৪. সাঁৎ পিয়েরের গির্জে

৪. সাঁৎ পিয়েরের গির্জে

এদিকে যত দিন যাচ্ছে, মাস্টার জাকারিয়ুসও ততই দেহে ও মনে অবসন্ন হয়ে পড়তে লাগলেন। তবু অস্বাভাবিকরকম উত্তেজিতভাবে তিনি প্রত্যেক দিন প্রচণ্ড উৎসাহে কাজে হাত দেন–কে যেন তাকে বাধ্য করে কাজ করার জন্য, তার ফলে তার কন্যা কিছুতেই তাঁকে এই কাজ থেকে বিরত করতে পারে না।

সেই অদ্ভুত আগন্তুকটি তাকে ভুলিয়ে অন্যায়ভাবে একেবারে সংকটের মাঝখানে নিয়ে হাজির করেছিলো; কিন্তু সেই জন্যই তিনি যেন জেদ করে আরো বেশি দাম্ভিক হয়ে উঠেছেন, যেন স্থির করেছেন তার অসাধারণ প্রতিভার দ্বারা তিনি সমস্ত অন্যায় অপবাদ কাটিয়ে উঠবেন। জেনিভা নগরীর যে-সব ঘড়ি তার তত্ত্বাবধানে ছিলো, প্রথমে তিনি সেগুলিকে গিয়ে মেরামত করলেন! চাকাগুলি যে ভালো আছে, কীলকগুলি যে শক্ত ও সুদৃঢ় এবং ভারের সমতা যে এক চুলও নষ্ট হয়নি–তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করে এ-বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ হলেন। প্রত্যেকটি কলকজা, এমনকী ঘণ্টাগুলি পর্যন্ত, তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখলেন–ঠিক যেমনভাবে কোনো ডাক্তার রোগীর বুক পরীক্ষা করে। ঘড়িগুলি যে কেন বিকল হয়ে পড়ছে তার কারণ কিন্তু তবু কিছুতেই আবিষ্কার করা গেলো না, হাজার চেষ্টাতেও না।

তিনি শহরের ঘড়িগুলো মেরামত করতে বেরুতেন, তার মেয়ে আর ওবের তখন প্রায়ই তার সঙ্গে যেতো। তারা যে আগ্রহভরে তার সঙ্গে যেতে চাচ্ছে, এতে যে তিনি খুশি হতেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যদি তিনি জানতেন যে তার প্রিয়জনের জন্যই তার জীবন দীর্ঘায়িত হচ্ছে, যদি তিনি জীবনের এই সত্যটা আবিষ্কার করতে পারতেন যে, পিতার কিছু অংশ তার সন্তানের মধ্যে চিরকালের মতো থেকে যায়, তাহলে হয়তো তার আয়ু যে শেষ হয়ে আসছে, এই চিন্তায় তিনি এমনভাবে মগ্ন ও তম্ময় হয়ে পড়তেন না।

বাড়ি ফিরে এসে বৃদ্ধ ঘড়িনির্মাতা যেন কেমন একটা জ্বরাতুরভাবে আবার উঠে-পড়ে তার কাজে লাগতেন। তাঁর যে সাফল্যলাভের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই, এটা যদিও তাকে অনেকবার বোঝাবার চেষ্টা করা হলো, তবু তিনি এ-ব্যাপারটা যে সম্ভব তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইতেন না। অবিশ্রান্তভাবে ঘড়িগুলির কলকজা খুলে দ্যাখেন তিনি, তারপর এক-এক করে আবার সব জোড়া লাগান, পরাজয় অনিবার্য জেনেও কিছুতেই হাল ছাড়েন না।

সমস্ত গণ্ডগোলের মূল কারণটা খুঁজে বের করার জন্য ওবের কেবল নিজেকেই কষ্ট ও যন্ত্রণা দেয়–কিন্তু কোনো ফল হয় না। নিশ্চয়ই কীলক আর চাকার দাঁতগুলি কোনো কারণে খয়ে যায় তাই

তুমি আমাকে তিলেতিলে কষ্ট দিয়ে মারতে চাও? অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন মাস্টার জাকারিয়ুস। এই ঘড়িগুলো কি ছেলেখেলা মাত্র? ছোটোদের খেলনা? লেদ-এ চাপিয়ে এই তামার পাতগুলি দিয়ে কাজ করতে গিয়ে আঙুলে আঘাত লাগেনি আমার? যাতে তারা আরো শক্তি পায় এই জন্য আমি কি নিজের হাতে আগুনে গালিয়ে গড়ে-পিঠে এই তামার টুকরোগুলো তৈরি করিনি? এই স্প্রিংগুলি কি উৎকর্ষের পরাকাষ্ঠা নয়? আমার চেয়ে পালা তেল কি আর-কেউ ব্যবহার করতে পারতো? তা যে অসম্ভব তা তুমি নিজেই জানো-ফলে তোমাকে এটা বলতেই হবে যে, এগুলিকে নিশ্চয়ই শনিতে কিংবা শয়তানে পেয়েছে।

সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত একের পর এক রুষ্ট ক্রেতারা এসে বাড়িতে চড়াও হয়–জাকারিয়ুসের সঙ্গে দেখা না-করে ফেরে না কেউ–আর সবাই মিলে এমন হৈ-চৈ করে যে, কার কথায় যে কান দেবেন জাকারিয়ুস তা ভেবেই পান না।

কেবলই পিছিয়ে পড়ে আমার ঘড়িটা-হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও কিছুতেই ঠিক সময় দেয় না, কেউ অভিযোগ করে।

কেউ-বা বলে, এই ঘড়িটা এত একগুঁয়ে যে এক চুলও নড়ে না–জোশুয়ার সূর্যের মতো নিশ্চল কেবল দাঁড়িয়েই থাকে।

আর এ-কথা যদি সত্যি হয় যে, অনেকেই এ-কথা বলে যায়, আপনার ঘড়িগুলিতে আপনার স্বাস্থ্যের প্রভাব পড়ে, তাহলে দয়া করে যত শিগগির সম্ভব সেরে-ওঠার চেষ্টা করুন।

জাকারিয়ুস শুধু উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তাদের দিকে, আর কেবলই মাথা নাড়েন, নয়তো বিষণ্ণভাবে বলে ওঠেন : বসন্তকাল আসুক–অন্তত ততদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। বসন্তকালে তো জীর্ণ ও জরাগ্রস্তও নতুন করে প্রাণ পেয়ে যায় যেন। সূর্য চাই আমাদের, যাতে ঠাণ্ডা রক্তও গরম হয়ে ওঠে।

বাঃ চমৎকার! সারা শীতকাল ধরে ঘড়িটা যদি রোগে ভোগে, তাহলেই হয়েছে; রেগে বলে ওঠে কেউ-কেউ। আধারের উপরে যে আপনার নামটা স্পষ্ট করে লেখা আছে, তা কি আপনি ভুলে গেছেন, মাস্টার জাকারিয়ুস? ঈশ্বরের দোহাই, নিজের স্বাক্ষরের মর্যাদা রাখার জন্য একটু চেষ্টা করুন।

শেষকালে এমন হয়ে উঠলো, লোকের তিরস্কার আর সহ্য করতে–পেরে এই বৃদ্ধ ঘড়িনির্মাতা পুরোনো সিন্দুক থেকে স্বর্ণমুদ্রা বের করে এক-এক করে সবগুলি বিকল ঘড়িই আবার কিনে নিতে লাগলেন। এ-কথা শুনে ক্রেতারা দল বেঁধে আসতে লাগলো, আর জলের মতো বেরিয়ে যেতে থাকলো তার সব টাকা। কিন্তু তার সততায় একটিও আঁচড় পড়লো না। জেরাঁদ কিন্তু সাগ্রহে তার এই সম্মানবোধের প্রশংসা করলে–অথচ এই জন্য ক্রমে তার সর্বস্বান্ত হয়ে যাবার জোগাড় হলো; শেষকালে ওবের নিজের জমানো টাকাও তার গুরুদেবকে নিবেদন করতে চাইলো।

পিতৃস্নেহের এই ভরাডুবির মধ্যেও মাঝে-মাঝে কাঠকুটো আঁকড়ে ধরতে চান জাকারিয়ুস, শেষকালে আমার মেয়ের কী হবে?

সাহস সঞ্চয় করে ওবের কিছুতেই আর এ-কথা বলতে পারে না যে ভবিষ্যতের উপর তার অসীম আস্থা ও প্রত্যাশা আছে; সে-যে জেরাঁদকে গভীরভাবে ভালোবাসে, এ-কথাটি সে আর প্রকাশ করে বলতে পারে না। সেদিন যদি সাহস করে বলতে পারতো, মাস্টার জাকারিয়ুস হয়তো তক্ষুনি তাকে তার কন্যাজামাতা-রূপে গ্রহণ করে সেই অলুক্ষুণে ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ করে দিতেন।জেরাঁদের সঙ্গে ওবেরের বিয়ে? উঁহু, কোনোদিনই হবে না, এই ভয়ংকর কথাটি এখনো তার কানে অবিশ্রাম গুঞ্জন করে ফেরে।

বিকল ঘড়িগুলি কিনে-নিতে নিতে জাকারিয়ুস শেষকালে যেন দেউলে হয়ে গেলেন। কারুকাজ-করা দামি-দামি সব পুরোনো বাসন-কোশন সব অচেনা লোকের হাতে তুলে দিলেন তিনি, বাড়ির দেয়ালে কাজ-করা যে-সব সুন্দর প্যানেল ছিলো, সব তিনি বেচে দিলেন। প্রাচীন ফ্লেমিশ শিল্পীদের আশ্চর্য ছবিগুলি আর জেরাঁদের চোখে পড়ে না। সব তিনি বেচে দিলেন–এমনকী তিনি নিজে যে-সব সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছিলেন, তাও এই হুলস্থূলের মধ্যে ক্রেতাদের তুষ্ট করার জন্য বেচে দিতে হলো।

কেবল স্কলাস্টিকাই এ-সম্বন্ধে কারু কাজে কোনোরকম যুক্তিতর্ক শুনতে চাইতো না। কিন্তু এইসব নাছোড়বান্দা লোকগুলিকেও সে কিছুতেই আটকাতে পারতো না–প্রভুর সঙ্গে দেখা করে শেষ পর্যন্ত তারা কোনো-না-কোনো দুমূল্য জিনিশ নিয়ে চলে যেতো–কোনোরকমেই সে তাতে বাধা দিতে পারতো না। ফলে তার একটানা চ্যাঁচামেচিতে সমস্ত পাড়া তারপর মুখর হয়ে উঠতো–পাড়ার লোকের কাছে অবশ্য আগে থেকেই তার মুখের খ্যাতি ছিলো। তার প্রভু ডাকিনীতন্ত্রের উপাসক, আসলে তিনি একজন কালো জাদুকর মাত্র–এই-যে জনরব সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিলো, দৃঢ় স্বরে সে তার প্রতিবাদ করতো; কিন্তু ভিতরে-ভিতরে শেষটায় তারও মনে হলো বোধকরি ব্যাপারটায় কিঞ্চিৎ সত্য আছে–তাই বারেবারে তার এই শুভ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যাচারিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতো ঈশ্বরের কাছে।

মাস্টার জাকারিয়ুস যে ইদানীং ধর্মকর্মে অত্যন্ত অবহেলা করছেন, এটা সকলেই খেয়াল করছিলো। এককালে তিনি মেয়েকে নিয়ে নিয়মিত গির্জেয় যেতেন–মানুষের কল্পনার মহিমা ও বিপুলতা অনুভব করতেন তিনি প্রার্থনা–সভায়–প্রত্যেক চিন্তাশীল লোকের যেমন হয়, তারও বুদ্ধিবৃত্তির কাছে এই স্তব ও স্তোত্রের সেই গভীর আবেদন ছিলো! অথচ এখন তাকে আর কখনও গিঞ্জেয় দেখা যায় না; তা ছাড়া মানুষটাও কিছুটা চাপা স্বভাবের–তার চারপাশে যেন অসীম রহস্য ছড়িয়ে আছে; ফলে তার সঙ্গে এবার তার সেই প্রার্থনাসভার যোগদানে অবহেলাটি যোগ হয়ে লোকের সন্দেহ ও অভিযোগকে আরো দৃঢ় করে তুললো। পিতা যাতে ঈশ্বর এবং জগতের কাছে আবার ফিরে আসেন, এই দুই কারণেই জেরাঁদ ধর্মের সাহায্য নেবে বলে স্থির করলে। তাঁর ম্রিয়মাণ আত্মায় হয়তো সঞ্জীবনীর কাজ করবে ধর্ম–অন্তত জেরাঁদের তাই মনে হলো, কিন্তু আস্থা, দীনতা ও বিনতির সঙ্গে অনতিক্রম্য এক দম্ভের প্রবল দ্বন্দ্ব শুরু হলো জাকারিয়ুসের হৃদয়ে; বিজ্ঞানের অহংকারের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষ শুরু হলো অন্তিম গুণ দীনতার, কেননা বিজ্ঞান তো কেবলি সব-কিছুকে নিজের সঙ্গে জুড়ে দিতে চায়; প্রথম নিয়মের সূত্রগুলি যে একদিন কোনো অসীম থেকেই উৎসারিত হয়েছিলো, বিজ্ঞান এটা তাকিয়ে দেখতে চায় না।

জাকারিয়ুসের মনের মধ্যে বিজ্ঞানই যখন সর্বেসর্বা, তখন এই তরুণী তার বাবাকে ফেরাতে চাইলে :নতুন করে তাঁকে দীক্ষিত করতে চাইলে জেরাঁদ; আর তার প্রভাব এতটাই কার্যকরী হলো যে, বৃদ্ধ জাকারিয়ুস পরের রোববারে গিঞ্জেয় গিয়ে প্রার্থনাসভায় যোগ দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। শুনে মেয়ের মন আনন্দে ও উচ্ছ্বাসে ভরে গেলো, যেন এতদিনে সে স্বর্গ খুঁজে পেয়েছে। বুড়ি স্কলাস্টিকা তো তার আনন্দ আর চেপে রাখতে পারলো না; এতদিনে সে সমস্ত গুজব ও জনরবের যোগ্য উত্তরটি দিতে পারবে, আর যে-ই তার প্রভুকে স্লেচ্ছ ও অধর্মাচারী বলতে আসুক, সে তাকে এই দুর্ধর্ষ যুক্তিটি দেখিয়ে দেবে। পাড়াপড়শিদের সবাইকে এই শুভ সংবাদ দিয়ে এলো সে, শত্রু-মিত্র, চেনা-অচেনা–এই খবর না-শুনিয়ে কাউকেই সে ছাড়লো না।

তাই নাকি! সত্যি? তোমার কথা তো বিশ্বাসই হতে চাচ্ছে না, স্কলাস্টিকা। লোকে তাকে বললো, মাস্টার জাকারিয়ুস তো এতকাল শয়তানের সঙ্গেই শলা-পরামর্শ করতেন!

তাহলে তোমরা শোনোনি তাঁর ঘড়ির ঘণ্টাগুলো কেমন আশ্চর্যভাবে বেজে ওঠে,বুড়ি দাসী তাদের বলে দিলে, ওই ঘণ্টাগুলিই ঢং-ঢং করে বেজে প্রার্থনাসভার সময় ঘোষণা করেছে এতকাল।

তা মানি। কিন্তু তিনি কি এমন যন্ত্র আবিষ্কার করেননি যা আপনা থেকেই চলে–ঠিক যেন জ্যান্ত মানুষের মতো কাজ করে যায়?

সেই-যে তিনি আশ্চর্য একটা লোহার ঘড়ি বানিয়েছিলেন, টাকা ছিলো না বলে জেনিভার লোক যা কিনতে পারেনি, আন্দেরনাৎ-এর এক বাগানবাড়িতে যেটা এখন আছে, রেগে ফুঁসে উঠলো স্কলাস্টিকা, কোনো শয়তানের কোনো সাধ্য ছিলো কি তেমন ঘড়ি বানায়? ঘণ্টায়-ঘণ্টায় একেকটি নীতি-বাক্য বেরিয়ে আসে ডায়াল থেকে–ওই নীতিগুলি পালন করলে যে কোনো ধর্মভীরু খ্রিষ্টানই সোজা স্বর্গে চলে যাবে! একে কি কখনো শয়তানের কাজ বলা চলে?

সত্যিই, এই ঘড়িটা জাকারিয়ুসের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। কুড়ি বছর আগে তিনি বানিয়েছিলেন এটা, আর এটার জন্যই খ্যাতির একেবারে শীর্ষদেশে আরোহণ করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কি না তার সম্বন্ধে ডাকিনীতন্ত্রের কথা ওঠে। তবে জাকারিয়ুস গির্জেয় গেলে অন্তত এই হবে যে, লোকের পিশুনভরা কথা স্তব্ধ হয়ে যাবে।

কন্যাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, মাস্টার জাকারিয়ুস কিন্তু তা একবারেই ভুলে গিয়েছিলেন; সকালবেলায় সোজা তিনি তাঁর কারখানায় চলে যান। বিকল ঘড়িগুলিকে পুনর্জীবন দেবার ক্ষমতা যে তার মোটেই নেই, এটা বুঝতে পেরে তিনি ঠিক করেছিলেন যে, কোনো নতুন ঘড়ি বানাতে পারেন কিনা তা পরীক্ষা করে দেখবেন। সমস্ত বিফল চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে তিনি এবার কেলাস-ঘড়িটা শেষ করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন : তার ধারণা ছিলো এই ঘড়িটাই তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি হবে। কিন্তু খামকাই তিনি সূক্ষ্ম ও নিখুঁত সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলেন, ঘর্ষণ রোধ করবার জন্য খামকাই তিনি চুনি আর হিরে বসালেন ঘড়িতে; কারণ ঘড়িটায় যেই তিনি দম দেবার চেষ্টা করলেন, অমনি সেটা তার হাত থেকে পড়ে গেলো।

এই ঘটনাটা তিনি সকলের কাছে চেপে গেলেন–এমনকী তার কন্যাকেও বললেন না; কিন্তু তারপর থেকেই তার স্বাস্থ্য অত্যন্ত তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়তে লাগলো। যেন ক্রমশ-মন্থর হয়ে যাচ্ছে এমন-এক দোলক হয়ে গেলেন তিনি, যার মূল শক্তি আর বেগ কিছুতেই ফিরে আসবে না–যেন শেষবারের মতো আন্দোলিত হচ্ছে সে, তারপর আস্তে আস্তে একদিন থেমে যাবে। কোনো-এক অপ্রতিরোধ্য অভিকর্ষ যেন সোজাসুজি তার উপর কাজ করে যাচ্ছে–অনিবার্যভাবে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কবরের দিকে।

জেরাঁদ এত উৎসুকভাবে যে-রোববারের প্রতীক্ষা করছিলো অবশেষে তা এলো। আবহাওয়া অত্যন্ত ভালো-আকাশ স্বচ্ছ ও জ্যোতির্ময়; তাপমাত্রা যেন প্রেরণা জাগায়। জেনিভার লোকেরা রাস্তায় বেরিয়েছে দল বেঁধে : বসন্ত। যে আবার ফিরে এলো, খুশি হয়ে এই কথা বলাবলি করতে-করতে যাচ্ছে তারা। অত্যন্ত কোমলভাবে বাপের হাত ধরে গির্জের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লো। জেরাঁদ। স্তবকবচমালা নিয়ে স্কলাস্টিকা চললো পিছনে। রাস্তায় লোকেরা কৌতূহলের সঙ্গে তাদের দিকে তাকিয়ে দেখলো। দেখলো যে, বাচ্চা ছেলেকে যেভাবে ধরে-ধরে হাঁটতে শেখানো হয়, তেমনিভাবে হাত ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বৃদ্ধ ঘড়িনির্মাতাকে–না, বাচ্চা ছেলে নয়, আসলে যেন কোনো অন্ধকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জেরাঁদ। সাঁৎ-পিয়েরের অনুগতরা যখন দেখলো চৌকাঠ পেরিয়ে তিনি গিঞ্জেয় ঢুকলেন, তাঁকে আসতে দেখেই কোনো-এক অজ্ঞাত বিষম ভয়ে ভরে গেলো তারা।

সারা গির্জে তখন স্তবগানে মুখর। প্রতিবার যেখানে গিয়ে বসে, জেরাঁদ সেখানে গিয়ে ভক্তি ও বিনতিভরে অত্যন্ত সরলভাবে নতজানু হয়ে বসলো। মাস্টার জাকারিয়ুস কিন্তু তার পাশে সোজা দাঁড়িয়ে রইলেন, অনমনীয় ও ঋজু।

সে-যুগ বিশ্বাসের যুগ। শ্রদ্ধাশীলভাবে অনুষ্ঠানটি ধীরে-ধীরে সেই উন্নত মহিমার স্মরণ করলো–কিন্তু এই বৃদ্ধের মনে বিশ্বাস বা শ্রদ্ধার লেশমাত্র ছিলো না। যে-তীব্র যন্ত্রণায় মানবজাতি ঈশ্বরের করুণা ভিক্ষা করে কাতরভাবে চেঁচিয়ে ওঠে, তার অন্তর তাতে সায় বা সাড়া কিছুই দিলো না। চূড়ান্ত মহিমা গানটিতে যোগ দিয়ে তিনি সেই ঐশ্বরিক দীপ্তির গৌরব ঘোষণা করলেন না; সুসমাচারের বাণী তাঁকে তাঁর অচিৎ জগৎ থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারলো না; এমনকী শেষের সেই সমবেত স্তবগানেও তিনি যোগ দিলেন না। অহংকারে দৃপ্ত এই বৃদ্ধ কেবল নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলেন–পাথরের মূর্তির মতো যেন তিনি তেমনি নিঃসাড় ও তেমনি স্তব্ধ। এমনকী যখন রুটি আর মদের সেই দিব্য রূপান্তর স্মরণ করে ঘণ্টা বেজে উঠলো, খ্রিষ্টের সেই রক্ত-মাংসের বেদনাতেও তিনি মাথা নোয়ালেন না, শুধু অনিমেষ নেত্রে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখলেন পুরোহিত কেমন করে নতজানু ভক্তদের ঐশী আমন্ত্রণ পাঠালেন। বাবার দিকে তাকিয়েই জেরাঁদের দু-চোখ ঘন অশ্রুবাষ্পে ঝাঁপশা হয়ে গেলো। ঠিক সেই সময়ে সাঁৎ-পিয়েরের গির্জের মস্ত ঘড়িটায় ঘণ্টা বেজে উঠলো : সাড়ে-এগারো বাজে। মাস্টার জাকারিয়ুস সেই প্রাচীন ও বাদ্যয় ঘড়িটার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন তক্ষুনি। তাঁর মনে হলো ঘড়িটা যেন অনিমেষ লোচনে তার দিকে তাকিয়ে আছে; এক থেকে বারো–প্রতিটি সংখ্যা এমন ভাবে জ্বলছে, জ্বলজ্বল করছে যেন রাঙা অঙ্গার দিয়ে লেখা; ঘড়ির কাটা থেকে যেন বিদ্যুতের ফুলকি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে চারদিকে।

স্তবগান শেষ হলো। গীর্জের রীতি অনুযায়ী বেলা দ্বিপ্রহরে দেবদূতের জয়গান করা হয়; তাই বেদী ছেড়ে যাবার আগে পুরোহিতেরা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন বেলা বারোটার ঘণ্টা পড়ে। আর কয়েক মুহূর্ত পরেই এই স্তব তারা সেই ঐশী কুমারীর চরণে নিবেদন করে দেবেন।

কিন্তু হঠাৎ একটা কর্কশ আওয়াজে গিঞ্জের সেই বিনত পরিবেশে টুকরো-টুকরো হয়ে গেলো। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তীব্র আর্তনাদ করে উঠলেন জাকারিয়ুস।

ঘড়ির কাঁটাটা বারোটার ঘরে গিয়ে হঠাৎ যেন মন্ত্রবলে থেমে গেছে, কোনোদিনই আর এই ঘড়িতে বারোটার ঘণ্টা বাজবে না।

তাড়াতাড়ি বাপের দিকে ছুটে গেলো জেরাঁদ। ছিন্ন গাছের মতো নিশ্চ পড়ে গেছেন তিনি মাটিতে; ধরাধরি করে তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো।

মরণকামড় এটা! ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো জেরাঁদ।

ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো তাকে; বিধ্বস্তের মতো তিনি পড়ে রইলেন–ব্যথায় একেবারে চুরমার হয়ে গেছেন যেন। যেন প্রাণ আস্তে-আস্তে তার দেহ থেকে অন্তর্ধান করছে।

মূৰ্ছা ভেঙে গেলে দেখলেন জেরাঁদ আর ওবের তার পাশে ঝুঁকে আছে। জীবনের একেবারে শেষ মুহূর্তে পৌঁছে ভবিষ্যৎকে তিনি এখুনি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পেলেন। জেরাঁদ যেন কোনো একাকিনী, সহায়সম্বলহীনা, বিষাদ-প্রতিমায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে, এটাই তার মনে হলো।

পুত্র, ওবেরকে তিনি বললেন, আমার কন্যাকে আমি তোমার হাতেই তুলে দিলাম। এই বলে তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি তাঁর মৃত্যুশয্যাতেই তারা দুজনে মিলিত হলো।

কিন্তু পরক্ষণেই যেন কোনো পরম রোষে তার সমস্ত অস্তিত্ব ভরে গেলো। উঠে বসতে চাইলেন তিনি, ক্ষিপ্ত ও ক্রুদ্ধ। সেই ভীষণ আগন্তুকটির কথা যেন এক অবিশ্রাম স্রোতের মতো তার বুকে বয়ে গেলো।

না-না, মরতে চাই না আমি। প্রচণ্ডভাবে চীৎকার করে উঠলেন জাকারিযুস। কিছুতেই মরতে পারি না আমি! আমি মাস্টার জাকারিয়ুস আমার মরে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আমার খাতা–আমার হিশেবের খাতা!

এই বলে তিনি লাফিয়ে উঠলেন বিছানা ছেড়ে, হিশেবের খাতাটা বের করে আনলেন তাড়াতাড়ি। এই খাতায় ক্রেতাদের নাম-ঠিকানা আর ঘড়ির বর্ণনা লেখা থাকে। তাড়াতাড়ি তার পাতা উলটে গেলেন ক্ষিপ্র ক্ষিপ্ত হাতে-শেষকালে বইয়ের একটা জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখালেন তিনি।

এই যে! চেঁচিয়ে উঠলেন জাকারিয়ুস। এই যে! পিত্তোনাচ্চিয়োকে যে-লোহার ঘড়িটা বিক্রি করেছিলুম, দ্যাখো, কেবল সেটাই আমার কাছে ফিরে আসেনি। এখনো ঘড়িটা চলছে-ঘড়িটা চাই! এখনো তা নষ্ট হয়ে যায়নি এখনো তা বেঁচে আছে! আঃ, এই আমার প্রাণ–যে করেই হোক এই ঘড়িটাকে খুঁজে বের করতেই হবে আমাকে। ঘড়িটাকে আমি এত যত্ন করে সাবধানে রেখে দেবো যে মৃত্যু আর আমার কাছে ঘেঁষতে পাবে না।

বলতে-বলতে আবার তিনি চেতনা হারিয়ে ফেললেন।

ওবের আর জেরাঁদ এই বিদ্রোহী বৃদ্ধের শয্যার পাশে নতজানু হয়ে বসে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলো।