১. তরল রুপোর উজ্জ্বলতা

রিভার গড – উইলবার স্মিথ
অনুবাদ : মখদুম আহমেদ

উৎসর্গ

হুমায়ুন আজাদ—

জানি না, এই অনুবাদটি হাতে পেলে তিনি পড়তেন কিনা;
পড়লে হয়তো তীব্র-তীক্ষ অসাধারণ সমালোচনায় বিদ্ধ করতেন,
অথবা, হয়তো দুএক ছত্র প্রশংসাও মিলতো।
দুটোই আমার জন্যে হতো সমান আনন্দের।

.

রিভার গডের জন্যে প্রশংসা

খুব কম ঔপন্যাসিক আছেন যাদের বর্ণনাশৈলী এততটা নিখুঁত- যেনো চোখের সামনে ঘটে চলেছে ব্যাপারগুলো…স্মিথ নিঃসন্দেহে তাদের একজন। তার প্রাচীন মিশরের উপাখ্যান অত্যন্ত চমকপ্রদ।

-অ্যানিস্টন স্টার।

প্রাচীন মিশরের উঁচু মানসম্পন্ন সাহিত্যের সঙ্গে টক্কর লাগিয়েছেন স্মিথ, জন্ম নিয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ এপিক।

-দ্য লন্ডন টাইমস্ ।

চমৎকার ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রের মতো ভালো এবং মন্দের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটেছে বইটির…. সুলিখিত, চমকপ্রদ।

-লেক্সিটন হেরাল্ড-লিডার।

প্রচন্ড শক্তিমাণ লেখক তার সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে রচনা করেছেন উপভোগ্য অ্যাডভেঞ্চার… রিভার গড়, একটি সুলিখিত সম্পূর্ণ উপন্যাস… এমন একটি সময়ের গল্প, যখন ইতিহাস এবং কিংবদন্তি মিলেমিশে একাকার।

-স্যান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকল।

রুদ্ধশ্বাসে পড়ার মতো।

-ডালাস মর্নিং নিউজ।

একবার শুরু করলে ছাড়তে মন চাইবে না… ষড়যন্ত্র, রোমান্স, লোভ, নিষ্ঠুরতা এবং অসাধারণ ঘটনাবলীর মিশেল… দারুণ উপভোগ্য।

-এল পাসো হেরাল্ড-পোস্ট।

.

ভূমিকা

উইলবার স্মিথের অত্যাধিক আলোচিত উপন্যাস, রিভার গড বা নদী-ঈশ্বর-এর কাহিনীর সত্যতা নিয়ে বিতর্ক আছে, আছে তুমুল জল্পনা-কল্পনা। বইয়ের সমাপ্তিতে লেখকের বক্তব্য এই বিতর্কের মূল কারণ, বইটির অসাধারণ জনপ্রিয়তার পর তিনি লিখেছেন এর সিকুয়েল। চার হাজার বছর আগের মিশরীয় ক্রীতদাসের মূল কাহিনী থেকে লেখক কতটুকু কাব্যিক স্বাধীনতা নিয়েছেন, সে বিতর্কে আমরা যাবো না। অনুবাদ প্রসঙ্গে বলতে পারি, প্রাচীন পটভূমির ভাব-গাম্ভির্য্য এবং সম্রাট-সম্রাজ্যের বর্ণনা ফুটিয়ে তোলার জন্যে আলঙ্কারিক ভাবটুকু আনা হয়েছে অনুবাদে। বহুদিন ধরেই উইলবার স্মিথের এই উপন্যাসটি অনুবাদের ইচ্ছে ছিলো, অবশেষে প্রকাশক রিয়াজ খানের নিরবচ্ছিন্ন উৎসাহ এবং সমর্থনে শেষ হলো পরিশ্রম-সাধ্য এই কাজ। আমার জানা মতে, বাঙলা ভাষায় এটিই উইলবার স্মিথের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ। চারহাজার বছর আগের পটভূমিতে রচিত হওয়ায় ভাষার আভিজাত্য উপন্যাসটির একটি বড়ো দিক। প্রচন্ড ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে অনুবাদ-কর্ম চালাতে হয়েছে; কিন্তু যে কোনো ভুল-ভ্রান্তির সবটুকু দায় আমারই। ইংরেজী শব্দ যথাসম্ভব পরিহার করে চেষ্টা করেছি বাংলা শব্দ ব্যবহারের । ভিন্ন কোনো অনুবাদ-উপন্যাসে হয়তো এর তেমন প্রয়োজন নেই- মূল ইংরেজী শব্দ বরঞ্চ অনেকক্ষেত্রে মানানসই হয় সেখানে। কিন্তু রিভার গডের বাঙলা রুপান্তরে প্রাচীন ভাব ফুটিয়ে তোলা নিতান্তই প্রয়োজনীয় ছিলো। বানানরীতি এবং বিশেষ কিছু আধুনিক শব্দ ও পংক্তির জন্যে ঋণী হয়ে রইলাম বাঙলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী এবং গবেষক প্রয়াত হুমায়ুন আজাদের নিকট ।

সবশেষে, উপন্যাসের শেষে লেখকের বক্তব্যে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই ভূমিকার সমাপ্তি টানছি।

মখদুম আহমেদ
ধানমন্ডি, ঢাকা।
১/০৫/০৭

.

তরল রুপোর উজ্জ্বলতা নিয়ে মরুর বুক চিরে বয়ে চলেছে নীল নদ। তাপ-তরঙ্গে ঝাপসা দেখায় আকাশ নির্দয় সূর্য আগুন ঢালছে অবিরত। দাবদাহের প্রচণ্ডতায় নৃত্যরত নদীর বাঁকের রুগ্ন পাহাড়শ্রেনী, তাপ-মরীচিৎকার ভেতর কেঁপে কেঁপে উঠছে।

প্যাপিরাসের ঝোঁপ ঘেঁষে চলছিলো আমাদের নৌকো। ছোটো ছোটো ঢেউগুলো ছলকে আঘাত হানছিলো জলাভূমির পাড়ে, গলুইয়ে বসে থাকা মেয়েদের সুললিত কণ্ঠের গানের সাথে কেমন অদ্ভুত ছন্দে বেজে চলছিলো সেই শব্দ।

লসট্রিসের বয়স তখন সবে চৌদ্দ। প্রথমবারের মতো এদিন ওর শরীরে নারীত্বের ফুল ফুটেছে, একই দিনে বছরের মতো বান ডেকেছিল নীলের বুকে বিষয়টাকে দেবতাদের আশীর্বাদপুষ্ট বলে মনে করেছেন হাপির মন্দিরের পুরোহিতেরা। তারাই ওর নাম রেখেছেন লসট্রিস; অর্থাৎ জলের মেয়ে।

সেদিনের ওর কথা আমার পরিষ্কার মনে পড়ে। সামনের বছরগুলোয় আরো কমনীয়, আরো রাজকীয় আর খোলতাই হয়েছিলো তার সৌন্দর্য; কিন্তু সেদিনের সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত কুমারী শরীরের যে আভা ফুটে উঠেছিলো ওর অবয়বে, তা বোধকরি আর কখনও ঘটেনি। নৌকার প্রতিটি মানুষ, এমনকি দাঁড়-টানা যোদ্ধারা পর্যন্ত অনুভব করেছিলো সেটা। আমি তো বটেই, কেউই চোখ সরাতে পারেনি ওর উপর থেকে। এই অনিন্দ-সৌন্দর্য আমাকে নিজের অপ্রাপ্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। গভীর হাহাকার উঠে বুক জুরে। যদিও আমি একজন অপুরুষ, তথাপি নারী দেহ আস্বাদনের পরেই খোঁজা করা ছুরি চালানো হয়েছিলো আমার উপর।

টাইটা, ডাকলো সে আমাকে। আমার সঙ্গে গাও!

আমি গাইতে শুরু করতেই আনন্দে মুখ ঝলমল করে উঠলো লসট্রিসের। অন্যান্য বহু কিছুর মতো আমার কণ্ঠস্বর তার খুব প্রিয়; ওর মিষ্টি গলার সাথে বেশ মিলে যায় আমার উঁচু তানের স্বর। আমার শেখানো কৃষকের পুরোনো একটা প্রেমের গান গাইছিলাম আমরা, লসট্রিসের দারুন প্রিয়:

শরবিদ্ধ কোয়েলের মতো ছটফট করে এই প্রাণ
যখন প্রিয়তমের মুখখানি দেখি
আর আমার কপোলে লালিমা জাগায়
তার সেই হাসি–

নৌকার পেছন থেকে আর একটি কন্ঠস্বর যোগ দেয় আমাদের ঐকতানে। একজন পুরুষের গলা। গম্ভির, শক্তিশালী–আমার স্বরের স্বচ্ছতা বা শুদ্ধতা তাতে নেই। আমারটা যদি হয় সকালের ঘুমভাঙানি পাখির, তো এরটা তরুণ সিংহের।

মুখ ফিরিয়ে হাসলো লসট্রিস, নীল নদে সূর্যকিরণ জাগল যেন। যার জন্যে এই হাসি, সে যদিও আমার বন্ধু; বলা ভালো, পৃথিবীতে আমার একমাত্র সত্যিকারের বন্ধু–বুকের গভীরে ঈর্ষার জ্বলুনি ঠিকই টের পেলাম। তবুও, ট্যানাসের দিকে ফিরে জোর করে হাসলাম আমিও, যার উদ্দেশ্যে ভালোবাসার হাসি হাসছে লসট্রিস।

ট্যানাসের বাবা পিয়াংকি, প্রভু হেরাব ছিলেন মিশরের অন্যতম রাজকীয় সভাষদ; তবে তার মা ছিলেন মুক্ত এক তেহেনু দাসের কন্যা। ট্যানাসের বালক বয়সে জলাভূমির জ্বরে মারা যায় তার মা, তবে লোকমুখে শুনেছি মিশরের দুই সাম্রাজ্যে তার মতো রূপসী পাওয়া ছিলো ভার।

ট্যানাসের বাবাকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনতাম। বেশ ভালো মনের মানুষ ছিলেন, প্রায় ফারাওয়ের সম-পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকা অবস্থাতেই সবকিছু হারিয়েছিলেন। যতোটা না সৌন্দর্য ছিলো, তার চেয়ে বেশি শক্তিমত্তা ছিলো তার। আর মনটা ছিলো একেবারে সাদা। হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই উদার ছিলেন। তাই নিজ বন্ধুদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে ফারাওয়ের সু-নজর হারিয়েছিলেন।

বিপুল ধন-সম্পদ ছাড়া বাবা-মার সব ভালো দিকগুলো পেয়েছে ট্যানাস। শক্তি মত্তায় বাপের মতো, সৌন্দর্যে ঠিক যেনো মা। তো, আমার কর্ত্রী যদি তাকে ভালবাসে, অনুতাপ করার কী আছে আমার? আমিও তাকে ভালোবাসি মনের গভীরে ঠিকই জানি, দেবতারা যদি হঠাৎ করে ক্রীতদাসের নিচু বর্ণ থেকে আমার মর্যাদা বাড়িয়েও দেন; ওকে আমি পাবো না কোনো দিনও। নপুংসক যে আমি। এরপরেও, মানবাত্মার স্বভাবই এমন, অসম্ভবের সুখ-স্বপ্ন আমার ভেতরটা তোলপাড় করে ফেলে।

পায়ের কাছে দুটো মিশমিশে কালো দাসী মেয়েকে নিয়ে গলুইয়ের কাছে বসেছে লসট্রিস। কুশ দেশের মেয়ে ও দুটো আস্ত বজ্জাত গলার চারপাশে সোনার কলার ছাড়া উদোম গা। লসট্রস নিজেও পরিশুদ্ধ লিনেনের একটা আঁটো জামা পরে আছে কেবল, ঝকঝকে সাদা রঙ ওটারঠিক যেনো সারসের পাখার মতো। ওর শরীরে উপরিভাগের বর্ণ তেল দেওয়া সিডারের মতো রোদে পোড়া, বিব্লসের ওপারের পর্বতে জন্মায় গাছগুলো। বুক জোড়ার আকৃতি ডুমুরের মতো, ডালিম দানার মতো লালচে হয়ে আছে বৃন্ত দুটো।

রাজকীয় পরচুলা একপাশ সরিয়ে রেখেছে সে। চুলগুলো একপাশে টেনে বেণী করেছে, মোটা বাদামী দড়ির মতো একটা বুকের উপর পরে আছে সেটা। ওর চোখের জাদুকে আরো মোহনীয় করেছে উপরের পাতায় ছোঁয়ানো নীলচে-সবুজ প্রসাধনী। লসট্রিসের চোখের রঙও অবশ্য সবুজ, শুকনো মরশুমের নীল নদের জলের মতো স্বচ্ছ। দুই বুকের মাঝখানে স্বর্ণ আর ল্যাপিস লাজুলিতে কারুকার্য করা নীল-নদের দেবী হাপির অবয়বের হার পরে আছে লসট্রিস। অসাধারণ একটা শিল্পকর্ম ওটা, নিজ হাতে ওরই জন্যে তৈরি করেছি আমি।

হঠাৎই মুঠো করা হাত মাথার উপরে তুলে ধরে ট্যানাস। একইসঙ্গে দাঁড় টানা থামিয়ে নিজেদের বৈঠা উঁচু করে পানির উপর ধরে রাখে দাড়ীরা, সূর্যালোক ঝিকমিক করছে তাদের দাঁড়ের ডগা থেকে ঝরে পড়া রূপালি পানিতে। এরপরে হাল ঘুরিয়ে দেয় ট্যানাস; ওপাশের দাঁড়ীরা পেছন দিকে বাইতে থাকে। সবুজ পানিতে তোলপাড় তুলছে বৈঠার আঘাত। এ পাশের দাঁড়ীরা সামনে টানতে লাগলো প্রাণপণে। এতো দ্রুত ঘুরে গেলো নৌকার নাক, বিপদজনক ভঙিতে কাত হয়ে গেলো ওটা। কিন্তু এরপরেই সামনে ছুটলো। চোখা গলুই, দেবতা হোরাসের নীল চক্ষু অঙ্কিত; ঘন প্যাপিরাস ঝোঁপের উপর দিয়ে হিঁচড়ে নদীর মূল স্রোতধারা ছেড়ে শান্ত পানির ছোটো একটা হ্রদে পড়লো।

গান থামিয়ে, চোখের উপরটা হাত দিয়ে আড়াল করে সামনে তাকাল লসট্রিস। ওই তো! চিৎকার করে উঠলো সে, ছোট্ট-কমনীয় হাত দিয়ে সামনে দেখাচ্ছে ।হ্রদের দক্ষিণ প্রান্ত পুরো ঘিরে রেখেছে ট্যানাসের নৌবহরের অন্যান্য জলযান; মূল নদীর প্রবেশ মুখ আটকে রেখেছে।

স্বাভাবিকভাবেই উত্তরে অবস্থান নিয়েছে ট্যানাস; তার জানা আছে, এখানটাতেই হিংস্র শিকারের দেখা মিলবে বেশি। আমি প্রার্থনা করছিলাম, তা যেনো না হয়। এমন নয় যে আমি একজন কাপুরুষ; তবে কি না আমার কর্ত্রীর নিরাপত্তার কথাও তো । ভাবতে হয় আমাকে! বেশ ষড়যন্ত্র করেই হোরাসের প্রশ্বাস নৌকায় অবস্থান করে নিয়েছে সে, প্রতিবারের মতোই এবারেও এতে আমার বেশ বড় একটা ভূমিকা ছিলো। ওর বাবা যদি টের পায় শিকারে এসেছে লসট্রিস, যা তিনি পাবেনই, সেক্ষেত্রে আমার অবস্থা বেগতিক হতে পারে। আর যদি এটা জানতে পারেন, হোরাসের প্রশ্বাসে পুরো একদিন ট্যানাসের সংস্পর্শে ছিলো লসট্রিস; এমনকি আমার প্রতি তার সদয় স্নেহও বাঁচাতে পারবে না আমাকে। তরুণ ট্যানাসের সম্পর্কে তাঁর নির্দেশ নিয়ে ভুল করার কোনো অবকাশ নেই।

হোরাসের প্রশ্বাসে এই মুহূর্তে সম্ভবত আমি একমাত্র প্রাণী, যে কি না শিকার নিয়ে উত্তেজিত নই। বাকিরা রীতিমতো টগবগ করে ফুটছে। হাতের ঝাঁপটায় ইশারা করলো ট্যানাস, ধীরে স্থির হলো নৌকা। হ্রদের সবুজ পানিতে অল্প অল্প দুলছে ওটা। এতো স্বচ্ছ, শান্ত পানি উঁকি মেরে নিজের অবয়ব দেখলাম আমি তাতে। প্রতিবারের মতোই নিজের সৌন্দর্যে অবাক হতে হলো, নীলপদ্মের চেয়েও যেনো কমনীয় আমার মুখাবয়ব। নৌকার উপরের ব্যস্ততা আমার নিজ-সৌন্দর্য উপভোগে ছেদ টানলো।

ট্যানাসের অধস্তন একজন যোদ্ধা নৌকার মাস্ট হেডে পতাকা টানিয়ে দেয়। নীল কুমীরের ছবি মুখ হা, কাঁটাওয়ালা ভীষণ লেজটা খাড়া হয়ে আছে। দশ হাজারের সেরা উপাধি-প্রাপ্ত একজন সৈন্যেরই কেবল নিজস্ব প্রতীক টাঙানোর অধিকার আছে। ফারাও-এর নিজস্ব রাজকীয় বাহিনী, নীল কুমীরের নেতৃত্বের পাশাপাশি দশ হাজারের সেরা উপাধিও পেয়েছে ট্যানাস। বিশতম জন্মদিনের আগেই এতোকিছুর মালিক হয়েছে সে।

মাস্টহেডের ওই সংকেতের অর্থ হলো, শিকার শুরুর আহবান। দূর দিগন্তে বিন্দুর মতো অন্যান্য নৌকাগুলোর বৈঠা ছন্দোবন্ধভাবে উঠানামা শুরু করে, ঠিক যেনো আকাশে ভাসমান বুনো হাঁসের পাখার মতো; সূর্য রশ্মি চমকাচ্ছে তাদের বৈঠা থেকে ঝরে পরা পানিতে লেগে। নৌকাগুলোর পেছন থেকে উৎসারিত ছোটো ছোটো ঢেউগুলো ছড়িয়ে পরে শান্ত পানির উপর অনেকক্ষণ ধরে জেগে থাকে।

স্টার্ন থেকে গং টা বের করলো ট্যানাস, লম্বা-ব্রোঞ্জের একটা নল ওটা। প্রান্তটা। পানিতে ডুবিয়ে দেয় সে। একই ধাতুতে তৈরি একটা হাতুড়ির বাড়িতে যে শব্দ তৈরি হবে, পানির তলা দিয়ে তা পৌঁছে যাবে আমাদের শিকারের কাছে। শুরু হতে যাচ্ছে এক দক্ষ-যজ্ঞ ।

আমার উদ্দেশ্যে হাসলো ট্যানাস। এতো উত্তেজনার মধ্যেও আমার উদ্বেগ নজরে পরেছে তার। বর্বর এক যোদ্ধার বিচারে প্রচণ্ড অনুভব আছে ওর। এখানে এস, টাইটা! নির্দেশ করে সে। তুমি বরঞ্চ আমাদের পক্ষ থেকে গং টা বাজাও আজ। এতে করে তোমার সুন্দরী সম্পত্তির নিরাপত্তা নিয়ে অমূলক দুঃশ্চিন্তা থেকে রেহাই পাবে।

তার এহেন অভদ্রতায় আঘাত পেলেও স্টার্ন টাওয়ারের নিরাপদ আশ্রয় যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকলো আমাকে। ওর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় খর চোখে তাকালাম। আমার মিসট্রেসের নিরাপত্তার দিকে একটু নজর রেখ। বুঝতে পারছো তো? কোনো রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ওকে উৎসাহ দেবে না, তোমার তুলনায় কম বন্য নয় সে। ফারাও বাহিনীর বীর যোদ্ধা, দশ হাজারের সেরা উপাধিপ্রাপ্ত কারও সাথে ওই সুরে কথা বলতে পারি আমি, কেননা একদা আমার ছাত্র ছিলো সে। বহুবার শাস্তিও দিয়েছি তাকে। সেই আগের দিনগুলোর মতোই দুষ্ট হাসলো ট্যানাস।

মেয়েটাকে আমার হাতে ছেড়ে দাও, বুড়ো বন্ধু। এর চেয়ে বেশি আর কিছু কখনও চাইনি আমি, বুঝলে? টাওয়ারে উঠতে এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম, এই বেয়াদপির উপযুক্ত জবাব দেওয়া হলো না। ওখানে দাঁড়িয়ে দেখলাম, নিজের ধনুক হাতে নিচ্ছে ট্যানাস।

ইতোমধ্যেই সেনাবাহিনীতে বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছে ওই ধনুকটা। সত্যিই, সেই জলপ্রপাত থেকে শুরু করে সাগর পর্যন্ত নীল নদের তীরে সবাই জানে ওটার কথা। জিনিসটা আমি তৈরি করেছিলাম ওর জন্যে, প্রচলিত অস্ত্র সম্পর্কে বেশ বিরক্ত ছিলো সে। আমাদের নদী-বিধৌত উপত্যকায় পাওয়া দুর্বল কাঠের ধনুকের বদলে নতুন কোনো উপাদান দিয়ে তৈরির পরামর্শ দিয়েছিলাম প্রথমটায়। হয় হিটটিদের এলাকার অলিভ গাছের কাণ্ড, অথবা, কুশ দেশীয় কোনো গাছের শাখা থেকে। এমনকি, গন্ডারের শিং বা হাতির দাঁতের কথাও ভেবেছিলাম।

তৈরির প্রাথমিক পর্যায়ে দেখা গেলো, ওই সমস্ত বস্তু অত্যন্ত দৃঢ়, মোটেও নমনীয় নয়। না ভেঙে বাঁকানো এক কথায় অসম্ভব। কেবল মাত্র বিশাল কোনো হাতির শুড়ের পক্ষেই তীর টানা সম্ভব এমন ধরনের ধনুক থেকে। হাতির দাঁতের সাথে কিছুটা রুপা মিশিয়ে শেষমেষ একটা ধনুক অবশ্য বানিয়েছিলাম, কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো ওটা টানার মতো মানুষ পাওয়া সম্ভব নয়।

যা হোক, আমাদের নির্ধারিত চারটি বই একত্রে গেঁথে শেষমেষ বানানো হয়েছিলো অস্ত্রটা অলিভ গাছের কাণ্ড, ইবোনি, শুড় এবং আইভরি । বহুমাসের প্রাণান্ত পরিশ্রম, অনুশীলনের পরেই সম্ভব হলো সেটা; বিশেষ আঠা প্রয়োজন হয়েছিলো জোড়া লাগাতে। শক্তিশালী একটা আঠা খুঁজে পেতে দারুন বেগ পেতে হয়েছে, ধাতব তার দিয়ে বেঁধে সমাধান করা হয়েছিলো সমস্যাটার। আঠা গরম থাকা অবস্থাতে ট্যানাস সহ আরো দুইজন মুশকো জওয়ান লেগেছিলো তারটা বাঁকা করতে। ঠাণ্ডা হতে শক্তিমত্তা আর স্থিতিস্থাপকতার এক উৎকর্ষ নিদর্শন হলো ধনুকটা।

এরপরে বিশাল কালো কেশরওয়ালা এক সিংহের নাড়ি কেটে সংগ্রহ করেছিলাম আমি। মরুর এই হিংস্র জানোয়ারটাকে ট্যানাসই মেরেছিল ওর ব্রোঞ্জের বর্শা দিয়ে। রোদে শুকিয়ে, বেণী বেঁধে নাড়ির ওই ফিতে দিয়ে বানিয়েছি ধনুকের ছিলো; ফলে যে অসাধারণ শক্তিশালী অস্ত্র জন্ম নিলো, তা ব্যবহার করতে হলে একশ যোদ্ধার শক্তি প্রয়োজন।

তীর-বিদ্যার নিয়ম হলো, শিকারের দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে–এরপরে ছিলা টেনে নিয়ে আসতে হয় বুকের দিকে টেনে; নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধরে রেখে ছেড়ে দিতে হয় তীর। কিন্তু এমনকি ওই ধনুক টেনে ধরে রাখা ট্যানাসের পক্ষেও সম্ভব ছিলো না; নতুন এক ধরন আবিষ্কার করতে হলো তাকে। শিকারের মুখোমুখি না দাঁড়িয়ে, পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে তীর চালনা; প্রসারিত বাঁ হাতে ধনুকটা রেখে ক্রমাগত টেনে চলা যতক্ষণ পর্যন্ত না তীরের পালক তার ঠোঁট ছোয়; এরপরে, যেনো তাক না করেই তীর ছেড়ে দেয় সে। হাত এবং বুকের মাংস পেশীর অকল্পনীয় জোর প্রয়োজন এমন কৌশলে।

প্রথমটায় চাক ভেঙে ছুটে চলা মৌমাছির মতোই দিক-বিদিগ ছুটত ট্যানাসের ছোঁড়া তীর, কিন্তু দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পরিশ্রম করে গেলো সে। ধনুকের ছিলার ঘর্ষণে ডান হাতের আঙুলগুলো রক্তাক্ত হলো, কিন্তু চালিয়ে গেলো সে। তীর ছোঁড়ার সময়ের ঘষায় বাঁ হাতের ভেতরের অংশ কালো হয়ে গেছিল, পরে চামড়ার একটা আবরণ বানিয়ে দিয়েছিলো আমি সেজন্যে। আর অনুশীলনের ধারা অব্যাহত রেখেছিলো ট্যানাস।

এমনকি আমি পর্যন্ত এ অস্ত্র ব্যবহারে তার পারদর্শিতা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম, কিন্তু ট্যানাস হাল ছাড়েনি। ধীরে, খুবই ধীরে ওটার নিয়ন্ত্রণ পেতে শুরু করে সে, এক সময় এসে শূন্যে একটির পর একটি করে পরপর তিনটি তীর ছুঁড়তে শিখে যায়। তাদের মধ্যে অন্তত দুটি কী তিনটি টার্গেটে লাগতো। মানুষের মাথার আকারের তামার একটা চাকতি হলো টার্গেট, ট্যানাসের ছোঁড়ার জায়গা থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে । এতটাই গতিবেগ ছিলো ছোঁড়া তীরগুলোর, আমার কড়ে আঙুলের সমান পুরুত্বের তামার পাত ফুটো করে বেরিয়ে যেতো ওগুলো।

ট্যানাস অস্ত্রটার নাম রেখেছে লানাটা। মজার ব্যাপার হলো, আমার কর্ত্রীর ছোটো বয়সের নামও ছিলো সেটা। আর এখন, হাতে প্রিয় ধনুক নিয়ে নৌকার পাটাতনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে, পাশে তার মানসপ্রিয়া। কী অদ্ভুত মানিয়েছে ওদের দুজনকে। আমার মনের অশান্তি বাষ্প ছড়ায়।

চেঁচিয়ে ডাকলাম, মিসট্রেস! এখনই ফিরে আস এখানে! জলদিএমনকি কাঁধের উপর দিয়ে তাকালো না পর্যন্ত লসট্রিস; কেবল হাত দিয়ে একটা ইশারা করে দেখালো আমাকে। নৌকার সবাই দেখেছে ব্যাপারটা, জোরে হেসে ফেললো বয়োজেষ্ঠ্য কয়েকজন। ওই কালো, শয়তানের ধারী মেয়ে দুটোর কাছ থেকে নির্ঘাত এই ইশারা শিখেছে সে। নদী তীরের বর্বরদের মেয়েদের পক্ষে শোভন এমন আচরণ, প্রভু ইনটেফের মেয়ের পক্ষে নয়। একবার ভাবলাম, এটা নিয়ে তীরস্কার করবো ওকে, পরে বাদ দিলাম চিন্তাটা। আমার মিসট্রেস কখনও কখনও এ ধরনের বাজে আচরণ করে বৈকি। পরিবর্তে, মনের ঝাল মেটাতে তামার গংটা পেটাতে লাগলাম আমি।

ল্যাগুনের আয়নার মতো স্বচ্ছ পানির উপর দিয়ে ছড়িয়ে পরে কাঁপা কাঁপা, প্রতিধ্বনিত আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গেই বাতাসে ডানা মেলে ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ি; নল খাগড়ার বন আর প্যাপিরাসের ঝোঁপের আড়াল থেকে–সূর্যটাকে যেনো লুকিয়ে ফেলবে পাখির মেঘ। মুক্ত পানি, ছোটো ছোটোদের উপরের বাতাসে ডানা ঝাঁপটাতে থাকে ওগুলো বিচিত্র রকমেরঃ কালো আর সাদা আইবিস এবং শকুনের মাথার মতো নদীর দেবীর সমতুল্য বলে মনে করা হয়; বুনো রাজহাঁস–বুকের ঠিক মাঝখানটায় রক্ত লাল একটা ফোঁটা সমেত; মাঝরাতের অন্ধকারের মতো বা সবজেটে নীল হিরন। সংখ্যায় এত–দর্শকের চোখে ধাঁধা লেগে যাবে।

মিশরীয় আভিজাত্যের একটি হলো বন্য-পাখি শিকার, কিন্তু আজ সেই শিকারে আসি নি আমরা। সেই মুহূর্তে, দূরে স্বচ্ছ জলের ঠিক নিচে একটা তোলপাড় লক্ষ্য করলাম আমি। বিশাল, বিরাট কোনো জg। আনন্দে বুক কেঁপে উঠল; জানি, কীসে করেছে ওটা। ট্যানাসও দেখেছে; তবে তার অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন। হিংস্র শিকারী কুকুরের মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠে সে; তার লোকেরা প্রকম্পিত চিল্কারে দাঁড় টানতে থাকে প্রাণপণে। ঠিক আকাশ কালো করে ফেলা পাখির ঝাকের মতোই যেনো উড়তে চায় হোরাসের প্রশ্বাস, আনন্দের আতিশায্যে ছোটো একটা চিৎকার করলো আমার মিসট্রেস; ট্যানাসের উন্মুক্ত বাহুতে মুঠো করা হাত দিয়ে আঘাত করছে সে।

আবারো আলোড়িত হলো সামনের পানি, ট্যানাসের ইশারায় সেই আন্দোলনকে অনুসরণ করে দাঁড় টেনে চলে যোদ্ধারা। যেনো নিজের সাহস বা ভরসা জিইয়ে রাখতেই গংটা পিটিয়ে চললাম আমি। শেষবার যেখানে আলোড়ন দেখা গেছে, পানির উপরে ঠিক সেইখানটায় পৌঁছলাম আমরা। থেমে আছে আমাদের নৌকা; পাটাতনে দাঁড়ানো প্রতিটি মানুষ তন্ন তন্ন করে পানিতে সামান্যতম আলোড়ন খুঁজছে।

একমাত্র আমি সরাসরি স্টার্নের উপর থেকে তাকালাম। নৌকার হালের ঠিক নিচে পানি একদম অগভীর, বাতাসের মতো স্বচ্ছ, পরিষ্কার। লসট্রিসের মতো করে তীক্ষ্ণ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলাম আমাদের ঠিক নিচেই আছে দৈত্যটা!

নীল নদের দেবী হাপির বেশ নিকটাত্মীয় প্রাণী হলো জলহস্তি। কেবল তাঁর বিশেষ অনুগ্রহেই ওটা শিকার করতে পারি আমরা। সেই সকালেই অনুমতি প্রার্থনার জন্যে তার মন্দিরে বলিদান করে এসেছে ট্যানাস; লসট্রিস ছিলো তার পাশে। হাপি হলেন আমার কর্ত্রীর প্রিয় দেবী; তবে আমি নিশ্চিত, শুধু এই কারণেই প্রার্থনা অনুষ্ঠানে আগ্রহভরে যোগ দেয়নি সে।

যে জলহস্তিটা দেখেছি আমাদের নিচে, ওটা একটা বুড়ো ষাঁড়। আমার চোখে আমাদের গ্যালির মতোই বড় দেখাল ওটাকে; বিরাট একটা আকৃতি হ্রদের মেঝেতে হেলেদুলে চলেছে। স্রোতের টানে ধীর হয়ে গেছে গতিবেগ, মনে হলো যেনো দু:স্বপ্ন থেকে উঠে আসা কোনো জীব। মরুভুমির ষাড় যেমন করে দৌড়ানোর আগে খুর দিয়ে ধুলো আঁচড়ায়, তেমনি করে কাঁদার দলা গোলা পাকিয়ে উঠছে ওটার পায়ের তলা থেকে।

হাল ধরে, নৌকাটা ঘুরিয়ে নেয় ট্যানাস; বঁড়টার পেছনে ছুটতে শুরু করে হোরাসের প্রশ্বাস। কিন্তু এমনকি ধীর, হেলেদুলে চলা গতিতেও খুব দ্রুতই আমাদের নৌকা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে ওটা। সামনে, হ্রদের গভীর সবুজ জলে হারিয়ে যায় তার অবয়ব।

টানো! সেথ –এর দুর্গন্ধময় শ্বাসের কসম, টানো! দাড়ীদের উদ্দেশ্যে গর্জে উঠে ট্যানাস। কিন্তু এক পদস্থ যোদ্ধা তার হাতে চাবুক তুলে দিতে নিঃশব্দে মানা করলো সে। প্রয়োজন ছাড়া কখনও কারো উপর চাবুক চালাতে দেখিনি ওকে।

হঠাই, সামনে পানি ছেড়ে জেগে উঠে জলহস্তি ষাড়, ফুসফুঁসের ভেতর থেকে বাষ্প ছিটিয়ে দেয় হিসহিস শব্দে। এতো দূরে আছে ওটা, এরপরেও দুর্গন্ধময় শ্বাস ধুয়ে দেয় আমাদের। এক মুহূর্তের জন্যে ওটার বিশাল পেছনটা চকচকে গ্রানাইটের মতো জেগে থাকে হ্রদের পানিতে; এরপরে, বাঁশির মতো শব্দে শ্বাস টেনে আবারো ডুব দেয়।

পেছনে লেগে থাকো! হুঙ্কার ছাড়ল ট্যানাস।

ওই তো, চিৎকার করে উঠে হাতের ইশারায় পাশে দেখালাম আমি, ফিরে আসছে ওটা!

দারুন দেখালে, বুড়োখোকা, আমার উদ্দেশ্যে হাসলো ট্যানাস, তোমাকে ঠিক ঠিক যোদ্ধা বানাতে পারবো আমরা, এখনও সময় আছে। একেবারেই বাজে কথা এটা, আমি একজন লিপিকার, গীতি-নাট্যকার বা শিল্পী হতে পারি যোদ্ধা কখনও নই। আমার যুদ্ধ চলে মনের গভীরে। এরপরেও ট্যানাসের প্রংশসায় সবসময়ের মতোই আপ্লুত হলাম। নৌকার উপরের উত্তেজনার বুঝি কোনো সীমা-পরিসীমা নেই এই মুহূর্তে।

দক্ষিণে, আমাদের বাহিনীর অন্যান্য গ্যালিগুলো যোগ দিলো শিকারে। হ্রদের পানির জলহস্তির সংখ্যা সতর্কভাবে হিসেব করে রাখে হাপির মন্দিরের পুরোহিতেরা। দেবতা ওসিরিসের উৎসবের জন্যে পঞ্চাশটি পর্যন্ত শিকার করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে আমাদের। এরপরেও, প্রায় তিনশ প্রাণী থাকবে হাপির ল্যাগুনে; ফলে আগাছা এবং প্যাপিরাসের ঝোঁপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে বলে মনে করেন মন্দিরের পুরোহিতেরা । দেবতা ওসিরিসের উৎসবের দশ দিন বাদে একমাত্র পুরোহিতেরা ছাড়া আর কেউ জলহস্তির মাংস খেতে পারে না।

পানির উপরে জটিল নৃত্যের মতো ছড়িয়ে পরে শিকার অভিযান। ঢেউয়ের তালে নাচতে লাগলো আমাদের গ্যালিগুলো; ধাওয়া করে চললো বিশাল জন্তুগুলোকে। পানিতে ডুবে আবার ভেসে উঠছে ওগুলো, শিষের মতো আওয়াজ করে পানি ছিটাচ্ছে; জান্তব হুঙ্কারে প্রকম্পিত হলো এলাকা। বারবার ডুবে আবার ভেসে উঠছে, প্রতিবার কমে আসছে পানির নিচে স্থায়িত্বকাল। ফুসফুস খালি হয়ে গেছে জল্পগুলোর, কিন্তু শ্বাস নিতে যখনই উপরে ওঠছে, আমাদের ধাওয়ারত গ্যালিগুলো চড়ে বসছে মাথার উপর বাধ্য করছে আবারো ডুব দিতে। প্রতিটি গ্যালির স্টার্ন টাওয়ারের গং বাজছে প্রচণ্ড শব্দে; দাঁড়া টানা যোদ্ধাদের অমানুষিক চিৎকারের সাথে তাল মিলিয়ে। আদিম, পাশবিক কোনো দৃশ্যের মঞ্চায়ন–এমনকি সবচেয়ে রক্তপিপাসু কোনো বর্বরের মতো উত্তেজনায়, আনন্দে আমিও চিৎকার করছি–আবিষ্কার করলাম।

প্রথমে যেটাকে দেখেছিলাম, সেই বিশালতম মদ্দাটার পেছনে লেগে আছে ট্যানাস। তীরের নাগালের মধ্যে থাকা মাদী-জন্তু আর বাচ্চাগুলোকে উপেক্ষা করছে সে। এঁকেবেঁকে, পেঁচিয়ে ডুবে, ভেসে আবার ডুবে ফাঁকি দেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করে চললো জটা কিন্তু প্রতিবারে আরো কাছে চলে এলো আমাদের গ্যালি। এতো উত্তেজনার মাঝেও হোরাসের প্রশ্বাস পরিচালনায় ট্যানাসের মুন্সিয়ানার প্রশংসা না করে পারলাম না; অদ্ভুত পারদর্শিতার সাথে নির্দেশনা দিয়ে চলেছে সে প্রতিটা মুহূর্ত। দাঁড়ীরাও তার আদেশ পালন করছে সুনিপুণভাবে। বোঝাই যায়, জন্ম-ভাগ্য বা পদস্থ বন্ধু-বান্ধব না থাকার পরেও কেমন করে এত কম বয়সে ফারাওয়ের বাহিনীতে আজকের উচ্চতায় পৌঁছেছে সে। সবই নিজের প্রচেষ্টায়, পরিশ্রমে–কোনোসময়ই তার পথে কাঁটা বিছানোর লোকের অভাব ছিলো না।

হঠাৎই আমাদের গলুই থেকে মাত্র তিরিশ গজ দূরে ভেসে উঠলো মদ্দাটা। সূর্যরশ্মি ঝিকমিক করছে তার চকচকে পিচ্ছিল শরীরে পরে; কালো আর বিপুল; নাকের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসছে বাষ্পের মেঘ ঠিক যেনো অন্ধকার জগতের শয়তানের মতো।

চোখ ধাঁধানো দ্রুততার সাথে ধনুকে তীর জুড়েই ছুঁড়ে দিলো ট্যানাস। কঁপা, কাঁপা- মৃদু আওয়াজের সাথে ছুটল সেটা লানাটা থেকে, চোখে ঠাওর হয় না, এতো দ্রুত। প্রথম তীরটা বাতাসে ভাসমান অবস্থাতেই ছুটল দ্বিতীয়টা; এরপরে আরো একটা। ধনুকের ছিলো যেনো কোনো বাদ্য-যন্ত্র, বাঁশির মতো শব্দ করে চলেছে ঘন ঘন। পর পর আঘাত করলো তীরগুলো জন্তুটার বিশাল পেছনটায়, পুরোটা সেঁধিয়ে গেছে; আর্তনাদ করে উঠে আবার ডুব দিলো মদ্দাটা।

বিশেষত আজকের অভিযানের জন্যে ভিন্ন তীর প্রস্তুত করেছিলাম আমি। পালকের পাতাগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে সেগুলো থেকে, তার বদলে জেলেরা তাদের জালে যে বেওয়াব গাছের কাঠের ছোটো টুকরো ব্যবহার করে, সেরকম লাগানো হয়েছিলো। তীরের মাথা থেকে এমনভাবে বেরিয়ে থাকে ওগুলো, গতিপথে কোনো পরিবর্তন আসবে না; কিন্তু একবার সেঁধিয়ে গেলে ছড়িয়ে পড়বে জন্তুটার শরীরে। ব্রোঞ্জের মাথার সাথে লিনেনের সুতা দিয়ে বাঁধা জন্তুটা পানিতে তলিয়ে যেতেই কাঠের টুকরোগুলো ভেসে উঠে আমাদের জানিয়ে দিলো ওটার অবস্থান। উজ্জ্বল হলুদ রঙে ওগুলোকে রাঙিয়েছিলাম আমি, এতে করে পানির উপরে স্পষ্টই দৃশ্যমান হয়েছে। মদ্দাটার অবস্থান প্রতিনিয়ত জানতে পারছি আমরা, যদিও ল্যাগুনের গভীর পানির তলায় রয়েছে ওটা।

জলহস্তির শেষ আক্রমনের সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করা এখন সহজ হয়ে গেছে ট্যানাসের জন্যে। প্রতিবার যখনই ভেসে উঠলো জটা, আগে থেকেই অবস্থান নিয়ে তার চকচকে পিঠে তীর গেঁথে দিতে লাগলো সে। হোরাসের প্রশ্বাস ও সেইমতো পিছু ধাওয়া করে চললো। এতক্ষণে লাল হতে শুরু করেছে ল্যাগুনের পানি। ট্যানাসের ছোঁড়া তীর আঘাত করেছে জায়গামত। এত উত্তেজনার মধ্যেও প্রতিবার উপরে ভেসে ওঠা জন্তুটার জন্যে মায়া অনুভব করলাম আমি। যতবার উপরে উঠল, ঝাকের পর ঝাক মারণ-তীর আশ্রয় করে নিল তার বিশাল শরীরে। আমার এই সহানুভূতি কিন্তু এতটুকু দেখা গেলো না আমার কীর আচরণে; বরঞ্চ উত্তেজনায় টান টান, থেকে থেকে তীক্ষ্ণ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠছে সে।

আবার ভেসে উঠলো মদ্দাটা; কিন্তু এবারে আমাদের গ্যালির মুখোমুখি । এতো বড় হা করা মুখ, গলার ভেতরে অনেকদূর দেখতে পেলাম। যেনো লাল মাংসের একটা সুড়ঙ্গ, সহজেই আস্ত একটা মানুষ গিলে খেতে পারবে। চোয়ালের তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো দেখে গা শির শির করে উঠলো আমার। নিচের চোয়ালে কাস্তে আকৃতির দাঁতগুলো প্রয়োজন হয় প্যাপিরাসের শক্ত নল ছিঁড়ে চিবুতে। উপরের চোয়ালে ঠিক আমার কবজির সমান চওড়া সাদা দাঁত; হোরাসের প্রশ্বাসে এর হাল-পাটাতন এমন সহজ ভাবে কেটে ফেলতে পারবে, যেমন করে পিঠা খাই আমরা। সম্প্রতি নদীর ধারে প্যাপিরাসের ঝোঁপ কাটার সময় এক জলহস্তিকে ভড়কে দেওয়া হতভাগ্য কৃষাণীর দেহাবশেষ দেখেছি; মাত্রই বাচ্চার জন্ম দিয়েছিল মাদী জটা; এমনভাবে দুই ভাগ হয়ে গেছিল মেয়েটার শরীর, যেনো ব্রোঞ্জের ফলা দিয়ে কাটা হয়েছে।

আর এখন, এই ক্ষ্যাপা জটা চকচকে দাঁত বের করে বিশাল হা সমেত চড়ে বসতে চাইছে আমাদের উপর; স্টার্ন টাওয়ারের সবচেয়ে নিরাপদ অবস্থানে থেকেও ভয়ে, আতঙ্কে ঠিক দেবতাদের মূর্তিগুলোর মতোই স্থির, বাকরুদ্ধ হয়ে রইলাম আমি।

আরো একটা তীর ছুঁড়লো ট্যানাস; সোজা মদ্দাটার হাঁ করা মুখের ভেতরে ঢুকে গেলো সেটা। কিন্তু ইতোমধ্যেই এতটা যন্ত্রণা সয়েছে ওটা, নতুন করে কিছু অনুভব করছে না। যদিও এবারের আঘাতটা নিঃসন্দেহে প্রাণঘাতি। কোনো রকম অস্বস্তি ছাড়াই হোরাসের প্রশ্বাসের গলুইয়ে চড়ে বসল ওটা। আঘাতপ্রাপ্ত গলার গভীরে কোথাও একটা ধমনী ছিঁড়ে গেছে; মরণ-চিৎকারে খোলা চোয়ালের ফাঁক দিয়ে গরম রক্তের ধারা যেনো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়লো। ঝকঝকে সূর্যালোকে লাল একটা মেঘের মতো জেগে রইলো বাতাসে; একইসঙ্গে কী মোহনীয় আর আতঙ্ক-জাগানিয়া। আর এরপরেই, সোজা আমাদের গলুইয়ের উপর আছড়ে পড়লো জটা।

দ্রুত ধাবমান গ্যাজেল হরিণের গতিতে ছুটছিল আমাদের গ্যালি; কিন্তু রাগে উন্মাদ, মৃত্যু-যন্ত্রণায় কাতর মদ্দাটার বিশাল আকারের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটলো হোরাসের প্রশ্বাসের। দাঁড়-টানা বেঞ্চের থেকে এদিক-সেদিক নিক্ষিপ্ত হলো যোদ্ধারা; স্টার্ন টাওয়ারের মাথা থেকে রেইলিংয়ের উপর এতো জোরে আছড়ে পড়লাম আমি, বুকের ভেতরের সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেলো এক পলকে নিঠুর যন্ত্রণা এখন সেখানে।

কিন্তু, এমনকি নিজের এই অবস্থাতেও আমার মূল দুঃশ্চিন্তা আমার মালকীনের জন্যে। চোখের পানিতে ঝাপসা দৃষ্টি; এরমধ্যেই দেখলাম সংঘর্ষের প্রাবল্যে ছিটকে সামনে পরে গেছে সে! হাত বাড়িয়ে ওকে ধরতে যথেষ্টই চেষ্টা চালাল ট্যানাস, কিন্তু সে নিজেও সংঘর্ষের কারণে টালমাটাল; বা হাতে ধরা ধনুকটাও বাধা হয়ে দাঁড়াল তার প্রচেষ্টায় । লসট্রিসের অধঃগতি কেবল কিছু সময়ের জন্যে রোধ করতে সক্ষম হলো সে; এরপরে হাত-পা ছড়িয়ে রেইলের উপর পড়লো লসট্রিস, পিঠ বাঁকা করে টপকে গেলো ওটা।

ট্যানাস, আতঙ্কে চেঁচালো মেয়েটা, এক হাত বাড়িয়ে ট্যানাসের হাত ধরতে চাইছে। মুহূর্তের মধ্যে দড়াবাজের কৌশলে ভারসাম্য ফিরে পেলো ট্যানাস, ধরতে চাইল হাতটা। এক পলকের জন্যে ওদের আঙ্গুল চুল পরস্পরকে, তারপর যেনো টেনে সরিয়ে নেওয়া হলো লসট্রিসকে।

সবার উপরে, স্টার্ন টাওয়ারে দাঁড়িয়ে লসট্রিসের পতন দেখতে পেলাম আমি। ঠিক বিড়ালের মতো শূন্যে মোচড় খেল সে, সাদা স্কার্ট কোমরের উপরে উঠতে দৃশ্যমান হলো এক জোড়া অসাধারণ উরু। মনে হলো যেনো এক জনম ধরেই পড়ছে সে, আমার হতাশ চিৎকারের সাথে মিশে গেছে ওর দারুন আর্তনাদ।

আমার ছোট্ট সোনা! কেঁদে ফেললাম আমি, আমার মিসট্রেস! নিশ্চিত জানি, ওকে হারিয়েছি আমরা। ওর পুরো জীবনটা যেনো এক লহমায় ভেসে উঠলো চোখের সামনে। বাচ্চা বয়সে ওর কান্না, দুষ্টামি; আমার সাথে যত খুনসুটি সব মনে পরে গেলো একে একে। তরুণী হয়ে উঠতে দেখেছি আমি ওকে; ওর প্রতিটি আনন্দে, যন্ত্রণায় আমার চেয়ে কাছাকাছি আর কে ছিলো? গত চৌদ্দটি বছরে ওকে যতোটা ভালোবেসেছি; আজ ওকে হারাবার দিনে যেনো তার চেয়ে বেশি ভালোবাসি মনে হলো।

বিশাল, রক্ত-চর্চিত মরণাপন্ন মদ্দাটার পিঠে আছড়ে পড়লো লসট্রিস; এক মুহূর্তের জন্যে হাত-পা ছড়িয়ে পরে থাকলে সেখানে; যেনো কোনো ধর্মের বলি হিসেবে ফেলে রাখা হয়েছে মূর্তির সামনের বেদীতে। পাক খেয়ে শূন্যে ভেসে উঠলো জলহস্তি, বিশাল, আক্রান্ত ঘাড় ঘুরিয়ে নাগাল পেতে চাইছে তার। রক্তাক্ত, শূকরের মতো ছোটো ছোটো চোখ দুটো রাগের সাথে পাল্লা দিয়ে জ্বলল, চোয়াল হাঁ হয়ে আছে।

কেমন করে যেনো নিজেকে ধরে রেখেছে লসট্রিস; জটার বিশাল পেছন থেকে বের হওয়া তীরের মাথা ধরে আটকে রেখেছে শরীরটা। হাত-পা ছড়িয়ে পরে আছে সে। এখন আর আর্তনাদ করছে না, বেঁচে থাকার জন্যে ব্যস্ত সময় কাটছে প্রতিটি প্রচেষ্টায়। প্রতিবার মনে হলো, যেনো এক চুলের জন্যে তার নাগাল পেলো না জলহস্তির হাঁ করা মুখ।

নৌকার সামনে, নিজেকে দ্রুত ফিরে পেলো ট্যানাস। এক মুহূর্তের জন্যে ওর মুখটা দেখতে পেলাম আমি, রাগে উন্মত্ত। একপাশে এই মুহূর্তে অকার্যকর ধনুকটা সরিয়ে রাখলো সে; পরিবর্তে আঁকড়ে ধরলো তলোয়ারের বাঁট। কুমীরের চামড়া দিয়ে তৈরি খাপ থেকে মুক্ত হলো ফলা, প্রায় তার হাতের সমান লম্বা সেটা; তামার তৈরি চকচকে।

এক লাফে গলুইয়ে চড়ল সে; নিজেকে স্থির করে নিয়ে তাকাল নিচের পানিতে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর জন্তুটার দিকে। এরপরে, দুই হাতে তলোয়ার নিচু করে ধরা অবস্থায় বাজ পাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো শূন্যে।

মদ্দাটার বিশাল ঘাড়ের উপর খাড়া হয়ে নামলো ট্যানাস, যেনো বিশাল প্রাণীটাকে পানিতে ডুবিয়ে দেবে। নিজের শরীরের ওজন, এতো উঁচু থেকে লাফের শক্তি–সবই ছিলো তলোয়ারের পেছনে। ঘাড়-মাথার সংযোগস্থলে পুরো অর্ধেক ফলা সেঁধিয়ে গেলো; উপরে চড়ে বসা ট্যানাস তার শক্তিশালী দুই কাঁধের জোরে খুঁচিয়ে আরো ভেতরে নিয়ে যেতে লাগলো সেটা। ল্যাগুনের জল ছেড়ে প্রায় পুরোটা শরীর শূন্যে নিক্ষিপ্ত হলো প্রাণীটার; এপাশ-ওপাশ দুলছে মাথা, পানির ভারী পশলা এত উপরে ছিটকে আসছে যে, আমাদের গ্যালিতে পর্দার মতো আড়াল তৈরি করে ফেললো নিচের রোমাঞ্চকর দৃশ্য থেকে।

এত কিছুর ভেতর দিয়েও, জন্তুটার পিঠে অসহায়ভাবে এক জোড়া মানুষকে দুলতে দেখছি আমি। হাতের একটা তীরের মাথা ছুটে যেতে প্রায় পরে যেতে বসেছে লসট্রিস। তেমনটি ঘটলে, তীক্ষ্ণ দাঁতে ওকে ফালাফালা করে ফেলবে মরণাপন্ন জলহস্তি। পেছনে ঝুঁকে এক হাতে লসট্রিসের পতন ঠেকালো ট্যানাস; ডান হাতে অবিরত খুঁচিয়ে চললো তলোয়ারের ফলাটা জানোয়ারটার শরীরের গভীরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে আরো।

ওদের নাগাল না পেয়ে দাঁত খিচাল জটা; গলার দুধারে মারাত্মক ক্ষত দেখা দিয়েছে ওটার গ্যালির পঞ্চাশ গজমত দূরের প্রতিটি প্রাণী, লসট্রিস এবং ট্যানাসের পা থেকে মাথা পর্যন্ত রক্তের ধারায় ভিজে গেলো । লাল পর্দার আড়াল থেকে কেবল চকচকে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে চোখদুটো।

মদ্দাটার মরণ-আস্ফালন গ্যালির পাশ থেকে বেশ খানিকটা দূরে ঠেলে নিয়ে গেছে ওদের; একমাত্র আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম সবার আগে। দাড়ীদের উদ্দেশ্যে চেঁচালাম, অনুসরণ কর ওটাকে! যেনো পালিয়ে যেতে না পারে! চমকে উঠে কাজে লেগে পরে তারা, সচল হয় হোরাসের প্রশ্বাস।

ঠিক সেই সময়েই, ট্যানাসের ব্রোঞ্জের ফলা সম্ভবত জন্তুটার ঘাড়ে মেরুদণ্ডের, সংযোগস্থল খুঁজে পায়, সেঁধিয়ে পরে ছিঁড়ে ফেলে মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগ। বিশাল শরীরটা যেনো জমে গেলো জায়গায়। শক্ত করা চার পা লম্বা করে চিৎ হয়ে পড়লো ওটা, ল্যাগুনের পানিতে লসট্রিস আর ট্যানাস সমেত তলিয়ে গেলো।

গলা দিয়ে উঠে আসা হতাশার চিৎকারটা রোধ করলাম আমি; হুঙ্কার দিয়ে নির্দেশ দিতে লাগলাম নৌকার পাটাতনে দাঁড়ানো হতবুদ্ধ কর্মীদের। পেছনে টানো! ওদের উপরে চড়ে বসো না! গলুইয়ের সাঁতারুরা ঝাঁপিয়ে পর! নিজের কণ্ঠস্বরের শক্তিমত্তা এবং দায়িত্বে এমনকি আমি নিজেও চমকে গেছি।

গ্যালির সম্মুখ-যাত্ৰা রোধ হলো। কী করছি বুঝে উঠার আগেই পাটাতনের উপর দিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় যোদ্ধার দলের মাঝখান দিয়ে ছুটলাম। অন্য কাউকে নৌকা থেকে পরে যেতে দেখলে হয়তো আমোদ পেত এরা, কিন্তু তাদের বীর সেনাপতি ট্যানাসকে দেখে নয়।

আমি স্কার্ট খুলে ফেলেছি ইতোমধ্যেই সম্পূর্ণ নগ্ন এই মুহূর্তে। ভিন্ন কোনো সময়ে চাবুকের একশ ঘা দিয়েও এটা করানো যেত না আমাকে দিয়ে, সাম্রাজ্যের জল্লাদের অনেক কাল আগে করা কীর্তি মাত্র আর একজন মানুষকে দেখেছে; মূলত সেই ব্যক্তিই খোঁজা করার উদ্দেশ্যে ছুরি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন আমার উপর। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, পৌরুষের তেজদীপ্ত অঙ্গহারা নিজেকে অন্যদের দৃষ্টির সামনে প্রদর্শন করতে এতটুকু ভাবলাম না।

খুব ভালো সাঁতারু আমি, হয়তো অন্য কোনো সময়ে এ ধরনের আচরণকে বোকামীর চোখে দেখতাম; কিন্তু আমি সত্যিই বিশ্বাস করি রেইল টপকে রক্তাক্ত পানিতে ঝাঁপিয়ে পরে সম্ভবত আমার মিসট্রেসকে উদ্ধার করতে পারবো এ যাত্রায় । যাই হোক, জাহাজের রেইলে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম; ঠিক আমার নিচের পানি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো দুটো মাথা এত কাছাকাছি যেনো পরস্পর মিলিত হয়ে আছে। একটা মাথা কালো, অপরটি পরিষ্কার, কিন্তু ও দুটোই আমার কাছে সবচেয়ে অভাবিত আচরণ করছিল। হাসছিলো ওরা। উত্তেজনা, আনন্দ আর রোমাঞ্চে হাসছে লসট্রিস আর ট্যানাস; জাহাজের পাশ ঘেঁসে ভেসে থেকে পরস্পরকে এতটা জোরে আঁকড়ে ধরে আছে, সন্দেহ হলো ডুবে না যায়।

সাথে সাথেই আমার যত উদ্বেগ পর্যবসিত হলো রাগে–এই উন্মাদনার প্রতি। নিজের প্রায় করতে যাওয়া নির্বুদ্ধিতার জন্যেও রাগ হচ্ছিলো খুব। হারানো সন্তানকে ফিরে পাওয়া মায়ের মতোই তীরস্কারে ব্যাপৃত হলাম; নিজের কণ্ঠস্বরে আর আগের দায়িত্ব নেই, আছে স্বস্তি মিশ্রিত উপহাস। ডজনখানেক উদ্বেল হাত যখন পানি থেকে ওদের দুজনকে টেনে তুললো জাহাজে, তখনও আমার মিসট্রেসকে তীরস্কার করছিলাম আমি।

তুমি অসাবধানী, পরিচর্যা না করা জংলী! ওর উদ্দেশ্যে ক্ষোভের স্বরে বলছিলাম, নির্বোধ! স্বার্থপর, অবাধ্য কোথাকার! প্রতিজ্ঞা করেছিলে আমার কাছে! দেবীদের কুমারীত্বের নামে কসম কেটেছিলে

দৌড়ে এসে আমাকে গলার দুধারে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো লসট্রিস। ওহ টাইটা! বলে উঠল, এখনও হাসছে আনন্দে। তুমি দেখেছ ওকে? দেখেছ, কেমন করে আমাকে উদ্ধার করেছে ট্যানাস? তোমার শোনা সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ কাজ ছিলো না ওটা? তোমার গল্পগুলোর সেই নায়কদের মত?

আমি নিজেও যে একই ধরনের নায়কোচিত একটা কাজ করবার প্রাক্কালে ছিলাম, সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হলো ব্যাপারটা। আমার মেজাজটা আরো খারাপ হলো তাতে। হঠাৎ টের পেলাম, পানিতে ওর স্কার্ট হারিয়েছে লসট্রিস; ঠান্ডা আর ভেজা আমার দেহের সাথে লেপ্টে থাকা শরীর সম্পূর্ণ নগ্ন ওর। যোদ্ধাদের কর্কশ দৃষ্টির সামনে পুরো মিশরের সবচেয়ে সুদর্শন, কমনীয় জোড়া-পুচ্ছ প্রদর্শন করছে সে এই মুহূর্তে।

কাছের একটা ঢাল তুলে নিয়ে আমাদের দুজনের শরীরই আড়াল করলাম আমি, দাসী মেয়েগুলোকে চিৎকার করে বললাম লসট্রিসের জন্যে আরেকটি স্কার্ট নিয়ে আসতে। ওদের খিলখিল হাসি আমার রাগ আরো বাড়িয়ে দিল; শেষমেষ আমি এবং লসট্রিস দুজনেই ভদ্রস্থ অবস্থা ফিরে পেতে ট্যানাসের উদ্দেশ্যে বললাম:

আর তুমি! অসাবধান বর্বর! আমার প্রভু, ইনটেফের কাছে তোমার ব্যাপারে বলব আমি! তোমার পাছার ছাল যদি না তুলে নেওয়া হয়েছে–

তুমি এমন কিছু করবে না, হেসে বললো ট্যানাস। শক্তিশালী দুই হাতে মতো জোরে জড়িয়ে ধরলো আমাকে, প্রায় শূন্যে উঠে গেলো পুরো শরীর। কেননা, সত্যিই স্বানন্দে আমার পাছার ছাল তুলে নেবেন উনি; যাই হোক, তোমার উদ্বেগের জন্যে ধন্যবাদ, বুড়ো বন্ধু।

দ্রুত ঘুরলো সে, এক হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে ভুরু কোঁচাকালো। বাহিনীর অন্যান্য জাহাজগুলো থেকে আলাদা হয়ে গেছে হোরাসের প্রশ্বাস, এতক্ষণে অবশ্য শিকার অভিযান শেষ হয়েছে। আমাদেরটা ছাড়া অন্য সবগুলো গ্যালি পুরোহিতদের নির্দেশিত পরিমাণ নিয়ে ফেলেছে।

মাথা নাড়ল ট্যানাস। আমরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারি নি, তাই না? হতাশার ধ্বনি বেরুলো তার গলা থেকে; বাহিনীকে ফিরে আসার জন্যে নতুন বার্তা সম্বলিত পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দিলো সে।

জোর করে হাসলো এরপরে আমার উদ্দেশ্যে। চল, এক জগ সুরা পাণ করা যাক। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, বেশ তৃষ্ণা পেয়ে গেছে। গলুইয়ের কাছে, যেখানে দাস-মেয়েগুলো গুজুড়-গুজুড় করছিল লসট্রিসের সাথে, সেই দিকে হেঁটে গেলো সে। প্রথমটায় এতো রেগে ছিলাম আমি, ভাবলাম এই পিকনিকে যোগ দেব না। স্টার্নের উদ্দেশ্যে হেঁটে যেতে থাকলাম দৃষ্টিতে বিরক্তি নিয়ে।

ওহ, ওকে কিছুসময় একা থাকতে দাও, ইচ্ছাকৃত জোরাল শব্দে ট্যানাসের কানে ফিসফিস করছে লসট্রিস; শুনতে পেলাম। ওর পাণ-পাত্র ভরে দিচ্ছে মেয়েটা। বুড়ো প্রিয়তমা আজ বেশ ভয় পেয়ে গেছে। তবে খিদে পেলে ঠিক হয়ে যাবে ও। খাওয়া ভালবাসে সে।

এই হলো আমার মিসট্রেসের বিচার; আমি মোটেও পেটুক নই, আর সেই সময় আমার বয়স ছিলো মাত্র ত্রিশ বছর। অবশ্য চৌদ্দ বছরের বালিকার পক্ষে ত্রিশ বছরের কাউকে বুড়ো মনে হতেই পারে, সেটা আমি মানি; তবে এটা সত্যি, খাওয়া-দাওয়ার বেলায় আমার রুচি একটু উঁচুই । বুনো হাঁসের ঝলসানো মাংস, ওটা এখন শোভা পাচ্ছে ওর থালায়, আমার খুব প্রিয় সেটা; বোধকরি, লসট্রিসও জানে এটা।

আরো কিছুক্ষণ ওদেরকে শাস্তি দিলাম আমি। শেষমেষ ট্যানাস নিজে এসে একটা পাত্রে সুরা বাড়িয়ে ধরে আহ্বান করতে ওর সাথে যোগ দিতে এগুলাম। এরপরেও, বেশ খানিকটা আড়ষ্ট বোধ করছিলাম, তবে লসট্রিস আমার দুই গালে চুমো খেতে বরফ গললো একটু; সবাইকে শুনিয়ে সে বললো, মেয়েরা আমাকে বলেছে, ঠিক বয়োজেষ্ঠ্য যোদ্ধার মতোই জাহাজের নির্দেশ দিয়েছিলে তুমি; আর একটু হলে নাকি নিজেই লাফিয়ে পানিতে পড়তে, আমাকে উদ্ধার করতে । ওহ টাইটা, তোমাকে ছাড়া কেমন করে চলতো আমার? কেবলমাত্র এই কথার পড়েই ওর এগিয়ে দেওয়া হাঁসের মাংস নিলাম আমি, হাসলাম একটু। দারুন ছিলো খাবারটা, আর সুরাটাও প্রথম শ্ৰেণীর। খুব কম করেই খেলাম, নিজের স্বাস্থ্যের দিকেও তো নজর রাখতে হবে– আমাকে। আর তাছাড়া, আমার ক্ষুধা সম্পর্কিত লসট্রিসের কিছুক্ষণ আগের উপহাসও ভূমিকা রাখলো এতে।

ল্যগুনের চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিলো ট্যানাসের বাহিনী। এতক্ষণে একত্র হতে কে করেছে জাহাজগুলো। কিছু কিছু গ্যালি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে–লক্ষ করলাম। শিকারের উত্ততায় মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটেছিল দুটো জাহাজের; বাকি চারটে আক্রান্ত হয়েছে জলহস্তির দ্বারা। যাই হোক, দ্রুতই একত্র হয়ে ফিরে যেতে উদ্যত সব কয়টা। হোরাসের প্রবাসের সমান্তরালে আসতে হর্ষ ধ্বনি করলো নাবিকেরা। মুঠি বদ্ধ হাত উঁচিয়ে অভিবাদনের প্রতুত্তর জানাল ট্যানাস; আমাদের মাস্ট হেডে শোভা পাচ্ছে নীল কুমীর বাহিনীর প্রতীক। হয়তো একটু ছেলেমানুষি কিন্তু সামরিক বাহিনীর উদ্যাপনের প্রকার তো এমনই।

প্যাডল এবং হালের অপূর্ব সমন্বয়ে জাহাজগুলো ধীরে নিজ নিজ অবস্থানে চলে এলো; মৃদু-মন্দ নীল নদের বাতাসের বিপরীতে। শিকার করা জলহস্তির কোনো চিহ্ন অবশ্য দেখা যাচ্ছে না, প্রতিটি গ্যালি কমপক্ষে একটি ক্ষেত্র বিশেষে দুই কি তিনটি করে জন্তু মেরেছে। ভারী মৃতদেহগুলো হারিয়ে গেছে হ্রদের গভীর জলের তলায়। আমি জানি, ট্যানাস মনে মনে অনুতাপ করছে, হোরাসের প্রশ্বাস শিকার অভিযানে সবচেয়ে সফল না হওয়ায়। আসলে, মদ্দাটার সাথে আমাদের যুদ্ধে বেশ খানিকটা সময় চলে যাওয়ায় কেবল ওই একটি জানোয়ার মারতে সক্ষম হয়েছি আমরা। নিজের জন্যে সর্বোচ্চ স্থান সব সময় ট্যানাসের আরাধ্য। হোরাসের প্রশ্বাসের জখমি হাল মেরামতের তদারকি করতে চললো সে।

মদ্দাটার আক্রমণে পানির তলায় কাঠের পাটাতন দারুন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে; চামড়ার বালতি দিয়ে সেঁচেও জাহাজে পানি উঠা ঠেকানো যাচ্ছে না। দাঁড়টানা যোদ্ধাদের নিজ নিজ কাজ ফেলে এটা করতে হচ্ছে বলে সময়ও নষ্ট হচ্ছে প্রচুর। নিশ্চই এর থেকে মুক্তির কোনো না কোনো উপায় আছে, নিজের মনেই ভাবলাম আমি।

নিহত জন্তুগুলোর দেহ ভেসে উঠার অপেক্ষায় আছি আমরা, একটা দার্স মেয়েকে ডেকে পাঠালাম আমার লেখার সরঞ্জাম ভর্তি পাত্র নিয়ে আসার জন্যে। এরপরে, মনে মনে ভেবে রাখা একটা প্রক্রিয়া এঁকে নিতে লাগলাম; যুদ্ধ-গ্যালির পাটাতনে উঠা পানি কৌশলে সরিয়ে নেওয়ার একটা উপায়, যাতে করে অর্ধেক যোদ্ধার প্রয়োজন হবে না এ কাজে। বারো জনের বদলে মাত্র দুইজনকে দিয়ে কাজটা করা সম্ভব বলেই আমার ধারণা।

আঁকা শেষ হতে গ্যালির অবস্থা পর্যবেক্ষণে গেলাম আমি। ইতিহাস বলে, ভূমির যুদ্ধের মতোই জলপথেও গ্যালি নিয়ে যুদ্ধের কৌশলগত পার্থক্য সামান্যই। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর চালনা। এরপরে, কাছাকাছি এসে অন্য জাহাজের দখল নিয়ে তলোয়ারের মাধ্যমেই ফয়সালা করা হয়। পরস্পর সংঘর্ষ থেকে দারুনভাবে সতর্ক থাকতে হয় গ্যালির প্রধান নাবিককে; মুখোমুখি ধাক্কা খাওয়া অত্যন্ত লজ্জাজনক বলে মনে করা হয়।

কিন্তু যদি–হঠাৎই একটা ভাবনা উঁকি দিলো আমার মনে; ভিন্ন রকম ভাবে সজ্জিত নতুন এক ধরনের গলুইয়ের ছবি আঁকলাম প্যাপিরাস ফ্রোলে। পরিকল্পনা ডালাপালা ছড়াতে লাগলো পানির সমান্তরালে গন্ডারের শিং-এর মতো একটা স্থাপনা যোগ করে দিলাম আমি। চেলাকাঠ থেকে তৈরি, ব্রোঞ্জের মাথাওয়ালা। সামনের দিকে বাঁকানো; এতে করে সামনের কোনো জল্যানের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটলে ওটাকে ছিঁড়ে ফেঁড়ে ফেলা যাবে। এতটাই তন্ময় হয়ে ছিলাম, কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ট্যানাস, টের পাইনি। আমার হাত থেকে প্যাপিরাসের স্ক্রোলটা ছিনিয়ে নিল সে; মনোযোগ দিয়ে দেখছে।

আমি কি ভাবছি, এটা অবশ্য সাথে সাথেই বুঝেছে সে। ওর বাবা সর্বস্ব হারিয়ে যখন পথের ভিখারী, বহু সাধ্য-সাধনা করে একজন ধনী লোকের সাহায্যে ওকে কোনো একটি মন্দিরে অন্তত: শিক্ষানবিস লিপিকারের কাজে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলাম; এতে করে কাজের পাশপাশি পড়া-শোনাটাও চালিয়ে নিতে পারতো সে। নিজের ছাত্র সম্পর্কে আমার ধারণা খুবই উঁচু, আমি মনে করি, সাঁকোয়ারাহ্–এ নির্মিত প্রথম পিরামিডের কারিগর ইমহোটেপের মতোই মিশরের ইতিহাসের অন্যতম সেরা বুদ্ধিজীবি হওয়ার সামর্থ্য তার আছে। এক হাজার বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছিলো ওটা।

কিন্তু, স্বাভাবিকভাবেই সেটা সম্ভব হয় নি। ট্যানাসের বাবার বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো, তাদেরই অনেকে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ওর পথে। দেশের একজন ব্যক্তি, তাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিলো না। বাধ্য হয়ে ওকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বলেছিলাম। দুঃখের বিষয়, যেদিন থেকে প্রথম দাঁড়াতে শিখেছিল, যোদ্ধা হওয়া ছিলো তার ধ্যান-জ্ঞান।

সেথ্‌–এর পাছার বিষফোঁড়ার নামে কসম! বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলো ট্যানাস, আমার আঁকাগুলো দেখতে দেখতে। তুমি আর ওই লেখনী দশ বাহিনীর সমান আমার কাছে!

পরাক্রমশালী দেবতা সেথকে নিয়ে ট্যানাসের এই ধরনের উপহাস বরাবরই ভাবিয়ে তোলে আমাকে। আমি বা সে, যদিও আমরা দুজনেই দেবতা হোরাসের উপাসক, এরপরেও মিশরের ঐতিহাসিক দেবদেবীর কাউকে নিয়ে ঠাট্টা করা সমীচীন নয়। যেকোনো মন্দিরে গেলেই কোনো না কোনো প্রার্থনা বা কোরবানী দেওয়া আমার স্বভাব, তা সে যে দেবতারই হোক না কেন। আমার মতে, ওটা হলো নিরাপত্তার কবচ। মানবসমাজেই যথেষ্ট শত্রু আছে আমাদের, অযথা দেবতা পর্যায়ে সেরকম কিছু তৈরি করা অবিবেচকের পরিচয়। বিশেষতঃ দেবতা সেথ-এর আক্রোশ নিয়ে বহু উপকথা প্রচলিত আছে। আমি অবশ্যই ভয় পাই তাঁকে। হয়তো ট্যানাসের এটা জানা আছে বলেই আমাকে বিরক্ত করার জন্যে বারবার উপহাস করে। যাই হোক, প্রশংসার জলে ভিজে আমার রাগ দূর হয়ে গেলো।

কেমন করে করো এগুলো? জানতে চায় ট্যানাস। আমি হলাম যোদ্ধা। আজ যা যা ঘটেছে, তোমার মতো আমিও দেখেছি। কিন্তু এই ভাবনাগুলো আমার মাথায় কেন এলো না?

আমার আঁকা ছবিগুলো নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হলাম দুজন। কিছুসময়ের মধ্যেই লসট্রিসও যোগ দিলো সাথে। দাসী মেয়েগুলো ওর চুল মুছে বেঁধে দিয়েছে, মুখেও প্রসাধনী ব্যবহার করেছে খানিকটা। মনোযোগ বজায় রাখাটা মুশকিল হয়ে পড়ল, বিশেষত যখন একটা হাত আনমনে আমার কাঁধে ফেলে রেখেছে সে। জনারণ্যে কোনো পুরুষ মানুষের দেহে এভাবে হাত রাখবে না লসট্রিস, ভদ্র-আভিজাত্যে সেটা সাজে না। কিন্তু আমি তো আর পুরুষ মানুষ নই; আর সারাটা সময় ট্যানাসের মুখেই সেঁটে থাকলো ওর চোখ দুটো।

ট্যানাসের প্রতি ওর এই মোহ সেই যখন ও বুঝতে শিখেছে, তখন থেকে। দশ বছরের বালক ট্যানাসের পেছন পেছন টলোমলো পায়ে হাঁটতে লসট্রস, সবসময় নকল করত তার ভাবভঙ্গি। ট্যানাস থুতু ফেলেছে, তো তারও ফেলতে হবে। ট্যানাস যদি কোনো বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলো; তো তারও করা চাই। শেষমেষ বিরক্ত হয়ে বালক আমার কাছে বিচার নিয়ে আসতো, ওকে আমার পিছ-ছাড়া করতে পারো না, টাইটা? একটা পুঁচকি। মজার ব্যাপার, আজ আর তেমন কোনো অভিযোগ ট্যানাস করছে না।

গলুইয়ের সামনে ভেসে ওঠা একটা শবদেহ আমাদের মনোযোগ কেড়ে নেয়। প্রথম মৃত-জলহস্তির দেহ ভেসে উঠেছে ল্যাগুনের জলে। পেট উপরে দিয়ে ভাসছে ওটা, নাড়ি-ভুঁড়ির ভেতরের গ্যাসের কারণে অমনটা ঘটেছে। চার পা শক্তভাবে ছড়িয়ে ভাসছে এখন। একটা গ্যালি এগিয়ে গিয়ে দায়িত্ব নেয় দেহটার। বিশাল দেহের উপরে লাফিয়ে নেমে দড়ি বেঁধে গ্যালির সাথে সংযোগ করলো একজন যোদ্ধা। কাজ শেষ হতেই, ভাসমান দেহটা টেনে নিয়ে তীরের দিকে চললো ওটা।

এতক্ষণে আমাদের চারপাশের পানিতে ভেসে উঠতে শুরু করেছে জলহস্তির প্রাণহীন দেহ। গ্যালিগুলো ওগুলোকে বেঁধে টেনে নিয়ে চললো । আমাদের জাহাজের সাথে দুটো জানোয়ারের দেহ আঁটকে নিলো ট্যানাস; দাঁড়ীরা প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় বেয়ে চললো হোরাসের প্রশ্বাস।

তীরের কাছাকাছি এসে পড়তে হাত উঁচিয়ে রৌদ্র আড়াল করে সামনে তাকালাম। মনে হলো যেনো উচ্চ-মিশরের সকল নারী, পুরুষ আর শিশু জড়ো হয়েছে নদীর পারে। বহু লোক; নাচছে, গাইছে স্তুতি করে চলেছে শিকারী যোদ্ধাদের। তাদের পরিহিত সাদা আলখাল্লা পতপত করে উড়ছে বাতাসে, যেনো কোনো ঝড়ের প্রস্তুতি।

পাড়ের কাছাকাছি চলে আসতে, কেবল কোমরে এক টুকরো কাপড় পরা মানুষজন কাধ-সমান পানিতে নেমে এসে ভাসমান প্রাণীগুলোর শবদেহে দড়ি বেঁধে দিতে থাকে। উত্তেজনার প্রাবল্যে মনেই নেই, হ্রদের সবুজ জলের তলায় ঘাপটি মেরে আছে হিংস্র কুমীরের দল। প্রতি বছর আমাদের বহু লোক প্রাণ হারায় এই ভয়ঙ্কর জম্ভর হাতে। কোনো কোন সময় এতটাই সাহসী হয়ে উঠে, নদী পাড়ে খেলতে থাকা শিশু কিংবা কাপড় ধুতে থাকা মেয়েলোক বা পানি নিতে আসা মহিলাদের পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় কুমীর।

এখন, মাংস-ক্ষুধায় কাতর লোকগুলোর মনে নেই অন্য কিছুর কথা। দড়ি ধরে টেনে পারের দিকে নিয়ে চলে তারা নিহত জানোয়ারগুলোকে। পাড়ের কাঁদাটে মাটিতে ঝড়ে পড়ে নিহত জলহস্তির দগদগে ঘায়ে মুখ বসানো ছোটো ছোটো মাছের দল। চকচকে রুপোর মতো দেখায় ওগুলোকে, মাটির উপর তড়পাচ্ছে যেনো আকাশের খসে পড়া তারা।

পুরুষ বা নারী প্রত্যেকে ছুরি বা কুঠার বহন করছে; পিলপিলে পিঁপড়ের মতোই শবদেহগুলো ঘিরে আসে তারা। লোভের আতিশায্যে উন্মত্ত হায়েনা বা শকুনের মতোই পরস্পরের উদ্দেশ্যে বকে চলে, একের পর এক আঘাত করতে থাকে জলহস্তির বিশাল নিথর দেহে। ছুরি বা কুঠারের কোপে বাতাসে ছিটকে আসে রক্ত আর হাড়ের কণা। সেই সন্ধায় আহত লোকের কোনো অভাব হবে না মন্দিরে; কাটা আঙুল বা অসাবধান কোপের চিকিৎসা দরকার হবে এদের।

আমি নিজেও সম্ভবত অর্ধেক রাত জেগেই কাটাতে বাধ্য হবো। চিকিৎসক হিসেবে কোনো কোন মহলে বিশেষ নাম আছে আমার, ক্ষেত্রবিশেষে ওসিরিসের মন্দিরের পুরোহিতদের চেয়ে বেশি। বিনয়ের সাথেই বলছি, এই যশ অযাচিত নয়; আর হোরাস জানেন, পুরোহিতদের তুলনায় আমার অর্থ-দাবি অযৌক্তিক নয় মোটেও। আমার মালিক, প্রভু ইনটে, চিকিৎসাকর্ম থেকে প্রাপ্ত আয়ের তিন ভাগের এক ভাগ আমাকে দিয়ে থাকেন। দাস হতে পারি, তবে কিছুটা হলেও সম্মান আমার আছে বৈকি।

হোরাসের প্রশ্বাসের স্টার্ন টাওয়ারে দাঁড়িয়ে মানব-চরিত্রের উন্নাসিকতা অবলোকন করতে লাগলাম আমি। ঐতিহ্যগতভাবে, তীরে থাকা অবস্থায় নিজের ভাগের মাংস খেতে পারে জনতা। আমাদের এই নদী-বিধৌত, উর্বর জনপদে মানুষজন ভুখা থাকে না। তবে আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য; মাসের পর মাসে কেটে যায়, মাংসের স্বাদ আমাদের লোকজন পায় না। আর তাছাড়া, উৎসবের সময় সব বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়; দেহজ ভোগ-বিলাস, খাদ্য, পানীয়-সবক্ষেত্রেই চলে অতি-উপভোগের অনুশীলন। বিষাক্ত পেট, মাথাব্যথায় কাতর লোকের দল আজ আসতেই থাকবে মন্দিরে; উৎসবের প্রথম দিনে ক্ষুধা মেটে না এদের।

পা থেকে মাথা পর্যন্ত রক্ত আর চর্বিতে মাখামাখি এক মেয়ে, বুক পর্যন্ত নগ্ন; বেরিয়ে আসে জলহস্তির পেটগহ্বর থেকে, হাতে ঝুলছে কলিজার একটা বড় টুকরো, নিজের সন্তানের হাতে দৌড়ানোর উপরই ওটা ছুঁড়ে দেয় সে। শবদেহ ঘিরে আস্ফালনে রত তার অন্যান্য বংশধরেরা। আবারো নিহত প্রাণীটার শরীরের অভ্যন্তরে হারিয়ে যায় সে; ওদিকে তীর ঘেঁষে তৈরি করা শতাধিক আগুনের কুণ্ডলির উদ্দেশ্যে হাতের মাংসপিণ্ড নিয়ে ছুটে যায় শিশুটা। ওর হাত থেকে কলিজার বড় অংশ ছিনিয়ে নিয়ে জ্বলন্ত কয়লায় ছুঁড়ে ফেলে তার বড় ভাই; বাকিরা আগ্রহের আতিশায্যে ঘিরে আসে তাকে ঠিক যেনো একপাল কুকুরছানা।

একটা কাঠি দিয়ে আধা-সেদ্ধ কলিজার কিছু অংশ খুবলে নেয় বয়োজৌষ্ঠ ছেলেটা, তার ভাইবোনেরা মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাবড়ে দেয় ওটা। শেষ হতে না হতেই, আরো পাওয়ার দাবিতে শোরগোল তোলে ওরা; রস আর তরল চর্বি গড়িয়ে পড়ছে চিবুক বেয়ে। এদের মধ্যে অনেকেই জীবনে কখনও জলহস্তির মাংসের স্বাদ পায়নি। বেশ সুস্বাদু, নরম–তবে বেশিরভাগ অংশই চর্বি গরু বা বুনো গাধার গোশের চেয়ে পরিমাণে অনেক বেশি। হাড়ের মজ্জা অবশ্য এমনকি দেবতা ওসিরিসের প্রিয় খাদ্য। আমাদের লোকেরা পশুর চর্বি কালেভদ্রে খেতে পায়, ওটার স্বাদ তাদের পাগল করে ফেলে। প্রাণভরে খাবে ওরা আজ, এটা তাদের অধিকার আজকের দিনে।

এই উদ্দাম জনতার কাছ থেকে দূরে থাকতে পেরে যার-পর-নাই আনন্দিত আমি। জানি, আমার মনিব, ইনটেফের লোকেরা এসে গোশতের সেরা অংশটুকু এবং হাড় মজ্জা নিয়ে যাবে প্রাসাদের রসুইখানায়; আমার পছন্দের মতো করে বিশেষভাবে রান্না করা হবে খাবার। রাজ-উজিরের প্রাসাদে আমার অবস্থান বেশ উঁচুতে, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে আমার মালিকের একান্ত ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর চেয়েও; যদিও সে মুক্ত মানুষ, আমার মতো দাস নয়। কেউ এ বিষয়ে খোলাখুলিভাবে বলে না, তথাপি আমার বিশেষ অবস্থান নিয়ে কারও রা করার সুযোগটি নেই।

প্রাসাদের লোকেরা চলে এসেছে; স্টার্ন টাওয়ারে দাঁড়িয়ে ওদের কাজ দেখতে লাগলাম আমি। আমার মনিব, প্রশাসক এবং মিশরের উচ্চ সাম্রাজ্যের রাজ-উজিরের অংশ দাবি করতে এসেছে তারা। অতি অনুশীলনে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে হাতের লাঠি দিয়ে সামনে দাঁড়ানো উন্মুক্ত পশ্চাৎদেশে আঘাত করে পথ করে নেয় ওরা, চিৎকার করে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস পায়।

নিহত জন্তুর দাঁত উজিরের সম্পত্তি। সতর্কতার সাথে তার প্রত্যেকটি সংগ্রহ করে তাঁর প্রতিনিধিরা। জলপ্রপাতের ওপারে, সেই কুশ দেশ হতে আসা হাতির দাঁতের চেয়ে কোনো অংশে কম মূল্যবান নয় সেগুলো। মন্দিরের হায়ারোগ্লিফিক্সের কথা অনুযায়ী আজ থেকে এক হাজার বছর পূর্বে শেষবারের মতো হাতি শিকার করা হয়েছিলো আমাদের এই মিশরে, চতুর্থ বংশ পরম্পরার ফারাওয়ের শাসনামলে। স্বাভাবিকভাবেই, শিকারের সেরা অংশ থেকে প্রাপ্ত পুরস্কারের অধিকাংশ হাপির মন্দিরের পুরোহিতদের তুষ্টিতে ব্যয় করবেন আমার মালিক, পবিত্র এই প্রাণীর রাখাল তো তারাই। অবশ্য উপঢৌকনের পরিমাণ নিয়ে চিন্তার অবকাশ আছে; প্রাসাদের হিসাবরক্ষক হিসেবে আমি জানি, সিংহভাগ সম্পদ কোথায় যায়। আমার মালিক, ইনটেফ অযাচিত উদারতায় বিশ্বাসী নন; তা এমনকি কোনো দেবীর প্রতিও নয়।

আর জলহস্তির চামড়াগুলো সেনাবাহিনীর অধিকারে যাবে, গার্ড বাহিনীর সৈন্যদের ঢালে ব্যবহৃত হবে সেগুলো। প্রায় বেদুইনের তাঁবুর সমান এক-একটি চামড়াকাটা তদারকি করছে সেনাবাহিনীর কসাই।

ভোজন শেষে তীরে পড়ে থাকা অবশিষ্ট মাংস আঁচার করে, নয়তো রোদে শুকিয়ে নেওয়া হবে। সেনাবাহিনীর সদস্য, আইনের লোকজন, মন্দির আর রাজ্যের কর্মীদের ভোজনে ব্যবহৃত হবে সেটা। তবে, আদপে এর বেশ কিছু অংশ বিচ্ছিন্নভাবে বিক্রি হবে, স্বাভাবিকভাবেই রাজ-উজির, আমার মালিক ইনটেফের কোষাগারে যাবে সেই অর্থ। আগেই বলেছি, স্বয়ং ফারাওয়ের পরে আমার মালিক ইনটেফ হলেন উচ্চ মিশরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। প্রতিদিন আরো বাড়ছে তার সম্পদের পরিমাণ।

একটা শোরগোল শুনছি পেছন থেকে, দ্রুত ফিরে তাকালাম। এখনও কাজে মত্ত ট্যানাসের বাহিনী। যুদ্ধের মতো করে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে প্রতিটি গ্যালি; তীরের সাথে সমান্তরালে পঞ্চাশ গজ দূরে গভীর পানিতে রয়েছে সবকয়টা। রেইলে দাঁড়িয়ে হারপুন হাতে ল্যাগুনের জলে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে যোদ্ধারা।

রক্ত আর তাজা মাংসের গন্ধ আকৃষ্ট করেছে কুমীরের দলকে। শুধু ল্যাগুনের পানিতে নয়, সেই নীল নদের প্রধান শাখা থেকে এসে ভোজে জড়ো হয়েছে জানোয়ারগুলো। হারপুন শিকারীরা তৈরি। প্রতিটি হারপুনের ডগায় কাঁটাওয়ালা ব্রোঞ্জের মাথা রয়েছে।

হারপুন শিকারীদের দক্ষতা সত্যিই অপূর্ব। লম্বা, অশুভ ছায়ার মতো পানির তলা থেকে ভেসে উঠে একটা সরীসৃপ; কাঁটাওয়ালা ভীষণ লেজটা মসৃণভাবে নেড়ে ঘাপটি মেরে থাকে। হারপুন শিকারীরাও এ সুযোগের অপেক্ষাই থাকে। গ্যালির নিচ দিয়ে ওটাকে যেতে দেবে তারা, তারপর যখন ওপাশে চলে যাবে; হালের আড়াল থেকে ছুঁড়বে প্রাণঘাতি বর্শা।

চরম আঘাত ঠিক নয়, বরং সুতীক্ষ একটা খোঁচা বলা যায়। শল্যবিদের সুঁইয়ের মতোই ধারালো হয় হারপুনের তামার তৈরি ডগা; সরীসৃপের শক্ত আঁইশঅলা দেহের গভীরে পুরোটা গেঁথে যায় ওটা। ঘাড়ের পেছনের জায়গাটা টার্গেট করে হারপুন শিকারীরা, এক পলকে ছিন্ন করে ফেলে স্পাইনাল কর্ড।

তবে, একটি-দুটি আঘাত ব্যর্থ হতে উদ্দাম আস্ফালনে জল তোলপাড় করে শয়তান জন্তগুলো। ডগার ব্রোঞ্জের মাথাটা সরীসৃপের দেহে অদৃশ্য হতে তার সাথে সংযুক্ত দড়ি ধরে টেনে চলে যোদ্ধার দল, নিয়ন্ত্রণ করে প্রাণীটির প্রতিটি নড়াচড়া। বড় কুমীর হলে অনেক সময় চারজন মানুষের সমান হয় একেকটা গ্যালির গানওয়েলের সঙ্গে জড়িয়ে বেঁধে রাখা হয় দড়ির প্রান্ত।

সেরকম দ্বন্দ্ব-যুদ্ধে তীরে দাঁড়ানো মানুষজন চেঁচিয়ে উৎসাহ যুগিয়ে চলে যোদ্ধাদের; একবার কোনমতে কুমীরের মুখটা নিজেদের দিকে যদি করা যায়, গভীর পানিতে সাঁতরে ফিরে যেতে পারে না ওটা। জাহাজের পাশের পানিতে ফেনা আর সাদা পানির আলোড়ন তোলাই সার হয় ওগুলোর; রেইলে দাঁড়ানো যোদ্ধারা খুঁচিয়ে ভেঙে ফেলে খুলির শক্ত হাড়।

কুমীরের শবদেহ যখন নদী তীরে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো, ওগুলোকে পরীক্ষা করতে চললাম আমি। ট্যানাস বাহিনীর কসাইরা ততক্ষণে চামড়া সংগ্রহের কাজে লেগে গেছে।

আমাদের বর্তমান রাজার পিতামহ, তার বাহিনীর নাম নীল কুমীর রক্ষীবাহিনী বলে অনুমোদন করেছিলেন; নীল কুমীর হলো তাদের পদমর্যাদা। ওদের যুদ্ধ-ঢাল নির্মিত হয় এই ভীষণ সরীসৃপের শক্ত চামড়া থেকে। সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হলে এমনকি শত্রুর ছোঁড়া তীর বা বর্শার আঘাত দিব্যি ঠেকিয়ে দেয় ওগুলো। ধাতবের চেয়ে অনেক হালকা, মরুভূমির গরমে পরিধানের পক্ষেও ঠাণ্ডা। কুমীরের চামড়ায় তৈরি ট্যানাসের হেলমেট অসট্রিচের পালকে সজ্জিত; বুকের আচ্ছাদনও কুমীরের চামড়ার, চকচকে পালিশ করা–তামার ফুলের কারুকার্য খচিত। শত্রুর চোখে আতঙ্ক জাগানোর জন্যেই এই প্রস্তুতি। কিংবা কুমারী হৃদয়ে কাপন তোলার জন্যে।

দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ মেপে দেখতে লাগলাম আমি; কসাইরা তাদের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। জলহস্তি শিকারে যে সামান্য মায়াও জেগেছিল মনে, এই নির্মম প্রাণিগুলোর জন্যে আমার কাছে তার ছিটেফোঁটাও নেই। বিষাক্ত সাপ ছাড়া এরচেয়ে নিঠুরতম প্রাণি আমার কাছে আর কোনোটিই নয়।

আমার ঘৃণা আরো বাড়ল যখন দেখতে পেলাম, এক কসাইয়ের ছুরির পোঁচে পেট কেটে যেতেই বিশাল সরীসৃপের ভেতর থেকে বেরুল অর্ধ-পাচিত একজন হতভাগ্য মেয়ের দেহাবশেষ। শরীরের পুরো উপরিভাগ আস্ত গিলে খেয়েছিল জানোয়ারটা; কোমরের উপর থেকে। গলার চারধারে একটা নেকলেস রয়েছে হতভাগিনীর, হাড় জিরজিরে হাতে পরে আছে লাল-নীল সিরামিকের অদ্ভুত সুন্দর বাজুবন্ধ।

এই খবর রটে যেতেই দুঃখ আর আতঙ্কের মর্মান্তিক চিল্কারে ভারী হয়ে আসে বাতাস। ভীড়ের মধ্য থেকে ঠেলে-ধাক্কিয়ে সৈন্যদের সরিয়ে বিভৎস দেহটার পাশে আছড়ে পড়ল একটা মেয়েমানুষ। শোকের মাতমে স্থির হয়ে থাকে চরাচর।

আমার মাণিক! আমার মেয়ে! গত দিনই প্রাসাদে এসে ওর মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার খবর জানিয়েছিল মহিলা। প্রাসাদের রক্ষীরা তাকে বলেছিল, হয়তো অপহরণের পরে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে তাকে দস্যুর দল। শহরের দ্বারে দিনে-দুপুরে এখন চলে এই দস্যুদের রাজত্ব; বিরাট একটা শক্তি হয়ে মাথাচাড়া দিয়েছে এরা। প্রাসাদের রক্ষীরা মহিলাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, ওর মেয়েকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। দেশের আইন-কানুনের উর্ধে চলে গেছে এই দস্যুদের কর্মকাণ্ড।

অন্তত একবারের জন্যে হলেও সেই অনুমান ভুল প্রমাণিত হলো। হতভাগ্য লাশের থেকে স্বর্ণালঙ্কারগুলো নিয়ে নেয় মহিলা। খুব খারাপ লাগছে আমার, শূন্য একটা সুরার পাত্র আনতে পাঠালাম আমি। দেহাবশেষগুলো সুরার পিপে হতে স্থানান্ত রের সময় চোখের পানি আটকে রাখা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে।

বুকের কাছে হতভাগিনী মেয়ের দেহাবশেষ সমেত পাত্রটা আঁকড়ে ধরে হেঁটে চলে মা টা; একটা ব্যাপার ভেবে দুঃখবোধ প্রবল হলো আমার। যত প্রার্থনা করা হোক না কেন, যত আচার পালন করা হোক; এমনকি, এই হত-দরিদ্র মহিলা যদি তার সন্তানের যেন-তেন একটা মমি পর্যন্ত প্রস্তুত করেও ফেলে, মৃত্যুর পরের জীবনে কখনও মুক্তি পাবে না মেয়েটার আত্মা। সেরকম হতে হলে, শব প্রস্তুতির আগে অক্ষত থাকতে হয় মৃতদেহ। নিরুপায় মায়ের জন্যে কেঁদে উঠে আমার মন। এ আমার এক ধরনের দুর্বলতা; জগতের সকল অন্যায্য আর দুঃখ বড় বেশি বুকে বাজে। বরং শক্ত হৃদয় হওয়াটা জরুরি।

সবসময়ের মতোই, দুঃখবোধ ভুলে থাকতে আমার তুলি আর প্যাপিরাস স্ক্রোল তুলে নিলাম। আমার চারপাশে চলতে থাকা ঘটনাবলি লিখে নিতে লাগলাম; সবকিছু সেই হারপুন শিকারী, হতভাগ্য মা, চামড়া সংগ্রহ, জলহস্তি বধ, কুমীর নিধন আর আমার লোকজনের পৈশাচিক ভোজ সবকথা দৃশ্যমান হতে থাকল আমার তুলির আঁচড়ে।

ইতিমধ্যেই মদ আর মাংসে আকণ্ঠ পরিপূর্ণ জনতার যে যেখানে ঢলে পড়েছে, সেখানেই ঘুমাচ্ছে নাক ডেকে। এখনও যারা দাঁড়িয়ে আছে দু পায়ের উপর, তাদের কেউই লাথি-গুতো আমলে নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। তরুণ, নির্লজ্জ ছেলেমেয়েরা আলিঙ্গন আর আদরে ভরিয়ে তুলছে পরস্পরকে; ঘনায়মান অন্ধকার আর হালকা ঝোঁপের ছায়ায়, প্যাপিরাসের বিছানায় মত্ত হয়েছে আদিম কামনায়। এদের অশ্লীল আচরণ পুরো জাতির ঝিমিয়ে পড়া অবস্থানের রূপক বলা যায়। এর কিছুই হতো না, যদি আমাদের একজন ইস্পাত-দৃঢ় ফারাও থাকতেন। শক্ত চরিত্রের, মনোবল আর অনুশাসনের বান্ধব কেউ যদি হতেন সিংহভাগ থিবেস নগরীর প্রভু। সাধারণ জনতা ঊর্ধস্তনদের থেকেই তো শিক্ষা নেয়।

যা ঘটেছে, যদিও আমি এর কিছুই অনুমোদন করি না, তথাপি প্রতিটি ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ করে যেতে লাগলাম। লেখা আর আঁকার ফাঁকে কেমন করে যেনো পেরিয়ে গেলো একটি ঘণ্টা; টের পাই নি। হোরাসের প্রশ্বাসের চালকের প্রকোষ্ঠে বসে লিখছিলাম এতটা সময়। পশ্চিমে ঢলে পড়েছে সূর্য, যেনো বিশাল নদী গহ্বরে ডুবে যেতে চাইছে; তামাটে অবয়ব রেখে যাচ্ছে পানিতে। আর আকাশে তারই ধোয়াটে উজ্জ্বলতা, যেনো আগুন লেগেছে প্যাপিরাসের ঝরে।

বেলাভূমির জনতা আরো বেপরোয়া, আরো অধৈৰ্য্য হয়ে উঠছে প্রতি ক্ষণে। একজন মাতাল নাবিক, আর শান্ত-সৌম্য পোশাকের মন্দির-পরিচর্যাকারিনীকে দেখলাম অগ্নিকুণ্ডের ওপাশের ছায়ায় হারিয়ে যেতে। নিজের আঁটো জামা খুলে মেলে ধরলো মেয়েটা; হাঁটু গেড়ে বসে বিশাল পেছনটা উপরে উঁচিয়ে রাখলো। যেনো কোনো কামার্ত কুকুরের মতোই উল্লাসের আনন্দে চিৎকার করে ওর উপর চড়ে বসে নাবিক; কিছুসময়ের মধ্যেই তার মতোই জোর শীৎকারে কেঁপে উঠে মেয়েটা। ওদের আলিঙ্গনবদ্ধ ছবিটা এঁকে নিতে লাগলাম আমি, কিন্তু আলো কমে আসছিল দ্রুত; তাই সেই দিনের মতো ক্ষান্ত দিতে হলো।

স্ক্রোলগুলো একপাশে রাখতে গিয়ে মনে পড়ল, বাচ্চা মেয়েটার মৃতদেহ। আবিষ্কারের পর থেকে আমার মিসট্রেসকে দেখছি না। আতঙ্কে চট করে দাঁড়িয়ে গেলাম। কেমন করে এতটা বেখেয়াল হতে পারলাম? আমার মিসট্রেস কঠোর অনুশাসনের মধ্যে বড় হয়েছে, আমি নিজে নিশ্চিত করেছি সেটা। সৎ আর শুভ্র মেয়ে ও; আইন এবং আচার তার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে, সে সম্পর্কে সচেতন। ওর বাবার রাগের সামনে আমি যতোটা অসহায়, লসট্রিস তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। অবশ্যই আমি ওকে বিশ্বাস করি।

নারী সত্তা লাভের মতো আবেগী দিনে, আজ, এই উন্মত্ত চরাচরে, আঁধার রাতে, সুপুরুষ এবং একই রকম তেজ-দীপ্ত কোনো সৈনিকের বাহুলগ্না হয়ে সে কী সীমা লঙ্ঘন করতে পারে না? আর তাছাড়া, ওকে তো সে ভালোবাসে।

যতোটা না আমার মিসট্রেসের কুমারীত্বের জন্যে, তার চেয়ে নিজের ভাগ্য নিয়ে শঙ্কিত হলাম আমি। সকালে কারনাকে, আমার মালিক ইনটেফের প্রাসাদে যখন যাব, তার কানে ঠিকই পৌঁছুবে আমার দায়িত্ব পালনে অযোগ্যতার কথা।

আমার মালিকের গুপ্তচরের অবাধ বিচরণ সমাজের প্রতিটি স্তরে, আমাদের ভূমির প্রতিটি কোণে; এমনকি, খোদ ফারাওয়ের প্রাসাদে পর্যন্ত। আমার চেয়ে অনেক লম্বা তাঁর হাত, অবশ্য দেওয়ার মতো এতো অর্থও নেই আমার। তবে তার এবং আমার গুপ্তচরেরা ক্ষেত্রবিশেষে একই লোক। লসট্রিস যদি আমাদের সবাইকে অপমান করেই ফেলে, সকালের আগেই সেটা জেনে যাবেন আমার মালিক; জানব আমিও।

জাহাজের একমাথা থেকে অপর মাথায় দৌড়ে চললাম আমি, খুঁজছি ওকে। স্টার্ন টাওয়ারে চড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরলাম বেলাভূমি। ট্যানাস বা লসট্রিস কারও চিহ্ন মাত্র নেই। আমার আশঙ্কা আরো দৃঢ় হয়।

এই উন্মাদ-রাতে কোথায় খুঁজব আমি ওদের? হতাশার প্রাবল্যে হাত ঝাঁপটাচ্ছি, নিজেকে স্থির করার প্রয়াস পেলাম। সবসময়ই নিজের অবয়বে নারীর প্রকাশভঙ্গি ঝেড়ে ফেলতে সচেষ্ট আমি। নপুংসক নয়, বরঞ্চ একজন পুরুষ মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিবেশনের চেষ্টা করি।

প্রাণান্ত চেষ্টায় নিজেকে শান্ত করলাম, শান্ত-যুক্তিতে বিচার করতে চাইলাম পরিস্থিতি; যুদ্ধের প্রচণ্ডতায় ট্যানাসকে এমন করতে দেখেছি বহুবার। মাথা ঠাণ্ডা হতে যুক্তি ফিরে এলো আমার মধ্যে। কী রকম ব্যবহার করতে পারে আমার মিসট্রেস, ভাবতে বসলাম। ওকে আমি অন্তরঙ্গভাবে জানি। চৌদ্দটি বছর ধরে তো ওকে দেখেই আসছি। মনে হলো, লসট্রিসের মধ্যে অনুশাসন আর নিজের উঁচু বংশপরিচয়ের বোধ এতো প্রবল; উন্মত্ত রাতে, বেলাভূমির অবর্ণনীয় লালসায় ও নিজেকে ভাসিয়ে দেবে না; ঝোঁপের আড়ালে মিলিত হবে না কামার্ত কুকুরীর মতো। একটা ব্যাপার নিশ্চিত, ওদের দুজনকে খুঁজে বের করতে কারো সাহায্য নেওয়া যাবে না। তার অর্থ হবে আমার মালিক ইনটেফের কানে কথাটা পৌঁছে দেয়া। নিজেকেই করতে হবে, যা কিছু করার আছে।

কোন গোপন স্থানে নিজেকে নিয়ে যেতে দেবে লসট্রিস? এই বয়সের যে কোনো– তরুণীর মতোই আবেগী ভালোবাসার ধারণায় পরিপূর্ণ ওর মন। ওই দুটো বজ্জাত কালো দাসী মেয়েও ভালোবাসার শারীরিক ব্যাপার সম্পর্কে তাকে প্রলুব্ধ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। আমি নিজেও অবশ্য একবার চেষ্টা করেছিলাম এ সম্পর্কিত কিছুটা জ্ঞান দিতে, ওটা আমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে, যাতে করে নিজেকে ভবিষ্যতে রক্ষা করতে পারে সে; কিন্তু তেমন আগ্রহ দেখায় নি লসট্রিস।

বুঝতে পারছি, এমন কোথাও খুঁজতে হবে ওকে, যার সাথে তার আবেগী মনের মিল আছে। হোরাসের প্রশ্বাসে কোনো ব্যক্তিগত কক্ষ থাকলে, সেখানেই আগে ছুটে যেতাম। কিন্তু আমাদের যুদ্ধ গ্যালিগুলো ছোটো, গতি এবং নিয়ন্ত্রণের জন্যে বিলাসিতা বর্জন করা হয়েছে ওগুলো থেকে। খোলা পাটাতনে ঘুমায় নাবিকেরা, এমনকি জাহাজের অধিনায়ক পর্যন্ত কিছুটা আড়াল করা একটা স্থানে রাত কাটায়। এখন, এমনকি কোনো আড়ালও নেই ডেকে, গোপনে মিলিত হওয়ার কোনো উপায় অন্তত হোরাসের প্রশ্বাসে নেই।

কারনাকে, আমাদের প্রাসাদ এখনও অর্ধেক দিনের পথ। উৎসবরত জনতার থেকে একটু তফাতে, ছোটো একটা দ্বীপ-মতো জায়গায় মাত্র তাঁবু খাড়া করা হচ্ছে আমাদের জন্যে। দাসগুলো নিশ্চই উৎসবে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়েছিল, না হলে এতো দেরি হওয়ার কথা নয় তবু তৈরিতে। মশালের আলোতে দেখতে পেলাম বেশ টলছে ওদের কেউ কেউ, দড়ি-দড়া হাতে। লসট্রিসের বিলাসবহুল, ব্যক্তিগত তবু এখনও তৈরি করা হয় নি যে, কার্পেট, দামী পর্দা আর লিনেন চাদরের সুখ হাতছানি দিয়ে ডাকবে প্রেমিক যুগলকে। তাহলে কোথায় যেতে পারে তারা?

ঠিক সেই মুহূর্তে নরম, হলুদ একটা আলো আমার মনোযোগ কেড়ে নিল । ল্যাগুনের ওপাশ থেকে আসছে আলোটা। সাথে সাথেই আমার অতিন্দ্রীয় সাড়া দেয়। আমার মিসট্রেসের সাথে দেবী হাপির যোগাযোগের কথা মনে হতে বুঝতে পারলাম, ল্যাগুনের ঠিক মধ্যিখানে দ্বীপের উপর তৈরি ছবির মতো সুন্দর তার মন্দির হাতছানি দিয়ে ডেকেছে তাকে। ওখানে যাওয়ার কোন উপায়ের খোঁজে তীরে চোখ বোলালাম আমি। মন্দিরে যাওয়া-আসার জন্যে ছোটো নৌকা আছে বটে, তবে মাঝিরা সবাই মাতাল, পড়ে আছে বেহুশ হয়ে।

ক্ৰাতাসকে দেখতে পেলাম তীরে। শিরস্ত্রাণের অস্ট্রিচের পালক সাধারণ জনতার মাথার উপরে গর্বিত ভঙ্গিতে উঁচু হয়ে আছে।

ক্ৰাতাস! চিৎকার করে ডাকতেই আমার দিকে ফিরে হাত নাড়ে সে। ক্ৰাতাস হলো ট্যানাসের ডান হাত; আর সম্ভবত আমি বাদে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন। অন্ধের মতো ওকে বিশ্বাস করতে পারি আমি।

একটা নৌকা জোগাড় কর! ওর উদ্দেশ্যে চেঁচালাম। যে কোনো একটা! আমার স্বরের তাগিদ ঠিকই পৌঁছুল কাতাসের কানে। অহেতুক প্রশ্ন করা বা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগার মানুষ নয় সে। তীরের সবচেয়ে কাছাকাছি ফেলুচার দিকে এগুল। মরার মতো ঘুমোচ্ছিল মাঝি। ঘাড়ের কাছের জামা ধরে শূন্যে তুলে তাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল ক্ৰাতাস। ঠিক যেমন করে পড়লো, সেইভাবেই ঘুমিয়ে রইল বেচারা; সস্তা চোলাই মদের নেশায় বুদ। নিজেই নৌকাটা চালিয়ে হোরাসের প্রশ্বাসের পাশে এনে ভেড়াল ক্ৰাতাস। টাওয়ারের মাথা থেকে লাফিয়ে ছোটো নৌকাটার উপরে পড়লাম আমি।

মন্দিরে নিয়ে চল, ক্ৰাতাস! তাড়াতাড়ি! কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম। দেবী হাপি, আমাদের যেনো খুব বেশি দেরি হয়ে না যায়?

সন্ধার বাতাসে তেকোণা পাল পতপত করে উড়ে, মুহূর্ত পরেই কালো পানি পেরিয়ে মন্দিরের পাথরের ঘাটে ভীড়লো নৌকা। খুঁটির সাথে জলযানটা বেঁধে আমাকে পথ দেখাতে উদ্যত হয় কাতাস; আমি থামালাম ওকে।

আমার নয়, ট্যানাসের খাতিরে, বললাম আমি, দয়া করে অনুসরণ কোর না।

এক মুহূর্তের জন্যে অস্বস্তিতে ভুগলো ক্ৰাতাস, শেষমেষ মাথা নেড়ে সায় দেয় । প্রয়োজন হলে ডাক দিয়ো। নিজের তরবারিটা খুলে হাতল এগিয়ে দিলো আমার দিকে। এটা প্রয়োজন হতে পারে।

মাথা নাড়লাম আমি। সে ধরনের কোনো বিপদ নয়। আর তাছাড়া, ছুরি আছে সঙ্গে। আমাকে বিশ্বাস করার জন্যে ধন্যবাদ। ওকে সেখানে ফেলে রেখে মন্দিরের গ্রানাইটের সিঁড়ি বেয়ে প্রবেশপথের দিকে ছুটলাম।

উঁচু প্রবেশ মুখের বাঁকানো পথে জ্বলন্ত মশালগুলো এক অপার্থিব আলো ছড়াচ্ছে, যেনো দেওয়ালে খোদাই করা মূর্তিগুলো এখনই হেসে উঠবে। দেবী হাপির প্রতি আমি বিশেষ অনুরক্ত। মূলত, তিনি না দেবতা, না দেবী অদ্ভুত অবয়ব তার; দাঁড়ি-মুখো, উভলিঙ্গিক, বিশাল পুংজননেন্দ্রীয় এবং নারী যোনী উভয়ই আছে। আর রয়েছে বিপুল আয়তন বক্ষযুগল আমাদের সকলকে দুধ বিলোয় সেটা। তিনি হলেন নীল নদের প্রতিরূপ, চাষ-কার্যের দেবী। মিশরের দুই রাজ্যের সকল অধিবাসী বিশাল এই নদীর পর্যাক্রম বন্যার জন্যে তারই অনুকম্পার উপর নির্ভর করে। যখন ইচ্ছে তখন নিজের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে সক্ষম উনি, আমাদের এই মিশরের অন্যান্য বহু দেব-দেবীর মতো পারেন যে কোনো প্রাণীর আকার ধারণ করতে। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় অবয়ব হলো জলহস্তির। এহেন ঘোলাটে লিঙ্গ পরিচয় হওয়া সত্ত্বেও আমার কর্ত্রী, লসট্রিস সবসময় তাকে নারী বলেই মনে করে; আমি নিজেও তাই করি। হাপির মন্দিরের পুরোহিতেরা অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন।

পাথরের দেওয়ালে তাঁর ছবিগুলো বিশাল, মাতৃ-তুল্য। লাল, নীল এবং হলুদের মৌলিক রঙে আঁকা, জলহস্তি সদৃশ মুখ নিয়ে নিচে দৃষ্টিপাত করে আছেন, প্রকৃতির সবকিছুকে যেনো সঙ্গমে আহ্বান করছেন। আমার বর্তমান উদ্বেগের সাথে অবশ্য এই আহ্বান ঠিক যায় না! ভয় হতে লাগল, হয়তো আমার অপরিণত মিসট্রেস এখন দেবীর নির্লজ্জ আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেহজ সুখে মত্ত।

পার্শ্ব-বেদীতে বসে ঝিমোচ্ছিল একজন নারী পুরোহিত, দৌড়ে তার কাছে চলে এলাম আমি, মাথার টুপির কিনারা ধরে ঝাঁকালাম অধৈৰ্য্য ভঙিতে । পবিত্র ভগিনী, আমাকে বলুন, রাজ-উজিরের কন্যা লসট্রিসকে দেখেছেন? উচ্চ-মিশরের খুব কম লোকই আছেন, যারা দেখামাত্র আমার মিসট্রেসকে চিনবে না। তার সৌন্দর্য্য, শিশুতোষ আগ্রহ আর চমৎকার মিষ্টি ব্যবহারের জন্যে দোকান, রাস্তা যেখানেই যাক, সবাই ঘিরে রাখে লসট্রিসকে।

ফোকলা দাঁতে আমার উদ্দেশ্যে হাসলো বুড়ি। এক হাত দিয়ে নাকের পাশে এমন ধরনের একটা ভঙ্গি করে দেখাল, আমার চরম আশঙ্কা সত্যি বলে মনে হলো।

এবারে কর্কশভাবে আঁকালাম বুড়িকে। কোথায় সে, বুড়ি মা? বলুন আমাকে! কিন্তু চোখদুটো কোটরের ভেতর ঘুরিয়ে হাসলো সে।

গ্রানাইটের চাতাল ধরে দৌড়ালাম আমি, পায়ের চেয়ে যেনো দ্রুত চলছে হৃদপিণ্ড; কিন্তু এতো কিছুর মাঝেও আমার মিসট্রেসের সাহস নিয়ে ভাবছিলাম। যদিও উচ্চ বংশীয় হওয়ার কারণে যে কোনো পবিত্র স্থাপনায় তার প্রবেশাধিকার আছে, কিন্তু পুরো মিশরেও ভালোবাসার এমন একটি স্থান নির্বাচনের সাহস কার আছে?

মঠ-এর প্রবেশ মুখে থমকে দাঁড়ালাম। আমার অতিন্দ্রীয় সত্যি কথাই বলেছে। ওই তো ওরা দুজন, ঠিক যেমনটা আশঙ্কা করেছিলাম। প্রায় চিৎকার করে উঠেছিলাম, জোর করে শান্ত করলাম নিজেকে।

স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আড্র আমার মিসট্রেস; ওর বুক জোড়া ঢাকা, মাথার উপর নীল উলের একটা শাল ফেলে রেখেছে। দেবী হাপির বিশাল মূর্তির সামনে উঁবু হয়ে রয়েছে সে।

পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ট্যানাস। নিজের অস্ত্র এবং ঢাল একপাশে সরিয়ে রেখেছে। মঠের সামনে ওগুলোকে দেখে এসেছি আমি। লিনেন কাপড় আর খাটো টিউনিক পরনে, পায়ে স্যান্ডল। হাতে হাত ধরে আছে প্রেমিক যুগল, ফিসফিস করে কথা বলছে, প্রায় জোড়া লেগে আছে দুটো মাথা।

আমার প্রকৃত সন্দেহ তিরোহিত হলো, লজ্জা আর অপরাধবোধ ঘিরে ধরছে এখন। কেমন করে আমার মিসট্রেসকে সন্দেহ করতে পারলাম? ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগলাম। পার্শ্ব-বেদীর সামনে এসে ধন্যবাদ জানালাম দেবীকে, নীরবে দেখছি ওদের দুজনকে।

সেই মুহূর্তে, উঠে দাঁড়িয়ে দেবীর মূর্তির উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো লসট্রিস। ওর তরুণী দেহের সৌন্দর্য্যে এতটাই বিমোহিত হলাম, নড়তে পারছি না আমি।

গলার চারধারে ঝোলানো ল্যাপিস-লাজুলির ছবি আঁকা আমার দেওয়া উপহারটা খুলে নিল ও। বেদনার সাথে বুঝলাম, সে হয়তো দান করতে যাচ্ছে ওটা। ওর প্রতি আমার সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে নেকলেসটা তৈরি করেছিলাম, অন্য কোথাও ওটাকে আমি সহ্য করতে পারব না। পায়ের পাতার উপর দাঁড়িয়ে মূর্তির গলায় ওটা পরিয়ে দেয় লসট্রিস। এরপরে নিচু হয়ে চুমো খায় পাথুরে পদতলে। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল ট্যানাস।

উঠে দাঁড়িয়ে ট্যানাসের দিকে যাচ্ছিল সে, আমাকে দেখে ফেলল দরোজায়। ছায়ায় মিশে যেতে ইচ্ছা হলো আমার, এতো আবেগঘন মুহূর্তে ওদের চুপিসারে দেখছি বলে লজ্জিত। কিন্তু, আমি পালিয়ে যাওয়ার আগেই আনন্দে ঝলমল করে উঠলো লসট্রিসের চোখ-মুখ, দৌড়ে এসে আমার হাত আঁকড়ে ধরলো ও।

ওহ, টাইটা! তুমি এখানে, কী যে খুশি লাগছে আমার! সত্যি, তোমারই অভাব ছিলো! হাত ধরে টেনে স্যাঙ্কটাম-এর দিকে নিয়ে যায় সে আমাকে। উঠে দাঁড়িয়ে আমার উদ্দেশ্যে স্মিত হাসলো ট্যানাস, অপর হাতটা ধরলো।

এখানে আসার জন্যে ধন্যবাদ । জানি, তোমার উপর সবসময় ভরসা করা যায়। যদি সত্যিই আমার উদ্দেশ্য এতটা খাঁটি হোত, যা ওরা ভাবছে। নিজের অপরাধদগ্ধ হৃদয় আড়াল করতে স্নেহের হাসি হাসলাম।

নিচু হও! লসট্রিস আদেশ করে আমাকে। শোনো, আমরা যা কিছু বলব, সব শোনো। দেবী হাপি আর মিশরের সব দেবতাদের সামনে তুমি আজ সাক্ষী হয়ে থাকবে। আমাকে হাঁটু ভাঁজ করে দাঁড়াতে চাপ দেয় সে, পরস্পরের হাত ধরে দেবীর মূর্তির সামনে চোখে চোখে তাকায় ওরা।

লসট্রিস বলে উঠে প্রথমে। তুমি আমার সূৰ্য্য, ফিসফিস করে বলে ও। তুমি ছাড়া আমার দিনগুলো অন্ধকার।

তুমি আমার হৃদয়ের নীল নদ, শান্ত স্বরে প্রত্যুত্তর করলো ট্যানাস। তোমার ভালোবাসার জল আমাকে পবিত্র করে।

এই জীবনে, আর যত জীবন আছে সবসময় তুমিই আমার মনের মানুষ।

তুমি আমার নারী, তোমাকে প্রার্থনা করছি, প্রিয়। হোরাসের রক্ত আর প্রশ্বাসের নামে কসম। পরিষ্কার, মুক্ত কন্ঠে বলে ট্যানাস, পাথুরে দেওয়ালে প্রতিধ্বনি তোলে তার আওয়াজ।

তোমার আবেদন মঞ্জুর করলাম, এর বিপরীতে সহস্রগুন ফেরত দেব, বলে চলে লসট্রিস, আমাদের মধ্যে কখনও কেউ আসতে পারবে না, কোনো কিছুই পারবে না আমাদের বিচ্ছেদ করতে। চিরজীবনের জন্যে আমরা এক হলাম।

মুখ উঁচিয়ে দয়িতের উদ্দেশ্যে মেলে ধরে লসট্রিস। ধীরে, গভীরভাবে চুমো খায় ওরা। আমার জানা মতে, এ হলো প্রেমিক যুগলের প্রথম চুম্বন। এতে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত অবলোকন করতে পেরে সম্মানিত বোধ করলাম।

ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন আলিঙ্গনাবদ্ধ হলো ওরা, ল্যাগুন থেকে ভেসে আসা এক পশলা ঠাণ্ডা বাতাস মন্দিরের স্বল্পালোকিত ঘরটাকে এলোমেলো করে ফেলল; মশালের শিখা কেঁপে উঠে নিভু নিভু হলো, এক মুহূর্তের জন্যে আমার চোখের আড়াল হয়ে গেলো প্রেমিক যুগল, আর দেবীর অবয়ব যেনো কেঁপে উঠে কিছু একটা বলতে চাইলো। যেমন করে এসেছিল, হঠাৎই চলে গেলো হাওয়া, কিন্তু বিশাল পাথুরে স্তম্ভের আড়ালে তার কানাকানি চললো অনেকক্ষণ; মনে হলো, যেনো দূরাগত প্রচণ্ড হাসিতে ভেঙে পড়ছেন দেব-দেবীরা। অতিন্দ্রিক আবেগে কেঁপে উঠলাম আমি।

দেবতাদের কাছে অতি-দাবি সবসময়ই বিপদজনক, আর এইমাত্র অসম্ভবের কামনা করেছে লসট্রিস। বহুদিন থেকেই এই দিনটির ভয় করে আসছিলাম আমি, নিজের মৃত্যু দিনের চেয়েও এ আমার কাছে অনেকগুন আতঙ্কের। যে প্রতিজ্ঞা এইমাত্র পরস্পরের প্রতি করেছে ট্যানাস আর লসট্রিস, তা কখনই টিকে থাকবে না। যত গভীর ভাবেই ওরা বলুক না কেন, এ হওয়ার নয়। শেষমেষ, ওরা যখন ঠোঁট সরিয়ে নিয়ে আমার দিকে ফিরল, মনে হলো, বুকটা যেনো ভেঙে যাবে আমার।

তুমি এতো দুঃখিত কেন, টাইটা? আনন্দে ঝলমল মুখে জানতে চায় লসট্রিস। আমার সাথে হাস না। আজ যে আমার জীবনের সেরা দিন।

জোর করে একটু হাসলাম আমি, কিন্তু কোনো কথা জোগাল না মুখে। হৃদয়ে তোলপার, ঠোঁটে হাসি নিয়ে এই পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ দুজনের দিকে তাকালাম ।

উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে আলিঙ্গন করলো ট্যানাস। আমার পক্ষ থেকে প্রভু ইনটেফের সঙ্গে কথা বলবে তুমি, তাই না? দাবি জানায় সে।

হ্যাঁ, টাইটা, লসট্রিস যোগ দেয় এই আবেদনে। বাবা তোমার কথা শুনবেন। এক তুমিই আছো, আমাদের জন্যে পারবে এটা করতে। করবে না, টাইটা? জীবনে কখনও আমাকে না কর নি তুমি, আমার জন্যে করবে না এটা?

কি বলব আমি ওদের? নিঠুর সত্যি কথাটা কেমন করে বলব? এই সজিব ভালোবাসাকে কী বলে মানাবো? ওরা অপেক্ষা করছে আমার উত্তরের জন্যে, চাইছে। আমি আনন্দ প্রকাশ করি, প্রতিজ্ঞা করি, সাহায্য করবো ওদের। কিন্তু বোবার মতো বসে রইলাম, শুষ্ক মুখে কথা সরছে না।

টাইটা, কী হলো? আমার মিসট্রেসের প্রিয় কমনীয় মুখে যেনো সন্ধার আঁধার ঘনালো। আমাদের সাথে আনন্দ করছ না কেন?

তোমরা জানো, তোমাদের দুজনকেই ভালোবাসি আমি, কিন্তু কথা শেষ করতে পারছি না আমি।

কিন্তু? কিন্তু কি, টাইটা? উদ্বিগ্ন লসট্রিস জানতে চাইল, আমার জীবনের সবচেয়ে সুখী দিনে অমন করছ কেন তুমি? রেগে যাচ্ছে ও, বুঝলাম; একইসঙ্গে বিন্দু বিন্দু অশ্রু জমা হচ্ছে চোখের কোণে। আমাদের সাহায্য করবে না তুমি? এতো বছর ধরে এতো অসংখ্যবার তাহলে এমনি প্রতিজ্ঞা করেছিলে আমার কাছে? আমার সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল ও, দৃষ্টিতে রোখ ।

মিসট্রেস, ওভাবে কথা বলো না। এমন ব্যবহার আমার পাওনা নয়। শোনো, আমার কথা! ওর ঠোঁটে আঙুল রেখে আরো একটা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আঁকলাম । আমি নই, তোমার বাবা, আমার মালিক প্রভু ইনটেফ–

ঠিক তাই। অধৈৰ্য্য লসট্রিস হাতের এক ঝাঁপটায় আমার হাতে সরিয়ে দেয় ওর মুখের উপর থেকে। আমার বাবা! তুমি তার কাছে গিয়ে আমাদের ব্যাপারে কথা বলবে, সবসময় যেমন করে বল। সবকিছু তাহলে ঠিক হয়ে যাবে।

লসট্রিস, শুরু করলাম আমি। এ আমার হতাশার বহিঃপ্রকাশ, সাধারণত ওর নাম ধরে সম্বোধন করি না। তুমি এখন আর শিশু নও। বাচ্চাদের মতো কল্পনায় নিজেকে ভাসিয়ে দিও না। তুমি জানো, তোমার বাবা কখনও সম্মত হবেন না

ও আমার কথা শুনবে না। সবচেয়ে সত্যি কথাটা শুনতে ও প্রস্তুত নয়, কথার তোড়ে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইল সে। আমি জানি, ট্যানাসের অত ধন সম্পদ নেই। কিন্তু ওর সামনে দারুন ভবিষ্যত পড়ে আছে। একদিন, সমগ্র মিশরের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেবে ও। তুমি দেখো, একদিন ওর নেতৃত্বে যুদ্ধে মিশরের দুই সাম্রাজ্য এক হবে, আমি সেদিন থাকব ওর পাশে।

মিসট্রেস, দয়া করে আমার কথা শোনো। ট্যানাসের ধন-সম্পত্তি নিয়ে কোনো কথা নেই। এরচেয়ে অনেক, অনেক বড় ব্যাপার।

তাহলে নিশ্চই ওর বংশধারা আর জন্ম নিয়ে কথা? ওটাই তো তোমার সমস্যা, না টাইটা? ভালো করেই জানো, আমাদের মতো ওরাও উচ্চ বংশীয়। পিয়াংকি, প্রভু হেরাব ছিলেন আমার বাবার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, তার সম মর্যাদার। ও আর আমার কোনো কথা শুনবে না। ও জানে না, কোনো ট্রাজেডির দ্বারপ্রান্তে এখন আমরা। ট্যানাস বা সে; ওরা কেউই জানে না। পুরো সাম্রাজ্যে সম্ভবত একমাত্র আমিই জানি সত্যিটা।

এতদিন ধরে ওর কাছ থেকে এই সত্যি গোপন রেখেছিলাম আমি, আর ট্যানাসকেও বলতে পারি নি কখনও। এখন কেমন করে ওকে বোঝাবো? কেমন করে ওকে বলব, তরুণ ট্যানাসের প্রতি তার বাবার গভীর ঘৃণার কথা? অপরাধবোধ আর ঈর্ষা থেকে জন্ম সেই ঘৃণা, হয়তো সে জন্যেই খুব বেশি স্থায়ী।

তবে, আমার প্রভু ইনটেফ খুবই চৌকস এবং চতুর মানুষ। চারপাশের লোকজনের কাছ থেকে সযত্নে আড়াল করে রেখেছেন তার অনুভূতি। তাঁর জিঘাংসা, ঘৃণাবোধ–সব লুকিয়ে রেখে হাসিমুখে চুমো খেয়েছেন তাঁরই হাতে ধ্বংস হওয়া কারো প্রতিনিধিকে। নদীর ধারে, পানির নিচে কাদায় লুকিয়ে থাকা কুমীরের মতো তাঁর ধৈৰ্য্য, সময় হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন অসতর্ক গ্যাজেলের উপর। প্রয়োজন হলে দিনের পর দিন, এমনকি দশক পার করে ফেলবেন; কিন্তু সুযোগ এলেই ছোবল মারবেন বিষাক্ত সরীসৃপের মতো তড়িৎ গতিতে।

বাপের এই বিষাক্ত স্পৃহা সম্বন্ধে একেবারে অজ্ঞ লসট্রিস। ও এমনকি বিশ্বাস করে তার বাবা পিয়াংকি, প্রভু হেরাবকে ভালবাসতেন। কিন্তু, ও জানবেই বা কেমন করে? এতদিন ধরে সত্যিটা তো আমিই গোপন রেখেছিলাম তার কাছে থেকে। নিষ্পাপ লসট্রিসের ধারণা, কেবল বংশ পরিচয় আর ধন-সম্পদ-ই ট্যানাস আর ওর মিলনের পথে একমাত্র বাধা।

তুমি জানো, এটা সত্যি, টাইটা। আভিজাত্যের তালিকায় ট্যানাস আমাদের সমান। মন্দিরের বেদীতে সবকিছু লেখা আছে। কেমন করে আমার বাবা না মেনে থাকবেন? তুমিই বা কেমন করে অমান্য করবে?

এটা মানা বা না মানার ব্যাপার নয়, মিসট্রেস–

তাহলে তুমি আমার বাবার কাছে যাচ্ছ, আমাদের ব্যাপারে কথা বলতে, তাই না টাইটা? বল, যাবে তুমি; যাবে না?

দৃষ্টির হতাশা আড়াল করে মাথা ঝাঁকালাম আমি।

*

কারনাকের উদ্দেশ্যে ফিরতি যাত্রায় চললো আমাদের জাহাজ বহর। কাঁচা চামড়া আর লবল দেওয়া মাংসের ভারে প্রতিটি গ্যালির পাটাতন পানি ছুঁই ছুঁই করছে। নীল নদের বিপরীতমুখী শক্তিশালী স্রোতের কারণে যাওয়ার সময় যেমনটা হয়েছিলো, তার তুলনায় ধীরে চলছে; তবে আশঙ্কায় জর্জরিত আমার হৃদয়ে দ্রুতই

মনে হতে লাগলো সেটা। সদ্য-ঘোষিত তরুণ প্রেমের উন্মাদনায়, পরস্পরের মিলনের পথে সব বাধা হটিয়ে দেওয়ার প্রত্যয়ে যেনো ভেসে যাবে প্রেমিক-যুগল। এই সুখ-স্বপ্নে বাগড়া দিতে মন সায় দিলো না, কারণ আমি নিঃসন্দেহে জানি, অন্তরঙ্গভাবে পরস্পরকে পাওয়ার দিন ওদের শেষ হতে চললো বলে। যদি সঠিক শব্দ বা সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারতাম, আমার মনে হয়, ওদের সত্যিকার মিলনে উৎসাহিত করতাম আমি; যা নিয়ে এতো ভয় পেয়ে গেছিলাম কাল রাতে। আর কখনও এমন সুযোগ পাবে না ওরা, যদি ইনটেফকে মূল ঘটনা জানাই। একবার ব্যাপারটা জানাজানি হলেই চিরদিনের মতো ওদেরকে আলাদা করে ফেলার বন্দোবস্ত করে ফেলবেন তিনি।

তাই, যতোটা পারি, ওদের মতোই হাসলাম আর আনন্দে মেতে থাকলাম; নিজের আশঙ্কা লুকিয়ে রাখলাম বহু চেষ্টায়। ভালোবাসায় এতটাই অন্ধ হয়ে আছে ওরা, কোনো সমস্যাই হলো না তা করতে; অন্য কোনো সময় হলে আমার মিসট্রেস খুব সহজেই ধরে ফেলতো আমার অনুভূতি। ওকে যতোটা জানি আমি, আমাকে ঠিক ততটাই ভালোভাবে চেনে সে।

গলুইয়ে বসে আমরা তিনজনে উৎসবের আকর্ষণ, ওসিরিসের গীতিনাট্য নিয়ে আলোচনা করছিলাম। নাটকের সঞ্চালক হিসেবে আমাকে মনোনীত করেছেন আমার মালিক প্রভু ইনটেফ, প্রধান চরিত্রের জন্যে ট্যানাস এবং লসট্রিস দুজনকেই নিয়েছি আমি।

প্রতি দুই বছরে একবার করে হয় এই উৎসব, ওসিরিসের পূর্ণিমায়। একটা সময়ে বছরে একবার করে হোত। কিন্তু, খরচ এবং প্রশাসনিক ঝামলোর কারণে মহান ফারাও, দুই উৎসবের মধ্যবর্তী ব্যবধান বাড়ানোর সমন জারি করেছেন। প্রতি উৎসবে সেই গজ-দ্বীপ থেকে থিবেস-নগরীতে স্থানান্তর করতে হয় রাজকার্য ।

গীতিনাট্যের চিন্তা সাম্প্রতিক আশঙ্কা থেকে খানিকটা হলেও রেহাই দিলোলা আমাকে। প্রেমিক যুগলকে তাদের নিজস্ব অংশ মুখস্ত করাতে লাগলাম। ওসিরিসের স্ত্রী, আইসিস-এর চরিত্র অভিনয় করবে লসট্রিস; আর প্রধান চরিত্র, হোরাসের ভূমিকায় ট্যানাস। লসট্রিসের ছেলের ভূমিকায় ট্যানাসের অভিনয়ের সম্ভবনায় ওরা দুজন হেসে খুন হয়, আমি বোঝালাম, দেব-দেবীদের বয়স বলে কিছু নেই, নিজের সন্তানের চেয়ে তাই তাদের বয়স কম দেখানোটা অস্বাভাবিক নয় বৈকি!

প্রায় এক হাজার বছর ধরে অভিনীত হয়ে আসা গীতি পুনলিখন করেছি আমি। বর্তমান দর্শকের কাছে আগের নাট্যের বচন বেশ আলঙ্কারিক এবং দুর্বোধ্য বলে মনে হবে। উৎসবের শেষ রাতে, ওসিরিসের মন্দিরে অভিনীত হবে গীতিনাট্যটি; মহান ফারাও থাকবেন প্রধান অতিথি হিসেবে। সে কারণেই বিশেষভাবে চিন্তিত আমি। প্রাজ্ঞ এবং পুরোহিতদের কাছ থেকে ইতিমধ্যেই নাট্যাংশ পুনর্লিখনের জন্যে আপত্তি উঠেছে। কেবল আমার মালিক, প্রভু ইনটেফের হস্তক্ষেপেই তাদের আপত্তি ধোপে টেকে নি।

আমার মালিক মোটেও ধার্মিক মানুষ নন, অন্য সময়ে হলে ধর্মীয় তত্ত্বকথায় বিতর্কে যেতেন না। তবে কিনা, কিছু বাক্যে তাঁকে স্তুতি করা হয়েছে। একটা ছুতো ধরে সেই বাক্যগুলো তাঁকে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলাম, এমনও বলেছিলাম, এটা প্রচারে প্রথম বাধা আসবে ওসিরিসের মন্দিরের বুড়ো পুরোহিতের কাছ থেকে। একবার, ছোটো বালকের অধিকার নিয়ে আমার মালিক ইনটেফের সাথে বিরোধ হয়েছিলো তার। আমার প্রভু, এই সমস্ত বাধা ক্ষমার চোখে দেখে অভ্যস্ত নন।

তো, আমার সংস্করণ প্রথমবারের মতো অভিনীত হতে যাচ্ছে। কুশীলবেরা যদি যথার্থভাবে আমার কাব্যের গৌরব ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, শেষবারের মতও প্রদর্শিত হবে নাটকটি।

ট্যানাস এবং লসট্রিস–ওদের দুজনের কণ্ঠস্বর যথেষ্ট শ্রুতিমধুর, ওদেরকে সাহায্য করার আমার প্রতিশ্রুতির পুরস্কার দিতে দুজনেই বদ্ধপরিকর। নিজেদের উজার করে দিলো ওরা, প্রতিটি শব্দে, বাক্যে আবেগের এমনই পরিস্ফুটন; নিজেকেই যেনো ভুলে গেলাম আমি।

হঠাৎই, গ্যালির সামনের কারো চিৎকারে দেবতাদের কল্পলোক থেকে বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে এলাম। নদীর শেষ বাঁক ঘুরছে আমাদের নৌবহর, সামনেই দেখা গেলো যমজ নগরী কারনাক এবং লুক্সর, দুটিতে মিলে তৈরি করেছে আমাদের মহান থিবেস নগরী। মুক্তোর কোনো নেকলেসের মতোই ঝলমল করছে তরুণ মিশরীয় সূর্যালোকে। নাটকের চমৎকার অবতরণিকা শেষ হয়ে গেছে, কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে এখন আমাদের। পায়ের উপর দাঁড়াতে আমার স্পৃহা যেনো টলমল করে উঠল।

ট্যানাস, আমি এবং লসট্রিসকে অবশ্যই ক্ৰাতাস-এর গ্যালিতে যেতে হবে; শহর কাছে চলে এসেছে। আমার মালিকের চরেরা সেই দূর থেকে নজর রাখছে। আমাদের একসঙ্গে দেখাটা ঠিক হবে না।

একটু দেরি হয়ে গেলো না? ট্যানাস হেসে বলে। আরো আগেই সেটা ভেবে রাখা উচিত ছিলো তোমার।

এমনিতেও আমার বাবা সবকিছু জানবেন, লসট্রিস এগিয়ে আসে প্রেমিকের কথার সমর্থনে। এতে করে বরঞ্চ তোমার কাজ আরো সহজ হয়ে গেলো।

যদি আমার চাইতে তোমার জ্ঞান বেশি হয়ে যায়, তবে যা ইচ্ছা করতে পারো; আমি আর এর মধ্যে নেই। কঠোর মুখাবয়ব ধারণ করলাম, সাথে সাথে কাজ হলো এতে।

ক্ৰাতাস-এর গ্যালিকে ইশারায় আমাদের পাশে নিয়ে এলো ট্যানাস, বিদায় জানাবার জন্যে অল্প কিছু সময় পেলো ওরা দুজন। অর্ধেক নৌবহরের সামনে আলিঙ্গনাদ্ধ হলো না বটে, কিন্তু ওদের পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিপাত আর কোমল স্বরের ফিসফিসানি জানিয়ে দিলো সবাইকে, যা জানার ছিলো।

ক্রাতাস-এর জাহাজের স্টার্ন টাওয়ারে দাঁড়িয়ে হোরাসের প্রশ্বাসকে বিদায় জানালাম আমরা, ঠিক চঞ্চল ফরিঙের মতো প্যাডল ঝাঁপটে লুক্সর নগরের সম্মুখের ঘাটের দিকে এগুল ওটা। নদীর উজানে, উজিরের প্রাসাদের উদ্দেশ্যে ভেসে চললো আমাদের জাহাজ।

*

প্রাসাদের ঘাটে নোঙর করতে না করতেই আমার মালিকের খোঁজ খবর করে একটু হলেও আশ্বস্ত হলাম। নদীর ওপারে নির্মাণাধীন ফারাওয়ের সমাধি এবং শেষকৃত্য-মন্দিরের কাজ তদারকি করতে গেছেন তিনি। গত বারো বছর ধরেই রাজার সমাধি এবং মন্দির নির্মাণ কাজ চলছে, ঠিক যেদিন থেকে দুই রাজ্যের সাদা এবং লাল রঙের মুকুট আরোহণ করেছেন আমাদের মহান ফারাও। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে কাজ, ওটা পরিদর্শনের জন্যে নিঃসন্দেহে উন্মুখ হয়ে আছেন ফারাও; ওসিরিসের উৎসব শেষ হতে না হতেই তা করবেন তিনি। আমার মালিক, ইনটেফ চাইছেন তাঁকে যে কোনো প্রকারে সন্তুষ্ট রাখতে। আমার মালিকের বহু পদবির মধ্যে একটি হলো, রাজকীয় সমাধির অভিভাবক; নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

তাঁর এই অনুপস্থিতি আরো একদিন সময় করে দিলো আমাকে, কিছু একটা ভেবে-চিন্তে বের করার জন্যে। কিন্তু, প্রেমিক যুগল আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছে, প্রথম সাক্ষাতেই তাদের কথা বলতে হবে।

হারেমে আমার মিসট্রেস নিরাপদে পৌঁছুতেই প্রাসাদের এক কোণে, উজিরের নিকটজনের জন্যে তৈরি করা নিজের প্রকোষ্ঠে ফিরে চললাম তরিঘরি করে।

তাঁর অন্যান্য কার্যাবলির মতোই আমার মালিকের পারিবারিক আয়োজনও বেশ চতুর। আটজন পত্নী আছে তার, প্রত্যেককেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক সুবিধা বা মোটা উপঢৌকনের বদৌলতে বিবাহ-শয্যায় নিয়েছেন তিনি। তবে তার মধ্যে তিনজনই কেবল সন্তান উপহার দিতে পেরেছে তাকে, আমার মিসট্রেস, লসট্রিস ছাড়াও দুই ছেলে আছে ইনটেফের।

যতদূর জানি, প্রাসাদের ভেতর-বাইরের সবকিছু আসলে আমার জানা, গত পনেরো বছরে একবারো হারেমে জান নি আমার মালিক। লসট্রিসের জন্ম ছিলো তার সর্বশেষ বৈবাহিক দায়িত্ব পালনের উদাহরণ। তার শয্যা-অভিরুচি ভিন্ন ধাতের। প্রাসাদে আমার অংশে বসবাস করে আমার মালিকের বিশেষ সঙ্গীরা; সমগ্র উচ্চ রাজ্যের সুদর্শন দাস-বালকের দল। বিগত একশ বছর ধরেই মহান মালিকদের তুষ্টিতে ওরা ভূমিকা পালন করে আসছে। আমাদের অসাধারণ সুন্দর জনপদের রুগ্ন ধারার এ ও একটি উদাহরণ বলা যায়।

দাস বালকদের সংগ্রহশালায় আমি ছিলাম বয়োজ্যেষ্ঠ। অতীতের বহু দাসের ভাগ্যে যা ঘটেছে, বয়সের কারণে সৌন্দৰ্য্য কমে যাওয়ার কারণে মুক্ত বাজারে বিক্রি হয়ে যাওয়া, আমার ক্ষেত্রে সেটা ঘটে নি। কেবল শারীরিক সৌন্দৰ্য্য নয়, আমার অন্যান্য গুণের কদর করেন আমার মালিক। এমন নয় যে, আমার রূপ তিরোহিত হয়েছে, বরঞ্চ তা বেড়েছে, বয়সের সাথে সাথে আরো খুলেছে বলা যায়। ভাবতে পারেন, এ আমার অতিকথন; কিন্তু এই লিপিতে মিছে কিছু লিখবো না বলে প্রতিজ্ঞা করেছি আমি।

সাম্প্রতিক কালে আমার মালিক তার শারীরিক তুষ্টির জন্যে খুব বেশি ডাকেন না আমাকে, বলা যায়, তার এই অনাগ্রহের জন্যে সত্যি আমি আনন্দিত। যখন ওটা করেন তিনি, আমার জন্যে একটা শাস্তি ছাড়া আর কিছু নয় তা। ভালো করেই জানা আছে তাঁর, শারীরিক যন্ত্রণা আর অপমানবোধ কতটা প্রখর আমার। অবশ্য, সেই বালক বয়স থেকেই নিজের অনুভূতি আড়াল করে আনন্দের ধ্বনি আরোপ করতে শিখেছিলাম বিশেষ সময়ে; কিন্তু কখনই আমার মালিককে ধোকা দিতে পারি নি।

আশ্চৰ্য্য, আমার এই অনাগ্রহ কখনও তাঁর উপভোগে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। বরঞ্চ এতে করে আরো বেড়েছে তার আমোদ। ভদ্র তো ননই, একটু মায়াও নেই আমার মালিক, ইনটেফের। কত শত বার বিগত দিনগুলোয় ক্রন্দনরত বালক ছেলেগুলোকে পরিচর্যা করেছি আমার মালিকের ভালোবাসার পর, ইয়ত্তা নেই। যতোটা সম্ভব, মানসিক সহায়তা দিয়েছি ওদের। হয়তো এ কারণেই দাসদের প্রকোষ্ঠে ওরা আমাকে আকহ্-কা বা বড় ভাই বলে ডাকে।

এখন আর আমার মালিকের শয্যাসঙ্গী হয়তো নই, তবে অন্যান্য কারণে আমার কদর করেন তিনি। আমি আরো বিশেষ কিছু তাঁর কাছে কবিরাজ এবং শিল্পী, সুরকার এবং লিপিকার, স্থপতি এবং বই-পুস্তকের সগ্রাহক; উপদেষ্টা ও প্রকৌশলী-তার মেয়ের পরিচর্যাকারী। এতটা বোকা আমি নই যে, ভেবে বসব আমাকে তিনি বিশ্বাস করেন বা ভালবাসেন, তবে মাঝে-মধ্যে মনে হয় বেশ পছন্দ করেন তিনি আমাকে। এ কারণেই লসট্রিস এই গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছে আমার উপর।

বিবাহের ক্ষেত্রে ফায়দা লোটার ব্যাপার ছাড়া একমাত্র কন্যার আর কোনো কিছু নিয়ে মাথাব্যথা নেই ইনটেফের। ওই দায়িত্বটাও আমার উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। কখনও কখনও এমন হয়, নীল নদীর বছর পরিক্রমায় একবারও মেয়ের সাথে কথা হয় না ইনটেফের । তার প্রশিক্ষণ বা অধ্যয়ন সম্পর্কিত আমার প্রতিবেদনও মনোযোগ দিয়ে শোনেন না কখনও।

লসট্রিসের প্রতি আমার সত্যিকারের অনুভূতি তার কাছে সযত্নে আড়াল করে রাখি আমি। জানি, প্রথম সুযোগে আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে সেটা। সবসময় ভাব করি, যেনো লসট্রিসের পড়াশোনা বা পরিচর্যা আমার জন্যে বিরক্তিকর একটা কাজ, সুযোগ পেলেই বাদ দেব। নারীদেহের প্রতি আমার মালিকের মতোই অভক্তি আছে। আমার, সময়ে সময়ে এমনও বলে থাকি। আমার ধারণা, এমনকি নপুংসক করার পরেও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আমার স্বাভাবিক আকর্ষণের খবর ইনটেফের জানা নেই।

মেয়ের কর্মকাণ্ডে আমার মালিকের এই অমনোযোগিতা কোনো কোনো সময়, অবশ্যই লসট্রিসের চাপাচাপিতে, সাহসী কাজ করতে ইন্ধন জোগায় আমাকে; ঠিক যেমন হোরাসের প্রশ্বাসে করে শিকার অভিযানে অংশগ্রহণ। পার পেয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ বোধহয় আছে এবারেও।

সেই বিকেলে, নিজের বাসস্থানে কাজ শেষ করে আমার প্রিয় সঙ্গীদের খাবার দেওয়া এবং আদর করতে চললাম। পশুপাখির প্রতি বিশেষ অনুরক্ত আমি, এতটা বুঝি ওদেরকে, মাঝে-মধ্যে নিজেও অবাক হয়ে যাই। এক ডজন বিড়ালের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুও আছে আমার, কেউ ওদের মালিক হতে পারে না। অপরদিকে, একটা সুন্দর কুকুরের পালের মালিক আমি। মরুর বুকে বিশাল গ্যাজেল হরিণ আর সিংহ শিকারের সময় ওদের ব্যবহার করি আমি এবং ট্যানাস।

বুনো পাখিগুলো উড়ে এসে বসে চাতালে। আমার কাঁধ বা হাতে রাখা পিচ ফল খেতে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু করে। সবচেয়ে সাহসীগুলো আমার দুই ঠোঁটের মাঝখান থেকে কিরে খায়। পোষ মানানো গ্যাজেল হরিণগুলো আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে, ঠিক পোষা বেড়ালের মতোই। আর চাতালে নিজেদের অবস্থান থেকে আমার উদ্দেশ্যে কর্কশ কণ্ঠে ডাকতে থাকে বাজপাখি দুটো। মরুর শিকারী ওরা, বিশাল, হিংস্র, সুন্দর। সময় পেলে ওদের নিয়ে মরুভূমির গরমে ঘুরে আসি ট্যানাস এবং আমি। শিকারের পানে ওগুলোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর চোখ ধাঁধানো গতি দারুন আনন্দ দেয় আমাকে। আমি ছাড়া আর কেউ অবশ্য আদর করতে চাইলে লম্বা-হলুদ ঠোঁটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হতে হবে; আমার কাছে ওরা পোষা চড়ই।

আমার পোষ্যদের পরিচর্যার পালা শেষ হতে একজন দাস ছেলেকে ডেকে নিজের খাবার আনতে বললাম। নীল নদীর বিশাল সবুজ বিস্তারের অপূর্ব দৃশ্যের সামনে, চাতালে বসে মধু আর ছাগ-দুগ্ধ দিয়ে রান্না করা বুনো কোয়েলের মাংস খেলাম তৃপ্তির সাথে; প্রাসাদের প্রধান রাঁধুনি কেবল আমার জন্যেই তৈরি করেছে খাবারটা। ওখানে বসে নদীর ওপার থেকে আমার মালিকের ফিরে আসার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলাম। ছোট্ট, চৌকোণা পালে লেগে ঝকমক করছে মিশরীয় সূর্যাস্তের অপরূপ আলো; তার জলযানের প্রত্যাবর্তন আমার ভেতরে ভয়ের এক পশলা ঠাণ্ডা হাওয়া বইয়ে দিতে লাগল। হয়তো আজ সন্ধাতেই আমাকে ডেকে পাঠাবেন তিনি, কিন্তু এখনই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে প্রস্তুত নই আমি।

এরপরেই, স্বস্তির সাথে শুনলাম, প্রাসাদের প্রধান রক্ষী, র‍্যাসফার চিৎকার করে দশ বছর বয়সী এক বেদুঈন দাস বালককে ডাকছে; এ মুহূর্তে আমার মালিকের প্রথম পছন্দ। কিছু সময়ে পরেই আমার দরোজার সামনে দিয়ে আতঙ্কে বিবশ ছেলেটাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চললো র‍্যাসফার; পর্দার আড়ালে উজিরের ব্যক্তিগত প্রকোষ্ঠে। অনেক, অনেকবার শুনেছি; তবুও কেন যেনো শিশুদের আর্ত চিৎকার সহ্য হয় না আমার। করুণায় মন ভরে গেলো। তবে, অন্তত এও স্বস্তির, যে আমাকে ডেকে পাঠানো হয় নি। রাতে ভালো ঘুম প্রয়োজন, সকালে পরিচ্ছন্ন অবস্থায় মোকাবেলা করতে হবে আমার মনিবকে।

ভারী মন নিয়ে সকালের সূর্য উঠার আগেই ঘুম ভাঙল। প্রতিদিনের মতো নীলের বরফ ঠাণ্ডা পানিতে স্নানও কোনো পরিবর্তন আনল না। দ্রুত নিজের প্রকোষ্ঠে ফিরে গেলাম; ওখানে দুই দাস ছেলে আমার শরীরে তেল মেখে, চুল আঁচড়ে দিতে লাগল। রাজপরিবারে প্রসাধনী ব্যবহারের যে প্রচলন, আমি তার বিরুদ্ধে। আমার দেহের বর্ণ বা চামড়ার যে উজ্জ্বলতা, তাতে এসবের কোনো প্রয়োজন নেই; কিন্তু আমার মনিব চান তার দাসেরা তা ব্যবহার করুক। আর আজকের দিনে তাকে সন্তুষ্ট করতেই হবে আমাকে।

তামার আয়নায় নিজের অবয়ব আশ্বস্ত করে আমাকে, কিন্তু খিদের অভাবে নাস্তা করতে পারলাম না। সভাসদদের মধ্যে সবার আগে আমিই পৌঁছলাম জলের বাগানে; প্রতিদিন সকালে ওখানেই বসে কাৰ্যসভা।

সভাসদের আগমনের অপেক্ষায় বসে মাছরাঙাদের কাজ দেখতে লাগলাম। জলের বাগানে যে ভবন তৈরি করা হয়েছে, তার ছক এবং নির্মাণ তদারকি আমি করেছি। বেশ কটি খাল এবং হ্রদের এক অপূর্ব সমন্বয় এটি, একটি থেকে অপরটিতে প্রবাহিত হয় জল। রাজ্যের প্রতিটি অংশ থেকে, এমনকি রাজ্যের বাইরে থেকেও নিয়ে আসা হয়েছে ফুল গাছ, কী অদ্ভুত বর্ণিল তাদের রঙ। নীল নদে যত প্রকারের মাছ আছে, তার সবই পাওয়া যাবে জল-বাগানের হ্রদে। তবে মাছরাঙাদের কারণে প্রতিনিয়তই নতুন করে জোগান দিতে হয় ওগুলো।

ল্যাপিস-লাজুলি পাথরের মতোই মুক্ত আকাশে পাখি ওড়া দেখতে পছন্দ করেন আমার মনিব, ইনটেফ; তারপর এক ঝলকে নিচে নেমে ছোঁ মেরে যখন ওরা লম্বা ঠোঁটে তুলে নেয় ছটফটে রুপালি শিকার তাঁর আনন্দ আর ধরে না। আমার মনে হয়, নিজেকে ওদের মতোই পরভোজী ভাবেন তিনি, মানুষ-শিকারী নিজেকে মনে করেন পাখির সখা। কখনওই পাখিদের বিরক্ত করা পছন্দ করেন না তিনি, মালীদের নিষেধ করা আছে এ ব্যাপারে।

ধীরে ভরে উঠছে সভা-প্রাঙ্গন। বেশিরভাগই এখনও ঘুমের আতিশায্যে লম্বা হাই তুলছে। আমার মনিব, ইনটেফ সাত সকালে ঘুম ভেঙে উঠেন, রৌদ্র চড়ার আগেই প্রাসাদের প্রাত্যহিক কাজ-কর্ম শেষ করে ফেলতে ভালবাসেন। সকালের প্রথম সূর্য। রশ্মিতে ভিজে তার আগমনের অপেক্ষায় বসে থাকি আমরা।

আজ মালিকের মন ভালো, ফিসফিস করে বলে রাজপরিচর্যক, আমার পাশেই আসন নেয় সে। আশার ছোটো একটা আলো যেনো দেখতে পেলাম আমি। লসট্রিসকে করা আমার অযাচিত প্রতিজ্ঞার ফলাফল হয়তো অত খারাপ নাও হতে পারে।

প্যাপিরাসের ঝারে কাঁপন তুলে বয়ে যায় নদী থেকে আসা বাতাস, ইনটেফের আগমনে গুঞ্জন উঠে সভাসদদের মধ্যে।

রাজকীয় তার হাটার ধরন, সম্মান আর ক্ষমতার বিচ্ছুরণ তাতে স্পষ্ট। গলার চারধারে প্রশংসার স্বর্ণ-শেকল পরে আছেন তিনি; খনি থেকে সংগ্রহীত লাল সোনার একটা হার ওটা, স্বয়ং ফারাও পরিয়ে দিয়েছেন তাকে নিজ হাতে। ইনটেফের আগে আগে হাঁটছে তাঁর বাণী-বন্দনাকারী, বাঁকা পায়ের এক বামন; তীক্ষ্ণ গলায়, নাকী সুরে গাইছে। সুন্দরই হোক বা কিম্ভুতকিমাকার, কৌতূহল উদ্দিপক সৃষ্টিতে নিজের চারপাশ ভরে রাখতে ভালবাসেন আমার মনিব।

জাগো, মিশরের জনতা! নীল নদীর জলের অভিভাবককে সেলাম জানাও! মহান ফারাওয়ের সতীর্থের সামনে নিচু হও! এ সমস্তই ইনটফকে দেওয়া রাজার অভিধা, প্রতিটি বিশেষ বিশেষ দায়িত্বভার ন্যস্ত করেছে তার উপর। যেমন, নীল নদির জলের অভিভাবক হিসেবে প্রতি মৌসুমেই বন্যা এবং পানির উপরিতলের গভীরতা জানতে হয় তাকে; বলাবাহুল্য, তার হয়ে সেই দায়িত্ব পালন করে চলেছে বিশ্বস্ত ছোটলোক কৃতদাস টাইটা।

অর্ধেক বছর ধরে প্রকৌশলী আর গণিতজ্ঞদের নিয়ে খেটেছি আমি, আসুয়ানের পাথুরে চূড়ার উচ্চতা মেপেছি যাতে করে বন্যার সময়ে পানির উচ্চতা নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা যায়। সেই হিসাব থেকে ফসল তোলার মৌসুমের আগাম ঘোষণা করা সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে, খরা এবং ভরা মৌসুমের পূর্বাভাস করাও যায় এ দেখে । আমার কাজে দারুন সন্তুষ্ট ফারাও আরও সম্মান এবং পুরস্কার দিয়েছেন আমার মালিক, ইনটেফকে।

কারনাকের সম্রাটের সামনে মাথা নত করুন, নেক্রোপলিসের প্রভু, রাজকীয় সমাধির রক্ষণাবেক্ষণকারীকে সেলাম! এই অভিধার বদৌলতে আমার মালিক বর্তমান ফারাও এবং পূর্ববর্তী সকল সম্রাটের মূর্তি তৈরি, প্রস্তুতি এবং পরিচর্যার দায়িত্ব পেয়েছেন। এবারেও, সমস্ত কাজের ভার ন্যস্ত হয়েছে বহু-ব্যবহারে ক্লান্ত ক্রীতদাসের কাঁধে। ওসিরিসের গেলো বছরের উৎসবের পর গতকালই কেবল ইনটেফ পরিদর্শন করেছেন নির্মাণাধীন রাজসমাধি। গরম আর ধুলোর মাঝে সব সময় আমিই গিয়েছি শ্রমিকদের কাজ তদারকিতে, রাজমিস্ত্রি আর প্রস্তরশিল্পীদের তাগিদ দিতে। মাঝে মধ্যে নিজের মতো গুণাবলির কথা মনিবকে জানতে দিয়েছি বলে আফসোস হয় বৈকি।

অনায়াসে আমাকে ভীড়ের মধ্য থেকে আলাদা করে ফেললেন তিনি। বুনো চিতার মতো হলদে চোখে তাকালেন আমার দিকে, সামান্য ঝাঁকালেন মাথা। ধীরে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম, প্রতিবারের মতোই বিস্মিত হলাম তাঁর উচচতা আর কাঁধের বিস্তারে। লম্বা, সুগঠিত হাত-পা, শক্ত মেদহীন পেটের একজন দারুন সুদর্শন মানুষ আমার মনিব। সিংহের মতো গর্বোদ্ধত মস্তক, ঘন চুলের অরণ্য মাথায়। তখন চল্লিশ বছর মতো ছিলো তাঁর বয়স, বিশ বছর ধরেই আমি তার দাস।

বাগানের কেন্দ্রে অবস্থিত বারাজ্জার উদ্দেশ্যে চললো সভা, চারদিকে কোনো দেয়াল নেই স্থাপনাটির, মাথার উপরে পাতার আচ্ছাদন; নদী থেকে বয়ে আসা স্নিগ্ধ বাতাস শরীর জুরায়। নিচু টেবিলের উপর পা ভাজ করে বসেন ইনটেফ, তার পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে রাজ্যের কার্যাবলি সম্বলিত স্ক্রোলগুলো। সবসময়ের মতো আমি বসলাম তার পেছনে। দিনের কার্যসূচি শুরু হলো।

সেই সকালে দুইবার ইনটেক মাথা সামান্য হেলিয়ে আমার দিকে ফিরিয়েছিলেন। ঘাড় ফেরান নি, এমনকি একটি শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেন নি, কিন্তু আমি জানি, আমার পরামর্শ চেয়েছিলেন তিনি। ঠোর্ট প্রায় না নড়িয়ে, এতো নিচু স্বরে কথা বললাম আমি; কেউ সেভাবে বুঝতেই পারে নি কিছু বলেছি তাকে।

একবার বিড়বিড় করে বললাম, ও মিছে বলছে, আর দ্বিতীয়বার, এই পদের জন্যে রেতিক যোগ্য লোক, আর তাছাড়া আমার মালিকের ব্যক্তিগত কোষাগারে পাঁচটি স্বর্ণের আংটি উপহার হিসেবে দিতে চেয়েছে সে। যে কথাটা বলি নি, তা হলো, কাজ হয়ে গেলে বাকি আর একটি আংটি আমাকে উপহার দেবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে সে।

দুপুর নাগাদ রাজকীয় সভা সমাপ্তি ঘোষণা করে খেতে চাইলেন ইনটেফ। প্রথমবারের মতো একা হলাম আমরা দুজন, কেবল মাত্র প্রাসাদের প্রধান রক্ষী এবং প্রধান জল্লাদ র‍্যাসফার ছাড়া। বারাজ্জার দৃষ্টিপথের বাইরে, দূরে দরোজায় অবস্থান নিল সে।

ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন ইনটেফ, তাঁর সামনে রাখা সুস্বাদু মাংস আর ফলমূলের থেকে খেতে বললেন। আমার উপর সম্ভাব্য বিষক্রিয়ার প্রভাবের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে সেদিন সকালের রাজকার্য নিয়ে আলোচনা চালিয়ে গেলাম আমরা।

এরপরে হাপির হ্রদে আমাদের অভিযান এবং জলহস্তি শিকার সম্বন্ধে জানতে চাইলেন ইনটেফ। সবকিছু বর্ণনা করে গেলাম আমি; জলহস্তির মাংস, চামড়া আর দাঁত থেকে কি পরিমাণ লাভ হতে পারে, তার একটা ধারণাও দিলাম। সম্ভাব্য লাভের পরিমাণটা একটু বাড়িয়ে বলতেই হাসি ফুটল আমার মালিকের মুখে। প্রাণখোলা, মনমুগ্ধকর তার হাসি। এ থেকে কিছুটা অনুমান করা যায় ইনটেফের মানুষ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। এমনকি আমি পর্যন্ত বোকা বনেছিলাম অন্তত একবার ।

জলহস্তির মাংসের তৈরি রান্নায় ইনটেফ মগ্ন হতেই, সাহস সঞ্চয় করে বলতে শুরু করলাম আমি। আমার মালিক তো জেনে গেছেন, অভিযানে আপনার কন্যাকে সাথে নেয়ার অনুমতি দিয়েছিলাম আমি। তার চোখের দৃষ্টি বলে দিল, এ তার জানা ছিলো; দেখছিলেন আমি ব্যাপারটা আড়াল করতে চাই কি না।

আমার অনুমতি নেওয়া দরকার বলে মনে হয় নি তোমার? মৃদুকণ্ঠে বললেন ইনটেফ, তার চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে একটা আঙুর ছিঁড়তে লাগলাম আমি। আমরা রওনা হওয়ার ঠিক আগে যেতে চেয়েছে লসট্রিস। আপনি তো জানেন, দেবী হাপি তার রক্ষক, তাই তাঁর মন্দিরে পূজো দিতে চেয়েছে সে।

তাও আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হয় নি? আবার বললেন ইনটেফ, আঙুরটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম আমি। ঠোঁট ফাঁক করে ওটা মুখের ভেতরে যেতে দিলেন তিনি। এর অর্থ হচ্ছে, এখনও আমার উপর ততটা বিরাগ নন, অতি অবশ্যই ট্যানাস এবং লসট্রিস সম্পর্কিত সত্যিটা তার কাছে পৌঁছে নি।

আসূনের সম্রাটের সঙ্গে সভায় ব্যস্ত ছিলেন আপনি সেই সময়ে। বিরক্ত করার সাহস করি নি। আর তাছাড়া, এতে কোনো ক্ষতি ছিলো না। সাধারণ একটা সিদ্ধান্ত, মালিকের পক্ষ থেকে মাঝে-মধ্যেই নিই আমি।

কী সহজ তুমি, তাই না, আমার প্রিয় টাইটা? মুচকি হাসলেন ইনটেফ। আর সুন্দরও বটে। চোখের পাতায় যে রঙ করেছ, ভালো লাগছে আমার। আর কি সুগন্ধি লাগিয়েছ শরীরে?

বুনো ভায়োলেটের পাঁপড়ির নির‍্যাস, উত্তরে বললাম। আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমি আনন্দিত। এক পাত্র উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছি আমি। আমার থলের ভেতর থেকে পাত্রটা বের করে কুর্নিশ করে তার পদতলে রাখলাম আমি ওটা। আমার চিবুকের নিচে এক আঙুল রেখে মুখ উঁচু করলেন ইনটেফ, চুমো খেলেন ঠোঁটে । বাধ্যগতের মতো আমি প্রত্যুত্তর করলাম তাঁর চুম্বনের, শেষে ঠোঁট সরিয়ে গালে হালকা করে আদর করে দিলেন ইনটেফ।

যা কিছু কর না কেন, তুমি এখনও অনেক আকর্ষণীয়, টাইটা। এতো বছর পরেও আমাকে আনন্দ দিতে পার তুমি। এখন বলো তো, লসট্রিসের খেয়াল নাও ঠিকমতো? এক মুহূর্তের জন্যেও তোমার দৃষ্টিসীমার বাইরে বা যত্নের বাইরে থাকে সে?

না, মালিক। সজাগ আমি বললাম ।

তো, ওর ব্যাপারে আলাদা করে কোনো কিছু বলতে চাও না আমাকে? আছে নাকি তেমন কিছু?

তখনও হাঁটুর উপরে দাঁড়িয়ে আমি, কথা সরছিল না মুখে। শুকিয়ে গেছে গলা।

আমার সামনে ঢোক গিলো না, প্রিয়, হাসলেন ইনটেফ। পুরুষ মানুষের মতো কথা বল, যদিও তুমি তা নও। নিষ্ঠুর একটা কৌতুক এটা, দারুন বাজল আমার বুকে।

সত্যিই, একটা ব্যাপার আমার মালিকের গোচরে আনতে চাই, বললাম আমি। আর ব্যাপারটা অবশ্যই লসট্রিসকে নিয়ে। আগেই জানিয়েছি, আপনার কন্যা প্রথমবারের মতো ঋতুমতী হয়েছে এ বছরের বন্যার সময়ে। এরপর থেকে প্রতিমাসেই। জোরালোভাবে হচ্ছে সেটা।

বিতৃষ্ণায় ঠোঁক বাঁকালেন ইনটেফ, নারী শরীরের জৈবিক কার্যাবলি ঘৃণা করেন তিনি। ব্যাপারটা আজব লাগে আমার কাছে, শারীরিক সুখে যিনি মত্ত থাকেন পুরুষ দেহ নিয়ে তার আবার কিসের ঘৃণা।

আমি বলে চলি, লসট্রিস এখন বিবাহযোগ্যা । আবেগী এবং কোমল মন ওর । আমার ধারণা, যত দ্রুত সম্ভব তার জন্যে-একজন পুরুষ খুঁজে বের করা জরুরি।

নির্ঘাত কোনো পরামর্শ আছে তোমার কাছে? শুষ্ক কণ্ঠে জানতে চাইলেন ইনটেফ, সায় দিয়ে আমি বললাম, সত্যিই একজন পাণিপ্রার্থী আছেন, মালিক।

একজন নয়, আমার ধারণা আরও একজনের কথা বলছ তুমি, টাইটা। ছয় জনের কথা ইতিমধ্যেই জানি আমি, আয়ূনের সম্রাট এবং স্বটের প্রশাসক রয়েছেন তাদের মধ্যে। প্রস্তাব দিয়েছেন তারা সবাই।

আর একজনের কথা বলেছি আমি, মালিক; এমন একজন লসট্রিস যাকে মনোনীত করেছে। আপনার হয়তো মনে পড়বে, সম্রাটকে মোটা ব্যাঙ আর প্রশাসককে বুড়ো ছাগল বলে সম্বোধন করেছিল সে।

মেয়ের আপত্তি বা অনুমতির আমার কাছে কোনো অর্থ নেই। মাথা নেড়ে হেসে আমার গাল টিপে দিলেন ইনটে। কিন্তু বলে যাও, টাইটা। এই প্রেম-পাগল পাণিপ্রার্থীর নাম শোনাও আমাকে, মিশরের সর্বোচ্চ পণের বিনিময়ে যে আমার আত্মীয়তা পেতে চায়। দম নিয়ে বলতে যাচ্ছিলাম আমি, কিন্তু আমাকে থামিয়ে দিলেন ইনটেফ। না, থাম! আমাকেই অনুমান করতে দাও

ধূর্ত আর কুটিল হাসিতে পাল্টে যায় তার মুখাবয়ব, বুঝতে পারলাম পুরোটা সময় আমাকে নিয়ে খেলছিলেন তিনি।

লসট্রিসের পছন্দ হলে তাকে হতে হবে তরুণ, সুদর্শন, অভিনয় করছেন ইনটেফ, আর তুমি তার পক্ষ হয়ে বলছ যেহেতু, সে নিশ্চই তোমার বন্ধু এবং সুহৃদ। নিঃসন্দেহে তার দাবি আমার কাছে পৌঁছানোর জন্যে তোমার সাহায্য কামনা করার সুযোগ পেয়েছে সে। কোথায় এবং কখন এমনটি করতে পারে সে? ভাবছি। হয়তো, মাঝরাত্তিরে হাপির মন্দিরে, হতে পারে না? আমি ঠিক বলছি তো, টাইটা?

বিবর্ণ হয়ে গেছি আমি । কেমন করে এতো কিছু জানেন ইনটেফ? আমার ঘাড়ের পেছনে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তিনি, হালকা করে চাপড় দিচ্ছেন। বেশিরভাগ সময়েই দেহজ সুখে মত্ত হওয়ার আগে এমনটা করেন ইনটেফ। হালকা করে চুমো খেলেন আমার ঠোঁটে ।

তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি, সত্যির খুব কাছাকছি বলেছি। একগাছি সুন্দর চুল আঙুলে জড়াতে লাগলেন। এখন কেবল নাম বলাটা বাকি আছে এই মহান প্রেমিকের। সেকি ডাক্কা নাকি? না, না, ডাক্কা এতো গর্দভ নয় যে আমার আক্রোশে পড়বে। ধীরে জোর বাড়াচ্ছেন ইনটেফ আমার চুলের গাছিতে, ব্যথায় চোখে পানি চলে এলো। তাহলে কি ক্ৰাতাস? সুদর্শন আর বোকা সেও। চুলের মুঠিতে জোর বাড়াতে শব্দ করে ছিঁড়ে গেলো ক গাছি, গলা দিয়ে উঠে আসা আর্তনাদ গিলে ফেললাম আমি।

উত্তর দাও, প্রিয় টাইটা, ওটা কি ক্ৰাতাস? নিজের কোলে আমার মুখ চেপে ধরলেন ইনটেফ।

না, মালিক, ব্যথায় ফিসফিস করে বললাম। তাকে সম্পূর্ণ উত্তেজিত দেখে এতটুকু অবাক হলাম না। তাকে মুখের ভেতরে নিতে বাধ্য করলেন ইনটেফ, ওভাবেই ধরে রাখলেন আমাকে।

ক্রাতাস নয়? তুমি নিশ্চিত? হতবুদ্ধ হওয়ার ভান করছেন ইনটেফ। যদি ক্ৰাতাস হয়, তবে এই বেকুব, প্রাণের মায়াহীন, হতভাগা কে হতে পারে আমি বুঝতে পারছি না; উচ্চ মিশরের রাজ উজিরের কুমারী কন্যার দাবি করতে পারে, এতো ধৃষ্টতা!

আচমকাই, স্বর উঁচালেন ইনটেফ। র‍্যাসফার! চেঁচিয়ে ডাকছেন। আমার মুখ বাঁকা হয়ে ছিলো তার কোলে, তাই রাসফারকে আসতে দেখছিলাম।

আসূনের গজ-দ্বীপে, ফারাওয়ের চিড়িয়াখানায় বিশাল এক কালো ভালুক ছিলো একসময়; পুবের ব্যবসায়ী ক্যারাভান থেকে কেনা হয়েছিলো। সেই বিভৎস, দাগপড়া বর্বরটাকে মনে করিয়ে দেয় আমার মনিবের প্রধান রক্ষী র‍্যাসফার। ওদের দুটিরই বিশাল, বিকৃত দেহ আর বুনো শক্তি রয়েছে যা দিয়ে খালি হাতে কাউকে মেরে ফেলতে পারে। তবে, চেহারা সৌন্দৰ্য্য আর আচরণে সেই ভালুক র‍্যাসফারের চাইতে অনেক বেশি কাম্য।

ভীষণ, গাছের গুঁড়ির মতো পায়ে প্রায় ছুটে এগুল সে, তাকে দেখে সেদিনের কথা মনে পড়ে গেলো যেদিন পুরুষত্বের নিদর্শন কেড়ে নেওয়া হয়েছিলো আমার শরীর থেকে।

এত মিল সেদিনের সাথে আজকের, যেনো জোর করে আবারো সেই ভয়ঙ্কর দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আমাকে। প্রতিটি খুঁটিনাটি এতো পরিষ্কার মানসপটে, আশঙ্কায় সিঁটিয়ে গেলাম। বহুকাল আগের সেই ট্রাজেডির কুশীলব একই আছে। দানব র‍্যাসফার, আমার মনিব আর আমি। কেবল সেই মেয়েটা নেই।

ওর নাম ছিলো এলাইদা । আমার মতোই বয়সী, ষোড়ষি এক মিষ্টি মেয়ে। দাসী হিসেবে প্রাসাদে থাকতো। আমার মনে হয়, অত্যন্ত সুন্দরী ছিলো এলাইদা, কিন্তু এমনও হতে পারে, স্মৃতি হয়তো প্রতারণা করছে আমার সাথে; কেননা, অত রূপ থাকলে মহান বাড়ির হারেমে ওর স্থান হোত, রান্নাঘরে নয়। একটা ব্যাপার জানি, ওর ত্বকের বর্ণ আর অনুভব ছিলো পালিশ করা তৈলস্ফটিকের মতো হলদেটে; উষ্ণ আর নরম। এলাইদার শরীরের ছোঁয়া আমি কোনোদিনও ভুলে যেতে পারব না, কারণ সে রকম আর কিছু কোনোদিন উপভোগ করার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে আমার কাছ থেকে। দুঃখের দিনগুলোতে আমরা পরস্পরের কাছে খুঁজে পেয়েছিলাম স্বাচ্ছন্দ্য আর সুখ। কখনও বুঝতে পারি নি, কে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল সেদিন। আমি প্রতিশোধপরায়ণ নই, কিন্তু মাঝেমাঝে মনে হয় যদি একবার সেই ব্যক্তির দেখা পেতাম!

সেই সময়ে আমি ছিলাম ইনটেফের সবচেয়ে প্রিয়, তার বিশেষ পছন্দের। যখন বুঝতে পারলেন, আমি তার প্রতি অবিশ্বস্ত ছিলাম, তার আত্মগরিমায় এতো লেগেছিল ব্যাপারটা, রাগে পাগল হয়ে উঠলেন।

র‍্যাসফার এসেছিল আমাদের নিয়ে যেতে। এক জোড়া মুরগির ছানার মতোই দুই হাতে দুজনকে ধরে হাজির করেছিল ইনটেফের ব্যক্তিগত প্রকোষ্ঠে। ওখানে সমস্ত কাপড় ছিঁড়ে ফেলে নগ্ন করা হলো আমাদের; আমার মনিব আধশোয়া হয়ে দেখছিলেন পুরোটা সময়, এখন যেমন দেখছেন। কাঁচা চামড়ার ফিতে দিয়ে এলাইদার দুই হাত পা বেঁধে দিয়েছিল র‍্যাসফার। আতঙ্কে বিবশ, কাঁপছিল ও; কিন্তু কাঁদোনি একটুও। আমার ভালোবাসা কিংবা ওর সাহসের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সেই মুহূর্তে যেনো আরো বেড়ে গিয়েছিল ।

ইশারায় আমাকে তাঁর সামনে উবু হতে বলেছিলেন আমার মনিব । চুলের মুঠি ধরে ফিসফিস করে কানে কানে বলছিলেন, তুমি কি আমাকে ভালবাসো, টাইটা? হয়তো ভেবেছিলাম, মিথ্যে বলে এলাইদাকে বাঁচাতে পারব, তাই বলেছিলাম, জ্বী।

আর কাউকে ভালবাসো তুমি, টাইটা? মসৃণ স্বরে বলেছিলেন তিনি। কাপুরুষ আর বিশ্বাসঘাতক আমি, উত্তরে বলেছিলাম, না, মালিক। আমি কেবল আপনাকেই ভালোবাসি। কেবল তখনই আমি শুনতে পেলাম, এলাইদা কাঁদছে। আমার জীবনে শোনা সবচেয়ে করুণ শব্দ ছিলো সেই কান্নার ।

র‍্যাসফারকে ডেকেছিলেন ইনটেফ, এখানে নিয়ে আসো মাগীটাকে। এমনভাবে রাখো, যেনো নিজেদের দেখতে পায় ওরা। ওকে নিয়ে কী করা হচ্ছে, তার সবকিছু যেনো পরিষ্কার দেখতে পায় টাইটা।

আমার দৃষ্টিপথে এলাইদাকে নিয়ে আসতে দেখলাম, দাঁত বের করে হাসছে র‍্যাসফার। এরপরে স্বর উঁচু করলেন ইনটেফ, ঠিক আছে, রাসফার। এবারে শুরু করতে পারো তুমি।

এলাইদার কপালের উপর দিয়ে পাকানো দড়ির ফাঁস রেখেছিল র‍্যাসফার। কিছু দূরত্ব পরপর গিঁট বাঁধা সেটায়। ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ছোটো, শক্ত অলিভ কাঠের একটা ব্যাটন পেঁচালো সে চামড়ার ফিতেটায়; মোচড় দিতে লাগলো যতক্ষণ পর্যন্ত না এলাইদার মসৃণ, নরম ত্বকে সেঁটে আসে। কর্কশ চামড়ার গিটগুলো এলাইদার ত্বকে চাপ দিতেই ব্যথায় গুঙিয়ে উঠেছিল ও।

ধীরে, র‍্যাসফার, ইনটেফ বলে উঠেছিলেন, এখনও অনেক সময় বাকি আছে।

র‍্যাসফারের বিশাল, লোমশ হাতে খেলনার মতো লাগছিল অলিভ কাঠের ব্যাটনটা। খুব সতর্কতার সাথে, ধীরে মোচড় দিতে লাগলো সে ওটায় । গিঁটগুলো যতই চেপে বসছিল, এলাইদার মুখ হা হচ্ছিল ক্রমশ, কাশির দমকে বেরিয়ে যেতে লাগলো ফুসফুঁসের সমস্ত বাতাস। ত্বকের রঙ সরে গিয়ে মরা ছাই ধারণ করেছিল মুখাবয়ব।

হাসতে হাসতেই, ব্যাটনে শেষ একটা মোচড় দিতে দড়ির গিঁটগুলো দেবে গেলো এলাইদার কপালে । মাথার আকার পাল্টে গেলো তার। দড়ির প্রতিটি মোচড়ের সাথে সাথে ক্রমেই লম্বা হয়ে যাচ্ছিল এলাইদার মাথা। ওর একটানা চিৎকার ছুরিকার মতো বিঁধছিল আমার বুকে। যেনো চিরকাল ধরে চলছিল সেই মুহূর্তগুলো।

এরপরে ফেটে গেলো মাথার হাড়। মৃদু শব্দটা ঠিকই শুনতে পেয়েছিলাম আমি। হঠাৎ থেমে যায় সেই ভয়ঙ্কর, হৃদয় বিদীর্ণ করা চিৎকার, র‍্যাসফারের হাতে শিথিল হয়ে পড়ে এলাইদার দেহ।

যেন একযুগ পর, আমার মুখ তুলে ধরে চোখে চোখে তাকালেন ইনটেফ। দুঃখের সাথে বললেন, ও চলে গেছে, টাইটা। শয়তানী ছিলো একটা, তোমাকে নষ্ট করে গেছে। আর যেনো এমন না ঘটে, নিশ্চিত করতে হবে আমাকে। আরো কোনো শয়তানীর হাত থেকে বাঁচাতে হবে তোমাকে।

আবারো র‍্যাসফারকে ইশারা করলেন ইনটেফ, এলাইদার নগ্ন প্রাণহীন দেহ। পা ধরে টেনে চাতালে নিয়ে গেলো সে। তুবড়ে যাওয়া মাথার পেছনটা ঘন ঘন বাড়ি খেতে লাগলো সিঁড়ির ধাপে, চুলগুলো হেঁচরে যাচ্ছে মাটিতে। শক্তিশালী কাঁধের ব্যবহারে বহুদূরে, নদীতে ছুঁড়ে ফেলল র‍্যাসফার নিহত এলাইদাকে। শূন্যে পাক খেল ওর নিপ্রাণ, ধবধবে হাত-পা; পানিতে আছড়ে পড়লো। দ্রুতই তলিয়ে গেলো দেহটা, চুলগুলো ছড়িয়ে পড়ল পানিতে, নদীর আগাছার মতো।

ঘুরে দাঁড়িয়ে চাতালের শেষ মাথার দিকে চললো র‍্যাসফার, ওখানে দুজন লোক গনগনে কয়লায় কি যেনো পড়াচ্ছিল। পাশেই কাঠের পাটাতনে রাখা ছিলো পুরোদস্তুর শল্যবিদের যন্ত্র। সেদিকে এক পলক তাকিয়ে অনুমোদনের হাসি হেসেছিল র‍্যাসফার । ফিরে পঁড়িয়ে, মনিব ইনটেফের সামনে মাথা ঝোকাল সে। সবকিছু তৈরি।

এক আঙুলে আমার কান্না-চর্চিত মুখ পরিষ্কার করেছিলেন ইনটেফ, এরপরে আঙুলটা চুষলেন, যেনো আমার বেদনার স্বাদ নিচ্ছেন। এদিকে এসো, আমার সুন্দর সঙ্গী, ফিসফিস করে বলেছিলেন তিনি। পায়ের উপর দাঁড় করিয়ে চাতালে নিয়ে এলেন আমাকে। কান্নার দমকে এতো অন্ধ ছিলাম আমি, নিজের সর্বনাশের কোনো ইশারা তখনও পাই নি। দুজন সৈনিক জেঁকে ধরেছিল আমার কাঁধ। টেরাকোটা ছকের মেঝের উপর চিৎপাত করে ধরে রেখেছিল ওরা আমাকে, কবজি আর গোড়ালিতে বজ্রকঠিন মুঠোতে। শুধু মাথা নাড়তে পারছিলাম ।

আমার মাথার কাছে ঝুঁকে এসেছিলেন ইনটেফ। রাসফার বসেছিল ছড়ানো দুই পায়ের মাঝে।

ওই শয়তানী তুমি আর কখনও করবে না, টাইটা। কেবলমাত্র তখন আমি টের পেলাম, র‍্যাসফারের ডানহাতে রয়েছে একটা তামার তৈরি শল্যবিদের ছুরি । আমার মনিব ইশারা করতেই মুক্ত হাত দিয়ে আমার বিশেষ অঙ্গ টেনে ধরেছিল র‍্যাসফার ।

কী অসাধারণ এক জোড়া ডিম আছে! দাঁত বের করে হেসে হাতের ছুরিটা আমাকে দেখিয়েছিল র‍্যাসফার । কিন্তু আফসোস, ওগুলো কুমীরের খাদ্য হবে, তোর মাগীর মতোই। ফলাটাকে চুমো খায় সে।

দয়া করুন, মালিক, আমি প্রার্থনা করেছিলাম। দয়া করুন। কিন্তু আমার আবেদন তীক্ষ্ণ আর্তনাদে পর্যবসিত হয়েছিলো, সেই মুহূর্তেই ছুরি চালিয়ে দিলো র‍্যাসফার। মনে হলো যেন, গনগনে লাল লোহার কাঠি কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে আমার পেটের ভেতর।

ওগুলোকে বিদায় বলো, ছোকরা, বিষণ্ণ, ভজ পরা চামড়ার দুটো থলে আর ওগুলোর ভেতরের জিনিস দেখালো আমাকে রাসফার। উঠে দাঁড়াতে গিয়েছিল সে, আমার মনিব বাধা দিয়েছিলেন। এখনও শেষ হয় নি, শান্তভাবে তাকে বললেন ইনটেফ। পুরোটা চাই আমার।

প্রথমটায় বোকার মতো তাঁর দিকে চেয়ে রইল র‍্যাসফার, নির্দেশটা বুঝতে পারেনি। এরপরে হাসির দমকে কেঁপে উঠে তার বিশাল পেট। হোরাসের রক্তের শপথ, গর্জে উঠে সে, এখন থেকে আমাদের ছোকরাকে মেয়েদের মতো বসে পেচ্ছাব করতে হবে! আবারো ছুরি চালায় সে, আঙুলের মতো বিচ্ছিন্ন অঙ্গ আমাকে দেখিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ে।

এখন থেকে নিজেকে অনেক হালকা বোধ হবে তোর। হাসির দমকে কাঁপতে কাঁপতে চাতালের প্রান্তে যায় সে, ছুঁড়ে নদীতে ফেলবে ওটা। কিন্তু আবারো আমার মনিব তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডেকে থামায় তাকে।

ওগুলো আমাকে দাও! তাঁর নির্দেশে বাধ্যগতের মতো রক্তাক্ত খণ্ডগুলো হাত বদল করে রাসফার। ক মুহূর্তের জন্যে দারুন মনোযোগর সাথে ওগুলো পরীক্ষা করে দেখেন ইনটেফ, এরপরে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, এত সুন্দর পুরস্কারের থেকে তোমাকে আমি চিরতরে বঞ্চিত করতে পারি না, প্রিয়। এগুলো শব প্রস্তুতকারীদের কাছে পাঠাবো আমি, ওরা ফিরিয়ে দিলে মুক্তো আর ল্যাপিস-লাজুলির সাথে গলার হারে পড়বো। ওসিরিসের আগামী উৎসবে ওটাই হবে আমার পক্ষ থেকে তোমার উপহার। এতে করে, কবরে যাওয়ার দিনে ওগুলো দেওয়া যাবে সাথে; দেবতারা সদয় হলে হয়তো পরের জীবনে ব্যবহার করতে পারবে ওটা।

শব প্রস্তুতির তরল দিয়ে আমার রক্তপাত বন্ধ করার সাথে সাথেই শেষ হওয়ার কথা ছিলো সেই অধ্যায়ের, কিন্তু আজ, এখন, আবারো সেই দুঃস্বপ্নে আটকে গেছি আমি। আবারো ঘটছে সেটা। কেবল এলাইদা নেই এবারে, আর খোঁজা-করা ছুরির বদলে র‍্যাসফারের লোমশ হাতে শোভা পাচ্ছে জলহস্তির চামড়ার চাবুক।

প্রায় ব্যাসফারের হাতের সমান লম্বা চাবুকটা, প্রান্তে এসে তার কড়ে আঙুলের মতো চিকন। ওটা প্রস্তুত করতে দেখেছি আমি ওকে। তৈলস্ফটিকের মতো রঙ ওটার, র‍্যাসফারের আদুরে পালিশে কাঁচের মতো ঝকঝক করছে। কতশত হতভাগ্যের রক্ত যে ওতে শুকিয়েছে দানবটা, তার কোনো হিসেব নেই।

একজন শিল্পী যেনো সে, ওই অস্ত্র হাতে। নিজের কাজ ভালবাসে গ্যাসফার, তার সমস্ত হিংসা আর নীচ মন নিয়ে ঘৃণা করে আমাকে; মনিবের আনুকূল্য আর সুদর্শন অবয়বের জন্যে।

আমার নগ্ন পিঠে চাপর দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ইনটেফ। মাঝে মধ্যে এতো চতুর তুমি, প্রিয় টাইটা। যার প্রতি তোমার এতো ঋণ, তাকেই প্রতারিত করতে চাও। না, না, কেবল ঋণ নয়, তুমি বেঁচে আছে যার দয়ায়। আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ইনটেফ। এই বাজে কাজটা করতে কেন আমাকে বাধ্য কর তুমি? উন্মাদের কাজ ওটা, এই প্রস্তাব আমি অবশ্য জানি, কেন এটা করলে তুমি। বাচ্চাদের মতো আবেগ তোমার বহু দুর্বলতার মধ্যে একটা। কোনদিন হয়তো ওটাই তোমার কাল হবে। যাই হোক, এক সময় ভেবেছিলাম তোমাকে ক্ষমা করে দেব, কিন্তু যে দায়িত্ব আমি তোমাকে দিয়েছি, এতে করে বরখেলাপ করা হলো তার। আমার মুখ ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরালেন তিনি। এ জন্যেই তোমাকে শাস্তি দিতেই হবে। বুঝতে পারছো?

জ্বী, মালিক, ফিসফিস করে বললাম। চোখের কোণা দিয়ে ব্যাসফারের হাতের চাবুকটা দেখছি। আবারো তার কোলে আমার মুখ চেপে ধরলেন ইনটেফ, ডাকলেন র‍্যাসফারকে।

তোমার সেরা কাজ চাই, র‍্যাসফার। চামড়া যেনো না ফাটে। এতো সুন্দর পেছনটা দাগ পড়ে যাক, চাই না। দশটা দিলেই চলবে, জোরে গুনো যাতে আমরা শুনতে পাই।

একশ বা তার অধিক হতভাগ্যকে এই শাস্তি পেতে দেখেছি আমি, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলো বীর যোদ্ধা। রাসফারের চাবুকের তলায় কেউ শান্ত থাকতে পারে নি। আমি নিজেও তা চাই না, নীরবতাকে ব্যক্তিগত অপমান বলে মনে করে সে। ওটাতো আমি জানিই। যে কোনো রকম বোকা গর্ব গিলে ফেলে তার কাজের প্রশংসা উচ্চ স্বরে করার প্রস্তুতি হিসেবে ফুসফুস ভরে বাতাস নিলাম।

এক! হুঙ্কার করে উঠলো র‍্যাসফার, বাঁশির মতো শব্দ করে আঘাত হানল চাবুক। সন্তান জন্মদানের সময় কাতর মহিলাদের চেয়েও জোরে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, ব্যথার প্রাবল্য চমকে দিল।

তুমি ভাগ্যবান, প্রিয় টাইটা, আমার কানে নিচু স্বরে বললেন ইনটেফ। ওসিরিসের পুরোহিতেরা কাল পরীক্ষা করে দেখেছে ওকে, এখনও অক্ষত আছে সে। তার কোলে আঁতকে উঠলাম আমি। কেবল ব্যথায় নয়, ওই বুড়ো ছাগলের দল আমার ছোট্ট সোনার সবকিছু খুঁচিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে–এই আফসোসে।

প্রতিবার আঘাতের পর বারাজ্জার চারপাশে ঘুরে ঘুরে নিজেকেই যেনো প্রশংসা করে রাসফার । শিকারকে আঘাত অনুধাবন করতে দেওয়ার এ তার বিশেষ কায়দা। উৎসবের তলোয়ারের মতো করে মাথার উপরে ধরে রাখে চাবুকটা। বৃত্ত পূর্ণ করে আবারো আঘাত হানতে ফিরে আসে সে, উঁচিয়ে ধরে চাবুকের হাতল।

দুই! চেঁচিয়ে উঠলো সে, তীক্ষ্ণ চিৎকার করে এলিয়ে পড়লাম আমি।

*

আমার প্রকোষ্ঠের প্রবেশমুখের চওড়া চাতালে অপেক্ষায় বসেছিলো লসট্রিসের একটা দাসী মেয়ে, বাগানের ধাপ টপকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে উঠলাম আমি।

আমার মনিব এখনই আপনার সঙ্গ চাইছেন, মেয়েটা জানাল

আমাকে। তাকে গিয়ে বলল, আমি অসুস্থ, সমন এড়িয়ে যেতে চাইলাম আমি। আঘাতগুলো পরিচর্যার জন্যে চিৎকার করে দাস বালকদের ডাকতে ডাকতে ঢুকে পড়লাম আমার প্রকোষ্ঠে । এই মুহূর্তে লসট্রিসের মুখোমুখি হতে পারব না, কিছুতেই ব্যর্থতার কথা বলা যাবে না তাকে। কেমন করে তাকে ট্যানাসের প্রতি তার ভালোবাসার অসারত্ব বোঝাবো? কালো দাসী মেয়েটা অনুসরণ করে ভেতরে ঢুকে পরেছে, উন্মুক্ত পিঠের দারুন আঘাতগুলো এখন দেখছে আতঙ্ক নিয়ে।

যাও, তোমার মনিবকে গিয়ে বলো আমি আঘাতপ্রাপ্ত, এখন তার সাথে দেখা করতে পারব না, কাঁধের উপর দিয়ে তিক্তস্বরে বললাম।

তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন, আপনি নানা অজুহাতে আসতে চাইবেন না; আমি যেনো সাথে করে নিয়ে যাই আপনাকে।

তুমি একটা বেয়াদব মেয়ে, ভর্ৎসনা করে বললাম মেয়েটাকে। একজন দাস বালক আমারই তৈরি মলম লাগিয়ে পরিচর্যা করতে লাগলো পিঠের আঘাতগুলোয়।

হ্যাঁ, ঝলমলে হাসির সাথে মেনে নিল সে। আপনিও তাই। আমার একটা অর্ধ চড় অনায়াসে এড়াল মেয়েটা। দাসী-পরিচর্যাকারীদের প্রতি লসট্রিস দারুন সদয় ।

যাও, গিয়ে বলো আমি আসছি, এবারে বললাম।

উনি বলে দিয়েছেন, আমি যেনো অপেক্ষা করে দেখি আপনি যান কিনা।

তো, হারেমের রক্ষীদের অতিক্রম করে যাওয়ার সময় একজন প্রহরী হয়ে মেয়েটা রইল আমার সাথে। রক্ষীরা সবাই আমারই মতো খোঁজা; তবে ব্যতিক্রম হলো এরা সবাই মোটা এবং উভলিঙ্গিক। দেহের বিশাল আকৃতির কারণেই হয়তো, দারুন শক্তিশালী মানুষ ওরা, ভীষণ হিংস্র। যাই হোক, আমার প্রভাব বলে এদের কাছ থেকে সম্মান আদায় করে নিতে সমর্থ হয়েছি, মেয়েদের প্রকোষ্ঠে একটা সালামের সাথে ঢুকতে দেওয়া হলো আমাকে।

দাস বালকদের থাকার জায়গার এতো আরামদায়ক বা পরিচ্ছন্ন নয় হারেম, বোঝাই যায় আমার মনিবের আগ্রহ কোনো দিকে। কাদার ইটে তৈরি ছোট্ট কুঁড়েঘর, উঁচু কাঁদায় তৈরি দেয়ালে ঘেরা। একমাত্র বাগান বা সাজ বলতে লসট্রিস আর তার দাসীদের হাতে তৈরি বাগান, আমার সহায়তায় করা হয়েছে সেটা। উজিরের পত্নীরা সবাই অলস আর স্কুল; হারেমের ষড়যন্ত্র, কেলেঙ্কারী নিয়েই তাদের যত মাতামাতি ।

প্রধান ফটকের কাছেই লসট্রিসের বাসভবন; সুন্দর পদ্ম-ফোঁটা পুকুর চারদিকে। বাঁশের খুঁচায় বিচিত্র স্বরে গাইছে পাখির দল। কাঁদার দেয়ালে নীল নদের উজ্জ্বল দৃশ্যাবলি আঁকা; মাছ, পাখি আর নদীর দেবীর ছবি–ওকে আঁকতে সাহায্য করেছিলাম আমি।

প্রবেশমুখে বিষণ্ণ দলে জড়ো হয়ে বসে আছে লসট্রিসের দাসী মেয়েদের দল; অনেকেই কাঁদছে। কান্নার জলে মুখ ভেজা তাদের। ওদের ঠেলে সরিয়ে অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা, অন্ধকারাচ্ছন্ন ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি। কোনো একটা কক্ষ হতে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে আমার মিসট্রেসের। দ্রুত এগুলাম, ওকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছি বলে লজ্জা লাগছে এখন।

নিচু একটা বিছানায় মুখ নামিয়ে কাঁদছিলো লসট্রিস, কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে পুরো শরীর; কিন্তু আমার ঢোকার শব্দ শুনে ঘুরে, এক ঝটকায় বিছানা ছেড়ে নেমে দৌড়ে এলো সে।

ওহ, টাইটা! ওরা ট্যানাসকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফারাও কাল কারানাকে আসবেন, আমার বাবা তাকে অনুরোধ করতে যাচ্ছেন ট্যানাসকে যেনো বাহিনী সহ নদীর উজানে, সেই গজ-দ্বীপ আর জলপ্রপাতের ওপারে পাঠানো হয়। ওহ, টাইটা! প্রথম জলপ্রপাত এখান থেকে বিশদিনের পথ। আর কখনও ওকে দেখতে পাবো না আমি। মরে যাওয়াও ভালো ছিলো এর থেকে। নীল নদির পানিতে ঝাঁপিয়ে কুমীরের খাবার হব আমি। ট্যানাসকে ছাড়া বেঁচে থেকে কী হবে একসঙ্গে বলে থামল লসট্রিস।

আস্তে, ছোট্ট সোনা, আলিঙ্গনের ভেতর ওকে অল্প অল্প দোলালাম। এত ভয়ঙ্কর সবকথা তুমি জানলে কেমন করে? এগুলো তো নাও হতে পারে।

ওহ, ঘটবে, টাইটা। ট্যানাস একটা বার্তা পাঠিয়েছে আমাকে। বাবার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের মধ্যে কাতাসের ভাই আছে। সে-ই শুনেছে রাসফারের সঙ্গে এই নিয়ে আলাপ করছিলেন বাবা । জানি না কেমন করে, আমার আর ট্যানাসের সবকিছু বাবা জেনে গেছেন। উনি জানেন, হাপির মন্দিরে একা ছিলাম আমরা। ওহ টাইটা, বাবা মন্দিরের পুরোহিতদের পাঠিয়েছিলেন আমাকে পরীক্ষা করে দেখতে। ওই নোংরা বুড়োগুলো ভীষণ কাজ করেছে আমার সাথে। ব্যথা পেয়েছি আমি, অনেক।

আস্তে করে ওকে আলিঙ্গন করলাম। এমন নয় যে সবসময় এটা করার সুযোগ পাই আমি, কিন্তু আজ সজোরে আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রত্যুত্তর করলো লসট্রিস। নিজের আঘাতের থেকে প্রেমিকের দিকে বয়ে গেলো তার চিন্তাধারা।

আর কোনোদিন আমি ট্যানাসকে দেখতে পাবো না, কেঁদে ফেলল লসট্রিস। কত ছোটো মেয়েটা এখনও, শিশুই বলা যায়, ক্ষোভে-দুঃখে ভগ্ন-হৃদয়। বাবা ওকে শেষ করে দেবে।

এমনকি তোমার বাবাও পারবে না সেটা, ওকে প্রবোধ দিতে চাইলাম। ফারাও এর নিজস্ব রাজকীয় রক্ষী বাহিনীর সেনাপতি ট্যানাস। রাজার লোক সে। কেবল মাত্র ফারাওয়ের কাছ থেকে নির্দেশ নেয় ট্যানাস, মিশরের দ্বৈত-মুকুটের সমস্ত সম্মান তার প্রাপ্য। ওকে বললাম না, সম্ভবত এই কারণেই এখনও ইনটে ধ্বংস করে দেয় নি তাকে। বলে চললাম, ট্যানাসকে আর দেখবে না কী বলছো, গীতিনাটকে ওর বিপরীতেই তো অভিনয় করছো তুমি । দৃশ্যের বিরতিতে তোমরা দুজন যেনো একা কথা বলতে পারো, সে ব্যবস্থা আমি করবো।

বাবা কিছুতেই নাটক হতে দেবেন না।

কোন উপায় নেই তাঁর হাতে, ফারাও-এর কু-নজরে যদি পড়তে না চান, তবে অবশ্যই আমার নাট্যগীতি তাঁকে দেখতেই হবে। এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকো।

ট্যানাসকে বাইরে পাঠিয়ে, অন্য কাউকে দিয়ে হোরাস-এর ভূমিকায় অভিনয় করাবেন তিনি, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে লসট্রিস।

অন্য একজন অভিনেতার অনুশীলন করার সময় নেই। ট্যানাসই দেবতা হোরাসের ভূমিকায় থাকবে। আমার মনিব, ইনটেফকে এ বিষয়ে বলবো আমি। তুমি আর ট্যানাস কথা বলার সুযোগ পাবে। তোমাদের জন্যে একটা উপায় বের করবো আমি।

কান্না গিলে ফেলে সম্পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে মুখ তুলে চাইল লসট্রিস। ওহ, টাইটা! আমি জানি, একটা না একটা উপায় তুমি বের করবেই। সবসময় তাই করো আচমকা থেমে গেলো সে, মুখভঙ্গি পাল্টে গেছে। আমার পিঠে ঘুরছে তার হাত, র‍্যাসফারের চাবুকের আঘাত যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার প্রান্তে লেগেছে আঙুল।

আমি দুঃখিত, মিসট্রেস। ট্যানাসের প্রস্তাব দিয়েছিলাম, যেমনটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোমাকে। আর এ সব কিছুই আমার গাধামীর ফল।

আমার পেছনে এসে দাঁড়াল ও, হালকা লিনেনের টিউনিকটা উঁচু করে ধরল–ওটা দিয়ে আড়াল করে রেখেছিলাম আঘাতের চিহ্ন। আঁতকে উঠে লসট্রিস। এটা র‍্যাসফারের কাজ। ওহ, প্রিয় টাইটা, আমাকে কেন আগে বলে নি, আমার আর ট্যানাসের প্রতি বাবার এতে ক্ষোভ?

এহেন বাজে অভিযোগে উত্তর না করতে মনস্থ করলাম আমি, কতবার বলতে চেয়েছি কথাটা যে, ইনটেফ মোটেও ভালো চোখে দেখবেন না ট্যানাসকে? দারুন দপদপ করছে পিঠের ক্ষতগুলো, তবু চুপ করে রইলাম।

আমার এই বাহ্যিক আঘাতে অন্তত লসট্রিস কিছু সময়ের জন্যে হলেও ভুলে গেছে নিজের দুর্দশা । বিছানায় বসার জন্যে আদেশ করলো সে, আমি পালন করতে টিউনিক খুলে নিয়ে পরিচর্যা শুরু করলো ক্ষতের। খাঁটি ভালোবাসা আর আবেগশূন্য স্থান পূরণ করলো তার অপরিণত প্রচেষ্টার। নিজের দুঃখের কথা এখন ভুলে গেছে মেয়েটা। কিছু সময়ের মধ্যেই কলকল করতে লাগলো সে, কেমন করে তার বাবার রাগ পেরিয়ে ট্যানাসের সঙ্গে মিলিত হবে–এইসব।

এর কিছু কিছু পরিকল্পনা তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিল, বাকিগুলো মূলত তারুণ্য আর দুনিয়ার তাবৎ দুষ্ট-অভিজ্ঞতায় অনভিজ্ঞতার কথাই যেনো প্রমাণ করলো। গীতি নাট্যে আইসিস-এর ভূমিকায় এতো সুন্দর অভিনয় করবো, এক পর্যায়ে এসে বললো লসট্রিস, ফারাও এতো খুশি হবেন, আমি যা চাই–তাই মেনে নেবেন। এরপর, ট্যানাসকে আমার স্বামী হিসেবে তাঁর কাছে প্রার্থনা করবো আমি, আর তিনি বলবেন এবারে রাজার ধীরলয়ের গুরুগম্ভীর উচ্চারণ এমন দক্ষতার সাথে নকল করলো সে, না হেসে পারলাম না আমি। তিনি বলবেন–লর্ড হেরাব, পিয়াংকির পুত্র ট্যানাসের সাথে উজির কন্যা, লেডি লসট্রিসের বিবাহের ঘোষণা দিচ্ছি আমি। আর আমার বিশ্বস্ত ভৃত্য, ট্যানাসকে মিশরের মহান সিংহ উপাধিতে ভূষিত করলাম, এর ফলে আমার সমস্ত বাহিনীর সেনাপতি হলো সে। আরও ঘোষণা করছি, তার বাবা, পিয়াংকি, লর্ড হেরাবের সমুদয় সম্পত্তি তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক এখানে এসে থেমে যায়, আমার আঘাতের পরিচর্যা শেষে গলা জড়িয়ে ধরলো লসট্রিস।

এমনকি হতে পারে না, টাইটা? বলো না, পারে না এমন হতে!

কোন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে তোমাকে অবজ্ঞা করা সম্ভব নয়, মিসট্রেস, ওর বোকামীতে হাসলাম আমি। এমনকি মহান ফারাও পর্যন্ত নন। তখন যদি জানতাম, সত্যির কত কাছাকাছি বলে ফেলছি, নির্ঘাত জ্বলন্ত কয়লার টুকরো রাখতাম নিজের জিভে।

আশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো লসট্রিসের মুখ। আমার জন্যে এর বেশি আর কি চাইবো, টিউনিকটা পরে নিয়ে ওর পরিচর্যায় ইতি টানলাম।

কিন্তু, এখন, মিসট্রেস; যদি সত্যিই অপরূপা আর অপ্রতিরোধ্য একজন আইসিস হতে চাও, তোমাকে বিশ্রাম নিতে হবে। লাল শেপেনের পাতা থেকে তৈরি ঘুমের গুড়ো নিয়ে এসেছিলাম সাথে করে, পুবের কোনো দূরদেশ থেকে এই ফুলের বীজ নিয়ে এসেছিল ব্যবসায়ী ক্যারাভান। আমার বাগানে এখন এই লাল-ফুলের চাষ করি, ঝরা পাতা থেকে স্বর্ণের তৈরি কাঁটা দিয়ে নেড়ে আমার নিজস্ব উপায়ে তৈরি করি গুড়ো। ঘুম আনে এই দ্রব্য, ব্যথা দূর করে, অদ্ভুত সব স্বপ্নও দেখায়।

আমার সাথে কিছুক্ষণ থাকো না, টাইটা, ঘুমকাতুর মুরগির ছানার মতো বিছানায় কুঁকড়ে আসে লসট্রিস, ঘুম পাড়িয়ে দাও, বাচ্চা ছিলাম যখন, তখনকার মতো করে। ও তো এখনও একটা বাচ্চা, কোলে নিতে নিতে মনে মনে ভাবলাম আমি।

সব ঠিক হয়ে যাবে, তাই না টাইটা? ফিসফিস করে বললো সে। সুখে-শান্তিতে চিরকাল বাস করবো আমরা, ঠিক তোমার গল্পের মত, করবো না, বলো টাইটা?

ও ঘুমিয়ে গেলে, কপালে নরম করে চুমো খেলাম আমি। পশমের একটা চাদর দিয়ে গা ঢেকে চুপি চুপি বেরিয়ে এলাম ওর কক্ষ ছেড়ে।

*

ওসিরিসের উৎসবের পঞ্চম দিনে গজ-দ্বীপে, নিজের প্রাসাদ ছেড়ে নদীর উজানে কারনাকে এলেন ফারাও; দ্রুতগামী গ্যালিতে দশ দিনের পথ পাড়ি দিয়ে। সমস্ত রাজকীয় সভাসদ সঙ্গে করে নিয়ে আসেন তিনি, যাতে করে পূর্ণ মর্যাদায় পালিত হয় উৎসব।

তিন দিন আগেই কারনাক ত্যাগ করেছে ট্যানাসের বাহিনী, নদীর উজানে দ্রুত এগিয়ে মিলিত হয়েছে রাজকীয় নৌবহরের সাথে, যাত্রার শেষভাগে পাহারা দিয়ে নিয়ে এসেছে ফারাওকে। হাপির ল্যাগুনে সেই জলহস্তি শিকারের পর থেকে আমি বা লসট্রিস, কেউ তার দেখা পাই নি। শক্তিশালী স্রোত আর মরুর বাতাসে প্রায় উড়ে নদীর শেষ বাঁক ঘুরে যখন দৃশ্যমান হলো তার জাহাজ, খুশি ধরে রাখতে পারলাম না আমি এবং লসট্রিস। দক্ষিণ দিক হতে রাজকীয় নৌবহরের নেতৃত্ব দিয়েছে হোরাসের প্রশ্বাস।

রাজ-উজিরের নিজস্ব ধারায় দুই ভাই, মেনসেট এবং সোবেকের পেছনে দাঁড়িয়েছে লসট্রিস। সুদর্শন, ভালো ব্যবহার দুজনেরই; তবে বাপের খুব বেশি প্রভাব দুটোতেই। বড় জন, মেনসেটকে বেশি অবিশ্বাস করি আমি। ছোটোটাও গিয়েছে বড়টার পথেই।

আরো পেছনে, ক্রীতদাস এবং অনুচরের সারিতে দাঁড়িয়েছি আমি, এতে করে একই সঙ্গে লসট্রিস এবং ইনটেফ দুজনের দিকেই নজর রাখতে পারছি। হোরাসের প্রশ্বাসের স্টার্ন টাওয়ারে ট্যানাসের সুগঠিত, লম্বা অবয়ব চোখে পড়তে আনন্দে ঝলমল করে উঠলো আমার মিসট্রেসের ঘারের পেছনটা। ট্যানাসের ব্রেস্টপ্লেটে কুমীরের চামড়ার আঁশগুলো চমকাচ্ছে সূর্যরশ্মি পড়ে, মাথার হেলমেটের অসট্রিচের পালক উড়ছে গ্যালির গতির সাথে তাল মিলিয়ে।

আনন্দের আতিশায্যে মাথার উপরে দুই হাত তুলে নাচাতে লাগলো লসট্রিস, কিন্তু ফারাওকে স্বাগত জানাতে নীল নদের দুই পারে আগত জনতার গর্জনে হারিয়ে গেলো তার উল্লাস। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় নগরী হলো আমাদের এই থিবেস, মনে হয়, বহু আত্মা আজ হাজির হয়েছে রাজাকে সম্মান প্রদর্শন করতে।

খোলা তরবারি স্যালুটের ভঙিতে ধরে সোজাসুজি সামনে তাকিয়ে রয়েছে ট্যানাস, ডানে-বাঁয়ে কোনো দিকে ফিরছে না। পাখির উড়ার ঢঙে ট্যানাসের বাহিনীর বাকি জাহাজগুলো অনুসরণ করছে হোরাসের প্রশ্বাসকে। তাদের প্রতীক, যুদ্ধে অর্জিত সম্মান সবকিছু যেনো রঙধনুর রঙে সজ্জিত আজ, উল্লাসে ফেটে পড়া জনতা পাগলের মতো হাত নাচাতে লাগল।

এর বেশ অনেক পরে রাজকীয় বাহিনীর প্রথম জাহাজ নদীর বাঁক ঘুরল। রাজার সফরসঙ্গী, ভদ্রমহিলা আর মহান পুরুষলোকে বোঝাই ওটা। এরপরে এলো আরো একটি জাহাজ, তাকে অনুসরণ করে ছোট, বড় নানা জলযানের অবিন্যস্ত কাফেলা। যেনো ঝাক বেঁধে এলো ওগুলো; প্রাসাদের চাকর-বাকর, দাস এবং তাদের সমস্ত ব্যক্তিগত আসবাব, বস্ত্রসহ। রসুইঘরের জন্যে বার্জ ভর্তি গাই, ছাগল এবং মুরগি; স্বর্ণপাতে মোড়া, রঙ করা জলযানগুলোতে আরো এলো প্রাসাদের আসবাব এবং ট্রেজার, হোক তা মহান লোকেদের বা তাদের অধস্তনের; সব এক ভীষণ বিশৃঙ্খল অ নাবিকসুলভ ভঙ্গিতে সাজানো। দ্রুতগামী নীল স্রোতে জ্যামিতিক সুশৃঙ্খলতার যে উদাহরণ ট্যানাস এবং তার বাহিনী দেখাল, তা এর পাশে কত মনোজ্ঞ।

শেষমেষ ফারাও-এর রাজকীয় জলযান দারুন আড়ষ্ট, টালমাটাল ভঙ্গিতে নদীর বাকে পৌঁছুল। জনতার আর্তনাদ যেনো আকাশ বিদীর্ণ করে দেবে। বিশাল সেই জলযান, মানুষের তৈরি করা সবচেয়ে বড়, ধীরে এগুতে লাগলো উজিরের প্রাসাদের নিচের ঘাটের উদ্দেশ্যে; যেখানে তাঁকে স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে আছি আমরা।

যথেষ্ট সময় নিয়ে ওটার আকৃতি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম, আমাদের এই মিশরের বর্তমান দশা এবং শাসনের অবস্থা যেনো ফুটে উঠছে জাহাজের নকশা এবং আকারে। মাতৃভূমি মিশর, ফারাও ম্রাট মামোসের শাসনের বারোতম বছরে দাঁড়িয়ে এখন, অষ্টম সম্রাট তিনি ওই বংশপরম্পরার, বলা যায় দুর্বল এবং টালমাটাল সাম্রাজ্যে তারচেয়েও দুর্বলতম শাসক তিনি। পাঁচটি যুদ্ধ গ্যালি পরপর সাজালে যতটুকু হবে, তার সমান লম্বা রাজকীয় জাহাজ; কিন্তু তার উচ্চতা এবং বিস্তার এতো অসমানুপাতিক–আমার শৈল্পিক অনুভবে আঘাত লাগল। যুগের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যুদ্ধের রঙে রাঙানো হয়েছে হাল, গলুইয়ে আঁকা দেবী ওসিরিসের মুখাবয়ব সত্যিকারের স্বর্ণ পাতায় মোড়া। আমাদের আরো কাছাকাছি আসতে বোঝা গেলো, রেইলের ওপারে উজ্জ্বল রঙ চটে গেছে জায়গায় জায়গায় যেখানে বর্জ্য গড়িয়ে পড়েছে নাবিকদের।

পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে লম্বা ডেক-হাউস, মূল্যবান সিডার কাঠে তৈরি মহান ফারাও-এর ব্যক্তিগত প্রকোষ্ঠ ভারী আসবাবে একদম বোঝাই হয়ে আছে, জাহাজের ভারসাম্যে কোনো অবদান রাখছে না সেটা। সেই বিচিত্র স্থাপনার উপরে, তাজা পদ্মে সজ্জিত রেইলের ওপাশে দারুন ট্যান করা গ্যাজেল হরিণের চামড়ায় তৈরি দেব দেবীদের মুখচ্ছবি অঙ্কিত, আচ্ছাদনের নিচে বসে আমাদের ফারাও। রাজকীয় নিঃসঙ্গতা তার অবয়বে। স্বর্ণের স্যান্ডল, গায়ের খাঁটি লিনেনের তৈরি আচকান ভরা গ্রীষ্মের আকাশে ধবধবে সাদা মেঘের মতো চমকাচ্ছে। মাথায় পরেছেন দীর্ঘ দ্বৈত মুকুট; শকুনী দেবী নেখবেট-এর অবয়বের সাদা রঙের উচ্চ সাম্রাজ্যের মুকুট, সাথে দেবী ডেল্টার লাল রঙের মুকুট।

মাথার শোভাবর্ধনকারী ওই ডেল্টা মুকুট মূলত একটা প্রহসন, দশ বছর আগেই সেই ভূখণ্ড হারিয়েছি আমরা। এই অবিন্যস্ত সময়ে নিম্ন-রাজ্যে শাসন করছেন আরো একজন ফারাও, তিনিও একটি দ্বৈত-মুকুট বা তার নিজস্ব সংস্করণ পরিধান করেন। আমাদের সাম্রাজ্যের ভয়ঙ্কর শত্রু তারা, উচ্চ এবং নিম্ন-রাজ্যের মধ্যে চলমান যুদ্ধে কত শত তরুণ যোদ্ধার প্রাণহানি হচ্ছে, ক্ষতি হয়েছে কত সম্পদের তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অন্তৰ্গত কলহ দুভাগ করে ফেলেছে মিশরকে। আমাদের মাতৃভূমির এক হাজার বছরের ইতিহাসে এমনটা হয়ে এসেছে যখনই কোনো দুর্বল ফারাও শাসন করেছেন। চির বিবদমান দুই সাম্রাজ্যকে একত্রে ধরে রাখতে হলে কঠোর, শক্তিশালী এবং চতুর সম্রাট প্রয়োজন।

প্রাসাদের ঘাটে ভীড়তে হলে টলায়মান জাহাজের চালকের উচিত ছিলো দূরের তীরের দিকে ঘেঁষে আসা, এতে করে স্রোতে পরে ভেসে আসতো জাহাজ। তেমনটি করলে নদীর পুরো প্রস্থ বরাবর ওটাকে ঘোরানো যেত বাকে। নিঃসন্দেহে বাতাস এবং স্রোতের শক্তি ঠিকমত ঠাওর করতে পারে নি চালক, মাঝ নদীতে এসে ঘুরতে শুরু করলো সে। প্রথমটায় শক্তিশালী স্রোতে পরে নাক ঘুরে গেলো জাহাজের, এরপরে উঁচু ডেক-হাউসে কামড় বসালো মরুর তীব্র বাতাস। দাড়ীদের উন্মুক্ত কাঁধে সপাসপ করে আঘাত হানা চাবুকের শব্দ মতো দূর থেকেও শোনা গেলো।

উন্মত্তের মতো দাঁড় টানতে লাগলো তারা, হালের চারপাশের পানি যেনো সাদা ফেনা; কিন্তু ছন্দোবদ্ধভাবে না টেনে বিচ্ছিন্নভাবে কাজটা করা হলো। ওদের গালি গালাজ আর অভিশাপের সাথে মিলেমিশে গেছে স্টার্নে দাঁড়ানো চালকের নিষ্ফলা নির্দেশ। ওদিকে, পুপ-ডেকে বসে অক্ষম আক্রোশে সাদা দাঁড়িতে হাত বোলাচ্ছেন রাজকীয় নৌবাহিনীর প্রধান নেমবেট।

এই জগাখিচুরীর উপরে বসে আমাদের মহান ফারাও, নিশ্চল, ঠিক যেনো মন্দিরের মূর্তিগুলোর মতোই; বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। হায়, এ-ই হলো আমাদের মিশর।

এরপরে বন্ধ হয়ে জাহাজের ঘূর্ণন, বাতাস এবং স্রোতের বিপরীতমুখি টানে পরে সোজা তীরের দিকে ছুটতে লাগলো ওটা। চালক বা নাবিকেরা কেউই কিছু করতে পারছে না, না পারছে পুরো ঘুরে গিয়ে জাহাজটাকে স্রোতের মধ্যে ফেলতে, না পারছে গলুই উঁচু করতে যাতে করে প্রাসাদের পাথুরে ঘাটে তার মুখোমুখি সংঘর্ষ না ঘটে।

আসন্ন দুর্ঘটনার কথা টের পেয়ে গেছে নীল নদের তীরে দাঁড়ানো জনতা, হর্ষ ধ্বনি থেমে গেছে, অদ্ভুত নিরবতা বিরাজ করছে এই মুহূর্তে । মাঝি-মাল্লাদের চিৎকার, চালকের কঠোর নির্দেশ সবকিছু পরিষ্কার ভেসে এলো ফারাও-এর জল্যান থেকে।

এরপরে, হঠাৎই, জনতার চোখ সরে গেলো নদীর ভাটিতে; বাহিনীর কাছ থেকে সরে উজানে যেনো উড়ে আসছে হোরাসের প্রশ্বাস। অদ্ভুত ছন্দের সাথে উঠা-নামা করছে তার দাঁড়গুলো, পানিতে পড়ে, কেটে আবার একসাথে ভেসে উঠছে উপরে। তড়িৎগতিতে রাজকীয় জাহাজের গলুইয়ের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো হোরাসের প্রশ্বাস, জনতার দম আটকে যাওয়ার শব্দ পরিষ্কার ভেসে এলো প্যাপিরাসের ঝোঁপের উপর দিয়ে। সংঘর্ষ যেনো অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু শেষ মুহূর্তে মাথার উপরে মুঠি-বদ্ধ হাত তুলে সংকেত দিলো ট্যানাস। সঙ্গে সঙ্গে পেছন দিকে দাঁড় টানতে লাগলো দাঁড়ীরা, চালক স্থির ধরে রেখেছে চাকা।

থেমে পরে, রাজকীয় জলযানের আওতার বাইরে রইল হোরাসের প্রশ্বাস। কুমারীর চুমোর মতো আলতো করে পরস্পরকে স্পর্শ করলো দুটো বাহন, এক মুহূর্তের জন্যে হোরাসের প্রশ্বাসের স্টার্ন টাওয়ার এক সমানে থাকল রাজকীয় জাহাজের প্রধান পাটাতনের।

সেই মুহূর্তেই, স্টার্ন টাওয়ারের কাঠামোতে নিজেকে শক্ত করে আঁটকালো ট্যানাস। ঢাল, স্যান্ডল, অস্ত্রশস্ত্র একপাশে সরিয়ে রেখেছে সে। কোমরের চারপাশে একটা দড়ি বাধা। দুই জলযানের মধ্যবর্তী দূরত্ব একলাফে অতিক্রম করলো, দড়ি উড়ছে পেছনে।

যেন ঘোর ভেঙে নড়েচড়ে বসে জনতা। তাদের মধ্যে একজনেরও যদি ট্যানাসের পরিচয় অজানা থাকে, তো আজ দিন শেষের আগে জানা হয়ে যাবে–এতে কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্যই, নিম্ন রাজ্যের বিরুদ্ধে জল-যুদ্ধে ট্যানাসের বীরত্বের কথা ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পরেছে। কিন্তু কেবলমাত্র তার নিজস্ব বাহিনী দেখেছে সেটা। নিচের চোখে দেখা আর শোনাকথার ওজন তো আর এক নয়!

আর এখন, ফারাও-এর দৃষ্টির সামনে, রাজকীয় নৌবহর এবং কারনাকের সমস্ত জনতাকে প্রত্যক্ষদর্শী রেখে ক্ষিপ্র চিতার মতোই এক জাহাজের পাটাতন থেকে অপরটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ট্যানাস।

ট্যানাস! আমি নিশ্চিত, প্রথম চিৎকারটা দিয়েছিল আমার মিসট্রেস, লসট্রিসই। কিন্তু তারপরেই আমি ডেকে উঠলাম।

ট্যানাস! হাহাকার করে উঠলাম আমি, এরপরে প্রবল চিৎকারে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দেয় জনতা। ট্যানাস! ট্যানাস! ট্যানাস! যেনো কোনো নতুন দেবতার স্তুতি করছে তারা।

রাজকীয় জলযানের পাটাতনে পড়তেই ঘুরে দাঁড়িয়ে গলুইয়ের উদ্দেশ্যে ছুটল ট্যানাস, দুই হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে দড়ির প্রান্ত । ওটার অপর প্রান্তে জাহাজ নোঙরের শক্ত, মোটা দড়ি ধরে রেখেছিল ট্যানাসের নাবিকেরা, এবারে ওটা হস্তান্তর করলো তারা ট্যানাসের কাছে। কাধ এবং পিঠের পেশি ঘামে চকচক করছে, ওটাকে টেনে নিয়ে চললো সে।

এতক্ষণে, রাজকীয় জাহাজের নাবিকেরা বুঝতে পেরেছে কী ঘটতে চলেছে, ট্যানাসের সাহায্যে এগিয়ে আসে তারা। তার নির্দেশে গলুইয়ে তিনবার পেঁচিয়ে বাঁধল তারা মোটা দড়িটা। বাধা শেষ হতেই নিজের গ্যালিকে সংকেত দেয় ট্যানাস।

স্রোতে ভেসে পরে হোরাসের প্রশ্বাস, দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করে। দড়ি টানটান হয়ে যেতেই বিশালাকায় রাজকীয় জলযানের টানে থেমে, পানিতে চেপে বসে তার খোল। একটা ভয়ঙ্কর মুহূর্তের জন্যে আমার মনে হলো এই বুঝি তলিয়ে গেলো ওটা; কিন্তু আগেই বুঝতে পেরে নাবিকদের পিছন দিকে দাঁড় টানার সংকেত দেয় ট্যানাস, প্রচণ্ড টান প্রশমিত হলো খানিকটা।

এত নিচুতে নেমে গেছে হোরাসের প্রশ্বাসের খোল, নীল নদের সাবজেটে পানি উঠতে লাগলো তার উপর, কেঁপে কেঁপে, ভেসে-ডুবে শেষ পর্যন্ত দড়ি ধরে রাজকীয় জলযানকে টেনে রাখলো ওটা। বেশ লম্বা মুহূর্ত ধরে কিছুই ঘটল না। বিশাল জাহাজের উপর গ্যালির সামান্য ওজন কোনো প্রভাবই রাখতে পারছে না। কুমীরের চোয়ালের ফাঁকে আটকে ধরা বুড়ো ষাড়ের মতো এক হয়ে রইল দুটো জলযান। এবারে রাজকীয় জলযানের অবিন্যস্ত নাবিকদের মুখোমুখি হয় ট্যানাস। তার দায়িত্বপূর্ণ ভাবভঙ্গিতে বেশ একটা পরিবর্তন আসে তাদের মধ্যে। ওর নির্দেশের অপেক্ষায় এখন তারা।

ফারাও বাহিনীর সকল নৌবহরের প্রধান হলেন নেমবেট, মিশরের সাহসী সিংহ তাঁর উপাধি। অনেক কাল আগে শক্তিশালী একজন মানুষ ছিলেন তিনি, কিন্তু এখন বুড়ো, দুর্বল। ঠিক নদীর স্রোত কিংবা বাতাসের মতোই তার কতৃত্ব সহজে নিজের হাতে নিয়ে নিল ট্যানাস, আর নৌবহরের নাবিকেরাও নির্দ্বিধায় মেনে নিল সেটা।

টানো! পোর্টের দিকের দাড়ীরা প্রাণপণে টানতে লাগল, পিঠ বাঁকা হয়ে গেছে তাদের।

পেছনে টানো! স্টারবোর্ড দিকের দাঁড়ীদের উদ্দেশ্যে মুষ্টিবদ্ধ হাত নাচায় ট্যানাস, দাঁড়ের চোখা মাথা দিয়ে টানতে থাকে তারা। রেইলের কাছে ছুটে গিয়ে হোরাসের প্রশ্বাসের নাবিকদের যুগপৎ নির্দেশ দেয় সে। এখনও তীরের পাথুরে ঘাটের দিকে চলছে রাজকীয় জলযান, সামান্য একটু ফাঁকা জল আছে জাহাজ এবং তীরের মাঝে।

কিন্তু, এবারে, ধীরে-ধীরে সাড়া দেয় ওটা। গ্যালির টানে ধীরে স্রোতের দিকে ফিরতে থাকে রঙ-চঙ গলুই। আবারো হর্ষধ্বনি কেটে গিয়ে আশঙ্কার আওয়াজ বেরোয় আমাদের মুখ থেকে, শেষপর্যন্ত কী পাশাপাশি তীরে আছড়ে পরে চুরমার হবে রাজকীয় জাহাজ? তেমনটি হলে ট্যানাসের ভাগ্যে কী ঘটবে, বলার অপেক্ষা রাখে না। বুড়ো নেমবেটের কাছ থেকে কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নিয়েছে সে, তার যে কোনো ভুলের মাশুল এখন ট্যানাসকেই দিতে হবে। যখন সংঘর্ষের প্রাবল্যে সিংহাসন থেকে ছিটকে পড়বেন ফারাও, তাঁর মর্যাদার প্রতীক দ্বৈত-মুকুট লুটাবে পাটাতনে; আর রাজকীয় জলযান পানিতে তলিয়ে গেলে যখন সমস্ত মিশরের সম্মুখে ভেজা কুকুরছানার মতো পানি থেকে উদ্ধার করা হবে তাকে; তখন নৌবাহিনী প্রধান নেমবেট এবং আমার মনিব, ইনটেফ দুজনের মন্ত্রণায় ফারাও-এর আক্রোশ এই টগবগে যোদ্ধার উপরে পড়তে বাধ্য।

অসহায় অবস্থায় তীরে দাঁড়িয়ে বন্ধুর জন্যে কাঁপছিলাম আমি, প্রার্থনা করে চলেছি একটা অসম্ভবের। দ্রুত ধাবমান পাথুরে ঘাটের মতো কাছাকাছি এখন জাহাজ, ট্যানাসের স্বর পরিষ্কার শুনতে পেলাম আমি। মহান হোরাস, সাহায্য কর! চেঁচিয়ে বললো সে।

মানবের ঘটনাচক্রে কখনও কখনও হস্তক্ষেপ করেন দেবতারা, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই আমার মনে। ট্যানাস হলো হোরাসের উপাসক, আর হোরাস বায়ুর দেবতা।

দক্ষিণে, সাহারা মরুর নির্জন বুক হতে তিন দিন, তিন রাত ধরে বয়ে চলেছে বাতাস। তীব্রতা নিয়ে ছুটেছে তা এই কদিন, কিন্তু এখন ধরে এলো সেটা। কমে গেলো না, একেবারে বন্ধ হয়ে গেলো। নদীর বুকে নৃত্যরত ছোটো ছোটো ঢেউগুলো সমান হয়ে আসে, তীরের পাম গাছগুলোর পাতা থেমে যায়। যেনো হঠাৎ বরফে পরিণত হয়েছে।

বাতাসের ধাবা থেকে মুক্তি পেতেই সোজা হয়ে, হোরাসের প্রশ্বাসের টানে সমর্থন জানায় রাজকীয় জাহাজ। বিশালাকায় গলুই স্রোতের টানে পরে পার্থরে ঘাটের সমান্তরালে চলে আসে; পাশটা আলতো ঘষা খায় সজ্জিত পাথরে, ঠিক সেই মুহূর্তে নীলের জল সামনের শান্ত পানিতে ঠেলে দেয় তাকে।

শেষ একটা নির্দেশ দেয় ট্যানাস, জাহাজ পেছনের দিকে যাওয়ার আগেই নোঙরের দড়ি দ্রুত বেঁধে ফেলা হলো পাথুরে স্তম্ভের সাথে। হালকা পালকের হাঁসের মতোই পানিতে ভাসতে থাকে জাহাজ; রাজকীয় জলযান নিরাপদে ভীড়ে তার ঘাটে, সিংহাসনে আসীন ফারাও কিংবা তাঁর মস্তকে শোভাবর্ধনকারী দীর্ঘ মুকুট কোনোটিই একচুল স্থানান্তরিত হয় না।

আমরা, যারা তীরে দাঁড়িয়ে অবলোকন করছিলাম, প্রশংসার গর্জনে ফেটে পড়ি; ফারাও নয়, আমাদের ঠোঁটে ছিলো ট্যানাসের নাম। বিনয়ের সাথে, কিন্তু যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে আমাদের প্রশংসা ধ্বনি গ্রহণ করার কোনোরকম চেষ্টা চালাল

ট্যানাস। রাজাকে অভ্যর্থনা জানাতে সমাগত জনতার মনোযোগ এমন করে কেড়ে নেওয়াটা মারাত্মক হতে পারে, আজকে যতটুকু রাজকীয় আনুকূল্য সে অর্জন করেছে, তাতে করে সেটা তিরোহিত হওয়ার আশঙ্কা ছিলো। নিজের রাজকীয় মর্যাদার। ভাগাভাগিতে ফারাও খুবই ঈর্ষান্বিত হতে পারেন। বদলে, নিরবে হোরাসের প্রশ্বাসকে কাছাকাছি আনার সংকেত দিলো ট্যানাস। জাহাজের বিশাল কাঠামোর আড়ালে হোরাসের প্রশ্বাস হারিয়ে যেতে ওটার পাটাতনে লাফিয়ে নেমে যায় সে, তারই জন্যে প্রস্তুত মঞ্চ দান করে যায় মহান ফারাওকে।

যা হোক, নেমবেটের চেহারায় ক্রোধ এবং অসন্তুষ্টির ছায়া ঠিকই দেখতে পেয়েছি আমি। মিশরের সাহসী সিংহ, প্রাজ্ঞ নৌ-প্রধান যখন মহান ফারাও-এর পিছুপিছু তীরে নেমে এলেন; আমি নিশ্চয় করে বুঝতে পারলাম আরো একজন প্রভাবশালী শত্রু তৈরি করেছে ট্যানাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *