৩. মন্দিরের দেয়ালে

ছেলেটা মন্দিরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল।

তার চোখ বন্ধ। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে কোথায়? কে সে? সে যেন কিছুই জানে না। আজ কি তার জন্ম হলো? না কি সে বহুদিন বাদে আজ নিদ্রা ভেঙে উঠেছে? গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন অন্য কোনো জগত থেকে এ যেন তার হঠাৎ পুনরাগমন। এই নিদ্রার সঙ্গে মৃত্যুর খুব একটা তফাৎ নেই। সে যেন মৃত্যু থেকে জেগে উঠল। সে আসলেই জানে না, কী ঘটেছিল! সবকিছুই কেমন একটা ঘোর, কেমন একটা বিভ্রমের মতোন। সে কি ঘুমিয়ে ছিল? নাকি মরে গিয়েছিল? তার আগে সে কী করছিল? অনেক চেষ্টা করেও ছেলেটা তার আগের স্মৃতি মনে করতে পারল না। তার মনে হলো সে কোনো এক অবাস্তব জগতে বাস করছে। মায়ার জগতে। এই জগতের সকলই মায়া। সকলই শূন্য। হঠাৎ সব মিলিয়ে যাবে। দীর্ঘ ঘুম বা মৃত্যুর শেষে সে জেগে উঠেছে অন্য এক বিভ্রমের জগতে।

প্রচণ্ড ক্ষিধেয় তার পেট গুলিয়ে উঠছে। তার আবছা মনে আছে, কেউ একজন এসে তাকে রোজ খাইয়ে দিত। কিন্তু তারপর থেকে হঠাৎ সেই কেউ একজন আর আসেনি। সেও মরার মতোন পড়ে ছিল। কতদিন খায়নি তাও জানে না। অসাড়-অচল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মাঝেমধ্যে যখন শরীরে খানিক সাড়া পেত, চেতনা ফিরত, তখন তীব্র খিদে টের পেত সে। তবে চোখ মেলে চাইবার মতোন অবস্থাও যেন তখন ছিল না। কখনো একটু-আধটু সাড় ফিরে পেলেই হাত বাড়িয়ে পাশে রাখা নানান ধরনের শুকনো খাবার থেকে কিছু কিছু খাবার নিয়ে খেত। জলভর্তি ঘটিও রেখে গিয়েছিল সেই মানুষটা। সেই জল খেয়ে আবার ঘোরের ভেতর ডুবে যেত ছেলেটা। মাঝেমধ্যে তার মনে হতো সে স্বপ্ন দেখছে। সেই স্বপ্নে সকল কিছুই কেমন আবছায়া! কেমন বিভ্রান্তির! সে কেবল স্পষ্ট টের পেত তার সারা শরীরজুড়ে তীব্র ব্যথা। আর একটা প্রবল ঘোর। এর বাইরে আর কিছুই না। গত কদিন ধরেই তার শরীরের ব্যথারা একটু একটু করে কমেছে। শরীরজুড়ে যে ভীষণ জড়তা ছিল, একটা খুব ভারী ওজন ছিল, তাও যেন কদিন ধরেই খানিকটা করে পলকা হয়েছে।

নিজের শরীরে ভর দিয়ে উঠে বসেছে সে। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইল। তার চোখ বন্ধ। কিন্তু পেটে রাজ্যের খিদে। দীর্ঘসময় অমন চুপ করে বসে রইল ছেলেটা। মনে করতে চেষ্টা করল অনেক কিছু। কিন্তু সবকিছুই কেমন এলোমেলো আর আবছা হয়ে আছে। কোনোকিছুই স্পষ্ট মনে পড়ছে না। গুছিয়ে ভাবনায় আসছে না।

ক্লান্ত-বিধ্বস্ত ছেলেটা তার বা হাতখানা আস্তে করে নাড়াল। তারপর ডান হাত। তারপর খানিকটা তুলল। আরো খানিকটা। আরও। মাথার কাছে। উঠালো। কিন্তু এইটুকু পরিশ্রমেই শরীরটা কাঁপছে। অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে। মাথার ভেতরটা বনবন করে ঘুরছে। পাশেই কোথাও পাখি ডাকছে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। গাছের পাতায় বাতাসের নাড়িয়ে যাওয়ার শব্দ। কোথাও কাঠঠোকরা ঠকঠক করে কাঠ ঠুকছে। তার বুকের ভেতর কেমন করে উঠল। মনে হলো বাতাসে শিস কেটে এক্ষুনি উড়ে যেতে পারত! তারপর এই এতদিনকার প্রবল গাঢ় অন্ধকারের পৃথিবী থেকে ঝলমলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারত। তারপর গলা ছেড়ে চিৎকারে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিতে পারত। কিন্তু তার বুক কাঁপছে। শরীর কাঁপছে। হাত কাঁপছে। মাথার ভেতর কী জানি হচ্ছে! সে বুক ভরে দম নিল।

তারপর আচমকা চোখ মেলে চাইল। একবার। আবার মুদল। আবার চাইল। আবার মুদল। আবার চাইল। এবার আর মুদল না। সে স্থাণুর মতো বসে রইল। দু’হাতের উল্টোপিঠ বাড়িয়ে চোখ দুটো ঘষল। একবার, দুবার, তিনবার। তারপর আবার চোখ বন্ধ করতে গিয়ে ছেলেটা হঠাৎ আবিষ্কার করল, সে আসলে চোখে দেখছে না! চোখ খুলে রাখা আর বন্ধ রাখায় কোনো পার্থক্য নেই। সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কিছু না। তার জগতজুড়ে গাঢ় কালো অন্ধকার। সীমাহীন অন্ধকার। এক অনন্ত অন্ধকারের জগত। সে বসে রইল। বসেই রইল। তারপর কম্পিত হাত বোলালো মুখে। তার মুখভর্তি বড় বড় গর্ত।

গুটিবসন্ত তার কাছে হার মেনে চলে গেছে। সে বেঁচে আছে। কিন্তু সেই হার মেনে চলে যাওয়ার আগে কালব্যাধি গুটিবসন্ত তার জীবনে সর্বশক্তিতে আঁচড় কেটে গেছে। মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর এক শাস্তি তার জন্য রেখে গেছে গুটিবসন্ত। সেই রোগা পলকা ছেলেটির হঠাৎ মনে হলো, এই জগতে এর চেয়ে বড় কোনো শাস্তি নেই। আর কোনো অভিশাপ নেই।

একটা সময় তার কেমন ঘুম ঘুম পেতে লাগল। ক্লান্ত শরীর তাকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে ফেলল। এই তন্দ্রাচ্ছন্নতার ভেতর হঠাৎ করেই তার চোখের ভেতর একটা মুখ ভেসে উঠল। নারী মুখ। সেই নারী মুখটি দেখে সে কিছুক্ষণের জন্য দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল। নারীটি তাকে ফিসফিস করে ডাকছে, বিভুঁই, বিভূঁই।

ছেলেটার তন্দ্রাচ্ছন্নতা হঠাৎ কেটে গেল। সে স্বপ্নের নারীটিকে চেনে। গুটিবসন্তের দাগে ভর্তি তার বীভৎস চেহারার ঠোঁটের কোণায় কিছুক্ষণের জন্য এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল। তারপর আবার মিলিয়েও গেল। এই নারীটির গায়ের ঘ্রাণ অবধি তার মনে আছে। সে যেন ঠিক এই মুহূর্তে তার ঘ্রাণ পাচ্ছে। তার হাতের স্পর্শ অবধি যেন তার গায়ে লেগে আছে। কিন্তু এই জনমে সে কি আর এই নারীটিকে দেখতে পাবে? সে তো অন্ধ একজন মানুষ! এই জনমে সে আর কখনোই এই মানুষটিকে দেখতে পাবে না। খুঁজে পেলেও না। এই নারীটি তার মা। তার মা হেমাঙ্গিনী দেবী। সে তাকে ঐ তন্দ্রাচ্ছন্নতার ভেতরেও কী অদ্ভুত মায়া নিয়েই না তার নাম ধরে ডাকছিল, বিভূঁই, বিভূঁই।

ছেলেটির নাম বিভুঁই। বিভুঁই ঘুমাল। ঘুম ভাঙল দুপুর গড়িয়ে বিকেলে। বিভূঁইয়ের কাছে অবশ্য সকাল-দুপুর-বিকেল সবই এক। পেটের ভেতর আবারও তীব্র খিদে। কিন্তু বিভুঁই তাও নড়ল না। তার হঠাৎ খুব মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। অভিমানে। কিন্তু কার উপর অভিমান? মায়ের উপর? নাকি ঈশ্বরের উপর? কার উপর?

অভিমানী বিভূঁইয়ের আরো দুটি দিন কেটে গেল। সে নেতিয়ে পড়েছে পুরোপুরি। সে তার বিছানা ছেড়ে সরে এসে নোংরা মেঝেতে পা বিছিয়ে পলেস্ত রা খসা জরাজীর্ণ দেয়ালে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। মাথা বীভৎসভাবে হেলে আছে কাঁধের উপর। বন্ধ চোখ। যেন মৃত এক মানুষ। দু’দিন বাদে বিভুঁই সেদিন আচমকা চোখ মেলে চাইল। তার কপাল কুঁচকে আছে। বারকয়েক চোখের পাতা পিটপিট করে নড়ল। বিভুঁই জানে সে চোখে কিছু দেখছে না। কিন্তু তারপরও তার চোখের পাতারা যেন সেসব জানে না। তারা বন্ধ হয়, খোলে। যেন দেখতে চায় জীব ও জগত। বিভুঁই কান খাড়া করে কিছু শুনলো। নাকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে ঘ্রাণ নিল কিছুর। তারপর যেমন ছিল তেমন পড়ে রইল আবার। খানিক বাদে মাথা তুলল। তারপর সন্তর্পণে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগুলো। বেড়ালের মতোন নিঃশব্দে। সে জানে না, তার সামনে কী! কোথাও হঠাৎ মাথা ঠুকে যাবে কি না! খানিকটা গিয়ে আবার স্থির পড়ে রইল। কান খাড়া করে কিছু একটা শুনলো। নাকে ঘ্রাণ নিল। তারপর তার ডান হাতটা হঠাৎ সাপের মতোন ছোবল মারল পাশে। একটা ধেড়ে ইঁদুর হাতের ভেতর। উঠে এলো। ইঁদুরটাকে শক্ত হাতে চেপে ধরল বিভুঁই। হামাগুড়ি দিয়ে আবার ফিরে এলো আগে যেখানে শুয়েছিল সেখানে। তারপর দেয়ালে হেলান দিয়ে শুয়ে দুহাতে ইঁদুরটাকে মাপজোখ করতে লাগল সে।

এতবড় ইঁদুর আগে কখনো দেখেনি সে। আজও দেখছে না। কিন্তু বিভুঁই তার হাতের ভেতর উঁদুরটাকে নিয়ে দীর্ঘসময় বসে রইল। তারপর চিন্তিত ভঙ্গিতে দূরে ছুঁড়ে মারল ইঁদুরটাকে। কিছু একটা অবাক করেছে বিভূঁইকে। কিন্তু সে ধরতে পারছে না বিষয়টি কী! ভেতরে ভেতরে সারাটা সময় কেমন খচখচ করতে থাকল বিষয়টি। বিভুঁই খাবারের পাত্রগুলো হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বের করল। পঁচা আধপঁচা খাবার। কিছু শুকনো চিড়ে। সে নাক বন্ধ করে তা-ই। খানিকটা গিলল। তারপর সারাটাক্ষণ কান খাড়া করে বসে রইল। আর যদি কোনো শব্দ। কোন মানুষ। বা আর কিছু! কিন্তু কেউ এলো না।

দিন কেটে যেতে লাগল। বিভুঁই যেন ডুবে থাকল অন্য কোনো জগতে। আলোবিহীন, মনুষ্যবিহীন এক নিবিঢ় অন্ধকারের জগত। তবে বিভুঁই হঠাৎ আবিষ্কার করল এই জগতে সে একা নয়। এখানে তার সাথে রয়েছে অথৈ ভাবনার এক জগত। এতদিন চোখ মেলে তাকালে তার চারপাশে যে জগত সে দেখত, সেই জগতের সকল কিছুই সুনির্দিষ্ট। পূর্ব নির্ধারিত। সেখানে তার নিজের ইচ্ছেমতো দৃশ্য ভাসে না। ছবি ভাসে না। মানুষ আসে না। কিন্তু এখন তার একান্ত এই নিবিড় জগতের সকলই তার একার। এখানে তার ভাবনামতোই সকল কিছু ঘটে। সে যা চায়, তাই হয়। ছবি ভাসে। মুখ ভাসে। এখানে সে চাইলেই তার ইচ্ছে মতো দৃশ্যপট দেখতে পারে, ভাবতে পারে। এই অন্ধকারের জগতে তাকে বাধা দেবার কেউ নেই। সে যেন তার নিজের ভাবনার এই জগতের এক মহাপরাক্রমশালী ঈশ্বর!

প্রবল অভিমানে মরে যেতে চাওয়া বিভুঁই যেন অন্ধত্বের চূড়ান্ত অভিশাপের ভেতরও এক অদ্ভুত আলোর জগত খুঁজে পেল। সে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিল, এমন জড়ভরত হয়ে আর পড়ে রইবে না সে। খানিক নড়াচড়া করবে। বোঝার চেষ্টা করবে সে কোথায়? তাকে বুঝতে হবে, জায়গাটা কোথায়? তবে একটা বিষয়ে বিভুঁই নিশ্চিত, সে রয়েছে কোনো গভীর জঙ্গলের ভেতর। যেখানে কোনো জনমনুষ্যের সাড়াশব্দ নেই। চারপাশজুড়ে কেবল পশুপাখির ডাক। গাছের পাতায় বাতাসের আঘাতে তীব্র স্পন্দনের শব্দ।

বিভুঁই আরো কিছুক্ষণ তেমনি শুয়ে রইল। তারপর ধীরে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল। তার উল্টো দিক থেকে মৃদু হাওয়া বইছে। সে খানিক স্থির দাঁড়িয়ে রইল। তার হঠাৎ মনে হলো, সে যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার উল্টোদিকটা নিশ্চয়ই উন্মুক্ত। ও পথেই হাওয়া আসছে। সে দেয়াল ধরে ধরে এগুলো। বারকয়েক হোঁচট খেল। কিন্তু থামলো না। খানিকবাদে টের পেলো, দেয়াল। ধরে ধরে তার ঘর পেরিয়ে অন্য এক ঘরে এসে পড়েছে সে।

এই ঘরের বা দিকে সরু এক সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। কিন্তু বিভুঁই সেই সিঁড়িখানা দেখতে পেল না। সে উল্টো দিকের দেয়াল ধরে হেঁটে গেল সামনে। খানিক যেতেই বিভূঁইয়ের হঠাৎ মনে হলো, এখানে তার দম নিতে খুব আরাম হচ্ছে। এখানে বাতাস, পাখি ও পাতার শব্দরা বেশ স্পষ্ট। প্রাণবন্ত। বিভূঁইয়ের বুকের ভেতরের এতদিনকার আবদ্ধ অনুভূতিটা যেন এই এতটুকুতেই অনেকখানি কেটে গেল। সে দীর্ঘসময় সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। দীর্ঘসময়। সেই গহীন অরণ্যে ভাঙা পরিত্যক্ত এক মন্দিরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধ বিভুঁই তার সেই অন্ধকার ভাবনার অন্তর্জগতে একের পর এক ছবি এঁকে যেতে লাগল, তার সামনের এই বৃক্ষ, জঙ্গল, পাখি আর পাতাদের।

রোজ একটু একটু করে বিভুঁই এমন কত কিছু যে বুকের ভেতর আঁকতে থাকল। কত কত ছবি। কত কত ভাবনা, দৃশ্যপট! তার এই অন্ধত্ব নিয়ে আজকাল তার আর আক্ষেপ হয় না। কেমন যেন খেলা মনে হয়। সে তার নিজের সাথে রোজ কত অদ্ভুত অদ্ভুত সব খেলা যে খেলে! তবে সবচেয়ে ভালো যে ব্যাপারটি হলো, তা হলো বিভুঁই আজকাল বেঁচে থাকতে চায়। সে তার চর্মচক্ষে দেখা এতদিনকার দৃশ্যমান জগৎ আর এখনকার তার ভাবনার চোখে দেখা এই কল্পনার জগত, এই দুই জগত নিয়ে সে খেলে। এই খেলার একখানা মাঠও তার রয়েছে। সেই মাঠের নাম অন্দরমহল। অন্ধ বিভূঁইয়ের বুকের ভেতরের অন্দরমহল।

কিন্তু দিন যেতেই বিভূঁইয়ের কাছে যে শুকনো পচা-আধপচা খাবার ছিল, তাও ফুরিয়ে গেল। সে এমনিতেই খাবার বাঁচাতে দিনে এক আধবার খেত। তার ওপর খাবার জলও ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু অন্ধ বিভূঁইয়ের আর সকল কিছুই যেন তাকে আলো দিয়ে যাচ্ছিল, সহায় দিয়ে যাচ্ছিল। ক’দিন বৃষ্টি হল খুব। বিভূঁই দেবেন্দ্রনারায়ণের রেখে যাওয়া জরের পাত্রে জল ধরে রাখল। খাবার শেষ হয়ে যেতে দু’দিন কিছু না খেয়েই রইল।

এখান থেকে বের হবার বহু পথ সে খুঁজেছে, বহু চেষ্টাও সে করেছে, কিন্তু উপায় মেলেনি। তবে সেদিন পাশের ঘরের সেই ভোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে বিভুঁই হঠাৎ আবিষ্কার করেছিল, সে আসলে যেখানে রয়েছে সেটি মাটি থেকে উঁচু কোনো জায়গায়। দেয়াল ধরে ধরে সামনে এগোতেই তার পায়ে লেগে ভারী কিছু একটা সরে গেল। খানিক বাদে সে বস্তুটির পতনের শব্দ শুনল। মুহূর্তেই। সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সে। আর এক পা-ও নড়েনি। বিভুঁই বুঝতে পেরেছিল, বস্তুটি পড়েছে সে যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার চেয়ে আরো অনেকটা নিচে মাটিতে কোথাও।

বিভুঁই একটা জিনিস সেদিন আবিষ্কার করল। সেই যে ইঁদুর ধরার দিনে যে বিষয়টি নিয়ে তার বুকের ভেতর খচখচ করছিল, তার জবাব যেন সে পেয়েছে। তার মনে হল, আজকাল সে অনেক সূক্ষ্ম শব্দও স্পষ্ট শুনতে পায়। খুব দূরের সামান্য কোনো ঘ্রাণও তার নাসারন্ধ্র এড়িয়ে যেতে পারে না। সে এখানে কতদিন রয়েছে তা সে জানে না। কিন্তু সে এটা ঠিক টের পায়, তার এখানকার এই অন্ধজগতের প্রতিটি মুহূর্ত তাকে তার বয়সের চেয়ে ঢের বেশি বড় করে তুলছে। ঢের বেশি অন্যরকম করে তুলছে ভাবনায়-চিন্তায়, অনুধাবনে।

সেদিন খিদেটা যেন আর সইছিল না বিভুঁইর। মাথার ভেতরটা অবশ হয়ে আসছিল। শরীর কাঁপছিল থরথর করে। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত বিভুঁই সেদিন রাতে ভয়ংকর এক কাজ করে ফেলল। সে হরিণের মতোন কান খাড়া করে বসে রইল সারাদিন। তারপর হঠাৎ হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগুলো। খানিক থামল। তারপর আবার এগুলো। তারপর আগের সেই দিনের মতোই তার হাতখানা। হঠাৎ বিদ্যুৎ বেগে ছোবল মারল। হাতের তালুতে উঠে আসল আরেকখানা প্রকাণ্ড ব্যাঙ। বিভুঁই আবার ফিরে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইল। তখন সময় কত বিভুঁই জানে না। সে কী করছে তাও যেন জানে না। সে কেবল জানে তাকে বাঁচতে হবে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য বিভঁই হঠাৎ জীবন্ত ব্যাঙটির শরীরে দাঁত বসিয়ে দিলো। তার চোয়ালের সমস্ত সঞ্চিত শক্তিতে কামড় বসিয়ে দাঁত দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চাইল অংশটুকু। চাবাতে লাগলো উন্মাদের মতোন। কিন্তু শেষ অবধি পারল না। হড়বড় করে বমি করে দিলো সে। এই এতদিনের উপোষ বিভূঁইয়ের শূন্য উদর কেবল খানিক ঘন তরল উগড়ে দিতে পারল। আর কিছুই না। বিভুঁই ব্যাঙটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো দূরে। তার শরীর তখন থরথর করে কাঁপছে। সে নেতিয়ে পড়ল তার তরল বমির ভেতর। তারপর চেতনা হারাল।

বিভুঁই দেখতে পেল না, তার শক্ত কামড়ে ব্যাঙটির পেছনের একখানা পা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে তখনও বিভৎসভাবে লেপ্টে রয়েছে শরীরের সাথে। সেই লেপ্টে থাকা ক্ষতবিক্ষত অকার্যকর পা’খানা নেতিয়ে আছে মেঝেতে। কিন্তু বিস্মিত ব্যাঙটি প্রবল বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে অচেতন বিভূঁইয়ের দিকে।

তার সেই চোখের ভাষার অর্থ কী কে জানে!

*

হরিহরণ বণিক যেখানে বসে আছে তার আশেপাশে কোনো মনুষ্য বসতি নেই। চারপাশে জল। জলের মাঝখানে মাথা উঁচু করে আছে নলখাগড়ার ঝোঁপ। লম্বা ঘন কাশবন। জল পেরিয়ে নলখাগড়ার ঝোঁপ আর কাশবন ডিঙালেই ঘন ঘাসে ছাওয়া চাতালের মতোন জায়গা। দু’খানা আম আর একখানা ছাতিম গাছ। তার নিচেই ছোট কুঁড়েঘর। এই জায়গার নাম বজরাডুবির চর। আগে হরিহরণ কোনো এক অদ্ভুত কারণে এই জায়গাটিতে প্রায় নিয়মিতই আসত। তবে আজকাল অনেকদিন আসা হয় না। এবার আসার কারণটা অবশ্য গুরুতর।

সেই রাতে হেমাঙ্গিনী দেবীকে নিয়ে আসার পর থেকে অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। বজরাডুবির চরেই হরিহরণ আর হেমাঙ্গিনী দেবী। হরিহরণ এদিক সেদিক থেকে নানান খাবার সগ্রহ করে এনেছে। নদী থেকে মাছ ধরেছে। এই কুঁড়েঘরে সে প্রায়ই আসত বলেই কিছু পাত্র আর আগুন ধরানোর ব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু সেই রাতেই হেমাঙ্গিনী দেবী প্রবল জ্বরে পড়ল। টানা এক সপ্তাহ নিষ্প্রাণ পড়ে রইল হেমাঙ্গিনী দেবী। জগত সংসারের আর কোনো কিছুর কথা

এই ক’দিনে তার আর খেয়াল রইল না। হরিহরণ বণিক মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে হেমাঙ্গিনী দেবীও গুটিবসন্তে-আক্রান্ত হতে যাচ্ছে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে হেমাঙ্গিনী দেবী জ্বর থেকে সেরে উঠল। ধীরে ধীরে খানিকটা করে দুর্বলতাও কাটিয়ে উঠেছে সে।

সেদিন বিকেলে ফুরফুরে হাওয়া আসছিল গঙ্গাবতী থেকে। হেমাঙ্গিনী দেবী ঘরের দাওয়ায় চুল মেলে বসে ছিল। হাওয়ায় তার চুল উড়ছিল। হরিহরণ দু’খানা বড় শুকনো ডাল নিয়ে এলো কোথা থেকে। সেগুলো ছোট ছোট করে ভেঙে সার বেঁধে রাখল। তারপর হেমাঙ্গিনী দেবীর সামনে এসে বসল।

হেমাঙ্গিনী দেবী অবশ্য হরিহরণের দিকে ফিরেও তাকাল না। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গঙ্গাবতীর দিকে। তার সামনের নলখাগড়া আর কাশবন হাওয়ায় দুলছে। হরিহরণ বলল, এখন কেমন ঠেকছিস?

হেমাঙ্গিনী দেবী কোনো জবাব দিলো না। সে যেমন তাকিয়ে ছিল ঠিক তেমনই তাকিয়ে রইল। যেন একখণ্ড প্রস্তর মূর্তি। হরিহরণ ধীরে হেমাঙ্গিনী দেবীর কাছে এলো, তারপর আলতো হাত রাখলো তার মাথায়। হেমাঙ্গিনী দেবীর কী যে হলো! এই এইটুকু ছোঁয়ায় সে যেন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল। হরিহরণকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সে। হরিহরণ কোনো কথা বলল না। সে হেমাঙ্গিনী দেবীকে ধরে রাখল। হরিহরণ জানে, হেমাঙ্গিনী দেবীর বুকের ভেতর না বলা এক পৃথিবী কথা। যার অনেক কিছুই কেউ জানে না। তবে হরিহরণ জানে, দুঃখ মানব জীবনের সবচেয়ে গভীরতম অনুভূতি। মানুষ তার জীবনের সকল আনন্দময় অনুভূতির কথা অবলীলায় ভুলে যেতে পারে। কিন্তু দুঃখের কথা ভোলে না। সে দুঃখদের বুকের ভেতর পুষে রাখে সারাজনম।

হেমাঙ্গিনী দেবী হঠাৎ কান্নাজড়িত গলায় বলল, আমি একটা নোংরা মেয়ে মানুষ হরি কাকা। আমি একটা নোংরা মেয়ে মানুষ। আমার সারা গা-ভর্তি পাপ। সেই পাপ আমার গা থেকে মনেও ছেয়ে গেছে। আমি আর মানুষ নাই গো হরি কাকা। আমি অমানুষ হয়ে গেছি, অমানুষ।

হরিহরণ কী বলবে! তার বলার কী আছে! সে কিছু বলল না। হেমাঙ্গিনী দেবীই বলল, আমার এই বুকের মধ্যে শুধু কষ্ট আর কষ্ট। অনেক অনেক কষ্ট হরি কাকা। অনেক অনেক কষ্ট।

হেমাঙ্গিনী দেবী থামলেও হরিহরণ কোনো কথা বলল না। হেমাঙ্গিনী দেবীই বলল, বুঝলে হরি কাকা, কিছু কিছু কষ্ট মানুষকে শেষ করে দেয়। নিস্তেজ করে দেয়। তোমায় যেমন দিয়েছে। আর কিছু কষ্ট মানুষকে হিংস্র জানোয়ার করে ফেলে। আমায় হিংস্র জানোয়ার করে ফেলেছে হরি কাকা।

হরিহরণ এবারও কোনো কথা বলল না। সে বুঝতে পারছে, হেমাঙ্গিনী দেবী তাকে অনেক কথা বলবে। অনেক না বলা কথা। যা হয়তো সে এই জগতের আর কাউকেই কখনো বলেনি। কাউকেই।

হেমাঙ্গিনী বলল, বিভূঁইয়ের জন্য মন কেমন করছে কাকা।

হেমাঙ্গিনী দেবীর ছেলের নাম বিভূঁই। এ কথা হরিহরণ জানে। এ কদিনে হেমাঙ্গিনী দেবী ঘুমের ভেতর অজস্রবার বিভূঁইয়ের কথা বলেছে। প্রলাপ বকেছে। কেঁদেছে। হরিহরণ সব শুনেছে। কখনো কখনো কিছু বিষয় ভেবে তার অবাক লেগেছে। কখনো কখনো সে উত্তর মেলাতে পারেনি। যেমন এই মুহূর্তে তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে ওই রাতে বিভুঁই কী করে গঙ্গাবতী নদীতে নিতাইয়ের নাওয়ের কাছে গেল! হেমাঙ্গিনী দেবীর কথা শুনে মনে হয়েছে সে এই সকলই জানত! কিন্তু কোনো মা কী করে তার কালব্যাধিতে-আক্রান্ত পুত্রকে ওভাবে ছেড়ে দিতে পারে?

হরিহরণ কিছু বলল না। হেমাঙ্গিনী দেবীই বলল, আমি তো মা নই, আমি এক রাক্ষুসি। প্রতিশোধ উন্মত্ত অমানুষ হরি কাকা, অমানুষ, রাক্ষুসি।

কিছুক্ষণ আগে কান্নায় ভেঙে পড়া হেমাঙ্গিনী দেবী মুহূর্তের মধ্যে শরীর কাঁপিয়ে উন্মাদের ন্যায় হাসতে লাগল। হরিহরণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হেমাঙ্গিনী দেবী অনেকক্ষণ বাদে হাসি থামিয়ে স্থির হলো। কিন্তু তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। স্থির হেমাঙ্গিনী দেবী বলল, তোমার কী মনে হয় হরি কাকা? জগতে ভগবান বলে কিছু আছে?

হরিহরণ জবাব দিল না। হেমাঙ্গিনী দেবীই বলল, থাকলে কি সে কিছু দেখতে পায় না? কিচ্ছু না?

হরিহরণ এবার বলল, হা পায়, দেখতে পায়। সকলই দেখতে পায়। কিন্তু সে তো আর আমাদের মতোন না, সে তার মতোন করেই দেখতে পায়।

হেমাঙ্গিনী দেবী বলল, তার মতোনটা কী? আমায় বল হরি কাকা, ভগবানের মতোনটা কি? সে কী রকম? কী রকম করে সে দেখে?

হরিহরণ জবাব দিলো না। সে হেমাঙ্গিনী দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই হেমাঙ্গিনী! সেই ছোট্ট কাপড়ের পুঁটলির ভেতর গঙ্গামহলে দেখা প্রথম দিনের হেমাঙ্গিনী দেবী তার সামনে বসে রয়েছে। সেই হেমাঙ্গিনী দেবী আর তার সামনে বসা এই মানুষ দু’টো এক! হরিহরণের যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।

হেমাঙ্গিনী দেবী বলল, আজ আমি তোমায় অনেক কথা বলব হরি কাকা। অনেক কথা।

হরিহরণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হেমাঙ্গিনী দেবী খানিক সময় নিল। তারপর শুরু করল, তুমি আমায় জিজ্ঞেস করেছিলে না, বিভূঁইয়ের পরিচয় কেউ জানে কি না?

হরিহরণ বলল, হু। তুই বললি, বড়বাবুর স্ত্রী বীণাবালা জানেন।

হেমাঙ্গিনী দেবী বলল, হা। বীণাবালা জানেন। তুমি তো জানোই, বড়বাবুর মেয়ে গায়ত্রীর শ্বশুর বাড়ি রাইপুরে।

হরিহরণ বলল, হা জানি।

হেমাঙ্গিনী দেবী বলল, দু’বছর আগে এক সন্ধ্যায় রাইপুরে গায়ত্রীর শ্বশুরবাড়ি থেকে আমার ডাক এলো। আমি ভারি অবাক হলাম। তবে অবাক হলেও গেলাম। গিয়ে দেখি সেখানে বড়বাবুর স্ত্রী বীণাবালা। বীণাবালার সাথে গঙ্গামহলের অতি পুরাতন এক দাসী। বীণাবালা আমায় খুব যত্ন করলেন। আক্ষেপও করলেন। আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। ওভাবে বহুদিন আমায় কেউ ভালোবাসেনি হরি কাকা। মায়ের মতোন করে। জগতের সকল পুরুষেরা আমার শরীরটাকে ভালোবেসেছে। আর সকল নারীরা আমায় ঘৃণা করেছে। কেউ আমায় এভাবে ভালোবাসেনি গো কাকা। তিনি আমায় কতকিছু কিনে দিলেন! দুদিন সে বাড়িতে রাখলেন। কত কথা যে বললেন! জানি না কী করে, কিন্তু তিনি যেন সকলই জানেন। আমার মা কিভাবে গঙ্গামহলে এলো! তারপর কী হলো! সকল ঘটনা তিনি জানেন! তবে তোমার কথা হয়তো জানেন না। তোমায় নিয়ে এই এতদিনে কখনো কিছু বলেননি। সেই দুটো দিন আমি যেন সব ভুলে রইলাম হরি কাকা। আমার রাইপুরের বাড়ির কথা। অতীতের কষ্টের কথা। সব। যেদিন চলে আসব, আমার আর আসতে মন চাইছিল না। সে কথা আমি তাকে বললাম। শুনে উনি বললেন, তোমার তো রাইপুরের ওই বাড়িতে থাকার কথা নয়। তোমার থাকার কথা গঙ্গামহলে। আমি কিন্তু তোমার ছেলের কথা জানি। আমি বললাম, কী জানেন? তিনি বললেন, তোমার ছেলের আসল পরিচয়। আমি খুব চমকে গেলাম। বললাম, কী করে জানেন? তিনি সোজা জবাব দিলেন না। বললেন, জানি, এটুকুই যথেষ্ঠ। আমি অনেক জানতে চাইলাম কী জানেন, কে কী বলেছে? কিন্তু উনি কিছুই বললেন না। আমার কেন যেন খুব ভয় হতে লাগল।

হরিহরণের কৌতূহল কম। কিন্তু আজ প্রবল কৌতূহল নিয়ে সে হেমাঙ্গিনী দেবীর কথা শুনছে। সে বলল, তারপর?

হেমাঙ্গিনী দেবী বলল, তারপর বীণাবালা বললেন, ওই ছেলের শরীরে যে বিষ্ণুপুর জমিদার পরিবারের রক্ত বইছে, সে কথা তিনি জানেন। এটা শুনে আমি যে খুব অবাক হয়েছি, তা নয়। কারণ সেই যে দেবেন্দ্রনারায়ণ আমায় রাইপুর থেকে জোর করে বারোহাটির বাগানবাড়িতে তুলে নিয়ে গেলেন। মাসখানেক রেখে আবার পাঠিয়েও দিলেন। তার আট-ন’মাস পরেই বিভূঁইয়ের জন্ম। হয়তো বিষ্ণুপুরের কেউ তারপর আর আমায় মনেই রাখেনি। ভুলেই গেছে। আমার খবরও কেউ রাখেনি। আর বিভূঁইয়ের খবরও আমি কাউকে জানতে দিতে চাইনি। ওকে লুকিয়ে রেখেছি যতটা পেরেছি। তাহলে কারো জানার। কথাও নয়। কিন্তু কেউ যদি পুরোটা খেয়াল করত, জানত। তাহলে তার জন্য বোঝা কঠিন কিছু ছিল না যে বিভুঁই দেবেন্দ্রনারায়ণেরই সন্তান।

এবার হরিহরণ থমকে গেল। সেও অবচেতনভাবেই কখনো না কখনো ভেবেছিল। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে সচেতনভাবে সে কখনোই ভাবতে চায়নি। জানতেও চায়নি। যতটা পেরেছিল, হেমাঙ্গিনী দেবীকে ভুলে থাকতে চেয়েছিল। তার ওপর নিজের মানসিক অবস্থাও ভয়াবহ। দিনকে দিন যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। ফলে এ নিয়ে সে কোনো আগ্রহই দেখায়নি। তাহলে হেমাঙ্গিনী দেবীর পুত্র বিভুঁই দেবেন্দ্রনারায়ণেরই সন্তান? বিষ্ণুপুরের জমিদার বাড়ির রক্ত তার গায়ে? তাহলে সেদিন রাতের সেই অন্ধকারে দেবেন্দ্রনারায়ণ ওই জঙ্গল থেকে বিভূঁইকে উদ্ধার করেছিলেন কি এই জন্যই? তাহলে কি দেবেন্দ্রনারায়ণও জানেন, বিভুঁই তারই সন্তান?

হরিহরণ কিছুই বুঝতে পারছে না। তার কাছে সকলই কেমন গোলকধাঁধার মতোন লাগছে। ভাবনা-চিন্তা গুলিয়ে যাচ্ছে। সে হেমাঙ্গিনী দেবীকে বলল, দেবেন্দ্রনারায়ণ জানতেন?

হেমাঙ্গিনী দেবী কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল, না, তিনি জানতেন না।

হরিহরণ বলল, তাহলে?

হেমাঙ্গিনী দেবী বলল, আগে পুরোটা শোনো হরি কাকা। এ এক লম্বা গল্প। এই গল্প বড় কষ্টের, লজ্জার। ভয়ঙ্কর রহস্যেরও।

হেমাঙ্গিনী দেবী খানিক থামল। তারপর বলল, তুমি কোনোদিন ভাবতেও পারবে না, তোমার সামনে দাঁড়ানো এই হেমাঙ্গিনী দেবী তার বুকের ভেতর দিনের পর দিন কী ভয়াবহ সব সত্য চেপে বেঁচে আছে! কী ভয়ংকর অবিশ্বাস্য সব সত্য!

হরিহরণ হেমাঙ্গিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। হেমাঙ্গিনী দেবীর কাছে তার অনেক জিজ্ঞাসা। কিন্তু খুব বড় একটি জিজ্ঞাসার জবাব সে পেয়ে গেছে। বিভূঁই দেবেন্দ্রনারায়ণের সন্তান। তাহলে? তাহলে আর কি এমন ভয়ংকর সত্য, যা দিনের পর দিন হেমাঙ্গিনী দেবী নিজের ভেতর পুষে রেখেছে!

হেমাঙ্গিনী দেবী আবার বলতে শুরু করল, সেদিন রাইপুরে গায়ত্রীর শ্বশুরবাড়িতে বীণাবালার কথা শুনে আমি খুব একটা অবাক হইনি দেখে তিনি বললেন, তোমার ওপর দেবেন্দ্রনারায়ণ আর বিষ্ণুনারায়ণ যে অন্যায় করেছে, তার কোনো প্রায়শ্চিত্ত নেই। প্রায়শ্চিত্ত হয়ও না। তারও আগে তোমার মা-বাবা, তাদের প্রতি যোগেন্দ্রনারায়ণ যা করেছেন…। এই পর্যন্ত বলেই বীণাবালা সেদিন থেমে গিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ কোনো কথা বলেননি। তারপর আমার হাত তার হাতের ভেতর নিয়ে চেপে ধরে বললেন, তুমি এদের ক্ষমা করো না। এদের ক্ষমা করলে ভগবানও রুষ্ট হবেন। আমি তোমার সাথে আছি। বীণাবালার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। তিনি আমায় বললেন, তোমায় গঙ্গামহল যেতে হবে। তোমার সন্তানকে নিয়ে। বাকিটুকু আমি দেখব।

হেমাঙ্গিনী দেবী সামান্য থামল। তারপর আবার বলল, এরপর বীণাবালা চলে গেলেন। তবে মাঝে-মধ্যেই আমার সাথে তার যোগাযোগ হতো। আসতেনও। খুব আদর করতেন আমায়। কিন্তু এমন হলে আর সবার যা হতো, আমারও সন্দেহ হতে লাগল। বারবার একটি প্রশ্নই মাথার ভেতর ঘুরে ফিরে এসেছে, উনি কেন আমায় সাহায্য করতে চাইছেন? উনি বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়ির বড় বউ। আমার মতো আশ্রিতা, নষ্টা এক বাজারের মেয়ে মানুষকে উনি কেন সাহায্য করতে চাইবেন? জমিদার বাড়ির প্রতি উনার কি ক্ষোভ? আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। তবে একদিন আমি উনাকে জিজ্ঞেসও করে ফেললাম।

হেমাঙ্গিনী দেবী খানিক ঢোক গিলল। তারপর তাকাল গঙ্গাবতীর দিকে। নদীর জল ছুঁই ছুঁই উচ্চতায় দুটি গাঙচিল উড়ে যাচ্ছে। কী সুন্দর দৃশ্য! কিন্তু সেই দৃশ্য তাকে টানল না। তার দৃষ্টি যেন সেসব ছাড়িয়েও দূরে কোথাও।

হরিহরণ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল। সে বুঝতে পারছে না বীণাবালা কী চাইছে? কেন সে হেমাঙ্গিনী দেবীকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে? কোন বিষবৃক্ষের বীজ লুকিয়ে ছিল গঙ্গামহলের অন্দরমহলে? হেমাঙ্গিনী দেবীর নিরবতা দেখে হরিহরণ শেষ অবধি জিজ্ঞেস করল, তারপর? বীণাবালা কী বলল?

হেমাঙ্গিনী খানিক সময় নিয়ে বলল, বীণাবালা বললেন, বিষ্ণুপুর জমিদারির উত্তরাধিকারী হবার কথা উনার স্বামী অবনীন্দ্রনারায়ণের। কিন্তু তার শ্বশুর বিষ্ণুনারায়ণ তা হতে দিচ্ছেন না। তিনি জমিদারির উত্তরাধিকারী করে তুলছেন মেজোপুত্র দেবেন্দ্রনারায়ণকে। এ তিনি মেনে নিতে পারেন না। তিনি এ কিছুতেই হতে দেবেন না। আরও অনেক কথাই তিনি বললেন। বললেন, বিষ্ণুনারায়ণ নাকি ছোটবেলা থেকেই দেবেন্দ্রনারায়ণের জন্য অবনীন্দ্রনারায়ণকে কম স্নেহ করতেন। কম গুরুত্ব দিতেন। এর কারণ অবনীন্দ্রনারায়ণ কোমল, তার মধ্যে বিষ্ণুপুর জমিদার পরিবারের মতোন ঔদ্ধত্য নেই। এ সকল কারণে তাকে সবসময় উপেক্ষা করা হয়েছে। এমনকি বীণাবালা গঙ্গামহলে বউ হয়ে আসবার পরও দেখেছেন, দেবেন্দ্রনারায়ণের বিবাহের পর থেকে তার স্ত্রী রেণুকাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যেন রেণুকাই গঙ্গামহলের জমিদারপত্নী। দিনের পর দিন তাকে অনেক উপেক্ষা, অপমান সহ্য করতে হয়েছে। অথচ তার বাবাও জমিদার। তিনি দিঘাগড়ের জমিদার পরিবার থেকে এসেছেন। কিন্তু সাধারণ এক পরিবার থেকে আসা মেজোবউ রেণুকার কাছে দিনের পর দিন তিনি উপেক্ষিত হয়েছেন। তিনি এসব আর সহ্য করতে পারছেন না। অবনীন্দ্রনারায়ণ এই জমিদারির প্রকৃত উত্তরাধিকারী। সুতরাং যে করেই হোক অবনীন্দ্রনারায়ণকেই তিনি বিষ্ণুপুরের জমিদারিতে দেখতে চান। এতে তিনি যেকোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত। প্রয়োজনে দেবেন্দ্রনারায়ণ আর বিষ্ণুনারায়ণের বিনাশ দেখতে চান তিনি। এদের বিনাশ হলেই কেবল অবনীন্দ্রনারায়ণ হবেন বিষ্ণুপুর জমিদারির জমিদার।

হেমাঙ্গিনী দেবী থামল। কিন্তু হরিহরণ সাথে সাথেই বলল, তারপর?

হেমাঙ্গিনী দেবী খানিক জল খেল। তারপর বলল, উনার কথা শুনে আমি প্রথম ভড়কে গিয়েছিলাম হরি কাকা। কিন্তু জানো তো, আমার এই পোড়া জীবনের সকল কিছুর জন্য দায়ী ওই বিষ্ণুপুর। বিষ্ণুপুরের ওই জমিদার বাড়ি, বিষ্ণুনারায়ণ, দেবেন্দ্রনারায়ণও। দেবেন্দ্রনারায়ণ দিনের পর দিন আমায় নিয়ে খেলেছেন। আমার বিশ্বাস নিয়ে খেলেছেন। আমায় বানিয়ে রেখেছিলেন তার খেলার পুতুল। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটিয়েছে বিষ্ণুনারায়ণ। আমার জীবনটা এই অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছে সে। তুমি জানো না হরি কাকা, ওই শান্ত শিষ্ট চেহারার বৃদ্ধ জমিদারের আড়ালে একটা নরকের কীট লুকিয়ে আছে। সাক্ষাৎ শয়তান! আমি ছাড়া সে কথা আর কেউ জানে না হরি কাকা। কেউ না।

হেমাঙ্গিনী দেবী হঠাৎ ফণা ধরা সাপের মতো ফুঁসে উঠল। তার চোখ জ্বলছে। বুক হাপড়ের মতো উঠছে নামছে। শক্ত চোয়ালের হেমাঙ্গিনী দেবী বলল, আমার তখন মনে হলো, যে করেই হোক আমি আমার সারা জনমের প্রতিশোধ চাই। প্রতিশোধ। প্রতিশোধ বড় খারাপ জিনিস হরি কাকা। আমি বীণাবালাকে বললাম, আমিও চাই, যে করেই হোক, আমিও দেবেন্দ্রনারায়ণ আর বিষ্ণুনারায়ণের ধ্বংস দেখতে চাই। বীণাবালা আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে শুরু করলেন। শুধু যে এসকল কথাই বলতেন, তা নয়। নানান কথা বলতেন। ঘন ঘন রাইপুর গায়ত্রীদের বাড়ি যেতেন। আমায় ডাকতেন। একসময় আমার সত্যি সত্যিই উনাকে খুব আপন মনে হতে লাগল হরি কাকা। খুব আপন। আমার চেয়ে বয়সে বড় হলে মায়ের মতো তো আর নন। কিন্তু আমার সাথে তিনি যেন হয়ে উঠলেন ঠিক মায়েরই মতোন। কী যে যত্ন করেন আমায়। আমার দুঃখে কাঁদেন অবধি। উনি বিভূঁইকে কখনো দেখেননি। রাইপুরে গায়ত্রীদের বাড়ি গেলেও আমার বাড়িতে কখনো যাননি তিনি। আমিও বিভূঁইকে কখনো কোথাও নিয়ে যাই না। বছরখানেক আগে উনিই আমায় বললেন, বিভূঁইকে আমার কাছে ওই পরিবেশে না রেখে আপাতত যেন দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিই। সেখানে পড়াশোনা করবে। ওনার কথাখানি আমার ভারি পছন্দ হলো। মনে হলো উনি ঠিকই বলেছেন। বিভূঁইকে পাঠিয়ে দিলাম বিনয়পুর। ওখানে পড়বে, থাকবে। আমি দু’তিনমাস বাদে গিয়ে দেখে আসব। কিন্তু কী ভাগ্য নিয়ে জন্মেছি হরি কাকা। বেশ্যা বলে সেখানেও মানুষ আমায় চেনে। আমার নাম শুনেছে। বাজারি মেয়ে হিসেবে ভালোই নাম কিনেছি গো হরি কাকা।

এই প্রবল বিষাদ সময়েও হেমাঙ্গিনী দেবী হাসল। আর হরিহরণ প্রতিশব্দেই না জানা নতুন গল্প শুনছে। এতকিছু ঘটে গেছে তার অগোচরে! হেমাঙ্গিনী দেবীকে আজ তার বড় অচেনা মনে হচ্ছে।

হেমাঙ্গিনী দেবী আবার শুরু করল, আমার পরিচয়ে বিভূঁইকে কেউ ভর্তি করতে চাইল না। বিনয়পুরেও আমার নাম সকলে জানে। শেষ অবধি ভর্তি করানো গেল, কিন্তু তা আমার নাম গোপন করে। ততদিনে আমি ভেতরে ভেতরে প্রতিহিংসায় উন্মাদ। দেবেন্দ্রনারায়ণ আর বিষ্ণুনারায়ণের উপর কিভাবে প্রতিশোধ নেব? কিভাবে! বীণাবালার সঙ্গে দেখা হলেই আমি জানতে চাইতাম। উনি প্রতিবারই বলতেন, সময় আসুক। অপেক্ষা করতে হবে। সময়ের কাজ অসময়ে হয় না। সময় আসবেই। কিন্তু আমার আর অপেক্ষা সহ্য হচ্ছিল না কাকা। রোজ আমার ভেতরের আগুন যেন আরো দাউদাউ জ্বলে। বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়ি বিষ্ণুনারায়ণ আর দেবেন্দ্রনারায়ণকে আমার পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে হবে। আমার তখন মার কথা খুব মনে পড়ত। খুব। বাবাকে দেখিনি, কিন্তু তাকে ভীষণ মনে পড়ত। হরিকাকা, আর এ সকল ছাড়াও আরেকটা অতীত আমার রয়েছে। ভয়াবহ অতীত হরিকাকা!

হেমাঙ্গিনী তার পা’দু’খানা বিছিয়ে দিল মাটিতে। তারপর দূর দিগন্ত থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেই বিছিয়ে রাখা পায়ের দিকে। তার চোয়াল যেন শক্ত হয়ে উঠল। সে সাপের মতো হিসহিস করে বলল, সেই ভয়াবহ অতীতের কথাও খুব মনে পড়ত। মনে হতো যে কিছুর বিনিময়েই হোক, বিষ্ণুনারায়ণ আর দেবেন্দ্রনারায়ণের বিনাশ চাই আমি। বিনাশ!

হেমাঙ্গিনী দেবী থামল। কিন্তু হরিহরণ বিস্ফারিত চোখে হেমাঙ্গিনী দেবীর দিকে তাকিয়ে রইল। এই হেমাঙ্গিনী দেবীকে সে চেনে না। এ যেন ফণা তোলা এক কালনাগিনী। হেমাঙ্গিনী দেবী সময় নিয়ে খানিক ধাতস্ত হলো।

তারপর বলল, কিন্তু ভগবান নেই হরি কাকা। ভগবান নেই। বিনয়পুরে গুটিবসন্তের প্রকোপ বাড়ল। বড় দেরি করে খবর পেলাম আমি। বিভূঁইয়ের গায়েও গুটি উঠেছে। সেখানে গুটি ওঠা কারো সাথেই তার আত্মীয়-স্বজনের দেখা করতে দিচ্ছে না। জানাচ্ছেও না কাউকে। যদি দেখা করতে গিয়ে রোগ আরো ছড়ায়? দূরের কোনো দেশ থেকে খেরেস্তান এসেছে চিকিৎসা দিতে। কিন্তু তাতে কেউ বাচছে না। আবার তারা কাউকে কারো সাথে দেখা করতেও দিচ্ছে না। তবে যাদের অনেক প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, তারা হয়তো কোনোভাবে রোগীর সাথে দেখা করতে পারছে, নিয়েও আসতে পারে। কিন্তু এখানে-সেখানে শোনা যাচ্ছে, রোজ রাতেই নাকি একজন দু’জন রোগী মারা যাচ্ছে। মারা যাওয়াদের পরদিন থেকে আর খোঁজ মিলছে না। এই নিয়ে কেউ কোনো উচ্চবাচ্যও করছে না। সকলেই গুটিবসন্তের ভয়ে শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। কে কার কথা বলবে! আমি পাগলের মতো বিনয়পুরে গেলাম। গুটিবসন্ত যাদের উঠেছে, তাদের সকলকে একটা আলাদা ঘরে রাখা হয়েছে। কাউকে সেখানে যেতে দেয়া হয় না। আমি দূর থেকে বিভুঁইকে দেখলাম কিন্তু কাছে যেতে পারলাম না। আমায় একভাবে তাড়িয়েই দিলো ওরা। সকলেই জানে, আমার কেউ নেই। তাছাড়া আমি বাজারের মেয়ে। কে শুনবে আমার কথা! আমার হয়ে কথা বলারও কেউ নেই। আর বিভুঁইকে তো আমার নামে ভর্তিও করা হয়নি। আমি পাগলের মতোন ফিরলাম রাইপুর। কী করব আমি? একবার মনে হয়েছিল, ভগবান যেমন চেয়েছেন তেমনই হচ্ছে। বিভূঁইকে ভগবান আমায় দিয়েছিলেন পাপের ফসল করে। আবার নিয়েও যাচ্ছেন। কিন্তু মায়ের মন তো! মানে না গো হরি কাকা! মানে না।

গঙ্গাবতীর তীর হতে দমকা হাওয়ায় হেমাঙ্গিনী দেবীর শাড়ির আঁচল, এলোমেলো চুল উড়ে গিয়ে তার মুখ ঢেকে দিচ্ছিল। হেমাঙ্গিনী দেবীর সে সবে খেয়াল নেই। সে বলে চলেছে, সেই রাতেই বহু বছর পর বারোহাটি বাগান বাড়ি থেকে দেবেন্দ্রনারায়ণের লোক গেল রাইপুরে। সোজা আমার বাড়িতে। দেবেন্দ্রনারায়ণের কাছ থেকে আমার ডাক এসেছে। কিন্তু আমি তাকে ফিরিয়ে দিলাম। আমার তখন ভয়াবহ অবস্থা। কিন্তু পরদিনই বীণাবালাও এলেন রাইপুরে। আমায় খবর দিয়ে নিলেন গায়ত্রীদের বাড়ি। আমি তার পায়ে লুটিয়ে পড়লাম, আমি একবার বিভুঁইকে দেখতে চাই, শুধু একবার। বীণাবালা সঙ্গে সঙ্গেই কিছু বললেন না। চুপ করে কী যেন ভাবলেন। তারপর অনেকক্ষণ বাদে বললেন, তিনি বিভুঁইকে আনানোর ব্যবস্থা করবেন। তবে তার আগে আমায় একখানা কাজ করতে হবে। বীণাবালা ছক কেটেই এসেছিলেন। তিনি বিষ্ণুপুর বসেই জেনেছিলেন যে দেবেন্দ্রনারায়ণ আমায় আনাতে লোক পাঠিয়েছেন। তিনি এতদিন ধরে যে অপেক্ষার কথা বলতেন, সময়ের কথা বলতেন, সেই সময় যেন এলো। তিনি আমায় বললেন, আমি যেন দেবেন্দ্রনারায়ণকে খবর পাঠাই যে, আমি বারোহাটিতে আসছি। আর ওদিকে তিনি বিনয়পুর থেকে বিভুঁইকে আনানোর ব্যবস্থা করবেন।

হরিহরণ বলল, তাতে বীণাবালার লাভ?

হেমাঙ্গিনী দেবী বলল, প্রতিশোধের নেশা বড় ধ্বংসের নেশা হরি কাকা। বীণাবালা আমায় বলল সে গভীর রাতে লোক দিয়ে বিভূঁইকে গঙ্গামহলের কাছাকাছি কোথাও নদীর তীরে পৌঁছে দেবে। বিভূঁইয়ের সাথে থাকবে আমার হাতের লেখা একখানা চিরকুট। সেই চিরকুটে বিভুঁইয়ের পরিচয় লেখা থাকবে। গুটিবসন্তে তো দেশজুড়ে মহামারি লেগে গেছে। সকলের আতঙ্ক। এইসময় ও রোগে আক্রান্ত বিভুঁইকে গঙ্গাবতীর তীরে পাওয়া গেলে এমনিতেই প্রজাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেবে। তার ওপর সেই সন্তান যদি হয় জমিদার বাড়ির সন্তান, যার মাতা কিনা আবার নষ্টা হেমাঙ্গিনী দেবী। একইসাথে এই দুটি ঘটনা প্রকাশ পেলে একটা ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে যাবে! আর এই সুযোগটা নেবেন বীণাবালা। কারণ ভুজঙ্গ দেব আর বিভূতিনাথ সাহার মতোন দু’জন মানুষ আছে। তার এই ষড়যন্ত্রে। বাদবাকি কাজ করবেন এই দু’জন। আর বীণাবালা আমায়। বলেছিলেন যে, অমন কালব্যাধিতে কেউ বাঁচে না। বিভূঁইও বাঁচবে না। তারপরও তিনি বিভুঁইকে যেকোনো উপায়ে আমার কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। আমার তখন আর নতুন করে হারানোর কিছু নেই হরি কাকা। আমার জগতে আর কী আছে বলো? বীণাবালা যা বললেন, আমি তাতেই রাজি হয়ে গেলাম। আমার বিভুঁইর সাথে দেখা তো হবে।

হরিহরণ বললেন, কিন্তু তোকে কেন দেবেন্দ্রনারায়ণের বাগানবাড়ি বারোহাটিতে আসতে হবে?

হেমাঙ্গিনী দেবী অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। তারপর হঠাৎ বলল, বীণাবালা বড় ভয়ংকর গো হরি কাকা। ওই মা দূর্গার মতোন মুখভর্তি কী মায়া! অথচ উনি চেয়েছিলেন আমি যেন দেবেন্দ্রনারায়ণকে খুন করি।

হরিহরণ যেন বড় কোনো ধাক্কা খেলেন, বললেন, খুন!

হেমাঙ্গিনী দেবী বললেন, হ্যাঁ, বীণাবালা চেয়েছিলেন আমি দেবেন্দ্রনারায়ণকে খুন করব। তার খাবারে বিষ মিশিয়ে হোক, আর অন্য কোনোভাবে তোক। আর খুন করে যেন আমি সেই রাতেই পালিয়ে যেতে পারি সে জন্যই তিনি বারোহাটি বাগানবাড়িতে দেবেন্দ্রনারায়ণের ঘরের যে গুপ্তপথ। রয়েছে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন।

হরিহরণের এসবের কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। তার এখনো মনে হচ্ছে, সে অবিশ্বাস্য কোনো ঘটনা শুনছে! তার আশেপাশের জগতের ঘটনা এ নয়। তার মনে এখনও অনেক প্রশ্ন। সে বলল, বীণাবালা কী করে জানল ওই গুপ্ত পথের কথা?

হেমাঙ্গিনী দেবী বলল, তুমি রামচরণ কারিগরকে চেন?

হরিহরণ বলল, হ্যাঁ, চিনি। এখন যে ছেলেটা বারোহাটি বাগান বাড়িতে মিস্ত্রির কাজ করে সনাতন, ওই সনাতনে মিস্ত্রীর বাপ হলো রামচরণ কারিগর। জানিসই তো, বারোহাটির বাগানবাড়ির কাজ পছন্দ হয়নি বলে দেবেন্দ্রনারায়ণ তার হাত কেটে ফেলতে চেয়েছিলেন।

হেমাঙ্গিনী দেবী বলল, হ্যাঁ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাত কেটে ফেলতে হয়নি। বিষ্ণুনারায়ণ ঠেকিয়েছিলেন। তবে সেই থেকে রামচরণ কারিগর আর কোনো কাজ করতে পারে না। বাকিটা জীবন সে ঘরে বসেই কাটিয়ে দিচ্ছে। তার ছেলে সনাতনকে সেই ছোট বয়স থেকেই কাজে নামতে হয়েছে। সনাতনের ভেতরে ভেতরে দেবেন্দ্রনারায়ণে প্রতি এই ক্ষোভটা ছিল। কিন্তু ক্ষোভ থাকলেই কী? সে দেবেন্দ্রনারায়ণের কী ক্ষতি করবে! তার বাবা রামচরণ কারিগর বৃদ্ধ মানুষ, তার ওপর ওই ঘটনার পর থেকে মানসিকভাবেও সে ভেঙে পড়েছিল। একদিন রামচরণ কারিগর সনাতনকে দিয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণের কাছে সেই গুপ্ত দরোজার খবর পাঠাল। কিন্তু সনাতন খবরটা দেবেন্দ্রনারায়ণকে দেয়নি। সে তখনও জানত না, এই খবর তার কাজে লাগবে কিনা! তবে বীণাবালা যখন দেবেন্দ্রনারায়ণের বিরুদ্ধে ভেতরে ভেতরে এই ষড়যন্ত্রে নেমেছিল, তখন সে দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে তিক্ত অতীত রয়েছে এমন মানুষদের খুঁজে খুঁজে বের। করেছিল। সেই সূত্র ধরেই ভুজঙ্গ দেব তাকে নিয়ে গিয়েছিল রামচরণ কারিগরের কাছে। কিন্তু বৃদ্ধ রামচরণ কারিগর আর কোনো কিছুর সাথে যুক্ত হতে চাননি। তবে তার পুত্র সনাতন গুপ্তকক্ষের ওই খবরটি দিয়েছিল বীণাবালাকে, যদি কখনো বীণাবালার কাজে লাগে!

হরিহরণ হেমাঙ্গিনীকে বলল, কিন্তু সেই চিরকুটে যখন তোর হস্তাক্ষরে বিভূঁইয়ের জন্ম পরিচয় লেখাই থাকবে, তাহলে সে তো সকলেই জানবে। বিভুঁই যে দেবেন্দ্রনারায়ণের সন্তান, সে কথা তখন তো আর গোপন থাকবে না। আর গুটিবসন্তে-আক্রান্ত ওই সন্তানের মা যে তুই, তাও জানবে সকলে। আর এই খবর প্রচার হলে তার সুযোগ নেয়ার জন্য ভুজঙ্গ দেব আর বিভূতিনাথ সাহা তো আছেনই। তাহলে দেবেন্দ্রনারায়ণকে আবার খুন করতে চাইবে কেন বীণাবালা?

হেমাঙ্গিনী দেবী সঙ্গে সঙ্গেই এই কথার জবাব দিলো না। সে সুদীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। তারপর ক্লান্ত অবসন্ন দেহে হেমাঙ্গিনী দেবী উঠে দাঁড়াল। অবাক হরিহরণ তাকিয়ে আছে হেমাঙ্গিনী দেবীর দিকে। হেমাঙ্গিনী দেবী অনেক সময় নিয়ে অবশেষে কথা বলল। সে হরিহরণের কাছে এসে দাঁড়াল, তারপর মাথা তুলে তাকাল আকাশে। তারপর হরিহরণের চিন্তার জগত কাঁপিয়ে, ভেঙে চুরে নিঃশেষ করে দিয়ে সে বলল, বিভঁই দেবেন্দ্রনারায়ণের সন্তান নয় হরি কাকা।

হরিহরণ বণিক বিদ্যুতের গতিতে মাটি থেকে উঠে দাঁড়াল। শক্ত হাতে হেমাঙ্গিনী দেবীর কাঁধ খামচে ধরে বলল, তুই কী বলছিস হেমাঙ্গিনী? বিভুঁই তাহলে কার সন্তান?

ঠাণ্ডা, শান্ত কণ্ঠের হেমাঙ্গিনী দেবী যেন তুমুল বজ্রপাতের শব্দ তুলল হরিহরণের কানে। সে বলল, বিভুঁই জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের সন্তান!

হরিহরণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই জগত, এই বৃক্ষ, এই আকাশ, মাটি, জল সকলই তার কাছে মুহূর্তেই মিথ্যে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এ সকলই তার চোখের সামনে বিভ্রম। হাত বাড়াতেই সব অদৃশ্য হয়ে যাবে। ছোঁয়া যাবে না। তার সামনে দাঁড়ানো হেমাঙ্গিনী দেবীও মিথ্যে। সবকিছু মিথ্যে। সে হয়তো স্বপ্ন দেখছে! বা পাগল হয়ে গেছে। তার মাথার ভেতর ভয়াবহ কিছু ঘটছে।

কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবী আকাশের দিকে তাকিয়েই স্থির শান্ত গলায় বলল, হরি কাকা, গঙ্গামহলের সেই যে দূর্গা পুজোর অনুষ্ঠানের মাঝখানে বিষ্ণুনারায়ণ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তারপর দেবেন্দ্রনারায়ণকে দক্ষিণ বলেশ্বর পাঠালেন চিকিৎসক ধনঞ্জয় গুপ্তকে আনাতে। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ ফেরার আগেই তিনি আরো অসুস্থ হওয়ায় তৎক্ষণাৎ তাকে নিয়ে যাওয়া হলো রাইপুরে। আর রাইপুর থেকে মাত্র একজন পেয়াদা আর একজন অতি পুরাতন দাসীসহ আমায় নিয়ে বিষ্ণুনারায়ণ হাওয়া বদলের নাম করে গেলেন বিনয়পুর। আসলে এ সকলই ছিল তার ভান, অভিনয়। আসলে স্ত্রী বিয়োগের পর বিষ্ণুনারায়ণ আর বিয়ে করেননি এর কারণ তিনি ছিলেন প্রচণ্ড রকম বিকৃত যৌনাচারী একজন মানুষ। এই জন্য তিনি আর বিয়ের দিকে যাননি। শেষ বয়স অবধি তিনি নানাভাবে তার বিকৃত লালসা মিটিয়েছেন। সেদিন গঙ্গামহলে সেই পুজোর নৃত্যানুষ্ঠানে নৃত্যরত আমায় দেখে বিষ্ণুনারায়ণের সেই লালসা জেগে উঠেছিল। তিনি তাই দেবেন্দ্রনারায়ণকে দক্ষিণ বলেশ্বর পাঠিয়ে দিয়ে আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে। দীর্ঘ দুই মাস তিনি হিংস্র জানোয়ারের মতোন আমায় আটকে রেখে তার লালসা মিটিয়েছিলেন রাইপুর আর বিনয়পুরে। আর সেই সময়ই আমার গর্ভে আসে বিভুঁই।

হেমাঙ্গিনী দেবী খানিক থামল। তারপর বলল, আর এই সকল কথা গঙ্গামহলে জমিদার পরিবারের একজন মাত্র মানুষ জানে, সেই মানুষটির নাম বীণাবালা। প্রথম দিন রাইপুরে গায়ত্রীদের বাড়িতে যখন বীণাবালার সাথে আমার দেখা হয়, তখন তার সাথে যে পুরাতন দাসীকে আমি দেখেছিলাম, সেই দাসীই বিষ্ণুনারায়ণের সাথে রাইপুর আর বিনয়পুরের পুরোটা সময় ছিল। সে সকলই জানত।

হরিহরণ বজ্রাহতের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে না সে কী বলবে! সময় যেন থমকে গেছে বজরাডুবির চর নামের এই বিচ্ছিন্ন এক জগতে। সকল কিছুই যেন এখানে নীরব, নিথর, নিষ্কম্প। দীর্ঘ স্তব্ধতার পরে সেই নিষ্কম্প সময়ে হরিহরণ যেন মৃদু কম্পন তুলল। সে বলল, কিন্তু চিরকুটখানাতে তুই কী লিখেছিলি? বিভূঁইয়ের পরিচয় প্রকাশ করেছিলি? বিভূঁইয়ের আসল পিতা কে সেটি লিখেছিলি?

হেমাঙ্গিনী দেবী খানিক চুপ করে থেকে বলল, না, শুধু লিখেছিলাম, বিভূঁইয়ের শরীরে জমিদার পরিবারের রক্ত।

হরিহরণ ভুরু কুঁচকে বলল, কিন্তু তাহলে তো সকলে ভাববে এই সন্তান দেবেন্দ্রনারায়ণের। আর তাতে লাভ হবে বীণাবালার। এতে করে তার পথ থেকে হয়তো দেবেন্দ্রনারায়ণ দূর হবে। কিন্তু তোর কী লাভ? তুই তো আসল প্রতিশোধটা নিতে চেয়েছিলি বিষ্ণুনারায়ণের উপর।

এই কথায় হেমাঙ্গিনী দেবী স্তব্ধ হয়ে গেল। সে এতক্ষণে বুঝতে পারল, দেবেন্দ্রনারায়ণ কেন এত বড় ঝুঁকি নিয়ে বিভূঁইকে বাঁচিয়েছেন। তার মানে দেবেন্দ্রনারায়ণের হাতে পড়েছে সেই চিরকুট? আর চিরকুট পড়েই তিনি ভেবেছেন ওই সন্তান তার?

হেমাঙ্গিনী দেবী কম্পিত কণ্ঠে বলল, আমায় বীণাবালা অমনই লিখতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন আমি যদি দেবেন্দ্রনারায়ণকে খুন করে পালিয়ে যেতে পারি, তাহলে বারোহাটির জঙ্গলে আমার জন্য তার লোক থাকবে। তারা আমায় নিয়ে যাবে গঙ্গামহলে। ওদিকে বিভূতিনাথ আর ভুজঙ্গ দেব প্রজাদের নিয়ে গঙ্গামহলে যাবেন বিষ্ণুনারায়ণের কাছে। প্রজাদের মধ্যে তারা এই অসন্তোষ ছড়িয়ে দিবেন যে গুটিবসন্ত-আক্রান্ত ওই সন্তান আসলে জমিদার বাড়ির কারো সন্তান। জমিদার বাড়ির কার রক্ত বইছে ওই বাঈজীর গর্ভের সন্তানের শরীরে? যে সন্তান কি না আবার ভগবানের অভিশাপে গুটিবসন্তে আক্রান্ত। সেই অভিশপ্ত সন্তানকে কে নিয়ে এসেছে বিষ্ণুপুর জমিদারির সকল প্রজাদের জীবন বিপন্ন করতে? সকলকে এমন ভয়াবহ কালব্যাধির মুখে ফেলতে?

হেমাঙ্গিনী দেবী একটু থামল। তারপর বলল, সেখানে ব্রাহ্মণরাও থাকবেন। যখন সকলে এর একটা কঠিন শাস্তি চাইবে, বিচার চাইবে, তখন, ঠিক সেই মুহূর্তে আমি সেখানে উপস্থিত হবে এবং সকলের সামনে ওই চিরকুটের আসল অর্থ খুলে বলব। বিষ্ণুনারায়ণের ভালো মানুষ মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তার আসল জঘন্য নোংরা চরিত্রটি উন্মোচন করব। দেবেন্দ্রনারায়ণ তো তখন এমনিতেই নেই। কিন্তু তাকে খুনের দায়ে তখন কেউ আর আমায় দোষী করবে না। আর বিষ্ণুনারায়ণের নোংরা চরিত্রও উন্মোচিত হবে সকলের সামনে, যে তার নিজ পুত্রের প্রেয়সীর গর্ভে কূট কৌশলে সন্তান জন্ম দিয়েছে। এর চেয়ে জঘন্য পাপ আর কী আছে! পিতা আর পুত্রের এক ভয়াবহ চরিত্র মানুষের সামনে আসবে। বীণাবালার পথের কাঁটারাও দূর হবে। আর এতদিনকার জমে থাকা সকল অবিচারের প্রতিশোধও নেয়া হবে আমার।

হেমাঙ্গিনী দেবীর চোখ আবার ধ্বক করে জ্বলে উঠল। কিন্তু হরিহরণ শান্ত কণ্ঠে বলল, কিন্তু কই? বারোহাটির জঙ্গলে বীণাবালার কোনো লোক তো তোর জন্য অপেক্ষায় ছিল না। ছিল? তুই দেবেন্দ্রনারায়ণকে খুন করতে পেরেছিস কিনা, তাও কিন্তু তখনো কারোই জানার কথা নয়। বীণাবালা লোক পাঠালে অনেক আগে থেকেই পাঠিয়ে রাখত। কারণ তুই তো যেকোনো মুহূর্তেই দেবেন্দ্রনারায়ণকে খুন করে পালাতে পারতি! কিন্তু কই? তোর অপেক্ষায় বীণাবালার পক্ষ থেকে কেউ ছিল ওই জঙ্গলে?

হেমাঙ্গিনী দেবীর চোখের আগুন যেন মুহূর্তেই নিভে গেল। সে ম্লান কণ্ঠে বলল, না, হরি কাকা! আমি অনেক খুঁজেছি। সেদিন রাত, তার পরের পুরোটা দিন, আবার রাত আমি ওই জঙ্গলে পাগলের মতো ঘুরেছি। কিন্তু কেউ এলো না, কেউ না।

হরিহরণ বলল, বীণাবালার কিন্তু কথা ছিল বিভুঁইকে তোর কাছে যেকোনো উপায়ে ফিরিয়ে দিবে। কিন্তু কই? সে রকম কিছুই তো হলো না! বরং আমার তো এখন মনে হচ্ছে তোর সেই চিরকুটের অর্থ উদ্ধার আর প্রকৃত দোষীর বিচারের দাবিতে প্রজাদের সাথে গঙ্গামহলে যে ব্রাহ্মণদের থাকার কথা ছিল, যারা বিষ্ণুনারায়ণের মুখোশ উন্মোচনে উপস্থিত থাকবে বলে বীণাবালা বলেছিল, সেই ব্রাহ্মণরা হয়তো এসব কিছু জানতই না। তাদের কানে হয়তো অন্য কোনো মন্ত্র উঁপেছে বীণাবালা। খেয়াল করে দেখ, সেই ব্রাহ্মণরাই কিন্তু তোর ছেলের জীবন্ত অগ্নিদাহের সিদ্ধান্ত দিয়েছে। আর এ সকলই বীণাবালার কূটচাল নয়তো?

হেমাঙ্গিনী দেবী নিজেই যেন এবার প্রস্তরমূর্তির ন্যায় জমে গেল। তার আচমকা মনে হচ্ছে, সে এক অন্ধকার গোলকধাঁধায় আটকে গেছে। এই জনমে এই গোলকধাঁধা থেকে তার আর মুক্তি নেই। সে হেরে গেছে। সর্বৈব অর্থেই হেরে গেছে। এই জগতে তার জন্ম হয়েছে পুতুলনাচ খেলার পুতুল হিসেবে। সে কেবল জীবনভর অন্যের হাতের ইশারায় নেচেই যাচ্ছে।

প্রতিশোধের বেপরোয়া স্পৃহায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হেমাঙ্গিনী দেবী তখনো জানে না, তার অগোচরে বিভূঁইয়ের নাওয়ে লেখা তার চিরকুটখানি নিয়ে বীণাবালা খেলেছেন অন্য খেলা। হেমাঙ্গিনী দেবী তার নিজ হস্তাক্ষরে যে চিরকুটখানা লিখে দিয়েছিল বিভুঁইয়ের সেই নাওয়ে, সেই চিরকুটের উপরে কারো নাম ছিল না, কোনো সম্বোধন ছিল না। কিন্তু যতটা সম্ভব হেমাঙ্গিনী দেবীর হাতের লেখা নকল করে সেখানে দেবেন্দ্রনারায়ণের নাম লিখে দিয়েছিলেন বীণাবালা। কারণ বীণাবালা জানতেন, তার পথের আসল কাঁটা বিষ্ণুনারায়ণ নন, তার পথের আসল কাঁটা দেবেন্দ্রনারায়ণ। ফলে হেমাঙ্গিনী দেবীর যতই বিষ্ণুনারায়ণের প্রতি জিঘাংসা, প্রতিশোধস্পৃহা থাকুক না কেন, বীণাবালার মূল লক্ষ্য ছিল আসলে দেবেন্দ্রনারায়ণ। সুতরাং তিনি চেয়েছিলন, সেই চিরকুটে দেবেন্দ্রনারায়ণের নাম লিখে সকলের কাছে এই প্রমাণ করতে যে দেবেন্দ্রনারায়ণ কূলটা বাঈজীর ঘরে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। শুধু তাই-ই নয়, সেই সন্তান যখন ভয়াবহ কালব্যাধিতে আক্রান্ত, তখন তাকে রাতের অন্ধকারে বিষ্ণুপুরে নিয়ে এসে বিষ্ণুপুরের সকল মানুষকে সেই মরণব্যাধি গুটিবসন্তের মুখে ঠেলে দিয়েছেন তিনি।

এমনকি বীণাবালা হেমাঙ্গিনী দেবীকে দেবেন্দ্রনারায়ণের কাছে পাঠিয়েও নিশ্চিন্ত ছিলেন না। কারণ হেমাঙ্গিনী দেবী যে প্রকৃতই দেবেন্দ্রনারায়ণকে খুন করতে পারবে এ বিষয়ে বীণাবালার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল! বীণাবালা জানতেন, যত যা-ই হোক দেবেন্দ্রনারায়ণের প্রতি হেমাঙ্গিনী দেবীর অনুভূতি অগ্রাহ্য করার মতো কিছু নয়। সেই অনুভূতিকে হয়তো কুপরামর্শে তিনি খানিক আড়াল করতে পেরেছেন। কিন্তু তার কতটুকু সত্যি-সত্যিই আড়াল হয়েছে, সে বিষয়ে বীণাবালা সন্দিহান ছিলেন। আর তাই তিনি এই ব্যবস্থাটিও করে রেখেছিলেন। এসবের পরেও প্রজাদের প্রতিক্রিয়া কী হতো, কিংবা বিষ্ণুনারায়ণ তার জমিদারির বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নিতেন তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন বীণাবালা। ফলে বাদবাকি শক্তিশালী প্রভাবক হিসেবে ভুজঙ্গ দেব আর বিভূতিনাথ সাহার ক্ষুরধার বুদ্ধি আর প্রভাব নিয়ে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু ততদিনে দেবেন্দ্রনারায়ণ যে গঙ্গাবতীর তীরে প্রহরা বসাবেন, এবং ওই নাও সরাসরি তার হাতেই পড়বে, সেটি বীণাবালা আঁচ করতে পারেননি। ফলে ঘটনা তিনি যেভাবে ঘটাতে চেয়েছিলেন, সেভাবে ঘটেনি। আর দেবেন্দ্রনারায়ণ বরং চিরকুটের কথা বেমালুম চেপে গেলেন। এদিকে নিজ থেকে সেই চিরকুটের কথা তোলার কোনো সুযোগও থাকল না বীণাবালার।

ওদিকে গুটিবসন্তে আক্রান্ত বিভূঁইয়ের সঙ্গে পাওয়া চিরকুটখানা পড়ে বিভূঁইয়ের পরিচয় নিয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণ দ্বিধান্বিত হয়ে গেলেন। হেমাঙ্গিনী দেবীর সাথে তার অসংখ্যবার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে। সুতরাং ওই চিরকুট পেয়ে তিনি প্রকৃত অর্থেই সন্দিহান হয়ে পড়লেন। বিভুঁই কি তাহলে আসলেই তার সন্তান? খানিকটা সময়েই দ্বিধান্বিত দেবেন্দ্রনারায়ণের ভেতরে এই বিশ্বাস গাঢ় হতে থাকল যে বিভুঁই আসলে তারই সন্তান।

আর পেয়াদা রঘুর দেয়া দুঃসংবাদ শুনে সেই রাতে দেবেন্দ্রনারায়ণ যখন বারোহাটির বাগানবাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন, হেমাঙ্গিনী দেবী তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, বীণাবালা তার পরিকল্পনা মতোই কাজ করেছেন। ওই নাওয়ে বিভুঁই রয়েছে। দেবেন্দ্রনারায়ণকে হত্যা করতে না পারলেও হেমাঙ্গিনী দেবী জানত, তাকে পালাতে হবে। বীণাবালা তাকে বিভূঁইয়ের কাছে পৌঁছে দিবে। কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবী তখনও জানে না, বীণাবালার কাছে ততক্ষণে হেমাঙ্গিনী দেবীর প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

বীণাবালা বরং সেদিনের গঙ্গামহলের সেই বিশেষ সভায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন কৌশল এঁটেছিলে। সেই কৌশলে অবনীন্দ্রনারায়ণকে দিয়ে তিনি প্রশ্ন করিয়েছিলেন যে দেবেন্দ্রনারায়ণ গুটিবসন্তে আক্রান্ত বিভুঁইকে ছুঁয়েছেন কিনা! শুধু তা-ই নয়, তাতেও সুবিধা করতে না পেরে ব্রাহ্মণদের দিয়ে নতুন চাল খেলেছিলেন বীণাবালা। বিভুঁই আর নিতাইয়ের জীবন্ত অগ্নিদাহের সিদ্ধান্তের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন, দেবেন্দ্রনারায়ণ বিভূঁইকে বাঁচাতে স্বীকার করেন কিনা যে, বিভুঁই তারই সন্তান! কিংবা সকল প্রজাদের এবং ব্রাহ্মণদের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে গিয়ে তিনি বিভূঁইকে বাঁচাতে সচেষ্ট হন কিনা। দেবেন্দ্রনারায়ণ যদি একবার ভুলেও সে চেষ্টা করতেন তাহলেই বীণাবালার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণরূপে সফল হতো।

কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ তা করেননি। আর বীণাবালাও এখনো জানেন না বিভুঁই সেই রাতের সেই অগ্নিকাণ্ডে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়নি। বরং দেবেন্দ্রনারায়ণই তাকে উদ্ধার করেছে। বীণাবালার অবশ্য এখন আর তাতে কিছু যায় আসে না। সে বরং এতদিনে গেড়ে বসেছে বিষ্ণুপুরের জমিদারির অন্দরমহলে। নতুন জমিদার অবনীন্দ্রনারায়ণ নামে জমিদার হলেও তার পেছনে পুতুলনাচের মতোন সুতো নেড়ে চলেছে বীণাবালা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বিষ্ণুপুর জমিদারির অন্দরমহল শান্ত হয়েছে।

কিন্তু সময় বলছে, সামনে অপেক্ষা করছে নতুন এক গল্প। বিবমিষার গভীর অন্ধকার থেকে উঁকি দেয়া নতুন এক আখ্যান। সেই আখ্যান জুড়ে অন্দরমহল। সেই অন্দরমহল শুধুমাত্র বিষ্ণুপুর জমিদারির কেন্দ্রস্থল গঙ্গামহলেরই অন্দরমহল নয়, এই অন্দরমহল মন ও মানবেরও এক সুগভীর অন্দরমহল।

*

হেমাঙ্গিনী দেবী আজকাল বিভুঁইয়ের খবরের জন্য খুব উতলা হয়ে উঠেছে।

হরিহরণ এর মধ্যে বার কয়েক বারোহাটিতে গিয়েছেও। প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্রও নিয়ে এসেছে। কিন্তু বিভূঁইয়ের কোনো খবর এখন অবধি সে পায়নি। অবশ্য খুব যে চেষ্টা করতে পেরেছে তাও নয়। কারণ বিভুঁইয়ের খবরের জন্য তাকে বারোহাটির বাগান বাড়িতে যেতে হবে। দেবেন্দ্রনারায়ণ ছাড়া আর কেউ বিভূঁইয়ের খবর জানে না। কিন্তু এই মুহূর্তে দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে দেখা করার কোনো সুযোগ তার নেই। দেবেন্দ্রনারায়ণ কোথায় আছেন এই নিয়ে প্রথম কয়েক দিনে হরিহরণ কারো কাছ থেকে কোনো রকমের খবরাখবরই পেল না।

হরিহরণের ধারণা ছিল, দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে খুঁজবে। ফলে সে যদি বারোহাটি থেকে রাতারাতি উধাও হয়ে যায় তাহলে বিপদ! হরিহরণ তাই বারোহাটিতে তার ছোট্ট বাড়িটিতে এসে দিন কয়েক ঘোরাঘুরিও করেছে। কিন্তু বারোহাটি বাগান বাড়ি থেকে তার সন্ধানে কেউ এলো না।

হরিহরণ খবরের সন্ধানে হাট-বাজার, মানুষের আড্ডাখানা চষে বেরালো। কিন্তু পুরো জনপদই কেমন থম মেরে গেছে। গুটিবসন্তে মানুষ মরেছে প্রচুর। তার চেয়েও বড় কথা, এই কালব্যাধি যেন বেঁচে থাকা মানুষদের কেমন সন্ত্রস্ত আর আত্মকেন্দ্রিক করে রেখে গেছে। সবাই সবাইকে যেন এড়িয়ে চলছে। মনে হচ্ছে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। গুটিবসন্তের তীব্র আতঙ্ক যেন এখনও কাটেনি।

হরিহরণের এই চষে বেড়ানো বৃথা গেল না। দেবেন্দ্রনারায়ণ যে গুটিবসন্ত আক্রান্ত হয়ে বারোহাটির বাগান বাড়িতে আটকা পড়েছেন এবং তিনি যে শুধুমাত্র দাসী অপলা ছাড়া আর কারো সাথেই দেখা করেন না, এই খবর হরিহরণ পেল। কিন্তু বিভূঁইয়ের কোনো খবর সে পেল না। তবে আসল খবর পেতে তার দেরি হলো আরো বেশ কিছু দিন। এই আসল খবর গঙ্গামহলের অন্দরমহলের পটপরিবর্তনের খবর। বিষ্ণুনারায়ণের মৃত্যু এবং অবনীন্দ্রনারায়ণের জমিদার হবার খবর। সেই সাথে গুটিবসন্তের ছোঁয়াচ থেকে গঙ্গামহলকে নিরাপদ রাখার অজুহাতে গঙ্গামহলের সিংহদরোজা বন্ধ করে দেয়ার খবরও সে পেল। সে শুনল, দীর্ঘদিন ধরে গঙ্গামহলে কেউ প্রবেশ করতে পারছে না, গঙ্গামহল থেকে কাউকে বের হতেও দেয়া হচ্ছে না। গঙ্গামহল যেন নিষিদ্ধ, বিচ্ছিন্ন, দুর্ভেদ্য এক দুর্গ! এমন অনেক খবর পেলেও হরিহরণ। বিভূঁইয়ের কোনো খবরই পেল না। বিভুঁই কি বেঁচে আছে? নাকি মরে গেছে? এই খবর কোথাও পেল না হরিহরণ।

হেমাঙ্গিনী দেবী সকলই শুনেছে। শুনে সে হেসেছেও। হেসে বলেছে, দেখলে হরি কাকা, ভগবানের বিচারখানা দেখলে? আমায় যারা ঠকালো, তারা সকলেই জিতল। কেবল হেরে রইলাম একা আমিই। এই হলো ভগবানের বিচার।

হরিহরণ কোনো কথা বলেনি। হেমাঙ্গনীই আবার বলেছিল, না হলে বিষ্ণুনারায়ণ অমন ভালো মানুষটি সেজেই টুপ করে মরে যাবেন কেন? কোনো শাস্তিই সে পেল না। কী বিচার ভগবানের দেখলে? আর দেখো, বীণাবালা আমার সাথে এতবড় মিছেমিছি খেলল, তারও কিছু হলো না। সে দিব্যি যা চেয়েছিল তাই পেয়ে গেল। এ কেমন বিচার গো হরি কাকা?

হরিহরণ গম্ভীর গলায় বলেছিল, ভগবানের বিচার বোঝা বড় দায়। আমরা অতি সামান্য মানুষ তার কী বুঝব?

হেমাঙ্গিনী দেবী বলেছিল, কী জানি! আজকাল আর কিছুতেই বিশ্বাস আসে না গো। এত মিছে, এত অবিশ্বাস দেখলাম জনম ভর। বিশ্বাসে অরুচি ধরে গেছে। খুব ইচ্ছে করে বীণাবালার কাছে যাই। গিয়ে জিজ্ঞেস করি, সে কেন এমন করল? কেন বিভুঁইকে নিয়েও ওই খেলা খেলল?

হরিহরণ বলেছিল, তোকে বীণাবালার কাছে যেতে হবে না। সে-ই তোকে খুঁজে বের করবে।

হেমাঙ্গিনী দেবী অবাক হয়েছিল খুব, আমায় সে-ই খুঁজে বের করবে? কেন?

হরিহরণ বলেছিল, কারণ হয়তো এই জগতে একমাত্র তুই, যে বীণাবালার এই সকল ষড়যন্ত্রের কথা জানিস। হয়তো পুরোপুরি আর কেউ জানে না। আর বিভূতিনাথ, ভুজঙ্গ দেব জানলেও তারা তো তারই লোক। এখন তোর মুখোনি তার বন্ধ করতে হবে না? তাছাড়া বীণাবালা যে তার ষড়যন্ত্রে তোকে শুধুই ব্যবহার করেছে, এ কথা যে এতদিনে তুইও বুঝে গেছিস, এ কথা সে জানে না ভেবেছিস? আর তোর ছেলেকে তোর কাছে ফিরিয়ে দেবার কথা ছিল, কিন্তু তা কি হয়েছে? হয়নি। বরং সেই রাতে সেই ব্রাহ্মণদের দিয়েই নিতাইয়ের সাথে বিভূঁইয়েরও অগ্নিদাহের সিদ্ধান্ত হলো। এ সকল বীণাবালার চাল নয়? তো সেও তো জানে, তুই সুযোগ পেলে তোর যা সাধ্য আছে তাই দিয়েই তার বিরুদ্ধে যাবি। জানে না?

হেমাঙ্গিনী দেবী এভাবে ভাবেনি। আসলেই তো! বিষয়টি তো আসলেই এমন। হরিহরণ বলেছিল, সে সকলই জানে, সকলই বোঝে। আমার ধারণা, জমিদার বাড়ির ঝামেলা কিছু কমলেই তোর সন্ধানে সে লোক পাঠাবে। কিংবা কে জানে, হয়তো এতদিনে পাঠিয়েছেও।

হেমাঙ্গিনী দেবী নির্বিকার গলায় বলেছিল, সে কি আমায় খুন করবে?

হরিহরণ সাথে সাথে জবাব দেয়নি। সে দীর্ঘসময় চুপ করে বসে থেকে বলেছিল, মুখ বন্ধ করবার ওইটাই তো সবচেয়ে ভালো উপায় হেমাঙ্গিনী। তাছাড়া সবকিছু দেখে-শুনে যা মনে হচ্ছে, পেছনে কাঁটা ফেলে রেখে সামনে এগোনোর মানুষ বীণাবালা নন।

হেমাঙ্গিনী বলেছিল, মরণ নিয়ে আমার ভয় নেই গো হরি কাকা। মরলেই বরং বাঁচি। তার আগে তুমি যে করেই পার আমার বিভূঁইয়ের খবর এনে দাও। একটা খবর এনে দাও।

হরিহরণ হেমাঙ্গিনী দেবীর এই কথার জবাব দেয়নি। কী জবাব দেবে সে? তবে দীর্ঘ নিরবতার পর হরিহরণ বলেছিল, সময়, মানুষের জীবনে সময়ের চেয়ে এত মূল্যবান কিছু নেই। এখন বীণাবালার সময়। দেখ, এই যে এত ষড়যন্ত্র, এত পরিকল্পনা, ছক কিন্তু কই, কিছুই কিন্তু তেমন কাজে লাগেনি। তোকে ছাড়াই বীণাবালার সকল উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। তার ভাগ্য তাকে সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। বিষ্ণুনারায়ণ মারা গেলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ এবং দীপেন্দ্রনারায়ণ কেউই গঙ্গামহলে নেই। যার জমিদার হবার কথা সকলের মুখে মুখে ভাসছিল সেই দেবেন্দ্রনারায়ণ আবার কঠিন এক রোগে পড়লেন। বীণাবালার জন্য এটা হয়ে এলো অভাবনীয় এক সুযোগ। সেই সুযোগ সে কাজে লাগিয়েছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ যাতে হুট করে গঙ্গামহলে গিয়ে কোনো উটকো ঝামেলা বাধাতে না পারে, সেজন্য সে গুটিবসন্তের অজুহাতে গঙ্গামহল বন্ধ করে দিলো। আবার কেউ যেন তখনই কোনো খবর নিয়ে গঙ্গামহল থেকে বারোহাটি না আসতে পারে সেই ব্যবস্থাও করল। কিন্তু বীণাবালাও জানেন, খেলা এখনও শেষ হয়নি। অনেক কিছুই বাকি। হয়তো সেসবের জন্য তার নানান ভাবনাও রয়েছে।

হেমাঙ্গিনী দেবী দু’হাতে শক্ত করে মাথা চেপে ধরল। তারপর ফিসফিস করে বলল, আমার মাথা কাজ করছে না গো হরি কাকা। তুমি শুধু আমায় বলো, আমার বিভুঁই? আমার বিভুঁইর কী হয়েছে?

হরিহরণ বলল, বিভূঁইয়ের কী হয়েছে জানি না। তুই তো জানিসই, ওই কালব্যাধিতে বড় ভাগ্য না হলে কেউ বাঁচে না রে। সে বেঁচে আছে কিনা, সেটি জানতে দেবেন্দ্রনারায়ণের পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠা অবধি অপেক্ষা করতে হবে। এছাড়া আর উপায় কী? তবে শুনেছি তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন।

হেমাঙ্গিনী দেবী সেই সারাটি দিন আর কথা বলল না। নিজের ভেতর নিজে ডুবে রইল না। খেল না, ঘুমাল না। মাঝরাতে একাকী হেমাঙ্গিনী দেবী কেন যেন আপন মনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। সেই কান্নার ভেতর হেমাঙ্গিনী দেবী হঠাৎ আবিষ্কার করল, দেবেন্দ্রনারায়ণ নামের মানুষটির প্রতি তার যত রাগ, ক্রোধ, ঘৃণাই থাকুক না কেন, বুকের ভেতর কোথায় যেন এই মানুষটির জন্য। প্রবল ভালোবাসাও জমিয়ে রেখেছে সে। যদিও সেই ভালোবাসার কথা তার সচেতন মন কখনো স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু তার অবচেতন মন তা প্রায়ই তাকে মনে করিয়ে দেয়। হয়তো সঞ্চিত ওই অবচেতন অনুভূতির কারণেই বীণাবালার নির্দেশ সত্ত্বেও বারোহাটির বাগান বাড়িতে সে দেবেন্দ্রনারায়ণকে খুন করতে পারেনি। এতদিন সে নিজের মনকেই নানান অজুহাত দিয়ে গেছে। কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবী জানে, চাইলেই খাবারে বিষ মিশিয়ে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে সে দেবেন্দ্রনারায়ণকে খুন করতে পারত।

হেমাঙ্গিনী দেবীর বুকের ভেতর অদ্ভুত এক চিনচিনে ব্যথা। তার দম নিতেও যেন কষ্ট হতে লাগল। দেবেন্দ্রনারায়ণের জন্য তার হঠাৎ প্রবল মায়া হতে লাগল। ওই মানুষটি হয়তো ভাবছে বিভুঁই তার নিজের সন্তান। তাই অমন। প্রবল বিপদ মাথায় নিয়ে মানুষটা সেই রাতে বিভুঁইকে উদ্ধার করেছে। কিন্তু মানুষটি যখন জানবে, এই বিভুঁই তার সন্তান নয়, বরং সে তার পিতা বিষ্ণুনারায়ণেরই আরেক সন্তান! কী করবে তখন সে?

হেমাঙ্গিনী দেবী আর ভাবতে পারছিল না। এই জনমে আর কখনো কি সে দেবেন্দ্রনারায়ণের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? সব জেনে গেলে তখন কী করবেন দেবেন্দ্রনারায়ণ? হেমাঙ্গিনী দেবীর সকল ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। তার নিজেকে মনে হচ্ছিল জগতের ঘৃণ্যতম কোনো প্রাণী। যাকে দেখলে ঘেন্নায় তার নিজেরই গা রিরি করে ওঠে। সারাদিনের অভূক্ত, ক্লান্ত-শ্রান্ত হেমাঙ্গিনী দেবীর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। গা গুলিয়ে বমি আসতে লাগল। তার মাথা ঘোরাচ্ছে। প্রবলভাবে ঘুরছে সমগ্র জগত সংসার। তার সকল কিছু যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। এ যেন কোনো কুহেলিকার জগত। সেই কুহেলিকার জগতে যেন সে ডুবে যাচ্ছিল। কিন্তু কুহেলিকার সেই জগতে ডুবে যেতে যেতেও হেমাঙ্গিনী দেবীর মনে হচ্ছিল, ভগবান দেবেন্দ্রনারায়ণের মঙ্গল করুন। তার ভালো থোক। যেখানেই থাক, ভালো থাকুক বিভুঁইও।

.

সেই থেকে হেমাঙ্গিনী দেবী আবার অসুস্থ হয়ে পড়ল। হরিহরণ তখন প্রায় নিয়মিতই লোকালয়ে যাতায়াত শুরু করেছে। অবশ্য মানুষ তাকে খুব একটা খেয়ালও করেনি। সকলেই জানে হরিহরণ এমনিতেই বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো রহস্যময় এক পাগলাটে মানুষ। কেউ তাকে তেমন ঘাটায়ও না। ফলে হরিহরণের জন্য বিষয়টি সহজ হয়ে গেল। সে যতটুকু সময় বারোহাটিতে গিয়ে থাকে, নিজের মতোই থাকে। তারপর আবার অন্ধকারে চলে আসে বজরাডুবির চরে। সময় কেটে যাচ্ছে।

হেমাঙ্গিনী দেবী আজকাল বড়ই অস্থির হয়ে উঠেছে। তবে এই অস্থিরতার মধ্যেও হেমাঙ্গিনী দেবী অবাক হয়ে একটা কথা ভেবেছে, তা হলো হরিহরণের কথা। এই মানুষটিকে কখনোই সমীহ করার মতো কোনো মানুষ তার মনে হয়নি। সবসময়ই মনে হয়েছে ভীত সন্ত্রস্ত, সরল-সাধারণ, বোকা একজন আত্মভোলো মানুষ। ফলে সে যতই বড় হয়েছে, ততই এই মানুষটাকে অবজ্ঞা করেছে। ক্রমশই হরিহরণের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছে। কিন্তু এই কটামাত্র দিনে হেমাঙ্গিনী দেবী আবিষ্কার করেছে এই বোকা-আত্মভোলা মানুষটির বুকের ভেতর আসলে লুকিয়ে আছে বিশাল এক মৃতপ্রায় বৃক্ষ। ওই বৃক্ষটিকে বাঁচিয়ে তোলা খুব জরুরি। হয়তো প্রয়োজনে ওই বৃক্ষ জেগে উঠবে। ছায়া দেবে। হাওয়া দেবে। আশ্রয় দেবে। হেমাঙ্গিনী দেবীর মনে হলো মৃতপ্রায় বৃক্ষটি আবার ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। আজকাল মানুষটার সামনে তার খুব ছোট হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। এই জীবনের সকল ভার এই মানুষটির হাতে তুলে দিয়ে শান্তিময় সুদীর্ঘ এক ঘুমে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। হেমাঙ্গিনী দেবী তার বাবাকে দেখেনি। বাবার স্নেহ-মমতার স্বাদ তার অজানা। কিন্তু আজকাল মাঝেমধ্যেই সেই অনাস্বাদিত মমতার-স্নেহের, আশ্রয়ের স্বাদ পেতে তার খুব ইচ্ছে হয়। এতদিনকার লতাগুল্ম হয়ে থাকা হরিহরণ যেন এই হেমাঙ্গিনী দেবীর চারপাশে সেই অনাস্বাদিত মমতার স্নেহ-আশ্রয়ের এক সুশীতল বৃক্ষ হয়ে উঠতে থাকল।

এখনও বিভূঁইয়ের কোনো খোঁজ বের করতে পারেনি হরিহরণ। কিভাবে কী করবে বুঝতেও পারছে না। তবে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল যে করেই হোক বারোহাটির বাগান বাড়িতে তাকে ঢুকতে হবে। তার পরদিন ভোরের আলো ফোঁটার আগেই বজরাডুবির চর থেকে নাও ভাসাল হরিহরণ। বারোহাটিতে ফিরতে ফিরতে সূর্য অনেকখানিই উপরে উঠে গেছে। সে বারোহাটি বাগান বাড়ির ফটকে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতরে সুনসান নিরবতা। আগের সেই রমরমা ভাবখানা আর নেই। ফটকের ফাঁক দিয়ে ভেতরের প্রশস্ত পথ, দুই পাশের বাগান দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেই বাগানে আগের সেই ঝলমলে রঙের ফুলেরা যেন নেই। যা-ও কিছু আছে সেসব অযত্নে অবহেলায় ম্লান। দু’টো ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে সেখানে। কিন্তু তাদের দেখেও মনে হচ্ছে নিষ্প্রাণ, নির্জীব। এ যেন নিঃশব্দ-ভূতুড়ে এক বাড়ি।

হরিহরণ অনেক সময় দাঁড়িয়ে রইল। কাউকে চোখে পড়ল না। এই এত বড় বাড়ি, অথচ ফটকে কেউ নেই! ভেতরের চতুরেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। দুপুর অবধি সেখানে দাঁড়িয়ে রইল হরিহরণ। কাউকেই চোখে পড়ল না। অনেক ভেবেও এর কোনো কারণ খুঁজে পেল না হরিহরণ। শেষ অবধি সাহস করে সে ফটকের ভারী পাল্লায় শব্দ করতে লাগল। ধাক্কাতে লাগল সর্বশক্তিতে, কিন্তু পাল্লাখানি এতটুকুও নড়ল না। হরিহরণ ভারি অবাক হলো। এই বাড়ির ফটক দিনের বেলায় কখনো এভাবে বন্ধ থাকতে দেখেনি সে। ফটকের পাল্লাগুলো ভেজানো থাকলেও ফটকের সামনে সবসময় দু’জন প্রহরী বসা থাকত। আজ সে কোথাও তেমন কাউকে দেখতেও পাচ্ছে না। হরিহরণ আবার ধাক্কা দিতে গিয়ে লক্ষ করল বিশাল আকারের দু’খানা লৌহদণ্ডের সাহায্যে ভেতর থেকে ফটকের পাল্লাগুলো আটকানো। ভেতর থেকে কেউ খুলে না দিলে কারো পক্ষেই ওই পাল্লা ভোলা সম্ভব না। হরিহরণ বুঝে পেল না, কী এমন ঘটনা ঘটেছে যে বারোহাটির বাগানবাড়ির ফটকে কোনো প্রহরী নেই! আবার ভেতর থেকে অমন বিশালাকায় লৌহদণ্ডে আটকেও রাখা হয়েছে ফটকের পাল্লা?

হরিহরণের অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো পড়ন্ত বিকেলে। সে ফটকের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল পেয়াদা রঘু গুটিগুটি পায়ে ফটকের দিকে হেঁটে আসছে। তার হাতে একটি ঘোড়ার লাগাম। ঘোড়াটি তার পেছন পেছন হেঁটে আসছে। রঘুর মুখে দীর্ঘদিনের না কামানো দাড়ি। হাঁটা চলায়ও শ্লথ ভাব। সে ফটকের সামনে এসে হরিহরণকে দেখে ভারি অবাক হলো। রঘু কী করে তা দেখতে হরিহরণ চুপচাপ অপেক্ষা করছিল। রঘু অতি কষ্টে লৌহদণ্ড দু’খানা সরিয়ে পাল্লা ফাঁক করল। তারপর পাল্লার ফাঁক দিয়ে ঘোড়াটিকে নিয়ে এলো বাইরে। হরিহরণ এবার কথা বলল, কী রে রঘু? ভেতরে কী হয়েছে? এ তো দেখি একদম শ্মশানঘাট!

রঘু নির্বিকার গলায় বলল, শ্মশানঘাটেরর মতোনই। তা তুমি এতদিন পরে? গুটিবসন্ত তোমায় পায়নি?

হরিহরণ বলল, আমার মতো ছুঁচো মেরে গুটিবসন্তের কাজ কী?

রঘু বলল, তোমার চেয়ে ছোট ছুঁচোও সে মেরেছে। এ বাড়িতেই ছ’জন মরেছে। জগাইও মরেছে।

জগাই মরেছে এ কথা হরিহরণ জানে। তারপরও সে না জানার ভান করে বলল, কী বলিস! এ তো ভয়ানক দুঃসংবাদ! তাহলে তো দেখি ভালো বিপদই কাটিয়ে উঠলামরে রঘু! বড় বাঁচা বেঁচে গেছি, কী বলিস?

রঘু এবার জবাব দিলো না। হরিহরণই আবার বলল, তা মেজোকর্তার খবর কি? কেমন আছেন? আমায় আর খবর-টবর দিলেন না, তাই ভাবলাম একবার এসে খোঁজ নিয়ে দেখি।

রঘু জানে হরিহরণের সাথে দেবেন্দ্রনারায়ণের একটা আলাদা সম্পর্ক আছে। বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে দেবেন্দ্রনারায়ণ হরিহরণকে ডাকেন। কিন্তু তারপরও হরিহরণের সামনে কিছু বলতে যেন রঘুর ঠিক ভরসা হচ্ছিল না। হরিহরণ বলল, কী, কথা বলছিস না কেন রঘু? গঙ্গামহলের ঘটনা তো সকলেই জানে। মেজোকর্তা যে বিপদে আছেন সে কথাও সকলেই জানে। তুই আমায় কিছু লুকোস না।

রঘু তার দ্বিধা ঝেড়ে ফেলতে পারছিল না। তারপরও সে বলল, মেজোকর্তা দিন কয় হলো একটু ভালোর দিকে। আজকাল খেতে পারছেন। অল্পবিস্তর হাঁটাচলাও করছেন। কিন্তু…।

রঘু তার কথা শেষ করল না। কোনো কারণে সে কথার মাঝখানেই থেমে গেল। হরিহরণ বলল, বল রঘু, কী হয়েছে বল?

রঘু এবার এদিক-সেদিক দেখে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, গঙ্গামহল থেকে। আগে প্রতি সপ্তাহে এ বাড়ির সকল খরচাপাতি আসত। চাল-ডালসহ সকল জিনিসপত্রই আসত। নায়েব নায়েবমশাই এসে দেখে যেতেন কোথায় কী লাগবে, কত পয়সা লাগবে! সেসব নিজের হাতে পাঠিয়েও দিতেন। এ বাড়িতে রোজ কত চাল-ডাল, আনাজ-পাতি লাগে, সে তো তুমি জানো! কতগুলো মানুষ, কত তার খরচা! তার সকলই তো গঙ্গামহল থেকেই আসত। কিন্তু বড় জমিদার কর্তা মারা যেতেই বড় বাবু জমিদার হলেন। তিনি জমিদার হবার পর গঙ্গামহলের সাথে তো বাইরের আর কোনো যোগাযোগই রইল না। গঙ্গামহলের ফটক অবধি বন্ধ করে দিলেন। সেই থেকে গঙ্গামহল থেকে আর কিছু আসছে

এখানে। বড় কর্তাবাবুর স্ত্রী নাকি বলেছেন, গঙ্গামহল থেকে আর কিছুই এখানে আসবে না। তারপর থেকে সকলই বন্ধ করে দিলেন। খরচ চালাতে না পেরে অপলা মাসি কাজকর্মের লোক কমিয়ে আনলেন। কেউ কেউ চলেও গেল। কিছু জমানো পয়সা ছিল তার কাছে। খাবারও মজুদ ছিল কিছু। তাতেই এতদিন চলছিল। কিন্তু এখন আর চলছে না। এসব অবশ্য মেজোকর্তাকে এখনও জানানো হয়নি। এমনিতেই সে অত বড় রোগ থেকে উঠল…।

হরিহরণ রঘুর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। এ কী খেলা শুরু করেছেন বীণাবালা! গঙ্গামহলের সিংহদরোজা বন্ধ করে সকল কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করার অনেকগুলো কারণের মধ্যে তাহলে এটিও একটি? কিন্তু হরিহরণের কাছে স্পষ্ট না, বীণাবালা আসলে কী চাইছেন?

হরিহরণ বলল, কিন্তু তাতে কী? মেজোকর্তার নাম করে প্রজাদের থেকে আগাম খাজনা বাবদ তো কিছু তুলে ফেলা যায়। বা কোনো চাল ডালের আড়ত থেকে নিয়ে এলেই তো হয়!

রঘু ম্লান গলায় বলল, গঙ্গামহল থেকে নতুন জমিদারের তরফে সকলকেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, মেজোকর্তার নামে যেন কোনো আদান-প্রদান না হয়।

হরিহরণ এবার সত্যি সত্যি অবাক হলো। এই তাহলে অবস্থা! দেবেন্দ্রনারায়ণ হয়তো জানেনও না, তিনি কী পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছেন! হরিহরণ ফটকের দিকে মুখ ঘুরিয়ে রঘুকে বলল, লোক নেই বলে ফটক ভেতর থেকে বন্ধ থাকে?

রঘু বলল, হ্যাঁ, আর তাছাড়া এ বাড়িতে তো এখন আর কেউ আসেও না।

হরিহরণ গম্ভীর স্বরে বলল, হুম।

রঘু চলে যাচ্ছিল, হরিহরণ বলল, কই যাচ্ছিস?

রঘু বলল, অপলা মাসি বলল, পুব তল্লাট থেকে কে একজন নৌকা করে রাতের আঁধারে লুকিয়ে কিছু চাল ডাল রেখে গেছে জঙ্গলের ভেতর নদীর ধারে। সেসব আনতে যাচ্ছি। এক সাথে আনা যাবে না। ঘোড়ার পিঠে কয়েক দফা যেতে হবে।

হরিহরণ বলল, মেজোকর্তার সাথে দেখা করা যাবে?

রঘু বলল, তা তো জানি না। জানে অপলা মাসি। সে-ই এখন এখানকার সব কিছু দেখে।

হরিহরণ এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করে ফেলল, আচ্ছা রঘু, এ বাড়িতে এখন কে কে আছে?

রঘু দেবেন্দ্রনারায়ণ আর অপলা ছাড়া আরো জনা দশেকের নাম বলল। এদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি আর সকলকেই হরিহরণ চেনে। সে যাকে চেনে না, তার নাম রতনকান্তি দাস। দেবেন্দ্রনারায়ণের কন্যাদের গানের শিক্ষক রতনকান্তি। সে সেই রাতে জুড়িগাড়ি চালিয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণকে গঙ্গামহল থেকে বারোহাটি নিয়ে এসেছিল। তারপর আর ফিরে যায়নি। হরিহরণ বলল, এই রতনকান্তি কে?

রঘু বলল, মেজোকর্তার কন্যাদের গান শেখাত।

হরিহরণ আর আগ্রহ দেখালো না। তবে বিস্তর দুশ্চিন্তা আর না মেলানো হিসেব নিয়ে সে বজরাডুবির চরে ফিরে গেল। একটা বিষয়ে সে নিশ্চিত, বিভুঁই বারোহাটির বাগান বাড়িতে নেই। সেটি অবশ্য থাকার কথাও না। স্বাভাবিকভাবেই দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে সহসাই জনসম্মুখে আনতে চাইবেন না। আর সেই রাতে তো না-ই। তাহলে? বিভুঁইকে দেবেন্দ্রনারায়ণ কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন? মানুষের চোখের আড়াল থেকে বিভুঁইকে তিনি কোথায় লুকিয়ে রাখতে পারেন? যেখানে বিভুঁইকে কেউ সহসা খুঁজে পাবে না!

হরিহরণ সারারাত গভীর চিন্তায় ডুবে থাকল। শেষরাতের দিকে প্রবল ঘুমে তার চোখ বুজে এলো। কিন্তু খানিক তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেও সে ঘুমাতে পারল না। তার ঘুম ভেঙে গেল কিছুক্ষণ পরেই। পুবাকাশে তখনও আলোর আভাস স্পষ্ট নয়। কিন্তু হরিহরণ চুপিচুপি তার বজরাডুবির কুঁড়েঘর থেকে বের হয়ে এলো। হেমাঙ্গিনী দেবী তখনও ঘুমাচ্ছে। হরিহরণ হেমাঙ্গিনী দেবীকে কিছু না বলেই বারোহাটির জঙ্গলের উদ্দেশ্যে নৌকা ভাসাল।

হরিহরণের কেন যেন মনে হচ্ছে, সে আসলে জানে বিভুঁই কোথায় আছে!

*

দীর্ঘদিন বাদে গঙ্গামহলের সিংহদরজা উন্মোচিত হয়েছে।

তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। বিষ্ণুপুরের নতুন জমিদার অবনীন্দ্রনারায়ণ প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন। তার সাথে পেয়াদা থাকার কথা ছিল, কিন্তু তিনি বেরিয়ে পড়েছেন একা। কাউকে কিছু না বলেই। আজকাল তার স্ত্রী বীণাবালা ভারি যন্ত্রণা করেন। তার কথা বলার ধরন থেকে পোশাক, হাঁটার ধরন থেকে খাওয়া অবধি, সকলি বীণাবালার মর্জিমাফিক হওয়া চাই। এই ক’দিনেই অবনীন্দ্রনারায়ণ হাঁপিয়ে উঠেছেন। আজ সিংহদরজা খোলার সাথে সাথেই অবনীন্দ্রনারায়ণ তাই চুপিচুপি বেড়িয়ে পড়েছেন। এই এতদিনে তার দমবন্ধ হয়ে এসেছিল। তিনি হাঁটছেন গঙ্গামহলের পাশে নদীর তীর ঘেঁষা রাস্তা ধরে। ভোরের ফুরফুরে হাওয়ায় অবনীন্দ্রনারায়ণের ভারি আরাম হচ্ছে। তিনি সেই হাওয়ায় গুনগুন করে একখানা গানও ধরলেন, যাহারে পিয়াসি কাটিল জনমও তাহারে নাহি হেরিলাম আঁখিতে, তবু তাহারই ছবি ভাসিয়া ভাসিয়া আসিছে ভ্রমেরও পাখিতে।

অবনীন্দ্রনারায়ণ আনমনে এই দুই চরণই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারংবার গাইতে লাগলেন। গাইতে গাইতে তিনি হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, এই গান তিনি আগে কখনো কোথাও শোনেননি। এই গানের সুরও তিনি জানেন না। তার মানে তিনি অবচেতন মনে নিজে নিজেই এই গান রচনা করে তাতে সুরও দিয়ে ফেলেছেন! এই ভাবনায় অবনীন্দ্রনারায়ণের হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। তিনি একখানা উঁচু মাটির ঢিবির উপর আয়েশ করে বসে পড়লেন। তার সামনে বিস্তৃত জলরাশি। ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় তার চুল উড়ছে। তিনি গলা ছেড়ে গান গাইতে থাকলেন, যাহারে ভাবিয়া পুলকে আপনা সঁপেছি আপনা তাহারি চরণে, তাহারও কী কথা লুকানো হৃদয়ে জানিছে আঘাতে আঘাতে মরণে, যাহারে। পিয়াসি কাটিল জনমও তাহারে নাহি হেরিলাম আঁখিতে, তাহার স্বপনও ভাঙিলো, খুনেতে রাঙিল…।

এই পর্যন্ত এসে অবনীন্দ্রনারায়ণ থেমে গেলেন। গানের বাদবাকি চরণ এতক্ষণ আপনা আপনি কী সুন্দর তার জিভের আগায় চলে আসছিল। কিন্তু এই অবধি এসে তিনি হঠাৎ থমকে গেলেন। পরের লাইনগুলো যেন আর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অসমাপ্ত চরণখানিও শেষ করতে পারছেন না, তাহার স্বপনও ভাঙিলো, খুনেতে রাঙিল…।

তারপর কী হবে? অনেক চেষ্টা করেও অবনীন্দ্রনারায়ণ আর মেলাতে পারছিলেন না। তার প্রবল হাসফাস লাগতে লাগল। তাহার স্বপনও ভাঙিলো, খুনেতে রাঙিল… তার পরেরটুকু কী হবে? তারপর কী হবে? বাকি চরণগুলোর জন্য অবনীন্দ্রনারায়ণের সমস্ত স্নায়ুরা তুমুল উত্তেজনায় উদগ্রীব হয়ে রইল। কিন্তু চরণগুলো সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে এলো না। তবে ঠিক সেই মুহূর্তে অবনীন্দ্রনারায়ণ আবিষ্কার করলেন অন্য একটি বিষয়। বিষটির সাথে গানের আর সকল চরণগুলোও গভীরভাবে যুক্ত। বিষয়টি আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে বহুদিন ধরে লালন করা একটি প্রবল অস্বস্তিকর সমস্যার সমাধান হলো অবনীন্দ্রনারায়ণের।

তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রায় রোজ রাতেই একটি বিদঘুঁটে স্বপ্ন দেখছিলেন। সেই স্বপ্নের কারণে প্রায় ভোরেই তার ঘুম ভাঙতে বিলম্ব হচ্ছিল। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই সেই স্বপ্নের কথা মনে করতে পারছিলেন না। আজ এই মুহূর্তে সেই স্বপ্নের কথা তার হঠাৎ মনে পড়ল।

তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন একখানা বড় বাড়ির ছাদের কার্নিশে তিনি বসে আছেন। নিচের মানুষগুলোকে খুব ছোট লাগছে। এই বাড়ি অবনীন্দ্রনারায়ণের অচেনা। তার মনে হচ্ছে এ বাড়িতে তিনি কখনোই আসেননি। কিন্তু বাড়ির এই কার্নিশে বসে থাকতে তার খুব ভালো লাগছে। বাড়ির উঠানে দুটি ছেলে-মেয়ে খেলা করছে। অতি উঁচু থেকে দেখছেন বলেই অবনীন্দ্রনারায়ণের কাছে ছেলে মেয়ে দুটিকে লাগছে অতি ক্ষুদ্র। অতি ক্ষুদ্র হলেও তার দেখতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে খানিক হাসল। তার ঠিক পরপরই ছেলেটিও। জবাবে অবনীন্দ্রনারায়ণও হাসলেন। ছেলে-মেয়ে দু’টিকে তার ভারি চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু আগে কোথায় দেখেছেন তা মনে করতে পারছেন না। হঠাৎ ঘাড়ের কাছে কিছু একটা টুপ করে পড়ল। অবনীন্দ্রনারায়ণ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। দেখলেন উল্টো দিকের ঘর থেকে একজন লম্বা মতো স্বাস্থ্যবান মানুষ বেরিয়ে এসেছেন। মানুষটির গাত্রবর্ণ গৌর। হাতে একখানা ঝোলা। সে ঝোলার ভেতর থেকে ক্ষুদ্র একখণ্ড পাথরের টুকরো বের করলো। তারপর ছুঁড়ে মারল তার দিকে। অবনীন্দ্রনারায়ণ এবার মাথা সরিয়ে নিলেন। পাথরের টুকরোটুকু একটুর জন্য তার মাথা এড়িয়ে গেল। তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন মানুষটির দিকে! মানুষটি তার সাথে এমন করছে কেন? তিনি কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। তিনি কার্নিশ থেকে খানিকটা সরে বসতে গিয়ে হঠাৎ আবিষ্কার করলেন তিনি উড়তে পারছেন। অবনীন্দ্রনারায়ণ ভারি অবাক হলেন। তিনি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তার ছোট ছোট দু’খানা পাখাও রয়েছে। সেই পাখা বাতাসে মেলে দিয়ে তিনি দিব্যি উড়ে যেতে পারছেন। অবনীন্দ্রনারায়ণ তার এই পাখাপ্রাপ্তিতে প্রচণ্ড পুলকিত হলেন। তিনি ভাবলেন, উড়ে উড়ে মানুষটির কাছে চলে গেলে কেমন হয়? গিয়ে। মানুষটিকে জিজ্ঞেস করতে চান, মানুষটি তার সাথে এমন করছে কেন? তিনি উড়ে উড়ে মানুষটির একদম কাছে চলে গেলেন। এই মুহূর্তে মানুষটি ছোট ছেলে-মেয়ে দুটিকে চেঁচিয়ে বলল, শকুন এসেছে, শকুন। পাথর মেরে তাড়াও। পাথর মেরে তাড়াও।

অবনীন্দ্রনারায়ণ অবাক হয়ে নিজের দিকে তাকালেন। তিনি কি শকুন? কিন্তু তিনি দেখলেন তিনি শকুন নন। তার শরীরভর্তি ধবধবে সাদা পালক। তিনি নিজের মুখখানাও অদ্ভুত কোনো উপায়ে দেখতে পাচ্ছেন। তিনি মোটেই শকুন নন। তাকে দেখতে লাগছে সুন্দর একটি পায়রার মতোন। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে দেখলেন বিভিন্ন ঘর থেকে মানুষ বেরিয়ে আসছে। তারা সকলেই বলছে শকুন তাড়াও, শকুন। এদিক-সেদিক তাকিয়ে ছোট্ট ছেলে-মেয়ে দুটিকে খুঁজলেন অবনীন্দ্রনারায়ণ। কিন্তু দেখলেন তাদের দুজনের হাত ভর্তিই পাথরের টুকরো। তারা সজোরে তার দিকে পাথরের টুকরো ছুঁড়ে মারছে। আর ভয়ংকর গলায় বলছে, শকুন তাড়াও, শকুন।

অবনীন্দ্রনারায়ণের দিকে বৃষ্টির ফোঁটার মতোন পাথরের টুকরোগুলো ছুটে আসছে। পাথরের আঘাতে তার শরীরের এখানে-সেখানে ফেটে যাচ্ছে। ক্ষতস্থান থেকে দরদর করে রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু তিনি কিছুতেই তার জায়গা। থেকে সরে যেতে পারছেন না। আহত, ভীত অবনীন্দ্রনারায়ণ চিৎকার করে কথা। বলতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। এই মুহূর্তে তিনি দেখলেন তার স্ত্রী বীণাবালা উঠানের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাকে দেখে সকলে চুপ হয়ে গেল। তিনি প্রবল অসহায়ত্ব নিয়ে বীণাবালার দিকে তাকালেন। বীণাবালা নিশ্চয়ই সকলকে বোঝাবে যে তিনি তার স্বামী এবং অন্যদেরও নিরস্ত করবে। কিন্তু অবনীন্দ্রনারায়ণ অবাক বিস্ময়ে দেখলেন খানিক আগের গৌরবর্ণের সেই স্বাস্থ্যবান মানুষটি দেখতে অবিকল তার নিজের মতো। অবনীন্দ্রনারায়ণ হতভম্ব হয়ে গেলেন, ওই মানুষটি যদি তিনি হন, তাহলে এই কবুতর বা শকুনটা কে? এই যে তাকে শকুন মনে করে যারা পাথর ছুড়ছে, তা তো তার শরীরেই লাগছে এবং তিনি দিব্যি আহত হচ্ছেন, ব্যথাও পাচ্ছেন। তাহলে?

অবনীন্দ্রনারায়ণ কিছুই বুঝতে পারলেন না। তার প্রচণ্ড কষ্ট হতে লাগল। তিনি চিৎকার করে বীণাবালাকে ডাকতে লাগলেন। তার হঠাৎ মনে হলো ওই ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে দুটি তারই সন্তান। তিনি এবার ভালো করে তাকাতেই দেখলেন, তারা আসলে তার সন্তান দ্বিজেন্দ্র আর গায়ত্রী। কিন্তু তারা কেউই তাকে চিনছে না। তিনি দ্বিজেন্দ্র, গায়ত্রী আর বীণাবালাকে ডাকতে লাগলেন। কিন্তু তার গলা থেকে কেবল অদ্ভুত এক শব্দ বের হতে লাগল। সেই শব্দের কোনো অর্থ নেই। বীণাবালার পাশে দাঁড়ানো অবিকল তার নিজের মতো দেখতে মানুষটি এবার শব্দ করে হাসতে লাগল। ছোট গায়ত্রী আর দ্বিজেন্দ্রও তার সাথে যোগ দিলো। বীণাবালা কেবল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর একখানা বিরাট লোহার খাঁচা এনে তার পাশে দাঁড়ানো অবিকল অবনীন্দ্রনারায়ণের মতো দেখতে মানুষটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, যাও, পক্ষিটাকে খাঁচায় পুরে রাখো।

অবিকল তার মতো দেখতে মানুষটা অবনীন্দ্রনারায়ণের দিকে এগিয়ে আসছে। অবনীন্দ্রনারায়ণ ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছেন। তিনি উড়ে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না। কেবল ডানা ঝাপ্টাচ্ছেন। এই ভয়াবহ মুহূর্তে পায়রা বা শকুনরূপী অবনীন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ শুনতে পেলেন দূরে কোথাও কেউ গান গাইছে–

‘যাহারে পিয়াসি কাটিল জনমও তাহারে নাহি হেরিলাম আঁখিতে,
তবু তাহারই ছবি ভাসিয়া ভাসিয়া আসিছে ভ্রমেরও পাখিতে।
যাহারে ভাবিয়া পুলকে আপনা সঁপেছি আপনা তাহারি চরণে,
তাহারও কি কথা লুকানো হৃদয়ে জানিছে আঘাতে-আঘাতে মরণে,
যাহারে পিয়াসি কাটিল জনমও তাহারে নাহি হেরিলাম আঁখিতে,
তাহার স্বপনও ভাঙিলো, খুনেতে রাঙিল, ঘোর অমানিশা ফাঁকিতে।

গানের শব্দগুলো ক্রমশই প্রবল থেকে প্রবলতর হতে লাগল। যেন তার কানের পর্দা ফেটে যাবে। অবনীন্দ্রনারায়ণ তার সকল শক্তি দিয়ে দূরে সরে যেতে চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না। অবনীন্দ্রনারায়ণের সারা শরীর থরথর। করে কাঁপতে লাগল। অবিকল তার মতো দেখতে মানুষটি বিকট খাঁচাখানি নিয়ে এগিয়ে আসছে। অবনীন্দ্রনারায়ণের দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। তার সারাশরীর বেয়ে দরদর করে রক্ত বইছে। প্রচণ্ড ব্যাথায় আড়ষ্ট হয়ে আছে শরীর। ঠিক এই মুহূর্তে তার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ঘামে নেয়ে উঠেছেন। সারা শরীরজুড়ে দরদর করে ঘাম বইছে।

গঙ্গাবতীর নির্মল হাওয়ায় বসে এই মুহূর্তে অবনীন্দ্রনারায়ণের মনে হলো কী জ্বলজ্বলে জীবন্ত স্বপ্ন। কিন্তু কোনো এক অব্যাখ্যেয় কারণে এতদিনেও এই স্বপ্ন তিনি মনে করতে পারেননি। ঘুম ভাঙলে প্রবল আতঙ্কে তার সময় কেটেছে। মন এবং শরীরজুড়ে কাজ করেছে প্রবল অস্বস্তি। তিনি বুঝতে পারতেন এ সকলই হচ্ছে রাতে দেখা তার ভয়াবহ স্বপ্নের কারণে। এই স্বপ্নের ফলেই তার নিদ্রা ভেঙেছে বিলম্বে। কিন্তু তিনি সেই স্বপ্নের কথা মনে করতে পারতেন না।

আজ এই স্নিগ্ধ-সুন্দর প্রভাতে অবনীন্দ্রনারায়ণের তার স্বপ্নের কথা মনে পড়ল। কিন্তু তা তাকে স্বস্তি দিলো না। বরং স্বপ্নের কথা ভেবে আরো ভয়ঙ্কর অস্বস্তিতে তিনি জড় হয়ে রইলেন। এ তিনি কী স্বপ্নে দেখলেন! এই স্বপ্নের অর্থ কী?

অবনীন্দ্রনারায়ণ দীর্ঘসময় ঠায় বসে রইলেন। এই পুরোটা সময় তার চিন্তার জগত আচ্ছন্ন হয়ে রইল সেই ভয়াবহ স্বপ্নে। ভোরের আলো আরো পরিস্ফুটিত হয়েছে। সেই আলোয় খানিক আগের স্নিগ্ধ গঙ্গাবতী ঝলমল করছে। কিন্তু অবনীন্দ্রনারায়ণ নড়লেন না। তবে তার আচ্ছন্নতা বাধাপ্রাপ্ত হলো। কারো পায়ের শব্দে তিনি ফিরে তাকালেন। যাকে দেখলেন, তাকে অবনীন্দ্রনারায়ণ চেনেন না। লম্বাচুলের ময়লা কাপড়ের যুবক বয়সী এক ছেলে। হাতে একখানা অতি পুরনো জীর্ণ বাদ্যযন্ত্র। যুবকটি দ্বিধান্বিত চোখে অবনীন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকিয়ে আছে। অবনীন্দ্রনারায়ণ নরম গলায় তাকে ডাকলেন, কে হে তুমি? এদিকে এসো।

ছেলেটি রতনকান্তি দাস। দেবেন্দ্রনারায়ণের দুই কন্যার সংগীত শিক্ষক। সেই রাতে জুড়িগাড়ি চালিয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণকে বারোহাটির বাগানবাড়ি পৌঁছে দিয়ে রতনকান্তি আর ফিরে আসতে পারেনি। দেবেন্দ্রনারায়ণের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় তাকে থেকে যেতে হয়েছিল বারোহাটিতেই। কিন্তু ঘটনাচক্রে সহসাই আর দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে তার দেখা করবার বা কথা বলবার সুযোগ হলো না। ইতোমধ্যে বিষ্ণুপুরজুড়ে নেমে এলো গুটিবসন্তের মহাপ্রলয়। দেবেন্দ্রনারায়ণও আক্রান্ত হলেন সেই কালব্যাধিতে। একমাত্র দাসী অপলা ছাড়া আর কারো সাথেই দেবেন্দ্রনারায়ণের আর কোনো যোগাযোগ রইল না। রতনকান্তিও রয়ে গেল বারোহাটির বাগান বাড়িতেই। সময়ে কালব্যাধির প্রকোপ কমলেও বিষ্ণুপুরের জমিদার বাড়ি গঙ্গামহলের অন্দরমহলে ক্ষমতার যে পালাবদল ঘটল তার অনেক খবর পৌঁছে গেল বারোহাটির বাগান বাড়িতেও। গুটিবসন্তে বারোহাটি বাগান বাড়িতেও প্রাণহানি ঘটল। পেয়াদা জগাই মারা। গেল। মারা গেল দু’জন দাসী আর কয়েকজন ভৃত্যও। তবে দেবেন্দ্রনারায়ণ এ যাত্রা বেঁচে গেলেন। প্রায় দু’মাস পরে তিনি শয্যা ছেড়ে উঠলেন। গম্ভীর মুখে অপলার কাছে গঙ্গামহলের ঘটনা শুনলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, রতনকান্তি ছেলেটি কোথায়?

অপলা রতনকান্তিকে ডাকল। রতনকান্তি জড়সড় হয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। দেবেন্দ্রনারায়ণের শরীর দুর্বল। তিনি দাঁড়াতে গিয়ে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলেন শয্যায়। রতনকান্তি তাকে ধরে আবার বসালো। দেবেন্দ্রনারায়ণ দীর্ঘসময় ঝিম মেরে বসে রইলেন। তার মস্তিষ্ক পরিষ্কার কাজ করছে না। সব ভাবনা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরো দিন কয় আবার নিজের মতো পড়ে রইলেন শয্যাবন্দী হয়ে। এই কদিনে একা একা নানান কথা ভেবেছেন। বিভূঁইয়ের কথা মনে পড়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে বিভূঁইয়ের জন্য তার কী করার আছে তা তিনি ভেবে পেলেন না। তিনি চান না বিভুঁইয়ের কথা কেউ জানুক। এতদিনে ছেলেটার কী অবস্থা হয়েছে তাও তিনি জানেন না। তবে স্বাভাবিকভাবেই ছেলেটার বেঁচে থাকার কথা নয়। দেবেন্দ্রনারায়ণ ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড বিচলিত। কিন্তু বাইরে তার কিছুই প্রকাশ করছেন না।

বিভূঁইয়ের কথা মাথায় থাকলেও এই মুহূর্তে তিনি অধিক বিচলিত গঙ্গামহলের অভ্যন্তরে বন্দী হয়ে থাকা তার স্ত্রী রেণুকা এবং দুই কন্যা সর্বজয়া আর সুদক্ষিণাকে নিয়ে। দেবেন্দ্রনারায়ণ স্পষ্ট বুঝতে পারছেন, দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে পাতা বীণাবালার ভয়াবহ ফাঁদে পড়ে গেছেন তিনি। গঙ্গামহলের অভ্যন্তরে আর কী কী ফাঁদ পেতে রেখেছেন বীণাবালা তা তিনি এখনো জানেন না। তবে এই এতদিনে দেবেন্দ্রনারায়ণ একা একা অনেক কিছুই ভেবেছেন, অনেক হিসেবই মেলাতে চেষ্টা করেছেন। ফলে তার আর বুঝতে বাকি নেই যে সকল কিছুর পেছনে বীণাবালা দীর্ঘসময় নিয়ে আটঘাট বেঁধেই নেমেছেন। না হলে তার এই অবস্থায়ও রেণুকাকে কী করে গঙ্গামহলে আটকে রাখা হয় এবং বিষ্ণুনারায়ণের মৃত্যু হতে না হতেই জমিদারির উত্তরাধিকার নির্ধারণ হয়ে যায়? এমনকি গঙ্গামহল থেকে কেউ দেবেন্দ্রনারায়ণের খবর অবধি নিতে এলো না!

দেবেন্দ্রনারায়ণ জানেন, এখন এই মুহূর্তে তার আর বিশেষ কিছু করার নেই। তবে বীণাবালা তাকে নিয়ে কী ভাবছেন সেটি জানা জরুরি। এই মুহূর্তে গঙ্গামহলে কী চলছে তাও তিনি জানেন না। যদিও এখন অবধি বীণাবালা বারোহাটির বাগানবাড়ি বিষয়ক কোনো কিছুতেই কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু এতে নিশ্চিন্ত হবার কোনো সুযোগ নেই। বরং এর আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে আরো বড় কোনো উদ্দেশ্য। তাছাড়া তার স্ত্রী রেণুকাও যে গঙ্গামহলে বিশেষ ভালো নেই, সেটি দেবেন্দ্রনারায়ণ আঁচ করতে পারছেন। না হলে যত যাই ঘটুক স্বামীর এমন জীবন-মরণ সঙ্কটে রেণুকাকে গঙ্গামহলে আটকে রাখার সাধ্য কারো ছিল না।

দেবেন্দ্রনারায়ণ খানিক সুস্থ বোধ করলেও এতটা পথ পাড়ি দিয়ে গঙ্গামহলে পৌঁছানোর ঝুঁকি যেমন তিনি নিতে চাইছিলেন না, তেমনি এতদিনকার খামখেয়ালি, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী দেবেন্দ্রনারায়ণ অনুভব করতে পারছিলেন যে সময় ও পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বীণাবালা আর কোনো সুযোগের অপেক্ষায় আছে তা তিনি জানেন না। সুতরাং গঙ্গামহলে ফিরবার আগে তার আরো কিছু সময় চাই। কিছু হিসেব মেলানো চাই।

দিনকয়েক বাদে দেবেন্দ্রনারায়ণ আবার রতনকান্তিকে ডাকলেন। অনেক ভেবে চিন্তেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে রতনকান্তিকে গঙ্গামহলে পাঠাবেন। একবার ভেবেছিলেন পেয়াদা রঘুকে পাঠাবেন। কিন্তু বীণাবালার মতোই গঙ্গামহলের সকলেই জানে, রঘু দেবেন্দ্রনারায়ণের কতটা বিশ্বাসভাজন পেয়াদা। সুতরাং সেটি ঠিক হবে না। তাছাড়া বারোহাটি বাগানবাড়ির যেকোনো পেয়াদা ভূত্যের চেয়ে রতনকান্তিই গঙ্গামহলে সবচেয়ে অপরিচিত মুখ যে। রেণুকার কাছে পৌঁছাতে পারবে। হয়তো রেণুকা তাকে বিশ্বাসও করবেন।

সেই রাতের সেই গভীর অন্ধকারে অতটা পথ যেভাবে জুড়িগাড়ি চালিয়ে এসেছিল রতনকান্তি, তাতে তার উপর দেবেন্দ্রনারায়ণের এক ধরনের আস্থাও তৈরি হয়েছে। একইভাবে এই এতটা দিন রতনকান্তি তার দেখা সাক্ষাৎ না পেয়েও যেভাবে দেবেন্দ্রনারায়ণের সিদ্ধান্তের জন্যই বারোহাটির বাগানবাড়িতে অপেক্ষা করেছে, তাও দেবেন্দ্রনারায়ণকে মুগ্ধ করেছে। তিনি রতনকান্তির প্রতি বিশেষ ভরসা অনুভব করছেন। তাছাড়া গঙ্গামহলে পেয়াদা ভৃত্যরা কেউ কেউ রতনকান্তিকে অল্প-বিস্তর চিনলেও বীণাবালা বা আর কারো চেনার সম্ভাবনা নেই। বললেই চলে। তারপরও দেবেন্দ্রনারায়ণ রতনকান্তিকে নানান বিষয়ে সাবধান করে দিলেন। তাকে স্বাভাবিক কোনো উপায়ে গঙ্গামহলে প্রবেশ করতে হবে এবং রেণুকা’র সাথে দেখা করে পুরো পরিস্থিতি বুঝে আসতে হবে।

রতনকান্তি অবনীন্দ্রনারায়ণের কোমল কণ্ঠের ডাক শুনেও আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। এই সময়ে সদ্য জমিদার অবনীন্দ্রনারায়ণকে এভাবে এই নদীর তীরে বসে থাকতে দেখবে রতনকান্তি তা ভাবেনি। রতনকান্তি অবনীন্দ্রনারায়ণকে চেনে। দেবেন্দ্রনারায়ণের কন্যা সর্বজয়া আর সুদক্ষিণাকে গান শেখাতে যাওয়ার সময় মাঝে-মধ্যে দেখেছে। তবে অবনীন্দ্রনারায়ণ যে তাকে কখনো খেয়াল করেননি, এ বিষয়ে রতনকান্তি নিশ্চিত। রতনকান্তির হাতে একখানা অতি পুরাতন বাদ্যযন্ত্র। এই বাদ্যযন্ত্রখানা তার সবসময়ের সঙ্গী। বাদ্যযন্ত্রখানায় অবনীন্দ্রনারায়ণের চক্ষু আটকে রয়েছে। তিনি আবারো ডাকলেন, কি হে, কে তুমি? এদিকে আসো।

রতনকান্তি এবার এক-পা দু-পা করে এগুলো। সে অবনীন্দ্রনারায়ণের কাছ থেকে খানিক দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। তারপর বলল, আজ্ঞে, আমি রতন, জমিদার কর্তা। রতনকান্তি দাস।

এই জমিদার কর্তা সম্বোধনখানা ভারি ওজনদার মনে হয় অবনীন্দ্রনারায়ণের। হাসফাস লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই। তিনি বললেন, কোন রতন? কী করো তুমি?

এই প্রশ্নের উত্তর রতনকান্তি কী দেবে? সে মিনমিন করে বলল, আজ্ঞে, আমি গান গাই কর্তা।

অবনীন্দ্রনারায়ণের চোখ যেন চকচক করে উঠল। এমনিতেই ওই ভয়াবহ স্বপ্নের কথা ভুলে যেতে চাইছিলেন তিনি। তার ওপর ভোরের ওই গানখানাও থেকে থেকে কানে বাজছিল। রতনকান্তিকে বেহালা হাতে দেখে তাই তার খুব আনন্দ হতে লাগল। তিনি বললেন, কী কী গান গাও হে?

রতনকান্তি বলল, কোনো ঠিক নাই কর্তা। মনে যা আসে তাই গাই।

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, ঠিক তত? মনে যা আসে তাই-ই গাও?

রতনকান্তি বলল, আজ্ঞে কর্তা।

অবনীন্দ্রনারায়ণ উফুল্ল গলায় বললেন, সেরকমই তো হওয়া উচিত। গান তো মানুষের মনেরই ব্যাপার। মনে যা আসবে তাই-ই গাইবে।

রতনকান্তি কথা বলল না। অবনীন্দ্রনারায়ণই আবার বললেন, তা তুমি কি নিজে নিজে গান বানাও?

রতনকান্তি বলল, ও তেমন কিছু নয় কর্তা। গান বানানো কি সহজ কথা?

অবনীন্দ্রনারায়ণ এদিক-সেদিক তাকিয়ে বললেন, তা অবশ্য ঠিক। গল্প বানানো সহজ হলেও গান আর কবিতা কিন্তু সহজ ব্যাপার নয় হে। কত কত কথা, ভাব, তার সাথে আবার সুর, তাল, ছন্দ থাকতে হয়। এ বড় কঠিন ব্যাপার।

রতনকান্তি এবারেও কোনো কথা বলল না। অবনীন্দ্রনারায়ণ এবার ফিসফিস করে বললেন, আমি না একখানা গান লিখে ফেলেছি। লিখে ফেলেছি মানে মনে মনে আওড়েছি। গুনগুন করে খানিক সুরও বেঁধে ফেলেছি। কিন্তু গান হলো কিনা বুঝতে পারছি না। তুমি কি শুনবে?

রতন গলায় বাড়তি আগ্রহ নিয়ে বলল, শুনব কর্তা। শুনব না কেন?

অবনীন্দ্রনারায়ণ সঙ্কোচ মিশ্রিত আগ্রহ নিয়ে রতনকান্তির মুখের দিকে তাকালেন। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক সেদিক দেখে নিয়ে চকিতে চোখ বন্ধ করে গাইতে শুরু করলেন। এতক্ষণ ধরে গুনগুন করে গাওয়া চরণগুলি বারংবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গলা ছেড়ে গাইতে থাকলেন। রতনকান্তি কিছুক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনল। গানের কথা এবং সুর তার ভালোই লাগছে। অবনীন্দ্রনারায়ণের গানের গলা মোটামুটি। গলায় খানিক সুরও আছে। রতনকান্তি বেহালায় গানের সুর তুলে ফেলল। মুদ্রিত নয়নের অবনীন্দ্রনারায়ণ যেন এক অপার্থিব সুরের আবেশে ডুবে গেলেন। দীর্ঘসময়। তার অবচেতন মন থেকে একে একে আরো গানের চরণ নিঃসৃত হতে থাকল–

‘আমায় কী ছোঁয়া ছুঁয়েছো বুঝিনি মোহিনী, রুখিনি হৃদয়ওখানি,
আমায় কী ভ্রমেতে বেঁধেছ, দাসেতে রেখেছ, কিছুই কভুও জানিনি।
এই অচেনা মানষে কী খেলা খেলিছ, কী তীর রাখিছ তুণেতে,
যে কান্তি নধরে, ভাবনা ফাঁদিছ, তাহার কতটা কাটিছে ঘুণেতে!’

রতনকান্তি অবনীন্দ্রনারায়ণের গান শুনে খানিকটা অবাক হয়েছে। অবনীন্দ্রনারায়ণের গলা যে খুব সুরেলা তা নয়, কিন্তু এই এতটুকুও রতনকান্তি আশা করেনি। তাছাড়া সুর এবং কণ্ঠের ক্ষেত্রে বয়স কিংবা অনভ্যস্ততাও একটা বড় ব্যাপার। তবে বিষ্ণুপুর জমিদারির জ্যেষ্ঠপুত্র, সদ্য জমিদার অবনীন্দ্রনারায়ণের গানের প্রতি এই যে আগ্রহ, তা রতনকান্তিকে অবাক করেছে। এই সকল গানের পঙক্তি যে অবনীন্দ্রনারায়ণের নিজের লেখা তা জেনে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছে সে। তবে সবচেয়ে বেশি যেটি তাকে চমকে দিয়েছে সেটি হলো অবনীন্দ্রনারায়ণের সলজ্জ আচার, বিক্স ব্যবহার।

অবনীন্দ্রনারায়ণ থামলেন। তার মুখজুড়ে দ্বিধা। তিনি কুণ্ঠিত গলায় বললেন, আমি কিন্তু কখনো গান-টান গাইনি।

রতনকান্তি সহসা গলায় মুগ্ধতা ঢেলে বলল, কী যে বলেন না কর্তা! আপনার গলা ভারি মিষ্টি। তাছাড়া গানের কথাগুলোও কী সুন্দর, কী গভীর!

অবনীন্দ্রনারায়ণ এবার সত্যি-সত্যি যেন খুশি হলেন। তিনি বললেন, ঠিক বলছ তো? নাকি আমি জমিদার বলে আমায় মিঠে মিঠে কথা বলে ভোলাচ্ছ?

রতনকান্তি বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, কী যে বলেন কর্তা? আর সকল কিছু নিয়ে মিছে বলা যায়, গান নিয়ে নয়।

অবনীন্দ্রনারায়ণের কথাখানি খুব মনে ধরল। তিনি বললেন, তা বেশ একখানা কথা বলেছ তো ছোঁকড়া। সকল কিছু নিয়ে মিছে বলা যায়, গান নিয়ে। নয়। বেশ বলেছ।

কথা শেষ করে অবনীন্দ্রনারায়ণ খানিক চুপ করে বসে রইলেন। গভীর মনোযোগে যেন কিছু একটা ভাবছিলেন। তারপর হঠাৎ মাথা তুলে আবার বললেন, কিন্তু এ তো তোমার আর আমার কথা, সকল লোক এ কথা মানবে কেন? ধর্ম রয়েছে, প্রেম রয়েছে, সততা, বিশ্বাস, ভালোবাসা রয়েছে। এমন কত কিছুই তো রয়েছে, যা নিয়ে মিছে বলা যায় না।

রতনকান্তি সঙ্গে সঙ্গেই বলল, গান তো সকল মঙ্গলের কথাই বলে কর্তা। গান অধর্মের কথা বলে না, অপ্রেম বা ঘৃণার কথাও বলে না। গান মানেই মানুষের কল্যাণের কথা। মনের ভেতরে যে শুভ তার কথা। আর যেখানে মনের শুভবোধ রয়েছে সেখানে কি মিছে বলা যায় জমিদার কর্তা?

অবনীন্দ্রনারায়ণ যেন এবার পুরোপুরি চোখ মেলে রতনকান্তির দিকে চাইলেন। তার এই তাকানোজুড়ে সমীহ। তিনি কিছুক্ষণ নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি কে হে ছোঁকড়া, বলো তো?

রতনকান্তি সঙ্গে সঙ্গে কোনো কথা বলল না। সে চুপ করে রইল। এই অবনীন্দ্রনারায়ণ মানুষটি সম্পর্কে সে-ও তেমন কিছুই জানে না। রতনকান্তি শুধু জানে, তাকে দেবেন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী রেণুকার সাথে দেখা করতে হবে। যেই রেণুকাকে আসলে গঙ্গামহলে গৃহবন্দী করে রাখা রয়েছে। যার কারণ তার কাছে স্পষ্ট না। এই মুহূর্তে বিষ্ণুপুরের জমিদার অবনীন্দ্রনারায়ণ। রতনকান্তির ধারণা ছিল এই মানুষটি প্রচণ্ড প্রতাপশালী, ভয়ানক রাগী, বদমেজাজী কেউ হবেন। কিন্তু এই ভোরে গঙ্গাবতী নদীর তীরে যে অতি সাধারণ এক মানুষকে সে বসে থাকতে দেখল, কথা বলতে দেখল, গান গাইতে দেখল, সেই মানুষটিই যে বিষ্ণুপুরের বর্তমান জমিদার এটি ভাবতে তার ভীষণ ভালো লাগল। আবার অবিশ্বাস্যও মনে হতে লাগল। কিন্তু সে জানে, ইনিই অবনীন্দ্রনারায়ণ। অবনীন্দ্রনারায়ণকে সে আগে দেখেছেও, এমনকি খানিক আগে বারকয়েক রতনকান্তি তাকে জমিদার কর্তা’ বলে সম্বোধনও করেছে। অবনীন্দ্রনারায়ণ তাতে বাধাও দেননি। রতনকান্তি মুখ তুলে মানুষটির দিকে তাকাল। অতি সাধারণ চেহারার সাদাসিধে একজন মানুষ। বিষ্ণুপুরের জমিদারির যে পরম্পরা, তাতে এই মানুষটি যেন বেমানান।

অবনীন্দ্রনারায়ণ আবার বললেন, কী ব্যাপার? তুমি আমার কথার জবাব দিচ্ছ না কেন?

রতনকান্তির হঠাৎ কী হলো, সে ঝট করে বলে দিলো, আমি আগে পথে পথে গান-বাজনা করে বেড়াতাম। তো একদিন মেজোকর্তা আমায় দেখলেন। আমার গান তার ভালো লেগে গেল। অমনি তিনি আমায় গঙ্গামহলে ডেকে নিয়ে এলেন।

অবনীন্দ্রনারায়ণ খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন, তার মানে দেবু তোমায় পথ থেকে টেনে নিয়ে গঙ্গামহলে তুলেছিল? কিন্তু কই, আমি তো তোমায় কখনো দেখিনি?

রতনকান্তি মুখ নিচু করে বলল, আমি আপনাকে দেখেছি জমিদার কর্তা। আপনি হয়তো খেয়াল করেননি। নানান কাজে ব্যস্ত থাকেন।

অবনীন্দ্রনারায়ণ এবার খুব হতাশ হলেন। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তা অবশ্য ঠিক বলেছ। এই কি এক ছাই জমিদারি! এসব করে কী হয় বলো তো! আমি এর কিছু বুঝি না, জানি না। জানতেও চাই না। এর জন্য দেবুই ঠিক। ওর নাকি আবার বারোহাটি গিয়ে গুটি উঠেছে। আর দেখো, সেই এতদিন হলো, সুস্থও নাকি হয়েছে, তা সে আর গঙ্গামহলে আসছে না কেন? ভাবছিলাম আমিই একদিন যাব, কিন্তু বীণাবালা বলল ও নিজে নিজেই নাকি চলে আসবে।

অবনীন্দ্রনারায়ণ একটু দম নিয়ে থেমে আবার বললেন, আমার এসব একদম ভাল্লাগে না। কই একটু তোমার মতোন মনের আনন্দে গান গাইব। সুর তুলব। পথে পথে ঘুরে বেড়াব, তা না। কী এক ভারী জমিদারি। জমিদারি করে কী হয় বলো তো? এই যে এত বড় জগত, এই জগতের কি-ই বা দেখেছি বল! জগতটা কি ওই গঙ্গামহলের চার দেয়াল, আর এই বিষ্ণুপুর? এর বাইরেও কত কিছু জানার আছে, দেখার আছে। তা না! আমায় বানিয়ে রেখেছে হাত-পা বাঁধা এক পুতুল। এ কি ঠিক বল?

রতনকান্তি কী বলবে! মানুষ এত সহজ হয়? কি অকপট জলের মতোন স্বচ্ছ সরল এক মানুষ। কী অবলীলায় তার মতো অচেনা অজানা এক পথের মানুষের কাছে মনের আগল খুলে দিচ্ছেন। অবনীন্দ্রনারায়ণকে ভারি পছন্দ হয়ে গেল রতনকান্তির। সে বলল, কিন্তু কর্তা, ভগবান কি সকলকে একই কাজের জন্য পাঠিয়েছেন?

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, সেইটেই কথা। আমি এসব কাজের জন্য নয়। এইসব জমিদারি, প্রজাপালন, হিসেব-নিকেশ আমায় দিয়ে হবে না।

রতনকান্তি কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। অবনীন্দ্রনারায়ণ সহজ সরল ভাবুক মানুষ। কিন্তু এও তো সত্যি যে তিনি বিষ্ণুপুরের বর্তমান জমিদার। সুতরাং তার সাথে আচরণে, বলায় তার আরো খানিক সংযতও হওয়া উচিত।

অবনীন্দ্রনারায়ণ বলল, তা তুমি কি এখনও গঙ্গামহলেই থাকো?

রতনকান্তি বলল, আজ্ঞে না কর্তা।

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, তাহলে? গঙ্গামহলে দেবু তোমায় কেন নিয়েছিল?

রতনকান্তি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, যতটা সম্ভব অবনীন্দ্রনারায়ণের কাছে সে সত্যি কথাই বলবে। সে বলল, আজ্ঞে, মেজোকর্তা আমায় কাজ দিয়েছিলেন। আমি রোজ যেতাম, তার ছোট কন্যাকে গান শেখাতাম।

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, তা বেশ তো! এখন আর আসো না কেন?

রতনকান্তি এবার আর পুরোপুরি সত্য বলল না, আবার পুরোপুরি মিথ্যেও বলল না। সে বলল, এক আত্মীয়ের অসুস্থতায় দিন কয় ছুটি নিয়েছিলাম। তারপর শুনলাম বিষ্ণুপুরে গুটি এসেছে। শুনে আর এমুখো হইনি। তারপর বিষ্ণুপুরে যখন ফিরলাম, ফিরে দেখি গঙ্গামহলের সিংহদরজা বন্ধ। কেউ বেরও হচ্ছে না, কাউকে ঢুকতেও দিচ্ছে না। তাই রোজ একবার করে আসি। আর বন্ধ দেখে ফিরে যাই।

অবনীন্দ্রনারায়ণ হেসে বললেন, আজ তোমার ভাগ্য প্রসন্ন হে রতনকান্তি। আজ গঙ্গামহলের সিংহদরজা খুলেছে। চলো দেখি, তুমি আমার সাথেই চলো। সুদক্ষিণার সাথে না হয় আমিও মাঝে মাঝে তোমার কাছে গানের তালিম নিলাম। কী বলে?

রতনকান্তি গঙ্গামহলে ঢোকার এমন সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে মনে মনে ভীষণ খুশি হলেও মুখে বলল, আমি মূর্খ মানুষ কর্তা। গান-বাজনা তেমন জানি না। পথে পথে ঘুরে নিজের ইচ্ছেয় যা শিখেছি তা অতি নগণ্য কর্তা।

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, তুমি তো দেখি বিনয়ের অবতার হে রতনকান্তি। চলো, চলো, এ বেলা ওঠা যাক। বীণাবালা আবার রেগে অগ্নিমূর্তি হবে। বিষ্ণুপুরের আসল জমিদার তো এখন সে-ই। হা হা হা।

অবনীন্দ্রনারায়ণ নির্দোষ কৌতুক করলেও কথাটার তাৎপর্য অনুধাবন করতে রতনকান্তির বিশেষ অসুবিধা হলো না। দেবেন্দ্রনারায়ণ যখন তাকে গঙ্গামহলের উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন তখনই বীণাবালার বিষয়ে অস্পষ্ট কিছু ধারণা দিয়েছিলেন। তবে দেবেন্দ্রনারায়ণ বিষ্ণুপুর জমিদারির অন্দরমহলের ঘটনা বিস্তারিত কিছু না বললেও রতনকান্তি নানান কানাঘুষো থেকে অনেক কিছুই আঁচ করতে পেরেছিল। ফলে অবনীন্দ্রনারায়ণের এই কথা বুঝতে তার বিশেষ অসুবিধা হলো না। সে বিনীত গলায় বলল, আজ্ঞে কর্তা। মেজো কর্তা তো গঙ্গামহলে নেই। তিনিই আমায় এ বাড়িতে এনেছিলেন। এখন-ওখানে কেউ আমায় কিছু বলবে না তো?

অবনীন্দ্রনারায়ণ আবারও অট্টহাসি হাসলেন। আজ তার খুব ভালো লাগছে। কতদিন পর গঙ্গামহল থেকে বের হয়েছেন। বাইরের খোলা আলো হাওয়ার জগত। সঙ্গে রতনকান্তির মতোন একজন মানুষ। তার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। তিনি বললেন, তুমিও তো দেখি আমার স্ত্রী বীণাবালার মতোই। বিষ্ণুপুরের বর্তমান জমিদার অবনীন্দ্রনারায়ণের উপর তো দেখি তোমারও কোনো আস্থা নেই হে!

রতনকান্তি সন্ত্রস্ত গলায় বলল, অপরাধ মার্জনা করুন কর্তা। আমি তা বলিনি। আজ্ঞে, ও বাড়িতে তো আমায় তেমন কেউ চিনত না। আমি সন্ধ্যার অন্ধকারে যেতাম। মেজোকর্তার অট্টালিকায় গান শিখিয়ে আবার অন্ধকারে অন্ধকারেই চলে আসতাম। দিনের আলোয় গঙ্গামহল কখনো যাইনি কর্তা। তাই ভাবছিলাম, আজ এভাবে, কেউ যদি আমায় না চেনে? না ঢুকতে দেয়?

অবনীন্দ্রনারায়ণ খানিক টিপ্পনি কেটে বললেন, তা আজও তাহলে সন্ধ্যেবেলাতেই আসতে। এখন কেন এলে? অন্ধকারে অন্ধকারেই ঢুকে যেতে!

রতনকান্তি বলল, আজ্ঞে কর্তা। তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু দেখেতে চাচ্ছিলাম, সিংহদরজা খুলেছে কিনা!

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, ঠিক আছে। চলো, দেখি কিছু ব্যবস্থা করা যায় কিনা!

অবনীন্দ্রনারায়ণ রতনকান্তিকে নিয়ে গঙ্গামহলে ঢুকলেন। ততক্ষণে গঙ্গামহলে অবনীন্দ্রনারায়ণের খোঁজে রীতিমতো হৈচৈ পড়ে গেছে। তিনি ঢুকতেই মুকুন্দ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। তার পিতা বিষ্ণুনারায়ণের মৃত্যুর পর বিষ্ণুনারায়ণের খাস ভৃত্য মুকুন্দ এখন বীণাবালার খাস লোক। সে বীণাবালার নির্দেশানুযায়ী অবনীন্দ্রনারায়ণের সাথে ছায়ার মতো লেগে থাকে। মুকুন্দ উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, বড় কর্তা, আপনি কোথায় ছিলেন? সেই ভোর থেকে বড় মা আপনার জন্য অস্থির হয়ে আছেন।

জমিদার কর্তা সম্বোধনের মতোন এই বড় কর্তা ডাকটিও অবনীন্দ্রনারায়ণের ভারি অপছন্দের। তার বাবা বিষ্ণুনারায়ণকেই সকলে বড় কর্তা ডাকত। তাকে ডাকত বড় বাবু। কিন্তু বীণাবালার কঠোর হুকুম, এখন থেকে বিষ্ণুপুর জমিদারির বড় কর্তা অবনীন্দ্রনারায়ণই। সুতরাং তাকে তা-ই ডাকতে হবে।

অবনীন্দ্রনারায়ণ খানিক বিরক্তি নিয়ে বললেন, জমিদার হয়েছি বলে কি একা একা মহলের বাইরেও যাওয়া যাবে না নাকি? এত হইচইয়ের কী আছে? আমি গঙ্গাবতীর তীরে হাওয়া খেতে গিয়েছিলাম।

মুকুন্দ গলা নামিয়ে বিড়বিড় করে বলল, আজ্ঞে বড় কর্তা। কিন্তু বড় মা যে বললেন উনাকে না বলে মহলের বার হওয়া সকলের জন্যই বারণ!

অবনীন্দ্রনারায়ণ ঝট করে মাথা তুলে তাকালেন, রতনকান্তি নিশ্চয়ই শুনে ফেলেছে! কিন্তু তিনি অবাক হয়ে দেখলেন রতনকান্তি আশেপাশে কোথাও নেই। তিনি মুকুন্দর কথার জবাব না দিয়ে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণের মহলের দিকে, ছেলেটা তাহলে এই হইচইয়ের ফাঁকে ঠিকই কেটে পড়েছে! তা গেলে যাক। অবনীন্দ্রনারয়ণের এত কিছু নিয়ে ভাববার দায়ও নেই। সে মুকুন্দকে বলল, তুই বড় বেশি বকিস রে মুকুন্দ। আগে বল জলখাবারের কী ব্যবস্থা হলো? পেটের ভেতর ছুঁচো ইঁদুর নাচছে।

মুকুন্দ বলল, বড় মা খাবার নিয়ে সেই কখন থেকে বসে আছেন। সাথে বিভূতিনাথ বাবুও রয়েছেন।

অবনীন্দ্রনারায়ণের কপাল এবার ভালো করেই কুঁচকালো। তিনি অন্দরমহলের দিকে পা ফেলতে ফেলতে গম্ভীর গলায় বললেন, এই সাত সকালে আবার বিভূতিনাথ বাবু কেন?

মুকুন্দ বলল, আজ্ঞে, বড় মা জানেন। উনারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।

অবনীন্দ্রনারায়ণ আর কথা বললেন না। বিভূতিনাথ এসেছেন শুনে তার বুকের ভেতর কেমন অস্বস্তিকর এক অনুভূতি হতে লাগল। এই মানুষটাকে তার। কেমন রহস্যময় এবং অস্বাভাবিক লাগে। অথচ এই মানুষটিই সকলের সাথে সবচেয়ে বেশি স্বাভাবিক আচরণ করেন। অবনীন্দ্রনারায়ণ চিন্তিত মুখে পা ফেলছেন। তিনি বুঝতে পারছেন না বিভূতিনাথের কথা শুনে তার এমন অস্থির লাগছে কেন?

*

হরিহরণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভগ্নপ্রায় মন্দিরটির দোতলায়।

অচেতন বিভুঁই মন্দিরের নোংরা মেঝেতে মরার মতো পড়ে রয়েছে। পচে যাওয়া কিছুর তীব্র গন্ধ চারধারে। বিভূঁইকে আগে কখনো না দেখলেও এই ছেলেটিই যে বিভুঁই তা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না হরিহরণের। বিভূঁইয়ের মুখভর্তি বীভৎস দাগ। হরিহরণ অনেক সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। বিভুঁই কি বেঁচে আছে? হরিহরণ লক্ষ করল খুব ধীরে হলেও বিভূঁইয়ের শ্বাস বইছে। কিন্তু এই এতদিনেও ছেলেটা এখানে কিভাবে বেঁচে রইল? হরিহরণ দেখল দোতলার এই মেঝেজুড়ে নানান ধরনের পাত্র, কাপড়ের থলে এলোমেলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। সেই সকল পাত্রভর্তি যে হরেক রকমের খাবার ছিল তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এখন সকল পাত্রই শূন্য। কোথাও খাবারের ছিটেফোঁটাও নেই। হরিহরণ সহজেই অনুমান করতে পারল যে দেবেন্দ্রনারায়ণ তার নিজের গুটিবসন্ত ওঠার লক্ষণ টের পেয়েই দীর্ঘদিনের জন্য এই সকল খাবার এখানে রেখে গিয়েছিলেন। এর পরপরই সম্ভবত তিনি গুটিবসন্তে পুরোপুরি আক্রান্ত হন এবং তারপর থেকে আর এখানে আসতে পারেননি।

কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণের রেখে যাওয়া সেই খাবার ক’দিন আগে শেষ হয়ে গেছে হরিহরণ তা জানে না। খাবার শেষ হয়ে যাবার পরও বিভুঁই যে এখানেই পড়ে রয়েছে তা বিভুঁইয়ের অবস্থা দেখেই হরিহরণ নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু হরিহরণ কিছুতেই বুঝতে পারছে না, খাবার বা অন্য কোনো সাহায্যের সন্ধানে বিভুঁই মন্দির থেকে বের হলো না কেন?

এই ভাবনার মাঝখানেই একটা বীভৎস দৃশ্য দেখে হরিহরণ চমকে উঠল। মেঝেতে বিভূঁইয়ের থেকে সামান্য দূরে একটি ব্যাঙ পড়ে রয়েছে। হরিহরণ অবাক হলো দেখে যে ব্যাঙটি সাধারণভাবে মারা যায়নি। ব্যাঙটির দেহের পেছনের অংশ ভয়ানক কিছুর আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে। পেছনের একটি পা শরীর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আঘাতের ধরণটি বিদঘুঁটে। যেন কোনো কিছু দিয়ে চেপে ধরে পা খানা টেনে হিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিল কেউ। কী হয়েছিল? হরিহরণ সন্তর্পণে পা ফেলে বিভূঁইয়ের কাছে গেল। খুব কাছ থেকে দেখলো। বিভূঁইয়ের ঠোঁটের কোণে ঘন তরল বেয়ে নামার দাগ শুকিয়ে আছে। তার মাঝে কালচে লাল রঙের সামান্য রক্তের আভাসও দেখা যাচ্ছে। হরিহরণ ভ্রু কুঁচকে আবার মৃত ব্যাঙটির দিকে চাইল, বিভুঁই কি তাহলে খিদের যন্ত্রণায় এই ব্যাঙটিকেই খেয়ে ফেলতে চেয়েছিল?

কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে এখান থেকে বের হয়ে সে খাবারের সন্ধানে যায়নি কেন? হরিহরণ একবার ভাবল, বিভূঁইকে সে এখান থেকে এক্ষুনি নিয়ে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো, এই মুহূর্তে বিভূঁইকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বরং এটি জটিলতা আরো বাড়াবে। আজ হোক, কাল হোক দেবেন্দ্রনারায়ণ এখানে আসবেনই। আর তিনি যদি এসে দেখেন যে বিভুঁই এখানে নেই তাহলে বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করবে। তাছাড়া বিভূঁইকে নিয়ে এখন কই যাবে সে? এমনিতেই হেমাঙ্গিনী দেবীকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। কোনো সিদ্ধান্তেই স্থির হতে পারল না দ্বিধান্বিত হরিহরণ। তবে সে আপাতত সিদ্ধান্ত নিলো যে, সে বিভুঁইর জন্য খাবার আর জলের ব্যবস্থা করবে। তারপর বাদবাকি দেখা যাক।

হরিহরণ যখন মন্দির থেকে বের হলো, তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রায়। এই মন্দিরে সে বহুবছর আগে দেবেন্দ্রনারায়ণকে নিয়ে এসেছিল। প্রথমবার এসেছিল বাঘের সাথে লড়াইয়ে আহত দেবেন্দ্রনারায়ণকে উদ্ধার করতে গিয়ে। সেবার ফেরার পথে দেবেন্দ্রনারায়ণের কথা মতো এখানেই থেমে বিশ্রাম নিয়েছিল তারা। তারপরও একাধিকবার তারা এখানে এসেছিল। অতি পুরনো এই মন্দিরটির প্রতি দেবেন্দ্রনারায়ণের একধরণের দুর্বলতা রয়েছে। হয়তো এটি জানতো বলেই আজ শেষ রাতে হঠাৎ এই জায়গাটির কথা মনে পড়েছিল হরিহরণের। আর মনে পড়ার সাথে সাথে সে ছুটে এসেছে এখানে। তবে বহুবছর বাদে আসার ফলে জায়গাটি খুঁজে পেতে তার অনেক সময় লেগেছে। চারপাশটা ঘন ঝোঁপঝাড়ে ঢেকে রয়েছে।

বারোহাটি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হলো হরিহরণের। তবে রাত যতই হোক, খাবার আর জল নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই আবার বিভূঁইয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো সে। মন্দিরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোর হয়ে গেল। চারপাশে আলো ফুটতে শুরু করেছে। হরিহরণ এখনো জানে না, বিভুঁই এতক্ষণে জেগে উঠেছে কিনা। সে এই মুহূর্তে বিভূঁইয়ের সাথে দেখা দিতে চায় না। কেবল খাবার দিয়েই চলে যেতে চায়। তবে দেবেন্দ্রনারায়ণ আসার আগ অবধি যতটা সম্ভব মাঝেমধ্যে এসে দেখেও যেতে চায়।

জলের পাত্র আর খাবারের থলেগুলো নিয়ে একসাথে ওই সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারবে না বলে জলের পাত্রখানি নিচে রেখে প্রথমে খাবারের পাত্রগুলো নিয়ে মন্দিরে ঢুকল হরিহরণ। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে উপরে উঠল। দরজার কাছটায় গলা বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখল বিভুঁই একইভাবে সেখানটায় পড়ে রয়েছে। মন্দিরের দেয়ালের ভাঙা ফাঁকফোকড় গলে আলো আসছে। সেই আলোতে বিভূঁইকে দেখে হরিহরণের হঠাৎ ভয় হতে লাগল। ছেলেটা মরে যায়নি তো? হরিহরণ ইটের দুটো ভাঙা টুকরো নিয়ে বিভূঁইয়ের শুয়ে থাকা মেঝেতে ছুঁড়ে দিতেই বিকট শব্দ হলো। একবার, দু’বার, তিনবার। কিন্তু বিভুঁই জাগল না।

শঙ্কিত হরিহরণ এবার খাবারের থলেগুলো মেঝেতে নামিয়ে রেখে ধীর পায়ে বিভূঁইয়ের কাছে গেল। তারপর নিচু হয়ে বসে বিভূঁইয়ের নাকের কাছে হাত রাখল। খুব মৃদুশ্বাস বইছে। তবে বিভুঁই যে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই সেটি বোঝার বাকি রইল না হরিহরণের।

হরিহরণ মেঝেতে বসে বিভূঁইয়ের মাথা নিজের কোলে নিয়ে নিল। সে দেখল বিভূঁইয়ের বা পাশে একটি পাত্রে খানিকটা জল রয়েছে। সেই জলের পাত্র থেকে খানিকটা জল নিয়ে সে বিভূঁইয়ের মুখে ছিটিয়ে দিল। তারপর গলা, ঘাড়, মাথা জলে ভিজিয়ে মুছিয়ে দিলো। নিজের আঙুলের ডগা জলের পাত্রে ডুবিয়ে নিয়ে সেই আঙুলখানি বিভূঁইয়ের ঠোঁটের উপর ধরল হরিহরণ। আঙুল বেয়ে নামা ফোঁটাফোঁটা জল বিভূঁইয়ের ঠোঁটের উপর পড়তে লাগল। হরিহরণ ঠোঁটজোড়া খানিক ফাঁক করে ধরল। খুব ধীরে জলের ফোঁটারা গড়িয়ে গড়িয়ে বিভূঁইয়ে ঠোঁটের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। দীর্ঘসময় নিয়ে এভাবে বিভুঁইকে জল পান করালো হরিহরণ। বিভুঁই এর মাঝে বার কয়েক কাশিও দিয়েছে। ঘনঘন নড়ছে সে। হয়তো যে কোনো সময় জেগে উঠবে। হরিহরণ এবার খাবারের পাত্রগুলো বিভূঁইয়ের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখল। তারপর নিচে রেখে আসা জলের পাত্রখানা আনতে নিচে নামল হরিহরণ।

পাত্রখানা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল সে। বিভুঁই চোখ মেলে তাকিয়েছে। কিন্তু সেই তাকানোর ধরন কেমন অদ্ভুত! তার কপাল কুঞ্চিত হয়ে আছে। নাকের পাটা ঘনঘন উঠছে, নামছে। সে দীর্ঘসময় নিয়ে নিঃশ্বাস টানল বার কয়েক। তারপর হঠাৎ ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিলো সামনে। সেখানে একখানা মাটির পাত্রে খানিকটা খাবার বেড়ে রেখেছিল হরিহরণ। বিভুঁই সেই খাবার হাত বাড়িয়ে নিল। তারপর পাগলের মতো খেতে শুরু করল। বিভুঁই কতদিনের অভুক্ত হরিহরণ তা জানে না। তবে তার মনে হলো, দীর্ঘ দিনের অভুক্ত মানুষের খাদ্যগ্রহণ জগতের সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্য। সে সেই সুন্দরতম দৃশ্যটি এই মুহূর্তে চোখের সামনে দেখছে। কিন্তু এই সুন্দরতম দৃশ্যটার কোথাও যেন বড় কোনো অসঙ্গতি রয়েছে। হরিহরণ অবশ্য সেই অসঙ্গতিটি এখনো ধরতে পারছে না। সে অসঙ্গতিটি ধরতে পারল বিভূঁইয়ের খাওয়া শেষ হলে। বিভুঁই অন্ধের মতোন হাতড়ে হাতড়ে বাদবাকি খাবারের পাত্রগুলো একে-একে ছুঁয়ে দেখতে লাগল। কখনো কখনো নিচু হয়ে খাবারের গন্ধ শুঁকতে লাগল। তারপর কিছুটা বা দিকে সরে গিয়ে হাতড়ে হাতড়ে জলের পাত্রখানি পেল।

হরিহরণের সকল আনন্দ যেন মুহূর্তেই কর্পূরের ন্যায় উবে গেল। ছেলেটা অন্ধ! বিভুঁই তাহলে অন্ধ? গুটিবসন্ত কি তাকে বাঁচিয়ে রেখে অন্ধ করে গেছে? এইটিই তাহলে এতক্ষণ ধরে তাকে খোঁচাচ্ছিল। কোথায় যেন কিছু একটা গোলমেলে লাগছিল তার! হরিহরণের এবার মনে হলো হেমাঙ্গিনী দেবী ঠিকই বলে, ভগবানের এ কেমন বিচার?

প্রবল কষ্টে হরিহরণের বুক ফেটে যেতে চাইছিল। এতক্ষণ সে যা-ও দ্বিধান্বিত ছিল যে বিভূঁইকে হেমাঙ্গিনী দেবীর কাছে নিয়ে যাবে কিনা! সংশয়ের দোলাচলে দুলছিল সে। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, এই বিভূঁইকে সে হেমাঙ্গিনী দেবীর কাছে নিয়ে যেতে পারবে না। কিছুতেই না। সে জানে না, বীণাবালা হেমাঙ্গিনী দেবীর সন্ধান পেতে নতুন কী ফন্দি আঁটছে! তবে সে যে কিছু না কিছু করবেই, এ বিষয়ে হরিহরণ নিশ্চিত। এমনিতেই হেমাঙ্গিনী দেবীকে সকলের দৃষ্টির আড়ালে রাখতে তাকে দিন রাত্রি ভাবতে হচ্ছে। তার ওপর এই অন্ধ ছেলেকে পেলে হেমাঙ্গিনী দেবীকে সামলানো তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাছাড়া বজরাডুবির চরেও হেমাঙ্গিনী দেবীকে নিয়ে কতদিন লুকিয়ে থাকা যাবে হরিহরণ তা এখনো জানে না। তার চেয়ে সে বরং আড়াল থেকে দেখে রাখবে বিভূঁইকে। যতক্ষণ না অবধি দেবেন্দ্রনারায়ণ বিভুঁইর খোঁজ নিতে আসেন ততক্ষণ অবধি হেমাঙ্গিনী দেবীকে সে কিছুই বলবে না। যখনই দেবেন্দ্রনারায়ণ বিভূঁইয়ের খোঁজ নিতে আসবে, ঠিক তখনই সে হেমাঙ্গিনী দেবীকে বলবে যে বিভুঁই দেবেন্দ্রনারায়ণের কাছে ভালো আছে। কিন্তু কতদিন সে এই সত্যি লুকিয়ে রাখতে পারবে? কতদিন?

হরিহরণ জানে না। এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। নতুন কোনো উপায় ভাবতে হবে। হরিহরণের এই সকল নানান জটিল ভাবনায় ডুবে ছিল, কিন্তু তার ভাবনার জাল ছিন্ন হলো বিভুঁইয়ের ডাকে। বিভুঁই উৎকর্ণ হয়ে অনিশ্চিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কে? কে ওখানে?

হরিহরণ অবাক হলো। বিভুঁই জেগে ওঠার পরে সে কোনো শব্দ করেনি। তাহলে? বিভুঁই নিশ্চয়ই খাবার পেয়ে ধরে নিয়েছে যে যিনি খাবার দিয়ে গেছেন, সেই মানুষটি এখনো এই ঘরেই রয়েছেন। কিন্তু হরিহরণ বিভূঁইয়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। বিভুঁই এবার তার নাসিকারব্ধ বার কয়েক কুঞ্চিত করে যেন কিছুর ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করল। তারপর বলল, আমি জানি আপনি এখানেই আছেন। আমি চোখে দেখতে পাই না। কিন্তু কী যেন হয়েছে আমার। আমি খুব গন্ধ পাই। একটার থেকে অন্যটার গন্ধ আলাদা করতে পারি। সে যত সামান্য গন্ধই হোক। শব্দও শুনতে পাই খুব। অনেক দূরের শব্দও খুব স্পষ্ট শুনতে পাই।

বিভুঁই থামল। হরিহরণ কোনো কথা বলল না। সে অবাক হয়ে বিভুঁইর কথা শুনছে। কী মিষ্টি করে কথা বলছে ছেলেটা। কেউ বিশ্বাসই করবে না যে গুটিবসন্তের দাগে বীভৎস হয়ে যাওয়া ওই মুখ থেকে এমন সুমিষ্ট কথা বের হচ্ছে।

বিভুঁই আবার বলল, আমি কিন্তু আগে এমন ছিলাম না। কী যে হলো হঠাৎ! আমার গা-ভর্তি গুটি উঠল। তারপর আর কিছু মনে নেই। আমি এখন কোথায় আছি, আপনি কি বলবেন? আমি কিন্তু ঠিক জানি, আপনি আশেপাশেই কোথাও লুকিয়ে আছেন। জানেন, আমি কিন্তু আগে ঠিকই দেখতে পেতাম। ওই রোগটার জন্যই সব হলো। চোখের ভেতরও গুটি উঠে গিয়েছিল। চোখগুলো নষ্টই হয়ে গেল।

হরিহরণের কী যে হলো! তার বুক জ্বালা করতে লাগল। ওই অতটুকুন এক ছেলে। কী মায়া করেই না কথা বলছে! তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে ছেলেটাকে বুকের। ভেতর জাপ্টে ধরতে। কিন্তু সে কিছুই করল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। বিভুঁই খানিক থেমে আবার বলল, আমার মা কোথায় জানেন? তাকে কি একটু আমার কথা বলবেন? আমার খুব মার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। আপনি কথা বলবেন।? আরো একজন আমায় খাবার দিয়ে যেত। কিন্তু আপনি যে সেই মানুষটা।, তা কিন্তু আমি জানি। কিভাবে জানি জানেন?

বিভূঁইয়ের মুখে এবার খানিকটা কৌতুক-মিশ্রিত রহস্য। সে বলল, ওই যে বললাম, আমি খুব গন্ধ চিনি। আমি সেই মানুষটার গায়ের গন্ধ চিনি। আপনি দূরে থাকলে কি হবে? আমি কিন্তু আপনার গায়ের গন্ধও পাচ্ছি। এই গন্ধও আমি ভুলব না। আপনি যদি আবার কখনো আসেন, আমি ঠিক এই গন্ধ শুঁকেই চিনে ফেলব। জানেন, আমি না আমার মায়ের গন্ধও পাই। মায়ের গায়ের গন্ধ, আঁচলের গন্ধ। আমি যখন ঘুমাই, তখন মনে হয় মা আমার পাশেই আছে। আমার তখন মায়ের গায়ের গন্ধে ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু উঠে দেখি, মা নেই।

বিভুঁই শব্দ করে হাসল। বলল, মিথ্যে বললাম দেখলেন! আমি কিভাবে দেখব? আমি তো আর চোখে দেখতে পাই না। আমার ঘুমও যা, জেগে থাকাও তা। আচ্ছা, আমার মার কাছে কি আমি আর কখনো যেতে পারব? অবশ্য পারলেই কী! আমি তো আর কখনোই তাকে দেখতে পাব না। কিন্তু গন্ধ তো পাবো, তাই না? গন্ধ পেলেই হবে। আমি আজকাল গন্ধ আর শব্দ শুনে শুনে নিজের মনের ভেতর অনেক কিছু দেখতে পাই। নিজে নিজে কল্পনা করে কত কিছু যে বানিয়ে নিই! বানিয়ে বানিয়ে দেখি। মজা না? মাকেও অমন করেই দেখব।

হরিহরণ জানেও না, তার চোখের কোল বেয়ে কখন জলের স্রোত নেমেছে। সে নিঃশব্দে পরিত্যক্ত সেই মন্দিরের দেয়ালে হেলান দিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। বিভুঁই খানিক বিরতি দিয়ে আবার বলল, আপনি কথা বলবেন না? কথা বললে কী হয়? আচ্ছা, থাক, বলতে হবে না। আমাকে কি সবসময় এখানেই থাকতে হবে? আপনি কি কিছু জানেন? ওহ্, আপনি তো আমার সাথে কথা বলবেন না। আচ্ছা, আপনি কি অন্ধদের সাথে কথা বলেন না?

হরিহরণ তারপরও কথা বলল না। কী বলবে সে! কী বলার আছে তার! এই প্রথম ভগবানের প্রতি তার খুব রাগ হতে লাগল। এক ভয়ানক রাগ। বিভুঁই এক পাপের ফসল, কিন্তু সেই পাপের ফসলের ভেতর এত মায়াই যদি দিলেন, তাহলে তাকে এত বড় শাস্তিই বা কেন দিলেন! কী দোষ অতটুকু ওই ছেলের?

বিভুঁই বিড়বিড় করে বলল, আপনি চলে যান। কথা না বললে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আমি এখন মায়ের গায়ের গন্ধ নেব। একটা মজার কথা শুনুন, তখন না বললাম, আমার চোখ বন্ধ থাকলেই কী, আর খোলা থাকলেই কী! সকলই সমান। আসলে কিন্তু তা না। আমি চোখ বন্ধ করে মা’র কথা ভাবলেই শুধু মায়ের গায়ের গন্ধ পাই। না হলে পাই না। আমি এখন চোখ বন্ধ করে মা’র কথা ভাবব!

বিভুঁই চোখ বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিল। তার চোখের পাতা কাঁপছে। নাক কাঁপছে। সে যেন ডুবে যাচ্ছে অন্য কোনো জগতে। হরিহরণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দেখল। অনেকক্ষণ। হঠাৎ দেখল বিভূঁইয়ের ঠোঁটজোড়া থরথর করে কাঁপছে। সেই ঠোঁটের ফাঁকে ফিসফিস শব্দ বেরুচ্ছে, মা, মা, মাগো!

বিভূঁইয়ের বন্ধ চোখের পাতার ভেতর থেকে বাঁধভাঙা স্রোতের মতোন নেমে আসছে জলেরা। হরিহরণ আর সহ্য করতে পারছে না। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, যে করেই হোক সে হেমাঙ্গিনী দেবীকে এখানে নিয়ে আসবেই। কাল পরশুর মধ্যেই নিয়ে আসবে। যা হবার হবে, সে বিভুঁইকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেবে। ছেলেটা সত্যি সত্যি মায়ের আঁচলের গন্ধ মেখে ঘুমাক। হরিহরণ জলের পাত্রখানা রেখে চুপিসারে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *