নকল কিশোর

ভলিউম ১৭ – নকল কিশোর – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ : সেপ্টেম্বর, ১৯৯২

০১.

আরে, গেল কোথায়! এখানেই তো ছিল! চেঁচিয়ে উঠল মুসা আমান।

ঝট করে তার দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন। মোবাইল হোমে তিন গোয়েন্দার গোপন হেডকোয়ার্টারে রয়েছে ওরা।

কি গেল কোথায়? জানতে চাইল রবিন।

কড়া চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। কেন, জান না?

নিরীহ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রবিন।

কি জানি না? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

দেখ, বিরক্ত ভঙ্গিতে হাত নাড়ল মুসা। সাংঘাতিক খিদে পেয়েছে আমার। এসব রসিকতা ভাল্লাগছে না! খেয়ে ফেলে থাকলে বল।

আমরা তোমার খাবার খেতে যাব কোন দুঃখে? আর তোমার মত খাই খাই করি নাকি?

সত্যি বলছ খাওনি?

না।

 সরিয়েও রাখনি, মজা করার জন্যে?

 না, এবার জবাব দিল রবিন। আমরা তো আমাদের কাজেই ব্যস্ত।

অবাক কাণ্ড! তাহলে গেল কোথায়?

দেখ, কোথায় রেখেছ, কিশোর বলল। একখানে রেখে আরেকখানে খুঁজলে পাবে কি করে? যাকগে, যা বলছিলাম, কিছু একটা করা দরকার আমাদের। রিক্রিয়েশনের জন্যে। ইয়ার্ডে কাজ করতে করতে হাড় কালো হয়ে গেছে আমার। আর ভাল্লাগে না। চল, কাল কোনখান থেকে ঘুরে আসি। কোথায় যাওয়া যায়? ডিজনিল্যাণ্ডে আর না, অনেক হয়েছে। এক কাজ করি, চল, ম্যাজিক মাউনটেইনে যাই। কখনও যাইনি।

আমিও না, মুসা বলল। জায়গাটা কেমন, তা-ও জানি না। রবিন, জান?

শুনেছি তো ভাল। ডিজনিল্যাণ্ডের ধারেকাছেও লাগে না, তবে ভাল। অনেক মজার মজার জিনিস আছে, চড়ার ব্যবস্থা। আসলে বাচ্চাদেরই বেশি ভাল লাগবে। এই যেমন ফেরিস হুইল, চাড রাইড, এসব আর কি।

— হুঁ, মাথা দোলাল মুসা। বাচ্চাদেরই। তবে আমারও খারাপ লাগবে না। অন্তত বাগান সাফ আর গ্যারেজ পরিষ্কারের চেয়ে তো ভাল।

আর মেরিচাচীর মরচে পড়া লোহার চেয়ার ঘষার চেয়ে, যোগ করল কিশোর। তাহলে কি ঠিক হল? ওখানেই যাচ্ছি আমরা। রোলস রয়েসে চেপে যাব। অনেক দিন ওটাতে চড়ি না। হ্যানসনকে ফোন করে দেব নিয়ে আসতে।

ভালই হবে, হেসে বলল রবিন। ওটা থেকে নামতে দেখলে লোকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। ভাবে কোনও কোটিপতির ছেলে। বন্ধু বান্ধব নিয়ে হাওয়া খেতে বেরিয়েছে। হাহ হাহ।

যাওয়ার ব্যবস্থা তো হল, অধৈর্য হয়ে বলল মুসা। এখন আমার খাওয়ার কি হবে? খিদেয় তো পেট জ্বলে গেল। সত্যিই তোমরা দেখনি?

আবার সেই এক কথা, হাত নাড়ল কিশোর। তুমি আর রবিন তো তখন ওয়ার্কশপে কাজ করছিলে। ওখানে রাখনি তো? চল, আমিই দেখছি। ওটা বের না করলে আর শান্তিতে থাকতে দেবে না আমাদের।

দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে ওয়ার্কশপে বেরিয়ে এল ওরা। রবিন খুঁজে বের করল ওটা, কিংবা বলা যায় তাকাতেই চোখে পড়ল। ওয়ার্কবেঞ্চের ওপর পড়ে রয়েছে লাঞ্চ প্যাকেট। বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল মুসা। একটা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে ভরে।

ওই তো, রবিন বলল। নিজেই ফেলে গেছ। আর এদিকে আমাদের মাথা খারাপ করছ।

ব্যাগটা তুলে নিল মুসা। ভেতরে ছেঁড়া প্যাকেট কে জানি খেয়ে ফেলেছে! কে? রবিনের দিকে তাকাল সে।

তুমিই হয়ত খেয়েছ, কিশোর বলল। তারপর ভুলে বসে আছ।

আমি? খেলে ভুলে যাব, কথা হল একটা? তাছাড়া পেটের তো ভোলার কথা নয়।

তাহলে ইঁদুর, ছেঁড়া কাগজটা দেখতে দেখতে রবিন বলল। ইঁদুরে সবই খায়। তোমার চেয়ে রাক্ষস।

 ইঁদুর? আমার বিশ্বাস হয় না। স্যালভিজ ইয়ার্ডে ইঁদুর থাকলে ওটার ঘুম হারাম করে ছাড়তেন মেরিচাচী। সেই সঙ্গে নিজের ঘুমও। না মারা পর্যন্ত। মনে নেই গত বছর…

তা আছে, হেসে বলল কিশোর। ওই একটা চোখে পড়েছিল বলে। শেষে ওটাকেই মেরেছে, না অন্যটাকে, সে ব্যাপারেও শিওর নই আমি। যত খুঁতখুতেই হোক, স্যালভিজ ইয়ার্ডের মত একটা জায়গা থেকে ইঁদুর নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার সাধ্য হবে না। ইঁদুর এমন এক জাত একেবারে শেষ করার ক্ষমতা কারও নেই।

এখন তাহলে কি করব? মাথায় হাত দিয়ে বসার অবস্থা মুসার। পেটের মধ্যেই তো ইঁদুর ঢুকে বসে আছে। তিনি

হেসে ফেলল কিশোর। আজ কিছু খাওনি নাকি? এমন করছ। চল, ফ্রিজে কিছু থাকতে পারে। না থাকলে মেরিচাচীকে বললেই রেডি করে দেবে।

ইয়ার্ডের অফিসের দিকে এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল কিশোর। গেটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। রাস্তা থেকে গেটে ঢোকার মাঝখানে এক চিলতে জায়গা, সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা সবুজ, মার্সিডিজ। কেউ বেরোচ্ছে না ওটা থেকে।

এই, ওই গাড়িটা আগে দেখেছ?

মুসা আর রবিনও তাকাল। মাথা নাড়ল দুজনেই।

আস্তে করে ওখানে এসে দাঁড়িয়ে গেল, কিশোর বলল। দেখলাম।

তাতে কি? মুসার প্রশ্ন। ওখানে কোনও গাড়ি থামতে পারে না নাকি? হয়ত ইয়ার্ডে ঢুকবে, কাস্টোমার।

হয়ত, মাথা দোলাল কিশোর। কিন্তু তাহলে কেউ নামছে না কেন? আজ সকালেও গেটের পাশ দিয়ে যেতে দেখেছি গাড়িটাকে। তখন থামেনি। খুব আস্তে আস্তে চলছিল।

কিশোর, বলে উঠল রবিন। এখন মনে পড়েছে, আমিও দেখেছি! পেছনের বেড়ার কাছে, রাস্তায়। সাইকেল নিয়ে যখন আসছিলাম। এই ঘণ্টাখানেক আগে।

ওরাই হয়ত আমার লাঞ্চ চুরি করেছে! মুসা বলল।

 তা তো নিশ্চয়, টিটকারির ভঙ্গিতে বলল রবিন। ইন্টারন্যাশনাল ফুড থিভস। তোমার কয়েকটা স্যাণ্ডউইচ চুরি না করলে কি ওদের চলে?

তোমার এই খাবারের চিন্তা মাথা থেকে নামাও তো, বিরক্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বলাই তো হল তুমি ভুলে না খেয়ে থাকলে ইঁদুরে খেয়েছে। ওই গাড়িটা কি চায় দেখা দরকার।

রবিন হাসল। হয়ত আরেক প্যাকেট লাঞ্চ চুরির সুযোগ খুঁজছে।

মনে হয় কিছু চায়, রবিনের কথা যেন শুনতেই পেল না কিশোর। দেখি।

রহস্যের গন্ধ পেয়েছে কিশোর, বুঝতে পারল অন্য দুজন। কি করে জানি পেয়ে যায় সে, অনেকবার দেখেছে রবিন আর মুসা। কখনও ভুল করে না। এখনও সেরকমই আচরণ করছে গোয়েন্দাপ্রধান।

মুসা, ইয়ার্ডের পেছনে চলে যাও, জরুরী কণ্ঠে বলল কিশোর। লুকিয়ে থেকে গাড়িটার ওপর চোখ রাখ। লাল কুকুর চার দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি আমি আর রবিন। বেড়ার চারপাশে চক্কর দিয়ে আসব। রবিন, তুমি বাঁয়ে যাও, আমি ডানে যাচ্ছি। এতে সব দিক থেকেই নজর রাখতে পারব। মুসা, চলে যাও।

মাথা ঝাঁকাল মুসা। দেখল, তিন গোয়েন্দার গোপন প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে তার বন্ধুরা। সে-ও রওনা হল। জঞ্জালের স্তূপের আড়ালে আড়ালে চলে এল মেইন গেটের কাছে। বেড়ার আড়ালে থেকেই উঁকি দিয়ে দেখল, মার্সিডিজটা আগের জায়গাতেই রয়েছে। ভেতরে দুজন লোক। চট করে মাথা নিচু করে ফেলল সে। হামাগুড়ি দিয়ে এগোল খোলা গেটের দিকে। উপুড় হয়ে পড়ে থেকেই ঘুরে তাকাল আবার।

এই যে, কিছু হারিয়েছ? সাহায্য করব?

ঢোক গিলল মুসা। গাট্টাগোট্টা একজন লোক। রোদে পোড়া চামড়া। হালকা স্যুট। তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাদামী কোঁকড়া চুল লোকটার। নীল চোখ। মুখে মোলায়েম হাসি। ইয়ার্ডের ভেতরে মুসাকে ওভাবে হামাগুড়ি দিতে দেখে যেন খুব মজা পাচ্ছে।

আমি…আমি…, নিজেকে বোকা বোকা লাগছে মুসার। ইয়ে-বল হারিয়ে ফেলেছি। সেটাই…খুঁ-খুঁজছি…

এদিকে তো কোনও বল দেখলাম না, লোকটা বলল।

তাহলে অন্য কোনও দিকে চলে গেছে হয়ত, ভোঁতা গলায় বলে উঠে দাঁড়াল মুসা।

হ্যাঁ, তা হতে পারে। লোকটার হাতে একটা লোক্যাল ম্যাপ। সেটা দেখিয়ে মুসাকে বলল, সাহায্য করবে একটু? হারিয়ে গেছি আমরা।

সবুজ মার্সিডিজের দরজা খুলে গেল। ভেতরে আরেকজন লোককে দেখতে পেল মুসা। সেদিকে ফিরে মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত করল রোদেপোড়া লোকটা, বোঝাতে চাইল দুজনেই হারিয়েছে। বলল, সেই তখন থেকে ঘুরে মরছি। বার বার একই জায়গায় ফিরে আসছি। পুরনো মিশনারিটা খুঁজছি আমরা।

লোকটার কথায় বিদেশী টান। ইংরেজিই বলছে তবে ইংরেজ নয় সেটা স্পষ্ট। তাহলে এই ব্যাপার! ভাবল সে। দুজন পথ হারানো টুরিস্ট। কিশোর পাশার রহস্য খোঁজায় তাহলে শুরুতেই ছাই পড়ল।

নিশ্চয় করব। ম্যাপটা নিয়ে দেখিয়ে দিল মুসা, কোস্ট হাইওয়ের কোন জায়গায় রয়েছে স্প্যানিশ মিশনটা। গোলমেলে রাস্তা। খুঁজে বের করাটা একটু জটিলই।

ঠিকই, মাথা ঝাঁকাল লোকটা। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।

গাড়িতে গিয়ে উঠল লোকটা। চলতে শুরু করল সবুজ মার্সিডিজ। দৌড়ে এল কিশোর আর রবিন। গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে গোয়েন্দাপ্রধান।

টুরিস্ট, তিক্ত কণ্ঠে বলল মুসা। লোকটার কাছে কিভাবে ধরা পড়ে গিয়েছিল জানাল। ইংরেজিই বলে, তবে অদ্ভুত টান।

 পথ হারিয়েছে? হতাশ গলায় বলল কিশোর। আর কিছু না?

 আর কি হবে? হাতে কোনও কেস নেই আমাদের যে পেছনে লাগবে।

গম্ভীর হয়ে আছে কিশোর। চিন্তিত। পথ হারাতেই পারে, যেহেতু বিদেশী, কিন্তু—

এর মাঝে আবার কিন্তু দেখলে কোথায়? ওরা পথ হারিয়েছে। ব্যস।

বাদ দাও, হাত নাড়ল রবিন। চল, ম্যাজিক মাউনটেইনে কখন কিভাবে যাব সেই আলোচনা করিগে।

 হ্যাঁ, চল। মনে করিয়ে দিল মুসা। তবে তার আগে আমার খাবারেরও ব্যবস্থা কর। বড্ড খিদে পেয়েছে।

.

০২.

পরদিন সকাল সকাল উঠল রবিন। হাতমুখ ধুয়ে কাপড় পড়ে তাড়াহুড়ো করে এসে রান্নাঘরে ঢুকল। গপগপ করে নাস্তা গিলছে, এই সময় খবরের কাগজটা নামিয়ে রেখে তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন তার বাবা।

কি ব্যাপার? জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার মিলফোর্ড। জরুরী তদন্ত আছে মনে হয়?

না, বাবা। আজ আমরা ম্যাজিক মাউনটেইনে যাচ্ছি তো, তাই। হ্যানসনকে রোলস রয়েস নিয়ে আসতে বলা হয়ে গেছে। সময়মত হাজির হয়ে যাবে সে। ব্রিটিশ শোফার। খুব সময় জ্ঞান। তার কাছে লজ্জা পেতে চাই না।

ও, শিস দিয়ে উঠলেন মিস্টার মিলফোর্ড। তিনজন সম্ভ্রান্ত বিশিষ্ট ভদ্রলোক। ভাল।

 একেবারেই কি অস্বীকার করতে চাও?

আরে না না, হাসলেন মিস্টার মিলফোর্ড। আসলেই তোমরা ভদ্র। রোলস রয়েসে চড়ে যাচ্ছ তো, সেজন্যেই সম্ভ্রান্ত আর বিশিষ্ট শব্দ দুটো যোগ করলাম।

বাবা, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি যাই। ডিনারের সময় ফিরব, মাকে বোলো। দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল রবিন।

রোদ উঠছে। সকালের প্রায় নির্জন রাস্তা দিয়ে দ্রুতবেগে সাইকেল চালাল। সে। ইয়ার্ডের গেট দিয়ে ঢোকার সময়ই দেখল অফিসের সামনে বারান্দায় একটা টুলে বসে রয়েছে মুসা। তাকিয়ে রয়েছে কালো বিশাল রোলস রয়েসটার দিকে। গাড়ি বটে একখান। মনে মনে আরেকবার তারিফ না করে পারল না রবিন।

 গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা, ফিটফাট শোফারের পোশাক পরা একজন লোক। হ্যানসন। রবিনকে দেখে হাসল। গুড মর্নিং, রবিন।

গুড মর্নিং, জবাব দিল রবিন।

নতুন কোনও কেস?

 নাহ। কেন, কিশোর বলেনি?

কথা হয়নি।

ও। ম্যাজিক মাউনটেইনে যাচ্ছি আমরা।

বেড়াতে? চমৎকার জায়গা।

 বারান্দা থেকে নেমে এল মুসা। রবিনকে বলল, চল, ওঠ।

গাড়িতে উঠল দুজনে।

কি ব্যাপার, কিশোর আসছে না? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন। কোথায় ও?

হেডকোয়ার্টারে। কি জানি করছে। চলে আসবে এখনি।

কিছুক্ষণ বসে থেকে অস্থির হয়ে উঠল রবিন। চল তো দেখি। নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। মুসাও নামল। রবিনের পেছন পেছন এসে ঢুকল দুই সুড়ঙ্গে।

ট্রেলারে ঢুকে দেখল, ডেস্কের ওপাশে বসে রয়েছে কিশোর। অনেকগুলো রঙিন ব্রশিয়ার ছড়ানো টেবিলে।

হ্যানসন বসে আছে, কিশোর, রবিন বলল।

এই হয়ে গেছে। আর একটু, মুখ না তুলেই জবাব দিল গোয়েন্দাপ্রধান। আরও কয়েক মিনিট পরে সন্তুষ্ট হয়ে হেলান দিল চেয়ারে, হ্যাঁ, হয়েছে। চলবে।

কি চলবে? মুসা জানতে চাইল।

আমাদের এক্সকারশনের প্ল্যান করলাম, কিশোর জানাল। ম্যাজিক মাউনটেইনের একটা ম্যাপ জোগাড় করেছি। সবচেয়ে কম সময়ে কত বেশি মেশিনে চড়তে পারব হিসেব করলাম। কোনও মেশিনে বেশি মজা পেলে দুবার করেও যাতে চড়তে পারি সেই সময়ও রেখেছি। আবার কোনটা যদি হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়, কিংবা বাতাসের কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দেরি করিয়ে দেয়…দিতেই পারে, তাই না? কতটা সময় নষ্ট হবে তাতে সেটাও ধরেছি…।

গুঙিয়ে উঠল মুসা। কিশোর, মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার মাথায় সত্যি ছিট আছে। চল, ওঠ তো।

রবিন বলল, এতসব ভেবে কি লাভ? সময় যা লাগার লাগবেই।

কি লাভ? ভ্রূকুটি করল কিশোর। হিসেব ছাড়া কিছুই চলে না…

আরে বাবা, দুহাত তুলল মুসা, ওখানে কাজ করতে যাচ্ছি না আমরা। যাচ্ছি নিছক মজা করতে। আনন্দ। তার আবার হিসেব কি?

বেশ, মুখ গোমড়া করে ফেলল কিশোর। আমার প্ল্যান যদি তোমার পছন্দ না হয়, বাদ দিতে পার।

টেবিলের কাগজগুলোর দিকে কয়েক সেকেণ্ড নীরবে তাকিয়ে রইল সে। এত কষ্ট করে অঙ্কগুলো করেছে। কাগজগুলো এক জায়গায় করে দলামোচড়া করে একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে ফেলে দিল ময়লা ফেলার ঝুড়িতে। রবিন আর মুসার মনে হল একটা জ্বালাতন থেকে মুক্তি মিলল, হাসি ফুটল মুখে। উঠে দাঁড়াল কিশোর। ট্রেলার থেকে বেরিয়ে এল তিনজনে।

গাড়িতে উঠে নির্দেশ দিল কিশোর, ম্যাজিক মাউন-টেইনে যান।

ইয়েস, স্যার, হেসে বলল হ্যানসন। ছেলেদের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক, তবু সৌজন্য ভুলতে রাজি নয় খাঁটি ইংরেজ শোফার।

জায়গাটা রকি বীচের পুবে। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে। শহর থেকে বেরিয়ে এসে কাউন্টি হাইওয়ে ধরে চলল বিশাল গাড়িটা। শুকনো, ধুলোময়, পাহাড়ের প্রথম ঢালটার কাছে পৌঁছে জিজ্ঞেস করল হ্যানসন, সত্যি বেড়াতে? না কোনও গোপন কেস?

নাহ, কেসটস না, হতাশ কণ্ঠে বলল কিশোর। বেড়াতেই এসেছি। কেন?

কারণ, অনুসরণ করা হচ্ছে আমাদেরকে।

অনুসরণ! প্রায় একই সঙ্গে বলল তিন কিশোর। মাথাগুলো ঘুরে যাচ্ছে পেছন দিকে।

কোথায়, হ্যানসন? রবিনের প্রশ্ন। আমি তো কোনও গাড়ি দেখছি না।

মোড়ের ওপাশে রয়েছে। স্যালভিজ ইয়ার্ড থেকে বেরোনোর পর পরই গাড়িটা চোখে পড়েছে আমার। তারপর থেকে লেগেই রয়েছে পিছে। একটা সবুজ মার্সিডিজ।

সবুজ মার্সিডিজ! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। আপনি শিওর?

গাড়ি চালানো আমার পেশা, কিশোর, দৃঢ়কণ্ঠে বলল হ্যানসন। ওই যে, বেরিয়েছে! আসছে আবার।

পেছনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা। ভুল নেই। পিছু নিয়েছে সবুজ গাড়িটা।

সেই গাড়িটাই! মুসা বলল।

তারমানে, কিশোরের কণ্ঠে খুশির আমেজ। টুরিস্ট নয় লোকগুলো। কাল মিথ্যে কথা বলেছে। আমার ধারণাই ঠিক।

তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু কি চায় ওরা?

বুঝতে পারছি না।

কিন্তু বুঝতে হবে মনে হচ্ছে, রবিন বলল। গতি বাড়িয়ে দিয়েছে ওরা।

 হ্যানসন, কিশোর বলল। ওদেরকে খসাতে পারবেন?

 চেষ্টা করতে পারি, শান্ত কণ্ঠে বলল হ্যানসন।

একসিলারেটরে চাপ বাড়াতেই লাফ দিয়ে আগে বাড়ল বিশাল গাড়িটা। প্রায় নিঃশব্দে। ইঞ্জিনের আওয়াজ এখনও তেমন বাড়েনি। পর্বতের ভেতরে ঢুকে পড়েছে ওরা এখন। সরু টু-লেন পথটা একেবেকে উঠে গেছে। এক পাশে গভীর খাত। স্টিয়ারিং চেপে ধরেছে হ্যানসন। দক্ষ হাতে মোড় ঘুরছে। একটু এদিক ওদিক হলেই গিয়ে খাতে পড়তে পারে গাড়ি।

গতি বেড়ে গেছে সবুজ মার্সিডিজের। রোলস রয়েসটাকে ধরার জন্যে তেড়ে আসছে ওটা। মোড় ঘোরার সময় গতি কমাচ্ছে না একটা গাড়িও, ফলে কর্কশ শব্দ করছে টায়ার। মাঝে মাঝেই বিপজ্জনক ভাবে রাস্তার কিনারে চলে যাচ্ছে একপাশের চাকা। যত শক্তিশালী ইঞ্জিনই হোক, স্বাভাবিক ভাবেই বড় গাড়ির চলন ভারি হয় ছোটগুলোর চেয়ে। অতটা ক্ষিপ্র হতে পারে না। তাই কাছিয়ে আসতে থাকল মার্সিডিজটা।

ধরে ফেলেছে! চিৎকার করে বলল মুসা।

শান্ত রয়েছে হ্যানসন। এর চেয়ে জোরে চালানো উচিত না। সামনের পথের ওপর দৃষ্টি স্থির। তবে… থেমে গেল সে। সামনে একটা বাঁক। সেটা ঘুরতে ক্ষণিকের জন্যে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল মার্সিডিজটা। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল হ্যানসন। স্কিড করে এগিয়ে গেল গাড়ি। ডানে আর কয়েক ইঞ্চি সরলেই চাকা চলে যেত পথের বাইরে। বন বন করে স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছে সে। ব্রেক ছেড়ে দিয়ে। আবার একসিলারেটরে চাপ দিল। বায়ের একটা সরু কাঁচা রাস্তায় নামিয়ে নিয়ে এল গাড়ি। ওকের বন আর চ্যাপারালের ঝোপের ভেতর দিয়ে চলে গেছে পথটা।

গর্জন করতে করতে চলে গেল মার্সিডিজটা।

 দিয়েছেন খসিয়ে! প্রায় চিৎকার করে বলল রবিন।

আপাতত, হ্যানসন বলল। তবে শীঘ্রি ওরা বুঝে যাবে ফাঁকিটা। ফিরে আসবে আমাদেরকে ধরার জন্যে। জলদি পালাতে হবে আমাদের।

একসিলারেটর চেপে ধরল সে। তীব্র গতিতে ছুটল গাড়ি, ধুলো ওড়াতে ওড়াতে। খানিক পরই গতি কমিয়ে ফেলল হ্যানসন। ব্রেক কষে থামিয়ে দিল। গাড়ি। সরি। লাভ হল না। এতক্ষণে হতাশা প্রকাশ পেল তার কণ্ঠে।

কি হয়েছে দেখল ছেলেরা। সামনে পাহাড়ের দেয়াল। দুধারে পাহাড়। পথ। রুদ্ধ। একটা বক্স ক্যানিয়নে ঢুকেছে গাড়ি।

হাইওয়েতে ফিরে চলুন! নির্দেশ দিল কিশোর। জলদি! হয়ত এখনও বুঝতে পারেনি ওরা যে আমরা ফাঁকি দিয়েছি।

গাড়ি ঘোরাল হ্যানসন। ফিরে চলল মেইন রোডের দিকে।

তীক্ষ্ণ একটা মোড় ঘুরতেই সামনে পড়ল মার্সিডিজ। আরেকটু হলেই ওটার। গায়ে গুতো মেরে বসত রোলস রয়েস। ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়েই স্টিয়ারিং ঘোরাতে শুরু করল হ্যানসন, পাশ কেটে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য বুঝে ফেলল মার্সিডিজের দুই আরোহী। দুপাশ থেকে দরজা খুলে লাফিয়ে। নেমে এল। হাতে পিস্তল।

বেরোও! জলদি! গর্জে উঠল একজন।

সাবধানে রোলস রয়েস থেকে নেমে এল হ্যানসন আর তিন গোয়েন্দা।

দেখুন, হ্যানসন বলল। বুঝলাম না কেন আপনারা

 চুপ! ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল লোকটা।

খপ করে বিস্মিত কিশোরের কব্জি চেপে ধরল আরেকজন। তার মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে একটা মোটা থলে নামিয়ে দিল মাথার ওপর। টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে তাকে মার্সিডিজে তোলা হল। পিস্তলের মুখে কিছুই করতে পারল না হ্যানসন, মুসা আর রবিন। নীরব অসহায় দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

খবরদার আমাদের পিছু নেবে না! শাসিয়ে বলল একজন, যদি বন্ধুর জীবন বাঁচাতে চাও। তোমরা গোলমাল করলে ওর বিপদ হবে।

চলতে শুরু করল মাসাজ। হারিয়ে গেল হাইওয়ের দিকে।

.

০৩.

চরকির মত পাক খেয়ে রোলস রয়েসের দিকে ঘুরল মুসা। আসুন, পিছু নেব!

না, মুসা! বলল রবিন আর হ্যানসন।

 ওদের দিকে তাকিয়ে রইল মুসা। কিন্তু ওকে বাঁচাতে হবে তো!

তা তো হবেই, মুসার কাঁধে হাত রাখল হ্যানসন। কিন্তু ওদের পিছু নেয়া চলবে না। কিডন্যাপাররা বিপজ্জনক লোক।

ওদের পিছু নিলে কিশোরের ক্ষতি করতে পারে, রবিন বলল। তবে ওরা। কোন দিকে গেল সেটা আমাদের দেখা দরকার, যাতে পুলিশকে বলতে পারি। ওরা জানে না আমাদের গাড়িতে ফোন আছে। পুলিশকে সতর্ক করে দিতে পারব ভাবেনি। মুসা, জলদি চল। পাহাড়ের ওপরে গিয়ে দেখি। হ্যানসন, আপনি থানায় ফোন করুন। চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে পান কিনা দেখুন।

প্রায় ডাইভ দিয়ে গাড়ির ভেতরে ঢুকল হ্যানসন। রবিন: আর মুসা উঠতে শুরু করল ঢাল বেয়ে। তাড়াতাড়ি ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে হাঁপাতে লাগল অল্পক্ষণেই। চূড়ায় যখন উঠল দরদর করে ঘামতে আরম্ভ করে দিয়েছে। হাইওয়ের দিকে তাকাল।

ওই যে! রবিন হাত তুলল।

দক্ষিণে যাচ্ছে! মুসাও দেখতে পেয়েছে। রকি বীচের দিকেই তো। এত আস্তে চলছে কেন?

কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে না হয়ত।

পুলিশ তাড়াতাড়ি করলে ওদেরকে ধরে ফেলতে পারবে। এস।

ঢাল বেয়ে দ্রুত নামতে গিয়ে পা পিছলাল রবিন। গড়িয়ে নামল কিছুদূর। আবার উঠল। মুসা একবারও না পড়ে দৌড়ে নেমে চলেছে। রোলস রয়েসের কাছে পৌঁছে শুনল পুলিশকে মার্সিডিজের লাইসেন্স নম্বর আর লোক দুটোর চেহারার বর্ণনা জানাচ্ছে হ্যানসন।

চীফকে বলুন, মুসা বলল। দক্ষিণে রকি বীচের দিকে যাচ্ছে ওরা। তাড়াতাড়ি করলে সামনে দিয়ে এসে পথ আগলাতে পারবে।

মুসার কথাগুলোও পুলিশকে জানাল হ্যানসন। ওপাশের কথা শুনল। তারপর বলল, চীফ। আমরা আছি। আসুন।

ফোন রেখে দিয়ে ছেলেদের দিকে তাকাল সে। কিশোরকে নিয়ে গিয়ে কি করতে চায়? ওরা কে সত্যিই চেন না?

কালকের আগে দেখিইনি কখনও, জবাব দিল রবিন।

 কিচ্ছু জানি না আমরা! প্রায় ককিয়ে উঠল মুসা।

নিরাশ দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল ওরা।

.

ধীরে চলছে মার্সিডিজ। ধীরে ধীরে নিচে নামছে পথ। কাউন্টি হাইওয়ে ধরে চলেছে, অনুমান করল কিশোর। তার মানে রকি বীচের দিকে চলেছে। তাকে নিয়ে কি করতে চায় লোকগুলো? ওরা কারা? কোনদেশী লোক?

পেছনের সীটে ফেলে রাখা হয়েছে তাকে। বান মাছের মত শরীর মোচড়াল। সে। পিস্তলের নলের খোঁচা লাগল পাজরে। একজন তার কাছেই বসে রয়েছে।

চুপ করে থাক, আদেশ দিল লোকটা।

কথা বলার চেষ্টা করল কিশোর। প্রতিবাদ করতে চাইল। কথা বেরোল না মুখ দিয়ে, শুধু গোঁ গো শব্দ।

চুপ করতে বললাম না! ধমকে উঠল লোকটা। লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকবে, বড় বংশের ছেলের মত।

নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠল লোকটা। কুৎসিত হাসি প্রতিধ্বনি তুলল বদ্ধ জায়গায়। অন্য লোকটা নীরবে গাড়ি চালাচ্ছে।

 কিন্তু আবার কথা বলার চেষ্টা করল কিশোর। তাকে নিয়ে কি করবে। লোকগুলো জিজ্ঞেস করতে চাইল। কিডন্যাপ লোকে একটা কারণেই সাধারণত করে। জিম্মি রেখে টাকা আদায়ের জন্যে। রাশেদ পাশার কাছে কি টাকা চাইবে! গোঙানি আর কুলকুচা করার মত এক ধরনের মিশ্র শব্দ বেরোল তার গলা থেকে। ছটফট করছে ডাঙায় ভোলা মাছের মত।

চুপ থাকতে বললাম না। বাবাকে নির্বংশ করার ইচ্ছে হচ্ছে নাকি?

 স্থির হয়ে গেল কিশোর। বাবা? কিন্তু তার তো বাবা নেই। সে অনেক ছোট থাকতেই মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেছে। সেটাই বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কথা বেরোল না মুখ দিয়ে।

পাঁজরে পিস্তলের খোঁচা খেল সে। ধমক দিল লোকটা, দেখ ছেলে, আর হুশিয়ার করব না।

তার পরেও থামল না কিশোর। বোঝানোর চেষ্টা করলই।

পিস্তলের খোঁচা না দিয়ে বরং এবার হেসে উঠল লোকটা। একেবারে বাবার মতই হয়েছে। একরোখা। তাই না, জন? হবেই। রক্তের দোষ।

থামাও ওকে ডেভ, সামনের সীট থেকে বলল অন্য লোকটা। ওরকম করতে থাকলে তো দম আটকেই মরে যাবে।

পেটালে পারি এখন। কথা তো শুনছে না।

হুঁ, মুশকিল। কোনও ক্ষতিও করা চলবে না। একটা মুহূর্ত নীরব রইল জন। সুস্থ অবস্থায় বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। নইলে লাভ হবে না আমাদের।

আবার হাসল ডেভ। স্যার মনটেরো যখন খবর শুনবে পিটারকে কিডন্যাপ করেছি আমরা, মুখখানা কেমন হবে দেখতে ইচ্ছে করছে এখনই। আমাদের কথা না শুনে পারবে না তখন।

সামনে ঝুঁকে ছিল, সীটে হেলান দিল কিশোর। স্যার মনটেরো? পিটার? বুঝে গেছে আসল ব্যাপারটা কি ঘটেছে। লোকগুলো তাকে অন্য কেউ বলে ভুল করেছে। এমন কেউ যার বাবা একজন নামী দামী ব্যক্তি, হোমড়া চোমড়া কেউ। টাকার জন্যে কিডন্যাপ করেনি। অন্য কারণ। হয়ত ব্ল্যাকমেল করবে। স্যার মনটেরো যে-ই হোন, তাকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে বাধ্য করবে। কিন্তু ভুল করে বসেছে ওরা। ভুল লোককে তুলে এনেছে। সেটাই ওদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করল।

 পিস্তল দিয়ে খোঁচা মেরে তাকে আর চুপ করাতে চাইল না লোকটা। পাহাড়ী রাস্তার নিচে নেমে এসেছে গাড়ি। সমতল পথ ধরে জোরে ছুটছে এখন। তীক্ষ্ণ মোড় নিল আচমকা। আর্তনাদ করে উঠল চাকা। প্রায় ছিটকে গিয়ে সীটের কিনারে ধাক্কা খেল কিশোর। এই সময় শোনা গেল সাইরেন। পুলিশ! বাড়ছে সাইরেনের শব্দ। ক্ষণিকের জন্যে দম বন্ধ করে ফেলল সে। তাহলে পুলিশ আসছে, তাকে বাঁচাতে..কমে যেতে শুরু করল আবার সাইরেনের ওয়াও ওয়াও। মিলিয়ে গেল দূরে।

ধরে ফেলেছিল আরেকটু হলেই! বলল কিশোরের পাশে বসা লোকটা, ডেভ।

আমাদের পেছনে লেগেছে? সামনের লোকটার প্রশ্ন।

তাই তো। দেখলে না পর্বতের দিকে চলে গেল ওরা। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি জানল কি করে?

কি করে জেনেছে, কিশোর বুঝতে পারছে। রোলস রয়েসে টেলিফোন আছে। নিশ্চয় ফোন করেছে তার বন্ধুরা। কিন্তু লাভ হল না। পার পেয়ে গেল। কিডন্যাপাররা। ধরতে পারেনি পুলিশ। লোকগুলোকে এখন বোঝানো দরকার যে ওরা ভুল করেছে।

কিন্তু আরেকটা কথা মনে পড়তেই ঘামতে শুরু করল সে। ভয়ে। ভুল লোককে ধরে এনেছে ওরা, এবং সেটা এখনও জানে না। পিটার নামে একটা ছেলেকে দরকার ওদের, কিশোর পাশাকে নয়। পিটারকে মারবে না ওরা, তাহলে তার বাবার বিরুদ্ধে অস্ত্রটা হারাবে। কিন্তু ভুলটা যখন বুঝতে পারবে ওরা তখন কি করবে?

.

কাঁচা রাস্তা ধরে গর্জন করতে করতে ছুটে এল দুটো গাড়ি। একটা পুলিশের। অন্যটা শেরিফের। ধুলোর মেঘ উড়িয়ে এসে ব্রেক কষে থামল দুটোই। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। লাফিয়ে নেমে দৌড়ে এলেন কাউন্টির শেরিফ আর পুলিশ। চীফ ইয়ান ফ্লেচার।

ওদের দেখেছেন? চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল রবিন।

 ধরতে পেরেছেন ওদের? জানতে চাইল মুসা।

মাথা নাড়লেন চীফ। হাইওয়ের প্রথম ক্রসরোডটা ব্লক করে দিয়েছি আমরা। তারপর সোজা চলে এসেছি এখানে। গাড়িটা তো দেখলাম না। রেডিব্লকের কাছেও নেই।

 তাহলে নিশ্চয় আমরা ব্লক করার আগেই বেরিয়ে গেছে, শেরিফ অনুমান করলেন। হাইওয়ের পাশের কোনও রাস্তায় নেমে যেতে পারে। বেশি দূর যেতে পারেনি নিশ্চয়। আরও লোক লাগাতে হবে আমাদের। দিকে দিকে খুজতে বেরিয়ে যাক।

এটা কাউন্টি এলাকা, ছেলেদেরকে বললেন চীফ। এখানে শেরিফের দায়িত্ব। তবে এরকম কেসে আমরা মিলেমিশেই কাজ করি। লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশ ডিপাটমেন্টকে সতর্ক করে দিয়েছি।

এখন, শেরিফ বললেন। এখানে সূত্র খুঁজতে হবে আমাদের।

কিছু পাবেন বলে মনে হয় না, স্যার, রবিন বলল। এখানে বেশিক্ষণ থাকেনি কিডন্যাপাররা। সূত্র ফেলে যাওয়ার কথা নয়।

ঠিকই বলেছে সে। কাঁচা রাস্তার প্রতিটি ইঞ্চি খুঁজে দেখলেন শেরিফ আর চীফ মিলে। কিছুই পেলেন না।

অল রাইট। অবশেষে চীফ বললেন, এখানে থেকে আর লাভ নেই। থানায় চলে যাই। এফ বি আইকেই খবর পাঠাতে হবে।

হ্যাঁ, স্যার, ততটা আশা করতে পারছে না রবিন। এভাবে খুঁজে লাভ হবে। না। একটা গাড়ি খুব ছোট্ট জিনিস, তাই না?

হোক ছোট। পুরো কাউন্টি ঘিরে ফেলব আমরা। সমস্ত রাস্তা ব্লক করে দেব। ওদের বেরিয়ে যাওয়ার কোনও পথই খোলা রাখব না।

 রোলস রয়েসে গিয়ে উঠল রবিন আর মুসা। একেবারে চুপ। হ্যানসন যখন পুলিশের গাড়িটাকে অনুসরণ করল তখনও কিছু বলল না, ওরা। নীরবে শুধু তাকাল একবার পরস্পরের দিকে। চোখে অস্বস্তি। একই কথা ভাবছে দুজনে।

রোডব্লক যে করা হবে কিডন্যাপাররাও নিশ্চয় জানে সেটা। কি করে বেরোতে হবে প্ল্যানট্যান করেই রেখেছে। বেরিয়ে যাবে। সাথে করে নিয়ে যাবে। কিশোরকে।

.

০৪.

থেমে গেল মার্সিডিজ।

থলের ভেতরে মুখ লুকানো। স্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার জন্যে নাকের ডগার সমান ছোট একটা ফুটো কেবল। কিছুই দেখতে পারছে না কিশোর। অনুমানে বোঝার চেষ্টা করেছে কোন পথে কোন দিকে এগিয়েছে গাড়ি। কয়টা মোড় নিয়েছে মনে। রেখেছে। কান পেতে রয়েছে পরিচিত শব্দের আশায়। এমন শব্দ, যেটা থেকে বুঝতে পারে কোথায় রয়েছে। কিন্তু কোনও শব্দই নেই। শুধু শূন্য নীরবতা। কোথাও কোনও নড়াচড়া নেই। না মানুষের, না যানবাহনের, না সাগরের।

বের কর ওকে, সামনের সীট থেকে বলল ড্রাইভার।

গাড়ির দরজা খোলার শব্দ শুনল কিশোর। শক্ত হাত চেপে ধরল তাকে। ঠেলে বের করল গাড়ি থেকে। মাটিতে দাঁড় করিয়ে দিল। জুতোর নিচে ঝরা পাতা, ঘাস, আর কঠিন মাটি।

ব্যাগটা খুলে নাও। দেখে দেখে নিজেই হাটুক।

একটানে কিশোরের মাথার ওপর থেকে থলেটা খুলে নেয়া হল। ঘন গাছপালার ভেতর দিয়ে আসা আলো চোখ ধাধিয়ে দিল যেন তার। আলো সইয়ে নেয়ার জন্যে চোখ মিটমিট করল সে। মুখ থেকে খুলে নেয়া হল কাপড়।

এখন অনেকটা আরাম লাগছে, না? বলল গাট্টাগোট্টা লোকটা যার নাম ভেজ। খুলে দিলাম বলেই যে চিৎকার করবে তা হবে না। একদম চুপ থাকবে। নইলে…, কিশোরের চোখের সামনে এনে পিস্তলটা নাড়ল সে।

মাথা ঝাঁকাল শুধু কিশোর। কিছু বলল না। যখন থেকেই বুঝতে পেরেছে তার আসল পরিচয় জানালে মারাত্মক বিপদে পড়ে যাবে তখন থেকেই চুপ হয়ে। গেছে সে। কথা বলতেও ভয় লাগছে এখন। লোকগুলো তার ইংরেজি শুনে যদি বুঝে যায় যাকে ধরেছে সে পিন্টার নয়! কিশোরের কথায় লোকগুলোর মত টান। নেই। পিটার ওদের দেশের ছেলে হয়ে থাকলে একই রকম টান থাকার কথা। খুব সাবধান হতে হবে এখন তাকে। ছোট্ট একটা ভুলও মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে। পারে।

এক মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল ডেভ। তারপর ফিরল সঙ্গীর দিকে। ব্যাগ তো খুললাম।

আরও সহজ ভাবে শ্বাস নিতে পারল কিশোর। লোকগুলো তাকে চিনতে পারেনি এখনও কাজেই আপাতত নিরাপদ। দ্রুত চারপাশে তাকাল সে। পর্বতের গোড়ায় ওকের বন আর চাপারালের ঘন ঝোপের মাঝখানে আরেকটা কাঁচা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অপরিচিত জায়গা। রকি বীচের একশ মাইলের মধ্যে এরকম জায়গা অনেক আছে।

কিশোরকে হাঁটার নির্দেশ দিল জন, অর্থাৎ ড্রাইভার। ড়েভের চেয়ে লম্বা, পাতলা শরীর। কালো চুল। ছোট ছোট চোখ কোটরে বসা। চোখের কোণের চামড়ায় ভাজ। ডেভের মত একই রকম রোদে পোড়া। একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে দিচ্ছে, এমন কোনও দেশ থেকে এসেছে লোকগুলো, যেখানে ভীষণ গরম, রোদ খুব কড়া।

 পথের পাশের ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে চলল ওরা। পঞ্চাশ গজ মত এগিয়ে ডানে ঘুরল। পর্বতের দিকে মুখ করে এগোল। রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। শুধু ঘন, প্রায় দুর্ভেদ্য ঝোপ।

জন, তুমি আগে যাও, ডেভ বলল। ব্যাগগুলো নিয়ে যাও। 

মাথা ঝাঁকাল ড্রাইভার। ব্যাগ মাটিতে নামিয়ে রেখে টেনে ঝোপ ফাঁক করল। বেরিয়ে পড়ল একটা সরু পায়েচলা পথ। তার ভেতরে দুটো ব্যাগ ঠেলে দিয়ে নিজেও ঢুকে পড়ল। গিলে ফেলল যেন তাকে ঝোপ।

এবার তুমি যাও, কিশোরকে আদেশ দিল ডেভ।

এক মুহূর্ত ঝোপটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। টেনে ফাঁক করল ঝোপের ডাল। ঢুকে পড়ল ভেতরে। হাত থেকে হঠাৎ ছুটে গেল চ্যাপারালের শক্ত ডাল। কাঁটাঝোপের আঘাত থেকে মুখ বাঁচাতে এক ঝটকায় হাত তুলে নিয়ে এল মুখের কাছে, ঢেকে ফেলল। লাফিয়ে পিছাতে গিয়ে গাছের গোড়ায় পা বেধে উল্টে পড়ে গেল। তাকে টেনে তুলল ডেভ। ঠেলে আবার ঢুকিয়ে দিল ঝোপের ভেতর।

 ধমক দিয়ে বলল, এরকম চমকে দিলে কিন্তু ট্রিগারে চাপ লেগে যাবে আমার।

ঢোক গিলল কিশোর। সরু পথ ধরে যতটা সম্ভব জোরে হাঁটতে লাগল। তার পেছনেই লেগে রয়েছে ডেভ, হাতে পিস্তল। কিছুদূর এগোতেই আবার ঘন ঝোপ। পড়ল সামনে। পথটা অদৃশ্য হয়ে গেল। তবে সামনের লোকটাকে দেখতে পাচ্ছে! ঝোপের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে।

তাকে অনুসরণ করল কিশোর। না দেখে ফেলতে গিয়ে পা আবার বেধে গেল। একটা শেকড়ে। পড়ে গেল উপুড় হয়ে। হাপাচ্ছে। উঠে পড়ল আবার পেছনের লোকটা তার গায়ে হাত দেয়ার আগেই।

লোকগুলোর কিছু হচ্ছে না। ঘন ঝোপের ভেতর দিয়ে এমন সাবলীল ভঙ্গিতে এগোচ্ছে, দেখলে মনে হয় জায়গাটা ওদের পরিচিত। আগেও এসেছে এখানে। ওদের সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে যেন হিমশিম খাচ্ছে কিশোর। পথটাই দেখতে পাচ্ছে না। আরও দুবার আছাড় খেল। তারপর এসে ঢুকল পর্বতের গভীরে সরু একটা বক্স ক্যানিয়নে।

দুধারে পাহাড়ের উঁচু দেয়াল। এক দেয়ালের গা ঘেঁষে রয়েছে ছোট একটা পাথরের কেবিন। কেবিনের দরজা খুলল ওদের একজন। আরেকজন ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল কিশোরকে। আবার লাগিয়ে দেয়া হল দরজা।

নির্জন কেবিনে ঢুকে শুনতে পেল কিশোর, দরজায় তালা লাগানোর শব্দ।

.

থানায় এসেছে মুসা, রবিন, রাশেদ পাশা আর মেরিচাচী। দেয়াল ঘেঁষা একটা বেঞ্চে বসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে রেখেছে।

আমাদের ইমারজেন্সি সিগন্যালগুলো যদি সঙ্গে থাকত! আফসোস করল মুস্রা।

থাকবে কি করে? মনে করিয়ে দিল রবিন, ওগুলো তো মেরামতই হয়নি। তবে যোগাযোগের একটা না একটা উপায় বের করেই ফেলবে কিশোর।

কড়া চোখে শেরিফ আর চীফের দিকে তাকালেন মেরিচাচী। সারাদিনই। এখানে বসে থাকব নাকি? কিডন্যাপাররা তো আর খেলা করছে না যে হাসতে হাসতে এসে ধরা দেবে।

মাথা নাড়লেন চীফ। ভাববেন না। সব রকম চেষ্টাই করা হচ্ছে। পুরো শহর আর কাউন্টি এলাকা ঘিরে ফেলা হয়েছে। পালাতে পারবে না কিডন্যাপাররা। এসব কিডন্যাপিঙের কেসে খুব হুশিয়ার থাকতে হয় আমাদের। একটা ভুলচুক হলেই মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। কাজেই তাড়াহুড়া করে রিস্ক তো আর নিতে পারি না।

যা যা করার সবই করা হচ্ছে, শেরিফ বললেন। ক্যালিফোর্নিয়া, নেভাডা, অরিগম, অ্যারিজোনার সমস্ত পুলিশ বিভাগকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এ বি আইকে খবর দেয়া হয়েছে। মেকসিকান অথরিটিকে জানান হয়েছে। টেলিটাইপ করে মার্সিডিজের লাইসেন্স নম্বর জানিয়ে দেয়া হচ্ছে প্রতিটি পেট্রল কারকে। পুলিশের ডিপার্টমেন্ট অভ দা মোটর ভেহিকলকেও জানানো হচ্ছে।

ল্যাবরেটরি এক্সপার্টদের একটা দল ইতিমধ্যেই রওনা হয়ে গেছে, চীফ, জানালেন। যে জায়গাটায় কিডন্যাপ করা হয়েছে সেখানটায় আবার ভালমত খুঁজবে ওরা। সূত্রটুত্র কিছু না পেলে তো এগোতে পারছি না আমরা।

আপনি নিজে গিয়ে কিছু করছেন না কেন? কিছুতেই বুঝতে চান না। মেরিচাচী।

এখন গিয়ে তো আর লাভ নেই, জবাবটা দিলেন শেরিফ। অযথা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানোর চেয়ে একটা সূত্র নিয়ে যদি বেরোতে পারি, তাহলে কাজ হতে পারে।

কিছুতেই বোঝান গেল না মেরিচাচীকে। চীফ আর শেরিফ বেরিয়ে গেলেন। সেদিকে জুলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তিনি। নিষ্ফল হয়ে ফিরে এল ল্যাবরেটরি টীম। শুনে আরও খেপে গেলেন তিনি। তার ধারণা, পুলিশ কোনও কাজের না। নইলে এতগুলো লোক মিলে এত চেষ্টা করেও এখনও কোনও খোঁজ বের করতে পারছে না কেন কিশোরের?

ছেলেটাকে যে কোথায় নিয়ে গেল! ফুঁসে উঠলেন মেরিচাচী। এই, মুসা আর রবিনের দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝাল কণ্ঠে বললেন। আবার কিছুর তদন্ত করছ না। তো তোমরা? কোনও কেটেস নয় তো? অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে গিয়েছিলে?  

না, আন্টি, জবাব দিল রবিন। সত্যি বলছি, ম্যাজিক মাউনটেইন দেখতে বেরিয়েছিলাম আমরা।

রাশেদ পাশা জিজ্ঞেস করলেন, কেন কিডন্যাপ করা হল কিছুই বুঝতে পারছ না?

ইস, যদি পারতাম! আবার আফসোস করল মুসা।

ব্যাটাদের যদি খালি ধরতে পারতাম, দাঁত কিড়মিড় করলেন মেরিচাচী। চট করে একে অন্যের দিকে তাকাল রবিন আর মুসা। এত দুঃখেও হাসি পেল। ওদের। মেরিচাচীর সামনে যদি এখন পড়ে কিডন্যাপাররা তাহলে তাদের জন্যেই। কষ্ট হবে ওদের।

একটা উপায় বের করতে পারলেও হত, রবিন বলল। খুঁজতে যেতে পারতাম। কিশোর কি কোনই পথ করে রেখে যায়নি?

পারলে তো করবে, মুসা বলল। লোকগুলো সাংঘাতিক চালাক। সুযোগ দেবে বলে মনে হয় না।

কাছে এসে দাঁড়ালেন চীফ। কতটা চালাক শীঘ্রি সেটা বের করব। হেলিকপ্টার নিয়ে বেরিয়েছিল শেরিফের একজন লোক। র‍্যাটলস্নেক রোডের পাশে মার্সিডিজটা দেখতে পেয়েছে সে। শহর থেকে তিন মাইলের বেশি হবে না।

চলুন! চলুন! পেছন থেকে প্রায় চিৎকার করে বললেন শেরিফ, এইবার পেয়েছি ব্যাটাদের!

.

কেবিনে একা বসে আছে কিশোর। বাইরে লোকগুলো কি বলে শোনার চেষ্টা করছে। ভাবছে, সে যে পিটার নয় এটা বুঝতে কতক্ষণ সময় লাগবে। লোকগুলোর?

ওদের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে সে, তবে কথা ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে দূরে কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করছে লোকগুলো। আরও একজন লোকের। ব্যাপারে কথা বলছে যে তখন ওখানে নেই। বুঝতে অসুবিধে হল না, সেই লোকটার আসার অপেক্ষাতেই রয়েছে ওরা। কেউ একজন আসবে। কিছু একটা ঘটবে।

 কিন্তু কে আসবে? আর এই পার্বত্য নির্জন এলাকায় ঘটবেটাই বা কি?

আরও ভাল করে শোনার জন্যে কান খাড়া করল সে। লাভ হল না। মোচড় দিয়ে উঠল পেটের ভেতর। যে আসবে সে যদি আসল পিটারকে চেনে? কেবিন থেকে বেরোনো দরকার। পালাতে হবে কিডন্যাপারদের কবল থেকে। নইলে কি যে ঘটবে বলা মুশকিল। মুখ বন্ধ করানোর জন্যে মেরেও ফেলা হতে পারে ওকে।

ছোট কেবিনটায় চোখ বোলাল সে। একটি মাত্র শূন্য ঘর। আসবাব নেই বললেই চলে। একমাত্র দরজাটা বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে আটকান। জানালাও একটাই। আড়াআড়ি তক্তা লাগিয়ে পেরেক ঠুকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিপজ্জনক জিনিস রাখা হত বোধহয় এখানে। পাহাড় ভাঙার জন্যে ডিনামাইট হতে পারে। কিংবা তেল তোলার যন্ত্রপাতি।

কিন্তু এখন আর কিছুই নেই কেবিনে। পালানোর পথও দেখতে পাচ্ছে না সে।

পাথরের দেয়ালের ধার ঘেঁষে একবার চক্কর দিল। দুর্বল জায়গা খুঁজল। নেই। প্রায় এক ফুট পুরু দেয়াল। ফাটল-টাটল দেখা গেল না। এই দেয়াল ভেঙে বেরোন সম্ভব না। আর ভাঙার কিছু নেইও কেবিনে। যদি থাকতও, তাতে লাভ হত না। ভাঙতে গেলে বিকট আওয়াজ হবে। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে এসে উঁকি দেবে লোকগুলো। মোট কথা, দেয়ালের গায়ে বেরোনোর কোনও পথ নেই। অবশেষে মেঝের দিকে নজর দিল সে।

 ইঞ্চিখানেক পুরু চওড়া বড় বড় তক্তা দিয়ে মেঝে তৈরি হয়েছে। গায়ে গায়ে ঠেসে বসান। ফাঁকও নেই তেমন। তবে জোরে চাপ দিলে বাঁকা হয়ে যায়। মাটিতে বসান হয়নি তক্তাগুলো। আড়াআড়ি কডিকাঠের মত তক্তা নিচে পেতে তার ওপর সাজান হয়েছে। নিচে ফাঁক তেমন নেই।

 হামাগুড়ি দিয়ে পুরো মেঝেটা ঘুরে দেখল কিশোর। পেছনে দেয়ালের কাছে একটা তক্তা আলগা। এক প্রান্তে পা দিয়ে চেপে ধরে তত্তটা তুলে তার ফাঁকে। হাত ঢুকিয়ে দিল সে। টেনে সরিয়ে আনল ওটা।

নিচে ফাঁক রয়েছে। নীরবে পাশের তক্তাটার ওপরও কাজ করে চলল সে। সরিয়ে ফেলতে পারল অনেক কায়দা কসরৎ করে। নেমে গেল ফাঁকটায়। মেঝে আর মাটির মধ্যখানে যেটুকু ফাঁক রয়েছে, তাতে শুয়ে পড়া যায়। তা-ই করল সে। একধারে ঢালু হয়ে নেমে গেছে মাটি। বুকে হেঁটে ঢাল ধরে এগোল সে। মেঝের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে ফাঁক এত কমে গেছে বুকে হেঁটেও আর এগোন যায় না। চারপাশের দেয়াল তৈরি করা হয়েছে পাথর দিয়ে। বাতাস চলাচলের জন্যে খুব ছোট ছোট ছিদ্র রাখা হয়েছে। সেসব দিয়ে মানুষ বেরোনো অসম্ভব। বেরোনোর পথ পেল না।

বাধ্য হয়ে যে পথে নেমেছিল সে পথে আবার ওপরে উঠে এল সে।

পালানোর কোনই পথ নেই।

.

র‍্যাটলস্নেক রোডে মার্সিডিজটার, পেছনে এসে থামল পুলিশের গাড়ি। গাড়ির। ভেতরটা ভালমত পরীক্ষা করে দেখা হল।

কিছুই নেই, মুখ কালো করে বললেন ইয়ান ফ্লেচার। এখান থেকে কোন দিকে গেছে বোঝার উপায় নেই।

কিন্তু জলজ্যান্ত একটা মানুষ গায়েব হয়ে যেতে পারে না, মেরিচাচী বললেন।

গাড়িটার আশপাশে খুঁজে দেখলেন রাশেদ পাশা, মুসা আর রবিন। রাস্তার পাশের ঘাসে ঢাকা জুমিতে নামিয়ে রাখা হয়েছে ওটা।

কিশোরের কোনও চিহ্নই তো দেখছি না, রবিন বলল।

একটা পায়ের ছাপ পর্যন্ত নেই, বললেন রাশেদ পাশা।

বাতাসে মিলিয়ে গেছে যেন, চীফ বললেন। আশপাশের ঘন ঝোপ আর একধারে মাথা তুলে দাঁড়ানো পর্বতের দিকে নজর। যা অঞ্চল! যেখানে খুশি নিয়ে । সব গিয়ে লুকিয়ে রাখতে পারে কিশোরকে।

তা পারে, মুসা বলল। তবে বেশি দূরে গেছে বলে মনে হয় না আমার।

.

০৫.

 কি করে বুঝলে? ভুরু নাচালেন শেরিফ।

সূত্রটুত্র পেয়েছ নাকি? চীফ জানতে চাইলেন।

মার্সিডিজের কাছে দাঁড়িয়ে কাঁচা রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। বসে পড়ে মাটিতে আলগা ধুলোয় হাত বোলাল।

দেখুন, স্যার! সামনের মাটির দিকে দেখাল সে। পুরো রাস্তাটায় ওখানটাতেই যা এক চিলতে নরম মাটি দেখছি। মার্সিডিজের চাকার দাগ আছে। আর কোনও গাড়ি নেই। তার মানে অন্য গাড়ি আসেনি এখানে ওদেরকে তুলে নেয়ার জন্যে। এ পথে হেঁটে যাওয়ারও কোনও লক্ষণ দেখছি না। এর একটাই অর্থ, কাছাকাছিই আছে ওরা।

মুসা যেখানটা দেখিয়েছে সে জায়গাটা চীফও পরীক্ষা করলেন। খটখটে শুকনো মাটি। প্রচুর ধুলো আছে। অথচ পায়ের ছাপ নেই।

তার মানে, রবিন বলে উঠল। মুসা ঠিকই বলেছে। কাছাকাছিই আছে ওরা।

আছে, আবার বলল মুসা। রাস্তাই পেরোয়নি। আমার ধারণা, সোজা নেমে গেছে ঝোপের কাছে। ওই চ্যাপারেলের ঝোপের ভেতর দিয়ে চলে গেছে পর্বতের দিকে পা বাড়াতে গেল সে।

দাঁড়াও! বাধা দিলেন চীফ। পথের একপাশ দেখিয়ে বললেন, এখানে ঘাস আছে, পায়ের ছাপ পড়বে না। এদিক দিয়েও গিয়ে থাকতে পারে।

শেরিফও একমত হলেন তার সঙ্গে। দুজন সহকারীকে বললেন, অ্যাই, এই ঘাস ধরে তোমরা দুজন দুদিকে চলে যাও। পায়ের ছাপ দেখলেই ডাকবে। আমরা ঝোপগুলোয় খুঁজব। দেখি ঢোকার কোনও পথ আছে কিনা।

আশ্চর্যবোধক চিহ্ন চোখে পড়ে কিনা দেখবেন, রবিন বলল। কিংবা অস্বাভাবিক কিছু। জড় করা পাথর হতে পারে। ভাঙা ডাল হতে পারে। ওরকম চিহ্ন রেখে যেতে পারে কিশোর।  

রাস্তার যে পাশে পর্বত সেদিকটায় খুঁজতে চলল পুলিশ আর শেরিফের দুই ডেপুটি। দুই দল দুই দিকে গেল। খানিক পরেই ফিরে এল ওরা। জানাল ঘাস বেশিদূর নেই। তাতে পায়ের ছাপও নেই। একজন খুঁজে পেল পাথরের ছোট একটা স্তূপ। আন্দাজ করল, ওটা কিশোরের রেখে যাওয়া নির্দেশক হতে পারে। পরীক্ষা করে দেখলেন শেরিফ। অনেক পুরনো মাটি বেরোল পাথরের ফাঁক থেকে। অনেক দিন ধরে একরকম ভাবে পড়ে আছে। নতুন নয়। তার মানে এটা কিশোর। রেখে যায়নি। একজন পুলিশ খুঁজে বের করল একটা ঝোপ। ওটার ডাল ভাঙা। ঘন ঝোপে খোঁজাখুজি করা হল। আর কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না। রাস্তা চোখে পড়ল না।

চীফ? ডেকে বলল আরেকজন পুলিশ। দেখুন তো!

 ছোট শাদা একটা জিনিস আটকে রয়েছে ঝোপের কাটায়। একটুকরো শাদা শক্ত কাগজ। দৌড়ে গেল রবিন আর মুসা।

দেখে তো…, শুরু করল রবিন।

শেষ করল মুসা, আমাদের কার্ডের মত মনে হচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে খুলে আনল কার্ডটা। হ্যাঁ, তিন গোয়েন্দার কার্ডই। কোনও ফাঁকে কিডন্যাপারদের চোখ এড়িয়ে ফেলে গেছে কিশোর।

দেখি, ঝোপটা ফাঁক কর, নির্দেশ দিলেন শেরিফ।

ডেপুটিরা আর পুলিশ মিলে টেনে ফাঁক করল ঝোপের ডাল। সরু পায়ে চলা। পথটা আবিষ্কার করতে বেশিক্ষণ লাগল না।

 রাস্তাই। সন্দেহ নেই, তাকিয়ে রয়েছে চীফ। দেখ, হেঁটে গেছে কেউ। পরিষ্কার চিহ্ন রয়েছে।

সরু পথটা ধরে চলল সবাই।

ওই তো! রবিন দেখাল। একটা ঝোপের পাতা ছেঁড়া, ডাল দোমড়ান; যেন কেউ পড়ে গিয়েছিল ওখানে। কাছেই একটা পাথরে খুদে একটা আশ্চর্যবোধক চিহ্ন।

কিশোরই এঁকেছে। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। চক ছিল পকেটে।

জলদি! তাগাদা দিলেন রাশেদ পাশা। আছে কাছাকাছিই, পর্বতে…

থেমে গেলেন তিনি। কান পেতে শব্দ শুনছেন। তারপর সকলেই শুনতে পেল শব্দটা। শক্তিশালী মোটরের আওয়াজ ক্রমেই বাড়ছে ঠিক যেন ওদের মাথার ওপর।

আকাশের দিকে হাত তুললেন মেরিচাচী। হেলিকপ্টার!

কপালের ওপর হাত রেখে দেখতে লাগলেন শেরিফ। পুলিশের কিনা বোঝার চেষ্টা করছেন। একশ গজ ওপর দিয়ে উড়ে গেল পর্বতের দিকে।

না, ইঞ্জিনের গর্জনকে ছাপিয়ে চিৎকার করে বললেন চীফ। পুলিশের নয়! কিনডন্যাপারদের! ওটাতে করেই পালাবে!

 গাছের আড়ালে হারিয়ে গেল কপ্টারটা। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল ইঞ্জিনের শব্দ।

আপনি না বললেন কিছুতেই বোরোতে পারবে না! শেরিফের ওপর ভীষণ রেগে গেলেন মেরিচাচী।

থামবে না কেউ, হাঁটো! মেরিচাচীর কথা এড়িয়ে গিয়ে বললেন শেরিফ। সামনেই কোথাও আছে। পালানোর আগেই ধরতে হবে

যদি সময় মত পৌঁছতে পারি! আর ভরসা করতে পারছে না মুসা।

.

ধুলোর ঘূর্ণি তুলে বক্স ক্যানিয়নে নামল হেলিকপ্টার। পরিষ্কার প্রেক্সিগ্লাস বাবলের ভেতর থেকে লাফিয়ে নামল পাইলট। পরনে ফ্লাইং স্যুট, মাথায় হেলমেট, চোখে গগলস, মাথা নিচু করে দৌড়ে এল দুই কিডন্যাপারের কাছে।

ঠিক সময়েই এসেছ, ডেভ বলল।

ওকে নিয়ে এসেছি! হেসে বলল অন্য লোকটা। জন।

জবাবে হাসল না পাইলট। মার্সিডিজটাকে হেঁকে ধরেছে পুলিশ, দেখে। এলাম। ঝোপের ভেতর দিয়ে এদিকে আসছে কয়েকজন।

ঝোপের ভেতর দিয়ে? ভুরু কোঁচকাল ডেভ। এত তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করল কিভাবে?

ওই ছেলেটা, জুন বলল। সব ওর শয়তানী। ইচ্ছে করেই পড়েছে কয়েকবার। চিহ্ন রেখে এসেছে।

হেসে উঠল ডেভ। রাখুক। লাভ হবে না। ওরা আসার আগেই উড়ে যাব আমরা।

অত হাসির কি হল! ধমকে উঠল পাইলট। যাও, নিয়ে এস ছেলেটাকে।

আনছি।

ও কোথায়?

ওই কেবিনে।

হুঁ। জলদি কর।

ক্যানিয়নের পাথরের মত শক্ত মাটির ওপর দিয়ে জুতোর শব্দ তুলে এগোল তিনজনে। তালা খুলল জন। ডেকে বলল, বেরিয়ে এস।

ডেভ! চিৎকার করে উঠল জন। ও নেই!

ডেভও উঁকি দিল ভেতরে। শূন্য কেবিন।

ঘাস খেয়েছ নাকি বসে বসে! কর্কশ কণ্ঠে বলল পাইলট, পালাল কিভাবে?

অসম্ভব! বেরোনোর কোনও পথ নেই!

তাহলে গেল কোথায়? জনের প্রশ্ন।

যেভাবেই হোক বেরিয়েছে! চেঁচিয়ে বলল পাইলট। থাকলে তো থাকতই!

হয়েছে, অত ঘাবড়ানোর কিছু নেই, কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল ডেভ। পালিয়ে যাবে কোথায়? কেবিন থেকে বেরোলেও ক্যানিয়ন থেকে বোরোতে পারবে না। পথ নেই। একটাই পথ, সেটা দিয়ে গেলে আমাদের সামনে দিয়ে যেতে হত। যায়নি। তারমানে আছে। জন, খোঁজ।

নির্জন ক্যানিয়নে ছড়িয়ে পড়ল তিন কিডন্যাপার।

.

হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সরু ক্যানিয়নের মুখে পৌঁছল উদ্ধারকারী দলটা। হেলিকপ্টারটাকে দেখার বিশ মিনিট পর।

ওই তো! হাত তুলল রবিন।

ধীরে ধীরে ঘুরছে হেলিকপ্টারের রোটর। ওদের চোখের সামনেই লাফিয়ে গিয়ে বাবলে উঠে পড়ল পাইলট। শক্তি বাড়তে শুরু করল রোটরের।

জলদি! বলেই দৌড় দিল মুসা।

তার পেছনে ছুটল অন্যেরা। কপ্টারটাকে ধরার জন্যে। কেবিনের পেছন থেকে বেরিয়ে এল দুজন লোক। ওরাও দৌড় দিল কপ্টারের দিকে।  

এই থাম, থাম! পুলিশ! চিৎকার করে উঠে ওদের দিকে দৌড় দিলেন শেরিফ।

 ততক্ষণে কপ্টারের কাছে পৌঁছে গেছে দুজনে। উঠে পড়ল। উদ্ধারকারীদের অসহায় দৃষ্টির সামনেই আকাশে উঠে পড়ল কপ্টার। ধুলোর ঝড় উঠেছে। বিশাল এক ফড়িঙের মত শূন্যে ঝুলে রইল একটা মুহূর্ত, তারপর আগে বাড়ল। দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল ক্যানিয়নের দেয়ালের ওপাশে, দক্ষিণে।

বোকা হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে উদ্ধারকারীরা।

গেল…চলে গেল! বিড়বিড় করলেন রাশেদ পাশা।

ওদেরকে যেতে দিলেন আপনারা! রাগে দুঃখে মাথার চুল ছেঁড়ার অবস্থা হল। মেরিচাচীর। আমার…আমার ছেলেটাকে নিয়ে গেল!,

সহকারীদের দিকে ফিরে আদেশ দিলেন শেরিফ, গাড়ির কাছে ফিরে যেতে। টেলিফোনে নির্দেশ দেবেন পুলিশের হেলিকপ্টারকে, যাতে পিছু নিতে পারে।

কিশোরকে কিন্তু দেখলাম, না হেলিকপ্টারে, রবিন বলল।

হয়ত কেবিনেই রয়ে গেছে, মুসা বলল। আমাদেরকে দেখেই পালিয়েছে ব্যাটারা। ওকে নেয়ার আর সময় পায়নি।

কেবিনের দিকে ছুটে গেলেন চীফ। ঠেলা দিয়ে খুলে ফেললেন ভেজানো দরজা। পেছনে ঢুকল অন্যেরা। শূন্য ঘর।

খাইছে! নেই তো! গুঙিয়ে উঠল মুসা।

আগেই হয়ত কপ্টারে তোলা হয়েছিল, রবিন বলল। দেরি করে ফেলেছি আমরা।

না, নথি, যেন গায়েবী আওয়াজ হল। বরং সময়মতই এসেছ।

কেবিনের পেছন দিকের দুটো তক্তা উঠে গেল। বেরিয়ে এল কিশোর পাশা। মুখে হাসি।

কিশোওর! প্রায় একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল সবাই।

হ্যাঁ, কিশোর, নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল গোয়েন্দাপ্রধান। আর কাউকে আশা করেছিলে নাকি?

০৬.

…বেরোনোর কোনও পথ পেলাম না, পত্রিকার লোকদেরকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলল কিশোর। তাই আর কি করব? ভাবলাম, লুকিয়েই থাকি। তারপর যা হয় হবে। কাজে লাগল ফন্দিটা। ধোঁকা খেল ব্যাটারা। আমিও বেঁচে গেলাম।

বুদ্ধিমান ছেলে, বলল একজন রিপোর্টার।

কিশোর পাশা বুদ্ধিমানই, হেসে বললেন চীফ ইয়ান ফ্লেচার। নইলে কি আর পুলিশকে সাহায্য করতে পারত?

রিপোর্টারদের সঙ্গে কথা বলছে, একই সাথে পুলিশের ফাইলও ঘাঁটছে কিশোর। রকি বীচ পুলিশের হাতে অ্যারেস্ট হওয়া অপরাধীদের সমস্ত ছবি রয়েছে

ফাইলে। কিডন্যাপারদের চেহারার লোক আছে নাকি ওখানে দেখছে সে।

কি চায় কিচ্ছু বলেনি? প্রশ্ন করল একজন রিপোটার।

অবান্তর প্রশ্ন, বাধা দিয়ে বললেন চীফ। সেটা পুলিশের ব্যাপার। আপনাদেরকে বলার জন্যে নয়। একটু থেমে বললেন, তবে একটা কথা বলতে পারি, মিস্টার রাশেদ পাশা তেমন বড়লোক নন যে তার ভাতিজাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে মস্ত লাভ হবে কিডন্যাপারদের। অন্তত টাকাপয়সার দিক দিয়ে।

 মনে মনে চীফের ওপর ভীষণ রেগে গেল রিপোর্টাররা। কিন্তু কিছু করার নেই। কেউ যদি কিছু বলতে না চায় তাকে চাপাচাপি করার অধিকার নেই ওদের। কিশোরের বেশ কিছু ছবি তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল ওরা।

ঠিক কিডন্যাপারদের মত কিন্তু লাগেনি ওদেরকে, রবিন মন্তব্য করল।

নতুন কিছু জেনেছেন, স্যার? চীফকে জিজ্ঞেস করল মুসা। ধরা যাবে?

বুঝতে পারছি না। অতটা সহজ হবে বলে মনে হয় না।

কিন্তু রিপোর্টারদেরকে তো বললেন সাধারণ কিডন্যাপিং।

 কিডন্যাপাররা ধরা না পড়া পর্যন্ত মুখ বুজে থাকাই ভাল। এতে কম সাবধান থাকে ওরা। ধরা সহজ হয়।

তা ঠিক, কিশোরও একমত হল। যত কম জানে ততই ধরতে সুবিধে। কিডন্যাপাররা ভাববে আমরা কিছুই জানি না। অসাবধান হবে। সেই সুযোগটা তখন কাজে লাগাতে হবে আমাদের।

ব্যাপারটা কি এখন খুলে বল তো, কিশোর, চীফ অনুরোধ করলেন।

আমাকে অন্য কেউ ভেবে ভুল করেছে ওরা। কোনও দেশের ভি আই পি গোছের কারও ছেলে মনে করেছে। পলিটিক্যাল কারণ হতে পারে। প্রতিশোধ হতে পারে। একজন জিম্মি খুঁজছে ওরা।

 হু। নীরবে ভাবলেন কিছুক্ষণ চীফ। তারপর মুখ তুললেন। ভালোয় ভালোয়। যে বেঁচে এসেছ এইই বেশি। ঠিক আছে, এখন যা করার পুলিশই করবে। তোমাকে কয়েক দিন সাবধানে থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। ইতিমধ্যে লোকগুলোকে ধরে ফেলতে পারব আমরা, আশা করি। তখন আর তোমার ভয় নেই, নিরাপদ। তোমার চাচা-চাচী তো চলে গেছেন। যাবে কিভাবে? পুলিশের গাড়িতে করে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করব?

মাথা কাত করে সায় জানাল কিশোর।

বাইরে বেরিয়েই দেখা গেল রোলস রয়েসটাকে। চারটে গাড়ির পেছনে। ওটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হ্যানসন। দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেল। তিন গোয়েন্দা।

আপনি? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

আমাকে যেতে বলা হয়নি, জবাব দিল হ্যানসন। তার মানে ডিউটিতেই রয়েছি আমি। তোমরা যেখানে থাকবে সেখানেই থাকতে হবে আমাকে। তাই আছি। কোথায় যেতে হবে এখন?

বাড়িতে। এক মিনিট দাঁড়ান। বলে দৌড়ে থানার সামনে ফিরে এল। কিশোর। একটা গাড়ি ঘোরানো হয়েছে ওদেরকে নেয়ার জন্যেই। ড্রাইভারকে ধন্যবাদ দিয়ে সে বলল, আর কষ্ট করতে হবে না। ওদের গাড়ি এসে গেছে।

রোলস রয়েসে উঠল তিন গোয়েন্দা। ড্রাইভিং সীট থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে জিজ্ঞেস করল হ্যানসন, কোথায় যাব?।

র‍্যাটলস্নেক রোড, শান্তকণ্ঠে নির্দেশ দিল কিশোর।

কোথায়? চমকে গেছে মুসা।

সেই বক্স ক্যানিয়নটায় যাব আবার। হ্যানসন, চালান।

প্রতিবাদ করে লাভ হবে না। চুপ করে রইল দুই সহকারী গোয়েন্দা।

র‍্যাটলস্নেক রোডে যখন পৌঁছল ওরা তখনও কড়া রোদ। গাড়িতে তালা লাগিয়ে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে হ্যানসনও চলল ঝোপের ভেতরে লুকান পথ ধরে। পঁচিশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেল ক্যানিয়নে, যেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কিশোরকে।

আমি ভেতরে খুঁজব, বলল সে। তোমরা কেবিনটার বাইরে খোঁজ। দেখ। কোনও সূত্র পাও কিনা।

আমি কেবিনের ভেতরে অনেকক্ষণ ছিলাম, বলল সে। কিছু থাকলেও এখন। আর চোখে পড়বে না আমার। মুসা, তুমি আর হ্যানসন ভেতরে খোঁজ। বাইরের চারপাশটায়ও ঘুরে দেখবে। আমি আর রবিন যাচ্ছি হেলিকপ্টারটা যেখানে নেমেছিল সেখানে।

কিন্তু খুঁজবটা কি? রবিনের প্রশ্ন।

আমারও সেই কথা, মুসা বলল।

যে কোনও সূত্র, জবাব দিল কিশোর। লোকগুলো কে, কোত্থেকে এসেছে, কি চায়, এখনই বা কোথায় গেল, এসব। এমন কিছু মিলতেও পারে যা থেকে এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে।

 ধীরে ধীরে পর্বতের ওপাশে হারিয়ে গেল সূর্য। লম্বা ছায়া পড়ল গিরিখাতের ভেতরে। কেবিনের ভেতরে বাইরে সমস্ত জায়গায় খুজল মুসা আর হ্যানসন। কিছু পেল না। রবিন আর কিশোরও কিছু পেল না হেলিকপ্টার নামার জায়গায়। মনে পড়ল কিশোরের, কেবিন থেকে দূরে তাকে খুঁজতে গিয়েছিল কিডন্যাপাররা। ছড়িয়ে পড়ে আবার শুরু হল খোঁজা। প্রায় নিরাশ হয়ে পড়েছে এই সময় হঠাৎ ঝুঁকল কিশোর। একটা জিনিস তুলে নিল মাটি থেকে। অন্যেরা দৌড়ে এল তার কাছে।

কী? জানতে চাইল রবিন।

বুঝতে পারছি না, আস্তে জবাব দিল কিশোর। দেখ।

গোধূলির ম্লান আলোতেও চকচক করে উঠল জিনিসটা। হাতির দাঁত কুঁদে। তৈরি হয়েছে আরেকটা খুদে হাতির দাঁত। সোনার জালিতে বসিয়ে ছোট একটা আঙটা লাগানো হয়েছে।

কানের দুল? মুসা বলল।  

অন্য গহনাও হতে পারে। কিংবা সৌভাগ্যের প্রতীক, রবিন বলল। ওই যে অনেকে বিশ্বাস করে, ওরকম কিছু আরকি।

যা-ই হোক, কিশোর বলল। নিখুঁত নয় জিনিসটা। হাতে বানানো। বিদেশী হস্তশিল্প হতে পারে। পর্বতের গভীরে গিরিখাতে এই জিনিস এল কি করে ভাবছি।

কিডন্যাপাররা ফেলে গেল? মুসার প্রশ্ন।

যেতেই পারে।

কিশোরের কাছ থেকে জিনিসটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল হ্যানসন। লোকগুলোর কথার টানটা কোন দেশের বোধহয় বুঝতে পারছি। আফ্রিকায় ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকাকালে ইংরেজদেরও কথার টান অনেকটা ওদেশের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। খাঁটি ব্রিটিশদের মত আর কথা বলতে পারত, না ঔপনিবেশিকরা। কোনও দেশে বেশিদিন থাকতে থাকতে ওরকম হয়েই যায়। এই জিনিসটা মনে হচ্ছে আফ্রিকার স্থানীয় অধিবাসীদের গহনা।

উত্তেজিত কণ্ঠে কিশোর বলল, কোন দেশের সেটাই এখন আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে।

কিশোর, মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি। আমি ভেবেছিলাম এ কেসটা আমাদের জন্যে বাদ।

লোক ভাল না ওরা, সাবধান করল রবিন।

জানি, জবাব দিল কিশোর। সেজন্যেই তো বাদ দিতে পারছি না। আমাদের বয়েসী একটা ছেলে মহাবিপদের মধ্যে রয়েছে। রকি বীচেই কোথাও আছে সে। আমাদের কাজ তাকে সাহায্য করা।

কেন, দুনিয়ার সব মানুষকে সাহায্যের দায়িত্ব কি শুধু আমাদেরই? গজগজ করল মুসা।

না। তবে অন্তত এই একটি কেসে পিছিয়ে আসতে পারছি না আমরা। আঘাতটা আমার ওপরও এসেছিল। মারাও পড়তে পারতাম। ওই ছেলেটারও একই অবস্থা হতে পারে। ওকে সাহায্য করা আমাদের মানবিক দায়িত্ব। ভুল করেই হোক আর যেভাবেই হোক, আমাকে কিডন্যাপ করা না হলে হয়ত এতে জড়াতাম না। বক্তৃতার ঢঙে কথাগুলো বলে হ্যানসনের দিকে ফিরল কিশোর। বাড়ি যেতে হবে। আপনারও ডিউটির সময় শেষ হয়ে এল।

চল। মাথা ঝাঁকাল হ্যানসন।

ঝোপের ভেতরের সরু পথ ধরে একসারিতে হাঁটছে ওরা। দ্রুত কমে আসছে গোধূলীর আলো। র‍্যাটলস্নেক রোডের দিকে চলতে চলতে মুসা বলল, কিশোর, ছেলেটাকে বের করব কিভাবে?

উপায় নিশ্চয় আছে। সেজন্যে তাঁর সম্পর্কে আরও কিছু জেনে নেয়া প্রয়োজন। আমাদের। আজ রাতে গবেষণা চালাব আমি। কাল সকালে হেডকোয়ার্টারে দেখা কর তোমরা। তখন বিস্তারিত আলোচনা করব।

.

০৭.

আরে আস্তে খাও না, মিসেস আমান বললেন। ফুরিয়ে তো আর যাচ্ছে না। গলায় আটকাবে তো।

পরদিন সকালে নাস্তা খেতে বসেছে মুসা। তাড়াহুড়া আছে, মা।।

খবরের কাগজ থেকে মুখ তুললেন মিস্টার আমান। কিশোরের কিডন্যাপিঙের ব্যাপারটা নয় তো? সাবধান। খুব বিপজ্জনক কিন্তু।

জানি।

মিসেস আমান বললেন, কেমন অদ্ভুত ব্যাপার বল তো? ভুল করে একজনের জায়গায় আরেকজনকে নিয়ে যাওয়া।

কিশোর তো তবু চুপ করেছিল। আমি হলে…, বাক্যটা শেষ না করে হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিল মুসা।

দ্রুত নাস্তা শেষ করে বেরিয়ে এল সে। সাইকেল নিয়ে স্যালভিজ ইয়ার্ডে রওনা হল। সুন্দর সকাল। ফুরফুরে বাতাস। হেডকোয়ার্টারে ঢোকার গোপন প্রবেশ পথ লাল কুকুর চার দিয়ে এসে ভেতরে ঢুকল মুসা। বাইরের ওয়ার্কশপে কাজ করতে দেখল কিশোরকে। ওয়ার্কবেঞ্চের ওপর তিনটে খুদে যন্ত্র খুলে ছড়িয়ে বসেছে গোয়েন্দাপ্রধান।

জরুরী সংকেতের প্রয়োজন হতে পারে,মুসাকে দেখে বলল কিশোর। এস, হাত লাগাও। রবিন আসতে আসতে সেরে ফেলি।

পিটারের ব্যাপারে খোঁজখবর করার কথা ছিল, ওয়ার্কবেঞ্চের অন্য প্রান্তে। বসল মুসা। তার কি হল? নিয়েছ?

নিয়েছি, হাসল কিশোর। অনেক কিছু জেনেছি কাল রাতে। পিটার মনটেরোকে খুঁজে বের করা কঠিন হবে না।

বল! উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছে না মুসা।

রবিন আসুক। এক কথা দুবার বলতে ভাল লাগে না।

জোর করে কিশোরের মুখ খোলান যাবে না। হতাশার একটা ভঙ্গি করে যন্ত্র। মেরামতে লাগল মুসা। পাটসগুলো সব পরিষ্কার করে আবার জুড়ে দেয়ার জন্যে রেডি করেছে, এই সময় হাজির হল রবিন। সবুজ ফটক এক দিয়ে ঢুকল সে। সরি, জোরে জোরে সাইকেল চালিয়ে আসাতে হাঁপাচ্ছে। মা দেরি করিয়ে দিল। কাজ না সেরে বেরোতে পারলাম না। তা কি খবর, কিশোর? আমাদের কেসের ব্যাপারে আলোচনার কথা ছিল। চীফ ফ্লেচারের কাছ থেকে আর কোনও খবর। পেয়েছ?

পেয়েছি। সকালেই ফোন করেছিলাম। হেলিকপ্টারটাকে পেয়েছে পুলিশ। ভেনচুরার কাছে একটা মাঠে ফেলে দিয়ে চলে গেছে।

আমাদেরকে বোকা বানিয়েছিল? উড়ে গেল দক্ষিণে, অথচ পাওয়া গেল উত্তরে।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ঠিকই করেছে। আমি হলেও ওরকমই কিছু করতাম। কে আর সেধে গিয়ে পুলিশের হাতে পড়তে চায়। চীফ বলেছেন লোকগুলোকে ধরার মত কোনও সূত্রই ছিল না কপ্টারে। ভাড়া নেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল জরুরী ডাক সরবরাহ করবে। এয়ারফিল্ড থেকে নিয়ে গিয়েছিল ওটা পাইলট মাথায় হেলমেট আর চোখে গগলস ছিল তার। ফলে চেহারা কেউ দেখতে পায়নি। আর কাগজপত্র যে সব ভুয়া তাতে তো কোনও সন্দেহই থাকার কথা নয়।

বাহ্, চমৎকার, ব্যঙ্গের সুরে বলল মুসা। অনেক উপকার হবে, আমাদের!

কিডন্যাপারদের খবর কি? রবিন জানতে চাইল।

এখনও সনাক্ত করা যায়নি, কিশোর জানাল। হেলিকপ্টার আর মার্সিডিজে আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। ওয়াশিংটনের এফ বি আই অফিসে ওই ছাপ রেকর্ড করা নেই। আর মার্সিডিজটাও ভাড়া করা।

বলতে চাও আমাদের হাতে কোনও সূত্রই নেই, ভোতা গলায় বলল মুসা।

না, ঠিক তা নয়, হাসল গোয়েন্দাপ্রধান। বলেছি না কাল রাতে অনেক গবেষণা করেছি। আমার মনে হয়…

এ কথা শেষ হল না তার। পেছনে শোনা গেল জোরাল কণ্ঠস্বর। মেরিচাচী। সবাই তাহলে এখানে। ভালই হল। কিশোর, দুই দিন আগে কথা দিয়েছিলি ছোট স্টোররুমটা পরিষ্কার করে দিবি।

সরি, চাচী।

ঠিক আছে। আজকে করে দে। মাল রাখতে হবে ওখানে। বাইরে থেকে থেকে নষ্ট হচ্ছে জিনিসগুলো। তিনজনে করতে আর কতক্ষণ লাগবে…

আমি একাই পারব, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে বলল, এগুলো লাগিয়ে ফেল। আমি আসছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল সে। অনেক বার কথাটা ভেবেছে আগেও, আজ আরেক বার ভাবল, পৃথিবীতে এই কাজ জিনিসটা না থাকলে অনেক ভাল হত। আর যদি খিদেটা না থাকত। অনেক ঝামেলা থেকে মুক্তি পেত মানুষ।

বিষণ্ণ দৃষ্টিতে কিশোরের চলে যাওয়া দেখতে লাগল রবিন আর মুসা। কিশোর কি জেনেছে জানার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু কিছু করার নেই। ছোট যন্ত্রগুলো জোড়া লাগানোয় মন দিল।

শেষ হয়ে গেল লাগানো।

অযথা বসে না থেকে ওয়ার্কশপটা গোছানোয় লেগে গেল দুজনে। সেই কাজও শেষ। অনেকক্ষণ বসে থেকে উসখুস করে হেডকোয়ার্টারে ঢোকার জন্যে যেই দুই সুড়ঙ্গের দিকে এগোল, শোনা গেল একটা কণ্ঠ, দাঁড়াও!

কাজ করতে করতে ঘেমে একাকার হয়ে এসেছে কিশোর। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। ওয়ার্কশপে এসে ঢুকল সে।

কাল রাতের কথাটা তাড়াতাড়ি বলে ফেল তো এবার! অস্থিরতা আর চেপে রাখতে পারল না মুসা।

কি জেনেছ? রবিনের প্রশ্ন।

কিশোর! আবার ডাক শোনা গেল মেরিচাচীর। অফিসের কাছ থেকে ডেকেছেন।

খাইছে! আবার! ককিয়ে উঠল মুসা।

চল লুকিয়ে পড়ি! পরামর্শ দিল রবিন। জবাব দিও না।

লাভ হবে না তাতে। ভাল করেই জানে আমরা এখানে আছি। বেরিয়ে যেতে দেখেনি, কিশোর বলল।

তা ঠিক, সাংঘাতিক হতাশ হয়েছে মুসা। মেরিচাচীর কাছ থেকে লুকিয়ে রক্ষা নেই। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড। না, এফ বি আই। না না, ক্যানাডিয়ান মাউনটিজ। উঁহু, তিনটা একসঙ্গেই। এত কড়া নজর ঈগলেরও নেই। চল, বেরোই।

বেরিয়ে এল তিনজুনে। জঞ্জালের পাশ দিয়ে এগোতে এগোতে হঠাৎ হাত তুলল রবিন, কিশোর, দুজন লোক!

কিডন্যাপারগুলো না তো! আঁতকে উঠল মুসা।

না। দেখছ না, একজন কালো চামড়া।

কালো? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ঠিকই আছে। এরকমই হওয়ার কথা। এস।

হওয়ার কথা? কিছুই বুঝতে পারল না মুসা। কি বলতে চাও?

কিন্তু জবাব দেয়ার অবকাশ নেই যেন কিশোরের। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোচ্ছে। তাকে ধরার জন্যে দ্রুত এগোল দুই সহকারী। কিন্তু অফিসের কাছাকাছি যাওয়ার আগে ধরতে পারল না।

চোখে সন্দেহ নিয়ে তিন গোয়েন্দার দিকে তাকালেন মেরিচাচী। এই ভদ্রলোকরা তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান। ভাড়াটাড়া করার ব্যাপার। মনে তো হচ্ছে আগামী পুরো হপ্তাটাই কাজ আটকে থাকবে আমার। কিছুই হবে না।

না, ম্যা ম, মেরিচাচীর আশঙ্কা দূর করার জন্যে তাড়াতাড়ি বলল শ্বেতাঙ্গ লোকটা। লম্বা, সোনালি চুল, মুখটা ওই দুই কিডন্যাপারের মতই রোদেপোড়া। আমাদের হয়ে ছোট্ট একটা তদন্ত করে দিতে হবে ওদের।

লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা। ইংরেজি বলছে ইংরেজদের মত, কিন্তু সেই অদ্ভুত টান।

ছোট হলেই ভাল, মেরিচাচী বললেন। আগামী হপ্তা থেকে ইস্কুল শুরু হবে ওদের। এর মধ্যেই আমার কাজগুলো সব করিয়ে রাখা দরকার।

বলে আর দাঁড়ালেন না তিনি। অফিসে চলে গেলেন। দ্রুত একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল কিশোর। তারপর লোকগুলোকে ইশারা করল সঙ্গে আসার জন্যে। ওয়ার্কশপে নিয়ে এল ওদেরকে।

কিডন্যাপিঙের ব্যাপারে, তাই না? জিজ্ঞেস করল সে, আপনাদের পরিচয়?

আমি হাবার্ট কিং, সোনালি চুল লোকটা বলল। কালো লোকটাকে দেখিয়ে বলল, ওর নাম হ্যারি ম্যাকঅ্যাডাম। কিডন্যাপিঙের ব্যাপারেই আলোচনা করতে এসেছি আমরা।

ভাল গোয়েন্দা দরকার আমাদের, হ্যারি বলল। তোমাদের ব্যাপারে খোঁজ  নিয়েছি। খুবই ভাল নাকি তোমরা। অনেক জটিল রহস্যের সমাধান করেছ। সেজন্যেই এলাম। সাহায্য করতে রাজি থাকলে বল, সব কথা খুলে বলছি। কেন কিডন্যাপ করা হয়েছিল তোমাকে। কি চায় ওরা।

খুশি হয়েই করব, মিস্টার ম্যাকঅ্যাডাম, কিশোর জবাব দিল। তবে কেন কিডন্যাপ করা হয়েছিল আমাকে, জানি, আপনাদেরকে আর বলতে হবে না। ওরা কি চায় তা-ও জানি।

জান? মুসা অবাক।

 জানি, সেকেণ্ড। আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল কারণ আমি দেখতে অনেকটা পিটার মনটেরোর মত। পিটার হল স্যার উইনিফ্রেড মনটেরোর ছেলে। আফ্রিকার একটা ছোট্ট ব্রিটিশ কলোনি নানদার প্রধানমন্ত্রী তিনি। ইংরেজ। বিয়ে করেছেন এক ভারতীয় মহিলাকে। আগামী বছরের মধ্যেই ওটাকে স্বাধীন স্বতন্ত্র দেশ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। তার সরকারে থাকবে বেশির ভাগই কালো চামড়ার মানুষ। আর শ্বেতাঙ্গ যারা থাকবে, তারা বাইরের কেউ নয়, নানদায় যারা জন্মগ্রহণ করেছে শুধু তারাই। কিন্তু প্রতিপক্ষ আছে। দলটার নাম ব্ল্যাক নানান এলিয়ান্স। গোপনে কাজ করছে এর সদস্যরা, দেশ থেকে সমস্ত শ্বেতাঙ্গদের তাড়াতে চাইছে। আরও একটা দল আছে, শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদী। ন্যাশনাল পার্টির লোক ওরা। ওরা চায়, কোনও কালো লোক থাকবে না সরকারে। সব শাদা। সেনাবাহিনীও গঠিত হবে সব শ্বেতাঙ্গদের দিয়ে, যাতে কালোদের দাবিয়ে রাখতে পারে।

কিশোর, তুমি এত কথা জানলে কি করে? রবিন অবাক।

আর এর সঙ্গে কিডন্যাপিঙেরই বা কি সম্পর্ক? মুসা জানতে চাইল।

অনেক সম্পর্ক, কিশোর বলল। কিডন্যাপাররা ন্যাশনাল পার্টির উগ্রবাদী। শ্বেতাঙ্গদের লোক। পিটারকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে তার বাবাকে বাধ্য করতে চায়, যাতে স্যার মনটেরো তাঁর প্ল্যান বাতিল করে তাদের কথায় রাজি হন। মিস্টার কিং আর মিস্টার ম্যাকঅ্যাডাম নিশ্চয় স্যার মনটেরোর সমতাবাদী দলের লোক। পিটারকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।

হঠাৎ নীরব হয়ে গেল যেন ওয়ার্কশপটা।

বড় বেশি জান তুমি, হ্যারি বলল। অনেক বেশি জেনে ফেলেছ। এতটা ভাল না।

তার কালো থাবায় ধরা ভয়ংকর দর্শন এক পিস্তল।

.

০৮.

কালো মুখে জ্বলন্ত কয়লার মত জ্বলছে যেন হ্যারির চোখ। সোজা কিশোরের দিকে পিস্তল তাক করে রেখেছে। এসব জানার একটাই উপায়। কিডন্যাপারদের সঙ্গে যোগসাজস আছে তোমার। তুমি স্পাই।

হুট করে কিছু কোরো না, হ্যারি, কিং বলল। তার দৃষ্টিও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। হ্যাঁ, ইয়াং ম্যান, বল তো কি করে এসব জানলে তুমি?

জানা কি এমন কঠিন কাজ নাকি? তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত ওল্টাল কিশোর। আমি ইও নই বোকাও নই। একটা সহজ কথা ভাবছেন না কেন? আমি কিডন্যাপারদের লোক হলে আমাকে ওভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া হত নাকি? আর আমিও কি ঢাকঢোল পেটাতাম?

তাকিয়ে রয়েছে হ্যারি। বলে যাও।

কাজটা সহজ হল কি করে বল, আদেশের সুরে বলল.কিং।

বেশ। বড় করে দম নিল কিশোর। ধরে তো নিয়ে যাওয়া হল আমাকে। ওদের আলাপ আলোচনা শুনলাম। কথায় অদ্ভুত টান। আমাকে পিটার বলে ভুল করল। ভাবল স্যার উইনিফ্রেড মনটেরোর ছেলে। যাই হোক, পালিয়ে আসতে পারলাম অবশেষে। তারপর আবার গেলাম কেবিনটার কাছে। এটা পেয়েছি, হাতির দাঁতে তৈরি জিনিসটা বের করে দেখাল সে। আমাদের শোফার হ্যানসনের বিশ্বাস, এটা আফ্রিকার কোনও ব্রিটিশ কলোনি থেকে এসেছে।

জিনিসটা হাতে নিয়ে দেখল কিং। তুলে ধরল হ্যারির জন্য। দেখে মাথা নাড়ল হ্যারি।

চমৎকার একটা লাইব্রেরি আছে আমাদের রকি বীচে, বলে গেল কিশোর। রেফারেন্স বই আর ম্যাগাজিন ঘেটে বের করতে খুব একটা কষ্ট হল না স্যার মনটেরোর নাম। জানতে পারলাম নান্দার ব্রিটিশ কলোনির প্রাইম মিনিস্টার তিনি। স্বাধীনতার জন্যে গোলমাল চলছে এখন দেশটায়। পার্টিগুলোর নাম। জানলাম। তারপর আর বুঝতে কষ্ট হল না কেন পিটারকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল লোকগুলো। আপনাদের কথায়ও একই রকম টান। এবং দুজন দুরঙের চামড়া হলেও কাজ করছেন একসাথে। অর্থাৎ স্যার মনটেরোর হয়ে। কাজেই বোঝাটা কি এতই কঠিন?

তাই তো, মুসা বলল। একেবারেই সহজ।

হ্যারির দিকে তাকিয়ে হাসল কিং। চলবে?

হ্যাঁ, বলে আবার হোলস্টারে পিস্তল রেখে দিল হ্যারি। সত্যিই বলছে মনে হয়।

এবং খুব ভাল গোয়েন্দা। আশা করি আমাদেরকে নিরাশ করবে না ও। কি বল, কিশোর?

না, করব না, দৃঢ় কণ্ঠে বলল কিশোর।

ভেরি গুড, কিং বলল। মাত্র গতকাল রকি বীচে এসেছি আমরা। বিকেলের কাগজে পড়েছি তোমার কিডন্যাপিঙের খবর। তোমার ছবি দেখেছি। তিন গোয়েন্দা নামে যে একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছ তোমরা, এবং সেটার সাংঘাতিক সুনাম, তা-ও জানলাম। ভাবলাম তোমাদেরকে দিয়েই হবে। চলে এলাম।

তাহলে কি আমাদের ভাড়া করছেন? মুসার প্রশ্ন।

হ্যারির দিকে তাকিয়ে যেন আলোচনার উদ্দেশ্যেই বলল কিং, তোমার কি মনে হয়, হ্যারি? ওরা পারবে? এমন গোয়েন্দাই আমাদের দরকার, তাই না? ।

মনে হয় পারবে, হ্যারির মুখেও হাসি।

রবিন আর মুসার মুখেও হাসি। কিন্তু কিশোর গম্ভীর। জিজ্ঞেস করল, পিটারের সঙ্গে চেহারার কতটা মিল আছে আমার, স্যার?

আমাকে শুধু কিং বললেই চলবে। মিল? একেবারে যমজ বলা চলে। আশ্চর্য! বিশ্বাসই হতে চায় না। দুবছর ধরে আমেরিকায় আছে পিটার। এতদিনে নিশ্চয় চেহারা কিছুটা হলেও বদলেছে। ফলে লোকগুলো আর চিনতে পারেনি। তোমাকেই পিটার বলে ভুল করে বসেছে। ওর কথায়ও নানদার টান। একটা। ব্যাপার বুঝতে পারছি না…।

আমার কথা শুনেও কেন বুঝতে পারল না ওরা, এই তো? হাসল কিশোর। মুখে কাপড় গোঁজা ছিল আমার। প্রথমে বলার চেষ্টা করেছি। তারপর যে-ই ওদের উদ্দেশ্য বুঝে গেলাম, চুপ হয়ে গেলাম একেবারে। একটা কথাও আর বললাম না।

ভাল করেছ, হ্যারি বলল। মারাত্মক বিপদে পড়ে যেতে তাহলে। ওদের নাম আর চেহারার বর্ণনা যা পেয়েছি তাতে পরিচিত লাগছে না। তবে উগ্রবাদী। দলের লোক সন্দেহ নেই। ওই দলের লোকরা ভয়ংকর।

দেশে থাকলে নিরাপদ নয়, কিং বলল। সেজন্যেই ছেলেকে আমেরিকায়। পাঠিয়ে দিয়েছিলেন স্যার-মনটেরো। লস অ্যাঞ্জেলেসে থেকে ইস্কুলে পড়ে। খুঁজে খুঁজে এখানেও এসে হাজির হয়েছে উগ্রবাদীরা। হপ্তাখানেক আগে প্রায় ধরেও ফেলেছিল পিটারকে। অনেক কষ্টে পালিয়েছে সে। তারপর তার আর খোঁজ নেই। স্যার মনটেরোর তো প্রায় পাগল হবার জোগাড়।  লস অ্যাঞ্জেলেসের নানদার ট্রেড মিশনের মাধ্যমে পিটার খবর পাঠানোর পর গিয়ে তিনি শান্ত হয়েছেন।

কি খবর পাঠিয়েছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

 ট্রেড মিশনটা কি? মুসা জানতে চাইল।

ট্রেড মিশন হল একটা অফিসিয়াল গ্রুপ, হ্যারি বলল। যাদের কাজ হল দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়ীক সম্পর্ক বৃদ্ধি করা।

আর মেসেজ যেটা পাঠিয়েছে, কিং বলল। সংক্ষিপ্ত। বেশ অদ্ভুত। আমরা। তো এর মাথামুণ্ড কিছুই বের করতে পারিনি। তাতে রকি বীচের কথা বলা হয়েছে। পিটারের নিশ্চয় ভয় শত্রুদের হাতে পড়ে যেতে পারে তার মেসেজ। সহজ করে লিখলে ওরাও বুঝে ফেলবে।

 ওই মেসেজের মানে করে দিতে বলছেন আমাদেরকে? মুসা জিজ্ঞেস করল।

দেখি তো? দেখতে চাইল রবিন।

হোটেলে রয়ে গেছে। ওখানেই নিরাপদ। হ্যারি বলল, যেতে চাইলে এখনি নিয়ে যেতে পারি।

দুজনকে অনুসরণ করে ওয়ার্কশপ থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। লম্বা, কালো একটা ক্যাডিলাক দাঁড়িয়ে আছে। তাতে চড়ল সবাই। হঠাৎ মুসা বলে। উঠল, কিশোর, দেখ! রাস্তার অন্যপাশে একটা জায়গা দেখাল সে।

কী?

ওই ঝোপের ভেতর কাকে দেখলাম, মুসা বলল।

চল তো দেখি, কিং বলল।

সাবধানে ঝোপটার দিকে এগোল সবাই। রাস্তার কিনার থেকে শুরু করে পরের ব্লক পর্যন্ত এগিয়ে গেছে ঝোপ। পাতলা। ভেতর দিয়ে অনেক দূর দেখা যায়। কাউকে দেখা গেল না সেখানে। তবে ছিল যে তার প্রমাণ মিলল। একটা পোড়া সিগারেটের গোড়া পড়ে রয়েছে।

বললাম না দেখেছি! প্রায় চিৎকার করে বলল মুসা।

 জিরাতে কেউ বসে থাকতে পারে, কিশোর বলল। সিগারেট টেনেছে।

হয়ত, কিং বলল।

তা না হলে, নিজেকেই যেন বোঝানোর চেষ্টা করছে কিশোর। স্যালভিজ ইয়ার্ডের ওপর নজর রাখতে আসবে কে? কিডন্যাপাররা এখনও এই এলাকায়। থেকে থাকলে নিশ্চয় খবরের কাগজ দেখেছে। ভুল লোককে ধরেছিল বুঝতে পেরেছে।

আবার ক্যাভিলাকে ফিরে এল ওরা। গাড়ি চালাল হ্যারি।

ছেলেদের দিকে ফিরে কিং বলল, পিটারকে খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের। ঝোপের ভেতর যে ছিল, সে হয়ত নজর রাখেনি, কিন্তু আমার ভয় লাগছে কিডন্যাপাররা এখনও এই শহরেই আছে। সহজে হাল ছাড়বে না ওরা।

এগুলো আসলে এক ধরনের জেদ, কিশোর বলল। নিজেরা যা ভাবে সেটাই ঠিক, অন্যদেরটা কিছু না।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। আর এই উগ্রপন্থী পলিটিশিয়ানগুলো তো আরও বেশি। আরেকটা ব্যাপার বুঝতে পারছে না ওরা, স্যার মনটেরো ছেলেকে যতই ভালবাসুন, সবার আগে তাঁর কাছে হল দেশ। পিটারকে ধরে নিয়ে গিয়ে হুমকি দিলেই তিনি শুনতেন না, তার কাজ করেই যেতেন। এমনকি পিটারকে মেরে ফেলারও হুমকি যদি দিত ওরা তিনি শুনতেন না।

চুপচাপ শুনল তিন গোয়েন্দা, কিছু বলল না। মোড় নিয়ে সৈকতের ধারে মিরামার হোটেলের ড্রাইভওয়েতে এসে ঢুকল গাড়ি। ছেলেদেরকে নিয়ে কামরায় চলল কিং, আর হ্যারি গেল হোটেলের সেফ থেকে মেসেজটা বের করে আনতে।

মেসেজ আনা হলে দরজায় তালা লাগিয়ে দিল কিং। টেবিল ঘিরে বসল সবাই। জোরে জোরে পড়ল কিশোর, অ্যাটাকড ইন এল. এ.। কেয়ারড। রকি। বীচ। জাঙ্গাস প্রেস।

নিরাশ হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল ছেলেরা।

মুসা বলল, কিছুই তো বলেনি!

এর মধ্যে সংকেতও তো কিছু দেখছি না, বলল রবিন।

না। সংক্ষিপ্ত মেসেজটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। শুধু শেষ দুটো শব্দ বাদে। জাঙ্গাস প্লেস। এটার কি মানে?

সেটা বোঝানোর জন্যই তো তোমাদেরকে ডেকে আনলাম, কিং বলল। রকি বীচের প্রতিটি গাইডবুক দেখেছি আমরা। কিন্তু জ্যাঙ্গার কথা কোথাও কিছু  লেখা নেই। ভাবলাম, এখানকার কেউ হয়ত বলতে পারবে।

আমি জীবনেও শুনিনি ওই নাম, রবিন বলল।

আমিও না, বলল মুসা।

কিশোর শুধু নীরবে মাথা নাড়ল।

হবে না, কিং, হ্যারি বলল। তার কাঁধ ঝুলে পড়েছে। এই ছেলেগুলোও আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে না।

.

০৯.

পারবই না, কিশোর বলল। তা বলতে পারেন না।

চট করে কিশোরের দিকে তাকাল কিং। তুমি… কিছু বুঝতে পেরেছ?

লস অ্যাঞ্জেলেসে তার ওপর হামলা আসায় ভয় পেয়ে গিয়েছে পিটার, কিশোর বলল। পালিয়েছে। চলে এসেছে এখানে। রকি বীচকে লুকানোর জায়গা বেছে নিল কেন সে?

ইস্কুল ছুটি হলে এখানেই আসে, হ্যারি জানাল। গতবার স্যার মনটেরো এসেছিলেন কয়েকটা দিন ছেলের সঙ্গে কাটাতে। তখনও দুজনে একহপ্তা রকি বীচে থেকে গেছে।

তার মানে রকি বীচ তার চেনা, চেনা শব্দটার ওপর জোর দিল কিশোর।

চেনা হতেই পারে, মুসা বলল। এতে অবাক হওয়ার কি আছে? গুরুত্ব কিসের?

আছে, মুসা, আছে। হতে পারে এখানে বিশেষ একটা জায়গা বেছেছে যেখানে লুকানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সেটাই ইঙ্গিতে বলতে চেয়েছে স্যার মনটেরোকে। জ্যাঙ্গাস প্রেস বলে ওই জায়গাকেই বুঝিয়েছে।

কিন্তু, হ্যারি বলল। স্যার মনটেরো বুঝতে পারেননি।

না পারলেও, কিশোর বলল। এটাই সেই জায়গা যেখানে সে লুকিয়েছে। ওরকম কোনও জায়গার নাম নেই রকি বীচে। তার মানে ইঙ্গিতে কিছু বোঝাতে চেয়েছে। সরাসরি বললে সবাই বুঝে ফেলত, সে জন্যে বলেনি।

হ্যাঁ, মুসা মাথা ঝাঁকাল। উগ্রবাদীরাও দেখে যাতে বুঝতে না পারে।

কিঙের দিকে তাকাল কিশোর। শব্দটা আফ্রিকান নয় তো? ওরকম কোনও শব্দ আছে আফ্রিকান ভাষায়?

তা আছে, নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল কিং। একজনের নাম। নানা উপজাতির মহান নেতা ছিলেন তিনি।

হ্যারি বলল, ১৮৮০ সালের দিকে ইউরোপিয়ানরা যখন বসতি স্থাপন করতে আরম্ভ করে তখন জ্যাঙ্গার সঙ্গে ভীষণ লড়াই বাধে ওদের। তিনিই নানদার শেষ নেতা, যার সঙ্গে বিদেশীদের যুদ্ধ হয়। এরপর ওভাবে আর কারও সঙ্গে হয়নি। তার নামের মানে অবশ্য কয়েক রকম হয়, কোন জায়গায় কি অনুবাদ করা হবে তার ওপর নির্ভর করে। এই যেমন কোথাও বলতে গেলে হয় বজ্ৰময় মেঘ, আবার। কোথাও বৃষ্টির শব্দ।

এই? হতাশ মনে হল গোয়েন্দাপ্রধানকে। জ্যান্সার কোনও বিশেষ জায়গা। ছিল? কোনও বিশেষ ঘটনা, কিংবা কোনও বিশেষ বন্ধু, যার সঙ্গে কিছুটা মিল পাওয়া যায়?

 কি বলতে চাও বুঝলাম না, কিং বলল। জ্যাঙ্গা হল নানদার একটা কিংবদন্তী। অসংখ্য গল্পগাথা আছে তার সম্পর্কে। হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে পরিচয়। বিশেষ কিছু খুঁজে বের করতে হলে কয়েক মাস লেগে যাবে।

অত সময় নেই আমাদের হাতে, হ্যারি বলল,। মাস তো দূরের কথা। কয়েকটা দিনও নেই।

নাহ, কোনও পথ দেখছি না, হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করল রবিন।

পথ তো একটা নিশ্চয় আছে, এত সহজে হাল ছাড়ে না গোয়েন্দাপ্রধান। পিটার তখন মরিয়া। সুতরাং ভালমত চেনে ওরকম একটা সংগঠনের সাহায্য নিয়েছিল। ভাবতেই যেটা প্রথমে তার মনে এসেছে। কিং, জ্যাঙ্গার সঙ্গে সম্পর্ক আছে এরকম জরুরী জায়গা, ঘটনা, যুদ্ধের কথা বলতে পারেন? এমন কিছু, নানদার বেশির ভাগ লোকই যেটা জানে।

চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবল কিং। কোনটা বলবে সেটাই ভাবছে বোধহয়। অবশেষে বলল, ইমবালায় ইংরেজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াইয়ে জিতেছিলেন একবার। শেষবার পরাজিত হয়েছিলেন জিয়ালায়। লর্ড ফাউড নামে একজন জেনারেলকে পরাজিত করেছিলেন তিনি, আবার তাঁকে পরাজিত করেছিল আরেকজন জেনারেল, জেনারেল অডলি।

 তাড়াতাড়ি পকেট থেকে নোটবুক বের করে সব লিখে নিতে লাগল রবিন।

জাঙ্গার রাজধানী ছিল উলাগায়, হ্যারি বলল। পরাজিত হওয়ার পর তাকে গিয়ে ফোর্ট জর্জের জেলখানায় বন্দি করল ইংরেজরা।

হ্যারির কথা কেড়ে নিয়ে যেন বলল কিং, সেখান থেকে পালালেন জ্যাঙ্গা। আবার লড়াই শুরু করলেন। হেডকোয়ার্টার করলেন কারগা ভ্যালির দুর্গম এক জায়গায়।

তারপর, উপসংহার টানল হ্যারি। স্মিথস ফোর্ড নামে একগায়ের কাছে লড়াইয়ে অবশেষে মৃত্যুবরণ করলেন।

 মাথা ঝাঁকাল কিশোর। তাঁর নামের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সমস্ত নাম এখন জোগাড় করতে হবে আমাদের। তার পর…

জোরে থাবা পড়ল দরজায়। ঝট করে একসঙ্গে সব কটা মাথা ঘুরে গেল সেদিকে। চেঁচিয়ে ডাকল একটা নারীকণ্ঠ, মিস্টার কিং! মিস্টার ম্যাকঅ্যাডাম! আছেন ওখানে?

দরজার কাছে এগিয়ে গেল কিং। বলতে বলতে গেল, ও মিস ডলি জেসাপ। ট্রেড মিশন থেকে এসেছে। স্যার মনটেরোর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রক্ষা.. করছে সে।

হয়ত পিটারের খোঁজ পেয়েছেন স্যার মনটেরো, আন্দাজ করল হ্যারি। ।

দরজা খুলল কিং। লম্বা, কালো চুলওয়ালা এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে নেভি সোয়েটার। পরনে ধূসর স্ল্যাকস। তাড়াহুড়ো করে এসে ঘরে ঢুকল।

ওকে পেয়েছেন? জিজ্ঞেস করল ডলি। ফোন করতে মানা করলেন। খবর দিই কি করে। স্যার মনটেরোর কাছ থেকে গোপন মেসেজ এসেছে… হঠাৎ ছেলেদের ওপর চোখ পড়তেই থেমে গেল সে। সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল ওদের। দিকে।

আমি বুঝিনি আপনারা একা নন, কিংকে বলল সে।

পিটারের সম্পর্কে কিছু? জিজ্ঞেস করল কিং।

তার খবর পাওয়া গেছে? হ্যারির প্রশ্ন।

না, ওসব নয়। অফিসিয়াল মেসেজ।

হুঁ, মাথা ঝাঁকাল কিং। ছেলেদের দিকে ফিরে বলল, অল রাইট, বয়েজ, তোমরা তোমাদের তদন্ত চালিয়ে যাও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পিটারকে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। কোনও খবর পেলেই সঙ্গে সঙ্গে এখানে জানাবে। আমাদেরকে।

 বেরিয়ে যেতে ইঙ্গিত করা হচ্ছে ওদেরকে, বুঝতে পারল ছেলেরা। বেরিয়ে এল হোটেলের কামরা থেকে। নিচে নেমে বাস স্টপের দিকে রওনা হলো।

রবিন জিজ্ঞেস করল, কোত্থেকে শুরু করব, কিশোর?

জ্যাঙ্গা। টেলিফোন বুক, ডিরেকটরি, ম্যাপ, রেফারেন্স বুক, মোটকথা যত জায়গায় ওই নামের সম্পর্ক থাকতে পারে মনে হবে সবখানে খুঁজব। ভাগাভাগি হয়ে খুঁজতে বেরোব আমরা। ম্যাপ খুঁজতে মুসা চলে যাও সিটি হলে। রবিন। লাইব্রেরিতে। সিটি ডিরেকটরি আর টেলিফোন বুক খুঁজবে। আমি যাব হিসটরিক্যাল সোসাইটিতে।

খিদে পেয়েছে, লজ্জিত হাসি হাসল মুসা। বাড়ি থেকে আগে লাঞ্চটা সেরে আসি?

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। নাহ, তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল। একটা স্ন্যাকসে ঢুকে কিছু খেয়ে নাও। তারপর চলে যাও কাজে। বিকেলের পরে হেডকোয়ার্টারে দেখা হবে।

বাস এল। তাতে চড়ল ওরা। নোট বুক বের করে যেসব জায়গায় গিয়ে লড়াই করেছেন জ্যাঙ্গা, সেগুলোর তিনটে লিস্ট করে একেকজনের হাতে একেকটা। দিল রবিন। তারপর বিশেষ বিশেষ জায়গায় নেমে আলাদা হয়ে গেল তিনজনে।

.

সাড়ে তিনটেয় হিসটরিক্যাল সোসাইটি থেকে বেরিয়ে ইয়ার্ডে ফিরে চলল কিশোর। তেমন কিছুই পায়নি সে। হেডকোয়ার্টারে ঢুকে দেখল রবিন কিংবা মুসা। ফেরেনি। চুপচাপ বসে থাকতে ভাল লাগে না। ইমারজেন্সি সিগন্যালগুলো নিয়ে। বসল সে। নতুন ব্যাটারি ভরল। ফাইন টিউনিং করল। তখনও ফিরল না দুই সহকারী। শেষে ট্রেলারে ঢুকে জ্যাঙ্গার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বসল কিশোর।

জবাব একটা নিশ্চয় আছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, জ্যাঙ্গা যেসব জায়গায় গিয়েছেন। ওগুলোর নামের মধ্যেই রয়েছে সূত্র। আর সেটা বের করতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি পিটারকে।

 রবিন আর মুসা যখন এল, তখন পাঁচটা প্রায় বাজে। ওদের গম্ভীর মুখ দেখেই যা বোঝার বুঝে নিল কিশোর।

কিছু না, জোরে নিঃশ্বাস ফেলে হাত নেড়ে বসে পড়ল রবিন।

নামগুলো সব আফ্রিকান, কিশোর, মুসা বলল হতাশ কণ্ঠে। রকি বীচে ওরকম নামের কিছু নেই।

আসলে সব জায়গায় চেষ্টা করিনি আমরা, নিরাশ মনে হলো না। গোয়েন্দাপ্রধানকে। খাওয়ার পর লাইব্রেরিতে গিয়ে জ্যাঙ্গা খুঁজব। আরও কোনও ইমপরট্যান্ট জায়গায় গিয়ে থাকতে পারেন যেটার কথা আমাদেরকে বলতে ভুলে গেছে কিং আর হ্যারি।

বাড়িতে কাজ আছে আমার, রবিন বলল। মাকে কথা দিয়ে এসেছি। তার সঙ্গে এক জায়গায় যেতে হবে।

আমারও আছে, মুসা জানাল।

আমার নেই, কিশোর বলল। আমি একাই যেতে পারব। বই ঘাঁটাটা এমন কোনও কঠিন কাজ না।.

কিশোর, মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি। মনে হয়… মনে হয় ভুল পথে খুঁজছি আমরা।

আমারও তাই মনে হচ্ছে, রবিন বলল।

কি জানি! গাল চুলকাল কিশোর। তার বিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে দিয়েছে মনে হয় দুই সহকারী। কিন্তু আমার বিশ্বাস, পিটার যা বলার বলে দিয়েছে। ওই মেসেজে জানিয়ে দিয়েছে কোথায় আছে সে।

.

১০.

পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বসে শুধু খাবার খুঁটতে লাগল কিশোর। অন্যমনস্ক। রুচি নেই যেন।

কি রে? ব্যাপারটা নজর এড়াল না মেরিচাচীর। অসুখ নাকি?

নাহ! প্লেটের দিকে চোখ ফেরাল কিশোর। আগের রাতে ঘুম ভাল হয়নি। সকালেও তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে। তার আগে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মনে হয়েছে, বোধহয় মুসার কথাই ঠিক। লাইব্রেরিতে নানদার ওপর একটা বই পেয়ে নিয়ে এসেছে। হেডকোয়ার্টারে বসে বসে অনেক রাত পর্যন্ত পড়েছে। পিটারকে খুঁজে বের করতে কাজে লাগে এমন কিছুই চোখে পড়েনি।

আরে কি হলো? খাচ্ছিস না কেন? ডিম নে, মেরিচাচী তাগাদা দিলেন। নাকি পেটে…

ঠিক আছে, দাও একটা, প্লেট বাড়িয়ে দিল কিশোর। কিশোরের এই উদাসীনতা রাশেদ পাশারও নজরে পড়েছে। আড়চোখে তাকালেন তিনি, কিছু বললেন না।

ভাবছে কিশোর। পিটার তার সূত্র ঠিকমতই দিয়েছে। বোঝার জন্যেই। কিন্তু কিশোর বুঝতে পারছে না। কিছু একটা মিস করছে। নাস্তা শেষ হলো। নতুন। কিছুই বের করতে পারল না ততক্ষণেও সে।

এই সময় বাজল টেলিফোন। মুখও তুলল না সে। সমস্যা তার ভাল লাগে। সেগুলোর সমাধান করতে…

কিশোর, ডেকে বললেন মেরিচাচী। রবিন।

নিরাসক্ত ভঙ্গিতে উঠে গিয়ে রিসিভার কানে ঠেকাল কিশোর। বলো।

কিশোর, পেয়ে তো গেলে! আমাদেরকে ফোন করলে না কেন?

কি বললে? চোখ মিটমিট করছে কিশোর। কি পেয়ে গেলাম?

কেন, জবাব। পিটার কোথায় লুকিয়েছে?

মজা করছ তো। করো। ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর। সকালে এমনিতেই মেজাজ ভাল নেই আমার। হ্যারি আর কিঙের কাছে গিয়ে আলোচনা। করব ভাবছি। হয়ত…

তার মানে পাওনি? রবিন অবাক।

পাইনি? কি পাইনি?

 লাইব্রেরি থেকে যে বইটা নিয়েছ তাতে?

 কি বলছ তুমি? নতুন কিছু তো দেখলাম না। আগাগোড়া পড়েছি।

 তাহলে মিস করেছ। চলে এস। আমরা হেডকোয়ার্টারে বসে আছি। রবিন, কী…? কিন্তু লাইন কেটে দিয়েছে রবিন। গেলাসের দুধটুকু না খেলে উঠতে দেবেন। মেরিচাচী। মাঝে মাঝে এটা অত্যাচার মনে হয় কিশোরের। এখন আবার একটা নতুন অত্যাচার যোগ হয়েছে, কিডন্যাপিঙের পরে, বাইরে বেরোতে গেলেই খালি সতর্ক করেন। দুই ঢোকে দুধটুকু শেষ করে ছুটে বেরোল রান্নাঘর থেকে। হেডকোয়ার্টারে এসে ঢুকল।

গোয়েন্দাকে সব সময় চোখকান সজাগ রাখতে হয়, গম্ভীর হওয়ার ভান করতে গিয়ে হেসে ফেলল মুসা।

টিটকারি রাখ তো এখন…

বাধা দিয়ে রবিন জিজ্ঞেস করল, সত্যি বলছ কিছু পাওনি?

 থাকলে তো পাব, বিড়বিড় করল কিশোর।

রবিন, বলেই দাও ওকে, মুসা বলল।

বেশ, শুরু করল রবিন। আমরা ঢুকে দেখি তুমি নেই। টেবিলে বইটা দেখতে পেল মুসা। টেনে নিলাম। চীফ জ্যাঙ্গার ওপর লেখা চ্যাপ্টারটাতেই পেলাম। ওটা।

কি পেলে? অত ভণিতা করছ কেন? জলদি বলো!

বইটা তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাল রবিন। পড়তে আরম্ভ করল, নানদা সর্দার জ্যাঙ্গার আশা বেড়ে গেল যখন ইমবালা, অর্থাৎ দা হিল অভ দা রেড লায়নে ইংরেজ বাহিনীকে পরাজিত করলেন। কারণ তিনি বুঝতে পারলেন অন্তত তিনটে বছরের জন্যে ঠেকিয়ে দিতে পেরেছেন ইউরোপিয়ানদের। এটুকু পড়েই থেমে গেল সে। কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসল।

মুসাও হাসল।

 হাঁ করে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। বুঝতে পারছে না। তো? কি পেলে? ইমবালার কথা তো আমরা…

কিশোর, অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়ল রবিন। এখনও বুঝতে পারলে না? তোমার হয়েছে কি? দা হিল অভ দা রেড লায়ন! ইমবালার ইংরেজি মানে, লাল সিংহের পাহাড়। মনে পড়ছে না? এখানেও আছে রেড লায়ন। দা রেড লায়ন র‍্যাঞ্চ। বিখ্যাত পুরনো হোটেলটা, যেখানে হলিউডের বড় বড় অভিনেতারা ছুটি কাটাতে আসে।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবে রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। তারপর ওপর দিকে মুখ তুলে হো হো করে হেসে উঠল। রবিনের পিঠ চাপড়ে দিতে দিতে বলল, রবিন, কাজই করেছ একটা! ঠিক বলেছ। দা রেড লায়ন র‍্যাঞ্চ। ছেলেকে নিয়ে নিশ্চয় ওখানে থেকেছেন স্যার মনটেরো। ইস, আমি একটা গাধা! লিখেই। দিয়েছে ইমবালার মানে, অথচ আমার চোখেই পড়ল না!

ভুল আমরা সবাই করে থাকি, ভারিক্কি চালে বলল মুসা।

হেসে ফেলল কিশোর। প্রতিশোধ নিচ্ছ, না? নাও। কিছু মনে করছি না। আমি। কাজ হয়েছে এতেই খুশি।

রবিনও হাসল।

হ্যারি আর কিংকে ফোন করা দরকার, কিশোর বলল।

কিন্তু কেউ ফোন ধরল না ওপাশ থেকে।

নাস্তা করতে গেছে হয়ত, রিসিভার রাখতে রাখতে বলল কিশোর। চল, গিয়ে ধরি। একসঙ্গেই নাহয় তখন র‍্যাঞ্চে যাওয়া যাবে।

তাহলে সাইকেল নেয়ার দরকার নেই, রবিন বলল। সাইকেলগুলো আবার কোথায় রাখব? বাসে চলে যাই। তারপর ওদের সঙ্গে গাড়িতে।

গুড আইডিয়া, মুসাও একমত।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। দ্রুত বেরিয়ে পড়ল হেডকোয়ার্টার থেকে। বিশ মিনিট পরে একটা বাস ওদেরকে নামিয়ে দিল মিরামার হোটেলের সামনে। কিরে ঘরে ফোন করল ক্লার্ক। আছে। ছেলেদেরকে পাঠিয়ে দিতে বলল কিং।

ঘরে ঢুকে কিশোর জিজ্ঞেস করল, কিছু শুনেছেন আর?

না, জবাব দিল কিং। নানদায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে আসছে। পিটারকে খুঁজে বের করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন স্যার মনটেরো, আমাদের নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন।

আমরা বোধহয় এবার সাহায্য করতে পারব আপনাদের। বই পড়ে যা আবিষ্কার করেছে সেটা খুলে বলল কিশোর।

দা হিল অভ দা রেড লায়ন! নিশ্চয়! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল হ্যারি। মনে হয়,  ঠিকই আন্দাজ করেছ তোমরা।

বলেছিলাম না, তার দিকে তাকিয়ে তিন গোয়েন্দার প্রশংসা করে বলল কিং। ছেলেগুলো চালাক। জলদি চল। গাড়ি বের করতে হবে।

পার্কিং লটে এসে বিশাল ক্যাডিলাক গাড়িটায় চড়ে বসল সবাই। ড্রাইভ করতে বসল কিং। তাকে পথ বাতলে দিতে লাগল রবিন। শহরের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ের পাদদেশে চলে এল ওরা। রেড লায়ন র‍্যাঞ্চের দোতলা বাড়িটা রাস্তা থেকেই চোখে পড়ে। ওটার দুপাশে ছড়িয়ে রয়েছে কয়েক গুচ্ছ হলদে রঙ করা। কাঠের বাড়ি আর কিছু শাদা রঙের কটেজ। পুরো অঞ্চলটাই ঘিরে দেয়া হয়েছে অলিণ্ডার আর হিবিসকাসের উঁচু বেড়া দিয়ে। গাড়ি পার্ক করে রেখে প্রধান। বাড়িটার দিকে এগোল ওরা।

রেজিস্ট্রেশন ডেস্কে বসে আছে, ধোপদুরস্ত কালো স্যুট পরা ক্লার্ক। মুখ তুলে তাকিয়ে মোলায়েম হাসি হাসল। হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেল হাসিটা। চিৎকার করে উঠল,  মিস্টার টিনটন!

ডেস্কের পেছনের দরজাটা খুলে গেল। বেরিয়ে এল একজন খাট, হালকাঁপাতলী লোক। গায়ে চেককাটা জ্যাকেট, পরনে ঢোলা পাজামা। কিশোরের দিকে তাকাল জ্বলন্ত দৃষ্টিতে। আবার এসেছ তাহলে! এবার বিল আদায় করেই ছাড়ব!

তারমানে পিটার মনটেরো এসেছিল! প্রায় চেঁচিয়েই উঠেছিল কিশোর, সময় মত সামলে নিল।

আপনি ম্যানেজার? খাটো লোকটাকে জিজ্ঞেস করল কিং।

হ্যাঁ, আমি ম্যানেজার, কর্কশ জবাব দিল লোকটা। কিশোরের দিক থেকে চোখ সরাচ্ছে না। ইয়াং ম্যান, এখুনি বিল মিটিয়ে না দিলে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব আমি।

তার দরকার হবে না, শান্তকণ্ঠে বলল, হ্যারি। টাকাটা আমরা দিয়ে দেব। একে পিটার ভাবছেন তো? ও পিটার নয়। ওই

নয়? সন্দেহ দেখা দিল ম্যানেজারের চোখে। তাহলে…

দেখতে পিটারের মতই, বুঝিয়ে দিল কিং। তবে পিটার নয়। চেহারা অনেকটা এক রকম।

কেন, খবরের কাগজে আমার ছবি দেখেননি? কিশোর জিজ্ঞেস করল। তাহলে তো এই ভুল করার কথা নয়

মাথা নাড়ল ম্যানেজার। সাংঘাতিক ব্যস্ত আমরা। বিশেষ করে এই হপ্তায়। কয়েকজন মেহমান এসেছে। তাদেরকে সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছি। পেপার দেখব। কখন। কিশোরের দিকে তাকিয়েই রয়েছে সে। তার কুঁচকানো কমদামী পোশাক দেখছে। পিটারকে অবশ্য এত বাজে পোশাকে এত অগোছালো অবস্থায় দেখিনি। কিন্তু তুমি যদি পিটারই না হও, তাহলে ওরা তোমার বিল দিতে চাইছে কেন?

আমি আর মিস্টার ম্যাকঅ্যাডাম, হ্যারিকে দেখাল কিং। স্যার মনটেরোর প্রতিনিধি। এই যে আমাদের আইডেনটিটি। লস অ্যাঞ্জেলেসে নানদার ট্রেড মিশন আছে, ইচ্ছে হলে আমাদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে পারেন ওখানে। এখন বলুন, পিটারের কাছে কত পান। দিয়ে দিচ্ছি।

একটা বিল বের করে দিল ক্লার্ক। টাকা মিটিয়ে দিল হ্যারি ইতিমধ্যে দুজনের আইডেনটিটি চেক করল ম্যানেজার। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, কেমন যেন দ্বিধায় ফেলে দেয়।

বুঝতে পারছি কেন এমন লাগছে আপনার, কিং বলল। আরেকটু খোলাসা করে বললেই আর দ্বিধা থাকত না। কিন্তু সেটা করতে পারছি না। অনেক জরুরী। কাজ পড়ে আছে আমাদের। পিটার এখানে না থাকলে কোথায় আছে খুঁজে বের করতে হবে। ও এখানে আসার পর থেকে কি কি ঘটেছে দয়া করে বলবেন কি?

 দ্বিধা করতে লাগল ম্যানেজার। তারপর মাথা ঝাঁকাল। ঠিক আছে, বলছি। হপ্তাখানেক আগে এসেছিল সে। এর আগেও এসেছিল তার বাবার সঙ্গে। কাজেই চিনতে পেরেছিলাম। এসে বলল কয়েক দিনের মধ্যেই তার বাবা আসবেন, তার সঙ্গে দেখা করবে। বিশ্বাস করলাম। জায়গা দিলাম তাকে। দুদিন পরে দুজন, লোক এসে বলল স্যার মনটেরোর কাছ থেকে এসেছে। পিটারের রুম নম্বর চাইল ওরা। কেউ এসে বললেই বোর্ডারদের নামধাম বলে দিই না আমরা। ওদের পরিচয়। জানতে চাইলাম। তারপর পিটারকে ফোন করলাম। লোকগুলোকে ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলল সে।

লোকগুলো দেখতে কেমন ছিল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ততটা ভাল মনে নেই, ম্যানেজার বলল। চারদিন আগে এসেছিল ওরা। একজন বেশ গাট্টাগোট্টা, কোকড়া বাদামী চুল। আরেকজন লম্বা, পাতলা, কালো চুল। ওদের নাম মনে করতে পারছি না।

কিশোরের দিকে তাকাল হ্যারি আর.কিং। মাথা ঝাঁকাল সে। চেহারার বর্ণনায় লোকগুলোকে দুই কিডন্যাপারের মতই লাগল ওদের।

ওরা চলে যাওয়ার পর কি হলো? জিজ্ঞেস করল কিং।

অদ্ভুত কাণ্ডই করেছে, তখন অবশ্য সে রকম মনে হয়নি। লোকগুলো ওপরে যাওয়ার একটু পরেই দেখলাম মেইন গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। মিনিট পাঁচেক পরেই লোকগুলো তাড়াহুড়ো করে নেমে এসে বেরিয়ে গেল।

পিটারকে আর দেখেননি? হ্যারি জানতে চাইল।

না। আর আসেনি। বিলের টাকাও দিয়ে যায়নি।

আবার হারালাম, তিক্তকণ্ঠে বলল হ্যারি।

আমরা ভেবেছিলাম পাবই, নিরাশ হয়েছে রবিনও।

চিন্তিত লাগছে কিশোরকে। ওর ঘরটা দেখতে পারি?

কী বক্সের দিকে তাকাল ম্যানেজার। খালিই আছে। হাত বাড়িয়ে চাবিটা তুলে আনল। ঊনত্রিশ নম্বর ঘর। দোতলায়। সামনের দিকে। ডানের এলিভেটর দিয়ে উঠতে পার। কিংবা এলিভেটরের পাশের সিঁড়ি দিয়ে।

এলিভেটরের দিকে এগোতে এগোতে মাথা নাড়ল কিং, যেন বিশেষ ভরসা। করতে পারছে না। কিশোর, ওর ঘর দেখে কি হবে? ওখানে তো নেই। একটা আশাই করতে পারি এখন শুধু, আবার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।

লোকগুলোকে সন্দেহ করেছিল, বোঝাই যায়, জবাব দিল কিশোর। এলিভেটরে ঢুকে পড়েছে। বোতাম টিপে দিয়ে বলল, তা না হলে ওভাবে হোটেল থেকে পালাত না। নিশ্চয় লোকগুলোকে চিনতে পেরেছিল, শত্রু হিসেবে। দেখেই আবার পালিয়েছে। লোকগুলো হয়ত তখনও তার ঘরেই ঢোকেনি।

তাতে আমাদের কি লাভ? হ্যারির প্রশ্ন।

সে আশা করছিল, তার মেসেজ পেয়ে স্যার মনটেরো ছুটে আসবেন হোটেলে। পালানোর আগে নিশ্চয় আবার ভেবেছিল সে কোথায় যাচ্ছে তার একটা নির্দেশ রেখে যাওয়া দরকার। কোনও একটা মেসেজ। কিংবা কোনও সূত্র।

এলিভেটর থেকে বেরিয়ে এল ও। রওনা হলো পিটারের ঘরের দিকে। সকলের মনেই আশা, ছোট্ট একটা মেসেজ অন্তত রেখে যাবে পিটার।

১১.

ঘরে পা দিয়েই গুঙিয়ে উঠল মুসা, কিশোর, সব সাফ করে ফেলা হয়েছে।

আনমনে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। তাকাল বিশাল ঘরটায়। জানালা দিয়ে রোদ আসছে। সেটা দিয়ে হোটেলের সামনের দিকের ড্রাইভওয়ে আর ট্যাক্সি পার্ক করার জায়গা দেখা যায়। তারপরেও বহুদূরে দৃষ্টি চলে যায়, একেবারে নীল প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত।

কিছু রেখে গেলেও আর পাওয়া যাবে না সেটা, রবিন বলল।

ঠিকই বলেছ, একমত হলো কিং। কিশোর, লাভ হবে না। নোটফোট কিছু রেখে গেলে নিশ্চয় ঝাড় দিয়ে ফেলে দিয়েছে ঝাড়ুদার।

হয়ত, স্বীকার করল কিশোর। তার পরেও কথা আছে। ঝাড়ুদাররা ঠিকমত ঝাড়ু দেয় না অনেক সময়। তাছাড়া আমার মনে হয় না এত সাধারণ কিছু রেখে গেছে পিটার যেটা সহজেই ফেলে দেয়া যায়। সহজে চোখে পড়ে এমন কিছু রেখে। গেছে বলেও মনে হয় না। কারণ সে জানে কিডন্যাপাররা খুঁজতে পারে। তাহলে ওরা দেখে ফেলবে। না, অত সহজ কিছু রেখে যায়নি সে। সাংকেতিক কিছু রেখে। গেছে। এমন কিছু যা স্যার মনটেরোর বন্ধুরা চিনতে পারবে, শত্রুরা নয়। কাগজের ওপরও লিখে রেখে যেতে পারে, কিংবা অন্য কিছুতে।

তুমি বলতে চাইছ, রবিন বলল। খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে এমন কিছু করেছে, যা ঘর থেকে সরানো যাবে না। কিডন্যাপারদের নজরে পড়বে না। অথচ তার বন্ধুদের চোখে ঠিকই পড়বে।

হ্যাঁ, সে রকমই কিছু।

এসো, তাহলে বের করে ফেলি, কিং বলল।

বাথরুমে খুঁজতে চলে গেল মুসা। অন্যেরা রইল শোবার ঘরেই। ওপরে নিচে, জিনিসপত্র যা আছে সব সরিয়ে, ছবির পেছনে, পর্দার আড়ালে, কার্পেটের নিচে, সব জায়গায় দেখা হতে লাগল। রেডিয়েটরের নিচে আর ছাতের আলোর শেড দেখা হলো। গদির কাভার সরিয়ে দেখল কিশোর, পিটার কিছু লিখে রেখে গেছে কিনা। কিছুই পাওয়া গেল না। এমন কিচ্ছু দেখা গেল না যেটাকে মেসেজ কিংবা সূত্র মনে হয়।

বেশি সহজ জায়গায় খোঁজাখুঁজি করছি আমরা, কিশোর বলল অবেশেষে। প্রথম মেসেজটাতে ডাবল কোড ব্যবহার করেছিল পিটার। জ্যাঙ্গাস প্রেস বলে বুঝিয়েছে ইমবালা। এবং ইমবালা বলে লাল সিংহের পাহাড় বোঝাতে চেয়েছে সে। এখানেও সে রকম কিছু করে রেখে যেতে পারে।

এবং সেটার সমাধান করতে পারবে, যোগ করল রবিন। ও ব্যাপারে বিশেষ জ্ঞান আছে শুধু যাদের, তারাই।

রাইট। তার মানে পিটারকে খুঁজে বের করতে হলে কিছু বিশেষ ব্যাপারে জ্ঞান থাকতেই হবে। সেটার ওপরই নির্ভর করছে সব। কিং, পিটারের কি কোনও বিশেষ স্বভাব ছিল? কোনও কিছুতে আগ্রহ? উদ্ভট কোনও আচরণ?

নানদার ইতিহাসের ওপর তার অসম্ভব আগ্রহ ছিল, হ্যারি জানাল।

কাঠের ওপর খোদাই করা আফ্রিকান শিল্পও সংগ্রহ করত সে, কিং বলল। ছোট ছোট স্কেচ করতে পছন্দ করত। বিশেষ করে দেয়ালে। স্যার মনটেরো একবার রাগ করে বলেছিলেন তাঁর অফিসের দেয়ালে পর্যন্ত আঁকাআঁকি করেছে। পিটার।

 ঠিক! তুড়ি বাজাল কিশোর। দেয়ালে স্কেচ আঁকলে সহজে সেটা মোছা। যাবে না, নতুন করে রঙ না করলে। আর কোনও হোটেলের ঘরেই অত তাড়াতাড়ি রঙ করা হয় না। এটাই খুঁজতে হবে আমাদের। এই, খোঁজো খোঁজো সবাই।

কিন্তু এবারেও কিছু পাওয়া গেল না। দেয়ালে কোনও স্কেচ নেই। এমনকি আসবাবপত্রেও নেই কিছু, কোনও চিহ্নও নয়। কিছুই আকেনি।

কিশোর, কিছুই নেই এখানে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল মুসা। আমার বিশ্বাস, কিডন্যাপারদের দেখার পর এখানে কিছু করার সময়ই পায়নি পিটার।

চরকির মত পাক খেয়ে মুসার দিকে ঘুরল কিশোর। ঠিক, ঠিক বলেছ, মুসা! এটাই জবাব!

মানে? মুসা অবাক। কি এমন বললাম?

পিটার খুব চালাক ছেলে, ধীরে ধীরে বলল কিশোর। অথচ ম্যানেজারকে বলল লোকগুলোকে পাঠিয়ে দিতে, বাইরের লোক সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকা সত্ত্বেও। সে তখন পালিয়ে রয়েছে। লোকগুলো শত্রু না বন্ধু জানে না। কিন্তু তবু ম্যানেজারকে বলল পাঠাতে। আমরা হলে বলতাম কি?

না, জবাব দিল রবিন। ম্যানেজারকে বলতাম ওদেরকে আটকাতে। যাতে লুকিয়ে ওদের চেহারা একবার দেখতে পারি।  

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। নিশ্চয়। পিটারও দেখেছিল। জানালা দিয়ে। তবে, সেটা কাকতালীয় ভাবেই। সে তখন জানালার কাছে দাঁড়িয়েছিল হয়ত। যাই হোক, লোকগুলোকে আটকাতে বলেনি ম্যানেজারকে। প্রয়োজন মনে করেনি। ওদেরকে বুঝতে দিতে চায়নি যে একটা প্ল্যান সে ইতিমধ্যেই করে বসে আছে।

প্ল্যান? ভুরু কোঁচকাল রবিন, কি প্ল্যান?

সব চেয়ে সহজ প্ল্যান, ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়া। এমন কোথাও যেখান থেকে লোকগুলোর ওপর চোখ রাখতে পারে। লোকগুলো শত্ৰু এটা বোঝর সঙ্গে সঙ্গে যাতে পালাতে পারে ওখান থেকে। এসো।

কিশোরকে অনুসরণ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সবাই।

বেরোনোর পথের কাছেই কোথাও হবে, নিজেকেই যেন বোঝাচ্ছে কিশোর। যেখান থেকে লোকগুলোর ওপর নজর রেখেছে সে। এমন কোথাও… হলওয়েতে নজর বোলাচ্ছে সে। ওই আলমারিটার মত কোনও জায়গা।

লম্বা, সরু একটা দেয়াল আলমারি। সিঁড়ি থেকে কয়েক ফুট দূরে। পর্দা আর বিছানার চাদরটাদরগুলো বোধহয় রাখা হয় ওখানে। ভেতরে ঢুকে দরজা সামান্য ফাঁক করে রাখলেই এলিভেটর আর সিঁড়ির ওপরের অংশ চোখে পড়বে। যে কেউ এসে পিটারের ঘরের দিকে যেতে চাইলে তাকে দেখা যাবেই ওখান থেকে।

পেন্সিলে আঁকা স্কেচ খোঁজ, নির্দেশ দিল কিশোর।

একবার তাকিয়েই দেখে ফেলল মুসা। আলমারির দরজার ভেতর দিকে। এই যে! খাইছে! দারুণ এঁকেছে তো! একটা গাড়ি। ভেতরে ড্রাইভারও আছে। পাশে ব্যাজের মত কি যেন আঁকা। ওপরেও আছে।

ভ্রূকুটি করল কিশোর। গাড়ি? গাড়ি একে কি বোঝাতে চেয়েছে?

সাধারণ গাড়ি নয়, কিশোর! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। দেখ, ড্রাইভারের মাথায় ক্যাপ আছে। আর হাতে একটা বাতির মত। তার মানে ট্যাক্সি!

কিং বলল, একটা ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড তো রয়েছেই হোটেলের সামনে।

সে বোঝাতে চেয়েছে, হ্যারি আন্দাজ করল। সব লোকের ওপরই নজর রেখেছিল সে। আর ট্যাক্সিতে করে পালানোর প্ল্যান করেছে।

বাইরের ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে একটা মাত্র ট্যাক্সি দেখা গেল। ম্যাগাজিন পড়ছে ড্রাইভার। ওকে জিজ্ঞেস করা হলো। না, চারদিন আগে কোনও কিশোরকে নিয়ে যায়নি সে এখান থেকে। তার আগেও নেয়নি, পরেও না।

কটা ট্যাক্সি আছে এখানে? হ্যারি জানতে চাইল।

অনেক, মিস্টার। তবে সবই আমাদের কোম্পানির। একটাই কোম্পানি।

তোমাদের মেইন গ্যারেজটা কোথায়? জিজ্ঞেস করল কিং।

বলে দিল ড্রাইভার। তার কথা মত ট্যাক্সি কোম্পানির সেন্ট্রাল গ্যারেজে চলে এল হ্যারি। বন্দরের কাছাকাছি। বিরাট এক কাঠের আড়তের পাশ দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। গ্যারেজের পেছন দিকে রয়েছে অফিস। সেখানে এসে, দিনের বেলা ডিউটি যে ম্যানেজারের তাকে পেল গোয়েন্দারা। কি চায়, বলল তাকে। একটা তালিকা দেখতে শুরু করল ম্যানেজার।

রেড লায়ন? চারদিন আগে? হ্যাঁ, সেদিন পাঁচজন ড্রাইভার ডিউটি দিয়েছে। ওখানে। দুজন এখন এখানেই আছে। রড আর হেগ। তাদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পার।

তার ট্যাক্সির ইঞ্জিন নিয়ে কাজ করছে হেগ। চারদিন আগে কোনও কিশোরকে কোথাও নিয়ে যায়নি সে।

রডকেও পাওয়া গেল। অলস ভঙ্গিতে বসে কফি খাচ্ছে। সে জানাল, হ্যাঁ, একটা ছেলেকে রেড লায়ন থেকে নিয়ে গিয়েছি। সরাসরি তাকাল কিশোরের দিকে। তোমাকেই তো। জিজ্ঞেস করছ কেন আবার? দুদিন পরই তোমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল, ঠিক না? পত্রিকায় বেরিয়েছে, দেখেছি। ব্যাপারটা কি বল তো!

বাধা দিয়ে কিশোর বলল, কিডন্যাপ করা হয়েছিল আমাকেই। তবে আপনি যাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সে আমি নই। ভাল করে তাকান তো আমার দিকে। দেখুন আলাদা করে চিনতে পারেন কি না।

ভাল করেই তাকাল লোকটা। ওই ছেলেটার মতই লাগছে। শুধু পোশাকের ব্যাপারটা আলাদা। সে অনেক বেশি ফিটফাট ছিল তোমার চেয়ে। তাহলে তুমি বলতে চাইছ তুমি সেই ছেলে নও?

কিশোর জবাব দেবার আগেই হ্যারি জিজ্ঞেস করল, ছেলেটাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিলেন মনে আছে?

নিশ্চয় আছে, মাথা ঝাঁকাল রড়। মনে আছে তার কারণ আজব আচরণ। করছিল ছেলেটা। মনে হচ্ছিল কিছু একটা ঘটাচ্ছে। হোটেল থেকে ছুটে বেরিয়ে এল। আমাকে বলল শহরের আরেক ধারে নিয়ে যেতে। নিয়ে চললাম। বার বার পেছনে তাকাতে লাগল সে। যেন ভূতে তাড়া করেছে। একবার মনে হলো, হোটেল থেকে কিছু চুরি করেনি তো? কিন্তু চোর মনে হলো না। তবে পালিয়েছে যে তাতে কোনও সন্দেহ ছিল না আমার। শেষে গাড়িটা…

কোথায় নিয়ে গিয়েছিলেন? অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়ল কিং।

বলছি বলছি। কেবলই পেছনে তাকাচ্ছিল। সারা শহর ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াল আমাকে। হঠাৎ থামতে বলল। কতগুলো গুদাম আর কারখানার মাঝখানে। আমার পাওনা মিটিয়ে দিয়ে নেমে গেল। দৌড় দিল গলি দিয়ে। টাকা বেশিই দিয়ে। ফেলেছিল আমাকে, ভাঙতি নেয়ার জন্যেও থামেনি। তারপর এল গাড়িটা, যেটার কথা বলছিলাম। আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। মনে হলো ছেলেটারই পিছু নিয়েছে।

কি গাড়ি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

সবুজ মার্সিডিজ। ভাল গাড়ি। ওরকম একটা গাড়ি পেলে আর কিছু চাইতাম, নাঃ..,

যেখানে নামিয়ে দিয়েছিলেন ছেলেটাকে, আমাদেরকে নিয়ে যেতে পারবেন সেখানে? ভাল পয়সা দেব, হ্যারি বলল।

পারব না কেন। নিশ্চয় পারব।

জায়গাটা গ্যারেজ থেকে বেশি দূরে না। শহরের একধারে কতগুলো গুদাম আর কারখানা বাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। নির্জন এলাকা। গুদামগুলোতে লোক আছে। বলে মনে হয় না। আর কারখানাও ছোট ছোট, টুকিটাকি জিনিস তৈরি হয়। বেশির ভাগই খালি অঞ্চল, বাড়িঘর কিছু নেই। দুটো বাড়ির মাঝের একটা গলি  দেখাল ড্রাইভার, ওদিক দিয়েই গেছে।

লোকটার ভাড়া মিটিয়ে দিল কিং। অনেক বেশিই দিল। মোড়ের কাছে ক্যাডিলাকটা রাখল হ্যারি।

এখানে আসতে গেল কেন? মুসার প্রশ্ন। নির্জন এলাকাটায় চোখ বোলাচ্ছে। ও কিডন্যাপারদের খসাতে চেয়েছে হয়ত, রবিনের অনুমান। নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিল ওরা তাকে অনুসরণ করছে।

তা হতে পারে, কিশোর বলল। লুকানোর আরেকটা জায়গা খুঁজছিল হয়ত। প্রচুর ঘোরপ্যাঁচ রয়েছে এমন কোথাও। চল, গলিটা দেখি। দেখা যাক আর সূত্র আছে কিনা।

সরু গলি। দুধারে ইটের দেয়াল। তিনটে দরজা দেখা গেল। সবগুলোতে বড় বড় তালা ঝোলানো। মরচে পড়া। বেশ কিছুদিন যে ভোলা হয়নি বোঝা যায়। গলির শেষ মাথায় চলে এল গোয়েন্দারা, বিশেষ কিছুই নজরে পড়ল না।

এবার? মুসা জিজ্ঞেস করল, এবার কি করব?

সামনে আরেকটা গলি। যেটাতে রয়েছে ওরা ওটারই মত দেখতে। দুপাশে গুদামঘর, ছোট ছোট কারখানা, আর প্রচুর শূন্য জায়গা, যেখানে স্তূপ করে রাখা হয়েছে জঞ্জাল। ওই গলির একমাথা দিয়ে আরেকটা রাস্তা চলে গেছে আড়াআড়ি, ইংরেজি টি অক্ষর তৈরি করে।

তিন দিকে যেতে পারে সে, হ্যারি বলল। যে কোনও তিনদিক। কোন পথে যে গেছে ঈশ্বরই জানে!

.

১২.

যেদিকেই যাক, কিশোর বলল। কোনও একটা দিকে তো গেছে। একবারে সব দিকেই যেতে পারে না।

কি বলতে চাও? রবিনের প্রশ্ন।

কিডন্যাপাররা তার পিছু লেগেছিল। সে সেটা জানত। বেশি দূর যাওয়ার উপায় ছিল না তার। সময়ই ছিল না। নিশ্চয় কোথাও লুকিয়ে পড়তে হয়েছে।

তা ঠিক, একমত হলো কিং। এখন আমাদের কাছেই কোথাও রয়েছে কিনা কে জানে!

ওগুলোর যে কোনও একটাতে লুকাতে পারে। কয়েকটা গুদামঘর দেখাল। কিশোর। কিন্তু এখানে থাকাটা নিরাপদ নয়। তাছাড়া খাবার দরকার। এখানে তা নেই। তার মানে এখানে লুকালেও কিছুক্ষণের জন্যে, সাময়িক। তারপর একটা মোটেল কিংবা রুমিং হাউস খুঁজে নিয়েছে। রাস্তায় থাকাও তার জন্যে নিরাপদ নয়।

তাহলে, হ্যারি প্রস্তাব দিল। ছড়িয়ে পড়ে খোঁজা শুরু করা দরকার আমাদের। ভাগ হয়ে তিনদিকে চলে যাই।

মুসা আর হ্যারি গেল ডানে। কিশোর আর কিং বায়ে। রবিন সামনের দিকে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আবার টি-এর মাথার কাছে মিলিত হবার সিদ্ধান্ত নিল।

সবার আগে ফিরে এল রবিন। সোজা এগিয়ে গিয়েছিল গলি ধরে। একটা মাঠের কিনারে গিয়ে শেষ হয়েছে পথটা।

 ধারেকাছে কোনও মোটেল কিংবা রুমিং হাউস চোখে পড়েনি। লাঞ্চটাইম হয়ে গেছে। খিদে পেয়েছে তার। অস্থির হয়ে অন্যদের ফেরার অপেক্ষা করতে লাগল সে।

তারপর এল কিশোর আর কিং।

কাছেই বড় রাস্তা, মোটর চলাচল করে, কিং জানাল। ওখান থেকে পাঁচ ব্লক দূরে একটা মোটেল আছে। সেখানে খোঁজ নিয়েছি। এক হপ্তার মধ্যে কোনও কিশোরকে ঘর ভাড়া দেয়নি ওরা। কিশোরকে চিনতে পেরেছে। খবরের কাগজে তার ছবি দেখেছিল।

বেশির ভাগই খালি জায়গা ওদিকে, কিশোর জানাল। মাঠ আর পতিত জমি।

অবশেষে ফিরে এল মুসা আর হ্যারি। ওরা অনেক দূর গিয়েছিল।

একটা মোটেল আর দুটো রুমিং হাউস পেয়েছি, মুসা বলল। কোনটাতেই কোনও কিশোর একা বাস করছে না।

পিটার যখন পালাচ্ছিল, তার পায়ে পায়ে লেগেছিল কিডন্যাপাররা, কিং বলল ধীরে ধীরে। সূত্র রেখে যাওয়ার সামান্যই সুযোগ পেয়েছে সে। আর আমরা তার মেসেজ পাব এমন আশাও নিশ্চয় করেনি। নাহ, কোনও উপায়ই দেখতে পাচ্ছি না।

হ্যাঁ, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল রবিন।

আপাতত সে রকমই লাগছে, ব্যর্থ হয়েছে, এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না কিশোর।

আমি আর হ্যারি হোটেলে ফিরে যাই, কিং বলল। দেখি লস অ্যাঞ্জেলেসে কোনও খবর পাঠিয়েছে কিনা পিটার। আমরা যে তাকে খুঁজছি, এটা বুঝতে পারছে সে। নিশানা হারিয়ে ফেলেছি এটা পারছে কিনা জানি না। তাকে সেটা কোনভাবে বোঝান দরকার। যাতে আরেকটা মেসেজ পাঠায়।

যদি সম্ভব হয় আরকি, তেমন আশা করতে পারছে না হ্যারি।

আমরা হেডকোয়ার্টারে ফিরে যাব, ভোতা গলায় বলল কিশোর। নতুন কোনও বুদ্ধি বের করার চেষ্টা করব। স্যালভিজ ইয়ার্ড এখান থেকে বেশি দূরে না। কিং, আপনি কি আমাদের নামিয়ে দিয়ে যাবেন?

আরিব্বাবা, এত্ত দেরি হয়ে গেছে। ঘড়ি দেখে প্রায় আঁতকে উঠল যেন মুসা। তাই তো বলি, পেটের ভেতর ছুঁচো দৌড়াদৌড়ি করে কেন?

তিন গোয়েন্দাকে বাড়ি পৌঁছে দিল কিং আর হ্যারি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হেডকোয়ার্টারে কিশোরের সঙ্গে দেখা করবে বলে চলে গেল মুসা ও রবিন।

কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যে পারল না। বাড়িতে কাজ পড়ে গিয়েছিল। আসতে আসতে দুই ঘণ্টা লেগে গেল দুজনেরই। হেডকোয়ার্টারে ঢুকে দেখে ডেস্কের ওপর।  রাজ্যের ম্যাপ ছড়িয়ে নিয়ে বসেছে গোয়েন্দাপ্রধান। স্ট্রীট ম্যাপ। অসংখ্য কাগজ ছড়ানো টেবিলে। স্কেচ করেছে, নানা রকম হিসেব করেছে ওগুলোতে কিশোর।

কিছু বুঝলে? ঢুকেই জিজ্ঞেস করল মুসা।

 নাহ, মাথা নাড়ল কিশোর। খুব একটা সুবিধে হচ্ছে না।

কিং ফোন করেছে?রবিন জিজ্ঞেস করল। ট্রেড মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল পিটার?

আমিই ফোন করেছিলাম হোটেলে, জবাব দিল কিশোর। না, কোনও খবর পাঠায়নি পিটার।

কিশোর, চিন্তিত ভঙ্গিতে মুসা বলল। বোধহয় ওকে ধরে ফেলেছে কিডন্যাপাররা। খবরের কাগজে তোমার ছবি দেখে ভুল বুঝতে পেরেছিল। তারপর খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলেছে আসল ছেলেটাকে।

সেকথাও ভেবেছি, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল কিশোর। ধরতে তো পারেই। তবে আমার তা মনে হয় না। তাহলে স্যার মনটেরোকে মেসেজ পাঠাত। আরেকটা ব্যাপার, আমাদের ওপর নজর রাখত না। তখন ঝোপে বসে রেখেছিল, মনে নেই?

ঢোক গিলল মুসা। তার মানে এখনও বসে আছে কোনখানে?

আমার তা-ই মনে হয়। হ্যারি আর কিঙের ওপরও নজর রাখছে ওরা। সাবধানে থাকতে হবে আমাদের। তবে পিটারকে যতক্ষণ খুঁজে বের করতে না পারছি ততক্ষণ আমরা নিরাপদ। কিছু করবে না আমাদেরকে।

আরেকটা কথা ভাবছ না কেন? রবিন বলল, কিশোরের কিডন্যাপিঙের খবর পিটারও তো পড়ে থাকতে পারে। এটাই তার সুযোগ, বেরিয়ে এসে পুলিশকে গিয়ে জানানো। জানাচ্ছে না কেন? পুলিশ তাকে সাহায্য করবে তখন। নিরাপদ জায়গায় রেখে দেবে।

তাই তো! মুসা বলল।

তাহলে ধরে নিতে হবে পেপার দেখেনি পিটার, কিশোর বলল। এমন কোথাও লুকিয়েছে যেখানে কাগজ নেই। বেরিয়ে আসতেও সাহস করছে না। সেই জায়গাটা যে কোথায় সেটা বুঝতে পারলেই হত!

এত ভাবনা চিন্তা করেও কিছু বের করতে পারলে না?

ভাবছি খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেব। সাংকেতিক ভাষায়, যাতে শুধু। পিটার বুঝতে পারে। হ্যারি আর কিঙের সঙ্গে কোথাও দেখা করতে বলব তাকে। কিন্তু সেই একই সমস্যা রয়ে যাবে এতেও। খবরের কাগজ দেখার সুবিধেই যদি না পায় সে?

না, হবে না, রবিন বলল।

তাহলে ভূত-থেকে-ভূতে ব্যবহার করে দেখতে পারি। রকি বীচের এত ছেলেমেয়ের মাঝে কেউ না কেউ দেখে থাকতে পারে কথায় অদ্ভুত টানওয়ালা একটা ছেলেকে।

তাতেও বিশেষ সুবিধে হবে বলে মনে হয় না, রবিন বলল। লুকিয়েই যদি থাকে, বেরোতে না পারে, কথা বলবে কিভাবে ছেলেদের সঙ্গে?

তাছাড়া, মুসা যোগ করল। তাকে তুমি মনে করে ভুল করতে পারে রকি বীচের ছেলেরা।

এটাই হলো সমস্যা, তিক্তকণ্ঠে বলল কিশোর। যাকগে, কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপর ভূত-থেকে-ভূতে ছাড়া উপায় নেই। এখন আরেকটু ভেবে দেখা যাক। পিটার নিশ্চয় এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে যারা তাকে খুঁজছে তারা তার চারদিন আগে রেখে আসা নিশানা হারিয়ে ফেলেছে। শেষ চিহ্নটা রেখে এসেছে রেড লায়ন র‍্যাঞ্চে। সুতরাং…

আবার সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করবে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

করবে। লুকিয়ে ঢোকার চেষ্টা করবে। সে জন্যে নজর রাখতে বলেছি হ্যারি। আর কিংকে। হয়ত এতক্ষণে ওখানে চলে গেছে ওরা। আর, আরেকটা কথা।

কী? জানতে চাইল রবিন।

মনের ভেতর একটা কথা কেবলই খচখচ করছে। আমাকে আবিষ্কার করল কিভাবে কিডন্যাপাররা? পিটার বলে, ভুলই বা করল কেন?

সহজ, সমাধান করে দিলে মুসা। তোমাকে ইয়ার্ডে দেখেছে ওরা।

 এখানে আসল পিটার না এসে থাকলে?

হয়ত রাস্তায় কিংবা বাজারে দেখেছে তোমাকে, রবিন বলল। তারপর পিছু নিয়ে চলে এসেছে।

হ্যাঁ, রবিনের সঙ্গে সুর মেলাল মুসা। এটা তো হতেই পারে। ব্যাপারটাকে কাকতালীয় ভেবেছে ওরা। তোমাকে হঠাৎ দেখে ফেলে নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করেছে।

যুক্তি আছে তোমাদের কথায়, ঠিক মেনে নিতে পারছে না কিশোর। তবু, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে জরুরী কিছু মিস করছি আমরা। নিশ্চয় ওই লোকগুলো এমন কিছু পেয়েছে, যা থেকে এখানে এসে খুঁজে বের করেছে আমাকে। রাস্তায় কিংবা বাজারে অ্যাক্সিডেন্টলি দেখে ফেলেনি।

সেটা কি, কিশোর?

জানি না।

নীরব হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা। ভাবছে। অনেক ভেবেও কিছু বের করতে পারল না। শেষে বাড়ি ফিরে গেল রবিন আর মুসা। দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ভাবতে ভাবতে এসে লিভিং রুমে ঢুকল কিশোর। টিভি দেখছেন রাশেদ। পাশা। সে-ও বসে পড়ল। একটা কাজ দিলেন তাকে রাশেদ পাশা। ইয়ার্ডের। অ্যাকাউন্ট বুকে কি একটা গোলমাল হয়েছে, হিসেবের, সেটা মিলিয়ে দিতে হবে। ডিনারের সময় হল। টেবিল সাজিয়ে ডাকতে এলেন মেরিচাচী।

বিরক্তিকর, নিরাশায় ভরা একটা দিন কেটেছে। কিন্তু খেতে বসে কিশোর দেখল, সাংঘাতিক খিদে পেয়েছে। বেশ খেতে পারছে। এক প্লেট শেষ করে আবার বাড়িয়ে দিয়ে হাসল, তোমার গরুর কাবাবটা খুব ভাল হয়েছে, চাচী।

অবাক হলেন মেরিচাচী। তোর কি হয়েছে আজ, বল তো কিশোর? এভাবে তো খেতে চাস না কখনও! আজ আমার ফ্রিজটাই খালি করে দিয়েছিস!

কিশোরও অবাক। আমি খেয়েছি! ছিলামই তো না সারাদিন, খেলাম কখন?

ওই যতক্ষণই ছিলি। খেয়েছিস ভাল করেছিস। আমিও তো চাই তুই খা…

কিশোরের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন মমরিচাচী। গোল গোল হয়ে গেছে। তার চোখ। হা হয়ে গেছে মুখ। চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি।

এই কিশোর, কি হলো? ভুরু কুঁচকে ফেলেছেন রাশেদ পাশী। শরীর খারাপ হয়ে গেল নাকি?

না..না..চাচা, আমি ভাল আছি…এত ভাল অনেকদিন থাকিনি! লাফিয়ে। উঠে দাঁড়াল কিশোর। আসছি!

আরে খেয়ে যা না! ঠেকাতে গেলেন মেরিচাচী।

 রওনা হয়ে গেছে ততক্ষণে কিশোর। মিনিটখানেকের বেশি লাগবে না।

দ্রুত এসে লিভিং রুমে ঢুকল সে। রবিনকে ফোন করল। নথি? জলদি মুসাকে নিয়ে হেডকোয়ার্টারে চলে এস। মাকে বলে আসবে সারারাত বাড়ি ফিরবে না। আমাদের সঙ্গে থাকবে।

 রবিনকে কোনও প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিল কিশোর। ফিরে এল রান্নাঘরে, খাবার টেবিলে। এত উত্তেজিত হয়ে গেছে, খিদেই নষ্ট হয়ে। গেছে। মেরিচাচীর বিখ্যাত অ্যাপল পাইয়ের টুকরো দুটোর বেশি খেতে পারল না। আর। তারপর চাচীর ভয়ে কোনমতে জোর করে এক গেলাস দুধ গিলে নিয়ে উঠে পড়ল। বেরিয়ে চলে এল ঘর থেকে। দ্রুত এগোল ট্রেলারের দিকে।

পনেরো মিনিট পর দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে ট্রেলারে ঢুকল রবিন আর মুসা। দেখল, ডেস্কে বসে তাদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে কিশোর পাশা। হাসিতে উদ্ভাসিত মুখ।

কি ব্যাপার? রীতিমত হাঁপাচ্ছে রবিন। জোরে জোরে প্যাভাল করে সাইকেল চালিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে।

সারা রাত থাকতে হবে কেন? মুসার প্রশ্ন।

কারণ, নাটকীয় ভঙ্গিতে ঘোষণা করল গোয়ন্দাপ্রধান। পিটার মনটেরো কোথায় লুকিয়ে আছে, জানি আমি।

.

১৩.

 কোথায়? চিৎকার করে উঠল রবিন।

কি করে জানলে? মুসাও না চেঁচিয়ে পারল না।

সারাক্ষণ আমাদের নাকের নিচেই রয়েছে, জবাব দিল কিশোর। অন্ধ হয়ে ছিলাম আমরা। বলেছি না একটা কিছু মিস করেছি। রাস্তায় দেখে আমাকে ফলো করে এখানে এসে হাজির হয়েছে কিডন্যাপাররা, কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার।

কেন? মুসার প্রশ্ন।

কারণ, তাহলে ওরা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যেত পালানোর চেষ্টা করছি না আমি। লুকানোরও চেষ্টা করছি না। তোমাদের সঙ্গে সহজভাবে মিশছি, রকি বীচের আর দশটা ছেলের মত। আমাকে কথা বলতেও শুনে থাকতে পারে। কথায় যে টান। নেই এটা বুঝতে বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন পড়ে না। ভুল ওরা করত না।

কিন্তু কিশোর, মনে করিয়ে দিল রবিন। ভুল ওরা ঠিকই করেছে।

করেছে। এবং সেটাই হলো জবাব। কারণ ওরা আমাকে এমন জায়গায় দেখেছে যেখানে পিটারকে আশা করেছিল। ওখানেই খুঁজছিল তাকে।

খুঁজছিল? হাঁ হয়ে গেছে রবিন।

হ্যাঁ, নথি। ট্যাক্সি থেকে নেমে বেশি দূর যেতে পারেনি পিটার। লুকিয়ে পড়তে হয়েছে। এমন জায়গায়, যেখানে গত কদিন ধরে খাবার চুরি যাচ্ছে। চকচক করছে কিশোরের চোখ। পিটার আমাদের নাকের নিচে এই ইয়ার্ডেই লুকিয়ে আছে!

ই.ই..ইয়ার্ডে! তোতলাতে শুরু করেছে মুসা।

যেখান থেকে সে গায়েব হয়েছে সেখান থেকে মাত্র এক মাইল দূরে ইয়ার্ড, বোকা হয়ে গেছে যেন রবিন। মুসা, সেদিন তোমার খাবার ইঁদুরে খায়নি। পিটার খেয়েছে।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কিডন্যাপারদের হাত থেকে পালাতে গিয়ে এই ইয়ার্ডে ঢুকে পড়েছিল সেদিন পিটার। এখানে এত বেশি জঞ্জাল, লুকানোর। জায়গার অভাব নেই। কাজেই এখানেই, থাকবে ঠিক করেছিল সে। খাবার চুরি। করাও এখানে সহজ। প্রায় সারাটা দিনই রান্নাঘর খালি পড়ে থাকে। কিডন্যাপাররা তাকে ইয়ার্ডে ঢুকতে দেখেছে, কিংবা দেখেনি, যা-ই হোক, ওরা আশপাশে ঘুরঘুর করেছে। আমাকে দেখেই মনে করেছে আমি পিটার। আর কিছু বোঝার অপেক্ষা করেনি। পয়লা সুযোগটা পেয়েই ধরে নিয়ে যাচ্ছিল।

সারাক্ষণ এই ইয়ার্ডেই রয়েছে। বিশ্বাস করতে পারছে না এখনও মুসা।

 তাতে কোনই সন্দেহ নেই। এখন আমাদের কাজ ওকে খুঁজে বের করা।

খুঁজব আর কি? বাইরে বেরিয়ে চিৎকার করে নাম ধরে ডাকি, বেরিয়ে চলে আসবে।

 মাথা নাড়ল কিশোর। না, তাতে কাজ হবে না। আমাদেরকে চেনে না সে। হয়ত দুর থেকেই দেখেছে শুধু। লুকিয়েছে ভালমতই। হ্যারি আর কিংকেও নিশ্চয়। দেখেনি, তাহলে বেরিয়ে আসত। আমরা চেঁচাতে শুরু করলে আবার ভয় পেয়ে গিয়ে পালাতে পারে। তার চেয়ে খুঁজেই বের করি।

এই জঞ্জালের মাঝে সেটাও সহজ না। কিশোর, অপেক্ষা তো করতে পারি। আমরা। বেরোতে তাকে হবেই, এক সময় না একসময়। সারাক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবে না।

না, তা পারবে না। থাকবেও না। কিছুটা নিরাপদ বোধ করলেই বেরিয়ে চলে যাবে, সম্ভবত রেড লায়নে। ট্রেড মিশনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করবে। তবে তার আগে পর্যন্ত লুকিয়েই থাকবে। সেটা কত দিন ঠিক বলা যায় না।

তাহলে কি করব? রবিনের প্রশ্ন।  

একটা বুদ্ধি করেছি। আমার বিশ্বাস, শুধু রাতের বেলাতেই বেরোয় পিটার। যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে। সব কিছু শান্ত থাকে।

সে জন্যেই সারারাত থাকতে বলেছ, বুঝতে পারল মুসা।

হ্যাঁ।

একটা ফাঁদ পাততে পারি না? রবিন বলল, পেতে অপেক্ষা করে বসে থাকব।

ও বুদ্ধিটা সেটাই। খাবারের দরকার হলেই কেবল বেরোয় পিটার। চালাক ছেলে। যতটা দরকার তার চেয়ে কম নেয়, যাতে ব্যাপারটা কারও নজরে না পড়ে। মেরিচাচীর কড়া নজর তার পরেও এড়াতে পারেনি। তবে চাচী ভেবেছে পরিবারেরই কেউ খেয়েছে। ফাঁদ পাততে অসুবিধে হবে না আমাদের।

খাবারের ফাঁদ, মুসা বলল।

ইয়ার্ড নীরব হলেই বেরিয়ে আসবে সে, বলল কিশোর। বাইরে বেরিয়ে প্রচুর কথা বলব আমরা।

কোন বিষয়ে?

যেন বাইরে চলে যাচ্ছি আমরা। কাল রওনা হব। তিনটে প্যাকেট লাঞ্চ তৈরি করে রাখতে হবে সে জন্যে। ওগুলো রান্নাঘরে না রেখে রাখব পাশের বারান্দায়। যাতে সকালে সহজেই নিতে পারি। কথাগুলো তার কানে যাবেই এমন না-ও হতে পারে। তবে যেতেও পারে। সে জন্যেই বলব।

বুঝলাম। তিনটে প্যাকেটে অনেক সময় পার করতে পারবে সে। কাজেই লোভী হয়ে উঠবেই। আকর্ষণটা এড়াতে পারবে না।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ভাববে, আমরা কিছু বুঝতে পারব না। ইঁদুরকে দোষ। দেব, কিংবা কোনও ভবঘুরেকে। রাত দশটায় ইয়ার্ড থেকে সরে যাব আমরা। খাবারের তিনটে প্যাকেট রেখে চলে যাব শোবার ঘরে। দুজন ঘরেই থাকব। আরেকজন পা টিপে টিপে নেমে চলে আসব নিচে। রান্নাঘরে বসে নজর রাখব। বারান্দার দিকে, যেখানে টেবিলে খাবারগুলো রাখব। দুই ঘণ্টা পর পর পালা করে পাহারা দেব আমরা।

ইমারজেন্সি সিগন্যালগুলো সঙ্গে রাখতে হবে। পিটারকে দেখলেই সঙ্কেত দেব অন্য দুজনকে। যদি ঘুমিয়েও পড়ি, জোরাল সঙ্কেত জাগিয়ে দেবে। আমাদেরকে।

তারপর? জিজ্ঞেস করল রবিন।

দৌড় দেব দুজনেই। দুদিক থেকে গিয়ে পিটারের পালানোর পথ বন্ধ করে দেব। তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলা হবে তাকে। যাওয়ার একটাই পথ থাকবে তার তখন। সামনের দিক। গেট থাকবে তালা দেয়া। যাবে কোথায়? ধরা তাকে। পড়তেই হবে।

তার পর আর কি? উপসংহার টানল মুসা। তাকে আমাদের পরিচয় দেব। শান্ত থাকতে বলব। হ্যারি আর কিংকে ফোন করব।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। তবে বেশি হৈ চৈ করা চলবে না আমাদের। চাচা চাচী যেন জেগে না যায়। চল এখন। সিগন্যালগুলো বের করে নিয়ে কাজে লেগে। যাই।

ওয়ার্কশপে এসে কাজে লাগল তিন গোয়েন্দা। আসলে কাজের ভান করতে লাগল। অনেক কথা বলল ওরা, জোরে জোরে। শব্দ করল। মেরিচাচী আর রাশেদ চাচা তখনও ঘুমাননি। কাজেই অসুবিধে হল না তাদেরকে নিয়ে। ওয়ার্কশপ থেকে বেরিয়ে লাঞ্চ প্যাকেট তৈরি করতে বসল তিনজনে। সেগুলো নিয়ে গিয়ে রাখল। বারান্দার টেবিলে, এমন জায়গায়, যাতে রান্নাঘর থেকে সহজেই চোখে পড়ে। দশটা বাজার কয়েক মিনিট আগে ইয়ার্ডের বাইরের আলোগুলো সব নিভিয়ে দিল। তারপর রওনা হল কিশোরের শোবার ঘরের দিকে।

প্রথম পাহারা দিতে নামল রবিন। লুকিয়ে রইল এসে অন্ধকার রান্নাঘরে। মেরিচাচী আর রাশেদ পাশা ওপর তলায় শোবার ঘরে চলে গেছেন। সঙ্কেত দেয়ার যন্ত্রগুলো শার্টের পকেটে ভরে নিয়েছে কিশোর আর মুসা। রবিনেরটা তার হাতে।

মাঝরাতে রবিনের জায়গায় এসে বসল কিশোর।

বারান্দায় টেবিলেই পড়ে আছে প্যাকেটগুলো। কোনও নড়াচড়া নেই কোথাও। কোনও শব্দ নেই। শুধু বাইরের রাস্তায় মাঝেসাঝে হুস হুস করে চলে যাচ্ছে দুএকটা গাড়ি।

রাত দুটোয় মুসার পাহারা দেয়ার পালা পড়ল। রান্নাঘরে ঢুকেই হাই তুলল। কয়েকবার। মেরিচাচীর ফ্রিজটায় হামলা চালাবে কিনা ভাবল একবার। বাতিল করে দিল ভাবনাটা। তাতে পাহারার অসুবিধে হতে পারে। ভোর চারটেয় আবার এসে তার জায়গা দখল করল রবিন।

কিশোর মনে হয় ভুল করেছে, ফিসফিস করে বলল মুসা। কিংবা অন্য কোথাও চলে গেছে পিটার। এই রাস্তায় এটাই একমাত্র বাড়ি নয়। আরও আছে। ওগুলোতে লুকানোর জায়গা আছে, খাবারের ব্যবস্থা আছে।

ভোর সাড়ে পাঁচটা। পুবের আকাশে ধূসর আলোর আভাস। তবে ইয়ার্ডের জঞ্জালে অন্ধকার আগের মতই শেকড় গেড়ে রয়েছে যেন, নড়তে চাইছে না। ঠিক এই সময় বাড়ির পেছনের বারান্দার কাছে কি যেন নড়তে দেখল রবিন।

তন্দ্রা এসেছিল। ঝট করে সোজা হলো সে। চোখ মিটমিট করে দৃষ্টি স্বচ্ছ করার চেষ্টা করল। ভাল করে তাকাল বারান্দার দিকে। আবছা একটা ছায়ামূর্তি এসে উঠেছে বারান্দায়। ইমারজেন্সি সিগন্যাল চালু করে দিল রবিন।

এত জোরে লাফিয়ে বিছানা থেকে নামতে গেল কিশোর, পড়েই যাচ্ছিল আরেকটু হলে। মুসার কাধ ধরে নাড়া দিল, এই ওঠ ওঠ, জলদি! বলেই দিল দরজার দিকে দৌড়। টিইপ টিইপ করছে তার পকেটে ইমারজেন্সি সিগন্যাল।

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমেই দুজন দুদিকে চলে গেল। লুকিয়ে পড়ল দুটো ঝোপের ভেতরে।

রান্নাঘরে বসে ঘড়ি দেখল রবিন। আবার তাকাল বারান্দার দিকে। বারান্দাটা একেবারে খোলা নয়। অর্ধেকটা বেড়া দেয়া। টেবিলটা রয়েছে সেই ঘেরা অংশের ভেতরে। সেখানে ঢোকার মুখের কাছে চলে গেছে ছায়ামূর্তিটা। একটা ছেলে, কোনও সন্দেহ নেই। আবছা অন্ধকারেও কিশোর পাশার অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠল যেন। অবিকল একই রকম শরীর দুজনের। টেবিলের কাছে এগিয়ে গেল ছেলেটা। খাবারের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়াল।

এই, থামো! চিৎকার করে বলল রবিন। তোমাকেই বলছি, পিটার মনটেরো!

যেন কারেন্টের শক খেয়েছে ছেলেটা, এমন করে ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে এল। ঘুরেই দিল দৌড়। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আছাড় খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল প্রায়। পেছন ফিরে তাকাল একবার। রবিনের দিকে চোখ পড়ল। ঘরের কোণ ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল ওপাশে।

 বেরিয়ে পড়েছে কিশোর। শিকারী বেড়ালের মতই এসে লাফ দিয়ে পড়ল যেন ছেলেটার ঘাড়ে।

ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ছেলেটা। পালাতে পারল না। ততক্ষণে হাজির হয়ে গেছে মুসা আর রবিন। চেপে ধরল পিটারকে। ছাড়া পাওয়ার জন্যে। ধস্তাধস্তি শুরু করল ছেলেটা।

ভয় নেই, আমরা বন্ধু! বোঝানোর চেষ্টা করল গোয়েন্দারা। স্যার মনটেলোর হয়ে কাজ করছি। তোমাকে সাহায্য করতে চাইছি! কিং আর হ্যারি…!

কিন্তু কোনও কথাই যেন ঢুকছে না ছেলেটার কানে। ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করেই চলেছে। শক্ত করে তাকে চেপে ধরে রাখল রবিন আর মুসা। কিশোর বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগল।

হার্বার্ট কিং? অবশেষে যেন কথা কানে ঢুকল ছেলেটার। হ্যারি ম্যাকঅ্যাডাম? ওরা এখানে?

হ্যাঁ, এখানে, কিশোর বলল। তুমি এখন পুরোপুরি নিরাপদ। কোনও ভয় নেই আর। চল, আমাদের হেডকোয়ার্টারে।

প্রায় টেনেহিঁচড়ে পিটারকে নিয়ে এসে ট্রেলারে ঢোকাল তিন গোয়েন্দা।

এটা…এটা কি? জানতে চাইল পিটার।

একটা ট্রেলার, জবাব দিল কিশোর। জঞ্জালের তলায় লুকানো একটা মোবাইল হোম। আমাদের হেডকোয়ার্টার। তোমার জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। কারণ, যারা তোমাকে কিডন্যাপ করতে চায়, এ মুহূর্তে তারা হয়ত এই ইয়ার্ডের চারপাশেই ঘুরঘুর করছে।

সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল রবিন।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে থ হয়ে গেল পিটার। বড় বড় হয়ে গেল চোখ। মুখ। হাঁ। অনেক কষ্টে যেন কথা খুঁজে পেল, তুমি…তুমি দেখতে একেবারে আমার মত! অবিকল এক! কেন?

.

১৪.

হেসে বলল কিশোর, একই প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি।

পিটারও হাসল। হ্যাঁ, তোমাদের দেশে যখন আমি প্রশ্ন করার অধিকারটা তোমারই বেশি।

তার ওপর আবার কিশোরের পোশাক পরেছ, মুসা বলল।

কিশোরের একটা পুরনো প্যান্ট পিটারের পরনে। গায়ে শাদা শার্ট, কয়েক মাস আগেই ওটা ফেলে দিয়েছিল সে। আর এক জোড়া ছেঁড়া স্যাণ্ডাল।

পালানোর সময় কাপড় ছিঁড়ে শেষ হয়ে গেছে আমার, পিটার বলল। একেবারে পরার অনুপযুক্ত। কি আর করব। জঞ্জালের নিচে হামাগুড়ি দেয়ার সময়। একটা বাক্সের ভেতরে পেয়ে গেলাম এগুলো।

খাইছে! গুঙিয়ে উঠল মুসা। কথাবার্তার ভঙ্গিও দেখি এক। একজন কিশোর পাশার যন্ত্রণায়ই অস্থির, দুজনকে সইব কি করে?

হাসতে লাগল সবাই।

তোমাদের বেকায়দায় ফেলে দিলাম। সরি, পিটার বলল। তবে আমাকে যে, খুঁজে বের করেছ এজন্যে আমি কৃতজ্ঞ। আমি তো ঘাবড়েই যাচ্ছিলাম আদৌ কেউ বের করতে পারবে কিনা ভেবে।

তোমাকে পেয়ে আমিও খুব খুশি, দাঁত বের করে হাসল কিশোর। যমজ তো।

একা থাকার যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারছিলাম না, পিটার বলল। কিন্তু তোমরা কে? পরিচয়ই কিন্তু হয়নি এখনও।

তোমার যমজ ভাইয়ের নাম তো শুনলেই-কিশোর পাশা, গোয়েন্দাপ্রধান, পরিচয় করিয়ে দিল রবিন। আমার নাম রবিন মিলফোর্ড। রেকর্ড রাখা আর রিসার্চের কাজগুলো আমি করি। আর ও হলো মুসা আমান, সহকারী গোয়েন্দা।

গোয়েন্দা? অবাক হয়েছে পিটার। সত্যি?

এই যে আমাদের কার্ড, পকেট থেকে বের করে দিল কিশোর।

দারুণ তো! তোমরা আমেরিকানরা খুব মজার মজার কাণ্ড কর। সত্যিই গোয়েন্দা?

সত্যিই গোয়েন্দা, জবাব দিল রবিন। তোমাকে খুঁজে বের করতে আমাদেরকে ভাড়া করেছে কিং আর হ্যারি। তুমি ভেবে কিডন্যাপাররা কিশোরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর।

তাই নাকি? কিশোরকে কিডন্যাপ করেছে?

সংক্ষেপে সব কথা পিটারকে জানাল কিশোর। মন দিয়ে শুনল ছেলেটা। তারপর বলল, তাহলে তোমরাই বের করেছ জ্যাঙ্গাস প্লেস বলে আমি কি বোঝাতে চেয়েছি। বের করেছ রেড লায়নের আলমারিতে আঁকা ট্যাক্সির ছবি। সত্যিই বুদ্ধিমান।

তুমি যে এখানে লুকিয়ে আছ, এটা অবশ্যই বুঝতে পেরেছে আমাদের কিশোর, মুসা বলল গর্বের সঙ্গে।

দারুণ দেখিয়েছ, সত্যি। তো এখন কি হবে? কিং আর হ্যারির সঙ্গে যোগাযোগ করবে, যাতে আমার বাবাকে খবর দিতে পারে?

নিশ্চয়। দুই বন্ধুর দিকে তাকাল মুসা। পিটারকে সোজা মিরামার হোটেলে নিয়ে যেতে পারি আমরা।

সেটা কি উচিত হবে? রবিনের প্রশ্ন। কিডন্যাপারগুলো ইয়ার্ডের বাইরে বসে চোখ রাখতে পারে। হোটেলেও চোখ রাখতে পারে।

তোমার তাই মনে হয়? সতর্ক হয়ে গেল পিটার।

রবিন ঠিকই বলেছে, কিশোর বলল। সেটা হতেই পারে। সহজে হাল ছাড়বে না উগ্রবাদীরা। পিটার এখানেই নিরাপদ। অযথা ঝুঁকি নেয়ার কোনও মানে হয় না। তার চেয়ে বরং হ্যারি আর কিংকে ফোন করি। এখানে চলে আসুক

করব? বলে জবাবের অপেক্ষা না করেই ফোনের দিকে হাত বাড়াল রবিন। মিরায়ার হোটেলে ডায়াল করল। অবাক হয়ে ট্রেলারের ভেতরটা দেখছে পিটার। সাজানো গোছানো চমৎকার একটা ছোটখাট বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার যেন। নানা রকম আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। বিড়বিড় করে আনমনেই বলল, বাইরে থেকে ট্রেলারটা দেখেছি আমি জঞ্জালের নিচে ঘোরার সময়। ভেতরে যে এই অবস্থা কল্পনাই করতে পারিনি!

বাইরে থেকে দেখে যাতে কিছু বোঝা না যায় সেই ব্যবস্থাই করেছি আমরা।

সাংঘাতিক!

রিসিভার রেখে দিল রবিন। কেউ ধরছে না ওদের ঘরে। কোথায় গেছে বলতে পারল না ক্লার্ক। বললাম আবার ফোন করব। মেসেজ দিতে হবে কিনা জিজ্ঞেস করল, দিলাম না। বলা যায় না কার চোখে পড়ে যায়।

ঠিকই করেছ, কিশোর বলল। আমার মনে হয় রেড লায়নে নজর রাখতে গেছে। ফিরে আসবে সময় হলেই। পিটারের দিকে তাকাল সে। তোমাকে আমরা খুঁজে না পেলে কি করতে?

আরও অপেক্ষা করতাম। তারপর নিরাপদ বুঝলে ফিরে যেতাম রেড লায়নে, দেখতাম, আমার মেসেজ পেয়ে ওখান পর্যন্ত কেউ যেতে পেরেছে কিনা।

ঠিক যা তাবছ আমি।

ট্রেড মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না? রবিন জিজ্ঞেস করল।

 সেটা একেবারে শেষ অবস্থায় গিয়ে পড়লে। অর্থাৎ বাধ্য হলে। রেড লায়নের কিডন্যাপারগুলোকে দেখেই বুঝে গেছিলাম আমার পাঠানো মেসেজ দেখে ফেলেছে ওরা। বুঝে ফেলেছে। তার মানে কোনও একটা যোগাযোগ রয়েছে জানার। স্পাই আছে ওখানে। কাজেই মিশনকে আর বিশ্বাস করতে পারি না পুরোপুরি।

ড্রয়ার থেকে হাতির দাঁতে তৈরি গহনাটা বের করল কিশোর। বক্স ক্যানিয়নে যেটা পেয়েছিল। পিটারকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, চিনতে পারো?

জিনিসটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল পিটার। নানদাতেই তৈরি হয়েছে, সন্দেহ নেই। চেনাও লাগছে। তবে কোথায় দেখেছি মনে করতে পারছি না।

রবিন, মুসা বলল। অনেকক্ষণ তো হলো। করে দেখ আরেকবার।

 আবার মিরামার হোটেলের নম্বরে ডায়াল শুরু করল রবিন।

 পিটার দেখতে লাগল ট্রেলারের ভেতরটা। সর্ব-দর্শন নামের পেরিস্কোপটা দেখল, ট্রেলারের ছাত ফুঁড়ে যেটা বেরিয়েছে। দেখল টেলিফোন লাইনের সঙ্গে লাগানো লাউডস্পীকার। ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন ক্যামেরাটার ওপর গিয়ে দৃষ্টি স্থির হলো। এত জিনিস কোথায় পেলে?

বেশির ভাগই বাতিল মাল থেকে নতুন করে বানিয়ে নিয়েছি, মুসা জানাল। ইলেকট্রনিকের জাদুকর বলতে পার কিশোরকে…

 আর ইঞ্জিনের জাদুকর মুসা, হেসে যোগ করল কিলোর।

রবিন হলো চলমান জ্ঞানকোষ, মুসা বলল।

 তোমরা জিনিয়াস! আরেকবার প্রশংসা করল পিটার।

রিসিভারের মাউথপিসে হাত রেখে ফিরে তাকাল রবিন। ক্লার্ক বলছে, হ্যারি নাকি ফিরেছে। ঘরের দিকে যেতে দেখেছে। কথা বলতে চাইলাম। ধরতে বলল।

ধর, মুসা বলল। আমরা পিটারকে ওয়ার্কশপটা দেখিয়ে আনছি।

দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে ওয়ার্কশপে বেরিয়ে এল কিশোর, মুসা আর পিটার। পিটার জানাল এটাতে কখনও ঢোকেনি। লোকজনের সাড়া পেয়ে ঢোকার সাহসই হয়নি আসলে। তিন গোয়েন্দার সঙ্গে যখন ট্রেলারে ঢুকেছে তখনও এখান দিয়ে নয়, ঢুকেছে সবুজ ফটক এক দিয়ে। ওয়ার্কশপের চেহারা দেখে আরও তাজ্জব হয়ে গেল। ছোটখাট একটা আধুনিক কারখানা বলেই মনে হল তার। বেলা হয়েছে। রোদ উঠেছে। পরিষ্কার দিনের আলোয় বেরিয়ে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল সে। ভয় ভয় করছে। প্রশ্ন করল, আমি এখানে নিরাপদ?

কেন নয়? কিশোর বলল, এখানে কেউ তোমাকে দেখতে পাবে না। ইয়ার্ডের চারপাশ ঘিরে বেড়া আছে দেখেছই তো। তার ওপর রয়েছে জায়গায় জায়গায় জঞ্জালের স্তূপ। এর ভেতরে কেউ দেখতে পাবে না।

হাসল বটে পিটার, তবে তেমন আশ্বস্ত হয়েছে বলে মনে হলো না। তাকিয়ে। তাকিয়ে দেখছে ওয়াকর্শপের জিনিসপত্র। সাজিয়েছ বটে!

সুড়ঙ্গমুখ দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল রবিন। হ্যারির সঙ্গে কথা বললাম, উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সে। কিংকে নিয়ে এখুনি চলে আসবে বলেছে। পিটারকে নিতে।

কিন্তু আমি যে যেতে চাই না, পিটার বলল। তোমাদের হেডকোয়ার্টার ভারি পছন্দ হয়েছে আমার। দেখার অনেক কিছু বাকি। ভাবছি আজ সারাদিন ধরে দেখব। ওয়ার্কবেঞ্চের নিচে ঝুঁকে একটা জিনিস দেখিয়ে বলল, এটা কি?

দেশলাইয়ের বাক্সের সমান কালো একটা বাক্সমত জিনিস বের করল সে।

ওটা? বলতে চাইল মুসা, ওটা-ওটা–কিশোর, কি জিনিস?

ছোট বাক্সটা দেখতে লাগল রবিন। এটা…এটা…

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জিনিসটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। সতর্ক হয়ে গেছে। এটা আমাদের জিনিস নয়! বাগ!

বাগ? ভুরু কোঁচকাল পিটার। ইংরেজিতে বাগ মানে তো পোকা, গোবরে পোকা, তাই না?

শ্রবণ যন্ত্রকেও বলে, বুঝিয়ে দিল কিশোর। এক ধরনের রিমোট মাইক্রোফোন। দূর থেকে চুরি করে কথা শোনার কাজে ব্যবহার করে স্পাইরা। নিশ্চয় আমাদের কথা শুনছে কেউ। জলদি চল! বেরোতে হবে…

ওয়ার্কশপের বাইরে থেকে কথা বলে উঠল কেউ। পরিচিত কণ্ঠ। তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই, বুঝলে। পালাতে পারবে না।

ওয়ার্কশপের দরজায় দেখা দিল লোকটা। বেঁটে, কোকড়া বাদামী চুল। তার পেছনে এসে দাঁড়াল পাতলা লম্বা লোকটা। সেই দুই কিডন্যাপার, কিশোরকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল যারা।

দুজনের হাতেই পিস্তল।

.

১৫.

 গুড, কুৎসিত হাসি হাসল বেঁটে লোকটা। সবাই আমরা এখানে রয়েছি।

ডেভ, লম্বু বলল। মনে হয় আমাদের লোককে পেলাম।

 সেরকমই তো লাগছে।

এই ছেলেগুলোর কাছে কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত আমাদের, লম্বা লোকটা বলল, তিন গোয়েন্দার কথা। চালাক ছেলে। ওরা না থাকলে আমরা বেরই করতে পারতাম না। অনেক সহজ করে দিল আমাদের কাজ।

ওদেরকে তাহলে ধন্যবাদ দেয়া দরকার, হেসে উঠল ডেভ।

যেন খুব উপভোগ করছে দুই উগ্রপন্থী।

হ্যারি আর কিং না আসা পর্যন্ত এদের আটকে রাখা দরকার, বুঝতে পারছে। তিন গোয়েন্দা। গরম হয়ে রবিন বলল, এসব করে পার পাবেন না আপনারা!

স্যার মনটেরোকেও বাগে আনতে পারবেন না, ফুঁসে উঠল মুসা।

ছেলেটাকে নিয়ে পার হয়ে যেতে পারলেই আমরা খুশি, ডেভ বলল। তারপর স্যার মনটেরো কথা শোনে কিনা দেখা যাবে।

হাসল খাটো কিডন্যাপার। পিটারের দিকে তাকাল, তারপর কিশোরের দিকে। অন্য লোকটাও দেখছে দুজনকে। কিশোরের চোখ চকচক করছে দেখতে পেল রবিন আর মুসা।

তুমি খুব চালাক, কিশোর পাশা, ডেভ বলল। তোমাদের মধ্যে কে, পিটার সেটা গোপন করতে চাইছ। ভেবেছ আমরা বের করতে পারব না। হেলিকপ্টারটা ফেলে রেখে আবার এখানে ফিরে এসে ভালই করেছি বুঝতে পারছি। খবরের কাগজ দেখেছি। ভুল বুঝতে পেরেছি। জানলাম, মাস্টার মনটেরো এখনও এই এলাকাতেই আছে। পুলিশ কল্পনাই করেনি ওদের নাকের নিচে রয়েছি আমরা। ওরা আমাদেরকে অন্য জায়গায় খুঁজছে, আর আমরা পিটারকে খুঁজতে লাগলাম এখানে। ঠিক জায়গায়।

হ্যারি আর কিংকে দেখে ফেললাম আমরা, হেসে যোগ করল জন। ওদের। সঙ্গে যোগ দিলে তোমরা, তিন গোয়েন্দার কথা বলল সে। বুঝে গেলাম আগে হোক পরে তোক পিটারের কাছে আমাদেরকে নিয়ে যাবেই তোমরা। এই ইয়ার্ডে অনেক লোক আসে। তাদের ভিড়ে ঢুকে পড়াটা কোনও ব্যাপারই না। ঢুকলাম। তোমরা তখন পিটারকে খুঁজতে এতই ব্যস্ত আমাদেরকে লক্ষই করলে না।

আপনাদের দেখেছি। রেগে গেল মুসা।

ঝোপের ভেতর ছিলাম চেহারা তো আর দেখনি। চিনবে কি করে? যাই হোক, তোমাদেরকে আমি ভাল করেই দেখেছি। কি করতে চলেছ বুঝেছি। এক ফাঁকে ঢুকে পড়লাম তোমাদের ওয়ার্কশপে। বাগটা ফেলে রাখলাম বেঞ্চের তলায়। তারপর তোমাদের অনেক আলোচনাই শুনেছি।

বিশাল এক জঞ্জালের স্তূপের দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুই কিডন্যাপার। চট করে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। এক ধরনের ফাঁদ পাতা আছে ওই জঞ্জালে। বিপদে পড়লে প্রয়োজনের সময় যাতে শত্রুর ওপর টান মেরে ফেলে দিতে পারে সেই ব্যবস্থা করে রেখেছে। মাথা নেড়ে নিষেধ করল কিশোর। দুজন পিস্তলধারী লোক, ভয়াবহ বিপজ্জনক, ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। তবে তার চোখ জ্বলজ্বল করতে দেখল রবিন। কি প্ল্যান করেছে গোয়েন্দাপ্রধান?

পুলিশ আপনাদেরকে হন্যে হয়ে খুঁজছে, সময় নষ্ট করার জন্যে বলল মুসা।

জানি, জবাব দিল ডেভ। আমাদের টিকিও ছুঁতে পারবে না। আমরা যাকে চাই তাকে পেয়ে গেছি।

আমাদের কিছু করতে পারবে না ওরা, জন বলল দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে।

পিটার, চল, আর দেরি করতে পারছি না, ডেভ বলল।

 চালাকির চেষ্টা করবে না কেউ, হুশিয়ার করল জন। গুলি করতে দ্বিধা করব না আমরা বুঝতেই পারছ।

তা পারছি, এগিয়ে গেল পিটার। চলুন, যাচ্ছি।

তার পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর, হ্যাঁ, চলুন।

কিশোর, পিটার বলল। আমার জন্যে তোমার এতবড় ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে। ওরা এত বোকা নয়। ঠিক বুঝে গেছে আমিই পিটার।

মস্ত বড় অভিনেতা কিশোর। বিখ্যাত পরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারকে পর্যন্ত বোকা বানিয়ে দিয়েছিল তার ভাতিজা সেজে। জন আর ডেভ তো কিছুই না। পিটারের কথার টান নকল করে ফেলল সে অবলীলায়, তুমি সরো তো কিশোর। আমিও জানি ওরা বোকা নয়। ঠিকই বুঝতে পেরেছে কে পিটার।

কিশোর! প্রতিবাদ করল পিটার। ওদেরকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। আমি যে পিটার বুঝতে পেরেছে। পেরেছেই।

দুজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে দুই কিডন্যাপার। হাসি হাসি ভাবটা দূর হয়ে গেছে চেহারা থেকে। হঠাৎই আবিষ্কার করেছে, দুটো ছেলের মাঝে কোনজন কিশোর আর কোনজন পিটার, জানে না। কিশোরের চোখ কেন জ্বলজ্বল করছিল। এতক্ষণে বুঝল রবিন। দুজনের পরনে এক ধরনের পোশাক, এক চেহারা, কথাও বলছে একই রকম ভাবে।

শাসানির ভঙ্গিতে পিস্তল নাড়ল ডেভ, অনেক হয়েছে। যথেষ্ট। আসল পিটার কে, জলদি বলো!  

প্লীজ, কিশোর, অনুরোধ করল পিটার। আমি চলে যাই ওদের সঙ্গে!

থামো! ধমক দিয়ে বলল, কিশোর, ওরা জানে আমি পিটার। খামোকা আমাকে বাঁচাতে চাইছ কেন? চলুন, আমি যাচ্ছি।

ভয়ংকর হয়ে উঠেছে দুই কিডন্যাপারের চেহারা।

 প্রিন্টের শার্ট পরা ছেলেটা পিটার, ডেভ বলল। ও-ই বেশি করে যেতে চাইছে। বেশি ইচ্ছুক। তার মানে নতুন বন্ধুকে বাঁচাতে চাইছে।

আমার তা মনে হয় না, জন বলল। শাদা সার্ট পরা ছেলেটা পিটার। অহেতুক কিশোরকে বিপদে ফেলতে চাইছে না।

পিস্তল হাতে আগে বাড়ল জন।

কাপড় দেখ ওদের, ডেভ বলল পেছন থেকে। ধোপার দোকানের চিহ্ন থাকবেই। বোঝা যাবে।

কিশোরের শার্টের কলারের ভেতরটা উল্টে দেখল জন। ও-ই কিশোর পাশা, ডেভ। এই তো। পাশা : তেরশো বত্রিশ!

শ্রাগ করল কিশোর। আমি কিশোর নই। পালানোর সময় কাপড় ছিঁড়ে গিয়েছিল। আমারগুলো ফেলে তখন কিশোরের কাপড় নিয়ে পরেছি। বিশ্বাস না হলে ওর কলারের ভেতর দেখুন।

পিটারের শার্টের কলারও দেখল জন। তাতেও লেখা রয়েছে পাশা : আঠারোশো তেইশ। গাল দিয়ে উঠল সে।

মাথা ঝাঁকাল পিটার। কিশোর ঠিকই বলেছে। আমি কাপড় ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। তখন তার এক সেট কাপড় নিয়ে পরেছি।

তারমানে দুজন পিটার হয়ে গেলাম আমরা, কিংবা দুজন কিশোর, হেসে বলল কিশোর। তাহলে আসল কিশোর কে? আমি? বুড়ো আঙুল নাড়ল সে। মোটেও না।

হাঁ হয়ে গেছে মুসা আর রবিন। কাপড়ের ব্যাপারটা জানা না থাকলে এখন ওরাও দ্বিধায় পড়ে যেত কে কিশোর আর কে পিটার ভেবে।

শুনুন, কিশোর বলল। কিশোরের পকেট দেখুন। একটা জিনিস পাবেন। যেটা প্রমাণ করবে সে কিশোর পাশা।

 দ্রুত পিটারের পকেটে হাত ঢোকাল জন। ছোট একটা যন্ত্র বের করল। ঘুরে তাকাল সঙ্গীর দিকে। এ তো আমাদেরই বাগ! এটা পাশাদের ওয়ার্কশপ। নিশ্চয় পাশাই কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে রেখেছে। সেটাই স্বাভাবিক।

ইডিয়েট! ধমকে উঠল ডেভ। ওটা পিটার পেয়েছে, শুনলাম না তখন? তারপর হাতে হাতে ঘুরেছে। কার কাছ থেকে কার কাছে গেছে কি করে বুঝব?

ওদের কথার কোনও বিশ্বাস নেই।

রাগে লাল হয়ে গেল জনের মুখ। কিশোরের কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল। লোকটার জ্যাকেট খামচে ধরল কিশোর, যেন পতন ঠেকানোর জন্যে। গাল দিয়ে উঠল কিডন্যাপার, এই ছাড়, ছাড়, আমার জ্যাকেট ছাড়!

ছেড়ে দিল কিশোর। তার পকেট ভালমত খুঁজে দেখল জন। তারপর পিটারের সব পকেট দেখল। কিছু নেই! সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে নিরাশ কণ্ঠে বলল সে।

 হাসতে আরম্ভ করল কিশোর। দেখাদেখি পিটারও হাসতে লাগল।

এটা বন্ধ করা দরকার! চেঁচিয়ে উঠল ডেভ। পিটারের বাবার একজন। শোফার আছে। আর্মির লোক। তার নাম আর র্যাংক বলতে হবে তোমাদেরকে। যে বলতে পারবে না, ধরে নেব সে-ই কিশোর পাশা। হ্যাঁ, বলে ফেল এখন।

বরফের মত জমে গেল যেন রবিন আর মুসা। এইবার ফাঁদে পড়েছে কিশোর। কি করবে? প্রশ্নের জবাব জানা নেই তার। তাকে বাঁচানোর জন্যে সঠিক জবাবটা দিয়ে দেবে এবার পিটার।

 বেশ, হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করল পিটার। এবার আটকে ফেলেছেন। বলতে পারলাম না। আমিই কিশোর পাশা।  

ভাবান্তর ঘটল না মুসা আর রবিনের চেহারায়। তবে মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে উঠল ওরা। কিশোরের খেলাটা ধরে ফেলেছে পিটার। পাকা খেলোয়াড়ের মত খেলতে আরম্ভ করেছে।

হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি, কিশোর বলল। আমি কিশোর পাশা। শোফারের নাম বলতে পারব না।

প্রচণ্ড রাগে জ্বলে উঠল দুই কিডন্যাপার, বিশেষ করে ডেভ। ঝটকা দিয়ে ঘুরল রবিন আর মুসার দিকে। আশা করি তোমরা ওদের মত বোকা নও! মরার ইচ্ছে নেই! বলে ফেল কে কিশোর আর কে পিটার?

ও! পিটারকে দেখাল মুসা।

ও! কিশোরকে দেখাল রবিন।

আস্তে মাথা নাড়ল ডেভ। হুঁ। একটাই উপায় আছে এখন আমাদের। এছাড়া আর কিছু করার নেই। দুই কিশোরের দিকে এগিয়ে এল সে, কিংবা দুই পিটার। কোনটা যে বের করবে এবার।

১৬.

রেড লায়ন থেকে কিংকে তুলে নিয়ে ইয়ার্ডে চলে এল হ্যারি। উজ্জ্বল রোদ। ভেতরে ঢুকল বিশাল চকচকে ক্যাডিলাকটা। ওদেরকে স্বাগত জানাতে ছুটে গেল না কোনও কিশোর। নীরব চত্বরের চারপাশে চোখ বোলাল ওঁরা।

পিটার! চিৎকার করে ডাকল কিং। কিশোর!

রবিন বলেছে, হ্যারি জানাল। ওদের গোপন হেডকোয়ার্টারে রেখেছে পিটারকে। জঞ্জালের ভেতরে লুকানো। গলা চড়িয়ে ডাকল, কিশোর! কিশোর পাশা!

পিটার! কিশোর! কিংও ডাকল।

এত চেঁচামেচি কিসের! এই সক্কাল বেলা! বাড়ির কোণ ঘুরে বেরিয়ে এলেন মেরিচাচী। ফুলগাছে পানি দিচ্ছিলেন বোধহয়। এখন কটা বাজে? এত সকালে এসে চেঁচামেচি জুড়েছেন!

সরি, ম্যাম, মোলায়েম গলায় বলল কিং। ছেলেগুলোকে খুঁজছি আমরা। কিশোরকে দেখেছেন?

 ও, আপনারা, চিনতে পারলেন মেরিচাচী।

কিশোরকে খুঁজছি আমরা, হ্যারি বলল এমন ভঙ্গিতে, যেন মস্ত অপরাধ করে ফেলেছে। ও কোথায়?

জানি না। রাতে রবিন আর মুসা ছিল এখানেই। ভোর হতেই কোথায় যে গায়েব হয়েছে সৃষ্টিকর্তাও বলতে পারবে কিনা সন্দেহ! আমি তো সাধারণ মানুষ!

কিন্তু আমাদেরকে এখানে দেখা করতে বলেছে ওরা, হ্যারি বলল।

তাহলে আছে কোথাও। ওদের ওয়ার্কশপে দেখুন। বায়ের ওই যে বড় জঞ্জালটা…

থ্যাংক ইউ, বাধা দিয়ে বলল, কিং। যাচ্ছি।

প্রায় দৌড়ে চত্বর পেরিয়ে এসে ওয়ার্কশপে ঢুকল দুজনে। কাউকে দেখল না।

নেই তো! কিং বলল।

ও কি? কান পেতে শুনছে হ্যারি।

কাছাকাছি কোনখান থেকে শব্দটা আসছে। ধাতব শব্দ। সেই সাথে চাপা, গোঙানি।

ওদিকটায়,হ্যারি বলল। ওই বড় পাইপটার কাছে।

পাইপের কাছে এসে খোলা মুখ দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল ওরা। হাত-পা বেঁধে। তার ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে রবিন আর মুসাকে। টেনে ওদেরকে বের করা হল। মুখের কাপড় খুলে নিতেই প্রায় চিৎকার করে বলল মুসা, কিডন্যাপার!

নিয়ে গেছে ওদেরকে! রবিন বলল।

ওদেরকে? কিং বলল, পিটার আর কিশোরকে? কোথায়? কখন?

পাঁচ মিনিটও হয়নি, ককিয়ে উঠল মুসা। হয়ত আরও কম। কে কিশোর আর কে পিটার বুঝতে পারেনি, তাই দুজনকেই ধরে নিয়ে গেছে?

কথা বলতে বলতেই রবিন আর মুসার বাঁধন খুলছে দুজনে। হ্যারি। জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

জানি না!

 কি গাড়ি? লাইসেন্স নম্বর রেখেছ?

গাড়িটা দেখতেই পারিনি! জবাব দিল রবিন।

বেশি দূর যেতে পারেনি, কিং বলল। পুলিশকে…

মুসা! তাকিয়ে রয়েছে হ্যারি। তোমার বুকে ও কিসের আলো? এত লাল…

ইমারজেন্সি লাইট, মুসা, চেঁচিয়ে উঠল রবিন। নিশ্চয় কিশোর! অন সুইচটা টিপে দিয়ে ডিরেকশনাল ডায়ালটা দেখ!

শার্টের বুক পকেট থেকে খুদে যন্ত্রটা বের করল মুসা। অনিয়মিত ভাবে জ্বলছে নিভছে লাল আলো। সুইচ টিপতেই টিইইপ টিইইপ শুরু করল। ডায়ালের। তীরটা ঘুরে গেল রকি বীচের কেন্দ্রের দিকে।

বেশ জোরাল! মুসা বলল। তার মানে বেশি দূর যেতে পারেনি!

শহরের দিকে চলেছে, বলল রবিন। কিং, জলদি! ওদের পিছু নেয়া যাবে। এখনও সময় আছে।

ওয়ার্কশপ থেকে ছুটে বেরোল চারজনে। ক্যাডিলাকে এসে উঠল। মুসার চোখ সিগন্যাল ডায়ালের দিকে। স্পষ্ট সংকেত দিচ্ছে যন্ত্রটা।

 ওদিকে, হাত তুলে দেখাল মুসা। সোজা শহরের দিকে।

দ্রুত গাড়ি চালাল হ্যারি। কিং তাকিয়ে রয়েছে ডায়ালটার দিকে। কি যন্ত্র? কিভাবে কাজ করে?

একই সঙ্গে দুটো কাজ করে এটা, বুঝিয়ে বলল রবিন। ডিরেকশনাল সিগন্যাল আর ইমারজেন্সি অ্যালার্ম। সংকেত পাঠাতেও পারে গ্রহণও করতে পারে। এখন ওটা কিশোরের পাঠান সংকেত ধরছে। টিপ টিপ করছে সে জন্যেই। যতই কাছাকাছি যাব জোরাল হবে, সংকেত। কোনদিক থেকে সংকেত আসছে। সেটা নির্দেশ করবে তীরটা। ইমারজেন্সি অ্যালার্ম হিসেবেও কাজ করে যন্ত্রটা, কণ্ঠস্বরেই চালু হয়ে যায়, ভয়েস কমাণ্ড। আলোটা জ্বলছে তার কারণ কিশোর এখন বলছে…

না না বলো না! চেঁচিয়ে বাধা দিল মুসা, তাহলে কিশোরের সিগন্যাল অফ হয়ে যাবে!

ঢোক গিলল রবিন। তাই তো! হেল্প শব্দটা বলতে পেরেছে হয়ত কিশোর, যন্ত্রের কাছে।

ডানে, হ্যারি, আচমকা নির্দেশ দিল মুসা। বিড়বিড় করল আনমনে, শব্দ বাড়ছে। মনে হয় থেমে গেছে কিডন্যাপাররা।

ভ্রূকুটি করল কিং। যন্ত্রগুলো একাধারে প্রেরক এবং গ্রাহক, তাই তো বললে? রবিন, কিশোর একটা যন্ত্র ব্যবহার করছে, তাই না? যেন নিজেকেই কথাগুলো বোঝাচ্ছে সে। অ্যাক্সিডেন্টালি ওর সিগন্যাল যদি বন্ধ করে দিই আমরা কি ঘটবে?

অফ হয়ে যাবে ওর বীপারটা, রবিন বলল। কিডন্যাপাররা কিছু শুনতে পাবে না। পকেট ভালমত লুকানো থাকলে আলো জ্বলাও দেখতে পাবে না।

আশা করি ভালমতই লুকানো আছে, কিং বলল ধীরে ধীরে। কারণ। সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়েছে ও। মারাত্মক। অ্যাক্সিডেন্টালি আমরা একটা গোলমাল করেও দিতে পারি। তাহলে সংকেত দিতে শুরু করবে ওর যন্ত্র। আর সেটা কিডন্যাপারদের চোখে পড়ে গেলে, ওরা বুঝতে পারলে একটা সংকেত পাঠানোর যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, ভয়ানক বিপদ হবে কিশোরের। বুঝে যাবে কোন ছেলেটা কিশোর!

মুখ শুকিয়ে গেল রবিনের। এ কথাটা ভাবেনি। তাগাদা দিল হ্যারিকে, জলদি, আরও জোরে চালান!  

.

কিডন্যাপারদের ভাড়া করে আনা নীল লিংকন গাড়িটা একটা সেলফ-সার্ভিস ফিলিং স্টেশনে ঢুকল। পেছনের সীটে বসে রইল, কিশোর আর পিটার, জনের সঙ্গে। ডেভ নেমে গিয়ে ট্যাঙ্কে পেট্রল ভরতে শুরু করল। কেউ এল না গাড়িটার কাছে।

সত্যি কথাটা বললে তোমাদের দুজনের জন্যেই ভাল হত, জন বলল।

সাহায্য আসছে, কিশোর বলল। আমি জানি, আসছেই। বেশিক্ষণ লাগবে না।

আমিও জানি, একমত হলো পিটার। আমার বন্ধুরা আসবেই।

আসতে দেরি হলেই বুঝবে মজা, খেঁকিয়ে উঠল ডেভ। এখনও সময়। আছে। কিশোর বেরিয়ে যেতে চাইলে তাকে চলে যেতে দেব আমরা। পরে আর সুযোগ দেয়া হবে না। এক সময় না এক সময় জানতে পারবই আমরা কোনজন। কিশোর। তখন তাকে মেরে ফেলা হবে।

কে বিশ্বাস করে আপনার কথা, পিটার বলল।

আমিও না, কিশোর বলল। আমি যে কিশোর, একথা বললেই আপনারা ছেড়ে দেবেন, মোটেও বিশ্বাস করি না আমি। সাপকে বিশ্বাস করা যায়, আপনাদেরকে না। ভয় করি না। সাহায্য আসবেই।

গাধার মত কথা বল না। ধমকে উঠল জন। কোত্থেকে সাহায্য আসবে? আর ভয়টা কিসের পাচ্ছ, শুনি? পিটার কে, সেটা জানলেও আমরা তার ক্ষতি করব না। বাঁচিয়ে রাখব আমাদেরই স্বার্থে। কারণ মেরে ফেললে তাকে দিয়ে আর কোনও কাজ হবে না। বল, কে পিটার?

আগে সাহায্য আসুক তো, কিশোর বলল। তারপর নিজেরাই দেখতে পাবেন।

কপালে দুঃখ আছে, দাঁতে দাঁত চেপে বলল জন। আমরা আর কি করব!

না, আপনাদের কিছুই করার নেই, পিটার বলল। যা ইচ্ছে করবেন। এত বকবক করছেন কেন?

চড় মারার জন্যে হাত তুলেও থেমে গেল জন। ড্রাইভিং সীটে উঠে বসল ডেভ। মাথা গরম কর না। সুযোগ দিয়েছি, কথা শোনেনি। পরে আর আমাদেরকে দোষ দিতে পারবে না। ছেলেগুলোকে চালাক ভেবেছিলাম, এখন দেখছি একেবারে বোকা।

.

রকি বীচের রাস্তা ধরে যতটা সম্ভব জোরে গাড়ি ছুটিয়েছে হ্যারি। তার পাশে বসে সিগন্যাল ডায়ালের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। পেছনের সীট থেকে তার ঘাড়ের। ওপর দিয়ে ঝুঁকে এসেছে কিং আর রবিন, দেখার জন্যে। হঠাৎ কমে যেতে শুরু করল সিগন্যাল, দুর্বল হয়ে যেতে লাগল।

 ডানে! চিৎকার করে বলল মুসা। তীরটা ঘুরে গেছে সাগরের দিকে।

মোড় নিল হ্যারি। চওড়া একটা রাস্তা, চলে গেছে বন্দরের দিকে। সকালে প্রচণ্ড ভিড় রাস্তায়, দুদিকেই ছুটে চলেছে প্রচুর গাড়ি। আরও কমে আসছে। সংকেতের শব্দ, ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে।

 দক্ষিণে ঘুরেছে! মুসা বলল।

মুসা, রবিন বলল।  নিশ্চয় হাইওয়ের দিকে চলেছে ওরা। তীরটা দেখছ? অর্ধেক উত্তরে অর্ধেক দক্ষিণে। তার মানে লস অ্যাঞ্জেলেস।

তুমি…মনে হয় ঠিকই বলেছ, ঘাবড়ে গেছে মুসা।

হাইওয়েটা কদ্দূর? জিজ্ঞেস করল কিং।

মাইলখানেক, জবাব দিল রবিন।

মাথা নাড়ল হ্যারি। যা ভিড়! কিছুতেই জোরে চালাতে পারছি না।

হাইওয়েতে আমাদের চার গুণ জোরে চালাতে পারবে ওবা, কিং বলল। তোমাদের যন্ত্রের রেঞ্জ কতোটা?

তিন মাইল, রবিন জানাল।

 জোরে চালানোর চেষ্টা করেও পারছে না হ্যারি। অসহায় লাগছে তার। পারলে গাড়ির ভিড়ের ওপর দিয়ে উড়ে চলে যায়। ডায়ালের তীর দেখছে মুসা। থিরথির করে কাঁপছে ওটা, যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কোনদিকে ঘুরবে। অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে সংকেত। দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে আসলে, সে জন্যেই হচ্ছে এরকম। এক সময় জিভারোতে চলে এল তীর, কোনও দিক নির্দেশ করছে না আর। থেমে গেল সংকেতের শব্দ। নিভে গেল লাল আলো। রেঞ্জের বাইরে চলে গেছে প্রেরক যন্ত্রটা।

গেল! মাথায় হাত দিয়ে ফেলল কিং। আর ওদেরকে ধরা যাবে না। কি গাড়ি তা-ও জানি না। কি ভাবে অনুসরণ করব? আর কোনও উপায় নেই। পুলিশের কাছেই যেতে হবে।

.

গা ঘেঁষাঘেষি করে বসেছে পিটার আর কিশোর। সীটের আরেক প্রান্তে পিস্তল হাতে বসে রয়েছে জন। চোখ বন্ধ।

কিশোরের কানে কানে বলল পিটার, মনে হচ্ছে বলে দেয়া উচিত, কিশোর। তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেবে।

না, দেবে না। আমি গিয়ে সব ফাঁস করে দেব, এই ভয়ে। বিপদ আরও বাড়বে তখন আমাদের। পিটারের কোনও ক্ষতি ওরা করবে না, কিন্তু কিশোর পাশাকে ওদের কোনও প্রয়োজন নেই। অহেতুক কেন ঝামেলা রাখবে? তাছাড়া। অনেক বেশি জেনে ফেলেছে কিশোর, তাকে চুপ করিয়ে দিতেই চাইবে…

আচমকা চোখ মেলে ধমকে উঠল জন, এই, থামবে! এত কথা কিসের! যত্তোসব! একটাকে খতম করে দিতে পারলেই এখন বাঁচি!

খিকখিক করে হাসল সে। আবার চোখ মুদল। সকালের উজ্জ্বল রোদে তীব্র বেগে ছুটছে লিংকন। কে জানে কোন অজানার উদ্দেশে।  

.

১৭.

 থানার লম্বা বেঞ্চটায় বসে রয়েছে দুই গোয়েন্দা, হ্যারি আর কিং। ওদের সঙ্গে রয়েছেন মেরিচাচী আর রাশেদ পাশা। সব কথা শোনার পর মেরিচাচী ভীষণ খেপে যাবেন ভেবেছিল রবিন আর মুসা। কিন্তু ওদেরকে অবাক করে দিয়ে আশ্চর্য রকম শান্ত রয়েছেন তিনি।

ওই যে, কিশোরের মত ছেলেটা, হ্যারিকে বললেন তিনি। পিটার মনটেরো, আপনার দেশের লোকের কাছে খুবই মূল্যবান, তাই না? ভবিষ্যতে দেশটার স্বাধীনতার জন্যে?

হ্যাঁ, মিসেস পাশা, মাথা দোলালো হ্যারি। খুবই দামী। সিভিল ওয়ার ছাড়া একমাত্র ওর বাবাই পারে দেশটাকে স্বাধীন করতে। শান্তি আনতে। কিন্তু ওই কিডন্যাপারগুলো তা চায় না। ওরা চায় ওদের ইচ্ছে মত চালাতে। স্যার মনটেরোর ছেলেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে তাকে ওদের কথা শোনাতে বাধ্য করতে। সে জন্যেই পিটারকে উদ্ধার করা এখন এত জরুরী।

কিশোর আর তার বন্ধুরা আপনাদেরকে সাহায্য করেছিল, বলছেন, আর তখনই পিটারকে সহ কিশোরকে তুলে নিয়ে গেছে ওরা?

হ্যাঁ, তাই, জবাবটা দিল কিং।

তাহলে ঠিক কাজই করেছে ছেলেরা, যেন রায় ঘোষণা করলেন মেরিচাচী। ওরা যে আপনাদেরকে সাহায্য করেছে এ জন্যে আমি খুশি। এখন ছেলেদুটো। নিরাপদে ফিরে এলেই আরও বেশি খুশি হই আমি।

বেরিয়ে এলেন ইয়ান ফ্লেচার। গম্ভীর হয়ে আছেন। লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশকে সতর্ক করে দিয়েছি। কিন্তু ওরাই বা কি করতে পারবে বুঝতে পারছি না। গাড়িটা কি গাড়ি জানি না। লাইসেন্স নম্বর জানি না। শুধু কিডন্যাপারদের চেহারার বর্ণনা জানিয়ে দেয়া হয়েছে…

আবার সেই একই ব্যাপার, নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করলেন মেরিচাচী। কিছুই করার নেই আপনাদের। আগের বারও একই অবস্থা হয়েছিল। আপনাদের নাকের নিচে দিয়ে সব কাণ্ড করে চলেছে লোকগুলো, কিছুই করতে পারছেন না আপনারা।

সাধারণত একই জায়গায় আবার ফিরে আসে না কিডন্যাপাররা, মিসেস পাশা। ওরা যে আসবে কি করে বুঝব?

বোঝা উচিত ছিল, চীফের কথা একটুও পছন্দ হচ্ছে না মেরিচাচীর। কিশোর তো বলেইছিল আপনাদেরকে ও সাধারণ কিডন্যাপার নয়। তার কথা। শোনা উচিত ছিল।

হয়ত ঠিকই বলেছেন আপনি, মিসেস পাশা, তর্ক করলেন না ইয়ান ফ্লেচার। যাই হোক, লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশ তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করার কথা দিয়েছে। তবে পেলেও সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নিতে পারবে কিনা সন্দেহ।

কেন নয়? প্রশ্ন করলেন রাশেদ পাশা।

কারণ কিশোর আর পিটারকে জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে গেছে। কিডন্যাপাররা। ওদের কাছে অস্ত্র আছে। যা শুনলাম, তাতে মনে হয় ওরা সাধারণ কিডন্যাপার নয়, আরমির লোক। আর ওসব লোক বড় ভয়ংকর হয়। উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে নিজের জীবনের পরোয়া করে না। মুখোমুখি হয়ে ওদেরকে ঠেকানো হয়ত যাবে, কিন্তু ছেলেগুলোর মারাত্মক বিপদ হয়ে যাবে। একটাই উপায় আছে। কোনভাবে ওদেরকে চিহ্নিত করে চুপি চুপি গিয়ে ছেলেগুলোকে উদ্ধার করে আনা।

হুঁ! ছেলেদের বিপদটা বুঝতে পেরে আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন রাশেদ পাশা।

তবে যতক্ষণ খোঁচাখুঁচি করা না হবে, কিং বলল। ক্ষতি হবে না। ছেলেগুলোর। পিটারকে মারবে না ওরা, তাহলে স্যার মনটেরোকে কথা শোনাতে পারবে না। কিশোরেরও ক্ষতি করবে না। করে কোনও লাভ নেই ওদের। শুধু। আটকে রাখবে দুজনকেই যতক্ষণ না ওদের উদ্দেশ্য সফল হয়।

তা ঠিক, চীফ বললেন। এখন একটাই জিনিস দেখতে হবে আমাদের, ছেলেগুলোকে নিয়ে যাতে আমেরিকা থেকে বেরিয়ে যেতে না পারে ওরা। আচ্ছা, ওদের তো নানায় যাওয়ার কথা। দক্ষিণ লস অ্যাঞ্জেলেসের দিকে গেল কেন? ওখানে কি আছে?

নিশ্চয় বেরিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছে ওরা, হ্যারি বলল।

চারজনকে বেরোতে হবে! কি ভেবে হঠাৎ বলে উঠল রবিন। নিজেরা। দুজন, আর কিশোররা দুজন। ওরা জানে না কোন জুন পিটার। ওদের প্ল্যান ছিল তিনজনের বেরোতে হবে, চারজনের নয়। এতে কি প্ল্যানের পরিবর্তন করতে হবে না? হ্যারি আর কিং-এর দিকে ফিরল সে। লস অ্যাঞ্জেলেসে যাওয়ার অন্য কারণ নেই তো? হয়ত ওখানে গিয়ে কোনভাবে সনাক্ত করতে পারবে পিটারকে।

আমার জানা নেই, রবিন, কিং বলল।

নানদাতে নিয়ে গেলে হতে পারে, হ্যারি বলল। তবে লস অ্যাঞ্জেলেসে নয়। আমার মনে হয় না কোনও উপায় আছে ওদের।

মুসা বলল, নানদান ট্রেড মিশনে এমন কেউ নেই তো যে পিটারকে চিনতে, পারবে? মানে, মনটেরোদের কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধু? কিংবা আত্মীয়?

চট করে পরস্পরের দিকে তাকাল হ্যারি আর কিং। অবাক হয়েছে। এই সহজ কথাটা কেন ওদের মনে পড়েনি ভেবে।

র‍্যামন রিভস? যেন কিং-এর কাছে জানতে চাইল হ্যারি।

স্যার মনটেরোর অনেক পুরনো বন্ধু অবশ্য তিনি, আনমনে বিড়বিড় করল। কিং। না, তাকে বোধহয় ফাঁকি দিতে পারবে না ছেলেগুলো। কি করে এখন…।

এই র‍্যামন রিভসটি কে? চীফ জানতে চাইলেন, আমেরিকায় কি করছেন?

লস অ্যাঞ্জেলেসে নানান ট্রেড মিশনের প্রধান তিনি, কিং জানাল। তবে ওই উগ্রপন্থীদের কিছুতেই সাহায্য করবেন না রিভস।

ইচ্ছে হয়ত নেই, চীফ বললেন। তবে রবিনের কথাটাও না ধরে পারছি না।  পালানোর পরিকল্পনা করেছিল ওরা তিনজন, চারজন নয়। এটা ওদের জন্যে বড় সমস্যা। এর জন্যে বেপরোয়া হয়ে উঠবে ওরা। মিস্টার রিভসকে বাধ্য করতে পারে পিটারকে চিনিয়ে দিতে। কিংবা চালাকি করে জেনে নেবে তার কাছ থেকে। এখুনি হুশিয়ার করে দেয়া দরকার।

তাহলে ফোন করি, কিং বলল। শয়তানগুলোকে বিশ্বাস নেই। আরেকটা ব্যাপার, মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে ওদের। ভেতরে নিশ্চয় ওদের স্পাই আছে। ওর সাহায্যও নিতে পারে ওরা। মিস্টার রিভসকে সতর্ক করে রাখলে তিনিও হয়ত আমাদের সাহায্য করতে পারেন। ফাঁদে ফেলে দেয়া যেতে পারে কিডন্যাপারগুলোকে।

করুন। এখুনি। আমার ফোনটাই ব্যবহার করুন, চীফ বললেন।

ফোন করতে গেল কিং। অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল অন্যেরা। মেরিচাচী আর বসে থাকতে পারলেন না, উঠে পায়চারি শুরু করলেন।

যদি কিছুতেই বুঝতে না পারে কোন ছেলেটা পিটার? হ্যারিকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

তাহলে, আমার বিশ্বাস, দুজনকেই নানদায় নিয়ে যেতে চাইবে।

আফ্রিকায়? প্রায় চিৎকার করে বললেন মেরিচাচী। ওই শয়তানগুলো নিয়ে গেলে আর বাঁচিয়ে রাখবে…

ফিরে এল কিং। মিশন অফিসে নেই রিভস। সম্ভবত হলিউডে গেছেন, জরুরী কাজে। প্রায়ই যান। অফিসের কেউ কিছু বলতে পারল না। মেসেজ রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু আমিও ওদেরকে কিছু বলতে সাহস করলাম না। কোন লোকটা বিশ্বাসঘাতক কে জানে! এখুনি আমাদের লস অ্যাঞ্জেলেসে চলে যাওয়া উচিত।

হ্যাঁ, তুড়ি বাজাল হ্যারি। লোকগুলো এখনও অফিসে না গিয়ে থাকলে ওদের আগেই আমাদের গিয়ে বসে থাকা উচিত। ঘাপটি মেরে থাকব। ওরা এলেই খপ করে ধরব।

ঠিক আছে, চীফ বললেন। বুদ্ধিটা মন্দ না। আমি লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশকে জানিয়ে দিচ্ছি। মিশন অফিসের ওপর নজর রাখুক ওরা। আপনারা যাওয়ার আগে যদি মিস্টার রিভস ফিরে আসেন তাহলে তাকেও যেন সতর্ক করে দেয়, বলে রাখব।

.

জানালাশূন্য, অন্ধকার, একটা ছোট ঘরে বসে রয়েছে কিশোর আর পিটার! কয়েক ঘণ্টা হলো এখানে এনে ওদেরকে ভরেছে কিডন্যাপাররা। ঘরটা পাহাড়ের ওপর। চারপাশ ঘন গাছপালায় ঘেরা। এই অন্ধকারে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ওরা।

কোথায় এনেছে, কিশোর? পিটারের প্রশ্ন।

হলিউড হিলের কোথাও হবে, জবাব দিল কিশোর। কারও বাড়ির স্টোররুম কিংবা সেলার এটা। ঢোকানোর সময় আলো ছিল, ঘরটায় একবার নজর বোলাতে। পেরেছিল সে। শক্ত করে ওদেরকে বেঁধে রেখে গেছে, তাই বেরোনোর পথ। খোঁজার চেষ্টাও করতে পারছে না। যদিও কিশোরের ধারণা, খোলা রেখে গেলেও বিশেষ সুবিধে করতে পারত না। পথ নেই, দেখেছে ঢোকার সময়ই।

মানে আমাদেরকে কি করবে, বল তো? আবার প্রশ্ন করল পিটার।

তোমাকে কি করবে, বলতে পারি। যেভাবেই হোক আমেরিকা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে, নানদায়। তবে এখানে যে কেন রেখে গেল বুঝতে পারছ না। যদি না…

কী, কিশোর?

যদি না কারও জন্যে অপেক্ষা করে। এমন কেউ, যে তোমাকে সনাক্ত করতে পারবে।

হুঁ, ঠিকই বলেছ। দুজনকে নেয়ার কোনও ইচ্ছেই ওদের নেই। ভাবছি, তখন তোমাকে কি করবে ওরা?

আমিও তাই ভাবছি, কিশোরের কণ্ঠে অস্বস্তি।

.

দুপুরের কড়া রোদ, রেজায় গরম। উইলশায়ার বুলভারের একটা অফিসের সামনে পাকিং লটে গাড়ি সেকালেন ইয়ান ফ্লেচার। বিশাল ক্যাডিলাকটা পুলিশের গাড়ির পাশে রাখল হ্যারি। চীফ গাড়ি থেকে বেরোতেই তাড়াহুড়া করে এগিয়ে এল লস অ্যাঞ্জেলেসের একজন পুলিশ।

মিস্টার রিভস ফেরেননি, চীফ, লোকটা জানাল। সন্দেহজনক কোনও লোককেও অফিসে ঢুকতে দেখিনি সারাক্ষণই চোখ রাখা হয়েছে অফিসের ওপর।

ওরা এখানে আসেনি, চীফ, মুসা বলল। ইমারজেন্সি সিগন্যালের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কোনও সাড়া নেই যন্ত্রের।

বাড়ির ভেতরে ঢুকলে হয়ত সাড়া দিতে পারে, হ্যারি বলল।

দেখা দরকার, বলল কিং। চীফ, আমার মনে হয় আপনার এখানে থাকাই ভাল। অবশ্যই লুকিয়ে থাকতে হবে। কিডন্যাপাররা যাতে দেখতে না পায়।

দুই গোয়েন্দাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল হ্যারি আর কিং। এলিভেটরে করে উঠে এল তিনতলায়, যেখানে রয়েছে মিশনের অফিস। বেশ সম্মান দেখিয়ে হ্যারি আর কিংকে স্বাগত জানাল রিসিপশনিস্ট মেয়েটা। রিভসের কথা জিজ্ঞেস করলে মাথা নাড়ল। কোনও খবর জানে না।

তাঁর অ্যাসিসটেন্ট মিস উলি জেসাপকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, মেয়েটা জানাল। নানদার হস্তশিল্পের একটা প্রদর্শনী হচ্ছে, সেখানেও যেতে পারেন। তবে সারাদিন তো থাকার কথা নয়। ওরকম থাকেন না কখনও। মিস জেসাপ ফিরে এলেও জানা যেত মিস্টার রিভস কোথায় আছেন। সকাল থেকেই কয়েকবার করে দুজনের কাছে ফোন এসেছে, কোথায় গেছে জানতে চেয়েছে, জবাব দিতে পারিনি।

প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্যেই যেন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল মেয়েটা, এই সময় ফোন রাজল। রিসিভার তুলে নিয়ে কানে ঠেকাল। ওখানে আর থাকার কোনও প্রয়োজন নেই। বেরিয়ে এল গোয়েন্দারা।

আপনারা বললেন মিশনে স্পাই আছে, মুসা বলল। স্পাইয়ের দরকার নেই। ওই একটা মেয়েই যে হারে কথা বলতে থাকে, সব গোপনীয়তা ফাঁস করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট।

হয়ত, হাসল কিং। মেয়েটা কথা একটু বেশিই বলে। তবে আসল কথাটাই বলতে পারল না। আমরা যা জানতে চাই। রিভস কোথায়?

তার মানে, হ্যারি বলল। মিস্টার রিভস কোথায় আছেন একথা কিডন্যাপারদেরকেও বলতে পারবে না সে।

তা তো বুঝলাম। এখন কি করা? এলিভেটর দিয়ে নামতে নামতে প্রশ্ন রাখল রবিন।

অপেক্ষা আর আশা করা ছাড়া আর কি করার আছে? কিং বলল। বসে থাকব। দেখব কে আগে আসে। মিস জেসাপ, মিস্টার রিভস, নাকি কিডন্যাপাররা। এছাড়া আর তো কিছু ভাবতে পারছি না।

প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পার্কিং লটে বসে বসে ঘামতে লাগল দুই গোয়েন্দা, দুজন। নানান আর কয়েকজন পুলিশম্যান। হতাশ হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। ডায়ালের। দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ ব্যথা করে ফেলল মুসা। একবারের জন্যেও জ্বলল না লাল আলো।

আর পারি না! অপেক্ষা অসহ্য হয়ে উঠেছে মুসার কাছে। কিশোর আর পিটারের সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে। কি করে জানব, পিটারকে চেনে এরকম আর কাউকে খুঁজে বের করেনি কিডন্যাপাররা?

জানার উপায় নেই, ভয়ানক গম্ভীর হয়ে আছে হ্যারি। শুধু জানি ট্রেড মিশনই ওদের একমাত্র আশা। সেজন্যেই বসে থাকতে হবে।

অবশেষে, দুপুরের পরে, ওপরতলায় বসে যে শাদা পোশাকের পুলিশম্যানটি নজর রাখছিল, সে ওয়াকি টকিতে কথা বলল ইয়ান ফ্লেচারের সঙ্গে। কালো চুলওয়ালা এক মহিলা এই মাত্র ঢুকল। এখানকারই কেউ মনে হচ্ছে। তাকে খুঁজছেন না তো?

মিস জেসাপ! চেঁচিয়ে উঠল কিং। সে-ই হবে! গিয়ে দেখা দরকার।

আবার ওপরতলায় ছুটে এল গোয়েন্দারা। একই রকম হাসি দিয়ে স্বাগত জানাল রিসিপশনিস্ট। হাল্লো, আবার এসেছেন! ভাল। মিস্টার রিভসের কোনও খবর নেই। তবে মিস জেসাপ ফিরেছে। ওর সঙ্গে দেখা করবেন? মিস্টার রিভসের অফিসে আছে।

কোণের দিকে মিস্টার রিভসের অফিস। সেদিকে এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল মুসা। কান পেতে শুনছে।

কি হয়েছে? জানতে চাইল রবিন।

অফিসে কথা শোনা যাচ্ছে। মিস জেসাপই বলছে হয়ত কারও সঙ্গে।

হ্যারিও কান পাতল। কই, আমি তো শুনছি না।

কি জানি, গাল চুলকাল মুসা। আমার ভুলও হতে পারে।

 দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকল ওরা। মিস্টার রিভসের ডেস্কের কাছে দাঁড়িয়ে কাগজপত্র ঘাঁটছে মিস ডলি জেসাপ। গায়ে সবুজ ব্লাউজ। পরনে ধূসর স্ন্যাকস। ওদেরকে দেখে চকচক করে উঠল চোখ, পিটারকে পেয়েছেন?

পেয়েছি, তিক্তকণ্ঠে বলল কিং। তারপর আবার হারিয়েছি।

হারিয়েছেন? ধীরে ধীরে ডেস্কের ওপর থেকে একটা কানের দুল, তুলে নিয়ে পরতে লাগল মিস জেসাপ।

সারাদিন কোথায় ছিলে, ডলি? হ্যারি জিজ্ঞেস করল। মিস্টার রিভসের সঙ্গে?

মাথা ঝাঁকাল ডলি।

পিটারের কথা কেউ তাকে জিজ্ঞেস করেছে?

না তো। কেন?

কিডন্যাপাররা পিটারকে ধরে নিয়ে গেছে। আমাদের ধারণা, কিং বলল। মিস্টার রিভসের কাছে যাবে ওরা পিটারকে সনাক্ত করার জন্যে…

সর্বনাশ! আঁতকে উঠল ডলি। মিস্টার রিভস তা পারবেন! ওরা তাঁকে ফাঁকি দিতে পারবে না। জলদি হুশিয়ার করে দেয়া দরকার!

তাকে পাব কোথায়?

ঘড়ি দেখল ডলি। দুটো জায়গার কোনও একটাতে হতে পারে। হ্যাঁণ্ডিক্র্যাফট ইমপোর্টার গিল্ড, কিংবা দি আর্টস অভ, আফ্রিকা। ওই দুটো জায়গায়। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। বিকেল পাঁচটার আগেই সারতে হবে।

দেড় ঘণ্টা বাকি, হিসেব করে বলল হ্যারি। একসঙ্গে গেলে সময় পাব না। ভাগাভাগি হয়ে যেতে হবে।

জলদি চলুন, রবিন বলল।

দুটো জায়গার ঠিকানা লিখে দিল ডলি। দ্রুত অফিস থেকে বেরিয়ে এলিভেটরের দিকে চলল চারজনে। যে মুহূর্তে এলিভেটরের দরজা বন্ধ হলো, ঘুরে। তাকাল মুসা, মিস্টার কিং! ও মিথ্যে বলেছে! গাধা বানানোর চেষ্টা করেছে। আমাদেরকে।

.

১৮.

 মানে? বুঝতে পারল না রবিন।

কি করে বুঝলে? হ্যারির প্রশ্ন।

ভুল করছ তুমি, মুসা, কিং বলল। ওই মেয়েটাকে বহু বছর ধরে চিনি

না, ভুল আমি করছি না, দৃঢ় কণ্ঠে বলল মুসা। ডলি বলেছে মিস্টার রিভস তা পারবেন। আরও বলেছে, ওরা তাঁকে ফাঁকি দিতে পারবে না।

বিস্ময় ফুটল কিং-এর চোখে। ঠিকই তো বলেছে। আমরা সবাই সেটা জানি।

জানি। কিন্তু আমরা একবারও বলিনি ডলিকে যে পিটার আর আরেকটা ছেলেকে নিয়ে কোনও গোলমাল হয়েছে। বলিনি কিডন্যাপাররা দুজনকে ধরে নিয়ে গেছে। তাহলে কি করে জানল সে, বোকা বানানো হয়েছে কিডন্যাপারদেরকে? পিটারকে সনাক্ত করা দরকার?

 চুপ হয়ে রইল অন্য তিনজন। এলিভেটর নিচে নামলে বেরিয়ে এল সবাই। অবশেষে হ্যারি বলল, ও ঠিকই বলেছে। ট্রেড মিশনের কেউই জানে না এ খবর। ডলি জানল কিভাবে?

মাথা ঝাঁকাল কিং। রকি বীচের বাইরে একমাত্র পুলিশ জানে। আর তারা নিশ্চয় ঢোল পিটিয়ে বলতে যাবে না ট্রেড মিশনের অফিসে। তার

এর একটাই মানে, মুসা বলল। ডিলির সঙ্গে কির্ডন্যাপারদের যোগাযোগ রয়েছে।

 তা কি করে হয়? প্রশ্ন তুলল কিং। সারাটা দিন সে মিস্টার রিভসের সঙ্গে সঙ্গে ছিল।

সেটা তার মুখের কথা। প্রমাণ তো আর নেই।

মিস্টার রিভসকে জিজ্ঞেস করলেই সব জানা যাবে। ডলি মিছে কথা বলে থাকলে ফাঁস হয়ে যাবে।

এক মিনিট হাত তুলল রবিন। মুসার মনে হয়েছিল সে অফিসে কথা বলতে শুনেছে। আমরা শুনিনি। সে ভুল করেছে ভেবেছি। কারণ ডলি অফিসে একা, কার সঙ্গে কথা বলবে? ডেস্ক থেকে একটা কানের দুল তুলে তাকে পরতে দেখেছি। আমি যতটা জানি, কিশোরও অনেকবার বলেছে, টেলিফোনে কথা বলার সময়ই শুধু ওরকম ভাবে দুল খুলে নেয় মহিলারা। অস্বাভাবিক বড় দুল যারা পরে। কানে থাকলে রিসিভার চেপে ধরতে অসুবিধে হয়। হতে পারে টেলিফোনে কিডনাপারদের সঙ্গে কথা বলেছিল সে। মনে আছে, রিসিপশনিস্ট বলেছিল, সকাল থেকে অনেক ফোন এসেছে মিস জেসাপের কাছে? অনেকে নাকি খুঁজেছে। বাজি রেখে বলতে পারি এখন কিডন্যাপাররাই যোগাযোগ করতে চেয়েছে ডলির সঙ্গে।

কিং, মুসা বলে। আপনি বলছেন, অনেক বছর ধরে চেনেল ডলিকে। তার মানে তার সঙ্গে কাজ করেছেন। ডলি কি স্যার মনটেরোর সঙ্গেও কাজ করেছে? পিটারকে দেখলে চিনবে?

আমি শিওর না, ভ্রূকুটি করল কিং। অনেক বছর ধরে স্যার মনটেরোর অফিসে কাজ করেছে অবশ্য, তবে মিস্টার রিভসের মত তার পারিরারিক বন্ধু নয়! পিটারকে চিনতে পারবে কিনা জানি না। তবে বলাও যায় না। চিনেও ফেলতে পারে। ঈশ্বর, তাই তো, এখন মনে হচ্ছে সে-ই। পিটারের মেসেজটা তার হাত দিকেও বেরিয়ে যেতে পারে!

  পার্কিং লটের দিকে দৌড় দিল চারজলে। ইয়ান ফ্লেচারকে জানাল সন্দেহের কথা।

ওকে ধরা দরকার। ফুঁসে উঠল হ্যারি। চাপ দিলেই…

না, রাজি হলেন না চীফ। লাভ হবে না। উগ্রবাদীদের দলে হলে ভীষণ শক্ত হবে। কিছুতেই মুখ খুলবে না। আপনাদেরকে ভুল জায়গায় পাঠাতে চেয়েছে। তার মানে সময় চেয়েছে সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে। দেখা করার জন্যেও হতে পারে। আর তা করলে সে-ই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের।

 ঠিকই বলেছেন, মুসা বলল। সে ভাববে আমরা মিস্টার রিভসের সঙ্গে দেখা, করতে চলে গেছি। এই সুযোগে সে চলে যাবে কিডন্যাপারদের সঙ্গে কথা বলতে।

হ্যাঁ। আমি পুলিশকে বলে যাচ্ছি এখানে থেকে অফিসের ওপর নজর রাখতে, চীফ বললেন। তারপর আমার গাড়িতে করে তোমাদেরকে নিয়ে সরে যাব এখান থেকে, ডলি ভাববে আমরা চলে গেছি। ঘুরে আবার আরেক দিক দিয়ে চলে আসব। লুকিয়ে উঠে পড়ব ক্যাডিলাকে। ওকে অনুসরণ করব। আমাদেরকে পুলিশ কারে করে চলে যেতে দেখবে সে। কাজেই একটা ক্যাডিলাক পিছু নিলে খেয়াল করবে বলে মনে হয় না।

বুদ্ধিটা ভাল। সবারই মনে ধরল। চীফের কথামতই কাজ করা হলো

পনেরো মিনিট পর বেরিয়ে এল ডলি জেসাপ। একটা লাল পনটিয়াকে উঠল। গাড়িটাকে অনুসরণ করে চলল হ্যারি আর কিং-এর ক্যাডিলাক।

.

দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চুপ করে বসে রয়েছে কিশোর আর পিটার। অনেকক্ষণ ধরে রয়েছে একই ভাবে।

আর আমাদের খুঁজে পাবে না তোমার বন্ধুরা, পিটার বলল।

 পাবেই! আমি জানি, ওরা পাবেই! খুঁজে বের করবেই আমাদের!

হঠাৎ জ্বলে উঠল আলো। ক্ষণিকের জন্যে অন্ধ করে দিল যেন ছেলেদের। ভেতরে ঢুকেছে দুই কিডন্যাপার। কিশোরের দিকে এগিয়ে এল জন, পিটারের দিকে ডেভ। টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল দুজনের শার্ট।

পিটারের দিকে তাকিয়ে ডেভ বলল, ভেরি গুড। খেল তাহলে খতম, অ্যাঁ?

কিশোরের দিকে তাকাল পিটার। তার পেটে ছোট একটা কাটা দাগ রয়েছে। কিশোরের তেমন দাগ নেই।

এবার কি বলবে? কিশোরের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে জন। ওরকম এক দাগ তোমার করে নেয়া উচিত ছিল।

.

 হলিউড হিলের একটা ছোট বাড়ির ড্রাইভওয়েতে ঢুকল লাল পনটিয়াক। থামল। বেরিয়ে এল ডলি। দৌড়ে এগোল সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়ল বারান্দায়। দুটো বাড়ি আগে একটা মোড়ে থেমে গেল ক্যাডিলাক। ইমারজেন্সি সিগন্যালের দিকে তাকাল মুসা।

না, কিছু নেই, হতাশ কণ্ঠে বলল সে। মনে হয় কিশোরের যন্ত্রটা পেয়ে গেছে কিডন্যাপাররা। অফ করে দিয়েছে। কিংবা ওরা এখানে নেইই।

তাহলে কি আমাদের ভুল হলো? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল হ্যারি।  

না, জোর দিয়ে বলল মুসা। ওই মেয়েটা কিডন্যাপারদের দলেরই।

চল, কিং বলল। বাড়িতে ঢুকে পড়ি। তারপর যা হয় হবে।  

গাড়ি রেখে হেঁটে এগোল দলটা। নিঃশব্দে দ্রুত চলে এল বাড়ির আঙিনায়। লম্বা লম্বা গাছ, লতা আর ঝোপঝাড়ের জঙ্গল হয়ে আছে বাড়ির চারপাশে। সামনের দরজার কাছে এসে কান পাতল ওরা। কথা শোনা গেল না। শুধু কাঠের। মেঝেতে ডলির হাই হিলের খটখট শব্দ। কলিং বেল বাজাল কিং! দরজা খুলে হাঁ হয়ে গেল ডলি।

এখানে কি? খেঁকিয়ে উঠল সে। পরক্ষণেই হাসল, অস্বস্তি আর ভয় মেশানো হাসি। সরে জায়গা করে দিল সবাইকে ঢোকার জন্যে। একটা লিভিং রুমে নিয়ে এল। মিস্টার রিভসকে পেয়েছেন? কিডন্যাপাররা তার কাছে গিয়েছিল?

তার সঙ্গে দেখা করতে যাইনি আমরা, হ্যারি বলল।

কারণ, কিং বলল। তার সঙ্গে দেখা করতে যাবার দরকার নেই কিডন্যাপারদের। পরে মনে হয়েছে আমাদের।

আপনাকে চুপ থাকতে অনুরোধ করব, শান্তকণ্ঠে ডলিকে সাবধান করলেন চীফ। কারণ বেফাঁস যা কিছু বলবেন এখন আদালতে সব যাবে আপনার বিরুদ্ধে।

ওরা কোথায়? ভুরু নাচাল মুসা। পিটার আর কিশোর?

কিডন্যাপারদের সঙ্গে কথা বলেছেন আপনি, রাগ চাপতে পারল না রবিন। জানি আমরা। ওরা কোথায়? কি করেছে কিশোর আর পিটারকে?

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ওদের দিকে তাকিয়ে রইল ডলি। নিরাশ ভঙ্গিতে হাত ছড়াল দুপাশে। কি বলছ বুঝতে পারছি না। এই কিশোরটি কে? কোনও কিশোরকে তো চিনি না আমি? আর আমি কি করে জানব পিটার কোথায় আছে?

 খুব ভাল করেই জান এখন তুমি, কড়া গলায় বলল কিং। কিশোর কে। আর পিটারের কি হয়েছে তা-ও জান, কারণ কিডন্যাপারদের দলেরই লোক তুমি।

 আমি! হাঁ হয়ে গেল ডলি। আমি? মানে আমি পিটারের ক্ষতি করব? বহু বছর আমি স্যার মনটেরোর কাজ করেছি। আমি তার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী।

কেন মিথ্যে বলছ? শান্ত কণ্ঠে বলল হ্যারি। চীফ, বাড়িটা খুঁজে দেখা দরকার।

তার জন্যে সার্চ ওয়ারেন্ট লাগবে। কঠিন হয়ে উঠল ডলির কণ্ঠ। তারপর কি ভেবে মনস্থির করে নিয়ে বলল, ঠিক আছে, দেখুন। যত খুশি দেখুন। আমার তো আর কিছু লুকানোর নেই। তবে মনে অনেক কষ্ট দিলেন আমাকে।

আমিও কি দিয়েছি? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

আপনি? পলকের জন্যে রাগে বিকৃত হয়ে গেল ডলির মুখ। তারপর জোর করে হাসল। হ্যাঁ, মিস্টার ম্যাকঅ্যাডাম, আপনিও দিয়েছেন।

কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, চীফ বললেন। খুঁজুন তো।

ছড়িয়ে পড়লেন চীফ, হ্যারি, রবিন, আর মুসা। লিভিং রুমে ডলির সঙ্গে রইল কিং।

এর জন্যে পস্তাতে হবে আপনাকে, কিং, শাসিয়ে বলল ডলি। কিডন্যাপারদের ব্যাপারে কিছু জানি না আমি। কিংবা ওই দুটো ছেলের ব্যাপারে।

ছেলে যে দুটো কি করে জানলে?

একটু আগেই তো বললেন কিশোর নামে আরও একটা ছেলে রয়েছে।

না, কিশোর নামে আরেকটা ছেলে রয়েছে ওভাবে একবারও বলিনি। ছেলে কেন, বয়স্ক মানুষও হতে পারে কিশোর। কিন্তু তুমি একেবারে নিশ্চিত ভাবে বলে দিলে সে ছেলে। তারমানে তুমি জান। এই নিয়ে দুবার মুখ ফসকাল তোমার। একবার অফিসে, একবার এখানে। তা কিডন্যাপারদেরকে চিনিয়ে দিয়েছ নাকি, পিটার কোনজন?

আর একটা কথাও বলতে চাই না আপনার সঙ্গে।

ভেতরের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এল রবিন আর হ্যারি। আরেক দিক থেকে এলেন ফ্লেচার আর মুসা। ডলির মুখোমুখি দাঁড়াল রবিন। কিছু কথার জবাব দিতে হবে আপনাকে, মিস জেসাপ।

ছেলেদেরকে দিয়েও আমাকে অপমান করাতে চান নাকি? কিং-এর দিকে। তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বলল ডলি।

কিং কিছু বলল না। রবিন তার কথা বলে গেল, আমার বন্ধু কিশোর বলে, ছোটখাট ব্যাপারও অবহেলা করতে নেই গোয়েন্দাগিরিতে। যাই হোক, আপনি একজন নানদান। এবং আমার বিশ্বাস, ওখানকার জুয়েলারি আপনার খুব পছন্দ।

কি বকবক করছে এই ছেলেটা? কিং-এর দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলল ডলি। দেখুন, আমি আপনাকে হুঁশিয়ার করছি…

পকেট থেকে হাত বের করল রবিন। হাতে হাতির দাঁতের তৈরি ছোট একটা গহনা। কানে পরার জন্যে। বলল, এটা আপনার বেডরুমে পেয়েছি, মিস জেসাপ। কানের দুল, তাই না? নানদার মেয়েরা পরে। মাত্র একটাই আছে। আরও একটা থাকার কথা ছিল, নেই। কারণ ওটা হারিয়ে গেছে। আবার পেয়েছি। সেই বক্স ক্যানিয়নে, যেখানে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিশোরকে। কিডন্যাপারদেরকে তুলে নেয়ার জন্যে ওখানে নেমেছিল হেলিকপ্টারটা।

 হাতির দাঁতের তৈরি খুদে হাতির দাঁতটার দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ডলির মুখ।

কিশোর বলে, বলতে থাকল রবিন। কোনও মহিলাই তার পছন্দের জিনিস ফেলে না, বিশেষ করে গহনা। একটা দুল হারিয়ে গেলে আরেকটা পরা যায় না, তবু রেখে দেয়। মহিলাদের স্বভাব। আপনিও মহিলা। একটা হারিয়ে এসেও আরেকটা ফেলতে পারেননি। আপনি স্যার মনটেরোর শত্রু, মিন্স জেসাপ। সেদিন ক্যানিয়নে আপনিই হেলিকপ্টার নিয়ে গিয়েছিলেন। পাইলট ছিলেন আপনিই। তখনই কোনভাবে আপনার কান থেকে দুলটা খুলে পড়ে গিয়েছিল।

.

১৯.

 খাইছে! বলে উঠল মুসা। ফ্লাইং স্যুট আর গগলসের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। একজন মহিলা!  

ও-ই পাইলট ছিল কিনা, চীফ বললেন। সেটা শিওর হতে হবে আমাদের।

তা হওয়া যাবে, কিং বুলল। যাদের কাছ থেকে হেলিকপ্টার ভাড়া নিয়েছিল তাদের কাছে গেলেই হবে। নিশ্চয় কণ্ঠস্বর চিনতে পারবে ওরা।

 আর কানের দুলটা তো আছেই, হ্যারি বলল। প্রমাণ।

জ্বলন্ত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ডলি। ঘৃণা আর রাগ ছড়িয়ে পড়েছে মুখে। আচমকা হেসে উঠল খিলখিল করে, বেশ, আমিই পাইলট ছিলাম, হেলিকপ্টার চালিয়েছি। স্বীকার করছি। তাতে দোষের কি আছে? আমি একজন নানদান। দুশো বছর ধরে ওখানে বাস করছে আমার বাপ-দাদারা।

আর আমরা বাস করছি দুহাজার বছর ধরে, বলল কালো চামড়ার নানদান, হ্যারি। আমরা তোমাদেরকে দয়া করে জায়গা দিয়েছি আমাদের দেশে, নানদা বলে মেনে নিয়েছি। কিন্তু ওটা আমাদের দেশ।

–কক্ষণো না! হিঁসিয়ে উঠল ডলি।

 চীফ বললেন, আপনাদের দেশ, আপনাদের পলিটিকস, সেটা আপনাদের ব্যাপার। ওসব নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। এটা নানদা নয়; আমেরিকা। এখানে এসে দুটো ছেলেকে কিডন্যাপ করেছেন। ভলির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি এখন কিডন্যাপারদের একজন। সেই বিচার হবে, শাস্তি আপনাকে মেনে নিতেই হবে। সাংঘাতিক কঠোর হয়ে উঠল তার কণ্ঠ, ছেলেদুটো কোথায়? পিটার আর কিশোর?

 ছিল এখানেই, ডলি জবাব দিল। এখন নেই। জন আর ডেভ এসে নিয়ে গেছে।

কোথায়? জানতে চাইল কিং।

 সেটা কোনদিনই তোমাকে বলব না আমি। পিটার এখন আমাদের কব্জায়। স্যার মনটেরোকে যা করতে বলব তাই করতে বাধ্য হবেন তিনি।

না, অত আশা কোরো না। তিনি কোনদিনই তোমাদের কথা শুনবেন না। নিজের ছেলের প্রাণের বিনিময়েও না। যা ভাল বুঝবেন তাই করবেন। তার কাছে সব চেয়ে বড় নানদার ভবিষ্যৎ।

 বানিজি একমাত্র ছেলের জীবনের ঝুঁকি নেবেন?

 নেবেন। আরও বড় ঝুঁকি হলেও নেবেন, হ্যারি বলল।

 চীফ রেগে গেলেন, জাহান্নামে যাক নানদা। আমি এখানকার পুলিশ। আমেরিকার। আমেরিকায় বসে কিডন্যাপিঙের মত মস্ত একটা অপরাধ করেছেন আপনি, মিস জেসাপ। ভাল চান তো ছেলেগুলো কোথায় আছে বলুন।

আমি একজন সৈনিক, দেশপ্রেমিক, জবাব দিল ডলি। কিডন্যাপার নই। কিছুতেই মুখ খোলাতে পারবেন না আমার। ওদেরকে নিয়ে চলে গেছে জন আর ডেভ। ওদেরকে ধরার সাধ্য নেই আর আপনাদের।

 চীফের মুখের ওপর হেসে উঠল সে। পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগলেন চীফ হ্যারি, কিং, রবিন আর মুসা। ডলি মুখ না খুললে কি করে জানা যাবে পিটার আর কিশোর কোথায় আছে? সবাই কিছুটা হতাশ, রবিন বাদে। চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে ডলির দিকে। এখানে কিডন্যাপাররা না এসে থাকলে কি করে জানবে কে কিশোর আর কে পিটার? ধীরে ধীরে বলল সে। নিশ্চয় মিস জেসপি বলেছেন ওদেরকে টেলিফোনে।

হেসে উঠল ডলি। অবশ্যই বলেছি। সহজ ব্যাপার। পিটারের পেটে ছোট একটা কাটা দাগ আছে। কয়েক বছর আগে, অ্যাপেনডিক্স অপারেশন করা হয়েছিল তার।

বুঝলাম, মাথা ঝাঁকাল রবিন। তবে সেটা নিয়ে ভাবছি না। আমি ভাবছি জন আর ডেভ যদি মিস জেসাপ আসার আগেই চলে গিয়ে থাকে তাহলে তিনি এত তাড়াহুড়া করে অফিস থেকে চলে এলেন কেন? আসারই বা কি প্রয়োজন ছিল? জবাব একটাই। ফোনে সঙ্গীদের বলে দিয়েছেন, কিভাবে পিটারকে সনাক্ত করতে হবে। ওরা তখন পিটারকে চিনে নিয়ে পালানোর ব্যবস্থা করতে লাগল। মিস জেসাপও চলে এলেন। নিশ্চয় কোনও জরুরী কাজ আছে।

ঠিক, একমত হয়ে মাথা দোলালেন চীফ। রবিন ঠিক বলেছে। নইলে এত তাড়াহুড়া করে অসময়ে বাড়ি আসতে যাবেন কেন মিস জেসাপ?

এটা আমার বাড়ি, কর্কশ কণ্ঠে বলল ডলি। যখন খুশি আমি আসতে পারি এখানে।

তা পারেন, রবিন স্বীকার করল। তবে, এত তাড়াহুড়া কেন? আমার কি মনে হয় জানেন? পিটারকে নিয়ে চলে যাবে আপনার বন্ধুরা। কিশোরকে ফেলে যাবে। তাকে পাহারা দিতেই আপনার এই আসা।

কিশোর? ভরু কোঁচকালেন চীফ।

হ্যাঁ, ঠিক! তুড়ি বাজাল হ্যারি। অহেতুক নানদায় বয়ে নিয়ে যাবে না ওরা কিশোরকে। ওদের দরকার পিটারকে। একলা তাকেই নেবে। দুটো ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি।

তা। তার মানে এখানেই আছে এখনও কিশোর! বলে উঠল মুসা।

খোঁজ, খোঁজ, আবার খোঁজ নির্দেশ দিলেন চীফ।

এবার ডলির পাহারায় রইল হ্যারি। অন্যেরা ছড়িয়ে গেল খোঁজার জন্যে। প্রতিটি ঘর, প্রতিটি আলমারি, মোট কথা একজন মানুষ লুকিয়ে থাকার মত যত জায়গা আছে সব খুঁজে খুঁজে দেখতে লাগল। বেশিক্ষণ লাগল না সব দেখতে। কিশোরের চিহ্নও দেখতে পেল না।

বাইরে দেখা দরকার, কিং বলল। গ্যারেজে। ছাউনি-টাউনিও থাকতে পারে।

ওদেরকে বাইরে বেরোতে দেখে মুচকি হাসল ডলি। গ্যারেজ বাদে ছোট একটা ছাউনি আছে। ছাউনির ভেতরে পাওয়া গেল শুধু বাগান করার যন্ত্রপাতি। গ্যারেজের ভেতরে কিছুই না। বাড়ির আশপাশে পাহাড়ের অনেকখানি জায়গা খুঁজে দেখল মুসা। কিশোরের চিহ্নও পেল না।

আবার ঘরে ফিরে এল দলটা।

টিটকারির সুরে ডলি বলল, বলেছিলাম না, নেই। পাবে না। কিং, হ্যারি স্বীকার করতেই হলো তোমাদেরকে। পরাজয় মেনে নিতে লজ্জা কিসের? দেখো, তোমাদের স্যার মনটেরোকেও কব্জা করে ছাড়ব আমরা।

আবার খোঁজ! কিছুতেই পরাজয় মেনে নিতে রাজি নন ইয়ান ফ্লেচার। রাগে পিত্তি জ্বলছে তাঁর, কিন্তু কিছুই করার নেই। কথা আদায় করা যাচ্ছে না ডলির মুখ থেকে, রাগটা তার এ জন্যেই।

অন্ধকার হয়ে আসছে। বাড়ির চারপাশে গাছপালা ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না শেষ বিকেলের রোদ। বিছানার নিচে আর আলমারিগুলোতে আবার খোঁজার জন্যে আলো জ্বেলে নিতে হল।

চীফ! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

মিটমিট করতে শুরু করেছে বাল্বগুলো।

কি ব্যাপার? অবাক হয়েছে হ্যারি। বৈদ্যুতিক গোলমাল?

জ্বলছে নিভছে…জ্বলছে নিভছে…কিছুতেই ঠিক হতে চাইছে না যেন আলো।

আকাশ তো ভালই, জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বলল রবিন। আবহাওয়ার জন্যে এরকম হচ্ছে না। গরমও তেমন নেই যে সার্কিটে ওভারলোড হয়ে যাবে।

জ্বলছে নিভছে…জ্বলছে নিভছে…নিয়মিত।

যেন ইচ্ছে করে করছে কেউ, কিং অনুমান করল। মাস্টার সুইচ নিয়ে কিছু করছে না তো? কিংবা ফিউজ…

নিশ্চয় কিশোর! আবার চেঁচিয়ে বলল মুসা। সংকেত দেয়ার চেষ্টা করছে! আশপাশেই আছে কোথাও!

কিন্তু কোথায়? ঘরের চারপাশে তাকাতে লাগলেন চীফ। সমস্ত জায়গায়ই তো খোঁজা হয়েছে।

ওই মহিলা জানে! ডলির দিকে আঙুল তুলে বলল রবিন।

হাসি মুছে গেছে ডলির মুখ থেকে।

চীফ, মুসা বলল। ঢালের ওপর তৈরি হয়েছে বাড়িটা। পেছন দিকের ভিত মাটিতে গড়া হয়েছে, কিন্তু সামনের দিকটা পিলারের ওপর। মেঝের নিচে ফাঁকা জায়গা আছে। গোপন সেলার-টেলার থাকলে অবাক হব না।

 ছুটে বেরিয়ে গেল মুসা। ফিরে এল একটু পরেই। জানাল, কংক্রীটের ভিতের ওপর তৈরি হয়েছে বাড়িটা। বিরাট একটা বাক্সের মত হয়ে আছে নিচেটা। ভেতরে ফাঁকা থাকতেই পারে। তবে ঢোকার পথ দেখলাম না।

বাইরে না থেকে থাকলে, রবিন বলল। ভেতরে আছে।

সরাও! নির্দেশ দিলেন চীফ। সমস্ত কার্পেট সরিয়ে ফেলো। বিছানার নিচে আবার দেখো। ট্র্যাপডোর থাকতে পারে। আলমারির ভেতরেও গোপন দরজা থাকতে পারে।

বেডরুমের সব চেয়ে বড় আলমারিটাতে পথ পেয়ে গেল রবিন। আলমারির নিচে। একটা ট্র্যাপডোর। সরু মই নেমে গেছে নিচের অন্ধকারে।

আলমারির ভেতরেই আলোর সুইচ খুঁজে পেল মুসা। জ্বেলে দিল। নিচের সেলারে জ্বলতে নিভতে আরম্ভ করল একটা বাল্ব। মই বেয়ে দ্রুত নেমে এল ওরা জানালাশূন্য একটা ঘরে। অনেক মদের বোতল আর বাতিল আসবাব পড়ে রয়েছে। আর রয়েছে…

কিশোর! চিৎকার করে বলল রবিন।

কিশোর? মুসাও চেঁচাল।

খুদে সেলারের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে গোয়েন্দাপ্রধান। পিঠের ওপর নিয়ে গিয়ে হাত বেঁধেছে। মুখে কাপড় গোঁজা। পুরনো ধাচের একটা সুইচ বক্সের হাতলে পা ঠেকানো। মাস্টার সুইচের হাতলে লাথি মারলেই নিভে যাচ্ছে আলো, আবার জ্বলে উঠছে।

আমরা বুঝেছি, মুসা বলল, তুমিই সংকেত দিচ্ছ।

তাড়াতাড়ি কিশোরের মুখের কাপড় খুলে নিল রবিন। বাঁধন খুলে দিল।

তোমাদের কথা অনেকক্ষণ থেকেই শুনছি, কিশোর বলল। খোঁজাখুঁজি করছ তা-ও বুঝতে পারছিলাম। শেষে তো ভয়ই হচ্ছিল, পাবে না ভেবে…

 তুমি সংকেত দেয়াতে ভাল হয়েছে, মুসা বলল।

নইলে সত্যিই হয়ত পেতাম না, বলল রবিন। তবে মুসা আন্দাজ করে ফেলেছিল, সেলারে আটকে রাখা হয়েছে তোমাকে।

দুর্বল ভঙ্গিতে হাসল কিশোর। এখন বলে ফেল তো, কি করে এখানে এসে খুঁজে বের করলে আমাকে?

সংক্ষেপে তাকে সব কথা জানাল রবিন আর মুসা।

চমৎকার! প্রশংসা করল কিশোর। ভাল গোয়েন্দা হয়ে উঠেছ তোমরা ইদানীং। ভেরি গুড।

কিশোরের প্রশংসা পাওয়া খুব কঠিন। খুশি হল দুই সহকারী। একনাগাড়ে বসে থেকে থেকে হাত-পা ঝিমঝিম করছে কিশোরের। তাকে মই বেয়ে উঠে বেরোতে সাহায্য করল রবিন আর মুসা। নিয়ে এল লিভিং রুমে। তার পিঠ চাপড়ে দিলেন ইয়ান ফ্লেচার।

তুমি ভাল আছ, কিশোর? কিং বলল, সত্যিই খুব খুশি লাগছে। তোমার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না।

রবিন আর মুসার কাছে তোমার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত, হেসে বললেন চীফ।

হয়েছি। চারপাশে চোঁখ বোলাচ্ছে কিশোর। পিটার কোথায়? তাকে নিয়ে গেছে নাকি কিডন্যাপাররা?

মাথা ঝাঁকাল হ্যারি।

তোমাদের ছাগল পেয়েছ, রবিন আর মুসার দিকে তাকিয়ে কুৎসিত হাসি হাসল ডলি। এবার কেটে পড়তে পারো। জন আর ডেভকে ধরার চেষ্টা করলে অহেতুক সময় নষ্ট করবে। পিটারকে হাতে পেয়েছে ওরা। হাওয়া হয়ে গেছে এতক্ষণে।

সবাইকে নিরাশ মনে হলো, বিশেষ করে কিং আর হ্যারিকে। কেবল কিশোরের মুখে কোনও ভাবান্তর নেই। ডলির দিকে তাকিয়ে হাসল। দাঁড়ান, ছাগলই ভেড়া বানাবে আপনাদের। হাওয়া হয়ে গেছে বলছেন তো। পারবে না। আমি কিশোর পাশা থাকতে অন্তত না।

.

২০.

লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশকে খবর দিলেন ইয়ান ফ্লেচার। তারা এসে গ্রেপ্তার করল ডলিকে। তারপর কিশোরের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে, স্যান ডিয়েগো পুলিশকে রেডিওতে খবর পাঠাল। নানদানদের ক্যাডিলাকটা ছুটে চলল মেকসিকো সীমান্তের দিকে।

এখন বল তো, কিশোর, চীফ জিজ্ঞেস করলেন। পিটারকে নিয়ে যাওয়া ঠেকাব কি করে?

ঠিক বলতে পারছি না এখনও। তবে সুযোগ আছে। পিটারকে সনাক্ত করার পর তাকে ওপরে তুলে নিয়ে গেল। তারপর ওদেরকে ফোনে কথা বলতে শুনেছি।

কার সঙ্গে?

ওদের সহকর্মীদের সঙ্গে, আমার বিশ্বাস। সহকারীরা রয়েছে মেকসিকোর টিজুয়ানায়। ওরা বলল, এবার পিটারকে ধরেছে, কোনও সন্দেহ নেই। আর প্ল্যান মোতাবেকই বেরিয়ে যাবে।

প্লানটা কি?

জানি না। ও সম্পর্কে কিছু বলেনি ওরা।

তাহলে কি করে…? বলতে গিয়ে বাধা পেল কিং।

কয়েকটা সূত্র আছে আমাদের হাতে, কিশোর বলল। কিডন্যাপাররা মেকসিকো সীমান্তের কাছে টিজুয়ানায় কারও সঙ্গে দেখা করবে। টিজুয়ানা দিয়ে মেকসিকো সীমান্ত পার হবে ওরা।

কিন্তু সেটা কখন? জিজ্ঞেস করলেন চীফ। যে কোনও সময় পেরোতে পারে ওরা।

ওরা বলেছে স্যান ডিয়েগোতে কাজ আছে ওদের। সীমান্ত পেরোনোর আগে কিছুক্ষণ থামবে ওখানে। সীমান্ত পার হবে রাত দশটায়।

আর ঠিক ওই সময় আমরা গিয়ে বসে থাকব ওখানে! কিং বলল। ভালই হবে, খুব ভাল। ভাবছি

ওদের প্ল্যান জানার আমাদের কোনও দরকার নেই, চীফ বললেন। কার সঙ্গে দেখা করবে সেটাও জানা লাগবে না। ওসব ছাড়াই ওদেরকে আটক করতে পারব আমরা।

সে রকমই আশা করছি, কিশোর বলল।

 কিশোর, রবিন জিজ্ঞেস করল। পিটারকে নিয়েই সীমান্ত পেরোবে তো? মানে, এতটা খোলাখুলি যাওয়ার সাহস করবে? ছদ্মবেশ নেবে না তো? কিংবা পিটারকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা?

তাই তো। মুসা কথাটা ধরল। পুলিশ যে ওদের পিছে লাগতে পারে এটা না বোঝার মত বোকা নিশ্চয় নয় ওরা। সীমান্তেও কড়া নজর রাখা হতে পারে, এই সন্দেহও করতে পারে ওরা।  

তা পারে, মাথা দোলাল কিং। তাহলে চিনব কি করে ওদেরকে? পুলিশই বা বুঝবে কিভাবে?

সেটা আমাদের কাজ, আশ্বস্ত করলেন্ত চীফ। ছদ্মবেশী লোককে কি করে চিনতে হয়, সে ব্যাপারে ট্রেনিং আছে আমাদের।

 নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। দক্ষিণে ছুটে চলেছে ক্যাডিলাক। স্যান ডিয়েগোতে পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে গেল। নটার বেশি বেজেছে। সোজা সীমান্তের দিকে যেতে দেখল স্যান ডিয়েগো পুলিশের দুটো পেট্রল কারকে।

আধ ঘণ্টা সময় আছে আমাদের হাতে, ঘড়ি দেখে বলল কিশোর। তার পরে যে কোনও মুহূর্তে সীমান্ত পেরোনোর চেষ্টা করতে পারে কিডন্যাপাররা।

ওরা, কিছুটা হতাশার সুরেই বলল মুসা। এবং আরও হাজারও মানুষ। সব সময়ই পেরোয়।

অনেকগুলো লেন এগিয়ে গেছে সীমান্তের দিকে। অসংখ্য গাড়ি, বাস, আর ট্রাকের সারি যেন স্রোতের মত এগিয়ে চলেছে সেদিকে সবাই সীমান্ত পেরোবে। প্রতিটি গাড়ির প্রায় বাম্পারে বাম্পারে লেগে যাচ্ছে, এতই কাছাকাছি। চেক পয়েন্টের দিকে এগোচ্ছে। চেক হয়ে যাওয়ার পর ঢুকে পড়ছে মেকসিকোতে।

 এগুলোর মাঝে কি করে চিনবেন ওদেরকে চীফ? কিং-এর প্রশ্ন।

লোকগুলোর চেহারার বর্ণনা বর্ডার গার্ডকে দিয়ে দিয়েছে স্যান ডিয়েগো পুলিশ। ওদের লিংকন গাড়িটার বর্ণনা। এবং অবশ্যই পিটারেরও। মেকসিকান পুলিশ কড়া নজর রাখবে। সন্দেহজনক লোক দেখলেই প্রশ্ন শুরু করবে।

আর আমরা তখন কি করব? হ্যারি জানতে চাইল।

বসে বসে নজর রাখব।

রাস্তার পাশে এমন জায়গায় গাড়ি রাখা হলো, যাতে একযোগে সমস্ত লেনগুলো চোখে পড়ে। স্যান ডিয়েগো পুলিশের একটা গাড়িকে দেখা গেল সেন্টার বর্ডার বুদের কাছে। আরেকটা বেশ কিছুটা দূরে। সময় কাটছে। দশটা বাজতে দশ।

দেখুন। হাত তুলল কিং.। একটা নীল লিংকন!

সীটের একেবারে কিলারে বসে গলা বাড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছে ক্যাভিলাকের দর্শকরা। বিরাট নীল গাড়িটা ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে চলেছে চেক পয়েন্টের দিকে। ভেতরে উঁকি দিল সীমান্ত প্রহরীরা। ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে সতর্ক নজর রাখল স্যান ডিয়েগো পুলিশ। অনেকক্ষণ কথা বলল প্রহরীরা। তারপর সরে হাত নেড়ে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দিল গাড়িটাকে।

ওরা নয়! গুঙিয়ে উঠল মুসা। কি।

হলে এমন ছদ্মবেশ নিয়েছে, হ্যারি বলল পুলিশ চিনতে পারেনি। ধোঁকা খেয়েছে।

ছদ্মবেশে ওদেরকে ফাঁকি দিতে পারবে বলে মনে হয় না আমার, মাথা নাড়লেন চীফ। বর্ডার গার্ডেরা এমনিতেই ভীষণ সতর্ক আর চালাক। তার ওপর হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে। তিনগুণ সতর্ক হয়ে গেছে ওরা। পিটারের বয়েসী কাউকে দেখলে সহজে ছাড়বে না। দরকার হলে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে পরীক্ষা করবে।

কিন্তু কিডন্যাপাররা কি সেটা জানে না? রবিন প্রশ্ন তুলল।

নিশ্চয় জানে, রবিন, জবাবটা দিল কিশোর। সেজন্যেই লুকিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করবে। এমন কোনও গাড়িতে করে যেটা নিয়মিত সীমান্ত দিয়ে যাতায়াত করে, এবং যেটার দিকে প্রহরীদের নজর কম।

যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল, ওই বাসগুলোর মত?

দুটো বাস এগিয়ে গিয়ে থামল চেক পয়েন্টের কাছে। ওগুলোতে উঠল স্যান ডিয়েগো পুলিশ। ক্যাডিলাকের দর্শকেরা দেখতে পেল সীটের সারির মাঝখান দিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে পুলিশেরা। প্রতিটি যাত্রীর চেহারা দেখছে। নেমে এল এক সময়। হাত নেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিল বাসদুটোকে।

নাহ, হবে বলে মনে হচ্ছে না, হ্যারির কণ্ঠে হতাশা।

আমি.. আমি আশা ছাড়তে পারছি না, কিশোর বলল। তাকিয়ে রয়েছে গাড়ির লম্বা সারিগুলোর দিকে। একে একে এগিয়ে যাচ্ছে ওগুলো চেক পয়েন্টের দিকে। চেক হয়ে গেলে বেরিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ছে মেকসিকোতে।

দশটা বাজতে দুই মিনিট।

বেরিয়ে যায়নি তো! আর আত্মবিশ্বাস রাখতে পারলেন না চীফ। মেকসিকো পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার…

জোরাল একটা টিইপ টিইপ যেন ভরে দিল ক্যাডিলাকের ভেতরটা। চমকে উঠল সবাই। সব কটা চোখ ঘুরে গেছে মুসার দিকে। শব্দটা আসছে তার শার্টের পকেট থেকে।

ইমারজেন্সি সিগন্যাল! চিৎকার করে বলল সে।

 অফ কর ওটা, চীফ বললেন। এখন এসব গোলমাল…

না না, কর না! হাসল কিশোর। ওটাই তো আসল। বের করো পকেট থেকে। দেখো, তীরটা কোন দিক নিদের্শ করছে। কিডন্যাপাররা কাছাকাছিই রয়েছে।

যন্ত্রটা বের করে ডায়ালের দিকে তাকাল মুসা। গাড়ির সারির দিকে নির্দেশ করে রয়েছে তীরটা। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে যানবাহনগুলো। ওগুলোর মাঝে একটাও নীল লিংকন নেই। আর কোনও বাসও নেই। শুধুই গাড়ি আর গাড়ি। চার-পাঁচটা ট্রাক আর ভ্যানও রয়েছে।

আসুন! নামুন সবাই! বলতে বলতে নেমে পড়ল কিশোর।

যানবাহনের সারির দিকে এগোল ওরা। মাঝের লেনে একটা পুরনো ট্রাক রয়েছে। মেকসিকোর লাইসেন্স প্লেট। দুপাশে মলিন অক্ষরে স্প্যানিশ ভাষায়, লেখা রয়েছে মেকসিকোর একটা লেটুস ফার্মের নাম। বর্ডার বুদের দিকে এগোচ্ছে। ওটা। মুসার ডায়ালের কাটা সোজা মুখ করে রয়েছে ওটার দিকে।

ওটাই! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। জলদি আসুন!

আগে আগে ছুটছেন এখন চীফ। বুদের সামনে গিয়ে থামল ট্রাকটা। তিনিও পৌঁছে গেলেন এই সময়। ট্রাকের পেছনের ক্যানভাসের  ঢাকনা তুলল গার্ড। ভেতরে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। স্যান ডিয়েগো পুলিশকে ইশারা করল গাড়িটা ছেড়ে দেয়ার জন্যে।

না। চিৎকার করে বলল কিশোর। এই ট্রাকেই আছে ওরা।

মাথা নাড়ল প্রহরী। সরি, ইয়াং ম্যান, ওতে কেউ নেই। পেছন দিকটা খালি। শুধু ড্রাইভিং সীটে ড্রাইভার। মেকসিকোর লোক।

হতেই পারে না, জোর তর্ক শুরু করল কিশোর। শুনছেন, আমাদের সিগন্যাল কত জোরে বাজছে?

যানবাহনের শব্দকে ছাপিয়ে টিপ টিপ করছে যন্ত্রটা। কিং আর ইয়ান ফ্লেচার গিয়ে ক্যানভাস তুলে দেখলেন। পেছনটা পুরো খালি।

 তোমার সিগন্যাল নিশ্চয় কোনও গোলমাল করছে, কিং বলল।

 ট্রাকের শূন্য পেছনটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। একপাশে চলে এল। দেখল ট্রাকের সে পাশটা চকচক করে উঠল চোখ। না, মিস্টার কিং, আমাদের সিগন্যাল ঠিকই কাজ করছে। ট্রাকের ভেতরটা দেখুন। বেখাপ্পা লাগছে না বডিটা? বাইরের দেয়ালের ভেতরে আরেকটা দেয়াল আছে। মাঝখানটায় ফাঁপা।

 স্যান ডিয়েগোর দুজন পুলিশকে নিয়ে লাফিয়ে ট্রাকের পেছনে উঠলেন ইয়ান ফ্লেচার। দেয়ালটা পরীক্ষা করে মাথা নাড়লেন। কিশোর, দরজা-টরজা কিছু নেই।

 থাকার কথাও নয়, জবাব দিল কিশোর। এত বোকা নয় কিডন্যাপাররা। ওরা ভেতরে ঢোকার পরই নিশ্চয় ভেতরের দেয়ালটা লাগান হয়েছে। স্যান, ডিয়েগোতে থেমেইছিল সেজন্যে। এটাই ছিল ওদের জরুরী কাজ। দেয়াল খুলে আনতে হবে।

সাবধান, চীফ, হুঁশিয়ার করল হ্যারি। ওরা ভয়ংকর লোক। অস্ত্র আছে।

ট্রাকের দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়তে ইশারা করলেন চীফ পুলিশ দুজনকে। পিস্তল বের করলেন। দেয়ালে লাথি দিয়ে বললেন, ব্যস, হয়েছে, এবার বেরিয়ে এসো। হাত তুলে। কিছু করার চেষ্টা করলে মরবে।

কোনও সাড়া এল না। শুধু যানবাহনের ইঞ্জিনের গুঞ্জন চলছে একটানা। আর মুসার সিগন্যালের জোরালো শব্দ।

কড়া গলায় আবার আদেশ দিলেন ফ্লেচার।

কয়েক সেকেণ্ড নীরবতা। তারপর মড়মড় করে কাঠ ভাঙার শব্দ হলো। ভেঙে খুলে গেল দেয়াল। হাত তুলে বেরিয়ে এল জন আর ডেভ। ওই যে কিশোর বলেছিল, ভেড়া বানিয়ে ছাড়বে, ভেড়াই বনে গেছে যেন ওরা।

 কিশোরের ওপর চোখ পড়ল ডেভের। জিজ্ঞেস করল, তুমি! এত তাড়াতাড়ি বেরোলে কি করে? ট্রাকটা চিনলে কি করে?

চুপ! ধমক দিয়ে বললেন চীফ। অত কথার দরকার নেই! ওদের পিস্তলগুলো কেড়ে নিলেন তিনি।

 ভেতরে হাত-পা বাঁধা আর মুখে কাপড় গোঁজা অবস্থায় পাওয়া গেল পিটারকে। তাকে বের করা হলো। মুখ থেকে কাপড় খুলতেই হাসল সে। অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে। বের করলে কিভাবে? তাজ্জব ব্যাপার!

কি করে, কিশোর? হ্যারিও অবাক। সিগন্যালের সাহায্যেই করেছ, বুঝলাম, কিন্তু যন্ত্রটা ওখানে গেল কিভাবে? ট্রাকটা তো আগে কখনও দেখোনি?

ট্রাকে ওই যন্ত্র আমি ঢোকাইনি, হেসে বলল কিশোর। ওরা নিজেরাই ঢুকিয়েছেন।

ওরা? একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল রবিন আর মুসা।  

মনে আছে, ওয়ার্কশপে ডেভকে বলেছিলাম, বুঝিয়ে দিল কিশোর। বাগটা রয়েছে পিটারের পকেটে? বলার কারণ ছিল। আমার যন্ত্রটা ছিল আমার প্যান্টের পকেটে। কাজেই চাইছিলাম পিটারের পকেটেই আগে খুঁজুক ও। পিটারের দিকে ঘুরল সে। আমি তার খুব কাছাকাছি ছিলাম। চট করে এক সুযোগে আমার যন্ত্রটা, ফেলে দিলাম ডেভের কোটের পকেটে।

দাঁত বের করে হাসল কিশোর। সারাক্ষণ তার পকেটেই ছিল যন্ত্রটা। ওটার বীপার অফ করা ছিল, কাজেই শব্দ করেনি। কিন্তু সিগন্যাল ঠিকই পাঠাচ্ছিল।

ডেভের দিকে তাকিয়ে রাগ করে বলল জন, গাধা কোথাকার!

জ্বলন্ত চোখে ডেভও তাকাল জনের দিকে, তোমার গাধামী বুদ্ধির জন্যেই এরকম হলো!

নিয়ে যান এগুলোকে বিরক্ত হয়ে পুলিশম্যানদের নির্দেশ দিলেন ফ্লেচার।

একে অন্যকে বকাবকি আর দোষারোপ করতেই থাকল দুই কিডন্যাপার। হাতকড়া পরিয়ে ওদের ট্রাক থেকে নামাল পুলিশ।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে কিছুটা রাগ করেই চীফ বললেন, সিগন্যালটার কথা আমাদেরকে বলনি, কিশোর!

ওটা যে কাজ করবে, শিওর ছিলাম না, স্যার, কৈফিয়ত দিচ্ছে যেন কিশোর। ডেভ পকেটে হাত ঢোকালেই তো শেষ হয়ে যেত। কাপড়ও বদল করতে পারত সে। করেনি, তার কারণ, অতিরিক্ত ব্যস্ত ছিল ওরা। আর বাঁ পকেটে ঢুকিয়েছিলাম। সাধারণত ওই পকেটে কমই হাত দেয় লোকে কোনও জিনিস বের করার জন্যে না হলে ঢোকায় না। আসল কথা হলো, আমাদের ভাগ্য ভাল, কাজটা হয়ে গেল।

হাসলেন চীফ। হ্যাঁ, তা বলতে পারো। যাই হোক, যন্ত্রটা ঢুকিয়ে দিয়ে কাজই করেছ একটা!

তিন গোয়েন্দা হাসল। পিটার হাসল। এখন সে পুরোপুরি নিরাপদ। বিপদ কেটে গেছে। আর কোনও ভয় নেই।

বাবারও কাজ করতে আর কোনও অসুবিধে হবে না, বলল সে। ইচ্ছেমত করতে পারবে।

পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে সে আর কিশোর। দুই যমজ ভাইয়ের মত। অনেকেই অবাক চোখে তাকাচ্ছে ওদের দিকে। অনেক অবাক ঘটনাই ঘটে এই পৃথিবীতে, যা বিশ্বাস করা কঠিন। এটাও তেমন একটা ঘটনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *