২. প্রতিজ্ঞা পালন

সেই সন্ধাতেই লসট্রিসকে করা আমার প্রতিজ্ঞা পালন করতে সক্ষম হলাম, আমার গীতিনাট্যের কুশীলবদের একত্র করে অনুশীলনের সময়। কাজ শুরু করার আগে কম করে হলেও এক ঘন্টা সময় একা পেয়েছিল প্রেমিক যুগল।

ওসিরিসের মন্দির প্রাঙ্গনে নির্ধারণ করা হয়েছে নাটকের মঞ্চ, প্রধান সকল চরিত্রের পোশাক পরিবর্তনের জন্যে বেশ কিছু তাবু ফেলা হয়েছে ওখানে, আমার নির্দেশে। ইচ্ছাকৃতভাবেই লসট্রিসের তাঁবুটা বাকি সবার চেয়ে একটু তফাতে তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিলাম আমি, মন্দিরের ছাদের অবলম্বন, ভারী একটা থামের আড়ালে। তাঁবুর প্রবেশমুখে পাহারায় রইলাম, অপরদিকের কাপড় সরিয়ে ভেতরে ঢুকল ট্যানাস।

পরস্পরকে দেখার মুহূর্তে ওদের আনন্দধ্বনি কিংবা ফিসফিসানি, চাপা হাসি বা ভালোবাসাবাসির মুহূর্তের কামনা-তপ্ত ছোট্ট গোঙানির আওয়াজে কান পাততে চাই নি আমি, কিন্তু শুনতে হলো। যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনো কিছুতেই বাধা দিতাম না, কিন্তু আমি নিশ্চিত, ভালোবাসার চূড়ান্ত পরিণতি, শারীরিক মিলনে যায় নি ওরা। এরও অনেক পরে, লসট্রিস এবং ট্যানাস দুই জনেই পৃথকভাবে আমার কাছে স্বীকার করেছিল এটা। নিজের বিয়ের দিনে কুমারীই ছিলো আমার মিসট্রেস। যদি আমাদের কারো জানা থাকতো, কত কাছাকাছি রয়েছে সে দিনটা; কী ভিন্নভাবেই আচরণ করতাম আমরা তখন।

পুরোটা সময় সতর্ক ছিলাম আমি, জানতাম ওদের দুজনকে একত্রে তাঁবুতে কেউ দেখে ফেলার পরিণতি কী হতে পারে; কিন্তু এরপরেও আলাদা করতে মন সায় দিচ্ছিল না। যদিও আমার পিঠে এখনও আছে র‍্যাসফারের চাবুকের দগদগে ঘা, যদিও আমার মনের গহিন কোণে–যেখানে সমস্ত অযাচিত অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রাখি আমি ঈর্ষার আগুনে পুড়ছিলাম, তবুও যতোটা উচিত ছিলো, তার চেয়ে বেশি সময় ওদের একা থাকতে দিলাম ।

আমার মনিব, ইনটেফের আগমন টের পাই নি। খুবই নরম চামড়ার স্যান্ডল পরেন তিনি, ভূতের মতোই নিঃশব্দ তাঁর চলাচল। প্রাসাদের ভেতরে বেফাঁস কথা বলে বহু সভাসদ এবং দাস আমার মনিবের ফাঁসি-কাষ্ঠ বা রাসফারের চাবুকের শিকার হয়েছে। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে ছায়ার ভেতর থেকে আমার মনিবের আগমনের আগেই ইন্দ্রিয়বলে সেটা অনুভব করার ক্ষমতা অর্জন করেছি আমি। সাধারণত এই অনুভূতি আমার সাথে প্রতারণা করে না, কিন্তু সেই সন্ধায় আমাকে চমকে দিলেন ইনটে। ঘুরে দাঁড়াতেই প্রায় টক্কর লেগে গেলো তাঁর সাথে; মন্দিরের উঁচু খিলানের মতো লম্বা, পাতলা বিষাক্ত কোব্রার মতো ফনা ভোলা ।

হুজুর, ইনটেফ! জোরে চেঁচিয়ে উঠলাম। আমাদের অনুশীলন দেখতে এসেছেন, কী সম্মানের কথা! আপনার কোনো মতামত, হুজুর–নিজের ভেতরের দ্বিধা আড়াল করে প্রেমিক যুগলকে সতর্ক করতে চাইলাম।

উভয় ক্ষেত্রেই বেশ সফল হলাম, বলা যায় । পেছনের তাঁবুতে হঠাৎ খসখস শব্দ করে বিচ্ছিন্ন হলো ওরা, এরপরেই তাঁবুর পেছনের কাপড় তুলে ট্যানাসের প্রস্থানের শব্দ পেলাম।

অন্য কোনো সময় হলে এতো সহজে ফাঁকি দেওয়া যেত না আমার মনিব, ইনটেফকে। মন্দিরের দেয়ালে লেখা হায়ারোগ্লিফিক্স যেমন সহজে পড়ি আমি, কিংবা আমার প্যাপিরাস স্ক্রোলের বর্ণমালা; ঠিক ততটা সহজে আমার মুখের অপরাধবোধ পড়ে ফেলতেন তিনি। কিন্তু নিজের ক্রোধ আর আক্রোশে অন্ধ হয়ে ছিলেন ইনটেফ । রাগে উন্মত্ত হয়ে চিৎকার করার মানুষ নন তিনি। নম্র-স্বর আর মসৃণ হাসি তাঁর সবচেয়ে বিষাক্ত অবস্থার পরিচয় দেয়।

প্রিয় টাইটা, প্রায় ফিসফিস স্বরে বললেন, আমি শুনেছি, আমার হুকুম সত্ত্বেও নাটকের প্রথম অঙ্কে পরিবর্তন করেছ তুমি। ভাবতে পারি না, কেমন করে এতটা সাহসী হলে। এই গরমে এতদূর পথ এসেছি শুধু সত্যিটা জানতে।

জানি, ভান করে বা উপেক্ষা করে কোনো লাভ নেই, তাই যন্ত্রণাক্লিষ্ট চেহারায় মাথা কেঁকালাম তার সম্মুখে। হুজুর, পরিবর্তন আমি করি নি, ওটা করেছেন ওসিরিসের মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ।

অধৈর্য্যের মতো বাধা দিলেন ইনটেফ, হ্যাঁ, অবশ্যই সে করেছে, কিন্তু কেবলমাত্র তোমার প্ররোচনায় । তোমার কী ধারণা তোমাকে বা ওই বুড়োভামকে আমি চিনিনা? কোনোদিনও ওর মাথায় একক চিন্তা ছিলো না তোমার মতো।

হুজুর! বলে উঠলাম আমি ।

কোন চতুর চাল এটা তোমার, টাইটা? ওই যে, মাঝে-মধ্যে দেবতারা তোমার কাছে যে দৈব বাণী পাঠায় সেরকম কিছু? জানতে চাইলেন ইনটেফ। তার স্বর পাথরের মেঝের উপর দিয়ে চলার সময় মন্দিরের পবিত্র কোব্রার সৃষ্ট শব্দের মতো নরম।

হুজুর! এহেন অভিযোগে বজ্রাহত হওয়ার মতো ভঙি করলাম, যদিও আদতে আমিই মন্দিরের বুড়ো পুরোহিতকে বর্ণনা করেছি, কেমন করে কালো কাকের ছদ্মবেশে ওসিরিস আমার স্বপ্নে এসেছিল; মন্দিরে রক্তপাতে তাঁর আপত্তি জানিয়েছিল।

এর আগ পর্যন্ত ফারাও-এর মনোরঞ্জনের জন্যে আমার মনিবের করা রক্তপাতের আয়োজনে কোনো আপত্তি করেন নি পুরোহিত। তাকে বাধা দেয়ার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতেই কেবল স্বপ্নের সাহায্য নিয়েছি আমি। নাটকের প্রথম অঙ্কে আমার মনিবের আয়োজন করা ব্যবস্থা ঘৃণ্য মনে হয়েছে আমার কাছে। আমার জানা আছে, পুবের কোনো কোনো দেশে দেব-দেবীদের প্রার্থনায় বলি দেওয়া হয়। শুনেছি, সেই ক্যাসাইটসে, ইউফ্রেতিস এবং টাইগ্রিস নদীর ওপারে নব জাতকদের অগ্নি-কুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়। সুদূর থেকে আসা ক্যারাভান মালিকদের কাছে জেনেছি ফসল ভালো হওয়ার অভিপ্রায়ে কুমারী মেয়ে বলি দেওয়া হয়, এমনকি যুদ্ধবন্দীদের জবাই করা হয় মৃতীর সম্মুখে।

যা হোক, আমরা মিশরীয়রা সভ্য মানুষ, জ্ঞানী এবং সদয় দেব-দেবীর পূজো করি, রক্ত-পিপাসু দানবের নয়। আমার মনিবকে এটাই বোঝাবার বহু চেষ্টা করেছি। এর আগে কেবল মাত্র একজন ফারাও নরহত্যা করেছিলেন; সেথ্‌-এর মন্দিরে সাত দস্যু রাজকুমারের গলা কেটেছিলেন রাজা মেনোটেপ, শবদেহগুলো মমি করে পাঠিয়েছিলেন বিভিন্ন রাজ্যে সতর্ক করে দেয়ার জন্যে। বিতৃষ্ণার সাথে সেই কথা স্মরণ করা হয় আজও। রক্তপিপাসু রাজা বলে দুর্নাম আছে মেনোটেপ-এর ।

এটা নরবলি নয়, আমার মনিব বলেছিলেন। কেবল একটা যৌক্তিক শাস্তি, মহৎ আয়োজনে করা হবে এই যা। তুমি নিশ্চই এটা বলতে চাইছ না, প্রিয় টাইটা, যে মৃত্যুদণ্ড আমাদের বিচারকাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে না? টড একটা চোর। রাজকীয় কফিন থেকে চুরি করেছে সে, মরাই উচিত তার। অন্যদের জন্যে ভালো একটা উদাহরণ হবে।

বেশ যুক্তিপূর্ণ কথা, কিন্তু আমি জানি বিচারে নয়, তাঁর উৎসাহ নিজের ধন-সম্পত্তি আগলে রেখে ফারাও-কে মুগ্ধ করার দিকে, নাটক দারুন ভালবাসেন তিনি। তো, স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না আমার। আর এখন, হাসির ভঙিতে ঠোঁট বেঁকে গেছে ইনটেফের, তার সুগঠিত ঝকঝকে সাদা দাঁত আমার রক্ত যেনো ঠাণ্ডা করে দেয়। ঘারের পেছনের চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেলো।

তোমার জন্যে একটা উপদেশ, আমার মুখের সামনে এসে ফিসফিস করে বললেন ইনটেফ, আজ রাতে আবারো একটা স্বপ্ন দেখবে তুমি। ঠিক যে দেবতা শেষবার দেখা দিয়েছিল, সে আবার এসে অন্য কথা বলবে; যাতে করে আমার আয়োজনে কোনো বাধা না থাকে। তা না ঘটলে, র‍্যাসফারের জন্যে একটা কাজ বরাদ্দ করতে হবে আমাকে এটা তোমার কাছে আমার প্রতিজ্ঞা। ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে চলে গেলেন ইনটেফ, আনন্দ আর হতাশার মিশ্র অনুভূতি খেলে গেলে আমার মনে।

যা হোক, ইনটেফ চলে যেতে আমাদের অনুশীলন দারুন হলো। ট্যানাসের সাথে সাক্ষাতের পর আনন্দে ঝলমল করছিল লসট্রিস, ওর রূপ যেনো স্বর্গীয়, আর শৌর্য বীর্যে উদ্ধত ট্যানাস যেনো সত্যিকারের হোরাস।

আমার কাব্যনাট্যে ওসিরিসের প্রবেশ নিয়ে দারুন শঙ্কায় আছি, এখন তো জানা হয়ে গেছে কী ঘটতে যাচ্ছে হতভাগ্য অভিনেতার ভাগ্যে। সুদর্শন, মধ্য-বয়স্ক একজন জামিন-প্রাপ্ত আসামী, টড অভিনয় করছে দেবতার ভূমিকায়।

রাজকীয় বিচারকার্য শেষে মৃত্যুর দিন গুনছিল সে, আমার মনিব কাব্যনাট্যে অভিনয়ের জন্যে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছেন তাকে। সন্তোষজনকভাবে অভিনয়ে সফল হলে তার শাস্তি মওকুফ করা হবে বলে ঘোষণা করেছেন ইনটেফ। হতভাগা টড বিশ্বাস করেছে সেই কথা, দারুন মনোযোগের সাথে অনুশীলন করেছে সে; মনে আশা-ভালো কাজ দেখালে ক্ষমা পাবে। সে জানে না, এরই মধ্যে গোপনে তার মৃত্যু পরোয়ানায় সই করে দিয়েছেন আমার মনিব, স্ক্রোলটা তুলে দিয়েছেন ব্যাসফারের হাতে। রাসফার শুধু প্রধান জল্লাদই নয়, আমার কাব্যনাট্যে সেথ-এর ভূমিকায়ও সে-ই অভিনয় করছে। মহান ফারাও-এর সম্মুখে একই সঙ্গে দুইটি কাজ সমাধা করার অভিপ্রায় আমার মনিবের । সেথ্‌-এর চরিত্রের জন্যে র‍্যাসফার অত্যন্ত যথাযথ, কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, টড-এর সঙ্গে তাকে অনুশীলন করতে দেখে আতঙ্কে শিউড়ে উঠলাম কী পৃথকই না হবে আসল দিনের অভিনয় আজকের অনুশীলন থেকে।

অনুশীলন শেষ হতে আমার মিসট্রেসকে হারেমে ফিরিয়ে দিয়ে এলাম। কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না সে, আজকের দিনের অসাধারণ ঘটনাবলিতে ট্যানাসের ভূমিকার কথা বারবার শুনতে হলো।

দেখেছ, টাইটা, ও কেমন করে হোরাসকে ডাকলো, আর কেমন করে দেবতা তার সাহায্য করলো, দেখেছ? আমাদের কোনো ক্ষতি হোরাস হতে দেবেন না, তাই টাইটা?

বিচ্ছেদ, আত্মহত্যা–এগুলোর কথা ভুলে গেছে আমার মিসট্রেস; ওর মন জুড়ে এখন কেবল কল্পলোকের রঙিন দৃশ্যাবলি। তরুণ প্রেমের হাওয়া কত দ্রুতই না। পাল্টায়।

আজ ট্যানাস যা দেখাল, যেমন করে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাল রাজকীয় জলযানকে, নিশ্চই মহান ফারাও-এর আনুকূল্য পেয়ে গেছে সে; তুমি কি বলো, টাইটা? দেবতা আর ফারাও-এর কৃপাদৃষ্টি পেলে আমার বাবা কিছুতেই তাকে নির্বাসনে পাঠাতে পারবে না, পারবে, বলো টাইটা?

ওর মনের সমস্ত আনন্দের কথায় আমাকে সমর্থন জানাতেই হলো। হারেম ছাড়ার আগে কম করে হলেও এক ডজন সংখ্যক বার বিভিন্নভাবে ওর ভালোবাসার বার্তা ট্যানাসের কাছে ব্যক্তিগতভাবে পৌঁছানোর জন্যে প্রতিজ্ঞা করতে হলো।

শেষমেষ, ক্লান্ত হয়ে যখন পৌঁছুলাম আমার ব্যক্তিগত প্রকোষ্ঠে, সেখানেও স্বস্তি নেই। আনন্দে উন্মুখ হয়ে আছে প্রায় সব দাস বালক, আমার মিসট্রেসের মতোই অপেক্ষায় বসে ছিলো আমার জন্যে। দিনের ঘটনাবলির উপর আমার মতামত তাদেরও শোনা চাই, ট্যানাসের বীরত্বের ফলাফল কী হতে পারে–এইসব। নদীর উপরে, চাতালে বসে আমার পোষ্যদের খাবার দেয়ার ফাঁকে শুনলাম ওদের সবার কথা ।

বড় ভাই, এটা কি সত্যি, ট্যানাস দেবতাকে ডেকেছে আর হোরাস সাথে সাথে তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল? আপনি এটা দেখেছেন? অনেকে বলে, দেবতা নাকি তার শকুনের ছদ্মবেশে এসেছিলেন, ডানা ছড়িয়ে রেখে ছায়া দিয়েছেন ট্যানাসকে? এগুলো সত্যি?

এটা কি সত্যি, জ্ঞানের দেবতা, তথ, ট্যানাসের জন্যে ভবিষ্যতবাণী করেছেন, সে নাকি মিশরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হবে, আর একদিন ফারাও তাঁকে সবচেয়ে বেশি সম্মান দেবেন? আজ যখন এই কথাগুলো মনে করি, অবাক লাগে, কেমন করে অদ্ভুত সেই সত্য লুকিয়ে ছিলো ওদের বাক্যে। কিন্তু তখন অবশ্য বাচ্চাদের কথার মতো অবজ্ঞায় উড়িয়ে দিয়েছিলাম ওদের কথাগুলো।

ঘুমোনোর আগে ভাবলাম, লুক্সর এবং কারনাকের সমস্ত জনতার হৃদয় জয় করে নিয়েছে ট্যানাস; কিন্তু এই মর্যাদা ওর জন্যে বোঝাস্বরূপ। যশ এবং খ্যাতি উচ্চপর্যায়ে হিংসার আগুন জ্বালাবে, আর কে না জানে, জনতার পূজা অর্চনা ক্ষণস্থায়ী। ঠিক যেমন করে মর্যাদার আসনে কাউকে সমাসীন করে তারা, ততোধিক আনন্দে তাকে ছুঁড়ে ফেলে।

বরঞ্চ, পর্দার অন্তরালে থেকে যাওয়া অনেক বেশি নিরাপদ, চিরকাল যেখানে থাকবার চেষ্টা করে এসেছি আমি।

*

উৎসবের ষষ্ঠ দিনে, কারনাক এবং ক্সরের মাঝামাঝিতে অবস্থিত নিজের রাজকীয় ভিলা ছেড়ে পাথুরে সিংহের মূর্তি-সজ্জিত চওড়া আভেন্যু ধরে নীল নদের তীরে, ওসিরিসের মন্দিরে এলেন মহান ফারাও, রাজকীয় ভাবগাম্ভির্য্য তার অবয়বে।

যে বিশাল স্লেজে চড়ে গেলেন তিনি, সেটা এতোটাই উঁচু, আভেন্যুর দুই ধারে সমবেত জনতা ঘার বাঁকা করে তাকাল স্বর্ণ-মণ্ডিত তাঁর সিংহাসনের দিকে। মাথার শিংয়ে ফুল সাজানো, বিরাট-পেশিবহুল বিশটি ষাড় টেনে নিয়ে চললো স্লেজটা। পায়ে হাঁটা পাথুরে পথে দাগ ফেলে দিলো তার বাহন।

একশ বাদক নেতৃত্ব দিলো এই যাত্রায়, লিয়ার এবং হার্প বাজিয়ে চললো তারা; সিবেল এবং ঢাকের শব্দ তাল মেলালো তার সাথে, ছন্দোবদ্ধ আওয়াজে বেজে উঠলো সিস্ট্রাম; ওরিক্স হরিণ এবং বুনো ছাগলের বাঁকানো শিংয়ে ফুঁ দিয়ে একটানা সুর তুলতে লাগলো বাদকেরা। মহান ফারাও এবং দেবতা ওসিরিসের প্রশংসাসূচক বাণী গাইল মিশরের শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পীরা। স্বাভাবিকভাবেই আমি নেতৃত্ব দিলাম তাঁদের। আমাদের পেছনে ট্যানাসের নেতৃত্বে নীল কুমীর বাহিনীর একটা দল সম্মান জানাল মহান ফারাওকে। বর্ম এবং যুদ্ধের সাজে সজ্জিত ট্যানাসকে দেখে কাপন জেগেছিল সেদিন কুমারী হৃদয়ে; দু চারজন হয়তো জ্ঞানও হারিয়েছিল। এমনই প্রিয় হয়ে উঠেছে সে।

নীল কুমীর বাহিনীর পরে এলেন রাজ্যের উজির, তার সভাসদদের সঙ্গে করে। এরপরে, মহৎ ব্যক্তিবর্গ, তাদের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে; তারপর বাজপাখি বাহিনীর একটা দল; সবশেষে মহান ফারাও-এর অতিকায় শ্লেজ। উচ্চ রাজ্যের কয়েক হাজার সম্পদশালী এবং প্রভাবশালী লোক জড়ো হয়েছে উৎসবে।

ওসিরিসের মন্দিরের নিকটবর্তী হতে প্রধান পুরোহিত তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সাথে নিয়ে ফারাও মামোসকে অভিবাদন জানাতে নেমে এলেন সিঁড়ি কোঠায়। নতুন করে রঙ করা হয়েছে মন্দির, সূর্যাস্তের সোনালি আভায় চকচক করতে লাগলো বাইরের দেওয়ালের তামার কারুকার্যগুলো। লম্বা স্তম্ভের মাথায় উড়ছে রঙ-বেরঙের তোরণ।

সিঁড়ি কোঠার সামনে নিজের স্লেজ থেকে নেমে পড়লেন মহান ফারাও; একশ ধাপের প্রথমটিতে পা রাখলেন। দুইপাশের সিঁড়িতে তার সঙ্গী হলো কণ্ঠশিল্পীর দল। পঞ্চাশতম ধাপে দাঁড়িয়ে আমাদের মহান ফারাওকে পর্যবেক্ষণ করলাম কিছু সময়।

তাঁকে অবশ্য আমি আগে থেকে জানি, তিনি আমার অন্যতম একজন রোগী ছিলেন, কিন্তু আজ মনে হলো আমি ভুলে গেছিলাম, তিনি কত ক্ষুদ্র অন্তত একজন দেবতার পক্ষে তো বটেই। এমনকি আমার কাধ পর্যন্তও লম্বা নন তিনি, অবশ্য উঁচু দ্বৈত মুকুটে অনেকটা ঢাকা পড়ে গেছে তার উচ্চতা। ভাবগাম্ভির্যের সাথে বুকে হাত বেঁধে রেখেছেন, তাতে শোভা পাচ্ছে মিশরের সাম্রাজ্যের প্রতীক-চিহ্ন। আগের মতোই এবারেও লক্ষ করলাম, তার হাতে কোনো লোম নেই; মসৃণ, মহিলাদের মতো কোমল ও দুটো। পা দুটোও বেশ ছোটো এবং পরিচ্ছন্ন। হাত এবং পায়ের আঙুলে আংটি পরেন মহান ফারাও, কবজিতে রয়েছে বাজুবন্ধ। বুকের বিশালাকায় বর্মে শোভা পাচ্ছে সত্যের পালক হাতে দেবতা তথ–এর বিভিন্ন রঙিন চিত্র; লাল সোনায় খচিত। প্রায় পাঁচশ বছরেরও পুরোনো ওটা, আমাদের মহান ফারাও-এর আগেও আরো সত্তরজন পরেছেন।

দ্বৈত মুকুটের নিচে তার মুখাবয়ব নিহতের মতো সাদা দেখায় প্রসাধনীর কারণে। চোখে ঘন কালো কাজল, ওষ্ঠে লাল রঙ করা। প্রসাধন-চর্চিত তার মুখ চিন্তাক্লিষ্ট, ঠোঁট দুটো বেঁকে আছে বিরক্তিতে। চোখে আত্মবিশ্বাসের ছিটে-ফোটও নেই ।

আদতে, আমাদের এই মহান জন্মভূমির ভিত্তিমূল ধ্বসে গেছে! সমগ্র রাজ্য আজ বিচ্ছিন্ন পাপাচারে টালমাটাল। আজ, এমনকি একজন দেবতার মুখও চিন্তাক্লিষ্ট। একটা সময়ে সুদূর সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো তার সাম্রাজ্য, ডেল্টার সাত মাথা পেরিয়ে, দক্ষিণে সেই আসূন আর প্রথম জলপ্রপাত পর্যন্ত তিনি ছিলেন জগতের শ্রেষ্ঠতম সম্রাট। কিন্তু তিনি বা তাঁর উত্তরাধিকারীরা সব নষ্ট করেছেন, আজ তারই সংকুচিত সীমারেখায় মাথা উঁচায় শত্রুরা; হায়েনা, শেয়াল আর শকুনের মতো আক্রমণ করে মিশরের শবদেহে।

দক্ষিণে আছে আফ্রিকার দস্যুর দল, উত্তরে, সাগরের ধার ঘেঁষে বাস করে জলদস্যুরা; আর নীল নদের নিচের প্রান্ত জুড়ে রাজত্ব করছে ভুয়া ফারাও। পশ্চিমে লিবিয়ার শয়তান বেদুঈনের ঘাটি, পুবে প্রতিদিন মাথাচাড়া দেয় নতুন দস্যু দল; পরাজিত, হতোদ্যম জাতির বুকে কাঁপন জাগায়। আসিরিয়রা এবং মেদেসীয়রা, ক্যাসাইটস্ এবং হারিয়রা, এবং হিটটিরা–এদের সংখ্যার কোনো শেষ নেই।

যদি বয়সের ভারে ন্যুজ আর দুর্বলই হয়ে পড়বে, তবে কি সুবিধা রইল এই প্রাচীন সভ্যতার? লোভ, ধ্বংস আর উন্নাসিকতায় মত্ত বর্বরদের কেমন করে ঠেকাবো আমরা? আমি নিশ্চিত, বর্তমান ফারাও বা তার সাম্প্রতিক পূর্বসুরিদের কারও ক্ষমতা নেই মিশরকে সেই আগের স্বর্ণযুগে ফিরিয়ে নেওয়ার। উনি এমনকি একটি পুত্রসন্তানও জন্ম দিতে সক্ষম হন নি।

রাজ্য হারানোর শঙ্কার বদলে ছেলে বংশধর জন্ম না দিতে পারার দুঃখ তাকে ভারাক্রান্ত করে। এই পর্যন্ত বিশজন পত্নী নিয়েছেন তিনি। কন্যাসন্তান হয়েছে তাদের, পুত্র নয়। এতো দ্রুত তবুও নিজের দোষের কথা মেনে নেবেন না আমাদের ফারাও। উচ্চ সাম্রাজ্যের সমস্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছেন, গিয়েছেন সব মন্দির আর গুরুত্বপূর্ণ শ্রাইন-এ।

এ সবই আমার জানা, কেননা তাঁর ডেকে পাঠানো চিকিৎসকদের একজন ছিলাম আমি। স্বীকার করি, সেই সময়ে একজন দেবতাকে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছি বলে খানিকটা আপুত ছিলাম, ভেবে অবাক হয়েছিলাম একজন দেবতার কেন প্রয়োজন পড়বে আমার মতো সামান্য মানবকে। যাই হোক, ষাঁড়ের অণ্ডকোষ খেতে উপদেশ দিয়েছি তাকে, মধুর সঙ্গে মিশিয়ে; পরামর্শ দিয়েছি মিশরের শ্রেষ্ঠতম রূপসী কুমারী মেয়েকে তার রজঃচক্রের প্রথম বছরেই ফুল-শয্যায় নিতে।

নিজের চিকিৎসায় খুব একটা আস্থা ছিলো না আমার; অবশ্য, আমার প্রস্তুত। প্রক্রিয়ায় রাঁধা হলে সঁড়ের শুক্রাশয় অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার। ভেবেছিলাম, রূপসী কুমারীর খোঁজে পুরো সাম্রাজ্য চষে ফেলার ব্যাপারটা ফারাও-এর কাছে বেশ উপভোগ্য হবে। মূলত, একজন রাজা যদি ক্রমাগত তরুণী মেয়েদের শয্যাসঙ্গিনী করতে থাকেন, তাহলে কোনো একজনের গর্ভে পুত্রসন্তান জন্ম নেওয়া খুবই স্বাভাবিক।

আমি অবশ্য নিজেকে এই বলে সান্তনা দেই, অন্যান্য ব্যবস্থাপত্র দানকারীদের তুলনায় আমার চিকিৎসা অতটা ভয়ঙ্কর নয়, বিশেষত ওসিরিসের মন্দিরের পুরোহিতদের চেয়ে তো নয়ই। যদি কাজ নাও হয়, আমার ব্যবস্থায় কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা ছিলো না। আমি তাই বিশ্বাস করতাম। যদি জানতাম, ভাগ্যের পরিহাসে কী বিপরীত ভূমিকা নেবে ফারাও-কে দেওয়া আমার উপদেশ, কাব্যনাট্যে টড-এর জায়গা আমিই নিতাম।

ফারাও আমার পরামর্শ মেনে তার রাজ্যের প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই এলো আমারনা থেকে জলপ্রপাত পর্যন্ত দেশের সমস্ত তেজী ষাঁড়ের শুক্রাশয় সংগ্রহ করতে; তাদের প্রতি আরো নির্দেশ রয়েছে রূপসী কুমারীদের খবর জোগাড় করে আনার। এসব জেনে দারুন আপ্লুত হয়েছিলাম। রাজপ্রাসাদে আমার দূত মারফত খবর পেয়েছি, ইতিমধ্যেই রাজ্যের সবচেয়ে রূপসী কুমারী কন্যা হিসেবে অন্তত একশ জনের আবেদন বাতিল হয়ে গেছে।

আর এখন, আমার সামনে দিয়ে হেঁটে মন্দিরে প্রবেশ করলেন মহান ফারাও। হাঁটু গেড়ে বসা পুরোহিতরা অভ্যর্থনা জানাল তাঁকে। রাজ-উজির এবং তার সভাসদবর্গ অনুসরণ করলো, পেছনে অবিন্যস্ত, পরিমরি জনতার কাফেলা সবাই চাইছে ভালো একটা অবস্থান থেকে নাটক উপভোগ করতে। মন্দিরের ভেতরে স্থান খুবই অপ্রতুল; কেবল মাত্র প্রভাবশালী, মহান লোকজন এবং যারা পুরোহিতদের ঘুষ দিতে সমর্থ হয়েছে তারা জায়গা পেলেন ভেতরে। অন্যদের বাধ্য করা হলো, মন্দিরের প্রবেশদ্বারের বাইরে থেকে দেখতে। বেশিরভাগ লোকজন দারুন হতাশ হলো এই আচরণে, কাব্যনাট্যের ধারাবিবরণী শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে তাদের। এমনকি, নাটকের পরিচালক হয়েও আমাকে পর্যন্ত বেগ পেতে হলো জনতার ভীড় ঠেলে ভেতরে যেতে। তাও সম্ভব হলো ট্যানাসের কারণে, আমার দুর্দশা দেখে তার দুজন সৈনিককে পাঠিয়ে পথ করে দেয়ার ব্যবস্থা করলো সে।

কাব্যনাট্য শুরুর আগে অবিরাম শুভেচ্ছাবাণী শুনতে হবে আমাদের, প্রথমে স্থানীয় প্রশাসকদের তরফ থেকে, পরবর্তীতে স্বয়ং রাজ-উজিরের নিকট থেকে। এই শুভেচ্ছা বাণীর হিড়িক কাজে লাগালাম আমি, শেষ মুহূর্তের ঠিকঠাক সেরে নিলাম। তাবুতে তাঁবুতে ঘুরে সব অভিনেতার প্রসাধনী, পোশাক পরখ করে দেখলাম, শেষ মুহূর্তের অস্বস্তি দূর করার চেষ্টা চালালাম সাধ্যমত।

হতভাগা টড ভাবছে, তার অভিনয় ইনটেকে সম্ভষ্ট করতে পারবে কি না। ওকে আশ্বস্ত করে জানালাম, নিশ্চই সে সক্ষম হবে। শেষমেষ লাল শেপেনের পাতা থেকে তৈরি গুঁড়ো খেতে দিলাম, এতে করে সামান্য হলেও লাঘব হবে তার মৃত্যু-যন্ত্রণা।

র‍্যাসফারে তাবুতে এসে দেখি, প্রাসাদের দুই সঙ্গীকে নিয়ে মদ্যপান করছে সে, ছোটো ব্রোঞ্জের তলোয়ার পাশে রাখা। প্রসাধনীর মাধ্যমে আরো বিকট দেখানোর চেষ্টা করেছি তাকে, যদিও বেশ কষ্টকর কাজ ছিলো সেটা। কালো দাঁতে হেসে যখন আমার উদ্দেশ্যে মদ বাড়িয়ে দিলো সে, বুঝলাম, সফল হওয়া গেছে সেই কাজে।

পেছনটা এখন কেমন ব্যথা করে, ছোট্ট সোনা? এই নাও, পুরুষ মানুষের পানীয় খাও! হয়তো এতে করে আবার বিচি ফেরত পাবে! তার এ ধরনের নির্মম কৌতুকে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি, পাত্তা দিলাম না। বললাম, আমার মনিব, প্রধান পুরোহিতের নির্দেশ বাতিল করেছেন, কাজেই আগের পরিকল্পনা মতো হবে প্রথম অঙ্ক।

মনিব ইনটেফের সঙ্গে কথা হয়েছে। তলোয়ার হাতে তুলে নেয় র‍্যাসফার। দ্যাখো, কত ধারালো এটা, ব্যাটা খোঁজা। কী মনে হয়? ওকে রেখে চলে এলাম আমি ।

দ্বিতীয় অঙ্কের আগে মঞ্চে আসবে না ট্যানাস, তবুও পোপাশাক পরে ফেলেছে সে। হেসে কাঁধ চাপড়ে দিলো আমার। কি হলো, বন্ধু, এই তো তোমার সুযোগ। আজকের সন্ধার পরে পুরো মিশরে নাট্যকার হিসেবে নাম ছড়িয়ে পড়বে তোমার।

ঠিক তোমার মতো। সবাই বলছে তোমার কথা। আরো বলতে চাইলাম আমি, কিন্তু বিনয়ের হাসি হেসে উড়িয়ে দেয় ট্যানাস। শেষের বক্তব্য তৈরি করেছ তো, ট্যানাস? জানতে চাই আমি, আমাকে এখন শোনাও ওটা।

ঐতিহ্যগতভাবে, হোরাসের ভূমিকায় অভিনয়কারী ব্যক্তি নাটক শেষে ফারাও-এর কাছে বার্তা দেয়, দেবতাদের পক্ষ থেকে। যদিও আসলে সেগুলো তারই বক্তব্য। অতীতে, যেসব ঘটনা সাধারণ সময়ে মহান ফারাও-এর কানে পৌঁছুতে ব্যর্থ হয়েছে, এই দিন হোরাসের রূপদানকারী অভিনেতার মাধ্যমে সেটাই করা হয়। তবে শেষ বংশধারার ফারাও-এর আমলে নিয়ম পরিবর্তন করা হয়েছে, এখন শেষ বক্তব্য দাঁড়িয়েছে মহান ফারাও-এর স্তব-স্তুতিতে।

গত কয়েক দিন থেকেই ট্যানাসকে তার বক্তব্য আমাকে শোনানোর জন্যে বলছি। প্রতিবারই এতো তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে এড়িয়ে গেছে সে, এখন রীতিমত সন্দেহ হতে লাগলো আমার। এ-ই শেষ সুযোগ। বলো, জোর করলাম, কিন্তু ট্যানাস হাসে প্রত্যুত্তরে ।

ফারাও-এর কাছে যেমন মনে হবে, তোমার কাছেও ঠিক একই রকম চমক হিসেবে থাক ওটা। দুজনেই মজা পাবে সেক্ষেত্রে। আর কোনো কিছু বলে লাভ নেই। এক একটা সময় আমার দেখা সবচেয়ে একরোখা বর্বর বলে মনে হয় ট্যানাসকে। ঝড়ো গতিতে ওর ভঁবু ছাড়লাম।

লসট্রিসের তাবুর প্রবেশমুখ ঠেলে ভেতরে ঢুকে চমকে গেলাম। যদিও ওর পরনের পোশাকটা আমারই নকশা করা, ওর প্রসাধনীর কথাও আমি বলে দিয়েছিলাম দাসী মেয়েদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা স্বর্গীয় অবয়বের জন্যে ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না। এক মুহূর্তের জন্যে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো, দেবী সত্যিই মর্ত্যে নেমে এসেছেন, অশরীরী কোনো দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে। শ্বাস আটকে আসতে চাইল, নিজের অজান্তেই নতজানু হলাম; আমার মিসট্রেসের খিলখিল হাসি চমক ভাঙ্গালো।

কী মজা, তাই না টাইটা? পুরোদস্তুর পোশাকে ট্যানাসকে দেখার জন্যে তর সইছে না। ওকে নির্ঘাত দেবতাদের মতোই লাগছে। ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর পোশাক দেখার সুযোগ তরে দিলো লসট্রিস, হাসলো কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে।

তোমার চেয়ে বেশি স্বর্গীয় কিছু হতে পারে না, মাই লেডি, বিড়বিড় করে বললাম আমি।

কথন শুরু হবে নাটক? অধৈর্যের মতো বলে উঠে লসট্রিস। আর বসে থাকতে ইচ্ছা হয় না।

তাঁবুর দেওয়াল কান পেতে প্রধান কামরার বক্তৃতায় মনোযোগ দেওয়ার প্রয়াস পেলাম। শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, যে কোনো মুহূর্তে আমার মনিব, ইনটেফ অভিনেতাদের নাটক শুরু করার নির্দেশ দেবেন।

লসট্রিসের হাতে নিজের হাতে তুলে নিলাম আমি। আলতো করে চাপ দিলাম। বেশ বিরতি দিয়ে কথা বলা আর অভিজাত ভঙির কথা মনে থাকবে তো? মনে করিয়ে দিতে চাইলাম ওকে। হালকা করে আমার কাঁধে ঘুষি মারে সে।

আরে, থামো তো! যত বকবক! দেখো, দারুন হবে সবকিছু। ঠিক সেই মুহূর্তে শুনলাম, ইনটেফ তার স্বর উঁচালেন।

পবিত্র দেবতা, ফারাও মামোস, মিশরের মহান স্রষ্টা, সাম্রাজ্যের অধিকারী, ন্যায় বিচারক, মহান যিনি সবকিছু দেখেন এবং জানেন, দয়ার আধার অভিধা এবং স্তুতি চলতেই থাকল; ওদিকে লসট্রিসের তাঁবু থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে কেন্দ্রীয় খিলানের নিচে, আমার নিজের জায়গায় অবস্থান নিলাম। খিলানের চারদিকে উঁকি মেরে দেখি, মন্দিরের ভেতরের স্থান লোকে-লোকারণ্য হয়ে গেছে। ফারাও এবং তার বয়োজ্যেষ্ঠ পত্নীরা বসেছেন সামনের সারির নিচু সিডার কাঠের কেদারায়, থেকে থেকে চুমুক দিয়ে চলেছেন ঠাণ্ডা শরবত; নয়ত মিষ্টান্ন দ্রব্যে।

বেদীর নিচে, উঁচু একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বলছেন আমার মালিক, ইনটেফ; ওটাই আমাদের মঞ্চ। লিনেনের পর্দা দিয়ে আড়াল করে রাখা হয়েছে মূল মঞ্চ। শেষবারের মতো ওটা একবার দেখে নিলাম, অবশ্য এখন আর কোনো কিছু পরিবর্তনের সুযোগ নেই।

পর্দার আড়ালে; দৃশ্যপট প্রস্তুত করা হয়েছে পাম এবং একাশিয়া গাছে সাজিয়ে, প্রাসাদের মালীরা আমারই নির্দেশে ওগুলো স্থাপন করেছে। পাথুরে শিল্পীদের ফারাও এর সমাধি নির্মাণ কাজ থেকে সরিয়ে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ প্রকোষ্ঠ। মন্দিরের পেছনের সেই প্রকোষ্ঠ থেকে পানি প্রবাহিত করা যাবে মঞ্চে, নীল নদের প্রতীক হিসেবে।

মঞ্চের পেছনে, ছাত থেকে মেঝে পর্যন্ত টানটান লিনেনের পর্দায় অসাধারণ ছবি এঁকেছেন নেক্রোপলিসের শিল্পীরা। সূর্যাস্তের ক্রমক্ষয়িষ্ণু আলো আর মশালের শিখার কাঁপন অদ্ভুত আবহ তৈরি করেছে তাতে, যেনো এক লহমায় অতীতের কোনো সময়ে নিয়ে যাবে সবাইকে।

ফারাও-এর মনোরঞ্জনের জন্যে আরো কিছু ব্যবস্থা রেখেছি আমি। খাঁচার পশু পাখি আর প্রজাপতি ছেড়ে দেওয়া হবে বিশেষ সময়ে, দেবতা আমন রার সৃষ্টি পৃথিবীকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে। মশালের শিখা জ্বলবে লাল এবং সবুজ রঙে; বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর রয়েছে বন্যা, সঙ্গে অদ্ভুতুরে ধোয়ার মতো মেঘ ঠিক অন্ধকার জগতের মতো, যেখানে বসবাস করেন দেব দেবীরা।

মামোস, রার পুত্র, আপনি চিরজীবী হোন! আমরা, আপনার প্রতিপালিত থিবেস নগরীর অধিবাসীরা আপনার মনোযোগ কামনা করছি এই নগণ্য কাব্যনাট্যে। এ আপনার উদ্দেশ্যে হে সকল সম্মানের মালিক।

আমার মনিব, ইনটেফ তাঁর স্বাগত বক্তব্য শেষে নিজের আসনে বসে পড়লেন। সুরের ধ্বনির সাথে মঞ্চে প্রবেশ করে, খিলানের আড়াল থেকে বেরিয়ে দর্শকদের মুখোমুখি দাঁড়ালাম আমি। শক্ত পাথরের মেঝেতে বসে থেকে বক্তব্য শুনে বিরক্ত হয়ে গেছে বেশিরভাগ লোকজন, উপভোগের জন্যে মুখিয়ে আছে এখন। দারুন হর্ষধ্বনির সাথে আমাকে স্বাগত জানায় জনতা। এমনকি মহান ফারাও-এর ঠোঁটেও স্মিত হাসি ফুটে উঠেছে।

হাত উঁচু করে নিরবতা কামনা করলাম। সম্পূর্ণ শান্ত হয়ে আসে জনতা, সূচনা বাণী শুরু করলাম আমি।

নীলের তীরে নলখাগড়ার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের শব্দ শুনে শুনে বড় হয়েছি আমি, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ছিলো আমার অবয়বে। তখন বুঝি নি সেই আওয়াজের মর্ম, কিন্তু কোনো ভয় ছিলো না মনে। মাত্রই পৌরুষত্ব অর্জন করেছিলাম তখন।

সেই সুর ছিলো বয়ে যাওয়া এক সৌন্দৰ্য্য। বাদকতে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম আমি, জানতাম না, সে ছিলো মৃত্যু স্বয়ং, সুরে সুরে প্রলুব্ধ করতে চাইছিল আমাকে। আমরা, মিশরীয়রা মৃত্যু দ্বারা আবেগ তাড়িত হই, সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত দর্শকের মনোযোগ গম্ভীর হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেঁপে উঠে তারা।

মৃত্যু আমাকে ছিনিয়ে নিল, তাঁর কঙ্কালসার হাতে নিয়ে চললো সূর্যের দেবতা আমন রার কাছে। তার সাদা আলোর অধিকারে চলে গেলাম আমি। দূর থেকে শুনি, আমার প্রিয়তমা কাঁদছে; কিন্তু তাকে দেখতে পাই না। আমার দিনগুলো শূন্য মনে হয়। জনতার সম্মুখে এই প্রথম উচ্চারিত হচ্ছে আমার গদ্য, সাথে সাথেই বুঝতে পারলাম, তাদের মনোযোগ পেয়েছি; সবার মুখাবয়বে সাগ্রহ উত্তেজনা। পিন-পতন নিরবতা সমগ্র মন্দির জুড়ে।

এরপর, উঁচু একটা স্থানে আমাকে নিয়ে গেলো মৃত্যু, যেখান থেকে আমার পৃথিবীকে দেখতে পেলাম। দুনিয়ায় বেঁচে থাকা সব মানুষ আর পশু-পাখিদের দেখতে পেলাম। শক্তিশালী নদীর মতো আমার সামনে উল্টো বয়ে যেতে থাকে সময়। হাজার বছর ধরে আমি দেখতে থাকি তাদের যন্ত্রণা, মৃত্যু। মৃত্যু থেকে শুরু করে নিজেদের শিশুকাল আর জন্মকালে ফিরে যেতে দেখি তাদের। আরো পেছনে যেতে থাকে সময়, আমি দেখতে পাই প্রথম নারী এবং পুরুষকে। তাদের জনুক্ষণ, তারও অতীতের সময়ে ফিরে চললাম। যখন কোনো মানুষ নয়, বাস করতো শুধু দেবতারা।

কিন্তু, দেবতাদের সময় ছাড়িয়ে আরো পেছনে যেতে থাকে কাল, সেই নাদের সময়ে-অন্ধকার আর প্রাগৈতিহাসিক বিশৃঙ্খলায়। আর পেছনে যেতে পারে না সময়ের নদী, পথ ঘুরিয়ে নেয় সে। আবার সামনে প্রবাহিত হতে থাকে, যেমনটা আমি জানি, জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত; দেবতাদের আবেগে আলোড়িত হই। আমাদের সাম্রাজ্যের ধর্ম-ইতিহাসে দারুন দখল আছে জনতার, কিন্তু রহস্যের অবগুণ্ঠন খোলার এমন আধুনিক প্রক্রিয়ার কথা তাদের জানা ছিলো না। নিচুপ, বিমুগ্ধ জনতা এক চুল নড়ে না।

নানযুগের বিশৃঙ্খলা আর অন্ধকারের ভেতর থেকে জন্ম নিলেন আমন রা, যিনি নিজেই নিজের স্রষ্টা। আমি দেখলাম, নিজের জননেন্দ্রীয়তে আলোড়ন তুলছেন তিনি, স্বমেহন করছেন; ছড়িয়ে দিচ্ছেন তার ঔরস কালো আকাশের বুকে, যাকে আমরা আকাশগঙ্গা বলে জানি। সেই বীজ থেকেই জন্ম নিল জেব এবং নাট, স্বর্গ এবং পৃথিবী।

বাক্‌-হার! একটি একাকী কণ্ঠ ভেঙে ফেলে মন্দিরের অসাধারণ নিরবতা। বাক হার! আমেন! নিজেকে ধরে রাখতে পারেন নি প্রধান পুরোহিত, আমার সৃষ্টি রহস্যের বর্ণনায় আন্দোলিত হয়েছেন। তার এহেন আচরণে এতো অবাক হলাম, আর একটু হলেই ভুলে গিয়েছিলাম পরবর্তী বাক্যগুলো। তখন পর্যন্ত তিনিই ছিলেন আমার কঠোরতম সমালোচক। তার হৃদয় জয় করে নিয়েছি আমি, আনন্দে আরো প্রবল হয়ে উঠলো আমার কণ্ঠস্বর।

জেব এবং নাট মিলিত হলো সঙ্গমে, ঠিক মানব-মানবীর মতোই। সেই অসাধারণ মিলন থেকে জন্ম নিল দেবতা ওসিরিস এবং সেথ্‌ আর দেবী আইসিস এবং নেফথিস।

আমার ইশারায় ধীরে সরে গেলো লিনেনের পর্দা, উন্মোচিত হলো আশ্চর্য এক জগত। সমগ্র মিশরে এরকম কোনো কিছু আর দেখে নি কেউ আগে, বিস্ময়ে শ্বাস আঁকালো জনতা। পরিকল্পিত মাপা পদক্ষেপে পিছু হটলাম আমি, মঞ্চে আমার জায়গা নিল দেবতা ওসিরিস। মাথায় লম্বা, বোতলের মতো পাগড়ি, বুকের উপরে হাত দুটো বাধা সাথে সাথেই তাকে চিনতে পারল দর্শক। প্রায় সব পরিবারই ওসিরিসের মূর্তি রাখে নিজেদের প্রার্থনার ঘরে।

প্রত্যেকের গলা দিয়ে উঠে আসে অবিশ্বাসের ধ্বনি। টডকে যে সম্মোহনি ওষুধ দিয়েছি, কাজ করছে সেটা; সত্যিই তার চোখে ফুটে উঠেছে এক অদ্ভুত, চকচকে দৃষ্টি । পরাবাস্তব জগতের দেবতার মতো দেখাচ্ছে। হাতের প্রতীক চিহ্ন হাতে রহস্যময় ইঙ্গিত দেয় ওসিরিস, বজ্র কঠিন কণ্ঠস্বরে আদেশ করে, জাগো, হে নদী!

আবারো হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ে জনতা, নীল নদের আগমনী বার্তা টের পেয়েছে তারা। নীল নদই হলো মিশর, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল।

বাক্-হার! বলে উঠে আরও একটি কণ্ঠস্বর, খিলানের আড়ালে আমার লুকানো জায়গা থেকে কে বলেছে টের পেয়ে আনন্দে, বিস্ময়ে আপ্লুত হলাম। স্বয়ং ফারাও। আমার কাব্যনাট্যে বাস্তব এবং পরাবাস্তব দু ধরনের উপাদানই রেখেছি, এখন আমি নিশ্চিত, আজ থেকে আমার সংস্করণটিই অভিনীত হবে। এক হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো আগের নাটক আজ থেকে বাতিল হবে। অমরত্ব অর্জন করেছি আমি, শতকে শতকে স্মরণ করা হবে আমাকে।

আনন্দের সাথে প্রকোষ্ঠের দিকে ইঙ্গিত করলাম, ওখান থেকে মঞ্চে আসতে লাগলো জলের প্রবাহ। প্রথমটায় ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারল না দর্শক। ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারল, মহান নীল নদের জন্ম দেখছে তারা; হাজার কণ্ঠের গর্জন কাঁপিয়ে দেয় বাতাস, বাক্-হার! বাক্-হার!

পানি, তুমি জেগে উঠো! আহ্বান জানাল ওসিরিসি। বাধ্যগতের মতো বন্যার জলে ফুলে-ফেঁপে উঠে নদী।

পানি নেমে যাক! এবারে ঘোষণা করেন দেবতা, তার আদেশে নেমে যায় পানির স্তর। আবারো জাগো!

মন্দিরের পেছনে, প্রকোষ্ঠের ভেতর থেকে পানি প্রবাহিত হওয়ার আগে রঙ মেশানোর ব্যবস্থা করেছিলাম আমি। প্রথমে সবুজ রঙ, খরা মৌসুমের কম পানি চিত্রিত করার জন্যে; কিন্তু পরে আবারো যখন জেগে উঠলো পানির স্তর, বন্যার পলিমিশ্রিত গাঢ় রঙের পানি প্রবাহিত হতে থাকল।

এখন, জাগো, কীটপতঙ্গ আর পাখিরা! এসো, পৃথিবীর বুকে! আদেশ দিলেন ওসিরিস, মন্দিরের পেছনের খাঁচার দরোজা খুলে যেতে কিচিরমিচির করতে করতে বুনো পাখির মেঘ এবং বর্ণিল প্রজাপতি ভরে ফেলল মন্দির।

একদম শিশুর মতো হয়ে গেছে দর্শক। অবাক, আনন্দিত, থেকে থেকে হাতের মুঠোয় ধরে ফেলছে প্রজাপতি, আবার ছেড়ে দিতেই মন্দিরের উঁচু খিলানের ফাঁকে উড়তে থাকল ওগুলো। সাদা, সিনামন আর কালো রঙের ডোরাকাটা অসাধারন একটা হুপো পাখি এসে বসল ফারাও-এর মুকুটে, নির্ভয়ে ।

খুশিতে আন্দোলিত হয় জনতা। একটা ইশারা! চেঁচায় তারা। রাজার জন্যে আশীর্বাদ। তিনি চিরজীবী হোন! হেসে উঠলেন মহান ফারাও।

ব্যাপারটা অবশ্য একটু চালাকি হয়ে গেছে, পরবর্তীতে আমার মনিব, ইনটেফের কাছে বলেছি, পাখিটাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ফারাও এর মুকুটে বসিয়েছি আমি। মজার ব্যাপার, এই অসম্ভব কথাটা বিশ্বাস করেছেন তিনি। পশুপাখির সাথে আমার যোগাযোগ নিয়ে এমন কথাও লোকে বিশ্বাস করে।

মঞ্চে, নিজের তৈরি স্বর্গে ঘুরে ফিরছেন ওসিরিস। নাটকীয় মুহূর্তের জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি আবহাওয়া। রক্ত হীম করা চিৎকারের সাথে মঞ্চে প্রবেশ করলো সেথ। সবাই তার আগমনের অপেক্ষায় ছিলো, এরপরেও তার কর্কশ উপস্থিতি চমকে দিলো দর্শকদের। চিৎকার করে মুখ ঢেকে ফেলে, কাঁপা-কাঁপা আঙুলের ফাঁকে দিয়ে দেখতে লাগলো মহিলারা।

একি করলে, ভাই? হিংসায় হুঙ্কার দিয়ে উঠে সেথ। আমিও কি দেবতা নই? সব সৃষ্টি যদি তোমার হবে, আমি তোমার ভাই হয়েও কিছু পাবো না?

শান্তস্বরে উত্তর দেয় ওসিরিস, তার মর্যাদাপূর্ণ কণ্ঠস্বর দূরাগত শোনাল ওষুধের প্রভাবে। আমাদের পিতা, আমন রা এ সবই দিয়েছেন আমাদের দু জনকে। অবশ্য তিনি আমাদেরকে পছন্দ করার স্বাধীনতা দিয়েছেন মন্দ বা ভালো যে কাজে ব্যবহার করি, দেবতার মুখে আমারই রচিত বাক্য প্রতিধ্বনি তোলে মন্দিরের ভেতরে। আমার লেখা সবচেয়ে উকৃষ্ট গদ্য এটা, যেনো গিলতে থাকে জনতা। কেবল আমি জানি, কী ঘটতে যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে; তিক্ততায় বিষিয়ে গেলো মন।

কথার শেষে পৌঁছে গেছে ওসিরিস। এটা আমার সৃষ্টি দুনিয়া। যদি শান্তি এবং ভালোবাসায় উপভোগ করতে চাও, তোমাকে স্বাগতম। কিন্তু যদি যুদ্ধের মতো উন্মত্ত আচরণ কর, যদি ঘৃণা আর নষ্ট তোমার হৃদয় অধিকার করে রাখে, তবে এখান থেকে চলে যাও। সাদা লিনেনে মোড়া হাত তুলে স্বর্গোদ্যান ত্যাগের নির্দেশ দেয় ওসিরিস।

ঠিক ষাঁড়ের মতোই ভীষণ লোমশ কাঁধ ঝাঁকায় সেথ, প্রচণ্ড হুঙ্কারে কেঁপে উঠে মন্দির। ব্রোঞ্জের তলোয়ারটা মাথার উপরে ঘুরিয়ে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। কখনই অনুশীলন করা হয় নি এটা, একদম বোকা বনে গেলো ওসিরিস। ডান হাত প্রসারিত রেখে হতবুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে, বাতাস কেটে প্রচণ্ড আঘাতে নেমে এলো তলোয়ারের ফলা। আমার চাতালের লতাগুল্ম যেমন করে ছিঁড়ে আনি কাণ্ড থেকে, ঠিক তেমনি সহজে কেটে গেলো হাতটা কবজি থেকে। ওসিরিসের পায়ের কাছেই পড়ল সেটা, থেকে থেকে লাফাচ্ছে আঙুলগুলো।

ঘটনার আকস্মিকতায়, তলোয়ারের প্রচণ্ড ধারের কারণেই হয়তো, কয়েক মুহূর্ত নড়ল না ওসিরিস, কেবল পা কেঁপে উঠলো তার। দর্শকরা ভাবল, এ-ও কোনো ধরনের মঞ্চ খেলা, কেটে যাওয়া হাতটা হয়তো নকল। সাথে সাথে রক্তপাত না হওয়ায় তাদের চিন্তা আরো জোরালো হলো। সতর্ক নয়, আরো মনোযোগী হলো তারা; কিন্তু হঠাৎই কাটা হাত আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠলো ওসিরিস। পড়ে গেলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে আঘাত থেকে, ভিজিয়ে লাল করে ফেলছে সাদা আচকান। হাত আঁকড়ে ধরে টলোমলো পায়ে দাঁড়াল ওসিরিস, মঞ্চের উপরে তীব্র চিৎকারে আবেদন করে চললো । তীব্র, তীক্ষ্ণ সেই চিৎকার এতো মর্মস্পর্শী, ঘোর ভাঙল জনতার। প্রথমবারের মতো তারা বুঝতে পারল, এটা নাটক নয়; আতঙ্কে নিচুপ হয়ে গেলো সবাই।

মঞ্চের প্রান্তসীমায় পৌঁছুবার আগেই দ্রুত পায়ে দৌড়ে ওসিরিসকে ধরে ফেলল সেথ। কাটা হাত ধরে টেনে মঞ্চের মাঝখানে নিয়ে এলো তাকে, ছুঁড়ে ফেলল পাথরের মেঝেতে। মাথার মুকুট খুলে যেতে দীর্ঘ কালো চুল বেরিয়ে পড়ল ওসিরিসের, নিজের রক্তের পুকুরে পড়ে রইল সে।

দয়া কর, ক্ষমা কর আমাকে! আবেদন জানাল ওসিরিস, তার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে হো হো হাসিতে ফেটে পড়ল সেথ। গভীর, নিঘাদ আনন্দ প্রকাশ পেলো তার হাসিতে। রাসফার এখন সেথ হয়ে গেছে, দারুন ভাবে উপভোগ করছে প্রতিটি মুহূর্ত। সেথ এর বন্য হাসিতে চমক পুরো ভাঙে জনতার। তাদের কেউই এখন বিশ্বাস করে না, নাটক চলছে এখানে; চরমধর্মী এই কর্মকাণ্ড এখন তাদের কাছে উপভোগ্য বাস্তব। তাদেরই দেবতার হত্যাদৃশ্য দেখে শিউরে উঠে মেয়েরা, পুরুষেরা গর্জন করে রাগের আতিশায্যে।

ছেড়ে দাও তাকে! মহান দেবতা, ওসিরিসকে ছেড়ে দাও! তারা চিৎকার করে, কিন্তু একজনও নিজের আসন ছেড়ে মঞ্চে এসে ভয়ঙ্কর এই ট্রাজেডি থামাবার কোনো চেষ্টাও করে না। দেবতাদের আবেগ আর বিরাগ তো তাদের হস্তক্ষেপের বাইরে, তাই না?

অবশিষ্ট এক হাতে সেথ এর পা আঁকড়ে ধরে ওসিরিস। তখনও হাসছিল সেথ, টেনে লম্বা করে দেখল সে হাতটাকে ঠিক যেমন জবাই করার আগে জম্ভগুলোকে পরখ করে কসাই।

কেটে ফেল! রক্তের নেশায় পাগল কোনো কন্ঠ বলে উঠে জনতার ভেতর থেকে। পাল্টে গেছে তাদের ভাবাবেগ।

মেরে ফেল তাকে! চেঁচিয়ে বলে আরেকটি কণ্ঠ। রক্ত-দর্শন আর হত্যা এমনকি সবচেয়ে শান্ত মানুষটিকেও কেমন করে ক্ষেপিয়ে তোলে, ব্যাপারটা সব সময়ই ভাবিয়েছে আমাকে। চরম এই দৃশ্যে আমি পর্যন্ত নড়ে গেছি, অসুস্থ এবং আতঙ্কিত বোধ হচ্ছে সত্যি; কিন্তু ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা দানা বাঁধছে আমারও।

তলোয়ারের নিরাসক্ত কোপে বাহুটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলল সেথ, তার লাল মুঠোয় ধরা প্রত্যঙ্গ ফেলে এলিয়ে পড়লো ওসিরিস। পায়ের উপর দাঁড়াতে চাইছে সে, হাতের অবলম্বন না থাকায় পারছে না। থেকে থেকে ছুঁড়ছে পা জোড়া, মাথা নড়ছে এপাশ ওপাশ; চেঁচিয়ে চলেছে সে। ভয়ঙ্কর এই দৃশ্য থেকে চোখ সরিয়ে নিতে চাইলাম আমি, পারলাম না।

কবজি এবং কনুইয়ের কাছ থেকে তিন টুকরো করলো সে হাতটাকে। এক এক করে খণ্ডগুলো ছুঁড়ে ফেলল দর্শকসারিতে। বাতাসে ভেসে যেতে যেতে রক্তের ধারা ঝরাল ওগুলো। ফারাও-এর চিড়িয়াখানায় আটক, ক্ষিধেয় উন্মত্ত সিংহের মতো হাত বাড়ায় তারা দেবতার দেহবশেষের দখল নিতে কাড়াকাড়ি শুরু করে।

অদ্ভুত মনোযোগর সাথে কাজ করে চলে সেথ। গোড়ালি বরাবর খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলে ওসিরিসের পা জোড়া। এরপরে, হাঁটু বরাবর এবং সবশেষে, কোমরে এসে খণ্ড করে উরু। দেহাবশেষগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেয় রক্ত-তৃষ্ণার্ত জনতার উদ্দেশ্যে। আরো দাবি করতে থাকে তারা।

সেথ এর উপহার! গর্জে উঠে একটা কণ্ঠ। আমাদেরকে সেথ এর উপহার দাও? এই আবেদন জোরালো রূপ নিল মুহূর্তেই। এ হলো সেথ্‌-এর তালিসমান। কিংবদন্তি অনুযায়ী, তালিসমান হলো সকল জাদুকরী ক্ষমতার মূল। যে ব্যক্তি তা পাবে, অন্ধকার জগতের শক্তিগুলো তার অধীন হবে। ওসিরিসের শরীরের চৌদ্দ খণ্ডাংশের মধ্যে কেবল একটি খণ্ড খুঁজে পায় নি আইসিস এবং তার বোন নেফথিস। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে সেগুলোকে ছড়িয়ে রেখেছিল সেথ। র‍্যাসফার আমার যে অঙ্গ কেটে ফেলেছে, সেটাই ছিলো সেথ-এর তালিসমান। আমার মনিব, ইনটেফের গলার হারে শোভা পাচ্ছে যা ।

সেথ্‌-এর তালিসমান দাও আমাদের! জনতার রোষ চরমে উঠে। লাল রক্তে ভিজে যাওয়া আচকান ধরে দেহকাণ্ডটা উঁচু করে সেথ। তখনও হাসছিল সে। নির্দয় সেই আওয়াজ কাঁপিয়ে দেয় আমাকে। করুণার সাথে উরুসন্ধির সেই আগুনে ক্ষত মনে পড়ে গেলো আমার, ইতিমধ্যেই শিকারের রক্তে ভিজে যাওয়া লোমশ হাতে দেহাকাণ্ড থেকে তলোয়ারের কোপে সেই অঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে সে; উল্লাসে উন্মত্ত জনতাকে উঁচু করে দেখায়।

আবেদনে ফেটে পড়ে দর্শককুল। আমাদের দাও ওটা! ভিক্ষে চায় তারা। তালিসমান-এর ক্ষমতা দাও আমাদের! জংলী জানোয়ারে পরিণত হয়েছে তারা।

এই আবেদনে কান দেয় না সেথ। একটি উপহার! চিৎকার করে উঠে সে। একজন দেবতা শুধু আর একজন দেবতাকেই উপহার দিতে পারে! আমি, অন্ধকারের দেবতা, সেথ, এই তালিসমান উপহার দেব-দেবতা ফারাওকে, মহান মামোসকে! শক্তিশালী পায়ে সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চ থেকে নেমে ফারাও-এর পায়ের কাছে ওটা রাখে সেথ।

অবিশ্বাসের সাথে দেখলাম, নিচু হয়ে সেটা কুড়িয়ে নিলেন ফারাও। তার প্রসাধন চর্চিত মুখাবয়বে বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠে, এ যেনো সত্যিই কোনো দেবতার দেহাবশেষ । আমি নিশ্চিত, সেই মুহূর্তে এটাই ভাবছিলেন তিনি। সবার সম্মুখে ডান হাতে ধরলেন তালিসমান।

তার উপহার গৃহীত হতে ছুটে মঞ্চে ফিরে এলো সেথ, কাজ শেষ করতে। হতভাগ্য সেই ওসিরিস তখনও সজাগ, প্রতিটি ব্যথার ঢেউ বোধ করতে পারছে। জানি, আমার দেওয়া ওষুধ এ নিদারুন কষ্টে কোনো উপকারেই আসছে না। নিজের রক্তের পুকুরে শুয়ে শরীরের একমাত্র সঞ্চালনক্ষম অংশ, মাথা নাড়ছিলো সে এপাশ-ওপাশ। দৃষ্টিতে অনন্যসাধারণ কষ্ট।

চুলের গোছা ধরে যখন মাথাটা আলাদা করে ফেলল সে, দারুন স্বস্তিবোধ করলাম আমি । এরপরেও, জীবনের শেষ পলক পর্যন্ত কোটরের ভেতরে অস্থির নড়াচড়া করে গেলো চোখের মণিদুটো। শেষমেষ ঘোলাটে হয়ে এলো সেই দৃষ্টি, ধীরে নিভে গেলো উজ্জ্বলতা। জনতার উদ্দেশ্যে মাথাটা ছুঁড়ে দিলো সেথ।

আর এভাবেই, মন্দিরের পাথুরে স্তম্ভের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দেওয়া হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে শেষ হলো আমাদের কাব্যনাট্যের প্রথম অঙ্ক।

*

দাস বালকেরা মঞ্চ থেকে বীভৎস হত্যাকাণ্ডের নিদর্শনগুলো সরিয়ে নিয়ে গেলো দৃশ্য-বিরতিতে। আমি বিশেষ চিন্তিত ছিলাম। লসট্রিসকে নিয়ে, সে যেনো টের না পায় ঠিক কী ঘটে গেছে কিছুক্ষণ আগে। মনে আশা, হয়তো ও ভাবছে সবকিছু অনুশীলনের মতোই হয়েছে। ওকে তাঁবুতেই রেখে, ট্যানাসের একজন লোককে পাহারায় রেখেছিলাম; আরো নজর রেখেছি কুশ দেশীয় দাসী মেয়েগুলো যেনো উঁকি মেরে কী ঘটছে দেখে আবার লসট্রিসকে গিয়ে বলতে না পারে। বিলক্ষণ জানি, কী ঘটেছে টের পেলে আর অভিনয়ে রাজী করানো যাবে না তাকে। বালতি ভর্তি পানি দিয়ে মঞ্চের বীভৎস দাগ মুছে ফেলল বালকেরা, ছুটে আমার মিসট্রেসের তাঁবুতে পৌঁছুলাম ওকে সাহস দিতে।

ওহ টাইটা, আমি লোকের চিৎকার শুনেছি, আনন্দে উদ্বেল লসট্রিস স্বাগত জানায়। আমাকে। সবাই পছন্দ করেছে তোমার নাটক । তোমার জন্যে কী যে খুশি লাগছে। এটা তোমার প্রাপ্য ছিলো। ষড়যন্ত্রির মতো মুচকি হাসলো ও, শুনে মনে হলো, ওরা বুঝি ভেবেছে ওসিরিসের মৃত্যু সত্যি ঘটেছে; যাঁড়ের রক্ত দেখে মনে করেছে আসলে টড-এর রক্ত ওগুলো!

তা-ই, মিসট্রেস, আমাদের চালাকি ওরা বুঝতে পারে নি। সম্মত হলাম আমি। মাত্রই দেখা নির্মম দৃশ্যাবলি এখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছে আমাকে।

কিছুই টের পায় নি লসট্রিস। মঞ্চে পৌঁছে দিলাম ওকে, মেঝের দাগগুলোর দিকে ফিরেও তাকালো না সে। উদ্বোধনী দৃশ্যের জন্যে ওকে দাঁড় করিয়ে দিলাম জায়গামতো, মশালের আলো ঠিক করে নিলাম। যদিও তার সৌন্দর্য্যে আমি অভ্যস্ত, কিন্তু এই মুহূর্তে যেনো গলায় জমে যাচ্ছে শব্দ ওর রূপের ছটায়।

লিনেন পর্দার ওপাশে আড়ালে থাকল লসট্রিস। দর্শকের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমি। এবারে আর উন্নাসিক কোনো কণ্ঠস্বর ব্যঙ্গ করলো না। উপস্থিত প্রত্যেকে, মহান ফারাও থেকে শুরু করে সবচেয়ে নিচু বর্ণের লোকটি পর্যন্ত আচ্ছন্ন হয়ে আছে আমার কথার জাদুতে। ধীর লয়ের গদ্যে আমি বর্ণনা করতে লাগলাম ভাইয়ের মৃত্যুতে আইসিস এবং তার বোন নেফথিস-এর শোকের কথা।

আমার বলা শেষ হতে একপাশে সরিয়ে নেওয়া হলো পর্দা, শোকাবহ আইসিস এর অনিন্দ্য সৌন্দর্য্যে দম আঁকালো জনতা। প্রথম অঙ্কের রক্ত আর হত্যাদর্শনের পর এই তার এই উপস্থিতি আরো অসাধারণ হয়ে উঠল।

মৃত ভাইয়ের শোকে আচ্ছন্ন আইসিস গাইতে লাগল, মন্দিরের বিষণ্ণ দেওয়াল যেনো শিউরে উঠলো সে সুরে। তার নড়াচড়ার সাথে সাথে মশালের আলোয় সরে গিয়ে পড়ল সেই সুন্দর মুখশ্রীতে, মাথার চকচকে মুকুট যেনো সোনা ছড়াতে লাগল।

পুরোটা সময় ফারাও-কে লক্ষ্য করলাম আমি । একবারের জন্যে তার চোখ সরলো লসট্রিসের উপর থেকে, সহানুভূতিতে আর্দ্র-হৃদয়, আইসিসের সঙ্গে নিঃশব্দে গাইতে লাগলেন তিনি।

ব্যথাতুর বিবশতা আমাকে পীড়ণ করছে
আমার হৃদয় এক আহত হরিণী
দুঃখের হিংস্র থাবায় ক্ষত-বিক্ষত—

শোকে আচ্ছন্ন আইসিসের গানে সঙ্গী হলেন মহান ফারাও এবং তার সভাসদ।

মধু-রাজ্যে আর মিষ্টি নেই,
গন্ধ নেই কোনো মরুভূমির ফুলে।
আমার হৃদয় আজ শূন্য মন্দির এক,
ভালোবাসার দেবতা ছেড়ে গেছে যাকে।

সামনের সারিতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ফারাও-এর পত্নীদের কয়েকজন, কেউ লক্ষ্যও করলো না সেদিকে।

হাসি-মুখে মৃত্যুর চোখে চোখে তাকিয়েছি আমি।

তার পিছু পিছু যেতে কোনো দ্বিধা নেই আর,
যদি এমন করে পৌঁছে যাই তাঁর পানে–

এতক্ষণে কেবল রাজার পত্নীই নয়, সমস্ত মেয়েরা কাঁদতে লাগল, বহু পুরুষের চোখেও দেখলাম অশ্রু। লসট্রিসের কণ্ঠস্বর, তার রূপ হৃদয় ছুঁয়ে গেছে সবার। একজন দেবতার পক্ষে সাধারণ মানুষের মতো আবেগ প্রদর্শন করা অসম্ভব বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আমাদের মহান ফারাও-এর প্রসাধন-চর্চিত গাল বেয়ে নামলো পানির ধারা; কাজল দেওয়া, পেঁচার মতো চোখে আমার মিসট্রেসের দিকে চেয়ে রইলেন তিনি।

নেফথিস তার বোনের সঙ্গে যোগ দিলো দ্বৈত-সংগীতে। হাতে হাত রেখে দুই দেবী মিলে খুঁজে ফিরতে লাগলো তাদের প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের দেহাবশেষ।

অবশ্যই, টড-এর সত্যিকারের দেহখণ্ডগুলো মঞ্চে রাখি নি আমি। বিরতির সময়ে, আমার নির্দেশে হতভাগ্য টড-এর দেহাবশেষ নিয়ে যাওয়া হয়েছে শব-প্রস্তুতকারীদের কাছে। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করবো আমি ওর শেষকৃত্যে। তার হত্যায় আমার ভূমিকার এতে করে যদি কিছুও লাঘব হয়। যদিও ফারাও-এর হাতে রয়েছে শেষ দেহখণ্ডটি, আমার বিশ্বাস, অন্তত একবারের জন্যে হলেও নিজেদের নিয়মের অন্যথা করে অঙ্গবিহীন টড-এর আত্মাকে অজানা রাজ্যে যেতে দেবেন দেবতারা; হয়তো আমাকে অতটা খারাপ চোখে দেখবে না সে সেখানে। বন্ধু থাকা জরুরি, তা সে এখানে, এই পৃথিবীতে হোক বা অজানা রাজ্যে।

দেবতা ওসিরিসের দেহ হিসেবে নেক্রোপলিসের শিল্পীদের দিয়ে চমৎকার একটা নকল তৈরি করেছিলাম আমি। তেরোটি খণ্ডে কাটা হয়েছে সেই দেহ, ঠিক শিশুদের খেলনার মতো জোড়া লাগানো সম্ভব।

প্রতিটি খণ্ড কুড়িয়ে নেওয়ার সময় গেয়ে চললো দুই বোন। দুই হাত, দুই পা, তার দেহকাণ্ড, শেষমেষ তার পবিত্র মস্তক।

এ এমন চোখ, যেনো স্বর্গের মিটমিটে তারা,
চিরকাল জ্বলে যাবে।
মৃত্যুর শক্তি নেই একে ম্লান করে,
শবাধারের নেই স্থান
একে ধরে।

শেষপর্যন্ত দুই দেবী মিলে জড় করে ফেললো ওসিরিসের সম্পূর্ণ দেহ, কেবল সেই হারিয়ে যাওয়া তালিসমান ছাড়া। তারা আলোচনা করে চললো কিভাবে ফিরে পাবে সেটা।

যে কোনো মঞ্চ-নাটক জনপ্রিয় করে তোলার অনুষঙ্গ হিসেবে একটা সুযোগ ছিলো এটা আমার। আমাদের সবার ভেতরেই বাস করে অতৃপ্ত কামনা, কাব্য বা নাটক রচনার সময়ে এ কথাটা মাথায় থাকলে অমরত্ব পেতে পারেন একজন কবি বা নাট্যকার। সাধারণ জনতার মনে দাগ কাটতে হলে এর বিকল্প নেই।

একটি মাত্র উপায় আছে আমাদের প্রিয় ভ্রাতাকে জগতে ফিরিয়ে আনার। কথাকটা দেবী নেফথিস-এর মুখ দিয়ে বলিয়েছিলাম আমি। তার খণ্ড-বিখণ্ড দেহের সাথে আমাদের কাউকেই পালন করতে হবে সৃষ্টির খেলা, একমাত্র এতে করেই জীবন ফিরে পাবে সে।

এই পরামর্শে আগ্রহে সামনে ঝুঁকে বসে দর্শক। সবচেয়ে শিল্পরসবোধহীন যিনি, এমনকি শব-বলাকারী পর্যন্ত উদ্দিপ্ত হবে এমন অনুষঙ্গে।

কিংবদন্তির এই ওসিরিস-পুনরুত্থান কেমন করে দেখাবো–এই নিয়ে বহু বিন্দ্ৰি রজনী কেটেছে আমার। আমাকে অবাক করে দিয়ে লসট্রিস সম্মত হয়েছিলো পুরো অভিনয়টুকু করে দেখাতে। এমনকি, দুষ্ট হেসে এমনও বলেছিল, এতে করে মূল্যবান কিছু জিনিস শেখা হবে তার। আমি জানি না, সে কি মজা করছিল নাকি সত্যিই করতো কাজটা; কিন্তু এতো বড় ঝুঁকি তো আর নিতে পারি না! তার পারিবারিক মর্যাদা হেলাফেলা করার মতো কোনো ব্যাপার নয়।

তো, আমার ইশারায় পর্দা টানা হলো, তড়িৎ মঞ্চ ত্যাগ করলো লসট্রিস। বন্দরের কাছেই, এক মধুকুঞ্জের উঁচু দরের রূপোপজীবনী তার জায়গা নিল। বহু মেয়ের মধ্য থেকে বেছে তাকে নিয়েছি আমি, অসাধারণ একটা শরীর আছে এর–আমার মিসট্রেসের সঙ্গে বেশ মেলে। অবশ্যই, মুখশ্রীতে আমার মিসট্রেসের ধারে-কাছেও নয় সে, তবে ওর মতো সুন্দরী আর কে-ই বা আছে?

প্রতিস্থাপিত দেবী তার অবস্থানে যেতেই, মঞ্চের পেছনের মশালগুলো জ্বলে উঠল, যেনো পর্দায় তার ছায়া পড়ে। ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙিতে কাপড় ছাড়তে লাগলো সে। আধো অন্ধকার, আধো ছায়ায় তার এই আন্দোলনে হর্ষধ্বনিতে মুখর হলো পুরুষেরা। এই উল্লাসের কারণেই কিনা কে জানে, আরো বেশি আবেদনময়ী হয়ে উঠলো মেয়েটার অভিনয়।

এবারে নাটকের এমন অংশে এসে পড়েছি আমরা, যা নিয়ে বেশ ভাবনা-চিন্তা করতে হয়েছে আমাকে। সন্তান জন্মের ঘটনা কেমন করে প্রদর্শন করতে পারি আমি? মাত্রই ওসিরিসকে অঙ্গ-হারা হতে দেখেছি আমরা। শেষ পর্যন্ত সেই পুরোনো মঞ্চ নাটকের সাহায্য নিতে হয়েছিলো আমাকে, দেব-দেবীদের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার দোহাই দিয়ে।

ভেতর থেকে কথা বলে উঠলো লসট্রিস; তার দেহের ছায়া পড়ল ওসিরিসের মমি করা দেহে, ইঙ্গিত করতে লাগলো সেটা। প্রিয় ভ্রাতা, আমাদের পিতামহ, আমন রার দেওয়া অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার বলে তোমাকে আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি সেই অংশ, যা থেকে নির্মম সেথ তোমাকে বঞ্চিত করেছিল।

মন্দিরের ছাদে সংযুক্ত একটা পুলির সাহায্যে লিনেনের সুতায় তুলে ধরা সম্ভব, এমন একটা বস্তু রেখেছিলাম ওসিরিসের দেহে। আইসিসের কথায়, স্বর্গীয় দেবতার জম্ম থেকে উঠে দাঁড়াল কাঠের জননাঙ্গ; প্রায় আমার হাতের সমান দীর্ঘ সেটা, সম্পূর্ণ উদ্ধত! মুগ্ধতায় গুঙ্গিয়ে উঠলো জনতা।

আইসিস আদর করতেই সুতার টানে নড়ালাম আমি ওটাকে। দর্শক আরো আনন্দ পেলো যখন দেবতার শায়িত শরীরে চড়ে বসল আইসিস। লসট্রিসের বদলী মেয়েটা অসধারণ কাজ দেখাল এবারে, শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেলো ব্যাপারটাকে। শিষ দিয়ে, হর্ষধ্বনির মাধ্যমে তাকে উৎসাহ যোগাল দর্শক। পরামর্শের বন্যা ধেয়ে যাচ্ছে তার দিকে।

পুলকের চরম শিখরে পৌঁছে গেছে আইসিস, ঠিক তখনই নিভে গেলো সমস্ত আলো । ঘুটঘুঁটে অন্ধকার এখন মন্দির জুড়ে। এই সুযোগে লসট্রিস চলে এলো মঞ্চে, আবার যখন জ্বলল মশাল, এক নবজাতককে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো আইসিসকে। মাত্র কয়েকদিন আগেই প্রাসাদের একজন রাধুনি সন্তান জন্ম দিয়েছে, তার কাছ থেকে একে ধার নিয়েছি আমি।

আমি তোমাদের দিলাম ওসিরিসের নবজাতক সন্তান, অজানা রাজ্যের দেবতা যিনি; এবং আইসিস-এর সন্তান যিনি চন্দ্র-তারার দেবী। নবজাতক ছেলেকে উঁচু করে ধরলো লসট্রিস, সামনের জনসমুদ্র দেখেই কিনা কে জানে, ভীষণ কান্না জুড়ে দিলো বাচ্চাটা!

তার চিৎকার ছাপিয়ে বলে চললো লসট্রিস, তরুণ দেবতা হোরাসকে স্বাগত জানাও! যিনি আকাশ, বাতাস আর স্বর্গের বাজপাখির দেবতা! দর্শকদের মধ্যে অর্ধেকই হোরাসের উপাসক, তাঁর প্রতি তাদের আনুগত্য সীমাহীন। গর্জনে ফেটে পড়ে পায়ের উপর দাঁড়িয়ে গেলো তারা। আমাকে আনন্দের বন্যায় ভাসিয়ে, আর তরুণ দেবতার আতঙ্কের মধ্য দিয়ে শেষ হলো দ্বিতীয় অঙ্ক। পরে জানা গেছে, ভয়ে কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছিলো বেচারা শিশু-হোরাস!

*

হোরাসের বাল্যকাল এবং যৌবনে পদার্পণের বর্ণনা আবৃত্তির মাধ্যমে শুরু হলে কাব্যনাট্যের শেষ অঙ্ক। তার উপরে অর্পিত পবিত্র দায়িত্বের কথা বললাম আমি নেপথ্যে, ঠিক তখনই পর্দা সরে যেতে মঞ্চে দেখা গেলো আইসিসকে।

দাসীদের সঙ্গী করে নীল নদে স্নান করছেন দেবী। ভেজা কাপড়টা সেঁটে আছে তার শরীরে, ত্বকের হলদেটে আভা ফুটে বেরুচ্ছে অবয়ব থেকে। কুমারী স্তনের সুডৌল আকৃতির কুঁড়োয় উদ্ধত গোলাপী বৃন্ত।

হোরাসরূপী ট্যানাস প্রবেশ করলো মঞ্চে। চকচকে বর্ম-সজ্জিত তার অবয়বে যোদ্ধার গর্ব, লসট্রিসের অসাধারণ সৌন্দর্য্যের যোগ্য সঙ্গী। জল যুদ্ধে তার অর্জিত বহু সম্মান এবং সাম্প্রতিক রাজকীয় জলযান উদ্ধারের ঘটনা দেশবাসীর মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে গেছে তাকে। আজ, এই মুহূর্তে, ট্যানাস পুরো মিশরের প্রিয়তম ব্যক্তি। সে মুখ খোলার আগেই হর্ষধ্বনিতে মুখর হলো জনতা, এতো দীর্ঘ সময় ধরে চললো সেই উচ্ছ্বাস, অভিনয় থামিয়ে নীরবে অপেক্ষা করতে লাগলো কুশীলবেরা।

চারিদিকে যখন এই উল্লাস-উচ্ছ্বাস, দর্শক সারিতে উপবিষ্ট কিছু মুখের ভাবাবেগ দেখলাম মনোযাগ দিয়ে। মিশরের সাহসী সিংহ, নেমবেট তাঁর দাড়ির আড়ালে বিড়বিড় করে অভিশাপ দিচ্ছেন, কোনো চেষ্টা নেই ভাবাবেগ গোপন করার। স্মিত হেসে সামান্য মাথা ঝাঁকালেন ফারাও, তার পেছনে বসা সভাসদদের উৎসাহ তাতে বাধ্য হয়ে চড়ল। আমার মনিব, ইনটেফ, কখনই বাতাসের বিপরীতে যাওয়ার লোক নন, তার সবচেয়ে মসৃণ হাসি হাসলেন তিনি, ফারাও-এর অনুকরণে মাথা ঝাঁকালেন। কিন্তু তার চোখের খুনে দৃষ্টি আমার নজর এড়াল না।

কোলাহল কমে আসতে মুখ খুলল ট্যানাস, কিন্তু যতবারই বাক্যে বিরতি পড়ছিল, তুমুল হট্টগোলে ফেটে পড়ছিল জনতা। অবশেষে আইসিস তার সুমিষ্ট গলায় গাইতে শুরু করতে নীরবতা নেমে এলো মন্দির জুড়ে।

তোমার পিতার সুতীব্র যন্ত্রণা,
দুঃসহ যে কালো মেঘ ভেসে আছে আমাদের মস্তকের উপরে
এর সবই ফিরিয়ে দিতে হবে।

পদ্যে আইসিস সতর্ক করে দিচ্ছেন তার মহান পুত্রকে, হাত উঁচিয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন–

সেথ্‌-এর অভিশাপ আমাদের ঘিরে আছে, শুধু তুমি পারো তা ভেঙে ফেলতে। খুঁজে বের করো ওই পাষণ্ডকে; তার ঔদ্ধত্য আর হিংস্রতায় তুমি চিনবে তাঁকে। তাকে জানো, আঘাত করো। শৃঙ্খলিত করো, বেঁধে ফেলো তোমার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে; ওই বর্বরের হাত থেকে মুক্ত করো সকল দেবতা আর মানবকে।

গাইতে গাইতে মঞ্চ ত্যাগ করলেন দেবী, তার পুত্রকে রখে গেলেন অজানা যুদ্ধে। বিপুল আগ্রহের সাথে পরবর্তি ঘটনাবলির জন্যে অপেক্ষা করে আছে দর্শক।

উন্মত্ত সেথ প্রবেশ করলো মঞ্চে; ভালো এবং মন্দ, সৌন্দৰ্য্য এবং পঙ্কিলতা, সম্মান এবং অসম্মানের মধ্যে চলে আসা চিরকালীন লড়াই শুরু হবে এবার। দর্শক অধীর আগ্রহে তৈরি এর জন্যে। স্বয়ংক্রিয় ঘৃণার প্রকাশে জনতা স্বাগত জানাল তাঁকে। মঞ্চে, আস্ফালনরত রাসফার হিংস্র মুখভঙ্গি করলো দর্শকের উদ্দেশ্যে; উরুসন্ধি চেপে ধরে কোমড় নাচিয়ে অশ্লীল ইশারা করলো দর্শকের দিকে, ক্ষেপে আগুন হলো জনতা।

মেরো ফ্যালো ওকে, হোরাস! হুঙ্কার দিয়ে উঠে তারা। কুৎসিত মুখটা থেতলে দাও!।

সেথ্‌ নেচে চলে তাদের সম্মুখে।

মহান ওসিরিসের খুনীকে মেরে ফ্যালো! ঘৃণায়, আক্রোশে উন্মাদ হয়ে গেছে দর্শক।

ওর মুখটা থেতলে দাও!

নাড়ি-ভূড়ি ছিঁড়ে বের করো!

মাথাটা ফেলে দাও! চিৎকার করে তারা।

মারো ওকে, মারো!

শেষমেষ সেথ যেনো প্রথমবারের মতো দেখতে পেলো তার ভ্রাতুস্পুত্রকে। কালো দাঁতের মাঝখান থেকে জিহ্বা বের করে ভেঙচি কাটল, রুপালি লালা ঝরে পড়ছে মুখের দুই কোনো বেয়ে। কখনও ভাবি নি, নিজেকে আরো বেশি বমিজাগানিয়া প্রমাণ করতে পারে রাসফার, কিন্তু আজ আমার সেই ভুল ভাঙল।

এই পুঁচকিটা কে রে? জানতে চায় সে। পুরো একটা দুর্গন্ধময় শ্বাস ছাড়ে ট্যানাসের মুখের উপর। সম্পূর্ন অপ্রস্তুত ছিলো ট্যানাস এটার জন্যে, নিজের অজান্তেই এক পা পেছাল সে; র‍্যাসফারের মদমত্ত পেটের বিশ্রী গন্ধ সহ্য করা মুশকিল।

দ্রুতই নিজেকে ফিরে পেলো ট্যানাস। নিজের প্রথম বাক্য বলল। আমি হোরাস, ওসিরিসের পুত্র।

অট্টহাসিতে ফেটে পরে সেথ। কি চাও হে তুমি? মরা দেবতার বাচ্চা ছেলে?

আমি প্রতিশোধ নিতে এসেছি। আমার বাবা, মৃত দেবতা ওসিরিসের মৃত্যুর বদলা চাই।

তাহলে আর খুঁজে লাভ নেই, চিৎকার করে উঠে সেথ। আমিই সেথ, তারা খেকো, পৃথিবী ধ্বংসকারী।

নিজেদের তলোয়ার খাপমুক্ত করে দুই দেবতা ঝাঁপিয়ে পরে পরস্পরের উদ্দেশ্যে। মধ্য-মঞ্চে ঝনঝন শব্দে মিলিত হয় তাদের ধারালো ফলা। আহত হওয়ার আশঙ্কায় তামার বদলে কাঠের তলোয়ার ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিলো আমার, কিন্তু তাদের দুইজনের কেউই রাজী হয় নি। র‍্যাসফারের আবেদনে সাড়া দিয়েছেন ইনটেফ। তিনি আদেশ জারি করেছেন, সবাই যেনো আসল অস্ত্র ব্যবহার করে। বাধ্য হয়ে আমাকে তা মেনে নিতে হয়েছে। অবশ্য, এতে করে বাস্তবতা এসেছে দৃশ্যে; আর এখন, তলোয়ারের ফলা দিয়ে একে অন্যেরটা আটকে রেখে চোখে চোখে চেয়ে আছে দুই অভিনেতা।

দারুন বৈপরীত্য তাদের অবয়বে, এতটা ভিন্ন, নাটকের মূল ভাবই যেনো প্রকাশ করে চলেছে। ভালো এবং মন্দের চিরকালীন যুদ্ধ এটা। ট্যানাস লম্বা, সুদর্শন, সভ্য। সেথ দুর্ধর্ষ, ভারী-বাকা পায়ের বর্বর। একদমই দৃশ্যমান তাদের বৈপরীত্য। দর্শকের মনোভাব এই মুহূর্তে যুদ্ধংদেহী।

একই সঙ্গে পরস্পরকে পিছনে ঠেলে দেয় তারা, আবার মিলিত হয়। বাতাসে কাটছে ফলা, মাথা নিচু করে, কোপ মেরে পাশ কাটাচ্ছে পরস্পরের আঘাত। ওরা দুজনেই ফারাও-এর সেনাবাহিনীর চৌকষতম তলোয়ারবাজ যোদ্ধা।

মশালের আলোয় পাক খেয়ে চমকাতে লাগলো তাদের অস্ত্র, নীল নদের অস্থির উপরিতল থেকে ধেয়ে আসা বাতাসের নাচনে অপার্থিব মনে হতে লাগলো সেটা। দ্বৈত-যুদ্ধের সেই শব্দ যেনো মন্দিরের শূন্য, বিষণ্ণ ছাতে ঝটপট ডানা ঝাঁপটানো পাখির আওয়াজ, কিন্তু যখন মিলিত হলো তাদের তলোয়ার সেটা প্রচণ্ড, যেনো হাতুরি পিটছে কেউ।

দর্শকের কাছে যেটা মনে হচ্ছে সত্যিকারের মরণপণ যুদ্ধ, সেটা আসলে সতর্কভাবে অনুশীলন করা একটা নাটক বৈ আর কিছু নয়। দুজনেই জানে, ঠিক কিভাবে কতটুকু আঘাত করতে হবে তাদেরকে। অসাধারণ দুইজন যোদ্ধার এক জীবনের পারদর্শিতার কারণেই হয়তো, দারুন সহজ মনে হতে লাগলো তাদের আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ।

যখন সেথ তলোয়ার চালাল, ঠিক শেষ মুহূর্তে সরে গেলো ট্যানাস, তার বর্মে দাগ কেটে গেলো তলোয়ারের ফলা। আর যখন হোরাস আক্রমণ শানালো, তার তলোয়ারের মতো নিচু দিয়ে উড়ে গেলো যে ক গাছি চুল হারালো সেথ্‌ তার মাথা থেকে। মন্দিরের নাচিয়েদের মতোই জটিল এবং অভিজাত তাদের পায়ের কাজ, বাজপাখির মতো ক্ষিপ্র, শিকারী চিতার মতো খুনে।

দর্শকের মতো আমিও বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম সেই লড়াইয়ে। এরপরেই, সম্ভবত কোনো গভীর অতিন্দ্রিয় আমাকে সতর্ক করে দিল, হতে পারে, কোনো দেবতারই কাজ সেটা; কে বলতে পারে? যাই হোক, কেননা যেনো যুদ্ধ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনের সারিতে উপবিষ্ট ইনটেফের দিকে চাইলাম আমি।

এবারেও, জানি না এটা কি অতিন্দ্রিক কোনো ক্রিয়া নাকি ইনটে সম্বন্ধে আমার গভীর জ্ঞানের কারণে, নাকি ট্যানাসকে রক্ষাকারী দেবতার ইশারায়, চিন্তাটা ঢুকে গেলো আমার মাথায়। হয়তো তিনটি ব্যপার মিলে যাওয়ার কারণেই, সাথে সাথেই পুরো ঘটনা দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো আমার কাছে। ইনটেকের ওই নেকড়ে-হাসির একটা মাত্র অর্থ আছে।

এখন আমি জানি, কেন সেথ্‌-এর চরিত্রে র‍্যাসফারকে নিয়েছেন তিনি। এখন আমি জানি, কেন হোরাসের ভূমিকা থেকে ট্যানাসকে সরিয়ে দেওয়ার কোনো চেষ্টা তিনি করেন নি। যখন তিনি জানতেন লসট্রিসের সাথে ওর সম্পর্কের কথা। বুঝলাম, কেননা সত্যিকারের অস্ত্র ব্যবহারে তিনি উৎসাহ দিয়েছেন। জানি, কেন এই মুহূর্তে হাসছেন ইনটেফ। আজকের সন্ধার সত্যিকারের নাটক এখনও শেষ হয় নি। আরো ঘটবে। এই অঙ্ক শেষ হওয়ার আগেই কাজ সমাধা করে ফেলবে র‍্যাসফার।

ট্যানাস! সামনে এগিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম। সাবধান! এটা একটা ফাঁদ! ওরা জনতার হুঙ্কারে তলিয়ে গেলো আমার কথা। এক পা এগোতেই পেছন থেকে একটা হাত জড়িয়ে ধরলো আমাকে। বহু চেষ্টা করেও ছাড়া পেলাম না, র‍্যাসফারের বর্বর সহযোগীরা টেনে সরিয়ে নিয়ে চললো আমাকে। ঠিক এই ধরনের কাজের জন্যেই রাখা হয়েছে ওদের, যেনো কেউ সতর্ক করতে না পারে ট্যানাসকে।

হোরাস, শক্তি দাও! ওদের বাধা দেওয়ার বদলে পেছনে হেলে পড়লাম, যেদিকে টানা হচ্ছিল আমাকে। এক মুহূর্তের জন্যে ভারসাম্য হারাল তারা, এক ঝটকায় মুক্ত হলাম আমি। আবার ধরে ফেলার আগেই মঞ্চের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম দৌড়ে।

হোরাস, গলায় জোর দাও! প্রার্থনা করে চলেছি; শেষমেষ সবটুকু শ্বাস নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, ট্যানাস, সাবধান! ও তোমাকে মেরে ফেলতে চাইছে।

এবারে জনতার চিৎকার ছাপিয়ে আমার কণ্ঠস্বর পৌঁছুল ট্যানাসের কানে। ওর চোখের কুঞ্চন এবং ঘারের শক্ত হয়ে যাওয়া নজর এড়ালো না আমার। রাসফারও শুনতে পেয়েছে আমার কথা। সাথে সাথেই, অনুশীলনের পদক্ষেপ ভেঙে সামনে বাড়ল সে। নিচ থেকে উপরে ধেয়ে যাওয়া তার জোরালো কোপে বাহু সমান উচ্চতায় থরথর করে কাঁপতে লাগলো ট্যানাসের তলোয়ার ।

অবাক করে না দিতে পারলে কখনই এই ফাঁক পেতো না সে ট্যানাসের প্রতিরক্ষায়। বিশাল দুই কাঁধের শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল র‍্যাসফার এবারে। ট্যানাসের মাথার আচ্ছাদনের এক ইঞ্চি মতো নিচে, ডান চোখের বরাবর তলোয়ার শানাল সে। চোখ গেলে দিয়ে, করোটি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় এমন আঘাত।

কিন্তু আমার চিৎকার এক মুহূর্তের সুযোগ এনে দিয়েছিল ট্যানাসকে, দারুনভাবে রক্ষণ-কৌশল ব্যবহার করলো সে। তলোয়ারের হাতল দিয়ে ঠেকিয়ে রাসফারের কবজিতে প্রতিআক্রমণ করলো। তলোয়ার ধারী হাত একটু নেমে গেলো র‍্যাসফারের, সেই মুহূর্তে তার চিবুক এবং মুখে ঘুষি হাঁকালো ট্যানাস। এতে করে অবশ্য মূল আঘাত পুরোপুরি ঠেকানো গেলো না। যে আঘাতে তার চোখ গেলে গিয়ে পাকা তরমুজের মতো ফেটে যাওয়ার কথা ছিলো করোটি, সেটা কেবল তার জ কেঁটে হাড় পর্যন্ত গভীরে পৌঁছে গেলো।

সাথে সাথেই রক্তের একটা স্রোত এসে ঢেকে ফেলল ট্যানাসের মুখ। ডান চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না সে। পরে যেতেই র‍্যাসফার চড়াও হলো তার উপর। মুক্ত হাতে চোখের রক্ত পরিষ্কার করে দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়ার প্রয়াস পেলো ট্যানাস। নিজেকে সে সম্ভবত আর রক্ষা করতে পারছে না; প্রাসাদের রক্ষীরা আমাকে ধরে না রাখলে কোমরের ছুরি বের করে ঝাঁপিয়ে পড়তাম ওর সাহায্যে।

প্ৰথম খুনে আক্রমণটা সামলে নিতে পারল ট্যানাস। আরো দুটো আঘাত ধারণ করলো শরীরে, বাম উরুর উপরে একটা, অস্ত্রধারী হাতের পেশিতে আরো একটা ছোট্ট কাটা। পেছনে সরে, মাথা নিচু করে ঠেকিয়ে চললো সে। রাসফার কোনো সুযোগ দিচ্ছে না, ভারসাম্য বা সম্পূর্ণ দৃষ্টি শক্তি কোনোটাই ফিরে পায় নি ট্যানাস এখনও। হাপরের মতো উঠানামা করছে র‍্যাসফারের ঘাম-চর্চিত বুক, মশালের আলোয় চকচক করছে, কিন্তু তার গতি বা আক্রমণের প্রচণ্ডতা এতটুকু কমে নি।

আমি যদিও তলোয়ারবাজ নই, শিল্পের বোদ্ধা আমি। বহুবার অনুশীলনে দেখতে দেখতে র‍্যাসফারে ভঙ্গিমা জানা হয়ে গেছে আমার। তার আক্রমণ ভঙ্গির নাম খামসিন, অর্থাৎ মরুর বাতাস। তার বিশাল দেহ এবং শক্তিমত্তার সাথে দারুনভাবে খাপ খায় এই ভঙ্গিমা। বহু শতবার তাকে এটা অনুশীলন করতে দেখেছি আমি, এখন তার পায়ের নড়াচড়া দেখে বুঝতে পারলাম–প্রস্তুতি নিচ্ছে সেটার জন্যে। শেষ এক আঘাতে সবকিছুর সমাপ্তি টানতে চাইছে ।

প্রহরীদের সাথে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে চেঁচিয়ে উঠলাম ট্যানাসের উদ্দেশ্যে। খামসিন! তৈরি থাকো! জনতার গর্জনে আমার চিৎকার চাপা পড়ে গেলো বলে ভেবেছিলাম, ট্যানাসও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। পরে সে অবশ্য আমাকে বলেছিল, আমার কথা শুনেছিল সে; দৃষ্টির বাধা সত্ত্বেও আমার সতর্কবাণী বাঁচিয়েছিল তাকে।

এক ধাপ পেছালো র‍্যাসফার, খামসিন-এর ধ্রুপদী ভঙিমা, এক মুহূর্তের জন্যে ঢিল দিয়ে প্রতিপক্ষের উপর চড়াও হওয়া। শরীরের ভার বদল করে বাঁ পা সামনে চলে এলো। সমস্ত ভরবেগ এবং শক্তি ডান পায়ের উপর চাপিয়ে আক্রমণে গেলো র‍্যাসফার, যেনো কোনো দানবপাখি উড়বার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুই পা যখন মাটি ছুঁল, তার তলোয়ারের চোখা মাথা ট্যানাসের গলা বরাবর ধরা। অবর্ণনীয় শক্তিমত্তার বহিঃপ্রকাশ ছিলো সেটা। কোনো কিছুই পারবে না একে ঠেকিয়ে দিতে কেবল একটি বিশেষ দক্ষতা ছাড়া বন্ধ-ঘাত।

ঠিক যখন আঘাত করবার প্রাক্কালে রয়েছে র‍্যাসফার, সমান শক্তির বিচ্ছুরণ দেখিয়ে সামনে বাড়ল ট্যানাস। ছেড়ে দেওয়া তীরের মতোই প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে ছুটে গেলো সে। শূন্যে, র‍্যাসফারের ফলার সাথে সংঘর্ষ ঘটল ট্যানাসেরটার, ওটাকে নামিয়ে আনতে সক্ষম হলো সে; হাতলের কাছে এসে জমে গেলো সেই মরণ-আঘাত । নিখুঁত একটা বন্ধ-ঘাত।

দুই যোদ্ধার ভর এবং গতি ন্যস্ত হলো রাসফারের মুঠোয় ধরা তলোয়ারের ফলায়। আঘাতের প্রাবল্য সহ্য করতে পারল না সেটা, দুইভাগ হয়ে গেলো। বুকে বুকে সেঁটে আছে এখন ওরা দুজন। যদিও ট্যানাসের অস্ত্র এখনও অক্ষত, সেটা ব্যবহার করতে পারছে না সে। তার অস্ত্রধারী হাত রাসফারের দেহের পেছনে সেঁটে আছে, আটকে রেখেছে দানবটাকে শরীরের সাথে।

মিশরীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের দক্ষতা আছে কুস্তিতে। পরস্পরকে ঝাঁপটে ধরে এখন মঞ্চে ঘুরছে দুই মল্লযোদ্ধা। চোখে চোখে তাকিয়ে, মাথার আচ্ছদনের আঘাতে আঘাতে, পায়ের গোড়ালির প্যাঁচে ফেলে দিতে চাইছে পরস্পরকে। শক্তি আর প্রতিজ্ঞায় সমানে সমান।

দর্শক বেশ আগেই টের পেয়ে গেছে, কোনো ভুয়া-লড়াই নয় এটা, এতে পরাজয় মানে মৃত্যু। ভেবেছিলাম আজকে সন্ধার মতো রক্ত-তৃষ্ণা মিটে গেছে তাদের, কিন্তু তা সত্যি নয়। আরো, আরো রক্তের জন্যে চিৎকার করছে তারা।

শেষপর্যন্ত ট্যানাসের বাহুপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করে ফেলল র‍্যাসফার। ভাঙা তলোয়ারের ডগা দিয়ে ট্যানাসের আহত ভুডুতে আক্রমণ শানালো। মাথা সরিয়ে নিয়ে ওটা এড়াল ট্যানাস। শিকারের চতুস্পার্শ্বে প্যাঁচ ছাড়ানো অজগরের মতো র‍্যাসফারের বুকে পেঁচিয়ে ধরলো সে। এতে প্রচণ্ড ছিলো সেই বেষ্টনী, র‍্যাসফারের অবয়ব যেনো ফুলে-ফেঁপে উঠল, রক্ত জমা হতে লাগলো মুখে। বুকের বাতাস বেরিয়ে যাওয়ায় হাঁস ফস করতে লাগলো সে। দৃশ্যত দুর্বল হয়ে পড়েছে র‍্যাসফার। প্রচণ্ড চাপে ফেটে গেছে র‍্যাসফারের পিঠের একটা ফোঁড়া, পুঁজ গড়িয়ে এসে জমা হচ্ছে তার কোমরের কাছে।

দম বন্ধ করা বেষ্টনীর ভেতরে ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলো র‍্যাসফার। আরো সেঁটে ধরলো ট্যানাস। কাঁধ একটু নিচু করে প্রতিপক্ষকে গোড়ালির উপর নামতে বাধ্য করলো সে। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে দানব, পেছাতে শুরু করেছে। বিশাল একটা থামের দিকে চলেছে দুই যোদ্ধা। তলোয়ার আড়াআড়ি রেখে র‍্যাসফারকে বিশাল সেই স্তম্ভের সাথে ঠেসে ধরলো ট্যানাস। প্রচণ্ড শব্দে গুঙিয়ে উঠে দুই হাত ছড়িয়ে পরে র‍্যাসফারের, ভাঙা অস্ত্রটা হাত থেকে মাটিতে পরে পাথরের মেঝেতে শব্দ তুলে সরে যায়।

হাঁটু ভেঙে নেতিয়ে পড়ে র‍্যাসফার, ট্যানাসের আলিঙ্গনে। কোমর বাঁকিয়ে মাথার উপর দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে ট্যানাস তাকে। প্রচণড শব্দে মাটিতে আছড়ে পরে সে। ঠিক আগুনে পোড়া পলকা কাঠির মতোই মটমট শব্দে ভাঙতে শুনলাম আমি রাসফারের কয়েকটি বুকের হাড়। মরুর তরমুজের মতো মাথাটা পাথরের মেঝেতে শব্দ করে বাড়ি খায়।

যন্ত্রণায় কাঁদছে র‍্যাসফার । হাত তুলবার শক্তিও অবশিষ্ট নেই। যুদ্ধের উন্মত্ততায়, দর্শকের একটানা হুঙ্কারে ট্যানাসও পশু হয়ে গেছে। ধরাশায়ী র‍্যাসফারের সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাতে তলোয়ার উঁচু করলো সে। ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য। চোখের আঘাত রক্তের মুখোশে ঢেকে ফেলেছে তাকে, ঘাম এবং রক্ত ভিজিয়ে ফেলেছে বুকের লোম, কাপড়।

মারো! মেরে ফ্যালো শয়তানটাকে!

ট্যানাসের তলোয়ারের ডগা নিশানা করেছে র‍্যাসফারের বুকের মধ্যিখানে, এখনই নেমে আসবে ওটা, শেষ হবে জানোয়ারটার ভবলীলা। আমি মনে-প্রাণে চাইছিলাম, তাই করুক ট্যানাস। দেবতারা জানেন, কী ভীষণ ঘৃণা করি আমি তাকে। এই নির্মম দৈত্যটা খোঁজা করেছিলো আমাকে।

কিছুই হলো না। আমার বোঝা উচিত ছিলো, ট্যানাস কখনও আত্মসমর্পণকারী শত্রুকে মেরে ফেলবে না। ওর চোখের উন্মত্ততা ফিকে হয়ে এলো। মাথাটা একটু আঁকালো সে, যেনো বাস্তবে ফিরিয়ে আনল নিজেকে। এরপর, আঘাত করার বদলে র‍্যাসফারের বুকে একটু ছোঁয়ালো সে তলোয়ারের ডগা। র‍্যাসফারের বুকের লোমের অরন্যে এক বিন্দু রক্ত উজ্জ্বল হয়ে জ্বললো। আর তারপর, নাটকের বাক্য আবৃত্তি করতে লাগলো ট্যানাস।

এভাবেই নিজের ইচ্ছা শক্তিতে আমি বাধলাম তোকে, আলো থেকে নির্বাসন দিলাম। অন্ধকার জগতের আনাচে-কানাচে ঘুরে ফির তুই চিরকাল। যা কিছু মহৎ, যে মানুষরূপী দেবতা আছেন, তাদের কারো চেয়ে বেশি ক্ষমতা তোর থাকবে না। চোর এবং কাপুরুষ, প্রতারক এবং লম্পট, মিথ্যুক এবং খুনী, সমাধি-চোর আর ধর্ষাকামী, ছলনাময় এবং অবিশ্বস্তদের অধিকার থাকবে তোর হাতে। আজ থেকে, তুই মন্দের দেবতা। চলে যা এখান থেকে, হোরাস এবং তার পুনরুত্থিত পিতা, ওসিরিস-এর অভিশাপ তোর সঙ্গী হলো।

ব্ল্যাসফারের বুক থেকে অস্ত্র সরিয়ে নিয়ে একপাশে ফেলে দেয় ট্যানাস। পাথরের মেঝেতে ঝনঝন আওয়াজ তোলে সেটা। ছুটে গিয়ে আমাদের সৃষ্ট নীল নদের পানিতে হাঁটু গেড়ে বসে সে, এক আজলা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলে মুখের রক্ত। কোমরের কাপড় ছিঁড়ে বেঁধে ফেলে হাতের আঘাত।

আমাকে ছেড়ে র‍্যাসফারের দুই বর্বর সঙ্গী ছুটে গিয়ে উঠে বসতে সাহায্য করলো তাদের আহত মনিবকে। ওদের সাহায্যে টলোমলো করে পায়ের উপর দাঁড়াল র‍্যাসফার, কষ্ট করে শ্বাস টানছে, আহত জন্তুর মতো শব্দ করছে মুখ দিয়ে। আমার ধারণা, ভীষণভাবে আহত হয়েছে সে। মঞ্চ থেকে টেনে-হিঁচড়ে তাকে নিয়ে গেলো দুইজন, দর্শকের বিদ্রূপ-উপহাস ছুটে গেলো পিছুপিছু।

আমার মনিব, ইনটেফের মুখের ভাবাবেগে এই মুহূর্তে কোনো খাদ নেই। আমার লেশমাত্র সন্দেহও এবারে তিরোহিত হয়। এভাবেই ট্যানাসের উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন তিনি সমগ্র জনতার সামনে তার মেয়ের সামনে; ওকে মেরে ফেলে শাস্তি দিতে চাইছিলেন লসট্রিসকে।

ইনটেফের হতাশা এবং অসন্তুষ্টি দারুন আনন্দের খোরাক যোগালো আমার মনে, র‍্যাসফারের জন্যে কী অপেক্ষা করছে ভেবে ভালো লাগছে। ট্যানাসের দেওয়া মারের চেয়েও বেশি কিছু দিতে চাইবেন ইনটেফ তাকে, এই ব্যর্থতার জন্যে-সন্দেহ কি! ব্যর্থ কারো জন্যে আমার মনিবের এতটুকু মায়া-দয়া নেই।

দ্বৈত-যুদ্ধের শ্রান্তিতে তখনও হাঁপাচ্ছিলো ট্যানাস, বড় করে শ্বাস টেনে মঞ্চের সম্মুখে এগুলো সে, কাব্যনাট্য শেষের ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জনতার মুখোমুখি হতেই নীরবতা নেমে এলো, রক্ত-ঘামে-রাগে আবৃত ট্যানাস এই মুহূর্তে দর্শনীয় ব্যক্তিত্ব।

দুই হাত মন্দিরের ছাতের দিকে তুলে জোরালো শব্দে বলে উঠে ট্যানাস, আমন রা, আমাকে কণ্ঠস্বর দাও! বলবার ক্ষমতা দাও! বক্তার চিরাচরিত রীতি এটা।

তাকে কণ্ঠস্বর দাও! বলুক ও! চেঁচিয়ে উঠে জনতা, সাম্প্রতিক দৃশ্যাবলিতে উন্মত্ত ।

ট্যানাস এক অদ্ভুত মানুষ, ঠিক যতোটা পারদর্শী অস্ত্রবাজীতে, ততটাই দক্ষতা তার আছে ভাষায়, পরিকল্পনায় । আমি জানি, সে হয়তো ঠিকই স্বীকার করবে বেশিরভাগ পরিকল্পনার বীজ তার মধ্যে বপন করেছে সেই তুচ্ছ দাস, টাইটা। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই, তার ভঙ্গিমা অপূর্ব।

বাগ্মীতায় ট্যানাসের বিকল্প পাওয়া ভার। যুদ্ধ শুরুর আগে নিজের বাহিনীর উদ্দেশ্যে তার ঘোষণা কিংবদন্তি হয়ে আছে। আমি তার সবগুলো শুনি নি, তবে ট্যানাসের বিশ্বস্ত সহচর কাতাস সবই মুখস্ত করে রেখেছে। অনেকগুলো মূল্যবান বক্তব্য তার কাছ থেকে শুনে শুনে সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে আমার প্যাপিরাসের স্ক্রোলে।

এমনকি সাধারণ জনতার হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে ট্যানাসের। আমার মনে হয় সহজাত স্বতঃস্ফুর্ততা এবং স্বচছ সতোর কারণেই ওটা পারে সে। ট্যানাসের আহ্বানে হাসিমুখে মৃত্যুকে পর্যন্ত বরণ করে নিতে প্রস্তুত বহুজন।

সদ্য সমাপ্ত দ্বৈত-যুদ্ধের মত্ততা আর ইনটেফের ফাঁদ টপকে ট্যানাসের বেরিয়ে আসার চিত্র তখনও ঘুরপাক খাচ্ছিল মনে, আমার কোনোরকম সাহায্য ছাড়া ওর বক্তব্য শুনতে বেশ আগ্রহী হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। সত্যি বলতে, আমার সহায়তা নেয় নি বলে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে আছি, বেফাঁস কিছু না আবার বলে বসে ট্যানাস! চাতুর্য্য কিংবা ধূর্ততা ট্যানাসের মহৎ গুণাবলির মধ্যে পড়ে না।

মিশরীয় রাজ্যের প্রতীক হাতে ইঙ্গিত করলেন ফারাও, মাথা ঝাঁকিয়ে অনুমতি দিলেন বক্তব্য পেশ করার। আগ্রহের আতিশায্যে সামনে ঝুঁকে বসে জনতা, কেউ কোনো শব্দ করছে না।

আমি, শকুন-মস্তকধারী হোরাস বলছি, শুরু করে ট্যানাস, জনতা উৎসাহ জোগায় তাকে। হা-কাহ-টাহ, মিশরের বর্তমান নাম যে আদি-শব্দ থেকে এসেছে, সেটাই উচ্চারণ করলো ট্যানাস। দশ হাজার বছরের প্রাচীন এই জন্মভূমির হয়ে কথা বলছি আমি, দেবতাদের শিশুকাল থেকে যা আমাদের মাতৃভূমি। এমন দুই রাজ্যের হয়ে বলছি, যারা মূলত এক ও অভিন্ন।

মাথা নেড়ে নিজের সম্মতি জানালেন মহান ফারাও।

হায়, কৃষ্ণভূমি! বাৎসরিক বন্যায় নীল নদের পলিমিশ্রিত পানি কালো বর্ণ ধারণ করে। এই মাতৃভূমির কথা বলছি আমি, আজ যা সন্ত্রস্ত, দ্বিধাবিভক্ত; গৃহযুদ্ধে টালমাটাল, রক্তাক্ত এবং সম্পদহারা। আমার মতোই উপস্থিত জনতা থমকে যায় । অশ্রুত সত্য কথা বলছে ট্যানাস। ইচ্ছা হলো দৌড়ে মঞ্চে গিয়ে ওর মুখ চেপে ধরি। অসহায় মনে হতে লাগলো নিজেকে।

হায়, টা-মেরি! আরো একটি ভূতপূর্ব নাম যার অর্থ প্রিয় জন্মভূমি। আমার তত্ত্বাবধানে ইতিহাস ভালোই রপ্ত করেছে ট্যানাস। বুড়ো, অথর্ব সেনাপতিগণ, যারা ব্যর্থ হয়েছেন শত্রুকে রুখে দিতে; আমি তাদের কথা বলছি। প্রাচীন, অযোগ্য বুড়ো যারা নির্দ্বিধায় অপচয় করেন তরুণ রক্ত–আমি সেইসব লোকেদের কথা বলছি।

দ্বিতীয় সারিতে বসা মিশরের সাহসী সিংহ উপাধিপ্রাপ্ত নেমবেট, রাগে-আক্রোশে দাঁড়িতে হাত চালালেন। অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতিরা ভুড় কুঁচকে, অস্ত্রের খাপে আঘাত করে নিজেদের মনোভাব প্রকাশ করলেন। আর তাদের সবার মাঝখানে বসে উল্লাসের হাসি হাসছেন আমার মনিব ইনটেফ। এক ফাঁদ থেকে বেঁচে ফিরে আবারো নিজেকে ফাঁদে ফেলছে ট্যানাস।

আমাদের প্রিয় জন্মভূমি আজ শত্রুর অভয়ারণ্য, আজ তার মহতী সন্তানেরা তলোয়ার হাতে তুলে নেওয়ার বদলে নিজেদের বিকলাঙ্গ করে ফেলে, দ্বিতীয় সারিতে বাপের দুপাশে বসা লসট্রিসের দুই ভাই মেনসেট আর সোবেকের উদ্দেশ্যে কঠোর চোখে তাকালো ট্যানাস।

রাজার দেওয়া প্রত্যাদেশ অনুযায়ী কেবলমাত্র বিকলাঙ্গরা সেনাবাহিনীতে যোগদান থেকে ক্ষমা পায়, সেই কারণেই দক্ষ শল্যবিদের সাহায্যে নিজেদের বুড়ো আঙুল কেটে ফেলেছে দুই ভাই। এতে করে তলোয়ার ধরা বা ধনুক টানা কোনোটিই সম্ভব নয় তাদের পক্ষে। কর্তিত অঙ্গ প্রদর্শনে কোনো লজ্জা নেই তাদের, গর্বিত চিত্তে নদীর ধারের ছাপড়ায় জুয়া খেলে তারা।

তরুণদের জীবন নিয়ে বুড়োদের ছিনিমিনি খেলাই হলো যুদ্ধ, লসট্রিসের ভাইদের বলতে শুনেছি আমি। দেশপ্রেম ফালতু কথা। যার ইচ্ছা মরুক, আমরা যুদ্ধে যাবো না। এই হলো উন্নাসিক দুই ভাইয়ের মনোভাব।

এখন, ট্যানাসের তীর্যক মন্তব্যে অপ্রস্তুত হয়ে নিজেদের বাম হাত কাপড় দিয়ে আড়াল করে তারা। যদিও তারা দুজনেই ডানহাতি, ঘুষের বদৌলতে বাম-হাতি বলে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করেছে।

বিশাল উন্মুক্ত অংশের পেছনে বসা সাধারণ জনতা মেঝেতে পা ঠুকরে নিজেদের সম্মতি জানায় ট্যানাসের বক্তব্যে। যুদ্ধ নৌকার দাঁড় তো টানে এদেরই সন্তানেরা, এদের সন্তানেরাই মরুর প্রখর রোদে প্রহরা দেয়।

মঞ্চের পেছনে হতাশায় মুষরে পড়লাম আমি। এতক্ষণের বক্তব্যে কম করে হলেও পঞ্চাশজন প্রভাবশালী শত্রু তৈরি করেছে ট্যানাস। সামনের সারির অতিথি তাঁরা সবাই। একদিন এরাই উচ্চ-রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হবেন। মনে-প্রাণে চাইছি, এবারে থেমে যাক ট্যানাস, কিন্তু সে বলে চলে।

হায়, দেবতাগণের ভূমি! আমি বলছি সেই বর্বর আর ডাকাত দলের কথা, যারা আজ ওত পেতে আছে প্রতিটি ঝোঁপের আড়ালে, পাহাড়ের চূড়ায়। আজ কৃষককে কাজ করতে হয় বর্ম পাশে রেখে, পথিক ভ্রমণ করে অস্ত্র হাতে।

সাধারণ জনতা আবারো সমর্থন জানায় ট্যানাসের কথায়। দস্যুদলের অত্যাচারে সমগ্র মিশর আজ অতিষ্ঠ। শহরের কাদার তৈরি দেওয়ালের ওপারে আমরা সবাই অরক্ষিত। শ্রাইক নামধারী এই দস্যুরা নির্মম। আইনের কোনো বালাই নেই তাদের কাছে ।

ঠিক জনতার মনের কথা বলেছে ট্যানাস, হঠাই আমিও এক আবেগে কেঁপে উঠি। এমন আবেগেই তো যুগে যুগে ঘটেছে অভ্যুত্থান, ধ্বসে পড়েছে বহু সম্রাটের সাম্রাজ্য। ট্যানাসের পরবর্তী বাক্যে আমার সন্দেহ সত্যি হলো।

খাজনা আদায়কারীর চাবুকের তলায় কেঁদে ফিরছে গরিবেরা, আর মহৎ ব্যক্তিরা কেবল নিজেদের আরাম-আয়েশে ব্যয় করেন সময়-দর্শকসারীর পেছন থেকে একটা হুঙ্কার ওঠে, ভয়ের বদলে উত্তেজনা বোধ করতে থাকি আমি। এ কী কোনো পরিকল্পিত আচরণ? আমার জানার বাইরে ধূর্ত এবং চতুর ট্যানাস?

হোরাসের কসম! নিজের রক্তে যেনো ডাক শুনতে পাই। আমাদের জন্মভূমি এখন অভ্যুত্থানের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে। নেতৃত্ব দানে ট্যানাসের চেয়ে যোগ্য আর কে হতে পারে? মন খারাপ হলো এই ভেবে তার পরিকল্পায় আমাকে নেয় নি ট্যানাস। যতোটা চাতুর্যের সাথে আমি গীতি লিখি বা নকশা করি, জাগরণের জন্যে কী সেই রকম বাক্য আমি তৈরি করতে পারতাম না?

দর্শকের মাথার উপর দিয়ে সাগ্রহে তাকালাম, মনে মনে আশা করছি যে কোনো মুহূর্তে নিজের বাহিনী নিয়ে প্রবেশ করবে ক্ৰাতাস। ফারাও-এর মাথা থেকে দ্বৈত-মুকুট ছিনিয়ে নিয়ে ট্যানাসের রক্তাক্ত মস্তকে বসাচ্ছে ক্ৰাতাস–এই দৃশ্য কল্পনা করে আমার ঘারের ছোটো চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেলো। কতই না উত্তেজনায় তখন চিৎকার করে উঠতাম আমি, ফারাও দীর্ঘজীবী হোন! রাজা ট্যানাস দীর্ঘজীবী হোন!

ট্যানাস তখনও বলে চলেছে। ঘোরের ফেরে আমি দেখতে লাগলাম, অভ্যুত্থান হয়েছে মরুভূর বুকে। আমার ছোট্ট সোনা লসট্রিসকে পাশে নিয়ে আমাদের এই মিশরের সিংহাসনে বসে ট্যানাস, রাজ-উজিরের পদে আসীন আমি দাঁড়িয়ে তার ঠিক পেছনে। কেন যে আমাকে অন্তর্ভুক্ত করলো না সে এই পরিকল্পনায়!

তার পরবর্তী বাক্যে এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। আমার সৎ, সাধারণ, মহৎ হৃদয় ট্যানাসকে ভুল বুঝেছিলাম আমি। চাতুৰ্য্য আর প্রতারণার স্থান যার কাছে নেই।

কোনো পরিকল্পনা ছিলো না এই ভাষণের পেছনে। এ হলো নির্ভীক ট্যানাসের মনের কথা। সাধারণ জনতার উদ্দেশ্যে এবারে অনলবর্ষণ শুরু করলো সে।

আমার কথা শোনো, হে মিশর! এ কেমন দেশ, যেখানে নষ্টরা অধিকার করে আছে সমস্ত চরাচর? যেখানে দেশপ্রেমিকেরা দণ্ডিত, যেখানে প্রাজ্ঞ লোকেদের অবহেলা করা হয়? যেখানে হিংসুটে, মগজহীনেরা ছিঁড়ে ফেলতে চায় সত্যভাষীর জিভ?

কোনো শব্দ বেরোয় না কারো মুখ ফুটে। ধনী-নির্ধন, মহান-তুচ্ছ সবার মনোযোগ অধিকার করে আছে কেবল আমার ট্যানাস। কেন যে আমার সাথে পরামর্শ করলো না ও! আমি জানি কেন করে নি। সে জানতো, আমি বাধা দিতাম তাকে।

এ কেমন সমাজ যেখানে পিতাকে অবজ্ঞা করা হয়? এমন সমাজ কী চাই আমরা, যেখানে একজন ক্রীতদাস অধিকার করে রাখুক গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ? মূল্যবান সম্পদ যাক অযোগ্যের হাতে, আমরা কী এটাই চাই?

হে হোরাস, তিক্ততার সাথে ভাবলাম, আজ আর কারো নিস্তার নেই ওর ধারালো কথার কোপ থেকে। নিজে যা সত্যি এবং সঠিক মনে করছে, নিরাপত্তার কথা না ভেবে তাই বলে চলেছে ট্যানাস।

অন্তত একজন খুবই উৎফুল্ল তার এই সত্য-ভাষণে। আমার পাশে এসে হাত চেপে ধরলো লসট্রিস।

ও কী সুন্দর, তাই না টাইটা? শ্বাসের তলায় বলে সে, প্রতিটি বর্ণ সত্য। আজ রাতে ও অবশ্যই একজন তরুণ দেবতা!

ওর মন্তব্যে সায় জানানোর মতো মানসিক অবস্থা বা ইচ্ছা কোনোটাই ছিলো না আমার, দুঃখের সাথে মাথা নিচু করে শুনতে লাগলাম ট্যানাসের কথা ।

ফারাও, আপনি আমাদের পিতা। প্রতিরক্ষা আর নিরাপত্তার জন্যে আপনার কাছে দাবি জানাই আমরা। যোগ্য এবং কৌশলী লোকের হাতে দিন প্রশাসনিক কাজের ভার। গর্দভ এবং চাটুকারদের চলে যেতে বলুন তাদের আস্তকুঁড়ে। অবিশ্বাসী পুরোহিত আর ষড়যন্ত্রী শাসকদের ফিরিয়ে নিন, যারা আজ পরভোজীর মতো খেয়ে ফেলছে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি।

হোরাস জানেন, আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি পুরোহিতদের। কিন্তু কেবল মাত্র একজন চরম সাহসী বা বোকা লোকের পক্ষেই সম্ভব তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা, তাঁরা অত্যন্ত প্রভাবশালী, হিংসুটে। আর চাটুকার আর ষড়যন্ত্রীর কথা যদি বলি, আমাদের এই মাতৃভূমির শত বছরের ইতিহাসে তারা ছিলো, আর ইনটে তাদের শিরোমণি। করুণায় মন ভরে গেলো আমার প্রিয় বন্ধুর জন্যে, পুরো সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তন করার উপায় বলে যেতে লাগলো সে ফারাও-এর উদ্দেশ্যে।

প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তির কথা শুনুন! হে মহান সম্রাট, শিল্পী এবং লিপিকারের যোগ্য সম্মান দিন! সাহসী যোদ্ধা এবং বিশ্বস্ত ভত্যকে পুরষ্কৃত করুন। মরুর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলুন দস্যুর দল। সাধারণ লোকের জন্যে উদাহরণ তৈরি করুন, তাদের জীবনাচরণের সঠিক পথ দেখান। কেবলমাত্র তাহলেই আমাদের এই মিশর আবারো সুখে-শান্তিতে মহান হবে।

মঞ্চের মাঝখানে হাঁটু গেলে বসে পরে ট্যানাস, দুই হাত প্রসারিত করে বলতে থাকে। হে ফারাও, আপনি আমাদের পিতা । আমাদের সমস্ত ভালোবাসা আপনার উদ্দেশ্যে। আমাদের এই ভালোবাসার প্রতিদান দিন। আমরা প্রার্থনা করি, আমাদের দাবি পূরণ করুন।

সেই মুহূর্ত পর্যন্ত আমার ট্যানাসের নির্বোধ বাগীতায় বিভোর হয়ে ছিলাম। সংবিৎ ফিরে পেতে তাড়াতাড়ি ইশারা করলাম যেনো পর্দা টেনে দেওয়া হয়। ধীরে ভেসে উজ্জ্বল সাদা পর্দা আড়াল করে ফেললো ট্যানাসকে। অবিশ্বাসের বজ্রাঘাতে নিঃশব্দে বসে থাকে জনতা, যেনো তারা চলৎশক্তিহীন হয়ে গেছে।

স্বয়ং ফারাও ভাঙলেন এই বিভোর। দাঁড়ালেন তিনি, প্রসাধন-চর্চিত তার মুখ ভাবাবেগহীন। ধীরে, সভাসদদের সঙ্গী করে মন্দির ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। মাথা ঝুঁকিয়ে তাঁকে সম্মান জানানোর পূর্ব মুহূর্তে আমার মনিব ইনটেফের দিকে চেয়ে দেখলাম। তার চোখে-মুখে ছিলো নিঃশব্দ উল্লাস।

*

সেই রাতে মন্দির থেকে পাহারা দিয়ে ট্যানাসের বাসস্থানে দিয়ে এলাম ওকে, বন্দরের কাছে নিজের বাহিনীর সঙ্গে থাকে সে। পুরোটা সময় ওর পাশে থেকে কোমরের অস্ত্রে সতর্ক হাত রেখে চললাম, যে কোনো সময় আক্রমণের আশঙ্কা করছি। ট্যানাস কিন্তু নির্বিকার। আসলেই নিজের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে বিপদ হতে পারে, সে সম্পর্কে সে এতটুকু সচেতন নয়।

সময় হয়ে এসেছিলো, কেউ একজনকে অবশ্যই উঠে দাঁড়িয়ে বলতে হতো কথাগুলো, কি বলো টাইটা? অন্ধকার গলিপথে জোরালো প্রতিধ্বনি তুলছে তার কণ্ঠস্বর । যেনো ওত পেতে থাকা আততায়ীকে আহ্বান জানাচ্ছে। কোনো প্রত্যুত্তর করা থেকে বিরত রইলাম আমি।

নিশ্চই এটা আশা কর নি তুমি, তাই না টাইটা? সত্যি করে বল । একদম অবাক হয়ে গিয়েছিলে না?

আমরা সবাই অবাক হয়েছিলাম, এবারে সম্মত হলাম ওর কথায়। এমনকি ফারাও পর্যন্ত।

কিন্তু উনি মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন, টাইটা। সব কিছু। দারুন দেখালাম যা হোক, কী বলো?

যখনই র‍্যাসফারের পরিকল্পিত আক্রমণে ইনটেফের যোগসাজশ নিয়ে বললাম, উড়িয়ে দিলো ট্যানাস। এটা অসম্ভব, টাইটা। তোমার কল্পনা ওটা। ইনটেফ ছিলেন আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি কেমন করে এটা করতে চাইবেন? আর তাছাড়া, আমি তার মেয়েজামাই হতে যাচ্ছি, তাই না? আহত শরীর নিয়েও প্রাণখোলা হাসিতে রাতের নৈশব্দ ভাঙে ট্যানাস।

তুমি ভুল ভেবেছিলে, বলে চলে সে। র‍্যাসফার নিজেই বড়াই করে মার খেলো। উচিত সাজা পেয়েছে। এতো জোরে আমাকে আলিঙ্গন করলো ট্যানাস, ব্যথা পেলাম। তুমি আজ রাতে দুই বার বাঁচিয়েছে আমাকে। তোমার কথা না শুনলে র‍্যাসফার এতক্ষণে মেরে ফেলতো আমাকে। কেমন করে এগুলো পারো তুমি? আমি নিশ্চিত, তুমি আসলে জাদু জানো, ভবিষ্যত দেখতে পাও। আবারো জোরে হেসে উঠে সে।

এই আনন্দে আমি কেমন করে বাধা দিই? ছোট্ট একটা বালকের মতো ও, কঠোর, বিশালদেহী বালক। ওকে ভালো না বেসে পারা যায় না। নিজেকে, এবং তার প্রিয়জনদের কী বিপদে সে ফেলেছে আজ, এটা এখন তাকে বোঝানো সম্ভব নয়।

থাক, আজ সে আনন্দে বিভোর থাকুক; কাল যুক্তি দিয়ে ওকে বোঝানোর একটা চেষ্টা করে দেখবো। বাড়ি ফিরে মাথার কাটাটা সেলাই করে দিলাম, অন্যান্য ক্ষতগুলোও পরিচর্যা করতে হলো। পচনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে আমার নিজের তৈরি মধু এবং লতাগুল্মের মিশ্রণ লেপে দিলাম ক্ষতমুখে। সবশেষে, রাতের জন্যে লাল শেপেনের কড়া-মাত্রা খেতে দিয়ে ক্রাতাসের প্রহরায় রেখে এলাম তাকে।

মধ্যরাতের বহু পরে আমার প্রকোষ্ঠে ফিরে দেখি দুইজন ডাক পাঠিয়েছে আমাকে: আমার মিসট্রেস, লসট্রিস আর মুমূর্ষ র‍্যাসফার। র‍্যাসফারের দুই সঙ্গী মিলে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চললো আমাকে। ঘামে জবজব কাপড়ের উপর শুয়ে অভিশাপ আর গালাগাল বকে চলছিলো সে; সেথ এবং অন্যান্য দেবতাদের ডাকছে তার এই করুণ অবস্থা দেখে যাওয়ার জন্যে।

ওহে, টাইটা! বহুকষ্টে এক কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে মাথা একটু উঁচালো র‍্যাসফার আমাকে দেখে। এত ব্যথা-বিশ্বাস করবে না! আমার বুকে আগুন জ্বলছে। দেবতাদের কসম, সবগুলো হাড় ভেঙে গেছে, মাথায় এতো ব্যথা মনে হয় ছিঁড়ে যাবে!

চিকিৎসকই বলুন আর ক্ষত-নিরাময়কারী; একটা ব্যাপার আমি দেখেছি, আপনার সামনে কেউ কাতরাতে থাকলে সাহায্য না করে পারা যায় না, তা সে যতই র‍্যাসফারের মতো বমিজাগানিয়া জন্তু হোক না কেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চামড়ার তৈরি থলে থেকে আমার চিকিৎসাবিদ্যার সরঞ্জাম খুলে কাজে লেগে পড়লাম।

র‍্যাসফারের নিজস্ব নির্ণয় সঠিক দেখে দারুন ভালো লাগলো; প্রচুর নীলা-ফোলা আর অগভীর কাটা-ছেঁড়া ছাড়াও কমপক্ষে তিনটে বুকের হাড় ভেঙেছে তার, মাথার পেছনে প্রায় আমার মুঠোর সমান একটা ফোলা। বুকের একটা হাড় এমনভাবে ভেঙে সরে গেছে, ফুসফুঁসে ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা ছিলো। দুই বর্বর সঙ্গী ধরে রাখলো র‍্যাসফারকে, ওদিকে আমি আগের জায়গায় বসলাম ভেঙে যাওয়া হাড়টা, গুঙ্গিয়ে, হুঙ্কারে, কান্নায় আস্ফালন করে চললো র‍্যাসফার। শেষমেষ, ভিনেগারে ভিজিয়ে একটা লিনেনের পট্টি বেঁধে দিলাম বুকের চারধারে। এতে করে, ভিনেগার শুকিয়ে গেলে সংকুচিত হয়ে কাপড়টা সেঁটে থাকবে বুকে।

মাথার যেখানটায় আঘাত লেগেছিলো পাথরের মেঝেতে, সেটা দারুন ফুলে গেছে। দেবতারা মাঝে-মধ্যেই দারুন উদারতা দেখান। আলোটা তুলে র‍্যাসফারের চোখ পরীক্ষা করে বুঝলাম বড় হয়ে গেছে তার চোখের মণি। এই মুহূর্তে কী চিকিৎসা প্রয়োজন তার, বুঝতে বাকি রইলো না আমার। বিশ্রী ওই করোটির ভেতরে রক্ত জমে গেছে বর্বরটার । আমার সাহায্য না পেলে আগামী সূর্যাস্ত আর দেখা হবে না তার । কুচিন্তা যে মাথায় আসে নি তা নয়, তবে শেষপর্যন্ত একজন শল্যবিদের দায়িত্বে অবহেলা করতে পারি নি।

করোটির ভেতরের আঘাত সারাতে পারেন, সমগ্র মিশরে এমন মাত্র তিনজন শল্যবিদ আছেন। নিজের কথা বাদ দিলাম, বাকি দুজনের উপরে কোনো ভরসা নেই আমার। এবারেও র‍্যাসফারের পাষণ্ড সঙ্গীরা তাকে মুখে চেপে ধরে রাখলো মেঝেতে, বোঝাই গেলো প্রভুর প্রতি গাঢ় মায়া-দরদ নেই এদের।

র‍্যাসফারের মাথার ফোলার উপর অর্ধবৃত্তাকারে কাটলাম আমি। হাড়ের উপর থেকে চামড়ার বেশ বড় একটা চাপড়া তুলে ফেলতে হলো। দুইজন পাষণ্ড মিলেও ধরে রাখতে পারছে না রাসফারকে, ব্যথার আতিশায্যে হুঙ্কার ছাড়তে লাগলো সে, রক্তের ফোয়ারা ছাতে লেপ্টে গেলো। আমাদের সবার জামাকাপড় ভিজে একশা, যেনো লাল পক্স ধরেছে। বাধ্য হয়ে তার হাত-পা চামড়ার ফিতে দিয়ে খাটের সাথে বেঁধে রাখতে নির্দেশ দিলাম দুই বর্বরকে।

ওহে, টাইটা! কী ব্যথা, তুমি বুঝবে না। তোমার ওই ফুলের রস একটু খেতে দাও, বন্ধু। দয়া কর । বহু কষ্টে বললো র‍্যাসফার ।

হাত-পা বাঁধা হতে পরিষ্কার করে বললাম তাকে, তোমার কেমন লাগছে, আমি বুঝি। যখন আমার শরীরে ছুরি চালিয়েছিলে একটু ফুলের রস আমারও দরকার ছিলো। কিন্তু বন্ধু, আমার ওষুধের সংগ্রহ শেষ হয়ে গেছে। আগামী এক মাসেও পুব থেকে কোনো ক্যারাভান আসবে না। সানন্দে মিথ্যে বললাম। খুব কম লোকে জানে বাগানে আমি নিজেই লাল-শেপেনের চাষ করি। ব্যথার এখনও কিছুই দেখে নি র‍্যাসফার। হাড় ফুটো করার সরঞ্জাম হাতে তুলে নিলাম।

সত্যি বললে, মানুষের মস্তিষ্কের বেশিরভাগ ব্যপারই আমার কাছে বোধগম্য নয়। ইনটেফের নির্দেশে দণ্ডপ্রাপ্ত সমস্ত আসামীর শবদেহ পাঠানো হয় আমার কাছে। ট্যানাসও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহু নমুনা নিয়ে এসেছিলো আমার জন্যে। ওগুলোকে কেটে ছিঁড়ে পরীক্ষা করেছি আমি। কোনদিক দিয়ে খাবার ঢোকে আর কোনদিক দিয়েই বা বেরোয় আমি এখন জানি। ফ্যাকাসে ফুসফুঁসের থলির মাঝখানে বসবাস করে আমাদের হৃদয়। রক্ত যেইসব নদীপথ দিয়ে পুরো শরীরে ভ্রমণ করে, আমি সেগুলোকে চিনেছি; এমনকি মানুষের আবেগ-নিয়ন্ত্রণকারী দুই রকমের রক্ত আমি চিনেছি।

এক আছে উজ্জ্বল, উজ্জ্বল রক্ত, ফিনকি দিয়ে ছোটে যেটা, ঝলকে ঝলকে। ওটা ভালোবাসা আর সুন্দর ভাবনার রক্ত। আরেক আছে গাঢ়, বিষণ্ণ রক্ত–ওতে কোনো উচ্ছ্বাস নেই। এ হলো ক্রোধ আর দুঃখের রক্তকুচিন্তার তরল।

আমার এই সমস্ত পর্যবেক্ষণ একশ প্যাপিরাসের ক্কোলে লিখে রেখেছি। জ্ঞানের এই ব্যপ্তি আর কারো নেই দুনিয়ায়, মন্দিরের ওই হাতুড়ে কবিরাজগুলোর তো নেইই। দেবতা ওসিরিসের পূজো আর মোটা উপঢৌকন ছাড়া কিছুই বলতে পারে না তারা। বিনয়ের সাথেই বলছি, এমন কোনো মানুষ আমি দেখি নি আমার চেয়ে মানুষের শরীর সম্পর্কে যার জ্ঞান বেশি। কিন্তু মস্তিষ্কের ব্যপার এখনও রহস্যময় আমার কাছে। স্বাভাবিকতা থেকে আমি বুঝি, চোখ দেখে; নাক গন্ধ নেয়, মুখ স্বাদ নেয় এবং কান শোনে কিন্তু নরম-ফ্যাকাসে যে বস্তু আমাদের মাথার ভেতরে আছে তার কাজ কী হতে পারে?

আমি ভেবে বের করতে পারি নি, এমন কাউকে পাই নি যে জানে। কেবল ট্যানাস একবার একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়েছিলো। সারারাত ধরে মদ গিলেছিলাম দু জন সেদিন। সকালে ঘুম ভেঙে উঠে মাথার ব্যথায় কাতর ট্যানাস বললো, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে সেথ ওটা ঢুকিয়ে দিয়েছে আমাদের মাথার ভেতরে।

একবার, সেই ইউফ্রেতিস আর টাইগ্রিসের ওপার থেকে ক্যারাভান নিয়ে আসা এক জ্ঞানী ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। অর্ধ-বছর ধরে দুনিয়ার যত রহস্য নিয়ে তর্ক করেছিলাম আমরা দুজনে। তিনি বলেছিলেন, আমাদের অনুভূতি আসলে হৃদযন্ত্র থেকে নয়, আসে মাথার ভেতরের নরম অংশ থেকে। এমনকি, তার মতো জ্ঞানী ব্যক্তিও এতো শোচনীয় ভুল করতে পারে!

যারা একবার দেখেছেন আমাদের শরীরের মাঝখানে বসে থাকা হৃদপিণ্ডকে; যা নিজেই নিজের স্পন্দন জোগায়, যাকে ভরে তুলেছে রক্তের নদীপথ; হাড়ের আচ্ছাদন যাকে রক্ষা করে, তারা জানেন আমাদের সমস্ত চিন্তা এবং আবেগের উৎস এই ঝর্ণাধারা। জীবনেও কী আপনি অনুভব করেননি মনোরম সুরে বা কোমল মুখশ্রী দেখে অথবা সুন্দর শব্দ-বাক্য-বর্ণে আপনার হৃদয় দ্রুততর হয়েছে? কখনও মাথার ভেতরে কিছু নড়তে শুনেছেন? আমার এই অকাট্য যুক্তির কাছে পূবের সেই জ্ঞানী ব্যক্তি হার মেনেছিলো।

কোনো যুক্তিবাদী মানুষই বিশ্বাস করবে না, রক্তবিহীন এক দলা দই, একলা মাথার খাঁচায় পরে থেকে থেকে রচনা করে চলেছে কাব্য; তৈরি করছে পিরামিডের নকশা। ভালোবাসায় মানুষকে, না হয় যুদ্ধে প্ররোচিত করে। এমনকি শবদেহ প্রস্তুতকারীরা পর্যন্ত মৃতদেহ থেকে ওই বস্তু বাদ দেয়।

কিন্তু একটা অবাক ব্যপার আছে। যখনই এই অবিন্যস্ত বস্তুতে এতটুকু আঘাত লাগে, তা সে মাথার ভেতরে জমা হওয়া সামান্য তরলের চাপ হোক না কেন মানুষ বাঁচে না। তাই যে থলিতে ওগুলো জমা থাকে, তার এতটুকু অসুবিধা না করে করোটি ফুটো করতে দারুন দক্ষতার প্রয়োজন। আমার আছে সেটা।

প্রচণ্ড চিৎকার করে চললো র‍্যাসফার। ধীরে ওর মাথায় ফুটো করে হাড়ের কণা, নোংরাগুলো ধুয়ে দিতে লাগলাম ভিনেগার দিয়ে। ভিনেগারের জ্বলুনি র‍্যাসফারের চিৎকারে ইন্ধন জোগালো ।

ছোট্ট গোল একটা ছিদ্র তৈরি হতে গরম রক্তের ধারা ছিটকে বেরিয়ে আমার মুখে লাগলো। সাথে সাথেই শান্ত হলো র‍্যাসফার । দুঃখের সাথে বুঝলাম, এই যাত্রা বেঁচে যাবে অমানুষটা। মাথার ফুটোটা বন্ধ করতে করতে ভাবছিলাম এই নমুনাটাকে বাঁচিয়ে রেখে মানবজাতীর কতটা ক্ষতি করলাম আমি।

মাথায় কাপড়ের পট্টি বেঁধে রেখে এলাম রাসফারকে। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছিলাম আমি। আজকের দিনের উত্তেজনা এবং বিস্ময় আমার সমস্ত শক্তি শুষে নিয়েছে। কিন্তু নিস্তার নেই আমার। চাতালের ধাপে পা রাখতেই লসট্রিসের বার্তাবাহক তাগাদা দিতে লাগলো তার কাছে যাওয়ার জন্যে। কেবল র‍্যাসফারের রক্ত ধুয়ে একটু সাফ-সুতরা হয়ে নেওয়ার সময় পাওয়া গেলো।

প্রাণান্ত কষ্টে, পা টেনে টেনে যখন পৌঁছুলাম লসট্রিসের আঙ্গিনায়; ভীষণ চেহারা, রক্তচক্ষু নিয়ে চাইলো লসট্রিস। কোথায় লুকিয়েছিলেন আপনি, প্রভু টাইটা? সেই দ্বি প্রহরে আপনাকে আনতে লোক পাঠিয়েছি, আর এখন তো প্রায় সকাল হয়ে এলো । কত বড় সাহস তোমার? মাঝে-মধ্যে নিজের অবস্থান ভুলে যাও। অবাধ্য দাসের শাস্তির কথা জানো তুমি–এতক্ষণ অপেক্ষার কারণে রাগে ফুঁসছিলো লসট্রিস। অসামান্য রূপসী তার রাগ, পা মাটিতে ঠুকে যে জেদ প্রকাশ করলো, তা একান্তই তার ভঙ্গিমা। ভালোবাসা উথলে উঠতে লাগলো আমার হৃদয়ে।

ওখানে দাঁড়িয়ে বোকার মতো হেসো না! জ্বলে উঠলো সে, এত রাগ করেছি, তোমাকে শূলে চড়াতে পারি। আবারো মাটিতে পা ঠুকলো লসট্রিস, অনুভব করলাম আমার সমস্ত ক্লান্তি কেটে গেছে। কেবল ওর উপস্থিতি আমাকে নতুন জীবনীশক্তি দেয়।

মিসট্রেস, কী অসাধারণ অভিনয় করলে তুমি আজ! আমাদের সবার মনে হচ্ছিলো যেনো সত্যিকারের দেবী এসেছেন।

চালাকি করো না, তৃতীয়বারের মতো মাটিতে পা ঠুকলো লসট্রিস, তবে এবারে রাগ পড়ে এসেছে তার। এতো সহজে পার পাবে না আজ।

সত্যি, মিসট্রেস, মন্দির থেকে প্রাসাদে ফেরার সময় শুনেছি; রাস্তার সবার মুখে কেবল তোমার কথা। ওরা বলছিলো, এতো সুন্দর গান কখনও শুনে নি। মুগ্ধ হয়ে গেছে তারা।

একটা বর্ণও বিশ্বাস করি না, ঘোষণার সুরে বললো লসট্রিস। রাগ ধরে রাখতে পারছে না। আমার তো মনে হয়, আজ রাতে আমার গলা সবচেয়ে বিশ্রী ছিলো। অন্ততঃ একবার স্বর উঠাতে পারছিলাম না।

তা নয়, মিসট্রেস। এতো ভালো কখনও ছিলো না কারো কণ্ঠস্বর । আর সৌন্দর্য্য। পুরো মন্দিরে যেনো আলো জ্বেলে দিয়েছিলে । লসট্রিস যত রাগই করুক, ও তো শেষ পর্যন্ত একটা মেয়ে।

তুমি জঘন্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো সে। সত্যি, এবার তোমাকে শাস্তি দেবো ভেবে রেখেছিলাম। এখন আমার পাশে বসে আজকের সব কথা শোনাও। ওহ, মনে হয় আরো এক সপ্তা ঘুমাতে পারবো না। আমার হাত ধরে টেনে বিছানার দিকে এগুলো লসট্রিস। বকবক করে চলেছে, কেমন করে সত্য-নির্ভিক ভাষণে এমনকি ফারাও-কে মুগ্ধ করে ফেলেছে ট্যানাস, সবাই তো ভালবাসে তাকে, কেমন করে শিশু-হোরাস তার কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছিলো, সত্যিই কী আমি মনে করি ও অসাধারণ কাজ করেছে এইসব।

শেষমেষ ওকে থামালাম আমি। মিসট্রেস, সকাল হয়ে এলো বলে। আগামীকাল রাজার সঙ্গে নদীর ওপারে যেতে হবে, সমাধি-নির্মাণ কাজ দেখবেন তিনি। এতো

গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে অতি অবশ্যই দারুন দেখাতে হবে তোমাকে।

কিন্তু আমার তো ঘুম আসছে না, টাইটা, প্রতিবাদ করলে লসট্রিস। বকবক করতে করতে কিছুসময় পর আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো।

ধীরে, ওর মাথাটা বিছানায় রেখে পশম দিয়ে ঢেকে দিলাম আমি। চুমো খেলাম কপালে । সাথে সাথেই যেতে পারলাম না, বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখ না খুলেই বিড়বিড় করে বললো লসট্রিস, কাল কী রাজার সঙ্গে আমি একটু কথা বলতে পারবো? উনি পারবেন বাবাকে বাধা দিতে যেনো ট্যানাসকে দূরে না পাঠান তিনি।

কোনো সদুত্তর জোগালো না ঠোঁটে। আমার বিমুগ্ধ দৃষ্টির সামনে ঘুমে তলিয়ে গেলো লসট্রিস।

*

সকাল হতে বহুকষ্টে নিজেকে টেনে তুলতে হলো, যেনো এই মাত্র বিছানায় পিঠ লাগিয়েছিলাম। সবার শেষে যোগ দিলাম ফারাও-এর শোভাযাত্রায়, কিন্তু এমনকি লসট্রিসও লক্ষ্য করলো না আমার দেরিতে আগমন। রাজকীয় জলযানের পাটাতনে অবস্থান নিয়েছে সে। স্থির দাঁড়িয়ে ওকে দেখলাম কিছুক্ষণ।

আজ রাজকীয় মহিলাদের সঙ্গে বসেছে সে, রাজার পত্নী, তাঁর বহু উপপত্নী এবং কন্যাদের সাথে। হামাগুড়ি দেওয়া শিশু থেকে শুরু করে বিবাহযোগ্য কন্যা আছে। আমাদের ফারাও-এর, এরাই মূলত তাঁর মনোকষ্টের কারণ। ছেলে ছাড়া কেমন করে তাঁর রাজকীয় রক্তধারা রক্ষিত হবে?

আমারই মতো লসট্রিসও এক কি দুই ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারে নি, কিন্তু আশ্চর্য হলো, আমার বাগানের মরু-ফুলের মতো মিষ্টি আর সজিব দেখাচ্ছে তাকে। বেছে

বেছে পছন্দ করা ফারাও-এর পত্নী, উপপত্নীদের মাঝে ও যেনো অতিমাত্রায় সুন্দর।

ট্যানাসের খোঁজে সামনে দৃষ্টি বোলালাম । ফারাও-এর নদী অতিক্রম পাহারা দিতে ইতিমধ্যে সামনে চলে গেছে তার গ্যালি। উদিয়মান সূর্যের প্রতিবিম্ব পড়েছে নদীর বুকে, চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয় যেন। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে হলো।

ঢাকের শব্দের সাথে ফারাও-এর জলযানে আগমন ঘোষিত হলো। আজ সকালে সোনার চওড়া পট্টি সমেত হালকা মুকুট, নেমেস পরেছেন ফারাও। উৎসব হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মুখে কোনো প্রসাধনের চিহ্ন নেই, সকালের কড়া সূর্যের আলোয় দারুন সাধাসিধা দেখাচ্ছে তাঁকে। চিন্তাক্লিষ্ট, বিশালবপু, বয়স্ক একজন ক্ষয়িষ্ণু দেবতা।

আমার দাঁড়ানোর স্থান অতিক্রম করার সময় মৃদু মাথা ঝাঁকালেন ফারাও, তার ইঙ্গিতে পাথরের হাঁটা-পথে উঠে এলাম। নিচু হয়ে তিনবার মাথা ঠেকালাম পবিত্র পদ যুগলের কাছে।

তুমিই কী সেই টাইটা, কবি? মেয়েদের মতো তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইলেন ফারাও।

আমি ক্রীতদাস টাইটা, মহান ফারাও, উত্তরে বললাম। তবে আমি একজন মামুলি লিপিকারও বটে।

হুম, ক্রীতদাস, কাল তোমার মামুলি লিপি মুগ্ধ করেছিলো আমাদের। কোনো গীতিনাট্যে এতো মজা আর কখনও পাই নি। আজ থেকে তোমার নাটকের সংস্করণই হবে রাজ্যের আনুষ্ঠানিক সংস্করণ।

সবার শোনার মতো করে জোরে কথা কটা উচ্চারণ করলেন ফারাও, এমনকি আমার মনিব ইনটেফ পর্যন্ত আন্দোলিত হলেন এই ঘোষণায়। যেহেতু আমি তার দাস, সম্মান তার আমার চেয়ে বেশি-বই-কম নয়! কিন্তু কথা এখনও শেষ করেন নি ফারাও।

তুমিই কী সেই শল্যবিদ টাইটা নও, যে আমাকে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে?

জ্বী, মালিক, আমিই সেই দাস যে মাঝে-মধ্যে ওষুধের অনুশীলন করে থাকি।

বলো তো, কবে থেকে তোমার ব্যবস্থা কাজ শুরু করবে? গলা নামিয়ে বললেন ফারাও। কেবল আমি শুনতে পেলাম কথাটা।

মালিক, আমার দেওয়া ব্যবস্থা পুরোপুরি পালন করা হলে নয় মাস সময় লাগবে এতে, যেহেতু এই মুহূর্তে চিকিৎসক-রোগী সম্পর্কে আছি ফারাও-এর সাথে, আমি যোগ করলাম, আমার নির্দেশিত খাবার খাওয়া হচ্ছে?

আইসিস-এর বিরাট বুক-জোড়ার কসম! চোখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেলো রাজার। এ-ত ষাঁড়ের বিচি খেয়ে ফেলেছি, একেকবার মনে হয় প্রাসাদের কোনো গাভীর পাল দেখে না ডাক দিয়ে বসি!

তার এহেন মানসিকতায় আমিও একটু তামাশা করার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমার বর্ণনা মতো মেয়ে পেয়েছেন?

হায়, এতো যদি সহজ হতো। সুন্দর ফুলের গন্ধে মৌমাছি একটু তাড়াতাড়ি আসে । তুমি তো বলেছো মেয়ে যেনো পুরোপুরি অনাঘ্রাতা হয়,তাই না?

কুমারী এবং অনাঘ্রাতা, রজঃচক্রের প্রথম বছরের মধ্যেই, দ্রুত যোগ করলাম, যতোটা সম্ভব কঠিন করতে চাইছি আমার ব্যবস্থা। এমন কাউকে খুঁজে পেয়েছেন, মালিক, যার সাথে বর্ণনা মেলে?

পাল্টে গেলো ফারাও-এর মুখাবয়ব। চিন্তান্বিতভাবে হাসলেন তিনি। বিষণ্ণ অবয়বে কেমন অদ্ভুত দেখালো হাস্যমুখর মুখ। দেখা যাক, বিড়বিড় করে আউড়ালেন ফারাও। ঘুরে দাঁড়িয়ে রাজকীয় জল্যানে উঠার ধাপে পা রাখলেন। আমার মনিব, ইনটেফের ইশারায় আমিও সঙ্গী হলাম তাদের পিছুপিছু।

রাতে ধরে এসেছে বাতাস, গাঢ় তেলতেলে দেখাচ্ছে পানির রঙ, কেবল মাছরাঙা আর পাখিদের হঠাৎ আলোড়ন ছাড়া সম্পূর্ণ শান্ত নীল নদ। এমনকি নেমবেট-এর পক্ষেও এ অবস্থায় নদী পারাপার কোনো সমস্যা নয়। এরপরেও ট্যানাস রয়েছে। প্রহরায়, যেনো কোনো অযাচিত বিপদে উদ্ধার করতে পারে।

পাটাতনে পৌঁছুতে আমাকে কাছে টেনে নিলেন ইনটেফে। এখনও মাঝে-মাঝে আমাকে অবাক করে দাও তুমি, প্রিয়, ফিসফিস করে বলে আমার হাত মুচড়ে দিলেন। তোমার বিশ্বস্ততা নিয়ে ঠিক যখন সন্দেহ করছিলাম, চমকে দিলে।

তার এহেন ভালো আচরণে অবাক না হয়ে পারলাম না। রাসফারের চাবুকের ক্ষত এখনও দগদগ করছে আমার পিঠে । যাই হোক, মাথা ঝুঁকিয়ে ভাবাবেগ গোপন করে অপেক্ষায় রইলাম, কী বলতে চান ইনটেফ–বোঝার চেষ্টা করছি। অবশেষে মুখ খুললেন তিনি।

ফারাও-এর সামনে বলার জন্যে এরচেয়ে ভালো ঘোষণা মনে হয় চাইলে আমিও তৈরি করতে পারতাম না। ট্যানাসের কথা বলছি। গর্দভ র‍্যাসফারের কারণে বরবাদ হতে যাওয়া রাতটা তুমিই রক্ষা করলে। এতক্ষণে সবকিছু পরিষ্কার হতে শুরু করেছে আমার কাছে। ইনটেফের ধারণা ট্যানাসের জ্বালাময়ী বক্তৃতা আমি প্রস্তুত করেছি, তার সুবিধার জন্যে। মন্দিরের কোলাহলের কারণে ট্যানাসের উদ্দেশ্যে আমার সতর্কবাণী শুনতে পান নি।

আপনি খুশি হয়েছেন জেনে আমি আনন্দিত, মালিক। ফিসফিস করে প্রত্যুত্তরে বললাম। স্বস্তি বোধ করছি। আর যাই হোক, আমার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় নি। কিন্তু নিজের কথা নয়, আমি ট্যানাস আর লসট্রিসের প্রেমের পরিণতি নিয়ে ভাবছিলাম। সামনের দিনগুলোতে আমার সাহায্য বড়ো বেশি প্রয়োজন ওদের। অন্তত কিছু সাহায্য করার সামর্থ এখনও আছে আমার চিন্তাটা স্বস্তি জাগালো মনে।

এতো আমার দায়িত্ব ছিলো, মালিক।

তথ্‌-এর মন্দিরের পেছনে, খালের ওপাশের জায়গাটার কথা মনে আছে? একবার আলাপ করেছিলাম ওটা নিয়ে? বললেন ইনটেফ।

জ্বী, মালিক। গত দশ বছর ধরে ওটার মালিকানা পাওয়ার জন্যে প্রাণ আঁই-ঢাই করছিলো আমার। লেখালিখির জন্যে ওর চেয়ে সেরা জায়গা আর হয় না। বুড়ো বয়সে বিশ্রামের জন্যেও আদর্শ।

ওটা এখন থেকে তোমার। সময় করে কাগজ নিয়ে এসো, স্বাক্ষর করে দেবো। কল্পনাপ্রসূত ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণের কারণে এতো বড় পুরস্কার পেয়ে যাবো আমি কখনও ভাবি নি। এক মুহূর্তের জন্যে উপহার ফিরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা হয়েছিলো। কিন্তু ওই এক মুহূর্তের জন্যেই। সংবিৎ ফিরে পেতে দেখলাম, ফারাও মামোসের নির্মাণাধীন সমাধিক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে নদীর ও মাথার খালের কাছে চলে এসেছি।

এখানেই মমি করা হবে মহান ফারাও-এর শবদেহ। স্থপতিদের সাহায্য না নিয়ে আমি নিজে নকশা করেছি নীল নদ থেকে আসা খালগুলোর। আমার ধারণা, গজ-দ্বীপে নিজের আলিশান প্রাসাদে মৃত্যুর পর রাজকীয় জলযানে করে নিয়ে আসা হবে মহান ফারাও-এর শবদেহ। তাই বিশাল এই জলযানের আকৃতির কথা মনে রেখে চওড়া করে কাটা হয়েছে খালগুলো।

আমার ছোরার ফলার মতো সোজাসুজি সমভূমির ভেতর দিয়ে চলে গেছে খাল, দুই হাজার ফুট সামনে সেই কঙ্কালসার সাহারা প্রদেশের পাহারশ্রেণীর পাদদেশ পর্যন্ত । বহু বছর ধরে, বহু শ্রমিকের ঘাম-ঝরা প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে এই পাথর বাঁধানো জলপথ। দুই পাশের পাড়ে দাঁড়িয়ে জাহাজে বাধা দড়ি ধরে টেনে নিয়ে চললো দাস বাহিনী; করুণ সুরের গান তাদের কন্ঠে । দুই ধারের জমিতে কাজ করতে থাকা কৃষকের দল ছুটে এলো ফারাও-কে অভ্যর্থনা জানাতে। অবশেষে, নিখুঁতভাবে জাহাজ ঘায় ভীড়লো রাজকীয় জলযান।

ইনটেফের আহ্বানে তাঁর জন্যে তৈরি কাঠের বিশাল বাহনে চড়ে বসলেন ফারাও। স্বর্ণ-মণ্ডিত এই অতিকায় বাহনে করেই বহন করা হবে তাঁর রাজকীয় শবাধার। অবুঝের মতো চকচক করছে ফারাও-এর চোখ; খুশিতে, উত্তেজনায়। তার বিষণ্ণ জীবনে হয়তো এটাই একমাত্র আনন্দের খোরাক–অন্ততঃ এই মুহূর্তে। দুঃখ হলো তার জন্যে। জীবনের সমস্ত শক্তি, প্রচেষ্টা দিয়ে মৃত্যুকে বরণ করার পূর্ব পরিকল্পনায় মত্ত আমাদের মহান নেতা।

যেন ঘোরের বসেই, ইনটেফ-কেও তাঁর রাজকীয় বাহনে ডেকে নিলেন ফারাও। এরপরে মুখ নিচু করে কিছু একটা বললেন রাজ-উজিরের কানে।

হেসে, লসট্রিসের উদ্দেশ্যে ইশারা করলেন ইনটেফ। স্পষ্টতঃই, লজ্জায়, উত্তেজনায় লাল হয়ে গেছে লসট্রিস। খুবই অদ্ভুত ব্যপার, সাধারণত নিজেকে অপ্রস্তুত অবস্থায় খুব কমই আবিষ্কার করেছে মিসট্রেস। অবশ্য দ্রুতই সামলে নিতে পারলো ও, মৃদু হাসির সাথে তার লম্বা পায়ের মোহনীয় ভঙ্গিমায় এগিয়ে গিয়ে চড়ে বসলো ফারাও-এর পালকিতে।

রাজার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে তিনবার মাথা ঠুকলো তাঁর পায়ের কাছে। এরপর, তাবৎ সভাসদ আর মন্দিরের সমস্ত পুরোহিতের সামনে অদ্ভুত একটা আচরণ করলেন ফারাও। নিচু হয়ে লসট্রিসের হাত নিজের হাতে তুলে নিলেন তিনি, ধরে বসিয়ে দিলেন নিজের পাশে। মহান ফারাও-এর রাজকীয় আচরণের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এটা। তার মন্ত্রীরা সবাই মুখ চাওয়া-চাউয়ি শুরু করে দিয়েছে।

আরও কিছু ঘটেছিলো ওখানে সেদিন, যা কেউ টের পায় নি। আমার বাল্যকালে, বধির একজন দাসের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিলো। ও আমাকে শিখিয়েছিলো কেমন করে শব্দ না শুনে কেবল ঠোঁটের নড়াচড়া দেখেই মানুষের কথা আঁচ করা যায়। অসাধারণ জ্ঞান এটা আমি আত্মস্থ করেছিলাম পুরোপুরি।

আর এখন, আমি জানি ফারাও গলা নামিয়ে আমার মিসট্রেসকে বলছেন, মন্দিরের মশালের আলোয় আইসিস যেমন স্বর্গীয়, আজ সূর্যালোকেও তুমি ঠিক তাই।

যেনো ঘুষি খেলাম পেটে। আমি কী অন্ধ ছিলাম, না আহাম্মক হয়ে গেছি? একটা গর্দভও বুঝতে পারতো আমার দেওয়া ব্যবস্থা ফারাও-কে কোন দিকে চালিত করছে।

নিঃসন্দেহে, আমার পরামর্শ লসট্রিসের দিকে মনোযোগ সরিয়ে দিয়েছে ফারা এর। রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দরী নারী, রজঃচক্রের কেবল প্রথম বছর চলছে যার–এ যে লসট্রিস স্বয়ং। আর কাব্যনাট্যে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতে দিয়ে দারুন উপাদেয়রূপে রাজার সামনে তাকে উপস্থাপন করেছি আমি।

হঠাৎ বুঝলাম, যা ঘটতে চলেছে তার দায়ভার সম্পূর্ণই আমার। কিছু করার নেই আর । হতবাক, নির্বোধ আমি দাঁড়িয়ে রইলাম সূর্যালোকে।

অবশেষে যখন ঘর্মাক্ত কলেবরে পুরোহিতেরা কাঁধে তুলে নিলেন রাজার পালকি, চমক ভাঙল আমার । কিছু বোঝার আগেই দেখি সমাধি-মন্দিরের আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে আছি। রাজকীয় সমাধি-স্থানের দরোজায় ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিয়ে পালকির পাশে এসে থামলাম। পুরোহিতদের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে লসট্রিসের অবস্থানের ঠিক নিচে চলে এলাম। ইচ্ছে করলে ওর হাত ছুঁতে পারি এখন। ওর সব কথা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি। নিজেকে পুরোপুরি সামলে নিয়ে এখন রাজার সঙ্গে স্বতস্ফুর্ত হাসি আর বাক্যলাপে মগ্ন লসট্রিস। মনে পড়লো, গত রাতে ঠিক এ-ই করতে চাইছিলো সে; ফারাও-কে মুগ্ধ করে তার এবং ট্যানাসের পরিণয়ের রাস্তা তৈরি করা। হায় অপরিণত মন! আজ, এই মুহূর্তে, গত রাতের মতো ওর পরিকল্পনা উপেক্ষা করতে পারছি না। অবুঝ মেয়েটা জানে না, কোন বিপদজনক পথে হাঁটছে সে। অসাধারণ যে কাহিনী বলছি আপনাদের, তাতে যদি শুরুতেই জানিয়ে দিতাম, লসট্রিসের কাঁচা মনে কেবল আবেগী হাওয়া বয়–তবে ঐতিহাসিক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করা হতো না। আমি সত্যের অপলাপ করবো না বলে পণ করেছি, কিছুতেই ভাঙবো না এই প্রতিজ্ঞা। এতো অল্প বয়সেও লসট্রিস ছিলো অত্যন্ত বিচক্ষণ মেয়ে। আমাদের মিশরের মেয়েরা নীলের জলে-বাতাসে দ্রুত বেড়ে উঠে। লসট্রিস শুধু মনোযোগী ছাত্রী নয়, উজ্জ্বল মনের অনুসন্ধিৎসু একজন নারীও বটে। আমি, টাইটার পরিচর্যাতেই বিকশিত হয়েছে। ওর সমস্ত গুণাবলি।

আমার তত্ত্বাবধানে ও এমন অবস্থানে পৌঁচেছে, ইচ্ছে করলেই মন্দিরের বিজ্ঞ পুরোহিতদের সাথে ধার্মিক তত্ত্ব নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা করতে পারে। প্রাসাদের গ্রন্থাগারের প্রায় প্রতিটি স্ক্রোল পড়ে ফেলেছে ও, তার মধ্যে আমার রচিত প্রায় এক হাজারেরও বেশি স্ক্রোল আছে। চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্তই হোক বা নৌযুদ্ধের কৌশল; অথবা জোতির্বিজ্ঞান, তীর-চালনা, তলোয়ার চালনা বিষয়ক সবকিছুই আগ্রহ নিয়ে পড়েছে লসট্রিস। এমনকি, আমার স্থাপত্য-কৌশলের সঙ্গে মহান ইমহোটেপ-এর কৌশলের তুলনা পর্যন্ত করতে পারঙ্গম আমার মিসট্রেস।

কাজেই, ফারাও-কে মুগ্ধ করবার মতো সব বিষয়েই অনর্গল বলতে পারে সে। ওর শব্দ-ভান্ডার বিশাল; ধাঁধা, কৌতুক আর ছন্দ্য-বাক্যে ফারাও মোহাবিষ্ট হয়ে রইলেন পুরোটা সময়। মিসট্রেসের সুললিত কণ্ঠ, তার মাদক হাসি যে কোনো পুরুষকে প্রলুব্ধ করবে। কী দেবতা, কী মানব কোথাও নেই এমন সুষম সৌন্দর্য । আর যখন ক্ষয়িষ্ণু একজন মানুষের কাছে পুত্র সন্তানের উত্তরাধিকারের মতো আরাধ্য ব্যপার অর্জিত হতে পারে তার মাধ্যমে প্রলোভন সামলানো অসম্ভব বইকি।

যেমন করেই হোক ওকে সতর্ক করতে হবে। কিন্তু একজন তুচ্ছ দাস কেমন করে অসীম উচ্চতার মানুষজনের আলাপে বিঘ্ন ঘটাতে পারে? লসট্রিসের কিন্নর কণ্ঠ শুনতে শুনতে চিন্তাক্লিষ্টভাবে হেঁটে চললাম আমি।

প্রায় দুপুর গড়িয়ে এলো ফারাও-এর সমাধি-মন্দিরের কাজ পরিদর্শন শেষ হতে। মন্দিরের আঙ্গিনায় সবার জন্যে উন্মুক্ত ভোজের আয়োজন করা হয়েছে।

এসো, এখানে কাছে এসে বসো, নক্ষত্ররাজি নিয়ে কথা বলবো আমরা! আবারো রাজকীয় আচরণ লঙ্ঘন করে তার জেষ্ঠ স্ত্রীকে সরিয়ে দিয়ে লসট্রিসকে পাশে বসালেন ফারাও। খাবারের পুরোটা সময় তার মনোযোগ অধিকার করে রাখলো লসট্রিস। রাজা তো বটেই, আশেপাশের সবাই তন্ময় হয়ে শুনলো তার কথা।

দাস হওয়ায় ভোজে অংশগ্রহণের যোগ্য নই আমি। লসট্রিসকে সতর্ক করার আর কোনো উপায় রইলো না। পাথরের একটা সিংহের মূর্তির পদতলে বসে সবার দিকে নজর রাখলাম পুরোটা সময় । আমি একা নই, নিজের বিছানো জালের কেন্দ্রে বসে থাকা মাকড়শার মতোই নিরাসক্তভাবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলেন ইনটেফ। অদ্ভুত রকম জ্বলছিলো তার চোখ দুটো।

খাবারের এক পর্যায়ে এসে লম্বা, হলুদ ঠোঁটের একটা চিল মাথার উপরে ডেকে উঠেছিলো। যেনো উপহাসের তীক্ষ্ণ হাসি হাসছিলো ওটা। খারাপ শক্তির বিপরীতে চিহ্ন আঁকলাম বুকে। কে বলবে, কোন্ দেবতা ওই চিলের ছদ্মবেশে এসে কী অভিশাপ দিয়ে গেলো?

ভোজের পর এক ঘন্টা বিশ্রাম করাই রীতি, আর বছরের এই সময়ে তো সেটা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এতটাই তরতাজা বোধ করছিলেন মহান ফারাও, সেটা পর্যন্ত নিতে অস্বীকার করলেন। ধন-সম্পদ দেখবার বাসনা প্রকাশ করলেন তিনি। মুকুট লাভের পর থেকেই, গত বারো বছর ধরে সমাধির জন্যে সম্পদ সংগ্রহ করা হচ্ছে তার জন্যে। এর সবই রক্ষিত আছে ছয়টি বিরাট প্রকোষ্ঠে।

প্রথম প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলেন ফারাও। এতে রয়েছে যুদ্ধ আর শিকারে ব্যবহৃত সমস্ত অস্ত্রাদি। নিজের সঙ্গে করে ওগুলোকে পরজগতে নিয়ে যাবেন মহান ফারাও, যদি তার প্রয়োজনে লাগে সেখানে। ইনটেফের নির্দেশে নিচু কাঠামোর উপরে এক এক করে সেগুলোকে সাজিয়ে রেখেছি আমি, যাতে করে ভালোভাবে দেখতে পান ফারাও।

ওগুলো পরিদর্শনের সময় এতো বেশি কৌশলগত প্রশ্ন করছিলেন তিনি, মন্দিরের পুরোহিত আর রাজকীয় সভাসদেরা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে এদিক-সেদিক চাইতে লাগলেন, যেনো আশা করছেন তাদের হয়ে কেউ ফারাও এর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেবে। শেষমেষ আমাকে ডেকে পাঠানো হলো। হন্তদন্ত হয়ে সামনে ছুটে গেলাম আমি, রাজার প্রশ্নবানের সামনে।

হুমম, আমাকে দেখে কপট তামাশার ভঙ্গিতে ভুড় কুঁচকালেন ফারাও। আরে, এ যে দেখছি সেই বিশ্বস্ত দাস, যে কিনা আবার নাটক লেখে রোগও সারায়! বলো দেখি, আমার জন্যে তৈরি করা যুদ্ধ ধনুকের ছিলো কোন বস্তু দিয়ে তৈরি?

মহান ফারাও, এক ভাগ তামা পাঁচ ভাগ রুপা আর চারভাগ সোনা দিয়ে তৈরি ওটা। কেবলমাত্র লট-এর খনিতে, সেই পশ্চিমের মরুতে পাওয়া যায় এই লাল সোনা। আর কোনো বস্তুই এতো ঘাতসহ, স্থিতিস্থাপক নয়, জনাব।

আচ্ছা! দুষ্ট বাচ্চাদের মতো সায় দিলেন ফারাও। কিন্তু ওটা এতো সরু করে তৈরি করলে কিভাবে? ঠিক আমার মাথার চুলের মতো?

মালিক, বিশেষভাবে নকশা করা পেন্ডুলামের মধ্য দিয়ে ধাতুটাকে গলিয়ে করা হয়েছে কাজটা। মালিক চাইলে পরে আপনাকে পুরো ব্যবস্থা দেখানো যাবে।

এর পর থেকে পরিদর্শনের বাকি সময় রাজার পাশে থাকার সুযোগ হলো আমার, কিন্তু লসট্রিসের সাথে একা কথা বলার কোনো উপায় পেলাম না।

অস্ত্রশালার বিপুল পরিমাণ বিচিত্র অস্ত্রের সবটুকু দেখলেন ফারাও। এর অনেকগুলো তাঁর পূর্বপুরুষের ব্যবহৃত। বিখ্যাত বহু যুদ্ধের সময়ে কাজে লেগেছিলো। আর বাকিগুলো সদ্য তৈরি, কখনই কোনো যুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না। প্রত্যেকটি বস্তুই গুণে অনন্য, একজন অস্ত্র বিশারদের শ্রেষ্ঠ কাজ। তামা, সোনা আর রুপার তৈরি মাথার আচ্ছাদন, বুকের বর্ম; হাতির দাঁতের হাতলওয়ালা তলোয়ার মূল্যবান পাথরে সজ্জিত; রাজার বিশেষ বাহিনীর প্রধানের পোশা; জলহস্তি এবং কুমীরের চামড়ায় তৈরি বর্ম প্রতিটি বস্তু স্বর্ণ-খচিত । অসাধারণ এক প্রদর্শনী।

অস্ত্রশালা ছেড়ে এবারে আসবাবপত্রের প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলেন ফারাও। ওখানে একশ জন আসবাব-শিল্পী সিডার, একাশিয়া আর মূল্যবান ইবোনি কাঠের তক্তা দিয়ে ফারাও-এর শেষযাত্রার জন্যে বিছানা তৈরি করছে। আমাদের এই উর্বর জনপদে বৃক্ষ জন্মে খুব কম, কাঠ আমাদের জন্যে বিলাসী দ্রব্য দারুন মূল্যবান। নিঃসন্দেহে এখানকার প্রতিটি কাঠের গুঁড়ি এসেছে সুদূর কোথাও হতে; মরুর ওপার থেকে, নয়তো দক্ষিণের ওই রহস্যময় এলাকা থেকে। উঁচু করে জমা করা হয়েছে কাঠের গুঁড়ি গুলো, যেনো খুবই সহজলভ্য একটি বস্তু ওটি। কাঠের গুঁড়োর গন্ধে মৌ মৌ করছে পুরো প্রকোষ্ঠ ।

আমাদের সম্মুখেই শ্রেষ্ঠ মুক্তো দিয়ে ফারাও-এর অন্তিম-শয্যার মাথার অংশের কাজ শেষ করলেন শিল্পী। বাকিরা মিলে কেদারা এবং বসার অন্যান্য আসবাবের অলঙ্করণের কাজ করে চললো। রুপার সিংহ আর সোনার বাজপাখি দিয়ে সজ্জিত হতে লাগলো প্রতিটি আসবাব। এমনকি গজদ্বীপে, রাজপ্রাসাদেও এতো নিখুঁত বস্তু নেই।

আসবাবপত্রের প্রকোষ্ঠ ছেড়ে এবারে ভাস্কর্যের প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলাম আমরা। মার্বেল, গ্রানাইট আর স্যান্ডস্টোনের খন্ড নিয়ে কাজ করে চলেছেন ভাস্করেরা। তাদের ছেনি, হাতুরি, বাটালের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে পাতলা ধুলো ভাসছে বাতাসে। মুখে কাপড় বেঁধে চলছে পাথর খোদাই-এর কাজ। পাতালা, সাদাটে ধুলোয় আপাদস্তক ঢাকা একেকজন শুষ্ক কাশি কাসছেন থেকে থেকে। এ রোগ সাড়বে না। ত্রিশ বছর ধরে ভাস্করের কাজ করা এক ব্যক্তির দেহ কেটে দেখেছি আমি; তার ফুসফুঁসে পাথরের কণা জমা হয়ে গিয়েছিলো। যত দ্রুত সম্ভব সরে এলাম ওখান থেকে।

তাদের কাজ অসাধারণ, সন্দেহ নেই। ফারাও এবং অসংখ্য দেব-দেবীর মূর্তিগুলো দেখে মনে হয়, যেনো এখনই কথা বলে উঠবে। সিংহাসনে উপবিষ্ট ফারাও, হেঁটে চলেছেন; কী দেবতার বেশে, কী মানবের রুপে মহান ফারাও-এর অসংখ্য বিশালাকায় মূর্তি রয়েছে সেখানে। লম্বা যে গলিপথ চলে গেছে সেই কালো পাহাড় পর্যন্ত, তার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয়েছে মূর্তিগুলো। তাঁর মৃত্যুর পরে স্বর্ণ মন্ডিত কাঠের বাহন টেনে নেবে একশ সাদা ষড়। বিশাল শবাধারের ওজন টানে, এমন সাধ্যি কোনো মানুষের নেই।

পাথুরে শবাধারের নির্মাণ এখনও শেষ হয়নি পুরোপুরি। ভোলা কক্ষের মাঝখানে রয়েছে সেটা। আসুনের খনি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিলো গোলাপী গ্রানাইটের এই একক খন্ডটি। বিশেষ জলযানে করে নিয়ে আসা হয়েছিলো তখন। পাঁচশো দাস লেগেছে তীর থেকে টেনে ওটাকে ভেতরে নিয়ে আসতে। এখন এই বিশাল গ্রানাইটের খন্ড খোদাই করা হচ্ছে যাতে করে ফারাও-এর কফিন এটে যায় ভেতরে। মোট সাতটি কফিন নির্মাণ করা হবে এর ভেতরে, সাত একটি পবিত্র সংখ্যা বলে গণ্য করা হয়। সবচেয়ে ভেতরের কফিনটি হবে সম্পূর্ণ সোনায় নির্মিত। পরবর্তীতে সেটার নির্মাণও দেখেছিলাম আমরা ।

মূর্তির এই মেলায় একটা অসাধারণ সংযোজন হলো উশব তি। প্রকোষ্ঠের পেছন দিকে নির্মাণ করা হয়েছে ফারাও-এর অন্তিম যাত্রায় তাঁকে পাহারা দেওয়া দাস এবং ভৃত্যদের নকল। এই জীবনে, এবং বাকি যতো জীবন আছে সবসময়ে রাজার সেবায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যারা; মিশরীয় সমাজের সমস্ত পেশার মানুষের কাঠের পুতুল তৈরি করা হয়েছে। নির্দিষ্ট পেশার মানুষের পোশাক, যন্ত্রপাতি সমেত পুতুলগুলো খুবই চমকপ্রদ। এখানে রয়েছে কৃষক এবং মালী; সৈনিক এবং খাজনা-আদায়কারী; জেলে এবং মুদি; মদ-প্রস্তুতকারী এবং চাকরানি; লিপিকার এবং বর্বর, হাজার হাজার তুচ্ছ শ্রমিক প্রত্যেকের উশব তি। বলা তো যায় না, পরের জীবনে কাকে কখন প্রয়োজন পরে মহান ফারাও-এর।

এই ছোট্ট পুতুলগুলোর নেতৃত্বে রয়েছে আমার মনিব, ইনটেফের একটি কাঠের পুতুল। ওটা হাতে তুলে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগলেন ফারাও। পুতুলের পেছনের খোদাই করা লেখাগুলোও পড়লেন।

আমি জমিদার ইনটেফ, উচ্চ-রাজ্যের রাজ-উজির। ফারাও-এর সবসময়ের সঙ্গী, তিনবার প্রশংসার স্বর্ণ উপাধি জয়ী। রাজার হয়ে জবাব দিতে আমি প্রস্তুত আছি।

পুতুলটা ইনটেফের হাতে দিয়ে ফারাও মন্তব্য করলেন, আপনি কী সত্যিই অতটা পেশীবহুল, হে উজির? মাথা নিচু করলেন ইনটেফ।

ভাস্কর ঠিক আমাকে ফুটিয়ে তুলতে পারে নি, মহান ফারাও।

আজকের দিনের শেষ পরিদর্শন হিসেবে ফারাও এবারে গেলেন স্বর্ণকারদের প্রকোষ্ঠে। অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে নিচু আসনে বসে কাজ করছে তারা। চুল্লীর গনগনে আগুন কেমন অপার্থিব আলো ছড়াচ্ছে সেখানে। যোগ্য শিক্ষা দিয়েছি আমি ওদের। ফারাও-এর প্রবেশক্ষণে হাঁটুর উপরে নিচু হলো তারা সবাই, এরপর আবারো নিরবে কাজে লেগে পরলো।

এতো বড় প্রকোষ্ঠ, অথচ চুল্লীর গরমে সেখানে শ্বাস নেওয়া দায়। নিমিষেই ঘামে ভিজে গোসল হয়ে গেলো আমাদের। কিন্তু তাঁর সামনের সম্পদে এতটাই মোহাবিষ্ট হয়ে পরেছেন ফারাও, গরম গ্রাহ্যই করলেন না। প্রকোষ্ঠের মাঝখানে, যেখানে সোনার কফিনের কাজ করছে শিল্পীরা, প্রায় ছুটে সেখানে চললেন তিনি। চকচকে ধাতুতে ফারাও-এর মুখাবয়ব চমৎকার ফুটিয়েছে তারা। সহজেই মহান ফারাও-এর পট্টি-বাঁধা মুখে এটে যাবে মৃত্যু-মুখোশটা। অবিসিডিয়ান এবং পাথুরে-ক্রিস্টালে তৈরি চোখ, মাথার উপরে ফনা তোলা গোখরোর ছবি অঙ্কিত ইউরিয়াস মুকুট। আমি নিশ্চিত, হাজার বছরেও কোনো স্বর্ণকার এমন একটি জিনিস তৈরি করে নি কখনও। অনাগত দিনগুলোর মানুষজন একদিন অবাক বিস্ময়ে দেখবে এই সৃষ্টি।

দেখেও যেনো আশ মিটছিলো না আমাদের সম্রাটের । দিনের বাকি সময় ওটার পাশে পার করে দিলেন, সাদা রঙের নিচু একটা আসনে বসে। তার সামনে পরে রইলো সিডার কাঠের বাক্সের পর বাক্স ভর্তি স্বর্ণ-রত্ন।

এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এতো বেশি পরিমাণ সম্পদ কখনও একত্র করা সম্ভব হয়েছিলো। কেবলমাত্র তালিকা তৈরি করে এর ব্যপকতা এবং বিচিত্রতা বোঝানো বোধ করি অসম্ভব। যা হোক, আপনাদের একটা ধারণা দেওয়ার জন্যে বলছি, ইতোমধ্যেই ছয় হাজার চারশ পঞ্চান্ন খন্ড সিডার বাক্সে ভরে গেছে। প্রতিদিন আরো একটু একটু করে যোগ করছে স্বর্ণকারেরা।

ফারাও-এর হাত এবং পায়ের আঙুলের জন্যে রয়েছে আংটি। রয়েছে বাজুবন্ধ, হার। দেব-দেবীদের স্বর্ণের প্রতিরূপ। বুকের আচ্ছাদন, কোমরবন্ধ–যাতে অলংকৃত করা আছে বাজপাখি, শকুন থেকে শুরু করে দুনিয়ার সমস্ত প্রাণীর ছবি। ল্যাপিস লাজুলি আর গারনেট, এজেট, কারণেলিয়ান, জেসপারসহ পৃথিবীর তাবৎ মূল্যবান পাথরে সজ্জিত মুকুট।

বিগত এক হাজার বছরের শিল্পের প্রতিফলন এই সম্পদ। ইতিহাস বলে, জাতীর ক্রান্তিলগ্নে নাকি তৈরি হয় তার শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে গঠনের দিকে লক্ষ্য থাকে সবার। ঠিক যখন একটি কাঠামো তৈরি হয়ে যায়, কিছুটা বিশ্রামে যেতে পারে মানুষ; মনের খোরাক হিসেবে তখনই সৃষ্টি হয় শিল্প-সাহিত্য। এবং অতি অবশ্যই, ধনবান এবং প্রভাবশালী ব্যক্তির সমর্থন প্রয়োজন শিল্প-সৃষ্টিতে।

সমস্ত স্বর্ণ-রত্নের ওজন ইতোমধ্যে পাঁচশ টাখ ছাড়িয়ে গেছে। নিশ্চই পাঁচশ সমর্থ লোক প্রয়োজন হবে এগুলো তুলতে। আমি হিসেব করে দেখেছি, বিগত এক হাজার বছরে তৈরি হওয়া সমস্ত ধন-সম্পদের ওজনের দশ ভাগের একভাগ ওজন এই সমাধি-সম্পদের। আর এই সমস্তই নিজের সঙ্গে করে কফিনে নিয়ে যাবেন মহান ফারাও।

একজন সম্রাটের মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে নিয়ে যাওয়া সম্পদের মূল্য হিসেব করার আমি কে? কেবল এটুকু বলি, এতো ধন-সম্পদ একত্র করতে গিয়ে, একই সঙ্গে নিম্ন রাজ্যের সাথে যুদ্ধের ব্যয় হিসেবে ধরলে, ফারাও একাই আমাদের এই মিশরকে ভিক্ষুকের ঝুলিতে পরিণত করে ফেলেছেন।

ট্যানাস যে তার আবেদনে খাজনা-আদায়কারীদের দৌরাত্নের কথা বলেছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। খাজনা-আদায়কারী এবং রাজ্যের কোণে কোণে রাজত্ব করা দস্যুদের অত্যাচারে আমরা আজ জর্জরিত। এ থেকে বাঁচতে হলে এদের নাগপাশ ছিঁড়ে বেরুতে হবে। নিজের কারণে যখন আমাদের রাজা ভিক্ষুকে পরিণত করছেন পুরো জাতিকে, আমরা যারা এই সমস্ত অবলোকন করেও চুপ আছি তারা সবাই দোষী। ধনী-নির্ধন, মহান বা নিচু বর্ণের আমাদের মধ্যে খুব কম লোকই আছে, যারা রাতে ভালো ঘুমায়। আশঙ্কায় দিন গুনি আমরা, কখন দরোজায় কড়া নাড়বে খাজনা আদায়কারী ।

হায় দুর্ভাগা, নির্যাতিত মাটি, আর কতকাল আর্তনাদ করে যাবে তুমি?

*

নীলনদের পশ্চিম তীরে, কালো কঙ্কালসার পাহাড়শ্রেণীর পাদদেশে নিজের অন্তিম-বাসস্থানের কাছেই নেক্রোপলিসে তৈরি করা হয়েছে ফারাও-এর আলিশান অস্থায়ী আবাস।

মৃতের নগরী, নেক্রোপলিস আয়তনে কারনাকের মতোই বিশাল। সমাধি-মন্দির এবং রাজকীয় শবের নির্মাণ এবং পরিচর্যায় নিয়োজিত লোকজনের ভিটে এখানে। সম্পূর্ণ একটি রাজকীয় বাহিনী সবসময় মোতায়েন রাখা হয়; কেননা উত্তরের দস্যুদের ধন-সম্পদের প্রতি লালসা আমাদের রাজার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ওদিকে, মরুর ডাকাতদল দিন দিন আরো সাহসী হয়ে উঠছে। সমাধি মন্দিরের ধন-সম্পদ যে কারো জন্যেই লোভনীয় একটা শিকার–তা সে যে রাজ্যের লোকই হোক না কেন।

রক্ষীরা বাদে, শিল্পী এবং কারিগরদের পরিবারও বাস করে এখানে। এদের সবার খাবার-দাবার এবং খরচাপাতি হিসেবের দায়িত্বে ছিলাম আমি। সঠিকভাবেই তাই জানা আছে, ঠিক কত জন লোকের বাস এখানে। শেষবারের মজুরি মিটানোর দিনে চার হাজার আটশ এগারো জন ছিলো। এছাড়াও, প্রায় দশ হাজার দাস তো রয়েছেই।

প্রতিদিন এদের খাবারের জন্যে কতটি ষাঁড় বা ভেড়া জবাই করতে হয়, সে হিসেব দিয়ে নিজেকে উদ্বিগ্ন করতে চাই না। নীলনদ থেকে কত মাছের সরবারহ আনা হয় এখানে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। চাবুকের তলায় নিয়ত পরিশ্রমরত এই জনগোষ্ঠীর পিপাসা মিটাতে চোলাই করা হয় হাজার হাজার পাত্র মদ।

যেহেতু নেক্রোপলিস একটি নগরী, ফারাও-এর বসবাসের জন্যে প্রাসাদ আছে এখানেও। দিনের শেষে ক্লান্ত আমরা প্রবেশ করলাম সেখানে। কিন্তু একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পেলাম না এবারেও।

লসট্রিসের নাগাল পেতে যেয়ে ব্যর্থ হতে হলো। কালো দাসী মেয়েটা প্রথমবারে জানালো স্নানাগারে আছে সে; এরপরে বিশ্রাম নিচ্ছে। ধৈর্য্য ধরে তবুও বসে ছিলাম ওর কামরার অভ্যর্থনা অংশে, ঠিক সেই সময় তলব এলো ইনটেফের তরফ থেকে । আর দেরি করা সম্ভব নয়, ছুটে গেলাম।

আমি তার কক্ষে প্রবেশ করতেই অন্য সবাইকে চলে যেতে বললেন ইনটেফ। একা হতে চুমো খেলেন ঠোঁটে। তার এমন দয়া-পরবশ আচরণে বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। খুব কমই এমন উচ্ছল থাকেন আমার মনিব।

ধন-সম্পদ আর ক্ষমতার রাস্তাটা মাঝে মধ্যে কী বিচিত্র ভাবেই না মিলে যায়। আমাকে একটু সোহাগ করে নিয়ে হেসে বললেন ইনটেফ। এবারে, ওই পথ এক মেয়েমানুষের উরুর মাঝখানে লুকিয়ে ছিলো, ভাবতে পারো? না বোঝার ভান করো না, প্রিয়, তোমার ধূর্ত মাথাটার কথা আমার জানা আছে। ফারাও আমাকে জানিয়েছেন, তুমিই এই পথে প্ররোচিত করেছে তাকে, ছেলে সন্তানের উত্তরাধিকারের কথা প্রতিজ্ঞা করে। সেথ্‌-এর কসম, তোমার ধূর্ততার তুলনা হয় না। আমাকে কিছু না জানতে দিয়ে কী অসাধারণ পরিকল্পনা করলে!

আবারো হেসে উঠে দুই আঙুলের ফাঁকে আমার চুলের গাছি জড়াতে লাগলেন ইনটেফ। নির্ঘাত শুরু থেকেই এটা তোমার মনে ছিলো, আমাকে কিছু বলে নি। নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে কাজ সমাধা করলে। অবশ্যই, এসব আমাকে না বলার জন্যে তোমাকে শাস্তি দেওয়া উচিত। আমার চোখে পানি চলে আসা পর্যন্ত চুলের গাছি আঙুলে পেচালেন ইনটেফ। কিন্তু কেমন করে তোমাকে শাস্তি দিই, যখন দ্বৈত-মুকুট আমার ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে নিয়ে এসেছো তুমি? চুলের গাছি ছেড়ে দিয়ে আমাকে চুমো খেলেন ইনটেফ। মাত্রই রাজার ওখান থেকে এলাম। দুই দিন পরে, উৎসবের শেষ দিনে, আমার কন্যা লসট্রিসের সাথে তার সম্বন্ধের ঘোষণা দেবেন তিনি। অনুভব করলাম, একটা অন্ধকার যেনো ছেয়ে এলো আমার চারপাশে, বরফ-ঠাণ্ডা শিশির যেনো ত্বক স্পর্শ করলো।

সেদিনই, উৎসবের সমাপ্তির পরপরই বিয়ে হবে। আমিই তাড়াহুড়ো করেছি ওটা নিয়ে, বেতাল কিছু ঘটার আগে ভালোয় ভালোয় হয়ে যাক বিয়েটা–আমি তাই চাই।

এতো দ্রুত কোনো রাজকীয় বিবাহ সম্পন্ন হওয়া অস্বাভাবিক, তবে অশ্রুত নয়। রাজনৈতিক কোনো সুবিধা অর্জনের জন্যে বা কোনো ভূ-খণ্ডের অধিকার পাওয়ার জন্যে এ ধরনের তড়িৎ বিয়ের নজির রয়েছে। প্রথম মামোস- যিনি আমাদের বর্তমান ফারাও-এর পিতা; যুদ্ধক্ষেত্রে একজন হারিয়ান দলনেতার কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু আমার চরমতম দুঃস্বপ্নের সত্যি হওয়ার ঘটনায় সেই উদাহরণ কোনো স্বস্তি জোগালো না।

আমার এই অস্বস্তি ইনটেফ লক্ষ্য করলেন না। সামনের দিনগুলোর সুখ-স্বপ্নে বিভোর তিনি, কথা বলে চললেন। রাজার প্রস্তাবে আনুষ্ঠানিক সম্মতি দেওয়ার আগে আমি বলে নিয়েছি, যদি আমার কন্যার গর্ভে তার কোনো পুত্র সন্তান হয়, তবে প্রধান পত্নী এবং রাণীর মর্যাদা লসট্রিস পাবে। খুশির আতিশায্যে হাততালি দিলেন ইনটেফ।

নিশ্চই বুঝতে পারছো, এর অর্থ কি। যদি আমার নাতি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই ফারাও মারা যান, সেক্ষেত্রে তার দাদা হিসেবে এবং সবচেয়ে নিকট পুরুষ-আত্মীয় হওয়ার কারণে শাসনভার পেয়ে যাবো হঠাৎই কথা থামিয়ে আমার চোখে চেয়ে রইলেন ইনটেফ। আমি জানি তার মাথায় এখন কী চলছে। মনের কথা উচ্চারণ করে ফেলেছেন একজন মামুলি দাসের সামনে। নিখুঁত ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছেন তিনি। যদি লসট্রিসের গর্ভে ফারাও-এর কোনো পুত্র সন্তান হয়, তবে বেশিদিন বাঁচতে দেওয়া যাবে না ফারাওকে। আমরা দুইজনেই বুঝেছি ইনটেফের মনোবাঞ্ছ। আমার মনিব এইমাত্র রাজার মৃত্যু-পরোয়ানা ঘোষণা করেছেন। আর একমাত্র জীবিত মানুষ, যে ওটা উচ্চারিত হতে শুনেছে, সে হলাম আমি, টাইটা–একজন মামুলি ক্রীতদাস। পরস্পরকে পরিষ্কার বুঝতে পারলাম আমরা সেই রাতে।

মালিক, ঠিক যেভাবে আমি সবকিছু পরিকল্পনা করেছিলাম, সেভাবে সবকিছু হওয়ায় আমি কৃতজ্ঞ। এখন স্বীকার করছি, ইচ্ছে করেই আপনার কন্যাকে রাজার যাত্রা পথে ঠেলে দিয়েছিলাম আমি। আমিই ফারাও-কে বলেছি, সে হতে যাচ্ছে রাজার পুত্র সন্তানের জননী। গীতি-নাট্যে ইচ্ছে করেই তার সম্মুখে উপস্থাপন করেছি লসট্রিসকে। কিন্তু সফল হওয়ার আগ পর্যন্ত এসব কথা আপনাকে বলার সাহস করে উঠতে পারিনি। কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকি আছে। সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিরাট তালিকা বলে যেতে লাগলাম; মিশরের সোনালি মুকুট পরিধানের আগে আর কী কী সমস্যা ইনটেফের হতে পারে সেই বিষয়ে। কৌশলে জানালাম, আমাকে এখনও কত প্রয়োজন তাঁর। ধীরে ধীরে শিথিল হলেন ইনটেফ। বুঝলাম অন্তত নিকট ভবিষ্যতের জন্যে আমার জীবন নিরাপদ।

এরও বেশ অনেকক্ষণ পরে ইনটেফের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে লসট্রিসের প্রকোষ্ঠের উদ্দেশ্যে ছুটলাম। কী ভয়ানক বিপদে তাকে ফেলেছি আমি, জানাতেই হবে ওকে। কিন্তু হঠাৎই থেমে দাঁড়ালাম ওর দরোজার সামনে। কী হবে ওকে সতর্ক করে? কেবল মানসিক অশান্তি, এমনকি আত্মহত্যা প্রবণতা উৎসাহিত করা হবে তাতে। ঘটনাবলির করুণ পরিণতি এড়াতে হলে দ্রুত কাজ করতে হবে এখন আমার ।

মাত্র একজন মানুষ এই মুহূর্তে সাহায্য করতে পারে আমাকে।

নেক্রোপলিস ছেড়ে চাঁদের আলোয় আলোকিত হাঁটা-পথ ধরে নদী তীরের উদ্দেশ্যে ছুটলাম আমি। ওখানেই আস্তানা গেড়েছে ট্যানাসের বাহিনী। পূর্ণিমার আর মাত্র তিন দিন বাকি, পশ্চিম দিগন্তের এলোমেলো পাহাড়ের সারি ঠাণ্ডা হলুদ আলো ছড়াচ্ছে, তাদের গাঢ় ছায়া পড়ছে নিচের সমভূমিতে। যেতে যেতে ভাবছিলাম আসছে দিনগুলোয় কী বিপদ অপেক্ষা করে আছে ট্যানাস, আমার আর লসট্রিসের জন্যে। নদী তীরে পৌঁছার অনেক আগেই ভিজে একশা হয়ে গেলাম।

নীল নদের তীরে, খালের মুখে সহজেই খুঁজে পাওয়া গেলো ট্যানাসের আস্তানা । যুদ্ধ গ্যালিগুলো একে একে নোঙড় করে রাখা হয়েছে খালের প্রবেশমুখে। আস্তানায় ঢোকার মুখে আমাকে বাধা দিলো পাহারাদার, পরে চিনতে পেরে পথ ছাড়লো। সোজা ট্যানাসের তাবুর উদ্দেশ্যে চললাম আমি।

ক্রাতাস এবং আরও চারজন বিশ্বস্ত সঙ্গীর সাথে রাতের খাবারে বসেছিলো ট্যানাস। হাসিমুখে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে স্বাগত জানালো সে, হাতের সুরার পাত্র বাড়িয়ে ধরলো। অবাক করলে, বন্ধু। এসো, পাশে বসে আরাম করে; তোমার জন্যে খাবার আনা হচ্ছে। তোমাকে কেমন যেনো অসুস্থ মনে হচ্ছে–

বুনো রাগে উন্মত্ত আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, সেথ্‌-এর সঙ্গে তুমিও একটা সত্যিকারের গর্দভ! কী উভয়সংকটে তুমি ফেলেছে আমাদের, জানো? তুমি আর তোমার ওই বড়ো মুখ! আমার মিসট্রেসের নিরাপত্তা কিংবা ভালো থাকা না থাকার কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে! এতটা বলতে চাই নি আমি, কিন্তু একবার মুখের অর্গল খুলে যেতে এক নাগারে কথা ক টা বলে থামলাম। জানি, এসব কিছুর জন্যেই ট্যানাস দায়ী নয়।

এক হাত উঁচু করে যেনো নিজেকে আড়াল করলো সে। আরোপা একেবারে চমকে দিয়েছে। এ রকম আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে কেনো অস্ত্র এই মুহূর্তে নেই আমার কাছে। বলতে বলতে ঠোঁটের হাসি ধরে রেখে এক হাতে হিড়হিড় করে টেনে আমাকে তাবুর বাইরের অন্ধকারে নিয়ে এলো ট্যানাস। যেনো ছোট্ট একটা বাচ্চার মতো ঝুলতে লাগলাম তার শক্তিশালী হাতের উপর ।

এবারে খুলে বলো সবকিছু! ধীর লয়ে আদেশ করে ট্যানাস। কী এমন ঘটেছে, সবার সামনে এ ধরনের একটা আচরণ করলে?

এখনও রেগে আছি আমি, তবে রাগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়। সারা জীবন ধরেই তোমাকে তোমার গাধামোর হাত থেকে রক্ষা করে করে আমি ক্লান্ত। তুমি কী কখনও বুঝতে শিখবে না? গত রাতের নির্বোধ আচরণের পর তোমার ধারণা, তোমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া হবে?

গীতি-নাট্যে আমার ঘোষণার কথা বলছো তুমি? বোকা বোকা দেখালো ট্যানাসকে। আমাকে মুঠো থেকে ছেড়ে দিলো সে। কেমন করে ওটাকে নির্বোধ আচরণ বলতে পারলে তুমি? আমার সব সৈনিকেরা, যার সাথেই আমি কথা বলেছি সবাই দারুন খুশি ওই ঘোষণায়–

আরে গাধা, তোমার সৈনিক আর বন্ধু-বান্ধবের মতামতের এক কানা-কড়ি মূল্যও নেই। অন্য যে কোনো শাসকের দিনে হলে এতক্ষণে মরে পচে যেতে, বন্ধু। কিন্তু, এমনকি আমাদের দুর্বল ফারাও পর্যন্ত তোমাকে ছাড়বে না। তার সিংহাসনের মায়া আছে। তোমাকে চরম মূল্য চুকাতে হবে, ট্যানাস, প্রভু হেরাব। হোরাস জানেন, কতো ভয়ঙ্কর হবে সেই হিসেব।

তুমি হেয়ালি করে বলছো, পাল্টা অভিযোগ করে ট্যানাস। আমি রাজার প্রতি দারুন অনুগত। উনার চারপাশে কেবল ভাঁড়েদের আনাগোনা, তারা রাতদিন মিছে কথা বলে তাঁকে। আমি তাকে সত্যি জানিয়েছি, আর আমি জানি, তিনিও ব্যপারটা চাইছিলেন। আমার প্রতি তার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

এহেন সোজাসুজি, নিখাদ সরল বিশ্বাসের সামনে আমার রাগ যেনো উবে গেলো। ট্যানাস, প্রিয় বন্ধু, কী বোকা তুমি! বিষাক্ত সত্য গলধঃকরণের পর কেউ কারও প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করে না। কিন্তু, ওটা বাদ দিলেও, ইনটেফের জালে নিজেকে ধরা পরতে দিয়েছো তুমি।

ইনটেফ? কঠোর চোখে আমার দিকে চাইলো ট্যানাস। ইনটে আবার কী করলেন? এমনভাবে বলছে, যেনো উনি আমার শত্রু। রাজ-উজির আমার বাবার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিলেন। আমি জানি, বিপদে-আপদে উনি আমার পাশে আছেন। বাবার মৃত্যু-শয্যায় তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।

টের পেলাম, আমার সাথে এতো দিনের বন্ধুত্ত সত্ত্বেও জীবনে এই প্রথমবারের মতো আমার উপর রেগে গেছে সে। ভালো করেই জানি, ট্যানাসের রাগ ভয়ঙ্কর।

ওহ, ট্যানাস, শেষমেষ আমার রাগের আগুনে ছাইচাপা দিলাম। আমি তোমাকে সত্যি বলি নি। অনেক কিছু বলা উচিত ছিলো, কিন্তু কখনও বলে উঠতে পারি নি। তুমি যা ভাবছো, তার কিছুই ঠিক নয়। কাপুরুষের মতো আচরণ করেছি আমি। কখনও তোমাকে বলিনি, ইনটেফ ছিলেন তোমার বাবার জানের শত্রু।

তা কী করে হয়? মাথা নাড়লো ট্যানাস। তারা দুজন বন্ধু ছিলেন, খুবই নিকটজন। ছোটো বয়সের কথা মনে পরে, দুজন কেবল একসাথে হাসতেন। বাবা বলেছিলেন, আমি ইনটেফের উপর আমার জীবন পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারি।

মহৎ পিয়াংকি, প্রভু হেরাব তাই বিশ্বাস করতেন। এই ভুল বিশ্বাসের কারণে সবকিছু হারিয়েছিলেন তিনি, শেষপর্যন্ত জীবনও দিয়েছেন।

না, না, এটা হতে পারে না। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার বাবা অনেকগুলো দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন

তার প্রতিটি দুর্ভাগ্যের পেছনে ইনটেফের সযত্ন হাত ছিলো। তোমার বাবার জনপ্রিয়তা আর গুণাবলির জন্যে ইনটেফ হিংসা করতেন তাঁকে। তার ধন-সম্পদ এবং ফারাও-এর সুনজরের জন্যেও ঘৃণা করতেন। তিনি জানতেন, প্রভু হেরাবকে তার আগেই রাজ-উজিরের পদ দেওয়া হবে। এসব কারণেই তাঁকে দারুন ঘৃণা করতেন ইনটে।

আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। কিছুতেই না। দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে আমাকে নাকচ করে দিলো ট্যানাস। রাগের শেষ ভাবটুকুও উবে গেলো আমার।

আজ সব বলবো তোমাকে, আরও অনেকদিন আগেই উচিত ছিলো বলা। কী প্রমাণ চাও তুমি? সব বোঝাবার সময় এখন নেই। আমাকে বিশ্বাস কর। ঠিক তোমার বাবার মতো তোমাকেও মনে-প্রাণে ঘৃণা করেন প্রভু ইনটেফ। তুমি জানো না, লসট্রিস এবং তুমি মহাবিপদে আছো এই মুহূর্তে। না, না, প্রাণঘাতি কিছু নয়; কেবল পরস্পরকে চিরতরে হারাতে যাচ্ছ।

তা কী করে সম্ভব, টাইটা? আমার কথায় একটু নড়ে গেছে ট্যানাস। আমার তো ধারণা ছিলো, ইনটে আমার প্রস্তাবে সম্মত হয়েছেন। তুমি কথা বলো নি তার সাথে?

বলেছি, চিৎকার করে উঠে ট্যানাসের একটা হাত আমার জামার নিচে গলিয়ে দিলাম। এই ছিলো তার উত্তর। দেখেছো, চাবুকের আঘাতগুলো দ্যাখো! কেবল তোমাদের কথা বলার কারণে এই শাস্তি। তোমাকে এতোটাই ঘৃণা করেন ইনটে।

নির্বাক ট্যানাস আমার পানে চেয়ে রইলো, এতক্ষণে আমার কথা বিশ্বাস করেছে সে বুঝলাম। এবারে, যে ভয়ঙ্কর সংবাদ তাকে দিতে এসেছি আমি, তা বলতে পারবো বলে মনে হলো।

আমার কথা শোনো, ট্যানাস, প্রস্তুত হও, সরাসরি বলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার হাতে; বিপরীত কোনো ক্ষেত্রে ট্যানাস নিজেও তাই করতো। আজ রাতে ইনটেফ তার মেয়ের বিয়ের ব্যপারে সম্মত হয়েছেন। খুব শীঘ্রই মহান ফারাও, মামোসের সঙ্গে তার বিয়ে; তাঁকে ছেলে সন্তান জন্ম দিতে পারলে লসট্রিস প্রধান পত্নী এবং রাণী হবে। ওসিরিসের উৎসবের শেষে রাজা স্বয়ং এই ঘোষণা দেবেন। সেই সন্ধাতেই বিয়ে সম্পন্ন হবে।

কেঁপে উঠলো ট্যানাস। চাঁদের আলোয় ছাই বর্ণ ধারণ করলো তার মুখাবয়ব। বহুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না আমরা কেউই; অবশেষে আমাকে একা রেখে দূরের ফসলের গাদার কাছে নিচুপ দাঁড়িয়ে রইলো সে। পিছু পিছু এগুলাম আমি, বেশ কিছু সময় পর কালো একটা পাথরের উপরে বসলো ট্যানাস। যেনো এই কয়েক মুহূর্তে কয়েক দশক বেড়ে গেছে তার বয়স। ইচ্ছে করেই চুপ থাকলাম আমি। অবশেষে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত স্বরে জানতে চাইলো ট্যানাস, লসট্রিস রাজী হয়েছে এই বিয়েতে?

প্রশ্নই উঠে না। ও সম্ভবত এসবের কিছুই জানে না। কিন্তু রাজার ইচ্ছার কাছে ওর মতামতের কোনো মূল্য নেই।

আমাদের কী করা উচিত, টাইটা?

করুণায় মন ভরে গেলো আমার। আমাদের সামনে আরো একটা খারাপ সংবাদ আছে, ওকে সতর্ক করে দিয়ে বললাম। যেদিন নিজের বিয়ের ঘোষণা দেবেন ফারাও, ঠিক সেদিনই তোমাকে আটক করা হবে। হতে পারে, তোমার মৃত্যু পরোয়ানা ঘঘাষিত হবে। ইনটেফ, রাজার কান ভারী করে রেখেছেন। আর কারণও আছে, সত্যিই তোমার বক্তব্য দেশদ্রোহীতার সামিল।

লসট্রিসকে ছাড়া আমার বেঁচে থেকেই কী লাভ। ফারাও যদি ওকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়েই নেন, তবে তাঁর বিয়ের উৎসবে আমার গর্দান যাবে উপহার হিসেবে। এতো সহজ, সাধারণভাবে কথাটা বললো ট্যানাস, ওর উপরে রাগ ফিরিয়ে আনতে বেগ পেতে হলো।

অসহায় নারীর মতো কথা বলছো তুমি, যেনো কিছু করার নেই। কেমন ভালোবাসা তোমার, ওর জন্যে লড়তে পর্যন্ত পারবে না!

কার সঙ্গে লড়বো, একজন রাজা–একজন দেবতার সঙ্গে? শান্ত-স্বরে প্রতুত্তর করে ট্যানাস। একজন রাজা যার প্রতি তুমি একান্ত অনুগত; একজন দেবতা যিনি সূর্যের মতোই ধ্রুব?।

রাজা হিসেবে কোনোরকম আনুগত্য পাবার অধিকার হারিয়েছেন তিনি। তোমার ঘোষণায় কী তুমি তাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাও নি? একজন দুর্বল, ক্ষয়িষ্ণু মানুষ আমাদের ফারাও। তাঁরই জন্যে আজ আমাদের টা-মেরি ভেঙে পরেছে, রক্ত ঝরছে।

আর একজন দেবতা হিসেবে? আবারো অচঞ্চল কন্ঠে জানতে চায় ট্যানাস, যেনো এর উত্তরে ওর কোনো আগ্রহ নেই। বহু বীর যোদ্ধার মতো ট্যানাসও ধার্মিক, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মানুষ ।

দেবতা? কন্ঠে ব্যঙ্গের সুর যোগ করে বললাম। তোমার তলোয়ারধারী হাতে বহু দেবতা-ঈশ্বর আছেন যা বোধকরি তার ছোট্ট-নরম শরীরেও নেই।

কী করতে বলো তুমি? নিরাসক্ত ম্রতায় বললো ট্যানাস। আমি কী করতে পারি এখন?

বড়ো করে শ্বাস টেনে বিস্ফোরণ ঘটালাম আমি, তোমার সৈনিক আর সহচরেরা শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তোমার সাথে আছে । তুমি সাহসী, সম্মান দিতে জানো সবাই পছন্দ করে তোমাকে–থেমে গেলাম আমি। চাঁদের রহস্যময় আলোয় ট্যানাসের মুখের অভিব্যক্তি আর কিছু বলতে উৎসাহ যোগালো না।

বিশটি দ্রুত হৃদস্পন্দন কেটে গেলো, রা করলো না ট্যানাস। অবশেষে নরম কণ্ঠে সে বললো, বলে যাও।

ট্যানাস, হাজার বছর ধরে তোমার মতো একজন ফারাও চাইছিলো আমাদের এই মাতৃভূমি। লসট্রিসকে পাশে নিয়ে, তুমি বসবে সিংহাসনে আবার আমাদের লোকেদের ফিরিয়ে দেবে সেই সময়, যখন মিশর ছিলো মহান। ডাকো তোমার যোদ্ধাদের, প্রাসাদ থেকে বিতারিত কর অযোগ্য ফারাওকে। আগামী সূর্যোদয়ের আগে তুমিই হবে আমাদের উচ্চ-রাজ্যের ফারাও। আগামী বছর এই সময়ে তোমার নেতৃত্বে দুই রাজ্য এক করবো আমরা। পরাজিত হবে যতো অপশিক্ত। ঝটকা মেরে দাঁড়িয়ে ট্যানাসের মুখোমুখি হলাম আমি। ট্যানাস-প্রভু হেরাব, তোমার নিয়তি, তোমার ভালোবাসা অপেক্ষায় আছে। এই দুটো শক্তিশালী যোদ্ধার হাতে তুলে নাও ওগুলো!

যোদ্ধার হাত হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। বিড়বিড় করে বলে আমার মুখের সামনে হাত দুটো তুললো ও। এই হাত দিয়েই তো মিশরের জন্যে লড়েছি, রক্ষা করেছি তার অভিভাবককে। আমাকে মন্ত্রণা দিলে তুমি, বুড়ো বন্ধু। এগুলো বিশ্বাসঘাতকের হাত নয়। এই হৃদয়ও নয় ছলনায় পরিপূর্ণ। একজন দেবতার অপমান করে তার রাজ্য এই হৃদয় অধিকার করবে না।

হতাশায় গুঙ্গিয়ে উঠলাম আমি। পাঁচশো বছরের মধ্যে সেরা ফারাও হবে তুমি। তোমাকে দেখা হতে হবে না সেজন্যে। আমার কথা শোনো, যা বলছি কর; আমাদের এই মাতৃভূমি মিশরের জন্যে; আমরা দুজনেই যে নারীকে ভালোবাসি, তার জন্যে।

একজন বিশ্বাসঘাতককেও কী একইভাবে ভালবাসবে লসট্রিস, যেমন করে একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধাকে ভালবাসতো? মাথা নেড়ে নিজেই উত্তর দিয়ে দিলো ট্যানাস, না, বাসবে না।

যাই ঘটুক না কেননা, সে তোমাকে–আমাকে থামিয়ে দিলো ট্যানাস।

মিছে বলো না, টাইটা। লসট্রিস যোগ্য নারী। বিশ্বাসঘাতকতা আর চুরি করলে আমি ওর যোগ্য থাকবো না। এরচেয়েও বড়ো কথা, আমি আর নিজেকেও সম্মান করতে পারবো না। ওর নিষ্পাপ প্রেমের যোগ্য নয় একজন বিশ্বাস ঘাতক। আমাদের বন্ধুত্বের নামে বলছি, এ ব্যপারে আর কথা বলো না। দ্বৈত-মুকুটের উপরে আমার কোনো অধিকার নেই, কোনো দিন থাকবেও না। হোরাস, তুমি আমার কথা শুনছো–কোনোদিন এই প্রতিজ্ঞা ভাঙলে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিও আমা হতে।

এ ব্যপারে কথা শেষ, ওকে আমি এতো ভালো করে চিনি–কোনো সন্দেহ নেই আর। যা বলছে, তার প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করে ট্যানাস।

কী করবে তাহলে, হতচ্ছাড়া বোকা, রাগে জ্বলে উঠলাম আমি। আমার কোনো কথারই মূল্য নেই তোমার কাছে। নিজেই যদি সব বোঝো, তবে একাই কর। হঠাৎ করেই যদি তোমার জ্ঞান এতো বেশি হয়ে থাকে যে আমাকে তোমার আর প্রয়োজন নেই, তাহলে আর কি করা।

তোমার পরামর্শ আমি ততক্ষণ পর্যন্ত নেবো, যতক্ষণ তা আমার কাছে অর্থবহ মনে হবে। হাত ধরে টেনে তার পাশে আমাকে বসালো ট্যানাস। দয়া করে আমাদের সাহায্য করো, টাইটা। লসট্রিস আর আমার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তোমাকে। সম্মানজনক একটা উপায় বাতলাও আমাদের।

আফসোস, সেরকম কিছু আর সম্ভব নয়, জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি বললাম। যদি মুকুটের দখল নেওয়ার কোনো অভিপ্রায় না থাকে, তাহলে আর এখানে থাকার সাহস করো না। লসট্রিসকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যাও।

চন্দ্রালোকিত সেই রাতে স্তব্ধ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো ট্যানাস। মিশর ছেড়ে চলে যাবো? নিশ্চই তামাশা করছো তুমি। এটা আমার মাটি, আমার আর লসট্রিসের জন্মস্থান।

না! জোর গলায় বললাম। আমি তা বোঝাতে চাইনি। মিশরে আরো একজন ফারাও আছেন। শক্ত লোক আর যোদ্ধার বড়ো প্রয়োজন তার। তোমাকে বরণ করে নেবে সে। এখানে, এই কারনাকের মতো নিম্ন-রাজ্যেও তোমার সুখ্যাতি আছে। হোরাসের প্রশ্বাসে করে লসট্রিসকে নিয়ে উত্তরে চলে যাও। কোনো জাহাজের সাধ্যি নেই তোমার নাগাল পায়। এই বাতাস আর স্রোত পেলে দশ দিনের মধ্যেই মেমফিস এ, লাল ফারাও-এর প্রাসাদে পৌঁছে যাবে। তাকে–

হোরাসের কসম, আমাকে বিশ্বাস ঘাতক বানিয়ে ছাড়বে তুমি! আমাকে থামিয়ে বলে উঠে ট্যানাস। কার আনুগত্য স্বীকার করবো, একজন জবরদখলকারির? ফারাও মামোসকে যে প্রতিজ্ঞা করেছি, তার কি হবে তাহলে? এর কোনো মানে নেই তোমার কাছে, তাই না? যদি একজন রাজা আর একজন দস্যর প্রতি একই প্রতিজ্ঞা করি তাহলে কি রকম মানুষ হলাম আমি? প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেলার জন্যে করা হয় না, টাইটা, এক জীবনে একবারই করা যায়। আমি সত্যিকারের ফারাও মামোসের অনুগত।

তোমার সেই সত্যিকারের ফারাও-ই কিন্তু ছিনিয়ে নেবে তোমার প্রেম, এবং গলায় ফাঁসির দড়ি পরানোর আদেশও তিনিই দেবেন, নিষ্ঠুরভাবে চোখে আঙুল দিয়ে সত্যিটা ওকে দেখিয়ে দিলাম আমি। এবারে ট্যানাসও যেনো একটু ভড়কালো।

ঠিকই বলছো। কারনাকে থাকা ঠিক হবে না আমাদের। কিন্তু আমি কখনই প্রতিজ্ঞা ভাঙতে পারবো না, আমার এই তলোয়ার কখনও ফারাও-এর বিরুদ্ধে চলবে না।

তোমার ভাবাবেগের এক বিন্দু অর্থ নেই আমার কাছে। গলার স্বরে ভর্ৎসনা লুকিয়ে রাখতে পারলাম না। আমি যা বুঝি, সব ভেস্তে যাবে। কী করবে নিজেকে, লসট্রিসকে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের হাত থেকে রক্ষা করতে?

জানি, বুড়ো বন্ধু, আমার উপর রাগ করার অনেক কারণ আছে। আমিই তোমার কাছে পরামর্শ চেয়েছিলাম, আবার আমিই তোমাকে নাকচ করছি। একটু ধৈর্য ধরো, টাইটা। আর কিছু সময় অন্তত আমাকে সাহায্য কর। উঠে দাঁড়িয়ে ফারাও-এর চিড়িয়াখানায় বন্দী চিতার মতো এদিক-সেদিক পায়চারী করতে লাগলো ট্যানাস। বিড়বড়ি করে নিজেকেই কি যেনো বলছে, থেকে থেকে মুঠো পাকাচ্ছে। ঘুষি মারছে হাতে।

শেষমেষ আমার সামনে এসে দাঁড়ালো সে। বিশ্বাসঘাতক আমি হতে পারবো । কিন্তু ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিজের উপর জোর খাঁটিয়ে কাপুরুষের ভূমিকায় খেলতে রাজী আছি। যদি লসট্রিস রাজী থাকে, তবে ওকে নিয়ে পালিয়ে যাবো আমি। এইখান থেকে দূরে কোথাও চলে যাবো আমরা। কোথায়? আমি জানতে চাইলাম।

জানি, নদী ছেড়ে থাকতে পারবে না লসট্রিস। হাপির সঙ্গেই থাকবো আমরা। একটাই মাত্র জায়গা আছে যাওয়ার, শক্তিশালী হাত উচিয়ে চাঁদের আলোয় দক্ষিণ দিক নির্দেশ করে ট্যানাস। নীলনদের গতিপথ ধরে দক্ষিণের গভীরে, আফ্রিকার গহীনে চলে যাবো আমরা সেই কুশ দেশের ওপারে। জলপ্রপাত পেরিয়ে চলে যাবো, যেখানে আজ পর্যন্ত কোনো সভ্য মানুষের পা পরেনি। ওখানে, দেবতারা সহায় হলে, হয়তো নিজেদের জন্যে আরো একটা টা-মেরি তৈরি করে নেবো আমরা।

তোমার সঙ্গী হবে কারা?

ক্ৰাতাস, অবশ্যই; আর আমার লোকেদের মধ্যে যারা শিকার আর বন্যপ্রাণী ভালবাসে, তারা যাবে। আজ রাতেই ওদের ডেকে নিয়ে সুযোগ দেবো আমি। পাঁচটা জাহাজ, আর ওগুলো চালানোর মতো যোদ্ধা হলেই চলবে। সূর্যোদয়ের আগেই যাত্রা শুরু করতে হবে আমাদের। তুমি নেক্রোপোলিসে গিয়ে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারবে এখন লসট্রিসকে?

আর আমি? শান্ত স্বরে জানতে চাইলাম। আমাকে নেবে সঙ্গে?

তুমি যাবে? হাসিতে ভেঙে পরলো ট্যানাস। সত্যিই কী তোমার বাগান, তোমার বই, গীতিনাট্য, মন্দির নির্মাণ ছেড়ে আসতে পারবে? বিপদজনক পথ ওটা, পদে পদে জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। সত্যিই কী আসতে চাও, টাইটা?

আমার পরিচর্যা ছাড়া তোমরা টিকতে পারবে না। আমি না থাকলে না জানি নির্বোধের মতো কত বিপদে ফেলবে তুমি মিসট্রেসকে।

এসো তাহলে! আমার পেছনে চাপড়ে দিয়ে বললো ট্যানাস। আমি জানতাম, তুমি আসবেই। এও জানি, লসট্রিস কখনও তোমাকে ছেড়ে আসবে না। অনেক কথা হয়েছে! এখন দ্রুত কাজ করতে হবে আমাদের। প্রথমে, ক্ৰাতাস এবং অন্যদের সুযোগ দেবো আমরা। এরপরে, নেক্রোপোলিসে গিয়ে লসট্রিসকে নিয়ে আসতে হবে তোমাকে। এদিকে আমি যাত্রার প্রস্তুতি শেষ করছি। বারোজন সেরা যোদ্ধা দিচ্ছি। তোমার সাথে, তাড়াতাড়ি করো। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে সেই কবে।

এতো বোকা আমি, ওর উত্তেজনা আমাকেও স্পর্শ করেছিলো সে রাতে; মন্দিরের নিচে ট্যানাসের বাহিনীর কাছে ছুটে চললাম দুজনে। এতোটাই উল্লসিত ছিলাম, বিপদের কোনো আভাস পাইনি। চাঁদের আলোয়, আমাদের সামনে অশান্ত নড়াচড়া ট্যানাসের চোখেই প্রথম ধরা পরলো। হাত ধরে টেনে একটা গাছের আড়ালে নিয়ে গেলো ও আমাকে।

সশস্ত্র যোদ্ধার দল, ফিসফিস করে বললো ট্যানাস। চাঁদের আলোয় চকচক করছে বর্ষার ডগা। ত্রিশ কি চল্লিশ জনের বিশাল একটা দল।

দস্যু মনে হয়, না হয় নিম্ন-রাজ্যের লুটেরার দল, গর্জে উঠলো ট্যানাস। সামনের লোকগুলোর লুকোচুরি সুলভ আচরণে আমি পর্যন্ত অবাক হলাম। পথ ধরে না এসে, ট্যানাসের আস্তানার চারদিকের ফসলের মাঠের উপর দিয়ে গুঁড়ি মেরে আসছে তারা।

এই দিক দিয়ে এসো! অভিজ্ঞ যোদ্ধার চোখে একটা ঢালের উপর দিয়ে কোণাকুণি পথ দেখালো ট্যানাস। ঢালের উপরে উঠে গড়িয়ে সোজা ট্যানাসের আস্তানার চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশ করলাম আমরা। হুঙ্কার দিয়ে উঠে সবাইকে সতর্ক করে দিলো ট্যানাস।

অস্ত্র হাতে নাও, সাহসী যোদ্ধার দল! আমার সঙ্গে এসো! এক লহমায় প্রাণ ফিরে এলো নীল কুমির বাহিনীর যোদ্ধাদের মধ্যে। আগুনের ধারে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমাতে থাকা লোকগুলো পর্যন্ত চকিতে অস্ত্র হাতে তৈরি হলো। তাবুর দরোজা ঠেলে বেরিয়ে এলো সতর্ক সৈনিকেরা। তলোয়ার হাতে যে যার অবস্থানে পৌঁছে গেছে।

মুহূর্ত পরেই বাহিনীকে এগুতে নির্দেশ দিলো ট্যানাস। তার নির্দেশে প্রতিরক্ষা নয়, পাল্টা আক্রমণে চললো যোদ্ধার দল। সম্ভবত ভয়ানক এই অগ্রযাত্রা ভড়কে দিয়েছিলো সামনের দলটাকে, কাঁপা কাঁপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো একজন ওপাশ থেকে। আমরা ফারাও-এর লোক, রাজ-কাজে এসেছি। থামো!

থামো, সাহসী যোদ্ধারা! একগুঁয়ে অগ্রযাত্রা থামালো ট্যানাস। তারপর যোগ করলো, কোন্ ফারাও-কে সেবা কর তোমরা; লাল-জবরদখলকারি নাকি সত্যিকারের ফারাও-এর?

আমরা সত্যিকারের রাজা, উচ্চ এবং নিম্ন রাজ্যের শাসক, দেবতা মামোস-এর সেবক। আমি তার দূত।

রাজার দূত সামনে এসে দাঁড়াও, চোরের মতো চুপি চুপি কোথায় চলছিলে? সামনে দাঁড়িয়ে তোমার বার্তা জানাও! আহ্বান জানায় ট্যানাস, কিন্তু শ্বাসের নিচে ক্ৰাতাসকে বলে, শয়তানীর জন্যে তৈরি থেকো। ভাবগতিক সুবিধার ঠেকছে না আমার। আগুন উস্কে দাও, আলো প্রয়োজন।

ক্রাতাসের নির্দেশে শুষ্ক পাতার স্তূপ ফেলা হলো অগ্নিকুন্ডে, কিছু সময় পরেই উজ্জ্বল শিখায় অন্ধকার দূর হলো অনেকটা। অদ্ভুত দলটার বার্তাবাহক সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার নাম নেতের, দশ হাজারের-সেরা উপাধিপ্রাপ্ত। ফারাও-এর দেহরক্ষীদের নেতা আমি। ট্যানাস, লর্ড হেরাবকে আটক করার অনুমতি সম্বলিত বাজপাখির প্রতীক আছে আমার কাছে।

হোরাসের কসম, মিথ্যে বলছে ও, চাপা কণ্ঠে গর্জে উঠে ক্ৰাতাস। আপনি কী আসামী নাকি, আটক করবে। আমাদের সবাইকে অপমান করেছে নেতের। অনুমতি দিন, বাজপাখির প্রতীক ওর পেছন দিয়ে ঢুকিয়ে দেবো!

থামো! ট্যানাস বাধা দেয়। ও কী বলতে চায়, আগে শুনি। স্বর উচায় সে। প্রতীকটা আমাদের দেখাও, নেতের।

চকচকে নীল রাজকীয় বাজপাখির প্রতীকচিহ্ন উঁচু করে দেখায় নেতের। বাজপাখির প্রতীক হলো রাজার বিশেষ ক্ষমতার অনুমোদন। ওটা বহনকারী, স্বয়ং ফারাও-এর ক্ষমতা এবং যথার্থতা ভোগ করে। যে কোনো কারণেই হোক, কোনো ব্যক্তির অধিকার নেই এই প্রতীক বহনকারীর কাজে বাধা দেয়। এই প্রতাঁকের বাহক কেবল রাজার কাছে মুখাপেক্ষী।

আমি ট্যানাস, লর্ড হেরাব, বলে ট্যানাস। বাজপাখির প্রতাঁকের প্রতি আমি অনুগত।

মাই লর্ড, মাই লর্ড! জরুরি ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বলে ক্ৰাতাস। রাজার কাছে যাবেন না। নির্ঘাত মেরে ফেলবে। অন্যদের সাথে কথা বলেছি আমি। পুরো বাহিনী আপনার পেছনে আছে। আপনি অনুমতি দিন, আগামী সূর্যোদয়ের আগে আপনাকে রাজার আসনে বসাবো আমরা।

একবার বলেছো, ঠিক আছে, নরম স্বরে তাকে বললো ট্যানাস, আর একবার ওই কথা তোমার মুখে শুনলে আমি নিজে তোমাকে রাজার হাতে তুলে দেবো; মেয়ডেসের পুত্র কাতাস।

আমাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে এরপর ট্যানাস বললো, দেরি হয়ে গেলো, বন্ধু। দেবতারা আমাদের উপর রুষ্ট । রাজার শুভ-বুদ্ধির কাছে এখন নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া উপায় নেই। যদি সত্যিই তিনি দেবতা হন, তবে আমার হৃদয়ের নিষ্কলুষতা তার চোখে ধরা পড়বে। আলতো করে আমার হাত স্পর্শ করলো সে, লসট্রিসকে জানিয়ে, কী ঘটেছে। বলল, আমি ওকে ভালোবাসি; যাই ঘটুক না কেন, এই জীবন আর পরবর্তি যতো জীবন আছে–আমি ভালবাসবো ওকে। বলো, প্রয়োজন হলে চিরকাল অপেক্ষা করবো আমি।

এরপর অস্ত্র খাপবন্দী করে বাজপাখির প্রতীক বাহকের উদ্দেশ্যে এগুলো ট্যানাস। রাজার আহ্বানে আত্মসমর্পণ করলাম আমি।

পেছনে, অস্ত্রের অসহিষ্ণু নড়াচড়ায়, হিসহিস শব্দে নিজেদের অননুমোদন প্রকাশ করলো তার যোদ্ধারা, কিন্তু পিছনে ফিরে তীব্র ভু-কুটিতে তাদের নিবৃত্ত করলো ট্যানাস। নেতেরের নির্দেশে রাজার রক্ষীরা ওকে ঘিরে ধরে খালের পাশের হাঁটা-পথ ধরে রওনা হয়ে গেলো নেক্রোপোলিসের উদ্দেশ্যে।

অসহিষ্ণু যোদ্ধার দলকে পেছনে ফেলে একটু দূরত্বে আমিও অনুসরণ করে চললাম রাজকীয় রক্ষীদের। মৃতের নগরীতে পৌঁছে সোজা লসট্রিসের প্রকোষ্ঠের উদ্দেশ্যে ছুটলাম। নেই ও। দাস মেয়েগুরো সিডার কাঠের বড়ো একটা বাক্সে কাপড় গোছাচ্ছে।

তোমাদের মনিব কোথায়? আমার প্রশ্নের উত্তরে সবচেয়ে বড় মেয়েটা নাক উঁচু করে বললো, যেখানে তুমি তার নাগাল পাবে না, ব্যাটা খোঁজা।

আমার প্রতি লসট্রিসের পক্ষপাতিত্বে এরা সবাই দারুন ঈর্ষান্বিত।

সোজা করে উত্তর দাও, না হয় মেরে পাছার ছাল তুলে নেবো। এহেন অভব্য হুমকিতে কাজ হলো, মসৃণ গলায় সে জানালো, ওরা তাকে ফারাও-এর হারেমে নিয়ে গেছে। কিছুই করার নেই তোমার ওখানে। শুনেছি, এমনকি খোঁজা ব্যাটাদেরও হারেমের ভেতরে যেতে দেয় না ওখানকার পাহাড়াদারেরা।

ঠিকই বলেছে সে, কিন্তু আমাকে তো চেষ্টা করতেই হবে। আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এখন মিসট্রেসের। যা ভেবেছিলাম, রাজার হারেমের রক্ষীরা খুব কড়া। ওরা চেনে আমাকে, কিন্তু তাদের উপর নির্দেশ আছে এমনকি লসট্রিসের নিকটাত্মীয়দেরকেও যেনো প্রবেশ করতে দেওয়া না হয়।

একটা স্বর্ণের আংটির বিনিময়ে আমার বার্তা লসট্রিসের কাছে পৌঁছানোর বন্দোবস্ত করলাম। প্যাপিরাসের টুকরোয় উৎসাহব্যঞ্জক কিছু কথা লিখে নিলাম দ্রুত। ট্যানাসের ভাগ্যে কী ঘটেছে–এসব কিছুই জানানোর সাহস হলো না। দুঃখের বিষয়, পরে জেনেছিলাম সেই বার্তা কখনও পৌঁছেনি লসট্রিসের কাছে। এই দুনিয়ায় কী কাউকেই বিশ্বাস করার যো নেই?

ওসিরিসের উৎসবের শেষ দিনের আগে ট্যানাস বা মিসট্রেসের সাথে আর দেখা হয়নি আমার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *