৩. দেবতার মন্দিরে

দেবতার মন্দিরে শেষ হলো ওসিরিসের উৎসব। সমগ্র বিবেসের অধিবাসীরা জড়ো হয়েছিলো মন্দির প্রাঙ্গনে, ভীড়ের চাপে শ্বাস নেওয়া দায়।

শোকে-চিন্তায় পরপর তিনরাত ঘুমাইনি আমি, একে তো ট্যানাসের ভাগ্যে কী ঘটেছে, সেই চিন্তা, তার সাথে ইনটেফের নির্দেশে লসট্রিসের বিয়ের আয়োজনের চাপ যোগ হয়েছে। মিসট্রেসের সাথে আমাকে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি এই কয় দিনে। দাস বালকেরা কেউই এমন উদভ্রান্ত, চিন্তিত অবস্থায় কখনও দেখেনি আমাকে।

ফারাও-এর ভাষণ শুনতে গিয়ে অন্তত দুই বার টলে পরে যাচ্ছিলাম। শেষমেষ, ধরে রাখতে পেরেছিলাম নিজেকে। ওদিকে অর্ধ-সত্য আর কল্পনাপ্রসূত ধ্যান-ধারণা নিয়ে বলে চললেন রাজা।

এটা সত্যি, নিজস্ব অচেতন ঢঙ্গে বলছিলেন তিনি, কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুটা হলেও আনন্দ দিলো আমাকে; ট্যানাসের বলা কথাগুলো মনে দাগ কেটেছে তার। ভাষণে ঘুরে-ফিরে ট্যানাসের নির্দেশিত অসামাঞ্জস্যগুলোর কথা আসছিলো বারবার।

সৈন্য বাহিনীতে যোগদান থেকে অব্যহতি পাবার জন্যে ইচ্ছাকৃত বিকলাঙ্গতা দারুণভাবে নিরুৎসাহিত করা হবে এখন থেকে, বলে চললেন ফারাও, যে কোনো তরুণ সৈন্য বাহিনীতে যোগদান থেকে ক্ষমা চাইলে তার কারণ খতিয়ে দেখা হবে। অন্তত একবার সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ফারাও, ক্লান্ত হাসির সাথে ভাবলাম। মেনসেট আর সোবেক কোনো অভিজ্ঞ যোদ্ধার সামনে নিজেদের বিকলাঙ্গতা নিয়ে জবাবদিহি করছে-ভাবনাটা দারুন আনন্দ দিলো আমাকে। এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা জরিমানা করা হবে, যদি ইচ্ছাকৃত অঙ্গহানীর অভিযোগ প্রমাণিত হয়। সেথ্‌ এর বিশাল বপুর কসম, এবারে অন্তত আমার মনিব ইনটেফের দুই বদমাশ ছেলের উপযুক্ত শাস্তি হবে।

এতো চিন্তার মধ্যেও ফারাও-এর ভাষণ শুনতে শুনতে কিছুটা ভালো বোধ করলাম, ওদিকে রাজা বলে চললেন, এখন থেকে, কোনো বেশ্যা মেয়ে নিজেদের এলাকার বাইরে ব্যবসা করতে পারবে না। দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা জরিমানা হবে এর অন্যথা ঘটলে। এইবারে, বহু কষ্টে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়া থেকে বিরত রাখলাম নিজেকে। ভাবছি, নদী-ফেরত নাবিকেরা কেমন ভাবে নেবে এই সিদ্ধান্ত। ফারাও একেবারে সীমা ছাড়িয়ে ফেলেছেন, কোনো পুরুষ মানুষই নিজের উপভোগের রাস্তায় বাধা পছন্দ করে না।

দারুন উত্তেজনা বোধ করছি। ট্যানাসের ঘোষণার সবদিক বিশেষভাবে ভেবে নজর কেড়েছে ফারাও-এর, এটা এখন পরিষ্কার। এখন কী ট্যানাসকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে শাস্তি দিতে পারেন তিনি? জানি না।

ফারাও-এর কথা তখনও শেষ হয়নি। আমি জেনেছি, আমার কিছু পদস্থ লোকেরা তাদের প্রতি আমার বিশ্বাস এবং আস্থার বরখেলাপ করেছে। খাজনা আদায় এবং সাধারণ মানুষের অর্থ নিয়ে এদের কার্যকলাপ খতিয়ে দেখা হবে। দোষী হলে, ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হবে তাদের। অবিশ্বাসের ধ্বনিতে মুখর হয় জনতা, রাজা কী সত্যিই তার খাজনা-আদায়কারীদের বাধা দিতে সক্ষম হবেন?

ঠিক সেই সময় পেছন থেকে কে যেনো বলে উঠলো, ফারাও মহান। তিনি চিরকাল বেঁচে থাকুন! পুরো মন্দিরে ছড়িয়ে পরে সেই চিৎকার। সম্ভবত ফারাও স্বয়ং, স্বতস্ফূর্ত এই প্রশংসাধ্বনি প্রত্যাশা করেন নি। এতো দূর থেকেও পরিষ্কার বুঝলাম, আনন্দে ঝলমল করছে তার চোখ। চিন্তাক্লিষ্ট অবয়ব যেনো একটু হলেও দূর হলো, দ্বৈত-মুকুট যেনো একটু হালকা হয়ে বসে রইলো তার শিরে। এসব কিছুই ট্যানাসের ভাগ্যে মৃত্যুর সম্ভাবনা হ্রাস করছে।

প্রশংসা ধ্বনি শেষ হতেই নিজস্ব ঢঙ্গে এতক্ষণের সমস্ত ঘোষণায় জল ঢেলে দিলেন ফারাও। আমার বিশ্বস্ত উজির, মহৎ ইনটেফকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। আজ থেকে সমস্ত তদন্ত, আটক করা খতিয়ে দেখবেন তিনি। এবারে আর হুঙ্কার নয়, নরম একটা ধ্বনি বেরুলো জনতার মুখ চীরে। বহুকষ্টে হতাশার বহিঃপ্রকাশ আঁকালাম আমি। মুরগির খোয়ার পাহাড়া দেওয়ার জন্যে হিংস্র চিতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন ফারাও। রাজকীয় সম্পদ আর খাজনার সিংহভাগ এবারে কোথায় যাবে, বলার অপেক্ষা রাখে না।

স্বতস্ফূর্ত ভাবাবেগে নিদারুন আঘাত করে ভেঙে-চুরে তছনছ করার বিরল ক্ষমতা আছে আমাদের মহান ফারাও-এর। না জানি ভাষণ শেষ করার আগে আরো কতো তামাশা শুনবো। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না।

বেশ অনেকদিন ধরেই আমাদের উচ্চ-রাজ্যের আইনের শাসনের অভাব নিয়ে আমি চিন্তান্বিত ছিলাম। আমাদের লোকেদের জান-মাল আজ ভয়ানক বিপদে। সঠিক সময়ে এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। কিন্তু, খুব সাম্প্রতিক অতীতে এমন ভাবে কিছু কথা উপস্থাপন করা হয়েছে আমার কাছে যা দেশদ্রোহিতার সামিল। অসময়ে, ওসিরিসের উৎসবের মধ্যে উচ্চারিত হয়েছে কথাগুলো। তবে, সেই ঘোষণা ব্যক্তি ফারাও এবং দেশের উপর আক্রমণের উদ্দেশ্যে করা হয়নি। নাটকীয় ঢঙ্গে বিরতি নিলেন ফারাও। বোঝাই যাচ্ছে, ট্যানাসের কথা বলছেন তিনি। তার ক্ষয়িষ্ণুতার প্রমাণ এখানেও পাওয়া গেলো, একজন শক্তিশালী ফারাও কখনও নিজের সিন্ধান্তের কার্য কারণ ব্যাখ্যায় যাবেন না, কেবল ঘোষণা করবেন।

অবশ্যই ট্যানাস, লর্ড হেরাবের কথা বলছি আমি, ওসিরিসের নাটকে প্রভু হোরাসের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলো যে। দেশ-দ্রোহিতার অভিযোগে আটক করা হয়েছে তাকে। আমার পরামর্শকেরা তার শাস্তি নিয়ে দ্বিধা-বিভক্ত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন, যারা ট্যানাসের মৃত্যুদন্ড চাইছেন ইনটেফের পানে তাকালাম আমি, তার চোখে মুখে ফুটে আছে মনের কথা। আর, অপর এক দল ভাবছেন, তার বক্তব্য দেবতাদের নিজস্ব; ট্যানাস, লর্ড হেরাবের মনের কথা নয়। এ ছিলো সত্যিকারের হোরাসের কথা। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে তাকে দোষী সাব্যস্ত করার কোনো কারণ নেই।

অবশ্যই, ফারাও-এর যুক্তি সঠিক। কিন্তু দ্বৈত-রাজ্যের মুকুটধারী সম্রাটের কী দায় পড়েছে দুনিয়ার অশিক্ষিত কৃষক, ব্যবসায়ী, শ্রমিক-দাস এদের সামনে তাঁর বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণের? ইতোমধ্যেই সস্তা মদের নেশায় ঢুলছে জনতা। সিংহাসনের নিচে দাঁড়ানো রাজকীয় বাহিনীর প্রধান, নেতেরের উদ্দেশ্যে ইশারা করলেন ফারাও। কেতাদুরস্ত ভঙিতে চলে গেলো সে, কিছু সময় পরে বন্দী-প্রকোষ্ঠ থেকে ট্যানাসকে নিয়ে হাজির হলো।

আমার বুকের ভেতরটা লাফিয়ে উঠলো তাকে দেখে, আরো আশান্বিত হলাম যখন বুঝলাম ওর পায়ে কোনো শেকল নেই। কোনো রকম অস্ত্র বা সম্মানসূচক প্রতীক পরিধান করে নেই সে, সাধাসিধা কাপড় গায়ে। পায়ে সেই তেজদ্বীপ্ত ছন্দ। কপালে র‍্যাসফারের আঘাতের চিহ্ন শুকিয়ে এসেছে, তবে তাকে নির্যাতন করা হয়নি বন্দী দশায়। আমার আশার পালে হাওয়া লাগলো। তার মানে, ওরা তাকে দন্ডিত বলে মনে করছে না!

এক মুহূর্ত পরেই সমস্ত আশার বাতি নিভে গেলো। সিংহাসনের সামনে এসে কুর্নিশ করলো ট্যানাস, এরপরে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। নির্দয়, নির্মম কণ্ঠে তার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন ফারাও, ট্যানাস, লর্ড হেরাব, দেশদ্রোহিতা এবং অবমাননার জন্যে অভিযুক্ত তুমি। এই দুই অভিযোগেই তুমি আমার চোখে দোষী। বিশ্বাসঘাতকের চিরন্ত ন শাস্তি, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলাম আমি তোমাকে।

দণ্ডিত আসামীকে চিহ্নিত করবার রীতি অনুায়ী ট্যানাসের গলার চারধারে ফাঁসের দড়ি পরালো নেতের। হালকা গুঞ্জন উঠলো জনতার মধ্যে থেকে। জোরে কেঁদে উঠলো একটা মেয়ে, মুহূর্ত পরেই কান্না-অনুতাপে ভারি হয়ে উঠলো মন্দিরের বাতাস। মৃত্যু দন্ড ঘোষণায় এমন প্রতিক্রিয়া আর কখনও হয়নি মিশরের ইতিহাসে। ট্যানাসের প্রতি মানুষের ভালোবাসা এমনই স্বতন্ত্র। তাদের অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম আমি নিজেও জানি না, কখন চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এসেছিলো।

রক্ষীরা তাদের অস্ত্রের বাটের আঘাতে নিবৃত্ত করতে চাইলো শোকাহত জনতাকে। কোনো কাজ হলো না তাতে। সবার গলা ছাপিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, দয়া করুন, মহান ফারাও! মহৎ ট্যানাসকে ক্ষমা করুন!

একজন রক্ষী অস্ত্রের বাট দিয়ে আঘাত করলো আমার মাথার পাশে, ছিটকে পরে গেলাম আমি। কিন্তু আমার আবেদন শুনছে জনতা। দয়া করুন, মহান মামোস! রক্ষীদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় কিছুটা স্তিমিত হলো হুঙ্কার, কিন্তু শব্দ করে তখনও কেঁদে চললো মেয়েরা।

অবশেষে ফারাও-এর উচ্চ স্বরে থামলো কোলাহল। অভিযুক্ত ব্যক্তি আইনের শাসনের ব্যর্থতার কথা উচ্চারণ করেছে। সিংহাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে, দস্যুর হাত থেকে এই মাটিকে রক্ষা করতে। সে একজন বীর কামনা করেছে। সবাই জানে, সে নিজেও একজন শক্তিশালী যোদ্ধা। যদি তাই হয়, তবে তার দাবিগুলো পূরণে সেই হতে যারে উপযুক্ত ব্যক্তি।

এবারে দ্বিধান্বিত হয়ে পরে জনতা। আস্তিনের কাপড় দিয়ে চোখ মুছলাম আমি। তন্ময় হয়ে শুনতে লাগলাম ফারাও-এর কথা। সেই কারণে, মৃত্যুদন্ড দুই বছর পর্যন্ত মুলতুবির ঘোষণা করছি। যদি সত্যিই দেবতা হোরাসের প্ররোচনায় দেশদ্রোহী বাক্য উচ্চারণ করে থাকে ট্যানাস, তাহলে আমার অর্পিত দায়িত্ব পালনে দেবতারা অবশ্যই সাহায্য করবে তাকে।

অসহনীয় নিরবতা নেমে এলো মন্দির জুরে। কী শুনছে, কেউ বুঝতে পারলো না। আশা-নিরাশার দোলাচলে বন্দী তখন আমরা।

ফারাও-এর ইঙ্গিতে তাঁর একজন উচ্চ-মন্ত্রী ছোট্ট একটা পাত্র এগিয়ে দেয়, নীল একটা মৃর্তি রাখা আছে তাতে। ওটা তুলে ধরে ফারাও বলে উঠেন, লর্ড হেরাবকে বাজপাখির প্রতীক অনুমোদন করলাম। এর ক্ষমতা বলে আজ থেকে, তার কাজের প্রয়োজনে যতো জন সৈনিক, যে বস্তু তার প্রয়োজন তা সে পেতে পারে। যে কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারে সে, কারও কাছে জবাবদিহিতার প্রয়োজন নেই। কেউ তাকে প্রশ্ন করতে পারবে না। আগামী পূর্ণ দুই বছর, সে শুধু মাত্র রাজার লোক, শুধুমাত্র তাঁরই কাছে মুখাপেক্ষী। সময় শেষ হলে, আগামী ওসিরিসের উৎসবের শেষ দিনে, আবারো এই সিংহাসনের সামনে দাঁড়াবে সে। গলায় থাকবে ফাঁসির দড়ি। যদি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, আজ ঠিক যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সেইখানে, তার গলায় ফাঁসির রশি এঁটে দেওয়ার হুকুম দেবো আমি। আর যদি সে সক্ষম হয় তার কাজে, আমি, ফারাও মামোস, নিজ হাতে ওই ফাঁসির দড়ি সরিয়ে তার গলায় স্বর্ণের হার পরিয়ে দেবো।

আমরা যেনো নড়তেও ভুলে গেছি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ফারাও-এর পানে চেয়ে রইলাম, রাজকীয় প্রতীক হাতে ইশারা করলেন তিনি। ট্যানাস, লর্ড হেরাব, উচ্চ-রাজ্য থেকে যাবতীয় বর্বর, লুটেরাদের নির্মূল করার দায়িত্ব দিলাম আমি তোমাকে। আগামী দুই বছরের মধ্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করো এই উচ্চ-সাম্রাজ্যে। ব্যর্থ হলে তোমার জন্যে অপেক্ষা করবে মৃত্যু।

পাথুরে দেয়াল কাঁপানো হুঙ্কারে ফেটে পরলো জনতা। ওরা আনন্দ করছে না। বুঝেই, দুঃখের সাথে ভাবলাম আমি। যে দায়িত্ব ফারাও আজ অর্পণ করলেন ট্যানাসের উপর, কোনো মরণশীল মানুষের পক্ষে তা অর্জন করা সম্ভব নয়। মৃত্যুর ছায়া এখনও সরে যায় নি তার উপর থেকে। আমি জানি, আজ থেকে দুই বছর পরে ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে আছে; সেই খানে,আজকের মতোই তেজদীপ্ত, গর্বোদ্ধত যোদ্ধা ট্যানাসের গলায় এঁটে বসবে ফাঁসির দড়ি।

*

পরিত্যক্ত, নিঃসহায়ের মতো তার চারদিকের ব্যস্ততার মাঝে স্থির দাঁড়িয়েছিলো ও, সামনের এক-সমুদ্র মুখের দিকে একবারো তাকালো না।

গোড়ালি ছুঁই-ছুঁই শুভ্র পোশাকে যেনো ঘোষিত হচ্ছিল কুমারীত্বের নিষ্কলুষতা। চুল ভোলা ওর। নরম, গাঢ় স্রোতের মতো কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা সেই চুলের রাশি ঝলমল করছিলো সূর্যালোকে। জল-পদ্মের তৈরি মুকুট মাথায়। স্বর্গীয় নীল সেই ফুলের ফাঁকে ফাঁকে বিশুদ্ধ স্বর্ণের সুতো।

এতো ফর্সা তার মুখশ্রী, যেনো দেবী আইসিস স্বয়ং দাঁড়িয়ে ছিলেন। বড়ো বড়ো, কালো দুই চোখে এখনও কিশোরীর ভীরুতা। হৃদয় ভেঙে যেতে চাইলো আমার; কতকাল দুঃস্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠা এই কিশোরীকে ঘুম পাড়িয়েছি আমি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু, আজ আর ওর জন্যে কিছু করতে পারবো না; অন্তত একবারের মতো সত্যি হতে যাচ্ছে ওর দুঃস্বপ্ন।

এমনকি কাছে পর্যন্ত যেতে পারছি না, পারি নি বিগত বেশ কয়েক দিনেও। ফারাও-এর বাহিনীর পুরোহিতেরা দিন রাত পাহারা দিয়ে রেখেছিলো ওকে। আমি জানি, চিরদিনের জন্যে আমার কাছ থেকে দূরে চলে গেছে লসট্রিস, কোনোদিনও আর কাছে পাবো না তাকে।

নীলে র তীরে বিয়ের মন্ডপ তৈরি করা হয়েছে। তার নিচে হবু-স্বামীর অপেক্ষায় বসেছিলো লসট্রিস। পাশে দাঁড়িয়ে তার বাবা ইনটেফ, প্রশংসার স্বর্ণ-শেকল গলায়; গবোদ্ধত, ঠোঁটে কোব্রার হাসি।

অবশেষে রাজকীয় বরের আগমন ঘঘাষিত হলো ঢাকের গুরুগম্ভির ধ্বনি এবং গ্যাজেল হরিণের শিঙ্গায় ফুয়ের মাধ্যমে। আমার কাছে এ হলো পুরো পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম ধ্বনি।

নেমেস মুকুট পরেছেন ফারাও, কিন্তু এতো জাঁকজমক, আভিজাত্য ফুঁড়েও বেরিয়ে পড়ছে তার আসল রূপ-ছোট-খাটো আকৃতির, বিশাল-বপু বিষণ-মুখো একজন মানুষ। যদি দেবতারা একটু সহায় হতেন, তাহলে ওই মন্ডপে, আমার লসট্রিসের পাশে আজ একজন বীর্যবান পুরুষের থাকার কথা ছিলো।

ফারাও-এর সভাসদ, মন্ত্রীরা ঘিরে রেখেছে তাকে, আমার চোখের সামনে থেকে আড়াল হয়ে গেলো মিসট্রেস। যদিও এই বিয়ের সমস্ত আয়োজন, খুঁটি-নাটি তদারক করেছি আমি, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় যাওয়ার অনুমতি নেই আমার। অনুষ্ঠান চলাকালে কেবল দুই-এক ঝলক দেখতে পেলাম লসট্রিসের।

নীলনদ থেকে সদ্য-ভোলা পানি দিয়ে বর-কনে উভয়ের হাত ধুয়ে দিলেন ওসিরিসের মন্দিরের পুরোহিত, এ হলো আসন্ন-বৈবাহিক সম্পর্কের বিশুদ্ধতার প্রতীক। প্রথা অনুযায়ী গমের তৈরি রুটি ছিঁড়ে এক টুকরো ভাবী বধূর উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে ধরলেন ফারাও, এ হলো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব। যেনো এক টুকরো পাথর মুখে নিয়েছে; টুকরোটা চাবালো বা গিলে ফেললো না লসট্রিস।

আবারো আমার চোখের আড়ালে চলে গেলো সে। এর কিছু সময় পরে সুরার খালি পাত্র ভাঙার শব্দ শুনতে পেলাম, তলোয়ারের এক কোপে ওটা ভাঙতে হয় কনেকে। সাঙ্গ হলো যতো আচার, বুঝলাম চিরকালের জন্যে ট্যানাসের নাগালের বাইরে চলে গেছে মিসট্রেস।

উঁচু মঞ্চের উপরে তার সদ্য-বিবাহিত কনের হাত ধরে এগিয়ে এলেন মহান ফারাও, জনতার উদ্দেশ্যে উপস্থাপন করলেন তাকে। গগনবিদারী চিৎকারে লসট্রিসের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করলো জনতা।

এই ভীড় ছেড়ে বেরিয়ে ট্যানাসের কাছে যেতে চাইছিলাম আমি। সে এখন মুক্ত, কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানে আসে নি ট্যানাস। সমগ্র থিবেসে সম্ভবত সেই একমাত্র ব্যক্তি যে আজ নদী তীরে সমবেত হয় নি অন্যদের সাথে। জানি, যেখানেই থাকুক না কেননা, আমাকে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তার। হোরাস জানেন, আমারও এই মুহূর্তে প্রয়োজন তাকে। কিন্তু ভীড় ছেড়ে বেরুনো সম্ভবপর হলো না। নির্দয় মুহূর্তগুলো দেখতে হলো আমাকে।

এই পর্যায়ে প্রভু ইনটেফ কন্যার কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিতে এলেন। জনতা নিরব হতে মেয়েকে আলিঙ্গন করলেন তিনি।

তাঁর আলিঙ্গনে লসট্রিস যেনো জীবন্ত একটা লাশ। দেহের পাশে শিথীলভাবে ঝুলে রইলো তার হাত, মুখ মৃতের মতো বিবর্ণ। আলিঙ্গন শেষে তার একটা হাত ধরে এবারে জনতার মুখোমুখি হলেন ইনটফে, প্রথা অনুযায়ী মেয়েকে এবারে বিদায়ী উপহার দিতে হবে তাকে। নিয়ম হলো, বরকে দেওয়া পণের অর্থের চেয়ে বেশি হতে হবে এই উপহার। কনের জন্যে এক ধরনের নিরাপত্তা এটা।

আজ তুমি আমার আবাস এবং নিরাপত্তা ছেড়ে তোমার স্বামীর বাড়ি চলে যাবে; এই বিচ্ছেদের কালে আমার ভালোবাসার চিহ্ন স্বরুপ বিদায়ী উপহার দিতে চাই তোমাকে। কী ভুল কথা, ভাবলাম আমি। জীবনে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসেন নি আমার মনিব, ইনটেফ। যা হোক, প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী বলে চললেন তিনি, যে কোনো কিছু চাইতে পারো তুমি, প্রিয়। আজকের দিনে কোনো কিছুই প্রত্যাখান করা হবে না।

প্রচলিত ব্যবস্থা অনুযায়ী অনুষ্ঠানের আগেই বাবা-মেয়েতে মিলে ঠিক করে রাখেন, কী উপহার দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে অবশ্য মেয়েকে কিছু বলে রাখেন নি ইনটে। তাকে নিজের সিদ্ধান্ত জানানোর আগে, গতকাল রাতে অবশ্য এই নিয়ে আলাপ করেছিলেন আমার সাথে, অতিরঞ্জন করার দরকার নেই, আবার ফারাও-এর সামনে কৃপণ হিসেবে পরিচিতি পেতে চাই না, বলেছিলেন তিনি। ধরো, পাঁচ হাজার স্বর্ণের আংটি; আর পঞ্চাশ ফেদান জমি অবশ্যই নদীর ধারে নয় । এরকম হলে কেমন হয়?

শেষমেষ অবশ্য আমার চাপাচাপিতে পাঁচ হাজার স্বর্ণের আংটি এবং নদী তীরের উর্বর এক হাজার ফেদান জমি দিতে সম্মত হয়েছেন তিনি। তার নির্দেশে ইতোমধ্যেই দলিলপত্র ঠিক করে রেখেছি আমি; তাঁর ব্যক্তিগত গোপন ভান্ডার থেকে স্বর্ণও আলাদা করেছি।

সবকিছু তৈরি। সমগ্র অতিথি এবং বরের সামনে এখন কেবল লসট্রিসের চাওয়ার অপেক্ষা । কিন্তু বিবর্ণ, নিপ, মূক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো লসট্রিস, কিছুই যেনো শুনছে না সে, কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না।

বলো, কন্যা; কী চাও তুমি আমার কাছে? ইনটেফের পিতৃসুলভ স্বর কষ্টার্জিত শোনাতে লাগলো, এক হাতে ঝুঁকি মেরে যেনো মেয়েকে জাগাতে চাইলেন তিনি। বলো, কিভাবে আজকের দিনে তোমাকে আরো সুখী করতে পারি?

যেনো ভয়ানক এক দুস্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠলো লসট্রিস। নিজের চারপাশে তাকাতে লাগলো সে, অশ্রুবিন্দু টলমল করছে চোখে, পাতা উপচে পরার হুমকি স্পষ্ট। কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলল ও, কিন্তু শরবিদ্ধ পাখির আর্তনাদের মতো আওয়াজ বেরুল কেবল কণ্ঠ থেকে। ঢোক গিলে নিরবে মাথা নাড়লো লসট্রিস।

কথা বলো, মেয়ে আমার। পিতৃসুলভ বাৎসল্য দেখাতে স্পষ্টতঃই দারুন কষ্ট হচ্ছে ইনটেফের। বলো, কী উপহার চাও আমার কাছে? যা চাও, তা-ই পাবে। বলো।

এতো দূর থেকেও পরিষ্কার টের পেলাম, কতোটা চেষ্টা করে মুখ খুলতে পারলো লসট্রিস; কিন্তু যখন কথা বলে উঠলো সে, স্পষ্ট-দ্বিধাহীন শোনালো তার কণ্ঠস্বর। উপস্থিত প্রত্যেকে পরিষ্কার শুনতে পেলো প্রতিটি শব্দ।

বিয়ের উপহার হিসেবে ক্রীতদাস টাইটা-কে চাই আমি।

যেনো পেটে ছুরি খেয়েছেন, চট করে এক পা পিছিয়ে গেলেন ইনটেফ। অবাক বিস্ময়ে মুখ হাঁ-বোবার মতো নিজের মেয়ের দিকে চেয়ে রইলেন তিনি কথা সরছে

মুখে। সম্ভবত কেবল ইনটেফ আর আমি জানি, কতো বড়ো উপহার চেয়েছে লসট্রিস। এক জীবনে যতো ধন-সম্পদ গড়েছেন ইনটেফ, তার সবকিছুর বদলেও এই দাবি মেটানোর সামর্থ্য নেই তার।

দ্রুতই নিজেকে ফিরে পেলেন ইনটেফ। মুখাবয়ব শান্ত, কোমল কিন্তু ঠোঁটের কোণ বেঁকে গেলো তার। তুমি খুবই কম চেয়ে ফেলেছো, কন্যা। মহান ফারাও-এর স্ত্রীর বিদায়ী উপহার একজন তুচ্ছ ক্রীতদাস? এ-ও কী হতে পারে?, না, এতটা ছোটো হতে পারবো না আমি। বরঞ্চ সত্যিকারের মূল্যবান কিছু তোমাকে দিতে চাই আমি, যেমন ধরে পাঁচ হাজার স্বর্ণের আংটি আর।

বাবা, আপনি সব সময়ই আমার প্রতি সদয় ছিলেন, কিন্তু আমার শুধু টাইটা-কে চাই।

ঝকঝকে হাসি হাসলেন ইনটেফ; ভীষণ উজ্জ্বল, ঠিক তার রাগের মতোই। টের পেলাম, ঝড়ের গতিতে কাজ করছে তার মাথা।

নিঃসন্দেহে আমি তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। কেবলমাত্র বিভিন্ন বিষয়ে আমার অসামান্য প্রতিভার জন্যেই নয়, তার চেয়ে বড়ো কথা, তাঁর সমস্ত জটিল, কুটিল কু-কর্মের সবকিছু আমি জানি। তার সমস্ত গুপ্তচরকে চিনি; ইনটেফ যাদেরকে আজ পর্যন্ত ঘুষ দিয়েছেন বা যাদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা আদায় করেছেন ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেককে জানি আমি। কোন্ কোন্ কাজ সমাধা হয়ে গেছে, কয়টিই বা বাকি আছে–এ সবই আমার জানা।

ইনটেফের শত্রুদের বিশাল তালিকা আমার নখদর্পণে। তাঁর বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীদের অপেক্ষাকৃত ছোট্ট তালিকাও আমার অজানা নয়। বিশাল সম্পদের যে পাহাড় তিনি চুরি করে গড়েছেন, তার প্রতিটি স্বর্ণ-খণ্ডের হদিশ বলে দিতে পারি। ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে কত জমি-জমা, মূল্যবান পাথর, যে তিনি অধিকার করেছেন, আমি ছাড়া আর ক জনই বা জানে সেটা? নিঃসন্দেহে এগুলো জানাজানি হলে তার সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হবেন মহান ফারাও।

আমার ধারণা, আমার সাহায্য ছাড়া নিজের সম্পদের সঠিক হিসেব ইনটেফ নিজেও উদ্ধার করতে পারবেন না। তার গোপন জগতের সমস্ত হিসাব-নিকাশ আমি করে থাকি, নিজেকে সব কিছুর উর্ধ্বে রেখেছেন তিনি। সবকিছুই আমার হাতে ন্যস্ত।

হাজার হাজার অন্ধকার গোপনীয়তা, ভীতিকর ব্যবসা, ডাকাতি এবং হত্যাকান্ডের এতো কিছু জানি আমি, রাজ-উজিরের পদে আসীন কাউকেও শেষ করে দিতে পারে এই সমস্ত তথ্য।

না, আমাকে ছাড়া চলবে না ইনটেফের। আমাকে উপহার হিসেবে দেওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে। কিন্তু, স্বয়ং ফারাও এবং মহান থিবেসের সমস্ত অধিবাসীর সামনে লসট্রিসকে ফিরিয়ে দেবেন কেমন করে?

আগেই বলেছিলাম, ইনটেফ মহা চতুর লোক। নির্ঘাত দেবতা সেথ-এরও এতো ঘৃণা আর ক্রোধ নেই। কিন্তু এমন উভয় সংকটে তাকে কোনোদিন পড়তে দেখিনি।

ক্রীতদাস টাইটা সামনে এসে দাঁড়াক, ডেকে উঠলেন ইনটেফ। দ্রুত ঠেলে ধাক্কিয়ে মঞ্চের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমি, চতুর কোনো পরিকল্পনার জন্যে সময় দিতে চাইছি না তাকে।

আমি হাজির, মালিক, বললাম। দৃষ্টিতে জিঘাংসা নিয়ে আমার পানে চাইলেন ইনটেফ। এতো দিন ধরে আমরা জানি পরস্পরকে, উচ্চারিত কোনো শব্দ ছাড়াও কেবল মুখের ভাব দেখে বুঝতে পারি আমি তাঁকে, তিনি আমাকে। নিরবে তাকিয়ে থাকলেন ইনটেফ, ভয়ের প্রাবল্যে পাখির মতো ডানা ঝাঁপটাতে লাগলো আমার হৃদয়। শেষমেষ নরম প্রায় আদুরে সুরে বলতে লাগলেন ইনটেফ, টাইটা, সেই শিশুকাল থেকে তুমি আমার কাছে আছে। দাস নয়, তোমাকে ঠিক আপন ভাইয়ের মতো জেনে এসেছি আমি। আমার কন্যার অনুরোধ তুমি শুনেছো। আমি দয়ালু মানুষ, এতদিন পরে তোমার ইচ্ছার বিপরীতে কোনোকিছু করা অন্যায় হবে। জানি, কোনো বিষয়েই কিছু বলার অধিকার নেই একজন দাসের, কিন্তু তোমার কথা আলাদা। বলো, টাইটা। যদি এতোদিন ধরে যেখানে থেকে এসেছে–যেটা তোমার একমাত্র বাড়ি সেখানে থেকে যেতে চাও; তাহলে তোমাকে চলে যেতে বলতে পারি না আমি; এমনকি আমার মেয়ে চাইলেও না। ভয়ঙ্কর হলদেটে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন ইনটে। কাপুরুষ নই আমি, কিন্তু নিজের নিরাপত্তার কথাও তো ভাবতে হবে। মনে হলো, যেনো সরাসরি মৃত্যুর চোখে তাকিয়ে আছি। গলায় স্বর খুঁজে পেলাম না ।

ইনটেফের দিক হতে দৃষ্টি সরিয়ে লসট্রিসের দিকে তাকালাম। এতো ভীষণ করুণ অনুনয় তার দৃষ্টিতে, এতো একাকিত্ব আর ভয়, আমার নিজের নিরাপত্তা তার কাছে কিছুই নয়। ওকে একা ছেড়ে দিতে পারি না আমি, যে কোনো মল্যে, চাই-কি নিজের

জীবনের বিনিময়ে হলেও।

মহান ফারাও-এর স্ত্রীর ইচ্ছাকে একজন তুচ্ছ দাস কেমন করে প্রত্যাখান করতে পারে, হুজুর? আমার নতুন মিসট্রেসের সাথে যেতে তৈরি আমি। জোরে, সবাইকে শুনিয়ে বললাম।

এদিকে এসো, ক্রীতদাস! আমার নতুন মনিব নির্দেশ দিলেন। আমার পেছনে এসে দাঁড়াও।

মঞ্চে উঠার সময় ইনটেফের পাশ ঘেঁষে যেতে হলো। তাঁর সাদা, ফ্যাকাসে ঠোঁট খুব সামান্যই নড়লো, কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পেলাম, তিনি বলছেন, বিদায়, প্রিয়। তুমি মরে গেছে।

কেঁপে উঠলাম, যেনো বিষাক্ত একটা কোব্রা হেঁটে গেছে আমার পথে। দ্রুত আমার মিসট্রেসের পেছনে জায়গা করে নিলাম, যেনো ওখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ আমি।

*

উত্সবের বাকি সময় সর্বক্ষণ লসট্রিসের পাশে পাশে থাকলাম আমি। খাবারের সময় চেষ্টা করলাম যেনো মিসট্রেস অন্তত কিছু একটু মুখে তোলে। আমি জানি, বিগত কয়েকদিন কিছুই খায়নি সে। এতো দুর্বল হয়ে পরেছে তাই।

বহু সাধ্য-সাধনার পর পানি মেশানো একটু মদ মুখে তুললো। সে, কিন্তু ও-ই, আর কিছু নয়। ফারাও-এর কাছে এ হলো তার সদ্য-বিবাহিত স্ত্রীর আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। নিজের স্বর্ণের পাত্র থেকে এবারে কিছুটা নির্জলা মদ খেতে আহ্বান জানালেন তিনি। নিজেও পান করলেন। দারুন উল্লাসে স্বাগত জানালো জনতা।

টাইটা, এক পাশে বসা ইনটেফের দিকে রাজার মনোযোগ সড়তেই আমাকে ডাকলো লসট্রিস, মনে হয়, বমি করে ফেলবো। এখানে থাকা সম্ভব নয়। দয়া করে আমার প্রকোষ্ঠে ফিরিয়ে নিয়ে চলো।

ভীষণ এক ঘটনা হতো মিসট্রেসের এই হঠাৎ অন্তর্ধান, কিন্তু চিকিৎসক সুখ্যাতির বদৌলতে খুব সহজেই কাজ হাসিল করলাম আমি। হাঁটুর উপর ভর করে এমন ভাবে ফারাও-এর কানে কানে বললাম কথাটা, অতিথিরা কেউ টেরই পেলো না।

পরে বুঝেছিলাম, মূলত বেশ দয়ালু প্রকৃতির মানুষ ছিলেন ফারাও মামোস। সেদিনই তার প্রমাণ দিয়েছিলেন তিনি। মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনে হাততালি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন অভ্যাগত অতিথিদের। রাতের প্রস্তুতির জন্যে আমার স্ত্রী এবারে তার প্রকোষ্ঠে ফিরবেন। তার এই ঘোষণায় আনন্দ, হুলোড় আর আমোদের ঝড় বয়ে গেলো।

আমার সাহায্য ছাড়াই উঠে দাঁড়িয়ে রাজাকে কুর্নিশ করলো মিসট্রেস, এরপরে ভোজ-সভা ত্যাগ করলো। প্রকোষ্ঠে ফিরতে না ফিরতেই উগড়ে দিলো পেটের মদ, বিধ্বস্ত অবস্থায় লুটালো বিছানায় ।

আমি ট্যানাসকে ছাড়া বেঁচে থাকতে চাই না, দুর্বল স্বরে বললল লসট্রিস, কিন্তু গলার জেদ পুরোপুরি অটুট।

ট্যানাস বেঁচে আছে, ওকে সান্ত্বনা দিতে চাইলাম, সে তরুণ, শক্তিমান আরো অন্তত পঞ্চাশ বছর বাঁচবে। তোমাকে ভালবাসে সে; বলেছে প্রয়োজন হলে সারা জীবন অপেক্ষা করতে পারে। রাজা তো বুড়ো মানুষ, কয় দিনই আর বাঁচবেন–

পশমের চাদরের উপরে উঠে বসলো লসট্রিস। তার কণ্ঠস্বরে আরো বেশি রোখ এখন। আমি ট্যানাসের মেয়ে মানুষ। আর কোনো পুরুষ আমাকে পাবে না, তারচেয়ে বরং মরে যাবো আমি।

আমরা সবাইই একসময় মারা যাবো, মিসট্রেস, জানি, বিয়ের প্রথম কিছুদিন যদি ওর মন সান্ত্বনা দিয়ে রাখতে পারি, তবে কাজ হাসিল হবে। কিন্তু আমাকে হাড়ে হাড়ে চেনে এই মেয়ে।

কিছু বলল না, টাইটা; তোমার ওই সুন্দর কথায় কিছুই হবে না। আমি মরে যাবো। এক পাত্র বিষ তৈরি করে আনো আমার জন্যে এ আমার নির্দেশ।

মিসট্রেস, বিষ তৈরির বিদ্যা আমার জানা নেই যে, বাজে একটা অযুহাত, ফোঁস করে উঠলো লসট্রিস।

বহুবার আমি দেখেছি, আহত জীবগুলো ওই বিষ দিয়েছো তুমি। কানে বিষফোঁড়া সমেত তোমার কুকুরটাকে ভুলে গেছো; আর চিতার থাবায় ক্ষত-বিক্ষত সেই গ্যাজেলে র কথা কী বলবে? তুমিই বলেছিলে, ওই বিষে কোনো ব্যথা নেই, একদম ঘুমের মতো মরণ হয়। আমিও তাই চাই, ঘুমের ভেতর মরে গিয়ে মমি হয়ে চলে যাবো অন্য রাজ্যে । ওখানে অপেক্ষায় থাকবো ট্যানাসের।

আরো অযুহাত ছিলো আমার। কিন্তু তাহলে আমার কি হবে, মিসট্রেস? কেবল আজই আমার মালিকানা পেলে তুমি, এখনই ফেলে রেখে যাবে? আমার উপর একটু দয়া কর। একটু যেনো থমকালো লসট্রিস, মনে হতে লাগলো পেয়ে গেছি ওকে; কিন্তু চিড়ে ভিজলো না।

তোমার কিছু হবে না, টাইটা। আমার বাবা হাসিমুখে তোমাকে ফিরিয়ে নেবেন।

ছোট্ট সোনা, শোনো, শেষ অস্ত্র হিসেবে ওর বাল্যকালের একটা ডাক ব্যবহার করলাম। সকালে না হয় কথা বলবো আমরা, দেখো তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিছুই ঠিক হবে না, নাছোড়বান্দা লসট্রিস। ট্যানাসের থেকে দূরে চলে যাবো আমি, আর ওই বুড়ো ব্যাটা বিছানায় জঘন্য কাজ করবে আমার সাথে! এতো উচ্চস্বরে কথা বলছে সে, আমার আশঙ্কা হলো রাজার হারেমের বাকি সদস্যরা না আবার শুনে ফেলে। সৌভাগ্যবশত তারা সবাই এখন উৎসবে।

লসট্রিসের স্বরে উন্মাদনা ক্রমশই বাড়তে লাগলো। এখন, এই মুহূর্তে ওই বিষ তৈরি কর আমার সামনে! আমি নির্দেশ করছি তোমাকে। অবাধ্যতার ফল ভালো হবে না। এবারে এতো জোরে বলতে লাগলো সে, ভয় হলো প্রাসাদের দ্বাররক্ষীর কান পর্যন্ত না পৌঁছে যায়।

ঠিক আছে, তাই করছি। আমার ওষুধের বাক্সটা নিয়ে আসতে হবে সেজন্যে।

বাক্স নিয়ে ফিরে এসে দেখি, অদ্ভুত জ্বলজ্বলে চোখে কক্ষের এ-মাথা ওমাথায় পায়চারী করছে লসট্রিস।

আমি নজর রাখছি তোমার উপর। কোনোরকম চালাকি করে লাভ নেই, লাল কাঁচের বোতল থেকে গুঁড়ো নিয়ে বিষ তৈরির সময় বললো সে।

তৈরি শেষ হতে নির্ভয়ে বোতলটা হাতে নিলো লসট্রিস। একটু থেমে চুমো খেলো আমার গালে। তুমি আমার কাছে প্রিয় ভাই, বাবার মতো। শেষ এই দয়ার জন্যে ধন্যবাদ। আমি তোমাকে ভালোবাসি, টাইটা। সবসময় বাসতাম। দুই হাতে বোতলটা উঁচু করে ধরে সে। ট্যানাস, প্রিয়, ওরা কখনই তোমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারবে

আমাকে। আবার আমাদের দেখা হবেই হবে! এক চুমুকে পুরো বোতল নিঃশেষ করে ওটা ছুঁড়ে ফেলে লসট্রিস। কিছু সময়ের মধ্যেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে লুটিয়ে পরে বিছানায়।

আমার পাশে এসে বসো না, টাইটা। মরতে খুব ভয় লাগছে।

খালি পেটে খুব দ্রুতই কাজ করলো বিষ। কেবল আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে একটা কথা বলতে পারলো সে, ট্যানাসকে বলো, কত ভালোবাসি ওকে। মরণের আগেও, পরেও অপেক্ষায় থাকবো ওরই জন্যে। এরপরে চোখ মুদল আমার মিসট্রেস।

এতোটাই ফ্যাকাসে আর স্থির দেখালো ওকে, এক মুহূর্তের জন্যে আশঙ্কায় শিউড়ে উঠলাম। তবে কি প্রাণঘাতি ধুতুরার বদলে লাল শেপেনের যে গুঁড়ো দিয়েছিলাম, তার মাত্রা কড়া হয়ে গিয়েছিলো? ছোটো একটা আয়না মিসট্রেসের মুখের সামনে রাখতেই আশ্বস্ত হলাম না, শ্বাস ফেলছে সে। যত্ন করে চাদরে মুড়ে দিলাম ওকে, মনে আশা হয়তো সকালে ঘুম ভেঙে জেগে উঠে বেঁচে থাকার জন্যে আমাকে ক্ষমা করবে।

ঠিক এই সময় প্রকোষ্ঠের বাইরের অংশের দরোজায় কড়াঘাতের শব্দ হলো। রাজ-পরিচর্যক, আতন ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি চাইছে। সে-ও একজন অপুরুষ ফারাও শাসনের আরও একজন সেবক। আমি তাকে ভাই বলেই জানি, দ্রুত স্বাগত জানাতে এগিয়ে গেলাম।

টাইটা, রাজার ভোগের জন্যে তোমার ছোট্ট কর্ত্রীকে নিয়ে যেতে এসেছি আমি, বিশাল দেহের তুলনায় দারুন বেমানান তীক্ষ্ণ, মেয়েলী স্বরে বললো আতন। যৌবন প্রাপ্তির আগেই নপুংসক করা হয়েছিলো তাকে। সে তৈরি তো?

একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে, ব্যাখ্যা করে বললাম। শেষমেষ ঘুমন্ত লসট্রিসের কাছে নিয়ে গেলাম তাকে।

ওর অবস্থা দেখে ভীষণ দুশ্চিন্তায় প্রসাধন-চর্চিত গাল ফোলাতে লাগলো আতন । ফারাও-কে কী বলবো এখন? প্রায় কেঁদে ফেললো সে। উনি মারবেন আমাকে। আমি এটা বলতে পারবো না। এই মেয়ে তোমার দায়িত্বে আছে, রাজার সামনে তুমি গিয়ে বলো তার অবস্থা। আমি পারবো না।

এমন নয় যে এই দায়িত্ব সানন্দে পালন করছি আমি, কিন্তু আতন সত্যিই ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। আর চিকিৎসক হিসেবে আমার পরিচয় বেশ কাজ দেবে বলে ধারণা করলাম । নিতান্তই অনিচ্ছাসত্ত্বে রাজকীয় শয্যাকক্ষের দিকে রওনা হলাম, আতনকে সঙ্গে করে। অবশ্য যাওয়ার আগে বৃদ্ধা একজন দাসীর পাহারায় রেখে এলাম লসট্রিসকে।

পরচুলা এবং মুকুট খুলে রেখেছেন ফারাও। অসট্রিচের ডিমের মতোই চকচকে টাক তার মাথায়। এমনকি আমি পর্যন্ত থমকে গেলাম, না জানি এটা দেখলে আমার মিসট্রেসের কি অনুভূতি হতো ।

আমাকে দেখতে পেয়ে ঠিক একই রকম চমকে গেলেন রাজা। হাঁটুগেড়ে বসে মাথা ঝোকালাম তার সামনে।

কী হয়েছে, দাস টাইটা?

দয়ার সাগর, মহান ফারাও; আমার কী লুসট্রিসের পক্ষ থেকে আপনার উপলব্ধি এবং ক্ষমা চাইতে এসেছি আমি। এরপরে, লসট্রিসের অবস্থার ভয়ঙ্কর বিবরণ দিয়ে গেলাম। চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত এক গাদা ধোয়াটে কথাবার্তা বলে ব্যাখ্যা করতে চাইলাম কেননা এই মুহূর্তে রাজার ভোগ-বিলাসের উপযুক্ত নয় সে। দুঃখিত চেহারায় আমার পাশে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে গেলো আতন।

যুবক কোনো পুরুষ হলে এই সব কথায় ভুলতো না আমি নিশ্চিত, কিন্তু ফারাও হলেন বুড়ো ষড়। গত ত্রিশ বছরে যে সুন্দরী রমণীদের সেবা দিয়ে এসেছেন, তার একটা ফলাফল তো থাকবেই। সম্ভবত, সমগ্র থিবেস নগরকে একশ বা তার অধিক বার ঘিরে রাখার মতো তাদের সংখ্যা।

মহান ফারাও, শেষপর্যন্ত বলে উঠে আতন। আপনি অনুমতি দিলে, আজকে রাতের জন্যে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে আসতে পারি আমি। ওই যে, সেই ছোট্ট হারিয়ার মেয়েটা–

না, না, বাধা দিয়ে বললেন রাজা। আমার স্ত্রী সুস্থ হলে এর জন্যে অনেক সময় পাওয়া যাবে। এখন তুমি বিদায় হও, পরিচর্যক। কিছু ব্যাপার নিয়ে চিকিৎসক মানে, ক্রীতদাস টাইটার সাথে কথা আছে আমার।

আমরা একা হতে কাপড় তুলে নিজের বিশাল পেট দেখালেন রাজা। এর কারণ কী, টাইটা? তাঁর উন্মুক্ত পেটের দানা দানা লালচে দাগগুলো পরীক্ষা করে দেখলাম আমি। সাধারণ ছত্রাক সংক্রমণ। নির্ঘাত নিয়মিত স্নান করে না, এমন কোনো মেয়ের শরীর থেকে ওই রোগ ধরেছে ফারাও-কে। আমি জানি, দারুন চুলকানি হয় এই রোগে।

সারাতে পারবে তুমি? ভয় আমাদের সবার কাছেই একই রকম। যে কোনো কাতর রোগীর মতোই এই মুহূর্তে ব্যবহার করছেন ফারাও।

তার অনুমতি নিয়ে আমার প্রকোষ্ঠ থেকে ওষুধের বাক্সটা নিয়ে এলাম। নিজের স্বর্ণ এবং আইভরি মন্ডিত বিছানায় শুয়ে রইলেন ফারাও, তাঁর লালচে ক্ষতে মল লাগিয়ে দিলাম আমি। আমার নিজের আবিস্কৃত এই মলমে তিন দিনে ঠিক হয়ে যান। এই রোগ–আশ্বস্ত করে জানালাম তাকে।

এই যে একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেছি, তা অনেকাংশে তোমার কারণে, বলে চললেন ফারাও। তোমার মলমে হয়তো এই রোগ সারবে, কিন্তু তোমার কর্ত্রী কী ছেলে সন্তান দিতে পারবে আমাকে? জানতে চাইলেন তিনি। ভীষণ দুঃশ্চিন্তায় আছি। আরো এক বছরের মধ্যেই পুত্র-সন্তান চাই আমার । সমগ্র সাম্রাজ্য আজ মহাবিপদে রয়েছে।

আমরা, চিকিৎসকেরা, নিজেদের ব্যবস্থায় আরোগ্য লাভ সম্পর্কে সাধারণত কোনো রকম নিশ্চয়তা দিতে চাই না। ঠিক আইনজ্ঞ বা জোতিষীদের মতোই। কিন্তু আমার পথ খুলে দিলেন ফারাও স্বয়ং।

আমি এখন আর যুবক নই, টাইটা। তুমি একজন চিকিৎসক, তোমার কাছে লুকাবো না। বহু যুদ্ধে ক্ষয়ে গেছে আমার অস্ত্র। আগের মতো আর ধার নেই তার ফলায়। সাম্প্রতিক সময়ে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে ওটা। তোমার বাক্সে কী এমন কিছু নেই, যা পদ্মের নরম ডাটাকে দৃঢ় করে দিতে পারে?

ফারাও, সমস্ত কিছু খুলে বলার জন্যে আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কোনো কোনো সময় দারুন অদ্ভুত রকম ভাবে কাজ করেন দেবতারা বলে চললাম আমি, আমার কুমারী কর্ত্রীর সঙ্গে আপনার প্রথম রাত সুসম্পন্ন হতে হবে। যে কোনো রকম দ্বিধা, বক্রতা; আপনার পৌরুষের নিদর্শন তুলে ধরতে যে কোনো রকম ব্যর্থতার ফলাফল ভালো হবে না। একটাই মাত্র সুযোগ আছে, প্রথম বারেই সফল মিলন প্রয়োজন। যদি দ্বিতীয়বার চেষ্টা করতে হয়, দেবতা না করুন, আবারো কন্যা সন্তান জন্মানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

তর্জনী উঁচিয়ে ধরলাম আমি। যদি আজ রাতে আমরা চেষ্টা করতাম, আর বাকিটুকু না বলে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে তর্জনী নামালাম। না, আমরা আসলেই অতি ভাগ্যবান। দেবতারা আর একটা সুযোগ দিয়েছেন আমাদের।

কী করা উচিত এখন? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন ফারাও। বেশ কিছু সময় নিরবে তার পাশে হাঁটুগেড়ে বসে রইলাম আমি।

হ্যাঁ, মহামান্য ফারাও, কিছু তো অবশ্যই করার আছে আমাদের। তবে এতে সময় লাগবে। এই চামড়ার রোগ সারানোর মতো সহজ হবে না সেটা। ঝড়ের বেগে চলছিলো আমার মস্তিস্ক। এই সুযোগ থেকে সবটুকু সুবিধা আদায় করে নিতে হবে আমাকে। খুব কড়া-কড়ি ভাবে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে, মালিক।

আর যাঁড়ের বিচি নয়, তোমাকে মিনতি জানাই, কবিরাজ।

না, আমার ধারণা, ওগুলো যথেষ্ট খেয়েছেন আপনি। কিন্তু, আপনার রক্ত গরম করতে এবং ঔরস মিঠে করতে হবে আমাদেরকে, নতুবা চেষ্টা করে লাভ নেই। গরম ছাগ-দুগ্ধ এবং তিনবেলা মধু খেতে হবে; এবং অবশ্যই আমি যে মিশ্রণ তৈরি করে দেবো সেটাও। গন্ডারের শিং-এর গুঁড়ো আর ম্যানড্রেকের গুল্ম থেকে তৈরি হবে সেই রস।

একটু আশ্বস্ত হলেন ফারাও। তুমি নিশ্চিত, এতে কাজ হবে?

এই ব্যবস্থা কখনওই ব্যর্থ হয় নি। তবে আরও একটা বিষয় আছে।

কী সেটা? স্বস্তি উবে গেলো ফারাও-এর, শঙ্কিত ভঙ্গিতে বিছানায় বসলেন তিনি।

ভোগ-বিলাস থেকে সম্পূর্ণ বিরতি। অবশ্যই রাজকীয় সদস্যের পূর্ণ শক্তি এবং ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্যে সময় দিতে হবে আপনাকে। হারেমের সমস্ত সম্ভোগ ত্যাগ করতে হবে। অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও। চিকিৎসকের ভাব-গাম্ভির্য নিয়ে বললাম আমি। বিলক্ষণ জানি, লসট্রিসকে অনাঘ্রাতা রাখার এ-ই একমাত্র উপায় । কিন্তু রাজার প্রতিক্রিয়া কী হবে ভেবে ভয় লাগছে। এমনও তো হতে পারে, দাম্পত্য সুখে বাধা পেয়ে ক্ষেপে গেলেন তিনি? আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারেন, সেক্ষেত্রে এতক্ষণের অর্জিত সমস্ত সুবিধা কোনও কাজে আসবে না। কিন্তু আমার মিসট্রেসের জন্যে এই ঝুঁকি নিতে হবে আমাকে, যতক্ষণ সম্ভব রক্ষা করতে হবে তাকে।

রাজার প্রতিক্রিয়ায় অবাক হলাম। বিছানায় মাথা রেখে আশ্বস্ত ভঙ্গিতে মৃদু হাসলেন ফারাও। কতো দিন? বেশ হাসিখুশি ভাবে জানতে চাইলেন। চরম বিস্ময়ের সাথে বুঝতে পারলাম, আমার এই নিষেধাজ্ঞা বেশ স্বস্তির হয়ে এসেছে তার জন্যে।

আমার কাছে নারীর দেহ-সম্ভোগ যেখানে অসম্ভব এক স্বপ্ন একজন ফারাও-এর কাছে অতি-ব্যবহারে পুরোনো একটা বিষয় সেটা।

সেই সময়ে, কম করে হলেও তিনশ পত্নী এবং উপ-পত্নী ছিলো ফারাও-এর হারেমে; আর কিছু এশীয় মেয়ে আছে, যাদের রয়েছে অতৃপ্ত তৃষ্ণা। রাতের পর রাত, বছরের পর বছর ঠিক একজন দেবতার মতো এই অক্লান্ত ভালোবাসায় কতোই না শক্তি ক্ষয় হয়েছে মহান ফারাও-এর ভেবে করুণা হলো।

নব্বই দিন, অবশেষে বললাম আমি।

নব্বই দিন? চিন্তান্বিত ভাবে বললেন ফারাও। দশ দিন করে ধরলে, নয়টি মিশরীয় সপ্তাহ?।

কম করে হলেও, শক্ত মুখে বললাম।

ঠিক আছে, সহজ ভঙ্গিতে মেনে নিয়ে বিষয় পরিবর্তন করলেন রাজা।

আমার পরিচর্যকের কাছে শুনলাম, তুমি নাকি আমাদের এই মিশরের সেরা তিনজন জোতিষী র একজন?

কেন যে অমন মন্তব্য করলো আতন-ভেবে পেলাম না। আমি ছাড়া বাকি দু জন আবার কারা? বিনয়ের সাথে কুর্নিশ করলাম, সে একটু অতিরঞ্জন করেছে, মহান ফারাও। তবে হয়তো স্বর্গীয় আত্মাদের কিছু ব্যপার আমার জানা আছে।

আগ্রহের আতিশায্যে উঠে বসলেন ফারাও। এখনই একটা ভবিষ্যদ্বানী কর আমার জন্যে।

এখন? দারুন বিস্ময়ে বললাম।

এখন! কেন নয়? তোমার কথা অনুযায়ী, এখন তো রাতে তেমন কিছু করার নেই আমার। তাঁর অপ্রত্যাশিত হাসি সত্যিই মিষ্টি; যদিও ট্যানাস এবং লসট্রিসের জীবনে তিনিই দুঃখ বয়ে নিয়ে এসেছেন–তাঁকে আমার ভালোই লাগলো।

প্রাসাদের গ্রন্থাগার থেকে কিছু স্ক্রোল নিয়ে আসতে হবে আমাকে সেজন্যে।

সারারাত পরে আছে। যা কিছু খুশি, নিয়ে এসো।

রাজার সাগ্রহ দৃষ্টির সামনে তার প্রথম দফা কুষ্ঠি তৈরি করলাম। ঠিক আমার পর্যবেক্ষণের মতোই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিজস্ব নক্ষত্র দ্বারা চালিত। সেই রক্ত লাল ভবঘুরে তারা, যেটাকে আমরা সেথ্‌-এর চোখ বলে জানি তার ভাগ্য দখল করে আছে। এ হলো সংঘর্ষ এবং অনিশ্চয়তা; দ্বিধা-ভারাতুরতা এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ; দুঃখ এবং দুর্ভাগ্য, এবং সবশেষে, অপঘাতে মৃতুর ইঙ্গিতবাহী নক্ষত্র।

কেমন করে তাকে এই সমস্ত কথা বলবো আমি?

তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া বহু ঘটনার বিবরণ দিয়ে গেলাম, এমনকি অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত কিছু বিষয়ের কথাও বললাম আমার গুপ্তচরদের কাছ থেকে যেগুলো জেনেছিলাম। এর অনেকগুলো অবশ্যই আতন জানিয়েছিলো আমাকে। এরপরে, সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘজীবনের নিশ্চয়তা দিলাম তাকে সব মানুষই এটা শুনতে চায়।

দারুন প্রভাবিত হলেন রাজা। এতো গুণ তোমার, আমার প্রত্যাশা বেড়ে চলেছে টাইটা।

ধন্যবাদ, মহান ফারাও। আপনার সেবায় আসতে পেরে আমি খুশি। স্ক্রোল আর প্রায় সকাল হয়ে এসেছে, ইতোমধ্যেই। প্রাসাদের দেয়ালের ওপারে সকালের পাখিদের ডাক শুনতে পাচ্ছি।

দাঁড়াও, আমি তোমাকে যাওয়ার অনুমতি দেই নি। যা জানতে চাই, তার কিছুই তুমি আমাকে বলনি। আমার কী পুত্র-সন্তান হবে? বংশধারা রক্ষা পাবে?

হায়, মহান ফারাও; ওই সব ব্যপার নক্ষত্র দেখে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কেবল আপনার জীবনের সাধারণ নির্দেশনা এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সামান্য কিছু অনুমান করা যায় নক্ষত্র থেকে–

আহ, আমাকে থামিয়ে দিলেন তিনি। কিন্তু ভবিষ্যত দেখার তো আরও উপায় আছে, নয় কি? কথার ধারা কোনদিকে যাচ্ছে ভেবে সতর্ক হলাম আমি, চলে যেতে পারলে বাঁচি। কিন্তু রাজা ছাড়বেন না।

আমি তোমার সম্পর্কে কৌতূহলি, টাইটা, তোমার ব্যপারে সব খোঁজই আছে আমার কাছে। আমন রার ইন্দ্রজাল তোমার সাধ্যের মধ্যেই, আমি জানি। মুষড়ে পড়লাম আমি। কেমন করে রাজা জানলেন এ কথা? খুব কম লোকেরই জানা আছে, এই ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী আমি। আমি চাই নি, সবাই জানুক এটা। চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই এখন।

তোমার ওষুধের বাক্সের তলায় রার ধাঁধা আছে, আমি দেখেছি, বললেন ফারাও। মিথ্যে বলে যে ধরা খেয়ে যাই নি, দেবতারা সহায় । জানি, এরপরে কী বলবেন ফারাও।

ইন্দ্রজাল তৈরি কর, আমাকে বল, আমার বংশধারা রক্ষিত হবে কি না। আমি কী পুত্র সন্তানের পিতা হতে পারবো না?

কুষ্ঠি হলো এক মামুলি ব্যাপার; কেবল নক্ষত্রের গতিপথ এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানা থাকলেই ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। আর, আমন রার স্বর্গীয় ইন্দ্রজাল সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। জীবনী শক্তি শুষে নেয় এটা, আত্মার গভীরে পুড়ে যায় প্রচুর অনুভূতি। ভীষণ দুর্বল হয়ে পরে মানুষ এটা করার পরে ।

আজকাল এ সব থেকে দূরে সরে থাকতে চাই আমি। হয়তো, কখনও কখনও আমন রার ধাঁধা অনুশীলন করতে বাধ্য হই; কিন্তু এরপর বহুদিন মানসিক এবং শারীরিক ক্লান্তি ঘিরে রাখে আমাকে। এমনকি, আমার কর্ত্রী লসট্রিস পর্যন্ত জানে আমার এই ঐশ্বরিক শক্তির কথা; এ-ও দেখেছে, কতটা দুর্বল হয়ে যাই এটা অনুশীলন করলে। তাই ওই কার্যে আমাকে বারণ করেছে সে।

কিন্তু, একজন রাজাকে তুচ্ছ ক্রীতদাস কী করে ফিরিয়ে দেবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওষুধের বাক্সের নিচ থেকে আমন রার ধাঁধা বের করলাম আমি। বাক্সটা একপাশে সরিয়ে রেখে লতাগুল থেকে মিশ্রণ তৈরিতে মগ্ন হলাম, আত্মার চোখ খুলে দেয় ওটা–ভবিষ্যতে নিয়ে চলে। তৈরি শেষ হতে মিশ্রণটা পান করে নিলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিচিত সেই অনুভূতি দেহ ছেড়ে আত্মার নিগমণ টের পেলাম। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পরছি ক্রমশই, মনে হলো বাস্তব জগৎ থেকে যোজন যোজন দূরে সরে গেছি। বাক্স থেকে আমন রার ধাঁধাগুলো হাতে নিলাম।

দশটি আইভরি চাকতি ধারণ করে আছে ধাঁধাগুলো । দশ হলো শুদ্ধতম জ্ঞানের প্রতীক। মানবের অস্তিত্বের এক একটি অংশ ধারণ করে ভিন্ন ভিন্ন চাকতি। ওগুলো নাড়াচাড়া করতে আমার সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হতে লাগলো । দ্রুত আমার হাতে গরম ঠেকতে লাগলো চাকতিগুলো, যেনো আমার দেহের তাপ শুষে নিচ্ছে। ফারাও কে একটি করে চাকতি হাতে নিতে বললাম আমি, আঙুলের ফাঁকে ঘষে ঘষে সম্পূর্ণ মনোযোগ এক করতে বললাম। একই সঙ্গে উচ্চস্বরে প্রশ্ন করে করতে লাগলেন তিনি, আমার কী পুত্র সন্তান হবে? বংশধারা রক্ষিত হবে?

সম্পূর্ণ শিথীল শরীরে দেহের ভেতরে ঐশ্বরিক শক্তিকে আমন্ত্রণ জানালাম। যেনো অন্তর্ভেদি গোলার মতো ফারাও-এর প্রশ্নগুলো ভেঙে ভেঙে ঢুকে পরলো আমার অভ্যন্তরে ।

বাঁশির আওয়াজে মোহমুগ্ধ কোব্রার মতো এদিক ওদিক দুলতে শুরু করেছি আমি। ঔষধের প্রভাব এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ। যেনো আমার দেহের কোনো ভর নেই, শূন্যে ভেসে চলেছি। অনেক দূর থেকে যেনো বলে উঠলাম আমি, কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি তুলছে মাথার ভেতর।

অন্ধকারের ভেতর থেকে ছায়ামূর্তি তৈরি হতে থাকলো আমার সামনে, অদ্ভুত আওয়াজে কান ভরে উঠলো। অর্থবহ কোনো ধ্বনি নয়, কেবলই বিশৃঙ্খল শব্দমালা। চোখ জ্বলছে আমার। আরো শূন্যে উঠে পরছি আমি ক্রমশই, মহাশূন্যে পৌঁছে গেছি যেনবা ।

মাথার ভেতরের শব্দমালা এবারে অর্থবহ হতে থাকে, চোখের সামনে তৈরি হয় পরিষ্কার ছবি।

নবজাতকের কান্না শুনতে পারছি আমি, কণ্ঠস্বর ভেঙে গেলো আমার।

ছেলে? মাথার ভেতরে যেনো দপদপিয়ে উঠলো ফারাও-এর কণ্ঠস্বর ।

ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসে আমার দৃষ্টি। দীর্ঘ একটা সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় আলোর একটু রেখা যেনো দেখতে পাই আমি। হাতেধরা আইভরি ধাঁধাগুলো যেনো আগুন-গরম–তালুতে ছ্যাঁকা দিচ্ছে ।

নাড়িতে পেঁচানো অবস্থায়, আলোর বৃত্তের মাঝে একটি শিশুকে দেখতে পেলাম আমি, মাতৃজঠরের তরলে সর্বাঙ্গ ভেঁজা।

একটা শিশু দেখছি আমি, কঁকিয়ে উঠলাম।

ছেলে শিশু? আমার চারপাশ ঘিরে থাকা আঁধারের ভেতর থেকে বলে উঠেন ফারাও।

কেঁদে উঠে শূন্যে পা ছেড়ে শিশুটি, ওর পায়ের ভাঁজে বসে থাকা ছোট্ট অঙ্গ দেখতে পেলাম আমি।

ছেলে, বলতে গিয়ে পরাবাস্তব জগতের এই নবজাতকের প্রতি আমার স্নেহের প্রাবল্যে অবাক হলাম। এগিয়ে গিয়ে একটু ধরতে চাইলাম ওকে, কিন্তু আমার দৃষ্টি ক্রমশই ঝাপসা হয়ে আসে–বাচ্চাটার কান্না দূরাগত হতে হতে মিলিয়ে যায় অন্ধকারে।

বংশধারা? আমার বংশধারার কী হবে? টিকবে ওটা? রাজার কণ্ঠস্বর আমার কান পর্যন্ত পৌঁছল, এরপর বিভিন্ন শব্দের শোরাগোলে হারিয়ে গেলো সেটা। যুদ্ধের ধ্বনি শুনতে পেলাম আমি, মরণপণ যুদ্ধরত সৈনিকের হুঙ্কার, ধাতুর সঙ্গে ধাতুর সংঘর্ষ শুনতে পেলাম। আমি দেখলাম, মাথার উপরের আকাশ ছেয়ে গেছে তীরের ঝাঁকে।

যুদ্ধ! ভীষণ নৃশংস এক যুদ্ধ দেখতে পারছি আমি যা পুরো দুনিয়া পাল্টে দেবে, রণ-হুঙ্কার ছাপিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলা

আমার বংশধার টিকে থাকবে? উদ্বিগ্ন শোনালো রাজার গলা, পাত্তা দিলাম না আমি। মরুর ঝড় অথবা নীল নদের জলপ্রপাতের আওয়াজ যেনো ভেসে এলো আমার কানে। দেখলাম, আমার দিগন্ত ঝাপসা করে রেখেছে অদ্ভুত এক টুকরো হলুদ মেঘ। তারই মাঝে হঠাৎ হঠাৎ চমকে উঠছে সূর্যরশ্মি।

আমার বংশধারার কী হবে? ফারাও-এর আর্তনাদে আমার দৃষ্টি ফিকে হয়ে আসে। মাথার ভেতরে এখন নিদারুন নিস্তদ্ধতা। নদীর ধারে একটা বৃক্ষ দেখতে পেলাম আমি। বিশাল এক একাশিয়া গাছ, পাতা বহুল-ফলে ফলে ভরে উঠেছে তার ডাল। সবচেয়ে উঁচু শাখায় বসে কর্কশ কন্ঠে ডেকে উঠে রাজকীয় বাজপাখি, কিন্তু আমার চোখের সামনে রঙ, আকৃতি পাল্টে গেলো তার। মিশরের লাল এবং সাদা দ্বৈত মুকুটে পরিণত হলো সেটা। এরপর, পাঁচবার নীলনদের পানির উত্থান-পতন দেখলাম আমি।

আমার তীব্র দৃষ্টির সামনে একাশিয়া গাছের মাথা ঢেকে ফেললো কীট-পতঙ্গের এক বিশাল মেঘ। প্রচুর কীট অধিকার নিলো গাছটির, একদম ঢেকে গেছে ওটা। পোকাগুলো সরে যেতে দেখলাম, কেবল কাণ্ড ছাড়া আর কিছু নেই, কোনো সবুজ অবশিষ্ট নেই গাছটার । একটি পাতাও নেই। এরপর, কেঁপে উঠে মাটিতে লুটিয়ে পরে সেটা। ডালপালার সঙ্গে ভেঙে টুকরো টুকরো হয় মিশরের দ্বৈত-মুকুট। খন্ডগুলো ক্রমেই পরিণত হয় ধুলোয়, বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায় সেগুলো। কিছু নয়, কেবল বাতাস আর মরুর ধুলো অধিকার করে রাখে চরাচর।

কি দেখছো তুমি? জানতে চাইলেন ফারাও। সব মিলিয়ে যায় আমার চোখের সামনে থেকে, নিজেকে রাজার শয্যাকক্ষে আবিষ্কার করি আমি। ফুঁপিয়ে উঠে শ্বাস ফেলছি, যেনো কতদূর পথ দৌড়ে এসেছি। কপালে লেপ্টে আছে ঘামের পুরু স্তর। গায়ের জামা ভিজিয়ে দেহের পাশে ছোটখাটো একটা পুকুর তৈরি করে ফেলেছে ঘামের ধারা। প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপুনি উঠে গেলো, পেটের ভেতরে সেই পরিচিত অসুস্থ অনুভূতি, আমি জানি যা আরো কিছুদিন সঙ্গী হবে আমার ।

এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন ফারাও, এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্যের বিবরণ কেমন করে দেবো তাকে? কি দেখেছো তুমি? ফিসফিস করে জানতে চাইলেন তিনি। আমার বংশধারা টিকে থাকবে?

সত্যি কথা বলা সম্ভব নয়, তাই ভিন্ন একটা গল্প তৈরি করতে হলো। আমি দেখেছি, সবুজে ছাওয়া একটা বন আমার দৃষ্টিসীমা অধিকার করে রেখেছিলো সেটা। এতো বৃক্ষ কোনো শেষ নেই তার; আর প্রতিটি গাছের শিখরে একটি করে দ্বৈত মুকুট।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন ফারাও। নিঃশব্দে বসে রইলাম আমরা। তাঁর প্রতি করুণায় মন আর্দ্র হলো আমার।

শেষমেষ, নরম স্বরে মিছে কথা বললাম তাঁকে। যে বন আমি দেখেছি, তা আপনার বংশধরদের। ফিসফিস করে বললাম। সময়ের শেষ পর্যন্ত আছে তারা, প্রত্যেকের শিরে রয়েছে মিশরের দ্বৈত-মুকুট।

মুখ উঁচু করে তাকালেন ফারাও। তাঁর আনন্দ আর কৃতজ্ঞতা করুণ দেখালো । ধন্যবাদ, টাইটা। নিজের চোখে দেখলাম, কতটা কষ্ট হয় তোমার। যাও, বিশ্রাম নাও। আগামীকাল আমরা গজ-দ্বীপে ফিরে যাবো। তোমার এবং তোমার কীর জন্যে ভিন্ন একটা গ্যালির ব্যবস্থা করা হবে। আমার অমরত্বের বীজ যে বহন করবে, জীবন দিয়ে হলেও ওকে রক্ষা কর তাকে।

এতো দুর্বলবোধ করছিলাম, বিছানার কিনারা ধরে উঠে দাঁড়াতে হলো। দরোজার কাছে পৌঁছে চৌকাঠ ধরে নিজেকে সামলালাম। কিন্তু মিসট্রেসের প্রতি আমার দায়িত্ব ভুলি নি।

ফুল শয্যার চাদরের কী হবে? মানুষ ওটা দেখতে চাইবে, মনে করিয়ে দিলাম ফারাওকে। আপনার এবং আমার কর্ত্রীর সম্মানের প্রশ্ন এটা।

তুমি কি বলো, টাইটা? এতো দ্রুত আমার উপর নির্ভর করতে শুরু করে দিয়েছেন তিনি। কিছু সময় আমার কথা শুনে মাথা ঝাঁকালেন, ঠিক আছে!

ফুল-শয্যার চাদর গুটিয়ে নিলাম আমি। পুব থেকে আসা মসলিনের সুতোয় বোনা বিশুদ্ধ লিনেনের কাপড় ওটা। শান্ত, ঘুম কাতর প্রাসাদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চাদর সমেত হারেমে প্রবেশ করলাম আমি। তখনও অন্ধকার ভালোভাবে কাটেনি।

এখনও মরার মতো ঘুমাচ্ছে মিসট্রেস। যতটুকু লাল শেপেনের গুঁড়ো দিয়েছি তাকে, তাতে করে আজকের দিন তো বটেই, আগামী সন্ধে পর্যন্ত ঘুমাবে সে। ওর বিছানার পাশে বসে রইলাম কিছু সময়। আমার সবটুকু শক্তি, স্পৃহা যেনো শুষে নিয়েছে আমন রার ইন্দ্রজাল। কিন্তু যে দৃশ্য দেখেছি তাতে আমার মনের অশান্তি আরো জোড়ালো হয়। একটা ব্যপারে আমি নিশ্চিত, যে বাচ্চাটা দেখেছি ওটা আমার মিসট্রেসেরই; কিন্তু বাকি যা দেখলাম তার কি ব্যাখ্যা? এই ধাঁধার কোনো উত্তর বের করতে না পেরে কাজে লেগে পড়লাম।

লসট্রিসের পাশে, চাদরটা বিছিয়ে দিলাম মেঝেতে। ছুরির ডগা দিয়ে সামান্য খোঁচা দিতেই রক্ত ঝরতে লাগলো আমার বাহু থেকে ফোঁটা গুলো চাদরের উপর ঝরতে দিলাম আমি। যখন সন্তুষ্ট হলাম যে, উদ্দেশ্যে হাসিল হয়েছে; হাতটা বেঁধে নিলাম লিনেনের ফালি দিয়ে। রক্তের দাগ পরা চাদরটা ভাজ করে দলা পাকিয়ে রাখলাম।

বাইরের কক্ষে এখনও পাহারায় রয়েছে সেই দাসী মহিলা। তাকে জানালাম, লসট্রিসকে যেনো কোনোরকম বিরক্ত করা না হয়। আদেশ পালিত হবে নিশ্চিত হয়ে মই টপকে হারেমের বাইরের দেয়ালের উপর চড়ে বসলাম।

তখনও পুরো ফোটেনি সকালের সূর্য। তারপরেও, বৃদ্ধা এবং উৎসুক জনতা ভীড় করে আছে হারেমের চৌহদ্দিতে। মেঘের মতো সাদা লিনেন চাদরে ঠিক ফুলের মতো ফুটে থাকা রক্তের দাগ দেখে উল্লাসে ফেটে পরে জনতা, আমার কর্ত্রীর কুমারী দেহের প্রমাণে উদ্বেলিত হয়। মনে আশা–এর জঠরেই ফারাও-এর পুত্র সন্তানের জন্ম হবে।

জনতার শেষ সারিতে দাঁড়িয়ে সবকিছু অবলোকন করছিলো দীর্ঘ একটি অবয়ব। দাগ অলা পশমের কাপড়ে মাথা ঢাকা। আমার দিকে মুখ ফেরাতে চিনতে পারলাম, ওই সোনালি চুলের মালিক আর কে-ই বা হতে পারে?

ট্যানাস! চিৎকার করে ডাকলাম আমি। আমার কথা শোনো!

দেয়ালের ওপার হতে আমার পানে চাইলো সে। এতো বেদনা তার দুচোখে, হৃদয় ভেঙে যেতে চাইলো আমার। চাদরের ওই দাগ ট্যানাসের জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে। ভালোবাসা হারানোর ব্যথা বুঝি আমি, এতোগুলো বছরেও সেই স্মৃতি এখনও অম্লান। ট্যানাসের আহত হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ চলছে, আমি জানি, যুদ্ধ ক্ষেত্রের কোনো আঘাতই তাকে এতো ব্যথা দেয়নি কখনও।

বেঁচে থাকতে হলে আমার সাহায্য এই মুহূর্তে বড়ো প্রয়োজন ওর।

পশমের শাল দিয়ে মুখ-মাথা ঢেকে ফিরে চলে ট্যানাস। ঠিক মাতাল লোকের মতোই এলোমেলো পদক্ষেপে ।

ট্যানাস! বৃথাই পেছন থেকে চিৎকার করে ডাকলাম। একবারো না তাকিয়ে গতি বাড়িয়ে হেঁটে চললো সে।

যতক্ষণে দেয়াল বেয়ে নিচে নেমে প্রধান ফটকের কাছে পৌঁছলাম আমি, শহরের গলি-ঘুপচি আর কাঁদায় লেপা কুঁড়ের গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেছে ট্যানাস।

.

অর্ধেকটা সকাল ট্যানাসের খোঁজে ঘুরে ফিরলাম, কিন্তু তার তাবুতে কেউ নেই, কেউ এমনকি দেখেওনি তাকে।

শেষমেষ, হাল ছেড়ে দিয়ে দাস বালকদের প্রকোষ্ঠে ফিরতে হলো। দক্ষিণে হলো । দক্ষিণে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজকীয় নৌ বহর। আর দেরি না করে নিজের বাক্স-পেটরা গুছিয়ে নিতে হবে আমাকে। ভারাক্রান্ত মনে এতোদিন ধরে আমার একমাত্র বাসস্থান ত্যাগের গোছ-গাছ শুরু করলাম।

এমনকি আমার পোষ্যরা পর্যন্ত কী করে যেনো বুঝে গেছে, অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটতে চলেছে। শিষ দিয়ে, কিচির-মিচির শব্দে আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালালো ওরা। বন্য পাখিরা ডানা ঝাঁপটালো বাইরের চাতালে। নিজেদের অবস্থান থেকে আমার উদ্দেশ্যে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডেকে চললো শিকারী বাজ পাখি । প্রিয় গ্যাজেল, বিড়াল আর কুকুরগুলো কেবলই পায়ে পায়ে ঘষটে হেঁটে চললো গোছগাছে যেনো বাধা দিতে চায় আমাকে।

বিছানার পাশে একটা জগে টক ছাগ-দুগ্ধ রয়েছে– লক্ষ্য করলাম। আমার খুব প্রিয় পানীয় দাস বালকেরা সব সময় পূর্ণ করে রাখে পাত্রটা। আমার পোষ্যরাও খুব ভালবাসে এই পানীয়, অনেকটা ওগুলোকে তাড়ানোর জন্যেই চাতালে গিয়ে মাটির পাত্রে ঢেলে দিলাম দুধটুকু। পড়িমড়ি করে ছুটে এলো পশু-পাখির দল কে কার আগে খাবে, তার দখল নিতে চায়। নিজের কাজে ফিরে চললাম আমি।

এক জীবনে, এমনকি একজন তুচ্ছ দাসেরও কতো কিছুর মালিকানা থাকে–ভেবে অবাক হতে হয়। কাজ শেষ হতে, পুরো এক দেয়াল জুড়ে উঁচু হয়ে রইলো আমার বাক্স-পেটরা। এতটা সময়ে আমার বিমর্ষভাব অনেকটা বেড়েছে, কিন্তু পরিবেশের নিরব ভাবটুকু ঠিকই ধরা পরলো কানে। কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সতর্কভাবে শুনতে লাগলাম। একমাত্র শব্দ বলতে আমার শিকারী বাজ-এর গলায় ঝোলানো ঘন্টার আওয়াজ। আর কিছু নেই। অন্য কোনো পশু বা পাখি একটি শব্দ পর্যন্ত করছে না ।

জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিতেই ঝকঝকে সূর্যালোক যেনো অন্ধ করে দিতে চাইলো। এরপরে, দৃষ্টি ফিরে আসতেই আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। প্রতিটি পশু-পাখি নিথর বিছিয়ে রয়েছে আমার চাতালে, বাগানে।

ঠিক যে যেখানে পরেছে, ওভাবেই মৃত্যুর কথা ঘোষণা করছে নিঃশব্দে। ছুটে গেলাম আমি, কেঁদে উঠে এক এক করে ডেকে চলেছি আমার প্রিয় পোষ্যদের নাম ধরে খুঁজে বের করতে চাইছি জীবনের এতটুকু চিহ্ন। এক বিন্দু নড়লো না একটি প্রাণীও। পাখিগুলোর শরীর দারুন হালকা, ছোট্ট কাগলো আমার হাতে।

মনে হলো, বিমর্ষ-ক্লান্ত এ হৃদয় বুঝি আর সইবে না। হাঁটুগেড়ে বসে ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি।

আরও অনেকক্ষণ পরে, এই নির্মম মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে ভাবার কথা মাথায় এলো। মেঝেতে পরে থাকা শূন্য মাটির পাত্রটা তুলে নিলাম। গন্ধ শুঁকে দেখলাম দারুন শক্তিশালী বিষ দেওয়া হয়েছিলো আমাকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে। যদিও টক দুধের গন্ধ অন্য যে কোনো ঘ্রাণ আড়াল করে ফেলেছে; আমি নিশ্চিত, দ্রুত কার্যকর বিষ ছিলো ওতে।

কোনো সন্দেহ নেই আমার মনে। কার নির্দেশে এই কাজ করা হয়েছে আমি জানি। বিদায়, প্রিয়। তুমি মরে গেছে, ইনটেফ বলেছিলেন আমাকে। একটুও দেরি করেননি তিনি।

উন্মাদ-রাগ আমাকে অধিকার করে নেয়। গতরাতের ধকল আর বিমর্ষ মন আরও ঘি ঢালে সেই অনুভূতির আগুনে। অভূতপূর্ব রাগে সর্বশরীর কাঁপছে আমার টের পেলাম। কোমর থেকে খুলে নিলাম ছোরাটা, নগ্ন ফলা হাতে উন্মত্তের মতো চাতালের ধাপ টপকে রওনা হলাম। জানি, সকালের এই সময়ে জল-বাগানে থাকবেন ইনটে। তাঁর এতো দিনের সমস্ত আচরণ, আমার প্রতি সমস্ত অন্যায়, অপমান যেনো প্রবল হয়ে উঠেছে। আঘাতে আঘাতে শেষ করে দেবো আমি তাকে, খুলে নেবো তার হৃদপিণ্ড।

জল-বাগানের দরোজা দৃশ্যমান হতে আমার ভেতরে যুক্তি ফিরে এলো। ছয় জন প্রহরী রয়েছে সেখানে, ভেতরে তো আরো আছেই। আমাকে দু টুকরো করে ফেলার আগে কিছুতেই ইনটেফের নাগাল পাবো না। রাগ নিয়ন্ত্রণে এনে ঘুরে দাঁড়ালাম। কাপড়ের আড়ালে ছোরাটা লুকিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করবার প্রয়াস পেলাম। চাতালে ফিরে একে একে তুলে নিলাম নিথর দেহগুলো।

আমার বাগানের সীমানা বরাবর সিকামোর গাছের সারি লাগানোর ইচ্ছে ছিলো, সে কারণেই বেশ অনেকগুলো গর্ত তৈরি করা হয়েছিলো। এখন যখন আমি আর থাকবো না এখানে, গাছ লাগাবার প্রশ্নও উঠেনা–গর্তগুলোতে আমার প্রিয় পশু পাখিগুলোর কবর দিলাম। প্রায় বিকেল ঘনিয়ে গেছে। মাটি চাপা দেওয়া শেষ করেছি, কিন্তু আমার রাগ তখনও দমে নি পুরোপুরি। যদি সম্পূর্ণ না-ও পারি, কিছুটা হলেও প্রতিশোধ নিতেই হবে আমাকে।

তখনও আমার বিছানার পাশের জগে কিছুটা টক দুধ ছিলো। ওটা হাতে নিলাম আমি, চিন্তার ঝড় চলছে মাথায় কেমন করে রাজ-উজিরের রান্নাঘরে ঢুকবো। জানি, এই পরিকল্পনা সফল হওয়ার নয়। বিষ এবং অন্য যেকোনো বস্তু সম্পর্কে সচেতন ইনটেফ। আরো ধৈর্য ধরতে হবে আমাকে। যদি তাকে না-ও মারতে পারি এখন, অন্তত কিছু একটা করতে হবে আমাকে।

দুধের জগ হাতে নিয়ে দাস বালকদের প্রকোষ্ঠে ছেড়ে রাস্তায় নেমে এলাম। কিছুদূর যেতেই এক গোয়ালার দেখা পেয়ে গেলাম, তার সঙ্গেই রয়েছে ছাগীর দল। অপেক্ষায় রইলাম, ওদিকে আমার জগ কানায় কানায় পূর্ণ করে দিতে লাগলো সে। যেনো প্রস্তুত করে থাকুক, এতো তীব্র ছিলো সেই বিষ–অর্ধেক কারনাক-কে মেরে ফেলার জন্যে যথেষ্ট। জানি, এখনও জগে যেনো পরিমাণ বিষ আছে, আমার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে যথেষ্ট।

র‍্যাসফারের প্রকোষ্ঠ পাহারা দিয়ে রেখেছে ইনটেফের একজন দেহরক্ষী। তার মানে, এখনও রাসফারকে মূল্যবান মনে করছেন তিনি। সেক্ষেত্রে র‍্যাসফারের মৃত্যু হতে পারে আমার যোগ্য বদলা ।

আমাকে দেখতেই কক্ষে ডেকে নিলো প্রহরী। নিজের ঘামে ভেঁজা, স্যাঁতসেঁতে বিছানায় শুয়ে কোঁকাচ্ছে র‍্যাসফার। আমি অবশ্য দেখেই বুঝলাম, তার শল্যচিকিৎসা সফল হয়েছে। চোখ খুলে বিড়বিড় করে আমাকে অভিশাপ দিলো র‍্যাসফার।

কোথায় ছিলি তুই, বিচি ছাড়া বলদ? আমার উদ্দেশ্যে গুঙ্গিয়ে উঠে সে। তুই চলে যাওয়ার পর থেকে ব্যথায় মরে যাচ্ছি। কেমন চিকিৎসা করিস–

তার কথা উপেক্ষা করে মাথার পট্টি খুলতে লাগলাম। ব্যথার জন্যে অন্তত কিছু দে আমাকে! আমার জামার সামনের অংশ আঁকড়ে ধরতে চাইলো র‍্যাসফার, ঝট করে সরে বসলাম।

লবণের গুঁড়ো নিয়ে কিছু করার ভান করলাম প্রথমে, তারপর র‍্যাসফারের পানির পাত্র কানায় কানায় ভরে দিলাম সদ্য দোয়ানো দুধ দিয়ে।

ব্যথা খুব বেশি হলে, এটা খেয়ে দেখো কমে যাবে, তার হাতের নাগালের মধ্যেই রাখলাম পাত্রটা। সরাসরি হাতে দিতে কোথায় যেনো বাঁধলো।

কনুইয়ের উপর উঁচু হয়ে এক থাবায় ওটা ধরতে চাইলো র‍্যাসফার । কিন্তু সে নাগাল পাবার আগেই পা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলাম আমি। রাসফারে যন্ত্রণায় হিংস্র আমোদ পাচ্ছি, যতোটা সম্ভব দীর্ঘায়িত করতে চাইছি ওর কষ্ট। কঁকিয়ে উঠে সে, ওহে টাইটা, দয়া করে দাও ওটা; না হয় পাগল হয়ে যাবো ব্যথায়।

চলো, বরং কিছুক্ষণ আলাপ করে নেই। তুমি কী জানো, লসট্রিস আমাকে উপহার হিসেবে চেয়ে নিয়েছে, তার বাবার কাছ থেকে?

এতো ব্যথার মধ্যেও হেসে উঠলো র‍্যাসফার। যদি মনে করে থাকো, ইনটেফ তোমাকে যেতে দেবেন তা হলে তুমি একটা গাধা। মরে গেছো তুমি, খোঁজা।

একই কথা বলেছিলেন ইনটেফ। আমার জন্যে শোক করবে না, র‍্যাসফার? কাঁদবে নাকি? মুচকি হেসে বললাম, চোখ দুধের পাত্রে।

আমি তো সব সময়ই তোমার ভক্ত হে, রাসফার বলে উঠে, এখন পাত্রটা দাও।

এততাই ভক্ত খোঁজা করে দিলে আমাকে? কেমন লেগেছিলো সেদিন? এই কথায় আমার পানে চেয়ে রইলো র‍্যাসফার।

এতো আগের কথা নিশ্চই মনে রাখো নি তুমি। সে তো বহু আগের কথা। আর তাছাড়া, ইনটেফের নির্দেশ কেমন করে অমান্য করতাম আমি?

তুমি হাসছিলে তখন। কেন হেসেছিলে, রাসফার? খুব মজা পেয়েছিলে, তাই না?

নড়ে উঠতেই ব্যথায় দম আঁকালো সে। আমি তো সবসময়ই হাসি। বন্ধু, ক্ষমা করে দাও, দয়া করে। ওই পাত্রটা দাও আমাকে।

পা দিয়ে পাত্রটা ঠেলে দিতেই প্রায় ছিনিয়ে নেয় র‍্যাসফার। ঠোঁটের উপর উঁচু করে ধরে।

জানি না, কী করছিলাম; কিছু বোঝার আগেই দেখি, পায়ের এক লাথিতে দুধের পাত্রটা ফেলে দিয়েছি আমি। দেওয়ালে দুধ ছিটিয়ে মাটিতে গড়িয়ে শান্ত হয় ওটা।

পরস্পরের দিকে অপলকে চেয়ে রইলাম আমরা। নিজের নির্বুদ্ধিতায় চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করলো আমার। বিষের যন্ত্রণায় নীল হয়ে মৃত্যু হোত এর যথার্থ শাস্তি। কিন্তু আমার পোষ্যদের বিকৃত দেহের কথা মনে হতেই বুঝলাম, কেন পারি নি রাসফারকে বিষ খেতে দিতে। একমাত্র একজন কাপুরুষই পারে এটা করতে।

র‍্যাসফারের রক্তবর্ণ দৃষ্টিতে ছায়া ঘনায়। বিষ! ফিসফিস করে বললো সে। দুধে বিষ ছিলো।

ওটা প্রভু ইনটেফ পাঠিয়েছিলেন আমায়, জানি না, কেন এইসব বলছিলাম ওকে। হয়তো, কাল রাতের ইন্দ্রজালের প্রভাবে এখনও দুর্বল আমি। কেঁপে উঠে দরোজার দিকে রওনা হলাম।

পেছনে, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে র‍্যাসফার। তার হাসির দমকে দেওয়ালগুলো যেনো কেঁপে উঠে।

তুই একটা গর্দভ, ব্যাটা খোঁজা, পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে চলে সে, আমাকে মেরে ফেলাই উচিত ছিলো তোর। আর কখনও এমন সুযোগ পাবি না! আর, এবার, আমি তোকে মারবো-দেখিস, কোনো সন্দেহ নেই–আমি খুন করবো তোকে।

লসট্রিসের প্রকোষ্ঠে ফিরে দেখি, এখনও ঘুমিয়ে আছে সে। ওর পায়ের কাছে ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় বসে রইলাম। গত রাত এবং আজকের দিনের ধকল আর সইতে পারলো না শরীর, ঠিক অসহায় কুকুরছানার মতোই মেঝেতে শুয়ে পড়লাম; ক্রমশই অন্ধকার হয়ে আসছে চারিদিক।

*

কিছু একটার আঘাতে ঘুম ভেঙে গেলো। মাথার এক পাশ দপ দপ করছে, পুরো জেগে উঠার আগেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। সঙ্গেই সঙ্গেই বাড়ি লাগলো কাঁধে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম। যেনো মৌমাছি কামড়েছে ওখানটায়।

আমাকে ঠকিয়েছো তুমি! চিৎকার করছে লসট্রিস, মরতে দাও নি! হাত-পাখাটা দিয়ে আবারও আঘাত করতে উদ্যত হলো সে। অস্ত্র হিসেবে মোটেও হেলাফেলা করা যায় না ওটাকে বাঁশের তৈরি লম্বা হাতল, অসট্রিচের পালকে তৈরি দাঁতওয়ালা ভীষণ শক্ত। ভাগ্যই বলতে হয়, ঘুমের ওষুধের প্রভাবে এখনও টলছে লসট্রিস, নিজের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। ওর হাঁকানো আঘাতের নিচে মাথা নামিয়ে নিতেই ভারসাম্য হারিয়ে বিছানায় পড়ে গেলো সে।

কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে পিঠ। আমি তো মরতেই চাই; কেনো এমনটা করলে, টাইটা?

ধীরে ওর কাছে গিয়ে এক হাতে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। ব্যথা লেগেছে, টাইটা? জানতে চাইলো লসট্রিস। কখনও তোমাকে মারি নি এর আগে।

প্রথমবারের চেষ্টাটা ভালোই ছিলো, ওকে স্বাগত জানিয়ে বললাম। এতো ভালো, মনে হয় আর অনুশীলন করার প্রয়োজন নেই! করুণ চেহারায় মাথা ডলতে লাগলাম, যেখানে লেগেছিলো আঘাতটা। কান্নার ভেতরেও হেসে ফেললো মিসট্রেস।

আহারে! সত্যি, বেশ খারাপ ব্যবহার করি তোমার সাথে। কিন্তু দোষ তোমার–মরতে দিলে না কেনো আমাকে? আমার আদেশ পর্যন্ত অমান্য করলে।

দ্রুত বিষয় পরিবর্তন করার প্রয়াস পেলাম। মিসট্রেস, দারুন খবর আছে তোমার জন্যে। কিন্তু, আগে আমাকে প্রতিজ্ঞা করো, কাউকে–এমনকি তোমার দাসীদেরকেও বলবে না কথাটা। কথা শেখার পর থেকে কোনো খবর কোনোদিন পেটে রাখতে পারে নি লসট্রিস; কিন্তু কোন মেয়েই বা পারে? প্রতিজ্ঞার কথায় বরাবরই আপুত হয় সে, এবারেও তার অন্যথা হলো না ।

এতো কান্না, ভগ্ন-হদয়েও ওর চোখে কৌতূহল ঝিলিক দিয়ে উঠলো। কান্না গিলে ফেলে সাগ্রহে উঠে বসলো সে, বলো আমাকে!

কিছু সময় চুপ থেকে কথা গুছিয়ে নিলাম। আমার পশুপাখির মৃত্যু বা ট্যানাসের দর্শন-লাভ–এসব কিছু বলা যাবে না ওকে। এমন কিছু বলতে হবে, যাতে করে ওর উৎসাহ বাড়ে।

গত রাতে ফারাও-এর শয্যাকক্ষে সারারাত কথা বলেছি তার সাথে।

দেখতে দেখতে কান্না উপচে পড়তে লাগলো লসট্রিসের চোখ থেকে। ওহ টাইটা! আমি ঘৃণা করি তাঁকে। কুৎসিত এক বুড়ো, তার সাথে–তার সাথে আমি—

দ্রুত বলে যেতে লাগলাম আমি, তার আদেশে ইন্দ্রজাল ব্যবহার করেছিলাম রাতে। সঙ্গে সঙ্গে মনোযোগী হলো লসট্রিস। ঐশ্বরিক শক্তি তার খুব প্রিয় বিষয়। ইন্দ্রজাল অনুশীলনে যদি আমার শারীরিক কষ্ট না হতো, তবে প্রতিদিনই আমাকে দিয়ে ওটা করিয়ে নিতো সে।

কী দেখলে? বলো না! আবার উৎসাহ ঝিলিক দিতে লাগলো ওর চোখে। এখন আর মরার বাসনা নেই সেখানে, সব দুঃখ ভুলে গেছে মেয়েটা। এতো নিষ্পাপ, এতো সরল ও–প্রতারক মনে হতে লাগলো নিজেকে।

অসাধারণ সব জিনিস দেখেছি, মিসট্রেস। কোনোদিন এতো পরিষ্কার ছবি দেখি নি এর আগে। এতো সুন্দর, এতো গভীর–

আরে বলোই না!

কিন্তু প্রথমে প্রতিজ্ঞা করো, কাউকে বলবে না। আর কেউ যেনো এইসব কথা না জানে।

কসম! সত্যি, কাউকে বলবো না!

মানে, এতো হালকাভাবে বললে তো চলবে না–

এক্ষণ বলো, কী দেখেছো! আমার সাথে চালাকি করে লাভ নেই। এখন বলো, না হলে–না হলে–হাতের মুঠো পাকালো লসট্রিস। আবার মারব তোমাকে!

আচ্ছা, আচ্ছা। বলছি, শোনো। আমি দেখলাম, নীল নদের তীরে বিশাল একটা গাছ। তার ছুঁড়োয় বসে রয়েছে মিশরের মুকুট।

ফারাও! ওই গাছটা হলো রাজা! দ্রুতই বুঝে নিলো লসট্রিস। বলো, টাইটা! আর কী দেখেছো?

আমি দেখলাম, পাঁচবার নীল নদে বন্যা এলো। পানির স্তর উঠলো-নামলো ঠিক পাঁচবার।

পাঁচ বছর–তার মানে, পাঁচ বছর পেরুলো! খুশির আতিশায্যে হাততালি দিয়ে উঠলো লসট্রিস। ধাঁধার সমাধাণ তার অত্যন্ত প্রিয়।

এরপর, কীট-পতঙ্গ গাছটির অধিকার নিলো; মুকুট লুটালো ধুলোয়। সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলো।

অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে রইলো লসট্রিস, মুখে কথা নেই। আমি বলে চললাম, পাঁচ বছর পর মারা যাবেন ফারাও। তুমি মুক্ত হবে, মিসট্রেস। তোমার বাবার অধিকার থেকেও। তখন ট্যানাসের কাছে যেতে আর কোনো বাধা থাকবে না।

মিথ্যে বলো না আমাকে, টাইটা! পরে যদি দেখি–এসব মিথ্যে কষ্টে মরে যাবো।

এগুলো সত্যি, মিসট্রেস। কিন্তু আরো আছে। আমি দেখলাম, একটা নবজাতক ছেলে! সাথে সাথেই দারুন ভালোবাসা বোধ করলাম ওর প্রতি, আমি জানি, ওই বাচ্চাটার মা হবে তুমি।

কিন্তু, ওর বাবা কে, টাইটা? বলো না!

আমি একদম নিশ্চিত, ওর বাবা ট্যানাস। এখানে এসে প্রথমবারের মতো সত্যের অপলাপ করতে হলো, কিন্তু এ সবই তো ওর ভালোর জন্যে এই ভেবে মনে সান্ত্বনা পেলাম।

বেশ কিছু সময় নিরবে বসে রইলো লসট্রিস। এক অপার্থিব আভা তার চোখে মুখে–এর বেশি আর কী চাওয়ার আছে আমার? শেষমেষ, ফিসফিস করে ও বললো, পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে পারবো আমি। সারাজীবন অপেক্ষা করতেও রাজী ছিলাম। কষ্ট হবে, কিন্তু আমি পাঁচ বছর ট্যানাসের অপেক্ষা করবো। তুমি ঠিক করেছো, টাইটা সরতে দাও নি আমাকে। দেবতারা রুষ্ট হতেন তাহলে।

স্বস্তিতে ভেসে গেলাম, এখন আমি জানি, সামনের দিনগুলোয় ওকে সান্ত্বনা দিয়ে মানিয়ে নিতে পারবো।

*

দিন সকালে কারনাক ছেড়ে রওনা হলো রাজকীয় নৌবহর। তাঁর প্রতিজ্ঞা মতো, লসট্রিস এবং তার যাত্রা-সঙ্গীদের জন্যে আলাদা একটা ছোট্ট গ্যালির বন্দোবস্ত করেছেন রাজা; দক্ষিণের বাহিনীর সাথে।

বিশেষত লসট্রিসের জন্যেই পাটাতনের উপর তৈরি করা একটা প্রকোষ্ঠে ওর সাথে বসে রইলাম। আমরা দু জনেই পেছন ফিরে তাকিয়ে আছি দিনের প্রথম হলদেটে সূর্যরশ্মি যেনো আদরের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে এতোদিনের প্রিয় কারনাক নগরীকে।

ও যে কোথায় গেলো, কে জানে। আমাদের জাহাজ-বহর পাল তোলার পর থেকে এই নিয়ে অনেকবার ট্যানাসের কথা বলেছে লসট্রিস। ভালো ভাবে খুঁজে দেখেছো তুমি? সবখানে?

সব জায়গায় খুঁজে দেখেছি, নিশ্চয়তা দিয়ে বললাম । সারাটা সকাল ধরে শহরতলী আর বন্দরে খুঁজেছি। নেই ও একেবারে মিলিয়ে গেছে বাতাসে। তবে, কাতাসের কাছে তোমার বার্তা পৌঁছে দিয়েছি। চিন্তা নেইক্ৰাতাস ঠিকই বলবে ট্যানাসকে।

পাঁচ বছর–ওকে ছাড়া পাঁচ বছর কেমন করে কাটবে, বলো তো টাইটা?

*

নদীর উজানে ভেসে চললো আমাদের জাহাজ বহর। অলস, আরামদায়ক দিনগুলো কেটে যেতে লাগলো আমার মিসট্রেসের সাথে হাস্যে-গল্পে। ভবিষ্যত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম আমরা, কী ঘটতে পারে সামনে, কী আশা করা উচিত এইসব।

রাজ্যসভার সমস্ত আচার, সম্ভাষণ, আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে তাকে অবগত করলাম আমি। ফারাও-এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ, শত্রু-মিত্র সব বিষয়েই কিছু না কিছু বললাম। এ ব্যপারে অবশ্য বন্ধু আতনের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। রাজ-পরিচর্য হওয়ায় বহুকিছু তার জানা। বিগত বারো বছরে গজ-দ্বীপ থেকে কারনাকে আসা প্রতিটি জাহাজে আমার জন্যে চিঠি পাঠাতো সে কেমন করে রাজ সভা চলে, কার কী উদ্দেশ্য, ক্ষমতা, অভিপ্রায় প্রায় সবকিছু নিয়ে আমাকে বিস্তারিত জানাতো আতন। অবশ্য, কৃতজ্ঞতার প্রকাশস্বরূপ একটা করে স্বর্ণমুদ্রা উপহার হিসেবে প্রতিবারেই পেতো সে আমার তরফ থেকে। লসট্রিসও মনোযোগী শ্রোতা। সমস্ত কথা হৃদয়ঙ্গম করে নিতে লাগলো সে।

খুব দ্রুতই একটা ব্যাপার বুঝে ফেললাম আমি। যে কোনো বিষয়ে লসট্রিসের মনোযোগ পেতে হলে এতটুকু বললেই যথেষ্ট যে, এইসব কিছু এক সময় ট্যানাসের উপকারে আসবে। যদি রাজসভায় তোমার ভালো ক্ষমতা থাকে, তো ওকে রক্ষা করতে পারবে তুমি। আমি বলেছি ওকে, অসম্ভব একটা কাজ দিয়েছেন রাজা তাকে। সফল হতে হলে আমাদের সাহায্য প্রয়োজন ওর; আর যদি ব্যর্থও হয়–এক তুমিই পারবে ওকে বাঁচাতে।

ওর কাজে সফল হওয়ার জন্যে আমরা কী করতে পারি, টাইটা? ট্যানাসের কথা বলতেই লসট্রিসের পূর্ণ মনোযোগ পেতাম। একটা সত্যি কথা বলে আমাকে, কোনো মানুষের পক্ষেই কি শ্রাইক-দের নির্মূল করা সম্ভব? এমনকি, ট্যানাসের মতো বীরের জন্যেও তো এটা অসম্ভব কাজ।

উচ্চ-রাজ্যে ত্রাস সৃষ্টিকারী দস্যুদল নিজেদের শ্রাইক বলে পরিচয় দেয়। আমাদের মিশরীয় ঘুঘুর চেয়েও ছোটো একটা পাখি আছে এই নামে; অন্য পাখির নীড়ে হানা দিয়ে ছিঁড়ে ফালাফালা করে দেহগুলোকে একাশিয়া গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখে এরা। সেই কসাই পাখির নামেই নিজেদের পরিচিত করে উচ্চ-রাজ্যের দস্যুরা।

তোমার কী মনে হয়, বাজপাখির প্রতাঁকের কারণে সফল হবে ট্যানাস? লসট্রিস বলে চলে, আমি শুনলাম, উচ্চ-রাজ্যের সমস্ত শ্রাইকদের নেতৃত্ব দেয় একজন দস্যু–ওরা তাকে ডাকে আকহ্-সেথ নামে। এটা সত্যি, টাইটা?

আমিও সে রকমই শুনেছি, চিন্তান্বিত স্বরে বললাম। সে রকম হলে, ট্যানাস যদি এই আকহ্-সেথকে ধ্বংস করে দিতে পারে শ্রাইকদের মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে। এ জন্যেই আমার সাহায্য বড়ো বেশি প্রয়োজন তার।

চোখ ছোটো করে আমার পানে চাইলো লসট্রিস। তুমি কী করে সাহায্য করবে? আর এইসব বিষয়ে তুমি কি-ই বা জানো?

বেশ চতুর মেয়ে আমার কর্ত্রী, ওকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল বটে। আমি যে কিছু একটা লুকোচ্ছি, এটা সে সাথে সাথেই বুঝে গেছে। আবারো পুরোনো অস্ত্র প্রয়োগ করতে হলো।

ট্যানাসের মঙ্গলের খাতিরেই এর বেশি আর জানতে চেয়ো না। কেবল, ওর সাহায্যার্থে যে কোনো কিছু করার অনুমতি দাও আমাকে।

নিশ্চই। বলো, আমি কিভাবে সাহায্য করবো ওকে?

গজ-দ্বীপে রাজপ্রাসাদে, তোমার সাথে নব্বই দিন থাকবো আমি, এরপরে ট্যানাসের কাছে যাওয়ার জন্যে ছুটি দিতে হবে আমাকে–

না, না–বাধা দিয়ে বলে ওঠে লসট্রিস, ট্যানাসকে সাহায্য করতে হলে এখনই রওনা হয়ে যাও তুমি।

নব্বই দিন, একগুঁয়ের মতো বললাম। এই সময় তো আমিই চেয়ে নিয়েছি ফারাও-এর কাছ থেকে। এখনই হঠাৎ করে রাজপ্রাসাদে এক ছেড়ে দেওয়া যাবে না লসট্রিসকে। একজন অভিভাবক প্রয়োজন ওর ।

এখনই নয়, তবে ওর কাছে যাবো আমি। ক্ৰাতাস আমার পথ চেয়ে বসে থাকবে। কিন্তু এই নব্বই দিনে, আমি কারনাকে ফেরার আগে যা যা করা দরকার সব বলে এসেছি কাতাসকে। সে সবকিছু তৈরি রাখবে। আর কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানালাম।

শুধুমাত্র দিনের আলোয় চলে জাহাজ বহর। রাতের অন্ধকার যেমন মিশরের সাহসী সিংহ, নেমবেটের নৌ-চালনায় উপযোগী নয়; আমাদের ফারাও-ও রাতে বিশ্রাম নেন। প্রতিরাতে নদীর ধারে একশ তাঁবুর মেলা বসে। সব সময়ই কোনো পাম গাছের তলায়, পাথুরে খোড়লে; মন্দির বা গ্রামের কাছেই ফেলা হয় তাবুগুলো। পুরো সভাসদের মাঝে এখনও উৎসবের আমেজ বিরাজমান। আগুনের ধারে নেচে-গেয়ে, খুনসুটি আর দেহজ প্রেমে বিভোর হয় তারা। দূরের মরু থেকে বয়ে আসা মিষ্টি হাওয়া কেমন শান্তির পরশ বুলায় শরীরে। প্রতিটি মুহূর্ত আমার এবং আমার কর্ত্রীর কাজে লাগালাম আমি। রাজার কয়েক শ পত্নীর মধ্যে লসট্রিস সবচেয়ে কনিষ্ঠ পুত্র সন্তান জন্মদানের আগ পর্যন্ত ওর কোনো মূল্য নেই হারেমে। যা করার, আমাকেই করতে হবে।

প্রায় প্রতি সন্ধাতেই, আমরা তীরে তাঁবু গাড়ার পরে আমাকে ডেকে পাঠাতেন ফারাও। যদিও বাহানা ছিলো ছত্রাক সংক্রমণের অবস্থা দেখার জন্যে, আসলে মিশরের দ্বৈত-মুকুটের উত্তরাধিকারী জন্মদানের জন্যে তার প্রস্তুতির খোঁজ-খবর সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন তিনি। তাঁর সাগ্রহ দৃষ্টির সামনে গণ্ডারের শিং এবং ম্যানড্রেকের গুল্ম থেকে মিশিয়ে নিতাম। ফারাও-এর সেবন শেষ হলে, রাজকীয় সদস্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে মনে মনে আশ্বস্ত হলাম–একজন দেবতার অনুপাতে সামাঞ্জস্যপূর্ণ দৈর্ঘ্য বা বেড়, কোনোটিই নেই এর। এমনকি, আমার কুমারী কর্ত্রীর জন্যেও সহজ হবে ওটাকে গ্রহণ করা। যতো যাই হোক, একদিন না একদিন তো রাজপত্নীর দায়িত্ব তাকে পালন করতেই হবে। রাতে, অলিভ তেলে ধোয়া একটা পুলটিস রাজকীয় সদস্যের উপরে জড়িয়ে রাখার পরামর্শ দিলাম ফারাও-কে। ইতিমধ্যেই, আমার মলমে তিন দিনের মধ্যেই ছত্রাক সক্রমণ থেকে আরোগ্য লাভ করেছিলেন তিনি। চিকিৎসক হিসেবে তাতে করে আমার অবস্থান আরো সুদৃঢ় হয় তার দরবারে। ফারাও-এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় সভাসদের কাছে দারুন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলাম আমি। আর যখন জানাজানি হলো, আমি শুধু যে চিকিৎসক, তা নয়, বরঞ্চ একজন ভবিষ্যত বক্তাও বটে–আমার জনপ্রিয়তার কোনো সীমা-পরিসীমা রইলো না।

প্রায় প্রতি সন্ধাতেই আমার কর্ত্রীর কাছে উপঢৌকন আসতো বিভিন্ন প্রভু, মন্ত্রীর তরফ থেকে, আমার পরামর্শ ধার চেয়ে। শুধুমাত্র অল্প কয়জন সভাসদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমাকে পাঠাতে মিসট্রেস।

ধীরে, হারেমের বাদ-বাকি সদস্যরা লক্ষ্য করলো, আমি এবং লসট্রিস খুব ভালো দ্বৈত-সংগীত গাইতে সক্ষম; বিচিত্র ধাঁধা, অসাধারণ সব গল্প–এসবই আমার এবং মিসট্রেসের নখদর্পনে। হারেমের শিশু, নারীদের কাছে ক্রমশই দারুন জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগলাম আমরা।

শীঘ্রই ফারাও-এর কানে আমাদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার খবর পৌঁছে গেলো। দিনে, ভ্রমণের সময়, রাজকীয় জাহাজে তার কাছে লসট্রিসকে ডেকে পাঠাতেন তিনি। রাজার সঙ্গে রাতের ভোজে শিশুতোষ ব্যবহারে সবাইকে মুগ্ধ করে রাখতে সে। আমি সব সময়ই কাছে-পিঠে থেকে সাহস জোগাতাম তাকে। রাতের পর রাত পেরিয়ে গেলো, অথচ তাকে শয্যাকক্ষে ডেকে পাঠানোর কোনো লক্ষণই দেখালেন না ফারাও এতে করে তাঁর প্রতি লসট্রিসের অনুভূতিতে একটু হলেও পরিবর্তন এসেছিলো।

আভিজাত্যপূর্ণ গাম্ভির্যের আড়ালে ফারাও মামোস অত্যন্ত দয়ালু এবং ভালো মনের মানুষ ছিলেন। খুব দ্রুতই এটা বুঝে গিয়েছিলো লসট্রিস, তার প্রতি কিছুটা হলেও শ্রদ্ধাবোধ জাগলো ওর মনে। আমরা গজ-দ্বীপে পৌঁছানোর আগেই ঠিক পিতৃব্য আচরণ করতে শুরু করেছিলো সে, ফারাও-এর প্রতি। সারাদিন নানান গল্প-খেলায় মেতে উঠতে লাগলো রাজার সাথে। পরে, আতন আমাকে জানিয়েছিলো কোনোদিনও তার মনিবকে এতো হাসতে দেখে নি সে।

যা বোঝার, বুঝে নিলো রাজসভার সদস্যরা। কিছুদিনের মধ্যেই, সন্ধেয় আমাদের তাঁবুতে ধরণা দিতে শুরু করলো চাটুকারের দল। লসট্রিসের মাধ্যমে রাজার কানে কোনো কিছু পৌঁছানোর অভিপ্রায় তাদের সবার ।

আমাদের যাত্রা শেষ হওয়ার আগেই সভাসদের দেওয়া উপঢৌকনের বদৌলতে বেশ ভালো রকম ধন-সম্পদের মালিক বনে গেলো আমার কর্ত্রী। এছাড়াও, প্রভাবশালী বহু বন্ধু-বান্ধবও পেয়ে গেলো সে। এসব কিছুরই পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব রাখছিলাম আমি।

কখনই এমনটি বলবো না, কেবল আমার জন্যেই সম্ভব হয়েছিলো এতো কিছু। আমার কর্ত্রীর সৌন্দৰ্য্য, তার বুদ্ধিমত্তা, উছুল-মিষ্টি ব্যবহার তার বড়ো সম্পদ। হয়তো আমি থাকাতে একটু দ্রুত সহজ হতে পেরেছিলো সে সবার সাথে।

সাফল্যের হাতে হাত ধরে এলো সমস্যা। আমাদের জনপ্রিয়তা ইর্ষার আগুন জ্বাললো উঁচু মহলে। ফারাও-এর আনুকূল্য-বঞ্চিত সভাসদেরা লসট্রিসের প্রতি তার এই প্রণয়ে দারুন অখুশি ছিলেন।

একদিন সন্ধায়, আমার তৈরি তরল পান শেষে রাজা বললেন, টাইটা, তোমার এই ওষুধ অত্যন্ত কার্যকরী। বহুদিন পর নিজেকে তরতাজা তরুণ বোধ হচ্ছে। আজ সকালে ঘুম ভেঙে জেগে দেখলাম, এতো দৃঢ় হয়ে আছে ওটা সাথে সাথে আতনকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম দেখতে। দারুন খুশি হয়ে সে বললো, আজ রাতেই তোমার কর্ত্রীকে ডেকে পাঠাতে পারি আমি।

আতঙ্কে নীল; দারুন উদ্বিগ্ন আমি মুখ দিয়ে বাতাস ছেড়ে, আফসোসের ভঙ্গিমায় মাথা নেড়ে নিজের মতামত জানালাম। আতনের পরামর্শ যে মেনে নেন নি, আপনাকে সালাম। প্রভু, এক পলকে আমাদের এতো দিনের সমস্ত পরিশ্রম পণ্ড হয়ে যেতো তাহলে। যদি পুত্রসন্তান চান, আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে।

সেই দিনের কথা ভেবে আশঙ্কায় বিবর্ণ হলাম আমি, যেদিন আমার নব্বই দিবস রজনীর বাধা শেষ লসট্রিসকে বিছানায় ডেকে পাঠাবেন তিনি।

লসট্রিসকে তৈরি করে নিতে হবে আমাকে এই অভিপ্রায়ে ওকে বোঝলাম, এটা অবশ্যম্ভাবী; যদি সত্যিই ফারাও-এর মৃত্যুর পরে ট্যানাসের কাছে যেতে চায় ও–তবে রাজার কাছে নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। লসট্রিস বিচক্ষণ মেয়ে, বুঝলো সে।

তাহলে, তুমি আমাকে আগে থেকে বলে রাখো–কী ঘটবে সে রাতে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলো ও। এই বিষয়ে অভিজ্ঞ নই আমি, কিন্তু অন্তত প্রধান ব্যাপারগুলো সহজ করে বোঝালাম ওকে।

ব্যথা লাগবে, টাইটা? ওর প্রশ্নের জবাবে তড়িৎ বললাম, রাজা দয়ালু মানুষ। নিশ্চই বহু তরুণী মেয়ের অভিজ্ঞতা তার আছে, ব্যথা দেবেন না। এক ধরণের মলম দেবো তোমাকে যাতে করে আরো সহজ হয় ব্যাপারটা। প্রতি রাতে, শোবার আগে ওটা লাগিয়ে দেবো দেখবে, সহজে খুলে যাবে দরোজাটা। মনে রেখো, এ সমস্ত কিছুই ট্যানাসের জন্যে।

মনে-প্রাণে নিজেকে একজন চিকিৎসকের দায়িত্ব পালনে ব্যাপৃত করতে চাইলাম। দেবতারা ক্ষমা করুন, আমার সেই প্রচেষ্টা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলো। লসট্রিসের নারী বৈশিষ্ট্য এতো সুন্দর, যেনো ফুটে থাকা গোলাপ। কিন্তু, অত চমৎকার পাঁপড়ি মরুর কোনো গোলাপে নেই। মলম লাগিয়ে দেওয়ার সময়ে নরম-মিষ্টি মধু ঝরলো ওটা থেকে, এতো মসৃণ-গরম কোনো তরল আমি কখনও প্রস্তুত করতে পারি নি।

গাল লাল হয়ে গিয়েছিলো লসট্রিসের, স্বর খসখসে। মৃদু স্বরে ও বললো, এতোদিন পর্যন্ত ভেবে এসেছি, কেবল বাচ্চা জন্ম হয় ওখান দিয়ে। কিন্তু, যখন ওটা লাগালে ট্যানাসের কথা খুব করে মনে পড়ে গেলো কেননা, বলো তো টাইটা?

এতো বিশ্বাস করতো ও আমাকে, আর শারীরিক-পরিতৃপ্তির অপরিচিত অনুভূতি সম্পর্কে এতো কাঁচা ছিলো; ঠিক যতক্ষণ প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি সময় ধরে মলম না লাগানোর জন্যে নিজেকে জোর করতে হলো আমার। কিন্তু, সেদিন রাতে আর ঘুমাতে পারলাম না। অসম্ভবের স্বপ্ন তাড়া করতে লাগালো থেকে থেকে।

*

যতই দক্ষিণে ভেসে চললাম আমরা, নদীর দুই তীরের সবুজের সমারোহ ক্রমশই কমে আসতে লাগলো; চারপাশ থেকে ঘিরে আসছে মরুভূমি। কোথাও কোথাও গ্রাইনাইটের বিশাল খণ্ডগুলো জলপথ আড়াল করে ফেলেছে প্রায়।

দুর্গমতম জায়গাটার নাম হাপির প্রবেশদ্বার। উঁচু, সংকীর্ণ পাথুরে পথে গর্জন তুলে বয়ে চলেছে নীল নদের পানি; উন্মত্ত, বন্য যেনো নিজস্ব খেয়াল-খুশি আছে তার।

প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় ওটা পেরিয়ে এলো জাহাজ বহর, অবশেষে গজ-দ্বীপে পৌঁছুলাম আমরা। নীলের সরু গলায়, যেখানে আগ্রাসী পাহারশ্রেণীর দাপটে সরু হয়ে গেছে নদী-প্রবাহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বেশকিছু দ্বীপ। গজ-দ্বীপ তার মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ। ছোটো মাছের ঝাকের পেছনে আক্রমণরত হাঙরের মতো আকৃতি এই দ্বীপের । নদীর দু ধারের মরুর যেনো নির্দিষ্ট রঙ-চরিত্র আছে। পশ্চিম তীরের সাহারা মরু গনগনে কমলা; ঠিক তার বুকে বসবাসকারী বেদুঈনদের মতোই। আর পুবে, আরবীয় মরুর রঙ মলিন-ধূসর; বুকে ধারণ করে আছে কালো পাহারশ্রেণী–প্রচণ্ড দাবদাহের মরীচিকায় যেনো নৃত্যরত। এই মরু দুইয়ের একটা ব্যাপার এক এবং অভিন্ন মনুষ্যজাতীর জীবনসংহারী এরা।

আর এসব কিছুর মাঝেই দারুন বৈপরিত্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গজ-দ্বীপ-নদীর রুপালি মুকুটে সবুজ পান্নার মতো জ্বলে আছে। দ্বীপের তীরে সাড়িবদ্ধ বোল্ডারের আকৃতি অনেকটা বিশাল হাতির মতো সে অনুসারেই এর নামকরণ। এছাড়াও, বিগত এক হাজার বছর ধরেই, জলপ্রপাতের ওপারে, সেই অসভ্য কূশ দেশ থেকে আইভরি নিয়ে আসা হতো এই দ্বীপে।

প্রায় পুরোটা দ্বীপে জুড়েই ফারাও-এর প্রাসাদের অবস্থান। উত্তরে যে আরেকজন ফারাও আছেন, তার থেকে সর্বাধিক দূরত্বে, নিরাপদ অবস্থানে থাকার স্পৃহা থাকা স্বাভাবিক।

চারপাশে পানি পরিবেষ্টিত এই দ্বীপ যথেষ্ট সুরক্ষিত। মহান থিবেসের পরে, পুব এবং পশ্চিম গজ-দ্বীপ আমাদের মিশরের উচ্চ-রাজ্যের সবচেয়ে বড় এবং জনবহুল নগর। নিম্ন-রাজ্যের শাসকের আবাসস্থল, মেমফিসের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।

সমগ্র মিশরে এক গজ-দ্বীপেই রয়েছে বৃক্ষের অপূর্ব সমারোহ। প্রতি বছরের বন্যার পানিতে ভেসে আসে বিভিন্ন গাছের বীজ, নদীর জল-বিধৌত উর্বর মাটিতে খুব সহজেই জন্মে ওগুলো।

শেষবার এখানে এসেছিলাম ইনটেফের প্রতিনিধি হিসেবে, নীলের জলের অবিভাবক তিনি। তার পক্ষ থেকে পানির স্তর মাপা থেকে শুরু করে সমস্ত কাজ আমাকেই করতে হতো। প্রধান মালীর সহায়তায় বহু মাস ধরে এখানকার গাছপালা, প্রাসাদের বাগানের বৃক্ষরাজীর সবকিছু টুকে নিয়েছিলাম সেবার । তো, এক এক করে সেগুলোই চিনিয়ে দিতে লাগলাম আমার কর্ত্রীকে। এখানে রয়েছে ফিকাস বৃক্ষ যা আমাদের মিশরে আর কোথাও নেই। এর মূল যেনো পেঁচিয়ে থাকা অজগর, ফল জন্মে গাছের প্রধান কাণ্ডে, শাখায় নয়। আরো রয়েছে ড্রাগন-রক্ত গাছ। ওগুলোর কাণ্ড আঁচড়ালে উজ্জ্বল লাল তরল ঝরে। রয়েছে কূশীয় সিকামোর সহ একশ প্রজাতীর বৃক্ষ অনিন্দ্যসুন্দর এই দ্বীপের উপরে সবুজ ছাতার মতো ঘিরে আছে।

উর্বর মাটির তলায় অবস্থিত একখণ্ড বিরাট গ্রানাইটের উপর নির্মিত ফারাও-এর রাজপ্রাসাদ। একটা বিষয় আমাকে সব সময়ই ভাবায়, কেবল আমাদের রাজা নন; তার পূর্বে পঞ্চাশ বংশধারার যে বহু ফারাও শাসন করেছেন বিগত এক হাজার বছরে তাঁরা সবাই গ্রানাইট এবং মার্বেলের বিশাল সমাধি নির্মাণে সমস্ত সম্পদ, শক্তি ব্যয় করেছেন, অথচ জীবদ্দশায় বাস করতেন মামুলি মাটির তৈরি প্রাসাদে। কারনাকে, ফারাও মামোসের জন্যে যে সমাধি-মন্দির নির্মাণ করা হচ্ছে, তার তুলনায় এই প্রাসাদ খুবই অনাড়ম্বর। আমার ভেতরের স্থপতি কিংবা গণিতজ্ঞের সত্তাকে যেনো অপমান করলো এর স্থাপনা-কৌশল।

তীরে পৌঁছে নিজেদের প্রকোষ্ঠে যখন এলাম আমরা, গজ-দ্বীপের সত্যিকারের আকর্ষণ যেনো আরো সুনির্দিষ্ট হলো। স্বাভাবিকভাবেই, দ্বীপের সবচেয়ে উত্তর কোণে দেয়াল-ঘেরা হারেমে জায়গা হলো আমাদের। কিন্তু দেওয়ালের কারুকাজ এবং প্রকোষ্ঠের বিশালত্ব আমাদের প্রতি ফারাও-এর সুনজরের ঘোষণা দিচ্ছে। কেবল ফারাও-ই নন, রাজ-পরিচর্যক আতন পর্যন্ত লসট্রিসের নির্লজ্জ ভক্ত বনে গেছে।

বারোটি বড়, পরিচ্ছন্ন কক্ষ, সাথে নিজস্ব আঙ্গিনা, রান্নাঘর বরাদ্দ হলো লসট্রিসের জন্যে। প্রধান দেওয়াল সংলগ্ন একটা পার্শ্ব-দরোজা সরাসরি চলে গেছে নদীর ধারের পাথুরে ঘাটে। প্রথম দিনেই তলা সমান একটা নৌকা কিনে নিলাম আমি, এতে করে মাছ ধরা যাবে নদীতে। ঘাটে বেঁধে রাখলাম ওটা।

কিন্তু, আমাদের আবাসের স্বাচ্ছন্দ্যে আমি বা লসট্রিস কেউই সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। পুরো প্রকোষ্ঠ ঢেলে সাজানোর কাজে হাত লাগালাম দুজনে। প্রধান মালীর সাহায্যে, আঙ্গিনায় নিজস্ব বাগান তৈরি করলাম আমি; মাথার উপরে পাতার আচ্ছাদন দিনের গরমে যেনো ওখানে বসা যায় সে ব্যবস্থা করলাম। আমার প্রিয় শিকার বাজপাখিগুলোও কাছাকাছি বসে ঠুকড়ে খেতে পারে।

নদীর ঘা থেকে সিরামিকের তৈরি নলের ভেতর দিয়ে সবসময় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করলাম আমার জল-পদ্মের বাগান এবং মাছের পুকুরে। সংকীর্ণ একটা অংশ দিয়ে ফিরে যাবে উপচে-পড়া পানি, আমার কর্ত্রীর ব্যক্তিগত কক্ষের ভেতর দিয়ে, ছোট্ট আড়াল করা একটা অংশ হয়ে নীলের মূল প্রবাহে।

আমাদের প্রকোষ্ঠের দেওয়াল লাল-কাদায় তৈরি। ওগুলোর উপর ছবি আঁকলাম আমি এবং লসট্রিস। দেব-দেবীদের ছবি, পশুপাখি সমেত আমাদের এই মিশরের ছবি ছিলো সেগুলো। আইসিস-এর প্রতিরূপ হিসেবে অবশ্যই আমার কর্ত্রীকে ব্যবহার করলাম আঁকার সময়, তবে সমস্ত ছবির কেন্দ্রে রইলো হোরাসের ছবি লসট্রিসের আগ্রহে। লাল-সোনালি চুলো হোরাস যেনো একটু বেশিই পরিচিত অবয়বের বুঝে নিন, কার কথা বলছি!

ছবির কথা জানাজানি হতে সাড়া পরে গেলো হারেমে। রাজ-বধুরা এসে একে একে দেখে যেতে লাগলেন। হারেমের বাকি কক্ষের সাজ-সজ্জার ব্যাপারেও আমার পরামর্শ চাওয়া হলো। উপযুক্ত অর্থের বিনিময়ে সেটা অবশ্য দিলাম আমি। এতে করে হারেমে অনেক নতুন বন্ধু তৈরি হলো আমাদের।

শীঘ্রই সবকিছু শুনে চিত্রকর্ম পরখ করতে চলে এলেন ফারাও স্বয়ং। দেখা শেষ হতে, পাতার আচ্ছাদনের নিচে আঙ্গিনায় বসে সুরা পান করলেন। যাওয়ার সময় হতে আমাকে তার সাথে কিছুদূর এগুতে বললেন তিনি। আমরা হারেমের বাইরে আসতেই শুরু করলেন, গত রাতে, তোমার কর্ত্রীকে স্বপ্নে দেখেছি। জেগে দেখলাম, আমার বীজ ছড়িয়ে আছে চাদরের উপর। সেই বালক বয়সের পর এমনটি কখনও হয় নি আমার। আমি নিশ্চিত জানি, এর সঙ্গে আমার একটা পুত্রসন্তান হবে। আর দেরি করে লাভ নেই। তুমি কি বলো, এখনই কী একবার চেষ্টা করে দেখবো?

মালিক, আমার পরামর্শ হলো নব্বই দিন সম্পূর্ণ হওয়াই ভালো। এর আগে কোনোকিছু করা বোকামী হবে। রাজার ইচ্ছাকে বোকামী বলাটা মারাত্মক হতে পারতো, কিন্তু আমি নিরুপায়। এতো কম সময়ের জন্যে আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দেওয়া ঠিক হবে না। গভীর চিত্তে রাজি হলেন ফারাও।

হারেমে ফিরে, রাজার ইচ্ছের কথা জানালাম আমার কর্ত্রীকে; তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়াই ব্যাপারটা মেনে নিলো সে। এতোদিনে তার প্রতি রাজার পক্ষপাতিত্ব ভালো লাগতে শুরু করেছে মিসট্রেসের কাছে, এছাড়া আমার কথামতো ও বিশ্বাস করে বসে আছে–এই গজ-দ্বীপে তার বন্দীদশা কেবল নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্যে।

অবশ্য, এখানে আমাদের অবস্থানকে কোনোমতেই বন্দী-দশা বলার উপায় নেই। আমি এবং আমার কর্ত্রী–আমরা দুজনেই নীল নদের দু ধারের এই জমজ নগরীতে স্বাধীনভাবে ঘুরতে-ফিরতে পারি। দ্বীপের পথে পথে ইতোমধ্যেই দারুন জনপ্রিয় হয়ে গেছে লসট্রিস। সাধারণ জনতা ওকে দেখলেই ভীড় করে আসে–আশীর্বাদ, না হয় পরামর্শ নিয়ে। ওর নিজস্ব শহর থিবেসের মতোই এখানকার মানুষজনও তার সৌন্দৰ্য্য আর আভিজাত্যের অনুরাগী। তার নির্দেশে, সব সময় পিঠে এবং মিষ্টান্ন ভর্তি থলে নিয়ে ওর পিছনে চলতাম আমি; রাস্তায় যাদেরকেই ওর কাছে ভুখা মনে হতো–ওগুলো তাদের মাঝে বিতরণ করতো আমার কর্ত্রী । সব সময়ই, উচ্ছল বালকের দল চলতো আমাদের পিছু-পিছু।

গরিব-দুঃখী মানুষের দুয়ারে বসে, বাড়ির স্ত্রীদের মুখে তাদের দুঃখ-শোকের গল্প খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে লসট্রিস। অথবা, গাছের তলায় বসে কৃষকের সাথে ঘণ্টার পর ঘন্টা আলাপে মগ্ন হয়। প্রথম সুযোগেই তাদের সমস্ত দুঃখের কথা ফারাও-এর কানে তুলতো সে। মাঝে-সাঝে, স্নেহবশত মেনে নিতেন ফারাও। সাধারণ জনতার কাছে দেবীরূপে আসীন হতে লাগলো লসট্রিস।

অন্যান্য দিনে, নীল নদের বন্যায় সৃষ্ট হদে আমাদের ছোটো নৌকায় বসে মাছ ধরি আমরা দুজনে। না হয়, বুনো হাঁসের জন্যে ফাঁদ পাতি। অবশ্যই ট্যানাসের লানাটার মতো নয়, তবে লসট্রিসের জন্যে ছোট্ট একটা ধনুক তৈরি করে দিয়েছি আমি। খুব কমই লক্ষ্য ভেদে ব্যর্থ হতো আমার কর্ত্রী । বুনো-হাঁস শিকারে ওর জুড়ি মেলা ভার।

যখনই শিকারে বেরুতেন ফারাও, লসট্রিস তার সঙ্গী হোত। প্যাপিরাসের ঝোঁপের ধার ঘেঁষে, বাহুতে বাজপাখি নিয়ে আমি চলতাম পিছুপিছু। কোনো হীরণ উড়ে গেলেই মৃদু শীষ বাজিয়ে নির্দেশ দিতে আমার কর্ত্রী। তার নির্দেশে ঠিক ঠিক উড়ে গিয়ে আক্রমণ শানাতো শিকারী-বাজ। গাঢ় নীল আকাশের বুকে কিছু সময়ের মধ্যেই হীরণের হালকা নীল পালক ছড়িয়ে পড়তো। নদীর মৃদু-মন্দ হাওয়া ধীরে ভাসিয়ে নিয়ে যেতো সেগুলো। আনন্দের আতিশায্যে হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে মিসট্রেস।

আকাশ, জল আর মাটির সব পশুপাখি ভালোবাসি আমি। আমার কর্ত্রীও তার ব্যতিক্রম নয়। তাহলে কেনো আমরা দু জনেই শিকার পছন্দ করি–এ কথাটা বহুদিন ভেবেছি আমি। সম্ভবত, এটা সবচেয়ে বড় সত্যি যে, পুরুষ এবং অতি অবশ্যই নারীও, পৃথিবীর হিংস্রতম পরভোজী। শিকারী বাজ-এর গতি, তার ক্ষিপ্র-হিংস্রতা ভালোবাসি আমরা। হীরণ আর বুনোহাঁস হলো শিকারী বাজ-এর জন্যে দেবতাদের উপহার, ঠিক যেমন পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টির উপরে কর্তৃত্ব করি আমরা মানুষ। দেবতাদের দেওয়া এই দান তো আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।

সেই শৈশবে, যখন মাত্র দাঁড়াতে শিখেছে লসট্রিস, আমার এবং ট্যানাসের সঙ্গে শিকারে বেরুতো সে। সম্ভবত প্রভু হেরাবের প্রতি তার হিংসা আড়াল করার জন্যেই ট্যানাসের সাথে আমাকে যেতে দিতেন ইনটেফ। বহু শিকার অভিযানে আমার এবং ট্যানাসের সঙ্গী হয়েছে লসট্রিস। ট্যানাস যেবারে সেই গবাদিপশু খেকো সিংহ মারলো, উপত্যকার উপরে, কালো-পাহাড়ে- সেদিনও মিসট্রেস ছিলো আমাদের সাথে। শিকারের সব কৌশল ওর নখদর্পনে। সমস্ত পশুপাখি, মাছ- সব প্রাণীর সঠিক নাম ধরে ডাকতে পারদর্শী আমার কর্ত্রী ।

তাবৎ প্রানিকুলের উপর আমাদের যেমন কর্তত্ব রয়েছে, ঠিক তেমনি, সব নারী পুরুষ হলো ফারাও-এর খোয়ারের পোষাপ্রাণী। তাকে লঙ্ন করে-এমন ক্ষমতা কারো নেই। ঠিক নব্বইতম রাতে, আমার কর্ত্রীকে তার শয্যাকক্ষে নিয়ে যেতে আতনকে পাঠালেন তিনি।

*

আমাদের মধ্যকার বন্ধুত্ব এবং মিসট্রেসের প্রতি তার ভক্তির কারণে আসার বেশ অনেকক্ষণ আগেই জানিয়ে গিয়েছিলো আতন। এতে করে, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতির কিছু সুযোগ পেয়ে গেলাম।

শেষবারের মতো মিসট্রেসকে দিয়ে অনুশীলন করিয়ে নিলাম–কী কী বলতে হবে ফারাওকে, কিভাবে ব্যবহার করতে হবে। এরপর, সেই মলমটা লাগিয়ে দিলাম ওর যোনীদ্বারে। কেবল পিচ্ছিলকারকই নয়, ব্যথাও অনেকটা কমায় এই জিনিস। অবশ করে দেয়।

আতন সদর দরোজায় আসার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত শক্তই ছিলো আমার কর্ত্রী, এরপরেই একেবারে ভেঙে পড়লো সে। আমার দিকে ফিরে কাঁদতে লাগলো লসট্রিস । আমি একা যেতে পারবো না, ভয় লাগছে। দয়া করে আমার সাথে এসো, টাইটা। আমার দেওয়া প্রসাধনীর নিচে ওর চেহারা একেবারে বিবর্ণ হয়ে গেছে, ভয়ে দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে।

মিসট্রেস, তুমি জানো–এটা সম্ভব নয়। ফারাও তোমাকে ডেকেছেন। অন্ততঃ এইবার আমার কিছুই করার নেই।

এবারে আতন এগিয়ে আসে। টাইটা ইচ্ছে করলে রাজার শয্যাকক্ষের বাইরে অপেক্ষা করতে পারে। আমার সাথে। সে যেহেতু রাজার চিকিৎসক–ওর সেবা প্রয়োজন হতেই পারে। আমার কর্ত্রী পায়ের আঙুলের উপর দাঁড়িয়ে আতনের গালে চুমো খায় এই কথায়।

তুমি খুব ভালো, আতন। লজ্জায় একেবারে পাকা কুমড়ো ধারণ করলো আতনের মুখাবয়ব।

শক্ত করে আমার হাত ধরে থাকলো লসট্রিস। আতনের পিছুপিছু প্রাসাদে, রাজার শয্যাকক্ষের দিকে চললাম আমরা। কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে শেষ বারের মতো শক্ত করে হাতে চাপ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে উদ্যত হয় লসট্রিস। আর কখনও এতো সুন্দর, এতো নাজুক মনে হয় নি ওকে। আমার হৃদয় যেনো ভেঙে যেতে চাইলো, কিন্তু হেসে সাহস দিলাম ওকে। পর্দা সরিয়ে শয্যাকক্ষের ভেতরে ঢুকে পড়লো মিসট্রেস। রাজার মৃদু সম্ভাষণ, প্রত্যুত্তরে লসট্রিসের নরম কণ্ঠ শুনতে পেলাম।

বাইরে, ছোটো কাঠের চৌকিতে আমার বিপরীতে বসে পড়লো আতন। বাক্য বিনিময় না করে বাও বোর্ড খুলে বসলো । খেলায় মনোযোগ দিতে পারছিলাম না আমি, পাথরের খুঁটিগুলো আনমনে নেড়ে চাল দিতে লাগলাম কাঠের বোর্ডের উপর। পর পর তিন বার জিতে গেলো আতন। এর আগে খুব কমই হারাতে পেরেছে সে আমাকে। কিন্তু আমাদের পেছনের কক্ষ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর আমার মনোযোগ সরিয়ে রাখলো পুরোটা সময়। যদিও টুকরো টুকরো কথাবার্তার কিছুই বুঝতে পারলাম না, তবু কান পেতে রইলাম।

এরপর, প্রায় পরিষ্কার শুনতে পেলাম, আমার কী বলছে, আমার প্রতি সদয় হোন, মহান ফারাও অনুরোধ করি, আমাকে ব্যথা দেবেন না। এতো মর্মস্পর্শী ছিলো সেই আবেদন, এমনকি আতন পর্যন্ত কেশে উঠে জামার হাতায় নাক মুছলো।

বেশ কিছু সময় আর কোনো শব্দ নেই। এরপরেই, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো লসট্রিস। তারপর আবার সব চুপচাপ।

বাও বোর্ড সামনে নিয়ে নীরবে বসে রইলাম আমি আর আতন–কেউই আর খেলার ভান করছি না। কত সময় পেরুলো ওভাবে, জানি না, রাতের শেষ প্রহরে পর্দার ওপাশ থেকে ভেসে এলো রাজার নাসিকা গর্জনের আওয়াজ। আমার উদ্দেশ্যে মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ায় আতন।

সে পর্দা সরিয়ে ভেতরে যাওয়ার আগেই ফাঁক গলে বেরিয়ে আসে লসট্রিস। আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো, টাইটা। ফিসফিস করে বলে সে।

কোনোকিছু না ভেবেই ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলাম, ছোট্ট বাচ্চার মতো আমার ঘাড় জড়িয়ে ধরে রইলো লসট্রিস। প্রদীপ হাতে হারেম পর্যন্ত রাস্তা দেখালো আতন। মিসট্রেসের শয্যাকক্ষের দরোজায় আমাদের ছেড়ে গেলো সে। বিছানায় শুইয়ে দিলাম আমি লসট্রিসকে। এরপরে, নরমভাবে পরীক্ষা করে দেখলাম ওকে। সিল্কের মতো মসৃণ দুই উরুতে সামান্য রক্তের দাগ লেগে আছে। কিন্তু রক্তপাত থেমে গেছে আপনাতেই। ওদিকে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে লসট্রিস।

কোনো ব্যথা আছে, ছোট্ট সোনা? আস্তে করে জানতে চাইলাম। চোখ খুলে মাথা নাড়লো ও।

এরপর, অপ্রত্যাশিতভাবে হাসলো মিসট্রেস। এত্তো কথা শুনেছি এটা নিয়ে, বিড়বিড় করে বলছিলো ও। কিন্তু, এ তো কিছুই নয়। বেশি সময়ও লাগে নি। কুঁকড়ে গোল হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো মিসট্রেস, আর একটি শব্দও উচ্চারণ করলো না।

স্বস্তিতে প্রায় কেঁদে ফেললাম আমি। দীর্ঘ প্রস্তুতি এবং লতাগুল্মের মলম কাজ দিয়েছে। আমার মিষ্টি সোনামণি, লসট্রিসের নরম মনে বা দেহে কোনো ক্ষতি করতে পারে নি ফারাও-এর দুর্বল সঙ্গম।

*

অলসতায় কেটে যেতে লাগলো গজ-দ্বীপে দিনগুলো। ধীরে ধীরে আমার কর্ত্রীও নিজেকে সম্পূর্ণ মানিয়ে নিলো পরিপার্শ্বের সাথে । যতই সময় পেরুলো, অস্থিরতা বোধ করতে শুরু করলাম আমি। কে জানে, কী করলো ক্ৰাতাস। ট্যানাসেরই বা কি হলো–ভেবে দুই চোখের পাতা এক করতে পারছিলাম না। ওদিকে লসট্রিসও তাগাদা দিতে শুরু করেছে, এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে আমার। মনস্থির করে ফেললাম-এখনই উপযুক্ত সময়।

যেই ভাবা সেই কাজ–পরদিন সকালে সূর্যোদয়ের আগেই একা একা মাছ শিকারে বেরুলাম আমি ছোট্ট নৌকায় চড়ে। তবে যাওয়ার আগে নিশ্চিত করে নিলাম, কমপক্ষে বারোজন দাস বালক, প্রহরী দেখেছে আমাকে নৌকায় চড়তে।

হ্রদের পেছন দিকে এসে চামড়ার থলে খুলে বের করলাম আমার পোষা বিড়ালটাকে। বুড়ো হয়ে গেছে ওটা চোখে তো দেখতে পায়ই না, দুই কানেও বিষফোঁড়ার ব্যথায় মরো মরো অবস্থা। ওর এই দুরবস্থা থেকে মুক্তির ব্যবস্থা হিসেবে ধুতুরার বিষ সমেত এক টুকরো গোশতো খেতে দিলাম। কোলে বসে আনন্দে মিউ মিউ শব্দ করে খেতে লাগলো ওটা। কিছু সময়ের মধ্যেই মরে গেলো, টু শব্দটি না করে। নিপ্রাণ জীবটার গলা কাটলাম আমি এবারে।

নৌকায় ভালো করে বিড়ালের রক্ত ছিটালাম এরপর। লাশটা রাখলাম পাটাতনে, জানি, কুমিরের দল কিছুক্ষণের মধ্যেই কাড়িকাড়ি শুরু করে দেবে ওটার জন্যে। এবারে, আমার হারপুন এবং অন্যান্য সরঞ্জাম নৌকায় রেখেই মৃদু-মন্দ স্রোতে ভাসিয়ে দিলাম নৌকা; নিজে নেমে পড়লাম প্যাপিরাসের ঝোঁপ ঘেঁষে অল্প পানিতে। পানি ঠেলে তীরে চলে এলাম।

আগেই ঠিক করে নিয়েছি, রাতের অন্ধকার পর্যন্ত অপেক্ষা করবে মিসট্রেস; এরপরে আমার অন্তর্ধানের খবর প্রকাশ করবে সে। কাজেই আগামীকাল দুপুরের আগে নৌকা বা রক্তের ছোপ আবিষ্কার করা সম্ভব হবে না কারো পক্ষে। সবাই ভাববে, কুমিরের পেটে গিয়েছি, নয়তো, শ্রাইকদের কোনো দলের হাতে কতল হয়ে গেছি আমি।

তীরে পৌঁছেই সঙ্গে করে নিয়ে আসা ছদ্মবেশ নিলাম। ওসিরিসের মন্দিরের একজন পুরোহিত সেজে নিয়েছি, আমার কর্ত্রীর আমোদের জন্যে বহুবার ওটা পরে পুরোহিতদের মতো ভাবগম্ভীর হাঁটা অনুশীলন করেছি আগে। কেবল একটা পরচুলা, কিছুটা প্রসাধনী আর সঠিক পোশাক একেবারে পুরোহিত বানিয়ে ছেড়েছে আমাকে। সবসময় পথ-চলতির উপরেই থাকে এই পুরোহিতেরা; নদীর উজান-ভাটিতে অবিরত যাওয়া-আসা–এক মন্দির থেকে অন্য মন্দিরে। পথে পথে ভিক্ষা বা সাহায্য চেয়ে ফিরে। কাজেই, খুব কম লোকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ হবে এই পোশাকে; শ্রাইকরাও আক্রমণে উৎসাহিত হবে না। মন্দিরের লোকেদের কেনো যেনো ঘটায় না এরা।

হ্রদ ছেড়ে তীরে উঠলাম। গরিব মানুষের এলাকা হয়ে পশ্চিম গজ-দ্বীপে প্রবেশ করছি। বন্দরে পৌঁছে সোজা চলে এলাম শস্যদানা ভর্তি এক জাহাজ-মালিকের কাছে। দেবতাদের দোহাই দিয়ে যথার্থ ভাবগম্ভীরতার সাথে তাকে অনুরোধ করলাম, নিরাপদে কারনাকে পৌঁছে দিতে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে সায় দিলো সে। হতে পারে, পুরোহিতদের অপছন্দ করে অনেকেই, কিন্তু অতিন্দ্রিক যে কোনো কিছুকে ভয় পায় লোকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, স্বয়ং ফারাও-এর মতো ক্ষমতাবান ধর্মের সেবকেরা।

পূর্ণিমা আজ। আর, নেমবেটের তুলনায় এই জাহাজের চালক অনেক বেশি দক্ষ। রাতে আর নোঙর করলাম না আমরা। বাতাসের সহায়তায়, স্রোতের অনুকূলে তরতর করে এগিয়ে চললো জাহাজ। পঞ্চম দিনে নদীর শেষ বাঁক ঘুরতেই সামনে দেখা গেলো কারনাক শহর।

তীরে নামতে অস্বস্তি বোধ হতে লাগলো, এ আমার শহর, প্রতিটি মানুষ ভিক্ষুক বা ভবঘুরে-চেনে আমাকে। যদি কেউ চিনে ফেলে, মুহূর্তেই সংবাদ পৌঁছে যাবে ইনটেফের কাছে। যা হোক, ছদ্মবেশের বদৌলতে নিরাপদে হেঁটে চললাম আমি, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্যানাসের বাহিনীর তাঁবুতে পৌঁছলাম ।

সদর দরোজা হাঁ হয়ে খোলা। সহজে ভেতরে ঢুকে পড়লাম, যেনো এটা আমারই বাড়ি। সম্পূর্ণ খালি পড়ে আছে জায়গাটা, এমন কিছু বা কেউ নেই যার থেকে কোনো খবর পাওয়া সম্ভব। মনে হলো, আমার এবং মিসট্রেসের চলে যাওয়ার পর থেকে খালি পড়ে আছে স্থানটা। খাবার পাত্রে ধুলোর পুরু আস্তরণ, দুধের জগে পচা দই।

কিন্তু, হারায় নি কিছুই; এখনও উপরের তাকে রাখা আছে সেই লানাটা ধনুক। ব্যাপারটা যদিও অস্বাভাবিক ট্যানাস সাধারণত হাতছাড়া করে না ওটা। এ অনেকটা তার শরীরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মতো ছিলো। বিছানার নিচে, আমারই তৈরি করা একটা গোপন জায়গায় অস্ত্রটা লুকিয়ে রাখলাম। অন্ধকার নামা পর্যন্ত ট্যানাসের আস্তানায়ই রইলাম, পাছে দিনের আলোয় কেউ চিনে ফেলে আমাকে। জায়গাটা সাফ সুতরা করে ব্যয় করলাম পুরোটা সময়।

রাতে, অন্ধকারে মিশে নদীর ধারে চলে এলাম। নোঙর করা আছে হোরাসের প্রশ্বাস। শেষবার যখন দেখেছিলাম ওটাকে, তার পরে নির্ঘাত যুদ্ধে গিয়েছে জায়গায় জায়গায় তার নিদর্শন ফুটে আছে। ভেঙে গেছে গলুই, পাটাতনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

হালটা ঠিক আমার পরামর্শ মতো নতুন করে নকশা করা হয়েছে দেখে আনন্দ হলো খুব। ধাতব পাতে মোড়া গলুই চোখা হয়ে বেরিয়ে আছে কয়েক ফুট সামনে, পানির স্তরের ঠিক উপরে। ওর অবস্থা দেখে বুঝতে পারছি, মুখোমুখি সংঘর্ষে লাল ফারাও-এর নৌবাহিনীর কী ভয়ানক ক্ষতি করে এসেছে ওটা।

কিন্তু, ট্যানাস বা ক্ৰাতাস কেউ নেই পাটাতনে। বন্দরের ঘাটে শোরগোল করতে থাকা নাবিকদের উদ্দেশ্যে এগুলাম। কাছাকাছি একটা ছোট্ট প্রকোষ্ঠে ক্রাতাসের দেখা পাওয়া গেলো। সমানে পান করছে, জুয়া খেলা চলছে সব মিলিয়ে নরক-গুলজার। এই জায়গায় তাকে ইশারা করা সাজে না, অপেক্ষা করতে লাগলাম। ওদিকে, দুই রূপোপজীবনী আমাকে তাদের সম্পদ দেখানোর জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছে বাইরের অন্ধকার গলিতে নিয়ে যেতে চাইছে। এমনকি, আমার পুরোহিতের পোশাকও তাদের প্রচেষ্টায় এতটুকু প্রভাব রাখতে পারছে না।

অবশেষে, বন্ধুদের শুভরাত্রি জানিয়ে বাইরের গলিতে পা রাখলো ক্ৰাতাস, ওর পিছু নিলাম আমি।

কী বলতে চাও তুমি, হে পুরোহিত? বিরক্ত স্বরে বললো ক্ৰাতাস। কি চাও? স্বর্ণমুদ্রা?

হ্যাঁ, তাই নেবো, উত্তরে বললাম। অন্য অনেকের চেয়ে ওটা বেশি আছে তোমার, ক্ৰাতাস। জায়গায় জমে গিয়ে সন্দেহপূর্ণ চোখে আমার দিকে তাকালো সে। সুরার প্রভাবে একটু একটু টলছে।

আমার নাম জানলে কেমন করে? আমার জামার হাত ধরে টেনে আলোর নিচে নিয়ে গেলো ক্ৰাতাস। ভালো করে পরখ করছে মুখটা, অবশেষে একটানে পরচুলা সরিয়ে ফেললো।

সেথ-এর পাছার বিষফোঁড়ার কসম! এ যে টাইটা! গর্জে উঠে সে।

দয়া করে চেঁচিয়ো না। এই কথায় সতর্ক হয় ক্ৰাতাস।

এসো! আমার কক্ষে চলো।

একা হতেই, দুই পাত্রে সুরা ঢেলে একটা এগিয়ে দিলো সে। এখনও কী যথেষ্ট পান করা হয় নি তোমার? আমার এই প্রশ্নের উত্তরে কেবল হাসলো ক্ৰাতাস।

এর উত্তর তো সকালের আগে পাওয়া যাবে না, টাইটা। এখন কী? এতো শক্ত হও কেনো রে ভাই। গত তিন সপ্তাহ ধরে নদীর ভাটিতে লড়াই করেছি। মিষ্টি মাতা হাপি! তোমার নতুন চোখা গলুই কাজে দিয়েছে! কম করে হলেও বিশটি গ্যালি স্রেফ দু টুকরো করেছি আমরা, আর দুশ বজ্জাতের কল্লা ফেলেছি। এতো কাজের চাপে কেবল পানি পরেছে পেটে–ভেবে দ্যাখো। অন্তত মদ খেতে বাধা দিও না। পান করো আমার সাথে! পাত্র উঁচু করে ধরে সে, আমারও কম তৃষ্ণা পায় নি; স্যালুট করে ঠোঁটে ঠেকালাম পাত্র। ট্যানাস কোথায়?

সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে ফেললো ক্ৰাতাস। সে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এই কথায় অপলকে ওর দিকে চেয়ে রইলাম।

অদৃশ্য হয়ে গেছে মানে? এর অর্থ কী? নদীর ভাটিতে যুদ্ধে যায় নি সে?

মাথা নাড়লো ক্ৰাতাস। না। ও নেই হয়ে গেছে। পুরো থিবেসের পথে, পথে প্রতিটি বাড়িতে খুঁজে দেখেছে আমার লোক কোনো চিহ্নও নেই ট্যানাসের। খুব চিন্তিত আছি, টাইটা।

শেষ কবে দেখেছো ওকে?

রাজার বিয়ের দুই দিন পরে; যেদিন কর্ত্রী লসট্রিস আর তুমি গজ-দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা হলে সেই সন্ধায়। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি, শুনলেই না।

কি বলেছে ট্যানাস?

হোরাসের প্রশ্বাস আর সমগ্র বাহিনীর দায়িত্ব আমার হাতে দিয়ে গেছে।

সে ওটা করতে পারো না, তাই না?

তা-ই করেছে সে। বাজপাখির প্রতাঁকের ক্ষমতাবলে।

মাথা ঝাঁকালাম। তারপর?

বললাম তো–হারিয়ে গেছে।

মদের পাত্রে চুমুক দিয়ে ভাবতে বসলাম আমি।

জানালার কাছে গিয়ে পেচ্ছাব করে এলো ক্ৰাতাস। নিচে, কারও গায়ে ঝরলো সেই তরল; কোনো এক রাগত পথিকের চিৎকার শোনা গেলো, কোথায় মুতিস, ব্যাটা নোংরা শুয়োর!

জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কাতাস তার ঘাড় ভাঙার অভিলাষ ব্যক্ত করতেই ঠাণ্ডা হয়ে আসে লোকটা। সাম্প্রতিক এই বিজয়ে উল্লসিত ক্ৰাতাস আমার কাছে ফিরে আসতেই শুধালাম, তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার সময় ট্যানাসের মনের অবস্থা কেমন ছিলো?

আবারো মেঘ ঘনায় ক্রাতাসের চেহারায়। এতো ক্ষ্যাপাটে ওকে আর দেখি নি কোনোদিন। দেবতা আর ফারাও-কে সমানে অভিশাপ দিচ্ছিলো। এমনকি, কর্ত্রী লসট্রিসকে পর্যন্ত রাজকীয় বেশ্যা বলে গাল দিয়েছিলো।

আঁতকে উঠলাম। যদিও জানি, মন থেকে কথাটা বলে নি ট্যানাস। অসহায় প্রেমিকের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিলো সেটা।

ও বলেছিলো, দেশদ্রোহিতার জন্যে ফারাও ওকে লটকাতে চাইলে তা-ই সই, সেটাই নাকি ভালো হবে তার জন্যে। ভীষণ খারাপ অবস্থায় ছিলো তখন ট্যানাস, আমার কোনো কথাতেই কান দেয় নি সে।

ব্যাস, এ-ই? কী করবে, কোথায় যাবে কিছু ইঙ্গিত দিয়ে যায় নি? মাথা নেড়ে আবারো পাত্রে মদ ঢেলে নেয় ক্ৰাতাস।

বাজপাখির প্রতাঁকের কী হলো? জানতে চাইলাম।

আমার কাছে রেখে গেছে। ওর নাকি ওটা দিয়ে আর কোনো কাজ নেই। হোরাসের প্রশ্বাসে নিরাপদে রাখা আছে ওটা।

অন্যান্য যেসব ব্যাপারে তোমার সাথে কথা বলে গিয়েছিলাম তার কী হলো? যা বলেছি, করে রেখেছো?

বিষণ্ণ চিত্তে পাত্রের সুরার দিকে তাকালো ক্ৰাতাস। আয়োজন শুরু করেছিলাম, বিড়বিড় করে বলে চললো সে, কিন্তু, যখন ট্যানাস চলেই গেলো, আর উৎসাহ পাই নি। আর তাছাড়া, নদীর ভাটিতে যুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

খুবই অবিশ্বস্ত কাজ হলো এটাক্ৰাতাস, তোমার যোগ্য নয়। আমার কর্ত্রী, লসট্রিস তোমার ভরসাতেই ছিলো । ও বলেছে, তোমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে সে।

ক্রাতাস আমার কর্ত্রীর আরো একজন মুগ্ধ ভক্ত। আমার এ কথাতে কাজ হলো, লসট্রিসের একটু অসন্তুষ্টির কারণ হতে চায় না সে।

ওহ্, হো, টাইটা! তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি একটা দুর্বল গর্দভ–নীরবে বসে রইলাম আমি। নীরবতা অনেক সময় খুব বেশি পীড়া দেয়। হোরাসের কসম কর্ত্রী–লসট্রিস আমার কাছে কী চান?

এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে যা যা করতে বলেছিলাম তোমাকে ঠিক তাই, বললাম তাকে। ধপাস করে হাতের পাত্র নামিয়ে রাখলো সে।

আমি সৈনিক। দায়িত্ব ফেলে রেখে অর্ধেক বাহিনী নিয়ে কোনোরকম আজব খেলাতে অংশগ্রহণ করা সাজে না আমার পক্ষে। ট্যানাস যখন বাজপাখির প্রতাঁকের মালিক ছিলো, তখন অন্য কথা। আর এখন

আর এখন তোমার কাছে আছে ওটা। নরম স্বরে বললাম।

নীরবে তাকিয়ে থাকলো ক্ৰাতাস। কিন্তু ট্যানাসের অনুমতি ছাড়া–।

তুমি তার বিশ্বস্ত সহচর। ট্যানাস ওটা তোমাকে দিয়েছে ব্যবহার করার জন্যে। কাজেই, যা ভালো বোঝো করতে হবে তোমাকে। অবশ্যই করতে হবে। আমি খুঁজে নিয়ে আসবো ট্যানাসকে, কিন্তু ততক্ষণে তৈরি হয়ে থাকতে হবে তোমাকে। অনেক রক্ত ঝরবে সামনে, প্রচুর কাজ তোমাকে বড়ো প্রয়োজন তার। আবারো তাকে হতাশ করো না।

এই কথায় রাগে চেহারা লাল হয়ে উঠে ক্রাতাসের। এই কথা গিলে নিতে বাধ্য হবে তুমি–এই বেলা বলে দিলাম! প্রতীজ্ঞা ফুটে উঠলো তার কণ্ঠস্বরে।

নিঃসন্দেহে, সেটাই হবে আমার আহার করা সবচেয়ে উপাদেয় খাবার! বললাম তাকে। সাহসী আর সৎ লোক পছন্দ করি আমি, খুব সহজেই মানানো যায় এদের।

*

ট্যানাসকে কেমন করে খুঁজে বের করবো ভেবে কোনো কূল কিনারা পেলাম না। ক্ৰাতাসকে রেখে শহরে বেরিয়ে পড়লাম। আবারো ট্যানাসের পুরোনো ভেঁরা, শহরের গলি-ঘুপচি ওর খোঁজে চষে ফেললাম। যাকে সামনে পেলাম, জিজ্ঞেস করলাম কবে, কোথায় দেখেছে ট্যানাসকে। জানি, এতে করে দারুন বিপদের ঝুঁকি নিচ্ছি। আমার পরিচিত কারো সামনে পড়ে গেলে এই ছদ্মবেশ কোনো কাজেই আসবে না। কিন্তু আমাকে তো খুঁজে বের করতেই হবে তাকে। রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেলাম, শেষমেষ ক্ষান্ত দিতে হলো।

সকাল হয়ে এসেছে। নীলের তীরে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত, অসহায় আমি ভাবতে চেষ্টা করলাম কোথাও খুঁজতে বাকি রেখেছি কি না। মাথার উপরে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডেকে উঠলো বুনোহাঁসের দল। পুব আকাশের স্নান সোনালি-তামাটে আভায় উড়ে চলেছে ওরা। অনেক সুখ-স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দিলো ওগুলো; আমাদের তিনজনের ট্যানাস, আমি আর মিসট্রেসের। কত দিন জলার ধারে সকালে শিকার করেছি আমরা, ইয়ত্তা নেই।

গর্দভ কোথাকার! হঠাৎই মনে পড়ে গেলো। ওখানেই আছে সে!

এতক্ষণে শহরের গলি-ঘুপচি জনাকীর্ণ হতে শুরু করেছে। পৃথিবীর ব্যস্ততম শহর আমাদের এই থিবেস, কেউই অলস নয় এখানে। এরা কাঁচ ভাঙে, স্বর্ণের কাজ করে, রুপোর বাসন-কোসন বানায়, পাত্র তৈরি করে। ইতিমধ্যেই দরদাম হাঁকাহকি শুরু করেছে বণিকের দল, আইনজ্ঞরা নিজ নিজ প্রকোষ্ঠে কাজ শুরু করেছে, পুরোহিতেরা তাঁদের প্রাত্যহিক যজ্ঞ আরম্ভ করেছে আর বেশ্যারাও খুলেছে তাদের ঝাপি। উত্তেজনাকর, দ্রুতগামী এক শহর থিবেস, আমি ভালোবাসি একে।

সকালের ব্যস্ততা ঠেলে এগিয়ে গেলাম। বাতাসে মশলা, ফলমূল, শাক-সবজি, মাছ-মাংসের গন্ধ ভাসছে। গরুর হাম্ভা রব, ছাগলের ব্যা ব্যা, সঙ্গে মানুষের চিৎকার সব মিলিয়ে এক দক্ষ-যজ্ঞ বেঁধে গেছে।

একবার ভাবলাম, একটা গাধা কিনে নেবো কি না–এই গরমে বেশ অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। শেষমেষ বাদ দিলাম চিন্তাটা; শুধু যে অর্থনৈতিক ভাবনা থেকে, তা নয় বরঞ্চ একবার শহরের বাইরে চলে গেলে শ্রাইকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সহায় হবে ওটা। সেক্ষেত্রে, পুরোহিতের ছদ্মবেশও লুটে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এক বোতল পানি, কিছু রুটি কিনে নিয়ে একটা চামড়ার থলেতে ভরে নিলাম। এরপর সরু রাস্তা ধরে রওনা হলাম শহরের প্রধান ফটকের উদ্দেশ্যে।

ফটকে পৌঁছানোর আগেই হঠাৎ শোরগোল উঠলো; প্রাসাদের একদল রক্ষী তাদের হাতের লাঠি দিয়ে মেরে পথ করে নিতে লাগলো। তাদের ঠিক পেছনেই একদল দাস কাঁধে পালকি নিয়ে হেঁটে চলেছে। প্রধান রক্ষী এবং ওই পালকি আমার পরিচিত। মুখোমুখি পড়ে গেলাম একেবারে ।

আতঙ্কে হৃৎপিণ্ড যেনো বন্ধ হয়ে যাবে। রাসফার হয়তো ভালো করে না দেখলে চিনবে না আমাকে, কিন্তু এই ছদ্মবেশ সত্ত্বেও ইনটেফ সাথে সাথে চিনে ফেলবেন আমাকে। আমার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে বুড়ি এক দাসী মহিলা বিশাল দুই বুক আর জলহস্তির মতো পাছা সমেত; তার পেছনে আড়াল নিলাম। এরপর চোখের উপর পরচুলা টেনে উঁকি মেরে দেখতে লাগলাম।

আতঙ্ক সত্ত্বেও, র‍্যাসফার যে মতো দ্রুত হাটাচলা করতে পারছে এ জন্যে নিজের ভেতরে গর্ব অনুভব করলাম। সময়মতো আমার শল্যচিকিৎসা না পেলে এতক্ষণে মরে যেতো সে। কাছাকাছি এসে পড়তে লক্ষ করলাম, মুখের একদিক ঝুলে পড়েছে তার। যেনো আগুনে গলে গেছে মোমের মতো। আগে যদি সে কুৎসিত ছিলো, তো এখন হয়েছে ভৌতিক। বেশিরভাগ সময়ই মস্তিষ্কের আঘাতে এমন দশা হয়।

দলবল নিয়ে আমার পাশ ঘেঁষে চলে গেলো সে। পর্দার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক দেখতে পেলাম ইনটেফকে–পুর থেকে আমদানি করা মসৃণ সিল্কের বালিশে আয়েস করে বসে আছেন।

সদ্য খৌরী করা গাল চকচক করছে; আনুষ্ঠানিক ভঙিতে চুল বেঁধেছেন। এক হাতের আঙুলে একগাদা আংটি, অপর হাত অলসভাবে ফেলে রেখেছেন ছোট্ট-সুন্দর এক দাস বালকের মসৃণ বাদামী উরুতে। নির্ঘাত তার নতুন সংগ্রহ ছেলেটাকে চিনতে পারলাম না।

পুরোনো মনিবের প্রতি আমার ঘৃণার প্রাবল্যে নিজেই অবাক হলাম। তাঁর হাতে অসংখ্যবার বিভিন্নভাবে নির্যাতনের সমস্ত কথা যন্ত্রণা করতে লাগলো নতুন করে। কখনই তাকে ক্ষমা করতে পারবো না আমি।

আমার দিকে ফিরতে শুরু করতেই সামনের পর্বত-প্রমাণ মহিলার আড়ালে লুকালাম। সরু আইল ধরে সামনে এগিয়ে গেলো পালকি। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খেয়াল হলো, রাগে আমার সর্বাঙ্গ কাঁপছে।

স্বর্গীয় হোরাস, অধমের এই আবেদন মঞ্জুর করুন! যতদিন পর্যন্ত ওই শয়তানকে তার প্রভু সেথ্‌-এর কাছে না পাঠাতে পারছি, আমার বিশ্রাম নেই, বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে প্রধান ফটকের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলাম আমি।

*

বাৎসরিক বন্যায় দু কূল ছাপিয়ে বয়ে চলেছে নীল নদ। সেই সৃষ্টির শুরু থেকে পলিমাটির কালো স্তর জমা করে চলেছে আমাদের মাটিতে। বন্যার পানি নেমে গেলে, এই বিস্তীর্ণ চকচকে জলের বুক চীরে আবারো দেখা দেবে জমিন সবুজে সবুজে ভরে উঠবে। মিশরীয় সূর্য আর উর্বর পলির প্রভাবে আগামী বন্যার আগেই ফসল তোলার সময় হয়ে যাবে।

জলমগ্ন মাঠের প্রান্তে রয়েছে উঁচু হাঁটা পথ। এ রকমই একটা পায়ে চলা পথ ধরে পুবে হেঁটে চললাম আমি, যতক্ষণ পর্যন্ত না পাথুরে জমিনের দেখা পেলাম । এরপরে দক্ষিণে চললাম। মনে প্রতিজ্ঞা। কিছু সময় পর পর পথের পাশে উঁচু পাথর খণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে রাস্তা ঠিক করে নিচ্ছিলাম।

আমার ডানধারের উঁচু-নিচু জমিনের দিকে ভালো করে নজর রেখে চলেছি, ওরকম আড়াল থেকেই অকস্মাৎ আক্রমণ শানাতে ওস্তাদ শ্রাইকের দল। ঠিক যখন সংকীর্ণ, গভীর একটা গিরিপথ পেরুচ্ছিলাম, কাছ থেকে কর্কশ কণ্ঠে থামার আদেশ করা হলো।

হে দেব-দেবী–আমাকে রক্ষা করুন! এতোটাই চমকে গেছিলাম, প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম।

আমার সামনে গিরিপথের ঠিক প্রান্তসীমায় বসে একজন রাখাল বালক। দশের বেশি নয় বয়স। কিন্তু দৃষ্টিতে গভীর বন্যতা। ছোটো ছেলেমেয়েদের খবরদাতা হিসেবে ব্যবহার করে শ্রাইকেরা শুনেছি। এই ছোট্ট শয়তানটা সে জন্যে একবারে উপযুক্ত। মাথাভর্তি জটা চুল, মতো দুর্গন্ধময় একটা পোশাক পরনে এখান থেকেও নাকে আসছে। ঠিক খুনে শকুনের মতো চকচকে তার দৃষ্টি, আমার মাল-সামানের দিকে নজর।

কোথায়, কী কারণে যাচ্ছ–পাত্রী? হাতের বাঁশিতে লম্বা, প্রলম্বিত একটা সুর বাজালো সে; নির্ঘাত কোনো ধরনের সংকেত ওটা।

কিছু সময় লাগলো হৃৎপিণ্ডের ধড়ফড়ানো নিয়ন্ত্রণে আনতে। কষ্টার্জিত স্বরে বললাম, তোমার তাতে কি প্রয়োজন, বাছা? আমি কে বা কোথায় যাই জেনে কী করবে?

সাথে সাথেই কথার ভাব বদলে গেলো তার। আমি ভুখা আছি, হে পুরোহিত। এতিম আমি, নিজের খাবার নিজেই যোগাড় করতে হয় আমাকে। তোমার ওই বড়ো থলেতে আমার জন্যে কি কিছুই নেই?

তোমাকে দেখে মনে হয় না যে, না খেয়ে আছে, অন্যদিকে ফিরে বললাম, কিন্তু নদীর পার ধরে আমার সাথে সাথে আসতে লাগলো শয়তানটা।

তোমার থলেটা একটু দেখতে দাও, ফাদার, বলে চলে সে, ভিক্ষা চাই।

ঠিক আছে। থলের ভেতর থেকে একটা আঙুর বের করলাম আমি, কিন্তু শয়তানটা ওটার নাগাল পাবার আগেই মুঠো বন্ধ করে আবার খুললাম। ততক্ষণে আঙুর পাল্টে একটা বিষাক্ত কাঁকড়া দেখা গেলো হাতে। কিলবিলে শাঁড়াশি নাচালো ওটা, ভয়ে এক লাফে পেছনে চলে গেলো ছেলেটা। উঠে-পড়ে দৌড়াচ্ছে চড়াই ধরে।

ছোট্ট পাহারটার চূড়োয় পৌঁছে চিৎকার করে উঠলো আমার উদ্দেশ্যে, তুমি ব্যাটা পাদ্রী নও! তুমি হলে মরুর জাদুকর! শয়তান, খোদ শয়তান মানুষ না! এরপরে খারাপ শক্তির বিপরীতে চিহ্ন এঁকে পালিয়ে গেলো সে।

পথে, একটা চ্যাপ্টা পাথরের তলা থেকে কাঁকড়াটা সংগ্রহ করেছিলাম। বিষাক্ত দাঁড়াটা ফেলে দিয়ে ইচ্ছে করেই থলের ভেতরে রেখেছি এখনকার মতো উপযুক্ত সময়ে ব্যবহারের জন্যে। যে বুড়ো দাসের কাছে ঠোঁটের নড়াচড়া থেকে কথা আঁচ করা শিখেছিলাম-সে আরও কিছু বিষয়ে জ্ঞান দান করেছিলো আমাকে। হাত সাফাই তার মধ্যে একটা।

পাহাড়ের কাছে পৌঁছে পিছনে ফিরে চাইলাম। বহু পিছনে বিন্দুর মতো দেখা গেলো রাখাল ছেলেটাকে, তবে সে একা নয় এখন। দুই জন পুরুষ দাঁড়িয়ে সঙ্গে। আমার দিকে ফিরে ভীষণ উত্তেজিত ভঙ্গিতে কী যেনো দেখাচ্ছে বালক, মনোযোগ দিয়ে তারা শুনছে সেটা। নির্ঘাত জাদুকর দৈত্য ভেবেছে আমাকে।

এক নাগাড়ে হেঁটে চললাম আমি। দুপুরের প্রখর রৌদ্রে দৃষ্টি চলে । হঠাৎই সামনে যেনো নড়াচড়া ঠাওর হলো। ছোট্ট, সাধারণ ধরনের একটা দল আসছে আমারই দিকে। আর একটু সামনে এগুতে বুকের ভেতরটা যেনো লাফ দিয়ে উঠলো–ওটা কী ট্যানাস? একটা খচ্চরের দড়ি ধরে এগুচ্ছে। হাড় জিরজিরে জটা বোঝার ভারে একেবারে ন্যুজ। বোঝার উপরে বসে একজন মহিলা আর একটা বাচ্চা। মহিলা পোয়াতী । বাচ্চাটা কেবল কৈশোর ছাড়িয়েছে।

প্রায় দৌড়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু হঠাই বুঝলাম লোকটা ট্যানাস নয়, সম্পূর্ণ আগন্তুক একজন। লম্বা, চওড়া কাঁধ-তার চলন এবং মাথার একরাশ সোনালি-হলুদ চুল দেখে ভুল হয়েছিলো। সন্দেহভরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, হাতের তলোয়ার তৈরি। এবারে খচ্চরটা পথ থেকে সরিয়ে আমার চোখে চোখে চেয়ে রইলো সে।

দেবতার আশীর্বাদ তোমার উপর ন্যস্ত থোক, বাছা, ঠিক পুরোহিতের মতো করেই বললাম। কিন্তু তলোয়ার না নামিয়ে আমার পেট বরাবর ধরে রইলো সে। অপরিচিতদের কেউ বিশ্বাস করে না আমাদের এই মিশরে।

এই পথে এসে নিজের এবং পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছ, বন্ধু। বরঞ্চ ক্যারাভানে এলে ভালো করতে। পেছনের পাহাড়ে দস্যু দল ওত পেতে আছে। সত্যিই ওদের জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। মেয়েটাকে দেখে মনে হয় ভদ্র, বাচ্চাটা কেঁদে ফেললো আমার কথায়।

তোমার কাজে যাও, হে পুরোহিত! নির্দেশের সুরে বললো লোকটা। যার প্রয়োজন, তাকে উপদেশ দিও।

আপনি ভালো লোক, জনাব, ফিসফিস করে বললো মেয়েটা। ক্যারাভানের অপেক্ষায় পুরো এক সপ্তাহ কেয়েনাতে ছিলাম আমরা আর বসে থাকা সম্ভব ছিলো না। আমার মার কাছে, লুক্সরে যেতে হবে দ্রুত বাচ্চার জন্মদানের জন্যে তার সাহায্য প্রয়োজন।

চুপ করো, মেয়েলোক! প্রায় গর্জে উঠলো তার সঙ্গী পুরুষ। পাদ্রী হোক আর যাই হোক কোনো অপরিচিতের কথায় ভুলবো না।

কিছু সময় ভাবলাম, ওদের জন্য কী করার আছে। কালো, অবিসিডিয়ান পাথরের মতো চোখ মেয়েটার, হৃদয় ছুঁয়েছে আমার। কিন্তু ওর স্বামীর তাগাদায় আবার সচল হলো খচ্চর, আমার পাশ ঘেঁষে চলে গেলো। অসহায়ের মতো কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওদের পানে চেয়ে রইলাম যতক্ষণ না দৃষ্টিসীমার আড়াল হলো। কেউ না চাইলে তো আর সাহায্য করা সম্ভব নয়।

শেষ বিকেলে জলাভূমির ধারে এসে পৌঁছলাম। প্যাপিরাসের ঝোঁপ এতো ঘন এখানে, কোনো মতেই ছোট্ট আস্তানাটা সনাক্ত সম্ভব নয়। আর তাছাড়া, ওটার ছাদও প্যাপিরাসের কাণ্ড দিয়ে তৈরি একেবারে নিখুঁত আড়াল। এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফিয়ে চললাম আমি, দ্রুতই চলে এলাম জলের ধারে। নীল নদের থেকে এতো দূরে তেমন একটা তারতম্য হয় নি জলের স্তরে। বন্যার কোনো আলামত নেই।

পুরোনো সেই নৌকাটা এখনও বাঁধা রয়েছে তীরে। অর্ধ-নিমগ্ন হয়ে আছে পানিতে, বেশ কিছুক্ষণ কসরৎ করে টেনে আনতে হলো। প্যাপিরাসের সুরঙ্গের ভেতর দিয়ে পথ করে এগুতে লাগলাম । জলের শেষ মাথায়, শুকনো এক টুকরো মাটির উপর রয়েছে একটা কুঁড়ে। কিন্তু এখন পানিতে ভেসে গেছে জমিন, এক মাথা সমান পানি ওখানে।

আমি যে নৌকায় চড়ে এসেছি, ঠিক একই রকম একটা নৌকা ভেড়ানো কুঁড়ের গায়ে। ওটার পাশে ভিড়িয়ে, ক্যাঁচ-কোঁচ করতে থাকা কঙ্কালসার মই বেয়ে উঠে এলাম ভেতরে। একটাই মাত্র ঘর, মাথার উপরের পাতার আচ্ছাদনের ফাঁক-ফোকর গলে সূর্যরশ্মি প্রবেশ করছে। আমাদের এই উচ্চ-মিশরে বৃষ্টি হয় না বললেই চলে, কাজেই পাতার আচ্ছাদনেই কাজ চলে যায়।

প্রথম যেদিন আমি আর ট্যানাস খুঁজে পেয়েছিলাম এই পরিত্যক্ত কুঁড়েটা আজ তার অবস্থা ঠিক সেই দিনের মতোই অবিন্যস্ত। কাপড়-চোপড়, অস্ত্র, খাবার পাত্র সব এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বাতাসে ভুরভুর করছে মদের গন্ধ।

ঘরের শেষ মাথায় ভয়ঙ্কর নোংরা একটা চাদরের উপর পরে আছে ততোধিক নোংরা দুটো দেহ। ময়লা মেঝেতে সাবধানে পা ফেললাম, বুঝতে চাইছি ওই দুটো বেঁচে আছে কি না। ঠিক তখনই গুঙ্গিয়ে উঠে পাশ ফিরলো মেয়েটা। অল্প-বয়স্ক, একেবারে ন্যাংটো শরীরে আদিম আহ্বান। গোলাকার বুক দুটো বেশ বড়ো, তল পেটের গোড়ায় বাদামী কোঁকড়া চুল । কিন্তু, এমনকি ঘুমের ভেতরেও তার মুখের সস্তা ভাব প্রকাশ্য। কোনো সন্দেহ নেই, ওটাকে জলের ধারের ছাপড়া থেকে নিয়ে এসেছে ট্যানাস।

ওকে সবসময় রক্ষণশীল বলেই জানতাম, কখনোই পান করে মাতাল হতে দেখি নি। কিন্তু এই সস্তা চিড়িয়া এবং দেওয়াল ঘেঁষে পড়ে থাকা মদের বোতলগুলো ভিন্ন। কথা বলছে। ট্যানাসের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হতে হলো। এ আমার পরিচিত মানুষটির মুখ নয়। সুরার প্রভাবে লাল, ফোলা-ফোলা মুখ, দাড়ি-গোফের জঙ্গল সেখানে। নির্ঘাত হারেমের বাইরে শেষ যেবার দেখেছিলাম, এর পরে আর খৌরি করা হয় নি।

ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে মেয়েটা। আমার উপস্থিতি টের পেতেই বিড়ালের মতো এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে ঝোলানো খাপ থেকে ছোরা হাতে নেয় সে। তড়িৎ গতিতে ওর হাত থেকে ওটা ছিনিয়ে নিলাম আমি, নগ্ন ডগা তাক করলাম পেট বরাবর।

ভাগো, শান্তস্বরে নির্দেশ দিলাম। আমি পেট ফেঁড়ে ফেলার আগেই ভাগো এখান থেকে!

রক্তচক্ষুতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দ্রুত কাপড় পরে নেয় মেয়েটা।

ও কোনো পয়সা দেয় নি আমাকে, কাপড় পরা শেষ হতে জানালো সে।

কোনো সন্দেহ নেই, এর মধ্যেই যা প্রাপ্য পেয়ে গেছো তুমি, বলে ছোরার ফলা দিয়ে দরোজার দিকে ইশারা করলাম।

ও বলেছিলো, পাঁচটি স্বর্ণের আংটি দেবে আমাকে, নাকী সুরে প্রায় কেঁদে ফেললো সে। গত বিশ দিনে অনেক খেটেছি। সবকিছু করতে হয়েছে–ঘর ধোয়া মোছা, রান্না করা, ওর নোংরা পরিষ্কার করা। আমার মজুরি দিতেই হবে। না দিলে–

চুলের গোছা ধরে হিড়হিড় করে টেনে দরোজার বাইরে নিয়ে গেলাম ওটাকে। ধরে বসিয়ে দিলাম একটা নৌকায় । আমার থেকে ছাড়া পেতেই এমন অশ্রাব্য গালি গালাজ আরম্ভ করলো সে, ভীত হয়ে চারপাশের নলখাগড়ার জঙ্গল থেকে উড়ে গেলো পাখির দল।

ফিরে এসে দেখি তখনো ঘুমন্ত ট্যানাস। মদের পাত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখলাম বেশিরভাগই খালি, কেবল দুটো-তিনটে পাত্র পূর্ণ । নির্ঘাত ওই মেয়েটাকে কারনাকে পাঠিয়ে কারো মাধ্যমে এগুলো সংগ্রহ করেছিলো সে। নীল কুমির বাহিনীর সবাইকে পুরো এক মাস মাতাল করে রাখার মতো যথেষ্ট পরিমাণ আছে এখানে।

ট্যানাসের বিছানার পাশে ভাবতে বসলাম। বেচারা নিজেকে শেষ করে দিতে চাইছে, করুণায় ভরে গেলো আমার ভেতরটা। আমার কর্ত্রীর প্রতি ওর ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই, ওকে ছাড়া ট্যানাস আসলেই বেঁচে থাকতে চায় না। ট্যানাসের এহেন অধঃপতনে অবশ্যই মেজাজ চড়ে গেছে আমার, কিন্তু এখনো, এই মুহূর্তেও ওর মহৎ গুণাবলি আমার কাছে বেশি মূল্যবান। এমন তো নয়, কেবল ট্যানাস একাই ভুল করেছে। ঠিক যে কারণে নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছে সে, একই কারণে আমার কর্ত্রীও তো বিষপান করতে চেয়েছিলো। মনে মনে ওকে মাফ করে দিলাম আমি। এছাড়া আর কী-ই বা করতে পারতাম? আমার জীবনে অর্থবহ, মূল্যবান কিছু বলতে এই দু জন মানুষের ভালোবাসা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে লেগে পড়লাম।

ট্যানাসের গোড়ালি ধরে টেনে চললাম প্রথমটায়। গুঙ্গিয়ে উঠে গাল বকে চললো সে, কর্ণপাত না করে টেনে দরোজা দিয়ে পানিতে ফেলে দিলাম দেহটা। মাথা নিচু করে জলাভূমিতে পড়লো সে, এরপর তলিয়ে গেলো। অর্ধ-চেতন অবস্থায় আবার ভেসে উঠলো।

পাশে নেমে পড়ে চুলের মুঠি ধরে মুখটা চেপে ধরলাম পানির তলায়। কিছু সময়ের জন্যে দুর্বলভাবে বাধা দিলো সে, কিন্তু আমি ধরে রাখতে সক্ষম হলাম । দ্রুতই শক্তি ফিরে এলো ট্যানাসের দেহে, এক ঝাড়া খেয়ে শূন্যে নিক্ষিপ্ত হলাম আমি।

গর্জে উঠে আক্রমণ শানালো ট্যানাস। ওর এক ঘুষি জলহস্তিকে পর্যন্ত শেষ করে দিতে পারে, কোনো রকমে গা বাঁচিয়ে নিরাপদ দূরত্বে থাকলাম আমি।

হাঁপাতে হাঁপাতে মইয়ের ধাপে বসলো সে, বন্য চুল থেকে পানি ঝরছে। পেটে বেশকিছু পানি গেছে, একটু উদ্বিগ্ন বোধ করলাম আমি ওর জন্যে। বেশকিছু পানি উগড়ে দিলো সে, সাথে পেটের মদও। পরিমাণ দেখে অবাক হতে হয়।

কুঁড়ের একটা ভিত্তিমূল ধরে অপেক্ষায় রইলাম আমি। আবারো বমি করছে ট্যানাস, কিছু সময় অপেক্ষা করে গলায় বিষ ঢেলে বললাম, আমার কর্ত্রী এখন তোমাকে দেখতে পেলে খুব খুশি হয়ে যেতো।

চোখ ছোটো করে আমার পানে চাইলো সে। টাইটা! নরকে যাও! আমাকে কি ডুবিয়ে মারতে চাইছিলে নাকি? মরে যেতাম তো!

যা অবস্থা এখন তোমার, কেবল মদ সাবাড় করা ছাড়া আর পারোটা কী? কী জঘন্য অবস্থা করেছো নিজের। ছিঃ!

ওকে মইয়ের ধাপে রেখে উপরে উঠে এলাম আমি। ধীরে ধীরে পরিষ্কার করতে লাগলাম জায়গাটা। বেশকিছু সময় পর লজ্জিত চেহারায় উঠে এলো ট্যানাস। ওকে উপেক্ষা করে কাজ করে যেতে লাগলাম। শেষমেষ ট্যানাসই নীরবতা ভাঙলো।

কেমন আছো, বুড়ো বন্ধু । খারাপ লেগেছে, তোমার জন্যে।

অন্যদেরও খারাপ লেগেছে তোমার জন্যে। ক্ৰাতাস তার মধ্যে একজন। নদীর ভাটিতে লড়াই করেছে পুরো বাহিনী। তোমার তলোয়ারের সাহায্য বড়ো প্রয়োজন ছিলো ওদের। আর, আমার কর্ত্রীর কথা না হয় নাই বললাম। প্রতি মুহূর্ত তোমার কথা স্মরণ করেছে সে, ওর ভালোবাসা নিখাদ। এই মাত্র যেনো বেশ্যাটাকে তোমার বিছানা থেকে তাড়ালামওটার কথা শুনলে ও কী ভাববে বলে মনে করো?

গুঙ্গিয়ে উঠে মাথা চেপে ধরে ট্যানাস। ওহ, টাইটা, তোমার কর্ত্রীর নামটাও মুখে এনো না! সহ্য করতে পারি না।

তো, আর এক বোতল মদ সাবাড় করো, নোংরার ভেতর মরো, রাগত স্বরে বললাম।

ওকে সারাজীবনের জন্যে হারিয়েছি আমি। কী করতে বলো তুমি আমাকে?

ঠিক ওর মতোই, বিশ্বাস এবং আস্থা রাখতে বলি।

করুণ চোখে আমার দিকে চাইলো ট্যানাস। ওর কথা বলো আমাকে। কেমন আছে ও, টাইটা? মনে করে আমাকে?

খুব কষ্টে আছে, দুঃখ ভরে বললাম আমি। তোমাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবে । সেদিনের অপেক্ষায় আছে ও, যেদিন তোমরা দু জন এক হবে।

সেটা কোনোদিনও হবে না। ওকে হারিয়েছি আমি, বেঁচে থেকে আর কী লাভ?

খুব ভালো! কড়া স্বরে বললাম। তাহলে আমি আর এখানে সময় নষ্ট করছি না । আমি বরঞ্চ মিসট্রেসকে গিয়ে বলি, তার বার্তা শুনতে রাজী নও তুমি। ওকে ঠেলে সরিয়ে দরোজা গলে বেরিয়ে এলাম আমি । মই বেয়ে নেমে এলাম নৌকায় ।

দাঁড়াও, টাইটা! চেঁচিয়ে ডাকলো ট্যানাস। দাঁড়াও!

কী কারণে? তুমি তো মরতে চাও। তো, তাই করো। লোক পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করে দেবো খন। মমি করা হবে তোমার দেহ-চিন্তা করো না।

এহেন কথায় হেসে ফেললো ট্যানাস। ঠিক আছে। বোকার মতো কথা বলেছি আমি । মদ মাথা বিগড়ে দিয়েছিলো। ফিরে এসো, দয়া করে। লসট্রিস কী বার্তা পাঠিয়েছে?

নিতান্ত অনিচ্ছার ভঙ্গি করে মই বেয়ে উঠে এলাম আমি।

আমার কী তোমাকে জানাতে বলেছে তোমার প্রতি তার ভালোবাসা এখনও, এতো কিছু পরেও অক্ষুণ্ণ আছে। চিরজীবন সে শুধু তোমারই মেয়েমানুষ থাকবে ।

হোরাসের কসম-আমার লজ্জা হচ্ছে এখন, বিড়বিড় করলো ট্যানাস।

নোংরা বিছানার উপরে ঝোলানো খাপ থেকে তরবারি খুলে নিয়ে এক কোপে মদের পাত্রগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ট্যানাস। ঝর্ণার মতো ছিটকে বেরিয়ে দেওয়ালে লেপ্টে গেলো পানীয়। হাঁপাতে হাঁপাতে আমার দিকে ফিরলো সে। দ্যাখো, কি অবস্থা করেছো নিজের; বুড়ো পুরোহিতের মতো দুর্বল, বেতস লতার মতো নরম।

অনেক বলেছো, টাইটা! থামো এবারে। আর যদি একবার তামাশা করো, ভালো হবে না বলে দিলাম।

ঠিক আমার ইচ্ছে মতো, রেগে গেছে ট্যানাস। আমার বলা অপমানসূচক বাক্য বুকে বড়ো লেগেছে তার। আমার কর্ত্রীর ইচ্ছে, ফারাও তোমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা পালন করে নিজেকে সম্মানিত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করো। পাঁচ বছর পর তোমার কাছে যেনো চলে আসতে পারে সে।

ট্যানাসের পূর্ণ মনোযোগ পেলাম এই কথাতে। পাঁচ বছর? সেটা আবার কী? এই বিচ্ছেদের কি কোনো নির্দিষ্ট সময় আছে নাকি?

ফারাও-এর নির্দেশে ইন্দ্রজাল ব্যবহার করেছিলাম আমি। এখন থেকে পাঁচ বছর পরে মারা যাবেন তিনি। সাধাসিধাভাবে বললাম। একভাবে আমার পানে তাকিয়ে থাকলো ট্যানাস। ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে মুখের রঙ। আমার রচিত যে কোনো স্কোলের মতোই ওকে পড়তে পারি আমি।

ইন্দ্রজাল! শেষমেষ ফিসফিস করে বলে সে। অনেক কাল আগে, জাদু-টোনা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতো সে। কিন্তু এখন আমার কর্ত্রীর চেয়ে বরঞ্চ তার বিশ্বাস বেশি এগুলোতে। বহুবার আমার স্বপ্ন সত্যি হতে দেখেছে ট্যানাস।

ভালোবাসার জন্যে এতোটা সময় অপেক্ষা করতে পারবে? জানতে চাইলাম । আমার কর্ত্রী কসম কেটে বলেছে, তোমার জন্যে প্রয়োজনে সারাজীবন অপেক্ষা করে থাকতে পারবে সে। তুমি কি পারবে, অল্প কিছু সময় ধৈৰ্য্য ধরতে?

সে বলেছে, অপেক্ষা করবে আমার জন্যে? ট্যানাস জানতে চায়।

আজীবন, উত্তরে বললাম। মনে হলো, ট্যানাস হয়তো কেঁদে ফেলবে। সেটা সহ্য করা মুশকিল হবে ট্যানাসের মতো একজন মানুষ কাঁদছে–এটা আমি দেখতে পারবো না। তাই তাড়াতাড়ি বলে চললাম, ইন্দ্রজালে কী দেখতে পেয়েছি জানতে চাইলে না?

কান্না গিলে ফেলে ট্যানাস। হা, হ্যাঁ! সোৎসাহে মাথা নাড়ে সে। রাত নামা পর্যন্ত কথা বলে চললাম আমরা।

সবকিছু খুলে বললাম আমি ওকে যেগুলো এতোদিন লুকিয়ে এসেছি ওদের দু জনের কাছ থেকে। কেমন করে পিয়াংকি, প্রভু হেরাবকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিলো; ইনটেফ কেমন করে তাকে মেরেছেন–এ সমস্ত শুনে এতোটাই উত্তেজিত হয়ে পড়লো ট্যানাস, মদের শেষ প্রভাবও দূর হয়ে গেলো ওর মাথা থেকে। সকাল হতে হতে আগের মতোই শক্ত, কঠোর মানুষটা ফিরে এলো ট্যানাসের মাঝে।

তাহলে, তোমার পরিকল্পনা মতোই কাজে লেগে পড়ি চলো মনে হচ্ছে, সেটাই একমাত্র উপায়। ঝট করে দাঁড়িয়ে তলোয়ার খাপে ভরে ফেলে ট্যানাস। আমি অবশ্য চাইছিলাম আরো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে মদের প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হোক সে, কিন্তু ট্যানাস শুনতেই চাইলো না।

এই মুহূর্তে কারানাকে ফিরে চলো! জোর গলায় বললো সে। ক্ৰাতাস অপেক্ষা করছে বাবার মৃত্যুর বদলা নিতে হবে। আমার মিষ্টি পাখি লসট্রিসকে দেখার জন্যে আর তর সইছে না!

*

জলাভূমি ছেড়ে আসতে পাথুরে হাঁটা পথ ধরে আগে আগে চললো ট্যানাস। ওর সাথে থাকার জন্যে রীতিমতো দৌড়াতে হলো আমাকে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গরম যেনো ঝাঁপিয়ে পড়লো, ঘামের স্রোতধারা গলগল করে বেয়ে জমা হতে লাগলো কোমড়ের কাছে। ট্যানাসকে দেখে মনে হলো যেনো পুরোনো মদের ভাড়ার উপচে পড়ছে ওর দেহ থেকে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে, কিন্তু বিরতি বা থামার কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না তার মাঝে। মরুর প্রচণ্ড গরমে একটানা হেঁটে চললো সে।

হঠাৎ চিৎকার করে ওকে থামালাম আমি। সামনে তাকিয়ে আছি দু জনেই। পাখির ঝাঁক উড়ছে আকাশে, দূর থেকে ওটাই আমার দৃষ্টি কেড়েছে।

শকুন, কর্কশ স্বরে বললো ট্যানাস। কিছু একটা মরে পরে আছে ওখানটায়। খাপ থেকে তলোয়ার খুলে নেয় সে, সাবধানে সামনে এগিয়ে চললাম আমরা।

প্রথমে পুরুষ মানুষটাকে খুঁজে পেলাম। শকুনগুলো উড়ে যেতে মাথার লালচে সোনালি চুল দেখে চিনতে পারলাম আমি সেই স্বামী ভদ্রলোক, আসার পথে যার সাথে দেখা হয়েছিলো। চেহারা আর চেনার যো নেই, ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে ফেলেছে শকুনের দল। শূন্য কোটর তাকিয়ে আছে আকাশ পানে। ঠোঁট-মাংস বিহীন দাঁতে ব্যঙ্গ হাসি হাসছে যেনো। ট্যানাস দেহটা চিৎ করতে পেটের ছোরার আঘাত নজরে এলো। কমপক্ষে বারো বার আঘাত করা হয়েছিলো তাকে।

যে-ই করে থাকুক এ কাজ–নিশ্চিত করে গেছে। সৈনিকের দৃঢ়তায় মৃত্যুকে সহজভাবে নিলো ট্যানাস।

পাথরের মাঝে হেঁটে চললাম আমি, কিছু সময়ের মধ্যেই কালো, ভনভনে মাছির মেঘ দেখে স্ত্রী লোকটির মৃতদেহ আবিষ্কার করলাম। সম্ভবত, ওরা যখন আমোদ করছিলো মেয়েটাকে নিয়ে, বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছিলো তার। নির্ঘাত এর পরও কিছু সময় বেঁচে ছিলো সে। ওই টুকু সময়ের মধ্যেই মৃত বাচ্চাটাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো মেয়েটা। ওই ভাবেই মরেছে সে, বোল্ডারে হেলান দেওয়া অবস্থায়, দুই হাতে মৃত-বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে।

ভাঙা পথ ধরে আরো সামনে এগিয়ে গেলাম। আবারো মাছির দল খোঁজ দিলো বাচ্চা মেয়েটার দেহের। সবাই ভোগ করার পর গলা কাটা হয়েছে এর। একটা মাছি এসে বসলো আমার ঠোঁটে, হাত দিয়ে সরিয়ে দিলাম আমি । চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এসেছে নিজের অজান্তেই।

ওদের চিনতে না কি? ট্যানাসের প্রশ্নের জবাবে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে কেশে গলা পরিষ্কার করলাম।

গতকাল রাস্তায় দেখা হয়েছিলো, আমি সাবধান করেছিলাম  কথা সরছে না মুখে। বড়ো করে একটা শ্বাস টেনে বললাম। একটা খচ্চর ছিলো সাথে। মনে হয়, শ্ৰাইকেরা নিয়ে গেছে ওটা।

সায় দেয় ট্যানাস। ফিরে দাঁড়িয়ে পাথরের মাঝে পথ খুঁজতে আরম্ভ করে।

এই পথে আসো! চিৎকার করে ডেকে পাথুরে মরুর উপর দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে সে।

ট্যানাস! বৃথাই পেছন থেকে ডাকলাম। ক্ৰাতাস অপেক্ষায় আছে  আমার কথা শুনলোই না সে, অগত্যা আমিও ছুটলাম পিছুপিছু। যেখানে এসে খচ্চরের চিহ্ন হারিয়ে গেছে, সেখানটায় পেলাম ওকে।

তোমার চেয়ে পরিবারটির প্রতি আমার অনুভূতি বেশি, ওকে বোঝাতে চাইলাম। কিন্তু এ সবের কোনো মানে নেই। ক্ৰাতাস বসে আছে, আমাদের হাতে সময় নেই

সাথে সাথে থামিয়ে দেয় ট্যানাস। কতো হবে মেয়েটার বয়স? নয় বছর? এর একটা শোধ আমি নেবোই! ঠাণ্ডা, কঠোর তার মুখাবয়ব। কথা না বাড়িয়ে আগে চললাম আমরা।

ট্যানাস এবং আমি মিলে কেবল গ্যাজেল আর ওরিক্স নয়; সিংহের পেছনেও ছুটেছি। দল বেঁধে কাজ শুরু করলাম, আকার-ইঙ্গিতে কথা বলছি, কোনো বাঁক বা চড়াই-এ এসে সাহায্য করছি পরস্পরকে। অল্পক্ষণের মধ্যেই কর্কশ একটা জমিনে চলে এলাম, নদী থেকে পুবে মরুর আরো গভীরে চলে গেছে। সেই পথেই গিয়েছে আমাদের শিকার কাজ আরো সহজ হয়ে গেলো আমাদের জন্যে।

প্রায় দুপুর হয়ে এলো, আমাদের পানির বোতলও একেবারে শূন্য ঠিক তখনই বদমাশগুলোর দেখা পেলাম আমরা। পাঁচজন তারা খচ্চরটা আছে সাথে। একেবারেই অসতর্ক, আশা করে নি এতো গভীর মরুতে কেউ অনুসরণ করে আসবে তাদের। এমনকি, নিজেদের ফেলে আসা চিহ্ন পর্যন্ত আড়াল করে নি।

আমাকে টেনে একটা বড়ো পাথর খণ্ডের আড়ালে নিয়ে যায় ট্যানাস। জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে দু জনেরই। ঘোরাপথে ওদের সামনে চলে যাবো আমরা। চেহারা দেখতে চাই সব কটার। শ্বাসের শব্দের সাথে বলে ট্যানাস।

লাফিয়ে, বেশ ঘোরাপথে রওনা হলাম। শ্রাইকদের দৃষ্টিসীমার বাইরে দিয়ে ওদের বেশ খানিকটা সামনে চলে এলাম। এরপর তাদের মাথার উপরে এসে থামলাম। জাত-সৈনিক ট্যানাস, সঠিক জায়গাতেই ওত পেতেছে।

খচ্চরের খুরের শব্দ, হাসি-তামাশার আওয়াজ দূর থেকেই পাওয়া গেলো। অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে ভাবলাম, কতোটা বোকার মতো হলো এদের ধাওয়া করাটা। সামনের দলটা ধীরে দৃষ্টিগোচর হলো জীবনে এর চেয়ে বর্বর, নোংরা, আক্রমণাত্মক কাউকে দেখিনি। অথচ আমার সম্বল বলতে কেবল সেই ছুরিটা।

আমাদের অবস্থান থেকে একটু দূরত্বে দাঁড়ি-অলা বেদুঈন সর্দার আচমকা থেমে দাঁড়ালো। পেছনের কাউকে খচ্চরের পিঠ থেকে পানির থলে নামানোর নির্দেশ দিচ্ছে। প্রথমে সে পান করলো, এরপরে হাতে হাতে ঘুরতে লাগলো পানির থলে। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাবে যেনো আমার।

হে হোরাস! দ্যাখো, এখনো মেয়েটার রক্ত লেগে আছে কাপড়ের সামনে। যদি লানাটা থাকতো এখন আমার সঙ্গে! ফিসফিস করে বললো ট্যানাস। ব্যাটার পেট ফুটো করে ওর পানি বের করে নিতাম। এরপর আমার কাঁধে হাত রাখে সে। আমি নড়া পর্যন্ত স্থির থাকো। কোনো ধরনের বীরোচিত কাজ যেনো না করতে দেখি। মাথা নেড়ে সায় জানালাম।

ঠিক যেখানে আছি আমরা, সেই দিকে আসতে লাগলো শ্রাইকের দল। অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত। সামনে হাঁটছে বেদুঈন সর্দার। মাথার আচ্ছাদনের কারণে আমাদের দেখতে পাচ্ছে না সে। তার পেছন পেছন আসা দুজনের মধ্যে একজন খচরটার দড়ি ধরে টেনে আনছে। জানোয়ারটার পেছনে বাকি দুজন নিহত মহিলার গা থেকে নেওয়া স্বর্ণের অলঙ্কারে পূর্ণ মনোযোগ। শেষ দুজনের হাতের বর্শা ছাড়া সব অস্ত্র খাপবন্দী।

সবাই এগিয়ে যেতে নিঃশব্দে। পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে ট্যানাস। ওর পদক্ষেপে কোনো শব্দ হচ্ছিলো না। ক্ষিপ্র চিতার মতো দ্রুততায় তলোয়ার বের করে সবচেয়ে পেছনের জনের ঘাড় বরাবর আঘাত হানলো ট্যানাস।

ওকে সাহায্য করার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নিজের জায়গায় রইলাম ট্যানাসের নির্দেশের কথা মনে পড়ে গেছে। আসলে, আমি ওখানে গেলে সাহায্যের চেয়ে বরঞ্চ অসুবিধা ওর তলোয়ার চালনায়। এর আগে নরহত্যা করতে দেখি নি আমি, ট্যানাসকে। জানতাম, এটা তার কাজের মধ্যে পরে, কিন্তু এতো স্বাভাবিক হিংস্রতায়, নিপুণ কৌশলে কাজটা করলো সে অবাক হয়ে গেলাম। ঠিক মরুর গর্ত থেকে লাফিয়ে ওঠা খরগোশের মতো কাটা মুণ্ডুটা নিক্ষিপ্ত হলো, একপাশ থেকে আবার আঘাত হানলো ট্যানাস। দ্বিতীয় বর্বর এবারে তার শিকার। প্রথমটির মতোই নিখুঁতভাবে ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হলো এর মাথা; ঝর্ণাধারার মতো আকাশের দিকে ছুটলো রক্তের ধারা।

রক্তপাত এবং কাটা মাথার পতনের ধপধপ আওয়াজে সতর্ক হলো বাকি দস্যুরা। চট করে ঘুরে দাঁড়িয়েই জায়গায় জমে গেলো তারা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছে না, কী ঘটেছে তাদের পেছনে। এরপরেই, বুনো চিৎকার দিয়ে উঠে নাঙ্গা অস্ত্র-সমেত ট্যানাসের উদ্দেশ্যে ছুটে আসতে শুরু করলো শ্রাইকের দল। পালানোর বদলে সোজা ওদের দিকে ধেয়ে গেলো ট্যানাস। ছত্রভঙ্গ করে ফেললো দস্যু-দলটাকে। সঙ্গীদের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া বর্বকে এবারে ধরলো ও, ভীষণ এক কোপে বুকের মাংস ফালি হয়ে ঝুলতে লাগলো শয়তানটার। চিৎকার করে বুক চেপে ধরে পেছালো সে। কিন্তু তার উপরে আবারো চড়াও হওয়ার আগেই বাকিরা ঝাঁপিয়ে পড়লো ট্যানাসের উপর। নিজের তলোয়ার দিয়ে মারণ-আঘাতগুলো প্রতিহত করছে ট্যানাস; তামার সাথে তামার ঘর্ষণে ঝনঝন শব্দ উঠছে। একজন একজন করে পেছাতে শুরু করলো বর্বর দুটো। ওদিকে, পেছন থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে আক্রমণ শানালো আহত শ্ৰাইক।

পেছনে! চিৎকার করে ওর উদ্দেশ্যে বললাম। ঠিক সময় মতো ফিরে তলোয়ারের ফলায় আঘাত ঠেকালো ট্যানাস। সাথে সাথে বাকি দুজনে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর উপর। চারপাশ থেকে এহেন আক্রমণে বাধ্য হয়ে পিছিয়ে গেলো ট্যানাস। শ্বাসরুদ্ধকর তলোয়ারবাজীর প্রদর্শনী চলছে যেনো। এতো দ্রুত চলছে ট্যানাসের তলোয়ার, মনে হলো যেনো নিজের চারপাশে ধাতব একটা দেওয়াল তৈরি করেছে সে। শ্রাইকদের অবিশ্রান্ত আঘাত বাধা পাচ্ছে সেই দেওয়ালে ।

এতক্ষণে দুর্বল হয়ে পড়েছে ট্যানাস। গরমে, ক্লান্তিতে হাঁপাচ্ছে হাতের কাজও ধীর হয়ে আসছে ক্রমশ। গত কয়েক সপ্তাহের মদ্য-পান এবং ব্যভিচার এতক্ষণে তার মাশুল দাবি করেছে। বেদুঈন সর্দারের এক আঘাত ঠেকাতে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো

সে, পাথরে পিঠ দিয়ে মরিয়া হয়ে লড়ে চললো। আমার বসার স্থান থেকে বিপরীত দিকের বোল্ডারে পিঠ রেখে এখন শেষ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে নিজেকে রক্ষা করার। এবারে বর্বরগুলো সবাই তার সামনে। তাদের আঘাত অবিরত ধেয়ে যাচ্ছে ট্যানাসের উদ্দেশ্যে। ধীর, দুর্বল প্রচেষ্টায় বুনো কুকুরগুলোর আক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করে চলেছে ও।

প্রথম নিহত শ্রাইকের বর্শাটা পড়ে আছে পথের ঠিক মাঝখানে। ট্যানাসের মরণ ঠেকাতে হলে এখনই কিছু করতে হবে আমাকে। আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমি, নিজেদের উন্মত্ততায় আমার কথা বেমালুম ভুলে গেছে বর্বরের দল। সবার অলক্ষ্যে বর্শাটা হাতে নিয়ে নিলাম, একটু একটু করে বুকে সাহস ফিরে আসছে।

বেদুঈন-সর্দার ব্যাটা সবচেয়ে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ট্যানাসের জন্যে, আমার সবচেয়ে কাছেও সে-ই আছে। আমার দিকে পেছন ফিরে ট্যানাসের রক্ত-পানের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে একেবারে । বর্শা উঁচিয়ে ধেয়ে গেলাম আমি।

মানবদেহের পেছন দিকে সবচেয়ে নাজুক অঙ্গ হলো বৃক্ক । চিকিৎসাবিদ্যায় আমার জ্ঞানের বদৌলতে নিখুঁতভাবে নিশানা করতে সক্ষম হলাম। আঙ্গুলের সমান বর্শার ডগাটা পুরো সেধিয়ে গেলো মেরুদণ্ডের একপাশে। ঠিক শল্যবিদের দক্ষতায় বর্শার ডগায় বিধিয়ে ফেললাম একটা বৃক্ক। নিমিষে জায়গায় জমে গেলো বেদুঈন মন্দিরের মূর্তি যেনো। বর্শাটা মুচড়ে দিতে এমন আর্তনাদ করে উঠে হাতের তলোয়ার ফেলে দিলো সে, চমকে গেলো দুই সঙ্গী। ক্ষণিকের এই অমনোযোগিতাই প্রয়োজন ছিলো ট্যানাসের। প্রচণ্ড এক আঘাতে দুই কাঁধের মাঝখান দিয়ে তলোয়ারের ফলা সেধিয়ে দিলো সে, সামনের শয়তানটার বুকে। কিন্তু আটকে গেলো তার অস্ত্রের ফলা, যতক্ষণে ওটা টেনে বের করলো ট্যানাস শেষ বর্বর ততক্ষণে জীবন বাজী রেখে ছুটতে শুরু করেছে। কিছু সময় ধাওয়া করে ক্ষান্ত দেয় ট্যানাস দারুন হাঁপাচ্ছে সে। আমি শেষটাইটা–বদমাশটাকে যেতে দিওনা!

দৌড়ে আমাকে হারায়, এমন লোক কমই আছে। আমার জানামতে, এক ট্যানাসের পক্ষে সেটা সম্ভব; তারপরেও নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করতে হবে তাকে সেটা হতে হলে। নিহত বেদুঈনের পিঠে পা রেখে বর্শাটা টেনে মুক্ত করলাম আমি, এরপরে শেষ শয়তানটার পিছনে ছুটতে লাগলাম।

দুইশ গজও যেতে পারার আগেই তাকে ধরে ফেললাম আমি, এতো হালকা পদক্ষেপে ছুটেছি ব্যাটা টেরই পায় নি, কেউ আছে পেছনে। বর্শার এক খোঁচায় পায়ের রগ কেটে ফেলতে পড়ে গেলো বদমাশটা। হাত থেকে ছুটে গেছে তলোয়ার । মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থেকে কাঁদতে লাগলো সে, বর্শার খোঁচায় তাকে জর্জরিত করতে লাগলাম।

কোন মেয়েটাকে নিয়ে বেশি মজা করেছো, হে? উরুতে এক খোঁচা লাগিয়ে জানতে চাইলাম, মা, বিশাল পেটসহ নাকি ছোটো মেয়েটা? ওটা বেশি আঁটোসাটো ছিলো, তাই না?

মাপ করো! চেঁচাতে লাগলো বর্বরটা। আমি কিছু করি নি, বাকিরা মজা লুটেছে।

তোর কাপড়ের সামনে তাহলে রক্ত কেননা রে, বললাম তাকে। হালকাভাবে বর্শাটা বেঁধালাম ব্যাটার পেটে। এখন যেমন করে চেঁচাচ্ছিস, বাচ্চা মেয়েটা কি এমন করেই আর্তনাদ করেছিলো?

কুঁজো হয়ে কুণ্ডলি পাকাতে মেরুদণ্ডের পাশে সেধিয়ে দিলাম বর্শার ডগা, মুহূর্তেই পা থেকে নিচ পর্যন্ত অবশ হয়ে গেলো শয়তানটার। ওর দিকে পিছন ফিরে রওনা হলাম আমি।

ঠিক আছে, মারলাম না তোকে। এটা ভালো হলো– পড়ে থাক এখানে।

ট্যানাসের কাছে ফিরে চললাম। দুই হাতে হিঁচড়ে কিছু সময় এগোলো বর্বরটা, পা দুটো মরা সাপের মতো হেঁচরাচ্ছে মাটিতে। এরপর ক্লান্তিতে মুষড়ে পড়লো সে। প্রখর দাবদাহে রাত নামার আগেই মরবে শয়তানটা কোনো সন্দেহ নেই।

ফিরে আসতে, অবাক চোখে আমার দিকে চাইলো ট্যানাস। তোমার মধ্যেও বুনো একটা লোক বাস করে ব্যাপারটা আগে বুঝি নি। অবাক বিস্ময়ে মাথা নাড়লো সে। সব সময় চমকে দাও, টাইটা।

খচ্চরটার পিঠ থেকে পানির থলে নামিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো ট্যানাস, কিন্তু মাথা নেড়ে বাধা দিলাম আমি। তোমার বেশি প্রয়োজন ওটা। বললাম তাকে।

চোখ বন্ধ করে পানি পান করলো সে, বেশ কিছুক্ষণ কাশলো বিষম খেয়ে। আইসিস-এর মিষ্টি শ্বাসের কসম–তুমি ঠিক বলেছো। একেবারে মেয়েমানুষের মতো নরম হয়ে গেছি। সামান্য একটু তলোয়ার খেলা প্রায় শেষ করে দিতে বসেছিলো আমাকে। এরপর চারপাশের দেহগুলোর দিকে তাকিয়ে হাসলো ট্যানাস। কিন্তু যাই বলো, ফারাও-এর শ্রাইক-নিধন অভিযানের শুরুটা কিন্তু মন্দ হলো না!

বিশ্রী আরম্ভ, উল্টো কথা বললাম আমি। আমার উদ্দেশ্যে ভুড় উঁচাতে বলে চললাম, আমাদের উচিত ছিলো, অন্তত একটাকে বাঁচিয়ে রেখে শ্রাইকদের আস্তানার খোঁজ জেনে নেওয়া। এমনকি ওই বদমাশটাও হাত উঁচিয়ে আমার ফেলে-আসা পথের দিকে ইঙ্গিত করলাম, এখন আর কোনো কাজে আসবে না। এরকম ভুল আর করা চলবে না।

নিহত পরিবারটির মৃতদেহ যেখানে রেখে এসেছি সেখানে ফিরে চললাম আমরা। পুরুষ লোকটির মৃতদেহ ততক্ষণে দারুন পঁচা গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। খুব কম মাংসই অবশিষ্ট রেখেছে শকুনের দল।

ওর চুলগুলো দ্যাখো, ট্যানাসকে বললাম। এ রকম চুল আর কার আছে, জানো? কিছু সময়ের জন্যে থমকালো ট্যানাস, এরপরে চওড়া হেসে নিজের মাথার ঘন চুলের অরণ্যে হাত চালালো।

খচ্চরের পিঠে লাশটা উঠাতে হবে–এসো, হাত লাগাও আমার সাথে, বললাম ওকে। কারনাকে ওটা নিয়ে যাবে ক্ৰাতাস-মমি করতে হবে। সুন্দর একটা সমাধি আর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করবো আমরা তোমার নামে। আগামীকালে সূর্যাস্তের আগেই সমস্ত থিবেস জানবে, ট্যানাস–প্রভু হেরাব মরুতে মারা গেছেন; শকুনে অর্ধেক ছিঁড়ে খেয়েছে তাঁর দেহ।

কিন্তু যদি লসট্রিস এই সংবাদ পায়- উদ্বিগ্ন দেখালো ট্যানাসকে।

ওকে সতর্ক করে দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়ে দেবো আমি। তোমার মৃত্যু-সংবাদে যে সুবিধাটুকু পাওয়া যাবে তার জন্যে আমার কর্ত্রীর একটু দুশ্চিন্তা না-হয় হলোই বা।

*

লোহিতসাগর অভিমুখী ক্যারাভান-চলা পথের উপর অবস্থিত প্রথম মরুদ্যানে আমাদের অপেক্ষায় ছিলো ক্ৰাতাস, কারনাক থেকে এক দিনের মতো হাঁটা-পথ দূরত্বে। নীল কুমির বাহিনীর বাছাই করা একশ যোদ্ধা রয়েছে তার সাথে, আমার নির্দেশমতো সতর্কভাবে বাছাই করা হয়েছে এদের। মধ্যরাতে ক্যাম্পে পৌঁছলাম আমি। এবং ট্যানাস। যাত্রার ধকলে আমরা দুজনেই দারুন ক্লান্ত। আগুনের ধারে শুয়ে মরার মতো ঘুমালাম সকাল পর্যন্ত।

সূর্যোদয়ের সাথে সাথে নিজের বাহিনীর সঙ্গে পরিকল্পনায় মত্ত হলো ট্যানাস। ওকে ফিরে পেয়ে ওদের মধ্যকার আনন্দ যেনো বাধ মানলো না, খুশিতে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করলো তারা। প্রত্যেকের নাম ধরে ডেকে কুশল জানতে চাইলো ট্যানাসও।

নাস্তার পরে ক্রাতাসকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে ট্যানাস জানালো, অর্ধ-গলিত মরদেহটা কারনাকে নিয়ে সমাধিস্থ করতে এবং সমগ্র থিবেসে জানিয়ে দিতে মহান ট্যানাসের মৃত্যু ঘটেছে। আমার কত্ৰী, লসট্রিসের জন্যে একটা চিঠি দিয়ে দিলাম আমি, কাতাসের কাছে। নির্ভরযোগ্য একজন বার্তাবাহকের মাধ্যমে নদীর উজানে, গজ-দ্বীপে ওটা পাঠানোর ব্যবস্থা করবে বলে কথা দিলো সে।

ক্রাতাসের পছন্দ করা দশ জন সৈনিক এবং গলিত মরদেহ সমেত খচ্চর নিয়ে নীল নদের তীরে, থিবেসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো সে।

সমুদ্রগামী পথ ধরে আমাদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করো, যদি ওখানে গিয়ে না পাও–তবে জেবেল-নাগারা মরুদ্যানে আমাদের ক্যাম্প পাবে। ওখানে তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করবো আমরা, পিছন থেকে চিৎকার করে ক্ৰাতাসকে জানালো ট্যানাস, আর, অবশ্যই আমার ধনুক লানাটানিয়ে এসো!

*

ক্ৰাতাস চোখের আড়াল হতেই বাহিনীর বাকি সদস্যদের একত্র করে বিপরীত দিকের সমুদ্র অভিমুখী ক্যারাভান চলাচলের পথ ধরে রওনা হলো ট্যানাস।

নীল নদের তীর থেকে লোহিতসাগর অভিমুখে চলা রাস্তাটি দারুন দীর্ঘ এবং বন্ধুর। বিশাল ক্যারাভানে করে যেতেও বিশ দিনের মতো সময় লেগে যায় । দিন-রাত দৌড়ে চললাম আমরা, চারদিনে পাড়ি দিলাম এই দূরত্ব। যাত্রার শুরুতে আমাদের দুজনের কেউই ঠিক সুস্থ অবস্থায় ছিলাম বলা যাবে না, কিন্তু যতক্ষণে জেবেল-নাগারা মরুদ্যানে পৌঁছুলাম আমরা শরীরের শেষ মেদটুক পর্যন্ত ঝড়িয়ে ফেলেছে ট্যানাস, সুরার প্রভাব আর অবশিষ্ট নেই ওর মাঝে। কঠোর, পাতলা হয়ে গেছে ও। প্রচণ্ড কষ্ট হলেও আত্মসম্মান বজায় রাখার খাতিরে সৈনিকদের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটেছি আমিও। যাত্রাপথে নীল নদের উদ্দেশ্যে চলা দুটো বড়ো ক্যারাভোনের সাথে দেখা হলো। দুনিয়ার মাল সামানে বোঝাই খচ্চরগুলোর শীর্ণ পা বাকা হয়ে গেছে বোঝার ভারে; বণিক কিংবা তাদের সাহায্যকারীর চেয়ে সশস্ত্র পাহারাদারের সংখ্যা অনেক বেশি। শ্রাইকদের মোটা অংকের উপঢৌকন না দিতে চাইলে এমন সশস্ত্র পাহাড়া ছাড়া কোনো গতান্তর নেই।

আগন্তুক কারো সঙ্গে দেখা হলেই শাল দিয়ে নিজের মুখ আড়াল করে ফেললো ট্যানাস, সোনালি চুলগুলোও এতে করে ঢাকা পড়লো। এতোই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দৈহিক অবয়বের মানুষ সে, যে কেউ একবার দেখলে চিনে ফেলতে পারে। অন্যান্য পথিকের শুভেচ্ছা বা প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে পথ চলেছি আমরা–এমনকি কারো পানে সরাসরি তাকাই নি পর্যন্ত।

সমুদ্র তীর থেকে এক দিনের মতো দূরত্বে থাকতে ক্যারাভান রাস্তা ছেড়ে পুরোনো একটা পায়ে হাঁটা পথ ধরে দক্ষিণে চললাম আমরা। বহুকাল আগে এক বেদুঈন বন্ধু পথটা চিনিয়েছিলো আমাকে। এই পুরোনো, সমুদ্রমুখী পথেই রয়েছে জেবেল-নাগারা কুয়ো । বেদুইন বা মরুর দস্যু ছাড়া আর কেউ এখন ব্যবহার করে না এটা।

শেষমেষ যখন জেবেল-নাগারার কুয়োর ধারে পৌঁছলাম, ততদিনে বেশ কষ্ট সহিষ্ণু হয়ে গেছি আমি নিজেও। রাতে, আগুনের পাশে মাঝে-মধ্যেই যাত্রা-সঙ্গীদের লোলুপ দৃষ্টি আমার উপর পড়ছে লক্ষ্য করলাম। এমনকি, সেনাবাহিনীর মতো জায়গাতেও আমাদের সমাজের ভিন্নধারার শারীরিক ভোগ-বিলাসের অনুশীলন রয়েছে।

রাতে, ছোরা পাশে রেখে ঘুমালাম। একবার কোনো এক আগ্রহী সৈনিক ওটার খোঁচা খেয়ে টের পেলো আমার সাথে সুবিধা হবে না। এরপর থেকে রাতে আর অনাহুত প্রেমিকের জ্বালাতন সহ্য করতে হলো না।

কুয়োর ধারে পৌঁছার পর ট্যানাসও বিশ্রাম নিতে সম্মত হলো। কাতাসের অপেক্ষায় থাকলাম আমরা, দৌঁড়-ঝাঁপ, তীর-চালনা, অস্ত্রের প্রশিক্ষণে নিজের বাহিনীকে ব্যস্ত রাখলো ট্যানাস। আমার নির্দেশ মতো বিশাল শরীরের কোনো দৈত্যকে নির্বাচন করে নি ক্ৰাতাস দেখে ভালো লাগলো। ট্যানাস ছাড়াও এরা সবাই পাতলা

শরীরের মানুষ আমার পরিকল্পনা কাজে লাগানোর জন্যে একদম উপযুক্ত।

আমাদের দুই দিন পরে পৌঁছুলো ক্ৰাতাস। বোঝাই যায়, রীতিমতো উড়ে এসেছে। সে।

কী ছিলো সাথে, হে? তাকে স্বাগত জানিয়ে বললো ট্যানাস। পথে কোনো সুন্দরীর দেখা পেয়েছিলে না কি?

দুটো ভারি জিনিস ছিলো আমার কাছে আলিঙ্গনে করে উত্তরে ক্রাতাস জানালো। তোমার ধনুক আর বাজপাখির প্রতীক ওগুলো হাত বদল করতে পেরে ভালো লাগছে। জিনিসগুলো ট্যানাসের কাছে ফিরিয়ে দেয় সে।

সাথে সাথে লানাটা নিয়ে মরুতে চললো ট্যানাস, আমি গেলাম তার সাথে। ছুটন্ত গ্যাজেলের একটা ঝাঁকের উদ্দেশ্যে বৃষ্টির মতো তীর বর্ষণ করলো সে। সেদিন রাতে আগুনের ধারে বসে হরিণের ঝলসানো মাংস এবং কলিজা খেতে খেতে পরবর্তী করণীয় নিয়ে কথা বললাম আমরা।

পরদিন সকালে বাহিনীকে ক্রাতাসের জিম্মায় রেখে, ট্যানাস এবং আমি সমুদ্র তীরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। অর্ধেক দিন লাগলো ছোট্ট জেলেদের গ্রামটাতে পৌঁছুতে; পড়ন্ত বিকেলে শেষ চড়াই টপকে পাহাড়ের উপর থেকে নিচের বিশাল বিস্ত তিতে তাকালাম আমরা দুজন। উন্মত্ত সমুদ্রের সফেন উচ্ছ্বাস দেখলাম প্রাণ ভরে।

গ্রামে প্রবেশ করেই সর্দারকে ডেকে পাঠালো ট্যানাস। কিছু সময়ের মধ্যেই দৌড়ে হাজির হলো সে। বাজপাখির প্রতীক দেখে কূর্নীশ করলো সদার, এতো জোরে মাটিতে মাথা ঠুকলো, ভয় হলো, মাথাটা ফেটেই না যায়! ওকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলাম আমি। নিজের বিশাল পরিবারকে লাথি এবং কনুইয়ের তোয় বাড়ি থেকে বের করে দিলো বুড়ো, আমার আর ট্যানাসের জায়গা হলো সেখানে।

আমাদের মেজবানের দেওয়া মাছের ঝোল এবং সুস্বাদু মদ দিয়ে আহার করলাম আমি এবং ট্যানাস। বিকেলে, ঝকঝকে সাদা বালুকাবেলায় হেঁটে খাড়ির পানিতে স্নান করে নিলাম দু জনে। বেশ গরম হয়ে ছিলো পানি, দারুন আরাম লাগলো। আমাদের পেছনে, বিরাট-বিশাল পাহাড় উঁচু হয়ে রয়েছে মরুর নীল আকাশে। কোনো সবুজের চিহ্ন নেই ওই পাহাড়ে–একেবারে বন্ধ্য। সমুদ্র, পাহাড় আর আকাশের মেলবন্ধন অদ্ভুত শান্তি জাগায় দেহ-মনে, সমস্ত অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে যেনো। কিন্তু বেশিক্ষণ এই সৌন্দর্য্য উপভোগ করা সম্ভব হলো না, মাছ-ধরা জেলে নৌকাগুলো ফিরে আসছে পাঁচটি ছোটো নৌকা, ছোটো ছোটো পালে বাতাস পেয়ে তরতর করে সরু খাড়ি বেয়ে ভেসে এলো। মাছে বোঝাই হয়ে আছে একেকটা, মনে হয় যেনো এখনই ডুবে যাবে ওগুলোর ভারে।

জগতে দেবতাদের সমস্ত অনুগ্রহই মোহিত করে আমাকে, আর এখন, বালুর উপর ছড়িয়ে ফেলা রুপালি মাছ পর্যবেক্ষণে চললাম। জেলেদের কাছে একের পর এক প্রশ্ন করে জেনে নিতে লাগলাম ওগুলোর নাম। রঙধনুর রঙের পসরা যেনো বসেছে এখানে–আফসোস হলো, কেননা যে আমার রঙ-তুলি আর স্ক্রোলগুলো নিয়ে এলাম না।

সমস্ত মাছ নামানো হতে, একটা ছোটো নৌকায় চড়ে বসলাম আমি, হাত নেড়ে বিদায় জানালাম ট্যানাসকে। মাছের বোঁটকা গন্ধে বমি আসতে চায়। জলপথ পেরিয়ে ওপাশের রীফে আমাকে পৌঁছে দেবে নৌকটা। আমার পরিকল্পনার পরবর্তী অংশ সম্পন্ন করার জন্যে প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে আমি ফিরে আসা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষায় থাকবে ট্যানাস। আগের বারের মতোই, আমি চাই না কেউ চিনে ফেলুক ট্যানাসকে। এই মুহূর্তে ওর কাজ হলো এটা নিশ্চিত করা, যেনো কোনো জেলেই গ্রাম ছেড়ে মরুতে গিয়ে শ্রাইকদের সতর্ক করে আসতে না পারে ।

সাগরের প্রথম বড়ো ঢেউয়ে নাক ডুবিয়ে দেয় আমাদের ছোটো নৌকা, ভয়ঙ্কর বিপদজনক তটরেখার সমান্তরালে বাতাসের গতিপথ ধরে উত্তরে রওনা হলো মাঝি। পৌঁছুতে খুব বেশি সময় লাগলো না। রাত নামার আগেই গলুইয়ের সামনে, দিগন্তে জেগে উঠলো সাফাগা বন্দরের পাথুরে বাড়ি-ঘর ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *