২. বিজ্ঞানের দম্ভ

২. বিজ্ঞানের দম্ভ

ব্যাবসার বিষয়ে জেনিভার বণিকদের কঠোরতা প্রায় প্রবাদবচনে পরিণত হয়েছে। বিপুল তাদের সম্মানবোধ, অতিরিক্ত তাদের সততা, আর মর্যাদার বিষয়ে তারা অত্যন্ত কঠোর। ফলে বিপুল ধৈর্য ও যত্ন সহকারে যে-ঘড়িগুলি বানিয়েছিলেন, সবখান থেকেই সেগুলো যখন ফিরে আসতে লাগলো, তখন লজ্জা ও ধিক্কারে মাস্টার জাকারিয়ুস যে কী পরিমাণ সংকুচিত হয়ে পড়লেন, তা সহজেই আন্দাজ করা যায়।

ঘড়িগুলো যে অকারণেই আচমকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অকারণে, কেননা ঘড়ির ভিতরকার চাকা ভালোই আছে, কোথাও ঢিলে বা আলগা হয়ে যায়নি, কাঁটাগুলোও ঠিক আছে; কিন্তু স্প্রিংয়ের স্থিতিস্থাপকতা আর একটুও নেই। দুজ্ঞেয় এই বিফলতা তাঁর মান ও মর্যাদাকে গভীরভাবে ক্ষুণ্ণ ও আহত করলো। আশ্চর্য-সব আবিষ্কারের জন্য বহুবারই লোকে তাঁকে কালেগা জাদু বা ডাকিনী তন্ত্রের উপাসক বলে সন্দেহ করেছে–এবার সেই সন্দেহ যেন প্রমাণিত হয়ে গেলো। আর এইসব গুজব ও জনরব শেষকালে জেরাদেরও কানে পৌঁছুলো; ভয়ে সে প্রায়ই তার বাবার কথা ভেবে শিউরে ওঠে–বিশেষ করে যখন দ্যাখে যে লোকে দারুণ ক্রতাভরা চোখে তাকে তির্যকভাবে নিরীক্ষণ করছে, তখন তার বুকের রক্ত যেন ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

তবু এই তীব্র মনস্তাপের রাত্রিটি কেটে গিয়ে যখন সকাল হলো, মাস্টার জাকারিয়ুস কিঞ্চিৎ আস্থার সঙ্গে পুনর্বার তার কাজে মন দিলেন। সকাল বেলার সূর্য যেন তাকে নতুন সাহস ও প্রেরণা দিলে। ওবের তাড়াতাড়ি গিয়ে কারখানাঘরে ঢুকলো; জাকারিয়ুস অত্যন্ত শিষ্ট ও অমায়িকভাবে তাকে সুপ্রভাত জানালেন।

আগের চেয়ে বেশ ভালো বোধ করছি, বৃদ্ধ বললেন, কাল যে কী একটা অদ্ভুত যন্ত্রণা হচ্ছিলো মাথার মধ্যে কে জানে। কিন্তু সকালের আলোেই যেন রাতের মেঘের সঙ্গে সঙ্গে তাকেও দূর করে দিয়েছে।

সত্যি-বলতে, ওবের বললে, আমাদের দুজনের কারু পক্ষেই রাতটা ঠিক সহ্য হয় না।

তুমি ঠিকই বলেছো, ওবের। কোনোদিন যদি বড়ো হয়ে ওঠো তো বুঝতে পারবে যে, দিন যেন তোমার কাছে খাদ্যের মতো জরুরি। যাঁরা জ্ঞানীগুণী ও মস্ত মানুষ, তাঁদের সবসময়েই সহযোগীদের প্রশংসা ও প্রশস্তির জন্য তৈরি থাকতে হয়।

মাঝে-মাঝে আমার মনে হয় আপনাকে বুঝি বিজ্ঞানের দম্ভ পেয়ে বসেছে।

দম্ভ, ওবের! দম্ভ? অতীত ধ্বংস করে ফ্যালো আমার, কেড়ে নাও আমার বর্তমান, ভবিষ্যৎকে একেবারে টুকরো-টুকরো করে ফ্যালো-আর একমাত্র তবেই আমি লোকচক্ষুর আড়ালে ও অজ্ঞাতসারে বাঁচতে পারবো। বেচারা, আমার এই শিল্প যে কোন মহান অসীমকে স্পর্শ করেছে, তা কি তুমি বুঝতে পারো না? এমনকী তুমিও কি আমারই হাতের নিছক একটা যন্ত্র মাত্র নও?

তবু, ওবের অত্যন্ত বিনীতভাবে তার গুরুদেবকে বললে, আপনিই তো আমাকে আপনার ঘড়ির অতি সূক্ষ্ম কলকজাগুলি জুড়ে দেবার জন্য একাধিকবার প্রশংসা করেছেন। আমি কি তার যোগ্য নই?

সে-বিষয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, ওবের। তুমি একজন ভালো কারিগর, এটা সত্যি, আর এই জন্যই তোমাকে আমি স্নেহ করি। কিন্তু কাজ করার সময় তুমি তো এটাই ভাবো যে তোমার হাতে বুঝি সোনা, রুপোবা তামাই রয়েছে কয়েক টুকরো। তুমি তো এটা কল্পনাও করতে পারো না যে এই ধাতুগুলো আমার মনীষা ও মেধার কাছ থেকে প্রাণ পেয়ে রক্তমাংসের জীবের মতো স্পন্দিত হয়ে ওঠে। ফলে তোমার তৈরি-করা কোনোকিছু বিকল হয়ে গেলে তো আর তুমি মরে যাবে না–কিন্তু আমি যাবো।

কথাগুলি বলেই জাকারিয়ুস কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, কিন্তু ওবের তবু কথাবার্তা চালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে।

সত্যি?” সে বললে, আপনার কাজ অফুরানভাবে দেখেও আমার আশ মেটে না। পরিষদের উৎসবের জন্য আপনাকে কিন্তু তৈরি থাকতে হবে–কারণ আমি জানি কেলাস-ঘড়ি নিয়ে আপনি যে-গবেষণা করেছেন, তা অমর হয়ে থাকবে।

সে-বিষয়ে আমারও কোনো সন্দেহ নেই, ওবের, বৃদ্ধ ঘড়িনির্মাতা ঈষৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। আমি যে কেলাসকে কেটে হিরের মতো স্থায়িত্ব ও আকার দিতে পারি, এটা মোটেই কম সম্মানের বিষয় নয়। আহ হিরে-কাটার বিদ্যেকে নিখুঁত করে লুই বেরজেম মহদুপকার করে গেছেন আমাদের সেই জন্যেই তো আমি সবচেয়ে কঠিন পাথরকেও ঘষে-মেজে এমন মসৃণ আর চকচকে করে তুলতে পেরেছি, তার জন্যে তাতে ছিদ্র করা সম্ভব হয়েছে আমার পক্ষে।

কেলাস কেটে তৈরি-করা কতকগুলি সূক্ষ্ম কলকজা তুলে দেখালেন। জাকারিয়ুস–প্রতিটি কাজই তার দক্ষতার চরম পরাকাষ্ঠার নজির। ঘড়ির চাক, কীলক, আধার–সবকিছুই কেলাস কেটে বানিয়েছেন তিনি, আর এই অতি কঠিন কাজেই তার অসীম দক্ষতার পরিচয় ফুটে উঠেছে।

জাকারিয়ুসের মুখ আরক্তিম হয়ে উঠলো। এই স্বচ্ছ আধারের ভিতরে ঘড়িটা স্পন্দিত হয়ে উঠেছে, তার হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকি শোনা যাচ্ছে–এটা কি আশ্চর্য লাগে না তোমার?

বছরে এই ঘড়ির যে এক সেকেণ্ডও এদিক-ওদিক হবে না, তরুণ শিক্ষানবিশটি বললে, তা আমি বাজি ধরে বলতে পারি।

তুমি যে বাজি জিতবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমার নিজের মধ্যে যা-কিছু শুদ্ধ ও নিষ্পাপ, সব কি আমি এতে ভরে দিইনি? আর আমার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন কি কখনো এদিক-ওদিক হয়? বলল, আমার হৃৎপিণ্ডের ধকধক কি কখনো হঠাৎ থেমে যায়?

গুরুর দিকে মুখ তুলে তাকাবার সাহস পেলো না ওবের।

সত্যি করে বলো আমাকে, জাকারিয়ুসের গলা বিষণ্ণ হয়ে এলো, আমাকে কি তোমার কখনো পাগল বলে মনে হয়নি? আমাকে কি কখনো ভয়ংকর নির্বোধ বলে মনে হয়নি তোমার? বলো, মনে হয়নি কি? কন্যা জেরাঁদ আর তোমার চোখে মাঝেমাঝে আমি যেন চিরদণ্ডের ছাপ দেখতে পাই। ওহ! আর্ত ও ব্যথাতুর হয়ে এলো তার কণ্ঠস্বর, জগতে যাদের সবচেয়ে ভালোবাসা যায়, তারা যদি কখনো ভুল বোঝে তো তার চেয়ে কষ্টের আর-কিছু নেই। কিন্তু, ওবের, আমি তোমাকে আজ বলছি যে আমি কোনো ভুল করিনি, এটা একদিন অত্যন্ত সফলভাবে প্রমাণ করে দেবো! না, না, মাথা নেড়ো না, তুমি স্তম্ভিত হয়ে যাবে তখন। আমার কথায় গভীর অর্থ যেদিন বুঝতে পারবে, সেদিন আমাকেও তুমি সত্যি-সত্যি বুঝতে পারবে। সেদিন দেখবে যে আমি অস্তিত্বের মূল রহস্য বের করে ফেলেছি। সেদিন দেখবে যে প্রাণ কাকে বলে, তা আমি জেনে ফেলেছি, জেনে ফেলেছি কোন জটিল রহস্যের মধ্যে দেহ আর আত্মার অভেদ মিলন রচনা হয়ে যায়।

এ-কথা বলতে-বলতে গর্বে ও অহমিকায় জাকারিয়ুস যেন রাজার মতো উন্নত হয়ে উঠলেন। কোনো-এক অতিপ্রাকৃত আগুন জ্বলে উঠলো যেন তার চোখে, তার সর্বাঙ্গ দম্ভে দীপ্ত হয়ে উঠলো। আর, সত্যি, যে দম্ভকে ক্ষমা করা যায়, জাকারিয়ুসের এই দম্ভ বোধহয় তাই।

কারণ তার শৈশবে ঘড়িনির্মাণবিদ্যা যেন আঁতুড় ঘরে ছিল। খ্রিষ্টযুগের চার শতাব্দী আগে প্লাতো বের করেছিলেন রাতের ঘড়ি, এই বিদ্যা তদবধি যেন প্রায় স্থবির হয়ে ছিলো। বাঁশির সুরে রাতের প্রহর ঘোষণা করতো, প্লাতোর তৈরি-করা এই ঘড়ি ছিলো অনেকটা ক্লেপসিড্রার মতো। ওস্তাদ কারিগরেরা তার যান্ত্রিক দিকের চেয়ে শিল্পিতার দিকে বেশি নজর দিতেন, ফলে সে-যুগে যেন কে কত সুন্দর ঘড়ি বানাতে পারে এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিলো লোহায়, তামায়, কাঠে বা রুপোয় কারুকাজ করা হতো এইসব ঘড়ি-চেল্লিনির কলসের মতো সুন্দর শিল্পকর্ম যেন। উৎকরণ বিদ্যার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন রচিত হয়েছিলো এ-যুগে : সময় যদিও ঠিকমতো দিতো না, তবু তারা যে কতটা উৎকৃষ্ট ছিলো, সেটা মোটেই অবহেলা অমান্য করার মতো নয়। শিল্পীর কল্পনা কলকজার চেয়েও বেশি নিবদ্ধ ছিলো বহির্বিভাগে : আধার ও আবরণ কত সুন্দর করা যেতে পারে, দৃষ্টি ছিলো সেই দিকে, সচল পুতুলে আর গানের সুরে ঘড়িগুলি যেন দামি খেলনা হয়ে উঠেছিলো। তাছাড়া, সেই সুদূর অতীতে কে-ই বা সময়ের নিখুঁত পরিমাপ নিয়ে মাথা ঘামাতো? ঘড়ি কেন হঠাৎ আস্তে চলতে শুরু করে, তার কারণ তখনও আবিষ্কৃত হয়নি; জ্যোতির্বিদ্যার অনুগণনা তখনও নিক্তিমাপা সংহিতার বশবর্তী হয়ে ওঠেনি, পদার্থবিদ্যায় নির্ভুল গণনার ভিত্তি রচিত হয়নি তখনও; নির্দিষ্ট সময়ে দোকান-পশার ভোলা বা বন্ধ করার তাগিদ ছিলো না তখন; ঘড়ির কাঁটায়-কাঁটায় তখন ট্রেন ছাড়তে না। সন্ধেবেলায় ঝমঝম করে ঘন্টা বেজে উঠতো তখন–আর বিশ্বজোড়া স্তব্ধতার মধ্যে প্রহর ঘোষণা করা হতো চীৎকার করে। যদি কাজের পরিমাণের উপর পরমায়ুর পরিমাপ নির্ভয় করে, তাহলে বলতে হয়–লোকে তখন এত দীর্ঘজীবী ছিলো না–কিন্তু তারা আরো ভালোভাবে বেঁচে থাকতে জানতো। এই বিশ্বসৃষ্টির পরম রহস্য ধ্যান করে হৃদয় তখন সমৃদ্ধ হতো। দুশো বছর লাগতো তাদের একটি গির্জে বা মঠ বানাতে; কোনো শিল্পী সারা জীবনে কেবল গোটাকয়েক ছবি আঁকতেন; কবি লিখতেন একটি মাত্র মহাকাব্য : কিন্তু তবু উত্তরকাল সেই সরল অতীতের কাছ থেকে কত আশ্চর্য রচনা পেলো।

অবশেষে যখন যথাযথ ও নির্ভুল বিজ্ঞানের অগ্রগিত শুরু হলো, ঘড়িনির্মাণবিদ্যাও ক্রমশ উন্নতিলাভ করতে লাগলো। কিন্তু তবু সেই দুরতিক্রম্য বাধ্য থেকে গেলো বিরাট প্রাচীরের মতো : সময়ের অবিরাম ও নিয়মিত

পরিমাপ নেয়া তখনও সাধ্যাতিরিক্তই থেকে গেলো।

এই বন্ধ্যা ভূমিতেই জাকারিয়ুস ঘড়ির এমন-একটি গতি-নিয়ন্ত্রক আবিষ্কার করেছিলেন, দোলকের অন্তর্লীন বলের উপর নির্ভর করতে বলে ঘড়িকে যা এক গাণিতিক অবিচ্যুতি দিয়েছিলো। এই আবিষ্কারই জাকারিয়ুসের সর্বনাশ করলো : তার মাথা ঘুরে গেলো। তাপমান যন্ত্রে যেমন পারদ ফুলে ওঠে, তেমনি তার বুকে স্ফীত হয়ে উঠলো অমেয় দম্ভ–একেবারে যেন শেষ সীমায় পৌঁছুলো পারদ, এবার চন্দ্র ফেটে বেরিয়ে আসবে। উপমার সাহায্যে নিজেকে তিনি অচিৎ সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে দিয়েছেন : আর তাই ঘড়ি বানাতে-বানাতে একদিন তার মনে হয়ে গেলো তিনি বুঝি দেহ ও আত্মার মিলনের মূল রহস্যটি ভেদ করেছেন।

কাজেই ওবেরকে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতে দেখে অতি সহজেই তিনি তার নিজের ধ্যান-ধারণা খুলে বললেন : তুমি জানো প্রাণ কাকে বলে? যে-সব স্প্রিং-এর জন্যে জীব বেঁচে থাকে তাদের রহস্য তুমি কখনো ভেবে দেখেছো? নিজেকে পরীক্ষা করে দেখেছে কোনোদিন? না। অথচ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে তুমি সহজেই আমার কাজ আর ভগবানের কাজের মাঝখানে গভীর মিল খুঁজে পেতে; কারণ তাঁর প্রাণীদের দেখেই ঘড়ির চাকা বানাবার কৌশল শিখেছি আমি।

উৎসুকভাবে ওবের বলে উঠলো, ভগবানের নিশ্বাসকেই তো আত্মা বলি আমরা–হাওয়া যেমন করে ফুলকে কাঁপিয়ে যায় তার নিশ্বাসও তেমনিভাবে আমাদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে দেয়–আর তার সঙ্গে কিনা আপনি কতগুলো লোহা আর তামার কলকজার তুলনা করছেন? প্রাণের চেয়ে রহস্যময় অথচ নির্ভুল ও প্রেরণাদীপ্ত কোন যন্ত্রবিদ্যা?

প্রশ্ন সেটা নয়, অত্যন্ত নরম স্বরে বললেন বটে জাকারিয়ুস, কিন্তু তার কথার মধ্যে খাদের-দিকে-এগিয়ে-যাওয়া অন্ধের প্রবল জেদ ফুটে উঠলো। আমাকে বুঝতে হলে আমার আবিষ্কার-করা সেই সময়-নিয়ন্ত্রক দোলকটির উদ্দেশ্য ও অর্থ মনে রাখতে হবে। যে-সব ঘড়ি ঠিকমতো চলে না, তাদের দেখেই এটা আমি বুঝতে পারি যে যে-গতি তাদের মধ্যে বন্দী হয়ে আছে তা ঠিক যথেষ্ট নয়–কোনো স্বাধীন বলের দ্বারা তাকে নিয়ন্ত্রণ ও শাসন না-করলে সেই গতি কোনো কাজেই লাগবে না। সমতা রাখার জন্যে কোনো চাকা যদি। থাকে তাহলেই হয়তো এটা সম্ভব হবে–একদিন আমার মনে হলো, এবং অবশেষে ওই গতিকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলুম, আবার স্বপ্ন সফল হলো। আমার এই চিন্তাটাকে মহান ঠেকে না তোমার? ঐশ্বরিক বলে মনে হয় না কি আমার এই চিন্তাকে, যার বলে আমি বলেছিলুম যে কোনোরকমে ঘড়ির মধ্যেই যদি সেই হারিয়ে-যাওয়া গতিকে ফিরিয়ে আনা যায় তাহলেই সমস্ত ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে?

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো ওবের।

ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন জাকারিয়ুস। ওবের, একবার নিজের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো। তুমি কি বুঝতে পারছে না যে আমাদের মধ্যে যুগপৎ দুটি শক্তি কাজ করে যাচ্ছে–দেহের শক্তি, আর আত্মার–গতি আর তার নিয়ন্ত্রণ। আত্মাই প্রাণের মূল–অর্থাৎ আত্মাই হলো গতি, আন্দোলনের উৎস, আলোড়নের আকর। কী থেকে তার সৃষ্টি হয়? কোনোভাব থাকে? না কি। কোনো স্প্রিং বা কোনো নির্জড় প্রভাব থেকে? তা জানি না, কিন্তু এটা জানি যে হৃৎপিণ্ড হলো সেই জিনিশ। কিন্তু দেহ না-থাকলে এই আন্দোলন অসমান হয়ে পড়তো, হয়ে পড়তো অনিয়মিত ও অসম্ভব। কাজেই দেহই এই আত্মাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে–দেহই হলো সমতা রক্ষার সেই চাকা, আত্মা যার নিয়মিত দোলনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আর এটা যে কত সত্যি, তার প্রমাণই তো এইখানে যে, খাদ্য পানীয় বা নিদ্রা না-হলে–অর্থাৎ দেহের ক্রিয়া নিয়মিত সংঘটিত না-হলে–মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। দোলনের ফলে যে-গতিটুকু হারিয়ে যায় তা ঠিক যেমনভাবে আবার দেহকে জুগিয়ে দেয় আত্মা, আমার ঘড়িতে আশ্চর্য এই গতিনিয়ন্ত্রকটি তা-ই করে। আর কীসের মধ্যে তাহলে দেহ ও মনের মিলনের রহস্য লুকিয়ে আছে? একটি চাকা ঘুরে চলে বলেই অন্য চাকাটি চলতে পারে। এটাই আমার আবিষ্কার, আর আমি তা হাতে-কলমে খাঁটিয়েছি আমার কাজের মধ্যে। প্রাণের আর-কোনো রহস্যই। অজানা নেই আমার প্রাণ যে আসলে আশ্চর্য নিখুঁত একটি কল, তা আমি জেনে গেছি।

মতিভ্রম, সন্দেহ নেই; কিন্তু তবু জাকারিয়ুস যেন সম্ভ্রম জাগান, কেননা এই বিভ্রমই তাকে অসীমের চরম রহস্যের মধ্যে নিয়ে এসেছে। কিন্তু তার কন্যা জেরাঁদ চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে সব কথাই শুনতে পেলো। ছুটে এসে সে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো–আর তার দেহটি যেন কান্নার তোড়ে ফুলে-ফুলে উঠতে লাগলো।

তোর আবার কী হলো? কন্যাকে জিগেস করলেন জাকারিয়ুস।

এখানে যদি কেবল একটা স্প্রিং থাকতো, বুকে হাত চেপে সে বললে, তাহলে কি তোমাকে এত ভালোবাসতে পারতুম, বাবা?

নিবিষ্টভাবে জেরাঁদকে নিরীক্ষণ করলেন জাকারিয়ুস, কোনো জবাব দিলেন না। তারপরেই হঠাৎ বুকে হাত চেপে আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি, আর মুছিত হয়ে তার পুরোনো চেয়ারটিতে পড়ে গেলেন।

কী হলো তোমার, বাবা?

শিগগিরি! ওবের চীৎকার করে ডাকলো, স্কলাস্টিকা!

স্কলাস্টিকা কিন্তু তক্ষুনি এলো না। সদর দরজার কে যেন কড়া নাড়ছিলো তখন–সে গিয়েছিলো দরজা খুলে দেখতে। সে যখন কারখানা-ঘরে এসে ঢুকলো, বৃদ্ধ ঘড়িনির্মাতা ততক্ষণে চেতনা ফিরে পেয়েছেন। তাকে ঢুকতে দেখে সে কোনো কথা বলার আগেই জাকারিয়ুস বললেন, নিশ্চয়ই তুমি আরেকটা নষ্ট ঘড়ি নিয়ে এসেছো? স্কলাস্টিকা, অভিশপ্ত ঘড়িটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে . গেছে, তাই না?

কী আশ্চর্য। আপনি তা জানলেন কী করে? ওবেরের হাতে স্কলাস্টিকা একটি বিকল ঘড়ি তুলে দিলে।

আমার হৃৎপিণ্ড কখনো ভুল করো না, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন জাকারিয়ুস।

অত্যন্ত যত্নসহকারে চাবি ঘুরিয়ে দম দিলো ওবের–কিন্তু তবু সে-ঘড়ি কিছুতেই আর চলবে না।