তিন পিশাচ

ভলিউম ১৭ – তিন পিশাচ – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ : অক্টোবর, ১৯৯২

০১.

রবিনের চোখে পড়ল প্ল্যাস্টিকের ব্যাগটা। সৈকতের বালিতে দেবে রয়েছে। তুলে নিয়ে দেখে হাসল। স্বচ্ছ প্ল্যাস্টিকের ব্যাগের গায়ে লাল রঙে আঁকা রয়েছে কয়েকটা বেড়ালছানা। গলায় নীল রুমাল বাঁধা। ভেতরে অনেক জিনিসের মধ্যে রয়েছে একটা খেলনা ভালুক, কালো কুৎকুতে চোখ মেলে যেন তারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

বাচ্চা মেয়ের জিনিস, বলল সে। ভুলে ফেলে গেছে।

সৈকতের এদিক ওদিক তাকাল মুসা। কোন বাচ্চা মেয়েকে চোখে পড়ল না। বেলা পড়ে এসেছে। নির্জন হয়ে গেছে সৈকত। কেবল একজন নিঃসঙ্গ সারফারকে দেখা গেল তার বোর্ড নিয়ে চলেছে রাস্তার দিকে। ওয়াচটাওয়ার থেকে নেমে চলে যাচ্ছে লাইফগার্ড।

যেখানে আছে ফেলে রাখো, বলল মুসা। মেয়েটার মনে পড়লে ফিরে এসে তুলে নেবে।

বয়েস বেশি কম হলে আসতে পারবে না, বলল দলের তৃতীয় সদস্য কিশোর পাশা। তাছাড়া অন্য কেউও তুলে নিয়ে যেতে পারে।

বালিতে বসে পড়ে ব্যাগটার জন্যে হাত বাড়াল সে। দেখি, কিছু মেলে কিনা। তাহলে পৌঁছে দিতে পারব।

ব্যাগটা নিয়ে উপুড় করে সমস্ত জিনিস কোলের ওপর ঢেলে দিল কিশোর। হুম! বলে ভুরু কোঁচকাল। মানিব্যাগ নেই। আইডেনটিটি নেই। রোমশ খেলনা ভালুকটা বাদেও রয়েছে একটা বই, নাম সাকসেস থ্রু ইমেজিং আর পিপল ম্যাগাজিনের একটা কপি। নানা রকম কসমেটিকসের বাক্স আর টিউব আছে। গুনল কিশোর। চার ধরনের লিপস্টিক, আই শ্যাডোর দুটো প্ল্যাস্টিক বক্স, একটা আইলাইনার পেনসিল এবং মেকাপ করার আরও কিছু টুকিটাকি জিনিস। একজোড়া লাল পাথর বসানো কানের টবও পাওয়া গেল।

বাচ্চা মেয়ের নয় ব্যাগটা, বলল সে। বয়স্ক মহিলার। প্রচুর মেকাপ নেয়।

এবং ছোটদের মত খেলনা পছন্দ করে, যোগ করল মুসা।

বইয়ের মলাট উল্টে দেখল কিশোর। লাইব্রেরির বই। পেছনের মলাটের ভেতর দিকে আঠা দিয়ে সাঁটা একটা ম্যানিলা খাম, ফ্রেনসো পাবলিক লাইব্রেরির ছাপ মারা।

সূত্র একটা মিলল, খুশি হয়ে বলল গোয়েন্দাপ্রধান। বই বন্ধ করে বন্ধুদের দিকে তাকাল। কে বইটা নিয়েছে নিশ্চয় খাতায় লেখা আছে। ঠিকানা নিয়ে ব্যাগটা ফিরিয়ে দিতে আর অসুবিধে হবে না।

ফ্রেনসো, না? ঠোঁট ওল্টাল রবিন। ফোন করতে অনেক পয়সা লাগবে।

 লাগুক, মুসা হাসল। জিনিস ফেরত পেলে খুশি হয়ে কলের দামটা দিয়ে দেবে মহিলা।

হয়ত আমাদেরকে দাওয়াতও করে বসতে পারে, আশা করল কিশোর। ফ্রেনসোর আঙুরের খেত দেখার জন্যে। চলো, তাড়াতাড়ি করতে হবে। নইলে লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যাবে।

বালির ওপর দিয়ে মেইন রোডের দিকে প্রায় দৌড়ে চলল তিন গোয়েন্দা। সাইকেল তিনটে শুইয়ে রেখে গেছে রাস্তার পাশে। তুলে নিয়ে ছুটল স্যালভিজ ইয়ার্ডে।

ইয়ার্ডে যখন পৌঁছল সূর্য তখন ডুবতে বসেছে। বাড়ির জানালাগুলোয় রোদ পড়ে কাচগুলোকে মনে হচ্ছে চারকোণা সোনার চাদর। সেদিকে নজর দেয়ার সময় নেই ওদের। তাড়াহুড়া করে দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে এসে ঢুকল হেডকোয়ার্টারে। ফ্রেনসোর ডিরেকটরি এনকয়ারিতে ফোন করল কিশোর। পাবলিক লাইব্রেরির নম্বর নিয়ে ডায়াল করল লাইব্রেরিতে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, সময় বেশি নেই।

 বেশি সময় লাগলও না। ওপাশ থেকে রিসিভার তুলতেই টেলিফোন লাইনে লাগানো স্পীকারের সুইচ অন করে দিল কিশোর, সবার শোনার জন্যে। ভারিক্কি চালে বলল, হ্যালো, কিশোর পাশা বলছি। তারপর জানাল কেন ফোন করেছে।

কমপিউটারে রেকর্ড করা আছে সব, ওপাশ থেকে জবাব দিল মহিলা কণ্ঠ। দেখি, কি করতে পারি।

কিছুক্ষণ নীরবতার পর আবার শোনা গেল কথা। উত্তেজিত হয়ে উঠেছে মহিলা। তোমাদের নম্বরটা দেয়া যাবে? আবার ফোন করতে হতে পারে–

যাবে।

প্লীজ!

নম্বর দিল কিশোর।

ফোনের কাছ থেকে নোড়ো না, মহিলা বলল। কেটে গেল লাইন।

আস্তে করে রিসিভার নামিয়ে রেখে দুই বন্ধুর দিকে তাকাল কিশোর। ব্যাপারটা কি বলো তো? মহিলাকে বেশ অস্থির মনে হল।

কিছু একটা হয়েছে, মুসা বলল।

কয়েক মিনিট পরেই ফোন বাজল। ওপাশের কণ্ঠটা এবারেও একজন মহিলার, তবে আগের জনের নয়। উত্তেজনায় কাঁপছে, উন্মাদ হয়ে গেছে যেন। ওকে দেখেছ? জিজ্ঞেস করল মহিলা। আমি আসছি। আমার মেয়েটা …মেয়েটা হারিয়ে গেছে!

ফুঁপিয়ে উঠল লাউডস্পীকার। আরেকটা পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেল। শান্ত হও নরিয়া, প্লীজ, ওরকম কোরো না! রিসিভারটা মহিলার হাত থেকে নিয়ে নিয়েছেন তিনি। কিশোর পাশা?

বলছি।

বইটা সৈকতে পেয়েছ?

হ্যাঁ।

ফ্রেনসো পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বইটা ধার নিয়েছিল আমার মেয়ে। তার পর পরই হারিয়ে গেছে।

বলুন।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, হলিউডে গিয়ে সিনেমায় অভিনয় করবে বলে।

পেছন থেকে মহিলা বললেন, ওকে বলো, আমরা আসছি।

বলছি, নরিয়া, বলছি।

লম্বা দম নিলেন ভদ্রলোক, টেলিফোনেই বোঝা গেল। বললেন, আমার নাম পিটার ডিকসন। তোমাদের ফোন পেয়ে আশা হচ্ছে, মনে হচ্ছে ডলি ভালই আছে। তোমাদের সঙ্গে দেখা করা দরকার। কথা বললে কিছু বেরিয়ে পড়তে পারে। ব্যাগে কোন ঠিকানা পেয়েছ?

না।

পুলিশ কিছু করতে পারছে না। তোমাদের ঠিকানাটা দাও। কাল সকাল নাগাদ পৌঁছে যাব।

লিখে নিন।

ঠিকানা লিখে নিয়ে কিশোরকে ধন্যবাদ জানিয়ে লাইন কেটে দিলেন মিস্টার ডিকসন।

মেয়ে হারিয়েছে। প্রায় চিৎকার করে বলল মুসা। চমৎকার আরেকটা কেস পেয়ে গেল বোধহয় তিন গোয়েন্দা, কি বলো?

বইটার পাতা ওল্টাতে আরম্ভ করেছে কিশোর। জানি না। কয়েকটা রশিদ বেরোল ভেতর থেকে। দেখে নিয়ে মাথা দোলাল সে, এটা হাই-লো লোন জুয়েলারি কোম্পানির। আর এটা ক্যাশ-ইন-আ-ফ্ল্যাশ, ইক। বন্ধকী কারবার করে। মনে হচ্ছে মেয়েটার টাকার খুব দরকার পড়েছিল।

রশিদগুলো ভেতরে রেখে বইটা বন্ধ করে নামটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। সাকসেস গ্রু ইমেজিং। নাম শুনেছি বইটার। লেখক বলতে চান, শুধু কল্পনা করেই মনের জোরে তুমি যা চাইবে তাই পেয়ে যাবে। মনের মত কাজ চাও? পেয়ে যাবে। বাড়ি চাও..

কিংবা সিনেমার অভিনেত্রী হতে চাইলেও হয়ে যাবে, রবিন বলল।

তাই। আবার বইটা খুলল কিলোর। একটা বিশেষ অধ্যায়ের বিশেষ জায়গা পড়তে শুরু করল, কি ভাবে উন্নতি করা যায়। ইচ্ছে শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যা ইচ্ছে তাই পাওয়া যায়।

 খাইছে! হেসে ফেলল মুসা। এ তো দেখছি আলাউদ্দিনের আশ্চর্য চেরাগ। উইল পাওয়ার খাটাতে খাটাতে বাড়ি যাই। দেখব, একটা আস্ত কেক দিয়ে ফেলে নাকি মা।

.

০২.

পরদিন সকালে ইয়ার্ডের অফিসের সামনে জটলা করছে তিন গোয়েন্দা। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল একটা টয়োটা। ড্রাইভিং সিট থেকে বেরিয়ে এসে কিশোর পাশাকে খুঁজলেন এক ভদ্রলোক। লম্বা, মাথায় বাদামী চুল পাতলা হয়ে আসছে, চেহারায়। বুদ্ধির ছাপ। পাশের প্যাসেঞ্জার সিট থেকে নামলেন এক মহিলা। কালো চুল। চোখেমুখে প্রচণ্ড উদ্বেগের ছাপ।

মিস্টার ডিকসন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

 হ্যাঁ। তুমিই ডলির ব্যাগটা পেয়েছিলে তো?

আমি না, রবিন পেয়েছে। দুই সহকারীর পরিচয় করিয়ে দিল, কিশোর। অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন মেরিচাচা। ডিকসনদের মেয়ে হারিয়েছে শুনে তাদেরকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেলেন বসে কথা বলার জন্যে।

 টেবিলে ব্যাগটা রেখে দিয়েছে কিশোর। মিসেস ডিকসন দেখে চিনতে পেরে মাথা ঝাঁকালেন। ও রকম ব্যাগ পছন্দ করে ডলি। হালকা। ভেতরের জিনিসগুলো ঢেলে দিলেন টেবিলে। খেলনা ভালুকটার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকালেন। এটা কিছু বলতে পারবে না।

লাইব্রেরির বইটা তুলে নিলেন তিনি। ভেতর থেকে বের করলেন রশিদগুলো। একবার দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন, পিটার, ও না খেয়ে আছে! পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভিখিরি আর চোর-বদমাশদের সঙ্গে! মরবে তো!

রশিদগুলো দেখে ডিকসনও গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, অনেক কারণেই মানুষ জিনিস বন্ধক রেখে টাকা ধার নেয়। না খেয়ে আছে, এটা জোর দিয়ে বলতে পারো না।

 হাতে করে একটা খাম নিয়ে এসেছেন তিনি। টেবিলের ওপর উপুড় করে ঢেলে দিলেন। একগাদা ফটোগ্রাফ। ডলির ছবি। আঠারো বছর বয়েস। সৈকতে বেশি যাওয়ার অভ্যেস থাকলে নিশ্চয় তাকে দেখেছ।

তিন গোয়েন্দার হাতে হাতে ছবিগুলো ঘুরতে থাকল। সুন্দর চেহারার কালো চুল আর সবুজ চোখওয়ালা একটা মেয়ের ছবি। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে বাজিয়ে দলের ড্রামবাদকের পোশাক পরা। কড়া করে লিপস্টিক লাগিয়েছে। কোনটাতে ব্যালে ড্যান্সার, কোনটাতে তীর্থযাত্রী। দশ বছর বয়েসে তোলা ছবি আছে, আছে তের বছর বয়েসে তোলা মিস টিন ফ্রেনসো প্রতিযোগিতায় রানার্স আপ হওয়ার ছবি।

ছবিগুলো অবাক করল ছেলেদের।

একেক ছবিতে একেক রকম লাগছে, মুসা বলল। কোনটা যে ওর আসল চেহারা বোঝাই মুশকিল।

চুলের কারণে লাগছে এরকম, বুঝিয়ে দিলেন মিসেস ডিকসন। কখনও লম্বা, কখনও ছোট। কখনও সাদা লিপস্টিক, কখনও গাঢ় লাল, কখনও কমলা। তবে সবুজ আর নীল কখনও লাগাতে দেখিনি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে চুলেও রঙ লাগায়নি।

কাঁদতে শুরু করলেন মিসেস ডিকসন।

পুলিশকে জানিয়েছি, ডিকসন বললেন। কিছুই করতে পারছে না। সৈকতে যে জায়গায় ব্যাগটা পেয়েছ, সে জায়গাটা দেখতে চাই। তারপর লাইফগার্ডদের সঙ্গে কথা বলব।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। সার বেঁধে গিয়ে উঠল ডিকসনের গাড়িতে। সারাটা সকাল তিনজনেই বসে বসে দেখল সৈকতময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন ডিকসন দম্পতি। লাইফগার্ড আর অল্প বয়েসী রৌদ্র স্নানার্থীদের সঙ্গে কথা বলছেন। বেলা একটা নাগাদ হতাশ এবং ক্লান্ত হয়ে পড়লেন দুজনে।

ছবিটা কেউ চিনতে পারল না, ডিকসন বললেন।

ছবিতে যা দেখাচ্ছে মেয়েটা তার চেয়ে সুন্দর, মিসেস বললেন। গোলমালটা বোধহয় সেখানেই। আবার কাঁদতে শুরু করলেন তিনি।

 খুঁজে ওকে বের করবই, বললেন ডিকসন। ছেলেদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, এ শহরে খুঁজতে কতটা সময় লাগবে, বলতে পার? বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করব। সুপারমার্কেটগুলোতে খোঁজ নেব। হ্যাণ্ডবিল বিলি করব। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেব।

এখানকার পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন, পরামর্শ দিল রবিন। খুব ভাল লোক।

সুতরাং থানায় চললেন ডিকসন দম্পতি। ফ্লেচারের সঙ্গে দেখা করে মেয়ে হারানোর কথা জানালেন।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ক্যাপ্টেন বললেন, আজকালকার ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই হলো সমস্যা। একটা ছবিতে টোকা দিয়ে বললেন, এটা রাখতে পারি?

নিশ্চয়ই, মিসেস বললেন।

 শেষ কবে তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে? জানতে চাইলেন ফ্লেচার।

দুমাস আগে। এর দুদিন আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। ফোন করে আমাদেরকে চিন্তা করতে মানা করল। আমরা তাকে বোঝাতে যেতেই কেটে দিল লাইন।

মাথা ঝাঁকালেন চীফ। ডিকসনদের ফোন নম্বর আর ঠিকানা লিখে নিয়ে বললেন, আমার লোকদের জানিয়ে দেব। খেয়াল রাখবে। ইয়ে, ছেলেগুলোকে কাজে লাগাচ্ছেন না কেন?

ছেলেগুলো? বুঝতে পারলেন না মিসেস ডিকসন।

হ্যাঁ, ওরা। তিন গোয়েন্দাকে দেখালেন চীফ। ওরা গোয়েন্দা। ভাল কাজ করে। বহুবার সাহায্য করেছে পুলিশকে।

এই সুযোগটারই যেন অপেক্ষায় ছিল কিশোর। চীফ বলেও সারতে পারলেন না, পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার কার্ড বের করে বাড়িয়ে ধরল সে।

কার্ডটা পড়লেন ডিকসন। বললেন, চীফ যখন সুপারিশ করছেন, কোন প্রশ্ন আর করতে চাই না। বুঝতে পারছি তোমরা ভাল কাজ করো। ঠিক আছে, ভাড়া করলাম। চেক লিখে দেব?

না, মাথা নাড়ল কিশোর। টাকা নিই না আমরা। শখে কাজ করি। তবে ডলিকে আগে পেয়ে নিই, খরচাপাতি যা হবে, বিল পাঠিয়ে দেব, দিয়ে দেবেন। এখন আপনার মেয়ের একটা ছবি দরকার আমাদের।

যা চাও, পুরো খামটাই কিশোরকে দিয়ে দিলেন ডিকসন। যখন যা দরকার হবে, শুধু একটা ফোন করবে আমাকে। পেয়ে যাবে।

তো, আমরা এখন কি করব? চীফকে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস।

বাড়ি ফিরে যান। টেলিফোনের কাছে বসে থাকবেন। আমরা কিছু জানতে পারলে জানাব।

হায়রে, মেয়েটাকে কত মানা করলাম বেরোতে, গলা ধরে এল মিসেস ডিকসনের, শুনল না। আর দেখব কিনা কে জানে!

.

০৩.

কাজটা আসলে আমাদেরকে গছিয়ে দিলেন চীফ, মুসা বলল।

তা তো দিলেন, টেবিলে বিছানো ছবির দিকে তাকিয়ে রবিন বলল, কিন্তু শুরু করব কোত্থেকে?

হাসল কিশোর। বন্ধকীর দোকানগুলো থেকে করতে পারি।

হেডকোয়ার্টারে বসে কথা বলছে ওরা।

সোজা হল রবিন। ঠিক।

ওসব জায়গা থেকে টাকা ধার করতে হলে, কিশোর বলল। কোন মূল্যবান জিনিস জমা রাখতে হয়। নাম-ঠিকানা দিতে হয়।

তাহলে তো পেয়েই গেলাম! নিশ্চিন্ত হলো মুসা।

পাব, সব সময় নিরাশ করার প্রবণতা কিশোরের, খারাপ দিকটা চিন্তা করে, যদি রশিদগুলো ডলির হয়। অন্য কারুরটাও রাখতে পারে। দুই সহকারীর মুখের দিকে তাকাল, গোয়েন্দাপ্রধান। রশিদে হলিউডের ঠিকানা দেখা যাচ্ছে। একটু পরেই পিকআপ নিয়ে হলিউডে যাবে বোরিস। লিফট নিতে পারি আমরা।

একমত হয়ে ট্রেলার থেকে বেরিয়ে এল তিনজনে।

হাতের কাজ শেষ করে গাড়ি বের করল বোরিস। মেয়েটা যে বাড়ি থেকে পালিয়েছে, একথা শুনেছে। রাশেদ পাশার কিনে রেখে আসা পুরনো মাল আনতে হলিউডে যাচ্ছে সে। তিন গোয়েন্দাকে নিতে অসুবিধে নেই।

 পেছনে উঠে বসল তিন কিশোর। রশিদের ঠিকানা মোতাবেক প্রথম দোকানটার সামনে নামল। ভেতরে আলো খুব সামান্য। কেমন ছাতলা পড়া গন্ধ। কিশোরের বাড়িয়ে দেয়া রশিদটার দিকে গম্ভীর মুখে তাকাল মালিক, তারপর নীরবে খুলল একটা আলমারির তালা। নীল ফিতে লাগানো রূপার একটা মেডেল বের করে আনল। ফেরত নেবে?

হাতে নিয়ে জিনিসটা দেখতে লাগল কিশোর। স্ট্যাচু অভ লিবার্টির মত দেখতে একটা মূর্তি আঁকা রয়েছে মেডেলের একপিঠে। আরেক পিঠে লেখা রয়েছেঃ ফ্রেনসো জেসিজ স্পেলিং বী প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। ডালিয়া ডিকসন।

মেয়েটা ঠিকানা রেখে গেছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর। আমরা তার বন্ধু।

বাড়ি থেকে পালিয়েছে নিশ্চয়?

 হ্যাঁ। মাস দুই আগে…

হাত তুলে থামিয়ে দিল কিশোরকে দোকানি। আর বোলো না। ওসব পুরানো কেচ্ছা। শুনতে ভাল লাগে না।

একটা রেজিস্টার বের করে কাউন্টারে বিছিয়ে পাতা ওল্টাতে শুরু করল সে। কি নাম বললে?

ডালিয়া ডিকসন।

মাথা নাড়ল লোকটা। না। জিনিসটা বন্ধক রেখে গেছে এলিজা পিলচার।

ঠিক বলছেন তো? রবিনের কণ্ঠে সন্দেহ।

চোখ ভালই আছে আমার।

ঠিকানা আছে? জানতে চাইল কিশোর।

আবার খাতার দিকে তাকাল লোকটা। পশ্চিম লস অ্যাঞ্জেলেস। তেরোশো বিরাশি রিভারসাইড ড্রাইভ।

কিন্তু পশ্চিম লস অ্যাঞ্জেলেসে তো কোন রিভারসাইড ড্রাইভ নেই? রবিনের প্রশ্ন।

মিথ্যে ঠিকানা অনেকেই দিয়ে থাকে, অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিশোরের বাড়িয়ে ধরা ছবিটা হাতে নিয়ে দেখল দোকানি। কিছুটা নরম হয়ে বলল, দেখতে তো ভালই। ও মেডেল নিয়ে আসেনি। যে এসেছিল তার চুল সোনালি, গালে একটা তিল আছে। ট্রায়াফে অভিনয় করে যে মেয়েটা তার মত। প্রতি সোমবার টিভিতে দেখে আমার স্ত্রী।

ওই অভিনেত্রীর নাম এলিজা পিলচার, কিশোর বলল।

মাথা ঝাঁকাল দোকানি। কি জানি, অন্য কেউও এসে তার নামে মেডেলটা দিয়ে টাকা নিতে পারে। ছদ্মবেশ ধরাটা তো কঠিন কিছু না। শোনো, এটা কি নেবে তোমরা? আট ডলার পঁচাত্তর সেন্ট লাগবে।

টাকা দিয়ে মেডেলটা নিয়ে নিল কিশোর।

 বাইরে বেরিয়ে পিকআপে এসে উঠল তিন গোয়েন্দা।

কেসটা বিশেষ সুবিধের মনে হচ্ছে না আমার, অভিযোগের সুরে বলল মুসা।

খুব তাড়াতাড়ি হতাশ হয়ে যাও তুমি, কিশোর বলল। তদন্ত চালিয়ে যেতে হবে। কোন দোকানে খোঁজ পেয়েও যেতে পারি।

দ্বিতীয় দোকানের মালিক ততটা নিরস নয়। তবে তেমন তথ্যও দিতে পারল। শুধু বলতে পারল, সোনার একটা আংটি নিয়ে এসেছিল একটা মেয়ে। পরনে টিউনিক, পায়ে হাঁটু সমান উঁচু বুট। মহাকাশের গল্প নিয়ে করা ছবি। সার্চ ফর এরিওয়ান-এর অভিনেত্রীর মত পোশাক।

 কি নাম বলল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

শেলি টেনার।

হু। ছবিটার নায়িকার নাম।

আংটিটা নেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না কিশোর। নিল না। পিকআপে ফিরে এসে দেখল অস্থির হয়ে উঠেছে বোরিস। বার বার ঘড়ি দেখছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে বোধহয়।

তোমাদের হলো? জিজ্ঞেস করল সে।

আর একটা দোকান, জবাব দিল কিশোর। হলিউড বুলভারে যেতে হবে।

দেরি করলে রেগে যাবেন মিসেস পাশা, বলল বটে, তবে গাড়ি নিয়ে চলল বুলভারে। এই রাস্তাটা আমার পছন্দ না।

কেন, সেটা জানা আছে গোয়েন্দাদের। গলিটা নোংরা। দুধারের বাড়িগুলো জীর্ণ, মলিন। মানুষগুলোও তেমনি। হলিউডের চাকচিক্যের ছিটেফোঁটাও নেই এখানে।

যে দোকানটা খুঁজছে কিশোররা, তার এক ব্লক দূরে মোড়ের কাছে গাড়ি রাখার জায়গা আছে। নেমে গেল ছেলেরা। স্যুভনির আর হলিউডের ম্যাপ বিক্রি করে ওরকম একটা দোকান পার হয়ে আরও দুটো দরজার পর বন্ধকী দোকানটা। আগে আগে চলেছে মুসা।

অহেতুক সময় নষ্ট, বিড়বিড় করে বলল সে। দোকানের দরজায় পা দিল।

হঠাৎ চেঁচামেচি শোনা গেল দোকানের ভেতর। ছুটে বেরোল একটা লোক। মুসার গায়ে এসে পড়ল। কনুইয়ের গুঁতো মেরে তাকে ফেলে দিয়েছিল আরেকটু হলেই।

অ্যাই অ্যাই! করে চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। তাকিয়ে রয়েছে মুসা। কালো মুখ ঠোঁটের দুই কোণ থেকে বেরিয়ে রয়েছে শ্বদন্ত। নাকের ফুটো বড় বড়। চোখ প্রায় দেখাই যায় না গভীর কোটরের অনেক ভেতরে যেন লুকিয়ে রয়েছে। শয়তানী ভরা চাহনি।

আবার চিৎকার করার জন্যে মুখ খুলল মুসা। শব্দ বেরোল না। লোকটার হাতের দিকে তাকাল। কালো, রোমশ থাবা। বড় বড় নখ বেরিয়ে আছে আঙুলের মাথা থেকে।

দোকানের ভেতরে চিৎকার শোনা গেল। ছুটতে শুরু করল অদ্ভুত লোকটা।

আবার চিৎকার করে উঠল দোকানের ভেতরের লোকটা, ধর! ধর!

গলির দিক থেকে চেঁচিয়ে উঠল এক মহিলা।

সুভনিরের দোকানের ভেতরে দুঃস্বপ্নের মত হারিয়ে গেল কিম্ভুত মানুষটা। আবার শোনা গেল চেঁচামেচি।

এতক্ষণে হুঁশ ফিরল যেন মুসার। দৌড়ে গেল স্যুভনিরের দোকানে। দেরি করে ফেলেছে। পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে চলে গেছে লোকটা।

বন্ধকীর দোকানে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা। দোকানদার কাঁপছে এখনও। কিশোরের প্রশ্নের জবাবে সে বলল, ডাকাতি করতে এসেছিল! পালাল!

 সাইরেন শোনা গেল গলির মাথায়। ভেতরে এসে ঢুকল একটা পুলিশের গাড়ি। ওটা দোকানের সামনে এসে থামতে না থামতেই পেছনে এসে দাঁড়াল, আরেকটা। ভিড় জমল। দোকানের মালিকের সঙ্গে বেরেলি তিন গোয়েন্দা। পাগলের মত হাত নাড়ছে লোকটা।

জনতাকে পিছে হটিয়ে দিল একজন পুলিশ অফিসার। আরেকজন জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেল দোকানদারকে। হাত তুলে মুসাকে দেখিয়ে দিল লোকটা। তৃতীয় আরেকজন অফিসার এসে প্রশ্ন করল মুসাকে, তুমিই লোকটাকে থামানোর চেষ্টা করেছিলে?

মাথা ঝাঁকাল মুসা।

কি হয়েছিল?

দ্বিধা করল মুসা। বলল, বললে তো বিশ্বাস করতে চাইবেন না। পাগল ভাববেন আমাকে।

বলো।

লোকটা…লোকটাকে মানুষ মনে হল না। দানব!

 ধৈর্য হারাল না অফিসার। গরিলা? না অন্য কোন ধরনের দানব?

গরিলা-টরিলা নয়। কি বলব?…মায়ানেকড়ের মত লাগল। সিনেমাতে যেগুলো দেখায়।

হুম! নোটবুক বের করল অফিসার। তা মায়ানেকড়েটা কতটা লম্বা হবে?

 প্রায় আমার সমান।

 কিশোরের দিকে ফিরল অফিসার। তুমি কি জিনিস দেখেছ?

কিশোর জানাল, সে-ও মায়ানেকড়েই দেখেছে। তারপর বলল, অবাক লাগছে না তো আপনার?

হাসল অফিসার। গত হপ্তায় একটা পেট্রল স্টেশনে এরকম ঘটনা ঘটেছে। গরিলা সেজে এসেছিল একজন।

হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে এতক্ষণে, বলে উঠল বন্ধকী দোকানের মালিক। কাগজে দেখেছি। সবুজ মুখওয়ালা মানুষের কথাও পড়েছি। ঘাড় থেকে নাকি কি একটী বেরিয়ে থাকে। সান্তা মনিকায় কি যেন করেছিল।

অফিসার হাসল। এ শহরে কোন কিছুই স্বাভাবিক নয়।

পুলিশ চলে গেলে তিন গোয়েন্দাকে বলল দোকানদার, আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলে?

ডলির কথা বলল তাকে কিশোর। দোকানে ঢুকে রেজিস্টার বের করল লোকটা। তারপর ড্রয়ার খুলে ধনুকের মত, দেখতে একটা সোনার পিন বের করল।

এ রকম একটা জিনিস বন্ধক রাখতে আসে কেউ, বল? লোকটা বলল। খারাপ লাগে না? ইস্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন নেয়ার পর সাধারণত মানুষ এ ধরনের জিনিস উপহার পায়।

যে মেয়েটা বন্ধক রাখতে এসেছিল তার চেহারা মনে আছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর। দেখুন তো ও নাকি?

কিশোরের বারিয়ে ধরা ডালিয়া ডিকসনের ছবিটা দেখল দোকানি। হতে পারে। কড়া মেকআপ করে এসেছিল। চুলের রঙও আরেকটু হালকা ছিল। তবে এ-ই হতে পারে।

আরেকবার রেজিস্টার দেখল লোকটা। জানাল পিনটা বন্ধক রাখতে এসেছিল এনভি নিউম্যান নামে একটা মেয়ে।

আরেকজন অভিনেত্রীর নাম, গুঙিয়ে উঠল কিশোর। নাহ, কোন পথ দেখতে পাচ্ছি না।

.

০৪.

সেদিন বিকেলে হেডকোয়ার্টারে মিলিত হলো তিনজনে। হাত-পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে পড়েছে মুসা। প্রশ্ন তুলল, এ রকম বহুরূপী একটা মেয়েকে কি করে খুঁজে বের করব আমরা?

একটা মুহূর্ত কেউ কোন জবাব দিতে পারল না। তারপর কিশোর বলল, সিনেমায় ঢোকার চেষ্টা করছে ডলি। কাজেই দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে পারে। ওদের কাছে গিয়ে খোঁজ নিতে পারি আমরা।

হ্যাঁ, চেষ্টা করতে দোষ কি? খুব একটা আশাবাদী মনে হল না মুসাকে।

পরদিন সকালে বাসে করে হলিউডে চলে এল তিনজনে। একটা তালিকা তৈরি করে নিয়ে এসেছে কিশোর। এক নম্বর নামটা থেকে শুরু করল। প্রথমেই রিসিপশনিস্টের সঙ্গে দেখা। রোগাটে এক মহিলা। ওদের কথা শুনতেই চাইল না। অবশেষে জানিয়ে দিল, মক্কেলদের কথা বাইরের লোকের কাছে বলার নিয়ম নেই।

সে আপনাদের মক্কেল না-ও হতে পারে, মরিয়া হয়ে বলল মুসা।

তাহলে আমাদের কাছে এসেছ কেন? আবার টাইপিঙে মন দিল মহিলা।

দ্বিতীয় এজেন্সীটাতে গোমড়ামুখো মহিলা কড়া গলায় বলল, জানলেও বলতাম না। লজ্জা করে না? এই বয়সেই অভিনেত্রীদের পিছে লেগেছ?

লাল হয়ে গেল কিশোরের মুখ। পিছে লাগিনি। তার বাবা-মা আমাদেরকে পাঠিয়েছেন তাকে খুঁজে বের করতে…

ও, বাড়ি থেকে পালিয়েছে। তাহলে পুলিশের কাছে যায় না কেন? তিনটে ছেলেকে পাঠায়। যত্তসব! ওসব শয়তান ছেলেমেয়ের খোঁজ রাখার দায়িত্ব নিইনি আমরা। যেতে পার।

তৃতীয় এজেন্সীটাতে অতটা খারাপ ব্যবহার করল না রিসিপশনিস্ট। কিশোরকে চিনতে পেরে চিৎকার করে উঠল, আরে, মোটুরাম না! কি কাণ্ড দেখো

ছেলেবেলায় একটা কমেডি সিরিজে অভিনয় করেছিল কিশোর। সেটাতে তার। নাম ছিল বেবি ফ্যাট সো। নামটাকে ঘৃণা করে সে। এবং যে ওই নামে তাকে ভাকে, তাকেও। 

ডলির ছবির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল মহিলা। ও রকম চেহারার অনেকেই আছে। কে ও? বোন? বন্ধু?

তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড মহিলাকে দিয়ে কিশোর জানাল, ওর নাম ডালিয়া ডিকসন। ওকে খুঁজে বের করে দেয়ার জন্যে আমাদেরকে অনুরোধ করেছে। ওর বাবা-মা। দুমাস আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে।

মনে হয় অহেতুক সময় নষ্ট করছ। ওর মত আরও হাজার হাজার ছেলেমেয়ে আছে। তবে সিনেমায় ঢোকার চেষ্টা করে থাকলে খোঁজ মিলতেও পারে। টেলিভিশনের জন্যে একটা সিরিজ হচ্ছে, রিচ ফর আ স্টার। তার অডিশনে যোগ দিতে পারে। ওখানে অ্যামেচারদেরকে ডাকা হয়েছে।

যে স্টুডিওতে অডিশন হবে তার ঠিকানাটা দিল মহিলা। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল ছেলেরা। স্টুডিওতে পৌঁছে দেখল গেটের সামনে লাইন, লম্বা হয়ে চলে গেছে, সেই ব্লক পেরিয়ে তার পরের ব্লকের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে।

সোজা গেটের দিকে এগোল কিশোর। চিৎকার করে উঠল লাইনে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েরা। প্রতিবাদের ঝড় উঠল।

কিশোরের হাত চেপে ধরল মুসা। এভাবে পারবে না। অন্য কোন উপায় বের করতে হবে। এ লাইনে দাঁড়ালে এ জনমে কোনদিন ঢুকতে পারব না।

 বাস স্টপেজের একটা বেঞ্চে বসে পড়ল কিশোর। উপায় তো একটা বের করতেই হবে।

তিনজনেই ভাবছে। উজ্জ্বল হলো রবিনের মুখ। এখানে ঢোকা যাবে না। তার চেয়ে আরেক কাজ করতে পারি আমরা। ট্যালেন্ট এজেন্টদের সাহায্য নিতে পারি। ডলির ছবি দিয়ে হ্যাঁন্ডবিল ছেপে ডাকে পাঠিয়ে দেব ওদের কাছে। এ শহরে যতগুলো স্টুডিও আর এজেন্ট আছে সবার কাছে পাঠাব। অনুরোধ থাকবে, এই মেয়েটিকে কেউ দেখে থাকলে দয়া করে তিন গোয়েন্দাকে একটা ফোন করবেন। ঠিকানা এবং ফোন নম্বর দিয়ে দেব আমাদের।

সাড়া দিল না কিশোর।

আমার কিন্তু বেশ ভাল মনে হচ্ছে, আবার বলল রবিন।

আমারও, তার সঙ্গে একমত হলো মুসা। সারা হলিউড চষে বেড়াতে হবে না। যে সব লোক আমাদের সঙ্গে কথাই বলতে চায় না তাদের কাছে গিয়ে ধরনা। দিতে হবে না।

এর চেয়ে ভাল আর কোন উপায় আপাতত কিশোরেরও মাথায় এল না। অগত্যা আবার কি বীচে ফিরে চলল বাসে করে। ইয়ার্ডে ফিরে দেখল, রোভার একা। ভেনচুরাতে মাল কিনতে গেছেন রাশেদ পাশা আর মেরিচাচী। বোরিসকেও নিয়ে গেছেন। কিশোরকে দেখেই রোভার বলল, বাজারে যেতে পারেননি আজ ম্যাম। ফ্রিজে কিছু নেই, বলে গেছেন, খিদে পেলে পয়সা বের করে নিয়ে গিয়ে পিজাটিজা কিছু কিনে খেতে।

খুব ভাল, খুব ভাল, খুশি হয়ে উঠল মুসা। তাই খাব। দেরি করছি কেন?

দাঁড়াও, টাকা নিয়ে আসি, কিশোর বলল। ভালই হল। খেতে খেতে হ্যাঁণ্ডবিলে কি লিখতে হবে সেটার একটা খসড়া করে ফেলতে পারব।

সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল তিনজনে। রকি বীচে কোস্ট, হাইওয়ের পাশের পিজা শ্যাকটা বেশ জনপ্রিয়। ওখানে গিয়ে ভিড় করে কিশোর আর তরুণেরা। পিজা খায়, ভিডিও গেম খেলে, মিউজিক শোনে, আর বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ জমায়।

তিন গোয়েন্দা ঢুকে দেখল, ভিডিও গেম খেলছে কয়েকজন। কালো চুলওয়ালা হাসিখুশি একটা মেয়ে খেলছে আর মাথা ঝাঁকিয়ে খিলখিল করে হাসছে।

বড় সাইজের তিনটে পিজার অর্ডার দিয়ে কাউন্টারের সামনে বসে অপেক্ষা করতে লাগল ওরা। হুল্লোড় করে উঠল ভিডিও গেম প্লেয়াররা।

মেয়েটা মনে হয় ভাল খেলে, রবিন মন্তব্য করল।

খেলা শেষ। ফিরে তাকাল মেয়েটা। তারপর উঠে এল টুল থেকে। দরজার দিকে এগোল। তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা। মেয়েটার স্কার্টের ঝুল এত বেশি। প্রায় মাটি ছুঁই ছুঁই করছে। পুরানো ছাটের একটা ব্রাউজ পরেছে, সামনের দিকটা দোমড়ানো। খুদে একটা ঘড়ি বসানো রয়েছে বুকের একপাশে। কানে দুল। সব কিছু মিলিয়ে তাকে এ যুগের মেয়ে লাগছে না, মনে হচ্ছে একশো বছর আগের। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওদের দিকে তাকিয়ে হাসল সে। বেরিয়ে গেল।

এ রকম পোশাক পরেছে কেন? অবাক হয়ে বলল রবিন।

কুমড়োর মত মোটা এক মহিলা বেরিয়ে এল রান্নাঘর থেকে। হাতে ট্রে। খাবারে বোঝাই। তিনটে পিজা ছেলেদের সামনে নামিয়ে রেখে কোকা কোলা। আনতে গেল।

 খাবারের দিকে হাত বাড়িয়েই থমকে গেল কিশোর। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, পেয়েছি! তুড়ি বাজাল। ওই মেয়েটাই!

কোন মেয়েটা? বুঝতে পারল না মুসা।

ডলি। ডালিয়া ডিকসন! কোন সন্দেহ নেই।

লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল কিশোর। হ্যাঁচকা টানে দরজা খুলে ছুটে বেরোল। পিজা শ্যাকের সামনের পার্কিং স্পেসে এসে দাঁড়িয়ে তাকাল ডানে বাঁয়ে। তারপর মেইন রোডের দিকে। দুদিক থেকেই চলাচল করছে গাড়ি। ওপাশে রাস্তার বাইরে। দাঁড়িয়ে-বসে রয়েছে কয়েকজন ভবঘুরে। কিন্তু পুরানো পোশাক পরা মেয়েটা নেই।

.

০৫.

 এই শুনছ! এই ভাই, খেলাটা একটু থামাবে তোমরা? জরুরী কথা বলতাম। খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে বলল কিশোর। আবার এসে পিজা শপে ঢুকেছে। খেলা থামিয়ে ফিরে তাকাল সবাই। অবাক হয়েছে। রান্নাঘরে যাচ্ছিল মোটা মহিলা, থমকে দাঁড়াল।

যে মেয়েটা এইমাত্র বেরিয়ে গেল, বলল কিশোর। তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি আমরা।

 পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল খেলোয়াড়েরা। কারও কারও চোখে সন্দেহ ফুটেছে এখন। অস্বস্তি বোধ করছে। একজন জানতে চাইল, কেন?

 ডলির ছবি বের করে দিল কিশোর। হাতে হাতে ঘুরতে লাগল ওটা। বলল, ওর বাবা দিয়েছেন ছবিটা। খুঁজে বের করতে অনুরোধ করেছেন। ফ্রেনসোতে বাড়ি। দুই মাস আগে বেরিয়েছে, আর ফিরে যায়নি।

কিন্তু ওর বাবার নাম তো ডিকসন নয়, বলল আরেকটা ছেলে। ওর নামও ডলি নয়।

হয়ত বানিয়ে অন্য নাম বলেছে, রবিন বলল।

 অনেক বেশি ডিটেকটিভ ছবি দেখো তোমরা, বলল একটা মেয়ে।

গরম হয়ে বলল মুসা, ছবি দেখলেই ডিটেকটিভ হয়ে যায় নাকি! খালি : এককথা। বোঝে না শোঝে না, একটা বলে দিলেই হলো।

তার ধমকে কাজ হলো। অস্বস্তিতে পড়ে গেল ছেলেমেয়েরা। আরেকটা মেয়ে বলল, ওই মেয়েটা বাড়ি থেকে পালায়নি। এদিকেই থাকে।

চেনো?

চিনি।

দুই মাসের বেশি? কিশোর জানতে চাইল

জবাব দিতে পারল না মেয়েটা।

ঘন ঘন পোশাক পাল্টায়, তাই না? আবার বলল কিশোর। চুলের রঙও বদলায়।

চুপ হয়ে গেছে সবাই। একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে খেলোয়াড়েরা। জবাব দিতে চাইছে না। ভাবছে বোধহয়, এই তিনজন কারা?

তামাটে রঙের একটা গাড়ি এসে থামল বাইরে। ধূসর চুলওয়ালা একজন। লোক ঢুকলেন। কি ব্যাপার, সবাই এত চুপচাপ? কিছু হয়েছে নাকি?

না, মিস্টার জেনসেন, এগিয়ে এল ওয়েইট্রেস। এই ছেলেগুলো ওদের একজন বন্ধুকে খুঁজতে এসেছে।

ও, বলে কাউন্টারের ওপাশে চলে গেলেন মিস্টার জেনসেন। ক্যাশ রেজিস্টার খোলা এবং টাকা গোনা দেখেই বোঝা গেল তিনি ম্যানেজার।

অবশেষে কিশোরকে বলল একটা মেয়ে, ওই মেয়েটা কোথায় থাকে আমি জানি। মেইন রোড ধরে গেলে পুরানো একটা হাউজিং কমপ্লেক্স পাবে, চেশায়ার স্কোয়্যার, ওখানে। নাম বেটসি।

ভাল নাম? রবিন জানতে চাইল।

বেটসি অ্যারিয়াগো।

নাক টানল কিশোর। নামটা ঠিক তো?

না হওয়ার তো কোন কারণ দেখি না, জবাব দিল একটা ছেলে। আর বাড়ি থেকে পালালেই কেউ নাম বানিয়ে বলে না। কেন বলবে? বাড়ি থেকে বেরোনো অপরাধ না। বেরিয়েছে যে তারও নিশ্চয় কোন কারণ আছে। হয়ত ওর মা দুর্ব্যবহার করত…

 ও অভিনেত্রী হতে চায়, বাধা দিয়ে বলল মুসা। পালিয়েছে সে জুন্যে। কেউ তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেনি। অন্তত আমাদের জানা নেই।

বেশ, ছেলেটা বলল। ওর সঙ্গে আবার দেখা হলে তোমাদের কথা বলব। ঠিক আছে?

দ্বিধা করল কিশোর। তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করে দিয়ে বলল, এই নাম্বারে ফোন করতে বোলো, প্লীজ।

কার্ডের দিকে তাকিয়ে হাসল ছেলেটা। বাহু, গোয়েন্দা। জিনসের প্যান্টের পকেটে রাখতে রাখতে বলল, বলব।

ওদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে দুই সহকারীকে নিয়ে আবার কাউন্টারে ফিরে এল কিশোর।

রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো ওয়েইট্রেস মহিলা। পেছনে চললেন ম্যানেজার। ছেলেমেয়েরা ফিরে গেল তাদের খেলায়।

কিশোরের দিকে কাত হয়ে নিচু স্বরে বলল রবিন, মেয়েটা ফোন করবে বলে মনে হয় তোমার?

না, পিজা চিবাতে চিবাতে জবাব দিল কিশোর। তার ফোনের অপেক্ষায় বসেও থাকব না। চেশায়ার স্কোয়্যার আমরাও চিনি। জলদি খাও।

.

চেহারা পুরানো হলেও এখন আর পুরানো নেই কমপ্লেক্সটা। অনেক সংস্কার করা। হয়েছে। পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে আছে, সাগরের দিকে মুখ। নতুন করে রঙ করা হয়েছে। চকচক করছে পেতলের জিনিসগুলো। নতুন লনে নতুন ফুলের বেড তৈরি হয়েছে।

যে লোক সংস্কার করেছেন, তিনি নিজেকে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবি করেন। রসিক লোক। সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভবিষ্যতের প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধাঁধায় ফেলার জন্যেই তিনি একাজ করেছেন। মাটি খুঁড়ে বের করবে ওরা আঠারোশো নব্বই সালের বাড়ি, তিনি বলেছেন। দেখবে ভেতরে বোঝাই হয়ে আছে উন্নত কারিগরির যন্ত্রপাতি, যেগুলো তৈরি হয়েছে। আরও একশো বছর পরে। দ্বিধায় পড়ে যাবে ওরা।

ডলি নামের কেউ থাকে না এখানে, পাহারাদার বলল।

তাহলে বেটসি অ্যারিয়াগো? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

 সতর্ক হলো লোকটা। তোমাকে চেনে?

 নিশ্চয়ই।

 তোমার নাম?

 কিশোর পাশা। ও রবিন মিলফোর্ড, আর ও মুসা আমান। ফ্রেনসোর মিস্টার ডিকসন পাঠিয়েছেন, আমাদেরকে। বেটসির সঙ্গে জরুরী কথা আছে আমাদের।

দ্বিধা করল প্রহরী। টেলিফোনে হাত।

বলেই দেখুন না, খুব খুশি হবে। মিস্টার ডিকসন, মনে রাখবেন। কিন্তু কিশোরের কথা শুনছে না লোকটা। নিচের মেন রোডে পুলিশের সাইরেন বাজছে। দ্রুত ছুটে আসছে।

রাস্তার দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। রকি বীচ পুলিশের গাড়িটা চিনতে অসুবিধে হলো না। মোড় নিয়ে চেশায়ার স্কোয়্যারে ওঠার গলিতে পড়ল। উঠে আসতে লাগল ওপরে।

 বাড়ির ভেতরে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল কেউ। রাগ আর ভয় মেশানো চিৎকার।

অ্যাই! অ্যাই! বলে চেঁচিয়ে উঠল রবিন।

দারোয়ানের ছোট ঘর থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল প্রহরী। বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে আসা লোকটার পথরোধ করে দাঁড়াল। গাঢ় রঙের শার্ট পরনে। একটা মোজা টেনে দিয়েছে মাথার ওপর, যাতে চেহারাটা চেনা না যায়। তবে মাথায় কালো চুল, এটা গোপন করতে পারল না।

ছুটে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল লোকটা। ঝট করে পা বাড়িয়ে দিল প্রহরী। তৈরিই ছিল লোকটা। পা-টা এড়িয়ে গিয়ে এক ঘুসিতে চিৎ করে ফেলল। প্রহরীকে।

 মুসাও আটকাতে গেল ওকে। প্রচণ্ড ঘূসি এসে লাগল মুখে। তার মনে হলো হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারা হয়েছে। বোঁ করে উঠল মাথা। রাস্তার ওপরই বসে পড়ল।

রবিন আর কিশোর কিছু করার আগেই ছুটে চলে গেল লোকটা। লাফাতে লাফাতে গিয়ে ঢুকল পাহাড়ের ঢালের ঝোপঝাড়ের ভেতর।

০৬.

ঘ্যাঁচ করে এসে গেটের কাছে ব্রেক কষল পুলিশের গাড়ি। লাফিয়ে গাড়ি থেকে নামল দুজন অফিসার, ছুটল লোকটাকে ধরার জন্যে। আরেকটা গাড়ি উঠে এল। ওপরে। আরও দুজন অফিসার নামল। দারোয়ানকে উঠতে সাহায্য করল একজন। আরেকজন ঝুঁকল মুসার ওপর। বেশি লেগেছে?

দাঁত বোধহয় বারো-চোদ্দটা খসে গেছে।

টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল মুসা। দারোয়ানের ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। এই সময়ে চোখে পড়ল মেয়েটাকে। সেই লম্বা ঝুলওয়ালা স্কার্ট আর দোমড়ানো ব্লাউজ পরা। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পুলিশকে বলতে লাগল, জোর করে ঢুকল!…আমি সবে বাড়িতে এসেছি।… দোতলায় উঠে হলের দিকে যাচ্ছি, এই। সময় টের পেলাম কেউ আছে!

সাদা হয়ে গেছে মেয়েটার মুখ। গলা কাঁপছে। পায়ে ব্যথা পেয়েছে দারোয়ান। খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে বসল তার ঘরের সামনে রাখা চেয়ারে।

কোন বাড়িটায়? জিজ্ঞেস করল অফিসার। কোথায় থাকো তুমি?

 ছোট পার্কটার দিকে দেখাল মেয়েটা। তারপর হঠাৎ করেই কাঁদতে শুরু করল।

লেসিঙের বাড়ি, হাত তুলে দেখিয়ে বলল দারোয়ান। ওইটা। এগারো নম্বর। পার্কের ওধারের ওই যে বাড়িটা।

মাথা ঝাঁকাল অফিসার। সঙ্গীকে নিয়ে গিয়ে উঠল আবার গাড়িতে। মেয়েটা দাঁড়িয়েই আছে। ডিকসনদের দেয়া ছবির মেয়েটার চেয়ে এই মেয়েটা রোগী, তবে চোখের রঙ মিলে যাচ্ছে। ডালিয়া ডিকসনই? নাকি প্রায় একই রকম দেখতে অন্য কোন মেয়ে?

খানিক বাদেই ফিরে এল পুলিশের গাড়িটা। লোকটার পিছু নিয়েছিল যে, দুজন অফিসার, তারাও ফিরে এল। হাঁপাচ্ছে। কপালে ঘাম। যে অফিসার মেয়েটার সঙ্গে কথা বলেছিল, সে নেমে আবার বলল, এখন একটু ভাল লাগছে, না? আমাদের সাহায্য করতে পারবে? কিছু চুরিটুরি গেল কিনা দেখা দরকার।

ক্লান্ত ভঙ্গিতে ধপ করে বসে পড়ল মেয়েটা।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, হাত নেড়ে বলল অফিসার। অত তাড়াহুড়া নেই। জিরিয়ে নাও। পুরো ঘটনাটা খুলে বলতে পারবে?

হলের দিকে যাচ্ছিলাম, মেয়েটা বলল। এই সময় মনে হলো পেছনে কেউ আছে। ফিরে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। তখন মনে হলো, শোবার ঘরে শব্দ হয়েছে। তারপর…

হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো।

কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল মেয়েটা। ভয় পেয়ে গেলাম। যদি চোরটোর হয়? মিসেস লেসিঙের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। আমার গলা ও শুনে ফেলতে পারে, এ জন্যে রেডিওটা জোরে চালিয়ে দিয়ে পুলিশকে ফোন করলাম।

 বুদ্ধিমানের কাজ করেছ। ওসব সময়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। তারপর?

তারপর আর কিছু না। পুলিশের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সাইরেনের শব্দ শুনে পালানোর চেষ্টা করল লোকটা। ওর পায়ের আওয়াজ শুনে মাথা খারাপ হয়ে গেল আমার, পালাতে দিতে চাইলাম না। সিঁড়িতে গিয়ে জাপটে ধরলাম। ওকে।

এটা বোকামি হয়ে গেছে। লোকটা কি করল?

ঝাড়া দিয়ে আমাকে ফেলে দিয়ে দৌড় দিল।

ভাগ্যিস ছুরিটুরি মারেনি। ওরকম বোকামি আর করবে না।

উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। চলুন। এখন যেতে পারব।

 দারোয়ান বলল, তোমার সঙ্গে কারও থাকা উচিত। বন্ধু-বান্ধব কেউ নেইখবর দাও না।

মাথা নাড়ল মেয়েটা। আমার বন্ধুরা সব শহরের বাইরে।

এগিয়ে গেল কিশোর। ডলি, আপনার মাকে খবর দিতে পারি আমরা।

থমকে গেল মেয়েটা। তারপর আস্তে করে ঘুরে তাকাল কিশোরের দিকে। ডলি? আমার নাম ডলি নয়। বেটসি। বড় জোর বেটি বলতে পারো।

ওকে বিরক্ত কোরো না! কড়া গলায় বলল দারোয়ান। এমনিতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে মেয়েটা। ভয়ে কাবু।

পুলিশের গাড়িতে করে চলে গেল বেটি। একজন অফিসার তিন গোয়েন্দার কাছ থেকে ঘটনাটার বিবরণ লিখে নিতে লাগল।

মুসার চোয়ালের বেগুনী হয়ে যাওয়া জায়গাটার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে লাগল দারোয়ান। ব্যাটার গায়ে জোর আছে। তোমারই যখন এ অবস্থা করে দিয়েছে…নাহ, আজকাল আর শান্তি নেই। এত বড় বাড়িতে মেয়েটার একা থাকা একেবারেই উচিত না।

 বাড়িটার মালিক কে? জিজ্ঞেস করল রবিন। কোথায় থাকে?

মিসেস আরনি লেসিং। কয়েকদিন আগে ইউরোপ গেছে। কয়েক হপ্তা হল এসেছে বেটি, মিসেস লেসিঙের সঙ্গে আছে। তিনি খুব ভাল। ছেলেমেয়েদের কষ্ট সইতে পারেন না। কেউ অসুবিধেয় আছে দেখলেই তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেন। বেটি বোধহয় কোথাও একটা পার্টটাইম কাজটাজ করে। এখানে মিসেস লেসিঙের বাড়িঘর দেখাশোনা করে যে মহিলা, তাকে সাহায্য করে। বাড়িতে কি একটা জরুরী কাজ পড়ে যাওয়ায় কাল থেকে আসছে না মহিলা। ফলে বেটি একা হয়ে গেছে।

 তিন গোয়েন্দার মুখের দিকে তাকাল দারোয়ান। সত্যিই তাকে তোমরা চেন?

ডালিয়া ডিকসনের ছবিটা বের করে দেখাল কিশোর। ডলির বাবা-মা এটা দিয়েছে আমাদেরকে। কি মনে হয়?

সময় নিয়ে ছবিটা দেখল দারোয়ান। ভাবের পরিবর্তন হল না। এই বয়েসের একটা মেয়ে আমারও আছে।

আপনি নিশ্চয় চান, আপনার মেয়ে ভাল থাকুক?

মাথা ঝাঁকাল লোকটা। বেটির সঙ্গে আমি কথা বলব। ও-ই ডলি কিনা জানার চেষ্টা করব। এখন হবে না। মুখ খুলবে না ও। একে তো চোরের ভয়; তার ওপর পুলিশের ঝামেলা। টেনশনে আছে।

কাল সকালে আসি একবার, কি বলেন?

এসো। আমি বেটির সঙ্গে কথা বলে রাখব। কাল সকালে বাড়িতে যাতে থাকে, তারও চেষ্টা করব। অন্তত তোমরা যতক্ষণ না আসো, কাজে বেরোতে দেব না। আশা করি, আমার কথা রাখবে ও।

.

পরদিন সকালে চেশায়ার স্কোয়্যারে একা এল কিশোর। মুসা আর রবিনের সঙ্গে স্ত্র আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, একা আসাই ভাল। বেশি মানুষ দেখলে হয়ত অস্বস্তিতে পড়ে যাবে মেয়েটা, তখন আর মুখ খুলতে চাইবে না।

কিশোরকে দেখেই বলতে শুরু করল দারোয়ান, ওর বাবা-মা যে তোমাদেরকে পাঠিয়েছে একথা বলিনি ওকে। নিজে নিজেই হয়ত আন্দাজ কবে নিয়েছে। আমি শুধু বলেছি, তোমরা তার ভাল চাও। দেখা করতে রাজি হয়েছে।

 মিসেস লেসিঙের বাড়িটা দেখিয়ে বলল সে, ওই যে, পার্কের ওপাশের বড় বাড়িটা।

দারোয়ানকে ধন্যবাদ দিয়ে চত্বরে ঢুকল কিশোর। এসে দাঁড়াল ১১ নম্বর বাড়ির সামনে। দোতলা বাড়ি। ভিক্টোরিয়ান আমলের চেহারা। সে আবার পা বাড়াতেই একটা দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এল বেটি। এসেছ। আমি তোমার জন্যেই বসে আছি।

 কিশোর পাশা, হাত বাড়িয়ে দিল গোয়েন্দাপ্রধান।

হেসে হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিল বেটি। তারপর ঘরে ঢুকে গেল ভেতরে। তাকে অনুসরণ করল কিশোর। ঢুকেই একটা ধাক্কা খেল। একলাফে যেন চলে। এসেছে অন্য এক যুগে। ঘরের চেহারাটা বানিয়ে রাখা হয়েছে একশো বছর আগের। চওড়া সিঁড়ি, দোতলার কাঠের গ্যালারি, দেয়ালের প্যানেলিং, আসবাবপত্র সব পুরানো আমলের। পুরু লাল কার্পেটে গোড়ালি দেবে যায়। দেয়ালে ঝুলছে ভারি ফ্রেমে বাঁধানো পেইনটিং।

কেমন জানি লাগে, তাই না? কিশোরকে বলল বেটি। এসো, রান্নাঘরে। এখানকার চেয়ে ভাল।

 মেয়েটার পিছু পিছু সিঁড়ির পাশ কাটিয়ে এল কিশোর। রান্নাঘরটা ভালই। বোদ আসছে। পুরানো আমলের একটা স্টোভে পানি ফুটছে। চেহারাটাই প্রাচীন, জিনিসটা আধুনিক, ইলেকট্রিক হীটার।

দুটো জানালার মাঝের দেয়াল ঘেঁষে রাখা হয়েছে টেবিল। ওখানে চেয়ারে বসতে বলল কিশোরকে বেটি। কিশোরকে কোক বের করে দিল সে। নিজের জন্যে চা ঢেলে নিল।

 বেটি কাজ করছে, আর চুপ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে কিশোর। মেঝে ছুঁয়ে যাওয়া গাউনই পরেছে। কালে ফিতে দিয়ে চুল বাঁধা। তার মনে হলো, বাড়িটার সঙ্গে মানানোর জন্যেই বুঝি এ রকম করে কাপড় পরেছে মেয়েটা।

সত্যি, শুরু করল কিশোর। মিসেস লেসিং খুব ভাল। আপনাকে থাকতে দিয়েছেন।

হ্যাঁ। আসলেই ভাল।

তার সঙ্গে পরিচয় হল কি করে?

একটা বিউটি পারলারে।

 পারলারটার নাম?

গোল্ডেন ড্রীম।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। চেনে। রকি বীচেই ওটা।

কাজকর্ম এখনও তেমন শিখতে পারিনি, মেয়েটা বলতে থাকল। কাটতে গিয়ে মিসেস লেসিঙের চুল নষ্ট করে ফেলেছিলাম। অনেকেই এ রকম করে অবশ্য। শিক্ষানবিস অনেক আছে ওখানে। অভিনেত্রী হতে চায় ওরা। যাই হোক, মিসেস লেসিং কিছু বলেননি আমাকে। অভিজ্ঞ একজন বিউটিশিয়ান এসে তখন তার চুল ঠিক করে দিয়েছিল। নিয়মিতই তিনি ওখানে যেতেন। কথা হত আমার। সঙ্গে। হপ্তা দুই আগে আমাকে বললেন, তিনি কিছুদিনের জন্যে ইউরোপে। যাচ্ছেন। হাউসকীপার একা থাকতে ভয় পায়। আমি চাইলে তার বাড়িতে থাকতে পারি। রাজি হয়ে গেলাম।

ভাল করেছেন। থাকাখাওয়ার জায়গা হয়ে গেলে সুবিধে। আপনি নিশ্চয় অভিনয় প্র্যাকটিস করার অনেক সুযোগ পাচ্ছেন।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটা। তার মনের কথাটা কি করে বুঝে ফেলল ভেবে অবাক হয়েছে। লুই গনজাগা বলল তোমরা নাকি বেশ চিন্তায় আছ।

দারোয়ান?

হ্যাঁ। সতর্ক হয়ে কথা বলছে বেটি। কিশোর কে, কতটা জানে তার সম্পর্কে, না জেনে সব কথা ফাঁস করতে চায় না।

ডলির ছবিটা বের করল কিশোর। টেবিলে রেখে ঠেলে দিল বেটির দিকে।

 একবার ছবিটা দেখল মেয়েটা। কিছু বলল না। ঘুরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

ডলি, কিশোর বলল। তাহলে ধরে নিতে পারি…

বার বার আমাকে ওই নামে ডাকছ কেন? রাগ করে বলল মেয়েটা। আমি বেটি। বেটসি অ্যারিয়াগো।

অভিনেত্রীরা ওরকম গালভরা নামই বেছে নেয়।

তাতে তোমার কি? কে তুমি?

আমাকে আর আমার দুই বন্ধুকে অনুরোধ করেছেন আপনার বাবা-মা, আপনাকে খুঁজে বের করে দিতে। সাগর সৈকতে পাওয়া ব্যাগটার কথা জানাল। কিশোর। সারা রাত গাড়ি চালিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তাঁরা। আপনার মা খুব কাঁদছিলেন।

ওদেরকে তো আমি বলেছি আমি ভাল আছি। চিৎকার করে উঠল ডলি।

 স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। যাক, স্বীকার করল এতক্ষণে! আসলে। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দরকার ছিল আপনার। তাহলেই আর দুশ্চিন্তা করতেন না।

যোগাযোগ! জোর করে ধরে নিয়ে যাবে তাহলে!

কিন্তু কি যে কষ্ট পাচ্ছেন। তারা কল্পনা করতে পারবেন না। একবার ফোন করেও তো বলে দিতে পারেন…

ঠিক আছে, বাবা, দেব!

ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে খানিকটা চা কাপড়ে ফেলে দিল ডলি। সিঙ্কের কাছে একটা দেয়াল টেলিফোন রয়েছে। সেটার বোতাম টিপতে লাগল দ্রুত।

চেয়ে রয়েছে কিশোর। তার কাজ শেষ।

হাল্লো!..হাল্লো! আম্মা?…আরে, হা হা, আমি! ডলি! যে ছেলেটাকে আমাকে খুঁজতে পাঠিয়েছ, এখানেই বসে আছে। …হ্যা…

থেমে ওপাশের কথা শুনতে লাগল ডলি। আবার বলল, না, আমি আসতে পারব না। খুব ভাল আছি। ছেলেটা বলল, তাই…

আবার কথা শুনতে লাগল ডলি। রেগে গেল হঠাৎ। যা বলার বলেছি! আমি আসব না! এখানে একটা চাকরি করছি আমি। থাকার চমৎকার জায়গা পেয়েছি। কিছুদিন ক্লাস করতে হবে আমাকে…

কিছুক্ষণ চুপ করে শুনুল আবার। কিসের ক্লাস জানো না? কতবার বলব! অ্যাকটিং ক্লাস, অভিনয় শেখায় যেখানে। ওসব অ্যালজেব্রা-ফ্যালজেব্রার মধ্যে কোনদিনই যাব না আমি আর।

ওপাশের কথা শুনে খেঁকিয়ে উঠল, আব্বার শরীর খারাপটা কি আমি করেছি। নাকি? তোমাকে ফোন করাটাই একটা গাধামি হয়ে গেছে। খটাস করে ক্রেডলে রিসিভার রেখে দিল ডলি। গজগজ করতে লাগল, যত্তসব! কারও কথা শোনাই উচিত না! কিশোরের দিকে চোখ পড়তে বলল, বাড়ি ফিরে যেতে বলে! গেলে কি হবে জান? আবার ধরে ইস্কুলে পাঠাবে। গলা টিপে মেরে ফেলার অবস্থা করবে। তারপর যখন কতগুলো ছাইপাশ হজম করে ইস্কুল থেকে বেরোব, ওদের পছন্দ করা কোন হাঁদার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেবে! ব্যস, গেল আমার লাইফ!

কি বলবে? জবাব খুঁজে পেল না কিশোর।

.

০৭.

সেদিন সন্ধেবেলা রকি বীচে পৌঁছলেন ডিকসনরা। মেরিচাচীর সঙ্গে ইয়ার্ডে কাজ করছিল তিন গোয়েন্দা, গাড়ির শব্দে ফিরে তাকাল। বাড়ি ফিরেই আগে নেসোতে ফোন করেছিল কিশোর। ডলির ঠিকানা দিয়েছিল, কি কি কথা হয়েছে বলেছিনা। তাহলে এখানে কেন ওরা?

খাইসে! মুসা বলল। কিছু একটা নিশ্চয় হয়েছে!

বেরিয়ে এলেন মিসেস ডিকসন। ডলিকে পেয়েছ! হাসছেন, কিন্তু চোখ লাল। অনেক কেঁদেছেন বোঝা যায়।

হ্যাঁ, জবাব দিল কিশোর। ফোনেই তো সব বললাম।

মুসার দিকে তাকালেন মিসেস ডিকান। চোয়াল এখনও নীল হয়ে আছে, যেখানে ঘুসি খেয়েছিল? আজেবাজে লোকের সঙ্গে মিশছে না তো ডলি?

না, মাথা নেড়ে বলল মুসা।

মিস্টার ডিকসনও বেরিয়ে এলেন। মেয়েটা এখন বাড়ি গেলেই হয়।

আপনাদের তো চেশায়ার স্কোয়্যারে যাওয়ার কথা, কিশোর বলল। কোন গোলমাল?

আসলে, হাসলেন মিসেস ডিকসন। তোমাদেরকে সঙ্গে নিয়েই যাব ভাবলাম। আমরা গেলে হয়ত ভাগিয়ে দেবে। তোমরা যদি একটু বলেকয়ে…

মেয়েকে ভয় পায় ডিকসনরা, বুঝে ফেলল কিশোর। তেতো হয়ে গেল মন। এদের সঙ্গে দেখা না হলেই ভাল হত, ভাবতে লাগল সে।

সরে গেল মুসা। জঞ্জালের কাছে গিয়ে অযথাই কি যেন খুঁজতে লাগল। রবিন একটা চেয়ার পরিষ্কারে মন দিল।

কিন্তু এমন অনুরোধ শুরু করল ডিকসনরা, গাড়িতে উঠতে বাধ্য হল তিন গোয়েন্দা। আবার চেশায়ার স্কোয়্যারে চলল।

লুই গনজাগা নেই গেটে। আরেকজন দারোয়ানের ডিউটি তখন। লেসিং হাউসের মেয়েটার মা-বাবা তাকে দেখতে এসেছেন শুনে খুশি হল সে।

দেখুন, বুঝিয়ে-শুনিয়ে নিয়ে যেতে পারেন কিনা। গেট খুলে দিল দারোয়ান।

ওরকম করে কথা বলল কেন লোকটা! ফিরে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে আছেন মিসেস।

 কি বলার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেলেন, ডিকসন। সামনের ছোট পার্কটার দিকে নজর। আরও ডজনখানেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। ভিক্টোরিয়ান চেহারার বাড়িটার পাশে ছেলেমেয়েরা ভিড় করছে ওখানে। ষোলো থেকে উনিশের মধ্যে বয়েস।

সবখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছেলেমেয়েরা। একটা ছেলে গিয়ে উঠেছে লেসিং হাউসের ছাতে। চিমনিতে পিঠ দিয়ে বসে পায়রাকে দানা খাওয়াচ্ছে। সামার হাউসের ওপরেও উঠেছে কয়েকটা ছেলে। ড্রাইভওয়েতে ব্রেকড্যান্স করছে একটা ছেলে, ওর দিকে তাকিয়ে চেঁচাচ্ছে ওরা। উৎসাহ দিচ্ছে।

সমস্ত কোলাহলকে ছাড়িয়ে গেছে মিউজিকের আওয়াজ। ড্রাম, বাঁশি, আর আরও নানারকম বাদ্যযন্ত্রের মিশ্র শব্দে কান ঝালাপালা।

পার্টি দিচ্ছে মেয়েটা, মিসেস ডিকসন অনুমান করলেন।

একে পার্টি বলো? মুখ বাঁকালেন ডিকসন। এ তো রায়ট লেগেছে!

লেসিং হাউসের কাছ থেকে চারটে বাড়ি দূরে গাড়ি রাখলেন তিনি। হেঁটে এগোলেন। বাগানে গিজগিজ করছে ছেলেমেয়ের দল। চত্বরে আর বাড়ির পাশেও একই অবস্থা। কয়েকজনকে চিনতে পারল তিন গোয়েন্দা, পিজা শ্যাকে দেখেছিল।

বিকট বাজনার তালে তালে নাচছে কয়েকজন। চিৎকার করছে। কাগজের মোড়ক খুলে পিজা খাচ্ছে। পোশাক-আশাকও উদ্ভট। কেউ কেউ গহনা পরেছে। পরেছে বলেই গহনা বলে মনে হচ্ছে ওগুলোকে, নইলে কি জিনিস চেনাই যেত না। একটা ছেলে শার্ট-প্যান্ট কিছু পরেনি। কতগুলো কাপড়ের টুকরো শরীরে জড়িয়ে নিয়ে একগাদা সেফটিপিন দিয়ে আটকে রেখেছে। গলায় পেঁচিয়ে রেখেছে একটা জীবন্ত সাপ। আরেকটা ছেলে এসব নাচানাচিতে নেই। সে গিয়ে চত্বরের পাশের সুইমিং পুলে ঢেলে, একটা মাছের অ্যাকোয়ারিয়াম খালি করছে।

সামনের সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে বেলের বোতাম টিপলেন মিসেস ডিকসন। এই সময় আরও জোরালো হয়ে গেল মিউজিক। ছাগলের ডাকের মত মাআঁ মাআঁ করে উঠল কি একটা যন্ত্র।

বাড়ির পাশ ঘুরে বেরিয়ে এল একটা ছেলে। হাতে ডিটারজেন্ট-পাউডারের বাক্স। ডিকসনদের ওপর চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাই, বেবি, লোক এসেছে।

সামনের চত্বরে ছোট ফোয়ারাটায় গিয়ে পুরো বাক্স ঢেলে দিল সে।

বেজে চলেছে বাজনা।

ফোয়ারায় সাবানের ফেনা তৈরি হচ্ছে। ফুলে উঠল। বাইরে উপচে পড়তে লাগল ফেনা, ঘাসের ওপর দিয়ে পানির সঙ্গে বইতে শুরু করল। বাতাস এসে ঝাপটা দিয়ে কিছু ফেনা উড়িয়ে নিল। দেখতে দেখতে সাদা ফেনায় ভরে গেল। কাছের পাতাবাহারের পাতা আর গাছের ডাল।

দারুণ! চিৎকার করে নিজের শিল্পকর্মের প্রশংসা করল ছেলেটা।

তিন গোয়েন্দার মনে হল, সব কটা বদ্ধ উন্মাদ।

দরজায় কিল মারতে শুরু করলেন ডিকসন। মারতেই থাকলেন, মারতেই থাকলেন।

অবশেষে খুলে গেল দরজা। মানুষের আকৃতির আজব একটা প্রাণী যেন বেরিয়ে এল। মেকাপ করে করে ফ্যাকাসে সাদা করে ফেলা হয়েছে চামড়া। কালো লিপস্টিক।

ডলি! চিৎকার করে বললেন মিসেস ডিকসন।

এটা কিসের সাজ? তিক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন ডিকসন। পেত্নীর?

দরজা বন্ধ করে দিতে গেল ডলি। ঝট করে একটা পা ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে আটকালেন তার বাবা।

ডলি! মা আমার! ককিয়ে উঠলেন মিসেস ডিকসন। মেয়েকে ধরার জন্যে হাত বাড়ালেন তিনি।

থমকে গেছে ডলি। কেঁপে উঠল ঠোঁট। চোখের কোণে পানি টলমল করল। ঝাঁপ দিয়ে এসে পড়ল মায়ের বুকে। জাপটে ধরল। মেয়ের ভুরুতে লাগানো কালো মাসকারা দাগ করে দিল মায়ের সাদা ব্লাউজ, কিন্তু পাত্তাই দিলেন না তিনি।

দরজায় হেলান দিলেন ডিকসন। চুপ করে আছেন। মা মেয়ের মিলন নাটক চলছে, তা-ই দেখছেন নীরবে। মা কাঁদছে, মেয়েও কাঁদছে। মিনিটখানেক পরে ওদের পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলেন।.স্টেরিও সেটটা দেখতে পেলেন, যেটা থেকে বেরোচ্ছে বিকট শব্দ। বন্ধ করে দিলেন।

 আচমকা এই নীরবতা যেন বড় বেশি কানে বাজল।

হৈ চৈ কমে গেল অতিথিদের। ওরা বুঝতে পেরেছে, বয়স্ক মানুষ ঢুকেছে। পিছলে সরে যেতে শুরু করল যেন সকলে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই মা-বাবার সঙ্গে একা হয়ে গেল ডলি। মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে পিজার মোড়ক, আর খাবারের ভুক্তাবশেষ। নোংরা করে রেখেছে। তিন গোয়েন্দার মনে হল, এই নরকে ঢোকার চেয়ে অন্য কোথাও গিয়ে বসে থাকা অনেক ভাল।

পার্টির লোকজনকে ভোজবাজির মত মিলিয়ে যেতে দেখে কান্না থামাল ডলি। ক্ষোভ জমতে লাগল মনে। শেষে সেটা প্রকাশই করে ফেলল, দিলে তো সব নষ্ট করে। আমার সব কিছুই এরকম করে নষ্ট কর তোমরা! চিৎকার করে উঠল, আমার পাটি নষ্ট করেছ! তা-ও যদি আমার টাকায় হত, এক কথা ছিল। সব করছে রোজার, আমার সম্মানে। কত কষ্ট করে কন্ট্রাক্টটা…

কন্ট্রাক্ট? মা-ও চেঁচিয়ে উঠলেন। কিসের কন্ট্রাক্ট?

কিসের আর! ড্রাকুলার! কি যে একখান ছবি হবে!..আম্মা, দেখলে তো আমি ভাল আছি। খামোকাই আমার জন্যে চিন্তা কর। অনেক শিখছি আমি। কিছু পয়সাও জমিয়েছি। ছবিতেও কাজ পেয়েছি। সব চেয়ে ভাল চরিত্রটা। ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস সাজতে হবে আমাকে।

 চোখের পানি মুছে গেছে। ঝকঝক করে জ্বলছে এখন। তাহলে বুঝতেই পারছ, অবশেষে কাজ একটা জোগাড় করেছি আমি।…ওই তো, রোজার। ইয়ান। রোজার। হাত নেড়ে ডেকে বলল, মিস্টার রোজার আসুন, এই যে আমার আব্বা আর আম্মা।…আম্মা, তুমি ভাবতেও পারবে না আমাকে কিভাবে নিয়েছেন মিস্টার রোজার। দেখেই বুঝে গেলেন, ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেসের চরিত্রটা আমাকেই দেয়া উচিত। আমিই পারব।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল লোকটা। এক চিলতে হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল ঠোঁটে। তাড়াতাড়ি বলল, গুড ইভনিং।

তাকিয়ে রয়েছেন মিসেস ডিকসন। গোঁ জাতীয় বিচিত্র একটা শব্দ বেরোল ডিকসনের কণ্ঠ থেকে।

রোজারের বয়েস তিরিশ হবে। মসৃণ চেহারা। তেমনি মসৃণ বালিরঙা চুল। কান ঢেকে আছে। পোশাক-আশাকও মসৃণ, একটা ভঁজ নেই কোথাও।

ডলির আম্মা! মিসেস ডিকসনের দিকে তাকিয়ে বলল রোজার। কণ্ঠস্বরও মসৃণ, পোশাক আর চেহারার সঙ্গে মানিয়ে গেছে। মা-মেয়ের চেহারা একেবারে এক। না বললেও চিনতাম।

কতোটা সত্যি বলেছে লোকটা, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে, তবু খুশি হলেন। মিসেস ডিকসন। আরও খুশি হলেন যখন তার একটা হাত হাতে তুলে নিল রোজার, যেন সাত রাজার ধন পেয়ে গেছে, এমনি ভঙ্গিতে। আপনারা এসেছেন, কি যে খুশি হয়েছি আমি। মনে হচ্ছে, এতদিন কেন দেখা হয়নি। আমিও ভুল করেছি। বেটসির সঙ্গে কন্ট্রাক্ট সই করার আগে আপনাদের অনুমতি নেয়া উচিত ছিল। তাতে দেরি হত অবশ্য। হলে হত।

বিড়বিড় করে কি যেন বললেন মিসেস।

এমন মুখভঙ্গি করলেন ডিকসন, যেন পচা ইঁদুরের গন্ধ পেয়েছেন। ড্রাকুলা, না? ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা?

ওটারই সীকল। পরের ঘটনা নিয়ে কাহিনী। একজন অভিনেত্রী চাইছিলাম। আমরা, অপরিচিত নতুন একজন, যে মিনার চরিত্রে অভিনয় করতে পারে। ব্রাম। স্টোকারের কাহিনী পড়ে আমার সব সময়েই মনে হয়েছে, ড্রাকুলার চেহারা দেখার পর আর তার ভোঁতা স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হবে না। হতে পারে না। জোনাথন হারকারটা কোন কাজেরই না তো, তাই ভ্যাম্পায়ারই হয়ে যেতে চাইবে মিনা। ড্রাকুলার সঙ্গে প্রেম করতে চাইবে। আর তা-ই করাব আমরা আমাদের ছবিতে। উপায় একটা বের করে ফেলেছি মিনাকে ড্রাকুলার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেয়ার।

কি করে? ডিকসনের কণ্ঠে সন্দেহ। যতদূর মনে পড়ে, ধুলো হয়ে গিয়েছিল। ড্রাকুলা।

তাতে কি? আমাদের মত জ্যান্ত মানুষের নিয়ম মানে না ভ্যাম্পায়াররা। ওদের জগতে অন্য রীতি। এমন ভাবভঙ্গি করছে রোজার, যেন গিয়ে বেড়িয়ে এসেছে জীবন্ত ভূতদের ওই জগৎ থেকে। আমাদের ছবিতে ধুলো থেকে ভ্যাম্পায়ারকে ফিরিয়ে আনার কৌশল জেনে যাবে মিনা। তারপর দুজনে মিলে একটা নতুন গল্প তৈরি করবে।

গলা টিপে ধরা হয়েছে যেন, এরকম শব্দ করলেন ডিকসন। ওই মুহূর্তে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল কে যেন।

ও, পরিচয় করিয়ে দিই, মসৃণ কণ্ঠে বলল রোজার। আমার সহকারী হ্যারিসন রিভস। নাটক না করে আসরে আসতে পারে না ও। ঢোকার সময় কিছু একটা করা চাই-ই। তার যুক্তি, এতে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সুবিধে। হ্যারি, এস। ওঁরা বেটসির আব্বা-আম্মা।

 গোলগাল চেহারা রিভসের। রোজারেরই বয়েসী। তবে বেশভূষায় একেবারে বিপরীত। রোজার যেমন, মসৃণ, সে তেমনি খসখসে। তার কালো, কোকড়া চুলগুলো খাটো, কান বেরিয়ে আছে। গোল গোল চোখ। নাকটা মুখের তুলনায়। ছোট। সিঁড়ির গোড়া থেকে ওঠার সময় একটা হাসি দিল। বোকা বোকা লাগল। হাসিটা।

ও তাই নাকি, তাই নাকি…, বলতে বলতে এগিয়ে এল রিভস। জুতোর গোড়ালিটা বেধে গিয়েছিল…

এই কিছুদিন আগেও টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সের সঙ্গে যুক্ত ছিল রিভস, রোজার জানাল। কয়েক হপ্তা আগে অনেক জোরজার করে রাজি করিয়েছি ওকে ইয়ান ফিল্মসে কাজ করার জন্যে। হরর ছবি তৈরিতে তার জুড়ি কমই আছে। লোককে ভয় দেখাতে, চমকে দিতে ওস্তাদ। মানুষের মনের সমস্ত অলিগলি তার চেনা। পারেও সে জন্যেই। আমাদের ছবির দর্শকরা টের পাবে আতঙ্ক কাকে বলে। ছবি দেখে বেরিয়েই যে ভুলে যাবে, তা পারবে না। ভয়টা অনেক দিন চেপে থাকবে মনের ওপর।

সাংঘাতিক! শুকনো গলায় বললেন ডিকসন।

ডলি, মিসেস ডিকসন বললেন। আয়, একটু বসা যাক। কথা বলি।

আবার কি কথা? মনে হলো আবার রেগে যাবে ডলি। যা বলার তো বলাই হল। আর কি??

অবাক মনে হলো রোজারকে। ডলি? আমি তো ভেবেছিলাম তোমার নাম বেটসিই। কিন্তু ভাবি-অভিনেত্রীর চোখে আগুনের ঝিলিক দেখেই তাড়াতাড়ি সামলে নিল, ও, বুঝেছি বুঝেছি। আমি একটা গাধা। ভুলেই গিয়েছিলাম। আসা নামে অনেকেই পরিচিত হতে চায় না সিনেমায়। বেটসি তোমার স্টেজ নেম। তোমার আব্বা-আম্মার সঙ্গে একলা থাকতে চাও তো? থাক। এতদিন পরে দেখা, ইচ্ছে তো করবেই। আমি দুএক দিনের মধ্যেই যোগাযোগ করব। ডিকসনের দিকে তাকাল রোজার। আমাকে আপনাদের দরকার হলে, কিংবা কোন প্রশ্ন করার থাকলে দয়া করে এই নাম্বারে একটা রিঙ করবেন।

মানিব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে দিল সে।

আপাতত মেষপালকের জীবন যাপন করতে হচ্ছে আমাকে আর রিভসকে, যেন দুঃখে মসৃণ কণ্ঠটা আরও মসৃণ হয়ে গেল রোজারের। পাহাড়ের ওপরে একটা বাড়িতে থাকি আমরা। বাড়িটা ক্রুগার মনটাগোর। বিশ্বাস করবেন, সকালে বাড়ির পেছনের পাহাড়ে ভেড়ার ডাকে ঘুম ভাঙে আমাদের? নাহ, আর পারা যায় না। বাড়িতে একটা ফোন পর্যন্ত নেই। তবে আপনাদের অসুবিধে হবে না। আমার সেক্রেটারি আপনাদের ফোন ধরবে, খবরটা ঠিকই পৌঁছে দেবে আমাকে।

কার্ডটার দিকে না তাকিয়েই পকেটে রেখে দিলেন ডিকসন। কঠিন কণ্ঠে বললেন, আমার মেয়ের যেন কোন ক্ষতি না হয়, এই বলে দিলাম। তাহলে জেল খাঁটিয়ে ছেড়ে দেব।

আব্বা! চিৎকার করে উঠল ডলি।

আপনার অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি, ডিক্সনের কথা গায়েই মাখল না। রোজার। বাপ তার মেয়ের জন্যে অস্থির হবেই। মসৃণ ভঙ্গিতে বাউ করে সহকারীর হাত ধরে টেনে নিয়ে দরজার দিকে এগোল সে।

সামান্যতম নরম হলেন না ডিকসন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, অনেক হয়েছে। কয়েকটা কথা খোলাসা করে নেয়া দরকার!

.

০৮.

 ডলি, মা আমার, মিসেস ডিকসন বললেন। তুই জানিস তোকে আমরা ভালবাসি। বিশ্বাস করি।

কই করি? স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন ডিকসন।

এড়িয়ে গেলেন মিসেস। মস্ত একটা সুযোগ তুই পেয়েছিস। তোকে আমরা সাহায্যই করব, কিন্তু…।

নরিয়া, কি বলছ তুমি? চিৎকার করে উঠলেন ডিকসন।

স্বামীর দিকে তাকালেন মিসেস ডিকসন। ও আমাদের মেয়ে বটে। কিন্তু আজ হোক কাল হোক বাড়ি তো ছাড়তেই হবে। চিরকাল তো আর বাপের ঘরে থাকবে না। তাছাড়া:তাছাড়া এখন ও বড় হয়েছে। বেশ, তোমার আপত্তি থাকলে আমিই নাহয় এখানে থেকে যাই ওর সঙ্গে।

কোন দরকার নেই! কচি খুকি নই আমি! চেঁচিয়ে উঠল ডলি। তাছাড়া থাকবে কি করে? এটা তোমার বাড়ি না। আমারও না। মিসেস লেসিঙের। আমাকেই থাকতে দেয়া হয়েছে দয়া করে। আরেকটা কথা তোমাদের জানা থাকা দরকার, একটা বিউটি পারলারে চাকরি করি আমি।

 ওসব কিছুই করার দরকার নেই, গম্ভীর হয়ে বললেন বাবা। আমরা যা করতে বলব, তাই করতে হবে। বাড়িতে থাকতে হবে তোমাকে।

আহ, থাম না পিটার। আমাকে কথা বলতে দাও। তোমার সঙ্গে ও কখনোই সহজ হতে পারে না।

না পারলে না, পারুক। পারার দরকারও নেই। আমি তার বাবা, ব্যস, যথেষ্ট।

ঘোঁৎ ঘোঁৎ করলেন। কয়েকবার হুমকি দিলেন। তবে আস্তে আস্তে গলার জোর কমে আসতে লাগল তার। সুযোগ বুঝে দরজার দিকে তাকে টেনে নিয়ে চললেন মিসেস ডিকসন। বেরোনোর আগে ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। মানিব্যাগ বের করলেন। এগিয়ে এসে কয়েকটা নোট মেয়ের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, সাবধানে থেক। বেরিয়ে গেলেন গাড়িতে ওঠার জন্যে।

মুসা আর রবিনকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না কেউ। এই পারিবারিক ঝগড়ার মাঝে পড়ে অস্বস্তি বোধ করছে তিন গোয়েন্দা। হেডকোয়ার্টারে ফিরে যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে উঠল। ডলিকে তো পাওয়াই গেছে, আর থেকে কি হবে?

ডিকসন দম্পতিকে অনুসরণ করে ওরাও বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল। হঠাৎ বলে উঠলেন মিস্টার ডিকসন, ছবি না কচু! ওই ব্যাটা ছবির প্রযোজক হয়ে থাকলে আমি আমার কান কেটে ফেলব।

চলতে আরম্ভ করল গাড়ি। চেশায়ার স্কোয়্যার থেকে বেরিয়ে পাহাড়ী পথ ধরে নেমে চলল মেন রোডের দিকে।

হয়ত তোমার কথাই ঠিক, মিসেস বললেন শান্ত কণ্ঠে।

হয়ত মানে?

মিস্টার রোজারকে চমৎকার লোক মনে হলো আমার। তবে আরেকটু খোঁজখবর নেয়া দরকার তার সম্পর্কে। না নিলেও অবশ্য ক্ষতি নেই।

 কি ভেবে ছেলেদের দিকে ঘুরলেন তিনি। একটা কাজ করতে পারবে? ওর কার্ড আছে আমাদের কাছে। কাজটা করতে পারবে? তোমরা চালাক ছেলে, ডলিকে যে ভাবে বের করে ফেললে, তাতেই বুঝেছি। জানতে পারবে মিস্টার রোজার সত্যিই ছবির প্রযোজক কিনা?

গুঙিয়ে উঠল মুসা।

তা বোধহয় পারা যাবে, কিশোর জবাব দিল। ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রিতে খোঁজ নিলেই জানা যাবে। তবে প্রযোজক হওয়ার জন্যে কোন সমিতি কিংবা সংগঠনে যোগ দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। টাকা থাকলেই হলো। আর ছবির ব্যাপারে সামান্য ধারণা। আসল কাজটা পরিচালকই করে দেয়।

ওই লোকটা একটা ধোঁকাবাজ! গোঁ গোঁ করে উঠলেন মিস্টার ডিকসন। ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস! কি একখান আইডিয়া! গল্পের ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই তার। আর ওর সহকারী, ওটা তো আরেক হাঁদা। ইচ্ছে করে সিঁড়ি থেকে পড়ে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ..হাহ! ধরে পাগলা গারদে পাঠানো উচিত।

মেন রোড ধরে চলতে চলতে মোড় নিলেন তিনি। স্যালভিজ ইয়ার্ডের দিকে। চললেন। নরিয়া, এভাবে মেয়েটাকে একলা ছেড়ে দেয়া ঠিক হচ্ছে না। এক কাজ করা যেতে পারে। তুমি থাকো, চোখ রাখো। আমি বাড়ি চলে যাই।

মাথা নাড়লেন মিসেস। না, তা করব না। ডলি এখন বড় হয়েছে। তাকে তার পছন্দমত চলতে দেয়া উচিত। আমরা বেশি নাক গলাতে গেলে অকর্মণ্য বানিয়ে ফেলব শেষে।

 আবার কিছুক্ষণ ঘোঁৎ ঘোঁৎ করলেন ডিকসন। নানা রকম ভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলেন স্ত্রীকে, মেয়ের ক্ষতি হতে পারে, বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিছুতেই যখন বুঝলেন না মিসেস, তখন হুমকি দিতে লাগলেন। তাতেও কাজ হল না। অবশেষে ইয়ার্ডটা দেখা গেল। গেটের কাছে গাড়ি থামিয়ে পকেট থেকে ইয়ান রোজারের কার্ডটা বের করে কিশোরের হাতে দিয়ে বললেন, কিছু জানতে পারলে ফ্রেনসোতে ফোন কোরো আমাদের। সত্যি কথাটা জানা দরকার। মাথা খারাপ না হলে ডলিকে কেউ কোটি কোটি টাকার একটা ছবিতে স্টার বানাবে না। ও ছবির কি বোঝে?

বোঝে, বোঝে, মিসেস বললেন। বুঝবে না কেন? বড় হয়নি?

.

পরদিন খুব সকালে হেডকোয়ার্টারে মিলিত হলো তিন গোয়েন্দা।

আমাদের কাজ এখন, কিশোর বলল। ইয়ান রোজার সত্যিই প্রযোজক কিনা এটা জানার চেষ্টা করা।

গোলমালের দিকেই যত ঝোঁক মেয়েটার, রবিন মন্তব্য করল। কিশোর, লেসিং হাউসে যে চোর ঢুকেছিল, তার সঙ্গে এই ছবিটবি বানানোর কোন যোগাযোগ নেই তো?

নাহ্, মাথা নাড়ল মুসা। তা বোধহয় নেই। চোর যখন-তখন যার-তার বাড়িতে ঢুকতে পারে। এর মধ্যে কোন রহস্য নেই।

তা ঠিক, মুসার সঙ্গে একমত হল কিশোর। এ সময়ে মিস্টার ক্রিস্টোফার হলিউডে থাকলে কাজ হত। তাকে একটা ফোন করলেই রোজারের খবর জেনে যেতে পারতাম।

নেই তো কি আর করা, হাত ওল্টাল মুসা। অন্য ভাবেই কাজ করতে হবে। আমাদের।

মিস্টার সাইমনের সাহায্য নেয়া যায় না? পরামর্শ দিল রবিন।

বোধহয় যায়। হুম! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। বিড়বিড় করল আনমনেই। ভিকটর সাইমন! তিনিও যেহেতু গোয়েন্দা…দাঁড়াও, ফোন করি।

 আরও একটা কথা ভুলে গেছ, মনে করিয়ে দিল রবিন। সিনেমার সঙ্গে তারও যোগাযোগ আছে। চিত্রনাট্য লেখেন। ইয়ান রোজারের কথা তিনিও শুনে থাকতে পারেন।

ভাল কথা মনে করেছ তো! ডায়াল করতে শুরু করল কিশোর।

ফোন ধরল ভিকটর সাইমনের ভিয়েতনামী কাজের লোক, নিসান জাং কিম। জানাল, তিনি নেই। ইডাহোতে একটা ছবির শুটিঙে দলের সাথে গেছেন। কয়েক দিন লাগতে পারে ফিরতে। কয়েক হপ্তাও হতে পারে। ঠিক করে বলে যাননি। ফিরলে তোমাদের কথা বলব।

কিমকে ধন্যবাদ জানিয়ে লাইন কেটে দিল কিশোর। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল, নেই। ওভাবে সাহায্য পাওয়া যাবে না। রোজারের কার্ডটা আছে। চলো, তার অফিসে চলে যাই।

ওর সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলতে? রবিন বলল। কিন্তু ওদেরকে বেতনই দেয়া হয় বাইরের লোক ঠেকানোর জন্যে। কথা গোপন রাখার জন্যে।

না বললে না বলবে। অফিসে গেলেই অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাব।

রেন্ট-আ-রাইড অটো রেন্টাল কোম্পানিতে ফোন করল কিশোর। হ্যানসনকে চাইল। আছে। আর রোলস রয়েসটাও আছে। গাড়িটা পাঠাতে অনুরোধ করল সে।

চকচকে রোলস রয়েস নিয়ে হাজির হয়ে গেল হ্যানসন। মেরিচাচীর চোখে, পড়ল প্রথমে। গুঙিয়ে উঠলেন তিনি। তারমানে সারাদিনের জন্যে লাপাত্তা হবি। কিশোর, তোকে যে কাজটার কথা বলেছিলাম তার কি হবে?

কাল করে দেব, চাচী। মিস্টার ডিকসনের একটা জরুরী কাজ করতে যাচ্ছি আমরা।

সব সময় কথা তৈরিই থাকে মুখে, নাক কুঁচকালেন চাচী। এমন কিছুই বলিস, যাতে মানা করা না যায়।

গাড়িতে উঠল তিন গোয়েন্দা। রোজারের কার্ডটায় সানসেট ট্রিপের ঠিকানা। দেয়া আছে। যেতে বলল হ্যানসনকে। যেতে প্রায় আধঘন্টা লেগে গেল। স্ট্রিপে পৌঁছে গতি কমিয়ে দিল হ্যানসন, যাতে অফিটা খুঁজে পাওয়া যায়।

মোড়ের কাছে ওই যে পার্কিঙের জায়গা, বলল সে। রাখব ওখানেলোকের চোখ পড়ে যায় গাড়িটার ওপর। গোয়েন্দাগিরিতে খুব অসুবিধে। নাকি লোকে দেখুক এখন, এটাই চাও?

অদৃশ্য হয়ে যেতে চাই, রবি বলল। ডলি যদি জানতে পারে, ওর প্রিয় প্রযোজকের পেছনে লেগেছি আমরা, হুলুস্থুল বাধিয়ে ফেলবে।

তাহলে আর কি, হাসল হ্যানসন। যা বললাম কৃরি। মোড়ের কাছে গেল। আরেকটু নিরাপদ হওয়ার জন্যে পাশের একটা গলিতে ঢুকে গাড়ি রাখার জায়গা বের করে নিল।

একসঙ্গে যাব সবাই? মুসার প্রশ্ন।

এক মুহূর্ত ভাবল কিশোর। না, বেশি লোক গিয়ে কাজ নেই। আমি একা যাব।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে রওনা হল সে।

 দোতলা একটা বাড়িতে রোজারের অফিস। নিচতলায় একটা কফি শপ আছে। তেমন চোখে পড়ার মত আহামরি কোন বিল্ডিং নয়। সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে আবিষ্কার করল কিশোর, একটা অ্যাকাউন্টিং ফার্মের সঙ্গে শেয়ারে অফিস ভাড়া করেছে ইয়ান ফিল্মস।

দরজার নবে হাত রেখেই চিৎকার শুনল কিশোর। যত্তোসব!

একটা মহিলা কণ্ঠ বলল, একজন স্টান্ট ম্যান না পেলে হবে না। প্রোডাকশন। বন্ধ রাখতে হবে। ডেভিস সাহেব তো আর রাজি হবেন না লাফটা দেয়ার জন্যে।

তাহলে তাই করা হচ্ছে না কেন? তোক জোগাড় করে নিয়ে এলেই হয়, বলল প্রথম কণ্ঠটা। রোজার নয়। অন্য কেউ, যার কণ্ঠটা মসৃণ নয় রোজারের মত। এখানে শুটিং করলে এসব গোলমালে আর পড়তে হত না। গ্রিফিথ পার্কের। পাহাড়ের সঙ্গে মেকসিকান পাহাড়ের কি এমন তফাৎ?

নবে মোচড় দিয়ে ঠেলে পাল্লা খুলে ফেলল কিশোর।

প্রথমেই চোখে পড়ল একজন মহিলাকে। ধূসর, কোকড়া চুল। চোখে রিমলেস চশমা। ডেস্কের সামনে বসে রয়েছে। হাতে টেলিফোন রিসিভার।

টাকমাথা, নীল চোখওয়ালা, একজন পুরুষ কটমট করে তাকালেন কিশোরের দিকে। তারপর গিয়ে ভেতরের আরেকটা ঘরে ঢুকে প্রাম করে লাগিয়ে দিলেন দরজা।

কি চাই? জিজ্ঞেস করল মহিলা। রিসিভার রাখল না।

 মিস্টার রোজার আছেন?

এখন অসময়। মিস্টার রোজারকে এসময়ে খুঁজতে এসেছ কেন?

ইয়ে… কাল তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। এক বন্ধুর বাড়িতে। কথা বলে মনে হল ছবিতে বোধহয় আমাকে ব্যবহার করতে পারবেন।

তোমাকে?

আমার অভিজ্ঞতা আছে। টেলিভিশনে অভিনয় করেছি। আপনাদের ড্রাকুলা ছবিতে কোন হাসির পার্ট থাকলে…

মিস্টার রোজার! চিৎকার করে ডাকল মহিলা।

মিস্টার. রোজার, এই ছেলেটার সঙ্গে নাকি কাল আপনার দেখা হয়েছিল? ড্রাকুলা ছবির কথা বলছে। ব্যাপারটা কি?

 এঘরে এসে দাঁড়ালেন মিস্টার রোজার। ড্রাকুলা? এনসিনাডার শুটিং নিয়েই তো মহা ঝামেলায় আছি, আবার কি? ড্রাকুলা নিয়ে ছবি তৈরি হবে কে বলল?

দুটো সেকেণ্ড লোকটার দিকে স্থির তাকিয়ে রইল কিশোর। পকেট থেকে কার্ডটা বের করল। নীরবে সেটা তুলে দিল লোকটার হাতে।

কার্ডের দিকে তাকিয়ে নাক দিয়ে খোঁতখোঁত করলেন ভদ্রলোক।

যে লোক এই কার্ড দিয়েছেন, তিনি বলেছেন আজ এখানে এলে দেখা হবে, কিশোর বলল। তিনি তাঁর নাম বলেছেন ইয়ান রোজার। এখন মনে হচ্ছে সত্যি কথা বলেননি তিনি।

তা তো বলেইনি। ছবিতে তোমাকে কোন কাজ দিয়েছে নাকি?

আসলে, আমাকে নয়। একটা মেয়েকে দিয়েছে। সংক্ষেপে জানাল কিশোর, ডলিকে কাজ দেয়ার কথাটা।

আমার কার্ড দিয়েছে, টাকমাথায় হাত বোলালেন রোজার। ড্রাকুলা নিয়ে ছবি বানাচ্ছি না আমি। ওসব আমি বানাইও না। আমি তৈরি করি ডকুমেন্টারি আর বিজ্ঞাপন। তোমার মত কাউকে আপাতত দরকার নেই আমার। আর মেয়েটাকে গিয়ে বলবে ড্রাকুলা ছবিতে অভিনয় করতে তাকে যে-ই বলে থাকুক, ঠিক বলেনি। মিথ্যে বলেছে। কাজটাজ কিচ্ছু দেবে না, নিশ্চয় ধোকাবজি। কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে কাজ করতে বলগে। টাকার কি খুব দরকার?

বলতে পারেন।

তোমার বন্ধু?

ঠিক তা নয়। চিনি আরকি। সবে পরিচয় হয়েছে।

তাকে একটা কথা বলবে, প্রযোজকের ব্যাপারে যেন হুশিয়ার থাকে। অনেকেই ওরকম মিথ্যে পরিচয় দিয়ে থাকে এখানে। লোক ঠকানোর জন্যে। আর যে লোক অন্যের কার্ড নিজের নামে চালিয়ে দিতে পারে, তার ব্যাপারে তো খুবই সাবধান থাকা দরকার।

 বলব। লোকটা কে কিছু আন্দাজ করতে পারেন? আপনার কার্ড নিয়ে এরকম ব্যাপার কি আরও ঘটেছে?

শ্রাগ করলেন মিস্টার রোজার। না। তবে একগাদা কার্ড তোমাকে দিয়ে দিতে পারি আমি। দেয়ার জন্যেই বানানো হয়েছে ওগুলো। যে কেউ এসে নিয়ে যেতে পারে। লোকটা দেখতে কেমন?

এই তিরিশ মত বয়েস। হালকা বাদামি চুল। সব কিছুই মসৃণ। চলন-বলন, পোশাক-আশাক, সব। বলল পাহাড়ের ওপরের একটা বাড়িতে থাকে। বাড়ির মালিকের নাম ক্রগার মনটাগো।

আরামেই আছে দেখা যায়। নিরাপদে। মনটাগো মারা গেছেন। চিন্তিত দেখাল রোজারকে। মেয়েটাকে গিয়ে বলবে, এক্ষুণি যাতে কেটে পড়ে। ওই লোকের ধারেকাছেও আর না যায়। শয়তানগুলো মানুষ ঠকানোর তালে থাকে। নাম্বার ওয়ান ঠগবাজ একেকটা। মাঝে মাঝে ভয়ানক বিপজ্জনক হয়ে ওঠে ওরা।

.

০৯.

 চেশায়ার স্কোয়্যারের গেটে এসে থামল রোলস রয়েস। ডিউটিতে রয়েছে লুই গনজাগা। তার ছোট্ট ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল বিশাল গাড়িটার দিকে।

ছেলেদের ওপর চোখ পড়তেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, আরিব্বাপরে, কি গাড়ি নিয়ে এসেছ! সত্যি বলছি, অবাক করেছ আমাকে! বেটসি জানে এটার কথা? নাকি সারপ্রাইজ দিতে এসেছ?

সারপ্রাইজ তো বটেই, মুসা বলল। আমরা যা বলতে এসেছি, শুনলে রীতিমত ভরকে যাবে। কারেন্টের শক খেলেও অতটা চমকাবে না।

ঘরে আছে? জানতে চাইল কিশোর।

আছে। লম্বা চুলওয়ালা লোকটা আর তার উজবুক সহকারীটা এসেছিল খানিক আগে। চলে গেছে। দাঁড়াও, ডাকছি।

ছোট ঘরে ফিরে গেল দারোয়ান। জানালা দিয়ে দেখা গেল, টেলিফোন করছে। কানে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। আছে তো আছেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অবশেষে নামিয়ে রাখল।

ধরছে না কেউ, জানাল দারোয়ান।

বাইরে-টাইরে যায়নি তো? রবিনের প্রশ্ন।

মাথা নাড়ল গনজাগা। গেলে দেখতাম।

সতর্ক হয়ে উঠল কিশোর। মিস্টার রোজারের সঙ্গে বেরোয়নি তো? ঠিক দেখেছেন?

না, বেরোয়নি। রোজারের সঙ্গে গেছে হাঁদাটা। মোটকা, কোকড়াচুলো। বেটি যায়নি।

উদ্বিগ্ন হলো দারোয়ান। তার ওপর আদেশ রয়েছে, ভালমত না জেনে, না চিনে যাতে স্কোয়্যারে কাউকে ঢুকতে না দেয়। দেখি, আবার চেষ্টা করি।

আবার গিয়ে ঘরে ঢুকল সে। রিসিভার তুলে বোতাম টিপল। কানে ঠেকিয়ে অপেক্ষা করল। এবারেও সেই একই ব্যাপার। ধরল না কেউ। হাত নেড়ে রোলস রয়েসটাকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিল সে। কিশোররা নিজেই গিয়ে যাতে দেখতে পারে।

দরজায় ধাক্কা দেবে, বলে দিল সে। না খুললে গিয়ে দেখবে সুইমিং পুলে। কোথাও না পেলে সোজা চলে আসবে আমার কাছে। তারপর দেখব কি করা যায়।

ছোট পার্কটার কাছে এনে গাড়ি রাখল হ্যানসন। নীরব হয়ে আছে লেসিং হাউস। আগের সন্ধ্যার মত সরব নয়। তবে পাটি যে একটা হয়েছিল, তার চিহ্ন এখনও রয়েছে। কাগজের কাপ, প্লেট, মোড়ক আর নানারকম জঞ্জাল পড়ে রয়েছে। এখানে ওখানে, ঝোপঝাড়ের নিচে। হাঁটার সময় পায়ের নিচে পড়ছে।

প্রথমে কলিংবেলের বোতাম টিপল কিশোর। কয়েকবার টিপেও কারও সাড়া পেল না। দরজা খুলতে এল না কেউ।

ডলি নেই, রবিন বলল।

কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, বলল কিশোর। আমি শিওর।

আমি গেটে যাচ্ছি, মুসা বলল। দারোয়ানের কাছে নিশ্চয় মাস্টার কী আছে।

দৌড় দিল সে। রোলস রয়েসটার পাশ কাটাল। ভেতরে অপেক্ষা করছে হ্যানসন।

কিশোর আর রবিন বাড়ির পাশ ঘুরে এগোল। দেখল, বাইরে কোথাও আছে কিনা ডলি। পেল না।

আবার সামনের চত্বরে ফিরে এসে দেখল দারোয়ানকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। হ্যানসনও নেমে এসেছে গাড়ি থেকে। সবাই উৎকণ্ঠিত। মাস্টার কী আছে দারোয়ানের কাছে। দরজার তালা খুলল। হলে ঢুকল সবাই। আগের সন্ধ্যার পার্টির চিহ্ন এখানেও রয়েছে।

ডলি! চিৎকার করে ডাকল কিশোর।

জবাব দিল না কেউ।

খুঁজতে আরম্ভ করল ছেলেরা। নিচতলাটা দেখতে বেশি সময় লাগল না। তারপর ওপরতলায় চলল ওরা। তাদের সঙ্গে চলল লুই গনজাগা। হ্যানসন। নিচতলায় পাহারায় রইল।

ওপরতলার দরজাগুলো বন্ধ। একের পর এক খুলতে লাগল দারোয়ান। ভেতরে উঁকি দিল ছেলেরা। আবছা অন্ধকার, অব্যবহৃত বেডরুমগুলোর পর্দা টানা। হলের শেষ মাথায় একটা ঘর দেখা গেল, যেটা হরদম ব্যবহৃত হয় বলে। মনে হল। বেশ বড় একটা বিছানা। লাল রঙের চাঁদরের একটা ধার ওল্টানো। একজোড়া চপ্পল যেন ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে চেয়ারের নিচে। বিছানার পায়ের কাছটায়। পড়ে রয়েছে একটা মখমলের আলখেল্লা।

একটা জানালার পর্দা টেনে দিল গজাগা। রোদ এসে পড়ল ভেতরে। আলোকিত হয়ে গেল ঘরটা।

 মনে হচ্ছে এটাই মিসেস লেসিঙের ঘর, দারোয়ান অনুমান করল। এই বেডরুমটাই ব্যবহার করেন। ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকাল। ছোট একটা ট্রেতে সাজানো রয়েছে নানারকম পারফিউমের শিশি। বেটি মেয়েটা ভাল। এঘরে নিশ্চয় ঢোকে না সে। জিনিসপত্র ব্যবহার করে না। করে থাকলে ঠিক করেনি।

ঘুরতে শুরু করল মুসা। টান দিয়ে একটা দেয়াল আলমারির পাল্লা খুলল। ভেতরে এত জায়গা, ছোটখাট একটা বেডরুমই বলা চলে। কাপড় বোঝাই

মিসেস লেসিং না ইউরোপে চলে গেছেন? ভুরু কুঁচকে বলল মুসা। কি নিয়ে। গেলেন তাহলে? সবই তো ফেলে গেছেন মনে হচ্ছে?

তার কথার জবাব দিল না কেউ। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে কার্পেটের দিকে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল দারোয়ানকে, আর কোন গেট আছে? স্কোয়্যার থেকে বেরোনোর?

আছে। আবর্জনার গাড়ি আর ডেলিভারি ভ্যানগুলো ঢোকে ও পথে। সব সময় তালা দেয়া থাকে। প্রয়োজনের সময় খুলে দেয়া হয়।

চাবি কার কাছে?

চাবি নেই। ঢোকার দরকার হলে আমাকে খবর পাঠায়। গার্ডহাউসে বসে সুইচ টিপে খুলে দিই।

পাশের বাড়ির কারও সঙ্গে দেখা করতে গেছে হয়ত ডলি, রবিন বলল।

মনে হয় না। এখানে কারও সঙ্গে মেলামেশা নেই ওর।

আরেকটা দরজা খুলল মুসা। আশা করেছিল আরেকটা আলমারি দেখবে। তা। নয়। ওটা বাথরুম। মার্বেল পাথরে তৈরি বাথটাবে উপচে পড়ছে সাবানের ফেনা। সাবানের গন্ধে বাতাস ভারি। মার্বেল পাথরে তৈরি একটা কাউন্টারের ওপর বসানো হয়েছে দুটো সিংক, ওগুলোতে নানারকম শিশিবোতল আর জার। উল্টে রয়েছে একটা বোতল। মার্বেলের কাউন্টারে পড়েছে হলদেটে তরল, সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঝরছে মেঝেতে।

নোংরা স্বভাবের মেয়ে, মন্তব্য করল রবিন।

জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। চোখ বোলাল পুরো বাথরুমে। ও বাথরুমে থাকতে ফোন বেজেছে। উঠে গিয়ে ধরেছে। জানল, গেটে দাঁড়িয়ে আছে রোজার। তাকে ছাড়তে বলল দারোয়ানকে। গায়ে কাপড় জড়িয়ে নিচে নামল দরজা খোলার জন্যে। তারপরই কিছু ঘটেছে। বিপজ্জনক কিছু। ফিরে এসে আর বাথরুমটা পরিষ্কার করতে পারেনি।

না, আমার মনে হয় ফিরে এসেছিল। লোকটার তাড়া খেয়ে এখানে এসে ঢুকেছিল। ধস্তাধস্তি হয়েছিল হয়ত। হাত লেগে উল্টে পড়েছে বোতলটা।

অতি কল্পনা করছ তোমরা, দারোয়ান বলল। অস্বস্তি বাড়ছে তার। আসলে অন্য কিছু ঘটেছে। স্বাভাবিক কিছু। মেয়েটা নোংরা। ফলে গোসল করার পর বাথরুম পরিষ্কার করেনি। পারফিউম ব্যবহার করে বোতলটা রেখেছে। উল্টে যে গিয়েছে খেয়ালই করেনি। বাথরুম এভাবে রেখেই মিস্টার রোজারকে দরজা খুলে দেয়ার জন্যে নিচে নেমে গিয়েছিল তারপর..তারপর…

তারপর কি? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর। তারপর কোথায় গেল? রোজারের সঙ্গেও যায়নি, পাশের বাড়িতেও যায়নি, তাহলে গেলটা কোথায়? কি হয়েছে তার?

 ছোট তোয়ালেটা নজরে পড়ল রবিনের। ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে। দাঁড়িয়েছে। পায়ের কাছে রয়েছে ওয়েস্টবাস্কেটটা। তাকিয়ে রয়েছে ওটার দিকে।

এই, দেখে যাও! নিচু হয়ে তোয়ালেটা বের করে আনল সে। সাদা রঙের। এককোণে এমব্রয়ডারি করা একটা প্রজাপতি। মরচে-লাল দাগ লেগে রয়েছে।

এটার কি কোন গুরুত্ব আছে? প্রশ্ন করল রবিন যেন নিজেকেই।

একবার তাকিয়েই চোখ বড় বড় হয়ে গেল গনজাগার। রক্ত! দুই লাফে এগিয়ে এসে হাত বাড়াল তোয়ালেটার জন্যে। এখনও ভেজা। কিছু একটা ঘটেছে আজ সকালে এখানে। পুলিশে খবর দেয়া দরকার।

.

১০.

খবর পেয়ে চীফ ইয়ান ফ্লেচার নিজে এসে হাজির হলেন। অগোছালো নোংরা হয়ে থাকা বাথরুমে একবার চোখ বুলিয়েই গম্ভীর হয়ে গেলেন।

ভুরু কুঁচকে তাকালেন দারোয়ানের দিকে। সকালে একজন লোক দেখা করতে এসেছিল বলছ। গাড়ির নম্বর রেখেছ?

রেখেছি। গাডহাউসের লগবুকে লেখা আছে। কসম খেয়ে বলতে পারি, মেয়েটা ওই গাড়িতে করে বেরোয়নি।

কিন্তু কোন ভাবে তো নিশ্চয় বেরিয়েছে। নাহলে নেই কেন? নিচতলায় চললেন চীফ।

পড়শীদের সঙ্গে কথা বলব, আবার বললেন চীফ। কেউ না কেউ কিছু দেখে থাকবেই। এই, তিন গোয়েন্দাকে বললেন, তোমরা বাড়ি চলে যাও।

স্যার…বলতে গেল কিশোর।

চলে যাও। এখন আর কিছু করার নেই তোমাদের। যা করার পুলিশ করবে।

নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরতে হলো তিন গোয়েন্দাকে, বিশেষ করে গোয়েন্দাপ্রধানকে। তাদেরকে ইয়ার্ডে ফিরিয়ে নিয়ে চলল হ্যানসন। কিছুক্ষণ থমথমে নীরবতা বিরাজ করল গাড়ির ভেতরে।

অবশেষে আর থাকতে না পেরে মুখ খুলল মুসা, রহস্যটা ঘোরালো হয়ে উঠছে।

কি বলতে চাও? রবিনের প্রশ্ন।

প্রথমে সৈকতে একটা ব্যাগ কুড়িয়ে পেলাম। মালিককে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। সহজেই হয়ে গেল কাজটা, লাইব্রেরিতে ফোন করে। কি জানলাম? ব্যাগের মালিকই হারিয়ে গেছে। তখন আবার তাকে খুঁজে বের করতে হল। করে। দিলাম। সন্তুষ্ট হতে পারলেন না বাবা-মা। আমাদেরকে তদন্ত চালিয়েই যেতে বললেন। যে লোকটা ওদের মেয়েকে কাজ দিয়েছে, তার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে। নিতে গিয়ে দেখলাম ভুয়া। গেলাম তখন মেয়েটাকে সতর্ক করতে। পারলাম না। কারণ, এখন মেয়েটাই গায়েব।

এবং এই প্রথম, যোগ করল কিশোর। রহস্যটা জমতে আরম্ভ করেছে। আরও মজা হল, পুলিশ, আমাদের বের করে দিয়েছে। নাক গলাতে নিষেধ করেছে।

করে তো ভালই করেছে। এই রহস্যের সমাধান করতে গেলে মাথাই খারাপ হয়ে যাবে।

এর চেয়ে জটিল রহস্যের সমাধান আমরা করেছি। বলে চুপ হয়ে গেল কিশোর।

আবার নীরবতা।

ছেলেদেরকে ইয়ার্ডে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল হ্যানসন। ইয়ার্ডের গেটের দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। বন্ধ করে রাখা হয়েছে পাল্লা। দিনের এই সময়ে, দুপুরবেলা ইয়ার্ডের গেট কখনও বন্ধ থাকে না।

চাচা-চাচী নেই নাকি? নিজেকেই প্রশ্নটা করল কিশোর।

আমি বলি কি হয়েছে, আগ বাড়িয়ে জবাব দিল রবিন। নোমে কতগুলো পুরানো বাড়ি ভেঙে ফেলার খবর পেয়েছেন রাশেদ আংকেল। ছুটে গেছেন দেখার জন্যে পুরানো পাইপ আর সিংক পাওয়া যায় কিনা।

রবিনের অনুমান ঠিক হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ এরকমই করেন রাশেদ পাশা। তবে জায়গার ব্যাপারে ভুল করেছে সে। নোম যাননি তিনি। ডাক শুনে জঞ্জালের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দুই বেভারিয়ান ভাইয়ের একজন, রোভার। জানাল, লস অ্যাঞ্জেলেসে গেছেন একটা ভাঙা বাড়ির পুরানো মাল কিনে আনতে।

ম্যাম গেছেন রান্নাঘরে, হাত তুলে দেখাল রোভার। ঢুকেছেন অনেকক্ষণ। আমি একা। চোরের তো অভাব নেই। কখন ঢুকে কি হাতে তুলে নিয়ে যায়। কাজ। করছি। দেখতেও পারব না। তাই লাগিয়ে রেখেছি।

গেট খুলে দিল সে। জিজ্ঞেস করল, তোমরা থাকবে তো? না, আবার। বেরোবে?

থাকবে, জানাল কিশোর।

গেট আর বন্ধ করার প্রয়োজন বোধ করল না রোভার। চলে গেল নিজের। কাজে।

রবিন আর মুসা বাড়ি চলে গেল। কিশোর রইল একা। অফিসের বারান্দায়। ওঠার সিঁড়িতে বসে গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল ডালিয়া ডিকসনের কথা। কল্পনায় ভাসছে অগোছালো বাথরুম। কি ঘটেছিল? চেশায়ার স্কোয়্যার থেকে মেয়েটাকে বেরিয়ে যেতে দেখেনি দারোয়ান। রোজারের গাড়ির বুটে লুকিয়ে থাকেনি তো? নাকি একাই কোনভাবে বেরিয়ে পালিয়েছে আবার? ভোয়ালেতে রক্তের দাগের কি অর্থ?

 খচখচ করছে মন। চাচী এতক্ষণ কি করছেন? এই সময়ে তো তিনি অফিস ফেলে সাধারণত রান্না করতে যান না। আর গেলেও বড় জোর দুই কি তিন মিনিট। তাড়াহুড়া করে ফিরে আসেন। চুলায় চাপিয়ে দিয়েই। তারপর মাঝে মাঝে উঠে যান কতটা কি হল দেখার জন্যে। সাংঘাতিক একটা ব্যস্ত আর উত্তেজনাময় সময় কাটে তখন তার। নাহ, দেখতে হচ্ছে।

রোভার?

জঞ্জালের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল রোভার। ঘামছে।

আমি বাড়ির ভেতরে যাচ্ছি, কিশোর বলল। কাজ আছে। গেট দেখবেন।

আচ্ছা।

রান্নাঘরের খোলা দরজায় এসে দাঁড়াল কিলোর।

ভেতরে কেউ নেই। চুলায়ও কিছু চাপানো নেই। মেঝেতে পড়ে আছে একটা খাবারের টিন, কেউ ফেলেছে। ঢাকনাটা খুলে গড়িয়ে গিয়ে পড়ে আছে এককোণে।

হঠাৎ শীত করতে লাগল কিশোরের।  

কান পেতে আছে। নীরব হয়ে আছে বাড়িটা। ডাকবে? মেরিচাচী কি আছে বাড়ির ভেতরে কোথাও? নাকি অন্য কেউ ঢুকে বসে আছে, যে চমকে দিয়েছে চাচীকে, হাত থেকে তখন টিনটা পড়ে গিয়েছিল তাঁর। কে চমকে দিয়েছিল? চাচীই বা এখন কোথায়?

ডাইনিং রুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল সে। উঁকি দিল ভেতরে। মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে কয়েকটা বাসন। সেগুলো মোছার কাপড়টাও মেঝেতে। আলমারির তাকের ড্রয়ারগুলো খোলা। নিচে পড়ে আছে আরও বাসন-পেয়ালা আর চামচ।

মুখ শুকিয়ে গেল কিশোরের। জোরে চিৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে করল, তবে চাপা দিল ইচ্ছেটা। উচিত হবে না। যে ঢুকেছে সে এখনও বাড়িতেই থাকতে পারে। মেরিচাচীকে ভয় দেখিয়ে আটকে রেখেছে হয়ত। কিশোর উল্টোপাল্টা কিছু করলে এখন চাচীর বিপদ হতে পারে।

ডাইনিং রুমের ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে এগোল কিশোর। লিভিং রুমেও একই অবস্থা। তাকের বই আর অন্যান্য জিনিস মেঝেতে ছড়ানো। টেবিলের ড্রয়ার খুলে মেঝেতে ফেলে রেখেছে। লিভিং রুমের পরে হলঘরেরও একটা অংশ চোখে পড়ছে। একটা ওয়ারড্রোব খোলা। কাপড়-চোপড় আর জুতো বের করে ছড়িয়ে ফেলা হয়েছে।

কিন্তু মেরিচাচী নেই। দেখা গেল না কোথাও।

রাশেদ পাশার ব্যক্তিগত ঘরটাকেও রেহাই দেয়া হয়নি। তার ডেকসেট আর টার্নটেবলটা নেই। আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে স্পীকারগুলো। বেশি বড় বলেই বোধহয় অসুবিধে হবে মনে করে নেয়নি চোর। নাকি নেয়ার সময় পায়নি? কেউ এসে হাজির হয়েছিল?

হাজির! হ্যাঁ, এটাই হবে! মেরিচাচী এসেছিলেন কোন কারণে। চোরটা বাধা পেয়েছিল।

কেন এসেছিলেন চাচী, সেটাও বুঝতে পারল কিশোর। ক্যাশবাক্সটা নিয়ে এসেছিলেন তিনি। মনে পড়ল, রান্নাঘর দিয়ে আসার সময় ছোট টেলিভিশন সেটটার পাশের কাউন্টারে সেটা দেখে এসেছে। নিশ্চয় চাচীই রেখেছেন ওখানে।

দ্রুত আবার রান্নাঘরে ফিরে এল কিশোর। এখনও রয়েছে বাক্সটা। ডালা খুলে দেখল, ভেতরে টাকাপয়সা ঠিকই আছে। অনেক টাকা। একশো ডলারের বেশি। সেগুলো নেয়নি চোর।

কেন? মেরিচাচীই বা কোথায়?

চাচী! চিৎকার করে ডাকল কিশোর। গলা কাঁপছে।

  জবাবে বিচিত্র একটা মিশ্র শব্দ কানে এল। চাপা চিৎকার। সেই সাথে কিল মারার আওয়াজ।

প্রায় উড়ে গেল যেন কিশোর। রান্নাঘরের লাগোয়া আরেকটা ছোট ঘর আছে! অনেকটা স্টোররুমের মত ব্যবহার করা হয় ওটাকে। ওয়াশিং মেশিন আর ড্রাইয়ার মেশিনাগুলো ওখানেই থাকে। এককোণ রয়েছে একটা আলমারি, তাতে ঝাড়, ব্রাশ আর ঘর পরিষ্কারের অন্যান্য জিনিস রাখা হয়। ওটার ভেতর থেকেই এসেছে শব্দটা।

বাইরে থেকে আটকে দেয়া হয়েছে আলমারির পাল্লা, ঝুল ঝাড়নের লম্বা ভাণ্ডা দিয়ে। একটা মাথা দরজার হাতলে ঠেকিয়ে আরেক মাথা আটকে দেয়া হয়েছে ওয়াশিং মেশিনের সঙ্গে। ফলে ভেতর থেকে যত ঠেলাঠেলিই করা হোক,

চাচী, চিৎকার করে বলল কিশোর। ভেতরে আছ তুমি? আমি কিশোর!

আলমারির ভেতর থেকে চাপা কথা শোনা গেল আবার।

হ্যাঁচকা টানে ডাণ্ডাটা সরিয়ে আনল কিশোর। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল আলমারির দরজা।

সফট ড্রিংকসের বোতল খুললে যেমন ফস করে আচমকা বেরিয়ে আসে গ্যাস আর তরল পদার্থ, অনেকটা তেমনি ভাবে বিশাল শরীর নিয়ে ছিটকে বেরোলেন মেরিচাচী। তার সঙ্গে বেরোল প্রচুর ধুলো, ব্রাশ আর নানারকম টিন।

কিশোর! এলি শেষতক!

টকটকে লাল হয়ে গেছে তার মুখ। ঘাড়ের কাছে চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। মেঝেতে বসে পড়ে হাঁপাতে লাগলেন তিনি। চোখ জ্বলছে।

দাঁড়া, আগে ধরে নিই শয়তানটাকে! তারপর দেখাব মজা!

মনে মনে হাসল, কিশোর। এই মুহূর্তে লোকটা যদি মেরিচাচীর সামনে পড়ে তাহলে ওর জন্যে করুণাই হবে তার।

১১.

কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুলিশ এল। রান্নাঘরের চেয়ারে বসে কিশোরের বানিয়ে দেয়া কফিতে চুমুক দিচ্ছেন তখন মেরিচাচী।

কি হয়েছিল, সব বলতে পারবেন, এখন ম্যাম? অনুরোধ করল একজন অফিসার।

 নিশ্চয় পারবেন তিনি। আর বললেনও বেশ উৎসাহের সঙ্গে। তবে তাতে রাগ আর ক্ষোভ প্রচুর পরিমাণে মিশিয়ে। রান্নাঘরে এসেছিলেন তিনি স্যুপ তৈরি করার। জন্যে। সবে একটা টিন পেড়েছেন তাক থেকে, এই সময় ডাইনিং রুমে নড়াচড়ার শব্দ শুনলেন। ভাবলেন কিশোর এসেছে। ডেকে জিজ্ঞেস করলেন।

জবাব পেলেন না। মুহূর্ত পরেই পেছন থেকে কেউ জাপটে ধরল তাকে। নাকেমুখে চেপে ধরল নরম কোন জিনিস। হাত থেকে টিনটা খসে পড়ে গেল। তার। ঠেলতে ঠেলতে তাকে নিয়ে যাওয়া হল আলমারিটার কাছে। ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা আটকে দেয়া হলো। এমন ভাবেই ঘটে গেল ঘটনাটা, লোকটাকে দেখতে পর্যন্ত পারেননি তিনি। সারাক্ষণই পেছনে ছিল লোকটা।

আলমারির কাছে একটা পুরানো বালিশ দেখতে পেল অফিসার। ওটাই মেরিচাচীর মুখে চেপে ধরা হয়েছিল বলে অনুমান করা হল। জিজ্ঞেস করল, লোকটা কতক্ষণ ছিল, আন্দাজ করতে পারবেন? ক্যাশবাক্স ছোয়নি সে। দামী আরও অনেক জিনিস আছে, ইচ্ছে করলে নিতে পারত। নেয়নি। যেন কোন কারণে ভয় পেয়ে পালিয়েছে।

ভয়! ভয় তো কাকে বলে জানেই না সে! জানাব! একবার ধরতে পারলে হয়!–ঘোষণা করে দিলেন মেরিচাচী। ঠিক বলতে পারব না, তবে মনে হয় বেশ কিছুক্ষণ ছিল। কিশোর আসার একটু আগে গেছে। কিশোর যে ঢুকেছে, টের পেয়েছি আমি। ভেবেছি, চোরটাই। সে না ডাকলে বুঝতে পারতাম না।

অফিসার আর তার সহকারী সূত্র খুঁজতে শুরু করল। ডাইনিং রুমের জানালার একটা পর্দা খুলে নিচে পড়ে আছে।

এদিক দিয়েই ঢুকেছে মনে হয়, কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল একজন অফিসার। চুরি করতে যা যা সরাতে চেয়েছিল সরানোর আগেই ঢুকে পড়েছিলেন তোমার চাচী। তাকে আটকে ফেলার পরেও আর বেশি সময় পায়নি। কিংবা এত বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিল, কাজটা আর ঠিকমত সারতে পারেনি। চুরি করতে ঢুকলে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে এমনিতেই চোরের কলজে কাপে। অনেক সময় অকারণেই ভয় পেয়ে পালায়।

চোরাই ডেকসেটটা উদ্ধারের ভরসা দিতে পারল না পুলিশ। তবু মেরিচাচীকে বলল, সাধ্যমত চেষ্টা করবে বের করার। বলে চলে গেল। ওরা যাওয়ার একটু পরেই রাশেদ পাশা এসে ঢুকলেন। কিশোর তখন অগোছাল জিনিসগুলো গুছিয়ে শেষ করেছে। পর্দাটা লাগাচ্ছে রোভার।

কাজ শেষ করে ওয়ার্কশপে চলল কিশোর। ঢুকে দেখল, মুসা এসেছে। সাইকেলটা স্ট্যাণ্ডে তুলে রাখছে।

পুলিশকে যেতে দেখলাম, মুসা বলল। এখানেই এসেছিল নাকি?

হ্যাঁ। রকি বীচে মনে হয় চোরের উপদ্রব বেড়েই গেল। দুদিন আগে মিস লেসিঙের বাড়িতে ঢুকেছিল। আজকে ঢুকেছে আমাদের বাড়িতে। মেরিচাচীকে আলমারিতে আটকে রেখেছিল।

কি বললে?

সংক্ষেপে জানাল কিশোর।

হা হা করে হাসতে লাগল মুসা। আল্লাহ না করুক, চোরটা যদি ধরা পড়ে তবে ওর কপালে দুঃখ আছে। হা হা! আর লোক পায়নি, শেষকালে মেরিচাচীকে..হাহ হা!

কিশোরও হাসল।

তা মেরিচাচীর চোরটাকে খুঁজতে বেরোবে নাকি?

না। পুলিশই যা করে করুক। মনে হচ্ছে সাধারণ চোর।

তার মানে ডালিয়া ডিকসনের কেসেই শুধু আপাতত মাথা ঘামার আমরা?

জবাব দেয়ার আগে ভাবল কিশোর। সেটাও পারব কিনা বুঝতে পারছি না। চীফ তো আমাদেরকে প্রায় তাড়িয়েই দিলেন। তার মানে তিনি চান না ডলিকে নিয়ে মাথা ঘামাই আমরা। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার সে। উজ্জ্বল হলো মুখ। তবে, তার বাবা-মাকে ফোন করতে পারি আমরা। যা যা ঘটেছে, জানাতে পারি।

আমরা মানে কি? আমাকে এসব থেকে বাদ দিতে পার তুমি। একা পারলে করগে। ডিকসনদেরকে অপছন্দ করি আমি, তা নয়। মিস্টার ডিকসন ঠিকই আছেন, তবে মিসেস একটু বেশি লাই দেন মেয়েকে। আমার মনে হয় তার। জন্যেই খারাপ হয়েছে মেয়েটা। ভাগ্যিস আমার মায়ের ঘরে জন্মায়নি। পিটিয়ে। পিঠের ছাল তুলে ফেলত।

হাসল কিশোর। দুই সুড়ঙ্গের ঢাকনা সরাল। এসো, ভেতরে গিয়ে কথা বলি।

হেডকোয়ার্টারে ঢুকল দুজনে। ডেস্কে বসেই আগে ফ্রেনসোতে ডিকসনদের নম্বরে ডায়াল করল কিশোর। ওপাশে বেজেই চলল ফোন। রিং হচ্ছে… হচ্ছে…দশবার পর্যন্ত গুনল সে। তারপর রিসিভার নামিয়ে রেখে বলল, বাড়ি নেই। কেউ ধরছে না।

চীফ হয়ত ফোন করেছিলেন, মুসা বলল। রওনা হয়ে গেছেন ওরা। রকি বীচে আসার জন্যে।

হতে পারে।…এখন ভেবে দেখা দরকার, কি কি সূত্র আছে আমাদের হাতে? রোজারের কার্ডটা ভুয়া। প্রমাণ হয়ে গেছে। আর তার সহকারী:সহ…

চুপ হয়ে গেলে কিশোর। হাত এখনও রিসিভারে।

কি হল? কিছু ভাবছ মনে হয়?

হ্যারিসন রিভস! রোজার বলেছে, টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সে কাজ করেছে নাকি লোকটা। সত্যি বলেছে?

 কিশোরের কথা শেষ হওয়ার আগেই টেলিফোন ডিরেক্টরি টেনে নিল মুসা। খুঁজতে শুরু করল। ফিল্ম স্টুডিওর নামটা বের করতে সময় লাগল না। দেখাল। সেটা কিশোরকে।

ডায়াল করল কিশোর। অপারেটরকে জিজ্ঞেস করল হ্যারিসন রিভসের নাম। কিছুক্ষণ খাতা ঘাটাঘাটি করে অপারেটর জানাল, ওই নামে, কেউ নেই। কিশোরকে জিজ্ঞেস করা হল সে কে বলছে। বানিয়ে বলে দিল কিশোর, সে রিভসের খালাত ভাই। লস অ্যাঞ্জেলেসে বেড়াতে এসেছে। ভাইয়ের ঠিকানাটা খুব দরকার।

এত মিথ্যে বলতে পারো! বিড়বিড় করে বলল মুসা।

মাউথপীসে হাত রেখে তার দিকে তাকিয়ে কিশোর জিজ্ঞেস করল, কি বললে?

জবাব শোনার আগেই ওপাশ থেকে মহিলা বলল, আরেকটা রেজিস্টার খুঁজে দেখলাম। নেই। ওই নামের কেউ নেই টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চরি ফক্সে।

তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লাইন কেটে দিল কিশোর।

নেই। কোন সূত্রও পেলাম না, যা দিয়ে শুরু করতে পারি। দুজন লোক যেমন রহস্যজনক ভাবে দেখা দিল, তেমনি ভাবেই গায়েব হয়ে গেল আবার। সেই সঙ্গে ডলিও গায়েব।

ওই পিজা শ্যাকে আরেকবার গেলে কেমন হয়? খাওয়াও যাবে, শোনাও যাবে। ডলির পার্টিতে যারা গিয়েছিল তাদের কাউকে পেলে জিজ্ঞেস করতে পারতাম, ডলির খোঁজ জানে কিনা। রোজার আর তার হাঁদা সহকারীটার কথাও কিছু জানতে পারে।

সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে একেবারে কিছু না পাওয়ার চেয়ে রাজি হয়ে গেল কিশোর। বেরিয়ে এল দুজনে। সাইকেল নিয়ে চলল পিজা শ্যাকে। রবিনকে ফোন করল না ইচ্ছে করেই। জানে, করলেও লাভ হবে না। কারণ অনেক দিন পর লাইব্রেরিতে গেছে রবিন। সেখান থেকে যাবে তার চাকরির জায়গায়, মিউজিক কোম্পানিতে।

পিজা শ্যাকে পৌঁছল দুজনে।

একই রকম ভাবে মিউজিক বাজছে, জোরে জোরে। ভিডিও গেম খেলছে ছেলেমেয়েরা। হৈ চৈ করছে। ছোট ছোট টেবিল ঘিরে বসে খাচ্ছে অনেকে। অর্থহীন কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছে।

সেদিন পার্টিতে গিয়েছিল এরকম একটা ছেলে কিশোর আর মুসাকে দেখেই চিনল।

অ্যাই! হাত নেড়ে ডাকল সে। হাসল। তার কাছে গিয়ে বসতে বলল। চিনতে পার? সেদিন পার্টিতে দেখা হয়েছিল। তো, আছ কেমন?

আছি একরকম, জবাব দিল কিশোর। ডলিকে খুঁজতে এলাম।

ডলি? ও আচ্ছা, বেটির কথা বলছ। কি হয় তোমার? বোন?

না। কিছু হয় না।

ও, কিছুটা অবাকই হলো যেন ছেলেটা।

তার পাশের চেয়ারটায় বসল কিশোর। মুসা বসল উল্টো দিকে, ওদের দিকে মুখ করে।

চেশায়ার স্কোয়্যার থেকে নিখোঁজ হয়েছে ভলি, ছেলেটাকে জানাল কিশোর। আমাদের ধারণা, কিডন্যাপ করা হয়েছে।

হাঁ হয়ে গেল ছেলেটা। যাহ,ঠাট্টা করছ।

 মাথা নাড়ল কিশোর। আজ সকালেও লেসিং হাউসে ছিল ডলি। দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলেছে। রোজার দেখা করতে এল তার সঙ্গে। সাথে করে রিভসকেও এনেছিল। তারপর থেকে আর পাওয়া যাচ্ছে না মেয়েটাকে।

এক সেকেণ্ড চুপ করে রইল ছেলেটা। তারপর চেঁচিয়ে ডাকল, অ্যাই, শুনে যাও তোমরা। এরা কি বলছে শুনে যাও।

 বন্ধ হয়ে গেল ভিডিও মেশিন। সরাই এসে ঘিরে দাঁড়াল কিশোরদেরকে, গল্প শোনার জন্যে। কাউন্টারের ওপাশে ওয়েইট্রেস মহিলাও গলা বাড়াল।

ডলির নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটা খুলে বলল কিশোর। খুঁটিনাটি কিছুই বাদ না দিয়ে। শেষে বলল, রোজার আর রিভস তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যেতে পারে। রোজারের সঙ্গে নিশ্চয় তোমাদের কারও কারও পরিচয় হয়েছে। লোকটা একটা ভুয়া। নামটাও আসল কিনা সন্দেহ আছে। ফলে তাকে ধরাটাও মুশকিল। তোমাদের কারও কি কিছু জানা আছে?

চুপ করে আছে সবাই।

দরজা খুলে ঢুকলেন ধূসর চুলওয়ালা লোকটা। ম্যানেজার। কিশোর আর মুসাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন ছেলেমেয়েদেরকে।

কি হয়েছে? ওয়েইট্রেসকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

ওদের বন্ধুর কথা আলোচনা করছে, মিস্টার জেনসেন, মহিলা বলল। এত সুন্দর একটা মেয়ে, হারিয়ে গেল। কত আসত এখানে। ভিডিও গেম খেলত। সবার সঙ্গে হাসিঠাট্টা করত। ওরা বলছে, ওকে নাকি তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

কিডন্যাপ? ভুরু কুঁচকে গেল ম্যানেজারের।

তাই তো বলছে।

মহিলার দিকে ঘুরে তাকাল কিশোর। রোজার সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন? এখান থেকে অনেক পিজা নিয়েছিল।

 মাথা ঝাঁকাল মহিলা। বিশেষ কিছু জানি না। তবে ওকে পছন্দ হয়নি আমার। এদের বন্ধু হওয়ার বয়েস নয় ওর।

হলিউডের অনেক বড় প্রযোজক ও, একটা ছেলে বলল। ও নিজেই বলেছে। বেটির অনেক প্রশংসা করে বলেছে, ও নাকি অভিনয়ে সাড়া জাগাতে পারবে।

এখানেই দেখা করেছে? কিশোর জানতে চাইল।

হ্যাঁ। সাথে করে নিয়ে এসেছে বোকা লোকটাকে। আলাদা হয়ে গিয়ে ফিসফাস করে কথা বলেছে রেটির সঙ্গে। এমন ভান করেছে যেন বেটিকে পেয়ে হাতে সোনার বার পেয়ে গেছে।

ভিড় সরিয়ে এগিয়ে এল একটা মেয়ে। একটা চেয়ার খালি রয়েছে, তাতে বসল।

বেটির মাথায়ও বোধহয় ছিটটিট আছে। বাস্তবতা বোঝে না, কল্পনার রাজ্যে ঘুরে বেড়ায়। কি বলছি বুঝতে পারছ? ওর ধারণা, ও ভাল অভিনেত্রী হতে পারবে। কাজেই লোকটা এসে যখন বলল, লাফিয়ে উঠল একেবারে। তারপর আর কি? লোকগুলোর সঙ্গে খাতির করে ফেলল। একসাথে বসে পিজা খেতে লাগল। লোকগুলো অনেকক্ষণ কথাটথা বলার পর আমাদের সবাইকে ডেকে বলল, বেটসির নতুন কাজটাকে সেলিব্রেট করার জন্যে একটা পার্টি দেবে।

বুঝলাম না,মুসা বলল। সবাইকে দাওয়াত করতে গেল কেন?

ওসব এক ধরনের চালিয়াতি। হয়ত ভেবেছে, এরকম ধুমধাম করলে বেটি তাকে বিশ্বাস করবে। কোন সন্দেহ থাকবে না। সবাইকে নিয়ে হৈ-হুঁল্লোড় করলে। তাড়াতাড়ি সহজ হয়ে আসবে বেটি।

কিশোর আর মুসার মুখের দিকে তাকাল মেয়েটা। কেন যেন মনে হচ্ছে, মিস লেসিঙের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই ওকাজ করেছে লোকটা। একা নিয়ে যেতে চাইলে নতুন পরিচিত একজনের সঙ্গে যেতে যদি রাজি না হয় বেটি, সে জন্যেই সবাইকে নিয়ে গেছে। পঞ্চাশ জনের কম ছিল না।…ইয়ে, সত্যিই হারিয়ে। গেছে বেটি?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

চিন্তিত দেখাল মেয়েটাকে। বিউটি পারলারে, যেখানে সে কাজ করে, টেলিফোন করেছিলাম। ওরা জানাল, আজ নাকি যায়নি। আর বেশ গরম গরম কথাই শুনিয়ে দিল। ওর বাবা-মা কোথায় এখন?

তারা ফ্রেনসোতে ফিরে গিয়েছিলেন, কিশোর বলল। আবার হয়ত রওনা হয়ে পড়েছেন এখানে আসার জন্যে। বাড়িতে ফোন করেছিলাম। পাইনি।

 লোকটার নাম রোজার নয় কেন মনে হলো তোমার? ভিড়ের মধ্য থেকে জিজ্ঞেস করল একটা ছেলে।

কারণ আজ সকালে আসল ইয়ান রোজারের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমাদের।

রোজার? লোকটা তার নাম রোজার বলেছে? কিন্তু তার দোস্ত তো অন্য নামে। ডাকছিল। অদ্ভুত একটা নাম!

ডেগি, বলল আরেকটা মেয়ে। হ্যাঁ, ডেগি বলেই ডাকছিল।

ডেগি? কাউন্টারের ওপাশ থেকে বলে উঠলেন ম্যানেজার।

সবাই ফিরে তাকাল তার দিকে।

ডেগি! গম্ভীর হয়ে গেছেন মিস্টার জেনসেন। এটা কি রকম নাম হলো? মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ওরকম নামের একটা লোক ভাল হতেই পারে না। খারাপ লোক। খুব খারাপ। এত সুন্দর মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গেল! কোন্ দুনিয়ায় বাস করছি আমরা।

তার সঙ্গে একমত হলো অনেকেই।

কিশোর আর মুসা অপেক্ষা করতে লাগল। ভুয়া চিত্র প্রযোজকের সম্পর্কে আর কেউ কিছু মনে করতে পারে কিনা সে সুযোগ দিল।

কেউই কিছু বলতে পারল না আর।

.

১২.

রাতেই রকি বীচে পৌঁছলেন ডিকসনরা। ইয়ার্ডে এলেন সকাল আটটায়। বিধ্বস্ত চেহারা। চোখ লাল। চীফ ইয়ান ফ্লেচারের সঙ্গে দেখা করেই এসেছেন।

তাদের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন মেরিচাচী। আদর করে বসিয়ে নাস্তা-টাস্তা এনে দিলেন। তবে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলেন না। মেয়েকে ফিরে না পেলে অহেতুক সান্ত্বনা দিয়ে মা-বাবার মন শান্ত করা যাবে না।

কেউ কিছুই দেখেনি এটা বিশ্বাসই করতে পারছি না, ডিকসন বললেন। পড়শীদের সঙ্গে কথা বলেছেন চীফ। ওই লোকদুটোর সঙ্গে ডলিকে বেরোতে দেখেনি কেউ। রোজার যে গাড়িটা নিয়ে এসেছিল সেটা রেজিস্ট্রি করা হয়েছে জনৈক ডক সাইমারের নামে। সাইমার আবার বিক্রি করে দিয়েছে পিটারের কাছে। পিটার আর নিজের নামে রেজিস্ট্রি করায়নি। কাজেই লাইসেন্স নম্বরে সুবিধে হয়নি। গাড়িটা ধূসর রঙের, এটুকুই জানি আমরা। ডলি যেখানে চাকরি করত সেখানেও খোঁজ নিয়েছি। যে বুড়িটা জবাব দিল, সে ভাল করে কথাও বলতে চায়নি।

শেষ দিকের কথাগুলো তিক্ত শোনাল তাঁর।

মিস্টার ডিকসন, মেরিচাচী বললেন। আপনারা দুজনেই ক্লান্ত। কয়েকদিন এখানেই থেকে যান না? আমাদের ঘর আছে। থাকতে অসুবিধে হবে না। এ

ধন্যবাদ। তার দরকার হবে না, জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন ডিকসন। রকি বীচ ইনে ঘর ভাড়া করেছি আমরা। ওখানেই থাকতে পারব। চীফের ফোনের অপেক্ষা করব। বাড়িতে একজনকে রেখে এসেছি ফোন ধরার জন্যে। কিছু জানলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জানাবে। কিডন্যাপাররা যদি ফোন করে, খবর দেবে। হয়ত মেয়েকে ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে কিছু টাকাটুকা চাইবে।

ঘোরের মধ্যে রয়েছেন যেন, এমন ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন মিসেস।

তুমি আর তোমার বন্ধুরা অনেক করেছ আমাদের জন্যে, কিশোরকে বললেন। ডিকসন। থ্যাঙ্কস।

স্ত্রীর হাত ধরে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

ওয়ার্কশপে চলে এল কিশোর। দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকল হেডকোয়ার্টারে। মুসা আর রবিন এসে বসে আছে।

ফাইলিং কেবিনেটে পিঠ দিয়ে মেঝেতে বসেছে মুসা। চোখে ঘুম। ডিকসনদের গাড়িটা দেখলাম অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রবিনকে ফোন করলাম সে জন্যেই। আর কিছু ঘটেছে?

না, নিজের ডেস্কের ওপাশে গিয়ে বসল কিশোর। রকি বীচ ইনে উঠেছেন। ডিকসনরা। ডলির খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত যাবেন না।

খোঁজটা পেয়ে গেলেই ভাল, রবিন বলল। নোটবুক বের করল। দেখে নিয়ে। বলল, এ যাবৎ যা যা করেছি আমরা, কোনটাতেই ফল হয়নি। যেখানে শুরু সেখানেই শেষ, এই হয়ে যাচ্ছে অবস্থা।

অনেক কিছুই মিলছে না, কিশোর বলল। ওই লোকদুটো ডলিকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যেতে পারে। ঠিক। কিন্তু সব কিছুর জন্যেই একটা মোটিভ লাগে। কেন নিল? উদ্দেশ্যটা কি? কিডন্যাপিং হলে মুক্তিপণ চাইছে না কেন? আর যদি নিয়েই থাকে নেয়ার অনেক সুযোগ পেয়েছে আগেই। কেন একটা পার্টি দিয়ে, লোক জানাজানি করে এরকম একটা কাজ করতে গেল?

দুহাতের আঙুলের মাথা এক করে ছোট একটা খাঁচার মত তৈরি করল সে। তারপর রয়েছে সেই রহস্যময় চোরটা। যে লেসিং হাউসে ঢুকেছিল, ডলির সঙ্গে রোজার আর রিভস দেখা করার আগেই। ওই দুজনেরই একজন চোরটা ছিল কিনা। কে জানে। তাহলে প্রশ্নঃ কেন ঢুকেছিল? ডলির জন্যে? নাকি লেসিং হাউস থেকে কিছু চুরি করতে?

কাকতালীয় না তো? রবিন বলল। সেই বন্ধকী দোকানের মায়ানেকড়েটার মত??

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। সারা দিন ধরে চিবালেও এই রহস্যের মধ্যে ছিবড়ে ছাড়া আর কিছু মিলবে না।

 প্ল্যাস্টিকের সেই ব্যাগ, যেটা সৈকতে কুড়িয়ে পেয়েছিল ওরা, এখনও অফিসেই রয়েছে। চেশায়ার স্কোয়ারে ডলির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় ওটা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল। ফাইলিং কেবিনেটের ওপর থেকে নামিয়ে এনে ভেতরের জিনিসগুলো টেবিলে ঢেলে দিল রবিন। মেকাপের সরঞ্জাম, লাইব্রেরির বই আর খেলনা ভালুকটার দিকে এমন ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল, যেন ওগুলো কোন সূত্র বলে দেবে। কিংবা বলবে ডলি এখন কোথায় আছে। কালো নিপ্রাণ দৃষ্টি মেলে ভালকটা তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।

 বইটা তুলে নিয়ে আনমনে পাতা ওল্টাতে লাগল কিশোর। কিছু কিছু পৃষ্ঠায় লেখার নিচে দাগ দেয়া রয়েছে। বিড়বিড় করে ইংরেজিতে যা পড়ল সে, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে সাফল্য, ভালবাসা, ধনী এই শব্দগুলো ঘন ঘন আওড়াবে। সূর্য যেমন উঠবেই, তেমনি নিশ্চিত করে জেনে রাখো, সাফল্য, ভালবাসা আর অগাধ সম্পদের মালিক হয়ে যাবে তুমি।

পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল ওরা।

ভালুকটাকে চোখের সামনে নিয়ে এল মুসা। বলল, তুমিও এই বইয়ের কথা মেনে চলতে পার। ভাবতে থাকো, কাল থেকে গভীর বনের বাতাসে শ্বাস নেবে। বুক ভরে। কে জানে, কাল সকালেই হয়ত খেলনা ভালুক থেকে জ্যান্ত ভালুকে পরিণত হবে তুমি।

আরেকবার হেসে উঠল ওরা।

বাড়ি রওনা হয়ে গেল রবিন আর মুসা।

কিশোর বসেই রইল। বসে বসে ভাবতে লাগল। তাকিয়ে রয়েছে ভালুকটার। দিকে। তার মনে হচ্ছে, কোথাও কিছু একটা সূত্র অবশ্যই রয়েছে, যেটা চোখ। এড়িয়ে যাচ্ছে ওদের। ওটা পেয়ে গেলেই ডলিকে বের করার ব্যবস্থা করতে পারবে।

ব্যাগের ভেতরে আবার জিনিসগুলো ভরতে আরম্ভ করল সে।

হঠাৎ ট্রেলারের বাইরে কি যেন নড়ে উঠল।

থমকে গেল সে। কান পাতল। কি নড়ছে? জঞ্জালের ভেতর কোন ছোট জানোয়ার ঢুকল?

আবার শোনা গেল শব্দটা। এতই মৃদু, বাতাসের ফিসফিসানি বলেই মনে হয়। কিংবা কেউ রোধহয় নিঃশ্বাস ফেলল জোরে। ঘাপটি মেরে রয়েছে কিশোরের বেরোনোর অপেক্ষায়।

নাহ, দেখতে হচ্ছে।

আস্তে করে উঠে দাঁড়াল সে। ধাক্কা লেগে চেয়ারটা যাতে সরে গিয়ে শব্দ না হয়ে যায়, খেয়াল রাখল। ঘুরে চলে এল ডেস্কের আরেক পাশে। আবার কান পাতল।

নীরব হয়ে আছে। আর হচ্ছে না শব্দটা।

কোন জানোয়ারই হবে। ইঁদুর, বেড়াল, কিংবা ছুঁচো। কাঠবেরালিও হতে পারে। মাঝে মাঝেই ওগুলোকে ইয়ার্ডে ঢুকতে দেখেছে সে।

হেডকোয়ার্টার থেকে সব চেয়ে তাড়াতাড়ি বেরোনোর পথটা হল সহজ তিন। সেই পথ ধরে চত্বরে বোরোল সে। ছোট জানোয়ার কিংবা রহস্যময় অনুপ্রবেশকারীকে দেখার আশায় তাকাল এদিক ওদিক। দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে আবার এসে ঢুকল হেডকোয়ার্টারে। প্রথমেই তাকাল টেবিলের দিকে, যেখানে ব্যাগটা রেখে গিয়েছে।

ওটা আছে জায়গামতই। কিন্তু একটা পরিবর্তন হয়ে গেছে ডেস্কের ওপর। টেলিফোনের কাছে খুলে রয়েছে একটা নোটপ্যাড। তারমানে সে যখন বাইরে বেরিয়েছিল, চুপ করে এখানে ঢুকে পড়েছিল কেউ। নোটপ্যাডটা খুলে দেখেছে ওটাতে কি লেখা রয়েছে। শিরশির করে উঠল মেরুদণ্ডের ভেতর।

 তেমন জরুরী কিছু লেখা নেই। তবে কেউ একজন ঢুকেছিল এটা স্পষ্ট। হঠাৎ করেই টের পেয়ে গেল, যে ঢুকেছে, সে এখনও ভেতরেই রয়েছে।

স্থির হয়ে গেল কিশোর। বুঝতে পারছে, পেছনেই রয়েছে অনুপ্রবেশকারী। ছোট ডার্করুমটার দিকে পেছন করে আছে সে। দরজায় পর্দা ঝুলছে। তার ওপাশেই রয়েছে কেউ অপেক্ষা করছে..নিঃশ্বাস ফেলছে…

নিঃশ্বাসটা এতই ধীর, প্রথমে বুঝতেই পারেনি কিছু সে। আস্তে আস্তে জোরাল হয়েছে। শব্দটা অদ্ভুত। খসখসে। হালকা ভাবে কোন জিনিস সিরিশ কাগজে ঘষা হচ্ছে যেন।

খলখল করে একটা শয়তানী হাসি যেন ফেটে পড়ল ঘরের ভেতরে।

লাফ দিয়ে পর্দার কাছ থেকে সরে গেল কিশোর। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে তাকাল।

টান দিয়ে সরিয়ে দেয়া হয়েছে পর্দা।

ভয়ঙ্কর একটা জিনিসের ওপর চোখ পড়ল তার। আঁশে ঢাকা শরীর। চোখা। দাঁত। চেহারার কোন আকৃতি নেই। গলে গলে পড়ছে মাংস। যেন হরর ছবি থেকে উঠে আসা জীবন্ত এক আতঙ্ক।

আবার হেসে উঠল ওটা। ঈগলের মত বাঁকা আঙুলওয়ালা একটা থাবা। বাড়িয়ে দিল কিশোরকে ধরার জন্যে।

সরার চেষ্টা করতে গিয়ে ডেস্কের সঙ্গে বাড়ি খেল সে। ঝট করে মাথা নামিয়ে ফেলল।

হাসতে হাসতেই আঘাত হানল বীভৎস প্রাণীটা।

আঘাতটা লাগল কিশোরের গায়ে। মনে হল, ধাতব ফাইলিং কেবিনেটটা ছুটে আসছে তার সঙ্গে মোলাকাত করার জন্যে।

-কপাল ঠুকে গেল ওটাতে। এরপর সব অন্ধকার।

.

১৩.

 ব্যাগটার জন্যেই এসেছিল, কিশোর বলল। হুঁশ ফিরতে দেখি ওটা নেই। চাচীকে যেদিন আলমারির ভেতরে আটক করেছিল, সেদিনও ওটা খুঁজতেই এসেছিল, ব্যাগটা নেই দেখে বুঝলাম। ওটার জন্যেই কিডন্যাপ করা হয়েছে ভলিকে। তারপর, আমাদের হেডকোয়ার্টারে ঢুকে ওটা পেয়ে নিয়ে চলে গেছে।

হুঁশ ফিরে পেয়েই দুই সহকারীকে ফোন করেছে গোয়েন্দাপ্রধান। ছুটে চলে এসেছে ওরা। বসে আছে এখন কিশোরের মুখোমুখি।

চেহারা এখনও ফ্যাকাসে হয়ে আছে কিশোরের। ধাক্কাটা পুরোপুরি. সামলে। উঠতে পারেনি। আর আমি গাধা, আবার বলল সে। কাজটা সহজ করে দিলাম তার জন্যে। সহজ তিনের পথ খুলে দিয়ে। ঘরে ঢুকে লুকিয়ে ছিল ওটা।

ভয়ানক কুৎসিত চেহারাটার কথা মনে হতেই গায়ে কাঁটা দিল তার।

মুসার মনে পড়ল বন্ধকী দোকানের সেই মায়ানেকড়ের চেহারার কথা। জিজ্ঞেস করল, একই চেহারার? ওই যে, সেদিন দেখেছিলাম, মায়ানেকড়ে?

না। অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে কিশোর। তবে একই লোক হতে পারে। মুখের রং ফিরতে শুরু করেছে তার। রোজার আর রিভস হরর ছবির ছাত্র। অন্তত ওদের কথাবার্তায় সে রকমই মনে হয়েছে। সুতরাং ছদ্মবেশে অপরাধ যদি করতেই আসে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

 তবে, রবিন বলল। লেসিং হাউসে যে চোরটা ঢুকেছিল, সে আর দশটা চোরের মতই সাধারণ। মোজা মাথায় গলিয়ে চেহারা ঢেকে অনেক চোরই চুরি করতে আসে।

ওই চোরটাকে সাধারণ ভাবতে পারছি না ডলির জন্যে। তার সঙ্গে কোনভাবে যোগাযোগ থাকতে পারে। কাজেই চোরটাও একই লোক হতে পারে।

ঠিক! একমত হল মুসা। কিন্তু দানবটা ব্যাগ নিল কেন? কি চায়? বন্ধকীর দোকানের রশিদগুলো?

যেগুলো বইয়ের ভেতরে রেখে দিয়েছিল ডলি? ভ্রূকুটি করল কিশোর। আমার তা মনে হয় না। যেসব জিনিস বন্ধক রেখেছে, একেবারেই সাধারণ। দাম আর কত। একটা আংটি, একটা মেডেল, আর একটা সোনার পিন। ওগুলো রেখে মাত্র কয়েকটা ডলার পেয়েছে ডলি। নাহ, ওই রশিদের পেছনে কেউ লাগেনি।

তাহলে কিসের জন্যে? বইটার জন্যে? উফ, মাথাই ধরে যাচ্ছে আমার।

ওই বই যে কোন লাইব্রেরিতে গেলেই মেলে, রবিন বলল। তবে বিশেষ ওই বইটাতে যদি কিছু লেখা থাকে তাহলে আলাদা কথা। নোটফোট লিখে থাকতে পারে ডলি। কিন্তু কিসের নোট? বয়েস কম। কোন অপরাধ করেছে বলে মনে হয় না। লুকানোর নিশ্চয় কিছু নেই। বাড়ি থেকে ওরকম অনেকেই পালায়। সে-ও পালিয়েছে। একটা উদ্দেশ্যও আছে তার। ছবিতে কাজ করতে চায়।

খেলনা ভালুক! আচমকা বলে উঠল কিশোর।

ওর দিকে তাকিয়ে রইল রবিন আর মুসা।

ওটার আবার কি হলো? জিজ্ঞেস করল মুসা।

ওটাই চায় তথাকথিত দানবটা, কিশোর বলল। সাধারণ খেলনা নয় ওটা। অন্যান্য টেডি বিয়ারগুলো বানানো হয় তুলো দিয়ে, কিন্তু ওটা আসল রোম।

তাতেই বা কি? যদি সবচেয়ে দামি মিংক দিয়েও বানানো হত, তাতেই বা কি হত? এমন কিছু দাম হত না যার জন্যে এতসব ঝামেলা করতে চাইবে কেউ।

হয়ত ভালুকটার ভেতর কিছু আছে।

এইবার বলেছ একটা কথা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রবিন। তাই হবে। রত্ন! অলঙ্কার। ড্রাগ! যেকোন জিনিস হতে পারে। রোজার আর রিভস জানে, একটা খেলনা ভালুকের ভেতরে সাংঘাতিক দামি কিছু লুকানো রয়েছে। সেটা খুঁজতে লেসিং হাউসেও গিয়েছিল, ডলির জন্যে পারেনি। সে দেখে ফেলে পুলিশে খবর দিয়েছিল। তারপর অন্যভাবে ঢুকেছে ওই বাড়িতে। খুঁজেছে, পায়নি। তখন ধরে। নিয়ে গেছে ওকে জিজ্ঞেস করার জন্যে। ও বলেছে ওটা আমাদের কাছে থাকতে পারে। তখন এসেছে ইয়ার্ডে। আমাদের অনুসরণ করেই এখানকার ঠিকানা বের করেছে ওরা।

ওদিকে ডলিকে আটকে রেখেছে, যোগ করল মুসা। যাতে সে পুলিসকে বলে দিতে না পারে।

চমৎকার থিওরি, কিশোর বলল। সব খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। এখন। বাথরুমের তোয়ালেতে রক্তের কথাটায় আসা যাক।

হ্যাঁ। ওটাও সহজ। জোরাজুরি করতে গিয়ে কেউ জখম হয়েছিল। কেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়েছে। তোয়ালে দিয়ে মুছেছে তখন।

টগবগ করে ফুটতে আরম্ভ করেছে কিশোর। রিসিভার তুলে নিল। চকচক করছে চোখ। আমাদের এখন জানতে হবে খেলনাটা ডলির হাতে এল কিভাবে? এটা জানা জরুরী। হয়ত এর সাহায্যেই ওই রহস্যময় দানবকে ধরতে পারব। আমরা।

দ্রুত ডিরেক্টরির পাতা ওল্টাল কিপোর। এই যে, পেয়েছি। রকি বীচ ইন।

ওপাশ থেকে রিসিভার তুলতেই মিস্টার ডিকসনকে চাইল সে। তিনি ধরতে বললেন, কিশোর পাশা বলছি। একটা সূত্র বোধহয় পেয়েছি, যেটা কাজে লাগতে পারে। ডলির ব্যাগের খেলনা ভালুকটার কথা মনে আছে? ফ্রেনসো থেকে আসার সময় কি ওটা সঙ্গে নিয়েছিল? ভালুকটা আসল রোম দিয়ে তৈরি।

কি ভালুক?

 টেডি বিয়ার।

এক মিনিট। নরিয়াকে জিজ্ঞেস করে দেখি।

ওপাশে আলোচনা চলছে, কথাগুলো বুঝতে পারল না কিশোর। একটু পরেই লাইনে ফিরে এলেন ডিকসন। না, সে-ও বলতে পারছে না। যতদূর জানি, কাপড় আর মেকআপের জিনিসগুলো ব্যাগে ভরেই বাড়ি ছেড়েছে ও। কেন?

আমরাও শিওর নই, মিস্টার ডিকসন। তবে ভালুকের ব্যাপারে জানাটা জরুরী হয়ে পড়েছে। যাই হোক, নতুন কিছু জানতে পারলে জানাব।

লাইন কেটে দিল কিশোর। সহকারীদেরকে বলল, ভালুকটা এখান থেকেই জোগাড় করেছে ও। কোত্থেকে, সেটা বের করব কিভাবে?

পিজা শ্যাক! রবিন বলল। ওখানকার ওরা কিছু জানতে পারে।

ঠিক বলেছ। ওখান থেকেই শুরু করতে পারি।

কয়েক মিনিট পরেই কোস্ট হাইওয়ে ধরে সাইকেল চালিয়ে চলল তিন। গোয়েন্দা। পিজা শ্যাকে ঢুকে কয়েকজন পরিচিতকে দেখল। ওরা হাত নাড়ল। কাউন্টারের ওপাশের মহিলা হাসল।

ওরা এলে খুব একটা খায়টায় না, হেসে মিস্টার জেনসেনকে বলল মহিলা। তবে ভাল ছেলে। ভদ্র।

মন্তব্য করলেন না ম্যানেজার। নজর রাখলেন তিন গোয়েন্দার দিকে। ওরা। ছেলেমেয়েদেরকে খেলনা ভালুকটার কথা জিজ্ঞেস করছে যে, সেটাও শুনলেন।

টেডি বিয়ার? একটা ছেলে বলল, কি বল! অতবড় একটা মেয়ে ব্যাগের ভেতর খেলনা বয়ে বেড়াবে?

এতে অবাকের কি আছে? গাঢ় লাল লিপস্টিক লাগানো একটা মেয়ে বলল। অনেকেই বয়েস হলেও বাচ্চাই থেকে যায়। অন্তত ছোটদের কিছু কিছু স্বভাব থেকে যায়। বেটিটা একটু পাগলাটে ধরনেরই। ওর পক্ষে সব সম্ভব। আমি দেখেছি ব্যাগে। জিজ্ঞেস করেছিলাম কোথায় পেয়েছে। বলেনি।

অনেক দিন ধরে ছিল তার কাছে? জানতে চাইল কিশোর।

 শ্রাগ করল মেয়েটা। দুএক দিন হবে।

আর কেউ কিছু বলতে পারল না। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে পিজা শপ থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা।

এবার? বেরিয়েই প্রশ্ন করল মুসা, আর কাকে জিজ্ঞেস করব?

খেলনার দোকানে যাওয়াই তো উচিত, জবাব দিল কিশোর।

গুঙিয়ে উঠল মুসা। জানো, কটা দোকান আছে?

জানি। গোয়েন্দাদের কাজটাই কঠিন।

পিজা শপ থেকে কোয়ার্টার মাইল দূরেই পাওয়া গেল প্রথম খেলনার দোকানটা। ওখান থেকেই শুরু করল তিন গোয়েন্দা। ওখানে ভালুকের সমাহার দেখে আরেকবার গোঙাল মুসা। খাইছে! কি করে জানব? এত ভালুক যারা বিক্রি করে তাদের কি আর মনে থাকবে?

দেখাই যাক না, কিশোর বলল। তবে এখানে জিজ্ঞেস করে লাভ হবে না। একটাও রোমশ ভালুক নেই। রোম দিয়ে তৈরি নয়, সব তুলো।

তবু, এসেছি যখন জিজ্ঞেস করেই যাই, রবিন বলল।

দোকানের মালিক এক মহিলা। একটা খেলনা ভালুকের খোঁজে বেরিয়েছে ওরা শুনে একটু অবাকই হল। কিশোর বলল, আসল রোম। মিংক হতে পারে।

এতটাই দামি?

কি জানি, বুঝতে পারছি না। গাঢ় রঙের রোম। আমাদের এক বন্ধুর কাছে। দেখেছি। এখান থেকেই কিনে নিল কিনা জানতে এসেছিলাম।

না। এখানে ওরকম জিনিস পাবে না। সান্তা মনিকায় চলে যাও। বন্দরের ধারে কয়েকটা বড় বড় দোকান আছে। দামি খেলনা বিক্রি করে একমাত্র ওরাই। আর ওদের কাছে যদি না থাকে, বলে দিতে পারবে কোথায় পাওয়া যাবে।

সাইকেল রেখে বাসে করে সান্তা মনিকায় এল তিন গোয়েন্দা। বন্দরের কাছে প্রথম যে দোকানটা দেখল, ওটাতেই ঢুকল। পরে এক এক করে বাকিগুলোতে ঘুরবে। অনেক ধরনের খেলনা ভালুক দেখতে পেল ওখানে। মিংকের তৈরি টেডি বিয়ার অবশ্য পেল না।

অল্প বয়েসী একটা সুন্দরী মেয়ে কাউন্টারে রয়েছে। সে ওদেরকে বলল, বেভারলি হিলের খেলনার দোকানগুলোতে খোঁজ নিতে। ওখানে নাকি মিংকের তৈরি টেডি ভালুক বিক্রি হয়। কয়েকটা দোকানের নাম ঠিকানাও দিল।

তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার রাস্তায় বেরোল ছেলেরা। একটা অডি গাড়ি চলে গেল সামনে দিয়ে। তারপর রাস্তা পেরিয়ে বাসস্টপে চলে এল ওরা। ধপাস করে বেঞ্চের ওপর বসে পড়ল মুসা। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, হবে না এভাবে। বুঝলে, হবে না। সারা জীবন ধরে খুঁজলেও পাব না।

হবে, কিশোর, অতটা নিরাশ হতে পারল না। তবে বাসে করে ঘুরে কূল করতে পারব না। একটা গাড়ি লাগবে।

.

১৪.

 রোলস রয়েস নিয়ে হাজির হয়ে গেল হ্যানসন। তিন গোয়েন্দাকে বেভারলি হিলে নিয়ে গেল। পার্ক করল বেভারলি ড্রাইভের একটা লোডিং জোনে।

আমি এখানেই থাকি, বলল সে। দরকার হলে ডাকবে। বাড়িটা ঘুরেই গাড়ি বের করে নিয়ে যেতে পারব।

দুজন মহিলা হেঁটে চলল। একজনের হাতে একটা গাইডবুক। অন্যজনকে বলল, এই, শোন, এখানকার সব চেয়ে সম্ভ্রান্ত অঞ্চল বেভারলি হিল। অনেক দামি দামি ফিল স্টারের বাড়ি এখানে। দোকানপাটগুলো… সাড়া না পেয়ে পেছনে তাকিয়ে মাঝ পথে কথা থামিয়ে দিল সে।

ইরিনা! চিৎকার করে উঠল সে। গাড়িটা কি দেখেছ! তোলো তোলো, ছবি তোলো।

দেখেও না দেখার ভান করল হ্যানসন। হেঁটে যাচ্ছে তিন গোয়েন্দা। ঝট করে ক্যামেরা তুলে রোলস রয়েসটার একটা ছবি তুলে ফেলল ইরিনা।

 যেখানে গাড়িটা পার্ক করা হয়েছে তার কাছেই পাওয়া গেল দুটো খেলনার দোকান। প্রথমটাতে খুঁজে কিছু পেল না গোয়েন্দারা। পরেরটাতে চামড়ার প্যান্ট পরা একজন লম্বা লোক জানাল একটা মিংকের তৈরি টেডি বিয়ার দেখেছে।

বিক্রির জন্যে ছিল না অবশ্য ওটা, লোকটা বলল। আমাদের একজন। কাস্টোমার বোনাস হিসেবে পেয়েছে ওটা। উইলশায়ারের কোণের একটা দোকান। থেকে একটা ফারের জ্যাকেট কিনেছিল। জ্যাকেটটা তার বাড়িতে ডেলিভারি। দেয়ার সময় ভালুকটা চলে গেছে ওটার সঙ্গে। দোকানের তরফ থেকে উপহার।

ও, কিশোর বলল।

ওখান থেকে ইচ্ছে করলে ওরকম ভালুক কিনতে পারো। যদি আরও থাকে।

থ্যাঙ্ক ইউ।

অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস আমাদের কাছেও আছে। দরকার হলে চলে। এসো। এই ধরো না মাউজ হাউসের কথাই। অনেক আছে আমাদের।

কেন? মুসা জানতে চাইল, ইঁদুর পোষার জন্যে?

খেলনা ইঁদুর। বেভারলি হিলে জ্যান্ত ইঁদুর রাখা নিষিদ্ধ।

নাক মুখ কুঁচকে এমন একটা ভঙ্গি করল মুসা, যেন বোঝাতে চাইল, সবখানেই পাগল থাকে। নইলে খেলনা ইঁদুরের আবার বাড়ি কেন?

গাড়িতে ফিরে এল ওরা। একজন পথচারীকে বোঝাচ্ছে হ্যানসন, গাড়িটা, ছবিতে ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়নি। বিশ্বাস করাতে পারছে না লোকটাকে। তিন গোয়েন্দাকে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাচল। তাড়াতাড়ি ওদেরকে তুলে নিয়ে ছেড়ে দিল। গাড়ি। উইলশায়ারের দিকে যেতে যেতে বলল, বেভারলি ড্রাইভ আস্তে আস্তে পর্যটন কেন্দ্র হয়ে যাচ্ছে। ট্যুরিস্টদের উৎপাত বাড়ছে।

কয়েকবার করে আমাকে সহ গাড়িটার ছবি তুলে নিয়ে গেছে কয়েকজনে, জানাল সে। লোকের ধারণা, আমি ফিল্ম স্টার।

 লোকের দোষ নেই, রবিন বলল। গাড়িটা যেমন চোখে পড়ার মত। আপনার ইউনিফর্ম তেমনি। এমনকি বেভারলি হিলের জন্যেও অস্বাভাবিক।

অস্বীকার করছি না, হেসে বলল হ্যানসন।

উইলশায়ারের কোণের দোকানটার নাম উচ্চারণ করাই কঠিনঃ, অনস্কি ফ্রেরিজ। সাদাটে ধূসর দেয়াল, ধূসর কার্পেটে গোড়ালি দেবে যায়। ছেলেরা ঢুকে দেখল, গলায় দরজির ফিতে ঝোলানো একজন লোক যুবক বয়েসী একজনকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিছুতেই বুঝতে চাইছে না যুবক। মুখ গোমড়া করে একনাগাড়ে অভিযোগ করে চলেছে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ভাল না হলে সে কিভাবে। কাজ করবে?

টেডি বিয়ার? কিশোরের প্রশ্ন শুনে লোকটা বলল। কিছু ভালুক ছিল আমার কাছে। তবে এখন একটাও নেই। সব নিয়ে গেছে।

নিয়ে গেছে?

চুরি। ও জানো না? জানবেই বা কি করে। পত্রিকায় ছাপা হয়নি। চুরিদারি আজকাল আর কোন ব্যাপারই না।

উত্তেজিত হলো কিশোর। চুরি? কবে?

প্রথমে কিছু ফরি চুরি করেছে। হপ্তাখানেক আগে। তারপর চারদিন আগে কিছু রেকর্ড চুরি করে নিয়ে গেছে। কেন? তোমার এসব জানার আগ্রহ কেন? খেলনা ভালুক চাও তো? খেলনার দোকানে চলে গেলেই পারো।

কিন্তু আমার বন্ধুরটা ছিল ফারের ভালুক। আসল রোমের তৈরি, বুঝতেই পারছেন। আমার কাছে রেখে গিয়েছিল। কে জানি আমাদের বাড়িতে ঢুকে নিয়ে গেছে।

মাথা ঝাঁকাল লোকটা। ঠিক আমার দোকানে যা ঘটেছে। পয়লা বার যখন চুরি করল, ফারের সঙ্গে খেলনাগুলোও নিয়ে গেল। তারপর এল আমার ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করতে। সারা মেঝেতে ছড়িয়ে ফেলে গেল। কিছু কাগজ এখনও পাচ্ছি না। ফারগুলো ভাগ্যিস বীমা করানো ছিল। ওগুলো নিয়েছে, নাহয় বুঝলাম দামি জিনিস বলে। কাগজপত্র ঘাটল কেন? সব শয়তানী। আসলে কাজের লোকের ওপর বোধহয় রাগ আছে। ফলে যারা কাজ করে খেতে চায় তাদের সঙ্গে নষ্টামি শুরু করেছে।

এটা যুক্তির কথা নয়। তবু কিশোর বলল, হবে হয়ত।

সকেট থেকে প্লাগ খুলে যন্ত্র নিয়ে পেছনের ঘরে চলে গেল যুবক।

ওই যে দেখ না, যুবকের কথা বলল লোকটা। এর কথাই ধরো। সে সৎও। হতে পারে আবার অসৎও হতে পারে, কি করে বুঝবে? কেবল অনুমান করতে পার। আর কিছু করার নেই। এ তো কাজটা অন্তত ঠিকভাবে করে, আগেরটা তা ও করত না। ওকে কাজ করতে বলতাম, চুপ করে থাকত। যা-ই বলতাম, কিছুই বলত না। এর চেয়ে কবর থেকে একটা লাশকে তুলে নিয়ে এসে যদি বকাঝকা কুরতাম, কাজ হত। তবে সিনেমার ব্যাপারে বেশ ভাল জ্ঞান ছিল। আমি সিনেমা দিয়ে কি করব, বল?

উত্তেজনা বাড়ল কিশোরের। এমনকি পেছনে মুসাও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। গলা বাড়িয়ে দিয়েছে রবিন, যাতে দোকানদারের একটা কথাও কান না এড়ায়।

 সিনেমায় কাজ করত? কিশোর জিজ্ঞেস করল, হরর ছবির ব্যাপারে কিছু জানত কি?

তুমি কি করে বুঝলে? জানত! অবশ্যই জানত! ড্রাকুলা! মায়ানেকড়ে! কবর থেকে উঠে আসা নানারকম পিশাচ, যারা মানুষের কলজে খায়! বিচ্ছিরি সব ভাবনাচিন্তা!।

হঠাৎ ভুরু কুঁচকে ফেলল লোকটা। সন্দেহ দেখা দিল চোখে। লোকটাকে চেন নাকি? তোমরা কারা? কি চাও?

আমরা…আমরা আমাদের বন্ধুকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি, সাবধানে বলল কিশোর। ভালুকটা তারই ছিল। হারিয়ে গেছে সে। তাকে উদ্ধার করা খুব। জরুরী। অনুরোধ করল সে। প্লীজ! একটা উপকার করুন। লোকটাকে কিভাবে জোগাড় করেছেন, বলবেন? কোন এজেন্সির মাধ্যমে?

ভ্রূকুটি করল লোকটা। এমনি এসে হাজির হলো একদিন। একটা চাকরি চাইল। খুব নাকি দরকার। যেকোন কাজ করতে রাজি।

চুরির আগে এসেছিল, না পরে? গেছে কবে? কতদিন কাজ করেছে?

দুদিনও করেনি। কোনমতে তাকে দিয়ে কাজ করাতে না পেরে শেষে বিদেয়। করে দিয়েছে। হপ্তা দুই আগের কথা সেটা। ওসব শুনে তোমার লাভ হবে না।

লোকটার ঠিকানা জানেন? চাপাচাপি শুরু করল কিশোর। কোথায় থাকে? কি নাম বলেছে? মিসেস লেসিংকে চেনেন? চেশায়ার স্কোয়্যারে থাকেন? তিনি আপনার কাস্টোমার?

বাহ! এবার আমার কাস্টোমারদের কথাও জানতে চায়? আরও সন্দিহান হয়ে। উঠল লোকটা। মতলবটা কি তোমার? যাবে, না পুলিশ ডাকব?

প্লীজ, আপনি বুঝতে পারছেন না! ব্যাপারটা জানা খুবই জরুরী। গড়গড় করে ডলির গল্প বলতে আরম্ভ করল কিশোর। কি করে বাড়ি থেকে পালিয়ে ছিল, কি করে ওরা খুঁজে বের করেছিল, কি করে লেসিং হাউসে চাকরি নিয়েছে, বলল। ওর ব্যাগের খেলনা ভালুকটার কথাও বলল। বলল তার উদ্বিগ্ন মা-বাবার কথা। শেষে বলল, মনে হয়, মেয়েটাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। আর এর সঙ্গে ভালুকটার যোগাযোগ থাকতে পারে।

পুরো গল্পটা শোনার পরেও সন্দেহ গেল না লোকটার। বলল, একজন মিস লেসিংকে চেনে। যে লোকটা দুদিন থেকে চলে গেছে তার নাম-ঠিকানা জানার জন্যে চাপাচাপি করতে লাগল কিশোর। কিছুতেই তাকে নিরস্ত করতে না পেরে রেগেমেগে শেষে গিয়ে পেছনের ঘর থেকে কতগুলো কাগজপত্র নিয়ে এল লোকটা।

একটা অফিশিয়াল ফর্ম রয়েছে ফাইলে, যেটা সরকারের কাছে জমা দেয় কর্মচারীরা। নাম আছে, সোশাল সিকিউরিটি নাম্বার আছে। জ্যাক ব্রাউন নামে ফর্ম পূরণ করেছে। আরেকটা কাগজ দেখাল দোকানদার, ওটাতে নিজের হাতে নাম ঠিকানা লিখেছে ব্রাউন।

টাকা নিয়ে যায়নি, লোকটা বলল। যে দুদিন কাজ করেছে, তার চেক ডাকে পাঠিয়ে দিয়েছি।

ফেরত এসেছে?

না।

এই ব্রাউন লোকটা দেখতে কেমন? রোগাপাতলা, কান ঢেকে ফেলা লম্বা। চুল। তাই না?

না। বেঁটে। পেটমোটা, হোঁকাই বলা চলে। ছোট করে হাঁটা কালো চুল। কোকড়া। দেখ, আমার এসব পছন্দ হচ্ছে না

আর একটা কথা, হাত তুলল কিশোর। টেডি বিয়ারটা কোথায় পেয়েছিলেন? আপনি তৈরি করেননি, তাই না?

না। একজন ডিলারের কাছ থেকে কিনেছি। এইচ. কে. ইমপোর্টারস।

 সেটা মিসেস. লেসিংকে দিয়েছিলেন?

আর সহ্য করল না দোকানদার। বেরোও!

দোকান থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। বেরোনোর আগে লক্ষ্য করল, রিসিভার তুলে ডায়াল করছে লোকটা।

পুলিশকে ফোন করছে, অনুমান করল মুসা।

শুনলই না যেন কিশোর। মোড়ের কাছে পৌঁছল। মেরুন রঙের একটা অডি গাড়িকে দেখল সরে যাচ্ছে। রাস্তা পেরিয়ে অন্য পাশে এল ওরা। রোলস রয়েস। নিয়ে যেখানে অপেক্ষা করছে হ্যানসন।

কিশোর বলল, ফারের একটা পোশাক কিনেছিলেন মিস লেসিং। সেই সাথে গিয়েছিল মিংকের ভালুকটা। তিনি ইউরোপে চলে গেলে ভালুকটা পেয়েছিল ডলি। কিংবা হয়ত চেয়েছিল, দিয়ে দিয়েছেন মিস লেসিং। বিনে পয়সায় পেয়েছেন তিনি। ওটা। খেলনা দিয়ে কি করবেন? মেয়েটা যখন চেয়েছে, দিয়েই দিই, এরকম ভেবেই হয়ত দিয়েছেন। এইবার আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে দোকানদারের অলস কর্মচারীকে।

ঠিকানাটা মনে আছে তো? জিজ্ঞেস করল রবিন। যদিও জানে কিশোর। পাশা একবার কোন জিনিস পড়লে সহজে ভোলে না।

আছে। সান্তা মনিকার একটা গলিতে। একটা অ্যাপার্টমেন্ট নাম্বার রয়েছে। তার মানে কোন অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙে তার বাসা।

নামটাও বানিয়ে লিখতে পারে, আশাবাদী হতে পারছে না মুসা, ঠিকানাটাও। অহেতুক গিয়ে ঘুরে আসব তাহলে।

হাসল কিশোর। একটা কথা ভুলে যাচ্ছ। বেতনের চেক পাঠিয়েছিল দোকানদার। সেটা ফেরত আসেনি। তারমানে সান্তা মনিকার ওই ঠিকানায় কেউ আছে যে ওটা গ্রহণ করেছে। হাত নেড়ে বলল, এখন আমাদের কাজ, চেকটা যে নিয়েছে, তাকে খুঁজে বের করা। হয়ত এর ওপর নির্ভর করছে ডলির বাঁচামরা!

.

১৫.

 বাড়িটা খুঁজে বের করতে অসুবিধে হল না। সাগরের তীর থেকে দশ ব্লক দূরে। একটা অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ির নিচতলায় জ্যাক ব্রাউনের ঘর।

দ্বিধা করল মুসা। কি করব?

বেল বাজাব, কিশোর বলল।

কিন্তু কলিং বেলের জবাব দিল না কেউ।

মিনিট দুই অপেক্ষা করে জানালার কাছে নাক চেপে ধরল রবিন। বই আর, কাগজপত্রে ঠাসা, গাদাগাদি করে রয়েছে মেঝেতে, পুরানো আসবাবপত্রের ওপরে। ছবির ফিল্ম রাখার কয়েকটা ক্যানূ পড়ে রয়েছে একধারে। বুককেসের ওপর একটা মানুষের খুলি। খুলির ওপরের দেয়ালে একটা পোস্টার। কালচে রঙের একটা কিম্ভুত জীবের ছবি, মুখটা সবুজ। কবর থেকে বেরিয়ে আসছে।

 থার্ড অ্যানুয়াল কনভেনশন! বিড়বিড় করে পড়ল রবিন, পোস্টারের ওপরের লেখাটা। হরর ফ্যান ক্লাব অভ নর্থ আমেরিকা। আগস্ট ফোরটিন অ্যাণ্ড ফিফটিন, সান্তা মনিকা সিভিক অডিটরিয়াম!

ফিরে তাকিয়ে বলল, ঠিক জায়গায় এসেছি আমরা!

অ্যাই, কি করছ? সামনের বাগানের কাছ থেকে বলে উঠল একটা কণ্ঠ।

 ফিরে তাকাল ছেলেরা। লাল চুল এক মহিলা। মিস্টার রিভসকে খুঁজছ, না? লোকটার ম্যানেজার হবে মনে হয় মহিলা।

তার বন্ধু জ্যাক ব্রাউনকে হলেও চলবে, কিশোর, বলল। উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।

ব্রাউন? চিনি না। তবে ওই নামটা নিজের লেটার বক্সে কদিন ধরে লাগিয়ে রেখেছেন মিস্টার রিভস। এখন তো বাড়ি নেই। ছুটিতে বেড়াতে গেছেন। কিছু বলতে হবে?

না। থ্যাঙ্ক ইউ। পকেট থেকে নোটবুক বের করল কিশোর। ব্রাউনের ব্যাপারে কিছুই জানেন না?

মাথা নাড়ল মহিলা। না। কখনও দেখিনি। হতে পারে, কিছু দিন ছিল মিস্টার রিভসের সঙ্গে। ওই মিস্টার কেইনের মত।

 মিস্টার কেইন? উত্তেজনায় কাঁপতে আরম্ভ করেছে কিশোর। লম্বা চুলওয়ালা। সেই মানুষটা? চুলে কান ঢেকে যায় যে?

হ্যাঁ। ডেগি কেইন।

ডেগি!

হ্যাঁ। আমার কাজ আছে। মিস্টার রিভসকে কিছু বলতে হবে?

খসখস করে নোটবুকে ফোন নম্বর আর ঠিকানা লিখে বাড়িয়ে দিয়ে কিশোর বলল, আমার কাছে কিছু পুরানো সিনেমার পোস্টার আছে। কিনতে চাইলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবেন মিস্টার রিভসকে। তার অফিসের নম্বর আছে?

না, নেই, এখন কোথাও কাজ করেন না। কয়েক হপ্তা আগে একটা স্টুডিওতে। করতেন, চোখে কৌতূহল নিয়ে কিশোরের দিকে তাকাল মহিলা। তাহলে তুমিও ওদেরই একজন?

মানে?

উদ্ভট জিনিস সংগ্রহ কর? মিস্টার রিভসের মত কি যে আজেবাজে জিনিস যোগাড় করে! ওসব কিনে পয়সা খরচ করে ফেলে। অনেক সময় না খেয়েও থাকে। তোমার বয়েস কম। ওসবে জড়িয়ে অহেতুক জীবনটা নষ্ট কোরো না।

বাড়ির ভেতরে টেলিফোন বাজল। জবাব দিতে গেল মহিলা।

রিভস তাহলে একজন সংগ্রাহক, কিশোর বলল। আগেই বোঝা উচিত ছিল। ডেগি কেইন ছিল কিছুদিন ওর সঙ্গে। আর কেইন যদি রোজারের ছদ্মনাম হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে অগ্রগতি হচ্ছে আমাদের।

পুলিসকে জানাব? মুসার প্রশ্ন। নাকি বসে থাকব। রিভস ফিরতে পারে। সংগ্রাহকরা তাদের জিনিসের জন্যে ফিরে আসে, তাই না?

আসে। ইউ অক্ষরের আকৃতিতে তৈরি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। ঢোকার জায়গা খুজছে মনে হয়। এগিয়ে গিয়ে একটা দরজার ফাঁকে সবে চোখ রাখতে যাবে, এই সময় একটা লোককে আসতে দেখল।

মুসা বলল, আরে! ওই তো, মিস্টার রিভস!

কালো কোঁকড়া চুলওয়ালা একজন লোক, রোজারের সঙ্গে ছিল ডলির। পার্টিতে। তিন গোয়েন্দাকে দেখেই চিনল। থমকে গেল মুহূর্তের জন্যে। তারপর এগিয়ে এল। বাহ, আবার দেখা হয়ে গেল। তা কি জন্যে এসেছ?

 ডলি ডিকসনের জন্যে, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। কিংবা বলতে পারেন। বেটসি আরিয়াগোর জন্যে।

ওর..ওর কি হলো?

হারিয়ে গেছে। আপনি ভাল করেই জানেন। ইয়ান রোজার নামের লোকটা…

রোজার? ওর আবার কি হল?

ওর নাম রোজার নয়। কোথায় আছে দয়া করে যদি বলেন গিয়ে কথা বলে। দেখতে পারি। আর

কিশোরের এসব নরম কথা ভাল লাগল না মুসার। খপ করে লোকটার হাত চেপে ধরে বলল, লোকটা কোথায়? ডলি ডিকসন কোথায়? ভাল চাইলে জলদি বলুন!,

কি বলছ তাই তো বুঝতে পারছি না। ঘামতে শুরু করেছে লোকটা। দেখো, হাত ছাড় বলছি। নইলে পুলিশ ডাকব।

ডাকুন। আমরা তো সেটাই চাই।

ইয়ে…মানে… রিভসের কতকতে চোখে অস্বস্তি দেখা দিল। শোন… হাতটা ছাড় না, বলছি। ডলির ট্যালেন্ট আছে। কিছুদিন ট্রেনিং দিলেই হয়ে যাবে। সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে। আচমকা কণ্ঠস্বর বদলে গেল লোকটার। বলল, এসো, দেখাচ্ছি একটা জিনিস।

একে অন্যের দিকে তাকাল ছেলেরা।

পকেট থেকে চাবি বের করে গ্যারেজের দরজা খুলল রিভস। ওই দেখ! এমন ভঙ্গিতে বলল লোকটা। যেন পবিত্র কোন কিছু সম্বন্ধে বলছে। দেখে চোখ সার্থক কর। পুরানো দুর্গে যে জোম্বি ঢুকেছিল ব্লাড হারভেস্ট ছবিতে, মনে আছে? তারই দৃশ্য। আর ওই কফিনটা ভিলেজ অভ কার্ড থেকে নেয়া। ওটা লন চ্যানি অভিনীত ফ্যান্টম অভ অপেরা থেকে…

এ তো হরর ছবির একটা মিউজিয়ম! হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে রবিন।

কিশোর তাকিয়ে রয়েছে বোরিস কারলফ অভিনীত ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ছবির পোস্টারের দিকে। একভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রিভসকে কিছু বলার জন্যে ঘুরেই স্থির হয়ে গেল কিশোর। নেই লোকটা। ওদেরকে কায়দা করে এখানে ঢুকিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে।

মিস্টার রিভস? চেঁচিয়ে ডাকল সে।

জবাবে ঝটকা দিয়ে লেগে গেল গ্যারেজের দরজা। অন্ধকার হয়ে গেল ঘর।

খাইছে! অ্যাইই! চিৎকার করে ডাকল মুসা।

বাইরে তালা লাগানোর শব্দ হল। চেঁচামেচি জুড়ে দিল তিন গোয়েন্দা। লাভ হল না। কেউ সাড়া দিল না। আটকা পড়ল ওরা।

.

 কয়েক মিনিট চিৎকার চেঁচামেচি করে ক্ষান্ত দিল ছেলেরা।

হ্যানসন কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? মুসা বলল। বেশি দেরি দেখলে নিশ্চয় খুঁজতে আসবে আমাদের। কিন্তু গ্যারেজে দেখার কথা কি ভাববে?

ওর জন্যে বসে থাকতে পারি না আমরা, কিশোর বলল। রিভস তার সঙ্গীকে নিয়ে ফিরে আসতে পারে। পিস্তল-টিস্তল নিয়ে।

তাই তো!

বোরোনোর চেষ্টা করতে হবে আমাদের। জানালা থাকতে পারে। শেষ মাথায়।

যদি না থাকে? রবিনের প্রশ্ন।

আবার এসে দরজায় ধাক্কা দেব আর চিৎকার করতে থাকব।

অনেক লম্বা ঘরটা। নানা রকম উদ্ভট জিনিসে বোঝাই। হরর ছবি তৈরি করার মালমশলার একটা গুদাম যেন। গন্ধটাও পুরানো কবরস্থানের কফিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। অনেক দিন পর পুরানো কবর খুললে যেমন বোটকা গন্ধ বেরোয়, অনেকটা তেমনি।

নরম কিছুতে পা পড়তে কিচ করে উঠল ওটা।

বাবারে! ভূত! বলে চিৎকার করে উঠল মুসা।

দূর! কি কর, ও তো ইঁদুর! রবিন বলল।

অনেক খোঁজাখুঁজি করল ওরা। অবশেষে দেয়ালের এক জায়গায় দেখল হার্ডবোর্ড লাগানো রয়েছে। একধার ধরে হ্যাঁচকা টান মারল মুসা। নড়ে উঠল, বোর্ডটা। আরেকটু জোরে. টানতেই খুলে চলে এল হাতে। বেরিয়ে পড়ল একটা জানালা।

ঠেলা দিতেই খুলে গেল পাল্লা। মাথা বের করল মুসা। পাশে তাকাতেই চোখে পড়ল পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন পুলিশ অফিসার।

বেরিয়ে এস, বলল অফিসার। শয়তানীর চেষ্টা করবে না একদম। এস।

 মুসা বেরোল। তারপর বেরোল রবিন। সব শেষে কিশোর।

অফিসারের কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছে লালচুল মহিলা। বলল, হ্যাঁ, এই ছেলেগুলোই। মিস্টার রিভসকে খুঁজতে এসেছিল। একটু পরে গ্যারেজে চেঁচামেচি শুনলাম। ভাবলাম ওরাই হবে।

আমাদের আটকে রেখে পালিয়েছে হ্যারিসন রিভস, অভিযোগের সুরে অফিসারকে বলল কিশোর।

তাই? পাথরের মত কঠিন হয়ে আছে অফিসারের মুখ।

কদিন ধরেই মিস্টার রিভস বাড়িতে নেই, মহিলা বলল। কি করে আটকাল। তোমাদের?

শান্ত কণ্ঠে বিশেষ একটা ভঙ্গি নিয়ে কিশোর বলতে লাগল, একটা মেয়ে। হারিয়ে গেছে। ওর নাম ডালিয়া ডিকসন। রিভস আর তার এক সঙ্গী শেষবার দেখা করেছে মেয়েটার সঙ্গে। গতকাল, চেশায়ার স্কোয়্যারে। আমাদের সন্দেহ, ওরা দুজনই মেয়েটাকে নিয়ে গেছে।

বড় বেশি টিভি দেখ তুমি, গম্ভীর কণ্ঠে বলল অফিসার।

 বিশ্বাস না করলে পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

বাড়ির কোণ ঘুরে এগিয়ে এল দুজন লোক। একজন বয়স্ক। পরনে ইউনিফর্ম। নেই, কিন্তু ভাবভঙ্গি আর পুলিশ অফিসারের সম্মান দেখানো থেকেই আন্দাজ করা গেল, ওই দুজনও পুলিশের লোক। সাদা পোশাকে এসেছে। ডিটেকটিভ।

কিশোরের কথা মন দিয়ে শুনল ওরা। তারপর বয়স্ক লোকটা ওদেরকে ওখানে থাকতে বলে চলে গেল। ইউনিফর্ম পরা অফিসার লাল চুল মহিলার সঙ্গে বাড়ির ভেতরে গেল, নিশ্চিত হয়ে আসার জন্যে যে রিভস বাড়িতে নেই। ফিরে এল খানিক বাদেই। তিন গোয়েন্দাকে তিরস্কার করে বলল সিনিয়র অফিসার, অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো উচিত নয়। তিন গোয়েন্দার নাম-ঠিকানা লিখে নিতে লাগল।

উঁকিঝুঁকি দিতে আরম্ভ করেছে কৌতূহলী পড়শীরা।

অ্যাই! ট্রাইসাইকেলে বসা একজন জিজ্ঞেস করল পুলিশকে, চোর ধরলেন। নাকি?

না। গম্ভীর হয়ে জবাব দিল অফিসার। আপনারা যান।

তিন গোয়েন্দাকে ছেড়ে দেয়া হলো। দ্রুতপায়ে ওখান থেকে সরে চলে এল। ওরা। আরও লোক জড়ো হওয়ার আগেই। অপমানকর কথা শুনতে ভাল লাগে না। অর্ধেক পথ আসতেই চোখে পড়ল, মোড়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে মেরুন অডি গাড়ি, সেই গাড়িটা, যেটা আরও দুবার দেখেছে। ওটার পাশে চলে এল তিন গোয়েন্দা। মুখ ফিরিয়ে তাকাল আরোহী, যেন প্যাসেঞ্জার সীটে পড়ে থাকা কিছু দেখছে।

এই! কিশোর বলল ফিসফিস করে।

 কী? রবিন জানতে চাইল।

পেছনে তাকাবে না। কোন দিকেই তাকাবে না। গাড়ির ভেতরে যে লোকটা বসে আছে, এখান থেকে সে রিভসের বাড়ির ওপর চোখ রাখতে পারে। রেখেছিল। বলেই মনে হয় আমার।

তাতে কি? মুসার প্রশ্ন। অনেকেই তো এখন রিভসের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।

এই গাড়িটা আজকে আরও দেখেছি। আর ভেতরের লোকটা মিস্টার জেনসেন, পিজা শ্যাকের ম্যানেজার। আমাদেরকে না দেখার ভান করছে। ও এখানে কি করছে?

১৬.

তিন গোয়েন্দা গাড়িতে উঠলে হ্যানসন জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?

একটা টেলিফোন বক্সের কাছে, কিশোর জবাব দিল।

একটা পেট্রল স্টেশনে গাড়ি ঢোকাল হ্যানসন।

টেলিফোন ডিরেক্টরি ঘেঁটে বের করল কিশোরআর জে. ইম্পোরটারসের ঠিকানা। লং বীচে। দক্ষিণে পয়তাল্লিশ মিনিটের পথ।

রিভসের সঙ্গে ফারের পোশাকের দোকানদারের যোগাযোগ আছে, দোকানদারের সঙ্গে ভালুকটার যোগাযোগ আছে, এবং ভালুকটার সঙ্গে ডলির। যোগাযোগ আছে, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। সুতরাং, যে কোম্পানি ভালুকটা সাপ্লাই করেছে, তাদের সঙ্গে দেখা করা দরকার।

অনেক দূরে, হ্যানসন বলল। ম্যাপ অবশ্য আছে গাড়িতে। ঠিকানাটা বের করে ফেলতে পারব।

 ঠিকানা জেনে নিয়ে আবার গাড়িতে উঠল তিন গোয়েন্দা। লং বীচে চলল। হ্যানসন। পেছনে উত্তেজিত হয়ে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। ছেলেরা।

লং বীচে সাগরের কিনারে বাড়িটা। কেমন বিষণ্ণ আর নির্জন মনে হচ্ছে জানালায় আলো নেই। বাড়ির সামনে ট্রাক-লড়ি কিছু নেই, কোম্পানিগুলোর সামনে সাধারণত যেমন থাকে।

এবারেও বাড়ি থেকে দূরে গাড়ি রাখল হানসন। বাড়িতে লোক থাকলে যাতে দেখতে না পায়।

 সামনে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে বাড়িটার দিকে তাকাল রবিন। পশ্চিমে সাগরের দিকে মুখ করা। ভেতরে কেউ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।

দেখি, দরজায় টোকা দিয়ে, কিশোর বলল।

দুই ধাপ সিঁড়ি উঠে দরজায় থাবা দিল সে। কেউ সাড়াও দিল না, বেরোলও না। দরজার পাল্লার ওপর দিকটায় কাঁচের প্যানেল লাগানো। সেখানে চোখ রেখে ভেতরে ছোট একটা অফিস দেখতে পেল। ঘরটা শূন্য।

নেই তো কিছু। ফিরে তাকিয়ে বলল কিশোর।

বাড়ির উত্তর পাশে একটা কার পার্ক। ওখানে এসে আবার তাকাল বাড়ির দিকে। জানালাগুলোতে লোহার গ্রিল লাগানো। একটা কাঠের বাক্স পড়ে থাকতে দেখে সেটা এনে একটা জানালার নিচে রেখে তার ওপর উঠল মুসা। জানালা দিয়ে ভেতরে তাকাল।

কি দেখছ? জানতে চাইল রবিন।

স্টোর রুম মনে হচ্ছে। বেশ কিছু ভালুক দেখতে পাচ্ছি। আর প্যাকেট করার জিনিসপত্র। একধারে ছোট একটা ঘর আছে মনে হয়। দরজায় সাইন লাগানো। পড়তে পারছি না।

নেমে এল মুসা। অন্য পাশ দিয়ে গিয়ে দেখি।

কিন্তু অন্য পাশে এসে দেখল, জানালাই নেই।

কিভাবে ঢোকা যায় আলোচনা করছে তিনজনে, এই সময় একটা গাড়িকে থামতে শুনল।

চুপ! ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারা করল কিশোর।

 দরজা খুলে নেমে এল কেউ। সিঁড়ি বেয়ে উঠল।

এইবার যাওয়া যাক, ফিসফিসিয়ে বলল রবিন। বলব, একটা ভালুক কিনতে চাই আমরা।

ঘুরে আবার বাড়ির কোণে এসেই থমকে দাঁড়াল তিনজনে। সেই মেরুন। অডি।

পিছিয়ে এল ওরা।

আশ্চর্য! আনমনেই বলল কিশোর। কার ওপর চোখ রাখছে? রিভস? না আমাদের ওপর?

নজর রাখব। দেখি কি করে? রবিন বলল।

অপেক্ষা করতে লাগল ওরা। পনেরো মিনিট গেল… বিশ…তারপর দরজা খুলল বাড়িটার। একটা ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এল একজন লোক। গাড়ির বুটে নিয়ে গিয়ে তুলল। গাড়ি চালিয়ে নিয়ে চলে গেল।

জেনসেনই, মুসা বলল। সন্দেহ নেই। মনে হচ্ছে শয়তানের চেলা সে-ই। সব কিছুর হোতা, নাটের গুরু। গাধার মত পিজা শ্যাকে বসে আলোচনা করেছি। আমরা। সব সে শুনেছে। পিছু নিয়েছে আমাদের।

এ বাড়িতে আটকে রাখেনি তো ডলিকে! বলে উঠল রবিন।

জলদি চলো! পুলিশকে ফোন করি!

যদি ডলি ভেতরে, না থাকে, নিরাশ করল ওদেরকে কিশোর। তখন কি জবাব দেব? পুলিশকে খবর দেয়ার আগে শিওর হতে হবে আমাদের।

ওপর দিকে তাকাল মুসা। আচ্ছা, এক কাজ তো করতে পারি। ওখানে উঠে গিয়ে স্কাইলাইটের ভেতর দিয়ে দেখতে পারি আছে কিনা কেউ ভেতরে।

বলেই রওনা হয়ে গেল সে। পিছু নিল কিশোর আর রবিন। কোণের কাছে একটা পাইপ নেমে এসেছে ওপর থেকে। ওটা বেয়ে উঠতে শুরু করল।

জলদি কর! তাগাদা দিল রবিন। কেউ দেখে ফেললে পুলিশকে খবর দেবে। এখানেও কিছু করতে পারব না আমরা।

ছাতে উঠে গেল মুসা। ছটা স্কাইলাইট আছে মোট। ছোট যে ঘরটার কথা সে বলেছিল, বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে দেখেছিল, একটা স্কাইলাইট দিয়ে সেটার ভেতরটা। দেখা যায়। কাঁচে পুরু হয়ে ময়লা লেগে রয়েছে। হাত দিয়ে ডলে ডলে পরিষ্কার করল সে। তারপর ভেতরে উঁকি দিল।

কি দেখছ? নিচে থেকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

কিছুই তো বুঝতে পারছি না। অন্ধকার। কিছু বস্তাটস্তা আছে মনে হয়।

 মাটিতে বসে পড়ল কিশোর। নাহ, মনে হয় এখানে নেই!

আরও কয়েক মিনিট চেষ্টা করে ফিরে এল মুসা।

তিনজনে বসে বসে আরও কিছুক্ষণ আলোচনা করল, সমস্যাটার সমাধান করা যায় কিনা। উপায় বের করতে পারল না।

শেষে কিশোর বলল, একটা স্কাইলাইট দিয়ে দেখেই নেমে এলে কেন? বাকিগুলো দেখা দরকার ছিল।

চল না, তিনজনেই উঠে যাই, রবিন প্রস্তাব দিল।

মন্দ বলনি। চলো, আরেকবার দেখি।

তিনজনেই ছাতে উঠে পড়ল। পুরানো ছাত। হঠাৎ এক জায়গায় মড়মড় করে। উঠল। তিনজনের ভার সইতে পারছে না।

খবরদার! নড়বে না! চিৎকার করে উঠল মুসা।

 আবার গুঙিয়ে উঠল ছাতের তক্তা। মড়মড় করে উঠল জোরে। দেবে যেতে শুরু করল। থাবা দিয়ে কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করল কিশোর। পারল না। পড়ে যাচ্ছে নিচের দিকে।

.

১৭.

অন্ধকারে পড়ে আছে কিশোর। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কোনমতে উঠে বসল। অনেকটা সহজ হয়ে এল শ্বাস-প্রশ্বাস।

কিশোর? কিশোর, তুমি ঠিক আছ? 

মুসা ডাকছে। যে ফোকরটা দিয়ে পড়েছে কিশোর, তার কিনারে গলা বাড়িয়ে দিয়েছে সে। আবার ডাকল, কিশোওর?

আমি ঠিকই আছি, গোঁ গোঁ করে জবাব দিল কিশোর। উঠে দাঁড়াল। ছোট ঘরের পাশের বড় ঘরটায় পড়েছে। নব ধরে মোচড় দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করল। নড়ল না নবটা। তালা দেয়া।

ঘরে অনেকগুলো ইস্পাতের র‍্যাক। তাকে সাজানো টেডি বিয়ার। আরও নানারকম খেলনা আর পুতুল রয়েছে। বাক্স, প্যাকেট করার কাগজ ছড়িয়ে রয়েছে মেঝেতে। কিছু খেলনা মেঝেতেও পড়ে আছে।

একটা ভালুক হাতে নিল কিশোর। ডলিরটা যেমন ছিল তেমনই দেখতে। নিয়ে এগোল আরেক দিকে। বাড়ির সামনের দিকে। আরেকটা দরজা চোখে পড়েছে। সহজেই খুলে গেল ওটা। ভেতরটা অফিসঘর। দুটো ডেস্ক আছে। ওপাশের দরজাটা খুলতে যাবে এই সময় আবার কানে এল গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ।

দরজার কাচের প্যানেল দিয়ে বাইরে তাকাল সে। ফিরে এসেছে মেরুন অডিটা। দ্রুত আবার স্টোররুমে ফিরে এল কিশোর। অফিসের দরজাটা লাগিয়ে দিল।

ছাতের ওপরে নড়েচড়ে উঠল মুসা। ডেকে জিজ্ঞেস করল, কিশোর, কি করছ?

আস্তে! সাবধান করল কিশোর। সরে যাও! ওই লোকটা ফিরে এসেছে!

কয়েকটা বাক্সের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল সে। দরজায় চাবি লাগানোর শব্দ শুনল। অফিসে ঢুকল কেউ। চেয়ার টানার শব্দ হল। ড্রয়ার খুলল; কাগজপত্রের খসখস হল, কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল লোকটা।

 কি করছে জেনসেন?

বিশাল ঘরটায় চোখ বোলাল কিশোর। একটা ডাবলডোর দেখতে পাচ্ছে। ওটা খুলতে পারলে বেরিয়ে যেতে পারত। নেবে নাকি ঝুঁকিটা? বেরোতে, পারবেই, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আওয়াজ করে ফেলতে পারে। শুনে ফেললে। দেখতে আসবে জেনসেন। তখন কি করবে কে জানে! লোকটার কাছে পিস্তল থাকতে পারে।

সামনের ঘরে আবার চেয়ার টানার শব্দ হল। তারপর পদশব্দ। আসছে লোকটা। এ ঘরে ঢুকলেই ছাতের ফোকরটা দেখে ফেলবে। তারপর?

খুলে গেল অফিস ঘরের দরজা। অনেকগুলো খেলনা বোঝাই একটা তাকের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল কিশোর। ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল লোকটার শরীর, মুখটা চোখে পড়ছে না।

কয়েক কদম এগিয়েই থমকে দাঁড়াল লোকটা। নিশ্চয় ফোকরটা চোখে পড়েছে। মেঝেতে পড়ে থাকা ভাঙা তক্তাও নজর এড়ানোর কথা নয়।

পকেটে হাত ঢুকে গেল জেনসেনের। বের করে আনল পিস্তল। এই ভয়ই করছিল কিশোর। আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে কিছু করার নেই। আরও গুটিসুটি হয়ে দেয়ালের সঙ্গে মিশে যেতে চাইল সে।

পালানোর চেষ্টা করবে? একদৌড়ে অফিসের দরজার কাছে যেতে সময় লাগবে না। কিন্তু তার আগেই যদি গুলি করে বসে লোকটা?

এই সময় নিতান্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই শোনা গেল পুলিশের সাইরেন। এগিয়ে আসছে। দ্বিধায় পড়ে গেছে লোকটা। নড়ছে না। হাতে উদ্যত পিস্তল। আস্তে আস্তে আবার সরে যেতে শুরু করল সাইরেন।

নড়ে উঠল জেনসেন। পা বাড়াল সামনে। এগিয়ে আসছে কিশোর যে র‍্যাকের আড়ালে লুকিয়েছে ওটার দিকে।

ধকধক করছে কিশোরের বুক। এই সময় ঘটল যেন অলৌকিক ঘটনা। সামনের দরজায় থাবা দিতে লাগল কেউ।

চমকে গেল জেনসেন।

থাবা পড়ছেই। ডেকে জিজ্ঞেস করল একটা কণ্ঠ, এই, ভেতরে কে আছেন? আছেন কেউ? আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?

ঘুরে অফিসের দিকে রওনা হয়ে গেল জেনসেন। দরজার ওপাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কে?

বাইরে থেকে জবাব এল, ফেরারস মেশিন পার্টসের অফিসটা কোথায় বলতে পারেন?

রাস্তার ওপারে। এক ব্লক পরে।

 কিন্তু সাইনবোর্ড তো দেখছি না।

আর দেরি করল না কিশোর। বেরিয়ে সোজা এগোল ডাবলডোরটার দিকে। ছিটকানি লাগানো আছে। টান দিতেই খুলে গেল। পাল্লা খুলে বেরোনোর আগের মুহূর্তেও কানে এল সামনের দরজার কাছে লোকটার কথা, যে মেশিন পার্টসের অফিস খুঁজছে। মুচকি হাসল কিশোর। বুদ্ধিটা ভালই বের করেছে হ্যানসন। কায়দা করে তাকে সুযোগ করে দিল বেরোনোর।

বেরিয়ে এসে আস্তে করে আবার পেছনে দরজাটা লাগিয়ে দিল কিলোর।

.

উত্তরে চলল রোলস রয়েস। রকি বীচে ফিরে চলেছে।

মুসা বলছে কিশোরকে, ছাত থেকে নেমে পড়লাম আমি আর রবিন। ভাবলাম, আমরা গিয়ে ডাকাডাকি করলে চিনে ফেলবে জেনসেন। সে জন্যেই হ্যানসনকে পাঠিয়েছি।

ভাল বুদ্ধি করেছ।

হাতের ভালুকটা টিপেটুপে দেখল কিশোর। বিড়বিড় করল, অদ্ভুত! সাধারণত খেলনা, যে রকম হয় সে রকম নরম নয়। ভেতরটা শক্ত।

কেটে দেখলেই হয়, রবিন পরামর্শ দিল।

পকেট নাইফ বের করে কাটতে শুরু করল কিশোর। দুপাশ থেকে ঝুঁকে এল। অন্য দুজন। নিরাশ হতে হল তিনজনকেই। ভেতরটা প্ল্যাস্টিকে তৈরি। ফাপা। কিছু নেই। প্ল্যাস্টিকের ওপরে রোমশ চামড়া পরিয়ে দেয়া হয়েছে।

দূর! নিরাশ হয়ে হেলান দিল মুসা। এত কিছু করেও কোনই লাভ হল না। একটা কথাই শুধু জানতে পারলাম, ওই রিভসটা শয়তানীতে জড়িত।

পুলিশের কাছে যাব? হ্যানসন জিজ্ঞেস করল।

গিয়ে কি বলব? জেনসেনের কথা বলতে পারি। কিন্তু কি প্রমাণ আছে আমাদের হাতে? কেন বিশ্বাস করবে পুলিশ?

জবাব দিতে না পেরে চুপ হয়ে গেল হ্যানসন।

.

১৮.

 গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল কিশোরের। কার একটা ভেড়া যেন ছুটে গিয়েছে। বাড়ির কাছে এসে ব্যা ব্যা করে ডেকে চলেছে।

 বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে কিশোর, ভেড়াটাকে তাড়াবে? না শব্দ উপেক্ষা করে বালিশে কান ঢেকে আবার ঘুমিয়ে পড়বে?

হঠাৎ বিছানায় উঠে বসল সে। ভেড়া! ঠিক! এই তো পাওয়া গেছে ডলির কিডন্যাপারদের!

ঘড়ির দিকে তাকাল। তিনটে বাজে। এই অসময়ে হ্যানসনকে পাওয়া যাবে। না। রবিন আর মুসাও ঘুমিয়ে। ওদেরকেও ডাকা যাবে না। তার মানে সকালের আগে কিছুই করতে পারছে না।

অন্ধকারে শুয়ে রইল সে। চুপ করে থেকে ভাবছে। ঘুম আসছে, পরক্ষণেই টুটে যাচ্ছে। উত্তেজনার সময় এ রকম হয়। ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে বিছানা ছাড়ল সে। হাতমুখ ধুয়ে কাপড় পরে নিচে নামল নাস্তা করার জন্যে।

সাড়ে সাতটায় রবিনকে ফোন করল।

ডলির বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় কি বলেছিল রোজার মনে আছে? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

বলেছিল ডলিকে ছবিতে নামাতে চায়।

তা তো বলেইছিল। আরও বলেছিল ক্রুগার মনটাগোর বাড়িতে থাকে ওরা। বাড়ির পেছনে ভেড়া চড়ে।

কিছু বলল না রবিন। তাকে হাই তুলতে শোনা গেল ফোনে।

বল তো লস অ্যাঞ্জেলেসের কোন এলাকায় ভেড়া দেখা যায়?

অনেকের বাড়িতেই…আচ্ছা, দাঁড়াও। বসন্তের শুরুতে উপকূলের ধারে পাহাড়ের ঢালে চড়ে বেড়ায় ভেড়ার পাল। তরপর সিয়েরা আর অন্যান্য জায়গায়। রপ্তানি করা হয় ওগুলো।

 ঠিক। এমন সব জায়গায় পাঠানো হয়, যেখানে শীত বেশি পড়ে, উলের দরকার হয়। তবে সব তো আর পাঠানো যায় না, কিছু না কিছু থেকেই যায়। সেগুলোকে কোথায় রাখা হয়? পাহাড়ের ওপরেই কোথাও। ওখানে যদি ভেড়া থাকতে পারে, দুতিনজন লোকও তো সহজেই লুকিয়ে থাকতে পারে। পারে না?

তাই তো! সজাগ হয়ে গেছে রবিন।

 সেখানেই যাব আমরা। আমি হ্যানসনকে ফোন করছি।

করো। আমি মুসাকে করছি।

.

নটার কয়েক মিনিট আগে হাজির হল হ্যানসন। তবে রোলস রয়েস নিয়ে নয়। এক জীপ নিয়ে। যেখানে যাচ্ছে সেখানে রোলস রয়েসের চেয়ে এ ধরনের জীপই বেশি উপযোগী। বলেই দিয়েছিল কিশোর।

জীপে চড়ে বসল তিন গোয়েন্দা। রওনা হল হ্যানসন। প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ে ধরে কিছুক্ষণ চলে মোড় নিয়ে একটা সরু পথে পড়ল জীপ। পথটার নাম কটনউডক্রীক রোড। পাহাড়ী পথ ধরে ওপরে উঠে চলল।

ডানে-বাঁয়ে চোখ রেখেছে ছেলেরা।

পনেরো মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেল মুলোল্যাণ্ড হাইওয়েতে। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে হলিউড পার হয়ে ভেনচুরায় চলে গেছে পথটা।

কিশোরের হাতে বিনকিউলার। আতিপাতি করে দেখছে পথের পাশের। পাহাড়ী অঞ্চল। পাহাড়ের ঢালে মাঠ আর চারণভূমি যেখানেই আছে ভাল করে দেখছে ভেড়া দেখা যায় কিনা। সাইকেল নিয়ে ঘামতে ঘামতে চলেছে একজন লোক। কিশোরের নির্দেশে তার কাছে এনে গাড়ি থামাল হ্যানসন।

এই যে ভাই, কিশোর বলল। এখানে আমার এক বন্ধু ভেড়া পালে। ডারমট নাম। কোথায় থাকে বলতে পারেন?

সরি, হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিল লোকটা। ও নামে কাউকে চিনি না।

আবার এগিয়ে চলা।

কিছুদূর গিয়ে পাহাড়ের ঢালে কিছু ধূসর জিনিস চোখে পড়ল কিশোরের। প্রথমে ভাবল পাথর, পরে দেখে নড়ছে। ভেড়া! সেদিকে এগিয়ে যেতে বলল। হ্যানসনকে।

আরেকটু কাছে গেলে দেখা গেল, পুরানো একটা ঝরঝরে ভ্যানের পাশে। ফোল্ডিং চেয়ার পেতে বসে রয়েছে একজন লোক। মাউথ অর্গান বাজাচ্ছে আপনমনে।

গাড়ি রাখতে বলল কিশোর।

বড় একটা পাথরের চাঙড়ের পাশে এনে জীপ থামাল হ্যানসন। নেমে পড়ল তিন গোয়েন্দা। লোকটার দিকে চলল।

কাছে এসে কিশোর বলল, কয়েকজন বন্ধুকে খুঁজছি। দুজন লোক, ডারমট আর তার ভাই। আর একটা মেয়ে। পাহাড়ের এদিকটাতেই কোথাও থাকে। ঠিকানা ঠিকমত বলতে পারব না। জানেন, কোথায় থাকে?

চারপাশে চোখ বোলাল রবিন। যতদূর চোখ যায়, কোন বাড়িঘর চোখে পড়ল না।

আমাদেরকে বলা হয়েছে, আবার বলল কিশোর। যেখানে ওরা থাকে, তার পেছনে ভেড়া থাকে। কই, এখানে তো বাড়িঘর দেখছি না। আর কোথাও ভেড়া পালে নাকি?

কাঁধ ঝাঁকাল লোকটা। কি জানি, বলতে পারব না তো। তবে পশ্চিমে গিয়ে দেখতে পার। থাকতেও পারে। এখানে এসেছি আমি কাল রাতে। পথের ওদিকটায় থাকতেও পারে। ভেড়ার ডাক শুনেছি আসার সময়।

লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার এসে গাড়িতে উঠল ছেলেরা।

পশ্চিমে, নির্দেশ দিল কিশোর। রাস্তার যা অবস্থা দেখছি, উঠতে গিয়ে না পড়ে মরি।

কিচ্ছু ভেব না। গাড়ি তো চালাব আমি।

 রাস্তার এই অংশটা একেবারে নির্জন। যানবাহন চোখে পড়ছে না, মানুষজন নেই। রকি বীচের এত কাছে যে এরকম একটা জায়গা থাকতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হয় না।

 মাইল খানেক এগোনোর পর দুভাগ হয়ে গেছে পথ। ধূসর একটা পাথরের টাওয়ার চোখে পড়ল। একঝাঁক গাছের মাথার ওপরে বেরিয়ে আছে।

সেদিকে এগোতে লাগল হ্যানসন।

আরি! মুসা বলল। দুর্গটুর্গ না তো?

একটা কাঁচা রাস্তায় পড়ল গাড়ি। আর এগোনোর দরকার নেই, কিশোর বলল। জীপ থামাল হ্যানসন।

দুর্গের মতই লাগছে, রবিন বলল। একপাশে কয়েকটা কাঠের কেবিন রয়েছে। উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা।

পুরানো ওয়েস্টার্ন শহরের মত লাগছে, মুসা বলল।

 এটাই জায়গা! চোখ চকচক করছে কিশোরের।

আমার কাছে তো ছবির লোকেশনের মত লাগছে।

ঠিক! এরকম জায়গাতেই তো লুকিয়ে থাকতে চাইবে কেইনের মত লোক। এখন ওই ধোঁকাবাজ প্রযোজক আর ডলিকে এখানে পেলেই হয়!

.

১৯.

হ্যানসন, কিশোর বলল। আপনি থাকুন এখানে। যদি মনে হয় আমরা বিপদে পড়েছি, সাহায্য করতে যাবেন। ঠিক আছে?

নিশ্চয়ই।

 অন্যান্য মুভি লোকেশনের মত এই জায়গাটারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে, বার বার নতুন করে সাজানো হয়েছে। বড় বেশি চুপচাপ।

কোনখান থেকে শুরু করব? ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন। জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে যেন।

কিশোরও ভাবছে সে কথা। বাড়িগুলোর ওপর নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে তার দৃষ্টি। কোথায় থাকতে পারে? কোনখানে? শেষে দুৰ্গটাকেই বেছে নিল সে।

অনেক দিনের অযত্নে ধুলো জমে আছে পুরু হয়ে, প্রতিটি ঘরে। কিন্তু ডলি কোথায়? খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে একটা দরজার সামনে এসে থামল তিনজনে। নতুন করে খিল লাগানো হয়েছে।

এইটাই! নিচু গলায় বলল রবিন।

 ঠোঁটে আঙুল রেখে কথা বলতে নিষেধ করল কিশোর।

ভেতরে কি করে দেখা যায়? একটা জানালা চোখে পড়ল। ওটার কাছে চলে এল ওরা। উঁকি দিল ভিতরে। কাঠের পাটাতনের ওপর জড়সড় হয়ে পড়ে আছে। যেন একগাদা কম্বল। কেউ অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেছে নষ্ট হওয়ার জন্যে, দেখে সে রকমই মনে হয়।

ডলি? নরম গলায় ডাকল কিশোর। ডলি, আপনি আছেন ওখানে?

নড়ে উঠল কম্বলের দলাটা। উঠে বসল ডলি ডিকসন। আবছা অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে ফ্যাকাসে হয়ে আছে ওর চেহারা।

ডলি, আমি। আমি কিশোর পাশা। রবিন আর মুসাও এসেছে। ওরা। কোথায়? রিভস আর কেইন? মানে, রোজার?

মূককীটের মত যেন গুটি থেকে বেরোল ডলি, তেমনি করে কম্বল সরিয়ে বেরিয়ে উঠে এল। পরনে কালো স্কার্ট, সাদা ব্লাউজ। সব কিছুতে ময়লা। হাতে ময়লা, মুখে ময়লা। পা খালি।

আপনাকে বের করে নিয়ে যেতে এসেছি, কিশোর বলল।

সাবধান! ফিসফিস করে বলল ডলি। লোকগুলো ভীষণ পাজি! অনেক চেষ্টা করেছি। কিছুতেই বেরোতে পারিনি। সব সময় পিস্তল নিয়ে পাহারা দেয়।

কোথায় ওরা?

ওদিকে। একটা জেনারেল স্টোর আছে না, ওটাতে।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। জানালায় কাঠ আটকে দেয়া হয়েছে, গরাদের মত করে। সেগুলো খুলতে চেষ্টা করল সে আর মুসা। রবিন বেরিয়ে গেল হ্যানসনকে বলার জন্যে, যাতে পুলিশকে খবর দেয়।

 সে ফিরে এসে দেখল, একটা কাঠ খুলে ফেলেছে কিশোর আর মুসা। জায়গাটা সিনেমার শুটিঙের জন্যে তৈরি হয়েছে। তাই সব কিছুতেই আসলের চেয়ে নকলের ছড়াছড়িই বেশি। জানালার শিকগুলোকে শিকের মত দেখতে হলেও আসলে কাঠের তৈরি।

ঘরের ভেতরে বসে কাঁদতে আরম্ভ করেছে ডলি।

পাগল! ওরা পাগল! সব বদ্ধ উন্মাদ! একটা খেলনার জন্যে এত কিছু করছে!

 ভালুকটা তো? কিশোর জিজ্ঞেস করল। পেয়ে গেছে। কেন চেয়েছে, জানেন?

না।

আপনাকে আনল কিভাবে এখানে?

বাথরুম থেকে সবে বেরিয়েছি, এই সময় এল ওরা। বলল, আমার সঙ্গে ভাকুলার ব্যাপারে কথা বলতে চায়। লিভিং রুমে বসে রিভসের সঙ্গে কথা বলছি। আমি, রোজার উঠে গেল ওপরে। আমাকে বলল, রান্নাঘরে যাবে পানি খেতে, অথচ গেল ওপরতলায়। অবাক লাগল। কি করছে ওখানে? শেষে আর থাকতে না। পেরে আমিও গেলাম ওখানে। আমাকে থামানোর চেষ্টা করেছে রিভস, পারেনি। গিয়ে দেখি, মিসেস লেসিঙের ঘরে আলমারি, ড্রয়ারে খোঁজাখুঁজি করছে রোজার। ভালুকটার কথা জিজ্ঞেস করল আমাকে। শেষে খপ করে এসে আমার হাত চেপে ধরে ঝাঁকাতে লাগল। চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ভালুকটা কোথায় আছে তাকে বলতেই হবে!

আবার ফুঁপিয়ে উঠল ডলি। হ্যাঁচকা টানে হাত দুটিয়ে নিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম। ছিটকানি লাগিয়ে দেয়ার আগেই সে-ও ঢুকে পড়ল। থাবড়া মারল আমার নাকেমুখে। নাক থেকে রক্ত বেরোতে শুরু করল আমার। আমার হাত মুচড়ে ধরে শাসাতে লাগল, ভালকুটার কথা না বললে না বললে..

 হয়েছে, থাক, বুঝতে পেরেছি। কাঠের আরেকটা শিক খুলে ফেলল কিশোর।

ভাবলাম, ডলি বলল। ভালুকটা পেয়ে গেলেই আমাকে ছেড়ে দেবে। দিল না।

দেয়নি, কারণ যদি পুলিশকে বলে দেন। গাড়ির বুটে ভরে আপনাকে এনেছে, না?

হ্যাঁ। রিভসের কাছে পিস্তল ছিল। আমাকে ভয় দেখাল, টু শব্দ করলেই গুলি করে মারবে। ভয়ে কিছু করলাম না।

শেষ শিকটা খুলে ফেলল মুসা। আসুন। বেরিয়ে আসুন। আমরা আপনাকে সাহায্য করছি।

মুসা আর কিশোরের সাহায্যে জানালা গলে বেরিয়ে এল ডলি। একটা পেরেকে লেগে ছিঁড়ে গেল স্কার্টের কিছুটা। বেরিয়ে এল চারজনে। রওনা হলো জীপের দিকে।

 ঠিক এই সময় খুলে গেল জেনারেল স্টোরের দরজা। বেরিয়ে এল হ্যারিসন রিভস। হাতে একটা কাগজের প্লেটে খাবার। স্তব্ধ হয়ে রইল একটা মুহূর্ত। তার পর ঘরের দিকে ফিরে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করল, ডেগি! ডেগি!

দৌড় দিতে বলল কিশোর। ভলির হাত ধরে টেনে নিয়ে ছুটল মুসা। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল ডলি। ব্যথায় কাতরে উঠল। বুড়ো আঙুল মুচড়ে গেছে। টেনেটুনে তাকে তুলল আবার মুসা।

বেরিয়ে পড়েছে রিভস আর রোজার। দুজনের হাতেই পিস্তল। দৌড়ে গাড়ির কাছে পৌঁছতে পারবে না, বুঝতে পেরে পাশের একটা বাড়ির দিকে ঘুরে গেল কিশোর। সবাইকে বলল বাড়িটাতে ঢুকে পড়তে।

কতদিন ওটাতে মানুষ ঢোকে না কে জানে! ভেতরে বাদুড়ের বাসা। ফড়ফড় করতে লাগল ওগুলো, সেই সঙ্গে কিচিক কিচিক করে বিচিত্র ডাক ছাড়তে লাগল।

অন্ধকার একটা ঘরে ঢুকে বসে রইল চারজনে।

রিভস ঢুকে পড়েছে। বাইরের ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল, জলদি বেরিয়ে এসো। যদি গুলি খেতে না চাও!

চুপ করে রইল কিশোর। সবাইকে চুপ থাকতে বলল।

বেরোতে বললাম না! আবার ধমক দিয়ে বলল রিভস। আমি জানি তোমরা। ওখানেই আছ!

ফিসফিসিয়ে মুসা বলল, ব্যাটা ঢুকতে দেখেনি আমাদের! বোধহয় গাছের জন্যে! নইলে ওরকম করে বলত না। সোজা ঢুকে পড়ত।

বাদুড়গুলোই বাঁচিয়ে দিল আমাদের, রবিন বলল।

রোজারও এসে ঢুকল ঘরে। রিভসকে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

কি জানি, বুঝতে পারছি না…

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ইঞ্জিনের শব্দ হলো। জীপের ইঞ্জিন। নিশ্চয়। পুলিশকে ফোন করে ফিরে এসেছে হ্যানসন। করল কোথা থেকে? পথের পাশের কোন ফোনবক্স থেকে হবে, ভাবল কিশোর।

 ঘরের বাইরে জীপ থামল। রোজারকে বোধহয় ঢুকতে দেখেছে হ্যানসন। অনুমান করল তিন গোয়েন্দা। ভেতরে ঢুকে পড়ল হ্যানসন। ধস্তাধস্তি শোনা গেল।

 আর চুপ থাকতে পারল না মুসা। কারাতে ব্যবহারের এরকম একটা মোক্ষম। সুযোগ ছাড়তে রাজি নয় সে। এক লাফে উঠে বেরিয়ে গেল।

কিশোর আর রবিনও বসে থাকল না। মুসা আর হ্যানসনকে সাহায্য করতে গেল।

 রোজারের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে হ্যানসন। আর পিস্তল উচিয়ে বার বার তাকে শাসাচ্ছে রিভস। গুলি করছে না।

তবে কি!…চট করে ভাবনাটা খেলে গেল কিশোরের মাথায়। এখানকার সব কিছুই তো নকল। ওদের পিস্তলগুলোও নকল নয় তো? নইলে গুলি করছে না। কেন?

পেছন থেকে পা টিপে টিপে গিয়ে এক থাবায় রিভসের পিস্তলটা কেড়ে নিল কিশোর। ওজন দেখেই বুঝে গেল, নকল।

দুটো মিনিটও আর টিকল না এরপর রোজার আর রিভস। কাবু করে ফেলল। হ্যানসন আর তিন গোয়েন্দা মিলে। সাহস বেড়ে গেছে ডলির! খুঁজেপেতে দড়ি বের করে নিয়ে এল। বেঁধে ফেলল দুই শয়তানকে।

.

২০.

কেসের রিপোর্ট লিখে তৈরি হয়ে রয়েছে রবিন। কিন্তু বিখ্যাত চিত্র পরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফার বিদেশ থেকে ফিরলেন না।

ডালিয়া ডিকসনকে উদ্ধারের এক হপ্তা পরে ইডাহো থেকে ফিরে এলেন ভিকটর সাইমন। কিশোরকে ফোন করলেন। কিশোর যে খোঁজ করেছিল, একথা তাকে জানিয়েছে কিম।

একটা কেস শেষ করেছি, কিশোর জানাল। শুনতে চান?

ফ্রেনসোর সেই মেয়েটার ব্যাপার তো?

আপনি কি করে জানলেন?

অনুমান। এতদিন ধরে গোয়েন্দাগিরি করছি, হাসলেন লেখক এবং গোয়েন্দা। পেপারে হেডলাইন হয়ে খবর বেরিয়েছে। কাল বিকেল চারটে নাগাদ চলে এসো না? চা খেতে খেতে শোনা যাবে। আজকাল চা খেতে দিচ্ছে কিম।

দ্বিধা করছে কিশোর। কিমকে বিশ্বাস নেই, খাবারের ব্যাপারে।

সত্যি বলছি, কিশোরের ভাব বুঝে বললেন লেখক। চা-ই দেবে। বিশ্বাস। করো।

বেশ। আরও দুজন বন্ধুকে কি আনব?

একজন নিশ্চয় ডালিয়া ডিকসন?র

হ্যাঁ। তবে ডলি আমাকে কথা দিয়েছে, সিনেমায় যোগাযোগ করিয়ে দিতে অনুরোধ করবে না আপনাকে। শুধু দেখা করতে চায়। নাম শুনেছে তো অনেক। হ্যানসনও আপনার ভক্ত। আপনার সব বই পড়েছে।

তাই নাকি? হ্যানসনের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছেটা কিন্তু অনেক দিনের। তোমাদের প্রথম কেসের কাহিনীটা পড়ার পর থেকেই। হাসলেন তিনি। তা। তোমরা তাকে আনবে, না সে-ই তোমাদেরকে নিয়ে আসবে?

কিশোরও হাসল। লাইন কেটে দিয়ে প্রথমে লেসিং হাউসে ডলিকে ফোন। করল, তারপর করল হ্যানসনকে।

পরদিন বিকেলে কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে তিনটেয় হাজির হল হ্যানসন। অবশ্যই রোলস রয়েস নিয়ে। তবে শোফারের ইউনিফর্ম পরে আসেনি। তার বদলে পরেছে খাঁটি ইংরেজের পোশাক। অভিজাত ইংরেজের মত বেশ গম্ভীর চালে বলল, আজ আমি মেহমান। শোফার নই। তাই ভাবলাম, এই পোশাকটাই পরে যাই।

দারুণ লাগছে আপনাকে, হ্যানসন, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল মুসা। সত্যি, তুলনা হয় না। ডলি কি পরে আসবে বুঝতে পারছি না।

পরবে হয়ত ড্রাকুলার বৌয়ের পোশাক, রবিন বলল। ভেলকি লাগিয়ে দেবে মিস্টার সাইমনকে।

কিন্তু ডলি অবাক করল ওদেরকে, নিরাশও করল। সাধারণ একটা জিনসের প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে এসেছে।

ডলি, ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল মুসা। আজকে আপনি কি সাজলেন?

যা সাজার সেজেছি। অতি সাধারণ আমি, নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল ডলি।

কোস্ট হাইওয়ে ধরে উত্তরে চলল রোলস রয়েস। ভিকটর সাইমনের বাড়িটা দেখা যেতেই সামনে ঝুঁকল ডলি। ভাল করে দেখার জন্যে।

 আরে, সত্যিই তো বলেছ তোমরা! সরাইখানাকে বাড়ি বানানো হয়েছে তোমরা যখন বললে, আমি কিন্তু বিশ্বাস করিনি।

বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল হ্যানসন। বারান্দায় বেরিয়ে এলেন সাইমন। পেছনে এসে দাঁড়াল কিম, একগাল হাসি নিয়ে। হ্যানসনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সম্মান জানাল ব্রিটিশ কায়দায়। পরক্ষণেই ছুটে পালাল যেন লজ্জা পেয়ে।

কিম খুব উত্তেজিত হয়ে ছিল আপনার আসার কথা শুনে, মিস্টার হ্যানসন, সাইমন বললেন।

প্লীজ, স্যার, আমাকে মিস্টার বলার দরকার নেই, বিনীত কণ্ঠে বলল হ্যানসন। তিন গোয়েন্দা আমার বন্ধু। আপনাকেও বন্ধু হিসেবে পেলেই আমি খুশি হব।

 নিশ্চয় নিশ্চয়, সাইমনও খুশি হলেন। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। টেলিভিশনে অসংখ্য ব্রিটিশ শো দেখেছে কিম। এখন একজন খাঁটি ইংরেজের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সারাদিন ধরেই তৈরি হচ্ছিল, আপনার সঙ্গে ইংরেজের মত আচরণ করার জন্যে।…রান্নাঘর থেকে চমৎকার গন্ধ আসছে, না?

হ্যাঁ।

ডলির দিকে তাকিয়ে হাসলেন সাইমন। একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন। হাত ধরে মেয়েটাকে নিয়ে এলেন বসার ঘরে।

তিন গোয়েন্দা শেষবার দেখে যাওয়ার পর কিছু রদবদল করা হয়েছে লিভিং রুমটার। ঢুকতেই সেটা চোখে পড়ল ছেলেদের।

মেহমানদেরকে বসতে অনুরোধ করলেন সাইমন। তারপর তিন গোয়েন্দাকে। বললেন, হ্যাঁ, এবার শুরু করতে পার।

কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিল রবিন। তারপর বলতে আরম্ভ করল। মাঝে মাঝে নোটবুক দেখে মিলিয়ে নিচ্ছে। কোথাও ঠেকে গেলে তাকে সাহায্য করছে মুসা আর কিশোর। হ্যানসনও করছে। কারণ সে-ও বেশিরভাগ সময়ই ওদের সঙ্গে ছিল এই কেসে।

 রবিন থামলে সাইমন জিজ্ঞেস করলেন, ভালুকটার ব্যাপারটা কি? এমন কি জিনিস ছিল?

শুনলে অবাকই হবেন, ডলি বলল।

রিভস আর রোজারকে বেঁধে ফেলে রাখলাম, রবিন বলল। পুলিশের। অপেক্ষায়। কিশোরের মনে পড়ল ওই দুৰ্গটা আগেও দেখেছে।

 একটা হরর ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছিল, কিশোর জানাল। প্রিজনার অভ হন্টেড হিলের শুটিং করা হয়েছিল ওই দুর্গে। মনে পড়ল একটা দৃশ্যের কথা। দেয়ালের গায়ে একটা গোপন কুঠুরির দরজা খুলে রাজকুমারীর মুকুট বের করেছিল। দুর্গের মালিক। আমার মনে হল, এটা নিশ্চয় জানে রিভস আর রোজার।

সুতরাং সোজা হেঁটে গিয়ে আবার দুর্গে ঢুকল কিশোর, মুসা বলল। খুঁজে খুঁজে ঘরটা ঠিক বের করে ফেলল। তার অনুমান ঠিক। ওই কুঠুরিতেই পাওয়া গেল ভালুকটা।

কিশোর পাশার জন্যে এটা কোন ব্যাপার না, হাত নাড়লেন লেখক। তা ছিলটা কি ভেতরে? ড্রাগ? হীরা? রত্ন…

হাসল কিশোর। আপনাকে নিরাশ করতে হচ্ছে, স্যার। ওসব কিছুই ছিল। ছিল একগাদা টাকা।

টাকা! জালনোট?

না, তা-ও না! আসল টাকা। মিস্টার জেনসেনের কাছ থেকে চুরি করেছিল রোজার আর রিভস।

তার মানে তিনজনে একসঙ্গে কাজ করেনি? একদলের নয়?

না। রোজার আর রিভস সিনেমা পাগল লোক। ছবি বানানোর ভীষণ শখ। কিন্তু টাকা নেই। রিভস কিছুদিন একটা স্টুডিওতে কাজ করেছে। আর রোজার একস্ট্রা হিসেবে অভিনয় করেছে হরর ছবিতে। দুজনে বন্ধু। আলাপ আলোচনা করে ঠিক করল একদিন, ছবি বানাবে। কি ছবি? ড্রাকুলার গল্প নিয়ে কিছু। সব প্ল্যান প্রোগ্রাম ঠিকঠাক। বাকি রইল টাকার ব্যবস্থা করা।

ড্রাকুলা? ভুরু কোঁচকালেন লেখক। ওই কাহিনী নিয়ে আর কত ছবি। বানাবে? বানিয়ে বানিয়ে পচিয়ে ফেলা হয়েছে।

হাসল মুসা। সে জন্যেই কেউ ওদেরকে টাকা দিতে রাজি হয়নি।

বাই চান্স, আগের কথার খেই ধরল কিশোর, মিস্টার জেনসেনের খেলনার কোম্পানিতে শিপিং ক্লার্কের একটা চাকরি পেয়ে গেল রোজার। খেলনার গুদামে তালা দেয়া ছোট একটা ঘর আছে, যেটাতে আমরা ঢুকতে পারিনি। ওটার প্রতি কৌতূহল বাড়তে লাগল ওর। একদিন জিনসেনের ড্রয়ার থেকে চাবি চুরি করে। ঢুকে পড়ল ওই ঘরে। দেখে আলমারিতে অনেক টাকা। বেশ কিছু বাণ্ডিল হাতিয়ে নিল সে। কিন্তু সরায় কি করে? শেষে এক বুদ্ধি করল। বড় দেখে একটা খেলনা ভালুকের ভেতরে ভরে ফেলল সেগুলো। ফারের পোশাক বিক্রি করে যে দোকানদার, তার দোকানে আরও খেলনার সঙ্গে চালান করে দিল বিশেষ ভালুকটা। এবং সেদিনই জেনসেনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেল রোজার।

ফারের দোকানদারের কাছ থেকে ভালুকটা আবার হাতানো দরকার। তাই গিয়ে যেচে পড়ে জোরজার করেই তার দোকানে চাকরি নিল রোজার। কিন্তু সে এতই অকর্মা, ভালুকটা দোকানে পৌঁছার আগেই তাকে বের করে দিল মালিক। খেলনা ভালুকগুলো এল। দোকানে কাজ করে না তখন রোজার, বেছে বেছে যে বের করবে কোনটাতে টাকা ভরেছে, সেই সুযোগ নেই। কাজেই ওই চালানে যে কটা খেলনা এসেছিল সব চুরি করল রোজার আর রিভস। সাধারণ ছুরি হিসেবে দেখানোর জন্যে কয়েকটা ফারের কোটও চুরি করল।

এবারেও ভাগ্য ওদের বিপক্ষে গেল। ওরা চুরি করার আগেই বিশেষ ভালুকটা মিসেস লেসিংকে দিয়ে দিয়েছে দোকানদার। চুরি করা ভালুকগুলো সব খুলেও যখন টাকা পেল না রোজার, মাথায় হাত দিয়ে বসল। খুঁজতে শুরু করল কার কাছে গেছে ভালুকটা। সেটা জানার জন্যেই আরেকবার চুরি করতে ঢুকতে হল দোকানে, কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করার জন্যে।

কত টাকা ছিল ভেতরে? জানতে চাইলো সাইমন।

দশ হাজার ডলার। ওই টাকায় ছবিটা শুরু করতে চেয়েছিল ওরা, মুসা, বলল। ভেবেছিল, পরে যা টান পড়বে, কোনভাবে জোগাড় করে নিতে পারবে।

যাই হোক, আবার বলতে লাগল কিশোর। ওরা জেনে গেল ভালুকটা কোথায় আছে। মিসেস লেসিং তখন বিদেশে। আছে শুধু ডলি। তাকেই পটাতে শুরু করল দুজনে। জেনে গেছে ডলি, সিনেমায় অভিনয় করতে আগ্রহী। তার সঙ্গে খাতির করেছে আসলে মিসেস লেসিঙের বাড়িতে ঢোকার সুযোগের জন্যে, যাতে ভালুকটা বের করে নিয়ে যেতে পারে। ওখানে পেল না। জানতে পারল, ওটা আছে আমাদের কাছে। কাজেই ঢুকল গিয়ে আমাদের ইয়ার্ডে।

দানবের সাজে সেজে আমাদের হেডকোয়ার্টার থেকে ওটা কেড়ে নিয়ে এল,. তিক্ত কণ্ঠে বলল মুসা।

ওরকম সাজা ওদের জন্যে কিছুই না, সাইমন বললেন। বিশেষ করে রোজারের জন্যে। হরর ছবিতে এক্সট্রার অভিনয় করেছে সে। দৈত্যদানবই সেজেছে বেশি। তাই না?

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল রবিন।

বন্ধকীর দোকানে কেন গিয়েছিল? আরও টাকা লুট করতে?

 না, ওরা যায়নি। গেছে আরেকটা পাগল। এই হলিউডে যে কত রকম পাগল আছে। হাত নেড়ে মুসা বলল, আমার তো একেক সময় মনে হয় এখানকার বেশির ভাগ মানুষেরই মাথায় ছিট। লোকটা ছদ্মবেশে গিয়েছিল ভয় দেখিয়ে মজা পেতে। যখন দেখল, লোকে সিটিয়ে যায়, টাকা লুট করার বুদ্ধিটা তখনই মাথায়। এল ওর। কয়েকটা করেছে ওভাবে। রোজার আর রিভস যেদিন ধরা পড়ল, তার পরদিনই ওই ব্যাটাকেও ধরে ফেলেছে পুলিশ।  

হাসলেন লেখক। এক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, আসল কথায় আসি এবার। জেনসেন এত টাকা পেল কোথায়? তোমাদেরকেই বা অনুসরণ করেছে কেন?

পিজা শ্যাকে আমাদেরকে ভালুকটার কথা বলতে শুনেছে, রবিন জানাল। ব্যাপারটা কি ঘটেছে, আন্দাজ করে ফেলল। কারণ আলমারি থেকে যে টাকা চুরি গিয়েছিল, জেনে গেছে তখন সে। কে, কিভাবে চুরি করেছে, বুঝতে পেরেছে আমাদের আলোচনা শুনেই।

পুলিশকে জানাল না কেন?

জানাবে কি করে? সে নিজেই তো চোর, কিশোর বলল।

আমিও সে রকমই কিছু আন্দাজ করছিলাম। তা কোত্থেকে চুরি করেছিল?

গত বছর নভেম্বর মাসে ট্রেজারি থেকে পঞ্চাশ হাজার ডলার চুরি হয়েছিল, জানেন আপনি? কাগজে বেরিয়েছিল।

মাথা ঝাঁকালেন সাইমন।

জেনসেনই সেই টাকা চুরি করেছিল। পুলিশ এতদিন ধরতে পারেনি। সেই টাকা পুঁজি খাঁটিয়ে ড্রাগ আর নানা রকম অবৈধ জিনিসের ব্যবসা করে অনেক কামিয়ে ফেলেছিল। সেগুলো ভরে রেখেছিল আলমারিতে।

হুঁ। তাহলে এই ব্যাপার। তোমাদের পিছু নিয়েছিল নিশ্চয় ভালুকটা কোথায় আছে জানার জন্যে?

হ্যাঁ।

কোথায় এখন? ধরেছে পুলিশ?

না। পালিয়েছে।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন লেখক। তারপর মুখ তুলে বললেন, রোজার আর রিভসের জন্যে খারাপই লাগছে। বেচারারা! ছবি আর বানাতে পারল না…

দরজা খুলে ঘরে ঢুকল কিম। হাতে বিশাল এক ট্রে। সামনের টেবিলে এনে

নামিয়ে রেখে হেসে বলল, খাঁটি ইংরেজি চা, মিস্টার হ্যানসন। আশা করি আপনার ভাল লাগবে।

প্লেটগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। বড় বড় কেক, আর একটা বিরাট প্লেটে পুডিং। জিজ্ঞেস করল, এগুলোও কি ইংরেজি?

নিশ্চয়ই। খেয়ে দেখতে পার। ভাল হয়েছে।

 হাসল মুসা।

কিশোর আর রবিন হাসতে পারল না। ভয় কাটেনি। কিমকে বিশ্বাস নেই। বলা যায় না, এগুলো খাওয়া শেষ হলেই হয়ত ইঁদুর কিংবা পোকা নিয়ে এসে হাজির হয়ে বলবে, এগুলো যেদেশের খবরই হোক, খাঁটি ইংরেজি পদ্ধতিতে কাবাব করা।

উঠে দাঁড়াল ডলি। বলল, চা-টা আমিই দিই। কেটলি হোকে কাপে ঢালতে শুরু করল সে। সবাইকে দিতে দিতে বলল, আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি দুএকদিনের মধ্যেই। বাবাকে বলে দিয়েছি, আবার স্কুলে যাব। পড়ালেখা ভ ল ত শেষ হলে ভর্তি হব অভিনয়ের স্কুলে। ট্যালেন্ট থাকলে আমার অভিনেত্রী হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না।

এই তো বুদ্ধিমতি মেয়ের মত কথা, লেখক বললেন। ট্যালেন্ট এবং আত্মবিশ্বাস। যে কোন কাজ স্বাভাবিক উপায়েই করা উচিত।

শেষ হয়ে গেল খাওয়া। কোন প্লেটেই তার কিছু নেই।

আতঙ্কের মহর্ত উপস্থিত। ভয়ে ভয়ে কিমের দিকে তাকাতে লাগল কিশোর আর রবিন।

বুঝে ফেলল কিম। জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, ভয় নেই, আজ ইংরেজি ছাড়া কিছু করিনি। তবে আমাজানের জংলীদের একটা বিশেষ ডিশ করার ইচ্ছে আছে। সাপের মাংস, বানরের রক্ত আর…

সেটা কবে! আতকে উঠল রবিন।

অবশ্যই জানাব। দাওয়াত করব তোমাদেরকে, আশ্বাস দিয়ে বলল কিম।

অন্তত সাতদিন আগে জানাবেন। যাতে আমেরিকা ছেড়েই পালাতে পারি। রীতিমত আতঙ্ক ফুটেছে রবিনের চোখে।

 লেখক বললেন, আমিও পালাব তোমার সঙ্গে। পরের একটা মাস আর বাড়িমুখো হব না।

মুখ বাকাল কিম। এত বেরসিক লোকদের নিয়ে পারা যায় না। বলল, আসলে আপনাদেরকে আমার দরকার নেই। আমি মুসাকে পেলেই খুশি। কি বলো, মুসা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *