৬. একেবারে আশা নেই

একেবারে আশা নেই আমাদের এমন নয়, ফিসফিস করে বললাম লসট্রিসকে; রাজার শয্যাপাশে বসে সে। ট্যানাস ওর বাহিনী গোছাচ্ছে, আর আমাদের এই মিশরকে যদি কেউ রক্ষা করতে পারে, তো সে ট্যানাস। এরপর রাজার চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

ক্ষত পরীক্ষা করে দেখার সময় আমার অভ্যাসবশত জোরে বলছিলাম। তীরবিদ্ধ হওয়ার পর এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে; তীরের দণ্ডের চারপাশের মাংস ফুলে বিচিত্র রঙ ধারণ করেছে।

ওটাকে বের করতেই হবে। ভেতরে থাকলে আগামীকাল সূর্যোদয়ের আগেই মারা যাবেন ফারাও। আমি ভেবেছিলাম, রাজা হয়তো অচেতন আছেন, কিন্তু আমার কথা শুনেছেন তিনি।

কোনো সম্ভাবনা আছে, টাইটা? দুর্বল কণ্ঠে জানতে চাইলেন ফারাও।

নিশ্চই। একেবারেই মিথ্যে কথা ওটা, আমার কণ্ঠস্বরেই প্রকাশ পেয়ে গেলো তা।

ধন্যবাদ, টাইটা। আমি জানি, চেষ্টার কোনো ত্রুটি করবে না তুমি। এই মুহূর্তে যে কোনো রকম দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিলাম তোমাকে। এ ছিলো তার দয়ালু স্বভাবের আরো একটি নমুনা, অতীতে বহুবার রাজার জীবন রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে চিকিৎসককে।

তীরের মাথাটা অনেক গভীরে আটকে গেছে। প্রচণ্ড ব্যথা করবে, আমি লাল শেপেনের গুঁড়ো দিচ্ছি, এতে করে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়বেন।

আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, রানি লসট্রিস কোথায়? তার প্রশ্নের সাথে সাথেই সাড়া দিলো মিসট্রেস। আমি আপনার পাশেই আছি, মহান ফারাও।

একটা প্রত্যাদেশ আছে আমার। সমস্ত রাজবধু আর লিপিকারদের খবর দেওয়া হোক, আমার ঘোষণা সবাই শোনার পর লিপিবদ্ধ করা হবে। ছোট্ট প্রকোষ্ঠে গাদাগাদি করে জড়ো হলো সবাই।

আমার কর্ত্রীর উদ্দেশ্যে হাত বাড়ালেন ফারাও। আমার হাত ধরো; আর যা বলছি, শোনো, তার নির্দেশে নিচু হয়ে বসলো লসট্রিস। নরম, প্রায় রুদ্ধশ্বাসে ফারাও বলে চললেন।

আমার মৃত্যুর পর, রানি লসট্রিস আমার পুত্রসন্তানের একমাত্র অভিভাবকরূপে বিবেচিত হবে। যে অল্প সময়ে তাকে জানার সুযোগ হয়েছে আমার, তা থেকে জানি, সে অত্যন্ত শক্ত মনের, বিচক্ষণ নারী। তা না হলে এতো বড়ো দায়িত্ব ওর উপর ন্যস্ত করতাম না।

আপনার বিশ্বাস আর ভালোবাসার জন্যে ধন্যবাদ, মহান মিশর। বিড়বিড় করে বললো রানি লসট্রিস, এবারে সরাসরি ওকে উদ্দেশ্যে করে ফারাও বললেন, সৎ আর জ্ঞানী লোকেদের নিজের চারপাশে রাখবে সবসময়। একজন যোগ্য ম্রাটের সমস্ত গুণাবলিতে ভূষিত করে গড়ে তোলো আমার পুত্রকে। তুমি জানো, কী চেয়েছি আমি।

সাধ্যমতো চেষ্টা করবো, ম্যাজেস্টি।

শাসনভার নেয়ার মতো বয়স হয়ে গেলে আর দেরি করো না। সে আমার রক্ত, ওর মাধ্যমেই আমার বংশধারা টিকে থাকবে।

আপনার ইচ্ছেমতো সবকিছু হবে, ফারাও।

যতোদিন তুমি শাসন করবে এই দেশ, জ্ঞান আর সতোর সাথে করবে যেনো আমার লোকেদের কোনো কষ্ট না হয়। বিভিন্নভাবে, বহুজন তোমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইবে এই মিশরের কর্তৃত্ব; কেবল এই হিকসস্ নয়, আরো শক্র আছে, যারা তোমার সিংহাসনের ছত্রছায়ায় বাস করবে। কিন্তু, তাদের বিরুদ্ধে লড়ে এই দ্বৈত-মুকুট আমার পুত্রের জন্যে সুরক্ষিত রাখবে তুমি।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, মহান ফারাও।

বেশ কিছু সময় নিশ্চুপ রইলেন রাজা। আমি ভাবলাম, হয়তো অচেতন হয়ে পড়েছেন, কিন্তু হঠাৎই আবার মিসট্রেসের হাত আঁকড়ে ধরলেন তিনি।

শেষ একটা দায়িত্ব আমি তোমাকে দিয়ে যেতে চাই। আমার সমাধি আর মন্দির এখনো অসম্পূর্ণ। আমার রাজ্যের মতো আজ ওগুলোও হুমকির মুখোমুখি, যে ভয়াবহ পরাজয় ঘটেছে আমাদের। আমার বীর সেনাপতিরা ওদের ঠেকিয়ে রাখতে না পারলে, হিকসসেরা থিবেস দখল করে নেবে।

দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করি, তেমনটি যেনো না ঘটে, ফিসফিস করে বললো লসট্রিস।

আমি তোমাকে কড়াকড়িভাবে বলে যেতে চাই, আমার শবদেহ মমি করে, সমস্ত ধন-সম্পদসহ মৃতের পুস্তক অনুযায়ী যেনো সমাধিস্থ করা হয়।

চুপ করে বসে রইলো লসট্রিস। আমি জানি, ওই বয়সেও ও বুঝেছিলো কতো কঠিন দায়িত্ব অর্পণ করলেন ফারাও।

লসট্রিসের হাতে ফারাও-এর মুঠি শক্ত হলো, আঙুলের গাঁট সাদা হয়ে গেছে একেবারে। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো লসট্রিস। তোমার জীবন আর অমরত্বের নামে শপথ করো শপথ করো, আমার সমস্ত সভাসদের সামনে। হাপির নামে শপথ করো–শপথ করো সেই মহান তৃতীয়া ওসিরিস, আইসিস আর হোরাসের নামে 

করুণ চোখে আমার দিকে চাইলো লসট্রিস। আমি জানি, একবার শপথ করলে জীবন দিয়ে হলেও তার প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে সে, ঠিক তার প্রেমিকের মতোই। এই ক্ষেত্রে ট্যানাস এবং লসট্রিস একই সুতোয় গাঁথা। আজ, রাজার কাছে করা শপথের কারণে একদিন হয়তো রাজকুমার মেমনন, ক্রীতদাস টাইটার জীবন বিপন্ন হবে। কিন্তু মৃত্যুশয্যায় একজন রাজাকে কেমন করে ফিরিয়ে দিতে পারে কেউ? নিজের অজান্তেই ওর উদ্দেশ্যে মাথা ঝোঁকালাম আমি।

দেবী হাপি আর সমস্ত দেবতাদের শপথ করলাম, নরম অথচ পরিষ্কার স্বরে বললো রানি লসট্রিস। সামনের বছরগুলোয় অন্ততঃ একশবার এই নিয়ে পরিতাপ করেছিলাম আমি, যদি শপথ এড়িয়ে যেতো লসট্রিস!

সন্তুষ্টির ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফারাও, ধীরে লসট্রিসের হাত ছেড়ে দিলেন। এবার তবে, তোমার চিকিৎসার জন্যে তৈরি আমি টাইটা। দেবতাদের যা ইচ্ছে করুন, কেবল একবার আমার শিশুপুত্রকে চুমু খেতে চাই।

ছোট্ট রাজকুমারকে নিয়ে আসার অবসরে সমস্ত মহৎপ্রাণ আর রাজবধূদের তাড়িয়ে দিলাম আমি প্রকোষ্ঠ থেকে। এরপর, দারুন শক্তিশালী একটা মিশ্রণ তৈরি করলাম লাল শেপেনের গুড়া থেকে। এতো ব্যথা হবে ফারাও-এর, যার ফলে মৃত্যু ঘটতে পারে।

সবুটুক মিশ্রণ খেয়ে ফেলতে তার চোখের মণি ছোটো হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। অবশেষে, ফারাও-এর চোখের পাতা বন্ধ হতে, পরিচারিকাদের সঙ্গে বাইরে পাঠিয়ে দিলাম রাজকুমারকে।

*

ট্যানাস যখন রাজকীয় জাহাজে চড়লো, ততক্ষণে অন্ধকার ঘনিয়েছে। মশালের আলোয় যুদ্ধক্ষেত্রের কোনো শবদেহের মতোই দেখালো তাকে। ক্লান্তি আর ধুলোয় মাখামাখি বিবর্ণ, ফ্যাকাসে মুখ। শুকনো রক্ত আর কাদামাটি লেপ্টে আছে কাপড়ে, চোখের নিচে কালো আর নীলাফোলা ছায়া। আমাকে দেখতে পেয়েই ফারাও-এর সম্বন্ধে জানতে চাইলো সে।

তীরটা বের করেছি আমি, জানালাম তাকে। কিন্তু আঘাত অত্যন্ত গভীর, হৃদপিণ্ডের কাছাকাছি। একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। তিনদিন পর্যন্ত টিকে গেলে হয়তো প্রাণ বাঁচানো যাবে।

তোমার কর্ত্রী আর তার পুত্রের কী খবর? যখনই দেখা হয়, এই প্রশ্ন ট্যানাস করবেন আমাকে।

রানি ক্লান্ত; তীর বের করার সময় শল্যচিকিৎসায় আমাকে সাহায্য করেছে সে। ফারাও, তাকে দেশের শাসনভার দিয়েছেন। রাজকুমার আগের মতোই সুস্থ, হাসিখুশি।

লক্ষ্য করলাম, কাঁপছে ট্যানাস। মূলত নিজের অসাধারণ শক্তিমত্তার প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছে সে। বিশ্রাম প্রয়োজন তোমার বলতেই, মাথা নেড়ে উড়িয়ে দিলো ট্যানাস।

আলো নিয়ে এসো এখানে, আদেশ করে সে। টাইটা, লেখার সরঞ্জাম রঙ তুলি, কালির পাত্র আর স্ক্রোল নিয়ে এসো। নেমবেটকে একটা সতর্কবার্তা পাঠাতে হবে এখনই, নচেৎ সরাসরি হিকসস্‌দের হাতে এসে পড়বে।

কাজেই, অর্ধেক রাত জাহাজের খোলা পাটাতনে বসে থেকে নেমবেটের উদ্দেশ্যে জরুরি বার্তা লিখলাম আমরা। বার্তাটি ছিলো এরকম : :

মিশরের সাহসী সিংহ, ফারাও সেনাবাহিনীর রা বিভাগের সেনাপতি, লর্ড নেমবেটকে অভিনন্দন। আপনি চিরজীবি হোন!

আপানাকে জানানো যাচ্ছে যে, আবনুবের সমভূমিতে শত্রু হিকসস্‌দের সঙ্গে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছি আমরা। ভয়ঙ্কর শক্তিশালী এবং হিংস্র তারা এমন অদ্ভুত, দ্রুতগামী বাহন আছে সঙ্গে, যার বিরুদ্ধে আমরা অসহায়।

আপানাকে আরো জানাতে চাই, শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে আমাদের সেনাবাহিনীর, ধ্বংস হয়ে গেছি আমরা। হিকসস্‌দের ঠেকিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই আমাদের কাছে।

আরো জানানো হচ্ছে, যুদ্ধে মারাত্বক আহত অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন ফারাও। আপনাকে সতর্ক করে দিয়ে জানাচ্ছি, কিছুতেই খোলা ময়দানে হিকসস্‌ বাহিনীর মুখোমুখি হবেন না; তাদের বাহন বায়ুর গতিতে চলে। যথাসম্ভব, পাথুরে দেওয়ালের আড়ালে আশ্রয় নিন, অথবা, জাহাজে অবস্থান নিন।

হিকসস্‌দের নিজস্ব কোনো জাহাজ নেই, কাজেই শুধুমাত্র আমাদের জাহাজের মাধ্যমেই তাদের সাথে যুদ্ধে টিকে থাকা সম্ভব।

আমরা আপনার বাহিনীর সঙ্গে যোগদান না করা পর্যন্ত লড়াইয়ে নামা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।

হোরাস এবং সমস্ত দেবতা আপনার সঙ্গী হোন।

ট্যানাস, লর্ড হেরাব, ফারাও সেনাবাহিনীর টাহ্ বিভাগের সেনাপতি।

.

চারটি বার্তা লিখলাম এ রকম, দক্ষিণে লর্ড নেমবেটের কাছে পৌঁছানোর জন্যে বার্তাবাহকদের খবর দিলো ট্যানাস। বার্তা সমেত দুইটি দ্রুতগামী গ্যালি নদীর উজানে পাঠিয়ে দিলো সে, এছাড়াও, নীল নদের পশ্চিম তীর ধরে পায়ে হেঁটে পাঠিয়ে দিলো কয়েকজন সৈনিককে।

একটা না একটা স্ক্রোল নেমবেটের কাছে পৌঁছুবেই। সকালের আগে আর কিছু করার নেই তোমার, ট্যানাসকে আশ্বস্ত করে বললাম আমি। এখন কিছুক্ষণ অন্তত ঘুমাও, না হলে তোমার সাথে সাথে মিশরের সমস্ত আশাও শেষ হয়ে যাবে।

রাজার প্রকোষ্ঠে ফিরে আমার কর্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে চললাম।

পরদিন সকালে আলো ফোঁটার আগেই জাহাজের পাটাতনে পৌঁছে শুনলাম, আমাদের জাহাজ পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছে ট্যানাস। অবাক বিস্ময়ে থ মেরে গেলাম, অবশেষে কর্কশ কণ্ঠে ট্যানাস বললো, আমার দলের অধিনায়কদের থেকে এই মাত্র খবর পেয়েছি গতকাল, আবনুবের সমভূমিতে যে ত্রিশ হাজার যোদ্ধা হিকসস্‌ রথের সঙ্গে লড়াইয়ে গিয়েছিলো, তাদের মধ্যে কেবল সাত হাজার বেঁচে গেছে। তার মধ্যে পাঁচ হাজার যোদ্ধা আহত, কারো কারো অবস্থা আশঙ্কাজনক। সুস্থদের মধ্যে নাবিকের সংখ্যা খুবই কম। কাজেই, জাহাজ চালানোর পর্যাপ্ত লোকবল নেই আমার। বাকি জাহাজগুলো নিশ্চই হিকসস্‌ দের জন্যে রেখে যেতে পারি না।

নলখাগড়ার ঝোপে করে আগুন জ্বাললো তারা। পুরো ছাই হয়ে গেলো আমাদের বহু গ্যালি। এর চেয়ে করুণ দৃশ্য আর কখনো দেখি নি। রাজকীয় জাহাজের গলুইয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো ট্যানাস, মুখের প্রতিটি রেখায়, চওড়া কাঁধের অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠলো শোক। তার কাছে জীবিত কোনো কিছুর মতোই সুন্দর ওই জাহাজবহর।

জ্বলন্ত মশালের মতো জাহাজগুলোর দিকে তাকিয়ে সমগ্র মিশর আর ট্যানাসের জন্যে শোকে মুহ্যমান হলাম আমি এবং লসট্রিস। সকালের সূর্যকে ম্লান করো দিয়ে জ্বললো আমাদের জাহাজগুলো।

এরপর, ট্যানাসের নির্দেশে অসুস্থ আর মৃতপ্রায় লোকে বোঝাই আমাদের অবশিষ্ট গ্যালি নোঙর তুললো। আবারো দক্ষিণে রওনা হলাম আমরা।

আমাদের পেছনে প্রজ্জ্বলিত কাঠামো থেকে বের হওয়া ধোয়া সকালের আকাশে উঁচু হয়ে রইলো, ওদিকে, সামনের আকাশের বহু উপরে এগিয়ে চললো হলুদ ধুলোর মেঘ; নীল নদের পুব তীর ধরে ক্রমশই ভেতরে প্রবেশ করছে হিকসস্‌ রথবাহিনী, এগিয়ে চলেছে অসহায় থিবেসের দিকে, উচ্চরাজ্যের আরো গভীরে।

মনে হলো, দেবতারা আমাদের মিশরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন; বছরের এই সময়ে উত্তর থেকে সাধারণত জোরালো হাওয়া বয়, কিন্তু এখন বাতাসে থমথমে স্থবিরতা। কিছু সময় পর বিপরীত দিকে থেকে বাতাস বইতে শুরু করায় সর্বনাশের ষোলোকলা পূর্ণ হলো। আহত, মৃতপ্রায় লোকে বোঝাই আমাদের গ্যালিগুলো স্রোত এবং বাতাসের বিরুদ্ধে ধীর গতিতে এগুতে লাগলো। স্বল্প সংখ্যক নাবিক প্রাণপণে দাঁড় টেনেও হিকসস্‌ বাহিনীর সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না, দ্রুত গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে তারা।

রাজার চিকিৎসায় পুরো সময় ব্যয় করতে লাগলাম আমি। কিন্তু, অন্য জাহাজগুলোয় অনেক আহত সৈনিক চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে। যতোবার ফারাও এর শয্যাপাশ থেকে উঠে একটু দম নিতে ভোলা পাটাতনে এলাম, আশেপাশের গ্যালিগুলো থেকে নদীতে লাশ ফেলতে দেখলাম। সাথে সাথেই পানিতে আলোড়ন করে উঠলো কুমিরের দল। ঠিক ক্ষুধার্ত শকুনের মতোই আমাদের গ্যালিগুলোর পেছনে চললো শয়তান সরীসৃপগুলো।

টিকে রইলেন ফারাও, দ্বিতীয় দিনে সামান্য একটু তরল খাওয়াতে সক্ষম হলাম। সেই সন্ধায় আবারো রাজকুমারকে দেখতে চাইলেন তিনি, ডেকে আনা হলো মেমননকে।

ততদিনে ঘাসফরিঙের মতো চঞ্চল আর পাখির মতো কিচির মিচির করতে শিখে। গেছে সে। সবসময়ই ছেলেটাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন ফারাও। মাঝে মধ্যে হয়তো বাড়াবাড়ি রকম প্রশ্রয় দিয়ে ফেলতেন, কাজেই তাঁর সান্নিধ্যে খুশির কমতি ছিলো না ছোট্ট মেমননের। ইতিমধ্যে অত্যন্ত সুন্দর এক শিশুতে পরিণত হয়েছে সে, পরিষ্কার, লম্বা হাত-পা, মায়ের মতো মসৃণ ত্বক আর গাঢ় সবুজ চোখ। সদ্য জন্মানো মেষশাবকের মতো কোঁকড়া ছিলো ওর চুল, কিন্তু সূর্যের আলো পড়লে ঠিক ট্যানাসের চুলের মতোই জ্বলতো।

অন্য সময়ের চেয়েও বেশি টান অনুভব করতেন ফারাও, মেমননের প্রতি। এই ছেলে আর আমার কীর থেকে নেওয়া শপথ তাঁর অমরত্বের চাবিকাঠি। সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমার সান্নিধ্যে রাজকুমারকে নিজের কাছে রাখতেন তিনি। জানতাম, মেমননের চঞ্চলতা, দুষ্টামি ফারাও-এর শক্তি শুষে নিচ্ছিলো, কিন্তু একমাত্র রাতের খাবারের সময় ছাড়া ছেলেকে কাছ ছাড়া করতেন না ফারাও।

আমার কর্ত্রী আর আমি, তিনি না ঘুমিয়ে যাওয়া পর্যন্ত শয্যাপাশে থাকতাম। প্রসাধনী ছাড়াও তার মুখাবয়ব ছিলো লিনেন চাদরের মতো সাদা।

পরবর্তী দিনটি হলো আঘাতপ্রাপ্তির তৃতীয় দিন, কাজেই সবচেয়ে বিপদজনক। যদি এই দিনটি টিকে থাকেন তিনি, আমি জানি, তাকে সেরে তুলতে পারবো। কিন্তু সকালে ঘুম ভেঙে জেগে উঠে দেখি, পুরো প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর গন্ধ। ফারাও-এর হুক ছুঁয়ে দেখি দারুন উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে মিসট্রেসকে ডাকলাম। হন্তদন্ত হয়ে পর্দার ওপাশ থেকে উঠে এলো সে।

কী হয়েছে, টাইটা? আর কিছু না বলে নীরবে আমার চেহারায় তাকিয়ে রইলো লসট্রিস। আমার পাশে বসতে, ধীরে ফারাও-এর বুকের পট্টি খুলে ফেলতে লাগলাম। যে সূতো দিয়ে সেলাই করেছিলাম ক্ষতটা, ওগুলো কেটে ফেলতে দৃষ্টি গোচর হলো আঘাতের ভয়াবহতা।

দয়াময়ী হাপি, উনার প্রতি দয়া করুন! ক্ষতের দিকে তাকিয়ে কঁকিয়ে উঠলো রানি। কালো যে পরত পড়েছিলো ক্ষতের মুখে, ওটা ফেটে গিয়ে ধীরে বেরিয়ে আসতে লাগলো ঘন, সবুজ পুঁজ।

পঁচন ধরে গেছে! ফিসফিসালাম আমি। এ হলো যে কোনো শল্যবিদের চরমতম দুঃস্বপ্ন। তৃতীয় দিবসে শুরু হয়ে সারা দেহে ছড়িয়ে পরে পঁচন।

কী করবো আমরা এখন? লসট্রিসের প্রশ্নের উত্তরে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লাম।

রাত নামার আগেই মারা যাবেন উনি, বললাম ওকে। পুরো জাহাজে এ খবর রটে যেতে সভাসদ, মহৎপ্রাণ, জমিদারগণ ভীড় করে এলেন ছোট্ট প্রকোষ্ঠে। নীরবে অপেক্ষায় রইলাম আমরা।

সবার শেষে এলো ট্যানাস। এক হাতে শিরস্ত্রাণ ধরে রেখে মাথা নিচু করে শোকের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো সে। মৃত্যুশয্যায় নয়, ওর নজর স্থির হলো লসট্রিসের উপর।

কারুকাজ করা লিনেনের শাল দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছিলো রানি, শরীরের ঊর্ধ্বাংশে কিছু পরেনি সে। রাজকুমারের মাতৃদুগ্ধ ছাড়ার পর স্বাভাবিক আকৃতি ফিরে পেয়েছে তার বুক জোড়া। কুমারীর মতোই পাতলা শরীরের কোথাও গর্ভাস্থার কারণে রুপালি দাগ পড়ে নি। এতো মসৃণ, উজ্জ্বল ত্বক ওর, যেনো মাত্রই সুগন্ধি তেল মেখেছে।

জ্বর কমানোর জন্যে ফারাও-এর শরীরে ভেঁজা কাপড় রাখলাম আমি। তাপে খুব দ্রুতই শুকিয়ে গেলো সেটা, বারবার পাল্টাতে হলো। এপাশ-ওপাশ করে, বেহুঁশ অবস্থায় তড়পালেন ফারাও সম্ভবত অন্য জগতের দৈত্য-দানোর আতঙ্কে।

মাঝে-মধ্যে মৃতের পুস্তক উদ্ধৃতি করছিলেন। সেই বালক বয়স থেকে পুরোহিতেরা শিক্ষা দিয়ে এসেছেন, স্বর্গের বিস্তীর্ণ মাঠে ঠিকানা খুঁজে পাবার চাবিকাঠি বা মানচিত্র হলো তা :

ফটিক-পথে আছে একুশটি বাঁক।
সবচেয়ে সরু পথ ঠিক তামার ফলার মতো।
দ্বিতীয় প্রবেশদ্বার প্রহরারত দেবী অত্যন্ত ধূর্ত
এবং কূটিল।
প্রজ্জ্বলিত শিখার রমনী তিনি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বেশ্যা,
মুখ তার সিংহীর ন্যায়,
পুরুষকে গিলে খায় তার যোনী,
দুগ্ধস্রোতে পথ হারায় তারা।

ক্রমশই দুর্বল হয়ে আসতে থাকে তাঁর কণ্ঠস্বর এবং নড়াচড়া। দুপুর গড়ানোর কিছু সময় পরে শেষ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিথর হয়ে গেলেন তিনি। নিচু হয়ে তাঁর গলায় হৃদস্পন্দন অনুভব করলাম, নেই, আমার স্পর্শের নিচে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। ফারাও-এর শরীর।

মহান ফারাও আর নেই, নরম স্বরে বলে তাঁর চোখের পাতা বন্ধ করে দিলাম।

শোকে চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়লো উপস্থিত প্রতিটি মানুষ। রাজবধূদের সঙ্গে চেঁচিয়ে কাঁদলো লসট্রিসও। এমন তীব্র-তীক্ষ সেই চিৎকার, আমার বৃকের নিচে যেনো সুড়সুড় করে উঠলো কোনো মাকড়শা, ধীরে প্রকোষ্ঠে ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। আমার পিছুপিছু পাটাতনে এসে হাত আঁকড়ে ধরলো ট্যানাস।

তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে তো? হিসহিস স্বরে বললো সে। নাকি, এ তোমার নতুন কোনো চাতুৰ্য্য?

জানি, নিজস্ব অপরাধবোধ আর ভয় থেকে ও রকম আচরণ করেছিলো ট্যানাস, কাজেই ভদ্রভাবে উত্তর দিলাম। হিকসস্‌ তীর তাঁকে শেষ করে দিয়েছিলো। আমার সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এ যে নিয়তির খেলা, আমন রার ইচ্ছে। আমাদের কারো কোনো দোষ নেই।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা ভারী হাত আমার কাঁধে রাখে ট্যানাস। এসব ঘটবে, কখনো ভাবতেও পারিনি। কেবল রানি আর আমাদের দুজনের সন্তানের কথা ভেবেছিলাম। ওর এই মুক্তিতে আমার বোধহয় আনন্দ করা উচিত; কিন্তু পারছি না। বহুকিছু শেষ হয়ে গেছে। দেবতার ইচ্ছাধীন আমরা সবাই।

এর পর থেকে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে সুখ আর আনন্দ। ওকে আশ্বস্ত করে বললাম। যদিও এই দাবির পেছনে কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু, এখনো আমার কর্ত্রীর উপর বেশ বড়ো একটা দায়িত্ব ন্যস্ত আছে। এবং তার মাধ্যমে, তোমার আর আমার উপরও। রাজাকে করা লসট্রিসের শপথের কথা মনে করিয়ে দিলাম ট্যানাসকে ফারাও-এর নশ্বর দেহকে যথাযথরূপে সমাধিস্থ করে তাঁর আত্মাকে স্বর্গের মাঠে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার শপথ সেটা।

বলো, কেমন করে সাহায্য করতে পারি আমি? ট্যানাস জানতে চায়। কিন্তু মনে রেখো, আমাদের সামনে উচ্চ-রাজ্যের অভ্যন্তরে তছনছ করছে হিকসস্‌ বাহিনী, কোনো নিশ্চয়তা নেই ফারাও-এর সমাধি লজ্জিত হবে না।

সেক্ষেত্রে, প্রয়োজনবোধে, তার জন্যে নতুন একটা সমাধি খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। এই গরমে, সূর্যাস্তের আগেই পঁচে-গলে যাবে তাঁর দেহ। যদিও শবপ্রস্ত তিতে ভালো দখল নেই আমার, কিন্তু কথা রাখার জন্যে মাত্র একটা উপায়ের কথাই জানা আছে।

ট্যানাসের নির্দেশে জাহাজের ভাড়ার থেকে বিশাল মাটির একটা পাত্র বের করলো নাবিকেরা। এরপর, আমার পরামর্শে, ওটা খালি করে ফুটন্ত পানিতে ভর্তি করা হলো। পানি গরম থাকতে থাকতেই বিশুদ্ধ সামুদ্রিক লবণের তিনটি পাত্র খালি করলো ট্যানাস, ওটার ভেতর। এরপর, চারটি ছোট্ট পাত্রে সেই পানি নিয়ে খোলা পাটাতনে ঠাণ্ডা হওয়ার জন্যে রেখে দেওয়া হলো।

ইত্যবসরে, রাজ-প্রকোষ্ঠে একা কাজ করছিলাম আমি। মিসট্রেস অবশ্য সাহায্য করতে চাইছিলো, কিন্তু রাজকুমারের যত্ন নেওয়ার জন্যে তাকে পাঠিয়ে দিলাম।

বুকের খাঁচা থেকে কোমড়ের হাড় পর্যন্ত ফারাও-এর শবদেহের একপাশ চিরে ফেললাম আমি। সেই ফাঁক দিয়ে বুক আর পেটের সমস্ত অঙ্গ আর বস্তু বের করে ফেললাম। মধ্যচ্ছদাও টেনে বের করে নিলাম ছুরির সাহায্যে। স্বাভাবিক কারণেই, জীবন আর বুদ্ধিমত্তার অঙ্গ হিসেবে হৃদপিণ্ড রেখে দিলাম শরীরের অভ্যন্তরে। বৃক্ক দুটোও রাখলাম–কেননা, ও দুটো হলো জলের ধারক, নীল নদের প্রতিনিধিত্বকারী অঙ্গ। শরীরের ফাঁপা অভ্যন্তরে লবন দিয়ে পূর্ণ করে সেলাই করে দিলাম। করোটির ভেতর থেকে থকথকে সেই বস্তু বের করার জন্যে নাকের ফুটো দিয়ে উপরে সেঁধিয়ে দেওয়ার যে বিশেষ চামচ প্রয়োজন, আমার কাছে তা না থাকায় রেখে দিতে হলো মগজ। অবশ্য, এর কোনো গুরুত্বও নেই। আলাদা করে রাখলাম সমস্ত অঙ্গ : যকৃত, পাকস্থলি, ফুসফুস আর নাড়ি। নাড়ি-ভুড়ি আর পাকস্থলি ধুয়ে পরিষ্কার করে নিলাম লবণাক্ত জল দিয়ে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিলো সেটা।

এ সমস্ত কাজ শেষ হতে, রাজার ফুসফুস পরীক্ষা করে দেখার ফুরসত পেলাম। ডান দিকের ফুসফুসটি এখনো গোলাপী, সুস্থ; কিন্তু তীরবিদ্ধ বাম দিকের ফুসফুস ফুটো হওয়া বেলুনের মতো চুপসে গেছে। এমন ভয়ঙ্কর আঘাত নিয়েও বুড়ো মানুষটা এতোটা সময় বেঁচে ছিলো কীভাবে, সেটাই আশ্চর্য। পৃথিবীর কোনো চিকিৎসকের সাধ্য ছিলো না, তাকে বাঁচিয়ে তোলে।

শেষমেষ, ঠাণ্ডা হয়ে আসা পানিভর্তি ছোট্ট পাত্রগুলো নিয়ে আসতে বললাম নাবিকদের। ট্যানাসের সহায়তার ভ্রুণের আকৃতিতে ভাঁজ করে অলিভের সেই প্রকাণ্ড জারে ঢোকালাম ফারাও-এর শবদেহ। শরীরের প্রতিটি অংশ অত্যন্ত শক্তিশালী লবণাক্ত তরলে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়েছে কি না নিশ্চিত করলাম আমি। দেহ অভ্যন্তরের অঙ্গগুলোর স্থান হলো ছোট্ট পাত্রগুলোতে। পিচ আর মোম দিয়ে সীলগালা করা হলো সবগুলো পাত্র। জাহাজের পাটাতনের নিচে একটা প্রকোষ্ঠে নিরাপদে সাজিয়ে রাখলাম সেগুলো। ওখানেই নিজের ধন-সম্পদ রাখতেন তিনি। আমার ধারণা, স্বর্ণ আর রুপোয় পরিবেষ্টিত অবস্থায় থাকতে খারাপ লাগবে না ফারাও-এর।

আমার কর্ত্রী যেনো তার শপথ রাখতে পারে, সে জন্যে সৰ্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। থিবেসে পৌঁছে, মমি প্রস্তুতকারীদের জিম্মায় তুলে দেবো ফারাও-এর শবদেহ। অবশ্য যদি, হিকসসেরা ইতিমধ্যে সেখানে না পৌঁছে গিয়ে থাকে, আর সেই জমজ নগরী এবং তার অধিবাসীরা আমরা যাওয়া পর্যন্ত টিকে থাকে।

*

দেয়ালঘেরা আসয়ুত নগরে পৌঁছুলো আমাদের গ্যালি বহর। ছোট্ট শহরের দখল নেওয়ার জন্যে খুব বেশি সৈন্য রেখে যায়নি হিকসস্‌ রথবাহিনী, সংখ্যায় একশ র অনেক কম। কিন্তু, পাথুরে দেয়ালের ওপাশে সুরক্ষিত রয়েছে রেমরেমের নেতৃত্বে পাঁচ হাজার যোদ্ধা, যাদের রেখে গিয়েছিলো ট্যানাস। মূল রথবাহিনী বীরবিক্রমে এগিয়ে চলেছে দক্ষিণে, থিবেস অভিমুখে। যদিও সংখ্যায় কম, তারপরেও হীন মনোবল মিশরীয় যোদ্ধাদের নিয়ে আবারো ভয়ঙ্কর রথের মুখোমুখি হওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিলো ট্যানাস, ওর ইচ্ছে দক্ষিণে এগিয়ে নেমবেটের ত্রিশ হাজার যোদ্ধার সঙ্গে একত্র হয়ে একবারে আক্রমণ শানানো। নীলের মূল স্রোতধারায় আমাদের ছুঁতে পারবে না রথ বাহিনী, তাই মাঝ নদীতেই রইলো গ্যালিগুলো। ট্যানাসের সংকেত পেয়ে রাতের অন্ধকারে কিছু সময়ে জন্যে বেলাভূমিতে ভীড়লো কয়েকটি জাহাজ, এই সময়ের মধ্যেই শত্রুরা তাদের রথে জানোয়ার জুড়ে নেওয়ার অবসরে নিরাপদে পালিয়ে আসতে সক্ষম হলো রেমরেমের প্রায় সমস্ত যোদ্ধা। দেরি না করে সাথে সাথেই থিবেসের উদ্দেশ্যে ভেসে চললাম আমরা।

রেমরেম জানালো, আমাদের বার্তাবহনকারী গ্যালি গতকালই আসয়ুত পেরিয়েছে, কাজেই ট্যানাসের নির্দেশে আমার লেখা সতর্কবাণী নিশ্চই এখন নেমবেটের হাতে।

হিকসস্‌দের সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলাম রেমরেমের কাছে। দুজন মিশরীয় বিশ্বাসঘাতককে পাকড়াও করেছিলো সে, যারা আসতের ভেতরে গুপ্তচরবৃত্তি করছিলো হিকসস্‌ রাজার হয়ে। নির্যাতন করে ওই দু জনের মুখ থেকে মূল্যবান তথ্য বের করতে সমর্থ হয়েছে রেমরেম।

আবনুবের সমতলে যে রাজার সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলাম আমরা, জানা গেলো, তার নাম স্যালিতিস। সেমেটিক রক্ত বইছে শরীরে, তার গোত্র মূলত যাযাবর গোছের, পেশায় রাখাল; জাগরোস পর্বতের কাছে ভ্যান হ্রদ এলাকায় তাদের বসবাস। এতে করে, রক্তপিপাসু এই এশীয়দের সম্পর্কে আমার প্রথম সন্দেহ সত্যি হলো। তাদের চেহারা দেখেই বুঝেছিলাম, এরা সেমিটিক বংশের; কিন্তু রাখাল গোছের। লোকেরা কেমন করে চাকায় চলা রথ তৈরি করলো, আর সেই ভয়ঙ্কর প্রাণী, আমরা মিশরীয়রা বর্তমানে যাকে ঘোড়া বলে জানি, যা আমাদের কাছে অন্ধকার জগতের জীব, সেগুলো কোথায় পেলো ভেবে কোনো কূল-কিনারা পেলাম না।

অন্যান্য ক্ষেত্রে, জানা গেলো, হিকসসেরা পিছিয়ে থাকা জাতি। লিখতে বা পড়তে জানে না তারা, একমাত্র শাসক এবং রাজা, স্যালিতিসের অধীনে দস্যুবৃত্তি করে বেড়ায়। রথ-টানা সেই ভয়ঙ্কর জীবের চেয়েও রাজা স্যালিতিসবে বেশি ভয় এবং ঘৃণা করতো মিশরীয়রা।

হিকসস্‌দের প্রধান দেবতার নাম সুতেখ-ঝড়ের দেবতা তিনি। আমাদের অন্ধকারের প্রতিনিধিত্বকারী দেবতা, সেথ-এর সাথে তার মিল খুঁজে পেতে বিশেষ ধর্মীয় জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। এদের ব্যবহার আর যে দেবতার পূজো করে তারা –তা থেকে তাদের সম্পর্কে ভালো কোনো ধারণা হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। কোনো সভ্য জাতিই এমনভাবে খুন, বর্বরতা আর জ্বালাও-পোড়াও নীতি চালিয়ে যেতে পারে না।

সত্যি, আগেও লক্ষ্য করেছি, নিজেদের প্রকৃত রূপ প্রকাশ করার জন্যে পছন্দমতো দেবতাদের পূজো করে বিভিন্ন জাতি। ফিলিস্তিনীরা বাল-এর অনুসারী জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে শিশুদের নিক্ষেপ করে তারা, যা তাদের কাছে দেবতার মুখ। কালো কুশীয়রা পূজো করে অন্ধকার জগতের দৈত্য-দানোর, বিচিত্র তাদের ধর্মীয় আচার-আচরণ। আমরা মিশরীয়রা দয়ালু এবং প্রকৃত দেব-দেবীর আরাধনা করি, মানব জাতির প্রতি যারা অত্যন্ত সদয়, বলি দেওয়া আমাদের ধর্মে নিষেধ।

ধারণা করি, রেমরেমের পাকড়াও করা গুপ্তচর দুজনই নয়, আরো মিশরীয় চর রয়েছে রাজা স্যালিতিস এর বাহিনীতে। পাছায় জ্বলন্ত কয়লার হ্যাঁকা খেয়ে একজন বন্দী স্বীকার গিয়েছিলো, উচ্চ-রাজ্যের কিছু লর্ড রয়েছে স্যালিতিসের যুদ্ধ পরামর্শকদের মধ্যে। বুঝলাম, কেমন করে আমাদের সেনাবাহিনীর একান্ত নিজস্ব কৌশল-বিন্যাস আগে থেকেই জেনে গিয়েছিলো হিকসসেরা, আবনুবের সমভূমিতে। তখনো মনে হয়েছিলো, আমাদের মধ্যে তাদের কোনো গুপ্তচর না থেকেই যায় না।

এসব সত্যি হলে, আমাদের শক্তিমত্তা, দুর্বলতা সবই তাদের জানা হয়ে গেছে। সমস্ত মিশরীয় নগরের মানচিত্র, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জানতে বাকি নেই তাদের। বিশেষত, সমাধি-মন্দিরে রাখা ফারাও-এর বিপুল ধন-সম্পদের হদিশ পেয়ে গেছে তারা।

সম্ভবত, এ কারণেই এতো দ্রুত থিবেস অভিমুখে চলেছে স্যালিতিস, ট্যানাসকে বললাম আমি। প্রথম সুযোগেই নীল নদ অতিক্রম করতে চাইবে তারা। তিক্তস্বরে অভিশাপ বকে ট্যানাস।

হোরাস সদয় হলে, বিশ্বাসঘাতক মিশরীয় লর্ডদের হাতে পাবো আমি, হাতে ঘুষি পাকিয়ে বললো সে। কিছুতেই নদী পেরোতে দেওয়া যাবে না রাজা স্যালিতিসকে। আমাদের জাহাজগুলোই একমাত্র শক্তি ওদের বিরুদ্ধে। কাজে লাগাতে হবে ওগুলোকে।

খোলা পাটাতনে পায়চারী করতে করতে আকাশে তাকালো সে। কখন যে উত্তর থেকে বাতাস বইবে! প্রতি মুহূর্তে আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে হিকসস্‌ রথ। নেমবেটের নৌবাহিনীই বা কোথায়? তার সাথে একত্র হয়ে নদীর সীমানা ধরে রাখতে হবে আমাদের। যে কোনো মূল্যে।

*

সেই বিকেলে, রাজকীয় জাহাজের চালকের প্রকোষ্ঠে বসলো যুদ্ধ কালীন সভা। ওসিরিসের মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ধর্মীয় প্রতিনিধি হিসেবে থাকলেন, লর্ড মারসেকেট রইলেন আহ্বায়ক, আর ট্যানাস, লর্ড হেরাব থাকলে সামরিক প্রতিনিধি হিসেবে।

তিনজন লর্ড মিলে রানি লসট্রিসকে বহন করে আমাদের এই মিশরের সিংহাসনে বসিয়ে দিলো, কোলে তুলে দিলো তার শিশুসন্তানকে। সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো নতুন শাসককে। যে জাহাজগুলো পাশ দিয়ে ভেসে গেলো, সেখানেও আহত যোদ্ধারা পর্যন্ত হাসিমুখে দাঁড়িয়ে শুভেচ্ছা জানালো মিশরের নতুন সম্রাজ্ঞী আর উত্তরসূরিকে।

ওসিরিসের মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রাজার প্রতীক, নকল দাড়ি আটকে দিলো আমার মিসট্রেসের চিবুকে। ওর সৌন্দর্য আর নারীত্ব তাতে এতোটুকু ক্ষুণ্ণ হলো না। লর্ড মারসেকেট সিংহের লম্বা লেজ বেঁধে দিলেন ওর কোমড়ে, অতঃপর লম্বা লাল সাদা মুকুট পরিয়ে দিলেন রানির মস্তকে। সবশেষে, সিংহাসনের কাছে এসে রাজ্যের প্রতীক রানির হাতে ধরিয়ে দিলো ট্যানাস। স্বর্ণের সেই প্রতাঁকে আকৃষ্ট হয়ে ট্যানাসের হাত থেকে ছোঁ মেরে ওটা নিয়ে নিলো মেমনন।

সে সত্যি একজন রাজা! রাজ্যের প্রতীক হাতে নিয়ে ফেলেছে! উৎসাহের সাথে বললো ট্যানাস, সাথে সাথে হর্ষধ্বনি করে নিজের সন্তুষ্টি প্রকাশ করে সভাষদ ।

আমার মনে হয়, আবনুবের সেই ভয়ঙ্কর দিনের পর সেই প্রথম হেসেছিলাম। এর আগ পর্যন্ত যুদ্ধে পরাজয় আর ফারাওকে হারানোর শোকে মুহ্যমান ছিলাম আমরা। আর এখন, রাজ্যের সমস্ত লর্ড যখন নিচু হয়ে সম্মান জানালেন সিংহাসনে উপবিষ্ট সুন্দরী তরুণী আর তার শিশুপুত্রকে, নতুন উদ্যম জেগে উঠলো আমাদের মাঝে।

সিংহাসনের সামনে নিচু হয়ে শপথবাক্য উচ্চারণ করলো ট্যানাস। ওর দিকে তাকানোর সময় রানির সুন্দর মুখাবয়বে ফুটে উঠলো নিখাদ ভালোবাসা, সবুজ চোখদুটো জুলছিলো ওর। আশ্চৰ্য্য, আমি ছাড়া কেউ সেটা টের পেলো বলে মনে হয় না।

সূর্যাস্তের পর, রাজকীয় প্রকোষ্ঠ থেকে আমার মাধ্যমে তার সামরিক প্রধানের উদ্দেশ্যে একটা বার্তা পাঠালো আমার কর্ত্রী। প্রধান কক্ষে ট্যানাসের সঙ্গে পরামর্শ সভায় বসতে চায় সে। সেই আদেশ অমান্য করার কোনো সুযোগ ছিলো না ট্যানাসের কাছে, মাত্রই রানির কাছে বাধ্য থাকার শপথ করেছে সে।

অদ্ভুত সেই যুদ্ধ-সভার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম আমি। কিন্তু সভা শুরু হতে হতেই আমাকে কক্ষ থেকে নির্বাসন দিয়ে দরোজা পাহারা দিতে পাঠালো মিশরের নতুন কর্ত্রী, যেনো কেউ বিরক্ত করতে না পারে। কক্ষের ভারী পর্দা টেনে দেওয়ার আগে এক ঝলক দৃশ্য দেখলাম–একে অপরের বাহুবন্ধনে জড়িয়ে রয়েছে ওরা দু জন। এতো তীব্র ছিলো ওদের আকর্ষণ, এতো দীর্ঘদিন এ থেকে বঞ্চিত হয়ে ছিলো ওরা, যেনো মরণপণ যুদ্ধে একে অপরকে পিষে ফেলতে লাগলো আলিঙ্গনে।

প্রেমমত্ত দয়িত-দয়িতার অস্ফুট ধ্বনি সারারাত কানে আসলো; নেমবেটের বাহিনীর সাথে যোগ দেওয়ার জন্যে আমাদের জাহাজ রাতেও ভেসে চলছিলো বলে রক্ষা। দাঁড় টানার শব্দ আর ঢাকের গুরুগম্ভীর ধ্বনি, রাজকীয় কক্ষের অভ্যন্তর থেকে ভেসে আসা শীকার আড়াল করে ফেললো।

রাতের শেষপ্রহরে জাহাজের দায়িত্ব নিতে চালকের প্রকোষ্ঠে এলো ট্যানাস। অদ্ভুত বিজয়ীর হাসি ওর ঠোঁটে, যেনো এই মাত্র কোনো যুদ্ধজয় করে এসেছে। কিছুসময় পর খোলা পাটাতনে লসট্রিস এলো ওর পিছুপিছু; স্বর্গীয় আভায় উদ্ভাসিত মুখ এমনকি আমি, যে ওর সৌন্দর্য্যে অভ্যস্ত পর্যন্ত চমকে গেলাম। দিনের পরবর্তী সময়ে সবার সাথে ঘুরে ঘুরে আলাপ করলো রানি, বিশেষত, কিছু সময় পর পরই তার সেনাপ্রধানের পরামর্শ শোনার ফুরসত হলো তার। রাজকুমার মেমননের সঙ্গে সারাদিন কাটালাম আমি।

ছোট্ট মেমননের জন্যে বেশ কটি খেলনা প্রস্তুত করেছিলাম কাঠ খোদাই করে । এর মধ্যে একটি হলো ঘোড়া সহ রথ। অপরটি হলো একটা চাকা এক্সেলের উপর তখনো কাজ করছিলাম।

পায়ের পাতার উপর দাঁড়িয়ে ছোট্ট কাঠের চাকার ঘূর্ণন দেখছিলো মেমনন।

নিখাঁদ চাকতিটা বেশ ভারী হয়ে যায়, কী বলো মেম? দেখছো, কতো দ্রুত গতি হারিয়ে থেমে পড়ছে।

ওটা দাও আমাকে! এক থাবায় চাকাটা কেড়ে নিতে হাত বাড়ায় সে। ওর ছোট্ট আঙুলের ফাঁক গলে পাটাতনে পরে গিয়ে ভেঙে গেলো চাকাটা, সমান চার ভাগ হয়ে গেলো।

তুমি হিকদের মতোই বর্বর দেখছি! আমার বকুনি প্রশংসা হিসেবে নিলো মেম, ওদিকে নিচু হয়ে সাধের খেলনার টুকরোগুলো তুলে নিলাম আমি।

তখনো গোলাকারভাবেই সাজানো অবস্থায় পড়ে আছে চাকার খণ্ডগুলো, হঠাৎই একটা চিন্তা এলো মাথায়। মনের চোখে, নিখাঁদ কাঠের জায়গায় ফাঁকা ফাঁকা স্থান যেনো দেখতে পেলাম আমি। আর মাঝখানে লম্বাটে দণ্ড।

হোরাসের মিষ্টি শ্বাসের কসম! কী করেছো তুমি, মেম! রাজকুমারকে আলিঙ্গন করলাম। গোলাকার আকৃতির মাঝে ছোটো ছোটো দণ্ড, কেন্দ্রে থাকবে একটা হাব! না জানি, ফারাও হলে আর কী চমৎকার দেখাবে তুমি!

তো, এইভাবেই, রাজকুমার মেমনন ওই নামধারী প্রথমজন, যিনি ছিলেন নতুন জাগরণের শাসক–তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধুর সহায়তায় চাকার স্পোকের ধারণা করেছিলেন। তখন স্বপ্নেও ভাবিনি, একদিন আমরা দুজন বিজয়ীর বেশে ওই চাকায়-চলা রথে চড়বো।

*

দুপুরের আগেই প্রথম মিশরীয় নিহতের দেখা পেলাম আমরা। নদীর উজান থেকে ভেসে এলো দেহটা, পেট ফুলে উঠেছে, নিথর মুখ চেয়ে আছে আকাশের দিকে। কালো একটা কাক বসে আছে বুকের উপর, ঠুকরে চোখের মণি উপড়ে ফেলতে ঝাঁকি খেলো মাথাটা। নিঃশব্দে জাহাজের ধারে দাঁড়িয়ে মৃতদেহটা ভেসে যেতে দেখলাম আমরা।

সিংহ বাহিনীর জামা ওর পরনে, শান্তস্বরে বলে উঠলো ট্যানাস। নেমবেটের বাহিনীর প্রথমসারির যোদ্ধা এরা। হোরাসের কাছে প্রার্থনা করি, আর যেনো এর মতো কোনো শবদেহের দেখা পেতে না হয়।

কিন্তু তা হওয়ার নয়। দশ, একশ, আরো, আরো মৃতদেহ ভেসে আসতে লাগলো উজান থেকে একসময় নদীর দুই তীরের মধ্যবর্তী পানি ছেয়ে গেলো মিশরীয় যোদ্ধাদের মৃতদেহে। গ্রীষ্মের সেচ খালগুলো যেমন কচুরীপানায় ভরা থাকে, সে রকমভাবে পানিতে বিছিয়ে রইলো লাশের পর লাশ।

শেষমেষ, একজন জীবিতের দেখা পেলাম আমরা। সিংহবাহিনীর একজন উচ্চ পদস্থ যোদ্ধা সে, নেমবেটের ডানহাত । একটা প্যাপিরাসের ঝোঁপ আঁকড়ে ধরে স্রোতে ভেসে চলছিলো। পানি থেকে তাকে উদ্ধার করে আঘাতের পরিচর্যা শুরু করা হলো। একটা কাঁধ শেষ হয়ে গেছে বেচারার, আর কখনো ওই হাতে কিছু ধরা সম্ভব হবে না।

কথা বলার মতো সুস্থ হয়ে উঠতেই, ট্যানাস তার পাশে মাদুরে বসলো।

লর্ড নেমবেটের কী খবর?

মারা গেছেন তিনি, সঙ্গে তাঁর পুরো বাহিনী। কর্কশ কণ্ঠে মুখ খুললো যোদ্ধা।

হিকসস্‌দের সম্পর্কে আমার পাঠানো সতর্কবার্তা কী তার কাছে পৌঁছেনি?

যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ওটা হাতে পেয়েছিলাম আমরা, পড়ে হেসেছিলেন নেমবেট।

হেসেছিলেন? গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চায় ট্যানাস। হাসির কী লেখা ছিলো ওখানে?

উনি বললেন কুত্তার বাচ্চাটা ধ্বংস হয়ে গেছে–আমাকে ক্ষমা করুন, ট্যানাস, কিন্তু ওই নামেই আপনাকে সম্বোধন করেছিলেন তিনি,–আর এখন নিজের কাপুরুষতা ঢাকতে আমার কাছে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে! উনি আরো বলেছিলেন, চিরাচরিত রীতি অনুযায়ীই লড়বো আমরা।

আত্মগরিমাপূর্ণ আহাম্মক একটা, অনুতাপ করে বললো ট্যানাস। তারপর কী হলো?

নদীর সামনে, পুব তীরে তাবু গাড়লেন নেমবেট। ঠিক বাতাসের মতো আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পানিতে ফেলে দিলো শক্ররা।

কতোজন বেঁচে গেছে? শান্তস্বরে জানতে চায় ট্যানাস।

আমার ধারণা, নেমবেটের সঙ্গে ময়দানে যাওয়া যোদ্ধাদের মধ্যে কেবল আমি বেঁচে আছি। আর কোনো জীবিত সৈনিক আমার চোখে পড়েনি। যে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে নদী তীরে, তার বর্ণনা করার ভাষা নেই আমার।

আমাদের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা শেষ হয়ে গেছে, শোকে মুষড়ে পড়লো ট্যানাস। আমরা প্রতিরক্ষাবিহীন হয়ে গেলাম। এক জাহাজগুলোই আছে এখন। নেমবেটের নৌবাহিনীর কী খবর? মাঝ নদীতে ছিলো ওগুলো?

বেশিরভাগ জাহাজই ছিলো মাঝ-নদীতে, কেবল পঞ্চাশটি গ্যালি তীরে ভিড়িয়েছিলেন নেমবেট।

কেমন করে এটা করেন তিনি, রাগে গর্জে উঠে ট্যানাস। জাহাজের নিরাপত্তা বিধান তো আমাদের চিরাচরিত যুদ্ধ-কৌশল!।

তিনি কী ভেবে এমন করেছিলেন, জানি না, তবে সম্ভবত আপনার সতর্কবার্তা সত্যি প্রমাণিত হলে পিছিয়ে যোদ্ধাদের নিয়ে জাহাজে উঠে পড়ার পরিকল্পনা ছিলো তার।

জাহাজগুলোর কী অবস্থা? সেনাবাহিনী হারিয়েছেন নেমবেট, গ্যালিগুলো রক্ষা করতে পেরেছিলেন? রাগে, দুশ্চিন্তায় কর্কশ শোনালো ট্যানাসের কণ্ঠ।

মাঝ নদীতে থাকা বেশিরভাগ জাহাজেই আগুন জ্বলতে দেখেছি আমি। কোনো কোনোটি নোঙর তুলে পালাচ্ছিলো থিবেসের পথে, এতে আতঙ্কিত ছিলো তারা, আমার চিৎকার শুনতে পায়নি।

আর, তীরে যে পঞ্চাশটি গ্যালি ছিলো দম নিয়ে প্রশ্নটা শেষ করে ট্যানাস। সেগুলোর কী হলো?

ওগুলো এখন হিকসস্‌ দের হাতে, কেঁপে উঠে মাথা নীচু করে ফেললো আহত সৈনিক। স্রোতে ভেসে আসার সময় পেছনে তাকিয়ে দেখেছি, দলে দলে আমাদের জাহাজের দখল নিচ্ছে শত্রু সৈনিকরা।

দাঁড়িয়ে, হন হন করে গলুইয়ের কাছে চলে এলো ট্যানাস। নদীর উজানে, যেখান থেকে শয়ে শয়ে মৃতদেহ আর নেমবেটের ধ্বংসপ্রাপ্ত নৌবাহিনীর জাহাজের ভাঙা কালো তক্তা ভেসে আসছে সবুজ জলের স্রোতে, সেদিকে চেয়ে রইলো সে। নীরবে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি।

তো, দম্ভপূর্ণ গর্দভটা নিজের আর সেনাদের জীবন শেষ করে দিলো, স্রেফ আমাকে ছোটো করতে গিয়ে। তার এই কাণ্ডের জন্যে অবশ্যই একটা পিরামিড তৈরি করা উচিত, কোনোদিনও মিশরের কেউ এমন কথা শোনেনি।

এ–ই সব নয়, যা শুনলে, বিড়বিড় করে বলতে আমার সঙ্গে সায় দেয় ট্যানাস।

হুমম। এমনকি, হিকসস্‌ দের নদী পার হওয়ার উপায় করে দিয়েছে সে। আইসিসের মিষ্টি বুকজোড়ার কসম, শত্রুবাহিনী একবার নীল নদ অতিক্রম করতে পারলে শেষ হয়ে যাবো আমরা।

সম্ভবত, নিজের নাম শুনতে পেলেন দেবী আইসিস; বিপরীত দিক থেকে বয়ে আসা বাতাস ধরে এলো। ট্যানাসও টের পেলো সেটা। ঝট করে ঘুরে, নিজের নাবিকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে চালকের প্রকোষ্ঠে চললো সে।

বাতাস এখন অনুকূলে। বাহিনীর সমস্ত জাহাজকে একই সংকেত দাও সবাই পাল তুলুক। প্রতি ঘন্টায় দাঁড়-টানা যোদ্ধাদের বদল করো। ঢাক বাদকেরা, তাল দ্রুত করো তোমরা ছুটে দক্ষিণে চলো সবাই!

উত্তুরে বাতাস বইতে লাগালো জোরেসোরে। গর্ভবতী নারীর পেটের মতো ফুলে উঠলো পাল। দ্রুত লয়ের তালে দাঁড়ীদের উৎসাহ জোগালো ঢাকবাদকেরা। আমাদের সমস্ত জাহাজ ছুটে চললো দক্ষিণে।

সকল প্রশংসা দেবীর জন্যে, গর্জে উঠে ট্যানাস। পবিত্র আইসিস, জলপথে যেনো ওদের ধরতে পারি আমরা, অতটুকু সময় দাও আমাদের!

*

বিশাল আকৃতির কারণে রাজকীয় জলযানের গতিবেগ অত্যন্ত ধীর, কাজেই হিকসস্‌দের জলপথে ধরার জন্যে মরিয়া ট্যানাস, তার হোরাসের প্রশ্বাসে বাহিনীসহ স্থানান্তরিত করলো নিজেকে। হালকা, দ্রুতগামী গ্যালিটা রাজকীয় জাহাজের পাশে ভিড়িয়ে ওটাতে চড়ে বসলো সে। কখনো কখনো নিজের অজান্তেই বড়ো নির্বোধের মতো আচরণ করে থাকে মানুষ, যেমনটি নেমবেট করেছিলেন ট্যানাসের সতর্কবার্তা অবহেলা করে। হঠাৎ করে দেখি, আমি নিজে ট্যানাসের পিছু পিছু হোরাসের প্রশ্বাসে অবস্থান নিয়েছি, অথচ আমার দায়িত্ব ছিলো রানি আর রাজকুমারের সঙ্গে থাকা। কিন্তু যতক্ষণে নিজের এই অযাচিত আচরণ টের পেয়ে শুধরানোর চেষ্টা করলাম, ততক্ষণে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে রাজকীয় জাহাজ।

হোরাসের প্রশ্বাসে অবস্থান নিয়েই নতুন নির্দেশ দিতে লাগলো ট্যানাস। পতাকা সংকেত আর নাবিকদের চিৎকারে মুহূর্তেই বাহিনীর অন্যান্য যুদ্ধ-জলযানের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো তার আদেশ। গতিবেগ একটুও না কমিয়ে, নতুন করে জাহাজগুলো বিন্যস্ত করা হলো, ট্যানাসের হোরাসের প্রশ্বাস রইলো সবার সামনে।

আহতরা, যার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবে না, তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো অপেক্ষাকৃত ধীর গতির জাহাজে। দ্রুতগামী গ্যালিগুলোতে লড়াইয়ের জন্যে মোতায়েন করা হলো মূলত রেমরেম-এর বাহিনীর যোদ্ধাদের। এখনো পর্যন্ত কোনো রকম ক্ষতি হয়নি এই বাহিনীর। আবনুবের অপমানের প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর তারা। হোরাসের প্রশ্বাসে নীল কুমির বাহিনীর পতাকা টানিয়ে দিতেই রণ-সঙ্গিতে মুখরিত হলো যোদ্ধারা। রক্তক্ষয়ী পরাজয়ের পর কী অসাধারণ নেতৃত্বের উদাহারণ দেখিয়ে মিশরীয় সৈনিকদের উদ্বুদ্ধ করেছিলো ট্যানাস সেদিন, না দেখলে বিশ্বাস হওয়ার নয়।

প্রতি লীগ জলপথ পাড়ি দেওয়ার সাথে সাথে নেমবেটের নির্বুদ্ধিতার আরো প্রমাণ মিলছিলো আমাদের। নিহত মিশরীয় যোদ্ধা, জাহাজের বড়ো বড়ো ভাঙ্গা অংশ, যুদ্ধের আবর্জনা নদীর দুই ধারের প্যাপিরাসের ঝারে আটকে গেছে। শেষমেষ, আমাদের সামনের আকাশে সেই রথসৃষ্ট ধূলিমেঘ আর ক্যাম্পের আগুনের ধোঁয়ার দেখা পাওয়া গেলো।

ঠিক যা ভেবেছিলাম, স্বস্তির স্বরে বললো ট্যানাস। থিবেস অভিমুখে যাত্রায় উগ্রতা কমেছে তাদের, এখন যখন নদী পার হওয়ার জন্যে জাহাজ পেয়েই গেছে নেমবেটের বদৌলতে, অতো তাড়াহুড়ো না করলেও চলে ব্যাটাদের। কিন্তু, এরা তো আর নাবিক নয়; নিজেদের রথ আর জানোয়ার ওঠাতে জান বের হয়ে যাওয়ার কথা। হোরাস সদয় হলে, আমরা তাদের এ ব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারবো।

যুদ্ধের ভঙ্গিতে ছড়িয়ে পড়ে নদীর শেষ চওড়া বাঁক ঘুরলো মিশরীয় জাহাজবহর; সামনেই দেখা যাচ্ছে হিকসস্‌ বর্বরদের। ঠিক সেই সময়ই নদী পারাপারের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তারা।

টলোমলোভাবে, অপটু প্রচেষ্টায় পুরো পঞ্চাশটি দখল হারানো গ্যালি তখন মাঝ নদীতে ভাসমান; তালগোল পাকিয়ে গেছে পালগুলো, নিজের নিজের দাঁড় নিয়ে যেনো কসরৎ করছে হিকসস্‌ যোদ্ধারা। প্যাডলগুলো অযথাই পানি কাটছে, প্রতিটি জাহাজের চালকের অদক্ষতা একেবারে দৃশ্যমান, একটি জাহাজের সাথে অপরটির কোনো তাল মিল নেই।

পাটাতনে অবস্থান নেওয়া বেশির ভাগ হিকসস্‌ যোদ্ধার পরনে তামার বর্ম রয়েছে লক্ষ্য করলাম। বোঝাই যাই, ওই পোশাকে সাঁতার দেওয়া যে কতোটা অসম্ভব, এ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। ওদের উপরে যখন চড়ে বসলো আমাদের যুদ্ধ-গ্যালিগুলো,দৃষ্টিতে আতঙ্ক আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো তারা। এবারে, নিজেদের মাঠে তাদের পেয়ে গেছি আমরা।

কাছে এসে পড়তে শত্রুদের পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ পেলাম আমি। এখনো পুব তীরে রয়ে গেছে তাদের বাহিনীর মূল অংশ। সেই মরুর পাহাড়সারি পর্যন্ত বিস্তৃত তাদের সৈনিক বহর, হোরাসের প্রশ্বাসের পাটাতন থেকে যতোদূর চোখ পড়লো পুব দিগন্তে কেবল হিকসস্‌ যোদ্ধা নজরে এলো।

ছোট্ট একটা দলকে নদী পার হওয়ার আদেশ দিয়েছেন রাজা স্যালিতিস। নিঃসন্দেহে তাদের উপর নির্দেশ আছে যতো দ্রুত সম্ভব পশ্চিম তীর ধরে অগ্রসর হয়ে ফারাও এর সমাধি-মন্দিরের দখল নেওয়ার।

হিককসস বহনকারী জাহাজগুলোর উপর বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা, রণ-হুঙ্কার আর আস্ফালন ছাপিয়ে চেঁচিয়ে ট্যানাসের উদ্দেশ্যে বললাম, ইতিমধ্যেই নিজেদের ঘোড়া পারাপার করে ফেলেছে তারা! ওদিকে দ্যাখো!

প্রায় কোনো প্রহরা ছাড়াই, কেবল অল্প কয়েকজন সৈনিক সহ, পশ্চিম তীরে চড়ে বেড়াচ্ছে বিশাল ঘোড়ার পাল। প্রথম দেখাতেই মনে হলো, কম করে হলেও কয়েক শ ঘোড়া রয়েছে সেখানে। আমাদের জন্যে দারুন চিন্তার বিষয়। আমার চারপাশে দাঁড়ানো কয়েকজন যোদ্ধা ভয়ে কেঁপে উঠে দেবতাদের কৃপা ভিক্ষা করতে লাগলো, ভয়ঙ্কর সেই জীব দেখে। একজনকে বলতে শুনলাম, হিকসস্‌ তাদের দৈত্যগুলোকে নির্ঘাত মানুষের গোশত খাওয়ায়। ঠিক পোষ মানানো সিংহের মতো। এজন্যেই এমনভাবে খুন করছে তারা, এই জানোয়ারগুলোকে খাওয়ানোর জন্যে শবদেহ প্রয়োজন তাদের! কে জানে, কতো সৈনিক এখন শয়তানগুলোর পেটে।

পেট মোচড় খেলো আমার, কে জানে, ওই সৈনিক হয়তো সত্যি কথাই বোলছে। জোর করে ঘোড়াগুলোর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনের যুদ্ধরত গ্যালির দিকে তাকালাম।

রথ আর সৈন্য পারাপারের মাঝপথে ধরেছি ওদের, ট্যানাসকে বললাম আমি । লর্ড নেমবেটের চুরি-হওয়া জাহাজগুলোর পাটাতনে উঁচু হয়ে রয়েছে রথের সরঞ্জাম আর রথ-চালকের দল। বিপদ টের পেয়ে কিছু হিকসস্‌ জাহাজ পিছিয়ে পুব তীরে ফিরতে চাইলো । পেছনের রথ-বহনকারী গ্যালিগুলোর সাথে সংঘর্ষ ঘটলো ওগুলোর; স্রোতে পরে ঘুরপাক খেতে লাগলো নিয়ন্ত্রণহীন জাহাজ।

শত্রুর দ্বিধা টের পেয়ে বর্বরের হাসি হাসলো ট্যানাস। চিৎকার করে উঠলো সে, সাধারণ সংকেত আক্রমণের তাল বাজাও! তীরে অগ্নিসংযোগ করো!

জীবনেও আগুনে-তীরের আক্রমণ দেখেনি হিকসসেরা, ওদের ভীতি দেখে ট্যানাসের সাথে সাথে আমিও চিন্তিত ভঙ্গিতে হেসে উঠলাম। এরপর, হঠাৎই গলায় জমে গেলো হাসিটা।

ট্যানাস! ওর হাত আঁকড়ে ধরলাম আমি। ওদিকে! সামনের গ্যালির চালকের আসনে তাকাও! ওই যে আমাদের বিশ্বাসঘাতক!

জাহাজের রেইল ধরে দাঁড়ানো লম্বা, রাজকীয় অবয়ব প্রথমটায় চিনতে পারলো ট্যানাস, কেননা মাছের আঁশের মতো বর্ম আর হিকসস্‌ শিরস্ত্রাণ পরে আছে সে। অবশেষে, ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে চেঁচালো, ইনটেফ! আগে যে কেনো বুঝি নি!

এখন তো সব পরিষ্কার হলো। রাজা স্যালিতিসকে এই মিশরের মাটিতে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে সে। ইচ্ছে করেই পুবে গিয়ে সমাধি-সম্পদের কথা বলে লোভ দেখিয়েছে হিকসস্‌দের। আমার ঘৃণা ট্যানাসের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

লানাটা তুলে ধরে একটা তীর ছুঁড়লো ট্যানাস, কিন্তু দূরত্ব বেশি হওয়ায় ইনটেফের বর্মে লেগে পিছলে গেলো ওটা। এক ঝাঁকিতে নড়ে উঠে, পানির উপর দিয়ে সরাসরি আমাদের দিকে তাকালেন ইনটেফ। মনে হলো, তার চোখে যেনো ভয় ঘনাতে দেখলাম। এরপর জাহাজ-কাঠামোর আড়ালে লুকালেন তিনি।

দ্বিধাগ্রস্ত, টলোমলো, জট-পাকানো হিকসস্‌ জাহাজের উপর চড়াও হলো সামনের গ্যালিগুলো। হোরাসের প্রশ্বাসের তামার পাত মোড়ানো চোখা গলুই নিমিষে মড়মড় আওয়াজ করে সেঁধিয়ে গেলো ইনটেফকে বহনকারী গ্যালির অভ্যন্তরে। সংঘর্ষের ধাক্কায় ছিটকে পড়লাম আমি। যতক্ষণে উঠে দাঁড়ালাম, আমাদের দাড়ীরা ততক্ষণে পিছিয়ে নিয়ে এসেছে জাহাজ।

তীরন্দাজেরা বৃষ্টির মতো আগুন-জ্বলা তীর ছুঁড়তে শুরু করেছে। দখলকারী জাহাজের পাল আর মাস্তুলে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজ্বলিত তীর আঘাত হানলো । নিমিষেই, উত্তরে বাতাস পেয়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো শক্ত বহনকারী জাহাজ।

জাহাজকাঠামোর ফাঁক হয়ে যাওয়া অংশ দিয়ে গলগল করে পানি ঢুকছে, একপাশে দ্রুত কাত হয়ে যেতে লাগলো ইনটেফকে বহনকারী শত্রু জাহাজ। দাউ দাউ আগুনে জ্বলছে পাল। আগুনের তাপে → যেনো পুড়ে যাবে। বিশাল প্রধান পাল, মাস্তুলসহ ধসে পড়লো পাটাতনের উপরে আতঙ্কিত হিকসস্‌ যোদ্ধাদের উপর। সাথে সাথে জ্বলে উঠলো সারি সারি হিকসস্‌ রথে। পুড়ে খাক হতে লাগলো রথ-চালক আর যোদ্ধারা। আগুনের তাপ সহ্য করতে না পেরে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো অনেকেই, দেহের বর্মের ভারে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তলিয়ে গেলো। আবনুবের সমতলের কথা মনে করলাম আমি কোনো মায়া অনুভব করছি না এই নিষ্ঠুর মৃত্যুর জন্যে।

সমস্ত হিকসস্‌ জাহাজ জ্বলছে এখন। অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা কোনোটিই নেই তাদের, নদীপথের যুদ্ধে আমাদের সাথে টক্কর লাগে। ঠিক রথ আক্রমণের সময় আমাদের যেমন হয়েছিলো, অসহায় অবস্থায় ধ্বংসের মুখোমুখি হলো তারা। বারবার পিছিয়ে এসে আবারো আক্রমণ শানালো মিশরীয় নৌবাহিনী ।

ইনটেফের খোঁজে প্রথম গ্যালিতে চোখ বোলালাম। ওটা ডুবে যাওয়ার একটু আগে দেখা দিলেন তিনি, শিরস্ত্রাণ, বর্ম সব ফেলে দিয়েছেন ইতিমধ্যে। কেবলমাত্র ছোট্ট এক টুকরো নেংটি পরনে। জাহাজ তলিয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পানিতে।

ইনটেফ তো নীলে র সন্তান, বেড়ে উঠেছেন এই নদীর জল-বাতাসে। ডুব-সাঁতার দিয়ে নিমিষে পঞ্চাশ গজ পেরিয়ে এলেন; চকচকে কালো চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পানির উপর।

ওই তো সে! ট্যানাসকে চিৎকার করে দেখালাম। ডুবিয়ে দাও হারামজাদাকে?

সাথে সাথেই জাহাজ ঘোরানোর নির্দেশ দেয় ট্যানাস। কিন্তু সম্পূর্ণ বাঁক ঘোরার আগেই ঠিক মাছের মতোই পিছলে ভেসে পুব তীরের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন ইনটেফ।

জোরে ঘোরো! চেঁচিয়ে উঠলো ট্যানাস। ডান ধারের দাড়ীরা প্রাণপণে বাইতে লাগলো। সাঁতাররত ইনটেফের বরাবরে আসতেই সোজা সামনে টানার নির্দেশ পেলো তারা। কিন্তু, ইতিমধ্যে পাড়ের অত্যন্ত নিকটে পৌঁছে গেছেন ইনটেফ; ওখানে, পুব তীরে, পাঁচ হাজার হিকসস্‌ তীরন্দাজ তাদের ভীষণ প্রান্ত-বাঁকানো ধনুক নিয়ে অপেক্ষায় আছে।

সেথ ওদের উপর মুতে দিক! হতাশায় চেঁচালো ট্যানাস। নাকের সামনে থেকে ইনটেফ শয়তানকে তুলে নেবোই নেবো! হোরাসের প্রশ্বাসকে সরাসরি তীরের উদ্দেশ্যে ছুটিয়ে নিয়ে চললো সে।

ধনুকের সীমানায় এসে পড়তেই আমাদের জাহাজ লক্ষ্য করে এতো তীর ছুটে আসতে লাগলো, মাথার উপরের আকাশ অন্ধকার হয়ে এলো। বৃষ্টির মতো আমাদের খোলা পাটাতনে আঘাত করতে লাগলো একের পর এক তীর, একজন দুই জন করে লুটিয়ে পড়তে লাগলো মিশরীয় সৈন্যরা।

কিন্তু, ইনটেফের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি আমরা। কাঁধের উপর দিয়ে পিছন ফিরে চাইতে তার চোখে মৃত্যুভয় দৃষ্টি গোচর হলো আমার। এখন ইনটেফ বুঝে গেছেন, আর রক্ষা নেই তার। তীরের ঝক অগ্রাহ্য করে, ছুটে গলুইয়ে এসে চেঁচিয়ে বললাম, প্রথম সাক্ষাত থেকে তোকে ঘৃণা করি আমি। তোকে মরতে দেখলে কী যে ভালো লাগবে! এখন তাই ঘটবে!

আমার কথা কানে গেছে ইনটেফের। ওর চোখেই ফুটে উঠলো সেটা। কিন্তু হায়, আবারো অন্ধকারের দেবতারা তার সহায় হলেন। ডুবন্ত একটা হিকসস্‌ জাহাজ, তার জ্বলন্ত কাঠামো নিয়ে ধেয়ে এলো আমাদের দিকে। কোনো রকমে একবার যদি আমাদের গ্যালি ছুঁতে পারে ওটা, নির্ঘাত আগুনে পুড়ে পানির তলায় ঠাই হবে হোরাসের প্রশ্বাসের। নিরুপায় ট্যানাস, তার দাঁড়ীদের জাহাজ পেছানোর হুকুম দিলো। জ্বলন্ত হিকসস্ গ্যালি এখন আমাদের আর পুব তীরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। চোখের আড়াল হয়ে গেছেন ইনটেফ। আবার যখন দেখতে পেলাম তাকে, তিনজন হিকসস্‌ সৈনিক টেনে পানি থেকে তুলছিলো।

তীরে দাঁড়িয়ে একবার পিছন ফিরে তাকালো ইনটেফ, হতাশা আর অক্ষম-ক্রোধে আমাদের ভাসিয়ে দিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেলো সে। তীর বর্ষণে তখনো পর্যদস্ত আমাদের যোদ্ধারা, ট্যানাসের নির্দেশে দ্রুত পিছিয়ে অবশিষ্ট গ্যালিগুলোর সাথে যোগ দিলো হোরাসের প্রশ্বাস।

শক্ত বহনকারী জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পশ্চিম তীরে নজর বোলালো ট্যানাস। বিশাল ঘোড়ার পাল আর অল্প কয়েকজন প্রহরী রয়েছে সেখানে। আমাদের গ্যালিগুলোকে ছুটে আসতে দেখে ছুটে পালাতে চাইলো প্রহরীরা; কিন্তু রণ-সংগীত গাইতে গাইতে তীরে নেমে তলোয়ার হাতে তাদের পিছু ধাওয়া করলো মিশরীয় যোদ্ধারা। হিকসস্‌রা রথে চড়ে অভ্যস্ত, সবসময় রথে চড়েই যুদ্ধ করে; অপরদিকে আমাদের সৈন্যরা প্রত্যেকে পদাতিক বাহিনীর বীর সেনা দৌড়ানোর জন্যেই প্রশিক্ষণ পেয়েছে তারা। সবুজ ধুররা ক্ষেতের উপর কিছুসময়ের মধ্যেই শ খানেক হিকসস্‌ যোদ্ধার রক্তাক্ত লাশ পরে রইলো।

প্রথম সৈন্যদলের পিছুপিছু আমিও তীরে নেমে এলাম। মাথায় অন্য চিন্তা চলছে। রথ-টানার উপায় খুঁজে না পেলে শুধু খেলনা কাঠামো আর চাকা তৈরির নকশা করার কোনো মানে হয়না।

প্রচণ্ড সাহসের প্রয়োজন হলো হিকসদের ভয়ঙ্কর প্রাণীগুলোর কাছাকাছি যেতে। পানির কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার পাল। অস্ত্রের ঝনঝনানি, সৈন্যদের চিৎকার আর দৌড়ানোর শব্দে চমকে গেছে জীবগুলো। আমি ভাবছিলাম, এই বুঝি এক পাল হিংস্র সিংহের মতো আমার দিকে তেড়ে আসবে। মনের চোখে দেখতে পেলাম, আমার তাজা মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে ওগুলো। মনোবল কমে এলো। দূরে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম দারুন সুন্দর প্রাণীগুলোকে।

সবেচেয়ে কাছের ঘোড়াটা আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে উপরের ঠোঁট উল্টাতে বিশাল চৌকোণা দাঁতগুলো থেকে আঁতকে উঠলাম। পেছনের পা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে চি-হি-হি-হি স্বরে এমন ভীষণভাবে ডেকে উঠলো, প্রাণ হাতে করে জাহাজে ফিরে চললাম আমি।

কাপুরুষের মতো আমার পলায়ন দেখে চেঁচিয়ে উঠলো একজন যোদ্ধা, হিকসস্‌ দৈত্যদের মেরে ফ্যালো!

বাকি সৈন্যরা ঠোঁটে তুলে নিলো সেই চিৎকার। মারো! মেরে ফ্যালো শয়তান দৈত্যগুলোকে!

না! নিজের নিরাপত্তার কথা ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। না! ঘোড়াগুলোকে মেরো না! ওগুলো আমাদের কাজে আসবে!

রণ-হুঙ্কারে উন্মত্ত যোদ্ধারা আমার আবেদনে কর্ণপাত না করে ঘোড়ার পালের উদ্দেশ্যে ছুটলো; হাতের বর্ম উঁচিয়ে রেখেছে তারা, বর্শার ডগা থেকে তখনো ঝরে পড়ছে শুক্র-প্রহরীদের রক্ত। কেউ কেউ নিজেদের ধনুকে তীর জুড়ে ছুঁড়ছে ঘোড়ার পালের উপর।

না! কঁকিয়ে উঠলাম আমি; ওদিকে কাঁধের কেশরে গেঁথে থাকা তীরের আঘাতে লাফিয়ে উঠলো কালো চকচকে একটা স্ট্যালিয়ন।

না, দয়া করে ঘোড়াগুলোকে মেরো না! কে শোনে কার কথা। একের পর এক বর্শার কোপে, তীরের আঘাতে ধুলোয় লুটাতে লাগলো চমৎকার প্রাণীগুলো।

মুহূর্তেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো ঘোড়ার পাল। প্রায় তিনশো ঘোড়ার দলটা উধশ্বাসে ছুটতে লাগলো, ধূলিময় পশ্চিম সমভূমির উপর দিয়ে সোজা মরুর উদ্দেশ্যে চলেছে ওগুলো।

হাত দিয়ে কপালের উপরটা আড়াল করে সেদিকে চেয়ে রইলাম আমি, মনে হলো, যেনো আমার হৃদয়ও হারিয়ে গেছে ঘোড়াগুলোর সাথে। দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতে, আহত অবস্থায় পড়ে থাকা জানোয়ারগুলোর উদ্দেশ্যে ছুটলাম। তীর বা বর্শাবিদ্ধ ঘোড়াগুলো মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। কিন্তু আমার আগে ওখানে পৌঁছে গেছে সৈনিকের দল। ঘৃণায়, রাগে উন্মত্ত হয়ে নিথর দেহগুলোর উপরে চড়ে সমানে আঘাত করে যাচ্ছে তারা।

এক ধারে, ছোট্ট একটা নলখাগড়ার ঝোঁপের আড়ালে পড়ে আছে সেই কালো স্ট্যালিয়নটা, যেটাকে তীরবিদ্ধ হতে দেখেছি আমি। যোদ্ধাদের দৃষ্টির আড়ালে রয়েছে জানোয়ারটা। বুকের গভীরে তীর গাঁথা; টলোমলো পায়ে, খুঁড়িয়ে সামনে এগুতে চাইছে। নিজের নিরাপত্তার কথা ভুলে গিয়ে ওর কাছে ছুটে গেলাম আমি। ঘাড় ফিরিয়ে একবার আমাকে দেখলো জানোয়ারটা।

টের পেলাম, ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছি। আহত সিংহের মতোই এখন আমার দিকে তেড়ে আসবে ঘোড়াটা কোনো সন্দেহ নেই। পরস্পরের চোখে চেয়ে রইলাম। আমরা যেনো ধীরে আমার কাঁধ থেকে খুলে পড়ে গেলো ভয়ের আচকান।

বিশাল, গভীর কালো চোখদুটো যন্ত্রণায় টলোমলো; এতো, এতো সুন্দর ওই চোখ জোড়া, মায়ায় ভরে গেলো বুকের ভেতরটা। হাত বাড়িয়ে ঘোড়াটার নাকের উপর রাখলাম, ঠিক আরবীয় সিল্কের মতো লাগলো। সরাসরি আমার দিকে এগিয়ে বুকে কপাল ঘষলো ও, যেনো বন্ধুর কাছে আবেদন জানাচ্ছে একদম মানুষের মতো! আমি জানি, সাহায্য কামনা করেছে ওটা।

নিজের অজান্তেই দুই হাত দিয়ে ঘোড়াটার গলা জড়িয়ে ধরলাম আমি। ওকে বাঁচানোর জন্যে জীবনের যে কোনো সঞ্চয় দিয়ে দিতে পারি আমি এই মুহূর্তে। কিন্তু নাকের ফুটো দিয়ে গরম রক্তের ফেনা দেখা যাচ্ছে। ফুসফুঁসে লেগেছে আঘাত, কোনো সন্দেহ নেই, মারা যাচ্ছে ওটা। কোনো রকম সাহায্যের উর্ধ্বে এখন।

ওহ্, ওই হতভাগা বর্বরগুলো তোমার কী অবস্থা করেছে! ফিসফিস করে বললাম। হতাশা, ক্ষোভ আর দুঃখের ভেতরও বুঝলাম, আমার জীবনটা পাল্টে গেলো আজ থেকে। এই মরণাপন্ন ঘোড়াটা সেই পরিবর্তন এনে দিয়েছে আমার ভেতর। সাথে সাথেই বুঝলাম, আসছে দিনগুলোতে এই আফ্রিকার মাটিতে যেখানেই আমার পা পড়বে, সাথে থাকবে দুই জোড়া খুড়ের ছাপও। আরো একবার প্রেমে পড়েছি আমি।

হুড়মুড় করে পড়ে গেলো স্ট্যালিয়ন, মুখ হা করে বাতাস টানতে চাইছে। বুকের আঘাত থেকে গোলাপী বুদবুদ বেরিয়ে আসছে বেচারার। নিচু হয়ে ওর মাথাটা কোলে তুলে নিলাম আমি। এভাবেই, আমার কোলে মাথা রেখে মারা গেলো ঘোড়াটা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে হোরাসের প্রশ্বাসে উদ্দেশ্যে ফিরে চললাম।

চোখ উপচে-পড়া পানির কারণে পথ ঠাওর হচ্ছে না; কিছুতেই বুকের গভী। থেকে উঠে আসা কান্না থামলো না। মানুষ হোক বা আর কিছু বিশেষত, যদি মহৎ আর সুন্দর হয়, তাদের যন্ত্রণা আমি সইতে পারি না ।

আরে, টাইটা! কোথায় পালিয়েছিলে? জাহাজে চড়তেই ট্যানাস চেঁচালো। একটা যুদ্ধ চলছে এখানে। তোমার দিবাস্বপ্ন শেষ হওয়ার অপেক্ষায় তো আর পুরো সেনাবাহিনী বসে থাকতে পারে না!

*

জাহাজ ছেড়ে ঘোড়র পালের পিছুপিছু আমার পশ্চিমে যাওয়ার প্রস্তাবে কর্ণপাত করলো না ট্যানাস। সাথে সৈন্য দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।

ওই রক্ত-পিপাসু, অপবিত্র জানোয়াগুলোর ছায়াও দেখতে চাই না আমি! চেঁচিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বললো সে। পালিয়ে যে যেতে পেরেছে, এটা জেনেই খারাপ লাগছে। দেবতারা করুন, সিংহ আর শিয়ালের পাল আমাদের হয়ে নিকেশ করে শয়তানগুলোকে।

আবনুবের সমভূমিতে ছিলে তুমি? গলা উঁচিয়ে বললাম। রাগে আমার সর্বশরীর কাঁপছে। নাকী, কোনো চোখ-থাকতে-অন্ধ গর্দভ ছিলো আমার পাশে? চাকায়-চলা রথে চলে ওই প্রাণীগুলো কেমন করে তোমার লোকদের শেয়ালের খাদ্যে পরিণত করেছে দেখেও শেখোনি? ওই রথ আর ঘোড়া ছাড়া তোমার-আমার মিশরের কোনো আশা নেই, এইবেলা শুনে নাও!

হোরাসের প্রশ্বাসের চালকের প্রকোষ্ঠে এই উত্তপ্ত বাক্য-বিনিময় চলছিলো। মিশরের সাহসী সিংহ, বীরশ্রেষ্ঠ ট্যানাসকে একজন ক্রীতদাস কর্তৃক গর্দভ ডাক শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছে তার অধস্তন যোদ্ধারা। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে আমার।

দেবতারা ওই সুন্দর উপহার পাঠিয়েছেন আমাদের। তিনশো ঘোড়া তোমার হাতে এখন! ওগুলোর সাথে জুড়বার জন্যে আমি তোমাকে রথ প্রস্তুত করে দেবো।

তুমি কি অন্ধ, কিছুই কি চোখে পড়ছে না?

আমার জাহাজ আছে! পাল্টা চেঁচালো ট্যানাস। ওই জঘন্য, মানুষ-খেকো জানোয়ার চাই না আমার! সেথ আর সুতেখ-এর সৃষ্টি ওগুলো আমার ধারে কাছেও যেনো না আসে!

গলার স্বর নামিয়ে, দ্রভাবে এবারে বললাম, ট্যানাস, দয়া করে আমার কথা শোনো। এই জানোয়ারগুলোর একটা আমার কোলে মাথা রেখে মারা গেছে। খুবই শক্তিশালী হতে পারে, কিন্তু অত্যন্ত ভদ্র প্রাণী এরা। ঠিক প্রভুভক্ত কুকুরের মতো আলো জ্বলে চোখে। মাংস খায় না এরা।

সামান্য একটু ছুঁয়ে এ ব্যাপারে কেমন করে নিশ্চয়তা দাও? এখনো রাগ কমেনি। ট্যানাসের।

দাঁত দেখে, উত্তরে বললাম। মাংসাশী প্রাণীর মতো বিষদাঁত নেই এদের। এ মাংসাশী নয়।

এবারে, একটু দ্বিধায় ভুগলো ট্যানাস; সুযোগটা নিলাম আমি। এতেও যদি বিশ্বাস করো; তাহলে দেখো, নদীর এপারে কী নিয়ে এসেছে হিকসস্‌ যোদ্ধারা। মাংসাশী সিংহ কখনো খড় খায়?

মাংসই হোক বা খড়; আমি এ নিয়ে আর তর্ক করতে চাই না। তুমি আমার সিদ্ধান্ত শুনেছো। ওই মরুতে মরুক ঘোড়ার পাল-এ-ই আমার কথা। ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে সরে গেলো সে।

এমন উদাহরণ খুব কম, যখন আমার কী কোনো ব্যাপারে আমার সাথে একমত হতে বাধ্য হয়নি, আর এখন তো ও এই মিশরের কর্ত্রী। সেই সন্ধ্যায়, যুদ্ধ গ্যালির নিরাপত্তার ভেতর রাজকীয় জাহাজ নোঙর ফেলতেই ওর কাছে গেলাম আমি।

আমার নিজের তৈরি কাঠ-খোদাই করা চাকায়-চলা রথ আর ঘোড়ার নকলটা লসট্রিসের হাতে তুলে দিলাম ওর প্রেমিকের অজান্তেই। দারুন প্রভাবিত হলো রানি। যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়ায় টানা রথের সর্বনাশা আক্রমণ সে দেখেনি, কাজেই সেনাবাহিনীর আর সবার মতো তার ঘৃণা নেই ওগুলোর প্রতি। এরপর, সেই কালো ঘোড়ার মর্মান্তিক মৃত্যুর বর্ণনা দিলাম ওকে। শেষ হতে দেখা গেলো, আমার দু জনেই কাঁদছি।

এক্ষুণি, মরুতে গিয়ে চমৎকার প্রাণীগুলোকে বাঁচাও তুমি, টাইটা। ওগুলো যদি উদ্ধার করতে পারো, আমি নির্দেশে দিচ্ছি, আমার সেনাবাহিনীর জন্যে রথ তৈরি করবে। দৃঢ়স্বরে বলে উঠলো রানি।

যদি আমার আগে ট্যানাসের সাথে এ ব্যাপারে কথা হতো ওর, আমি জানি, এ সিদ্ধান্তে আসতো না মিসট্রেস। আর আমাদের দেশের ইতিহাসও ভিন্ন রকম হতো সেক্ষেত্রে। স্বাভাবিকভাবেই, আমার এই ছলনাপূর্ণ আচরণের খবর জেনে দারুন রাগ করলো ট্যানাস, ওর সাথে এতো দিনের বন্ধুত্বে ফাটল ধরার উপক্রম হলো এতে।

যা হোক, অবশেষে রানির ইচ্ছেয় সামান্য কয়জন লোক জোগাড় করতে সমর্থ হলাম।

গালালা মরুতে আমাদের হাতে ধরা-পড়া শ্ৰইক, পরে যে ট্যানাসের গ্যালি বাহিনীর একটা অংশের নেতৃত্ব পেয়েছিলো, সেই হই থাকলো আমার সাথে। ওর জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, কাজেই এই মুহূর্তে তেমন কোনো কাজ নেই হাতে।

ঘোড়া সম্পর্কে কী জানো তুমি? তাচ্ছিল্যের স্বরে আমাকে বললো হুই। সেই মুহূর্তে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যে ঠিক তৈরি ছিলাম না।

নিশ্চই তুমি বেশি জানো আমার থেকে? সতর্ক স্বরে বললাম।

আমি সহিস ছিলাম আগে, উদাস স্বরে জানালো হুই।

সেটা আবার কোন প্রাণী?

ঘোড়ার দেখভাল করে, এমন লোক, তার উত্তরে অবাক হয়ে গেলাম আমি।

আবনুবের সর্বনাশা লড়াইয়ের আগে তুমি তাহলে ঘোড়া দেখেছো!

ছোট্ট বয়সে আমার বাবা-মা মারা যাওয়ার পর, পুবের বর্বর একটা গোত্রে বড়ো হয়েছি আমি। ইউফ্রেতিস নদী থেকে এক বছর মতো যাত্রার দূরত্বে, সেই পূবের এক সমভূমিতে। যাদের কাছে ছিলাম তখন, ওরা ঘোড়া পালতো; বাচ্চা বয়সে ঘোড়ার সঙ্গে বহু সময় কেটেছে আমার। রাতে ওগুলোর পেটের তলায় ঘুমোতাম, ঘোটকির দুধ ছিলো আমার প্রিয় খাদ্য। দাস হওয়ার কারণে তাঁবুতে আশ্রয় মিলতো না তো। ওই বর্বরগুলোর হাত থেকে পালিয়েওছি একটা কালো ঘোড়ায় চড়ে। দ্রুত গতিতে চলে, ইউফ্রেতিস নদীর কাছে এসে মরে গেলো ওটা।

তো, এই হুই আর অল্প কয়েকজন নিরাসক্ত ঘোড়া-ধরা সৈন্য নিয়ে পশ্চিম তীরে নামলাম আমি। মোট ষোলোজন ছিলো আমার দলে, সেরা কোনো লোক যেনো আমার সাথে না আসতে পারে, সেটা অবশ্য নিশ্চিত করেছিলো ট্যানাস।

হুই-এর পরামর্শে লিনেনের দড়ি আর ধুররা শস্যের থলে নিয়ে রওনা হলাম আমরা। সে ছাড়া আর সবাই, এমনকি আমিও, ভয়ঙ্কর হিকসস্‌ প্রাণীর ভয়ে কাপড় ভিজিয়ে ফেলার উপক্রম। প্রথম সকালে উঠে দেখি, ক্যাম্প খালি করে সব ক জন পালিয়ে গেছে।

ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, দুঃখে ভার মন নিয়ে বললাম আমি, একা একা আর কী করবো। ট্যানাস জানতো, এমন কিছু ঘটতে পারে।

আরে, তুমি একা কোথায়? উৎফুল্ল স্বরে হুই বলে। আমি তো আছি। সেই প্রথম, ওর প্রতি আমার অনুভূতি পাল্টে গেলো। ধুরুরা শস্যের গুড়ো আর দড়ি আলাদা করে আবারো রওনা হলাম আমরা দুজন।

মাটির বুকে পরিষ্কার চিহ্ন রয়েছে ঘোড়ার পালের, হুই আমাকে আশ্বস্ত করে জানালো, দলবদ্ধ ভাবে ঘুরতে পছন্দ করে এরা। নদীর ধার ছাড়া অন্য কোথাও যাবে না। মরুতে হারিয়ে যাওয়ার কথা নয় এদের।

সত্যি, হুই-এর কথা পরবর্তীতে সত্যি প্রমাণিত হয়েছিলো।

হিকসস্‌ আক্রমণের পর কৃষাণেরা ঘর-দোর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে দেয়ালঘেরা আসয়ূত নগরে। একের পর এক বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ তাই শূন্য পড়ে আছে। শস্য কাটা হয়নি অনেক ক্ষেতে। দ্বিতীয় দিন দুপুরের আগেই ঘোড়ার পালের দেখা পেলাম। ছড়িয়ে পড়ে মাঠে চড়ছে প্রাণীগুলো। আশঙ্কায় লাফিয়ে উঠলো আমার বুকের ভেতরটা।

এগুলো ধরা নিশ্চই অত্যন্ত বিপদজনক কাজ, ভয়ে ভয়ে স্বীকার করলাম হুই-এর কাছে। তখন পুরো তিনশো তো দূরের কথা, একটি-দুটি ঘোড়া ধরতে পারলেও খুশি আমি।

আমি শুনেছি, চালু-দাস হিসেবে বেশ নাম-ডাক আছে তোমার, দাঁত বের করে হাসলো হুই; দৃশ্যত এই বিষয়ে আমার জ্ঞানের স্বল্পতা বেশ আনন্দ দিচ্ছিলো তাকে। বোঝাই যায়, তোমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি বলে সবাই।

এরপর সে আমাকে দেখালো, কেমন করে দড়ি দিয়ে ফাঁস প্রস্তুত করতে হয়। বারোটা এ রকম ফাঁস তৈরি হতে সন্তুষ্ট হলো হুই। একটা করে ফাঁস আর ধুররা শস্যের গুড়ো সমেত থলে নিয়ে ঘোড়ার পালের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমরা। হুই-এর পরামর্শে সরাসরি না গিয়ে, একটু বাঁকা পথে ধীরে ঘোড়াগুলো পেরিয়ে তারপর থামলাম।

এবার, ধীরে, নরম স্বরে আমাকে সমর্ক করে দিলো হুই। মাথা উঁচিয়ে, ঠিক শিশুদের মতো নিষ্পাপ দৃষ্টিতে আমাদের পরখ করে দেখতে লাগলো ঘোড়াগুলো।

বসে পড়ো। ধীরে বসে পড়লাম আমরা দু জন। মুখ নামিয়ে শস্য খাওয়ায় মন দিলো ঘোড়াগুলো; আবারো ধীরে এগুতে লাগলাম আমি আর হুই, যতক্ষণ পর্যন্ত না অস্বস্তিতে নড়া-চড়া আরম্ভ করলো ওগুলো।

নিচু হও! আদেশ করে হুই। নম্র কণ্ঠস্বর বেশ পছন্দ করে এরা। ছোট্ট বয়সে গান গেয়ে ঘোড়ার পাল শান্ত করতাম আমি। দেখো! বিচিত্র কোনো ভাষায় সুর করে গাইতে লাগলো সে।

এমন কর্কশ সেই স্বর, ঠিক যেনো মরা কুকুরের লাশের উপর কাক ডাকছে। সবেচেয়ে কাছের ঘোড়াগুলো উৎসুক চোখে চাইলে আমাদের দিকে। আমার মতোই ওদের কাছেও হুই-এর গান অত্যন্ত বিশ্রী লেগেছে আমি নিশ্চিত।

আমি একটু চেষ্টা করে দেখি, ফিসফিস করে ওকে বলে, রাজকুমারের জন্যে আমার তৈরি একটা ঘুমপাড়ানি-গান ধরলাম।

ঘুমাও, ছোট্ট মেম, প্রভাতের শাসন করে যে;
ঘুমাও, ছোট্ট রাজকুমার, এই পৃথিবী একদিন তোমার হবে।
কোঁকড়া-চুলো ওই ছোট্ট মাথাটা একটু রাখো না কোলে,
বিশ্রাম দাও ওই হাত দুটোকে, একদিন যা দিয়ে তরবারি আর ধনুক ধরবে।

একটা মাদী-ঘোড়া কাছে ঘেষে এসে মুখ দিয়ে নরম আওয়াজ করে উঠলো। গেয়ে চললাম আমি। পায়ের কাছে একটা শাবক নিয়ে ধীরে আরো কাছে এলো ঘোড়াটা।

জীব-জন্তুর প্রতি আমার বিশেষ অনুভূতি থেকে এতক্ষণে ঘোড়াগুলোর সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছি আমি, হুই-এর উপর আর নির্ভর করতে হচ্ছে না।

গাইতে গাইতে এক মুঠো শস্যদানা তুলে দিলাম ঘোড়ার মুখের কাছে। সাথে সাথেই বোঝা গেলো, হাত থেকে খাওয়ার অভ্যাস আছে এর; কাজেই আমার বাড়ানো হাতের মর্ম বুঝতে কোনো অসুবিধা হলো না তার। এখনো সেই অনুভূতি মনে পড়লে শিহরিত হই, যখন মুখ ডুবিয়ে আমার হাত থেকে শস্যদানা খেলো মাদী-ঘোড়াটা, সেই মুহূর্তটি কোনোদিনও ভুলে যাবো না। কাঁধে হাত বুলিয়ে দিতে একটু সরে গেলো না ওটা, নাক দিয়ে ওর চামড়ার অদ্ভুত-গরম গন্ধ নিতে লাগলাম।

ফাঁসটা, হুই নরম স্বরে মনে করিয়ে দিলো আমায়; ওর দেখানো পদ্ধতি অনুযায়ী ধীরে ঘোড়াটার গলায় পরিয়ে দিলাম দড়ির ফাঁস।

এখন থেকে ও তোমার, বললো হুই।

আর আমি ওর, চিন্তা-ভাবনা না করেই বলে উঠলাম আমি । সেই মুহূর্ত থেকেই পরস্পরের মায়াজালে বন্দী হলাম আমরা।

পালের বাকি ঘোড়াগুলো দেখেছে এই সবই। মাদী-ঘোড়ার গলার চারপাশে লাগামের ফাঁস পরিয়ে দিতে অন্যান্যগুলোও কাছাকাছি এসে হাত থেকে দানা খুঁটে খেতে লাগলো। ধীরে, একে একে সবগুলোর গলায় লাগাম পরিয়ে দিলাম আমি আর হই।

সেই সময় এই ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যজনক মনে হলেও পরে বুঝেছিলাম –সেটাই ছিলো স্বাভাবিক। জন্মকাল থেকেই মানুষের সান্নিধ্যে বড়ো হয়েছে প্রাণীগুলো; হাত থেকে দানা খেয়ে, আস্তাবলে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে। তবে সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, ভালোবাসা বোঝে ওরা, ফিরিয়েও দিতে পারে!

আরো একটা মাদী-ঘোড়ার গলায় লাগাম পরিয়েছে দুই; সর্বক্ষণ বকবক করেই যাচ্ছে। এতে উৎফুল্লচিত্ত ছিলাম সেদিন, ওর বাগাড়ম্বরে কর্ণপাত করিনি।

ঠিক আছে, শেষমেষ বললো হুই, এবারে, চড়ে বসতে পারি আমরা। আমাকে চরম অবাক করে দিয়ে ওর মাদী-ঘোড়াটার পাছায় দুই হাত রেখে এক দোল খেয়ে পিঠে চড়ে বসলো সে। ঘোড়াটার হিংস্র প্রতিবাদের জন্যে অপেক্ষা করছি, হুই-কে এক্ষুণি মাটিতে ফেলে পিষে ফেলবে ওটা; চৌকোণা দাঁতে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে ওকে এই ছিলো আমার নিঃসন্দেহ ধারণা। কিন্তু এ সবের কিছুই করলো না ওটা, চুপচাপ দাঁড়িয়ে যেনো হুকুমের অপেক্ষায় রইলো।

চলো, প্রিয়তমা! হেঁকে উঠে, ঘোড়ার পেটে গোড়ালি দিয়ে গুতো দিতে লাগলো হুই। সামনে এগুলো ওটা, এরপর আবারো হুইয়ের পায়ের তোয় দুলকি চালে ছুটতে আরম্ভ করলো। দ্রুত পুরো মাঠে একটা চক্কর খেয়ে আমার কাছে ফিরে এলো ঘোড়া আর সওয়ারী।

এসো, টাইটা, ঘোড়া ছুটিয়ে দ্যাখো! পরিষ্কার বুঝলাম, আমি মানা করবো–এমনই আশা করছে হুই। সম্ভবত এই কারণেই রাজী হয়ে গেলাম–ওই ছোট্ট শয়তানটা আমার উপরে ছড়ি ঘোরাক, চাই না।

ঘোড়ার পেছনে উঠার আমার প্রথম প্রচেষ্টাটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো । কিন্তু মাজা শক্ত করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো মাদী-ঘোড়াটা। এর থেকে অনেক কিছু শেখার আছে তোমার, টাইটা। জানোয়ারটাকে বরঞ্চ ধৈৰ্য্য বলেই ডেকো। এতে অবশ্য মজার কিছু দেখলাম না আমি, কিন্তু টিকে গেলো নামটা। এর পর থেকে ধৈৰ্য্য নামেই পরিচিতি পেয়েছিলো মাদী-ঘোড়াটা।

পা ঘোরানোর আগে একটু বেশি উঁচুতে লাফাতে হবে, আর সাবধান, ভুলেও নিজের বিচির উপর বসে পোড়ো না যেনো! কর্কশ হাসিতে ফেটে পড়ে পরামর্শ দিয়ে চললো হুই। ওহ্ হো, এই পরামর্শ তোমার প্রয়োজন নেই। কারণ ওই জিনিস তো তোমার নেই। তবে কি, ও রকম দুটো বিচি থাকলে বুঝতে, জিনিসটা মন্দ নয়।

ওর প্রতি সমস্ত ভালো অনুভূতিগুলো দূর হয়ে গেলো আমার, ঘোড়ার পিঠে চড়ে দুই হাতে কেশর আঁকড়ে উবু হয়ে বসে থাকলাম।

সোজা হয়ে বসো! হুই শুধরে দেয়; ওদিকে ধৈৰ্য্য তার শান্ত ব্যবহার দিয়ে সাহায্য করতে থাকে।

মানবিক গুণাবলির হিসেবে এই প্রাণীগুলোর বৈচিত্রে সত্যি অবাক হতে হয়; পরবর্তী কয়েক দিনে থিবেস অভিমুখে আমাদের দক্ষিণ যাত্রায় টের পেলাম, এরা সন্দেহপূর্ণ অথবা বিশ্বাসী, কর্কশ অথবা শয়তান, বন্ধু-বৎসল নচেৎ একাকী, সাহসী নয়তো ভীতু, সধৈৰ্য্য নয়তো অধৈৰ্য্য, বিস্ময়কর অথবা অনুমিত স্বভাবের হতে পারে । মানুষের আচরণের সাথে অনেক মিল আছে ঘোড়ার অন্তত চারপায়ের অন্য যে কোনো প্রাণীর চেয়ে তো বটেই। যতোই শিখছি ওদের সম্পর্কে, ততোই আগ্রহ বাড়ছে; যতো বেশি সময় কাটালাম ঘোড়ার সাথে, ততো বেশি করে ভালোবেসে ফেললাম ।

ধৈর্য্যের পিঠে চড়ে এগোলাম আমি, পেছনে পেছনে ছুটলো ওর শাবক। তিনশো ষোলোটি ঘোড়ার পুরো পাল বাধ্যগতের মতো ছুটলো পিছু পিছু। পিছনে থেকে কোনো দলছুট, ঘোড়াকে পালের মধ্যে ফিরিয়ে আনার কাজ সম্পাদন করলো হুই। যতোই। সময় গড়িয়ে গেলো, ধৈর্য্যের পিঠে আরো সুস্থির আর চৌকষ হয়ে উঠলাম আমি; আমাদের মধ্যকার বন্ধুত্ব গাঢ় হতে লাগলো প্রতি মুহূর্তে। আমার নিজের দেহেরই একটা অংশ যেনো হয়ে উঠতে লাগলো মাদী-ঘোড়াটা; কেবল আমার দুর্বল হাত পায়ের বদলে ওর উপাঙ্গ অত্যন্ত শক্তিশালী আর দ্রুতগতিসম্পন্ন। ঘোড়ার পিঠে চড়ার ব্যাপারে অন্যদের অনীহা দারুন পীড়া দিয়েছিলো আমাকে।

সম্ভবত, সেই আবনুবের সমভূমির আতঙ্কই শুধু নয়, ট্যানাসের নিজস্ব ধ্যান ধারণারও প্রভাব আছে এতে। যে কারণেই হোক, এমন একজন মিশরীয় যোদ্ধাকেও পেলাম না যে ঘোড়ার পিঠে চড়ে লড়তে চায়। কেবল হুই, আর বহু সময় পর, রাজকুমার মেমনন ছাড়া। অবশ্য, ঘোড়ার যত্ন নেওয়া, দলাই-মলাই করা শিখে নিয়েছিলো তারা। আমার প্রত্যক্ষ সাহায্যে দুর্ধর্ষ রথ-চালক হয়ে উঠেছিলো মিশরীয়রা, কিন্তু আমি, হুই আর রাজকুমার ছাড়া এমন একজন লোককেও পাইনি যে জীবনে কখনো ঘোড়ার পিঠে চড়েছে। হালকা স্পোক সমৃদ্ধ যে চাকা আমি নকশা করেছিলাম, তার উপর চড়া রথ যখন সমগ্র মিশরে আধিপত্য বিস্তার করেছিলো, আর মিশরীয়রা বনে গিয়েছিলো রথ-তৈরির শ্রেষ্ঠ কারিগর, ট্যানাস কখনোই এই সৃষ্টি গ্রহণ করে নি। তার জীবনকালে কখনো রথ-টানা বোবা প্রাণীগুলোর প্রশংসা করেনি সে।

*

পরবর্তী সময়ে যখন ঘোড়া হয়ে উঠেছিলো মিশরের স্বাভাবিক বাহন, এমনকি তখনো তেমন সম্মানের চোখে দেখা হতো না সওয়ারীকে। আমরা তিনজনে যখনই কোনো সাধারণ মানুষজনের পাশ দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যেতাম, মাটিতে তিনবার থুতু ফেলে নিজেদের বুকে শয়তানের বিপরীতে চিহ্ন আঁকতো তারা।

এসবই ভবিষ্যতের কথা; আর এখন, নীল নদের পশ্চিম তীর ধরে থিবেস অভিমুখে আমার ঘোড়ার পাল নিয়ে ছুটে চললাম। আমার কর্ত্রী দারুন আপুত হলো সুন্দর প্রাণীগুলোকে দেখে; অপরদিকে মিশরীয় সেনাবাহিনীর প্রধানের নিরুৎসাহী স্বাগতম জুটলো কপালে ।

এই শয়তান প্রাণীগুলোকে আমার থেকে দূরে রাখবে, এই বেলা বলে দিলাম, কঠোর স্বরে ট্যানাস বললো আমাকে। ওকে টেক্কা দিয়ে মিসট্রেসের সাথে যোগসাজশের জন্যে এখনো আমাকে ক্ষমা করতে পারেনি সে।

অবশ্য, তার এই কর্কশ মেজাজের পেছনে কারণও রয়েছে। রাজ্যের নিরাপত্তা এই মুহূর্তে ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন, আমাদের এই মিশরের ইতিহাসে কখনো এমন সময় আসেনি এর আগে।

ইতিমধ্যেই আসয়ুত হারিয়েছি আমরা; সেই ডানডেরা নদী পর্যন্ত সমগ্র পুব তীর এখন হিকসস্‌ বাহিনীর দখলে। নৌপথে পর্যুদস্ত হলেও একটু দমে যায়নি রাজা স্যালিতিস, বিপুল বিক্রমে নিজের রথ-বাহিনী নিয়ে ঘিরে ফেলেছে দেয়ালঘেরা থিবেস নগর।

অন্য কোনো ক্ষেত্রে হলে, থিবেসের এই দেয়াল প্রতিরক্ষার জন্যে যথেষ্ট, কিন্তু শত্রুশিবিরে ইনটেফের উপস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যতোদূর জানা গেছে, রাজ উজির থাকাকালে থিবেসের দেয়ালের নীচ দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিলেন তিনি। এমনকি, আমি, যে ছিলাম তার বিশ্বস্ত দাস, পর্যন্ত জানতাম না এ কথা। যে মিস্ত্রি এই সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিলো, ইনটেফ পরে তাকে হত্যা করেছিলেন, যাতে করে তিনি ছাড়া আর কারো এই পথের কথা জানা না থাকে।

ইনটেফের কাছ থেকে প্রাপ্ত সংবাদে রাজা স্যালিতিস রাতের অন্ধকারে একটা ছোট্ট বাহিনী পাঠালেন সেই গোপন পথে । একবার দেয়ালের ভেতরে চলে আসতে, খুব সহজেই প্রধান ফটকের অপ্রস্তুত রক্ষীদের অতর্কিতে আক্রমণ করে তারা; মুহূর্তেই তাদের খুন করে হা করে মেলে ধরা হলো প্রধান ফটক। সাথে সাথেই প্রধান হিকসস্‌ বাহিনী বানের পানির মতো ঢুকে পড়লো শহরের অভ্যন্তরে, অল্প সময়ের মধ্যেই অর্ধেক থিবেসবাসী প্রাণ হারালো।

অর্ধ-সমাপ্ত মেমনন প্রাসাদে, পশ্চিম তীরে আস্তানা গেড়েছে মিশরীয় বাহিনী, নদীর ও পারের আগুনে পোড়া, ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি-ঘর নজরে এলো আমাদের। প্রতিদিনই হিকসস্‌ রথ-বাহিনীর সৃষ্ট বিশাল ধুলোর মেঘ পুব তীরের এ মাথা থেকে ও মাথায় ছুটোছুটি করে কসরৎ চালিয়ে যেতো, ত দের বর্শার চকচকে ডগা আর বর্মের আলোর ঝিলিক আমাদের মনে করিয়ে দিতে সামনের ভয়াবহ যুদ্ধের কথা।

ক্ষয়িষ্ণু বাহিনী নিয়েও নদীর শাসন ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে ট্যানাস, আমার অনুপস্থিতির সময়টাতে আরো একবার হিকসস্‌দের নদী পেরোনোর প্রচেষ্ট রুখে দিয়েছে সে। কিন্তু বিশাল নদীর বড় অংশ পাহাড়া দিতে হচ্ছে তাকে, যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো স্থান দিয়ে পারাপার হওয়ার চেষ্টা চালাতে পারে হিকসস্‌ যোদ্ধারা। পুব তীরে আমাদের গুপ্তচর মারফত জানা গেলো, হাতের কাছের সমস্ত নৌযান প্রস্তুত রেখেছে তারা। থিবেসের বহু নৌ-কারিগর ধরে ধরে নৌকা তৈরিতে লাগিয়ে দিয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই, এই সমস্ত পরিকল্পনায় ইনটেফের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে; বর্বর স্যালিতিসের মতোই ফারাও-এর সমাধি-সম্পদের উপর তার লোভ কম নয়।

সারারাত ধরে পাহাড়া দিতে লাগলো গ্যালির প্রতিটি যোদ্ধা। নির্মুম সময় কাটাতে লাগলো ট্যানাস, আমি কিংবা মিসট্রেস তার চেহারাও দেখতে পেলাম না কদিন।

প্রতিরাতে প্রচুর শরণার্থীর আগমন ঘটতে পশ্চিম তীরে। বিভিন্ন বয়সের নারী ও পুরুষ ছোটো ছোটো জলযানে চড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পাড়ি দিতে লাগলো। কেউ কেউ আবার সরাসরি সঁতরে নদী পেরুলো। হিকসস্‌দের ভয়াবহ অত্যাচার থেকে মুক্তি চায় এরা। হিকসস্‌ কর্মতৎপরতার নতুন বিবরণ পাওয়া গেলো এদের কাছ থেকে।

যদিও এদের স্বাগতই জানালাম আমরা, কেননা এরা তো আমাদেরই দেশের লোক, ভাই-বন্ধু-আত্মীয়; কিন্তু আমাদের ফুরিয়ে আসা রসদের উপর চাপ পড়লো এই কারণে। শস্যের মজুদ, গবাদি পশু-পাখি সব এই মুহূর্তে থিবেসে, হিকসস্ বাহিনীর দখলে। পশ্চিম তীরের সমস্ত খাদ্যভাণ্ডার সংগ্রহের দায়িত্ব দিলেন আমাকে রানি। ভাগ্য প্রসন্ন আমাদের, নীল নদে মাছের কোনো অভাব নেই, কখনোই না খাইয়ে মারতে পারবে না আমাদের হিকসস্‌ বাহিনী।

রাজকীয় আস্তাবলের পরিচালক নিযুক্ত করলেন রানি আমাকে। অবশ্য, এই পদের জন্যে যে খুব প্রতিযোগিতা হয়েছিলো তা নয়, আর বিশাল কোনো বেতন-ভাতাও নেই এই চাকরিতে। হুইকে আমার সহকারী নিযুক্ত করলাম, ঘুষ না হয় ভয়-ভীতি অথবা হুমকি দিয়ে একশ জন সাহায্যকারী যোগাড় করে ফেললো সে। পরবর্তীতে এরাই হয়েছিলো আমাদের প্রথম রথ-চালক।

নেক্রেপলিসে, আমাদের অস্থায়ী আস্তাবল প্রতিদিন পরিদর্শন করতাম। সেই মাদী-ঘোড়া ধৈৰ্য্য আমাকে দেখলেই ছুটে এসে স্বাগত জানাতো। ওর আর ওর শাবকের জন্যে পিঠা নিয়ে যেতাম আমি। মাঝে-মধ্যেই, মা আর পরিচারিকার কাছ থেকে রাজকুমার মেমননকে কাঁধে করে আস্তাবলে নিয়ে যেতাম। ঘোড়া দেখার সাথে সাথেই চিৎকার করে নিজের আনন্দের কথা জানান দিতো রাজকুমার।

নদী তীর ধরে ধৈর্য্যের পিঠে চড়ে যখন ঘুরে বেড়াতাম, মেমনন আমার কোলে থাকতো। অবশ্য, একটা ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতাম যেনো আমাদের পথে ট্যানাস না পড়ে। আমাকে এখনো ক্ষমা করতে পারেনি সে, আর যদি দেখে তার ছেলেকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে ফিরছি, শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা আছে বৈকি আমার।

ফারাও-এর যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কারিগরদের সহায়তায় প্রথম রথ তৈরির কাজে ব্যাপৃত হলাম। এখানেই, রথের নকশা তৈরির সময় হিকসস্‌ রথের বিরুদ্ধে আমাদের প্রথম প্রতিরক্ষা অস্ত্রের পরিকল্পনা করেছিলাম আমি। কাঁটাওয়ালা, শক্ত প্রান্তের ছোটো ছোটো ছুঁচালো ডগাসমৃদ্ধপিপে ছিলো সেগুলো। আমাদের বাহিনীর যোদ্ধারা নদী তীরে নিয়ে যাবে এই পিপেগুলো। শত্রু ঘোড়ার বুক সমান উঁচু পিপের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে তীর ছুঁড়বে তারা। কাটার কারণে পিপের উপর চড়াও হতে শতবার ভাববে হিকসস্‌ বাহিনী ।

যখন ট্যানাসকে দেখালাম এই অস্ত্র, ঘোড়া নিয়ে আমাদের ঝগড়ার পর সেই প্রথম। সব ভুলে আমাকে আলিঙ্গন করলো সে। বুঝলাম, আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে সে।

অবশেষে, আমার প্রথম রথ তৈরি হলো। কাঠামো আর দেয়াল তৈরি হলো বাঁক চিরে। এক্সেল তৈরি হলো একাশিয়া গাছের ডাল থেকে। হাব হলো তামার তৈরি, গরুর চর্বিতে পিচ্ছিল-করা, চাকার শোক তৈরি হলো আমার সরু দণ্ড দিয়ে। এতো হালকা ছিলো সেই রথ, দুইজন যোদ্ধা মিলে অনায়াসে বহন করে উপযুক্ত স্থানে নিয়ে গিয়ে ঘোড়ার সাথে জুড়ে নিতে পারে। সাথে সাথে বুঝলাম, অসাধারণ একটা জিনিস হয়েছে ওটা। মিস্ত্রিরা নাম দিলো টাইটা-রথ ।

আমি আর হুই, আমাদের দুটো সেরা ঘোড়া ধৈৰ্য্য আর ফলাকে জুড়ে দিলাম রথের সাথে। প্রথমবারের মতো পথ-চলার জন্যে তৈরি হলো টাইটা-রথ । বেশ কিছুক্ষণ লেগেছিলো ওটা নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে, কিন্তু ঘোড়াগুলো এতে অভ্যস্ত হওয়ায় তেমন কোনো সমস্যা হলো না চালাতে।

উত্তেজনায় লাল হয়ে আস্তাবলে ফিরলাম। আমরা দু জনেই নিশ্চিত, হিকসস্‌ রথের তুলনায় আমাদের বাহন দ্রুততর এবং হালকা। পুরো দশদিন-দশরাত জেগে মশালের আলোয় শেষ মুহূর্তের টুকিটাকি কাজ শেষ করতে ট্যানাসের দর্শনের জন্যে প্রস্তুত হলা টাইটা-রথ ।

নিরাসক্ত চেহারায় আস্তাবলে এলো ট্যানাস, আমার পিছন পিছন বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে বলবে চড়ে বসলো রথ-কাঠামোতে।

প্রথমটায় ধীরগতিতে ছোটালাম ঘোড়াগুলোকে, দেখলাম শিথিল হয়ে এলো ট্যানাসের শরীর, একটু একটু করে সেও উপভোগ করতে শুরু করেছে রথ-দৌড়নো। এরপর, দ্রুতগতিতে ছোটাতে লাগলাম ঘোড়াগুলোকে। দ্যাখো, কী গতিবেগ! একেবারে উড়ে গিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে এটা নিয়ে! বললাম ওকে।

প্রথমবারের মতো হাসলো ট্যানাস। উৎসাহ বাড়লো আমার । জাহাজ দিয়ে নদী শাসন করবে তুমি। আর এই রথ দিয়ে শাসন করবে জমিন। পুরো পৃথিবী শাসন করবে তুমি। কিছুই তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না।

এ-ই তোমার সর্বোচ্চ গতিবেগ? বাতাসের গর্জন ছাপিয়ে চেঁচিয়ে বললো ট্যানাস। বাতাসের সাহায্য পেলে হোরাসের প্রশ্বাস তো এর চেয়ে দ্রুত চলে। ডাহা মিথ্যে কথা; আসলে ট্যানাস দেখতে চাইছে আর কতো দ্রুত চলতে পারে রথ ।

দেয়াল আঁকড়ে ধরে থাকো! ওকে সতর্ক করে দিয়ে বললাম। ঈগলের মতো উড়িয়ে নিয়ে যাবো এবারে! ধৈৰ্য্য আর ফলাকে ছুটিয়ে দিলাম আমি।

এর চেয়ে দ্রুত কোনো মানুষ চলেনি এর আগে । বাতাসের ঝাঁপটায় চোখ বন্ধ, চুলে প্রচণ্ড টানে পানি ঝরছে ব্যথায়, হুলের মতো মুখে আঘাত করছে বাতাস।

আইসিসের মিষ্টি শ্বাসের কসম! উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলো ট্যানাস। এটা তো আর কখনো জানা হয়নি, কী বলতে চাইছিলো সে, কেননা ও বাক্যটা সম্পূর্ণ করার আগেই পাথুরে টিলার সাথে সংঘর্ষে ফেটে গেলো একটা চাকা।

উল্টে পড়ে ডিগবাজি খেলা রথ, আমি এবং ট্যানাস শূন্যে নিক্ষিপ্ত হলাম। আছড়ে মাটিতে পড়ার মুহূর্তে ব্যথার চেয়ে বেশি পীড়া দিচ্ছিলো একটা ব্যাপার, এই দুর্ঘটনায় ট্যানাসের প্রতিক্রিয়া কী হবে, কে জানে।

পায়ের উপর দাঁড়িয়ে দেখি বিশ গজ মতো দূরে রক্তাক্ত হাঁটু ঝাঁপটে ধরে বসে আছে ট্যানাস। মনে হলো, মুখের একপাশের চামড়া হারিয়েছে সে, সারা মুখ-মাথা ধুলোয় মাখামাখি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অদূরেই পড়ে থাকা ধ্বংসপ্রাপ্ত রথের উদ্দেশ্যে চললো মিশরীয় সেনাপ্রধান। বেশ কিছুক্ষণ ওটার দিকে চেয়ে থেকে শেষে প্রচণ্ড একটা হুঙ্কার দিয়ে এতো জোরে লাথি কষালো ভাঙ্গা রথ-কাঠামোতে, বাচ্চাদের খেলনার মতো উল্টে গড়াতে লাগলো ওটা। একবারো আমার দিকে না তাকিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে চললো সে। এর এক সপ্তাহ পর পর্যন্ত ওর সাথে আর দেখা হয়নি আমার। এ বিষয়ে আমরা আর কখনো আলাপও করিনি।

মূলত, আমার রানির একগুঁয়েমির কারণে শেষপর্যন্ত একটা রথ-বাহিনী প্রস্তুত করতে পেরেছিলাম। হুই আর আমি তিনদিনের মধ্যে ভেঙ্গে পড়া রথটা মেরামত করে নতুন আরো একটা তৈরি করে ফেললাম।

যতোদিনে সমাধি-মন্দিরের যাজকেরা ফারাও-এর শবদেহ মমি করার সত্তর দিবস-রজনীর আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন, ততোদিনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালকসহ পঞ্চাশটি রথের প্রথম বাহিনী তৈরি হয়ে গেছে আমাদের।

*

মমি তৈরির আনুষ্ঠানিকতা শেষে কফিনে ঢোকানো হলো ফারাও এর শবদেহ। কিন্তু শত্রু অধ্যুষিত মিশরে তার মমি নিরাপদ নয়; যে কোনো মুহূর্তে লজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাই ফারাওকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক যতোদিন পর্যন্ত না কোনো নিরাপদ স্থান খুঁজে পাওয়া যায়, তার শবদেহ সমাধিস্থ না করে কফিনেই রাখার সিদ্ধান্ত নিলো রানি।

তিন রাত পর তার এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমাণিত হলো। নদী পারাপারের হিকসস্‌ প্রচেষ্টা কোনোমতে রুখে দিলো ট্যানাস। এনার দুই মাইল উত্তরে অরক্ষিত অবস্থান দিয়ে নদী পার হতে চাইলো শত্রুরা। ঘোড়াগুলোকে সঁতরে পার করে, দলবেঁধে নৌকায় চড়ে পানিতে নেমে এলো হিকসস্‌ বাহিনী।

পশ্চিম তীরে পৌঁছতে সক্ষম হলো তাদের ঘোড়ার পাল, ঠিক সেই সময়ে গ্যালি নিয়ে ছুটে এলো ট্যানাস। রথের সরঞ্জাম নামিয়ে ঘোড়ার সঙ্গে জুড়ে ফেলার আগেই কতল করা হলো শত্রু যোদ্ধাদের। তাদের নৌকাগুলো রথসহ ডুবিয়ে দেওয়া হলো । হৈ-হট্টগোলের মধ্যে ছুটে পালিয়ে গেলো ঘোড়াগুলো। তিন হাজার শত্রুসৈন্য ততক্ষণে পশ্চিমতীরে অবস্থান নিয়ে ফেলেছে। সারারাত ধরে চললো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। অন্ধকারে কেবল মশালের আলোয় হিংস্রতা নিয়ে পরস্পরের উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো দুই বাহিনী। রথ ছাড়া হিকসসেরা মিশরীয় বাহিনীর সমানে সমান, মাত্র এক দল যোদ্ধা নিয়ে তাদের সঙ্গে পেরে উঠছিলো না ট্যানাস।

ওদিকে, দেবতাদের কোনো ইশারায় হয়তো, হুই আর আমি মিলে আমাদের পঞ্চাশ রথের বাহিনী নিয়ে এস্নায় প্রশিক্ষণ করছিলাম সেই সময়।

হোরাসের মন্দিরের পাশে, সবুজ বৃক্ষের ছায়াঘেরা একটা স্থানে ক্যাম্প ফেলেছিলাম আমরা। সারদিনের প্রশিক্ষণ শেষে ক্লান্ত আমি, রাতে তাঁবুতে পড়ে মরার মতো ঘুমোচ্ছিলাম, এ সময় হুই এসে জাগিয়ে তুললো।

নদীর তীর ধরে পশ্চিমে আগুন জ্বলছে! হুই বললো। বাতাস এদিকে বইলে হর্ষোধ্বনি শুনতে পাবে, কিছুক্ষণ আগে মনে হলো যেনো নীল বাহিনীর রণ-সংগীত শুনতে পেয়েছি আমি। ভীষণ যুদ্ধ চলছে ওখানে!

চিৎকার করে সবাইকে জড়ো করে রথে ঘোড়া জুড়ার নির্দেশ দিলাম আমি। অপটু হাতে ঘোড়া জড়ো করে রথে জুড়তে সকাল হয়ে এলো প্রায়। নদীর কুয়াশার ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে রথ-বাহিনী নিয়ে উত্তর রাস্তা ধরে এগুতে লাগলাম আমরা। সামনের রথে নেতৃত্বে রইলাম আমি, পিছনে থাকলো হুই। গতদিনের প্রশিক্ষণের পর পঞ্চাশ থেকে তিরিশে পরিণত হয়েছে আমাদের রথের সংখ্যা; কেননা, চাকার স্পোকের সমস্যা থেকে এখনো মুক্তির উপায় খুঁজে পাইনি আমি। গতিবেগ বেড়ে গেলে হঠাৎ টুকরো টুকরো হয়ে যায় চাকা। অর্ধেক রথ এ কারণে অকেজো হয়ে গেছে।

চলতে চলতে ভাবছিলাম, হুই হয়তো ভুল করেছে; কিন্তু হঠাৎই সামনে থেকে ভেসে এলো তামার সাথে তামার সংঘর্ষ, রণ-হুঙ্কার, আর্তনাদ আর হর্ষোধ্বনির চিরপরিচিত সেই আওয়াজ। কৃষকের তৈরি পথের বাঁক ঘুরতেই খোলা মাঠে পুরো রণ ক্ষেত্র দৃষ্টিগোচর হলো আমাদের।

হাঁটু-সমান উঁচু সবুজ শস্যক্ষেতে দাঁড়িয়ে লড়ে চলেছে হিকসস্‌ বাহিনী। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে হাতের বর্ম একে অপরের সাথে জোড়া লাগিয়ে দারুন লড়ছে তারা। আমাদের সামনেই তাদের বৃত্ত ধ্বংস করার ট্যানাসের আরো একটি প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দিলো হিকসস্‌ বীরেরা। শত্রুবুহ্যের কাছে আহত আর নিহতদের ফেলে রেখে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলো মিশরীয় বাহিনী।

যুদ্ধকৌশলের উপর স্ক্রোল লিখলেও আমি কোনো যোদ্ধা নই। নিরুপায় হয়ে রাজকীয় আস্তাবলের পরিচালকের পদ গ্রহণ করেছিলাম। রথ-বাহিনী তৈরি করে, রথ চালনায় অন্যদের দীক্ষা দিয়ে হুই বা আর কারো হাতে দায়িত্বভার তুলে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্যে ছিলো।

শুনতে পেলাম, কর্কশ গলায় রথ-বাহিনীকে তীরের আকৃতিতে বিন্যস্ত হওয়ার জন্যে নির্দেশ দিচ্ছি আমি নিজে! গতকালই এই বিন্যাস নিয়ে প্রশিক্ষণ করছিলাম আমরা। দ্রুত অবস্থানে চলে এলো যোদ্ধারা। তীরের সামনে রইলো আমার রথ । হিকসদের থেকেই এই কৌশল রপ্ত করেছিলাম। বড়ো করে শ্বাস টেনে হাঁক দিলাম।

রথ-বাহিনী সামনে এগোও! ছুটে চলো! সামনে!

হাতের লাগামের সামান্য ঝুঁকিতে ধৈৰ্য্য আর ফলা দুর্বার গতিতে ছুটতে আরম্ভ করলো, রথের দেয়াল আঁকড়ে ধরে পতন সামলালাম আমি। সোজা হিকসস্ বৃত্তের মাঝে ঢুকে পড়লো আমাদের রথ-বাহিনী।

চারপাশে আর্তনাদরত সৈনিকের আস্ফালন, হেষারব, রণ-হুঙ্কারে কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। আমি নিজেও উন্মত্ত কুকুরের মতো হুঙ্কার ছাড়ছি টের পেলাম।

পিছিয়ে আসা মিশরীয় যোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে গেলো রথ-বাহিনী। অবাক বিস্ময়ে আমাদের দিকে চেয়ে রইলো ওরা।

এসো! দ্যাখো, কেমন করে লড়তে হয়! অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বললাম আমাদের যোদ্ধাদের। ঘুরে, রথের পিছু পিছু ছুটলো মিশরীয় যোদ্ধারা। শক্রর উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা। পাশে তাকিয়ে ট্যানাসের শিরস্ত্রাণ নজরে পড়লো । ঢেউয়ের মতো রথের পাশে পাশে চলেছে সৈনিকের দল।

সামনের শত্রু সারির বর্মের আড়াল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছুটে আসছে, হিসহিস শব্দে পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। তাদের রণ-হুঙ্কার, শিরস্ত্রাণে আঁকা বিচিত্র জীব-জন্তুর ছবি সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমি। এরপরই, নিমিষে শক্রবৃত্তে ঢুকে পড়লো আমাদের রথ।

ঘোড়ার উন্মত্ত খুড়ের তলায় পিষ্ট হলো বহু হিকসস্‌ যোদ্ধা। আমার পাশে, রথের পাদানীতে দাঁড়িয়ে একের পর এক অব্যর্থ তীর ছুঁড়ে দিচ্ছে তীরন্দাজ। বহু যোদ্ধার মধ্য থেকে একে নির্বাচিত করেছি আমি, আজ সে যেনো তারই প্রত্যুত্তর দিচ্ছে।

আমার রথের তৈরি করা ফোকড় গলে শক্রবুহ্যে একে একে ঢুকে পড়তে লাগলো মিশরীয় রথবহর। হিকসস্‌ বৃত্ত পেরিয়ে গিয়ে আবারো ফিরে ফিরে আসতে লাগলাম আমরা, মিশিয়ে দিতে লাগলাম ওদের মাটির সাথে।

মুহূর্তে সুযোগ নিলো ট্যানাস, ওর পদাতিক বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো আক্রমণে। নিমিষেই ছত্রভঙ্গ হয়ে নদীর উদ্দেশ্যে দৌড়তে লাগলো হিকসস্‌ যোদ্ধারা প্রাণ হাতে করে। তীরের সীমানায় চলে আসতেই নদীতে অবস্থিত গ্যালি থেকে মিশরীয় তীরন্দাজেরা ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছুঁড়ে মারতে লাগলো তাদের উদ্দেশ্যে।

আমার সামনে, বিচ্ছিন্ন একটা হিকসস্‌ যোদ্ধার দল প্রাণপণ লড়ে আমাদের বাহিনীকে ঠেকিয়ে রেখেছে। রথ ঘুরিয়ে সোজা তাদের উদ্দেশ্যে ছোটালাম আমি। কিন্তু পৌঁছুবার আগেই বিকট শব্দে ফেটে গেলো আমার রথের ডানদিকের চাকাটা; সাথে সাথে উল্টে গেলো রথ-শূন্যে ভেসে ভীষণ গতিতে মাটিতে আছড়ে পড়লাম আমি । মাথাটা পড়লো আগে, বিভিন্ন আলোর ফুটকি জ্বললো চোখের সামনে। তারপর সব অন্ধকার।

যখন জ্ঞান ফিরলো, ট্যানাসের জাহাজের খোলা পাটাতনে শুয়ে আছি। ভেড়ার পশমের একটা মাদুরে শায়িত আমার উপরে উদ্বিগ্ন-মুখে ঝুঁকে বসেছিলো ট্যানাস। আমাকে নড়ে-চড়ে উঠে বসতে দেখে মুখাবয়বে কপট কাঠিন্য ফিরিয়ে আনলো সে।

তুমি পাগল বুড়ো গাধা! জোর করে হাসলো ট্যানাস। কী কারণে হাসছিলে যুদ্ধের ময়দানে, হু?

ঠিকমতো বসতেই আবারো চক্কর দিয়ে উঠলো মাথাটা, দুই হাতে চেপে ধরে গুঙিয়ে উঠলাম আমি। সব মনে পড়ে গেছে।

ট্যানাস–রাতের আঁধারে যে কয়টি শত্রু ঘোড়া নদী পাড়ি দিয়েছে–তার সব ক টা চাই আমার!

আর ওই ভাঙ্গা মাথাটাকে কষ্ট দিও না। ইতিমধ্যেই হুইকে পাঠিয়ে দিয়েছি আমি। আশ্বস্ত করে জানায় ট্যানাস। কিন্তু হিকসস্‌ বাহিনীর চেয়ে বরঞ্চ তোমার আবিষ্কার করা ওই চাকা বেশি বিপদজনক! যতোক্ষণ পর্যন্ত না ওগুলো ঠিক করার ব্যবস্থা করছো, আমি আর তোমার সাথে রথে চড়ছি না।

কিছু সময় লাগলো বুঝতে, নিজের গর্ব ভুলে গিয়ে আমাকে স্বাগত জানিয়েছে ট্যানাস। আমার এতিম রথ-বাহিনী অবশেষে মিশরীয় সেনাবাহিনীর অংশ হতে যাচ্ছে। প্রয়োজনে স্বর্ণ আর লোকবল দিয়ে আরো পাঁচশো রথ প্রস্তুত করতে দেবে ও আমাকে।

তবে, এসব কিছু নয়, সেদিন সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো ট্যানাস আমাকে ক্ষমা করেছে জেনে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অটুট ছিলো আমাদের বন্ধুত্ব।

*

এসনায় আমার রথ-বাহিনীর সাফল্য এবং তার ফলশ্রুতিতে আমাদের উত্তুঙ্গ আত্মবিশ্বাস ছিলো ক্ষণস্থায়ী। এরপর যা ঘটেছিলো, আগেই ধারণা করেছিলাম আমি। কেননা, সেই মুহূর্তে ওটাই ছিলো শত্রুপক্ষের যৌক্তিক কার্যধারা; রাজা স্যালিতিস এবং ইনটেফের আরো আগেই এটা করার কথা।

আমরা জেনে গেছিলাম নিম্ন-রাজ্যে ধ্বংসলীলা চালানোর সময় লাল-ফারাও-এর নৌবাহিনীর সমস্ত জাহাজ নিজের দখলে নিয়ে ফেলেছিলো স্যালিতিস। ডেল্টায়, মেমফিস্ আর তানিস-এর জাহাজ তৈরির স্থানে ফেলে রাখা হয়েছিলো সেগুলো। যদিও হিকসসেরা নাবিক নয়, তবে গাঁজা বা যোপ্পা এবং সমুদ্রের পূবতীরবর্তী বন্দরগুলো থেকে ভাড়াটে নাবিক জোগাড় করে আনা কোনো কঠিন বিষয় নয়।

এ সবই অনুমান করেছিলাম আমি, কিন্তু ট্যানাস বা আমার কর্ত্রীকে ব্যাপারগুলো জানিয়ে আরো নিরাশ করতে চাইনি। স্যালিতিস বা ইনটেফের এই কৌশলের বিরুদ্ধে কিছুই ভেবে বের করতে পারিনি। কাজেই, যা ঠেকিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই, তা বলে বলে সবার ভেতরে ভয় ছড়িয়ে দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না।

যখন সত্যিই ঘটলো এটা, আসয়ুতের বিপরীতে নদীর পুব তীর থেকে আমাদের গুপ্তচরেরা সতর্ক করে দিলো, ডেল্টা থেকে জাহাজবহর আসছে। নিজের গ্যালিবাহিনী নিয়ে উত্তরে ছুটলো ট্যানাস, ওদের ঠেকানোর জন্যে। স্যালিতিস বা ইনটেফের জলযানের চেয়ে তার গ্যালিবহর অনেক বেশি দক্ষ, শক্তিশালী। এক সপ্তাহব্যাপী মরণপণ লড়াইয়ের পর পর্যদস্ত শত্রুবাহিনী পিছু হঠতে বাধ্য হলো, আবারো ডেল্টায় ফিরে গেলো তারা।

কিন্তু, এই যুদ্ধের মূল সুযোগ নিলো স্যালিতিস; ডামাডোলের ভেতর সম্পূর্ণ দুই বাহিনী রথ আর সৈনিক নদী পার করে পশ্চিম তীরে নিয়ে আসলো সে। নদী পথের যুদ্ধে ব্যস্ত ট্যানাসের পক্ষে এবার আর তাদের ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হলো না।

তিনশো দ্রুতগামী যুদ্ধ-রথ নিয়ে স্যালিতিস স্বয়ং নেতৃত্বে ছিলো সেই হিকসস্‌ বাহিনীর। শেষমেষ আমাদের ছক উল্টে দিতে সক্ষম হলো সে, এখন আর তাকে থামানোর কোনো উপায় নেই। নদীর পশ্চিম তীর ধরে দক্ষিণে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে ছুটে চললো শত্রু রথ-বহর। ফারাও মামোসের সমাধি-মন্দির অভিমুখে শত্রু বাহিনীর এই অগ্রযাত্রা চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার নেই গ্যালিবহরের।

*

মেমননের প্রাসাদে যখন হিকসসুদের নদী পারাপারের সংবাদ পৌঁছুলো, জরুরি সভা ডাকলো মিশরের রানি। প্রথমেই ট্যানাসের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো সে।

এখন যখন নদী পেরিয়ে গেছে তারা, এই বর্বরদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন আপনি? হয়তো দেরি করিয়ে দিতে পারি তাদের, খোলাখুলি স্বীকার গেলো ট্যানাস। লড়তে পারি, টাইটার ছুঁচালো-পিপে দিয়ে হয়তো ক্ষয়ক্ষতিও করতে পারি কিন্তু ওদের থামানো সম্ভব নয়।

এবারে আমার পানে তাকালো রানি। টাইটা, তোমার রথের কী খবর? তারা কী হিকসস্‌দের সাথে যুদ্ধে জয়ী হতে পারে না?

মহারানি, মাত্র চল্লিশটি রথ যুদ্ধে পাঠাতে পারবো আমি। আর রাজা স্যালিতিসের বাহিনীতে আছে তিনশো রথ। তাদের দক্ষতা আর প্রশিক্ষণের কাছে আমরা কিছুই নই। এছাড়াও, চাকার সমস্যা এখনো রয়েছে, ওগুলোকে ত্রুটিহীন করতে সক্ষম হই নি আমি। খুব সহজেই আমাদের শেষ করে ফেলবে স্যালিতিস। সময় এবং সরঞ্জাম পেলে ত্রুটিহীন, নতুন রথ তৈরি করতে পারবো, কিন্তু ঘোড়ার কী হবে? ঘোড়া হারালে আর কিছুতেই উঠে দাঁড়াতে পারবো না আমরা।

এই তর্ক-বিতর্ক যখন চলছে, দক্ষিণ থেকে নতুন বার্তা নিয়ে এলো সংবাদবাহক। মাত্র একদিনের পুরোনো খবর আছে তার কাছে, ট্যানাসের নির্দেশে রানির পায়ের কাছে পড়লো সে।

বলো, কী বলার আছে তোমার? ট্যানাস জানতে চাইলো।

প্রাণভয়ে ভীত বার্তাবাহক শিউড়ে উঠে, মহারানি, আমাদের জাহাজবহর যখন আসয়ুতে ব্যস্ত আছে, এসৃনা দিয়ে আবারো নদী পেরিয়েছে শত্রুরা । পুরো দুই বাহিনী–এবারে সংখ্যায় অনেক বেশি। বিরাট ধুলোর মেঘ তুলে দক্ষিণে ছুটে আসছে হিকসস্। তিনদিনের মধ্যে এখানে পৌঁছে যাবে তারা।

নীরবতা নামলো সভাকক্ষে। রানি লসট্রিসের পায়ে চুমো খেয়ে প্রস্থান করলো বার্তাবাহক।

আমরা একা হতেই নরমস্বরে ট্যানাস বললো, মোট চারটি বাহিনী, অর্থাৎ ছয়শো রথ এখন নদীর এ পারে। সব শেষ।

না! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো আমার কর্ত্রী । আমাদের এই মিশরের দিক থেকে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন না দেবতারা। আমাদের সভ্যতা এভাবে ধ্বংস হবে না। এই পৃথিবীকে বহুকিছু দেওয়ার আছে আমাদের।

আমি যুদ্ধ লড়তে পারি, অবশ্যই, সায় দিয়ে ট্যানাস বলে। কিন্তু কিছু আসবে যাবে না তাতে। শত্রু রথের বিরুদ্ধে আমরা অসহায়।

আমার দিকে ফিরলো মিসট্রেস। টাইটা, আগে এ অনুরোধ কোরিনি তোমাকে, কারণ আমি জানি কী ভীষণ কষ্ট হয় তোমার। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তোমাকে বলতেই হচ্ছে আমি চাই, আমার জন্যে আমন রা র ইন্দ্রজাল অনুশীলন করো তুমি। আমি জানতে চাই, দেবতারা কী চান আমার কাছে।

বাধ্যগতের মতো মাথা নিচু করে ফিসফিসালাম, এখনই আমার বাক্স নিয়ে আসছি।

*

অর্ধ-সমাপ্ত মেমনন প্রাসাদে, হোরাসের শ্রাবনের ভেতরের প্রকোষ্ঠে ঐন্দ্রজালিক-শক্তির আরাধনায় বসার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। যদিও এখনো হোরাসের মূর্তি তৈরি করা হয়নি এখানে, কিন্তু আমি জানি, তাঁর কৃপা রয়েছে আমাদের উপর।

ট্যানাসকে পাশে নিয়ে আমার সামনে বসলো রানি, ওদিকে একটা পাত্র থেকে ডাইনীর মিশ্রণ পান করে নিলাম; আমার কথা বা আত্মার নির্গমন ঘটবে কিছু সময়ের মধ্যেই।

সামনে আইভরি ধাঁধাগুলো রেখে ওগুলো হাতে নিয়ে এই মিশরের জন্যে নিজেদের উদ্বেগ আর ভালোবাসার কথা স্মরণ করতে বললাম ট্যানাস আর রানিকে। ওরা যখন নাড়াচাড়া করছিলো আইভরি চাকতিগুলো, টের পেলাম রক্তস্রোতে প্রবেশ করছে ওষুধ, ধীর হয়ে আসছে হৃদপিণ্ডের গতিবেগ, ছোট্ট এক মৃত্যু ঘটবে এখন আমার।

শেষ স্তূপ থেকে দুটো চাকতি নিয়ে বুকের কাছে তুলে ধরলাম। আগুনে-গরম হয়ে উঠতে লাগলো ওগুলো; ইচ্ছে হলো যে অন্ধকার ঘিরে আসছে আমার উপর, তা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসি নিজেকে। বদলে, আত্মসমর্পণ করলাম সেই অন্ধকারে, দূরে দূরে কোথায় যেন চলে যেতে থাকলাম।

বহুদূর থেকে ভেসে এলো আমার কীর কণ্ঠস্বর। দ্বৈত-মুকুটের ভাগ্যে কী ঘটবে? এই বর্বরদের আমরা কেমন করে প্রতিহত করবো?

চোখের সামনে নানা দৃশ্য তৈরি হতে শুরু করলো, ভবিষ্যতের পরতে লুকিয়ে থাকা ঘটনাবলি পার হয়ে যেতে লাগলো আমাকে।

ছাতের ফাঁকা স্থান দিয়ে সূর্যরশ্মি এসে আলোকিত করে তুললো হোরাসের বেদী, শেষমেষ ধীরে, ধাঁধার জগত থেকে ফিরে এলাম আমি। বিভ্ৰম-সৃষ্টিকারী ওষুধের প্রভাবে দারুন আলস্য শরীরে, বমি পাচ্ছে; অসাধারণ যে ঘটনাবলি এই মাত্র দেখলাম ভয়ে কাঁপছে বুক।

সারারাত ধরে ট্যানাস আর রানি আমায় সঙ্গ দিয়েছিলো। আমন রা র ইন্দ্রজাল থেকে ফিরে এসে প্রথম ওদের দু জনের উদ্বিগ্ন মুখ আমার চোখে পড়েছে।

টাইটা, তুমি ঠিক আছো? কথা বলো। কী দেখলে, বলো আমাদের? চিন্তিত হয়ে গেছে মিসট্রেস। আমন রা র ইন্দ্রজাল ব্যবহারে আমার কষ্টে আপুত।

একটা সরীসৃপ দেখেছি, অদ্ভুত রকম প্রতিধ্বনি তুললো আমার কণ্ঠস্বর। বিশাল, সবুজ এক সরীসৃপ মরুর বুক চিরে এগিয়ে চলেছে।

ওদের দুজনের মুখাবয়বে ফুটে উঠলো হতবুদ্ধির ছাপ, অবশ্য আমি নিজেও এই দৃশ্যের কোনো মানে করে উঠতে পারি নি।  তৃষ্ণা পেয়েছে, ফিসফিস করে বললাম। গলা শুকিয়ে গেছে আমার, জীভ যেনো পাথরের টুকরো। একটা পাত্র থেকে সামান্য সুরা ঢেলে এগিয়ে দেয় ট্যানাস। কৃতজ্ঞচিত্তে ওটা পান করে নিলাম।

ওই সরীসৃপ সম্পর্কে আরো বলো, পান করা শেষ হতে আমার কর্ত্রী বলে উঠলো।

তার বক্র দেহের কোনো শেষ নেই, সূর্যালোকে যেনো সবুজ আভা বিকিরণ করে চলছিলো। অদ্ভুত এক ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেলো ওটা তারপর–যেখানে লম্বা

অবয়বের উলঙ্গ মানুষের বসবাস, অসাধারণ জীব-জন্তুতে বোঝাই সেই ভূখণ্ড।

সরীসৃপের মাথা বা মুখ দেখতে পাওনি? লসট্রিসের প্রশ্নের উত্তরে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লাম।

কোথায় ছিলে তুমি? কোথাও দাঁড়ানো ছিলে? ভুলেই গেছিলাম, আমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা বা সমাধান করা লসট্রিসের অত্যন্ত প্রিয় বিষয়।

আমি সেই সরীসৃপের পিঠে চড়ে ছিলাম, উত্তরে জানালাম। কিন্তু আমি একা নই।

আর কে ছিলো তোমার সাথে?

তুমি আমার পাশে ছিলে, মিসট্রেস; আর তোমার কোলে মেমনন। আমার আরেক পাশে ছিলো ট্যানাস। আমাদের সবাইকে পিঠে করে নিয়ে চলছিলো সেই সরীসৃপ।

নীল নদ! সরীসৃপটা হলো নীল নদ! খুশিতে চিৎকার করে উঠলো লসট্রিস । নদীর বুকে আমাদের অনাগত কোনো অভিযানের দৃশ্য দেখেছো তুমি।

কোন দিকে? এবারে ট্যানাস জানতে চাইলো। কোন দিকে চলছিলে সেই নদী?

সবকিছু মনে করার জোর চেষ্টা চালালাম আমি। আমার বাম দিকে সূর্য উদয় হতে দেখেছি।

তার মানে দক্ষিণে! চাপা কণ্ঠে বলে উঠে ট্যানাস।

আফ্রিকায়! আমার কর্ত্রী চেঁচিয়ে উঠে।

শেষপর্যন্ত সরীসৃপের মাথা দেখতে পেলাম সামনে। দ্বিধাবিভক্ত ছিলো তার দেহ, দুই অংশের জন্যে দুটো মাথা তার।

নীল নদের কী দুটো শাখা আছে? চিন্তিত ভঙ্গিতে জানতে চাইলো রানি। নাকি অন্য কোনো অর্থ আছে এই ধাঁধার?

তার চেয়ে বরঞ্চ টাইটার কাছ থেকে সবটুকু শুনে নেই আগে, লসট্রিসকে থামিয়ে দেয় টানাস। বলো, বুড়ো বন্ধু।

এরপর, দেবীকে দেখতে পেলাম, আমি বলে চলি, উঁচু একটা পর্বতের উপরে আসীন তিনি। সরীসৃপের দুটো মাথাই তাকে পূজো করছে সেখানে।

নিজেকে প্রবোধ দিয়ে রাখতে পারছে না মিসট্রেস। কোন্ দেবী? ওহ, টাইটা! বলো, কোন্ দেবীকে দেখেছো?

পুরুষের মতো দাড়ি-মুখো, কিন্তু নারীর স্তন্য আর জননেন্দ্রীয় রয়েছে তার। তার যোনী থেকে উৎসরিত বিশাল দুই জলের ধারা সরীসৃপের খোলা দ্বৈত-মুখে ঢুকছে।

এ যে দেবী হাপি নদীর দেবী। রানি ফিসফিসিয়ে উঠেন। নিজের অভ্যন্তর থেকে তিনি সৃষ্টি করেছেন এই মহান নদী, ঢেলে দিচ্ছেন তার জলধারা।

আর কী কী দেখলে, টাইটা? ট্যানাস জানতে চাইলো ।

আমাদের পানে চেয়ে হাসলেন দেবী, ভালোবাসা আর দয়ায় উজ্জ্বল তার মুখাবয়ব। বাতাস আর সাগরের গর্জনের মতো করে কথা বলে উঠলেন তিনি। দূর দূরান্তের পর্বতে বজ্রপাতের মতো শোনালো সেই শব্দ।

কী বললেন তিনি আমাদের? উত্তেজনায় অধীর হয়ে জানতে চায় লসট্রিস।

তিনি বললেন, আমার সন্তানকে আসতে দাও। তাকে শক্তিশালী করে দেবো আমি, কোনো কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না ওর । বর্বরদের হাতে ধ্বংস হবে না আমার সন্তান। মাথার ভেতরে ঢাকের মতো বাজছিলো শব্দগুলো তখনো।

আমিই তো নদী-দেবীর সন্তান! দ্বিধাহীন স্বরে বলে উঠলো আমার কর্ত্রী । জন্মের সময় থেকেই আমি তার প্রতি একনিষ্ঠ। এখন তিনি ডাকছেন আমাকে, নীল নদের শেষ মাথা পর্যন্ত অবশ্যই যেতে হবে আমাকে।

এ যে সেই যাত্রা, একবার আমি আর টাইটা যার পরিকল্পনা করেছিলাম, আনমনা স্বরে ট্যানাস বলে। এখন তো দেবী স্বয়ং এর নির্দেশ দিলেন। তাঁকে অমান্য করা উচিত হবে না।

ঠিক। অবশ্যই সেই অজানা দেশে যাবো আমরা। কিন্তু ফিরে আসবো একদিন। নিশ্চই ফিরে আসবো। গাঢ় স্বরে বললো আমার কর্ত্রী । এটা আমার দেশ আমাদের এই মিশর। এ আমার নগরীএকশো দরোজার রূপসী থিবেস। চিরজীবনের জন্যে একে ছাড়তে পারবো না আমি। ফিরে আসবো এখানে এ আমার শপথ–দেবী হাপি সাক্ষী। আমরা ফিরে আসবো!

*

এতো বড়ো একটি অভিযানের জন্যে প্রস্তুতির কোনো সময় নেই আমাদের হাতে। দুই দিক হতে এগিয়ে আসছে হানাদার বাহিনী, সংবাদবাহকদের খবর মোতাবেক মেমনন প্রাসাদের ছাদে দাঁড়ালে আর মাত্র তিন দিনের মধ্যে দেখা যাবে শত্রুবহর।

ক্রাতাসের নেতৃত্বে অর্ধেক যোদ্ধাদের উত্তরে পাঠিয়ে দিলো ট্যানাস। ওদিক থেকেই বীর-বিক্রমে এগিয়ে আসছে রাজা স্যালিতিস, সবার আগে নেক্রোপলিস আর মেমনন প্রাসাদের তারই পৌঁছুনোর সম্ভাবনা। যতোদূর সম্ভব, রাজা স্যালিতিসকে দেরি করিয়ে দেয়াই হবে ক্রাতাসের দায়িত্ব।

ওদিকে, বাহিনীর বাকি যোদ্ধাদের নিয়ে দক্ষিণে, এসনা থেকে ধেয়ে আসা হিকসস্‌ বর্বরদের রুখতে ছুটলো ট্যানাস।

ইত্যবসরে আমাদের সমস্ত জনগণ আর মাল-সামান অবশিষ্ট জাহাজ-বহরে তুলে ফেলার তদারকির ভার পড়লো মিসট্রেসের কাঁধে। লর্ড মারসেকেটের অধীনে এই কাজ সম্পাদনের জন্যে দায়িত্ব পেলাম আমি। বলার অপেক্ষা রাখে না, লর্ড মারসেকেট নন, সমস্ত কাজ একা আমাকেই দেখভাল করতে হলো।

ওদিকে ঘোড়াগুলোর যত্ন নিতে হচ্ছে আমাকে। কোনো সন্দেহ নেই, এই প্রাণীগুলো ছাড়া আমাদের একবিন্দু আশা নেই। এস্নায় শত্রুদের ফেলে আসা ঘোড়া সমেত এখন আমার আস্তাবলে ঘোড়ার সংখ্যা বেশ ক হাজারে উন্নিত হয়েছে। ছোটো চারটি দলে ভাগ করে রেখেছি আমি প্রাণীগুলোকে।

রথ-চালকদের সহ হুই আর ঘোড়ার পালকে গজ-দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দিলাম। ওদের উপর কঠোর নির্দেশ রইলো যেনো কিছুতেই নদীর তীর ঘেঁষে না যায়। যথাসম্ভব মরুর কাছাকাছি থেকে চলতে হবে তাদের।

ঘোড়ার পালের একটা গতি হতে এবারে মানুষজনের দিকে খেয়াল দিলাম । জাহাজের সংখ্যা কমে যাওয়ায় খুব বেশি লোক সাথে নেওয়া সম্ভব হবে না। কোনো সন্দেহ নেই, প্রতিটি মিশরীয় এই তীর্থযাত্রায় যোগ দিতে চাইবে। আফ্রিকার মাটির অজানা বিপদ এখানকার হিকসস্‌ বর্বরতার বিপরীতে তুচ্ছ।

হিসাব কষে বের করলাম, জাহাজে মাত্র বারোহাজার মিশরীয় নাগরিকের স্থান হবে। মিসট্রেসকে জানালাম এ কথা। কিন্তু কিছুতেই কাউকে ছেড়ে যেতে রাজী হলো না সে। প্রয়োজনে নিজের এবং রাজকুমারের স্থানে অপর কাউকে নিতে অনুরোধ জানালো লসট্রিস।

অবশেষে, যখন রওনা হলাম আমরা, প্রতিটি জাহাজের গলুই পানি ছুঁই-ছুঁই করছিলো। সমস্ত পেশার লোক নিয়েছি সাথে প্রস্তরশিল্পী আর তাঁতী, কামার এবং কুমোর, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকারী এবং রাজমিস্ত্রি, লিপিকার এবং শিল্পী, জাহাজের কারিগর এবং কাঠমিস্ত্রি নিজের নিজের পেশায় তারা সবাই শ্রেষ্ঠ। পুরোহিত আর আইনজ্ঞদের সবচেয়ে বিশ্রী জাহাজ বরাদ্দ করে যার-পর-নাই আনন্দ পেলাম, কেননা এরা হলো রাজ্যের রক্তচোষা জোকের মতো।

লোকজন তুলে নেওয়া শেষ হতে মন্দিরের ঘাটে ভিড়ালাম জাহাজগুলোকে। কোন্ ধন-সম্পদ আগে তোলা হবে এই নিয়ে চিন্তার অবকাশ ছিলো বৈকি। অস্ত্র শস্ত্র, যন্ত্রপাতি এবং সমস্ত কাঁচামাল সঙ্গে নিলাম, অজানা দেশে সভ্যতা গড়ে তুলতে হলে ওগুলোর বিকল্প নেই। অন্যান্য মালের ক্ষেত্রে যতোটা সম্ভব ওজন কমানোর দিকে লক্ষ্য রাখলাম। ফলমূলের বদলে সমস্ত গাছের চারা এবং বীজ নিয়ে নিলাম মুখ সীলগালা কার কাদামাটির পাত্রে।

কোথায় চলেছি, জানি না–দশ বছর, এমনকি পুরো জীবনও লেগে যেতে পারে। অত্যন্ত কঠিন হবে এই অভিযান। সামনের জলপ্রপাতগুলো পেরুতে হবে আমাদের–যতোটা সম্ভব জাহাজ হালকা রাখাটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু, ফারাও-এর প্রতি আমার কর্ত্রীর শপথের কী হবে তাহলে? তাঁর সমাধি-সম্পদেরই বা কী হবে?

মৃত্যুর সময় রাজাকে কথা দিয়েছি আমি এসব রেখে যেতে পারবো না, একবাক্যে জানিয়ে দিলো রানি।

মহারানি, রাজার শবদেহ এমন একটা গোপন স্থানে রেখে যাবো–কেউ খুঁজে বের করতে পারবে না। থিবেসে যেদিন ফিরে আসবো আমরা, আবার উত্তোলন করে রাজকীয় মর্যাদায় তখন না হয় সমাধিস্থ করা যাবে।

যদি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করি, দেবতারা এই অভিযানে আমাদের সহায় হবেন না। রাজার শবদেহ আমাদের সাথেই যাবে। এক কথায় সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলো রানি।

লসট্রিসের অজান্তে কফিনের দুই স্তর ফেলে দিলাম আমি, এতে করে ওজন কমলো যথেষ্ট। ক্যানভাসে মুড়ে, হোরাসের প্রশ্বাসের মালবহনের স্থানে রাখা হলো রাজকীয় কফিন। সমস্ত রাজকীয় সমাধি-সম্পদ সিডার কাঠের বাক্সে ভরা হলো। প্রতিটি জাহাজে সমান পরিমাণ সম্পদ বরাদ্দ করলাম। এতে করে যেমন সবগুলো জাহাজ সমান ওজন বহন করলো, একই সঙ্গে একটি জাহাজের ধ্বংসে সম্পূর্ণ সমাধি সম্পদের হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমলো ।

দারুন দ্রুততার সাথে সম্পন্ন হলো মালামাল উঠানোর কাজ। শেষ জাহাজ তৈরি হওয়ার আগেই প্রাসাদের ছাদে অবস্থান নেওয়া পরিদর্শক চিৎকার করে হিকসস্‌ রথের ধুলোর মেঘের দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা ঘোষণা করলো। কিছু সময়ের মধ্যেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত ট্যানাস আর কাতাসের বাহিনী নেক্রোপলিস থেকে পিছু হঠে গ্যালিতে অবস্থান নিতে শুরু করলো।

প্রাণপণ লড়ে অন্তত দুই তিন দিন সময় দেরি করিয়ে দিতে পেরেছে তারা শত্রু বাহিনীকে। ক্লান্ত, আহত ট্যানাসকে চিৎকার করে ডাকতে, গোলমালের শব্দ ছাপিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো সে, রানি লসট্রিস আর রাজকুমার কোথায়? হোরাসের প্রশ্বাসে চড়েছে তো তারা?

জনতার ভীড় ঢেলে তার কাছে চলে এলাম আমি। সমস্ত জনতা জাহাজে না উঠা পর্যন্ত কিছুতেই চড়বে না মিসট্রেস। তুমি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আমাকে নির্দেশ দিয়েছে ও। প্রাসাদে, তার কক্ষে তোমার অপেক্ষায় আছে লসট্রিস।

বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেলো ট্যানাসের। শক্ররা যে কোনো মুহূর্তে চলে আসবে এখানে! সব কিছুর চেয়ে রানি আর রাজকুমার জরুরি। তুমি তাকে জোর করোনি?

তুমি তো জানোই, ওর সাথে জেদ করে লাভ নেই।

সেথ এই মেয়ের গর্ব ধ্বংস করুক! চলো, নিয়ে আসি ওদেরকে।

ওই মুহূর্তে চিৎকার করে কেউ জানান দিলো, হিকসস্‌ চলে এসেছে! পালাও। সাথে সাথে চরম হুড়োহুড়ি, হৈ-হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো। ছোট্ট জাহাজঘাটে একসাথে সবাই ধাক্কাধাক্কি শুরু করলো, হাতের ছুঁচালো লাঠি দিয়ে ঠেলে পথ করে এগুতে লাগলাম আমি এবং ট্যানাস। শেষমেষ প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় প্রাসাদের প্রধান দরোজায় পৌঁছুলাম।

শূন্য পড়ে আছে বিরাট কক্ষ আর গলিপথগুলো। কেবল ছিঁচকে কিছু চোর তখনো এটা-ওটা হাতিয়ে নেওয়ার প্রয়াসে আছে। ট্যানাসকে দেখেই দৌড়ে পালালো তারা। রানির প্রকোষ্ঠের খোলা দরোজা গলে এক ঝটকায় ঢুকে পড়লাম আমরা দুজন।

রাজকুমারকে কোলে নিয়ে চাতালে বসেছিলো লসট্রিস। বিশাল চাতালের সামনে নোঙর করা মিশরীয় জাহাজগুলো হাত তুলে মেমননকে দেখাচ্ছিলো সে।

দ্যাখো, কী সুন্দর জাহাজ!

আমাদের দেখতে পেয়ে দাঁড়ালো লসট্রিস, ওর কোল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে এসে ট্যানাসের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো মেমনন।

তোমার ভৃত্যরা কোথায়? আতন আর লর্ড মারসেকেট? ট্যানাস জানতে চায় ।

জাহাজে পাঠিয়ে দিয়েছি ওদের।

টাইটা বললো, তুমি নাকি জাহাজে চড়তে চাইছো না?

হাসলো লসট্রিস। ওর হাসি আমাকে এক লহমায় জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে, আবার নিমিষেই ভেঙ্গে ফেলতে পারে এই হৃদয়। ক্ষমা করো, টাইটা।

বরঞ্চ, রাজা স্যালিতিসের কাছে ক্ষমা চাও, যে কোনো মুহূর্তে এখানে চলে আসবে সে। এক হাত আঁকড়ে ধরলাম রানির। এখন যখন তোমার এই অবাধ্য সৈনিক চলেই এসেছে, চলো, জাহাজে চড়ি।

চাতাল ছেড়ে প্রাসাদের গলিপথ ধরে ছুটলাম আমরা। এখন আর এমনকি চোর বাটপারেরাও নেই পুরো প্রাসাদে। ট্যানাসের কাঁধে চড়ে মেমনন তখনো ঘোড়া দাবড়াচ্ছে, চলো! এগোও! ধৈর্য্যের পিঠে চড়ে এই অভ্যাস হয়েছে তার।

নদীর খোলামুখের কাছে চলে গেছে প্রথম জাহাজ। পেটে শূন্য একটা অনুভূতি হলো–একমাত্র আমরাই তীরে রয়ে গেছি! পুরো জাহাজঘাটা জনশূন্য! হোরাসের প্রশ্বাসে পৌঁছুতে হলে এখনো আধা-মাইল খোলা ময়দান পেরুতে হবে আমাদের। থেমে পড়লাম সবাই।

এদিকে এসো! গর্জে উঠলো ট্যানাস। টাইটা, তোমার কর্ত্রীর দিকে খেয়াল রাখো। আমার পিছুপিছু! জলদি!

লসট্রিসের হাত ধরে টেনে নিয়ে চললাম আমি। কিন্তু সে নিজেই চঞ্চল রাখাল বালকের মতো ছুটছে। হঠাৎ খুব কাছে, ঘোড়ার হেষারব আর রথের ঝনঝনানি শুনতে পেলাম; এতো কাছে ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। সাথে সাথে থেমে দাঁড়ালো আমাদের ছোট্ট দলটা।

হিকসস্‌! নরমস্বরে বললাম। সম্ভবত তাদের অগ্রবর্তী ছোট্ট একটা দল।

শব্দ শুনে মনে হলো দুই কি তিনটি রথ হবে, ট্যানাস বলে, কিন্তু, এ-ই যথেষ্ট। আমরা আটকে গেছি।

তখন যদি আমার অনুরোধ মতো জাহাজে চড়তে লসট্রিস, এমনটা হতো না। এতক্ষণে, হোরাসের প্রশ্বাস গজদ্বীপে পৌঁছে যেতো।

এক হাত উঁচু করে নীরবতা কামনা করলো ট্যানাস। শত্রু রথ এগিয়ে এসে থামলো দেয়ালের ওপাশে। কাছে এসে পড়তে নিশ্চিত হলাম, বড়োজোর তিন রথের একটা অগ্রবর্তী দল এটা।

আচমকা থেমে দাঁড়ালো তারা। বিচিত্র কোনো ভাষায় কথা বলছে রথের আরোহীরা, তাদের ঘোড়াগুলো অস্থির নড়াচড়া কানে আসছে। ঠিক আমাদের নিচে দাঁড়িয়ে এখন তারা। জরুরি ভঙ্গিতে ইশারা করে চুপ থাকতে বললো ট্যানাস, সবাইকে। কিন্তু রাজকুমার মেমনন এতে মোটেও প্রভাবিত হলো না পরিচিত আওয়াজ পেয়ে গেছে সে।

ঘোড়া! স্বভাবগত জোরালো রিনিঝিনি কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো সে। ঘোড়া দেখবো আমি! 

সাথে সাথেই চিৎকার শোনা গেলো নিচে। নির্দেশ উচ্চারিত হতে অস্ত্র খাপ থেকে খুলে পাথরের সিঁড়ি কোঠা ভেঙ্গে ধুপধাপ দৌড়ে আসতে লাগলো হিকসস্‌ যোদ্ধারা।

পাঁচজন তারা তলোয়ার বাগিয়ে ধরে ছুটে আসছে আমাদের দিকে। বিশাল আকৃতির, মাছের আঁশের মতো বর্ম, উজ্জ্বল রঙের ফিতে ঝুলছে দাড়ি থেকে। একজন সবার চেয়ে লম্বা। প্রথমটায় চিনতে পারিনি আমি, কেননা বড়ো দাড়ি আর রঙিন ফিতে দিয়ে হিকসস্‌ সাজে নিজেকে সাজিয়েছে সে; কিন্তু যখন চেঁচিয়ে কথা বলে উঠলো, চিরপরিচিত সেই কণ্ঠস্বর চিনতে বেগ পেতে হলো না। আরে, এ যে দেখছি তরুণ হেরাব। বুড়ো কুকুরটাকে তো আগেই মেরেছি, এবারে এই কুত্তার বাচ্চটাকে শেষ করবো!

আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো, ফারাও-এর সমাধি-সম্পদের পেছনে লোলুপ হায়েনার মতো ছুটে আসাদের মধ্যে ইনটেফ প্রথম হবেন। নিঃসন্দেহে হিকসস্‌ বাহিনীর সামনে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছেন তিনি; ট্যানাসের প্রতি ঘৃণার বাণী উচ্চারণ কোরলেও ইশারায় রথ চালকদের ধন-সম্পদ লুটের জন্যে পাঠিয়ে দিলেন।

কাঁধ থেকে নামিয়ে পুতুলের মতো মেমননকে আমার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিলো ট্যানাস।

দৌড়াও! চিৎকার করলো সে। কিছুটা সময় পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো আমি তোমাদের! সিঁড়িকোঠায় গাদাগাদি করে দাঁড়ানো হিকসস্‌ যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে তেড়ে গেলো ট্যানাস। তলোয়ারের এক কোপে নিহত হলো প্রথম শত্রুসৈন্য; নিখুঁত ভঙ্গিমায় গলা দিয়ে সেঁধিয়ে দিয়েছে ট্যানাস।

ওখানে দাঁড়িয়ে হা করে থেকো না! কাঁধের উপর দিয়ে চেঁচিয়ে বললো ট্যানাস। দৌড়াও!

কিন্তু, কাঁধে মেমননকে নিয়ে কিছুতেই দৌড়ে নদী-তীরে পৌঁছুতে পারবো না আমি। প্রাসাদের দেয়াল বেয়ে উঠে উঁকি মেরে দেখলাম সামনে। আমার ঠিক নিচেই থেমে দাঁড়ানো দুটি হিকসস্‌ রথ, অসহিষ্ণু ঘোড়াগুলো নড়াচড়া করছে। কেবল একজন লোক আছে রথ পাহাড়া দেওয়ার জন্যে। সমস্ত মনোযোগ সামনে আমাকে উঁকি দিতে দেখলো না সে।

মেমননকে আঁকড়ে ধরে সরাসরি লাফিয়ে পড়লাম আমি। একজন লম্বা মানুষেরও চারগুণ দুরুত্ব অতিক্রম করতে হলো শুন্যে; পা ভেঙ্গে ফেলা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু হিকসস্‌ পাহারাদারের ঘাড়ের উপর পড়ায় এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। মট করে হাড় ভাঙ্গার শব্দ হলো ঘাড় ভেঙ্গে গেছে অপ্রস্তুত পাহাড়াদারের।

তারস্বরে প্রতিবাদ করতে থাকা মেমননকে মাটি থেকে তুলে নিয়ে উপরে তাকালাম। ভয়ে ভয়ে নিচে উঁকি মেরে দেখছে লসট্রিস। কাছের রথে চালকের আসনে বসিয়ে দিলাম মেমননকে।

লাফ দাও! চেঁচিয়ে অভয় দিলাম রানিকে। আমি ধরবো তোমাকে। একটু অস্বস্তি না করে সাথে সাথে লাফিয়ে পড়লো লসট্রিস। তখনো প্রস্তুত হওয়ার সময় পাইনি আমি। সামলাতে না পেরে জড়াজড়ি করে পড়ে গেলাম ওকে নিয়ে ফুসফুস থেকে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেছে সংঘর্ষের প্রাবল্যে।

টেনে-হিঁচড়ে উঠে বসে, একটানে দাঁড় করালাম লসট্রিসকে। মেমননকে আঁকড়ে ধরে থাকো! গলা দিয়ে যেনো কোলাব্যাঙের আওয়াজ বেরুলো। ভীষণ রাগে উন্মত্ত রাজকুমার হুঙ্কার ছাড়ছে থেকে থেকে, রথে উঠে বসে ওকে জোরে ধরে রাখলো লসট্রিস। লাফিয়ে ওদের টপকে, ঘোড়াগুলোর লাগাম হাতে নিলাম আমি।

শক্ত করে ধরে থাকো! আমার লাগামের ঝাঁকিতে সাথে সাথে সাড়া দিলো ঘোড়া দুটো, মসৃণভাবে দেয়ালের কাছ ঘেঁষে থামালাম রথ।

ট্যানাস, এইখানে! আমার চিৎকার শুনছে মিশরের বীরশ্রেষ্ঠ। লড়াই থামিয়ে দেয়ালে চড়লো সে, এক লাফে নেমে এলো বাম ধারের ঘোড়ার পিঠে। হাত থেকে ছুটে গেলো তলোয়ার, মাটিতে আছড়ে পড়ে ঝনঝন আওয়াজ তুললো। দুই হাতে ঘোড়ার গলা জড়িয়ে ধরে টানাস।

চলো! আমার আহ্বানে ছুটলো ঘোড়া দুটো। প্রাসাদের বাধানো পথ পেরিয়ে খোলা মাঠে পড়লো আমাদের রথ, সোজা নদীতীরের উদ্দেশ্যে ছুটতে লাগলো। মাঝ নদীতে আমাদের জাহাজের পাল দেখতে পাচ্ছি আমি, এমনকি হোরাসের প্রশ্বাসের পতাকাও চিনতে পারছি। আর মাত্র আধা মাইল পথ পাড়ি দিলেই জাহাজে চড়তে পারবো আমরা। উদ্বিগ্ন চোখে কাঁধের উপর দিয়ে ফিরে তাকালাম।

ইনটেফ আর শত্রু সৈনিকেরা সিঁড়িকোঠা বেয়ে ছুটে নেমে আসছে। দ্রুত অপর রথে চড়লো তারা। কেননা যে ওটাকে আসার পথে নষ্ট করে দিয়ে আসিনি, ভেবে আফসোসে মরে যেতে ইচ্ছে করলো। এক মুহূর্ত সময় লাগতো ওটার লাগাম আর দড়ি-দড়া কেটে ঘোড়াগুলোকে ভাগিয়ে দিতে।

এখন, আমাদের উদ্দেশ্যে ছুটে আসছেন ইনটেফ। কিছু সময়ের মধ্যেই বুঝলাম, আমাদের রথের চেয়ে ওটার গতি ঢের বেশি। একটা ঘোড়ার উপর আঁকড়ে বসে আছে ট্যানাস–ওর ওজনের কারণে গতি হারাচ্ছে ওটা। সম্ভবত সেই প্রথম ট্যানাসের চোখে মুখে ভয় দেখেছিলাম।

পিছনের কথা ভুলে গিয়ে সমস্ত মনোযোগ ঢেলে দিলাম সামনের পথে। সেচ খালগুলোর জটিল নকশা আর ছোটো ছোটো খানা-খন্দ পেরিয়ে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে রথ। আমার নকশা করা রথের তুলনায় অনেক ভারী হিকসস্‌ রথ, নিরেট কাঠের চাকা মাটিতে বসে যাচ্ছে। এছাড়াও, আমরা চড়ার আগে নিশ্চই অনেক পথ দৌড়েছিলো ঘোড়া দুটো। নাক দিয়ে ফেনা উঠছে ওদের।

অর্ধেক দূরত্বও পেরোইনি, পিছনে শক্র যোদ্ধাদের কর্কশ হুঙ্কার শুনতে পেলাম। মাত্র তিন রথ পেছনে এখন তারা, বিচিত্র এবং কর্কশ ভাষায় ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষিয়ে চলেছে হিকসস্‌ চালক, পেছনে কাঠামোতে বসা ইনটেফের চোখে-মুখে শিকারীর জিঘাংসা।

চেঁচিয়ে আমার উদ্দেশ্যে মুখ খুললেন তিনি, টাইটা, পুরোনো প্রেমিক আমার এখনো ভালোবাসো আমাকে? মরার আগে আরো একবার না হয় প্রমাণ করো, কতোটা ভালোবাসো। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন ইনটেফ। আমার সামনে নত হয়ে মুখে ওটা নিয়ে মরবে তুমি!

ছোট্ট একটা সেচের জলাশয় এড়ানোর জন্যে রথ ঘুরিয়ে নিলাম আমি। সাথে সাথে নিখুঁতভাবে পিছু নিলো হিকসস্‌ রথ, প্রতি মুহূর্তে ধরে ফেলছে আমাদের।

আর তুমি আমার সুন্দরী কন্যা, হিকসস্‌ সৈন্যরা তোমাকে নিয়ে ফুর্তি করবে! হেরাব তোমাকে দিতে পারেনি, এমন কিছু ওরা শেখাবে তোমাকে। তোমার পুত্র তো এখন আমার জিম্মায় প্রয়োজন ফুরিয়েছে তোমার। বুকের কাছে মেমননকে আঁকড়ে ধরলো লসট্রিস মুখ পাড়ুর।

ইনটেফের উদ্দেশ্যে পরিষ্কার। রাজকীয় রক্তের কাউকে পুতুল হিসেবে ব্যবহার করে দুই রাজ্য শাসন করতে চায় স্যালিতিস এবং তিনি। সেই সুপরিচিত এবং প্রাচীন নকশা। ধীর হয়ে আসছে আমাদের ঘোড়াগুলোর গতিবেগ এখন আর চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছে না ইনটেফকে।

লর্ড হেরাব বহুদিন এর জন্যে অপেক্ষায় ছিলাম। কী করা যায় তোমাকে নিয়ে? প্রথমে, আমার মেয়ের সাথে সৈন্যদের আমোদ-ফুর্তি দেখবো দু জনে মিলে

চোখের কোণা দিয়ে দেখতে পেলাম, হিকসস্‌ ঘোড়া দুটো আমাদের সমান্তরালে চলে এসেছে। ইনটেফের পেছনে পাদানীতে দাঁড়ানো তীরন্দাজ তীর জুড়ছে তার প্রান্ত বাঁকানো ধনুকে। এতো কাছে থেকে লক্ষ্য ব্যর্থ হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

এই লড়াই-এ কোনো ভূমিকা নেই ট্যানাসের। নিজের অস্ত্র হারিয়েছে সে। কোনো রকমে টিকে আছে ঘোড়ার পিঠে। আমার কাছে কেবল একটা ছোরা আছে। মিসট্রেস নিরস্ত্র বাচ্চাকে নিজের শরীর দিয়ে ঢেকে রাখার প্রচেষ্টারত। এরপরই হিকসস্‌ চালকের ভুলটা আমার চোখে পড়লো। আমাদের এবং গভীর সেচ পুকুরের মাঝামাঝি স্থানে ঘোড়া দুটো দাবড়ে নিয়ে এসেছে সে। এখন আর রথ ঘোরানোর কোনো উপায় নেই।

আমাকে লক্ষ্য করে ধনুক উঁচালো তীরন্দাজ। আমাদের ডানপাশের চাকার সমান্ত রালে ছুটছে হিকসস্‌ রথ। একটুও অস্বস্তি না করে লাগাম টেনে ডানে নিয়ে গেলাম ছুটন্ত রথ। চাকার মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসা ঘুরন্ত ফলা হিসহিস শব্দে হিকসস্‌ রথের ঘোড়া দুটোর পায়ের দিকে এগুলো। এতক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরে হতাশায় গুঙিয়ে উঠলো শুক্র চালক; এই ফলার হাত থেকে বাঁচতে ডানে সরতে পারবে না সে-ওপাশে সেচ পুকুর । আমার হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তনের কারণে তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। কানে লেগে সামান্য একটু রক্ত ঝরালো কেবল। শত্রু রথের চালক এবারে দূরে সরে বাঁচতে চাইলো ধারালো ফলার আঘাত থেকে, কিন্তু সেচা জলাশয়ের পারে ঠেকে গেছে তার চাকা আর সরে যাওয়ার উপায় নেই। আচমকা পার ভেঙে ধীরে ডেবে যেতে লাগলো হিকসস্‌ রথের এক পাশের চাকা। সুযোগ বুঝে আবারো পাশে চাপিয়ে আনলাম আমাদের রথ; কাছের ঘোড়ার পিছনের পায়ে সেঁধিয়ে গেলো ঘুরন্ত ফলা। তীক্ষ্ণ চিহিহিহি স্বরে প্রতিবাদ করলো ওটা, বাতাসে ভাসছে চামড়া আর চুল। আবারো রথ পাশে সরিয়ে আনলাম আমি, এবারে আর চামড়া নয়, রক্ত আর হাড়ের কণা উড়ে গেলো বাতাসে। পা ভেঙ্গে গেছে হিকসস্‌ ঘোড়ার। সঙ্গী ঘোড়াসহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ওটা। জলাশয়ের ধার থেকে নিচে খসে পড়লো রথ। চাকার নিচে চাপা পড়ে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটলো চালকের। আমাদের রথও বিপদজনক ভঙিতে পারের কাছে চলে এসেছে, দ্রুত লাগাম টেনে নিরাপদে সরিয়ে নিলাম আমি ওটাকে। পিছনে ধুলোর মেঘ। গতি কমিয়ে থেমে দাঁড়ালাম। নদীতীর থেকে আর মাত্র দুইশো গজ মতো দূরত্বে রয়েছি কিছুই আর থামাতে পারবে না আমাদের ।

পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি, জলাশয়ের ধার থেকে কিছুটা দূরে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছেন ইনটেফ। আমার দৃষ্টির সামনেই, টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, হয়তো নড়াচড়া না করে পরে থাকলে ওভাবেই ফেলে রেখে যেতাম তাকে সেদিন।

আচমকা, তীব্র রাগে-ঘৃণায় সর্বশরীর কেঁপে উঠলো আমার। চোখের সামনে যেনো রক্তের লাল পর্দা দেখতে পেলাম কমে গেলো দৃষ্টিশক্তি। জংলী, বুনো চিৎকার বেরিয়ে এলো বুক চিরে; ঘোড়া ঘুরিয়ে সোজা এগিয়ে চললাম ইনটেফের দিকে।

সরাসরি আমার পথে রয়েছেন ইনটেফ। অস্ত্র, বর্ম সবকিছু হারিয়েছেন পতনের সময়, মনে হলো ঘোরের মধ্যে আছেন তখনো। চাবুক কষিয়ে গতি আরো বাড়ালাম ঘোড়াগুলোর, যেনো উড়ে চললো রথ। দাড়ি নোংরা, মুখ-মাথা ধুলো আর রক্তে মাখামাখি-চোখেও কেমন যেনো ঢুলুঢুলু দৃষ্টি ইনটেফের। হঠাই, আমাকে দেখে মাথা পরিষ্কার হলো তার।

না! চিৎকার করে পথ থেকে সরে দাঁড়াতে চাইলেন, হাত বাড়িয়ে যেনো থামতে চাইছেন আগুয়ান রথ। সোজা তার দিকেই রথ চালিয়েছিলাম আমি, কিন্তু শেষবারের জন্যে অন্ধকারের দেবতারা আবারো সহায় হলো ইনটেফের। যখন প্রায় চড়ে বসেছি তার উপর, একপাশে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। যদিও আহত, এখনো শেয়ালের মতোই ক্ষিপ্র ইনটেফ। ভারী রথ ঘুরিয়ে তার নাগাল পাওয়ার আগেই সরে গেলেন। ঊর্ধ্বশ্বাসে জলাশয়ের নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে ছুটলেন। একবার ওখানে পৌঁছুতে পারলে বেঁচে যাবেন বুঝলাম আমি। বিড়বিড় করে অভিশাপ বকে আবারো রথ ছোেটালাম।

ঠিক সেই মুহূর্তে শেষপর্যন্ত ইনটেফকে ছেড়ে গেলো অন্ধকারের দেবতারা। জলাশয়ে প্রায় পৌঁছে গেছিলেন তিনি, ঘাড় ফিরিয়ে দেখছিলেন আমাকে হঠাৎই উঁচু শক্ত-কাদামাটির একটা ঢেলায় লেগে পা মচকে গেলো তার। সম্পর্ণ ওজন নিয়ে ওই পায়ের উপর পড়লো দেহটা, একটা ডিগবাজি খেয়ে শরীর কসরকারীর ভঙিমায় আবারো দাঁড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু ভাঙ্গা গোড়ালির ব্যথা তাকে বেশিদূর এগোতে দিলো না। এক, পা দুপা এগোনোর পর পরে গিয়ে হেঁচড়ে এগুতে লাগলেন।

শেষমেষ তোকে পেয়েছি! চিৎকার করে বলে উঠলাম আমি। এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালেন ইনটেফ। মুখ বিবর্ণ, চিতার মতো জ্বলজ্বলে চোখে শুধুই ঘৃণা আর তিক্ততা।

উনি আমার বাবা! রাজকুমারকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে ফেললো লসট্রস। ছেড়ে দাও, মেরো না, টাইটা।

কখনো আমার কর্ত্রীকে অমান্য করিনি এর আগে সেই ছিলো প্রথম ও শেষ। একবারের জন্যেও ঘোড়াগুলোর গতিবেগ কমানোর কোনো চেষ্টা করলাম না, সরাসরি ইনটেফের চোখে তাকিয়ে সোজা তার উদ্দেশ্যে চালিয়ে নিয়ে চললাম রথ ।

একেবারে শেষ মুহূর্তে, আবারো আমাকে ধোকা দিতে চেয়েছিলেন ইনটে। একপাশে ঝাঁপিয়ে পড়ে রথের চাকা এড়িয়ে গেলেন, কিন্তু ঘুরন্ত-ফলার নাগালের বাইরে যেতে পারলেন না। বর্ম ভেদ করে তার পেটের ভেতর সেঁধিয়ে গেলো চাকার কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসা ঝকঝকে ঘুরন্ত ছোরা; ইনটেফের পেটের নাড়ি-ভুড়ি আটকে গেলো ওটার সাথে। নিমিষেই লম্বা দড়ির মতো প্যাঁচ ছাড়ানো নাড়ি ঝুলতে লাগলো চাকার গা থেকে।

নিজের পিচ্ছিল নাড়ি রথের পেছন পেছন টেনে নিয়ে চললো ইনটেফকে। ধীরে গতি হারাতে থাকলো তার দেহ, কেননা প্রচুর প্যাঁচ-খোলা নাড়ি-ভুড়ি বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে তার পেট থেকে।

যতোদিন বেঁচে থাকবো, তার ওই আর্তনাদ আমার মনে থাকবে। সেই আর্তনাদের প্রতিধ্বনি এখনো আমার দুঃস্বপ্নে হানা দেয়। তাকে ভুলে যাওয়া কখনো সম্ভব নয় আমার পক্ষে, যতোই চাই।

অবশেষে, সমস্ত নাড়ি পেট থেকে বেরিয়ে যেতে খোলা মাঠে নিস্তেজ পড়ে রইলো ইনটেফের দেহ। আর কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না গলা চিরে।

ঘোড়া থামালাম আমি। ট্যানাস নেমে এসে জড়িয়ে ধরলো লসট্রিস আর তার শিশুপুত্রকে। কাঁদছিলো মহারানি।

কী ভয়ঙ্কর মৃত্যু! যা-ই করে থাকুক-উনি আমার বাবা ছিলেন।

ঠিক আছে, শান্ত হও, ট্যানাস সান্ত্বনা দিয়ে চলছিলো ওকে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

দাদার নিথর পড়ে থাকা দেহের দিকে একমনে তাকিয়ে দেখলো ছোট্ট মেমনন। আচমকা, তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলো সে, ও একটা বিশ্রী লোক।

হ্যাঁ, একমত হলাম আমি। সত্যিই, উনি একজন বাজে লোক ছিলেন।

বাজে মানুষটা কি মরে গেছে?

হ্যাঁ, মেম, মরে গেছে। এখন থেকে রাতে ভালো করে ঘুমোত পারবো আমরা।

ভীষণ দ্রুতগতিতে নদীর ধার ধরে ছোটাতে হলো রথ, অবশেষে, কাতাসের গ্যালির সমান্তরালে চলে আসতে শক্র রথের মধ্যে আমাদের সনাক্ত করতে সক্ষম হলো ক্ৰাতাস। এতোদূর থেকেও ওর বিস্ময় টের পাওয়া গেলো। পরে সে আমাকে বলেছিলো, তার ধারণা ছিলো সামনের কোনো একটা জাহাজে আগেই চড়েছিলাম আমরা।

রথ ত্যাগ করার আগে ঘোড়াগুলোকে ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি। কাতাসের পাঠানো ছোট্ট নৌকায় চড়ে আমরা সবাই পৌঁছেছিলাম জাহাজে।

*

এতো সহজে আমাদের চলে যেতে দেবে না হিকসস্‌ বাহিনী। দিনের পর দিন নদীর দুই তীর ধরে আমাদের অনুসরণ করে চললো তাদের রথ বহর।

হোরাসের প্রশ্বাসের পিছনে তাকালেই শরথের বিশাল ধুলোর মেঘ চোখে পড়তো। চলতি পথে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছিলো হিকসসেরা। প্রতিটি ছোট্ট মিশরীয় নগর থেকে নৌকায় করে আমার নৌ কাফেলায় যোগ দিতে লাগলো অসহায় অধিবাসীরা।

এভাবেই, দিনে দিনে বড়ো হতে লাগলো আমাদের বাহিনী। কখনও কখনও যখন বাতাস ধরে আসতো, আমাদের জাহাজের সমান্তরালে পৌঁছে যেতো হিকসস্‌ রথবহর। কিন্তু, চিরকালের মতেই, নদীর দেবী মাতা হাপি আমাদের সহায় ছিলেন, স্রোত ঠেলে আমাদের গ্যালিবহরে পৌঁছুতে সাহস করেনি কোনো হিকসস্‌ যোদ্ধা। তারপর আবার বাতাস আমাদের অনুকূলে বইতে লাগলো, আবারো রথবহর থেকে অনেক এগিয়ে গেলাম আমরা। ধুলোর মেঘ উত্তর দিগন্তে ক্রমশ হারিয়ে যেতে লাগলো।

ঘোড়া নিয়ে ওরা আমাদের ধরতে পারবে না, বারোতম দিন সকালে ট্যানাসকে বললাম আমি।

একেবারে নিশ্চিত হয়ো না। ফারাও মামোসের সম্পদের লোভ আছে স্যালিতিসের, দ্বৈত মুকুটের উত্তরাধিকারীও রয়েছে আমাদের সাথে। এতো সহজে হাল ছাড়বে না ওরা, ট্যানাস উত্তরে বলেছিলো। স্বর্ণ আর ক্ষমতার লোভ একজন মানুষের রোখ অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে। এই বর্বরের শেষ দেখা এখনো বাকি আছে।

পরদিন সকালে আবারো ধরে এলো বাতাস। হাপির প্রবেশদ্বারের নিকটে এসে আমাদের অগ্রবর্তী জাহাজগুলোকে ছাড়িয়ে গেলো শত্রু রথ। এখানে, নদীর দুই তীর সংকুচিত হয়ে গেছে কালো গ্রানাইটের দেয়াল প্রায় ছুঁয়ে দিচ্ছে পরস্পরকে। দুই তীরের মধ্যবর্তী দূরত্ব এখন চারশো গজের মতো। বিপরীতমুখী স্রোতে পরে হাপির প্রবেশদ্বারে প্রায় থেমে পড়লো আমাদের জাহাজবহর। তরতাজা যযাদ্ধারাও দাঁড় টেনে কুলিয়ে উঠতে পারছিলো না।

আমার ধারণা, এখানেই ওরা আমাদের কাছে পৌঁছুতে চেষ্টা করবে, উদ্বিগ্ন স্বরে বললো ট্যানাস। প্রায় সাথে সাথেই হাত তুলে দেখালো সে। ওই যে!

নৌ-বহরের সামনে হোরাসের প্রশ্বাস মাত্র প্রবেশ করেছে হাপির দরোজা দিয়ে; উপরের পাথুরে দেয়ালে দাঁড়িয়ে তীর ছুঁড়ে দিতে লাগলো অসংখ্য তীরন্দাজ।

ওই উচ্চতা থেকে নদী দুই তীরে ইচ্ছেমতো আক্রমণ চালাতে পারবে তারা। বিড়বিড় করলো ট্যানাস। সারাটাদিনই তীরের আওতায় থাকতে হবে আমাদের। দারুন কঠিন দিন সামনে।

সত্যিই, ভীষণ একটা দিন ছিলো সেটা। আগুনে তীর নিয়ে হাপির প্রবেশদ্বারের গ্রানাইটের দেয়াল থেকে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়লো হিকসস্‌ বাহিনী। উচ্চতার কারণে কোনো রকম প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হলো না আমাদের তীরন্দাজদের পক্ষে। দারণভাবে পর্যুদস্ত হলো মিশরীয় বাহিনী।

হাপির প্রবেশদ্ধারে পঞ্চাশটি জাহাজ হারিয়েছিলাম আমরা। গজ-দ্বীপের উদ্দেশ্যে আমাদের অব্যাহত যাত্রায় প্রতিটি জাহাজে রইলো শোকের কালো পতাকা। অবশেষে, দক্ষিণ অভিমুখী একটানা যাত্রায় ক্ষান্ত দিলো হিকসস্‌ বাহিনী। এখন আর উত্তর দিগন্তে চোখে পড়ে না ধুলোর মেঘ। মৃতদের জন্যে শোক করবার আর ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ মেরামত করার জন্যে একটু দম ফেলার সুযোগ পেলাম আমরা। ( যাই ঘটুক, একটি বারের জন্যেও আমরা বিশ্বাস করিনি হাল ছেড়ে দিয়েছে শক্ররা। ফারাও-এর সম্পদের লোভ সামলানো বড়ো কঠিন।

*

গজদ্বীপে আমাদের উপর নতুন কোনো আক্রমণ হলো না হিকসস্‌দের পক্ষ থেকে। বেশ ক দিন ধরেই অনুসরণরত রথের দেখা না পেয়ে আশায় বুক বাঁধলো জনতা। অনেকেই বলাবলি করতে লাগলো, দক্ষিণ যাত্রা বাতিল করে এখানেই সংঘবদ্ধ হয়ে নতুন সেনাবাহিনী গড়ে তুলে দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া উচিত আমাদের।

আমি অবশ্য এ ধরনের কথাবার্তায় মিসট্রেসকে কান না দেয়ার জন্যে পরামর্শ দিলাম। তাকে আশ্বস্ত করে জানালাম, ঐন্দ্রজালিক শক্তি আমাকে ভবিষ্যতের যে ছবি দেখিয়েছে, সে অনুযায়ী সঠিক পথেই আছি আমরা। দক্ষিণেই আছে আমাদের নিয়তি। এরই মধ্যে, অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রস্তুতি চালু রাখলাম। আমার ধারণা, হিকসস্‌ থেকে পলায়ন নয়, বরঞ্চ যাত্রাপথের রোমাঞ্চ ততোদিনে আমাকে অধিকার করে নিয়েছিলো।

জলপ্রপাতের ওপারে কী আছে–দেখতে চাই আমি। এক রাতে প্রাসাদের গ্রন্থাগারে বসে সেই সব স্বল্পসংখ্যক লোকের লিখে যাওয়া বর্ণনা পড়লাম, যারা একদা ওই অজানা দেশে গিয়েছিলো।

তাদের বর্ণনা মতে, এই নদীর কোনো শেষ নেই, পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত এর বিস্ত তি। আরো জানা গেলো, প্রথম জলপ্রপাতের পরে একটি জলপ্রপাত আছে, যা এতো খাড়া কোনো মানুষ কিংবা জাহাজের পক্ষে পাড়ি দেওয়া অসম্ভব। জানলাম, প্রথম জলপ্রপাত থেকে দ্বিতীয় জলপ্রপাত পুরো এক বছরের যাত্রা, তার পরেও নাকি শেষ হয়নি নীল নদ।

এর শেষ দেখতে চাই আমি। আমি দেখতে চাই, কোথায় শুরু হয়েছে আমাদের এই মহান নদী–আমাদের জীবন।

শেষমেষ, আলো জ্বলা অবস্থাতেই ক্রোলের উপর মাথা রেখে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। স্বপ্নে দেখি, সেই পর্বতের উপরে বসে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছেন মহান দেবী; তাঁর বিশালকার যোনী থেকে উৎসরিত হচ্ছে দুটি জলের ধারা। সকালে ঘুম ভেঙ্গে জেগে আরো তরতাজা মনে হলো নিজেকে, উৎসাহ নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

আমি ভাগ্যবান, গজ-দ্বীপে পুরো মিশরের শ্রেষ্ঠ লিনেন সুতার দড়ি উৎপন্ন হয়। জলপ্রপাত সফলভাবে পেরুতে হলে দড়ির কোনো বিকল্প নেই।

এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, আমাদের সঙ্গী অনেকের দুর্বল চিত্ত প্রকাশ হয়ে পড়লো গজদ্বীপে। অনেকেই বলাবলি করতে লাগলো, দক্ষিণের ভয়ঙ্কর হিংস্র জীব জন্তুতে পরিপূর্ণ মরুর চেয়ে বরঞ্চ হিকসস্‌দের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত। ট্যানাস যখন শুনলো, বেশ ক হাজার লোক অভিযান ছেড়ে চলে যেতে চাইছে, হতাশায় গর্জে উঠলো সে, বিশ্বাসঘাতক, চোর ওগুলো! কী করতে হয় এদের সাথে বিলক্ষণ জানা আছে আমার। জোর করে এদের জাহাজে ফিরিয়ে নিয়ে আসাই ছিলো ওর সিদ্ধান্ত।

পুরো অর্ধেক রাত তর্কাতর্কি শেষে আমি তাকে বোঝাতে সমর্থ হলাম, এই ধরনের নিরাসক্ত লোকেদের সাথে না নেয়াই বরঞ্চ আমাদের জন্যে ভালো। শেষমেষ, রানি লসট্রিস একটি প্রত্যাদেশ জারি করলেন যে, যার ইচ্ছে সে গজ-দ্বীপে থেকে যেতে পারে। তবে সেই ঘোষণায় নিজের কিছু ছাপও রাখলো আমার কর্ত্রী। গজ-দ্বীপের রাস্তায়-রাস্তায়, বন্দরে জোরে জোরে পঠিত হলো সেই ঘোষণা।

.

আমি, রানি লসট্রিস, এই মিশরের শাসক, রাজপুত্র মেমননের মাতা, দ্বৈত-মুকুটের একমাত্র উত্তরাধিকারী, এই মর্মে এই দেশের অধিবাসীদের কাছে আমার শপথ ব্যক্ত করছি।

সমস্ত দেবতাকে সাক্ষী রেখে শপথ করছি; শপথ করছি রাজপুত্রের জনপ্রিয়তার নামে এইখানে, এই গজ-দ্বীপে ফিরে এসে তাকে রাজার সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করে দ্বৈত-মুকুট তার শিরে অর্পণ করবো, যাতে করে চিরকাল সুখ-শান্তিতে সে এই দেশের জনগণকে শাসন করতে পারে।

রানি লসট্রিস, এই মিশরের শাসনকর্ত্রী ।

.

এই ঘোষণার ফলে কয়েকগুন বেড়ে গেলো রানির জনপ্রিয়তা। আমাদের ইতিহাসে কোনো ফারাও এতো জনপ্রিয় ছিলেন বলে মনে হয় না।

অবশেষে, আমাদের সাথে যারা জলপ্রপাতের ওপারে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রাসঙ্গী হবে তাদের নামের তালিকা পেলাম। স্বাভাবিকভাবেই, রানির প্রতি অনুগত এবং চৌকষ লোকেরাই আসছে সাথে। যারা আসবেন না, তাদের আমরা রেখে যেতে পেরেই বরঞ্চ আনন্দিত। পুরোহিতদের একটা বড়ো দল এই শ্রেণীর অন্যতম।

পরবর্তীতে অবশ্য সময়ের নিরিখে প্রমাণিত হলো, গজ-দ্বীপে রয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠী ভীষণ উপকারে এসেছিলো আমাদের। নিব্যাসনের বেশ ক বছরে এরাই মানুষের মনে রানি লসট্রিস, রাজকুমার মেমননের স্মৃতি জ্বালিয়ে রেখেছিলো। রানির ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা কখনো ভুলে যায়নি তারা।

হিকসস্‌ শাসনের দীর্ঘ বছরগুলোতে মনের ভিতরে রাজকুমারের প্রত্যাবর্তনের আশা সুপ্ত রেখেছিলো তারা। একটা সময় পুরো মিশরে সেই প্রথম জলপ্রপাত থেকে মহান ডেল্টায়, নীল নদের সাতটি মুখ পর্যন্ত সবাই বিশ্বাস করতো একদিন ফিরে আসবে রাজপুত্র। তারই জন্যে প্রার্থনা করতে তারা প্রতিদিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *