দারোগা, ভূত ও চোর

দারোগা, ভূত ও চোর

কৈলাসপুর থানার দারোগাবাবু ভূতনাথ পাত্রের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল নেহাত দৈবদুর্বিপাকে। পাড়াগাঁয়ের এক রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে গিয়েছিলুম। সবে উদ্বোধন সঙ্গীত শেষ হয়েছে, হইহই-রইরই করে তেড়ে এসে গেল কালবৈশাখি। যেমন ঝড়, তেমনি বৃষ্টি। সে এক ধুন্ধুমার অবস্থা। মঞ্চের তেরপল উড়ে গিয়ে কোন তেপান্তরের মাঠে পড়ল কে জানে! গাঁয়ের লোকজন আর কাচ্চাবাচ্চা যে যার বাড়ি গিয়ে ঢুকল। উদ্যোক্তাদের আর খুঁজে পেলুম না। একে তো ভর সন্ধেয় অনুষ্ঠান শুরু। তার ওপর ঝড়বৃষ্টির কালো রং সন্ধ্যাটাকে বেজায় আলকাতরা করে ফেলল। ভাগ্যিস বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। মাথা বাঁচাতে দৌডুচ্ছিলুম দিশেহারা হয়ে। বিদ্যুতের ঝলকানিতে ঘন গাছপালার ভেতর একটা বাড়ি দেখে তার বারান্দায় উঠলুম। কিন্তু বারান্দায় টেকা দায়। দরজায় ধাক্কা দিতে গিয়ে দেখি, দরজা ভাঙা। ভেতরে ঢুকে পড়লুম।

পকেটে দেশলাই ছিল। ভিজে গেছে ততক্ষণে। কোনওরকমে একটা কাঠি জ্বালিয়ে যা দেখলুম, তাতে স্বস্তি পেলুম না। মেঝেয় আবর্জনার ভঁই, ইঁদুরের গর্ত, চামচিকের নাদি–একটা সাপের খোলস পর্যন্ত।

সর্বনাশ! বাড়িটা যে দেখছি পোড়োবাড়ি। ভূতকে যদি বা মন্তরতম্ভর আওড়ে জব্দ করতে পারি, সাপকে মন্তরতন্তরে বশ করব এমন ওঝা তো আমি নই। কারণ শুনেছি সাপ কানে শোনে না। ভূত কিন্তু দিব্যি শুনতে পায়। কারণ তার আমাদের মতোই একজোড়া কান আছে–সে কান যত বিদঘুঁটে গড়নেরই হোক না কেন? সাপের যে কানই নেই।

মরিয়া হয়ে ওপাশের আরেকটা ভাঙা দরজা পেরিয়ে আরেকটা ঘরে ঢুকলুম। ফের দেশলাই জ্বেলেই দেখি একটা সাইকেল চকচক করছে। তাহলে মানুষ আছে।

কিন্তু যেই সাইকেলের মালিককে ডাকতে গেছি, দেশলাই কাঠিটাও নিভেছে হঠাৎ কেউ শক্ত হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে গর্জে বলে উঠল,–তবে রে ব্যাটা চোর!

আর্তনাদ করে উঠলুম, আঃ! লাগছে, লাগছে! ছাড়ুনআমি চোর নই। আমি প্রধান অতিথি।

মুখের ওপর অনেকটা উঁচু থেকে আওয়াজ এল,–কী বললে?

প্রধান অতিথি।–হাঁফাতে-হাঁফাতে বললুম। আমি এখানে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলুম।

লোকটা আমাকে ছেড়ে দিল। তারপর টর্চ জ্বেলে ভাল করে আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বলল,–হুম। সেইরকমই মনে হয় বটে। মশায়ের নাম?

নাম বললে তাগড়াই উঁচু লোকটা নমস্কার করে বলল, যা গে। আলাপ করে বেজায় আনন্দ হল। আপনার এক গুণমুগ্ধ পাঠক আমি।

জিগ্যেস করলুম,–আপনার নামটা জানতে পারলে আনন্দ হত।

আমি ভূতনাথ পাত্র। কৈলাসপুর থানার চার্জে আছি।ভূতনাথ দারোগা প্রাণখোলা হেসে বললেন। আর বলবেন না মশাই। এ গাঁয়ে এসেছিলুম একটা দাগী আসামি ধরতে। ঝড়-বৃষ্টির চোটে সে ব্যাটাকে কায়দা করতে পারলুম না। সেপাইরাও মাথা বাঁচাতে কে কোথায় কেটে পড়ল। আমিও বেগতিক দেখে এই পোড়াবাড়িতে আশ্রয় নিলুম।

ভূতনাথকে খুব অমায়িক লোক মনে হচ্ছিল। একথা-সেকথার পর জিগ্যেস করলুম,–এই পোড়োবাড়িটা কার জানেন দারোগাবাবু?

ভূতনাথ বললেন,–শুনেছি এ বাড়িটার মালিক ছিলেন কোন এক হারাধনবাবু। একা থাকতেন। তাঁকে এক রাত্তিরে ডাকাত এসে খুন করেছিল।

চমকে উঠে বললুম, সর্বনাশ! তারপর?

ভূতনাথ বললেন, তারপর আর কী? হারাধনবাবুর মৃত্যুর পর বাড়ির মালিকানা নিয়ে ওঁর আত্মীয়দের মধ্যে মামলা বাধে। সেই মামলা এখনও চলছে। এদিকে বাড়ির অবস্থা তো দেখছেন। শ্যালকুকুর, প্যাচা-ছুঁচো-চামচিকের আখড়া হয়ে উঠেছে। ভূত থাকাও আশ্চর্য নয়। ওই যে আপনি ভূতের কেত্তনে লিখেছেন, বাড়ি খালি পড়ে থাকলেই ভূতেরা এসে জোটে এবং রাত-বিরেতে কেত্তন গায়।

ভূতনাথ দারোগা হা-হা, খ্যাক খ্যাক করে প্রচণ্ড হাসতে থাকলেন। ওদিকে বাইরে তুলকালাম ঝড়, বৃষ্টি, বাজের ডাকে–সে এক প্রলয়কাণ্ড চলছে।

হাসি থামিয়ে ভূতনাথ বললেন,–এই পোড়োবাড়িতে ভূত থাকলে সত্যি বড় মজা হত। বুঝলেন? ভূতের সঙ্গে জমিয়ে এখন আড্ডা দেওয়া যেত। কেত্তন শুনতেও আপত্তি ছিল না–যদিও কেত্তন জিনিসটা আমার ধাতে সয় না। কারণ ওতে গানের চাইতে খোল কলের আওয়াজ বড্ড বেশি। আপনার কী মত?

বললুম,–ঠিকই বলেছেন। তবে কী জানেন? ভূত নিয়ে বই লিখি-টিখি বটে, কিন্তু চর্মচক্ষে ভূত দেখতে আমার আপত্তি আছে।

কেন, কেন?–ভূতনাথ খুব আগ্রহের সঙ্গে জিগ্যেস করলেন।

বইয়ের ভূতেরা মারাত্মক হয় না। সত্যিকার ভূত খুব সাংঘাতিক বলেই আমার ধারণা। তারা নাকি ঘাড় মটকে মানুষকে মেরে ফেলে। ভয়ে-ভয়ে কথাটা বলে এদিক ওদিক তাকালাম। জানালাও ভাঙা। বিদ্যুতের ঝিলিকে বাইরে উঠোন দেখা যাচ্ছে। ঘরে দারুণ অন্ধকার। ভূতনাথ টর্চ নিভিয়ে ফেলেছেন কখন।

দারোগাবাবু খিকখিক করে হেসে বললেন, ধুর মশাই। ভূতের আবার সত্যি মিথ্যে আছে নাকি? ভূত ইজ ভূত। ভূতকে ভয় পেতে নেই। তাছাড়া আমি পুলিশের দারোগা। আমায় দেখলেই ভূতের হৃৎকম্প হয়।

এইসময় খ্যানখেনে গলায় ভেতরের দরজার কাছে কে বলে উঠল,–কে বাপু তোমরা খালি ভূত-ভূত করছ তখন থেকে?

ভূতনাথ টর্চের বোতাম টিপলেন হয়তো, পুট-পুট আওয়াজ শুনলুম। কিন্তু আলো জুলল না। ভূতনাথ রেগেমেগে বললেন, ধ্যাত্তেরি!

আমি আরেকজন মানুষের সাড়া পেয়ে প্রথম চমকালেও পরে সাহসী হয়েছি। বললুম, তুমি কে হে? সাড়া না দিয়ে ঘরে ঢোকাটা ঠিক হয়নি কিন্তু।

বিদ্যুতের আলোর ঝিলিকে রোগা একটা লোককে দেখতে পেলুম। খালি গা। ভিজেছে বলেই মনে হচ্ছিল। সে বলল, তখন থেকে ভেতরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি আর তোমাদের কেত্তন শুনছি। আমায় ভয় পাওনা বুঝি?

ভূতনাথ খাপ্পা হয়ে বললেন, তুমিই আস্ত ভূত। সাড়া না দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়েছিলে কোন মতলবে? কে তুমি? বাড়ি কোথায়?

লোকটাও চটেমটে বলে উঠল, দারোগাই হও আর যেই হও বাপু, ভদ্রতা করে কথা বলবে। ইস! বলে–কে তুমি, বাড়ি কোথায়! আমার বাড়িতে আমারই শোওয়ার ঘরে ঢুকে আমাকে ধমক দেওয়া হচ্ছে! কী স্পর্ধা।

আমার একটু সন্দেহ জাগল। বললুম,–মশায়ের নাম কি হারাধনবাবু?

–আবার কী? আমি সেই হারাধন জোয়ারদার।

আমার বুকে হাতুড়ির শব্দ হতে থাকল। দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালাম। কিন্তু ভূতনাথ দারোগা হা হা করে হেসে উঠলেন। বললেন,–এ ব্যাটা নির্ঘাৎ উন্মাদ। বদ্ধ পাগল। হারাধনবাবু শুনেছি মান্ধাতার আমলে ডাকাতের হাতে খুন হয়ে মারা পড়েছেন!

চোপরাও। –লোকটা গর্জে উঠল। কাসর-ঘণ্টার আওয়াজ যেন। তারপর ভেংচি কেটে বলল, ডাকাতের হাতে খুন হয়ে মারা পড়েছে–তো কী হয়েছে?

দারোগাবাবু আমাকে লক্ষ করে বললেন,–শুনছেন? শুনছেন মশাই ব্যাটার কথা?

এই? ব্যাটাব্যাটা কোরও না বলে দিচ্ছি! মানহানির মামলা করব। লোকটা শাসাল। আমার মাসতুতো ভাইয়ের নাতির বন্ধু এম. এল. এ। আমার ভাগ্নের সম্বন্ধীর খুড়ো এম. পি.-র প্রাইভেট সেক্রেটারি। আমার মেজদার শ্বশুর বিলেতে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বাপের ক্লাসফেন্ড ছিলেন। সাবধান!

ভড়কে গিয়ে ভূতনাথ দারোগা বললেন, আহা! ব্যাটা কি আপনাকে বলছি, বলছি আপনার ব্যবহারকে। আগে সাড়া নেই শব্দ নেই, হঠাৎ অমন করে কথা বলতে শুরু করলেন। তার ওপর বলছেন এক সৃষ্টিছাড়া কথা। যে মানুষ ডাকাতের হাতে খুন হয়, সে বেঁচে থাকে কেমন করে? বলুন না–এটা কি কেউ মানবে?

প্রচণ্ড শব্দ করে কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়ল। বাড়িটা কেঁপে উঠল থরথর করে। ভয় হল, ছাদ ভেঙে পড়বে না তো?

লোকটা দারোগাবাবুর কথায় একটু শান্ত হয়ে বলল,-দেখ বাপু। সত্যি বলছি, আমি মরিনি। হা-আমার দেহটা পঞ্চভূতে বিলীন হয়েছে; কিন্তু আত্মা? আত্মার তো বিনাশ নেই।

ভূতনাথ দারোগা আরও ভড়কে গিয়ে বললেন,–আপনি যদি হারাধনবাবুর আত্মা তাহলে যে-দেহ ধরে এসেছেন এবং কথা বলছেন, সেই দেহটা কোথায় পেলেন?

–চুরি করেছি।

–চুরি! আপনি তাহলে চোর! দারোগাবাবু পা বাড়াচ্ছেন। টের পেলুম অন্ধকারে। জানেন? আপনাকে তাহলে আমি অ্যারেস্ট করতে পারি!

আবার ঝগড়া বাধবে দেখে বললুম,

–একটা কথা হারাধনবাবু। কার দেহ চুরি করেছেন? পাঁচু নামে একটা লোকের।

ভূতনাথ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন,–সেই দামি হারামজাদা পাঁচুর? কী কাণ্ড । আজ এক গাঁয়ে পাঁচুকেই তো পাকড়াও করতে এসেছিলুম!

আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললুম,–ও হারাধনবাবু! পাঁচুর দেহটা যে চুরি করলেন, পাঁচুর আত্মার কী হল? তাকে কীভাবে তাড়িয়ে তার দেহ চুরি করলেন?

লোকটা তেমনি খ্যানখ্যানে গলায় হেসে বলল, একটু আগে ব্যাটা পেঁচো পুকুরপাড়ে একটা গাছের তলায় বাজ পড়ে মারা গেছে। আমি ছিলাম সেই গাছের ডালে! যেই না কেঁচোর আত্মাটা দেহছাড়া হয়েছে, আমি সুড়ুৎ করে ওর দেহে ঢুকে পড়েছি। পেঁচোর আত্মা এখনও টের পায়নি অবিশ্যি। টের পেয়ে ঝগড়া করতে এলে না হয় ফেরত দেব। কী বলেন?

ভূতনাথ ততক্ষণে মনে মনে বুঝি আইনের প্যাঁচ কষছিলেন। এবার বললেন, দেখুন মশাই! ভেবে দেখলুম, আমরা যখন কোনও আসামি পাকড়াও করি, তখন তার দেহটাকেই পাকড়াও করি। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, দেহটা পাঁচুর। অতএব পাচুর দেহকে অ্যারেস্ট করলে আইনসম্মত কাজ হয়। কই, দেখি হাত দুটো! 

ভূতনাথের পকেটে নিশ্চয় হাতকড়া ছিল! অন্ধকারের মধ্যে মালুম হল, হাতকড়া নিয়ে এগোচ্ছেন। তারপর একটা ধস্তাধস্তির শব্দ শুনলুম! তারপর বিকট

চেঁচিয়ে উঠলেন ভূতনাথ,-পাকড়ো! পাকড়োয় আসামি ভাগ যাতা!

বাইরে বিদ্যুতের আলোয় দেখলুম, ভূতনাথ দারোগা উঠোনে ছুটোছুটি করছেন বৃষ্টির মধ্যে। লোকটাকে দেখতে পেলুম না। একটু পরে ভূতনাথেরও পাত্তা নেই। ওঁর সাইকেলটা পড়ে রইল ঘরে।

এবার আমার ভীষণ ভয় হতে লাগল। মরিয়া হয়ে পাশের ঘরে, তারপর সেই ভাঙা দরজা দিয়ে বাইরে গেলুম। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে টলতে টলতে কিছুটা এগিয়েছি, দেখি একদল লোক লণ্ঠন আর টর্চ নিয়ে আসছে।

আমাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন রবীন্দ্রজয়ন্তীর উদ্যোক্তারা।… বছরখানেক পরে মফস্বলে এক আত্মীয় বাড়ি গেছি। ফেরার সময় রেলস্টেশনে ভূতনাথ দারোগার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আরও প্রকাণ্ড হয়েছেন উনি। ঊড়ির বহরও বেড়েছে। একথা-সেকথার পর জিগ্যেস করলুম,–সেই পাঁচুর দেহটাকে শেষ পর্যন্ত পাকড়াও করতে পেরেছিলেন তো?

ভূতনাথ খ্যা খ্যা করে হেসে বললেন,-মনে আছে আপনার? মশাই, ব্যাটা আমার মতো ধুরন্ধর লোককেও কী রামঠকানো ঠকিয়েছিল ভাবা যায় না। বাজ পড়ে সত্যি-সত্যি পাঁচু-চোর মরেনি। কাজেই হারাধনবাবুর ভূতও তার দেহে ঢুকে ঝড় বৃষ্টির সময় নিজের পোড়োবাড়িতে হাজির হননি। আসলে সাক্ষাৎ পাঁচুই আমাকে গণ্ডগোলে ফেলেছিল। ব্যাটা অসম্ভব ধূর্ত মশাই! আমার সঙ্গে রসিকতা করতে এসেছিল। কী স্পর্ধা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *