১. ছোট্ট গ্রাম সুন্দরপুর

হীরামানিক জ্বলে – কিশোর উপন্যাস – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

ছোট্ট গ্রাম সুন্দরপুর।

একটি নদীও আছে গ্রামের উত্তর প্রান্তে। মহকুমা থেকে বারো-তেরো মাইল, রেলস্টেশন থেকেও সাত-আট মাইল।

গ্রামের মুস্তাফি বংশ এক সময়ে সমৃদ্ধিশালী জমিদার ছিলেন, এখন তাঁদের অবস্থা আগের মতো না থাকলেও আশপাশের অনেকগুলি গ্রামের মধ্যে তাঁরাই এখনও পর্যন্ত বড়োলোক বলে গণ্য, যদিও ভাঙা পুজোর দালানে আগের মতো জাঁকজমকে এখন আর পুজো হয় না–প্রকান্ড বাড়ির যে মহলগুলোর ছাদ খসে পড়েছে গত বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যে, সেগুলো মেরামত করবার পয়সা জোটে না, বাড়ির মেয়েদের বিবাহ দিতে হয় কেরানি পাত্রদের সঙ্গে–অর্থের এতই অভাব।

সুশীল এই বংশের ছেলে। ম্যাট্রিক পাস করে বাড়ি বসে আছে–বড়ো বংশের ছেলে, তার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ কখনো চাকুরি করেননি, সুতরাং বাড়ি বসেই বাপের অন্ন ধ্বংস করুক, এই ছিল বাড়ির সকলেরই প্রচ্ছন্ন অভিপ্রায়।

সুশীল তাই করে আসছে অবশ্যি।

সুন্দরপুর গ্রামে ব্রাহ্মণ-কায়স্থের বাস খুব বেশি নেই–আগে অনেক ভদ্র গৃহস্থের বাস ছিল, তাদের সবাই এখন বিদেশে চাকুরি করে–বড়ো বড়ো বাড়ি জঙ্গলাবৃত হয়ে পড়ে আছে।

মুস্তাফিদের প্রকান্ড ভদ্রাসনের দক্ষিণে ও পূর্বে তাঁদের দৌহিত্র রায় বংশ বাস করে। পূর্বে যখন মুস্তাফিদের সমৃদ্ধির অবস্থা ছিল তখন বিদেশ থেকে কুলগৌরব-সম্পন্ন রায়দের আনিয়ে কন্যাদান করে জমি দিয়ে এখানেই বাস করিয়েছিলেন এঁরা।

কালের বিপর্যয়ে সেই রায় বংশের ছেলেরা এখন সুশিক্ষিত ও প্রায় সকলেই বিদেশে ভালো চাকুরি করে। নগদ টাকার মুখ দেখতে পায়–বাড়ি কেউ বড়ো একটা আসে না– যখন আসে তখন খুব বড়োমানুষি চাল দেখিয়ে যায়। পদে পদে মাতুল বংশের ওপর টেক্কা দিয়ে চলাই যেন তাদের দু-একমাস-স্থায়ী পল্লিবাসের সর্বপ্রধান লক্ষ্য।

আশ্বিন মাস। পুজোর বেশি দিন দেরি নেই।

অঘোর রায়ের বড়ো ছেলে অবনী সস্ত্রীক বাড়ি এসেছে। শোনা যাচ্ছে, দুর্গোৎসব না করলেও অবনী এবার ধুমধামে নাকি কালী পুজো করবে। অবনী সরকারি দপ্তরে ভালো চাকুরি করে। অবনীর বাবা অঘোর রায় ছেলের কাছেই বিদেশে থাকেন। তিনি এ-সময় বাড়ি আসেননি, তাঁর মেজো ছেলে অখিলের সঙ্গে পুরী গিয়েছেন। অখিল যেন কোথাকার সাবডেপুটি–পনেরো দিন ছুটি নিয়ে স্ত্রীপুত্র ও বৃদ্ধ পিতাকে নিয়ে বেড়াতে বার হয়েছে।

সুশীল অবনীদের বৈঠকখানায় বসে এদের চালবাজির কথা শুনছিল অনেকক্ষণ থেকে।

অবনী বললে–মামা, তোমাদের বড়ো শতরঞ্জি আছে?

একখানা দালানজোড়া শতরঞ্জি তো ছিল জানি–কিন্তু সেটা ছিঁড়ে গিয়েছে জায়গায় জায়গায়।

ছেঁড়া শতরঞ্জি আমার চলবে না। তাহলে কলকাতায় লোক পাঠিয়ে ভালো একখানি বড়ো শতরঞ্জি কিনে আনি, বন্ধুবান্ধব পাঁচজনে আসবে, তাদের সামনে বার করার উপযুক্ত হওয়া চাই তো! বড়ো আলো আছে?

বাতির ঝাড় ছিল, এক-এক থাকে কাঁচ খুলে গিয়েছে–তাতে চলে তো নিও।

তোমাদের তাতেই কাজ চলে?

কেন চলবে না? দেখায় খুব ভালো। তা ছাড়া দুর্গোৎসবের কাজ দিনমানেই বেশি–রাত্রে আরতি হয়ে গেলেই আলোর কাজ তো মিটে গেল।

আমায় ডে-লাইটের ব্যবস্থা করতে হবে দেখছি। কালী পুজোর রাতে আলোর ব্যবস্থা একটু ভালোরকম থাকা দরকার। ইলেকট্রিক আলোয় বারো মাস বাস করা অভ্যেস, সত্যি পাড়াগাঁয়ে এসে এমন অসুবিধে হয়!

বৃদ্ধ সত্যনারায়ণ গাঙ্গুলি তাঁর ছোটো ছেলের একটা চাকুরির জন্যে অবনীর কাছে ক-দিন ধরে হাঁটাহাঁটি করে একটু–অবশ্যি খুব সামান্যই একটু–ভরসা পেয়েছিলেন, তিনি অমনি বলে উঠলেন–তা অসুবিধে হবে না? বলি তোমরা বাবাজি কীরকম জায়গায় থাক, কী ধরনে থাক–তা আমার জানা আছে তো! গঙ্গাচানের যোগে কলকাতা গেলেই তোমাদের ওখানে গিয়ে উঠি, আর সে কী যত্ন। ওঃ, ইলেকটিরি আলো না হলে কি বাবাজি তোমাদের চলে।

সুশীল কলকাতায় দু-একবার মাত্র গিয়েছে,–আধুনিক সভ্যতার যুগের নতুন জিনিসই তার অপরিচিত–শিক্ষিত ও শহুরেবাবু অবনীর সঙ্গে ভয়ে ভয়ে তাকে কথা বলতে হয়।

তবুও সে বললে–ডে-লাইটের চেয়ে কিন্তু ঝাড় লণ্ঠন দেখায় ভালো—

অবনী হেসে গড়িয়ে পড়ে আর-কী!

ওহে যে যুগে জমিদারপুত্রেরা নিষ্কর্মা বসে থাকত আর হাতিতে চড়ে জরদগবের মতো ঘুরে বেড়াত–ওসব চাল ছিল সেকালের। মডার্ন যুগে ওসব অচল, বুঝলে মামা? এ হল প্রগতির যুগ–হ্যাঁতির বদলে এসেছে ইলেকট্রিক লাইট–সেকালকে আঁকড়ে বসে থাকলে চলবে?

বনেদি পুরোনো আমলের চালচলনে আবাল্য অভ্যস্ত সুশীল। বয়সে যুবক হলেও প্রাচীনের ভক্ত।

সে বললে–কেন, হাতি চড়াটা কী খারাপ দেখলে?

রামো:! জবড়জং ব্যাপার! হাতির মতো মোটা জানোয়ারের ওপর বসে-থাকা পেটমোটা নাদুস-নুদুস–

সত্যনারায়ণ গাঙ্গুলি বললেন–গোবর-গণেশ–

জমিদারের ছেলেরই শোভা পায়, কিন্তু কাজে যারা ব্যস্ত, সময় যাদের হাতে কম, দিনে যাদের ত্রিশ মাইল চক্কর দিয়ে বেড়াতে হয় নিজের কাজে বা অফিসের কাজে তাদের পক্ষে দরকার মোটর বাইক বা মোটর কার। স্মার্ট যারা–তাদের উপযুক্ত যানই হচ্ছে–

সুশীল প্রতিবাদ করে বললে–স্মার্ট কারা জানি নে; মোগল বাদশাহের সময় আকবর আওরঙ্গজেবের মতো বীর হাতিতে চড়ে যুদ্ধ করত–তারা স্মার্ট হল না–হল তোমাদের কলকাতার আদ্দির-পাঞ্জাবি-পরা চশমা-চোখে ছোকরাবাবুর দল, যারা বাপের পয়সায় গড়ের মাঠে হাওয়া খায়–কিংবা শখে পড়ে দু-দশ কদম মোটর ড্রাইভ করে, তারা? অত বড়ো সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, তারা হাতিতে চড়ে যুদ্ধ করত, পুরুরাজ হাতির পিঠে চড়ে আলেকজাণ্ডারের গ্রিক বাহিনীর বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল–তারা স্মার্ট ছিল না, স্মার্ট হল সিনেমার ছোকরা অ্যাক্টরের দল?

সুশীল সেখান থেকে উঠে চলে এল। অবনীর ধরন-ধারণ তার ভালো লাগেনি–দূর সম্পর্কের মামা-ভাগনে, কোন-কালের দৌহিত্র বংশের লোক, এই পর্যন্ত। এখন তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কি যোগ আছে?–কিছুই না। জমিদারের ছেলেদের ওপর অবনীর এ কটাক্ষ, সুশীলের মনে হল তাকে লক্ষ করে করা হয়েছে।

তা করতে পারে–এরা এখন সব হঠাৎ-বড়োলোকের দল, পুরোনো বংশের ওপর এদের রাগ থাকা অসম্ভব নয়।

সুশীল জমিদারপুত্রও বটে, নিষ্কর্মাও বটে। বসে খেতে খেতে দিনকতক পরে পেটমোটা হয়েও উঠবে–এ বিষয়েও নিঃসন্দেহ। অবনী তাকে লক্ষ করেই বলেছে নিশ্চয়ই।

বাড়ি এসে সুশীল জ্যাঠামশায়কে জিজ্ঞেস করলে–আচ্ছা জ্যাঠামণি, আমাদের বংশে কখনো কেউ চাকরি করেছে?

জ্যাঠামশায় তারাকান্ত মুস্তাফির বয়স সত্তরের কাছাকাছি। তিনি পুজোর দালানের সঙ্গের ছোটো কুঠরিতে সারাদিন বৈষয়িক কাগজপত্র দেখেন এবং মাঝে মাঝে গীতা পাঠ করেন। ঘরটার কুলুঙ্গিতে ও দেওয়ালের গায়ের তাকে গত পঞ্চাশ বছরের পুরোনো পাঁজি সাজানো। তারাকান্ত বললেন–কেন বাবা সুশীল? এ বংশে কারো কোনো ভাবনা ছিল যে চাকুরি করবে?

ছেলেরা কী করত জ্যাঠামণি?

পায়ের ওপরে পা দিয়ে বসে খেয়ে আমাদের পুরুষানুক্রমে চলে আসছে–তবে আজকাল বড়ো খারাপ সময় পড়েছে, জমিজমাও অনেক বেরিয়ে গেল–তাই যা-হয় একটু কষ্ট যাচ্ছে। কী আবার করবে কে? ওতে আমাদের মান যায়।

সুশীল কথাটা ভেবে দেখলে অবসর সময়ে। অবনীর কথাগুলো হিংসেতে ভরা ছিল এখন দেখা যাচ্ছে। অবনীদের বাইরে বেরিয়ে চাকুরি না করলে চলে না–আর তাদের চিরকাল চলে আসছে বাড়ি বসে–এতে অবনীর হিংসের কথা বই কী।

মামার বাড়ি খেয়ে চিরকাল ওরা মানুষ। আজ হঠাৎ বড়োলোক হয়ে চাল দেওয়া কথাবার্তায় সেই মাতুল বংশকেই ছোটো করতে চায়।

সুশীল এর প্রমাণ অন্য একদিক থেকে খুব শিগগিরই পেলে। মুস্তাফিদের সাবেকি পুজোর মন্ডপে দুর্গোৎসব টিমটিম করে সমাধা হল–লোকের পাতে হেঁচড়া, কলাইয়ের ডাল, খেতের রাঙা নাগরা চালের ভাত, পুকুরের মাছ, জোলো দুধোলো দই ও চিনির ডেলা ঘোঙা মোন্ডা খাইয়ে–কিন্তু অবনীদের বাড়িতে যে কালী পুজো হল– সে একটা দেখবার জিনিস!

কালী পুজোর রাত্রে গাঁ-সুদ্ধ পোলাও মাংস, কলকাতা থেকে আনা দই রাবড়ি সন্দেশ খেলে। টিন টিন দামি সিগারেট নিমন্ত্রিতদের মধ্যে বিলি হল, পরদিন দুপুরে যাত্রা ও ভাসানের রাত্রে প্রীতি সম্মেলনে প্রচুর জলযোগের ব্যবস্থা ছিল। অবনীর এক বন্ধু আবার ম্যাজিক লণ্ঠনের স্লাইড দেখিয়ে স্বাস্থ্য সম্বন্ধে এক বক্তৃতাও করলে। গ্রামের লোক সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল। এ গাঁয়ে এমনটি আর কখনো হয়নি–কেউ দেখেনি! সকলের মুখে অবনীর সুখ্যাতি।

কিন্তু তাতে কোনো ক্ষতি ছিল না, যদি তারা সেইসঙ্গে অমনি মুস্তাফি জমিদারদের ছোটো করে না দিত।

নাঃ, মুস্তাফিরা কখনো এদের সঙ্গে দাঁড়ায়? বলে–কীসে আর কীসে!

যা বলেছ ভায়া! নামে তালপুকুর, ঘটি ডোবে না—

শুধু লম্বা লম্বা কথা আছে–আর কিছু নেই রে ভাই।

এ-ধরনের একটা কথা একদিন সুশীলের নিজের কানেই গেল। নিজেদের পুকুরের ঘাটে বসে সুশীল ছিপে মাছ ধরছে, গাঁয়ের ওর পরিচিত দু-টি ভদ্রলোক কথা বলতে বলতে পথ দিয়ে যাচ্ছেন। একজন বললেন–মুস্তাফিদের ওপর এবার খুব একহাত নিয়েছে অবনী! অপরজন বললে–তার মানে মুস্তাফিদের আর কিছু নেই। সব ছেলেগুলো বাড়ি বসে বসে খাবে, আজকালকার দিনে কি আর সেকেলে বনেদি চাল চলে? লেখাপড়া তো একটা ছেলেও ভালো করে শিখলে না–

লেখাপড়া শিখেও তো ওই সুশীলটা বাপের হোটেলে দিব্যি বসে খাচ্ছে–ওদের কখনো কিছু হবে না বলে দিলাম। যত সব আলসে আর কুঁড়ে।

কথাটা সুশীলের মনে লাগল। এদিক থেকে সে কোনোদিন নিজেকে বিচার করে দেখেনি। চিরকাল তো এইরকম হয়ে আসছে তাদের বংশে, এতদিন কেউ কিছু বলেনি, আজকাল বলে কেন তবে?

পাশের গ্রামে সুশীলের এক বন্ধু থাকত, সুশীল তার সঙ্গে গিয়ে দেখা করলে। ছেলেটির নাম প্রমথ, তার বাবা এক সময়ে মুস্তাফিদের স্টেটের নায়েব ছিলেন, কিন্তু তারপর চাকুরি ছেড়ে মাল-চালানি ব্যাবসা করে অবস্থা ফিরিয়ে ফেলেছেন।

প্রমথ বেশ বুদ্ধিমান ও বলিষ্ঠ যুবক। সে নিজের চেষ্টায় গ্রামে একটা নৈশ স্কুল করেছে, একটা দরিদ্র-ভান্ডার খুলেছে–তার পেছনে গ্রামের তরুণদের যে দলটি গড়ে উঠেছে– গ্রামের মঙ্গলের জন্যে তারা না করতে পারে এমন কাজ নেই। সম্প্রতি প্রমথ বাবার আড়তে বেরোতে আরম্ভ করেছে।

সুশীল বললে–প্রমথ, আমাকে তোমাদের আড়তে কাজ শেখাবে?

প্রমথ আশ্চর্য হয়ে ওর দিকে চেয়ে বললে–কেন বলো তো? হঠাৎ একথা কেন তোমার মুখে?

বসে বসে চিরকাল বাপের ভাত খাব?

তোমাদের বংশে কেউ কখনো অন্য কাজ করেনি, তাই বলছি। হঠাৎ এ মতিবুদ্ধি ঘটল কেন তোমার?

সেসব বলব পরে। আপাতত একটা হিল্লে করে দাও তো।

ওর মধ্যে কঠিন আর কী? যেদিন ইচ্ছে এসো, বাবার কাছে নিয়ে যাব।

মাস খানেক ধরে সুশীল ওদের আড়তে বেরোতে লাগল, কিন্তু ক্রমশ সে দেখলে, ভুসি মাল চালানির কাজের সঙ্গে তার অন্তরের যোগাযোগ নেই। তার বাবা ছেলেকে আড়তে যোগ দিতে বাধা দেননি, বরং বলেছিল ব্যাবসার কাজে যদি কিছু টাকা দরকার হয়, তাও তিনি দেবেন।

একদিন তিনি জিজ্ঞেস করলেন–আড়তের কাজ কীরকম হচ্ছে?

সুশীল বললে–ও ভালো লাগে না, তার চেয়ে বরং ডাক্তারি পড়ি।

তোমার ইচ্ছে। তাহলে কলকাতায় গিয়ে দেখে-শুনে এসো।

কলকাতায় এসে সুশীল দেখলে, ডাক্তারি স্কুলে ভরতি হবার সময় এখন নয়। ওদের বছর আরম্ভ হয় জুলাই মাসে–তার এখনও তিন চার মাস দেরি। সুশীলের এক মামা খিদিরপুরে বাসা করে থাকতেন, তাঁর বাসাতেই সুশীল এসে উঠেছিল–তাঁরই পরামর্শে সে দু-একটা অফিসে কাজের চেষ্টা করতে লাগল।

দিন-পনেরো অনেক অফিসে ঘোরাফেরা করেও সে কোথাও কোনো কাজের সুবিধে করতে পারলে না–এদিকে টাকা এল ফুরিয়ে। মামার বাসায় খাবার খরচ লাগত না অবশ্য, কিন্তু হাতখরচের জন্যে রোজ একটি টাকা দরকার। বাবার কাছে সে চাইবে না–নগদ টাকার সেখানে বড়ো টানাটানি, সে জানে। একটা কিছু না করে এবার বাড়ি ফিরবার ইচ্ছে নেই তার। অথচ করাই বা যায় কী? সন্ধ্যার দিকে গড়ের মাঠে বসে রোজ ভাবে।

সুশীল সেদিন গড়ের মাঠের একটা নির্জন জায়গায় বসেছিল চুপ করে। বড্ড গরম পড়ে গিয়েছে–খিদিরপুরে তার মামার বাসাটিও ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের চিৎকার ও উপদ্রবে সদা সরগরম–সেখানে গিয়ে একটা ঘরে তিন-চারটি আট-দশ বছরের মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে একঘরে রাত কাটাতে হবে। সুশীলের ভালো লাগে না আদৌ। তাদের অবস্থা এখন খারাপ হতে পারে, কিন্তু দেশের বাড়িতে জায়গার কোনো অভাব নেই।

ওপরে নীচে বড়ো ঘর আছে–লম্বা লম্বা দালান, বারান্দা–পুকুরের ধারের দিকে বাইরের মহলে এত বড়ো একটা রোয়াক আছে যে, সেখানে অনায়াসে একটা যাত্রার আসর হতে পারে।

এমন সব জ্যোৎস্না রাতে কতদিন সে পুকুরের ধারে ওই রোয়াকটায় একা বসে কাটিয়েছে। পুকুরের ওপারে নারিকেল গাছের সারি, তার পেছনে রাধাগোবিন্দের মন্দিরের চুড়োটা, সামনের দিকে ওর ঠাকুরদাদার আমলের পুরোনো বৈঠকখানা। এ বৈঠকখানায় এখন আর কেউ বসে না–কাঠ ও বিচুলি, শুকনো তেঁতুল, ভুসি খুঁটে ইত্যাদি রাখা হয় বর্ষাকালে।

মাঝে মাঝে সাপ বেরোয় এখানে।

সেবার ভাদ্র মাসে তালনবমীর ব্রতের বাহ্মণ ভোজন হচ্ছে পুজোর দালানে, হঠাৎ একটা চেঁচামেচি শোনা গেল পুকুরপাড়ের পুরোনো বৈঠকখানার দিক থেকে।

সবাই ছুটে গিয়ে দেখে, হরি চাকর বৈঠকখানার মধ্যে ঢুকেছিল বিচুলি পাড়বার জন্যে সেই সময় কী সাপে তাকে কামড়েছে।

হইহই হল। লোকজন এসে সারা বৈঠকখানার মালামাল বার করে সাপের খোঁজ করতে লাগল। কিছু গেল না দেখা। হরি চাকর বললে সে সাপ দেখেনি, বিচুলির মধ্যে থেকে তাকে কামড়েছে।

ওঝার জন্যে রানিনগরে খবর গেল। রানিনগরের সাপের ওঝা তিনটে জেলার মধ্যে বিখ্যাত–তারা এসে ঝাড়ফুঁক করে হরিকে সে-যাত্রা বাঁচালে। লোকজনে খুঁজে সাপও বের করলে–প্রকান্ড খয়ে-গোখরো। হরি যে বেঁচে গেল, তার পুনর্জন্ম বলতে হবে।

বাবু, ম্যাচিস আছে–ম্যাচিস?

সুশীল চমকে মাথা তুলে দেখলে, একটি কালোমতো লোক। অন্ধকারে ভালো দেখা গেল না। নিম্নশ্রেণির অশিক্ষিত অবাঙালি লোক বলেই সুশীলের ধারণা হল–কারণ তারাই সাধারণত দেশলাইকে ম্যাচিস বলে থাকে।

সুশীল ধূমপান করে না, সুতরাং সে দেশলাইও রাখে না। সে-কথা লোকটাকে বলতে সে চলেই যাচ্ছিল–কিন্তু খানিকটা গিয়ে আবার অন্ধকারের মধ্যে যেন কী ভেবে ফিরে এল।

সুশীলের একটু ভয় হল। লোকটিকে এবার সে ভালো করে দেখে নিয়েছে অস্পষ্ট অন্ধকারের মধ্যে। বেশ সবল, শক্ত-হাত-পা-ওয়ালা চেহারা–গুণ্ডা হওয়া বিচিত্র নয়। সুশীলের পকেটে বিশেষ কিছু নেই–টাকা-তিনেক মাত্র। সুশীল একটু সতর্ক হয়ে সরে বসল। লোকটা ওর কাছে এসে বিনীত সুরে বললে–বাবুজি, দু-আনা পয়সা হবে?

সুশীল বিনা বাক্যব্যয়ে একটা দু-আনি পকেট থেকে বের করে লোকটার হাতে দিলে। তাই নিয়ে যদি খুশি হয়, হোক না। এখন ও চলে গেলে যে হয়!

চলে যাওয়ার কোনো লক্ষণ কিন্তু লোকটার মধ্যে দেখা গেল না। সে সুশীলের কাছেই এসে সকৃতজ্ঞ সুরে বললে–বহুৎ মেহেরবানি আপনার বাবু! আমার আজ খাওয়ার কিছু ছিল না–এই পয়সা লিয়ে হুটেলে গিয়ে রোটি খাব। বাবুজির ঘর কুথায়?

ভালো বিপদ দেখা যাচ্ছে! পয়সা পেয়ে তবুও নড়ে না যে! নিশ্চয় আরও কিছু পাবার মতলব আছে ওর মনে মনে। সুশীল চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখলে, কাছাকাছি কেউ নেই। পকেটে টাকা তিনটে ছাড়া সোনার বোতামও আছে জামায়, হঠাৎ এখন মনে পড়ল।

ও উত্তর দিলে–কলকাতাতেই বাড়ি, বালিগঞ্জে। আমার কাকা পুলিশে কাজ করেন কিনা, এদিকে রোজ বেড়াতে আসেন মোটর নিয়ে। এতক্ষণে এলেন বলে, রেড রোডে মোটর রেখে এখানেই আসবেন। আমি এখানে থাকি রোজ, উনি জানেন।

বেশ বাবু, আপনাকে দেখেই বড়ো ঘরানা বলে মনে হয়।

সুশীলের মনে কৌতূহল হওয়াতে সে বললে–তুমি কোথায় থাক?

মেটেবুরুজে বাবুজি।

কিছু কর নাকি?

জাহাজে কাজ করতাম, এখন কাজ নেই। ঘুরি-ফিরি কাজের খোঁজে। রোটির জোগাড় করতে হবে তো?

লোকটার সম্বন্ধে সুশীলের কৌতূহল আরও বেড়ে উঠল। তা ছাড়া লোকটার কথাবার্তার ধরনে মনে হয় লোকটা খুব খারাপ ধরনের নয় হয়তো। সুশীল বললে–জাহাজে কতদিন খালাসিগিরি করছ?

দশ বছরের কুছু ওপর হবে।

কোন কোন দেশে গিয়েছ?

সব দেশে। যে দেশে বলবেন সে দেশে। জাপান লাইন, বিলেত লাইন, জাভা-সুমাত্রার লাইন–এস এস পেনগুইন, এস এস গোলকুন্ডা–এস এস নলডেরা, পিয়েনোর বড়ো জাহাজ নলডেরা, নাম শুনেছেন?

পিয়েনো কী জিনিস, পল্লিগ্রামের সুশীল তা বুঝতে পারলে না। না, ওসব নাম সে শোনেনি।

তা বাবুজি, আপনার কাছে ছিপাব না। সরাব পিয়ে পিয়ে কাজটা খারাবি হয়ে পড়ল, জাহাজ থেকে ডিসচার্জ করে দিলে। এখন এই কোষ্টো যাচ্ছে, মুখ ফুটে কাউকে বলতে ভি পারিনি। কী করব, নসিব বাবুজি!

জাহাজের কাজ আবার পাবে না?

পাব বাবুজি, ডিসচার্জ সাটিক-ফিটিক ভালো আছে। সরাব টরাবের কথা ওতে কুছু নেই। কাপ্তানটা ভালো লোক, তাকে কেঁদে গোড়-পাকড়ে বললাম–সাহেব আমার রোটি মেরো না। ওকথা লিখো না!

লোকটি আর-একটু কাছে এসে ঘেঁষে বসল। বললে–আমার নসিব খারাপ বাবু–নয় তো আমায় আজ চাকরি করে খেতে হবে কেন? আজ তো আমি রাজা!

সুশীল মৃদু কৌতূহলের সুরে জিজ্ঞাসা করলে–কীরকম?

লোকটি এদিক-ওদিক চেয়ে সুর নামিয়ে বললে–আজ আর বলব না। এইখানে কাল আপনি আসতে পারবেন?

কেন পারব না?

তাই আসবেন কাল। আচ্ছা বাবু, আপনি পুরোনো লিখা পড়তে পারেন?

সুশীল একটু আশ্চর্য হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে বললে–কী লেখা?

সে কাল বালাব। আপনি কাল এখানে আসবেন, তবে, বেলা থাকতে আসবেন–সুর ডুববার আগে।

মামার বাসায় এসে কৌতূহলে সুশীলের রাতে চোখে ঘুমই এল না। এক-একবার তার মনে হল, জাহাজি মাল্লা কত দূর কত দেশ ঘুরেছে, কোনো এক আশ্চর্য ব্যাপারের কথা কি তাকে বলবে? কেননা নতুন দেশের কথা? পুরোনো লেখা কীসের? …

ওর ছোটো মামাতো ভাই সনৎ ওর পাশেই শোয়। গরমে তারও চোখে ঘুম নেই। খানিকটা উশখুশ করার পরে সে উঠে সুইচ টিপে আলো জ্বাললে। বললে–দাদা চা খাবে? চা করব?

এত রাত্তিরে চা কী রে?

কী করি বল। ঘুম আসছে না চোখে–খাও একটু চা।

সনৎ ছেলেটিকে সুশীল খুব পছন্দ করে। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, লেখা-পড়াতেও ভালো, ফুটবল খেলায় এরই মধ্যে বেশ নাম করেছে, কলেজ টিমের বড়ো বড়ো ম্যাচে খেলবার সময় ওকে ভিন্ন চলে না।

সনৎ-এর আর একটা গুণ, ভয় বলে কোনো জিনিস নেই তার শরীরে। মনে হয় দুনিয়ার কোনো কিছুকে সে গ্রাহ্য করে না। দু-বার এই স্বভাবের দোষে তাকে বিপদে পড়তে হয়েছিল, একবার খেলার মাঠে এক সার্জেন্টের সঙ্গে মারামারি করে, নিজে তাতে মার খেয়েছিলও, খুব-মার দিয়েছিলও। সেবার ওর বাবা টাকাকড়ি খরচ করে ওকে জেলের দরজা থেকে ফিরিয়ে আনেন। আর একবার মাহেশের রথতলায় একটি মেয়েকে গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে গুন্ডার ছুরিতে প্রায় প্রাণ দিয়েছিল আর-কী। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক যুবকদল ওকে গুণ্ডাদের মাঝখান থেকে টেনে উদ্ধার করে আনে।

সুশীল বললে–সনৎ কতদূর লেখাপড়া করবি ভাবছিস?

দেখি দাদা। বি. এসসি. পর্যন্ত পড়ে একটা কারখানায় ঢুকে কাজ শিখব। কলকবজার দিকে আমার ঝোঁক, সে তো তুমি জানই–

আমি যদি কোনো ব্যবসায় নামি, আমার সঙ্গে থাকবি তুই?

নিশ্চয়ই থাকব। তুমি যেখানে থাকবে, যা করবে–আমি তাতে থাকি এ আমার বড়ো ইচ্ছে কিন্তু। কী ব্যাবসা করবে ভাবছ দাদা?

আচ্ছা, কাউকে এখন এসব কিছু বলিস নে। তোকে আমি জানাব ঠিক সময়ে। তোকে নইলে আমার চলবে না। চল আজ শুয়ে পড়ি–রাত দুটো বাজে–

পরদিন সুশীল গড়ের মাঠে নির্দিষ্ট জায়গাটিতে গিয়ে একা বসে রইল। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল–তবুও লোকটির দেখা নেই।

অন্ধকার নামল। আসবে না সে লোক? হয়তো নয়। কী একটা বলবে ভেবেছিল কাল, রাতারাতি তার মন ঘুরে গেছে।

রাত আটটার সময় সুশীল উঠতে যাবে, এমন সময়ে পেছনে পায়ের শব্দ শুনে সে চেয়ে দেখলে।

পরক্ষণেই তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

লোকটা ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে।

সেলাম, বাবুজি! মাপ করবেন, বড়ো দেরি হয়ে গেল। এই দেখুন–

লোকটার পায়ের ওপর দিয়ে ভারি একটা জিনিস চলে গিয়েছে যেন। সাদা কাপড়ের ব্যাণ্ডেজ বাঁধা–কিন্তু ব্যাণ্ডেজ রক্তে ভিজে উঠেছে।

সুশীল বললে–এঃ, কী হয়েছে পায়ে?

এই জন্যেই দেরি হয়ে গেল বাবুজি। বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, আর একটা ভারী হাতেঠেলা গাড়ি পায়ের ওপর এসে পড়ল। দু-জন লোক ঠেলছিল, তাদের সঙ্গে মারামারি হয়ে গেল আমার সঙ্গের লোকদের।

বোসো বোসো। তোমার পায়ে দেখছি সাঙ্ঘাতিক লেগেছে! না এলেই পারতে!

না এলে আপনি তো হারিয়ে যেতেন। আপনাকে আর পেতাম কোথায়? রিকশা করে এসেছি বাবুজি, দাঁড়াতে পারছি নে!

লোকটা ঘাসের ওপর বসে পড়ল। বললে–আজ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে বাবুজি, আজ কোনো কাজ হবে না।

লোকটা কথা বলবে, সুশীল শুনবে। এতে দিনের আলোর কী দরকার, সুশীল বুঝতে পারলে না। বললে–কী কথা বলবে বলেছিলে–বলে যাও না?

লোকটা ধীরে ধীরে চাপা গলায় অনেক কথা বললে–মোটামুটি তার বক্তব্য এই–

তার বাড়ি আগে ছিল পশ্চিমে। কিন্তু অনেকদিন থেকে সে বাংলা দেশে আছে এবং বাঙালি খালাসিদের সঙ্গে কাজ করে বাংলা শিখেছে। লোকটা মুসলমান, ওর নাম জামাতুল্লা। একবার কয়েকজন তেলুগু লস্করের সঙ্গে সে একটা জাহাজে কাজ করে–ডাচ ইস্ট-ইণ্ডিজের বিভিন্ন দ্বীপে নারকোল-কুচি বোঝাই দিয়ে নিয়ে যেত মাদ্রাজ থেকে। সেই সময় একবার তাদের জাহাজ ডুবো-পাহাড়ে ধাক্কা লেগে অচল হয়ে পড়ে। সৌরাবায়া থেকে তাদের কোম্পানির অন্য জাহাজ এসে তাদের জাহাজের মাল তুলে নিয়ে যাবার আগে সাতদিন ওরা সেইখানে পড়েছিল। একদিন সমুদ্রের বিষাক্ত কাঁকড়া খেয়ে জাহাজসুদ্ধ লোকের কলেরা হল।

এইখানে সুশীল জিজ্ঞেস করলে–সবারই কলেরা হল?

কেউ বাদ ছিল না বাবু। খাবার পাওয়া যেত না, পাহাড়ের একটা গর্তে কাঁকড়া পেয়ে সেদিন ওরা তাই ধরেছিল। ছোটো-ছোটো–লাল কাঁকড়া।

তারপর?

দু-জন বাদে বাকি সব সেই রাত্রে মারা গেল। বাবুজি, সে-রাতের কথা ভাবলে এখনও ভয় হয়। সতেরো জন দিশি লস্কর আর দু-জন ওলন্দাজ সাহেব–একজন মেট আর একজন ইঞ্জিনিয়ার–সেই রাত্রে সাবাড়। রইলাম বাকি কাপ্তান আর আমি।

তারপর জাহাজের কাপ্তান ওকে বললে–মড়াগুলি টান দিয়ে ফেলে দাও জলে—

ও বললে–আমি মুদাফরাশ নই সাহেব, ও আমি ছোঁব না—

সাহেব ওকে গুলি করে মারতে এল। ও গিয়ে লুকোলো ডেকের ঢাকনি খুলে হোল্ডের মধ্যে। সেই রাত্রে কাপ্তান সাহেব খুব মদ খেয়ে চিৎকার করে গান গাইছে–ও সেই সময় জাহাজের বোট খুলে নিয়ে নামাতে গেল।

ডেভিট থেকে বোট নামাবার শব্দে সাহেবের মদের নেশা ভাঙল না তাই নিস্তার ডেকের ওপরে তখন দুটো মড়া পড়ে রয়েছে–মরণের বীজ জাহাজের সর্বত্র ছড়ানো, ভয়ে ও কিছু খায়নি সকাল থেকে, পাছে কলেরা হয়। সুতরাং অনাহারে ও ভয়ে খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে।

দূরে ডাঙা দেখা যাচ্ছিল, দুপুরের দিকে ও লক্ষ করেছিল। সারারাত নৌকো বাইবার পর ভোরে এসে বোট ডাঙায় লাগল। ও নেমে দেখে ডাঙায় ভীষণ জঙ্গল–ওদেশের সব দ্বীপেই এ ধরনের জঙ্গল ও জানত। লোকজনের কোনো চিহ্ন নেই কোনোদিকে।

বোট ডাঙায় বেঁধে ও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দু-দিন হাঁটলে, শুধু গাছের কচি পাতা আর এক ধরনের অম্ল-মধুর ফল খেয়ে। মানুষের বসতির সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় এসে হঠাৎ একেবারে ও অবাক হয়ে গেল।

ওর সামনে প্রকান্ড বড়ো সিংহদরজা–কিন্তু বড়ো বড়ো লতাপাতা উঠে একেবারে ঢেকে ফেলে দিয়েছে। সিংহদরজার পর একটা বড়ো পাঁচিলের খানিকটা–আরও খানিক গিয়ে একটা বড়ো মন্দির, তার চুড়ো ভেঙে পড়েছে–মন্দিরের গায়ে হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি বলে তার মনে হল। সে ভারতের লোক, হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি সে চেনে। এ ক্ষেত্রে হয়তো সে ঠিক চিনতে পারেনি–তবে তার ওইরকম বলেই মনে হয়েছিল।

অবাক হয়ে সে আরও ঘুরে ঘুরে দেখলে। জায়গাটা একটা বহুকালের পুরোনো শহরের ভগ্নস্তূপ মনে হল। কত মন্দির, কত ঘর, কত পাথরের সিংহদরজা, গভীর বনের মধ্যে বড়ো বড়ো কাছির মতো লতার নাগপাশ বন্ধনে জড়িয়ে কত যুগ ধরে পড়ে আছে। ভীষণ বিষধর সাপের আড্ডা সর্বত্র। একটা বড়ো ভাঙা মন্দিরে সে পাথরের প্রকান্ড বড়ো মূর্তি দেখেছিল–প্রায় আট-দশ হাত উঁচু।

সন্ধ্যা আসবার আর বেশি দেরি নেই দেখে তার বড়ো ভয় হয়ে গেল। এসব প্রাচীনকালের নগর শহর–জিন পরীর আচ্ছা, তেলুগু লস্করেরা যাকে ওদের ভাষায় বলে বিহ্মমুনি।

বিহ্মমুনি বড়ো ভয়ানক জিন, হিন্দুদের পুরোহিত মারা যাওয়ার পর বিহ্মমুনি হয়। এই গহন অরণ্যের মধ্যে লোকহীন পরিত্যক্ত বহু প্রাচীন নগরীর অলিতে-গলিতে ঝোপে ঝোপে ধুম্রবর্ণ, বিকটাকার, কত যুগের বুভুক্ষু বিহ্মমুনির দল সন্ধ্যার অন্ধকার পড়বার সঙ্গে সঙ্গে শিকারের সন্ধানে জাগ্রত হয়ে উঠে হাঁক পাড়ে–ম্যায় ভুখা! তাদের হাতের নাগালে

পড়লে কি আর রক্ষে আছে? অতএব এখান থেকে পালানোই একমাত্র বাঁচবার পথ।

সুশীল এক মনে শুনছিল, পালিয়ে গেলে কোথায়?

সেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আবার দু-দিন তিন দিন ধরে হেঁটে সমুদ্রের ধারে পৌঁছোলাম। জাহাজে উঠব এসে এই তখন খেয়াল।

আবার সেই মড়া-ভরতি জাহাজে কেন?

বুঝলেন না বাবুজি? যদি জাহাজে উঠি, তবে তো দেশে পৌঁছোবার ঠিকানা মেলে। নয়তো সেই জংলি মুলুকে যাব কোথায়? চারিধারে সমুদ্র, যদি জাহাজ না পাই তবে সেই জংলি মুলুকে না খেয়ে মরতে হবে–নয়তো জংলি লোকেরা খুন করে ফেলবে। বাবুজি, তখন এমন ডর, যে রাতে ঘুমোতে পারি নে। একদিন প্রকান্ড এক বনমানুষের হাতে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম–নসিবের জোর খুব। অমন ধরনের জানোয়ার যে দুনিয়ায় আছে তা জানতাম না। গাছের ওপর একদল বনমানুষ ছিল–ধাড়িটা আমার দেখতে পেলে না বাবুজি, দেখলে আর বাঁচতাম না।

সুশীল মনে মনে একবার চিন্তা করে দেখলে। লোকটা মিথ্যা কথা বলছে না সত্যি বলছে, ওর এই বনমানুষের কথা তার একটা মস্ত বড়ো পরীক্ষা। সুশীল জন্তুজানোয়ার সম্বন্ধে কিছু কিছু পড়াশুনো করেছিল, বাড়িতে আগে নানারকম পাখি, বেঁজি, খরগোশ, সজারু, ও বাঁদর পুষত। গাঁয়ের লোকে ঠাট্টা করে বলত, মুস্তাফিদের চিড়িয়াখানা। এ সম্বন্ধে ইংরেজি বইও নিজের পয়সায় কিনেছিল।

ও বললে–কত বড়ো বনমানুষ?

খুব বড়ো বাবুজি। ইন্দোরের পালোয়ন রামনকিব সিং-এর চেয়েও একটা বাচ্চার গায়ে জোর বেশি। নিজের আঁখসে দেখলাম।

কী করে দেখলে?

ডাল ফাড়লে হাত আর পা দিয়ে ধরে! আমার মাথার ওপর গাছপালার ডালগুলো তো বনমানুষে বিলকুল ভরতি হয়ে গিয়েছিল।

তবে তো তুমি সুমাত্রা দ্বীপে কিংবা বোর্নিওতে গিয়েছিলে কিংবা ওর কাছাকাছি কোনো ছোটো দ্বীপে। তুমি যে বনমানুষ বলছ–ও হচ্ছে ওরাং ওটাং-ও ছাড়া আর কোনো বনমানুষ ও দেশে থাকবে না–

লোকটা হঠাৎ অত্যন্ত বিস্ময়ে সুশীলের মুখের দিকে চেয়ে বলে উঠল–দাঁড়ান–দাঁড়ান, বাবুজি, কী জায়গার নাম করলেন আপনি?

সুমাত্রা আর বোর্নিও–

ওঃ, বাবুজি, আপনি বহুৎ পড়ালিখা আদমি! এই না, কতকাল শুনিনি জানেন? আজ দশ বারো বছর। শেষের নামটা–কী বললেন বাবুজি? বোর্নিও? ঠিক। সুলু সি-র নাম জাহাজি চার্টে দেখবেন। সুলু সি-র কাছাকাছি, এপার-ওপার। কেন জানেন বাবুজি? এই নাম শুনলে আমার বহুত কথা মনে পড়ে যায়! তাজ্জব কথা! আজ দেখচেন আমায় এই গড়ের মাঠে বসে দু-একটা পয়সা ভিক্ষে করছি–কিন্তু আমি আজ–আচ্ছা, সেকথা এখন থাক।

তারপর কী করলে বলো না! জঙ্গল থেকে এসে উঠলে আবার জাহাজে?

হ্যাঁ, উঠলাম। সেই কাপ্তান তখন মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে নিজের কেবিনে চাবি দিয়ে ঘুমোচ্ছে–আমি আগে তো ভাবলাম মরে গিয়েছে। মড়াগুলি কতক কাপ্তান ফেলে দিয়েছে –কতক তখনও রয়েছে। ভীষণ বদ গন্ধ–আর সেই গরম! আমি জাহাজের কিছু খেতে পারিনে কলেরার ভয়ে। ডাঙায় গিয়ে মাছ ধরতাম–আর কচ্ছপ।

কাপ্তেন বেঁচে ছিল?

বেঁচে ছিল, কিন্তু বেচারির মগজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল একেবারে। তখনকার দিনে বেতার ছিল না, আমাদের জাহাজে যে অমন হয়ে গেল, সে খবর কোথাও দেওয়া যায়নি। ওসব দিকের সমুদ্রে জাহাজ বেশি চলাচল করে না–জাহাজের লাইন নয়। এগারো দিন পরে সৌরাবায়া থেকে জাহাজ যাচ্ছিল পাসারাপং,–তারা আমাদের আগুন দেখে এসে জাহাজে তুলে নিয়ে বাঁচায়।

কীসের আগুন?

ডুবো পাহাড়ের খানিকটা ভাটার সময় বেরিয়ে থাকত। পাটের থলে জ্বালিয়ে সেখানে রোজ আগুন করতাম–অন্য জাহাজের যদি চোখে পড়ে। তাতেই তো বেঁচে গেলাম।

এ পর্যন্ত শুনে সুশীল বুঝতে পারলে না লোকটার ভাগ্য কীসে ফিরেছিল। তবে লোকটা যে মিথ্যা কথা বলছে না, ওর কথার ধরন থেকে সুশীলের তা মনে হল। কিন্তু এইবার লোকটা যে কাহিনি বললে, তা শেষ পর্যন্ত শুনে সুশীল বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে গেল– অল্পক্ষণের জন্য সারা গড়ের মাঠ, এমনকী বিরাট কলকাতা শহরটাই যেন তার সমস্ত আলোর মালা নিয়ে তার চোখের সামনে থেকে গেল বেমালুম মুছে–বহু দূরের কোনো বিপদসংকুল নীল সমুদ্রে সে একা পাড়ি জমিয়েছে বহুকালের লুকোনো হীরে-মানিক-মুক্তোর সন্ধানে–পৃথিবীর কত পর্বতে, কন্দরে, মরুতে, অরণ্যে অজানা স্বর্ণরাশি মানুষের চোখের আড়ালে আত্মগোপন করে আছে–বেরিয়ে পড়তে হবে সেই লুকোনো রত্নভান্ডারের সন্ধানে –পুরুষ যদি হও! নয় তো অফিসের দোরে দোরে মেরুদন্ডহীন প্রাণীদের মতো ঘুরে ঘুরে সেলাম বাজিয়ে চাকুরির সন্ধান করে বেড়ানোই যার একমাত্র লক্ষ্য, তার ভাগ্যে নৈব চ, নৈব চ!

এই খালাসিটা হয়তো লেখাপড়া শেখেনি, হয়তো মার্জিত নয়–কিন্তু এ সপ্ত সমুদ্রে পাড়ি জমিয়ে এসেছে, দুনিয়ার বড়ো বড়ো নগর বন্দর, বড়ো বড়ো দ্বীপ দেখতে কিছু বাকি রাখেনি–এ একটা পুরুষ মানুষ বটে–কত বিপদে পড়েছে, কত বিপদ থেকে উদ্ধার হয়েছে!

বিপদের নামে ত্রিশ হাত পেছিয়ে থাকে যারা, গা বাঁচিয়ে চলবার ঝোঁক যাদের সারাজীবন ধরে, তাদের দ্বারা না ঘুচবে অপরের দুঃখ, না ঘুচবে তাদের নিজেদের দুঃখ। লক্ষ্মী যান না কাপুরুষের কাছে, অলসের কাছে–তাদের তিনি কৃপা করেন যারা বিপদকে, বিলাসকে, আরামপ্রিয়তাকে তুচ্ছ বোধ করে।

জাহাজ সৌরাবায়া এসে পৌঁছোবার সঙ্গেসঙ্গে ওদের দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। সত্যিই ক্লান্তিতে, অনিদ্রায়, দুশ্চিন্তায়, অখাদ্য ভক্ষণে ওদের শরীর ভেঙে পড়েছিল। দিন পনেরো হাসপাতালে শুয়ে থাকবার পরে ক্রমশ ওর শরীর ভালো হয়ে গেল– কাপ্তেনের মস্তিষ্ক-বিকৃতির লক্ষণও ক্রমে দূর হল।

ওদের জন্যে কিছু টাকা চাঁদা উঠেছিল, ও হাসপাতাল থেকে যেদিন বাইরে পা দিলে, সেদিন এক দয়াবতী মেমসাহেব ওকে টাকাটা দিয়ে গেলেন। দুস্থনাবিকদের থাকবার জন্যে গভর্নমেন্টের একটা বাড়ি আছে সেখানে ওকে বিনি খরচায় থাকবার অনুমতি দেওয়া হল।

এই বাড়িতে সে প্রায় দু-মাস ছিল, তারপর অন্য জাহাজে চাকরি নিয়ে ওখান থেকে চলে আসে। তারপর পাঁচ-সাত বছর কেটে গেল। ও যেমন জাহাজে কাজ করে তেমনি করে যাচ্ছে। প্রাচ্যদেশের বড়ো বড়ো বন্দরের মদের দোকান ও জুয়ার আড্ডার সঙ্গে তখন সে সুপরিচিত।

একবার তাদের জাহাজ ম্যানিলাতে থেমেছে। ও অন্যান্য লস্করদের সঙ্গে নিয়ে এক পরিচিত জুয়ার আড্ডায় উঠেছে–এমন সময়ে আড্ডাধারী এসে ওকে বললে–একবার এসো তো! তোমাদের দেশের একজন লোক তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

ও অবাক হয়ে বললে–আমাদের দেশের?

আড্ডাধারী চীনাম্যান হেসে বললে–হ্যাঁ, ইণ্ডিয়ার। এতকাল দোকান করছি বন্দরে, ইণ্ডিয়ান মানুষ চিনিনে?

ও আড্ডাধারীর পিছু পিছু গিয়ে দেখলে জুয়ার আড্ডার পেছনে একটা পায়রার খোপের মতো ছোট্ট ভীষণ নোংরা ঘরে একজন লোক শুয়ে। লোকটার বয়স কত ঠিক বোঝবার জো নেই–চল্লিশও হতে পারে, আবার ষাটও হতে পারে। বিছানার সঙ্গে যেন সে মিশে গিয়েছে বহুদিন ধরে অসুখে ভুগে।

ওকে দেখে লোকটা ক্ষীণ কণ্ঠে তেলুগু ভাষায় বললে দেশের লোককে দেখতে পাইনে। যখন হংকং হাসপাতালে ছিলাম, অনেক দেশের লোক দেখতাম সেখানে। বোসস এখানে। আহা, ভারতের লোক তুমি! মুসলমান? তা কী? এতদূর বিদেশে তুমি শুধু ভারতের লোক, যে দেশের মাটিতে আমার জন্ম, সেই একই দেশের মাটিতে তোমারও জন্ম। এখানে তুমি আমার ভাই।

ও রোগীর বিছানার পাশে বসল। সেই অপরিচিত মুমূর্ষ স্বদেশবাসীকে দেখে ওর মনে একটা গভীর অনুকম্পা ও মমতা জেগে উঠল– যেন সত্যিই কতকালের আপনার জন।

রোগী বললে–আমার নাম নটরাজন, ত্রিবেন্দ্রাম শহর থেকে এগারো মাইল দূরে কাটিউপ্পা বলে ছোট্ট একটি গ্রামে আমার বাড়ি। কোচিন থেকে যে স্টিমলঞ্চ ছাড়ে ত্রিবেন্দ্রাম যাবার জন্যে, সে স্টিমার আমার গ্রামের ঘাট ছুঁয়ে যায়। বেউয়া কাপ্পিয়াম নদীর ধারে, চারিধারে ঘন আর ছোটো ছোটো পাহাড় কাটিউস্লা গ্রাম তুমি দেখোনি, বুঝতে পারবে না সে কী চমৎকার জায়গা। আমি অনেক দেশ বেড়িয়েছি পৃথিবীর, ভবঘুরে হয়ে চিরদিন কাটিয়ে দিলাম জীবনটা–কিন্তু আমি তোমায় বলছি শোনো, ভারতবর্ষের মধ্যে তো বটেই, এমনকী পৃথিবীর মধ্যে ত্রিবাঙ্কুর একটি অদ্ভুত সুন্দর দেশ। কিন্তু আমার দেশের বর্ণনা শোনাবার জন্যে আজ তোমায় আমি ডাকিনি। আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে, কাল যে সূর্যদেব উঠবে আকাশে, তা আমি চোখে বোধ হয় দেখতে পাব না–তুমি আমার দেশবাসী ভাই, একটা উপকার করবে আমার?

কী বলুন? আপনি আমার চাচার বয়সি, যা হুকুম করবেন বলুন। সম্ভব হলে নিশ্চয়ই করব।

রোগীর পান্ডুর মুখ অল্পক্ষণের জন্যে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল–নিবুনিবু প্রদীপের শিখার মতো। ওর দিকে গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে বললে–কথা দিলে? কিন্তু ভীষণ লোভ দমন করতে হবে ভাই!

আল্লার নামে বলছি, যা করতে বলবেন, তাই করব।

আমার মাথার বালিশের তলায় একটা চামড়ার ব্যাগ আছে, সেটা বার করে নাও। আমার মৃত্যুর পরে ব্যাগটা আমার গ্রামে আমার স্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেবে।

ও রোগীর মাথাটা সন্তর্পণে একধারে সরিয়ে আস্তে আস্তে একটা ছোটো চামড়ার ব্যাগ বার করলে। ব্যাগের মধ্যে কতগুলো কাগজপত্র ছাড়া আর কিছু আছে বলে মনে হল না ওর।

বৃদ্ধ নটরাজন বললে–তোমার কাছে আমি কোনো কথা লুকোব না। ব্যাগটার মধ্যে একখানা ম্যাপ আছে–জীবনে অনেক সাহসের কাজ করেছি, অনেক বনে-জঙ্গলে ঘুরেছি –অনেকরকম লোকের সঙ্গে মিশেছি। এই ম্যাপখানা এবং ব্যাগের মধ্যে যা যা আছে–তা আমি সৎপথে থেকে হস্তগত করিনি। সংক্ষেপে কথাটা বলে নিই, কারণ বেশি বলবার আমার সময় বা শক্তি নেই। আজ বিশ-বাইশ বছর আগে এই ব্যাগ আমার হস্তগত হয়। যে ম্যাপখানা এই ব্যাগের মধ্যে আছে–তার সাহায্যে যেকোনো লোক দুনিয়ায় মহাধনী লোক হয়ে যেতে পারে। সুলু সি-র একটা খাড়ির ধারে নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে প্রাচীন আমলের এক নগরের ভগ্নস্তূপ আছে। সেই নগর প্রাচীন যুগের এক হিন্দু রাজ্যের রাজধানী ছিল। তার এক জায়গায় প্রচুর ধনরত্ন লুকোনো আছে। যার কাছ থেকে এ ম্যাপ আমি পাই, সে আমারই বন্ধু, দু-জনে মিলে সুলু সমুদ্রে বোম্বেটেগিরি করেছি দশ বছর ধরে। সে জাতিতে মালয়, ম্যাপ তার তৈরি– সে নিজে ওই শহরের সন্ধান খুঁজে বার করেছিল। সেখানে নিজের প্রাণ বিপন্ন করে, সামান্য কিছু পাথর ছাড়া সে বেশি কোনো জিনিস আনতে পারেনি সেখান থেকে। তার নিজের লেখা জাহাজের লগ বুকের (Log Book) কয়েকখানা পাতা আমি মালয় ভাষা থেকে নিজের সুবিধার জন্যে ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়ে নিই সৌরাবায়াতে এক গরিব মালয় স্কুল মাস্টারকে ধরে। সেই অনুবাদের কাগজখানাও এই ব্যাগের মধ্যে আছে। তারপর ম্যাপখানা হস্তগত করে আমি নিজে অনেক খোঁজাখুঁজি করি–কিন্তু সুলু সমুদ্র ও ওদিকের বহুশত বসতিহীন ও বসতিযুক্ত ছোটো ও বড়ো দ্বীপ– তাদের প্রত্যেকটিতে ভীষণ জঙ্গল। ম্যাপেও যা আছে, তা খুব নিখুঁত নয় মোটের ওপর সে-দ্বীপ আমি বার করতে পারিনি। দেশের গ্রামে আমার ছেলে আছে, তাকে নিয়ে গিয়ে ম্যাপটা আর ব্যাগ দিও। এর মধ্যে আর একটা জিনিস আছে–আমার বোম্বেটে বন্ধু সেই প্রাচীন শহরে একটা জিনিস পায়। জিনিসটা একটা সিলমোহর বলেই মনে হয়। একখানা গোটা পদ্মরাগ মণির ওপর সিলমোহরটা খোদাই করা। সেটা এর মধ্যে আছে। সেই মোহরের ওপর যে অদ্ভুত চিহ্নটি আঁকা আছে–আমার বিশ্বাস ছিল, সেটা একটা বড়ো হদিশ ওই প্রাচীন নগরীর রত্নভান্ডারের। তাই ওখানা আমি কবচের মতো গলায় ঝুলিয়ে বেড়িয়েছি এতদিন। কিন্তু আজ বুঝেছি আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে। উনিশ বছর আগে গ্রাম থেকে যখন চলে আসি, তখন আমার ছেলে ছিল দু-বছরের–আর আমার স্ত্রী-পুত্রকে দেখিনি এই উনিশ বছরের মধ্যে। বেঁচে থাকলে আজ সে একুশ-বাইশ বছরের যুবক। তার হাতে এগুলো সব দিয়ে বলে দিও, বাপের ছেলে যদি হয়, সে যেন খুঁজে বার করে সেই নগরী, তার বাবা যা পারেনি। আর আমার কিছু বলবার নেই! ব্যাগটা নাও হাতে তুলে।

রোগী এই পর্যন্ত বলে ক্লান্তিতে চোখ বুজল। চীনা আড্ডাধারীর ইঙ্গিতে ও রোগীর ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

সুশীল বললে–তারপর?

বাবুজি, যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম, নটরাজন বাঁচল কি মারা গেল সেদিকে কোনো খেয়াল করিনি। আমার মাথা তখন ঘুরছে। ব্যাগ খুলে দেখলাম কতকগুলো পুরোনো কাগজপত্র ও ম্যাপখানা ছাড়া আর কিছুই নেই। পদ্মরাগ মণিটা নেড়ে-চেড়ে দেখে কিছু বুঝলাম না–ওসব জিনিসের আমরা কী বুঝি বলুন! কিন্তু তখন আমার আর একটা বড়ো কথা মনে হয়েছে। নটরাজন যখন ওর গল্প করছিল, আমার মনে পড়ল সাত বছর আগের সেই ঘটনা। জাহাজে সেই কলেরা হওয়া, আমার জাহাজ থেকে পালানো এবং বন-জঙ্গলের মধ্যে সেই বিহ্মমুনির দেশের মধ্যে গিয়ে পড়া, বুঝলেন না বাবুজি?

খুব বুঝেছি, বলে যাও।

আমার মনে হল, আমি সেখানে গিয়ে পড়েছিলাম ঘুরতে ঘুরতে। সে পুরোনো শহর আমি দেখেছি। নটরাজন যা বের করতে পারেনি, আমি সেখানে একটা গোটা দিন কাটিয়েছি। এই জায়গা সুলু সি-র ধারে, তাও আমি জানি। যদিও ঠিক বলতে পারব না হয়তো–কিন্তু দূর থেকে দেখলে বোধ হয় চিনব।

ত্রিবাঙ্কুরের সেই গাঁয়ে গেলে না?

লোকটা বললে, প্রথমে ওর লোভ হয়েছিল খুব। পদ্মরাগ মণিটার দাম যাচাই করে দেখা গেল প্রায় দেড় হাজার টাকা দাম সেটার। তা ছাড়া আরও লোভ হল, নটরাজনের ছেলেকে ম্যাপ দেবার কী দরকার? এই ম্যাপের সাহায্যে সে-ই তো জায়গাটা খুঁজে বার করতে পারে। বিশেষ করে একবার যখন সেখানে সে গিয়েছিল। কিন্তু তিন-চার দিন ভাবার পরে ওর মনে হল মরবার আগে বিশ্বাস করে নটরাজন ওর হাতে জিনিসগুলো সঁপে দিয়েছে তার ছেলেকে দেবার জন্যে। এখন যদি না দেয়, তবে নটরাজনের ভূত ওর পেছনে লেগে থাকবে, হয়তো-বা মেরেও ফেলতে পারে। অতএব খানিকটা ইচ্ছা এবং খানিকটা অনিচ্ছাতে সেখানে যেতে সে বাধ্যই হল। বড়ো মজার ব্যাপার ঘটল কিন্তু সেখানে।

সুশীল বললে–কীরকম?

বাবুজি, অনেক কষ্ট করে বেউয়া কাপ্পিয়াম নদীর ধারে সেই কেটিউপ্পা গাঁয়ে গিয়ে পৌঁছোলাম। দেখলাম নটরাজন মিথ্যে বলেনি, নদীটা একেবারে ওদের গ্রামের নীচে দিয়েই গিয়েছে বটে। নিজের পকেট থেকে যাওয়ার খরচ করলাম। গাঁয়ে গিয়ে যাকেই জিজ্ঞেস করি, কেউ নটরাজনের ছেলের খোঁজ দিতে পারে না। নটরাজনের কথাই অনেকের মনে নেই। দু একজন বুড়ো লোক বললে, নটরাজনকে তারা চিনত বটে–তবে অনেকদিন আগে সে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, তার স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে তারা জানে না।

তারপর?

মানে খানিকটা আনন্দ যে না হল তা নয়। ছেলেকে যদি সন্ধান না করতে পারি তবে আমার দোষ কী! তবুও একে ওকে জিজ্ঞেস করি। শেষকালে গাঁয়ের কাছারিতে কী ভেবে গিয়ে খোঁজ করলাম। তারা শুনে বললে, অনেকদিন আগে নটরাজনের জায়গা-জমি নীলাম করতে হয়েছিল খাজনা না দেওয়ার জন্যে। নীলামের নোটিশ তারা পাঠিয়েছিল ত্রিবেন্দ্রাম শহরে।

পেলে খুঁজে?–

ঠিকানা তো খুঁজে বার করলাম। ছোট্ট একটা কাঠের বাড়ি, নারকেল গাছের বাগান সামনে। শহরের মধ্যে বাড়িটা নয়, শহর থেকে মাইল খানেক দূরে। অনেক ডাকাডাকির পর এক বুড়ি এসে দোর খুলে দিলে। মাথার চুল সব সাদা হয়েছে, অথচ মুখ দেখে খুব বয়স হয়েছে বলে মনে হয় না। বললে–কাকে চাও? আমি বললাম নটরাজনের ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। বুড়ি আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে বললে–ও নাম কোথায় শুনলে? ও নাম তো কেউ জানে না। আমি তখন সব কথা বুড়িকে বললাম। শুনে বুড়ি কেঁদে ফেললে। বললে–আমার ছেলেও আজ নিরুদ্দেশ, তার বাপের মতো সেও বেরিয়েছে– আজ তিন বছর হয়ে গেল। কোনো খবর পাইনি।

তুমি কী করলে?

এই কথা শুনে আমার বড়ো কষ্ট হল, বাবুজি। আমি সেখানে বুড়ির বাড়ি সাত-আটদিন রইলাম। তাকে মা বলে ডাকি। বুড়িও আমায় বড়ো যত্ন করতে লাগল। বুড়ি বড়ো গরিব ভাড়াটে ঘরে থাকে। তার ছেলে স্কুলে পড়ত। সে রাঁধুনিগিরি করে ছেলের পড়ার খরচ ও নিজেদের খরচ চালাত। এখনও সে নারকেল তেলের গুদামের শেঠজিদের বাড়ি রাঁধে। কোনোরকমে একটা পেট চলে যায়। বুড়িকে পদ্মরাগ মণিটা আমি দেখাইনি–

এত কষ্ট করে গিয়ে ওটার বেলা ফাঁকি দিলে?

ওই যে নটরাজন বলেছিল, পদ্মরাগ মণির গায়ে একটা আঁক-জোক আছে–যা হদিশ দেবে হীরে-জহরতের–ওই হল ওখানা না দেওয়ার গোড়ার কথা। ভাবলাম কী জানেন? ভাবলাম এই, নটরাজনের ছেলে না-পাত্তা–বুড়ির কাজ নয় ম্যাপ দেখে সুলু-সি যাওয়া আর সেই দ্বীপের মধ্যে লুকোনো শহর খুঁজে বার করা। যদি ওকে দিই ওগুলো এখানে পড়ে নষ্ট হবে। তার চেয়ে যদি আমি নিই, হয়তো চেষ্টা করলে একদিন-না-একদিন আমি সেখানে গিয়ে পৌঁছেতেও পারি। যদি হীরে-জহরত পাই, বুড়িকে আমি ভালোভাবে খোরপোশ দিয়ে রাখব। কিন্তু যদি পদ্মরাগ মণিখানা দিয়ে দিই–তবে হদিশটা হাতছাড়া হয়ে গেল। বুড়ি এখুনি অপরকে মণি বিক্রি করবে। যে কিনবে, সে মণির গায়ে আঁকা সিলমোহরের কোনো মানেই বুঝবে না। লোহার সিন্দুকে আটকা থাকবে জিনিসটা। তাতে কারো কোনো উপকার নেই। কী বলেন আপনি?

তোমার যুক্তি মন্দ না। যদিও আমার মনে হয় জিনিসটা দেওয়াই তোমার উচিত ছিল। যাদের জিনিস, তারা সেটা নিয়ে যা খুশি করুক না কেন। তোমার ওপর শুধু পৌঁছে দেওয়ার ভার। সেটা তুমি রাখলে নিজের কাছে?

হাঁ বাবুজি। এই দেখুন আমার কাছেই আছে। আসুন ওই আলোর কাছে।

সুশীল আলোর নীচে গিয়ে বিস্ময় ও কৌতূহলের সঙ্গে ওর প্রসারিত করতলের ওপর প্রায় ঝুঁকে পড়ল। মস্ত একখানা পাথর, একটু চ্যাপটা গড়নের, উজ্জ্বল সবুজ রঙের–তার ওপর খোদাই-কাজ করা।

সুশীল ওর হাত থেকে সিলমোহরটা নিয়ে দেখলে উলটে-পালটে। খোদাই-কাজ করা এত বড়ো পাথর সে কখনো দেখেনি। বড় সাইজের একটা কলার লজে°সের মতো। সিলমোহরের মধ্যে চেয়ে সে অবাক হয়ে গেল–বড়ো একটা ওঁকারের ওঁর ল্যাজ জড়িয়ে জড়িয়ে পাকিয়েছে একটা বট গাছ কিংবা অন্য কোনো গাছকে। তারপর সে আরও ভালো করে চেয়ে দেখলে–আসলে ওটা ওঁকার নয়, যদিও সেইরকম দেখাচ্ছে বটে। কোনো নাগদেবতার মূর্তি হওয়াও বিচিত্র নয়। ত্রিভুজাকৃতি কী একটা আঁকা রয়েছে ছবির বাঁ-দিকে। কোনো নাম বা সন-তারিখ নেই।

লোকটা বললে–কিছু বুঝলেন বাবু?

না:, তবে হিন্দুর সঙ্গে এ জিনিসের সম্পর্ক আছে বলে মনে হল। দেড় হাজার টাকার জিনিসটা তুমি যে বড়ো বিক্রি করে ফেলনি এতদিন?

ওই যে নটরাজন বলেছিল এই খোদাই-করা আঁক-জোকের মধ্যে আসল মালের হদিশ পাওয়া যাবে– সেই লোভেই একে হাতছাড়া করে ফেলিনি।

নটরাজনের স্ত্রী কোথায়?

তাকে কেটিউপ্পা গাঁয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। মাসে মাসে টাকা পাঠাই। শহরে খরচ বেশি, গাঁয়ে খরচ কম। ঘর ভাড়া লাগে না। সেই সেদিনও পাঁচ টাকা ডাকে পাঠিয়েছি। এখন চাকরি নেই–নিজের পেটই চলে না।

কাগজপত্র আর ম্যাপগুলো?

ওই নটরাজনের স্ত্রী–তাকে আমি মা বলি– সেখানে তার কাছেই আছে। সঙ্গে নিয়ে বেড়াইনে, বড় দামি ও দরকারি জিনিস–আমার কাছে থাকলে হারিয়ে যেতে পারে। সে বুড়ি তার বেতের পেটরায় তুলে রেখে দিয়েছে, যখন দরকার হবে, নিয়ে আসব গিয়ে।

এসব আজ কত বছরের কথা হল?

বেশি দিনের নয়। আজ দু-বছর আগে আমি নটরাজনের গাঁয়ে গিয়ে বুড়ির সঙ্গে প্রথম দেখা করি।

তোমাকে একটা পরামর্শ দিই শোনো। এই মানিকখানা বিক্রি করে ফেলে টাকাটা নটরাজনের স্ত্রীকে দাওগে। তার জীবনটা একটু ভালোভাবে কাটবে। দেড় হাজার টাকা হাতে পেলে সে খুব খুশি হবে। তাদেরই জিনিস ধৰ্মত দেখতে গেলে, তোমার নিজের কাছে রাখা মানে চুরি করা।

কিন্তু বাবু, তাহলে হদিশ চলে গেল যে।

যাবে না। প্যারিস প্লাস্টারের ছাঁচে ওটা তুলে নিলেই চলে। ওই ছবিটার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক। মানিকখানা যার জিনিস, তাকে দাও ফিরিয়ে। তুমি যখন মা বলে ডাকো, তখন তার আশীর্বাদ তোমার বড়ো দরকার। মানিকখানা যদি বুড়ি বিক্রি করে, যে কিনবে সে ওর খোদাই ছবির কোনো মানে করতে পারবে না, তার কোনো কাজেই লাগবে না।

বেশ বাবুজি, আপনিই কাজটা করিয়ে দিন না?

কাল এটা সঙ্গে করে নিয়ে আমার সঙ্গে এখানে দেখা কোরো। আমার একটা জানাশুনো লোক আছে, সে এইসব কাজ করে–তাকে দিয়ে করিয়ে দেব।

রাত হয়ে গিয়েছিল। সুশীল মাঠ থেকে ফিরতে ফিরতে কত কথাই ভাবলে। তার মাথার মধ্যে যেন কেমন করছে। এ যেন আরব্য উপন্যাসের কাহিনির মতো অদ্ভুত! এমনভাবে গড়ের মাঠে বেড়াতে বেড়াতে একজন মুসলমান লশকরের সঙ্গে দেখা হবে– সে তাকে এমন একটি আজগুবি গল্প বলে যাবে–এ কখনো সে ভেবেছিল? গল্পটা আগাগোড়া গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিতেও পারত সে, যদি ওই চুনির সিলমোহরখানা সে না দেখত নিজের চোখে।

লোকটার গল্প যে সত্যি, তা ওই পাথরখানা থেকে বোঝা যাচ্ছে। সন তারিখ ও জায়গা মিলিয়ে এমনভাবে সে গল্প বলে গেল–যা অবিশ্বাস করা শক্ত। সুশীল ওকে শেষের দিকে। যে প্রশ্নটা করেছিল, অর্থাৎ কতদিন আগে বুড়ির সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়েছিল, সেটা শুধু সময় সম্বন্ধে তাকে জেরা করা মাত্র।

সুশীল বাড়ি গিয়ে সনৎকে বললে–এই কলকাতা শহরেই অনেক মজা ঘটে যায় দেখছি।

সনৎ বললে–কী দাদা?

সে একটা অদ্ভুত গল্প। যদি বলবার দরকার বুঝি তবে বলব—

পরদিন গড়ের মাঠে আবার সে নির্দিষ্ট জায়গাটিতে বসে রইল। একটু পরে জামাতুল্লা খালাসি এসে ওর পাশে নিঃশব্দে বসে পড়ল। বললে–আমার কথা ভাবলেন বাবুজি?

চলো আমার সঙ্গে। একটা ছাঁচ তোমাকে করিয়ে দিই। এনেছ ওটা?

হাঁ বাবুজি। দেখুন, আমি ভিক্ষে করে খাচ্ছি আজ দু-মাস, তবুও এত বড়ো দামি পাথরটা বিক্রি করিনি শুধু বড়ো একটা লাভের আশায়। কিন্তু যত দিন যাচ্চে, তত আমার মনে হচ্চে নসিব আমার খারাপ, নইলে সেই জায়গায় গিয়েও তো কিছু করতে–

জামাতুল্লা, তুমি লেখাপড়া-জানা লোক না হলেও খুব বুদ্ধি আছে। একা তুমি কিছু করতে পারবে না তা বেশ বোঝো। এ কাজে টাকা চাই, লোক চাই, জাহাজ চাই। অনেক টাকার খেলা সেসব। তোমার অত টাকা নেই। মিছে কেন নটরাজনের স্ত্রীর পাওনা জিনিস থেকে তাকে বঞ্চিত করবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *