৮. যাত্রাপথের ঝাঁকুনি

যাত্রাপথের ঝাঁকুনি সত্ত্বেও আমার পায়ের ক্ষত দ্রুত শুকিয়ে আসতে লাগলো। এতে করে আরো প্রভাবিত হলো গোত্রের লোকেরা। নিজেদের আহত লোকদের খুব শীঘ্রই আমার কাছে নিয়ে এলো তারা।

ছত্রাক সক্ৰমণ সারালাম একজনের। অপর এক বর্বরের হাতের ফোঁড়া কেটে দিলাম। মারামারি করে মাথা ফাটানো দু জনের চামড়া সেলাইও করলাম। এই ইথিওপিয়ানদের একটা সমস্যা হলো যে কোনো ঝামেলা এরা ছুরি হাতে লড়ে সমাধা করতে চায়। ঘোড়া থেকে আছড়ে পড়ে হাত ভাঙা একজনকে যখন সারিয়ে তুললাম, ততদিনে আমি দারুন জনপ্রিয় হয়ে গেছি তাদের মাঝে। সর্দার আমার দিকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকাতেন; দ্রুতই তার পাত্র থেকে খাবার অধিকার মিললো আমার।

পায়ে চলার মতো সুস্থ হয়ে উঠতেই ক্যাম্পে চলাফেরা করার অনুমতি দেওয়া হলো আমাকে। কিন্তু, কখনোই চোখের আড়াল হতে দেওয়া হলো না। একজন শসস্ত্র প্রহরী সবসময় আশে পাশে থাকতো। এমনকি একান্ত ব্যাক্তিগত কর্ম-সম্পাদনের সময়ও আমাকে একা থাকতে দেওয়া হতো না।

মাসারার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিলো আমাকে। প্রতিদিনের যাত্রার শুরুতে এবং রাতে ক্যাম্প ফেলার সময় দূর থেকে দেখতে পেতাম তাকে। যাত্রাপথে তার সাথে দেখা হওয়ার কোনো সুযোগই এরা রাখে নি। সব সময় মহিলা প্রহরী নয়তো অস্ত্রধারী জওয়ান মোতায়েন থাকতো ওর ক্যারাভানের পাশে।

যখনই দেখা হতো, তা যতো অল্প সময়ের জন্যেই হোক; খুব কাতর চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকে মাসারা, যেনো কিছু করবার আছে আমার, ওর জন্যে। এতে কোনো সন্দেহ নেই, খুব মূল্যবান একজন বন্দী সে। এতো অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য ছিলো তার, মাঝে-মধ্যেই আমার চিন্তার জগত দখল করে নিতো মেয়েটা। আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম, হয় সে একজন নিরুৎসাহী স্ত্রী জোর করে যাকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে; না হয় কোনো রকম রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের ঘুটি।

এদের ভাষা না জেনে কী ঘটছে, তা বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই ইথিওপিয়ার ভাষা, গীজ শিখতে উঠে-পড়ে লাগলাম।

এমনিতেও জাত সুরকারের কান আমার, একটু বুদ্ধি ঘটালাম তার উপর। আমার চারপাশের কথাবার্তা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম, এরপর কথার তাল এবং লয় ধরে ফেললাম। প্রথম দিকে কেবল তাদের সর্দারের নাম উদ্ধার করেছিলাম আমি ব্যাটার নাম ছিলো আরকুন। একদিন সকালে যখন ক্যারাভান যাত্রা শুরু হবে, আরকুন তার ঢাক বাদকদের নির্দেশ দিচ্ছিলো। যতক্ষণ পর্যন্ত না তার কথা শেষ হয়, মনোযোগ দিয়ে শুনলাম, তারপর ঠিক একই ভঙ্গিতে নকল করে শোনালাম কথাগুলো।

বজ্রাহতের মতো আমার কথা শুনলো তারা। তারপর ফেটে পড়লো অট্টহাসিতে। হাসতে হাসতে একেকজন গড়াগড়ি খেলো, চোখে পানি চলে এলো হাসির প্রাবল্যে।

কী বলেছিলাম নিজেও জানি না, তবে নির্ঘাত সঠিক বলেছিলাম।

আমার বলা কথার অংশবিশেষ পরস্পরকে শুনিয়ে দারুন হাসলো তারা। শেষমেষ, শেরাগোল থামতে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলো আরকুন। তার প্রশ্নের উত্তরে ঠিক একই কথা প্রত্যুত্তর করলাম আমি একটা বর্ণও না বুঝলেও ঠিক আরকুনের প্রশ্নটাই উচ্চারণ করেছিলাম আবার।

এবারে যে তুমুল হৈ-হট্টগোল শুরু হলো, তা থামবার নয়। সস্তা রসবোধের অধিকারী বর্বরগুলো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। একজন তো আগুনে পড়ে গিয়ে হাত পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেললো। এমনকি আরকুনও হেসে আমার পিঠ চাপড়ে দিলো। এর পর থেকে ক্যাম্পের প্রতিটি নারী-পুরুষ আমার ভাষা-শিক্ষক হয়ে উঠলো। যে কোনো গীজ শব্দের অর্থ আমাকে বোঝাতে ব্যাকুল ছিলো তারা। ধীরে বিভিন্ন শব্দ এক করে যখন বাক্য তৈরি করার চেষ্টা করতাম, আমাকে শুধরে দিতো তারা।

বেশ ক দিন সময় লেগেছিলো তাদের ব্যাকরণ শিখতে। যা-ই হোক, দশদিনের মাথায় বুদ্ধিদীপ্ত গীজ বলতে শিখে গেলাম আমি। এমনকি, বিশেষ কিছু গালি এবং অভিশাপ দিতেও শিখেছিলাম।

ভাষা শিক্ষার সময় তাদের সংস্কৃতির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখলাম। একটা ব্যাপার আগেই বুঝেছিলাম, এরা জন্ম-জুয়াড়ি; ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বাও-এর মতো একটা খেলা খেলে তারা। তাদের ভাষায় সেই খেলার নাম ডোম–তবে মূলত সেটা ছিলো বাও খেলারই সাধারণ এবং প্রাচীন রূপ। নিয়ম-নীতি প্রায় একই, সামান্য কিছু ঘুটির অদল বদল আছে।

আরকুন নিজে ছিলো সেই খেলার সেরা খেলোয়ার। ভালো করে তার খেলা পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম, সাত ঘুটির ধ্রুপদি ধারাই জানা নেই তার। চার গোলার নিয়মও তার অজানা। এসব নিয়ম না জেনে কোনো বাও খেলোয়ারই তৃতীয় শ্রেণীর মর্যাদাও পায় না। আমি বুঝলাম, আরকুনের উপরে টেক্কা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই একমাত্র উপায় আমার কাছে।

পরেবার যখন বোর্ড বিছিয়ে গোঁফে তা দিয়ে নতুন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর অপেক্ষায় বসেছিলো সে, সামনে এগিয়ে একজনকে কনুইয়ের ধাক্কায় সরিয়ে আরকুনের সামনে আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে পড়লাম।

বাজি ধরার মতো কোনো রুপা নেই আমার, আধো গীজ বুলিতে তাকে বললাম আমি। আমি এ খেলা কেবল আনন্দ পাওয়ার জন্যে খেলি।

ভীষণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে আরকুন। এই খেলায় আসক্ত কারো জন্যে রীতিমতো অপমানসূচক কথা বলেছি আমি। আরকুনের সাথে আমার খেলার খবর রটে যেতে পুরো ক্যাম্প এসে ভীড় করলো বোর্ডের পাশে।

যখন পুব দিকের দুর্গে আরকুনকে তিনটি ঘুটি নিতে দিলাম আমি, এক অপরকে ধাক্কা দিয়ে মুচকি হাসলো তারা। মনে দুরাশা–এতো তাড়াতাড়ি হেরে যাবো আমি। পুবে আর একটি মাত্র ঘুটি গেলে আমার হার নিশ্চিত। দক্ষিণে আমার তৈরি রাখা চারটি হাতির কারণ তারা বুঝতেও পারে নি। ওগুলোকে চালু করে দিতেই দ্রুত খেলার দখল পেতে শুরু করলাম আমি। সহায়হীণ ঘুটিগুলোকে পুরে দুর্গ থেকে আলাদা করে দিলাম এভাবে। ঠেকানোর কোনো উপায় রইলো না আরকুনের হাতে। চারচালে খেলা জিতে নিলাম আমি।

বেশকিছু সময় নীরবে বসে রইলো পাহাড়িরা। আমার ধারণা, নিজের চরম পরাজয়ের পুরো ব্যাপারটা আরকুন তখনো অনুধাবন করে নি। যখন অবশেষে বোধগম্য হলো, হেরে গেছে; ভয়ঙ্কর নীল তলোয়ার হাতে উঠে দাঁড়ালো সে। আমি ভেবেছিলাম, কল্লা পড়তে যাচ্ছে বুছি; পরে দেখি রাগে অস্থির হয়ে খেলার বোর্ডটাকে টুকরো টুকরো করে ফেললো সে। দিগ্বিদিক ছুঁড়ে ফেললো ঘুটিগুলো। এরপর নিজের দাড়ি ছিঁড়তে ছিঁড়তে আমার উদ্দেশ্যে মৃত্যুর হুমকি জানালো জোরে জোরে। উঁচু পাথুরে দেয়ালে লেগে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো তার চিৎকার।

এর তিনদিন পর আবারো বোর্ড বিছিয়ে আমাকে বিপরীতে বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো আরকুন। বেচারা বুঝতেও পারে নি, কী অপেক্ষা করছে তার জন্যে।

*

প্রতিদিন গীজ ভাষায় আমার দক্ষতা বাড়তে লাগলো। শেষপর্যন্ত আমাকে আটকে রাখা দলের পরিচয় এবং উপত্যকা আর খাদ পেরিয়ে তাদের অবিরত ভ্রমণের কারণ বুঝতে পারলাম।

আরকুনকে ছোটো করে দেখেছিলাম আমি। সে মোটেও গোত্রপ্রধান নয়–স্বয়ং একজন রাজা। তার পুরো নাম আরকুন গানুচি মারিয়াম সে ছিলো নেসা নাগাস্ত, অর্থাৎ রাজাদের রাজা, ইথিওপিয়ার আকসুম প্রদেশের শাসনকর্তা। পরে জেনেছিলাম, যে কোনো পর্বত-দর কাছে একশ ঘোড়া এবং পঞ্চাশজন পত্নী থাকলে নিজেকে একজন রাজা হিসেবে ঘোষণা করা যায় এখানে।

আরকুনের সবচেয়ে নিকটস্থ প্রতিবেশি রাজা হলো প্রেসটার বেনি-জন। সে-ও নিজেকে রাজার রাজা ঘোষণা করে ইথিওপিয়ার আকসুম প্রদেশের শাসনকর্তা বলে দাবি করে। এদের দুজনের মধ্যে চিরকালীন কোনো শত্রুতা বা লড়াই আছে বলে আমার ধারণা। ইতিমধ্যেই বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়ে গেছে এই দুই গোত্রের মধ্যে।

মাসারা ছিলো প্রেসটার বেনি-জনের সবচেয়ে আদরের কন্যা। আরো একজন গোত্রপ্রধান যে এখনো নিজেকে রাজা বলে ঘোষণা করে নি তার হাতে অপহৃত হয়েছিলো মাসারা। এক ঘোড়া রুপার খণ্ডে বিনিময়ে আরকুনের কাছে মেয়েটাকে বিক্রি করে দিয়েছে সেই গোত্রপ্রধান। এখন আরকুন চাইছে চিরশত্রুর মেয়েকে পণ রেখে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করতে।

কারো উপর ভরসা রাখতে না পেরে রাজকুমারী মাসারাকে নিজের জিম্মায় রেখেছে আরকুন। আমাদের ক্যারাভান এখন তার শক্তিশালী ঘাঁটিতে ফিরিয়ে নিয়ে চলেছে। আমার খাবার নিয়ে আসা দাসী মহিলাগুলোর কথাবার্তা থেকে এগুলো শুনেছি আমি। যতোদিনে আম্বা কামারায়, পর্বতের উপরে রাজা আরকুন গানুচি মারিয়ামের দুর্গে পৌঁছুলাম; আকসুম প্রদেশের ঘোলাটে রাজনীতির অনেকটাই বোঝা হয়ে গেছে আমার ।

যাত্রার শেষে চলে আসতে ক্যারাভানের ভেতরে নতুন এক উত্তেজনা টের পেলাম। অবশেষে, সংকীর্ণ বাঁক নেওয়া পাহাড়ি পথে একটি আমবায় উঠে এলাম আমরা। এই আম্বা গুলো মূলত কয়েকটি পর্বত অঞ্চলের সমষ্টি, কেন্দ্রিয় ইথিওপিয়ার ভূ-খণ্ড। চ্যাপ্টা মাথা পর্বতের পাশে থেকে খাড়া নিচের উপত্যকায় নেমে গেছে পাথুরে দেয়াল আর একটি পর্বত থেকে আলাদা করেছে নিজেকে।

এক একটি আম্বা প্রাকৃতিক দুর্গ বিশেষ। এর দখল নিতে পারলে কেউ নিজেকে রাজা দাবি করতেই পারে।

আমার পাশে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ দিগন্তের পর্বতশ্রেণীর দিকে দিকে দেখালো আরকুন। ওই হলো ঘোড়াচোর, বদমাশ প্রেসটার বেনি-জনের এলাকা। ভয়ঙ্কর ধূর্ত এই শয়তান।

আমি ততোদিনে জেনে ফেলেছি, কেবল অসম্ভব হিংস্রই নয়, দারুন ধূর্ত মানুষ আরকুন স্বয়ং। যদি সে নিজে এই প্রেসটার বেনি-জনকে ধূর্ত উপাধি দিয়ে থাকে, তবে মাসারার বাবা নিঃসন্দেহে মারাত্মক কেউ ।

আম্বা কামারার সমতল অংশ পেরিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা, পাথুরে দেয়ালের কিছু বাড়ি-ঘর সমেত ছোটো ছোটো গ্রাম চোখে পড়লো। ধূরা শস্যের মাঠও দেখতে পেলাম। ক্ষেতে কাজ করতে থাকা কৃষকেরা আমাদের ক্যারাভানের লোকেদের মতোই লম্বা অবয়বের বর্বর।

আমবার দূর প্রান্তের পথ বেয়ে আমার দেখা সবচেয়ে নিখুঁত প্রাকৃতিক সুরক্ষার স্থানে উঠে এলো ক্যারাভান। পর্বতের চ্যাপ্টা অংশ থেকে খাদের উপর বেরিয়ে এসেছে সরু একটা প্রলম্বিত অংশ-তলা-নেই এমন গভীর সেই গিরিখাদের উপর দিয়ে চলে গেছে।

হাজার ফুট নিচে ফেনা তুলে বয়ে চলেছে প্রমত্তা নদী। এমন বিপদজনক পথে চড়তে চাইলো না ঘোড়াগুলো, অবশেষে চোখ বেঁধে নিতে হলো জানোয়ারগুলোর । অর্ধেক পথ পেরিয়েই মাথা ঘুরতে আরম্ভ করলো আমার নিচের শূন্যতার দিকে তাকানোর সাহস করে উঠতে পারলাম না। অবশেষে মনের সমস্ত জোর একত্র করে হেঁটে পেরিয়েছিলাম সেই ভয়ঙ্কর বিপদজনক পথ।

সরু প্রাকৃতিক সেতুর ওপারে পাথরের তৈরির কদাকার চেহারার দুর্গ আছে। চামড়ার আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে সবকটা জানালা। বিশ্রী দুর্গন্ধে পেট উল্টে আসে।

দুর্গের দেয়ালে কারুকাজের মতো করে সাজানো রয়েছে নর-নারীর মৃতদেহ। কোনো কোনোটি এতো আগে ঝোলানো, কঙ্কাল শুকিয়ে সাদা হাড় দেখা যায়। কাকের দল উড়ে বেড়ায় খাদের উপরের আকাশে। গোড়ালি ঝোলানো কিছু কিছু দেহ অবশ্য সামান্য নড়তে দেখলাম। কিন্তু বেশিরভাগ দেহ পঁচে গেছে, চারিদিকের বাতাসে ভারী দুর্গন্ধ।

রাজা আরকুন কাকে বলে তার মুরগির বাচ্চা। কখনো কখনো নিজ হাতে খাবার ছুঁড়ে দেয় সে ওই কদাকার পাখিগুলোকে। হঠাৎই দুর্গের দেয়াল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিচের অসীম খাদে পড়ে গেলো একটা দেহ তার চিৎকার প্রতিধ্বনি তুলতে লাগলো পর্বত থেকে পর্বতে। আবার সেজেদ-এ, বাতাস যেখানে গান গায়–এই ধরনের মরণ-চিৎকার ছিলো আমার সবসময়ের সঙ্গী ।

এই নৃশংস মৃত্যু আর প্রতিদিন শাস্তি হিসেবে হাত বা পায়ের কর্তন; নয়তো গরম-লাল লোহা দিয়ে জীভ টেনে বের করা ডোম খেলা বাদে এ-ই ছিলো আরকুনের বিনোদন। নিমর্ম অত্যাচারে আনন্দ পেতে সে হা হা করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তো।

আদবার সেজেদ-এর মূল প্রাঙ্গনে আমাদের ক্যারাভান প্রবেশ করতেই, মহিলা রক্ষিরা টেনে-হিঁচড়ে পাথুরে গলিপথ ধরে বন্দী-প্রকোষ্ঠে নিয়ে গেলো মাসারাকে। আরকুনের কক্ষের কাছের প্রকোষ্ঠে স্থান হলো আমার।

পাথুরে একটা প্রকোষ্ঠ, অন্ধকার, শুকনো। খোলা অগ্নিকুরে ধোয়া দেয়াল কালো করে ফেলেছে, সামান্যই তাপ পাওয়া যাচ্ছে ওটা থেকে। গরম উলের কাপড় পরেও কোনোদিন শীতের হাত থেকে রক্ষা পাই নি আমি আদবার সেজেদ-এর সংকীর্ণ প্রকোষ্ঠে। নীলের সূর্যালোক আর প্রাণপ্রিয় মিশরের উজ্জ্বল মরুদ্যানের স্বপ্নে বিভোর থাকতাম সবসময়। ট্যানাস, মেমনন, আমার ছোট্ট রাজকুমারীদের কথা ভেবে রাতে চোখ ভিজে আসতো।

মাঝে-মধ্যে আমাকে ছেড়ে দেয়ার জন্যে অনুরোধ করতাম আরকুনকে।

কেননা এখান থেকে চলে যেতে চাইছে, টাইটা? 

আমার পরিবার আছে, তাদের কাছে ফিরতে চাই।

আমিই তোমার পরিবার এখন, হাসতো আরকুন। আমিই তোমার পিতা।

তার সাথে শর্ত ছিলো, একটানা একশ দান ডোম খেলায় যদি জিততে পারি আমি, নীলের সমতলে প্রহরা দিয়ে আমাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। শততম খেলায় যেদিন জিতলাম, মুচকি হেসে আরকুন বললো, একশ বলেছিলাম নাকি? মনে হয় না। নির্ঘাত এক হাজার হবে, তাই না? পাশের প্রহরীর উদ্দেশ্যে জানতে চাইতো সে, এক হাজারের কথা ছিলো না?

এক হাজার! এক বাক্যে স্বীকার গেলো সে। এক হাজারের কথাই ছিলো হুজুর।

দারুন কৌতুক মনে করেছিলো তারা ব্যাপারটাকে। খেলতে অস্বীকৃতি জানালে নগ্ন করে ঝুলিয়ে রাখতো দুর্গের বাইরের দেয়ালে, যতক্ষণ পর্যন্ত না আবারো খেলতে বসতে রাজী হই।

আমার নগ্ন দেহ দেখে অট্টহাসতো আরকুন। হতে পারে, ডোম খেলায় তোমার জুড়ি নেই, কিন্তু মনে হয় নিজের আসল ঘুটি হারিয়ে ফেলেছো তুমি, ওহে মিশরীয়! ধরা পড়ার পর সেই প্রথম আমার অঙ্গহানীর কথা প্রকাশ হয়ে পড়লো। আবারো, লোকে নপুংসক বলতে লাগলো আমাকে।

অবশ্য, এর ফলে লাভই হলো আখেরে। যদি একজন সত্যিকারের পুরুষ হোতাম, কখনোই মাসারার প্রকোষ্ঠে আমাকে যেতে দিতো না তারা।

*

একরাতে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে আসার প্রকোষ্ঠে নিয়ে গেলো প্রহরীরা। খড়ের তৈরি একটা মাদুরের উপর শুয়ে ব্যথায় পেটে চেপে ধরে গোঙাচ্ছিলো তরুণী। বমি করে ভাসিয়ে ফেলেছে। প্রচণ্ড ব্যথায় থেকে থেকে মুচড়ে উঠছে।

দ্রুত নিচু হয়ে তাকে পরীক্ষা করে দেখলাম আমি। ভেবেছিলাম পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে তার পেট, কিন্তু তা নরম; উষ্ণ। আমার প্রাথমিক ধারণা ভুল, পেটের নাড়ি ফুলে যায়নি এর। যদিও গোঙানি চালিয়ে গেলো মাসারা, আমি নিশ্চিত হলাম এ তার অভিনয়। এরপর, মাসারার চোখের ইঙ্গিতে নিশ্চিত হলাম তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে।

যা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে খারাপ অবস্থা, গীজ ভাষায় সঙ্গে আসা দুজন মহিলাকে বললাম আমি। ওকে বাঁচাতে হলে আমার ওষুধের বাক্স প্রয়োজন। যাও, এক্ষণ নিয়ে আসো ওটা।

ওরা দরোজার দিয়ে বেরিয়ে যেতে, মাথা নামিয়ে ফিসফিসালাম, দারুন চালাক মেয়ে তুমি। ভালো অভিনেত্রীও বটে। পাখির পালক গলায় ঢুকিয়ে বমি করেছো, তাই না?

আমার উদ্দেশ্যে হেসে প্রতুত্তর করলো মাসারা, আর কোনো উপায় ছিলো না তোমার সাথে দেখা করার। যখন ওই মেয়েলোকগুলোর কাছে শুনলাম, তুমি গীজ বলতে পারো, সাথে সাথেই বুঝেছি আমরা পরস্পরকে সাহায্য করতে পারবো।

তাই যেনো হয়।

বহুদিন একা আছি আমি। কেউ একজনের সাথে কথা বলতে পারলেও ভালো লাগবে। ওর সরলতায় মুগ্ধ হলাম। হয়তো, দুজনে মিলে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার একটা উপায় খুঁজে বের করতে পারি।

এমন সময় গলিপথ ধরে আসতে থাকা মেয়েলোকগুলোর আওয়াজ পাওয়া গেলো। আমার হাত টেনে ধরলো মাসারা।

বলো, তুমি আমার বন্ধু নও? আসবে না আবার এখানে?

ঠিক আছে। আসবো।

আচ্ছা, তাড়াতাড়ি বলে একটা কথা। কী নাম ছিলো ওর?

কার?

নদীর ধারে প্রথমদিন যে ছিলো তোমার সাথে। তরুণ-দেবতার মতো দেখতে?

ওর নাম মেমনন।

মেমনন! অদ্ভুত ভঙ্গিতে নামটা উচ্চারণ করলো মেয়েটা। কী সুন্দর নাম। তার মতোই।

প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলো মহিলা দু জন। সাথে সাথে সুস্থ পেট চেপে ধরে মরণ চিৎকার দিতে শুরু করলো মাসারা। সহানুভূতির শব্দ করে লতাগুল্মের একটা মিশ্রন খাইয়ে দিলাম আমি ওকে। সকালে আবার দেখে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়ে এলাম প্রকোষ্ঠ ছেড়ে।

সকালে উন্নতি ঘটলো মাসারার অবস্থার। বেশ কিছু সময় তার সাথে থাকার সৌভাগ্য হলো। একজন মাত্র মহিলা কিছুক্ষণ থেকে বিরক্ত হয়ে দূরে সরে গেলো। নিচু স্বরে কথা বলে চললাম আমরা দুজন।

মেমনন কিছু একটা বলেছিলো আমাকে। কী, আমি বুঝি নি। কী বলেছিলো সে?

ও বলেছিলো, আমি তোমার জন্যে ফিরে আসবো। সাহস রেখো। আমি ফিরে আসবো তোমার জন্যে।

এটা কেমন করে বোলবে সে। সে তো চেনে না আমাকে, দেখেছেও কয়েক মুহূর্তের জন্যে। মাথা নাড়লো মাসারা। চোখ ভর্তি জল তার। মিথ্যে বলছো, টাইটা? দুঃখে বুকের ভেতরটা ভেঙে যেতে চাইলো আমার।

ও মিশরের যুবরাজ। সম্মানিত ব্যক্তি। কথাগুলো এমনিতে বলে নি মেমনন।

পরদিন যখন আবার দেখতে গেলাম মাসারাকে, প্রথম আমাকে যেটা জিজ্ঞেস করলো সে, তা হলো, আবার বলো, মেমনন কী বলেছিলো আমাকে? কাজেই, মেমননের বলা কথার পুনরাবৃত্তি করতে হলো আমাকে।

আরকুনকে জানালাম, মাসারার অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু প্রতিদিন একবার করে বাইরে হাঁটতে দিতে হবে তাকে। এছাড়া তার স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো হবে না । মাসারা ছিলো দারুন মূল্যবান এক বন্দী। তার কোনো রকম ক্ষতি হোক–এটা

আরকুন বরদাস্ত করবে না। এক দিন ভেবে-চিন্তে শেষমেষ অনুমতি দিলো সে।

প্রথম দিকে প্রহরী থাকতো আমাদের সাথে। পরবর্তীতে একা আমরা দুজন আদর সেজেদের প্রাচীরঘেরা স্থানে ঘুরে বেড়াতাম প্রতি সকাল। কথার যেনো শেষ হবে না মাসারার। মেমননের সমস্ত কথা, গল্প শুনতে চাইলো সে। স্মরন করে করে মেমননের বহু কীর্তি শুনিয়েছিলাম তাকে। বারবার সেগুলো শুনে মুখস্ত হয়ে গেলো মাসারার। পরের বার বলতে গেলে বরং ও-ই আমাকে শুদ্ধ করে দিতে ভুল-ভাল কিছু বলে ফেললে। বিশেষত, কীভাবে ট্যানাস আর আমাকে উন্মত্ত হাতির কবল থেকে বাঁচিয়েছিলো মেমনন–এটা মাসারার ভীষণ প্রিয়। কেমন করে সাহসী বীরের উপাধি পেলো সে, এ-ও বারবার শুনতে সে।

ওর মা-রানি সম্পর্কে বলো আমাকে। এরপর, মিশর সম্বন্ধে বলো। তোমাদের দেব-দেবী, যখন মেমনন ছোটো ছিলো তখনকার কথা বলো না। ঘুরে-ফিরে সেই মেমননে ফিরে যেতো তার কথাবার্তা। আমিও অফুরন্ত বলে পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকার দুঃখ ভুলতাম ।

একদিন সকালে মাসারা বললো, গতকাল এক ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছি আমি। স্বপ্নে দেখলাম, মেমনন এসেছে আমার কাছে; কিন্তু সে কী বোলছে কিছুই বুঝছি না আমি। অবশ্যই আমাকে মিশরীয় ভাষা শেখাবে তুমি, টাইটা। আজ থেকে শুরু।

বুদ্ধিমতী মেয়ে মাসারা। খুব দ্রুতই নিজেদের মধ্যে মিশরীয় বলতে শুরু করলাম আমরা। এখান থেকে পালানোর ব্যাপারে মাঝে-মধ্যেই কথা বোলতাম দু জন।

যদিও বা এই দুর্গ থেকে পালিয়ে যেতে পারো, সাহায্য ছাড়া পর্বতের ভেতর দিয়ে কখনো যেতে পারবে না, আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বললো মাসারা। এতো সরু-প্যাচানো পথ। তুমি হারিয়ে যাবে। প্রত্যেক গোত্র নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছে ওখানে। গুপ্তচর ভেবে তোমার গলা কাটবে এরা।

তাহলে, আমাদের কী করা উচিত?

যদি এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারো, আমার বাবার কাছে যাবে। উনি তোমাকে প্রহরী দিয়ে তোমার পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দিতে পারবেন। তুমি মেমননকে বোলবে কোথায় আছি আমি। সে নিশ্চই আমাকে উদ্ধার করতে আসবে। এমন আত্মবিশ্বাসের সুরে কথা কটা বলেছিলো মাসারা, আমি ওর চোখে চোখে তাকাতে পারলাম না।

বুঝলাম, নিজের মনের গভীরে মেমননের এমন এক ছবি এঁকেছে সে, যা বাস্তবতার সাথে মেলে না। একজন দেবতার প্রেমে পড়েছে সে–তার মতোই অল্প বয়স্ক, উদ্যমী কোনো তরুণের নয়। আমিই দায়ী এজন্যে। রাজপুত্রের এতো সব গল্প ওকে না বললেই হতো। এই মুহূর্তে বাস্তবতার কথা বলে ওর মন ভাঙতে পারবো না আমি।

যদি তোমার বাবা, প্রেসটার বেনি-জনের কাছে পৌঁছুতে পারি, তিনি ভাববেন আমি হয়তো আরকুনের গুপ্তচর। আমারা মাথা কাটবেন সাথে সাথে, দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চিন্তায় কথাটা বললাম আমি।

তাকে কী বলতে হবে আমি শিখিয়ে দেবো তোমাকে। ওই কথা শুধু তিনি আর আমি জানি। এতে প্রমাণ হবে তুমি আমার কাছে থেকেই এসেছো।

আর কিছু বলার নেই এখানে। অন্যভাবে চেষ্টা চালালাম আমি।

তোমার বাবার দুর্গে কেমন করে পৌঁছুবো? তুমিই তো বললে, ওই রাস্তা এতো । সোজা নয়।

আমি শিখিয়ে দেবো। তোমার অনেক বুদ্ধি সহজেই মনে রাখতে পারবে।

তততদিনে আমার ছোট্ট রাজকুমারীদের মতো ওকেই ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম আমি। ওর মনে আঘাত লাগে–এমন কিছু করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। মাসারা আমাকে এই বয়সের মিসট্রেসকে মনে করিয়ে দেয়।

ঠিক আছে, এখন বলো তাহলে, কেমন করে তোমার বাবার কাছে পৌঁছুবো। এভাবেই, পালানোর পরিকল্পনা শুরু করলাম আমরা। আমার জন্যে মূলত এ ছিলো একটা খেলা, সবসময় মাসারার সাহস বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিলাম আমি। সত্যিই এই দূর্গম দুর্গ থেকে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে আমার মনে হয়না।

একটা লম্বা দড়ি তৈরি করে, ওটা বেয়ে নিচে নেমে যাওয়ার কথা বললাম আমরা। মাদুরের নিচে লুকিয়ে রাখা কাপড় থেকে উল সংগ্রহ করে দড়ি বানাতে লাগলো মাসারা, চুপিচুপি। আমি ওকে বলি নি, আমাদের ওজন সইতে পারে, এমন দড়ি তৈরি সম্ভব নয় ওটা থেকে।

দীর্ঘ দুই বছর আদবার সেজেদের উচ্চতায় পরিকল্পনা করে চললাম আমরা। পালিয়ে যাওয়ার একটা মাত্র উপায়ও খুঁজে বের করতে পারি নি। কিন্তু কখনো বিশ্বাস ভাঙে নি মাসারার। প্রতিদিন সে আমার কাছে জানতে চাইতো, মেমনন আমার সম্পর্কে কী বলেছিলো? আবার বলো, কি প্রতিজ্ঞা করেছিলো সে?

ও বলেছিলো, আমি তোমার জন্যে ফিরে আসবো। সাহস রেখো।  

ঠিক। বলল, আমি সাহসী নই, টাইটা?

আমার দেখা সবচেয়ে সাহসী মেয়ে তুমি।

বাবার সাথে দেখা হলে কী বলবে, বলোতো দেখি।

আমি ওর নির্দেশ মতো কথাগুলো উচ্চারণ করতাম। আর পালনের পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে উৎসাহভরে বলতো ও।

ছোট্ট চড়ুই পাখিগুলো, যেগুলো চাতালে আমার হাত থেকে খুঁটে খায়, ওগুলোর একটাকে ধরবো আমি। আমার বাবাকে একটা চিঠি লিখবে তুমি, কোথায় আছি জানিয়ে । চড়ুইয়ের পায়ে বেঁধে ওটাকে ছেড়ে দেবো আমরা।

ওটা আরকুনের কাছে উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমাদের আর দেখা করতে দেবে না সে। কোনো লাভ হবে না।

শেষপর্যন্ত অবশ্য দারুন এক ঘোড়ার পিঠে চড়ে আদবার সেজেদ থেকে বের হয়েছিলাম আমি। রাজা প্রেসটার বেনি-জনের সাথে আরো একটি যুদ্ধে নেমেছিলো আরকুন। ব্যক্তিগত চিকিত্সক এবং ভোম খেলোয়ার হিসেবে তার সাথে থাকার নির্দেশ ছিলো আমার উপর।

সরু পাহাড়ি পথে ঘোড়ার চোখ বেঁধে যখন নামছিলাম, ঘাড় ফিরিয়ে চাতালের উপর তাকিয়ে দেখলাম, ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মাসারা। মিশরীয় ভাষায় কথা বলে উঠলো ও। বাতাসের শব্দ ছাপিয়ে ওর কথাগুলো আমার কানে পৌঁছেছিলো।

ওকে বলো, ওর অপেক্ষায় আছি আমি। বলো, আমি সাহস হারাই নি। এরপর, নরম স্বরে যা বলেছিলো, আমি ভালোভাবে ঠাওর করতে পারলাম না। তবে মনে হয়, মাসারা বলেছিলো, বলো, আমি ভালোবাসি ওকে।

ঠাণ্ডা বাতাসে গালের উপর বরফের মতো মনে হলো চোখের পানি। আম্বা কামারার উপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলাম আমি।

*

যুদ্ধের আগের রাতে তার তাবুতে বহু রাত পর্যন্ত আমাকে বেসিয়ে রাখলো আরকুন। শেষমুহূর্তের নির্দেশ দিচ্ছিলো সেনাপতিদের, একই সঙ্গে নীল রঙের তলোয়ারে ফলায় ধার দিচিছলো সে। এরপর বিশুদ্ধ গরুর চর্বি দিয়ে ফলাটা ভালো করে মাখালো সে। সেই অদ্ভুত রুপালি-নীল তলোয়ারটার যত্ন নিতে হয়, না হয় লাল গুঁড়োর মতো কিছু একটা জন্মে ওটার গায়ে।

ঠিক ট্যানাসের মতোই আমিও দারুন পছন্দ করে ফেললাম তলোয়ারটা। মাঝে মধ্যে যখন খুব ভালো আচরণ করতো আরকুন, আমাকে তলোয়ারটা হাতে নিতে দিতো সে। ওটার ওজন, ফলার ধার সবকিছুই ছিলো অবিশ্বাস্য। ভাবছিলাম, ট্যানাসের মতো একজন তুখোড় তলোয়ারবাজের হাতে পড়লে কী জাদু দেখাবে ওটা। আবার আমাদের দেখা হলে নির্ঘাত এর সম্পর্কে জানতে চাইবে ট্যানাস, কাজেই আরকুনের কাছে। তলোয়ার সম্পর্কে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করতাম আমি । আরকুনেরও এই নিয়ে বলতে যেনো কোনো ক্লান্তি নেই।

সে আমাকে জানালো, ইথিওপিয়ার কোনো এক সূর্য দেবতা গলিত আগ্নেয়শিলা থেকে তৈরি করেছেন এই তলোয়ার। ডোম খেলায় জিতে সেই দেবতার কাছ থেকে এটা পেয়েছিলেন আরকুনের দাদার দাদা। বিশদিন বিশরাত ধরে চলেছিলো সেই খেলা। আমি ভাবলাম, আরকুনের দাদার দাদা যদি তার মতো মানের খেলোয়ার হয়ে থাকে, তাহলে সেই দেবতা নির্ঘাত অকাল-কুম্মাণ্ড।

পরদিন তার যুদ্ধের পরিকল্পনা সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চাইলো আরকুন। তততদিনে সে জেনে গেছে, সামরিক কৌশল আমি বুঝি। আমি তাকে জানালাম, তার পরিকল্পনা অসাধারণ। ডোম খেলার মতোই সামরিক কৌশলে দারুন পিছিয়ে ছিলো ইথিওপিওরা। যে ভূ-খণ্ডে যুদ্ধ হচ্ছে, ঘোড়ার কোনো ভূমিকা নেই সেখানে। তাদের কোনো রথ নেই। বিশৃঙ্খল ভঙ্গিতে যুদ্ধ লড়ে অভ্যস্ত এরা।

তুমি হলে ইতিহাসের সেরা সমরনায়ক, আমি আরকুনকে বললাম। তোমার এই কীর্তিগাথা একটা স্লোলে লিখে রাখতে চাই আমি। চিন্তাটা মনে ধরলো আরকুনের। আদবার সেজেদ-এ ফিরে এর জন্যে যা যা প্রয়োজন, সব আমাকে জোগাড় করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলো সে।

যতোদূর বুঝলাম, রাজা প্রেসটার বেনি-জনও একই গোছের যুদ্ধবাজ। খাড়া ঢাল বিশিষ্ট চওড়া এক উপত্যকায় পরের দিন তার বাহিনীর সাথে দেখা হলো আমাদের। কয়েক মাস আগেই যুদ্ধের স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিলো এই স্থান। আমরা আসার আগেই নিজের বাহিনীর সামনে অবস্থান নিয়ে ফেলেছিলো রাজা প্রেসটার বেনি জন। নিরাপদ দূরত্বে থেকে, আগে বেড়ে আরকুনের উদ্দেশ্যে গাল-মন্দ বকতে লাগলো সে।

ভীষণ বিচ্ছিরি লোক এই প্রেসটার বেনি-জন। শুকনো, লম্বা-সাদা দাড়ি কোমড়ে এসে পড়েছে। দূর থেকে দেখে ভালো বুঝলাম না। কিন্তু মহিলারা আমাকে জানালো, যৌবনে ইথিওপিয়ার সুদর্শনতম পুরুষ ছিলো সেটার বেনি-জন; দুইশো স্ত্রী আছে তার। অনেক মেয়ে এর ভালোবাসা পাবার জন্যে আত্মাহুতি দিয়েছে। সম্ভবত, হারেমের ভেতরেই তার দক্ষতা বেশি, যুদ্ধের ময়দানে নয়।

প্ৰেসটার বেনি-জনের গাল-মন্দ শেষ হতে, এবারে আরকুন সামনে এগিয়ে প্রত্যুত্তর করলো। বেশ আগুনঝড়া, কাব্যিক হলো তার গাল-মন্দ, চারপাশের উঁচু পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো তার কণ্ঠস্বর।

আরকুনের শেষ হতে, যুদ্ধ শুরু অপেক্ষায় রইলাম আমি। কিন্তু না, দুই পক্ষেরই বেশ কয়েকজন সৈনিকের বলার পালা এবারে। উষ্ণ সূর্যের তলায়, পাথরে হেলান দিয়ে আরাম করে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি ঠোঁটে হাসি নিয়ে। ট্যানাস আর নীল বাহিনী যে কী করবে এই আহাম্মক দলের সাথে ভেবে দারুন আনন্দ পেলাম।

সন্ধ্যার দিকে অস্ত্রের ঝনঝনানির শব্দে জেগে উঠলাম আমি। প্রথম আক্রমণে গিয়েছে আরকুন। হৈ হৈ আওয়াজ করে, বর্মে নিজেদের অস্ত্র পিটিয়ে এগিয়ে গেলো তারা। সামান্য সময় পড়ে, দারুন ভীত অবস্থায় আবার ফিরে এলো শত্রুর গায়ে একটা আঁচড়ও কাটে নি তাদের কারো অস্ত্র।

আবারো, গালি-গালাজের বিনিময় ঘটলো। এরপর নিজের বাহিনী ছোটালেন রাজা প্রেসটার বেনি-জন। ঠিক একই ফল ঘটলো এবারেও কোনো রকম সংঘর্ষ ঘটলো না দুই বাহিনীর মধ্যে। এভাবেই, দিন কেটে গেলো। অপমান আর গাল-মন্দ; ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া কিন্তু কোনো লড়াই নয়। রাত হতে, দুই দলই বিশ্রামে গেলো । উপত্যকার পাদদেশে ক্যাম্প ফেললাম আমরা, আমাকে ডেকে পাঠালো আরকুন।

কী যুদ্ধ! দারুন উৎসাহের সাথে বললো সে। বহুমাস লাগবে সেটার বেনি জনের, আবারো মাঠের দখল নিতে।

আর যুদ্ধ হবে না কাল? আমি জানতে চাইলাম।

আগামীকাল আমরা আবার সেজেদ-এ ফিরে যাবো। আরকুন জানালো। আমার বিজয়ের পুরো গল্প ফ্লোলে লিখবে তুমি। আমি নিশ্চিত, এমন শোচনীয় পরাজয়ের পর যুদ্ধবিরতি কামনা করবে সেটার বেনি-জন।

পরদিন রাত নামবার আগেই পিছনে ফেলে আসা একটা অগভীর নদীবক্ষে পৌঁছুলাম আমরা। মাসারার দেওয়া বর্ণনা থেকে এটা চিনলাম আমি। পর্বত থেকে নেমে আসা মাতা নীলের অসংখ্য শাখা-প্রশাখার একটি এই নদী। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিপাতে পানির স্তর বেশ উঁচু হয়ে গেছে। নদী অতিক্রমের জন্যে পানিতে নেমে এলাম আমরা। কিন্তু স্রোতের গতি আর পানির উচ্চতা ভুল বুঝেছিলাম আমি। দারুন শক্তিশালী স্রোত এখানে। টলোমলো শুরু করলো ঘোড়াগুলো। টেনে নিয়ে গেলো গভীর পানিতে। কিছুক্ষণ পরেই দেখি, পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছি আমি এবং আমার ঘোড়াটা। স্রোতের টানে নদীর ভাটিতে ভেসে চললাম আমরা। জীবন বাঁচানোর তাগিদে প্রাণপণ সাঁতরে চললাম আমি। কোনো রকম চিৎ হয়ে পায়ে দিয়ে পানির তলার পাথরের ভঁজে আটকে নিলাম। প্রচণ্ড স্রোত স্থির হতে দিচ্ছে না। কিছু সময় পর্যন্ত আরকুনের সৈনিকেরা নদীর পার ধরে আমার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে চললো। কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই নদী বাঁক ঘুরতে, সামনের পাথুরে প্রতিবন্ধকের কারণে আর এগুনো সম্ভবপর হলো না তাদের পক্ষে । একা ভেসে চললাম আমি আর ঘোড়াটা।

বাকের পরে এসে ধীরে কমে এলো স্রোতের গতিবেগ । সাঁতরে এগিয়ে, এক হাত দিয়ে ঘোড়ার গলা জড়িয়ে ধরলাম আমি। এই মুহূর্তের জন্যে আমি নিরাপদ। তখনই, প্রথমবারের মতে পালানোর কথা মাথায় এলো আমার বুঝলাম, দেবতারা একটা সুযোগ করে দিয়েছেন আমাকে। বিড়বিড় করে প্রার্থনা আউড়ালাম দেবতার প্রতি, আরো ভালো করে ঘোড়াটাকে জড়িয়ে ধরে থাকলাম।

বেশ ক মাইল ভাটিতে নিয়ে এলো নদী আমাদের। এরপর, চারিদিকে যখন আঁধার ঘনিয়েছে, তীরে উঠে এলাম ঘোড়াসমেত। আমি নিশ্চিত, সকাল হওয়ার আগে আমাকে খুঁজতে বেরুবে না আরুকুনের লোকেরা। শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো সর্বাঙ্গ।

বাতাসের আড়ালে, একটা পাথুরে খোড়লে ঘোড়াটাকে এনে, ওর গায়ে গা ঠেকিয়ে শুয়ে রইলাম। চাঁদের আলোয় চকচক করছে জটার মখমলের মতো ত্বক। ধীরে, ঘোড়ার গায়ের তাপ এসে লাগলো শরীরে, কমে এলো কাঁপুনি। একটু গরম হয়ে নিতে, বালুময় তীর থেকে ভাঙা ডাল কুড়িয়ে নিয়ে আসলাম। শিলুকদের শেখানো কৌশলে, বহু কণ্ঠে একটা ছোট্ট আগুন ধরাতে সমর্থ হলাম। আগুনের ধারে ভেজা জামা শুকোতে দিয়ে সারারাত কুঁজো হয়ে পড়ে থাকলাম।

সকালের আলো ফুটে উঠতেই, কাপড় গায়ে দিয়ে চড়ে বসলাম ঘোড়ার পিঠে। নদী থেকে যথাসম্ভব সরে থাকতে হবে আমাকে। আরকুন ওখানেই খুঁজবে।

দুইদিন পর, মাসারার দেওয়া পথচিহ্ন অনুসরণ করে প্রেসটার বেনি- জনের এলাকায়, চাষ-বাস করা হয়, এমন একটা চ্যাপ্টা পাহাড়ে উঠে এলাম আমি। গ্রামের সর্দার কিছু মাত্র দেরি না করে আমার গলা কেটে, ঘোড়া হাতিয়ে নেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলো। প্রাণপণ চেষ্টায় তাকে বোঝাতে সক্ষম হলাম আমি, ঘোড়াটা রেখে আমাকে যেনো প্রেসটার বেনি-জনের কাছে যেতে দেওয়া হয়। শেষমেষ, আমাকে তার দুর্গে নিয়ে যেতে সম্মত হলো সর্দার।

*

যে প্রহরীরা আমাকে প্রেসটার বেনি-জনের কাছে নিয়ে চলছিলো, তাদের কথাবার্তা থেকে টের পেলাম, দারুন শ্রদ্ধা করে তারা রাজাকে। যে সমস্ত গ্রাম পেরিয়ে এলাম, তাদের অধিবাসীরা অন্তত আরকুনের লোকেদের চেয়ে পরিচ্ছন্ন। ভালো স্বাস্থ্যের লোকজন নিজেদের এলাকায় চাষবাস করছে। তাদের ঘোড়াগুলো চমৎকার। এতো সুন্দর চোখে প্রায় জল চলে এলো আমার।

অবশেষে, ভীষণ উঁচু এক আমবার উপরে দুর্গ দৃষ্টিগোচর হলো। আরকুনের চেয়ে এ ঢের ভাললা, কোনো বিভৎস দেহ ঝুলে নেই দেয়ালে।

কাছ থেকে অবশ্য রাজা প্রেসটার বেনি-জন অত্যন্ত সুপুরুষ। রুপালি চুল আর দাড়ি ভিন্ন এক আভিজাত্য এনে দিয়েছে তাকে। গায়ের রঙ ফর্সা; গভীর কালো চোখে বুদ্ধির ঝিলিক। প্রথমে আমার গল্পের কাহিনীতে সন্দেহ পোষণ করলো সে, কিন্তু মাসারার সাথে আমার বিভিন্ন কথা-বার্তার খবরে একটু একটু করে তার আচরণ পরিবর্তন ঘটতে লাগলো।

মেয়ের বার্তা পেয়ে আবেগে আপ্লুত হলো প্রেসটার বেনি-জন। তার স্বাস্থ্যের খবরাখবর জানতে উদগ্রিব হয়ে আমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চললো। এরপর, তার নির্দেশে ভালো একটা কক্ষে নিয়ে গিয়ে খাবার আর গরম উলের কাপড় দেওয়া হলো আমাকে। খাবার আর বিশ্রাম শেষ হতে, ভৃত্যরা এসে রাজার সভাকক্ষে নিয়ে চললো আমাকে।

সম্মানিত রাজা, গত দু বছর ধরেই আরকুনের দুর্গে বন্দী জীবন যাপন করছে। মাসারা। কথা বলার সুযোগ পেয়েই বললাম। তরুণী একজন মেয়ে সে। বহুকষ্টে, বিচ্ছিরি পরিবেশে কোনোক্রমে টিকে আছে। এরপর তার অবস্থার কথা খুলে বললাম যথাসম্ভব।

আরকুনের দাবি করা মুক্তিপণ জোগাড় করার চেষ্টা করছি আমি। নিজেকেই যেনো সান্ত্বনা দিতে চাইলো প্রেসটার বেনি-জন। কিন্তু ওই বদমাশের লোভ পূরণের জন্যে যে পরিমাণ রুপোর প্রয়োজন, তা এতো দ্রুত জোগাড় করা সম্ভব নয়। এ ছাড়াও, বহু জমি এবং আমার সেরা কিছু গ্রাম দাবি করেছে সে। এতে করে আমার সম্পূর্ণ রাজত্ব, লোকবল তার হয়ে যাবে।

আপনার বাহিনীকে, আদর সেজেদ-এ, আরকুনের দুর্গে নিয়ে যেতে পারি আমি। সেখানে পৌঁছুতে পারলে, তাকে কজা করে মারা কে ফিরে পেতে পারেন।

এমন প্রস্তাবে হকচকিয়ে গেলো প্রেসটার বেনি-জন। এ ভাবে লড়তে অভ্যস্ত নয় ইথিওপিয় রা ।

আমি খুব ভালো করে চিনি আদবার সেজেদ, কিন্তু ওই দুর্গ দূর্ভেদ্য। প্রত্যুত্তরে বললো প্রেসটার বেনি-জন। ভীষণ শক্তিশালী বাহিনী আছে আরকুনের। বহু ভয়ঙ্কর যুদ্ধ লড়েছি আমরা তার সাথে। আমার লোকেরা সিংহের মতো সাহসী, তবুও কখনো হারাতে পারিনি তাকে। প্রেসটার বেনি-জন-এর সিংহবাহিনীকে দেখেছি আমি যুদ্ধের ময়দানে, তার চিন্তা-ভাবনা একেবারেই সঠিক। ওই রকম বাহিনী নিয়ে আবার সেজেদ আক্রমণ করে মাসারা কে ফিরে পাবার আশা বৃথা।

পরদিন ভিন্ন একটা প্রস্তাব নিয়ে গেলাম রাজার কাছে। আকসুম প্রদেশের শাসনকর্তা, রাজাদের রাজা, আপনি তো জানেন, আমি মিশরীয় নাগরিক। মিশরের শাসনকর্ত্রী, রানি লসট্রিস তার বাহিনী নিয়ে জোড়া নদীর মিলনস্থলে অপেক্ষা করছেন।

সায় দিলো প্রেসটার বেনি-জন। সত্যি কথা। মিশরীয়রা আমার এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছে বটে। আমার উপত্যকায় খোঁড়াখুড়ি করছে তারা। শীঘিই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সীমান্ত ছাড়া করবো আমি তাদের।

এবারে আমার অবাক হওয়ার পালা। ফারাও-এর সমাধির নির্মাণ কাজ সম্বন্ধে অবগত আছেন প্রেসটার বেনি-জন! আর আমার লোকেরা তার আক্রমণের হুমকির মধ্যে আছে। সাথে সাথেই কথার উদ্দেশ্য পরিবর্তন করে ফেললাম।

আমার লোকেরা যুদ্ধ আর আক্রমণ কৌশলে পারদর্শী। ব্যাখ্যা করে জানালাম তাকে। রানি লসট্রিসের সাথে ভালো সম্পর্ক আমার। আমাকে যদি নিরাপদে তার কাছে পৌঁছে দেন, আপনার সাথে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে দেবো। মিশরীয় বাহিনী সদলবলে আদবার সেজেদ উড়িয়ে দিয়ে আপনার কন্যাকে উদ্ধার করে আনবে।

এই প্রস্তাবে ভেতরে ভেতরে দারুন আন্দোলিত হয়েছিলো সেটার বেনি-জন। বন্ধুত্বের বিনিময়ে তোমার কী কী চাইবে আমার কাছে? সতর্কভঙ্গিতে জানতে চাইলো সে।

বেশ ক দিন দরদাম করলাম আমরা। শেষপর্যন্ত চূড়ান্ত হলো দাবি। রানি লসট্রিসকে আপনার উপত্যকায় খোঁড়া-খুড়ি চালিয়ে দিতে হবে আপনাকে। ওই উপত্যকাকে আপনি নিষিদ্ধ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করবেন। এমনকি মৃত্যুর হুমকি দিলেও আপনার লোকেরা কখনো সেই এলাকায় প্রবেশ করবে না। আমার স্ত্রীর জন্যে এটুকু করলাম, এতে করে ফারাও-এর সমাধি লজ্জিত হবে না।

ঠিক আছে, একমত হলো প্রেসটার বেনি-জন।

আপনার ঘোড়ার পাল থেকে আমার পছন্দ করা দুই হাজার ঘোড়া দিতে হবে রানি লসট্রিসকে, উপহার হিসেবে। এটা আমার জন্যে।

এক হাজার, রাজা বললো।

দুই হাজার, একটুও নমনীয় হলাম না আমি।

ঠিক আছে, শেষমেষ মেনে নিলো প্রেসটার বেনি-জন।

মুক্তি পাওয়ার পর তার পছন্দ মতো পুরুষকে বিয়ে করার অনুমতি দিতে হবে রাজকুমারী মাসারাকে। এ বিষয়ে আপনি কোনো রকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবেন না। এটা মেমনন আর মাসারার জন্যে।

এ যে আমাদের আচার-অনুষ্ঠানের বাইরে, দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রেসটার বেনি জন। ঠিক আছে, তাও মেনে নিলাম।

যুদ্ধ শেষে আরকুন এবং তার আদবার সেজেদ দুর্গ আপনার হাতে তুলে দেবো আমরা। এবারে বেশ উৎফুল্ল দেখালো তাকে।

শেষ একটা কথা আরকুনের সমস্ত যুদ্ধাস্ত্র বিশেষত কিংবদন্তির সেই নীল তলোয়ার, ওগুলো আমরা, মিশরীয়রা পাবো। এটা ট্যানাসের জন্যে।

আমি একমত।

পঞ্চাশজন যোদ্ধার একটা প্রহরী বাহিনী দিলো প্রেসটার বেনি-জন; তারই উপহার দেওয়া চমৎকার একটা স্ট্যালিয়নের পিঠে চড়ে পরদিনই কেবুই-এর উদ্দেশ্যে ফিরে চললাম আমি।

*

তখনো কেবুই থেকে পাঁচদিন মতো দূরত্বে আমরা, এ সময় আকাশের গায়ে চলমান ধুলোর মেঘ দৃষ্টিগোচর হলো। এরপরই তাপ-মরীচিৎকার ভেতর নাচতে দেখলাম রথ বহরকে। আক্রমণের ভঙ্গিতে বিন্যস্ত হয়ে এগিয়ে চলেছে রথবহর, সমভূমির উপর দিয়ে। এতো চমৎকার ভাবে বিন্যস্ত সুদৃশ্য রথগুলোকে ওগুলোর নেতৃত্বে রয়েছে–ভাবলাম আমি।

চোখের উপর হাত দিয়ে আড়াল করে সামনে তাকালাম। সামনের রথের ঘোড়াদুটো দেখে লাফিয়ে উঠলো বুকের ভেতরটা। এ যে অজেয় আর শেকল আমার প্রিয় দুটো ছেলেমেয়ে। অবশ্য, রথের কাঠামোতে বসা অবয়বটাকে সহসা চিনতে পারি নি। তিন বছর আগে শেষ দেখেছিলাম মেমননকে। তেরো থেকে সতেরো বছরের ফারাক আসলে ছেলে থেকে পুরুষে রূপান্তরিত করেছে তাকে।

জিনের উপরে রাখা কাপড় আর পাদানীসহ ইথিওপিও ধাচে ঘোড়া দাবড়াতে শিখে গেছি আমি ততোদিনে। পাদানী উপর দাঁড়িয়ে হাত নাচালাম; বাঁক ঘুরিয়ে ফেলেছে রথ টের পেলাম। মেমনন আমাকে চিনেছে। দ্রুত ছুটে আসতে লাগলো সে।

মেম! চিৎকার করে উঠলাম আমি। মেম! বাতাসে ভেসে এলো মেমননের আনন্দচ্ছল কণ্ঠ।

টাটা! আইসিসের মিষ্টি বুকজোড়ার কসম! এ যে টাটা!

রথ থামিয়ে, নেমে এসে আমাকে টেনে ঘোড়া থেকে নামালো সে। প্রথমেই আলিঙ্গন করে, একহাত দূরত্বে থেকে পরস্পরকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম আমরা দু জন।

তুমি ফ্যাকাসে আর পাতলা হয়ে গেছে, টাটা। হাড় বেড়িয়ে গেছে শরীরের। মাথায় এগুলো কী ধূসর চুল দেখছি আমি? আমার চাদির চুলগুলো আলতো কোর টানলো সে।

আমার চেয়ে ততোদিনে লম্বা হয়ে গেছে মেমনন। হালকা-পাতলা, চওড়া কাঁধের অধিকারী সে। পালিশ করা তৈল-স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ তার ত্বক, হাসির সময় ঘাড়ের পেশি শক্ত হয়ে উঠলো। স্বর্ণের বাজুবন্ধ হাতে; নগ্ন বুকে ঝুলছে বীরশ্রেষ্ঠ পদক। ক্ষীপ্র চিতার কথা মনে করিয়ে দিলো ও আমাকে।

আমাকে কোলে তুলে নিয়ে রথের পাদানীতে দাঁড় করিয়ে দিলো মেমনন। লাগাম হাতে নাও, নির্দেশের সুরে বললো সে। দেখতে চাই, আগের কৌশল সব ভুলে গেছো কি না!

কোন্ দিকে? জানতে চাইলাম।

পশ্চিমে কেবুই-এ। আর কোথায়? মা যদি শুনে তোমাকে সরাসরি তার কাছে নিয়ে যাইনি, মেরেই ফেলকে আমাকে।

সেই রাতে, অন্যান্যদের থেকে একটু আলাদা স্থানে ক্যাম্প ফেললাম আমরা দু জন। আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্ররাজীর দিকে চেয়ে থেকে নীরব রইলাম কিছুক্ষণ। এরপর মেমনন বললো, যখনই ভাবতাম, তোমাকে হারিয়েছি, মনে হতো নিজেরই একটা অংশ যেনো নেই আমার। আমার সবচেয়ে পুরোনো স্মৃতিতেও তুমি আছো।

আমি, যার কাজই হলো শব্দের মালা গাঁথা, যথোপযুক্ত কোনো শব্দ খুঁজে পেলাম ওর কথার উত্তরে। আবারো নীরবতা নেমে এলো আমাদের মাঝে। শেষমেষ মেমনন এক হাত রাখলো আমার কাঁধে।

ওই মেয়েটাকে আর কখনো দেখেছিলে? ধীর, সহজ ভঙ্গিতে জানতে চাইলো সে, যেনো এতে কিছুই আসে যায় না। কিন্তু আমার কাঁধে রাখা হাত শক্ত হয়ে উঠলো তার।

কোন্ মেয়ে? ইচ্ছে করেই বললাম আমি।

নদীর ধারের সেই মেয়েটা যেদিন আমরা আলাদা হলাম, সেদিন দেখা হয়েছিলো?

কোনো মেয়ে ছিলো নাকি সেখানে? ভ্রু কুঁচকে মনে করার চেষ্ট করলাম যেনো। দেখতে কেমন, মনে আছে?

ওর মুখ যেন গাঢ় পদ্মফুল, বন্য-মধু রঙা গা। ওরা তাকে মাসারা বলে ডাকছিলো। ওর কথা ভেবে অনেক রাত ঘুম হয় নি আমার।

ওর নাম মাসারা বেনি-জন, আমি জানালাম রাজপুত্রকে। আবার সেজেদ পর্বতে দীর্ঘ দুই বছর ওর সঙ্গেই বন্দী জীবন কাটিয়েছি আমি। ওখানে ওকে ভালোবাসতে শুরু করেছি, শুধু চেহারায় নয়, মনেও অত্যন্ত সুন্দর ও।

দুই হাতে আমাকে নির্মমভাবে ঝাঁকুনি দিতে লাগলো যুবরাজ। ওর কথা বলো আমাকে, টাটা! সবকিছু বলো!

কাজেই, সারারাত আগুনের ধারে বসে মাসারার কথা বললাম আমরা দু জন। আমি তাকে জানালাম, নিজের গরজেই মিশরীয় ভাষা শিখে নিয়েছে মাসারা। জানালাম, মেমননের শপথ তাকে অন্ধকার দিনগুলোতে বাঁচিয়ে রেখেছে। সবশেষে জানালাম মাসারার পাঠানো বার্তার কথা, যেদিন আবার সেজেদ ছেড়ে চলে আসলাম, সেদিন বলেছিলো ও।

ওকে বলো, আমি সাহস হারাই নি। বলল, আমি ভালোবাসি ওকে।

আগুনের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো মেমনন কিছু সময়। এরপর নরম স্বরে জানতে চাইলো, কেমন করে ও ভালোবাসবে আমাকে? আমাকে তো চেনেই না।

তুমি কী তাকে ভালো করে জানো, ও তোমাকে যেমন জানে, তার চাইতে ভালো করে? আমার প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়ে রাজকুমার।

ভালোবাসো ওকে?

হ্যাঁ, দ্বিধাহীন কণ্ঠে বললো মেমনন।

তবে সেও তোমাকে একই রকম ভালোবাসে।

ওর কাছে শপথ করেছি আমি। ওই শপথ পূর্ণ করতে আমাকে সাহায্য করবে তো টাটা?

*

কেবুই-এ ফিরে, হোরাসের প্রশ্বাসে চড়ার পর আমার আনন্দ যেনো বাধ মানতে চাইলো না।

আগেই বার্তাবাহক পাঠিয়ে আমাদের আগমনের কথা জানিয়ে রেখেছিলো মেমনন, কাজেই খোলা পাটাতনে আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলো পুরো মিশর।

সেথ্‌-এর পাছার ভাজে লুকোনো ময়লার দুর্গন্ধের কসম! চিৎকার করে বললো ক্ৰাতাস। আমি তো ভেবেছিলাম, তোমার হাত থেকে চিরদিনের মতো নিস্তার মিলেছে, টাইটা! ব্যাটা বুড়ো জংলী! বুকের সাথে যেনো পিষে ফেলবে ও আমাকে।

একটানে নিজের দিকে আমাকে ঘুরিয়ে চোখে চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হাসলো ট্যানাস। তোমার জন্যে আর একটু হলে জংলী ইথিওপিও ব্যাটা ধরে ফেলেছিলো আমাকে! তোমার কারণেই বেঁচে গেছি। ধন্যবাদ, বুড়ো বন্ধু। দেখলাম, কতোটা বুড়িয়ে গেছে ট্যানাস। আমার মতোই ওর চুলও ধূসর হতে শুরু করেছে, মুখটা গ্রানাইটের খণ্ডের মতো ঝড়-অত্যাচারের চিহ্ন বইছে।

আমার ছোট্ট রাজকুমারীরা আর ছোট্টটি নেই অনেক বড়ো হয়ে গেছে ওরা। আমার কাছে আসতে একটু লজ্জা পেলো, আগের কথা খুব একটা মনে থাকার কথা নয় ওদের। সামনে গিয়ে কুর্নিশ করতে, বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে থাকলো। বেকাথার চুলের রঙ গাঢ় তামাটে হয়ে গেছে ততোদিনে।

শেষমেষ, তেহুতি চিনতে পারলো আমাকে। টাটা! বললো সে। কী উপহার এনেছো আমার জন্যে?

হ্যাঁ, সম্মানিত রাজকুমারী, আমি বললাম উত্তরে । এনেছি তো। আমার হৃদয়!

পাটাতন ধরে যখন আমার কর্ত্রীর উদ্দেশ্যে হেঁটে গেলাম, হাসছিলো ও। হালকা নেমেস মুকুট মাথায়, কপালে কোব্রার স্বর্ণমণ্ডিত মাথা । কোমড়ের দিকে ভারী হয়ে গেছে লসট্রিস। দীর্ঘ বছরগুলোর শাসনভার কপালে আর চোখের কোণে কুঞ্চন ফেলে দিয়েছে। আমার কাছে অবশ্য সে তখনো পৃথিবীর সেরা সুন্দরী।

ঝুঁকে মাথা নত করতে সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ও। এ হলো সর্বোচ্চ সম্মানের ব্যাপার। আমার নিচু করে রাখা মাথায় হাত রাখলো মিশরের রানি।

বহুদিন আমাদের থেকে দূরে সরে ছিলে তুমি, টাইটা, এতো নরমস্বরে বললো ও, অনেক কষ্টে শুনতে পেলাম। আজ রাতে, আবার আমার বিছানার পায়ের কাছে ঘুমাবে তুমি, ঠিক আগের মতো।

সেই রাতে, আমার তৈরি করা লতা-গুল্মের মিশ্রণ পান শেষে যখন শুলো ও; পশমের কম্বল দিয়ে গা ঢেকে দিলাম আমি। চোখ বন্ধ রেখেই বিড়বিড় করলো লসট্রিস, ঘুমে থাকবো যখন, আমাকে আবার চুমো দেবে না তো?

না, মহারানি, উত্তরে বললাম আমি। তারপর ওর উপর ঝুঁকে এলাম, পরস্পরকে স্পর্শ করলো আমাদের ঠোঁট । হাসলো লসট্রিস।

আর কখনো আমাদের ফেলে রেখে চলে যেও না, টাইটা।

*

আরকুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লসট্রিসকে রাজী করাতে বেগ পেতে হলো না। দ্রুত প্রশিক্ষণ শুরু করলাম আমরা। পাহাড়ের গভীরে রথ নিয়ে আক্রমণে যাওয়ার উপায় নেই, কাজেই শিলুকদের পদাতিক বাহিনী আমাদের ভরসা।

ফারাও-এর সমাধি উপত্যকায় আমাদের ওয়াগন আর রথ ফেলে রেখে পর্বত বেয়ে উঠতে লাগলাম আমরা। প্রেসটার বেনি জন একদল প্রহরী পাঠিয়ে দিয়েছে আমাদের পথ দেখানোর জন্যে। একশ জন সেরা লোক তারা।

বন্য, রক্তপিপাসু শিলুকদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুরো এক বাহিনী নিয়ে এসেছে ট্যানাস। ধরা পরা সমস্ত গবাদিপশু তারা পাবে–এই মর্মে প্রতিজ্ঞা করেছে সে। সাহায্যের জন্যে দুই বাহিনী মিশরীয় তীরন্দাজ নিয়েছি আমরা সাথে, কাতাসের নেতৃত্বে। আমাদের ধনুকের পাল্লা ইথিওপিও ধনুকের দ্বিগুণ বেশি। যুদ্ধের জন্যে মুখিয়ে আছে পুরো বাহিনী।

আমাদের মধ্য থেকে সেরা ক জন তলোয়ারবাজ যযাদ্ধা নিয়েছে মেমনন। রেমরেম, লর্ড আকের আর আসতেস তাদের মধ্যে অন্যতম। পথপ্রদর্শক হিসেবে রইলাম আমি, আদবার সেজেদ-এ কেবল আমিই গিয়েছি এর আগে। হুই-কে সাথে নিয়েছি প্রেসটার বেনি-জনের উপহার দেওয়া ঘোড়গুলোকে দেখভালের জন্যে।

ট্যানাস আর রাজপুত্রকে বোঝালাম, দ্রুত এগিয়ে যাওয়াই আমাদের সাফল্যের চাবিকাঠি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বৃষ্টি নেমে আসবে। আবার সেজেদ-এ থাকতে, পাহাড়ি এলাকার আবহাওয়া সম্পর্কে একটা ধারণা হয়ে গেছে আমার। একবার বৃষ্টি নেমে এলে এর চেয়ে বড়ো শত্রু আর কিছু হবে না।

এক মাসেরও কম সময়ে আম্বা কামারায় পায়ে হেঁটে চলে এলাম আমরা। লম্বা, ভীষণ এক কোব্রার মতোই পাহাড়ি রাস্তায় এঁকে-বেঁকে এগুলো আমাদের সারি সারি সৈন্য। শিলুকদের বর্শা পাহাড়ি সূর্যালোকে ঝকমক করছিলো। কেউ আমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো না। আমাদের ফেলে আসা গ্রামগুলো সব পরিত্যক্ত। পালিয়ে গেছে অধিবাসীরা। মাঝে-মধ্যে যদিও কালো করে এলো আকাশ, কিন্তু বৃষ্টি ঝরালো না মেঘের দল।

যাত্রা শুরুর পঁচিশ দিনের মাথায় আম্বা কামারার নিচের উপত্যকায় পৌঁছুলাম আমরা। আমাদের উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আবার সেজেদ পর্বতমালা।

আমার অভিজ্ঞতা থেকে পথের উপরে আরকুনের রাখা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা জানি। পাথর-ধ্বস আর পাথরের দেয়াল তার মধ্যে অন্যতম। হাত তুলে ট্যানাসকে দেখালাম ওগুলো। আড়ালে লুকিয়ে থাকা জংলী শিরস্ত্রাণ ঠিকই চোখে পড়লো তার।

পাথর-ধসের একটা দুর্বলতা হলো কেবল একবারই ফেলা যায় ওগুলো। আমার শিলুক যোদ্ধারা অত্যন্ত দ্রুত, উদ্ধত মোষকে পর্যন্ত ফাঁকি দিতে পারে এরা, চিন্তান্বিত স্বরে ট্যানাস বললো।

ছোটো ছোটো দলে ভাগ করে তাদের উপরে পাঠালো সে। পাথর-ধস নেমে আসতেই তড়িৎ গতিতে ডানে-বাঁয়ে সরে সেগুলোকে পাহাড়ি ছাগলের মতোই এড়িয়ে গেলো তারা। একবার পাথর-ধস থামতেই, বন্যহুঙ্কার দিয়ে সামনে ছুটে চললো শিলুকের দল। তাদের হিংস্র উন্মত্ত চিল্কারে ঘাড়ের চুল দাঁড়িয়ে গেলো আমার।

পাথরের দেয়ালের আড়ালে মোতায়েন আরকুনের তীরন্দাজেরা অবশ্য আটকে দিতে সমর্থ হলো আমাদের। ক্ৰাতাস এবারে তার বাহিনী নিয়ে সামনে এগুলো। দূরবর্তী পাল্লার ধনুকের সাহায্যে মিশরীয় তীরন্দাজেরা বহুদূর থেকে তীরের বৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগলো উপরে ।

চমৎকার ভঙ্গিতে আকাশ পানে খাড়া ছুটে যেতে লাগলো তীরের ঝক। উন্নতির শিখড়ে পৌঁছে সা সা করে নেমে যেতে লাগলো পাথরের আড়ালে স্থান নেওয়া লোকগুলোর আশ্রয়ে। উপায়ান্তর না দেখে নিজেদের গোপন আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এলো তারা। সাথে সাথেই রণ-হুঙ্কার দিয়ে ছুটলো শিলুক পদাতিক বাহিনী। কাজান! কাজান! মারো! মারো!

মেমননের সাথে থাকতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছিলো আমার। বয়স কাউকে ক্ষমা করে না।

লম্বা, উলের ইথিওপিও আচকান পরেছি আমরা; হাতে আমাদের শত্রুদের মতোই গোলাকার বর্ম। অবশ্য ঘোড়াগুলোকে পরচুলা পরাই নি।

অবশেষে যখন আম্বার চ্যাপ্টা মাথা পর্বতের উপরে উঠে এলাম, এক পলক তাকিয়ে দেখি ট্যানাস তার বাহিনীকে পুর্নবিন্যাস করছে। শিলুকদের একটা দুর্বলতা হলো, রক্তের গন্ধ পেলে উন্মাদ হয়ে যায় তারা। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। চাবুক হাতে সমানে চেঁচিয়ে চলছিলো ট্যানাস। আবারো, সংঘবদ্ধ হয়ে সামনের গ্রামের দিকে এগিয়ে গেলো শিলুক পদাতিক বাহিনী। ওখানে গ্রামের ভেতরে অপেক্ষা করছে শত্রুরা। বৃষ্টির মতোই তীর ছুটে আসতে লাগলো আমাদের দিকে, কিন্তু বর্ম তুলে ধরে নিজেদের রক্ষা করলো শিলুকেরা।

তারপর যখন পাল্টা আক্রমণে গেলো তারা, হকচকিয়ে গেলো ইথিওপিওরা। এ ধরনের মারো অথবা মরো লড়াইয়ে অভ্যস্ত নয় তারা।

ভীষণ লড়াইয়ে যখন মত্ত মিশরীয় বাহিনী, চিৎকার করে মেমনন আর তার ছোট্ট তলোয়ারবাজের দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম আমি। পরচুলাগুলো! সাথে সাথেই নিজেদের লম্বা পরচুলাগুলো মাথায় জড়িয়ে নেয় যোদ্ধারা। ঘোড়ার চুল থেকে নিজে ওগুলো তৈরি করেছি আমি। ইথিওপিও ডোরাকাটা পোশাকে, লম্বা চুলের আমাদের দেখে এখন আরকুনের লোক বলে ভুল করাই স্বাভাবিক।

এইদিকে! আমার পিছনে! জোরে ইথিওপিও রণ-হুঙ্কার দিয়ে পথ দেখালাম আমি। যুদ্ধরত গ্রাম ফেলে শষ্য ক্ষেতের উপর দিয়ে ছুটে চললাম আমরা। শেষমেষ আরকুন যখন বুঝবে, হারতে যাচ্ছে সে, তখন মাসারার পাশে থাকতে হবে আমাদের। সুযোগ পেলেই ওকে মেরে ফেলবে আরকুন, যখন বুঝবে আর কোনো ফায়দা লোটা যাবে না মাসারাকে দিয়ে। নির্ঘাত নীল তলোয়ার দিয়ে মেরে নিচের খাদে ফেলে দেবে সে তাকে।

আম্বার মধ্য দিয়ে পথ করে এগুতে লাগলাম আমরা। দলে দলে পিছু হটা গ্রামের অধিবাসীদের সাথে সাথে আমরাও আম্বার শেষমাথার খাড়া আদবার সেজেদ অভিমুখে চললাম। সরু, বিপদজনক সেই পথের কাছে জট পাকিয়ে আছে লোকজন। ভিড় ঠেলে এগুলো আমাদের ছোট্ট দলটা। পথের শেষমাথায় প্রহরী রয়েছে। তলোয়ার বাগিয়ে শরণার্থীদের ঠেকিয়ে রাখছে তারা। বাচ্চা কোলে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি জানিয়ে কাঁদছে মহিলারা। কেউ কেউ পড়ে গিয়ে পিছনের লোকজনের পদতলে পিষ্ট হতে লাগলো।

যখন সরু পথের প্রবেশমুখে পৌঁছুলাম আমরা, বাধা দিলো প্রহরীরা।

আমরা রাজা আরকুনের সরাসরি নির্দেশে এসেছি! পথ ছাড়ো! গীজ ভাষায় চেঁচালাম আমি। সাথে সাথেই একজন প্রহরী জানতে চাইলো, গুপ্তবাক্য বলো? মানুষের ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সে। আমার উদ্দেশ্যে তলোয়ার বাগিয়ে ধরলো, গুপ্তসংকেত ছাড়া যেতে পারবে না।

বন্দী দিনগুলোতে হাজার বার আমার প্রকোষ্ঠ থেকে এই বাক্য আউড়াতে শুনেছি আমি সৈনিকদের। চেঁচিয়ে বললাম, পর্বত অনেক উঁচু!

ঠিক আছে, যাও! তলোয়ার সরিয়ে পথ করে দিলো প্রহরী। ধাক্কাধাক্কি করে এগিয়ে চললাম আমরা। মাসারার চিন্তায় এতোটাই বিভোর হয়ে ছিলাম সবাই, দুই পাশের অতল ধাদের কথা একবারো মাথায় এলো না কারো। আমার পিছু পিছু এগিয়ে চললো বাকিরা।

রাজা আরকুন কোথায়? দুর্গের প্রবেশমুখে দাঁড়ানো প্রহরীদের উদ্দেশ্যে বললাম আমি। তারা একটু ইতস্তত করতেই চেঁচালাম, পর্বত অনেক উঁচু! রাজার জন্যে জরুরি বার্তা নিয়ে এসেছি আমি! সরে দাঁড়াও! যেতে দাও আমাদের, বোকার হদ্দ! তারা কিছু করার আগেই আমরা বারোজন সিঁড়িকোঠা টপকে উপরের চাতালে চড়লাম।

মাসারার প্রকোষ্ঠের সামনে প্রহরায় ছিলো দু জন। তাদের চিনতে পেরে আনন্দে আত্মহারা হলাম আমি। ভেবেছিলাম, ওকে হয়তো দূরে কোথাও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রহরীদের উপস্থিতি তার অবস্থান নিশ্চিত করছে।

কে তুমি? চিৎকার করে, নিজের অস্ত্র বাগিয়ে ধরলো একজন। কার অনুমতি নিয়ে  বাক্য সম্পন্ন করতে পারলো না সে। একপাশে সরে গিয়ে মেমনন এবং রেমরেমকে পথ করে দিলাম আমি। পরিচিত দক্ষতায় ঝাঁপিয়ে পড়লো ওরা দু জন। নিমিষে নিকেশ করলো দু জন প্রহরীকে।

মাসারার প্রকোষ্ঠের দরোজা ডিতর থেকে বন্ধ। ওপাশের দেয়াল থেকে শোনা যাচ্ছে নারীকণ্ঠের সম্মিলিত আর্তনাদ। তৃতীয় প্রচেষ্টায় দরোজা খুলে হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি।

মাসারা! মাথা থেকে পরচুলা খুলে ফেলে ডাকলাম। সাথে সাথেই চিনলো ও আমাকে।

টাইটা! ওকে ধরে রাখা একজন মহিলার কবজিতে কামড়ে দিলো সে, দৌড়ে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো দু হাতে। কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে চোখ পড়তে হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে এলো তার, বড়ো বড়ো চোখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেলো।

নিজের পরচুলা খুলে ফেলেছে মেমনন। একপাশে সরে গিয়ে মাসারাকে পথ করে দিলাম আমি। এক দৃষ্টে পরস্পরের দিকে চেয়ে থাকলো ওরা, কেউ কোনো কথা বলছে না। এক যুগ কেটে গেলো যেনো। এরপর, নরমস্বরে আধো মিশরীয় বুলিতে মাসারা বলে উঠলো, তাহলে এসেছো । তোমার প্রতিজ্ঞা পালন করবে–এ আমি জানতাম।

সেই প্রথম মেমননকে হারিয়ে যেতে দেখেছিলাম আমি। একটু মাথা নাড়লো সে। এরপর অবিস্মরণীয় একটা ব্যাপার ঘটলো। লজ্জায় রাঙা হলো মেমননের ফর্সা মুখ, ঘাড়। মিশরের রাজপুত্র, ফারাও-এর সন্তান, প্রথম রথ বহরের অধিনায়ক, দশ হাজারের সেরা উপাধিপ্রাপ্ত, বীরশ্রেষ্ঠ পদকে ভূষিত যুবরাজ নির্বাক বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো।

আমার পেছনে, চমকে যাওয়া মুরগির মতো ঝটপটিয়ে উঠলো একজন স্ত্রীলোক। ওকে ধরার আগেই আমার হাতের নীচ দিয়ে মাথা নামিয়ে পালিয়ে গেলো সিঁড়িকোঠা ধরে। চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো তার চিৎকার, প্রহরী! পুব দিকে ঢুকে পড়েছে শত্রুরা! দ্রুত এসো, জলদি! সাথে সাথেই সিঁড়িপথে বেশ ক জোড়া পায়ের ধুপ ধাপ শব্দ পাওয়া গেলো।

নিমিষেই লাজুক প্রেমিক থেকে কঠোর যোদ্ধায় পরিণত হলো মেমনন। ওকে দেখো, টাটা। কোনো আঁচড় যেনো না লাগে!  আমাকে বলে, নিজে এগিয়ে গেলো দরোজার দিকে।

ট্যানাসের শেখানো ধ্রুপদি আঘাতে প্রথম প্রহরীকে নিকেশ করলো সে, এরপর মৃতদেহটা ছুঁড়ে দিলো পিছনের লোকগুলোর উপর। উল্টে পাল্টে পরে গিয়ে সিঁড়িপথ উন্মুক্ত করে দিলো তারা।

আমার দিকে ফিরলো মেমনন এবারে। কী মনে হয়, বন্ধ করে ফেলার আগে দুর্গের প্রবেশদ্বারে পৌঁছুতে পারবো আমরা?

পারতেই হবে। উত্তরে বললাম আমি। বাইরের সিঁড়ি ধরে নামাটাই সঠিক হবে আমাদের জন্যে।

রেমরেম, সামনে থাকো। টাটা আর রাজকুমারী মাঝে। পিছনে আমি পাহাড়া দিচ্ছি। কর্কশ স্বরে বলে আগুয়ান আরো একজন বর্বরের চোখের ভেতর তলোয়ারের ফলা সেঁধিয়ে দেয় মেমনন। এবারে, চোখে আঙুল দিয়ে ঢেকে রাখা ইথিওপিওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো রাস্তা পরিষ্কার করে সে। রেমরেমের পিছনে যাও। আমাকে উদ্দেশ্যে করে চেঁচালো রাজপুত্র। ওখানে না দাঁড়িয়ে থেকে যতো জোরে পারো, ছোটো!

আমার পিছনে ছুটলো মাসারা । চাতালে নেমে আসতেই সূর্যরশ্মি যেনো অন্ধ করে দিলো আমাদের। পিটপিট করে চোখ পরিষ্কার কোরে নিচের সরু পথে, চ্যাপ্টা মাথা পর্বতের ধার পর্যন্ত দেখে নিলাম। ট্যানাসের শিলুকেরা আছে সেখানে। বর্ম উঁচু করে ধরে রেখে লড়ে চলেছে তারা।

আরকুনের দু শ কি তিনশো সৈন্য রয়েছে সেখানে। পিছনে অতল গিরিখাদ। ফাঁদে পড়ে একেকজন বীর যোদ্ধা হয়ে উঠেছে। মরিয়া হয়ে সিংহের মতোই লড়ছে তারা। শিলুকদের প্রথম আক্রমণ ঠেকিয়ে দিলো আমার চোখের সামনে।

ঠিক যেখানে থাকার কথা, বাহিনীর মাঝখানে ট্যানাসকে দেখতে পেলাম। শিলুক যোদ্ধাদের ভিড়ে চকচক করছে তার শিরস্ত্রাণ। আবারো আক্রমণে ধেয়ে গেলো শিলুক বাহিনী। এবারে আর ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হলো না আরকুনের সৈন্যদের পক্ষে। সবার সামনে থেকে সরু বিপদজনক পথ পেড়িয়ে এলো ট্যানাস। রণসংগীত গাইছে সে। তার পিছনে এক সারিতে এগুলো শিলুক যোদ্ধারা।

অর্ধেক পথ পেরিয়ে যেতে, গান থেমে গেলো ট্যানাসের। থেমে দাঁড়ালো সে।

নিচে, সরু পথের শেষমাথায় পথ আগলে দাঁড়িয়ে একজন। আমার অবস্থান থেকে তার মুখ না দেখা গেলেও হাতের অস্ত্র ভুল হওয়ার নয়। সূর্যালোকে ঝলমল করছে নীল কিংবদন্তির তলোয়ার।

আরকুন! গর্জে উঠে ট্যানাস। চলো, লড়াইটা শেষ কোরি!

কথা না বুঝলেও ভাবটা ঠিকই ধরতে পারলো আরকুন। হেসে উঠে, মাথার উপর তলোয়ার ঘোরালো সে। সরু পাথুরে সেতুর উদ্দেশ্যে লম্বা পদক্ষেপে ট্যানাসের উদ্দেশ্যে ছুটে চললো ইথিওপিয়ার স্ব-ঘোষিত রাজা।

হাতের তলোয়ারে মুঠো ঢিল দিয়ে, আমার বর্মের নিচে মাথা আংশিক আড়াল করলো ট্যানাস। চকচকে ওই নীল ফলার ধার তার জানা হয়ে গেছে, নিজের নরম ধাতুর অস্ত্র দিয়ে ওটার মোকাবিলা করার কোনোরকম ইচ্ছে নেই তার–বুঝলাম আমি। গতবার লড়াইয়ের ফলে আরকুনও একটা ব্যাপার শিখেছে। তার তলোয়ার-ধরা হাত দেখে বুঝলাম, হঠাৎ আগে বেড়ে উল্টো-পাল্টা কোনো আঘাত হানার অভিপ্রায়ে নেই সে।

পরস্পরের দিকে এগিয়ে গেলো তারা। শক্ত হয়ে উঠলো আরকুনের কাধ, দেহের উপর একটু ঝুঁকে সামনে এগুলো সে। সোজা ট্যানাসের গলা বরাবর আঘাত হানলো । বর্ম তুলে, ঠিক কেন্দ্র বরাবর আঘাতটা ঠেকালো ট্যানাস। যেনো ছাগলের চামড়ায় তৈরি মসৃণভাবে বর্ম ভেদ করে ঢুকে গেলো নীল ফলা। অর্ধেকটা সেঁধিয়ে গেলো তামার বর্মে। তখনই ট্যানাসের উদ্দেশ্য বোধগম্য হলো আমার কাছে। এমন ভাবে মুচড়ে দিলো সে বর্মটা, তলোয়ারের ফলাটা আটকে গেলো। অস্ত্র মুক্ত করতে আস্ফালন করে চললো আরকুন; শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে পিছনে টেনে, নেচে-কুঁদে ওটা ছাড়াতে চাইলো সে। এবারে, বিপরীত দিকে না টেনে ঠিক যেদিকে টানছে আরকুন সেদিকে ঝুঁকে পরে এগোলো ট্যানাস, হঠাৎ ওপাশের টান ঢিলে হয়ে যেতে ভারসাম্য হারালো আরকুন।

অপ্রস্তুত টানা-হেঁচড়ায় মুখ থুবরে পড়ে গেলো ইথিওপিও রাজা। টলোমলো পদক্ষেপে নিচের শূন্যতার পড়ে যেতে গিয়েও সামলে নিলো নিজেকে। অস্ত্র ছেড়ে, দুই হাত শরীরের দু পাশে মেলে দিয়ে কোনো রকমে ভারসাম্য ফিরে পেতে চাইলো আরকুন। এবারে স্থান বদল করলো ট্যানাস। বর্মের পিছনে নিজের শরীর নিয়ে সামনে ধেয়ে গেলো সে। আরকুনের বুকে প্রচণ্ড ধাক্কা খেলো বর্ম; ট্যানাসের সমস্ত শক্তি এক করা ধাক্কাটা মাটি থেকে শূন্যে ছুঁড়ে দিলো তাকে। অতল খাদের উপরে, শূন্যে ধীরে ডিগবাজী খেলো ইথিওপিও রাজার শরীর; সোজা নিচে পড়ছে সে। দেহের চারপাশে ফুলে উঠলো আলখাল্লা, সাদা দাড়ি ঝকঝক করছে সূর্যালোকে।

আমার অবস্থান থেকে দাঁড়িয়ে দেখলাম, শেষযাত্রায় চলেছে আরকুন; কতো শতো অসহায় মানুষকে যে পথে পাঠিয়েছিলো সে, আজ সেই একই খাদে পড়ে শেষ হচ্ছে তার ভবলীলা দেবতাদের ইচ্ছেয়। হাজার ফুট নিচে পাথরে আছড়ে পড়ার আগ-মুহূর্ত পর্যন্ত চিৎকার করলো আরকুন। তারপর সব নিস্তব্ধ।

সরুপথের উপর নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো ট্যানাস। এখনো বর্মে গাঁথা অবস্থায় রয়েছে তলোয়ারটা।

ধীরে স্তিমিত হয়ে এলে লড়াই। নিজেদের রাজাকে খাদে পড়ে মরতে দেখেছে ইথিওপিওরা। অস্ত্র নামিয়ে রেখে প্রাণভিক্ষা চাইলো তারা। রক্তপিপাসু শিলুকদের কবল থেকে মাত্র অল্প ক জনকেই রক্ষা করতে সমর্থ হলো মিশরীয় সেনাপতিরা। তাদেরকে ধরে, দাস-শিক্ষকদের কাছে প্রেরণ করা হবে।

এসব কিছুই নয় খাদের উপরে, প্রাকৃতিক সেতুতে দাঁড়ানো ট্যানাসকে দেখছিলাম আমি। দুর্গের প্রবেশদ্বারের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলো সে, অভিবাদন জানিয়ে নিজেদের অস্ত্র মাথার উপরে তুলে ধরলো সৈনিকেরা।

বুড়ো ষাঁড়টা এখনো অনেক লড়তে পারবে, গর্বে উজ্জ্বল মুখে হাসলো মেমনন। ওর আনন্দে শরীক হতে পারলাম না আমি। কোনো এক মর্মান্তিক ট্রাজেডির অশনি সংকেত বাজছে হৃদয়ে যেনো বাতাসে ঝাঁপটা মেরে নিজের শিকারের উপর বসতে যাচ্ছে শকুনের দল।

ট্যানাস, ফিসফিস করে বললাম। ধীর, এলোমেলো পদক্ষেপে হাঁটছে সে। পাথুরে সেতুর শেষমাথায় এসে তলোয়ারসমেত বর্মটা নামিয়ে রাখলো মিশরীয় সমরনায়ক। কেবলমাত্র তখনই তার বুকের আচ্ছাদনের রক্তের ছোপ চোখে পড়লো আমার।

মাসারাকে মেমননের হাতে সঁপে দিয়ে দৌড়ে সিঁড়িকোঠা বেয়ে নামতে লাগলাম। দরোজায় দাঁড়িয়ে থাকা ইথিওপিও প্রহরীরা নিজেদের অস্ত্র নামিয়ে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করলো, কিন্তু তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বিপদজনক পাহাড়ি সেতুর উদ্দেশ্যে ছুটলাম আমি।

আমাকে ছুটে আসতে দেখছে ট্যানাস। হাসলো ও। ধীরে থেমে দাঁড়ালো সে, পা ভাঁজ হয়ে যেতে পথের মাঝখানে ধপ করে বসে পড়লো। ওর পাশে পৌঁছে তড়িৎ ঝুঁকে পরে দেখলাম, বুকের আচ্ছাদনের কুমিরের চামড়া ফুটো হয়ে গেছে। চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে সেখান দিয়ে। আমি যা ভেবেছিলাম, নীল তলোয়ারের ফলা তার চেয়ে বেশিদূর ঢুকে গিয়েছিলো। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য-আরকুনের প্রথম আঘাত তামার বর্ম ফুটো করে, ট্যানাসের কুমিরের চামড়ায় তৈরি আস্তরণ ভেদ করে ওর বুকের গভীরে সেঁধিয়ে গেছে।

ধীরে, সতর্কভাবে ওর বুকের আচ্ছাদনের ফিতেগুলো খুলে ওটা ছাড়িয়ে আনলাম আমি। আমরা দু জনেই তাকিয়ে দেখছি ক্ষতটা। ঠিক নীল তলোয়ারের ফলার মাপে ভেতরে ঢুকে গেছে ক্ষত; রক্তাক্ত-ভেঁজা মুখ ওটার। ট্যানাসের প্রতিটি প্রশ্বাসের সঙ্গে বাষ্পের বুদবুদ উঠছে সেখান থেকে। নিজের কাছেও স্বীকার করতে চাইছিলাম না–ফুসফুঁসের আঘাত ওটা। ফুসফুঁসে সেঁধিয়ে যাওয়া তলোয়ারের আঘাত থেকে কোনো মানুষ বেঁচে ফিরতে পারে না।

তুমি আঘাত পেয়েছে, বোকার মতো হলো কথাগুলো। ট্যানাসের মুখে তাকাতে পারলাম না আমি।

না, বুড়ো বন্ধু। আমি আঘাত পাই নি, নরমস্বরে প্রত্যুত্তর করে ট্যানাস। আমি মারা গেছি হে।

*

ট্যানাসের শিলুকেরা একটা ডুলা তৈরি করলো তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। ধীরে, সতর্কতার সাথে তাকে কাঁধে নিয়ে আবার সেজেদ-এর দুর্গ অভিমুখে চললো তারা।

রাজা আরকুনের বিছানায় ওকে শুইয়ে দিয়ে সবাইকে তাড়িয়ে দিলাম আমি। একা হতে, বিছানার পাশে সাজিয়ে রাখলাম নীল সেই তলোয়ার। একটু হেসে, আলতো করে ওটার ফলায় হাত বুলিয়ে দিলো ট্যানাস। এর জন্যে চরম মূল্যই দিতে হচ্ছে আমাকে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো সে, একবার যদি ওটা হাতে যুদ্ধের ময়দানে যেতে পারতাম!

কোনো আশার বাণী শোনানো বৃথা এখন। অভিজ্ঞ যোদ্ধা ট্যানাস–বহু লড়াইয়ে এ রকম ফুসফুঁসের আঘাত দেখেছে সে। বাজে কথা বলে ওকে ভুলাতে পারবো না আমি। উল আর লিনেন কাপড়ের পট্টি বেঁধে দিলাম ক্ষতে। ওটা বাঁধতে বাঁধতে রক্তপাথ বন্ধের মন্ত্র জপছিলাম, দূরে সরে থাকো, সেথ-এর ঘৃন্য সৃষ্টি ।

কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছিলো ট্যানাস। প্রতিটি শ্বাস বহু কষ্টে নিতে হোচ্ছিলো তাকে। বুকের ভেতরে রক্তের গর্জন শুনতে পাচ্ছিলাম আমি।

কিছুটা ঘুমোনোর জন্যে মিশ্রণ দিতেই ওটা খেতে অস্বীকৃতি জানালো মিশরীয় সমরনায়ক। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বেঁচে থাকতে চাই আমি। শেষ পর্যন্ত।

কী করতে পারি তোমার জন্যে?

অনেক তো করেছো, বললো সে। তোমার কাছে আমাদের দাবি যে শেষ হওয়ার নয়।

মাথা নাড়লাম আমি। তোমাদেরও চিরকাল সেবা করে যেতে চাই।

ঠিক আছে, শেষবারের মতো কিছু চাইছি। প্রথমত, কখনো মেমননকে তুমি জানতে দেবে না, আমি তার প্রকৃত পিতা। ও যেনো সব সময় মনে করে, ফারাও-এর রক্ত বইছে তার দেহে। নিয়তির খেলায় অনেক শক্তি প্রয়োজন ওর।

রাজার চেয়ে তোমার রক্ত বহন করতে এতোটুকু অপমান হবে না তার।

প্রতিজ্ঞা করো–ওকে বোলবে না এটা?

প্রতিজ্ঞা করছি, আমি বললাম। বড়ো করে স্বস্তির শ্বাস ফেললো ট্যানাস।

আরো একটা দাবি আছে।

বলার আগেই ধরে নাও, ওটা পূরণ হয়ে গেছে। বললাম।

ওর যত্ন নিও কোনোদিনও আমার স্ত্রী হতে পারলো না যে। এতকাল ধরে যা করে এসেছে বিপদে-আপদে ওকে সঙ্গ দিও।

তুমি জানো, তা করবো আমি।

জানি। আমার মতোই ওকে ভালোবাসতে তুমি। লসট্রিস আর আমার সন্তানদেরও দেখে রেখো। সবাইকে যে তোমার হাতে দিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই আমার কাছে।

চোখ বন্ধ করলো ট্যানাস। আমি ভাবলাম, সময় এসে গেছে; কিন্তু যে কোনো মানুষের চেয়ে অনেক বেশি ছিলো তার প্রাণশক্তি। কিছু সময় পর, আবারো চোখ খুললো সে।

রাজপুত্রকে একবার দেখতে চাই।

চাতালে, তোমার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। দরোজার কাছে গিয়ে পর্দা তুলে ধরলাম আমি। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলো মেমনন এবং মাসারা। নিচু স্বরে কিছু একটা বলছিলো তারা। আমার আহ্বানে তড়িঘরি ছুটে এলো মেমনন। মেয়েটাকে একা রেখে সরাসরি ট্যানাসের বিছানার কাছে এসে তাকিয়ে দেখলো ওকে। বহুকষ্টে ঠোঁটে হাসি ফোঁটালো ট্যানাস।

সম্মানিত রাজপুত্র, যুদ্ধের সমস্ত জ্ঞান আমি তোমাকে শিক্ষা দিয়েছি, কিন্তু জীবন সম্পর্কে শেখাতে পারিনি। সেটা প্রত্যেক মানুষকে নিজে থেকে শিখে নিতে হয়। নতুন যে যাত্রায় চলেছি আমি, তার আগে একটা বিষয় ব লে যেতে চাই, তোমাকে সেবা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

একজন শিক্ষকের চেয়ে অনেক বেশি কিছু ছিলে তুমি আমার কাছে। মৃদুস্বরে বলে মেমনন। তুমি ছিলে আমার-না-চেনা পিতার মতো।

চোখ মুদলো ট্যানাস। যন্ত্রণায় বেঁকে গেছে মুখ।

একটু এগিয়ে, ওর হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নিলো রাজপুত্র। যন্ত্রণা হলো আরো একটি শক্রর মতো মুখোমুখি যার সামনা করতে হয়। তুমি ওটা আমাকে শিখিয়েছিলে লর্ড ট্যানাস, সে ভেবেছে ক্ষতের ব্যথায় অমন মুখাবয়ব করেছে। ট্যানাস। আমি জানি, মূলত পিতা শব্দটিই কষ্ট দিয়েছে ট্যানাসকে।

চোখ খুললো সে। ধন্যবাদ, যুবরাজ। শেষ এই যে যন্ত্রণা, এতে তুমি আমার সঙ্গে থাকায় ভালো লাগছে।

বন্ধু বলো আমাকে যুবরাজ নয়। ট্যানাসের হাত ধরে রেখেই বিছানার পাশে হাঁটু-গেড়ে বসলো মেমনন।

তোমার জন্যে একটা উপহার আছে, বন্ধু, ফুসফুঁসে জমতে থাকা রক্ত ট্যানাসের স্বর রুদ্ধ করে ফেলেছে। বিছানার পাশেই রাখা তলোয়ারটার হাতল ধরলো সে, কিন্তু ওটা তোলার শক্তি নেই শরীরে।

মেমননের হাত নিজের বাহু থেকে সরিয়ে, তলোয়ারের হাতলের উপর রাখলো ট্যানাস। এটা আজ থেকে তোমার, ফিসফিস করে কথা ক টা উচ্চারণ করলো ও।

যখনই খাপ থেকে খুলবো এটা তোমাকে মনে করবো আমি। যতোবার রণক্ষেত্রে ব্যবহার করবো, তোমার নাম উচ্চারণ করবে লর্ড ট্যানাস। কারুকাজ করা তলোয়ারটা হাতে তুলে নেয় রাজকুমার।

অনেক সম্মান দিলে আজ।

কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অস্ত্র হাতে ধ্রুপদি ভঙ্গিমায় দাঁড়ায় মেমনন। তলোয়ারের ফলা ঠোঁটে ঠেকিয়ে খাড়া রেখে সালাম জানায় মৃত্যুশয্যায় শায়িত সেনাপতিকে।

এরপর, দু পায়ের মাঝখানে তলোয়ারের ডগা মাটিতে রেখে দুই হাত হাতলে রেখে স্থির হয়ে দাঁড়ায় সে।

সব কিছু শিখে নিয়েছো তুমি। সন্তুষ্টি ধ্বনিত হলো ট্যানাসের কণ্ঠে। তোমাকে শেখানোর আর কিছু নেই আমার। মনে হয় না বেশী তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছি।

আমি অপেক্ষা কোরি এখানে, তোমার সাথে? মেমনন বলে।

না, কঠোর ভঙ্গিমায় বলে উঠে মিশরের বীরশ্রেষ্ঠ। এই সংকীর্ণ কক্ষের বাইরে তোমার অপেক্ষায় বসে আছে নিয়তি। একবারো পিছনে না ফিরে, যাও, বরণ করে নাও তাকে। টাইটা থাকুক আমার সাথে। মেয়েটাকেও নিয়ে যেও সঙ্গে। রানি লসট্রিসকে জানাও আমার বিদায়ের খবর।

শান্তিতে বিদায় নিন, লর্ড ট্যানাস, অযথা তর্ক করে মৃত্যুপথযাত্রীর সময় নষ্ট করার মানুষ নয় রাজপুত্র। এক পা এগিয়ে পিতার ঠোঁটে চুমো খায় সে। এরপর, একবারো পিছনে ফিরে না তাকিয়ে নীল তলোয়ার হাতে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়।

বিজয়ের পথে যাও, পুত্র, ফিসফিসিয়ে বললো ট্যানাস। মুখ কাত করে একভাবে তাকিয়ে রইলো পাশের দেয়ালে। বিছানায়, ওর পায়ের কাছে বসে মূর্তির মতো নোংরা মেঝের দিকে চেয়ে রইলাম আমি, ট্যানাসের মতো কাউকে কাঁদতে দেখা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।

*

শিলুকদের ঢাকের শব্দে ঘুম ভাঙলো আমার। চারিদিকে আঁধার ঘনিয়েছে ততক্ষণে।

নিচু হয়ে এসেছে প্রদীপের শিখা, বিছানার পাশে এখন দপদপ করে জ্বলছে ওটা। শকুনের ডানা ঝাঁপটানোর মতো ভূতুড়ে ছায়া

ফেলছে কক্ষের ছাদে। ধীরে ট্যানাসের শায়িত দেহের দিকে এগুলাম। জানি, ভুল হয় নি শিলুকদের, এসব ব্যাপারে ভুল করে না তারা। মৃত্যু-শোক পালন করছে ঢাকের শব্দ।

ঠিক যেমন দেখেছিলাম, দেয়ালের দিকে মুখ কাত করে শুয়ে আছে ট্যানাস। কাঁধে হাত দিতেই মৃত্যুর শীতল স্পর্শ লাগলোঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার শরীর।

সারারাত তার পাশে বসে থেকে শোক পালন করলাম আমি, শিলুকদের মতোই।

সকালে খবর পাঠালাম শবদেহ প্রস্তুতকারীদের।

ওই কসাইগুলো আমার বন্ধুর অঙ্গ-প্রতঙ্গ কেটে ফেলুক এ আমি হতে দিই নি। ট্যানাসের শরীরের বাম পাশ দিয়ে লম্বা করে কাটলাম। এ কসাইয়ের পোচ নয়, দক্ষ শল্যবিদের নিখুঁত কাটা।

ওই কাটা পথে টেনে বের করে এনেছিলাম তার দেহের অভ্যন্তরের অঙ্গ। ট্যানাসের হৃৎপিণ্ড হাতে নিয়ে আবেগে কেঁপেছিলাম । যেনো ওর অমানুষিক শক্তি আর তারুণ্যের কথা অনুভব করছিলাম রক্ত-মাংসের সেই বস্তু হাতে নিয়ে। ওটার বদলে ভালোবাসায় ভরে দিলাম নিহত বীরের বুকের খাঁচা। দেহের একপাশের কাটা এবং বুকের ক্ষতটা বুজিয়ে দিলাম ভালো করে।

এরপর, তামার চামচ নিয়ে ওর নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে শেষমাথা পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। যখন আর এগুতে চাইলো না ওটা, এক ধাক্কায় ভেঙ্গে ফেললাম বাধা প্রদানকারী হাড়। এরপর, সেই পথে ধীরে চামচে আঁচড়ে বের করে আনলাম নরম থকথকে মস্তিষ্ক। কেবলমাত্র তখনি শবদেহপ্রস্তুকারীরা অনুমতি পেলো ওর কাছে আসার ।

আর কিছুই করার ছিলো না বন্ধুর জন্যে। তবুও আদবার সেজেদ-এর সেই বিষণ্ণ দুর্গে মমি-করবার চল্লিশ দিবস-রজনীতে আমি ট্যানাসের সঙ্গেই রইলাম। এখন বুঝি, ওটা ছিলো দুর্বলতা। ট্যানাসের মৃতু-সংবাদে আমার কর্ত্রীর শোক সহ্য করা সম্ভব ছিলো না আমার পক্ষে। সেই দায়িত্ব মেমননের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলাম। মৃতের সাথে লুকিয়ে ছিলাম আমি, অথচ জীবিত মানুষদের আমাকে প্রয়োজন ছিলো বেশি। সব সময়ই কাপুরুষ ছিলাম আমি।

ট্যানাসের মমিকৃত দেহ ধারণ করার জন্যে কোনো কফিন নেই। কেবুই-এ পৌঁছুলে আমি নিজ হাতে তৈরি করে দেবো একটা। এর মধ্যে ইথিওপিও মহিলারা সেলাই করে লম্বা থলে তৈরি করলো মৃতদেহ বহনের জন্যে।

*

পর্বতের উপর থেকে ওকে নামিয়ে নিয়ে এলাম আমরা। শুকিয়ে আসা হালকা শরীরের ওজন সহজেই বহন করলো তার শিলুকেরা। এই সম্মান পাওয়ার জন্যে নিজেদের মধ্যে লড়লো তারা। বাঁকানো পথে, পর্বত পেরিয়ে এগিয়ে চলা যাত্রাপথে থেকে থেকে শোকসংহগীত গাইলো শিলুকেরা। অন্যান্য সময়ে, ট্যানাসের শেখানো নীল বাহিনীর রণ-সংগীত গাইলো। সারাটা পথ ট্যানাসকে বহনকারী থলের পাশে পাশে হেঁটেছিলাম আমি। বৃষ্টি নেমে এলো। ভিজে একশা হয়ে গেলাম আমরা। প্রবল স্রোতস্বিনী নদী দড়ি ধরে সাঁতরে পার হতে হলো আমাদের । রাতে আমার বিছানার পাশেই থাকলো ট্যানাসও। জোরে জোরে প্রশ্ন করে নিজের সাথেই কথা বোলতাম আমি, যেনো মৃত্যুর ওপার থেকে ফিরে এসে আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে ট্যানাস।

অবশেষে, শেষ খাড়াই বেয়ে সমতলে নেমে এলাম আমরা। কেবুই-এর দিকে এগুতে দেখলাম, এগিয়ে আসছে আমার মিসট্রেস। মেমনরে পাশে, রথের পাদানীতে দাঁড়িয়ে আছে সে।

ঘেসো জমির উপর দিয়ে আমাদের কাছে চলে আসতে, বিশাল জিরাফ একাশিয়া গাছের ছায়ায় ট্যানাসের মরদেহ নামিয়ে রাখার নির্দেশ দিলাম শিলুকদের। রথ থেকে নেমে ধীরে এগুলো আমার কর্ত্রী । এক হাত কফিনের উপর রেখে মাথা নিচু করে সম্মান জানালো সে নীরবে।

শোক তার উপর কী প্রভাব ফেলেছে, দেখে হতবাক হয়ে গেলাম । চুলে পাক ধরে গেছে লসট্রিসের, চোখে নিদারুন বেদনা। সবসময়ের ঔজ্জ্বল্য আর নেই অবয়বে। বুঝলাম, অসাধারণ সৌন্দর্য আর তারুণ্য চিরদিনের মতো বিদায় নিয়েছে লসট্রিসের কাছ থেকে। নিঃসঙ্গতা ঘিরে আছে ঘন মেঘের মতোন। কিন্তু এখনো যথেষ্ট সাহসী রানি, কেউ বুঝবে না মাত্রই বিধবা হয়েছে সে।

ওর পাশে গিয়ে নিচু স্বরে সতর্ক করলাম, মিসট্রেস, তোমার শোকের কথা যেনো সবাই ভালোভাবে বুঝতে না পারে। ওরা যেনো না জানে, কেবল প্রধান সেনাপতি নয়, আরো কিছু ছিলো সে তোমার। ওর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হলেও কান্না সামলাও।

চোখে আর পানি নেই যে, শান্ত স্বরে লসট্রিস বলে। কেবল তুমি আর আমি জানো সত্যিটা।

হোরাসের প্রশ্বাসে, ফারাও-এর বিশালাকায় স্বর্ণের কফিনের পাশেই স্থান হলো ট্যানাসের কাপড়ে তৈরি কফিনের। ট্যানাসের কাছে করা প্রতিজ্ঞামতো মিসট্রেসের পাশে রইলাম আমি। কিন্তু শোক এক অদ্ভুত নীরব বেদনা উপহার দিয়ে গেছে তাকে, আর কখনো স্বাভাবিক হতে পারে নি লসট্রিস। এরপর একদিন তার নির্দেশে ফারাও এর সমাধি-নির্মাণ কাজ তদারকি করতে সমাধি-উপত্যকায় ফিরে গেলাম আমি।

তার পরামর্শমতো ট্যানাসের সমাধির জন্যে উপত্যকার গভীরে ভিন্ন একটা স্থান। নির্বাচন করলাম। যদিও শিল্পীদের সাথে নিয়ে যথেষ্ট চেষ্টা কোরেছিলাম আমি, ফারাও এর সমাধির কাছে একটা গরিবী কুড়ের মতো দেখালে ট্যানাসের চিরবিশ্রামের স্থান।

এতোগুলো বছরে একদল শিল্পীর নিরলস প্রচেষ্টায় রাজার সমাধির গলিপথ আর মাটির অভ্যন্তরের প্রকোষ্ঠের দেয়ালে ঝলমল করছে অত্যাশ্চর্য দেয়ালচিত্র। সমাধির ভাড়ার ঘরে বোঝাই হয়ে আছে সুদূর থিবেস থেকে বয়ে নিয়ে আসা বিপুল পরিমাণ সমাধি-সম্পদ।

দ্রুততার সাথে ট্যানাসের সমাধিরনির্মাণকাজ সম্পন্ন হলো। দেশের এবং ফারাও এর সেবায় নিয়োজিত থেকে জীবনভর কোনো সম্পদ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয় নি সে। তার জীবদ্দশায় বিভিন্ন কীর্তি দেয়ালে এঁকে দিলাম আমি; শক্তিশালী জম্ভ শিকার অভিযান, লাল-ফারাও এবং হিকসস্‌দের সাথে মরণপণ যুদ্ধ, আদবার সেজেদ-এর শেষ লড়াই কিছুই বাদ গেলো না। কিন্তু মিসট্রেসের প্রতি তার ভালোবাসা বা আমার প্রতি তার বন্ধুত্বের উল্লেখ থাকলো না কোথাও। রানির প্রতি প্রণয় দেশদ্রোহিতারই নামান্তর। ক্রীতদাসের সঙ্গে বন্ধুত্ব পরিচয় দেয় হীনম্মন্যতার।

শেষপর্যন্ত যখন কাজ সম্পন্ন হলো, ট্যানাসের সেই আড়ম্বরহীন কবরে একা দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। এই সেই স্থান, যেখানে সময়ের শেষ পর্যন্ত শায়িত থাকবে ও; আচমকা রাগে আমার সর্বশরীর কেঁপে উঠলো–কেবল এ-ই করার আছে আমার ট্যানাসের জন্যে? আমার চোখে দ্বৈত-মুকুটধারী যে কোনো ফারাও-এর চেয়ে বড়ো মাপের মানুষ ছিলো সে। মুকুট ওর প্রাপ্য ছিলো, ওটা ইচ্ছে করলেন পেতে পারতো সে। আমার কাছে যে কোনো ফারাও-এর চেয়ে বড়ো সম্রাট ছিলো ট্যানাস।

ঠিক তখনই চিন্তাটা এসেছিলো মাথায়। এতো ভয়ঙ্কর সেই চিন্তা প্রথমে জোর করে ভুলে থাকতে চাইলাম। এমনকি, অমন ভাবাও দেশদ্রোহিতা এবং মানুষ ও দেবতাদের চোখে অসামান্য অপরাধ।

কিন্তু পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে আমাকে কুড়ে কুড়ে খেলো চিন্তাটা। ট্যানাসের কাছে আমার অনেক ঋণ, ফারাও-এর কাছে এর অর্ধেকও নেই। যদি কেউ আমাকে শাস্তিও দেয়, বন্ধুর জন্যে এটুকু করবো আমি।

একা এতো বড়ো কর্ম সম্পাদন সম্ভব নয় আমার পক্ষে। সাহায্য চাই কিন্তু কার কাছে চাইবো? রানি বা রাজপুত্রকে জানানোর প্রশ্নই উঠে না। ফারাওকে করা শপথ ভাঙতে পারবে না মিসট্রেস; আর রাজপুত্র তার আসল পিতার পরিচয় জানে না। আর তাছাড়া ট্যানাসের কাছে করা শপথ ভেঙ্গে তাকে সবকিছু খুলে বলা সম্ভব নয়।

শেষমেষ, যে ট্যানাসকে আমারই মতো ভালোবাসতো, যে না ভয় পায় মানুষকে, দেবতাদের সেই ক্ৰাতাসকে নির্বাচিত করলাম আমি।

সেথ্‌-এর অশুচি পাছার কসম! আমার পরিকল্পনা শুনে হাসিতে ফেটে পড়লো ক্ৰাতাস। তুমি ছাড়া আর কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারতো না ওটা। জীবিত সেরা জালিয়াত তুমি, টাইটা! কিন্তু ট্যানাসকে এই শেষ সম্মান জানানোর সুযোগ করে দেয়ায় তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আমি।

আমরা দুজনে মিলে সতর্ক পরিকল্পনা করলাম। এমনকি, হোরাসের প্রশ্বাসের ভাড়ার প্রহরীদের ঘুমের গুঁড়ো খাইয়েছিলাম।

অবশেষে ক্ৰাতাস এবং আমি সবার অগোচরে জাহাজের খোলের তলায়, কফিন রাখার স্থানে প্রবেশ করলাম। একটু কেঁপে উঠেছিলাম ভয়ে; মনে হয়েছিরো ফারাও মামোসের কা আমাকে দেখে রাখছে, আজীবন আমাকে তাড়া করে ফিরবে এর পর থেকে।

বিশাল ক্রাতাসের মনে এ ধরনের কোনো ভয়-ডর নেই, এমন দ্রুততার সাথে কাজ শুরু করলো সে, বারবার সতর্ক করে দিতে হলো যেনো শব্দ না হয়। স্বর্ণের কফিনের ডালা খুলে ফারাও-এর মমি বের করে আনলো ক্ৰাতাস।

ফারাও-এর তুলনায় অনেক বড়ো শরীর ট্যানাসের, ভাগ্যবশত কফিন প্রস্তুতকারীরা অনেকটা জায়গা রেখেছিলো, আর মমি করার পর ট্যানাসের শরীরও বেশ অনেকটা শুকিয়ে গেছে ততোদিনে। এতদ্সত্ত্বেও, মমির বেশ অনেকটা পরত খুলে তবেই ট্যানাসকে ফারাও-এর কফিনে ঢোকাতে সক্ষম হলাম আমরা।

কাঠের সাধারণ কফিনে ফারাও মামোসকে রাখার সময় বিড়বিড় করে ক্ষমা চাইলাম আমি, কফিনের ডালায় মিশরের সাহসী সিংহ উপাধি অংকিত। ফারাও-এর দেহ রাখার পরেও অনেক জায়গা ছিলো সেখানে। ট্যানাসের মমি থেকে খুলে আনা লিনেন কাপড়ে পট্রিগুলো সেখানে রেখেছিলাম আমরা।

*

বৃষ্টি কেটে যেতে আবার শীতের কাল এসে গেলো। কেবুই ছেড়ে শোকযাত্রায়, সমাধি-উপত্যকায় সবাইকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন রানি।

মেমননের নেতৃত্বে সামনে থাকলে প্রথম রথবহর। পিছনে রইলো পঞ্চাশটি মাল বহনকারী ওয়াগন, যাতে ফারাও মামোসের সমাধি-সম্পদ বোঝাই হয়ে আছে। রাজ-বিধবা, রানি লসট্রিস থাকলো স্বণের কফিন বহনকারী ওয়াগনের সঙ্গে। ভালোবাসার মানুষের সাথেই শেষ-যাত্রায় চলেছে ট্যানাস–এটা ভেবে দারুন ভালো লাগলো আমার, যদিও লসট্রিস জানতো না সেটা। মাঝে-মধ্যেই পিছন ফিরে, লম্বা কাফেলার শেষমাথায় তাকাচ্ছিলো সে।

কাফেলার পিছনে, হালকা কাঠের কফিনের পিছুপিছু হেঁটে আসছিলো শিলুক বাহিনী। সারির মাথায় আমাদের কাছে পরিষ্কার ভেসে এলো তাদের শোকসংগীত । আমি জানি, ট্যানাস শুনেছে সেই গান, জানে, কার উদ্দেশ্যে এই নিবেদন।

*

সমাধি-উপত্যকায় যখন পৌঁছুলাম আমরা, রাজ-সমাধির প্রবেশদ্বারে নির্মিত তাবুতে নামিয়ে রাখা হলো স্বর্ণের কফিন। লিনেন তাঁবুর ছাদে জ্বলজ্বল করলো মৃতের পুস্তক থেকে নেওয়া বিভিন্ন উদ্ধৃতি ।

দুটি ভিন্ন শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন রয়েছে। প্রথমটি, অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্ণের মিশরের সাহসী সিংহের। পরেরটি, রাজকীয় জাঁক-জমকের সাথে পালিত হবে।

কাজেই, সমাধি-উপতকায় আমাদের আগমনের তিন দিন পর, ট্যানাসের জন্যে আমার নির্মাণ করা সমাধিতে রাখা হলো কাঠের কফিন। সুর করে গাইলো হোরাসের মন্দিরের পুরোহিতেরা যে হোরাস ছিলেন ট্যানাসের পিতৃ-দেবতা। এরপর, সীল করে দেওয়া হলো সমাধি।

শেষকৃত্যের সময়টাতে একজন বিশ্বস্ত ভূত্যের মৃত্যুতে রানির যতোটুকু শোক করা উচিত, তার চেয়ে বেশি কিছু দেখালো না লসট্রিস। আমি ঠিকই বুঝছিলাম, ওর ভেতরে কিছু একটা মরে যাচ্ছে, আর কখনোই যা জাগবে না।

সারাটা রাত ধরে গাইলো শিলুকেরা। ওদের কাছে দেবতায় পরিণত হয়েছিলো ট্যানাস। আজকে পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে ওর নাম নিয়ে হুঙ্কার ছাড়ে শিলুক গোত্র ।

দশদিন পর, স্বর্ণের কফিনটা তোলা হলো কাঠের স্লেজে; অতপর ওটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো বিশাল রাজ-সমাধির কাছে। গলিপথ ধরে ঢোকাতে তিনশো দাসের প্রাণান্ত পরিশ্রম প্রয়োজন হয়েছিলো। এমন চমৎকার মাপে তৈরি করেছিলাম সেই সমাধি, কফিন বসানোর পর হাত গলানোরও জায়গা রইলো না।

ভবিষ্যতে সমাধি-চোর এবং সমাধি-লক্ষ্মনকারীদের হাত থেকে বাঁচতে পর্বতের নিচে গলিপথের এক গোলকধাঁধা তৈরি করেছিলাম আমি। পাথুরে প্রবেশ মুখে, একটি গলিপথ সোজা চলে গেছে অসাধারণ এক সমাধি প্রকোষ্ঠে যেখানকার দেয়ালে শোভা পাচ্ছে রঙ-বেরঙের চমৎকার সব মুর্যাল। সেই কক্ষের কেন্দ্রে রয়েছে বিশাল এক শবাধার, নাটকীয়ভাবে ডালা খোলা অবস্থায় পড়ে আছে সেটা। প্রথম সমাধি-চোর, যে এখানে প্রবেশ করবে, এ দেখে ধোকা খেয়ে যাবে। হয়তো তার আগেই অন্য কেউ এসে লুটে নিয়ে গেছে যাবতীয় সম্পদ–এমন ভাবতে পারে সে।

মূলত, প্রবেশদ্বার থেকে সমকোণে ভিতরে চলে গেছে আরো একটি গলিপথ। তার প্রবেশমুখ দেখে মনে হয়, সমাধি-সম্পদ রাখার কক্ষ সেটা। স্বর্ণের কফিন উল্টে, কাত করে তবেই সম্ভব হলো সেই গলিপথ ধরে ঢোকা। সেখান থেকে অসংখ্য গলিপথ চলে গেছে বিভিন্ন ভুয়া প্রকোষ্ঠে আর কবরে। প্রতিটি গলিপথ একে অপরের চেয়ে বেশি সর্পিল, ধাঁধার মতো।

মোটমাট চারটি সমাধি প্রকোষ্ঠ রয়েছে সেখানে। যার মধ্যে তিনটি চিরকাল ফাঁকা পড়ে থাকবে। তিনটি লুকোনো দরোজা আর দুটি শ্যাফট আছে, যার একটি ধরে পুড়ে উঠিয়ে পরেরটি ধরে রাজ-কফিন রাখব্দেবতারা আমাকে

এই গোলকধাঁধা পেরিয়ে রাজ-কফিন রাখতে পনেরোদিন লেগে গেলো। অবশেষে, তার শেষ বিশ্রামস্থানে পৌঁছুলো সেটা। দেবতারা আমাকে যতোটুকু সাধ্য দিয়েছেন, তার সবটুকু ব্যবহার করে দেয়াল আর ছাদে আঁকলাম আমি। এমনকি, আমার বুড়ো আঙুলের সমান জায়গাও ফাঁকা রইলো না। রঙ-বেরঙের দেয়ালচিত্রের এক অপূর্ব প্রদর্শনীর সাক্ষী হয়ে রইলো সমাধি-প্রকোষ্ঠটি।

সেই প্রকোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে গেছে পাঁচটি ভাড়ার ঘর। ওগুলোতে স্থান হলো ফারাও মামোসের জীবনকালে সংগ্রহ করা সমস্ত সম্পদ যার কারণে ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছিলো আমাদের এই মিশর।

আমি মিসট্রেসকে বলেছিলাম, মাটির তলায় চাপা দেওয়ার বদলে ওগুলো ব্যয় করে আমাদের সেনাবাহিনীর কল্যাণ সাধন করতে। হিকসস্‌দের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন আমাদের।

ওই সম্পদ ফারাও-এর, উত্তরে বলেছিলো লসট্রিস। স্বর্ণ, আইভরি আর দাসসমেত বিশাল সম্পদ পেয়েছি আমরা এই কুশ দেশে। আমাদের জন্যে যথেষ্ট ওটা। স্বর্গীয় মামোস নিজের জিনিস নিয়ে চিরবিশ্রাম নিন–এ ব্যাপারে তার কাছে শপথ করেছি আমি।

এইভাবে, পনোরোতম দিনে স্বর্ণের কফিন রাখা হলো পাথর কেটে তৈরি করা শবাধারে। দড়ি আর পুলির সহায়তায় ভারী ডালাটা বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হলো।

রাজ-পরিবার, পুরোহিত আর মহৎপ্রাণেরা সর্বশেষ আচার পালন করার জন্যে সমাধি-প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলেন।

শবাধারের মাথার কাছে দাঁড়ালো আমার কী আর রাজকুমার, মন্ত্র আবৃত্তি করে চললেন পুরোহিতবর্গ-মৃতের পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি করছেন তারা। প্রদীপের আলো থেকে এঁকে-বেঁকে উপরে উঠে যাচ্ছে ধোয়ার রেখা। সমবেত লোকজনের নিঃশ্বাসে ভারী হয়ে গেছে প্রকোষ্ঠের বাতাস। শ্বাস নেওয়া দায়।

ঝাপসা হলুদ আলোতে দেখতে পেলাম, আমার কর্ত্রীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, বিবর্ণ লাগছে ওকে। গায়ে গা ঠেকানো জনতার ভিড় ঠেলে ওর কাছে পাশে পৌঁছুলাম আমি মাত্র সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লো লসট্রিস। পাথুরে শবাধারে কোণায় লেগে মাথা ফাটার আগেই ওকে ধরে ফেললাম।

সমাধি থেকে একটা ভুলায় করে বের করে নিয়ে আসা হলো ওকে। পর্বতের তাজা বাতাসে অল্পসময়ের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠলো লসট্রস, কিন্তু জোর করে বিছানায় শুইয়ে রাখলাম আমি তাকে। তবু ছেড়ে বেরুতে দিলাম না ।

রাতে, যখন লতাগুলোর মিশ্রণ তৈরি করছিলাম ওর তাবুতে, চিন্তিত ভঙ্গিতে স্থির শুয়ে রইলো সে। মিশ্রণ পান করা শেষ হতে, ফিসফিস করে বললো, ফারাও-এর কবরের কাছে দাঁড়িয়ে থাকার সময় এক অস্বাভাবিক অনুভূতি হয়েছিলো আমার, টাইটা। হঠাৎ মনে হলো, আমার খুব কাছেই এসেছে ট্যানাস। মনে হলো, আমার হাত ছুঁলো ও, কানে যেনো ওরই কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। ওই সময়ই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাই।

ও সব সময়ই তোমার কাছেই থাকবে, বললাম আমি তাকে ।

আমিও তাই বিশ্বাস কোরি, একভাবে বললো লসট্রিস।

যদিও তখন টের পাই নি, এখন বুঝি, ট্যানাসকে কবরে শোয়ানোর দিন থেকেই ওর সময় ফুরিয়ে আসছিলো। বেঁচে থাকার স্পৃহা, আনন্দ সেই দিন থেকেই হারিয়ে ফেলেছিলো আমার রানি।

*

পরদিন ক্রীতদাসের বিশাল এক দল এবং রাজমিস্ত্রিদের নিয়ে আবারো সমাধি-উপত্যকায় ফিরে গেলাম আমি; সমাধির প্রবেশমুখ এবং শ্যাফট বন্ধ করা এবং বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা তৈরির কাজ বাকি পড়ে আছে।

গলিপথের গোলকধাঁধা দিয়ে পথ করে যখন এগুতে লাগলাম, ধূর্ততার সাথে পাথরধসের ব্যবস্থা করে সেগুলোর উপর আস্তরণ তৈরি করে রঙিন ছবি এঁকে দিলাম আমি। শ্যাফট দুটোকে সীল করা হলো এমনভাবে, দেখে মনে হয় ওগুলো মেঝে এবং ছাদ।

টিল-করা কোনো পাথরের পাদানীতে চাপ পড়লে শুরু হবে পাথরধস। খাড়া শ্যাফটগুলোতে বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ি সাজিয়ে রাখলাম। কালের আঁচড়ে যখন পচে যাবে কাঠ, কীটপতঙ্গ বাসা বাঁধবে ওখানে তৈরি হবে বিষাক্ত গ্যাস। গুপ্ত দরোজার বিপদ পেরিয়ে কেউ যদি শ্যাফট পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে, এই গ্যাসে শ্বাস নিয়ে মারা পড়বে সে।

কিন্তু, এ সমস্ত করার আগে মূল সমাধি-প্রকোষ্ঠে গিয়ে বিদায় নিয়ে এলাম ট্যানাসের কাছ থেকে। লিনেনের কাপড়ে মুড়ে লম্বা একটা বান্ডেল নিয়ে গেলাম সাথে । শেষবারের মতো যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম পাথুরে শবাধারের কাছে, সমস্ত শ্রমিকদের দূরে সরিয়ে দিলাম আমি। আমার পরে আর কারো পা পড়বে না এই সমাধিতে।

একা হতে কাপড়ের পুঁটুলিটা খুললাম। সেই লম্বা ধনুক লানাটা বেরুলো ওটা থেকে। আমার মিসট্রেসের নামে এটার নাম দিয়েছিলো ট্যানাস। কেবলমাত্র ওরই জন্যে আমি তৈরি করেছিলাম ধনুকটা। আমাদের দু জনের পক্ষ থেকে শেষ এই উপহার ট্যানাসের জন্যে। সীল করা পাথরের কফিনের ডালার উপরে ওটা রেখে দিলাম।

আরো একটা জিনিস ছিলো পুঁটুলিতে। আমার নিজহস্তে খোদাই করা একটা উশব তি পুতুল ওটা। শবাধারের পায়ের কাছে রাখলাম ওটা। ওটা খোদাই করার সময় তামার আয়না রেখেছিলাম সামনে যাতে করে নিজের অবয়ব নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারি। পুতুলটা ছিলো একটা ছোটো টাইটা।

পুতুলের নিচের অংশে কাঠ খোদাই করে লিখেছিলাম : আমি টাইটা। আমি একজন চিকিৎসক এবং কবি। আমি একজন স্থপতি এবং দার্শনিক। আমি তোমার বন্ধু। তোমার পক্ষ থেকে আমি জবাবদিহি করবো।

সমাধি ছেড়ে বেরিয়ে প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো পিছু ফিরে চাইলাম।

বিদায়, বুড়ো বন্ধু, বললাম। তোমার সাথে পরিচিত হয়ে ধন্য হয়েছি। আবার দেখা হবে মরণের ওপারে।

রাজকীয় সমাধির কাজ শেষ করতে বহু মাস সময় লেগেছিলো আমার। প্রতিটি সীল করা দরোজা, মৃত্যু-ফাঁদ পরখ করে দেখেছি আমি নিজে।

প্রেমটার বেনি-জনের সাথে দেখা করতে পর্বতের উপরে গেছে রাজপুত্র আর রানি। মেমনন এবং মাসারার বিয়ে উপলক্ষ্যে পুরো সভাসদ গিয়েছে সাথে। আদবার সেজেদ-এ যুদ্ধ জয়ের পুরস্কার স্বরূপ যে ঘোড়া দেওয়ার প্রতিশ্রতি করেছিলো সেটার বেনি-জন, সেগুলো পছন্দ করার জন্যে হুই-ও গিয়েছে সাথে। এখানে একদম একা আমি। কাজ শেষ হতে ঠাণ্ডা, স্যাঁত-স্যাঁতে পথে নিজেও রওনা হলাম পর্বতের উপরে। বিয়ের উৎসবে থাকতে চাই আমি। সমাধি উপত্যকার প্রবেশমুখ আড়াল করতে ধারণার চেয়েও বেশি সময় লেগেছে।

বিয়ের পাঁচদিন আগে প্রেসটার বেনি-জনের এলাকায় পৌঁছলাম। মিসট্রেস দুর্গের যে অংশে আছে, প্রথমেই সেখানে গেলাম ।

তোমাকে না দেখে ভালো লাগছিলো না, টাইটা, লসট্রিস স্বাগত জানিয়ে বললো। গান গাও আমার জন্যে। গল্প বলো। আমাকে শান্তি দাও।

আত্মার গভীরে বিষণ্ণতা ঢুকে গেলে আর শান্তি পায় না মানুষ। আমি নিজেও কেমন আনমনা হয়ে গেছি। শেষমেষ রাজত্বের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে চললাম আমরা দুজন।

মাসারা এবং মেমননের মিলন প্রকৃতপক্ষে দুটি তরুণ হৃদয়ের ভালোবাসার সফল পরিণতি। কিন্তু আমাদের কাছে এটা মূলত দুই জাতির মধ্যে চুক্তির মাধ্যম। বিভিন্ন বিষয়ে একমত হওয়ার ব্যাপার আছে, যেমন যৌতুক, আকসুম প্রদেশ এবং মিশরের মধ্যে বাণিজ্যিক বিনিময়ের কথাও রয়েছে। প্রথমটায় আমার ধারণা মতো এই বিয়েতে সুখী ছিলো না রানি। পরে অবশ্য মনকে প্রবোধ দিয়েছিলো সে।

বিয়ের সময়ে প্রেমিক যুগলের কাছাকাছি থাকার সম্মান পেয়েছিলাম আমি। যদিও লসট্রিসের কথা সত্য কোনো বিষয়েই মিল নেই বর-কনের, তথাপি ওদের হৃদয় এক ও অভিন্ন। আমি দু জনের কাছেই ছিলাম বিশ্বস্ত বন্ধু। ওদের মিলনের ক্ষেত্রে আমার ভূমিকার কথা বারবার স্মরণ করলো দুজন।

আমার কর্ত্রীর দুশ্চিন্তা আমাকে স্পর্শ করলো না। মাসারা এবং মেমনন পরস্পরের জন্যেই তৈরি। জানি, কখনো মেমননকে লক্ষ্যচুত করবে না এই মেয়ে। বরঞ্চ উৎসাহ আর সমর্থন দিয়ে তরতাজা করে রাখবে আমাদের যুবরাজকে।

এক আলোকজ্জ্বল সকালে, পর্বতের উপরে বিশ হাজার ইথিওপিও নারী-পুরুষ এবং মিশরীয় নাগরিকের সামনে মেমনন এবং মাসারা নদী তীরে দাঁড়িয়ে ওসিরিসের মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের ভোলা নীলের জলভর্তি পাত্র ভেঙে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলো।

বর-কনে আমাদের কাফেলার সামনে থেকে নেমে এলো পর্বতাঞ্চল থেকে। ওয়াগন বোঝাই যৌতুক দিয়েছে প্রেসটার বেনি-জন।

হুই এবং তার সাহায্যকারীরা আমাদের পিছনে পঁচ হাজার শক্তিশালী ঘোড়ার পাল নিয়ে এগুলো। এদের মধ্যে কিছু মাসারাকে উদ্ধার করে আনার পুরস্কার, বাকিগুলো যৌতুক। কেবুই-এ, জোড়া নদীর মিলনস্থলে পৌঁছে আমরা দেখতে পেলাম, মেঘের ছায়ায় যেনো কালো হয়ে গেছে পুরো সমভূমি। কিন্তু চারিদিকে রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া।

বার্ষিক স্থানান্তর অভিযানে চলেছে ন্যূ-এর পাল।

স্বাভাবিক কারণেই চিন্তিত হয়ে পড়লাম আমি এবং হুই। আবার সেই মহামারীর আশঙ্কা অমূলক তো নয়; কিন্তু তৈরি আছি আমরা। প্রত্যেকটি রথ চালক এবং সহিসকে শ্বাসনালী ফুটো করে হলুদ-ফাঁস রোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। বহু রাত পর্যন্ত নির্মুম কাটালাম আমরা, কিন্তু শেষমেষ পাহাড়ি ঘোড়ার পালের কেবলমাত্র দুই হাজার ঘোড়া মারা পড়লো মহামারীতে। নীলের জল্যে পরবর্তী বন্যার আগে অসুস্থ ঘোড়গুলোও শক্তি ফিরে পেলো।

*

বন্যা এলে নদীর তীরে নিজের নিজের দেবতাদের উদ্দেশ্যে দান করলেন পুরোহিতেরা। নিজেদের মধ্যে দেবতার চিহ্ন নিয়ে বলাবলি করতে শুরু করলেন তারা। কেউ বলি দেওয়া ভেড়ার নাড়ি, কেউ আবার উড়ন্ত পাখির গতিপথকে পবিত্র মনে করলেন; আবার এমনলোকও আছেন যারা নীলের জলভর্তি পাত্রের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।

হাপির উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করলো রানি লসট্রিস। যদিও তার সাথে প্রার্থনায় যোগ দিলাম আমি, আমার হৃদয় ছিলো অন্য কোথাও। আমি হোরাসের উপাসক, ক্ৰাতাস এবং রাজপুত্র মেমননও তাই। স্বর্ণ আর আইভরি উৎসর্গ করে দেবতার নামে স্তুতি গাইলাম আমরা।

দেবতারা একে অপরের সাথে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেরই একমত হন না, আর তাদের উপাসকেরা তো আরো হয় না। কিন্তু এ বছর অন্যান্য বারের চেয়ে ভিন্ন রকম হলো। দেবতা আনুবিস এবং তথ আর দেবী নাটু বাদে সমস্ত দেবতারা যেনো এক সুরে কথা বোলগ্ন। ওই তিন দেব-দেবী অবশ্য নিচু পদ-পর্যাদার। সমস্ত মহান দেব দেবী আমন রা, ওসিরিস, হোরাস, হাপি এবং আইসিস, এবং আরো দুইশো নীচ পদ-মর্যাদার বিভিন্ন দেবতা এক যোগে তাদের পরামর্শ শোনালেন : সময় এসে গেছে পবিত্র কালো ভূমি, কেমিট ফিরে যাওয়ার!

লর্ড ক্ৰাতাস, যে আদতে কোনো দেব-দেবীর ধার ধারে না, মতামত জানালো, এ হলো পুরোহিতদের ষড়যন্ত্র; ইচ্ছেকৃতভাবেই সমস্ত দেবতাদের ঠোঁটে একই কথা বলিয়ে নিয়েছে তারা। যদিও তার এহেন ভয়ঙ্কর অভিযোগে কেঁপে উঠেছিলাম, মনে মনে কাতাসের সঙ্গে আমিও একমত।

পুরোহিতেরা হলেন নরম আর আরামপ্রিয় মানুষ। দীর্ঘ প্রায় দুই দশক যাযাবরের মতো বন্য কুশ দেশের ভূখণ্ডে ঘুরে ফিরেছেন তারা। আমামার ধারণা, থিবেস-নগরীর জন্যে আমার কর্ত্রীর চেয়ে তাদের মন বেশি উতলা হয়ে পড়েছে। হয়তো, দেবতারা নয়, মানুষেরাই তাদের ঠোঁটে দেশে ফিরে যাওয়ার শব্দ তুলে দিয়েছিলো।

রাজ্যের উচ্চ পরিষদের সভা ডাকলো লসট্রিস। যখন দেবতাদের ইচ্ছে অনুযায়ী মিশরে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা উচ্চারণ করলো ও, মহৎপ্রাণ পুরোহিতো পায়ের উপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সমর্থন জানালো তাকে। তাদের যে কারো চেয়ে বেশি আনন্দ করেছিলাম আমি। সেই রাতে থিবেস-এর স্বপ্নে বিভোর হয়ে সুখী দিনগুলোর কথা ভাবলাম, যখন ট্যানাস, লসট্রিস এবং আমি ছিলাম তরুণ আর উচ্ছল ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *