৭. ঘোড়ার পাল

পশ্চিম তীরে ঘোড়ার পাল দেখাশোনা করায় একটুও গাফিলতি করেনি হই। প্রতিদিন সেখানে পরিদর্শনে যেতাম আমি আর মেমনন। ততোদিনে নিজের পছন্দের প্রাণীগুলোর নাম জেনে গেছে রাজপুত্র, ওর হাত থেকে খেতে শিখে গেছে ঘোড়াগুলো। একদিন সাহস করে ধৈর্য্যের পিঠে একা চড়ে ঘুরে বেড়ালো মেমনন।

আমাদের যাত্রাপথের পরবর্তী বাধা সম্পর্কে হুইকে অবগত করলাম আমি। জলপ্রপাত পেরুনোর ব্যাপারে ঘোড়াগুলোর ভূমিকা সম্বন্ধেও আলোচনা করলাম আমরা। হুই এবং রথ চালকদের দায়িত্ব দিলাম, ঘোড়ার হারনেস খুলে সেগুলোকে পিটিয়ে হালকা পাতের আকারে তৈরি করতে।

সুযোগমতো আমি আর ট্যানাস গিয়ে পরিদর্শন করে এলাম নদীর উজানে অবস্থিত প্রথম জলপ্রপাত। পানি এতো কম এখন সমস্ত ডুবো দ্বীপ দৃশ্যমান। কোনো কোনো জায়গায় এক মাথা সমান পানিও নেই। বহু মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত সেই জলপ্রপাত উজ্জ্বল, জলের আচড়ে মসৃণ গ্রানাইটের খণ্ড আর সরীসৃপের মতো পিচ্ছিল জলের ধারা এঁকে-বেঁকে এগিয়ে গেছে সামনে। সামনে কী কাজ পড়ে আছে, দেখে এমনকি আমি পর্যন্ত নিরাশ হলাম। ওদিকে ট্যানাস তার স্বভাবগত শক্ত মানসিকতা বজায় রাখলো।

তলা না ফাটিয়ে এমনকি একটা ছোট্ট নৌকাও পার করতে পারবে না এখান দিয়ে। আর, পেটভর্তি মালামাল সহ একটা গ্যালি কী করে পেরুবে? তোমার সেই হতচ্ছাড়া ঘোড়ার পিঠে চড়ে? কর্কশ হাসি হেসে বললো সে।

গজ-দ্বীপের উদ্দেশ্যে ফিরতি পথে আমি বুঝলাম, গ্যালি ছেড়ে পায়ে হাঁটা ছাড়া জলপ্রপাত পেরুনোর আর কোনো উপায় নেই। এতে করে যে কী পরিমাণ কষ্ট হবে, তা বর্ণনাতীত তবে, একবার জলপ্রপাতের ওপারে চলে গেলে, নদী তীরে নতুন করে তৈরি করা যাবে নৌ-বাহিনী।

গজ-দ্বীপে পৌঁছেই রানিকে পরিদর্শনের ফলাফল জানাতে রাজপ্রাসাদে চললাম আমরা দু জন। সবকিছু শুনে মাথা নাড়লো লসট্রিস।

এতো তাড়াতাড়ি দেবী আমাদের ছেড়ে গেছেন এ আমি বিশ্বাস করি না, এই বলে, দ্বীপের দক্ষিণ অংশে হাপির মন্দিরে পুরো সভাষদ নিয়ে চললো সে, পূজো দিতে।

সারারাত ধরে প্রার্থনায় রত হলাম আমরা দেবী হাপি যেনো সঠিক পথ দেখান। কিছু ছাগল কোরবানী দিয়ে অথবা পাথুরে বেদীতে আঙুর ফল দান করে কোনো দেব দেবীর আনুকূল্য পাওয়া যায় এ আমি বিশ্বাস করি না; তথাপি সারারাত ধরে প্রধান পুরোহিতের সাথে আমিও প্রার্থনা করে চললাম। সকালে দেখি, পাথরের মেঝেতে বসে থেকে থেকে পাছা ব্যথা হয়ে গেছে!

সকালের প্রথম সূর্যরশ্মি যখন মন্দিরের ছাদ গলে মূর্তির বেদী আলোকিত করলো, নাইলোমিটারের সুড়ঙ্গে পাঠালো রানি আমাকে। শেষ ধাপ পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই দেখি গোড়ালি ডুবে গেছে!

হাপি আমাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। সময়ের বেশ ক সপ্তাহ আগেই বান ডেকেছে নীলের জলে ।

*

ঠিক যেদিন বান ডাকলো নীলের জলে, সেদিনই উত্তর থেকে বাতাসের গতিতে ছুটে এলো ট্যানাসের একটি প্রহরী গ্যালি। আবারো এগিয়ে আসছে হিকসস্‌ বাহিনী। এক সপ্তাহের মধ্যেই গজ-দ্বীপে চলে আসবে তারা।

সাথে সাথেই নিজের বাহিনী নিয়ে জলপ্রপাত প্রতিরক্ষায় ছুটলো ট্যানাস। লর্ড মারসেকেট এবং আমার উপর দায়িত্ব রইলো সমস্ত লোকজনকে জাহাজে উঠানোর। এইবার অবশ্য থিবেসের মতো এলোমেলো, ছত্রভঙ্গ অবস্থা হলো না। সঠিকভাবে এবং কম সময়ের মধ্যেই জলপ্রপাতের লেজের উদ্দেশ্যে পাল তুললো নৌ-বহর।

পঞ্চাশ হাজার মিশরীয় নাগরিক নদীর দুই তীরে দাঁড়িয়ে জল-ভরা চোখে বিদায় জানালো আমাদের। তাদের ঠোঁটে ছিলো দেবী হাপির নৈবেদ্য। ছোট্ট রাজপুত্রকে পাশে নিয়ে হোরাসের প্রশ্বাসের গলুইয়ে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালো রানি। একুশ বছর বয়সে, আমার কর্ত্রী তখন তার সৌন্দর্য্যের শিখড়ে অবস্থান করছিলো। ওর সৌন্দর্য্যের স্বর্গীয় দ্যুতি ধর্মীয় ভক্তি জাগিয়ে তোলে। সেই একই সৌন্দর্য প্রতিফলিত হচ্ছিলো রানির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুপুত্রের অবয়বে। ছোট্ট, সংকল্পবদ্ধ হাতে রাজ্যের প্রতীক চিহ্ন ধরে রেখেছে মেমনন।

আমরা ফিরে আসবো, জনতার উদ্দেশ্যে বললো আমার কর্ত্রী, রাজপুত্রের কণ্ঠে তারই প্রতিধ্বনি, আমরা ফিরবো। অপেক্ষা করো, আমরা অবশ্যই ফিরবো।

সেইদিনই, আমাদের দুর্গত, শোষিত জনপদের ভাগ্যাকাশে যখন দুর্যোগের ঘনঘটা, মাতা নীলের তীরে জন্ম হলো একটি কিংবদন্তির, বহুকাল যা ছিলো আমাদের লোকেদের সঙ্গী।

*

পরদিন দুপুরে জলপ্রপাতের লেজের অংশে পৌঁছুলাম আমরা। নদীর জীবনচক্রের এই দশা আমাদের অভিযানের জন্যে সবচেয়ে উপযোগী। পানির উচ্চতা আমাদের জাহাজগুলো পার হয়ে যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট, কোনো গ্যালিই নদীর তলায় ঠেকে যাবে না। তবে বন্যার পানি তখনো এতো তীব্র স্রোত অর্জন করেনি যে, ঠেলে জলপ্রপাতে উঠতে বাধা দেবে জাহাজগুলোকে। ট্যানাস নিজে জাহাজগুলোর নিরাপদ পারাপার দেখভালের দায়িত্বে রইলো, ওদিকে আমি এবং হুই লর্ড মারসেকেটের অধীনে তীরের লোকজনের তত্ত্বাবধানে ব্যস্ত থাকলাম।

ভারী লিনেনের দড়ির সাথে জুড়ে দেওয়া হলো আমাদের দশ ঘোড়ার এক একটি দল। একবারে দশটি দল–অর্থাৎ একশো ঘোড়া পার করা সম্ভব হলো। ঘোড়া ছাড়াও, প্রায় দুই হাজার লোক থাকলো দড়ির প্রান্তে। নদীর জলবাতাসেই বেড়ে উঠেছে আমাদের লোকজন, নদী আর নৌকার আচরণ তারা নিজেদের স্ত্রীদের চেয়ে ভালো জানে। মসৃণগতিতে, বিশেষ ঝুট-ঝামেলা ছাড়াই একশো ঘোড়া আর দুই হাজার লোকের টানে ধীরে জলপ্রপাতের খাড়া ধার বেয়ে উঠে আসতে লাগলো হোরাসের প্রশ্বাস। অবশেষে যখন জলপ্রপাত পেরিয়ে ওপাশের ঘন সবুজ শান্ত পানিতে পড়লো ওটা, খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলাম আমরা।

কিন্তু এখনো ছয় মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে। জলপ্রপাতের মাথায় চড়েছি কেবল। ঘোড়া এবং লোকবল পরিবর্তন করে আবারো টেনে নিয়ে চললাম আমরা হোরাসের প্রশ্বাসকে। এদিক-ওদিক জেগে আছে ডুবো পাথরের মাথা, এর যে কোনো একটায় বাড়ি লাগলে চুরমার হয়ে যাবে জাহাজের খোল। কিন্তু ঘোড়া আর মানুষের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় নিরাপদে সামনে এগিয়ে গেলে হোরাসের প্রশ্বাস, ছিড়লো না লিনেনের তৈরি দৃঢ় দড়ি।

ঘর্মাক্ত সৈনিকদের পাশে পাশে, তীরে হেঁটে চললো আমার কর্ত্রী । সেদ্ধ হওয়ার মতো গরমওে ফুলের মতো সজীব আর সুন্দর ও লসট্রিসের উৎসাহব্যঞ্জক হাসি কর্মউদ্দীপনা দ্বিগুণ করলো যোদ্ধাদের। নতুন উদ্যমে দড়ি টেনে চললো তারা।

সবার সামনে, ঘোড়ার পালের সঙ্গে ধৈর্য্যের পিঠে চড়ে থাকলো মেমনন। গ্যালির চালকের আসনে বসা নিজের পিতার উদ্দেশ্যে গর্বের সাথে হাত নাচালো সে।

অবশেষে, জলপ্রপাতের উপরের গভীর শান্ত নদীর মূল ধারায় উঠে এলাম আমরা; হাপির উদ্দেশ্যে প্রার্থনা সংগীতে ফেটে পড়লো মিশরীয় যোদ্ধা আর অভিযাত্রীরা।

গ্যালিতে চড়েই আমার কী খবর পাঠালো প্রস্তরশিল্পীদের। জলপ্রপাতের ধারের বিশাল গ্রানাইটের খণ্ডের উপর একটি ভাস্কর্য তৈরির নির্দেশ দিলো সে। যতক্ষণে বাহিনীর অন্য জাহাজগুলোকে প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় পারাপার করা হলো, আগুন আর ছেনির সহায়তায় লম্বা, পাতলা একটা থাম তৈরি করে ফেলেছে মিস্ত্রিরা। রানির নির্দেশে ফারাও-এর বিশেষ হায়ারোগ্লিফিক্স ব্যবহার করে তার এবং রাজপুত্রের নামে বিশেষ বাণী খোদাই করতে লাগলো তারা।

*

একটি জাহাজ পার হয়ে যেতে এ ব্যাপারে দক্ষতা অর্জন করে ফেললাম আমরা।

হোরাসের প্রশ্বাসকে জলপ্রপাতের খাড়া ধার ধরে উঠাতে পুরো একদিন লেগেছিলো আমাদের। পরবর্তী সপ্তাহে, এর

অর্ধেকেরও কম সময়ে ছয়টি জাহাজ একই সাথে পার করা হলো। একটির পর একটি গ্যালি যেনো কোনো রাজকীয় শোভাযাত্রার মতো করে উঠে আসতে লাগলো জলপ্রপাতের উপরে। দশ হাজার সৈনিক এবং এক হাজার ঘোড়া যুগপৎ খেটে চললো দিন-রাত ।

অবশেষে, জলপ্রপাতের উপরে নীলে র ঘন সবুজ শান্ত জলে স্থির হলো আমাদের একশ জাহাজ। এই সময়ই আবারো আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়লো হিকসস্‌ বাহিনী।

গজ-দ্বীপে লুটপাট চালাতে গিয়ে দেরি হয়েছে রাজা স্যালিতিসের। তারা ভাবতেও পারেনি, ফারাও মামোসের সিংহভাগ ধন-সম্পদ গ্যালিতে নিয়ে নদীর উজানে চলেছি আমরা। নদীর গতি-প্রকৃতি, চরিত্র সম্বন্ধে যা যা জানতো স্যালিতিস; বা ইনটেফ যা জানিয়েছেন তাকে, তাতে করে এমন একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছিলো হিকসস্‌দের মধ্যে যে, জলপ্রপাতের উপরে গ্যালি নিয়ে উঠে যাওয়া অসম্ভব। কাজেই, নিশ্চিন্ত মনে লুটপাট চালিয়েছে হিকসসেরা, সময় নষ্ট করেছে নিজেদের অজান্তেই।

রাজকুমার আর সমাধি-সম্পদের খোঁজে পুরো গজ-দ্বীপ তছনছ করেছেন স্যালিতিস। কিন্তু একটিবারের জন্যেও মুখ খুলেনি কেউ, আমাদের পলায়নের সুযোগ করে দেওয়ার জন্যে নীরব থেকেছে।

অবশ্য, অনির্দিষ্ট সময় ধরে হিকসস্‌ অত্যাচার সহ্য করা সম্ভব হয়নি কোনো অসহায় মিশরীয় নাগরিকের পক্ষে। অবশেষে, আমাদের পলায়নের খবর জানতে পেরে আবারো ঘোড়া তৈরি করে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন স্যালিতিস; তার বাহিনী নিয়ে।

ট্যানাস তৈরি ছিলো এর জন্যে। তার নির্দেশে আসতেস, রেমরেম এবং ক্ৰাতাস সদা-সতর্ক অবস্থায় প্রহরা দিয়ে রাখছিলো রাত-দিন। প্রতিটি অভিযাত্রী একটু দম ফেলার সুযোগ পেতেই যুদ্ধে লাগিয়ে দেওয়া হলো তাদের।

এ আমাদের ভূমি। চিরপরিচিত ভূখণ্ডের সমস্ত সুযোগ নিলাম আমরা। খাড়া, পাথুরে দেয়াল বেয়ে নেমে এসেছে বিশাল জলপ্রপাত; উঁচু-নিচু তীরভূমি অত্যন্ত সংকীর্ণ। নদীর প্রতিটি বাঁকে উঁচু পাথুরে ধার অসংখ্য গুহার গোলকধাঁধা সেখানে আমাদের জন্যে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে চমৎকার কাজে লাগবে সেগুলো।

জলপ্রপাতের উপরে রথ নিয়ে চড়া অসম্ভব। নদী ছেড়ে, মরুর উপর দিয়ে ঘুরে জলপ্রপাত পেরিয়ে আসাও সম্ভব নয় হিকসস্‌দের পক্ষে। নরম বালুতে তাদের ঘোড়ার পা যেমন ডেবে যাবে, তেমনি পানিবিহীন মরু গনগনে সূর্যের নিচে চলাফেরার অযোগ্য স্থান। এছাড়া, রথের চাকাও মরুতে চলবার উপযোগী নয়। বাধ্য হয়ে, জলপ্রপাতের নিচে সরু পাথুরে ধার ধরে একসারিতে উঠে আসতে লাগলো তারা। ঠিক এই প্রচেষ্টা রুখে দেওয়ার জন্যেই পাথুরে ঢালের উচ্চতায় তীরন্দাজদের মজুদ রেখেছিলো ক্ৰাতাস। হিকসসেরা উঠে আসার চেষ্টা করতেই উপরের সুরক্ষিত দেয়ালঘেরা স্থান থেকে তীরের বর্ষণ ছুটে এলো তাদের দিকে। পাথরের বড়ো বড়ো খণ্ড গড়িয়ে ফেললো আমাদের যোদ্ধারা মানুষ, রথ আর ঘোড়ার বিশৃঙ্খল এক জটলা উপর থেকে আছড়ে পড়তে লাগলো নীল নদের সবুজ পানিতে। উপর থেকে আমি আর কাতাস জলপ্রপাতের তীব্র স্রোতে অসহায় অবস্থায় হাবুডুবু খেতে দেখলাম হিকসস্‌ যোদ্ধাদের। তাদের আর্তনাদ প্রতিধ্বনি তুলতে লাগলো উঁচু পাথুরে দেওয়ালে লেগে। বর্মের ওজনের কারণে খুব দ্রুতই ডুবে গেলো তারা।

চিন্তিত হয়ে পড়লেন স্যালিতিস। তার একের পর এক বাহিনী পর্যদস্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে; ওদিকে আমাদের টিকিটিরও নাগাল পেলো না তারা। এই অসম যুদ্ধের কেবল একটা ফলাফলই হতে পারতো। জলপ্রপাতের খাড়াই ধরে অর্ধেক পথ উঠে আসার পর এই প্রচেষ্টায় ক্ষান্ত দিলো হিকসস্‌ বাহিনী। তারা যখন নিজেদের প্রত্যাহার করে জলপ্রপাতের ঢাল বেয়ে ফিরে যেতে লাগলো দলে দলে, ট্যানাস, আমি আর মিসট্রেস পাথুরে দেওয়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। রথের ধ্বংসাবশেষ, নিহত-আহতের দেহ, আবর্জনা ফেলে রেখে পিছু হঠলো হিকসস্।

বিজয়ের দামামা বাজাও! ট্যানাসের নির্দেশে বেজে উঠলো সঙ্গিত। পলায়নরত শক্রদের পিছনে প্রতিধ্বনি তুললো সেই সুর। এতো উপর থেকেও রাজা স্যালিতিসের স্বর্ণ-মণ্ডিত রথ আর লম্বা অবয়ব চিনতে পারলাম আমি। উঁচু তামার তৈরি শিরস্ত্রাণ, বড়ো বড়ো দাড়ি টেনে পিছনে কাঁধে ফেলে রেখেছেন। হাতের ধনুক উঁচিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে ঝাঁকালেন রাখাল রাজা। হতাশা আর রাগের বহিঃপ্রকাশ ছিলো তার হাবভাবে।

এরপর দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে না যাওয়া পর্যন্ত হিকসস্‌দের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমরা। গজ-দ্বীপ পর্যন্ত তারা ফিরে যায় কি না দেখার জন্যে প্রহরী দল পাঠালো ট্যানাস। কিন্তু মনের গভীরে আমি ঠিকই জানি, রাজা স্যালিতিস আর আমাদের পিছু ধাওয়া করবে না। দয়াময়ী দেবী হাপি তার প্রতিজ্ঞা রেখেছেন, আবারো আমাদের আশ্রয় দিয়ে রক্ষা করেছেন তিনি।

ঘুরে, পাহাড়ি ছাগলের চলাচলের ফলে সৃষ্ট সরু, আঁকা-বাঁকা পথ ধরে আমাদের জাহাজগুলোর কাছে ফিরে চললাম তিনজন।

*

স্মারকচিহ্ন তৈরির কাজ সমাপ্ত করে ফেলেছে শিল্পীরা। তিনমানুষ সমান উচ্চতার একটা শ্যাফট ওটা নিরেট গ্রানাইট খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে। কাটার আগে, বিরাট পাথুরে খণ্ডের উপর চিহ্ন এঁকে মাপ বুঝিয়ে দিয়েছিলাম আমি মিস্ত্রিদের। আমাদের বাহিনীর উপরে, আকাশের দিকে গর্বিত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে এখন ওটা।

সমস্ত মিশরীয় জড়ো হলো সেই স্তম্ভের নিচে। নদীর দেবী হাপির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলেন রাণী লসট্রিস ওটাকে। পালিশ-করা পাথরের উপর শিল্পীদের খোদাই করা বানী জোরে জোরে পড়ে শোনালো ও—

.

আমি, রানি লসট্রিস, এই মিশরের শাসনকর্ত্রী এবং ফারাও মামোসের বিধবা পত্নী, যিনি ছিলেন ওই নামধারী অষ্টম ফারাও; আমার পরে যে এই দুই রাজ্য শাসন করবে সেই রাজকুমার মেমননের মাতা, এই স্তম্ভ তৈরির নির্দেশ দিয়েছি।

এই স্থাপত্য, মিশরের অধিবাসীদের প্রতি আমার শপথের চিহ্ন–যে অজানা যাত্রায় আমি রওনা হয়েছি জবরদখলকারী বর্বরদের দ্বারা তাড়িত হয়ে, সেখান থেকে অবশ্যই আবার ফিরে আসবো।

এই পাথুরে স্তম্ভ, আমার শাসনামলের প্রথম বছরে প্রস্তুতকৃত; ফারাও চিপস এর মহান পিরামিড তৈরির নয়শততম বছরে।

পিরামিডের মতোই এই স্থাপনাও অনড় থাকবে, যততদিন পর্যন্ত না আমি ফিরে আসবো।

এরপর, সমস্ত জনতার সামনে ট্যানাস, ক্ৰাতাস, আসতেস এবং রেমরেমের গলায় বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পরিয়ে দিলেন রানি যাদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টার কারণেই মূলত জলপ্রপাত অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছিলো।

সবার শেষে আমাকে ডাকলেন রানি। তার সামনে কুর্নিশ করতেই, ফিসফিসিয়ে, কেবল আমি শুনতে পাই, এমন স্বরে বলে উঠলেন, তোমার অবদান কেমন করে ভুলে যাই, বিশ্বস্ত, প্রাণপ্রিয় টাইটা? তোমার সাহায্য আর প্রজ্ঞা ছাড়া এ পর্যন্ত আসা সম্ভব হতো না কখনোই। আলতো করে আমার চিবুকে আঙুল ছোঁয়ালো লসট্রিস। এরপর প্রশংসার স্বর্ণ শেকল পরিয়ে দিলো গলায়। পরে, ওজন করে দেখেছিলাম ওটা পুরো ত্রিশ ডেবেন, ফারাও আমাকে যে হার দিয়েছিলেন তার তুলনায় পাঁচ ডেবেন বেশি।

এরপর, জলপ্রপাতের পাথুরে ধার ধরে যখন হেঁটে চললো মিসট্রেস, ওর মাথার উপরে অসট্রিচের পালকে তৈরি ছাতা ধরে রাখলাম আমি। দু একবার আমার উদ্দেশ্যে হাসলো ও, প্রতিটি হাসি আমার কাছে গলার ওই প্রশংসার স্বর্ণ শেকলের চেয়ে বহুগুনে মূল্যবান।

পরদিন সকালে হোরাসের প্রশ্বাসে অবস্থান নিলাম আমরা। গলুই ঘুরিয়ে দক্ষিণের উদ্দেশ্যে রওনা হলো জাহাজ। শুরু হলো দীর্ঘ এক যাত্রা।

*

নদীর রূপ আর চরিত্র বদলে যেতে লাগলো প্রতিদিন। এ আর কোনো শান্ত, বিশাল জলরাশি নয় যা আমাদের চিরকাল স্বাচ্ছন্দ দিয়ে এসেছে। এই নীল নদ উন্মত্ত, বন্য–যেনো নিজস্ব খেয়াল খুশি আছে তার। অনেক সরু আর গভীর এখানে পানি। দুই তীরের স্থলভূমি অত্যন্ত বন্ধুর, কর্কশ। খাড়া ঢাল বেয়ে এখানে-সেখানে নেমে আসছে ঝর্ণাধারা। কুঞ্চিত দ্রু-যুগলে আমাদের উদ্দেশ্যে যেনো তাকিয়ে আছে উঁচু-নিচু পাথুরে ঢাল। কোনো কোনো স্থানে পরিসর এতো সংকীর্ণ, একসারিতে পেরুতে হলো ঘোড়ার পাল আর সৈনিকদের। আবার কোথাও কোথাও পায়ে চলাচলের জন্যে কোনো পথ নেই; বিশাল গ্রানাইটের পাহাড় মুখ ব্যাদান করে নীল নদের তীর প্রহরা দিচ্ছে। এমন একটা স্থানে এসেই আর সামনে এগুনো অসম্ভব হয়ে পড়লো ঘোড়ার পালের পক্ষে। বাধ্য হয়ে ঘোড়াগুলোকে সাঁতরে পার করে, অপরদিকের তীরের সবুজ বিস্তৃতিতে নিয়ে এলো হুই।

সপ্তাহের পর সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো, কোনো জন-মানুষের দেখা পেলাম না আমরা। মাঝে-মধ্যে আমাদের প্রহরীরা অবশ্য তীরের ধারে পরিত্যক্ত কুঁড়ের দেখা পেলো; ধ্বংসপ্রাপ্ত ক্যানু চোখে পড়লো কখনো কখনো। কোনো ধরনের ব্যবহার্য দ্রব্য বা শিল্পকর্ম পেলাম না পরিত্যক্ত কুঁড়েগুলোতে, যা থেকে এখানকার অধিবাসীদের সম্পর্কে অনুমান করা সম্ভব।

কুশ দেশের অধিবাসীদের দেখা পেতে মরিয়া হয়ে আছি আমরা, এই মুহূর্তে দাস প্রয়োজন আমাদের। আমাদের পুরো সভ্যতা টিকে আছে দাস-প্রথার উপর, আর এই যাত্রায় সামান্য কয়েকজন মিশরীয় ক্রীতদাস নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। জাহাজবহরের বহু সামনে প্রহরী দল পাঠিয়ে দিলো ট্যানাস, যাতে করে মানুষের দেখা পেলে আগেভাগেই জানাতে পারে তারা। এছাড়া, আমাদের দাস-ধরা লোকগুলোর প্রস্তুতির ব্যাপারও আছে। চিরজীবন একজন দাস হিসেবে বসবাস করেও এই শ্রেণীর মানুষ ধরে আনার ব্যাপারে বহু পরিকল্পনা করেছি আমি–এতে অবশ্য লজ্জার কিছু দেখি না।

সমস্ত সম্পদই চারভাগে ভাগ করা যায় ভূখণ্ড, স্বর্ণ, ক্রীতদাস এবং হাতির দাঁত। আমাদের ধারণা, সামনের ভূখণ্ড এই সমস্ত ধন-দৌলতে ভরপুর। শক্তিশালী হয়ে মিশরে ফিরে হিকসস্‌দের তাড়িয়ে দিতে পারলেও আবার এখানে ফিরে দুর্গম এই দেশ ঘুরে দেখা উচিত আমাদের।

নদীর ধারের পাহারের গুহায় স্বর্ণের খোঁজে লোক পাঠালেন রানি। খাড়া পাথুরে পথ বেয়ে উঠে, শুকনো ঝর্ণার তলায়, পাথরের খাজে স্বর্ণ খুঁজে ফিরলো তারা। তাদের সাথে গেলো রাজ-শিকারীর দল। এতো বড়ো একটা দলের আহারের জন্যে পর্যাপ্ত মাংস পেতে হলে শিকার প্রয়োজন। বিশাল দৈত্যাকার মাথায় মূল্যবান আইভরি বহনকারী সেই তামাটে রঙের প্রাণীর খোঁজও করলো তারা। জীবনে কখনো হাতি দেখেছে এমন লোকের খোঁজে পুরো নৌবাহিনী তন্নতন্ন করে ফেললাম আমি। যদিও সভ্য জগতে ওগুলোর দাঁত খুবই স্বাভাবিক বস্তু, কিন্তু জীবনে এমনকি নিহত হাতিও দেখেছে এমন লোক খুঁজে পেলাম না।

হাতি ছাড়াও আরো বহু প্রাণী রয়েছে এই ভূখণ্ডে। এর কিছু কিছুর সাথে আমাদের পরিচয় আছে, কিছুকিছু আবার একেবারেই নতুন।

নদীর তীরে যেখানেই নল-খাগড়া জন্মেছে, বিশাল গ্রানাইটের বোল্ডারের মতো স্থির শুয়ে আছে জলহস্তির দল। জলপ্রপাতের উপরের জলহস্তিও কী পবিত্র প্রাণী কি না, এই নিয়ে বেশ এক দফা তর্ক হয়ে গেলো আমাদের মধ্যে। হাপির মন্দিরের পুরোহিতদের মতে এরা দেবীর ভক্ত পবিত্র প্রাণী; অপরদিকে মাংস আর চর্বির লোভে প্রাণ আঁই-ডাই করতে থাকা আমরা অন্য দলে।

একেবারেই দৈবাৎ ঘটনা বলতে হয়, হঠাৎ দেবী আমার স্বপ্নে দেখা দিলেন। হাসিমুখে নদীবক্ষ থেকে উঠে এসে আমার কর্ত্রীর হাতে ছোট্ট আকারের একটা জলহস্তি তুলে দিতে দেখলাম আমি তাঁকে। সকালে উঠে আর দেরি না করে মিশরের শাসনকর্ত্রীর কাছে খুলে বললাম আমার স্বপ্নের কথা। আজকাল আমার স্বপ্ন-দর্শনের দারুন ভক্ত হয়ে গেছেন রানি।

সেই সন্ধায়, জাহাজ নোঙর করে, তীরে আগুন জ্বালিয়ে জলহস্তির ঝলসানো মাংস প্রাণভরে খেলাম আমরা সবাই। এহেন স্বপ্নের কারণে বাহিনীতে আমার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কোনো সীমা-পরিসীমা রইলো না। অবশ্য, স্বাভাবিক কারণেই হাপির পুরোহিতেরা সেই চোখে দেখলেন না আমাকে।

নদীর পানিতে মাছের কোনো অভাব নেই। জলপ্রপাতের নিচে আমাদের লোকেরা হাজার বছর ধরে মাছ ধরে আসছে। এই দিকের পানিতে কোনো মানুষের হাত বা মাছ-ধরা জাল পড়েনি। বিশাল বিশাল মাছ ধরলাম আমরা, এর এক একটির গোঁফ আমার বাহুর সমান লম্বা। এতে ওজন জাল ছিঁড়ে যেতে চায়। পানি থেকে উঠানোর পর বর্শা গেঁথে মারতে হলো ওগুলোকে ঠিক জলহস্তির মতোই। পঞ্চাশ মানুষ খাওয়ানো যায় এমন আকারের মাছ দিয়ে। আগুনের ধারে নিয়ে যাওয়ার সময় ঝরঝর করে চর্বি ঝরলো মাছের কাটা মাংস থেকে।

পানির উপরের পাথুরে ধারে বসবাস ঈগল আর শকুনের। সারাক্ষণ আমাদের জাহাজবহরের উপরে বৃত্তাকারে উড়ে চললো ওগুলো।

উঁচু পাথুরে পথে ভাবগম্ভীরতার সাথে আমাদের যাত্রা অবলোকন করলো পাহারী ছাগলের দল। ট্যানাস তার ধনুক নিয়ে শিকারে গিয়েছিলো, কিন্তু বহু সময় লাগলো একটা মাত্র পাহারী ছাগলের দেখা পেতে।

জীব-জন্তুর প্রতি আমার আগ্রহের কারণে পাহারী ছাগলের চামড়া ছাড়ানোর পর ওর শিং আর চামড়া আমাকে দিয়েছিলো ট্যানাস। মাথাটা পরিষ্কার করে, আমাদের গ্যালির মাস্তুলে টানিয়ে দিলাম ওটা। ওদিকে প্রতিদিনই অজানার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেছি আমরা।

*

মাসের পর মাস পেরিয়ে যেতে লাগলো। আমাদের জাহাজে খোলের তলায় নদীর পানি কমে গেলো শেষ হয়ে গেছে এই বছরের বন্যা। চারপাশের কঙ্কালসার পাহাড়ের গায়ে গতবছরের বন্যায় সৃষ্ট জলের উচ্চতা অনুযায়ী দাগ পরে আছে।

প্রতিরাতে মেমনন এবং আমি জাহাজের ভোলা পাটাতনে শুয়ে। আকাশের তারা পর্যবেক্ষণ করতাম–অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত না রাজপুত্রের মা তাকে ডেকে নেয়। এ রকমই এক দিন তারাদের গতিপথ পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম, এখন আর সরাসরি দক্ষিণে নিয়ে যাচ্ছে না আমাদের নদী। এই বিষয়টি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলো আমাদের পণ্ডিত আর বিজ্ঞজনদের মাঝে।

নদী আমাদের সরাসরি পশ্চিমের স্বর্গের মাঠে নিয়ে যাচ্ছে, মন্তব্য করলেন ওসিরিসের মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। এ হলো সেথএর চাল। আমাদের বিভ্রান্ত করাই তার লক্ষ্য। এবারে বললেন হাপির মন্দিরের পুরোহিত আমাদের বাহিনীতে ইতিমধ্যেই অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলেছেন উনি। নদীর এহেন গতিপথ পরিবর্তনে দারুন নাখোশ পুরোহিতবর্গ। খুব দ্রুতই আবার দক্ষিণে মোড় নেবে নদী। একবাক্যে উচ্চারণ করলো তারা। খুবই আশ্চর্য লাগে মাঝে-মধ্যে, নির্বোধ মানুষজন কী অবলীলায় নিজের আকাঙ্ক্ষাকে দেবতাদের উপর চাপিয়ে দিতে চায় ।

এই তর্ক-বিতর্ক যখন চলছে, দ্বিতীয় জলপ্রপাতে পৌঁছুলাম আমরা।

এই হলো সেই স্থান যেখান পর্যন্ত কোনো সভ্য মানুষের পা পড়েছে। এর পর আর কেউ অগ্রসর হতে পারেনি কখনো। জলপ্রপাতের প্রকৃতি পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম কেননা এখানে নৌ চালনা করা সম্ভব হয়নি।

বিশাল এলাকা জুড়ে নীলের জলধারা বিভক্ত হয়ে আছে বিশাল দ্বীপপুঞ্জ আর অপেক্ষাকৃত ছোটো পাথুরে কাঠামো দিয়ে। পানি একেবারেই অগভীর–এখানে সেখানে নদীর তলানি চোখে পড়ে। আমাদের সামনে যততদূর চোখ যায়, পাথুরে খণ্ডে পরিপূর্ণ খাল এঁকে বেঁকে এগিয়ে গেছে।

কেমন করে বুঝবো, এর পরেও আর কোনো জলপ্রপাত নেই; কিংবা তার পরে আরো একটা? অল্পতেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এমন কেউ মন্তব্য করলো। ক্রমশ শক্তি ক্ষয় করে শেষমেষ জলপ্রপাতের মধ্যখানে চিরদিনের জন্যে আঁকা পড়ে যাবো আমরা সামনে এগোনো যাবে; না পারবো পিছু হটতে। আরো দেরি হওয়ার আগেই ফিরে যাওয়া উচিত।

আমরা চলতে থাকবো, আদেশ জারী করলেন রানি। যারা থেকে যেতে চায় এখানে, থেকে যেতে পারে। কিন্তু কোনো জাহাজ বা ঘোড়া রেখে যাওয়া যাবে না । নিজের পায়ে হেঁটে ফিরতে হবে আমি নিশ্চিত, দারুন অভ্যর্থনা জানাবে হিকসস্‌ বাহিনী।

এমন একজনও পাওয়া গেলো না, যে থেকে যেতে চায়। পরিবর্তে, পায়ে হেঁটে আশে পাশের উর্বর দ্বীপে উঠলো তারা। দুই তীরের ভয়াবহ মরুর বিপরীতে বানের পানি আর পলিমাটির প্রভাবে ঘন সবুজ বনে পরিণত হয়েছে এক একটি দ্বীপ। পানিতে ভেসে আসা বীজ অনুকূল পরিবেশ পেয়ে বেড়ে উঠেছে লকলক করে; এতো লম্বা গাছ আমরা জীবনেও দেখিনি। দ্বীপের গ্রানাইটের ভিত্তির উপর মাতা নীলের পলিমাটিতে জন্মেছে সেই বৃক্ষ।

পরবর্তী বন্যার আগে এই খাড়া জলপ্রপাত পেরুনো সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। বহুমাস বাকি বন্যা আসতে।

দ্বীপে পৌঁছে সাথে করে নিয়ে আসা বীজ বপন করতে লাগলো আমাদের কৃষকেরা। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই চারাগাছ গজালো বীজ থেকে। কয়েক মাসের মধ্যেই ফসল তোলার সময় এসে গেলো ধুররা শস্যের মিষ্টি ফলমূল আরা তাজা শাক-সজি দিয়ে প্রাণভরে আহার করতে পারলাম আমরা, যা এতোকাল মিশরে পাইনি। যা কিছু অস্বস্তি ছিলো আমাদের লোকেদের মনে, উবে গেলো সেটা।

মূলত, এতো আকর্ষণীয় আর উর্বর ছিলো সেই দ্বীপ, অনেকেই এখানে পাকাপাকিভাবে থেকে যাওয়ার কথা বলাবলি করতে লাগলো। আমন রার পুরোহিতেরা রানির কাছে আর্জি নিয়ে গেলো, এখানে দেবতাদের জন্যে একটা মন্দির নির্মাণ করতে চায় তারা। উত্তরে আমার কর্ত্রী বলেছিলো, আমরা কেবল অভিযাত্রী হিসেবে এসেছি এখানে। মিশরে ফিরে যাবো আমরা। এ আমার প্রতিজ্ঞা। কাজেই, স্থায়ী কোনো স্থাপনা বা মন্দির আমরা নির্মাণ করবো না। যতোদিন না মিশরে ফিরছি, যাযাবর বেদুঈরের মতোই তবু বা কুঁড়েতে বসবাস করবে মিশরীয়রা।

*

এখন আমার হাতে দ্বীপে পরে থাকা গাছের কাঠ আছে, যা দিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারি।

একাশিয়া গাছের কাণ্ড অত্যন্ত ঘাতসহ এবং শক্তিশালী। আমার রথের জন্যে সেরা কাঠ দিয়ে চাকার স্পোক তৈরি করলাম

এখানে। দ্বীপে জন্মানো গাছ আর বাঁশের সহায়তায় নতুন করে সমস্ত রথ তৈরির জন্যে লাগিয়ে দিলাম মিস্ত্রিদের। কিছু দিনের মধ্যেই বিশাল সমভূমিতে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে চলাচল শুরু করলো নতুন রথ। এখনো, খুব বেশি দ্রুত চললে চাকা ভেঙ্গে যায়, কিন্তু আগের মতো ঘন ঘন হয় না ব্যাপারটা। এক পর্যায়ে এসে জোর করে রথের পাদানীতে উঠতে বাধ্য করলাম ট্যানাসকে।

একই সময়ে গাছের কাণ্ড দিয়ে প্রথম প্রান্ত-বাকানো ধনুক তৈরি শেষ করলাম আমি। গজ-দ্বীপ থেকেই ওটা নিয়ে কাজ করছিলাম। লানাটার মতো সেই একই বস্তু দিয়েই তৈরি এটা, কিন্তু আকৃতিতে ভিন্ন। আমার অনুরোধে পুব তীরে সার বেঁধে দাঁড় করানো নিশানার উপর নতুন ধনুক পরখ করে দেখতে রাজী হলো ট্যানাস। বিশটি তীর ছোঁড়ার পর ও মুখে কিছু না বললেও, আমি নিশ্চিত, এর পাল্লা আর নিখুঁত নিশানাভেদে চমকে গেছিলো সে। ট্যানাসকে হাড়ে হাড়ে চিনি আমি। সব সময়ই অত্যন্ত রক্ষণশীল মানুষ ও। লানাটা ছিলো তার প্রথম ভালোবাসালসট্রিসের মতোই। কাজেই নতুন কিছু গ্রহণ করতে একটু সময় লাগবে ওর। চাপ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি।

এসময়ই প্রহরীরা ঘোষণা করলো, মরুর দিক থেকে ওরিক্সের পাল আসছে। প্রথম জলপ্রপাত অতিক্রমের পর এই অসাধারণ প্রাণীর ছোটো কয়েকটি পাল আমাদের চোখে পড়েছে। জাহাজ দেখলেই দৌড়ে মরুতে ফিরে যেতো তারা। যখন প্রহরীরা জানালো দলে দলে ফিরে আসছে ওরিক্সের দল; চিন্তিত হয়ে পড়লাম আমি। এ আমি আগেও দেখেছি। সাধারণত কোনো বজ্রপাতসই মরুঝড়, যা বিশ বছরে একবার হয়, এমন ঘটার পূর্বাভাস পেলে পালে পালে মরু থেকে পালিয়ে আসে জীবজন্তু।

সজীব দ্বীপের মাটিতে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই চড়ে বেড়াতে লাগলো বিশাল ওরিক্সের পাল। কাজেই, শিকার এবং রথ-চালানোর অজুহাত পেয়ে গেলাম আমরা।

প্রথমবারের মতো আমার রথে আগ্রহ দেখালো ট্যানাস। কেননা, পায়ে হেঁটে এতো দ্রুতগামী প্রাণী শিকারের আশা বৃথা। রথের পাদানীতে, আমার পাশে যখন শেষমেষ চড়লো সে; লক্ষ্য করলাম, লানাটা নয়, ওর কাঁধে ঝুলছে নতুন প্রান্ত বাঁকানো ধনুক। কিছুমাত্র না বলে রথ চালানোয় মন দিলাম আমি।

বাহিনীতে এখন পঞ্চাশটি রথ, ভারী চাকার মালামাল বহনকারী আরো কিছু বাহন রয়েছে। দুই সারিতে এগুলাম আমরা সামনে থাকলে দুটি করে রথ। কিছুপথ এগুতেই সামনের পাথর খণ্ডের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো ছোট্ট একটা অবয়ব।

হোয়া! ঘোড়াগুলোর লাগাম টেনে ধরলাম আমি। জাহাজ থেকে এতোদূরে কী করছো তুমি?

গত সন্ধ্যার পর আর দেখিনি রাজপুত্রকে, ভেবেছিলাম হয়তো পরিচারিকাদের কাছে নিরাপদে আছে। এখানে, এই উন্মুক্ত ময়দানে ওর দেখা পেয়ে দারুন হকচকিয়ে গেছি। রাগে কর্কশ শোনালো গলা। তখন ছয় বছরও হয়নি মেমননের বয়স, কাঁধে খেলনা ধনুক ফেলে ঠিক বাপের মতোই একরোখা চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে সে।

আমি তোমাদের সাথে শিকারে যাচ্ছি, ঘোষণা করলো মেমনন।

না, মোটেও তা নয়, আমি বললাম কঠোর চেহারায়। এই মুহূর্তে মায়ের কাছে ফেরত পাঠাচ্ছি তোমাকে। যে সব ছোট্ট বাচ্চা পালিয়ে বাইরে চলে আসে, তাদের উপযুক্ত সাজা ওর জানা আছে।

আমি মিশরের রাজপুত্র, একরোখা ভঙ্গিতে বললো মেমনন। ঠোঁট কাঁপছে তার। কেউ আমাকে নিষেধ করতে পারে না। প্রয়োজনের সময় আমার লোকেদের সঙ্গে থাকবো আমি।

বিপদজনক দিকে মোড় নিয়েছে কথা-বার্তা। রাজপুত্র তার অধিকার-সম্মানের প্রসঙ্গে জানে; আমি নিজেই তাকে শিক্ষা দিয়েছি। কিন্তু এতো দ্রুত এ বিষয়ে কথা বোলবে ও–ভাবিনি। মরিয়া হয়ে একটা কিছু বলতে চাইলাম।

আগে আমাকে বলো নি কেননা, শিকারে আসতে চাও?

কারণ, বললেই মায়ের কাছে নিয়ে যেতে তুমি, সরল সতোর সাথে বললো রাজকুমার । আর, উনি তোমার কথায় সায় দিতেন, যেমন সবসময় দেন।

আমি তো এখনো রানির কাছে যেতে পারি, হুমকির স্বরে বললাম। পিছু ফিরে, দূরে খেলনার মতো আকৃতির জাহাজগুলোর দিকে তাকালো মেমনন। আমার মতো সেও জানে, এতোদূর পথ আবার ফিরতে হলে অনেক সময় অপচয় হবে।

দয়া করো আমাকে সঙ্গে নাও, টাটা, গলার সুর পাল্টে ফেলে বললো ছোট্ট রাজকুমার। তখনি, একটা ফাঁক পেয়ে গেলাম আমি। লর্ড হেরাব হলেন এই অভিযানের নেতা। তার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে তোমাকে।

রাজপুত্র নিজের পিতাকে জানতো তার শিক্ষক আর সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে। যদিও ট্যানাসকে ভালোবাসতো সে, ভয়ও পেতে কিছুটা।

পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইরো বাপ-ব্যাটা। হাসি চেপে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে ট্যানাস টের পেলাম ।

লর্ড হেরাব, আনুষ্ঠানিক ভঙ্গিতে অনুমতি প্রার্থনা করলো রাজপুত্র। আমি আপনার সাথে শিকার অভিযানে আসতে চাই। আমি মনে করি, আমার জন্যে দারুন একটা অভিজ্ঞতা হবে সেটা। যাই হোক, একদিন তো আমাকেই এই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিতে হবে! ঠিক আমার দেওয়া শিক্ষা মোতাবেক যুক্তি দিয়ে কথা বলতে শিখে গেছে সে।

রাজকুমার মেমনন আপনি কি আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন? হাসি চেপে রেখে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো ট্যানাস। মেমননের চোখে অশ্রু টলমল করছে।

করুণ চেহারায় মাথা এপাশ-ওপাশ নাড়লো সে। না, মাই লর্ড। শিকারে যেতে আমার খুবই ভালো লাগবে।

রানি আমাকে ফাঁসিতে চড়াবেন এ জন্যে, ট্যানাস বলে। যা হোক, এখানে, আমার সামনে এসে বসো।

এক হাত বাড়িয়ে দিতে, লাফ দিয়ে ট্যানাসের পাশে রথের পাদানীতে চড়লো মেম।

চলো! ধৈৰ্য্য আর ফলার উদ্দেশ্যে চেঁচালো সে। একজন বার্তাবাহককে দিয়ে রাজকুমারের খবর জাহাজে পাঠিয়ে তবেই রওনা হলাম আমরা। সবুজ বিশাল বিস্তৃতির উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললাম। সামনে শিকারী রথ পেছনে ভারী ওয়াগন-টানা রথ।

দূরের পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে ওরিক্সের পাল। দশ বা একশটির মতো রয়েছে এক একটি দলে; আবার বুড়ো মদ্দাগুলো একা একা ঘুরে ফিরছে। কোনো কোনো পালে কতটি ওরিক্স আছে–তা গুনে শেষ করার নয়। সমভূমির উপর মেঘের ছায়ার মতো লাগছে প্রাণীগুলোকে। মনে হলো, আফ্রিকার সমস্ত ওরিক্স যেনো জড়ো হয়েছে এখানে।

দিগন্তে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। সামান্য কৌতূহল নিয়ে মাথা উঁচিয়ে আমাদের দেখলো কাছের প্রাণীগুলো। সম্ভবত আগে কখনো মানুষ দেখিনি এরা, কাজেই কোনো বিপদ আশা করছে না আমাদের থেকে। অতপর : রথ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা ওরিক্সের পালের অভ্যন্তরে। জম্ভগুলোর খুঁড়ের ঘায়ে পাক খেয়ে উঠলো ধোঁয়ার মেঘ। একের পর এক লুটিয়ে পড়তে লাগলো প্রাণীগুলো, চলন্ত রথ থেকে ছোঁড়া তীরের আঘাতে।

অবশেষে যখন যথেষ্ট পরিমাণ মাংস সগ্রহ নিশ্চিত হলো, রথ থেকে নিচে নেমে গুনে দেখলাম আমি। তখনো মৃত্যু-যন্ত্রণায় পা ছুঁড়ছিলো কিছু ওরিক্স। রথে ফিরে এসে রাজপুত্রের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখলাম কান্নায় ভেজা তার চোখ, ওরিক্সের খুঁড়ের ঘায়ে ছুটে আসা মাটির ঢেলায় লেগে কেটে গেছে কপাল; অসহায় প্রাণীগুলোর প্রতি দরদ উথলে উঠছে চেহারায়। আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো সে, যেনো চোখের পানি দেখতে না পাই। গর্ববোধ করলাম ওর জন্যে। একজন সত্যিকারের শিকারীর অবশ্যই তার শিকারের জন্যে মায়া থাকবে।

কোঁকড়া-চুলে ভরা মাথাটা আমার দিকে ঘুরিয়ে খুব আলতো করে পরিষ্কার করলাম রাজপুত্রের মাথার ক্ষতটা। এক ফালি লিনেন দিয়ে বেঁধে দিলাম ।

সেই রাতে ফুলের ঝাড়ের ধারে ক্যাম্প ফেললাম আমরা। তাজা রক্তের গন্ধ ছাপিয়ে রাতের বাতাসে মৌ মৌ করলো বুনো ফুলের সুবাস।

চাঁদ ছিলো না আকাশে। কিন্তু অসংখ্য তারা ভরে রেখেছে পুরো আকাশ। স্নান রুপালী আভায় স্নান করছে দিগন্তের পাহারশ্রেণী। আগুনের ধারে বসে ওরিক্সের ঝলসানো কলিজা আর হৃদপিণ্ড খেলাম তৃপ্তি সহকারে। প্রথমটায় আমার আর ট্যানাসের মাঝে বসেছিলো মেমনন, কিছু সময়ের মধেই যোদ্ধারা তার মনোযোগ জয় করে নিলো। ধীরে ধীরে সহজ হয়ে উঠলো রাজপুত্র, নির্ভয়ে এক দল থেকে অপর দলের যোদ্ধাদের মধ্যে ঘুরে ফিরতে লাগলো সে।

কপালের পট্টি দেখে দারুন মুগ্ধ সৈনিকেরা। তুমি এখন থেকে সাচ্চা সৈনিক, ওরা বললো রাজপুত্রকে। ঠিক আমাদের মতো। নিজেদের দেহের বিভিন্ন ক্ষত মেমননকে একে একে দেখাতে লাগলো তারা।

ওকে শিকারে আসতে দিয়ে সঠিক কাজটাই করেছো, ট্যানাসকে উদ্দেশ্যে করে বললাম। এর চেয়ে ভালো প্রশিক্ষণ আর কিছু হতে পারে না।

হুমম। সৈনিকেরা এখনই ভালোবেসে ফেলেছে ওকে। একমত হলো ট্যানাস। একজন সমরনায়কের দুটো জিনিস চাই–এক, ভাগ্যের সহায়তা, অপরটি হোলো নিজের বাহিনীর সদস্যদের আনুগত্য।

খুব বেশি বিপদের আশঙ্কা না থাকলে মেমননকে আগামী সমস্ত অভিযানে নিয়ে যাওয়া উচিত। আমার এই কথায় ট্যানাস হাসে।

ওর মাকে তুমি বোঝাবে তাহলে! ওটা আমার ক্ষমতার বাইরে।

ওদিকে, আগুনের অপর পাশে বসে নীল বাহিনীর রণ-সংগীত শেখাচ্ছে ক্ৰাতাস, মেমননকে। মিষ্টি, পরিষ্কার গলা ওর হাত তালি দিয়ে ঐকতানে গাইতে লাগলো যোদ্ধারা। রথে তৈরি করা অস্থায়ী বিছানায় শোয়ানোর জন্যে যখন নিয়ে যেতে চাইলাম ওকে; যোদ্ধারা তো বটেই, এমনকি ট্যানাস পর্যন্ত আপত্তি জানালো।

আরো কিছুক্ষণ থাকুক বাচ্চাটা, তার নির্দেশে মধ্যরাতের পরও অনেক সময় পর্যন্ত আগুনের ধারে রইলো মেমনন। অবশেষে, ওকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে ভেড়ার পশমের চাদরে ঢেকে দিলাম আমি।

টাটা, লর্ড ট্যানাসের মতো কখনো তীর ছুঁড়তে পারবো আমি? ঘুম জড়ানো স্বরে জানতে চায় রাজপুত্র।

আমাদের এই মিশরের শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক হবে তুমি। একদিন তোমার সমস্ত কীর্তি পাথরে খোদাই করে লিখে রাখবো আমি পৃথিবীর সবাই যেনো জানতে পারে।

কিছু সময় এ নিয়ে চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেম। কোন্ দিন একটা সত্যিকারের ধনুক তৈরি করে দেবে আমার জন্যে?

যেদিন তুমি ওটা টানতে পারবে, প্রতিজ্ঞা করলাম আমি।

ধন্যবাদ, টাটা। ওটা যেনো আমার পছন্দ মতো হয়, বলে দিলাম। এরপর সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লো মেম।

*

ওয়াগন ভর্তি ওরিক্সের লবণ-দেওয়া শুকনো মাংস নিয়ে উল্লাসের সাথে জাহাজের কাছে ফিরে এলাম আমরা। রাজপুত্রকে শিকারে নিয়ে যাওয়ায় আমার কপালে বিস্তর গাল-বকুনি আছে–এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমিও অবশ্য তৈরি। সমস্ত দোষ ট্যানাসের চওড়া কাঁধে চাপিয়ে দেবো এ যাত্রা।

কিন্তু, স্বাভাবিকের চেয়ে সংযত আচরণ করলো লসট্রিস। মেমননকে একটু বকুনি দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলো অনেকক্ষণ। আমার দিকে ফিরতেই, সাথে সাথে লম্বা এক গল্প ফেঁদে বসলামস্ট্যানাসের কী ভূমিকা ছিলো এখানে, এই অভিযানের ফলে প্রশিক্ষণে কী কী সুবিধা হলো রাজকুমারের ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু লসট্রিস মনে হয় ভুলেই গেছে ও কথা।

শেষ কবে তুমি আর আমি মাছ ধরতে গিয়েছিলাম, টাইটা? জানতে চাইলো আমার কী। যাও, মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে এসো। ছোটো একটা নৌকা নেবো আমরা শুধু আমি আর তুমি। সেই পুরোনো দিনের মতো নদীতে মাছ ধরবো আজ দু জনে মিলে।

বিলক্ষণ জানা আছে, মাছ ধরা না ছাই। মূলত আমার কাছে নিভৃতে কিছু একটা বলতে চায় সে; আর কেউ শুনে ফেলার ভয় নেই এমন কোথাও। নিঃসন্দেহে, বড়ো রকমের গণ্ডগোল হয়েছে একটা।

শুকনো নদীর স্থির সবুজ পানিতে দাঁড় বেয়ে চললাম আমি যতক্ষণ পর্যন্ত না বাকের আড়ালে হারিয়ে গেলো আমাদের জাহাজ-বহর। কোনো কথা বলছে না মিসট্রেস। অগত্যা বাঁশি তুলে নিলাম হাতে। লসট্রিসের অত্যন্ত প্রিয় কয়েকটি গানের সুর বাজিয়ে শোনালাম। ওর মুখ খোলার অপেক্ষায় আছি।

শেষমেষ যখন আমার পানে তাকালো ও, দেখলাম, উদ্বেগ আর আনন্দের মিশ্র অনুভূতি খেলা করছে দু চোখে।

টাইটা, আমার মনে হয় আমি আবারো মা হতে যাচ্ছি।

এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। গজ-দ্বীপ ছাড়ার পর থেকে প্রতিরাতে নিজের শয্যা প্রকোষ্ঠে গোপন প্রণয়ে লিপ্ত হতো লসট্রিস; তার সেনাপ্রধানের সঙ্গে। আমি, টাইটা, ছিলাম প্রহরীর ভূমিকায়। কিন্তু এতোটাই ভয় পেলাম, বাঁশি-ধরা হাতটা যেনো জায়গায় জমে গেলো আমার। গান আটকে গেছে গলায়।

মাই লেডি, লতাগুলোর যে মিশ্রণ দিয়েছিলাম তোমাকে, ওগুলো খেয়েছো ঠিকমতো? সতর্কভঙ্গিতে জানতে চাইলাম।

মাঝে-মধ্যে খেয়েছি; আবার কখনো কখনো বাদ পড়েছে। লাজুক হাসলো মিসট্রেস। ট্যানাস খুবই অধৈৰ্য্য মানুষ। একদম অপেক্ষা করতে পারে না। ওসব খাওয়ার চেয়ে জরুরি কাজ পরে থাকে ওর জন্যে সব সময়।

যেমন- রাজ-পিতা ছাড়া সন্তান উৎপাদন?

খুব জটিল সমস্যা–তাই না?

মনের মধ্যে উত্তর তৈরি করতে করতে একটা সুর ধরলাম। জটিল সমস্যা? আমার মনে হয়, এতে করে কিছুই প্রকাশ হয় না। যদি একটা জারজ সন্তান জন্ম দাও তুমি, অথবা, কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করো এখন, মিশরের শাসনক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হবে। ওটাই নিয়ম। লর্ড মারসেকেট থাকবেন শাসনকর্তা হওয়ার তালিকায় এক নম্বরে; তবে এই নিয়ে বিরাট একটা বিশৃঙ্খলা হওয়ার আশঙ্কা আছে। শাসনক্ষমতা ছেড়ে দিলে সবচেয়ে বঞ্চিত হবে রাজকুমার। আর আমাদের মিশর কেঁপে উঠে থেমে গেলাম আমি।

আমার বদলে ট্যানাস শাসন করতে পারে; আর সেক্ষেত্রে আমি ওকে বিয়ে করতে পারি, উজ্জ্বল মুখে জানালো লসট্রিস।

মনে করো না, ওটা নিয়ে ভাবিনি আমি, শক্তভাবে বললাম ওকে। এতে করে আমাদের সবার সমস্যার সমাধান হতে পারে। কিন্তু ট্যানাস কি মানবে?

আমি অনুরোধ কোরলে, হাসিমুখে মেনে নেবে ট্যানাস আমি নিশ্চিত, স্বস্তির সাথে বললো মিসট্রেস। আমি ওর স্ত্রী হবো। একসাথে থাকার জন্যে এভাবে আর লুকোচুরি খেলতে হবে না আমাদের।

ও রকম হলে ভালোই হতো। কিন্তু কখনো এটা মানবে না ট্যানাস। ও—

রাগে জ্বলে উঠলো মিশরের রানি। এর মানে কী? কেননা মেনে নেবে না সে?

সেই রাতে, যখন দেশদ্রোহিতার অভিযোগে ওকে আটক করার জন্যে সৈনিক পাঠিয়েছিলেন ফারাও, আমি ওকে ক্ষমতা দখলের জন্যে চাপ দিয়েছিলাম। কাতাস এবং তার যোদ্ধারা তাদের আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলো তখন। প্রাসাদে গিয়ে ট্যানাসকে সিংহাসনে বসাতে প্রস্তুত ছিলো তারা।

তাদের কথা শুনলো কেননা ট্যানাস তখন? অসাধারণ একজন রাজা হতে পারতো সে; আমরাও অনেক সমস্যার হাত থেকে বেঁচে যেতাম!

ট্যানাস তার যোদ্ধাদের ভৎর্সনা করেছিলো সেই রাতে। ঘোষণা করেছিলো, সে বিশ্বাসঘাতক নয়, মিশরের সিংহাসনে তার কোনো অধিকার নেই।

সে তো অনেক আগের কথা। এখন অনেক কিছু পাল্টেছে, মরিয়া হয়ে বলে উঠলো আমার কর্ত্রী।

না, কিছুই পাল্টে নি। সেদিন হোরাসকে সাক্ষী রেখে শপথ করেছিলো ট্যানাস। ও শপথ করেছিলো, কোনোদিনও মিশরের মুকুট কেড়ে নেবে না।

কিন্তু এখন ওই শপথের কোনো মূল্য নেই। ওটা ধরে বসে থাকতে পারে না সে।

হোরাসের শপথ কেটে ভঙ্গ করতে পারবে তুমি? জানতে চাইলাম। হতাশায় কাঁধ ঝুলে পড়লো লসট্রিসের।

না, ফিসফিস করে বললো ও, পারবো না।

ওখানেই বাঁধা পড়েছে ট্যানাস। যা তুমি নিজে করতে পারবে না, ওকে অনুরোধ করার কোনো মানে হয় না। জানোই তো, এ সম্ভব নয় ওর দ্বারা।

কিছু সময় চুপ থাকলো লসট্রিস। অবশেষে কথা বলে উঠলো সে, আমি নিজে বরঞ্চ মরে যাবো, কিন্তু কিছুতেই যে সৃষ্টি ট্যানাস আমার গর্ভে দিয়ে গেছে, তা নষ্ট করতে পারবো না। পেটের এই শিশু ওর আর আমার ভালোবাসার চিহ্ন কখনোই নষ্ট করবো না আমি।

সেক্ষেত্রে, আমার কিছুই করার নেই, ম্যাজেস্টি।

পরি পুর্ণ আস্থা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমার উদ্দেশ্যে হাসলো এবারে লসট্রিস। গা শিরশির করে উঠলো আমার, মনে হলো, যেনো শ্বাস নিতে পারছি না। আমি নিশ্চিত সব সময়ের মতো এবারেও কোনো না কোনো উপায় খুঁজে বের করবে তুমি, টাইটা।

কাজেই, একটা স্বপ্ন দেখলাম আমি।

*

আমাদের এই মিশরের সমস্ত রাজকীয় সভাষদের উপস্থিতিতে সেই স্বপ্নের বৃত্তান্ত বর্ণনা করলাম।

হোরাসের প্রশ্বাসের চালকের প্রকোষ্ঠে উঁচু স্থানে সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলো আমার কর্ত্রী, কোলে মেমননকে নিয়ে। নীল নদের

পশ্চিম তীরে নোঙর করা আছে জাহাজ। তীরের বেলাভূমিতে, রানির নিচে সমবেত সমস্ত অভিযাত্রী।

লর্ড মারসেকেট এবং অন্যান্য মহৎপ্রাণেরা রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে রইলেন। আমন রা এবং ওসিরিসের পুরোহিতেরা থাকলেন ধর্মীয় প্রতিনিধি হিসেবে। লর্ড হেরাব, তাঁর পঞ্চাশ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রইলো সামরিক প্রতিনিধিত্বকারী।

সিংহাসনের নিচে, খোলা পাটাতনে দাঁড়িয়ে জনতার মুখোমুখি হলাম আমি। আজকের দিনের জন্যে বেশ সাজ-গোজ করেছি। পরনে পরিপাটি পোশাক।

সম্মানিত সভাষদ, শুরু করলাম। আমার উদ্দেশ্যে এক গাল হাসলো মেমনন। এখনো ওর কপালে সেই পড়ি আছে। আমার ভ্রুকুটির সামনে দ্রুতই আরো একটু ভাবগম্ভীর হাবভাব ধরলো রাজকুমার।

সম্মানিত সভাষদ, গত রাতে এতো অদ্ভুত আর অসাধারণ স্বপ্ন দেখেছি, যা আপনাদের না বর্ণনা কোরলে দায়িত্বে অবহেলা করা হবে। আপনাদের অনুমতি পেলে শুরু করতে পারি।

উৎফুল্ল চিত্তে প্রত্যুত্তর করলেন রানি। আমাদের সবারই জানা আছে, অসাধারণ ঐন্দ্রজালিক শক্তির অধিকারী তুমি। ভবিষ্যতে উঁকি দেওয়ার ক্ষমতা আছে তোমার–এ তো আমার জানা। স্বপ্ন আর ভবিষ্যতের কথা দেখার মাধ্যমে দেব-দেবীদের অভিপ্রায় জেনে ফেলেছো এর আগেও । তোমার উপর পূর্ণ বিশ্বাস আছে আমার এবং রাজপুত্রের। বলো, কী রহস্য খোলার আছে তোমার?

মাথা ঝুঁকিয়ে, সভাষদের উদ্দেশ্যে আবারো ফিরলাম আমি।

গত রাতে, রাজকীয় কক্ষের দরোজায় প্রহরীর দায়িত্ব পালন করছিলাম। বিছানায় একাই শুয়েছিলেন রানি লসট্রিস; পাশের ছোট্ট বিছানায় রাজকুমার।

এমনকি, লর্ড মারসেকেট পর্যন্ত সামনে ঝুঁকে এলেন; চমৎকার গল্পের সূচনা টের পেয়ে গেছে সবাই।

রাতের তৃতীয় প্রহরে জেগে গেলাম আমি, সমগ্র জাহাজে এক অদ্ভুত আলো জ্বলছিলো। যদিও সমস্ত দরোজা আর ফাঁক-ফোকড় বন্ধ ছিলো, আমি অনুভব করলাম ঠাণ্ডা বাতাস ঝাঁপটা মারছে মুখে।

উৎসাহে নড়ে চড়ে বসলো শ্রোতারা। বুঝলাম, সঠিক ভূতুড়ে আবহ তৈরি হয়েছে।

এরপর, খোলা পাটাতনে পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম ধীর, রাজকীয় পায়ে যেনো হেঁটে আসছে কোনো মানুষ। চারিদিকে সেই শব্দেরই প্রতিধ্বনি। নাটকীয় ভঙ্গিতে বিরতি দিলাম কথায়। সেই অপার্থিব পদ-শব্দ আসছিলো জাহাজের ভাড়ার থেকে।

আবারো, থেমে পড়ে সবাইকে গল্প গলাধঃকরণের সুযোগ করে দিলাম।

হাঁ, প্রিয় সভাষদ; সেই শব্দ ভেসে আসছিলো জাহাজের ভাঁড়ারে রাখা স্বর্ণের কফিন থেকে, যেখানে শায়িত আছেন ফারাও মামোস–ওই নামধারী অষ্টম ফারাও।

শ্রোতাদের মধ্যে কেউ কেউ শিউড়ে উঠলো, বাকিরা শয়তানের বিপরীতে চিহ্ন আঁকলো বুকে।

তারপর সেই পদশব্দ রানির শয্যাপ্রকোষ্ঠের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো, যার দরোজার কাছেই ঘুমিয়েছিলাম আমি। হঠাৎ সেই পবিত্র আলো যেনো আরো তীব্র হলো, ভয়ে কাঁপছি আমি; এমন সময় আমার সম্মুখে কারো অবয়ব দেখতে পেলাম। একজন মানুষের অবয়ব কিন্তু মানুষ নয়, কোনো মানুষের শরীর এমন পূর্ণিমার চাঁদের মতো জ্যোতি বিলোয় না; তার মুখমণ্ডল আমার চিরপরিচিত ফারাও মামোসের–দেবত্বের পবিত্রতায় উদ্ভাসিত।

নীরবতা নেমে এসেছে শ্রোতাদের মাঝে। একজন মানুষও নড়ছে না। উদ্বিগ্ন চোখে তাদের চেহারায় অবিশ্বাসের চিহ্ন খুঁজলাম আমি পেলাম না।

তখনই চিৎকার করে উঠে নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দিলো একটা কাঁচা কণ্ঠস্বর-রাজপুত্র মেমননের কণ্ঠ সেটা। বা কার! এ যে আমার পিতা! বা কার! উনি ছিলেন ফারাও স্বয়ং!

সেই চিত্তার ঠোঁটে তুলে নেয় হাজারো জনতা। বা কার! ফারাও স্বয়ং এসেছিলেন। তিনি চিরজীবি হোন!

নীরবতা নামার অপেক্ষায় রইলাম আমি; অবশেষে জনতার শোরগোল স্তিমিত হতে আবারো মুখ খুললাম।

আমার উদ্দেশ্যে হেঁটে এলেন ফারাও, নড়তেও যেনো ভুলে গেছিলাম আমি। আমাকে অতিক্রম করে, তার পবিত্র স্ত্রী, রানি লসট্রিসের শয্যাকক্ষে প্রবেশ করলেন তিনি। নড়তে-চড়তে ভুলে গেলেও যা ঘটছিলো, সবই দেখেছি আমি। ঘুমন্ত রানির উপর রাজকীয় ভঙ্গিমায় চড়লেন ফারাও; স্বামী হিসেবে তার পবিত্র প্রেমলীলা সম্পন্ন করলেন। ভালোবাসায় মত্ত হলো তাদের রাজকীয় দেহ–যেনো এক হয়ে গেলো।

এখনো, কারো মুখে একটুও অবিশ্বাসের চিহ্ন নেই। আমার কথার সম্পূর্ণ অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে দিতে আরো কিছু সময় চুপ থাকলাম, এরপর বলে চললাম, ঘুমন্ত রানির বুকের মধ্য থেকে উঠে এলেন ফারাও অবশেষে; তারপর আমার উদ্দেশ্যে বললেন–

যে কারো কণ্ঠস্বর এতো চমৎকারভাবে নকল করতে পারি আমি, অনেকেই ভয় পায়। এখন আমার কণ্ঠ আর আমার নয়, স্বয়ং স্বর্গত ফারাও মামোসের।

আমার দেবত্বের বীজ বপন করে গেলাম রানির অভ্যন্তরে। আমারই মতো এখন থেকে দেবত্ব লাভ করলো সে। আমি ছাড়া আর কারো নয় সে, চিরকাল আমারই থাকবে। রাজকীয় রক্তের সন্তান আবারো পেটে ধারণ করবে রানি। এতদ্বারা সমস্ত পুরুষ জেনে রাখুক, আমার ছায়া তাকে প্রহরা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।

সিংহাসনে উপবিষ্ট রাজ-জোড়ার উদ্দেশ্যে মাথা ঝোকালাম আমি। এরপর, আবারো জাহাজের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলে গেলেন রাজা, স্বর্ণের সেই কফিনে ঢুকে পড়লেন ধীরে । বিশ্রাম প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো তার। এ-ই ছিলো আমার স্বপ্ন।

ফারাও চিরজীবি হোন! আমার শেখানো মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠলো ট্যানাস, সাথে সাথেই জনতা চিৎকার করে উঠে।

জয় হোক রানি লসট্রিসের। তিনি চিরকাল বেঁচে থাকুন! জয় হোক সেই পবিত্র শিশুর, যাকে তিনি পেটে ধারণ করে আছেন! তার সব সন্তান চিরজীবি হোক!

সেই রাতে যখন ঘুমোনোর তোরজোর করছিলাম, আমাকে ডেকে পাঠালো মিসট্রেস। এতো নিখুঁত ছিলো তোমার স্বপ্ন, আর এতো সুন্দর করে বলেছো ফারাও এসে পড়েন এই ভয়ে রাতে আমার ঘুম হবে না! ভালো করে দরোজা পাহারা দাও। ফিসফিস করে বললো লসট্রিস।

একটা কথা বলতে পারি, এমন একজন একরোখা ব্যক্তি আছে, যে তোমার রাতের শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, তবে সে ফারাও মামোস নয়–এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ। যদি কোনো মূর্খ বীর তোমার কোমল আর দয়ালু স্বভারে সুযোগ নিতে চায়, কী করা উচিত আমার?

খুব করে ঘুমাবে তখন, প্রিয় টাইটা, আর কান বন্ধ রেখো। প্রদীপের আলোতেও লক্ষ্য করলাম, লজ্জায় লাল হয়ে গেছে লসট্রিসের গাল।

সত্যিই, রাতের ঘটনাবলি সম্পর্কে আমার পূর্বানুমাণ সঠিক প্রমাণিত হলো। সেই রাতে আমার কর্ত্রীর শয্যাপ্রকোষ্ঠে একজন দর্শনার্থী এসেছিলো বটে, তবে সেটা ফারাও

মামোসের ভূত নয়। রানির নির্দেশ মতোই কাজ করেছিলাম আমি তখন, কান বন্ধ রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

*

আবারো বান ডাকলো নীল নদে, আমাদের মনে করিয়ে দিলো এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে দেশ ছেড়েছি। সমভূমিতে কৃষকদের বপন করা শস্যের ফসল ঘরে তোলার সময় হয়ে গেছে। রথ-ভেঙে ঘোড়াগুলোকে জড়ো করলাম সবাই মিলে। তারপর তাঁবুর ভেতর জমা করে রাখলাম শস্য। প্রস্তুতি সম্পন্ন হতে, দড়ি-টানা লোক থাকলো বেলাভূমিতে; ঘোড়া আর মানুষের সম্মিলিত পরিশ্রমে আবারো শুরু হলো জলপ্রপাত অতিক্রমের কাজ।

এক মাসের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম শেষে সেই ভয়ঙ্কর জলপ্রপাত অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিলাম আমরা। মোলোজন মানুষ ডুবে মরেছিলো, পাঁচটি গ্যালি হারিয়েছিলাম। শেষমেষ, জলপ্রপাত পেরিয়ে উপরের শান্ত জলরাশির উপর দিয়ে তরতর করে ভেসে চললো গ্যালি বহর।

সপ্তাহ, মাস পেরিয়ে যেতে লাগলো, আমাদের জাহাজের খোলের তলায় ধীরে বাঁক নিতে শুরু করেছে নীল নদ। গজ-দ্বীপ ছাড়ার পর থেকেই নদীর গতিপথ লিখে রাখছিলাম আমি। সূর্য আর তারাদের সহায়তা নিয়েছিলাম। কিন্তু অতিক্রান্ত পথের দূরত্ব পরিমাপ করতে দারুন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হোচ্ছিলো।

তারপর, হঠাৎ করেই একদিন সমাধান হয়ে গেলো এই সমস্যার। লক্ষ্য করলাম, রথের চাকা একবার ঘুরলে ঠিক তার পরিধির সমান দূরত্ব অতিক্রম করে। এরপর থেকে একটি রথ সব সময় জাহাজের পিছন পিছন তীর ধরে চলতো। চাকায় আঁকানো চিহ্ন দেখে চালক হিসেব রাখতো, কতোবার ঘুরেছে ওটা। আমি টের পেলাম, বিরাট একটা বাঁক ঘুরে নদী আবারো দক্ষিণে নিয়ে চলেছে আমাদের ঠিক হাপির পুরোহিতেরা যা ধারণা করেছিলেন।

ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সময় লসট্রিস সব সময় গুরুত্ব দিতো গতিপথের হিসেব রাখার ব্যাপারে। ও বলতো, ভালো করে হিসাব রেখো, টাইটা। ফিরে যাওয়ার সময় রাস্তা খুঁজে পাওয়ার জন্যে বিশ্বস্ত কারো সাহায্য চাই আমাদের। কিন্তু নদীর তীরে কোনো রকম মন্দির বা স্থাপনা তৈরিতে নিজের নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখলো মিশরের রানি।

এভাবেই, অসীম মরুর বুক চিরে ছুটে যাওয়া নীল নদে ভেসে চললো আমাদের কাফেলা। জীবন এগিয়ে চললো উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে। আমাদের অভিযাত্রীরা বেশিরভাগই বয়সে তরুণ। নদীর তীরে নীলের জল ভর্তি পাত্র ভেঙ্গে বিয়ে বসলো অনেকেই। আমাদের চোখের সামনেই বেড়ে উঠতে লাগলো নতুন দিনের সন্তানেরা।

দুর্ঘটনাবশত বা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। তরুণ প্রাণও ঝড়ে গেলো কিছু।

উৎসব, পালা-পার্বণ সবই পালন করতাম আমরা নদী তীরে। দেব-দেবীর আরাধনা, সংগীত, আমোদ-ফুর্তি, জ্ঞান-অন্বেষণ কিছুই বাদ গেলো না।

বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই দক্ষিণগামী নীল নদের গতিপথে আবারো বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো তৃতীয় একটি জলপ্রপাত। আগেরবারের মতোই, তীরে উঠে গেলাম আমরা। সমভূমি পরিষ্কার করে ফসল বপন করলাম। আগামী বন্যা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।

*

তৃতীয় সেই জলপ্রপাতের সন্নিকটেই আরো একটি আনন্দ জীবন ভরিয়ে দিলো আমার।

নদীর তীরে লিনেন-ঘেরা তাঁবুতে আমার পরিচর্যায় রাজকুমারী তেহুতির জন্ম দিলো লসট্রিস–যে ছিলো মৃত ফারাও মামোসের স্বীকৃত সন্তান।

আমার চোখে যে কোনো অত্যাশ্চর্য ব্যাপারের মতোই অসামান্য সুন্দরী ছিলো রাজকুমারী। যখনই সময় পেতাম, তার দোলনার পাশে বসে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম ছোট্ট ছোট্ট হাত-পার নড়াচড়া। ওর ক্ষিধে পেলে মাঝে-মধ্যে কড়ে আঙুল ধরতাম ঠোঁটের সামনে–মায়ের দুধের বোটা মনে করে খুব করে চাবাতো ওটা তেহুতি!

অবশেষে, বন্যার পানিতে উঁচু হলো নদীর পানি। জলপ্রপাত অতিক্রম করলাম আমরা। ধীরে, পুব দিকে বাঁক নিলো নদী, বিশাল এক বাঁক ঘুরে।

বছর শেষের আগেই আরো একবার আমার বিখ্যাত স্বপ্ন দেখতে হলো, কেননা আবারো আমারর কর্ত্রী ঐশ্বরিক কোনো শক্তির প্রভাবে গর্ভবতী হয়ে পড়লো। মৃত ফারাও-এর ভূত এবারেও ধরনা দিয়েছিলো রানির শয্যাকক্ষে।

চতুর্থ জলপ্রপাতের কাছে যতদিনে পৌঁছলাম আমরা, ততোদিনে বিশাল বপুর অধিকারী হয়ে গেছেন রানি। এর আগে যতোগুলো জলপ্রপাত পেরিয়ে এসেছি, এর চেয়ে বিপদজনক নয় কোনোটিই। কুমিরের দাঁতের মতো পাথর-খণ্ডের উপর ঝরে পড়ছে তুমুল জলরাশি–এর ভয়াবহ রূপ দেখে দমে গেলো মিশরীয় বাহিনী। তারা বলাবলি করতে লাগলো, এই পাথুরে প্রতিবন্ধক আমাদের ঘিরে ফেলেছে। দেবতারাই নদীর উপর এ বাধা দিয়েছেন, যাতে করে আর সামনে না যাই আমরা।

এমনকি, মিশরের জ্ঞানী-গুণী মহৎপ্রাণেরাও নিজেদের মধ্যে আলাপ করতো, এই ভয়ঙ্কর খাড়া জলপ্রপাতের এপাশে আটকে গেছি আমরা। আর নদীর ভাটিতেও ফিরে যেতে পারবো না। দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই ফিরে যাওয়া উচিত।

একবার, রাজসভায় শুনলাম একজন লর্ড বোলছেন, এখন যদি এগোই, নির্ঘাত মরুতে মারা পড়বে সবাই। কোনো দিনও মুক্তি পাবে না আমাদের আত্মা।

ধীরে দানা বেঁধে উঠলো অসন্তোষ। তরুণদের নেতৃত্ব দিলো লর্ড মারসেকেটের কনিষ্ঠ পুত্র লর্ড আকের। সে সবাইকে সংঘবদ্ধ করতে লাগলো। একবার শুনলাম, আকের ঘোষণা করছে, মৃত রাজার এই বেশ্যা স্ত্রীর হাতে পড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি আমরা। এই মুহূর্তে একজন শক্ত পুরুষ শাসনকর্তার প্রয়োজন। ওই মেয়ের হাত থেকে মুক্তি পেতেই হবে আমাদের।

ট্যানাস আর লসট্রিসকে এ সমস্ত কথা খুলে বলতেই নদীর তীরে জরুরি সভা ডাকা হলো।

রানি লসট্রিস তার ভাষণের শুরুতে বললেন, আমি জানি, নিজের মাটির জন্যে কেমন খারাপ লাগছে আপনাদের। এই দীর্ঘ যাত্রা নিয়ে আপনাদের উদ্বেগের কথাও আমার অজানা নয়। আমি নিজেও সবার মতোই থিবেসে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন দেখি।

কটাক্ষপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় কোররো আকের এবং বিদ্রোহী তরুণেরা।

যাই হোক, রানি বলে চলেন, হে মিশরের জনগণ, যা মনে হয়, অবস্থা ততো খারাপ নয় মোটেও। হাপি তাঁর প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী আমাদের রক্ষা করবেন। আপনাদের ধারণার চেয়েও কাছাকাছি আছি আমরা থিবেস নগরীর। ফিরতি পথে ঠিক যেভাবে এসেছি, সেই দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হবে না আমাদের। আবারো এইসব ভয়ঙ্কর জলপ্রপাত পেরুতে হবে না।

হতবুদ্ধি ভাব ফুটে উঠলো আকের সহ সবার চেহারায়। রানি ব্যাখা করে জানালেন, কেমন করে রথের চাকার চিহ্ন থেকে অতিক্রান্ত পথের দূরত্ব হিসাব করে রাখছি আমি। এরপর, সভাষদের সামনে এসে আমার বক্তব্য পেশ করার আহ্বান জানালেন।

মেমননের সহায়তায় নদীর গতিপথ বিশটি স্লোলে নকল করে রেখেছি আমি। নয় বছর বয়স তখন রাজপুত্রের, ততোদিনে দারুন লিখতে শিখে গেছিলো সে।

মাই লর্ড, এই গতিপথ দেখে নিশ্চই বুঝতে পারছেন, দ্বিতীয় জলপ্রপাত অতিক্রমের পর থেকে প্রায় এক হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়েছি আমরা, কিন্তু এই মুহূর্তে ঠিক যে স্থান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেই স্থান থেকে কয়েক শ মাইলের বেশি দূরত্বে নেই আমরা।

আমার শেখানো মতো উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো ক্ৰাতাস। তার মানে, মরুর উপর দিয়ে সংক্ষিপ্ত কোনো পথে দ্বিতীয় জলপ্রপাতের ধারে পৌঁছুনো যাবে? এতে করে নিশ্চই সময়ও অনেক কম লাগবে?

ওর দিকে ফিরলাম আমি। এর অর্থ হলো, এখান থেকে কয়েকমাসের মধ্যেই গজ-দ্বীপে ফিরে যাওয়া সম্ভব, কেবলমাত্র আসূনের প্রথম জলপ্রপাত অতিক্রম করতে হবে সেক্ষেত্রে।

আশ্চর্য হয়ে নদীর গতিপথের মানচিত্র পর্যবেক্ষণে মন দিলো প্রত্যেকে। চারিদিকে বিস্ময়ের গুঞ্জন।

এই ক্রীতদাসের হিসাব কতোটা সঠিক? আক্রমণাতৃক স্বরে বলে উঠলো আকের। কাগজের উপরে আঁকি-ঝুঁকি কাটা এক কথা; আর মাইলের পর মাইল মরু পাড়ি দেওয়া একেবারেই ভিন্ন ব্যাপার। এইসব যে সত্য, তার কী প্রমাণ আছে এই দাসের কাছে?

সাহসী যোদ্ধা আকের ভালো কথা বলেছে, আমুদে স্বরে বলে উঠলো আমার কর্ত্রী। মরুর উপর দিয়ে এই পথের উপযুক্ততা পরীক্ষার জন্যে বীর সৈনিকদের একটা দল পাঠানোর অভিপ্রায় আছে আমার রূপসী থিবেসে ফিরে যাওয়ার পথ দেখে ফিরে আসবে তারা। সাথে সাথেই মুখের জ্যোতি নিভে এলো আকেরের। মিসট্রেসের উদ্দেশ্যে বুঝতে পেরে বসে পড়লো সে। কিন্তু লসট্রিস বলে চললো, আমি ভাবছিলাম, কাকে দেওয়া যায় এই দায়িত্ব। কিন্তু এই বিষয়ে নিজের প্রজ্ঞা আর দুশ্চিন্তার কথা প্রকাশ করে লর্ড আকের সেই চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়েছেন আমাকে। কী বলেন? এহেন সরাসরি প্রস্তাবে অমত করার সুযোগ নেই আকেরের জন্যে।

আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ লর্ড আকের। যতো লোকবল, যা কিছু প্রয়োজন সাথে নিতে পারেন আপনি। আগামী পূর্ণিমার আগেই রওনা হয়ে যাওয়ার হুকুম করছি আমি। এতে করে চাঁদের আলোয় রাতে পথ-চলা সহজ হবে। নক্ষত্র দেখে পথ চিনতে পারে, এমন লোক দিচ্ছি সাথে। একমাসের মধ্যেই আশা করি দ্বিতীয় জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছে আবার ফিরে আসতে সক্ষম হবেন আপনি। সেক্ষেত্রে, আমি নিজে বীরশ্রেষ্ঠের পদক পরিয়ে দেবো আপনার গলায়।

হা করে চেয়ে রইলো আকের। আমি নিশ্চিত ছিলাম, কোনো না কোনো অজুহাতে অভিযান এড়িয়ে যেতে চাইবে সে, কিন্তু শেষপর্যন্ত আমাকে অবাক করে দিয়ে দল গঠনের জন্যে আমার পরামর্শ চাইতে এলো আকের। হয়তো আমিই ভুল ভেবেছিলাম তাকে।

আমাদের সেরা কয়েকজন সৈনিক আর ঘোড়া দিয়েছিলাম তাকে। সাথে সেরা পাঁচটি রথ । পূর্ণিমার আগেই বেশ চনমনে, আশাবাদী মনে ঘুরে ফিরতে লাগলো আকের। ওদিকে, দূরত্বের হিসাব কম করে বলায় আত্মদংশনে ভুগছিলাম আমি।

যাত্রার রাতে চাঁদের আলোয় বিদায় জানালাম অভিযাত্রী দলকে। উত্তর দিগন্তের তারাভরা আকাশে ওরা হারিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকলাম।

চতুর্থ জলপ্রপাতের পাদদেশে যতো দিন ছিলাম, সব সময় আকের এবং তার দলের কথা ভেবেছি আমি। মনে মনে প্রার্থনা করেছি, আমার দেওয়া মানচিত্র যেনো খুব বেশি ভুল না হয়। যা-ই হোক, অন্তত এতে করে বিদ্রোহ তো দমন করা গেছে।

অপেক্ষার দিনগুলোতে আগাছা পরিষ্কার করে দ্বীপের মাটিতে শস্য বপন করলাম আমরা। এখানকার জমিন অবশ্য বেশ খাড়া। শস্যের ক্ষেতে পানি দেওয়া বিশেষ কষ্টকর হয়ে উঠলো।

প্রতি সন্ধ্যাতেই রথ নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম আমি আর মেমনন। শস্যের করুণ ফলনে চিন্তিত বোধ করছি। এখনো বহু মাইল পথ পড়ে আছে সামনে। কেমন করে খাওয়াবো আমাদের লোকদের? ঠিক মতো সেচকাজ না করতে পারলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে শীঘ্রই।

জানি না, কেমন করে সেচের জল তোলার জন্যে চাকার কথা মাথায় এসেছিলো আমার। নদীর স্রোতে একদিন ভেসে গেলো আমাদের একটা নৌকা, দু জন লোক ডুবে মরলো। সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার সাক্ষী আমি আর মেমনন। এরপরই, রাজপুত্রকে স্রোতের জোর দেখানোর জন্যে রথের একটা চাকা পানিতে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম আমি। সাথে সাথে স্রোতের টানে এমন বনবন করে ঘুরতে শুরু করলো

সেটা, দশ বছর বয়সী মেমনন মন্তব্য করেছিলো, টাইটা, চাকার ধারের সঙ্গে পাদানী যুক্ত কার থাকলে তো আরো দ্রুত ঘুরবে সেটা! অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়েছিলাম সেদিন। কী অসাধারণ চিন্তাশক্তি অতোটুকু ছেলের।

পরবর্তী পূর্ণিমার আগেই নদীর স্রোতের জোরে ঘুর্ণায়মান চাকা থেকে ছোট্ট কাদামাটির পাত্রে জল তোলার ব্যবস্থা করলাম; উঁচু তীরের উপর তৈরি করা সরু খালের মাধ্যমে সেই জল চলে যাবে শস্যের ক্ষেতে।

ট্যানাস পর্যন্ত মুগ্ধ হলো এই ব্যবস্থায়। খুব চমৎকার, টাইটা। কিন্তু কবে তোমার বিখ্যাত চাকার মতো এটাও ফেটে যাবে হে? আমুদে স্বরে বললো সে। তখন কোনো চাকা ফেটে গেলেই সৈনিকেরা বলে উঠতো, টাইটা গেলো!

যা হোক, ধুররা শস্যের মাঠ ক্রমশই পর্যাপ্ত পানি পেয়ে ঘন সবুজে ভরে উঠলো; সোনালি শীষ নীলের সূর্যালোকে ঝকমক করতে লাগলো। চতুর্থ জলপ্রপাতের কাছে সেই ফসলই শুধু নয়, আরো কিছু পেলাম আমরা। আরো একজন রাজকুমারীর জন্ম দিলেন রানি লসট্রিস। এ যেনো তার বোনের চেয়েও সুন্দরী।

অদ্ভুত ব্যাপারই বলতে হয় রাজকুমারী বেকাথা জন্ম নিয়েছিলো এক মাথা লাল সোনালি চুল নিয়ে। তার স্বর্গত এবং ভূত পিতা, ফারাও মামোস বা মা লসট্রিস কারও চুলের রঙই ওটা নয়। এর কারণ না বুঝলেও, ওর সৌন্দর্যে সবাই মোহিত ছিলো।

রাজকুমারী বেকাথার দুই মাস বয়সে বন্যা এসে গেলো। ততোদিনে বার্ষিক জলপ্রপাত অতিক্রম অভিযানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা। এই দুর্গম নদীকে বশে আনার সমস্ত কৌশলই জানা হয়ে গেছে।

*

জলপ্রপাত অতিক্রমের আগেই ভীষণ উত্তেজনার ব্যাপার ঘটলো আমাদের বাহিনীতে। রাজকুমার মেমনন এবং আমি ঘোড়াগুলোর তদারকি করছিলাম, ঠিক সেই সময় নদীর তীর থেকে ভেসে এলো শোরগোলের আওয়াজ।

দ্রুত নৌকায় চড়ে নদী পাড়ি দিয়ে পুব তীরে, ক্যাম্পে পৌঁছুলাম আমি আর মেমনন। দারুন উফুল্ল জনতার ভীড় ঠেলে সামনে এগুলাম, চারিদিকে ক্যাম্পের লোকেদের সাগত সঙ্গিতের মূৰ্ছণা। ভীড়ের কেন্দ্রে ভাঙ্গাচোড়া একটা ওয়াগন, আর কঙ্কালসার কয়েকটি ঘোড়া; সঙ্গে মরুর তাপে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া অভিজ্ঞ কিছু মুখ ।

তুমি আর তোমার ওই জঘন্য মানচিত্রের উপর সেথের অভিশাপ পড়ক, টাইটা! সামনের ওয়াগন থেকে চিৎকার করে আমার উদ্দেশ্যে বললো লর্ড আকের। একটা কথা যদি সত্যি বলতে! প্রায় দ্বিগুন দূরত্ব পাড়ি দিতে হয়েছে আমাদের!

সত্যিই কি নদীর বাঁকের উত্তর দিকে পৌঁছুতে পেরেছিলে? পাল্টা চিৎকার করলাম আমি। উত্তেজনায় কাঁপছি রীতিমতো।

হ্যাঁ, পৌঁছেছি এবং ফিরেও এসেছি! সন্তুষ্টির হাসি হাসলো আকের। নিজের অর্জনে দারুন পরিতৃপ্ত। দ্বিতীয় জলপ্রপাতের কাছেই ক্যাম্প ফেলেছিলাম আমরা, নীল নদ থেকে তাজা মাছ ধরে খেয়েছি। থিবেস প্রত্যাবর্তনের রাস্তা একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট।

অভিযাত্রীদলের ফিরে আসা উপলক্ষ্যে ভোজের ঘোষণা দিলেন রানি। লর্ড আকের হলো দিনের আলোচ্য চরিত্র। উৎসবের শুরুতেই তার গলায় প্রশংসার স্বর্ণ শেকল পরিয়ে দিলো লসট্রিস। দশ হাজারের সেরা উপাধিতে ভূষিত করা হলো আকেরকে। এ-ই শুধু নয়, রথ বাহিনীর চতুর্থ বহরের নেতৃত্বও দেওয়া হলো তাকে; প্রতিশ্রুতি করা হলো থিবেস প্রত্যাবর্তনের পর নদীর তীরে একশ ফেদান জমিন দেওয়া হবে তাকে।

যদিও আমার কাছে একটু বাড়াবাড়ি মনে হলো মিসট্রেসের এই আচরণ, তথাপি ওর ধূর্ত রাজ্য পরিচালনায় মুগ্ধ হলাম। বিদ্রোহীদের নেতা, তার সবচেয়ে বড়ো শত্রু আকেরকে বিশ্বস্ত একজন ভূত্যে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলো লসট্রিস। পরবর্তী দিনগুলোতে বহুবার আকের তার অপরিহার্য তার প্রমাণ দিয়ে রানির সেবায় নিয়োজিত থেকেছিলো। সত্যিই, মিসট্রেসের শাসনক্ষমতা ছিলো তুলানহীন।

লর্ড আকেরের বিদ্রোহের অঙ্কুরেই পরিসমাপ্তি এবং ফিরতি-পথের আবিষ্কার নিশ্চিত হওয়ার পর উত্তেজনা আর সাহসে টগবগ করতে থাকা মিশরীয় বাহিনী সাহসী হৃদয়ে চতুর্থ জলপ্রপাত অতিক্রমে মনোনিবেশ করলো।

*

জলপ্রপাত পেরিয়ে, এক মাসেরও কম সময় এগিয়ে চলবার পর আমরা বুঝতে পারলাম, আমাদের ভাগ্য পাল্টে গেছে। দেবী তার প্রতিজ্ঞা রেখেছেন।

একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেলো সবার কাছে, কঠিন দিন পিছনে ফেলে এসেছি আমরা। শেষমেষ, মরুভূমি পিছনে রয়ে গেছে। আমাদের সামনের নদী চওড়া, বিশাল; মসৃণ পানির ব্যাপক বিস্তার বয়ে চলেছে দক্ষিণে। এমন ভূখণ্ডে নিয়ে চলেছে আমাদের, যার সাথে পরিচিত নই আমরা।

এখানেই প্রথমবারের মতো বৃষ্টির দেখা পেলাম আমরা। যদিও নিম্ন-রাজ্যে বৃষ্টি পড়তে দেখেছিলাম আমি, আমাদের মধ্যে অনেকেই কখনো তা দেখেনি। অবাক বিস্ময়ে মুখ হা, মাথা উঁচিয়ে আকাশ পানে চেয়ে রইলো তারা সাদা বিদ্যুতের ঝলকানির সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে নেমে এলো জলের ধারা।

সেই বিপুল পরিমাণ নিয়মিত বৃষ্টির ফসল নতুন এক ভূখণ্ড উন্মোচিত হচ্ছিলো আমাদের সামনে। নীল নদের অপর তীরে বিশাল-বিস্তৃর্ণ তৃণভূমি গ্যালির পাটাতন থেকে যতদূর চোখ পড়ে কেবল সবুজ সমভূমি। সেই চমৎকার তৃর্ণভূমিতে চড়ে বেড়ালো আমাদের ঘোড়ার পাল। রথ নিয়ে যতোদূর ইচ্ছে, ছোটা যায় সেখানে। কোনো পাহাড়, টিলা বা পাথর খণ্ড পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে নেই।

কেবল এ-ই সব নয়। প্রচুর গাছ ছিলো সেখানে। সরু যে উপত্যকায় ক্যাম্প ফেলতাম আমরা, নিঃসন্দেহে কোনো কালে বন ছিলো সেখানে কেউ বলতে পারে না। আমরা, মিশরীয়দের কাছে কাঠ অত্যন্ত মূল্যবান। এখন যেখানেই তাকাই আমরা, কেবল গাছ আর গাছ। জলপ্রপাতের দ্বীপগুলোতে যেমন ঘন বনের আকারে জন্মাতো, এখানে তেমন নয়। বিশাল উঁচু গাছের শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে আছে অনেকটা জায়গা নিয়ে। এতো কাণ্ড পড়ে আছে, যা দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত দেশের সব নৌবাহিনীর জাহাজ তৈরি করা সম্ভব। যে কোনো সভ্যতা তৈরির সমস্ত উপকরণ মজুত এখানে। আমরা যারা গবাদিপশুর বিষ্ঠায় তৈরি ইটের আগুনে রান্না করে অভ্যস্ত, কাঠের এহেন সহজলভ্যতায় বিস্ময়ে হা হয়ে গেলাম।

কিংবদন্তির সেই কুশ দেশে আমাদের জন্যে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো।

দূর থেকে দেখে প্রথমে ওগুলোকে বিশাল গ্রানাইটের খণ্ড মনে করেছিলাম আমি। হলদেটে সবজ তৃণভূমির উপরে একাশিয়া গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়েছিলো তারা। আচমকাই আমাদের দৃষ্টির সামনে নড়তে শুরু করলো পাথর-খণ্ডগুলো!

হাতি! যদিও এর আগে কখনো দেখিনি, কিন্তু এ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। ওগুলো। পাটাতনে দাঁড়িয়ে থাক যোদ্ধারা আমার কথা ঠোঁটে তুলে নেয়।

হাতি! আইভরি! এ হলো সেই সম্পদ, ফারাও মামোস তার সমস্ত সমাধি সম্পদ সত্ত্বেও যা স্বপ্ন দেখতেন। যেদিকে তাকাই, বিরাট হাতির পাল চোখে পড়লো।

হাজারে হাজারে হাতি, শিকারীর দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে বললো ট্যানাস। একবার কেবল তাকিয়ে দ্যাখো, টাইটা! এর কোনো শেষ নেই!

সমভূমিতে চড়ে বেড়ায় বহু বন্য প্রাণী। শুধু হাতির পাল নয়, সেখানে আছে অ্যান্টিলোপ হরিণ, গ্যাজেল; এদের কিছু কিছু আমাদের পরিচিত, বাকিদের জীবনেও কখনো দেখিনি। আরো অনেক পরে এই সব চমৎকার প্রাণিকুলের সবার নাম জেনেছিলাম আমরা। কিন্তু সে ভবিষ্যতের কথা। আর এখন, এই বিচিত্র অবাধ জীব জ দর্শনে শিকারের স্পৃহা তুঙ্গে উঠে গেলো ট্যানাসের।

জাহাজ থেকে রথের সরঞ্জাম নামাও, অধৈৰ্য্য ভঙ্গিতে গর্জে উঠে সে। ঘোড়া জুড়ো রথের সাথে। শিকারে যাচ্ছি আমরা!

যদি তখন জানতাম কী বিপদের মুখে পড়তে যাচ্ছি আমরা, কখনো মেমননকে রথের পাদানীতে, আমাদের সাথে নিতাম না। প্রথম হাতি শিকার অভিযানে চললাম আমরা। এদের সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ আমাদের কাছে ধীর-আয়েশী গতির বোকা প্রাণী মনে হয়েছিলো ওগুলোকে। ভেবেছিলাম একেবারেই সহজ হবে শিকার অভিযান।

আর একটু হলেই চরম মূল্য দিতে হয়েছিলো এই বোকামীর জন্যে। রথ থেকে ছোঁড়া তীরের আঘাতে আহত মদ্দা হাতির দুর্দান্ত গতির ক্ষ্যাপাটে দৌড়ের কাছে দারুণভাবে পরাভূত হয়েছিলো আমাদের রথ। হাতির পায়ের তলায় অল্পের জন্যে চাপা পড়ে জীবন দেয়নি ট্যানাস। চরম বিপদের মুখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসীম সাহসিকতার সাথে পিতাকে বাঁচিয়েছিলো মেমনন সেদিন। তার নির্ভয় ঘোড়াচালনা আমাকেও তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো। যখন হাতির উন্মত্ত দৌড়ের মুখে পড়ে পালাতে গিয়ে চাকা ফেটে ধ্বংস হয়ে গেছিলো আমাদের রথ; মেমনন নিজে লাগাম কেটে ধৈর্য্যের পিঠে চড়ে আমাদের দুইজনকে জীবিত ফিরিয়ে এনেছিলো।

শেষমেষ অবশ্য তীরের আঘাতে নিহত হলো মদ্দা হাতি। কিন্তু আমরা বুঝেছিলাম, অল্প সংখ্যক লোকবল নিয়ে সামান্য রথ ধনুক দ্বারা হাতি শিকার কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মেমননের সেই বীরোচিত ভূমিকার সবটাই গ্যালির পাটাতন থেকে দেখেছিলো লসট্রিস। উদ্বিগ্ন চোখে পুরোটা সময় তাকিয়েছিলো সে।

অবশেষে যখন ফিরে এলাম আমরা, এক পা মচকে বেশ ক দিনের জন্যে অচল হয়ে পড়েছে ট্যানাস। কিন্তু পিতৃগর্বে উজ্জ্বল তার মুখাবয়ব।

পরদিন সমস্ত সভাষদের সামনে, হোরাসের প্রশ্বাসের পাটাতনে রানি ঘোষণা করলেন, শিকার অভিযানের বীরত্বপূর্ণ কার্যের জন্যে আজ থেকে নীল কুমির বাহিনীর একজন হিসেবে গ্রহণ করা হবে রাজকুমার মেমননকে। দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন শিক্ষানবিশ হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করবে সে। তার বীরত্বের জন্যে সাহসী-হৃদয় পদকে ভূষিত করলাম রাজপুত্রকে।

এই সম্মান যেনো আরো একনিষ্ঠ, আরো পরিশ্রমী করে তুললো মেমননকে। নিয়মিত অধ্যয়ন, আর শরীর কসরতে নিজেকে শক্ত করে গড়ে তুলতে লাগলো রাজকুমার। ভবিষ্যতের ফারাও হিসেবে ওর প্রস্তুতিতে কোনো কমতি রইলো না।

*

নদীপথে আরো একটি জলপ্রপাত পড়লো আমাদের সামনে, পরে বুঝতে পেরেছিলাম পঞ্চম সেই জলপ্রপাত ছিলো যাত্রাপথের সর্বশেষটি। কিন্তু, অপর চারটির মতো আমাদের যাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারলো না ওটা। এখন আমাদের চারপাশে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, নদীপথে এগুতে আর বাধ্য নই আমরা।

প্রতিবারের মতোই, নৌবহর নোঙর করে, বন্যার অপেক্ষায় নদী তীরে ফসল বুনলো আমাদের কৃষকেরা। কিন্তু বসে না থেকে, বিশাল তৃণভূমির উপর দিয়ে দূর-দূরান্তে রথ ছোটালাম আমরা। দক্ষিণে বড়ো বাহিনী পাঠিয়ে হাতি শিকার করে আইভরি সংগ্রহের নির্দেশ দিলেন রানি। এখন আর অসাবধান নই আমরা, শিখে গেছি কেমন করে উন্মত্ত হাতির পাল থেকে বেঁচে থাকতে হয়। পঞ্চম জলপ্রপাতের ধারে, প্রথম দিনেই একশ সাতটি হাতি শিকার করতে সমর্থ হয়েছিলো আমাদের বাহিনী। মাত্র তিনটি রথ ধ্বংস হয়েছিলো সেই অভিযানে।

পরদিন জাহাজের পাটাতন থেকে যেদিকে দৃষ্টি গেলো, হাতির পালের দেখা পাওয়া গেলো না। দেখা গেলো, বহুদূর পথ অতিক্রম করে দিনের পর দিন ধাওয়া করেও হাতির নাগাল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যা দেখে মনে হয়েছিলো অনন্ত আইভরি প্রাপ্তির সমূহ সম্ভবনা, তা মূলত ছিলো ভুল ধারণা। প্রথম শিকার অভিযানে বলা মেমননের একটা কথা মনে পড়ে আজো। ও বলেছিলো, যা মনে হয়, হাতি শিকার ততোটা সহজ কাজ নয়।

তবে দক্ষিণ ঘুরে ফিরে আসা রথ বাহিনী হাতির দাঁতের চেয়েও মূল্যবান সংবাদ নিয়ে এলো আমাদের ক্যাম্পে। মানুষের দেখা পেয়েছে তারা। আমি অবশ্য বহুমাস ধরে ক্যাম্পের বাইরে যাই নি তখন। অনেক দিন ধরেই কাজ করছিলাম রথের চাকা নিয়ে, অবশেষে একটা সমাধান বের করতে পেরেছি। বিভিন্ন কাঠের তক্তা দিয়ে চেষ্টা করে শেষমেষ চূড়ান্ত করেছিলাম ত্রুটিবিহীন চাকা। সেই চাকায় তৈরি আমার প্রথম দশটি রথ দিগ্বিদিক বেকায়দায় ছুটিয়েও চাকা ফাটাতে পারলো না কাতাস আর রেমরেম। ওরা ছিলো আমাদের বাহিনীর সবচেয়ে জঘন্য রথ-চালক।

সেই সেময়েই, বীর আকেরের নেতৃত্বে হাতির পাল ধাওয়াকারী দল ফিরে এলো দক্ষিণ থেকে। তারা জানালো, অনেক দক্ষিণে মানুষের বসতির দেখা পেয়েছে তারা।

প্রথম জলপ্রপাত অতিক্রমের পর থেকেই আফ্রিকান গোত্রভুক্ত লোকের দেখা পাওয়ার আশায় ছিলাম। শত বছর থেকেই কুশ দেশীয় ক্রীতদাস বিকোতে মিশরের বাজারে। নিজ-গোত্রের মানুষেরাই তাদের ধরে অন্যান্য দ্রব্যাদি, যেমন আইভরি, অসট্রিচের পালক, গণ্ডারের শিং আর স্বর্ণের গুঁড়ো সমেত সম্রাটের সীমান্তবর্তী এলাকায় বিক্রি করতো। রানি লসট্রিসের দুটি দাসী মেয়েও একইভাবে গজ-দ্বীপের বাজারে পৌঁছেছিলো।

এখনো একটা ব্যাপার বুঝতে পারি না, কেনো এর আগেই মানুষের দেখা পাইনি আমরা। হয়তো যুদ্ধ বা দাস বিদ্রোহের কারণে আরো ভেতরের অঞ্চলে চলে গিয়েছিলো তারা, ঠিক যেমন হাতির পাল শিকার করে ওগুলোকে আফ্রিকার গভীরে চলে যেতে বাধ্য করেছি আমরা।

সঙ্গে সঙ্গেই পুরোদস্তুর বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলো ট্যানাস। নিজে নেতৃত্বে রইলো সে। যেহেতু আমি ছাড়া আর কারো রথ-চালনার প্রতি আস্থা নেই তার, আমিও গেলাম সঙ্গে। মেমনন নিজে রইলো একটা রথের দায়িত্বে।

নদী তীরে প্রথম গ্রামে পৌঁছলাম আমরা। জলপ্রপাতের উপর দিয়ে তিনদিনের যাত্রা শেষে। ঘাসের চাপড়া দিয়ে তৈরি অস্থায়ী আবাসগুলোকে আসলে কুঁড়ে বলার যো নেই। সন্ধ্যার দিকে পুরো বাহিনী নিয়ে গ্রাম ঘিরে ফেললাম আমরা। আশ্রয় ছেড়ে বেড়িয়ে আসা মানুষগুলো এতোটাই ভীত আর বিস্মিত ছিলো, কোনো রকম বাধা না দিয়ে ধরা দিলো তারা। পুরুষগুলো লম্বা, পাতলা অবয়বের। আমাদের বাহিনীর যে কারোর চেয়ে অনেক লম্বা তারা, এমনকি ট্যানাসকেও বেশ খাটো মনে হলো তাদের কাছে। ধীরে কয়েকটি দলে ভাগ করতে লাগলো ট্যানাস, ধরা-পড়া কালো লোকগুলোকে।

তাদের মেয়েমানুষগুলোও অত্যন্ত শক্তিশালী এবং স্বাস্থ্যবতী । শক্ত পাছা, ঝকঝকে সাদা সমান দাঁত। প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি মহিলার কোলে একটা বাচ্চা, হাতে ধরে রেখেছে আরো একজন। এরা ছিলো আমার দেখা সবচেয়ে জংলী মানুষ। কি নারী কি পুরুষ–গায়ে কোনো রকম কাপড় পরে না তারা। কেবল তরুণী মেয়েগুলো কোমড়ে অসট্রিচের পালক জড়িয়ে রাখতো। আমি লক্ষ্য করেছিলাম, প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নারীকে জঘন্য বর্বরতার পরিচয় দিয়ে অঙ্গহানী করা হয়েছে। পরে জেনেছিলাম, ছুরির খোঁচায় বা তীক্ষ্ণ বাঁশের ডগা দিয়ে সারা হতো সেই ভয়ঙ্কর অস্ত্রোপচার। তাদের মেয়েদের ক্ষতের দাগ-অলা, কুৎসিত নারী যোনী ছিলো এক একটি গর্তের মতো। তাতে রুপা না হয় হাতির দাঁতের তৈরি গহনা পড়তো তারা। তরুণী মেয়েগুলোকে তখনো অস্ত্রোপচার করা হয় নি। সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিলাম, অদূর ভবিষ্যতে বন্ধ করতে হবে এই জঘন্য আচার । জানি, অনায়াসে মিসট্রেসের সমর্থন পাবো এই ব্যাপারে।

যখন রাজপুত্র মেমনন এদের ধরে নিয়ে আসার অধিকার সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলো, আমি উত্তরে বলেছিলাম, এরা জংলী বর্বর, আর আমরা সভ্য জাতি। একজন বাবার যেমন সন্তানের প্রতি দায়িত্ব আছে, তেমনি আমাদেরও দায়িত্ব এদের শিক্ষা দান করা, প্রকৃত দেব-দেবীর পরিচয় দেয়া। নিজেদের পরিশ্রমের বিনিময়ে আমাদের ঋণ ফিরিয়ে দিচ্ছে তারা।

লসট্রিসের দুটি দাসী মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছিলো অভিযানে। প্রায় ভুলতে বসা জংলী ভাষায় আমাদের পক্ষ থেকে প্রথম কোনো রকম যোগাযোগ স্থাপন করলো তারা আফ্রিকার গোত্রভুক্ত জণগোষ্ঠীর সঙ্গে। এতে করে কিছুটা হলেও শান্ত হলো তারা। এমনিতেও সুর ভালো ধরতে পারি আমি, আর তাছাড়া ভাষা নকল করার স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে আমার। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এদের ভাষা বলতে শিখলাম আমি। জানা গেলো, এরা নিজেদের শিলুক বলে পরিচয় দেয়। কেবল মাত্র পাঁচশো শব্দ আছে। এদের ভাষায়। একটা ফ্রোলে সেগুলো লিখে রাখলাম আমি। পরে ট্যানাসের দাস শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিলাম সেই ভাষায়। অচিরেই নিজের দাস-বাহিনী থেকে রথ চালনার উপযুক্ত কয়েকজন পেয়ে গেলো ট্যানাস।

শিলুকদের যুদ্ধমত্ততার প্রমাণ তখনো পাই নি আমরা। হঠাৎই একদিন নদী তীরের একটা গ্রাম থেকে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো তারা। ততোদিনে আমাদের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে গেছিলো। নিজেদের বাচ্চা-কাচ্চা, মেয়েমানুষ, গবাদি-পশু লুকিয়ে রেখে কাঠের অস্ত্র হাতে নির্ভয়ে ধেয়ে এলো তারা।

সেথের কানের ময়লার দুর্গন্ধের কসম! তাড়া খেয়ে পিছু-হঠে আসা ক্ৰাতাস দাঁত বের করে হেসে ঘোষণা করলো, এই প্রত্যেকটি কালো মানুষ এক-একজন জন্ম যোদ্ধা!

প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে দাও, পৃথিবীর যে কোনো দেশের পদাতিক সৈন্য পেরে উঠবে না এদের সাথে। একমত হলো ট্যানাস। তীর ছুঁড়ো না কেউ! যতোজন সম্ভব, জীবিত চাই আমার!

অবশেষে, বহু দৌড়ঝাঁপ শেষে ধরতে পারা গেলো কিছু জংলীকে। এদের মধ্যে সেরা লোকগুলোকে নিজের বাহিনীতে প্রশিক্ষণে লাগিয়ে দিলো ট্যানাস। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সেও ওদের ভাষা শিখে গেলো। পরবর্তীতে দেখা গেলো, এখন আর তাড়া করে ধরতে হয় না, নিজেরাই গ্রাম থেকে দলে দলে বের হয়ে এসে বর্শা হাতে ট্যানাসের বাহিনীতে যোগ দিতে লাগলো শিলুকেরা।

লম্বা, তামার প্রান্তওয়ালা বর্শায় তাদের সজ্জিত করেছিলো ট্যানাস, হাতির চামড়া থেকে তৈরি বর্ম, আঁটো জামা আর অসট্রিচের পালকে তৈরি পাগড়িতে দারুন দক্ষ হয়ে উঠলো তারা।

সবাইকে অবশ্য সেনাবাহিনীতে নেওয়া হলো না। বাকিরা গ্যালির দাড়ী হিসেবে চমৎকার উতরে গেলো। আর কেউ কেউ নিয়োগ পেলো রাখাল হিসেবে।

খুব দ্রুতই আমরা জেনে গেলাম, আরো দক্ষিণে বাস করে এদের শত্রু দিকা এবং মান্দারি গোত্র। এরা আরো বর্বর, কিন্তু শিলুকদের মতো যোদ্ধার অনুভূতি নেই । কাজেই, মিশরীয় রথ-বাহিনীর সমর্থনে পায়ে হেঁটে দক্ষিণের গোত্রের সঙ্গে আনন্দের সাথে লড়তে যেতো শিলুকেরা। দিনকা এবং মান্দারি গোত্রের লোকেদের দলে দলে ধরে নিয়ে আসতে লাগলো তারা। ভারী মালামাল বহন এবং অপেক্ষাকৃত মোটা দাগের কাজে তাদের লাগিয়ে দিলাম আমরা।

*

পঞ্চম জলপ্রপাত বেয়ে উঠে এলো জাহাজবহর। সম্পূর্ণ কুশ দেশ এখন উন্মুক্ত আমাদের সামনে। শিলুকদের সহায়তায় এগিয়ে যেতে লাগলাম আমরা। নদীতীর ধরে বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিতে লাগলো আমাদের রথ-বাহিনী। আইভরি আর দাস সগ্রহ করে ফিরে আসতো তারা। পুব থেকে আসা একটা শাখানদীর দেখা পেলাম আমরা, নীলের মূল প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। অবশ্য, পানি এখানে একদম কম ছোটো পুকুরের মতো। শিলুকেরা জানালো, মৌসুমের সময় প্রমত্তা নদী হয়ে উঠবে এটা, বন্যার সময় ভীষণ স্রোতস্বিনী এই নদী। আমার তার নাম রাখলাম আটবারা। শিলুক পথ-প্রদর্শনকারীদের সঙ্গে করে নদী ধরে দূর-দূরান্তে স্বর্ণের খোঁজে বাহিনী পাঠিয়ে দিলেন রানি। বেশিরভাগ সময়ই মেমননের রথ সবার আগে আগে চললো। যদিও আমি চাইছিলাম, আরো বেশি সময় পড়াশোনায় মনোনিবেশ করুক সে, কিন্তু তা হওয়ার নয়।

যা হোক, আমার দুই রাজকুমারীকে নিয়ে দুঃখ ভুলতে হলো। তেহুতি এবং বেকাথা প্রতিদিন যেনো আরো বেশি সুন্দরী হয়ে পড়ছে। একজন পিতার মতোই ওদের দেখভাল করতাম আমি। বেকাথার শেখা প্রথম বুলি ছিলো, টাটা। আর, রাতে গল্প না শুনলে তো ঘুমোতেই চাইতো না তেহুতি।

সেটা ছিলো আমাদের অভিযানের শ্রেষ্ঠ সময়। শীঘ্রই স্বর্ণের নমুনা সঙ্গে করে হাজির হলো বাহিনী। স্বর্ণকারেরা পরীক্ষা করে রায় দিলেন, বিশুদ্ধ স্বর্ণ রয়েছে সেই নমুনায়। অভিযাত্রীদের সঙ্গে করে আমি আর ট্যানাস দেখে এলাম আটবারা নদীর কোথা থেকে আসছে এই স্বর্ণ। দিনকা এবং মান্দারি গোত্রের হাজার হাজার দাস রাতদিন খেটে নদীর পানি থেকে নুড়ি-পাথর সংগ্রহ করে নিয়ে আসলো। তারই মধ্যে পাওয়া স্বর্ণ থেকে তৈরি হলো আংটি আর বিভিন্ন অলঙ্কার ।

*

আমাদের দক্ষিণযাত্রায় আরো একটি জলপ্রপাতের দেখা পেয়েছিলাম। ষষ্ঠ এই জলপ্রপাতে চড়তে অবশ্য একটুও সময় লাগলো না, অনায়াসে ওটা পেরিয়ে এলাম আমরা। রথ এবং ওয়াগনগুলো জলপ্রপাতের পাশ দিয়ে ঘুরে উপরের জমিনে উঠে এলো। শেষপর্যন্ত সেই রহস্যময় স্থানে পৌঁছুলাম আমরা, যেখানে দুইটি বিশাল নদী প্রবাহ এক হয়ে সৃষ্টি করেছে আমাদের প্রিয় নীল নদ।

এই সেই স্থান যেটা আমন রার ভবিষ্যতের ছবিতে দেখেছিলো টাইটা। এখানেই হাপি তার জলধারা ঢেলে দিচ্ছেন। এই হলো দেবীর পবিত্র স্থান। রানি লসট্রিস ঘোষণা করলেন। আমাদের যাত্রা শেষ হয়েছে। এইখানেই আমাদের শক্তিশালী করে দেবেন দেবী, যাতে করে মিশরে ফিরে যেতে পারি আমরা। আমি এর নাম দিলাম কেবুই উত্তুরে বায়ুর স্থান। কেননা, এই উত্তুরে বাতাসই তো এতোদূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে আমাদের।

এ হলো পবিত্র স্থান। ইতিমধ্যেই স্বর্ণ আর ভূত্য দিয়ে আমাদের তার আনুকুল্য প্রদর্শন করেছেন দেবী, একবাক্যে স্বীকার গেলো সভাসদ। আর এগুলো না আমরা। এখানেই যাত্রার পরিসমাপ্তি হোক।

এখন কেবল আমার স্বামী, স্বর্গত ফারাও মামোসের সমাধির উপযুক্ত স্থান খুঁজে বের করা বাকি, সিদ্ধান্ত জানালেন রানি। সমাধি নির্মাণ শেষ হতে যখন ফারাও চিরন্দ্রিায় শায়িত হবেন সেখানে, তার কাছে করা আমার শপথ পূর্ণ হবে। এরপর, খুশিমনে আমাদের মিশরে ফিরে যাবো আমরা। একমাত্র তখনই বর্বর হিকসস্‌দের বিরুদ্ধে লড়তে ফিরে যেতে পারবো আমরা।

আমার ধারণা, অল্প কিছু লোকের মতো আমিও নিরাশ হয়েছিলাম এই সিদ্ধান্তে । আমি দেখতে চাইছিলাম, নদীর এই বাকের পরে কী আছে; কী আছে ওই পাহাড়ের চূড়ার ওপারে। ওদিকে বেশিরভাগ লোকই ততদিনে দীর্ঘযাত্রার ধকলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। আমি আরো ঘুরে দেখতে চাইছিলাম। কাজেই আমার কর্ত্রী যখন ফারাও এর সমাধির উপযুক্ত স্থান খুঁজে বের করার জন্যে রাজকুমার মেমননের রথ-বাহিনীর সহায়তায় এগোনোর অনুরোধ করলো–খুব খুশি হয়েছিলাম। কেবল যাত্রা পথের আনন্দই নয়, রাজপুত্রের সান্নিধ্যও পাওয়া যাবে সেক্ষেত্রে।

চৌদ্দ বছর বয়সেই রাজপুত্র মেমনন সেই অভিযানের অধিনায়ক মনোনীত হয়েছিলো। এ অবশ্য কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। আমাদের ইতিহাসে অনেক ফারাওই এর চেয়ে কম বয়সে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। রথ-বহর তৈরি হতে রাজপুত্র নিজে পরীক্ষা করে দেখলো প্রতিটি বাহন, ঘোড়া। প্রত্যেকটি রথের জন্যে দুটি করে বাড়তি ঘোড়া বরাদ্দ করা হয়েছিলো, যাতে করে জানোয়ারগুলোকে পালাক্রমে বিশ্রাম দিয়ে দিন-রাত চলতে পারি আমরা।

এরপর আমরা দুজনে মিলে আলোচনায় বসলাম, কীভাবে, কততদূর পর্যন্ত যাওয়া যায়। নিশ্চই এমন একটা স্থান আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, কোনোদিনই কোনো সমাধি-চোর যেনো তার নাগাল না পায়।

কুশ দেশে প্রবেশ করার পর থেকে এমন কোনো স্থান আমরা দেখি নি, যা এই কাজের জন্যে উপযুক্ত। সামনে কেমন ভূমি পাওয়া যাবে, তাই নিয়ে গবেষণা চললো । এখন যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা, দুই নদীর সংযোগস্থল কেবুই-এ, তা ছিলো আমাদের দীর্ঘ যাত্রাপথের সবচেয়ে মনোরম স্থান।

মনে হয়, পৃথিবীর সমস্ত পাখি যেনো জড়ো হয়েছিলো সেখানে। কি অলঙ্কারপূর্ণ মাছরাঙা, কি রাজকীয় নীল সারস; সূর্যকে আড়াল করে ফেলা বুনোহাঁসের ঝাঁক, বৌ কথা-কও পাখিএর যেনো কোনো শেষ নেই। রুপালি একাশিয়া গাছের ছায়া, দিগন্ত বিস্তৃত সাভান্নাহ্ যেখানে চড়ে বেড়ায় অসংখ্য অ্যান্টিলোপ। মনে হয় এ যেনো সত্যিই কোনো পবিত্র স্থান, যা দেবী নিজে মনোনীত করেছেন। মুক্ত নীল আফ্রিকার আকাশের নিচে নীলের স্রোতধারায় মাছের কোনো অভাব নেই।

ঠিক যেমন একই গর্ভের মাতার দুই সন্তানের আচরণ ভিন্ন হয়, তেমনি এই জোড়া নদীর চরিত্র আর ব্যবহারও একেবারেই ভিন্ন। ডান দিকের শাখা হলদেটে, ধীর; পরিমাণে বেশি জল ধারণ করছে, কিন্তু অপরটির মতো এতো বর্ণনাবহুল নয়। পূর্বদিকের শাখা ছিলো ধূসর-নীল রঙের, উন্মত্ত, স্রোতস্বিনী নিজের সহোদরের সঙ্গে মিলে যাওয়ার জন্যে ছুটে এসেছে যেনো। বহুদূর পর্যন্ত তার সত্তা আলাদা করা যায় মূল নদীর মধ্য থেকে।

কোন্ নদী ধরে যাবো আমরা, টাটা? মেমননের প্রশ্নের উত্তরে শিলুক পথ প্রদর্শনকারীদের ডেকে পাঠালাম আমি।

হলদেটে নদী এসেছে বিশাল, মশা-মাছি ভরা জলাভূমি থেকে যার কোনো শেষ নেই। কোনো মানুষ সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। কুমির, জলহস্তি আর বিষাক্ত পোকা-মাকড়ের দেশ সেটা। এমন জ্বর হয় সেই স্থানের বাতাসে, মানুষ চিরকালের জন্যে হারিয়ে যায়, জানালো শিলুকরা।

আর, অন্য নদীটা? আমরা প্রশ্ন করলাম।

গাঢ় রঙের নদী পড়েছে আকাশ থেকে, ভীষণ উঁচু সেই মেঘ-ছোঁয়া পর্বতের উপর থেকে। ওইখানে চড়ে, এমন সাধ্যি নেই কোনো মানুষের।

আমরা বাম দিকের গাঢ়-রঙা নদী ধরেই এগোবো, সিদ্ধান্ত নিলো রাজপুত্র। পাথুরে পর্বতে আমার পিতার চিরন্দ্রিার জন্যে কোনো না কোনো জায়গা অবশ্যই পাওয়া যাবে।

কাজেই, পুব দিকে চললাম আমরা যততক্ষণ পর্যন্ত না দিগন্তে দেখা দিলো পর্বতশৃঙ্গ। এমন উঁচু প্রতিবন্ধক কেউ জীবনেও দেখে নি। যতোই এগুলাম আমরা, প্রতিমুহূর্তে আমাদের দৃষ্টির সামনে আরো উঁচু হতে লাগলো সেই পর্বতশ্রেণী।

কোনো মানুষের পক্ষে ওখানে পৌঁছুনো সম্ভব নয়, চমৎকৃত মেমনন মন্তব্য করে। ওটা নিঃসন্দেহে দেবতাদের বাসস্থান।

পর্বতের উপরে বিদ্যুৎ চমকাতে দেখলাম আমরা। চারপাশের খাড়া পাহাড়ে লেগে ভারী গুমগুম প্রতিধ্বনি তুললো সেই শব্দ। যেনো কোনো পাহাড়ি সিংহ গর্জাচ্ছে।

সেই ভীষণ পর্বতের পাদদেশ পর্যন্ত যেতে পারলাম আমরা। এরপর আর রথ নিয়ে এগুনোর কোনো উপায় নেই। পর্বতের পাদদেশে, খাড়া দেয়ালঘেরা একটা লুকোনো উপত্যকা আবিষ্কার করেছিলাম আমরা। পুরো বিশদিন ধরে আমি এবং রাজপুত্র মিলে পরীক্ষা করে দেখলাম সেই দুর্গম স্থান, এরপর কালো দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে নরম স্বরে মেমনন বললো, এইখানেই আমার পিতার নশ্বর দেহ চিরকাল শায়িত থাকবে। স্বপ্নপুর, রহস্যময় চোখে উপরে তাকালো সে। মনে হয়, যেনো আমার মাথার ভেতর কথা বোলছেন। তিনি এখানে ভালো থাকবেন।

কাজেই, জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করে পাথুরে দেয়ালের গায়ে চিহ্ন এঁকে রাখলাম আমি; পথের নির্দেশনা এবং উপত্যকায় প্রবেশদ্বারের কৌণিক দূরত্ব হিসেব করে রাখলাম রাজমিস্ত্রিদের সুবিধার্থে। এই সমস্ত কাজ শেষ হতে, উপত্যকার গোলকধাঁধা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমরা। নীলের তীরে, আমাদের নৌবহরের উদ্দেশ্যে ফিরে চললাম।

*

কেবুই থেকে অল্প কয়েকদিনের দূরত্বে সমভূমির উপর রাতের মতো ক্যাম্প ফেললাম আমরা। রাতে ঘুম ভেঙে গেলো অ্যান্টিলোপ হরিণের বিশাল পালের চলাচলের শব্দে। দলে দলে আসছে হরিণের দল, এর যেনো কোনো শেষ নেই। একটির সঙ্গে অপটির অবয়বে কিছুমাত্র অমিল নেই। এ অবস্থায় ঘুমোনো বিপদজনক। তাই গোল হয়ে রথের চারধারে দাঁড়িয়ে রাত পার করলাম আমরা। সকাল হতে দেখা গেলো, হরিণের পালের ধাক্কায় মাটির সাথে মিশে গেছে বেশ কিছু রথ।

শিলুক পথ-প্রদর্শকদের কাছ থেকে জানা গেলো প্রতিবছরই এক স্থান থেকে কয়েকশ মাইল দূরের অপর কোনো চারণভূমিতে স্থানান্তরিত হয় অ্যান্টিলোপ। শিলুকরা এদের বলে নূ। এর কোনো শেষ নেই। প্রতিবছর কেবল বাড়ছে এদের সংখ্যা। রাজপুত্রকে জানালাম আমি।

তখন আমাদের কেউ বুঝতে পারে নি, এই অ্যান্টিলোপের পাল কত বড়ো সর্বনাশ ডেকে আনছে আমাদের জন্যে। অবশ্য, প্রাণীগুলোর নাকের শ্লেষা দেখে ব্যাপারটা বোঝা উচিত ছিলো আমার। অস্থির আচরণ করছিলো অ্যান্টিলোপের পাল।

যা হোক, জোড়া নদীর ধারে কেবুইয়ে ফিরে রানিকে ন্যূ-এর পালের চলাচলের বিষয়টা জানালাম আমরা। পরবর্তীতে তার নির্দেশে বেশকিছু অ্যান্টিলোপ শিকার করে মাংসের চাহিদা পূরণ করা হলো। এর ঠিক বারোদিন পর, একদিন আতনের সাথে বাও খেলায় বসেছিলাম, এমন সময় হুই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এলো রথ নিয়ে।

টাইটা! একশ গজ দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো সে। ঘোড়ার পাল! দেবী আইসিস আমাদের প্রতি সদয় হোন! ঘোড়ার পাল শেষ!

ওর কথা শুনতে যতো দেরি, ছুটে রথে চড়ে দ্রুত আস্তাবলে ফিরে চললাম। অর্ধেক ঘোড়া ততক্ষণে মাটিতে শায়িত। প্রথমেই দৌড়ে ধৈর্যের কাছে ছুটে গেলাম আমি। নাক দিয়ে শ্লেষা ঝরছিলো ওর, অবস্থা দেখে শিউড়ে উঠলাম। ঘাড় আর গলা ফুলে ঢোল স্বাভাবিকের দ্বিগুন আকৃতি পেয়েছে ওগুলো । মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে হলুদ পুঁজের ধারা। এ সেই রোগ যা অ্যান্টিলোপের পালের ভিতর দেখেছিলাম আমি। তাপে গা পুড়ে যাচ্ছে ঘোড়াটার। আবেগাপ্লুত আমি বুঝে উঠছিলাম না, কী করা উচিত। ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছিলো ধৈৰ্য্য।

কেউ একজন ঝুঁকে এলো আমার পাশে। একজন শিলুক-গোত্র প্রধান, অত্যন্ত মনোযোগী মানুষ। আমি বন্ধু হিসেবে নিয়েছিলাম তাকে। এ হলো নৃ-দের রোগ, তাদের নিজস্ব ভাষায় সে জানালো আমাকে। অনেক ঘোড়া মরবে। ন্যূ বছর শেষে এলে আমাদের অনেক পশু মরে। যেগুলো বেঁচে যায়, তাদের আর এই রোগ হয়না। তারা নিরাপদ চিরজীবনের জন্যে।

অসুস্থদের বাঁচানোর জন্যে কী করতে পারি, হা বানি? আমার প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়লো সে এপাশ-ওপাশ।

কিছুই করার নেই।

আমার কোলে মাথা রেখে গেলো ধৈৰ্য্য। সেই হলদেটে-ফাঁস রোগে আমাদের পালের সাত হাজার ঘোড়া মারা গিয়েছিলো সেবার। যেগুলো বেঁচে গেলো, সেগুলোও এতোটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলো, বহু মাস ধরে রথ টানার মতো শক্তি ছিলো না। ধৈর্য্যের শাবকটা অবশ্য বেঁচে গেলো, আমার রথের ডানদিকের লাগামটা সে-ই টানতো পরে। এতে শক্তিশালী এবং সহ্যক্ষমতা ছিলো ওর, আমি নাম দিয়েছিলাম অজেয়।

এই মহামারীর ফলে আমাদের মিশরে ফিরে যাওয়ায় কেমন প্রভাব পড়বে? আমার কী জানতে চাইলো একদিন।

বহু বছর পিছিয়ে দিয়েছে ওটা আমাদের, সত্যি কথাটাই বললাম তাকে। আমাদের বেশিরভাগ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়া মারা পড়েছে। আবারো রাজকীয়-আস্তাবল গড়ে তোলার জন্যে কাজ করতে হবে আমাদের। রথের সামনে থাকার জন্যে তরুণ ঘোড়াগুলোকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

পরের বছর চরম আতঙ্ক নিয়ে অ্যান্টিলোপের পালের বার্ষিক স্থান পরিবর্তন অভিযানের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু হা বানির কথাই সত্যি প্রমাণিত হলো । কেবল অল্প কয়েকটি ঘোড়ার হলুদ ফাঁস রোগ দেখা দিয়েছিলো, তা-ও অতোটা ভয়াবহ আকারে নয়। সামান্য কয়েকদিনের মধ্যেই আবারো সুস্থ হয়ে উঠলো ওগুলো ।

সবচেয়ে অবাক করা ব্যপার, প্রথম ন্যূ-এর পালের আগমনের পরে জন্ম নেওয়া অনেক শাবকেরও রোগ দেখা দেয় নি। সম্ভবত মায়ের দুধের সাথে সাথে এই রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতাও পেয়ে গেছিলো তারা। আর কখনো মহামারীর ভয়াবহতার সম্মুখীন হতে হয় নি আমাদের।

*

এখন ফারাও-এর সমাধি নির্মাণ তদারকি করেই দিন কাটে আমার। আট হাজার শিলুক শ্রমিকের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে পর্বতের অভ্যন্তরের উপত্যকায় তৈরি হতে লাগলো ফারাও মামোসের সমাধি মন্দির। যখনই কাজ থেকে একটু বিশ্রাম পেতাম, পর্বতের দিকে তাকিয়ে দেখতাম আমি। ওটা যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকতো আমাকে। কখনো একা, কখনো বা হুইকে সাথে নিয়ে পর্বতের আনাচে-কানাচে ঘুরে ফিরতাম। দুর্গম পাথুরে পথ, উপত্যকা, গুহা এ সমস্তই দারুনভাবে আকর্ষণ করে আমাকে।

পর্বতের অনেক উপরে যেবার প্রথম আইবেক্স-এর পাল দেখলাম, হুই ছিলো তখন আমার সাথে। এমন প্রজাতির প্রাণী আমি এর আগে দেখি নি। নীল নদের উপত্যকার বুনো ছাগলের চেয়ে দ্বিগুন লম্বা এরা, বৃদ্ধ মদ্দাগুলোর মাথার উপরের বাঁকানো শিং ভীষণ রকম লম্বা।

কেবুইয়ে, জোড়া-নদীর তীরে আমাদের কাফেলায় এই খবর পৌঁছে দিয়েছিলো হুই। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ধনুক কাঁধে, মেমননকে পাশে নিয়ে ট্যানাস এসে হাজির হলো রাজার সমাধি উপত্যকায়। ঠিক বাপের মতোই শিকারে পারদর্শী হয়ে উঠেছে রাজপুত্র ততোদিনে। আর আমার কথা বললে, শিকারের চেয়ে বুনো-দুর্গম অঞ্চল ঘুরে দেখাতেই বেশি আগ্রহী ছিলাম আমি।

কেবল প্রথম শৃঙ্গ পর্যন্ত এগোনোই ছিলো আমাদের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত, কিন্তু ওখানে চড়ে যে দৃশ্য দেখলাম, তাতে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। আরো বহু পর্বত গায়ে গায়ে লেগে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ পানে তাকিয়ে। ওগুলোর কাছে আমাদের পর্বতশৃঙ্গ একেবারেই বামন আকৃতির। সিংহের মতো হলদেটে-সোনালি রঙ সেগুলোর। উপত্যকার পর উপত্যকা, খাড়াই, মালভূমি এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।

আমাদের সাথে সাথে এঁকে-বেঁকে খাড়া ঢাল ধরে, ঝর্ণার আকৃতিতে এগিয়ে চলেছে নীল নদও। সব সময় অবশ্য আমরা তার গতিপথ অনুসরণ করতে সক্ষম হলাম না। অবশেষে যখন পর্বতের অভ্যন্তরের ভিন্ন দেশে সম্পূর্ণ ঢুকে পড়লাম, কেবল তখনই এই বোকামীর প্রকৃত স্বরূপ বোধগম্য হলো।

দশটি মাল বহনকারী ঘোড়াসহ একশ জন লোক আমরা। অন্তহীন খাদের কিনারে ক্যাম্প ফেলেছিলাম, ট্যানাস আর মেমননের শিকার করা নিত্য-নতুন জন্তুর দেহ বিছিয়ে রাখতাম আগুনের ধারে। এতো বড়ো ছিলো সেই আইবেক্স-এর মাথা, দু জন দাস মিলেও উঁচু করে ধরতে কষ্ট হতো। এরপর, বৃষ্টি শুরু হলো হঠাৎ করেই।

আমাদের চারপাশ ঘিরে রাখা খাড়া দেয়ালের উপরের আকাশ কালো করে মেঘ জমলো প্রথমে। রৌদ্রজ্জ্বল দুপুর থেকে এক লহমায় যেনো গোধূলী নেমে এলো। ঠাণ্ডা, ঝড়ো বাতাসে আমাদের শরীর সিঁটিয়ে গেলো। ভয়ে জড়াজড়ি করে অপেক্ষায় রইলাম আমরা।

এরপর বিদ্যুত চমকের সাথে সাথে শুরু হলো বজ্রপাত। একের পর এক বিশাল পাথরখণ্ড গুড়ো হয়ে গেলো সেই বজ্রপাতে। চারিদিকে গন্ধকের কটু গন্ধ। পাথুরে দেওয়ালে লেগে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগলো বজ্রপাতের আওয়াজ যেনো থামবে না কখনো। পায়ের নিচ ভীষণ রকম কাঁপতে লাগলো মাটি।

বৃষ্টি নেমে এলো তারপর। এ কোনো ফোঁটা নয়, মনে হলো নীল নদের গতিপথে অতিক্রম করা কোনো জলপ্রপাত যেনো ঝরে পড়ছে আমাদের উপর। শ্বাস নেওয়ার কোনো উপায় নেই, পানিতে ভরে গেছে নাকের ফুটো, ফুসফুস। আমরা যেনো ডুবে যাচ্ছি। এতো তীব্র বৃষ্টিতে এক হাত সামনে দাঁড়ানো মানুষ চেনার যো নেই। কাছাকাছি পাথরের খোড়লে আশ্রয় নিয়েছিলাম আমরা। বোধ-শক্তি যেনো অবশ হয়ে এলো।

ঠাণ্ডা কী জিনিস–সেদিন টের পেয়েছিলাম । কেবল লিনেন কাপড়ের পাতলা শাল পরে ঠকঠক করে কাঁপছিলাম আমরা। জোর করে চোয়াল চেপে রেখেও দাঁতে দাঁত বাড়ি খাওয়া ঠেকিয়ে রাখতে পারছিলাম না।

তখনই, বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে নতুন একটা শব্দ ধরা পড়লো আমার কানে। পানির গর্জন ছিলো সেটা। সরু যে উপত্যকায় আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম, গাঢ় ধূসর জলস্রোতে হারিয়ে গেলো সেটা। সামনে যা কিছু পেলো, ভাসিয়ে নিয়ে গেলো সেই জলস্রোত।

উল্টে-পাল্টে, হাবুডুবু খেতে খেতে ভেসে চললাম আমিও। এক পাথর থেকে। অপর পাথরে বাড়ি খেয়ে যেনো প্রাণ বেরিয়ে যাবে; বরফ-ঠাণ্ডা পানিতে মুখ-ভরা। কালো অন্ধকার ঘিরে ধরলো হঠাৎ করেই, মনে হলো মারা গেছি।

আবছাভাবে মনে পরে, কয়েকজোড়া হাত মিলে পানি থেকে টেনে তুলেছিলো আমাকে। তীরে নিয়ে শুইয়ে দেওয়া হলো। রাজপুত্রের কণ্ঠস্বর চিনতে পারলাম আমি। চোখ মেলার আগে ধোয়ার গন্ধ পেলাম, আরাম দায়ক উষ্ণতা দেহের একপাশে।

টাটা, চোখ মেলো! কথা বলো! নাছোড়বান্দা কণ্ঠস্বরে অনেক কষ্টে চোখ খুললাম আমি। আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে মেমনন। চোখ খুলতে দেখে হাসি ফুটে উঠলো ওর ঠোঁটে। ঘাড় ফিরিয়ে, কাঁধের উপর দিয়ে চেঁচালো সে, জেগে উঠেছে ও, লর্ড ট্যানাস!

টের পেলাম, একটা গুহায় আছি আমরা। বাইরে রাত নেমেছে। সাতসতে কাঠের আগুনের ধারে হেঁটে এলো ট্যানাস। বসে পড়লো রাজপুত্রের পাশে।

কেমন আছো, বুড়ো বন্ধু? হাড়-গোড় ভেঙ্গেছে বলে মনে হয় না।

বার দুয়েক চেষ্টা করে উঠে বসলাম আমি। শরীরের সমস্ত অঙ্গ যেনো চিৎকার করে প্রতিবাদ জানালো। মাথা দপদপ করছে। শরীরের সবখানে ব্যথা। এছাড়া, দারুন ক্ষিধে পেয়েছে।

তবে তোমার কিছুই হয় নি, মুচকি হেসে বলে ট্যানাস। কিছুক্ষণ আগে ভাবছিলাম, আমরা কেউ বোধহয় বাঁচবো না। আরো কিছু ঘটার আগেই এই অভিশপ্ত পর্বত থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। যেখানে আকাশ থেকে নদী ঝরে পড়ে তেমন একটা স্থানে শিকারে আসার চিন্তাই বোকামী।

বাকিদের কী হলো? জানতে চাইলাম।

মাথা নাড়লো ট্যানাস। সবাই ডুবে মরেছে। এক তোমাকেই পানির স্রোত থেকে টেনে তুলতে পেরেছিলাম আমরা।

আর ঘোড়া?

নেই, তিক্ত স্বরে বললো ট্যানাস। সব শেষ।

খাবার?

কিছু নেই। এমনকি আমার ধনুক পর্যন্ত হারিয়েছি। গায়ের কাপড় আর এই তলোয়ার কেবল সম্বল এখন।

*

সকাল হতে গুহার আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমরা, ভয়ঙ্কর সেই উপত্যকায় ফিরে চললাম। খাড়া ঢাল ধরে নিচে নেমে আসার পথে আমাদের সঙ্গী ক জনের মৃতদেহ পাওয়া গেলো। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ওখানেই পাথরের উপর এলোমেলো পড়ে আছে ক টা দেই। ঘোড়াগুলোর নিথর দেহও দেখতে পেলাম।

কিছু মূল্যবান সরঞ্জাম সংগ্রহ করা সম্ভব হলো সেখানে। যদিও পানিতে টইটুম্বুর, কিন্তু আমার ওষুধের বাক্সটা অক্ষতই আছে দেখে দারুন খুশি হলাম। ওটার সমস্ত দ্রব্য পাথরের উপর মেলে দিলাম শুকোনোর জন্যে, ঘোড়ার লাগাম কেটে চামড়ার ফিতে তৈরি করলাম কাঁধে ঔষধের বাক্সটা ঝুলানোর জন্য।

এরই মধ্যে নিহত ঘোড়ার দেহ থেকে সামান্য মাংস কেটে আগুনে ঝলসে নিয়েছে মেমনন। পেট ভরে খেয়ে বাকি মাংস সাথে করে নিয়ে নিলাম আমরা। ফিরতি পথে হেঁটে চললাম।

খাড়া পথ, উঁচু-নিচু প্রতিবন্ধক বারবার যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো। এ যেনো ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন–আমাদের পথচলা কখনো যেনো শেষ হবে না। রক্তাক্ত পা আর চলতে চায় না। এই বনের যেনো কোনো শেষ নেই। প্রতি রাতে সামান্য খড়-কুটো দিয়ে ধরানো ছোট্ট আগুনের পাশে বসে কাঁপতাম আমরা।

দ্বিতীয় দিনেই সবাই টের পেয়েছিলাম, পথ হারিয়েছি আমরা। এখন দিকচিহ্ন হারিয়ে উদভ্রান্তের মতো ঘুরে ফিরছি। আমি মোটামুটি নিশ্চিত এই অভিশপ্ত পর্বতে ক্লান্ত হয়ে প্রাণ হারাতে যাচ্ছি আমরা। এরপর নদীর শব্দ শুনতে পাওয়া গেলো। দুই খাড়াইয়ের মাঝামাঝি পৌঁছে দেখলাম, শিশু নীল নদ এঁকে-বেঁকে চলেছে নিচে। কেবল এ-ই সব নয়। নদীর ধারে কিছু রঙিন তাঁবু দেখা যাচ্ছে, ওগুলোর আশে পাশে মানুষের নড়াচড়া ঠাওর করা যায় দূর থেকে।

সভ্য মানুষ, সাথে সাথেই মন্তব্য করলাম আমি। ওই তাবুর কাপড় সেলাই করে তৈরি করা।

হ্যাঁ, ঘোড়াও দেখতে পাচ্ছি, সায় দিয়ে বললো মেমনন। দূরে, তাঁবুর ধারেই ঘুটিতে বাঁধা রয়েছে বেশ কিছু ঘোড়া।

দ্যাখো! ট্যানাস হাত উঁচিয়ে দেখায়। ওটা নির্ঘাত তলোয়ার নয়তো বর্শার গা থেকে ঠিকরে আশা সূর্যরশ্মির ঝলক। এরা ধাতু নিয়ে কাজ করে।

এরা কারা বুঝতে হবে আগে। এহেন দুর্গম ভূখণ্ডে কারা বসবাস করে, জানতে দারুন আগ্রহী আমি।

নির্ঘাত গলা কাটবে, ঘেৎ করে উঠে ট্যানাস। কেমন করে বুঝেছো, যে স্থানে বসবাস করে সেখানকার মতোই জংলী নয় এরাও? এরও বহু পরে আমরা জেনেছিলাম, তারা ছিলো ইথিওপিয়ার অধিবাসী।

ঘোড়াগুলো অসাধারণ! ফিসফিস করে বললো মেমনন। আমাদেরগুলো এমন লম্বা আর শক্তিশালী নয়। আমাদের উচিত নিচে নেমে একবার দেখে আসা। রাজপুত্র একজন জাত-ঘোড়সওয়ার।

ট্যানাস ঠিক বলেছে, ট্যানাসের সতর্কবার্তা আমার মধ্যে যুক্তি ফিরিয়ে এনেছে ততক্ষণে। হতে পারে, এরা বিপদজনক জংলী; সভ্য মানুষের জিনিসপত্র ব্যবহার করে।

সেই পর্বতের উপরে, পাথরে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করলাম আমরা তিনজন। শেষপর্যন্ত, কৌতূহলেরই জয় হলো। গাছপালার আড়ালে ঢাল ধরে গুঁড়ি মেরে নেমে এলাম আমরা।

কাছাকাছি এসে পড়তে বোঝা গেলো, এরা লম্বা গড়নের মানুষ, শক্তিশালী; সম্ভবত মিশরীয়দের তুলনায় একটু ভারী। ঘন কালো চুল কোঁকড়া। এদের পুরুষেরা দাড়ি রাখে–আমরা নিয়মিত খৌরি করি। লম্বা ঢোলা আলখাল্লা পরে এরা, খুব সম্ভব উল দিয়ে বোনা ওগুলো উজ্জ্বল রঙের। আমরা সাধারণত খালি গায়ে থাকি, আর তাছাড়া আমাদের আঁটো জামার রঙ সাদা। আমাদের পাতলা স্যান্ডলের বিপরীতে এরা। চামড়ার তৈরি জুতো পরে; মাথায় রঙ-বেরঙের পাগড়ি।

তাঁবুর চারপাশে কাজ করতে থাকা মহিলারা বেশ হাসিখুশি, ঘোমটায় আবৃত নয়। গান গাইতে গাইতে নিজেদের মধ্যে কোনো এক বিচিত্র ভাষায় কথা বলছিলো তারা। দারুন মিষ্টি তাদের কণ্ঠস্বর ।

একদল লোক মিলে কোনো একটা খেলা খেলছে, দেখে আমার কাছে বাও খেলার মতোই মনে হলো। তারস্বরে চেঁচিয়ে বাজি ধরছে, পাথরের ঘুটি চালছে। এক পর্যায়ে দুইজন লোক উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে কোমরে গোজা ছুরি বাগিয়ে ধরলো পরস্পরের দিকে। উন্মত্ত বেড়ালের মতোই লড়তে শুরু করলো তারা ।

এই সময়, এতক্ষণ ধরে একা বসে থাকা তৃতীয় এক ব্যক্তি অলস ভঙ্গিতে আড়ামোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ালো। ঠিক যেনো বিশ্রাম নিতে থাকা চিতার মতো। সামনে এগিয়ে নিজের তলোয়ারের বাড়িতে ছুরি দুটো ফেলে দিলো যুদ্ধরত দুই জনের হাত থেকে। সাথে সাথেই শান্ত হয়ে পড়লো দুই যোদ্ধা।

কোনো সন্দেহ নেই, এই লোকই গোত্রপ্রধান। ভীষণ লম্বা সে ঠিক পাহাড়ি ছাগলের মতো দুর্ধর্ষ আকৃতির। অন্যান্য কিছু বিষয়েও ছাগলের সাথে মিল আছে তার। এতো ঘন আর লম্বা তার দাড়ি, যেনো পাহাড়ি ছাগলের শিং; আকার আকৃতিতে কর্কশ; ভারী বাঁকা নাক, চওড়া মুখে নিষ্ঠুরতার ছাপ। আমার ধারণা, পাহাড়ি ছাগলের মতোই এর গায়েও দারুন গন্ধ আছে।

আচমকা আমার হাত চেপে ধরলো ট্যানাস, ফিসফিসিয়ে বললো, ওদিকে দ্যাখো!

সবার চেয়ে দামী পোশাক পরে আছে গোত্রপ্রধান। লাল এবং নীলের ডোরাকাট আচকান, কানে জ্বলছে মূল্যবান পাথর। কিন্তু কী দেখে উত্তেজিত হয়েছে ট্যানাস, প্রথমটায় ঠাওর করতে পারলাম না।

ওর হাতের তলোয়ার! হিসহিসিয়ে উঠলো ট্যানাস। তলোয়ারটা দ্যাখো একবার!

প্রথমবারের মতো ওটা ভালো করে দেখলাম আমি। আমাদেরগুলোর তুলনায় অনেক লম্বা ছিলো ওটা, হাতলটা নিঃসন্দেহে বিশুদ্ধ স্বর্ণের তৈরি, এতো সূক্ষ কারুকাজ করা, যা আমি এর আগে কখনো দেখি নি।

তবে ট্যানাসের দৃষ্টি কেড়েছে তলোয়ারের ফলা। গোত্রপ্রধানের বাহুর সমান দীর্ঘ–এমন কোনো ধাতু থেকে তৈরি, যা হলুদ তামা বা লাল কপার নয়। অদ্ভুত ঝকমকে রুপালি নীল ওটা ঠিক যেনো নীলের জল থেকে সদ্যতোলা মাছের আঁশের মতো। স্বর্ণের পাত মোড়া।

কী ওটা? ট্যানাস জানতে চায় রুদ্ধশ্বাসে। কী ধাতু এমন চমকায়?

জানি না।

নিজের ভাবুর সামনে আসনে বসলো সর্দার। কোলের উপর তলোয়ারটা ফেলে সামনে রাখা এক টুকরো আগ্নেয় শিলায় তৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘষতে লাগলো ওটার ফলা। পাথরের স্পর্শে ঝনঝন আওয়াজ করে উঠলো সেটা–তামা কখনো এমন শব্দ করে না। এ যেনো বিশ্রামরত সিংহের মৃদু গরগর ধ্বনি।

ওটা চাই আমার, ফিসফিস করে বলে ট্যানাস। ওই তলোয়ার হাতে না পাওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই আমার।

অবাত হয়ে ওর পানে তাকালাম-এমন কণ্ঠস্বরে কখনো কিছু বলতে শুনি নি। ট্যানাসকে। যা বোলছে ঠিক তাই চায় সে। ভীষণ এক আবেগে কাঁপছে তার সর্বাঙ্গ।

এখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না আমরা, নরমস্বরে মনে করিয়ে দিলাম। তাকে। ওরা দেখে ফেলবে আমাদের। ট্যানাসের হাত ধরে টানতে, থেমে পরে নিজের অস্ত্রের দিকে চেয়ে রইলো সে।

চলো, ওদের ঘোড়াগুলো দেখে আসি। তাগাদা দিলাম আমি। অবশেষে নিতান্ত অনিচ্ছায় এগুলো ট্যানাস। মেমননকে আরেক হাতে ধরে ক্যাম্পের চারপাশে বৃত্তকারে ঘুরে খুঁটিতে বাধা ঘোড়াগুলোর কাছে এগিয়ে গেলাম।

ঘোড়ার পালের কাছে পৌঁছুতে অনেকটা ট্যানাসের মতোই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম আমি, ঠিক যেমন নীল তলোয়ার দেখে হয়েছিলো ও। হিকসস্‌ ঘোড়ার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এরা। অনেক দীর্ঘ, অসাধারণ সুষমা তাদের দেহের শক্তিশালী পেশিতে। মাথা-ঘাড় অনেক বেশি সুন্দর, নাকের ফুটো চওড়া। উজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত টলটলে চোখ।

কী সুন্দর, আমার পাশ থেকে বলে উঠলো মেমনন। দ্যাখো, কী সুন্দর বাঁকানো গ্রীবা!

ট্যানাসের তলোয়ারের প্রতি মোহ আমাদের ঘোড়ার প্রতি আকর্ষণের চেয়ে নিঃসন্দেহে কম।

ও রকম একটা মদ্দা শুধু যদি আমাদেরন মাদী-ঘোড়ার সঙ্গে রাখা যায়, শ্রবণরত কোনো দেবতার উদ্দেশ্যে যেনো আবেদন জানালাম আমি। একটা মাত্র ও রকম ঘোড়া পেলে পুনরুজ্জীবনের আশা ছেড়ে দিতে রাজী আমি!

এমন সময়, একজন ঘোড়া-পরিচর্যাকারী কী যেনো বললো তার পাশের জনকে। রুরে, আমাদের অবস্থানের দিকে তাকিয়ে সোজা এদিকেই আসতে লাগলো সে। এবারে আর আমার তাগাদার প্রয়োজন হলো না, পাথরের আড়ালে ঝট করে মাথা নামিয়ে ধীরে বুকে হেঁটে পিছিয়ে আসতে লাগলাম তিনজনে। নদীর আরো ভাটিতে লুকোনোর ভালো একটা জায়গা পাওয়া গেলো। একবার সেখানে স্থান করে নিতেই নিজেদের মধ্যে তর্কে লিপ্ত হলাম।

ওখানে ফিরে গিয়ে এক হাজার ডেবেন স্বর্ণ সাধবো আমি তাকে, কঠিন স্বরে বললো ট্যানাস। ওই তলোয়ার পেতেই হবে আমাকে।

প্রথমেই তোমাকে মেরে ফেলবে সে। দ্যাখে নি, কেমন আদর করে ধার দিচ্ছিলো ফলায়?

ঘোড়াগুলো! মেমনন এবারে স্বপ্নলু স্বরে বলে উঠে। এমন সুন্দর প্রাণী কেবল স্বপ্নেই দেখা পাওয়া যায়। নির্ঘাত হোরাসের রথ টানে এরা।

এদের দু জনকে তো লড়তে দেখলে, সতর্ক করে দিয়ে বললাম আমি। এরা রক্তপিপাসু বর্বর। কিছু বলার আগেই তোমার পেট ফেঁড়ে ফেলবে। আর তাছাড়া, কী দেবে ওদের? এই মুহূর্তে আমরা ভিক্ষুক বৈ কিছু নই।

রাতের অন্ধকারে তিনটি ঘোড়া চুরি করে সমভূমিতে ফিরে যেতে পারি আমরা, নির্বিকার স্বরে বললো মেমনন। যদিও চিন্তাটা আকর্ষণীয় ছিলো, তথাপি কঠোর স্বরে আমি প্রত্যুত্তর করলাম, তুমি মিশরের রাজপুত্র চুরি তোমার কাজ নয়।

আমার উদ্দেশ্যে দাঁত বের করে হাসলো সে। ও রকম একটা ঘোড়ার বিনিময়ে যে কোনো কিছু করতে রাজী আমি।

এই যখন তর্ক চলছিলো, হঠাৎই নদীর তীর ধরে কাদের যেনো আগমনের শব্দ পাওয়া গেলো। সাথে সাথেই ভালো করে আড়াল নিলাম আমরা।

কাছে চলে এসেছে কণ্ঠস্বর । একদল মেয়ে আমাদের দৃষ্টিপথের মধ্যেই পানির কিনারায় এসে থেমে দাঁড়ালো। তিনজন বয়স্কা মহিলা, সঙ্গে এক তরুণী। মহিলাগুলোকে দেখে পরিচারিকা বলে মনে হলো আমার।

তরুণী মেয়েটা লম্বা, হালকা-পাতলা গড়নের। তার হাঁটার ভঙ্গিটা অনেকটা নীলের মৃদুমন্দ বাতাসে নাড়া খাওয়া প্যাপিরাসের ঝারের মতো মসৃণ। দামী উলের খাটো আলখাল্লা পরনে, হলুদ আর আকাশী সবুজের ডোরাকাটা-হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তোলা মেয়েটার। যদিও পায়ে চামড়ার জুতো আছে–আমি নিশ্চিত অত্যন্ত সুন্দর পা জোড়া।

আমাদের লুকোনোর জায়গার ঠিক নিচেই এসে দাঁড়ালো সে। একজন মহিলা তার পরনের কাপড় খুলে দিতে লাগলো। অপর দুইজনে মিলে কাদামাটির পাত্রে তুলে নিতে লাগলো নীলের জল। তখনো দারুন স্রোত নীল নদে, বরফ-শীতল সেই পানিতে নামার সাহস কারো হবে না।

মাথা গলিয়ে মেয়েটার পোশাক খুলে নিলো মহিলা–একেবারে নগ্ন সে এখন। মেমননের শ্বাস আটকে রাখার শব্দ শুনতে পেলাম আমি। তাকিয়ে দেখি, ঘোড়ার কথা। বেমালুম ভুলে গেছে সে।

দুইজন বয়স্ক স্ত্রী লোক পাত্র থেকে জল ঢেলে দিতে থাকলো তরুণীর নগ্ন দেহে। অপরজন ভাঁজ করা কাপড় দিয়ে গা ডলে দিতে লাগলো। মাথার উপরে দুই হাত তুলে ঘুরে ঘুরে দেহের সমস্ত অংশ পরিষ্কার করে দেওয়ার সুযোগ করে দিলো তরুণী। ঠাণ্ডা পানিতে গা শিরশির করে উঠায় চিৎকার করে হাসলো সে। পালিশ-করা চকচকে রুবী পাথরের মতো তার বুকের বৃন্তু দুটো দৃঢ় হয়ে উঠলো পানির স্পর্শে। নিখুঁত গোলাকার, উদ্ধত স্তন দারুন মসৃণ।

চুলগুলো ঘন কোঁকড়া একটা জঙ্গল। একাশিয়া গাছের ভেতরের কাণ্ডের মতো তার গায়ের রঙ, তেল চকচকে। পাহাড়ি এলাকার ঝকঝকে সূর্যালোকে ঝিলিক দিয়ে উঠছে।

সরু, পাতলা নাক; নরম-পূর্ণ ঠোঁট কিন্তু ভারী নয়। বড়ো বড়ো গাঢ় দু চোখ, উঁচু গালের হাড়ের উপর যেনো নিখুঁত মাপে বসান। এতো ভারী পাঁপড়ি যেনো জট পাকিয়ে গেছে। অসামান্য সুন্দরী এই মেয়ে। আর কেবল একজন মানবীর কথা জানি আমি–যে এরচেয়ে বেশি সুন্দরী।

এই সময়, কিছু একটা বললো সে মহিলাদের উদ্দেশ্যে। তারা সরে দাঁড়াতে, লম্বা লম্বা নগ্ন পায়ে ঠিক আমাদের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসতে লাগলো। কিন্তু আমাদের আড়াল-নেওয়া জায়গার আগেই, কাছের একটা বোল্ডারের আড়ালে এসে থামলো সে। এখন আর মহিলারা দেখতে পাবে না মেয়েটাকে। কিন্তু আমাদের পূর্ণ দৃটিসীমার ভেতর রয়েছে সে এখনো। চারিদিকে দ্রুত একবার তাকিয়ে নিলো রূপসী, আমাদের অবস্থান টের পায় নি। সম্ভবত ঠাণ্ডা পানির ফল বসে পড়ে জল-বিয়োগ করতে লাগলো সে।

নরমস্বরে গুঙিয়ে উঠলো মেমনন। ইচ্ছেকৃত নয়, স্রেফ প্রতিক্রিয়া বশত; তীব্র আকর্ষণের এক দুর্বার যন্ত্রণা-মুখর কাতর ধ্বনি। চমকে লাফিয়ে উঠে সরাসরি ওর দিকে চাইলো মেয়েটা। ট্যানাস আর আমার থেকে একটু দূরে, একপাশে দাঁড়িয়ে তখন মেমনন। আমরা দু জনে আড়ালে পড়ে গেলেও, মেয়েটার দৃষ্টিপথে একেবারে সরাসরি সে।

পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা। বিশাল দুই চোখে ভয়, কাঁপছে তরুণী নগ্ন দেহে। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো চিৎকার করে দৌড় দেবে সে। পরিবর্তে, কাঁধের উপর দিয়ে ষড়যন্ত্রীর মতো করে পিছনে চাইলো মেয়েটা, যেনো নিশ্চিত হয়ে নিতে চাইছে তাকে অনুসরণ করে আসে নি মহিলারা। এরপর, মেমননের দিকে ফিরে নরম মিষ্টি স্বরে কিছু একটা জানতে চাইলো; হাতের ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে আবেদন।

আমি বুঝছি না, অসহায়ের মতো ভঙ্গি করে ফিসফিসালো মেমনন।

এক পা এগিয়ে, আবারো সেই একই কথা বললো মেয়েটা। এরপরও যখন মাথা নাড়লো রাজপুত্র, এগিয়ে এসে ওর এক হাত ধরে ঝাঁকালো সে। দ্রুত, জরুরি ভঙ্গিতে স্বর উঁচালো। কিছু একটা চাইছে সে রাজপুত্রের কাছে।

মাসারা! একজন পরিচারিকা মেয়েটার গলার স্বর শুনে ফেলেছে। মাসারা! নিঃসন্দেহে, মেয়েটার নাম ওটা। দ্রুত চুপ থাকার নির্দেশ দিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্যে ঘুরলো তরুণী। কিন্তু ততক্ষণে ঢাল বেয়ে উঠে এসেছে তার পরিচারিকারা। কলকল করতে করতে উদ্বিগ্ন অবয়বে উঠে এসেই মেমননকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো তারা।

এক মুহূর্তের জন্যে নড়লো না কেউ। এরপর, একযোগে চিৎকার শুরু করলো তিনজন স্ত্রী লোক। নগ্ন মেয়েটাকে দেখে মনে হলো, হয়তো দৌড়ে মেমননের পাশে চলে আসবে সে, কিন্তু এক পা এগুতেই দুই পাশ থেকে তাকে ধরে ফেললো দুইজন। এবারে, চারজনে মিলে চেঁচাতে লাগলো তরুণী চেষ্টা করছে হাত ছাড়ানোর।

চলো, পালাই! আমার হাতে টান পড়তেই ট্যানাসের পিছন পিছন ছুটলাম।

নারীকন্ঠের চিৎকার পৌঁছেছে ক্যাম্পের কাছে। পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেলাম দলে দলে ছুটে আসছে তারা। একই সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, মেমনন আসে নি আমাদের পিছু পিছু। সুন্দরী সেই অচেনা তরুণীর পাশে প্রহরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে সে।

পূর্ণ-বয়স্ক তিনজন মহিলার সাথে টানা-হেঁচড়ায় ঠিক পেরে উঠছে না মাসারা বা মেমনন।

ট্যানাস! চিৎকার করে ডাকলাম আমি। মেম বিপদে পড়েছে!

দু জনে পিছন ফিরে এসে টেনে নিয়ে চললাম রাজপুত্রকে। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে সামনে চললো মেমনন। আমি তোমার জন্যে ফিরে আসবো। কাঁধের উপর দিয়ে মেয়েটার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললো সে। সাহস রেখো। আমি ফিরে আসবো তোমার জন্যে ।

আজকাল যখন কাউকে বলতে শুনি, প্রথম দর্শনে প্রেম বলতে কিছু নেই আপন মনে হাসি আমি। আর মনে করি সেই দিনের কথা, যেদিন মেমনন প্রথম দেখেছিলো মাসারাকে।

মেমননকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে গিয়ে সময় নষ্ট করে ফেলেছিলাম আমরা। পিছুধাওয়াকারীরা বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে এখন। সাঁ করে একটা তীর মেমননের কাঁধের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলো । অল্পের জন্য রক্ষা পেলো রাজপুত্র।

সরু পথে এক সারিতে ছুটছিলাম আমরা। মেমনন সামনে, পেছনে ট্যানাস। সবার শেষে ছিলাম আমি, পিঠের ওষুধের বাক্সের ওজনে ছুটতে অসুবিধা হচ্ছিলো। ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছিলাম ওদের থেকে। আরো একটা তীর উড়ে গেলো মাথার উপর দিয়ে, এরপর তৃতীয় একটা তীর সোজা আঘাক করলো আমার পিঠে। ওষুধের বাক্সের কারণে এফেঁড়-ওফোড় হওয়া থেকে রক্ষা পেলাম।

দৌড়াও, টাইটা! ট্যানাস চেঁচালো সামনে থেকে। ওই হতচ্ছারা বাক্সটা ফেলো এবারে! না হয় ধরা পড়ে যাবে!

ততক্ষণে আমার তেকে পঞ্চাশ গজমতো এগিয়ে গেছে সে আর মেমনন। কিন্তু কিছুতেই আমার প্রাণপ্রিয় ওষুধের বাক্স ফেলে রেখে যেতে পারবো না। ঠিক এ সময়ই, আবারো আঘাত হানলো তীর। এবারে আর রক্ষা নেই, উরুর মাংসল এলাকা ভেদ করে ঢুকে গেলো ওটা। উল্টে-পাল্টে পথের উপর পড়ে গেলাম।

টাইটা! ট্যানাস চেঁচিয়ে ডাকলো, তুমি ঠিক আছো? ঢালের গোড়ায় দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে আমার অবস্থা দেখলো সে। মেমনন ততক্ষণে চুড়ো টপকে বাঁকের আড়ালে হারিয়ে গেছে।

তীর লেগেছে পায়ে! পাল্টা চেঁচালাম আমি। আমাকে ছাড়াই এগিয়ে যাও। আমি আর হাঁটতে পারবো না!

এক মুহূর্ত অস্বস্তি না করে, ঘুরে ফিরে আসতে লাগলো ট্যানাস। পিছু ধাওয়াকারী লোকেদেরে মধ্যে ইথিওপিয়ান সর্দারও ছিলো, ট্যানাস ফিরে আসতে দেখে গর্জে উঠলো সে। তলোয়ার মাথার উপরে ঘুরিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছে।

আমার কাছে পৌঁছে গেছে ট্যানাস, ধরে দাঁড় করানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলো ও। কোনো লাভ নেই, খারাপ আঘাত পেয়েছি। বরঞ্চ নিজে বাচো! কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। একেবারে গায়ের উপরে এসে পড়েছে ইথিওপিয়ানরা। আমাকে ফেলে রেখে এক হাতে তলোয়ার বাগিয়ে ধরে ট্যানাস।

ওরা দুই জন পরস্পরের দিকে উন্মত্তের মতো এগিয়ে যায় ট্যানাস আর ইথিওপিয়ার সর্দার। এই লড়াইয়ের ফলাফল সম্পর্কে অবশ্য আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। ট্যানাস মিশরের সেরা তলোয়ারবাজ। একবার যদি সর্দারকে সে মেরে ফেলে, আমাদের কাউকে ছেড়ে দেবে না এরা।

প্রথমে ট্যানাসের মাথা বরাবর ভীষণ এক আঘাত হানলো ইথিওপিয়ান সর্দার। সমমানের কোনো যোদ্ধার বিপরীতে এ বড়ো নাজুক কৌশল–আমি জানি, এবারে একহাতে আঘাত ঠেকিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে সর্দারের গলা বরাবর প্রিয় মার দেবে ট্যানাস।

পরস্পরের সাথে সংঘর্ষ ঘটলো দুই তলোয়ারের ফলার। কিন্তু কোনো আওয়াজ হলো না। নীল তলোয়ারের ফলা সহজেই ভেদ করে গেলো ট্যানাসের হলদেটে-তামার তলোয়ার–যেনো ওটা কোনো নরম চারাগাছের কাণ্ড। কেবল তলোয়ারের হাতল ধরা অবস্থায় এক আঙুলের সমান অবশিষ্ট ফলা সমেত হতবুদ্ধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলো ট্যানাস। অল্পের জন্যে ইথিওপিয়ানের পরবর্তী আঘাত থেকে বেঁচে যেতে পারলো সে, কিন্তু বুকের খোলা তুকে আঁচড় কেটে দিয়েছে নীল তলোয়ার। সাথে সাথে রক্ত বেরুতে শুরু করলো ফিনকি দিয়ে।

পালাও, ট্যানাস! চেঁচালাম আমি। না হয় আমরা দুজনেই মারা পড়বো।

আমার কাছেই লড়ছিলো ওরা। কিছুমাত্র না ভেবে দুই হাতে ইথিওপিয়ার সর্দারের পা আঁকড়ে ধরে মাটিতে ফেলে দিলাম আমি।

জড়াজড়ি অবস্থায় ঢালুপথে গড়াতে থাকলাম আমরা দু জন। গড়িয়ে পথ থেকে পরে যাওয়ার আগের মুহূর্তে এক ঝলক দেখলাম ট্যানাসকে; উঁকি মেরে দেখছে ঘাড় ফিরিয়ে। দৌড়াও! মেমননকে দেখো রেখো!

ঝপাৎ করে ঠাণ্ডা জলস্রোতে খসে পড়লাম আমি আর সর্দার। পতনের ধাক্কায় মাথার ভেতরটা এমন ঝাঁকি খেলো, এক মুহূর্তের জন্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম আমি। কিছু সময়ের মধ্যেই কয়েকজোড়া কর্কশ হাত পানি থেকে টেনে তুললো আমাকে, তাদের এলোপাথারি মারের চোটে জ্ঞান ফিরে এলো। শেষপর্যন্ত গোত্রপ্রধানের হস্তক্ষেপে প্রাণে বেঁচে গেলাম। টেনে-হিঁচড়ে ক্যাম্পের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো ওরা আমাকে, এ সময় দেখতে পেলাম আমার ওষুধের বাক্সটা পড়ে আছে পথের উপর। কাঁধে ঝুলানোর ফিতেটা ছিঁড়ে গেছে।

ওটা নিয়ে এসো! যতোটা সম্ভব দৃঢ়তা দেখিয়ে আদেশ দিলাম আমাকে ধরে রাখা বর্বরদের। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেও, সদারের নির্দেশে বাক্সটা নিয়ে নিলো তারা।

আমার পক্ষে হাঁটা সম্ভব নয়। কিছু সময় পর পর বুকের পাজরে লাথি ঝেড়ে মনের ঝাল মিটাচ্ছিলো শয়তানগুলো। আমার উদ্দেশ্যে বা কোথা থেকে এসেছি–এই নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক চললো তাদের মধ্যে। অচিরেই, ট্যানাস আর মেমননকে ধাওয়া করা দলটা ফিরে এলো ব্যর্থ-মনোরথে। ওরা পালিয়ে যেতে পেরেছে জেনে মনের মধ্যে খুশির হাওয়া বইতে লাগলো আমার।

আরো কিছুক্ষণ লাথি-ঘুষি চললো আমার উপর। অবশেষে সর্দার নিরস্ত্র করলো তাদের। রক্তাক্ত-ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় নিথর পড়ে রইলাম আমি। শরীরের শেষবিন্দু শক্তিও নিঃশেষিত।

সবচেয়ে বড়ো তাঁবুর সামনে, নিজের আসনে বসলো ইথিওপিয়ান সর্দার। তলোয়ারের ফলায় আলতো করে হাত বুলিয়ে কৌতূহলী চোখে আমাকে দেখতে লাগলো সে। যদিও মাঝে-মধ্যে বিড়বিড় করে কিছু বলছিলো নিজের লোকেদের, আমার মনে হলো বিপদজনক সময়টা পেরিয়ে এসেছি।

কিছু সময় অপেক্ষা করে, সরাসরি তার উদ্দেশ্যে মুখ খুললাম আমি । বাক্সটা প্রয়োজন আমার। ক্ষতের পরিচর্যা করতে হবে।

কথা না বুঝলেও ইঙ্গিতে আমার কথার ভাবার্থ বুঝে নিয়েছে সর্দার। একজন লোককে আমার ওষুধের বাক্সটা এগিয়ে দিতে নির্দেশ দেয় সে। তার সামনে বসে, বাক্সের ডালা খুললাম আমি। বাক্সের সমস্ত জিনিস মাটিতে ঢেলে তন্নতন্ন করে খুঁজলো সর্দার। যখনই কোনো বিষয়ে প্রশ্ন জাগলো তার মনে, হাতে তুলে ধরে দেখালো আমাকে। আমিও যতোটা পারি আকারে-ইঙ্গিতে বোঝালাম তাকে।

এক শল্যবিদের ছুরি ছাড়া আর কোনো বিপদজনক অস্ত্র বাক্সে নেই দেখে সন্তুষ্ট হলো সর্দার। আমার ধারণা, এগুলো যে চিকিৎসার সরঞ্জাম–এ কথা তার মাথায় আসেনি তখন। এরপর, ইশারায় তাকে দেখিয়ে দিলাম, তীরটা বের করতে হবে আমার পায়ের মাংস থেকে। তলোয়ারের উগা দিয়ে ক্ষতের মুখটা বড়ো করলো সর্দার; এরপর একটানে বের করে ফেললো তীরটা। শল্যবিদের ছুরির সাহায্যে তীরের আটকে যাওয়া মাথাটা ছাড়ালাম আমি। ততক্ষণে ক্যাম্পের অর্ধেক তোক আগ্রহ ভরে দেখছে আমার কাণ্ড।

যে কোনো যুগে, যে কোনো সমাজে চিকিৎসকের এক বিরল সম্মান রয়েছে। এতো চাতুৰ্য্যের সাথে আমাকে কাজ করতে দেখে পুরো ক্যাম্পের মনোভাব পাল্টে গেলো আমার প্রতি।

সর্দারের নির্দেশে একটা তাঁবুতে নিয়ে মাদুরের উপর শুইয়ে দেওয়া হলো আমাকে। মাথার কাছেই রাখা হলো ওষুধের সরঞ্জাম। একজন স্ত্রী লোক গমের তৈরি রুটি, মুরগির ঝোল আর ভারী টক দুধ নিয়ে এলো আমার জন্যে।

সকালে, যখন রওনা হলো পুরো গোত্র, ঘোড়ায় টানা একটা ভুলায় স্থান হলো আমার। বন্ধুর পথে আমাকে টেনে নিয়ে চললো ওয়াগন-টানা ঘোড়া। সূর্যের কোণ দেখে দুঃখে বুকটা ফেটে যেতে চাইলো। অসীম পর্বতের অভ্যন্তরের উঁচু বনাঞ্চলে চলেছে এরা, বুঝলাম চিরকালের জন্যে হয়তো আমার লোকেদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। চিকিৎসক হওয়ায় হয়তো প্রাণে মারে নি, কিন্তু এতো মূল্যবান পেশার একজন লোককে কখনোই যেতে দেবে না গোত্র সর্দার। বুঝতে পারলাম, সত্যিই আজ একজন ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *