণ করত। জানত, ওই মানুষটা যেখানেই থাকুক, যত দূরেই থাকুক, যেভাবেই থাকুক, মানুষটা আমার। এই জানাজানিটা সম্পর্কে খুব দরকার। একটা স্পষ্ট বোঝাঁপড়া। হেমার ধারণা সেই বোঝাঁপড়াটা তাদের ছিল। কিন্তু জগতে কোনো কিছুই কি নিশ্চিত? সম্ভবত না। এই অবধি এসে হেমার ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়।

তার মনে হয়, আমরা যখন প্রবল ভালোবাসায় আচ্ছন্ন থাকি, তখন মনে হয় সারা জনমের জন্য এই মানুষটা, এই ভালোবাসাটা আমার। নিশ্চিত করেই আমার। এটা আমার আজন্ম অধিকারের বিষয়। কিন্তু এমন অসংখ্য সম্পর্কও মুহূর্তেই ভেঙে যেতে দেখেছে হেমা। সম্পর্ক আসলে কি? কেবলই কি নির্দিষ্ট সময়ের অনুভূতি? এর বাইরেও অবশ্য আছে, সামাজিক, রীতি প্রথায় আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে থাকা সম্পর্ক। কিন্তু সেই সম্পর্কের ভেতর অনুভূতির গভীরতায় প্রবহমান সম্পর্ক কতটুকু?

নয়নের সাথে একটা দীর্ঘ যোগাযোগহীনতা চলছে হেমার। সেটি নয়নের কারণেই। নয়ন কোনো একটা ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে। কিন্তু বিষয়টা সে হেমাকে বলতে চায় না। হেমা যে জানার চেষ্টা করেনি, তা নয়। সম্ভাব্য সকল উপায়েই সে জানার চেষ্টা করেছে। তবে একটা জিনিস হেমা সব সময় মানে, ভালোবাসি বলেই ভালোবাসার সেই মানুষটার সকল কিছু আমায় জানতে হবে, এটি ঠিক নয়। প্রতিটি মানুষেরই নিজের একান্ত কিছু গোপন বিষয় থাকে, অনুভূতি থাকে। কেবল তার একার, খুব একান্ত একার কিছু হাসি থাকে, কান্না থাকে, আনন্দ থাকে, দুঃখ থাকে। সেই হাসি কান্না, আনন্দ দুঃখের অনুভূতি স্পর্শ করবার ক্ষমতা জগতে আর কারোরই থাকে না। হেমা এই সংবেদনশীলতার জায়গাটুকু বোঝে বলেই কখনোই নয়নের অনুভূতির সেই একান্ত গোপন কুঠুরিতে প্রবেশ করতে চায়নি। কিন্তু ওই যে প্রশ্নটা, সম্পর্ক তাহলে কতটা দূরত্বে, কতটা বিচ্ছিন্নতায়, কতটা স্পর্শহীনতায়, কতদিন টিকে থাকে!

জগতের সকল সম্পর্কই পারস্পরিক। সকল সম্পর্কই স্বার্থযুক্ত। একজন যদি দিনের পর দিন অন্যজনের মন খারাপের বিশেষ সময়ের সঙ্গী হয়, তার খারাপ সময়ে হাতখানা শক্ত করে ধরে, মুঠোবন্দি করে সাহস দেয়, সমর্থন যোগায়, তবে অন্যজনের জন্য তা অবচেতনেই একটা অব্যক্ত ঋণ তৈরি করে। সেও তার অমন দুঃখের সময়, মন খারাপের সময় চায় এই মুহূর্তে তার হাতখানাও কেউ শক্ত করে ধরুক। খানিকটা সময় পাশে বসে কথা বলুক। বলুক আমরা আছি, ছিলাম, থাকব। এমন অসংখ্য দুঃসময় আমাদের শক্ত করে ধরে রাখা হাতের পাশ ঘেঁষে চলে যাবে। কিন্তু আমরা থাকব।

আচ্ছা, এই যে-কোনো একজন যদি কেবল ওই নেয়াটুকুই শুধু জানে, দেয়াটুকু আর না জানে না, তবে সেই সম্পর্কটা কি আর আদৌ টিকে থাকে? সম্ভবত না। বা থাকলেও সেটি ক্রমশই হয়ে ওঠে মৃত সম্পর্ক।

হেমার আচমকা মনে হলো, সে ভাববে না ভাববে না করেও এত কিছু কেন ভাবছে! নয়ন আর তার সম্পর্কটাও কি তাহলে ক্রমশই মৃত সম্পর্ক হয়ে উঠেছে? এই দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা, যোগাযোগহীনতা তাকেও কি দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলছে না? একটা অদৃশ্য শক্তিশালী দেয়া তুলে দিচ্ছে না? এই যে এখন, এই মুহূর্তে তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে নয়নের সাথে রিকশায় হুড তুলে ঘুরতে। কিন্তু সে নয়নকে ফোন করে এই কথা বলতে পারছে না। নয়ন যদি না করে দেয়? দিলে দিবে, তার বলতে ইচ্ছে করছে, সে বলুক না? কিন্তু সে পারছে না। কেন পারছে না?

এই প্রশ্নটির স্পষ্ট উত্তর হেমা জানে। যদিও উত্তরটি সে মানতে চায় না। কিন্তু জানে। ওই মানুষটা যেখানেই থাকুক, যেভাবেই থাকুক, মানুষটা আমার, এই অনুভূতিটা, অধিকারবোধটা ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে। অধিকারবোধ হারিয়ে গেলে সেই সম্পর্কে আর কি থাকে? কিছুই না। হেমার এই প্রথম মনে হলো, তাদের সম্পর্কটা আর নেই। কিন্তু দুজনের কেউ সেটা স্বীকার করতে চাইছে না। তার ভান করছে সকলই আছে, ঠিক আগের মতোই। একই রকম আছে। আসলে নেই। কিছুই নেই।

হেমা বাসা থেকে বের হলো তার কিছুক্ষণ পর। কিন্তু বাসা থেকে বের হবারও দীর্ঘ সময় অবধি সে বুঝতে পারল না কোথায় যাবে? দুপুর হয়ে গেছে। একটা মৃদু হাওয়া চারধারে। গত কিছুদিনের ভ্যাপসা গরমটা কেটে গেছে। এই সময়টায় রিকশায় ঘোরার চেয়ে আনন্দদায়ক কিছু নেই। কিন্তু সে রিকশাও নিল না। শরীরটা খানিক দুর্বল। তবুও সে লালমাটিয়া থেকে হেঁটে ধানমন্ডি সাতাশের দৃক গ্যালারীর সামনে এলো। গ্যালারিতে কোনো একটা প্রদর্শনী চলছে, কী মনে করে সেখানে ঢুকে পড়ল হেমা। ঢুকেই মন ভালো হয়ে গেল তার। যৌনকর্মীদের সন্তানদের পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করছে একটি সংগঠন। তারাই এই প্রদর্শনীর আয়োজন করছে। প্রদর্শনী জুড়ে যৌনকর্মীদের বাচ্চাদের আঁকা ছবি। সে সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিগুলো দেখল। বাচ্চাগুলোকেও। গ্যালারিতে জড় করেছে আয়োজকরা। তারা মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটাতে খেলছে। ছবিগুলো দেখে হেমার যে কী অসম্ভব মন ভালো হয়ে গেল! মন ভালো হয়ে যাবার কারণ তারা অনেকেই একটা কাল্পনিক জগতের ছবি এঁকেছে। সেই ছবিতে তারা অনেকেই তাদের মায়ের ছবি এঁকেছে, বাবার ছবি এঁকেছে, ভাই বোনের ছবি এঁকেছে। কী অদ্ভুত! অথচ এরা কেউ এদের বাবা কে জানে না। এদের ভাই বোন নেই। অথচ এদের চিন্তার জগতেও কী আশ্চর্যভাবেই না বাস করছেন একজন বাবা! একটি পরিবার?

আচ্ছা, এই শিশুদের কারোর বাবারও কি মনে পড়ে এমন করে তার এই সন্তানের কথা? হয়তো অনেকেই জানেনই না যে এই সন্তান তার, কিন্তু কেউ কেউ নিশ্চয়ই জানেন, যারা জানেন, তাদের কি একবারও মনে হয়?

হেমা কয়েকটা শিশুর সাথে কথাও বলল। তাদের স্বপ্নের গল্প, ভাবনার গল্প, অভিজ্ঞতার গল্প। এইটুকু এইটুকু বাচ্চা কিন্তু এদের অভিজ্ঞতাগুলোও যে কী জীবন্ত আর বৈচিত্র্যময়!

হেমা গ্যালারি থেকে বের হয়ে দেখে বিকেলও মরে আসছে প্রায়। খানিকবাদেই সন্ধ্যা নামবে। সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝুপড়ি চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চা খেলো। সাথে একটা নোনতা বিস্কুট। খেতে মন্দ লাগল না। বেশ কিছুদিন ধরে কিছুই খেতে পারছিল না সে। এই ঝুপড়ি দোকানের চা আর বিস্কুট যেন জিভের স্বাদটা ফিরে আসার বার্তা দিলো। পুরোপুরি সন্ধ্যা নামতে আরো কিছুটা সময় বাকি। এক কাজ করলে কেমন হয়? রিকশা করে রবীন্দ্র সরোবর অবধি গিয়ে ঘুরে আসলে কেমন হয়? হেমা গেল। শুধু গেলই না। সে একা একা রবীন্দ্র সরোবরের পাশের বটগাছটার তলায় দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইল। চারপাশের এই এত মানুষ, এত এত কোলাহল, তার কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করতে পারল না। লেকে অন্ধকার নেমে আসলেও চারপাশের বৈদ্যুতিক আলোর আভায় অন্ধকার খুব একটা পাত্তা পাচ্ছে না। সেখানে নৌকায় করে তরুণ-তরুণীরা ঘুরছে। হাসিখুশি মুখের কত কত সুখী মানুষ। হেমা সহজে ঈর্ষান্বিত হয় না। কিন্তু এই মুহূর্তে তার খুব ঈর্ষা হতে লাগল। নাকি কষ্ট? সে ঠিকঠাক বুঝতে পারছে না। কিন্তু ওই হাস্যোজ্জ্বল তরুণ-তরুণীদের দেখে মুহূর্তের জন্য তার নিজেরও তাদের একজন হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। কম বয়সী কয়েকজোড়া বাবা-মাও আছেন, সাথে তাদের সন্তান। এক তরুণী মেয়ে তার মাঝবয়সী বাবা-মাকে নিয়ে নৌকায় চড়েছে। নৌকার দুলুনীতে বাবা-মা বেশ ভয় পাচ্ছেন। তারা শক্ত করে একে অপরের হাত ধরে রেখেছেন। তরুণী। তা দেখে যেন বেশ মজা পাচ্ছে। সে ইচ্ছে করেই নৌকাটি আরো খানিকটা দোলাচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে। কে জানে, হয়তো সে চাইছে, তার এই ঢেউ তোলা দুলুনিতে তার মা-বাবা আরো শক্ত করে পরস্পরকে ধরে রাখুক!

হেমার আচমকা মনে হলো, তার কাছে কি এমন করে ঢেউ তোলার মতো কিছু আছে, যা দিয়ে সে তার বাবা আর মাকে এমন শক্ত করে ধরে রাখাতে পারবে?

*

মাঝরাতে পলাশীর মোড়ে ডিম পরোটা খেতে এসেছিল রাহাত। এসে দেখে নয়ন বসে আছে। নয়নকে দেখে সে অবাক হয়েছে। হেমার সাথে খানিক আগেই তার কথা হয়েছে। নয়নের কথা জিজ্ঞেসও করেছে সে। কিন্তু হেমা বলেছে তার কাছে নয়নের কোনো খবর নেই। নয়ন যে ঢাকা এসেছে এটা কি তাহলে হেমা জানে না!

বিষয়টা কেমন অদ্ভুত লাগল রাহাতের। সে দীর্ঘদিন থেকেই এই দুজনকে চেনে। হেমা তার ক্লাসমেট। কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু। অন্তত রাহাতের কাছে তো বটেই! আর নয়নকে সে হেমার সূত্রেই চেনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর মেডিকেল গা লাগানো দূরত্বে বলে হেমা আর নয়নের দেখা হওয়া কিংবা গল্পের জায়গাগুলো ওই ঘুরে ফিরে একই। তাতে রাহাত যেমন থেকেছে, থেকেছে অন্য আরো অনেকেই। কিন্তু হেমার ব্যাক্তিত্ব যেমন আলাদা করে কোনো কিছু না করেই আপনা আপনিই মানুষকে কাছে টানে, আকর্ষণ করে। নয়নের ব্যাক্তিত্বটা তেমন নয়। নয়ন মানুষকে আকর্ষণ করে ঠিকই, কিন্তু কোথায় যেন একটা স্পষ্ট দূরত্বও রেখে দেয়। কিন্তু এই এতদিন পর নয়ন ঢাকাতে, অথচ হেমা কিছুই জানে না! বিষয়টা কেমন রহস্যময় মনে হলো রাহাতের কাছে। মুহূর্তের মধ্যে তার বুকের ভেতর একটা সম্ভাবনার আভাসও। দেখা দিলো। দুজনের মধ্যে কোনো সমস্যা হয়নি তো! বড় কোনো সমস্যা!

রাহাত অবশ্য ওই সম্ভাবনাটুকুকে পাত্তা দিলো না। সে নয়নের কাছে গিয়ে বসল। নয়ন ফিরে তাকাতেই রাহাত দাঁত বের করে হাসল। বলল, কেমন। আছেন?

অদ্ভুত ব্যাপার হলো নয়ন যেন রাহাতকে চিনতেই পারল না। সে দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, হ ভালো।

রাহাত বলল, নয়ন ভাই, আপনি ঠিক আছেন তো? আপনাকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে।

নয়ন বলল, কেন বলুন তো?

রাহাত বলল, কারণ, আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন।

নয়ন থতমত খেয়ে গেল। ছেলেটাকে সে চেনে। কিন্তু কোথায় দেখেছে সেটা মনে করতে পারছে না। ছেলেটার নামটাও মনে করতে পারছে না সে। রাহাত নয়নের কাঁধে হাত রাখল। তারপর বলল, আপনি কি কোনো কারণে চিন্তিত? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার উপর দিয়ে বড় রকমের কোনো ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

নয়ন বলল, না না। আমি ঠিক আছি।

রাহাত বলল, কিন্তু আপনার চোখ টকটকে লাল। দেখেও অসুস্থ লাগছে।

নয়ন বলল, তেমন কিছু না। ইনসমনিয়া যাচ্ছে। ঘুম হচ্ছে না অনেকদিন।

রাহাত বলল, আপনি কি কিছু খাবেন?

নয়ন বলল, নাহ্। আমি খেয়ে এসেছি। তুমি বসো। আমি তাহলে আজ উঠি।

রাহাত বলল, আপনি কোথায় যাবেন?

নয়ন বলল, বাসায় যাব। এখন কটা বাজে বলো তো?

রাহাত বলল, দুটা।

নয়ন বলল, আমাকে একটা রিকশা ডেকে দাও তো।

রাহাত রিকশা ডাকতে গেল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এত রাতে কোনো রিকশাই নয়নের বাসা অবধি অতটা দূর যেতে চাইছে না। রাহাত ফিরে এসে বলল, কোনো রিকশাই যেতে চাইছে না ভাই। আপনি যদি একটু অপেক্ষা করেন, আমি হল থেকে আমার একটা ফ্রেন্ডকে ফোন করে তার বাইক নিয়ে চলে আসতে বলতে পারি। সে আপনাকে দিয়ে আসবে।

নয়ন কিছুক্ষণ কি ভাবল। সে ঠিকমত দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। একটা ইলেক্ট্রিকের খামের সাথে ভর দিয়ে সে দাঁড়াল। তারপর রাহাতকে ডেকে বলল, আচ্ছা, বলো।

রাহাত তার এক বন্ধুকে ফোন দিয়ে নিয়ে এলো। নয়ন বাইকের পিছে উঠতে রাহাত বলল, নয়ন ভাই, আপনি ওকে লোকেশনটা বলে দিয়েন। আর আপনার অবস্থা খুবই খারাপ। সাবধানে যাবেন।

নয়ন জড়ানো গলায় বলল, আচ্ছা।

ছেলেটা বাইক চালু করে দু’চার চাকা সামনে বাড়াতেই নয়ন তাকে বাইক থামাতে বলল। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে রাহাতকে হাতের ইশারায় ডাকল। রাহাত দাঁড়িয়েই ছিল। সে কাছে আসতে নয়ন তার কাঁধে হাত রেখে বলল, তোমার নাম রাহাত। তুমি হেমার সাথে পড়। আমরা বারকয়েক একসাথে আড্ডাও দিয়েছি। রাইট?

রাহাত মাথা নাড়ল, রাইট।

নয়ন মৃদু হেসে বলল, তোমাকে না চেনার তো কিছু নেই। আই ওয়াজ জাস্ট জোকিং।

রাহাতও হাসল। নয়ন বলল, যাচ্ছি তাহলে। শীঘ্রই দেখা হবে।

রাহাত মাথা নাড়ল। নয়নরা মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগ অবধি সে দাঁড়িয়েই রইল। তারপর ফোন বের করে চিন্তিত ভঙ্গিতে হেমাকে ফোন করল। হেমার ফোন বন্ধ। আজকাল হেমারও যে কি হয়েছে। দিনরাত ফোন বন্ধ, ফেসবুক বন্ধ। কি যে হচ্ছে দুজনের! হেমাকে রাহাত ভালোবাসে সত্যি। এটিও সত্যি এই ভালোবাসা আর আট-দশজনের চেয়ে বেশিই। কিন্তু এই ভালোবাসাটা অদ্ভুত! এখানে কেবল ভালোবাসাই আছে, প্রত্যাশা নেই। মাঝে মধ্যে যে নিজের এই অনুভূতি নিয়ে রাহাত ভাবে না, তা না। কিন্তু সে চেষ্টা করে দেখেছে, হেমাকে ভালো না বেসে সে থাকতে পারে না। রাহাত তাই নিজেকে নানান যুক্তি দেয়। বোঝায়, পাওয়া হয়ে গেলে পাওয়ার জন্য এই যে দুর্নিবার আকর্ষণ, এ কী থাকে? ছোটবেলায় কত খেলনা পাওয়ার জন্য কেঁদে কেটে অস্থির করে তুলত সে বাবা-মাকে। দিনের পর দিন গোঁ ধরে থাকত। খেত না, ঘুমাত না, স্কুলে যেত না। কিন্তু সেই খেলনা পেয়ে যাওয়ার পর দিন দুই-চার বা বড়জোর সপ্তাহখানেক তা নিয়ে মেতে থাকত! তারপর অবহেলায় পড়ে থাকত ঘরের কোণে। চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে কী আশ্চর্য এক বৈপরীত্য! রাহাতের আজকাল বরং মনে হয়, যা পাওয়া হয় না, তা-ই হয়তো আরো বেশি রয়ে যায় চিরকাল।

রাহাত হলে ফিরে হেমাকে আর্জেন্ট’ লেখা মেসেজ পাঠিয়ে ঘুমাতে গেল। হেমার সাথে কথা হলো পরদিন দুপুরে। হেমা ফোন খুলে মেসেজ দেখেই ফোন করেছে। রাহাত বলল, দেখা করতে পারবি?

হেমা বলল, কেন, এই মুহূর্তে না দেখলে মরে যাবি?

রাহাত বলল, আমি না, তুই।

হেমা হাসলো। বলল, এই মুহূর্তে তোকে না দেখলে আমি মরে যাব?

রাহাত বলল, যেতেও পারিস।

হেমা বলল, তাহলে আর চোখের সামনে আসিস না। বেঁচে থাকতে ভাল্লাগছে না। তোর কারণে হলেও না হয় মরে যাই।

রাহাত বলল, নয়ন ভাইয়ের বিষয়ে জরুরি কথা আছে।

হেমার বুকের ভেতরটা হঠাৎ ধক করে উঠল। নয়নের বিষয়ে কি এমন জরুরি কথা বলবে রাহাত! আর সাথে সাথে তার মনে হলো, এই যে নয়নের কথা শুনেই তার বুকের ভেতরটা কেমন ধক করে উঠল, এটা কী? এটাই ভালোবাসা? এই অনুভূতিটুকুকে কোনো কিছুতে ঢেকে রাখা যায় না। অগ্রাহ্য করা যায় না।

রাহাতের সাথে হেমার দেখা হলো তার ঘণ্টাখানেক পর। তারা বসেছে টিএসসিতে। হেমা বলল, কি হয়েছে?

রাহাত বলল, তার আগে বল নয়ন ভাইয়ের কি হয়েছে? সে যে ঢাকায় তুই জানিস?

হেমা বলল, হু জানি।

রাহাত বলল, কোনো সমস্যা না তো? আই মিন, তোদের দুজনের মধ্যে?

হেমা হাসলো, উঁহু। উই আর ওকে। এভ ইউ হ্যাভ নো চান্স অ্যাট অল বন্ধু।

রাহাত হাসল না। বলল, নয়ন ভাইয়ের কি কোনো সমস্যা যাচ্ছে? অন্য কোনো সমস্যা?

হেমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হু। আমি বলছি শোন। ছোটবেলা থেকেই নয়ন খুব একা একা মানুষ হয়েছে। ওর বাবা-মা একটু চুপচাপ ধরনের। আর ওকে কারো সাথে খুব একটা মিশতেও দিত না। এই ধরনের বাচ্চারা দুইরকম হয়। খুব জেদী, খুব বেপরোয়া অথবা খুব চুপচাপ, শান্ত। ও ছিল দ্বিতীয়টা। সারাদিন বই পড়ত। নিজের একটা আলাদা জগৎ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেই জগৎটা ছিল খুব শান্ত-স্নিগ্ধ একটা জগৎ। মানে এই ধর, এমন হয় না যে আঁকা ছবির মতো ব্যাপার-স্যাপার। সবকিছুতেই একটা সৌন্দর্য। তবে সারাক্ষণ বাসায় একা একা থাকতে থাকতে ওর মধ্যে একটা সঙ্গীরও খুব অভাব তৈরি হয়েছিল। ওর মা বলতে গেলে সেই অর্থে কারো সাথেই তেমন কথা বলেন না। টুকটাক যা বলার তা ওই নয়নের সাথেই। তাও না বলার মতোই। বাবাও খুব ইন্ট্রোভার্ট। এমন একটা ছেলে একা একা বেড়ে উঠেছে একটা ঘরের মধ্যে। তার জগৎ বলতে বই আর কল্পনা। সে কেবল জানত বই পড়তে আর ভাবতে। এরপর স্কুল-কলেজ-মেডিকেল। মানুষ ওকে পছন্দ করত, কিন্তু ও মিশতে পারত না কারো সাথে তেমন। খুব ঘরকুনো স্বভাবের। ক্লাস শেষ হতেই বাসায় গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যেত। ওই ঘরটাই ওর জগৎ। ওই সময়ে গ্রাম থেকে একটা মেয়ে আসে ওদের বাসায়। নাম আসমা। বছর চার পাঁচ আগের ঘটনা। মেয়েটা আসে আসলে কাজ করতে। কিন্তু খুব অল্পদিনেই মেয়েটার প্রতি একটা মায়া জন্মে যেতে থাকে নয়নের। একদম অজপাড়া গাঁ থেকে আসা একটা মেয়ে। হঠাৎ শহরে চলে এসেছে। সবকিছুই তার অপরিচিত। বাবা-মা, ভাই-বোনের কথা ভেবে কাঁদে। কেউ কিছু বললেও ভয় পায়, না বললেও ভয় পায়। সারাক্ষণ একটা আতঙ্কে থাকে। একটা বেড়াল লাফিয়ে পড়লেও সে আঁৎকে ওঠে। বিষয়গুলো নয়ন খুব খেয়াল করত। ওর কাছে আসমা তখন একটা আবিষ্কারের মতো। একটা খেলনার মতো। আসমার এই জড়োসড়ো হয়ে গুটিয়ে যাওয়া, ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে থাকা বিষয়গুলো ও খুব ফিল করত। ও প্রচণ্ড মমতা দিয়ে সেই ভয়গুলো কাটাতে লাগত। নয়নের ভাবনার জগৎটা তখনো খুব চমৎকার একটা কোমলতায় পূর্ণ। মেয়েটার প্রতি ধীরে ধীরে ওর প্রচণ্ড একটা দুর্বলতা তৈরি হয়…।

রাহাত হঠাৎ হেমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, বয়স কত মেয়ের? কাজের মেয়ের সাথে প্রেম-ফ্রেমের ব্যাপার নয় তো?

হেমা আচমকা গম্ভীর গলায় বলল, রাহাত!

এই সামান্য রাহাত উচ্চারণেই হেমার গলায় কিছু একটা ছিল। রাহাত চুপ করে গেল। হেমা বলল, মেয়েটার প্রতি অসম্ভব একটা মায়া তৈরি হয়েছিল নয়নের। ধর অনেকটা এমন যে ঘরে একটামাত্র মানুষ যার সাথে ও কথা বলতে পারে। গল্প করতে পারে। রাগ উঠলে মারতেও পারে। কিন্তু সেই মার খেয়েও সে কিছু মনে করে না। খানিকবাদে বেড়ালের বাচ্চার মতো গা ঘেঁষে এসে বসে। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলে খুশিতে গলে যায়। ধর একটা ছোট বাচ্চার মতো। ছোট বোনের মতো। নয়নের তো আর কোনো ভাই-বোন নেই। আসমা আসলে ওর বোনই হয়ে গেল। আর সে যে ওর কতটা ছিল, এটা চিন্তাও করা যাবে না।

হেমা একটু থামল। কিছু একটা ভাবল সে। তারপর বলল, একটা বিষয়। ধর নয়নের সাথে আমার পরিচয়েরও আগে আসমা ওদের বাসায় আসে। আমার আর নয়নের চেনা জানাও ঠিক ওই সময়টাতেই। এই ধর চার-পাঁচ বছর। প্রেমের প্রথম প্রথম কি হয়? নিজেদের নিয়ে অনেক কথা হয় না? অনেক প্ল্যান, রোমান্টিসিজম। আমাদের মধ্যে এমন কিছুই হয়নি। নয়নের সাথে আমার সম্পর্কটাই হয়েছিল ওই আসমাকে নিয়ে কথা বলতে বলতেই। আসমা ওর। কাছে ছিল ওর দীর্ঘদিনের একঘেঁয়ে একার পৃথিবীতে একটা আলাদা জগৎ। একটা শান্ত পুকুরে ঢেউয়ের মতো। একটা ঘটনা বলি শোন, একবার মাছ কুটতে গিয়ে আসমা হাত কেটে ফেলল। খুবই খারাপভাবে কেটেছিল। নয়ন তখন ঢাকায় নেই। বাসায় কেউ বিষয়টাকে তেমন পাত্তাও দেয়নি। আসমার হাতে ইনফেকশন হয়ে গেল। ভয়াবহ অবস্থা। আমার মনে আছে নয়ন রাতের পর রাত ঘুমায়নি। মেডিকেলের স্টুডেন্ট ও। এই সামান্য বিষয় নিয়ে এমন করা ওর জন্য অস্বাভাবিক। বিষয়টা দেখলে যে কেউ বলবে আদিখ্যেতা। কিন্তু আমি ওকে সামান্য হলেও বুঝতে পারতাম। ও এমনই ছিল আসমার জন্য। আমারো মাঝে-মধ্যে রাগ হতো। অন্য কেউ হলে হয়তো ভুলও বুঝত। কিন্তু আমি তো ওকে বুঝতাম। এরপর নয়ন একদিন ওর বাবাকে বলল বাসায় আর মাছ না আনতে। আসমাকে পড়াত ও। ওর ধারণা আসমাকে ঠিকঠাক টেক কেয়ার করা গেলে, আসমা চমকে দেবার মতো কিছু একটা করে ফেলবে। নয়ন আসলে আসমাকে নতুন করে সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। এই নেশাটা ওর ছিল। সৃষ্টির নেশা। ও বলত, আমি একটা অন্য আসমাকে তৈরি করছি। আসমাও বিষয়টা বুঝতে পেরেছিল। সে তার বাবা-মার চেয়েও নয়নকে বেশি ভালোবাসত।

হেমা আবারো থামল। তারপর খুব গভীর শান্ত গলায় বলল, নয়ন ওকে কি ডাকতে শিখিয়েছিল জানিস? দাদা। ও বলত আসমা ওকে যখন দাদা বলে ডাকে, ওর বুকের ভেতর রক্ত ছলকে ওঠে। ওটা ছিল ওর কাছে জগতের সবচেয়ে আনন্দময় বিষয়ের একটা।

হেমা খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলছিল। কিন্তু এই দীর্ঘ কথাবার্তাকে রাহাতের তেমন আগ্রহের কিছু মনে হচ্ছিল না। হেমা থামতেই সে বলল, তুই তো দেখি ধান ভানতে শীবের গীত গেয়ে ফেললি।

হেমা সাথে সাথে কোনো জবাব দিলো না। সে ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে তাকাল। মাথার উপরে নীল-সাদা মেঘের ঝকঝকে আকাশ। সে সেই আকাশের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ। তারপর স্পষ্ট গলায় বলল, একদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সবাই দেখল আসমা মারা গেছে। সে এমনি এমনি মারা যায়নি। সে মরেছে বিষ খেয়ে। ইঁদুর মারার বিষ। সে আত্মহত্যা করেছে।

রাহাত রীতিমতো একটা ঝুঁকির মতো খেলো। এই কথা সে আশা করেনি। সে খপ করে হেমার বা হাতখানা ধরে ফেলল। তারপর বলল, কি বলছিস তুই? কেন?

হেমা বলল, কেউ জানে না কেন! নয়ন রীতিমত পাগলের মতো হয়ে গেল। তখন তার ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। শেষ পরীক্ষাটা বাকি। আসমার লাশ পাঠিয়ে দেয়া হলো বাড়ি। পরীক্ষা শেষ হবার পর নয়ন আবার সেই চার পাঁচ বছর আগের মতো হয়ে গেল। একদম চুপচাপ। একা। কারো সাথে মেশে না। কথা বলে না। ঘর থেকে বের হয় না। ফোন বন্ধ করে রাখে। জগতের সকল কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। মাঝে-মধ্যে গভীর রাতে আমাকে সামান্য সময়ের জন্য ফোন দিত। ফোন দিয়ে কাঁদত। সে ঘুমাতে পারত না। চোখ বুজলেই মৃত আসমার মুখটা চলে আসত চোখের ভেতর।

হেমা থামতেই রাহাত বলল, তারপর?

হেমা বলল, তারপর হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গেল নয়ন। কিছুদিন বাদে জানা গেল সে গিয়েছে ফতেহপুর। ফতেহপুরই আসমাদের বাড়ি।

হেমা চুপ করে রইল। চুপ করে রইল রাহাতও। অনেকটা সময় কেটে গেল নৈঃশব্দ্যে। তারপর রাহাত হেমার হাতখানা শক্ত করে ধরে বলল, আমি জানি না কি হয়েছে। কিন্তু নয়ন ভাই নিডস ইওর সাপোর্টস। এই মুহূর্তে তোকে খুব দরকার তার। তিনি খুব খারাপ আছেন।

হেমা মাথা নিচু করে রাহাতের দিকে তাকাল। তারপর বলল, তুই কি করে জানলি?

রাহাত গতরাতের ঘটনা খুলে বলল। হেমা সব শুনে বলল, কি হয়েছে ওর? শরীর খারাপ ছিল কোনো কারণে?

রাহাত বলল, ঠিক জানি না। তবে উনি স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন না। ওনার চোখ টকটকে লাল। ঠিকমতো পা ফেলতে পারছিলেন না। আমাকে চিনলেন না অবধি।

হেমা চুপ করে রইল। রাহাত বলল, কিছু মনে করিস না, উনি কি ড্রাগস নিতেন? বা ধর, নিদেনপক্ষে ড্রিংকস করতেন? আমার কেন যেন অমন মনে হলো।

হেমা ঝট করে তার হাতখানা ছাড়িয়ে নিলো। তারপর কঠিন গলায় বলল, কক্ষনো না।

রাহাত খানিক চুপ করে থেকে বলল, আমারও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। তবে একটা ব্যাপার সিওর, তিনি স্বাভাবিক ছিলেন না। এমনও হতে পারে, রাতের পর রাত ঘুমাতে পারছেন না বলে হয়তো হাই ডোজ কোনো স্লিপিং পিল বা সিডাকটিভ নিয়েছেন। তারপরও ঘুম হচ্ছিল না, এইজন্যই হয়তো রাতে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তিনি নিজেও বলছিলেন, দীর্ঘ ইনসমনিয়া। ঘুম হচ্ছে না কিছুতেই। এমন হয়, খুব বেশি ডোজের ঘুমের ওষুধ খাওয়ার পরও ঘুম না হলে এক ধরনের ইস্যুশন হয়। মাথা ঝিমঝিম লাগে। এলোমেলো লাগে চারপাশ। হাঁটাচলায় ভারসাম্য রাখতে কষ্ট হয়।

হেমা কথা বলল না। বসে রইল চুপচাপ। রাহাতও। হেমা বুঝতে পারছে না সে এখন কি করবে! সে কি নয়নের বাসায় যাবে? কিন্তু কেমন হবে ব্যাপারটা? নয়নের বাবা-মায়ের কথা সে শুনেছে। কিন্তু কখনোই দেখা বা কথা হয়নি তাদের কারো সাথেই। তার চেয়েও বড় কথা নয়ন কীভাবে নিবে বিষয়টা?

দীর্ঘ সময় ভেবেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারল না হেমা। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সে যদি নয়নের বাসায় যায়, তবে এখন তা সম্ভব নয়। মনটা কেমন ভারি হয়ে উঠছে আবার। মাথার ভেতর চিনচিনে একটা ব্যথা হচ্ছে। বাসায় ফেরা দরকার। এই ব্যথাটা আজকাল প্রায় প্রায়ই হচ্ছে। কখনো কখনো ব্যথাটা অসহনীয়ও হয়ে ওঠে। সে চট করে উঠে দাঁড়াল। রাহাত অবাক হয়ে তাকাল। তারপর বলল, কি হলো?

হেমা বলল, বাসায় যাব। শরীরটা ভালো লাগছে না।

রাহাত বলল, চল পৌঁছে দিয়ে আসি।

হেমা বলল, না, আমি যেতে পারব।

.

সে রাহাতকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না। তাকালও না আর রাহাতের দিকে। সোজা হেঁটে টিএসসি থেকে বেরিয়ে রিকশা ধরল। রিকশায় উঠতেই কেমন স্নিগ্ধ একটা হাওয়া ছুঁয়ে দিলো তাকে। এই হাওয়াটুকু ভারি ভালো লাগল হেমার। সে হঠাৎ রিকশাওয়ালাকে বলল, মামা, একটু ঘুরে যাবেন? দোয়েল চত্বর, শহীদ মিনারের ওদিকটা ঘুরে এসএম হল, ইডেন কলেজ হয়ে।

রিকশাওয়ালা প্যাডেল চাপতে চাপতে বলল, আইচ্ছা।

রিকশা বাংলা একাডেমির সামনে হয়ে দোয়েল চত্বর অবধি পৌঁছাল। সেখানে সামান্য জ্যাম। হেমা রিকশায় বসে কতকিছুই যে ভাবছে! এলোমেলো সব ভাবনা। একটা সহজ, সাধারণ জীবন তার, অথচ মাত্র ক’দিনেই কেমন জটিল হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই জটিলতা নিয়েও আজকাল আর এত ভাবতে ভালো লাগে না তার। এই ভাবনা রোগটা সে তাড়াতে চায়। ভাবতে বড্ড ক্লান্ত লাগে আজকাল।

কিন্তু হেমার ভাগ্যটা বড় খাঁরাপ। ভাবনারা তার পথ ছাড়ল না। বরং আরো দৃঢ় হয়ে পথ আগলেই রইল। সে এতক্ষণ খেয়াল করেনি। তার ঠিক ডান পাশেই, সামনের রিকশাটাতেই সে যাকে দেখল, তাকে এখানে আশা করেনি হেমা। রিকশায় বসে আছেন তার বাবা আসলাম সাহেব। আসলাম সাহেবের সাথে রিকশায় বসে রয়েছে ঝলমলে হাস্যোজ্জ্বল এক মেয়ে। দেখতে তরুণী মনে হলেও মেয়েটার বয়স খুব একটা কম হবে বলে মনে হলো না হেমার। চল্লিশের কাছাকাছি হবে হয়তো! তরুণী হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে। তার কথা শুনে আসলাম সাহেব হাসতে হাসতে ভেঙে গড়িয়ে পড়ছেন মেয়েটার গায়ে। তাদের দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে জগতের সুখীতম মানব-মানবী।

*

তাবারন কাঁদছে। পারুল বারকয়েক কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু তাবারন কিছু বলেনি। বরং পারুল তার সামনে গেলেই তাবারন কান্না বন্ধ করে দেয়। পারুল আজও গেল। সে যাওয়ার সাথে সাথেই তাবারন চুপ মেরে গেল। পারুল রাগল না। সে নরম গলায় বলল, তাবারন খালা, কান্দেন ক্যান, কারণটা বলেন। কারণ না বললে সমস্যার সমাধান কি কইরা হইব?

তাবারন চুপ। পারুল বলল, আপনের বুকে কি আবার ব্যথা হইতেছে? ঘা শুকায় নাই পুরাপুরি?

তাবারন চুপ। পারুল তাবারনের পাশে গিয়ে বসল। তারপর বলল, ডাক্তার বলছিল ঘাও না শুকাইলে তারে জানাইতে। আপনে বলেন, ঘাও কি শুকায় নাই? কোনো চুলকানি হইতেছে?

তাবারন চুপ। পারুলের হঠাৎ রাগ উঠে গেল। সে গলা চড়িয়ে বলল, আপনেরা সবাই কি পাইছেন আমারে? আমি তো একটা মানুষ, নাকি? এই বাড়ি একটা পাগলের কারখানা। এহন আপনেরা সবাই মিল্যা কি আমারেও পাগল বানাইবেন নাকি?

তাবারন এবারও চুপ। পারুল এবার রীতিমত চেঁচাল, হয় কথা কইবেন! কান্দনের কারণ কইবেন। না হইলে আর একবারও কানবেন না। একবারও না। যদি কান্দেন তাইলে এই বাড়ির বাইরে গিয়া কানবেন। এই আমার এক কথা। এই বাড়িতে থাইকা আর কান্দন যাইব না। কথা বুঝছেন?

তাবারন কথা বুঝেছে কিনা বোঝা গেল না। তবে সে এবার শব্দ করল। সে শব্দ করে কান্না শুরু করল। তাবারন বসা ছিল তার ঘরের মেঝেতে মাদুরের ওপর। আচমকা বসা থেকে সে সেই মাদুরের উপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল।

পারুল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সেই কান্না দেখল। তারপর প্রচণ্ড রাগ, বিরক্তি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আজ নুরুন্নাহার সুস্থ। তিনি ভরদুপুরে উঠানের মাঝখানে বসে কচুর লতি কুটছেন। কিছুক্ষণ আগে পুকুর পারের নিচু জলাভূমি থেকে এই কচুর লতি তিনি কুড়িয়ে এনেছেন। পারুল মাকে দেখে বলল, এইগুলান যে রানবা, এইগুলান খাইলে যে গলা চুলকায়, সেইটা তুমি জানো না?

নুরুন্নাহার বললেন, গলা চুলকাইব ক্যান?

পারুল বলল, যদি রোদ না লাগে, আর পানি বা ছেওয়ার মইধ্যে কচু হয়, তাইলে সেই কচুতে যে গলা চুলকায় এইটা তুমি জানো না? এইটা কি নতুন কোনো ঘটনা?

নুরুন্নাহার বললেন, মাইয়া মাইনষের বয়স হইতে হয় অল্পতেই। তুই দামড়ি মাইয়া হইছস, এহনও তোর বয়স হইল না?

পারুল মায়ের কথা বুঝতে পারল না। সে আজকাল নুরুন্নাহারকে নিয়ে খুব ভয়ে থাকে। কখন সে সুস্থ আর কখন অসুস্থ এ বোঝা বড় কঠিন। এইজন্য তার কথাবার্তা মনোযোগ দিয়ে শোনা খুব জরুরি। নুরুন্নাহার বলল, মাইয়া মাইনসের মায়ের প্যাটেরতন পইড়াই অনেক কিছু জানতে হয়। না জানলে বিয়ার জইন্য ভালো গেরস্ত পাওন যায় না। আর গেরস্ত পাইলেও বিয়ার পর যায় শ্বশুর-শাশুরির খোটা শুনতে শুনতে।

পারুল বলল, এইসব কথা বলতেছ ক্যান?

নুরুন্নাহার বললেন, এই যে কচু। এই কচু পানিতে থোক আর ছেওয়ায় হোক। রান্ধনের সময় এই কচুর লগে কয় দানা তেঁতুল দিবি। তারপর রানবি। খাইলে মনে হইব বেহেস্তের খানা খাইতে আছস।

পারুল বলল, তোমার বেহেস্তের খানা তুমিই খাও। ওই জিনিস আমি খাইতে পারব না।

নুরুন্নাহার কথা বললেন না। তিনি এক মনে তরকারি কুটছেন। তাবারন কেঁদেই চলছে। নুরুন্নাহার বললেন, ওই ছেমড়ি হারাদিন এমন কান্দে ক্যান? সে কি এই বাড়ির রাজরানী নাকি? তারে তিন বেলা রাইন্ধা-বাইরা সাজাই গোজাইয়া দিতে হইব? মুখে খাওয়াইয়া দিতে হইব না?

পারুল বলল, সে যে অসুস্থ তুমি জানো না? আর তারে এই অবস্থা কে করছে তুমি জানো না?

নুরুন্নাহার বললেন, মাগী গো আবার সুস্থ-অসুস্থ কী? আর যেইহানে পুড়ছে, ওইহানে ওর চুলকানি বেশি আছিল। চুলকানি কমে নাই এহনো? নাকি আগুন আরো লাগব?

পারুল বলল, মা, একখান কথা বলো তো? তুমি কি আসলেই অসুস্থ? নাকি অসুস্থের ভান ধইরা থাক? এই তাবারন খালারে তুমি সুস্থ থাকলেও দেখতে পারো না, অসুস্থ থাকলেও দেখতে পারো না। ঘটনা কি, আমারে খুইল্যা কও তো?

নুরুন্নাহার বললেন, ঘটনা কিছু না। আমি মাগী-ছাগী দেখতে পারি না।

পারুল বলল, তোমার মুখ এত খারাপ ক্যান মা? সব সময় খালি খারাপ ভাষা বাইর হয়।

নুরুন্নাহার বললেন, আমি নিজে খারাপ মানুষ, এইজইন্য আমার মুখেরতন খারাপ ভাষা বাইর হয়। তুই আর তোর বাপে সাধু-সন্ন্যাসী মানুষ। এইজইন্য তোগো মুখ দিয়া সাধু কথা বাইর হয়।

পারুল বলল, তুমি খারাপ মানুষ কেন হইবা? তুমি মানুষ ভালো।

নুরুন্নাহার বললেন, আমি ভালো মানুষ হইলে কি আর আমার ভাতারে আমারে ছাইড়া অন্য মাগী গো ধরে শুইতে যাইত!

পারুল তার মার মুখে এই কথা অসংখ্যবার শুনেছে। তার বাবা আব্দুল ফকিরকে নিয়ে নানান আজে-বাজে কথা তার মা বলেন। শুধু যে মার মুখে শুনেছে তা-ই নয়। মাঝে-মধ্যে এখান সেখান থেকেও সে টুকটাক কথাবার্তা শুনেছে। কিন্তু বাবাকে সে একজন বাবার বাইরে অন্য কিছু একটি মুহূর্তের জন্যও ভাবতে পারেনি। মানুষটা কার কাছে কেমন তা সে জানে না, কিন্তু তার কাছে আব্দুল ফকির একজন অসাধারণ বাবা। মাঝে-মধ্যে এই বাবার জন্যই তার নিজেকে বড় ভাগ্যবতী মনে হয়। বাবাকে নিয়ে তার অসাধারণ সব স্মৃতি আছে। সেইসব স্মৃতি একটা মানুষের এক জীবনের সেরা সংগ্রহ হতে পারে।

তার স্পষ্ট মনে আছে, বাবা তাকে নিয়ে একবার গিয়েছিলেন রায়গঞ্জ ধান ভানাতে। তখন তাদের খুব অভাবের কাল। ধান ভানানো শেষে নৌকায় যে চাল নিয়ে তারা ফিরছিল, তা-ই ছিল বছরের বাকি সময়ে তাদের সকলের খোঁড়াকি। চাল নিয়ে নৌকায় ফেরার পথে হঠাৎ তুফান উঠল নদীতে। সে কী ভয়াবহ তুফান! নৌকার পাল ছিঁড়ে উড়ে চলে গেল। আব্দুল ফকির বহুকষ্টে নাওখানা নদীর তীরের কাছাকাছি নিয়ে এলেন। কিন্তু নদীর তীর জুড়ে নলখাগড়ার দীর্ঘ বন। এই বনের মধ্যে নৌকা আটকে গেলে সমস্যা। এখন নৌকা নিয়ে যেতে হবে গুণ টেনে। আব্দুল ফকির দড়ি বেঁধে নিলেন নৌকার গলুইয়ের সাথে। তারপর হাঁটু পানিতে নেমে সেই দড়ির অন্য প্রান্ত কাঁধের সাথে বেঁধে নৌকা টেনে নিয়ে যেতে থাকলেন সামনে। কিন্তু নৌকার ভেতর একা একা প্রচণ্ড ভয়ে কাঁদছিল পারুল। তখন তার বয়স কত হবে? পারুল স্পষ্ট মনে করতে পারে না। তবে চার-পাঁচ হতে পারে। বেশিও হতে পারে। আব্দুল ফকির নৌকা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, আর পারুল সমানে চিৎকার করে কাঁদছে। তিনি তখন গুণ টানা রেখে মেয়ের কাছে গিয়ে বললেন, কি গো মা, কান্দো ক্যান?

পারুল বাবার কথার জবাব দিলো না। সে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতেই বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আব্দুল ফকির দুই হাতে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বাইরে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি। এই ঝড়-বৃষ্টিতে নৌকা এভাবে এইখানে রেখে দেওয়া নিরাপদও না। যে-কোনো সময় উল্টে যেতে পারে। তাছাড়া ঝড় বৃষ্টি কখন থামে তার কোনো ঠিকঠিকানাও নেই। এদিকে সন্ধ্যা নামতে দেরীও নেই বেশি। রাতে নৌকা এখানে আটকে গেলে ভয়াবহ বিপদ। তিনি কোনোভাবেই পারুলকে নৌকার ভেতর রাখতে পারলেন না। কী করবেন এখন? শেষ পর্যন্ত সেই চালভর্তি নৌকা কাঁধে করে গুণ টেনে নিয়ে যেতে হলো তাকে। কাঁধের দুইপাশে দুই পা রেখে বসিয়ে দিতে হলো পারুলকেও। পারুল বাবার মাথা ধরে বাবার কাঁধে পা ঝুলিয়ে বসে রইল। তার বাবা অচিন্তনীয় কষ্টে সেই একই কাঁধে অতগুলো চালের ওজনে ভারি নৌকাখানাকে সেই নলখাগড়ার ভেতর দিয়ে মাইলের পর মাইল গুণ টেনে নিয়ে এলেন।

আব্দুল ফকিরের বাম পায়ের সামনের দিকটা কাটা। ফলে সেই পায়ে তিনি পুরোপুরি শক্তিও পান না। এশার আজানের সময় তিনি নৌকা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। পারুল তখন বাবার কাঁধেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আব্দুল ফকির এক হাতে মেয়েকে শক্ত করে চেপে ধরে আরেক হাতে গুণ টেনে যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন গুণের দড়ির ক্রমাগত ঘর্ষণে তার কাঁধের চামড়া, মাংস ছিলে পিঠ বেয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছিল। হাঁটু অবধি নলখাগড়ার ঝোঁপের মধ্য দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে তার পা দু’খানা ধারাল নলখাগড়ায় কেটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। সেইসব ক্ষত বেয়ে অঝর ধারায় রক্ত বইছিল।

এরপর প্রায় দিন সাতেক বিছানা থেকেই উঠতে পারেননি আব্দুল ফকির। পারুলের এমন কত কত স্মৃতি যে মনে আছে! একবার কাঠবাদাম কাটতে গিয়ে সে হাত কেটে ফেলল। তার সেই কাটা হাত দেখে আব্দুল ফকির বাচ্চাদের মতো কেঁদে বুক ভাসালেন। তিনি সারাক্ষণ পারুলের পাশে বসে থাকতেন। পারুল ঘুমালে পারুলের পাশে সারারাত জেগে থাকতেন। যদি ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতে বা নড়তে গিয়ে সে ব্যথা পায়!

সেই বাবাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে পারুলের সহ্য হয় না। কিন্তু সে কিছু বলেও না। বাবার সাথেও যে তার সম্পর্ক খুব মাখামাখির, তাও না। বরং একটা স্পষ্ট দূরত্ব যেন রয়েই গেছে। বড় হবার সাথে সাথে সেটি আরো বেড়েছে। কিন্তু তারপরও বাবা তার কাছে সব সময়ই আলাদা কেউ। এই মানুষটার কাছে সে যেন এক রাজকন্যা। হতে পারে তার বাবা রাজা নন, কিন্তু পারুল জানে, তার বাবার কাছে সে সত্যিকারের রাজকন্যাই।

পারুল তার মাকে বলল, তোমারে আল্লাহর দোহাই লাগে মা, আব্বারে নিয়া সব সময় এমন কুকথা বইল না।

নুরুন্নাহার বললেন, বাপের আসল রূপখান যদি দেখতি, তাইলে বুঝতি, আকথা-কুকথা কারে কয়?

পারুল বলল, তোমার বাপরে নিয়াও তো তুমি কত ভালো ভালো কথা কও। সেও কি ফেরেস্তা আছিল? তোমার বাপ বিয়া করছিল তিনখান। তার তিন বউর কাছে গিয়া জিজ্ঞাস কইরা দেখতা, তারা তাগো স্বামীর নামে কি কয়!

নুরুন্নাহার বললেন, হেইযুগে, টাকাওয়ালা সব মাইনষেই দুই-তিনখান কইরা বিয়া করত। তহন খারাপ মানুষ ভালো মানুষ বইলা কম বেশি বিয়া করত না। তহন বিয়া করত কাজ-কাম করানির লাইগ্যা। শত শত মণ ধান। উঠত, পাট উঠত, গম, মরিচ, ডাইল আরো কত ফসল উঠত। এত ফসল লওনের লোক পাইব কই? এইসময় যাগো আত্মীয়-স্বজন বেশি, তাগো হইত সুবিধা। মাসকে মাস এই আত্মীয়-স্বজনরা আইসা, থাইক্যা কাম কইরা দিয়া যাইত। দুই তিনটা বউ থাকলে আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যাও বাইড়া যাইত। কাজে-কামে সুবিধা হইত।

পারুল হঠাৎ হা হা হা করে হেসে উঠল। নুরুন্নাহার বললেন, ওইরম দাঁত কেলাইয়া হাসনের মতো কিছু কইছি আমি?

পারুল বলল, না, তা কও নাই। তয় এই প্রথম কেউরে দেখলাম যে তার বাপের দুই তিনখান বিয়া করনের পক্ষে কথা কয়। তোমার বাজান মানুষ যেমন হোক, মাইয়া একখান জন্ম দিছে মাশাল্লাহ ভালো।

নুরুন্নাহার বললেন, খবরদার আমার বাপেরে লইয়া কোনো আজেবাজে কথা কইবি না। সে আছিল ফেরেস্তা। আশেপাশের দশগ্রামের মানুষে তারে এক কথায় মাইন্য করত।

পারুল বলল, আমার বাপরেও করে। তারে দগ্রামের বেশিই করে।

নুরুন্নাহার বললেন, এমনে এমনে করে না। ডরায় দেইখ্যা করে। তাও সবাই করে না। করে ওই গরীব যারা আছে তারা। তাগো নানান উপায়ে ডর দেহাইয়া দমাইয়া রাহন যায় তো!

পারুল বলল, হ। অন্যের বাপ সব সময় খারাপ। নিজের বাপ সব সময় ভালো। তা আমার বাপ আমার কাছে ভালো হইলেই হইব। তোমার কাছে। ভালো হওনের দরকার নাই।

নুরুন্নাহার হঠাৎ কচুর লতি কোটা রেখে উঠে গেলেন। পারুল প্রথমে ভেবেছিল নুরুন্নাহার ঘরে কিছু আনতে গেছেন। কিন্তু অনেক সময় পরও যখন তিনি ফিরলেন না, তখন পারুলের বুকের ভেতরটা হঠাৎ ছ্যাৎ করে উঠল। আবার কোনো অঘটন নয় তো! সে দৌড়ে প্রথম তাবারনের ঘরে গেল। তাবারন কাঁদতে কাঁদতে ঘরের মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। পারুল একটা লম্বা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। তারপর নুরুন্নাহারের ঘরে এলো। নুরুন্নাহার অন্ধকার ঘরে বসে আছেন। ঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ। পারুল মায়ের কাছে গিয়ে বসল। তারপর আচমকা দুই হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ও মা। মাগো।

নুরুন্নাহার কোনো কথা বললেন না। তিনি চুপচাপ বসেই রইলেন। পারুল তার এই মাকে সেভাবে পায়নি। ছোটবেলা থেকেই সে মাকে দেখেছে পাগল। অপ্রকৃতিস্থ। যেটুকু সময় ভালো থাকতেন, সেটুকু সময়ও সারাটাক্ষণ বাবাকে গালমন্দ করতেন। বিষয়টা পারুলের ভালো লাগত না। কারণ এইটুকু বয়সের বেশিরভাগ সময়ই সে বেড়ে উঠেছে বাবার কাছে। সেই বেড়ে ওঠায় মুহূর্তের জন্যও তার বাবাকে খারাপ কিছু মনে হয়নি তার। নাকি পিতৃপ্রেমে অন্ধ সে?

মার সাথে এমন আহ্লাদ করে কথা বলতেও তার কেমন অস্বস্তি হয়। এই বিষয়গুলোর সাথে সে পরিচিত নয়। তবে তার বাবার যে কোনো একটা সমস্যা রয়েছে, সেটি পারুল খুব সামান্য হলেও বোঝে। মানুষ যা বলে তার কিছু না কিছু হলেও তো সত্য। কিন্তু ওই যে, সচেতন কিংবা অবচেতন, কোনোভাবে। সে তা কখনোই বিশ্বাস করতে চায় না। তাছাড়া নিজের চোখে সে এমন কিছু কখনো দেখেওনি। তবে তার মায়ের এই সুদীর্ঘ অসুস্থতার পেছনে তার বাবার যে একটা ভূমিকা রয়েছে, তা পারুল অনেকের কাছ থেকেই ঠারে-ঠুরে শুনেছে। কিন্তু এ নিয়ে সে বাবাকে কখনো কিছু জিজ্ঞেস করেনি। আসলে কি জিজ্ঞেস করবে সে?

আর মাকে জিজ্ঞেস করার প্রশ্নই আসে না। বাবার বিরুদ্ধে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলেই হয়েছে। তার মুখ ছুটবে আগুনের গোলার মতো। পারুল মাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। সে হঠাৎ টের পেল, নুরুন্নাহারের শরীরটা থেকে থেকে কাঁপছে। পারুল হাত বাড়িয়ে মার মুখটা তার দিকে ঘোরাল। নুরুন্নাহার কাঁদছেন। তার চোখের পানিতে গাল ভিজে গেছে। পারুল বলল, ও মা, কান্দো ক্যান?

নুরুন্নাহার কথা বললেন। তবে এবার আর তিনি সবসময়ের মতো। ঝাঁঝালো গলায় আক্রমনাত্মক ভঙ্গিতে কথা বললেন না। তিনি খুব ধীরে সুস্থে শান্ত ভঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, জীবন নষ্ট করনের লইগ্যা কান্দি। একলা আমার জীবন না। আরো অনেকের জীবনই। আমার বাপজান কোনোদিন এই ওঝা-ফইরের লগে আমারে বিয়া দিতে চান নাই। আমি তার কথার অবাধ্য হইছি। বংশের মুখে চুনকালি মাখছি। মাইখ্যা তার লগে ভাইগ্যা আইছি। আমার জইন্য আমার আর বইনোগোও বাজান এক লগে বিয়া দিয়া দিছে। আমার লগে কারো কোনো যোগাযোগ রাখতে দেয় নাই। সেই আমি আইসা দেখি এই মানুষটা একটা আস্তা ইবলিশ শয়তান। বাইরে থেইকা কিছু বোঝা যায় নাই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এর রূপ যে দেখছে, সে জানে এ কত বড় হারামি। আইজ আমি পাগল, আমার কথার কোনো দাম নাই। কেন নাই? আমি কি এইরম আছিলাম? আছিলাম না। আমারে এইরম বানাইছে সে। কত অত্যাচার যে এই মানুষটা আমারে করছে! রাইতের পর রাইত ঘুমাইতে দেয় নাই। জ্বীনে ভূতে ধরছে কইয়া ঘরের মইধ্যে আটকাইয়া আমার চিকিৎসা করছে। খাওন দেয় নাই, পানি দেয় নাই। আমি চিকুর দিয়া মাইনষেরে কইছি, আপনেরা একটু শোনেন, আমারে কিছুতে ধরে নাই, আমি সুস্থ স্বাভাবিক একটা মানুষ। সে আমারে পাগল বানাইতেছে। আপনেরা একটু আমার বাপ-ভাইরে খবর দেন। কেউ আমার কথা শোনে নাই। ঘরের মইধ্যে আটকাইয়া পিটাইতো। ভাত দিত না খাইতে। কতদিন মাথার মইধ্যে বাড়ি মারছে! যাতে মাথায় আঘাত পাইয়া পাগল হইয়া যাই। পায় ধইরা কানতাম, লাথি দিত! সারাদিন-রাইত ঘরের মইধ্যে কি জানি পুইড়া ধুয়া দিয়া রাখত। সেই ধুয়া গেলে মাথা ঘুরাইত। চোখে কিছু দেখতাম না। সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা লাগত। পানির লগে মিশাইয়া কত কি যে খাওয়াইছে। আরো কতকিছু। কিয়ের লগে মিশাইয়া খাওইয়াছে আল্লায় জানে! আর জানে, ওই ইবলিশ শয়তানটায়। আমার জীবনটা সে নষ্ট কইরা দিলো।

নুরুন্নাহার ডুকরে কেঁদে উঠলেন। পারুল মায়ের মাথাটা বুকে চেপে ধরে রাখল। এইসব কথা কম-বেশি সে মায়ের মুখ থেকে শুনেছে। শুনেছে, আরো কত কথাই! সবচেয়ে বেশি যা শুনেছে, তা হলো তার মা সময়ে-অসময়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। তার বাবার কথা শুনতেন না। জ্বিন, পরী, খারাপ শক্তির আছর থেকে বাড়ি-ঘর সুরক্ষিত রাখতে তার বাবা আব্দুল ফকির নানান মন্ত্র পড়ে বাড়ির চারপাশে কি সব পুঁতে বাড়ি বন্ধন দেন। কিন্তু তার মা যখন তখন সেই বন্ধনের বাইরে চলে যেতেন। এইসব কারণেই তার উপর বদজ্বীনের আছর পড়েছে।

গ্রামে এমন অনেক ঘটনা পারুল নিজ চোখেই দেখেছে। সে এও দেখেছে, সেইসব ঘটনায় তার বাবাকে লোকজন খুব সম্মানের সাথেই নিয়ে যায়। শুধু যে এই গ্রামেই নেয়, তাও না। দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসে তাকে নিয়ে যেতে। তার বাবার যে আলাদা একটা ক্ষমতা আছে সেটা সকলেই জানে। কিন্তু মা আজ যখন এমন করে বললেন, পারুলের তখন খুব মন খারাপ হয়ে গেল। এমন করে আগে কখনো সে মায়ের কথাগুলো শোনেনি। অনুভবও করেনি। তবে মা যা যা বলেছেন, তার সবই বাবা করেছে, এটা তার বিশ্বাস হয় না। মার মাথার ঠিক নেই, তিনি কখন কি বলেন, তা নিজেও জানে না।

নুরুন্নাহার কাঁদছেন। পারুল মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ও মা, মাগো।

নুরুন্নাহার জবাব দিলেন না। পারুল বলল, তোমারে এইসব কইরা আব্বার লাভ কি?

নুরুন্নাহার চট করে কান্না থামালেন। কিছু সময় স্থির স্তব্ধ বসে রইলেন। তারপর বললেন, কত কারণ যে আছে, সেইগুলান শুনলে আমারে আবারো পাগল বানাবি। তয় একটা কারণ শোন। এই একটা কারণ হইল ওই তাবারন!

পারুল যেন মায়ের কথা বুঝতে পারল না। সে আবার জিজ্ঞেস করল, কার কথা কইলা?

নুরুন্নাহার আবার বললেন, জানতাম আমার কথা বিশ্বাস করবি না। ভাববি আমি পাগল। কিন্তু ওই তাবারন। তাবারন একটা কারণ।

পারুল এবার মোটামুটি নিশ্চিত, মা আবারো আবোল-তাবোল বকবেন। তাবারনের কারণে বাবা তাকে এই অবস্থা করবেন! বিষয়টি যথেষ্ট হাস্যকর। নুরুন্নাহার বললেন, তাবারনের যে পোলা মাইয়া হইব না, এই খবর জানস?

পারুল বলল, এই খবর সকলেই জানে। এই কারণে তার দুইবার বিয়াও ভাঙছে।

নুরুন্নাহার বললেন, তারে যে বাজা বানাইছে তোর বাপ, এই কথা তুই জানস? কি খাওয়াইলে, কি পদ্ধতি করলে বাচ্চা-কাচ্চা হয় না, বাচ্চা-কাচ্চা। পেটে আইলেও নষ্ট করন যায়, এইগুলানের হাজারটা তরিকা যে তোর বাপ জানে, সেইটা তুই জানস?

পারুল এবার আর মায়ের কথার জবাব দিলো না। নুরুন্নাহার বলল, তোর বাপ যে কি জানে, এইটা কেউ জানে না। এইটা যদি কেউ জানত…!

কথা শেষ না করেই নুরুন্নাহার থেমে গেলেন। পারুল বলল, এইটা কেউ জানলে কি হইত?

নুরুন্নাহার বললেন, তোর বাপের কিছু হইত না। হইত যে জানত, তার। সে আমার মতো হইয়া যাইত। আধপাগল হইয়া রাস্তায় রাস্তায় ঘুরত।

নুরুন্নাহার সামান্য থেমে আবার বললেন, ওই তাবারনের বিয়া ভাঙনের লইগ্যা এইগুলান সব সে করছে। যাতে আজীবন তাবারনের এই বাড়িতে থাকুন লাগে। তাবারনের বয়স তহন কত? তেরো-চৌদ্দ বছর। সেই বয়সে সে মাইটার জীবনটা নষ্ট করছে! কেন নষ্ট করছে বুঝস না ছেমড়ি? এত বড় হইছস বাতাসে?

পারুল কিছু একটা আঁচ করছে। কিন্তু এই এতবছরেও কখনো কোনোদিন এমন কিছু দেখেনি যার জন্য সে কোনো সন্দেহ করবে! নুরুন্নাহার বললেন, ওই তাবারনের নরম শরীল। ওই শরীলটা তার খুব…।

পারুলের হঠাৎ যেন গা গুলিয়ে এলো। সে বলল, আল্লারস্তে একটু থামো মা। তোমার পায় পড়ি, একটু থামো। একটা মাইনষের নামে এত খারাপ কথা কইতে তোমার বাধে না মা? খারাপ হোক, ভালো হোক, মানুষটা তোমার স্বামী। আমার বাপ।

নুরুন্নাহার ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন। পারুলকে ছিটকে ফেলে দিলেন দূরে। তারপর চিৎকার করে বললেন, সব নেমকহারাম। সব নেমকহারাম। নিজের। প্যাটে যে মাইয়া ধরছি, সেও নেমকহারাম। সবাই ইবলিশ। এই দুইন্যায় আমি থাকত কোনো ইবলিশ রাখব না। আমার দাও কই? আমার দাও?

তিনি দৌড়ে ঘর থেকে বের হলেন। তারপর চিৎকার করে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে লাগলেন তাবারন আর আব্দুল ফকিরকে। পারুল ছুটে গিয়ে মাকে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু ততক্ষণে নুরুন্নাহার হাতে তুলে নিয়েছে সেই রামদা। তিনি রামদা নাচাতে নাচাতে বললেন, আইছি একা, যাইমু একা, সঙ্গে কেউ যাইব না, এই দুনিয়া ফানা হইব জাইনাও জানোনা না…

তিনি সুর করে একের পর এক এলোমেলো গান গাইতে লাগলেন। পারুল মাকে বার বার অনুরোধ করছে দা’খানা ফেরত দিতে, কিন্তু নুরুন্নাহার তার কিছুই খেয়াল করছেন না। পারুল শেষমেশ নুরুন্নাহারের দিকে এগুলো। সে নিশ্চিত, আর যাই হোক, অন্তত পারুলকে নুরুন্নাহার আঘাত করবেন না। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। নুরুন্নাহার চোখ বন্ধ করে সাই করে দা চালালেন। পারুল জগতের সকল অবিশ্বাস নিয়ে হতভম্ব চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। সে নিজের অজান্তেই সহজাত প্রবৃত্তিতে সামান্য বাঁ দিকে ঘুরে গেল। কিন্তু তাতেও বড় ধরনের আঘাত থেকে সে নিজেকে বাঁচাতে পারল না। তার বাহুর আড়াআড়ি প্রায় অর্ধেকটা মাংস কেটে দা খানা বেরিয়ে গেল। সেখানে বীভৎস এক ক্ষতস্থান তৈরি হয়েছে। হা করা মুখের মতো আড়াআড়ি। ফাঁক হয়ে আছে কেটে যাওয়া মাংসপিণ্ড। সেই ফাঁক গলে দরদর করে রক্ত বের হচ্ছে।

পারুল ডান হাতে ক্ষতস্থান চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ল। নুরুন্নাহার তখনো সাইসাই করে তার মাথার উপর দা খানা ঘোরাচ্ছেন। পারুল চূড়ান্ত অবিশ্বাস নিয়ে সেই দিকে তাকিয়ে রইল। নুরুন্নাহার এক পা দু পা করে এগিয়ে আসছেন। তার চোখে-মুখে স্পষ্ট হিংস্রতা। যেন এক নৃশংস, খুনি, উন্মাদিনী। পারুলের এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আর কিছুক্ষণের মধ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে! তার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই যে সে এখান থেকে সরে যাবে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে পারুল। নুরুন্নাহারকে দেখে এখন আর মনে হচ্ছে না যে। এই মানুষটা তার মা। দেখে মনে হচ্ছে, তার শরীরে অন্য কেউ ভর করেছে। নুরুন্নাহার একদম পারুলের হাতছোঁয়া দূরত্বে চলে এসেছেন। পারুল ভয়াবহ আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলল। যে-কোনো মুহূর্তে তার গলায়, মাথায় বা অন্য কোথাও প্রচণ্ড আঘাত পড়বে। তার জীবনের শেষ আঘাত। শেষ মুহূর্তের আঘাত। কিন্তু আঘাতটা পড়ল না। বরং অস্বাভাবিকভাবে নুরুন্নাহারের কণ্ঠে ভয়ার্ত করুণ স্বর শুনতে পেল পারুল। তিনি কাঁদো কাঁদো গলায় করুণ সুরে। বলছেন, আমারে মাফ কইরা দেন। আমি আর এরম করব না। আর করব না। আমারে মাফ কইরা দ্যান। এই শেষবারের মতো আমারে মাফ কইরা দেন।

নুরুন্নাহার কাঁদছেন। প্রচণ্ড ভয়-আতঙ্কের সেই কান্না। পারুল প্রবল বিস্ময় নিয়ে চোখ খুলে তাকাল। নুরুন্নাহার হাতের দা ফেলে তার সামনেই মাটিতে বসে থরথর করে কাঁপছে। তার দৃষ্টি পারুলের মাথার উপর দিয়ে পেছনে। পারুল ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকাল। সেখানে আব্দুল ফকির দাঁড়ানো। আব্দুল ফকিরের হাতে পুরনো মোটা একখানা লোহার রড। রডের একটি মাথা আগুনে পুড়িয়ে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করা হয়েছে। সেই চ্যাপ্টা মাথাখানা কুচকুচে কালো। পারুল কিছুই বুঝল না। তবে নুরুন্নাহারের অমন করুণ আর্তনাদ দেখে তার বরং মায়াই হতে লাগল। সে আব্দুল ফকিরকে কিছু বলতে যাবে। কিন্তু তার আগেই আব্দুল ফকির ঠান্ডা গলায় বললেন, ঘরে যাও মা।

আব্দুল ফকিরের এই কণ্ঠ পারুল তার এই জীবনে আর কখনো শোনেনি। কী ভয়ঙ্কর, ঠান্ডা, শীতল, গা হিম করা এক কণ্ঠ! মুহূর্তের জন্য পারুলের মনে হলো, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এতদিনকার চেনা মানুষটার মুখে আসলে কথা বলছেন অচেনা অজানা অন্য কোনো ভয়ানক এক মানুষ। সেই মানুষের নির্দেশ অমান্য করার ক্ষমতা কারো নেই। পারুল বহু কষ্টে উঠে দাঁড়াল। সে শরীরে শক্তি পাচ্ছে না। কিন্তু তারপরও টলতে টলতে নিজের ঘর অবধি গেল সে।

গভীর রাত অবধি নুরুন্নাহারের ঘর থেকে তার হাড় হিম করা আর্তনাদ শোনা গেল। কিন্তু পারুল ঘর থেকে বের হতে পারল না। কেউ একজন বাইরে থেকে তার ঘরের দরজা আটকে রেখেছে। সে চিৎকার করে তার বাবাকে, জুলফিকারকে, রতনকে ডাকল। কিন্তু কেউ কোনো সাড়া দিলো না।

আব্দুল ফকির পারুলের ঘরে এলেন মাঝরাতেরও পর। ততক্ষণে। নুরুন্নাহারের ঘর শান্ত-চুপচাপ। পারুলের ক্ষতস্থান যথেষ্ট গভীর। সেই ক্ষতস্থান থেকে ক্রমাগত রক্ত ঝড়ে ঝড়ে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তীব্র ব্যথায় জ্বর চলে এসেছে পারুলের। আব্দুল ফকির কিছুক্ষণ চুপচাপ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। তারপর জুলফিকারকে ডেকে বললেন নৌকা বের করতে। সেই রাতে পারুলকে নিয়ে নৌকায় রায়গঞ্জ রওয়ানা করলেন আব্দুল ফকির। ক্লান্তি আর দুর্বলতায় পারুলের প্রাণশক্তি নিঃশেষ প্রায়। সে মৃত মানুষের মতো নেতিয়ে পড়ে রয়েছে নৌকার পাটাতনে। তার বোধ ও শ্রবণশক্তি যেন ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। সে কি জ্ঞান হারাচ্ছে?

পারুলের মনে হচ্ছে সে জ্ঞান হারাচ্ছে। কিন্তু জ্ঞান হারানোর আগে পারুল শুনতে পেল আব্দুল ফকির কাঁদছেন। তিনি তার কন্যার মাথা কোলের মধ্যে নিয়ে বসে হাউমাউ করে কাঁদছেন। পারুলের চোখ বন্ধ, কিন্তু তারপরও সে

যেন তার বাবার কান্নাভেজা মুখখানা দেখতে পাচ্ছে। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। হাতখানা তুলে বাবার গাল ছুঁয়ে দিতে। বাবার চোখজোড়া মুছিয়ে দিতে। কিন্তু সে তার কিছুই করতে পারল না। সে কেবল টের পেল, তার বাবার কান্নার অশ্রু টপটপ করে ঝরে পড়ছে তার কপালে, চোখে, গালে, মুখে।

সেই অশ্রুরা তাকে স্পর্শ করে চলেছে পিতৃস্নেহের পরম মমতায়।

*

নয়নের সামনে বসে আছে হেমা। কিছুক্ষণ আগে সে নয়নদের বাসায় এসেছে। তার সাথে এসেছে রাহাত। রাহাত বসে আছে বাইরের ঘরে। নয়ন আধশোয়া হয়ে আছে বিছানায়। হেমা নয়নের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সিওর যে তুমিই নয়ন?

নয়ন হাসল। বলল, কনফিউশন হচ্ছে?

হেমা বলল, না, কনফিউশন হচ্ছে না।

নয়ন বলল, তাহলে?

হেমা বলল, অবিশ্বাস হচ্ছে।

নয়ন বলল, আমি কি খুব শুকিয়ে গেছি?

হেমা কথা বলল না। নয়নই বলল, তুমিও কিন্তু শুকিয়ে গেছ।

হেমা হাসল এবার। সে বলল, মেয়েরা শুকালে সেটা ফ্যাশন। একটু শুকানোর জন্য কতকিছু করে মেয়েরা।

নয়ন বলল, এই শুকানো সেই শুকানো না। রোগা হয়ে যাওয়া।

হেমা বলল, ওই একই হলো।

নয়ন চুপ। হেমাও। তাদের কথা কি ফুড়িয়ে গেল? অনেকটা সময় চুপ। করে বসে রইল দুজন। কথা নেই, শব্দ নেই। স্পর্শও নেই যেন কিছুতে। এই

যে কথা বলা, এও যেন কেবল কথা বলার জন্যই কথা বলা। দেয়াল ঘড়ির। কাঁটার টিকটিক শব্দের সাথে এই কথার শব্দের যেন কোনো তফাৎ নেই। আলাদা কোনো অর্থ নেই। অনেকক্ষণ বাদে হেমা বলল, আমাদের আর কোনো কথা নেই তাই না?

নয়ন বলল, কেন থাকবে না?

হেমা বলল, কি কথা?

নয়ন বলল, কথা কি নির্দিষ্ট করে হয়?

হেমা বলল, সেই অবাধ, অফুরন্ত কথার দিন কি আমাদের আছে?

নয়ন বলল, নেই?

হেমা বলল, কই? একটা দুটা কথার পরই তো কথারা সব ফুড়িয়ে যাচ্ছে। অনেক খুঁজে, চেষ্টা করেও কেউ আর একটা কথাও খুঁজে পাচ্ছি না।

নয়ন বলল, এই যে এখন বলছি।

হেমা হাসলো, বলল, হ্যাঁ, তা বলছি।

তারপর আবার নৈঃশব্দ্য। আবার কথা খোঁজা। আবার দেয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দ। এবার নয়ন বলল, ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস হচ্ছে?

হেমা হাসল, খুব হচ্ছে। তার হাসিতে শ্লেষ।

নয়ন বলল, হাসলে যে!

হেমা বলল, ইউনিভার্সিটির ক্লাসের কথা জিজ্ঞেস করলে তো তাই!

নয়ন বলল, কেন? ইউনিভার্সিটির ক্লাসের কথা জিজ্ঞেস করা যাবে না?

হেমা বলল, তা যাবে না কেন?

নিশ্চয়ই যাবে। আসলে গত পাঁচ বছরে আর কখনো এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করোনি তো! আজই প্রথম। তাই হয়তো আনন্দে উদ্ভাসিত হয়েছি।

নয়ন বলল, তুমি কেমন করে যেন কথা বলছ!

হেমা বলল, ঠিক তাই। আমি আসার সময় ভাবিনি এমন করে কথা বলব। ইনফ্যাক্ট আমি এমন করে কথা বলার মানুষও না। কিন্তু এখানে আসার পর থেকে আমার কিছু একটা হয়েছে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছি না। ভেতর থেকে যা আসছে, তাই-ই করছি, তাই-ই বলছি।

নয়ন বলল, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কেন? যা ভাবছ, তা লুকাতে হবে কেন?

হেমা বলল, এই যে, ভেতর থেকে যা আসছিল তা তুমি নিতে পারছিলে না।

নয়ন আবারো চুপ করে গেল। হেমা বলল, যখন খুব কাছের দুজন মানুষ পরস্পরের সাথে দেখা হবার পর অনেকক্ষণ ধরে কেবল কেমন আছ, কি করছ, কি খেয়েছ, পড়াশোনা কেমন চলছে- এই ধরনের প্রশ্নোত্তর করতে থাকে, তখন কি ধরে নিতে হবে জানো? তখন ধরে নিতে হবে এরা আর কাছের মানুষ নেই। এরা এখন অনেক দূরের মানুষ। কিন্তু এরা এখনো সেই আগের কাছের মানুষের ভাবনা থেকে বের হতে পারেনি। অথবা কাছের নেই জেনেও কাছের মানুষের ভান ধরে আছে।

নয়ন বলল, আমরা আর কাছের মানুষ নেই?

হেমা বলল, আমার তো মনে হয় না। তোমার কি মনে হয়?

নয়ন বলল, তোমার কেন মনে হচ্ছে না?

হেমা বলল, আমার এসেই তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। কাঁদতে কাঁদতেই বলতে ইচ্ছে করছিল, তুমি কী জানো, আমি তোমাকে কী অসম্ভব ভালোবাসি! তুমি যতটুকু ভাবো, তার চেয়েও হাজারগুন বেশি। তোমাকে না দেখতে দেখতে আমার গলা শুকিয়ে গেছে, তোমার গলা না শুনতে শুনতে আমি তোমার কণ্ঠস্বর ভুলে গেছি। তুমি কি আজ সারাদিন আমার সামনে বসে থাকবে? তাহলে আমার তেষ্টাটা মিটবে। আর তুমি কি খানিক পর পর আমার কানের কাছে ফিস ফিস করে বলতে থাকবে যে তুমি আমায় ভালোবাসো! অসম্ভব ভালোবাসো। খানিক পরপর এই কথাটা আমাকে বলবে? তাহলে তোমার কণ্ঠস্বরটা হয়তো আবার আমার মনে পড়বে! কিন্তু এই এসবের কিছুই কিন্তু আমি করতে পারিনি। আমার কেবল মনে হয়েছে, এটা ন্যাকামি হয়ে যাচ্ছে না তো! আমি কি আগে কখনো আর এমন করেছি? তার চেয়েও বড় কথা, আমি এটা করলে তুমি কি ভাববে? তুমি কি এটা স্বাভাবিকভাবে নেবে? নাকি বিরক্ত হবে! কি আশ্চর্য না?

নয়ন হেমার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। হেমাই বলল, কেউ যখন তার প্রিয়তম মানুষটাকে অধিকারের কথা, স্পর্শের কথা, তেষ্টার কথা, চাওয়ার কথা বলতে গিয়ে দ্বিধায় ভোগে, তাহলে তখন বুঝে নিতে হবে, সেখানে আর যাই থাকুক, অন্তত ভালোবাসাটা আর নেই।

নয়ন বলল, তুমি আজ সবকিছু এমন জটিল করে ভাবছ কেন?

হেমা হাসল বলল, ওই যে! হয়তো ভেতর থেকে আসছে বলে!

নয়ন বলল, তোমাকে কি আমি একটা রিকুয়েস্ট করতে পারি?

হেমা তার বুকে হাত রেখে অভিবাদনের ভঙ্গিতে বলল, ইটস মাই অনার ইওর এক্সিলেন্সি।

নয়ন হঠাৎ হাত বাড়িয়ে হেমার হাতখানা ধরল। নয়নের স্পর্শে হেমা কি সামান্য চমকে গেল! হেমার মনে হলো সম্ভবত এই প্রথম, নয়নের স্পর্শে সে কেঁপে উঠেছে। কিন্তু কেন? সুদীর্ঘ বিরতির স্পর্শ বলে? নাকি এই স্পর্শটা সত্যি সত্যিই অন্যরকম কিছু ছিল? নয়ন হেমার হাতখানা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে ধরে বলল, আমার সাথে এমন করে আর কথা বলো না প্লিজ। আমার ভালো লাগে না আর। আমি ক্লান্ত। আমার পাগল পাগল লাগে। আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয়।

নয়নের গলায় কিছু একটা ছিল। হেমা তার হাতের মুঠোয় থাকা নয়নের হাতখানা আরো শক্ত করে ধরল। তারপর বলল, আর বলব না।

নয়ন চুপচাপ হেমার হাত ধরে বসে রইল। বসে রইল হেমাও। মাঝখানে বয়ে যাচ্ছে নৈঃশব্দ্যের সময়। কিন্তু এই নৈঃশব্দ্যে কথা আছে অনেক। স্পর্শ আছে। অনুভূতি আছে। আছে খানিক আগের সেই দেয়াল ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দও। কিন্তু ওই শব্দও যেন এই নৈঃশব্দ্যের ভাষা বোঝে।

নয়ন ফিসফিস করে বলল, পুরুষ মানুষ হিসেবে আমি খুব দুর্বল তাই না?

হেমা বলল, সাহসী আর দুর্বলের বিষয়টা আমি ঠিক বুঝি না জানো? যে মানুষটা হাসতে হাসতে কাউকে খুন করে ফেলতে পারে, তাকে আমরা সাহসী বলি। আর যে মানুষটা সেই খুন দেখে কেঁদে ফেলে তাকে আমরা দুর্বল বলি। অথচ উল্টোটাই তো হওয়ার কথা ছিল। যে হাসতে হাসতে খুন করছে, সে বরং দুর্বল। মনুষ্যত্বের দিক থেকে দুর্বল। মানবিক অনুভূতির দিক থেকে দুর্বল। আর যে মানুষটি সেই খুন দেখে কেঁদে ফেলছে সে আসলে সবল, সেই মনুষ্যত্বের দিক থেকে সবল, মানবিক অনুভূতির দিক থেকে সবল। তাই না? অথচ দেখো কি অদ্ভুত! আমরা ভাবি উল্টোটাই।

হেমার কথা শুনে নয়ন ভারি অবাক হলো। মেয়েটা এই ক’মাসেই যেন কত বড় হয়ে গেছে! আচ্ছা, হেমা কি আগেই এমন কথা বলতো? নাকি এই ক’মাসে সে একা একা অনেক বড় হয়ে গেছে! নয়নের মনে হচ্ছে, তাকে ছাড়া হেমা ক্রমশই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আর হেমাকে ছাড়া সে হয়ে গেছে দুর্বল।

নয়ন বলল, আমি আমার ভেতরে একটা ভয়ঙ্কর গোপন কথা আটকে রেখেছি। সেই কথাটি আমি কাউকে বলতে পারিনি। না পারার পেছনে অনেক অনেক কারণ ছিল। কিন্তু কথাগুলো আমি আর আমার নিজের ভেতর আটকে রাখতে পারছি না। এই কষ্টটা আমি আর একা বহন করতে পারছি না। আমি কি কথাটা তোমাকে বলব?

হেমা বলল, তোমার যদি মনে হয় কথাটা আমাকে বললে ভালো লাগবে, তাহলে অবশ্যই বলবে। আর ভালো না লাগলে বলবে না।

নয়ন বলল, আমি এখনো বুঝতি পারছি না কথাটা তোমাকে বলা ঠিক হবে কিনা। বা তুমি কথাটিকে কীভাবে নেবে!

হেমা বলল, আমি ধরে নিচ্ছি তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুততম কথাটি বলবে। কিন্তু আমি সেটা শোনার জন্যও নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলেছি। তুমি নিশ্চিন্তে বলল।

নয়ন বলল, কথাটা শুনে তুমি আর যা-ই করো কেঁদে দিও না প্লিজ।

হেমা আরো শক্ত করে নয়নের হাতটা ধরল। তারপর বলল, তুমি নিশ্চিন্তে বলো। আমি কাঁদব না।

নয়ন বলল, কথাটা শোনার পরও তুমি আমার হাতটা ছেড়ে দিবে না।

হেমা বলল, দেবো না।

নয়ন লম্বা করে বার দুই দম নিলো। তারপর চোখ বন্ধ করল। তারপর আবার খুলল। তারপর হেমাকে বলল, তুমি কি তোমার মুখটা আরেকটু আমার কাছে আনবে? আমি চাই না, আমার এই গোপন কথাটা তুমি ছাড়া আর কেউ শুনুক।

হেমা তার মুখটা নয়নের কাছে নিয়ে এলো। নয়ন খানিকটা এগিয়ে হেমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। একমুহূর্তও না।

হেমা তার কথা রাখতে পারল না। সে নয়নের হাত ধরে বসে আছে। কিন্তু তার চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। তার এত এত প্রস্তুতির কোনো কিছুই কাজে লাগল না। নয়ন তাকে ভেঙে-চুড়ে, সমূলে নাড়িয়ে দিয়েছে। সে কাঁদছে। নয়ন হাসি হাসিমুখে তাকিয়ে হেমার সেই কান্না দেখছে। এই দৃশ্য অন্য কেউ দেখলে বলত, কী অদ্ভুত, মেয়েটাকে কাঁদিয়ে ছেলেটা অমন নিষ্ঠুরের মতো হাসছে কেন! কী আশ্চর্য! কিন্তু যিনি এই দৃশ্যটি তৈরি করেছেন, তিনি জানেন, এই দৃশ্যটি এই জগতের সবচেয়ে মায়াময় দৃশ্য।

*

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর হাতে লাঠি। মাঝখানে বহুদিন তিনি লাঠি ছাড়াই হেঁটেছেন। কিন্তু সেদিনের হঠাৎ বমির ঘটনার পর আজকাল আবার লাঠিখানা সাথে রাখছেন তিনি। তিনি বসে রয়েছেন তার ঘরে। আমোদি বেগম দাঁড়িয়ে আছেন তার সামনে। যে ঘটনার জন্য তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আমোদি বেগমকে ডেকেছেন, তাতে আমোদি বেগমের চিন্তিত বোধ করার কথা। কিন্তু আমোদি বেগম দাঁড়িয়ে আছেন হাসি মুখে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এস্কান্দারকে বললেন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। তারপর আমোদি বেগমকে বললেন বসতে। আমোদি বেগম তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সামনে রাখা চেয়ারে বসলেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ শান্ত স্বাভাবিক গলায় বললেন, কেমন আছ তুমি?

আমোদি বেগম বললেন, বাতের বেদনা ছাড়া, মাশাল্লাহ ভালো আছি।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আর কোনো অসুবিধা আছে?

আমোদি বেগম বললেন, আছে।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, কি অসুবিধা?

আমোদি বেগম বললেন, বাতের বেদনা।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, সেইটার বিষয় তো আগেই বললা।

আমোদি বেগম বললেন, আসল ঘটনা তো বলি নাই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, কিসের আসল ঘটনা?

আমোদি বেগম বললেন, বাতের।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ভারি বিরক্ত লাগছে। কিন্তু তিনি তা প্রকাশ করলেন না। বললেন, বাতের আবার আসল ঘটনা কি?

আমোদি বেগম বললেন, বয়সকালে আপনে প্রত্যেকদিন আমারে নিয়ম কইরা তিন বেলা পিটাইতেন। পিটানোর কারণ আছিল, আমি কথায় কথায় হাসি কেন? হাসি বন্ধ করার চেষ্টা যে আমি করি নাই, তা না। কিন্তু তারপরও হাসি আসত। বন্ধ করতে পারতাম না। কেউ মারা গেছে, সেই সংবাদও আমি দিতাম হাসতে হাসতে। এই হাসি দেইখ্যাই আপনে আমারে বিয়া করছিলেন। কিন্তু বিয়ার পর আমার হাসন হইলো মানা। অনেক চেষ্টা কইরাও যহন হাসি বন্ধ করতে পারলাম না। তহন এক রাইতে আপনে আমারে ডাইকা কইলেন, আইজ তোরে আমি জন্মের মতো হাসামু। সেই রাইতে আপনে আমারে গরুর মতো বাইন্ধা পিটাইলেন। কিন্তু আপনে কইলেন, ব্যথা পাইলেও আমি কানতে পারব না। আমার হাসতে হইব। কানলেই আরো জোরে পিটান। কোহিনূর তহন ছোট। অর সামনে বইসাই আপনে পিটাইতেন। আপনে পিটান আর আমি হাসি। কী আচানক কাহিনি বলেন খাঁ সাব? আচানক না?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ গম্ভীর হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, এই ঘটনার লগে বাতের কি সম্পর্ক?

আমোদি বেগম বললেন, সেই পিটানিতে শরীলে যে বেদনা জমা হইছিল, সেই বেদনা তো শরীল ছাইড়া আর যায় নাই। সেই বেদনা এতদিন শরীলেই লুকাই আছিল। এহন এই বুড়া বয়সে আইসা আবার বাতের বেদনা হইয়া। জাইগা উঠছে।

আমোদি বেগম হাসলেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তাকিয়ে আছেন তার দিকে। আমোদি বেগম বললেন, এহন আবার যদি একটু আগের মতো বেয়ান, বিয়াল, রাইত- এই তিনবেলা পিটাইতেন, তাইলে মনে হয় বাতের বেদনাটা যাইত।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আমোদি বেগমের সাহস দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন! এমন আমোদি বেগমকে তিনি এর আগে কোনোদিন দেখেননি! এত সাহস সে পেল কোথায়! আমোদি বেগম আরো কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই তাকে হাতের ইশারায় থামতে বললেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। তারপর বললেন, তোমার ঘটনা কি সেইটা নিয়া আমার মাথা ব্যথা নাই। আমার যেইটা নিয়া মাথা ব্যথা সেইটার বিষয়ে যা যা জিজ্ঞাস করব, ঠিক তাই তাই উত্তর দিবা। কথা পরিষ্কার?

আমোদি বেগম বললেন, জ্বে পরিষ্কার।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, সেইদিন যে ফজু ব্যাপারীর বউ সালেহারে খবর দিয়া বাড়িতে আনতে বলছিলাম, সেই কথা তো মনে আছে তোমার?

আমোদি বেগম বললেন, জ্বে, মনে আছে।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তোমারে দেখতে বলছিলাম, সালেহার হাতে বা গায়ে সোনার কোনো গয়না আছে কিনা, তুমি কি দেখছিলা?

আমোদি বেগম বললেন, জ্বে, দেখছিলাম।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তার শরীলে কোনো গয়না আছিল?

আমোদি বেগম বললেন, জ্বে আছিল।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, সেই কথা তুমি আমার কাছে লুকাইছিলা?

আমোদি বেগম বললেন, জ্বে, লুকাইছিলাম।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, সালেহারে যখন আমি আমার ঘরে ডাকছি, তহন তারে তুমি গয়নাখান খুইলা লুকাই রাইখ্যা আমার সামনে আসতে বলছিলা?

আমোদি বেগম বললেন, জ্বে। বলছিলাম।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, ফজু ব্যাপারী যে এক কলসী গয়না পাইছে, আর সেইটা যে আমি সন্দেহ করতেছি, এই কথা তুমিই সালেহারে বইলা দিছিলা?

আমোদি বেগম বললেন, জ্বে। ঠিক ধরেছেন।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, ফজু ব্যাপারীর বাড়িতে রাইতের আন্ধারে ডাকাতির নামে লোকজন পাঠাইয়া যে সেই গয়নার কলসির খোঁজ করা হইব,

এই কথাও তুমি আগেভাগেই জানতা?

আমোদি বেগম বললেন, জ্বে, জানতাম।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এই ঘটনা তোমারে কে জানাইছে?

আমোদি বেগম বললেন, কেউ জানায় নাই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, কেউ না জানাইলে তুমি জানলা কেমনে?

আমোদি বেগম বললেন, খবির আর এস্কান্দার কথা বলতেছিল, আমি আড়ালে দাঁড়াইয়া শুইন্যা ফালাইছি।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তারপর রাইতের আন্ধারে আগেভাগে গিয়া এই কথা তুমি ফজু ব্যাপারীরে জানাই আসছ?

আমোদি বেগম বললেন, জ্বে। ঠিক ধরেছেন। তবে তাতে আপনের ক্ষতি কিছু হয় নাই। সে আগে থেইকাই জিনিস তার ঘরে রাহে নাই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তুমি কি বুঝতে পারতেছ যে তুমি কত বড় অন্যায় করছ?

আমোদি বেগম বললেন, না, বুঝতে পারতেছি না।

তীব্র রাগে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর লাঠি ধরা হাতখানা কাঁপছে। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সেই রাগ প্রকাশ করলেন না। যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখলেন। পরবর্তী কথাটা বলার আগে সময় নিয়ে নিজের রাগ সংবরণ করলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, ক্যান বোঝো নাই যে তুমি একটা অন্যায় করছ?

আমোদি বেগম বললেন, ফজু ব্যাপারী যদি কিছু পাইয়াও থাহে, সেইটা তার জিনিস। সেই জিনিস আপনে চুরি করবেন কেন? আমি তো একখান ভালো কাজ করছি। চুরি হইতে পারে এই কথা গেরস্তরে আগেভাগে জানাই দিছি। এইটা অন্যায় হইব ক্যান? ধরেন, আপনের ঘরে চুরি হইব, এইরম কোনো ঘটনা যদি আমি আগেভাগে জানি, আর সেইটা যদি আপনেরে জানাই দেই, তাইলে সেইটা আমার অন্যায় হইব?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আমারে তোমার চোর মনে হয়?

আমোদি বেগম বললেন, আমার সবাইরেই চোর মনে হয়।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ যেন নিজের উপর সামান্য নিয়ন্ত্রণ হারালেন। তিনি খনিক কঠিন গলায় বললেন, হেঁয়ালি করবা না আমোদি বেগম। আমি হেঁয়ালি করনের লোক না।

আমোদি বেগম বললেন, হেঁয়ালি কি করব? হেঁয়ালি কি জিনিস, তাই তো আমি বুঝি না। করব কেমনে?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আমারে তোমার চোর মনে হয়?

আমোদি বেগম বললেন, হয়।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার এই দীর্ঘ জীবনে এমন অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি আর কখনো হয়েছিলেন কিনা মনে করতে পারছেন না। কিন্তু তিনি অবাক হচ্ছেন এই ভেবে যে তাকে এই অদ্ভুত কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি যিনি ফেলেছেন, তিনি হলেন এমন একজন মানুষ, যাকে তিনি চিরটাকাল সামান্য একজন গৃহকর্মির চেয়ে বেশি কিছু ভাবেননি।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তোমার নিজেরে কি মনে হয়?

আমোদি বেগম বললেন, আমার নিজেরেও চোর মনে হয়। আপনার চাইতেও বড় চোর।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এবার থতমত খেয়ে গেলেন। এই প্রথম কারো সামনে কি বলবেন, না বলবেন তা নিয়ে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। খানিক চুপ থেকে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তোমার নিজেরে চোর মনে হয় ক্যান?

আমোদি বেগম বললেন, এইটা কি কথা জিগাইলেন? চুরি করি দেইখ্যাই চোর মনে হয়।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সতর্ক হয়ে উঠলেন। একে বিশ্বাস করা যায় না। এই এতটা বছর ধরে এ এই খাঁ-বাড়ির অন্দরে রয়েছে। কে জানে, এমন করে আর কত ক্ষতি সে খ-বাড়ির করেছে! কত ধনসম্পদ সে চুরি করে সরিয়েছে! যে ছোট ঘর, ছোট বংশ থেকে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আমোদি বেগমকে বিয়ে করে এনেছিলেন, তাতে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সামনে সে কথা বলার সাহস কারোই ছিল না। সেই আমোদি বেগমের আজকের এই রূপ দেখে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ যারপরনাই বিস্মিত হয়েছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি চিন্তিতও বোধ করছেন। এই বাড়ি থেকে কি কি চুরি করেছে আমোদি বেগম? সেই চুরি করা জিনিসপত্র সে রেখেছেই বা কোথায়?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার ভেতরের দুশ্চিন্তাটা চেপে রেখে স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলেন, কি কি চুরি করছ তুমি?

আমোদি বেগম হাসলেন। বললেন, ডরাইয়েন না। আমি আপনের কোনো ধন-সম্পদ চুরি করি নাই। আমি চুরি করছি দুঃখ-কষ্ট। এইগুলান গোপনে চুরি কইরা নিজের কাছে রাইখ্যা দিছি। যাতে কেউ না দেখতে পারে। আপনে ওই যে প্রত্যেক রাইতে আমারে মারতেন। সেই মাইরের দাগও আমি চুরি করছি। আমার লগে যে খাঁ-বাড়ির ঝি চাকরের মতো আচরণ করতেন, এইগুলানও যাতে বাইরের মাইনষে কোনো দিন না দেখতে পারে, না জানতে পারে, সেইজইন্য এইসব জিনিস চুরি কইরা গোপনে আলাদা কইরা রাখছি। আমি আছিলাম চোর। সব সময় খালি চুরি করছি। জীবনভর চুরি। দুঃখ চুরি।

আজকের এই আমোদি বেগমকে দেখে, তার কথা শুনে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ক্রমাগত বিস্মিত হচ্ছেন। এই আমোদি বেগম তার অচেনা। এই এতটা বছরেও এই আমোদি বেগমকে তিনি ঘুণাক্ষরেও কখনো চিনতে পারেননি। আমোদি বেগম বললেন, আপনেরে চোর বলছি বইলা দুঃখ পাইয়েন না। দুইন্যায় আমরা সকলেই চোর। একেকজন একেকরকম চোর।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আমার ঘরে তোমার মতো এতবড় জ্ঞানী মানুষ, আর আমি এতদিনে টের পাই নাই! বড়ই তাজ্জব হইলাম। তায় একখান কথা ভুল বলছ।

আমোদি বেগম বললেন, কোন কথা?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কোনোদিন চুরি করনের মানুষ। সে যদি এইরম কিছু করেও, করব ডাকাতি। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ চুরি করন পছন্দ করে না। তার ডাকাতি পছন্দ। তুমি যেইটা করছ, এইটা হইল চুরি। ঘরের ইন্দুর হইয়া, ঘরের বেড়া কাটতেছ। এহন বলল, এই কাজখান তুমি ক্যান করলা?

আমোদি বেগম হেসে বললেন, মাইর খাইতে। বহুকাল মারেন না, শরীলডাও বাতের ব্যথা-বেদনায় কাতর। আবার মাইর ধইর খাইতে পারি, এই জইন্য করছি। হুনছি, ব্যথায় নাকি ব্যথা যায়।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ শান্ত গলায় বললেন, তুমি যাও আমোদি বেগম। এক্ষুণি আমার চোখের সামনে থেকে যাও।

আমোদি বেগমও আর কিছু বললেন না। তিনি ঘুরে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। কিন্তু দরজা অবধি যাওয়ার আগেই তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আবার ডাকলেন। তারপর বললেন, তুমি ফজুর উপকার করতে গিয়া কিন্তু আসলে তার ক্ষতিই কইরা ফালাইলা।

আমোদি বেগম কথা বললেন না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এতদিন পর্যন্ত আমি পুরাপুরি জানতাম না যে ফজু সত্য সত্যই সেই গয়না খুঁইজা পাইছে কিনা! মনে মনে একটা সন্দেহ করতাম। কিন্তু নিশ্চিত আছিলাম না। আইজ তুমি তো আমার সেই সন্দেহটাও দূর কইরা দিলা!

আমোদি বেগম বললেন, আপনে যেইটা একবার সন্দেহ করছেন, সেইটার শেষ আপনে না দেইখা ছাড়বেন? এই কথাও আমারে বিশ্বাস করতে কন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তারপরও। নিশ্চিত তো আছিলাম না। আর একটা কথা, তুমি এমনে এমনে সব স্বীকার কইরা নিলা? তোমার ডর লাগে নাই?

আমোদি বেগম বললেন, ডর থাহে জ্যাতা মাইনষের। মরা মাইনষের আবার ডর ভয় কিয়ের।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তুমি মরা মানুষ? আচ্ছা। কিন্তু ফজু তো আর মরা মানুষ না, সে তো জ্যাতা মানুষ। তারও কি ডর ভয় নাই নাই?

আমোদি বেগম বললেন, ডরের তো কিছু দেহি না। গয়না হাতে না পাওনের আগে তো ফজুর গায়ে ফুলের টোক্কাটাও আপনে পড়তে দিবেন না। ফজুরে সুস্থ রাখন, বাঁচাই রাখন এহন আপনের জইন্যই সব চাইতে বেশি দরকারি। সে না থাকলে গয়নার খোঁজও আপনে পাইবেন না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, ক্যামনে খোঁজ বাইর করতে হয় সেইটা আমি জানি।

আমোদি বেগম বললেন, গয়নার কথা কিন্তু এহন আব্দুল ফইরও জানে। আপনে একলা না, সেও চেষ্টা করব গয়নার খোঁজ বাইর করনের। ফজুরতন গয়না বাইর করন সোজা হইলেও আব্দুল ফইররে ফাঁকি দেওন যে সোজা হইব না, সেইটা তো আপনে জানেন। জানেন না?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ যেন আর্তনাদ করে উঠলে, আব্দুল ফইরও জানে?

আমোদি বেগম বললেন, সন্দেহ করে। আর সেও কিন্তু আপনের মতোই। একবার যহন সন্দেহ করছে, তহন এর শেষ না দেইখ্যা ছাড়ব না। আরেকখান কথা, গয়নার কথা জানাজানি হইলে কিন্তু সমস্যা। হুনছি, এই ধরনের মালামালের আসল মালিক নাকি হয় সরকার! এই ঘটনাও কিন্তু ফজু ব্যাপারী জানে।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আর একটা কথাও বললেন না। তিনি রীতিমতো স্থবির হয়ে গেছেন। এতদিন তার ধারণা ছিল যে তিনি তার আশেপাশের সকলের চেয়েই সব খবর বেশি রাখেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, না। সময় পাল্টে গেছে। অনেক কথাই তার কানে আসার আগেই আটকে যায় অন্যদের কানে। এটাও একটা সতর্ক সঙ্কেত। তার ভেতরটা আবরো কেমন করে উঠল! তিনি আমোদি বেগমকে চলে যেতে বললেন। আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের প্রায় সকল কথোপকথনই শুনেছে এস্কান্দার। সে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল আমোদি বেগমের শাস্তি দেখার জন্য। কিন্তু তার সেই ইচ্ছে পূরণ হলো না! তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সাথে আমোদি বেগমের এই অবিশ্বাস্য কথোপকথনের পরও তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আমোদি বেগমকে কিছুই বললেন না।

তিনি ডাকলেন খবির খাঁ আর মনিরকে। তবে আমোদি বেগমের বিষয়ে এদের তিনি কিছুই বললেন না। উঠে জানালার কাছে গিয়ে বার দুই কেশে গলার কফ পরিষ্কার করলেন। তারপর বললেন, পুরুষ মাইনষের আসল পরীক্ষা বিপদে। তয় তার চাইতেও বড় পরীক্ষা বিপদ আইসা পড়নের আগেই বিপদ টের পাওনে। যে যত আগে বিপদ টের পাইব, সে তত আগাই থাকব। শুনছি ভূমি অফিস থাইক্যা শিগগিরই হামুকভাঙার বিলের বেয়াল্লিশ বিঘা জমির বিষয়ে নুটিশ আইব। ওই জমিনের দলিলপত্র, রেকর্ড, মিউটেশন, খাজনার কাগজপত্রের বিষয়ে জানতে চাইব। দক্ষিণের খালের ধারেরও বিঘা কুড়ি জমিনেরও একই অবস্থা। আরো কিছু ঘটনা শুরু হইছে। এইগুলান আলামত মাত্র। আসল ঘটনা এহনো শুরু হয় নাই। আসল ঘটনা শুরু হইব আরো পরে।

জানালার বাইরে দুটো বেড়াল খুনসুটি করছে। কিছু ঘাসের মধ্যে কিছু একটা খুঁজে পেয়ে তারা মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সেদিকে তাকিয়ে বললেন, এহন সকলের আগে কি করন দরকার, সেইটা চিন্তা ভাবনা কইরা বাইর করতে হইব।

খবির খাঁ বললেন, বাজান, এই বিষয়ে হেইদিনই তো কথা হইল। কাগজপত্র বাইর করতে হইব জমিনের। জমা দিতে হইব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মনিরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ঘটনা তো সব শুনছস তুই। কি মনে হয়, এহন সবচেয়ে কম সময়ে পরিস্থিতি সামলানোর সব চাইতে ভালো উপায় কি?

মনিরের দুই হাত পেছনে বাঁধা ছিল। সে কথা বলার আগে বার দুই গলা খাকড়ি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল। তাপর হাত দুখানা সামনে এনে আড়াআড়ি বুকের উপর বাঁধল। যেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সাথে প্রথম কোনো গুরুতর বিষয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়ে সে নিজেকে প্রস্তুত করছে, সাহস সঞ্চয় করছে।

মনির যতটা সম্ভব গলা স্থির রেখে বলল, দাদাজান, কাগজপত্রের এইসব ঝামেলা মিটাইতে সময় লাগব। অনেক সময়। পয়সাপাতির বিষয় আছে, বহুত দৌড়াদৌড়িরও বিষয় আছে। এহন সবার আগে চিন্তা কইরা বাইর করতে হইব, এইগুলান ছাড়াও আর কোনো শটকাট উপায় আছে কিনা?

খবির খাঁ মনিরের কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, কি মনে হয়, এইরম কোনো উপায় আছে?

মনির বলল, আছে। একটা উপায় আছে। উপায়টা সহজ, আবার কঠিনও।

খবির খাঁ চিন্তিত গলায় বললেন, কি উপায়?

মনির বলল, যে কোনো উপায়েই হোক, ফজু ব্যাপারীর গয়নার কলসি হাতে পাইতে হইব। গয়নার কলসি তার হাতছাড়া হওন মানে তার বুদ্ধি, সাহস সব শ্যাস। এতদিন তার হাতে পয়সাপাতি আছিল না, তহন এই কাজ করনের বুদ্ধি সাহসও কোনোটাই তার হয় নাই। এহন এই জিনিস হাতে আসছে, আর লগে লগেই খায়গো লগে তার টক্কর দেওনেরও বুদ্ধি, সাহস হইছে। গয়নাগুলান যদি আমরা একবার পাই, আর কিছু করন লাগব না। তারপর আস্তে ধিরে জমিজমার বিষয়ে চিন্তা করন যাইব। তহন আর এত পেরেশান হওন লাগব না।

খুবই সহজ সাধারণ বিষয়। কিন্তু খবির খাঁ পুত্রের কথায় যুগপৎ বিস্মিত এবং মুগ্ধ হয়েছেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ অবশ্য কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তিনি মৃদুস্বরে বললেন, হুম। কিন্তু ঘটনা এহন আর এত সহজ নাই। জটিল হইয়া গেছে। গয়নার কথা আব্দুল ফইর সন্দেহ করতেছে। সে সন্দেহ করা মানে, এই গয়না এহন আর কারো পক্ষেই হজম করন সহজ হইব না। আর গয়নার কথা জানাজানি হইলে বিপদ। এই ধরনের সম্পত্তির আসল মালিক সরকার।

মনির বলল, ফইরসাবে এহনও নিশ্চিন্ত না যে ফজুকাকুর কাছে কি আছে! তার নিশ্চিন্ত হইতে সময় লাগব। কিন্তু আমরা তো এহনই জানি। এইজইন্য যেমনেই হোক তার আগেই জিনিস আমাগো হাতে পাইতে হইব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, কিন্তু কেমনে?

মনির বলল, দেহি কি করন যায়! তয় দাদাজান, আমার কেন জানি মনে হয়, ওই কলসি আমি দেখছি!

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, কি বলস?

মনির বলল, হ, দাদাজান।

সে নয়নের সাথে ফজু ব্যাপারীর বাড়ির পাশের খালে মাছ ধরতে যাওয়ার দিনের ঘটনা সবিস্তারে খুলে বলল। তারপর বলল, সেই দিন তো আর বুঝি নাই, ওই কলসিই সেই কলসি! ফজু কাকুরে দেইখাই মনে হইছিল ঘটনা কিছু একটা আছে। কেমন একটা চোরের মতো ভাবভঙ্গি। ঘাস কাইট্টা সেই কলসির উপরে রাখতে আছিল। আমি তো বুঝি নাই। খুব খেয়াল কইরাও দেহি নাই। ভাবছিলাম পানি নিতে আসছে। কিন্তু এহন মনে হইতেছে, তাইলে অমনে মাটির মইধ্যে কলসি ঢুকাইয়া রাইখ্যা তার উপরে ঘাস রাখব ক্যান? তহন ভালো কইরা খেয়ালও করি নাই।

মনির কথা বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ অবশ্য মনিরের কথা শুনছেন বলে মনে হলো না। তিনি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন বাইরে। সেখানে রান্নাঘরের পাশে অনেকটা জায়গা ফাঁকা রেখে গোয়াল ঘর। সেই ফাঁকা জায়গায় ঘাস লতাপাতা হয়ে গালিচার মতো বিছিয়ে আছে। সেখানে সেই। বেড়াল দুটি এখনো রয়েছে। তারা একটা ইঁদুরের বাচ্চাকে ধাওয়া করছে। ইঁদুরের বাচ্চাটা ফুড়ুৎ করে লাফিয়ে ঘাসের ভেতর ঢুকে গেল। সেখানে একটা গর্ত। সে সেই গর্তের ভেতর ঢুকে পড়ল। বেড়াল দুটি বুঝতেই পারল না ইঁদুরটি কই লুকিয়েছে! তারা ইঁদুরটাকে খুঁজতে লাগল এদিকসেদিক। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সেই দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থেকে হঠাৎ খবির খাঁকে বললেন, ওই দিন রাইতে গয়নার কলসখান ফজুর বাড়ির কই কই খোঁজা হইছিল?

খবির খাঁ সেই রাতে ফজু ব্যাপারীর বাড়িতে তল্লাশির বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিলেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মন দিয়ে শুনলেন। তারপর বললেন, বড় গাধা আমি! ওই জিনিস ফজু তার নিজের বাড়িতে কেন রাখব? আমি ফজুর জায়গায় হইলে আমিও তো ওই জিনিস নিজের বাড়িতে রাখতাম না। রাখতাম অন্য কোনোখানে।

খবির খাঁ বললেন, কই রাখতেন বাজান?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, কই রাখতাম, সেইটা ভাবতে হইব। তয় ওই জিনিস লইয়া গ্রামের বাইরে সে যায় নাই। জিনিস আছে এই গ্রামেই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আবার চুপ করে গেলেন। চুপ করে রইল খবির খাঁ আর মনিরও। দীর্ঘ নিস্তব্ধতার পর তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হঠাৎ বললেন, আমার ধারণা। আমি আন্দাজ করতে পারতেছি জিনিসখান ফজু কই রাখছে!

খবির খাঁ আর মনির, দুজনেই বিভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল তৈয়ব উদ্দিন খাঁর দিকে। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তখনও তাকিয়ে আছেন বাইরের ঘাস লতাপাতায় হেঁয়ে থাকা পরিত্যাক্ত জায়গাটুকুতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *