১-৫. জুলাইয়ের শুরু

ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট – ফিয়োডোর ডস্টয়েভস্কি
ভাষান্তর। সৈয়দ হালিম

লেখক পরিচিতি

ফিয়োডোর ডস্টয়েভস্কি ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের ১১ই নভেম্বর মস্কো শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তরুণ বয়সে তিনি যোগদান করেন রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে। সুবিস্তৃত রুশ সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি তখন জার।

ফিয়োডোর শৈশব থেকেই ছিলেন ভাবুক, কল্পনাপ্রবণ। তাই এ চাকরিজীবন বেশিদিন ভাল লাগলো না তার। তিনি চাইলেন তার মনের নিত্যনতুন ভাবগুলো লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলবেন। বই লিখবেন স্থির করলেন তিনি।

১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দের মাত্র ২৪ বছর বয়সে বের হলো তাঁর বই পুয়োর ফোক বইটি পড়ে সবাই মুগ্ধ হলেন।

তাঁর দিকে কঠোর দৃষ্টি রাখলো রাশিয়ার আমলাতন্ত্র। আমলারা ভাবলেন দরিদ্রের সুখ-দুঃখ নিয়ে এর এত মাথাব্যথা কেন? গরিব হয়ে যারা জন্মেছে, অভিশপ্ত জীবন-যাপনই হচ্ছে তাদের নিয়তি। তার বিরুদ্ধে ইঙ্গিত দিতে সাহস করে, কে এই লোক?

ভয়েভস্কি পুলিশের দৃষ্টি এড়াতে পারলেন না। তিন বছর পরে এক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগে জার তাকে পাঠালেন সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে…।

ফিয়োডোর নেই। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে ২৮শে জানুয়ারি তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু পৃথিবী যতকাল থাকবে, মানুষের স্মৃতিপটে তিনি অবিনশ্বর হয়ে থাকবেন।

.

এক

জুলাইয়ের শুরু। প্রচণ্ড গরম। খুপরির মত ঘর থেকে নেমে এল এক তরুণ। এগিয়ে চলল কোহুশকিন ব্রীজের দিকে। সবে সন্ধ্যে হয়েছে। তার হাঁটার ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কোনদিকে যাওয়া যায়–এখনো ভেবে ঠিক করে উঠতে পারেনি। ঘরে বসে থাকতেও ভালো লাগছ না; তাই পথে বেরিয়ে আসা।

ভাড়া করা খুপরি ঘর থেকে নেমে আসবার সময়ে বাড়িওলির চোখে ধুলো দিয়েছে প্রতিবারের মতো। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই বাড়িওলির রান্নাঘর। দরজা খোলা থাকে সব সময়ে। ঠিক এই সময়টাতে বুক ঢিব ঢিব করতে থাকে তরুণের। বড় কাপুরুষ মনে হয় নিজেকে, তারপরেই ধিক্কার দেয় নিজেকে–এত ভয় কেন?

ভয় তো দেনার জন্যে। অনেক টাকা পাবে বাড়িওলি। কানাকড়িও দিতে পারেনি তরুণ। থাকে সে পাঁচতলা বাড়ির চিলে কোঠায়। ঘর তো নয়, যেন আলমারি।

অথচ সে সত্যি সত্যি কাপুরুষ নয়। ঠিক উল্টো। মেজাজ খিঁচড়ে আছে বেশ কিছুদিন ধরে উৎকণ্ঠায় বেকার হয়ে থাকার দরুন। মনও তাই মুষড়ে আছে। বিমর্ষতা চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছলে মন-মেজাজ এইরকমই দাঁড়ায়। একলা থাকতে ইচ্ছে হয়। দুনিয়ার কারো সঙ্গে মুখোমুখি হতে মন চায় না–বাড়িওলির সঙ্গে তো নয়ই।

এই ভয় থেকেই এসেছে কাপুরুষতা। কিছুদিন ধরে দারিদ্র্যের বোঝাও যেন ওকে খুঁড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিদিন কত কাজই তো থাকে–আগ্রহ নেই কোনো কাজে। আগ্রহ যে ফিরিয়ে আনবে সে আগ্রহও নেই তার। কেউ যেন চারদিকে ঘোর ষড়যন্ত্র জাল বুনে চলেছে মানুষটাকে ঘিরে। ভয় বাড়িওলিকে নয়–কাউকেই নয়। থোড়াই কেয়ার করে সে ষড়যন্ত্রকে–অথচ মন মুষড়ে আছে নিদারুণ।

সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়ে বাড়িওলির চোখে পড়লেই রোজই শুনতে হয় সেই একই গান…একই ঘ্যানঘ্যানানি…একই ভয় দেখানো। ভাড়া না দিলে অমুক করেঙ্গা, তমুক করেঙ্গা! বানিয়ে বানিয়ে কাঁহাতক আর মিথ্যে বলা যায়। তার চাইতে বেড়ালের মত পা টিপে টিপে নেমে যাওয়া ভাল।

রাস্তায় নেমে এসে কিন্তু বেজায় হাসি পেল তরুণের। এত ভয় বাড়িওলিকে।

হাসিটা কিন্তু তার অদ্ভুত ধরনের। কথাও বলে সে আপন মনে–আশ্চর্য! যা করব বলে ভেবে রেখেছি, সে কাজ তো পুরুষ মানুষের হাতের পাঁচ! তবুও এত ভয়!…না, বড্ড বেশি কথা বলছি আজকাল। মনে মনে আকশ-পাতাল রচনা করছি।

গরম আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এত ভিড়, গায়ে গায়ে ঘষাঘষি, ইট-চুন ধুলোর গন্ধ। রাজমিস্ত্রীদের তৈরি বাড়ি, সব মিলিয়ে গ্রীষ্মের এই পচা গন্ধ পিটার্সবার্গবাসীদের সহ্য করতেই হয় প্রতি গ্রীষ্মে–গ্রীষ্ম-কুটিরে বাস করার মতো পয়সা যাদের নেই–তাদেরকেই সহ্য করতে হয়ই এসব।

সামান্য এই ভাড়ার চিন্তায় তরুণের স্নায়ুতে দারুণ চাপ পড়ে। এমনিতেই মনটা খারাপ হয়ে রয়েছে তার ওপর আবার এই অত্যাচার। অসহ্য!

শহরের এদিকটায় মাতালদের ভিড়ও বেশি। মদের দোকানও কম নয়। ছুটির দিন নয় আজ তা সত্তেও মত্ত মানুষদের ভিড় লেগেই আছে। এদের গায়ে গা লাগতেই আরও মুষড়ে যাচ্ছে মন–রাগ বাড়ছে।

এ সবকিছুই ঘৃণা করে তরুণটি। ঘৃণা চেপে রাখতেও পারছে না সে। মুখ বেঁকে গেছে তাই। মুখ মনের অনুভূতি ফুটিয়ে তুলতে পারে সহজেই; তাই সে গোপন করতে পারছে না মনের গভীর ঘৃণাবোধকে।

তরুণের চেহারাটা কিন্তু চমৎকার! রীতিমত সুদর্শন। বেশ লম্বা, দশজনের ভিড়ে দাঁড়ালে মাথা উঁচু হয়ে থাকে সবার ওপরে। ছিপছিপে শরীর অথচ সুগঠিত। দু চোখ গভীর কালো আর ভারি সুন্দর। মাথাভর্তি ঈষৎ কালচে অথচ সোনালি চুল মুখের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ।

ঘৃণায় মুখ কুঁচকে গিয়েছিল ক্ষণেকের জন্যে। তারপরেই ফের বিভোর হয়ে গেল চিন্তায়। এমনই মশগুল হয়ে রইল গভীর ভাবনায় যে আশপাশে আর নজরই রইল না। নজর দেওয়ার প্রবৃত্তিও নেই। কথা বলে চলছে আপনমনে। নিজের কথা নিজেই শুনছে। বুঝতে পারছে, তালগোল পাকিয়ে রয়েছে মনের ভাবনাগুলো।

দুর্বলতার জন্যেও এমন হতে পারে। এই নিয়ে দুদিন হল, না খেয়ে আছে। জামাকাপড়ের অবস্থাও শোচনীয়। ভিখিরি ভবঘুরেও এমন গরিবহালে দিনের আলোয় পথে বেরোতে লজ্জা পাবে। শহরের এই অঞ্চলে অবশ্য কোনো কিছুই কাউকে অবাক করেনা বলেই রক্ষে। বাজে মেয়ে আর পাঁচ কাজের ব্যাপারীদের ভিড় এখানে এত বেশি যে কোনো কিছুই বিস্ময়কর লাগে না কারো চোখে।

তরুণের রুচিবোধ কিন্তু মাঝে মধ্যে মাথাচাড়া দেয়। জামাকাপড় নিয়ে খুঁতখুঁতুনি তার মধ্যেও আছে। এই মুহূর্তে গোটা দুনিয়াটার ওপর মনটা তার এমনই বিষিয়ে গেছে যে, নিজের গায়ের ছেঁড়াফাটা জামাকাপড়ের দিকে খেয়াল নেই একেবারেই।

আসলে গোটা দুনিয়াটার ওপর বিদ্বেষে ভরে আছে ওর মনের ভেতরটা। বাইরের দুনিয়ার দিকে তাই ভ্রূক্ষেপ নেই। পুরনো বন্ধু-বান্ধদের সঙ্গে দেখা হলে অবশ্য আলাদা ব্যাপার হতো। কিন্তু যেচে কারো সঙ্গে দহরম-মহরম করতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।

ঠিক এই সময়ে একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ি প্রায় এসে পড়ল ওর গায়ের ওপর। মাতাল একটা লোক রয়েছে গাড়ির ওপর। তরুণকে দেখেই আচমকা সে কি চিৎকার–এই ব্যাটা! জঘন্য এই জার্মান টুপিটা মাথায় পরে আছিস কেন?

বলেই হাত নেড়ে বিকট উল্লাস জানিয়ে নিমেষে উধাও হয়ে গেল পাগল লোকটা ঘোড়ার গাড়ি হাঁকিয়ে।

তখনই খেয়াল হল সুন্দর তরুণের, সত্যিই তো! মাথার টুপিটা জিমারমান জার্মান টুপি। তুবড়ে, থেঁতলে এর বেতিকিচ্ছিরি চেহারা হয়েছে। চারদিকে অজস্র ফুটোও আছে। মাথায় তেড়াবেকাভাবে আটকে রয়েছে–লোকে তো হাসবেই।

এ অবস্থায় লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া উচিত। তরুণ কিন্তু লজ্জা পেল না। ভয় পেল। মনটাকে সাপের মত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে অবশ করে তুলল অদ্ভুত এক ভয়।

আবার শুরু হল মনেমনে বকুনি–কী আশ্চর্য! পাঁচজনের চোখে পড়ার মত বিকট এই টুপি পরে আছি কেন? এমন টুপি মাথায় দিতে হবে যা সবার চোখ এড়িয়ে যাবে। গায়ে যেহেতু ছেঁড়া কাঁথার মত জামাকাপড়–মাথার টুপিও হওয়া উচিত কুলি-কামিনের টুপির মতন। দামি জার্মান টুপি পরা খুব ভুল হয়েছে। ছোট্ট এই ভুল থেকেই গোটা প্ল্যানটা ভেস্তে যেতে পারে।

বেশিদূর আর যেতে হল না। বাড়িটার ফটক এখান থেকে আর মাত্র সাতশ তিরিশ পা দূরে। স্বপ্নে এটা সে গুনেছে কতবার।

একটা সময় গেছে যখন এসব স্বপ্নকে মোটেই পাত্তা দেয়নি তরুণ। কদাকার স্বপ্নগুলোকে মনের মধ্যে আনাগোনাও করতে দেয়নি। স্বপ্নের প্রলোভনেও পড়েনি আগে।

ঝাড়া একমাস এইসব লোভনীয় অথচ বীভৎস স্বপ্ন দেখবার পর মনের অবস্থা দাঁড়িয়েছে অন্যরকম। স্বপ্ন এখন ওকে লোভাতুর করে তুলেছে। মন না চাইলেও কুৎসিত স্বপ্নকে রূপ দিতে চলেছে। মনের মধ্যে ইচ্ছে আর অনিচ্ছের লড়াই চলছে বিরামহীনভাবে। বিড়বিড় করে বকেও যাচ্ছে সেই কারণে।

এখন সে চলেছে স্বপ্ন রূপায়ণ সম্ভব হবে কি করে, তা যাচাই করার সঙ্কল্প নিয়ে। এক এক পা এগোচ্ছে। একটু একটু করে মন উত্তেজিত হয়ে উঠছে এ জন্যেই।

প্রকাণ্ড একটা বাড়ির দিকে এগোচ্ছে তরুণ। এ বাড়িটা রয়েছে একটা খালের পাশেই। অন্য পাশে রয়েছে সাদোভাইয়া স্ট্রিট। বুকের মধ্যে যেন সাঁই সাঁই করে হাপর ওঠানামা করছে। শরীরের প্রত্যেকটা মায় সজাগ।

এ বাড়িতে ফ্ল্যাট অনেক। নানা ধরনের বাণিজ্য চলেছে ঘরে ঘরে। দরজি, মিস্ত্রী, রাঁধুনি, জার্মান ধান্দাবাজ, বাজে মেয়ে, কেরানি–আরও কত রকম মানুষ দখল করে রয়েছে এক-একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে ঢুকবার মুখে উঠোন দুটোয় নানা ধরনের মানুষ আসা-যাওয়া করছে। জনা দুই দারোয়ানও নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে।

নিশ্চিন্ত হল তরুণ। কারোরই চোখ নেই তার মতো বিবর্ণ চেহারার মানুষের দিকে। টুক করে ফটক পেরিয়ে ডাইনে মোড় নিয়ে পা দিল সিঁড়িতে।

এ সিঁড়িটা বাড়ির পেছন দিককার সিঁড়ি। তাই বেশ অন্ধকার। রীতিমত সরু। অথচ কোথায় কি আছে, সবই সে জানে। নখদর্পণে বললেই চলে। এর আগেও এসেছে। সিঁড়ির আঁধার আর নির্জনতা মনটাকে খুশিতে ভরিয়ে তুলেছে। কোনো কৌতূহলী চোখ এই অন্ধকার ফুঁড়ে তাকে দেখতে পাবে না।

চারতলায় উঠেই আবার ভয় ঢুকল মনের মধ্যে। বিড়বিড় করতে লাগল আপনমনে–কাজটা যদি করেই ফেলি, তাহলে কি ঠিক হবে।

চারতলার পথ জুড়ে রয়েছে একটা ফ্ল্যাটের আসবাবপত্র। এ ফ্ল্যাটে থাকত এক জার্মান কেরানি বউ-বাচ্চা নিয়ে। এখন নিশ্চয়ই ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিচ্ছে–তাই ফার্নিচার বের করছে।

তাহলে তো ভালই হল। চারতলার এই সিঁড়ি পেরিয়ে বুড়ির ফ্ল্যাট ছাড়া আর কোনো ফ্ল্যাট নেই। ভাল…ভাল…

এসে গেছে বুড়ির নিরালা ফ্ল্যাট। দরজার ঘন্টা বাজিয়ে দিল তরুণ। টুনটুন করে বাজছে ঘণ্টা যেন টিন দিয়ে তৈরি–পেতল দিয়ে তৈরি হলে আরও জোর আওয়াজ হতো।

অবশ্য বিশাল এই বাড়ির পায়রার খোপের মত ছোট ছোট ঘরগুলোয় ঘন্টা বাজে এই রকমই মিনমিনে আওয়াজে। ব্যাপারটা ভুলেই গেছিল তরুণ। উৎকণ্ঠায় মনের অবস্থা সত্যিই শোচনীয় হয়ে এসেছে। নইলে ঘন্টার ওই ক্ষীণ আর্তনাদ শুনে অমন শিউরে উঠবে কেন?

ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হল একটু পরেই। পাল্লা ফাঁক হচ্ছে। সামান্য ফাঁক হতেই ফ্ল্যাটের ভাড়াটে বিষম বিতৃষ্ণায় চেয়ে রইল তরুণের দিকে। বিতৃষ্ণা ছাড়াও পিটপিটে দুই চোখে রয়েছে রাজ্যের অবিশ্বাস।

শুধু চোখ দুটোই দেখতে পাচ্ছে তরুণ। ওটুকু ফাঁক দিয়ে সন্দেহ আর অবিশ্বাসভরা একজোড়া চোখ ছাড়া আর কিছু দেখাও যাচ্ছে না। অন্ধকারের মধ্যে ঝিকঝিক করছে শুধু দুটো চোখ।

চৌকাঠ পেরিয়ে সামনের ঘরে ঢুকে গেল তরুণ।

এ ঘরেও অন্ধকার বিরাজ করছে। ঘরের মাঝে একটা কাঠের পার্টিশন। পার্টিশনের ওদিকে ক্ষুদে রান্নাঘর। আর ঠিক এখানেই দাঁড়িয়ে আছে বুড়ি। মুখে কোনো কথা নেই। কিন্তু চাহনির মধ্যেই অনেক জিজ্ঞাসা জেগে রয়েছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তরুণের পা থেকে মাথা পর্যন্ত।

বুড়ির বয়স প্রায় ষাট। ছোটখাট চেহারা। শুকনো রুটির টুকরোর মতই যেন শুকিয়ে গুটিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। চোখ দুটো কিন্তু বেশ ধারালো আর নোংরা!

টিকালো নাক। ছোট্ট মাথায় টুপি নেই। চুল সামান্য পেকেছে। তেল দিয়ে সেঁটে লাগানো মাথায়। ফ্লানেলের চাদর জড়ানো গলায়। গলাটা সরু আর লম্বা। মোরগের নখওলা থাবার মত উচিয়ে রয়েছে চাদরের ঘেরাটোপ থেকে।

গরমে আইঢাই অবস্থা হয় তরুণের। বুড়ি কিন্তু এই বিচ্ছিরি গরমেও একটা পশুলোমের জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে রেখেছে। কাশছে খখক করে।

এ হেন বিচিত্র মূর্তির দিকে নিশ্চয়ই অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে ধরেছিল তরুণ, নইলে বডির চোখে অবিশ্বাস ফের ঘনিয়ে উঠবে কেন?

তাই দেখেই তড়িঘড়ি বলে ওঠে তরুণ–আমি রাসকোল্‌নিকভ। ছাত্র। মাসখানেক আগে একবার এসেছিলাম।

এ অবস্থায় বিনয়ের অবতার হওয়া উচিত। তাই বাতাসে মাথা ঠুকে ছোই অভিবাদনও সেরে নেয় সে।

তীক্ষ্ণ গলায় তক্ষুণি জবাব দিল বুড়ি—মনে আছে।

তরুণের মুখের ওপর থেকে কিন্তু সরে গেল না বুড়ির সন্ধানী চোখ।

এত অবিশ্বাস! অস্বস্তি বোধ করে রাসকোল্‌নিকভ।

আমতা আমতা করে বলে এসেছি একই উদ্দেশ্যে–

একটু ভেবে নিয়ে পাশে সরে দাঁড়ায় বুড়ি –ভেতরে এসো।

যে ঘরে ঢুকল রাসকোল্‌নিকভ, সে ঘরে তত অন্ধকার নেই। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় দেখা যাচ্ছে দেওয়ালে সাঁটা হলদে কাগজ, জানালায় হিজিবিজি জিরেনিয়ামের রঙিন ফুল আর রঙবেরঙের ছিটের পর্দা।

এই দেখেই বিদ্যুঝলকের মতো ভেবে নিল রাসকোল্‌নিকভ–সেদিনও ঠিক এইভাবে সূর্য ঝকঝক করবে ঘরের মধ্যে!

ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎবেগে চোখ বুলিয়ে নিলো ঘরের সবকিছুর ওপর। কিছুই বাদ দিল না–মনের ম্যাপে টুকে নিলো প্রতিটি জিনিস। এই তো সুযোগ। সবই দেখতে হবে। স্মৃতিতে গেঁথে রাখতে হবে। সময় এলে যেন ঠিক জিনিসটা ঝটপট সরিয়ে ফেলা যায়।

তবে হ্যাঁ, ঘরের মধ্যে সেরকম বিশেষ কিছুই নেই। ফার্নিচার সবই মান্ধাতার আমলের। হলদে কাঠ দিয়ে তৈরি। একটা প্রকাণ্ড পিঠ-উঁচু সোফা–সামনে বসানো একটা কাঠের খোদাইকরা গোল টেবিল। একটা সাজগোজ করার টেবিল। দুটো জানলার ফাঁকে রয়েছে একটা আয়না। দেয়ালের পাশে বসানো খান কয়েক চেয়ার। হলদে ফ্রেমে বাঁধানো কয়েকটা সস্তা ছবি–জার্মান মেয়েদের ছবি নিশ্চয়–পাখি ধরে রয়েছে হাতে।

ফার্নিচার বলতে তো এই। এক কোণে একটা মূর্তি–সামনে জ্বলছে একটা তেলের প্রদিপ।

প্রতিটি জিনিস কিন্তু ঝকঝকে তকতকে। মেঝে আর ফার্নিচার দুটোই নিশ্চয় পালিশ করা হয় রোজ–তাই এত চকচকে।

আপনমনেই ফের বিড়বিড় করে ওঠে রাসকোল্‌নিকভ–নচ্ছার বিধবা বুড়িদের ঘর এত পরিষ্কার হয়–এক কণা ধুলোও রাখেনি কোথাও।

বলতে বলতে হাত দিল দরজার ছিটের সুতি-পর্দায়। এ পর্দা ঝুলছে দুই ঘরের মাঝের দরজায়। এ ঘরে এখনো ঢোকেনি রাসকোল্‌নিকভ। ওদিকে রয়েছে বুড়ির শোবার খাট আর জিনিসপত্রের দেরাজ-আলমারি। ফ্ল্যাটে ঘর বলতে এই দুটোই–আর নেই।

ঘরের মধ্যে উঁকি দিতেই বুড়ি ধড়মড় করে এসে দাঁড়াল সামনে। পথ আটকে দাঁড়িয়েছে।

বলে উঠল কড়া গলায়–-কি চাই।

পকেট হাতড়ে সেকেলে, চ্যাপটা, রুপোর ঘড়িটা বের করে রাসকোল্‌নিকভ। পেছনের ডালায় খোদাই করা রয়েছে একটা ভূগোলক। শেকলটা ইস্পাতের।

বললে—বন্ধক দিতে এসেছি।

গতবার যেটা বন্ধক রেখে গেলে, তার মেয়াদই ফুরিয়েছে। গতকাল চলে গেছে টাকা দেবার শেষ তারিখ।

একটু ধৈর্য ধরুন, ম্যাডাম। কথা দিচ্ছি, সুদ সমেত আসল ফিরিয়ে দেব।

সেটা তো বলব আমি। মেয়াদ পেরিয়ে গেছে, বন্ধকী বেচেও দিতে পারি এখনি।

ঘড়ির জন্যে কত দেবেন, অ্যালিওনা আইভানোভনা?

কোথাকার রদ্দি এক মর্চে-পড়া ঘড়ি! কারো কাজে লাগবে না। গতবার আংটিটার বদলে নিয়ে গেছিলে দু ফুল। যেটা কোনো গয়নার দোকানে দেড় রুবলেই কিনে নিতে পারতাম।

চার রুব্‌ল দিন। সব ফেরৎ নেব। এ ঘড়ি আমার বাবার। দিন কয়েকের মধ্যে হাতে বেশ কিছু টাকা আসবে।

দেড় রুলের এক পয়সাও বেশি দেব না–সুদ আগে দিতে হবে। নিতে হলে নাও, নইলে বিদেয় হও।

মাত্র দেড় রুব্‌ল!

সরে পড়ো, রাসকোল্‌নিকভের হাতে ঘড়ি গছিয়ে দিয়ে বললো বুড়ি। মাথায় রক্ত চড়ে গেলেও সামনে নিলো সে। ইচ্ছে হচ্ছিল এখুনি ছুটে বেরিয়ে যায়। কিন্তু তাহলে তো যে মতলবে আসা, সেটাই হয় না।

রুক্ষ গলায় বললো–ঠিক আছে, দিন।

চাবির খোঁজে পকেটে হাত ঢোকায় বুড়ি। তারপর চলে যায় পর্দার ওদিকে পাশের ঘরে।

ঘরে এখন রাসকোল্‌নিকভ একা। কান খাড়া করে শুনছে পাশের ঘরের ক্ষীণতম আওয়াজও। মনের চোখে অনুসরণ করে চলেছে বুড়িকে। দেরাজ-আলমারি খোলার শব্দ ভেসে এল কানে। নিশ্চয় ওপরের ড্রয়ার, মনে মনে ভেবে নেয় রাসকোল্‌নিকভচাবির গোছা রাখে ডান-হাতি পকেটে…ইস্পাতের রিঙে রয়েছে সমস্ত চাবি…একটা চাবি অন্য চাবিদের চেয়ে তিন গুণ বড়…মাথায় খাঁজকাটা…দেরাজ-আলমারির চাবি নয় নিশ্চয়…আর একটা আলমারি অথবা সিন্দুক আছে বলে মনে হচ্ছে…অদ্ভুত…সব সিন্দুকেরই চাবি একই রকম…যাচ্ছেতাই কারবার…

ফিরে এল বুড়ি।

এই নাও। রুব্‌ল পিছু মাসে দশ কোপেক, দেড় রুব্‌ল থেকে প্রতি মাসের পনেরো কোপেক বাদ। একই হারে, আগের নেওয়া দু ফুল থেকে বাদ গেল বিশ কোপেক। মোট দাঁড়ালো পঁয়ত্রিশ। তাহলে তুমি পেলে এক রুব্‌ল পনেরো কোপেক–রদ্দিমার্কা এই ঘড়ির জন্যে।

মাত্র এক রুব্‌ল পনেরো কোপেক!

কড়ায় গণ্ডায়।

তর্কের মধ্যে গেল না তরুণ। বলার অনেক কিছুই ছিল–সেসব কথা জিভের ডগাতেও এসে গেছিল কিন্তু কিছুই না বলে হাত পেতে সামান্য অর্থ নিতে নিতে এদৃষ্টে চেয়ে রইল বুড়ির দিকে–তাড়াহুড়োর লক্ষণ দেখা গেল না হাভভাবে।

তারপর আস্তে আস্তে বললো–দিন দুয়েকের মধ্যে আরও একটা জিনিস আনব। বন্ধুর দেওয়া উপহার। রুপোর সিগারেট কেস।

চুপ মেরে গেল এটুকু বলেই। মাথার মধ্যে যেন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

যখন আনবে, তখন দেখা যাবে।

তাহলে চলি,বাইরের ঘরে বেরিয়ে যেতে যেতে কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বললো সে–ভালো কথা, আপনার বোনকে তো দেখছি না! একলাই থাকেন নাকি?

তা নিয়ে তোমার দরকার কি?

কিসসু না…এমনিই জিজ্ঞেস করলাম…আপনি তো রয়েছেন…চলি, অ্যালিওনা আইভানোভনা!

তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল রাসকোল্‌নিকভ। উত্তেজনায় কাঁপছে সারা শরীর! একি হঠকারিতা করে বসল সে। পুরো একটা মাস ধরে মনকে এত শায়েস্তা করার পরেও নেমে পড়ল নোংরা এই কাজে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!

সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে কতবার থামল আর ঘোলাটে মাথায় কতবার যে নিজেকে ধিক্কার জানালো তরুণ, তা সে নিজেই জানে না।

রাস্তায় এসে বিহ্বলভাবে এদিক ওদিক চাইতেই চোখে পড়ল একটা মদের দোকান। কক্ষণো এসব জায়গায় সে ঢোকে না। কিন্তু আজ তার মনের অবস্থা এমনই যে আপনা থেকেই পা দুটো তাকে টেনে নিয়ে গেল সেটার ভেতরে।

একটু মদ পান করে মাথার মধ্যেকার দাপাদাপি যখন থেমে এসেছে, তখন এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলো, জনা দুই মদ্যপ এককোণে বসে আছে বেহুশ অবস্থায়।

আর এককোণে বসে যে লোকটা, তাকে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারি বলেই মনে হচ্ছে।

লোকটা এত উত্তেজিত কেন?

.

দুই

রাসকোল্‌নিকভ সবাইকে এড়িয়ে চলছিল কিছুদিন ধরে–কিন্তু এই মুহূর্তে…মনের এরকম তোলপাড় অবস্থায়…ইচ্ছে হচ্ছিল মানুষের সঙ্গ পেতে। মদের দোকানের এই ধুলো আর বদ গন্ধও তাই ওর কাছে অসহ্য ঠেকেনি। বরং স্বস্তিবোধ করছিল অন্য লোক আশপাশে থাকায়। নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিল না। ভয়-ভয় ভাবটাও চলে গেলো।

মদের দোকানের মালিক ওপর থেকে নেমে এসে বসল কাউন্টারে। ফাইফরমাশ খাটার ছোকরা কজনও বসে আছে। ওরা প্রত্যেকেই হাই তুলছে আর চেয়ে আছে কোণের উত্তেজিত লোকটার দিকে।

একেই রিটায়ার্ড সরকারি কর্মচারি বলে মনে হয়েছিল রাসকোল্‌নিকভের। জ্বলজ্বল করা অদ্ভুত চোখে লোকটা একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকেই। কোটের বোতাম ছেঁড়া। চোখমুখ ফুলো। হতশ্রী অবস্থা। একগাল খোঁচা খোঁচা দাড়ির জন্যে আরও বিচ্ছিরি লাগছে দেখতে।

আচমকা কথা বলে উঠল লোকটা–দেখে তো মনে হচ্ছে বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। কি করা হয়?

অন্য সময়ে এইভাবে গায়ে পড়ে কেউ কথা বললে জবাব দিত না রাসকোল্‌নিকভ। কিন্তু এখন ও নিজেই চায় কথা বলতে।

তাই বললো–আমি ছাত্র।

তাই চেহারায় ধার আছে–নেই শুধু জামাকাপড়ে। তাতে কি হয়েছে! আমার জামাকাপড়ের ছিরি তো দেখতেই পাচ্ছেন। আমার নাম মারমেলাডভ।

এরপরেই শুরু হল মারমেলাডভের দীর্ঘ বক্তৃতা। লোকটার প্রথম বউ মারা যাবার পর যাকে বিয়ে করেছিল সে ভদ্রমহিলাও বিধবা। বিধবা হয়েছিল তিনটে বাচ্চা নিয়ে। মারমেলাডভের প্রথম পক্ষের আছে একটি মেয়ে। সোনিয়া তার নাম। বয়স ছিল চোদ্দ–দ্বিতীয় বিয়ের সময়ে। এখন একটু বড় হয়েছে। বাবার চাকরি যাওয়ার পর সন্মায়ের মুখঝামটা খেয়ে ও মেয়েটা রোজগার করতে শুরু করেছে। নিজে থাকে অন্য জায়গায়। রাতে এসে বাবা আর সত্যাকে টাকাপয়সা দিয়ে যায় সংসার চালানোর জন্যে। সেই টাকাই বাক্স থেকে চুরি করে এনে উড়িয়ে দিয়েছে মারমেডত। পাঁচ দিন বাড়ি ফেরেনি। এখন তো না ফিরলেই নয়।

বাড়ি বেশিদূরে নয়। রাসকোল্‌নিকভই তাকে নিয়ে গেল। চারতলা বাড়ির ওপরতলায় থাকে মারমেডভ। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উঠবার পর বারান্দায় দাঁড়িয়েই দেখা গেল ঘরের মধ্যেকার দীনহীন অবস্থা। তিনটে বাচ্চার একজন মেঝেতে বসে সোফায় মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছে। অন্য দুজন ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো জামা গায়ে দিয়ে দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কালকে কি খাবে– তাই জানে না। উপোসি রয়েছে কদিন ধরেই। ঘরে অন্যমনস্ক হয়ে পায়চারি করছে বছর তিরিশেক বয়সের এক মহিলা।

মারমেলাডভের দ্বিতীয় বউ। ভীষণ রোগা। রোগযন্ত্রণায় সিঁটিয়ে রয়েছে। কাশছে। নিশ্চয় ক্ষয়রোগে ধরেছে।

এ ঘরের কোনো আবরু নেই। ঘরের মধ্যে দিয়েই যেতে হয় আর একটা ঘরে। সেখানে থাকে অন্য ভাড়াটে। তারা হাসছে, কথা বলছে, খেলছে।

মারমেলাডভকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠেছিল তার বউ। মারধরও শুরু করেছিল তক্ষুণি। দৌড়ে এসেছিল ওদিককার ঘরের লোকজন। তারা মজা দেখছিল।

রাসকোল্‌নিকভ নিঃশব্দে পকেট উজাড় করে খুচরো কোপেকগুলো জানলার ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে ফেলে নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। একবারও ভাবল না নিজের কি হবে।

টাকাপয়সা নিয়ে সোনিয়া মেয়েটার ওপর আবার যেন চাপ না পড়ে–এই ভেবেই আনন্দ পেল রাসকোল্‌নিকভ।

.

তিন

অনেক বেলায় ঘুম ভাঙল রাসকোল্‌নিকভের। শরীর এখনো ম্যাজম্যাজ করছে।

মেজাজ খিঁচড়ে যায় ঘরের চেহারা দেখে। এত ছোট ঘর যে তাকে খুপরি বলাই উচিত। দেওয়ালের হলদে কাগজ ছিঁড়ে ঝুলছে। সোজা হয়ে দাঁড়ালে মনে হয় ছাদে মাথা ঠুকে যাবে।

মাত্র তিনটা টলমলে চেয়ার আর একটা রঙ-করা টেবিল ছাড়া এ ঘরে রয়েছে একটা বদখত সোফা। পুরনো, ছেঁড়া এবং রাসকোল্‌নিকভ তাতে শোয়। ছেঁড়া জামা তাল পাকিয়ে মাথার বালিশ করে নেয়। লেপ নেই বলে ওভারকোট গায়ে দেয়। পোশাক পরেই ঘুমোয়।

রঙ-করা টেবিলটার ওপরে বই আর খাতায় পুরু ধুলো জমে আছে। হাত পড়েনি সেখানে অনেকদিন।

কদাকার সোফার সামনে আর একটা ছোট টেবিল। সেখানে ভাঙা চায়ের পাত্র রেখে দাঁড়ালো ন্যাসটাসিয়া-রাসকোল্‌নিকভের একমাত্র কাজের মেয়ে।

অনেকদিন মাইনে পায়নি ন্যাসটাসিয়া। ফলে ঘর ঝাট দেওয়া বন্ধ করেছে। হাঁটলেই ধুলোর মেঘ ওঠে মেঝে থেকে।

টাকার অভাবে হোটেল থেকেও খাবার আনা হয়নি গত পনেরো দিন।

তা সত্ত্বেও আজ চা এনেছে। কেন, তা ন্যাসটাসিয়াই জানে।

হাঁকাহাঁকি শুরু করে দেয় পাত্র নামিয়ে রেখেই–ওঠো, ওঠো, দশটা বাজল। চা-টা অন্তত খাও, উপোস করেই তো আছে।

মেজাজটা খিঁচড়ে যেতেই আবার চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল রাসকোল্‌নিকভ। হাঁকডাক শুনে চোখ খুলে বললো–চা কোত্থেকে এল? বাড়িওলি পাঠালো নাকি?

বাড়িওলির বয়ে গেছে, খানিকটা হলদে চিনি চায়ের পাত্রের পাশে রাখতে রাখতে বললো ন্যাসটাসিয়া–আমার ঘরের চা।

পকেট হাতড়ে খানকয়েক কোপেক বের করে ন্যাসটাসিয়ার হাতে দিয়ে বললে রাসকোল্‌নিকভতাহলে একটা রুটি আর একটু মাংস এনে দাও।

রুটি না হয় এনে দিচ্ছি। কিন্তু এ সময়ে বাসি মাংস ছাড়া তো কিছু পাবে। তার চাইতে বরং আমার রান্নাঘরের বাঁধাকপির তরকারি খাও।

এল রুটি আর তরকারি। খাওয়া শুরু হল রাসকোল্‌নিকভের। সেই সঙ্গে ন্যাসটাসিয়ার কথা–বাড়িওলি পুলিশকে খবর দিয়েছেন।

কেন?

টাকা দেবে না, ঘরও ছাড়বে না–পুলিশ তাই এর বিহিত করবে।

আচ্ছা বোকা তো! দেখি বুঝিয়ে বলতে হবে বাড়িওলিকে।

বোকা তো সবাই–-আমিও। তোমার ঘটেই যদি এত বুদ্ধি তো রোজগার নেই কেন? আগে তো ছেলে পড়াতে–

এখন অন্য কাজ করছি।

কি কাজ?

ভাবছি।

ভাবলে টাকা রোজগার হবে।

কি মুশকিল! জুতো কোথায় যে পড়াতে যাব? তাছাড়া পড়াতে আমার ভালো লাগে না।

পেটের খাবারটা তো জুটছিল!

অত কম মাইনেতে পোষায় না।

তবে কি রাতারাতি টাকার কুমির হাতে চাও?

হ্যাঁ, চাই। অদ্ভুত চোখে তাকায় রাসকোল্‌নিকভ।

এটা একটা কথা হল? শুনলে ভয় হয়। যাকগে, কাল যখন বেরিয়েছিলে, একটা চিঠি এসেছিল তোমার নামে।

চিঠি! আমার নামে? কার চিঠি? কোত্থেকে?

অতশত জানি নে। পিয়নকে তিন কোপেক দিয়ে রেখে দিয়েছি চিঠিটা।

কই সে চিঠি!

নাসটাসিয়া চিঠিখানা নিয়ে এলো। লিখেছে রাসকোল্‌নিকভের মা। দূর মফস্বল থেকে।

এবার সে চঞ্চল হয়েছে মায়ের চিঠি পেয়ে।

সে ন্যাসটাসিয়াকে হাতে তিনটে কোপেক দিয়ে বলে, যাও, এবার সরে পড়ো!

ন্যাসটাসিয়ার ইচ্ছে ছিল চিঠির কথা শুনবার। তাড়া খেয়ে তাকে বিদেয় হতে হল ঘর থেকে।

খামের ওপর ছোট ছোট মেয়েলি হাতের লেখার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল রাসকোল্‌নিকভ।

মায়ের হাতের লেখা। যে মা তাকে লিখতে শিখিয়েছে, পড়তে শিখিয়েছে, মানুষ করেছে।

খামটায় আলতো একটা চুমু খেয়ে ছিঁড়ে ফেলে রাসকোল্‌নিকভ। বেশ বড় চিঠি। দু-খানা বড় বড় কাগজে ছোট ছোট অক্ষরে মা লিখেছে—

রোডিয়া,

দু-মাস আগে তোমার চিঠি পেয়েছি। তোমার টাকার দরকার। কিন্তু যে-টাকা আগে পাঠিয়েছিলাম, তা ধার করা টাকা। এতদিনে তা শোধ হল। আবার ধার করছি। দু-একদিনের মধ্যে পাঠাব।

চিঠির জবাব দিতে মন চায়নি হাতে টাকা ছিল না বলে।

আগে পাঠিয়েছিলাম পনেরো রুব্‌ল। এবার পাঠাব কুড়ি-পঁচিশ রুব্‌ল। যে জামিনে পনেরো রুব্‌ল ধার পেয়েছিলাম, সেই একই জামিনে এখন তার ডবল টাকা পাব। কারণ একটা ঘটনায় সমাজে আমাদের মর্যাদা বেড়েছে। এক সঙ্গে তোমার বোন দুনিয়ার ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে।

গোড়া থেকে বলি। গত বছর ষাট রুব্‌ল পাঠিয়েছিলাম মনে আছে? তুমি যখন টাকা চেয়ে পাঠালে, তখন আমাদের হাত খালি। ঠিক তখনি। দুনিয়া ছেলেমেয়ে পড়ানোর কাজ পেয়ে গেল সিদ্রিগয়লভ সাহেবের বাড়িতে। মাইনে ভালই।

আগাম পাওয়া গেছিল একশ রুব্‌ল। দিয়েছিলেন সিদ্রিগয়লভের স্ত্রী মার্কা পেত্রো। তাই থেকে তোমাকে পাঠাই ষাট রুব্‌ল–বাকি দিয়ে আমার দেনা শোধ করেছিলাম এখানকার।

বিপদটা এল তারপরেই। সিদ্রিগয়লভ লোকটার বয়স হয়েছে ঠিকই, কথাবার্তাও ভাল, কিন্তু স্বভাবচরিত্র তেমন সুবিধের নয়। দু দিনেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠল দুনিয়া কিন্তু চাকরি ছাড়তে পারল না। কারণ একশ রুব্‌ল যে আগাম নেওয়া রয়েছে।

ভরসা ছিল মাফা-র ওপর। কড়া মহিলা। বেশি খারাপ ব্যবহার নিশ্চয় বরদাস্ত করবেন না।

কিন্তু ঘটনাটা ঘটল ঠিক উল্টো। উনি দুনিয়াকেই ভুল বুঝলেন। সব দোষ নাকি দুনিয়ার। ওকে তাড়ালেন বাড়ি থেকে। শহরময় দুর্নাম ছড়াতে লাগলেন দুনিয়ার নামে। উনি বড়লোক; তাই উনার কথা সবারই বিশ্বাস হল। আমাদের মুখ দেখানো দায় হয়ে দাঁড়াল।

পুরো ব্যাপারটা কিন্তু ঘুরে গেল দুনিয়ার একটা চিঠির জোরে। চিঠিখানা লিখেছিল সিদ্রিগয়লভকে। তার খারাপ ব্যবহারের প্রতিবাদ করে। চিঠি পড়ল গিয়ে মার্কার হাতে। তিনি ভুল বুঝতে পেরে ভীষণ রেগে গেলেন স্বামীর ওপর। যা ভুল করেছেন, তা শোধরানোর জন্যে শহরের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে এলেন–দুনিয়া নির্দোষ।

এত কথা লিখছি এই জন্যে যে, মার্কা দিন কয়েক আগে হঠাৎ মারা গেছেন। কিন্তু তিনি আমাদের অবস্থাটা ঘুরিয়ে দিয়ে গেলেন। অনেকেই যেচে এল আমাদের বাড়িতে। এদের মধ্যে ছিলেন সুজিন নামে এক ভদ্রলোক। মার্কার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। নামী উকিল। বড়লোক। সরকারি চাকুরে।

শহরে আমাদের খাতির বেড়েছে এই লুজিনের জন্যে। আলাপ হওয়ার দু-দিন পরেই বিয়ে করতে চেয়েছেন দুনিয়াকে। কারণ, দুনিয়া সুন্দরী, শিক্ষিতা, গরিব। শেষের কারণটা একটা বড় কারণ লুজিনের কাছে। তার মতে, বড়লোকদের উচিত গরিব মেয়ে বিয়ে করা। তাতে ঘরে শান্তি থাকে। বউ স্বামীর বাধ্য থাকে।

কথাটা আমাদের খুব একটা ভাল না লাগলেও এ নিয়ে মাথা ঘামাইনি। ওসব বড়লোকি খেয়াল। মোট কথা, দুনিয়াও পছন্দ করেছে লুজিনকে। লোক ভাল, হাতে টাকা আছে, সমাজে প্রতিপত্তি আছে। আত্মীয়তা গড়ে উঠলে আমাদেরই লাভ।

তুমি আইন পড়ছ শুনে লুজিন বলেছেন–ভালই হল। পিটার্সবার্গে আমি অফিস খুলছি। রোডিয়াকে আমার সেক্রেটারি করে নেব।

অর্থাৎ বিয়ের আগেই তোমার চাকরির কথা পাকা হয়ে গেল। পরে ওঁর অংশীদারও হয়ে যেতে পারো।

যাই হোক, তোমার টাকা পাঠাচ্ছি। ইতিমধ্যে লুজিন পিটার্সবার্গে চলে যাচ্ছেন। অফিস খুলবেন। থাকার ঘর নেবেন। আমাদের থাকবারও ব্যবস্থা করবেন। তারপর আমরা যাব। বিয়েটা হয়ে গেলেই আমি ফিরে আসব এখানে আর দুনিয়া যাবে ওর স্বামীর কাছে।

আমাদের বাক্সটা লুজিন সাথে নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা যাব পরে নিজেদের খরচে, থার্ড ক্লাসে। এমন কিছু খরচ হবে না।

দেখা হবে হপ্তাখানেকের মধ্যেই তোমার ঘরে।

ইতি
তোমার মা
পলচেরিয়া রাসকোল্‌নিকভ

চিঠি পড়েই মাথা ঘুরে গেল রাসকোল্‌নিকভের।

এ কী করতে চলেছে মা আর বোন! এ যে মহাকিপটের গোলামি করা। লুজিন! ব্যাটাকে চোখে না দেখলেও তার কদর্য মনের পরিচয় চিঠির মধ্যে পেয়ে গেছে রাসকোল্‌নিকভ!

শয়তান! শয়তান! বাক্সটা নিয়ে আসছে যেন কত দয়াই না করছে। কিন্তু যাকে বিয়ে করবে, সে তার মাকে নিয়ে আসবে নিজের খরচে। বাড়ি থেকে ষাট মাইল দূরের রেলস্টেশনে আসবে মালটানা ঘোড়ার গাড়ির চটে বসে-সাতশো মাইল পথ আসবে ট্রেনের থার্ড ক্লাসে!

খুপরি ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায় রাসকোল্‌নিকভ। পাগলের মত ঘুরতে থাকে পথে পথে। মাথার মধ্যে পাক খেতে থাকে দুশ্চিন্তার ঘূর্ণিঝড়!

এ বিয়ে বন্ধ করতেই হবে। প্রবঞ্চক লুজিনকে দুনিয়া বিয়ে করতে চায় কেন সেটা সে বুঝতে পারছে। ভাইয়ের চাকরি হবে। মা সুখে থাকবে–

লুজিন দুনিয়াকে বিয়ে করতে চায় কেন? সে গরিব বলে? আর যখন তখন বায়না করবে না বলে?

ছি! ছি! ছি! এ বিয়ে হতে পারে না–কক্ষণো না।

কিন্তু রাসকোল্‌নিকভের মুরোদই বা কতটুকু? তিন হাজার রুব্‌ল নেই বলে কলেজে যেতে পারছে না, আইন পড়তে পারছে না। পেট চলছে কোনোমতে মায়ের ধার করা টাকায়।

ভাবতে ভাবতে কখন জানি রাস্তার মাঝেই দাঁড়িয়ে গেছিল রাসকোল্‌নিকভ। সম্বিৎ ফিরল আচমকা সপাং করে পিঠে চাবুক পড়ায়–কানে ভেসে এল খটাখট খটাখট ঘোড়ার খুরের আওয়াজ!

চমকে পাশে সরে গেল বটে রাসকোল্‌নিকভ। পাশ দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘোড়ার গাড়িটা। কিন্তু রাস্তার লোক অবাক হয়ে চেয়ে থাকে তার দিকে।

ভাবছে, পাগল না কি লোকটা। রাস্তার মাঝে ওইভাবে কেউ দাঁড়ায়? চাবুক খেয়েও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সে।

কে যেন একটা বিশ কোপেক মুদ্রা গুঁজে দিয়ে যায় ওর হাতে। চোখ তুলে তাকায় রাসকোল্‌নিকভ এক প্রৌঢ়া দয়া করছেন তাকে। সঙ্গে ছোট্ট একটি মেয়ে।

প্রৌঢ়ার চোখে করুণা। কিন্তু রাসকোল্‌নিকভের হাসি পেলো। এত দুঃখেও ইচ্ছে হলো হো-হো করে হেসে ওঠে।

ভিখিরি ভাবা হয়েছে তাকে। তাই এই ভিক্ষে! অথচ সে বড় বংশের ছেলে। শিক্ষিত। আইন পাশ করলেই মোটা রোজগার বাধা।

তার দরকার মোটে তিন হাজার রুব্‌ল! যার অভাবে বই বেচতে হয়েছে, কলেজ ছাড়তে হয়েছে। মাত্র তিন হাজার রুব্‌ল! যা পেলে সে প্রতিভার চমক দেখিয়ে এদেশের চেহারা পালটে দেবব আর তাকেই কিনা হাত পেতে বিশ কোপে ভিক্ষে নিতে হল একজন স্ত্রীলোকের হাত থেকে।

ধিক! ধিক! ধিক। নেভা নদীর সেতুতে দাঁড়িয়েছিল রাসকোল্‌নিকভ। ছুঁড়ে মুদ্রাটা ফেলে দিল নদীর পানিতে।

মনের জ্বালা একটু কমল। হনহনিয়ে নেমে এল সেতু থেকে।

মাথার মধ্যে কিন্তু ঘুরপাক দিচ্ছে একটাই কথা। তিন হাজার রুব্‌ল! তিন হাজার রুব্‌ল! যা পেলে সে আবার পড়াশুনো আরম্ভ করতে পারবে। দারিদ্র্যের

অপমানকে কাটিয়ে উঠতে পারবে। কতজনের মঙ্গল করতে পারবে।

লুজিনের মত তো সে টাকার পিশাচ নয়। এই তো গতকালই একটা ঘড়ি বন্ধক দিয়েছিল অ্যালিওনাআইভানোভনাকে। পেয়েছিল মাত্র দেড় রুব্‌ল। তা থেকেই অতগুলো কোপে দান করেছে মার্মেলাডভ্‌ভকে।

ঘড়ি বন্ধক রেখে পাওয়া টাকা! পারবে কেউ দান করতে?

তিন হাজার রুবুল হাতে পেলে সে যে কি করবে–

মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকে আর আবোলতাবোল ভাবতে থাকে। হঠাৎ চোখ তুলেই থমকে যায় রাসকোল্‌নিকভ।

সামনেই রাজুমিখিনের বাড়ি। তারা একই ক্লাসের বন্ধু। একই অবস্থা দুজনের। টাকার অভাবে পড়াশুনো শিকেয় উঠেছে।

কিন্তু কেউ কাউকে তা মুখ ফুটে বলে না। অভাব থাকতে পারে– আত্মসম্মানও তো আছে। দেখা হলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। এসেই যখন পড়েছে, তখন দেবাটাও করে যাওয়া যাক বন্ধুর সঙ্গে।

রাজুমিখিন কিন্তু ওকে দেখেই ভূত দেখার মত চমকে উঠল। তার ঘরের অবস্থাও রাসকোল্‌নিকভের ঘরের মত। কম আলোয় ঘাড় হেঁটে করে কি যেন লিখছিল সে।

রাসকোল্‌নিকভকে সামনে দেখেই বলে উঠলো বিড়বিড় করে–কী আশ্চর্য! এই অবস্থা হয়েছে তোমার!

তারপরেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো–আমার একটা উপকার করবে, রাসকোল্‌নিকভ? একজন প্রকাশক আমাকে ছ রুব্‌ল আগাম দিয়েছেন–আর জার্মান থেকে রুশ ভাষায় অনুবাদের জন্যে এই বইগুলো দিয়েছেন। জার্মানটা তো আমি ভাল জানি না–বড্ড দেরি হচ্ছে। অর্ধেক অনুবাদ তুমি করে দাও–এই নাও বই আর এই নাও তিন রুব্‌ল।

বই আর টাকা নিয়ে পথে নেমে এসেছিল রাসকোল্‌নিকভ। তারপর আবার কি মনে করে ফিরে গিয়ে ফিরিয়ে দিল সবকিছুই।

হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল রাজুমিখিন।

রাস্তায় নেমে এল রাসকোল্‌নিকভ। হাঁটছে আনমনাভাবে। হঠাৎ কানে ভেসে এল এই কথাগুলো–

কাল সন্ধ্যেবেলা। ছটা থেকে সাতটার মধ্যে যেও। অনেক কাপড় কিনবে লোকটা।

যাব।

শেষ কথাটা বলল লিজাভেটা। বলল এক ফিরিওলাকে।

লিজাভেটাকে চেনে রাসকোল্‌নিকভ। অ্যালিওনাআইভানোভনা-র বোন–যার কাছে সে কালকে ঘড়ি বন্ধক দিয়ে এসেছে।

কথাগুলো গেঁথে গেল মাথার মধ্যে।

তিন হাজার রুব্‌ল রোজগারের উপায়টাও ঝিলিক দিয়ে উঠল মগজে!

.

চার

বুড়ির ঘরে ছটা থেকে সাতটার মধ্যে তাহলে বুড়ি ছাড়া আর কেউ থাকবে না!

সেখানে আছে লোহার সিন্দুক–ভেতরের ঘরে। রাসকোল্‌নিকভ নিজে অবশ্য দেখেনি, দেখেছে শুধু চাবির গোছাটা। থাকে বুড়ির ডান পকেটে। একটা চাবি বড়–খাঁজকাটা। নিশ্চয় সিন্দুকের।

তিন হাজার রুব্‌ল থাকবে না সিন্দুকে? নিশ্চয় থাকবে। আইন কলেজের অভাবী ছেলেরা ওখান থেকেই ধার নেয়। হাজার হাজার রুব্‌ল ধার নেবার মত লোকও আসে।

বুড়ির একটাই বোন। লিজাভেটা। কাপড় ফেরি করে। তখন বুড়ি একলা থাকে।

থাকবে কালকেও। সন্ধ্যে ছটা থেকে সাতটার মধ্যে।

ফ্ল্যাটটা অবশ্য পাঁচতলায়। তাতে বয়ে গেল বুড়ির। টাকার দরকার পড়লে লোকে ওখানেই ছোটে।

আইন? সে তো বড়লোকদের হাতের অস্ত্র। আইনকে পায়ের তলায় রাখে বড়লোকরা। আইন কিন্তু পায়ের তলায় রাখে গরিবদের।

আইন! নেপোলিয়ন কি আইন মেনেছিলেন? লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছেন। লেনা, অস্টারলিজ, ওয়াটারলুতে রক্তের সমুদ্র বইয়েছেন। মিশরে বিশাল সেনাবাহিনী ফেলে চলে এসেছেন–যারা না খেয়ে মরে গেছে। রাশিয়ায়

তার চেয়েও বেশি সৈন্যদের শীতে কেঁপে মরে যেতে হয়েছে।

তবুও তাকে খুনী বলা হয়নি। উল্টো মহামানব বলে শ্রদ্ধা করা হয়েছে।

অপরাধ নিয়ে একটা প্রবন্ধও লিখেছিল রাসকোল্‌নিকভ। কিন্তু ছাপবার জন্যে যে কাগজে পাঠিয়েছিল, সে কাগজটা গেল উঠে। প্রবন্ধ তো ছাপা হলই না–ফেরৎও দিল না।

নেপোলিয়ন! অসাধারণ মানুষ নেপোলিয়ন! মানুষ খুন করা যে বেআইনী, একথা আইনবি বললে কি তিনি যুদ্ধ বন্ধ রাখবেন?

ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল রাসকোল্‌নিকভ।

একে তো পেটভরে খাওয়া হয়নি কতদিন, তার ওপর পথে পথে টো-টো করে মোরা–শরীর অবসন্ন তো হবেই। তাই ঘুমে কাদা হয়ে গেছিল রাসকোল্‌নিকভ।

সকালে একবার বেরিয়েছিল। যেন নেশায় ঘোরে ঘুরপাক দিয়েছিল রাস্তায় রাস্তায়। ফিরে এসে শুতে না শুতেই ঘুম।

ঘুম আর যায় না চোখ থেকে। ঘুম-ঘুম চোখেই একবার মনে হয়েছিল, কি যেন আজ করতে হবে–এখুনি ওঠা দরকার, কিন্তু শরীরটা যে বাগে নেই। কাজটা কি, তা ভেবে ওঠার আগেই আবার পাশ ফিরে ঘুমে অচেতন হয়ে গেল রাসকোল্‌নিকভ।

ঘুমের ঘোরেই হঠাৎ শুনল, কে যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে নিচের দালানে– কি মুশকিল! যাবি কখন? পাঁচটা যে বেজে গেল!

ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো রাসকোল্‌নিকভ।

পাঁচটা বাজে! পাঁচটা! তাহলে তো হাতে সময় খুবই কম! ছটা থেকে সাতটার মধ্যে যে বুড়ির বাড়িতে রয়েছে মস্ত কাজ।

তিন হাজার রুব্‌ল রোজগারের কাজ। আজকেই যেতে হবে। আবার কবে যে সে ঘরে বুড়ি আবার একলা থাকবে তা জানবে কি করে রাসকোল্‌নিকভ।

যাবেই সে–আজকেই। কিন্তু আয়োজন তো কিছুই হয়নি! পিস্তল সে নেবে। ওতে বড় আওয়াজ হয়, কাজ সারতে হবে নিঃশব্দে। পিস্তল তার নেইও। থাকলেও নিত না।

কুড়োলটা নিতে হবে। আছে ন্যাসটাসিয়ার রান্নাঘরে। কিন্তু কুড়োল হাতে তো রাস্তায় বেরোনো যায় না। লোকের চোখে পড়বেই। সুতরাং…।

বালিশের তলা থেকে একটা ছেঁড়া জামা টেনে নিল রাসকোল্‌নিকভ। একটা ফালি ছিঁড়ে নিয়ে পাকিয়ে দড়ি করে নিল ঝটপট। ওভারকোটের হাতার মধ্যে গলিয়ে ফাঁস করে নিল ঝড়ের বেগে হাত চালিয়ে। কুড়োল আটকে থাকবে সেখানে। বগলে থাকবে একটা ফাঁস। কুড়ালের মাথা আটকে রাখার জন্যে।

চমৎকার ফন্দী! অভিনব কৌশল! নিজেই নিজের তারিফ করে রাসকো নিকভ। ফাঁস বানিয়ে নেয় ছেঁড়া ন্যাকড়া দিয়ে খুশি খুশি মনে।

এর পরের কাজটা আরও অদ্ভুত। সোফার তলা হাতড়ে বের করে একটা চৌকো কাঠ, আর একটা প্রায় একই মাপের টিন। টিন মুড়লো কাঠের গায়ে, সুতো দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধল বারবার–যাতে চট করে খোলা না যায়। তার ওপর জড়ালো কাগজ।

ছটা বেজে গেল বোধহয়। এবার যোগাড় করতে হবে কুড়োলখানা।

তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নিচের তলায়। রান্নাঘরে এখন ন্যাসটাসিয়া নাও থাকতে পারে…

ঢুকতে গিয়েই থমকে গেল। ন্যাসটাসিয়া রয়েছে। দরজার দিকে পেছন ফিরে একমনে কাজ করছে।

গেল সব ভেস্তে! এখন উপায়? ছটা বেজে গেল–অথচ এখনও হাতিয়ার সংগ্রহ হল না!

এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটাও বিপদ। কখন পেছন ফিরবে ন্যাসটাসিয়া–শুরু হবে বকবকানি।

পলকে সরে এল রাসকোল্‌নিকভ। মাথার মধ্যে চিন্তার তুফান ছুটলো। তিন হাজার রুব্‌ল রোজগার আর হল না। খতম হয়ে গেল পরিকল্পনা–

শুধু একটা কুড়োলের অভাবে!

কি করবে এখন? রান্নাঘরের কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেও তো লোকের সন্দেহ হবে। ঘরে ফিরে যেতেও মন চাইছে না। রাস্তায় টো-টো করতেও ইচ্ছে হচ্ছে না মনভর্তি হতাশা নিয়ে…

সদর দরজার কাছে গিয়ে ভাবছিল কি করবে…

এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা দারোয়ান দেখছে না তো? তাকিয়ে দেখলো সে দারোয়ানের ঘরের দিকে…

সে নেই ঘরে। নিশ্চয় কাছাকাছি কোথাও গেছে। ঘরে তালা দিয়ে যায়নি।

ঘর অন্ধকার। কিন্তু বেঞ্চির নিচে চক্ করছে ওটা কী? বুকটা ধড়াস করে ওঠে রাসকোল্‌নিকভের!

এদিকে ওদিকে চেয়েই ঢুকে পড়ল ঘরে। টেনে বের করল চকচকে জিনিসটা।

একটা কুড়োল!

চোখের নিমেষে ঢুকিয়ে নিল ওভারকোটের হাতায়, ঝুলিয়ে নিল বগলের ফাঁসটাতে। দ্রুত বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

না। কেউ নেই আশেপাশে। কেউ তাকে দেখেনি দারোয়ানের ঘরে ঢুকতে আর বেরোতে।

শয়তান আছে তার সঙ্গে। ভয় কী? ঠিক দরকারের সময় কাজের জিনিস জুটিয়ে দিয়েছে হাতের কাছে। যার কেউ নেই, তার শয়তান আছে। নরকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে এক পায়ে খাড়া শয়তান স্বয়ং।

রাস্তায় নেমে হনহনিয়ে যেতে যেতে এক দোকানে ঘড়ি দেখল রাসকোল্‌নিকভ।

সাতটা বেজে দশ মিনিট!

দেরি হয়ে গেছে–খুবই! কিন্তু তাই বলে সোজা পথে গেলে তো চলবে না। যে পথে ঘড়ি বন্ধক দিতে গেছিল, সেপথে না গিয়ে যেতে হবে ঘুরপথে। সাবধানের মার নেই।

তাই সে চলল ইউসুফ বাগানের মধ্যে দিয়ে।

বড় ফোয়ারাটার দিকে তাকিয়ে মনে হল–হাওয়া ঠাণ্ডা রাখার জন্যে সব বাগানেই ফোয়ারা রাখা দরকার।

মিয়লাভস্কি প্রাসাদ পর্যন্ত যদি এ বাগানকে বাড়িয়ে নেওয়া হয় কেমন হয় তাহলে? খুবই ভাল হয়। শহরের এই অংশের চেহারা ফিরে যাবে–শহরবাসীদের স্বাস্থ্যও ভাল থাকবে…

পরক্ষণেই অন্য এক সমস্যা নিয়ে মশগুল হল ওর মগজ–

শহরের একটা দিকে বাগান-বাগিচা কিছু নেই। বড় নোংরা। অথচ লোকগুলো ওইখানেই গাদাগাদি করে থাকতে চায় কেন?

কাছেই একটা ঘড়িতে টং করে একটা ঘণ্টা বাজতেই চমকে ওঠে রাসকোল্‌নিকভ। সাড়ে সাতটা বেজে গেল।

এলোমেলো এত চিন্তা মাথায় আসছেই বা কি করে? ফাঁসির আগে নাকি এরকম হয়। হাজার চিন্তা মগজকে ছেয়ে ফেলে।

সত্যিই কি সাড়ে সাতটা বাজল? এ ঘড়িটা ঘোড়ার মত চলছে নিশ্চয়।

এসে গেছে বাড়িটা। এখানেও ভাগ্য মুখ তুলে চেয়েছে। অথবা, শয়তান সহায় হয়েছে। খড়-বোঝাই একটা গাড়ি ঢুকছিল ফটক দিয়ে। ডান দিকে দারোয়ান ব্যস্ত চাক-মজুরদের নিয়ে। বাঁ দিকে কেউ নেই। সেই দিক দিয়েই দেয়াল আর গাড়ির মাঝখানে থেকে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল রাসকোল্‌নিকভ। কেউ দেখতেও পেল না।

ভেতরে ঢুকেই ডাইনের সরু সিঁড়িটায় লাফিয়ে উঠেই বাঁচল হাঁফ ছেড়ে। শয়তান। শয়তান। শয়তান ছাড়া এত সাহায্য কে করবে তাকে। কিন্তু যা বুক ধড়ফড় করছে। হাত দিয়ে একবার খামচে ধরল বুকখানা। অথচ কেউ ওকে দেখেনি।

কুড়োলটা? আছে ঠিক জায়গায়।

শুরু হল সিঁড়ি বেয়ে পা টিপে টিপে ওঠা। ঘনঘন দেখতে লাগল ডাইনে বায়ে। না, কেউ দেখছে না–সব দরজাই বন্ধ।

দোতলার একটা ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। রঙ-মিস্ত্রীরা কাজ করছে সেখানে।

রাজকোনিকভকে দেখেনি তারা। কিন্তু খুঁতখুঁত করতে থাকে মনটা। তিনতলায় উঠে একটু দাঁড়ায়। রঙ-মিন্ত্রীগুলো না থাকলেই ভাল হত। গুটিগুটি আবার উঠতে থাকে সিঁড়ি বেয়ে। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে পাঁচতলায় উঠে আবার থমকে দাঁড়ায়।

সিঁড়িতে কেউ নেই। কান পাতে বুড়ির দরজায়। ঘরের মধ্যেও কোনো আওয়াজ নেই।

কুড়োলটা? ঠিকই ঝুলছে বগলের ফাঁকে।

মুখখানা কি ফ্যাকাশে মনে হচ্ছে? একটু চঞ্চল? দেখলে বুড়ির সন্দেহ হবে না তো?

আর একটু দাঁড়ালে হয় না? বুকের ধড়াস ধড়াস ভাবটা যাতে একটু কমে।

ধুত্তোর! বুকের হাতুড়ি-পেটা তো কমছে না। এ যে বেড়েইে চলেছে। কাঁহাতক এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে রাসকোল্‌নিকভ? অসহা! হাত বাড়িয়ে বাজিয়ে দে, বুড়ির দরজার ঘন্টা।

জবাব নেই।

আধমিনিট পরে আবার বাজায়–এবার আরও জোরে। এবারও কোনো সাড়া নেই।

বড় ধুরন্ধর এই বুড়ি। আছে ভেতরেই। একা, তাই ভয় পাচ্ছে।

বুড়ির এই সাবধানী স্বভাবটা আগেও দেখেছে রাসকোল্‌নিকভ। তাই কান পাতে দরজায়–নিঃশব্দে।

ভেতরের তালার ওপর কে যেন হাত রাখল। খুব সাবধানে। দরজার একদম কাছে খসখস আওয়াজও শোনা গেল। জামাকাপড়ের আওয়াজ।

নিশ্চয় হুশিয়ার বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে পাল্লার ওপিঠে। এপিঠে দাঁড়িয়ে রাসকোল্‌নিকভ।

রাগে গা রি-রি করে ওঠে রাসকোল্‌নিকভের।

সঙ্গে সঙ্গে কুচুটে বুদ্ধিটাও মাথায় আসে। ইচ্ছে করেই একটু নড়াচড়ার আওয়াজ করে। আগডুমবাগডুম কথাও বলে খাটো গলায়। বুড়ি যেন বোঝে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। লুকোছাপা করছে না।

নিজের এই বুদ্ধির বহর নিয়ে পরে কিন্তু অবাক হয়েছিল রাসকোল্‌নিকভ। মগজ এত খোলতাই হল কি করে সেই সময়ে? সবই তো গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। অসাড় হয়ে যাচ্ছিল শরীরটা?

খুট করে একটা আওয়াজ হল ভেতরে। ছিটকিনি খোলার আওয়াজ।

সামান্য ফাঁক হল পাল্লা দুটো। দেখা যাচ্ছে সন্দেহভরা চোখের চাহনি।

এই হল বুড়ির স্বভাব। প্রতিবারই তাকায় এইভাবে।

গুলিয়ে গেল রাসকোল্‌নিকভের মাথাটা। পাছে তার মুখের চেহারা দেখে ভয়ের চোটে দরজা বন্ধ করে দো বুড়ি, তাই নিজের দিকে হ্যাঁচকা টান মেরে বসল পাল্লায়।

ফলটা হল উল্টো। সত্যিই ঘাবড়ে গিয়ে শক্ত করে পান্না ধরে রইল বুড়ি।

পারবে কেন রাসকোল্‌নিকভের সঙ্গে? আবার একটা হ্যাঁচকা টান মারতেই পান্না তো খুলে গেলই; নিজেও তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে গেল সিঁড়ির দিকে।

বুড়িও ছিটকে এসেছে চৌকাঠের এপারে। পথ জুড়ে দাঁড়িয়েছে রাসকো নিকভের–সরে যায়নি।

মরিয়া হয়ে গেল রাসকোল্‌নিকভ। হুড়মুড় করে এসে পড়ল বুড়ির গায়ের ওপর।

বুড়ি তখনও সরে দাঁড়াল না। কি যেন বলতে গিয়েও বলতে পারল না। চোখ বড় বড় করে শুধু চেয়ে রইল রাসকোল্‌নিকভের দিকে। চোখে আতঙ্ক।

আদাব, অ্যালিওনাআইভানোভনা, তড়বড় করে কথা বলে ওঠে রাসকোল্‌নিকভ। তখনি বোঝে, গলা ভেঙে গেছে তার–এসেছিলাম একটা জিনিস নিয়ে–কিন্তু এখানে যা অন্ধকার ভেতরে চলুন।

বলেই ঝট করে বুড়ির পাশ দিয়ে ঢুকে গেল ঘরে। বুড়ি হ্যাঁ কি না বলার আগেই।

পেছন পেছন ছুটে এসেই চেঁচাতে লাগলো বুড়ি–বলি ব্যাপারটা কী? এসব কি হচ্ছে? কী চাই?

সিগারেটের কৌটোটা বন্ধক দিতে চাই। সেদিন যেটার কথা বলে গেছিলাম, বলতে বলতে পকেট থেকে টিন আর কাগজ জড়ানো কাঠের কৌটোটা বের করে রাসকোল্‌নিকভ।

জিনিসটার দিকে এক পলক চেয়ে রাসকোল্‌নিকভের চোখে চোখে চেয়ে রইল বুড়ি। স্থির চাহনি। ওর মনের ভেতর পর্যন্ত যেন দেখতে পাচ্ছে। ঠোঁটেও বুঝি স্ক্রিপের হাসি ফুটে উঠছে।

গাঁ শিরশির করে ওঠে রাসকোল্‌নিকভের। বুড়ি কি ওর কুমতলব ধরে ফেলেছে।

কুটিল ওই চোখের মধ্যে জাদু আছে নাকি? পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে রাসকোল্‌নিকভের।

তেড়ে উঠেই তাই বলেছিল–দেখছেন কি অমন প্যাটপ্যাট করে? নিতে হয় নিন-নইলে আমি যাই।

কড়া গলায় ধমক শুনেই বুড়ি কিন্তু সহজ হয়ে গেল। মনের মধ্যে প্যাঁচ নিয়ে এলে খদ্দের কখনো তেড়েমেড়ে কথা বলে না।

বললো অত ছটফট করছ কেন? কি আছে প্যাকেটে?

রূপোর সেই সিগারেট কেস। সেদিন বলে গেছিলাম, মনে নেই?

হাত কাঁপছে কেন? শীতে না জ্বরে? মুখ তো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে দেখছি।

জ্বরে! জ্বরে কাঁপছি! ফ্যাকাশে মেরে গেছি পেটে খাবার নেই বলে! আরও বাজখাই গলায় বলে ওঠে রাসকোল্‌নিকভ।

এতক্ষণে বুড়ির সন্দেহ যায়। অভাবে না পড়লে এরকম বিকটভাবে কেউ চেঁচায় না। হাত বাড়িয়ে নেয় কাগজে মোড়া প্যাকেটটা।

কি আছে এতে?

বললাম তো রুপোর সিগারেট কেস।

কপো! মনে তো হচ্ছে না–ইস্! এভাবে কেউ জড়ায়! বলতে বলতে জানালার দিকে এগোয় বুড়ি, আলোয় দেখবে বলে।

দাঁড়িয়ে রইল রাসকোল্‌নিকভ। বুড়ি গজগজ করতে করতে যাচ্ছে জানালার দিকে। রাসকোল্‌নিকভ তখন কোটের বোতাম খুলে ফাঁস থেকে কুড়ালের ফলা টেনে বের করে। হাতলটা ধরে ডান মুঠোয়।

হাতে শক্তি নেই কেন? হাত ফসকে টং করে কুড়োল পড়ে না যায়।

মাথা ঘুরছে। চোখে ধোয়া দেখছে।

কী জ্বালা! কী জ্বালা! এভাবে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কেউ বাঁধে? গজগজ করতে করতে জানালার দিক থেকে ফিরে আসছে বুড়ি।

কুড়োলখানা মাথার ওপর তুলল রাসকোল্‌নিকভ। জ্ঞান ছিল কি সেই সময়ে। খুনের চেষ্টায় কি সব উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে।

মনে হয় তাই হয়েছিলো; তাই কুড়োলখানা নেমে এল উল্টো হয়ে।

ফলা নয়–কুড়োলের ভোতা দিকটা সজোরে পড়ল বুড়ির মাথায়।

আর সঙ্গে সঙ্গে হুঁশ ফিরে এল রাসকোল্‌নিকভের। ঘোর কেটে গেল চোখের নিমেষে। মাথাচাড়া দিল খুন করার ইচ্ছেটা। সেই সঙ্গে ফিরে এল হাতের শক্তি।

মাথার ওপর চোট খেয়েই বুড়ি কিন্তু অস্ফুট একটা আওয়াজ করে গড়িয়ে পড়েছে মেঝের ওপর। উঁচু করে ধরেছে হাত দুখানা। কাগজের প্যাকেট তখনও তার হাতে।

বেঁটে বুড়ি। মাথার পাতলা চুল ইঁদুরের ল্যাজের মত বিনুনি পাকান। শিঙের চিরুনি দিয়ে আটকানো।

কুড়োলের উল্টো পিঠ দিয়ে আবার একটা ঘা মারে রাসকোল্‌নিকভ। তার পরে আর একটা।

খুলি ফেটে গেছে। হুড়হুড় করে রক্ত বেরোচ্ছে।

চিৎ হয়ে বুড়ি পড়ে গেল মেঝেতে। নিচু হয়ে মুখখানা দেখে নিল রাসকোল্‌নিকভ। হ্যাঁ, মারা গেছে। চোখ দুটো কোটর থেকে যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কুড়োল নামিয়ে রাখল রাসকোল্‌নিকভ–বুড়ির পাশে, মেঝের ওপর।

এবার দরকার চাবির গোছা। যেটা থাকে বুড়ির ডান পকেটে।

হ্যাঁ আছে। টেনে বার করল রাসকোল্‌নিকভ। হাত কাঁপছে এখনও কিন্তু বেসামাল নয়। নিজের হাতে বা জামাকাপড়ে যাতে রক্ত লেগে না যায়, সে ব্যাপারে হুঁশিয়ার সে। চাবি এখন ওর হাতে। লোহার রিঙে ঝুলছে অনেকগুলো চাবি।

ছুটে শোবার ঘরে ঢুকল রাসকোল্‌নিকভ।

ছোট্ট ঘর। দেয়ালে যিশু আর সাধুদের ছবি। চাদর ঢাকা একটা পরিষ্কার বিছানা। সিকের ওয়াড় পরানো সে।

দেরাজটা রয়েছে দেওয়ালের গায়ে। কিন্তু চাবি লাগাতে গিয়েই সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল রাসকোল্‌নিকভজ্ঞে। চাবির ফুটোয় চাবি আর লাগে না! ইয়ে হচ্ছে দৌড়ে পালায়। পরমুহূর্তেই হেসে ওঠে ফিক করে–এখন কি পালানো যায়।

তারপরেই ভয়ানক আতঙ্ক দেখা দিল তার মনের মধ্যে। হঠাৎ যদি বুড়ি এখন চেঁচিয়ে ওঠে? হয়তো মরেনি-মরার ভান করে পড়ে আছে!

চাবি ঝুলতে লাগল দেরাজের গায়ে। হন্তদন্ত হয়ে সামনের ঘরে ফিরে এল রাসকোল্‌নিকভ। থপ্ করে কুড়োলখানা তুলে নিয়ে আর এক ঘা কষিয়ে দিতে গিয়েই…দেখল, বুড়ি সত্যিই মরেছে।

খুলি ভেঙে হাড় ঢুকে গেছে ভেতরে। আঙুল দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতেও যাসিল… সামলে নিল নিজেকে। এত রক্ত!..গা বমি-বমি করছে রাসকোল্‌নিকভডের। বুড়ির গলায় একগাহা সুতো রয়েছে না? কিসের সুতো?

টেনে ছিঁড়তে গেল রাসকোল্‌নিকভ। পারল না। খুবই শক্ত সুতো। তার ওপর রক্তে ভিজে গেছে। টেনে বের করাও যানে না। জামার মধ্যে কি একটা জিনিসে যেন আটকে যাচ্ছে।

শেষমেষ কুড়োল দিয়েই কাটতে হল সুতোটা।

টান মারতেই হাতে উঠে এল সুতোয় বাঁধা একটা টাকার থলি।

থলিটা নিজের পকেটে রাখল রাসকোল্‌নিকভ। কত টাকা ভেতরে আছে, তা পরে দেখবে। এখন তার দুহাত রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে।

শোবার ঘরে ফিরে এল। হাতে কুড়োল। একটার পর একটা চাবি লাগিয়ে গেল দেরাজের ফুটোয়। কিন্তু লাগল না কোনোটাই। তবুও একই চাবি বারবার লাগিয়ে যাচ্ছে। মাথা তার ঠিক নেই।

হঠাৎ বড় চাবিটার দিকে খেয়াল হল, এটা অন্য কিছুর চাবি নয় তো? নাকি সিন্দুকের।

খাটের তলায় উঁকি দিতেই দেখা গেল সিন্দুকটা।

টেনে বের করল রাসকোল্‌নিকভ। বেশ বড় সিন্দুক। লম্বায় গজ খানেক। ডালাটা ধনুকের মত বাঁকানো। লাল চামড়া দিয়ে মোড়া। তার ওপরে লোহার পেরেক বসানো।

খাঁজকাটা বড় চাবিটা লেগে গেল সিন্দুকে। ডালা খুলতেই দেখা গেল, বেশ কিছু জামাকাপড়। ওপরে রয়েছে একটা লাল কোট।

হাতের রক্ত এই লাল কোটেই মুছে নিল রাসকোল্‌নিকভ।

মনে মনে বললো–লাল কোটে লাল রক্ত-চোখে পড়বে না।

জামাকাপড়ের নিচে রয়েছে সোনার বন্ধকী জিনিস–ঘড়ি, ব্রেসলেট, হার, ইয়ার-রিং, পিন–আরও কত কী!

সেগুলো তুলে নিয়ে প্যান্ট আর কোটের পকেটে ঢুকিয়ে নেয় রাসকোল্‌নিকভ। হয়তো তারপরও কিছু থেকে গেল কিন্তু দেখবার সময় কই?

পাশের ঘরে একটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। বুড়ি মরে পড়ে আছে যেখানে–শব্দটা আসছে মনে হয় সেখান থেকেই।

ঠিক যেন পায়ের শব্দ! তারপরেই কে যেন কেঁদে উঠল! ব্যস, আর কোনো শব্দ নেই। যেন কবরের নিস্তব্ধতা।

কুড়োলটা নিয়ে লাফিয়ে উঠে ধেয়ে গেল রাসকোল্‌নিকভ।

ঘরে দাঁড়িয়ে লিজাভেটা, বুড়ির বোন। বগলে এক বান্ডিল কাপড়। মুখ সাদা। কাঁদতেও পারছে না।

রাসকোল্‌নিকভকে দেখেই সে কাঁপতে শুরু করেছে। মুখে বিভীষিকা ফুটে উঠেছে। একহাত উঁচু করে চেঁচাতে গেল কিন্তু আওয়াজ বেরোলো না গলা তার দিয়ে।

পিছিয়ে যাচ্ছে সে একটু একটু করে। ভয়ার্ত চোখ তার রাসকোল্‌নিকভের দিকে। সে আসছে! হাতের কুড়োল মাথার ওপর তুলে সে আসছে!

লিজাভেটার মুখে করুণ আকুতি। যেন অসহায় শিশু।

কুড়োল নেমে এল তার মাথায়। এবার ফলার দিকটা। খুলি চিরে দু-ফাত হয়ে গেল তক্ষুণি। লুটিয়ে পড়ল লিজাভেটা।

আর গুলিয়ে গেল রাসন্সেনিকভের মাথা। এই দ্বিতীয় খুনটা সে করতে চায় নি…

কাপড়ের বান্ডিলটা মেঝে থেকে তুলে নিয়েই ফেলে দিল আছড়ে। ছুটল বাইরের দরজার দিকে।

পালাতে চেয়েছিল রাসকোল্‌নিকভ। ভয়ে আর ঘৃণায়। মৃণাটা নিজের ওপর। লিজাভেটাকে তো সে খুন করতে চায়নি! ডবল খুন করে ভয়ও পেয়েছে খুব। বুদ্ধিসুদ্ধি সব গুলিয়ে যাচ্ছে। সিন্দুকের কাছে যেতেও আর মন চাইছে না।

মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল বলেই দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে ছিল রাসকোল্‌নিকভ। এই সময়ে চোখ গেল রান্নাঘরের দিকে। এক বালতি পানি রয়েছে সেখানে।

এই তো চাই! হাতের রক্ত আর কুড়োলের রক্ত ধুয়ে নেওয়া যাবে বালতির পানি দিয়ে। সাবানও পেয়ে গেল সেখানে। আগে পরিষ্কার করল হাতের রক্ত–বালতিতে হাত ডুবিয়ে।

তারপর শুরু হল কুড়োল ধোয়া। খুব খুঁটিয়ে বাট থেকে, ফলা থেকে সমস্ত রক্ত ঘষে ঘষে তুলতেই গেল মিনিট তিনেক।

রান্নাঘরের দড়িতে কাপড় শুকোচ্ছিল। তাই দিয়ে মুছল হাত আর কুড়োল।

এতক্ষণে ঠাণ্ডা হল প্রাণটা! কুড়োল ঝুলিয়ে নিল বগলের ফাঁসে।

তারপরেই মনে হল, আচ্ছা, কোট প্যান্ট বুটে রক্ত লেগে নেই তো?

ভালো করে তাকিয়ে রক্তের খোঁজে তন্ময় হয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ।

না, কোট-প্যান্টে লাগেনি বটে; তবে বুটে রয়েছে রক্তের ছিটে।

সঙ্গে সঙ্গে ন্যাকড়া ভিজিয়ে ঘষে ঘষে তুলে ফেলল রক্তের দাগ। তবুও খুঁতখুঁত করছে মনটা। জুতো থেকে রক্ত গেল বটে–কিন্তু কোট-প্যান্টে নিশ্চয় লেগেছে রক্ত।

আবার তীক্ষ্ণ চোখে দেখল কোট আর প্যান্ট। দেখছে তো দেখছেই..

হঠাৎ মনে হল, একী! ডবল খুন করে এখনও দাঁড়িয়ে আছে! এখুনি তার পালানো উচিত ঘর ছেড়ে।

ধড়মড়িয়ে দরজার দিকে ছুটে গিয়েই আঁৎকে উঠল দরজা খোলা রয়েছে দেখে!

পাল্লার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে সিঁড়ি।

কী সর্বনাশ! দরজা খোলা রেখেই এতক্ষণ ধরে খুনখারাবি আর সিন্দুক লুট করে গেছে সে।

দরজা খোলা না থাকলে তো লিজাভেটা হুট করে ঘরে ঢুকেতে পারত না আর খুনও হত না! এত আহাম্মক রাসকোল্‌নিকভ!

দড়াম করে পাল্লা বন্ধ করে দিয়ে ছিটকিনি তুলে দিল তক্ষুণি।

তারপরেই মনে হল–কি করছে সে। এখন তো পালানো দরকার–দরজা বন্ধ করছে কেন?

সঙ্গে সঙ্গে ছিটকিনি খুলে, পাল্লা ঠেলে মিটমিট করে চেয়ে রইল সিঁড়ির দিকে।

কান খাড়া করে শুনছে। কারা যেন নিচতলায় কথা কাটাকাটি করছে। দুটো লোক।

জ্বালাতন! পালানোর সময়ে একী ফ্যাসাদ।

বেশ কিছুক্ষণ পরে গলাবাজি বন্ধ হল লোক দুটোর। নিশ্চিন্ত হয়ে যেই দরজা খুলে বেরোতে যাবে রাসকোল্‌নিকভ, অমনি দড়াম করে খুলে গেল নিচের একটা দরজা!

কে যেন বেরিয়ে এল ঘর থেকে। ফুর্তিতে শিস দিতে দিতে নামছে সিঁড়ি দিয়ে।

কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাসকোল্‌নিকভ। নেমে গেছে লোকটা। কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। এইবার চম্পট দেওয়া যাক।

দরজা খুলে বাইরে বেরোতে না বেরোতেই বুকটা ধড়াস করে ওঠে রাসকোল্‌নিকভের!

কে যেন উঠে আসছে সিঁড়ি বেয়ে!

না…না…এখন নামা যাবে না। সিঁড়িতেই মুখোমুখি হয়ে যাবে!

পায়ের শব্দ উঠে এল দোতলায়।

তিনতলায়।

চারতলায়।

তড়াক করে পিছিয়ে এসে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো রাসকোল্‌নিকভ।

পায়ের শব্দ উঠে এল পাঁচতলায়। থামল দরজার দিকে।

বেজে উঠল ঘণ্টা!

মাথা ঘুরছে রাসকোল্‌নিকভের। একবার মনে হল, ঘণ্টার আওয়াজ শুনে বুড়িই বুঝি মেঝে ছেড়ে উঠে আসছে দরজা খুলে দেবার জন্যে…

কী আশ্চর্য! ঘুমিয়ে পড়ল নাকি দুজনে?

আগন্তুকের গলা! টং টং করে আবারও ঘন্টা বাজাচ্ছে!

আরও একজনের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। উঠে আসছে সিঁড়ি দিয়ে। উঠতে উঠতে বললো হেঁকে–কক? কেউ নেই ঘরে?

না থাকলে ঘর বন্ধ কেন ভেতর থেকে। ঘুমোচ্ছে নিশ্চয়। এদিকে আসতে বলল ঠিক আটটায়। আবার বাজল ঘণ্টা, ধাক্কা পড়ল দরজায়–সেই সঙ্গে হাঁক-ডাক।

দরজার এদিকে রাসকোল্‌নিকভ শক্ত করে ধরে রয়েছে পাল্লা।

দ্বিতীয় লোকটার গলা শোনা গেল-–কক। ব্যাপার সুবিধের মনে হচ্ছে না।

সাড়া দিচ্ছে না কেন? বললো প্রথমজন।

খুন হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।

খুন!

খুনী হয়তো ঘরেই আছে। বেরোতে পারবে না। তুমি দাঁড়াও–আমি ডেকে আনি দারোয়ানকে।

একজনের পায়ের আওয়াজ নেমে গেল নিচে।

কক্ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টা বাজাচ্ছে আর পাল্লা দিয়ে টানাটানি ঠ্যালাঠেলি করছে। চাবির ফুটো দিয়ে ভেতরে দেখবার চেষ্টাও করছে।

কুড়োল বাগিয়ে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রাসকোল্‌নিকভ।

লড়বার জন্যে সে তৈরি। কিন্তু উৎকণ্ঠা যে আর সইতে পারছে না।

হঠাৎ প্রচণ্ড ইচ্ছে হল, চেঁচিয়ে বলে ওঠে–এই যে আমি!

শেষ হয়ে যাক সমস্ত উৎকণ্ঠার।

একী! কক্ নামের লোকটা যে হন্তদন্ত হয়ে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে!

ভয় পেয়েছে! খুনী যদি একা পেয়ে তাকেই মেরে দেয়?

চট করে বেরিয়ে এল রাসকোল্‌নিকভ।

তরতর করে নেমে এল চারতলায়…তিনতলায়…

আচমকা আবার হৈ-হল্লা ভেসে এল নিচ থেকে।

দড়াম করে খুলে গেল একটা দরজা–দৌড়ে নেমে গেল একজনের পায়ের আওয়াজ।

ধর। ধর। পালাল যে! মিটকা! এই মিটকা!

ভীষণ চমকে উঠেছিল রাসকোল্‌নিকভ। কিন্তু চেঁচামেচিটা যে তাকে নিয়ে নয়, তা বুঝতে পেরে যেই আবার নামতে যাচ্ছে… তিন-চারটে গলার আওয়াজ শোনা গেল একই সঙ্গে। কক আর তার বন্ধুর কণ্ঠস্বর চেনা যাচ্ছে…

ওরা দলবেঁধে উঠছে।

মরিয়া হয়ে গেল রাসকোল্‌নিকভ। দাঁড়িয়ে থাকলে তো দেখে ফেলবে–চিনে ফেলবে।

নেমেই যাওয়া যাক।

লোকগুলোও উঠছে। আর একটা তলা বাকি–মোড় ঘুরলেই–

সামনের ঘরের একটা দরজা খোলা রয়েছে। একটু আগেই তো রঙের মিস্ত্রীরা কাজ করছিল এখানে! এইমাত্র হুল্লোড় করে নেমে গেল ওরাই।

এই তো সুযোগ! ফাঁকা ঘরে ঢুকে পড়ল রাসকোল্‌নিকভ।

আর ঠিক সেই সময়ে দলবল নিয়ে তারস্বরে কথা বলতে বলতে কক্ উঠে গেল সেই দরজার সামনে দিয়ে।

পায়ের শব্দ ওপরে মিলিয়ে যেতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল রাসকোল্‌নিকভ।

সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায়। সেখান থেকে বাড়ির বাইরে।

কেউ ওকে দেখতে পেল না।

.

পাঁচ

রাসকোল্‌নিকভ অনেকক্ষণ অবসন্ন শরীরটাকে যেন টেনে হিঁচড়ে নিয়ে পাগলের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছিল। দরদর করে ঘেমেছে আর টলেছে। রাস্তার লোক ভেবেছে নেশাখোর যাচ্ছে।

অবশেষে ফিরল বাড়িতে। ফটক পেরিয়ে পা দিল সিঁড়িতে। কিছুটা উঠেই খেয়াল হল কুড়োলের কথা।

ওটা তো ফেরৎ দিতে হবে দারোয়ানের ঘরে! কিন্তু দিতে গেলেই একরাশ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। জবাব দেবার মত মন এখন নেই। কি বলতে কি বলে ফেলবে। শেষে ধরা পড়ে যাবে।

নিজের ঘরে নিয়ে যাবে নাকি? সেখানেও যদি কেউ দেখে এবং জিজ্ঞেস করে? কি জবাব দেবে?

তার চাইতে… নেমে এসে সটান দারোয়ানের ঘরের সামনেই গেল রাসকোল্‌নিকভ। কেউ নেই ঘরে। বেঞ্চির তলায় কুড়োল রেখেই বেরিয়ে এল সে। ভাগ্য ভাল। কেউ নেই আশেপাশে। কেউ তাকে দেখেনি।

সিঁড়ি বেয়ে ওঠবার সময়েও কারো সঙ্গে দেখা হয়নি। দেখা হলে অবশ্যই চমকে উঠত তার চেহারা দেখে।

ঘরে ঢুকেই টুপি, কোট, প্যান্ট, বুট পরেই সে আছড়ে পড়ল বিছানায়– তারপর আর কিছু মনে নেই।

ঘুম? না, না। ঘুমের চাইতেও বড় জিনিস–বিস্মৃতি। ও যেন ভুলে গেল সবকিছুই–এমন কি নিজের নামটাও।

এইভাবেই ঘোরের মধ্যে কাটল সারাটা সময়। মাঝে মাঝে চেতনা ফিরে আসছে–আবার আচ্ছন্নের মত নেতিয়ে পড়ছে।

রাত যখন প্রায় দুটো, রাস্তায় নেশাখোরদের চেঁচামেচিতে ঘোর কাটল আর একবার।

তড়াক করে উঠে বসল বিছানায়–কী সর্বনাশ! অনেক রাত হল যে!

আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল সবকিছু!

কাঁপছে রাসকোল্‌নিকভ…ঠক্‌ঠক্ করে কাঁপছে…শীতের জন্যে, নাকি জ্বর এল? পাগল হয়ে যাচ্ছে না তো?

দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি লাগছে–এত কাঁপুনি! তা সত্ত্বেও ঘরের বাইরে গেল।

কান খাড়া করে শুনল কেউ কোথাও জেগে আছে কিনা।

সারা বাড়ি ঘুমোচ্ছে। নিস্তব্ধ চারদিক।

ঘরে ফিরে এসে বিড়বিড় করতে থাকে আপন মনে–আশ্চর্য! টুপিটা পর্যন্ত না খুলে ঘুমিয়ে পড়লাম! টুপি তো গড়াচ্ছে মেঝেতে। যে দেখবে, সে-ই বলবে, নিশ্চয় নেশা করেছি–

এই পর্যন্ত বকেই ছিটকে গেল জানলার সামনে। যথেষ্ট আলো আসছে জানলা দিয়ে। চোখ বড় বড় করে দেখতে লাগল নিজের জামাকাপড়…রক্তের দাগ নেই তো? দেখেছে মাত্র একবার…হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে।

খুলে ফেলল সমস্ত জামাকাপড়…তন্নতন্ন করে দেখল কোথাও এক ফোঁটাও রক্ত আছে কিনা…দেখল নিজের সারা গা!

কোথাও কিছু নেই। শুধু-শুধু ভয় পাচ্ছে। তবে হ্যাঁ, কালোমত কটা ফোঁটা দেখা যাচ্ছে বটে শতন্নি প্যান্টের পায়ের কাছে।

রক্ত! রক্তের ফোঁটা! শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে।

শিউরে উঠে রাসকোল্‌নিকভ। তক্ষুণি ছুরি দিয়ে ক্যাচ ক্যাচ করে কেটে ফেলে সেই জায়গার কাপড়।

ব্যস! এবার নিশ্চিন্ত। আর ঠিক তক্ষুণি মনে পড়ে যায় টাকার থলির কথাটা–আর সিন্দুকের গয়নাগুলো?

বুড়ির গলা থেকে থলি আর সিন্দুক থেকে গয়না নিয়ে ঠেসেটুসে রেখেছিল কোট আর প্যান্টের পকেটে। রক্তমাখা হাতে। হাতের রক্ত ধুয়েছে–ওগুলোয় তো রক্ত লেগে রয়েছে।

এতক্ষণ মনেও পড়েনি। পাগল হয়ে গেল কি রাসকোল্‌নিকভ! রক্তমাখা জিনিসগুলো পকেটে নিয়ে ঘুরেছে। তাই নিয়ে অঘোরে ঘুমিয়েও ছিল এতক্ষণ!

কী সর্বনাশ! কী সর্বনাশ! পাগলের মতই পকেট হাতড়াতে লাগলো রাস কোনিকভ।

এই তো! পকেটেই রয়েছে লুটের জিনিস! সেই সঙ্গে রয়েছে রক্তমাখা রুমালটাও।

ঈশ্বর বাঁচিয়েছেন। ঠিক সময়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছেন। মাথাটাও ঠিকঠাক কাজ করছে। অর্থাৎ, ঈশ্বর তার সহায়, তাই ধরা পড়েনি নিশ্চয় পড়বেও না। মাথাটাও খারাপ হয়নি; তাই এত চুলচেরা ভাবতে পারছে।

কোথায় লুকোনো যায় জিনিসগুলো? এই তো পুঁচকে ঘর। বাক্স আলমারি কিছু নেই।

এদিক-ওদিক চাইতেই চোখে পড়ল দেয়ালের গায়ে ছেঁড়া হলুদ কাগজগুলো দিকে। ছিঁড়ে গিয়ে ঝুলছে। নিচে নিশ্চয় গর্ত আছে? ইঁদুরের গর্ত। ঘরে ইঁদুর আছে অনেক।

লাফ দিয়ে গিয়ে কাগজের তলায় হাত গলিয়ে গর্ত খুঁজতে থাকে রাসকোল্‌নিকভ। পেয়েও যায় মনের মত একটা ফোকর। ওপরে ঝুলছে ঘেঁড়া কাগজ। বাইরে থেকে দেখা যায় না গর্তের মুখ।

তাড়াতাড়ি টাকার থলি আর গয়নাগুলো ঢুকিয়ে রাখে সেই গর্তের মধ্যে। সরে এসে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখতে থাকে নিজের কীর্তি!

চমৎকার! নিজেই নিজের বুদ্ধির তারিফ করে রাসকোল্‌নিকভ। আর অমনি একটা কাঁটা খচখচ করে ওঠে মনের মধ্যে।

টাকার থলিতে কিন্তু রক্ত জবজব করছিল। সেই রক্ত নিশ্চয় প্যান্টের পকেটেও লেগে রয়েছে–এতক্ষণ দেখাই হয়নি!

ধড়ফড় করে প্যান্টের পকেট বাইরে টেনে নিয়ে দেখে ও। সত্যিই দাগ রয়েছে! রক্ত! রক্ত!

দেখে কি খুশিই না হয় রাসকোল্‌নিকভ! মগজ বটে তার! কী বুদ্ধি! খুন করেছে সবার চোখের আড়ালে–পালিয়েও এসেছে সবার চোখে ধুলো দিয়ে।

এখন কি সুন্দরভাবে একটার পর একটা প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করে যাচ্ছে!

অসাধারণ মানুষ সে! নইলে এত ঠাণ্ডা মাথায় এত বড় কাজ কি করতে পারত।

খুশি খুশি মনে ছুরি দিয়ে কচকচ করে কেটে ফেলল প্যান্টের পকেট। রক্তমাখা কাপড়টা এখুনি ফেলে আসতে হবে বাইরে। ঘরে রাখা বিপজ্জনক।

এখনও ভোরের আলো ওঠেনি। এই বেলা বেরিয়ে পড়া যাক।

উঠতে গিয়েও ওঠা হল না। রক্তমাখা প্যান্টের পকেটটা কারারগ্রেসের ঠাণ্ডা উনুনের মধ্যে রেখে ঢাকনা চাপা দিল। তারপর বিছানায় মাথা রেখে একটু গড়িয়ে নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল তক্ষুণি।

ঘুম! ঘুম! ঘুম! বেহুশ ঘুম!

ধড়মড় করে উঠে বসল দশটায় দরজার ওপর দুমদাম ধাক্কা শুনে। ব্যাপার কী? পুলিশ এসে গেল নাকি?

আসুক! এর আগে ও যেচে নিজেকে ধরিয়ে দিতে গেছিল–এবারও না হয় দেবে। এত উকণ্ঠা আর সয় না!

বিছানায় বসেই হাত বাড়িয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দিল রাসকোল্‌নিকভ।

হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল প্রথমে ন্যাসটাসিয়া–পেছনেই দারোয়ান!

রক্ত পানি হয়ে যায় রাসকোল্‌নিকভের!

দারোয়ান তার ঘরে কেন? কখনও তো আসে না! তবে কি কুড়োল নেওয়ার ব্যাপারটা জেনে ফেলেছে?

দারোয়ান চেয়ে আছে তার দিকে–মুখ গম্ভীর।

চেঁচাচ্ছে ন্যাসটাসিয়া–কী কাণ্ড! দরজায় তো কক্ষণো ছিটকিনি দাও না–আজ কেন দিলে? কি আছে তোমার ঘরে যে চুরি করতে চোর ঢুকবে?

ঘুমটা ভাঙালে কেন?

বেলা দশটা বাজল–-ঘুম ভাঙাব না? কদিন ধরেই দেখছি খালি ঘুমিয়েই যাচ্ছো! উঠে পড়ো–অফিসে যাও–চিঠি এসেছে।

অফিসে! চিঠি!

পুলিশ অফিস থেকে চিঠি এসেছে!

দারোয়ান মুখখানা গম্ভীর করে চেয়েই ছিল–গরিব ভাড়াটেদের দিকে সে এইভাবেই তাকায়।

রাসকোল্‌নিকভের কিন্তু মনে হচ্ছিল-কুড়োলের ব্যাপারটা জেনে ফেলেছে বলেই তাকিয়ে আছে অমনভাবে।

চিঠিখানা ছিল তারই হাতে। কটমট করে তাকিয়ে চিঠি দিয়ে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।

কাঁপা হাতে চিঠি খুলল রাসকোল্‌নিকভ।

পুলিশ তাকে থানায় যেতে বলেছে–আজকেই।

বিড়বিড় করে ওঠে রাসকোল্‌নিকভ–এ আবার কি ব্যাপার! থানায় যাব কেন?

ভাড়া দাওনি, ভুলে গেছো? ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে ন্যাসটাসিয়া–বাড়িওলি নালিশ তো কবেই!

ভাড়া দিইনি বলে কি আজকেই ডাকতে হবে?

চা খাবে?

চা! কিছু খেতে হবে ভাবতেই গা গুলিয়ে ওঠে রাসকোল্‌নিকভের–চোখের সামনে ভেসে ওঠে থইথই রক্ত।

ওর মুখের চেহারা দেখে এবার চমকে ওঠে ন্যাসটাসিয়া। ঝপ করে হাত দেয় কপালে।

চোখ কপালে তুলে বলে–জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে যে! থাকগে আজকে–যেতে হবে না থানায়।

না, না আজকেই যাব। যত দেরি করব, যন্ত্রণা ততই বাড়বে।

রেগে যায় ন্যাসটাসিয়া–তবে যাও! বলছিলাম তোমার ভালর জন্যেই। রেগেমেগে চলে যায় ন্যাসটাসিয়া।

চিঠিখানা আর একবার পড়ল রাসকোল্‌নিকভ। সাদামাটা চিঠি। এখুনি থানায় যেতে হবে–কেন, কি বৃত্তান্ত–সেসব কথা লেখা নেই।

ভাড়া বাকি ফেলেছে বলে ধমকাবে? বাড়িওলি নালিশ ঠুকেছে বলে ঠিক আজকেই চিঠিখানা এল?

নিশ্চয় নয়। কেন থানায় যেতে হবে তা জানে শুধু পুলিশ আর রাসকোল্‌নিকভ।

যাই হোক, আজই যাওয়া যাক। এই উৎকণ্ঠার অবসান ঘটুক।

রাতে জুতোমোজা খুলে রেখেছিল রাসকোল্‌নিকভ–দেখেছিল কোথাও রক্ত লেগে আছে কিনা। এখন সেই মোজা পরতে গিয়ে আবার আঁতকে উঠল ভীষণভাবে।

রক্ত লেগে রয়েছে মোজায়! অথচ তন্নতন্ন করে দেখেছিল রাতে। তখন তো চোখে পড়েনি! ঠিক তেমনি, জামাকাপড়েও নিশ্চয় এখনও রক্ত লেগে আছে– রাতে চোখে পড়েনি…

ভাবতে ভাবতেই ফের জামাকাপড় খুলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রক্তের দাগ খুঁজতে লাগল রাসকোল্‌নিকভ।

নিশ্চিন্ত হলো অনেকক্ষণ পরে। নেই। আর কোথাও নেই রক্ত। শুধু ওই মোজায়। অন্য মোজাও তো নেই!

বাধ্য হয়ে ওই মোজাই পরতে হলো। পুলিশ তো জেনেশুনেই তাকে ডেকেছে–রক্তের দাগ দেখল তো বয়েই গেল!

মোজাটা পরে হাসি পায় রাসকোল্‌নিকভের। রক্তের দাগ তো ময়লা মোজায় চাপা পড়ে গেছে বললেই চলে! রক্ত বলে শুধু ও জানে, তাই ধরতে পারছে অন্যের কাছে ওটা ময়লা ছাড়া কিসস নয়!

বেরিয়ে পড়ল রাসকোল্‌নিকভ। ঘর খোলা রইল। ফায়ারপ্লেসের ঠাণ্ডা উনুনের মধ্যে রইল রক্তমাখা প্যান্টের পকেট। মেঝেতে প্যান্টের পা থেকে চেঁচে নেওয়া শুকনো রক্ত। দেওয়ালের কাগজের আড়ালে গর্তের মধ্যে গয়না আর রক্তমাখা টাকার থলে।

.

পুলিশ দপ্তর। মস্ত বাড়ি। সিঁড়িতে লোকজন উঠছে আর নামছে, বারান্দায় ভিড় করে রয়েছে। অফিসঘরগুলোতেও লোকে ভর্তি।

এককোণে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছে রাসকোল্‌নিকভ। পা কাঁপছে। জ্বরে মাথা ঘুরছে।

অফিসঘরে ঢুকবে? পেট থেকে যদি সব কথা বের করে নেয়।

মনে মনে ভাবছে–মাথার তো ঠিক নেই–কি বলতে কি বলে বসব!

শেষকালে মরিয়া হয়ে ঢুকে পড়ল ঘরে। কেরানীদের একজনকে দেখাল পুলিশের চিঠিটা। সে বললো উদাসীনভাবে ছাত্র নাকি?

জি হ্যাঁ। আগে তাই ছিলাম।

সবশেষের ঘরটা দেখিয়ে বললে কেরানী–বড় সাহেবের কাছে যান।

বড়সাহেবের ঘরে আরও ভিড়। তিনি চিঠিখানা দেখেই বললেন–একটু বসুন।

বলেই, বকর বকর করতে লাগলেন সামনের ভদ্রমহিলার সঙ্গে।

বসেই রইল রাসকোল্‌নিকভ। একটু একটু করে সহজ হয়ে এল। মনে মনে বললো–যা ভেবেছিলাম, দেখছি তা নয়। সাবধানে কথা বলতে হবে–বেফাঁস বললেই মরব। ইস্! এত হাওয়া কম এখানে! মাথা ঘুরছে!

আচমকা সত্যিই মাথার মধ্যে যেন কিরকম দাপাদাপি আরম্ভ হয়ে গেল। প্রচণ্ড ইচ্ছে হল তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদেকেটে একাকার করে এখুনি–খুনী! খুনী! আমি খুনী! নিজেই গলাবাজি করে কথাটা জানাবে এইখানেই!

অতি কষ্টে নিজেকে সামলে রাখলো রাসকোল্‌নিকভ।

জোর করে অন্যমনস্ক হতে চাইল। চোখ পাকিয়ে চেয়ে রইল বড় সাহেবের দিকে। নেহাৎই ছেলেমানুষ! খুব জোর বাইশ বছর বয়স। কিন্তু মুখখানাকে এমন গম্ভীর করে রেখেছে যে দেখে মনে হচ্ছে না জানি কি কত বয়স! তার ওপর সাজের বাহারও আছে। টেরি কেটেছে কত কায়দা করে। আঙুলে আঙুলে আংটি ঝলমল করছে। ওয়েস্টকোটে সোনার চেন ঝিকমিক করছে। মুখে ফরাসী বুকনি ফুরফুর করে বেরিয়ে আসছে।

সেজেগুজে যে মেয়েটি সামনেই দাঁড়িয়েছিল, পাশের খালি চেয়ারে সে বসতে সাহস পাচ্ছিল না।

বড়সাহেব বললেন–বসতে পারো, লুইজি আইভানোনা।

মেয়েটি বসল। আর ঠিক তক্ষুণি ভীষণ চেঁচামেচি করতে করতে ওপরওলা এসে ধাই করে মাথার টুপিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো টেবিলে–ধপ্ করে বসে পড়ল আরামকেদারায়।

তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়লো মেয়েটি। তার আর বসা হল না।

রাসকোল্‌নিকভ চোখের পাতা না ফেলে চেয়ে রইল ওপরওলার দিকে। সহকারী সুপারিটেনডেন্ট বলেই মনে হচ্ছে। লালচে গোঁফ খাড়া হয়ে হরিণের শিং-এর মত উঠে রয়েছে মুখের দু-পাশে। নাক ছোট, মুখ ছোট, চোখ ছোট। ভীষণ দাম্ভিক।

রাসকোল্‌নিকভ যে একদৃষ্টে তাকে দেখছে, তিনিও সেটা দেখেছেন। রাসকোল্‌নিকভের নোংরা জামাকাপড় দেখেও তাকে তাচ্ছিল্য করতে পারেননি, কারণ তার চোখ-মুখ চালচলনের মধ্যে রয়েছে শিক্ষাদীক্ষার ছাপ।

কিন্তু সে যেই হোক, থানায় বসে থানায় ওপরওলার দিকে এইভাবে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে এমন আস্পর্ধা খুব কম লোকেরই আছে।

তিনি তাই ধমকে উঠেছিলেন কড়া গলায়–কে তুমি? কি চাও?

থেমে থেমে জবাব দিল রাসকোল্‌নিকভ–থানার চিঠি পেয়ে এসেছি।

তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন বড়সাহেব–টাকা আদায়ের জন্যে ডেকে পাঠানো হয়েছে। এই যে– বলতে বলতে টেবিল থেকে একটা দলিল তুলে নিয়ে রাসকোল্‌লিকডের সামনে ফেলে দিয়ে বললেন–পড়ুন।

মনটা নিমেষে হাল্কা হয়ে গেল রাসকোল্‌নিকভের। খুনী হিসেবে তাহলে তাকে ডাকা হয়নি! নাকি মিথ্যে বলছেন বড়সাহেব?

ওপরওলার মেজাজ কিন্তু সপ্তমে চড়ে রয়েছে। আরও কড়া ধমকের সুরে বলে উঠলেন–নটায় আসতে বলা হয়েছে–এসেছেন বারোটায়।

মাথায় রক্ত চড়ে গেল রাসকোল্‌নিকভের। পাল্লা দিয়ে চেঁচিয়ে জবাব দিল বেশ কড়া গলাতেই–নোটিশ পেয়েছি মাত্র পনেরো মিনিট আগে। এসেছি এই যথেষ্ট জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে আমার।

চেঁচাবেন না।

আপনি আগে চেঁচিয়েছেন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। চেঁচিয়ে কথা বললে সইতে পারি না।

মুখ লাল হয়ে গেল সহকারি সুপারিনটেনডেন্টের। চেয়ার থেকে ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন তারস্বরে–এটা সরকারি অফিস। বেয়াদবি করবেন না।

সমানে চেঁচিয়ে বলতে লাগল রাসকোল্‌নিকভ সরকারি অফিসে রয়েছেন আপনিও। চেঁচাচ্ছেন, আবার সিগারেটও খাচ্ছেন।

ফিক করে হেসে ফেললেন বড় সাহেব। ওপরওলার এই অপমান তার ভালই লেগেছে।

ঝেড়ে গলাবাজি করে রাসকোল্‌নিকভও বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করছে। কিন্তু তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন সহকারি সুপারিনটেনডেন্ট–তাতে আপনার কী? মুচলেকা দিতে এসেছেন–দিয়ে চলে যান। ভাড়ার টাকা বাকি পড়ে কেন?

কথা কানে তুলল না রাসকোল্‌নিকভ। বড়সাহেবের দেওয়া দলিলটা তখন সে পড়ছে। অনেকদিন আগে ঘরভাড়া আর খাওয়ার টাকা শোধ করতে পারেনি বলে বাড়িওলিকে সে লিখে জানিয়েছিল। এটা সেই কাগজ। বাড়িওলি পুলিশকে জানিয়েছে–রাসকোল্‌নিকভ বোধহয় এই টাকা না দিয়েই শহর ছেড়ে চম্পট দেওয়ার ফিকিরে আছে। পুলিশ যেন টাকাটা আদায় করে দেয়।

কাগজটা পড়ে বিরক্তি ঝড়ে রাসকোল্‌নিকভের। এই ব্যাপার!

খুশি মনে মুচলেকা লিখে দিল তক্ষুণি। টাকা না দিয়ে শহর ছেড়ে যাবে না– শুধু এই প্রতিশ্রুতি।

সহকারি সুপারিনটেনডেন্টের তর্জন গর্জন তখনও সমানে চলছে। এবারে তার চোখে পড়লো পরিপাটি মেয়েটির ওপর–লুইজি, আবার তোমার বাড়িতে চেঁচামেচি হয়েছে। এর আগে দশবার হয়েছে–বারণ করা সত্ত্বেও আবার?

আমি কি করব? নামকরা সেই লেখক আমারই টাকায় পেট পুরে খেয়ে আবার আমার কাছ থেকেই পাঁচ রুব্‌ল ধার করে নিয়ে গেলেন। তারপরও সেকী হষি তম্বি না দিলে নাকি কাগজে কাগজে আমার কুৎসা রটাবেন!

এত সাফাই শোনবার সময় কোথায় সহকারি সুপারিনটেনডেন্টের। তেড়েমেড়ে লুইজি মেয়েটাকে বেশ কিছু বকাঝকা করে বিদেয় করলেন।

তারপর ঝাল ঝাড়তে লাগলেন রাসকোল্‌নিকভের ওপর–লেখক! জাতটাই আলাদা! সেদিন এক লেখক হোটেলে খেয়ে পয়সা না দিয়ে ধমকেছে–দাম চাইলেই প্যারডি গান লিখব তোমার নামে! আর একজন লেখক সেদিন স্টিমারে চেপে যাচ্ছেতাই ঝগড়া করেছে একজন খানদানী ভদ্রলোকের সঙ্গে। লেখক, ছাত্র–সব একই দলের!

বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন সহকারি সুপারিনটেনডেন্ট। সারা ঘর গমগম করছে তার লেকচারে। ঘরসুদ্ধ লোক হাঁ করে শুনছে তার বক্তৃতা।

এমন সময়ে ঘরে ঢুকলেন জমকালো চেহারার এক পুরুষ। দেখতে সুন্দর। মুখে হাসি। নাকের নিচে মোটা গোটা ভারি চমৎকার।

ইনি পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট–নিকোডিম ফোমিচ।

ঘুরে ঢুকেই ঠাট্টার সুরে বললেন সহকারি সুপারিনটেনডেন্টকে-ইলিয়া পেত্রোভিচ-তোমার হাঁকডাক তো সিঁড়ি থেকে শোনা যাচ্ছে!

তা তো যাবেই। বলেই আরামকেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ইলিয়া পেত্রোভিচ। গিয়ে বসলেন দূরের ছোট্ট একটা টেবিলে।

আরামকেদারায় বসলেন নিকোডিম ফেমিচ।

হোট টেবিলে বসেও কথার ফুলঝুরি চালিয়ে গেলেন ইলিয়া পেত্রোতি–বলছিলাম লেখক আর ছাত্রদের কীর্তিকলাপের কথা। এই যে এই ভদ্রলোক– ছাত্র–অথচ ঘরভাড়ার টাকা দেননি। দেবার ইচ্ছেও নেই। নালিশ আসছে আমাদের কাছে। আবার থানায় বসে ধমক দিনে আমাকেই-সিগারেট খালি কেন? জামাকাপড়ের ছিরি তো দেখছেন–

শান্ত গলায় বললেন নিকোডিম ফোমিচ–শুধু-শুধু রেগে যাচ্ছ, ইলিয়া। গরিব হওয়া কি অপরাধ? আপনার কি ব্যাপার বলুন তো?

প্রশ্নটা করলেন রাসকোল্‌নিকভকে।

বুঝিয়ে বলল রাসকোল্‌নিকভ। পকেট খালি তো টাকা দেবে কোত্থেকে। মা টাকা পাঠাচ্ছেন–এলেই কড়ায় গন্ডায় পাওনা মিটিয়ে দেবো।

বেশ তো, বললেন নিকোডিম–মুচলেকা লিখে দিয়ে যান ঠিক সেইভাবে।

লেখা তো শুরুই করেছিল রাসকোল্‌নিকভ। তাড়াতাড়ি লিখতে পারছে না–এত হাত কাঁপছে!

বড় সাহেবও তা লক্ষ্য করেছেন।

বললেন–শরীর খারাপ নাকি?

মাথা ঘুরছে। আর কিছু লিখতে হবে।

না। সই করে দিন। সই করে কাগজ কলম বড়সাহেবের হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার দু-হাতে রগ চেপে ধরে টেবিলে দু-কনুই রেখে ঝুঁকে পড়ল রাসকোল্‌নিকভ।

মাথার ভীতরটা মনে হচ্ছে চৌচির হয়ে ফেটে যাবে।

আচমকা একটা চিন্তা মাথাচাড়া দিচ্ছে–এখুনি গিয়ে সব বলতে হবে নিকোডিমকে। ওঁকে ডেকে নিয়ে যাবে নিজের ঘরে–দেওয়ালের গর্ত থেকে বের করে দেবে গয়না আর টাকা।

ভয়ঙ্কর চিন্তাটা ওকে ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ঝোঁকের মাথায় পা পর্যন্ত বাড়িয়েছে নিকোডিমের দিকে….

সঙ্গে সঙ্গে আর একটা চিন্তা লাফঝাষ শুরু করে দিলো মাথার মধ্যে–এত তাড়াহুড়ো কেন? আর একটু ভাবতে ক্ষতি কী?

ঝোঁকটা তেড়ে উঠল তক্ষুণি–আবার চিন্তা কী? খুলে বলে হাল্কা হয়ে যাও এখুনি।

নিকোডিমের দিকে দু-পা এগিয়ে গেল রাসকোল্‌নিকভ। থমকে গেল নিকোডিমের কথাটা শুনে! এ কী বলছেন উনি ইলিয়াকে। বলছেন–খুন করে কেউ দারোয়ান ডাকতে যায়। দুজনেই বেকসুর খালাস পাবে।

ওটাই তো ওদের ধড়িবাজি–বললো ইলিয়া।

অতটা ধূর্ত ওরা নয়। তাছাড়া, বাড়িতে ঢোকার আগে কক নিচের তলায় এক স্যাকরার দোকানে ছিল আধঘন্টার মত। ওর বন্ধু পেচায়াকভ যখন এল, তখন তার সঙ্গে ছিল তিনজন বন্ধু। এত লোকজন নিয়ে কেউ খুন করতে আসে।

কিন্তু ওদের কথার মধ্যেই তো গোজামিল থেকে যাচ্ছে। দারোয়ানকে বলেছিল, বুড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দারোয়ান গিয়ে দেখল, দরজা হাঁ করে খোলা।

কি মুশকিল! খুনীই তো দরজা বন্ধ করে রেখেছিল। ক আর পেচলিয়াকত দারোয়ানকে ডাকতে নেমে যেতেই খুনী দরজা খুলে নেমে গেছে। কক তো বলছেই-খুব জোর বেঁচে গেছে। না নেমে গেলে কুড়োলের কোপ ওর মাথাতেও পড়তো।…

ইলিয়া বললেন–অথচ কেউ দেখতে পেল না খুনী কে?

এই সময়ে বলে উঠলেন বড় সাহেব–বাড়িটা যে সেকেলে। অলিগলি অনেক–

নিকোডিম বললেন–তাহলে দ্যাখো-ধুনী ওরা নয়। দুজনেই নির্দোষ।

টেবিল থেকে টুপিটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল রাসকোল্‌নিকভ।

জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল দরজা পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই।

.

জ্ঞান ফিরে এল রাসকোল্‌নিকভের। আধশোয়া অবস্থায় রয়েছে একটা চেয়ারে। বাঁ দিকে একটা লোক ধরে রয়েছে ওকে। ডান দিকে আর একজন। হাতে এক গেলাস হলদে তরল পদার্থ।

সামনেই দাঁড়িয়ে নিকোডিস ফোমিচ। ধারালো চাহনি দিয়ে দেখছেন ওকে। দাঁড়িয়েছিলেন ইলিয়াও। এইমাত্র সরে গেলেন।

রাসকোল্‌নিকভ ধড়মড় করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই তীক্ষ্ণ গলায় শুধোলেন নিকোডিম–আপনার কি শরীর খারাপ?

বড় সাহেব বলে উঠলেন–মুচলেকা লেখবার সময়ে হাত কাঁপছিল। সই করেছেন অনেক কষ্টে।

টেবিল থেকে হেঁকে জিজ্ঞেস করলেন ইলিয়া-অসুখ কদ্দিনের?

কাল থেকে, আস্তে করে বললে রাসকোল্‌নিকভ।

বেরিয়েছিলেন কালকে?

হ্যাঁ।

জ্বর সত্ত্বেও?

হ্যাঁ।

কটার সময়ে?

সাতটা নাগাদ।

কোথায় গেছিলেন?

রাস্তায়।

ব্যস?

রাসকোল্‌নিকভের চোখে চোখে চেয়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছেন ইলিয়া। চোখ না নামিয়ে একইভাবে জবাব দিয়ে যাচ্ছে রাসকোল্‌নিকভ।

নিকোডিম বলে উঠলেন–ভদ্রলোক খাড়া থাকতে পারছেন না–এখন কি জেরা করার সময়?

অদ্ভুত গলায় বললেন ইলিয়া–এটাই তো সময়।

কি বলতে গিয়েও থেমে গেলেন নিকোডিম। হঠাৎ চোখোচোখি হয়েছে বড় সাহেবের সঙ্গে। ভদ্রলোক শক্ত চোখে চেয়ে আছেন নিকোডিমের দিকে।

হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেল গোটা ঘরটা বড় অস্বভাবিক নিস্তব্ধতা।

বলে উঠলেন ইলিয়া–আসতে পারেন এখন।

বেরিয়ে গেল রাসকোল্‌নিকোভ। যেতে যেতে শুনল, ঘর আবার মুখর হয়ে উঠেছে তিনজনের কথায়। সবার ওপরে শোনা যাচ্ছে নিকোডিমের প্রতিবাদের গলা।

রাস্তায় নেমেই দ্রুত বাড়ির দিকে পা চালায় রাসকোল্‌নিকভ। মাথা এখন পরিষ্কার। কিন্তু মনে আতঙ্ক চেপে বসেছে আগের মতই।

সন্দেহ করেছে পুলিশ। এবার হবে খানাতল্লাশী!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *