৬. বজরার ছাদে

ভুজঙ্গ দেব বসে আছেন বজরার ছাদে। তিনি দীপেন্দ্রনারায়ণের সাথে দেখা করতে দীপেন্দ্রনারায়ণের শ্বশুরালয়ে এসেছেন বেশ কিছুদিন হলো। পিতার মৃত্যু সংবাদ পেতে দীপেন্দ্রনারায়ণের মাস পেরিয়ে গিয়েছিল। এখন ভুজঙ্গ দেবের নিকট বিস্তারিত শুনলেন। গুটিবসন্তের আক্রমণ থেকে শুরু করে দেবেন্দ্রনারায়ণের অসুস্থতা অবধি সকলই বললেন ভুজঙ্গ দেব। সবকিছু শুনেও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না দীপেন্দ্রনারায়ণ। বিষ্ণুনারায়ণের মৃত্যুর পর নতুন জমিদার হয়েছেন অবনীন্দ্রনারায়ণ, এই কথা শুনে অবশ্য খানিক মুচকি হাসলেন দীপেন্দ্রনারায়ণ। তবে কোনো মন্তব্য করলেন না।

সমুদ্রশহর বিনয়পুরের মহালের ঘটনায় ভুজঙ্গ দেব বীণাবালার উপর কিঞ্চিৎ অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি ধারণা করেছিলেন বিনয়পুরের ওই মহালখানি চাইলে বীণাবালা হৃষ্টচিত্তেই তা তাকে উপহার দিবেন। কারণ এই এতটা বছর বীণাবালার উদ্দেশ্য সাধনের সকল ষড়যন্ত্রেই তিনি নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু বীণাবালার এই অতি হিসেবী আচরণ এবং কঠিন কথাবার্তায় ভুজঙ্গ দেব আহত হয়েছেন।

আজ ভোরে দীপেন্দ্রনারায়ণ ভুজঙ্গ দেবকে নিয়ে নৌবিহারে বের হয়েছেন। এই নদীখানা গঙ্গাবতীর ন্যায় অমন বিশাল না হলেও বেশ স্রোতস্বিনী। নদীর দু’ধারে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। দীপেন্দ্রনারায়ণের চুলে আজও চুপচুপে তেল। তিনি সেই তেল মাখা চুলে হাত বোলাতে বোলাতে এসে ভুজঙ্গ দেবের পাশে বসলেন। তেলের গন্ধে চারধার ভরে উঠল। ভুজঙ্গ দেব হঠাৎ দীপেন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকিয়ে বললেন, তা ছোটবাবু, একখানা কথা, আপনি এই যে একদম জল ঢালার মতোন করে মাথার সকল চুল তেলে ডোবান। তা এর উপকারিতাখানা কী বলুন তো দেখি? কে যেন আমায় বলেছিল, এ নাকি নিদ্রা সুখকর। তা আজকাল আমারও নিদ্রাজনিত সমস্যা হচ্ছে খুব। মাখব নাকি খানিক, কী বলুন?

দীপেন্দ্রনারায়ণ হাসলেন। বললেন, এর সাথে নিদ্রার কোনো সম্পর্ক আছে কি না জানি না। এ আমার সেই বাল্যকালের অভ্যাস। আর ছাড়তে পারিনি। চুপচুপ করে মাথা তেলে না ডোবালে মনে হয় মাথা স্থির থাকে না। বুঝেছেন? সকলের বিষয় তো এক নয় ভুজঙ্গ বাবু।

ভুজঙ্গ দেব অবশ্য এ নিয়ে আর কথা বললেন না। তিনি সরাসরি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। তিনি বললেন, তা আপনার ইচ্ছেখানা এখন কী? বিষ্ণুপুরে কবে ফিরবেন?

দীপেন্দ্রনারায়ণ সামান্য হাসলেন। বললেন, ফিরব, সময় হলেই ফিরব।

ভুজঙ্গ দেব বললেন, বিষ্ণুপুরের সকলই তো শুনলেন। তা হিসেব-নিকেশ কি বুঝছেন এখন?

দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, বড় বউঠান বড় ঘরের মেয়ে। তিনি হিসেব নিকেশও বড়খানাই বোঝেন। মেজো বউঠান ছোটঘরের মেয়ে, তার হিসেব নিকেশ ছোট। বোঝাবুঝির তো কিছু নেই।

ভুজঙ্গ দেব দীপেন্দ্রনারায়ণের কথার কিছু বুঝলেন না। তিনি বললেন, তা ঠিক বলেছেন। অতবড় জমিদার বাড়ির মেয়ে বীণাবালা। তার বুদ্ধি বিচক্ষণতার সাথে অন্যের মিলবে কেন? এত বছর ধরে এত মানুষের সাথে মিশছি। বিদেশ বিভূঁইয়ে অবধি ব্যবসা-বাণিজ্য করে বেড়াচ্ছি। সেই আমিই কি-না বীণাবালার কাছে দুধের শিশু হয়ে আছি।

দীপেন্দ্রনারায়ণ আবারও মৃদু হাসলেন, বললেন, আপনারা কেউই দুধের শিশু নন। আপনাদের এই স্বার্থের খেলার মাঝে একমাত্র মেজদাই যা দুধের শিশু। আপনারা বাদবাকি সকলেই একেকজন তুখোড় খেলোয়াড়।

ভুজঙ্গ দেব এই কথায় খানিক থতমত খেয়ে গেলেন। দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, বড়দার মতোন স্বামী পেয়ে বীণাবালার ভালোই হয়েছে, কী বলেন? দীঘাগড়ের জমিদার বাড়ির মেয়ে এখন বিষ্ণুপুরের জমিদার! চমৎকার!

ভুজঙ্গ দেব যেন আবার উৎসাহ পেলেন। তিনি বললেন, সেইটেই হচ্ছে কথা ছোটবাবু। আপনার জ্যেষ্ঠভ্রাতা জমিদারি করার মানুষই নন। পুতুলনাচের মতোন আড়াল থেকে বিষ্ণুপুরের জমিদার এখন বীণাবালা। এ কেমন কথা বলুন দেখি? আপনাদের মতো তাজা রক্ত থাকতে কি-না বিষ্ণুপুরের জমিদারি চলে যাবে দীঘাগড়ের কোনো এক মেয়েছেলের ভোগে? এ কেমনতরো কথা হলো বলুন?

দীপেন্দ্রনারায়ণ খুব ধীরে ভুজঙ্গ দেবের দিকে ফিরলেন, তারপর শান্ত ও আত্মবিশ্বাসী গলায় বললেন, বড় বৌঠানের সাথে কী নিয়ে এমন লেগে গেল আপনার? স্বার্থে কোথাও টান পড়েছে?

ভুজঙ্গ দেব রীতিমতো ধাক্কা খেলেন। আজকাল আশেপাশের কিছুই যেন তিনি ধরতে পারেন না। এই দীপেন্দ্রনারায়ণ কি শান্তশিষ্ট বিনয়ী এক ছেলে। সে এই জমিদারির কোনোকিছুর মধ্যে কখনো নেই। কিছু ভাবে বা জানে বলেও কখনো মনে হয়নি। কিন্তু এই ক’দিনে তাকে অসংখ্যবার চমকে দিয়েছেন দীপেন্দ্রনারায়ণ। এ যেন একেবারেই অন্য এক মানুষ। যেন এতদিন নিজেকে আড়াল করে রেখে সব দেখেছেন, শুনেছেন, বুঝেছেন। এখন এসে আস্তে আস্তে তার সেই আড়াল থেকে বের হচ্ছেন। তবে এই দীপেন্দ্রনারায়ণ ভারি অদ্ভুত আর রহস্যময়তায় পূর্ণ। তিনি কী ভাবছেন, কী চাইছেন, কী করবেন তার কিছুই যেন বোঝার কোনো উপায় নেই।

ভুজঙ্গ দেব ঢোক গিলে বললেন, না না। কী নিয়ে লাগবে! আর তাছাড়া কারো সাথেই তো আমার সেরকম ভাব কখোনোই ছিল না। বিভূতিনাথ বাবুর সাথে ছোটখাট কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য আমার রয়েছে। সেই সূত্রেই বীণাবালার সাথে কথাবার্তা হতো।

একটু থেমে ভুজঙ্গ দেব এদিক-সেদিক তাকিয়ে এবার গলা নামিয়ে। বললেন, জানেনই তো, বীণাবালার সাথে বিভূতিনাথ বাবুর বড় দহরম-মহরম। বিষ্ণুপুরের জমিদারি না অন্য মানুষের ভোগে যায়। আমার আর কি! এইটুকুই আপনাকে যা বলার ছিল। আমরা সেই কয়েক পুরুষ ধরেই এই জমিদারির কল্যাণ কামনা করে আসছি। সে আপনার অজানা নয়।

দীপেন্দ্রনারায়ণ যেন এবার আরো রহস্যময় হয়ে উঠলেন। তিনি সেই একই রকম শান্ত গলায় বললেন, আরো অনেক কিছুই আমার অজানা নয় ভুজঙ্গ বাবু।

ভুজঙ্গ দেব মোলায়েম গলায় বললেন, আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ছোটবাবু।

দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, সকলকে সকল কিছু বুঝতে হবে এমন কোনো কথা কি রয়েছে? ছাড়ন, আপনি আমার শ্বশুরালয়ে বেড়াতে এসেছেন। এইসকল গুরুগম্ভীর আলোচনা থাকুক। আমরা এই বজরায় এক জায়গায় যাচ্ছি। বেড়াতে। আপনাকে কিছু দেখিয়ে নিয়ে আনি।

ভুজঙ্গ দেব বললেন, কী দেখাবেন?

দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, ঐ যে বললাম, আরো অনেক কিছুই আমার অজানা নয়। তার একটি আপনাকে দেখাবো।

ভুজঙ্গ দেব দীর্ঘক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন দীপেন্দ্রনারায়ণের দিকে। দীপেন্দ্রনারায়ণ গভীর মনোযোগে তামাক টানছেন। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ দূর-দিগন্তে। সেই দিগন্তে নিবিষ্ট দীপেন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকিয়ে ভুজঙ্গ দেবের হঠাৎ মনে হলো, এই মানুষটাকে সে এতদিন দেখেনি। সে কেন, কেউ দেখেনি। বিষ্ণুপুর জমিদারির পূর্বপুরুষের যে ধাত, তাদের রক্তের যে প্রবাহ তাতে অবনীন্দ্রনারায়ণ যেমন বেমানান, তেমনি বেমানান দেবেন্দ্রনারায়ণও। দেবেন্দ্রনারায়ণ ডাকাবুকো দাপুটে মানুষ হলেও পূর্বপুরুষের সেই সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিটি আর পাননি। এতদিন চোখের আড়ালে অবজ্ঞায় অবহেলায় পড়ে থাকা এই দীপেন্দ্রনারায়ণকে যেন এই মুহূর্তে হঠাৎ নতুন করে আবিষ্কার করলেন ভুজঙ্গ দেব। এই দীপেন্দ্রনারায়ণের ভেতর যেন তার পূর্বপুরুষের সকল বৈশিষ্ট্য ক্রমশই জেগে উঠছে যা তিনি অতি বিলম্বে অনুভব করতে পারলেন।

দুপুর নাগাদ তারা পৌঁছে গেলেন এক বিপজ্জনক জায়গায়। নদী যেন এখানে উন্মাদ হয়ে গেছে। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে বজরার গায়। বজরাখানা ছোট পানসির ন্যায় থরথর করে কাঁপছে। ভুজঙ্গ দেবও ভয়ে আঁৎকে উঠলেন। কিন্তু দীপেন্দ্রনারায়ণের সে দিকে কোনো খেয়াল নেই। তিনি তাকিয়ে রয়েছেন নদীর পাড়ে। ভুজঙ্গ দেব এতক্ষণ খেয়াল করেননি। এবার খেয়াল করলেন। নদীর যে পাড় ঘেঁষে তারা যাচ্ছেন, সে পাড়ে বড় বড় ঢেউগুলো দানবের মতোন আছড়ে পড়ছে। আর প্রতিবার ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে নদীর পাড়ের জমি। একেকবারে অনেকখানি করে জমি ভেঙে নিচ্ছে নদীর ঢেউ। ভুজঙ্গ দেব ভীত গলায় বললেন, ওহ ভগবান! এ তো দেখছি প্রলয় ঘটছে এখানে। এই প্রলয় দেখাতে আমায় নিয়ে এলেন ছোটবাবু?

দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, ভয়ের কী হলো ভুজঙ্গ বাবু। নদীর রীতি তো। এই-ই। এ-পাড় ভাঙে, ও-পাড় গড়ে। ও-পাড়ে তাকিয়ে দেখুন, কি স্থির সুন্দর দৃশ্য। আর এ-পাড়ে? যেন প্রলয়!

ভুজঙ্গ দেব হতচকিত গলায় বললেন, তাই তো দেখছি। ভগবান! রক্ষা করো।

দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, হ্যাঁ, এ-পাড়ে বহু বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে গেছে। ক্রোশের পর ক্রোশ ভাঙছে। এই নদী নাকি শেষ ভেঙেছিল বহু বছর আগে। তারপর এবার আবার ভাঙন শুরু হলো। বর্ষায় জল জমেছিল উপর দিকে, ওদিকে টানা ভারী বর্ষণ হয়েছিল এবার। সেই জল নামতে গিয়েই শুরু হলো এই রাক্ষুসি নদীর ভাঙন। চলুন, বজরা থেকে নেমে খানিকটা হেঁটে ভেতরের দিকে যাই। নদীভাঙনের শিকার বহু মানুষ ওদিকে আশ্রয় নিয়েছে। দেখবেন, কী হতশ্রী অবস্থায়ই না তারা বেঁচে আছে।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভুজঙ্গ দেব নামলেন। নামার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলেন বজরা থেকে কয়েকজন মাঝি-মল্লা আর ভৃত্যও নেমে আসল। তাদের সকলের হাতেই। বড়বড় কাপড়ের পুঁটলি। ভুজঙ্গ দেবের কৌতূহলী দৃষ্টি দেখে দীপেন্দ্রনারায়ণ নিজ থেকেই বললেন, দুর্গত মানুষের জন্য কিছু খাবার আর কাপড় এনেছিলাম ভুজঙ্গ বাবু। ভারি উপকার হবে ওদের।

ভুজঙ্গ দেব অবাক হলেও কিছু বললেন না। দুর্গতদের অবস্থা আসলেই করুণ। এই বিশাল এলাকার যিনি জমিদার, তিনি এ অঞ্চলে থাকেন না। তার নায়েব বছর বছর এসে খাজনা নিয়ে যায়। কিন্তু প্রজাদের এমন দুর্যোগে তাদের পাশে দাঁড়াবার কেউ থাকে না। খাদ্য আর কাপড় বিতরণ করতে গিয়ে রীতিমত তুলকালাম লেগে গেল। সকলেই সকলের আগে চায়। তুমুল বিশৃঙ্খলা। দীপেন্দ্রনারায়ণ শেষ পর্যন্ত মাঝি আর ভৃত্যদের হাতে বিতরণের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সরে এলেন। কাছেই একখানা বিশাল অশত্থ বৃক্ষ। সেই বৃক্ষের নিচে কয়েকজন মলিন চেহারার মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। বিষয়টি দীপেন্দ্রনারায়ণকে খানিক অবাক করল। এই আকালের দিনে এমন কাপড় আর খাবারের লোভ অগ্রাহ্য করে ওখানে কী করছে ওরা?

কৌতূহলবশতই দীপেন্দ্রনারায়ণ ভুজঙ্গ দেবকে নিয়ে অশথবৃক্ষের দিকে এগোলেন। সেখানে বৃক্ষের তলায় এক সাধু বসে আছেন। সাধুর ঊর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ নগ্ন হলেও নিম্নাঙ্গে গেরুয়া বসন। গলায় বিচিত্ররকমের রুদ্রাক্ষের মালা। দীপেন্দ্রনারায়ণ ছোটখাট জটলার ভেতর ঢুকে দাঁড়ালেন। একজন একজন করে লোক সাধুকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। সাধু সেই হাত ধরেই রাখছেন, কিছু বলছেন না। কয়েকজন এভাবে চলে যাবার পর এক ছিপছিপে গড়নের কালো লোক হঠাৎ সাধুর পা জড়িয়ে ধরে উপর হয়ে শুয়ে পড়ল। সাধু নিশ্চল। নড়লেন না, বা কিছু বললেনও না। লোকটি এবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল, বাবা, এই রাক্ষুসি নদী আমার সব কেড়ে নিল, সব। আমার ঘর, গৃহস্থালী, পাকা ধানের জমি, আমার স্ত্রীর গর্ভে আটমাসের সন্তান ছিল, তাও নিল। আপনি আমায় সব ফিরিয়ে দিন। আপনি সাক্ষাৎ ভগবান। আপনি সব পারেন, আমায় ফিরিয়ে দিন। না দিলে এই এখান থেকে আমি আর উঠব না। মরে গেলেও না।

সাধুর সাথে গেরুয়া বসন পরিহিত আরও দু’জন রয়েছেন। তারা ছুটে এলেন লোকটিকে সরিয়ে নিতে। কিন্তু সাধু হাত তুলে বাধা দিলেন। তারপর যেমন চুপ করে ছিলেন, তেমনই বসে রইলেন। দীর্ঘসময় বাদে সাধুর ঠোঁট নড়ল। তিনি ভরাট গলায় সুর করে গীতা থেকে সংস্কৃত শ্লোক আওড়ালেন, না জায়তে মিয়তে বা কদাচিৎ, নায়ং ভূত্ত্বাভবিতা বা ন ভূয়ঃ, অজো নিত্যঃ শ্বাশতোহয়ং পুরাণো, ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।

শ্লোকখানি বলা শেষে সাধু কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। লোকটি তখনও উঠেনি। সাধু এবার খুব শান্ত সমাহিত কণ্ঠে বললেন, ওহে, জানিস না, পবিত্র আত্মার ধ্বংস নেই। আত্মা শ্বাশত। তার আবার মৃত্যু কী রে!”

লোকটি তাও উঠল না। সেই একইভাবে শুয়ে রইল। সাধু আবারো চোখ বন্ধ করে ধ্যানমগ্ন হয়ে রইলেন। দীর্ঘসময়। দীপেন্দ্রনারায়ণের কী হলো, তিনিও দাঁড়িয়ে রইলেন। সাধু হঠাৎ চোখ মেলে সোজা দীপেন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকালেন। তারপর বাজখাই গলায় ডাকলেন, এই, তুই এইদিকে আয়।

দীপেন্দ্রনারায়ণ হকচকিয়ে গেলেও ধীর পায়ে সাধুর সামনে গেলেন। সাধু গম্ভীর গলায় বললেন, কোথাকার জমিদার?

দীপেন্দ্রনারায়ণ থতমত খেয়ে গেলেন। তিনি বললেন, আজ্ঞে গুরুজী, আমি জমিদার নই।

সাধু বললেন, তা জমিদার হবার শখ জেগেছে মনে?

পেছনে দাঁড়িয়ে ভুজঙ্গ দেব এতক্ষণ ভারি বিরক্ত হচ্ছিলেন। এবার যেন খানিক আগ্রহ পেলেন। তিনি গলা বাড়িয়ে সাধু আর দীপেন্দ্রনারায়ণকে এবার ভালোভাবে লক্ষ করতে লাগলেন। দীপেন্দ্রনারায়ণ বিব্রত গলায় বললেন, কী যে বলছেন গুরুজী!

সাধু বললেন, জগতের সকলে ভান ধরে থাকে। ভানের আড়ালের চেহারাখানি বোঝা খুব শক্ত। তবে সাধনা করলে সকলই চেনা যায়। পরমেশ্বরকে যেমন, তেমনি অসুরকেও।

দীপেন্দ্রনারায়ণের হঠাৎ মনে হলো, এর কাছে আর কিছু লুকিয়ে কোনো লাভ নেই। তিনি বললেন, আজ্ঞে…।

সাধু বললেন, কোনো লাভ নেই। ভেবেছিলি নদীভাঙনে এই মহালের দাম পড়ে যাবে? আর জমিদারের কাছ থেকে সস্তায় কিনে নিবি? তার আগে প্রজাদের লোভে বশ করতে এসেছিস? শোন, প্রলয় আসছে। এই জল প্রলয় নিয়ে এসেছে। মনে রাখিস, এখানে তো প্রলয় হচ্ছে, কিন্তু মহাপ্রলয় অপেক্ষা করছে। বহু বছর পর নদীতে আবার অসুর নেমেছে। সাক্ষাৎ দানব। দানব এসেছে।

দীপেন্দ্রনারায়ণ কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই সাধু হাত নেড়ে বললেন, সোনা-দানা, পয়সা-কড়ি যা আছে, তা সিন্ধুকে ভরে যত পারিস দূরে সরে যা। পার্থিব জীবনের জন্য যখন বাচছিস, তখন পার্থিবটাই ধরে রাখ।

সাধু আবার চক্ষু মুদলেন। দীপেন্দ্রনারায়ণ কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু তার আগেই সাধু হাত নেড়ে চলে যাওয়ার ইশারা করলেন। দীপেন্দ্রনারায়ণ আর কথা বাড়ালেন না। সাধুর কথা শুনে তার ভীত বা চিন্তিত হবার কথা ছিল। কিন্তু তিনি কিছুই হলেন না। বরং ধীর পায়ে বজরায় ফিরলেন। তার মুখে লেগে রয়েছে রহস্যময় এক হাসি।

ভুজঙ্গ দেব অবশ্য ভয় পেয়েছেন। তবে সাথে খানিকটা আনন্দও পেয়েছেন। তিনি সাধু-সন্ন্যাসী খুব বিশ্বাস করেন। তার আনন্দের কারণ দীপেন্দ্রনারায়ণ। তার ধারণা, দীপেন্দ্রনারায়ণ নিশ্চয়ই এবার অতি দ্রুতই গঙ্গামহল ফিরবেন। এবং এটি তো এখন স্পষ্ট যে জমিদারির ইচ্ছেটা দীপেন্দ্রনারায়ণের ভেতর প্রবলভাবেই রয়েছে। হয়তো বিষ্ণুপুরের জমিদারির দখল নিয়ে বীণাবালা আর দেবেন্দ্রনারায়ণের ওই ভয়াবহ লড়াইয়ের ভেতর তিনি আর জড়াতে চাননি। আর তাই বিষ্ণুপুরের জমিদারিতে না গিয়ে নিজেই আলাদা মহাল কিনতে চাইছিলেন। কিন্তু ইচ্ছে থাকলে তো বিষ্ণুপুরেই একটা উপায় হয়ে যেত। এখনও সম্ভব। তাছাড়া, নিজের বাপ-দাদার ভিটে-জমিদারি ছেড়ে অন্য কোথাও কেন? ভুজঙ্গ দেব এই ক’দিনে দীপেন্দ্রনারায়ণকে যতটুকু দেখেছেন, তাতে ভেবেচিন্তে কাজ না করার মানুষ দীপেন্দ্রনারায়ণ নন। তাহলে তার চিন্তাখানা আসলে কী? ভুজঙ্গ দেব অনেক ভেবেও কোনো কূল করতে পারল না। শেষে ভাবলেন, যাই হোক, যেহেতু দীপেন্দ্রনারায়ণের জমিদারি সংক্রান্ত উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তখন আর অন্য কোথাও না, তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বিষ্ণুপুরেই। বীণাবালার বিরুদ্ধে একটি শক্ত খেলাই খেলতে হবে। আর সে খেলায় দীপেন্দ্রনারায়ণ যদি হন তুরুপের তাস, তাহলে আর চিন্তা কী! লড়াই হবে সেয়ানে-সেয়ানে, সে বিষয়ে ভুজঙ্গ দেব এখন নিশ্চিত।

*

দীঘাগড় জমিদার বাড়িতে দ্বিজেন্দ্রর সামনে বসে আছে দাসী কমলা। কমলা বহুবছর পর দীঘাগড় জমিদার বাড়িতে এসেছে। এ বাড়িতে তার শৈশব কৈশোর, যৌবনের সময় কেটেছে। তারপর বীণাবালার সাথে পাড়ি দিতে হয়েছে বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়ি গঙ্গামহলে। সেই থেকে সে বিষ্ণুপুরেই। তার স্বামীও কাজ করত দীঘাগড়ের এই জমিদার বাড়িতেই। কিন্তু চুরি করে ধরা পড়ায় সেই কাজটা সে হারিয়েছিল। শুধু কাজই নয়, জীবন হারানোরও উপক্রম হয়েছিল। কমলা দাসীর অনুরোধে তাকে রক্ষা করেছিলেন বিষ্ণুনারায়ণ। তবে সেই থেকে দীঘাগড় জমিদার বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষা নিষেধ ছিল কমলা দাসী আর তার স্বামী-সন্তানদের। এবার সে এসেছে বিশেষ কারণে। তাকে পাঠিয়েছেন বীণাবালা স্বয়ং। সাথে এসেছেন বিভূতিনাথ সাহা।

অন্যদিকে বিভূতিনাথ সাহার সাথে বীণাবালার সম্পর্কটি বিষ্ণুপুরে সেভাবে প্রকাশিত নয়, যতটা প্রকাশিত বিষ্ণুপুর জমিদারির সাথে বিভূতিনাথের সম্পর্ক। সকলেই জানে, বিভূতিনাথ সাহারা বংশানুক্রমে সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবার। বিষ্ণুপুরে তাদের কয়েক পুরুষের পারিবারিক বসবাস। বিষ্ণুপুর জমিদারির সাথে বিভূতিনাথদের পারিবারিক সম্পর্কও বংশ পরম্পরায়।

এই অবধি সকলেই জানলেও বেশিরভাগ মানুষই যা জানে না তা হলো, বিভূতিনাথের মাতুলালয় হচ্ছে দীঘাগড়। সেইসূত্রে বিভূতিনাথের শৈশব কৈশোর, যৌবনের বেশির ভাগ সময়ই তিনি কাটিয়েছেন দীঘাগড়ের মাতুলালয়েই। তার মায়ের পরিবার দীঘাগড়ের অতি প্রভাবশালী পরিবার, সে কারণেই দীঘাগড় জমিদারবাড়ির সাথে একটা উষ্ণ সম্পর্ক তাদের সবসময়ই ছিল। যার সূত্র ধরেই দীঘাগড় জমিদার বাড়িতে ছোটবেলা থেকেই বিভূতিনাথের যাতায়াত। ফলে বীণাবালার থেকে বয়সে বছর দশেকের বড় হলেও বীণাবালার সাথে বিভূতিনাথের জানাশোনা বহু আগে থেকেই।

বীণাবালার বিয়ের পর বীণাবালা যখন বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়ি গঙ্গামহলে গেলেন, তখন বিভূতিনাথের সাথে তার নতুন করে পরিচয়। এই নতুন পরিচয়ের সূত্র বিভূতিনাথ সাহার সাথে বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়ির সম্পর্ক। বীণাবালা তখন বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়ির জ্যেষ্ঠ পুত্রবধু। সুতরাং বিষ্ণুপুরের গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং শুভাকাক্ষী হিসেবেই বিভূতিনাথ সাহার সাথে বীণাবালার এই নতুন পরিচয়। বিভূতিনাথের সাথে বীণাবালার এই নতুন পরিচয়টিই সকলের কাছে প্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত। তবে দীঘাগড়ে তাদের পূর্বপরিচয়ের উৎসটি রয়ে গেল সকলের অজ্ঞাতেই।

.

দীঘাগড় জমিদার বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরেই অবাঞ্চিত কমলা দাসীকে নিয়ে এসেছেন বিভূতিনাথ সাহা স্বয়ং। সুতরাং এ নিয়ে কেউ আর কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। বিভূতিনাথ সাহার সাথে দ্বিজেন্দ্রর আচরণ খানিকটা শীতল। তাদের মধ্যে অপ্রয়োজনে খুব একটা কথাবার্তাও হয় না। বীণাবালার ধারণা দ্বিজেন্দ্র কোনো কারণে বিভূতিনাথকে পছন্দ করে না। যদিও দ্বিজেন্দ্র নিজে এ কথা কখনো মুখ ফুটে স্বীকার করেনি। সতর্ক বীণাবালা তবুও বিভূতিনাথ সাহার সঙ্গে কমলা দাসীকেও পাঠিয়েছেন। যাতে পুরো ঘটনা দ্বিজেন্দ্রকে বিশ্বাসযোগ্যরূপে বিস্তারিত জানানো যায়।

.

দাসী কমলা দ্বিজেন্দ্রকে তার পিতা অবনীন্দ্রনারায়ণের গৃহত্যাগের পুরো ঘটনা বিস্তারিত বলল। দ্বিজেন্দ্র চুপ করে শুনলেও এ বিষয়ে তার আগ্রহ আছে। বলে মনে হলো না। সে বারবার কমলা দাসীকে একটিই প্রশ্ন করছে।

দ্বিজেন্দ্র তৃতীয়বারের মতো কমলাকে জিজ্ঞেস করল, গঙ্গামহলের সকলেই ভালো আছে?

কমলা দাসী বলল, সকলেই ভালো আছে। সে কথা আর কতবার বলব? শুধু আপনার বাবাই যা বাড়িতে নেই। এ বিষয়ে আপনাকে বাকি কথা বলবেন বিভূতিনাথ বাবু।

দ্বিজেন্দ্র বলল, তুমি বুঝছ না আমার কথা, বাড়িতে কারোরই কিছুই হয়নি? সকলেই ভালো আছে?

কমলা দাসী মনে মনে ভারি বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ করল না। বলল, কার কী হবে? হা, ব্রজগোপালের পা কেটে গিয়েছিল। সে মাছ কাটতে গিয়ে পা কেটে ফেলেছে। বুঝুন কী কাণ্ড! মাছ কাটতে গিয়ে কেউ পা কেটে ফেলে! হা হা হা।

দ্বিজেন্দ্র’র সাথে কমলা দাসীর সম্পর্ক অনেকটাই সহজ। ছোটবেলা থেকেই দ্বিজেন্দ্র দেখেছে তার মায়ের সকল প্রয়োজনে কমলা সবসময় সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও প্রয়োজনীয় নাম। সে এবার বলল, সর্বজয়াদের মহলে সকলে ভালো আছে?

কমলা এবার বিরক্তিটা প্রকাশ করেই ফেলল। সে বলল, আপনার কী হয়েছে বলুন তো দেখি! সেই থেকে এক এক করে বাড়ির সকলের খবর নিচ্ছেন! এদিকে নিজের বাপটা যে ঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশ হলো, তার তো কিছু জিজ্ঞেস করলেন না!

কমলার কথায় দ্বিজেন্দ্র যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। সে বলল, না, গত ক’রাত থেকে উল্টাপাল্টা নানান স্বপ্ন দেখছি কি-না। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।

কমলা উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, কী স্বপ্ন?

দ্বিজেন্দ্র খানিক দ্বিধাজড়িত গলায় বলল, দেখলাম সর্বজয়াদের মহলে আগুন লেগেছে। আগুনে সকল কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তাই জানতে চাইছিলাম ওরা কেমন আছে?

কমলা এবার হাসল। হাসতে হাসতে বলল, ও মহলে আগুন তো লেগেছেই। শুনলেনই তো, দেবেন্দ্রনারায়ণ ল্যাংড়া হয়েছে। হাঁটতে চলতে পারে না। কই, তার সেই তেজ কই, আঁ? একদম গলে যেন জল হয়েছে। আপনার মায়ের সাথে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। তা কারো সাথেই কোনো কথা বলল না।

দ্বিজেন্দ্র বলল, সর্বজয়া? অনেক কাঁদল বাবার জন্য?

কমলা বলল, কই? ভালো কথা বলেছেন তো! ওই ছুড়িকে তো আর দেখলাম না! কী তেজ গো বাবা। একদম বাপের গুণ সব পেয়েছে। আপনার সাথে সেদিন কী বিচ্ছিরি কাণ্ডটাই না করল। কই, তারপর তো আর তাকে। দেখলাম না। সেদিন যে মহলে গেলাম, তাও তো দেখলাম না।

দ্বিজেন্দ্র এবার সত্যিকারের গোলকধাঁধায় পড়ে গেল। সে রাতে মধু তাকে বলল যে সে সর্বজয়াকে ধর্ষণ করতে গিয়ে খুন করে ফেলেছে। কিন্তু কমলা তো তার কিছু বলছে না! একটি জলজ্যান্ত মানুষ মরে গেল অথচ গঙ্গামহলে থেকেও কমলা জানল না, সে কী করে হয়! দ্বিজেন্দ্র অনেক ভেবেও কোনো কূল-কিনারা করতে পারল না। মাতাল মধু মদের ঘঘারে ভুল বকেনি তো! দ্বিজেন্দ্র ভেবেছিল এই ঘটনার রেশ না কাটা অবধি সে গঙ্গামহলে ফিরবে না। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে, যত দ্রুতসম্ভব গঙ্গামহলে গিয়ে তার নিজ চোখে ঘটনা দেখা দরকার। সেই রাতেই বিভূতিনাথ সাহা দ্বিজেন্দ্র’র সাথে বসতে চাইলেন। অবনীন্দ্রনারায়ণের গৃহত্যাগের ফলে বিষ্ণুপুরের জমিদারির উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে যে নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে এবং তাতে দ্বিজেন্দ্র’র ভূমিকা যে এখন সবচেয়ে গুরুতুপূর্ণ সেটিও তিনি বলতে চাইলেন। কিন্তু দ্বিজেন্দ্র তার কথা বেশিক্ষণ শুনল না। সে আচমকা উঠে গিয়ে বলল, কাল ভোরে গঙ্গামহলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে চাই। বজরা প্রস্তুত রাখতে বলুন।

বিভূতিনাথ সাহা কিছুই বুঝলেন না। ছেলেটিকে তিনি আপাতদৃষ্টিতে খুবই শান্ত সহজ সরল দেখেছেন। কিন্তু এর মাঝেই কোথায় যেন কী লুকিয়ে আছে, যা হুট করে ধরা যায় না।

বীণাবালা দ্বিজেন্দ্রর অপেক্ষায় অস্থির হয়ে আছেন। কখন আসবে তারা? তিনি জানেন, বজরাযোগে দীঘাগড় যেতে এবং আসতে যতটা সময় দরকার, তার চেয়ে বেশি বিলম্ব হচ্ছে না। দিন তিনেক আগে কেবল গঙ্গামহল থেকে দীঘাগড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন তারা। তারপরও বীণাবালা স্থির হতে পারছিলেন না। এর মধ্যে অবশ্য কিছু কাজ নিয়ে তিনি বসেছিলেন। নায়েব গোপীনাথ সরকারকে একদিন ডাকলেন বীণাবালা। তারপর হিসেব-নিকেশের খাতা খুলে নিয়ে বসতে বললেন। গোপীনাথ সরকার দিন দুই সময় চাইলেন। এ বড় বিড়ম্বনার কাজ। কতকিছু গুছিয়ে নিয়ে বসতে হবে। দিন দুই বাদে গোপীনাথ সরকার জমিদারির খাজনাপাতি থেকে শুরু করে সিন্দুকে রাখা নগদ পয়সা, স্বর্ণালঙ্কারের হিসেব-নিকেশ নিয়ে বসলেন। কিন্তু হিসেব-নিকেশের মাঝখানে বীণাবালা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। গোপীনাথ সরকার নানান কিছু বোঝাচ্ছেন। কিন্তু বীণাবালার সেদিকে আর খেয়াল নেই। তিনি হঠাৎ বললেন, এক কাজ করুন নায়েব মশাই, আগে চলুন দেখে আসি ক’খানা সিন্দুক রয়েছে গঙ্গামহলে?

গোপীনাথ সরকার এই কথায় খানিক ভড়কে গেলেন। তার মুখ শুকিয়ে আসলো। তবে সে গেল। বীণাবালা গেল তার পিছু পিছু। বিষ্ণুনারায়ণের মহলের নিচতলার সর্ব পুবের ঘরের মেঝেতে গিয়ে দাঁড়াল তারা। গোপীনাথ সরকার কাঁপাকাঁপা হাতে লণ্ঠন জ্বালল। তারপর মেঝের বা দিকের কোণ ঘেঁষে রাখা কাঠের বাক্সখানা ঠেলে সরাল। বাক্সের নিচে একখানা বিশাল সুড়ঙ্গ। সেই সুড়ঙ্গের নিচ অবধি একখানা লোহার সরু সিঁড়ি বয়ে গেছে। গোপীনাথ সরকার সেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। বীণাবালা অবাক হয়ে গেছেন। তিনি এতবছর এ বাড়িতে আছেন, এতকিছু জানেন, অথচ গঙ্গামহলের সোনা-দানা, পয়সা-কড়ি কোথায় থাকে, তা তিনি জানেন না। এমনকি এই এতদিন তার মাথায়ও আসেনি। কী অদ্ভুত বিষয়! নিজের উপর ভারি বিরক্ত হলেন বীণাবালা। তবে এই মুহূর্তে এই সুড়ঙ্গের সরু সিঁড়ি বেয়ে নিচের ঘরে নামতে খুব ভয় হচ্ছে। তার। কিন্তু বীণাবালা নামলেন। এই না জানাকে আর প্রশ্রয় দেয়ার কোনো অর্থ হয় না। গোপীনাথ সরকারের হাতের লণ্ঠনের আলোয় সুড়ঙ্গের নিচের ঘরখানা কিছুটা আলোকিত হয়েছে। তবে তাতে ঘরখানাকে কেমন ভৌতিক আর অশরীরি লাগছে। বীণাবালা চেষ্টা করছেন নিঃশব্দে পা ফেলার, কিন্তু তাতেও যে মৃদু শব্দে হচ্ছে, সেই শব্দ চারপাশের দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে। মাটির নিচে এত বড় ঘর ভাবনারও অতীত ছিল বীণাবালার। সেই ঘরের দু’পাশের দেয়াল ঘেঁষে প্রকাণ্ড চারখানা লোহার সিন্দুক। বীণাবালা হেঁটে গিয়ে একখানা সিন্দুকের গায়ে হাত রাখলেন। নিজের অজান্তেই যেন শিরদাঁড়া বেয়ে হিম শীতল স্রোত বয়ে গেল। কী ঠাণ্ডা! যেন মৃত মানুষের শরীর।

গোপীনাথ সরকার যথাসম্ভব গলা নামিয়ে বললেন, এইখানে এই চারখানা সিন্দুক রয়েছে। তিনখানাতে রয়েছে সোনা দানা, স্বর্ণালঙ্কার। আর একখানাতে নগদ পয়সা। বীণাবালা মনে মনে আনন্দিত হলেন। এই প্রকাণ্ড সিন্দুকগুলোতে যে কী পরিমাণ স্বর্ণালঙ্কার রয়েছে, ভাবতেই তার বুকের ভেতর ফুরফুরে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। তিনি প্রজাপতির মতোন ঘুরে ঘুরে প্রতিটি সিন্দুক দেখলেন। হাতের স্পর্শে ছুঁয়ে দেখলেন। আজ তার ভারি আনন্দ হচ্ছে। ভীষণ আনন্দ। মনে হচ্ছে এই এতদিনের এত ষড়যন্ত্র, এত পরিকল্পনা, পরিশ্রম সকলই যেন আজ সার্থক হয়েছে। চোখের সামনে তার প্রমাণ জ্বলজ্বল করছে। তিনি হঠাৎ গোপীনাথ সরকারকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, এই সকল কিছুর চাবি আপনার কাছেই থাকে?

গোপীনাথ সরকার বললেন, আজ্ঞে। এখন আমার কাছেই রয়েছে। তার আগে জমিদার কর্তার কাছেই থাকত। খুব জরুরি কিছু না হলে এই চাবি তিনি আর কাউকেই দিতেন না। তবে মাঝে-মধ্যেই আমায় চাবি দিয়ে বলতেন, ঘরখানা পরিষ্কার করে রাখো। শুধু আমায়ই এই ভার দিতেন। আর কাউকে নয়। তার মৃত্যুর পর থেকে চাবিগুলো আমার কাছেই রয়েছে।

বীণাবালা বললেন, আপনায় এত বিশ্বাস করার কারণ কী?

গোপীনাথ সরকার অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। তারপর হঠাৎ কী হলো, তার চোখ ছলছল করে উঠল। সে ভাঙা গলায় বলল, মা জননী, আমরা এই গঙ্গামহলের নুন খেয়ে বড় হয়েছি। আমার বাপ, তার বাপ, তারও বাপ। এ বাড়িতেই। এ বাড়ি আমাদের কাছে মন্দিরের চেয়ে কম কিছু নয়। এ কথা সকলেই জানেন। জমিদার কর্তারাও জানতেন।

বীণাবালা এ বিষয়ে আর কথা বললেন না। তবে একখানা সিন্দুকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি গম্ভীর গলায় গোপীনাথ সরকারকে বললেন, তা নায়েব মশাই, এই সিন্দুকখানা খুলুন তো!

বীণাবালার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই গোপীনাথ সরকার যেন সামান্য কেঁপে উঠলেন। তিনি জায়গা থেকে নড়লেন না। বীণাবালা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বললেন, কী ব্যাপার নায়েব মশাই? দ্রুত করুন। এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

গোপীনাথ সরকার খুব ধীরে কম্পিত পায়ে এসে সিন্দুকের সামনে দাঁড়াল। তারপর অনেক সময় নিয়ে কাঁপাচঁপা হাতে চাবি ঘোরালেন। তারপর সিন্দুকের ভারী ডালাখানা দুহাতে ধরে টান দিলেন। বীণাবালা প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন। উত্তেজনায় তার দমবন্ধ হয়ে আসছে। গোপীনাথ সরকার ডালাখানা সরালেন। বীণাবালা সিন্দুকের ভেতরে হতভম্ব দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলেন। সিন্দুক শূন্য!

এই বিশাল সিন্দুকজুড়ে সামান্য এক টুকরো স্বর্ণের কণাও কোথাও নেই। কোথাও না!

.

বীণাবালা মুহূর্তেই যেন গোখরো সাপের ন্যায় ফণা তুলে উঠে দাঁড়ালেন, গোপীনাথ বাবু! নায়েব মশাই!

গোপীনাথ সরকার এবার আর ভয়ে নুজ হলো না। কাঁপলোও না। তবে নিশ্চল বসে রইল। ভাবলেশহীন মুখ। বীণাবালা চারপাশের দেয়ালে লোমহর্ষক প্রতিধ্বনি তুলে বললেন, এই আপনার মন্দির! এই আপনার বিশ্বস্ততা! আপনার মতোন জঘন্য লোভী বিশ্বাসঘাতককে…!

বীণাবালা প্রবল রাগে, ক্রোধে তার কথা শেষ করতে পারলেন না। তিনি ধপ করে গোপীনাথ সরকারের পাশে বসে পড়লেন। তারপর হিসহিস করে বললেন, সবগুলো? সবগুলো থেকেই সরিয়েছেন? নাকি শুধু এই একটিই? আপনার বুদ্ধি ভালো। কী ভেবেছিলেন? ভেবেছিলেন এখন গঙ্গামহলের সকল কিছু এলোমেলো। কেউ জানবে না, বুঝবে না। সময়মতো সিন্দুকখানাও সরিয়ে ফেললেই হলো… কারো কাছে খবরও থাকবে না, ক’খানা সিন্দুক! কতটুকু কী! তাই তো?

গোপীনাথ সরকার মাথা নিচু করে বসে রইল। কোনো কথা বলল না। বীণাবালা হঠাৎ ভয়ানক গলায় বললেন, এত বড় বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি কী। হবে গোপীনাথ বাবু? আপনিই বলুন, আপনার শাস্তি কী হবে?

গোপীনাথ সরকার এবার মাথা তুললেন, তারপর বললেন, আমি কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। গোপীনাথ সরকার বিশ্বাঘাতক নয়।

গোপীনাথ সরকারের দৃঢ়, নিষ্কম্প কণ্ঠ শুনে বীণাবালা খানিক থমকে গেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই কিছু বললেন না। তবে আগের মতোই অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন গোপীনাথ সরকারের দিকে। গোপীনাথ সরকার বীণাবালার চোখে চোখ রেখেই বলল, এই শূন্য সিন্দুকখানার কথা জমিদার কর্তাও জানতেন। আমি সেই জন্যই আপনাকে নিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছিলাম। আমি জানতাম, এই সিন্দুকখানা খালি দেখলে সবার আগে আপনার আমাকেই চোর মনে হবে। কিন্তু গোপীনাথ সরকার চোর নয়।

গোপীনাথ সরকারের চোখ এবার ছলছল করে উঠল। কিন্তু বীণাবালা তাতে বিন্দুমাত্র কোমল হলেন না। তিনি বললেন, আমায় মিথ্যে বলবেন না। আমায় ঠকালে বা ঠকানোর চেষ্টা করলে আমি কী করতে পারি, আশা করি তা আপনার অজানা নয়। আমার নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই?

গোপীনাথ সরকার সেই একই নিষ্কম্প কণ্ঠে বললেন, আপনার নিষ্ঠুরতা দিয়ে আপনি আমায় মিথ্যেবাদী বানাতে পারবেন না বড় বৌ। এই গঙ্গামহলের কত শত গোপন কথা এই বুকের ভেতর চেপে রেখেছি বছরের পর বছর, সে কেবল আমি জানি। আমাদের এই ভয়টাই থাকে। সকলই নীরবে সয়ে যাব। চোখ-কান খোলা রেখে, মুখ বুজে দেখে যাব। শেষ অবধি গিয়ে আমরাই কাঠগড়ায় দাঁড়াবো। তবুও ওই বিশ্বাসাতকতাটুকু আসে না। ওটুকু আসলে আর এই বাদবাকি সকল কিছু করতে হতো না। আমায় ভয় দেখাবেন না। আমরা কৃতজ্ঞ মানুষ, ভীত নই।

বীণাবালা এবার পুরোপুরি থমকে গেলেন। তিনি এই গোপীনাথ সরকারকে যেন চেনেন না। এ যেন অচেনা এক মানুষ। বীণাবালা তবুও কঠিন গলায়ই বললেন, আপনার সকল কথাই বুঝলাম। কিন্তু আপনিই বলুন, এই সিন্দুকখানা ফাঁকা কেন? কেউ তো নিশ্চয়ই সরিয়েছে, না হলে সিন্দুকের শরীর তো আর তার ভেতরের সোনাদানা খেয়ে ফেলেনি!

.

গোপীনাথ সরকার জবাব দিলো না। গম্ভীর হয়ে বসে রইল। তারপর মুখ তুলেই ধীর-স্থির কণ্ঠে বলল, যতদিন জমিদার কর্তা বেঁচেছিলেন, ততদিন এই সকল কিছুই তিনি জানতেন। তার অগোচরে কখনো কিছু রাখিনি। জমিদার কর্তার মৃত্যুর পর কার কাছে কী বলব, সে নিয়ে বিস্তর সংশয় ছিল। কিন্তু এ তো আর এমন অন্ধকারে ফেলে রাখার বিষয় নয়। কাউকে না কাউকে তো বলতেই হবে। আজ যখন আপনি জানতেই চাইলেন, তবে শুনুন। এখানে। কেবল এই চারখানা সিন্দুকই নয়, এমন আরো একখানা সিন্দুক ছিল। কিন্তু মেজোকর্তা দেবেন্দ্রনারায়ণ যখন বারোহাটি বাগান বাড়ি করেন, তখন সেই সিন্দুকখানা ভেঙেই বাগানবাড়ির খরচ চালানো হয়। আপনি জানেন, জমিদার কর্তা মেজোকর্তার কথার উপর কোনো কথা বলতেন না। মেজোকৰ্তাই যা ইচ্ছে করতেন। তো বারোহাটি বাগানবাড়ি হবার পরে এক গভীর রাতে মেজোকর্তা আমায় ডাকলেন। তিনি তখন মদের ঘোরে। আমায় বললেন, সেই অর্ধেক ফাঁকা সিন্দুকখানাও তিনি বারোহাটির বাগান বাড়িতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু বাগানবাড়ি হবার পরে মেজোকর্তার আরো এক অদ্ভুত খেয়াল চাপল। তিনি বললেন, বাগানবাড়িতে যে বাঈজী-নর্তকীই আসুক, তাদের পারিশ্রমিক বাদেও যেন প্রত্যেককেই অতিরিক্ত উপহার হিসেবে স্বর্ণালঙ্কার দেয়া হয়। তিনি বললেন, ও বাড়ি দেবেন্দ্রনারায়ণের বাগানবাড়ি। কিন্তু বাড়ি নির্মাণে তার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এখন তিনি চান, দান-দাক্ষিণ্যে মানুষ যাতে ওই বাড়ির এমন সুখ্যাতি করে যে বারোহাটির বাগানবাড়ির নাম দশদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং প্রত্যেক জলসার শেষেই তিনি দু’হাত ভরে দান-দাক্ষিণ্য করতে লাগলেন। শুধু যে বাঈজী-নর্তকীদেরই করেছেন তা-ই নয়, বড় বড় কোনো অতিথি বা তার বন্ধুস্থানীয় কেউ আসলেও তিনি উপহার হিসেবে স্বর্ণালঙ্কার দিতেন। তা বারোহাটির বাগান বাড়ির নাম ছড়িয়েছিল। ওই জঙ্গলের ভেতর বাড়ি, তার কথা কে না জানে! কত দূর-দূরান্তে গিয়েও যে বারোহাটি বাগান বাড়ির কথা শুনেছি! এই রকম দু’হাত ভরে মানুষকে দিতে গিয়ে আগের সিন্দুকখানার যা বেঁচেছিল, তাও ফুরালো। তখন মেজোকর্তা এসে এই সিন্দুকখানার সকলকিছুও নিয়ে গেলেন। আর এ সকলই জমিদারকর্তা তখন জানতেন। আমি তাকে। জানিয়েছিলাম। কিন্তু জমিদারকর্তা নিষেধ করেননি। বরং একবার তিনি বলেছিলেন, দেবেন্দ্র যা চায়, করুক। ওকে বাধা দিও না। সকলে কি আর একরকম হয়!

বীণাবালা স্থির দাঁড়িয়ে রইল। তার বুকের ভেতরের মৃদু আগুনের কণারা যেন আবার দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করল। এই জামিদার বাড়ির সকল কিছুর একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠেছিলেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। বিষ্ণুনারায়ণ তাতে বাধা তো দেননি বরং উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন। এমন আরো অসংখ্য ব্যাপার বীণাবালা দিনের পর দিন দেখেছেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ, তার স্ত্রী রেণুকা, তাদের সন্তান এমনকি দাসী-বাদীরাও অবধি এই গঙ্গামহলে আলাদা যত্ন পেয়েছে, ক্ষমতা পেয়েছে, সুবিধা পেয়েছে। অথচ যার সকল কিছুর প্রকৃত দাবিদার অবনীন্দ্রনারায়ণ, তার স্ত্রী-সন্তানরা…।

বীণাবালা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বললেন, বাদবাকি সিন্দুকগুলোও খুলুন নায়েব মশাই। আর এখন থেকে এই ঘরে ঢোকার সকল চাবি কেবল আমার কাছে থাকবে। এমনকি আপনার কাছেও নয়।

বীণাবালার এহেন কথায় গোপীনাথ সরকার অবাক হলেন না। তিনি মৃদু গলায় বললেন, আজ্ঞে, খুলছি।

দেবেন্দ্রনারায়ণের প্রতি জিঘাংসার যে তীব্র আগুন বীণাবালা এতদিন পুষে রেখেছিলেন, তার অনেক কিছুই যেন এই শেষ কিছুদিনে নিভে যেতে বসেছিল। কিন্তু আজ এই শূন্য সিন্দুকের বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করা যে শূন্যতা তা

বীণাবালাকে আবারো হেরে যাওয়ার তীব্র অনুভূতিদের ফিরিয়ে দিলো। বীণাবালা ধীর পায়ে হেঁটে বাকি সিন্দুকগুলোর দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর কী মনে করে হঠাৎ গোপীনাথ সরকারের হাত থেকে সিন্দুকের চাবিখানি নিয়ে নিজেই বসে পড়লেন বন্ধ সিন্দুকটির সামনে। চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিয়ে সিন্দুকখানি খুলতে গিয়ে বীণাবালা খানিক অবাক হলেন। খুব সহজেই সিন্দুকের তালা খুলে গেছে। কিন্তু এই সিন্দুকের তালা এত সহজে খুলে যাওয়ার কথা নয়। বহুদিন না খোলা তালা কঠিন হয়ে আটকে থাকার কথা। এই সিন্দুক যেহেতু অতি প্রয়োজন না হলে ভোলা হয় না বা হওয়ার কথা না, সেহেতু চাবি ঘোরানো মাত্রই এত সহজে এই তালা খুলে যাওয়ারও কথা না। কিন্তু তিনি চাবি ঘোরানো মাত্রই সিন্দুকের তালা খুলে গেল। বীণাবালা প্রবল উত্তেজনা চেপে রেখে সিন্দুকের ভারী ডালাখানি সরানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু অত ভারী ডালা তিনি একা সরাতে পারছিলেন না। তাকে সাহায্য করল গোপীনাথ সরকার। ভারী ডালা সরাতেই তারা উঁকি দিলেন সিন্দুকের ভেতর। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা নিয়ে বীণাবালা আর গোপীনাথ সরকার দেখলেন, এই সিন্দুকের ভেতরও শূন্য, এক কণা স্বর্ণ বা অলঙ্কারের চিহ্নমাত্রও কোথাও নেই। মরুভূমির মতোন খাঁ খাঁ করছে পুরো সিন্দুক! বীণাবালা পাগলের মতোন ছুটে গেলেন বাকি দু’খানা সিন্দুকের দিকেও। যদিও বীণাবালা এবার মনে মনে বুঝেই নিয়েছেন, ওই বাকি সিন্দুকগুলোর ভেতরের অবস্থার কথা। তারপরও নিজের চোখে দেখে নিশ্চিত হতে চাইছিলেন তিনি। বীণাবালা দেখলেনও। তার আশঙ্কাই সত্যি হলো, বাকি সিন্দুক দু’খানিও শূন্য। কোথাও কিছু নেই।

দীর্ঘসময় বীণাবালা কথা বললেন না। নড়লেন না। ঠায় বসে রইলেন মেঝেতে। তার মাথা নিচু, স্থির। বীণাবালার বিশাল ছায়া পড়েছে দেয়ালে। সেই ছায়াজুড়ে কেমন এক অশরীরী আবহ। বীণাবালার অমন গা ছমছমে প্রস্তরমূর্তি দেখে গোপীনাথ সরকারের বুকের ভেতরটা কেমন শিরশির করে কেঁপে উঠল।

বীণাবালা উঠলেন দীর্ঘসময় পর। তারপর গোপীনাথ সরকারের দিকে তাকিয়ে একদম স্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠে বললেন, আপনার কী মনে হয় নায়েব মশাই? এ সকল কোথায় গেল? নাকি বলবেন যে বাকি তিনখানাও দেবেন্দ্রনারায়ণই নিয়েছেন, এবং আপনি সে কথাও আমার শ্বশুরকে জানিয়েছিলেন?

বীণাবালার এমন শান্ত স্বাভাবিক কণ্ঠ শুনে এতক্ষণে গোপীনাথ সরকারের বুকের ভেতরের হিম জমাট বাঁধল। গোপীনাথ সরকার এবার কম্পিত গলায় বলল, আমি জানি না। এ কী করে হলো আমি জানি না! বিশ্বাস করুন, আমি কেবল ওই সিন্দুকখানির কথাই জানতাম। মেজোকর্তা ওইখানা থেকে সকল। কিছুই নিয়ে নিয়েছেন সে কথা জমিদার কর্তাও জানতেন। কিন্তু এ কী করে। হলো! কী করে হলো! আমি সত্যিই জানি না। সব ক’খানা সিন্দুক কী করে। এমন খালি হলো! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার মাথায় কিছু আসছে না। এই কক্ষ আর সিন্দুকের চাবি তার কাছেই থাকত। বিশেষ প্রয়োজন না হলে কখনো সেই চাবি আমায়ও দিতেন না। আর তার মৃত্যুর পর এই চাবি আমি ছাড়া আর কারো কাছে তো নেই। আমি…।

গোপীনাথ সরকার আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বীণাবালা তাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, চলুন নায়েব মশাই। এখানে আমার দমবন্ধ লাগছে। শ্বাস নিতে পারছি না। আপনি উপরে চলুন।

গোপীনাথ সরকার বীণাবালার সাথে উঠে এলো উপরে। কিন্তু তার হাত পা কাঁপছে। খানিক আগের সেই দৃঢ় কঠিন গোপীনাথ সরকার যেন আর নেই। মুহূর্তেই যেন সে পরিণত হয়েছে শিকারের সামনে দিশেহারা ভীত-সন্ত্রস্ত এক হরিণশাবকে। গোপীনাথ সরকারের এই পরিবর্তন বীণাবালার চোখ এড়ায়নি। কিন্তু বীণাবালা একটি বিষয় কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না যে প্রথম সিন্দুকখানি ফাঁকা দেখেও গোপীনাথ সরকার অমন দৃঢ় প্রতিক্রিয়া দেখালেও এখন কেন এমন ভীত সন্ত্রস্ত আচরণ করছে? তাহলে কি ভেবেছিল গোপীনাথ সরকার? সে কি তবে ভেবেছিল যে বীণাবালা কেবল সিন্দুক দেখেই ফিরে যাবেন? একখানা সিন্দুকও খুলে দেখবেন না? আর যখন একটি খুলেই দেখলেন তখন কি গোপীনাথ সরকার তাকে দেবেন্দ্রনারায়ণের কথা বলে পার পেয়ে যাবার কথা ভেবেছিল বলেই অমন দৃঢ় আর কঠিন আচরণ করেছিল? সে হয়তো ভেবেছিল এরপর আর বাকিগুলো বীণাবালা দেখবেন না? কিন্তু এই এতগুলো সিন্দুকের অলঙ্কার, নগদ অর্থ গোপীনাথ সরকার এ বাড়ি থেকে সকলের চোখ এড়িয়ে কী করে সরালো?

বীণাবালা এও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার মনের ভেতর নানান ভাবনা খচখচ করতে লাগল। তিনি চাইলেই এখন গোপীনাথ সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করে কঠিন শাস্তি দিতে পারেন। কিন্তু বীণাবালা জানেন, এটি হবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় বোকামি। এটি আসলেই কোনো সমাধান নয়। বরং তার মন বলছে, গোপীনাথ সরকার বাদবাকি সিন্দুকের জিনিসপত্র সরায়নি বা এর সাথে যুক্তও না। তাহলে কে সরিয়েছে? সবার আগে বীণাবালাকে আসল ঘটনা জানতে হবে। আর সেই আসল ঘটনা জানার একমাত্র উপায় এই গোপীনাথ সরকারই। কিন্তু গোপীনাথ সরকার যদি প্রকৃতই না জেনে থাকে যে বাকি তিনখানা সিন্দুক কে খুলেছে, তাহলে? তাহলে কে সরিয়েছে বাদবাকি স্বর্ণালঙ্কার? দেবেন্দ্রনারায়ণ? কিন্তু এটিও বীণাবালার বিশ্বাস হচ্ছে না। আর যা ই হোক, চুপিচুপি স্বর্ণালঙ্কার সরানোর মতো মানুষ দেবেন্দ্রনারায়ণ নন। তাহলে?

গত কিছুদিনের মধ্যে গঙ্গামহল-সংক্রান্ত কোনো ঘটনায় বীণাবালা এই প্রথম প্রকৃত অর্থেই চিন্তিত বোধ করতে লাগলেন। তাহলে কি দেবেন্দ্রনারায়ণ ব্যতিতও গঙ্গামহলে তার সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আরো কেউ রয়েছে? যে নিজেকে রেখে দিয়েছে আড়ালে-আবডালে? কিন্তু অনেক ভেবেও বীণাবালা সেই আড়ালে আবডালের মানুষটিকে চিহ্নিত করতে পারলেন না। তবে এই ভাবনা বীণাবালাকে মুহূর্তের জন্যও স্বস্তি দিলো না, সারাক্ষণ তার মাথার ভেতর কাঁটা হয়ে রইল এই চিন্তাটি, কে সরিয়েছে সিন্দুকের অলংকার, নগদ অর্থ? কার এতবড় দুঃসাহস? বীণাবালা জানেন, দৃশ্যমান শত্রুর চেয়ে অদৃশ্য শত্রুকে মোকাবিলা করা হাজার গুণ কঠিন।

কিন্তু কে হতে পারে সেই অদৃশ্য শত্রু? কে সে?

*

রতনকান্তির ঘুমে আজকাল আর সমস্যা হয় না। রাতের সেই শব্দের সাথে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সম্ভবত এই অভ্যস্ততার কারণেই আজকাল তার ঘুম আর বাধাগ্রস্ত হয় না। বরং সে যেন অবচেতনে ওই শব্দেরই অপেক্ষা করে। তবে একটি অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই বাড়ির আর কেউই শব্দটি শুনছে না। শুনলে সে কথা রতনকান্তির জানার কথা। অবশ্য এমনও হতে পারে যে বিষয়টি কেউ শুনে থাকলেও সে হয়তো অত গুরুত্ব দেয়নি, কিংবা ইচ্ছে করেই কাউকে বলেনি।

কয়েকটা দিন কেটে গেল নানান এলোমেলো ভাবনায়। এর মাঝে রতনকান্তি বারদুয়েক বাড়ির ভেতরের এখানে-সেখানে ঘুরে ফিরে দেখেছে। কিন্তু শব্দের সম্ভাব্য উৎস হতে পারে এমন কিছুই খুঁজে পায়নি সে। আজ ভোরবেলা অপলা দাসী কোথাও বেরুলো। তার সাথে গেল রঘুও। বাড়িটাও কেমন সুনসান নীরব। রতনকান্তি ভাবল, বিভূঁইয়ের সাথে দেখা করবার এটি একটি ভালো সুযোগ। ছেলেটিকে তার ভারি পছন্দ হয়েছে। সে দোতলার সিঁড়ির কাছে গিয়ে আবিষ্কার করল সেখানে এক ভৃত্য বসে রয়েছে। রতনকান্তি বুঝল, অপলা দাসী কাউকে কোনোভাবেই উপরে উঠতে দিতে চায় না।

রতনকান্তি শেষ অবধি আবার বাড়ির পেছন ঘুরে সেই আগের মতোই দেয়াল বেয়ে উঠে বিভূঁইয়ের জানালায় উঁকি দিলো। মজার ব্যপার হচ্ছে বিভুঁই সঙ্গে সঙ্গেই বলল, আপনি এতদিন পরে এলেন?

রতনকান্তি এবার আর চমকালো না। সে বলল, হ্যাঁ, এলাম। এতদিন অনেক ব্যস্ত ছিলাম, তাই তোমায় আর দেখতে আসতে পারিনি। আজ সময় করে এলাম।

বিভুঁই বলল, আমি একটি কথা বলি?

রতনকান্তি বলল, হা বলো।

বিভুঁই বলল, আপনি আমায় দেখতে আসেননি। আপনি এসেছেন কাজে। আমার কাছ থেকে একটা রহস্যের সমাধান জানতে।

রতনকান্তি এবার খানিক থমকে গেল। সে চমকে যায়নি, তবে থমকে গিয়েছে। সেকি আসলেই বিভূঁইয়ের কাছে কোনো রহস্যের সমাধান জানতে এসেছে? রতনকান্তি ভাবল, কিন্তু কোনো উত্তর পেল না। তবে সে এটি জানে, বিভুঁই যা বলেছে, তার নিশ্চয়ই কোনো গূঢ় তাৎপর্য রয়েছে। কিন্তু সেটি কী?

রতনকান্তি বলল, কী রহস্য?

বিভুঁই সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো না। খানিক চুপ করে বসে রইল। তারপর বলল, আপনি আমার কাছে এসেছেন রোজ গভীর রাতে যে শব্দ হয়, সেই শব্দের কারণ জানতে।

রতনকান্তি এবার চমকে গেল। বিভুঁই কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে হলো, বিভুঁই যা বলছে তা-ই ঠিক। বিষয়টি তার অবচেতনে ছিল, কিন্তু সচেতনভাবে সেটি সে বুঝতে পারেনি। সে আসলে ওই শব্দের উৎস নিয়ে কথা বলতেই বিভূঁইয়ের কাছে এসেছে। এর যৌক্তিক কারণও অবশ্য রয়েছে। সেদিন বিভূঁইয়ের তীব্র ক্ষমতা সে প্রত্যক্ষ করেছিল। সেই ঘটনাই হয়তো তাকে অবচেতনভাবে প্ররোচিত করেছে এখানে আসতে। সে জানতে চেয়েছে যে বিভুঁইও শব্দটি শুনতে পাচ্ছে কিনা! যদিও এই দোতলা অবধি শব্দটি আসার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। তারপরও রতনকান্তির ভাবনার কোথাও সম্ভাবনাটি দৃঢ়ভাবেই গেঁথে ছিল। বিভুঁই বলার আগ অবধি বিষয়টি রতনকান্তির নিজের কাছেই স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু বিভূঁইয়ের ইন্দ্রিয়শক্তির যে প্রবল ক্ষমতা তার এমন আরো একটি প্রমাণ রতনকান্তিকে ভালোভাবেই চমকে দিলো। রতনকান্তি আমতা-আমতা করে বলল, না, মানে, কিসের শব্দের কথা বলছ তুমি?

বিভুঁই হাসল। সেই হাসি দেখে রতনকান্তি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। বড় বড় গুটিবসন্তের দাগে-ভর্তি একটি কুৎসিত মুখে এমন সহজ-সরল সুন্দর হাসি হতে পারে, তা তার জানা ছিল না।

বিভুঁই বলল, রোজ অনেক রাতে একটা শব্দ হয়। আমি শব্দটা টের পাই। আপনিও পান, আমি জানি।

রতনকান্তি বলল, তুমি কী করে জানো যে আমি টের পাই?

বিভুঁই বলল, আমি জানি না, কিভাবে জানি! কিন্তু আমি জানি যে আপনি টের পান। আর সেটা জানার জন্যই আপনি এখানে এসেছেন।

রতনকান্তি এই কথার উত্তরে কোনো কথা বলল না। ছেলেটির প্রতি তার আগ্রহ প্রতি মুহূর্তেই বেড়ে চলেছে। কে এই ছেলে! এভাবে তাকে লুকিয়েই বা রাখা হয়েছে কেন? দেবেন্দ্রনারায়ণ একে রেখে সেই যে গঙ্গামহলে গেলেন,

তারপর থেকে তার আর কোনো খবরই নেই।

রতনকান্তি খানিক চুপ থেকে বলল, তুমিও তাহলে রোজ রাতে শব্দটা শুনতে পাও?

বিভুঁই মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, পাই।

রতনকান্তি বলল, শব্দটা কিসের বলতে পারো?

বিভুঁই বলল, এই এখানে বসে আমি সে ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি চারদিকটা খুঁজে দেখেননি?

রতনকান্তি বলল, বাড়ির ভেতরে যতটা সম্ভব দেখেছি, কিন্তু কোথাও তো কিছু খুঁজে পেলাম না।

বিভুঁই বলল, শব্দটা মাটি থেকেই আসছে।

রতনকান্তি বলল, হুঁ, সে আমিও ভেবেছি। আমি মেঝেতে কান পেতে দেখেছি, মনে হয়ছে খুব সামান্য হলেও মাটিতে কম্পন হচ্ছে।

বিভুঁই আর রতনকান্তি অনেকক্ষণ অনেক বিষয় নিয়েই কথা বলল। বিভুঁই কথার এ পর্যায়ে বলল, আচ্ছা, এই বাড়িখান তো অনেক বড়, তাই না?

রতনকান্তি বলল, হ্যাঁ, অনেক বিশাল এক বাড়ি এটা। বিষ্ণুপুরের জমিদারের মেজোপুত্র দেবেন্দ্রনারায়ণের বাগানবাড়ি।

বিভুঁই বলল, এই বিষ্ণুপুর কি আমাদের বাড়ি থেকে কাছে?

রতনকান্তি বলল, তোমাদের বাড়ি কোথায়?

বিভুঁই বলল, রাইপুর। আমি আর মা থাকতাম।

রতনকান্তি বলল, না। রাইপুরের দিকে না।

বিভুঁই বলল, তাহলে কোথায়? আর আমায় এখানে কেন এনেছে? দেবেন্দ্রনারায়ণই কি কর্তাবাবু?

রতনকান্তি অনেকক্ষণ কী ভাবল। তারপর তার হঠাৎ মনে হলো কিছু কথা বিভূঁইকে খুলে বলা উচিত! না হলে বিভুঁই কখনো হুট করে বড় কোনো বিপদে পড়ে যেতে পারে। রতনকান্তি বিষ্ণুপুর জমিদারি সম্পর্কে যতটুকু জানে, তা ধীরে ধীরে বিভুঁইকে বলতে শুরু করল। এই গল্প বিভুঁই’র জানা দরকার। দেবেন্দ্রনারায়ণ নিশ্চিত করেই বীণাবালার এই সুগভীর-চক্রান্ত থেকে চট করে বের হতে পারবেন না। সুতরাং বিভুঁই যদি কোনো কারণে কারো কাছে তার পরিচয় প্রকাশ করে দেয়, তাহলে দেবেন্দ্রনারায়ণ যেমন নতুন করে আরো বিপদে পড়বেন। তেমনি বিপদে পড়বে বিভুঁইও। বিভূঁইয়ের সাথে কথা বলে ছেলেটিকে তার বুদ্ধিমান মনে হয়েছে। সুতরাং তার কোনো কথার কারণে সে নিজে এবং দেবেন্দ্রনারায়ণও যেন কোনো বিপদে না পড়েন।

বিভুঁই অবশ্য এটুকু বুঝতে পারছে যে দেবেন্দ্রনারায়ণ তার কোনো ক্ষতি করবেন না, বরং তিনি তার শুভাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু তারপরও রতনকান্তি যতটুকু সম্ভব গঙ্গামহলের ভেতরের কথা বিভুঁইকে বলল। তাতে দেবেন্দ্রনারায়ণের কথা যেমন থাকল, থাকলো সদ্য প্রয়াত জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ, তার বাকি দুই সন্তান অবনীন্দ্রনারায়ণ এবং দীপেন্দ্রনারায়ণের কথা। দুই পুত্রবধু বীণাবালা আর রেণুকার কথাও।

বিভুঁই সকলই শুনল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই কোনো কথা বলল না। রতনকান্তি বলল, তুমি কি বুঝতে পারছ, জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা থেকে মেজোকর্তা তোমায় রক্ষা করেছেন?

বিভুঁই জবাব দিলো না। মাথাও নাড়ল না। রতনকান্তি আবার বলল, মেজোকর্তা এত কষ্ট করে তোমায় বাঁচিয়েছেন, এর মানে তিনি তোমায় অনেক ভালোবাসেন। কিন্তু বুঝতেই পারছ, তিনি নিজেই এখন রয়েছেন ভয়াবহ বিপদে। তাই তুমি কারো সাথে কথা বলার সময় খুব সাবধান। সেদিন আমার কথা টের পেয়েই যেভাবে তোমার সকল কথা আমায় সব বলে দিলে, তাতে আমি না হয়ে যদি জানালার বাইরে অন্য কেউ হতো তাহলে কিন্তু বিপদ হতে পারত। অমন আর কাউকে বলতে যেও না যেন।

.

বিভুঁই শুনল, কিন্তু সে জানে না কেন, তার আচমকা খুব মন খারাপ হয়ে গেল। সে তেমনই চুপচাপ বসে রইল দীর্ঘসময়। তার এই হঠাৎ মন খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণ তার মা। তার মনে হচ্ছে তার মায়ের সাথে সহসা তার আর দেখা হবে না। কথাটা ভাবতেই বিভূঁইয়ের চোখ কেমন করে উঠল। তার অন্ধ, দৃষ্টিশক্তিবিহীন এ চোখজোড়া কেমন ভিজে উঠতে চাইল। সে বা হাতের উল্টো পিঠে তার ছলছল করে ওঠা চোখজোড়া মুছল। সে কেন ভাবছে, তার মা’র সাথে তার আর সহসা দেখা হবে না? তার সাথে তো তার মা’র আর কখনোই দেখা হবে না! কখনোই না। এই জনমে আর না। সে তো অন্ধ! হয়তো কোনোদিন তার মাকে সে ছুঁয়ে দেখতে পারবে। হয়তো কখনো আঁচলে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিতে পারবে। কিন্তু দেখতে? না সে কখনোই আর তার মাকে দেখতে পারবে না। এই জনমে না।

বিভূঁইয়ের হঠাৎ মনে হলো, পরের জন্মে সে আর মানুষ হতে চায় না। মানুষ হলে যদি সে আবার অন্ধ হয়ে যায়? চোখ আছে এমন কিছুই সে হতে চায় না। সে বরং পাথর বা বৃক্ষ হবে, কিন্তু অন্ধ নয়। আচ্ছা, পাথর বা বৃক্ষদের কি চোখ থাকে? তারা কি অন্ধ হয়? তাদের কি কষ্ট হয়? মায়ের জন্য কষ্ট? তাদেরও কি থাকে? মা? মেই মায়ের আঁচলভর্তি কি ঘ্রাণ থাকে? মায়ের ঘ্রাণ? বিভুঁই আর কিছু ভাবতে চায় না। সে স্থির বসে থাকে। রতনকান্তি আরো কত কথা বলে, তার কিছু সে শোনে, কিছু শোনে না।

কতক্ষণ হলো বিভুঁই জানে না। রতনকান্তি বারকয়েক ডাকল, বিভুঁই, বিভূঁই।

বিভুঁই যেন অন্য কোনো জগত থেকে ফিরে এলো। সে বলল, হ্যাঁ, বলুন।

রতনকান্তি বলল, আমি যাই? আবার আসব।

বিভুঁই কথা বলল না। রতনকান্তি দেয়াল বেয়ে নেমে যাচ্ছিল। এই সময় বিভুঁই তাকে ডাকল। কিন্তু রতনকান্তির নাম জানে না বলে সে বলল, এই যে শুনুন।

রতনকান্তি থামল। তারপর বলল, আমার নাম রতনকান্তি। রতনকান্তি দাস। তুমি চাইলে আমার নাম ধরে ডাকতে পারো। শুধু রতন।

বিভুঁই রতনকান্তির এই কথার কোনো উত্তর করল না। সে গম্ভীর এবং শান্ত গলায় বলল, এই বাড়ির চারপাশ জুড়ে কি উঁচু পাচিল?

রতনকান্তি বলল, হ্যাঁ। কেন বলো তো?

বিভুঁই বলল, তারপর কী?

রতনকান্তি বলল, কিছুদূর অবধি ঝোঁপঝাড় রয়েছে, তবে বড় বৃক্ষ তেমন নেই, মোটামুটি ফাঁকাই। এরপর শুরু হয়েছে বারোহাটির জঙ্গল।

বিভুঁই বলল, এই বাড়ির যে পাঁচিল রয়েছে, আপনি কি একটু তার বাইরে ঘুরে দেখবেন, শব্দটা ওদিক থেকে আসছে কিনা?

রতনকান্তি কপাল কুঁচকে বলল, তুমি কি কিছু ভাবছ?

বিভুঁই উত্তর দিতে খানিক সময় নিল। তারপর বলল, আমার মনে হচ্ছে কেউ গভীর রাতে ওই পাঁচিলের বাইরে মাটি খুঁড়ছে।

রতনকান্তি চট করে জিজ্ঞেস করল, কেন?

বিভুঁই বলল, আমি জানি না কেন। তবে অতরাতে রোজ শব্দ শুনে মনে হয়েছে কেউ লুকিয়ে এই বাড়িতে ঢুকতে চাইছে। হয়তো এজন্যই পাঁচিলের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু কাজটি সকলের অগোচরে করতে হবে বলেই সকলে যখন গভীর ঘুমে থাকে তখন সে কাজ করে।

রতনকান্তি বিভুঁইয়ের কথা শুনে চুপ হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, কিন্তু বাড়ির ভেতর ঢুকতে হলে তো অন্য কোনো উপায়েও ঢুকতে পারে। পাঁচিল টপকে বা অন্য কোনোভাবে।

বিভুঁই বলল, আমি জানি না। তবে শব্দ শুনে আমার মনে হয়েছে কেউ মাটি খোঁড়ার চেষ্টা করছে।

রতনকান্তি কিছুই বুঝল না। সে বিভ্রান্ত এবং একইসাথে চিন্তিত চোখে বিভূঁই’র দিকে তাকিয়ে রইল।

.

দাসী অপলা আর পেয়াদা রঘু সেই দিন আর ফিরল না। ফিরল পরদিন ভোরে। তবে তারা কোথায় গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল, সে বিষয়ে কারো সাথে কোনো কথা হলো না। রতনকান্তি খেয়াল করেছে অপলা এবং রঘু দুজনেরই মুখ ভার। গভীর চিন্তা আর বিষাদের রেখা চেহারাজুড়ে। রতনকান্তি সেদিন ভোরেই বাগানবাড়ি থেকে বের হলো। তার মনে হচ্ছে বিভুঁই যা বলেছে তা-ই হয়তো ঠিক। পাঁচিলের বাইরেই কেউ মাটি খুঁড়ছে, কিন্তু কেন? রতনকান্তি পুরো বাড়ির চারপাশে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। তবে এতে প্রায় পুরোটা দিন লেগে গেল তার। বারোহাটি বাগান বাড়ির আয়তন বিশাল। তার সীমানাপ্রাচীরও বিস্তৃত জায়গাজুড়ে। রতনকান্তির ধারণা ছিল পুরো সীমানাপ্রাচীর ধরে ঘুরে আসলেই হয়তো তার কাজ শেষ। কিন্তু ঘটনা হলো উল্টো। গত মাসকয়েক ধরে বারোহাটি বাগানবাড়ির কোনো রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। ফলে বাড়ির বাইরে ঘাস, লতা-পাতার ঝোঁপ বেড়ে উঠেছে। সেই ঝোঁপঝাড় প্রাচীরের গা অবধি বিস্তৃত হয়েছে। প্রাচীরের বেশির ভাগ জায়গাজুড়েই ঘন ঝোঁপ, লতাপাতায় ছেয়ে গেছে। ফলে কেউ যদি এই লতাপাতা ঝোঁপঝাড়ের ভেতরে বসে মাটি খোড়ে, তবে তা খুঁজে বের করা কঠিনই। তাছাড়া যে খুঁড়ছে সে যে প্রবল সতর্কতার সাথেই কাজটি করছে তা সহজেই অনুমেয়। ফলে যেকোনো উপায়েই হোক সে চাইবে সম্ভাব্য প্রমাণগুলো লুকিয়ে রাখতে।

দিন শেষে রতনকান্তি প্রবল ক্লান্তি নিয়েই ঘরে ফিরল। সেই রাতে তার আর ঘুম হলো না। গভীর রাত অবধি অপেক্ষায় রইল সে। শেষরাতের আগে আগে শব্দটা আবার শুনতে পেল। একবার ভাবল, পাঁচিল টপকে এখনই বাড়ির বাইরে বের হবে কিনা! কিন্তু এই বাড়ির পাঁচিল টপকানো সহজ কথা নয়। তাছাড়া এই এতরাতে কেউ তাকে বাড়ির পাঁচিল টপকাতে দেখে ফেললে বিষয়টি যথেষ্টই আপত্তিকর এবং সন্দেহজনক হবে। তার চেয়ে পরদিন ভোর অবধি অপেক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু পরদিন ভোরে রতনকান্তির আর বের হওয়া হলো না। ভুব ভোরেই অপলা দাসী তাকে ডেকে পাঠাল। তারপর দেবেন্দ্রনারায়ণের পক্ষাঘাগ্রস্ততার খবর দিলো। অপলার মুখ ভার। রতনকান্তি বলল, এ খবর আপনি কোথায় শুনেছেন?

অপলা বলল, এ এখন সকলেই জানে। এখানে কেউ খবর পৌঁছায়নি বলে আমরা এতদিনেও তা জানতে পারিনি। আর সবদিকে সকলেই জানে।

রতনকান্তি অপলার চিন্তিত হবার কারণ বুঝতে পারছে। প্রথমত দেবেন্দ্রনারায়ণকে অপলা অসম্ভব পছন্দ করে। দ্বিতীয়ত, বারোহাটি বাগানবাড়ির ভাগ্য এতদিন যে সুতোর উপর ঝুলছিল, এই ঘটনায় তাও যেন ছিঁড়ে গেল। সেক্ষেত্রে এই বাড়িতে এখনো যে লোকজন রয়েছে, এই এত জিনিসপত্র, এর রক্ষণাবেক্ষণের কী হবে? অপলা দাসী আর কতদিনই বা এ বাড়ি এভাবে দেখে শুনে রাখতে পারবে?

রতনকান্তি বলল, তাহলে উপায়?

অপলা কোনো কথা বলল না। সে গম্ভীর মুখ করে তাকিয়ে রইল বাইরে। তার বুকের ভেতর দীর্ঘশ্বাসের ওলটপালট হাওয়া। সেই হাওয়ায় সবকিছু যেন উড়ে দুমড়ে-মুচড়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ বাদে সে রতনকান্তির দিকে মুখ ফেরাল। তারপর কথা বলল, এই বাড়িখানা মেজোকর্তার বড় শখের বাড়ি ছিল। সেই এতটুকু কাল থেকে মানুষটাকে আমি দেখে এসেছি। কোনো রোখ চাপলে তা না করে ছাড়তেন না। তবে মনখানা বড় সাদা। এই বাড়ি নিয়ে কতকিছুই না করেছেন। কত দিন-রাত শুধু ভাবতেন আর ভাবতেন, এই বাড়ি হবে সকলের কাছে আশ্চর্য এক বাড়ি। চারদিকে এই বাড়ির নাম-ডাক ছড়িয়ে যাবে! গুচ্ছের পয়সাও খরচ করেছেন। কিন্তু শেষ অবধি বাড়িখানা আর তার মন মতো হলো না। সে নিয়ে কী যে আক্ষেপ! তারপরও যতটা পেরেছেন। বাড়িটাকে আনন্দ-ফূর্তিতে মাতিয়ে রাখতেন। এই বাড়িতে এসে কখনো কেউ খালি হাতে ফেরত যায়নি। এই বাড়ির নাম ঠিকই ছড়িয়েছিল চারদিক।

অপলার চোখ ছলছল করছে। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। কিন্তু তার ঝাপসা চোখে সে কিছুই দেখছে না। অনেকক্ষণ পর সে আবার বলল, এখন বীণাবালা বাড়িখানা নিয়ে কী করেন কে জানে! বড় বাবুর এ সকলের প্রতি কোনো খেয়াল নেই। অমন ভালো মানুষটার কপালে ভগবান কী স্ত্রীটাই না জুটিয়েছেন। এই বাড়ির প্রতি বীণাবালার ক্ষোভও কিছু কম নয়। সবসময়ই তার মনে এই বিষ জমেছিল যে জমিদার কর্তা সকল কিছুই। মেজোকর্তাকে দিচ্ছেন। বড় ছেলেকে রেখে সকল কিছু করাচ্ছেন মেজো ছেলেকে দিয়ে। আর বড়কে করে রেখেছেন ফেলনা। তা তুমিই বলো, বড়জনের ধাতই তো অমন। এ সকলে তার মন ছিল? এখন বীণাবালা এই বাড়ির কী করেন তা তিনিই জানেন। এই বাড়িতে মেজোকর্তার শখের কত কী রয়েছে। তিনি যেখান থেকে যা কিছু আনতেন, সকলই এ বাড়িতেই রাখতেন। কাউকে কিছু ধরতে দিতেন না অবধি। আমায় কড়া করে বলে দিয়েছিলেন, যেন আমি ছাড়া আর কেউ যেখানে সেখানে না যায়। অনেক ঘর রয়েছে কাউকে তিনি ঢুকতেও দিতেন না।

অপলা একটু থামল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, এ বাড়িতে মাটির তলায় একখানা পাতাল ঘরের কথাও ছিল, সেই ঘর হয়েও গেছিল প্রায়। কিন্তু শেষের দিকে সেই ঘরখানা দেখে মেজোকর্তার পছন্দ হলো না। ভারি রেগে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর সেই ঘরখানা আর শেষও করতে দিলেন না, তেমনই রেখে দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে অবশ্য বারকয়েক গিয়েছিলেন। কী সব রাখতেন। আমায় বলতেন, এই বাড়ি তার পাগলামি পূরণের জায়গা, এখানে তিনি যা ইচ্ছে তাই করবেন। কেউ যেন অনুমতি ছাড়া বাড়ির এখানে-সেখানে ঘুরে না বেড়ায়। তা আমিও নিজের সন্তানের মতোন করে এই বাড়িখানা ধরেছিলাম। এখন কার হাতে পরে কী হয়, কে জানে?

শেষের দিকে এসে অপলার গলা বুজে এলো। রতনকান্তি অবাক দৃষ্টি মেলে অপলাকে দেখছে, দেবেন্দ্রনারায়ণের জন্য কী ভীষণ মায়া সে পুষে রেখেছে বুকের ভেতর। শুধু দেবেন্দ্রনারায়ণের জন্যই নয়, দেবেন্দ্রনারায়ণের ইচ্ছে পূরণের এই ইট-কাঠ-পাথরের জড় এক বাড়ির জন্যও মায়া পুষে রেখেছে সে!

মানুষ এমনই। যে বুকের ভেতর সে কারো কারো জন্য এমন সযতনে পুষে রাখে মায়া, মমতা, স্নেহ। আবার সেই বুকের ভেতরই কারো কারো জন্য পুষে রাখে ঘৃণা, ক্ষোভ, ক্রোধ। কী বিস্ময়করভাবেই না সে একই বুকের ভেতর পাশাপাশি পুষে রাখে ঘৃণা আর ভালোবাসা, মায়া আর ক্রোধ! মানুষ অদ্ভুত। ভারি অদ্ভুত।

রতনকান্তি তৃতীয় দিন দুপুরে পাঁচিলের বাইরের মাটি খোঁড়ার জায়গাটি খুঁজে পেল। সেখানে পাঁচিলের গা ঘেঁষে ঘন ঝোঁপঝাড় বেড়ে উঠেছে। সেই ঝোঁপের ভেতর কেউ একজন খুব সন্তর্পণে মাটি খুঁড়েছে। কিছু পাতাবিছানো সেই ঝোঁপের ভেতর। সেখানে বসে মানুষটা মাটি খোড়ে রোজ। তবে মানুষটার জন্য হতাশার কথা এই এতদিন ধরে খুঁড়েও সে তার কাজ খুব একটা এগিয়ে নিতে পারেনি। এর কারণও অবশ্য আছে। মানুষটা মাটি খোঁড়ার জন্য সময় পায় খুবই কম। শেষরাতের দিকে যখন সকলে থাকে গভীর নিদ্রায়, তখন সামান্য সময়ের জন্য এই সুযোগ সে পায়। কিন্তু ভোরের আলো ফোঁটার আগে আগেই তাকে আবার চলে যেতে হয়। আরেকটি কারণ, এই বাড়ির পাঁচিলের বাইরেও অনেকটা জায়গাজুড়ে ইট-সুড়কি বিছানো। ফলে এই ইট-সুড়কি সরিয়ে মাটি খোঁড়ার কাজটি খুব সহজ কোনো কাজ নয়।

রতনকান্তি সেই ঝোঁপের ভেতর দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে রইল। সে বুঝতে পারছে না, এত কষ্ট করে এই কাজটি মানুষটা কেন করছে? তার উদ্দেশ্যই বা কী? সে কি এই বাড়িতে ঢুকতে চায়? কিন্তু এই বাড়িতে ঢোকার এর চেয়ে সহজ অনেক উপায়ই রয়েছে। তাহলে? তাহলে এমন কষ্টসাধ্য বিপজ্জনক উপায় কেন? রতনকান্তি কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারল না।

সেই রাতেও রতনকান্তির ঘুম হলো না। তার দেবেন্দ্রনারায়ণের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। একবার গঙ্গামহলে গিয়ে পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখে আসার কথাও সে ভাবছে। কদিন ধরে অবনীন্দ্রনারায়ণের কথাও খুব মনে পড়ছে। মানুষটার সান্নিধ্য বড় টানছে তাকে। কিন্তু এই বাড়ির ওই মাটি খোঁড়ার রহস্যের সমাধান কী? রতনকান্তি একবার ভাবল অপলাকে ঘটনাটা বলবে সে। কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তাটা বাতিল করে দিলো। আগে ঘটনার কারণটি তাকে জানতে হবে। তাছাড়া সে এখনো জানেই না যে কাজটা কে করছে! অবশ্য যে খুঁড়ছে, সে যে কারণেই খুঁড়ে থাকুক না কেন, ওই সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তার এই বাড়িতে ঢুকতে বছর লেগে যাবে। কিন্তু এই বাড়িতে ঢোকার জন্য এত দীর্ঘসময়, এত দীর্ঘ শ্রমের কাজ কেউ কেন করবে?

ঠিক এই প্রশ্নে এসেই রতনকান্তি থমকে গেল। তার হঠাৎ মনে হলো যে মাটি খুঁড়ছে সে কেবল এই বাড়ির পাঁচিলের ভেতর প্রবেশ করার ইচ্ছে নিয়েই কাজটি করছে না। তার আরো বড় কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে, যেই উদ্দেশ্যের সাথেও এই মাটি খুঁড়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করার বিষয়টি যুক্ত। উদ্দেশ্যটি কী? উদ্দেশ্যটি কি তবে মাটির নিচের অন্য কোনো কিছু? কিন্তু কী সেটি? মুহূর্তেই রতনকান্তির মাথায় যেন বিদ্যুৎ চমকে গেল। সেদিন সকালেই অপলা দাসী বলছিল দেবেন্দ্রনারায়ণ এই বাড়িতে একখানা পাতাল ঘর করতে চেয়েছিলেন। সেই ঘরখানা তার মন মতো হয়নি বলে পুরোপুরি সমাপ্ত করার আগেই তিনি তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই পরিত্যক্ত ঘরখানাতেই তিনি মাঝে মাঝে যেতেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। একা। তাহলে কি সেই ঘরের উদ্দেশ্যেই কেউ মাটি। খুঁড়ছে?

রতনকান্তি শোয়া থেকে উঠে বসল। উত্তেজনায় তার ঘাড়ের রগ টানটান হয়ে উঠেছে। কী আছে ওই পাতাল ঘরে? আর থাকলেও সেটির কথা দেবেন্দ্রনারায়ণ ছাড়া আর কে জানে? সারারাত রতনকান্তি আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল না। সেই রাতে আবারো শব্দ হলো। তবে রতনকান্তি এই নিয়ে আর উদ্বিগ্ন হলো না। সে যেমন ছিল তেমন বসে রইল। এতরাতে এই অন্ধকারে সে আর পাঁচিল টপকে বাইরে যেতে পারবে না। তার চেয়ে পরদিনের অপেক্ষায় থাকাটাই শ্রেয়।

পরদিন সন্ধ্যার খানিক পরেই রতনকান্তি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। অন্ধকারে পা টিপে টিপে সে জায়গাটির কাছে এলো। কাছাকাছি একখানা ছোটখাট গাছ দেখে সে বেয়ে উঠে গেল। কিন্তু মশার ভয়াবহ আক্রমণে তার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। তারপরও দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল রতনকান্তি। তার ধারণা মানুষটা যত গভীর রাতেই মাটি খোঁড়া শুরু করুক না কেন, সে এখানে আসে তার অনেক আগেই। এসে ঝোঁপের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে থাকে।

সময় যাচ্ছে খুব ধীরে। তবে কতক্ষণ গেছে রতনকান্তি জানে না। প্রতিটি মুহূর্ত তার কাছে মনে হচ্ছে অনন্তকাল। অনেকক্ষণ অন্ধকারে বসে থাকার ফলে তার চোখে অন্ধকারটা খানিক সয়েও এসেছে। অনেক কিছুই সে এখন মোটামুটি দেখতে পাচ্ছে। রতনকান্তি হাত তুলেছিল ঘাড়ের কাছের মশাটাকে চাটি মারবে বলে, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই সে মানুষটাকে দেখল। ঠিক মানুষ নয়, মানুষের ছায়ামূর্তি। সন্তর্পণে পা ফেলে ছায়ামূর্তিটি এগিয়ে আসছে। এসে খুব ধীরে, শান্ত সতর্ক ভঙ্গিতে সে ঝোঁপের কাছে দাঁড়াল। খানিকটা নুয়ে কাঁধ থেকে একখানা ঝোলা নামিয়ে রাখলো মাটিতে। তারপর খানিক সময় নিয়ে এদিক-সেদিক দেখে মাথা নুইয়ে টুপ করে ঝোঁপের ভেতর ঢুকে গেল। রতনকান্তি একটু হতাশ হয়েছে। সে ভেবেছিল মানুষটার চেহারা সে বুঝতে পারবে। কিন্তু অন্ধকারে তার চেহারা বোঝা গেল না।

সমস্যা হচ্ছে এখন তাকে সারারাত এই গাছে বসে থাকতে হবে। যেটি কিনা একভাবে অসম্ভব। অথচ এখন গাছ থেকে নামতে গেলেই মানুষটি তার উপস্থিতি টের পেয়ে যাবে। যতটা সম্ভব ধৈর্য ধরে বসে রইল রতনকান্তি। কিন্তু মাঝরাত অবধি মশার আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল সে। শেষ অবধি আর না পেরে গাছ থেকে নেমে আসার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু নামতে গিয়ে বাধল বিপত্তি। অন্ধকারে পা হড়কে গেল তার। চারপাশের নিরবতায় গাছের সরু ডাল বিকট শব্দে আওয়াজ তুলল। পা ছুটে গেলেও দু’হাতে গাছের ডাল ধরে শূন্যে ঝুলে রইল সে। কিন্তু হঠাৎ অমন বিকট শব্দ টের পেয়ে ঝোঁপের ভেতর থেকে ছায়ামূর্তিটি মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে তাকাল। তার মাথার উপরের গাছের ডালখানা তখনো সশব্দে এলোমেলো নড়ছে। তাকাতেই মাথার উপর অন্ধকারে বিশালাকায় কিছু একটা ঝুলতে দেখল মানুষটা। মুহূর্তেই ভয়ে তার অন্তরাত্মা বুঝি কেঁপে উঠল। সে এই অন্ধকারে তার চিন্তা গুছিয়ে নেয়ার আর সময় পেল না। তার আগেই তার সদা সন্ত্রস্ত মস্তিষ্ক তাকে এই বার্তা পৌঁছে দিলো যে ভয়ংকর কোনো বুনো প্রাণী বা অশরীরি কিছু গাছ বেয়ে নেমে আসছে। মানুষটা মুহূর্তকাল থমকালো, তারপর রাম রাম’ চিৎকারে প্রবল আতঙ্ক নিয়ে সে ছুটে বেরিয়ে এলো ঝোঁপ থেকে। কোনো দিকে না তাকিয়ে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। রতনকান্তি সেই গাছের ডালে ঝুলে থেকেও তার হাসি চাপতে পারল না, মানুষটা দেখা যাচ্ছে ভারি সাহসী! সে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই গাছ থেকে নেমে এলো।

রতনকান্তি বাড়িতে ঢুকল পরদিন ভোরে। সেই দিন রাতে আর শব্দ হলো না। ছায়ামূর্তি ভালোই ভয় পেয়েছে। আপাতত কিছুদিন সে আর আসবে বলে মনে হয় না। তবে রতনকান্তি চায় মানুষটা আসুক। সে দেখতে চায় মানুষটা। কে? এই এত ঝুঁকি-শ্রম আর সময় নিয়ে সে আসলে কী মহার্ঘ বস্তু খুঁজছে? দেবেন্দ্রনারায়ণ সেই পাতাল ঘরে কি এমন রেখেছেন? নাকি রতনকান্তি ভুল ধারণা করছে? তবে রতনকান্তি এটি স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে, এত সহজে হাল ছেড়ে দেবে না মানুষটা। যদিও আপাতত কিছুদিন যে সে আর আসবে না, এ বিষয়ে রতনকান্তি নিশ্চিত।

এ বিষয়ে অপলাকে কিছু জানাল না রতনকান্তি। তার মনে হলো বিষয়টি নিয়ে আপাতত দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তাছাড়া সে নিজে একধরনের রহস্য অনুভব করছে। যে রহস্যের সমাধান সে নিজে নিজেই করতে চায়। অপলাকে বললে মাঝখান থেকে সবকিছু ভেস্তে যাবে। উপরন্তু অপলা তাকে কিছু বলবেও না। সে কোনোভাবেই এই বাড়ির গোপন বিষয়াদি তার সামনে উন্মুক্ত করবে না। রতনকান্তি বহুদিন বাদে ভারি উত্তেজনা অনুভব করছে। সে নিজে নিজেই আবিষ্কার করতে চায় ঘটনাটি কী? তবে গতরাতের ঘটনায় কিছুদিনের জন্য সে নিজেই এই উত্তেজনায় জল ঢেলে দিয়েছে। ওই লোক শীঘ্রই আর আসবে বলে মনে হয় না। সে রতনকান্তিকে ভূত-প্রেত কিছু ভেবেছে বলেই অমন রাম নাম জপতে জপতে পালিয়েছে। তবে ভাগ্য ভালো, রতনকান্তিকে স্পষ্ট দেখতে পেলে মানুষটার আবার ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। তখন সকলের কাছে ঘটনা জানাজানি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকত লোকটার। কিন্তু ভূত-প্রেত বা অন্য কোনো প্রাণীর কাছ থেকে সে সম্ভাবনা নেই। তার মানে মানুষটা নিশ্চিত করেই আবার আসবে। রতনকান্তি মনে মনে হাসল। তার চোখের সামনে মানুষটার হাঁচড়ে-পাঁচড়ে দৌড়ে যাওয়ার দৃশ্যটি এখনও ভাসছে। ভারি মজার দৃশ্য।

*

অবনীন্দ্রনারায়ণ গঙ্গামহলে নেই, এই খবর প্রকাশিত হলো দ্বিজেন্দ্র গঙ্গামহলে ফিরে আসারও দিন কয়েক পরে। তবে অবনীন্দ্রনারায়ণ যে কাউকে কিছু না জানিয়েই সকলের অগোচরে অনির্দিষ্টকালের জন্য কিংবা চিরকালের জন্যই নিরুদ্দেশ হয়েছেন, এ কথা জনসম্মুখে প্রকাশ করলেন না বীণাবালা। বরং বলা হলো, স্বভাবতই গঙ্গামহলের চার দেয়ালের ভেতর থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন অবনীন্দ্রনারায়ণ। ফলে তার নিজের ইচ্ছেতেই তিনি দীর্ঘদিনের জন্য দেশভ্রমণে বেরিয়েছেন। গতকাল প্রত্যুষে তিনি গঙ্গামহলের ঘাট থেকে বজরাযোগে যাত্রা শুরু করেছেন। যাওয়ার আগে তিনি বলে গিয়েছেন যে তার অনুপস্থিতিতে তার একমাত্র পুত্র দ্বিজেন্দ্রনারায়ণই বিষ্ণুপুর জমিদারির দেখভাল করবে। অবনীন্দ্রনারায়ণের এই সংবাদ নিয়ে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য না করলেও হরিহরণ কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। সে তাকিয়ে রইল অবনীন্দ্রনারায়ণের মহলের ছাদে। কারণ গত বেশ কয়েকদিন থেকেই সে লক্ষ করেছে অবনীন্দ্রনারায়ণ আর রোজ ভোরে এবং সন্ধ্যায় ছাদে উঠছেন না। তার মানে তিনি আরো আগেই গঙ্গামহল ছেড়েছেন। কিন্তু বীণাবালা সে কথা এতদিন গোপন রেখেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রকে দীঘাগড় থেকে না আনা অবধি তিনি এই সংবাদ প্রকাশ করতে চাননি। সে জন্যই সেদিন অমন লুকোচুরি করে কমলা দাসী আর বিভূতিনাথকে দীঘাগড়ে পাঠিয়েছিলেন বীণাবালা? যাতে অবনীন্দ্রনারায়ণের এই অনুপস্থিতিতে তড়িঘড়ি করে দ্বিজেন্দ্রকে তার স্থলাভিষিক্ত করা যায়!

সকল কিছু বীণাবালার পরিকল্পনা মতোই এগোচ্ছে। হরিহরণের কাছে এতক্ষণে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। তবে এর মধ্যে গঙ্গামহলে কিছু ঘটনা ঘটে গেল অতি দ্রুত। দ্বিজেন্দ্র দিঘাগড় থেকে গঙ্গামহলে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই দীপেন্দ্রনারায়ণও ফিরলেন তার শ্বশুরালয় থেকে। তার সাথে ফিরেছেন ভুজঙ্গ দেবও। তবে দীপেন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী আর সন্তান ফেরেনি। দীপেন্দ্রনারায়ণকে দেখে বীণাবালা প্রচণ্ড অবাক হয়েছেন। তিনি ভুজঙ্গ দেবকে পাঠিয়েছিলেন দীপেন্দ্রনারায়ণের ফিরে আসা বিলম্বিত করতে। কিন্তু ভুজঙ্গ দেব তো তা করেনইনি, বরং দীপেন্দ্রনারায়ণকে সাথে করেই নিয়ে এসেছেন। এমনকি দীপেন্দ্রনারায়ণের শ্বশুরালয় থেকে ভুজঙ্গ দেবের যাওয়ার কথা ছিল সমুদ্রশহর বিনয়পুরে। নতুন ব্যবসা শুরু করার উদ্দেশ্যে সেখানকার যে মহাল তিনি বিণাবালার কাছে চেয়েছিলেন, সেই মহাল দেখতে যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু বীণাবালা খবর নিয়েছেন, ভুজঙ্গ দেব সেখানে যাননি।

এদিকে সিন্দুকের বিষয়টি নিয়ে বীণাবালা এখন অবধি আর কাউকেই কিছু বলেননি। কেন যেন তার ভেতরে প্রবল অবিশ্বাস দানা বেঁধে উঠেছে, তিনি আজকাল আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। তবে এ বিষয়ে কাউকে কিছু না বললেও নায়েব গোপীনাথ সরকারকে তিনি একভাবে গৃহবন্দী করে রেখেছেন। তিনি না বলা অবধি গোপীনাথ সরকারের গঙ্গামহলের বাইরে যাওয়া নিষেধ।

অন্যদিকে দ্বিজেন্দ্র সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠিত ছিল সর্বজয়াকে নিয়ে। আসলে কী হয়েছে সর্বজয়ার? শেষ পর্যন্ত অবশ্য সর্বজয়ার একখানা খবর তাকে এনে দিয়েছে কমলা দাসী। সে দ্বিজেন্দ্রকে জানিয়েছে, সর্বজয়া কঠিন জ্বরে আক্রান্ত এ কারণে সে আর তার ঘর থেকে বের হয় না। কমলা দাসীর কথা শুনে দ্বিজেন্দ্র অবাক হলেও কিছু বলেনি। তবে এটি সে নিশ্চিত যে সর্বজয়া বেঁচে আছে। তবে বাদবাকি ঘটনা জানার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হবে। সে অপেক্ষা করারই সিদ্ধান্ত নিল।

বীণাবালার মনজুড়ে প্রচণ্ড অস্থিরতা। অতগুলো সিন্দুক হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু তিনি ভেবেও কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছেন না যে সিন্দুকগুলো আসলে কে নিয়েছে? কোথায় নিয়েছে?

আপাতত সিন্দুক বিষয়ক চিন্তার সমাধান বীণাবালার হাতে নেই। তবে এইমুহূর্তে যেটি জরুরি, তা হলো অবনীন্দ্রনারায়ণের অনুপস্থিতিতে দ্বিজেন্দ্রকে বিষ্ণুপুরের জমিদার হিসেবে স্থলাভিষিক্ত করা। এটিই এখন বীণাবালার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা। বীণাবালা নিশ্চিত, দেবেন্দ্রনারায়ণের কাছ থেকে এ নিয়ে কোনো ধরনের বাধা আসার সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু দীপেন্দ্রনারায়ণের উপস্থিতিতে বীণাবালার সেই নিশ্চিন্তভাব খুব একটা দীর্ঘায়িত হলো না। তিনি চিন্তিত মনে ভুজঙ্গ দেবকে ডেকে পাঠালেন। ভুজঙ্গ দেবের কাছে তিনি দীপেন্দ্রনারায়ণের ফিরে আসার কারণ জানতে চাইলেন। ভুজঙ্গ দেব বললেন, তিনি নানাভাবেই চেষ্টা করেছিলেন দীপেন্দ্রনারায়ণের প্রত্যাবর্তন বিলম্বিত করতে, কিন্তু তাতে তিনি সক্ষম হননি। বরং দীপেন্দ্রনারায়ণ বিষ্ণুপুরে ফিরে আসার জন্য প্রচণ্ডরকম উদগ্রীব ছিলেন।

ভুজঙ্গ দেবের এই কথায় বীণাবালার কপালের চিন্তার রেখা আরো গম্ভীর হলো। দীপেন্দ্রনারায়ণের উদ্দেশ্য তাহলে কী? সে কি কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই এমন বেপরোয়া হয়ে ফিরে এলো! এমনকি তার স্ত্রী-সন্তান না নিয়েই সে ফিরে এসেছে! বীণাবালা চিন্তিত হয়ে পড়লেও ভুজঙ্গ দেব কিন্তু মনে মনে দারুণ পুলকিত হলেন। নানান কৌশলে, প্ররোচনায় অবশেষে তিনি দীপেন্দ্রনারায়ণকে বিষ্ণুপুরে নিয়ে আসতে পেরেছেন। এবার বীণাবালার সাথে দীপেন্দ্রনারায়ণের খেলাটা তাহলে জমল! যে দীপেন্দ্রনারায়ণকে তিনি শেষ কয়েকদিনে দেখেছেন, সে সত্যিকার অর্থেই দূরদর্শী, চতুর, তীক্ষ্ণ এবং ভীষণ অঘটনঘটনপটিয়সী।

কিন্তু দ্বিজেন্দ্রকে জমিদার ঘোষণার দিন দীপেন্দ্রনারায়ণ চমকে দিলেন বীণাবালা এবং ভুজঙ্গ দেব দু’জনকেই। চমকে দিতে যে তিনি বিশেষ কিছু করেছেন তা নয়। বরং তিনি পুরোটা সময়জুড়েই ছিলেন বাড়াবাড়ি রকমের চুপ। বীণাবালা আশঙ্কা করছিলেন যে দীপেন্দ্রনারায়ণ হয়তো কোনো না কোনো ঝামেলা বাধাবেনই। কিন্তু তিনি কিছুই করলেন না। ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে স্বস্তি পেলেও মনে মনে ভারি চমকে গেলেন বীণাবালা। চমকে গেলেন ভুজঙ্গ দেবও। এত আশা করে এতকিছু বুঝিয়ে তিনি দীপেন্দ্রনারায়ণকে নিয়ে এলেন, কিন্তু মানুষটা কিনা পুরোটা সময় চুপ করে রইলেন! দ্বিজেন্দ্রকে জমিদার ঘোষণার দিন গণ্যমান্য সকলেই উপস্থিত থাকলেও সেদিনের মতো আজও উপস্থিত থাকতে পারলেন না ব্রাক্ষ্মণ দিবাকর চাটুজ্জে। বীণাবালা জানতেন তিনি অবশ্যই থাকবেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দিবাকর চাটুজ্জে বাহক মারফত সংবাদ পাঠিয়েছেন যে জরুরি কাজে তিনি আজ বিষ্ণুপুর থাকতে পারছেন না। তবে পরবর্তীকালে এসে তিনি অবশ্যই দ্বিজেন্দ্রকে আশির্বাদ করে যাবেন। বীণাবালা মনে মনে খানিক রুষ্ট হলেও তিনি তার কিছুই প্রকাশ করলেন না। তবে বীণাবালা একটি বিষয় খেয়াল করেছেন যে শেষ কিছুদিন ধরে দিবাকর চাটুজ্জে কেমন যেন দূরে দূরে থাকছেন। বিষয়টি নিয়ে বীণাবালার মনের ভেতরে দিবাকর চাটুজ্জের প্রতি খানিক অসন্তোষও জমেছে। তবে তিনি এও জানেন, এখনো এ সকল নিয়ে উচ্চবাচ্য করার সময় আসেনি।

অবশ্য এটাও ঠিক যে বীণাবালা আজকাল আর কোনো কিছুতেই নিশ্চিন্ত বোধ করেন না। পুরোপুরি স্বস্তি পান না। সবসময়ই কেবল মনে হয় এই বুঝি তার অগোচরে কিছু ঘটছে যা তিনি বুঝতে পারছেন না, জানতে পারছেন না। এমনকী দীপেন্দ্রনারায়ণের এই নিরবতাও তার মনের ভেতর কেমন এক অস্বস্তির কাঁটা বিঁধিয়ে রাখল। দিনকয় বাদে দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, তিনি তার স্ত্রীকে অসুস্থ অবস্থায় রেখে এসেছেন। স্ত্রী অসুস্থ থাকার কারণে তার নবজাতক সন্তানও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। চিকিৎসকরা বলেছেন তার স্ত্রীকে দীর্ঘদিন গভীর তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। ফলে তাকে শীঘ্রই আবার তার শ্বশুরালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হবে। আর এবার তার ফিরতে হয়তো আরো অনেক বিলম্ব হবে।

এই সংবাদে বীণাবালার খুশি হবার কথা ছিল। কিন্তু কেন যেন তিনি খুশি হতে পারলেন না। তার মনে হতে লাগল তার অগোচরে কিছু একটা ঘটছে। যেটি তিনি ধরতে পারছেন না। এমনকি গঙ্গামহলের এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও দীপেন্দ্রনারায়ণের এমন আশ্চর্য নির্লিপ্তততাও তার কাছে স্বাভাবিক মনে হলো না। এর পেছনে কিছু একটা রয়েছে। কিন্তু সেই কিছু একটাকে তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। যদিও বিষ্ণুপুর জমিদারির কনিষ্ঠপুত্র হবার কারণেই দীপেন্দ্রনারায়ণ কখনোই কোনো কিছুতে সরব ছিলেন না। কিন্তু তার এবারের নীরবতা, নির্লিপ্ততা কেন যেন বীণাবালাকে এক অদ্ভুত অস্বস্তিকর অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে রাখল।

.

তবে দীপেন্দ্রনারায়ণের আচরণে প্রকৃতই যদি কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন তিনি ভুজঙ্গ দেব। যে দীপেন্দ্রনারায়ণকে তিনি তার শ্বশুরালয়ের সেই বজরাতে দেখেছিলেন, সেই দীপেন্দ্রনারায়ণের সাথে যেন গঙ্গামহলের এই দীপেন্দ্রনারায়ণের কোনো সম্পর্কই নেই। এ যেন আলাদা দুই মানুষ। বিভ্রান্ত এবং হতাশ ভুজঙ্গ দেব এক সন্ধ্যায় দীপেন্দ্রনারায়ণের সাথে গঙ্গাবতীর তীর ধরে হাঁটতে বেরুলেন। ভুজঙ্গ দেব ধারণা করেছিলেন, দীপেন্দ্রনারায়ণ নিজ থেকেই সেদিনকার তার নির্লিপ্ততার প্রসঙ্গটা তুলবেন। হয়তো এই নির্লিপ্ততার পেছনে লুকিয়ে থাকা তার অন্য কোনো কৌশল বা গুঢ় রহস্যের কথা বলবেন। কিন্তু তাকে আবারো হতাশ করে দীপেন্দ্রনারায়ণ ওই প্রসঙ্গে কোনো কথাই বললেন না। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই তিনি হেঁটে যাচ্ছিলেন নদীর তীর ধরে। অধৈর্য ভুজঙ্গ দেব শেষ অবধি বিতৃষ্ণ গলায় বললেন, আপনি মেনে নিলেন?

দীপেন্দ্রনারায়ণ যেন অন্য কোনো গভীর ভাবনায় ডুবে ছিলেন। সেই গভীর ভাবনা থেকে ফিরে এসে তিনি যেন হঠাৎ বুঝতে পারলেন না ভুজঙ্গ দেব কী নিয়ে কথা বলছেন। তিনি মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কিছু বলছিলেন ভুজঙ্গ বাবু?

ভুজঙ্গ দেব পুনরায় একই কথা বললেন, আপনি মেনে নিলেন?

দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, কী মেনে নিলাম?

ভুজঙ্গ দেব বললেন, এই যে দ্বিজেন্দ্রর মতোন একটা দুধের শিশুকে বিষ্ণুপুরের জমিদার বানিয়ে দিলো।

দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, সেইবা কতকাল থেকে তো গঙ্গামহলে এই রীতিই চলে আসছে ভুজঙ্গ বাবু। জ্যেষ্ঠপুত্র জমিদারির উত্তরাধিকারী হয়। উল্টো তো কিছু ঘটেনি।

ভুজঙ্গ দেব বললেন, এ কেমন কথা বলছেন বলুন তো! এ জমিদারি আপনার পিতার। তার জ্যেষ্ঠপুত্র অবনীন্দ্রবাবু। তা অবনীন্দ্রবাবু যদি সত্যি সত্যি বিষ্ণুপুরের জমিদার হতেন, তখন না হয় এই রীতি চলত। কিন্তু আপনিই বলুন, তিনি কি আর সত্যিকারের জমিদার হবার মতোন মানুষ? দেবেন্দ্রবাবু হলেও একখানা কথা ছিল। কিন্তু তিনিও যেহেতু নেই, তখন আপনিই এখন এই জমিদারির প্রকৃত উত্তরাধিকারী।

দীপেন্দ্রনারায়ণ এই কথার জবাব দিলেন না। তিনি নীরবে হেঁটে গেলেন অনেকটা পথ। তারপর ফাঁকা একটা জায়গা দেখে দাঁড়ালেন। ভরা বর্ষায় টইটম্বুর গঙ্গাবতাঁকে দেখতে যেমন ভালো লাগছে, তেমনি ভয়ও হচ্ছে। বহুদিন গঙ্গাবতীতে এমন ঢেউ দেখা যায়নি। এমনিতে বর্ষা-বাদল ছাড়া গঙ্গাবতী শান্ত নদী। কিন্তু আজ যেন তাকে কেমন অস্থির আর অশান্ত লাগছে। দীপেন্দ্রনারায়ণ সেই উত্তাল নদীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ভুজঙ্গ বাবু, এই যে বিষ্ণুপুর, কী বিশাল জমিদারি। এই বিশাল তল্লাট আজ থেকে শত শত বছর আগে কেমন ছিল জানেন?

ভুজঙ্গ দেব দীপেন্দ্রনারায়ণের কথা ধরতে পারলেন না। তিনি দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বললেন, কেমন ছিল?

দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, আপনি বয়সে আমার অনেক বড়। আপনার জানার কথা। আমিও অন্যের মুখে শুনেছি। এই পুরো তল্লাটের বেশির ভাগই একসময় ছিল জলের তলে। ওই যে গঙ্গামহল, ওই যে গাছ, লতা, ঝোঁপ, ঝড়, পথ হয়তো কোনো একদিন ওইখানেই ছিল এই সামনের মতোন থই থই জল।

ভুজঙ্গ দেব এবার বুঝলেন দীপেন্দ্রনারায়ণ কী বিষয়ে কথা বলছেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ, তা তো জানি। এই পুরো অঞ্চলই আসলে জেগে ওঠা চর। জলের ভেতর থেকে শত শত বছর আগে একটু একুট করে চর জেগে উঠেছে। গঙ্গাবতী নদীর মূল প্রবাহ ছিল আরো উত্তরে। সেই নদী কালে কালে সরে এসেছে এই দিকে। সেই প্রমত্তা ভাবও আর এখন নেই।

দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, ঠিক ধরেছেন। জগতের নিয়ম হচ্ছে কেউ মরে গেলে কেউ বাঁচে। আবার কেউ বাঁচলে কেউ মরে যায়।

হঠাৎ করেই দীপেন্দ্রনারায়ণের এমন দার্শনিক কথাবার্তায় খানিক বিরক্ত বোধ করছেন ভুজঙ্গ দেব। তিনি বললেন, তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন। তবে উল্টোটাও কিন্তু হয়। ধরুন কেউ বাঁচলে কিন্তু আবার অন্য কেউ বাঁচেও। আবার কারো মৃত্যু অন্য কারো মৃত্যুও ডেকে আনে। যেমন এই নদী মরে গেলে, এর মাছ, জলজ প্রাণীরা মরে যাবে।

দীপেন্দ্রনারায়ণ সাথে সাথে জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, সে আমি জানি ভুজঙ্গ বাবু। কিন্তু সেই বিশাল বিস্তৃত গঙ্গাবতী উত্তর দিকে খানিকটা করে মরেছিল বলেই আমাদের এই বিষ্ণুপুর জেগে উঠেছিল, বেঁচে উঠেছিল। গঙ্গাবতী যখন কালে কালে উত্তর থেকে সরে দক্ষিণে এলো, তখন কিন্তু সে দক্ষিণ দিকে ক্রমাগত ভেঙে এগিয়েছে। হয়তো দক্ষিণ দিকে তখন কোনো জনপদ ছিল, লোকালয় ছিল, সেই জনপদ হারিয়ে গেছে গঙ্গাবতীর গর্ভে।

ভুজঙ্গ দেব এবার অসহিষ্ণু বোধ করছেন। তিনি বললেন, কিন্তু এ সকল কথা কেন বলছেন?

দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, ভাবছি এই যে নদী, এই যে কত হাজার বছর ধরে বয়ে চলছে, সেও কি মানুষের মতোন ঐশ্বর্যময় হয়ে বেঁচে থাকতে চায়? মানুষ যেমন বেঁচে থাকতে গিয়ে ধন-দৌলত, ক্ষমতার জন্য উন্মত্ত হয়ে ওঠে, এই নদীও কি তেমন বেঁচে থাকতে গিয়ে, টিকে থাকতে গিয়ে প্রবল স্রোতস্বিনী হতে চায়? সেই স্রোতে তার চারপাশ ভেঙে-চুরে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে উন্মাদ হয়ে। যায়?

ভুজঙ্গ দেব জবাব দিলেন না। দীপেন্দ্রনারায়ণ অবশ্য তার জবাব আশাও করেননি। তিনি নিজ থেকেই আবার বললেন, আমার কী মনে হয় জানেন, নদীরা মানুষের মতোন। তাদেরও জন্ম আছে, শৈশব-কৈশোর, যৌবন-বার্ধক্য এবং মৃত্যু আছে। রাগ আছে। আনন্দ, ভালো লাগা আছে। তারা রাগে উন্মাতাল হলে দু’কূল ভাসিয়ে নিয়ে খুনি হয়ে যায়। আবার মরে যেতে যেতে বেঁচে ওঠে। কত মৃত নদী শুকিয়ে গিয়েও আবার জেগে উঠে প্রবল প্রমত্তা হয়েছে। আবার তাদের আনন্দ হলে তারা কী সুন্দর শান্ত স্নিগ্ধ। মৃদু ঢেউ বুকজুড়ে। এসব আজকাল খুব ভাবায় আমায়। সেই যে সেদিন বজরায় করে সেই প্রবল প্রমত্তা নদীটাকে দেখলাম। দেখলেন না, কী করে ভাসিয়ে নিচ্ছে। লোকালয়। মানুষের জীবন, সম্পদ, সেই থেকে মাথায় ঢুকে গেল এই ভাবনা।

দীপেন্দ্রনারায়ণ থামলেও ভুজঙ্গ দেব কোনো কথা বললেন না। আজকাল ভুজঙ্গ দেবের নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগে। যখনই কোনো বিষয়ে স্থির কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছেন। তখনই দেখছেন যে তার সিদ্ধান্তটি আসলে ভুল। এই সেদিনও দীপেন্দ্রনারায়ণ সম্পর্কে তার ধারণা ছিল একরকম। সেই ধারণা বদলালো সেদিন বজরার ওই অতটুকু সময়ের অন্য এক দীপেন্দ্রনারায়ণকে দেখে। তখন মনে হলো, অবশেষে এতদিন পর বিষ্ণুপুর জমিদারির রক্ত বইছে, প্রকৃত বৈশিষ্ট্য বহন করছেন এমন সত্যিকারের মানুষটাকে তিনি আবিষ্কার করতে পেরেছেন। কিন্তু আজ এসে আবার এ কী দেখছেন! এ আবার কোন দীপেন্দ্রনারায়ণ?

ভুজঙ্গ দেব খানিকটা রুষ্টচিত্তেই বললেন, কিছু মনে করবেন না দীপেন্দ্রবাবু, এখন দেখছি আপনার জ্যেষ্ঠভ্রাতা আর আপনাতে কোনো তফাৎ নেই। দু’জনই প্রবল কাব্যভাবে-আক্রান্ত। আপনাদের জমিদার বংশে তো এমন কাউকে দেখিনি। আপনারা দু’জন এই অভ্যাস কোথা থেকে পেলেন, ভেবে বড় আশ্চর্য হই।

দীপেন্দ্রনারায়ণ শব্দ করে হাসলেন। বললেন, অনেক কিছুই অগোচরে রয়ে যায় ভুজঙ্গ বাবু। আমার পিতা স্বর্গবাসী শ্রী বিষ্ণুনারায়ণও কিন্তু ভাবের জগতের মানুষ ছিলেন। তার পিতা যোগেন্দ্রনারায়ণও। এমনকি তিনি মুখে মুখে এক আধটুকু কাব্যচর্চাও করতেন। সে কথা জানেন না বোধ হয়…। হা হা হা।

দীপেন্দ্রনারায়ণ কথা শেষ না করেই এবার সশব্দে হাসলেন। ভুজঙ্গ দেব রীতিমতো বিভ্রান্ত বোধ করছেন। এ কোন দীপেন্দ্রনারায়ণকে দেখছেন তিনি! মুহুর্মুহু রঙ পাল্টানো এক মানুষ! কিছু বলতে গিয়েও দ্বিধান্বিত ভুজঙ্গ দেব আর কিছু বললেন না। দীপেন্দ্রনারায়ণ দরাজ গলায় বললেন, এই জমিদারি নিয়ে এত বিড়ম্বনা করে কী হবে বলুন ভুজঙ্গ বাবু? সেই তো একদিন সবকিছু ছেড়ে চলেই যেতে হবে। তাই না? চলে গেলে তো আর কখনো এমন উত্তাল গঙ্গাবতীর তীরে দাঁড়ানো যাবে না। যাবে? তার চেয়ে আসুন ওই সকল ধন সম্পদের কথা ছেড়ে এই আসল জিনিস দেখি।

ভুজঙ্গ দেব আর কথা বললেন না। এই মানুষের সাথে আর কথা চলে না। তবে ভেতরে ভেতরে তিনি তীব্র হতাশায় ডুবে যাচ্ছেন। প্রচণ্ড ক্লান্তি তাকে আঁকড়ে ধরেছে। যেন বারবার পরাজয় ঘটছে তার। বীণাবালার কাছে যেমন ঘটেছে, তেমনি এই দীপেন্দ্রনারায়ণকে বিশ্বাস করেও ঠকেছেন তিনি। প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ ভুজঙ্গ দেব বললেন, আমি তাহলে যাই দীপেন্দ্রবাবু। আমার বিশেষ কাজ রয়েছে।

দীপেন্দ্রনারায়ণ মুখ ঘুরিয়ে ভুজঙ্গ দেবের দিকে চাইলেন। তারপর বললেন, খুব হতাশ হলেন ভুজঙ্গ বাবু? আমায় এত করে নিয়ে এলেন, আর সেই আমি কিনা আপনার কোনো কাজেই এলাম না? হতাশ হবেন না। জগতটাই এমন, সকলে কেবল নিজের স্বার্থটিই বোঝে। আপনি যেমন আমায় দিয়ে আপনার স্বার্থ বুঝতে চেয়েছিলেন। আমিও তেমনি আমার স্বার্থটিই বুঝছি। হয়তো ভাবছেন, এই বিষ্ণুপুরের জমিদারি ছাড়া আমার স্বার্থ কী, তাই না? আছে ভুজঙ্গ বাবু, এই বিষ্ণুপুরের জমিদারি, এই গঙ্গামহল ছাড়াও জগতে আরো বহু কিছু রয়েছে। এ সকল বুঝতে চোখ-কান, মন ভোলা রাখতে হয়। কোনো কিছুতে অন্ধের মতোন, মাতালের মতোন কুঁদ হয়ে রইলে চলে না ভুজঙ্গ বাবু। এই যে দেখুন, আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা, অবনীন্দ্রনারায়ণ, এই এত ক্ষমতা, এত ঐশ্বর্য সকল কিছু ছেড়ে কোন প্রাপ্তির আশায় ছুটে গেছেন, তা কি তার কাছে এর চেয়ে কম। মূল্যবান কিছু বলুন?

ভুজঙ্গ দেব আর কথা বাড়ালেন না। দীপেন্দ্রনারায়ণ আবার গঙ্গাবতীর দিকে তাকিয়ে উদাস গলায় বললেন, আমি তার মতো চাইলেও হতে পারব না ভুজঙ্গ বাবু। আমি আমার মতো, ছোটবেলা থেকেই। আমি ছিলাম অন্ধকারের ছায়া। কেউ কখনো আমায় আলাদা করে খেয়াল করেনি। তবে আমি সকলই খেয়াল করতাম। সকল কিছু খুব আলাদা করেই খেয়াল করতাম। আর টের পেতাম এ সংসারে কিছু মানুষ থাকে, যারা সকলের ভেতর থেকেও সারাজীবন নাই হয়েই থাকে, আমি সেইরকম এক মানুষ। দেবেন্দ্রনারায়ণ প্রবল প্রতাপশালী মানুষ, তাকে সবাই বড় সমীহ করে, মানে, যত্ন করে। অবনীন্দ্রনারায়ণ সহজ-সরল ভালো মানুষ। তাকে মানুষ সমীহ করে না, ভয় পায় না। কিন্তু যত্ন করে। তার প্রতিও কোথায় যেন একটা আলাদা ভাবনা রয়ে যায় সকলের। কোনো না কোনোভাবে সেও সকলের কাছেই রয়ে যায়।

দীপেন্দ্রনারায়ণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, সবচেয়ে খারাপ আর সবচেয়ে ভালো, এই দুইকেই মানুষ চিরকাল মনে রাখে। আর যে ভালোও না, মন্দও না, বা খানিক ভালো, খানিক মন্দ, তাকে মানুষ মনে রাখে না। মানুষ মাঝারিকে ভুলে যায়।

দীপেন্দ্রনারয়ণ দুই কদম সামনে বেড়ে গিয়ে আবার বললেন, আমি সেই মধ্যমজন। যে ভালো-মন্দের মিশেল অতি সাধারণ মানুষ। সুতরাং এই সকল কিছুর মধ্যে একমাত্র যে নেই, সে হলাম আমি। আমি কোথাও ছিলাম না। থেকেও না থাকাতেই রয়ে গেলাম চিরকাল। যেন গঙ্গামহলে ঘুরে বেড়ানো অদৃশ্য এক ছায়া। যাকে কেউই দেখে না, কিন্তু সে সকলকেই দেখে। এই দেখতে দেখতে আমার চোখ, কান, বোধ বুদ্ধি ভারি খুলে গেল ভুজঙ্গ বাবু। সকলে এত ব্যস্ত, তাদের আলাদা করে কিছু দেখার সময় কোথায়? সেই দেখতে দেখতেই আমি অনেক কিছু বুঝে নিলাম। যা কেউ টের পায়নি কখনো। সকলে আমায় অপ্রয়োজনীয় হিসেবে খরচের খাতায় তুলে রেখেছিল। এই দেখে দেখে আমি ভারি নিজের হয়ে গেলাম। একদম নিজের। সেখানে বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়ির বংশ পরিচয়েরও কোনো জায়গা রইল না। কারণ এই পরিচয় আমার জন্য ভারি বোঝার মতোন ছিল, যা আমার নিজের ব্যক্তি সত্তাটাকেও ঢেকে ফেলেছিল। তারপর আমায় ছায়ার মতোন অদৃশ্য অপ্রয়োজনীয় করে রেখে দিয়েছে। আমাকে অন্যদের ছায়া থেকেও বের হতে দেয়নি। ফলে আমি ধীরে ধীরে কেবল আমার হয়ে উঠলাম। আমার নিজের ভাবনার জগতে নিজের আলাদা পরিচয়। তার পুরোটাজুড়েই কেবল আমি ভুজঙ্গ বাবু। সেই আমি কেবল নিজের কাজটিই সবচেয়ে ভালো বুঝি। আমি আমার নিজের গোত্রের, একার, খুব একার, বুঝলেন ভুজঙ্গ বাবু?

দীপেন্দ্রনারায়ণ সামান্য সময়ের বিরতি নিয়ে বললেন, জীবনে উপেক্ষা পাবার মতো কষ্ট খুব কম আছে। যখন চারপাশের কেউ আপনার উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে, তখন বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা মরে যায়। কেউ কেউ তখন নিজেকে হেরে যাওয়া দলের, বা এটিকে অদৃষ্ট বলে মেনে নেয়। কেউ কেউ নিজের। উপস্থিতিকে জানান দেয়ার চেষ্টা করে। আমি কোন দলের আমি নিজেই। জানতাম না। এখন জানি, আমি আমার দলের। একার আমার।

ভুজঙ্গ দেব ফ্যালফ্যাল করে দীপেন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, এমন অবাক হবার কিছু নেই। এই জনমে এই উপেক্ষাই আমি সবচেয়ে অধিক পেয়েছি ভুজঙ্গ বাবু। তা আপনি তো আমার ভালো চান। এ কদিন ধরে নিয়ম করে কানের কাছে সে মন্ত্রই তো জপ করেছেন। তবে শুনুন, আমার যা ভালো হয় আমি তা-ই করছি ভুজঙ্গ বাবু।

ভুজঙ্গ দেব কী বলবেন! তিনি কিছুক্ষণের জন্য ভাবলেন, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটি সত্যি তো? নাকি কল্পনা? বাস্তবে এমন অদ্ভুত এমন মুহুর্মুহ রঙ পাল্টানো রহস্যময় মানুষ তিনি আর দেখেননি। মানুষটা কখন কী ভাবছেন, কী বলছেন, তার কিছুই বোঝার কোনো উপায় নেই। ভুজঙ্গ দেব আর বিন্দুমাত্র দাঁড়ালেন না। তিনি ঘুরে হাঁটা দিলেন। মিলিয়ে গেলেন অন্ধকারে। ভুজঙ্গ দেবের অপসৃয়মান শরীরের দিকে তাকিয়ে দীপেন্দ্রনারায়ণ মৃদু হাসলেন। তারপর তাকালেন আবছা অন্ধকারের গঙ্গাবতীর দিকে। বাতাসের বেগ খানিকটা বেড়েছে। গঙ্গাবতীর বুকে কিলবিল করতে শুরু করেছে জলের অজস্র ফণা। সেই ঢেউয়ের ফণার দিকে তাকিয়ে দীপেন্দ্রনারায়ণের হঠাৎ কেমন ভয় লাগতে লাগল। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা খানিক আগের সেই মৃদু হাসি কেন যেন মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল।

*

হরিহরণ ভাবছিল সে এবার ফিরে যাবে। অনেক দিন তো হলো। কিন্তু গঙ্গামহলের এই অদ্ভুত এবং একইসাথে জটিলসব কর্মকাণ্ডে সে এক ধরনের উত্তেজনাও বোধ করছে। মাঝখানে বারকয়েক বারোহাটি গিয়ে হেমাঙ্গিনী দেবীর সাথে দেখা করেও এসেছে হরিহরণ। আজকাল পুত্রচিন্তায় আর তেমন অস্থির নয় হেমাঙ্গিনী দেবী। এখন তারও দৃঢ় বিশ্বাস যে, বিভুঁই রয়েছে বারোহাটির বাগানবাড়িতেই।

এই এতদিনে হরিহরণ একটানা গঙ্গামহলে থেকে যা বুঝল, তা হলো, গঙ্গামহলের সকল ঘটনাই ভারি রহস্যময়। গাছ থেকে পাতাটি পড়ল, কি চিঁহি স্বরে ঘোড়ার হ্রেষা শোনা গেল, কোন ভৃত্য কাজ করতে করতে উঠোনে হোঁচট খেয়ে পড়ল, এই সকল কিছুরই কোনো না কোনো কার্যকরণ থাকে। কেবল চোখ কান খোলা রেখে দেখে যেতে হয়, খেয়াল করতে হয়। বাদবাকি বোঝা তাহলে এমনিতেই সহজ হয়ে যায়। এতদিনে সে মোটামুটি সকলের হাঁটার ধরন থেকে কথা বলার ভঙ্গি অবধি রপ্ত করে ফেলেছে। এ মানুষ দেখার অভ্যাস এক অশ্চর্য অভ্যাস। সেই অভ্যাস মতোই রোজ রাতে বিশাল উঠোনের এক পাশের গোলা ঘরের আড়ালে বসে চারপাশটা দেখে হরিহরণ। অন্ধকারেও কত কিছুতে যে তার চোখ আটকায়! আজও আটকালো। গভীর রাতে হঠাৎ চোরের মতো নিঃশব্দে বীণাবালাদের মহল থেকে বেরিয়ে এলো মুকুন্দ।

মুকুন্দ প্রয়াত জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের খাস ভৃত্য। বিষ্ণুনারায়ণ বেঁচে থাকতে তার হাঁটা চলা থেকে শুরু করে প্রাতঃকৃত্যসহ সকল কাজই মুকুন্দের সাহায্য লাগত। কারণ শেষের দিকে তিনি শারীরিকভাবে তেমন সক্ষম ছিলেন না। বিষ্ণুনারায়ণের মৃত্যুর পর থেকে ভৃত্য ব্রজগোপালের সাথে মুকুন্দও বীণাবালার মহলে একান্ত ভৃত্য হিসেবে কাজ করছে।

এতরাতে সেই মুকুন্দকে পা টিপে টিপে, অতি সতর্ক চাহনিতে উঠোনে নেমে আসতে দেখে হরিহরণ তাই কৌতূহলী হয়ে উঠল। হরিহরণকে পুরোপুরি সন্দিগ্ধ করে দিয়ে মুকুন্দ ঢুকে গেল দীপেন্দ্রনারায়ণের মহলে। অবাক ব্যাপার হলো এতরাতেও দীপেন্দ্রনারায়ণের মহলের মূল দরজা খোলাই ছিল। মুকুন্দ ঢুকতেই তা বন্ধ হয়ে গেল। বিষয়টি হরিহরণের কাছে ভীষণ আশ্চর্যের মনে হলো। দীপেন্দ্রনারায়ণের সাথে মুকুন্দর কী এমন সম্পর্ক যে এই গভীর রাতে সে এমন পা টিপেটিপে দীপেন্দ্রনারায়ণের মহলে প্রবেশ করছে! আরো একটি বিষয় হরিহরণ খেয়াল করেছে, আগের দীপেন্দ্রনারায়ণের সাথে যেন এবারের দীপেন্দ্রনারায়ণের কোনো সম্পর্কই নেই। বহু বছর ধরে গঙ্গামহলে যাতায়াত না থাকলেও তার আগে মোটামুটি নিয়মিতই আসত হরিহরণ। ফলে দীপেন্দ্রনারায়ণকে সে আগেও খুব কাছ থেকেই দেখেছে। কিন্তু সেই দীপেন্দ্রনারায়ণের সাথে এই দীপেন্দ্রনারায়ণের কোথায় যেন বিস্তর ফারাক।

হরিহরণ গোলাঘরের আড়ালেই দাঁড়িয়ে রইল। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মুকুন্দ যতক্ষণ অবধি দীপেন্দ্রনারায়ণের মহল থেকে বের না হবে, ততক্ষণ অবধিই সে সেখানেই এমন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে। দীপেন্দ্রনারায়ণের সাথে যে মুকুন্দর কোনো একটা গুরুতর ব্যাপার রয়েছে, সে বিষয়ে হরিহরণ নিশ্চিত। মুকুন্দ বের হলো প্রায় শেষ রাতের দিকে। কিন্তু সে একা বেরুলো না। তার সাথে বের হলেন দীপেন্দ্রনারায়ণ। তবে হরিহরণ চমকে গেলে তৃতীয় ব্যক্তিটিকে দেখে। মুকুন্দ আর দীপেন্দ্রনারায়ণের সাথে তৃতীয় আরো একজন বেরিয়েছেন। মানুষটির মুখে লম্বা করে চাদর টানা। সেই চাদরের ফাঁক গলে দোতলার কোনো এক লণ্ঠনের একচিলতে আলো এসে পড়ল মানুষটার মুখে। সেই চিলতে আলোয় মানুষটাকে দেখে হরিহরণ ভারি অবাক হলো। মানুষটি হলেন ব্রাক্ষ্মণ দিবাকর চাটুজ্জে! কিন্তু দিবাকর চাটুজ্জে এই এতরাতে এখানে কেন? হরিহরণ জানে, বীণাবালার সকল কর্মকাণ্ডের খুবই শক্তিশালী দুই অস্ত্র এই দিবাকর চাটুজ্জে আর গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে। প্রভাবশালী এই দুই ব্রাক্ষ্মণ বীণাবালার স্বার্থ চরিতার্থ করতে তাদের নানান প্রভাব অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে চলেছেন। তারা বীণাবালার খুব বিশ্বস্তও। তাহলে এতরাতে এমন লুকিয়ে চুরিয়ে দীপেন্দ্রনারায়ণের মহলে কী করছেন দিবাকর চাটুজ্জে! হরিহরণ নতুন আবিষ্কারের নেশায় রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইল।

দিবাকর চাটুজ্জে চাদরখানা টেনে তার মুখ আরো ঢেকে দিলেন। এখন আর তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি কে! দীপেন্দ্রনারায়ণ মুকুন্দকে নিয়ে অতি সতর্কভঙ্গিতে গঙ্গামহলের পেছনের দিকে ছোট ফটকখানার দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর দিবাকর চাটুজ্জেকে সেই ফটক খুলে দিলেন। দিবাকর চাটুজ্জে ফটক গলে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

.

দীপেন্দ্রনারায়ণের যাওয়ার দিনক্ষণ প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। শেষ মুহূর্তে এসে তিনি বীণাবালাকে বললেন মুকুন্দকে তিনি সাথে করে নিয়ে যেতে চান। যেহেতু দীর্ঘসময়ের জন্য তিনি এবার যাচ্ছেন, সেহেতু তার মহল থেকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও নিয়ে যেতে চাচ্ছেন সাথে করে। সাহায্যের জন্য মাঝি মাল্লারা থাকলেও মুকুন্দ থাকলে খানিক সুবিধা হবে। বীণাবালা অবশ্য এতে আপত্তির কিছু দেখলেন না। তাছাড়া সামান্য এক ভূত্যের বিষয়ে দীপেন্দ্রনারায়ণের সামনে আপত্তি দেখানো গঙ্গামহলের যে কারোর জন্যই ধৃষ্টতা। দীপেন্দ্রনারায়ণ যে বিনয় করে অনুমতি চেয়েছেন এতেই বীণাবালা সন্তুষ্ট।

সেদিন গরম পড়েছে বেশ। ত্যক্ত হরিহরণ দুপুরে গঙ্গাবতীর ঘাটে গিয়ে দাঁড়াল। আজ দীর্ঘসময় জলের ভেতর গলা অবধি ডুবিয়ে বসে থাকবে সে। কিন্তু ঘাটে বাঁধা দীপেন্দ্রনারায়ণের বজরাখানাতে মাঝি মাল্লাদের সরব উপস্থিতি দেখে হরিহরণের কৌতূহল হলো। দীপেন্দ্রনারায়ণ কি তাহলে আজই যাত্রা করছেন? গঙ্গাবতীতে ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে, সাথে মৃদু ঢেউ। এতক্ষণে যেন তার শরীরে গরম সয়ে আসছে। ভারি আরাম লাগছে হরিহরণের। ঘাটের সাথেই যে ঝোঁপ আর গাছের ছায়া সেখানে গিয়ে গা এলিয়ে বসে পড়ল সে। এখানে বসে বজরাখানাতেও নজর রাখা যাবে। বেশিক্ষণ হয়নি হরিহরণ বসেছে, এই মুহূর্তে হঠাৎ সে মুকুন্দকে দেখল। মুকুন্দর হাতে কী সব জিনিসপত্র। ঘাটে ভেড়ানো বজরাখানাতে সে সেসব ওঠালো। ব্যস্ত মুকুন্দ হরিহরণকে খেয়াল করেনি। অবশ্য হরিহরণ যেখানে বসেছে, ঘাট থেকে কারো সেখানে খেয়াল করার কথাও নয়। মুকুন্দ বজরা থেকে নেমে ঘাটে এসে দাঁড়াতেই দেখা গেল দীপেন্দ্রনারায়ণও এসেছেন। দীপেন্দ্রনারায়ণ মুকুন্দকে বললেন, বজরার কী খবর মুকুন্দ?

মুকুন্দ ঘাড় নেড়ে বলল, আজ্ঞে কর্তা। আপনার কথা মতোনই সকল ব্যবস্থা করা হয়েছে।

দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, মাঝি মাল্লাদের একটু জোয়ান দেখে নিস, মুকুন্দ।

মুকুন্দ বলল, আজ্ঞে কর্তা, সে নিয়ে আপনি ভাববেন না।

দীপেন্দ্রনারায়ণ খানিক গলা নামিয়ে বললেন, আর ওই যে বলেছিলাম, সাথে তাগড়া দেখে কয়েকজন রাখিস যারা দরকারে বর্শা বল্লমও ছুঁড়তে পারে। বলা যায় না, অতদূরের পথ। কোন দিক দিয়ে কোন বিপদ ঘটে যায়।

মুকুন্দ বলল, আপনি চিন্তা নিবেন না কর্তা। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, তা বাদবাকি আর সকল ঠিক তো?

মুকুন্দ বলল, সব ব্যবস্থা হয়ে আছে কর্তা। আপনি ভাববেন না।

দীপেন্দ্রনারায়ণ এবার হাসলেন। বললেন, ব্যবস্থা তো হতেই হবে রে মুকুন্দ। আমার ব্যবস্থা মানেই যে তোরও ব্যবস্থা।

মুকুন্দ বিগলিত গলায় বলল, সকলই আপনার দয়া কর্তা। এ জগতে আপনিই আমার মা, আপনিই আমার বাবা।

দীপেন্দ্রনারায়ণ হাসলেন।

হরিহরণ ঝোপের আড়ালে বসে এই দু’জনের কথাবার্তার কিছুই বুঝল না। মাঝি মাল্লাতো সব বজরাতেই আছে, তাহলে আরো মাঝি মাল্লার দরকারই বা কী? আর কিসের জন্য এত ব্যবস্থা, লুকোছাপা, আয়োজন?

হরিহরণ গঙ্গামহলে ফিরেও স্বস্তি পাচ্ছিল না। কী এমন কাজ যে এত সতর্কতার সাথে, এত পরিকল্পনা করে করতে হচ্ছে! দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। হরিহরণের অস্থিরতা ক্রমশই বাড়তে লাগল। কিন্তু কী করবে সেটি সে বুঝতে পারছিল না। সন্ধ্যের মুখে দীপেন্দ্রনারায়ণ এলেন দেবেন্দ্রনারায়ণের মহলে। তিনি আর খানিক পরেই তার শ্বশুরালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবেন। দিনভর প্রবল রোদ আর গরমের কারণেই রাতে যাত্রা করবেন বলে জানালেন। যাত্রার আগে দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে দেখা করতে এসেছেন। হরিহরণের সামনে বসেই দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে তার কথা হচ্ছিল। নানান কথা। সকলই মন দিয়ে হরিহরণ শুনছিল। কিন্তু তার চিন্তায় রয়েছে। দীপেন্দ্রনারায়ণের সাথে মুকুন্দর কথোপকথন। কিছু একটা করতে চাইছে সে। কিন্তু কোনো বুদ্ধি আসছে না মাথায়।

আচমকা হরিহরণের মনে হলো তার কিছু একটা করা উচিত। হুট করে সুযোগটা চলে এসেছে, এই সুযোগ আর হারানো যায় না। তাকে যেকোনো উপায়েই হোক দীপেন্দ্রনারায়ণের বজরায় উঠতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় বজরা গঙ্গামহলের ঘাট ছেড়ে যাওয়ার পরও বজরায় থাকতে পারলে। তাহলে আসল ঘটনা বোঝা যেত। কিন্তু সেটি প্রায় অসম্ভব কাজ। এই মুহূর্তে দীপেন্দ্রনারায়ণের বজরায় সে কী করে উঠবে!

তারপরও ফলাফল পুরোপুরি ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে হরিহরণ একটা শেষ চেষ্টা করল। সে দেবেন্দ্রনারায়ণকে বলল, আজ্ঞে কর্তা, একখানা জরুরি কথা।

দেবেন্দ্রনারায়ণ আজকাল হরিহরণের উপর খুব নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। তিনি বললেন, কী জরুরি কথা হরিহরণ?

হরিহরণ সাথে সাথে একখানা গল্প বানিয়ে ফেলল। সে বলল, বারোহাটিতে আমার বাড়ির সামনের রাস্তায় এক থুথুড়ে ভিখারি বুড়ি অচেতন হয়ে পড়েছিল দিন কয় আগে। তা সে বুড়ির গায়ে কি ভয়াবহ জ্বর। থরথর করে কাঁপছিল। আমার তো তিনকূলে কেউ নেই। বড় মায়া হলো বুড়িটাকে দেখে। মা নেই, বাবা নেই অনাথ মানুষ আমি। বুকের ভেতর কেমন যে করে উঠল। মানুষটাকে নিয়ে যত্ন-আত্মি করে সারিয়ে তুললাম। সমস্যা হলো এখন আর সে যাবে না। আমিও ভাবলাম ভালোই হলো, একা থাকি, তার চেয়ে বরং মানুষটাও থাকুক। নিজের মা থাকলেও তো তাকে দেখতাম।

দেবেন্দ্রনারায়ণ হরিহরণকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তা এই গল্প এই অসময়ে কেন হরিহরণ? আর তোমার তো দেখি ভারি দয়ার শরীর।

হরিহরণ বলল, কসুর নেবেন না কর্তা। সেই বুড়িকে সেই যে রেখে এসেছি। মাঝখানে বার দুই গেলেও এবার শেষ গিয়েছিলাম বহু আগে। তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তা সে কি না খেয়ে আছে, না মরে গেছে, ভেবে আজ সকাল থেকেই মনটা কেমন করছিল।

দেবেন্দ্রনারায়ণ অন্য সময় হলে কী বলতেন কে জানে, কিন্তু এই মুহূর্তে বললেন, তা সে তো বড় দুশ্চিন্তার কাজই করেছ হে হরিহরণ বন্নিক। যা পূণ্য রোজগার করেছিল, তা তো সকলই এবার হারাতে বসেছ দেখছি। এক কাজ করো, এক্ষনই রওয়ানা দিয়ে দাও। ভোরের আগেই পৌঁছে যাবে বারোহাটি। অবশ্য যা গরম পড়েছে, তাতে অত পথ হেঁটে যাওয়া সহজ কথা নয়।

হরিহরণ এই সুযোগেই ছিল। সে চট করে বলল, আজ্ঞে কর্তা। গরমটা যা পড়েছে। তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন। এই অবধি বলেই সে দীপেন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকাল, তারপর প্রবল দ্বিধা আর সংশয়ের ভঙ্গিতে বলল, ছোটবাবু তো খানিকবাদেই রওয়ানা দিচ্ছেন। আর আপনার যাত্রাপথে তো বিরামপুর পড়বেই। যদি আমায় সেখানে একটু নামিয়ে দিতেন বড় উপকার হতো।

হরিহরণ কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই দেবেন্দ্রনারায়ণ বলে উঠলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। ভালো কথা বলেছো তো বন্নিক। এই জন্যই তো বলি, তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি বেশ পাকা হরিহরণ। তা দীপেন্দ্র, তুই যাওয়ার পথে হরিহরণ বন্নিককে বিরামপুর নামিয়ে দিয়ে যাস।

দীপেন্দ্রনারায়ণ আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। তার আগেই হরিহরণ। বলল, আজ্ঞে কর্তা। আমি তাহলে নিচ থেকে কিছু গোছগাছ করে আসি।

দীপেন্দ্রনারায়ণ হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে তার আর বিশেষ কোনো কথাও এগোলো না। খানিক আগের ঘটনায় তিনি পুরোপুরি হতচকিত হয়ে গেছেন। কিন্তু এখন কোন অজুহাতে তিনি হরিহরণকে বারণ করবেন, তাও তিনি খুঁজে পেলেন না।

.

দীপেন্দ্রনারায়ণের বজরা ছাড়ল সন্ধ্যার খানিক পর। হরিহরণ জড়সড় হয়ে বসে আছে বজরার ছাদের এক কোণে। গঙ্গাবতীতে ঢেউ হচ্ছে খুব। সেই ঢেউয়ে বজরা দুলছে। দীপেন্দ্রনারায়ণ মনে মনে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। কিন্তু সেটি প্রকাশ করার কারণও খুঁজে পাচ্ছেন না। হরিহরণ এর মধ্যেই সুযোগ বুঝে বজরার ভেতর যতটা সম্ভব উঁকিঝুঁকি মেরেছে। কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই তার চোখে পড়েনি। সে ভেবেছিল দিবাকর চাটুজ্জে হয়তো বজরাতেই থাকবেন। কিন্তু যতটুকু দেখতে পেরেছে, তাতে দিবাকর চাটুজ্জেকে তার চোখে পড়েনি। এমনকি দুপুরে পালোয়ানদের মতোন শক্তিশালী মাঝি মাল্লাদের কথা সে শুনেছিল, তার কিছুই তার চোখে পড়েনি। তবে দীপেন্দ্রনারায়ণের অস্থিরভঙ্গি আর বারবার নিচুস্বরে মুকুন্দর সাথে কথা বলা দেখেই হরিহরণ অনুমান করতে পারছিল যে কোনোকিছুর অপেক্ষায় বিচলিত হয়ে আছেন তিনি।

হরিহরণ মনে মনে ভগবানকে খুব ডাকছিল, যাতে বিরামপুর অবধি পৌঁছাবার আগেই কিছু ঘটে, যাতে সে কিছুটা হলেও জানতে পারে আসল ঘটনা। কী! কিন্তু হরিহরণের ভাগ্য খারাপ, বিরামপুর পৌঁছাবার বহু আগেই জংলামতো এক জায়গা দেখে তাকে নামিয়ে দেয়া হলো। দীপেন্দ্রনারায়ণ তাকে সরাসরি কিছু না বললেও মুকুন্দ এসে বলল, হরিহর বন্নিক, একটু কষ্ট করতে হবে যে!

হরিহরণ বলল, কী?

মুকুন্দ বলল, কর্তাবাবু বললেন, নদীতে ভাটার টান লেগেছে, বাতাসও পড়ে যাচ্ছে। এখন পাল ছাড়া জলের উল্টোদিকে এই বজরা বেয়ে নিয়ে গেলে মাঝিদের বেশ কসরত হবে। কাল সারাদিন আর পরিশ্রম করতে পারবে না তারা। তাই বজরা এখন এই পথে না গিয়ে দক্ষিণ দিকের সরু এক খালে ঢুকবে। তা ও পথে গেলে তো আর বিরামপুর পড়বে না। তুমি বরং এখানেই নেমে যাও। খানিক সোজ হাঁটলেই রাস্তা একখানা পেয়ে যাবে।

হরিহরণ কিছু বলল না। সে জানে আর কিছু বলে লাভও নেই। সে দ্বিরুক্তি না করে বজরা থেকে নেমে গেল। কিন্তু এখানে গঙ্গাবতীর তীরজুড়ে ঘন ঝোঁপঝাড়, জঙ্গল। এসব পেরিয়ে এই অন্ধকারে মূল রাস্তা খুঁজে পাওয়া সত্যিকার অর্থেই ভারি কঠিন। হরিহরণ মনে মনে খুব হতাশ বোধ করছে। শেষ অবধি এত চেষ্টার পুরোটাই নিষ্ফল হলো। সে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ক্রমশই দূরে সরে যেতে থাকা বজরাখানার দিকে। অন্ধকারেও বজরাখানার লণ্ঠনের আলো দেখে মনে হচ্ছে জলের ভেতর একখানা আলোর মিছিল ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। হরিহরণ প্রবল হতাশা নিয়ে সেই আলোর দিকে তাকিয়ে রইল। ঘন ঝোঁপের ভেতর থেকে বের হবার পথ খুঁজতে গিয়ে হরিহরণের হঠাৎ মনে হলো, সে চাইলে দূর থেকেও তো বজরাটাকে যতটা সম্ভব অনুসরণ করতে পারে। কারণ সে জানে, মুকুন্দ তাকে মিথ্যে কথা বলেই বজরা থেকে নামিয়েছে, বজরা মূল গঙ্গাবতী ছেড়ে আশেপাশে কোথাও ঢুকবে না। আর এই অন্ধকারে বহু দূর থেকেও বজরার আলো দেখে বজরাটাকে অনুসরণ করা যাবে।

হরিহরণ নদীর তির ধরেই হাঁটতে শুরু করল। অবশ্য বেশিক্ষণ তাকে হাঁটতেও হলো না। বজরাখানা ধীরে ধীরে তীরের দিকেই সরে আসছে। একটা সময় গঙ্গাবতীর প্রায় পাড় ঘেঁষেই খুব ধীরে সামনে এগোতে লাগল বজরাখানা। হরিহরণও বজরার আলো লক্ষ্য রেখে এগোতে লাগল। আরো খানিক এগোতেই বটতলার শ্মশানঘাট চোখে পড়ল হরিহরণের। এককালে এই শ্মশানঘাটে মরা পোড়ানো হলেও এখন আর পোড়ানো হয় না। লোকমুখে এই শ্মশানঘাট নিয়ে নানান ভৌতিক গল্পগাঁথা শুনেছে হরিহরণ! পরিত্যক্ত শ্মশানের চারপাশজুড়ে তাই ঘন জঙ্গল। সাপখোপের আস্তানা। ভুলেও কেউ আর এ মুখো হয় না। হরিহরণ অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, বজরাখানা সেই শ্মশানঘাট ঘেঁষেই ভিড়ল। ভারি বিস্মিত হলো হরিহরণ। এই ক’দিনে, কিছুদিন পরপরই কী সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে, যার কিছুই সে বুঝতে পারছে না। বারবার চমকে যাচ্ছে।

শ্মশানঘাটের খানিক দূরত্বে একখানা মস্ত পাকুড় গাছে আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল সে। তার চোখে তিক্ষ্ণ দৃষ্টি। শ্মশানঘাটে সম্ভবত কোনো মরা পোড়ানো হচ্ছে। কিন্তু এই পরিত্যক্ত জংলা শ্মশানঘাটে এতদিন পর আবার মরা পোড়ানো হচ্ছে দেখে অস্বস্তি লাগতে লাগল হরিহরণের। সেখানে মানুষের জটলা। বড় বড় মশাল জ্বলছে।

হরিহরণ অবাক হয়ে দেখল ভেড়ানো বজরা থেকে দীপেন্দ্রনারায়ণ নেমে আসছেন এবং সেখানে কোনো মরা পোড়ানো হচ্ছে না। এমনিতেই কতগুলো মানুষ জটলা পাকিয়ে ছিল। দীপেন্দ্রনারায়ণ বজরা থেকে নেমে আসতেই মানুষগুলো শান্ত হলো। তিনি সকলকে কাছে ডেকে নিলেন। তারপর দীর্ঘসময় ধরে কিছু একটা বললেন, কিন্তু হরিহরণ এতদূর থেকে তা শুনতে পেল না।

হরিহরণের পায়ের কাছে কোমড় অবধি লম্বা ঘাস। হরিহরণ সেই ঘাসের ভেতর বসে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগোতে লাগল। ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে জেনেও যতটা সম্ভব মানুষগুলোর কাছাকাছি পৌঁছে থামল সে। দীপেন্দ্রনারায়ণের কথা এখন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, আমাদের যাত্রাপথ দীর্ঘ। বজরা যোগে দশ থেকে পনের দিন লেগে যাবে। তবে জোয়ার-ভাটা আর অনুকূল হাওয়ার উপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে।

তার সামনের মানুষগুলোকে এতক্ষণে দেখল হরিহরণ। পালোয়ানের মতোন শরীর প্রত্যেকের। বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে প্রত্যেকেই। এদের কথাই তাহলে দুপুরে বলেছিল মুকুন্দ! কিন্তু এদের কাজ কী? এরা কি দীপেন্দ্রনারায়ণের এই দীর্ঘ যাত্রাকে নিরাপদ করতে এসেছে? কিন্তু কী এমন মূল্যবান জিনিস দীপেন্দ্রনারায়ণ তার শ্বশুরালয়ের উদ্দেশ্যে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন যে তাকে এমন বিশাল সৈন্যসামন্ত নিয়ে যেতে হচ্ছে! হরিহরণ কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে তার চমকানোর আরো বাকি ছিল। দীপেন্দ্রনারায়ণের সামনের মানুষের জটলা থেকে কথা বলে উঠল ব্রাক্ষ্মণ দিবাকর চাটুজ্জে। হরিহরণ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে এতক্ষণ দিবাকর চাটুজ্জের মুখ দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে তিনি খানিক ঘুরতেই তার মুখ দেখতে পেল হরিহরণ।

দিবাকর চাটুজ্জে চারপাশের লোকজন থেকে দীপেন্দ্রনারায়ণকে আলাদা করে সরিয়ে নিয়ে এলেন। তারা হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন হরিহরণ যেখানে লুকিয়ে আছে, তার একদম কাছাকাছি। তাদের দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ অবধি হরিহরণ শুনতে পাচ্ছে। দিবাকর চাটুজ্জে চাপা গলায় দীপেন্দ্রনারায়ণকে বললেন, আপনি বড় বেশি সতর্ক ছোটবাবু। কাউকে বিশ্বাস করেন না। ওই জিনিসের জন্য অত খাটলাম। কতবার এই যজ্ঞ, সে যজ্ঞের নাম করে জমিদার কর্তার মহল আপনার জন্য ফাঁকা করে দিলাম। কত সময় ধরে কত ছক আঁটলাম। মানি, সবকিছু আপনার বুদ্ধিতেই হয়েছে, তা ঝুঁকি তো আমিও কিছু কম নিইনি। কিন্তু গঙ্গামহল থেকে জিনিসগুলো বের করার পর তার টিকিটির খবর অবধিও আর জানালেন না!

দীপেন্দ্রনারায়ণ হাসলেন। বললেন, গত রাতে গঙ্গামহলেই তো আপনাকে বললাম, সকলই এখানে রয়েছে। তা এখানে খুঁজে পাননি?

দিবাকর চাটুজ্জে এবার খানিক অসহিষ্ণু গলায় বললেন, খুঁজে যে পাবো না, সে জানতাম। তেমন হলে তো আর আপনি বলতেন না! তারপরও তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। এখানে কোথাও তো কিছু নেই।

দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, অস্থির হবেন না। আপনার ভাগের অংশ আপনি ঠিকঠাক বুঝে পাবেন। অপেক্ষা করুন, এইখানেই সব রয়েছে। আর গতরাতে আপনাকে যেমন লোক যোগাড় করতে বলেছিলাম, আপনি তেমন লোকই যোগাড় করেছেন দেখে খুশি হয়েছি। এদের আমার পছন্দ হয়েছে। এই কাজের জন্য আপনার ভাগের বাইরেও আপনি আলাদা ইনাম পাবেন। কারণ এরা না হলে সিন্দুকগুলো তোলা যাবে না।

দিবাকর চাটুজ্জে এবার ভারি আশ্চর্য হলেন। বললেন, আপনি সিন্দুক কোথায় পেলেন? গঙ্গামহল থেকে তো সিন্দুকসহ কিছুই আনা হয়নি। অতগুলো মাস ধরে ধীরে ধীরে সব সরানো হলো!

দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, এ জিনিসের বিপদ কখনো বুঝেছেন? এই জিনিস আপনি কোথায় রাখবেন? কার কাছে রাখবেন? আর এসব চেনাজানা পাঁচজনকে জানানোর বিষয়ও না। সিন্দুক ছাড়া রাখার জিনিসও নয়। আমি তিনখানা মস্ত সিন্দুকই বানিয়ে রেখেছিলাম।

দিবাকর চাটুজ্জের আর তর সইছিল না। তিনি বললেন, তা অতবড় সিন্দুকগুলো এখানে কোথায় রেখেছেন?

দীপেন্দ্রনারায়ণ মুকুন্দকে ডেকে কিছু একটা ইশারা করলেন। দীপেন্দ্রনারায়ণের ইশারা পেয়ে মুকুন্দ তড়িঘড়ি বজরার ভেতর ঢুকে গেল। কিছুক্ষণবাদে সে বজরার ভেতর থেকে আবার বেরিয়েও এলো। তার সাথে আরো একজন ভৃত্য। তাদের দু’জনের হাতেই দু’খানা মস্ত চটের থলে। থলের ভেতর বিশালাকায় অজগরের মতোন মস্ত রশি। সেই রশি দেখে উপস্থিত সকলেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। দীপেন্দ্রনারায়ণ গঙ্গাবতীর জলের উপর শ্মশানঘাটের গা ঘেঁষে লণ্ঠনের আলো জ্বেলে দিতে বললেন। মুকুন্দ তার সাথের ভৃত্যসহ শ্মশানের গা ঘেঁষে জলে ভেতর নামল।

দু’খানা মস্ত রশি নিয়ে তারা ডুবে গেল সেই জলের ভেতর। ডাঙায় দাঁড়ানো বাদবাকি সকলে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা নিয়ে তাকিয়ে রইল জলে। জলের ডুব দেয়া জায়গাটুকুজুড়ে এখনও মৃদু কম্পন। কিছুক্ষণ বাদে জলের নিচ থেকে উঠে এলো মুকুন্দ। বুক ভরে দম নিয়ে সে আবার ডুব দিলো। একইভাবে তার সাথের ভৃত্যটিও। তাদের দুজনের হাতেই ধরা রয়েছে সেই মস্ত রশির প্রান্ত। তারা দুজনেই চেষ্টা করছে জলের ভেতর কিছুর সাথে এই বিশালাকায় রশির প্রান্তগুলো বেঁধে দিতে। বারকয়েকের চেষ্টায় অবশেষে তারা সফল হলো। মুকুন্দ আর তার সাথের ভৃত্যটি রশির অন্য প্রান্ত হাতে নিয়ে জল থেকে উঠে আসল।

দীপেন্দ্রনারায়ণ এবার দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে ইশারা করলেন রশির প্রান্ত ধরে টেনে তুলতে। সবল বাহুর ভীমদর্শন মানুষগুলো সর্বশক্তিতে দু’খানা রশির প্রান্ত ধরে টানতে লাগল। কিন্তু রশি দু’খানার অপর প্রান্তে বাঁধা বস্তুটি যে প্রচণ্ড রকমের ওজনদার, তা তাদের প্রবল কসরত দেখেই অনুমান করা যাচ্ছিল। অনেক চেষ্টায় অবশেষে জলের ভেতর থেকে দৈত্যাকায় ভারী বস্তুটি উঠে এলো। বস্তুটি বিরাট আকারের এক লোহার সিন্দুক। দড়ি ধরে টেনেই সিন্দুকটিকে বজরায় উঠানো হলো। তারপর সিন্দুক থেকে দড়ির প্রান্ত গুলো খুলে নিয়ে নিয়ে মুকুন্দ আর তার সাথের ভূত্যটি আবার নেমে গেল জলে। তারপর দড়ি বেঁধে আগের মতোই টেনে উপরে উঠানো হলো বাকি দু’খানা সিন্দুকও। এ যেন অবিশ্বাস্য কোনো কল্পগল্প। পুরো ঘটনা দেখে হরিহরণ রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে রইল! তার চোখের সামনে ঘটে চলা এই একের পর এক অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলো তার কল্পনা আর বাস্তবের বিভাজন যেন ক্রমশই মুছে দিচ্ছে।

কি অদ্ভুত অকল্পনীয় সব ঘটনাই না ঘটে চলেছে তার চোখের সামনে।

*

সর্বজয়াকে আজকাল মানুষ বলে ভুল হয়। সে ঘর থেকে বের হয় না কত দিন সে নিজেও জানে না। তার ঘরের দরজা জানালা বন্ধই থাকে। খুব দরকার না হলে সেগুলো ভোলা হয় না। ঘরে আলো জ্বলে না। কেউ আলো দিলেও সর্বজয়া কথা বলে না, তবে তার শরীর জবাই করা মুরগীর মতোন কাঁপতে থাকে। সে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এই এতদিনে সর্বজয়া কখনো কাঁদেওনি। এই ঘরে আজকাল আর কেউ আসে না। রেণুকার শরীর আরো ভারী হয়ে এসেছে। যে কোনো দিন তার সন্তান হবে। দেবেন্দ্রনারায়ণকে রোজ ভোরে হরিহরণ ছাদে নিয়ে যায়। খগেনের সাথে কারো খুব একটা কথা হয় না। সারাক্ষণ নিচের ঘরের দরজার কাছে বসে সে ঝিমায়। কারো কিছু প্রয়োজন। হলে সেই কাজ সেরে এসে আবার বসে থাকে। দাসী অতসীবালা রেণুকার দেখভাল করছে। যে যার কাজ করলেও মনে হচ্ছে প্রাণহীন এক মৃত্যুপুরী যেন এই মহল। অথচ গঙ্গামহলের সবচেয়ে সরব, সবচেয়ে প্রাণবন্ত ছিল দেবেন্দ্রনারায়ণের এই মহলখানি।

সেদিন সুদক্ষিণা ঘরে ঢুকে চুপচাপ সর্বজয়ার গা ঘেঁষে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে রইল। সর্বজয়া কথা বলল না। অন্ধকারে যেমন পড়ে ছিল তেমন পড়েই রইল। সুদক্ষিণা হঠাৎ ডাকল, দিদি?

সর্বজয়া কোনো উত্তর দিলো না। সুদক্ষিণা আবারও ডাকল, ও দিদি। কথা বল।

সর্বজয়া নিষ্প্রাণ পড়েই রইল। সুদক্ষিণা এবার সর্বজয়ার শরীরে হাত রাখল। মুহূর্তেই তীক্ষ্ণ তীরের মতোন যেন ছুটে এলো সর্বজয়ার হাত। সে এক ঝটকায় সুদক্ষিণার হাতখানি সরিয়ে দিয়ে উঠে বসল। আবছা অন্ধকারে সুদক্ষিণা তার দিদির দিকে তাকিয়ে রইল। সর্বজয়া কাঁপছে। তার বুক দ্রুতলয়ে ওঠানামা করছে। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। যেন তপ্ত নিঃশ্বাসে পুড়িয়ে দিতে চাইছে সবকিছু। সুদক্ষিণা ভারি ভয় পেয়ে গেছে। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তোমার কী হয়েছে দিদি?

সর্বজয়া এই কথারও কোনো উত্তর দিলো না। সুদক্ষিণা আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তুমি আমায় মারবে? আগের মতোন? তারপর আমি কাঁদলে তুমি আমার চুল বেঁধে দেবে? এই যে দেখো, আমার চুল কত বড় হয়েছে। কিন্তু তুমি তো আর আমার সাথে কথাই বলো না!

সর্বজয়া যেমন বসে ছিল তেমন বসেই রইল। সুদক্ষিণা বলল, আমার সাথে ছাদেও যাও না, তুমি এমন কেন হয়ে গেলে? আমার তোমায় ভয় লাগে দিদি। খুব ভয়!

সুদিক্ষণা ভয়ে ভয়ে তার একখানা হাত আবার সর্বজয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো। সর্বজয়া এবার আর ছিটকে সরে গেল না। আঘাতও করল না। সুদক্ষিণা সাহস পেয়ে আরো খানিকটা এগোলো। তারপর পা তুলে পালঙ্কের উপর উঠল। সর্বজয়া নড়ল না। ঠায় বসে রইল। সুদক্ষিণা সর্বজয়ার চুলের ভেতর আলতো করে হাত রাখল। তারপর তার ছোট হাতখানা দিদির মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, মা বলেছে, তোমায় কেউ মেরেছে। কে মেরেছে দিদি? মাস্টার মশাই? ওই যে গান শিখতে চাইতে না বলে? আমি মাকে বলেছি, আমিও আর মাস্টার মশাইয়ের কাছে গান শিখব না। সে তোমায় মারল কেন? আমি অবশ্য আরো একখানা কথা ভেবেছি। মাস্টার মশাই যখন আমায় ছাদের ঘরে গান শেখাতে নিয়ে যাবেন, তখন আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেব। একদম ঠিক হবে, তাই না দিদি?

সুদক্ষিণা তার দিদির চোখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু দিদি কোনো কথা বলছে না দেখে সে তার মুখখানা নিয়ে গেল দিদির আরো কাছে। তারপর হাতখানা আলতো করে ছোঁয়ালো দিদির গালের ওপর। এবার ফিসফিস করে বললো, দিদি, ও দিদি, একটু কথা বলো। দিদি, একটু কথা বলো। তুমি রোজ আমায় মেরো, আমি আর মাকে বলব না। আমায় বকো, তাও বলবো না। তুমি যা বলবে, আমি সব শুনবো। ও দিদি, দিদি। একটু কথা বলো। দিদি।

সুদক্ষিণার ঠোঁট ফুলে ফুলে উঠছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার চোখের দু’কুল উপচে উঠছে। সে কাঁদতে চাইছে না, কিন্তু তার চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল টুপটাপ ঝরে পড়তে লাগল। সে দু’হাতে তার দিদির গাল চেপে ধরেছে। দিদির মুখের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে দিদিকে অবিরাম ডাকতেই থাকল। তার চোখের জলে দিদির কাপড় ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু তার দিদি, সর্বজয়া একবারের জন্যও তার দিকে চোখ তুলে চাইল না। একটি কথাও বলল না। একবারের জন্যও না। সে তাকিয়ে আছে শূন্যে। কোনো এক নিঃসীম শূন্যতায়। সেই নিঃসীম শূন্যতার ঠিকানা অতটুকু সুদক্ষিণার জানা নেই।

.

রেণুকা পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছেন। ঘটনাটি হতে পারত গঙ্গামহল এবং বিষ্ণুপুরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। সবচেয়ে আড়ম্বরপূর্ণভাবে উদযাপিত হওয়ার কথা ছিল এই নবজন্ম। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এ নিয়ে গঙ্গামহলে তেমন কোনো আড়ম্বর নেই। নেই দেবেন্দ্রনারায়ণের মহলেও। বরং সকলের ভেতরেই এক আশ্চর্য নিস্পৃহতা। যেন এই মুহূর্তে এই জন্মের ঘটনাটির চেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত আর কিছু নেই। দেবেন্দ্রনারায়ণও যেন চান না এ নিয়ে কোনো আড়ম্বর হোক।

হরিহরণ সেই রাতে বারোহাটি গিয়েছিল। দিনকয় থেকে আবার ফিরে এসেছে। গঙ্গামহল এই মুহূর্তে পুরোপুরি শান্ত। তবে এই শান্ত গঙ্গামহলের ভেতরে ভেতরে যে চাপা অস্থিরতার হাওয়া বয়ে যাচ্ছে তা কেউ জানছে না। জানছে কেবল এক বীণাবালা। বীণাবালার সকল ইচ্ছেই মোটামুটি পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এখন অবধিও তিনি সিন্দুকের কোনো খোঁজ বের করতে পারেননি। এই খোঁজ বের করতে না পারা অবধি তার শান্তি নেই। এক ভয়ংকর আশঙ্কা নিয়ে। প্রতিমুহূর্ত পার করতে হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে বিষাক্ত তীক্ষ্ণ ছোরা হাতে তার পিঠের কাছেই কোথাও দাঁড়িয়ে রয়েছে এক অদৃশ্য আততায়ী!

এর মধ্যে বারকয়েক গোপীনাথ সরকারের সাথে বসেছিলেন বীণাবালা। কিন্তু গোপীনাথ সরকার তাকে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য তথ্যই দিতে পারেননি। অবশেষে বিভূতিনাথ সাহার সাথে সিন্দুকের ধনরত্ন খোয়া যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। পুরো ঘটনা শুনে বিভূতিনাথ সাহা বজ্রাহতের ন্যায় বসে রইলেন। এ কী করে সম্ভব! সেই রাতে গোপীনাথ সরকারের সাথে আবার বসলেন বীণাবালা। সাথে রইলেন বিভূতিনাথ সাহাও। কিন্তু গোপীনাথ সরকারের সেই একই কথা তিনি জানেনই না কী ঘটেছে!

পরদিন ভোরে গোপীনাথ সরকারকে নিয়ে বীণাবালা আর বিভূতিনাথ সাহা বিষ্ণুনারায়ণের মহলের নিচে সিন্দুক রাখার সেই ঘরে আবার ঢুকলেন। পুরো বিষয়টি স্বচক্ষে দেখে ভীষণ চিন্তিত ও শঙ্কিত হয়ে পড়লেন বিভূতিনাথ সাহা। এমন দুর্ভেদ্য জায়গা থেকে এই বিশাল পরিমাণ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার কে সরিয়েছে! কিভাবে সরিয়েছে? তাছাড়া ওই পরিমাণ স্বর্ণালঙ্কার একদিনে সরানো অসম্ভব। এর জন্য একনাগাড়ে বহুদিন কারো এখানে আসতে হয়েছে। কিন্তু কে সে?

বিভূতিনাথ সাহা চিন্তিত গলায় বললেন, নায়েব মশাই, আপনি নিশ্চিত যে এখানে আসার চাবি একখানাই?

গোপীনাথ সরকার বলল, আজ্ঞে একখানাই। এ কথা আমি বড় বৌকে বহুবার বলেছি। আর সেই চাবি থাকতো জমিদারকর্তার কাছেই। কখনো কিছু দরকার হলে তিনি আমায় দিতেন।

বিভূতিনাথ সাহা বললেন, কিন্তু একখানা কথা ভেবে দেখুন। এই এত বড় বড় সিন্দুক। এর ভেতরে যে পরিমাণ স্বর্ণালঙ্কার ছিল, তা একদিনে একসাথে সকলের চোখ এড়িয়ে এখান থেকে সরিয়ে নেয়া অসম্ভব। এসব সরাতে হয়েছে। দিনের পর দিন, একটু একটু করে। এখন বলুন, গঙ্গামহলের বাইরে থেকে এসে এই কাজ করা কি কারো পক্ষে সম্ভব? আর গঙ্গামহলের ভেতরের এমন। দুর্ভেদ্য জায়গা থেকে কার সাধ্য এই সকল কিছু এত এত দিন ধরে এভাবে। সরায়?

বীণাবালা এবং গোপীনাথ সরকার দু’জনই নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। বিভূতিনাথ আবার বললেন, নায়েব মশাই, আপনি বুঝতে পারছেন আপনাকে আমরা কত বড় অভিযোগ থেকে রেহাই দিচ্ছি? আমরা চাইলেই আপনাকে অভিযুক্ত করতে পারি। কারণ আপনি ছাড়া আর কারো পক্ষে এই কাজ করা। সম্ভব নয়। আপনিই বলুন, সম্ভব?

গোপীনাথ সরকার আজকাল প্রকৃতই অসহায় বোধ করছেন। তার নিজেরও আজকাল নিজেকে সন্দেহ হয়। মনে হয়, হয়তো সে নিজেই কাজটি করেছে, তার এখন ঢের বয়স হয়েছে, হয়তো সেই বয়সের কারণেই ভুলেও গেছে। কিন্তু সে জানে, এটি অসংলগ্ন চিন্তা। প্রচণ্ড এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে নিজের ভেতরটা। নিজেকেই নিজে অবিশ্বাস করতে শুরু করছে। নিজের ছায়া। দেখেও অবিশ্বাসে, সন্দেহে কুঁকড়ে যাচ্ছে। বীণাবালা যত যাই বলুন, সে নিজের কাছে নিজে প্রচন্ড অপরাধী হয়ে গেছে। এ সকল দেখে রাখার দায়িত্ব ছিল তার। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালনে সে ব্যর্থ হয়েছে। এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে!

গোপীনাথ সরকার হঠাৎ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো। সে কান্নাজড়িত। গলায় বললো, আমায় শাস্তি দিন। আমি বিশ্বাস রক্ষা করতে পারিনি। জমিদার কর্তা আমায় কত বড় গুরুভার দিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু আমি তা রাখতে। পারিনি।

বিভূতিনাথ এবং বীণাবালা কিছু বললেন না। গোপীনাথ সরকার তার বুক। চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়ল। বিভূতিনাথ হঠাৎ বীণাবালাকে বললেন, দেখি, এই সিন্দুকের চাবিখানা দাও তো?

বীণাবালা চাবির গোছা থেকে একখানা চাবি খুলে বিভূতিনাথের হাতে দিলেন। বিভূতিনাথ সেই চাবিখানা নিয়ে সিন্দুকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন। কিন্তু হাঁটু গেড়ে বসেই বিভূতিনাথের নাক কুঁচকে গেল। তিনি কোনো একটা সমস্যা অনুভব করছেন। সমস্যাটা কী? বিভূতিনাথ সিন্দুকের গায়ে চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিতেই সিন্দুক খুলে গেল। তিনি বীণাবালার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, এতদিন ধরে বন্ধ থাকা তালার ভেতরটা মরিচা পড়ে কঠিন হয়ে থাকার কথা। কিন্তু এই তালা তো মনে হচ্ছে রোজ রোজ ভোলা হতো। তালার ভেতরটা একদম হড়হড়ে, তেলের মতোন…।

কথা বলতে গিয়ে বিভূতিনাথ হঠাৎ থমকে গেলেন। তার নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। উত্তেজনায় তার কপালের শিরা কাঁপছে। তিনি খানিক নিচু হয়ে তালার ফুটোয় নাক চেপে ধরে দীর্ঘনিঃশ্বাস নিলেন। তারপর ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন। গোপীনাথ সরকারের কাছে গিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বললেন, নায়েব মশাই, দীপেন্দ্রনারয়ণ কি এই চাবির কথা জানত?

গোপীনাথ সরকার বলল, হু, জানতেন। চাবির কথা তো মেজোকর্তা, ছোটবাবু দু’জনই জানতেন।

বিভূতিনাথ সাহা এবার কঠিন গলায় বললেন, আমি মেজোকর্তার কথা জিজ্ঞেস করছি না। আমি জিজ্ঞেস করছি ছোট দীপেন্দ্রনারায়ণের কথা। দীপেন্দ্রনারায়ণের কি কখনো এই চাবি পাবার কোনো সুযোগ ছিল?

গোপীনাথ সরকার যেন এই প্রশ্নের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারল। সে। সাথে সাথে জবাব দিলো না। কিছুটা সময় চুপ করে রইল। তারপর বলল, দীপেন্দ্রবাবুর চাবিখানা পাবার সুযোগ ছিল কিনা জানি না। তবে তিনি তো মাঝে মাঝেই জমিদার কর্তার কাছে এই মহলে আসতেন। কিন্তু পিতার কাছে তিনি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আসবেন, তাতে আলাদা করে কিছু তো কখনো ভাবিনি। ভাবা যায় না।

বিভূতিনাথ বললেন, এমন কী হতে পারে যে জমিদারবাবু চাবির গোছাখানা এমন কোথাও রাখতেন যেটা দীপেন্দ্রনারায়ণ জানত?

এবার পেছন থেকে কথা বলে উঠল বীণাবালা। তিনি বললেন, বিভূতিবাবু, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনি কি দীপেন্দ্রকে সন্দেহ করছেন?

বিভূতিনাথ ঘাড় ঘুরিয়ে বীণাবালার দিকে তাকালেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, আর সন্দেহর কিছু নেই। কাজটি দীপেন্দ্রনারায়ণই করেছে।

বীণাবালা বিস্মিত গলায় বললেন, কী বলছেন আপনি? এতটা নিশ্চিত কী করে হলেন?

বিভূতিনাথ বললেন, তুমি কিছু টের পাচ্ছ না বীণাবালা?

বীণাবালা বিভ্রান্ত চোখে চারপাশে তাকালেন। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি দ্বিধামিশ্রিত গলায় বললেন, কী?

বিভূতিনাথ বললেন, গন্ধ। কেন? তুমি খেয়াল করোনি? দীপেন্দ্রনারায়ণ তার চুলে কেমন জলের মতোন তেল মেখে বেড়াত না? কী ভয়ানক বিশ্রি গন্ধ। ওই বিশ্রি গন্ধের তেল আমি আর কাউকে কখনো মাখতে দেখিনি।

বীণাবালা এবার যেন কিছুটা আঁচ করতে পারলেন। দরজা জানালাবিহীন এই আবদ্ধ ঘরে কিসের একটা মৃদু গন্ধ যেন ভেসে বেড়াচ্ছে। তিনি নিঃশ্বাস টেনে সেই গন্ধ পাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুই বুঝলেন না। বিভূতিনাথ বললেন, বহুদিন থেকে সিন্দুকের তালা খোলা হয়নি বলে এর ভেতরটা মরিচা পড়ে কঠিন হয়েছিল। হয়তো সে কারণেই অনেক চেষ্টা করেও খুলতে না পেরে ভেতরে তেল মেখে খানিক সরস করতে চেয়েছিল দীপেন্দ্রনারায়ণ। আর অসতর্কতাবশত কিংবা হয়তো হাতের কাছে সহজেই পেয়ে সে তার চুলে মাখার ওই তেলই মেখেছিল এই সিন্দুকের মরিচা পড়ে শক্ত হয়ে থাকা তালায়। তালার ভেতরে এখনও সেই তেলের গন্ধ লেগে আছে।

বীণাবালা বিস্ফারিত চোখে বিভূতিনাথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বিভূতিনাথ হঠাৎ কী ভেবে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, মুকুন্দ কি দীপেন্দ্রর সাথে গিয়েছে?

বীণাবালা বললেন, হ্যাঁ।

বিভূতিনাথ সাহা সাথে সাথে গোপীনাথ সরকারের দিকে ঘুরলেন। তারপর বললেন, আমার মনে হয় হিসেব এবার পরিষ্কার। মুকুন্দ যেহেতু জমিদারবাবুর সাথে সবসময় থাকত, তার একান্ত ভৃত্য ছিল। তার সকল কাজ বলতে গেলে মুকুন্দই করত। ফলে চাবির বিষয়টি সে নিশ্চয়ই জানত। জামিদারবাবু হয়তো

অন্যান্য কিছুর মতো চাবির গোছাও তার হাত দিয়েই কোথাও রাখত। আর সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে দীপেন্দ্রনারায়ণ। সে মুকুন্দকে হাত করেছিল। এরা দু’জন বলেই দিনের পর দিন কাজটি করে গেলেও কেউ জানেনি, সন্দেহ করেনি।

বীণাবালা অদ্ভুত ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে আছেন। বিভূতিনাথ বললেন, এখন কী করবে?

বীণাবালা আচমকা দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ মুদ্রিত করলেন। অনেকক্ষণ কোনো কথা বললেন না। বিভূতিনাথ তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, দীপেন্দ্রনারায়ণকে এবার দেখেই আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কোথাও কোনো একটি সমস্যা আছে। কিন্তু সেটি আমি ধরতে পারছি না। সে যে এত বড় অকল্পনীয় একটি কাজ করবে, আমি এখনও তা ভাবতে পারছি না।

বীণাবালা এবার চোখ মেলে তাকালেন। তারপর বললেন, আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, আমার পেছনেই এক অদৃশ্য আততায়ী। আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু ধরতে পারছি না, কে সে! কী যে অস্থির লাগছিল!

বিভূতিনাথ বললেন, কিন্তু কি করবে এখন?

বীণাবালা মুহূর্তেই সাপের মতোন ফোঁস করে উঠলেন। তারপর বললেন, জানি না কী করব, তবে ছেড়ে যে দেব না, সে আমি জানি। আমি হারতে পছন্দ করি না। এর শোধ আমি তুলবই।

এই বীণাবালাকে বিভূতিনাথ প্রচণ্ড ভয় পান। তিনি আর বীণাবালাকে কিছু বললেন না। গোপীনাথ সরকারের দিকে তাকিয়ে বললেন, চলুন গোপীনাথ বাবু। এখানে থেকে আর কাজ কী!

হতচকিত গোপীনাথ সরকার অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াল। এই কটা মাত্র দিনেই সে যেন হঠাৎ থুথুড়ে বৃদ্ধ নিঃস্ব এক মানুষ হয়ে গিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *