৩. অদ্ভুত আগন্তুক

৩. অদ্ভুত আগন্তুক

বেচারি জেরাঁদ-যদি-না ওবেরের কথা তার মনে জেগে থাকতো-হয়তো পিতার সঙ্গেই তার প্রাণ হারাতে; ওবেরই এখন তার বেঁচে-থাকার একমাত্র আকর্ষণ।

বৃদ্ধ ঘড়িনির্মাতা, ধীরে-ধীরে, নির্জীব ও নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন। যতই তিনি কেবল একটি বিষয়েই মনঃসংযোগ করছেন, ততই তার ক্ষমতা যেন আরো দুর্বল হয়ে আসছে। স্মৃতির বিষণ্ণ অনুষঙ্গ-বশত সবকিছুই কেমন করে যেন তার অদ্ভুত বাতিকটির সঙ্গে জড়িয়ে যায়; মনে হয় ক্রমেই যেন মানবিক অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছেন তিনি, আর তার বদলে যেন কোনো পরাবাস্তব শক্তি জেগে উঠেছে তার মধ্যে, যেন কোনো অতিপ্রাকৃত জগতে বেঁচে আছেন তিনি এখন। উপরন্তু, কয়েকজন অসূয়াপরায়ণ ও মৎসর প্রতিদ্বন্দ্বীর চেষ্টায় তার পরিশ্রম ও ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধে আবার সেই পুরোনো জনরবটা জেগে উঠলো।

তাঁর ঘড়িগুলি হঠাৎ একযোগে বিকল হয়ে যাচ্ছে, এই খবর জেনিভার সেরা কারিগরদের মধ্যে প্রকাণ্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলো। ঘড়ির চাকাগুলো হঠাৎ এ-রকমভাবে অসাড় হয়ে যাচ্ছে কেন? বৃদ্ধ জাকারিয়ুসের প্রাণের সঙ্গে তাদের যেন গভীর এক সম্বন্ধ আছে। কিন্তু সেই সম্বন্ধটা আসলে কী? এগুলো এমন-সব রহস্য যে এ-সম্বন্ধে চিন্তা করতে গেলেই কেমন একটা গোপন আতঙ্কে সর্বাঙ্গ শিরশির করে ওঠে। শহরের নানা শ্রেণীর লোকের মধ্যে–তা সে তরুণ শিক্ষার্থী বা প্রাচীন ঘড়িনির্মাতাদের ঘড়ি-ব্যবহারকারী কোনো মস্ত ভূস্বামী, যেই হোন না কেন–সকলেই এই অদ্ভুত ও অসাধারণ তথ্যটি লক্ষ না-করে পারলো না। মাস্টার জাকারিয়ুসের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে জেগে উঠলো চারদিকে–কিন্তু লোকের এই আশা সফল হলো না। ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়লেন জাকারিয়ুস; আর সেই জন্যেই রোজ এই যে অবাঞ্ছিত লোকেরা অবিশ্রান্ত এসে শাসায়, তিরস্কার করে, ভয় দেখায়, তাদের হাত থেকে বাবাকে রক্ষা করতে পারলো জেরাঁদ।

এই জৈব অপলাপ ও ক্ষয়ের বিরুদ্ধে চিকিৎসক আর ওষুধপত্র সমানভাবে অক্ষম ও অসহায় হয়ে পড়লো। এই ক্ষয়ের কোনো কারণই কেউ বের করতে পারলো না; মাঝে-মাঝে মনে হয় এই বৃদ্ধের হৃৎপিণ্ড যেন আর ধুকধুক্ করে না হঠাৎ-হঠাৎ তা যেন বন্ধ হয়ে যেতে চায়; আর তারপরেই আবার এক বিষম ও ভয়ংকর বেগে সেই নিশ্চল হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।

শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের রচনা জনসমক্ষে প্রদর্শন করার রীতি ছিলো তখনকার দিনে। কাজের নতুনত্ব বা নৈপুণ্য দেখিয়ে বহু প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করতে চাইতেন; জাকারিয়ুসের এই অবস্থা কেবল তাদের মধ্যেই উজ্জীবন্ত সমবেদনা ও সহানুভূতির উদ্রেক করলো–কেননা তার সম্বন্ধে তারাই সবচেয়ে উৎসুক ও আগ্রহী ছিলেন। এবার আর তাকে কোনো ভয় নেই বলেই তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের এত অনুকম্পা। এই বৃদ্ধের সাফল্য ও বিজয়ের কাহিনী তারা কোনোদিনই ভোলেননি। তারা কি জানেন না যখন তিনি তার চমৎকার ঘড়িগুলি প্রদর্শনীতে পাঠাতেন, তখন সচলমূর্তিবসানো, গানের মতো বেজে-ওঠা সেই ঘড়িগুলি লোকের মধ্যে কী পরিমাণ সম্ভ্রম, ভালোবাসা ও প্রশংসার উদ্রেক করত? ফরাশি দেশ, আলেমান ভূখণ্ড, সুইজারলাণ্ড–সর্বত্রই কী চড়া দামে বিকোতো সেই ঘড়িগুলি, তা কি তারা কোনোদিনও ভুলতে পারবেন?

এদিকে জেরাঁদ আর ওবেরের অবিরাম মমতা ও সেবায় জাকারিয়ুসের হৃত শক্তি একটু একটু করে ফিরে আসতে লাগলো। তাঁর এই রোগ ও বিক্ষোভ তাকে অনেকটা শান্ত করে তুলেছে; যে-চিন্তা এতকাল তাকে সম্পূর্ণ অধিকার করে বসেছিল, এখন তা থেকে নিজেকে তিনি সরিয়ে আনতে পারেন। হাঁটার ক্ষমতা যেই ফিরে পেলেন, অমনি তাঁর কন্যা তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে এলো–কেননা এখনো বিরক্ত ও অতৃপ্ত ক্রেতাদের আক্রমণে বাড়িটা সবসময় ভরে থাকে। ওবের অবশ্য কারখানায় বসে মনোযোগর সঙ্গে সেই বিদ্রোহী ঘড়িগুলোকে বশ মানবার চেষ্টা করে সারাক্ষণ, নানাভাবে সে কলকজাগুলি জুড়ে দ্যাখে যদি কোথাও কোনো টিকটিক শব্দ জেগে ওঠে–কিন্তু তার সব চেষ্টাই বিফল হয়, মিথ্যেই সে এত পরিশ্রম করে এদের নিয়ে। ফলে শেষটায় বেচারি সম্পূর্ণ হতাশ ও স্তম্ভিত হয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে বসে থাকে, তবে মনে হয় সেও বুঝি জাকারিয়ুসের মতো পাগল হয়ে যাবে।

শহরের সবচেয়ে সুন্দর অঞ্চলগুলিতে বাবাকে নিয়ে বেড়ায় জেরাঁদ। কখনো সে তার হাত ধরে-ধরে সাঁৎ-আঁতোয়ানের মাঠের পাশ দিয়ে নিয়ে যায়, অনেক দূর পর্যন্ত দৃষ্টি যায় এখান থেকে–হ্রদের গায়ে যেখানে কোলন পাহাড় উঠছে, একেবারেই সেই পর্যন্ত। সকালটি যেদিন জ্যোতির্ময় হয়ে দেখা দেয়, ব্যয়ে পাহাড়ের চুড়ো জেগে ওঠে দিগন্তে। আঙুল তুলে-তুলে বাবাকে সব দেখায় জেরাঁদ–তাদের নামগুলো পর্যন্ত জাকারিয়ুস ভুলে গেছেন। তার স্মৃতির ভিতরে যেন একের পর এক পরদা সরে যায়, নতুন করে সব নামগুলি জেনে নিতে কেমন একটা ছেলেমানুষি আমোদ ও আনন্দ পান তিনি। মেয়ের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি তাকান দিগন্তের দিকে, আর একই সূর্যের আলো এসে পড়ে দুজনের মাথায়–একটি মাথায় এলোমেলো ওড়ে শুভ্র চুল আর অন্যটি সোনালি চুলের গুচ্ছে ভরা।

অবশেষে ধীরে-ধীরে সেই বৃদ্ধ ঘড়িনির্মাতা বুঝলেন যে মোটেই একা নন তিনি জগতে। মাঝে-মাঝে তার এই তরুণী ও রূপসী কন্যার দিকে তাকান তিনি, তারপর নিজের ভেঙে পড়া জীর্ণ দেহটির দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবেন, তাঁর মৃত্যুর পর মেয়েটি একেবারে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়বে। জেনিভার তরুণ ঘড়িনির্মাতাদের মধ্যে অনেকেই জেরাঁদের প্রণয়-প্রার্থনা করেছিলো। কিন্তু জাকারিয়ুসের এই দুর্ভেদ্য গৃহে কেউই প্রবেশাধিকার পায়নি। কাজেই, স্বাভাবিকভাবেই, জাকারিয়ুসের উন্মত্ততায় যখন এই সাময়িক বিরতি নেমে এলো, তখন তিনি ওবের তুনকেই পাত্র নির্বাচন করলেন। একবার যেই এই চিন্তাটার উদয় হলো, অমনি হঠাৎ যেন তিনি আবিষ্কার করলেন যে, এরা দুজনে যেন একজনের জন্যই আরেকজন জন্মেছে; দুজনেরই মনের গড়ন একরকম, একই আস্থা ও বিশ্বাস দুজনের; তাদের দুজনেরই হৃৎস্পন্দন যেন কোনো এক অনড় দোলকের বশবর্তী বলে মনে হলো তার–অন্তত এই কথাই তিনি স্কলাস্টিকাকে একদিন বললেন।

ঘড়ির সঙ্গে যে তুলনাটি তিনি দিয়েছিলেন, তা পুরোপুরি মাথায়–ঢুকলেও বুড়ি স্কলাস্টিকা এ-কথা শুনে অত্যন্ত আহ্লাদিত হয়ে পড়লো; সাধু-সন্তদের নামে শপথ করে সে বললে যে, সিকি ঘণ্টার মধ্যেই সমগ্র জেনিভার এ-কথা জেনে-যাওয়া উচিত। তাকে শান্ত করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হলো জাকারিয়ুসকে; কিন্তু অনেক চেষ্টার পর জাকারিয়ুস তার কাছে থেকে এই কথা আদায় করলেন যে, কিছুতেই সে এই কথা প্রচার করবে –অবশ্য এই প্রতিশ্রুতি সে আদৌ কখনো রেখেছিলো বলে কেউ জানে না।

কাজেই, জেরাঁদ আর ওবের তার বিন্দুবিসর্গও না-জানলেও আস্ত জেনিভা তাদের আশু বিবাহ সম্বন্ধে নানা কথা বলতে লাগলো। কিন্তু লোকে যখন এই সম্বন্ধে গাল-গল্প করে, তখন নাকি মাঝে-মাঝে অদ্ভুত ধরনের এক খুকখুক হাসি শোনা যায়, আর কে নাকি এই কথা বলে ওঠে, জেরাঁদ কোনোদিনই ওই বরকে বিয়ে করবে না।

এই কথা শুনে লোকে ফিরে তাকিয়ে দ্যাখে বেঁটেখাটো এক অচেনা বুড়ো দাঁড়িয়ে আছে।

বুড়ো, কিন্তু বয়স কত লোকটার? সে-কথা বলার ক্ষমতা কারুরই ছিলো না। সে বুঝি কয়েক শতাব্দী ধরে বেঁচে আছে–এ-কথাই শুধু মনে হতো লোকের। মস্ত একটি চ্যাপটামতো মাথা বসানো তার কাঁধে, আর কাঁধটি এতই চওড়া যে সারা দেহের দৈর্ঘ্যের প্রায় সমান বলে মনে হয়–এবং দৈর্ঘ্য তিন ফিটের বেশি হবে না। কোনো দোলক বা পেনডুলাম বসবার আধার হতে পারে তার দেহ-বলাই বাহুল্য, ঘড়ির ডায়াল হবে তার মুখমণ্ডল, আর সমতা-রক্ষক চাকাটি অনায়াসেই তার বুকের মধ্যে দুলতে থাকবে। নাকটা প্রায় সূর্য-ঘড়ির ধরনে তৈরি যেন, এমন সংকীর্ণ ও তীক্ষ্ণ; দাঁতগুলো ফাঁক-ফাঁক হয়ে আছে, যেন দুই ঠোঁটের মাঝখানে চাকার দাঁত দেখা যাচ্ছে ও তার গলার স্বরের মধ্যে ঘণ্টার ধাতব ধ্বনি লুকিয়ে আছে যেন, আর কান পাতলে শোনা যাবে তার হৃৎপিণ্ডটি যেন ঘড়ির মতো টিকটিক করে বাজছে। ডায়ালের মধ্যে কাটা যেমন করে ঘোরে, তেমনিভাবে হাত নাড়ে সে। কীরকম ঝাঁকুনি দিয়ে চলে সে, একবারও পিছন ফিরে তাকায় না। কেউ যদি তার পিছু নিতো তো দেখতে পেতো ঘণ্টায় সে ঠিক এক লিগ পথ হাঁটে, আর তার রাস্তা গেছে প্রায় যেন বৃত্তের মতো গোল হয়ে।

এই অদ্ভুত জীবটি খুব বেশিদিন ধরে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে–বা, বলা যায়, খুব বেশিদিন হলো এই জীবটি অন্ধকার থেকে ছাড়া পায়নি; কিন্তু এটা লক্ষ্য করা গেছে যে, প্রত্যেক দিন সূর্য যখন ঠিক মধ্যরেখা পেরিয়ে যায়, সাঁৎ-পিয়েরের গির্জের কাছে গিয়ে সে থেমে পড়ে, তারপর ঠিক বেলা বারোটার ঘণ্টা বেজে যাবার পর আবার সে চলতে শুরু করে। ঠিক এই মুহূর্তটি ছাড়া শহরের যাবতীয় আড্ডা ও গাল গল্পেরই সে অংশ যেন-বিশেষ করে যেখানেই জাকারিয়ুস সম্বন্ধে কোনো আলোচনা হচ্ছে, সেখানেই সে আছে; ফলে কিছুদিনের মধ্যেই ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে লোকেরা পরস্পরকে জিগেস করতে লাগলো, জাকারিয়ুসের সঙ্গে কী সম্পর্ক আছে লোকটার। এটাও সবাই লক্ষ করেছিলো যে জাকারিয়ুস যখন তার কন্যার সঙ্গে বেড়াতে বেরোন, তখন এই অদ্ভুত লোকটি যেন একদৃষ্টে সারাক্ষণ জাকায়ুিসের দিকে তাকিয়ে থাকে।

জেরাঁদ হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলে যে এই অপদেবতাটি তার দিকে তাকিয়ে কদাকারভাবে মুচকি হাসছে। ভয় পেয়ে সে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।

কী হলো তোর? কন্যাকে জিগেশ করলেন মাস্টার জাকারিয়ুস।

জানি না, বাবা, ভীতভাবে উত্তর দিলে জেরাঁদ।

কিন্তু কি-রকম শুকনো দেখাচ্ছে তোকে–পাণ্ডুর ও কালিবর্ণ। এবার কি তোর অসুখ বাধিয়ে বসার পালা নাকি? বেশ, তাহলে, বিষণ্ণভাবে একটু হাসলেন জাকারিয়ুস, আমিই তোর শুশ্রূষা করবো না-হয়, অত্যন্ত যত্ন করেই সেবা করবো তোর।

না, বাবা, তা নয়। কীরকম যেন ঠাণ্ডা লাগছে আমার–মনে হয়–

কী?

মনে হয় ওই লোকটাই এর কারণ। জানো বাবা, লোকটা সবসময়েই আমাদের পিছন-পিছন ঘোরে, অত্যন্ত নিচু গলায় সে উত্তর দিলো।

জাকারিয়ুস পিছন ফিরে বেঁটে লোকটার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন।

বাঃ, ঠিক চলেছে তো, তার গলার স্বরে তৃপ্তির ভাবই ফুটে উঠলো। কাঁটায়-কাঁটায় চারটে বাজছে এখন। ভয় পাসনি, জেরাঁদ। ও কোনো মানুষ নয়, আসলে মস্ত একটা ঘড়ি।

স্তম্ভিত হয়ে গেলো জেরাঁদ, আতঙ্কে বাবার মুখের দিকে তাকালো সে। এই অদ্ভুত জীবটির মুখে সময় দেখলেন তিনি কী করে?

হ্যাঁ, ভালো কথা, জাকারিয়ুস এ-সম্বন্ধে মোটেই মাথা ঘামালেন না, ওবেরকে যে কয়েকদিন ধরে দেখছি না!

না, বাবা, ও আমাদের ছেড়ে যায়নি, জেরাঁদের কণ্ঠস্বরে লজ্জা ও কোমলতা জেগে উঠলো।

কী করছে তাহলে আজকাল?

কাজ করছে বসে-বসে।

আহ! জাকারিয়ুস চেঁচিয়ে উঠলেন, ও আমার ঘড়িগুলি সারাচ্ছে, তাই না? অন্তত সারাতে চেষ্টা করছে নিশ্চয়ই? কিন্তু ওগুলো ও সারাতে পারবে না কিছুতেই। কারণে ওদের তো আর মেরামত করলে চলবে না, একেবারে পুনর্জীবন দিতে হবে!

মেয়ে কোনো কথা না-বলে চুপ করে রইলো।

আর-কতগুলো ঘড়ি ফিরে এসেছে, জানতে হবে, জাকারিয়ুস যোগ করলেন, আহ, যেন শয়তান নিজে এসে তাদের মধ্যে মহামারীর বীজ ছড়িয়ে দিয়ে গেছে।

এই কথা বলে জাকারিয়ুস কি-রকম গম্ভীর আর স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বাড়ি ফেরার পথে আর একটাও কথা বললেন না তিনি বাড়ি ফিরে এসেই সোজা কারখানা-ঘরে চলে গেলেন–অসুখ থেকে ওঠবার পর এই প্রথম তিনি সে-ঘরে ঢুকলেন। আর তার মেয়ে অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।

জাকারিয়ুস যেই তার কারখানা-ঘরের চৌকাঠে এসে দাঁড়ালেন, অমনি দেয়ালের একটা ঘড়িতে ঢং-ঢং করে পাঁচটা বেজে উঠলো। ঘড়িগুলো খুবই ঠিকভাবে চলতো এতকাল–সবগুলো ঘড়ি একসঙ্গে বেজে উঠত, একতিলও এদিক-ওদিক হতো না, আর জাকারিয়ুসের মন গর্ব ও উল্লাসে ভরে যেত। কিন্তু সেদিন একসঙ্গে না-বেজে পর-পর বাজলো ঘড়িগুলো, একটার পর আরেকটা, ফলে প্রায় পনেরো মিনিট ধরে এই ঘণ্টাধ্বনি প্রায় যেন বধির করে দিতে চাইলো তাকে। বিষম কষ্টে ব্যথায় জাকারিয়ুস যেন ছটফট করে উঠলেন। হাতুড়ির বাড়ির মতো ঘণ্টাধ্বনি পড়ছে তার গায়ে; একটার পর একটা ঘড়ির কাছে গিয়ে হাত নাড়তে লাগলেন তিনি-কিন্তু নির্দেশ অমান্য করে বাজনাগুলো ইচ্ছেমতো বেজে উঠলে, কোনো সংগীত পরিচালকের যে-রকম অবস্থা হয়, তার দশাও যেমন তেমনি হলো; আর যেন এদের উপর তার কোনোরকম কর্তৃত্বই নেই।

শেষ ঘণ্টার রেশ মিলিয়ে যাবার আগেই ঘরের দরজা আবার দুম করে খুলে গেলো; সামনে সেই খর্বকায় বামনটিকে দেখে জাকারিয়ুসের আপাত-মস্তক যেন শিউরে উঠলো। একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে সেই অদ্ভুত লোকটি বললে, মাস্টার জাকারিয়ুস, আপনার সঙ্গে দু-একটা কথা বলতে পারি?

কে তুমি? কে? জাকারিয়ুস হঠাৎ জিগেশ করে বসলেন।

আপনারই একজন সহযোগী। সূর্যের গতিবিধি শাসন করাই আমার কাজ।

ওঃ, তুমি সূর্যকে শাসন করো? একটুও বিস্মিত না-হয়ে জাকারিয়ুস তাকে সাগ্রহে বললেন, তা, এই কাজের জন্যে তোমার তোত বিশেষ প্রশংসা করতে পারবো না, বাপু। তোমার সূর্যের চলাফেরার তো কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই–ফলে তার সঙ্গে মানিয়ে চলতে গিয়ে কখনো আমরা ঘড়ির সময় খানিকটা এগিয়ে নিই, আবার কখনো-বা পেছিয়ে দিই।

আপনি ঠিকই বলেছেন, হুজুর! ভীষণ লোকটি বলে উঠলো, আপনার ঘড়ি যেমন নিখুঁত সময়ে দ্বিপ্রহর ঘোষণা করে, আমার সূর্য সমসময় তা করে না কিন্তু একদিন লোকে বুঝতে পারবে যে, পৃথিবীর আবর্তনের জন্যই এ-রকম হয়, এবং তখন একটি মধ্যক আবিষ্কার করে লোকে এই অনিয়মের মধ্যে সমতা আনবে।

ততদিন পর্যন্ত কি আর আমি বেঁচে থাকবো? জাকারিয়ুসের চোখ কেমন চক করে উঠলো।

নিশ্চয়ই বেঁচে থাকবেন! আগন্তুকটি হেসে উঠলো, কেন? কোনাদিনে মরে যাবেন এ-ভয় আপনার হচ্ছে নাকি আজকাল?

হায়! সে-কথা আর কী বলবো! হঠাৎ আমি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছি।

সে-সম্বন্ধেই আমার কিছু বক্তব্য আছে। শয়তান জানে, আমি সেই জন্যেই এসেছি।” এই বলে অদ্ভুত আগন্তুকটি লাফিয়ে গিয়ে বসলো চামড়ার চেয়ারে। তারপর এমনভাবে পা তুলে আড়াআড়ি ভাজ করে রইলো যে মনে হলো ঠিক যেন কোনো শিল্পীর আঁকা কোনো মড়ার খুলির তলায় কাটাকুটি করে রাখা দুটি হাড়। তারপর বিদ্রুপের ভঙ্গিতে সে বললে, কিন্তু মাস্টার জাকারিয়ুস, তার আগে প্রথমটায় দেখে নিই এই জেনিভা নগরে কী ব্যাপার চলছে। লোকে বলাবলি করছে যে, আপনার স্বাস্থ্য নাকি ক্রমেই ভেঙে পড়ছে, ফলে আপনার শরীরের ঘড়ি সারিয়ে তোলবার জন্য একজন ধন্বন্তরি নাকি জরুরি হয়ে উঠেছে।

এইসব ঘড়িগুলির সচলতা আর আমার প্রাণের মধ্যে কোনো গভীর যোগ আছে বলে মনে হয় না কি তোমার? মাস্টার জাকারিয়ুস চেঁচিয়ে উঠলেন।

বাঃ রে! আমার তো মনে হয় ঘড়িগুলোর দোষের শেষ নেই–মহা বদমাশ একেকটা। এই হতচ্ছাড়াগুলি যদি শৃঙ্খলা না-মানে, যা-খুশি তাই করে তাহলে এই উচ্চুঙ্খলতার জন্য যোগ্য প্রতিফল পাওয়া উচিত তাদের। মনে হয়, ইদানীং তাদের চরিত্রশোধনের বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

উচ্ছৃঙ্খলতা কাকে বলো? তার ঠাট্টায় জাকারিয়ুস একেবারে আরক্তিম হয়ে উঠলেন। বংশমর্যাদার জন্য তারা গর্ব করতে পারে না কি?

তাই বলে এতটা দম্ভ ভালো নয়। আগন্তুকের উত্তর মুহূর্তে তৈরি : স্বীকার করি, ভুবনবন্দিত একটি নামের সঙ্গে তাদের সংযোগ আছে, তাদের আধারে এক বিরাট প্রতিভার স্বাক্ষর আছে, তাও মানি; তাছাড়া জগতের সব অভিজাত পরিবারে আমন্ত্রিত হবার সুযোগ যে কেবল তাদেরই আছে, তাও অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু এটা তো ঠিক যে কিছুকাল হলো তারা বিকল হয়ে পড়ছে একে-একে, আর আপনি সে-সম্বন্ধে কিছুই করতে পারছেন না। জেনিভার সবচেয়ে হাবা কারিগরও এটা আপনার কাছে মুহূর্তে প্রমাণ করে দিতে পারবে।

আমি–মাস্টার জাকারিয়ুস–আমার রুষ্ট দম্ভে জাকারিয়ুস তার কথা শেষ করতে পারলেন না।

আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি-মাস্টার জাকারিয়ুস–এমনকী আপনিও হাজার চেষ্টা করেও আপনার ঘড়িগুলিকে সারিয়ে তুলতে পারছেন না।

বাঃ রে! হঠাৎ আমার অসুখ করে বসেছিলো বলেই তো তাদেরও অসুখ করলো, জাকারিয়ুসের সর্বাঙ্গে ঠাণ্ডা ঘাম ছড়িয়ে পড়লো।

বাঃ, তাহলে তো ভালোই হলো : যেহেতু তাদের স্প্রিং-এ একচুলও স্থিতিস্থাপকতা আনতে পারছেন না, সেইজন্য আপনার সঙ্গে-সঙ্গে তাদেরও মরতে হবে।

তাদেরও মরতে হবে! মোটেই না, কারণ তুমি তো নিজেই বললে যে আমি কোনোদিনই মরবো না। আমি–জগতের এক নম্বর ঘড়িনির্মাতা মাস্টার জাকারিয়ুস–আমিই তো এইসব সূক্ষ্ম কলকজা আর নানা চাকার সাহায্যে অত্যন্ত নিখুঁত ও নির্ভুলভাবে প্রতিটি ঘড়িকে নিয়ন্ত্রিত করেছি। আমি কি বন্দী করে রাখিনি মহাকালকে–আমি কি রাজার মতো তাকে নিয়ে যা-খুশি তা-ই করতে পারি না? এই ভ্রাম্যমাণ বিশৃঙ্খল মুহূর্তগুলিকে কোনো দিব্য প্রতিভা নিয়ন্ত্রিত করার আগে কি বিশাল অনিশ্চয়তাই মানব জাতির নিয়তি ছিলো না? জীবনের একটি মুহূর্তের সঙ্গে আরেকটি মুহূর্তের কোনো যোগসূত্র ছিলো কি তখন? কিন্তু তুমি–জানি না তুমি কে, মানুষ না শয়তান–তুমি আমার এই বিরাট শিল্পের মহিমাকে একবারও তলিয়ে দেখলে না। জানো, মানুষের যাবতীয় বিজ্ঞান আমি কাজে লাগিয়েছি। না, না! আমি, মাস্টার জাকারিয়ুস-আমি কিছুতেই মরতে পারি না। কারণ সময়কে শাসন করেছি আমি–বাধ্য অনুগত ও বশংবদ ভৃত্য সে আমার আমার সঙ্গে-সঙ্গে মহাকালেরও অবসান! আবার সেই অসীমে ফিরে যাবে সে; যে-অফুরন্ত সীমাহীন থেকে আমার প্রতিভা তাকে বাঁচিয়েছিলো, আবার সেই অসীম শূন্যতার তলহীন গহ্বরে সে চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে–যদি আমার মৃত্যু হয় কোনোদিন! এই সৌর পরিবার যাঁর অবদান ও যাঁর সংহিতা ও বিধান কীটাণুকট থেকে বিপুল নীহারিকামণ্ডলকে বন্দী করে আছে, সেই সৃষ্টিকর্তার মতো আমিও মৃত্যুহীন! আমিই তার প্রতিদ্বন্দ্বী–তারই সমান, আমি মাস্টার জাকারিয়ুস, তার শক্তি কেড়ে নিয়েছি। ঈশ্বর যদি অসীমকে সৃষ্টি করে থাকেন, কীটাণুকনাদিন! এই সে চিরকালে তাহলে আমি সৃষ্টি করেছি সীমা, সৃষ্টি করেছি সময়, অর্থাৎ ঘণ্টা, মিনিট, মুহূর্ত। দিগ্ভ্রান্ত কিন্নরের মতো দেখালো এই বৃদ্ধ ঘড়িনির্মাতাকে, যেন সৃষ্টিকর্তার সামনে তিনি সবেগে ও সজোরে বিদ্রোহ ঘোষণা করছেন। অচেনা আগন্তুকটি একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রইলো; এই পাপ-চিন্তা বুঝি সে-ই সংক্রামিত করেছে তার মধ্যে, এমনি মনে হয় তাকে দেখলে।

ঠিক বলেছেন, কর্তা! সে উত্তর দিলে, স্বয়ং শয়তানও নিজেকে ভগবানের সঙ্গে এমন চুলচেরা তুলনা করতে পারেনি! কিছুতেই আপনার মহিমার অবসান ঘটতে দেয়া চলবে না। আর সেই জন্যই আপনার এই ভৃত্য আপনাকে এই বিদ্রোহী ঘড়িগুলিকে বশ করার উপায় জানিয়ে দিতে এসেছে।

কী সেই উপায়, খুলে বলল আমাকে, বলো! মাস্টার জাকারিয়ুস চেঁচিয়ে। উঠলেন।

আপনার কন্যার সঙ্গে আমার বিয়ে দিলেই তা আপনি জানতে পারবেন। কী?

জেরাঁদ–আমার জেরাঁদের সঙ্গে–

হ্যাঁ, তাঁরই সঙ্গে।

কিন্তু আমার কন্যা তো আরেকজনকে ভালোবাসে, এই অদ্ভুত দাবিতে জাকারিয়ুস আদৌ বিস্মিত বা ক্ষুব্ধ হলেন না।

আপনার কন্যা ওই ঘড়িগুলোর চেয়ে কম সুন্দর নন, কিন্তু তারও হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন একদিন থেমে যাবে–

কে? আমার কন্যা? না! কিছুতেই না–

আপনার ঘড়ির কথাতেই তাহলে আবার ফিরে-আসা যাক। বারেবারে চেষ্টা করে দেখুন, তারা আদৌ সারে কি না! যান, আপনার সহকারীর সঙ্গে আপনার কন্যার বিবাহের ব্যবস্থা করুন গিয়ে। সেরা জাতের ইস্পাত কেটে বানান গিয়ে স্প্রিং। ওবের আর আপনার কন্যার চিরসুখ প্রার্থনা করুন–কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার ঘড়িগুলি আর-কোনোদিনই চলবে না–আর জেরাঁদের সঙ্গেও ওবেরের বিয়ে হবে না।

এই কথা বলেই কদাকার বামনটি চলে গেলো। কিন্তু যতই সে তাড়াতাড়ি যাক, সে যাবার আগেই জাকারিয়ুস শুনতে পেলেন তার বুকের মধ্যে ঢং ঢং করে ছটা বাজলো।