৪. মাইরা উধাও

যোড়শ পরিচ্ছেদ

মাইরা উধাও হয়ে গিয়েছে!

আতঙ্কিত চীৎকারে সারা বাড়িটা যখন কেঁপে উঠেছে, গোড়ায় কেউই বুঝতে পারেনি কী হয়েছে…উধাও? তার তো কোনোই মানে হয় না। শুধু অপ্রত্যাশিতই নয়, অবিশ্বাস্য!

মাইরা তার রোগশয্যায় যে-ঘরটায় শুয়েছিলা, আধঘণ্টা আগেও মার্ক আর মাদাম রডারিখ সে-ঘরে ছিলেন। ততক্ষণে তাকে পথের জন্যে পোশাক পরানো হয়ে গিয়েছিলো, শান্তই ছিলো সে, নতুন-কোনো অস্থিরতা তার ঘুমের মধ্যটা ছিঁড়ে দিচ্ছে বলে মনে হয়নি। তার একটু আগেই মার্ক তাকে পথ্য খাইয়েছে, তারপর নিজে গেছে। খাবারটেবিলে। আর খাওয়া শেষ হতেই ডাক্তার রডারিখকে নিয়ে সে মাইরার ঘরে ফিরে গেছে-তাকে ধরাধরি করে নিয়ে আসবে বলে, কোচগাড়ির কাছে। আর ঠিক তখনই। এই জবরদস্ত নাটুকে আঘাতটা পড়েছে, আচমকা! তারা তাকে তার ঘরে, তার বিছানায় দেখতে পায়নি। ঘরটা পড়ে আছে ফাঁকা, পরিত্যক্ত, জনমানবহীন!

মাইরা! আর্ত ডুকরে উঠেই মার্ক ছুটে চলে গিয়েছে জানলায়, গিয়ে ছিটকিনিটা খোলবার চেষ্টা করছে। কিন্তু ছিটকিনি খুলতে সে পারেনি সে, জং-ধরে যেন সেটা শক্তভাবে এঁটে আছে! কেউ যদি মাইরাকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে থাকে, গুম করে থাকে, তবে তাকে এই জানলা খুলে কেউ নিয়ে যায়নি।

মাদাম রডারিখ ছুটে এসেছেন আলুথালু, তার পেছন-পেছন কাপ্তেন হারালান। তার সারা বাড়িটা ছুঁড়ে বেরিয়েছেন, চীৎকার করে ডেকেছেন, মাইরা!… মাইরা!

সে-যে কোনো উত্তর দেয়নি, সেটা তো সহজেই বোঝা যায়, কেউই তার কোনো সাড়া পাবে বলেও আশা করেনি। কিন্তু এই-যে ঘর থেকে সে উধাও হয়ে গেছে, এর যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা কী হবে? তার পক্ষে কি সম্ভব ছিলো যে সে বিছানা ছেড়ে উঠবে, তারপর পাশে, মায়ের ঘরের মধ্য দিয়ে গিয়ে, সিঁড়ির পইঠা দিয়ে নিচে নেমে যাবে?-–অথচ কেউই তাকে দেখতে পায়নি!

আমি তখন কোচগাড়িগুলোয় মালপত্র ঠিকমতো গুছিয়ে রাখার কাজটা তদারক করছিলুম–এমন সময় এই চীৎকার ও শোরগোল শুনে আমি আঁৎকে উঠেছি। ছুটে আমি উঠে গিয়েছি দোতলায়।

ডাক্তার রডারিখ আর মার্ক ক্রমাগত চেঁচিয়ে তার নাম ধরে ডেকেই চলেছে আর খ্যাপার মতো এ-ঘরে ও-ঘরে ছুটোছুটি করছে।

মাইরা! আমি জিগেস করেছি, এ তুই কী বলছিস, মার্ক?

ডাক্তারের যেন কথা বলবার শক্তিটুকুও আর ছিলো না। তিনি শুধু ভাঙা গলায় বলেছেন, আমার মেয়ে–উধাও হয়ে গেছে!

মাদাম রডারিখ ততক্ষণে সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন, তাকে ধরাধরি করে তার বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয়া হয়েছে। কাপ্তেন হারালানের মুখটা বিকৃত হয়ে আছে, কোটর থেকে এই-বুঝি চোখদুটি ফুটে বেরুবে, সে শুধু আমার কাছে এসে বলেছে : সে… আবারও সে!

কিন্তু আমি শুধু কোনোরকমে ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা ভাববার চেষ্টা করেছি। কাপ্তেন হারালানের শঙ্কার পেছনে যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু স্টেরিৎসই এসে যে কাজটা করেছে, এ-কথা মানা যাবে কী করে? আমরা যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছি, সবাই যে রকম হুঁশিয়ার ছিলুম, তাতে এটা মানা শক্ত যে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস এসে এ-বাড়িতে ঢুকতে পেরেছিলো। তর্কের খাতিরে না-হয় মেনেই নেয়া গেলো যে যাত্রার প্রস্তুতির জন্যে যখন বাড়িটায় হুড়োহুড়ি চলেছে, তখন সে একফাঁকে সকলের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে–কিন্তু তা করতে হলে তাকে তো সর্বক্ষণ নজর রাখতে হয়েছে বাড়িটার ওপর, তক্কেতক্কে থাকতে হয়েছে, কখন একটা মওকা মেলে, আর তখন নিশ্চয়ই অবিশ্বাস্য তাড়াহুড়োয় পুরো কাজটা হাসিল করতে হয়েছে। অথচ এই সন্দেহটাকে সত্য বলে মেনে নিলেও, কাউকে এসে সে গুম করে ফেলেছে, এটা অবিশ্বাস্য। গ্যালারির কাছের দরজাটা ছেড়ে একমুহূর্তের জন্যেও আমি কোথাও যাইনি–কোচগাড়িটা দাঁড়িয়েছিলো সেখানেই, মাইরা সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে বাগানে যাবে-অথচ আমি তাকে দেখতে পাবো না, এটা কী করে হয়। না-হয় মেনেই নিলুম যে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস অদৃশ্য হয়ে যাবার ক্ষমতা ধরে, কিন্তু সে, মাইরা?…

আমি নিচে গ্যালারিতে গিয়ে কাজের লোককে ডাক দিলুম। বুলভার তেকেলির দিকে দরজাটা তালা বন্ধ, তার চাবি আমি নিজের কাছেই রেখেছি। তারপর পুরো বাড়িটা, চিলেকোঠা, মাটির তলার ভাড়ারঘর, মিনার আর তার অলিন্দ-সবকিছু আমি তন্নতন্ন করে হাড়ে দেখেছি, একটা কোণাও বাকি রাখিনি। তারপর বাগান…

কাউকেই দেখতে পাইনি আমি।

আমি মার্কের কাছে ফিরে গেলুম। সে তখন খোলাখুলি, প্রায় হাউহাউ করেই, কাঁদছে। তাকে এখন আমি কোন সান্ত্বনা দিই?

আমার মনে হচ্ছিলো, প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে মঁসিয় স্টেপার্ককে গিয়ে সবকিছু জানিয়ে আসা।আমি টাউনহলে যাচ্ছি। তুমিও আমার সঙ্গে চলো। আমি বলেছি কাপ্তেন হারালানকে।

কোচগাড়িগুলো তখনও দাঁড়িয়েছিলো। গাড়িতে করেই চটপট গিয়ে টাউনহলে পৌঁছেছি আমরা।

মঁসিয় স্টেপার্ক তার খাশকামরাতেই কতগুলো নথিপত্র খুলে কী-সব দেখছিলেন। আমি তাকে সব খুলে বলেছি। সাধারণত মঁসিয় স্টেপার্ককে কখনও খুব-একটা ভড়কে যেতে দেখিনি আমি, কিন্তু এবারে তিনিও তার বিস্ময় চাপতে পারেননি।

স্তম্ভিতভাবে বলে উঠেছেন, মাদমোয়াজেল রডারিখ উধাও!

হ্যাঁ, আমি তাকে জানিয়েছি। শুনে অবিশ্বাস্য ঠেকতে পারে, মনে হতে পারে অসম্ভব। তবে সে আপন খেয়ালে কোথাও চলে গিয়েছে কি না, অথবা তাকে কেউ গুম করেছে কি না জানি না–তবে মোদ্দা কথা হলো সে আর ও-বাড়িতে নেই!

তার মানে সেই দুবৃত্ত স্টোরিৎসই এর পেছনে আছে! অস্ফুট স্বরে বলেছেন মঁসিয় স্টেপার্ক। কাপ্তেন হারালানের সঙ্গে তিনিও একমত যে স্টোরিৎসই এই দুষ্কর্মের হোতা। একটু চুপ কর থেকে তিনি বলেছেন, এই সেই ভীষণ চক্রান্ত যার কথা সেদিন বলছিলো হেরমানকে!

মঁসিয় স্টেপার্ক মোটেই ভুল বলেননি। হ্যাঁ, সত্যি-তো, ভিলহেল্ম স্টোরিৎস তো সেদিনই বলেছিলো যে সে এমন-একটা কাজ করতে চলেছে যাতে সবাই একেবারে কেঁপে উঠবে। আর আমরা সবাই এমনই হাঁদা যে আমরা আত্মরক্ষার কোনো চেষ্টাই করিনি।

মঁসিয় স্টেপার্ক ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আপনারাও আমার সঙ্গে যাবেন তো?

এক্ষুনি, আমরা সমস্বরে সাড়া দিয়েছি।

শুধু একমিনিট সবুর করুন। আমাকে কতগুলো নির্দেশ দিয়ে যেতে হবে।

একজন সার্জেন্টকে ডেকে তারপর তিনি নির্দেশ দিয়েছেন : একদল সেপাইকে নিয়ে গিয়ে রডারিখ-ভবনের চারপাশে সারাক্ষণ কড়া পাহারা রাখতে। তারপরে নিচুগলায় তাঁর সহকারীর সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কী-সব শলাপরামর্শ করেছেন। তারপর আমরা তিনজনে ঐ কোচগাড়িটায় করেই ডাক্তারের বাড়ি ফিরে গিয়েছি।

দ্বিতীয়বার বাড়িটাকে লণ্ডভণ্ড করে সবকিছু তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে, কিন্তু তাতে কোনো লাভই হয়নি। তবে মাইরার ঘরে ঢুকতে গিয়ে মঁসিয় স্টেপার্ক হঠাৎ বলে উঠেছেন,মঁসিয় ভিদাল, আপনি একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছেন না কি ঘরটায়? এর আগেও এ-গন্ধটা কোথাও যেন নাকে এসেছে।

আর, সত্যি, মৃদু একটা ঝাপসা গন্ধ ঝিম ধরে আছে হাওয়ায়, আর এবারে আচমকা আমার মনে পড়ে গেছে। হ্যাঁ, মঁসিয় স্টেপার্ক। মনে আছে, স্টোরিসের ল্যাবরেটরিতে নীল শিশিটা যখন পড়ে গিয়ে ভেঙে গিয়েছিলো, তখন ঠিক এমনি-একটা গন্ধ বেরিয়েছিলো!

হ্যাঁ-হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন, মঁসিয় ভিদাল, এটা ঠিক সেই গন্ধ। আর তা থেকে কতগুলো অনুমান করা যায়। যদি এই তরল পদার্থ লোককে অদৃশ্য করে দিতে পারে, তাহলে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস সম্ভবত মাদমোয়াজেল রডারিখকে বাধ্য করেছিলো তা পান করতে, তারপর তাকে নিজের মতোই অদৃশ্য করে ফেলে কাঁধে করে নিয়ে গেছে।

শুনে, আমরা যেন বজ্রাহত হয়ে গেছি! হ্যাঁ, তা-ই তো, নিশ্চয়ই এ-রকমই কিছু একটা ঘটেছে। এখন আমার মনে আর-কোনো সন্দেহই নেই : আমরা যখন তার বাড়িতে তল্লাশি চালাচ্ছিলুম, তখন ভিলহেল্ম স্টোরিৎস স্বয়ং ল্যাবরেটরি ঘরে অদৃশ্য অবস্থায় ছিলো, আর সে-ই ইচ্ছে করে তখন শিশিটা ঠেলে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিয়ে ভেঙে ফেলেছিলো, আর আমাদের হাতে না-পড়ে সেই তরল রাসায়নিক পদার্থ তক্ষুনি হাওয়ায় উবে গিয়েছিলো। হ্যাঁ, এটা সেই বিদঘুঁটে গন্ধটাই! তারই রেশ আমরা পাচ্ছি এ-ঘরে! হ্যাঁ, যাত্রার প্রস্তুতির জন্যে আমরা যখন বারেবারে দরজা খুলে যাওয়া-আসা করেছি, সে তখন একফাঁকে চুপিসাড়ে এ-ঘরে ঢুকে পড়ে মাইরা রডারিখকে গুম করে নিয়ে গেছে।

কী-একখানা রাত্তিরই যে কেটেছে। আমি সারাক্ষণ বসে থেকেছি মার্কের পাশে, ডাক্তার রডারিখ থম মেরে বসে থেকেছেন মাদাম রড়ারিখের পাশে! কী-যে অধীরভাবে আমরা অপেক্ষা করেছি কখন দিন ফোটে, আলো হয়!

আলো হয়?… কিন্তু দিনের আলোই বা আমাদের কোন কাজে আসবে?… ভিলহেল্ম স্টোরিংসের কাছে কি দিনরাত্রির কোনো ফারাক আছে? সে কি জানে না যে তাকে সারাক্ষণ ঘিরে আছে ঘনতামসী, অবতামসী, আঁধার-নিশা?

ভোর না-হওয়া পর্যন্ত মঁসিয় স্টেপার্ক আমাদের সঙ্গেই থেকেছেন, রাজভবনে খবর দিতে পর্যন্ত যাননি। যাবার আগে আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছেন–যা বলেছেন তার মাথামুণ্ডু কোনো মানে বুঝতে পারিনি আমি–বিশেষত বর্তমান পরিস্থিতিতে তো তার কোনো অর্থই হয় না–বলেছেন, শুধু একটা কথা, মঁসিয় ভিদাল। কিছুতেই হতাশ হবেন না। সব দেখে-শুনে মনে হচ্ছে আপনাদের দুঃসময়ের শেষ হয়ে

এসেছে।– এমনতর উৎসাহব্যঞ্জক কথা শুনে হয়তো আমার খুশি হওয়া উচিত ছিলো, কিন্তু আমার মনে হলো এত-সব কাণ্ড দেখে মঁসিয় স্টেপার্কেরও মাথাটা খারাপ হয়ে যায়নি। তো? এ-কথার কোনো জবাব দেবো কি, আমি বুঝি হাবার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছি তার মুখের দিকে। আমি ভুল শুনিনি তো কথাগুলো? এমনিতেই আমার তখন বিমূঢ় দশা, সব শক্তি সব উৎসাহ কেউ যেন নিংড়ে বার করে নিয়ে গিয়েছে আমার মধ্য থেকে।

আটটা নাগাদ খোদ রাজ্যপাল এসে হাজির সান্ত্বনা আর আশ্বাস দিতে। ডাক্তার রডারিখকে তিনি জানিয়েছেন মাইরাকে উদ্ধার করবার জন্যে চেষ্টার কোনোই ত্রুটি হবে না। আমি ডাক্তার রডারিখের মতোই শুধু তেতো-একটু শুকনো হেসে তার আশ্বাস শুনেছি। রাজ্যপাল, বেচারা, তিনিই বা এ-অবস্থায় কী করতে পারেন?

কিন্তু ভোরবেলাতেই দাবানলের মতো মাইরার গুম হবার কথা গোটা রাগৎ-এ ছড়িয়ে পড়েছে–আর তার যা প্রতিক্রিয়া হয়েছে, সেটা বর্ণনা করার ভাষা বা অভিব্যক্তি –কিছুই আমার নেই।

নটার আগেই লিউটেনান্ট আর্মগড় এসে বন্ধুকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে-বেচারাই বা কী আর বলবে? তবে কাপ্তেন হারালান কিন্তু বন্ধুকে দেখেই যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। কোমরবন্ধে তলোয়ার ঝুলিয়ে তাকে শুধু একটা কথাই বলেছে : এসো।

সামরিক বাহিনীর এই দুই অফিসার যখন দরজার কাছে গেছে, হঠাৎ আমার মধ্যে অপ্রতিরোধ্য একটি বাসনা জেগেছে তাদের অনুসরণ করার। মার্ককেও তখন আমি ডেকেছি আমাদের সঙ্গে চলে আসতে। কিন্তু তার কানে পৌঁছেছিলো কি ডাকটা? জানি না। জবাবে টু শব্দটিও করেনি সে।

বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি অফিসার দুজন হনহন করে নদীর তীর ধরে হেঁটে চলেছে। পথচারীদের কেউ-কেউ থমকে থেমে রডারিখ-ভবনের দিকে তাকাচ্ছে, তাদের মুখ-চোখে সমবেদনা আর আতঙ্কের একটা মিশ্র ছাপ।

আমি যখন গিয়ে অফিসার দুজনের নাগাল ধরেছি, কাপ্তেন হারালান একবারও আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি। আমি যে সঙ্গে-সঙ্গে আসছি, এটা যদি কেউ তাকে তখন বলতো, তবে সে তা বুঝতে পারতো কি না সে বিষয়ে আমার গভীর সন্দেহ আছে। শুধু লিউটেনান্ট আমগাড় আমায় জিগেস করেছে, আপনিও কি আমাদের সঙ্গে আসছেন?

হ্যাঁ। তবে আপনারা কোথায়…

লিউটেনান্ট শুধু অস্পষ্ট ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়েছে। কোথায় যাচ্ছি আমরা?… তার কি কোনো ঠিক ঠিকানা আছে? যে-দিকে দু-চোখ যায়। এ-অবস্থায় অবশ্য তার চেয়ে ভালো পরিকল্পনা আর কী-ই বা হতে পারতো?

আমরা নীরবে কয়েক পা এগিয়ে যাবার পর, হঠাৎ দুম করে থেমে পড়েছে কাপ্তেন হারালান, কাটা-কাটাভাবে জিগেস করেছে : ক-টা বাজে?

সোয়া নটা। তার বন্ধু তার ঘড়ি দেখে বলেছে।

তারপরে ফের আমরা চলতে শুরু করেছি–নীরবে, আর হয়তো–খানিকটা উদ্দেশ্যহীন। মাঝে-মাঝেই কাপ্তেন হারালান এমনভাবে তার পা তুলে হেঁটেছে, মনে হয়েছে কেউ যেন পেরেক ঠুকে তার পা-দুটো মাটির সঙ্গে আটকে দিতে চাচ্ছে। আর বারেবারে জিগেস করেছে :কটা বাজে?নটা পঁচিশ… সাড়ে নটা… দশটা বাজতে কুড়ি, বলেছে তার বন্ধু, আর অমনি কাপ্তেন হারালান আবার বিমূঢ় পদক্ষেপে পথ হেঁটেছে। বাঁ-দিকে মোড় ঘুরে আমরা পেরিয়ে এসেছি ক্যাথিড্রালের সামনের চত্বরটা।

মনে হচ্ছে মরে গেছে যেন সবাই, রাগৃৎস-এর এই বড়োলোক পাড়ায়, এই অভিজাতপল্লিতে কেউই যেন নেই আর। ক্কচিৎ চোখে পড়ছে দু-একজন পথচারী, বেশির ভাগ দরজা-জানলাই বন্ধ, যেন কোনো সমবেত শোকের দিন।

রাস্তার শেষপ্রান্তে এসে দেখা গেলো লম্বা একটা মরা সাপের মতো পড়ে আছে বুলভার তেকেলি। রাস্তাটা ফাঁকা, পরিত্যক্ত, পড়ে আছে। সেই অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে সহজে কেউ এই রাস্তায় আর আসে না।

কোনদিকে যাবে এবার কাপ্তেন হারালান? ওপরে, দুর্গের দিকে? না, নিচে, নদীর দিকে? আবারও সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে পথের ওপর, যেন বুঝতে পারছে না কী করবে। আবারও সেই একই প্রশ্ন অস্ফুট বেরিয়ে এসেছে তার মুখ থেকে : কটা বাজে, আমগাড়?

দশটা বাজতে দশ, উত্তর দিয়েছে লিউটেনান্ট।

অবশেষে সময় হয়েছে, ঘোষণাই যেন করেছে হারালান। এবার সে হনহন করে হেঁটে গেছে বুলভার দিয়ে।

ভিলহেল্ম স্টোরিৎসের বাড়ি ঘিরে যে-বেড়া ছিলো, তার পাশ দিয়ে আমরা হেঁটে গেছি, হারালান কিন্তু হানাবাড়ির ভগ্নস্তূপের দিকে একবারও ফিরেও তাকায়নি। গতি না কমিয়েই সে আস্ত বাড়িটাকে ঘিরে হেঁটেছে, পেছনের গলিটায় এসে না-পৌঁছুনো অব্দি একবারও থামেনি। সেখান থেকে সাত ফিট উঁচু একটা ভাঙা-পোড়া দেয়াল দিয়ে ধ্বংসস্তূপটা ঘেরা।

আমাকে একটু তুলে ধরো তো, সে ইঙ্গিত করেছে, দেয়ালের ওপরটা দেখিয়ে।

ঐ কথা কটিই মুহূর্তে সব হেঁয়ালির সমাধান করে দিয়েছে। মাইরার দুর্ভাগা সহোদর কী করতে চাচ্ছে, চট করেই তখন তা যেন আমি বুঝে গিয়েছি।

বেলা দশটা-দু-দিন আগে আমরা আড়াল থেকে যে-কথাবার্তা শুনেছিলুম, তাতে বেলা দশটাই কি বলেনি ভিলহেল্ম স্টোরিৎস? আর সে-কথা কি আমিই খুলে বলিনি কাপ্তেন হারালানকে?, এখুনি ঐ পিশাচ এখানে আসবে, দেয়ালের আড়ালে, যে গুপ্তস্থানে সে লুকিয়ে রেখেছে তার ঐ অজ্ঞাত রাসায়নিক তরল, সেখানে গিয়ে ঢুকবে! সে যখন তার দুরভিসন্ধি কাজে খাটাতে ব্যস্ত থাকবে, তখন অপ্রস্তুত তার ওপর আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবো কি?

পরস্পরকে সাহায্য করে ক-মিনিটের মধ্যেই আমরা টপকেছি দেয়ালটা। আমরা গিয়ে নেমেছি ছোট্ট একচিলতে পায়েচলার পথে, তার দুপাশে ঘন ঝোঁপঝাড়। এখানে লুকিয়ে থাকলে স্টোরিৎস তো দূরের কথা, খোদ বীলজেবাবেরও হয়তো সাধ্য হবে না। যে আমাদের দেখতে পায়।

এখানে লুকিয়ে পড়ুন, আস্তে দৃঢ় স্বরে আমাদের বলেছে কাপ্তেন হারালান। বাগানের দেয়ালের গা ঘেঁসে বাড়ির দিকে যেতে-যেতে চট করেই সে আমাদের চোখের আড়ালে চলে গেছে।

আমরা প্রায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে থেকেছি একঝলক। তারপর, অপ্রতিরোধ্য কৌতূহলের তাড়ায়, আমরা এগিয়ে গেছি পায়ে-পায়ে-ঝোঁপের মধ্য দিয়ে, নুয়ে, ঝুঁকে, সন্তর্পণে, চুপিসাড়ে, শেষটায় আমরাও বাড়িটার কাছে চলে গেছি। গাছপালার ঝাড় যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকেই আমাদের চোখে পড়েছে হানাবাড়ির ধ্বংসস্তূপ। মাঝে শুধু ভোলা জমি আছে বিশ গজ, তারপরেই সেই বাড়ি।

গুঁড়ি মেরে বসে, রুদ্ধনিশ্বাসে, আমরা অপলকে, ব্যগ্রভাবে তাকিয়ে থেকেছি বাড়িটার দিকে।

বাড়িটা তো নয়, যা আছে তা শুধু তার চার দেয়ালই, আগুনে-পোড়া, কালো। নিচে পড়ে আছে ইটপাথর, পোড়া কাঠের টুকরো, দুমড়ে-মুচড়ে বেঁকে-যাওয়া লোহার শিক, ঢিবির মতো ছাইভস্ম, আর আশবাবপত্রের ঝলসানো টুকরো-টাকরা।

অপলকেই আমরা তাকিয়ে থেকেছি সেই ধ্বংসস্তূপের দিকে। ঈশ! বাড়িটার সাথে সাথে তারা যদি ঐ অভিশপ্ত আলেমানটিকেও জ্যান্ত পুড়িয়ে মারতে পারতো! যদি তার সঙ্গে-সঙ্গেই ধ্বংস হয়ে যেতো তার ঐ ভয়াবহ আবিষ্কার?

লিউটেনান্ট আর আমি ব্যগ্র চোখ বুলিয়ে গেছি ঐ খোলা জমির ওপর–আর তার পরেই ভীষণ চমকে গেছি! তিরিশ পাও দূরে হবে না, কাপ্তেন হারালান আমাদেরই মতো গুঁড়ি মেরে আছে একটা ঝোঁপের পাশে, যেখানটায় গিয়ে সে থেমেছে, তারপরেই ঝোঁপের সারি বেঁকে গিয়েছে বাড়ির কোণায়, বাড়ির সঙ্গে ঝোঁপটার ব্যবধান ছ-গজও হবে কি না সন্দেহ। সেই কোণাটার দিকেই অনিমেষলোচনে তাকিয়ে আছে কাপ্তেন হারালান। একটুও নড়ছে না সে। গুঁড়ি মেরে আছে সে, উদ্যত, পেশীগুলো টানটান, যেন কোনো হিংস্র বুনো জানোয়ার-লাফ মারবার ঠিক আগের মুহূর্তটায়।

সে যেদিকটায় তাকিয়েছিলো, আমরাও এবার সেদিকটাতেই তাকিয়েছি। কিছু একটা আশ্চর্য নিশ্চয়ই ঘটছে সেদিকটায়। আমরা যদিও কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না, তবুবুঝতে পারছি ঐ ধ্বংসস্তূপের ইটকাঠপাথর দুর্বোধ্য কোনো প্রহেলিকার মতোই নড়ে যাচ্ছে! আস্তে, সন্তর্পণে, হুঁশিয়ার হাতে কেউ যেন সেই ইটকাঠপাথর সরাচ্ছে!

আমাদের ঘাড়ে হাত চেপে রেখেছে যেন কোনো পৈশাচিক রহস্য, আমাদের চোখগুলো বুঝি ঠিকরেই বেরিয়ে আসতে চেয়েছে কোটর থেকে। সত্যটা যেন ধাঁধিয়েই দিয়েছে আমাদের চোখ। ভিলহেল্ম স্টোরিৎস আছে ওখানে। মজুরদের যদি নাও দেখা। যায় চোখে, তাদের কাজকর্ম কিন্তু স্পষ্টই চোখে পড়ে যায়, হোক না তারা অদৃশ্য।

হঠাৎ যেন খ্যাপার মতো হুংকার দিয়ে উঠলো কেউ… কাপ্তেন হারালান একলাফে ডিঙিয়ে গেছে ফাঁকা জমিটা, যেন কোনো অদৃশ্য বাধার ওপরই লাফিয়ে পড়েছে।… যেন ছুঁ মারতে চাচ্ছে সে, এগিয়ে যেতে চাচ্ছে, ঠেলা খেয়ে পেছিয়ে আসছে, দুই হাত খুলে কোন্ অদৃশ্যকে যেন সে জড়িয়ে ধরেছে প্রাণপণে, যেন কোনো মল্লযুদ্ধ চলেছে, অদৃশ্যের সঙ্গে কোনো পাঞ্জা,…

এসো! হাত লাগাও! চেঁচিয়ে উঠেছে সে, বাগে পেয়েছি এবার শয়তানটাকে?

লিউটেনান্ট আর আমার বুঝি একমুহূর্তও লাগেনি ঐ ধস্তাধস্তির কাছে গিয়ে। পৌঁছুতে।

বাগে পেয়েছি বাছাধনকে আবারও বলেছে সে, হাত লাগান, ভিদাল! আমগাড়!

হঠাৎ আমার মনে হলো কার যেন অদৃশ্য হাত প্রচণ্ড জোরে আমায় ধাক্কা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে ফেলতে চাচ্ছে, আমার চোখে-মুখে এসে পড়ছে কার ফোঁসফোঁস নিশ্বাস। হ্যাঁ, এ একেবারে একটা হাতাহাতি লড়াই, ফ্রি-স্টাইল কুস্তি, যেন কোনো নিয়মকানুন–মানা এক মল্লযুদ্ধ! এই-তো সে, ঐ ভয়ংকর, ঐ অদৃশ্য মানুষ, ভিলহেল্ম স্টোরিংস, অথবা অন্যকোনো পিশাচ! সে যে-ই হোক না কেন, এবার আমরা তাকে কাবু করে ফেলেছি, এবং আমাদের কবল থেকে তার আর উদ্ধার নেই, এবার তাকে বলতেই হবে মাইরাকে নিয়ে সে কী করেছে। আমরা জানি কী করে কাউকে দিয়ে কথা বলাতে হয়!

অর্থাৎ মঁসিয় স্টেপার্ক যা বলেছিলেন, তা-ই ঠিক, সে তার দৃশ্যমানতাকে ধ্বংস করতে পারে বটে, কিন্তু অশরীরী হয়ে যেতে পারে না। এ-তো আর কোনো ভূতপ্রেত নয়, রক্তমাংসের কোনো শরীর, যেটা এখন প্রাণপণে যুঝছে, ধস্তাধস্তি করছে!

আর অবশেষে আমরা তাকে জব্দ করতে পেরেছি। তার একটা হাত চেপে ধরে রেখেছি আমি, আর অন্যহাতটা পাকড়েছে লিউটেনান্ট আর্মগাড়।

মাইরা কোথায়? বল, মাইরাকে তুই কী করেছিস? যেন জ্বরের ঘোরে চেঁচিয়ে উঠেছে, এমনভাবে জিগেস করেছে কাপ্তেন হারালান।

কোনো সাড়া নেই। দুবৃত্তটি এখনও হাল ছাড়েনি, এখনও সে তার হাতদুটো হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে সটকে পড়তে চাচ্ছে। এই দুবৃত্তটি আবার অসীম বলশালীও বটে–আমরা তিনজনে মিলেও যেন তাকে সামলাতে পারছি না। একবার যদি সে আমাদের হাত এড়িয়ে পালাতে পারে, তবে আর তাকে কখনও পাকড়ানো যাবে কি না সন্দেহ।

মাইরা কোথায়? বলবি কি না বল? কাপ্তেন হারালান তখন বুঝি কাণ্ডকাণ্ড জ্ঞানই হারিয়ে ফেলেছে।

বলবো না! ককখনো না!

এই হাঁফাতে-থাকা রূঢ় কর্কশ গলা শুনে আর-কোনো সন্দেহই থাকেনিঃ এ খোদ ভিলহেল্ম স্টোরিৎস, তার কোনো সাগরেদ নয়!

কিন্তু তিনের সঙ্গে এক আর কতক্ষণ যুঝবে! সে-তো আর চিরকাল এই ধস্তাধস্তি চালিয়ে যেতে পারবে না।

হঠাৎ এক ধাক্কায় ছিটকে পড়েছে লিউটেনান্ট আমগাড়; তারপরেই আমার মনে হয়েছে আমার ঠ্যাঙের মধ্যে কেউ যেন আচমকা ল্যাং কষিয়েছে! আমি টাল সামলাতে না-পেরে ছিটকে পড়ে গেছি, হাতটা ছেড়ে দিতে হয়েছে আমায়। তারপরেই কেউ যেন সজোরে বিরাশি সিক্কার একটা থাপ্পড় কষিয়েছে কাপ্তেন হারালানের মুখে! সে টলতে টলতে যেন শূন্যকে আঁকড়েই টাল সামলাতে চেয়েছে।

পালালো! পালালো? এ-তো চীৎকার নয়, যেন কোনো হিংস্র জানোয়ারের ক্রুদ্ধ গর্জন।

না, সন্দেহ নেই আর, প্রভুর সাহায্যে কোত্থেকে আচমকা যেন হেরমান এসে উদয় হয়েছে।

আমি কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়েছি, যদিও মাথা তখনও ঘুরছে, জোর চোট লেগেছিলো! লিউটেনান্ট আমগাড় চিৎপাত পড়ে আছে ভঁয়ে, প্রায় সংজ্ঞাহীন-আর আমি ছুটে গেছি তাকে সাহায্য করতে, ভেবেছি তার ওপর হয়তো স্টোরিৎসই চেপে বসে আছে। কিন্তু মিথ্যেই আশা করেছি। আমরা যা আঁকড়ে ধরতে পেরেছি তা শুধুই শূন্যতা, একমুঠো খোলাহাওয়া।

ভিলহেল্ম স্টোরিৎস আবারও আমাদের কবল থেকে পালিয়ে গিয়েছে।

তারপরেই হঠাৎ ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে জনাকতক সেপাই, অন্যরা টপকে আসছে দেয়াল, কেউ-কেউ যেন বেরিয়ে আসছে ঐ ধ্বংসপ্প কুঁড়েই, পাতাল থেকেই যেন। চারপাশ থেকে দলে-দলে কাতারে-কাতারে আসছে সেপাইরা। শয়ে-শয়ে। কারু পরনে সেপাইয়ের পোশাক, কয়েকজনের গায়ে পদাতিক বাহিনীর উর্দি। মুহূর্তের মধ্যে তারা আমাদের ঘিরে চারপাশে গণ্ডি তৈরি করে ফেলেছে, তারপর বৃত্তটা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে, ছোটো, আরো-ছোটো…।

আর শুধু তখনই আমি ধরতে পেরেছি মঁসিয় স্টোপার্কের ঐ আশাব্যঞ্জক বাণীর অর্থ। স্টোরিৎস সেদিন নিজের অজান্তেই আমাদের কাছে ফাস করে দিয়েছিলো তার দুরভিসন্ধি। তালেগোলে আমি খেয়াল না-করলেও, মঁসিয় স্টেপার্ক কিন্তু মোটেই ভোলেননি স্টোরিৎস কী মৎলব এঁটেছে, আর সেই অনুযায়ীই তিনি ব্যবস্থা করেছেন, এমনই নিখুঁতভাবে যে দেখে আমার সত্যি তাক লেগে গিয়েছে। কেননা এই কয়েকশো লোকের একজনকেও কিন্তু আমরা দেয়াল টপকে ভেতরে ঢোকবার সময় দেখতে পাইনি।

বৃত্ত ক্রমেই ছোটো হয়ে এসেছে, যেন কেন্দ্রে পৌঁছেছে। এইবারে ফাঁদে পড়েছে স্টোরিৎস আর তার চেলা। আর তাদের রেহাই নেই!

আর এই মোটা কথাটাই যেন ততক্ষণে তার নিজের মাথাতেও গিয়ে ঢুকেছে। কারণ হঠাৎ আমাদের কানের পাশেই কেউ যেন রুদ্ধ আক্রোশে গররর করে উঠেছে। তারপর যেই মনে হয়েছে লিউটেনান্ট আমগাড় তার জ্ঞান ফিরে পেতে চলেছে, উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে, কেউ যেন হ্যাঁচকা একটা টান মেরে তার কোষ থেকে খুলে নিয়েছে তলোয়ারটা, একটা অদৃশ্য হাত সেটা নেড়ে যেন ভয় দেখাতে চাচ্ছে, হাওয়ায় বনবন করে ঘোরাচ্ছে!

এই হাত আর-কারু নয়, নিশ্চয়ই ভিলহেল্ম স্টোরিৎসের, এভাবেই জনকতককে ঘায়েল করে এবার সে তার গায়ের ঝাল মেটাবে! পালাতেই যখন পারবে না, তখন সে তার শেষ মোক্ষম ঘাটা মেরে যাবে, কাপ্তেন হারালানকেই নিকেশ করে দেবে!…

শত্রুর দৃষ্টান্ত দেখে কাপ্তেন হারালানও কোষ থেকে তখন বার করে এনেছে তার তলোয়ার। যেন কোনো দ্বন্দ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে, এমনিভাবে তলোয়ার হাতে তারা দাঁড়িয়েছে পরস্পরের মুখোমুখি–একজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, অন্যজনকে কেউই দেখতে পাচ্ছে না!… তলোয়ারে-তলোয়ারে ঠোকাঠুকি লড়াই হচ্ছে, ফুলকি উড়ছে, ঝনঝনঝন আওয়াজ হচ্ছে… আর এত দ্রুত শুরু হয়েছে এই দৃশ্য অদৃশ্যের দ্বন্দ্বযুদ্ধ যে আমরা তাতে কোনো বাধাই দিতে পারিনি। আর এটাও বোঝা যাচ্ছে যে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস অসিযুদ্ধেও দারুণ নিপুণ। সে জানে তলোয়ার কী করে চালাতে হয়। আর কাপ্তেন হারালান? সে খ্যাপার মতো আক্রমণই করে চলেছে, আত্মরক্ষার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করছে না। তার কাঁধে পড়েছে তলোয়ারের কোপ, ফিনকি : দিয়ে বেরিয়েছে রক্ত, কিন্তু তবু ঝলসে উঠছে তার তলোয়ার–সামনে কীসের গায়ে যেন বিঁধেছে গিয়ে সেটা সজোরে! একটা আর্তনাদে তালা ধরে গেছে যেন আমাদের কানে, তারপরেই আমাদের সামনের জমিতে সমস্ত ঘাস যেন থেলে চেপটে গিয়েছে…

মানুষের একটা শরীর পড়েছে ঘাসের ওপর প্রচণ্ড জোরে, ভিলহেল্ম স্টোরিসের শরীর, তার বুকে এফোঁড়-ওফোড় বিঁধে গিয়েছে তলোয়ারের ফলা… ফিনকি দিয়ে ঘাসের ওপর দিয়ে রক্ত উঠেছে, আর রক্তের সঙ্গে-সঙ্গে তার দেহটা থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে যেন, আর অমনি রক্তমাংসের শরীর ফিরে পাচ্ছে তার আকৃতি, ত্রিরায়তনিক, চাক্ষুষ, রক্তমাংসের শরীর, মরণযাতনায় থরথর!

কাপ্তেন হারালান তখন নিজেকে ছুঁড়ে ফেলেছে ভিলহেল্ম স্টোরিসের ওপর। চীৎকার করে জিগেস করেছে তাকে : মাইরা? মাইরা কোথায়?

কিন্তু একটা নিষ্প্রাণ লাশ পড়ে আছে তখন ঘাসের ওপর, যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে মুখটা, চোখদুটো বিস্ফারিত, ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে যেন, ভিলহেল্ম স্টোরিংস এর দৃশ্যমান মৃত্যুযন্ত্রণায় দুমড়ে-যাওয়া শরীরটা আর-কোনোদিনই কোনো জ্যান্ত মানুষের ভষায় কথা বলবে না।

ভয়ও দেখাবে না!

.

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

এইই হলো ভিলহেল্ম স্টোরিসের জীবনের শোচনীয় পরিণাম।

তবে, হায়, তার এই মৃত্যু এলো বড়-বেশি দেরি করে। এখন যদিও তার কাছ থেকে রডারিখ পরিবারের নতুন করে ভয় পাবার আর কিছু নেই, তবু তার মৃত্যু কিন্তু অবস্থাটার উন্নতি করার বদলে বরং আরো-শোচনীয় করে তুলেছে, কেননা তার মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গেই মাইরাকে ফিরে পাবার সব আশাই হারিয়ে গেছে।

এদিকে এখন এই নতুন হতাশা এসে দখল করে বসেছে হারালানকে-খুশি হবার বদলে সে যেন কি-রকম হতভম্বভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার এই শত্রুর দিকে। শেষটায় যেন এই অপূরণীয় সর্বনাশকে মেনে নেবার জন্যেই, একটা হাতছাড়া ভঙ্গি করে, হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে রডারিখ ভবনের দিকে–কী করে যে এই শোচনীয় পরিণামটার কথা সে বাড়ির লোকের কাছে ভাঙবে, তা-ই যেন সে ভাবতে পারছিলো না।

আমি আর লিউটেনান্ট আমগাড় কিন্তু অকুস্থলেই থেকে গিয়েছি, আর হঠাৎ দেখতে পেয়েছি মঁসিয় স্টেপার্কও যেন কোত্থেকে হঠাৎ এসে উদয় হয়েছেন। প্রায় কয়েকশো লোক ভিড় করে আছে এখানটায়, অথচ সবাই কী-রকম যেন মোহ্যমান আর বিহ্বল হয়ে আছে, সকলেরই বুকের ওপর চেপে বসে আছে অদ্ভুত-এক স্তব্ধতা, চূড়ান্ত কৌতূহলের সঙ্গে এসে মিশেছে অকথ্য-এক মর্মান্তিক যন্ত্রণা, নীরবে শুধু ঠেলাঠেলি করছে কেউ-কেউ, মুখ বাড়িয়ে দেখতে চাচ্ছে কীভাবে পড়ে আছে ভিলহেল্ম স্টোরিংসের অসিবিদ্ধ মৃতদেহ।

সকলেরই চোখ চুম্বকের মতো আটকে আছে লাশটার ওপর। একটু বাঁ-কাৎ হয়ে আছে দেহটা, রক্তে জামাকাপড় মাখামাখি, মুখটা পাণ্ডুর বিবর্ণ, তার হাতটা তখনও বদ্ধ মুঠোয় আঁকড়ে আছে লিউটেনান্ট আমগাড়ের তলোয়ারটা, বাঁ-হাত বেকায়দায় পড়ে কেমন কিম্ভুতভাবে মুড়ে আছে।

কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে মৃতদেহটার দিকে তাগিয়ে থেকে শেষটায় স্তব্ধতা ভেঙে মঁসিয় স্টেপার্ক বলে উঠেছেন :এ কি তবে সত্যি সে-ই?

সেপাইরা আমাদের কাছে ঘনিয়ে এসেছিলো, তাদের চোখে-মুখে এখনও একটা শঙ্কার চাপ। তারাও ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকে চিনতে পেরেছে। যা দেখছেন, তাকে বিশ্বাস করবার জন্যেই যেন মঁসিয় স্টেপার্ক হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেছেন মৃতদেহটির আপাদমস্তক।

মরে গেছে। মরে ভূত হয়ে গেছে! বলে, তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন!

চেঁচিয়ে তিনি তারপর একটা নির্দেশ দিয়েছেন সেপাইদের, আর তক্ষুনি জনা-বারো সেপাই ঠিক সেই জায়গাটা থেকেই আবর্জনা সরাতে শুরু করেছে, মরবার আগে ধ্বংসস্তূপের যে-জায়গাটা থেকে স্টোরিৎসই জঞ্জাল সরাতে শুরু করেছিলো।

আমরা আড়ালে থেকে যে-কথাবার্তা শুনেছি, মঁসিয় স্টেপার্ক যেন আমার মনের প্রশ্নটা পড়ে ফেলেই উত্তর দিয়েছেন, তাতে মনে হয় এখানেই সেই গোপন জায়গাটা খুঁজে পেয়ে যাবো। মনে আছে রাস্কেলটা কী বলেছিলো? অনেকটাই তরল রাসায়নিক সে লুকিয়ে রেখেছে এখানে, যার সাহায্যে সে একাই গোটা শহরটার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে বলে ভেবেছিলো। যতক্ষণ-না সেই গুপ্ত জায়গাটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ এখান থেকে আমি এক পাও নড়ছি না। এখানকার সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে তবেই আমি ছাড়বো। স্টোরিৎস মারা গেছে। বিজ্ঞান আমাকে যে-অভিশাপ দেয় দিক, আমি চাই তার সঙ্গে-সঙ্গে যেন তার সমস্ত গুপ্তরহস্যও খতম হয়ে যায়।

আর তখন আমার মনে হয়েছে : মঁসিয় স্টেপার্ক সম্ভবত সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। যদিও আমার মতো যারা কোনো-না-কোনোভাবে বিজ্ঞান বা প্রকৌশলের সঙ্গে জড়িত, তাদের কাছে অটো স্টোরিসের এই অবিষ্কার যথার্থই কৌতূহলোদ্দীপক কিছু, তবু আমার মনে হচ্ছিলো, এর হয়তো ব্যাবহারিক কোনো প্রয়োগ আদপেই নেই–বরং এ হয়তো স্বভাবদুবৃর্তদের নতুন-নতুন অপকর্মেই উসকে দেবে।

শিগগিরই ধ্বংসস্তূপের তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা ধাতুর পাত–একটা ঢাকনাই সেটা, আর ঢাকনাটা তুলতেই তার তলায় দেখা গেছে সরু-একটা সিঁড়ির প্রথম পইঠাগুলো।

আর অমনি কে যেন আমার হাতটা চেপে ধরেছে, আর কাতর স্বরে কে যেন বলে উঠেছে : দয়া করুন! দয়া ।

আমি তড়াক করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, কিন্তু কাউকেই চোখে পড়েনি–অথচ আমার হাতটা তখন কেউ চেপে ধরে আছে, আর অনুনয়টা তখনও শোনা যাচ্ছে।

সেপাইরা হাতের কাজ ফেলে অবাক হয়ে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে! আমিও যে কতটা বোমকে গিয়েছি তা বলে বোঝাতে পারবো না। অন্য হাতটা বাড়িয়ে আমার আশপাশটা হাড়েছি আমি তখন। ঠিক আমার কোমর বরাবর আমার হাত যেন কার চুলের ওপর পড়েছে, আর তার একটু-নিচে–কার যেন মুখ, চোখের জলে ভেজা। স্পষ্টই কেউ-একজন যেন নতজানু হয়ে আছে এখানে, কান্নাকাটি অনুনয়-বিনয় করছে, অথচ তাকে আমি চোখে দেখতে পাচ্ছি না! আমি কি-রকম ঘাবড়ে গিয়ে তোলাতে তোৎলাতে বলেছি : কে তুমি?

কে যেন বলেছে : হেরমান!

তুমি আবার কী চাও?

কান্নাভেজা ছোট্ট কতগুলো কথায় স্টোরিসের অদৃশ্য সাগরেদ তখন আমাদের বলেছে, সে মঁসিয় স্টেপার্কের সিদ্ধান্তের কথা শুনেছে–এখানে যা-ই পাওয়া যাবে, তা-ই নাকি ধ্বংস করে ফেলা হবে–আর তা যদি হয় তবে সেহেরমান–সে কী করে আবার তার মানুষী আকৃতি ফিরে পাবে? তাকে কি সারা জীবন তবে মানুষের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে থাকতে হবে–নিঃসঙ্গ, চির-একাকী? সে অনুনয় করে বলেছে, মঁসিয় স্টেপার্ক যদি কৃপা করে সবগুলো শিশি ধ্বংস করে ফেলার আগে অন্তত একটা শিশি থেকে একটোক যদি তাকে খেতে দেন, তবে সে বর্তে যাবে।

স্টেপার্ক তার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন বটে, তবে হেরমানও তত ফেরারি আসামী, আইনের চোখে সেও অপরাধী, ফলে সে যাতে আর-কোনো ঝামেলা পাকাতে না-পারে, সেইজন্যে তাকে যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। তার হুকুমে, চারজন হেঁইয়ো-জোয়ান সেপাই এসে জাপটে ধরেছে অদৃশ্য মানুষকে। তারা যে তাকে কখনো ছেড়ে দেবে না, এ-বিষয়ে শুধু-তখনই আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি।

যে-চারজন লোক অদৃশ্য বন্দীকে জাপটে ধরে ছিলো, তাদের আগে-আগে আমি আর মঁসিয় স্টোপার্ক নেমেছি ঐ সিঁড়ি দিয়ে, গিয়ে পৌঁছেছি মাটির তলার একটা ভাড়ারঘরে, মণিকোঠায়, ওপরের ঢাকনা-দরজা ভোলা আছে বলে তা দিয়ে ক্ষীণ একটু আলো এসে ঢুকেছে ভেতরে, সেখানে, একসার সরু-সরু তাকের ওপর, পর-পর অনেকগুলো শিশি সাজানো আছে-তাদের কোনোটার গায়ে লেবেল আঁটা-১, আবার কোনোটার গায়ে লেবেল-২।

হেরমান অধীর স্বরে দু-নম্বর একটা শিশি চেয়েছে, আর মঁসিয় স্টেপার্ক নিজেই সেটা তার হাতে তুলে দিয়েছেন। তারপর অবর্ণনীয় একটি তাজ্জব ব্যাপার ঘটেছে যদিও এমন-কিছু যে ঘটবে, সেটা আমাদের বোঝা উচিতই ছিলো–আমরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখেছি শিশিটা যেন আপনা থেকে শূন্যে উঠে গিয়ে একটা পাক খেলো, তারপর উপুড় হয়ে গেলো, যেন কেউ শিশিটা থেকে ঢকঢক করে কিছু পান করছে।

তারপরে ঘটলো আরো-তাজ্জব, আরো-চমকপ্রদ একটা ব্যাপার। যতই সে ঢকঢক করে পানীয়টা পান করছে, ততই যেন শূন্যের মধ্যে আস্তে-আস্তে সাকার হয়ে উঠছে হেরমান। প্রথম দেখা গেলো আবছা-একটা আকৃতি, মণিকোঠার আবছায়ায় ঝাপসা তাকে দেখা যাচ্ছে, তারপরেই ক্রমে-ক্রমে স্পষ্ট হয়ে, উঠেছে তার আকৃতি, তার পরিণাহ, আর শেষটায় আমি সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছি, আমি যেদিন রাগৎস এসে পৌঁছেছিলুম, সেদিন সন্ধেবেলায় এই লোকটাই আমার পেছন নিয়েছিলো।

মঁসিয় স্টেপার্কের ইঙ্গিতে বাকি শিশিগুলো কিন্তু তক্ষুনি ভেঙে ফেলা হয়েছে, আর তাদের ভেতর যে-তরল পদার্থ ছিলো তা মেঝেয় ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তেই যেন বাষ্প হয়ে গিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এর পরে ফের আমরা সদলবলে ওপরে, দিনের। আলোয়, ফিরে এসেছি।

তাহলে? এবার আপনি কী করবেন বলে ভেবেছেন, মঁসিয় স্টেপার্ক? তাকে জিগেস করেছে লিউটেনান্ট আমগাড়।

উত্তর এলো, আমি মৃতদেহটা এক্ষুনি টাউনহলে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করছি।

প্রকাশ্য দিবালোকে? সকলের চোখের সামনে দিয়ে?

হ্যাঁ, প্রকাশ্যে, সারা রাৎসেরই জানা উচিত যে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস মারা গেছে। নিজের চোখে মৃতদেহটা না-দেখলে তারা সে-কথা বিশ্বাসই করবে না।

যতক্ষণ-না কবরে যাচ্ছে, আমি মন্তব্য করেছি, ততক্ষণ-বা তারাই এ-কথা বিশ্বাস করে কী করে?

কবরে যদি যায় আদৌ, বলেছেন মঁসিয় স্টেপার্ক।

মানে? আমি বুঝি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কী-রকম তাকিয়ে থেকেছি।

হ্যাঁ, মঁসিয় স্টেপার্ক ব্যাখ্যা করে বলেছেন, আমার মতে মৃতদেহটা পুড়িয়ে হাওয়ায় ছাইগুলো উড়িয়ে দেয়াই ভালো হবে-যেমন তারা করতো মধ্যযুগে, ডাইনি মারতে গিয়ে।

তারপর তিনি একটা স্ট্রেচার আনতে বলেছেন মৃতদেহটার জন্যে, আর তার বেশির ভাগ সেপাইকে নিয়ে কয়েদি সমেত চলে গিয়েছেন টাউনহলের দিকে। হেরমানকে এখন খুবই সাধারণ নগণ্য লোক হিশেবে দেখাচ্ছে, যেই সে দৃশ্যমান হয়েছে অমনি যেন তার সব জারিজুরিও উধাও হয়ে গিয়েছে। আর আমি লিউটেনান্ট আর্মগাড়কে সঙ্গে করে ফিরে গিয়েছি রডারিখ-ভবনে।

কাপ্তেন হারালান এদিকে বাড়ি ফিরে এসে বাবার কাছে সবকিছু খুলে বলেছে। মাদাম রডারিখের শরীর-মনের দশার কথা চিন্তা করে তাকে কিছু খুলে বলা হবে না বলেই ঠিক হয়েছে। ভিলহেল্ম স্টোরিৎসের মৃত্যু তো আর তার মেয়েকে তার কাছে ফিরিয়ে দেবে না।

মার্কও এখনও-অব্দি ব্যাপারটা জানে না। তাকে অবশ্য বলতেই হবে সব, আর সেইজন্যেই আমরা তাকে ডেকে পাঠিয়েছি ডাক্তারের পড়ার ঘরে। সে কিন্তু, সব শুনে, প্রতিশোধ নেবার উল্লোসে আদৌ ভরে ওঠেনি। বরং আবার ভেঙে পড়েছে কান্নায়, আর ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে নিদারুণ হতাশায় বলে উঠেছে : ভিলহেল্ম স্টোরিৎস মারা গেছে!… তুমি তাকে হত্যা করেছো!… সে মরে গিয়েছে, কিন্তু মারা যাবার আগে কিছুই বলে যায়নি!… মাইরা!… আমার মাইরা!… হায়, আমি তাকে আর-কখনও চোখেও দেখবো না!…।

শোকের এই প্রচণ্ড প্রকাশের সামনে কীই-বা সান্ত্বনা দিতে পারতুম আমি!

অথচ তবু আমি চেষ্টা করেছি। না-না, আমাদের সমস্ত আশা হারিয়ে ফেললে চলবে না। আমরা এখনও জানি না বটে মাইরা কোথায়, তবে একজন লোক সে-খবর জানে, সে হলো হেরমান, ভিলহেল্ম স্টোরিসের সাগরেদ, তাকে তো এখন আমরা পাকড়াও করেছিসে তো এখন হাজতে আছে, তালা বন্ধ। তাকে আমরা জেরা করতে পারি, প্রশ্ন করতে পারি; আর ব্যাপারটায় যেহেতু তার প্রভুর মতো তার কোনো অতিরিক্ত আগ্রহ নেই, একটু চাপ দিলেই সে সবকথা ফাঁস করে দেবে, খুলে বলবে মাইরা কোথায় আছে।… গোড়ায় যদি নাও বলতে চায়, আমরা তাকে নানাভাবে বলতে বাধ্য করতে পারি, যদি দরকার হয় সেজন্যে আমরা বিস্তর টাকাও খরচ করবো। আর তাতেও যদি না-হয় তো তাকে খুব কষে ধোলাই দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। সেপাইরা সবখানেই থার্ড ডিগ্রি ব্যবহার করে : কারু পেট থেকে গোপন কথা বার করবার যথেষ্ট উপায় জানে তারা।… মাইরা আবার ফিরে আসবে তার আপনজনের কাছে, তার স্বামীর কাছে, আর সেবা-যত্ন-শুশ্রূষায় আবার সে পুরোপুরি সেরেও উঠবে…..

কিন্তু এর একটা কথাও যদি মার্কের কানে গিয়ে থাকে! সে যেন কোনো কথা শুনবে না বলেই পণ করে আছে। তার ধারণা, মাইরা কোথায় আছে, সেটা একজনই বলতে পারতো, এবং সে এখন আর বেঁচে নেই। তার পেট থেকে সব কথা আদায় করে নেবার আগে তাকে হত্যা করা আমাদের উচিত হয়নি।

কেমন করে যে মার্ককে শান্ত করবো, তা-ই আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না, আর এমন সময়ে, হঠাৎ আমাদের কথার চাপান-উতোরে বাধা পড়ে গেলো বাইরের তুলকালাম হট্টগোলে। আমরা সবাই ছুটে চলে গিয়েছি কোণের জানলায়, তার পাল্লাটা বুলভারের দিকে খোলে।

এখন আবার নতুন করে কী ঘটছে?… আমাদের মনের অবস্থা তখন যা ছিলো, তাতে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস যদি পুনর্জীবন লাভ করে এখানে এসে উদয় হতো তাতেও বোধহয় আমরা এতটুকু অবাক হতুম না।

কিন্তু তা নয়। সে মৃত্যু থেকে ফিরে আসেনি মোটেই। বরং তার মৃতদেহ নিয়ে মিছিল চলেছে লাশকাটা ঘরের দিকে। একটা খাঁটিয়ার ওপর চাপানো হয়েছে মৃতদেহটা, তাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে চারজন সেপাই, পেছন-পেছন মস্ত একটা ভিড়। তাহলে সারা রাগস এক্ষুনি জেনে যাবে যে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস মারা গেছে এবং তার বিরচিত আতঙ্কেরও তার রাজত্বের সাথে-সাথেই অবসান হয়েছে।

মঁসিয় স্টেপার্ক শহরের প্রত্যেকটা রাস্তায়, প্রত্যেকটা মোড়ে মৃতদেহটা ঘুরিয়ে দেখাতে চাচ্ছেন। শুধু বুলভার ধরেই নয়, সব কটা বড়োরাস্তা ধরে যাবে এই মিছিল, যাবে সবচেয়ে জনবহুল পাড়াগুলো দিয়ে, সবশেষে আসবে টাউনহলে। আমার কিন্তু মনে হচ্ছিলো, মিছিলটা যদি রডারিখ-ভবনের পাশ দিয়ে না-যেতো, তাহলেই হয়তো ভালো হতো।

মার্কও এসে দাঁড়িয়েছে জানলায়, আমাদের সকলেরই সাথে। সেই রক্তাপ্লুত মৃতদেহটা দেখেই সে আর্ত একটা চীৎকার করে উঠেছে-পারলে সে হয়তো নিজের জীবন দিয়েও এই লাশটায় প্রাণ ফিরিয়ে আনতে।

ভিড় কিন্তু খ্যাপা একটা উল্লাসে ফেটে পড়ছে। বেঁচে থাকলে, তারা নিশ্চয়ই ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকে ফাঁসিতে ঝোলাতো। হয়তো খণ্ড খণ্ড করে কাটতো তাকে কুপিয়ে। মরে গেছে বলেই তার মৃতদেহটাকে তারা আর ছোয়নি। কিন্তু মঁসিয় স্টেপার্ক যেমন ভেবেছিলেন তারাও তেমনিঃ তাকে সাধারণ মর্তমানবের কবর দিতে তারা রাজি নয়। তারা চাচ্ছে তাকে যেন লাল চকটায় প্রকাশ্যে পোড়ানো হয়, অথবা যেন মৃতদেহটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয় দানিউবের জলে । দানিউব তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে দূরে, কৃষ্ণসাগরের শেষকিনারে।

প্রায় পনেরো মিনিট ধরে শতকণ্ঠের উল্লাস বেজেছে বাড়ির সামনে, তারপর আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে গেছে মিছিল, আর স্তব্ধতা নেমে এসেছে পরিপূর্ণ।

কাপ্তেন হারালান হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলেছে সে এক্ষুনি টাউনহলে যাবে। সেখানে সে এক্ষুনি জেরা করবে হেরমানকে, আর একফোঁটাও সময় নষ্ট করা চলবে না। আমরা তার প্রস্তাবে সায় দিতেই, সে তৎক্ষণাৎ হন্তদন্ত হয়ে লিউটেনান্ট আমগাড়কে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।

আমি মার্কের পাশেই সময় কাটিয়েছি । অমন শোকাহত প্রহর আমি এর আগে আর-কখনও কাটাইনি।… আমি তো তাকে বুঝিয়ে-শুঝিয়ে ঠাণ্ডা করতে পারিইনি, বরং উলটে তার ভাবগতিক দেখে মনে হয়েছে, এই বুঝি সে আমাদের হাত ফসকে বিকারের ঘেরের মধ্যে চলে যাবে। একবার যদি তার মাথাখারাপ হয়ে যায়, তবে তাকে সারানো বিষম মুশকিল হবে। আমার কথা সে কানেই নিতে চাচ্ছে না। তর্ক করারও কোনো সাধ, কোনো প্রবৃত্তি তার নেই যেন। শুধু একটা ভাবনার ঘোরেই সে পাক খাচ্ছে, স্থির অপরিবর্তনীয় এক দুর্ভাবনা : মাইরা কোথায়–এক্ষুনি বেরিয়ে গিয়ে তার খোঁজ করা উচিত। আর তোমাকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে, অঁরি। এই তার এক গোঁ।

তাকে, অনেক সাধ্যসাধনা করে, শুধু এটুকুতেই রাজি করাতে পেরেছি যে কাপ্তেন হারালানের ফিরে-আসা অব্দি আমরা অপেক্ষা করবো। কাপ্তেন হারালান অবশ্য তার বন্ধুকে নিয়ে চারটের আগে ফিরে আসেনি, আর যে-খবর সে নিয়ে এসেছে সেটা আমাদের কাছে আদৌ অপ্রত্যাশিত ছিলো না। হেরমানকে জেরায়-জেরায় জেরবার করে দেয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে কোনো ফায়দাই হয়নি। মিথ্যেই হারালান, মঁসিয় স্টেপার্ক, এমনকী খোদ রাজ্যপাল অব্দি, তাকে ভয় দেখিয়েছেন, অনুনয়-বিনয় করেছেন, মিনতি করেছেন। মিথ্যেই তাকে ধনদৌলতের প্রলোভন দেখানো হয়েছে, মিথ্যেই তাকে বলা হয়েছে খবরটা না-বলে দিলে কী কঠোর সাজা তাকে দেয়া হবে। কিন্তু তার কাছ থেকে একটাও কথা বার করা যায়নি। হেরমান একবারও তার কাহন বা কৈফিয়ৎ পালটায়নি। সে জানে না মাইরা কোথায় আছে । এমনকী স্টোরিৎস যে তাকে চুরি করে নিয়ে এসেছিলো, সে-তথ্যটাও তার নাকি অজানা ছিলো। তার প্রভু তাকে সব কথা খুলে বলা সম্ভবত সমীচীন বোধ করেনি।

তিন ঘণ্টা ধরে যাবতীয় চেষ্টা ও ধস্তাধস্তির পর প্রশ্নকর্তাদের মেনে নিতে হয়েছে তার এজাহার : হেরমান সত্যিকথাই বলছে। সে-যে কিছু জানে না, এ-বিষয়ে সন্দেহ করার কোনো অবকাশই নেই। আর তাই, সহায়হীনা মাইরাকে আবার চোখে দেখার আশা আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে।

কী শোচনীয় সমাপ্তিই না হলো দিনটার। বিধ্বস্ত বসে থেকেছি আমরা চেয়ারে, দুঃখেতাপে নুয়ে-পড়া, কেউ কোনো কথা বলিনি, আর মুহূর্তের পর মুহূর্ত গড়িয়ে গেছে নীরবে। কীই-বা আর নতুন বলতে পারতুম, যা আমরা আগে অন্তত একশোবার নিজেরাই বলাবলি করিনি?

আটটার একটু আগে কাজের লোক এসে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। ডাক্তার রডারিখ এখনও তার শোকার্তা স্ত্রীকে স্তোক দিয়ে চলেছেন তার শোবার ঘরে; ড্রয়িংরুমে বসে আছে অফিসার দুজন, আর মার্ক; আর আমিও সেখানে বেহাল বসে আছি। কাজের লোক বাতি রেখে চলে যেতেই ঢং-ঢং করে আটটার ঘণ্টা পড়তে শুরু করেছে।

আর ঠিক তক্ষুনি গ্যালারির দরজা দুম করে খুলে গিয়েছে। নিশ্চয়ই দমকা হাওয়ার ঝাঁপটায় খুলে গিয়েছে পাল্লাটা, কেননা কাউকেই আমি দরজার আশপাশে দেখিনি। কিন্তু যেটা সবচেয়ে চমকপ্রদ সেটা হলো পাল্লাদুটোর আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যাওয়া।…

আর তারপর–না-না, এ-দৃশ্য আমি জীবনের শেষদিন অব্দি ভুলবো না!–শোনা গেছে-স্পষ্ট শোনা গেছে রিনরিনে গলার স্বর। না, না, কোনো রূঢ় রুক্ষ চোয়াড়ে স্বর নয়, যেটা ঘৃণাবিদ্বেষের স্তব গেয়ে অন্য-একটা সন্ধ্যায় আমাদের অপমান করেছিলো-–বরং সহজ, সতেজ, উৎফুল্ল, সুরেলা একটা স্বর, যে-গলার স্বর আমাদের চেনা, আমাদের প্রিয়, অর্থাৎ মাইরার কণ্ঠস্বর!

মার্ক, বলে উঠেছে উৎফুল্ল, সুরেলা, রিনরিনে গলা, আর আপনি, মঁসিয়ে অঁরি, আর হারালান–এখানে বসে-বসে কী নিয়ে গুলতানি হচ্ছে সকলের? ডিনারের সময় হলো, আর আমি যে খিদেয় মরে যাচ্ছি!

মাইরা, স্বয়ং মাইরাই! মাইরা–যে তার কাণ্ডজ্ঞান ফিরে পেয়েছে। মাইরা-যে মাইরা এখন সুস্থ, স্বস্থ, সজ্ঞান!… যে-কেউ শুনে বলতো, সে হয়তো এক্ষুনি সহজভাবে নিজের ঘর থেকেই নেমে এসেছে, যেমন রোজ নেমে আসে ডিনারের আগে। এ এমন এক মাইরা, যাকে আমরা চোখে দেখতে পাচ্ছি না!… এ-যে অদৃশ্য মাইরা!

মাইরার এই সহজসরল কথাগুলো যেভাবে আমাদের চমকে দিয়েছিলো, তেমন। বোধহয় আর-কোনো কথাই পারেনি। চেয়ারে যেন গজাল মেরে কেউ আটকে দিয়েছে। আমাদের, হতভম্ব, ভ্যাবাচাকা, আমরা বসেই থেকেছি, নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারিনি, কেউই উঠে সেদিকে যাইনি, যেখান থেকে এই গলার স্বর ভেসে আসছিলো। অথচ মাইরা আছে ওখানে, ঐ-তো, জ্যান্ত, সজ্ঞান, আর অদৃশ্য– কিন্তু ধরা-ছোঁয়ার মধ্যেই!…

কোত্থেকে এসেছে সে?… যে-বাড়িতে চুরি করে নিয়ে গিয়ে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস তাকে লুকিয়ে রেখেছিলো?… সেখান থেকে সে নিজের বুদ্ধিতেই পালাতে পেরেছে। তবে, শহরের মধ্য দিয়ে নিজেই হেঁটে-হেঁটে চলে এসেছে বাড়ি?… আর দরজা ছিলো বন্ধ, কেউই তার জন্যে সাদরে সাগ্রহে দরজা খুলে দেয়নি।

না–তার উপস্থিতির আসলে রহস্যটা বুঝে ফেলতে আমাদের খুব-একটা দেরি হয়নি। যে-ঘরে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস তাকে অদৃশ্য করে রেখে গিয়েছিলো, সেই ঘর থেকেই এসেছে সে। আমরা সারাক্ষণ যখন ভেবেছি তাকে স্টোরিৎস নিশ্চয়ই বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়েছে, সে কিনা তখন তার বিছানা ছেড়েই ওঠেনি। সে পড়ে থেকেছে। সেখানে, এলায়িত, লম্বালম্বি, নড়তে-চড়তে অক্ষম, সারাক্ষণ স্তব্ধ ও সংজ্ঞাহীন–এই চব্বিশ ঘণ্টাই! এটা কারুই মাথাতেও ঢোকেনি যে সে হয়তো তার বিছানাতেই পড়ে থাকতে পারে–আর, সত্যি-তো, এমনটা ভাববেই বা কেন?

ভিলহেল্ম স্টোরিৎস নিশ্চয়ই তক্ষুনি তাকে গুম করে নিয়ে যেতে পারেনি, কিন্তু শেষ অব্দি সে তাকে কিডন্যাপ করতোই নিশ্চয়ই–যদি-না, আজ সকালেই, কাপ্তেন হারালানের তলোয়ারের ফলা চিরকালের মতো তার সে-সাধ ঘুচিয়ে দিতো!

আর এখন, এইখানে, অদৃশ্য দাঁড়িয়ে আছে মাইরা–আর সে পাগল নয় এখন সম্ভবত যে-তরল রাসায়নিক তাকে খাইয়ে দিয়েছিলো ভিলহেল্ম স্টোরিৎস তা-ই তাকে সারিয়ে তুলেছে! আর মাইরা জানেও না সেদিন ক্যাথিড্রালের ঐ কেলেঙ্কারির পর থেকে ঝড়ের বেগে কত-কী ঘটে গিয়েছে সারা রাগৎস-এ। মাইরা আমাদেরই মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আমাদের সঙ্গে, আমাদের চোখে দেখতে পারছে। চিনতে পারছে দেখে, কিন্তু এখনও, প্রদোষের আবছায়ায়, এটা বুঝতে পারছে না যে আমরা তাকে চাক্ষুষ দেখতে পারছি না।

মার্ক ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে, তার দুই বাহু প্রসারিত, যেন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছে…

আর মাইরা বলে উঠেছে, কী ব্যাপার বলো তো, তোমাদের? আমি তোমাদের সঙ্গে কথা বলছি, অথচ তোমরা কোনোই সাড়া দিচ্ছে না। আমাকে দেখে যেন ভূত দেখেছে বলে মনে হচ্ছে তোমাদের? কী হয়েছে, বলো তো?… মা-ই-বা এখানে নেই কেন? মা-র কি শরীর খারাপ করেছে?

আবারও খুলে গিয়েছে দরজা, আর এবার ঘরে এসে ঢুকেছেন ডাক্তার রডারিখ । মাইরা তক্ষুনি নিশ্চয়ই ছুটেই গেছে তার দিকে–অন্তত সেটাই আমরা ভেবেছি, কারণ অবাক হয়ে সে বলে উঠেছে, বাবা!… তোমার আবার কী হলো?… মার্ক আর হারালানকেই বা অমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে কেন?

ডাক্তার রডারিখ অমনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন, অভিভূত, স্তম্ভিত-চৌকাঠে। মুহূর্তের মধ্যে তিনি বুঝে ফেলেছেন সবকিছু। আর মাইরা তাঁর কাছে গিয়ে আদর করে চুমু খেয়েছে তাকে, আবারও জিগেস করেছে, কী ব্যাপার, বলো তো? মা? মা কই?

তোর মা ভালোই আছেন, মাইরা, বলেছেন ডাক্তার রডারিখ। এক্ষুনি নিচে নামবেন। কিন্তু তোর এখন বিশ্রাম করা উচিত্ত মাইরা, বিশ্রাম।

সেই মুহূর্তে মার্ক তার স্ত্রীর হাত খুঁজে পেয়েছে, তাকে আস্তে টেনে নিয়েছে নিজের দিকে, যেন কোনো অন্ধকে পথ দেখাচ্ছে–অথচ মাইরা তো আর মোটেই অন্ধ নয়, সে-ই বরং সবাইকেই দেখতে পাচ্ছে, আমরাই শুধু তাকে দেখতে পাচ্ছি না। মার্ক তাকে নিয়ে গিয়ে তার পাশে বসিয়েছে…

হঠাৎ তার উপস্থিতি এমন-অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে কেন, কিছুই বুঝতে না পেরে, মাইরা বোধহয় একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলো। বিশেষত এবার যখন মার্ক কাঁপা গলায় অস্ফুট কথাগুলো বলেছে, তখন তো আরো : মাইরা!… আমার মাইরা!… এ কি তবে সত্যি তুমি? এ কি তবে সবই সত্য? … আমি তোমাকে ছুঁতে পারছি এখানে… আমার পাশে!… ওহ্, মাইরা, আর আমায় ছেড়ে চলে যেয়ো না, কিছুতেই না…

মার্ক, তোমায় কেমন যেন বিমূঢ় আর হতভম্ব দেখাচ্ছে-তোমাদের সবাইকেই–যেন আমায় তোমরা ভয় পাচ্ছো!. বাবা, তুমিই বলো। সত্যি বোলো কিন্তু। কোনো কি ঝামেলা পাকিয়েছে?

মার্কের বুঝি মনে হয়েছে যে সে উঠে যাবার চেষ্টা করছে। সে তাকে আবারও আলতো করে টেনে বসিয়েছে, পাশে। না, সে বলেছে, মনখারাপ করার কিছু হয়নি। কোনোই গোল নেই–কোনোই ঝামেলা বাধেনি, কিন্তু মাইরা– আবার-একবার কিছু বলো তুমি–তোমার গলা শুনতে দাও আবার

হ্যাঁ; এই দৃশ্য–এটা আমরা বসে-বসে দেখেছি; এই কথাগুলো–সেও আমরা শুনেছি। আমরা বসে থেকেছি সেখানে, অনড়, নিশ্চল, রুদ্ধানিশ্বাস, আর ভয়ে যেন আধমরা হয়ে আছি সবাই-শুধুমাত্র যে-লোক মাইরাকে তার দৃশ্যরূপ, চাক্ষুষরূপ, মানুষী-আকৃতি ফিরিয়ে দিতে পারতো, সে এখন আর বেঁচে নেই, আর মরবার সময় তার সব রহস্য সব গুপ্তকথাই সে নিয়ে গেছে পরপারে!

.

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

এই-যে পরিস্থিতি–যেটা পুরোপুরি আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে-তার কি কোনো মধুর পরিসমাপ্তি হতে পারে? কে এমন হাবা আছে যে এ-কথা ভাববে? সাহস করে সে কে এসে এখন বলবে যে মাইরা এখন চিরকালের মতো দৃশ্যপৃথিবী থেকে মুছে যায়নি? তাকে ফিরে পেয়ে আমরা যেমন উল্লাস বোধ করেছি, তেমনি তীব্র মর্মপীড়াতেও ভরে গিয়েছি। সে কি তবে কোনোদিনই আর তার শ্রী আর লাবণ্য ফিরে পাবে না?

আর এসব প্রশ্ন থেকেই বোঝা যাবে এ-রকম পরিস্থিতিতে রডারিখ পরিবারের জীবন তখন কেমন করে কাটতে পারতো।

পুরো অবস্থাটা বুঝে ফেলতে বেশি সময় লাগেনি মাইরার। ম্যান্টলপীসের ওপরকার আয়নার সামনে দিয়ে যাবার সময় সে তার আপন প্রতিবিম্ব দেখতে পায়নি… কী-এক শঙ্কায় অস্ফুট-একটা আর্তনাদ করে সে সবেগে ঘুরে দাঁড়িয়েছে আমাদের দিকে, বুঝতে পেরেছে যে নিজের ছায়া সে দেখতে পাচ্ছে না…

আর যখন আর্ত কান্নায় সে ভেঙে পড়েছে, আমাদের তাকে খুলে বলতে হয়েছে সবকিছু, আর মার্ক সারাক্ষণ তার চেয়ারের পাশে নতজানু হয়ে বসে তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছে-মিথ্যেই চেষ্টা করেছে তাকে শান্ত করতে। দৃশ্য-মাইরাকে সে ভালোবাসতো, সে অদৃশ্য-মাইরাকেও ভালোবাসবে। একইরকম। আর এই কথা শুনে মাইরার বুকটা যেন ফেটে গিয়েছে।

পরে, রাত্তিরে, ডাক্তার রডারিখ মাইরাকে চাপ দিয়েছেন, তাড়া দিয়ে বলেছেন একবার তার মায়ের ঘরে যাওয়া উচিত। দূরে-দূরে সরে-থাকার চাইতে মায়ের কাছাকাছি থাকাই ভালো, অন্তত কথা তো বলতে পারবে।

আর এভাবেই কেটে গিয়েছে কয়েকটা দিন। আমাদের আশ্বাস যে-সান্ত্বনা দিতে পারেনি, সময় সেটা দিয়েছে; মাইরা মেনে নিয়েছে তার এই নিয়তি। তার মনের জোর নিশ্চয়ই প্রচণ্ড, নইলে আমাদের দিনাদৈনিক জীবনযাপনের ধরন আবার সেই অভ্যস্ত পথে ফিরে যেতে কী করে। সারাক্ষণ কথা বলেই সে বুঝিয়ে দিতো যে সে আমাদের কাছে-কাছেই আছে। আমার এখনও মনে পড়ে সে কেমন করে শুরু করতে দিন

এই-যে বন্ধুরা, শোনো, আমি কিন্তু কাছাকাছিই আছি… কিছু চাই তোমাদের? ঠিক আছে, আমি এনে দিচ্ছি।… অঁঁরি, তুমি কী চাচ্ছো, বলো তো?-ওহ, যেবইটা টেবিলে ফেলে রেখে এসেছো?… এই-যে, নাও তোমার কেতাব।… তোমার কাগজ? সে-তো তোমার পাশেই পড়ে গিয়েছে।…

বাবা, দিনের এই সময়েই রোজ তোমাকে চুমু খেতুম… হারালান, তুই আবার অমন দুঃখী-দুঃখী মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?… তোকে তো কতবার বলেছি, আমি সবসময় হাসিখুশি থাকি, তাহলে তোরই বা অমন মনখারাপ করার কী হলো? … আর মার্ক, এই-যে, এই নাও আমার দুই হাত।… বাগানে বেড়াতে যেতে চাও? চলো। … অঁঁরি, দেখি, তোমার হাতটা দাও-তো, চলো… বিস্তর গুলতানি করার আছে আমাদের… জবর আড্ডা দেয়া যাবে।

বাড়ির লোকের অভ্যস্ত জীবনযাত্রায় কোনো বদল আসুক, এটা সে কিছুতেই চায়নি। সে আর মার্ক অনেকক্ষণ ধরে সময় কাটিয়েছে রোজ, আর স্ফুট-অস্ফুট স্বরে কখনও তার মধুর গুঞ্জন সে থামায়নি, কেননা সারাক্ষণ তাকে ভরসা জুগিয়ে যেতে চেয়েছে, সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে ভবিষ্যতের ওপর পূর্ণ আস্থা আছে তার, একদিন নিশ্চয়ই এই অদৃশ্যমানতা ঘুচে যাবে… কিন্তু সত্যি কি ভেতরে-ভেতরে এমনতর কোনো আস্থা তার আছে? বা ছিলো?

একটা বদল, শুধু-একটাই, এসেছে আমাদের জীবনে। মাইরা বুঝতে পেরেছে এ অবস্থায় তার উপস্থিতি আমাদের কাছে কতটা বেদনাদায়ক হবে, তাই সে খাবারটেবিলে ককখনো এসে আমাদের সঙ্গে বসে না। আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে পরই এসে সে যোগ দিয়েছে আমাদের সঙ্গে, ড্রয়িংরুমে। দরজা খুলে যায়, বন্ধ হয়, আর সে বলে ওঠে : এই-যে বন্ধুরা, আমি এসে গেছি! আর তারপর একেবারে শুভরাত্রি না-জানানো অব্দি সারাক্ষণ আমাদেরই সঙ্গে-সঙ্গে কাটায়।

এটা নিশ্চয়ই বলার দরকার নেই, মাইরা রডারিখের উধাও-হয়ে-যাওয়াটা শহরে যে-তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়েছিলো, তার পুনরাগমন–না কি পুনরাবির্ভাব?-শহরে তার চেয়েও ঢের-বেশি হুলুস্থুল তুলেছিলো।

চব্বিশে জুন সকালবেলায় মার্ক আড়ালে ডেকে নিয়ে কথা বলেছে আমার সঙ্গে, আগের চাইতে তার অস্থিরতা অনেক কম এখন। বলেছে, অঁঁরি, আমি যে-সিদ্ধান্তটায় এসে পৌঁছেছি তাতে তোমারও সায় চাই। আমার স্থির বিশ্বাস, এটা তুমি অনুমোদন করবে।

তুই পুরো ভরসা রেখেই সব বলতে পারিস আমাকে, আমি তাকে বলেছি, আমি জানি তুই অযৌক্তিক-কিছু বলবি না।

যুক্তি, তবে মোটেই আবেগহীন নয়, অঁরি। মাইরা তো এখনও, সত্যি-বলতে, আমার আংশিক বউ-আমাদের বিয়ে কিন্তু ক্যাথিড্রালে পুরোপুরি সাঙ্গ হয়নি, চার্চের অনুমোদনের কথাগুলো তখনও বলা বাকি ছিলো। কিন্তু আধাশেঁচড়া বিয়ের তো কোনো মানে নেই, আমি তাই চাচ্ছি এই অবস্থার শেষ হোক । মাইরার জন্যে তো বটেই, তার বাড়ির লোকের জন্যেও ওটা জরুরিই–আর আমাদেরও এটা দরকার।

আমি আবেগের বশে মার্কের হাত চেপে ধরেছি।আমি তোর কথা বুঝতে পারছি, মার্ক, এতে বাধা কোথায়, তা তো আমি ভাবতে পারছি না–

যাজক যদি মাইরাকে দেখতেই না-পান, মার্ক বলেছে, ব্যাপারটা কেমনতর যেন ঠেকবে, তবু তিনি-তো শুনতে পাবেন যে মাইরা নিজের মুখে উচ্চারণ করছে সে আমাকে স্বামী হিশেবে গ্রহণ করতে রাজি আছে। আমিও ঘোষণা করবো যে আমি কাকে আমার বিবাহিতা পত্নী বলে গ্রহণ করলুম। চার্চের বিধানকর্তারা এতে কোনো আপত্তি করবেন বলে আমার মনে হয় না।

আমিও তো আপত্তির কোনো কারণ দেখছি না। তুই মিথ্যে কিছু ভাবিসনে, মার্ক, আমি গিয়ে এক্ষুনি সব ব্যবস্থা করছি।

আমি যখন প্রধানযাজকের সঙ্গে দেখা করতে গেছি, তার আগেই আমি তার সহকারীদের সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি কোনো মুশকিল দেখা দিতে পারে কি না। বুড়ো যাজক আমায় আশ্বাস দিয়ে বলেছেন যে ব্যাপারটা নিয়ে তারা আগেই একটা ফয়সালা করে নিয়েছেন-খোদ রাগৎস-এর আর্চবিশপ বিয়েটার অনুমোদন দিয়েছেন। সে অদৃশ্য হতে পারে, কিন্তু এতে তো কোনো সন্দেহই নেই যে নববধু বেঁচেই আছে, আর সেইজন্যে সে বিয়েও করতে পারে। আগেই তো বিয়ের তিন-চতুর্থাংশ অনুষ্ঠান সরকারিভাবেই ক্যাথিড্রালে সম্পন্ন হয়েছিলো, তাই ঠিক হলো আগামী দোসরা জুলাই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হবে।

পয়লা জুলাই রাতে মাইরা আমায় মনে করিয়ে দিয়েছে, যেমন সে আগের বারও করেছিলো, কালকে কিন্তু, অঁঁরি। ভুলো না যেন!

প্রথম অনুষ্ঠানটির মতোই দ্বিতীয় অনুষ্ঠানটিও সম্পন্ন হয়েছে সন্ত মিখায়েলের ক্যাথিড্রালে। আর একইভাবে আসর সরগরম হয়েছে, একই অতিথিরা এসেছে-আর ঝেটিয়ে এসেছে শহরের লোক, চার্চ থেকে বাইরেও উপচে পড়েছে ভিড়। এটা ঠিক যে, ভিলহেল্ম স্টোরিৎস আর বেঁচে নেই। তার সাগরেদ হেরমান এখন কয়েদখানায় । তবু যদি-লোকের বুকের মধ্যে ধুকপুক করছিলো শঙ্কা–সেই জার্মানের প্রেতাত্মা এসে আবার নতুন-কোনো ঝামেলা পাকায়!

কিন্তু আবার নতুন করে ক্রমানুযায়ী পর-পর শেষ হয়েছে অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্ব, আর খ্রিষ্টযাগ শেষ হবার পর, বুড়ো প্রধানযাজক সকলের সামনে কাঁপা-কাঁপা গলায় জিগেস করেছেন :

মাইরা রডারিখ, তুমি কি এখানে আছো?

হ্যাঁ, আমি এখানেই আছি।

বুড়ো যাজক মার্ককে বলেছেন :.মার্ক ভিদাল, তুমি কি এখানে-উপস্থিত মাইরা রডারিখকে তোমার বিবাহিতা পত্নী বলে গ্রহণ করতে সম্মত আছো?

আছি। বলেছে মার্ক।

মাইরা রডারিখ, তুমি কি এখানে-উপস্থিত মার্ক ভিদালকে তোমার বৈধ পতি রূপে গ্রহণ করতে স্বীকৃত আছো?

আছি। এমন স্বরে মাইরা কথাটা বলেছে সে ক্যাথিড্রালের মধ্যে সমবেত সকলের কানে গিয়ে পৌঁছেছে কথাটা : আছি।

মার্ক ভিদাল আর মাইরা রডারিখ। প্রধানযাজক তখন ঘোষণা করেছেন, আমি তোমাদের ধর্মস্বীকৃতভাবে বিবাহিত পতি-পত্নী বলে ঘোষণা করছি।

অনুষ্ঠানের পর, ভিড়, দু-ভাগ হয়ে দু-পাশে সরে গিয়েছে, যাতে নবদম্পতি অনায়াসে হাত-ধরাধরি করে হেঁটে যেতে পারে। বিয়ের অনুষ্ঠানে এমন সময় একটা বিকট হৈ-হট্টগোল হয় সাধারণত, তেমন উৎকট-কিছুই এবারে কিন্তু হয়নি। সবাই চুপ করে থেকে, গলা বাড়িয়ে দেখতে চেয়েছে আশ্চর্য-কিছু, অসম্ভব-কিছু। কেউ নিজের জায়গা ছেড়ে নড়েনি–তবে কেউই আবার সকলের আগেভাগে গিয়ে দাঁড়াতে চায়নি। . কৌতূহল যেমন তাদের হিড়হিড় করে টেনে এনেছে এখানে, তেমনি কী-একটা অজানা আশঙ্কাও যেন তাদের ঘাড় ধরে টেনে রাখতে চেয়েছে পেছনে।

আর একটু-হয়তো-অস্বস্তিতেই ভুগছে এমন দু-ভাগ ভিড়ের মধ্য দিয়ে বর-বধু, তাদের স্বামীরা, স্বজনবন্ধুরা, সবাই হেঁটে গিয়েছে ক্যাথিড্রালের নথিসেরেস্তা রাখার টেবিলের দিকে, সেখানে খুলে রাখা সেরেস্তায় মার্ক ভিদালের স্বাক্ষরের পাশে যুক্ত হয়েছে আরো-একটি নাম, মাইরা রডারিখ, যে-নামটি স্বাক্ষর করেছে এমন-একটি হাত, যাকে কেউই দেখতে পায়নি–যাকে কেউই কোনোদিনও দেখতে পাবে না।

.

উনবিংশ পরিচ্ছেদ

এইই ছিলো সেই দিন, দোসরা জুলাই, ১৭৫৭; এই অদ্ভুত কাহিনীর তুঙ্গমুহূর্ত, যেটা কোন-এক আজব খেয়ালে আমি পরে বসে-বসে লিপিবব্ধ করেছি। কবুল করি যে সকলেরই এটা অবিশ্বাস্য ঠেকবে–আজগুবি যদি না-ও ঠেকে। আর তা যদি হয় তাকে ধরে নিতে হবে এই অনভ্যস্ত লেখকের অক্ষমতা হিশেবে। কাহিনীটা কিন্তু যতই অবিশ্বাস্য ঠেকুক, সর্বৈব সত্য, এর একটি কথাও মিথ্যে নয়–আর যদিও অতীত আখ্যান হিশেবে অদ্বিতীয় বলে ঠেকবে, আমি আশা করবো ভবিষ্যতেও এই কাহিনী যেন অদ্বিতীয়ই থেকে যায়। আর-কারু জীবনে এমন-কিছু ঘটে যাক, তা আমি চাইবো না।

বাহুল্য হবে বলা যে, মার্ক আর মাইরা আগে যে-পরিকল্পনা করেছিলো, এখন তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। এখন আর ফ্রানসে যাবার কোনো কথাই ওঠে না, আর এও বুঝতে পেরেছি পরেও শুধু ক্কচিৎ-কখনোই মার্ক পারী আসবে-সে বরং চিরকালের জন্যে এই রাগৎসেই বাসা বাঁধবে। আমার যতই খারাপ লাগুক, এ-ব্যাপারটা শেষ অব্দি আমায় মেনেই নিতে হয়েছে।

মার্ক আর মাইরার পক্ষে সবচেয়ে ভালো হবে তারা যদি ডাক্তার ও মাদাম রডারিখের কাছাকাছিই বাসা বাঁধে। সময় একসময় এই ঘনিষ্ঠতাকেই নিবিড় করে তুলবে, আর মার্কও এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। সে-যে সবসময়েই কাছে আছে, এই ধারণাটা তৈরি করে দিতে ক্রমেই পটীয়সী হয়ে উঠেছে মাইরা, আমরা সবসময়েই বুঝতে পেরেছি সে কোথায় আছে, কী করছে। সে-ই যেন বাড়ির আত্মা–আর আত্মার মতোই। অদৃশ্য ।

আর সত্যি-বলতে, তার পার্থিব অস্তিত্ব পুরোটাই তো আর ঘুচে যায়নি, মার্ক তার যে-আশ্চর্য ছবিটা এঁকেছিলো, সেটা কি টাঙানো নেই দেয়ালে–সবসময়? মাইরার। সবচেয়ে ভালো লাগতো তার পাশে বসতে, আর আশ্বাস দিয়ে বলতে;এই-তো আমি, আবারও দৃশ্যমানা, আমি যেমন নিজেকে দেখতে পাচ্ছি তেমনি তোমারও তো আমায় দেখতে পাচ্ছো।

বিয়ের পর আরো-কয়েকটা সপ্তাহ আমি কাটিয়েছি রাগৎস-এ। আর পুরো সময়টাই অন্তরঙ্গভাবে কাটিয়েছি রডারিখ-ভবনে–কী বিষম সংকটেই যে পড়েছিলো এই চমৎকার পরিবারটি। একদিন এদের সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভাবলেই আমার ভারি কষ্ট হতো, কিন্তু সবচেয়ে লম্বা ছুটিও তো একদিন শেষ হয়ে যায়, আর আমাকেও পারী। ফিরে যেতে হবে, আমার জীবিকার ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে।

আবারও আমি নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থেকেছি ফ্রাসে এসেলোকে কী ভাবে জানি না, আমার এনজিনিয়ারিং-বিদ্যা এখন আমার আরো-ভালো লেগেছে। অথচ অনিচ্ছুক আমাকে যে-আশ্চর্য ঘটনাগুলোর উত্তাল ঘূর্ণিপাকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিলো, তা ছিলো এতই রহস্যময় ও চমকপ্রদ যে আমি কখনোই ঘটনাগুলো ভুলতে পারিনি। কেবলই থেকে-থেকে, ঘুরে-ঘুরে, ফিরে গিয়েছি ঘটনাচক্রের আবর্তের মধ্যে, আমার মন বারেবারে উড়ে গিয়েছে রাগৎস-এ, মার্ক আর মাইরার কাছে, যারা সবসময় ই আছে আমার মনের মধ্যে, অথচ শরীরীভাবে কতটাই না দূরে!

পরের বছর জানুয়ারি মাসে আমি যখন আবার সহস্রাধিক-একবার সেই ভয়ানক দৃশ্যটা মনশ্চক্ষুকে দেখছি যেখানে কাপ্তেন হারালানের তলোয়ারের ফলা বিধে গিয়েছিলো ভিলহেল্ম স্টোরিসের বুকে, হঠাৎ ধ্বক করে লাফিয়ে উঠেছে আমার উত্তাল হৃৎপিণ্ড! এত সহজ, এত স্বতোপ্রকাশ, এত সরল এই সমাধান যে আমি নিজেই তাজ্জব হয়ে গেছি এতদিন কথাটা আমার মাথাতেই আসেনি বলে। কী হাঁদা আমি, আকাট বোকা একটা! কোথায় অ্যাদ্দিন চাপা পড়ে ছিলো আমার বুদ্ধিশুদ্ধি, যুক্তির বোধ, কোন-সে অন্ধ আবেগের আলোড়নে তা হারিয়ে গিয়েছিলো? দুয়ে-দুয়ে চার করবার কথাটা কি-না একবারও আমি ভাবিনি, অথচ আমি কিনা প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলুম সব ঘটনার!

সেদিন চোখের সামনে ভেলকির মতো ভিলহেল্ম স্টোরিৎসের অদৃশ্য নিপ্রাণ দেহ গলগল করে রক্ত বেরুবার সঙ্গে-সঙ্গে ফিরে পেয়েছিলো তার দৃশ্যমানতা! যেন হঠাৎ আলোর-ঝলকানিতে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো, দৃশ্যটা আবার চোখের সামনে ফুটে উঠতেই। আরে! যে-রহস্যময় রাসায়নিক রক্তে মিশে গিয়ে তাকে অদৃশ্য করে তুলেছিলো, রক্তস্রাবের সঙ্গে-সঙ্গে তা তার শিরাগুলো থেকে বেরিয়ে গেছে, আর তাকে দৃশ্যমান করে তুলেছে!

হারালানের অসির ফলা যা করতে পারে, কোনো শল্যচিকিৎসকের ছুরির ফলাও তো তা-ই করতে পারে! অর্থাৎ যা চাই, তা শুধু কোনো শল্যচিকিৎসকের ওস্তাদ হাতের কারসাজি–একবারে যদি না-ও হয়, একাধিকবার অপারেশনের পর, ব্যবচ্ছেদের পর, তা তত সহজেই সম্ভব! মাইরা যে-রক্ত হারাবে, নতুন রক্ত গজাবে সে-জায়গায়, আর এমন-একদিন তারপর প্রভাত হবে যেদিন ঐ অভিশপ্ত রাসায়নিক আর একবিন্দুও থাকবে না তার ধমনীতে।

তক্ষুনি, প্রায় ভূতে-পাওয়ার মতোই আমি মার্ককে চিঠিতে লিখে জানিয়েছি সব, কিন্তু চিঠিটা ডাকে দেবার আগেই, হঠাৎ দেখি মার্কেরই কাছ থেকে একটা চিঠি এসে হাজির হয়েছে। আর তা পড়ে মনে হয়েছে এখন–অন্তত আপাতত-এ-চিঠিটা আর না-পাঠানোই ভালো, কারণ আমার পরামর্শ আপাতত তাদের কোনো কাজেই আসবে না। সে চিঠি লিখে জানিয়েছে, সে বাবা হতে চলেছে। এখন কোনো রক্তস্রাব না মাইরার না তার বাচ্চার পক্ষে ভালো হবে।

আমার ভাইপো-বা ভাইঝি–জন্মাবে মে মাসের শেষ দিকে । শুনে আমি অমনি সব ব্যবস্থা করেছি, আর ঠিক পনেরোই মে ১৭৫৮-তে গিয়ে ফের হাজির হয়েছি রাগংস-এ। মার্কের মতো, নবজাতকের বা নবজাতিকার জন্যে আমার অধীরতাও খুব কিছু কম নেই।

জন্ম হলো সাতাশে মে–আর সেইদিনটা আমার স্মৃতি থেকে কোনোদিনই আর মুছে যাবে না। লোকে বলে, অঘটন আজও ঘটে, আজও অলৌকিক এসে প্রমাণ করে দেয় ঈশ্বরের অপার করুণা। আর সেদিন যে-অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিলো, আমি অঁঁরি ভিদাল, এনজিনিয়ার, তার জলজ্যান্ত সাক্ষী।

কেননা অঘটনই এটা-তেমনি অপ্রত্যাশিত ও আশ্চর্য। প্রকৃতি নিজেই মঙ্গল বর্ষায় আমাদের ওপর, মানুষের কোনো উদ্ভাবনী কৌশলের প্রয়োজনই হয় না সবসময়। মাইরা ঐ সাতাশে মে ল্যাজারাসের মতোই কবর থেকে উঠে এসেছে। মার্ক, হতভম্ব, ভ্যাবাচাকা; উল্লাসে কী-যে করবে ভেবেই পাচ্ছিলো না। একসঙ্গে দুজনের জন্ম দেখেছে। সেতার বাচ্চার এবং বাচ্চার মায়ের–মাইরাকে যেন আরো-সুন্দর দেখাচ্ছে, যেন এতদিন চোখের আড়ালে লুকিয়েছিলো বলেই। সন্তানের জন্ম দেবার সময় যে অজস্র রক্তস্রাব হয়েছে, তা থেকেই ফের দৃশ্যমানতায় ফিরে এসেছে মাইরা–আর নতুন করেই তার যেন জন্ম হয়েছে, কোনো শল্যচিকিৎসকের আর সাহায্য লাগেনি। আর, বলে রাখি, ভাইপোই হয়েছে আমার।

আর নবজাতক আর তার মাকে দেখতে গিয়ে আমি শুধু মনে-মনে প্রার্থনা করেছি : ঈশ্বর করুন, আর-কেউ যেন কোনোদিনও ভিলহেল্ম স্টোরিসের ঐ গুপ্তরহস্য পুনরাবিষ্কার না-করে। অদৃশ্য হবার কৌশল জেনে আমাদের কোনো লাভ নেই। আমরা চাই দৃশ্যমানকে-ইন্দ্রিয়গম্য কোনো রূপ, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোনো আকৃতি, যাকে আমরা দু চোখ ভরে সারা জীবন দেখতে পারবো।