১. ভয়াবহ দুঃসংবাদ

অন্দরমহল – উপন্যাস – সাদাত হোসাইন

উৎসর্গ

নুসরাত

‘কিছু কিছু কিনে নেই দামে, কিছু কিছু ঘামে
কিছু কিছু মূল্যবিহীন।
একটা জনম তবু জানে
কার কাছে রয়ে যায় কতটুকু ঋণ!’

.

ভূমিকা

‘ডেথ অব দ্য অথার’ বলে একটি কথা আছে। কথাটি আমি খুব বিশ্বাস করি। এই কথার মানে, কোনো বই পাঠকের কাছে যাওয়া মাত্র সেই বইয়ের লেখকের মৃত্যু ঘটে। অর্থাৎ লেখক কী ভেবে সেই বইটি লিখেছেন, লেখার সময় লেখকের অনুভূতি কী ছিল বা তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন, পাঠক সেই মতে বইটি অনুধাবন করতে বাধ্য নন। পাঠকের নিজস্ব ভাবনা রয়েছে, অনুভূতি রয়েছে, জীবনের নানান অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুতরাং খুবই স্বাভাবিক যে পাঠক তার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই লেখাটি হৃদয়াঙ্গম করবেন। এটি পাঠকের স্বাধীনতা। সুতরাং পাঠকের কাছে যাওয়া মাত্র বই হয়ে যায়। পাঠকের। মৃত্যু ঘটে লেখকের।

তাহলে অন্দরমহল-এর ভূমিকা লেখার কারণ কী? ভূমিকা লেখার ছোট্ট একটি কারণ। কারণটি দায়মুক্তির। অন্দরমহল বহু পুরনো আমলের আবহে লেখা একটি উপন্যাস। ফলে উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সেই পুরনো আমলের সময়কাল কত? স্থানটি কোথায়? পুরো উপন্যাসে খুব সচেতনভাবেই এই সময় ও স্থানের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এর কারণ, অন্দরমহলকে কোনোভাবেই ঐতিহাসিক উপন্যাসের কাতারে না ফেলতে চাওয়া। সুনির্দিষ্ট সময়কাল ও স্থান সেই সময়ে সংঘটিত নানান রাজনৈতিক, জাতীয়, প্রাকৃতিক ঘটনা, ভাষা ও নিয়ম নীতির সাপেক্ষে উপন্যাসের কাহিনীকে প্রভাবিত বা সংযুক্ত হতে বাধ্য করে। কিন্তু অন্দরমহল একটি শতভাগ ফিকশন। এতে ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিককার

কিছু অনুষঙ্গ ব্যবহার করা হলেও এই উপন্যাসের সাথে সে সময়ের বাস্তব কোনো ঘটনা, স্থান, কাল, পাত্র এমনকি সময়কালেরও সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি এই বাস্তবঘনিষ্ঠতা এড়াতেই উপন্যাসের গানগুলোও কোনো বাস্তব উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়নি। চরিত্র ও আবহ মাথায় রেখে এই উপন্যাসের জন্যই গানগুলো লেখা হয়েছে। অন্দরমহল মূলত এক হিন্দু জমিদার পরিবারের আখ্যান। এই হিন্দু জমিদার পরিবার-সংক্রান্ত নানান তথ্য দিয়ে অপরিসীম সমর্থন জুগিয়েছে কলকাতা থেকে রঞ্জু প্রসাদ মণ্ডল। রঞ্জুকে ধন্যবাদ। সবশেষে, পাঠক, অপার স্বাধীনতায় ভাবনার উন্মুক্ত আকাশ নিয়ে প্রবেশ করতে পারেন অন্দরমহল-এ। কারণ অন্দরমহল বিশুদ্ধ কল্পনার নির্যাস।

সাদাত হোসাইন
১১ জানুয়ারি ২০১৬

*

ভয়াবহ দুঃসংবাদটা এলো রাত্রির তৃতীয় প্রহরে। পেয়াদা রঘু এসে যখন খবরটা দিল, তখন বিষ্ণুপুরের হবু জমিদার দেবেন্দ্রনারায়ণ কেবল ঘুমাতে যাচ্ছিলেন। রবিবার দিবাগত রাতে দেবেন্দ্রনারায়ণ খানিকটা মদ্যপান করেন। বিষ্ণুপুর জমিদারির উত্তর তল্লাট ঘেঁষে শুরু হয়েছে বারোহাটির বিশাল জঙ্গল। জঙ্গলের গা ঘেঁষে দেবেন্দ্রনারায়ণের বাগানবাড়ি। দেবেন্দ্রনারায়ণ মাসের কোনো এক রবিবার এই বাগানবাড়িতে রাত্রিযাপন করেন। মাঝরাত অবধি নাচগান হয়। তবে সেই নাচগানের জলসায় লোকজনের সমাগম থাকে না। সংগীত বা নৃত্যপিপাসু মানুষ থাকে না। থাকেন দেবেন্দ্রনারায়ণ একা। আর থাকে দূর-দূরান্ত থেকে আসা রূপবতী বাঈজির দল। তাদের পর্যাপ্ত সম্মানির ব্যবস্থা থাকে। তারা সারারাত ধরে দেবেন্দ্রনারায়ণের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করে। তবে দেবেন্দ্রনারায়ণের মনোরঞ্জন করা সহজ কোনো ব্যাপার নয়। এই প্রায় পঞ্চাশেই জগতের বেশির ভাগ ভোগবিলাসের সাথে দেবেন্দ্রনারায়ণের পরিচয় হয়েছে। সম্ভাব্য সকল কিছুর স্বাদ নেয়ার চেষ্টা তিনি করেছেন। ফলে আজকাল তার ভেতর একধরনের অতৃপ্তির হাহাকার দেখা যায়। কোনো কিছুতেই যেন তিনি তুষ্ট হতে পারেন না।

আজ তার শয্যাসঙ্গিনী হয়েছে রাইপুরের বিখ্যাত নর্তকী হেমাঙ্গিনী দেবী। হেমাঙ্গিনী দেবীকে দেবেন্দ্রনারায়ণ বিশেষ পছন্দ করেন। এককালে হেমাঙ্গিনী দেবী অহরহ আসত এই বিষ্ণুপুরে। বারোহাটির এই বাগানবাড়ি ছিল তার নিয়মিত নিবাস। কেউ কেউ বলাবলি করছিল যে, বিষ্ণুপুর জমিদারির মেজোকুমার দেবেন্দ্রনারায়ণ বুঝি হেমাঙ্গিনী দেবীর প্রেমে পড়েছেন। তাহলে কি জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের মেজোপুত্র দেবেন্দ্রনারায়ণ নর্তকী বিয়ে করবেন! এই নিয়ে নানান কানাঘুষা। ঘটনা অনেকদূর গড়িয়েছিলও। তবে শেষ অবধি হেমাঙ্গিনী দেবীর আর জমিদার বাড়ির বউ হওয়া হয়ে ওঠেনি।

এত ঘটনার পরও দেবেন্দ্রনারায়ণ কখনো ডাকলে ছুটে আসে হেমাঙ্গিনী দেবী। এবারও এসেছে। তবে এবার সে এসেছে বহু বছর বাদে। সদা হাস্যময়ী হেমাঙ্গিনী দেবীকে দেখে তার অন্তর্জগতের খবর বোঝার উপায় নেই। সে হাসিমুখে দেবেন্দ্রনারায়ণের নানান তেষ্টা মেটানোর চেষ্টা করে। দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে সে আর আট-দশজন সাধারণ বাঈজীর মতোই আচরণ করে। তবে দেবেন্দ্রনারায়ণ তার সাথে আর সকলের মতন তুচ্ছাতিতুচ্ছ আচরণ করেন না। কোথায় যেন খানিকটা সমীহই করেন। হেমাঙ্গিনী দেবী বারোহাটির বাগানবাড়িতে আসলেই আবার নতুন করে নানান গল্প শুরু হয়। সে সকল গল্প ডালপালা ছড়ায়। আড়ালে-আবডালে লোকজন নানান কথা বলে। সেসব কথার বেশির ভাগই নানাবিধ রহস্যে ভরপুর।

প্রায় শেষরাতের ভয়াবহ দুঃসংবাদ পেয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণ চকিতে শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হেমাঙ্গিনী দেবীও আলুথালু বেশে উঠে বসল। সে জড়ানো গলায় বলল, এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন?

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, গঙ্গাবতীর তীর থেকে রঘু এসেছে। ভয়াবহ দুঃসংবাদ।

দুঃসংবাদের কথা শুনে হেমাঙ্গিনী দেবী বিচলিত হলো না। সে স্থির গলায় বলল, প্রথম প্রহরে সবাই জাগে, দ্বিতীয় প্রহরে ভোগী। তৃতীয় প্রহরে তস্কর জাগে, চতুর্থ প্রহরে যোগী। তা শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনারায়ণ, আপনি তস্করও নন, যোগীও নন। আপনি হলেন ভোগী। রাতের দ্বিতীয় প্রহর নাগাদ আপনার ভোগবিলাস সম্পন্ন হয়েছে। এখন আপনার নিদ্রাযাপনের সময়। রাতের এই তৃতীয় প্রহরে নদীর পাড়ে ছুটে যাওয়া আপনার কাজ নয়।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বিচলিত গলায় বললেন, হেঁয়ালি রাখ হেমাঙ্গিনী। দুঃসংবাদ, ভয়াবহ দুঃসংবাদ।

দেবেন্দ্রনারায়ণ হেমাঙ্গিনী দেবীকে আর কিছু বলতে দিলেন না। তিনি ঝড়ের বেগে বেড়িয়ে এলেন। বিষ্ণুপুরের দক্ষিণ দিক জুড়ে রয়েছে বিরাট নদী। নদীর নাম গঙ্গাবতী।

ঘণ্টাদুয়েক বাদে নিতাইয়ের সাথে জমিদার দেবেন্দ্রনারায়ণের দেখা হলো গঙ্গাবতীর তীরে। গঙ্গাবতীর এপার থেকে ওপার দেখা যায় না। নিতাই সেই নদীতে নাও বায়। মাছ ধরে। সে দেবেন্দ্রনারায়ণের সামনে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছিল।

দেবেন্দ্রনারায়ণ গম্ভীর গলায় বললেন, ঘটনা খুলে বল নিতাই।

নিতাই ঘটনা খুলে বলল। কিংবা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু কী বলল, তা বোঝা গেল না। তার মুখ থেকে কেবল ঘড়ঘড় শব্দ বের হলো। দেবেন্দ্রনারায়ণ সেসবের কিছুই বুঝলেন না। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন চাতালের মতোন একটা জায়গায়। তার পায়ে চকচকে নাগড়া জুতো। নদীতে মৃদু ঢেউ। সেই ঢেউ এসে দেবেন্দ্রনারায়ণের পায়ের কাছটায় থামছে। নাগড়া ভেজার ভয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণ খানিকটা উপরের দিকে উঠে এসে দাঁড়ালেন। পরের ঢেউটা এসে থামল এতক্ষণ তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঠিক সেখানে। তারপর আবার নেমেও গেল। তবে নিতাই যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে তখনো জল। তার পায়ের গোড়ালি জলে ডুবে আছে। ভোরের আলো এখনো ঠিকঠাক ফোটেনি। অবশ্য দেবেন্দ্রনারায়ণের তাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। যা দেখবার জন্য তিনি এই অসময়ে গঙ্গাবতীর তীরে ছুটে এসেছেন, তা তিনি ঠিকই দেখতে পেয়েছেন। নিতাইয়ের বা পাশে হাত দুই দূরে নিতাইয়ের ডিঙি নাওখানা বাঁধা। তার নাওয়ের সাথেই আরো একখানা নাও। নাওটি ছইঅলা। ছইয়ের ভেতরে আলো জ্বলছে। লণ্ঠনের আবছা আলো। সেই আলোয় নাওয়ের ভেতর শুয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে। এক ক্ষীণকায় বাচ্চা ছেলে। বয়স কত হবে? মুখ দেখে বোঝা ভার। দশ-এগারোও হতে পারে। আবার বারো-তেরো বছরের কিশোরও হতে পারে। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, কী ব্যাপার নিতাই? কথা। বলছিস না কেন?

নিতাই আবারও কথা বলল, তবে এবার আগের চেয়ে স্পষ্ট। সে কম্পমান গলায় বলল আজ্ঞে, আমি নির্দোষ কত্তা। ভোরের দিকে খানিক তন্দ্রামতন লেগে এসেছিল, হঠাৎ দেখি নাওখানা কিসের সাথে যেন বাড়ি খেল। চোখ খুলে দেখি ছইঅলা একখানা নাও। নাওয়ের ভেতর একটা ছেলে শুয়ে আছে।

নিতাই দম নেয়ার জন্য খানিক থামল। দেবেন্দ্রনারায়ণ কিছু বললেন না। দূরে নদীর উঁচু পাড়ের খেজুর গাছের তলায় দাঁড়িয়ে রয়েছে পেয়াদা রঘু আর জগাই। দেবেন্দ্রনারায়ণ তাদের ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছেন। নিতাই আবার বলল, প্রথমে আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম কত্তা। তারপর কী ভেবে নাওয়ের ভেতর ঢুকলাম। ঢুকে দেখি…।

ভয়ে নিতাইয়ের চক্ষু বিস্ফারিত হওয়ার যোগাড়। সে বার দুই ঢোক গিলল। তারপর পায়ের গোড়ালি অবধি জলের ভেতর হাঁটু গেড়ে বসে হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে বলল, ঢুকে দেখি ছেলেটার গা-ভর্তি গুটিবসন্ত কত্তা। বড় বড় কুল বড়ইয়ের সমান একেকটা গুটি। দেখে আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। আমি ছেলেটাকে ছুঁয়ে দিয়েছিলাম কত্তা। আমি পাপ করেছি কত্তা! মহাপাপ। করেছি।

দেবেন্দ্রনারায়ণ নিতাইয়ের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু নিতাইয়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি সরে আরো খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। নিতাই বলল, ছেলেটা এখনও বেঁচে আছে কত্তা! শ্বাস বইছে। তবে খুব ধীরে।

দেবেন্দ্রনারায়ণ কঠিন গলায় বললেন, চারদিকে গুটিবসন্ত ছড়াচ্ছে এই কথা তুই জানিস না নিতাই?

নিতাই জলের ভেতর হাঁটু গেড়ে বসা অবস্থায়ই বলল, আজ্ঞে, জানি কত্তা। কিন্তু তখন আমার কী যে হলো! অতরাতে, নদীর ভেতর নৌকায় একটা বাচ্চা ছেলে ভেসে আসল। আমার বোধবুদ্ধি হঠাৎ কাজ করছিল না কত্তা।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, এই গুটিবসন্তে গাঁয়ের পর গাঁ বিনাশ হয়ে যাচ্ছে, একজন আক্রান্ত হলে তার শরীর থেকে আরেকজনের হচ্ছে। গ্রামে গ্রামে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। কতবড় ছোঁয়াচে এই রোগ! হাজার-হাজার লোক মারা যাচ্ছে, আর তুই এসবের কিছুই জানিস না?

নিতাই জবাব দিলো না। সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

দেবেন্দ্রনারায়ণ খানিক চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, এই নৌকো এখানে কী করে এলো? কে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে এই নৌকো?

নিতাই জড়ানো গলায় বলল, বিশ্বাস করুন কত্তা, এসবের আমি কিছুই জানি না। কিছুই জানি না।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, নৌকোর ভেতর আর কিছু আছে?

নিতাইয়ের হঠাৎ যেন কিছু একটা মনে পড়ল। সে হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, ছেলেটার পাশে একখানা জলের ঘটি ছিল কত্তা। সেই ঘটির গলায় এক টুকরো কাগজ বাঁধা।

দেবেন্দ্রনারায়ণ মুহূর্তে থমকে গেলেন। তিনি কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন। ভয়ঙ্কর কোনো অশুভ সঙ্কেত যেন বেজে উঠছে তার মাথায়। তিনি নিতাইকে বললেন, কিসের কাগজ?

নিতাই বলল, জানি না কত্তা। আমি মুখ-সুখ মানুষ, লেখাপড়া জানি না। কাগজে কী জানি কী লেখা!

দেবেন্দ্রনারায়ণ কাল বিলম্ব করলেন না। তিনি নিতাইকে দিয়ে কাগজখানা আনালেন। নিতাই জলভর্তি ঘটিসহ কাগজখানা এনে দেবেন্দ্রেনারায়ণের থেকে খানিক দূরে মাটিতে রেখে সরে দাঁড়াল। দেবেন্দ্রনারায়ণ দীর্ঘসময় নিয়ে পা বাড়ালেন। তার পদক্ষেপ জুড়ে দ্বিধা, শঙ্কা, দুশ্চিন্তা। ভোরের আবছা আলোয় বিষ্ণুপুরের হবু জমিদার দেবেন্দ্রনারায়ণ ঘটির মুখে বাঁধা সেই চিরকুটখানা দেখলেন। দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর মাথা তুলে তাকালেন আকাশের দিকে। শান্ত স্নিগ্ধ ভোরের আকাশ। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণের বুকের ভেতর তখন প্রলয়ঙ্করি সমুদ্রের সর্বগ্রাসী জলোচ্ছাস!

এ তিনি কী দেখলেন!

.

দেবেন্দ্রনারায়ণের ঘোড়ার গাড়িখানা ঊধ্বশ্বাসে ছুটছে। তবে গাড়ির ভেতরে দেবেন্দ্রনারায়ণ নেই, আছে পেয়াদা রঘু। সে খানিক পরপর সহিসকে তাড়া দিচ্ছে, জোরসে ছুট! জোরসে।

গাড়ি জোরসেই ছুটছে। কিন্তু রঘুর মনে হচ্ছে ঘোড়াগুলো চলছে দুলকি চালে। ক’দিন ধরেই আকাশজুড়ে মেঘ, বৃষ্টি। তবে এই মুহূর্তে গাছপালার ফাঁক-ফোকড় দিয়ে চড়চড়িয়ে উঠছে ভোরের আলো। গঙ্গাবতীর তীর থেকে বারোহাটি যেতে ঘণ্টাদুয়েক লাগার কথা। কিন্তু রঘুর যেন অতটা তর সইছে না। সে ক্রমাগত সহিসকে তাড়া দিতে লাগল। তারা যখন বারোহাটিতে পৌঁছাল, তখন বারোহাটি বাগানবাড়ির রন্ধনশালা জুড়ে খাবারের ম ম গন্ধ। দেবেন্দ্রনারায়ণ এই বাগানবাড়িতে থাকা মানে পাঁচক-পাচিকাদের দিনভর ব্যস্ততা। দেবেন্দ্রনারায়ণ যে খুব বেশি আহার গ্রহণ করেন বিষয়টা এমন নয়। তবে তার জন্য নানান পদের আহার প্রস্তুত রাখা আবশ্যক। তিনি কখন কী। চেয়ে বসেন সে বিষয়ে কারো পক্ষে আগাম ধারণা করা সম্ভব না।

রঘু দেবেন্দ্রনারায়ণের খাস পেয়াদা। তার জন্য জমিদার বাড়ির প্রচলিত অনেক নিয়ম-কানুনই শিথিল। বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে সে পূর্ব অনুমতি ছাড়াই বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকতে পারে। সে ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে ত্রস্ত পায়ে বাগানবাড়ির ভেতরে ঢুকল। মূল ফটক পেরিয়ে লম্বা পথ। পথের দুই ধারে হরেক রকম ফুলের বাগান। তারপর বৈঠকখানা। বৈঠকখানার দুই পাশে বিশাল হলঘরের মতো ভোলা ঘর। এ দু’টিতে নাচগানের আসর বসে। এর পেছন দিকে সুদৃশ্য সাজসজ্জায় পরিপূর্ণ অনেকগুলো কক্ষ। অতিথিরা এলে এ সকল কক্ষ পূর্ণ হয়ে ওঠে। বাকি সময় ফাঁকা পরে থাকে। তবে দেবেন্দ্রনারায়ণের ঘরখানা দোতলায়। রঘু দীর্ঘ বারান্দা পেরিয়ে দোতলায় উঠল। বাড়ির ভৃত্য কর্মচারিরা সকলেই যার যার কাজকর্মে ব্যস্ত। রঘুর অমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা তারা কেউই তেমন খেয়াল করল না। অপলা নামের মধ্যবয়স্কা দাসীটি বসে আছে দেবেন্দ্রনারায়ণের বন্ধ ঘরের সামনের জলচৌকিতে। তার কোলে ভাঁজ করে রাখা নতুন কাপড়। হাতে কাঁসার থালাভর্তি পুজোর নানান রকম উপকরণ সাজানো।

সে বসে আছে হেমাঙ্গিনী দেবী আর দেবেন্দ্রনারায়ণের নিদ্রাভঙ্গের অপেক্ষায়। দেবেন্দ্রনারায়ণ ঘুম থেকে উঠেই স্নান করবেন, নতুন কাপড় পরবেন, পুজো-অর্চনা করবেন। অপলা তাই ভোরের আলো ফোঁটার আগেই এখানে এসে বসে আছে। সে অবশ্য এখনও জানে না যে, গভীর রাতে কী ভয়াবহ দুঃসংবাদ শুনে দেবেন্দ্রনারায়ণ বেরিয়ে গেছেন!

রঘু এসে সরাসরি দরজার সামনে দাঁড়াল। সে অপলাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। তবে অপলা কৌতূহলী গলায় বলল, কী রে রঘু? এই সাত-সকালে অমন ভীম সেজে কোথায় যাচ্ছিস?

রঘু অপলার কথার কোনো জবাব দিলো না। সে দরজার কাছে গিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। তার কান সতর্ক। এই সাত-সকালে রঘুর আচরণে অপলা খানিক অবাক হলো। সে এই বারোহাটি বাগানবাড়ির অতি পুরাতন দাসী। তবে এ বাড়িতে তার ভূমিকা, কাজকর্ম কোনোভাবেই দাসীর মতো নয়। তার অবস্থান আর সকল দাস-দাসীর উপরে। সে দেবেন্দ্রনারায়ণের অতি আস্থার পাত্রী। তার কাজ মূলত দাস-দাসীদের কাজকর্ম দেখাশোনা, হুকুমদারি করা। দাস-দাসীদের মধ্যে একমাত্র তারই অধিকার রয়েছে সরাসরি দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে কথা বলার। ফলে অন্য আর দশজন চাকর-বাকর। তাকে সমীহ করে কথা বলে। অপলার বয়স হয়েছে। রঘুকে সে ছোট্টকাল থেকে চেনে। সে অবাক চোখে রঘুর দিকে তাকিয়ে রইল, সেদিনের সেই লিকলিকে ছেলেটা কি তাগড়া জোয়ানই না হয়ে উঠেছে।

অপলা আবার জিজ্ঞেস করল, ও রঘু, কথা বলছিস না যে!

রঘু সাথে সাথে কোনো জবাব দিল না। গভীর মনোযোগে দেবেন্দ্রনারায়ণের বন্ধ দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকল। অনেকক্ষণ বাদে সে। অপলার দিকে তাকিয়ে বলল, ভেতরে উনি আছেন?

অপলা বলল, উনি মানে কী রে? দুজনের কেউই এখনও রা করেনি। ঘুমাচ্ছে। রাতভর কসরত তো আর কম যায়নি। এখন অজ্ঞানের মতন ঘুমাচ্ছে। আমি সেই ভোরের আলো ফোঁটার আগে থেকে এখানে বসে আছি।

রঘু বলল, ভেতরে যে আছে, তাকে ডাক।

অপলা আঁৎকে ওঠা গলায় বলল, ভেতরে যে আছে তাকে ডাক মানে কী রে রঘু! তোর কি বুদ্ধিনাশ হয়েছে। কর্তাবাবু সারারাত পরিশ্রম করে এখন ঘুমুচ্ছেন, আর তুই বলছিস তাকে ডাকতে?

রঘু গম্ভীর গলায় বলল, ভেতরে কর্তাবাবু নেই। কর্তাবাবুর মেয়ে মানুষটা আছে। উনাকে ডাক।

অপলা রঘুর কথা কিছু বুঝল না। সে কাকডাকা ভোর থেকে এখানে বসে আছে। ঘর থেকে কাউকে বের হওয়া তো দূরের কথা, দরজা খুলতেও দেখেনি। অথচ রঘু কিনা বলছে, ভেতরে কর্তাবাবু নেই!

 সে জলচৌকি থেকে ধীরে-সুস্থে উঠে এসে বলল, কী বলছিস রঘু? কর্তাবাবু কই গেলেন? রাতেও তো তাকে দিব্যি এ ঘরেই দেখলাম। নাচগানের শব্দ শুনলাম!

রঘু বিরক্ত গলায় বলল, তুমি বড্ড বেশি বকো! যা বলেছি তা-ই করো।

অপলা অভিজ্ঞ দাসী। রঘুর এমন আচরণের অর্থ যেন সে সহসাই ধরতে পারল, বিশেষ কোনো ঝামেলা হয়নি তো! সে আর কথা বাড়াল। দরজার কড়া ধরে নাড়ল, হেমাঙ্গিনী, ও হেমাঙ্গিনী, উঠো। কত বেলা হয়ে এলো। এখনো ঘুমাচ্ছ? উঠো।

কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবী উঠল না। রঘু দীর্ঘ সময় ধরে দরজায় কান পেতে রেখেও কিছুই ঠাহর করতে পারছে না। ভেতরে নড়াচড়ার শব্দ অবধি নেই। অপলা ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে। তার গলার স্বর নিচু থেকে উচ্চগ্রামে উঠছে। কিন্তু ভেতরে কোনো সাড়া-শব্দ নেই। রঘু এবার ভয় পেয়ে গেল। ভোরবেলা

সে যখন গঙ্গাবতীর তীর থেকে দেবেন্দ্রনারায়ণের ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে। বারোহাটির দিকে ছুটল, তখনো দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে তেমন কিছুই খোলাসা করেননি। কেবল গঙ্গাবতীর তীর থেকে রঘুকে ডেকে তিনি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, রঘু, বাতাসের আগে বারোহাটি যা। গিয়ে দেখ হেমাঙ্গিনী দেবীর কী অবস্থা?

রঘু আর কোনো প্রশ্ন করেনি। সে সাথে সাথে বারোহাটির পথে ছুটেছে। গত রাতেও দিব্যি সুস্থ সবল হেমাঙ্গিনী দেবীকে দেখেছে রঘু। হঠাৎ করে দেবেন্দ্রনারায়ণ কেন এত উৎকণ্ঠিত হলেন, রঘুর কাছে তা পরিষ্কার না। তবে সে এটা বুঝেছে যে, তাকে এমন চটজলদি পাঠানোর পেছনে নিশ্চয়ই গুরুতর কোনো ব্যাপার রয়েছে। সে পুরো পথজুড়ে সেই গুরুতর ব্যাপারখানা ভেবেছে। বোঝার চেষ্টা করেছে। তেমন কিছুই বের করতে পারেনি। কিন্তু এই মুহূর্তে এই বন্ধ ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রঘুর হঠাৎ মনে হলো, দেবেন্দ্রনারায়ণ যেকোনো উপায়ে হেমাঙ্গিনী দেবীর অবস্থা তাকে স্বচক্ষে দেখার জন্য। পাঠিয়েছেন। সরাসরি না বললেও এটিই ছিল তার অন্তর্নিহিত কথা!

রঘু এবার তার হাতের বিশাল থাবা বসিয়ে বিকট শব্দ তুলল দরজায়। শব্দের পর শব্দ। আঘাতের পর আঘাত। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া নেই। অপলা হঠাৎ রঘুর হাত চেপে ধরে বলল, রঘু, কোনো বিপদ হয়নি তো?

এই কথায় মুহূর্তেই যেন এতক্ষণ ধরে অনাবিস্কৃত একটি গুরুতর বিষয় হঠাৎ আবিষ্কৃত হয়ে গেল। বন্ধ ঘরের ভেতর হেমাঙ্গিনী দেবীর কিছু হয়নি তো! এই তল্লাটের সকলেই জানে হেমাঙ্গিনী দেবীর সাথে দেবেন্দ্রনারায়ণের সম্পর্ক খুব সাধারণ কোনো সম্পর্ক নয়। এই সম্পর্কের ভেতর লুকিয়ে আছে অনেক গলি-খুঁজি, নানান হিসেব-নিকেশ আর জানা-অজানা অনেক গল্প। দেবেন্দ্রনারায়ণের অমন তটস্থ তড়িৎ নির্দেশের কারণ যেন হঠাৎ পরিষ্কার হয়ে গেল রঘুর কাছে। অতরাতে অমন শশব্যস্ত হয়ে গঙ্গাবতীর তীরে ছুটে যাওয়া, মাঝি নিতাইয়ের সাথে দেবেন্দ্রনারায়ণের অমন নিবিড় সাক্ষাৎ আর তারপর মুহূর্তেই রঘুকে বাতাসের বেগে ছুটে এসে হেমাঙ্গিনী দেবীর অবস্থা দেখতে বলা, এই সব মিলিয়ে রঘুর কাছে যেন ঘরের ভেতরের দৃশ্যটি পরিষ্কার হয়ে উঠল। সেই দৃশ্যে কী আছে পুরোপুরি না জানলেও রঘুর মন বলছে, হেমাঙ্গিনী দেবীর কোনো বিপদ হয়েছে, এবং সেই বিপদ হেমাঙ্গিনী দেবী নিজেই করেছে! রঘু বিচলিত চোখে তাকিয়ে রইল অপলার দিকে। অপলা নিচু গলায় বলল, এখুনি সনাতন মিস্ত্রিকে খবর দে। দরজা ভাঙতে হবে।

রঘু বলল, দরজা ভাঙতে সনাতন মিস্ত্রিকে খবর দিতে হবে কেন? দরজা। তো আমিই ভাঙতে পারি।

অপলা রঘুর হাত ছাড়ল না। সে গম্ভীর গলায় বলল, সনাতন মিস্ত্রিকে ডাক। সকালে নায়েব মশাই এসেছেন কী কাজে। তার সামনে সনাতন মিস্ত্রিই দরজা ভাঙুক।

রঘু যেন এতক্ষণে খানিক ধাতস্ত হলো। অপলা অভিজ্ঞ মানুষ। এই বাড়ি আর এই জীবনের অনেক বিষয়েই তার অভিজ্ঞতা রঘুর চেয়ে ঢের বেশি। দেবেন্দ্রনারায়ণ গঙ্গাবতীর তীর থেকে কোথায় যাবেন সে বিষয়ে রঘুকে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তবে তিনি যে আজ আর বারোহাটি বাগান বাড়িতে ফিরবেন না, সে বিষয়ে রঘু নিশ্চিত।

গঙ্গাবতীর তীর ঘেঁষেই বিষ্ণুপুরের মূল জমিদার বাড়ি। বাড়ির নাম গঙ্গামহল। বিশাল চারখানা দ্বিতল অট্টালিকায় ঘেরা গঙ্গামহলে থাকেন দেবেন্দ্রনারায়ণের বৃদ্ধ পিতা জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ। আছেন দেবেন্দ্রনারায়ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অবনীন্দ্রনারায়ণ ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা দীপেন্দ্রনারায়ণও। বিষ্ণুপুর জমিদারির মূল কেন্দ্রস্থলই হলো গঙ্গাবতীর তীরের ওই বিশালগঙ্গামহল। তবে বিষ্ণুনারায়ণের মেজোপুত্র দেবেন্দ্রনারায়ণের কল্যাণে বারোহাটির গভীর জঙ্গলের কোল ঘেঁষে দাঁড়ানো এই বাগানবাড়ির জৌলুসও কিছু কম নয়।

দেবেন্দ্রনারায়ণ তার আর দুই ভাইয়ের মতোন নন। তিনি স্বভাবে বদমেজাজি, খেয়ালি, আমুদে, বেহিসেবি মানুষ। জীবন তার কাছে উপভোগের নামান্তর। এই জীবনকে উপভোগ করতে তার চেষ্টার কমতি নেই। তার সকল ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভোগ-বিলাস আর আমোদ-প্রমোদের কেন্দ্রস্থল হচ্ছে বারোহাটির এই বাগানবাড়ি। এখানে তার সার্বক্ষণিক যাতায়াত। মাঝেমধ্যে তিনি যদি এই বাগানবাড়িতে নাও আসেন, তারপরও বারোহাটি বাগানবাড়ির সকল কিছুই সদাপ্রস্তুত থাকা চাই দেবেন্দ্রনারায়ণের। বৃদ্ধ নায়েব গোপীনাথ সরকারকে তাই গঙ্গামহল থেকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও ঘণ্টাতিনেকের ঘোড়ার গাড়ির পথ পাড়ি দিয়ে বারোহাটির বাগানবাড়ি আসতে হয়। তীক্ষ্ণ চোখ মেলে দেখতে হয় বাগানবাড়ির হালচাল। হিসেব-নিকেশের তদারকি করতে হয়। খোঁজ-খবর নিতে হয় নানান বিষয়ের। জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ বৃদ্ধ মানুষ। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় তিনি অর্ধযুগ ধরে শয্যাশায়ী। কিন্তু নায়েব গোপীনাথ সরকারের কাছ থেকে রোজ একবার হলেও পুরো তল্লাটের খোঁজ-খবর, হিসেব নিকেশ নেয়া চাই বৃদ্ধ বিষ্ণুনারায়ণের।

গোপীনাথ সরকার স্বল্পভাষী মানুষ। বিষ্ণুপুরের এই জমিদারির নায়েব হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করে আসছে সে। গভীর মনোযোগে রঘুর কাছে পুরো ঘটনাটা শুনলো গোপীনাথ সরকার। তারপর চুপ করে বসে রইল। রঘু বলল, এখন কী করব নায়েব মশাই?

গোপীনাথ সরকার সাথে সাথে জবাব দিলো না। সে রঘুকে সাথে নিয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণের বন্ধ ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর সেও বলল, সনাতন মিস্ত্রিকে খবর দে।

রঘু সনাতন মিস্ত্রিকে খবর দিলো। সনাতন মিস্ত্রি খবর পেয়ে ছুটে এলো সঙ্গে সঙ্গেই। ততক্ষণে ঝলমলে রোদের আকাশজুড়ে মেঘ করেছে। টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সনাতন মিস্ত্রি বন্ধ ঘরের দরজার সামনে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে রইল। অপলা, রঘু, গোপীনাথ সরকার সকলেই উৎকণ্ঠিত। যেন ভয়ঙ্কর কোনো দৃশ্য দেখার অপেক্ষায়! যেন এই বন্ধ ঘরের দরজার ওপাশেই ওঁৎ পেতে রয়েছে। সহজ অনুমানযোগ্য কিন্তু কঠিন এক সত্য। সেই সত্যটিই লুকিয়ে ছিল গঙ্গাবতীর তীরে রঘুকে বলা দেবেন্দ্রনারায়ণের ঠাণ্ডা কণ্ঠের নির্দেশের মধ্যে, রঘু, বাতাসের আগে বারোহাটি যা। গিয়ে দেখ হেমাঙ্গিনী দেবীর কী অবস্থা…। এই বাক্যের গভীরেই প্রোথিত কোনো অমোঘ নিয়তির অব্যক্ত আশঙ্কা।

সনাতন মিস্ত্রি দরজা ভাঙতে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে গোপীনাথ সরকার হঠাৎ বলল, রঘু, দরজা ভাঙার আগে আরেকবার ডাক দেখি।

রঘু ডাকল, একবার না, বারবার। সে তার শক্ত থাবার আঘাতে দরজায় তীব্র কম্পন তুলে ডাকল। কিন্তু বন্ধ দরজার ভেতর থেকে কোনো সাড়া এলো না। সনাতন মিস্ত্রি দরজা ভাঙল তার কিছুক্ষণ পর। গোপীনাথ সরকার সতর্ক পায়ে ঘরে ঢুকল। দেবেন্দ্রনারায়ণের খোলামেলা বড় ঘর পছন্দ। ঘরের দুই দিকের দেয়ালজুড়ে বিশাল জানালা। জানালাগুলো ভেতর থেকে খিল এঁটে দেয়া। ঘরভর্তি আসবাবপত্র দেবেন্দ্রনারায়ণের অপছন্দ বলে এই ঘরেও তেমন কোনো আসবাবপত্র নেই। আসবাবপত্রের বাহুল্যবর্জিত ঘরখানা লাগছে খোলা মাঠের মতো। তবে পশ্চিমদিকের দেয়ালজুড়ে সেগুনকাঠের একখানা ভারী আলমারি রয়েছে। সেই আলমারির তাকজুড়ে থরে থরে সাজানো নানান রঙের পানীয়ের বোতল। তার পাশে মেঝেতে বিশাল উঁচু নরম গদির উপর বাহারি রঙের শতরঞ্জি বিছানো। সেখানে নানান রকমের বাদ্যযন্ত্র। জানালার গা ঘেঁষে বিশাল পালঙ্ক। পালঙ্কের ওপর ফিনফিনে সাদা ধবধবে মশারি টানানো। সাজানো গোছানো পরিপাটি একখানা শয়নকক্ষ। কোথাও অস্বাভাবিক কিছু নেই। সকলই যেন শান্ত, সমাহিত, স্নিগ্ধ। কিন্তু এই শান্ত সমাহিত স্নিগ্ধ ঘরের ভেতরের আলো হাওয়ারা যেন মুহূর্তেই থম মেরে গেল। গোপীনাথ সরকার, রঘু, অপলা আর সনাতন মিস্ত্রির চারজোড়া চোখ প্রবল বিস্ময় এবং আতঙ্ক নিয়ে আবিষ্কার করল, এই ঘরের কোথাও কেউ নেই।

ঘরের ভেতর থেকে খিল এঁটে বন্ধ করা দরজা-জানালার এই ঘরে হেমাঙ্গিনী দেবী নেই!

*

গঙ্গাবতীর জল বাড়ছে হু হু করে।

এতদিন বৃষ্টির প্রকোপ তেমন না থাকলেও গত দু’দিন থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে থেমে থেমে। গঙ্গাবতীর তীরজুড়ে জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের বিশাল বাড়ি গঙ্গামহল। গঙ্গামহলের সিংহ দরজার বাইরে শানবাঁধানো চত্বর। চত্বরের মাঝ বরাবর ভাগ হয়ে দু’ধারে বাড়ির সীমানা প্রাচীরের গা ঘেঁষে সোজা রাস্তা। রাস্তার আরেক পাশেই গঙ্গাবতীর তীর। রাস্তাটি নদীর তীর ধরে বাড়ির সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে দু’দিক দিয়েই কিছু দূর গিয়েছে। তারপর গঙ্গামহলকে বেষ্টন করে অর্ধবৃত্তাকারে বাঁক নিয়ে চলে গেছে গাঁয়ের দিকে। সিংহদরজার ঠিক উল্টো দিকে ওই চত্বরটুকু পেরোলেই দীর্ঘ বাঁধানো ঘাট নেমে গেছে গঙ্গাবতীর জলের ভেতর। নদীমুখী গঙ্গামহল থেকে যাতায়াতের জন্য ঘাটে নৌকো কিংবা বজরা বাধা থাকে, আবার পদব্রজে বা ঘোড়ার গাড়ি যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হয় নদীর পাড় আর সীমানা প্রাচীরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া ওই রাস্তা।

বৃদ্ধ জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ বসে আছেন জানালার পাশে। ভোরের আলো ফোঁটার আগেই তার ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙলে তিনি একা একা উঠে বসেন। নিজে নিজেই পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে হেলান দেন। তারপর নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকেন বিস্তৃত গঙ্গাবতীর দিকে। বিষ্ণুনারায়ণের ধারণা তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না। তার বয়স যে খুব বেশি হয়েছে তা না। তার ঠাকুরদা বয়স পেয়েছিলেন শ’য়ের কাছাকাছি। বাবাও নব্বই পেরিয়েছিলেন। কিন্তু এই সত্তরেই বিষ্ণুনারায়ণ শয্যাশায়ী। একা একা বিছানা থেকে উঠে বসতে পারলেও নেমে হাঁটতে পারেন না। কারো সাহায্য ছাড়া ঘর থেকে বের হতে পারেন না। বাইরের আলো হাওয়ায় কতদিন বের হওয়া হয় না। তবে ভোরের এই গঙ্গাবতী যেন তাকে রোজ রোজ নতুন জীবনের আনন্দ দেয়। কী ফুরফুরে স্নিগ্ধ হাওয়া। অদ্ভুত আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে বিষ্ণুনারায়ণের। সেই বন্ধ চোখের ভেতর কত কত ছবি, স্মৃতি, কত কত গল্প।

.

বিষ্ণুনারায়ণের নাম রেখেছিলেন তার বাবা যোগেন্দ্রনারায়ণ। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে পরপর নয় কন্যা সন্তানের পর যোগেন্দ্রনারায়ণ দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেন। কিন্তু সেই স্ত্রীর গর্ভেও তিনি কোনো পুত্র সন্তান দিতে পারেননি। যোগেন্দ্রনারায়ণ তখন জমিদারির উত্তরাধিকার চিন্তায় দিশেহারা। কারণ তার পূর্বপুরুষের ছোট এক গাঁয়ের জমিদারি এবং অল্পবিস্তর যে প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল, যোগেন্দ্রনারায়ণ তার সময়ে নানান কৌশলে, বুদ্ধিতে, কর্মকাণ্ডে, শক্তি-প্রয়োগে তা বিস্তৃত করেছেন বিশাল অঞ্চলজুড়ে। যদিও যোগেন্দ্রনারায়ণের এই জমিদারি বিস্তৃতির আড়ালের ঘটনা নিয়ে নানান কথা রয়েছে। প্রবল বৈষয়িক যোগেন্দ্রনারায়ণ তার মনোবাঞ্ছা পূরণে এমন কোনো উপায় নেই যা গ্রহণ করেননি। এই জমিদারির বিস্তৃতিতে যেকোনো কাজ করতে তিনি সদাপ্রস্তুত ছিলেন। এই গঙ্গাবতী নদী আর বারোহাটির জঙ্গলজুড়ে বিভিন্ন সময়ে যোগেন্দ্রনারায়ণের নানান অপকর্মের কথা আড়ালে আবডালে ভাসে। কিন্তু সেই সময়ে একটি পুত্র সন্তানের অভাব যোগেন্দ্রনারায়ণকে প্রবলভাবে অসহায় করে তুলল। দিনের পর দিন ডাক্তার, কবিরাজ, ওষুধ, পথ্যসহ চলতে থাকল নানান যজ্ঞ, পুজো-অর্চনাও!

মধ্যবয়স পার করে ফেলা যোগেন্দ্রনারায়ণ তখন একা রাত্রিযাপন করেন। এক গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে তিনি তার স্ত্রীদের ডাকলেন। তারপর উফুল্ল গলায় বললেন, বড় আর মেজো, আমি স্বপ্ন দেখেছি। অতি উত্তম স্বপ্ন।

কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে আসা তার দুই স্ত্রী বিভ্রান্ত চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। কনিষ্ঠ স্ত্রী হঠাৎ মিনমিন করে বললেন, আপনি আমায় মেজো বলছেন কেন? আমি তো ছোট!

যোগেন্দ্রনারায়ণ স্মিত হেসে বললেন, এই জন্যই তো তোমাদের ডেকেছি। আমি স্বপ্ন দেখেছি। অতি উত্তম স্বপ্ন। সেই স্বপ্নে আমি দেখেছি যে আমি তৃতীয়বারের মতন দার পরিগ্রহ করেছি। এই স্ত্রীর বয়স অতি কম। তার গর্ভে আমি পুত্র সন্তান লাভ করেছি।

যোগেন্দ্রনারায়ণ থামলেন। কিন্তু তার চোখে মুখে তখনো ঝলমলে আনন্দ লেগে আছে। তিনি সেই আনন্দ ঝলমলে মুখে তার কনিষ্ঠ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি যদি তৃতীয় স্ত্রী গ্রহণ করি, তাহলে তো তুমি আর ছোট থাকো না, তুমি হয়ে যাও মেজো। এখন থেকে তুমি মেজো। মেজো বউ।

এতকিছুর পরও যোগেন্দ্রনারায়ণ তার স্বপ্ন নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন। তার কখনো কখনো মনে হতে লাগল যে এ সকলই তার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা। আবার মাঝে মাঝে মনে হতে লাগল, তিনি সত্যিই স্বপ্ন দেখেছেন এবং এই স্বপ্নই কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। তার ধারণা তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন তাকে পুত্র সন্তান পেতে হলে একখানা বিষ্ণুমন্দিরও গড়তে হবে। তিনি কালবিলম্ব না করে গঙ্গামহলের ভেতর বড় করে বিষ্ণুমন্দির গড়লেন। বিষ্ণুমন্দির গড়া শেষ হলে তিনি নয় বছর বয়সের এক বালিকাকে বিয়ে করে আনলেন। বালিকার নাম বিভাবতী। বিভাবতী অতি দরিদ্র ঘরের মেয়ে। সে তখনো ঋতুমতি হয়নি। যোগেন্দ্রনারায়ণ বিভাবতীর ঋতুমতি হওয়া অবধি অপেক্ষা করলেন। বিয়ের বছর চারেকের মাথায় বিভাবতী পুত্রসন্তানের মা হলেন। খবর শুনে আনন্দে আত্মহারা যোগেন্দ্রনারায়ণ গঙ্গামহলের সিংহদরজা খুলে দিতে বললেন।

বিষ্ণুপুর জমিদারির সকল প্রজাদের জন্য আনন্দ-উৎসবের আয়োজন করা হলো। তিনদিন তিনরাত ধরে চলল সেই উৎসব। উৎসবের শেষ দিনে যোগেন্দ্রনারায়ণ গঙ্গামহলের সিংহদরোজার সামনে দাঁড়িয়ে তার পুত্রের নাম ঘোষণা করলেন। তিনি তার পুত্রের নাম রাখলেন বিষ্ণুনারায়ণ। বিষ্ণুনারায়ণের নাম রাখার এই দিনে যোগেন্দ্রনারায়ণ আরো একটি ঘোষণা দিলেন, তিনি এই অঞ্চলের পূর্ব নাম পাল্টে নতুন নাম রাখলেন বিষ্ণুপুর। বিষ্ণুপুরের পুরনো নাম ছিল বারোহাটি। পুরনো বারোহাটি নতুন নামে বিষ্ণুপুর হলেও জমিদারির উত্তর তল্লাট ঘেঁষে যে বিশাল জঙ্গল, তার নাম রয়ে গেল আগের সেই বারোহাটির জঙ্গলই। শুধু তাই নয়, বিষ্ণুপুর জমিদারির অধিনস্ত দূর-দূরান্তের সকল অঞ্চলের আলাদা করে স্থানীয় নাম থাকলেও তা বিষ্ণুপুরের জমিদারি হিসেবেই পরিচিত হতে লাগল।

.

এই ঘটনা নানানজনের মুখে অজস্রবার শুনেছেন বিষ্ণুনারায়ণ। তিনি খুব একটা ধর্মকর্ম করা মানুষ নন। তবে এই ঘটনা তাকে ভেতরে ভেতরে একধরনের চাপা আনন্দ দেয়। নিজেকে খানিকটা আলাদা এবং বিশেষ মানুষ বলে ভাবতে তার ভালো লাগে। বিষ্ণুনারায়ণের নিজের জীবনে অবশ্য পুত্রসন্তান-সংক্রান্ত কোনো জটিলতা তৈরি হয়নি। তার স্ত্রী মারা গেছেন বছর পঁচিশেক আগে। ততদিনে অবশ্য বিষ্ণুনারায়ণকে তিনি তিন-তিনটি পুত্র সন্তান দিয়ে গেছেন। বিষ্ণুনারায়ণ জমিদার হয়েছেন অনেক বয়সে। কারণ তার বাবা যোগেন্দ্রনারায়ণ দীর্ঘ আয়ু পেয়েছিলেন। ফলে বিষ্ণুপুরের জমিদার হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য পিতা যোগেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু অবধি করতে হয়েছিল তার। স্ত্রী বিয়োগের পর বিষ্ণুনারায়ণ আর বিবাহ করেননি। তিনি স্বাধীন মানুষ, নতুন করে আর কোনো জটিলতায় জড়াতে চাননি। কিন্তু জীবনজুড়েই জটিলতা মানুষকে ছাড়ে না। ছাড়েনি বিষ্ণুনারায়ণকেও।

জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে বিষ্ণুনারায়ণ তার পুত্রদের নিয়ে একটি গুরুতর সমস্যায় পড়েছেন। নিয়মানুযায়ী তার মৃত্যুর পরে উত্তরাধিকারসূত্রে বিষ্ণুপুরের জমিদার হওয়ার কথা তার জ্যেষ্ঠ পুত্র অবনীন্দ্রনারায়ণের। কিন্তু অবনীন্দ্রনারায়ণ জমিদারি পরিচালনার মতো কতটা শক্ত-সামর্থ্য কিংবা বিচক্ষণ, তা নিয়ে সকলেরই সংশয় রয়েছে। সংশয় রয়েছে বিষ্ণুনারায়ণের নিজেরও। উপরন্তু মেজো ছেলে দেবেন্দ্রনারায়ণ প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ববান, সুপুরুষ। নিজের সামর্থ্য এবং সিদ্ধান্তের প্রতি তার অগাধ আস্থা। কৈশোর থেকে সে কাউকে তোয়াক্কা করেনি। এমনকি বিষ্ণুনারায়ণের নিজেরও কখনো না কখনো দেবেন্দ্রনারায়ণের সামনে গুটিয়ে যেতে হয়েছে। বছর ছয়েক আগে বিষ্ণুনারায়ণ যখন নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হলেন, তখন থেকেই মূলত বিষ্ণুপুর জমিদারির অঘোষিত উত্তরাধিকার হিসেবে সকলেই দেবেন্দ্রনারায়ণকেই ধরে নিয়েছে। জমিদারির সকল কাজকর্ম যেন অবধারিতভাবেই তার উপর ন্যস্ত হয়েছে। যদিও বিষ্ণুনারায়ণ এখন অবধি এই ঘরে বসেই সকল কিছুর খোঁজ-খবর রাখার চেষ্টা করেন। নানান বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন। কিন্তু তিনি জানেন, পুরোপুরি সক্ষম বিষ্ণুনারায়ণই যেখানে দেবেন্দ্রনারায়ণের মতো বুনো ঘোড়াকে বশে আনতে পারেননি, সেখানে এই অক্ষম, বৃদ্ধ বিষ্ণুনারায়ণ তাকে কী করে সামলাবেন!

.

গঙ্গামহলে যে চারখানা বিরাট দ্বিতল অট্টালিকা রয়েছে, তার একখানার দোতলাতে থাকেন বিষ্ণুনারায়ণ নিজে। বাকি তিনখানাতে থাকেন তার তিন পুত্র, তাদের স্ত্রী-সন্তান এবং দাস-দাসীরা। মেজোপুত্র দেবেন্দ্রনারায়ণ বিষ্ণুপুরের অঘোষিত হবু জমিদার হিসেবে সকলের কাছেই স্বীকৃত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জমিদারির এই প্রথাবিরুদ্ধ উত্তরাধিকার নিয়ে কারোরই কোনো আপত্তি নেই, কোথাও কোনো সমস্যা নেই।

কিন্তু বিষ্ণুনারায়ণ জানেন, যখন সকল কিছু আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে সহজ এবং সঠিক মনে হয়, তখন তার কোথাও না কোথাও লুকিয়ে থাকে সবচেয়ে অসহজ এবং অপ্রত্যাশিত কোনো কঠিন বিপরীত সত্য। বিষ্ণুনারায়ণের কেন যেন মনে হয় গঙ্গামহলের অন্দরে অন্দরে নানাবিধ অসন্তোষের হাওয়া চুপি চুপি বয়ে বেড়াচ্ছে। এই হাওয়া কোনো একদিন তুমুল ঝঞ্ঝা হয়ে সব কিছু এলোমেলো করে দেবে।

.

বিষ্ণুনারায়ণ দীর্ঘশ্বাস চেপে জানালা বন্ধ করলেন। বাইরে ঝলমলে রোদ উঠেছে। যদিও আকাশ দেখে মনে হচ্ছে এই রোদ সাময়িক। দীর্ঘ বৃষ্টি অপেক্ষা করছে। সকাল হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। বিষ্ণুনারায়ণের প্রাতঃরাশের সময় হয়েছে। অবশ্য প্রাতঃরাশ গ্রহণের পূর্বে প্রাণতোষ বৈদ্য রোজ একবার বিষ্ণুনারায়ণকে দেখে যান। কিন্তু আজ প্রাণতোষ বৈদ্য আসেননি এখনো। বিষ্ণুনারায়ণ হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, গঙ্গামহল আজ বাড়াবাড়ি রকমের শান্ত, নিস্তব্ধ। বাইরে চাকর-বাকরদের তেমন কোলাহল নেই, হৈ-হল্লা নেই। এ সময়টায় গঙ্গাবতী থেকে মাছ নিয়ে জেলেদের আসার কথা। সেখান থেকে তাজা মাছ রাখা হয়। বিষ্ণুনারায়ণের পারদা মাছ পছন্দ। জেলেদের আনা মাছ থেকে বেছে বড় আর তাজা পাবদাগুলো তাকে দেখানো হয়। তার পছন্দ হলে সেই মাছ রাখা হয়, আর পছন্দ না হলে মাছ নিয়ে জেলেরা চলে যায় আশেপাশের বাজারে। কিন্তু আজ সব কিছুই বড় বেশি নিঃশব্দ। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। আশ্চর্যরকম শান্ত এই বাড়ি!

বিষ্ণুনারায়ণ গলা উঁচু করে মুকুন্দকে ডাকলেন। মুকুন্দ তার খাস ভৃত্য। তার সার্বক্ষণিক দেখাশোনায় ন্যস্ত। আর রয়েছে দাসী কমলা। কিন্তু আজকাল কমলা বেশির ভাগ সময়ই থাকে তার বড়পুত্রবধু বীণাবালার মহলে। তিনি শুনেছেন বীণাবালার বাতের ব্যথাটা বড় বেড়েছে।

কয়েকবার ডাকার পরেও যখন মুকুন্দের কোনো খোঁজ মিলল না, তখন বিষ্ণুনারায়ণের খানিক দুশ্চিন্তা হতে লাগল। তিনি এদিক-সেদিক তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলেন না। বন্ধ দরজা জানালার এই নির্জন একাকী ঘরে বিষ্ণুনারায়ণ হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, বিশাল এই বিষ্ণুপুর জমিদারির সবচেয়ে অসহায় মানুষটি আসলে তিনি নিজে। তিনি একটি শিশুর চেয়েও অসহায়। এই বন্ধ ঘরে তিনি নবজাতক শিশুর মতো। এখান থেকে কেউ যদি তাকে বের হতে সাহায্য না করে তাহলে তিনি বের হতে পারবেন না। কেউ খাবার না দিলে তিনি খেতে পারবেন না। এখানেই হতে পারে তার এই দীর্ঘ জীবনের করুণ এবং অসহায় সমাপ্তি!

.

প্রাণতোষ বৈদ্য দাঁড়িয়ে আছে গঙ্গাবতীর তীরে। এই জায়গার নাম বিরামপুর। তার সামনে বসে আছেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। জায়গাটা নদীর তীর থেকে খানিক উঁচু। দেবেন্দ্রনারায়ণের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নদী থেকে হু হু করে হাওয়া বইছে। খোলা হাওয়ায় প্রাণতোষ বৈদ্যর চুল উড়ছে। এই মুহূর্তে অবশ্য প্রাণতোষ বৈদ্যর এখানে থাকার কথা না। তার থাকার কথা জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের মহলে। ভোরের এই সময়ে সে বিষ্ণুনারায়ণের প্রাত্যহিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। কিন্তু আজ কাকভোরে দেবেন্দ্রনারায়ণের পেয়াদা জগাই তাকে বাড়ি থেকে ডেকে এনেছে। প্রাণতোষ বৈদ্য প্রথমে ভেবেছিল বিষ্ণুনারায়ণের গুরুতর কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই জন্য জগাইকে জরুরি ভিত্তিতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু জগাই তাকে গঙ্গামহল নিয়ে যায়নি। সে তাকে নিয়ে এসেছে গঙ্গামহল থেকে অনেকটা দূরে বিরামপুরের এই নদীতীরে।

প্রাণতোষ বৈদ্য কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার সামনে বসা মানুষটিকে বাঘের মতো ভয় পায়। জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের এই মেজোপুত্রকে সে চোখের সামনে বেড়ে উঠতে দেখেছে, কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে দেবেন্দ্রনারায়ণকে সে আর সকলের মতোই ভয় পায়। দেবেন্দ্রনারায়ণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সামনের বিস্তৃত নদী গঙ্গাবতীর দিকে। কোনো কথা বলছেন না তিনি। শান্ত-নিশ্ৰুপ। দেবেন্দ্রনারায়ণ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেন। দূরে মানুষের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। তিনি জগাই’র দিকে তাকিয়ে বললেন, জগাই, এর মধ্যে ঘটনা গ্রাম ছড়িয়েছে?

জগাই মাথা নিচু করে বলল, আজ্ঞে কর্তা, আপনি যে বললেন গঙ্গামহল থেকে দু’খানা ঘোড়ার গাড়ি আর ক’জন পাইক-বরকন্দাজ নিয়ে আসতে। আমি তাই গেলাম। ওই সাত-সকালে ঘোড়ার গাড়ি, পাইক-বরকন্দাজের বহর দেখে সকলেই ভয় খেয়ে গেল। গঙ্গামহল থেকেও অনেকেই ছুটে এসেছে।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, যা, কাউকে পাঠিয়ে লোকজন ওখানেই আটকে রাখ। দেখিস, এদিকে কাছাকাছি যেন কেউ না আসে।

জগাই চলে যেতে দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকালেন প্রাণতোষ বৈদ্য’র দিকে, তারপর ঠাণ্ডা গলায় বললেন, অত সকালে আপনাকে বাড়ি থেকে না এনে উপায় ছিল না কবিরাজ মশাই। বিপদ হয়েছে, মহা বিপদ।

প্রাণতোষ বৈদ্য শুকনো মুখে তাকিয়ে রইল দেবেন্দ্রনারায়ণের দিকে। দেবেন্দ্রনারায়ণ আঙুল তুলে নদীর নিচু ঢালের দিকে দেখিয়ে বললেন, ওই যে দেখেন, জলের ভেতর দু’খানা নাও বাধা আর নিতাই দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিতাইকে তো চেনেন?

প্রাণতোষ বৈদ্য মিনমিন করে বলল, আজ্ঞে চিনি, মাঝেমধ্যে গঙ্গামহলে দেখেছি। আপনার পিতার জন্য ভোরবেলা মাছ নিয়ে যেত।

দেবেন্দ্রনারায়ণ সাথে সাথে কোনো কথা বললেন না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর নদীর তীর ধরে খানিকটা এলোমেলো পায়চারি করলেন। তারপর প্রাণতোষ বৈদ্যর সামনে এসে দাঁড়ালেন। নিজের ক’দিনের না কামানো দাঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, কবিরাজ মশাই, শেষ রাতে রঘুর কাছে খবর পেয়ে আমি বারোহাটি থেকে ছুটে এসেছি। আপনি তো জানেন, সবখানেই গুটিবসন্তের বড় প্রকোপ চলছে। একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে ছড়াচ্ছে। এই গ্রাম থেকে ওই গ্রামে যাচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম বিনাশ হয়ে যাচ্ছে এই মরণব্যাধিতে। একবার কোনো গায়ে ঢুকে পড়লে আর রক্ষে নেই। পুরো গাঁ শ্মশান। এই জন্যই নদীর তীরজুড়ে রাত-দিন পাহারার ব্যবস্থা করেছি। যতটা সম্ভব পাইক-পেয়াদা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছি, গুটিবসন্তের কোনো রোগী যেন বিষ্ণুপুরে নামতে না পারে। কোনো নৌকা বা বজরা ভেড়ানোর আগে যেন ঠিকঠাক দেখে নেয়া হয়, তাতে গুটিবসন্তের কোনো রোগী রয়েছে কিনা!

দেবেন্দ্রনারায়ণ খানিক থামলেন। তারপর হেঁটে নদীর কিনারে চলে এলেন। নদীর ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া পাড়ের নিচে পায়ের গোড়ালি ডোবা জলের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে নিতাই। দেবেন্দ্রনারায়ণ নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রাণতোষ বৈদ্যকে বললেন, গতরাতে নিতাই ওই নাওখানা গায়ে ভিড়িয়েছে, শুধু তা-ই না, নাওয়ের ভেতরে এক ছেলে। সেই ছেলের গা-ভর্তি গুটিবসন্ত। নিতাই ওই নাওয়ে ঢুকে সেই ছেলেকে ছুঁয়েছে।

দেবেন্দ্রনারায়ণের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণতোষ বৈদ্য ভীত গলায় বলল, এ কী ভয়ানক কথা! এখন উপায়?

দেবেন্দ্রনারায়ণ ঘাড় ঘুরিয়ে প্রাণতোষ বৈদ্য’র দিকে তাকিয়ে বললেন, এ তল্লাটে ডাক্তার কবিরাজ বলতে যা বোঝায় তা তো এক আপনিই। এখন আপনিই বলুন কী উপায়?

প্রাণতোষ বৈদ্য সাথে সাথে কোনো জবাব দিলো না। সে দীর্ঘক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। দূরে মানুষের কোলাহল বাড়ছে। সেই কোলাহলজুড়ে আতঙ্ক। ঘটনা এরইমধ্যে গোটা গাঁয়ে রটে গেছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, সকলে ক্রমেই আরো আতঙ্কিত হয়ে উঠবে। বিষ্ণুপুরের সকল গাঁয়ে, সকল তল্লাটেই এই ঘটনা রটে যাবে। তার আগেই কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিস্থিতি আপাতত সামাল দিতে হবে।

প্রাণতোষ বৈদ্য বিড়বিড় করে বলল, আজ্ঞে, উপায় তো কিছুই দেখছি না। তবে সবকিছুর আগে আপনার পিতার সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরামর্শ করে নেয়া আবশ্যক।

দেবেন্দ্রনারায়ণ একা সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করেন। কিন্তু তিনি ঘটনার স্পর্শকাতরতা সম্পর্কে সজাগ। বিষ্ণুপুর জমিদারির আয়তন বিশাল। অনেকগুলো গ্রাম-তল্লাট মিলে এই বিশাল জমিদারির বিস্তৃতি। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই প্রজারা আতঙ্কিত হয়ে উঠবে। আর দেবেন্দ্রনারায়ণ জানেন, আতঙ্কিত জনতার চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু নেই। এদের সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে। তবে আশার কথা, নিতাই যেখানে নাওখানা ভিড়িয়েছে, সেটি জনবসতি থেকে বেশ দূরে। ছোঁয়াচে রোগ হলেও নিতাই এবং নাওয়ের ওই শিশুটিকে এ গাঁয়ের আর কেউ ছোয়নি। সুতরাং প্রজাদের হয়তো বা বোঝানো যাবে যে, বিপদের কিছু নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, নিতাই আর ওই গুটিবসন্ত-আক্রান্ত ছেলেটির ব্যবস্থা কী হবে? এরা কই যাবে?

দেবেন্দ্রনারায়ণ খানিক চুপ করে রইলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, তবে তাই হোক। গঙ্গামহলেই সিদ্ধান্ত হোক। কিন্তু যা করার করতে হবে দ্রুত। হাতে কিন্তু সময় খুব কম।

প্রাণতোষ বৈদ্য নিতাইয়ের নাওয়ের দিকে ইশারা করে বলল, আজ্ঞে, আমরা সকলেই এখন গঙ্গামহল গেলে এদের কী হবে?

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, এদের ব্যবস্থা আমি করছি। আপনি গঙ্গামহলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান।

দেবেন্দ্রনারায়ণ ভেতরে-ভেতরে চিন্তিত। রঘু কতক্ষণে বারোহাটি থেকে হেমাঙ্গিনী দেবীর খবর নিয়ে আসবে, তা তিনি জানেন না। আর রঘু না আসা পর্যন্ত দেবেন্দ্রনারায়ণ কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্তেও পৌঁছাতে পারছেন না। তার মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন কিলবিল করছে, কিন্তু তিনি সে সকল প্রশ্নের উত্তরও মেলাতে পারছেন না। আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি শুরু হবে। দেবেন্দ্রনারায়ণের মাথায় একটি চিন্তা কাজ করছে, কিন্তু সেটি কতটা ফলপ্রসূ হবে সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। তিনি জগাইকে ডাকলেন। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভারী বৃষ্টি হবে রে জগাই। তার আগেই নিতাই আর ওই ছেলের একটা ব্যবস্থা যে করতে হয়!

জগাই অবাক চোখে তাকাল, কী ব্যবস্থা কর্তা?

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, আপাতত এদের গাঁয়ের কাছাকাছি থেকে সরিয়ে জনবসতি নেই এমন দূরে কোথাও নিয়ে যা।

জগাই ভীত গলায় বলল, আজ্ঞে, আমি কর্তা? ওই সর্বনেশে রোগ যদি আমার শরীরেরও আসে কর্তা?

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, কিন্তু উপায় তো একটা বের করতে হবে জগাই।

জগাই কোনো জবাব দিল না। দেবেন্দ্রনারায়ণ কী ভেবে জগাইকে কাছে ডাকলেন। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, এক কাজ কর জগাই, নিতাইকে ওই ছেলেটারে নাওয়ে উঠিয়ে দে। আর তুই নিতাইয়ের নাওয়ে উঠ। সাথে অন্য একজন মাঝি নে। তারপর নাও বেয়ে পশ্চিম তল্লাট ঘুরে গঙ্গাবতী যেখানে উত্তরে বারোহাটির জঙ্গলে মিশেছে, সেখানে চলে যা। নাও ভেড়াবি বারোহাটির জঙ্গলের গভীরে আরও দু’চার ক্রোশ গিয়ে।

জগাই বলল, সে তো বড় দূরের পথ কর্তা!

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, বেশি দূরের পথ নয়। এখন যাত্রা শুরু করলে সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছে যাবি। বারোহাটির বাগান বাড়ি থেকে লোক থাকবে। ওখানে। তারা তোদের আরো দূরের গভীর জঙ্গলে নিয়ে যাবে।

জগাই আতঙ্কিত গলায় বলল, কেন কর্তা?

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, তোর ভয়ের কিছু নেই। কাজটা ঠিকঠাক মতো করতে পারলে তোর জন্য পুরষ্কার রয়েছে।

জগাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তার ভয় কাটছে না। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, বারোহাটির বাগান বাড়ি ছাড়িয়ে গভীর জঙ্গলের ভেতর বাঘ শিকারের জন্য একখানা ঘর বানানো হয়েছিল অনেক আগে। বহু পুরনো ঘর। এতদিনে সে ঘর হয়তো সাপ-খোপের আশ্রম হয়েছে। ওইখানে আপাতত নিতাই আর ওই ছেলের থাকার ব্যবস্থা হবে।

জগাই আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে সেই সুযোগ দিলেন না। তিনি হনহন করে হেঁটে চললেন ঘোড়ার গাড়ির দিকে। তাকে অতি দ্রুত গঙ্গামহলে পৌঁছাতে হবে। সামনে অনেক কাজ।

*

অবনীন্দ্রনারায়ণ জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের জ্যেষ্ঠ সন্তান। আজ তার ঘুম ভেঙেছে দেরি করে। তিনি সাধারণত খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে আজ তিনি ঘুম থেকে উঠতে দেরি করেছেন। এই বেলা করে ঘুম থেকে উঠে তিনি খানিকটা বিরক্ত। পালঙ্কে হেলান দিয়ে তিনি তার এই বিলম্বে নিদ্রাভঙ্গের কারণ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অনেকটা সময় ধরে তিনি উপযুক্ত কারণটি খুঁজলেন, কিন্তু পেলেন না। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠায় অনেকগুলো সমস্যা হয়েছে। তিনি ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই স্নান করেন। স্নান শেষে পট্টবস্ত্র পরিধান করে মন্দিরে দীর্ঘসময় নিয়ে প্রার্থনা করেন। তারপর সামান্য আহার গ্রহণ করেন। আহার শেষে তিনি ছাদে চলে যান। ছাদে একখানা উঁচু তক্তপোষ বসানো রয়েছে। তক্তপোষের উপরে কোমল আরামদায়ক বিছানা পাতা। তিনি সেই বিছানায় আয়েশ করে বসে সংগীতচর্চা করেন। এই বয়সে এসে তার সংগীতচর্চা গঙ্গামহলের অন্দরে-অন্দরে বিপুল হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে। অনেকেই আড়ালে-আবডালে এই নিয়ে হাসি-তামাশাও করে। কিন্তু অবনীন্দ্রনারায়ণ তা নিয়ে মোটেও বিচলিত নন। তার ধারণা শখের কোনো বয়স নেই। তাছাড়া শিল্পের প্রতি অনুরাগ দোষের কিছু নয়। তিনি রোজ নিয়ম করে রেওয়াজ করেন। তার বয়স প্রায় পঞ্চাশ। দুয়েক বছর কম-বেশি হতে পারে। এই বয়সে এসে গলায় সুর খেলানো কঠিন। কিন্তু অবনীন্দ্রনারায়ণ চেষ্টার কমতি রাখছেন না। হতাশার বিষয় তাতে তেমন কোনো লাভ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। তিনি খেয়াল করেছেন, তিনি যখন ভোরে ছাদে উঠে রেওয়াজ করেন, তখন কেউ ভুলেও ছাদে আসে না। তিনি কাউকে ছাদে আসতে বারণ করেছেন বিষয়টি এমন নয়। বরং তিনি আকারে-ইঙ্গিতে অনেককেই বলেছেন, ভোরের হাওয়া অতিশয় উৎকৃষ্ট। স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি। কেউ চাইলে তার সাথে ভোরে ছাদে যেতে পারে। পাশের গঙ্গাবতীর তাজা স্নিগ্ধ হাওয়া এই সময়ে হু হু করে বইতে থাকে। কিন্তু তার ডাকে তেমন কেউ সাড়া দেয়নি। আগে তার ভৃত্য ব্রজগোপাল জল নিয়ে তক্তপোষের পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। কারণ এই সময়ে অবনীন্দ্রনারায়ণ কিছুক্ষণ পরপর খানিক ঈষদুষ্ণ জল পান করেন। মুখ কুলকুচো করেন। কিন্তু তিনি লক্ষ করেছেন, গত কিছুদিন ধরে ব্রজগোপাল আর জল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না। সে জলের পাত্র রেখে চলে যায়। বিষয়টি নিয়ে অবনীন্দ্রনারায়ণের কিঞ্চিৎ মন খারাপ হয়েছিল। তবে তিনি বিষয়টি মেনে নিয়েছেন।

অবনীন্দ্রনারায়ণের অবশ্য তীব্র মন খারাপ হয়েছিল অন্য একটি কারণে। কারণটি তিনি কাউকে বলেননি। তার সন্দেহ, কারণটি বললে তার স্ত্রী বীণাবালা হয়তো তাকে কটুকথা শোনাবেন। বীণাবালাকে তিনি খানিকটা সমীহ করেন। হয়তো ভয়ও পান। তবে অবনীন্দ্রনারায়ণ সচেতনভাবে তা কখনোই স্বীকার করেন না। ঘটনাটি অস্বাভাবিক। রোজ ভোরে ছাদে আসা তার পুরনো অভ্যাস। এই সময়টায় তিনি ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে নানান চিন্তা-ভাবনায় ডুবে থাকেন। তার এই চিন্তা-ভাবনায় প্রায়ই ব্যাঘাত ঘটাতো একঝাঁক পাখি। এই পাখিরা রোজ ভোরে ছাদের কার্নিশজুড়ে বসে থাকত। এরা যে শুধু বসে থাকত তা নয়, একসঙ্গে গলা ফাটিয়ে কিচিরমিচির শব্দ করত। এদের যন্ত্রণায় একটু চিন্তামগ্ন হবারও উপায় ছিল না। হুশহাশ তাড়িয়ে দিলেও খানিক দূরে উড়ে গিয়ে আবার ফিরে আসত। অদ্ভুত ব্যাপার হলো অবনীন্দ্রনারায়ণ একদিন খেয়াল করলেন, তিনি ছাদে রেওয়াজ করতে আসার কিছুদিন পর থেকেই পাখিগুলোকে আর ছাদে দেখা যায় না। এমনকি আশেপাশে কোথাও না। এই নিয়ে তার প্রবল মন খারাপ হলো। তিনি পরপর কয়েকদিন ছাদে এলেন না।

.

আজ বেলা করে ঘুম ভাঙায় অবনীন্দ্রনারায়ণের দিনের শুরুটা এলোমেলো হয়ে গেল। দিনের শুরুটা এলোমেলো হয়ে যাওয়া মানে বাকি দিনটাই অন্যরকম হয়ে যাওয়া। সকালে রেওয়াজ করতে না পারলে তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। তার ওপর কী কারণে আজ এত বেলা করে ঘুম ভাঙল সে বিষয়টাও তিনি ধরতে পারছেন না। সবকিছু মিলিয়ে একটি অস্বস্তিকর বাজে দিনের শুরু।

অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও অবনীন্দ্রনারায়ণ এই বিলম্বে নিদ্রাভঙ্গের কারণটা ধরতে পারলেন না। প্রবল অস্বস্তি নিয়ে তিনি বিছানা ছাড়লেন। প্রাতঃকৃত্য সেরে ভৃত্য ব্রজগোপালকে ডাকলেন। ব্রজগোপাল বলল, আপনার জন্য বড় মা সেই ভোর থেকে অপেক্ষা করছেন, বড় বাবু।

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, যা, গিয়ে বল আমি আসছি।

ব্রজগোপাল চলে যাচ্ছিল। অবনীন্দ্রনারায়ণ আবার ডাকলেন, তোর বড় মা কি জলখাবার খেয়েছেন?

ব্রজগোপাল বলল, না, সেই কখন থেকে বসে আছেন। আপনি উঠবেন, তারপর খাবেন। আমি বার কয় এসে ঘুরে গেলাম, দেখলাম আপনি ঘুমুচ্ছেন।

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, আচ্ছা, তুই যা।

ব্রজগোপাল যেতেই অবনীন্দ্রনারায়ণ আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি কি বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন? কত হয়েছে তার বয়স? পঞ্চাশ? বায়ান্ন? কিন্তু পঞ্চাশ-বায়ান্ন কি বৃদ্ধ হবার মতোন বয়স? নাকি তিনি বয়সের আগেই বুড়িয়ে। যাচ্ছেন! যদি তা না-ই হবে, তাহলে আজ এতবেলা করে ঘুম থেকে ওঠার কারণ কী? তার তো আগে কখনো এমন হয়নি!

অবনীন্দ্রনারায়ণ খাবার টেবিলে বসতেই বীণাবালা বললেন, আপনার কি শরীর খারাপ?

অবনীন্দ্রনারায়ণ যেন ভেতরে ভেতরে খানিক গুটিয়ে গেলেন, বীণাবালা তাকে এই প্রশ্ন কেন করছে। তিনি চোখে-মুখে একটা হাসি হাসি ভাব ফুটিয়ে বললেন, নাহ্, শরীর খারাপ হবে কেন? শেষ রাতের দিকের বৃষ্টিতে একটু শীতল ভাব ছিল, ঘুমটা তাই জমে গিয়েছিল।

বীণাবালা অবশ্য এই কথায় নিশ্ৰুপ রইলেন। তার নিজের ঘুমের সমস্যা আছে। শরীরজুড়ে বাতের ব্যথা, সারারাত ব্যথায় ছটফট করেন। মাথাটাও মাঝে-মধ্যেই কেমন ঝিমঝিম করে। চোখে ঘুম আসে না। হাত-পা, মাথা টিপে দিলে ব্যথায় বেশ আরাম, তখন খানিক ঘুম হয়। ফলে প্রায় রাতেই বীণাবালা। দাসী-বাদীদের নিয়ে আলাদা কক্ষে থাকেন। আজও ছিলেন। আজকাল তার। সাথে বেশির ভাগ সময়ই থাকে বিষ্ণুনারায়ণের দাসী কমলা।

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, আর সকলে কই? সকলের খাওয়া শেষ?

বীণাবালা জবাব দিলেন, না। তিনি থালায় খাবার তুলে দিয়ে তারপর বললেন, সকলে মহলের বাইরে।

অবনীন্দ্রনারায়ণ অবাক গলায় বললেন, সকলে মহলের বাইরে মানে কী?

বীণাবালা খাবার মুখে দিতে দিতে বললেন, মেজো ঠাকুরপো পেয়াদা পাঠিয়েছেন। জগাইকে কয়েকজন পাইক-বরকন্দাজ আর একখানা ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে গঙ্গাবতীর তীর ধরে বিরামপুর যেতে বলেছেন।

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, এই সাতসকালে বিরামপুর কেন? আর দ্বিজেন্দ্র কোথায়? দ্বিজেন্দ্রও বেরিয়েছে?

দ্বিজেন্দ্র অবনীন্দ্রনারায়ণের একমাত্র পুত্র। পুরো নাম দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ। বীণাবালা আর অবনীন্দ্রনারায়ণের একটি কন্যাসন্তানও রয়েছে। কন্যাসন্তানটির। নাম গায়ত্রী। গায়ত্রীর বিয়ে হয়েছে রাইপুরের প্রভাবশালী এক ধনাঢ্য পরিবারে। রাইপুর বড় শহরের আদলে গড়ে উঠেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। সেখানে। ধনাঢ্য লোকজন আসেন। অনেকে স্থায়ী বসতও করছেন। তবে গায়ত্রীর শ্বশুর পরিবার বংশ পরম্পরায় রাইপুরের বাসিন্দা। গায়ত্রী এখন শ্বশুরালয়ে। দ্বিজেন্দ্র বয়সে গায়ত্রীর চেয়ে বছর তিনেকের ছোট। সদ্য বাইশে পা দেয়া দ্বিজেন্দ্র দেখতে হয়েছে অবিকল তার মায়ের মতো। তার আচার-আচরণও মা বীণাবালার মতোন। পিতা অবনীন্দ্রনারায়ণের সাথে পুত্র দ্বিজেন্দ্র বা কন্যা গায়ত্রীর তেমন একটা সংশ্রব নেই। এর কারণ অবশ্য অবনীন্দ্রনারায়ণ নিজেই। কেমন অন্য এক ধারার মানুষ তিনি। সকল সময় কী এক ভাবের জগতে ডুবে থাকেন। সেখানে আশেপাশের কোনো কিছুরই যেন কোনো অস্তিত্ব নেই। অবশ্য পিতামহ জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের নিকট দ্বিজেন্দ্র ভারি আদরের। তিনি তার আর সকল নাতি-নাতনির তুলনায় দ্বিজেন্দ্রকে খানিকটা বেশিই স্নেহ করেন।

বীণাবালা বললেন, হ্যাঁ, দ্বিজেন্দ্রও বেরিয়েছে। তবে দ্বিজেন্দ্র’র সাথে মুকুন্দও রয়েছে।

অবনীন্দ্রনারায়ণ লক্ষ করলেন বীণাবালা তার প্রথম প্রশ্নের উত্তর দেননি। তিনি তাই আবার জিজ্ঞেস করলেন, এত সকালে বিরামপুর কী?

বীণাবালা ঘটনার যতটুকু জানেন, অবনীন্দ্রনারায়ণকে তা খুলে বললেন। অবশ্য ঘটনা শুনে অবনীন্দ্রনারায়ণকে খুব একটা উদ্বিগ্ন বলে মনে হলো না। তিনি বরং ভেতরে ভেতরে তার বিলম্বিত নিদ্রাভঙ্গ নিয়ে উদ্বিগ্ন।

খাবার টেবিলে বীণাবালার সাথে তার আর বিশেষ কোনো কথা হলো না। তবে অবনীন্দ্রনারায়ণ একটা বিষয়ে নিশ্চিত যে বীণাবালা তাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্যই এতক্ষণ খাবার টেবিলে বসেছিলেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তার আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। তিনি তড়িঘড়ি করে খাবার শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। বীণাবালা হঠাৎ মাথা উঁচু করে তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, আপনার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা রয়েছে। আপনার খানিক সময় হবে?

অবনীন্দ্রনারায়ণ এই কথার কোনো জবাব দিলেন না। তবে তিনি কেদারায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। বীণাবালা বললেন, আপনি কি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত?

অবনীন্দ্রনারায়ণ বিব্রত ভঙ্গিতে হাসলেন, না না, কী নিয়ে চিন্তিত হবো?

বীণাবালা বললেন, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত।

অবনীন্দ্রনারায়ণ জবাব দিলেন না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। বীণাবালা তার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। অবনীন্দ্রনারায়ণ শেষ অবধি কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। কী বলবেন তা যেন খুঁজে পাচ্ছেন না, তিনি শুকনো মুখে হাসলেন।

বীণাবালা বললেন, অবশ্য আপনার চিন্তার বিষয় নিয়ে চিন্তিত হবার কিছু নেই। আপনি সবসময়ই অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে চিন্তা করেন। প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে আপনার ভাবনা-চিন্তা নেই।

অবনীন্দ্রনারায়ণ খোঁচাটা গায়ে মাখলেন না। আজকাল তিনি বীণাবালার সামনে কেমন যেন সংকুচিত হয়ে থাকেন। কিছুই গুছিয়ে বলতে পারেন না কিংবা কথাই বলতে পারেন না। সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। অবশ্য কথা বলতে পারেন না, এটিও পুরোপুরি ঠিক নয়। বীণাবালা যে সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে চান, সে সব বিষয় নিয়ে আসলে অবনীন্দ্রনারায়ণ কথা বলতে চান না। সেসব বিষয়ে তার কথা বলতে ভালো লাগে না।

বীণাবালা বললেন, বিরামপুরে গঙ্গাবতীর তীরের ঘটনা যে একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, এটা কি আপনি বুঝতে পারছেন?

অবনীন্দ্রনারায়ণ আমতা আমতা করে বললেন, বুঝব না কেন?

বীণাবালা বললেন, তাহলে ওই বিষয় নিয়ে একটা কথাও যে বললেন না?

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, দেবু তো রয়েছে। মেজো থাকলে আর চিন্তা কী! ও ঠিকই সব সামলে নেবে।

অবনীন্দ্রনারায়ণের দৃঢ় বিশ্বাস, দেবেন্দ্রনারায়ণ সব সামলে নিবেন। মেজোভাই দেবেন্দ্রনারায়ণের প্রতি তার অগাধ আস্থা। দেবেন্দ্রনারায়ণকে তিনি দেবু বলে ডাকেন। মাঝেমধ্যে মেজোও বলেন। তবে তিনি একা নন, গঙ্গামহলের অন্দরে জমিদার পরিবারের সকল সদস্যরাই দেবেন্দ্রনারায়ণকে দেবু বা মেজো বলেই ডাকে। অবশ্য দাসী-বাদীদের কাছে দেবেন্দ্রনারায়ণের সম্বোধন কর্তাবাবু বা মেজোকর্তা। যদিও এই হিসেব অনুযায়ী বড়কুমার অবনীন্দ্রনারায়ণ আর ছোটকুমার দীপেন্দ্রনারায়ণকে বড় কর্তা বা ছোট কর্তা হিসেবেই সম্বোধন করার কথা। তবে তা কেউ করে না। এই দুইজনকে ডাকা হয় বড় বাবু আর ছোটবাবু বলে। একইভাবে তাদের স্ত্রীদেরও ডাকা হয় বড় মা আর ছোট মা বলে। তবে দেবেন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী রেণুকাকে আবার ডাকা হয় কর্তা মা বা মেজো কর্তা মা বলে। গঙ্গামহলে দেবেন্দ্রনারায়ণ মেজোকর্তা হলেও অবনীন্দ্রনারায়ণ বড় কর্তা না হবার কারণ বোধ করি এই যে, বিষ্ণুপুর জমিদারির বড় কর্তা একজনই এবং তিনি জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ স্বয়ং।

অবনীন্দ্রনারায়ণের কথা শুনে বীণাবালা সাথে সাথে কোনো জবাব দিলেন না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন অবনীন্দ্রনারায়ণের দিকে। বীণাবালার এই চোখ অবনীন্দ্রনারায়ণের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। তিনি চোখ নামিয়ে নিয়ে বললেন, মেজোর প্রতি তোমার এত বিরাগ কেন বীণাবালা? তুমি দেখো, ও ঠিকই সব সামলে নেবে।

বীণাবালা যেন মুহূর্তেই সাপের মতো ফণা তুললেন। তিনি নিচু গলায় হিসহিস করে বললেন, মেজো নয়, এই সকল কিছুই সামলে নেয়ার কথা আপনার। এই বিষ্ণুপুরের জমিদারি মেজোর না, এর প্রকৃত উত্তরাধিকারী আপনি। আপনার পরে এর উত্তরাধিকারী হবে আপনার একমাত্র পুত্র। দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ। মেজো এখানে কেউ না, কেউ না।

অবনীন্দ্রনারায়ণ যেন এবার খানিকটা শক্ত হলেন। তিনি স্পষ্ট গলায় বললেন, দেখো বীণাবালা, তোমায় আমি অসংখ্যবার বলেছি, এই জমিদারি নিয়ে আমার কোনো লোভ নেই। এসব আমায় টানে না। সকলকে দিয়ে সব কাজ হয় না। আমার হাতে পড়লে এসকল বরং নষ্ট হবে। এসবের জন্য দেবুই যথার্থ।

বীণাবালা বললেন, কিন্তু আপনার সন্তান তো যোগ্য!

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, তুমি এসব কী বলছ বীণা? দ্বিজেন্দ্র এখনো নেহাৎ-ই শিশু!

বীণাবালা বললেন, দ্বিজেন্দ্রর বয়স এখন বাইশ, প্রায় এই বয়সেই আপনি আমায় বিয়ে করে দীঘাগড় জমিদার বাড়ি থেকে এই বিষ্ণুপুরের গঙ্গামহলে নিয়ে এসেছিলেন। আপনি এখন দিব্যি ভুলেও গেছেন, আমার পিতা তার একমাত্র কন্যাকে সমপ্রদান করেছিলেন বিষ্ণুপুরের হবু জমিদারের হাতে। কিন্তু সেই হবু জমিদার অবনীন্দ্রনারায়ণ এখন দিগ্বজয়ী হবু সংগীতশিল্পী, ভাবকবি। আপনার মতিভ্রম ঘটেছে।

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, মানুষ যা ভাবে, সকলি কি হয় বীণাবালা?

বীণাবালা বললেন, না হোক, চেষ্টার তো ত্রুটি রাখতে নেই। কিন্তু সেই চেষ্টাটাই কি আপনার আছে? করেছেন কখনো?

অবনীন্দ্রনারায়ণ ক্লান্ত গলায় বললেন, আমায় দিয়ে এসব হবে না বীণাবালা। তোমরা দেখো আমি চেষ্টা করিনি। কিন্তু করেছি কিনা সে আমি নিজে জানি।

বীণাবালা বললেন, আপনি কি চেষ্টা করেছেন? কোনোদিন বিষ্ণুপুরের কোনো তল্লাটে প্রজাদের দেখতে গিয়েছেন? নায়েব মশাইয়ের সাথে জমিদারির অবস্থা নিয়ে কখনো আলাপ করেছেন? জমি, ফসল, তল্লাট, খাজনা- এসবের হিসেব নিয়েছেন?

বিষ্ণুনারায়ণ ঈষৎ আত্মবিশ্বাসী গলায় বললেন, গিয়েছিলাম, আমি তো কিছুদিন আগেই পশ্চিম আর দক্ষিণ তল্লাট ঘুরে এসেছি, বারোহাটির জঙ্গলের দিকটাতে দিন কয় ছিলামও।

বীণাবালা ঠোঁট উল্টে বক্র হাসি হাসলেন, আপনি জমিদারপুত্র হিসেবে যাননি। হবু জমিদার হিসেবেও না। আপনি গিয়েছিলেন ভাবুক কবি, বাউল সাধক হিসেবে। আপনার অন্তর ভাবে পরিপূর্ণ। আপনি সেই ভাব আরো জমিয়ে তুলতে আকাশ, বাতাস, বৃক্ষ, বিহঙ্গ দর্শন করে এসেছেন। যে অতি সাধারণ বেশভূষা আর আয়োজনহীনভাবে আপনি গিয়েছিলেন তাতে বিষ্ণুপুরের একজন মানুষও আপনাকে চিনতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। আর চিনতে পারলেও আপনাকে দেখে তাদের মনে এই ধারণা আরো পাকাঁপোক্ত হয়ে গেঁথে গিয়েছে যে, আপনি এই জমিদারির যোগ্য মানুষ নন, মেজোই আসল যোগ্য লোক।

অবনীন্দ্রনারায়ণের গলা থেকে আগের আত্মবিশ্বাস উবে গেল। তিনি স্তিমিত গলায় বললেন, তোমার কথা সত্য বীণাবালা।

বীণাবালা ঘুরে এসে অবনীন্দ্রনারায়ণের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তারপর তার বুকের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে গাঢ় ও স্পষ্ট গলায় বললেন, আমি এতকিছু বুঝি না। এখন থেকে আপনাকে আপনার দায়িত্ব বুঝে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। শ্বশুরমশাই বেঁচে থাকতে থাকতেই আপনার অধিকার আদায় করতে হবে। তিনি মারা গেলে কিন্তু আর কোনো সুযোগ থাকবে না।

অবনীন্দ্রনারায়ণ কী করবেন ভেবে পেলেন না। তার নিজেকে হাওয়ায় ভাসা এক টুকরো তুলোর মতো মনে হচ্ছে। যে স্থির হয়ে কোথাও জিরোতে চায়। কিন্তু চারপাশের হাওয়া তাকে জোর করে তাদের ইচ্ছেমতো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পলকা তুলোটুকুর এই উড়ে যাওয়া ঠেকানোর সাধ্য নেই।

অবনীন্দ্রনারায়ণ মৃদুকণ্ঠে বললেন, আমাকে কী করতে হবে বীণাবালা?

বীণাবালা অবনীন্দ্রনারায়ণের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, আজ আর কিছুক্ষণ পরেই গঙ্গামহলে জরুরি বৈঠক বসবে। সেখানে আপনাকে একটা খেলা খেলতে হবে।

অবনীন্দ্রনারায়ণ বিস্মিত গলায় বললেন, খেলা?

বীণাবালা বললেন, হ্যাঁ, খেলা। আপনি তো দাবা ভালো খেলেন। কখন কোন চাল দিতে হয় তা তো আপনার অজানা থাকার কথা নয়!

অবনীন্দ্রনারায়ণ কিছুই বললেন না। বীণাবালা তার কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচু গলায় অনেকক্ষণ কথা বললেন। তারপর চাপা গলায় হেসে উঠলেন। অবনীন্দ্রনারায়ণ স্থাণুর মতোন দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি তার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তার নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। বীণাবালা যত যাই বলুক, তিনি আসলে কিছুই বুঝছেন না। তার নিজেকে প্রবল আলোতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন অন্ধ মানুষের মতো মনে হচ্ছে। যেখানে চারপাশের সকলেই সবকিছু দেখছে, কেবল তিনি একাই কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। তার কাছে জগতের সকল কিছুই অন্ধকার।

*

গঙ্গামহলে জরুরি বৈঠক বসেছে।

বৈঠকে জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ আর তার তিন পুত্র অবনীন্দ্রনারায়ণ, দেবেন্দ্রনারায়ণ এবং দীপেন্দ্রনারায়ণও আছেন। সাথে আছেন বিষ্ণুনারায়ণের অতি কাছের দু’জন মানুষ বিভূতিনাথ সাহা এবং ভুজঙ্গ দেব। দু’জনই পেশাগতভাবে ব্যবসায়ী। বিষ্ণুনারায়ণদের পরিবারের সাথে এদের সম্পর্ক বংশ পরম্পরায় অতি পুরনো। বিভূতিনাথ সাহা এবং ভুজঙ্গ দেব সময়ে-অসময়ে বিষ্ণুনারায়ণের পাশে থেকেছেন। তবে ভুজঙ্গ দেবের তুলনায় বিভূতিনাথ সাহা বয়সে কনিষ্ঠ। বিষ্ণুনারায়ণের জ্যেষ্ঠপুত্র অবনীন্দ্রনারায়ণের চেয়ে বয়সে কিছু বড় হলেও বিভূতিনাথ সাহার বুদ্ধিমত্তা, প্রখর ব্যক্তিত্ব তাকে তার বয়সের। তুলনায় বিজ্ঞ ও আশেপাশের মানুষের নিকট গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। বিভূতিনাথ সাহা এবং ভুজঙ্গ দেবের বয়সের পার্থক্য হলেও এদের মধ্যে একটি বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। নানা বুদ্ধি-পরামর্শ কিংবা অন্য যেকোনো প্রয়োজনেও বিষ্ণুপুরের প্রভাবশালী এই মানুষ দু’জনকে পাশে পেয়েছেন বিষ্ণুনারায়ণ। আজও বিষ্ণুনারায়ণের ডাক শুনেই তারা ছুটে এসেছেন। ঘরের এক কোণায় খানিক দূরে বসে আছে প্রাণতোষ বৈদ্য।

.

বৈঠকে সকলের শেষে এসেছেন জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ। তাকে দু’জন ভৃত্যের সাহায্যে নিয়ে এসেছে তার খাসভৃত্য মুকুন্দ। ভোরবেলা এই মুকুন্দই অবনীন্দ্রনারায়ণের পুত্র দ্বিজেন্দ্রের সাথে বিরামপুর গিয়েছিল। তারা প্রাণতোষ বৈদ্য’র সাথে আবার গঙ্গামহলে ফিরে এসেছে।

বিষ্ণুনারায়ণ তার জ্যেষ্ঠপুত্র অবনীন্দ্রনারায়ণকে দেখে খানিক বিস্মিত হয়েছেন। জমিদারির কোনো বিষয়ে সাধারণত অবনীন্দ্রনারায়ণকে দেখা যায় না। আজ অবনীন্দ্রনারায়ণ এসেছেন সকলের আগে। একে একে বাকি সকলেই এসেছেন। তারা বসেছেন বিষ্ণুনারায়ণের মহলের নিচতলার একটি ঘরে।

বিষ্ণুনারায়ণ সরাসরি আলোচনায় চলে গেলেন, নায়েব মশাই কোথায়?

মুকুন্দ দাঁড়িয়েছিল দরজার বাইরে। সে গলা বাড়িয়ে বলল, আজ্ঞে কর্তা, উনি বারোহাটি গিয়েছেন।

বিষ্ণুনারায়ণ বললেন, কখন ফিরবে কিছু বলে গেছে?

মুকুন্দ বলল, না কর্তা। তবে অন্যদিন তো এরমধ্যেই ফিরে আসেন। খুব ভোরে গিয়ে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে আসেন। আজই দেরি করলেন।

বিষ্ণুনারায়ণ বললেন, আচ্ছা। উনি আসামাত্র এ ঘরে নিয়ে আসিস।

বিষ্ণুনারায়ণের হাঁপানির টান আছে। এইটুকু কথা বলেই তার যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল। তিনি চোখ বন্ধ করে সময় নিয়ে শ্বাস নিলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, দেবেন্দ্র, তুমি বলো ঘটনা কী ঘটেছে?

দেবেন্দ্রনারায়ণ কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। তারপর গভীর রাতে বারোহাটির বাগান বাড়িতে রঘুর খবর নিয়ে ছুটে যাওয়া থেকে শুরু করলেন। যতটা সম্ভব সবিস্তারে তিনি ঘটনা বর্ণনা করলেন। জগাইকে দিয়ে গুটিবসন্তে আক্রান্ত ছেলেটা আর নিতাইকে বারোহাটির জঙ্গলের গভীরে পাঠিয়ে দেয়া অবধি বলে তিনি থামলেন। এতকিছু বললেও দেবেন্দ্রনারায়ণ খুব সতর্কভাবেই ছেলেটার নৌকায় পাওয়া সেই চিরকুটখানার কথা বেমালুম চেপে গেলেন। এই ঘটনা তিনি কাউকে বলবেন না। এই চিরকুটে যে ভয়াবহ কথা লেখা রয়েছে তা দেবেন্দ্রনারায়ণের পক্ষে হজম করা কঠিন। কিন্তু এই চিরকুটের কথা তিনি কাউকে বলতেও পারছেন না। অবশ্য কারো সাথে যদি বলতেই হয় তবে সে একমাত্র হেমাঙ্গিনী দেবী। কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবী কই? কী অবস্থা তার? রঘুর এখন অবধি কোনো খোঁজ নেই। দেবেন্দ্রনারায়ণ নিজের ভেতরে তুমুল উৎকণ্ঠায় ভুগছেন। প্রবল উত্তেজনা নিয়ে তিনি অপেক্ষা করছেন রঘুর জন্য। দেবেন্দ্রনারায়ণ এখনো জানেন না রঘু কী খবর নিয়ে আসবে, তবে তার কেন যেন মনে হচ্ছে রঘু কোনো সুসংবাদ নিয়ে আসবে না। সে নিয়ে আসবে দুঃসংবাদ। বারোহাটির বাগান বাড়িতে কোনো অঘটন ঘটে গেছে!

দেবেন্দ্রনারায়ণ তার দীর্ঘ ঘটনার বর্ণনা শেষ করলেন। তবে তার কথা শেষ হবার পর সঙ্গে সঙ্গেই কেউ কথা বলল না। সকলেই যেন ঘটনার গভীরতা বোঝার চেষ্টা করছে।

বিভূতিনাথ যতখানি সাহসী, ভুজঙ্গ দেব ঠিক তার উল্টোটা। তার ভূত প্রেতে প্রবল ভয়। তিনি শুনেছেন ওলা ওঠা, গুটিবসন্ত এ সকল রোগ মানুষের বেশ ধরে আসে। তারপর ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামকে গ্রাম মানুষ এই রোগে মারা যায়। এ সকল রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তাছাড়া তিনি সেই শৈশব থেকেই শুনে এসেছেন, গুটিবসন্ত আসলে সাধারণ কোনো রোগ নয়, এটি ভগবান প্রদত্ত মানুষের পাপের শাস্তি। যেসকল মানুষ ভয়ঙ্কর পাপ করেছে, ভগবান তাদের গুটিবসন্তে আক্রান্ত করে অমানুষিক যন্ত্রণার মৃত্যু দেন। কেউ কেউ ভগবানের অশেষ কৃপায় বেঁচে গেলেও তার কোনো না কোনো অঙ্গহানী ঘটে। যেহেতু মানুষকে দেয়া ভগবানের শাস্তি এই রোগ; সেহেতু এর নিরাময়ে ওষুধ-পথ্য খাওয়া, বৈদ্য-কবিরাজ ডাকাও পাপ। কারণ, ভগবানের সিদ্ধান্তের ওপরে জোর খাটানো মহা-অন্যায়। ভগবান এতে রুষ্ট হন। ভুজঙ্গ দেবের এই বিশ্বাস প্রবল। গুটিবসন্ত নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে এমন হাজারো বিশ্বাস, হাজারো গল্প মানুষের মুখে মুখে ফেরে। দেবেন্দ্রনারায়ণের কথা শেষ হতেই তিনি ঊর্ধ্বমুখী হয়ে মুদ্রিত চোখে প্রণামের ভঙ্গিতে বললেন, মা শীতলা, দয়া করো মা, দয়া করো। রক্ষা করো।

ভুজঙ্গ দেবের এমন আচরণে বা সন্ত্রস্ততায় কেউ অবাক হলো না। সকলেই ভুজঙ্গ দেবের ঈশ্বরভক্তি এবং ভয়ভীতি সম্পর্কে কম-বেশি অবগত। বরং ভুজঙ্গ দেবের এমন আচরণে অন্যদের মধ্যেও যেন এক ভীতিকর অনুভূতির সৃষ্টি হলো।

ভুজঙ্গ দেব চোখ খুলে বললেন, এখন উপায় কী জমিদার মশাই?

বিষ্ণুনারায়ণ বললেন, সেটাই তো ভাবছি। আপনাদের সকলের এখানে আসবার কারণও তো তা-ই। এই ব্যাধি বড় ভয়ঙ্কর মরণব্যাধি। এর বিস্তার রোধ করতে হবে। কিন্তু উপায় কী আসলেই কিছু আছে? তিনি খানিক ঘুরে প্রাণতোষ বৈদ্য’র দিকে তাকিয়ে বললেন, কী হে প্রাণতোষ? তুমি কিছু বলো?

প্রাণতোষ বৈদ্য হাত জোড় করে বলল, সেইটেই ভাবছি কর্তা। এ অতি ভয়ানক ব্যাধি। তার ওপর ছোঁয়াচে। যে গাঁয়ে একবার ঢুকেছে সে গাঁ শ্মশান করে ছেড়েছে।

বিষ্ণুনারায়ণ বললেন, এর কোনো ওষুধ পত্তরও তো নেই বলে শুনেছি।

প্রাণতোষ বৈদ্য বললেন, আজ্ঞে কর্তা, চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে আমার জানাশোনা অতি সামান্য। তবে শুনেছি দেশ-বিদেশে বহু বড় বড় ডাক্তার কবিরাজও এর কোনো ওষুধপত্তর বের করতে পারেননি। তাছাড়া…।

প্রাণতোষ বৈদ্য কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই ভুজঙ্গ দেব। বললেন, ওষুধ-পত্তর? আঁ? ওষুধপত্তর? চিকিৎসা? আরে রাখো তোমার ওষুধ পত্তর, চিকিৎসা। শোনোনি, বহু অঞ্চলেই সাধু-ব্রাহ্মণরা বলছেন এ কোনো রোগ নয়, এ ভগবানের অভিশাপ? এর চিকিৎসা করতে গেলে ভগবান বরং আরো। রুষ্ট হবেন। এ হলো মনুষ্যের পাপের ফল। ভগবান পৃথিবীতেই এই শাস্তি দিয়ে যাচ্ছেন! এর আবার চিকিৎসা কী?

ভুজঙ্গ দেব রীতিমতো উত্তেজিত। তিনি খানিক থামলেন। তবে তিনি থামলেও কেউ কোনো কথা বলল না। ভুজঙ্গ দেব নিজেই আবার বললেন, চিকিৎসা, ওষুধ-পত্তর যদি কিছু থেকেও থাকে, তবে তা ওই মা শীতলার চরণে শাপমোচন। প্রতি প্রত্যুষে আর সন্ধ্যায় মা শিতলার নাম করে ঘটিভর্তি জল ছিটাতে হবে। তাতে যদি মা শীতলা দয়া করেন। শাপ আর পাপ, দুই-ই যদি তাতে কিছু কাটে।

ভুজঙ্গ দেব থামলেও অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। বিষ্ণুনারায়ণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বিভূতিনাথ সাহার দিকে তাকালেন। বিভূতিনাথ সাহা গোড়া হিন্দু মানুষ। ধর্মীয় আচার-রীতি সম্পর্কে তার অগাধ বিশ্বাস। তবে একইসঙ্গে তিনি যুক্তিবাদীও বটে। ধর্মীয় রীতি-নীতি মানলেও অনেক কিছুই তিনি তার নিজের যুক্তি-বুদ্ধি ব্যবহার করে যাচাই-বাছাই করেন। সেই মতে সিদ্ধান্ত দেন। বিভূতিনাথ শান্ত গলায় বললেন, জগতের সকল ব্যাধিই ভগবান দেন জমিদার বাবু। আবার তিনিই সারেন। তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন? সতর্ক থাকতে হবে। ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া এই ব্যাধিটি আর সকল ব্যাধির মতো নয়, এ তার চেয়েও ভয়ঙ্কর এক কালব্যাধি। এ যাতে না ছড়ায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।

ভুজঙ্গ দেব বললেন, এ কী কথা বলছেন বিভূতিবাবু? আপনার কি ধর্মনাশ হয়েছে? ব্রাহ্মণরা কী বলছে, তা আপনি শোনেননি?

বিভূতিনাথ সাহা বললেন, অকারণে অস্থির হবেন না ভুজঙ্গ বাবু। এখানে আমরা সকলে রয়েছি, আলাপ-আলোচনা হোক। তারপর একটা না একটা সিদ্ধান্ত তো হবেই।

ভুজঙ্গ দেব চুপ করে গেলেন। তবে তিনি মনে মনে ভীষণ অসন্তুষ্ট এবং ভীত হয়েই রইলেন। বিষ্ণুনারায়ণ অবনীন্দ্রনারায়ণের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, তা অবনী, তোমাকে তো কখনো কোথাও দেখা যায় না। আজ যখন এসেছ, কিছু তো বলো।

বিষ্ণুনারায়ণের কথা শুনে অবনীন্দ্রনারায়ণ যেন খানিক গুটিয়ে গেলেন। তিনি নড়েচড়ে বসলেন। কিন্তু কী বলবেন সেটিই যেন খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বীণাবালা অবশ্য তাকে শিখিয়ে দিয়েছেন কখন কী বলতে হবে। কোন কথাখানা হবে বীণাবালার দাবার চাল। যদিও বীণাবালার কথা অবনীন্দ্রনারায়ণ কিছুই বুঝতে পারেননি। বীণাবালা যে কথাখানা তাকে বলতে শিখিয়ে দিয়েছেন, সেখানা কিভাবে দাবার চাল হবে সে বিষয়েও অবনীন্দ্রনারায়ণ পরিষ্কার নন! এতে বীণাবালার লাভটাই কী হবে, তাও বুঝতে পারেননি তিনি। তারপরও গলায় কিঞ্চিৎ জোর ঢেলে অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, এ রোগ তো ছোঁয়াচে। তা নিতাই ছাড়া এ গাঁয়ে আর কারো শরীরে ওই ছেলের কোনো ছোঁয়া লাগেনি তো?

কথাটি নির্দোষভাবেই বলেছেন অবনীন্দ্রনারায়ণ। কিন্তু তার এই এইটুকু কথায় ছোট্ট এই বৈঠকঘরখানা মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ কোনো কথা বলল না। দেবেন্দ্রনারায়ণ মুহূর্তের জন্য তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অবনীন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকালেন। তার সেই দৃষ্টিতে এতকাল ধরে দেখে আসা সহজ-সরল জলের মতোন পরিষ্কার, স্বচ্ছ অবনীন্দ্রনারায়ণকে নতুন করে দেখার চেষ্টা। সেই দেখায় দেবেন্দ্রনারায়ণ কী দেখতে পেলেন, সেটি স্পষ্ট না। তবে দেবেন্দ্রনারায়ণ খেয়াল করলেন, এই মুহূর্তে ঘরের সবগুলো চোখ তার দিকে। সকলেই একটি অতি গুরুতর প্রশ্ন নিয়ে অপেক্ষা করছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ নিজ থেকেই সেই প্রশ্নের উত্তর দিলেন। তিনি বললেন, না, এই গাঁয়ে আর কারো শরীরে ওই ছেলের ছোঁয়া লাগেনি।

বিভূতিনাথ সাহা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, দেবেন্দ্রবাবু জ্ঞানী বুদ্ধিমান মানুষ। এমন ভুল তিনি করবেন না। তবে তারপরও এ এক মহা দুর্যোগের কাল। এ দুর্যোগ রাজা-প্রজা কাউকে বিচার করে না। অবনীবাবুর প্রশ্নটা তাই যথোপযুক্ত। কী বলুন জমিদার বাবু?

জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ পরিস্থিতি দেখে খানিক হকচকিয়ে গিয়েছেন। শান্ত শিষ্ট, সহজ অবনীন্দ্রনারায়ণের ওই ছোট্ট এক প্রশ্নে পরিস্থিতি এমন পাল্টে যাবে, এটি তিনি ভাবেননি। বিষ্ণুনারায়ণ শান্ত এবং গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, দেবেন্দ্র এত বড় ভুল যে করবে না, সে আমি নিশ্চিত। আর যদি কোনো কারণে করেও ফেলত, তবে সে নিজে থেকেই ওই ছোঁয়াচে ব্যাধির ছোঁয়া নিয়ে এই জমিদার বাড়িতে আর প্রবেশ করত না। এখানে সকলেই তার প্রাণাধিক প্রিয়।

অবনীন্দ্রনারায়ণ যেন এতক্ষণে তার কথার তাৎপর্য এবং প্রভাব বুঝতে পারলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, না বাবা। আমি সে কথা বলছি না। আমি বলছিলাম যে ছোঁয়াচে রোগটা যেন আর না ছড়াতে পারে।

এতক্ষণে কনিষ্ঠ জমিদারপুত্র দীপেন্দ্রনারায়ণ কথা বললেন। তিনি বললেন, মেজদা তো নিতাই আর ছেলেটাকে নৌকো করেই বারোহাটির জঙ্গলে পাঠিয়ে দিয়েছে। কোনো লোকালয়ের ভেতর দিয়েও পাঠায়নি। তাহলে আর ছড়ানোর কথা আসছে কেন?

দীপেন্দ্রনারায়ণের মাথায় দীর্ঘ চুল। তিনি সেই চুলে যত্ন করে বিশেষ এক ধরনের তেল মাখেন। এই তেল তার ভারি পছন্দ। তেলের সুবাসটি খানিক তীব্র, ঝাঁঝালো। বহুদূর থেকে এই তেল তিনি নিয়মিত খরিদ করেন। তার ধারণা, এই তেল নিদ্রা সুখকর। তবে বিভূতিনাথ সাহা এই তেলের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না। ফলে পারতপক্ষে তিনি দীপেন্দ্রনারায়ণের আশেপাশে থাকেন না। থাকলেও তার নাক সর্বদা কুঁচকে থাকে। এখনও বিভূতিনাথ সাহা নাক কুঁচকে বললেন, দীপেন্দ্র বাবুর কথা অবশ্য ঠিক। দেবেন্দ্রবাবু বিচক্ষণ মানুষ। তিনি বলেই এমন বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। তাছাড়া নিতাই আর ওই ছেলেকে অতদূরের গভীর বারোহাটির জঙ্গলে পাঠানোর সিদ্ধান্তও কিন্তু অতি সাবধানী চিন্তারই লক্ষণ।

বিষ্ণুনারায়ণ এতক্ষণে খানিক বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, এ আলোচনা থাক বিভূতিবাবু। আমরা বরং নিতাই আর ওই ছেলের ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলি।

বিভূতিনাথ সাহা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তথাস্তু।

কিন্তু দীর্ঘ আলোচনায়ও এর কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সমাধান বের হলো না। প্রাণতোষ বৈদ্য এবং দীপেন্দ্রনারায়ণ কিছু কিছু উপায়ের কথা বললেও তা ভুজঙ্গ দেব, বিভূতিনাথ সাহা এবং জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের মনে ধরল না। এই তিনজনের ভাবনায় আরো গভীর এবং বিস্তৃত কিছুর প্রত্যাশা। তারা চান ব্যবস্থাটি যেন এমন হয় যে অন্য সকল পক্ষ এই ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট এবং নিশ্চিন্ত বোধ করে। বিশেষ করে প্রজা এবং ব্রাহ্মণসমাজ।

তাদের বক্তব্য, নিতাই আর গুটিবসন্ত-আক্রান্ত ছেলেটার এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে যা দেখে বিষ্ণুপুরের প্রজারা যেন অন্তত নিশ্চিন্ত হয় যে, এই ছোঁয়াচে ভয়ঙ্কর মরণব্যাধি ছড়ানোর আর কোনো উপায় নেই। তাদের আতঙ্কিত হবার কোনো কারণ নেই। একইভাবে সেই ব্যবস্থা যেন ধর্মীয়ভাবেও প্রভাব ফেলতে পারে, এমন একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে। আলোচনার আপাতত সমাপ্তি ঘটল ভুজঙ্গ দেবের একটি প্রস্তাবে। ভুজঙ্গ দেব বললেন, জমিদারবাবু, কয়েকজন ব্রাহ্মণ থাকলে বোধ করি বিষয়টি অধিক সহজ ও গ্রহণযোগ্য হয়। তাছাড়া ঘটনাটি গুরুতরও বটে। বিলম্বে ক্ষতির আশঙ্কাও রয়েছে।

ভুজঙ্গ দেবের এই প্রস্তাব বিষ্ণুনারায়ণের পছন্দ হলো। তিনি কৌতূহলী চোখে ভুজঙ্গ দেবের দিকে তাকালেন। ভুজঙ্গ দেব বললেন, সন্ধ্যার আগেই আরেকবার বসা যেতে পারে। এরমধ্যে কয়েকজন বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ ব্রাহ্মণের উপস্থিতি যদি নিশ্চিত করা যায়, তবে ভালো হয়!

বিষ্ণুনারায়ণ এই দায়িত্ব দিলেন ভুজঙ্গ দেবকেই। তখনকার মতো বৈঠক সমাপ্ত হলো। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, আলোচনার এই পুরোটা সময়জুড়ে বিষ্ণুপুরের প্রবল পরাক্রমশালী খামখেয়ালি জমিদারপুত্র, হবু জমিদার দেবেন্দ্রনারায়ণ আর একটি কথাও বললেন না। তিনি ডুবে রইলেন গভীর চিন্তায়। বিষ্ণুপুর জমিদারির অন্দরমহলের বাতাসে-বাতাসে কী এক গোপন ফিসফিসানি যেন ভেসে বেড়াচ্ছে! দেবেন্দ্রনারায়ণ সেই ফিসফিসানি টের পাচ্ছেন। কিন্তু তার অর্থ পরিষ্কারভাবে ধরতে পারছেন না। অন্দরমহলের বাতাসে-বাতাসে ভয়ানক দুর্যোগের আভাস।

এই দুর্যোগ কালব্যাধি গুটিবসন্তের চেয়েও ভয়ঙ্কর। সর্বগ্রাসী।

*

দেবেন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী রেণুকা বসেছিলেন দোতলার বারান্দায়।

দীর্ঘাঙ্গিনী, ছিপছিপে গড়নের রেণুকার গায়ের রং দুধসাদা। তার সামনে বিশাল আয়না। আয়না ধরে আছে নতুন আসা অল্পবয়সী দাসীটি। রেণুকা এখনো এই নতুন অল্পবয়সী দাসীর নাম জানেন না। পুরনো দাসী অতসীবালা রেণুকার চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল। অন্দরে দেবেন্দ্রনারায়ণ ঘুমাচ্ছেন। তিনি খানিক ক্লান্ত, অবসন্ন।

রেণুকার সাথে দেবেন্দ্রনারায়ণের বয়সের পার্থক্য অনেক। দেবেন্দ্রনারায়ণ বিয়ে করেছিলেন খানিক বিলম্বে। জ্যেষ্ঠভ্রাতা অবনীন্দ্রনারায়ণ যেখানে কুড়ি বাইশেই কৃতদার হয়েছিলে, সেখানে দেবেন্দ্রনারায়ণ বিয়ে করেছিলেন তিরিশের অনেক পর। তাদের দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। জ্যেষ্ঠ কন্যার নাম সর্বজয়া। সর্বজয়ার বয়স বারো। কনিষ্ঠ কন্যার নাম সুদক্ষিণা। সুদক্ষিণার বয়স সাত।

সকলেই জানে, পুত্রসন্তান নিয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণের তেমন কোনো আক্ষেপ নেই। তাছাড়া তিনি অত হিসেবী, সংসারি মানুষও নন। তবে গত কিছুদিন ধরেই গঙ্গামহলের অন্দরে-অন্দরে ভেসে বেড়াচ্ছে যে দেবেন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী রেণুকা আবার গর্ভবতী। মুফতে পেতে যাওয়া জমিদারিতে নিজের উত্তরাধিকারীর চিন্তায় দেবেন্দ্রনারায়ণ তাহলে দেরিতে হলেও মনোযোগী হয়েছেন। এ কারণেই হয়তো এই বয়সে এসে তিনি আরো একবার চেষ্টা করে দেখতে চাইছেন, যদি একটি পুত্র সন্তানের ভাগ্য হয়! যদিও রেণুকাকে দেখে সে রকম কোনো লক্ষণ টের পাওয়া যাচ্ছে না।

গঙ্গামহলের সিংহ দরোজায় ঘোড়ার গাড়ি প্রবেশের শব্দে সকলেই ফিরে তাকালো। দেবেন্দ্রনারায়ণের এই অট্টালিকাখানা দক্ষিণ দিকে নদী গঙ্গাবতীমুখী সিংহ দরজার ঠিক বিপরীতে উত্তর পাশে অবস্থিত। সিংহ দরোজা পেরিয়ে গঙ্গামহলে প্রবেশ করলে বিশাল উঠোন। সোজা উঠোন পেরোলেই তার এই অট্টালিকা। উঠোনের পুরোটা একপলকেই দেখে নেয়া যায় দেবেন্দ্রনারায়ণের অট্টালিকার এই বারান্দা থেকে। আর গঙ্গামহলে প্রবেশ করতেই উঠানের বা প্রান্তের অট্টালিকাখানা বিষ্ণুনারায়ণের জ্যেষ্ঠপুত্র অবনীন্দ্রনারায়ণের, ডানদিকে পূর্বপাশের অট্টালিকাখানা ছোট দীপেন্দ্রনারায়ণের আর সিংহ দরজার গা ঘেঁষে গঙ্গাবতীর পাড়ের প্রাচীর ঘেঁষা অট্টালিকাতে থাকেন বিষ্ণুনারায়ণ নিজে।

বারান্দা থেকে নিচে রঘুকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখলেন রেণুকা। রঘুর ত্রস্ত পদক্ষেপ আর চোখমুখের বিভ্রান্ত, আতঙ্কিত দৃষ্টি এতদূর থেকেও রেণুকার চোখ এড়াল না। তিনি দাসী অতসীবালাকে বললেন রঘুকে উপরে নিয়ে আসতে। রঘু কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে রেণুকার সামনে এসে দাঁড়াল। রেণুকা শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কিরে রঘু, কী হয়েছে, তোর চোখ-মুখ অমন চিমসে হয়ে রয়েছে কেন?

রঘু জানে, হেমাঙ্গিনী দেবীর কথা এ বাড়ির সকলেই জানে। তারপরও গঙ্গামহলের কারো সামনেই হেমাঙ্গিনী দেবীর নাম উচ্চারণ করা যাবে না। এটি অঘোষিতভাবে হলেও নিষিদ্ধ। যদিও রেণুকা তার স্বামীর অবাধ ভোগ-বিলাস, উদ্ধৃঙ্খল জীবনযাপন এবং চাল-চলন সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে জ্ঞাত। কিন্তু তারপরও সেসকল বিষয়ে চাকর-বাকররা তার সঙ্গে কোনোরূপ বাক্যালাপ করে না। রঘু মিনমিনে গলায় বলল, আজ্ঞে, মেজোকর্তার সঙ্গে জরুরি দরকার।

রেণুকা বললেন, মেজোকর্তা এখন ঘুমুচ্ছেন। তুই আমাকে বল।

এই কথায় রঘু মহাবিপদে পড়ে গেল। সে এখন কী করবে? রেণুকা’র কাছে এ সকল কথা বললে দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে নিশ্চিত জ্যান্ত পুঁতে ফেলবেন। আবার এই মুহূর্তে রেণুকা’র কাছ থেকে সে কী করে ছাড়া পাবে তাও তার মাথায় ঢুকছে না। রেণুকা আবার বললেন, কী হলো রঘু, কথা কানে যাচ্ছে না?

রঘু আমতা-আমতা করে বলল, আজ্ঞে কর্তা মা। একখানা জরুরি কথা ছিল। মেজো কর্তাকে এখুনি না বলতে পারলে…।

রঘুকে বিপদ থেকে উদ্ধার করল দেবেন্দ্রনারায়ণের কনিষ্ঠ কন্যা সুদক্ষিণা। সে ঝলমলে জরির পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সুদক্ষিণা এসে রেণুকাকে বলল, মা, রঘুকে বাবা ডাকছেন, এখুনি।

রেণুকা কিছু বলার আগেই রঘু নড়ে উঠল। সুদক্ষিণা যেন তাকে বন্ধ হয়ে আসা দম ছাড়ার সুযোগ দিলো। সে যেতে যেতে বলল, যাই কর্তা মা। বিলম্বে। মেজো কর্তা রেগে যাবেন।

রেণুকা মুখে কিছু বললেন না। তবে মাথা নেড়ে সায় দিলেন। রেণুকা ততক্ষণে তাকিয়ে আছেন তার ছোট কন্যা সুদক্ষিণার দিকে। সুদক্ষিণা লম্বা বারান্দার এ-পাড় থেকে ও-পাড় অবধি গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তাকে লাগছে ঝলমলে প্রজাপতির মতোন। রেণুকা লক্ষ করলেন, সুদক্ষিণার এই হাঁটার মধ্যে কোথায় যেন একটা ছন্দ আছে। সুদক্ষিণাকে এই ঝলমলে জরির পোশাক কিনে এনে দিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনারায়ণ।

দেবেন্দ্রনারায়ণ এমনিতে যে খুব ধর্ম-কর্ম করেন, তা নয়। তবে কিছু কিছু বিষয়ে তার অন্ধ এবং গোড়া বিশ্বাস রয়েছে। রাইপুরে এক তান্ত্রিক রয়েছেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ এই তান্ত্রিকের অন্ধ ভক্ত। মাঝেমধ্যেই তিনি সেই তান্ত্রিকের সাথে দেখা করতে দু’চার দিনের জন্য রাইপুর চলে যান। সেবারও গিয়েছিলেন। রাইপুর বড় শহর। পথের ধারে লোকজনের সমাগম দেখে দেবেন্দ্রনারায়ণ তার জুড়িগাড়ি থামিয়েছিলেন। তারপর রঘুকে পাঠালেন ঘটনা দেখে আসতে। রঘু দেখে এসে জানাল যে, পথের পাশে গানের আসর বসেছে। আসরে ছোট এক মেয়ে নাচছে, আর মেয়েটার বাবা ঢোল-তবলা বাজিয়ে গান গাইছে। দেবেন্দ্রনারায়ণের হঠাৎ কি হলো, তিনি গাড়ি থেকে নেমে ভিড় ঠেলে উৎসুক সাধারণ দর্শকের ভিড়ে মিশে গেলেন। ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে দেখলেন, ঠিক এইরকম ঝলমলে জরির পোশাক পরে পুতুলের মতো ছোট্ট এক মেয়ে নাচছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ সেই নাচ দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতোন দাঁড়িয়ে রইলেন। গানের আসর শেষ হতে তিনি পিতা ও কন্যাকে ডেকে দু’হাত ভরে বকশিশ দিলেন। তারপর দিন তিনি তার দুই কন্যার জন্য জরির পোশাক কিনলেন।

বাড়ি ফিরে দেবেন্দ্রনারায়ণ তার কন্যাদের হাতে পোশাক দিয়ে বললেন, তোমাদের আমি নৃত্য-গীত শেখাবো।

দেবেন্দ্রনারায়ণের বড় কন্যা সর্বজয়া বাবার সামনে কিছু বলল না। তবে সে সেই পোশাক দেখে অগচোরে মুখ কোঁচকাল। তারপর অন্দরমহলে গিয়ে মা রেণুকাকে ঠোঁট উল্টে বলল, দেখেছ, বাবার পছন্দ? আমরা এখন এসব পরে বাঈজী সেজে নাচ গান করব?

রেণুকা নানা কারণেই তার এই বড় কন্যাকে নিয়ে চিন্তিত। এই মেয়ে কাউকে মানে না, কারো কথা শোনে না। বড় অবাধ্য। সর্বজয়াকে নিয়ে আড়ালে-আবডালে অনেকেই নানা কথা বলে। তবে সবচেয়ে বেশি যেটি বলে, তা হলো, এ হলো বাপকা বেটি। শেষ অবধি ভগবান দেবেন্দ্রনারায়ণের ঘরে আবার দেবেন্দ্রনারায়ণকেই সর্বজয়া রূপে পাঠিয়েছেন। এ কাউকে মানে না, কারো কথা শোনে না। দেবেন্দ্রনারায়ণ পুরুষ মানুষ বলে টিকে গেছেন। কিন্তু এই মেয়ের কপালে ভারী দুঃখ আছে।

সর্বজয়া শরীরে, আচারে, কথাবার্তায় বয়সের চেয়ে খানিক বেশিই বেড়ে উঠেছে। এই বারো-তেরো বছরের মেয়েকে নিয়ে রেণুকা’র চিন্তারও তাই অন্ত নেই। অবশ্য দেবেন্দ্রনারায়ণের সামনে সর্বজয়া সুবোধ বালিকা হয়েই থাকে। রেণুকা সেদিন মেয়েকে কোমল গলায় বলেছিলেন, ছিঃ মা, এভাবে বলতে নেই। উনি শখ করে এনেছেন।

সর্বজয়া মুখ ভেংচি কেটে বলেছিল, উনি শখ করে এনেছেন! শখ করে যখন এনেছেন, তুমিই পরো। এই বলে সে জরির পোশাকগুলো ছুঁড়ে দিয়েছিল বিছানায়। রেণুকা দীর্ঘক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পোশাকগুলো নিয়ে আলমারিতে তুলে রাখলেন। তবে আশার কথা, এই পোশাকের কথা দেবেন্দ্রনারায়ণ ভুলে যাবেন। রাত পোহালেই তার আর এই পোশাকের কথা মনে থাকবে না। তাছাড়া দেবেন্দ্রনারায়ণ যতই বলুন, প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে জমিদার বাড়ির মেয়েদের নাচ-গান কোনোভাবেই শোভনীয় নয়। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ যে খামখেয়ালি মানুষ, তিনি হয়তো এসকল নিয়ম-নীতি, রীতি-প্রথার ধার ধারবেন না। বাস্তবে এই ধারণা যতই প্রতিষ্ঠিত থাকুক যে, ভদ্রঘরের মেয়েরা নাচ-গান করে না, তারপরেও সকলেই জানেন যে, দেবেন্দ্রনারায়ণের ইচ্ছে হলে তিনি এসকল কিছুই মানবেন না।

রেণুকা ভেবেছিলেন দেবেন্দ্রনারায়ণ দিন যেতেই এসব তুচ্ছ বিষয় ভুলে যাবেন। ভুলে গেলেনও। বিনা ঝাটে সপ্তাহখানেক কেটেও গেলে। কিন্তু দিন দশেক বাদে এক বিকেলে দেবেন্দ্রনারায়ণ এলোমেলো চুলের এক ছেলেকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। ছেলের নাম রতনকান্তি দাস। দেবেন্দ্রনারায়ণ রেণুকাকে ডেকে বললেন, এ সর্বজয়া আর সুদক্ষিণার গানের শিক্ষক। আজ থেকে এ তাদের গান শেখাবে। গানের তালিম শেষ হলে এদের জন্য নৃত্যের শিক্ষক রাখা হবে।

রেণুকার মনে হচ্ছিল তিনি স্বামীকে সর্বজয়ার অনিচ্ছার কথা বলেন। কিন্তু তিনি এই ভেবে নিরস্ত রইলেন যে দেবেন্দ্রনারায়ণ তার নিজের সিদ্ধান্তের বাইরে আর কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। শুধু তাই-ই না, তিনি অন্য কারো কথা শুনতেও পছন্দ করেন না। সুতরাং আর কিছু বলে লাভ নেই।

রতনকান্তি সেই থেকে সর্বজয়া আর সুদক্ষিণাকে ছাদের ঘরে গান শেখায়। যদিও সর্বজয়া প্রথম ক’দিন গিয়ে আর যায়নি। প্রথম কদিন গিয়েই রতনকান্তি সম্পর্কে তার নানা বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা হয়েছে। সর্বজয়ার ধারণা রতনকান্তি গানের কিছুই জানে না। সে এমনিতেই দরিদ্র যুবক। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই রতনকান্তির। সে এখানে-সেখানে পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়াত। বেসুরো গলায় গান গেয়ে দু’টো রোজগার করত। তাতে কোনোদিন তার এক আধবেলা আহার জুটে যেত, কোনোদিন হয়তো জুটতোও না।

সেই রতনকান্তির বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়িতে চাকরি পাওয়া বিশাল ব্যাপার। জমিদার বাড়িতে শিক্ষক নিয়োগ দিলে সেই শিক্ষকের বর্ণাঢ্য অতীত এবং অভিজ্ঞতা থাকা আবশ্যক। কিন্তু রতনকান্তির সেসব কিছুই নেই। দেবেন্দ্রনারায়ণ পশ্চিম তল্লাট দর্শনে গিয়েছিলেন। সেখানে পথের ধারে রতনকান্তির গান শুনে তিনি অতিশয় মুগ্ধ হয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে তার কন্যাদের গানের শিক্ষক করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। সর্বজয়ার ধারণা, তার পিতা নিজেকে যতই বুদ্ধিমান ভাবুক, তিনি আসলে বোকা। কিন্তু তার রাগী আর একগুঁয়ে স্বভাবের কারণে আশেপাশের সকলেই তাকে ভয় পায়।

রতনকান্তি যে গানের কিছু জানে না, সর্বজয়া তা তার মুখের উপর বারকয়েক বলেছেও। রতনকান্তি অবশ্য এসবে কিছু মনে করে না। সে গম্ভীর ও বিষণ্ণ মুখে গান শেখায়। তার দৃষ্টি থাকে অবনত। আশেপাশে আর কোনোদিকে সে তাকায় না। গান শেখানো শেষ হলে সে চলে যায়। সর্বজয়া গান না শিখলেও সুদক্ষিণা আগ্রহ নিয়ে গান শেখে। দেবেন্দ্রনারায়ণ অবশ্য মাসখানেক বাদে রেণুকাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন সর্বজয়া আর সুদক্ষিণার গান শেখার অগ্রগতির বিষয়ে। রেণুকা সুদক্ষিণার কথা আগ্রহ নিয়ে বললেও সর্বজয়ার কথা বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ অবশ্য অতকিছু খেয়াল করেননি। তিনি ব্যস্ত মানুষ। অতকিছু খেয়াল করার সময় তার কই!

.

রেণুকা বারান্দায় আপন মনে হাঁটতে থাকা সুদক্ষিণার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তার এই মেয়ে হয়েছে পরীর মতোন সুন্দর। তিনি নিজে কি সুদক্ষিণার বয়সে এত সুন্দর ছিলেন! তার হঠাৎ মনে হলো সুদক্ষিণা অবিকল তার মতো হয়েছে। সাত-আট বছর বয়সে তিনি একদম তার সামনে গুটগুট করে হেঁটে যাওয়া ওই ছোট্ট বালিকাটির মতোই ছিলেন। এতদিনে সুদক্ষিণার সাথে তার এই অদ্ভুত মিলের বিষয়টি কেন তার চোখে পড়েনি, এই ভেবে তিনি খানিক অবাক হলেন। তিনি অপলক দৃষ্টিতে সুদক্ষিণার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

.

রঘু দেবেন্দ্রনারায়ণের সামনে দাঁড়িয়ে রীতিমতো কাঁপছে।

দেবেন্দ্রনারায়ণ ঘটনা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, নায়েব মশাই ফিরেছেন?

রঘু কাঁপা গলায় বলল, আজ্ঞে কর্তা, ফিরেছেন।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, নায়েব মশাইকে খবর দে। বল এখুনি আসতে।

রঘু ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে আবার ডাকলেন, আর শোন। তুই এখুনই আবার বারোহাটি যা। যত দ্রুত সম্ভব বারোহাটিতে পৌঁছাতে হবে। অপলাকে বলবি হরিহরণ বন্নিককে খবর দিয়ে আনাতে। তারপর হরিহরণ বন্নিকের সাথে আরো দু’জন পেয়াদা নিয়ে বাগানবাড়ি ছাড়িয়ে সোজা জঙ্গলে ঢুকে যাবি। মশাল জ্বালিয়ে নিস বেশি করে। যদিও আজকাল আর বাঘের উপদ্রব খুব একটা নেই, তারপরও সাবধান থাকা ভালো।

রঘু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণের কথা না বুঝতে পেরে সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর নিচু গলায় বলল, আজ্ঞে কর্তা?

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, ভোরে জগাইকে দিয়ে নদীপথে নিতাই আর সেই ছেলেকে বারোহাটির জঙ্গলে পাঠিয়েছি। জানিসই তো ও রোগ বড় ছোঁয়াচে। ওদের কী করা হবে সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তাই সিদ্ধান্ত হবার আগ পর্যন্ত ওদের থাকার ব্যবস্থা হবে বারোহাটির জঙ্গলের ভেতরে। ওখানে একখানা পুরনো ভাঙা বাড়ি রয়েছে। বহুকাল আগের বাড়ি। হরিহরণ বন্নিকের এককালে খুব যাতায়াত ছিল ওদিকে। চোখ বেঁধে দিলেও সে চিনে নিয়ে যেতে পারবে তোদের।

দেবেন্দ্রনারায়ণ একটু থেমে আবার বললেন, বারোহাটির বাগানবাড়ি ছাড়িয়ে সোজা জঙ্গলের ভেতর ক্রোশ দুই তিন হাঁটলে গঙ্গাবতী যেখানে জঙ্গলে এসে পড়েছে, সেখানে জগাই ওদের নিয়ে নৌকোয় থাকবে। তোরা সেখান থেকে নিতাই আর ওই ছেলেকে নিয়ে জঙ্গলের ভেতর বাড়িটাতে রেখে আসবি।

রঘু বলল, সেখানে ওদের বাঘে খাবে না কর্তা?

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, বাঘ আবার কোত্থেকে এলো? শেষ কবে। বারোহাটির জঙ্গলে বাঘ দেখেছিস, বল দেখি! ওই শুনে শুনে সকলেই বারোহাটির জঙ্গলকে এক বাঘের আবাস বানিয়ে ছেড়েছে! আর শোন, বাঘ থাকলে ও বাড়িতে বাঘের ভয় নেই। বাঘ ওখানে কস্মিনকালেও ঢুকতে পারবে না। ভয় যদি কিছুর থেকেও থাকে তো সে মশা আর সাপ-খোপের। যে ঘরে। ওদের রাখবি, সে ঘরখানা পরিষ্কার করে দিয়ে আসিস। খাবার-দাবারও দিয়ে রাখিস কয়েকদিনের। কয়েকখানা মশাল রেখে আসবি আর বেশি করে ধূপ। জ্বালিয়ে দিস। ধূপের ধোঁয়ায় মশার বেশ অসুবিধে হয়।

রঘু এই মানুষটাকে যত দেখে ততই অবাক হয়। তার সামনের এই মানুষটাকে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এই তাকে মনে হয় জগতের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর মানুষ, আবার মুহূর্তেই মনে হয় তার ঠিক উল্টো।

রঘু বলল, আজ্ঞে কর্তা, জঙ্গলে গঙ্গাবতীর পাড় থেকে ওই বাড়ি অবধি নিতাই না হয় হেঁটেই গেল, কিন্তু ওই ছেলে, ও কিভাবে যাবে? কেউই তো ওকে ছুঁতে চাইবে না কর্তা? . দেবেন্দ্রনারায়ণ সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলেন না। এই বিষয়টা তিনি ভেবে দেখেননি। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। তারপর বললেন, একটা ঘোড়া নিয়ে যাস। নিতাইকে দিয়ে ছেলেটাকে ঘোড়ার পিঠে তুলিয়ে নিস। তারপর ঘোড়ার সামনে সামনে নিতাইকে লাগাম ধরিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাস।

রঘু মাথা নুইয়ে চলে যাচ্ছিল। দেবেন্দ্রনারায়ণ রঘুকে আবার ডাকলেন। রঘু দরোজার কাছে মাথা নিচু করে দাঁড়াতেই দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, এদিকে আয় রঘু।

রঘু খানিকটা ভীত এবং অবাক চোখে দেবেন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকাল। তারপর ধীর পায়ে দেবেন্দ্রনারায়ণের কাছে এসে দাঁড়াল। দেবেন্দ্রনারায়ণ নিচু গলায় বললেন, খবরদার, ওই ছেলের মুখ যেন কেউ না দেখে। তাহলে তার বিরাট সর্বনাশ হয়ে যাবে। গুটিবসন্তে তার বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে।

রঘু বিহ্বল চোখে দেবেন্দ্রনারায়ণের দিকে চাইল। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, বারোহাটির জঙ্গলে ওই ছেলেকে নৌকা থেকে নামানোর আগে নিতাইকে বলবি ওর মুখ ভালো করে ঢেকে দিতে। সাবধান, কেউ যেন ওর মুখ দেখতে না পায়। খুব সাবধান।

রঘু প্রচণ্ড ভীত সন্ত্রস্ত গলায় বলল, আজ্ঞে কর্তা। কেউ দেখবে না।

দেবেন্দ্রনারায়ণ শীতল এবং কঠিন গলায় বললেন, একমাত্র নিতাই ছাড়া আর কেউ না।

.

রঘু চলে যেতেই দেবেন্দ্রনারায়ণ রেণুকাকে ডাকলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, তোমার শরীর কেমন?

রেণুকা বিস্মিত গলায় বললেন, আমার শরীরের আবার কি হয়েছে?

দেবেন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ শীতল গলায় বললেন, আমার সঙ্গে চালাকি করবে রেণুকা। আমি চালাকি পছন্দ করি না।

দেবেন্দ্রনারায়ণের এই গলা রেণুকা চেনেন। তিনি তীব্র আতঙ্ক নিয়ে সিংহের পায়ের ছাপ খোদিত পালঙ্কের পায়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, তোমার গর্ভে সন্তান এসেছে এ কথা তুমি আমায় কেন জানাওনি?

রেণুকা কাঁপা গলায় বললেন, ভয়ে। আপনি তো আর কোনো সন্তান চান না। কিন্তু আমার একটি পুত্র সন্তানের বড় শখ।

দেবেন্দ্রনারায়ণ আবার শান্ত এবং স্বাভাবিক গলায় বললেন, আমি কেন সন্তান চাই না, সে বিষয়ে তুমি জানো রেণুকা। জানো না?

রেণুকা মৃদু কণ্ঠে জবাব দিলেন, জ্বি, জানি।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, আমি তোমাকে শতবার বলেছি, কিছু বিষয়ে আমার বিশ্বাস অন্ধ। রাইপুরের যে তান্ত্রিকের কাছে আমি যাই, সেই তান্ত্রিক গুরুজী কিছু কিছু ভবিষ্যৎ দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পান। গুরুজী আমায় স্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে আমার পরবর্তী সন্তান হবে অন্ধ। তুমিই বলো রেণুকা, জগতের কোনো পিতাই কি জেনে শুনে কোনো অন্ধ সন্তানকে জন্ম দিতে চাইবে?

রেণুকা এই কথার কোনো জবাব দিলেন না। চুপ করে বসে রইলেন। তার বুক ফেটে কান্না আসছে। কিন্তু এই মুহূর্তে দেবেন্দ্রনারায়ণের সামনে কান্নাকাটির চেয়ে ভয়াবহ কিছু হতে পারে না। দেবেন্দ্রনারায়ণ কান্নাকাটি পছন্দ করেন না।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, রাইপুর থেকে আমি তোমার জন্য ওষুধও এনেছি। প্রতিবার তোমার সাথে রাত্রিযাপন শেষে, সেই ওষুধ আমি নিজ হাতে তোমায় খাইয়ে দিই, যাতে তোমার গর্ভধারণ না হয়।

দেবেন্দ্রনারায়ণ একটু থামলেন। তিনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন রেণুকার অবনত, ভীত, কম্পমান মুখের দিকে। তারপর ভয়ংকর শীতল গলায় বললেন, অথচ শেষবার তোমার সাথে রাত্রিযাপন শেষে সেই ওষুধ তুমি খাওনি। তুমি আমায় বললে, তুমি নিজে নিজেই খেয়ে নেবে। কিন্তু তুমি আমার সাথে মিথ্যে বলেছ রেণুকা। ওই ওষুধ না খেয়ে তুমি আমার অগোচরে গর্ভধারণ করেছ। তুমি কি জানো, তুমি ক্ষমার অযোগ্য অন্যায় করেছ?

দেবেন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন। একদম চুপ। তারপর খুব সহজ এবং স্বাভাবিক গলায় রেণুকাকে ডাকলেন, রেণুকা, কাছে আসো।

কিন্তু সেই সহজ আর স্বাভাবিক গলা শুনে প্রবল আতঙ্কে রেণুকার সারা। শরীর কেঁপে উঠল। তিনি যেন অনেক চেষ্টা করেও দেবেন্দ্রনারায়ণের কাছে। আর এতটুকু সরে আসার শক্তি পেলেন না। দেবেন্দ্রনারায়ণ আগের মতোই সহজ এবং স্বাভাবিক গলায় বললেন, তোমার এই অন্যায়ের শাস্তি কী রেণুকা?

রেণুকা হঠাৎ দেবেন্দ্রনারায়ণের প্রসারিত পদযুগলের উপর লুটিয়ে পড়লেন। তারপর ডুকরে কাঁদতে লাগলেন, আমায় ক্ষমা করুন। আমায় ক্ষমা করুন। আমি অন্যায় করেছি, আমায় ক্ষমা করুন।

দেবেন্দ্রনারায়ণ পাথরের মূর্তির মতোন শীতল এবং নিষ্কম্প চোখে তাকিয়ে রইলেন ছাদের দিকে। একবারের জন্যও তিনি রেণুকার দিকে ফিরে তাকালেন না। এই সময়ে ঘরের দরজার বাইরে দাসী অতসীবালার গলা শোনা গেল, কর্তা মা, নায়েব মশাই নিচের ঘরে এসেছেন। কর্তাবাবু ডেকেছেন বলে বলছেন।

রেণুকা খুব ধীরে দেবেন্দ্রনারায়ণের পদযুগল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ সঙ্গে সঙ্গেই উঠলেন না। তিনি দীর্ঘসময় একই দৃষ্টিতে শূন্যে তাকিয়ে শুয়ে রইলেন। তারপর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বিছানা থেকে নামলেন। কিছুক্ষণ পরেই বিষ্ণুনারায়ণের ঘরে আবার জরুরি বৈঠক। তার আগে নায়েব মশাইয়ের সাথে অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটা সেরে নিতে হবে। দেবেন্দ্রনারায়ণ বাইরের বেরোবার পোশাক পরলেন। সময় নিয়ে জুতো। পরলেন। মাথায় চিরুনি বোলালেন। তারপর ঘর থেকে বের হতে যাওয়ার আগে দাসী অতসীবালাকে ডেকে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, নতুন ওই অল্পবয়সি মেয়েটি কে রে?

অতসীবালা মাথা নিচু করে জবাব দিলো, কর্তা মা’র নতুন দাসী কর্তাবাবু।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, কী নাম?

অতসীবালা বলল, তপতী।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, আচ্ছা, তুই যা।

অতসীবালা চলে যেতে দেবেন্দ্রনারায়ণ কিছুক্ষণ নিশ্ৰুপ দাঁড়িয়ে রইলেন। স্থির। তারপর ধীর পায়ে রেণুকার কাছে এলেন। আলতো ছোঁয়ায় রেণুকার। মাথার চুলে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন, ওই ওষুধ প্রস্তুত রেখো। আজ রাতে তুমি এই ঘরে তোমার নতুন দাসী তপতীকে নিজ হাতে ওই ওষুধ খাওয়াবে।

রেণুকা প্রথমে যেন কিছুই বুঝতে পারলেন না। তার মুহূর্তকাল সময় লাগল। দেবেন্দ্রনারায়ণের এই কথার ভাবার্থ বুঝতে। যখন বুঝতে পারলেন, রেণুকা কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে দেবেন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। দেবেন্দ্রনারায়ণের পায়ে মাথা চেপে ধরে ডুকরে কাঁদতে লাগলেন রেণুকা। সেই কান্নার শব্দের ভেতর থেকেই তিনি হাউমাউ করে বলতে লাগলেন, আমি অন্যায় করেছি, মহা অন্যায়। আপনি আমায় আর কোনো শাস্তি দিন। আর কোনো শাস্তি দিন। ওদের কাছে আমায় এত ছোট করবেন না।

দেবেন্দ্রনারায়ণ রেণুকার কথা শুনলেন বলে মনে হলো না। তিনি স্থির এবং শান্ত গলায় বললেন, তুমি নিজ হাতে তপতীকে সাজিয়ে রাখবে। যত্ন করে সাজাবে। তপতীর চেহারা ভালো। যত্ন করে সাজালে তাকে তোমার চেয়ে কিছু কম সুন্দরী দেখাবে না। আজ আমি তোমার এই নতুন দাসীর সঙ্গে রাত্রিযাপন করব। এই পালঙ্কও সাজাবে। পুস্পসজ্জা।

দেবেন্দ্রনারায়ণ খানিক থেমেই আবার বললেন, আর আমি যখন তপতীর সাথে রাত্রিযাপন করব, তখন পুরোটা সময় তুমি এই পালঙ্কের পাশে বসে থাকবে। সারারাত বসে থাকবে। আমাদের সঙ্গম শেষে তুমি নিজ হাতে

তপতীকে ওই ওষুধ খাইয়ে দিবে। এই তোমার শাস্তি।

রেণুকা হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন। তার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না, জগতে কেউ কাউকে এতবড় শাস্তি দিতে পারে! এমন ভয়ানক শাস্তি! রেণুকার মনে হচ্ছে, তিনি তীব্র ভয়ের কোনো ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু এই দুঃস্বপ্ন মাঝপথে ভাঙবে না। বিমূঢ় রেণুকা অবিশ্বাস্য আতঙ্ক নিয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তবে এবার আর কাঁদলেন না তিনি, বরং তার কান্নারা যেন মুহূর্তেই থমকে গেল। জগতের সকল অবিশ্বাস, সকল অসহায়ত্ব তার চোখে। দেবেন্দ্রনারায়ণ তার সেই চোখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, অবশ্য তুমি চাইলে নাও খাওয়াতে পারো রেণু। সেক্ষেত্রে তোমার দাসী তপতীর গর্ভেও জন্ম নিতে পারে বিষ্ণুপুরের হবু জমিদার দেবেন্দ্রনারায়ণের আরেক সন্তান!

দেবেন্দ্রনারায়ণ সামান্য থামলেন। তারপর আবার বললেন, জমিদারপত্নীর গর্ভে অন্ধ সন্তান জন্মের চেয়ে, জমিদার পত্নীর দাসীর গর্ভে অন্ধ সন্তানের জন্ম অধিক দৃষ্টিগ্রাহ্য। কী বলো রেণুকা? ঠিক বলেছি কিনা?

দেবেন্দ্রনারায়ণ রেণুকার উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। তিনি দ্রুত পায়ে কক্ষ ত্যাগ করলেন।

.

নায়েব গোপীনাথ সরকার বসে আছে নিচতলার ঘরে।

তার পরনের ধবধবে সাদা ধুতিখানা কাদা জলে ময়লা হয়ে আছে। দেবেন্দ্রনারায়ণকে দেখে গোপীনাথ সরকার উঠে দাঁড়াল। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, ভোর থেকে জরুরি আলাপ চলছে দক্ষিণের বৈঠক ঘরে, আপনার খোঁজও হয়েছিল। নিতাই আর ওই ছেলের ঘটনা তো শুনেছেন?

গোপীনাথ সরকার বলল, আজ্ঞে, বড় কর্তা জরুরি তলব করেছিলেন। সব বলেছেন। গঙ্গামহলে পা দিয়ে উনার সাথে দেখা করেই এলাম।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, বারোহাটির বিষয়ে কিছু বলেননি?

গোপীনাথ সরকার বলল, বড়কর্তা বারোহাটি নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেননি।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, হিসেব-নিকেশের কথাও না?

গোপীনাথ সরকার বলল, না, আজ তাও জিজ্ঞেস করলেন না। আমি হিসেব-নিকেশের কথা বলতে গেলাম, কর্তা বললেন আজ থাক। অন্যদিন দিও। গোপীনাথ সরকার খানিক থেমে আবার বলল, এই একদিনেই কেমন অসুস্থ আর অস্থির লাগল। কী সব বিষয় নিয়ে বেশ চিন্তিত।

দেবেন্দ্রনারায়ণ কোনো কথা বললেন না। কী যেন ভাবলেন। তারপর খানিকবাদে শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, আমিও চিন্তিত নায়েব মশাই। অনেক বিষয় নিয়ে চিন্তিত।

গোপীনাথ সরকার এই কথার কোনো জবাব দিলো না। দেবেন্দ্রনারায়ণই আবার বললেন, তারপর নায়েব মশাই? বারোহাটির ঘটনা বলুন।

গোপীনাথ সরকার বলল, আজ্ঞে, কী যে বলব! রঘুর কাছে তো সকলই শুনেছেন। ঘরের দরজা, জানালা সব বন্ধ। রঘু কতবার যে ডাকল! কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ নেই। শেষ অবধি দরজা ভাঙতে সনাতন মিস্ত্রিকে ডাকা হলো। ভেতরে ঢুকে দেখি কেউ নেই। কেউ না! জলজ্যান্ত মানুষটা নেই! নেই মানে নেই-ই। একেবারে ভোজবাজির মতো উধাও!

এই কথা রঘুর কাছেও শুনেছেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। ঘটনা শুনে তার হতভম্ব হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কেন তিনি তেমন অবাক হলেন না, তা নিজেও ভেবে পেলেন না দেবেন্দ্রনারায়ণ। অবশ্য এটা হতে পারে যে, তিনি মনে মনে ধরেই নিয়েছিলেন বারোহাটিতে হেমাঙ্গিনী দেবীর খারাপ কিছু ঘটেছে এবং তিনি খারাপ কোনো খবর শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। হতে পারে, এ জন্যই তিনি ততটা অবাক হননি। কিন্তু ঘটনা যা শুনেছেন তাতে সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, আপনার কী মনে হয়, কী ঘটেছে?

গোপীনাথ সরকার বললেন, আমার মাথায় কিছু ধরছে না। পেছনের জানালাগুলোও দেখেছি। ও জানালার শিক গলে যাওয়া অসম্ভব।

দেবেন্দ্রনারায়ণ কোনো কথা বললেন না। তিনি চুপ করে আছেন। ঘটনা প্রথম শুনে তিনি ততটা বিচলিত হননি। অবচেতনভাবেই ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে বিষয়টি নিয়ে তিনি ততই চিন্তিত হয়ে পড়ছেন এবং এই চিন্তার কোনো তল পাচ্ছেন না। আজ দিনটিই যেন একটি দীর্ঘ ক্লান্তিকর দিন। এর যেন আর শেষ নেই। গোপীনাথ সরকারের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেও দেবেন্দ্রনারায়ণ হেমাঙ্গিনী দেবীর উধাও রহস্যের কোনো কূল-কিনারা করতে পারলেন না। প্রবল অস্বস্তিকর এক অনুভূতি নিয়ে তিনি বিষ্ণুনারায়ণের অট্টালিকায় গেলেন।

.

দেবেন্দ্রনারায়ণের কেন যেন মনে হচ্ছে আজকের এই বৈঠক হবে তার জন্য একটি বড়সড় অগ্নিপরীক্ষার বৈঠক। কিন্তু এই অগ্নিপরীক্ষার পাঠ্যসূচি সম্পর্কে তার আগাম কোনো ধারণাই নেই। তবে খেয়ালি দেবেন্দ্রনারায়ণের অগোচরে কোন গভীর ষড়যন্ত্রের ধুম্রজাল যে গঙ্গামহলের অন্দরমহলে দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে পাকিয়ে উঠেছে তা দেবেন্দ্রনারায়ণের ভাবনায়ও ছিল না। তিনি তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা অবনীন্দ্রনারায়ণকে ভালো করেই চেনেন। ফলে এই ভাবনা তার দূরতম কল্পনাতেও আসার কোনো কারণ ছিল না। তবে আজ ভোরে একটি স্পষ্ট আভাসই দেবেন্দ্রনারায়ণ পেয়েছেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ এখন পরিষ্কারভাবে এটি জানেন, আজকের এই বৈঠক যে শুধুমাত্রই গুটিবসন্তের ঘটনার কারণে তা নয়, বরং তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, এর কোথাও না কোথাও লুকিয়ে রয়েছে আরো গুরুতর অন্য কোনো ঘটনা, অন্য কোনো উদ্দেশ্য। তিনি ধরতে পারছেন না এমন গভীর কোনো চাল। আজকের এই বৈঠকের প্রতিটি মুহূর্ত তাই অতি গুরুত্বপূর্ণ দেবেন্দ্রনারায়ণের জন্য। সদা সতর্ক, ক্ষুরধার মস্তিস্কের স্থির মানসিকতা দেবেন্দ্রনারায়ণের খুব দরকার আজ। কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবীর উধাও ঘটনা দেবেন্দ্রনারায়ণের মনকে অস্থির করে তুলেছে। তিনি এই রহস্যের কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছেন না। যতই ভাবছেন, ততই ডুবে যাচ্ছেন গভীর অতলে। এই রহস্যের যেন কোনো শেষ নেই। ভেতরে ভেতরে প্রবল অস্থিরতায় দিশেহারা হয়ে আছেন তিনি। তিনি জানেন, আজ স্থির হওয়াটা তার জন্য কতটা জরুরি! কিন্তু তিনি কোনোভাবেই নিজেকে স্থির করতে পারছেন না। বরং ক্রমশই ডুবে যাচ্ছেন। এই মুহূর্তে স্থির হতে তার সবচেয়ে বেশি যাকে দরকার সে হেমাঙ্গিনী দেবী। অথচ সে-ই তৈরি করে গেছে সবচেয়ে বড় অস্থিরতা, সবচেয়ে বড় রহস্য। এই রহস্যের কোনো সমাধান জানা নেই দেবেন্দ্রনারায়ণের। চিরকুটের ওই লেখার পরিষ্কার ব্যখ্যা যদি এই জগতে তাকে কেউ দিতে পারে তবে তা একমাত্র হেমাঙ্গিনী দেবীই।

কিন্তু কোথায় সে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *