৪. সাফাগা বন্দর

বিগত প্রায় এক হাজার বছর ধরেই পূর্ব থেকে সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্যের দ্রব্য সাফাগা বন্দরের মাধ্যমে আমাদের এই উচ্চ-রাজ্যে আসে। নৌকার গলুইয়ে দাঁড়িয়ে উত্তরের দিগন্তে বড়ো বড়ো জাহাজের আকৃতি দেখতে পেলাম; সাফাগা এবং বিভিন্ন আরবীয় বন্দরের মধ্যে আসা-যাওয়া করে ওগুলো।

বন্দরের বেলাভূমিতে যখন পা রাখলাম, আঁধার ঘনিয়েছে তখন। আমার আগমন কেউ দেখেছে বলে মনে হলো না। ইনটেফের ব্যবসার খাতিরে বহুবার আসতে হয়েছে এখানে সব কিছু তাই আমার চেনা। রাতের এই সময়ে পুরোপুরি নির্জন পড়ে আছে বন্দরের রাস্তা-ঘা। দ্রুত পায়ে হেঁটে বণিক তিয়ামাতের বাড়ির উদ্দেশ্যে চলেছি। পুরোনো এই শহরতলীর ধনী ব্যবসায়ী সে, সবচেয়ে বড়ো বাড়িটা তারই। বাড়ির সামনে প্রহরায় রয়েছে একজন সশস্ত্র দাস।

তোমার মালিককে গিয়ে বলো, কারনাকের যে শল্যবিদ তার পা বাঁচিয়েছিলো একদা সে এসেছে, বললাম তাকে। কিছু সময়ের মধ্যে তিয়ামাত স্বয়ং ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এসে অভিবাদন জানালো আমাকে। তবে অন্য সবার সামনে আমার নাম ধরে ডাকার মতো নির্বুদ্ধিতা দেখালো না সে। ওর দেয়াল-ঘেরা বাগানে বসতে, বিস্ময়ের সুরে বললো, সত্যি তুমি টাইটা? আমি তো শুনেছি, গজ-দ্বীপে শ্রাইকদের আক্রমণে নিহত হয়েছো তুমি।

মধ্য-বয়স্ক, মোটাসোটা আকৃতির মানুষ তিয়ামাত, ভরাটে মুখাবয়ব-তীক্ষ্ণ, ধূর্ত মনের অধিকারী। বহু বছর আগের কথা, লোকজন ধরাধরি করে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলো তাকে। শ্রাইকরা মেরে, সমস্ত মালামাল লুটপাট করে মরতে ফেলে রেখে গেছিলো তাকে। প্রায় বরবাদ হতে যাওয়া একটা পা রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলাম আমি–তবে এখনো খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয় বেচারাকে।

তোমার মৃত্যুর খবরটা একটু আগে-ভাগেই আমার কাছে চলে এসেছিলো-ভালোই লাগছে দেখে, মুচকি হেসে যোগ করে তিয়ামাত। হাততালি দিয়ে তার ভৃত্যদের ডাকলো সে, কিছু ক্ষণের মধ্যেই মিষ্টি ঠাণ্ডা শরবত এবং আঙুর পরিবেশন করা হলো আমার জন্যে।

কিছুসময় এটা-ওটা আলোচনার পর, তিয়ামাত কোমল স্বরে জানতে চাইলো, তোমার জন্যে কি করতে পারি? আমার জীবন বাঁচিয়েছো তুমি, টাইটা শুধু বলল, কী সাহায্য প্রয়োজন। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করবো।

আমি রাজার পক্ষ থেকে এসেছি, বলে, জামার ভেতর থেকে বাজপাখির প্রতীক বের করে দেখালাম তাকে।

দারুন চিন্তিত হয়ে গেলো তিয়ামাত। ফারাও-এর প্রতীক আমার সম্মান গ্রহণ করুক। কিন্তু, ওটা দেখানোর কোনো প্রয়োজন ছিলো না। কেবল বলো, কী সাহায্য করতে পারি? আমি তোমার জন্যে সবকিছু করতে রাজী।

নীরবে আমার কথা শুনতে লাগলো সে। শেষ হতে, তার বার্তাবাহকে ডেকে পাঠিয়ে নির্দেশ দিলো আমার সম্মুখে। লোকটি চলে যাওয়ার আগে, আমার উদ্দেশ্যে ফিরলো তিয়ামাত, কিছু ভুল-ভালো বলি নি তো? আর কিছু প্রয়োজন তোমার?

তোমার উদারতার তুলনা হয় না, তিয়ামাত, বললাম তাকে। কিন্তু আরো একটি জিনিস প্রয়োজন আমার লেখার সরঞ্জাম।

বার্তাবাহকের দিকে ফিরে তাকায় তিয়ামাত। খেয়াল রেখো একটা থলিতে যেনো স্ক্রোল, তুলি এবং কালির পাত্র থাকে।

নির্দেশ নিয়ে সে চলে যেতে, অর্ধেক রাত পর্যন্ত গল্প করে কাটালাম আমরা দু জন। উচ্চ-রাজ্যের ব্যস্ততম ব্যবসাক্ষেত্রের ঠিক মাঝখানে তিয়ামাতের রাজত্ব; যেখানে যে ঘটনাই ঘটুক সব তার নখদর্পনে। গজ-দ্বীপে বসে এক মাসে যা জানতে পারতাম, এখানে তার বাগানে কয়েক ঘণ্টায় তার চেয়ে বেশি জানা হয়ে গেলো আমার।

এখনো কি ক্যারাভান চলাচলের জন্যে শ্রাইকদের চাঁদা দাও? আমার প্রশ্নের উত্তরে অসহায়ের মতো কাঁধ ঝাঁকালো সে।

আমার পায়ের এই দশার পড়ে এ ছাড়া আর কী করার আছে? প্রতি মৌসুমেই আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে দাবি করছে তারা। সাফাগা ছেড়ে যাওয়া সমস্ত মালের এক-চতুর্থাংশ; থিবেসে ওগুলো বিক্রির লাভের ঠিক অর্ধেক টাকা দিতে হয়। এমনভাবে চলতে থাকলে দ্রুতই পথের ফকির হয়ে যাবো এই ব্যবসা আর চলবে না।

টাকাটা দাও কী ভাবে? জানতে চাইলাম। পরিমাণ নির্ধারণ করে কে? এসে নিয়ে যায়-ই বা কে?

বন্দরে ওদের চর আছে। প্রতিটি জাহাজ থেকে কী নামানো হয় সব হিসাব আছে তাদের কাছে। গিরিপথের কাছে যাওয়ার আগেই কোনো ক্যারাভানে কী আছে জানা হয়ে যায় তাদের। ওখানে, একজন দস্যু-প্রধান এসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দাবি করে।

মধ্যরাতের অনেক পরে একজন দাস ডেকে, আলো হাতে আমার জন্যে সাজিয়ে রাখা প্রকোষ্ঠে নিয়ে এলো তিয়ামাত।

সকালে আমি জাগবার আগেই তো চলে যাবে তুমি, আমাকে আলিঙ্গন করে বললো সে। বিদায়, বন্ধু। তোমার কাছে আমার ঋণ শোধ হয় নি পুরোপুরি। যখন প্রয়োজন একবার ডেকেই দেখো, চেষ্টা করবো সাহায্য করার।

সেই পথ-দেখানো দাস ছেলেটা সকালে সূর্যোদয়ের আগেই আমার ঘুম ভাঙিয়ে, সমুদ্রের ধারে নিয়ে এলো। চারপাশে তখনো ভীষণ অন্ধকার। তিয়ামাতের নৌবহরের একটা চমৎকার সওদাগরী নৌকা নোঙর করা রয়েছে ঘাটে। আমি চড়ে বসতে না বসতেই নোঙর তুলে ফেলা হলো।

মধ্য-সকালে, প্রবালের মাঝখান দিয়ে পথ করে ছোট্ট জেলেদের গ্রামটার সামনে পৌঁছে গেলাম। বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে ট্যানাস অপেক্ষা করছিলো আমার জন্যে।

*

আমার অনুপস্থিতির সময়টাতে হাড় জিড়জিড়ে ছয়টা খচ্চর সহ করতে সমর্থ হয়েছে ট্যানাস। তিয়ামাতের নৌকার নাবিকেরা ধরাধরি করে সাফাগা থেকে আমার-নিয়ে-আসা বড়ো বড়ো বাক্স গুলো তুলে দিলো ওগুলোর পিঠে। নৌকার প্রধানকে আমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার কঠোর নির্দেশ দিয়ে খচ্চরগুলো সমেত জেবেল-নাগারা কুয়োর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমি এবং ট্যান্যাস।

প্রচণ্ড গরম, ধুলো আর মাছির অত্যাচার সয়ে সয়ে একেবারে বিরক্ত হয়ে গেছে কাতাসের লোকেরা। আমাদের দেখতে পেয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না তারা। যোদ্ধাদের সামনে প্রথম খচ্চরের পিঠ থেকে নামানো বাক্সটা খুললাম আমি। ওটার ভেতর থেকে বেরুলো একজন দাসী মেয়ের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে দারুন আমোদ পেলো যোদ্ধার দল। আরো উন-আশিটি পোশাক একে একে বেরুতে রীতিমতো তর্ক বাধিয়ে দিলো তারা।

ক্রাতাসের দুই জন সহযোগীর সাহায্যে একে একে প্রত্যেক প্রহরী-সৈনিকের সামনে একটা করে মেয়েদের পোশাক সাজিয়ে রাখলাম, বালুর উপর। এবারে গর্জে উঠে ট্যানাস, কাপড় খুলে, নিজেদের সামনে রাখা পোশাক পরে নাও সবাই! তুমল প্রতিবাদ, শোরগোলে একেবারে ভজগট বেঁধে যাওয়ার দশা হলো, শেষমেষ ক্ৰাতাস এবং তার উচ্চ-পদস্থ লোকেরা মিলে কঠোর নির্দেশ দিতে নিতান্ত অনিচ্ছায় মেনে নিলো তারা।

আমাদের মেয়েরা স্বল্প-বসন পরে থাকে। বেশিরভাগ সময় বুক এবং পা উন্মুক্ত রাখতেই অভ্যস্ত তারা। কিন্তু আসিরীয় মহিলারা মাটিতে হেঁচরানো ঘাগড়া, দুই-হাত সম্পূর্ণ ঢাকা কাপড় পরে। এমনকি, কপট-নম্রতার নিদর্শন স্বরূপ বাইরে গেলে মুখ পর্যন্ত নেকাবে ঢেকে রাখে তারা, সম্ভবত তাদের পুরুষদের নির্দেশে। এখানেও দেখুন, আমাদের এই সূর্যালোকিত মিশরের তুলনায় ওখানে, যেখানে আকাশ-ফুটো-করে পানি ঝরে কঠোর-সাদা হয়ে জমা হয় পর্বতের মাথায় যেখানে মৃত্যুর মতো ঠাণ্ডা বাতাস হাড়-মাংস জমিয়ে দেয় সেখানকার কতো বিশাল তফাত।

মেয়েদের পোশাকে নিজেদের সজ্জিত করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ে প্রহরীরা। কিছু সময়ের মধ্যেই গোড়ালী ছুঁই-ছুঁই ঘাগড়া পরা, মুখ নেকাবে ঢাকা আশিটি দাসী মেয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকে আমাদের সম্মুখে। তাদের পাছা দোলানো হাঁটার ভঙি দেখে হেসে খুন হতে হয়।

গাম্ভীৰ্য্য ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে আমাদের জন্যে। এই হট্টগোলের মাঝখানে নিজেকে অভিবাদন জানালাম আমি, আমার নির্দেশেই বাহিনীর সবচেয়ে ছোটোখাটো, পাতলা শরীরের সৈনিকদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো ক্ৰাতাস। এই মুহূর্তে ওদের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত হলাম এরা এই ছলনা বজায় রাখতে সক্ষম হবে। কেবল নারী-আচরণের উপর সামান্য দীক্ষার প্রয়োজন এখন।

*

পরের দিন সকালে ছোট্ট জেলেদের গ্রামটাতে পৌঁছুলো আমাদের অদ্ভুত ক্যারাভান, সোজা তীরে গিয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষমাণ সওদাগরী নৌকায় চড়ে বসলাম আমরা। ক্ৰাতাস এবং তার আটজন পদস্থ যোদ্ধা পাহারায় রইলো। এতো মূল্যবান সম্পদের জন্যে কোনো রকম প্রহরার অনুপস্থিতি সন্দেহের উদ্রেগ করতে বাধ্য। ভাড়াটে প্রহরীর ছদ্মবেশে থাকা নয়জন যোদ্ধা এই দলের জন্যে যথেষ্ট, কিন্তু শ্রাইকদের কোনো দলকে ভড়কে দেওয়ার জন্যে খুবই অপ্রতুল।

দামী আলখাল্লা, মাথায় পাগড়ী ইউফ্রেতিস নদীর ওপার থেকে আসা কোনো ধনী সওদাগরের মতোই দেখাচ্ছে ট্যানাসকে। ঘন দাড়ির জঙ্গল মুখে, আসিরীয়দের পছন্দমতো ওগুলোকে টেনে বেণী করে দিয়েছি আমি। অনেক উত্তরে, সেই উঁচু পর্বতেরও ওপারে বসবাসকারী বহু এশীয়দের গায়ের রঙ অনেকটা ট্যানাসের মতোই।

ওর ঠিক পেছনেই চলেছি আমি। লম্বা ঘাগড়া, নেকাব পড়নে সঙ্গে আসিরীয় বধূদের মতো অলঙ্কার। সাফাগার কেউ যেনো আমাকে চিনে না ফেলে তার সব ব্যবস্থাই করা হয়েছে।

পুরোটা নৌ-যাত্রায় আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে রইলো দলের সবাই। এরা নীল নদের শান্ত পানিতে চলাচল করে অভ্যস্ত, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে নয়।

সাফাগা বন্দরের বেলাভূমিতে পা রাখতে পেরে দারুন স্বস্তিবোধ করলাম আমরা । এদিকে আমাদের আগমন রীতিমতো শোরগোল ফেলে দিলো। প্রেমের কলা-কৌশলে আসিরীয় মেয়েদের সুনাম আছে। প্রচলিত আছে, এদের মধ্যে অনেকে এমন কলাও জানে, যা এক হাজার বছরের পুরোনো মমি পর্যন্ত জীবিত করে ফেলতে সক্ষম। বোরখার ওধারে সব কটি মেয়েই যে অনিন্দ্য-সুন্দর–এ ব্যাপারে দর্শনার্থীদের মনে কোনো সন্দেহ নেই। একজন ধূর্ত এশীয় ব্যবসায়ী নিশ্চই ভালো দাম পাওয়ার আশা না থাকলে, এতোদূর থেকে, এতো কষ্ট করে ওদের বয়ে নিয়ে আসতো না।

দ্রুতই সাফাগা বন্দরের একজন বণিক প্রস্তাব করে বসলো ট্যানাসকে। সব কটি মেয়েকেই কিনে নিতে চায় সে, এতে করে মরুর উপরে দীর্ঘ-কষ্টকর যাত্রার প্রয়োজন হবে না তাদের। তীব্র হাসিতে তাকে উড়িয়ে দেয় ট্যানাস।

আপনি কী জানেন, ওই যাত্রায় বহু সমস্যা আছে? ভদ্রলোক জোর করতে লাগলো। নীল নদে পৌঁছার অনেক আগেই নিরাপদ যাত্রার জন্যে পণ দিতে বাধ্য করা হবে আপনাকে লাভের সব অংশই তাতে চলে যাবে।

কে বাধ্য করবে আমাকে? ট্যানাস বলে। কাউকে এমনিতে কিছু দিই না আমি।

আরে, রাস্তা আটকে পাহারা দিচ্ছে দস্যুরা, বণিক সতর্ক করে দিয়ে বলে, যদি আপনি তারা যা চায়, দিয়েও দেন নিরাপদে যেতে দেবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিশেষত, যে জিনিস নিয়ে যাচ্ছেন বরঞ্চ আমার কাছে ভালো দামে বেচে দিন, লাভও হবে–

আমার সাথে সশস্ত্র প্রহরী আছে, কাতাস আর তার ছোটো বাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করে ট্যানাস। যে কোনো দস্যুর জন্যে ওরাই যথেষ্ট। এই কথায় দর্শনার্থীরা একে অপরের গা টেপা-টিপি শুরু করে দিলো।

কাঁধ ঝাঁকানো বণিক। ঠিক আছে, আমার সাহসী বন্ধু। পরের বার যখন মরুপথে যাবো, পথের ধারে তোমার কঙ্কাল খুঁজে দেখবো খন। লাল দাড়ি দেখে ঠিকই চেনা যাবে।

কথা অনুযায়ী চল্লিশটি খচ্চর তৈরি রেখেছিলো তিয়ামাত। এর মধ্যে বিশটিতে আছে পানির থলে, বাকিগুলোতে আমাদের মাল-সামান চাপানোর জন্যে জিন বসানো।

এতোজন দর্শনার্থীর সামনে বেশি সময় এখানে থাকার ইচ্ছে নেই আমার। সামান্য একটা ভুলের কারণে ধরা পড়ে যেতে পারে বোরখার আড়ালের মানুষগুলোর সত্যিকারের লিঙ্গ-পরিচয়। আর তাহলেই সব শেষ। দ্রুতই প্রহরীরা ঠেলে-ধাক্কিয়ে পথ করে দিতে লাগলো, কোনোদিকে না তাকিয়ে, আশেপাশের উৎসুক পুরুষদের তীর্যক মন্তব্যে কর্ণপাত না করে হেঁটে চললো দাসী মেয়েদের দলটা। কিছু সময়ের মধ্যেই শহর অতিক্রম করে খোলা মাটিতে চলে এলাম আমরা।

সাফাগার দৃষ্টি-সীমার মধ্যেই প্রথম রাতে ক্যাম্প ফেললাম। প্রথম গিরিপথের আগে কোনো রকম আক্রমণ আশা করছি না আমি, তবে কোনো সন্দেহ নেই, শ্রাইকদের চর নজর রাখছে আমাদের উপর। আলো থাকা পর্যন্ত অভিনয় চালিয়ে গেলো দাসী মেয়েরা মুখ-মাথা ঢাকা থাকলে তাদের; প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় বসে কাজ সারলো তারা।

রাত নামার পর ট্যানাসের নির্দেশে খচ্চরের পিঠ থেকে বাক্সগুলো নামানো হলো, একটি করে অস্ত্র বরাদ্দ করা হলো প্রতিটি দাসী মেয়ের জন্যে। বিছানার মাদুরের নিচে খোলা তরবারি আর ধনুক তৈরি রেখে ঘুমোলো সবাই ।

ক্যাম্পের চারধারে দ্বিগুন প্রহরা মোতায়েন করা হলো। সবকিছু পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হতে, আমি আর ট্যানাস রাতের অন্ধকারে সাফাগা বন্দরে ফিরে এলাম। পথ দেখিয়ে অপেক্ষমাণ তিয়ামাতের ঘরে নিয়ে এলাম আমি তাকে, রাতের খাবার নিয়ে বসেছিলো সে আমাদের জন্যে। ট্যানাসের সাথে পরিচিত হয়ে দারুন উত্তেজিত বোধ করছে তিয়ামাত।

আপনার সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, প্রভু হেরাব। আপনার বাবাকেও চিনতাম আমি একজন প্রকৃত পুরুষ-মানুষ ছিলেন। ট্যানাসকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললো সে। অবশ্য, গুজব শুনেছি মরুতে মারা গেছেন আপনি, আপনার দেহ এখন শব-প্রস্তুতকারীদের জিম্মায় তবুও, আমার বাড়িতে আপনাকে স্বাগতম।

তিয়ামাতের পরিবেশিত খাদ্য উপভোগে ব্যাপৃত হলাম আমরা দুজন। শ্রাইকদের সম্বন্ধে বিষদ জেনে নিতে লাগলো ট্যানাস; খোলাখুলি উত্তর দিয়ে গেলো তিয়ামাত, যা যা তার জানা আছে, সবই বললো।

অবশেষে আমার পানে চেয়ে ইশারা করলো ট্যানাস। তিয়ামাতের দিকে ফিরে বললো, আমাদের প্রতি তুমি অত্যন্ত সদয়, তিয়ামাত। কিন্তু তোমাকে সবটুকু সত্যি বলা হয় নি। অবশ্য তার প্রয়োজন ছিলো আমাদের পরিকল্পনার কথা গোপন রাখা একান্তই জরুরি। তো এখন বলছি শোনো আমার উদ্দেশ্য হলো শ্রাইকদের মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে, ওদের দলনেতাদের ফারাও-এর বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো।

হেসে দাঁড়িতে হাত চালালো তিয়ামাত। খুব একটা অবাক হয়েছি বলবো না, বলে চলে সে, ওরিসিসের উৎসবে ফারাও আপনার উপর কী দায়িত্ব দিয়েছেন, তা আমি জানি। এছাড়া, ওই দস্যুদের সম্পর্কে আপনার আগ্রহ থেকে ব্যাপারটা আঁচ করে নিয়েছিলাম। দেবতাদের কাছে বলি দেবো আমি, আপনার সাফল্যের জন্যে, প্রভু হেরাব।

সফল হতে হলে তোমার সাহায্য আবারো প্রয়োজন হবে, তিয়ামাত, ট্যানাস বললো।

শুধু বলেই দেখুন।

কি মনে হয়, শ্রাইকেরা আমাদের ক্যারাভানের খবর পেয়ে গেছে?

সমগ্র সাফাগা আপনাদের ক্যারাভানের কথা বলছে, উত্তরে বললো তিয়ামাত। এই মৌসুমে আসা সবচেয়ে মূল্যবান ক্যারাভান ওটা। আশিজন সুন্দরী দাসী মেয়ে, কম করে হলেও প্রত্যেকে হাজার স্বর্ণ-আংটিতে বিকোবে কারনাকের বাজারে। মুচকি হেসে মাথা নাড়ে তিয়ামাত। নিশ্চিত থাকুনশ্ৰাইকেরা আপনাদের খবর জানে। সেদিন বন্দরে কমপক্ষে ওদের তিনজন চর দেখেছি আমি, প্রথম গিরিপথের কাছে যাওয়ার আগেই পণ দাবি করবে তারা। এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

আমাদের বিদায়ের ক্ষণ চলে আসতে দরোজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো তিয়ামাত। প্রার্থনা করি–সব দেবতারা যেনো আপনাদের সহায় হয়। কেবল ফারাও-ই নন, এই দেশের প্রতিটি নাগরিক আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে যদি ভয়ঙ্কর দস্যুদের কবল থেকে আমাদের মুক্ত করতে সক্ষম হন। বিদায়, প্রভু হেরাব।

*

পরদিন আঁধার থাকতে থাকতেই রওনা হলাম আমরা। কাঁধে লানাটা নিয়ে ক্যারাভানের সামনে রইলো ট্যানাস, তার ঠিক পেছনেই আমি। নারীর মোহনীয় বৈশিষ্ট্যের কোনো কমতি রইলো না আমার পদক্ষেপে। আমাদের পেছনে এক সাড়িতে চলেছে খচ্চরের দল, বহুল ব্যবহৃত পথ অনুসরণ করছি আমরা। খচ্চরগুলোর দু পাশে সারি বেঁধে হেঁটে চলেছে দাসী মেয়েরা, ওদের অস্ত্রগুলো খচ্চরের পিঠে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। প্রয়োজন হলে কেবল হাত বাড়ালেই নিয়ে নিতে পারবে।

আসতেস, রেমরেম এবং ক্রাতাসের নেতৃত্বে ছয়জনের একটি করে দলে তিনভাগ হয়ে গেছে আমাদের প্রহরীরা। যোদ্ধা হিসেবে আসতেস এবং রেমেরেম-এর যথেষ্ট সুনাম আছে। কেবল ট্যানাসের সাথে থাকার জন্যেই বহুবার পদোন্নতি নেয় নি তারা। নিজের চারপাশের মানুষগুলোর প্রতি এহেন প্রভাব ছিলো ট্যানাসের। কী অসাধারণ একজন ফারাও হতে পারতো ওভেবে আবারো আপ্লুত হলাম। দেখে মনে হয়, মেয়েগুলো যেনো পালিয়ে না যায়, এ জন্যে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে প্রহরীরা। আদতে, সৈনিকের চালে না ছোটার জন্যে ওদের বলতে বলতে মুখ ব্যথা করে ফেলছে তারা।

ওই ছুকরী! রেমরেমকে বলতে শুনলাম। এতো বড়ো বড়ো পা ফেলো না, শালী। বরঞ্চ ওই বিশাল পাছাটা একটু দোলাও! একটু আকর্ষণীয় ভঙিতে হাঁটো!

একটা চুমো দাও না, মরদ আমার! উত্তরে বললো কারনিত, তুমি যা চাও, তাই করবো তাহলে!

ধীরে ধীরে চড়ছে রৌদ্র। মরীচিকায় নাচতে শুরু করেছে সামনের পর্বতশ্রেণী। আমার দিকে ফিরলো ট্যানাস। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশ্রামের জন্যে থামবো আমরা। প্রত্যেকের জন্যে এক পাত্র করে

হে আমার উদার স্বামী, ওকে বাধা দিয়ে বললাম, আপনার বন্ধুরা চলে এসেছে। সামনে দেখুন!

পেছনে ফিরে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই পিঠে ঝোলানো ধনুকের ছিলোয় হাত বোলালো ট্যানাস। আহা, কী অপূর্ব!

ঠিক সেই মুহূর্তে পাহাড়ের সংকীর্ণ পেঁচানো ঢাল ধরে নামছিলাম আমরা। দুই পাশে খাড়া উঠে গেছে পাহাড়ের গা । আমাদের সামনের পথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন। সবার সামনে দাঁড়ানো লোকটা লম্বা অবয়বের, ভীষণ স্বাস্থ্যের মরুর বেদুইনের পোশাক পরনে, মুখ-মাথা অবশ্য খোলা। মিশমিশে কালো মুখাবয়বে গুটি বসন্তের বিচ্ছিরি দাগ ভরা, শকুনের ঠোঁটের মতো লম্বা নাক, এক চোখের কোটর হাঁ হয়ে চেয়ে আছে।

এক চোখা শয়তানটাকে চিনি আমি, নরম স্বরে জানালাম ট্যানাসকে। ওর নাম শুফতি। শ্রাইকদের সমস্ত নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য। ওর থেকে সাবধান। সিংহ এর তুলনায় কিছুই না!

কোনো কথা না বলে হাত উঁচিয়ে দেখালো ট্যানাস, ওর কাছে কোনো অস্ত্র নেই। এরপরে আমুদে স্বরে মুখ খুললো সে, তোমার দিনগুলো জেসমিনের সুবাসে ভরে উঠুক, হে দ্র-পথিক। পথ চলা শেষ হতে তোমার দরোজায় মিষ্টি একটা বউ অপেক্ষায় বসে আছে এই কামনাই করি।

তৃষ্ণ-ভূমি পাড়ি দেওয়ার সময়ে তোমার পানির থলে পরিপূর্ণ থাকুক, ঠাণ্ডা বাতাস আদরের পরশ বুলিয়ে দিক অভিবাদন জানাই। হেসে প্রত্যুত্তর করে শুফতি। চিতাবাঘের হাসি। দগদগ করছে একটা মাত্র চোখ।

তুমি অত্যন্ত সদয়, হে পথিক, ধন্যবাদ জানিয়ে ট্যানাস বলে, আমার আতিথেয়তা গ্রহণ করো, আমাদের দু জনের সামনেই দীর্ঘ পথ পরে আছে। খাবার পর এসো প্রার্থনা করি।

একটু কাজ বাকি আছে, আসিরীয় বন্ধু। সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়ালো শুফতি। নিরাপদে নীল নদের তীরে পৌঁছুতে হলে যে জিনিস তোমার লাগবে, ওটা এখন আমার কাছে যে। ছোট্ট একটা বস্তু বাড়িয়ে ধরে সে।

বাহু, কী অবাক কাণ্ড! স্বরে আমোদ ফুটিয়ে ট্যানাস বলে। তুমি কী জাদুকর নাকি হে? কি দিতে চাচ্ছ আমাকে?

পাখির পালক, তখনো হাসছে শুফতি। শ্রাইকের প্রতীক চিহ্ন।

যেনো বাচ্চাদের কোনো কথা পাত্তা না দিয়ে হাসলো ট্যানাসও। তো ঠিক আছে, ওটা দিয়ে দাও যার যার পথে চলে যাই আমরা।

উপহারের বদলে উপহার দিতে হয়। শুফতি বললো। তোমার বিশজন দাসী মেয়ে আমাকে দাও। এরপর, যখন মিশর থেকে ফিরে আসবে, বাকি আটজনের বিক্রির লাভের অর্ধেক দিতে হবে।

একটামাত্র পালকের বিনিময়ে? ঠোঁট উল্টালো ট্যানাস। এটা কোনো সওদা হলো?

এ কোনো সাধারণ পালক নয়। এটা শ্রাইকের পালক। মনে করিয়ে দিয়ে শুফতি বলে। এখনও কি ওই পাখির নাম শুনো নি তুমি?

দেখি, তোমার ওই পালকে কী আছে? ডান হাত বাড়িয়ে ধরে শুফতির উদ্দেশ্যে এগোয় ট্যানাস। সাথে সাথে ক্ৰাতাস, রেমরেম এবং আসতেস-ও এগোয়, যেনো ওরাও পালকটা পরীক্ষা করে দেখতে চাইছে।

নিমিষে শুফতির হাত আঁকড়ে ধরে মুচড়ে দুই কাঁধের মাঝখানে নিয়ে গেলো ট্যানাস। কঁকিয়ে উঠে মাটিকে বসে পড়লো সে, সহজে ধরে থাকলো ট্যানাস ওকে। ঠিক একই সময়ে ক্ৰাতাস এবং অন্যরা সামনে বেড়ে বাকি দু জনেরও একই হাল করে ফেললো। হাতের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ট্যানাসের সামনে হাজির করা হলো দুই দস্যুকে।

তো, তোমরা পুঁচকে পাখির দল আসিরীয়ার কারিককে ভয় দেখাতে চাচ্ছিলে? হুমম, পাখির পালকের সওদাগর, শ্রাইকদের কথা আমি শুনেছি। শুনেছি, কিচির-মিচির একটু বেশিই করে তারা, কাপুরুষের বাচ্চা একেকটা। শুফতির হাত ধরে একটা মোচড় লাগাতে যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠে সে, মুখ মাটিতে চেপে বসেছে। হ্যাঁ, শ্রাইকদের কথা আমি শুনেছি। কিন্তু, ভয়ঙ্কর কারিকের নাম শুনেছো তোমরা? ক্ৰাতাস কে মাথা নেড়ে ইশারা করে ট্যানাস। মুহূর্তেই তিন দস্যুকে একেবারে ন্যাংটো করে মাটির উপর হাত-পা ছড়িয়ে ফেলে রাখে তারা।

আমি চাই, তোমরা আমার নামটা মনে রাখো। এরপর যখনই এই নাম শুনবে, ভদ্র-পাখির মতো উড়ে পালাবে–কী বলেছি বুঝেছো? আবারো ক্রাতাসের উদ্দেশ্যে ইশারা করে ট্যানাস। দাসী ঠেঙানো চাবুকের ফিতে হাতে পেঁচিয়ে নেয় সে। মদ্দা জলহস্তির চামড়া থেকে তৈরি, এ অনেকটা র‍্যাসফারের চাবুকের প্রতিরূপ। ট্যানাস হাত বাড়িয়ে দিতে নিরাসক্তভাবে ওটা হাত-বদল করলো ক্ৰাতাস।

এতো দুঃখিত হয়ো না, দাস-সর্দার, ট্যানাস বললো তাকে। পরে সুযোগ পাবে। কিন্তু আসিরীয়ার কারিক প্রথমে আঁশ মিটিয়ে নিতে চায়।

বাতাসে সপাঙ করে চাবুক চালালো ট্যানাস। শুয়ে থাকা অবস্থাতেই চিৎকার করে উঠে শুফতি, এরপর ট্যানাসের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলে, তুমি পাগল হয়ে গেছে! আমি শ্রাইক বাহিনীর নেতা! আমার সাথে এ ধরনের আচরণের ফল ভালো হবে  ওর ন্যাংটো পাছা বসন্তের দাগে ভরা।

চাবুক উঁচিয়ে ধরে ট্যানাস, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নামিয়ে আনে ওটা। ঠিক আমার আঙুলের সমান একটা বেগুনি দাগ ফুটে উঠে শুফতির নগ্ন পাছায়। প্রচণ্ড ব্যথায় কোনো আওয়াজ বেড়োয় না তার মুখ দিয়ে, কেবল হিসহিস শব্দে বাতাস টানে। যন্ত্রণায় মোচড় খাচ্ছে শরীর। আবারো চাবুক চালায় ট্যানাস, নিপুণ দক্ষতার সাথে ঠিক আগের আঘাতের সমান্তরালে পড়ে এবারের আঘাতটা। ফাঁদে পড়া ষাঁড়ের মতো এবারে গর্জে উঠে শুফতি। বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে দারুন মনোযোগের সাথে আঘাতের পর আঘাত করে চললো ট্যানাস, যেনো কোনো মাদুর সেলাই করছে।

শেষমেষ যখন ক্ষান্ত দিলো সে, শিকারের নগ্ন পাছায় রক্তাক্ত খাল হয়ে গেছে অনেকগুলো। একটা আঘাত অপরটিকে ছোয় নি। এখন আর চিৎকার করতে পারছে

শুফতি। নোংরা জমিনে মুখ চেপে পরে আছে সে, নিঃশ্বাসের সাথে কেবল ধুলো উড়ছে। রেমরেম আর ক্ৰাতাস ছেড়ে দিতেও একটু নড়লো না সে, উঠে বসার কোনো লক্ষণও নেই।

চাবুকটা ক্রাতাসের হাতে দিয়ে দিলো ট্যানাস। পরের টা তোমার, দাস-সর্দার। দেখি, কেমন চিত্রকর্ম আঁকতে পারো তুমি।

প্রচণ্ড শক্তিতে শুরু করলো ক্ৰাতাস, কিন্তু তার আঘাতে ট্যানাসের অপূর্ব দক্ষতার প্রমাণ মিললো না। মুহূর্ত পরেই রক্তের চাদরে ঢাকা পড়ে গেলো বেচারা দস্যুর পেছনটা। বালুতে পড়ে মুক্তোর দানার মতো জ্বলতে লাগলো রক্তের ফোঁটা।

হাঁপাতে হাঁপাতে চাবুকটা আসতেসের হাতে দিয়ে দেয় ক্ৰাতাস, শেষ দস্যুর উপর প্রয়োগের জন্যে। মনে রাখার মতো কিছু উপহার ওকেও দিয়ে দাও।

ক্রাতাসের চেয়েও কর্কশ হলো আসতেস-এর অবদান। কাজ শেষ হতে সদ্য চামড়া খালাই করা গরুর মাংসের মতো দেখাতে লাগলো শেষ দস্যুর পেছনটা।

ক্যারাভান সামনে বাড়ার ইশারা করলো ট্যানাস এবারে। লাল পাথরের পাহাড়ের ওধারে, গিরিপথ হয়ে। তিন নগ্ন দস্যুর সামনে কিছু সময় দাঁড়ালাম আমরা।

শেষমেষ একটু নড়ে উঠে মুখ তুললো শুফতি। দ্রভাবে তাকে সম্বোধন করে ট্যানাস বললো, তো, বন্ধু, চলে যাওয়ার অনুমতি দিন তাহলে । আমার চেহারাটা মনে রাখুন, এবং এরপর দেখলে ত্রিসীমানায় থাকবেন না। শ্রাইকদের পালকটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে এবারে শুফতির কপালে ছোঁয়ালো সে। তোমার উপহারের জন্যে ধন্যবাদ। প্রার্থনা করি, আসছে রাতগুলো যেনো কোনো রমনীর কোলে কাটাতে পারো। এরপর আসিরীয় ভদ্রতায় সালাম জানিয়ে ক্যারাভানের পিছুপিছ চললো সে, পেছনে আমি।

শেষ চড়াইয়ের ওপারে হারিয়ে যাওয়ার আগে পিছন ফিরে তাকালাম আমি। একে অপরের সহায়তায় কোনো রকমে নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়েছে তিন দস্যু। এতোদূর থেকেও শুফতির মুখের ভাব সম্পূর্ণ বোঝা যায় ঘৃণায়, যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে আছে।

গিরিপথের পেরুলেই, নীল নদের এপাড়ের প্রত্যেকটি শ্ৰাইক এবারে আঁদা-জল খেয়ে আমাদের পেছনে লাগবে–এতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্ৰাতাস আর তার বর্বর সঙ্গীদের শুনিয়ে বললাম আমি। পাগলের মতো হেসে উঠলো তারা, নির্ঘাত এক জাহাজ-ভর্তি মদ কিংবা সুন্দরী মেয়ে উপহার হিসেবে পেলেও এতো খুশি হতো না।

*

গিরিপথের প্রান্ত হতে শেষবারের মতো নীল সমুদ্রের দিকে চাইলাম আমরা, এরপরে ঢালু পথ ধরে নেমে এলাম পাথর আর বালুর রাজ্যে। নীল নদ এবং আমাদের মাঝখানে এখন কেবল এই মরু।

যতোই সামনে এগুলাম, গরম যেনো ঝাঁপিয়ে পড়লো। প্রতিবার শ্বাস নেওয়ার সাথে সাথে নাক-মুখ দিয়ে ভেতরে ঢুকছে ভীষণ উত্তপ্ত বাম্প। চোরের মতো আমাদের শরীরের আর্দ্রতা শুষে নিতে চাইছে। পায়ের নিচের পাথুরে জমিন এতো গরম, ফোস্কা পড়ে গেলো চামড়ায়। দিনের বেলায় এগোনো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লো। তিয়ামাতের দেওয়া লিনেন তাবুর নিচে ধাওয়া খাওয়া কুকুরের মতো জিভ বের করে হাঁপাতে লাগলাম আমরা।

দিগন্তের আঁকা-বাঁকা পাহারশ্রেণীর নিচে সূর্য হারিয়ে যেতে আবার পথে নামলাম। চারপাশের মরু এমনই বৈরী, এমনকি নীল কুমির বাহিনীর সদস্যরা পর্যন্ত পর্যদস্ত। রাতে যেনো তারার মেলা বসে আকাশে, আমার অবস্থান থেকে পেছনের সাড়িতে ক্ৰাতাসকে পর্যন্ত পরিষ্কার দেখতে পেলাম আমি। অর্ধেক রাত জুড়ে এগিয়ে চললাম আমরা, অবশেষে বিশ্রামের জন্যে থামার আদেশ করলো ট্যানাস। এরপর আবারো সকাল পর্যন্ত ছুটলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত না সামনের দিগন্ত মরীচিকায় নাচতে শুরু করে দিলো। সম্পূর্ণ মৃত এই মরু, বেবুনের দল আর মাথার উপরে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘুরতে থাকা শকুনের দল ছাড়া আর কোনো প্রাণী আমার চোখে পড়ে নি। পানি মুখে তুলবার আগেই বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, এমন দাবদাহ এখানে। বাহিনীর সদস্যদের মেজাজেও প্রভাব পড়লো তার । একে অপরের প্রতি ক্রমশই অসহিষ্ণু হয়ে পড়তে লাগলাম আমরা।

শুফতি একটা ধূর্ত কুকুর, ট্যানাসকে বললাম। নিজের বাহিনীকে একত্র করে অপেক্ষায় থাকবে সে। গরমে আমরা ক্লান্ত হয়ে যাওয়া পর্যন্ত কিছুই করবে না।

যাত্রার পঞ্চম দিনে গালালা মরুদ্যানের সন্নিকটে পৌঁছে গেলাম আমরা। সামনের গাঢ় পাহাড়ের বুকে রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন সমাধির গোলকধাঁধা। বহু শতাব্দি আগে এই মরুদ্যানে ছিল বিশাল এক নগরী, কিন্তু ভূমিকম্পের ফলে ধসে পড়ে পাহাড়; বিলুপ্ত হয় সুপেয় পানির কুয়োগুলো। ক্রমে মরে যায় সেই শহর। ছাদহীন দেয়ালগুলো এখনো কালের সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এক সময় যেখানে ছিলো ধনী সওদাগরের হারেম, আজ সেখানে রোদ পোহায় মরুর সরীসৃপ।

পানির থলেগুলো পরিপূর্ণ করে নেওয়া আমাদের জন্যে অত্যন্ত জরুরি। মরে যাওয়া কুয়োগুলোর নিচে নেমে জল ভরে নিতে লাগলো ক্রাতাসের লোকেরা। আমি আর ট্যানাস মরা শহরটা ঘুরে দেখতে চললাম। বাতাস কেমন নিঃসঙ্গ, বিষণ্ণ এখানে। শহরের মাঝখানে দেবতা গালালার মন্দির আজো টিকে আছে। জায়গায় জায়গায় ধসে পড়েছে ছাদ, দেওয়ালও নেই বিভিন্ন স্থানে। পশ্চিম ধারের একমাত্র প্রবেশ পথটা অবশ্য এখনো দণ্ডায়মান।

কাজ হবে এটা দিয়ে, খাঁটি সৈনিকের চোখে জায়গাটার মাপ-জোক নিতে লাগলো ট্যানাস। ওর উদ্দেশ্য কী জানতে চাইলে হেসে মাথা নাড়লো সে। ওটা পরে শুনো। যুদ্ধ-মারপিট আমার কাজ।

মন্দিরের মাঝখানে যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে, তার ঠিক নিকটেই একপাল বেবুনের বেশ তাজা চিহ্ন রয়েছে। ওগুলো ট্যানাসকে দেখিয়ে বললাম, নির্ঘাত কুয়োর পানি খেতে আসে তারা।

সেই সন্ধায় প্রাচীন মন্দিরে আলো জ্বেলে বসেছিলাম আমরা, বেবুনের ডাক শুনতে পেলাম তখন ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরের চারপাশের পাহাড়শ্রেণীকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে কোনো বুড়ো মদ্দা। পাথরে লেগে প্রতিধ্বনি তুললো তার হুঙ্কার । আগুনের ওপাশে বসা ট্যানাসের উদ্দেশ্যে মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, তোমার দোস্ত শুফতি চলে এসেছে। ওর চরেরা এখন পাহাড়ের উপরে, দেখে নিচ্ছে আমাদের। বেবুনেরা ওদের দেখেই চেঁচামেচি করেছে।

আশা করি, ঠিক বলেছো তুমি। আমার প্রহরীরা বিদ্রোহের দাঁড়প্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছে। ওরা জানে, এ সবই তোমার পরিকল্পনা। যদি ভুল হয়, তবে তোমার কল্লা আর পশ্চাৎ দেশে ঝাল মেটাতে চাইলে কী যে করবো। পাশে, আগুনের ধারে বসা আসতেস-এর সাথে কথা বলতে উঠে গেলো ট্যানাস।

শত্রু কাছে-পিঠেই আছে–এ খবরে পুরো ভাব পাল্টে গেলো ক্যাম্পের । ঘুমোনোর মাদুরের নিচে লুকিয়ে রাখা তলোয়ারের ফলায় আদর করে হাত বোলাতে লাগলো মেয়ে-রূপী প্রহরীরা, চওড়া হাসি ঠোঁটে। কিন্তু স্বাভাবিক আচরণে কোনো পরিবর্তন এলো না কারো। ধীরে সবাই শুয়ে পড়লাম আমরা, নিভে গেলো আগুন। একজন প্রাণীও ঘুমোয় নি। থেকে থেকে কাশির শব্দ আসছে আমার চারপাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকা লোকগুলোর কাছ থেকে। লম্বা ঘণ্টাগুলো এক এক করে পেরিয়ে যেতে লাগলো। ভাঙা ছাতের মধ্যদিয়ে মাথার উপরের আকাশে তারার মেলা দেখলাম আমি, কোনো আক্রমণ এলো না কোথাও থেকে।

সূর্যোদয়ের ঠিক আগে শেষবারের মতো ক্যাম্পের প্রহরা পরীক্ষা করে নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার পথে আমার মাদুরের পাশে এসে ফিসফিসালো ট্যানাস। তোমার বন্ধু বেকুনেরা বোধহয় ভুল করেছে। তুমিও তাই।

শ্ৰাইকেরা এখানে। আমি গন্ধ পাচ্ছি। পুরো পাহাড়ে গিজগিজ করছে তারা। বললাম আমি।

তুমি আসলে নাস্তার সুবাস পাচ্ছ। ঘোৎ করে উঠে ট্যানাস। আমি পেটুক–এ কথাতে যে রাগ হই, বিলক্ষণ জানা আছে ওর। এহেন রসিকতায় কর্ণপাত করলাম না । কাছেই ধ্বংসাবশেষের কাছে চলে এলাম পেট খালি করতে।

জলবিয়োগ করতে বসেছি মাত্র, তীব্র-তীক্ষ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো একটা বেবুন রাতের শেষপ্রহরের শান্তি প্রায় বরবাদ হয়ে গেলো জানোয়ারটার চিৎকারে। শব্দের উৎস মুখে কান পাতলাম আমি, মৃদু প্রায় না-শোনার-মতো একটা আওয়াজ পেলাম। মনে হলো অসাবধানে কেউ হয়তো হাতের অস্ত্র বা ঢাল ফেলে দিয়েছে শক্ত পাথরে।

আপনমনেই হাসলাম আমি। ট্যানাসের কথা ভুল প্রমাণ করতে পারাটা আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার। মাদুরের উদ্দেশ্যে ফেরার সময় কাছের যোদ্ধাকে শুনিয়ে ফিসফিস করে বললাম, তৈরি থাকো। ওরা এসে গেছে! মুখে মুখে সবার কাছে পৌঁছে গেলো সতর্কবাণী।

মাথার উপরে ধীরে ফ্যাকাসে হয়ে এলো তারার আলো; চুপিচুপি চলে এলো সকাল ঠিক যেমন করে একদল হরিণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষুধার্ত সিংহী। হঠাৎ পশ্চিম ধারের প্রহরী শিষ দিয়ে উঠলে চাঞ্চল্য দেখা দিলো ক্যাম্পে। নিচু, জরুরি স্বরে ওদের সামলালো ক্ৰাতাস এবং তার অধীনস্থ যযাদ্ধারা। ধীরে! সাহসী যোদ্ধারা, ধীরে! নির্দেশ ভুলে যেও না। নিজের নিজের জায়গায় থাকো! নিজের মাদুর ছেড়ে উঠলো না কেউ।

ধীরে, মাথা কাপড়ে ঢাকা অবস্থাতেই ক্যাম্পের চারধারের পাহাড়ে চোখ বোলালাম আমি। যেখানেই তাকাই, একই দৃশ্য। আমাদের দিগন্ত ঢাকা পড়ে গেছে সশস্ত্র লোকেদের অবয়বে। জাল গুটোনোর মতো করে আস্তে আস্তে ঘিরে আসছে তারা।

এখন বুঝলাম, কেননা এতো দেরি করেছে শুফতি। এতোগুলো শয়তানকে একত্র করতে সময় লেগেছে তার। স্বল্প আলোতে সঠিক সংখ্যা হিসাব করা সম্ভব নয়, তবে কম করে হলেও এক হাজার বা তারো অধিক লোক আছে ওদের দলে। দশগুন বেশি আমাদের, ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার দশা হলো আমার। এমনকি, নীল কুমির বাহিনীর পক্ষেও এ বড্ড বেমানান যুদ্ধ।

চারপাশের পাথরখন্ডের মতোই অনড় দাঁড়িয়ে রইলো শ্রাইকেরা। ধীরে, আলো তীব্র হতে ভালোভাবে দেখতে পেলাম তাদের। দারুন সুশৃঙ্খল, কোনো উদ্দাম হুঙ্কার বা আস্ফালন নেই–অপেক্ষা করছে নেতার নির্দেশের। তামার বর্ম আর অস্ত্রে ঠিকরে পড়ছে সকালের প্রথম সূর্যরশ্মি। প্রত্যেকের মাথা মুখোশে ঢাকা। চোখের জায়গায় দুটো ফাঁক।

নীরবতা একেবারে অসহনীয় হয়ে উঠলো। এরপর গর্জে উঠলো একটা কণ্ঠস্বর, ভেঙে গেলো সকালের নিস্তব্ধতা। চারপাশের পাহাড়ের গায়ে লেগে প্রতিধ্বনিত হলো সেই গর্জন। কারিক! জেগে আছো?

মুখোশ থাকা সত্ত্বেও শুফতিকে চিনতে পারলাম। পশ্চিমধারের টিলার উপরে দাঁড়িয়ে সে, যেখান দিয়ে চলে গেছে রাস্তাটা। কারিক! আবারো ডাকলো সে। পণ দেওয়ার সময় এসে গেছে। কেবল এবারে পরিমাণটা একটু বেড়েছে। এখন সবকিছু চাই আমার! শুনেছো তুমি, সব কিছু!

মাদুর ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ট্যানাস, পশমের শালটা ছুঁড়ে ফেললো। সেক্ষেত্রে, নেমে এসে আমার কাছ থেকে ওটা নিয়ে যেতে হবে তোমাকে! পাল্টা গর্জে উঠে তলোয়ার আঁকড়ে ধরলো সে।

ডান হাত মাথার উপরে তুলে ধরলো শুফতি। রুপোর মুদ্রার মতো চকচক করছে তার চোখের শূন্য কোটর। ঝট করে হাতটা নামালো সে।

জমিনে থাকা যোদ্ধাদের একজন হুঙ্কার করে উঠে, শত শত অস্ত্র উদ্যত হয় আকাশ পানে। শুফতির ইশারায় ঢাল বেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসে তারা সংকীর্ণ গালালা উপত্যকায়।

মন্দিরের মাঝে অবস্থিত পাথুরে বেদীতে ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো ট্যানাস; অন্ধকার আর মাদকতার দেবতা বেস্-এর লম্বা একটা মূর্তি আছে সেখানে। ক্ৰাতাস আর তার যযাদ্ধারা যোগ দিলো তার সাথে। মাথা ঢেকে, মাদুরে শুয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগলাম আমি আর দাসী মেয়েগুলো।

একটা বেদীতে চড়ে এক হাঁটুর উপর ভর করে দাঁড়ালো ট্যানাস, বিশাল লানাটা ধনুকটা ঠিক করে নিচ্ছে। প্রায় সবটুকু শক্তি লাগলো ওটা টেনে নিতে, কিন্তু যখন সোজা হয়ে দাঁড়ালো সেচকচকে রুপোর ছিলাটা যেনো কথা বলে উঠলো। পিঠের থলে থেকে একটা তীর হাতে নেয় ট্যানাস; প্রধান দরোজার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। ওই পথ দিয়েই মন্দিরে ঢুকতে হবে শ্রাইকদের।

বেদীর নিচে, নিজের যোদ্ধাদের এক সারিতে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে ক্ৰাতাস। ধনুক হাতে ওরাও প্রধান দরোজার দিকে মুখ রেখে তৈরি। বেদীর চারধারে সংখ্যায় তারা একেবারে স্বল্প, গলায় কী যেনো একটা দলা পাকিয়ে গেলো আমার। এতোটাই বীরত্বপূর্ণ ছিলো তাদের অবদান, একটা কাব্য লিখবো ওদের নিয়ে সাথে সাথে ঠিক করে ফেললাম। কিন্তু প্রথম পংক্তি মনে আসার আগেই শয়তানদের প্রথম দলটা ভাঙা দরোজা গলে ঢুকে পড়লো, প্রচণ্ড হুঙ্কার ছাড়ছে সবাই।

শুরুতে কেবল পাঁচজনে উঠতে পারলো খাড়া সিঁড়িপথ বেয়ে, বেদীতে ট্যানাস যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে মাত্র চল্লিশ গজমতো দূরত্বে। প্রথম তীরটা ছুঁড়ে দিলো ট্যানাস। তিনজন পড়ে গেলো সাথে সাথে । প্রথম লোকটার বুক এঁফোড় ওফোড় হয়ে বেড়িয়ে গেলো তীরটা। পরের জনের গলা কুঁড়ে আটকে গেলো তৃতীয় জনের দেহে। চোখের কোটড়ে পুরো সেঁধিয়ে তবেই থামলো ওটা। প্রথম দু জন জট পাকিয়ে পরে গিয়ে পথ আটকে ফেললো। শেষপর্যন্ত বাঁধভাঙা বন্যার মতো ভেতরে ঢুকতে শুরু করলো তারা। ঝকের পর ঝাক তীর ছুঁড়ে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে লাগলো বেদীর চারপাশের ছোট্ট দলটা। নিহত-আহতদের এলোমেলো দেহ আরো সমস্যায় ফেললো পেছনের দস্যুদের।

কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে হবে না শত্রুরা সংখ্যায় এতো বেশি, একজন আহতের জায়গা নিলো দশজন বর্বর। কিছু সময়ের মধ্যেই মন্দিরের বেদী ঘিরে ফেললো তারা। এখন আর তীর চালানোর মতো দূরত্বে নেই কেউ, ট্যানাস আর অন্যরা এবারে তলোয়ার হাতে তুলে নেয়। হোরাস, আমাকে অস্ত্র দাও! রণহুঙ্কার ছাড়লো ট্যানাস, তার পাশের যোদ্ধারা সেই সুর ঠোঁটে তুলে নেয়। তামার সাথে তামার সংঘর্ষে আগুনের ফুলকি ছোটে, বেদীর চারপাশে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে শ্রাইকের দল। নারকীয় তলোয়ারবাজির প্রদর্শনীতে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে থাকে ট্যানাস আর তার যোদ্ধারা। শ্রাইকেরা ভীতু নয়, বেদীর চারধারে ফুঁসে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। একজন দ্বি-খণ্ডিত হয়ে যাওয়া মাত্র আরেকজন নির্ভয়ে তার জায়গা নিয়ে নিলো।

প্রবেশমুখে শুফতিকে দেখতে পেলাম আমি। মূল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একটু দূরে সরে সমানে উৎসাহ জুগিয়ে চলেছে সে। অন্ধ চোখের কোটরটা ধকধক জ্বলছে; চেঁচিয়ে সে বলছে, আসিরীয় শয়তানটাকে জীবিত চাই আমার। ধীরে ধীরে ওকে মারবো আমি!

মাথা ঢেকে, মাদুরে শুয়ে থাকা মেয়েগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে শ্রাইকের দল। ছোট্ট জায়গাটাতে এই মুহূর্তে এক হাজারের মতো দস্যু ঢুকে পড়েছে। তাদের পায়ের আঘাতে ওড়া ধুলোয় দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো, এক কোণার দিকে সরে গেলাম আমি।

একটা শয়তান লড়াই ছেড়ে ঝুঁকে এলো আমার উপর। এক ঝটকায় মুখের উপরে ফেলা শালটা ছুঁড়ে ফেলে চোখে চোখে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।

হে আইসিসের মা! শ্বাসের সাথে বললো সে, তুমি দারুন সুন্দর।

একটা কুৎসিত শয়তান ওটা, সামনের দাঁত নেই, ডান গালে বিচ্ছিরি কাটা দাগ। মুখ থেকে পঁচা নর্দমার গন্ধ বেরুচ্ছে। এই যুদ্ধটা শেষ হওয়ার অপেক্ষা কর, এরপর এমন কিছু দেববা তোকে, খু-উ-ব মজা পাবি! যেনো প্রতিজ্ঞা করলো সে। তারপর আমার মুখটা টেনে ধরে চুমু খেতে চাইলো ঠোঁটে।

সহজাত প্রতিক্রিয়ায় প্রথমটায় মুখ সরিয়ে নিতে চাইলাম আমি, কিন্তু শেষমেষ নিজেকে সামলে নিয়ে চুমুর প্রত্যুত্তর করতে উদ্যত হলাম। ইনটেফের সংস্পর্শে থেকে থেকে শরীরী কলা আমি কম শিখি নি, যে কোনো মানুষকে জাগিয়ে তুলতে পারি চুমো দিয়ে।

জায়গায় জমে গেলো বর্বরটা, এমন আদর সে কখনো পায় নি। ওই অবস্থাতেই, কাপড়ের ভেতর থেকে ছোরাটা বের করে শয়তানটার বুকের খাঁচায় সেঁধিয়ে দিলাম। ওর চিৎকার চাপা পড়ে গেলো আমার চুমুতে; যতক্ষণ পর্যন্ত না ছোরাটা হৃদপিণ্ডে গেঁথে গেলো, ভালোবাসার বাহুডোরে বেঁধে রাখলাম ব্যাটাকে। অবশেষে, ধীরে শিথিল হয়ে গেলো দেহটা, আমি ছেড়ে দিতে গড়িয়ে পরে গেলো একপাশে।

দ্রুত চারধারে চাইলাম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই বেদীর চারধারে দাঁড়ানো যোদ্ধাদের দেওয়ালে ফাটল ধরেছে। দু জন নিথর পড়ে আছে, আহত হয়েছে আমসেথ। বাম হাতে তলোয়ার চালাচ্ছে সে, রক্তাক্ত ডান হাত একেবারে অকেজো ।

স্বস্তির সাথে লক্ষ্য করলাম, এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে ট্যানাস। জংলী হাসিতে উন্মত্ত, নিপুণ ভঙ্গিতে তলোয়ার চালাচ্ছে। মনে হলো, ফাঁদটা কাজে লাগাতে একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছে সে। শ্রাইকদের পুরো দলটা এখন মন্দিরের ভেতরে, আহত চিতার চারপাশে হিংস্র কুকুরের মতো তড়পাচ্ছে তারা। আর কিছু সময়ের মধ্যে সবাইকে শেষ করে ফেলবে এরা।

আমার চোখের সামনে তলোয়ারের এক মারণ-খোঁচায় একটাকে নিকেশ করলো ট্যানাস। এরপর এক পা পিছিয়ে, গর্জে উঠলো সে, এদিকে! যোদ্ধারা!

সাথে সাথেই প্রতিটি দাসী মেয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় নিজেদের স্থান ছেড়ে। জবরজং পোশাক ছুঁড়ে ফেলে তলোয়ার বাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। আশ্চর্যান্বিত শ্ৰাইকেরা যেনো পঙ্গু হয়ে গেছে নীরবে চেয়ে থাকলো তারা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একশ বার তার বেশি বর্বর প্রাণ হারালো। অবশেষে যখন সামান্য প্রতিরোধে ব্যাপৃত হতে চাইলো তারা, পেছন থেকে ট্যানাস এবং তার ছোট্ট বাহিনী তেড়ে গেলো।

মৃত্যুভয়ে দারুন লড়লো শয়তানের দল। কিন্তু সংখ্যায় এতো বেশি পরিমাণে হওয়ার কারণে মুক্তভাবে অস্ত্র চালাতে পারছে না তারা। আর তাদের প্রতিপক্ষ সমগ্র মিশরের সেরা আশিজন সৈনিক।

কিছু সময়ের জন্যে টিকে থাকলো তারা। গোলমালের মাঝখান থেকে গর্জে উঠলো ট্যানাস; প্রথমটায় আমি ভাবলাম এ বুঝি কোনো নতুন নির্দেশ, কিন্তু এরপরেই বুঝলাম এ হলো রক্ষীবাহিনীর রণ-সংগীত। একশ বা তার অধিক কণ্ঠস্বর সেই সুর ঠোঁটে তুলে নেয় :

আমরা হোরাসের প্রশ্বাস,
মরুর বাতাসের মতো প্রচণ্ড;
শুষে খাই শত্রুর রক্ত–

গানের সাথে একতালে তলোয়ার চললো, যেনো অন্ধকার জগতের শয়তানের বিরুদ্ধে দেবতাদের মুগুর ওগুলো। এহেন আক্রমণের সামনে খড়কুটোর মতো উড়ে গেলো শ্রাইকদের প্রতিরোধ; যুদ্ধ নয়, শেষমেষ একপেশে নরহত্যার উৎসবে পরিণত হলো এই লড়াই।

বুনো কুকরের দল দ্বারা একপাল ভেড়াকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলতে দেখেছি আমি। এ যেনো তারচেয়ে খারাপ । অনেক শ্রাইক যোদ্ধা হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে হাঁটুর উপর দাঁড়িয়ে প্রাণ ভিক্ষা চাইলো। কিন্তু কোনো দয়া দেখানো হলো না তাদের প্রতি। বাকিরা দরোজা দিয়ে পালাতে চাইলো, কিন্তু ওখানে মোতায়েন প্রহরীরা কচুকাটা করে ফেললো তাদের।

এই উন্মত্ত লড়াইয়ের মধ্যে চিৎকার করে ট্যানাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলাম আমি। থামাও ওদের! বন্দী চাই আমরা!

আমার কথা তার কান পর্যন্ত পৌঁছুলো না, অথবা শুনেও না শোনার ভঙ্গি করলো ট্যানাস। হাসছে, গান গাইছে–একপাশে কাতাস, আরেকপাশে রেরেমকে নিয়ে শ্রাইকদের ছিঁড়ে ফেলছে সে। মরণাপন্ন শয়তানগুলোর রক্তে ভিজে গেছে মুখের দাড়ি, উন্মাদ চেহারায় লাল আস্তর জ্বলজ্বল করছে। হে মাতা হাপি, কী ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ ওর!

থামো, ট্যানাস! সবগুলোকে মেরো না! এইবারে আমার কথা তার কানে গেলো। ফিকে হয়ে এলো মুখের উন্মত্ততা, চকিতে সংযত করলো ট্যানাস নিজেকে।

প্রাণভিক্ষা চাইলে, ছেড়ে দাও! চিৎকার করে নির্দেশ দিলো সে। সঙ্গে সঙ্গে পালিত হলো সেটা। কিন্তু শেষমেষ, হাজার শ্রাইকের মধ্যে মাত্র দু শ জন মতো অবশিষ্ট থাকলো । রক্তাক্ত পাথুরে মেঝেতে হাঁটু-গেড়ে বসে প্রাণভিক্ষা চাইছে।

কয়েক মুহূর্তের জন্যে আচ্ছন্ন বোধ করলাম আমি। এরপরই, হঠাৎ চোখের কোণে অস্বাভাবিক নড়াচড়া ধরা পড়লো।

শুফতি বুঝে গেছে, মূল দরোজা দিয়ে এখান থেকে সে বেরুতে পারবে না; তলোয়ার বাগিয়ে ধরে পুবের দেওয়ালের উদ্দেশ্যে ছুটছে সে। আমার অবস্থা থেকে একদম কাছে। মন্দিরের ওই অংশের দেয়াল ধ্বসে বেশ বড়ো একটা ফাঁকা জায়গা সৃষ্টি হয়েছে। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে খাড়া ঢাল ধরে উঠলো শুফতি; প্রায় পৌঁছে গেছে দেওয়ালের উপরে । মনে হয়, কেবল আমি একাই দেখছি ওর এই পলায়ন প্রচেষ্টা। প্রহরীরা সবাই বন্দী নিয়ে ব্যস্ত, ট্যানাস নিজেও আমার দিকে পিছন ফিরে নির্দেশ দিয়ে চলেছে।

কোনো কিছু চিন্তা না করেই, একটা ভাঙা ইটের টুকরো তুলে নিলাম। ততক্ষণে দেওয়ালে চড়ে বসেছে শুফতি। শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে ছুঁড়লাম কাদা-মাটির ইটটা। শুফতির মাথার পেছনে এতো জোরে আঘাত করলো ওটা, হাঁটুর উপর পড়ে গেলো সে; পিছলে-এক গাদা ধুলো-ভস্ম নিয়ে গড়িয়ে আমার পায়ের কাছে এসে থামলো। ঝাঁপিয়ে শয়তানটার বুকে চড়ে বসলাম, আমার ছোরার ডগাটা ওর গলায় নিশানা করছি। একটা মাত্র চোখে ধুনে দৃষ্টি নিয়ে আমার চোখে চেয়ে রইলো শুফতি।

স্থির থাকো, সতর্ক করে দিয়ে বললাম তাকে। নাহলে হুঁড়ি গেলে দেবো।

গায়ের শাল, মাথার ঘোমটা সরে গেছে আমার; অবাধ্য চুল নেমে এসেছে কাঁধ পর্যন্ত। সাথে সাথেই আমাকে চিনে ফেললো শুফতি। ভিন্ন সময়ে বহুবার দেখা হয়েছিলো আমাদের।

টাইটা, সেই খোঁজাটা! কথা হারিয়ে ফেলেছে শয়তানটা। তোর মনিব ইনটেফ জানে, এগুলো করে বেড়াচ্ছিস?

খুব দ্রুতই জানবে, তাকে আশ্বস্ত করে ছোরার ডগা দিয়ে খোঁচালাম। কিন্তু তোর পক্ষে তার কোনো উপকারে আসা সম্ভব হবে না।

চিৎকার করে দু জন প্রহরী ডাকলাম আমি। মুখ চেপে ধরে তার হাত বাঁধালো তারা, এরপর টেনে নিয়ে চললো ট্যানাসের কাছে।

শুফতিকে ধরার দৃশ্য ট্যানাস দেখেছে, এখন দৌড়ে আমার কাছে এসে অভিবাদন জানালো সে, খুব দেখালে, টাইটা। কিছুই ভুলো নি দেখছি। এতো জোরে চাপড়ে দিলো পিছনটা, ব্যথায় চোখে জল চলে এলো আমার। প্রচুর কাজ পড়ে আছে তোমার জন্যে। আমাদের চারজন নেই, আর কমপক্ষে বারোজন ভীষণ আহত।

শয়তানগুলোর আস্তানার কি খবর? বললাম আমি। একদৃষ্টে চেয়ে রইলো ট্যানাস।

আস্তানা মানে?

নিশ্চই মরুর ফুলের মতো মাটির তলা থেকে হঠাৎ করেই এক হাজার শ্রাইক উদয় হয় নি, তাই না? নির্ঘাত ভারবাহী জম্ভ, দাস-দাসী আছে এদের। এখান থেকে খুব একটা দূরে হওয়ার কথা নয়। ওদের পালিয়ে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না। আজকের লড়াই-এর কেউ যেনো এই গল্প অন্যদের জানাতে না পারে। কারনাকে যেনো তোমার বেঁচে থাকার খবর না পৌঁছে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

হে প্রেমময়ী মিষ্টি আইসিস, তুমি ঠিকই বলেছো! কিন্তু কেমন করে তাদের আস্তানা খুঁজে পাবো? যুদ্ধের প্রচণ্ডতা এখনো আচ্ছন্ন করে রেখেছে ট্যানাসকে। মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমাকে ছাড়া যে কী হতো ওর!

আরে, চিহ্ন দেখে এগোও। অধৈৰ্য্য ভঙ্গিতে বললাম। এক হাজার জোড়া পায়ের ছাপ নিশ্চই হাওয়ায় মিলিয়ে যায় নি।

নিমিষে চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ট্যানাসের, মন্দিরের ও মাথায় দাঁড়ানো ক্ৰাতাসকে চেঁচিয়ে ডাকলো সে, পঞ্চাশজন যোদ্ধা নাও! টাইটার সাথে এগোও! ও পথ দেখিয়ে ব্যাটাদের ভেঁরায় নিয়ে যাবে। যাও । জলদি!

কিন্তু আহতরা প্রতিবাদ করে বললাম আমি। আজকের দিনের মতো অনেক মারপিট হয়েছে, এখন কিছুটা চিকিৎসাবিদ্যার অনুশীলন প্রয়োজন; কিন্তু আমার কথা উড়িয়ে দেয় ট্যানাস। আমাদের মধ্যে তুমি হলে সেরা পথ-পাঠক। আহতরা তোমার জন্যে অপেক্ষা করবে, আর আমার যোদ্ধারা হলো এক একটা ষড়–তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত মরবে না, দেখো!

*

যেমন বলেছিলাম, সহজেই খুঁজে পেলাম শয়তানগুলোর আস্তানা। ক্ৰাতাস আর তার পঞ্চাশ জন যোদ্ধা পিছুপিছু রইলো, পুরোনো শহরটা ঘুরে প্রথম পাহাড়শ্রেণীর পেছনে গিয়ে আবিষ্কার করলাম তাদের অবস্থানের চিহ্ন। এখান থেকেই জড়ো হয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। চিহ্ন অনুসরণ করে দুলকিচালে ছুটলো আমাদের দলটা, এক মাইলের কিছু কম দূরত্বে পেরিয়ে ছোট্ট একটা টিলার উপরে উঠতেই নিচের উপত্যকায় শ্রাইকদের ক্যাম্প দৃষ্টিগোচর হলো।

একেবারে হতচকিত হয়ে গেছে তারা। খচ্চর এবং মেয়েমানুষগুলোকে পাহাড়ার জন্যে কেবল জনা বিশেক লোক রয়েছে সেখানে। প্রথম চোটেই তাদের একেবারে পিষে ফেললো কাতাসের যোদ্ধারা। এবারে আর কোনো বন্দী যোগাড় করা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে। কেবলমাত্র মেয়েগুলো ক্ষমা পেলো; ক্যাম্পের দখল পেতেই বিজয়ীর প্রাপ্য পুরস্কার হিসেবে ওদের ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে গেলো।

এ ধরনের একটা দলের পক্ষে মেয়েগুলো বেশ সুন্দরী বলতে হয়। বেশ কিছু চোখে-পড়ার মতো মুখ রয়েছে। প্রায় স্বস্তির সঙ্গেই নিজেদের সমর্পণ করলো তারা। এমনকি দু একজনকে হাসি-তামাশায় মেতে উঠতেও দেখলাম। নিঃসন্দেহে অনাঘ্রাতা কুমারী নয় এরা, লজ্জাবতী মনে করাটা বোকামী। কাছের পাথুরে টিলার আড়ালে সদ্য বরণ করে নেওয়া মরদের সাথে ভালোবাসার খেলায় মত্ত হতে চলে গেলো ওরা।

পুরোনো চাঁদের পরে আসে নতুন চাঁদ, শীতের পর বসন্ত; নিজেদের হতাহত পুরোনো সঙ্গীদের জন্যে মেয়েগুলোর কারো মনে কোনো গভীর ব্যথা যে নেই–এ কথা বলে দিতে হয় না। হয়তো, নতুন এবং স্থিতিশীল সম্পর্কের সূচনার জন্যে মরুর বিস্তৃতির চেয়ে ভালো কোনো স্থান আর হতে পারে না।

নিজের কথা বললে, আমি বরঞ্চ খচ্চরগুলোর পিঠের বোঁচকা সম্বন্ধে বেশি কৌতূহলী। একশ পঞ্চাশটিরও বেশি খচ্চর আছে, একদম সুস্থ্য; কারনাক বা সাফাগা বন্দরে বেশ ভালো দামে বিকোবে ওগুলো। এ বিষয়ে ট্যানাসের সাথে কথা বলতে হবে, মনে মনে ঠিক করে নিলাম।

পরিত্যক্ত গালালা নগরে যখন ফিরে এলাম, সূর্য ততক্ষণে অস্তমিত হয়েছে। খচ্চরগুলোর পিঠে মাল-সামান, ওগুলোর পেছনে সদ্য হাতবদল হওয়া মেয়েদের দল। কুয়োর ধারে, ধসে পড়া একটা স্থাপনায় তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী হাসপাতাল। রাত পর্যন্ত ওখানেই পড়ে রইলাম আমি, মশালের আলোয় ক্ষত সেলাই করলাম আহত যোদ্ধাদের। অনেকের আঘাত অত্যন্ত মারাত্মক এবং ব্যথাদায়ক। যাই হোক, সকাল পর্যন্ত মাত্র একজন রোগী মারা গেলো। হাতের ছেঁড়া ধমনী থেকে রক্তপাতের কারণে মারা গেলো আমসেথ। লড়াইয়ের ঠিক পরপরই যদি ওকে দেখতে পারতাম, হয়তো বেঁচে যেতো সে। যদিও কাজটা ট্যানাসের কারণে করা হয় নি, অপরাধবোধের হাত থেকে রেহাই পেলাম না আমি। তবে আমার অন্যান্য রোগীদের সুস্থ্য হয়ে ওঠার ব্যাপারে আমি জোর আশাবাদী। এরা সবাই শক্ত তরুণ, সহজে কাবু হয় না।

শ্রাইকদের মধ্যে আহত কেউ নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছে তাদের কাটা মুণ্ডু। আহত শত্রুদের নিকেশ করে ফেলার এই চিরন্তন রীতিতে আমি বিশ্বাসী নই; কিন্তু এর পক্ষে যুক্তি আছে বৈকি। এদের সেবা-পথ্যে নিজেদের মূল্যবান সম্পদ নষ্ট করার কোনো মানে হয় না, এমন তো নয় যে, কোনোদিন এরা দাস হিসেবে কাজ করে খেতে পারবে। আবার, সুস্থ্য যদি হয়ে উঠে, একদিন হয়তো এদের বিরুদ্ধেই লড়তে হতে পারে, তাই না?

দুই এক চুমুক মদ আর সামান্য এক গ্রাস আহার ছাড়া কিছু মুখে তুললাম না সেই রাতে। কিন্তু রাত শেষ হতেও বিশ্রাম মিললো না। আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ট্যানাস ডেকে পাঠালো আমাকে।

*

বন্দীরা সবাই দেবতা বেস্-এর মন্দিরে আটক রয়েছে, দুই কবজি পিছমোড়া করে বাঁধা প্রত্যেকের, উত্তর ধারের দেওয়াল ঘেঁসে এক সারিতে দাঁড়ানো। প্রহরীরা সতর্ক নজর রাখছে তাদের উপর ।

মন্দিরে ঢুকতেই ট্যানাস ডেকে নিলো আমাকে। তখনো আসিরীয় বধূর পোশাক পরনে, লম্বা ঘাগড়া উঁচু করে ধরে যুদ্ধের আবর্জনা ডিঙিয়ে এগুলাম।

শ্রাইকদের তেরোটি বাহিনী আছে, তাই তো বলেছিলো তুমি, তাই না টাইটা? ট্যানাসের প্রশ্নের উত্তরে মাথা কঁকিয়ে সায় দিলাম আমি। প্রতিটি বাহিনীর নিজস্ব নেতা আছে। এখন তো শুফতি আমাদের হাতে। দ্যাখো, এই ভদ্রলোকেদের মধ্যে আর কোনো নেতা আছেন কি না। মুচকি হেসে বন্দীদের দিকে ইশারায় দেখালো ট্যানাস। হাত ধরে টেনে নিয়ে দাঁড় করালো সারিবদ্ধ মানুষগুলোর সামনে।

মুখ ঢেকে রাখলাম আমি, পাছে এদের মধ্যে কেউ চিনে ফেলে আমাকে। প্রতিটি মুখের দিকে তাকিয়ে দু জনকে চিনতে পারলাম। আখেকু ছিলো দক্ষিণের শ্রাইকদের প্রধান; আসূন, গজ-দ্বীপ এবং প্রথম জলপ্রপাতের চারপাশের এলাকায় রাজত্ব তার। অপরদিকে, সেতেক হলো আরো উত্তরের কম-ওষো বাহিনীর নেতা।

স্বল্পতম সময়ের মধ্যে যাকে সামনে পেয়েছে, যোগাড় করে এনেছিলো শুফতি। প্রায় সব বাহিনীর প্রতিনিধিই আছে আমাদের বন্দীদের মধ্যে। কাঁধে টোকা দিয়ে যখন নেতা দুজনকে চিহ্নিত করলাম, সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের।

সারির শেষে পৌঁছুতে ট্যানাস জানতে চাইলো, তুমি নিশ্চিত, আর কেউ নেই?

কেমন করে বলি? আমি তো আর সব নেতাদের চিনি না।

কাঁধ ঝাঁকায় ট্যানাস। একবারে তো আর সব পাখি ধরা সম্ভব নয়। এতো তাড়াতাড়ি যে তিনজনকে ধরেছি, তাতেই আসলে নিজেদের ভাগ্যবান মনে করা উচিত। চলো, ব্যাটাদের সাথে একটু গল্প-সস্লো করি, কে জানে, অন্যদের খোঁজ মিলেও যেতে পারে।

মন্দিরের ধাপে বসে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম আমরা। রক্ত-চর্চিত চুলের মুঠি ধরে নিহত সমস্ত শ্রাইকের কাটা মুণ্ডু একে একে তুলে ধরা হলো আমাদের সম্মুখে; ঝুলে-পড়া ঠোঁটের ফাঁক থেকে বেরিয়ে পড়েছে জিভ, নিপ্রাণ চোখের মণিতে মিহি বালুকণা ।

আমার ক্ষুধা আগের মতোই রইলো, গত কয়েকদিনে তেমন কিছু পেটে পড়েনি। তিয়ামাতের দেওয়া সুস্বাদু পিঠে, ফল-মূল গোগ্রাসে খেয়ে চললাম। পরিচিত কোনো চেহারা দেখলে চিহ্নিত করছি। কাটা মাথা থেকে কেবল আর একজন নেতাকে চিনতে পারলাম কেয়েনার নেফার-তেমু।

তো, চারজন হলো তাহলে, সন্তুষ্টি ধ্বনিত হলো ট্যানাসের কণ্ঠে। গালালা কুয়োর সামনে কাটা মুণ্ডু দিয়ে পিরামিড তৈরি করা হচ্ছে, নেফার-তেমুর মাথাটা সবার উপরে রাখা হলো।

বাকি নয়জন নেতাকেও খুঁজে পেতে হবে। আমাদের বন্দীরা এই বিষয়ে কী বলতে পারে, এসো দেখি। ঝট করে দাঁড়িয়ে পরে ট্যানাস। নাস্তার বাকি অংশ জোর করে মুখে পুরে নিরাসক্তভাবে ওর পিছু পিছু বেস্-এর মন্দিরে চললাম আমি।

শ্ৰাইক দস্যুদের ভেতরে নিজেদের চর ঢুকিয়ে দেওয়ার বুদ্ধি আমিই দিয়েছিলাম ট্যানাসকে, কেমন করে করতে হবে কাজটা তাও শিখিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বুদ্ধি দেওয়া এক কথা, আর কাজে বাস্তবায়ন করে দেখানো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার।

মিনমিন করে বলতে চাইলাম, অসুস্থ লোকেদের প্রয়োজন আমাকে, কিন্তু সানন্দ চিত্তে আমার কথা উড়িয়ে দেয় ট্যানাস। চালিয়াতি করে লাভ নেই, টাইটা। শয়তানগুলোর সওয়াল-জওয়াব-এর সময় তুমি অবশ্যই আমার পাশে থাকবে।

প্রশ্নোত্তর পর্বটা দ্রুত এবং নির্দয় হলো, নিঃসন্দেহে যে ধরনের লোক এরা এর চেয়ে ভালো কিছু হওয়ার নয়।

প্রথমটায় বেস্-এর উঁচু পাথুরে বেদীতে গিয়ে দাঁড়ালো ট্যানাস, হাতে বাজপাখির প্রতীক নিয়ে ক্রুর হাসিতে তাকালো নিচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো বন্দীদের দিকে। তপ্ত সূর্য প্রখর তাপ বিলিয়ে চলেছে।

আমি ফারাও মামোসের বাজপাখির প্রতীক বাহক, এবং স্বয়ং তার পক্ষ থেকে বলছি, নির্মম কণ্ঠে বললো সে। আমিই তোমাদের বিচারক, আমিই জল্লাদ। একটু থেমে, সবার মুখে চোখ বুলিয়ে নেয় ট্যানাস। চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলো শ্ৰাইক দস্যুরা। কারো সাহস নেই, ওই তীব্র দৃষ্টিকে অবজ্ঞা করে।

ডাকাতি এবং হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত তোমরা। যদি এমন কেউ থাকো, যে মনে করে সে নির্দোষ সামনে এসে দাঁড়াও।

অপেক্ষা করে আছে ট্যানাস। মাথার উপরে উড়ে-চলা শকুনের ছায়া খেলা করতে লাগলো ধুলোময় মন্দির প্রাঙ্গনে। এগিয়ে এসো! বলো, কে নির্দোষ। উপরে তাকিয়ে চক্রাকারে উড়ে-চলা শকুনের ঋকের দিকে তাকালো সে। ভোজের জন্যে অধীর হয়ে আছে তোমাদের দোস্তেরা। ওদের অপেক্ষা করিয়ে রেখে কি লাভ?

এখনো, কেউ নড়লো না। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। বাজপাখির প্রতীক নামিয়ে রাখলো ট্যানাস। তোমাদের কীর্তির কথা আমরা সবাই জানি। এই নীরবতা তারই প্রমাণ। তোমরা প্রত্যেকে দোষী। ফারাও-এর পক্ষ থেকে সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম আমি। মাথা কেটে ফেলা হোক এদের। ক্যারাভান চলাচলের পথে সাজিয়ে রাখা হবে সেই সব মুণ্ডু। সমস্ত অপরাধীরা ওই পথে যাওয়ার সময় যেনো দেখতে পায়, ঈগলের দেখা পেয়েছে শ্রাইক পাখি। তারা জানুক, এই দেশ থেকে আইনহীনতার কাল শেষ হয়েছে। শান্তি ফিরে এসেছে আমাদের এই মিশরে। আমি ঘোষণা করলাম, ফারাও মামোসের পক্ষ থেকে।

সে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিতে প্রথম বন্দীকে টেনে-হিঁচড়ে বেদীর সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। হাঁটুর উপর ভর করে মাথা নামানো হলো।

তিনটি প্রশ্নের সত্যি জবাব দিলে প্রাণে বেঁচে যাবে। আমার বাহিনীতে একজন চর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে তোমাকে। বেতনও পাবে। আর, উত্তর না দিলে সাথে সাথে পালিত হবে মৃত্যুদণ্ড। কঠোর স্বরে বললো ট্যানাস।

হাঁটু-গেড়ে থাকা বন্দীর উদ্দেশ্যে এবারে তীক্ষ্ণ চোখে চাইলো সে। এই হলো তোমার প্রথম প্রশ্ন কোন্ বাহিনীর লোক তুমি?

অভিযুক্ত ব্যক্তি কোনো উত্তর করলো না। শ্রাইকদের রক্ত-শপথ বড়ো কঠিন।

দ্বিতীয় প্রশ্ন তোমার নেতা কে? এবারেও কোনো উত্তর দিলো না শ্রাইক-দস্যু।

তৃতীয় এবং শেষ প্রশ্ন। তোমার বাহিনী যেখানে লুকিয়ে আছে, সেই গোপন আস্তানায় নিয়ে যাবে আমাকে? এবারে, ট্যানাসের পানে তাকায় আসামী । কেশে, এক দলা থুতু ছুঁড়ে মারে। তলোয়ার হাতে দাঁড়ানো যোদ্ধার উদ্দেশ্যে মাথা নাড়ে ট্যানাস।

তলোয়ারের এক কোপে পরিষ্কারভাবে কেটে যায় মাথাটা। বেদীর সামনে, মন্দিরের সিঁড়ির ধাপে আওয়াজ তুলে। পিরামিডের জন্যে আরো একটা মাথা পাওয়া গেলো। শান্তভাবে বলে, পরের বন্দীর উদ্দেশ্যে ইশারা করলো ট্যানাস।

একই প্রশ্ন করা হলো একেও, কিন্তু সেই একরোখা ভঙ্গিতে নিশ্চুপ রইলো এ জনও। মাথা নেড়ে সায় দেয় ট্যানাস। কিন্তু এবারের কোপটা একটু কেঁপে যাওয়ায় অর্ধেক কাটা পড়লো মাথাটা। দুই তিন কোপ লাগলো পুরোটা আলাদা করতে।

তেইশটি মাথা পড়লো একে একে। আবেগ লুকিয়ে রাখতে গুনে চললাম আমি। অবশেষে, একটা দস্য-শ্ৰাইক ভাঙলো। একবারেই অল্প বয়স তার, বালকই বলা যায়। ট্যানাস প্রশ্ন করার আগেই কাঁপা-কাঁপা স্বরে বলে উঠলো, আমার নাম হুই। আমি বাস্তি র আপন ভাই, তার দলে কাজ করি। ওদের গোপন আস্তানা চিনি, আমি আপনাকে নিয়ে যাবো সেখানে। দারুন সন্তুষ্টির হাসি হাসলো ট্যানাস, ইশারায় একধারে নিয়ে যেতে বললো ছেলেটাকে। ওর যত্ন নাও। প্রহরীদের উদ্দেশ্যে বললো সে, এখন থেকে এই ছেলে নীল কুমির বাহিনীর সদস্য, তোমাদের সতীর্থ।

একজন ভেঙে পড়তে বাকিরা আর বাধা হয়ে দাঁড়ালো না। তবে কেউ কেউ তখনো ঘাড় ত্যাড়ামো চালিয়ে গেলো। কেউ গাল বকলো, কেউ বা উপহাসের হাসি হাসলো উত্তর হিসেবে তরবারির ধারালো ফলায় কল্লা হারালো তারা। রক্তের ফোয়ারায় ধুয়ে গেলো তাদের শেষ শয়তানী।

যে লোকগুলো এমন কাপুরুষোচিত জীবন-যাপনের পরও শেষমুহূর্ত পর্যন্ত মৃত্যুকে হাসি মুখে বরণ করে নিলো, তাদের প্রতি কেমন একটা টান অনুভব করলাম। আমি জানি, এ কখনো আমার দ্বারা সম্ভব হতো না। সুযোগ পেলে, দুর্বল বন্দীগুলোর মতো আমিও প্রশ্নের উত্তর দিয়ে প্রাণে বাঁচতে চাইতাম।

আমি উর বাহিনীর সদস্য, স্বীকার গেলো আরেকজন।

আমি মা-এন-তে এর লোক, এলো বারগা পর্যন্ত পশ্চিম তীরের সবটুকু তার দখলে, আরেকজন বললো। বাদবাকি সমস্ত দস্যু-সর্দারের গোপন আস্তানার খবর এক এক করে পেলাম আমরা। ওদিকে, কাঁধ সমান উঁচু হলো কাটা মুণ্ডুর স্তূপ। দেওয়ালের ধারে, পিরামিডে যোগ করা হবে ওগুলো।

*

একটা ব্যাপারে আমি এবং ট্যানাস একমত, যে দস্য-নেতাদের আমরা ধরেছি, এবং যে সমস্ত শ্ৰাইক মুখ খুলেছে এদের খুব নিরাপদে সরিয়ে রাখতে হবে। শাইকদের হাত এতো লম্বা আমাদের এই মিশরে, কোথাও আসলে নিরাপদ নয় এরা। আকহ্ সেথ্‌ অতি-অবশ্যই এদের নাগাল পেয়ে যাবে । হয় ঘুষ দিয়ে না হয় ভয়-ভীতি দেখিয়ে অথবা বিষপ্রয়োগে হত্যার মাধ্যমে এদের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেবে আকহ্ সেথ। সে হলো এক অক্টোপাসের মতো, যার মাথা লুকোনো কিন্তু শুড় পৌঁছেছে আমাদের শাসন-ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কেউ চেনে না তাকে, সমগ্র শ্রাইক বাহিনীর একচ্ছত্র অধিপতি হলো এই আকহ্ সেথ।

এই সময়ে হঠাৎ করেই সাফাগার বণিক তিয়ামাতের কথা মনে এলো আমার।

এবারে আর মেয়েদের ছদ্মবেশে নয়, সৈনিক হিসেবে ছুটে লোহিতসাগর তীরে অবস্থিত এই বন্দরে পৌঁছলাম। গালালা পৌঁছুতে যে সময় লেগেছিলো, তার অর্ধেকও লাগলো না ফিরে আসতে। বন্দরে ভীড়ানো তিয়ামাতের সওদাগরী নৌকায় তুলে দেওয়া হলো আমাদের বন্দীদের, সাথে সাথেই আরবীয় ভূখণ্ডের উদ্দেশ্যে পাল তুললো সেটা। নিজস্ব একটা দাসখানা আছে সেখানে তিয়ামাতের; জেজ বাকোয়ান নামের ছোট্ট একটা দ্বীপে। তিয়ামাত আমাদের আশ্বস্ত করে জানালো, কারো সাহস নেই সেখান থেকে পালিয়ে আসে। দ্বীপের চারধারের পানিতে গিজগিজ করছে ক্ষুধার্ত হাঙরের পাল।

কেবল একজন বন্দীকে দ্বীপে পাঠাই নি আমরা। সে হলো নিষ্ঠুর-বাস্তির দলের সদস্য হুই। সাফাগা আসার পথে পুরোটা রাস্তা ওকে সঙ্গে রেখেছিলো ট্যানাস, এখন তার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে গেছে তরুণ ছেলেটা। বাধ্যগত দাস, সে এখন।

ট্যানাসের ব্যক্তিত্বের জাদুতে যা যা জানে, সব বলে দিয়েছে হুই। লেখার সরঞ্জাম তৈরি রেখে সবকিছু শুনে গেলাম আমি, ট্যানাসের প্রশ্নের উত্তরে যা যা বললো ছেলেটা- সব লিখে রাখলাম।

জানা গেলো, বাস্তির মূল আস্তানা হলো জেবেল-উম-বাহারি র অভিশপ্ত মরুতে, চ্যাপ্টা-মাথা পর্বতগুলোর একটার উপরে । চারপাশে খাড়া ঢাল দিয়ে সুরক্ষিত। নীল নদের পূর্ব কোণ থেকে মাত্র দুই দিনের পথ, ক্যারাভান রাস্তা ঘেঁসে দারুন চমৎকার অবস্থানে।

মাত্র একটা পথ আছে ওখানে পৌঁছানোর, পাথরের ভেতর দিয়ে সিঁড়ির মতো উঠে গেছে। একবারে মাত্র একজন উঠতে পারবে, এতো সরু। হুই জানালো।

আর কোনো রাস্তা নেই চুড়োয় পৌঁছানোর? ট্যানাস প্রশ্ন করে। দাঁত বের করে হাসে হুই, ষড়ন্ত্রির মতো নাকের একপাশে ইশারা করে।

আর একটা পথ আছে। নিজের অবস্থান ছেড়ে একটা মেয়ের সাথে দেখা করতে ওই রাস্তাটা অনেকবার ব্যবহার করেছি আমি। বাস্তি যদি জানতো, পাহাড়া ছেড়ে অন্য কোথাও গেছি নির্ঘাত মেরে ফেলতো আমাকে। খুবই বিপদজনক, খাড়া পথ। কিন্তু শক্ত-সমর্থ বারোজন যোদ্ধার জন্যে কিছুই না। ওরা উপরে উঠে গেলে, মূল রাস্তা দিয়ে বাকিরা আক্রমণ করতে পারবে। আমি তোমাকে ওই পথ দেখাবো, আকহ্ হোরাস।

সেই প্রথম ওই নাম শুনেছিলাম আমি। আকহ্ হোরাস হোরাসের ভ্রাতা। ট্যানাসের জন্যে উপযুক্ত নাম। সে দেখতেও দেবতাদের মতো, লড়েও তাদেরই মতো

আর যুদ্ধের ময়দানে বহুবার হোরাসের নাম নিয়েছে সে। তো, যুক্তি আছে বৈকি! ট্যানাসকে হোরাসের ভাই বলতেই পারে তারা।

আকহ্ হোরাস! পরবর্তিতে এই নাম সমগ্র মিশরে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো। এক পাহাড় থেকে অপর পাহাড়ে ধ্বনিত হয়েছিলো, ক্যারাভান রাস্তা ধরে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলো আহ্ হোরাসের সুখ্যাতি। নদীপথের প্রতিটি মাঝির ঠোঁটে ছিলো এই নাম, নগরে-নগরে, রাজ্যের পর রাজ্যে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছেছিলো ওই। প্রতিটি গল্পে একটু করে রঙ চড়তে চড়তে শেষপর্যন্ত কিংবদন্তি বনে গিয়েছিলো আকহ্-হোরাস।

সে ছিলো, শ্রাইকদের অধিনায়ক-–শয়তান আকহ্-সেথ এর বিরুদ্ধে ভালো-মন্দের চিরকালীন যুদ্ধে হোরাসের প্রতিনিধিতাঁরই আপন ভাই।

আকহ্-হোরাস! যতোবার এই নাম নিতে মিশরের লোকেরা, নতুন আশায় বুক বাঁধতো তারা।

এ সবই ভবিষ্যতের কথা। এখন, তিয়ামতের বাগানে বসে কথা বলছিলাম আমরা। আমি জানি, জেবেল-উম-বাহারি মরুতে গিয়ে বাস্তির টুটি চেপে ধরতে কী রকম উদ্বেল হয়ে আছে ট্যানাস। ব্যক্তিগত একটা লেনাদেনা আছে ট্যানাসের, শয়তানটার সাথে।

আমার কাছ থেকে সে জেনেছে, তার বাবা পিয়াংকি, প্রভু হেরাবকে ধ্বংস করার জন্যে এই বাস্তির সহায়তা নিয়েছিলো আকহ্-সেথ্‌ ।

জেবেল-উম-বাহারি র পর্বতের ঢালে নিয়ে যাবো আমি, হুই বললো, বাস্তিকে আপনার হাতে তুলে দেবো।

অন্ধকারে নিশ্চুপ বসে রইলো ট্যানাস। তিয়ামাতের বাগানের নাইটিঙ্গেল পাখির গান নেশা ধরিয়ে দেয়। নোংরা, কদর্য দুনিয়ায় কেমন অপার্থিব শোনায় সেই আওয়াজ। কিছু সময় পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো ট্যানাস।

ভালো কাজ দেখিয়েছো, হুইকে বলে সে, আমার জন্যে কাজ করো, পুরস্কার পাবে। ঠিক একজন দেবতাকে সম্মান প্রদর্শনের মতো ওর পায়ে পড়ে হুই। পায়ের অধৈৰ্য্য খোঁচায় তাকে সরিয়ে দেয় ট্যানাস। অনেক হয়েছে তামাশা! এখন ভাগো, যাও!

নিজের হঠাৎ-দেবত্বে একদম খুশি নয় ট্যানাস। জীবনেও ফারাও কিংবা স্বর্গীয় কিছু হওয়ার কথা মনে স্থান দেয় নি সে। নিজের অবস্থান সম্পর্কে সব সময় সচেতন ছিলো।

ছেলেটা চলে যেতে, আমার উদ্দেশ্যে ফিরলো ট্যানাস। অনেক রাত একা জেগে বাবা সম্পর্কে তোমার বলা কথাগুলো নিয়ে ভেবেছি আমি। যে তাকে এমন হেনস্তা করেছে, শেষমেষ জীবন কেড়ে নিয়েছে তাকে শেষ করতে না পারলে শান্তি নেই আমার। আকহ্ সেথকে ধরার জন্যে যে চতুর পরিকল্পনা তুমি করেছো, ওটা আর এগিয়ে নিতে ইচ্ছে হয় না। বরঞ্চ, সোজাসুজি লড়াইয়ে ওর হৃদপিণ্ডটা ছিঁড়ে আনতে চাই আমি।

ও রকম করলে, সব হারাবে। বললাম। ভালো করেই জানো সেটা। আমি যেমন পরিকল্পনা করেছি, তেমন করে কাজ করো নিজের সম্মান তো ফেরত পাবেই, বাপের মৃত্যুর বদলাও নিতে পারবে। এইভাবে তোমার থেকে কেড়ে নেওয়া সম্পদ, ভাগ্য সবই ফেরত পাবে। শুধু যে প্রতিশোধ নেওয়া হবে, তাই নয়, বরঞ্চ এতে করে লসট্রিসের কাছেও ফিরে যেতে পারবে; আমন রা র ধাঁধায় আমার দেখা স্বপ্ন তাহলে সত্যি হবে। বিশ্বাস করো আমাকে। নিজের জন্য, আমার কর্ত্রীর সুখের জন্যে দয়া করে আমার উপর ভরসা রাখো।

তোমাকে বিশ্বাস না করলে কাকে করবো? বলে, আমার বাহুতে হাত ছোঁয়ালো ট্যানাস। আমি জানি, ঠিক বলছো তুমি। সব সময়ই ধৈৰ্য্য কম আমার ।

অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও মাথা থেকে বের করে দাও আকহ্-সেথকে। কেবল পরবর্তী ধাপের কথা চিন্তা করো। বাস্তিকে কজা করতে হবে আগে। পুব থেকে আসা সমস্ত ক্যারভান ও-ই লুটপাট করেছিলো তোমার বাবার গুলোও। পর পর পাঁচ মৌসুম প্রভু হেরাবের কোনো ক্যারাভান কারনাকে পৌঁছেনি। সেস্ত্রা-তে তোমার বাবার তামার খনিগুলো পর্যন্ত ধ্বংস করেছে বাস্তি। প্রকৌশলীদের খুন করেছে। নীল নদের তীরে তার সম্পদ নষ্ট করেছে। সমস্ত দাসদের মেরেছে। ফসল জ্বালিয়ে দিয়েছে।

এ সবই সত্যি; কিন্তু তাকে নির্দেশ তো দিতো আকহ সেথ।

কেউ তা বিশ্বাস করবে না, এমনকি ফারাও পর্যন্ত না; যতক্ষণ না বাস্তি নিজ মুখে স্বীকার করছে, অধৈৰ্য্য ভঙ্গিতে বললাম। একরোখা আচরণ করে কী লাভ? বহুবার এই নিয়ে কথা বলেছি আমরা। প্রথমে, বাহিনীর নেতারা; সবশেষে সাপের মাথা-আকহ্ সেন্থ।

জানি, ঠিক বলছো। কিন্তু অপেক্ষা করতে ইচ্ছে হয় না। নিজের উপর বর্তানো দেশদ্রোহীর খেতাব মুছে ফেলতে চাই আমি, আর আর–ওহ্, লসট্রিসকে চাই আমি!

ঝুঁকে পড়ে আমার কাঁধে চেপে ধরে সে। এখানে তোমার কাজ শেষ, বুড়ো বন্ধু। তোমাকে ছাড়া এসব সম্ভব হতো না। তুমি না এলে, এখনো মদে ডুবে থাকতাম। পরে থাকতাম কোনো নোংরা বেশ্যাকে নিয়ে। তোমার ঋণ শোধ হওয়ার নয়, কিন্তু এখন তোমাকে যেতে হবে। অন্য কারো প্রয়োজন তোমাকে। বাস্তি আমার, আর কেউ তাকে ছুঁতেও পারবে না। জেবেল-উম-বাহারি মরুতে তুমি আসছো না আমাদের সাথে। যেখানে তোমার থাকা উচিত আমারও থাকার কথা, কিন্তু যেতে পারি না-ওখানে ফিরে যাও; লসট্রিসের পাশে।

আমার ওজোর-আপত্তি, প্রতিবাদে কোনো কাজ হলো না। একবার যখন মন ঠিক করে ফেলেছে ট্যানাস, তখন ওকে আর কিছু বলে লাভ হবে না ।

একটা কথা ঠিকই বলেছে ট্যানাস–এই মুহূর্তে আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে এখানে। আমি কোনো যোদ্ধা নই। তবে সাথে সাথেই চলে গেলে, আমার সম্পর্কে খারাপ ধারণা হতে পারে সবার।

শেষমেষ, নিজের ভেতরের উচ্ছ্বাস গোপন করে গজ-দ্বীপে ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করলাম।

*

জেবেল-উম-বাহারি মরুতে অভিযানের জন্যে লোকবল এবং রসদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ক্ৰাতাসকে কারনাকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্যানাস। তার পাহাড়ায় অন্তত কারনাক পর্যন্ত যেতে পারবো আমি। এদিকে, ট্যানাসের থেকে বিদায় নেওয়াটা বিশেষ ঝক্কি হয়ে দাঁড়ালো। দু বার তিয়ামাতের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে বেরুতে পিছন থেকে ডেকে নিলো ট্যানাস। লসট্রিসের জন্যে বার্তা আছে ওর।

ওকে বলো, প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত আমি ওর কথা ভাবি!

ওটা তো বলেছো একবার, প্রতিবাদ করে বললাম।

বলবে, ওর মিষ্টি মুখটা আমার স্বপ্ন-জাগরণে এখনো অম্লান।

এটাও বলেছো। নতুন কিছু বলার থাকলে বলো, না হয় যেতে দাও আমাকে।

ওকে বলবে, আমন রা র ধাঁধা আমি বিশ্বাস করেছি, আর মাত্র বছর পাঁচেক পর আমরা একসাথে থাকতে পারবো–

ক্রাতাস আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। এখানে যদি আটকে রাখো আমাকে, কেমন করে এগুলো বলবো লসট্রিসকে?

ক্ষান্ত দেয় ট্যানাস। আমি না দেখা পর্যন্ত ভালো খেয়াল নিয়ে ওর। যাও, তাড়াতাড়ি!

ক্রাতাসকে সামনে রেখে, ছুটে চললো আমাদের ছোট্ট বাহিনী। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে কারনাকে পৌঁছে গেলাম আমরা। র‍্যাসফার বা ইনটেফের কোপানল থেকে বাঁচতে যতোটা সম্ভব কম সময় থাকলাম থিবেসে। প্রথম সুযোগেই দক্ষিণগামী জাহাজে চড়ে বসলাম। ওদিকে, ক্ৰাতাস ব্যস্ত হয়ে পড়লো ট্যানাসের অভিযানের জন্যে একহাজার শক্ত যোদ্ধা খুঁজে বের করতে।

পালে উত্তুরে হাওয়া নিয়ে তরতর করে বয়ে চললো আমাদের জাহাজ। থিবেস ছাড়ার বারোতম দিনে পুব গজ-দ্বীপের ঘাটে ভীড়লাম। এখনো, পুরোহিতের পরচুলা এবং পোশাক পরে আছি, তাই কেউ চিনতে পারলো না আমাকে।

ছোট্ট একটা তামার আংটির বিনিময়ে ফেলুচা ভাড়া করে নদী পাড়ি দেয় পৌঁছে গেলাম রাজকীয় দ্বীপে। হারেমে, আমাদের বাগানের ঘাটে চলে এলাম। সিঁড়িপথ ধরে উঠার সময় পাগলের মতো বাজতে শুরু করলো আমার হৃদয়। অনেকটা সময় আমার কর্ত্রীর কাছ থেকে দূরে সরে ছিলাম। বিচ্ছেদের কালে বুঝতে পেরেছি, ওর প্রতি আমার অনুভূতি কতো প্রবল। আমি নিশ্চিত জানি, আমার আবেগের কাছে ট্যানাসের ভালোবাসা যেনো মরুর ঝড়ের বিপরীতে নদীর মৃদুমন্দ বাতাসের মতো।

লসট্রিসের একজন কূশ দেশীয় দাসী মেয়ে প্রথমে দরোজায় দেখতে পেলো আমাকে। ঢুকতে দিচ্ছে না সে আমাকে। আমার কর্ত্রী অসুস্থ-হে পুরোহিত। এই মুহূর্তে একজন কবিরাজ আছেন ভেতরে, আপনি যেতে পারবেন না।

অবশ্যই পিরবো, ওকে বললাম। এক টানে মাথার পরচুলা খুলে ফেলতে চিৎকার করে উঠলো সে, টাইটাএবারে হাঁটু ভাজ করে বসে পরে শয়তানের বিপরীতে চিহ্ন আঁকলো। তুমি তো মরে গেছে। এটা টাইটা নয়, তার ভুত!

এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে মিসট্রেসের ব্যক্তিগত কক্ষের দিকে চললাম আমি। ওসিরিসের মন্দিরের হাতুড়ে-চিকিৎসকদের একজন দরোজায় আঁকালো।

তুমি এখানে কি করছো? জানতে চাইলাম, এই হাতুড়েগুলো আমার কর্ত্রীর আশেপাশে রয়েছে ভেবেই শঙ্কিত হয়ে পড়েছি। সে উত্তর দেওয়ার আগেই গর্জে উঠলাম, বেরোও এখান থেকে! ওই তুকতাক, মন্ত্র-ফন্ত্র নিয়ে বিদায় হও!

এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে সোজা ঢুকে পড়লাম ভেতরে।

অসুস্থতার গন্ধ ভাসছে বাতাসে শক্তিশালী, তিক্ত বুনো দুঃখবোধ ঘিরে ধরলো আমাকে যখন মিসট্রেসের দিকে চোখ পড়লো। আকৃতিতে ছোট্ট হয়ে গেছে ও, পুরোনো ছাই-এর মতো বিবর্ণ গায়ের ত্বক। ঘুমে অথবা আচ্ছনে আছে সে, কোন্ টা ঠিক নিশ্চিত নই আমি। দুই চোখের নিচে নীলা-ফোলা ছায়া। ঠোঁটদুটো শুকনো, দাগ পড়া দুঃখে বুকটা ফেটে যেতে চাইলো।

গায়ের চাদরটা সরিয়ে দিতে দেখলাম, সম্পূর্ণ নগ্ন ও। আতঙ্ক খামচে ধরলো আমার হৃদয়। ঠিক বুকের হাড়ের মতোই সরু হয়ে গেছে ওর হাত-পা; অসুস্থ চামড়া ঠেলে বেরিয়ে এসেছে কোমড়ের হাড়। বগলের তলায় হাত নিয়ে তাপমাত্রা বুঝতে চাইলাম-ঠাণ্ডা শরীর। কি ধরনের রোগ হতে পারে এটা ভাবতে বসলাম। আগে কখনো এ ধরনের কিছু দেখিনি।

চিৎকার করে একটা দাসী মেয়েকে ডাকলাম আমি। কিন্তু একজনও ভয়ে টাইটার ভুতের কাছে আসতে রাজী হলো না। শেষমেষ, ওদের প্রকোষ্ঠে ছুটে গিয়ে চুল ধরে টেনে বের করতে হলো বিছানার তলা থেকে।

কেমন করে তোমাদের কর্ত্রীর এ অবস্থা করলে? বিশাল চর্বিবহুল পাছায় এক লাথি ঝেড়ে জানতে চাইলাম। ভয়ে মুখ ঢেকে, তোতলে বলতে লাগলো মেয়েটা।

সে কিছুই খায়নি। এই কয়েক সপ্তাহে কেবল দুই এক গ্রাস খাবার খেয়েছে। মহৎ-প্রাণের উপত্যকায় ট্যানাস, প্রভু হেরাবের মমি কবরে রাখার সংবাদের পর থেকে এই চলছে। এমনকি, উনার পেটে ফারাও-এর সন্তান পর্যন্ত নষ্ট হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করো, মহান আত্মা আমি ওর খেয়াল রেখেছিলাম।

অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে চেয়ে রইলাম আমি, শেষমেষ বুঝলাম কী ঘটেছে। লসট্রিসের কাছে আমার পাঠানো বার্তা পৌঁছেনি। ক্ৰাতাস যাকে পাঠিয়েছিলো ট্যানাসের মৃত্যু সম্পর্কিত কথা জানিয়ে, সে লোক আদৌ আসেনি গজ দ্বীপে। নির্ঘাত যাত্রাপথে শ্রাইকদের শিকারে পরিণত হয়েছিলো। খোদা জানে, ওই বার্তাটা কার হাতে পড়েছে।

দৌড়ে মিসট্রেসের কাছে ফিরে গিয়ে ওর পাশে বসলাম আমি। প্রিয়, ফিসফিস করে বললাম। এই যে আমি টাইটা তোমার দাস।

সামান্য নড়ে উঠে কী যেনো বললো ও। খুব বেশি সময় নেই, যা করার খুব দ্রুত করতে হবে ওকে বাঁচাতে হলে। প্রায় মাসখানেক পেরিয়ে গেছে ট্যানাসের কথিত মৃত্যু-সংবাদের পরে । যদি দাসী মেয়েটার কথা সঠিক হয়, এতোটা সময় কিছু না খেয়ে আছে লসট্রিস, মরে যে যায়নি এখনো, এ-ই ঢের।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের কক্ষে ছুটে চললাম। কিছুই পাল্টেনি ওখানে। আমার ঔষধের বাক্সটা জায়গামতোই আছে। দুই হাতে ওটা জড়িয়ে ধরে মিসট্রেসের প্রকোষ্ঠে ফিরে এলাম। ওর বিছানার পাশের রাখা বাতির শিখার নিচে কঁকড়াবিছের দাঁড়া পুড়িয়ে, জ্বলন্ত প্রান্তটা ধরলাম লসট্রিসের নাকের তলায়। ভীষণ বিচ্ছিরি গন্ধে হাঁচি দিয়ে উঠলো ও, সরিয়ে নিতে চাইলো মুখ ।

মিসট্রেস, আমি টাইটা কথা বলো!

চোখ মেলে চাইলো লসট্রিস, দৃষ্টিতে আনন্দের ঝিলিক। সরু, রুগ্ন হাত মেলে ধরে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।

টাইটা, ক্ষীণ স্বরে বললো ও, ও মরে গেছে। ট্যানাস মরে গেছে।

না! না! ও বেঁচে আছে। মাত্রই তার কাছ থেকে এসেছি আমি। ভালোবাসা জানিয়েছে সে তোমাকে।

ও রকম নিষ্ঠুর কৌতুক করো না আমার সাথে। আমি জানি ও মরে গেছে ওর কবর–

শক্রর চোখে ধোকা দেওয়ার জন্যে ওটা বলা হয়েছিলো, প্রায় কেঁদে ফেললাম আমি। বিশ্বাস করো স্ট্যানাস বেঁচে আছে। ও তোমাকে ভালোবাসে। তোমার অপেক্ষায় আছে।

ওহ, টাইটা! কেমন করে তোমার কথা বিশ্বাস করবো? মিথ্যে কথা বলে কেনো কষ্ট দিচ্ছে আমাকে? ঘৃণা করি আমি আমার হাত সরিয়ে দিতে চাইলো লসট্রিস।

কসম! ট্যানাস জীবিত।

মায়ের নামে শপথ করে বলো। দেবতাদের নামে বলো, করুণ স্বরে বললো ও। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আর স্নেহের নামে শপথ করে বলছি–

কেমন করে এটা হবে? আশার শক্তি ফিরে এসেছে লসট্রিসের মাঝে। মুখে যেনো রঙ ফিরে এলো তার। ওহ টাইটা! এটা সত্যি হয় কেমন করে?

যদি সত্যি না হতো, আমি এতো আনন্দচিত্তে থাকতাম? তোমার চেয়ে কম ভালোবাসি না আমি ওকে। যদি সত্যিই ট্যানাস মরে যেতো নিশ্চই এমন হাসি-মুখে থাকতাম না আমি।

ধীরে, সবকিছু খুলে বললাম ওকে। কেবল সেই জলাভূমির ধারের ছাপড়ায় ট্যানাসকে কী অবস্থায় পেয়েছি ওটা চেপে গেলাম।

একটা কথাও বললো না লসট্রিস। আমার মুখে চেয়ে থেকে নীরবে সমস্ত কথা গিলতে লাগলো। ফ্যাকাসে, প্রায় স্বচ্ছ মুখে যেনো মুক্তোর উজ্জ্বলতা ফিরে এলো যখন গালালা মরুতে ট্যানাসের নেতৃত্বে আমাদের অভিযানের বর্ণনা দিলাম আমি।

তো, বুঝতেই পারছো, ট্যানাস বেঁচে আছে, শেষ করলাম আমি। মুখ খুললো লসট্রিস।

যদি তাই হয়, তবে ওকে নিয়ে আসো আমার কাছে। ওকে না দেখা পর্যন্ত কিছুই মুখে তুলবো না আমি।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তা করবো আমি। এখন একটা বার্তা পাঠানোর সময় দাও আমাকে। বলে, আমার ওষুধের বাক্স থেকে একটা তামার আয়না বের করলাম।

লসট্রিসের সামনে ওটা ধরে, নরম স্বরে বললাম, তুমি চাও, এই অবস্থায় ও দেখুক তোমাকে?

নিজের কঙ্কালসার, রুগ্ন অবয়বের দিকে চেয়ে রইলো ও।

তুমি বললে, আজই ট্যানাসের কাছে খবর পাঠাতে পারি। সপ্তাহের মধ্যেই এখানে চলে আসবে সে, যদি সত্যিই তাই চাও।

আবেগের সাথে লড়লো লসট্রিস। আমি কুৎসিত হয়ে গেছি, ফিসফিস করে বললো সে। একদম বুড়ি মহিলাদের মতো দেখাচ্ছে।

তোমার সৌন্দৰ্য্য এখনো অটুট, কেবল চাপা পড়ে গেছে।

ট্যানাস এ অবস্থায় আমাকে দেখুক, এটা চাই না। নারীর চিরন্তন অনুভূতি বিজয়ী হলোঅপর সব আবেগের সঙ্গে লড়াইয়ে।

তাহলে তোমাকে খেতে হবে।

তুমি কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছো, একটু যেনো কেঁপে গেলো লসট্রিস। তুমি প্রতিজ্ঞা করেছো-ট্যানাস বেঁচে আছে, আমি সুস্থ্য হয়ে উঠলেই ওকে আমার কাছে নিয়ে আসবে তুমি? আমার হৃদয়ে হাত দিয়ে বলো–

ওর প্রতিটি বুকের হাড় অনুভব করা যায়, হৃদপিণ্ড অত্যন্ত দ্রুত চলছে আমার আঙুলের নিচে। প্রতিজ্ঞা করলাম। বললাম।

এবারের মতো বিশ্বাস করলাম তোমাকে। কিন্তু মিথ্যে কথা যদি বলে থাকো, জীবনেও আর তোমাকে ডাকবো না। খাবার নিয়ে এসো আমার জন্যে!

দৌড়ে রান্নাঘরে ছুটলাম আমি। আবারো সফল হয়েছে টাইটার চাতুর্য্য।

গরম দুধ আর মধু মেশালাম একটা পাত্রে। ধীরে ধীরে খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে, অনেকদিন পেটে কিছু পড়েনি আমার কর্ত্রীর। প্রথমে বমি করে ফেলে দিলো সে, পরে আস্তে আস্তে খেতে পারলো। আর একদিন দেরি করে যদি আসতাম, হয়তো বেশি দেরি হয়ে যেতো।

*

দাসী মেয়েগুলোর কল্যাণে মরণের ওপার থেকে আমার প্রত্যাবর্তনে খবর গুটিবসন্তের মতো ছড়িয়ে পড়লো সমগ্র দ্বীপে।

রাত নামার আগেই আতনকে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠালেন ফারাও। এমনকি সে পর্যন্ত কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো আমার সাথে। আমি ছুঁতে চাইলে কেঁপে উঠে সরে গেলো, যেনো আমি কোনো অপার্থিব শক্তি। ওর পিছু পিছু প্রাসাদে যাওয়ার পথে দাস, সভাষদেরা ভয়ে ভয়ে দেখতে লাগলো আমাকে।

শ্রদ্ধা এবং ভয়ের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে আমাকে স্বাগত জানালেন ফারাও।

কোথায় ছিলে তুমি, টাইটা? এমনভাবে করলেন প্রশ্নটা, যেনো উত্তর না শুনতে পেলে বেঁচে যান।

তার পায়ে পড়লাম। স্বর্গীয় ফারাও, আপনি নিজে যেখানে দেবত্বের প্রতিনিধি, সম্ভবত আমাকে পরীক্ষা করার জন্যে প্রশ্ন করেছেন। আপনি তো জানেন, আমার মুখ বন্ধ। ওইসব রহস্য নিয়ে আমার বলাটা ধৃষ্টতা। দয়া করে আপনার সঙ্গী দেবতা বিশেষ করে, সমাধি-দেব আনুবিসকে জানাবেন, আমার উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করেছি। বলবেন, আপনার নেওয়া পরীক্ষা আমি পাশ করেছি।

চিন্তিত চেহারায় বসে রইলেন রাজা। বিলক্ষণ বুঝতে পারছি, প্রশ্নের পর প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে তার মনে; কিন্তু একে একে সেগুলোকে গিলে ফেলছেন উনি। আমি আসলে কোনো ফাঁক রাখিনি তার জন্যে।

শেষমেষ, নিরাসক্ত ভঙ্গিতে মুখ খুললেন ফারাও। সত্যিই, টাইটা। আমার নেওয়া পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছো তুমি । স্বাগতম। তোমার অভাব আমরা অনুভব করেছি। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, আমার আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পর্কে আরো নিশ্চিত হলেন তিনি।

কাছে ঘেঁষে, ফিসফিস করে তার কানে বললাম, মহান মিশর, আপনি জানেন, কেননা আমাকে ফেরত পাঠানো হলো?

দ্বিধান্বিত চেহারায় মাথা আঁকালেন ফারাও। পায়ের উপরে দাঁড়িয়ে সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক চাইলাম আমি যেনো কোনো অতীন্দ্রিক শক্তির অস্তিত্ব আশঙ্কা করছি। বুকে খারাপ শক্তির বিপরীতে চিহ্ন এঁকে বলে চললাম, কর্ত্রী লসট্রিস। তাঁর অসুস্থতা আসলে ছিলো মুখে কিছু না বলে দুই আঙুলে চিহ্ন আঁকলাম আমি, অন্ধকারের দেবতা সেথ্‌-এর।

দ্বিধা থেকে এবারে আশঙ্কায় রূপ নিলো রাজার অভিব্যক্তি, কেঁপে উঠে আমার নিকটে ঝুঁকলেন; ওদিকে আমি বলতে লাগলাম, আমাকে নিয়ে যাওয়ার আগে, কর্ত্রীর পেটে ছিলো মহান ফারাও-এর সন্তান। এমন সময় অন্ধকারের দেবতা নষ্ট করে দিয়েছেন ওটাকে।

ভীষণ দেখালো ফারাও-এর মুখাবয়ব। তো, এরই কারণে অমন হয়েছে বলে থেমে গেলেন।

চতুরতার সাথে কথা এগিয়ে নিলাম আমি। ভয় করবেন না, মহান মিশর। অন্ধকারের দেবতার চেয়ে অনেক শক্তিশালী দেবতাদের ইশারায় ফিরে এসেছি আমি, কেবল ওকে বাঁচাতে। যাতে করে আমন রার ধাঁধা সত্যি হয়। আরো একটি পুত্র-সন্ত নি হবে আপনার, বংশধারা রক্ষা পাবে।

তবে তো সুস্থ্য না হওয়া পর্যন্ত লসট্রিসকে কাছছাড়া করা ঠিক হবে না তোমার, আবেগে কেঁপে গেলো ফারাও-এর গলা। যদি ওকে বাঁচাতে পারো, আর আরো একটা পুত্র-সন্তান হয় আমার যা ইচ্ছে পাবে তুমি। কিন্তু যদি ওর কিছু হয় এই পর্যায়ে এসে থেমে গেলেন তিনি। সম্ভবত ভাবলেন, মৃত্যুর ওপার থেকে যে ফিরে এসেছে, তাকে আর কিসের ভয় দেখাবেন?

আপনি অনুমতি দিলে, মহান ফারাও, এই মুহূর্তেই আমি ওর কাছে ফিরে যেতে চাই।

এই মুহূর্তে! ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠলেন রাজা। যাও, যাও!

*

বিস্ময়কর দ্রুততার সাথে সুস্থ্য হয়ে উঠলো আমার কর্ত্রী। নিজেরে ভেতরে অনাবিকৃত কোনো অতীন্দ্রিক শক্তির কথা ভেবে আমি একটু আত্মপ্রসাদ বোধ করেছিলাম বৈকি।

যেনো চোখের সামনে মাংস লাগলো লসট্রিসের হাড় জিড়জিড়ে শরীরে। বিবর্ণ, ঝুলে পড়া ত্বকে ফিরে এলো ভরাটে উজ্জ্বলতা। বুক জোড়া ফিরে পেলো তাদের অসাধারণ গোলাকার অবয়ব, এতো চমৎকার জোড়া বোধকরি দরোজার কাছে দেওয়ালে আঁকা হাপির মূর্তিরও নেই। রিনিঝিনি হাসিতে আবারো প্রাণ ফিরে এলো আমাদের জল-বাগানে।

বিছানায় ধরে রাখা সম্ভব হলো না লসট্রিসকে। গজ-দ্বীপে আমার ফিরে আসার তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যেই দাসীদের সাথে খেলাধুলোয় মত্ত হতে লাগলো সে, নাচে-গানে, লাফ-ঝাপে মুখরিত করে ফেললো হারেম প্রাঙ্গন। আমার ভয় হতে লাগলো, না জানি নিজের কোনো ক্ষতি করে ফেলে মেয়েটা । বিছানায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিতে একটা শর্তে মেনে নিলো সে। ওর সাথে হয় গান গাইতে হবে আমার নয়তো বাও খেলার নতুন কোনো কৌশল শিখিয়ে দিতে হবে। আজকাল আতনের সঙ্গে খেলায় জয়ের সুবাস পেতে শুরু করেছে লসট্রিস, দু জনেই বেশ আসক্ত এখন ওই খেলায়।

প্রায় প্রতি সন্ধাতেই রাজার প্রতিনিধি হিসেবে লসট্রিসের স্বাস্থ্যের খবরাখবর নিতে আসে আতন। পরে বাও খেলতে বসে আমাদের সাথে। শেষমেষ আমাকে বিপদজনক ভূত হিসেবে দেখা বাদ দিয়েছে সে, তবে নতুন এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধের বহিঃপ্রকাশ তার আচরণে স্পষ্ট।

প্রতি সকালেই নতুন করে প্রতিজ্ঞা করতে হয় লসট্রিসের কাছে। এরপর অখণ্ড মনোযোগের সাথে আয়নায় নিজের অবয়ব পরীক্ষা করে সে, চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখে এখন তার রূপ ট্যানাসের দর্শানুপযোগী হয়েছে কিনা।

আমার চুলগুলো একদম খড়ের মতো হয়ে গেছে, আর গালেও একটা পুঁটুলি দেখছি, অনুতাপ করে বলতো সে। আবার আমাকে সুন্দরী করে দাও, টাইটা। ট্যানাসের জন্যে, আমাকে আবার সুন্দর হতে হবে যে!

নিজের ক্ষতি করে এখন টাইটাকে ডাকছো, আমি বলতেই হেসে, দুই হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরতোলসট্রিস।

তুমি তবে আছো কিসের জন্যে? আমার খেয়াল রাখাই ভোমার কাজ, বুঝলে!

প্রতি সন্ধাতে যখন বিশেষ শক্তিবর্ধক মিশ্রণ নিয়ে আসতাম ওর জন্যে, প্রতিবার আমার প্রতিজ্ঞা পুনরায় করিয়ে নিতে মিসট্রেস। শপথ করে বলো–ট্যানাসকে তুমি নিয়ে আসবে আমার কাছে, ঠিক যখন আমি তৈরি হবো।

এই প্রতিজ্ঞা পালন করতে হলে কী ধরনের বিপদের মুখোমুখি হতে হবে, মনে মনে সেগুলো উড়িয়ে দিতে চাইলাম আমি। শপথ করলাম। প্রতিদিন বাধ্যগতের মতো বলতাম। আইভরির বিছানায় তখন ঘুমিয়ে পড়তে লসট্রিস, ঠোঁটে অদ্ভুত এক টুকরো হাসি নিয়ে। সময় এলে তখন ভাবা যাবে, কী ভাবে কী করা যায়।

*

আতনের কাছে লসট্রিসের দ্রুত আরোগ্যলাভের খবর পেয়ে সরেজমিনে দেখতে এলেন ফারাও। স্বর্ণ এবং ল্যাপিস-লাজুলিতে তৈরি ঈগলের আকারের একটা হার নিয়ে এলেন তিনি লসট্রিসের জন্যে। সন্ধ্যা পর্যন্ত শব্দের খেলা, ধাঁধা নিয়ে ব্যস্ত রইলেন ওর সাথে। যাওয়ার সময়ে আমাকে ডেকে নিয়ে তাঁর প্রকোষ্ঠ পর্যন্ত হেঁটে গেলেন।

ওর পরিবর্তন দেখেও বিশ্বাস হয় না। এ যে অভূতপূর্ব ব্যাপার, টাইটা। কবে আবার বিছানায় নিয়ে যেতে পারবো তাকে দেখে তো মনে হয়, এখনই আমার সন্তান পেটে নেওয়ার জন্যে একেবারে তৈরি সে।

এখনো নয়, মহান মিশর। কঠোর স্বরে বললাম তাকে। সামান্য পরিশ্রমে আবারো অসুস্থ্য হয়ে পড়তে পারে ও।

এখন আর আমার কোনো কথায় প্রশ্ন করেন না ফারাও, মৃতের জগত থেকে ফিরে আসায় নতুন ক্ষমতা পেয়েছি আমি।

ধীরে ধীরে দাসী মেয়েগুলোও সহজ হয়ে এলো। এখন আর আমার প্রত্যাবর্তন, প্রাসাদের জল্পনা-কল্পনার বিষয় নয়। অন্য একটি বিষয় পেয়ে গেছে তারা। নীল নদের তীরবর্তী প্রতিটি মানুষের জীবনে এখন আকহ্ হোরাস একটি অবাক নাম।

প্রথম যেদিন প্রাসাদের গলিপথে ওই নাম উচ্চারিত হতে শুনেছিলাম, তেমন কিছু ভাবিনি। লোহিতসাগরের পার্শ্ববর্তী তিয়ামাতের বাগান যেনো কতোকাল আগের কথা। হুই যে এই নাম দিয়েছে ট্যানাসকে কবেই ভুলে গেছি আমি। কিন্তু, পরে যখন এই হঠাৎ-দেবতার কাণ্ড-কীর্তি শুনলাম, আচমকা সব মনে পড়লো।

উত্তেজনার প্রাবল্যে দৌড়ে হারেমে ফিরে চললাম, দর্শনার্থী পরিবেষ্টিত অবস্থায় জল-বাগানে পেলাম মিসট্রেসকে।

নিজের অবস্থান ভুলে, জোর করে তাড়িয়ে দিলাম সবাইকে। পরিমরি করে পালালো রাজ-বধূ, জমিদার-পত্নীরা। লসট্রিস ক্ষেপে গেলো আমার এহেন ব্যবহারে।

একি করলে, টাইটা? কি হয়েছে তোমার?

ট্যানাস! যেনো মন্ত্র জপার মতো কথাটা উচ্চারণ করলাম আমি। সাথে সাথেই সব ভুলে আমার হাত চেপে ধরলো লসট্রিস।

তোমার কাছে খবর আছে ওর? তাড়াতাড়ি বলো! না হয় মরেই যাবো!

খবর? হ্যাঁ, খবর তো আছে। কী খবর! কী কীর্তি! কী অবিশ্বাস্য ঘটনা!

হাত ছেড়ে দিয়ে হাত-পাখা তুলে নিলো মিসট্রেস। এই মুহূর্তে তোমার বকবক বন্ধ করো, অস্ত্র হিসেবে হাত-পাখাটা ব্যবহার করলো সে। এ রকম করে আমাকে জ্বালাবে না। এক্ষুনি বলল, না হয় মাথা ফাটিয়ে দেবো।

চলো! আড়ালে গিয়ে বলি! হাত ধরে নৌকা ঘাটে নিয়ে গেলাম ওকে। আমাদের ছোট্ট নৌকাটাতে চড়ে, মাঝ-নদীতে ভেসে এসে তবেই মুখ খুললাম।

পুরো দেশ জুড়ে পরিষ্কার-সজীব বাতাস বইতে শুরু করেছে, বললাম ওকে। সবাই ওটাকে বলছে, আকহ্ হোরাস।

হোরাসের ভাই, শ্বাস টেনে বললো লসট্রিস। ওরা কি এখন এই নামে ডাকে ট্যানাসকে?

কেউ জানে না ওটা ট্যানাস। সবার ধারণা, এ হলো এক দেবতা।

ও তো তা-ই, জোর দিয়ে বললো মিসট্রেস। আমার কাছে ও অবশ্যই দেবতা।

হুমম। যদি তা না-ই হবে, তাহলে ও কেমন করে জানে কোথায় লুকিয়ে আছে শ্ৰাইকের দল? কেমন করে ওদের ভেঁরায় আঘাত হানছে সে? কেমন করে জানতে পারছে, ক্যারাভান পথের কোথায় কোথায় ওঁত পেতে আছে দস্যুরা?

এত্তো কিছু ও একা করেছে? অবাক হয়ে জানতে চায় লসট্রিস।

আরো বহু কিছু। যদি কান কথায় বিশ্বাস করো। সবাই বলাবলি করছে, সমস্ত চোর আর লুটেরার দল আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। একের পর এক শ্ৰাইক বাহিনী পর্যন্ত হয়ে চলেছে। তারা বলছে, আকহ্ হোরাস-এর পাখা আছে, ঠিক ঈগলের মতো, জেবেল-উম-বাহরির প্রচণ্ড খাড়া পাহাড়ের গা টপকে হঠাৎ সে দেখা দিয়েছে নিষ্ঠুর বাস্তির দলের মধ্যে। নিজ হাতে পাঁচশদস্যুকে সে ফেলে দিয়েছে পাহাড়ের চূড়া থেকে।

আরো বলো! হাততালি দিয়ে বললো লসট্রিস, আর একটু হলেই উল্টে গিয়েছিলো নৌকাটা।

সবাই বলাবলি করছে, প্রতিটি রাস্তার বাঁকে, ক্যারাভান পথের মোড়ে নিজের মূর্তি রেখে গেছে সে। নিজের অবস্থানের নিশান।

মূর্তি? কিসের মূর্তি?

মানুষের করোটির স্তূপ, পিরামিডের মতো করে সাজানো। যে সমস্ত দস্যুর প্রাণ হরণ করেছে সে, তাদের সবার মুণ্ডু যাতে করে বাকিরা সতর্ক হয়ে যায়।

এবারে তৃপ্তিকর আতঙ্কে শিউড়ে উঠে আমার কর্ত্রী। জ্বলছে ওর চোখ-মুখ । অনেককে মেরেছে ও? জানতে চায় সে।

কেউ বলে পাঁচ হাজার, কেউ বলে পঞ্চাশ হাজার। অনেকে তো দাবি করে এক লাখ দস্যু মারা গেছে আমার ধারণা, সেটা অতিরঞ্জন।

আরো বলো আমাকে! বলো!

সবাই বলছে, ও ছয়জন শ্রাইক নেতাকে ধরে ফেলেছে—

আর তাদের মাথা কেটেছে! ছোট্ট হুঙ্কারে আমাকে উৎসাহ জোগায় লসট্রিস।

না, সে তাদের মারেনি, কিন্তু বেবুনে পরিণত করেছে! এখন খাঁচায় ভরে তামাশা দেখবে?

এগুলো সত্যি? খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে লসট্রিস।

দেবতাদের জন্যে অসম্ভব বলে কিছু নেই!

ও তো আমার দেবতা। ওহ, টাইটা, কবে ওকে দেখতে দেবে তুমি?

শি, প্রতিজ্ঞা করলাম। প্রতিদিন তোমার সৌন্দৰ্য্য রঙ ছড়াচ্ছে। আর অল্প দিনেই পুরো ফিরে পাবে।

তাহলে, এর মধ্যে আকহ্ হোরাস সম্পর্কিত সমস্ত গল্প-রটনা শুনে এসে আমাকে বলবে তুমি।

তো, এরপর থেকে প্রতিদিন আমাকে বন্দরে পাঠাতে লাগলো মিসট্রেস। উত্তর থেকে আসা প্রতিটি জাহাজে আকহ্ হোরাসের খোঁজ-খবর নিতে শুরু করলাম আমি।

সবাই বলছে, আকহ্ হোরাস-এর চেহারা কেউ কখনো দেখেনি, কেননা এমন একটা মাথার আচ্ছাদন পরে সে যাতে করে চোখ ছাড়া সবকিছু ঢাকা থাকে। কথিত আছে, যুদ্ধের ময়দানে আগুনের কুণ্ডে পরিণত হন তিনি, ওই আগুনে পুড়ে যায় শত্রুরা। একবার বন্দর ঘুরে এসে জানালাম মিসট্রেসকে।

সূর্যের আলোয় ট্যানাসের চুল সত্যিই আগুনের মতো জ্বলে, সায় দিয়ে জানালো লসট্রিস।

আরেকদিন সকালে, ওকে বললাম, সবাই বলে, প্রতিবিম্বের মতো নিজের শরীর বিভাজিত করতে পারে সে, একই সময়ে তাই বিভিন্ন জায়গায় একসাথে অবস্থান করতে পারে। একই সময়ে কেয়েনা এবং কম-ওম্বোতে দেখা গিয়েছে তাকে।

তা কী করে সম্ভব? জানতে চাইলো লসট্রিস।

কেউ বলে, এটা অসম্ভব। তাদের ধারণা, না ঘুমিয়ে দ্রুত চলাচল করে বলে এতো বিশাল দূরত্ব এতো তাড়াতাড়ি পাড়ি দেয় আকহু হোরাস। রাতে, সিংহের পিঠে করে চড়ে বেড়ায় সে; দিন হলে সাদা ঈগলের ডানায়।

হতে পারে, নিশ্চিত ভঙ্গিতে বলে লসট্রিস। প্রতিবিম্বের কথা আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু সিংহ আর ঈগলের কথা সত্যি হতে পারে। ট্যানাসের পক্ষে সম্ভব এমন কিছু করা।

আমার মনে হয়, সমগ্র মিশর ওর দর্শন পাওয়ার জন্যে এতো উতলা হয়ে উঠেছে, কাল্পনিক কথা বলছে তারা। প্রতিটি জংলার আড়ালে তাঁকে দেখছে মানুষজন। আর, গতির কথা বললে, রক্ষীদের সাথে আমি দৌড়েছি; কাজেই আমার জানা আছে আমাকে শেষ করতে দেয় না লসট্রিস; নিজেই বলে উঠে, তোমার আত্মায় কোনো কাব্য নেই, টাইটা। তুমি ধারণা করতে পারো, পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ হলো ওসিরিসের পশমী আচ্ছাদন, আর সূর্য হলো আমন রার মুখ; কেননা ওগুলোকে তুমি ছুঁতে পারো না। আমি বিশ্বাস করি, এ সবকিছুই ট্যানাসের পক্ষে সম্ভব।

এহেন কথা মেনে না নিয়ে আর কী উপায়? নীরবে মাথা ঝোঁকালাম আমি।

*

দেখতে দেখতে সেই দিন চলে এলো, যার ভয় করছিলাম। একদিন সকালে, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে আয়নায় নিজের অবয়ব পরীক্ষা করে লসট্রিস ঘোষণা করলো, এবারে ট্যানাসের সঙ্গে তার দেখা করার সময় এসেছে। আমাকে স্বীকার করতেই হচ্ছে, সত্যিই এর চেয়ে ভালো আর কখনো লাগে নি ওকে। এই কয়েক দিনের ধকল ওর সৌন্দর্য্যকে যেনো স্থায়িত্ব দিয়েছে। কিশোরীর ভীরুতার শেষ চিহ্ন পর্যন্ত মুছে গেছে ওর ব্যক্তিত্ব থেকে; পূর্ণবয়স্কা, রহস্যময়ী একজন নারীতে পরিণত হয়েছে লসট্রিস।

আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, টাইটা। এখন আমার আস্থার প্রতিদান দাও। ট্যানাসকে নিয়ে আসো আমার কাছে।

সাফাগা ছাড়ার সময় কীভাবে বার্তা আদান-প্রদান হবে দুজনের মধ্যে এ ব্যাপারে ট্যানাস এবং আমি কোনো সিন্ধান্তে পৌঁছি নি। গুজব বা গল্প ছাড়া ট্যানাসের অবস্থানের কোনো সঠিক খবর আমার কাছে নেই।

আবারো, আমাকে বাঁচানোর জন্যেই যেনো হস্তক্ষেপ করলেন দেবতারা। সেই দিন বাজারে নতুন একটা গুজব শোনা গেলো। উত্তরের রাস্তা ধরে আসা এক ক্যারাভান চালক জানালো, শহরের দেওয়ালের মাইল দুয়েক দূরে নরমুণ্ডু-এর তৈরি পিরামিড দেখে এসেছে সে খুব বেশিদিন আগের নয়। তাজা মাথাগুলো এমনকি গন্ধ পর্যন্ত ছড়াতে শুরু করে নি।

এর অর্থ হলো, লোকজন বলাবলি করতে লাগলো, আসূনের নিকটেই আছেন আকহ হোরাস। গজ-দ্বীপের দৃষ্টিসীমার ভেতরে। আখেকুর দলের বাকি সদস্যদের নিকেশ করতে এসেছে। শেষ দস্যুটিকে পর্যন্ত কতল করেছে আকহ্ হোরাস, এরপর হয়তো রাস্তার ধারে পিরামিড তৈরি করেছে। দক্ষিণ তাহলে শ্রাইকমুক্ত হলো?

এতো মধুর সংবাদ বহুকাল শুনি নি; মিসট্রেসকে জানানোর জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠলাম । নাবিক, বষিক, মাঝি-মাল্লার ভীড় ঠেলে এগুলাম, বন্দরের একটা নৌকা ভাড়া করে দ্রুত দ্বীপে ফিরতে চাইছি।

কেউ একজন আমার হাত টেনে ধরলো। এক ঝটকায় ওটা সরিয়ে দিতে চাইলাম। যতোই শ্ৰাইকমুক্ত হচ্ছে দেশটা, ভিক্ষুকের দল যেনো আরো বেপোরোয়া হয়ে উঠছে। এ ব্যাটাকে দেখছি তাড়ানোই যাচ্ছে না। রাগের সাথে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি, ব্যাটাকে দাবড়ানো দিতে তৈরি ।

পুরোনো বন্ধুকে মেরো না! একজন দেবতার কাছ থেকে তোমার জন্যে বার্তা নিয়ে এসেছি আমি, কেঁদে ফেলে বললো ভিক্ষুক, অবাক চোখে ওর দিকে চেয়ে রইলাম আমি।

হুই! বুকের ভেতরটা যেনো কেঁপে উঠলো যখন ছেলেটার দুষ্টু হাসি চিনতে পারলাম। কী করছো এখানে? ওকে উত্তর দেওয়ার সময় না দিয়ে বলে চললাম, এখন আমাকে দূর থেকে অনুসরণ করো।

বন্দরের পেছনের কানাগলিতে ছোট্ট একটা ছাপড়ায় নিয়ে গেলাম ওকে। এখানে সাধারণত আমোদ-উল্লাসে মত্ত হয় জাহাজীরা। বড়ো একটা তামার আংটিতে ভাড়া চুকিয়ে হুইয়ের জামা ধরে টেনে ওকে ভেতরে ঢুকালাম।

তোমার মনিবের থেকে কী খবর এনেছো? জিজ্ঞেস করতেই মুচকি হাসলো হুই।

এতো শুকিয়ে আছে গলাটা, কথাই বলতে পারছি না, ইতিমধ্যেই নীল কুমির বাহিনীর যোগ্য সদস্যের মতো কথার কলা শিখে গেছে সে। চিৎকার করে একজন লোক ডেকে মদ আনতে বললাম আমি। ঠিক তৃষ্ণার্ত খচ্চরের মতোই পুরো পাত্র সাবাড় করলো হুই; এরপর বিশাল একটা সেঁকুর তুললো।

দেবতা আকহ্ হোরাস শুভেচ্ছা জানিয়েছে, তোমাকে এবং অন্যদের যাদের নাম মুখে আনতে বারণ। সে আরো বলেছে, তার কাজ সম্পন্ন হয়েছে, সব পাখি এখন খাঁচায় বন্দী। মনে করিয়ে দিতে বলেছে, ওরিসিসের উৎসবের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি; রাজার উপভোগের জন্যে নতুন কাব্যনাট্য রচনা করতে তাগিদ দিয়েছে তোমাকে।

কোথায় সে? ওর কাছে ফিরে যেতে কতদিন লাগবে তোমার? আগ্রহভরে জানতে চাইলাম আমি।

সূৰ্য্য-দেব আমন রা যতক্ষণে ওই পাহাড়ের আড়ালে অস্ত যাবে, ততক্ষণে তার কাছে পৌঁছে যাবো আমি। হুই জানালো। জানালা দিয়ে সূর্যের দিকে চাইলাম, প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে। তারমানে, শহরের খুব কাছেই ঘাঁটি গেড়েছে ট্যানাস। ওর কর্কশ আলিঙ্গন, দরাজ হাসি শুনতে প্রাণ আঁই-ঢাই শুরু করে দিলো।

আপন মনেই হাসলাম। নোংরা মেঝেতে পায়চারী করতে করতে ট্যানাসের কাছে কী বার্তা পাঠাবো, তার খসরা তৈরি করতে লাগলাম মনে মনে।

*

প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেলো হারেমের ঘাটে ফিরে আসতে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে দেখলাম, একটা দাসী মেয়ে কাঁদছে দরোজায় দাঁড়িয়ে, কান ফুলে ঢোল বেচারীর।

ও মেরেছে আমাকে, বললো মেয়েটা। বোঝা গেলো, আঘাতের চেয়ে মর্যাদাহানী তাকে বেশি কষ্ট দিয়েছে।

কর্ত্রী লসট্রিস কে কখনো ও বলবে না, তাকে ভর্ৎসনা করে বললাম। আর কাঁদছো কেননা? দাস-দাসীদের জন্মই হয়েছে মার খাবার জন্যে।

কিন্তু, কারো উপরে হাত তোলা আমার কর্ত্রীর পক্ষে বিস্ময়কর বৈকি। নির্ঘাত বেশ খারাপ তার মনের অবস্থা, গতি ধীর হয়ে এলো আমার আপনাতেই। ভয়ে ভয়ে আরো কিছুদূর এগোতে আরো একটা দাসী মেয়েকে মিসট্রেসের প্রকোষ্ঠ থেকে কাঁদতে কাঁদতে বেরুতে দেখলাম। রাগে লাল, তার পেছন পেছন লসট্রিস বেরিয়ে এলো। আমার চুলগুলোকে খড়ের গাদা বানিয়ে দিয়েছে।

আমার উপর চোখ পড়তেই থেমে গেলো সে। এরপরে নিয়ে পড়লো আমাকে।

কোথায় ছিলেন? দুপুরের আগেই আপনার খোঁজে বন্দরে লোক পাঠিয়েছি। কতো সাহস তোমার, আমাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখো? প্রায় তেড়ে এলো ও, নিজের অজান্তেই এক পা পিছিয়ে গেলাম আমি।

ট্যানাস এখানে, দ্রুত বললাম। গলার স্বর নামালাম, যেনো কোনো দাসী মেয়ের কানে না যায় কথাগুলো। পরশুদিন তোমাকে করা আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারবো।

মুহূর্তেই লসট্রিসের মেজাজ পাল্টে গেলো, লাফিয়ে উঠে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো সে। এরপর মার-খাওয়া মেয়েগুলোকে আদর করে সান্ত্বনা দিতে ছুটলো।

*

বার্ষিক উপহার হিসেবে লোহিতসাগরের ওপারের রাজ্যের ম্রাট এক জোড়া শিকারী চিতা পাঠিয়েছেন ফারাওকে। পশ্চিম তীরের মরুতে গ্যাজেলের পালের উপর সেগুলোকে চড়াও হতে দেখার খায়েশ হলো তার। পুরো সভাষদ, আমার কর্ত্রীসহ, আমন্ত্রিত হলো এই শিকার উৎসবে।

ছোটো নৌকায় চড়ে পশ্চিম তীরের উদ্দেশ্যে ভেসে পড়লাম আমরা, সাদা পালে বাতাস পেয়ে তড়তড় করে ছুটলো সেটা। হাসি-উচ্ছ্বাসের ফোয়ারা আর বাঁশি, সিট্রামের ছন্দবদ্ধ সুর আমাদের সঙ্গী হলো। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাৎসরিক বন্যা শুরু হবে, সাথে সাথে সূচনা ঘটবে নতুন ঋতুর; উৎসবমুখর পরিবেশে তাই শিকারে চললো ফারাও বাহিনী।

গ্যাজেলের চারণভূমি শিকারের জন্যে সংরক্ষিত এলাকা, পূর্ববর্তী সমস্ত ফারাও একে আইনের মাধ্যমে সুরক্ষিত করে গেছেন। উপত্যকার উপরের পাহাড়ে সব সময় মোতায়ান থাকে ফারাও-এর বিশেষ প্রহরী, যে কোনো প্রাণী-হত্যা প্রতিরোধ করাই তাদের দায়িত্ব। রাজকীয় অনুমতি ব্যতিরেকে শিকার করার শাস্তি হলো ফাঁসির দড়িতে ঝুলে মৃত্যুদণ্ড।

চওড়া, বাদামী উপত্যকার উপরের একটা পাহাড়ের চূড়োয় অবস্থান নিলো রাজকীয় সভাষদ। সাথে সাথেই তাঁবু তৈরি তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো, এতোটা সময় প্রখর রৌদ্রে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হবে না। বিস্ময়কর পরিমাণে শরবত, সুরার পাত্র নিয়ে আসা হয়েছে তাদের তৃষ্ণা মেটাতে।

এমন একটা জায়গা নির্বাচন করলাম মিসট্রেসের জন্যে, যাতে করে শিকার অভিযানের সম্পূর্ণ দৃশ্য তো দেখা যাবেই; আবার কারো দৃষ্টি আকর্ষণ না করে সটকে পড়া যাবে ইচ্ছে করলেই। তাপ-তরঙ্গে কাঁপছে উপত্যকার পিঠ; দূরে গ্যাজেলের পালের চলাচল চোখে পড়ে এখান থেকে । হাত তুলে মিসট্রেসকে দেখালাম আমি।

ওখানে খাবার মতো কী পায় ওরা? লসট্রিস জানতে চায়। একটু সবুজ পর্যন্ত নেই ওখানে। মনে হয়, পাথর খায়–ওটা ছাড়া তো আর কিছু নেই দেখছি।

অনেক গাছও আছে, মিসট্রেস, বললাম ওকে। ও হেসে আমার কথা উড়িয়ে দিতে পাথুরে মাটি থেকে টেনে তুলে দেখলাম অদ্ভুত লতাগুলো।

ওগুলো পাথর, মানতে চাইলো না লসট্রিস, যতক্ষণ পর্যন্ত না হাতে নিয়ে গুঁড়ো করে ফেললো কতোগুলো। আঠার মতো ভারী তরল ওর হাত বেয়ে গড়িয়ে পড়তে দেবতাদের ধূর্ততায় মুগ্ধ হয়ে গেলো সে। তো, এগুলো খেয়ে বাঁচে গ্যাজেল? কী অদ্ভুত।

শিকার শুরু হতে সেদিকে মনোযোগ ফেরালাম আমরা। দুজন রাজ-শিকারী খাঁচার দরোজা খুলে দিতেই লাফিয়ে মাটিতে নেমে এলো চিতা দুটো। আমার ধারণা ছিলো, ছাড়া পেতেই পালিয়ে যেতে চাইবে ওগুলো, কিন্তু পোষা বেড়ালের মতোই শিকারীর পায়ে গা ঘষতে শুরু করে দিলো জানোয়ারগুলো। হিংস্র, উন্মত্ত কোনো আওয়াজ নয়, পাখির মতো নরম আওয়াজ বেরুচ্ছে গলা থেকে।

প্রখর রৌদ্রে পুড়তে থাকা বাদামি উপত্যকার দূর প্রান্তে তাড়ুয়াদের দেখা যাচ্ছে। প্রচণ্ড দাবদাহে ভাঙা ভাঙা দেখাচ্ছে তাদের অবয়ব। ধীরে, হরিণগুলোকে আমাদের দিকে তাড়িয়ে আছে তারা।

শিকারীদের সহ উপত্যকার ঢাল বেয়ে নিচে নামতে লাগলেন ফারাও। গলায় বেঁধে রাখা চামড়ার ফিতে দিয়ে চিতাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে দু জন। বেশিরভাগ সভাষদসহ আমরা পাহাড়ের উপরেই রইলাম। ইতিমধ্যেই একে-অপরের সাথে বাজি ধরতে মেতে উঠেছে সবাই। শিকারের ফলাফল দেখতে আমার উৎসাহও কম নয়, কিন্তু মিসট্রেসের এ দিকে কোনো মন নেই।

কখন যাবো আমরা? ফিসফিস করে জানতে চাইলো সে। মরুতে পালাবো কখন?

শিকার শুরু হলে সবার চোখ থাকবে সেদিকে। এই সুযোগটাই নিতে হবে আমাদের। হঠাৎই নদী থেকে বয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাস থেমে গেলো একেবারে। মনে হলো, যেনো এই মাত্র চুল্লীর দরোজা খুলে দিয়েছে কোনো কামার। এতো গরম বাতাস–শ্বাস নেওয়া দায়।

আবারো, পশ্চিম দিগন্তে চোখ রাখলাম আমি। গন্ধকের বর্ণ ধারণ করেছে ওখানকার আকাশ। আমার দৃষ্টির সামনে যেনো পুরো দিগন্ত ছেয়ে গেলো সেই রঙে। দারুন অস্বস্তি বোধ হতে লাগলো। কিন্তু আমি ছাড়া ব্যাপারটা আর কেউ লক্ষ্য করেছে বলে মনে হলো না।

দারুণ সুন্দর চিতাগুলোকে দূর থেকে দেখছিলাম। তাড়িয়ে নিয়ে আসা গ্যাজেলের পালের গন্ধ পেয়ে গেছে ওরা, এখন আর শান্ত পোষ্য নয়, সত্যিকারের শিকারীর মতো ফুসতে শুরু করে দিয়েছে। মাথা উচানো, সতর্ক; কানগুলো খাড়া, চামড়ার ফিতের সাথে সেঁটে আছে। প্রায় অবতল পেট ভেতরের দিকে চুপসে ঢুকে গেছে, শরীরের প্রতিটি পেশি টানা-দেওয়া তারের মতো শক্ত।

আমার আঁটো-জামা ধরে অধৈৰ্য্য ভঙিতে টানলো মিসট্রেস, জরুরি তাগিদ দিতে লাগলো। চলো পালাই, টাইটা। নিরাসক্তভাবে কাছের এক সারি পাথর খণ্ডের আড়ালে সরে যেতে লাগলাম আমরা দু জন । এতে করে আমাদের প্রস্থান কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না। ভারবাহী জানোয়ারগুলোর পরিচর্যককে একটা রুপোর মুদ্রা ঘুষ দিয়ে খচর তৈরি রাখার ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। দৃষ্টিচক্ষুর অন্তরালে, পাথরের সারির ওপাশে এখন দাঁড়িয়ে ওটা। প্রথমেই পরীক্ষা করে দেখে নিলাম, আমার নির্দেশ মতো সবকিছু দেওয়া হয়েছে কিনা–পানির থলে এবং সামান্য খাবার। সব ঠিকঠাক রয়েছে।

শিকার দেখার প্রচণ্ড আগ্রহে শেষপর্যন্ত বলেই বসলাম লসট্রিসকে, আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো না। ও কিছু বলার আগেই হাঁচড়ে-পাঁচড়ে পাথরের গা বেয়ে উঠে নিচের উপত্যকার দিকে তাকালাম।

সবেচেয়ে অগ্রবর্তী অ্যান্টিলোপ হরিণটা, ফারাও-এর হাতে চামড়ার ফিতেয় আঁকানো চিতা জোড়ার থেকে প্রায় একশ গজ দূরত্বে রয়েছে এখন। ঠিক যেনো মুহূর্তে আমি পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম, ওগুলোকে ছেড়ে দিলেন তিনি। সহজ, দ্রুত ভঙ্গিমায় ছুটলো ওগুলো, মাথা সোজা, যেনো হরিণের পালের থেকে শিকার পছন্দ করছে। ওদিকে, চিতার আগমন টের পেয়ে গেছে হরিণগুলো, সাথে সাথেই বিশৃঙ্খলভাবে ছুটতে শুরু করলো ওরা। ধূলি-ধূসর মরুর বুকে দিক-বিদিগ ছুটছে।

দীর্ঘ শরীর আরো লম্বা হতে লাগলো চিতাগুলোর; সামনের পা জোড়া দিয়ে নাগাল পেতে চাইছে হরিণের পালের; পেছনের পায়ের ঘায়ে যেনো ধূলিঝড় শুরু হলো। সর্বোচ্চ গতিতে এখন ছুটছে জানোয়ারগুলো। জীবনেও কোনো প্রাণীকে এতো দ্রুত ছুটতে দেখি নি আমি। এর তুলনায় হরিণের গতি কিছুই নয়। অনায়াসে, রাজকীয় হিংস্রতায় গ্যাজেলের পালের উপর চড়াও হলো ওরা। প্রথমটায় টপকে গেলো হরিণের পালটাকে, এরপর ধস্তাধস্তি রত দুটোকে নিয়ে মাটিতে আঁছড়ে পড়লো।

আতঙ্কে বিদিশা, ভয়াল আক্রমণ থেকে এদিক-ওদিক সরে গিয়ে বাঁচতে চাইলো হরিণগুলো। লাফিয়ে শূন্যে উঠলো, দিক বদল করলো বাতাসে থাকা অবস্থাতেই মোচড় খেয়ে, ভজ হয়ে আঁছড়ে পড়লো মাটিতে। প্রতিটি বাক, দিক বদল নিশ্চিন্ত, অনায়াস ভঙ্গিমায় অনুসরণ করলো চিতাগুলো। সমাপ্তি হলো একপেশে লড়াইয়ের। পিছলে, পাক-খেয়ে-উঠা ধোয়ার মেঘের আড়ালে একটি করে হরিণকে মাটিতে শুইয়ে দিলো রাজকীয় বিড়ালগুলো, শ্বাসনালী কামড়ে ধরে ছিঁড়ে ফেলছে; মৃত্যু-যন্ত্রণায় শূন্যে চার পা ছুঁড়লো শায়িত শিকার, ধীরে স্থির হয়ে এলো।

উত্তেজনায় টলোমলো, রীতিমতো শ্বাস রোধ হয়ে গেছে আমার। কর্ত্রীর কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙলো। টাইটা! এক্ষুনি নিচে নেমে এসো! পিছলে নেমে এসে ওর পাশে দাঁড়ালাম। লসট্রিসকে খচ্চরের পিঠে ঠিকমতো বসিয়ে লাগাম ধরে নেমে এলাম বন্ধ্যা মাটিতে। পেছনের পাহাড়ের কারণে এখন আর আমাদের দেখতে পাবে না কেউ। বারবার তাগাদা দিতে লাগলো মিসট্রেস, ট্যানাসকে দেখার জন্যে তর সইছে না একেবারে।

আরো একটা পাথুরে গা টপকে এলাম আমরা। এখন গ্যাজেল উপত্যকার থেকে বেশ নিরাপদ দূরত্বে চলে এসেছি; খচ্চর ঘুরিয়ে নিয়ে সোজা ট্রাস-এর গোরস্থানের দিকে চললাম। স্থির, ভীষণ গরম বাতাস; খচ্চরের খুড় মাটিতে লেগে ঠিক কাঁচ ভাঙার মতো শব্দ করছে। ঘামে ভিজে চটচটে হয়ে গেছে আমার পিঠ; বাতাস থমথমে নির্ঘাত বড়ো একটা ঝড় আসছে। সমাধিগুলোর কাছে পৌঁছার বেশ আগেই লসট্রিসকে জানালাম, বাতাস একেবারে মরা হাড়ের মতো শুষ্ক। কিছুটা পানি খেয়ে নিলে ভালো করতে–

আরে, রাখো তো! পরে অনেক সময় পাবে পেট ভরে পানি খাওয়ার জন্যে।

আমি শুধু তোমার কথা ভাবছিলাম, মিসট্রেস। প্রতিবাদ করে বললাম।

দেরি করা ঠিক হবে না। যতোটা সময় এখানে নষ্ট হবে, ট্যানাসের সঙ্গে থাকার সময়ও কমে যাবে। ঠিকই বলেছে লসট্রিস। কিছু সময়ের মধ্যেই আমাদের খোঁজ পড়ে যাবে ক্যাম্পে। আমার কর্ত্রী জনপ্রিয়তা এতো বেশি, শিকার শেষ হতে না হতেই ওর সঙ্গ পাওয়ার জন্যে উন্মুখ হয়ে পড়বে মহৎ প্রভু, সভাষদ।

পাহাড়ের খাড়া গায়ের যতো কাছাকাছি চলে আসছি আমরা, উত্তেজনা বাড়ছে লসট্রিসের; শেষমেষ খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে দৌড়ে চড়াইয়ে উঠলো ও। ওই তো! ওখানেই আমার অপেক্ষায় থাকবে ও। চিৎকার করে সামনে দেখালো মিসট্রেস।

ঠিক তখনই, নেকড়ের গর্জনের মতো ধেয়ে এলো বাতাস; পাহাড়ের দেওয়ালে লেগে চাপা-স্বরে গুমগুম করছে। পতপত করে উড়তে লাগলো মিসট্রেসের চুল, মাথা মুখের চারপাশে জড়িয়ে যাচ্ছে। আঁটো জামাটা উঠে যেতে দৃশ্যমান হলো ওর মসৃণ, বাদামি উরু; হেসে উঠে বাতাসে হাত বোলালো লসট্রিস-যেনো প্রেমিকের সাথে খেলছে। ওর এই আনন্দে অবশ্য আমি শরিক হতে পারলাম না।

পেছনে তাকিয়ে, সেই সাহারা থেকে ধেয়ে আসা ঝড়টা দেখলাম। উঁচু, হলদেটে অবয়ব; পাক খেয়ে উঠছে বাতাস। প্রবাহিত বালুকণা দারুন আঘাত করছে পায়ে; খচ্চরের দড়ি হাতে দৌড়ে আড়াল নিতে ছুটলাম। পিঠে বাতাসের প্রচণ্ড ধাক্কায় আর একটু হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলাম, সামলে নিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম লসট্রিসকে।

তাড়াতাড়ি ছুটতে হবে, বাতাসের গর্জন ছাপিয়ে বললাম ওকে। গোরস্থানের আশ্রয় পেতে হবে, ঝড় আসার আগেই!

বিশাল বালির মেঘ আড়াল করে ফেললো সূর্য, দৃষ্টিসীমা খুবই কম এখন। স্নান, ঘোলাটে সূর্যের নিচে পুরো পৃথিবী যেনো ছায়াঘেরা। উন্মুক্ত হাত-পা, ঘাড়ে আঘাত হানছে ছুটে আসা বালুকণা। আমার গায়ের শাল খুলে মিসট্রেসের মুখ-মাথায় জড়িয়ে দিলাম, হাত ধরে টেনে নিয়ে চলেছি ওকে।

বালুর পুরু পর্দা আমাদের চারপাশ ঘিরে আছে, ভয় হলো, শেষমেষ না পথ হারাই। হঠাৎই, সামনের বালুর পর্দায় একটা ফুটো তৈরি হলো; ঠিক সামনেই একটা সমাধির কালো ছোট্ট মুখ দেখতে পেলাম। এক হাতে লসট্রিস, অপর হাতে খচ্চরটা টেনে নিয়ে সমাধির আশ্রয়ে ছুটলাম। শক্ত পাথর খুঁজে তৈরি করা হয়েছিলো সমাধির প্রবেশমুখ, ওটা ধরে একেবারে পাহাড়ের পেটে চলে এলাম আমরা। এরপর হঠাৎ বাঁক নিয়েছে পথটা, চলে এসেছে শতাব্দী প্রাচীন মমি-রাখার স্থানে। বহু বছর আগেই সমাধি চোরেরা নিয়ে গেছে শবদেহ আর সমাধি-সম্পদ। কেবল ঝাপসা হয়ে আসা দেয়ালচিত্র গুলো রয়েছে এখন দেব-দেবী আর দৈত্য-দানোর ছবি।

পাথুরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লো লসট্রিস, তার প্রথম চিন্তা ছিলো প্রেমিকের জন্যে। এখন আর কিছুতেই আমাদের খুঁজে পাবে না ট্যানাস। খচ্চরটার পিঠ থেকে মালপত্র নামিয়ে রাখলাম আমি। এক পাত্র পানি খাওয়ালাম ওকে।

বাকিদের ভাগ্যে কি ঘটবে, টাইটা? রাজা, সভাষদ? পানিতে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে জানতে চাইলো লসট্রিস।

ওদের দেখভালের জন্যে শিকারীরা আছে। বললাম ওকে। তারা মরুকে হাতের উল্টো পিঠের মতোই চেনে। কেবল ঝড়ের পূর্বাভাস পায় নি, দুঃখের সাথে ভাবলাম । লসট্রিসকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে বলেছি কথাটা, আসলে ক্যাম্পের নারী এবং শিশুদের খুবই কষ্ট হবে এই ঝড়ে।

আর ট্যানাস? ওর কি হবে?

ট্যানাস ভালো করেই জানে, কী করতে হয় এমন অবস্থায়। ও হলো ঠিক বেদুঈনের মতো। নিশ্চিত থাকো, ঝড় ওর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

আমরা কখনো নদীর ধারে ফিরতে পারবে তো? ক্যাম্পের ওরা আমাদের খুঁজে পাবে এখানে? শেষমেষ, নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হলো মিসট্রেস।

আমরা এখানে নিরাপদ। বেশ ক দিন চলার মতো পানি আছে সঙ্গে। ঝড় থেমে গেলে, ফিরে যাবো। পানি এই মুহূর্তে মহা-মূল্যবান, ক দিন এখানে থাকতে হয় তার কোনো ঠিক নেই। পানির থলেটা খচ্চরের নাগালের বাইরে নিয়ে রাখলাম। ভীষণ অন্ধকার এখানে। বাক্স-পেটরা খুলে বাতি ধরালাম, হলদেটে আলো প্রাচীন সমাধিগুলোয় পরে অপার্থিব আলো ছড়াতে লাগলো।

লসট্রিসের দিকে পেছন ফিরে বাতি ধরাচ্ছিলাম, হঠাৎ ওর চিৎকারে চমকে গেলাম। এতো তীক্ষ্ণ, আতঙ্কিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিলো ও, শরীরের রক্ত যেনো জমে গেলো আমার। ঝট করে কোমড়ে গোঁজা ছোরাটা হাতে নিয়ে সমাধি-সুড়ঙ্গের প্রবেশপথে তাকিয়ে দেখি, বিশাল এক দৈত্যাকার অবয়ব প্রবেশমুখ আড়াল করে ফেলেছে। নড়তেও যেনো ভুলে গেছি। এমন আকারের বিরুদ্ধে ছুরি কোনো অস্ত্রই নয়।

বাতির ম্লান আলোয় ভাঙা-ভাঙা ভূতুড়ে দেখাচ্ছে বিশাল শরীরটা। মনে হলো, হয়তো মানুষেরই অবয়ব কিন্তু এতো লম্বা, বিশাল আকার কোনো মানুষের হতে পারে না। কুমীর সদৃশ মাথা, কোনো সন্দেহ নেই এ হলো অন্ধকার জগতের দৈত্য, যে মৃত মানুষের হৃদপিণ্ড খুবলে খায়। সরীসৃপের মতো আঁশ রয়েছে মাথায়; বাঁকানো ঠোঁটটা ঠিক ঈগলের মতো। গভীর গর্তের মতো চোখ দুটো দৃষ্টিহীন। কাঁধ থেকে বেরিয়ে এসেছে বিশাল পাখা। চরম আতঙ্ক নিয়ে ভাবলাম, এখনই ওই পাখায় ভর করে উড়ে এসে আমার কত্রর উপর চড়াও হবে ওটা। সমানে চেঁচিয়ে চলেছে লসট্রিস, উবু হয়ে বসে আছে দৈত্যটার পায়ের কাছে।

এরপর, আচমকাই বুঝতে পারলাম, দৈত্যটার কোনো পাখা নেই; লম্বা পশমী টুপির প্রান্ত ওগুলো, বেদুঈনের পোশাক–বাতাসে উড়ছে। আতঙ্কে বিবশ; আমাদের চোখের সামনে দুই হাত উঠিয়ে মাথা থেকে মুখোশ খুলে ফেললো ওটা, ঠিক ঈগলের ঠোঁটের মতো আকৃতি আচ্ছাদনটার। মাথা ঝাড়া দিতেই একরাশ লাল-সোনালি চুল ছড়িয়ে পড়লো চওড়া দুই কাঁধে।

চড়াই-এর উপর থেকে ঝড়ের মধ্যে তোমাদের দেখেছি আমি, চিরপরিচিত স্বরে বলে উঠলো মানুষটা।

আবারো চেঁচালো লসট্রিস, এবারে বন্য-আনন্দের চিৎকার। ট্যানাস!

যেনো উড়ে গিয়ে ট্যানাসের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো ও। ঠিক বাচ্চা মেয়েদের মতোই কোলে তুলে নিলো ট্যানাস ওকে। ছটফট করে আলিঙ্গন ছাড়ালো লসট্রিস, পাগলের মতো খুঁজে ফিরছে প্রেমিকের ঠোঁট। আবেগের তীব্রতায় যেনো পরস্পরকে পিষে ফেলবে ওরা।

ছায়া ঘেরা সমাধি-প্রকোষ্ঠে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। যদিও এই যুগলকে একত্র করার জন্যে সমস্ত ষড়যন্ত্রের মূলে ছিলাম আমি স্বয়ং; আজ, ওদের মিলনের দিনে কী অনুভূতি আমাকে তাড়া করে ফিরছিলো, তা লিখবো না বলে ঠিক করেছি। আমি বিশ্বাস করি, ঈর্ষা হলো আমাদের সবচাইতে খারাপ রীপু, কিন্তু এ-ও তো সত্যি, আমি ভালোবাসি লসট্রিসকে, ঠিক যেমন ট্যানাস ভালোবাসে ওকে। এ ভালোবাসা ভ্রাতৃসুলভ অথবা পিতৃসুলভ বাৎসল্য নয়। হতে পারে আমি অপুরুষ, একজন সাধারণ স্বাভাবিক মানুষের মতোই আমি কামনা করি ওকে। কোনো মানে হয় না। আমি জানি। হয়তো এ জন্যেই বড়ো তিক্ত এই অনুভূতি। ওখানে দাঁড়িয়ে ওদের দেখা সম্ভব ছিলো না আমার পক্ষে; মার-খাওয়া কুকুরের মতোই পিছিয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু ট্যানাস দেখে ফেললো আমাকে। আমার হৃদয় বিদীর্ণ করা চুমুটা ভেঙে, লসট্রিসের ঠোঁট থেকে নিজের ঠোঁট সরিয়ে নিলো সে।

টাইটা, রাজার পত্নীর সাথে একা ছেড়ে যেও না আমাকে। এখানেই থাকো। প্রলোভন থেকে বাঁচাও আমাদের। নিজের উপর কোনো আস্থা নেই আমার, জানি না কখন অপমান করে ফেলবো নিজেকেই। দেখো, আমি যেনো রাজ-পত্নীর কোনো অসম্মান না করি।

ভাগো, চিৎকার করে বলে উঠলো লসট্রিস, ট্যানাসের বাহুবন্ধনে। একা থাকতে দাও আমাদের। কোনো সম্মান-অসম্মান নিয়ে ভাবতে চাই না আমি। বহুদিন থেকে অপেক্ষা করে আছি, আমাদের ভালোবাসা অপেক্ষা করে আছে। কবে, কখন ইন্দ্রজাল সত্যি হবে এই আশায় বসে থাকতে পারবো না। আমাদেরকে একা থাকতে দাও, প্রিয় টাইটা।

সমাধি-প্রকোষ্ঠ থেকে পালিয়ে এলাম, যেনো আমার জীবন বিপন্ন হতো তা না হলে। আর একটু হলেই ঝড়ের মধ্যে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে প্রাণ হারাতাম। হয়তো, সেটাই ঠিক হতো। কিন্তু কাপুরুষ যে আমি ঠিক ঠিক রয়ে গেলাম প্রবেশমুখের কাছে। সুড়ঙ্গের এক কোণায় বয়ে নিলাম নিজেকে। এখন আর বাতাসের গর্জন শুনছি না। মাথার উপর পশমী চাদরটা দিয়ে ঘিরে চোখ-কান বন্ধ রাখতে চাইলাম। কিন্তু, ঝড়ের উন্মত্ততা সত্ত্বেও সমাধি-প্রকোষ্ঠ থেকে ভেসে আসা অস্ফুট ধ্বনি পরিষ্কার পৌঁছুলো আমার কাছে।

সমস্ত হিংস্রতা নিয়ে একটানা দুই দিন বয়ে গেলো সেই ঝড়। জোর করে নিজেকে ঘুমাতে বাধ্য করেছিলাম আমি, কিন্তু যখনই জেগে বসে থাকতাম ওদের দুজনের প্রেম-মত্ত শীকার আমাকে নির্যাতন করতো। কী আশ্চৰ্য্য, রাজার শয্যায় কখনো এমন করে নি লসট্রিস; অবশ্য ওই বুড়ো মানুষটার শরীর নিঃসন্দেহে ওর উপযোগী নয়।

অদ্ভুত যন্ত্রণার এক জগতের বাসিন্দা হয়ে রইলাম আমি। ওদের চিৎকার, গোঙানো আর ফিসফিস আলাপন এঁফোড়-ওফোঁড় করে ফেললো আমার হৃদয়। নারী কণ্ঠের ছন্দোবদ্ধ শীকার, কাতর ধ্বনি আমাকে ধ্বংস করে দিতে চাইলো। খোঁজা-করা ছুরির চাইতেও বেশি বেদনাপূর্ণ ছিলো পুলকের শিখড়ে পৌঁছা লসট্রিসের আর্তনাদ।

শেষমেষ, ধরে এলো বাতাস। এখন আর গর্জন নয়, পাহাড়ের গায়ে লেগে মৃদু গোঙাতে লাগলো। ধীরে, আলো বাড়লো । ট্রাস-এর গোরস্থানে আমাদের আশ্রয়ের তিন দিন পেরিয়ে গেছে। উঠে দাঁড়িয়ে ওদের দুজনকে ডাকলাম আমি। ভয়ে সমাধি প্রকোষ্ঠে ঢুকলাম না–পাছে কি না কি দেখতে হয়। বেশ কিছুক্ষণ কোনো উত্তর পেলাম না; এরপর ভাঙা ভাঙা, ভারী কণ্ঠে আমার কী জানতে চাইলো, ওটা কী তুমি, টাইটা? আমি তো ভেবেছিলাম, মরে গিয়ে স্বর্গে পৌঁছে গেছি!

*

ঝড় থেমে গেছে, কাজেই আর বেশি সময় নেই আমাদের হাতে। নিশ্চই ইতিমধ্যে রাজ-শিকারীরা আমাদের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। ঝড়ের কারণে অনুপস্থিতির একটা অজুহাত মিলে গেলো। আমার ধারণা, ঝড়ের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া দলটা এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে উপত্যকায়। কিন্তু ট্যানাসের সঙ্গে আমাদের কেউ দেখে ফেললে বিপদ হবে।

ওদিকে, এই ক দিনে খুব কমই বাক্য বিনিময় করেছি আমি আর ট্যানাস। অনেক ব্যাপারে আলাপ করবার আছে। সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে পরিকল্পনা সাজিয়ে নিলাম আমরা।

বেশ শান্ত-সৌম্য হয়ে গেছে লসট্রিস, কখনো এমন দেখি নি ওকে। মোটেও বকবক করছে না, নীরবে ট্যানাসের পাশে দাঁড়িয়ে অপলকে চেয়ে চেয়ে দেখছে ওকে। দেবতার মূর্তির সামনে দাঁড়ানো একজন মহিলা-পুরোহিতের কথা মনে করিয়ে দিলো ও আমায়। এক মুহূর্তের জন্যেও ট্যানাসের মুখ থেকে সরলো না তার দৃষ্টি, মাঝে-মধ্যেই ছুঁয়ে দেখছে যেনো নিশ্চিত হতে চাইছে ট্যানাস আছে ওর সম্মুখে।

যখনই এমনটা করছিলো লসট্রিস, কথা বন্ধ করে ফেলছিলো ট্যানাস। হারিয়ে যাচ্ছিলো ওর গাঢ়-সবুজ চোখে। শেষমেষ, ডেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে হলো ওকে। এহেন আহ্বাদের সামনে আমার নিজস্ব অনুভূতিগুলো নিতান্তই খেলো মনে হলো, জোর করে ওদের আনন্দে শরিক হতে নিজেকে বাধ্য করলাম।

বেশ অনেকটা সময় লেগে গেলো কথা শেষ হতে। অবশেষে ট্যানাসকে বিদায় জানিয়ে আলিঙ্গন করলাম আমি, খচ্চরটা টেনে নিয়ে বাইরের মরুতে বেরিয়ে এলাম। মিহি বালুকণা এখনো বাতাসে ভাসছে। লসট্রিস থেমে দাঁড়াতে, নিচের উপত্যকায় নেমে ওর অপেক্ষায় রইলাম আমি।

পেছনে তাকাতে ওদের দু জনকে সুড়ঙ্গ-মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। বেশ ক মুহূর্ত পরস্পরের চোখে চোখে চেয়ে রইলো ওরা, স্পর্শ করলো না। এরপর একটি কথাও না বলে ঘুরে, হনহন করে হেঁটে চলে গেলো ট্যানাস। দৃষ্টিসীমায় ও থাকা পর্যন্ত সেদিকে চেয়ে রইলো আমার কী, তারপর নিচে নেমে এলো। যেনো স্বপ্নের ঘোরে আছে এখনো।

ওকে খচ্চরের পিঠে চড়তে সাহায্য করলাম, দড়িগুলো আঁটো করছি যখন; একটু ঝুঁকে আমার হাত নিজের হাতে নিলো লসট্রিস। ধন্যবাদ, টাইটা।

কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কোনো প্রয়োজন নেই, জানালাম ওকে।

পুরো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ আমি এখন। ভালোবাসা সম্পর্কে তোমার প্রতিটি কথা সত্যি। আমার সাথে একটু আনন্দ করো, যদিও আমি জানি– এই পর্যায়ে এসে থেমে গেলো সে। হঠাৎই বুঝতে পারলাম, আমার ভেতরের অনুভূতিগুলো ওর অজানা নয়। এতে আনন্দের মাঝেও আমার দুঃখ তাকে ছুঁয়েছে। সেই মুহূর্তে ওকে যতোটা ভালোবেসেছিলাম, জানি, সারা জীবনেও অতোটা বাসি নি।

খচ্চরের লাগাম হাতে নিয়ে নীল নদের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমি।

*

উঁচু একটা পাহাড়ের উপর থেকে আমাদের সনাক্ত করলো একজন রাজ-শিকারী । দ্রুত ধেয়ে এলো সে।

রাজা নির্দেশে আপনাদের খুঁজছি আমরা, হাঁপাতে হাঁপাতে বললো সে।

উনি অক্ষত আছেন? জানতে চাইলাম আমি।

গজ-দ্বীপের প্রাসাদে নিরাপদে আছেন তিনি। আমাদের উপর নির্দেশ আছে, কর্ত্রী লসট্রিসকে খুঁজে পাওয়া মাত্র তার কাছে নিয়ে যেতে হবে।

প্রাসাদের ঘাটে যখন পা ফেললাম আমরা, দেখি, আতন দাঁড়িয়ে ওখানে; থেকে থেকে প্রসাধন-চর্চিত গাল ফোলাচ্ছে অভিমানের আতিশায্যে। ঝড়ে মারা-পড়া তেইশজনের লাশ পাওয়া গেছে, স্বস্তির সাথে আমাদের জানালো সে। সবাই নিশ্চিত ছিলো, তোমরাও মরে গেছে। কিন্তু, আমি প্রার্থনা করেছি হাপির কাছে, যেনো নিরাপদে ফিরে আসো তোমরা। কেবল গা ধোয়া-মোছা আর সামান্য সুগন্ধি তেল মাখবার সময় পাওয়া গেলো। এরপরই, আমাদেরকে রাজ-দরবারে নিয়ে গেলো আতন।

মিসট্রেসের প্রত্যাবর্তনে সত্যিই আলোড়িত হলেন ফারাও। ঠিক অন্য সবার মতোই লসট্রিসকে ভালোবেসে ফেলেছেন উনি, সেটা কেবল এ জন্যে নয় যে তার অমরত্বের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে ওর গর্ভে। তাঁর সামনে যখন ঝুঁকে কুর্নিশ করছিলো লসট্রিস, ভিজে উঠলো রাজার চোখ।

ভেবেছিলাম, তোমাকে হারিয়েছি আমি, ধরা গলায় বললেন ফারাও। রাজকীয় আভিজাত্য অনুমতি দিলে হয়তো আলিঙ্গনই করতেন লসট্রিসকে। কিন্তু এখন দেখছি, আগের চাইতে অনেক বেশি সৌন্দৰ্য্য আর প্রাণশক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে। একদম সত্যি কথা। ভালোবাসার অমূল্য মুহূর্তগুলো বিশেষ জাদু দিয়েছে লসট্রিসের অবয়বে।

টাইটা বাঁচিয়েছে আমাকে, ফারাওকে বললো মিসট্রেস। পথ দেখিয়ে একটা আশ্রয়ে নিয়ে ভয়ঙ্কর বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। ও না থাকলে, অন্য অনেকের মতো মরে পরে থাকতাম।

সত্যি, টাইটা? সরাসরি জানতে চাইলেন ফারাও। বিনয়ী ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে বললাম, আমি তো কেবল উছিলা, এ যে দেবতাদের কৃপা।

হাসলেন ফারাও। জানি, আমাকেও অত্যন্ত পছন্দ করেন তিনি। তুমি বহুভাবে আমাদের সেবা দিয়েছে, হে দেবতাদের উছিলা! কিন্তু আজ যা করেছে, তার কোনো তুলনা হয় না। সামনে এসে দাঁড়াও! তাঁর নির্দেশে সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে দাঁড়ালাম।

আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছোট্ট সিডার কাঠের একটা বাক্স খুললো আতন। ভেতর থেকে স্বর্ণের একটা হার বের করলেন ফারাও। বিশুদ্ধ, অমিশ্রিত স্বর্ণ আছে ওতে । রাজ-স্বর্ণকারের প্রতীক অঙ্কিত, কম করে হলেও বিশ ডেবে হবে ওটার ওজন।

আমার গলায় হারটা পড়িয়ে দিয়ে রাজা বলে উঠলেন, তোমাকে প্রশংসার স্বর্ণ শেকল উপহার হিসেবে দিলাম আমি। এ হলো রাজ্যের শ্রেষ্ঠতম সম্মান, শুধুমাত্র সামরিক ব্যক্তিত্ব অথবা কূটনীতিকদের জন্যে বরাদ্দ করা হয়; অথবা রাজ-উজিরের মতো উচ্চ-পদস্থ লোকেদের ভাগ্যে জোটে। আমাদের এই মিশরের ইতিহাসে কখনো, কোনো দাসের গলায় ওটা শোভা পায় নি।

কিন্তু সেদিনে এ-ই আমার পুরুষ্কারের শেষ নয়। তখনো আমার কর্ত্রীর উপহার বাকি আছে। সেই সন্ধাতে, যখন ওর গোসল তদারকি করছিলাম, হঠাৎই সমস্ত দাসীদের তাড়িয়ে দিলো লসট্রিস। আমার সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন দাঁড়িয়ে বললো, আমাকে পোশাক পরতে সাহায্য করো না, টাইটা। ও জানে, কতোটা উপভোগ করি আমি কাজটা।

তলপেটের গোড়ায় কোঁকড়া চুলগুলো যেনো ঝকমক করছে। মনে হলো, ট্যানাসের সঙ্গে দিনগুলো ওর সৌন্দৰ্য্যকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ভেতর থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে রূপ-ছটা। লসট্রিস যেনো জ্বলছে রূপের আগুনে।

কখনো ভাবিনি, আমার এই শরীরে এতো সুখ আছে। নিজের নগ্ন দেহের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলো লসট্রিস। চাইছে আমিও তাই করি। ঠিক যা যা বলেছিলে, ট্যানাসের সাথে থাকার সময় তেমনটি বোধ হয়েছিলো, টাইটা। ফারাও তোমাকে প্রশংসার স্বর্ণ শেকল দিয়েছেন, আমিই বা পিছিয়ে থাকবো কেনো? আমিও চাই, এই আনন্দে তোমাকে একটা উপহার দিতে।

তোমার সেবায় আসতে পারাই আমার সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার।

পোশাক পরিয়ে দাও, ও নির্দেশ দিলো আমাকে। মাথার উপরে উঁচু করে ধরলো হাত দুটো। যেনো জীবন্ত লাফিয়ে উঠলো বুকজোড়া। আমার চোখের সামনেই তো বড়ো হয়েছে ও দুটো। ধীরে রাতের পোশাক চড়িয়ে দিলাম ওর অনবদ্য শরীরে। এতে করে যেনো আরো খোলতাই হলো ওর সৌন্দর্য ঠিক যেমনি করে সকালের কুয়াশার আবরণে আরো সুন্দর দেখায় নীলের জল।

ভোজসভার আয়োজন করেছি আমি, সকল রাজ-বধূদের দাওয়াত করেছি।

খুব ভালো, মাই লেডি। আয়োজন সফল করতে সবকিছু করবো, চিন্তা করো না।

আরে, না, না। তোমার সম্মানে ওই ভোজসভা। আমার পাশে অতিথি হিসেবে বসবে তুমি।

এর চেয়ে ভয়ানক কথা কে কবে শুনেছে? পাগল হয়েছে, মিসট্রেস? ওটা রীতি নয়।

আমি ফারাও-এর স্ত্রী। রীতিনীতি সমস্ত আমারই তৈরি। ভোজসভায় তোমার জন্যে একটা উপহার দেবো। সবার সামনে সেই উপহার গ্রহণ করবে তুমি।

কী উপহার? দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জানতে চাইলাম। কোন্ বিদঘুঁটে কাণ্ড করছে এবারে লসট্রিস, কে বলবে?

নিশ্চই বোলবো, রহস্য করে হাসলো ও। তবে এখন নয়।

*

যদিও আমার সম্মানেই ডোজসভা, তথাপি রান্না-আয়োজনের ভার তো আর রাধুনি-দাসী মেয়েদের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না। মেজবান হিসেবে আমার কর্ত্রীর সম্মানের দিকটাওতো দেখতে হবে। পরদিন সূর্যোদয়ের আগেই বাজারে গিয়ে সবচেয়ে তাজা মাছ-সবজি নিয়ে এলাম।

আতনকে প্রতিজ্ঞা করে বলেছি, ও থাকবে নিমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে; রাজার মদের ভাড়ার খুলে দিয়ে ওখান থেকে আমার পছন্দমতো জিনিস নেওয়ার সুযোগ করে দিলো সে। শহরের সেরা বাদক দল আর কসরৎ প্রদর্শনকারীদের ভাড়া করেছি। ইতিমধ্যেই আমাদের বাগানে ফুটে থাকা অসংখ্য ফুলের সমারোহ উৎসবের আমেজ নিয়ে এসেছে। অভ্যাগত অতিথিদের বসার জন্যে ফুল বিছানো নরম তুলোর তাকিয়া সাজিয়ে রাখলাম।

রাত নামতেই রাজ-বধূরা আসতে শুরু করলো একে একে। কেউ কেউ নিজেদের আসল চুল ফেলে দিয়ে পেটের দায়ে গরিবের বিক্রি করা চুল থেকে তৈরি পরচুলা পরে এসেছে। সবচেয়ে ঘৃণা করি আমি এই সাজ, জীবনের সমস্ত শক্তি দিয়ে হলেও আমার মিসট্রেসকে ওটা করতে বাধা দেবো এ আমার প্রতিজ্ঞা। ওর দীর্ঘ কালো চুলগুলো অসাধারণ সম্পদ; কিন্তু এমনকি সবচেয়ে রূপসী মেয়েকেও সাজ-সজ্জার ব্যাপারে বিশ্বাস করতে নেই।

লসট্রিসের চাপাচাপিতে বাধ্য হয়ে নরম গদিতে, ওর পাশে বসতে হলো। আমার এই আসনে সমাগত অতিথিদের মধ্যে কানা-ঘুষা শুরু হয়ে গেলো। আমার মতো তারাও চরম অস্বস্তিতে ভুগছে। অনেকটা অস্বস্তি কাটানোর জন্যেই দাস বালকগুলোকে ইশারায় জানালাম মদের পাত্রগুলো পূর্ণ করে দিতে। বাদ্য বেজে উঠতে নাচতে শুরু করে দিলো ভাড়া করে আনা নাচিয়েরা।

দারুন খাঁটি মদ, অসাধারণ আবেদনময়ী সুর আর পুরুষ নাচিয়েদের প্রদর্শনীতে মুহূর্তে জমে গেলো আমাদের অনুষ্ঠান। নাচিয়েদের আগেই বলে রেখেছিলাম, যেনো প্রকৃতি-প্রদত্ত ত্বক ছাড়া খুব কম বস্ত্র পরিধান করে আসে; কথামতো নিজেদের লিঙ্গ পরিচয় প্রদর্শনে ব্যপৃত হলো তারা। আমাদের রাজ-বধূরা অত্যন্ত চমৎকৃত হলো এমন আয়োজনে, খুব দ্রুতই মদ তার প্রভাব বিস্তার করলো। আমি নিশ্চিত, বেশিরভাগ পুরুষ নাচিয়ে সকালের আগে হারেম ছেড়ে যাবে না। অনেক রাজ-বধূরই শারীরিক চাহিদা অফুরন্ত, আর রাজা সবাইকে শয্যাপাশে ডেকে নেন না। অনেকের ক্ষেত্রে বছর পর্যন্ত গড়িয়ে যায় ।

এই যখন পরিস্থিতি, আমার মিসট্রেস উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। এরপর, আমার আর ওর ফেলে আসা জীবনের এতো কথা বলতে শুরু করলো। আমি পর্যন্ত লজ্জা পেয়ে গেলাম। সুরার প্রভাব কমবেশি সবার উপরেই পড়েছে, কেউ কেউ দেখলাম বিনা কারণে কাঁদছে। অনেকে আবার মিসট্রেসের আমাকে নিয়ে বলা কথা শুনে হর্ষধ্বনি করতে শুরু করলো।

যা হোক, এই পর্যায়ে এসে আমাকে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসার আদেশ দিলো লসট্রিস। বিশুদ্ধ লিনেনের তৈরি একটা আঁটো জামা পড়েছি আমি, চুলগুলো সুন্দর করে টেনে আঁচড়ে দিয়েছে দাসী মেয়েরা। গলার চারধারে প্রশংসার স্বর্ণ-শেকল ছাড়া শরীরে উপরিভাগে আর কোনো বস্ত্র নেই। এমন জাঁক-জমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে আমার এই সাধারণ বেশ-ভূষা ছিলো সত্যিই মনে গেঁথে যাওয়ার মতো। নিয়মিত সাঁতার আর ব্যায়ামের কারণে আমার শরীরও চমৎকার অবস্থায় আছে। সেই সময়ে আমার স্বাস্থ্য আসলেও চোখে পড়ার মতো ছিলো।

শুনলাম, এক বয়স্কা রাজ-বধূ তার পাশের জনকে বলছে, আফসোস, বেচারা ওর আসল জিনিসটাই হারিয়ে ফেলেছে। না হলে যে কী অসাধারণ একটা খেলনা হতো সে! আজকে সন্ধার জন্যে এই কথাগুলো উড়িয়ে দিতে পারি আমি, অন্য সময়ে হলে হয়তো বুকে বড়ো বাজতো।

বেশ আত্মতৃপ্ত দেখাচ্ছিলো লসট্রিসকে। এতটা সময় পর্যন্ত ওর উপহার সম্পর্কে আমাকে অন্ধকারে রেখেছে সে। সাধারণত, আমার কাছ থেকে কোনো কিছু গোপন রাখতে পারে না ও। আমার নিচু করে রাখা মাথার দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে শুরু করলো লসট্রিস।

দাস টাইটা, আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তুমি ছায়া হয়ে পাশে থেকেছে। তুমিই ছিলে আমার অভিভাবক, তুমিই আমার শিক্ষক। আমি লিখতে-পড়তে শিখেছি তোমার কাছে। নক্ষত্ররাজীর রহস্য থেকে শুরু করে শিল্পকলা সবকিছু তুমিই শিখিয়েছো। কেমন করে সুখ আর পরিতৃপ্তি খুঁজে পেতে হয়, এ আমি তোমার কাছে। শিখেছি। আমি কৃতজ্ঞ।

আবারো উসখুস করতে শুরু করে দিলো রাজ-বধূরা; জীবনেও কোনো দাসের জন্যে এতো প্রশংসা বাণী কেউ কখনো শুনে নি।

খামসিন-এর দিনে আমার জন্যে এমন কিছু করেছো তুমি, এর প্রতিদান দেওয়া তো আমার সাধ্যে নেই–তবে পুরস্কার দিতেই পারি। ফারাও তোমাকে প্রশংসার স্বর্ণ শেকলে ভূষিত করেছেন। আমিও তোমাকে কিছু দিতে চাই।

লম্বা আল্লাখল্লার মতো পোশাকের আড়াল থেকে রঙিন সুতায় কারুকাজ করা একটা প্যাপিরাস-স্ক্রোল বের করে লসট্রিস। একজন দাস হিসেবে তুমি আমার সামনে কুর্নিশ করেছে, এবারে মুক্ত একজন মানুষ হিসেবে উঠে দাঁড়াও! প্যাপিরাসের গুটানো কাগজটা আমার উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে ধরে সে। রাজ্যের আইনজ্ঞদের তৈরি প্রত্যয়ন পত্র এটা। আজ থেকে তুমি মুক্ত।

প্রথমবারের মতো মাথা উঁচালাম আমি, চোখে অবিশ্বাস নিয়ে লসট্রিসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার বিবশ আঙুলে প্যাপিরাসের স্ক্রোলটা হস্তান্তর করলো সে, ঠোঁটে পরিতৃপ্তির হাসি।

অবাক হয়েছে, তাই না? মুখ দিয়ে কোনো কথা সরছে না? কিছু অন্তত বলো, টাইটা। বলো, কতোটা সুখী হয়েছো তুমি এই পুরস্কারে?

যেনো বিষমাখা তীরের মতো ওর প্রতিটি শব্দ আঘাত করলো আমাকে। মুখের ভেতর পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে জীভ। মুক্ত একজন মানুষ হলে, চিরদিনের জন্যে লসট্রিসের সঙ্গ হারাতে হবে আমাকে। আর কখনো ওর খাবার প্রস্তুত করতে পারবো না, তদারকি করতে পারবো না স্নানের । ঘুমানোর সময় হলে আর কখনো ওর গায়ের উপর চাদর টেনে দিতে পারবো না। প্রতিদিন ভোর হলে, যখন ওই গাঢ়-সবুজ চোখদুটি প্রথমবারের মতো খুলবে সে–আমি দেখবো না। কোনোদিনও আর গাইবো ওর সঙ্গে, খাবার পাত্র এগিয়ে দেবো না; সাহায্য করবো না পোশাক পরতে।

বজ্রাহত, নিপ্রাণ চোখে অসহায়ের মতো লসট্রিসের দিকে চেয়ে রইলাম।

খুশি হও, টাইটা, যেনো আমাকে আদেশ করলো মিসট্রেস। নতুন এই স্বাধীনতা, যা আমি তোমাকে দিলাম–অমূল্য নয় কি?

আর কোনোদিনও সুখী হতে পারবো না আমি, কান্না রুদ্ধ স্বরে বলে উঠলাম। তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিলে, মিসট্রেস। কেমন করে সুখী হবো, বলো?

নিমিষে হাসি মুছে গেলো লসট্রিসের, দ্বিধান্বিত চোখে আমার দিকে চাইলো সে। আমার ক্ষমতার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান উপহার তোমাকে দিয়েছি-স্বাধীনতা দিয়েছি আমি তোমাকে।

মাথা নাড়লাম। সবচেয়ে খারাপ শাস্তি দিলে তুমি। আমাকে দূরে সরিয়ে দিলে তোমার কাছ থেকে। সুখ কী বস্তু–এ আমি কোনোদিনও আর জানবো না।

কিন্তু, এটা কোনো শাস্তি নয়, টাইটা। এ যে তোমার পুরস্কার। কেনো বুঝছো না?

একমাত্র পুরস্কার যা আমার কাছে মূল্যবান, তা হলো, চিরকাল তোমার পাশে থেকে সেবা করা। ভেতর থেকে যেনো কান্না উথলে উঠলো, অনেক কষ্টে আঁকাতে চাইলাম। দয়া করো, মিসট্রেস। আমাকে ক্ষমা করো। তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ো না। যদি সত্যিই কিছু দিতে চাও, তোমার পাশে থাকতে দাও আমাকে।

কেঁদো না, লসট্রিস আদেশ করে। না হলে, সমস্ত অতিথিদের সামনে আমিও কেঁদে ফেলবো। আমার ধারণা, ততক্ষণ পর্যন্ত তার উপহারের প্রকৃতি অনুধাবন করতে পারে নি লসট্রিস স্বয়ং। চোখের পাতা উপচে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো আমার গাল বেয়ে।

থামো! আমি–আমি এমন কিছু চাই নি। অঝোরে কাঁদতে শুরু করলো লসট্রিসও। আমি তোমাকে সম্মানিত করতে চাইছিলাম–ঠিক রাজা যেমন করেছেন।

টানো প্যাপিরাসটা বাড়িয়ে ধরলাম ওর দিকে। দয়া করে এই কাগজ ছিঁড়ে ফেলার অনুমতি দাও আমাকে। আবার তোমার সেবায় ডেকে নাও আমাকে! তোমার পেছনে–যেটা আমার উপযুক্ত স্থান দাঁড়ানোর অনুমতি দাও।

থামো, টাইটা! তুমি কষ্ট দিচ্ছো আমাকে! জোর করে কান্না গিলে ফেলতে চাইলো সে, কিন্তু আমি নির্দয়ের মতো বলে চললাম ।

তোমার কাছে একটা উপহারই চাই আমি–জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সেবা করার সুযোগ চাই। শোনো মিসট্রেস, অনুমতি দাও–এ কাগজ ছিঁড়ে ফেলি।

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মাথা ঝাঁকালোলসট্রিস। বাচ্চা বয়সে পড়ে গিয়ে হাঁটু ছিলে ফেললে এমন করে কাঁদতো ও। একটানে প্যাপিরাসের স্ক্রোলটা ছিঁড়ে ফেললাম আমি; তারপর আবার; আবার। যেনো এতে সন্তুষ্ট না হয়ে, বাতির শিখায় ওগুলোকে পুড়িয়ে কালো করে ফেললাম।

প্রতিজ্ঞা করো–আর কোনোদিন আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইবে না।

শপথ করো–কখনো আমাকে স্বাধীনতা চাপিয়ে দিতে চাইবে না।

কান্নার ভেতর মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। কিন্তু আমি জোর করলাম।

বলো, জোরে বলো, যেনো সবাই শুনতে পায়।

তোমাকে আমার দাস হিসেবে রাখবো আমি, কখনো কোনোদিনও বিক্রি বা মুক্ত করে দেবো না। কান্নায় ভারী কণ্ঠে বললো মিসট্রেস। এরপর, সবুজ চোখ-দুটো থেকে দুষ্টুমীর ছটা বেরুলো। অবশ্য, যদি–আমার কথা না শোনো সাথে সাথে আইন লেখকদের ডেকে পাঠাবো! এক হাতে ধরে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলো সে। উঠে দাঁড়াও কাঁদুনে ব্যাটা। নিজের কাজ করো। আমার পাত্র খালি হয়ে গেছে।

লসট্রিসের পেছনে, আমার চিরাচরিত জায়গায় ফিরে গেলাম। ভরে দিলাম ওর শূন্য পাত্র। সুরার প্রভাবে টলোমলো অতিথিরা মনে করলো, তাদের মনোরঞ্জনের জন্যে এতক্ষণ একটা নাটক অভিনীত হলো; কাজেই হাততালি দিয়ে, শিষ বাজিয়ে, ফুলের পাঁপড়ি ছুঁড়ে নিজেদের আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলো তারা। বুঝতে পারলাম, অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন যাক, একজন দাস তবে দাস-ই আছে।

সুরার পাত্র ঠোঁটের সামনে ধরলো লসট্রিস, চুমুক দেওয়ার আগে পাত্রের ধারের ওপার থেকে হাসলো একটু। চিরজীবন ওর কাছাকাছি থাকবো আমি–এ আমার প্রতিজ্ঞা।

*

ভোজসভা এবং আমার মুক্তি-প্রহরের দিন সকালে বার্ষিক বন্যার পানিতে নীল নদের প্লাবনের সংবাদে আমাদের ঘুম ভাঙলো। আগে থেকে কিছুই বোঝে নি কেউ; বন্দরের দাড়োয়ানের চিৎকারে সচকিত হলো জনতা। মদের প্রভাবে তখনো ভার হয়ে আছে মাথা, দৌড়ে নদীর ধারে পৌঁছুলাম। ইতিমধ্যেই দুই তীর লোকে-লোকারণ্য হয়ে গেছে। হর্ষ-মুখর জনতা গান গেয়ে, নেচে-প্রার্থনা করে স্বাগত জানালো বানের পানি।

নতুন পানিতে ধুয়ে-মুছে গেলো ঘোলাটে সবুজ রঙ; এখন নদীর বর্ণ দারুন ধূসর। রাতের মধ্যেই বন্দরের পাথুরে সিঁড়ির অর্ধেক ডুবে গেছে, অল্প কিছু সময়ের মধ্যে জমিনে উঠে পড়বে পানি। এরপর, সেচ-খালগুলো ধরে পৌঁছে যাবে তৃষ্ণার্ত ফসলের মাঠে। ডুবিয়ে দেবে কৃষাণের ঘর-দোর, জমিনের সীমানা নির্ধারক খুঁটি।

বন্যাশেষে নতুন সীমানা নির্ধারণ, নীলের জলের অভিভাবকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ধনী এবং ক্ষমবানদের সম্পত্তি বাড়ানোর এই সুযোগ ইনটে কখনো ছাড়েন নি। উপঢৌকনের বদৌলতে তাদের জমিন বাড়িয়ে দিতেন তিনি।

নদীর উজান থেকে ভেসে এলো জলপ্রপাতের গর্জন। প্রকৃতিপ্রদত্ত গ্রানাইটের বাঁধ টপকে ছুটছে বানের পানি; সংকীর্ণ পথে বাধা পেয়ে ফুঁসছে, নীল আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে পানির ফোয়ারা। মিহি জলকণার মেঘ শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে লাগলো দ্বীপের বাসিন্দাদের মুখে । আনন্দে উদ্বেলিত হই আমরা দেবতাদের এই উপহারে; আমাদের ভূ-খণ্ডে বৃষ্টি বলতে এ-ই।

চোখের সামনে দ্বীপের আশেপাশের বেলাভূমি প্লাবিত হতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের ঘা ভেসে যাবে। জলবাগানের দরোজায় কড়া নাড়বে পানি। শুধুমাত্র নাইলোমিটারে পরিমাপ করে বলা যাবে কতদূর পর্যন্ত পৌঁছুবে পানির স্তর। এর উপরই নির্ভর করছে উৎসব অথবা দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব।

হন্তদন্ত হয়ে মিসট্রেসের কাছে ফিরে চললাম, কিছু সময়ের মধ্যেই জল-উৎসব আরম্ভ হবে। ওতে আমার বেশ বড়ো একটা ভূমিকা আছে। সুন্দর পোশাকে সজ্জিত হলাম আমরা দু জন; পুরস্কারের স্বর্ণের হার পরে নিলাম গলায়। এরপর, আমাদের হারেমের অন্যান্যদের সাথে নিয়ে স্বতঃস্ফুর্ত মিছিলে যোগ দিলাম। হাপির মন্দির অভিমুখে চলেছে সবাই।

ফারাও এবং মিশরের সমস্ত মহৎপ্রাণ আমাদের নেতৃত্বে রইলেন। পুরোহিতেরা আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে মন্দিরের ধাপে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কামানো মাথা চকচক করছে তাদের, চোখ উজ্জ্বল–অবশ্যই লোভ জ্বলজ্বল করছে সেখানে, রাজা আজ অনেক দান-সওগাত করবেন যে!

রাজা আসার আগেই দেব-দেবীর মূর্তি নিয়ে যাওয়া হয়েছে মন্দিরে; লাল লিনেন আর ফুলে-ফুলে বোঝাই ওগুলো। সুগন্ধি-তেলে মাখানো হয়েছে মূর্তিগুলো, বন্যার জন্যে প্রার্থনাসূচক গান গাইতে লাগলাম আমরা ওগুলোর সম্মুখে।

বহুদূর দক্ষিণে, যেখানে কোনো সভ্য মানুষের পা পড়ে নি; দুটো অসীম ধারণক্ষমতার কলসী নিয়ে তার পর্বতে আসীন দেবী হাপি–ও দুটো থেকেই নীল নদের পবিত্র জলের উৎপত্তি। দুই কলসীর জলের রঙ, স্বাদ ভিন্ন। একটির রঙ উজ্জ্বল সবুজ; স্বাদ মিষ্টি। অপরটি পলির কারণে গাঢ় ধূসর–যে পলি পড়ে আমাদের জমিন, ফসলের মাঠ উর্বর হয়ে উঠে।

আমাদের সঙ্গিতের মধ্যেই শস্যদানা, গোশত আর মদ, সোনা-রুপা উপঢৌকন হিসেবে দিলেন ফারাও। এরপর তার পরামর্শদাতা, প্রকৌশলী আর গণিতজ্ঞদের ডেকে নিলেন তিনি। নাইলোমিটারে তাদের হিসেব কষতে আদেশ দিলেন।

ইনটেফের দাস থাকার সময়ে আমি জলের পরিমাপে অংশ নিতাম। বিশাল, বর্ণাঢ্য দলে আমার মতো দাস নেই একজনও; কিন্তু কজনের কাছেই বা আছে প্রশংসার স্বর্ণ-শেকল এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। আমাকে অবশ্য উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করলো অন্যান্যরা। ওরা জানে আমার ক্ষমতার কথা, আগে এই কাজ করেছে আমার সাথে। নদীর প্রবাহ পরিমাপের জন্যে নাইলোমিটারের নকশা আমিই করেছি, যে ভবনে তারা কাজ করেন–সেটির নকশাও আমারই করা। যুক্তিগ্রাহ্য অনুমাণ থেকে বন্যার পানির সম্ভাব্য উচ্চতা এবং আয়তন নির্ণয়ের সূত্রও আমার তৈরি।

প্রচুর সাবধানতার সঙ্গে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ মাপ নিলাম আমরা। আগামী পাঁচদিন পালাক্রমে নদীর পানির উচ্চতা এবং সময়ের হিসাব কষে জল-ঘড়ির সাথে মিলিয়ে দেখা হবে। পানির নমুনা থেকে জানা যাবে, কী পরিমাণ পলি আছে ওতে; এ সমস্তই চূড়ান্ত হিসেবে যোগ হবে।

পাঁচদিনের উপযুপরি পরিদর্শন শেষ হতে আরো তিনদিনের জন্যে হিসাব কষতে বসলাম আমরা। অনেকগুলো প্যাপিরাসের স্ক্রোল লাগলো তাতে। শেষমেষ, রাজার কাছে প্রদর্শনের জন্যে চূড়ান্ত হলো হিসাব । রাজকীয় সভাষদসহ মন্দিরে এলেন ফারাও, সাথে এলো অর্ধেক দ্বীপবাসী।

প্রধান পুরোহিত যখন উচ্চস্বরে পাঠ করলো সেই হিসাব, হাসি ফুটে উঠলো রাজার মুখে। প্রায় যথার্থ বন্যার পূর্বাভাস করেছি আমরা। খুব কমও নয়, আবার এতো বেশিও নয় যে, নদীর ধারের গ্রাম আর শহর ডুবিয়ে দেয়। এই বন্যায় দারুন ফসল ফলবে, গবাদীপশুগুলোও মোটা-তাজা হয়ে উঠবে।

এমন নয় যে, দারুন ফসলের পূর্বানুমানের জন্যে হেসেছেন ফারাও; বরঞ্চ তাঁর খাজনা আদায়কারীদের সম্ভাব্য সগ্রহে উদ্বেলিত তিনি। বন্যার হিসেব দেখে খাজনার মান ঠিক করা হয় । এই বছর তাহলে সমাধি মন্দিরের জন্যে অনেক সম্পদ পাওয়া যাবে–এ-ই ছিলো তার আনন্দের কারণ। হাপির মন্দিরে জল-উৎসবের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন তিনি, থিবেস অভিমুখে তীর্থযাত্রা শেষে ওসিরিসের উৎসবের দিনক্ষণ জানালেন। শেষবার ওসিরিসের গীতিনাট্যে আমার কর্ত্রীর অভিনয়ের পর দুই বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে বিশ্বাস হতে চাইলো না আমার।

সারারাত জেগে থেকে ট্যানাসের গল্প শোনাতে হলো মিসট্রেসকে। থিবেস যাত্রা নিয়ে এতো উত্তেজিত হয়ে আছে ও, ঘুম হারাম হয়ে গেছে ।

আর মাত্র আটদিনের মাথায় উত্তরে রওনা হবে রাজকীয় নৌবহর। ওখানে, থিবেসে, আমাদের অপেক্ষায় থাকবে ট্যানাস। আমার কর্ত্রীর আনন্দের কোনো সীমা পরিসীমা রইলো না।

*

বিশাল, রাজকীয় নৌবহর যাত্রার জন্যে তৈরি। আমরা ছাড়াও বাদাবাকি সভাষদ ততক্ষণে বরাদ্দ করা জলযানে চড়ে বসেছি, প্রাসাদের ধাপ টপকে যখন রাজকীয় জলযানে আরোহণ করলেন ফারাও, চেঁচিয়ে উৎসাহ জানালাম আমরা। ফারাও নিরাপদে আসন গ্রহণ করতেই হাজার হাজার বাঁশি ধ্বনিত হলো–এ হলো পাল তোলার সংকেত। একই সঙ্গে পাল তুলে উত্তরে গলুই ঘোরানো হলো জাহাজগুলোর। বন্যার স্রোতে পড়ে তরতর করে বয়ে চললাম আমরা।

আকহ্ হোরাস, শ্রাইকদের ধ্বংস করার পর থেকেই সজীব বাতাস বইতে শুরু করেছে দেশটায় । যতোগুলো গ্রাম পেরিয়ে এলাম আমরা, তীরে এসে রাজাকে অভিবাদন জানিয়ে গেলো অধিবাসীরা। উচ্চ-আসনে বসা, মাথায় জবরজং দ্বৈত মুকুট–মৃদু হাসলেন ফারাও।

আমাদের এই নৌযাত্রায় অন্তত দুই বার জাহাজ ছেড়ে, সভাষদসহ জমিনে নেমে আকহ হোরাসের নিশানা মূর্তিগুলো পরিদর্শন করলেন ফারাও। ক্যারাভান পথের ধারের গ্রামের অধিবাসীরা নরমুণ্ডুর এই মূর্তিগুলো পবিত্র নিদর্শন হিসেবে রেখে দিয়েছে। প্রতিটি মুণ্ডু ঘষে-মেজে চকচকে করে ফেলেছে তারা; কাদা মাটি দিয়ে পিরামিড তৈরি করে রেখেছে। এমনকি নরমুণ্ডুের পিরামিডের চারপাশে শ্রাইন তৈরি করে পুরোহিত পর্যন্ত নিয়োগ করেছে, যেনো এই নিদর্শন নষ্ট না হয়।

দুটো শ্রাইনেই স্বর্ণের আংটি উপহার হিসেবে দিলো লসট্রিস, আমার প্রতিবাদে কোনো কাজ হলো না। অনেক সময়ই খেয়াল করেছি, সম্পদের কোনো হিসেব রাখে না আমার কর্ত্রী । আমি না থাকলে নির্ঘাত হাসি মুখে নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিতো সে।

গজ-দ্বীপ ছাড়ার দশম রাতে, নদীর বাঁকে ছিমছাম একটা ভূখণ্ডে ক্যাম্প ফেললাম আমরা। সেই রাতের আমোদ-প্রমোদের মধ্যে ছিলো দেশের সেরা গল্প-বলিয়ের পরিবেশনা। গল্প দারুন ভালোবাসে আমার কর্ত্রী, এ তো আপনাদের আগে থেকেই জানা। প্রাসাদ ছাড়ার পর থেকেই আজ রাতের ব্যাপারে জল্পনা-কল্পনা করছিলাম আমরা। কিন্তু, দুঃখের সাথে লক্ষ্য করলাম, ক্লান্তি এবং অসুস্থতার জন্যে গল্প শুনতে অপারগতা জানালো লসট্রিস। আমাকে অবশ্য অন্যদের সাথে অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করলো সে, কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় ওকে একা রেখে যাই কি করে? গরম ওষুধ দিয়ে, মেঝেতে ওর পাশে থাকলাম যদি রাতে আমাকে প্রয়োজন হয়।

সকালে যখন ওকে জাগাতে গেলাম, বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছি ততক্ষণে। সাধারণত ঠোঁটে হাসি নিয়ে এক লাফে বিছানা ছাড়ে লসট্রিস। কিন্তু আজ সকালে, মাথার উপরে চাদর টেনে ফিসফিস করে বললো, আর একটু ঘুমাতে দাও, টাইটা। বুড়ি মানুষের মতো ভারী আর ক্লান্ত লাগছে।

রাজা আজ দ্রুত রওনা হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সূর্যোদয়ের আগেই আমাদের জাহাজে চড়তে হবে। গরম একটা পানীয় দেবো তোমাকে, দেখো, ভালো লাগবে তখন। গত পূর্ণিমায় আমার নিজের হাতে তোলা লতাগুল্ম, গরম পানিতে ঢেলে মিশ্রণ তৈরি করলাম।

বেশি কথা বলো না তো, আমাকে দাবড়ি লাগালো মিসট্রেস, কিন্তু ছাড়লাম না আমি। ঘুম থেকে তুলে, পানীয়টুকু খাওয়ালাম। চেহারা বিকৃত করে ফেললো সে। নির্ঘাত আমাকে বিষ খাওয়াচ্ছো। বললো লসট্রিস। এরপর, কোনোরকম সতর্কতা না জানিয়ে বমি করে ফেললো।

একেবারে চমকে গেছি আমরা দু জনেই।

কী হয়েছে আমার, টাইটা? ফিসফিসালো লসট্রিস। এ রকম আর কখনো হয়নি।

এরপরই, পুরো ব্যাপারটা বুঝলাম আমি।

খামসিন চেঁচিয়ে উঠলাম। ট্রাসের গোরস্থান! ট্যানাস!

প্রথমটায় শূন্য চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলো সে, এরপর ঠোঁটে জেগে ওঠা হাসিটা পুরো তাবুতে যেনো আলো জ্বেলে দিলো। আমার পেটে বাচ্চা! চেঁচালো লসট্রিস।

এতো জোরে বলো না, মিসট্রেস। আবেদন জানিয়ে বললাম।

ট্যানাসের বাচ্চা! আমার পেটে ওটা ট্যানাসের বাচ্চা! নিঃসন্দেহে। ওর অসুস্থতার পর থেকে রাজাকে ঠেকিয়ে রেখেছিলাম আমি, লসট্রিসের সাথে শারীরিক সম্পর্ক থেকে।

ওহ, টাইটা, স্বাপ্নিক স্বরে বলে উঠে, নিজের রাতের পোশাক তুলে ফেললো লসট্রিস। শক্ত, সমান পেটটাতে হাত বোলাতে লাগলো। ভাবো একবার! ঠিক ট্যানাসের মতো, ছোট্ট একটা শয়তান তৈরি হচ্ছে এখানে। পুরো পেটে আদর করে হাত বোলালো সে। জানতাম, ট্রাসের গোরস্থানে যে সুখ আমি আবিষ্কার করেছি, তার নিদর্শন অবশ্যই থাকবে। দেবতারা আমাকে একটা স্মৃতিচিহ্ন দিয়েছেন। সারা জীবনের জন্যে।

বেশি বকো তুমি, সতর্ক করে দিয়ে বললাম। এমনও হতে পারে, এ সামান্য পেট ব্যথা । নিশ্চিত হওয়ার আগে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

কোনো পরীক্ষার দরকার নেই আমার। আমার মন বলছে–ওটা আমার বাচ্চা।

তারপরও পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। বলে, একটা পাত্র আনতে ছুটলাম। ওটাতে আমার মিসট্রেসের দিনের প্রথম প্রস্রাব সংগ্রহ করে, সমান দুই ভাগে ভাগ করলাম।

প্রথম অংশের প্রস্রাবের সঙ্গে সমান পরিমাণ নীল নদের জল মেশালাম। এরপর, দুটো পাত্রে কালো মাটি ভরে পাঁচটি করে ধুররা বীজ বপন করলাম। একটি পাত্রে নীল নদের বিশুদ্ধ জল, অপর পাত্রে আমার কর্ত্রীর মিশ্রণ ঢেলে দিলাম। এটা হলো প্রথম পরীক্ষা।

এরপর, ক্যাম্পের ধারের আগাছার ভেতর খুঁজে-পেতে দশটি ব্যাঙ ধরে নিয়ে এলাম। কালো, পিচ্ছিল প্রাণী ওগুলো। স্কুল দেহে কোনো ঘাড় নেই, চ্যাপ্টা মাথার উপরে বসানো ড্যাবড্যাবে চোখ দুটো। ছেলেমেয়েরা বলে আকাশ-পণ্ডিত।

দুটি পাত্রে নদীর জল ঢেলে পাঁচটি করে আকাশ-পণ্ডিত রাখলাম। একটির মধ্যে আমার কর্ত্রীর শরীরের তরল ঢেলে দিলাম, বাকিটা আগের মতোই রইলো। পরদিন সকালে, গ্যালির উপরে আমার কর্ত্রীর প্রকোষ্ঠের গোপনীয়তায় চাদর দিয়ে ঢাকা পাত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখলাম।

যে শস্যদানার পাত্রে লসট্রিসের তরল ছিলো, সবুজ চারাগাছ দেখা দিয়েছে ওটাতে, বাকিগুলো আগের মতোই আছে। পাঁচ আকাশ-পণ্ডিত যেগুলো আমার কর্ত্রীর আশীর্বাদ পেয়েছে, লম্বা, রুপালি ডিম পেড়েছে। বাকি পাঁচ বেচারা শূন্য পাত্রে বসে আছে ড্যাব-ড্যাবে চোখে।

বলেছিলাম না, আমি কোনো কিছু বলার আগেই লাফিয়ে উঠলো লসট্রিস। দেবতাদের ধন্যাবাদ! এ চেয়ে সুখের কিছু আর ঘটে নি আমার জীবনে!

এখনই আতনের সাথে কথা বলতে হবে আমাকে। আজ রাতেই রাজার শয্যায় যাবে তুমি। শান্তস্বরে বললাম ওকে। হতবুদ্ধ লসট্রিস একদৃষ্টে চেয়ে রইলো আমার পানে।

এমনকি ফারাও পর্যন্ত এটা বিশ্বাস করবেন না, মরু ঝড়ের বাতাসে ভেসে আসা বীজে গর্ভবতী হয়ে পড়েছো তুমি। ওই ছোট্ট জারজটার জন্যে একটা সৎ-পিতা খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। ইতিমধ্যেই, পেটের বাচ্চাকে আমাদের বলে সম্বোধন করতে শুরু করে দিয়েছি আমি। গম্ভীর ভাবভঙ্গির আড়ালে আমি নিজেও আনন্দে আত্মহারা।

আর কখনো ওকে জারজ বলবে না! জ্বলে উঠলো লসট্রিস। ও একজন রাজকুমার হবে!

অবশ্যই হবে, যদি আরকি ওর জন্যে রাজ-পিতা জোগাড় করতে পারি। তৈরি হয়ে নাও, রাজার কাছে যাচ্ছি আমি।

*

গতরাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি, মহান মিশর, ফারাওকে বললাম। এতো অসাধারণ ছিলো সেই স্বপ্ন; নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আমন রার ইন্দ্রজাল অনুশীলন করেছিলাম।

আগ্রহের আতিশায্যে সামনে ঝুঁকে বসলেন ফারাও; অন্য সবার মতোই আমার স্বপ্ন আর আমন রার ইন্দ্রজালের ভক্ত হয়ে গেছেন তিনিও।

এইবারে, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই আর, মহান ফারাও। আমার স্বপ্নে দেবী আইসিস এসেছিলেন, তিনি আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করে গেছেন, তার ভাই সেথ এর কারণে আপনার যে পুত্রসন্তান নষ্ট হয়েছিলো, তার ক্ষতিপূরণ তিনি স্বয়ং দেবেন। ওসিরিসের উৎসবের প্রথম রাতেই আমার কর্ত্রীকে আপনার শয্যাপাশে ডেকে নিন, শীঘ্রই আরো একটি পুত্রসন্তান উপহার পাবেন। এ দেবী আইসিসের প্রতিজ্ঞা।

আজই তো উৎসবের শুরু, আনন্দে উদ্বেলিত রাজা বলে উঠলেন, সত্যি কথা হলো, টাইটা, গত একমাস থেকেই ওই কাজ করার জন্যে উত্তেজিত হয়ে আছি আমি। তোমার নিষেধের কারণে কিছু বলিনি। কিন্তু, আমন রার ইন্দ্রজালে কী দেখলে, কই, বললে না তো! আবারো, সামনে ঝুঁকে বসলেন ফারাও, আমিও তৈরি।

ঠিক আগের বারের মতোই, তবে এবারে আরো পরিষ্কার, আরো খুঁটিনাটি সমৃদ্ধ। সেই বৃক্ষের সমুদ্র নদীর তীর ধরে অনন্তকাল পর্যন্ত টিকে আছে, মাথায় মিশরের দ্বৈত-মুকুট। আপনার বংশধারা শক্তিশালী, সময়ের শেষ পর্যন্ত টিকে আছে।

সন্তুষ্টির দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফারাও। যাও, মেয়েটাকে পাঠাও আমার কাছে।

তাঁবুতে ফিরে দেখি, আমার অপেক্ষায় বসে আছে লসট্রিস। সুন্দর করে সেজেছে সে।

আমি চোখ বন্ধ করে রাখবো পুরোটা সময়। ভাববো, ট্যানাসের সঙ্গে সেই ট্রাস এর সমাধিতে রয়েছি। বলে খিলখিল করে হেসে ফেললো মিসট্রেস। অবশ্য, রাজার সঙ্গে ট্যানাসের তুলনা অনেকটা ইঁদুরের লেজের সঙ্গে হাতির শুড়ের তুলনার মতো!

রাতের খাবারের ঠিক পর পরই রাজার তাঁবুতে লসট্রিসকে নিয়ে যেতে এলো আতন। শান্ত, দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলো লসট্রিস; হয়তো, ওর ছোট্ট রাজকুমারের কথা ভাবছিলো, ভাবছিলো তার সত্যিকারের বাবার কথা থিবেসে যে আমাদের পথ চেয়ে বসে আছে।

*

প্রিয়তমা থিবেস, একশো দরোজার নগরী, রূপসী থিবেস কী যে খুশি হয়েছিলাম আমরা, নদী তীরের ঝকঝকে মন্দির আর শহরের দেয়াল যখন দেখা দিলো সামনে।

পরিচিত সমস্ত স্থাপনা দেখতে পেয়ে আপ্লুত আমার কত্ৰী গান গেয়ে উঠলো। অবশেষে, যখন উজিরের প্রাসাদের ঘাটে ধীরে ভীড়লো আমাদের গ্যালি, ঘরে ফেরার আনন্দ ম্লান হয়ে এলো আমাদের। নীরব হয়ে গেলাম দু জনেই। নিজের পিতাকে দেখতে পেয়ে ভয়-পাওয়া শিশুদের মতো আমার হাত জড়িয়ে ধরলো লসট্রিস।

উজির ইনটেফ, সঙ্গে বুড়ো-আঙুলবিহীন তার দুই ছেলে-মেনসেট আর সোবেক দাঁড়িয়ে আছে অভ্যর্থনা বাহিনীর সামনের সারিতে; তাদের পেছনে মিশরের তাবৎ মহৎ প্রাণ, জমিদার, প্রভুরা । ঠিক যেমন কল্পনা করেছিলাম, দারুন শক্তিমান সুদর্শন আছেন ইনটেফ। ভেতরে ভেতরে দমে গেলাম আমি।

তোমাকে এখন থেকে সতর্ক থাকতে হবে, টাইটা, লসট্রিস ফিসফিস করে বললো আমার কানে, সুযোগ পাওয়া মাত্রই তোমাকে রাস্তা থেকে হঠিয়ে দেবে এরা।

রাজ-উজিরের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে র‍্যাসফার। আমার অনুপস্থিতির সময়টাতে নিঃসন্দেহে পদোন্নতি পেয়েছে সে। তার মাথায় দশ হাজারের সেরা উপাধির টুপি। হাতে স্বর্ণ-মণ্ডিত চাবুক। মুখমণ্ডলের মাংশপেশির অবশ্য কোনো উন্নতি হয়নি, মুখের একপাশ এখনো ঝুলে আছে, লালা গড়াচ্ছে ওখান থেকে। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার দিকে নজর পড়লো তার, অর্ধেক-মুখে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি। ব্যাঙ্গ করে চাবুক মাথার উপরে তুলে অভিবাদন জানালো।

তোমাকে শপথ করে বলছি, মিসট্রেস, প্রতিটি মুহূর্ত ছোরার বাটে হাত রাখবো আমি; ফলমূল ছাড়া আর কিছু মুখে তুলবো না যতদিন রাসফার থিবেসে আছে। বিড়বিড় করে বলে, স্বতঃস্ফুর্ত ভঙ্গিতে আমিও ফিরিয়ে দিলাম র‍্যাসফারের হাসি।

কোনো রকম উপহার গ্রহণ করবে না, লসট্রিস বলে উঠলো। আর আমার বিছানার পায়ের কাছে ঘুমাবে রাতে। দিনে সব সময় আমার পাশে থাকবে, এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করতে যেনো না দেখি।

যা বলেছো-অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। ওকে অভয় দিয়ে বললাম। সত্যিই, পরবর্তী দিনগুলোতে লসট্রিসের কাছাকাছি রইলাম আমি; জানি, আর যাই হোক, মেয়ের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোনোকিছু করে সিংহাসনে বসার সুযোগ ইনটেফ নষ্ট করতে চাইবেন না।

স্বাভাবিক কারণেই, রাজ-উজিরের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যেই রইলাম আমরা বেশিরভাগ সময়। ওসিরিসের উৎসবের মেজবান তো তিনিই। এই সময়টুকুতে যথার্থ পিতা হিসেবে চমৎকার অভিনয় করে গেলেন ইনটেফ, ঠিক একজন রাণীর সাথে যেমন করে ব্যবহার করে মানুষ তেমন আচরণ করলেন মেয়ের সাথে। প্রতিদিন সকালে উপহার, সোনা-গহনা, আইভরি আর মূল্যবান কাঠের উপরে খোদাই করা দেব-দেবীদের মূর্তি প্রভৃতি পাঠালেন। লসট্রিসের আদেশ সত্ত্বেও উপহারগুলো ফেলিনি আমি। মূল্যবান জিনিস হেলায় নষ্ট করা সাজে না। গোপনে ওগুলো বিক্রি করে, শহরে আমার বন্ধু বণিকের সাহায্যে শষ্য ব্যবসায় কাজে লাগালাম টাকাগুলো।

মাঝে-মধ্যেই ইনটেফের ফ্যাকাসে হলুদ চোখে চোখ পড়তে বুঝলাম, আমার প্রতি তার মনোভাব পাল্টায়নি। শত্রুর সঙ্গে মোকাবেলায় তার ধৈৰ্য্য আর রোখ অবিশ্বাস্য। ভীষণ এক মাকড়শার মতো নিজের সৃষ্ট জালের কেন্দ্রে বসে যেনো তিনি–চোখ জ্বলছে ঘৃণার আগুনে। মনে পড়লো, বিষমিশ্রিত দুধের কথা–কেঁপে উঠলাম আমি।

এদিকে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যেমন চলে আসছে, আনন্দ-উল্লাস মুখর পরিবেশে আচার মেনে চললো ওসিরিসের উৎসবের উদযাপন। এইবার অবশ্য হাপির হদে শিকারে অংশগ্রহণ করলো না ট্যানাসের বাহিনী, ওসিরিসের মন্দিরের গীতি নাট্যেও অভিনয় করলো ভিন্ন অভিনেতার দল। ফারাও-এর প্রত্যাদেশ অনুযায়ী আমার রচিত নাটকই পুনরাভিনীত হলো, আগের মতোই হৃদয়-ছোঁয়া সংলাপ আর কাব্যে আপ্লুত হলো জনতা। অবশ্য, আমার কর্ত্রীর মতো সুন্দরী নয় এবারের আইসিস; হোরাসও নয় আমার ট্যানাসের মতো শৌর্য-বীর্যে উদ্ধত। আর র‍্যাসফারের তুলনায় সেথ যেনো বেশি অমায়িক।

গীতিনাট্যের পরদিন নদী পাড়ি দিয়ে সমাধি মন্দিরের নির্মাণকাজ তদারকি করতে চললেন ফারাও; সারাদিনই তার নিকটে থাকার সৌভাগ্য হলো আমার। বহুবার খোলাখুলিভাবে নির্মাণের বিভিন্ন কৌশল নিয়ে আমার মতামত জানতে চাইলেন তিনি। সবসময়ই স্বর্ণের হারটা গলায় পরে থাকলাম আমি, কিছুই নজর এড়ালো না ইনটেফের। আমার প্রতি রাজার স্পষ্ট পক্ষপাতিত্বে তার রোষ ছিলো দেখার মতো। এই কারণে হয়তো আমার বিরুদ্ধে কিছু করার আগে দু বার ভাববেন ভেবে মনে মনে আত্মপ্রসাদ বোধ করলাম।

আমি থিবেস ছাড়ার পর অপর একজন স্থপতি মন্দির নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছেন। নিঃসন্দেহে যে উঁচু মান নির্ধারণ করে গেছিলাম, তার ধারে-কাছেও যেতে পারে নি সে, কাজেও কোনো গতি আসেনি।

হোরাসের মহান মাতার কসম, যদি তুমি এখনো দায়িত্বে থাকতে, টাইটা! দু:খের সাথে মাথা নাড়লেন ফারাও। তোমার কর্ত্রী রাজী হলে, ওর থেকে তোমাকে কিনে নিয়ে এখানে, এই মৃতের নগরে সবসময়ের জন্যে নিয়োজীত করতাম। যে গর্দভটা এখন কাজ করছে, ও ব্যাটা খরচ তো দ্বিগুন করেইছে, কাজের অবস্থাও খারাপ।

হুম। সে একজন তরুণ উন্নাসিক বান্দা। সায় দিয়ে বললাম। রাজমিস্ত্রি, প্রস্তরশিখী ও ব্যাটার বিচি চুরি করে ফেললেও টের পাবে না।

উঁহু, ওর নয়, আমার বিচি চুরি করছে ওরা! ভৎর্সনার স্বরে বলে উঠলেন ফারাও। বরঞ্চ, তুমি খরচের তালিকা মিলিয়ে একটু দেখো, কোথায় কোথায় চুরিটা হচ্ছে–আমাকে জানাও।

অবশ্যই, আমার প্রতি এহেন আস্থা প্রদর্শনের জন্যে বেশ সম্মানিত বোধ করলাম । নতুন স্থপতি আমার নকশা করা বহু কিছু পরিবর্তনের ধৃষ্টতা পর্যন্ত দেখিয়েছে। নিম্ন রাজ্যের লাল ফারাও-এর কারিগরদের মতো সিরিয়ার নকশা নকল করে আমাদের নিজস্ব শিল্প নষ্টের হুমকিতে ফেলে দিয়েছে সে।

সমাধি মন্দিরের ধন-সম্পদ পরিদর্শন করে দিনের বাকি অংশ পার করে দিলেন ফারাও। পরদিনও সেই একই কাজ। এখানে অবশ্য তাঁর অনুযোগ করার মতো কিছু নেই। এই পৃথিবীর ইতিহাসে, কখনো কোনোদিন এতো সম্পদ একত্র করা সম্ভব হয়নি। এমনকি আমি পর্যন্ত স্বর্ণ-খণ্ডের পরিমাণ এবং ঔজ্জ্বল্যে বিরক্ত বোধ করতে শুরু করলাম।

রাজার আগ্রহে পুরোটা সময় লসট্রিস তার পাশে পাশে রইলো। আমার ধারণা, কনিষ্ঠ বন্ধুর প্রতি তাঁর এই আগ্রহ মূলত সত্যিকারের ভালোবাসায় রূপ নিয়েছিলো ততদিনে। কিন্তু এর ফল হিসেবে দারুন ক্লান্ত হয়ে পড়লো মিসট্রেস; নদী পাড়ি দিয়ে থিবেসে ফিরে আসতে একেবারে ভেঙে পড়লো ও। পেটের বাচ্চার জন্যে চিন্তায় পড়ে গেলাম আমি। এখনো রাজাকে লসট্রিসের গর্ভাবস্থার কথা জানানোর মতো সময় আসেনি। সপ্তাহও পেরোয়নি রাজার শয্যাপাশ থেকে ফিরেছে সে, এতো দ্রুত ওকে গর্ভবতী ঘোষণা করা এমনকি আমার পক্ষেও সম্ভব নয়। রাজার কাছে তখনো উদ্দাম, উচ্ছল এক তরুণী সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *